সেই এরফান
গোড়ার কথা
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়ার আগে তোমার আর নতুন কিছু বলার আছে, হার্ভি?
রুক্ষ প্রশ্নটার সুরে আসন্ন মৃত্যুর পূর্বাভাস সুস্পষ্ট। এবং বক্তার কাছে এটা কেবল একটা নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। শক্ত গড়নের লোকটার বয়স তিরিশের কাছাকাছি হবে। হাতের দুটো বুড়ো আঙুলই নিজের গান-বেল্টে গুঁজে গোড়ালির ওপর সে সামনে-পিছনে দুলছে। কোটরে ঢুকানো দুটো চোখ আর ওর বাঁকা নাকে ওকে অনেকটা মড়া-খেকো শকুনের মতই দেখাচ্ছে। নিচের দিকে নামানো চওড়া গোঁফ ওর নিষ্ঠুর চিবুক আর ঠোঁট মোটেও ঢাকতে পারেনি।
যাকে সম্বোধন করে কথাটা বলা হয়েছে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের মানুষ। বক্তার চেয়ে তার বয়স অন্তত বিশ বছর বেশি। পাক ধরা চুল আর দাড়িওয়ালা চেহারায় রয়েছে একটা কঠিন ধৈর্যের ছাপ, যেটা অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করার পরেও জীবনের পথে তেমন কোন উন্নতি করতে না পারার ফল। এর কারণ হচ্ছে সে আমেরিকার এমন একটা নিষ্ফলা জমিতে বাস করছে যেখানে কেবল কোনমতে বেঁচে থাকাটাই প্রায় অসম্ভব। হাত বাঁধা অবস্থায় সে একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর হতাশ ভাবে নিরুপায় হয়ে বুকে চিবুক ঠেকিয়ে বসে আছে। চেহারায় বিফল হওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। একটা ছোট ঝর্নার ধারে সে নিজের হাতে তৈরি করেছে তার কেবিন। নিজের হাতে তৈরি র্যাঞ্চটাকে সে ভালবাসে; কিন্তু এটা যখন মাত্র লাভজনক হয়ে উঠতে শুরু করেছে, তখনই তাকে বাধ্য হয়ে এটা ছেড়ে যেতে হচ্ছে। সেটাও অনেক নির্যাতন আর মিথ্যা অপমানের লাঞ্ছনা মাথায় নিয়ে। পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে অবাস্তব ঠেকছে। আজও সূর্য উঠেছে, পাখিরা গান গাইছে, মৃদু আওয়াজ তুলে বয়ে যাচ্ছে ঝর্না-তবু বাতাসটা যেন দুঃখের ভারে ভারী হয়ে আছে।
তাকে অর্ধ-চক্রাকারে ঘিরে দাড়ানো লোকগুলোর ওপর একবার ঘুরে এলো হার্ভি বোলটনের চাখ। ওদের চেহারায় নিষ্ঠুর একটা কৌতূহল ছাড়া আর কিছুই নেই। ওরা সবাই কাউবয়-এবং বক্তার ভাড়া করা লোক। ওদের কাছে কোনরকম সুবিচারই আশা করে না হার্ভি। ওদের যেমন হুকুম দেয়া হয়েছে। তা-ই ওরা করবে।
এবার মুখ তুলে তাকিয়ে ওদের লীডারের দিকে চেয়ে কথা বলল হার্ভি। গলার স্বর শান্ত এবং নিচু-চেহারায় ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই।
আমি আগেও যা বলেছি সেটাই আবার বলছি-আমি তোমার কোন গরু ছুঁইনি, বার্ট, ভারী স্বরে বলল সে।
তাহলে ওগুলো তোমার করালে এলো কিভাবে? ওগুলোর মার্কাও বার বি থেকে ফোর বি করা হয়েছে, অবজ্ঞার সাথে ভেঙচি কেটে বলল বার্ট। আমার গরু চুরি করার জন্যে সুবিধামত একটা ব্র্যান্ডই তুমি বেছে নিয়েছ বটে!
এখানে আসার বহু বছর আগে থেকেই ওটা আমার নিজস্ব ব্র্যান্ড। আমার নামও বোলটন-এবং নামের সাথে মিল রেখেই ওই ব্র্যান্ড রেজিস্ট্রি করেছিলাম। আমি, যুক্তি দেখাল সে। আর তাছাড়া তুমি কি মনে করো আমি এতই থোকা যে ব্র্যান্ড পাল্টে তোমার গরু চুরি করে থাকলে সেগুলোর ক্ষত শুকাবার আগেই আমি ওদের করালে ঢোকাব?
ওহ, তোমাদের মত নেস্টাররা মনে করো তোমরা যা খুশি করেও পার পেয়ে যাবে, কিন্তু তুমি জানতে না যে আমরা তোমাকে সন্দেহ করে তোমার ওপর নজর রেখেছিলাম! অস্থির স্বরে বলল বার্ট। ওই গরুগুলোর পাখা নেই যে ওরা তোমার বেড়া দেয়া করালে উড়ে এসে ঢুকেছে! এর কি ব্যাখ্যা দেবে তুমি?
ওগুলো এখানে কিভাবে এলো তা আমি জানি না। গতকাল আমি এখানে ছিলাম না, হোপ শহরে রসদ আনতে গেছিলাম; আমার অনুপস্থিতিতে আর কেউ ওগুলো ঐখানে এনেছে।
হ্যাঁ, ভাল একটা গল্প ফেঁদেছ বটে! এদিককার কাজ সেরে তুমি অন্যত্র থাকার অজুহাতে রেহাই পাওয়ার আশায় ছিলে; ভাল একটা প্ল্যান করলেও এতে কোন কাজ হবে না।
অভিযুক্ত লোকটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পারছে তার আর বাঁচার কোন রাস্তা নেই। যখন থেকে সে এখানে বসবাস শুরু করেছে তখন। থেকেই তাকে টিকে থাকার জন্যে লড়তে হয়েছে। তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে, ঘোড়াকে খোড়া করা হয়েছে-একবার তার জমির খড় পুড়িয়ে দিয়ে শীতের জন্যে পশুর খাবার নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তবু সে হাল ছেড়ে বসে থাকেনি, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে-ভেবেছে আপন মনে নিজের কাজ করে গেলে নেস্টারদের প্রতি স্থানীয় মত একদিন পাল্টাবে। এবং এটা হয়ত ঘটত, কিন্তু কেবল বার্টের জন্যেই তা সম্ভব হয়নি।
এখানে আমার অধিকার আছে, বলল সে। এটা সরকারি জমি।
এটা ফ্রী রেঞ্জ, কঠিন স্বরে বলল বার্ট।
হ্যাঁ, তোমার জন্যেই কেবল ফ্রী, আমার জন্যে নয়, প্রতিবাদ জানাল বন্দি লোকটা।
এখানে আমিই প্রথমে এসেছি, যুক্তি দেখাল বার্ট; তারপর আবার বলল, এসব কথা আগেও হয়েছে, তাই এখন তার নতুন করে বলে কোন লাভ নেই। এখানে গরু চোরের জন্যে একটা জিনিসই কেবল ফ্রী, সেটা হচেছ ফাঁসির দড়ি।
গাছের গুড়ির ওপর বসা লোকটা হতাশ ভাবে কাঁধ উঁচাল। আমি চোর নই, কিন্তু তোমরা যেভাবে আমাকে আটক করে বেঁধে রেখেছ তাতে আমার বিদায় নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমার ছেলেটা না থাকলে কোন তোয়াক্কাই ছিল না আমার। এভাবে লড়াই করে টিকে থাকার কোন অর্থই হয় না, কিন্তু আমি ছাড়া, ছেলেটার আর কেউ নেই।
এতদিনে তোমার বিদায় নেয়ার কথা মনে পড়ল? কঠিন আর নিষ্ঠুর স্বরে বলল বলিষ্ঠ লোকটা। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, এখন আর তা হয় না-তোমাকে বহুদিন আগেই এখান থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল, তখনই তোমার যাওয়া উচিত ছিল। আমার কথায় তুমি কান দাওনি; এখন ফাঁসি ছাড়া তোমার আর কোন পথ নেই।
হার্ভি ধীরে মুখ তুলে তাকাল। চেহারায় বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। এতক্ষণ পর্যন্ত তার ধারণা ছিল যে তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হবে, কিন্তু এখন বার্টের নিষ্ঠুর চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তাকে মেরে ফেলাই লোকটার উদ্দেশ্য। অভিযোগটা বাই তাকে মেরে ফেলার জন্যে সাজিয়েছে। আবার একে একে সে সবার চেহারা দেখল। ওদের মধ্যে কেবল বার্ট আর হেনডন ছাড়া আর সবাই তার অপরিচিত। ওদের সবাই ওর দিকে নিষ্ঠুর চোখে। চেয়ে থাকল, একমাত্র হেনডনই তার চোখ নামিয়ে নিল। বাকি সবার চোখে সে একজন ঘৃণ্য গরু চোর ছাড়া আর কিছুই না। কোনরকম করুণার অযোগ্য।
তোমরাও কি এই অবিচার মুখ বুজে সহ্য করবে? হতাশ স্বরে প্রশ্ন করল
কেবল হেনডনই ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলল। শোনো, বস, ও যদি সত্যিই দেশ ছেড়ে চলে যায়– শুরু করেছিল সে।
ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল বার্ট। অসম্ভব! ওকে অনেক দয়া দেখানো। হয়েছে। আমরা অনেকদিন ওর অত্যাচার সহ্য করেছি, আর নয়। নেস্টার আর ইন্ডিয়ানদের মধ্যে কোন তফাত নেই–মৃতগুলোই কেবল ভাল। চুরির মাল সমেত ধরা পড়েছে ও। এটা হয়ত অন্যান্য নেস্টারদের জন্যেও একটা দৃষ্টান্ত হবে; ওরা বুঝবে এখানে ওদের দৌরাত্ম সহ্য করা হবে না। তোমার দড়িটা নিয়ে এসো, ডোভার।
যাকে আদেশ করা হলো সে এগিয়ে তার ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো দড়ির কয়েলটা নিয়ে ফিরে এলো।
আমার বাবাকে তুমি ছেড়ে দাও, নইলে তোমাকে আমি সোজা জাহান্নামে পাঠিয়ে দেব, বার্ট।
আদেশটা চড়া চিকন সুরে এলো। ওর কচি স্বরটা রাগে নাকি ভয়ে কাঁপা শোনাল তা ঠিক বোঝা গেল না। সবাই বক্তার দিকে ফিরে তাকাল। দেখল একটা বারো-তেরো বছর বয়সের নীল শার্ট পরা বাচ্চার থেকে চূড়ান্ত আদেশটা এসেছে। বড়দের কাছে ওটা একটা হাসির ব্যাপারই মনে হত, কিন্তু ওর হাতে সরাসরি বার্টের বুক লক্ষ্য করে ধরা ভারী রাইফেলটা হালকা ভাবে নেয়া যায় না। এবং ছেলেটার চেহারা গভীর আবেগে ভরা।
আমি ঠাট্টা করছি না, বার্ট, চেঁচাল সে। আমার বাবাকে ছেড়ে দাও বলছি, নইলে তোমাকে মেরে ফেলব আমি!
হুমকির মুখে বার্ট হেসে উঠল। ঠিক আছে, বাছা, বলে সে হার্ভির দিকে এগোল। কিন্তু একই সাথে সে দড়ির ফাস হাতে লোকটার দিকে চেয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে চোখ টিপল। ছেলেটা বার্টের ওপর চোখ রেখেছিল। তাই সে ডোভারের কজির হঠাৎ নড়ে ওঠা লক্ষ করল না। যখন টের পেল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে; দড়ির ফাসটা ছেলেটার কাঁধে এঁটে বসেছে। একটা জোর হেঁচকা টান ওকে মাটিতে ফেলে দিল। তবু পড়ে যাওয়ার আগেই সে ট্রিগার টেনে দিল, কিন্তু গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।
নরকের শয়তানের বাচ্চা, ছেলেটাকে কাবু করে বেঁধে ফেলার পর অবজ্ঞার সাথে মন্তব্য করল বার্ট। ওর বয়স আর একটু বেশি হলে ওকে স্রেফ খুন করে ফেলতাম আমি। তোমাদের কেউ আমাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওকে ঘরে নিয়ে আটকে রাখো।
হেনডন নিজে থেকেই ওই কাজের ভার নিতে এগিয়ে এসে ওকে ঘরে নিয়ে গেল। ছেলেটা সমানে গালি দিচ্ছে আর নিষ্ফল ভাবে পা ছুঁড়ছে। বার্ট তার ভাড়াটে গুণ্ডাদের দিকে ফিরল।
তোমাদের কাজ শেষ হলে ছাপরায় আগুন ধরিয়ে করাল থেকে সবগুলো গরু তাড়িয়ে নিয়ে এসো, কঠিন সুরে সাঙ্গপাঙ্গকে আদেশ দিয়ে নিজের ঘোড়া নিয়ে সে রওনা হয়ে গেল। যাকে সে আসন্ন মৃত্যুর মুখে ফেলে গেল তার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না।
*
একঘণ্টা পর ছেলেটা ক্ৰীকের ধারের ঝোঁপের ভিতর তার লুকানো অবস্থান থেকে বেরিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পুড়ে ছাই হওয়া বাড়ি পার হয়ে বড় কটুউড গাছটার দিকে এগোল। ছাপরা থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে। গাছে ঝুলানো বাবার নিথর মৃতদেহটা দেখে সে ভীষণ ভাবে কেঁপে উঠল এক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকার পরে পা নড়তে না চাইলেও মনের জোরেই সে আবার এগোল। মৃতদেহের নিচেই কতগুলো জিনিস স্তূপ হয়ে পড়ে আছে–পুরোনো একটা মানিব্যাগ, তামাকের থলি আর একটা পাইপ, একটা লকেট, যার ভিতর ওর মায়ের ছবি আছে বলে সে জানে, একটা ভাঁজ করা বড় ছুরি, আর একটা কাগজ।-ওটাতে দ্রুতহাতে পেনসিল দিয়ে লেখা কয়েকটা শব্দ:
গুডবাই, বাছা। খুশি মনেই আমি বিদায় নিচ্ছি। আমাকে ভুলে যেয়ো না। আমি জানি উচিত কাজই তুমি করবে। বাবা।
পানি ভরা ঝাপসা চোখে মেসেজটা পড়ল সে।
রূদ্ধস্বরে সে আপন মনেই বলল, আমি যা উচিত সেটাই করব, বাবা, ওই। শয়তানটাকে আমি উচিত সাজাই দেব।
এর আগে যা সে বহুবার নিছক আনন্দের জন্যে করেছে, তাই তাকে আবারও করতে হলো; তবে এবার তা মোটেও আনন্দময় হলো না। গাছে চড়ে ছুরি দিয়ে ফাঁসির দড়িটা কেটে দিল। ঝপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল হার্ভির শিথিল দেহ। মাথাটা ঝিমঝিম করছে ওর। কয়েক মুহূর্ত গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচে নেমে এলো। বাবার গালে একটা চুমো খেয়ে ছোট্ট বাগান থেকে একটা বেলচা হাতে ফিরে এসে কবর খোড়া শুরু করল।
ছোট ছেলের জন্যে একটা কঠিন পরিশ্রমের কাজ। কবর দেয়া শেষ করতে বিকেল হয়ে গেল। চলে যাওয়ার জন্যে রওনা হতে গিয়েও সে হঠাৎ কি মনেকরে থমকে দাঁড়াল। পকেট থেকে ছুরিটা বের করে গাছের গোড়ায় সে তার বাবার ব্র্যান্ড ফোর বি বড়বড় অক্ষরে খোদাই করল।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তবু সদ্য গাছের বাকল তুলে লেখা নামটা যেন ঝলমলে সাদা দাঁত খিচিয়ে অন্যায় লিঞ্চিঙের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
ছেলেটা দেখতে পেল করালের কাছেই একটা গাছের সাথে তার ঘোড়াটা বাধা আছে। ওটার পিঠে তারই পুরোনো জিনটা চড়ানো হয়েছে। এসবের জন্য মনেমনে হেনডনকে ধন্যবাদ জানাল টেড।
আমি তোমার বাবার জন্যে কিছুই করতে পারব না, বাছা, ওর বাঁধন খুলে দিয়ে বলেছিল হেনডন। তবে তোমাকে পায়ে হেঁটে এখান থেকে বিদায় নিতে হবে না। তোমার জন্যে আমি একটা ঘোড়ায় জিন চাপিয়ে করালের পাশে রেখে যাব।
ঘোড়ার পিঠে উঠে শেষ বারের মত পিছন ফিরে তাকাল টেড। সব শেষ হয়ে গেছে।
আমি আবার ফিরে আসব, ব্ল্যাক বার্ট, বিড়বিড় করে বলল টেড বোলটন। এবং যখন ফিরব তখন তৈরি হয়েই ফিরব।
০১.
দুপুরের প্রখর ফোস্কা-পড়া রোদে হোপ এগেইন শহরটা ঝিমাচ্ছে; এই প্রচণ্ড গরমে পরিশ্রম করাটা অভিশাপ, আর ছায়া হচেছ একটা আশীর্বাদ। শহরের এই অদ্ভুত নামকরণের কারণ কেউ সঠিক বলতে পারবে না। হতে পারে নতুনের সন্ধানে কোন অভিযাত্রী-দল হয়ত বহু ধকল সহ্য করে প্রায় মরমর অবস্থায় দূর থেকে এদিকে গাছপালা দেখে এখানে পৌঁছে আশ্রয় পেয়ে শহরের ওই নাম রেখেছিল।
তবে এখানকার বাসিন্দাদের কাছে এখন এটা কেবল বোপ নামেই। পরিচিত। কিন্তু মরুভূমি ছাড়া আর কোনদিক থেকে আসা মানুষের কাছে নামটা অযৌক্তিক বলেই মনে হবে। এটা সীমান্তের অন্যান্য যেকোন শহরের মতই। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলো এমন দেখায় যে মনে হয় নিজেদের অসমান আর দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার জন্যে যেন ক্ষমা চাইছে। বাড়িগুলোর ফাঁকে ব্যবহার করা খালি টিন আর বিভিন্ন আবর্জনা। এগুলোর মধ্যে দুটো দালানই কেবল শহরের মান কিছুটা রক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে; এগুলোর একটা হচ্ছে হোটেল, আর দ্বিতীয়টা হিউগো সেলুন, যেটার নামের তলায় ‘আবার এসো’ লিখে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই সেলুনের সংলগ্ন একটা ডান্স হলও রয়েছে। শহরে আর যা আছে তার মধ্যে রোদে পোড়ানো ইটের তৈরি একটা মজবুত ব্যাঙ্ক, দুটো জেনারেল স্টোর, যার মধ্যে একটা পোস্ট অফিসের কাজও করে। এছাড়া একটা কামারশালা আর কয়েকটা ছোট সেলুনও আছে। রাস্তার দুপাশে চওড়া কাঠের ফুটপাত লোকজনের পথ চলার কাজ অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। উত্তরের মেসা মাউন্টিন থেকে নেমে আসা ছোট্ট নদীটার ওপর একটা কাঠের ব্রিজও আছে; ওই নদীই শহরবাসীর যাবতীয় পানির চাহিদা মেটায়। তবে নদীটা শহর থেকে মাইলখানেক এগিয়েই মরুভূমির বালুর ভিতর হারিয়ে গেছে। মরুভূমির সৌজন্যে শহরের প্রত্যেকটা বাড়ির ওপরই পুরু ধুলোর পরত পড়েছে।
শহরটাকে একেবারে পরিত্যক্ত বলেই মনে হচ্ছে। পুরো শহরে কেবল একটা ছোট সেলুনের দরজার মুখে দাঁড়ানো দুজন মানুষ ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তাদের একজন বেঁটে আর মোটা সেলুনের মালিক, ফেনটন যার চোখ দুটো নির্মল কৌতুকে সর্বক্ষণ ঝিকমিক করছে। অন্যজন, নবাগত স্ট্রেঞ্জার।
স্বভাবতই নবাগত লোকটার সম্পর্কে জানার কৌতূহল বোধ করছে ফেনটন। কিন্তু প্রকাশ করছে না, কারণ সে ভাল করেই জানে পশ্চিমে বেশি কৌতূহল প্রকাশ করাটা ডিনামাইটের মতই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
লোকটা বেশ লম্বা, বয়স সম্ভবত তিরিশের কোঠায়। চওড়া কাঁধ আর পাতলা কোমরে তাকে দেখেই বোঝা যায় লোকটা শক্ত ধাতুতে তৈরি। কোমরের দুপাশে দুটো পিস্তল ঝুলছে, দ্রুত বের করার সুবিধার জন্যে ওগুলো পায়ের সাথে ফিতে দিয়ে বাঁধা। ওর পরনের কাউবয় পোশাক সাধারণ হলেও পরিচ্ছন্ন। ওর পিস্তল দুটোও যে বহুল ব্যবহার দেখেছে তা দেখেই বোঝা যায়। ওর ঘোড়ার ব্র্যান্ড দেখেও ফেনটনের কোন লাভ হলো না, কারণ ওটা তার অপরিচিত।
ফেনটন আড়চোখে আগন্তুককে দেখে এবার আঁচ করার চেষ্টা করছে। এই শক্ত গড়নের লোকটা কি কোন বেকার কাউবয়, নাকি একজন পিস্তলবাজ, অথবা দুটোই? লোকটা কি কারণে হোপে এসেছে, এটা তো সরাসরি আর কোথাও যাওয়ার পথে পড়ে না-তাহলে লোকটা এখানে কি কারণে এসে। থাকতে পারে? লোকটার এই অদ্ভুত নীরবতা ওকে আরও কৌতূহলী করে তুলেছে।
রাস্তার একটু আগে দোতালা সেলুনের দিক থেকে পিস্তলের গুলির মত শব্দে একটা চাবুক ফোঁটার শব্দ শোনা গেল; একই সাথে একটা কুকুর আর্তচিৎকার দিয়ে প্রায় উড়ে এসে হোটেল থেকে বাইরের রাস্তায় ধুলোর ওপর আছড়ে পড়ল। অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে একটা লোক চাবুক হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো। কুকুরটা নিজের দুরবস্থা কিছুটা সামলে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে রাস্তা ধরে ফেনটনের সেলুনের দিকে মাত্র রওনা হয়েছিল, কিন্তু তার আগেই। চাবুকের দ্বিতীয় একটা বাড়ি ওর পিঠের কিছুটা ছাল তুলে নিল।
আমাকে কামড়াতে চেষ্টা করার উচিত শিক্ষাই তোকে আজ আমি দেব, বেজন্মা শয়তান!
কুকুরের ‘কেউ’ শব্দের সাথে লোকটার উল্লাসের হাসি শোনা গেল। পিস্তলের গুলির মত শব্দে যেন ম্যাজিকের মত লোকজনের মাথা হাজির হলো বিভিন্ন বাড়ির দরজা আর জানালায়। কৌতূহলী কিছু লোক ফুটপাতেও নেমে এলো, কিন্তু খুব সতর্ক আছে ওরা, যদি গোলাগুলিই হয় তবে সীসার গুলি কোনদিকে যাবে তার কোন ঠিক নেই। কি ঘটছে দেখার পর ওদের কয়েকজন হেসে উঠল। একজন মন্তব্য করল, পাগলা মার্টি আবার খেপেছে!
চাবুকটা ফেলে দাও! কঠিন স্বরে আদেশ এলো।
স্ট্রেঞ্জার হঠাৎ সজীব হয়ে নিমেশে ফুটপাতে নেমে এলো, ওই কথাটা সে-ই বলেছে। মার্টির খুদে চোখ দুটোতে বুনো বিস্ময় ফুটে উঠেছে।
জাহান্নামে যাও তুমি, রোষের সাথে জবাব দিল সে।
ওটা ফেলে দাও বলছি, পাজি খটাস! আবার নির্দেশ এলো। এবার ওর স্বরে ঠাণ্ডা হুমকির পরিষ্কার স্পষ্ট আভাস।
সেটা টের পেয়ে একটু থমকাল মার্টি। সে স্পষ্ট বুঝে নিয়েছে এখন হয় ওকে আদেশটা মানতে হবে অথবা লড়তে হবে। সে একসাথে দুটোই করার সিদ্ধান্ত নিল। চাবুকটা ফেলে দিয়ে পিস্তল বের করার জন্যে হাত বাড়াল সে। নবাগত লোকটাকে দেখে মনে হলো তার যেন কোন তাড়া নেই। মাটি তার খাপ থেকে পিস্তল না বের করা পর্যন্ত নবাগত লোকটা একেবারে স্থির দাঁড়িয়ে। থাকল। কিন্তু পিস্তলটা খাপ থেকে বের করার সাথেসাথেই কোমরের পাশ থেকে স্ট্রেঞ্জারের বাম হাতের পিস্তল গর্জে উঠল। মার্টি কাত হয়ে ধুলোর ওপর পড়ল। পিস্তলটাও হাত থেকে ছুটে ধুলোয় গড়াচ্ছে। এবার নবাগত লোকটা মার্টির। দিকে এগিয়ে গেল।
ওই কুকুরটা কি তোমার? প্রশ্ন করল সে।
আহত লোকটা রোষের সাথে জবাব দিল, হ্যাঁ, কিন্তু তাতে তোমার কি?
আমি তোমার কুকুরটাকে কিনে নিচ্ছি, ঠাণ্ডা স্বরে জবাব দিল লোকটা। তারপর পকেট থেকে নোটের একটা মোটা বান্ডিল বের করে ওখান থেকে একটা নোট খুলে মার্টির দিকে ছুঁড়ে দিল। কুকুরের দামের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি দিলাম, এবং তোমার পঞ্চাশ গুণ, অবজ্ঞার সুরে বলল সে।
ব্যাপারটার এখানেই শেষ নয়-এর পুরো শোধ আমি তুলে ছাড়ব! রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল মার্টি।
আগে নিজেকে সামলে নাও তারপর আমার সামনে দাড়াবার কথা ভেবো।
বাম হাত দিয়ে ডান হাতের জখম চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল সে। ওর আঙুলের ফাঁক দিয়ে ফোঁটাফেঁটা রক্ত বেয়ে পড়ছে। ওকে কয়েক সেকেন্ড লক্ষ করে কুকুরটার দিকে নজর দিল বিজয়ী। ওটা অবলা প্রাণী হলেও পুরো ঘটনা দেখে সে ঠিকই বুঝেছে অকথ্য নির্যাতন থেকে ওকে কে বাঁচিয়েছে-এবং কে ওর বন্ধু। লেজ নাড়তে নাড়তে কম বয়সী কুকুরটা ওর ত্রাণকর্তার দিকে এগিয়ে এলো। ঝুঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে একটু আদর করে দিল লোকটা।
তোমাকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, বাছা, বলল সে। তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে নিয়মিত খাবারও তোমার কপালে জোটেনি। ঠিক আছে, সেটার ব্যবস্থা আমি করব।
কাপুরুষ!
স্বরটা নিচু, এবং যেটা মিষ্টি হওয়ার কথা, সেটা এখন রাগ আর বিদ্বেষে। ভরপুর। কুকুরটাকে আদর করা ছেড়ে অবাক হয়ে লোকটা মুখ তুলে চাইল। পাশের একটা দোকান থেকে কথাটা বলা হয়েছে। বক্তা মাঝারি উচ্চতার। পাতলা গড়নের সুন্দরী এক তরুণী মেয়ে। রাইডিং পোশাক পরায় ওর সুগঠিত দেহের সৌন্দর্য আর বাঁকগুলো যেন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। মেয়েটার গলায় একটা রুমাল কাউবয় স্টাইলে পেঁচানো রয়েছে। মাথার মোটা কাপড়ের নরম হ্যাটটা ওর বাদামী চুল পুরোপুরি চাকতে পারেনি। ওই চুলের ওপর রোদ পড়ে একটা চমৎকার তামাটে উজ্জ্বলতা এনেছে।
লোকটা মরে যেতে পারত, রাগের সাথে বলে চলল সে।
স্বভাবতই স্ট্রেঞ্জার বুঝতে পারছে যে মেয়েটা কুকুরের মালিক সম্পর্কেই কথা বলছে। লোকটার চোখে দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল।
আমি চাইলে সে অবশ্যই মরত, গম্ভীর স্বরে জবাব দিল সে। কিন্তু আমি কেবল ওর পিস্তল ধরা হাতটা জখম করেছি। মনে হচ্ছে তুমি কুকুর পছন্দ করো না, ম্যাম?
তোমার ধারণা ভুল-আসলে কুকুর আমার খুব প্রিয়, জবাব দিল মেয়েটা। কিন্তু ওদের আমি মানুষের সম পর্যায়ের বলে মনে করি না।
স্ট্রেঞ্জারের চোখদুটো আনন্দে ঝিলিক দিয়ে উঠল। তুমি ঠিক কথাই বলেছ, বলে উঠল সে। কোনকোন সময়ে সেটা কুকুরকে অপমান করারই সামিল হয়।
মেয়েটা নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল। তুমি ওই লোকটাকে উস্কে পিস্তল ড্র করতে বাধ্য করেছ। কারণ তুমি জানতে তুমিই ওর আগে গুলি ছুঁড়তে পারবে।
যাকে আমি আগে কখনও দেখিনি তার ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে আমি কিভাবে জানব? শান্ত স্বরে নিজের পক্ষে যুক্তি দেখাল সে। তাছাড়া সে তার পিস্তল বের করে ফেলেছিল, এবং তার উদ্দেশ্য মোটেও ভাল ছিল না।
হ্যাঁ, সমান সমান সুযোগ-পেশাদার খুনীর সেই চিরাচরিত অজুহাত, মেয়েটা ঘৃণার সাথে বলল। তুমিও একটা খুনী, তাই ওই অজুহাত দেখাচ্ছ, আমার ধারণা পিস্তলে আরও একটা আঁচড় বাড়াবার উদ্দেশ্যেই তুমি এটা করেছ। জানো, গুলি ছোড়ার সময়ে আমি তোমাকে হাসতে দেখেছি!
এক ঝটকায় পিস্তলের হাতল দুটো মেয়েটাকে দেখাতে তুলে ধরল সে। তারপর ওগুলো আবার খাপে ভরে রেখে কুকুরটার উদ্দেশে বলল, মনে হচ্ছে এখন থেকে বাঁট দুটোতে আমার কিছু আঁচড় কাটা শুরু করতে হবে; এই কাজটা পুরোপুরি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে, বাছা।
আগুন বর্ষানো চোখে মেয়েটা ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তুমি অসম্ভব রকম উদ্ধত, বলে আবার দোকানে ঢুকে পড়ল।
মেয়েটার সাথে কথা বলার সময়ে লোকটা মাথা থেকে হ্যাটটা নামিয়ে নিয়েছিল, সেটা আবার পরে নিয়ে কুকুরটাকেই বলল, এখানে আমরা একেবারেই অবাঞ্ছিত, বাছা, ওর কাছে আমাদের মূল্য রাস্তার ধুলোর চেয়েও কম। তবে মেয়েটা দেখলে যে চোখ জুড়িয়ে যায় তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ওর কথা শেষ হতেই চারজন ঘোড়সওয়ার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ফেনটনের সেলুনের পাশে এসে থামল। ওদের লীডার বিশাল দেহধারী কালো চুলের একটা লোক; নাকটা টিয়ার ঠোঁটের মতই বাঁকা। বোঝাই যাচ্ছে লোকটার মেজাজ খুব চড়ে আছে।
তুমিই সেই লোক যে আমার একজন লোককে গুলি করেছে? এক নিঃশ্বাসে বলল লোকটা।
তুমি কি আমার সাথে কথা বলছ? মুখ তুলে চেয়ে প্রশ্ন করল স্ট্রেঞ্জার। আমি একটা দুপেয়ে খটাসকে গুলি করেছি বটে; সে যদি ভোমার আউটফিটের কেউ হয়, তাহলে বলতেই হবে মানুষ আর জন্তুর তফাৎ তুমি বোঝ না।
লোকটা অপমানটা উপেক্ষা করে বলল, একটা কুকুর আর তার মালিকের মধ্যে কোন অধিকারে নাক গলিয়েছ তুমি?
আমার ডাইনে আর বায়ে দুদিকেই একটা করে অধিকার ঝুলছে, দাঁত বের করে হেসে পিস্তলের বাঁট দুটো ছুঁয়ে জবাব দিল সে।
হুম, তাহলে তুমিও বেয়াড়া দলের একটা লোক, অবজ্ঞার সাথে বলল সে। এখানে তোমার কি কাজ?
সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার, উদ্ধত স্বরে বলল স্ট্রেঞ্জার; তুমি জিজ্ঞেস করার কে? তুমি কি এখানকার শেরিফ বা তার কোন ডেপুটি?
যেমন ধীর স্বরে কথাগুলো উচ্চারিত হলো তা সুস্পষ্ট ভাবেই অপমানজনক। দলপতির চোয়াল দুটো রাগে শক্ত হয়ে ফুলে উঠল।
আমি শেরিফ নই, বলল সে। কিন্তু
কিন্তু তোমার আদেশেই সে চলে, ওকে বাধা দিয়ে ব্যঙ্গের সুরে বলল স্ট্রেঞ্জার। ভাল, সেটা তো প্রায় সমান কথাই হলো, তাই না? এবার কঠিন সুরে বলল, তোমার পিছনের লোকটা যদি তার হাত স্থির না রাখে তাহলে তোমার আরও একটা লোক কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এর মধ্য নাক গলাতে এসো না, ডোভার, যা করার তা আমিই করব, বলল লীডার। তারপর আবার স্ট্রেঞ্জারের দিকে ফিরে বলল, আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এখানে তোমার কি কাজ। আমার ধৈর্যের সীমা পরীক্ষা করতে চাওয়ার ফল ভাল হবে না।
অপরিচিত লোকটা হাসল। তোমার ধৈর্যের সীমা! বলল সে। না, তোমার কতটা নার্ভ আছে সেটাই আমি দেখতে চাই। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকগুলো চেয়ে, অবাক হয়ে দেখল দুহাতে দুটো পিস্তল বাগিয়ে ধরে ওদের কাভার করে আছে স্ট্রেঞ্জার। ও যে কখন পিস্তল বের করেছে তা টেরই পায়নি কেউ। শোনো, তোমাদের ভালর জন্যেই আমি বলছি, ঠাণ্ডা স্বরে হুমকি দিল সে, তোমাদের চারজনকে ফেলে দিতে আমার চার সেকেন্ড সময় লাগবে না। লোকটা যে মিথ্যে হুমকি দেয়নি সেটা ওর পিস্তল ড্র করার ধরন দেখেই নিঃসন্দেহে বুঝে নিয়েছে ওরা। ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিল সবাই। শেষ কথাটা ওদের দলপতিই বলল।
এবারে তোমার জিত হলো বটে, কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হলো মনে করলে খুব ভুল করবে-আবারও আমাদের দেখা হবে।
আমিও সেই আশাতেই থাকলাম, জবাব দিল, স্ট্রেঞ্জার।
অনেকগুলো কৌতূহলী লোকের বিহ্বল দৃষ্টির সামনে অভিভূত আর অপমানিত দলটা ধীর গতিতে এগিয়ে আবার এসে সেলুনের সামনে ঘোড়া থামিয়ে দরজা দিয়ে ভিতরে অদৃশ্য হলো। নবাগত লোকটা ঘুরে দাড়িয়ে দেখল ফেনটন সেলুনের মালিক অবাক চোখে ওর দিকেই চেয়ে আছে।
কি হলো, ওল্ড টাইমার? কোন সমস্যা হয়েছে?
সমস্যা আমার হয়নি-সমস্যাটা হয়েছে তোমার। তুমি জানো ওই লোকটা কে? ওকে মাথা নাড়তে দেখে সে বলে চলল, ওর নাম ব্ল্যাক বার্ট, যদিও ওর সামনে কেউ ওকে ওই নামে ডাকতে সাহস পায় না, কেবল বার্ট বলেই ডাকে। ও যখন কথা বলে, কেউ ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলে না-মাথা হেট করে থাকে।
তাই নাকি? সহজ সুরে বলল সে। তাহলে তো এটা ওর জন্যে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলো।
হ্যাঁ, কিন্তু এর গুরুত্ব ঠিক বুঝতে পারছ না তুমি। সোজা ভীমরুলের চাকে হাত দিয়েছ তুমি। এটা মোটেও হাসির ব্যাপার নয়। এই পুরো শহরটাই ওর হাতের মুঠোয়। প্রথম সুযোগেই তোমাকে সে তার দলবল নিয়ে গুলি করে আঁঝরা করবে।
আশা করি এই শহরে বেশ বড়সড় কবরখানা আছে, কারণ ওরা আমার সাথে লাগতে এলে ওটার প্রয়োজন হবে, জবাব দিল সে। কবরে গেলে আমি একা যাব না, ওদেরও সাথে নিয়ে যাব।
এটা ঠিক যে তুমিও ওদের কিছু লোককে মারতে পারবে বটে, কিন্তু তাতে কি লাভ হবে? একজন লোক কি বিশজনের বিরুদ্ধে জিততে পারবে? বার্টের সাথে আমার মোটেও সখ্যতা নেই, কিন্তু তোমার পক্ষ নিলে সে আমার দোকান লণ্ডভণ্ড করে দেবে-তবু প্রয়োজন হলে তোমাকে আমি সাহায্য করব।
স্ট্রেঞ্জারের চোখ দুটো খুশিতে উতল হয়ে উঠল। তুমি খুব সাদা মনের লোক, স্যার, বলল সে। এখনকার মত আমি নিজের পথ ধরছি; পরে আবার দেখা হবে।
ওর চলায় কোনরকম তাড়া দেখা গেল না। সোজা দোকানের সামনে রাখা নিজের ঘোড়র কাছে গিয়ে সে জিনে চেপে বসে শিস দিয়ে কুকুরটাকে ডাকল।
অবলা প্রাণী হলে কি হবে, ওর চোখের সামনে যা যা ঘটেছে সবই সে লক্ষ করেছে। কে যে তার বন্ধু সেটা সে ঠিকই বুঝেছে। শিস শোনার সাথেসাথে সে দৌড়ে ছুটে এল। শহর ছেড়ে ট্রেইল ধরার পর থেকে সে-ই ঘোড়ার আগে আগে ছুটল। যেন কাল্পনিক খরগোশের পিছনে ধাওয়া করছে। কিন্তু অল্পক্ষণ পরপরই আবার ফিরে এসে নতুন প্রভুকে উত্তেজিত স্বরে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
তুমি একটা কৃত বাচ্চা কুকুর, তাই না? কুকুরের উচ্ছ্বসিত আনন্দের প্রকাশ দেখে মন্তব্য করল রাইডার। এখনও তোমার দাম পুরোপুরি চুকানো হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস।
সেলুনের মালিক ওকে যতক্ষণ দেখা যায় দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে থেকে শেষে নিজের খালি সেলুনের বারের পিছনে দাঁড়াল; গভীর চিন্তায় মগ্ন তার চেহারা।
সবাই তোমরা চুপ করো, বিড়বিড় করে খালি সেলুনে যেন নিজেকেই বল সে, শহরে একটা লোক এসেছে বটে!
০২.
জ্যাক মাস্টারসন, লেজি এম র্যাঞ্চের মালিক তার র্যাঞ্চহাউসের বারান্দায় একটা চুরুট মুখে বসে চিন্তামগ্ন মনে ট্রেইলের দিকে চেয়ে আছে। ওটা একটা সরু সাদা ফিতের মত এঁকেবেঁকে হোপ এগেইন শহরের দিকে এগিয়ে গেছে। সাধারণত হাসিখুশি চেহারার লোকটাকে গত কয়েক বছর ধরেই মাঝেমাঝে একটা কালো বিষণতায় ডুবে থাকতে দেখা যায়। এই এলাকার সবথেকে ভাল এবং অনেক বর্গমাইল জায়গা জুড়ে তার র্যাঞ্চ থাকা সত্ত্বেও ওর এই বিষণ্ণতার কি কারণ থাকতে পারে এটা বোঝা ভার।
অল্পক্ষণের মধ্যেই র্যাঞ্চারের অভিজ্ঞ চোখে ট্রেইলের ওপর বহু দূরে একটা ছোট্ট বিন্দুর মত কি যেন ধরা পড়ল। পনেরো মিনিটের মধ্যেই ওটা বড় হয়ে একজন রাইডারে পরিণত হলো। ওর সামনে আরও একটা ছোট বিন্দুর মত কিছু ছুটছে।
এটা নিশ্চয় সেই লোক, আপন মনেই বলল র্যাঞ্চার। কিন্তু একটা কয়োটিকে সে কেন ধাওয়া করছে?
র্যাঞ্চহাউসের ঢাল শুরুর কাছে ট্রেইলটা বাঁক নিয়েছে বলে রাইডার। কিছুক্ষণের জন্যে বাঙ্কহাউসের আড়ালে অদৃশ্য হলো। জ্যাক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির ভাবে বারান্দায় পায়চারি করা শুরু করল। ওকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না; শীঘ্রি রাইডারকে আবার দেখা গেল। হাত তুলে সংবর্ধনা জানিয়ে বিশ গজ দূরে ঘোড়া থামিয়ে দাঁড়াল সে।
হ্যালো, জেমস; আবার তোমার দেখা পেয়ে খুব খুশি হলাম। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ভিতরে এসো।
যে কামরায় ওরা ঢুকল সেটা এই সময় আর দিনকাল অনুযায়ী অত্যন্ত বিলাসী। পুরো কামরার মেঝে কারপেটে মোড়া; ভারী ওকের আসবাবপত্র শোভা পাচ্ছে; একটা পিয়ানোও রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থিত স্টেশন থেকে ওগুলো ওয়্যাগনে করে এখানে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। খোলা ফায়ার প্লেসের সামনে পাতা রয়েছে একটা ভালুকের চামড়া। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নানারকম ইন্ডিয়ান ট্রোফি আর ছবি অতিথি আপ্যায়নের জন্যে টেবিলের ওপর একটা বোতলের সাথে দুটো গ্লাস রেখে চুরুটের বাক্সটা ওর দিকে ঠেলে দিল সে। একটা চুরুট তুলে নিয়ে অপেক্ষায় রইল জেমস।
দুহপ্তা আগে আমার ফোরম্যান স্টিভকে কেউ পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছে,’ কথা আরম্ভ করল র্যাঞ্চার। আমি ওদের অনেক টাকা দিয়েছি, কিন্তু এখন আমার পক্ষে আর টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়। স্টিভ খুব অনুগত আর শান্ত প্রকৃতির লোক ছিল, এবং ওর কোন শত্রু ছিল বলে আমার জানা নেই। যে লোক ওর জায়গা নেবে তাকেও একই রকম বিপদ পোহাতে হবে। পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছ তো?
নিশ্চয়, বেপরোয়া সুরে জবাব দিল জেমস।
অনেক বছর ধরে একটা লোক আমার পিছনে লেগে আছে। এখন সে আমার গরু নিয়ে যেতে শুরু করেছে। ওকে উচিত শিক্ষা দেয়ার একটা পরিকল্পনা আমার আছে। কিন্তু এতে আমি বিফলও হতে পারি। কারণ কাজটায় বেশ ঝুঁকি আছে। তাই একজন যোগ্য লোকের হাতে আমি এই র্যাঞ্চের ভার তুলে দিতে চাই। সেইজন্যেই আমি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। তোমার কি মত?
লোকটা কে? প্রশ্ন করল আগন্তুক।
ব্ল্যাক বার্ট, বার বির মালিক। মেসা মাউন্টিনের কাছে ওর র্যাঞ্চ, জবাব দিল জ্যাক। এবার সে আমার র্যাঞ্চের দিকে হাত বাড়াবে।
আমি তোমাকে সাহায্য করব, সংক্ষেপে জবাব দিল সে।
র্যাঞ্চারের চেহারা আশ্বস্ত দেখাল। পরবর্তী কথায় বোঝা গেল লোকটা আসলেই সৎ। সে বলল, তুমি যদি আমার প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখার জন্যে দু’এক দিন সময় নিতে চাও তাতে আমি কিছু মনে করব না। তুমি বরং একটু ভেবেচিন্তেই জবাব দিয়ো। কারণ যে-প্রস্তাবটা আমি দিয়েছি সেটা সত্যিই একটা শক্ত কাজ। এই এলাকায় বার্টই হচেছ সর্বেসর্বা। কেউ ওর বিরোধিতা করলে সে বেশিদিন বাঁচে না-সেইজন্যেই তোমাকে আমি সময় নিয়ে ভেবে জবাব দিতে বলছি।
আমার তরফ থেকে এতে ভেবে দেখার কিছুই নেই, বলল জেমস। কিন্তু একটা কথা তোমাকে আমার জানিয়ে রাখা উচিত, সেটা হচেছ জাজ এমারি তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময়ে আমাকে জেমস গ্রীন বলে পরিচয় দিলেও আমার আসল নাম হচ্ছে এরফান জেসাপ। টেক্সাসে আমি বিদ্যুৎ এরফান বলেই বেশি পরিচিত; হয়ত নামটা তুমি শুনেছ?
হঠাৎ সোজা বসে অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ এরফানের দিকে চেয়ে থেকে সে বলল, শুনেছি মানে? ওই নাম এদিকের সবার কাছেই পরিচিত। পিস্তলে তোমার হাত বিদ্যুতের মত দ্রুত চলার গল্প এখানে আমরা অনেক শুনেছি।
সেইজন্যে জাজকে আমার নামটা গোপন রাখতে আমিই অনুরোধ করেছিলাম, এবং তোমাকেও আমি একই অনুরোধ করছি তুমি আমাকে জেমস বলেই ডেকো। এখানে কথাটা এত সহজে জানাজানি হয়ে যাক এটা আমি চাই না; এতে আমার কাজ কিছুটা সহজ হবে।
বেশ, তুমি যা চাও তাই হবে। আমি জানি তোমাকে আউটলরাও যমের মতই ভয় করে। তোমার পরিচয় জানলে সহজে তোমার কাছে কেউ মুখ খুলবে না এটা আমি ভাল করেই জানি। ওই বার্ট লোকটা একটা পাকা শয়তান। সে-ই এখন আমাকে জ্বালাতন করছে। র্যাঞ্চার এরফানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। শেক, বলল সে।
হাত মিলিয়ে এরফান বলল, তাহলে আমিও তোমাকে জ্যাক বলেই ডাকব।
জ্যাক বলল, এখন আমার আশা হচ্ছে যে আমার কপাল সত্যিই বদলাতে শুরু করেছে। আমি তো শুনেছি তোমার নিজেরই ওয়াইওনিঙে একটা বিরাট র্যাঞ্চ রয়েছে: তুমি এর মধ্যে নিজেকে জড়াতে যাচ্ছ কেন?
এমারি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এবং এতে আমার নিজস্ব কারণও কিছু আছে। তাছাড়া ইতোমধ্যে এর সাথে হরে আরও কিছু কারণ যোগ হয়েছে। শহরে ব্ল্যাক বার্টের সাথে যা যা ঘটেছে তা খুলে বলল সে মেয়েটার কথাটা কেবল এড়িয়ে গেল।
বার বি মালিকের এভাবে সবার সামনে অপমানিত হওয়ার বর্ণনা শুনে হো হো করে হেসে উঠল জ্যাক ব্ল্যাক বার্ট আর তার তিন সঙ্গীর ওই দুরবস্থা, নিজের চোখে দেখার জন্যে আমি ওরডান হাত কেটে দিতেও আপত্তি করতাম না। আমার মনে হয় আগে তাকে কখনও চারজন থাকা সত্ত্বেও একজনের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপমান হজম করতে হয়নি। এটা সে সহজে ভুলবে না, জেমস। পাগল মাটিও সাইড ওয়াইন্ডার সাপের মতই বিও। (ওই মরু-সাপের মুখ সামনের দিকে থাকলেও ওরা এঁকেবেঁকে পাশের দিকে চলে বলেই ওই সাপের এই নামকরণ করা হয়েছে) তোমার এখন থেকে একটু সাবধানে চলাফেরা করা দরকার।
আমি সবসময়েই সাবধানে চলি, বলল এরফান। তোমার সব লোকজন কি বিশ্বাসী?
র্যাঞ্চার মাথা নাড়ল। আমার সেটা জানা নেই, জবাব দিল সে। ওটা তোমার নিজেকেই বিচার করে বুঝে দেখাতে হবে। কিছু লোককে বাটের চাপে পড়ে আমাকে কাজে নিতে হয়েছে। এই ব্যাপারে তোমার পুরো স্বাধীনতা থাকবে।
মাথা ঝাঁকাল এরফান। তুমি বলছ বার্ট তোমার গরু নিয়ে যাচ্ছে। তুমি কি বলতে চাও সে ওগুলো চুরি করছে?
না, ও একটা সাক্ষাৎ শয়তান, খেপে উঠল জ্যাক। সে শুধু বলে দেয়। পঞ্চাশ বা একশোটা গরু পাঠিয়ে দাও, এবং আমাকে বাধ্য হয়ে তাই পাঠাতে হয়। একটা বিশেষ কারণ আছে যেজন্যে ওর প্রস্তাব আমি এখনও প্রত্যাখ্যান করতে পারছি না। তুমি এখানে এসে পড়ায় আমি স্বস্তি পাচ্ছি, জেমস; আমার বিশ্বাস যদি কেউ পারে তাহলে একমাত্র তুমিই ফিল আর আমাকে এই সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে পারবে।
ফিল? আমি জানতাম না তোমার একটা ছেলেও আছে।
না, আমার কোন ছেলে নেই; ফিলিপা আমার মেয়ের নাম। আমার কোন ছেলে নেই বলে ওকেই আমি ফিল বলে ডাকি।
এই সময়ে বাইরে থেকে পাতলা স্বরে একটা ডাক শোনা গেল। হ্যালো, দা হাউস।
ওই যে ফিল এসে গেছে, বলে উঠে দাঁড়াল র্যাঞ্চার। আমি একটা ছেলেই চেয়েছিলাম, কিন্তু যখন মেয়ে হলো তখন ওকে দিয়েই আমাকে ছেলের সাধ মেটাতে হলো। মনে রেখো, ও কিন্তু এসব কোন কথাই জানে না।
জ্যাকের পিছন পিছন এরফানও বারান্দায় বেরিয়ে এলো। মেয়েটা বাবাকে আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরে আদর জানানোর পরে শহরে দেখা নবাগত লোকটার দিকে ওর চোখ পড়ল। ওকে দেখামাত্র বাবাকে ছেড়ে পিছিয়ে গেল সে।
ফিল, তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই, বলল সে। এ হচ্ছে জেমস গ্রান, স্টিভের জায়গায় ওকে কাজে নিয়েছি আমি।
মেয়েটা হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়াল। ওর চোখে কোন স্বাগত জানানোর চিহ্নও ফুটে উঠল না। মিস্টার গ্রীনের সাথে আমার আগেই দেখা হয়েছে, নির্লিপ্ত স্বরে বলল সে।
র্যাঞ্চার অবাক হয়ে চেয়ে আছে দেখে ব্যাখ্যা করল এরফান।
আমি কুকুরটা কেনার সময়ে মিস মাস্টারসন ওখানে উপস্থিত ছিল। আমার সাথে, বেশ কিছু কথা কাটাকাটি হওয়ার পর লোকটা পিস্তল বের করে। আমি হাতে গুলি করে ওর পিস্তলের হাত জখম করেছি সেটা তোর তোর ঠিক পছন্দ হয়নি।
গম্ভীর সুরেই কথা বলেছে এরফান; কিন্তু তবু মেয়েটার কাছে মনে হয়েছে ওর চোখদুটো যেন বঙ্গভরে হাসছে। এতে ওর রাগ আরও বড় র্যাঞ্চারের চোখ এরফানের ঘোড়ার পাশে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কুকুরটার ওপর পড়ল।
কুকুর সম্বন্ধে আমার বিশেষ জ্ঞান নেই, তবে ওটাকে দেখে তো আমার কাছে নিতান্ত সাধারণ একটা কুকুর বলেই মনে হচ্ছে; ওটার জন্যে তুমি এত ঝামেলা পোহাতে গেলে কেন?
সাধারণ কুকুরই আমার পছন্দ। ওটা অন্তত গর্বে নাক উঁচু করে আমাকে সাধারণ কাউবয় হিসেবে হেয় মনে করবে না। না, স্যার, ওই কুকুরটা যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে। ওর চোখদুটো বেশ দূরে বসানো; আমার সাথে চলার যোগ্যতা ওর আছে।
র্যাঞ্চার ওর কথায় হেসে উঠল, কিন্তু মেয়েটা ওই হাসিতে কোন অংশ নিল। জেমস তার বিনয়ী কথার অন্তরালে যেন ভদ্র ভাষায় তাকেই খোঁচা দিল। বলে মনে করে কঠিন হলো তার চোখ।
তুমি কি আমাদের সাথে সাপার খাবে, জেমস? প্রশ্ন করল র্যাঞ্চার।
ধন্যবাদ, কিন্তু আমি অন্যান্য কাউবয়দের সাথেই খাব, জবাব দিল এরফান। প্রস্তাবটা যে ফিলিপাও সমর্থন করেনি এটা নতুন ফোরম্যানের নজর এড়ায়নি।
র্যাঞ্চার মাথা ঝাঁকাল। এই সময়ে কাউহ্যান্ডদের ফিরে আসার শব্দে সে বলল, এসো তোমার সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিই। আমি এখনই ফিরে আসছি, ফিলি।
মেয়েটা নবাগত লোকটাকে ছোট্ট একটা নড় করে ওখানেই দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত ওদের যাওয়া লক্ষ করল। লোকটাকে ওর পছন্দ না হলেও ওকে চিতার মত মসৃণ ভাবে চলতে দেখে নিজের অজান্তেই কেন যেন সে শিউরে উঠল।
লোকগুলো ঘোড়ার পিঠ থেকে জিন নামাচ্ছিল, কিন্তু মালিক কিছু বলতে এগিয়ে আসছে দেখে থামল। পরিচয়ের পালা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলো।
এ হচ্ছে জেমস গ্রীন, বয়েজ। স্টিভের জায়গায় ওকে নেয়া হয়েছে, এবং এখন থেকে সেই তোমাদের বস।
কিছু লোক হাওডি বলল, কেউ কেবল নড করল, কয়েকজন শুধু চেয়ে থাকল। এরফানের কাছে ওদের দৃষ্টি ঠিক বন্ধুসুলভ বলে মনে হলো না। সে নিজেও নীরব থেকে মনেমনে ওদের কেবল যাচাই করল।
পাশের ওটাই তোমার থাকার কামরা, জেমস, বলে আঙুল তুলে পাশেই কাঠের তৈরি ছোট একটা বাসা দেখাল জ্যাক। ওটা আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা হয়েছে, তোমার যদি আর কিছুর দরকার হয় তবে রাধুনীকে জানালেই তা। পাবে; পরে আবার দেখা হবে।
এরফান ঘোড়ার পিঠ থেকে জিন আর ব্যাগ নামিয়ে ওকে করালে ছেড়ে দিয়ে নিজের নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে ঢুকল। এক রূমের কেবিনটায় একটা বিছানা, একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার রাখা আছে সামনে এবং পিছনে একটা কারে জানালা রয়েছে, বাচচা কুকুরটা ভিতরে ঢুকে চারপাশ একবার ভাল করে শুঁকে দেখে বিছানার গোড়ায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে প্রভুর দিকে চেয়ে শুয়ে থাকল।
কি রে, জায়গাটা তোর পছন্দ হয়েছে তো, টমি? প্রশ্ন করল এরফান। সে ওটার নাম রেখেছে টমি।
টমি কোন জবাব দিল না। জামা কাপড় থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলে দরজার দিকে এগোল এরফান। বাইরে থেকে কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
কুকুর আমি মোটেও পছন্দ করি না, বলছিল রাঁধুনী ড্যানিয়েল। রাতের বেলা ওদের আমি ভীষণ ভয় পাই।
এরফানের আগমনে ওর কথায় ছেদ পড়ল। বিশালদেহী নিগ্রো লোকটা ছোট্ট টমিকে দেখে ভয়ে যেভাবে কুঁকড়ে গেল তাতে নতুন ফোরম্যান হেসে ফেলল।
আমি তোমাকে ওদের বশ করার নতুন একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিচ্ছি, ড্যানিয়েল, বলল সে। তুমি ওকে একটা বড় মাংসের টুকরো খেতে দাও, দেখবে সে তোমার সারা জীবনের বন্ধু হয়ে গেছে। ওরা মানুষের মত নয়-একবার তোমার কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পেলে সেটা সে কখনও ভুলবে না।
কালো লোকটা বিশদ একটা হাসি দিল। ঠিক আছে, স্যার, ওকে আমি পেট ভরেই খেতে দেব, বলল সে।
সাপারের সময়ে তাই ঘটতে দেখা গেল। লম্বা টেবিলের মাথায় বসে আর সবার সাথে খাচ্ছে এরকান। ওর পায়ের কাছে বসে বড় এক টুকরো মাংস চিবাচ্ছে টমি। এরফান নিজে চুপ করে খাওয়ার ফাঁকে তার সামনে বসা লোকগুলোকে যাচাই করে দেখছে। ওখানে মোট দশজন লোক রয়েছে, সে জেনেছে আরও তিনজন লোক দূরবর্তী লাইন ক্যাম্পে কাজ করছে। যুবক বয়সের লোকের সাথে কিছু মাঝবয়সী লোকও রয়েছে, ওখানে। ওদের সবাইকে বেশ শক্ত সমর্থ লোক বলেই এরফানের ধারণা হলো। তবে ওদের মধ্যে একজন বিশেষ করে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। লোকটার নাম বুল ডেভিস। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি; নামের সাথে ওর যথেষ্ট মিল আছে। যাঁড়ের মতই শক্তিশালী মাঝারি গড়নের মানুষটার চোখদুটো ওর বিশাল মাথায় খুদে দেখাচ্ছে। ও যে এরফানের কর্তৃত্ব ঠিক মেনে নিতে পারেনি এটা ওর চেহারায় স্পষ্টই প্রকাশ পাচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে সে এখন তার কফির দিকে চেয়ে আছে।
এই কালো কালির ডিব্বা, চিৎকার করল সে, এটা কি তৈরি করেছ তুমি?
একটু মুচকি হেসে এরফান তার কফিতে চুমুক দিয়ে স্বাদ নিয়ে দেখল। আমার কাছে তো বেশ ভালই মনে হচ্ছে, শান্ত স্বরে বলল সে।
তোমার কাছে তাই মনে হচ্ছে? টিটকারির সুরে বলল বুল। যে যেমন খেয়ে অভ্যস্ত স্টিভ কখনও এটা বরদাস্ত করত না-সে তার কাজ ঠিকই বুঝত। ওর মত ভাল ফোরম্যান আমরা আর সহসা পাব না।
ইচ্ছাকৃত ভাবে বেয়াড়া ব্যবহার করার চেষ্টা ওর ভাবে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু এরফান কোন জবাব দেয়ার আগেই পাতলা গড়নের ছেলে ল্যাঙ্কি বলে উঠল, হ্যাঁ, স্টিভ সত্যিই ভাল লোক ছিল বটে, বুল, কিন্তু তুমি এটা আবিষ্কার করতে একটু বেশি দেরি করে ফেলেছ না? দাঁত বের করে হাসল সে। এতদিন পরে দরদ হঠাৎ করে কেন উথলে উঠল? আমরা সবাই স্টিভের লাশ আনতে যাওয়ার সময়ে তুমি কোথায় ছিলে? ওর জন্যে কোন শোক তুমি প্রকাশ করোনি। এমনকি ওকে কবর দেয়ার সময়েও আমরা কেউ তোমাকে দেখিনি। আমার তো সন্দেহ হয় ওর জায়গায় নিজেফোরম্যান হওয়ার আশায় হয়ত তুমি নিজেই, ওকে খুন করেছ বা করিয়েছ!
ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটি মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আগেই এরফান এতে বাধ সাধল।
মাস্টারসন আমাকে বলেছিল যে স্টিভের মত্যটা পুরোপুরি একটা রহস্য, ওর কোন শক্রই ছিল না, টেবিলে উপস্থিত সবার উদ্দেশে শান্ত স্বরে বলল এরফান।
এতে রহস্যের কিছু নেই, বলে উঠল বান্ডি, যাকে সবাই ঠাট্টা করে হাড়ের বান্ডিল বলেই ডাকে-কারণ ওর দেহে হাড় আর চামড়াই কেবল আছে। কাজটা ব্ল্যাক-মাস্ক ছাড়া আর কারও নয়; এটা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।
এমন কথা প্রচার করে বেড়ালে তুমি নিজেই স্টিভের সাথে আলাপ করে উত্তরটা জেনে নেয়ার সুযোগ পাবে, সাবধান করল ল্যাঙ্কি।
এই ব্ল্যাক-মাস্কটা কে? প্রশ্ন করল এরফান। ওর কথা আমি এই প্রথম শুনলাম।
অর্থাৎ ওল্ড ম্যান (মালিক) তোমাকে ওর কথা কিছুই বলেনি? আশ্চর্য ব্যাপার! বলে উঠল ল্যাঙ্কি। ওর কথার সুরে বোঝা গেল এমন জরুরী একটা কথা না জানানো নতুন ফোরম্যানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করারই সামিল।
উক্তিটা উপেক্ষা করেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বান্ডির দিকে তাকাল এরফান।
ব্ল্যাক-মাস্ক একজন লোক নয়, ওরা একদল ডাকাত; যারা এদিক-ওদিক সবখানেই ডাকাতি করে বেড়ায়। ওদের পরিচয় কেউ জানে না, জবাব দিল বান্ডি। শোনা যায় পাহাড়ের চূড়ার কাছে একটা গুহায় ওরা থাকে। হোপের একটা লোক দাবি করেছিল যে ওদের আস্তানা সে চেনে। পাসিকে পথ দেখিয়ে ওখানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবও সে দিয়েছিল; কিন্তু শেরিফ টেলর হেসেই ওর কথা উড়িয়ে দিয়ে ওকে ঘুমিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করতে বলল। এখন সে তাই করছে-কবরখানায়।
সে কিভাবে মরল? জানতে চাইল ফোরম্যান।
লোকটা হোপে একজন স্ট্রেঞ্জারের বিরুদ্ধে ছুরি ছেড়ার প্রতিযোগিতায় নেমে হেরে যায়, ব্যাখ্যা করল সে।
ওদের কি স্টিভের বিরুদ্ধে কোন আক্রোশ ছিল?
মনে হয় না, তবে হতে পারে যে সে ঘুরতে ঘুরতে ওদের আস্তানার কাছাকাছি কোথাও পৌঁছে গেছিল, নিজের মত জানাল সে। ব্ল্যাক-মাস্কের দলটা সত্যিই সাংঘাতিক। ব্লাডি বার্ট পর্যন্ত ওদের চটাতে সাহস পায় না।
হাহ, তোমার কথা শুনে হাসি পায়, বলে উঠল বুল ডেভিস। একটু অবসর পেলেই বার্ট ওখানে হানা দিয়ে ওদের জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে। বান্ডির উক্তিতে বুলকে এমন কঠিন প্রতিবাদ শুনে এরফানের ধারণা হলো সম্ভবত জ্যাককে চাপ দিয়ে বাটই এই লোকটাকে তার র্যাঞ্চে কাজে নিতে বাধ্য। করেছে।
বার্টের একটু অবসর পেতে খুব লম্বা সময় লাগছে, মন্তব্য করল শান্ত প্রকৃতির মাঝ-বয়সী রে এদারটন। আমার মনে হয় এখানে যদি বিদ্যুৎ এরফান থাকত, যে হ্যাচেটস ফলি গ্যাঙকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল, তাহলে ব্ল্যাক মাস্কের দল পালিয়ে কুল পেত না।
শুনেছি ওর হাত নাকি দারুণ চালু, যোগান দিল ল্যাঙ্কি।
শুধু চালু? বলে উঠল রে। বিদ্যুৎই ওর উপযুক্ত নাম।
হাহ্, আমি বাজি ধরে বলতে পারি ওর হাত এখন আর আগের মত চালু নেই, বলল বুল। বিয়ে করে সংসারী হওয়ার পর মানুষ অনেক ধীর হয়ে যায়।
টেবিলের মাথায় বসে এরফান ওদের কথাবার্তা শুনে মনেমনে পুলকিত হচ্ছে। তাহলে বিদ্যুৎ এরফানের কথা এরা এখনও ভোলেনি। সে ভাবছে বয়স্ক এদারটন নোকটা তাকে আগে কখনও দেখেনি তো? কিন্তু কাউবয়ের চেহারা খুঁটিয়ে লক্ষ করেও লোকটার চেহারায় তাকে চেনার কোন লক্ষণ দেখতে পেল না। সে মনে করে না যে বিয়ে করায় পিস্তলে তার দক্ষতার একটুও ঘাটতি ঘটেছে। সময়ই এর প্রমাণ দেবে। যাহোক, আবার খেলায় নেমে সে বেশ ভাল বোধ করছে। খাওয়ার শেষে কিছুক্ষণ সে তার কর্মচারীদের সাথে এটা-ওটা নিয়ে আলাপ করে নিজের ঘরে ফিরল। তৃপ্ত টমিও ওর পিছন পিছন কামরায় ঢুকল-রাঁধুনী ওর ভাল তুই নিয়েছে। পুরো একঘণ্টা এরফান, সিগারেট ফুকে আর বিভিন্ন চিন্তা করেই সময় কাটাল। এটা সুস্পষ্ট যে মাস্টারসন খুব দুশ্চিন্তায়। আছে। র্যাঞ্চটা কিভাবে রক্ষা করা যাবে তাই নিয়েই ওর এত চিন্তা। সন্দেহ নেই যে সে খুব বিপজ্জনক একটা পথ বেছে নিয়েছে। তার পুরোনো বন্ধু জাজ। এমারি নিজে এসে ওকে এই কাজটা নিতে অনুরোধ জানাল, তখনই সে বুঝেছিল কাজটা মোটেও সহজ হবে না।
০৩.
পরদিন সকালে নাস্তা শেষ করার পরেই এরফান বাইরে বেরিয়ে দেখল কাউবয়রা সবাই কাজে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে করালের কাছে দাঁড়িয়ে ওর নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। ওইদিন কাকে কোন কাজে যেতে হবে সেটা জানতে পারলেই ওরা রওনা হবে। বুল ডেভিস, হেনডন, এবং একজন মেক্সিকান-যাকে সে মারিও নামে ডাকতে শুনেছে, ওরা একটা পৃথক দলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে নতুন ফোরম্যান গোলযোগের গন্ধ টের পেয়ে সোজা ওদের দিকে এগিয়ে গেল।
স্টিভের মৃতু্যর পর থেকে তুমিই অস্থায়ী বস হিসেবে কাজ চালাচ্ছিলে, বুলকে বলল সে, ওকে করে অসন্তুষ্ট ভাবে নড় করতে দেখে এরফান বলল, আপাতত তুমি সেটাই চালিয়ে যাও।
বুলের চোখদুটো একটা হিংস্র আনন্দে জ্বলে উঠল। সে মনে করল এই নতুন ফোরম্যান যদি তাকে ভয় নাও পায়, তবু লোকটা ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চাইছে। কাধ সোজা করে চ্যালেঞ্জিং ভঙ্গিতে বুক ফুলিয়ে সে বলল, যে চাকরিটা তুমি পেয়েছ সেটা ন্যায্যত আমাদেরই কারও পাওয়া উচিত ছিল। আমার বিশ্বাস র্যাঞ্চার এই আউটফিটের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বাইরের একজনকে ধরে এনে আমাদের মাথার ওপর ফোরম্যান করেছে।
ঝড়ের আগের থমথমে একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। চুপ করে দেখছে সবাই। এরফানের মাথায় দ্রুত চিন্তা চলছে। সে এখনই দলের কারও সাথে সরাসরি বিরোধে যেতে চাইছে না বটে, কিন্তু যাদের নিয়ে তাকে কাজ করতে। হবে তাদের অন্তত বুঝিয়ে দেয়া দরকার; যে-কাজের ভার তাকে দেয়া হয়েছে। সেটার জন্যে সে সত্যিই উপযুক্ত লোক। ডেভিসের দিকে তাকাল সে, ওর চাহনিতে আমোদ পাওয়ার ভাব একটা দেখা যাচ্ছে।
এতে আমার কি করার আছে? প্রশ্ন করল সে। তুমি কি আশা করছ আমারই মাস্টারসনকে গিয়ে বলা উচিত যে সে ভুল লোককে কাজে নিয়েছে?
দর্শক কয়েকজনকে চাপা হাসি হাসতে শোনা গেল। বোঝা যাচ্ছে ওদের কাছে বড় গলায় নতুন ফোরম্যানের মুরোদ সে আজ পরীক্ষা করে দেখবে বলে বড়াই করে এসেছে; কিন্তু এখন বুঝতে পারছে লোকটার সাথে কথায় পারা যাবে না।
মাস্টারসনকে কিছু বলার দরকার হলে সেটা আমি নিজেই বলতে পারব, ওর মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠেছে।
বেশি কিছু বলার দরকার নেই, শুধু এটুকু বললেই চলবে যে আমি তোমাকে কাজ থেকে বরখাস্ত করেছি। তোমার পাওনা টাকা সে বুঝিয়ে দেবে, শান্ত স্বরেই কথাগুলো বলল এরফান। কিন্তু ওকে হুমকির ভঙ্গিতে পিস্তলের বাঁটে হাত রাখতে দেখে বলল, ওটা ধরে মিছেই তুমি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ; ওটা খাপ থেকে বের করার সাহস তোমার নেই।
কয়েক সেকেন্ড পরস্পরের দিকে চেয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল ওরা। মাত্র দুগজ দূরে দুজনেই ড্র করার ভঙ্গিতে একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে অপর পক্ষ থেকে সামান্যতম নড়াচড়ার ওপর সতর্ক নজর রেখেছে। তারপর বুল এদিক ওদিক চেয়ে শেষে চোখ নামিয়ে নিল।
আমি যেমন বলেছিলাম-কাপুরুষ, বলে এরফান ফেরার জন্য অর্ধেকটা মাত্র ঘুরেছে।
ড্যাম ইউ, চিৎকার করল বুল। আমি
কিন্তু ছোবল দিয়ে বুল পিস্তল বের করার আগেই আড়চোখে ওর হাত নড়ে উঠতে দেখে এরফান স্টীলের মত শক্ত আঙুলে বাম হাতে ওর কজি ঠেসে ধরল। একই সাথে ওর ডান হাত বুলের গলায় চেপে বসল।
নড়াচড়ায় অক্ষম লোকটা প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল। এরফানের আঙুলগুলো বুলের গলায় আরও এটে বসছে। লোকটার চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, চেহারাটাও বেগুনি হয়ে ওর প্রায় মরার দশা হয়েছে দেখে জোরে আকস্মিক একটা ধাক্কায় ওকে মুখ থুবড়ে ধুলোর ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল এরফান। ফুপিয়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা সামলে উঠে দাঁড়াতে সে বেশ সময় নিল।
র্যাঞ্চহাউসে গিয়ে নিজের পাওনা বুঝে নিয়ে ট্রেইল ধরো, ওকে সংক্ষেপে নির্দেশ দিল ফোরম্যান।
শয়তানের মত একটা চাহনি দিয়ে বিড়বিড় করে ওকে হুমকি দিতে দিতে মাথা নিচু করে ওর নির্দেশ পালন করল পরাজিত বুল।
এরফান আর সবার দিকে ফিরে দাঁড়াল। পুরো অ্যাসিডে ভরা স্বরে সে বলল, আর কারও কোন বক্তব্য আছে?
আমিও মিস্টার ডেভিসের সাথে যাচ্ছি, বলল মেক্সিকান।
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল ফোরম্যান। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে এবার হেনডনের দিকে তাকাল সে। একটা হাসি দিয়ে ওর অব্যক্ত প্রশ্নের জবাব দিল হেনডন।
আমি এখানেই থাকছি, জানাল সে।
ভাল কথা, বলে সবাইকে দিনের কাজ বুঝিয়ে দেয়ার কাজে মন দিল সে।
ঈশ্বর! হেনডনের সাথে কাজে যেতে যেতে বলল ল্যাঙ্কি। তুমি দেখেছ? লোকটা বুলকে শায়েস্তা করার সময়ে রীতিমত হাসছিল!
হাসছিল? খেপে উঠল হেনডন। হ্যাঁ, নেকড়ে যখন বাছুরকে শিকার করে, মাটিতে ফেলার সময়ে যেমন দাঁত খিচায় ঠিক তেমনি। আমার বিশ্বাস বুলের কাছে এখন ফাঁসি আর নতুন কোন অভিজ্ঞতা বলে মনে হবে না।
লোকজনকে কাজে পাঠিয়ে এরফান সোজা র্যাঞ্চহাউসে ঢুকল। বাইরের কামরাতেই জ্যাক আর তার মেয়ের দেখা পাওয়া গেল। মেয়েটা রাইডিঙে যাওয়ার পোশাক পরেছে। এরফানকে দেখে মেয়েটার ভূরু একটু কুঁচকাল।
হ্যালো, জেমস, তুমি এখনই আগাছা ছাটতে শুরু করে দিয়েছ শুনলাম, স্বাগত জানাল র্যাঞ্চার।
হ্যাঁ, দুজন কর্মচারীকে বিদায় দিতে বাধ্য হলাম, এরফান একটু হাসল। এখানকার কাজে ওদের মন ছিল না।
তুমি আসার আগে পর্যন্ত ওরা মন দিয়েই কাজ করছিল, আপত্তি জানাল ফিল। ওরা দুজনই বিশ্বস্ত লোক ছিল, মিস্টার বার্টের সুপারিশে ওরা এসেছিল।
এই তীব্র আক্রমণের তিক্ততা এরফানকে অবাক করল। কিন্তু শান্ত আর স্বাভাবিক স্বরেই এরফান বলল, আমি জানতাম না যে ওরা তোমার প্রিয়পাত্র, মিস মাস্টারসন।
আমি কাউবয় বা মেক্সিকানদের সাথে বন্ধুত্ব করি না, ঠাণ্ডা স্বরে জবাব। দিল ফিল। আমার ধারণা তোমার নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করেই তুমি ওদের উস্কে পিস্তলের লড়াইয়ে নামাতে চেয়েছিলে?
সচিলে হাসল এরফান। এবং আমার পিস্তলে আরও দুটো আঁচড়, না? ভালই বুঝেছ; বুলকে উস্কানোর জন্যে আমি যা করেছিলাম, সেটা হচ্ছে ওকে আমি ডেপুটি ফোরম্যান নিযুক্ত করতে চেয়েছিলাম, সে বিনা যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করল-একটা ধন্যবাদও দিল না। বরং আমি ঘুরতেই সে যখন আমাকে পেছন থেকে গুলি করে মারার চেষ্টা করল, তখন বাধ্য হয়েই ওকে আমার একটু শায়েস্তা করতে হলো। মেক্সিকানটাও ওর পিছু নিল।
মিস্টার বাট ব্যাপারটা পছন্দ করবে না, মেয়েটা বলল।
ড্যাম বার্ট, রাগে ফেটে পড়ল জ্যাক। এটা আমার র্যাঞ্চ এবং আমিই এটা চালাচ্ছি। আমি যখন একটা লোককে এটা চালাবার ভার দিয়েছি, তখন তাকে আমি শেষ পর্যন্ত ব্যাক করব। সত্যিই প্রয়োজন মনে করলে তুমি ইচ্ছে করলে এই আউটফিটের সবাইকে বরখাস্ত করতে পারো, জেমস। আমার সাথে কি তোমার আর কোন কথা ছিল?
না, আমি এখন রেঞ্জটা একটু ঘুরে দেখে আসতে যাচ্ছি, বলল এরফান। আড়চোখে রাইডিঙের পোশাক পরা ফিলিপার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলল ওর মাথায় সে বলে উঠল, আমি ভাবছি মিস মাস্টারসনের যদি রাইডিঙে যাওয়ার প্ল্যান থেকে থাকে তাহলে সে হয়ত আমাকে রেঞ্জটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে পারে।
এরফানের ঔদ্ধত্য দেখে মেয়েটার চেহারায় বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল। না, আমার মা একটা কাজ আছে, সে সংক্ষেপে জবাব দিল।
রেঞ্জটা ঘুরে দেখতে বেরিয়েছে এরফান। উফুল, টমি ঘোড়ার কয়েক গজ আগে আগে ছুটছে। ওর উদ্দেশে এরফান বলল, ওই রাজকুমারীর অন্য কাজ আছে, টমি, কাজটা আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। মেয়েটা আমাদের মোটেও দেখতে পারে না। না, এটা খুশি হওয়ার কোন কথা নয়-ওর ঘাড়ে আমরা একটা বিষ ফেঁড়া ছাড়া আর কিছুই নই।
*
প্রায় মাঝরাত হবে হঠাৎ এরফানের ঘুম ভেঙে গেল বিছানার পায়ার কাছে শোয়া টমির গলার ভিতর থেকে নির্গত নিচু গরগর শব্দে! উঠে চারপাশে চেয়ে দেখল সে। আকাশে চাঁদ নেই, কিন্তু তারার ক্ষীণ আলোয় অস্পষ্ট ভাবে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। তার মনে হলো যেন পিছনের জানালায় আবছা কিছু ওর চোখে পড়ল।
চুপ থাকো, বাছা, ফিসফিস করে টমিকে নির্দেশ দিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকল সে। ডান হাতে চলে এসেছে ওর একটা পিস্তল।
যেটাকে সে ছায়া ভেবেছিল সেটা আবার দেখতে পেল সে। এবার জানালাটা একটু ককিয়ে উঠল, মনে হলো কেউ যেন জোর করে ওটা খোলার চেষ্টা করছে। এরফান একটুও নড়ল না; অল্প সময়ের জন্যে কোন শব্দ হলো না। সম্ভবত ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুমের কোন ব্যাঘাত হয়নি মনে করেই নিশ্চিন্ত হয়ে গোপনে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা আবার শুরু করল। আবার জানালা ককিয়ে ওঠার শব্দ শোনা গেল। জানালাটা এখন ইঞ্চি দুয়েক ফাঁক হয়েছে। ফ্লপ শব্দে মেঝের ওপর কিছু পড়ার পরই জানালা থেকে একটা মুখ অদৃশ্য হলো। কিন্তু তার আগেই সে দেখতে পেয়েছে ওই মুখটা কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল নিজের মনেই হাসল এরফান; সম্ভবত এই আউটফিটেরই কেউ নতুন ফোরম্যানের সাথে মস্করা করার জন্যেই ওকে ব্ল্যাক-মাস্কের গল্প শুনিয়েছে।
ড্যাম ফুল, সে যেই হোক, বিড়বিড় করল এরফান, আমি যদি গুলি করতাম–
ওর বাক্যটা অসমাপ্তই রয়ে গেল, কারণ ওই মুহূর্তেই সে মেঝের ওপর পড়া কুণ্ডলীর থেকে একটা ক্রুদ্ধ হিসহিসানির সাথে র্যাটল স্নেকের লেজের ঝুনঝুনি শুনতে পেল। বিপদ টের পেয়ে কুকুরটাও ঘেউঘেউ শুরু করল। কুকুরের মাথায় হাত রেখে ওকে শান্ত করল এরফান।
কান পেতে শুনে সে বোঝার চেষ্টা করছে সাপটার অবস্থান। কিন্তু মাটির মেঝের ওপর ওটার নড়াচড়ার কোন শব্দই শোনা গেল না। এরফান জানে র্যাটল স্নেক ভীতু প্রাণী। একান্ত কোণঠাসা না হলে ওরা কাউকে আক্রমণ করে না। কিন্তু আবদ্ধ অবস্থায় থাকার পর ওটার মেজাজ এখন কেমন আছে তার কোন ঠিক নেই। ভয়ে ভয়ে অন্ধকারে হাতড়ে বিছানার পাশে রাখা বুট দুটো তুলে পরে নিল সে।
উত্তেজনাময় একটা পরিস্থিতি। লম্বা লম্বা দুই কদমে ঘরের মাঝখানে পৌঁছে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে ম্যাচের বাক্স খুঁজে পেল বটে কিন্তু বাতিটা হাতের কাছে পেল না। ওটা খুজতে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে আর প্রতি পদক্ষেপেই ভয় হচ্ছে এই বুঝি সাপটা পায়ের তলায় চাপা পড়ল। তা ঘটলে সাথেসাথে ওর পায়ের মাংস ভেদ করে ঢুকে যাবে সাপের তীক্ষ্ণ বিষদাঁত। টেবিলের ওপর রাখা বাতিটা খুঁজে পেয়েই ম্যাচ জ্বালাল এরফান। ম্যাচের আলোয় ওর চোখে পড়ল মাত্র এক গজ দূরেই সাপটা আধা কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথা তুলে আঘাত হানার জন্যে তৈরি হয়েছে। ঠিক সময় মতই লাফিয়ে পিছিয়ে গিয়ে সাপের চ্যাপ্টা মাথায় গুলি করল এরফান! বাতিটা জ্বালিয়ে লাথি মেরে মৃত সাপটাকে দূরে পাঠিয়ে দিল সে। মারা গেলেও সাপের দেহটা তখনও পাকাচ্ছে। বাইরে একদল লোকের ছুটে আসার শব্দ আর কথাবার্তার সাড়ার সাথে দরজার ওপর নক করার আওয়াজ শোনা গেল। ওটা খুলে সে দেখল তারই লোকজন গুলির শব্দে রাতের পোশাক পরেই ছুটে এসেছে। কিন্তু সবার হাতেই রয়েছে পিস্তল।
কি ঘটেছে? প্রশ্ন করল হেনডন-সেই সবার আগে ছিল।
একটা ডায়মন্ড-ব্যাক (র্যাটল স্নেকের স্থানীয় নাম) দেখা করতে এসেছিল, ব্যাখ্যা করল এরফান। বাধ্য হয়ে ওটাকে মেরে ফেলতে হলো।
লোকগুলো ভিতরে ঢুকে সাপটাকে পরীক্ষা করে দেখল! বিশাল লম্বা একটা সাপ।
দশটা র্যাটল, (প্রতি বছর ওদের লেজে বিষাক্ত র্যাটলের সংখ্যা একটা করে বাড়ে) মন্তব্য করল ওদের একজন। নিশ্চয় ওটার অনেক বাচ্চাকাচ্চা আছে। ওরাও সঙ্গে আসেনি তো?
সবাই মিলে কামরাটা ভাল করে খুঁজেও আর কোন সাপ দেখতে পেল না। ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে বাঙ্কহাউসে ফিরে গেল; কেবল হেনডন ইতস্তত করছে।
ওটার এখানে ঢোকাটা সত্যিই একটা আশ্চর্য ব্যাপার, বলল সে। এই কামরার চারপাশেই কাঁকর দিয়ে ছাওয়া আছে, এবং ওরা কাকরের ওপর দিয়ে চলা পছন্দ করে না।
জানালার কাছে গিয়ে সে ঝুঁকে একটা কিছু হাতে তুলে নিল। ওটা এখানে বাস করার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছি-সাথে সে নিজের ব্যাগও নিয়ে এসেছিল; চামড়ার ব্যাগটা তুলে ধরল :নে। ওটায় ফিতে টেনে মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা আছে। ওটা থেকে ব্যাটল স্নেকের বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে। তোমার জীব-জন্তু প্রীতির কথা সবাই জানে, বলে চলল সে। এর পরে তুমি, হয়ত একটা দুর্গন্ধময় স্কাঙ্কই পোষা শুরু করবে।
আজ রাতেই একটাকে আমি পেতে পারতাম, জবাব দিল ফোরম্যান, কিন্তু আর কোন তথ্য সে প্রকাশ করল না। যদিও এই লোকটাকে এখনও বিশ্বাসী বলেই মনে হয়, তবু এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না। তাকে হত্যা করার একটা জঘন্য চেষ্টা যে আজ করা হয়েছিল তাতে কোনই সন্দেহ নেই। তার হাতে এমন কোন প্রমাণ নেই যাতে ওই অপরাধীকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। হেনডন চলে যাওয়ার পর টমিকে সময় থাকতে ওকে সাবধান করার জন্য একটু আদর করে ধন্যবাদ জানিয়ে এরফান আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমানোর আগে সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, যেহেতু হেনডন, বুল আর মারিওর সাথেই দাড়িয়ে ছিল, তাই ওর ওপর সে নজর রাখবে।
সকালে সূর্য ওঠার সাথেই এরফান বাইরে জানালার কাছে গিয়ে ট্র্যাক খোঁজ শুরু করল। কিন্তু হেনডনের কথাই ঠিক, চারপাশে খোয়া বিছানো থাকায় কোন চিহ্নই দেখা গেল না। কিন্তু দশ গজ দূরে এক চিলতে বালু ঘাস থেকে খোয়াকে বিছিন্ন করেছে। ওখানেই ট্রাকের প্রথম চিহ্ন দেখতে পেল এরফান। এক জোড়া গভীর গোড়ালির ছাপ রয়েছে ওখানে। লোকটা যে ওখানে দাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছে, সেটা ছাপের গভীরতায় স্পষ্ট বোঝা যাচে। ওটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে এরফান দেখল ডান গোড়ালির বুটে ছোট্ট একটা ক্রস চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। মাস্টারসন পুরো ঘটনা শোনার পর হেসেই কথাটা উড়িয়ে দিল।
ব্ল্যাক-মস্কের কাছ থেকে আমাদের ওপর কখনও কোন হামলা আসেনি, এবং সেটা আমি চাইও না, বলল সে। ওরা বড় জোর মাঝেমধ্যে আমাদের একটা-দুটো গরু হয়ত নেয়; কিন্তু সেটা শুধু খাবার উদ্দেশেই-বিক্রি করার জন্যে নয়। এমন নীচ কাজ কখনও ওরা করবে না। মনে হয় এতে কোন গ্রীজারের হাত আছে। (ঘৃণা প্রকাশ করতে আমেরিকানরা মেক্সিকানদের ওই নামে ডাকে)।
র্যাঞ্চারের মতবাদ এরফানের সাথে মিলে যাওয়ায় আর কথা না বাড়িয়ে ওখানেই কথা শেষ করলো এরফান। সারাদিন আবার রেঞ্জ দেখে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে সে দেখল একতা লোক ওর সাখে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করছে। মাঝারি উচচতার লোকটা নাদুসনুদুস গড়নের। গোলগাল চেহারা রোদে পুড়ে বাদামী না হয়ে একটু লালচে দেখাচ্ছে।
আমি আন্দাজ করছি তুমিই এই আউটফিটের ফোরম্যান, বলল কমবয়সী যুবক।
তোমার আন্দাজ করার ক্ষমতা, বেশ ভাল, বলল এরফান। তা তোমার সমস্যাটা কি?
অতিথির হালকা নীল চোখদুটো ঝিলিক দিচ্ছে। একমাত্র পকেটে প্রচণ্ড শূন্যতা ছাড়া আমার আর কোন সমস্যা নেই, জবাব দিল সে।
তুমি কি চাকরি খুঁজছ? প্রশ্ন করল এরফান।
একটা চাকরি আমার প্রয়োজন, যেটা সম্ভবত একই কথা হলো, জবাব দিল সে। মুশকিলটা হচ্ছে বহু বছর আগেই আমি খুব খারাপ একটা অভ্যাস করে ফেলেছি, যেজন্যে নিয়মিত খাবার না খেলে এখন আর আমার চলে না।
এই ধরনের অভ্যাস ছাড়া খুবই কঠিন, স্বীকার করল এরফান। তুমি গরু সম্পর্কে কিছু জানো?
গরু? বলল কি? বলতে গেলে গরুর দুধ খেয়েই তো আমি বড় হয়েছি, হেসে বলল স্ট্রেঞ্জার।
তাই নাকি? খাটো লোকটার দিকে চেয়ে শান্ত স্বরে বলল এরফান। তাহলে বলতে হয় ওরা তোমাকে বেশি বড় করতে সক্ষম হয়নি-হয়েছে? এই কথায় যে হাসির রোল উঠল নবাগত লোকটাও সেই হাসিতে যোগ দিল।
তোমার যেকোন আদেশ পালন করতে আমি একান্ত বাধ্য কুকুরের মতই ছুটে আসব, জবাব দিল হাসিখুশি লোকটা।
ঠিক আছে, ফোরম্যান হেসে বলল, আমাদেরও একজন বাড়তি লোকের প্রয়োজন ছিল; আমরা তাহলে তোমাকে সানসেট বলেই ডাকব-ওটা তোমার গায়ের রঙের সাথে সুন্দর মেলে।
মুহূর্তের জন্যে ওর হালকা নীল চোখদুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং বিশদ একটা হাসিতে ওর মুখটা আরও লাল হলো।
সানসেট নামটাও চলবে, যদিও আমার আসল নাম লরি লরি বই, বলল সে।
মাথা ঝাঁকাল এরফান। শীঘ্রি সাপার তৈরি হয়ে যাবে, ওকে জানাল সে। ল্যাঙ্কি তোমাকে তোমার বাঙ্ক দেখিয়ে দেবে।
সন্ধ্যার পরে বস্টন চুপিচুপি ফোরম্যার দরজায় নক • করেই ভিতরে ঢুকে পড়ল এবং নির্লজ্জ ভাবে নতুন বাসের দিকে তাকিয়ে হল।
জবাবে সেও হেসে বলল, সানসেট, তোমাকে স্বাগতম
আমি যদি জানতাম তুমি আমার ওপর এমন একটা গম চাপিয়ে দেবে, তাহলে চাকরির জন্যে আমি
আমার সাথে ঝামেলায় না জড়ালেই তুমি ভাল করবে, ওকে সাবধান করল এরফান। তাছাড়া তোমার একজন সঙ্গীও জুটেছে: জেন্টল অ্যানি।
জেন্টল অ্যানি? হেসে উঠল সানসেট। এমন একটা নাম তুমি কোথায় খুঁজে পেলে?
আজ সকালেই সে অসুস্থ বাছুরের মত হেড়ে গলায় গাইছিল, জেন্টল অ্যানি, তুমি কি আমাকে আগের মতই ভালবাস? আমি ওই নাম নিজে থেকে আবিষ্কার করিনি। তবে ছেলেটা সত্যিই ভাল, একেবারে লোহার মত শক্ত।
ওরা আর সবাই কি ধরনের লোক? প্রশ্ন করল লরি।
আমি চাই সেটাই তুমি খোঁজ নিয়ে বের করে, বলল নতুন ফোরম্যান। শোনো, আমি হোপে আসার পর থেকে কি কি ঘটেছে তা তোমাকে বলছি।
হোপ শহরে পৌঁছানোর পর থেকে শুরু করে তার কামরায় ব্যাটল স্নেক ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা পর্যন্ত সব ঘটনাই ওকে জানাল এরফান। সব শুনে সানসেটের হাসি ধীরে ধীরে আরও প্রশস্ত হলো!
হুঁ, তুমি দেখছি কোন সুযোগই হাতছাড়া করোনি, মন্তব্য করল সে। মনে হচ্ছে দুহপ্তার মধ্যেই তুমি গুটি-বসন্তে আক্রান্ত রোগীর মত জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। হাসি-ঠাট্টার সুর বদলে এবার সে একটু সিরিয়াস হলো। তুমি কখনও ভেবে দেখেছ কেন আমি তোমার সাথে এখানে আসার জন্যে এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম?
আমার তো ধারণা তুমি নিয়মিত কাজে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নিতেই আমার পিছু নিয়েছ। তারপর ঠাট্টার সুর ছেড়ে সে বলল, আচ্ছা, তুমিই না হয় বলো।
তোমার সাথে কাজ করার একটা আলাদা উদ্দেশ্য আছে আমার। ওর কোমল চেহারাটা এবার পাথরের মত কঠিন হয়ে উঠল। ছেলেমানুষি ভাবটা এখন ওর চেহারা থেকে পুরোপুরি মুছে গেছে। র্সে ভারী স্বরে বলে চলল, আমার আসল নাম টেড; টেড বোলটন। আমার বাবা হার্ভি বোলটনের বিরুদ্ধে মিথ্যা গরু চুরির অভিযোগ সাজিয়ে ব্লডি বার্ট তাকে বিনা বিচারে ফাঁসি দিয়েছিল। তখন আমার বয়স ছিল বারো বছর। এখন বড় হয়ে আমি তার প্রতিশোধ নিতে এসেছি।
এরপর ধীর গলায় সেই ঘটনার পুরো বিবরণ দিল সে। সবটা শুনে এরফানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সে উঠে দাঁড়িয়ে টেডের কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির স্বরে প্রশ্ন করল, ওখানে যারা উপস্থিত ছিল তাদের সবাইকে তুমি চেনো?
ওদের সবার নাম জানা না থাকলেও ওদের চেহারাগুলো আমি কোনদিন ভুলব না, জবাব দিল যুবক। ওদের একজন ছিল তোমার আউটফিটের হেনডন। কিন্তু বার্ট আমাকে বেঁধে ছাপরার ভিতর বন্দী করে রেখে ছাপরা আগুনে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে গেলেও সে আমাকে পিছনের দরজা দিয়ে বের করে দিয়ে আমার জন্যে ঝোঁপের ভিতর একটা ঘোড়া রেখে গিয়েছিল বলে ওকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু বার্টের সাথে আর যারা ছিল তাদের কাউকে আমি ছাড়ব না। ওদের কেবল তিনজনের নাম আমার জানা আছে। ওদের একজনকে ডোভার বলে সম্বোধন করা হয়েছিল; একজনকে মারিও আর অন্যজনকে ফিলিপ।
ফিলিপের কথা তোমাকে ভাবতে হবে না; সে ডেজার্ট এজে আমার বিরুদ্ধে পিস্তল ড্র করে মারা পড়েছে। মারিও এখানেই কাজ করত, কিন্তু বুল ডেভিসের সাথে সেও কাজ ছেড়ে চলে গেছে। তবে ওদের •গাল আমরা পরেও পাব।
তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ, লরি কেবল এটুকুই বলতে পারল। তারপর কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতার পর সে প্রশ্ন করল, মাস্টারসনের ওপর বার্টের কি ধরনের চাপ রয়েছে যে ওকে বাধ্য হয়ে ওই শয়তানটার সব কথাই মেনে নিতে হচ্ছে?
না, সেটা সে আমাকে বলেনি, তবে আমার ধারণা অত্যন্ত কঠিন কোন চাপ হবে। কারণ র্যাঞ্চারকে দেখে আমার নরম লোক বলে মনে হয়নি।
মেয়েটা কেমন? ওর দ্বিতীয় প্রশ্ন এলো।
খুব সুন্দরী, কিন্তু মেয়েদের মতই-অদ্ভুত প্রকৃতির, হেসে জবাব দিল এরফান।
হাহ, হাসল লরি। তুমি ওর প্রেমে পটে যাওনি তো?
নিষ্ঠাবান বিবাহিত পুরুষের পরকীয়া প্রেম করা সাজে না। না, লরি, তেমন কিছুই ঘটেনি বা ঘটার কোন সম্ভাবনাও নেই।
তাহলে দেখা যাচ্ছে এখানে এই বাচ্চা-কুকুরটাই তোমার একমাত্র প্রকৃত বন্ধু।
আসলে কুকুরই হয় মানুষের সত্যিকার বন্ধু, মন্তব্য করল এরফান। এখন আমার দুটো হয়েছে।
কি! তুমি আমাকে কুকুর বলে
না, বন্ধু বললাম। টমি তোমাকে হিংসে করবে না, কারণ সে কুকুরের চেয়ে নীচ মানুষও অনেক দেখেছে। কথা শেষ করে ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। তবে তুমি টেড হলেও তোমাকে আমি লরি বা সানসেট বলেই ডাকব। আর, মনে রেখো, ফোরম্যান সবার সামনে তোমার বন্ধু নয়, এবং তুমি তাকে বিশেষ পছন্দও করো না-বুঝেছ?
তোমাকে পছন্দ না করার পার্টে অভিনয় করতে আমার এক বিন্দুও অসুবিধা হবে না; ওটা স্বাভাবিক ভাবেই আসবে, খোঁচা দেয়ার সুযোগটা ছাড়ল লো লরি! তোমার সাথে কথার যুদ্ধ ভালই জমবে, বিদায় নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সে।
০৪.
তারই পাঠানো দুজন কাউবয়কে লেজি এম র্যাঞ্চ থেকে ছাঁটাই করে ফেরত পাঠানোটা বার বির মালিক বার্ট তাকে সরাসরি অবত্ত করা হয়েছে বলেই ধরে নিল। পরের দিন বিকেলেই সে ঘোড়ার পিঠে জ্যাকের ব্যাঞ্চে গিয়ে হাজির হলো। ওর হাক শুনে বেরিয়ে এলো জ্যাক।
হ্যালো, মাস্টারসন, অভিবাদন জানাল সে। ফিকে রাইডে নিয়ে যেতে এসেছি, কিন্তু তার আগে তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
এত বড় দেহ নিয়েও সে যেমন অনায়াসে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল সেটা দেখে কেউ বুঝবে না, ওর বয়স এখন চল্লিশ পার হয়ে গেছে। জ্যাককে অনুসরণ করে সে বসার ঘরে ঢুকল।
বুল আর মারিওকে তোমার এভাবে ছাঁটাই করার কি কারণ? রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করল সে।
বুলকে অস্থায়ী ফোরম্যানের কাজ করার প্রস্তাব দেয়ায় সে খেপে গিয়ে আমার ফোরম্যানকে গুলি করার জন্যে পিস্তল বের করার চেষ্টা করেছিল, ব্যাখ্যা করল জ্যাক। আর মারিও নিজের ইচ্ছেতেই কাজ ছেড়েছে।
ভাল, কিন্তু বুলকে যদি তোমার অপছন্দই ছিল তাহলে তুমি সেটা আমাকে জানালেই পারতে, আমি ওর বদলে আর কাউকে পাঠাতাম, বলল বার বি র্যঞ্চের মালিক। কিন্তু এই জেমসের খোঁজ তুমি কোথায় পেলে?
ডেজার্ট এজে ওর কথা আমি শুনেছি, জবাব দিল জ্যাক। মনে হলো আমার কাজের জন্যে লোকটা সত্যিই যোগ্য।
হতে পারে, ঠাণ্ডা স্বরে বলল বার্ট। কিন্তু ওকে আমার মোটেও পছন্দ নয়, মাস্টারসন, ওকে বিদায় করো।
র্যাঞ্চারের দুচোখে মুহূর্তের জন্যে অবাধ্য একটা ভাব ফুটে উঠল। কিন্তু বার্টের কঠিন দৃষ্টির সামনে সে চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলো।
হয়ত কিছুদিন পরে আমি তাকে
না, বাধা দিয়ে বলে উঠল বার্ট। আগামীকালই ওকে যেতে হবে। ও, আর একটা কথা, ট্রেইলে পাঠাবার জন্যে আমার পঁচাত্তরটা তিন-বছরবয়সী গরু কম পড়েছে; ওগুলো নেয়ার জন্যে আমি দুদিনের মধ্যেই তোক পাঠাব।
রাগে র্যাঞ্চার ভিতরে ভিতরে জ্বলছে; কিন্তু মনের ইচ্ছাটা মনেই রয়ে গেল। লোকটাকে গুলি করে মারার সাহস হচ্ছে না, কারণ বার্ট ওকে বহুবার সাবধান করেছে, মনে রেখো, জ্যাক, আমি যতদিন বেঁচে আছি কেবল ততক্ষণই তুমি নিরাপদ।
বাইরে থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ওকে কোন জবাব দেয়ার একটা কঠিন পরিস্থিতি থেকে রেহাই দিল। ফিলকে দেখা গেল দরজায়। রাইডিঙের পোশাক পরে তৈরি হয়ে কাউপোনি নিয়েই এসেছে সে। বার্টকে নিয়ে বেড়াতে চলে গেল মেয়েটা। কাউবয়, স্টাইলে স্যাডল হর্নের খুব কাছে বসে দ্রুত ঘোড়া ছুটাল ফিল। ওর উৎফুল্ল ডাকে সাড়া দিতে বার্টও ঘোড়া ছুটিয়ে পাশাপাশি এসে হাজির হলো। ওদের যেতে দেখে বাঙ্কহাউসে ঢুকল এরফান।
ওই লোকটাই তো তোমাদের নতুন ফোরম্যান, তাই না? প্রশ্ন করল বার্ট। ওর সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
ওসব সাধারণ কর্মচারীদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, হালকা সুরে বললেও কথাটা সম্পূর্ণ সত্য বলেনি ফিল।
তাহলে তো আমার দুশ্চিন্তার কিছুই নেই, বলল তার সঙ্গী। আমি তোমার বাবাকে বলেছি ওকে যেন কালই বিদায় করা হয়। আমার ভয় ছিল তোমার যদি ওকে ভাল লেগে থাকে
ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে ফিল বলল, আমার প্রশ্রয় পাওয়া এত সহজ নয়, মিস্টার বার্ট। আশা করি বাবা তোমার উপদেশ মতই কাজ করবে।
মুখে ওই কথা বললেও ওর মনে একটা সন্দেহ থেকেই গেল। ফিলের ধারণা নতুন ফোরম্যান আসার পর থেকে ওর বাবা যেন দুশ্চিন্তা ছেড়ে আবার সেই আগের প্রত্যয় ফিরে পেয়েছে।
বাটও মেয়েটার কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে জেমসের কথা, আর তুলল না। মাঝেমাঝে সে তার পাশের অপরূপা সুন্দরী যুবতীর দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। যেকোন মূল্যেই হোক মেয়েটাকে তার চাই। যদিও ওদের মধ্যে বয়সের বেশ ব্যবধান রয়েছে, তবু সে আকারে ইঙ্গিতে ওকে এটা জানিয়েছে। তবে সে প্রকাশ্যে কখনও ওর সাথে প্রেম করার চেষ্টা করেনি। সে নিজেকে বুঝিয়েছে যে তার এখনও বয়স এমন কিছু বেশি হয়নি, এবং এছাড়াও তার যথেষ্ট ধন সম্পত্তি আর প্রতিষ্ঠা আছে-এটাও ফেলনা কিছু নয়।
মেয়েটার চিন্তাও প্রায় একই খাতে বইছে। সে ভাল করেই জানে যে বার বির মালিক তার প্রেমে পাগল-এটা ভেবে নিজেও সে মনেমনে পুলকিত হচ্ছে। বার্টের পরনে রেঞ্জে কাজ করার উপযুক্ত কাউবয়দের মত পেশাক থাকলেও তা উন্নত মানের দামী কাপড়ে তৈরি এবং পরিচ্ছন্ন। নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে সে সম্পর্কে লোকটা সচেতন। এদিককার মেয়েদের মতে লোকটা পৌরুষোচিত, আত্মপ্রত্যয়শীল, এবং চাইলে সে অতন্ত ভাল আর আনন্দদায়ক সঙ্গী হতে পারে। যদিও বিষয়টা নিয়ে কখনও গভীর ভাবে ভাবেনি ফিল, তবু সে মনে করে এই মেলামেশার পরিণতিতে বার্টের সাথেই তার বিয়ে হবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ বেড়াতে বের হয়ে কেন যেন বারবারই ওর মনে হচ্ছে যার সম্পর্কে সে ভাবে মা বলেছিল, তার সামনে এই লোকটার ব্যক্তিত্ব নেহাতই খেলে। হয়ত এই কারণেই ফিলের বেড়ানোটা আজকে অন্যান্য দিনের মত উপভোগ্য হলো না।
ওইদিনই সন্ধ্যার পরে ফোরম্যান তার দরজায় খুব হালকা একটা নকের আওয়াজ শুনতে পেল। দরজা খুলে জ্যাককে দেখে ওকে ভিতরে ঢুকতে দিল সে। র্যাঞ্চারের চেহারাটা বিষণ দেখাচ্ছে, কিন্তু কথা বলার সময়ে তার স্বরটা দৃঢ়প্রত্যয়ে কঠিন শোনাল।
বার্ট আজ এখানে এসেছিল, এ নে হচ্ছে পরিস্থিতি চূড়ান্ত একটা সংঘর্ষের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে, শুরু করল সে। আমাকে পঁচাত্তরটা গরু হস্তান্তর করার আদেশের সাথে কালই তোমাকে বিদায় করে দিতে বলা হয়েছে। তার আগে ওর সাথে আমি নরকে দেখা করব। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার পরও এরফান কোন মন্তব্য করল না দেখে র্যাঞ্চার আবার বলে চলল, এটা আমি আরও দেরিতে ঘটবে বলে আশা করেছিলাম, কিন্তু এখন আর করার কিছু নেই। একটা কথা জেনে রাখো, আমি ব্যক্তিগত কারণে বার্টের মুঠোয় আছি-কিন্তু আমি যদি এখানে না থাকি
এরফান বোঝার ভঙ্গিতে হেসে মাথা ঝাঁকাল! মালিক যদি উপস্থিত না থাকে তাহলে লেজি এম র্যাঞ্চের ওপর বার্টের আর কোন অধিকারই খাটবে না।
আমার প্ল্যানটা হচ্ছে, আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাব। এবং তুমি র্যাঞ্চ চালাবার ভার নেবে। আমি যদি একটা যুক্তিসম্মত সময়ের মধ্যে ফেরত না আসি, তখন সবাই ধরে নেবে আমি মারা গেছি এবং ডেজার্ট এজের জাজ এমারি আমার উইল অনুযায়ী চার্জ নিয়ে ফিলের অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে। ফিলের পরিণত বয়স্কা হতে এখনও বারো মাস দেরি আছে। তুমি জানো জাজের সুপারিশেই তোমাকে আমি কাজে নিয়েছি। সে জানে না আমি কি প্ল্যান করেছি, তোমার যেকোন ঝামেলায় সে তোমাকে সাহায্য করবে।
তোমার মেয়ের জন্যে এটা খুব কষ্টদায়ক হবে। সে জানবে না তুমি বেঁচে আছ কি না।
সেটাও আমি ভেবে দেখেছি, কিন্তু এর বিকল্প আর কোন পথ নেই, জবাব দিল র্যাঞ্চার। আমি যদি কোন মেসেজ রেখে যাই তবে পুরো প্ল্যানটাই পণ্ড হয়ে যাবে-ওর আচরণেই সে ধরা পড়ে যাবে। এবং ব্ল্যাক বার্ট আমাকে খুঁজে বের করবে। আমি চাই বার্ট মনে করুক আমি মারা গেছি। এতে আমি নিশ্চিন্তে কাজ। করতে পারব। তাছাড়া ফিলের বয়সে দুঃখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বার্টকে দেয়ার জন্যে জাজ এমারি আমার র্যাঞ্চ বন্ধক রেখে ব্যাঙ্কের কাছ থেকে আমাকে টাকা জোগাড় করে দিয়েছিল। আমার ধারণা ব্যাঙ্ক এত সহজে জাজকে টাকা ফেরত দিতে তাগিদ দেবে না। তাছাড়া ব্রিজের ধারে এক্স টি র্যাঞ্চ লেজি এম থেকে আশিটা গরু কিনতে চেয়েছে; ওরা ক্যাশ টাকাই দেবে। ওই টাকা দিয়েই কিছুদিন তুমি র্যাঞ্চের খরচ চালাতে পারবে। ব্যস, ওই সময়টুকুই আমার জন্যে যথেষ্ট হবে। জাজ এমারি তোমার সম্পর্কে আমাকে যা বলেছে সেই ভিত্তিতেই তোমাকে বিশ্বাস করে সব ভার তোমার ওপর ছেড়ে যাচ্ছি।
তুমি আমার ওপর আস্থা রাখতে পরো, শান্ত স্বরে বলল এরফান।
হ্যাঁ, তোমার ওপরই আমি আমার শেষ কড়িও বাজি রাখছি, জবাব দিল জ্যাক। আর মনে রেখো, আজ তোমার সাথে আমার দেখা হয়নি-এবং তুমি আমার গতিবিধি সম্পর্কেও কিছু জানো না। অ্যাডিঅস।
অনেকক্ষণ পরস্পরের হাত চেপে ধরে হ্যান্ডশেক করার পর যেমন চুপিচুপি এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে বেরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল র্যাঞ্চার। এখন ওর মন অনেকটা হালকা ঠেকছে। সে একটা মরিয়া অবস্থায় পড়েছিল, এতদিন পরে মুক্তি পেয়ে যেন ওর মনটা এখন হাওয়ায় উড়ছে। যদিও সদ্য পরিচিত একটা স্ট্রেঞ্জারের হাতে সে সব ভার তুলে দিয়ে এসেছে, তবু ওর মন বলছে উপযুক্ত লোকের কাছেই সে দায়িত্ব দিয়েছে।
সকালে খাবার টেবিলে বাবার অনুপস্থিতি ফিলের কাছে কিছুটা অস্বাভাবিক ঠেকলেও আর কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামাল না। কারণ মাঝেমাঝে সকালে উঠে সে তার প্রিয় ঘোড়া নিয়ে বেড়াতে বের হয়। তবে কেউ ওকে বেরোতে দেখেনি। যখন পরের দিনও তার কোন খবর পাওয়া গেল না তখন ফিলের উদ্বেগ আশঙ্কায় পরিণত হলো যদিও সে জেমস লোকটাকে পছন্দ করে না, তবু তার কাছেই গিয়ে হাজির হলো মেয়েটা। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারল না।
ওর এক্স টি র্যাঞ্চের সাথে একটা ব্যবসা করার কথা ছিল, হয়ত সে ওখানেই গেছে, বলল এরফান। অথবা এমনও হতে পারে কোন কাজে ডেজার্ট এজে গিয়ে সে আর ফেরার সময় করে উঠতে পারেনি।
ফিল মাথা নাড়ল। আমাকে না জানিয়ে বাবা এর আগে আর কোথাও যায়নি, বলল সে। তারপর একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখে মেয়েটা প্রশ্ন করল, কি খবর হেনডন?
ফিলের প্রশ্নে লোকটা খুব অস্বস্তি বোধ করছে বলে মনে হলো। আমি ফোরম্যানের সাথে একটু আলাপ করতে চাই, মিস মাস্টারসন, জবাব দিল সে।
মেয়েটার চেহারা ফেকাসে হয়ে গেল। কথাটা যদি আমার বাবার বিষয়ে কোন খবর হয়, তাহলে আমিও সেটা শুনতে চাই। ফিলের স্বরটা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ শোনাল।
কাউবয়কে তবু ইতস্তত করতে দেখে এরফান বলল, তুমি কি খবর এনেছ সেটা বলেই ফেলো শুনি।
মালিকের ঘোড়াটা এইমাত্র ফিরে এসেছে, জানাল হেনডন। ওটা ওখানে করালের ধারে দাঁড়িয়ে আছে।
ফিল কোন মন্তব্য করল না, কিন্তু ওর ঠোঁট পর্যন্ত সাদা হয়ে গেছে এবং থরথর করে কাঁপছে। সোজা করালের দিকে রওনা হলো মেয়েটা।
ওর পিছু নিয়ে এগোবার সময়ে হেনডন ফিসফিস করে বলল, ওকে কি তুমি একটু সরিয়ে রাখতে পারো না? ঘোড়াটার জিনের ওপর রক্তের দাগ রয়েছে।
মাথা নাড়ল এরফান। এখন আর তা সম্ভব নয়, অনেক দেরি হয়ে গেছে। লম্বা লম্বা পদক্ষেপে মেয়েটা প্রায় করালের কাছে পৌঁছে গেছে। ঘোড়াটা মাথা। নিচু করে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে; পরিষ্কার বোঝা যাচেছ ওটা অত্যন্ত ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত। খাপে রাইফেলটা নেই-এবং জিনের ওপর শুকনো রক্তের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা বিস্ফারিত আতঙ্কিত চোখে ওদিকে চেয়ে আছে। এর মানে কি হতে পারে বোঝার বুদ্ধি তার আছে।
এরফানের কথায় সবার চটকা ভাঙল। তোমরা সবাই চটপট কাজে ব্যস্ত হও, বলল সে, ঘোড়া, রাইফেল আর খাবার নিয়ে দুমিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নাও। আমি তোমাদের এখানে হাজির চাই। আমরা আজ জ্যাকের খোঁজে পুরো রেঞ্জ চষে ফেলব।
এরফানের জোরালো আদেশে ফিলেরও অভিভূত অবস্থাটা কেটে গেল। আমিও আমার ঘোড়া নিয়ে তৈরি হয়ে আসছি, বলে সে উদ্ধত দৃষ্টিতে এরফানের দিকে তাকাল, যেন আশা করছে। তাকে যেতে নিষেধ করবে, ফোরম্যান।
এরফান কিন্তু ঠিক তার উল্টোটাই করল। নিশ্চয়, বরং তোমার সাহায্যই আমাদের বেশি প্রয়োজন হবে, বলল সে, এই এলাকা তোমার চেয়ে বেশি আর কেউ চিনবে না। তাছাড়া জ্যাক যেসব জায়গায় বেড়ানো পছন্দ করত সেগুলো তুমি চেনো।
জোড়ায় জোড়ায় বিভক্ত করে সবাইকে বিভিন্ন দিকে পাঠাল এরফান, কারণ অনেক এলাকা জুড়ে ওদের খুজতে হবে। তবে কড়া নির্দেশ থাকল কেউ যেন একা কোন দিকে না যায়। ফিলকে পাঠানো হলো রে এদারটনের সাথে। কেবল বাকি থেকে গেল সে নিজে। অবশ্য টমি ওকে সঙ্গ দিল। স্টিভের লাশ যেখানে পাওয়া গেছিল সেই এলাকাটাই প্রথমে খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নিল এরফান।
যাওয়ার পথে পুরো ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখল সে। কিন্তু ওকে স্বাকার। করাতেই হলো যে এখন পুরো ঘটনাটাই কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে। এই এলাকায় কোন মানুষই স্বেচ্ছায় কেউ ঘোড়া ছেড়ে পায়ে হেঁটে কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে না। তাছাড়া রাইফেলটাও খাপ থেকে অদৃশ্য হওয়ার অর্থ একটাই হতে পারে-সেটা হচ্ছে স্টিভের ভাগ্যে যা ঘটেছিল তাই ঘটেছে র্যাঞ্চারের। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে হত্যাকারী কে হতে পারে? এতে বার্টের কোন হাত থাকতে পারে না, কারণ র্যাঞ্চার বেঁচে থাকলেই তার লাভ। তবে কি ব্ল্যাক মাস্ক দলের কারও সাথে জ্যাকের শত্রুতা ছিল? এসব প্রশ্নের কোন সমাধান না পেয়ে শেষে সে ওসব চিন্তা মাথা থেকে আপাতত বাদ দিয়ে খোজার কাজে মন দিল। এমনও হতে পারে যে গুলি খেয়ে আহত অবস্থায় কোথাও পড়ে আছে র্যাঞ্চার। তাহলে তাকে যত তাড়াতাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় ততই মঙ্গল।
কিন্তু ওর সব চেষ্টাই বৃথা গেল; আহত জ্যাক বা তার লাশ সে খুঁজে পেল। লেজি এম-এ ফিরে এরফান দেখল ওর মতই আর সব কাউবয়রাও বিফল হয়ে ফিরেছে। র্যাঞ্চারকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডেজার্ট এজ আর হোপেও খবর পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু ওদিকেও তার কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
ষষ্ঠদিন খুব সকালে এরফান দেখল র্যাঞ্চহাউসের বারান্দায় বসে বার্ট আর ফিল আলাপ করছে। বিশাল লোকটা ব্যাখ্যা দিল যে সে কিছুদিন বাইরে ছিল-ফিল্পে খবরটা শুনেই ছুটে এসেছে। ফোরম্যানকে দেখেই তার চেহারা রাগে। বিকৃত হলো।
যদি চাও তুমি আমার আউটফিটের লোকজনকেও খোঁজার কাজে ব্যবহার। করতে পারো, ফিল, বলল সে। আমি বুঝতেই পারছি না জলজ্যান্ত লোকটা হঠাৎ এভাবে অদৃশ্য হলো কিভাবে। এবার এরফানের দিকে ফিরে সে প্রশ্ন করল, তোমরা পুরো এলাকা ভালভাবে খুঁজে দেখেছ তো? জবাবে ওকে নড করতে দেখে সে আবার বলল, তাহলে আর খোজাখুঁজি করে কোন লাভ নেই, সে যদি মাটির উপরে থাকে তবে নিজে থেকেই ফিরে আসবে-আর তা না থাকলে- ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে কাঁধ উঁচাল বার্ট। তারপর, হঠাৎ ফোরম্যানকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এই ব্যাপারে তোমার কোন আইডিয়া আছে?
না, এসম্পর্কে আমি পুরো অন্ধকারে, জবাব দিয়ে বার্টের তীক্ষ্ণদৃষ্টি উপেক্ষা করে ওর চোখেচোখে চেয়ে থাকল এরফান।
বার্ট আবার ফিলের দিকে চোখ ফেরাল। এখন আমাদের আর করার কিছুই নেই। আশা রেখে আমাদের দৈনন্দিন জীবন চালিয়ে যেতে হবে। হ্যাঁ, ভাল কথা, তোমার বাবা আমাকে ট্রেইল হার্ড তৈরি করার জন্যে পঁচাত্তরটা গরু দেবে বলে কথা দিয়েছিল।
তুমি দেখো ওগুলো যেন পাঠিয়ে দেয়া হয়, এরফানকে নির্দেশ দিল ফিল।
তুমি ওগুলোর জন্যে কত টাকা দিচ্ছ? প্রশ্ন করল এরফান।
বেকায়দা পাল্টা প্রশ্নে বার্টের মুখ কালো হলো। এখানে দামের কোন প্রশ্ন উঠছে না, বলল সে। গরুগুলো আগের দেনা পরিশোধ করার আংশিক দাম, ফিলকে জানাল সে।
দেনা আছে প্রমাণ করার জন্যে লিখিত কিছু আছে? এরফান জানতে চাইল।
এতে তোমার নাক গলাবার কি আছে? খেপে উঠল বার্ট। তোমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে, ব্যস!
তুমি আমাকে আদেশ দেয়ার কে? শান্ত স্বরে পাল্টা জবাব দিল এরফান। এখানে এখন আমিই ইনচার্জ, মিস মাস্টারসনের ইচ্ছা বিবেচনা করে যদি আমি সেটা যুক্তিসঙ্গত মনে করি তবেই তা আমি পূরণ করব। আমি আমার মালিকের সবকিছুর জন্যে দায়ী, তাই একমাত্র মালিকের আদেশ ছাড়া যার-তার মুখের কথায় আমি কোনকিছুই কাউকে দিতে বাধ্য নই।
তুমিই ইনচার্জ, না? দাঁত খিচিয়ে বলল বার্ট। ভাল, কিন্তু এখন আর তুমি তা নও। মিস মাস্টারসন তোমাকে এই মুহূর্তেই বিদায় করবে।
ফিলের দিকে তাকাল এরফান। মেয়েটার ঠোঁট কাঁপছে, মুখ লাল হয়ে উঠেছে এবং বোঝা যাচ্ছে বাক্টই ওর হয়ে কথা বলুক, সে এটাই চাইছে।
ওটা তার পক্ষে সম্ভব নয়, চট করে জবাব দিল সে।
পারে না, না? আবার দাঁত খিচাল বার্ট। তাহলে তোমার ধারণা র্যাঞ্চটা ওর নয়?
তুমি ঠিকই ধরেছ, উল্লেখ করল ফোরম্যান। মালিক মৃত তা প্রমাণিত হওয়ার আগে তো নয়ই। এবং সেটা যদি সত্যি হয় তার পরেও ওকে পরিণত বয়স্কা না। হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মাস্টারসন আমাকে এই পদে বসিয়েছে, এবং আমি এখান থেকে যে নড়ছি না, এসম্পর্কে তুমি নিশ্চিত থাকতে পরো।
বার্টকে তার শেষ কথা জানিয়ে দিয়ে সে ঘুরে নিজের কাজে চলে গেল।
বার্ট সেদিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মেয়েটাকে বলল, ওর একটা উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত। আমি নিজে এর একটা ব্যবস্থা করব। ওকে সাজা দেয়ার কাজটা আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।
অতিথি বিদায় নিয়ে চলে যাবার পরেও ফিল অনেকক্ষণ ধরে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বারান্দাতেই বসে থাকল। পরিস্থিতিটা ভালমত বিচার করে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছে সে। সারা সপ্তাহটা বাবার শোকে মুহ্যমান হয়ে সারাদিন তাকে খুঁজে বেড়িয়েই কেটেছে ওর-কারণ অন্যান্য কাউবয়ের সাথে সমানে তাল রেখে সে-ও হন্যে হয়ে জ্যাককে খুঁজেছে। তখন তার আর কিছু ভাবার অবসর ছিল না। কিন্তু এইমাত্র বার্টের সাথে ফোরম্যানের ইচ্ছার বিরোধ দেখার পর। নিজের অবস্থান এখন সে ঠিকই বুঝতে পারছে। যদিও তার কাছে জেমসের কঠিন হাতে র্যাঞ্চের কর্তৃত্ব তুলে নেয়াটা ঠিক পছন্দ হয়নি, তবু যেন মনে ক্ষীণ একটা স্বস্তি বোধ করছে। স্বীকার না করলেও জেমসকে সে যে তার উদ্ধত আচরণের জন্যে পছন্দ করে না, এটা সত্যি। বার্ট যদি ওকে সত্যিই শায়েস্তা করতে পারে, তবে সে মনেমনে খুশিই হবে।
০৫.
এক এক করে দুহপ্তা পার হয়ে গেল, কিন্তু নিরুদ্দেশ র্যাঞ্চারের কোন খবর পাওয়া গেল না। গতানুগতিক নিয়মে র্যাঞ্চের কাজ ঠিকই চলছে। বুল ডেভিসকে ফোরম্যান যেভাবে সামলেছে তাতে আর সবাই বুঝে গেছে যে জেমসের সাথে লাগতে যাওয়ার ফল ভাল হয় না। এতে এ-ও বোঝা গেছে যে লোকটা কাজ বোঝে। তাই ওকে আর কেউ ঘটাতে সাহস পায়নি।
একদিন সকালে রাঁধুনী আর র্যাঞ্চহাউস দেখাশোনা করার পোর্ক ড্যানিয়েল এসে এরফানকে খবর দিল যে মিস মাস্টারসন ওকে দেখা করতে বলেছে। ওখানে পৌঁছে সে দেখল, ফিল বড় কামরাটায় তার অপেক্ষাতেই বসে আছে। মেয়েটাকে ফেকাসে দেখাচ্ছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে; এসব এতদিন দুশ্চিন্তায় কাটানোর ফল।
আমি শুনলাম তুমি কিছু গরু একত্রে জড়ো করছ, বলল সে। ওগুলো কি মিস্টার বার্টের জন্যে?
না, বলল এরফান। ওগুলো এক্স টি র্যাঞ্চে বিক্রি করা হবে। তোমার বাবাই এর ব্যবস্থা করেছিল-তাছাড়া আমার কিছু টাকার দরকার হয়ে পড়েছে।
তোমার দরকার? ব্যঙ্গাত্মক সুরে খোঁচা দিল ফিল।
নিশ্চয়; আমাকে কর্মচারীদের বেতন আর খরচ দিতে হবে, জবাব দিল সে। হয়ত এক্ষেত্রে আমার না বলে আমাদের বলাটাই বেশি সঙ্গত হত; কিন্তু হরেদরে সেটা একই কথা হলো।
আমি ডেজার্ট এজ থেকে না ফেরা পর্যন্ত দয়া করে বিক্রিটা তুমি স্থগিত রেখো, ঠাণ্ডা স্বরে বলল ফিল।
ওর কথায় জেমস কোনরকম কৌতূহল প্রকাশ না করায় খুব নিরাশ হলো। মেয়েটা। এরফান কেবল বলল, তোমাকে এতদূর পথ আমি একা যেতে দিতে পারি না। অপেক্ষা করছে ফিল, সে ভাবছে লোকটা হয়ত নিজেই তার সাথে যাওয়ার প্রস্তাব দেবে, আর সে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে মনের ঝাল মেটাবে। কিন্তু আবারও তাকে নিরাশ হতে হলো। বস্টনকে আমি তোমার সঙ্গে পাঠাতে পারি, ওর তেমন কোন কাজ নেই, বলল এরফান।
ওরা দুজনে বেশ দ্রুত গতিতেই ডেজার্ট এজের ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে। প্রথমে ফিলের কিছুটা পিছনে থেকেই এগোচ্ছিল সে। কিন্তু কোন কথা ছাড়া চুপচাপ পথ চলতে চলতে বিরক্ত হয়ে শেষে মেয়েটা নিজেই ওকে এগিয়ে এসে পাশাপাশি চলতে বলল; গোলগাল চেহারার নতুন কাউহ্যান্ডকে আসলে ফিলের বেশ ভালই লেগেছে। যুবককে একটু লাজুক প্রকৃতির আর নিরীহ বলেই ওর। মনে হচ্ছে। যখন ফিল প্রশ্ন করল র্যাঞ্চটা ওর কেমন বলে মনে হয়, সে এক কথায় জবাব দিল চমৎকার কিন্তু ওকে যখন ওর ফোরম্যান কেমন জিজ্ঞেস করা হলো, তখন জবাবটা আগের মত তাড়াতাড়ি এলো, না বা তেমন উৎসাহও দেখা গেল না।
কিছুক্ষণ ভেবে সে বলল, লোকটা তার কাজ খুব ভাল বোঝে বটে, কিন্তু ওকে সন্তুষ্ট করা সহজ কাজ নয়। আসল কথা কি জানো, মিস, সে যখন কাউকে কোন কাজ করতে দেয়, কাজটা ঠিক ওর মন মত না হলে সে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে বসতে পারে।
অর্থাৎ প্রচণ্ড উদ্ধত একটা হেঁকড়া লোক, মন্তব্য করল ফিল।
লরি বস্টন আড়চোখে মেয়েটার দিকে চেয়ে খিকখিক করে হেসে উঠল। ওকে আমি ঠিক উদ্ধত বলবনা-তবে সে তার নিজস্ব কঠিন আইডিয়ায় চলে, এটা সত্যি, বলল লরি।
আমার মতে সে একজন পেশাদার পিস্তলবাজ রোষের সাথে বলল ফিল।
অবশ্যই তা হতে পারে, স্বীকার করল লরি, কিন্তু আমার তা মনে হয় না; কারণ ওই ধরনের লোকের চোখগুলো সাধারণত নীচ দেখায়। তবু আমি বলব কেউ যদি ওর বিরুদ্ধে পিস্তল ড্র করতে যায় তবে হয়ত টের পাবে একটু দেরি করে ফেলেছে সে।
এরপর লরি মেয়েটাকে খুনী আর গান-ফাইটারদের অনেক গল্প শোনাল; ওয়াইল্ড বিল হিকক, শ্লেইড, বিদ্যুৎ এরফান, এবং আরও অনেকের কথা, সেইসাথে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করল ওরা দেশে শান্তি আর শৃঙ্খলা আনার জন্যে কিভাবে লড়াই করেছে। কিন্তু মেয়েটা যখন প্রতিবাদ জানিয়ে বলল যে ওসব দেখার জন্যে দেশের আইন রয়েছে, আইনের লোকেরাই যারা খারাপ কাজ করে তাদের ধরে শাস্তি দেবে, তখন লরি হাসল।
মৃত লোকের কাছে আইন থাকলেই বা কি লাভ? প্রশ্ন করল সে। না, ম্যাম, ওইসব আইন-শৃঙ্খলাহীন এলাকা এবং এই এলাকায় মানুষকে আইন তার কোমরে হাতের কাছে তৈরি রাখতে হয়। যেখান থেকে সে যেকোন সময়ে দ্রুত কোমরে ঝোলানো আইনের সাহায্য পেতে পারে। আমি নিজে একজন ভদ্র মানুষ, কিন্তু তা হলেও আমাকে পর্যন্ত নিজেকে রক্ষার জন্য কোমরে অস্ত্র ঝোলাতে হয়।
এইসব কথাবার্তার মাঝেই ফিলকে ব্যস্ত আর আমোদে রেখে ওকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিল কাউবয়। ডেজার্ট এজ ঠিক হোপের মতই আর একটা শহর। যদিও ফিল আরও কয়েকবার তার বাবার সাথে পুবে যাওয়ার সময়ে এখামে এসেছে, তবু এই শহর ওর কাছে বিশেষ পরিচিত নয়। এক পাকা চুলওয়ালা বুড়োর কাছে জাজ এমারির ঠিকানা জিজ্ঞেস করল ও। লোকটার মাথায় হ্যাট না থাকলেও স্বভাবজাত ভাবেই বুড়ো তার হ্যাট খোলার চেষ্টায় বিফল হয়ে একটু লজ্জা পেয়ে বাড়িটা দেখিয়ে দিল।
জাজ লোকটা বেশ লম্বা বয়স ষাটের মত হবে; তাকে মুখ দেখে টাইটেলটা দেয়া হয়নি। আসলেই সে সরকারি জাজ এবং আইন তার ভালভাবেই জানা আছে। কাজের মেয়েটা যখন তাকে জানাল যে মিস মাস্টারসন তার সাথে দেখা করতে এসেছে, সে তখন শার্ট পরিহিত অবস্থায় বসার ঘরে বসে চুরুট কুঁকছিল। ওটা তাড়াতাড়ি নিভিয়ে লম্বা কালো কোর্ট চাপিয়ে সাথে সাথেই বেরিয়ে সে নিজেই অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এলো।
তাহলে তুমিই জ্যাক মাস্টারসনের সেই ছোট্ট মেয়েটা, না? এসো ভিতরে চলো। আমি ধরেই নিচ্ছি জ্যাকের কোন খবর তোমরা এখনও পাওনি? যাক, এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নেই, পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল এমারি। এখন সুস্থির হয়ে বসে বলো তোমাকে আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি।
প্রথম দৃষ্টিতেই জাজকে পছন্দ করে ফেলেছে ফিল। বসার আগেই সে ভাবল: এই লোককে বিশ্বাস করা যায়।
আমি বাবার কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম, এই সময়ে দেখি ওগুলোর একটায় লেখা আছে তার যদি কিছু হয়, তাহলে আমি যেন এসে তোমার সাথে দেখা করি।
খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা, বলল জাজ। এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে তোমার। বাবার সব ব্যবসা বহু বছর ধরে আমিই দেখাশোনা করি। কয়েক মাস আগে আমার কাছে সে একটা উইল করে। ওটার শর্ত অনুযায়ী এখন আইনত আমিই তোমার অভিভাবক। বলতে বাধা নেই যে আমি আমার বর্তমান মর্যাদায় গর্বিত। সে একটা আনুষ্ঠানিক কুর্নিশের ভঙ্গি করে মেয়েটাকে সম্মান দেখাল। যখন দেখল ব্যাপারটা ফিলের মাথায় ঠিক ঢোকেনি তখন জাজ বলল, এর মানে হচ্ছে তোমার বাবা না ফেরা বা তার সম্পর্কে কোন নিশ্চিত খবর না পাওয়া। পর্যন্ত আমাকেই তোমার ভালমন্দ দেখতে হবে-তুমি প্রাপ্ত বয়স্কা হলেই কেবল র্যাঞ্চের মালিকানা পাবে।
মেয়েটা চুপ করে বসে আছে, ভাবছে। এবং ধরো-যদি এর মধ্যে আমি বিয়ে করতে চাই-তবে তোমার অনুমতি আমার নিতে হবে, এই তো?
ওর কথা শুনে ধূর্ত জাজের চোখে একটা ঝিলিক দেখা দিল, কারণ সে বুঝেছে এই তরুণী কেবল সুন্দরীই নয়, বুদ্ধিমতীও বটে। হ্যাঁ বলল সে, জ্যাক যে কেন এই শর্তটার ওপর এত জোর দিল তা আমার বোধগম্য হয়নি-কিন্তু এটা ওর উইল, সুতরাং আপত্তি করার কোন উপায় আমার ছিল না। ওতে আরও বলা হয়েছে, তুমি যদি আমার মতের বিরোধিতা করো তবে পুরো সম্পত্তির বদলে তুমি কেবল একটা সামান্য মাসিক ভাতা পাবে। কেন যে সে এই শর্তের ওপর এত গুরুত্ব দিল তা আমি নিজেও জানি না।
মেয়েটা আবার চুপ করে থাকল। আবছা ভাবে তার ধারণায় ছিল যে সে যদি বার্টকে বিয়ে করে তাহলে হয়ত:জেমসকে র্যাঞ্চ থেকে তাড়ানো অনেক সহজ হবে। এখন সে ভাবছে, এই শর্তটা কি বার বির মালিকের উদ্দেশেই করেছে বাবা? তার বাবার সাথে বার্টের সবসময়ে সদ্ভাবই ছিল; কিন্তু ইদানীং সে লক্ষ করেছে তার বাবার সাথে তার সম্পর্কে যেন কেমন একটা চিড় ধরেছে। এখন সে আর তাকে আগের মত পছন্দ করে না।
তুমি যদি তোমার র্যাঞ্চ সম্পর্কে দুশ্চিন্তায় থাকো তার কোন প্রয়োজন নেই, মন্তব্য করল জাজ। তোমাদের ফোরম্যান অত্যন্ত উপযুক্ত লোক।
আমি ওকে পছন্দ করি না, পরিষ্কার জানিয়ে দিল ফিল। সে এমন ব্যবহার করে যেন ওই র্যাঞ্চটা তারই সম্পত্তি।
সে তার মালিকের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করছে, তাকে আদেশ দেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে, ওকে মনে করিয়ে দিল জাজ এমারি।
কিন্তু তাই বলে আমাকেও? প্রতিবাদ জানাল মেয়েটা।
তা কি সে কখনও করেছে? প্রশ্ন করল এমারি।
একটু ইতস্তত করে ফিল বলল, না, ঠিক তা নয়, তবে আমার ওকে পছন্দ হয় না, আমার আদেশও সে উপেক্ষা করেছে, বলে সে ওর সামনে বার্টকে গরু দিতে অস্বীকার করার পুরো ঘটনা খুলে বলল।
পুরোপুরি ঠিক কাজুই করেছে সে, বলল জাজ। তোমাদের র্যাঞ্চের ব্যবসা সংক্রান্ত সব কথাই জানি। আমার জানামতে বাটের কাছে কোন দেনা মাস্টারসনের নেই। এবং এটাও তোমাকে জানিয়ে রাখছি যে তোমার বাবার কাছে আমিই ওই লোককে রাখার সুপারিশ করেছিলাম। শুনে খুশি হলাম যে সে আমার বিশ্বাস ভঙ্গ না করে ঠিক মতই র্যাঞ্চ চালাচ্ছে।
আবার, মেয়েটা চুপ থাকল। সে ভেবেছিল বার্টকে বিয়ে করলে বিনা রক্তপাতেই ফোরম্যানকে সহজে বিদায় করা যাবে। কিন্তু তার বাবা উইলে ওই শর্তটা জুড়ে দিয়েই তার সব প্ল্যান পণ্ড করে দিয়েছে। সে আগে মনে করত তার বাবা বার্টকে পছন্দই করে, কিন্তু পরের দিকে তার মনে সন্দেহ জাগতে শুরু করেছিল। এখন তার মনে হচ্ছে হয়ত বার্টকে ঠেকাবার উদ্দেশ্যেই ওই শর্তটা। উইলে ঢুকানো হয়েছে। চতুর বুড়ো জাজই হয়ত এমন ভাবে উইলটা লিখেছে যেন বেকায়দা পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। তার বার্টের পাওনার কথা এভাবে উড়িয়ে দেয়া থেকেই বোঝা যায় যে জাজেরও বার্ট সম্পর্কে তেমন উঁচু ধারণা নেই। তার এতদূর আসাটাই বৃথা হলো বুঝে বেজার মুখে যাওয়ার জন্যে উঠে দাড়াল সে। ওর এই তিক্ত চেহারার ভুল অর্থ করল জাজ।
দরদভরা স্বরে সে বলল, শোনো, লক্ষ্মী:মেয়ে, এখনই ভেঙে পড়ার কিছু নেই; আশপাশের সবকটা শহরে খবর নেয়ার ব্যবস্থা আমি করেছি, আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যেই তোমার বাবার সন্ধান আমরা পেয়ে যাব। যদি যে-কোন করণে প্রয়োজন হয় তবে তুমি সোজা আমার কাছে চলে এসো, অথবা আমাকে একটা খবর পাঠালে আমি নিজেই চলে আসব-তবে তোমার ফোরম্যানকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো।
লরির সঙ্গী ফিরতি পথে একেবারে নীরব থাকল। আসলে ওর মাথায় বিভিন্ন রকম চিন্তা চলছে এখন। সকালে ডেজার্ট এজের পথে রওনা হওয়ার সময়ে সে অনেক আশা নিয়ে বেরিয়েছিল যে জাজের সাথে দেখা করে এটা প্রতিষ্ঠিত করেই ফিরবে আসল মালিক কে, এবং কার আদেশ ফোরম্যানকে মেনে চলতে হবে; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তার হাত-পা বাঁধা। ফোরম্যান বা জাজের কথা অনুযায়ীই ওকে চলতে হবে-অন্তত পরিণত বয়স না হওয়া পর্যন্ত তাকে এইভাবেই চলতে হবে। ওর এই অসহায় অবস্থার কথাটা জাজ এমারি যেন ভদ্র ভাষায় হাতুড়ি ঠকে ওর মাথায় ভাল করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তবে বার্ট ওর পক্ষে আছে, সে জানবে এই অবস্থা কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
পরদিন সকালে বার বির মালিক আবার ওর সাথে দেখা করতে এলো, তখন সে জাজের সাথে দেখা করা থেকে শুরু করে নিজের বর্তমান অসহায় অবস্থার সব কথা সবিস্তারে জানাল ওকে। বার্ট তার নিজের বিরক্তিটা লুকাতে সক্ষম হলো বটে, কিন্তু কথার শেষে দেখা গেল তার ভুরুতে গভীর ভাঁজ পড়েছে।
আমি ভাবছি তোমার বাবা এই বুড়ো গাধাটাকে কেন কর্তৃত্ব দিতে গেল? মন্তব্য করল সে। এর পিছনে নিশ্চয় কোন গৃঢ় কারণ আছে। আমাদের সাবধান থাকতে হবে, ফিল, এটা একটা ফাঁদও হতে পারে।
তুমি কি বোঝাতে চাইছ? প্রশ্ন করল মেয়েটা।
আমি বলছি না যে এটাই সত্যি, কিন্তু ভেবে দেখো এমারিই ওই উইলটা লিখেছে, এবং সে নিজেই ওই জেমস গ্রীন লোকটাকে ফোরম্যান করার পরামর্শ জ্যাককে দিয়েছে। তারপর তোমার বাবা নিখোঁজ হলো; অর্থাৎ এখন এমারি আর জেমূসই হয়ে বসল এই সবথেকে বড় আর ভাল র্যাঞ্চটার কর্তা। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে তোমাকে এমারির অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে দেয়া হবে না।
না, আমি পরিণত বয়স্কা না হওয়া পর্যন্ত তা পারব না, ফিল স্বীকার করল।
আমি জানতাম! উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠল বার্ট। ওরা আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছে। প্রথমে স্টিভকে সরানো হলো, এবং ওর জায়গায়। জাজের পরামর্শেই নেয়া হলো জেমসকে। পুরো র্যাঞ্চটাই এখন ওদের দুজনের হাঁতে। এখন জেমসু তোমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারলেই মেয়েটা বাঁকা হাসি হাসল। ফিল কি ভাবছে আঁচ করে নিল বার্ট। তুমি কোন ভুল করতে যেয়ো না-কিছু লোকের বিশ্বাস কোন মেয়েকে কঠিন ফাঁদে ফেলতে পারলেই তার মন জয় করে নেয়া যায়। আমি বাজি ধরে বলতে পারি ওর সাথে বিয়েতে জাজের অমত হবে না। কিন্তু ওকে সেই সুযোগ আমরা দেব না, তুমি কি বলো, ফিল? আমরা ওদের ঠিকই হারিয়ে দেব-ওদের চালাকি আমরা ধরে ফেলেছি। তুমি জানো ওর কাছে ক্যাশ কি পরিমাণ আছে?
রিজের মাথায় এক্স টি র্যাঞ্চে সে আশিটা গরু বিক্রি করবে।
ওগুলো সে কবে পাঠাচ্ছে?
আগামী পরশু।
খুব ভাল কথা, বিশাল লোকটা হাসল। এতে আমি ওর প্যানে কিছুটা বাগড়া বাধাবার যথেষ্ট সময় পাব।
মেয়েটা জিজ্ঞেস করল ন বা কি করবে; সে ধারণা করল কোন না কোন উপায়ে গরুর ডেলিভারি ঠেকানো হবে। এতে করে কোন নগদ টাকাই জেমস পাবে না। কিন্তু জেমসের প্রতি তার রাগ ওকে এমনই অন্ধ করে দিয়েছে যে সে। বুঝছে না যে এতে সে হয়ত তার নিজেরই ক্ষতি করছে। বার্ট তার মনে ওদের জঘন্য প্লটের মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে ওর মনটা এতই বিষিয়ে দিয়েছে যে নিজের ফোরম্যানকে ঠেকাতে সে যে-কোন কাজই এখন করতে প্রস্তুত।
০৬.
একজন স্টোরকীপার কোন পার্সেলের মোড়ক হিসেবে যেমন দুমড়ানো বাজে কাগজ ব্যবহার করে ঠিক তেমনি একটা কাগজে পেনসিল দিয়ে বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে একটা মেসেজ:
তুমি যদি স্কাল ক্যানিয়নের ভিতর দিয়ে এক্স টির জন্যে গরু নেয়ার চেষ্টা করো তবে তুমি
গরুগুলো হারাবে।
একজন বন্ধু।
কাগজটা এরফান তার কামরায় দরজার তলা দিয়ে ঢুকানো অবস্থায় পেল। এটা ফিলের ডেজার্ট এজ থেকে ফেরার পর দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। কৌতুক মিশ্রিত অবজ্ঞার সাথে সে ভাবছে তার এই অজানা বন্ধুটা কে হতে পারে। এটা ডেলিভারি দেরি করানোর একটা ফন্দিও হতে পারে। নোর্টটা পকেটে ভরে সে বাঙ্কহাউসে হেনডনের খোঁজে গেল।
স্কাল ক্যানিয়ন কি এক্স টি র্যাঞ্চে যাওয়ার পথেই পড়ে? হেনডনের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে প্রশ্ন করল ফোরম্যান।
নিশ্চয়, জবাব দিল সে। মাঝামাঝি একটা জায়গায় বাঁক নিয়ে ট্রেইলটা ঘুরে, কিছু রুক্ষ জমি পার হয়ে চূড়ার নিচের ঢাল বেয়ে এগিয়েছে। কিন্তু তা হলেও পথ চলার জন্যে যথেষ্ট ভাল।
সবাইকে জানিয়ে দাও যে আমরা আজকের বদলে কালকে রওনা হব, নির্দেশ দিল জেমস।
আজ রওনা হওয়ার বদলে কাল যাওয়া একই কথা, মন্তব্য করল হেনান।
নড করে বেরিয়ে এসে নিজের ঘোড়া নিয়ে উত্তরে রওনা হলো এরফান। টমি ওর পিছু নিল। ট্রেইলটা এরফান আগে থেকেই দেখে রেখে পরিচিত হয়ে নিতে চাইছে। প্রায় অর্ধেক পথ খোলা জমির ওপর দিয়েই এগিয়েছে ওটা। তারপর হেনডনের কথা মত ট্রেইলটা ঠিকই বাঁক নিয়ে উঁচুনিচু জংলা জমির ভিতর দিয়ে এগোল। টি আর এম র্যাঞ্চের মধ্যে মোট দূরত্ব বিশ মাইল। তবে এই ট্রেইলটাও পরিষ্কার ভাবে চিহ্নিত, কারণ ডেজার্ট এজে গরু নেয়ার জন্যে এক্স টি ওই ট্রেইলই ব্যবহার করে।
এরফান খোলা এলাকা ছেড়ে একটা অগভীর ঢালু পথ ধরে এগোচ্ছে, এই সময়ে উপরের রিম থেকে রাইফেলের গর্জনের সাথে বাতাস কেটে একটা বুলেট ওর কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। ও সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ঘুরিয়ে বিপরীত ঢালের দিকে ছুটল–আরও একটা বুলেট ওর হ্যাটের কার্নিস ফুটো করে বেরিয়ে গেল। ঘোড়া থেকে নেমে ওটাকে একটা গাছের আড়ালে বেধে কুকুরটাকে বসে থাকার। আদেশ দিয়ে রাইফেল হাতে, খোলা জায়গায় বেরিয়ে সে একটা অগভীর গর্ত মত জায়গায় আশ্রয় নিল। ওর চেহারা কঠিন হয়ে উঠেছে, গুপ্তহত্যাকারীর জন্য কোন ক্ষমাই ওর কাছে নেই। রাইফেল তুলে যেদিক থেকে গুলি এসেছে সেই জায়গায় গুলি ছুঁড়ল সে। দশ গজ দূর থেকে জবাব আসায় জেসাপ বুবিল লোকটা ঝুঁকি না নিয়ে আগের জায়গা থেকে সরে গেছে।
তাহলে পালাওনি, এখনও আছ, নিজের মনেই বিড়বিড় করল সে। ভাল, এবার আমি একটা চালাকি খাটাব। হয়ত নিজেকে যত চালাক মনে করছ ততটা চালাক তুমি নও।
ধীরে ধীরে পিছনে সরে ঝোঁপ না নড়িয়ে উঠে দাঁড়াল ও। ঘোড়ার পিঠ থেকে দড়ির গোছাটা নামিয়ে একটা ছোট ঝোঁপের গোড়ায় বেঁধে দূরে সরে গিয়ে দড়ির অন্য প্রান্ত টেনে ঝোপে নাড়া দেয়ার সঙ্গেসঙ্গে ওপাশ থেকে একটা গুলি এলো। ধোয়া লক্ষ্য করে পরপর তিনটে গুলি ছুঁড়ল এরফান। প্রতিটা আগেরটার চেয়ে একটু বায়ে। এবার আর ওদিক থেকে পাল্টা কোন গুলি এলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থেকে আবার ঝোপে নাড়া দিল, কিন্তু ওদিক থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। এবার আর একটা গুলি ছুঁড়ল, কিন্তু ওদিক থেকে। কোন সাড়া এলো না। হয় লোকটা মারা পড়েছে, অথবা পালিয়েছে, টমিকে জানাল। উঠে দাঁড়িয়ে দড়ি খুলে নিয়ে ওটা পেঁচিয়ে ঘোড়ার পিঠে ঝুলিয়ে রেখে, ঘোড়াটাকে ঝোঁপের আড়াল দিয়ে হাঁটিয়ে বেসিন ঘুরে ওপাশের রিমে যেখান থেকে গুলি আসছিল, সেখানে পৌঁছল এরফান। ওদের আসতে দেখে গাছের সাথে বাঁধা একটা ঘোড়া ডেকে উঠল। অদূরেই হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে। থাকা লোকটাকে পা দিয়ে ঠেলে চিৎ করে দেখল ওটা মারিও, সেই মেক্সিকান শয়তানটা। গুলিতে ওর গলা ফুটো হয়ে গেছে।
মাস্টারসন ঠিকই সন্দেহ করেছিল, আমারও তা-ই ধারণা ছিল, বিড়বিড় করল এরফান। ভাল, তোমার ব্যাটল স্নেক ধরার দিন শেষ হয়েছে।
লোকটাকে সার্চ করে বিশেষ কিছুই পাওয়া গেল না, কয়েকটা কয়েন, একটা তামাকের থলি, আর একটা অর্ধেক ভেঁড়া কাগজের টুকরা। ওটার শেষ কয়েকটা কথা হচ্ছে:
…তোমার শেষ সুযোগ। কাজ পণ্ড করা আমি সহ্য করি না।
কালো মাস্ক।
হাহ্, আমি হয়ত নিজের অজান্তেই ওদের পা মাড়িয়ে দিয়েছি, মন্তব্য করল এরফান। কাগজটা যত্ন করে পকেটে রেখে দিল সে।
এবার আততায়ীর রাইফেলটা তুলে নিল। একটা উইনচেস্টার রিপিটার রাইফেল। বাঁটের একপাশে রূপার ছোট ছোট পেরেক গেঁথে দুটো অক্ষর লেখা রয়েছে; জে.এম.।
জ্যাক মাস্টারসন, বিড়বিড় করে বলল সে। এটা এই লোকের কাছে কিভাবে এলো?
মৃত লোকটার পিস্তুল পরীক্ষা করে দেখল ওটা ৪৫, কিন্তু সে জানে জ্যাক •৪৪ ব্যবহার করত। ওই কার্তুজ উইনচেস্টারেও ব্যবহার করা যায়। সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়ল এরফান; ব্যস্পারটা ওর ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। ঘোড়ার পিঠে উঠে স্কাল ক্যানিয়নের উদ্দেশে রওনা হলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওটা। চিনতে পারল; সরু আর গভীর একটা গালশ (Gulch)। দ্রুত ঢালু হয়ে ওটা নিচে নেমে গেছে। দুপাশের পাথুরে দেয়াল ছোট ছোট আগাছায় ভরা। এক নজর দেখাই ওর জন্যে যথেষ্ট হলো। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সে ফিরতি পথ ধরল।
সন্ধ্যায় নিজের কামরায় নিভৃতে বসে লরিকে দিনের সব ঘটনা খুলে বলল ফোরম্যান। কেবল কে যে ওকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল সেটা চেপে গেল। লরির মন্তব্যটা কাউবয়সুলভ হলো।
সে বলল, শুনেছি বোকারা নাকি লাকি হয়।
কথাটা খুবই খাঁটি, নইলে বহু আগেই তোমাকে ডানা পরতে হত, পাল্টা জবাব দিল এরফান।
তোমাকে খোলা জায়গায় পেয়ে দুবার গুলি করেও লাগাতে পারল না, বলে চলল সানসেট। অবশ্য দ্বিতীয় গুলি করার সময়ে তুমি পুরোদমে ছুটছিলে।
অবশ্যই, ফুল তোলার জন্যেও দাঁড়াইনি আমি, হেসে জবাব দিল সে। ওখানে গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না।
তাহলে তুমি বলছ স্টিভ আর মাস্টারসন মরতে চেয়েছিল? লরি খোঁচা দিয়ে প্রশ্ন করল।
মাস্টারসন আবার এসে হাজির হতে পারে, নিজের মত প্রকাশ করল ফোরম্যান, যদিও ওর স্বরে তেমন প্রত্যয় নেই।
তুমি ওই বুশওয়্যাকারকে চিনতে পেরেছিলে?
হ্যাঁ, মেক্সিকান মারিও, জবাব দিল সে।
তুমি নিশ্চয় ওকে ওখানেই ফেলে এসেছ? বলল লরি।
না, ওকে আমি গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছি; যেভাবে তোমার বাবাকে ওরা ফেলে গেছিল। ওই গাছে আমি দুটো আঁচড়ের দাগও কেটে এসেছি, ওটা নিয়ে ওরা একটু চিন্তায় পড়বে।
ফোর বির বিরুদ্ধে ভাল প্রতিশোধ, বলল যুবক। তোমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি, জেমস।
ধন্যবাদের কোন প্রয়োজন নেই; ওই ব্যাটা আমাকে মারার জন্যে গুলি ছুঁড়ছিল, মনে করিয়ে দিল সে। এই আউটফিটের কি খবর?
আমার ধারণা কেবল একজন ছাড়া বাকি আর সবাই ভাল। যে লোকটা সম্প্রতি লাইন ক্যাম্প থেকে ফিরেছে সে বার্টের লোক, ওকে আমি আগেও দেখেছি। ওর নাম গেভার? এরফান মাথা ঝাঁকাল। আগামীকাল তুমি কতজনকে সাথে নিচ্ছে?
আমি সহ ছয়জন, জানাল এরফান। ছোট একটা গরুর দল তাড়িয়ে নিতে এই কয়জনই যথেষ্ট হওয়া উচিত।
কালকে খুব ভোরেই রওনা হতে হবে জানিয়ে লরিকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিল সে।
বার্ট লোকটা সাড়ে হারামজাদা। আমার বিশ্বাস ওর হাতে কোন বিশেষ তুরুপের তাস আছে, বলে বেরিয়ে গেল লরি।
ভোর হওয়ার সাথেই গরু নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা। এরফান ওদের নির্দেশ দিল গরুগুলোকে দাবড়ে নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই, ওদের নিজস্ব গতিতেই চলতে দেয়া হবে। হয়ত এক্স টি র্যাঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছে ওদের দ্রুত চলার দরকার হতে পারে।
মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে চলেছে ওরা। অর্ধেক পথ পার হওয়া। পর্যন্ত কিছুই ঘটল না। স্কাল ক্যানিয়ন থেকে দুমাইল দূরে একটু বিশ্রাম আর খাওয়ার জন্যে ওদের থামাল এরফান। অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করার সময়ে ফোরম্যানই লীড দিল। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে ট্রেইল আড়াআড়ি একটা গিরিখাতে মোড় নিল। গেভার বাম দিক থেকে তাড়াতাড়ি ঘোড়া ছুটিয়ে ওর পাশে চলে এলো।
বস, এটা এক্স টি র্যাঞ্চে যাওয়ার পথ নয়, চেঁচিয়ে উঠল সে, ওখানে যাওয়ার পথ সোজা স্কাল ক্যানিয়নের ভিতর দিয়ে।
আমি তা জানি, কিন্তু আমার ধারণা এটা বেশি নিরাপদ, ফোরম্যান জবাব দিল। সে এটাও লক্ষ করল যে গেভার তার চতুর চোখ দুটো চট করে নামিয়ে নিল।
ভাল, এটা তোমার মত হতে পারে, কিন্তু এই পথে গরু নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হবে, বেজার চেহারায় বলল সে।
তুমি ভাবছ স্কাল ক্যানিয়ন দিয়ে যাওয়াটাই সহজ হত, না? উদ্দেশ্যমূলক ভাবে প্রশ্ন করল এরফান।
লোকটা বিড়বিড় করে মন্তব্য করল এই ট্রেইলটা খোলা আর নিচু। পরের কয়েক মাইল পথে ওর বক্তব্যই ঠিক প্রমাণিত হলো। অনেক ঝোঁপঝাড় আর বাধা কাটিয়ে ওদের এগোতে হচ্ছে। বেশ খারাপ পথ পেরিয়ে শেষে ওরা একটা খোলা ঘেসো জমিতে এসে পৌঁছল। হঠাৎ পরপর দুটো গুলির শব্দে পিছন ফিরে এরফান দেখল গেভার বোকার মত ওর ধূমায়িত পিস্তলের দিকে চেয়ে আছে। রেগে ঘোড়া ছুটিয়ে ওর কাছে এগিয়ে গেল এরফান।
বিষয়টা কি? প্রশ্ন করল সে। গরুগুলোকে কি স্ট্যামপিড় করাবার চেষ্টা করছ তুমি?
পিস্তলটা পথ চলায় অসুবিধা ঘটাচ্ছিল, তাই ওটা বের করে পরীক্ষা করতে গিয়ে কিভাবে যে গুলি ছুটে গেল তা আমি নিজেও বলতে পারব না, ব্যাখ্যা করল কাউবয়।
ফোরম্যানকে ওই ব্যাখ্যাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। কিন্তু সে নিশ্চিত যে ইচছা করেই কাজটা করেছে গেভার। লোকটা কি দস্যু দলের সাথে জড়িত? সেটার সম্ভাবনাই বেশি। লোকটার ওপর কড়া নজর রাখল সে এবং সাথে। সাথেই লক্ষ করল ওর গোড়াটা খোড়াচ্ছে।
ঘোড়াটা খোঁড়া হয়ে গেছে; আমি তোমাদের পিছন পিছন পরে আসছি, বিষণ্ণ মুখে বলল রাইডার।
এরফানের মুখ দিয়ে একটা গালি বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন স্বরে বলল, না, তুমি আমাদের সাথেই যাবে। ঘোড়ার হাঁটুর ভাঁজ থেকে তোমার বুটের মাথাটা সরিয়ে নিলেই ঘোড়াটার খোঁড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি মোটেও–
সিধে নও-সেটা আমি জানি, বলে উঠল ফোরম্যান। কাজ সেরে র্যাঞ্চে ফেরার পর তুমি যেখানে খুশি যেতে পারো, কিন্তু আপাতত তোমাকে গরুর। সাথেই থাকতে হবে।
আবার সে তার চোখ নামিয়ে নিল।
তিন মাইল ঘুরে তারা ট্রেইলে ফিরে এলো। আমি মিছেই হয়ত বেশি সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম, কিন্তু তোমরা সবাই মিলে আমার সাথে সহযোগিতা করেছ সে-জন্যে ধন্যবাদ। এক্স টিতে পৌঁছা’নোর পরে সে তার লোকজনকে ঘোরা পথ নেয়ার আসল কারণ খুলে বলল। বাকি পথে ওদের আর কোন ঝামেলা পোহাতে হলো না।
এক্স টি র্যাঞ্চের টিম একজন মোটাসোটা মাঝবয়সী লোক। সে নিজেই খালি করালের সামনে ওদের স্বাগত জানাল। গরু গুনে করালে ঢুকানোর পর এরফানকে টিম তার র্যাঞ্চহাউসে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে সে তার দুজন। কাউহ্যান্ডকে বাকি আর সবার দেখাশোনা করার নির্দেশ দিয়ে গেল।
তোমাদের খাওয়া শেষ হলে তোমরা র্যাঞ্চে ফিরে যেয়ো, আমি পরে আসছি, বলল ফোরম্যান। তারপর লরিকে বলল, তোমরা যখন যাওয়ার জন্যে তৈরি হবে আমাকে খবর দিয়ো।
খাওয়া শেষ হলে ওরা দুজন বৈঠকখানায় এসে বসল লেনদেনের কাজটা সারতে। টাকা গুনে নেয়া মাত্র শেষ হয়েছে, এই সময়ে লরি এসে বলল, তোমার লোকজন সবাই যাওয়ার জন্যে তৈরি। কিন্তু আমি থাকছি, টাকা-পয়সা নিয়ে এই এলাকায় তোমার একা যাওয়া ঠিক হবে না।
আমি যেমন আদেশ দিয়েছি সেভাবেই কাজ হবে, জবাব দিল এরফান। আমাকে যখন দেখাশোনার দরকার হবে তখন আমি নিজেই তোমাকে জানাব। গেভার কোন সময়ে গেছে?
লরি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, তোমাকে কে বলল? যদি আন্দাজ করে থাকো তাহলে বলতেই হবে ভাল আঁচ করেছ তুমি। প্রায় আধঘণ্টা আগে এক ফাঁকে সটকে পড়েছে সে। এরপর আর ওকে আমরা দেখিনি।
লরিকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গরু বিক্রির টাকার বান্ডিলটা ওর হাতে তুলে দিয়ে ফোরম্যান বলল, এটা দেখাশোনার ভার তোমার ওপর দিলাম। সাবধানে সামলে রেখো।
টাকাটা পকেটে ভরে রাখল যুবক। তারপর শান্ত স্বরে বলল, জেমস তুমি একটা বড় ঝুঁকি নিচ্ছ।
মানুষের জীবনটাই ঝুঁকিতে ভরা, হালকা সুরে বলল সে। যাও, এবার তুমি ওদের সাথেই রওনা হয়ে যাও। কিন্তু সাবধান এই টাকা সম্বন্ধে কারও কাছেই মুখ খোলা চলবে না।
ঘণ্টাখানেক পরে ট্রেইল ধরল এরফান। কিন্তু এবার ঘুরে না গিয়ে সোজা স্কাল ক্যানিয়নের ভিতর দিয়েই এগোল। টিমের সাথে কথা বলার পর ওর মনটা এখন অনেক হালকা ঠেকছে। এই এলাকায় বার্টের যতটা আধিপত্য আছে বলে। ধারণা করেছিল সে, টিমের সাথে কথা বলে বুঝেছে যে আসলে সেটা ঠিক নয়। যদিও এক্স টি র্যাঞ্চের মালিককে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় বলেই সে অনুভব করেছে, তবু মারিওকে হত্যা করা বা জ্যাকের রাইফেল পাওয়ার কথা সে টিমকে। জানায়নি। একটা ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় নেমেছে সে, তাই প্রতিটা পদক্ষেপই ওকে। হিসেব করে ফেলতে হচ্ছে। পরে অবশ্য তার মনে হয়েছে আরও খোলাখুলি আলাপ করাই হয়ত ভাল ছিল।
যেন কোন তাড়াই নেই এমন ভাব দেখিয়ে সে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে, এই সময়ে ক্যানিয়নের সবথেকে সরু এলাকায়। পৌঁছল সে। হঠাৎ একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে দুটো ছায়ামূর্তি নড়ে উঠল। হেঁড়ে গলায় একটা আদেশ এলো:
হাত তুলে দাঁড়াও! প্রন্তো! তারপর ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়াও!
অন্ধকার জায়গায় তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে সে দেখল কালো মুখোশ পরা দুটো লোক ওর দিকেই পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত তুলে পাদানি থেকে পা ছাড়িয়ে নিয়ে নিচে নেমে পড়ল। ওদের একজন সঙ্গে সঙ্গে এক পা এগিয়ে এসে বলল, মাল বের করো।
তার মানে? জিজ্ঞেস করল এরফান।
এক্স টির টিম নিশ্চয় তোমাকে গরু বিক্রির টাকা দিয়েছে, লোকটা জবাব দিল।
লেজি এমের ফোরম্যান হো হো করে হেসে উঠল। ওটা আমার কাছে নেই, বন্ধু, শান্ত স্বরে বলল সে। আমার এক কর্মচারীর হাতে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। তোমরা হয়ত ওদের যেতে দেখেছ।
দূর, ব্যাটা মিথ্যে কথা বলছে; ওকে সার্চ করে দেখো, গিল।
তোমার কি কোন বুদ্ধিশুদ্ধি নেই? খেপে উঠল গিল।
আমি বলেছি ওর তল্লাশী নাও-তার মানে সময় নষ্ট কোরো না, তাড়াতাড়ি বলে উঠল অন্যজন। আবার হেসে উঠল এরফান।
চালাক লোক, ব্যঙ্গ করল বন্দি। তোমাকে কে বলেছে যে আমার কাছে ওই টাকা আছে, গেভার?
লোকটা রাগে দাঁত কিড়মিড় করে একটা গালি দিয়ে পিস্তল খাপে ভরে এগিয়ে এসে ওকে ভাল করে সার্চ করে দেখল; এই পুরো সময়টা তার সঙ্গী পিস্তল তাক করে বন্দিকৈ কাভার করে থাকল। টাকা না পেয়ে ওকে ছেড়ে সে এবার ঘোড়ার স্যাডলব্যাগ খুঁজেও কিছুই পেল না।
ওটা এখানেও নেই, বিরক্তির সাথে বলল লোকটা।
সেটা তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম, মিস্টার, হয়ত সত্যবাদী লোকের সাথে তোমার চলাফেরা নেই।
রাগে উন্মত্ত হয়ে লোকটা তার পিস্তল বের করে এরফানের মুখে ঠেসে ধরল। ওইরকম আর একটা মন্তব্য করলে তোমার মাথা চুর করে ছাতু করে দেব আমি।
কিন্তু এখানেই সে ভুলটা করল। মার্চ চালাবার সময়ে জেসাপ যে তার কনুই খুব ধীরে ওদের অজান্তেই কিছুটা নিচে নামিয়েছে, এটা ওদের কেউই খেয়াল করেনি। এবার বাম হাতের ঝটকায় সে ওর পিস্তলের নলটার মুখ একটু দূরে সরিয়ে একই সাথে ডান হাতে প্রচণ্ড একটা ঘুসি বসাল লোকটার সোলার প্লেক্সাসের ওপর। ওই নার্ভ অবশকারী আঘাতে লোকটা দুভাজ হয়ে গেল। তার। সঙ্গী একটা গুলি করে মিস করল। ততক্ষণে এরফান নিজের পিস্তল বের করে তাকে গেঁথে ফেলল। দ্বিতীয় গুলি করার সুযোগ লোকটা আর পেল না। দস্যুরা কি ঘটছে কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক লাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে ক্যানিয়ন ধরে দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হলো এরফান।
সেই সন্ধ্যায় লরি যখন ওকে টাকা ফেরত দিতে এলো, তখন এরফান ব্যাখ্যা করল, বুঝলে, লরি, গেভারের স্কাল ক্যানিয়ন দিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়ার অতি মাত্রায় আগ্রহ দেখানোই আমাকে সন্দিগ্ধ করে তোলে। এরপর ওর পিস্তল ঘটনাক্রমে পরপর দুবার অসাবধানে ফুটতে শুনে আমার সন্দেহ হলো ওটা একটা সঙ্কেত। তারপর ওর ঘোড়া খোড়া হলো যেন পিছিয়ে পড়ে ওর সাথীদের সে খবর দিতে পারে। তখন আমি নিশ্চিত হলাম। বুঝলাম আমি একা ফিরব শুনলে সে ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের খবর দিতে আগেই রওনা হবে। গরুগুলো কেড়ে নিতে না পেরে বিক্রির টাকা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা নিশ্চয়ই করবে। ওরা ভাবতেই পারেনি কাউবয়দের কাউকে বিশ্বাস করে আমি টাকা দিতে পারি। তাই ওরা তোমাদের যেতে দেখেও বাধা দেয়নি। ঠিক আমার প্ল্যান অনুযায়ীই সবকিছু ঘটেছে।
ফোরম্যান আর কাউকেই ওর এই অ্যাডভেঞ্চারের কোন কথা জানায়নি, কিন্তু কেউ নিশ্চয় কথা বলেছে, কারণ আউটফিটের সবাই ঘটনাটা জেনে গেছে। তবে এতে ফোরম্যান হিসেবে ওর যোগ্যতায় কোন ঘাটতি পড়েনি।
পরদিন সকালে এরফান দেখল গেভার মিস মাস্টারসনের সাথে কথা বলছে।
গত রাতে তোমার কি হয়েছিল, গেভার? প্রশ্ন করল সে।
আমি এই জুনে সবার আগে রওনা হয়েছিলাম, কারণ আমার ভয় ছিল যে ঘোড়াটা হয়ত আবার খোড়া হয়ে যেতে পারে। ঠিক তাই ঘটল, এই কারণেই আমি আর গতকাল র্যাঞ্চে ফিরতে পারিনি।
আমার কামরায় এসে তোমার পাওনা টাকা বুঝে নাও, এরফান এমন সুরে কথাটা বলল, ওর কথা যে সে বিশ্বাস করেনি তা স্পষ্ট বোঝা গেল।
তুমি গেভারকে কেন বরখাস্ত করছ? তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইল ফিল। ওর ঘোড়া খোড়া হয়ে গেলে সে কি করবে?
ওকে বিদায় দেয়া হচ্ছে কারণ এমন কয়েকটা কাজ করেছে ট্রেইলে যে আর সবার কাছে তার মুখ দেখাতেও এখন লজ্জা পাবে, কি ঠিক বলিনি, গেভার?
ওর প্রশ্নে মুখ কাঁচুমাচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে শেষে সে নিষ্ঠুর সুরে বলল, যেখানে আমি সবার অপ্রিয়, সেখানে আমিও থাকতে চাই
তোমার যেমন ইচ্ছে, সমর্থন করল এরফান। তবে তুমি লেজি এম থেকে দূরে থেকো, নইলে তোমাকে স্থায়ীভাবেই এখানে থাকতে, হতে পারে-মাটির তলায়।
এক ঝলক আড়চোখে এরফানকে দেখে মেয়েটা বাড়ির ভিতর সোজা নিজের কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ওর মনে হচ্ছে সারা দুনিয়ায় যেন কোন বন্ধু নেই।
০৭.
বার বির মালিক তার চেয়ারে বসে একটা চুরুট ধরিয়ে বিতৃষ্ণার সাথে চারপাশের পরিবেশ এক নজর তাকিয়ে দেখল। কামরাটা মূলত পুরুষের একটা ঘর। এলোমেলো আসবাব, নগ্ন মেঝের চার পাশেই ঘোড়ার জিন, রাইফেল, দড়ি, ইত্যাদি অগোছাল ভাবে পড়ে আছে। এর চেয়ে লেজি এমের পরিবেশ অনেক সুন্দর। কিন্তু সংসার গুছানোর প্রতি বার্টের মোটেও মনোযোগ নেই। বিয়ের পর সে লেজি এমেই থাকবে; কিন্তু এখন তার কাছে সেই সুযোগ সুদূর পরাহত বলে মনে হচ্ছে। যে-কাজটা সে খুব সহজ হবে বলে মনে করেছিল, সেটাই জেমসের চালাকিতে পুরো পণ্ড হয়ে গেল। তাছাড়া জ্যাকের হঠাৎ অদৃশ্য হওয়াও নতুন জটিলতার সৃষ্টি করেছে।
ডোভারের আবির্ভাবে ওর গভীর চিন্তায় ছেদ পড়ল। ওই একটা লোকেরই অবাধে র্যাঞ্চহাউসে প্রবেশ করার অধিকার আছে। বেজার চেহারার চোখা লোকটা কম কথা বললেও সে তার খুদে চোখে বার্টকে এক নজর দেখেই ওর মৃড় বুঝে নিল। হ্যাটটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসল সে।
এত দুশ্চিন্তা কিসের, বার্ট? পরে আবার যোগ করল, আমি সেদিন মাস্টারমনের মেয়েকে ডেজার্ট এজে দেখলাম।
সে এমারির সাথে দেখা করতে গেছিল; তার বাবার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে গিয়ে সে জেনেছিল তাকে ওইরকম নির্দেশই দেয়া হয়েছে, ব্যাখ্যা কাল র্যাঞ্চার। বুড়ো গাধাটা জাজ এমারিকেই ওর, অভিভাবক করে গেছে; এখন মেয়েটার তার অনুমতি ছাড়া কোনকিছুই করার উপায় নেই।
শিস দিয়ে উঠল ডোভার। এতে করে তোমাদের বিয়ের ব্যাপারটা বেশ পিছিয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটা যদি ওর কথা না শোনে?
তাহলে র্যাঞ্চটা সে হারাবে, রাগের সাথে বলল বার্ট।
চতুর বুড়ো কয়োটি, মন্তব্য করল গানম্যান। মেয়েটা যদিও অত্যন্ত সুন্দরী, তবু র্যাঞ্চ এমের ফ্রেমে আঁটা অবস্থায় ওকে আরও সুন্দরী দেখাবে।
বার্টের দুশ্চিন্তাটাই যেন ডোভার কথায় প্রকাশ করল। বার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে তার সমর্থন জানাল। জ্যাকের কোন খবর পেলে? প্রশ্ন করল র্যাঞ্চার।
নাহ্, ওর কোন খবরই নেই। খোঁজ নিয়ে কেবল এটুকু জেনেছি-যে এমারি তোমাকে মোটেও পছন্দ করে না। জানাল সে।
ওটা কি নতুন কোন খবর হলো? রেগে উঠল বার্ট। তুমি আবার কাউকে জানতে দাওনি তো যে আমিই তোমাকে পাঠিয়েছি?
দরকার পড়েনি-সে আগেই জানত। জেমসের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, বাড়ির কাছে খোদ জেমসের কাছ থেকেই আমি ওর সব খবর জানতে পারি-একটা বাও করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।
সমঝদারের মত মাথা ঝাঁকাল বার্ট। কয়েকবারই তার ওই জাজের সাথে আলাপ হয়েছে। ওই হাসি তার পরিচিত।
জেমস গ্রীন ডেজার্ট এজে তেমন পরিচিত নয়। তবে কয়েকবার সে জাজের সাথে দেখা করতে এসেছে-কিন্তু সে যে কোথাকার লোক তা ওরা কেউ বলতে পারল না, বলে চলল ওর গানম্যান। তোমার মনে আছে, ফ্যালান। একজন স্ট্রেঞ্জারের হাতে মারা পড়েছিল? সেই স্ট্রেঞ্জারই হচ্ছে জেমস। ওহ্, এতে কারও কিছু বলার ছিল না, কারণ ওতে ফ্যালানকে সমান সমানেরও বেশি সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া মৃত ব্যক্তি ওখানে জনপ্রিয় ছিল না। ওই মৃত্যুতে কেবল ওর পাওনাদাররাই দুঃখিত হয়েছিল।
অর্থাৎ তুমি কি বোঝাতে চাইছ? প্রশ্ন করল বার্ট, কিন্তু ডোভার তার নিজস্ব ভঙ্গিতেই তার পুরো কথা শেষ করল।
কেন যেন ফেরার পথে আমি হার্ভি বোলটনের বাড়ির পাশ দিয়ে সেই পুরোনো ট্রেইল ধরেই আসছিলাম, বলে চলল সে। ওই বড় কটনউড গাছে দেখলাম আবার ফুল ধরেছে-ওই একই ডাল থেকে একটা লাশ ঝুলছে। লাশটাকে নামিয়ে দেখলাম লোকটা মারিও। গলায় গুলি করে লাশটাকে ওখানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ওই গাছে আঁকা হার্ভির ফোর বি ব্র্যান্ডের মাঝে দিয়ে লম্বা। দুটো দাগও সদ্য কাটা হয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?
ঘটনা শুনে উত্তেজিত হয়ে বার্ট একটা গালি দিল।
এখন, ফ্যালান আর ওই মেক্সিকান মারিও দুজনই আমাদের সাথে হার্ভিকে ওই গাছে ঝুলানোর কাজে জড়িত ছিল। বাকি রইলাম আমরা পাঁচজন। তুমি, আমি, হেনডন, বুল আর গেভার। এখন এর পরে খাজটা আমাদের মধ্যে কার জন্যে কাটা হবে তাই ভাবছি আমি।
রুক্ষভাবে হেসে উঠল র্যাঞ্চার।
এসব হিসেব করে তুমি কি সাহস হারিয়ে আজেবাজে দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করেছ নাকি, ডোভার? ঠাট্টা করল বার্ট। ওটা দশ বছর আগের ঘটনা; এতদিনে আমাদের কেউ না কেউ যে মারা পড়ব এটাই তো স্বাভাবিক। ওই গ্রীজার (মেক্সিকানদের অবজ্ঞা করে আমেরিকানরা গ্রীজার বলে সম্বোধন করে; তবে এর জবাবে ওরা আমেরিকানদের গ্রিংগো বলে ডাকে। মারিও যে মোটেও জনপ্রিয় ছিল না, একথা সবাই জানে। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, যে লোকটা ওকে মেরেছে সে মারিওকে ঝুলাবার জন্যে.. ওই গাছটাই কেন বেছে। নিল, সেটা সত্যিই মনে কৌতূহল জাগায়। এখন শোনো, ওটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে, আরও জরুরী একটা বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার। আমি শুনলাম জেমস তার গরু এক্স টিতে পৌঁছে দিয়ে নিরাপদেই টাকা নিয়ে ফিরে গেছে। তাছাড়া সে লেজি এমেও শক্ত হয়ে জমে বসেছে। এই মুহূর্তে তার হাতে র্যাঞ্চ চালাবার মত টাকাও আছে। এখন আমরা কি করতে পারি?
ডোভার কিছুক্ষণ সাপের মত অপলক চোখে দেয়ালের দিকে চেয়ে নির্বিকার ভাবে বসে থাকল। ওর চেহারা দেখে কেউ বুঝবে না যে সে ঠাণ্ডা মাথায় কাউকে খুন করার কথা ভাবছে। যখন সে কথা বলল তখনও তার স্বরে তেমন কোন আভাস পাওয়া গেল না।
শেডিকে কাজে লাগাও। পিস্তলে লোকটা ওস্তাদ, তাছাড়া ওকে হোপের কেউ চেনে না। এতে আমাদের কোন হাত আছে তা কেউ বলতে পারবে না।
লোকটার হাত ঠিকই চালু, কিন্তু সে সামনা-সামনি মোকাবেলায় জেমসকে হারাতে পাবে বলে মনে হয় না, মন্তব্য করল বার্ট।
সামনা-সামনি লড়ার কথা কে বলেছে? শেডি ওকে ঠিকই শেষ করতে পারবে, এবং শহরে আমাদের যেমন দখল আছে তাতে আমরা সহজেই ওর নিরাপদে ফেরার ব্যবস্থা করতে পারব।
ওর প্রস্তাবটা ভেবে দেখছে বার্ট। ওর চেহারায় একটা নৃশংস ভাব ফুটে উঠেছে। সিদ্ধান্ত নিতে বেশি দেরি করল না সে।
মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক, বলল বার্ট। আমি এর ব্যবস্থা করছি, তাছাড়া জ্যাকের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে জেমসই দায়ীএমন একটা ইঙ্গিত দেয়াতেও কোন ক্ষতি নেই।
ওকে মেরে ফেলাটাই আমাদের জন্যে সবদিক থেকে ভাল হবে, মন্তব্য করল ডোভার। ও এখানে একজন স্ট্রেঞ্জার, তাই সে মারা পড়লে কেউ ওকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আমি বলছি, লোকটা আমাদের দুজনের জন্যেই একটা অভিশাপ। লোকটা শকুনের খাবারে পরিণত হলে আমি অনেক স্বস্তি পাব।
ট্রেইলের পথে কোন একটা খাঁজে ফেলে দিলে কেউ আর ওকে খুঁজে পাবে না। এই ব্যাপারে কোনরকম বিচার বসানো হোক তা আমি মোটেও চাই না, বলল র্যাঞ্চার।
শেষ বিকেলে এগেইন শহরে পৌঁছে এরফান আর লরি হোপ ব্যাঙ্কের সামনে ঘোড়া থামাল। ফোরম্যান দুহাজারের মত ডলার বয়ে বেড়ানোর দায়িত্বটা এড়াতে চাইছে। ব্যাঙ্কের স্টাফ বলতে কেবল ম্যানেজার আর একজন ক্লার্ক। মিস্টার রাস্টন পুবের মানুষ তাই চেষ্টা করেও সে এখানকার পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। ক্লার্ক একটা কাজে বাইরে যাওয়ায় সে নিজেই ওদের অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে এলো। লোকটা বেঁটে আর মোটা, চকচকে টাক আর গোল রিমের চশমা দেখে ওর দিনকাল বিশেষ ভাল যাচ্ছে বলে মনে হয় না। টাকা জমা দেয়া শেষ করে এরফান শহর সম্পর্কে আলাপ শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কার নিজের অবস্থান ব্যক্ত করল।
মিস্টার গ্রীন, ব্যবসায়ী হিসেবে আমি নিয়ম করে নিয়েছি, কোন স্থানীয় বিরোধে আমি পক্ষ নিই না, বলল সে। এই ব্যাঙ্ক যে-কোন সম্মানীত ব্যক্তিকেই সমান চোখে দেখে। এই নীতিটাই আমরা মেনে চলি।
বুক ফুলিয়ে কথাটা বলে সে অত্যন্ত আনন্দ পেল। লরি বেশ কষ্ট করে তার হাসি চাপল। এই ধরনের কথা সে বইয়ের বুলি বলেই মনে করে। এরফান ওর কথার জবাবে কি বলে শোনার জন্যে সে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ওকে খুব নিরাশ হতে হলো।
আমার ধারণা তোমার কথাই ঠিক, স্যার, জবাব দিল সে। বাইরে বেরিয়ে একটা গালি দিল সে। বোঝা মুশকিল লোকটা কি করতে পারে।
যদি কথাটা ওই মোটা লোকটার উদ্দেশে বলে থাকো তবে তুমি ভুল বলেছ, ফোরম্যান বলল। সে যে প্রতিবারই নিরাপদ পথে চলবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
লরি আর কথা না বাড়িয়ে এরুফানের পিছন পিছন ফেনটনের সেলুনে গিয়ে ঢুকল। সেলুনটা পুরোই খালি, কিন্তু বারের পিছন থেকে মালিক আন্তরিক হাসি দিয়ে ওদের অভ্যর্থনা জানাল।
আমি আবার তোমার দেখা পেয়ে সত্যিই খুশি হলাম, বলে সে হাত বাড়িয়ে পিছনের শেলফ থেকে একটা বোতল বের করল। আমি নিজেও এই ব্র্যান্ডের মদ খাই; আশা করি তোমারও স্বাদটা ভাল লাগবে। লেজি এমে তোমার দিন কেমন চলছে?
প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে গ্লাসে চুমুক দিয়ে চেখে দেখে সে জানাল মদটা সত্যিই ভাল। বেশ ভালই কাটছে, অন্তত এখন পর্যন্ত বড় কোন ঝামেলা হয়নি, জানাল সে।
খুশি হয়ে নিজের ঊরুতে একটা চাপড় মেরে আনন্দ প্রকাশ করল ফেনটন। আমি তোমার মত একটা লোকের অপেক্ষাতেই দিন গুনছিলাম-এই শহরে তোমার মত একজন লোকেরই খুব দরকার, বলল সে।
একজন লোক বিশজনের বিরুদ্ধে জিততে পারবে না, চোখে কৌতুক নিয়ে বলল এয়ফান।
ঠিক আছে, কথাটা আমি বলেছি এবং ফিরিয়েও নিচ্ছি না, দাঁত বের করে হেসে বলল সে। কিন্তু উপযুক্ত একটা লোকের পিছনে যদি ভাল কিছু লোক থাকে, তবে বিশজন কেন, চল্লিশজন লোককেও হারানো সম্ভব, বুঝলে?
নিশ্চয়, ওকে সমর্থন করল এরফান। এক্স টি র্যাঞ্চের টিম কি ওদের। একজন হতে পারে?
অবশ্যই, ওর মত সৎ লোক আজকাল কমই দেখা যায়; তাছাড়া তার কিছু ভাল বন্ধুবান্ধবও আছে। ওর সাথে তোমার কথা হয়েছে? আরে, আমি তো ভুলেই গেছিলাম-তুমি তোমার গরুর পাল নিয়ে নিরাপদেই এক্স টিতে পৌঁছে দিয়েছিলে। তুমি তা পারবে না মনে করে হোপে সবাই এক ডলারে তিন ডলার দেয়ার বাজি ধরেছিল।
খবরটা নীরবেই হজম করল এরফান। কালো মুখোশ দলের কেউ কেউ যারা প্রায়ই শহরে আসে তারা কি আগে থেকেই জানত যে ডাকাত দল গরু ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে? নাকি এটা নিছক বাজি ধরার একটা সুযোগ পেয়েই ঝুঁকি নেয়া? একটা ব্যাপার এতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কেউ লেজি এমে কি কি ঘটছে তার ওপর কড়া নজর রাখছে।
চূড়ার কাছে যে ডাকাতের দলটা রয়েছে, তাদের কেউ ঘাটাতে চায় না। বলে মনে হচ্ছে, কথার ছলে বলল এরফান।
হোপের কাউকে ওরা কখনও উত্যক্ত করেনি; তাছাড়া এই শহরের শেরিফ কখনও কাজের খোঁজে নিজের চোখ খারাপ করতে নারাজ, জবাব দিল সেলুন মালিক।
আমাকে ভাল মানুষ খুঁজে দেয়ার ভার তোমাকেই দিলাম, বলে ফেনটন বার ছেড়ে বেরিয়ে এলো ফোরম্যান।
তোমার যখনই প্রয়োজন তখনই ওদের তুমি যুদ্ধের জন্যে তৈরি পাবে, আশ্বাস দিল ফেনটন।
রাস্তায় বেরিয়ে র্যাঞ্চের রসদের জন্যে পাশের দোকানেই ঢুকল এরফান। শুকনো পাতলা আইরিশ মালিক চোখ পিটপিট করে ওদের দেখল।
হ্যাঁ, এই দোকান থেকেই মিস্টার মাস্টারসন সব সময়ে মাল কিনত, এরফানের একটা প্রশ্নের জবাবে জানাল সে। কিন্তু তোমার কাছে কোন মাল বিক্রি করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে।
তাহলে আমাকে বাধ্য হয়ে রবার্টসের দোকানেই যেতে হবে, রাগের স্বরে বলল ফোরম্যান।
হেসে উঠল, দোকানি। ওখানে গিয়েও তোমার কোন লাভ হবে না। লোকটার সবকিছুর মালিক হচ্ছে বার্ট। ওকেও নিশ্চয় একই নির্দেশ দিয়েছে বার্ট।
তাহলে ডেজার্ট এজের ব্যবসায়ীরাই আমার ব্যবসা পাবে, সে জবাব দিল।
আরে, শান্ত হও, হেসে বলল আইরিশম্যান! আমাকে ওরা আদেশ দিয়েছে বটে, কিন্তু সেটা মানা না মানা আমার ওপর। পাশের বারের ফেনটন আমার বন্ধু। আর বার্টের থেকে এই প্রথম আমি এই ধরনের কোন নির্দেশ পেলাম। ওর আদেশ আমি মানি না-এখন বলো তোমার কি কি প্রয়োজন।
দরকারী জিনিসের লিস্ট দিয়ে পরদিন মাল নেয়ার জন্যে লোক আর, গাড়ি পাঠাবে জানিয়ে বিদায় নিল এরফান।
এই শহরবাসীদের আমি যতটা পোষা মনে করেছিলাম এখন দেখছি সেটা ঠিক নয়; এখানেও কিছু মানুষের মেরুদণ্ড আছে।
না, এখানেও কিছু শক্ত মানুষ আছে, স্বীকার করল লরি।
গুণ্ডাদের আস্তানা, কাম এগেইন সেলুনটা এই ছোট শহরের তুলনায় অনেক বড় আর বিলাসী। বার এবং ডান্স-ইল, দুটোই বড় বড় গিল্টি করা আয়না বসিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। আসবাবপত্রও বেশ উন্নত মানের। লম্বা বারে হরেক রকম, মদের সমাবেশ রয়েছে। সদর দরজার বিপরীতেই বার। মাঝের অংশে বেশ কিছু টেবিল আর চেয়ার বসানো হয়েছে। এরফান যখন একা। ভিতরে ঢুকল তখন চেয়ারগুলো বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে। ধীর পায়ে এগিয়ে বারে দাঁড়িয়ে সে একটা ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল। অলস ভাবে গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে লোকগুলোর দিকে নজর দিল সে।
বুঝল তার ওখানে উপস্থিতিতে বিভিন্ন মন্তব্যের ফিসফিসানি চলছে ওদের মধ্যে। কেউ কেউ আড়চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে। কেবল একটা লালচে মুখের কাউহ্যান্ড, যে ঠিক তার পরপরই বারে ঢুকেছে, তারই যেন ওর প্রতি কোন আগ্রহ নেই। লোকটা বারের অন্য মাথায় দাঁড়িয়ে মদের গ্লাটাকে দুহাতে। জড়িয়ে এমন আদর করছে যেন বহুদিন পরে সে তার হারানো প্রেমিকাকে খুঁজে পেয়েছে। অথচ তার চেহারা দেখে মনে হয় না বেশিক্ষণ ওদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে। বারের অন্য মাথায় পাগলা মার্টি আর ডোভার বার্টের সাথে কথা বলছিল। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই মার্টি বিদায় নিল।
হঠাৎ এরফানের মাথায় চিন্তা এলো, ফেনটনের “ভাল লোক” এখানে। কতজন উপস্থিত আছে। সে নিজেও জানে না তার মাথায় বার্টের প্রধান, আস্তানায় এভাবে হানা দেয়ার ইচ্ছা কেন জাগল। এতে শুধু ওকে উপেক্ষাই দেখানো হলো না, এটা নাটকের চূড়ান্ত উত্তেজনাময় একটা দৃশ্যও বটে। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটবে বলে আশা করছে না ও, কিন্তু ওর ধারণা জরুরী কিছু তথ্য হয়ত এখানে পাওয়া যেতে পারে। তুমুল বাকবিতণ্ডার পর লরি এখানে ঢুকতে অস্বীকার করেছিল। ওকে চুপিচুপি দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে নিজের মনেই একটু হাসল এরফান।
যেসব লোক তাদের সারাটা জীবন বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাটিয়েছে, সহজাত প্রবৃত্তি আসন্ন বিপদ সম্পর্কে তাদের আগেই সাবধান করে দেয়। সেলুনে ঢোকার পর বেশিক্ষণ কাটেনি, এরই মধ্যে এরফান টের পেল একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মার্টির চট করে ওভাবে সরে পড়া সবাই কাপুরুষতার লক্ষণ বলেই মনে করবে। তাই নেহাত জরুরী কোন ব্যাপার না হলে সে নিজের সম্মান ক্ষুণ্ণ করে সটকে পড়ত না। বারে হেলান দিয়ে তর্করত দুজন বার বি লোকের ওপর নজর রাখল এরফান। কোন ঝামেলা এলে ওদিক থেকেই আসবে। কিন্তু বার্ট আর ডোভারের ওপর নজর রাখতে গিয়ে সে নতুন একজন খদ্দেরের সেলুনে ঢোকা খেয়াল করল না। লোকটা আর কোন দিকে খেয়াল না করে সোজা এগিয়ে লেজি এমের ফোরম্যান থেকে মাত্র দুই গজ দূরে পিছনে এসে দাঁড়াল।
নতুন লোকটা লক্ষ করার অযোগ্য মোটেও নয়। চওড়া আর পুষ্ট হওয়ায় ওকে যতটা নয় তার চেয়ে খাটো দেখায়। পরনে রেঞ্জে কাজ করার পোশাক, কিন্তু দুপাশে ঊরুর সাথে ফিতে দিয়ে বাঁধা দুটো পিস্তল ঝুলছে। ডান হাতের লম্বা আঙুলগুলো রোদে পুড়ে বাদামী হয়েছে। এরফান লক্ষ না করলেও লরি ওকে তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিয়ে দেখছে।
লোকটাকে আমি আগেও কোথায় যেন দেখেছি, ভাবছে লরি, ও যে একজন খুনী পিস্তলবাজ তাতে কোন সন্দেহ নেই। ও ডান হাতে কখনও গ্লাভস পরে না এটা ওর হাতের রং দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু লোকটা এখানে কি করছে?
লোকটার ভারী চেহারা, চৌকো চোয়াল, নোংরা হলুদ চামড়া, নিচের দিকে নামানো গোঁফ, আর সাদাটে ঠাণ্ডা চোখ, এসব দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় সে। এককথায় নিষ্ঠুর একটা মানুষ।
লরি বারে গিয়ে একটা চুরুট কিনে ধরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বারে উপস্থিত সবার ওপর একবার চোখ বুলাল।
লোকটা কার পিছনে লাগতে এসেছে? আমি বাজি ধরে বলতে পারি এখানে শীঘ্রি একটা কিছু ঘটবে, ভাবল সে।
এই সময়ে শেরিফকে ঢুকতে দেখে আবার ভাবল হয়ত শেরিফ এসে পড়ায় লোকটা আর ঝামেলা করতে সাহস পাবে না। শেরিফের পিছনে মাটিও বারে ঢুকে সোজা বার বির দুজনের দিকে এগিয়ে ওদের সাথে মিলিত হলো। ব্ল্যাক বার্ট এবার বারে এসে বলল, ফ্রেড, আমাদের জন্যে ড্রিঙ্ক ঢেলে দাও।
ওদের জন্যে জায়গা ছেড়ে দিতে এরফানকে বাধ্য হয়ে কিছুটা সরতে হলো। এতে যার উপস্থিতি সম্পর্কে সে সচেতন ছিল না তার কাছাকাছি পৌঁছে গেল এরফান। এরপরেই একটা গ্লাস ভাঙার শব্দ শোনা গেল।
ড্যাম ইউ, আনাড়ি কাউপাঞ্চার। আমার পা মাড়িয়ে দেয়ার জন্যে তোমাকে আমি উচিত শিক্ষা দেব, ওর পিছন থেকে কেউ রুক্ষ স্বরে বলে উঠল। এবং একই সাথে একটা শক্ত গোল কিছুর স্পর্শ অনুভব করল সে তার শিরদাঁড়ার ওপর। একটু নড়লেই তোমাকে আমি দুটুকরো করে ফেলব! হুমকি দিল লোকটা।
আড়ষ্ট হলো এরফান। শক্ত গোলাকার জিনিসটা যে কি জানে ও। এবং লোকটার কর্কশ স্বর শুনে সে এটাও টের পেয়েছে যে ওকে নিছক ভয় দেখাবার জন্যে কথাটা বলা হয়নি। একটু নড়লেই ওর মরণ অনিবার্য। বার্টের ওপর ওর চোখ পড়ল, দেখল লোকটার চোখ আনন্দে আর কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পুরো কামরাটা এখন একটা নীরব উত্তেজনায় ভরা। তাস ফেঁটা আর বাজি ধরাও এখন বন্ধ।
খবরদার! আরেকটা স্বর শোনা গেল। আমি তিন গোনার আগে পিস্তল ফেলে না দিলে তুমিই মরবে। এক…দুই…
লোকটা কাঁধের ওপর দিয়ে আড়চোখে এক নজর চেয়ে দেখল বক্তা একজন তরুণ কাউবয়। সে-ই কথাটা বলেছে। নেশা ছুটে গেল তার। কারণ তরুণ হলেও কাউবয়ের নীল চোখদুটো কঠিন ইস্পাতের মত কঠিন আর ঠাণ্ডা; আর ঠোঁটের চুরুটটা চেহারায় এমন একটা ভাব এনেছে যাতে ওকে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি অভিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে। লোকটার পিস্তল শব্দ তুলে মেঝের ওপর পড়ল।
ঠিক আছে, জেমস, ওর বিষদাঁত আমি তুলে দিয়েছি, বাকিটা এখন তুমি সামলাও।
লরির পিস্তলের তাক অবিচল রয়েছে। বিদ্যুৎ গতিতে ঘুরে হুমকি প্রদানকারীর বাম চোয়ালে দেহের সব শক্তি নিয়োগ করে একটা প্রচণ্ড ঘুসি বসাল এরফান। ওই জোরালো ঘুসি খেয়ে লোকটা মাটি ছেড়ে শূন্যে উড়ে একটা জুয়ার টেবিল ভেঙে নিচে পড়ল। দুজন লোক লাফিয়ে উল্টো ডিগবাজি দিয়ে চমৎকার ভাবে চেয়ার ছেড়ে সরে গেল। শেরিফ টেলরের ফোলা মুখ আর খুদে চোখ দেখে বোঝাই যায় না লোকটা এমন তর্জন-গর্জন করুতে পারে।
তোমার মতলবটা কি? হুঙ্কার দিল সে। এখানে এসে শান্তি ভঙ্গ করে সম্মানিত খদ্দেরের সাথে মারপিট করছ! আমার তো ইচ্ছা করছে।
তুমি অযথা বড়াই করছ, শেরিফ। আমার তো মনে হয় না তোমার এতটা সাহস আছে, পাল্টা জবাব দিল এরফান। দর্শকের মধ্যে খিকখিক করে হাসির শব্দ উঠল যেটা শেরিফকে আরও খেপিয়ে তুলল। অবশ্য আমি জানতাম না ওই লোকটা তোমার বন্ধু।
বন্ধু না ছাই-ওকে আগে কখনও দেখিনি আমি, জবাব দিল শেরিফ। কিন্তু আমিই এই শহরের আইন রক্ষক-
তুমি কি তোমার কাজে একটু বেশি দেরি করে ফেললে না? ব্যঙ্গ করে বলল লেজি এম ফোরম্যান। ওই লোকটা যখন আমার পিঠে পিস্তল ঠেসে ধরেছিল তখন কি তুমি চোখে ঠুলি পরে ছিলে?
আমি দেখেছি তুমি ইচ্ছে করে ওর পা মাড়িয়ে ওর ড্রিঙ্ক ফেলে দিয়েছ, খেপে উঠে বলল,শেরিফ। তোমাকে সে যদি মেরে ফেলুত তবে তোমার উচিত সাজাই হত।
দর্শকের চক্রের দিকে চেয়ে হাসল এরফান।
তোমার চোখ পরীক্ষা করিয়ে নেয়া দরকার, শেরিফ, বলল সে। নইলে ওটাই একদিন তোমার কাল হয়ে দাঁড়াবে। তারপর ওর চেহারা থেকে হাসিটা মুছে গেল। আমি জীবনে অনেক শেরিফ আর মার্শাল দেখেছি, কিন্তু অযোগ্যতার দিক দিয়ে তুমিই সবার শীর্ষে, তিক্ত স্বরে বলল সে। এই শহরের লোকেরা কি আর মানুষ খুঁজে পেল না যে মরুভূমি থেকে একটা বিষাক্ত ব্যাঙ ধরে এনে তার বুকেই একটা স্টার ঝুলিয়ে দিল?
রাগে শেরিফের গাল দুটো আরও ফুলে উঠল, চেহারা ফেকাসে হলো, এবং খুদে চোখ দুটো আরও ছোট হয়ে গিয়ে তাকে এখন অনেকটা ব্যাঙের মতই দেখাচ্ছে।
তুমি আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে আইনকে অপমান করছ! চেঁচিয়ে উঠল টেলর।
মরিয়া হয়ে সে পিস্তলের বাঁটে হাত রেখে স্বরটাকে যতটা সম্ভব বিশ্বাসযোগ্য রাখার চেষ্টা করে সে বলল, হাত তুলে দাঁড়াও, আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করছি।
সহজ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ওর মুখের ওপর হাসল এরফান। তুমি ওই কামানটা বের করার আগেই তোমাকে আমি গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলতে পারি, তা জানো? উল্লসিত স্বরে বলল সে। শোনো শেরিফ, আমি তোমাকে একটা ভাল প্রস্তাব দিচ্ছি। এক প্যাকেট নতুন তাস আনাও, আমরা দুজনেই একবার করে কাটার সুযোগ পাব। যার তাসটা বড় সেই প্রথমে গুলি করার সুযোগ পাবে। তুমি জিতলে মাত্র দুই কদম দূর থেকে গুলি ছুঁড়বে। ওই দূরত্ব থেকে তোমার মত মানুষও মিস করতে পারবে না। ওটা তোমাকে সমান সমান সুযোগ দেবে। তুমি কি বলো?
শেরিফের চেহারা ওই অদ্ভুত প্রস্তাবে দৃশ্যত পার হলো। সে ধাপ্পা দিতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। চট করে দর্শকদের ওপর তার চোখ একবার ঘুরে গেল, ওদের চেহারায় কৌতূহল ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না সে। সে যদি জেমসকে গ্রেপ্তার করার জন্যে ওদের সাহায্য চায় তাহলে আরও জলদি মৃত্যু হবে তার-এটা সে গ্রীনের চোখ দেখে স্পষ্ট আঁচ করতে পারছে। কিন্তু অন্যদিকে নিছক তাস কাটার ভাগ্যের ওপর তার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে। এরফানের নির্ভীক চেহারার দিকে চেয়ে বুঝতে পারছে যে সে-ই হারবে। হঠাৎ তার মাথায় একটা ফাঁক ধরা পড়ল; সে বলে উঠল, তুমি ভাল করেই জানো যে এটা পরে থাকা অবস্থায় তোমার বিরুদ্ধে ওই শর্তে আমি আইনত লড়তে পারি না, ব্যাজ স্পর্শ করে দেখাল টেলর।
ওটা কি তোমার, চামড়ার সাথে সেলাই করা আছে? এরফান প্রশ্ন করল। তারপর আবার বলল, ভাল, আমি জানতাম তুমি ওই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে নিজেকে বাচাবার জন্যে কোন গর্তে ঢুকবে। কিন্তু আমি যে ভাওতা দিইনি সেটা প্রমাণ করার জন্যে আমার শর্তটা তোমার যেকোন বন্ধুর জন্যেও জারি থাকল।
আক্রমণকারীর অচেতন দেহটার দিকে ইঙ্গিত করল, এরফান। কিন্তু ওর চোখ বার্টের ওপর স্থির হয়ে আছে। বার বির মালিক কাঁধ উঁচিয়ে বলল, ওই লোকটা আমার কাছে স্ট্রেঞ্জার। নিজের লড়াই আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে আমি নিজেই লড়ি।
সেটা আমিও শুনেছি, মন্তব্য করল এরফান। কিন্তু ওর অবজ্ঞা প্রকটভাবে প্রকাশিত হলো হাসিতে। ওই লোকটার জ্ঞান ফিরে এলে ওকে জানিয়ে আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে, বার রক্ষককে কথাটা বলে সোজা পিছন ফিরে ঘুরে সে বাইরে বেরিয়ে এলো।
শহর ছেড়ে অল্প এগিয়ে লরির জন্যে অপেক্ষায় থাকল এরফান। ওকে বেশি দেরি করতে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে হাজির হলো। এরফান ওকে ধন্যবাদ জানালে সে লজ্জা পেয়ে বলল, ধন্যবাদের কোন প্রয়োজন নেই। আমি পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করেছি, ওটা ছিল তোমাকে ফাঁদে ফেলার একটা কৌশল। তুমি ওকে স্পর্শও করোনি, সে ইচ্ছে করেই নিজের গ্লাস ভেঙে তোমার ওপর পা মাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ এনেছিল ওরা সবাই মিলে যুক্তি করেই এটা করেছে। ওকে দেখে চেনাচেনা মনে হলেও প্রথমে চিনতে পারিনি আমি। ও একজন পেশাদার গানম্যান। ওর পুরো নাম শ্যাডওয়ার্থ, কিন্তু সে শেডি নামেই বেশি পরিচিত। তুমি বোকার মত তাস কাটার বাজি ধরেছিলে কেন? যদি শেরিফ তাতে রাজি হত তাহলে তুমি হারলে কি করতে?
হেসে উঠল ফোরম্যান। আমি জানতাম লোকটার মেরুদণ্ড বলতে কিছু নেই। বারের সবাই জানে আমার চ্যালেঞ্জটার উদ্দেশ্য ছিল বার্ট। আমি জানতাম। তাস কাটায় আমার হারার কোনই সম্ভাবনা নেই-তাই আমি নতুন প্যাকেট তাস। আনাতে চেয়েছি। নতুন প্যাকেট তাসের টেক্কাগুলো বেশি পিছল থাকে। তাই টেক্কা চিনতে পিছন দিক থেকেও আমার কোন অসুবিধা হত না।
ঠিক আছে, প্রফেসর, আজ আমি তোমার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখলাম।
০৮.
লেজি এম রাঞ্চে ফিলের দিন দুঃসহ ভাবে কাটছে। একের পর এক যতই দিন যাচ্ছে, বাবাকে আবার খুঁজে পাওয়ার আশা ততই কমে আসছে ওর।
কিন্তু ব্ল্যাঙ্কের সব কাজ স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। কিছুটা তিক্ততার সাথে মেয়েটা স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে মালিকের অনুপস্থিতিতেও র্যাঞ্চের কাজে কোন ক্ষতি হচ্ছে না; জেমস তার লোকজনকে নিয়ে বেশ সুষ্ঠু ভাবেই কাজ চালাচ্ছে।
ফোরম্যানের কামরা পার হওয়ার সময়ে নেহাত মেয়েলি কৌতূহল বশেই একটু ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখার লোভ হলো ওর। কামরাটা খালি, কিন্তু দেয়ালের সাথে একটা উইনচেস্টার ঠেস দিয়ে রাখা আছে। ওটা দেখামাত্র সে থমকে দাড়াল, যেন ওই রাইফেলের একটা বুলেট ওকে আঘাত করেছে। একটু ভাল করে রাইফেলটা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে মেয়েটা কামরায় ঢুকল। এই সময়ে গলার ভিতর থেকে নির্গত একটা নিচু গরগর শব্দ ওর কানে পৌঁছল। চেয়ে দেখল টমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ইতস্তত করছে ফিল, পিছন থেকে একটা পায়ের শব্দে সে ঘুরে ফোরম্যানের মুখোমুখি হলো।
তুমি কি আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলে? প্রশ্ন করল সে।
হ্যাঁ, কিন্তু তোমার কুকুরের সেটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না, জবাব দিল ফিল।
এরফান ওকে ডাকতেই টমি লাফিয়ে এসে ওর পাশে বসল। এই অল্প সময়ের মধ্যেই কুকুরটা বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে। এরফান এ-সম্পর্কে একটা মন্তব্যও করল।
ভাল খাবার আর বিশ্রাম ওদের ওপর অদ্ভুত প্রভাব ফেলে। যদি তুমি ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও তবে সে বুঝবে তুমি ওর বন্ধু, এবং তা মনেও রাখবে।
মেয়েটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে এরফানের দিকে একবার চেয়ে ওর কথা মতই কাজ করল। টমি নীরবেই ওর আদর গ্রহণ করল। হঠাৎ মেয়েটার মনে টমির প্রভুর সবার ওপর নিজের ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতার প্রতি তীব্র একটা বিদ্রোহের ভাব ফুটে উঠল। সবাইকেই সে নিজের ইচ্ছা মত চালায়-এমন কি তাকেও। হঠাৎ সে এরফানের ওপর চড়াও হলো।
ওটা আমার বাবার রাইফেল, আঙুল তুলে দেখাল সে। ওটা এখানে। কিভাবে এলো?
এরফান ইতস্তত করছে, সে জানে মেয়েটা তাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করছে, কিন্তু তার চেহারায় কোনরকম ভাবই প্রকাশ পেল না। যদিও সে মনেমনে নিজেকে গালি দিচ্ছে ওটা এমন বোকামি করে সহজেই চোখে পড়ার মত জায়গায় রাখায়। ওটা আমি খুঁজে পেয়েছি, বলল সে। ওর পরবর্তী প্রশ্ন আঁচ করে আবার বলল, ওটা এক্স টি ব্যাঙ্কে গরু নিয়ে যাওয়ার আগের দিনের ঘটনা। আমি ওদিক দিয়ে যাওয়ার সময়ে একজন আড়াল থেকে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। বাধ্য হয়েই আমাকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হলো। রাইফেলটা। ওর দেহের পাশেই পড়ে ছিল।
তুমি ওকে মেরে ফেলেছ?
নিশ্চয়, ওকে না মারলে আমাকে মরতে হত।
লোকটা কে ছিল? জিজ্ঞেস করল ফিল। ওর চোখে পরিষ্কার আতঙ্কের চিহ্ন ফুটে উঠেছে।
ও ছিল সেই মেক্সিকান-মারিও, জানাল সে।
মারিও? তুমি বলতে চাও সে-ই আমার বাবাকে খুন করেছে?
এতে কিছুই প্রমাণ হয় না-ওই গ্রীজার হয়ত ওটা পেয়েছে অথবা চুরি করে থাকতে পারে, যুক্তি দেখাল এরফান। আমি মিছে তোমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইনি। জ্যাকের লাশ না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে কিছুই বলা যায় না।
মেয়েটার চেহারা ফেকাসে আর আড়ষ্ট হলো, মুঠো পাকানো হাতের। গাঁটগুলো সাদা দেখাচ্ছে। ওর বড় বড় বাদামী চোখে ঝড়ের পূর্বাভাস। ফোরম্যানের অজুহাতে ফিলের ঠোঁট জোড়া বাঁকা হয়ে বিকৃত হলো।
ওর লাশটা এখন কোথায়? পরবর্তী প্রশ্ন এলো।
তা আমি জানি না, জবাব দিল এরফান। আমি যেখানে রেখে এসেছিলাম সেখান থেকে ওটা অদৃশ্য হয়েছে।
তুমি কি আশা করো এই বানোয়াট গল্প আমি বিশ্বাস করব? বাঁকা স্বরে প্রশ্ন করল ফিল।
না, শক্ত অকম্পিত স্বরে জবাব দিল এরফান। তা আমি আশা করছি না, আমার কোন কথাই তুমি বিশ্বাস করবে না সেটা আমি জানি; কারণ তোমাকে অন্যরকম বোঝানো হয়েছে। কিন্তু আমি সত্যি কথাই বলছি। তোমার অবিশ্বাসে সত্য বদলাবে না।
এরফানের প্রতি সরাসরি অবজ্ঞার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেয়েটা ঘুরে চলে গেল। ফিলের দিকে চেয়ে থাকল এরফান; ওর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে, কিন্তু চোখে সমবেদনা।
মেয়েটা আমাদের মোটেও সহ্য করতে পারছে না, টমিকে বলল সে, সে এখন ভাবছে আমিই ওর বাবাকে হত্যা করেছি, ওকে অবশ্য দোষ দেয়া যায় না; বেচারির খুব কঠিন সময় যাচ্ছে এখন।
র্যাঞ্চহাউসে ঢোকার আগে মেয়েটা পিছন ফিরে দেখল টমি পিছনের দুপায়ে দাঁড়িয়ে আদর করে এরফানের মুখ চেটে দেয়ার চেষ্টা করছে। এতে ওর রাগ আরও বাড়ল।
একটা বর্বর পশু! রাগে ফেটে পড়ল সে। তবে পশু বলতে সে কুকুরটাকে বোঝায়নি। বার্ট ঠিকই বলেছিল-এর পিছনে কোন বড় একটা ষড়যন্ত্র আছে। ওই, আমার বাবাকে যে খুন করেছে তাকে যদি আমি ধরতে পারি তাহলে তাকে ফাঁসিতে না ঝুলানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
*
দ্বিতীয় বিপদ সঙ্কেতটাও প্রথমটার মত রহস্যজনক ভাবেই এলো এরফানের হোপে টাকা জমা দেয়ার কয়েকদিন পর। ওতে লেখা:
ব্যাঙ্কে তোমার টাকা জমা থাকলে ওটা তুমি হারাবে।
তোমার বন্ধু।
এটাও একই ধরনের কাগজে আগের মতই বড় হরফে লেখা।
ছোট নোটটা হাতে নিয়ে এরফান ভাবছে তার এই অচেনা বন্ধু কে হতে পারে। লোকটা যে এই র্যাঞ্চেরই কোন কর্মচারী এতে কোন সন্দেহ সেই। কিন্তু সে কে? একমাত্র হেনডন ছাড়া আর কারও কথা ওর মাথায় আসছে না। লোকটাকে যে বার্টের চর হিসেবে এই র্যাঞ্চে কাজে পাঠানো হয়েছে তা সে জানে। তবে কি-না, আর চিন্তা করার সময় নেই, ঘোড়া নিয়ে হোপের পথে দ্রুত গতিতে রওনা হয়ে গেল এরফান। সকাল এগারোটার আগেই সে গন্তব্যে পৌঁছে গেল।
ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে কোন কৈফিয়ত না দিয়েই সব টাকা তুলে নিয়ে সে সোজা ফেনটনের সেলুনে ঢুকল। টিমকে ওখানে দেখে অবাক হয়ে গেল ও। লোকটা ফেনটনের কোন কথায় চড়া স্বরে হাসছে।
জেমস, আমি তোমার সাথে হাত মেলাচ্ছি, বলে সে তার হাত বাড়িয়ে দিল। এইমাত্র আমি ফেনটনের কাছে শুনলাম তুমি কিভাবে বার্টকে জব্দ করেছ।
ওর থলথলে হাতটা গ্রহণ করে সে হেসে বলল, আমার পাঁজরে কারও পিস্তল ঠেকানোকে আমি খুব অপছন্দ করি। হয়ত এতটা করা আমার ঠিক হয়নি, কিন্তু এটা আমার জন্মগত অভ্যাস।
এতে বার্টের যা ক্ষতি হয়েছে সেটা সবার সামনে মার খাওয়ার চেয়েও বেশি, বলল ফেনটন। শহরের সবার মুখে ওই একই কথা। টেলরের কারও কাছে মুখ দেখাবার জো নেই, সবাই কেবল ওকে তাস কাটতে বলছে। এত জলদি তোমার আবার শহরে ফিরে আসার কি কারণ, জেমস?
লেজি এমের ফোরম্যান তার পকেট থেকে তাকে সতর্ক করে লেখা কাগজটা বের করে দেখাল, অন্য নোটার কথাও ওদের জানাল। যে খেলায়, নেমেছি তাতে কোন ঝুঁকিই আমি নিতে রাজি নই। বলতে পারো ওই ব্যাঙ্কের পিছনে কে আছে?
নামে ওটা পাইওনিয়ার ব্যাঙ্কিং করপোরেশন হলেও আমার ধারণা ওটা নিছক একটা পোশাকী নাম; আসল মালিক হলো ওটার ম্যানেজার রাস্টন, বলল ফেনটন। ও বেশ কিছুদিন এখানে আছে। ওকে সৎ বলেই মনে হয়। আমারও বেশ কিছু টাকা আছে ওখানে, যেটা আমি খোয়াতে চাই না।
আমারও তাই। আমিও তোমার আশঙ্কাই অনুসরণ করব। তাহলে ব্ল্যাক মাস্ক তোমার ওপর একটা চান্স নিয়েছিল, জেমস?
দুজন কালো মুখোশ পরা লোক হামলা করেছিল, খালি হাতেই ওদের ফিরতে হয়েছে, জানাল সে। আচ্ছা কি নামে এখানে কেউ আছে?
স্লিক রেমন্ড নামে একটা লোক বার্টের র্যাঞ্চে কাজ করত বটে, কিন্তু বছরখানেক আগে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে, বলল ফেনটন, এরফানও ওর। সম্পর্কে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে অন্য প্রসঙ্গ ধরল।
আচ্ছা, ক্ৰীকের উজানে যে পুরোনো পোড়া কেবিনটা আছে, ওটা কার, প্রশ্ন করল সে। এলাকাটা ভালই মনে হলো।
হ্যাঁ, হার্ভি বোলটন নামে একজন নেস্টার, ওটা খোলা রেঞ্জ মনে করে কেবিনটা তৈরি করেছিল। কিন্তু সে ভুল করেছিল-বার্ট মনে করে ওটা ওরই রেঞ্জের মধ্যে পড়ে।
কি ঘটেছে ওর?
বার্টের কথা অনুযায়ী, লোকটা নিজেই রাগ করে ওটা পুড়িয়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। কিন্তু আমাদের কিছু লোকের ধারণা অন্যরকম, বলল সেলুনের মালিক। কিছু বোকা লোক মনে করে ওটা ভুতুড়ে এলাকা। এই তো কয়েকদিন আগেই একটা লোক অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় শহরে এসে বলছিল। ওই পথে আসার সময়ে সে দেখেছে একটা ছায়া আরেকটা ছায়াকে ক্ৰীকের ধারে বড় কটনউড় গাছে ঝুলাচ্ছে। কিন্তু লোকটা রাই মদ খেয়ে মাঝারি গোছের মাতাল অবস্থায় কি দেখতে কি দেখেছে তা বলা মুশকিল।
প্রচলিত নিয়মে আরও এক রাউন্ড ড্রিঙ্ক খাওয়ার পর ওরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল। শহরে আর কোন কাজ না থাকায় এরফান র্যাঞ্চে ফেরার ট্রেইল ধরল। কিন্তু র্যাঞ্চ থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে থাকতেই সে কি মনে করে ট্রেইল ছেড়ে রেঞ্জের দক্ষিণ সীমানার দিকে রওনা হলো। এদিকটা কাজের চাপে আগৈ তার দেখা হয়ে ওঠেনি। দেখল মরুভূমির কাছে হওয়ায় এদিকের ঘাস ক্রমেই কমে এসেছে। কিছু গরু দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু ওগুলো একটাও লেজি এম ব্র্যান্ডের না। ঘোড়াটা ক্লান্ত বুকে ধীর গতিতে পথ চলছে সে। সন্ধ্যা নাগাদ র্যাঞ্চে ফিরে দেখল তার লোকজন করালের কাছে ঘোড়ার পিঠ থেকে জিন নামাচ্ছে। হঠাৎ দূর থেকে প্রচণ্ড বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে কারও আসার শব্দ শোনা গেল। ট্রেইলের ওপর কালো একটা বিন্দু ক্রমশই বড় হচ্ছে। সামনে এসে থামল।
আরে, এ-তো আমাদের জেন্টল অ্যানি! কাউবয়দের একজন মন্তব্য করল। কেউ কি তোমাকে তাড়া করছে, অ্যানি?
ওকে মাথা নাড়তে দেখে বান্ডি বলল, তাহলে তোমার এত তাড়ার কোন প্রয়োজন ছিল না, সাপার এখনও তৈরি হয়নি।
তোমরা চমৎকার একদল মানুষ বটে, তাই না? ওদের সবাইকে দাঁত বের করে হাসতে দেখে রুষ্ট স্বরে বলল ল্যাঙ্কি।
এরফান বুঝতে পারছে ল্যাঙ্কি জরুরী কোন খবর এনেছে।
খবরটা দিয়েই ফেলো, জেন্টল, নইলে ওরা তোমার পেটে গুতো মেরে কথাটা আদায় করবে, বলল এরফান।
ল্যাঙ্কি ফোরম্যানের দিকে চেয়ে হেসে নাটকীয় ভাবে খবরটা আকস্মিক ভাবেই পরিবেশন করল।
হোপের ব্যাঙ্কে আজ একটা দুর্ধর্ষ ডাকাতি ঘটে গেছে। রাস্টনকে খুন করে ডাকাতরা ব্যাঙ্কের সব টাকা লুট করে নিয়ে গেছে, জানাল সে।
কাউবয়দের মুখ থেকে বিস্ময়সূচক শব্দ বের হলো ওর ঘোষণা শুনে। সমস্বরে বিভিন্ন প্রশ্ন এসে ল্যাঙ্কিকে অতিষ্ঠ করে তুলল। এরই মাঝে রাঁধুনীর টিনের থালায় ঘন্টার সাথে খাবার প্রস্তুতের সংবাদ প্রচারিত হলো।
সবাই এসো, বায়েজ, বলল এরফান, খেতে বসে ধীরেসুস্থে ওর সব কথা শোনা যাবে।
সবার বিভিন্ন প্রশ্নের মাঝে ওর কথা থেকে যেটুকু উদ্ধার করা গেল সেটা হচ্ছে: দুপুরের অল্প পরেই তিনজন স্ট্রেঞ্জার ঘোড়ার পিঠে ব্যাঙ্কের সামনে এসে থামে। ওদের সবার পরনেই ছিল রেঞ্জ পোশাক, হাটের কার্নিস খুব নিচু করে টানা ছিল বলে কারও চোখ দেখা যায়নি। প্রত্যেকেই ছিল সশস্ত্র। ওদের মুখের নিচের অংশ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। ওদের দুজন ব্যাঙ্কে ঢুকে কোন সময় নষ্ট করেনি। ক্লার্ক লাঞ্চে যাওয়ায় ম্যানেজার ওখানে একাই ছিল।
তোমরা কি চাও? তোতলাল রাস্টন।
যা আছে সব, জবাব দিল ওদের একজন। প্রোন্তো।
রূঢ় স্বর আর বাগিয়ে ধরা অস্ত্র দেখেই ম্যানেজার বুঝে নিয়েছে ওদের কথা মত কাজ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বাধ্য হয়েই ওকে সিন্দুক খুলতে হলো। অন্য ডাকতটা চামড়ার একটা ব্যাগ বের করে দ্রুতহাতে ব্যাঙ্কে যা টাকা ছিল সব ওতে ভরে নিল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিজের সর্বনাশ চোখের সামনে হতে দেখে মরিয়া হয়ে সে ড্রয়ার থেকে গুলি ভরা পিস্তলটা বের করে গুলি ছোঁড়ার চেষ্টা করল। হয়ত সে ভেবেছিল গুলির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে কেউ ওকে সাহায্য করতে আসবে।
বেপরোয়া ডাকাতরা কেউ ওর ওপর কড়া নজর রাখেনি। হাত মাথার ওপর তুলে রেখেই রাস্টন ধীরে ধীরে পিস্তল রাখা ড্রয়ারের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ বাইরে একটা শব্দ শুনে যেই ওরা পিছন ফিরেছে সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ বুঝে এক। টানে ড্রয়ার খুলে ম্যানেজার পিস্তল বের করে তাক না করেই ট্রিগার টেনে দিল। ওর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বিপদ সঙ্কেত দেয়া। ডাকাতদের একজন ওর দিকে ফিরে দাঁড়াল।
পাজি কুকুর! চিৎকার করে উঠেই সরাসরি ওকে গুলি করল লোকটা।
ককিয়ে উঠে পড়ে গেল রাস্টন। ডাকাত দুজন এক লাফে দরজার কাছে পৌঁছে চট করে বেরিয়ে গেল। গুলির শব্দে বাইরে দাঁড়ানো লোকটা ততক্ষণে তার রাইফেল বের করে ফেলেছে। এক কৌতূহলী দর্শক গুলির শব্দে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছিল বটে, রাইফেলের গুলি ওর গালের পাশে লাগায় মুহূর্তে তার কৌতূহলের সমাপ্তি ঘটল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডাকাত তিনজন ঘোড়া নিয়ে কাঠের ব্রিজটা পার হয়ে পুবের ট্রেইল ধরে অদৃশ্য হলো।
আমি বাজি ধরে বলতে পারি, রকি মাউন্টিনের এপাশে হোপের মত বুনো। শহর আর নেই, ল্যাঙ্কি কথা শেষ করল। না, রাস্টন মরেনি, কিন্তু মারাত্মক রকম জখম হয়েছে, বান্ডির প্রশ্নের জবাবে বলল সে। ওর অবস্থা যে কেমন তা। ডেজার্ট এজ থেকে ডাক্তার না আসা পর্যন্ত জানা যাবে না।
ব্ল্যাক বার্ট কি শহরে ছিল? জানতে চাইল এরফান।
না, এই ঘটনার আধঘণ্টা পরে সে শহরে পৌঁছে টেলরকে ব্ল্যাক মাস্ককে। এতদিনেও গ্রেপ্তার করতে না পারার জন্যে এমন বকা বকল যে সেটা দেখার মত একটা দৃশ্য। বার্টের কথা অনুযায়ী ওই ব্যাঙ্কে ওর পাঁচ হাজার ডলার জমা ছিল। আমি যখন ফিরি তখন সে বড় একটা পাসির দল গঠনে ব্যস্ত ছিল। সে জোর গলায় বলছিল যে ডাকাতদের ধরে এনে জীবন্ত অবস্থাতেই পিঠের ছাল তুলে নেবে সে।
উত্তেজিত কথাবার্তার মাঝে ফোরম্যান নীরবে বসে ভাবছে, ওই রহস্যময় অচেনা বন্ধুর সাবধানবাণীর কথা। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ডাকাতি হওয়ার কথা ওই লোকটা আগে থেকেই জানত। লোকটা কে হতে পারে? নিজের কামরায় ফিরে এই সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করছে, এই সময়ে লরি ওর ঘরে ঢুকল।
বাঙ্কহাউসে কাউবয়রা সবাই আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করেছে যে গরু বিক্রির টাকাটা হারিয়ে তুমি যদি বেশি ঝামেলায় পড়ে থাকো তাহলে ওরা বেতনের জন্যে অপেক্ষা করতে রাজি আছে; যখন তোমার সম্ভব হয় তখন টাকা দিলেই ওরা খুশি। এই কথা জানাতেই আমি এলাম।
এরফান হাসল, কিন্তু চেহারায় বোঝা গেল ওদের এই সিদ্ধান্ত সত্যি ওর মনকে বেশ নাড়া দিয়েছে। স্বীকার করতেই হবে যে ওরা সত্যিই সাদা মনের লোক, বলল সে। তবে ওদের চিন্তার কিছু নেই, কারণ আজ সকালেই আমি সব টাকা তুলে এনেছি।
সব টাকা তুলে এনেছ তুমি? অবাক বিস্ময়ে পুনরাবৃত্তি করল লরি। বলতে হবে তোমার কপাল দরুণ ভাল
না, এটা কপালের কোন ব্যাপার নয়, বলল এরফান। এগুলো দেখো। পকেট থেকে সতর্কবাণী দুটো বের করল সে। ১২-সেই এরফান
ওগুলো পড়ে শিস দিয়ে উঠল লরি।
অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? নিশ্চয় তোমার ওপর কোন ভাল জিন-পরীর আশীর্বাদ আছে, জেমস। তোমার কোন ধারণা আছে লোকটা কে হতে পারে?
এটা হেনডনের কাজ হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করল এরফান, কিন্তু লরি এক কথায় নাকচ করে দিল।
সে বলল, ধরে নিলাম সে বার্টের হয়ে কাজ করছে, কিন্তু ওর সাথে ব্ল্যাক মাস্কের কোন সম্পর্ক থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
যাহোক, ওই লোকটার কাছে আমি সত্যিই ঋণী। আর ঋণী থাকাটা আমার নীতি নয়।
হয়ত একদিন তুমি ঋণ শোধ করার সুযোগ পাবে, মন্তব্য করল লরি। তবে তোমার এখন একটু সাবধান হওয়া উচিত; এই গার্ডিয়ান এইঞ্জেল যদি কোন মানুষ হয় তবে হয়ত মাঝেমধ্যে তার ঘুমের প্রয়োজন হতে পারে।
জিতি বা হারি, যে তাস বাঁটা হবে তা নিয়েই খেলতে হবে আমার। ওকে বিদায় দেয়ার আগে এরফান বলল, তুমি আমার পক্ষ থেকে ওদের জানিয়ো যে এমন একটা সিদ্ধান্ত ওরা নেয়ায় আমি কৃতজ্ঞ। আমার জন্যে ওদের এই ত্যাগ মেনে নেয়ার কথা আমি কোনদিন ভুলব না।
০৯.
পরদিন সকালেই ক্লান্ত ঘোড়া এবং চেহারা নিয়ে লেজি এম র্যাঞ্চে পৌঁছল বার্ট। সে নিজেই ছিল পাসির প্রকৃত লীডার। হেনডনকে যা বলা হলো তাতে সে বুঝল স্টোনি রিভারের কাছে পৌঁছে ওরা ডাকাতদের ট্রেইল হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকঘণ্টা খুঁজেও ওদের কোন ট্রেইল আর ওরা খুঁজে পায়নি।
তোমাকে ইদানীং আর বার বিতে দেখিনি, বলল সে। কি ব্যাপার? ওখানে তোমার বেশ কিছু টাকা পাওনা হয়ে আছে।
ওই টাকা সংগ্রহ করার ইচ্ছে আমার নেই জবাব দিল সে। বার বির মালিক ভুরু উঁচাল। কারণ? তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করল সে।
ওই টাকা অর্জন করার ইচ্ছে আর আমার নেই। ব্যাখ্যা দিল সে।
দল পাল্টে বিপক্ষ দলে যোগ দিচ্ছ, না? আমাকে উপেক্ষা? দাঁত খিচিয়ে বলল র্যাঞ্চার।
না, সেটা আমার রীতি নয়-আমি যা জানি সেটা আমি ঠিকই গোপন রাখব, শান্ত স্বরে জবাব দিল কাউবয়। আমি যে কাজটা ছাড়ছি তা আমার ঠিক পছন্দের ছিল না। আমি যার থেকে বেতন নিচ্ছি তাকে আমি ঠকাতে পারব না। সৎ ভাবেই চলব।
অর্থাৎ গ্রীনের সাথে?
হেনডন নড় করল। চেহারা ফেকাসে দেখাচ্ছে, কিন্তু ঠোঁটজোড়া অটল প্রতিজ্ঞায় শক্তভাবে আঁটা। এভাবে প্রত্যাখ্যান করায় যে সে তার নিজের জীবন বিপন্ন করছে এটা সে জানে; কিন্তু বার্ট স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওকে আর টলানো যাবে না। বার্টের চেহারা রাগে কঠিন হয়ে উঠল।
ঠিক আছে, হেনডন, বলল সে। এটা স্বাধীন দেশ, কিন্তু এটা ভাল ভাবে শুনে রাখো, যে আমার সাথে নেই, সে বিপক্ষে। তারা আর আমার নিরাপত্তা পাবে না।
তুমি আমার বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলেই আমি মুখ খুলব-এটা তুমিও জেনে রাখো, পাল্টা হুমকি দিল সে।
হেসে ওর কথা উড়িয়ে দিয়ে র্যাঞ্চহাউসের দিকে এগোল বার্ট। বারান্দাতেই ফিলের দেখা পেল র্যাঞ্চার। ওর এমন বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মেয়েটার দৃষ্টি নরম হলো। মুখ দিয়ে সন্তুষ্টির একটা শব্দ বের করে ধপ করে নরম সোফায় বসে দাঁত বের করে হেসে ওর দিকে ফিরল বার্ট।
আমি অত্যন্ত ক্লান্ত, ফিল, আমাকে অনেক দূর পথ পেরিয়ে এখানে আবার আসতে হয়েছে।
একটু হেসে ভিতরে ঢুকে একটা গ্লাস আর বোতল নিয়ে ফিরে এলো ফিল। লোকটা চারপাশে, দেখে নিজের কামরার সাথে এটাকে মনেমনে যাচাই করল চোয়াল দুটো দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় শক্ত হয়ে উঠল তার; নিজের জন্যে একটা ড্রিঙ্ক টেলে নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিল, যেভাবেই হোক এই র্যাঞ্চটা ওকে পেতেই হবে। গ্লাস উঁচিয়ে ফিলকে সম্মান দেখাল বার্ট।
এই হলো অবস্থা, বলল সে, একটা খড়ের গাদায় সুঁই খুঁজে পাওয়ার চেয়েও কঠিন। তুমি নিশ্চয় ব্যাঙ্কে ডাকাতি হওয়ার কথা শুনেছ?
হ্যাঁ, সম্ভবত এটা ব্ল্যাক মাস্ক দলের কাজ?
আমি তাই ধরে নিচ্ছি, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ব্ল্যাক মাস্কের নেতৃা কে? এই ডাকাতির সাথে কিছু আশ্চর্য ঘটনাও জড়িত আছে; দুতিনজন লোক এই ডাকাতির অল্পক্ষণ আগেই তাদের সব টাকা তুলে নিয়েছিল; ওদের মধ্যে প্রথম। ব্যক্তি হচ্ছে জেমস। অবশ্য এটা দৈবাত কোন ঘটনাও হতে পারে; আবার তা না–ও হতে পারে।
রাস্টন কি মারাত্মক রকম জখম হয়েছে?
ওকে দেখে তো তাই মনে হলো। সে কেবল টাকা তুলে নেয়ার ব্যাপারটইি আমাকে বলতে পেরেছে। ডাকাতদের চেহারা পুরোপুরি মুখোশে ঢাকা ছিল বলে ওদের সে আবার দেখলেও চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ। এটুকু বলেই সে আবার জ্ঞান হারাল।…তোমার কাছে নতুন কোন খবর আছে?
ফিল বাবার রাইফেলটা দেখা আর জেমসের ব্যাখ্যার কথা জানাল। শোনার সময়ে বার্টের চেহারা অবিশ্বাসে বিকৃত হলো। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সংবাদটাকে নিজের সুবিধা মত কিভাবে ব্যবহার করবে।
তুমি কি ওর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট, ফিল? প্রশ্ন করল সে। ওকে ওই মেক্সিকানের লাশ দেখাতে হবে ওর কথা সত্যি প্রমাণ করতে হলে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে লোকটার মিথ্যে কথা বানিয়ে বলার ক্ষমতা অসাধারণ। আমি বাজি ধরে বলতে পারি সে ওই লাশ হাজির করতে পারবে না। আমি জানি মারিও এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমার কথা শোনো, কথাটা তুমি আর কাউকে জানিয়ো না। ও যেন ফাঁসির দড়িতে ঝোলে তার ব্যবস্থা আমিই করব।
তোমার ধারণা সে-ই আমার বাবাকে হত্যা করেছে? ভাঙা গলায় প্রশ্ন করল মেয়েটা।
এ ব্যাপারে আমার নিজের কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের প্রমাণ দরকার, বলল সে। এটাও আমাদের জানা খুব দরকার এর সাথে এমারিও জড়িত আছে কিনা। তারপর এই ব্ল্যাক মাস্কের ব্যাপারটা; ব্যাঙ্কে যখন ডাকাতি হয় তখন কি জেমস এই র্যাঞ্চে হাজির ছিল?
না, সে সাপারের ঠিক আগে এসে হাজির হয়, জবাব দিল মেয়েটা। আমি নিজে ওকে ফিরতে দেখেছি।
হাহ, এতেই বোঝা যাচ্ছে বন্ধুদের সাথে মিলিত হয়ে কাজ সেরে ফেরার জন্যে সে প্রচুর সময় পেয়েছে। রাস্টনের বর্ণনায় যে লোকটা ওকে গুলি করেছে সে উচ্চতা আর গড়নে জেমসের মতই ছিল। কিন্তু এর সবই আন্দাজের কথা-নিশ্চিত না হয়ে আমরা কোন কিছুই করব না। উঠে দাঁড়িয়ে ফিলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে সে বলল, তুমি কোন দুশ্চিন্তা কোরো না, সব কিছু গুছিয়ে নেয়ার পর তোমাকে আমি এমন খবর শোনাব, শুনে তুমি খুব খুশি হবে।
ওর আচরণ আর চাহনি দেখে মেয়েটা একটু লাল হলো, লোকটা কি বোঝাতে চাইছে তা সে বুঝেছে। কিন্তু কেন যেন তার মনটা ঠিক সেভাবে সাড়া দিতে পারছে না। বার্ট যেন তার সেই আগের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। তাই র্যাঞ্চার বিদায় নেয়ায় সে মোটেও ব্যথিত হলো না।
কিন্তু অত্যন্ত খুশি মনেই বার্ট নিজের র্যাঞ্চে ফিরল। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে সে।
খুব ভোরে কয়েকজন কাউবয়কে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় বার্টের লেজি এমে আসার কথা জানল না এরফান। র্যাঞ্চে গরুর সংখ্যা যে কত, তার মোটামুটি একটা হিসেব নেয়াই ছিল ওর উদ্দেশ্য। বিকেলের শেষের দিকে সে র্যাঞ্চে নিজের ঘরে পৌঁছল। ওর তীক্ষ্ণ চোখে সাথে সাথেই ধরা পড়ল যে কেউ তার কামরায় ঢুকে তার জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করেছে। বাঙ্কহাউসে গিয়ে রাঁধুনী ড্যানিয়েলকে প্রশ্ন করল, আজ র্যাঞ্চে কোন অতিথি এসেছিল?
হ্যাঁ, স্যার, ওই অপদার্থ কাউবয় গেভার আবার এখানে জ্বালাতে এসেছিল, হাসি মুখে জবাব দিল সে। তুমি র্যাঞ্চে নেই তা ওকে আমি বলা সত্ত্বেও সে তোমার ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়েছে।
চিন্তান্বিত চেহারায় নিজের ঘরে ফিরল ফোরম্যান। প্রথমে সে ফিলকে সন্দেহ করেছিল-ভেবেছিল মেয়েটা হয়ত তার বাবার বিষয়ে আরও কোন তথ্য বা প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা দেখতে এসেছিল; যদিও মেয়েটা এমন জঘন্য একটা কাজ করতে পারে এটা বিশ্বাস করা কঠিন।
সন্ধ্যায় আর নতুন কিছুই ঘটল না। অবশ্য গেভারের আবার এখানে আসা নিয়ে কাউবয়দের মধ্যে অনেক জল্পনা-কল্পনা হলেও জেমস লোকটার এখানে আসার আসল কারণ কাউকে জানাল না। এক্স টি র্যাঞ্চের একজন রাইডার এসে জানিয়ে গেল ডেজাট এজের ডাক্তার এসে রাস্টনকে পরীক্ষা করে দেখে বলেছে যে ওর বাঁচার সম্ভাবনা দশ ভাগের এক ভাগ। সে এখনও এতই দুর্বল যে বিবৃতি দিতে সক্ষম হয়নি। এদিকে নিরর্থক বুঝে ডাকাতদের ধরার সব চেষ্টাই ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
নিজেদের মধ্যে কাউবয়রা সর্বোচ্চ দশ সেন্ট বাজির যে তাস খেলে সেটার নাম ওরা দিয়েছে “কিড পোকার”। ওরা সবাই বসে গেল খেলায়। কিন্তু এরফান ওতে যোগ দিল না; ঘরে ফিরে একটা সিগারেট ধরিয়ে খোলা দরজা দিয়ে তারায় ভরা আকাশের দিকে চেয়ে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো।
মিস্টার বন্ধু হচ্ছে তাসের প্যাকেটের তুরুপ, ভাবছে সে। আমি যদি ওর খোঁজ পেতাম তাহলে সত্যিই খুব ভাল হত।
কিন্তু নিজের কামরায় বসে একঘণ্টা চিন্তা করেও এই সমস্যার কোন সমাধান খুঁজে পেল না এরফান। শেষে ঘুমিয়ে পড়ল।
প্রায় মাঝরাতে টমির গরগর শব্দের বিপদ সঙ্কেতে ওর ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার রাত, কিন্তু তারার আলোয় কিছুটা দেখা যায়; নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে বুট পরে নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে সে বাইরের দিকে চাইল। তার কাছে মনে হলো যেন একটা আবছা ছায়ামূর্তি খুব সাবধানে র্যাঞ্চহাউসের দিকে এগোচ্ছে। দ্রুত কাপড়-জামা আর গানবেল্ট পরে নিয়ে বেরিয়ে এলো সে। কুকুরটাকে সাথে না নিয়েই হালকা পায়ে এগোল। সাথে আরও লোক আছে কিনা দেখার জন্যে সতর্ক নজর রেখেছে। এরফান নিশ্চিত, কাউকে আসতে দেখেছে, অথচ কাউকেই এখন দেখতে পাচ্ছে না।
ঘুরে বাড়ির পিছন দিকে চলে এলো সে; একটা জানালা খোলা আছে দেখে ওদিক দিয়েই ভিতরে ঢুকল। বুঝল লোকটা রান্নাঘরে আছে। দরজা দিয়ে। বেরিয়ে একটা করিডর দেখতে পেল; ওখান থেকে একটা সিঁড়ি দোতালায় উঠে গেছে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত অবস্থায় ভাবছে সে, জানালাটা হয়ত অসাবধানতায় খোলা থাকতে পারে, কিন্তু তার আবছা দেখাটা যদি চোখের ভুল হয়ে থাকে? এই মাঝরাতে তাকে বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখলে মিস মাস্টারসন কি ভাববে? তার চোখের ঘৃণা ভরা তিরস্কারের চাহনি, সে কল্পনায়
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরতে যাচ্ছে, এই সময়ে নিচু একটা কর্কশ কথার আওয়াজ ওর কানে এলো। কি বলা হয়েছে তা সে ঠিক শুনতে। পায়নি বটে, কিন্তু ওটা যে একটা পুরুষের স্বর তাতে কোন সন্দেহ নেই। দোতালা থেকে এসেছে শব্দটা। থমকে দাড়িয়ে নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল সে। শব্দটা কোন ঘর থেকে আসছে বোঝার চেষ্টায় কান পাতল।
ফিল গভীর ঘুম থেকে জেগে বিছানার পাশে একটা লোককে কুঁজো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ানক রকম আতঙ্কিত হলো। ও কিছু বলার আগেই লোকটা বলল, একেবারে চুপ করে থাকলে তোমাকে কোন ব্যথা দেয়া হবে না।
গেভার! স্বর শুনে লোকটাকে চিনতে পেরে চেঁচিয়ে উঠল সে, তুমি এখানে কি করছ? কোন সাহসে-
চুপ! হস্পিতম্পি করে কোন লাভ হবে না, নিশ্চিন্ত স্বরে বলল সে। আমাকে বলো টাকাটা কোথায় আছে, ওটা নিয়েই আমি বিদায় হব। তারপর ফিলের চেহারায় কথাটা না বোঝর আভাস দেখে সে আবার বলল, আমি সেই দুহাজার ডলারের কথা বলছি যেটা জেমস এক্স টি র্যাঞ্চে গরু বিক্রি করে পেয়েছে, এবং ব্যাঙ্ক ডাকাতির আগেই তুলে এনেছে। লোকটা যে কিভাবে টের পেল সেটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না।
এই ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, বলল ফিল। সে যদি টাকাটা তুলে থাকে তবে ওটা ওর কাছেই আছে। ওর স্বরে এখন কিছুটা আত্মপ্রত্যয় ফিরে এসেছে।
টাকাটা ওর ঘরে নেই, আমি ওর কামরা ভাল মত খুঁজে দেখেছি। নিশ্চয়ই এত টাকা সাথে নিয়ে সে ঘুরবে না। ওটা এখানেই কোথাও আছে, জোর দিয়ে বলল গেভার।
জঘন্য একটা ইতর তুমি, রাগের সাথে বলল সে। আমি জানি না ওটা কোথায়। জানলেও তোমাকে বলতাম না।
সেটা দেখা যাবে। কথা বের করার অনেক উপায়ই আমার জানা আছে। হঠাৎ থাবার মত দুহাত বাড়িয়ে মেয়েটার কাধ চেপে ধরল। ওর বড় বড় নখের খামচিতে ফিলের পাতলা নরম রাতের পোশাক ছিঁড়ে নগ্ন কাঁধ বেরিয়ে পড়ল। গেভারের লোভাতুর চোখদুটো এই দৃশ্যে পাশবিক আনন্দে জ্বলে উঠল।
মেয়েটা ওকে দুহাতে কিল মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু লোহার মত শক্ত মুঠোয় ওকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে টানতে শুরু করল গেভার। গেভারের ঠোঁট জোড়া ওর মুখের কাছে চলে এসেছে। শ্বাসের গন্ধেই ফিল টের পেল লোকটা প্রচুর মদ খেয়েছে।
এর জন্যে বাৰ্ট তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে, ফিল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। খামচি মেরে বসল গেভারের মুখে।
হঠাৎ ব্যথা পেয়ে রাগে একটা গালি বকে পিছিয়ে গেল গেভার। হারামি বিড়াল! গর্জে উঠল, তোর মুখ আমি জন্মের মত বন্ধ করে দেব।
কামনার আতিশয্যে লোকটা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। মেয়েটার ধারাল নখের খামচিতে গেভারের গাল কেটে রক্ত ঝরছে। হাত তুলে গাল ছুঁয়ে রক্ত দেখে সে এখন কামনা ভুলে রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠল। কোমর থেকে ছুরি বের করে অন্তিম আঘাত হানার জন্যে মাথার ওপর ছুরি তুলল। মেয়েটার চোখ এখন অসহায় অবস্থায় ওর ছুরির ঝিলিক আর কালো মুখোশের ওপর ঘোরাফেরা করছে। ভয়ে ফিলের জ্ঞান হারাবার মত অবস্থা। যেকোন মুহূর্তে ছুরিটা নেমে এলেই ওর মৃত্যু অনিবার্য। একটা অস্ফুট ভয়ার্ত চিৎকার দিয়ে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় সে বিছানার ওপর পড়ল। আর এক সেকেন্ড দেরি হলেই ছুরিটা ওর বুকে আমূল ঢুকে যেত। কামরার ভিতর পা রেখে দরজার কাছ থেকেই গুলি করল এরফান। বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে আধপাক ঘুরে চিৎ হয়ে পড়ার আগেই মারা গেল গেভার। দ্রুত পায়ে ভিতরে ঢুকে মেয়েটার দিকে কোন নজর না দিয়ে গেভারের লাশ টেনে বাইরের ল্যান্ডিঙে নিয়ে রেখে এলো এরফান। মেয়েটাকে যে সুযোগ দিয়েছে তার পুরো সদ্ব্যবহার করে ছেড়া কাপড়ের ওপর সে একটা ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে নিয়েছে।
লোকটা তোমাকে জখম করেনি তো? প্রশ্ন করল এরফান, ফিলকে মাথা নাড়তে দেখে বলল, তোমার দুশ্চিন্তা করার আর কোন প্রয়োজন নেই। আমার ধারণা সে একাই কাজ করছিল, তবু নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে এই বাড়ির ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা আমি করব।
মেঝের ওপর পড়া ছুরির ফলাটা মৃদু আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে। ওটা তুলে নিয়ে ওর জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করেই কামরা ছেড়ে সোজা বেরিয়ে এলো এরফান। সিঁড়ির মাথাতেই সে দেখল আতঙ্কিত চোখে লাশটার দিকে চেয়ে দাড়িয়ে আছে ড্যানিয়েলের স্ত্রী ডিনা। গুলির শব্দে রান্নাঘরের পাশে ওর কামরা থেকে বেরিয়ে এসেছে সে।
ঈশ্বরের দোহাই- শুরু করেছিল ডিনা, কিন্তু ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল ফোরম্যান।
তোমার মালিকা একটা বড় ধরনের শক পেয়েছে, যাও, তাকে সঙ্গ দিয়ে কিছুটা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করো, ওকে নির্দেশ দিয়ে লাশটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যে-পথে ঢুকেছে সেই পথেই আবার বেরিয়ে এলো এরফান।
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে ফিরে দেখল দরজার কাছেই ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ফিল। আগে যতবারই ওদের দেখা হয়েছে সেই কঠিন ভাব ওর চোখে আর এখন নেই।
গত রাতে আমার জীবন বাঁচানোর জন্যে আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি, বলল মেয়েটা।
এরফানের চেহারা অস্বস্তিতে একটু রাঙা হলো। ওটা উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন নেই; ওটাও আমার কাজেরই একটা অঙ্গ, জবাব দিল সে।
আমি বুঝতে পারছি না ঠিক সময় মত তুমি কিভাবে ওখানে পৌঁছলে, বলল সে।
টমির গরগর শব্দে আমি দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম কে যেন চুপিচুপি র্যাঞ্চহাউসের দিকে এগোচ্ছে। আমিও ওর পিছু নিলাম, ব্যাখ্যা করল এরফান। এই সময় কুকুরটা ছুটে এসে ওর ঠাণ্ডা নাক মেয়েটার হাতে ঘষে ওকে আদর জানাল। ও-ই আসলে তোমার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য পাত্র।
তাহলে তো তুমি ওকে নিয়ে আসায় আমার খুশি হওয়াই উচিত, লজ্জিতভাবে বলল ফিল।
একটু হাসল ফোরম্যান, যে হাসিটা একেবারে নিষ্পাপ শিশুর মত সরল-ফিলের সামনে থাকাকালীন ওর আগের সেই নিষ্ঠুর আর কঠিন চেহারার সঙ্গে কোন মিলই নেই।
ওর এখানে উপস্থিতির জন্যে আমাদের দুজনেরই খুশি হওয়া উচিত, কারণ এটাই ওর প্রথম ভাল কাজ নয়। এর আগেও টমি একবার আমার জীবন বাঁচিয়েছে, বলে র্যাটল স্নেকের ব্যাপারটা ওকে জানাল সে।
শুনতে শুনতে মেয়েটার আতঙ্কিত চোখ বিস্ফারিত হলো।
জঘন্য ব্যাপার, বলল সে। এই কাজ কার জানো তুমি?
হ্যাঁ, কাজটা করেছিল ওই মেক্সিকান মারিও।
ভুরু উঁচাল ফিল, এবং তার চেহারায় সেই আগের ঠাণ্ডা ভাব আবার ফিরে এলো। সে বলল, আমি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জেনেছি সে এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
কথাটা ঠিক, কিন্তু তোমাকে সে পুরোটা বলেনি। একেবারে দুনিয়া ছেড়েই চলে গেছে সে। যেমন তোমাকে বলেছি।
কিন্তু তুমি কি কথাটা প্রমাণ করতে পারো? প্রতিবাদ জানাল মেয়েটা।
না, গম্ভীর স্বরে বলল সে। প্রমাণ না থাকলেও, আমার কথাটাই সত্যি।
কয়েকটা মুহূর্ত অস্বস্তিকর নীরবতার মধ্যে কাটল। এরফান বুঝতে পারছে ফিলের মনে আবার সন্দেহ জেগে উঠছে। গত রাতের ঘটনায় ওর মনে যে সামান্য একটু প্রীতির মরূদ্যান জেগে উঠেছিল সেটা আবার সন্দেহের মরুভূমিতে ছেয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করেই সে কথা পাল্টে অন্য কথা পাড়ল। ওই বাসায় তোমার একা থাকাটা ঠিক হবে না।
ওখানে রাঁধুনী ড্যানিয়েলের বউ ডিনা থাকে, জানাল ফিল। ওর স্বামীও ওর সাথেই থাকে, কেবল গত রাতেই সে রান্নাঘরের পাশে বাঙ্কহাউসে শুয়েছিল।
আমি টমিকে ওখানে থাকতে দিতে পারতাম, কিন্তু ও যেমন অস্থির তাতে তোমার ঘর লণ্ডভণ্ড করে ছাড়বে।
সে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল এই সময়ে লক্ষ করল এরফানের চেহারায় আবার সেই আগের কঠিন ভাবটা ফিরে এসেছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল বার্ট ঘোড়ার পিঠ থেকে নামছে।
আবার তোমাকে আর টমিকে ধন্যবাদ, বলে ঘুরে চলে গেল ফিল।
১০.
যদিও একা রাইডে না গিয়ে বস্টনকে সাথে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে মোটেও খুশি হতে পারেনি ফিল, কিন্তু শীঘ্রি সে আবিষ্কার করল ফোরম্যানের প্রস্তাব মেনে নিয়ে ভালই করেছে ও। সাথে সঙ্গী থাকায় ওর সকালের রাইড অনেক আনন্দময় হয়ে উঠেছে। ফিলের সাথে প্রথম রাইডের সকালে লরি হাঁটু উপর আড়াআড়ি রাইফেল রেখে একটা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখেই ওর পিছন পিছন আসছিল। কিন্তু পিছন ফিরে চেয়ে রাইফেলটা খাপে ভরে রেখে ওকে পাশাপাশি রাইড করতে বলল ফিল।
আগ্রহী কাউবয়কে আর দ্বিতীয়বার সাধতে হলো না, সাথে সাথে অস্ত্রটা খাপে ভরে মেয়েটার পাশাপাশি চলে এলো সে। আর মেয়েটার কাছে ওর বালকসুলভ লজ্জা এবং ওর আনন্দোজ্জ্বল চোখ ভাল লেগেছে। এটা যেন যৌবনকে যৌবনের ডাক।
লরি নিজের সম্পর্কে কিছুই বলছে না। তাই ফিল নিজেই ওকে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিল যে আত্মীয়স্বজন বলতে তার কেউ নেই। এই পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা। ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাতে সক্ষম হওয়ার বয়স থেকেই ও গরুর সব রকম কাজ করে আসছে। এই কাজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়েছে ওকে। আরও অনুসন্ধানে জানা গেল বেশ কয়েক হাজার মাইল ঘুরে সে দেশের বিভিন্ন এলাকা দেখেছে। একটা ব্যাপার লক্ষ করে ফিল বেশ মজা পেল, সেটা হচ্ছে যখনই ওরা বিশ্রাম নিতে অথবা কোন দৃশ্য উপভোগ করতে থেমেছে, প্রতিবারই লরি খাপ থেকে তার রাইফেল বের করে হাতে নিয়েছে।
আমার মনে হয় না এদিকে আমাদের কোন বিপদ হতে পারে, তৃতীয়বারের মত কিছুই ঘটল না দেখে মন্তব্য করল ফিল। এখানে একা এলেও আমার কোন বিপদ ঘটত না; মিছেই তুমি তোমার সময় নষ্ট করছ।
আমি না আসি সেটাই কি তুমি চাও? প্রশ্ন করল সে।
ওর কথায় আন্তরিক সুর আর চাহনি ফিলের গালে রক্ত প্রবাহ একটু বাড়িয়ে তুলল। নিজের উত্তেজনা আর আনন্দ সম্পর্কেও ও পুরোপুরি সচেতন। যখন হাত বাড়িয়ে হঠাৎ ফিলের লাগাম টেনে ধরল লরি, তখন মেয়েটা ভাবল কিভাবে এই বেপরোয়া যুবককে একটা ভাল শিক্ষা দেয়া যায়। কিন্তু পর মুহূর্তেই ফিল টের পেল যুবক কেন ওকে থামিয়েছে। মাইলখানেক দূরেই একটা বাঁক ঘুরে ছয়জন কালো মুখোশধারী ঘোড়সওয়ার বেরিয়ে এসেছে দেখতে পেল। লোকগুলোকে দেখামাত্রই ফিরতি পথ ধরে নিজেদের ঘোড়ার গতি বাড়াল ওরা।
ব্ল্যাক মাস্কের লোক, ফুপিয়ে উঠল ফিল।
দেখে তো তাই মনে হচ্ছে, স্বীকার করল লরি। হয়ত ওরা আমাদের খোঁজে আসেনি, কিন্তু সেটা পরখ করে দেখার ইচ্ছা নেই আমার। বাতাসের বেগে ছুটব আমরা।
ক্লান্ত ঘোড়া নিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত ছুটল ওরা। পিছন থেকে উল্লসিত একটা চিৎকারে লরি ঘুরে দেখল ওরাও ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে পিছু নিয়েছে। কিছুদূর পর্যন্ত ওরা দূরত্ব বজায় রাখতে পারল বটে, কিন্তু ক্রমেই এটা পরিষ্কার হয়ে উঠল যে ডাকাতদের ফ্রেশ ঘোড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ক্লান্ত ঘোড়াদুটো কিছুতেই পারবে না। ওদের মাঝে দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে।
আমরা কিছুতেই নিরাপদে পৌঁছতে পারব না-ওদের ঘোড়া অনেক বেশি তেজী, ভাবল লরি, কিন্তু ফিলকে কিছু জানাল না।
পাশাপাশি ছোট কাউ-পোনি নিয়ে ছুটে চলেছে ওরা; ঘোড়া দুটো প্রাণ। থাকা পর্যন্ত উধ্বশ্বাসেই ছুটবে। চমৎকার দক্ষতার সাথে ঘোড়া চালাচ্ছে ফিল। একটা বুলেট বাতাস কেটে শব্দ তুলে ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। পরক্ষণেই রাইফেলের গর্জন ওদের কানে পৌঁছল। আবার পিছন ফিরে চেয়ে শঙ্কিত চোখে লরি দেখল পিছনের দলটা অনেক দূর এগিয়ে এসেছে।
ওর মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই যে মেয়েটাই ওদের লক্ষ্য। আরও একটা গুলির শব্দের সাথে লরির ঘোড়া হোঁচট খেলো, ওটা হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার আগেই কাউবয় লাফিয়ে নিচে নেমে পড়েছে। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে লাগাম টেনে থেমে দাঁড়াল। লরির ঘোড়াটা থরথর করে একটু কেঁপে স্থির হয়ে পড়ে রইল।
তুমি র্যাঞ্চের দিকে এগিয়ে যাও, চিৎকার করে বলল লরি। আমি ওদের কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারব।
কিন্তু ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে, লরি, প্রতিবাদ জানাল ফিল। তুমি লাফিয়ে আমার পিছনে উঠে বসো।
একটা ঘোড়া আমাদের দুজনকে নিয়ে ছুটতে পারবে না; ওরা আমাকে নয়, তোমাকে ধরতে চায়। তুমি আমাদের লোকের উদ্দেশে ছুটে এগোও জেমসকে বৈলো আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম।
আমার মনে থাকবে লরি-তোমার কথা আমি কোনদিন ভুলব না। মেয়েটার চোখ ছলছল করছে।
আর কথা না বাড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছোটাল ফিল। খাপ থেকে রাইফেল বের করে নিয়ে কাউবয় মৃত ঘোড়াটার পিছনেই আড়াল নিয়ে লড়ার জন্যে তৈরি হলো। ডাকাতের দলটা ছয়শো গজ দূরে জটলা করে থেমে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু লরির গুলিতে ওদের একটা ঘোড়া মারা পড়ায় ওরা অর্ধচক্রাকারে আরও দূরে সরে গেল। পাল্টা জবাবে দুটো গুলি এলো, কিন্তু দুটোই মিস হলো। একটা ব্যাপার লক্ষ করে সে অবাক হলো যে ওদের দলের কেউই মেয়েটার পিছু নেয়ার চেষ্টা করল না। সবথেকে ডানের এবং বামের দুজন করে লোক ঘোরা পথ ধরে। ধীর গতিতে অদৃশ্য হলো। বাকি দুজন মরা ঘোড়াটার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকল। তবে তারা রাইফেল রেঞ্জের অনেক বাইরে রয়েছে।
ওরা চুপিসারে আমাকে পিছন থেকে আক্রমণ করতে চাইছে, আন্দাজ করল লরি। চারপাশে তাকিয়ে সে দেখল তার ঠিক পিছনেই একটা রিজ রয়েছে; ওটা ওদের কাজ অত্যন্ত সহজ করে তুলবে। আমার কাছে একটা ঘোড়া থাকলে খুব ভাল হত, ভাবল সে। কিন্তু যা নেই, তার কথা ভেবে কি লাভ?
একটা সিগারেট তৈরি করে ওটা ফুকতে ফুকতে দার্শনিক ভাবে নিজের নিয়তির কথাই ভাবল ও। প্রায় আধঘণ্টা পর রিজের ওপর থেকে কঠিন স্বরে একটা নির্দেশ এলো।
রাইফেল ফেলে দিয়ে গানবেল্ট খুলে হাত উপরে তুলে দাঁড়াও! আমরা দুজন তোমাকে কাভার করে আছি!
মুখ তুলে চেয়ে দেখল রিজের ওপর দুজন মুখোশধারী লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওদের নির্দেশ মত রাইফেল ফেলে বেল্ট খুলে ফেলল সে। কিন্তু হাত উপরে না তুলে নিশ্চিন্ত মনে আরেকটা সিগারেট তৈরি করা শুরু করল।
এগিয়ে এসো, শান্ত স্বরে বলল সে।
আমি তোমাকে হাত তুলে দাঁড়াতে বলেছি, বলে দুজন লোক রাইফেল বাগিয়ে ধরে, ওর দিকে এগিয়ে এলো।
আমি ভুলে গেছি, এমন ভুল আমার হতেই থাকবে, হেসে জবাব দিল বন্দি। তোমরা কি করবে?
লোকটা দাঁতে দাঁত চেপে একটা অশ্রাব্য গালি দিল। প্রায় একই সাথে বাকি চারজনও রিজের উপর উঠে এলো। ওদের দুজন একই ঘোড়ার পিঠে রয়েছে। যাকে ওদের লীডার বলে মনে হলো সে ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নিচে নেমে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে কাঠিতে গেথে মাটিতে পুতে রাখল। তার কাজকর্ম অবাক চোখে দেখছে লরি।
তুমি যদি আমার ঘোড়ার কবরের স্মৃতিচিহ্ন রাখতে চাও, ওর নামটা ছিল বাউন্সার, নিজে থেকেই জানাল সে।
ওর কথার কোন জবাব না দিয়ে লোকটা সঙ্গীদের নির্দেশ দিল,..ওকে বেঁধে কোন ঘোড়ার পিঠে তুলে নাও। এখন দুজনকে ডাবল-রাইড করতে হবে।
লরিকে একটা ঘোড়ার পিঠে তুলে ঘোড়ার পেটের তলায় পা আর পিছমোড়া করে হাত বেঁধে তারা সোজা চূড়া লক্ষ্য করে রওনা হলো। সে জানে না ওর ভাগ্যে কি ঘটবে-কিন্তু এখন আর ওর মনে কোন দুঃখ নেই। ফিল এখন নিরাপদ। মেয়েটার শেষ কথাগুলোই ওর জন্যে একমাত্র সান্ত্বনা।
ফিলকে ক্লান্ত ঘোড়ার পিঠে ওভাবে একা ফিরতে দেখে এরফান আর অন্যান্য কাউবয়রা ছুটে ওর দিকে এগিয়ে গেল। অল্প কথায় কি ঘটেছে তা ওদের জানাল মেয়েটা। ফোরম্যান একটুও সময় নষ্ট করল না।
ঘোড়া আর রাইফেল, আদেশ দিল সে।
আমার জন্যেও একটা, হেনডন, বলে উঠল ফিল।
ফোরম্যান ওর দিকে তাকাল। তুমি এখন ক্লান্ত বলেই মনে হচ্ছে- শুরু করেছিল এরফান।
কিন্তু ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে মেয়েটা জোর দিয়ে বলল, আমি যাচ্ছি। আমাকে বাঁচাবার জন্যেই ও গলা বুজে আসায় মুখ ফিরিয়ে নিল ফিল।
এরফান, আর কোন আপত্তি তুলল না, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছয়জন কাউবয় আর ফিলকে সাথে নিয়ে রওনা হয়ে গেল সে। ওরা নীরবেই রাইড করছে আক্রমণস্থলের উদ্দেশে। এতক্ষণ ওরা ঊর্ধ্বশ্বাসেই ঘোড়া ছোটাচ্ছিল, ফিল যখন সাবধান করল ঘটনার প্রায় কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছে গেছে, কেবল তখনই ঘোড়ার গতি কমানো হলো। রিজটা চোখে পড়তেই সবাইকে থামার নির্দেশ দিল ফোরম্যান। ফিলের মনে পড়ল ওই রিজের ওপাশেই সে লরিকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো, বয়েজ, বলল এরফান। ওরা হয়ত আমাদের জন্যে নিজের ওপাশেই অপেক্ষা করছে। অন্ধের মত ওদের অ্যামবুশে পা দেয়ার কোন অর্থ নেই।
একাই এগিয়ে রিজ পেরিয়ে ওপাশে অদৃশ্য হলো এরফান।
ওর জায়গায় ব্ল্যাক বার্ট হলে নিজে ঝুঁকি না নিয়ে আমাদের কাউকেই সে পাঠাত, হেনডনকে বলতে শুনল ফিল।
কেন যেন তার মনে হলো লোকটা ঠিকই বলেছে। এতে ওই সাহসী ফোরম্যানের প্রতি ওর শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল। নিজের জীবনের ওপর এই অহেতুক ঝুঁকি সে না নিলেও পারত। কিন্তু পর মুহূর্তই বার্টের ঢুকানো বিষ তাকে সন্দিগ্ধ করে তুলল। সত্যিই কি সে ঝুঁকি নিয়েছে-নাকি এটাও তার নাটকেরই একটা সাজানো অঙ্কঃ
একটু পরেই চিৎকার করে ফোরম্যান সবাইকে এগিয়ে আসার নির্দেশ দিল। সবার আগে ফিলই রিজের মাথায় উঠল।
ওর ঘোড়াটাকে শকুনে খাওয়ার পর যেটুকু বাকি রেখেছে তা এখানে রয়েছে, জানাল এফান। তবে ঘোড়ার জিন আর মাথার সাজ অদৃশ্য হয়েছে। লরির কোন চিহ্নই এখানে নেই। কেবল এই কাগজটা একটা কাঠির মাথায় গাঁথা ছিল। লেখা আছে:
‘তোমার লোক এখন আমাদের হাতে, জেমস। ওকে যদি তুমি ফেরত চাও তবে
আগামীকাল গরু বিক্রির দুহাজার ডলার সহ দুপুর বেলা স্কাল ক্যানিয়নে হাজির হয়ো। তুমি না
এলে, বা কোন চালাকি করার চেষ্টা করলে ওকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।
দা, ব্ল্যাক মাস্ক।‘
ফিলের আতঙ্কিত চিৎকার আর কাউবয়দের বিড়বিড় করে বকা গালির শব্দ, পেনসিল দিয়ে লেখা মেসেজের প্রতিবাদে ওদের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট ব্যক্ত করল। এরফান লক্ষ করল মারিওর পকেটে পাওয়া লেখাটার সাথে এই লেখার হুবহু মিল রয়েছে। জেসাপ কাউবয়দের দিকে ফিরে ওদের র্যাঞ্চে ফেরার নির্দেশ দিল। ঝট করে ঘুরে ফোরম্যানের মুখোমুখি দাড়াল ফিল।
তুমি কি ওকে বাঁচাবার কোন চেষ্টাই করবে না? বলে উঠল মেয়েটা। তুমি নিশ্চয়ই ওর মৃত্যু চাও না?
এখন আর আমাদের কিছুই করার নেই, জবাব দিল সে। ওরা এতক্ষণে ওদের সব ট্র্যাক ঢেকে ফেলেছে। আমরা যদি এখন ওদের অনুসরণ করার চেষ্টা করি, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা অ্যামবুশের শিকার হব।
ওর দিকে চেয়ে থাকল ফিল; চোখে ঝড়ের পূর্বাভাস।
আমি বলব তুমি একটা কাপুরুষ, বলল সে। তুমি ওদের লীড় না করলে আমি নিজেই ওদের নিয়ে এগিয়ে যাব।
ওর কথার কোন জবাব দিল না এরফান। কিন্তু কাউবয়দের দিকে চেয়ে সে বুঝল ওরা কেউই ফিলের আদেশ মানবে না। শেষে হেনডনের থেকেই জবাবটা এলো।
ফোরম্যানের কথাই ঠিক, মিস মাস্টারসন, বলল সে। মিছে এভাবে পাথরে মাথা ঠুকে কোন লাভ নেই। ধরো আমরা যদি ওকে ওই দুর্গম উঁচু এলাকায় খুঁজেও পাই, আমাদের দেখামাত্র ওরা লরিকে কোন গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে সরে পড়বে। আমাদের ওরা বগা-চিপিতেই আটকেছে।
কাউবয়দের দিকে রোষের দৃষ্টিতে একবার চেয়ে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরল ফিল। নীরবেই পথ চলছে মেয়েটা; ওর চোখের সামনে লরির হাসিখুশি চেহারাটা ভাসছে। সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না কিভাবে বিষণ্ণ চেহারায় কঠিন স্বরে যুবক, ওকে যত দ্রুত সম্ভব র্যাঞ্চে পৌঁছে খবর দিতে বলেছিল। সম্ভবত ওর জন্যেই যুবক নিজের জীবন নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিল। হেঁট মাথায় ওকে অনুসরণ করছে নিরুপায় কাউবয়রা।
প্রায় বিনিদ্র একটা রাত কাটিয়ে পরদিন ফিল নিচে নেমে দেখল ফোরম্যান ওর সাথে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে নোটের একটা বান্ডিল মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা সেই গরু বিক্রির টাকা। অবশ্য এর থেকে কাউবয়দের বেতন দিতে কিছু টাকা আমি খরচ করেছি। বাকি টাকাটা তুমি কোথাও নিরাপদে সামলে রাখো।
এটা তুমি আমাকে রাখতে দিচ্ছ কেন? প্রশ্ন করল ফিল।
তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আজ দুপুরে আমাকে স্কাল ক্যানিয়নে হাজির থাকতে। হবে, মনে করিয়ে দিল সে।
তুমি কি সত্যিই স্কাল ক্যানিয়নে যাচ্ছ? বিস্মিত স্বরে বলল সে। কিন্তু তাহলে তো টাকাটাও তোমাকে সাথে নিতে হবে।
অবশ্যই আমি যাচ্ছি, কিন্তু কোন টাকা আমি সাথে নিচ্ছি না, জবাব দিল সে। আমি কচি খোকা নই।
কিন্তু টাকা ছাড়া তুমি ওকে কিভাবে বাঁচাবে?
তা আমি এখনও ঠিক করিনি; যেমন তাস পাব তার ওপর নির্ভর করবে খেলাটা আমি কিভাবে খেলব।
হালকা স্বরেই কথাটা বলল সে। কিন্তু ওর চোখের কোণে যে কৌতুকের আভাস ঝিলিক দিচ্ছে তা ফিলের নজর এড়াল না। তবু লোকটা মরিয়া একটা ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ফিলের মনোভাব কিছুটা প্রসন্ন হলেও আবার সেই পুরোনো সন্দেহটা মনে চাড়া দিয়ে উঠল।
ব্যাপারটা যতটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে হয়ত আসলে তা নয়, ঠাণ্ডা স্বরে মন্তব্য করল ফিল। ওখানে তোমার কিছু বন্ধু-বান্ধব থাকতে পারে।
কথাটা শুনে রাগে এরফানের চোখদুটো কঠিন হয়ে উঠল; ঠোঁটও পরস্পরের ওপর চেপে বসল।
শোনো মেয়ে, কঠিন স্বরে বলল এরফান। ঈশ্বর তোমার কাঁধের ওপর। একটা সুন্দর মুখ বসিয়েছে বটে, কিন্তু সে তোমার মাথার ভিতর কোন মগজ ঢুকাতে কেন ভুলে গেল সেটাই আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে। যদি সত্যিই তোমার কোন বুদ্ধি থাকে তবে যৎসামান্য যা আছে সেটুকু ব্যবহার কোরো।
আর একটা কথাও না বলে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। তারপর। বাইরে অপেক্ষমাণ ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে দ্রুতবেগে অদৃশ্য হলো। তার। মন্তব্য এরফানকে কি পরিমাণ খেপিয়ে তুলেছে দেখে মেয়েটা স্তম্ভিত হলো। কিন্তু স্কাল ক্যানিয়নের ট্রেইল ধরার আগে হাত তুলে লোকটাকে তার। আউটফিটের লোকজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে দেখল সে। এবার ধপাস। করে পাশের চেয়ারে বসে মেয়েটা শূন্য দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে চেয়ে রইল। এটা তার জন্যে একটা নতুন অভিজ্ঞতা-মানুষকে সে আগেও রাগতে দেখছে, কিন্তু তাকে উদ্দেশ্য করে কেউ কখনও এতটা রাগ দেখায়নি। সারাটা দিন সে সন্দেহ আর অশান্তির মধ্যেই কাটাল। তার চোখ ঘুরে ফিরে উত্তরের ট্রেইলের ওপরই পড়ছে; সে জানে লরিকে দেখার আশাতেই ওর চোখ বারবার ওদিকে যাচ্ছে।
১১.
মাইলখানেক পথ অতিক্রম করার পর এরফান আবার স্বভাবগত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। এখন নিজের ওপরই, রাগ হচ্ছে ওর। এভাবে একটা তরুণী মেয়েকে কথা শোনানো তার মোটেও ঠিক হয়নি।
যখন বলেছিল বন্দি যুবককে সে কিভাবে উদ্ধার করবে তা ওর জানা নেই তখন মিথ্যে বলেনি ও। এখনও কোন প্ল্যান সে ঠিক করেনি। ওর নিশ্চিত ধারণা, লরি নয়, সে নিজেই ওদের টার্গেট। ওকে ফাঁসানোর জন্যেই লরিকে ওরা বন্দি করেছে। মুক্তি পণটা কাকে আনতে হবে তার নাম উল্লেখ করাতেই সে বুঝে নিয়েছে ওদের আসল টার্গেট কে। কঠিন একটা হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে; সে ইচ্ছে করেই ধরা দেবে।
বিগত দিনগুলোর ঘটনা, মেয়েটার অপছন্দ, এবং ওর সাথে বার্টের সম্পর্ক, এসবই আমাকে এই এলাকায় একটা ভেজা কুকুরের মত প্রিয় করে তুলেছে, মনে মনে ভাবল এরফান।
প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে, এই সময় স্কাল ক্যানিয়নে ঢুকল ও। ঘোড়া থামিয়ে অপেক্ষায় থাকল; ওর ঠোঁটে একটা বেপরোয়া হাসি ফুটে উঠেছে। কোন ঝোঁপের আড়াল থেকে শব্দ তুলে একটা গুলি এসে ওকে ফুটো করে দিলেও অবাক হত না, কিন্তু তার বদলে ঝোঁপের আড়াল থেকে স্বর ভেসে এলো।
কোমরের বেল্ট আর রাইফেলুটা মাটিতে ফেলে দাও, জেমস, আমরা তোমাকে কাভার করে আছি, দাবি করল সে। মনে রেখো তোমার পিছনেও আমাদের দুজন লোক রয়েছে। তুমি আমার পিছন পিছন এসো, কোন চালাকি বা পালাবার চেষ্টা করলে তোমাকে গুলি করার নির্দেশ দেয়া আছে ওদের।
আমি এখানে কোন খেলা খেলতে আসিনি, কঠিন স্বরে জবাব দিল এরফান। আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
অপেক্ষা করো, নিজেই দেখতে পাবে, জবাব এলো।
ওদের মধ্যে আর কোন কথা হলো না। এরফান নীরবেই তার কালো মুখোশধারী পথ প্রদর্শককে অনুসরণ করছে ট্রেইলটা নিছক একটা আবছা পথ ছাড়া আর কিছুই নয়। বোঝাই যাচ্ছে এটা ওদের আস্তানায় পৌঁছা’র প্রধান রাস্তা নয়। ওকে কোন ঘোরা পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেবদারু আর, অ্যাসপেনের একটা বনের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছে ওরা। একটু পরেই ওরা এমন একটা ভাঙাচোরা বুনো এলাকায় ঢুকল যে এমন দুর্গম ট্রেইল, এরফান জীবনে খুব কমই দেখেছে
সারাটা পথ ক্রমশ ওরা কেবল উপর দিকেই উঠেছে। হঠাৎ করেই ওরা উঁচু পাহাড়টার পাদদেশে পৌঁছল। নিচের ঢালটা পাইন গাছে ভরা। এখানকার বাতাস অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা। গাছ আর ঘন ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে মাত্র কয়েক চিলতে রোদ ভিতরে ঢোকার অধিকার পেয়েছে। এরফান পিছন ফিরে দেখল দুজন মুখোশ পরা লোক হাঁটুর উপর আড়াআড়ি রাইফেল তৈরি রেখে রাইড করছে। ওই সামনের লোকটা তাহলে মিথ্যে ধাপ্পা দেয়নি। ওরা নিশ্চয়ই এর মধ্যে আড়াল ছেড়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছে; কারণ এর আগে ওদের দেখতে পায়নি জেসাপ। উপরে ওঠায় গাছের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। ওদের অনেক উপরে চূড়াগুলোর দৈত্যাকার দাঁতের সারি দেখা যাচ্ছে। ছোট একটা নিচু ঢলের কাছে পৌঁছল ওরা। প্রায় এক মাইল লম্বা আর আধমাইল চওড়া পেয়ালা আকারের সীমানা ওটা। ঝোপে ভরা ঢালগুলো ছাড়া পুরো এলাকাটাই গাঢ় সবুজ ঘাসে ছাওয়া। এর ঠিক মাঝখানে একটা ছোট লেকও দেখা যাচ্ছে। অনেক গরু আর ঘোড়া সন্তুষ্ট মনে ওখানে চরছে।
আপাতদৃষ্টিতে নিচে নামার কোন পথই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ওর গাইড নির্দ্বিধায় ঘোড়াকে একটা ঢাল বেয়ে পিছলে নিচে নামাল। চক্রাকারে কিছু ঝোঁপঝাড় কাটিয়ে একটা করালের সামনে থামল সে।
তোমার ঘোড়াটাকে ওই করালে ঢুকিয়ে রাখো; এখন আমাদের কিছুদূর হাঁটতে হবে। লোকটা প্রথমে নিজেই, তাই করল।
এরফানও অনুসরণ করল। তারপর একটা সরু পাথুরে পথ ধরে প্রায় একশো ফুট উঁচুতে উঠে দেখল ওখানে কয়েকটা গুহার মুখ দেখা যাচ্ছে; সে বুঝল এগুলো হোপি ইন্ডিয়ানদের তৈরি। তবে সম্ভবত এর বর্তমান বাসিন্দরা ওদের চেয়েও নিষ্ঠুর। এরফান লক্ষ করল কয়েকটা গুহার মুখে দরজা বসানো হয়েছে। ওগুলোর মধ্যে একটায় এরফানকে, ঢোকানো হলো।
আপাতত তুমি এখানেই থাকো, আমাদের যখন দরকার ডাকা হবে, বলল লোকটা। খিদে পেয়েছে?
তা পেয়েছে বটে; সেই ভোর বেলায় নাস্তার পর আর পেটে কিছু পড়েনি, বলল লেজি এমের ফোরম্যান। তারপর পকেট থেকে একটা পাঁচ ডলারের নোট বের করে বলল, তুমি কি এক বোতল হুইস্কির ব্যবস্থা করতে পারবে? গলাটা বড্ড শুকিয়ে এসেছে
ডাচ কারেজ, অ্যাঁ? খিকখিক করে লোকটা হাসল। আমি দেখছি তোমার জন্যে কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
লোকটা চলে গেল, কিন্তু যাবার আগে দরজায় তালা লাগিয়ে গেল। একটু পরেই সে কিছু মাংস, রুটি, আর এক বোতল মদ নিয়ে ফিরে এলো।
ওই মাল একটু কম করে খাওয়াই ভাল, সাবধান করল সে, অভ্যস্ত না হলে ওটা ডিনামাইটের চেয়েও খারাপ।
মাথা ঝাঁকাল এরফান; ওই জিনিসের সাথে তার পরিচয় আছে। লোকটা চলে যাওয়ার পর ওকে যেখানে বন্দি করা হয়েছে সেই কামরাটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল। পাথর খুড়ে তৈরি করা একটা গর্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। আলো বাতাস কেবল অপটু হাতে তৈরি দরজার ফাঁক দিয়ে সামান্য আসছে। ওটাই ভরসা। খাবার শেষ করে এক চুমুক মদ মুখে নিয়ে কুলি করে ফেলে দিল এরফান, তারপর বাকি মদের তিন ভাগের দুই ভাগ মাটিতে ঢেলে ফেলে বোতলটা নিজের পাশেই রেখে দিল।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে একটা সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে ভরে পরবর্তী ঘটনা ঘটার অপেক্ষায় থাকল সে। ওর চোখে কোন পট্টি না বেঁধে এখানে আনা এবং হাতও না বেঁধে মুক্ত রাখাতেই সে স্পষ্ট বুঝে নিয়েছে শেষ পর্যন্ত ওর ভাগ্যে কি ঘটুবে। ওকে কোনমতেই এখান থেকে জীবন্ত বেরোতে দেয়া হবে না। লরিকে কোথায় রাখা হয়েছে সেটাই ভাবছে সে।
ঘণ্টা দুই পরে বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েই এরফান বুকের সাথে থুতনি ঠেকিয়ে এমন ভাবে কাত হয়ে বসল যেন সে পুরোপুরি মাতাল অবস্থায় কুঁদ হয়ে আছে। যে লোকটা ওকে নিয়ে এসেছিল বোতলটার দিকে একবার চেয়েই সে খিস্তি করল।
ইউ ড্যাম ফুল-আমি আগেই সাবধান করেছিলাম, কিন্তু তুমি আমার কথায় কান দাওনি, বলল মুখোশধারী।
পাঁড় মাতালের মত জড়ানো স্বরে বিড়বিড় করল এরফান, আওয়ি ঠিগই আসি, তুয়ি গি চাও?
এরফানের বাহু জড়িয়ে ধরে ওকে উঠতে সাহায্য করল সে। তারপর একরকম জোর করেই ওকে নিয়ে এগোল। টলতে টলতে কোনরকমে ওর সাথে চলেছে এরফান। উঁচু ছাদওয়ালা একটা গুহায় ওকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল লোকটা। বড় গুহাটা থেকে কয়েকটা সুড়ং বিভিন্ন দিকে গেছে। পাথরের একটা গর্ত দিয়ে আলো আসছে। ওখানে সাতজন লোক আলোর কাছে চেয়ারে বসা রয়েছে। প্রত্যেকের মুখই কালো মুখোশে ঢাকা; কেবল চোখদুটো দেখা যাচ্ছে।
ওকে তুমি বাঁধোনি কেন? ওদের একজন জিজ্ঞেস করল; যার আকৃতি এরফানের কাছে কেমন যেন পরিচিত মনে হলো।
কি দরকার? জবাব দিল লোকটা। ও তো নিজেকেই নিজে বেঁধে ফেলেছে-দেখছ না ওর অবস্থা?
প্রচুর মাল গিলেছে, না? অবজ্ঞার সাথে বলল প্রথম বক্তা। ওই লোকটা যে নেতা ধরনের কেউ তা ওর কথায় বোঝা যায়। তারপর সে এরফানের দিকে চেয়ে বলল, ডলারগুলো কোথায়?
সম্মানের সাথে মাথা তুলে দাঁড়াতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাওয়ার ভান করল এরফান।
তোমরা আমাকে কি এতই বোকা মনে করো যে আমি তোমাদের ওই ফাঁদে পা দেব? জড়ানো স্বরে বলল সে। আমি কচি খোকা নই।
তুমি যদি টাকাটা না এনে থাকো, তাহলে তোমাদের দুজনকেই আমি এক সাথে ঝুলিয়ে দেব, অপরিচিত লোকটা গর্জে উঠল।
এরফান মাথা নাড়ল। ওসব হুমকিতে কোন কাজ হবে না, দাঁত দেখিয়ে হাসল সে দুজন কাউবয়ের লাশ দিয়ে তোমার কি লাভ হবে? ভারী স্বরে জবাব দিল সে। মাংস আর চামড়া বিক্রি করবে? আমার কথা শোনো, আমি কিভাবে নিশ্চিত হব যে তুমি আমার লোককেই আটক করেছ? প্রমাণ করো যে ও আমারই লোক, তাহলে আমি র্যাঞ্চে চিঠি দিয়ে টাকাটা আনাব। তোমার একজন সঙ্গী •ওটা আনতে যাবে। এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর কি হতে পারে? (কথাগুলো এরফান জড়ানো ভাবে তোতলামির সাথে বললেও পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্যে বিকৃত করা হয়নি।)।
ওই গাধাটাকেও এখানে নিয়ে এসো, সামনে দাঁড়ানো টলায়মান লোকটার দিকে বিষ্ণা নিয়ে চেয়ে নির্দেশ দিল লীডার।
দুমিনিটের মধ্যেই হাত পিছনে বাঁধা অবস্থায় ওখানে হাজির করা হলো লরিকে। ফোরম্যানকে ভারী চোখে পিটপিট করে ওকে দেখতে দেখে লরি অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।
ওটা লরিই বটে, কিন্তু ওরা দুজন কেন? কৌতুক মেশানো স্বরে বলল সে। ওরা কি যমজ নাকি?
ওর কথা শুনে মুখোশের আড়াল থেকে সমস্বরে হাসির শব্দ শোনা গেল। পেঁচার মত ভারিক্কি চেহারা করে ওদের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল সে।
হ্যাঁ, স্যার, যমজ বা একই বাপের ছেলে না হলে এতটা মিল একেবারে অসম্ভব। আমি কখনও ভিন্ন বাপের একই চেহারার ছেলে থাকার কথা শুনিনি।
আবার দর্শকদের মধ্যে হাসির ফোয়ারা ঠেল। আমোদ ফুর্তির মধ্যে, ডাকাত দল একটু অসতর্ক হয়ে উঠল। এই ধরনের একটা সুযোগই খুঁজছিল এরফান। সে আগেই খেয়াল করেছে, যে-লোকটা ওদের এখানে নিয়ে এসেছে সে ঠিক তার পিছনেই দাড়িয়ে আছে। বিরক্তিতে-সে-ও বেখেয়াল হয়ে পড়েছে।
টুইনরা সমাজের জন্যে খুব ক্ষতিকর হয়।
হঠাৎ দুহাত দুপাশে তুলে নিজের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় ওই পিছনের গার্ডের সাথে ধাক্কা খেলো এরফান। পরমুহূর্তেই ঝট করে সামনের লোকগুলোকে দুহাতে দুটো পিস্তল নিয়ে কাভার করে দাঁড়াল সে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গার্ডের দুটো পিস্তলই ছিনিয়ে নিয়েছে ও।
তোমরা সবাই ছাদের দিকে হাত তুলে দাঁড়াও। আমি যেমন বলছিলাম-টুইনরা সত্যিই খুব সাংঘাতিক হয়; এবং এই গান দুটো টুইন।
মাতাল কাউরয়ের কথায় এখন আর বিন্দুমাত্রও জড়তা নেই। এখন সে একটু কুঁজো হয়ে হিংস্র কঠিন দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে আছে। এখন একজনের বিরুদ্ধে আটজন হলেও ওরা সবাই জানে কেউ বিরোধিতা করতে গেলেই তার মৃত্যু অনিবার্য। মরতে ওদের কেউই রাজি নয়; তাই সবাই এরফানের আদেশ মত হাত তুলল।
ওরা সবাই দ্রুত এরফানের আদেশ পালন করার পর একটা পিস্তল খাপে ভরে এগিয়ে গিয়ে সে একজন ডাকাতের বেল্ট থেকে তার ছুরিটা বের করে নিয়ে লরিকে কাছে ডেকে নিয়ে হাতের বাঁধন কেটে দিল। বিষদাঁত ভেঙে দেয়ার জন্যে ওদের প্রত্যেকের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলো, সঙ্গীকে নির্দেশ দিল সে।
উল্লসিত একটা চিৎকার দিয়ে লরি কেবল ওদের বেঁধেই ক্ষান্ত হলো না, পিস্তলগুলোও বের করে নিয়ে মাঝখানে ফেলল। ওখানে খুঁজে এরফান নিজের পিস্তল দুটো পেল বটে, কিন্তু নিজের রাইফেল ছাড়াই ওকে কাজ চালাতে হবে।
এবার যাকে পরিচিত মনে হয়েছিল তার পিছনে গিয়ে এক টানে লোকটার মুখোশ খুলে ফেলল।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, বলল সে। তোমার আকৃতিটা বেশ কিছুটা অসাধারণ, মিস্টার শ্যাডওয়ার্থ-ওরফে শেডি। চলো তোমাকেও আমরা সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
ড্যাম ইউ, আমি তোমাদের দুজনকেই শেষ করব, হিসিয়ে উঠল সে।
হয়ত, কিন্তু আপাতত নয়, এখন তুমি আমাদের হাতে, বলল এরফান। আমাদের আগে আগে এগিয়ে চলে, পাজি কুকুর, নইলে তোমাকে কবর দেয়ার মতও বিশেষ কিছু অবশিষ্ট রাখব না আমি।
ওকে আর দ্বিতীয়বার বলতে হলো না, পাঁজরে পিস্তল ঠেকাতেই সে মাথা হেঁট করে চলতে শুরু করল। এর আগেই এরফানের নির্দেশ অনুযায়ী ওদের সব অস্ত্র নিচের উপত্যকায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে লরি। করালে পৌঁছে এরফান নিজের ঘোড়াটাই নিল। লরি তার নিহত ঘোড়ার বদলে ভাল দেখে একটাতে চড়ে বসল। শেডিকেও একটা ঘোড়ায় তুলে দেয়া হলো। পাদানির সাথে ওর পা দুটো বেঁধে ওর গলাটাও দড়িব ফাঁসে আটকে নিজের জিনের সাথে বেঁধে নিল এরফান।
তুমি যদি লাফিয়ে পড়ে জল্লাদের কাজটা কমিয়ে দিতে চাও তাতে আমি আপত্তি করব না, হালকা সুরে মন্তব্য করল এরফান।
জবাবে শেডি কেবল আক্রোশে ভরা একটা ভেঙচি কাটল।
অনেক মানুষেরই এমন আক্রোশ এরফান আগেও দেখেছে, তাই এখান। থেকে হোপে পৌঁছা’র সবথেকে কাছের ট্রেইটা ধরতে বলল ও সাবধান করল, অযথা দেরি করাবার চেষ্টা কোরো না, কারণ তোমার সঙ্গ যদি আমাদের অসহ্য হয়ে ওঠে তাহলে এখানে গাছের কোন অভাব নেই।
তুমি আর কাউকে সঙ্গে আনননি কেন? নাকি জয়ের পুরো গৌরব তুমি একাই লুটতে চেয়েছিলে?
ওদের চিঠিতে ওকে একা আসতে বলার কথা মনে করিয়ে দিয়ে সে আরও বলল, তাছাড়া প্রিন্সেস গতকালই তোমার খোঁজে না আসার জন্যে আমার ওপর খুব খেপেছিল। একটা কিছু না করে আমার আর কোন উপায় ছিল না। তোমার জন্যে সে যে কেন এতটা উতলা হয়ে উঠেছিল তা তুমিই জানো।
লরির মুখটা লজ্জায় ঈষৎ লাল হয়ে ওর সানসেট নামকরণের যথার্থতা প্রমাণ করল।
এই শয়তামটাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার তোমার কি কারণ? মাথা হেলিয়ে সামনে ঘোড়ার পিঠে কুঁজো হয়ে বসা লোকটার দিকে ইঙ্গিত করল লরি।
ওকে শেরিফের হাতে তুলে দেব।
তাতে কি লাভ হবে? টেলর ওকে ঠিকই ছেড়ে দেবে।
বাজি ধরে বলা যায় ঠিক তাই সে করবে; কিন্তু এতে হোপের অর্ধেক লোকের মত ওর বিপক্ষে চলে যাবে। এটা সে মোটেও পছন্দ করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
এরফান ওকে গাছে ঝুলিয়ে দেয়ার ভয় দেখানোতেই হোক, বা ওর নিজস্ব বিশেষ কোন কারণেই হোক, শেডিকেও তাড়াতাড়ি শহরে পৌঁছা’নোয় অত্যন্ত উদগ্রীব বলে মনে হলো।
সন্ধ্যার আগেই ওরা হোপে পৌঁছে গেল। ওদের আবির্ভাবে রাস্তায় কৌতূহলী দর্শকের ভিড় জমে গেল। কিছু লোক ওদের পিছুপিছু টেলরের বাড়ি পর্যন্ত গেল। হাজত আর টেলরের বাড়ি দুটোই একসঙ্গে। টেলরকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। যাকে বেঁধে আনা হয়েছে তার চেহারা দেখে শেরিফের চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার জোগাড় হলো।
এর মানেটা কি? উদ্ধত সুরে প্রশ্ন করল সে।
অল্প কথায় লরিকে উদ্ধার আর শ্যাডওয়ার্থকে বন্দি করার ঘটনা ব্যাখ্যা করল এরফান। ফোরম্যানের কথা শেষ হতেই তুমুল প্রতিবাদ জানাল শেডি।
সব মিথ্যে কথা। কোন মেয়ের কথা আমি কিছুই জানি না। এর আগে একদিন সেলুনে দেখার আগে জীবনে এদের আমি আর কখনও দেখিনি। সেদিন এদের একজন আমার পিঠে পিস্তল ঠেসে ধরেছিল রি অন্যজন আমাকে ঘুসি মেরে অজ্ঞান করেছিল। আজ বিকেলে আমি ডেজার্ট এজের, ট্রেইল ধরে যাচ্ছিলাম, এই সময়ে এরা দুজন হঠাৎ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
তাহলে এটাও নিশ্চয় তোমার নয়? কালো মুখোশটা পকেট থেকে বের করে দেখাল এরফান।
কোনদিন দেখিওনি, নির্বিকার মুখে মিথ্যা বলল সে। এবার টেলরের দিকে ফিরল শেড়ি। আমার বিশ্বাস তুমিই এই শহরের শেরিফ; এরা দুজন কি তোমার ডেপুটি?
অবশ্যই না, জোর দিয়ে বলল সে।
দর্শকদের মধ্যে একটা নড়াচড়ার আভাস দেখা গেল; বার্টকে ভিতরে ঢোকার জন্যে দর্শকরা রাস্তা ছেড়ে দিল। বিশাল লোকটা আউটলর দিকে তাকাল বটে, কিন্তু ওর চাহনিতে শেডিকে চেনার কোন চিহ্নই ধরা পড়ল না।
তাহলে এই হচ্ছে তোমাদের ডাকাত সর্দার, তাই না? বলল সে। এটা ঠিক, ওর চেহারাটা যথেষ্ট কুৎসিত। দর্শকদের কিছু লোক ওর কথায় হেসে উঠল। এরফান তীক্ষ্ণ, চোখে শেডির চেহারা লক্ষ করছি-ওর চোখদুটো রাগে জ্বলে উঠতে দেখল। এই লোকটাই সেদিন কাম এগেইন সেলুনের সেই ঝামেলায় জড়িত ছিল, তাই না? তা ঘটনাটা কি?
এরফান যা বলেছিল সেটারই পুনরাবৃত্তি করল শেরিফ। বার বি র্যাঞ্চার এরফানের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ওই চিঠিটা তোমার কাছে আছে?
কাগজটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে দেখল বার্ট। তারপর ওর পরামর্শে বন্দিকে শেরিফের অফিসে নিয়ে ওকে একটা কাগজ আর পেনসিল ধরিয়ে দেয়া হলো। বার্ট চিঠির লেখাগুলো পড়ে গেল, এবং শেডিকে কথাগুলো লিখতে বলা হলোঁলৈখার পরে স্পষ্টই বোঝা গেল যে দুটো লেখায় কোন মিল নেই।
এরফান এগিয়ে গিয়ে চিঠিটা ফেরত নেয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে বলল, ওই চিঠিটা আমার, সুতরাং ওটা আমার কাছেই থাকবে।
আইনত ওটা একটা এভিডেন্স, ত্বাই ওটা শেরিফের ধীছেই থাকবে, বলল বার্ট।
ওর যখন প্রয়োজন হবে সে ওটা চাইলেই ফেরত পাবে। এখন, ওটা আমি ফেরত চাই। ওর স্বরে স্পষ্ট হুমকি।
এক মুহূর্ত ইতস্তত করল বার্ট। মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠেছে। কাগজটা এরফানের হাতে না দিয়ে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলল সে।
তোমার ঔদ্ধত্ব দিনদিন বেড়েই চলেছে, গ্রীন, হিসহিসিয়ে বলল সে, একটা মোকাবিলার দিন ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে।
টেবিল থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে ওটা আসল কিনা নিশ্চিত হয়ে ভাজ করে পকেটে ভরে রাখল এরফান। নিশ্চয়, যেকোন সময়ে, হেসে জবাব দিল। এবং যদি সাহসে কুলায় তবে তুমি তোমার পাসিকে জড়ো করো, আমি নিজে লীড করে ওদের আড্ডায় তোমাদের পৌঁছে দেব।
আমার যদি তোমার সাহায্যের প্রয়োজন হয় তুমি জানবে, বলল বার্ট। যাক, আমি কাল সকালেই মিস মাস্টারসনের সাথে দেখা করে জানব তোমার গল্প কতটা সত্যি।…এই লোকের ব্যাপারে আপাতত তুমি চার্জ নাও, টেলর। ওর কি হবে সেটা আমি পরে তোমাকে জানাব। লেজি এমের কোন লোকের কথায় এখন আমি আর বিশ্বাস করি না।
হ্যাঁ, যখন থেকে তোমার স্পাইরা ওখান থেকে দেশান্তরে গেছে তার পর থেকেই, পাল্টা খোঁচা দিতে ছাড়ল না এরফান।
ওর মন্তব্যে বার্টকে একটু চমকে উঠতে দেখে মনে মনে বেশ আনন্দ পেল এরফান। ওখান থেকে বেরিয়ে নিজের ঘোড়ার পিঠে উঠল সে। শেরিফকে একটা বেকায়দা অবস্থায় ফেলতে পেরেও ওর মন কিছুটা হালকা হয়েছে।
*
বাঙ্কহাউস থেকে একটা সমস্বরে উল্লসিত আওয়াজ ফিলকে বাইরে বারান্দায় এনে হাজির করল। ওখানে দাঁড়িয়েই সে লরিকে সাথে নিয়ে বিজয়ী ফোরম্যানকে উঠানে প্রবেশ করতে দেখল। অল্পক্ষণ পরই বাঙ্কহাউস থেকে হাসির শব্দ আসতে শুনে ফিলের কৌতূহল চরমে উঠলেও ড্যানিয়েল না আসা পর্যন্ত পুরো সংবাদটা শোনার জন্যে ওকে অপেক্ষা করতে হলো। কিন্তু সব শোনার পরেও সে বুঝে উঠতে পারছে না জেমস সম্পর্কে ও কি ভাবকে। মাত্র একজন লোকের পক্ষে কি এভাবে ডাকাতদের ডেরায় ঢুকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসা সম্ভব। শুধু তাই নয়, ওদের সর্দারকে ধরে নিয়ে আসা-একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। শেষে বিরক্ত হয়ে চিন্তাটা বাদ দিল সে।
পরদিন সকালে লরির ডাকে অদ্ভুত একটা লজ্জা-জড়িত হাসি মুখে সাড়া দিল ফিল। মেয়েটা রাইডে যাবে কিনা জানতে এসেছে সে। লরি অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসায় সে যে খুব খুশি হয়েছে বলার পর সে জানাল আজ আর বেড়াতে বেরোবে না ও।
মেয়েটাকে তাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনাবার জন্যে অস্থির হয়ে আছে লরি। আমরা আজ দক্ষিণে বেড়াতে যেতে পারি, প্রস্তাব দিল সে।
না, আজ আমার কাছে একজন অতিথি আসার কথা।
জবাব শুনে লরির মুখটা চুপসে গেল।
মর্নিং, ফিল, ওই বাচ্চাটা কি চায়? ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে নামতে বলল বার্ট।
মেয়েটার কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। বার্টের গলার সুর বা সম্বোধন, কোনটাই ওর পছন্দ হয়নি। ওর মানসিক তুলনামূলক বিচারে তরুণ লরির থেকে বয়স্ক কঠিন বার্টের স্থান অনেক নিচে।
ও আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিল আমি আজ বাইরে যাব কিনা; আজকাল বাইরে যতে হলে আমাকে একজন সঙ্গী নিয়ে যেতে হয়-এই এলাকায় এখন মেদের জন্যেও একা বাইরে যাওয়া আর নিরাপদ নয়। একটু কড়া সুরেই জবাব দল ফিল। এর পর ব্ল্যাক মাস্কদের সাথে ঝামেলা হওয়ার কথা জানাল। প আরও বলল, তাহলে বুঝতেই পারছ, লরির ভাষায়, ঝামেলা যখন আসে, দল বেঁধেই আসে।
কাউবয়ের সাথে ওকে প্রথম নামে ডাকার মত ঘনিষ্ঠতা হতে দেখে বার্টের ভুরতে একটু ভাঁজ পড়ল। এই সম্ভাবনাটার কথা তার একবারও মাথায় আসেনি।
তাহলে গল্পের ওই অংশটা অন্তত ঠিক, মন্তব্য করল সে। ও, ভাল কথা, শোনো ফিল, এভাবে তোমার সাধারণ কাউবয়ের সাথে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানো আমি পছন্দ করি না।
তীব্র প্রতিবাদে ফিলের চোখদুটো জ্বলে উঠল। রাগের সাথে সে বলল, আমার যেমন ইচ্ছা তা-ই আমি করব। আমাকে নির্দেশ দেয়া বা আমার কোন সমালোচনা করার কোন অধিকার তোমার নেই।
আমার বিশ্বাস তা আমার আছে, বলল সে। তুমি জানো আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি।
সেটা আমি জানি না, এবং অন্তত বর্তমানে, আমার তেমন কোন ইচ্ছে নেই, পাল্টা জবাব দিল ফিল।
যদিও স্পষ্ট বুঝতে পারছে ভুল পদ্ধতিতে এগিয়েছে সে; তবু সেটা শুধরে নেয়ার চেষ্টায় বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দিল বার্ট। কিন্তু ফিল সরাসরি তা নাকচ করে দিল। খেপা একটা রাগে জ্বলতে জ্বলতে লেজি এম ত্যাগ করে বার বির ট্রেইল ধরল সে।
বার বিতে যাওয়ার পথ খোলা রেঞ্জ পার হয়ে সোজা উত্তর-পশ্চিমে এগিয়েছে; তারপর ঢাল বেয়ে কিছুটা নিচে নেমে জংলা কিছু ভাঙাচোরা অঞ্চলে ঢুকেছে। ওই এলাকাটা সিঙ্গ নামেই বেশি পরিচিত। ছোট ছোট ঝোঁপের জঙ্গল আর ক্যানিয়নের কাঁধগুলো কখনও সমতল জমির চেয়ে উঁচুতে ওঠেনি বলেই এর নাম সিঙ্ক। একটা ছোট ক্যানিয়নের মুখ পার হওয়ার সময়ে বার্ট লক্ষ করল বালুর ওপর একটা ঘোড়ার ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে। ট্র্যাকটা নতুন নয়, ওটা হয়ত একটু আড়ালে থাকাতেই এতদিন কারও চোখে পড়েনি। কৌতূহলী হয়ে ওটা অনুসরণ করল সে। ঝোঁপের ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে ওকে এগোতে হচ্ছে।
দুশো গজ দূরে একটা ছোট ক্লিফের ধারে ঘন ঝোঁপের ভিতরে ঢুকেছে ওটা। র্যাঞ্চার ঘুরতে যাচ্ছে, এই সময়ে ঝোঁপের পাতার ভিতর থেকে একটা চকচকে ঝিলিক ওর নজর আকর্ষণ করল। নিচে নেমে সে পাতা সরিয়ে একটা। ছোট খাজ থেকে ওটা বের করে আনল। দেখল কিছু কাপড় আর একটা সমব্রেরো আছে ওখানে। শার্টের চকচকে বোতামটাই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। একটা একটা করে সবগুলোই খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখল সে। ওই হ্যাটের ব্যান্ডে কালি দিয়ে লেখা রয়েছে দুটো অক্ষর-জে, এম। শার্টের পকেটে একটা খালি খাম পাওয়া গেল যেটার ওপর ঠিকানা লেখা আছে, জ্যাক মাস্টারসন, লেজি এম র্যাঞ্চ।
এই নতুন আবিষ্কারে আশ্চর্য হয়ে একটা শিস দিয়ে উঠল বার্ট। এই জামা কাপড়গুলো এখানে কিভাবে এলো? শেষ যেদিন সে জ্যাককে দেখেছে সেদিন এইসব জামাই তার পরনে ছিল। কিন্তু এগুলো এই নিভৃত স্থানে এলো কিভাবে? লাশটা কোথায়? এখন আর তার মনে কোন সন্দেহ নেই যে জ্যাক মৃত। পুরো ক্যানিয়নটা সে তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাশের কোন হদিস দেখতে পেল না।
আমার আগে এখানে কেবল একটা লোকই এসেছে, আপন মনেই মন্তব্য করল সে। বালুতে আর কোন ছাপ ওখানে নেই।
সবদিক বিচার করে সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে খুনী আর কোন জায়গায় ওকে হত্যা করে কবর দিয়ে ওর জামা-কাপড় এই জায়গায় ফেলে গেছে। কেবল একটা ঘোড়ার পায়ের ছাপই ওখানে দেখা যাচ্ছে; এবং সেই ঘোড়াটাই আবার ফিরে গেছে। কাপড়গুলো এমন জায়গায় ফেলে গেছে, কারও এগুলো খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ওগুলো যেখানে পেয়েছিল সেখানেই আবার রেখে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে সে আবার নিজের র্যাঞ্চের পথ ধরল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার ঠোঁটে সাফল্যের একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল।
এর চেয়ে ভাল আর হতে পারত না। আমার বিশ্বাস, তোমাকে আমি জীবিত অবস্থায় যেমন ব্যবহার করেছি, নিহতও তেমনি ব্যবহার করতে পারব, মিস্টার মাস্টারসন। হাসল সে।
সেই রাতে ডোভারের সাথে লম্বা সময় ধরে আলাপ করল র্যাঞ্চার। ডোভার যখন আলাপ সেরে ফিরল তখন ফোরম্যানের তিক্ত চেহারাতেও হাসি দেখা গেল, কিন্তু হাসিটা কুৎসিত।
Leave a Reply