সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস – আহমদ ছফা
[রচনাকাল ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল। ১৯৭৯ সালে লেখাটি প্রথম বাংলাবাজারস্থ বুক সোসাইটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়। এই রচনাটিকে ওই একই সালে বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসের পরবর্তী সংস্করণও বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। তৃতীয় সংস্করণটি ১৯৯৬ সালে প্রতিপক্ষ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। ইতোমধ্যে কোলকাতার ইসলামী পাবলিকেশন্স সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসের একটি পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্করণও প্রকাশ করেন।]
উৎসর্গ
পিতৃপ্রতিম উলানিয়ার পুণ্যশ্লোক মরহুম আরিফ চৌধুরী
এবং
অবহেলিত জ্ঞানতাপস অজাতশত্রু ইতিহাসবেত্তা প্রফেসর আগা মাহদী হুসেইন
এই দুই মহান ব্যক্তির নামে এই অপরিপাটি গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হলো।
পরিচায়িকা
সমগ্র ভারতে এবং পাকিস্তানের অংশ বিশেষে ১৯৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহ শতবার্ষিকী পালন করা হয়েছিল, ঘটনাবহুল সভা-সমিতি ও উৎসবানুষ্ঠানের মাধ্যমে। তখন বহু ঐতিহাসিক সিপাই যুদ্ধের বিভিন্ন দিকের উপর আলোকপাত করে জনপ্রিয় ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও বইপত্র লিখেছিলেন শতবার্ষিকীর বৎসরটিকে উজ্জ্বলভাবে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে। তাঁদের মধ্যে অনেকের ধারণা ছিল, সিপাই যুদ্ধ ছিল ভারতবাসীদের জন্য একটি ব্যাপক স্বাধীনতা সংগ্রাম অথবা একটি সুসংহত জাতীয় আন্দোলন। অন্য এক দল ঐতিহাসিকের মতে এই বিদ্রোহ মূলতঃ একটি সামরিক অভ্যুত্থান, নতুন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার আওতায় এসে যাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, সেই অপরিতৃপ্ত রাজা, মহারাজা ও জমিদারশ্রেণী এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ অথবা শ্ৰেণীস্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিলেন। পরস্পর বিরোধী এইসব মতামতের যথার্থ বিচার না করেও বলতে চাই, তখন আমার মনে হয়েছিল এবং এখনো মনে হয়) উপরোক্ত দু’ধরনের অভিমতের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা প্রশ্রয় পেয়েছিল; নইলে উপমহাদেশের খ্যাতনামা ঐতিহাসিকগণ বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে এবং বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে সিপাই যুদ্ধ সম্বন্ধে মতামত প্রকাশের জন্য অতটা আগ্রহ কেন দেখিয়েছিলেন? ইংরেজ শাসন অবসানের মাত্র দশ বছর পর ঐতিহাসিকদের তরফ থেকে ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়ত বা স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম যে, তখনকার দিনের পূর্ব-পাকিস্তানের সিপাই বিদ্রোহের উপর কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ অথবা প্রবন্ধ লেখা হয়নি। আজো এ-কথা ভেবে অবাক হতে হয় যে, যে দেশে মাতৃভাষার জন্য রক্তপাত হয় এবং সুদীর্ঘ ২৭ বছর ধরে ২১শে ফেব্রুয়ারি শোকদিবস হিসেবে গতানুগতিকভাবে উদযাপিত হয়, সেই দেশে ঐতিহাসিক ও দার্শনিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে বাংলা ভাষায় কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থ অথবা জনপ্রিয় গ্রন্থ লেখা হয়নি। আমাদের দেশের লেখক ও গবেষকদের সাম্প্রতিক এই বন্ধ্যাত্বসূচক মানসিকতা ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের চেয়েও বেশি শোকাবহ। কেননা সেই রক্তের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার অফুরন্ত সম্ভাবনা ছিল; আর লেখক ও গবেষকদের সাম্প্রতিক মানসিক পঙ্গুতা প্রমাণ করছে যে, সেই সম্ভাবনা প্রায় তিন যুগের মধ্যেও বাস্তবে পরিণতি পায়নি। ইতিহাস ও দর্শনের ব্যাপক অনুশীলন ছাড়া কোন ব্যক্তি বা সমাজ মানসিক পরিশীলন অর্জন করতে পারে না- সভ্যজীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। সেই জন্য ইতিহাস বা দর্শনের বিশেষ অংশের উপর বাংলায় লেখা যে কোন চলনসই গবেষণাগ্রন্থ অথবা জনপ্রিয় পুস্তকের আবির্ভাব নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য।
সিপাই বিদ্রোহের গুরুত্ব আধুনিককালের ইতিহাসে অপরিসীম। শাসিত ও শাসক উভয়েই এই ঘটনা থেকে বিশেষভাবে শিক্ষা নিয়েছিল। বিদ্রোহের চুড়ান্ত পর্যায়ে ভারতের ইংরেজ শাসনের মেরুদণ্ড প্রায় নুয়ে পড়েছিল। সেইজন্য বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্যাপক প্রশাসনিক পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল এবং এই পরিবর্তিত ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ভারতে ইংরেজ শাসনের যে অধ্যায় রচিত হল তা বিভিন্ন কারণে বিশিষ্ট; তা ইংরেজ রাজত্বের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। বিদ্রোহের শেষে শাসিতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বুঝতে পারল যে ইংরেজ শাসন টিকে গেছে; অতএব শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পশ্চিমের ধ্যান-ধারণাকে স্বাগত না জানিয়ে আর উপায় নেই। উনিশ শতকের শেষার্ধে তাই ভারতের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকাল।
সিপাই বিদ্রোহ জাতীয় ঘটনার উপর লেখা ইংরেজি গ্রন্থ অসংখ্য, কিন্তু বাংলা লেখা বই প্রায় নেই বললেই চলে। আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক শূন্যতার ক্ষেত্রে যেখানে বাংলায় ইতিহাসচর্চা অত্যন্ত নিরুৎসাহজনক পর্যায়ে বিষয়বস্তুর গুরুত্বের জন্যও আহমদ ছফার এই রচনাটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আহমদ ছফা সৃজনশীল লেখক, কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে বহুদিন আগেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের উপর লেখা তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ব্যাপক ইতিহাস আলোচনার ভিত্তিতে রচিত গ্রন্থ হিসেবে ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসই তাঁর প্রথম রচনা। এ-গ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে ঘটনার ধারাবাহিকতা চিহ্নিতকরণের প্রয়াস এবং সর্বোপরি লেখকের অনুসন্ধিৎসু মন। তাঁর ভাষার সাবলীল গতি লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারা যায়, এ-ভাষা এসেছে কোনো সৃষ্টিশীল শিল্পীর লেখনী থেকে। লেখক নিষ্ঠার সঙ্গে বহু প্রামাণ্য গ্রন্থ পড়ে রচনাটির জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
গ্রন্থের ভালমন্দের বিশদ আলোচনা এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার উদ্দেশ্য নয়। সে ভার সাধারণ পাঠক ও বিশেষজ্ঞদের উপর ছেড়ে দিয়ে শুধু এই কথা বলতে চাই যে, এ গ্রন্থ আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য সংযোজনা এবং আহমদ ছফার নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
মমতাজুর রহমান তরফদার
অধ্যাপক, ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২২শে অক্টোবর ১৯৭৯
ঢাকা
স্বীকারোক্তি
আমার যৌবনধর্মের অপরাধের প্রমাণ এই গ্রন্থ। বিএ পরীক্ষা দেয়ার পর পরই এ গ্রন্থ লিখতে প্রবৃত্ত হই এবং শেষ করতে একটানা দু’বছর লেগে যায়। আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক শ্রী সত্যেন সেনের মহাবিদ্রোহের কাহিনী পড়ার পর এই বিষয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখার আকাক্ষা মনে প্রথম জাগ্রত হয়। তার আগে মরহুম আরিফ চৌধুরী সাহেব বার বার এ বিষয়ে আমাকে কিছু লিখতে উপদেশ দেন। সে যাক, সত্যেন বাবুর অনুপ্রেরণায় আমার আকাঙ্ক্ষাটিকে কাজে রূপ দেয়ার পাকা সংকল্প গ্রহণ করি। প্রকাশ ভবনের স্বত্বাধিকারী জনাব আবদুল হক। লিখিতব্য গ্রন্থটি প্রকাশ করবেন আশ্বাস দেন এবং যে পরিমাণ অর্থ না পেলে দু’বেলা অন্নসংস্থান করে দীর্ঘ একটি গ্রন্থ লেখার কাজে দীর্ঘকাল একটানা লেগে থাকা সম্ভব নয়, তার একটা অংশ সময়ে সময়ে তিনি আমাকে সরবরাহ করেছেন। সেই সময়ে এই গ্রন্থের নামকরণ করেছিলাম ‘মহাজাগরণ’। মলাট ইত্যাদিও আঁকাজোকা হয়ে গিয়েছিলো। তারপরে কি কারণে জানি না হক সাহেব পাণ্ডুলিপি প্রেসে দিতে দেরী করলেন।
তখন অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। গল্পকার, উপন্যাসিক, কবি, প্রবন্ধ লেখক হওয়া এবং গরম বক্তৃতা দেয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলে যে লিখিত গ্রন্থটির প্রতি আমি সব রকমের অনুরাগ হারিয়ে ফেলি। এরই মধ্যে প্রায় দেড় বছর সময় চলে যায়। মাঝখানে একবার হক সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানালেন যে তাড়াতাড়ি পাণ্ডুলিপিটি প্রেসে পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন। আমি তখন বেঁকে বসলাম। তাকে বললাম, ইতিহাস বিষয়ে আমার মতো অশিক্ষিত একজন লোকের লেখা অতোবড়ো একটি বই দেখলে আমার সাহিত্যিক বন্ধুরা হয়ত আমাকে ঠিশারা করবেন। আরো একটা ভয় আমার ছিলো। এ রকম জমকালো বিষয়ে গম্ভীর একখানি কেতাবের লেখক জানলে লোকে আমার লেখা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, অন্যান্য রচনা পড়বে না। আমাদের দেশের পণ্ডিতদের লেখার প্রতি সাধারণ মার্জিত রুচির পাঠকদের একটা ভীতি এবং একটা অনীহার কথা আমি জানতাম। পাছে এ বইয়ের লেখক জেনে আমাকে পণ্ডিত মনে করে লোকে, সে আকাক্ষা করে প্রস্তাব করেছিলাম, হক সাহেব তাঁর নিজের নামে অথবা তাঁর স্ত্রীর নামে নিদেনপক্ষে তাঁর পরলোকগত পিতৃদেব কিংবা শ্বশুর সাহেবের নামে এ গ্রন্থ যদি প্রকাশ করেন আমার। কোনো আপত্তি থাকবে না, বরং সানন্দে স্বীকৃতি জানাবো। সেটিও ঘটেনি।
তারপরে প্রায় দশ বছর কেটে গেছে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে দুটি বছরের কঠোর বিরতিহীন পরিশ্রমে আমার কলম থেকে একটি ইতিহাসগ্রন্থ জন্ম নিয়েছিলো। প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমার সঙ্গে হক সাহেবের দেখা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো সময় তিনিও আমাকে কিছু বলেননি। এরই মধ্যে একদিন, আজ থেকে প্রায় ছ’মাস আগে হক সাহেব কথায় কথায় আমাকে জানালেন, আমার ইতিহাস বইটি ছাপতে তার অনেক টাকা খরচ হবে। উপস্থিত মুহূর্তে অতো টাকা তাঁর নেই। আমি যদি অন্য কোনো প্রকাশক কিংবা বাংলা একাডেমী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে বইটি ছেপে বের করতে পারি, তাহলে তিনি পাণ্ডুলিপিটি ফেরত দিতে রাজী আছেন। জন্মান্তরের স্মৃতির মতো আমার মনে ভেসে উঠলো এক সময়ে দৈনিক আট নয় ঘণ্টা খেটে দু’বছরে একখানা ইতিহাস লিখেছিলাম। অতীতের প্রতি একটা আকর্ষণ তো সকলেরই থাকে।
মুখ্যতঃ সে কারণে আমি পাণ্ডুলিপিটি কৌতূহলবশত দেখতে চাইলাম। তিনি দিন দশেক বাদে আমাকে পাণ্ডুলিপিটি প্রত্যর্পণ করলেন। দেখি জায়গায় জায়গায় উই পোকা পাণ্ডুলিপিটি কেটে ফেলেছে। প্রথম দিকের পৃষ্ঠাটি এবং শেষদিকের অনেকগুলো পাতা এই পাণ্ডুলিপিভুক কীটদের উদরে চলে গেছে। ভারী ব্যথা পেলাম।
এখানে সেখানে পড়ে দেখি যে বেশ ইতিহাস ইতিহাস একটা গন্ধ বইটার আছে। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে দেখাই। তারাও আমার সঙ্গে একমত হলেন। কেউ কেউ বললেন যে আমাদের এই বাংলাদেশে সিপাহী যুদ্ধের ওপর বাংলা ভাষায় লেখা একখানিও বই নেই। ছাপলে পণ্ডিতদের না হোক সাধারণ আগ্রহী পাঠকদের চাহিদা পূরণ করবে। এতোসব শুনে বাংলা একাডেমীর শরণাপন্ন হলাম। একাডেমী কর্তৃপক্ষ জানালেন যে, তারা আমার বই গ্রহণ করলেও কবে ছাপা হবে সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দিতে অপারগ। দশ বছরও লাগতে পারে আবার কমও লাগতে পারে কিংবা বেশিও লাগতে পারে। নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। পাণ্ডুলিপিটির যে মুমূর্ষ অবস্থা, ছ’মাসের পরমায়ু সম্বন্ধে আমার সন্দেহ ছিলো। কি আর করবো। ভারী বুক নিয়ে ফিরে এলাম।
এর অব্যবহিত পরে বাড়িতে ডাকাত পড়ার মতো কিছু টাকার প্রয়োজন আমাকে প্রায় ক্ষিপ্ত করে তোলে। উপায়ান্তর না পেয়ে পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে আমার বন্ধু বুক-সোসাইটির স্বত্বাধিকারী মোস্তফা কামালের কাছে গিয়ে মৃত্যু পরোয়ানার মতো হাজির হই এবং সরাসরি দাবি করে বসি যে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে এবং পাণ্ডুলিপিটি অবিলম্বে ছেপে বের করতে হবে। তাঁর সম্পর্কে অধিক বলবো না। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি এ কারণে যে এরকম একজন বন্ধু আমার আছেন। তারপরে আর কোনো কথা নয়, দু’মাসের মধ্যে দশ বছর আগের লেখা পাণ্ডুলিপি কীট সহবাস পরিত্যাগ করে নতুন মোড়কে দিনের আলোর মুখ দেখলো। এরকম অবিশ্বাস্য কাণ্ড এই যুগে ঘটতে দেখলে কার না আনন্দ হয়!
সহৃদয় রম্য-সাহিত্যিক জনাব লুৎফর রহমান সরকার সাহেব এই গ্রন্থটি ছাপা হওয়ার সময়ে আমাকে এক হাজার টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করেছেন। কল্যাণীয়া লুতফা হাসিন রোজী কীটদষ্ট প্রথম পৃষ্ঠা এবং শেষের ক’টি পৃষ্ঠা পুনরুদ্ধার করার কাজে সাহায্য করেছে। কল্যাণীয় মহিউদ্দিন প্রথম একশো পৃষ্ঠার নির্ঘণ্ট তৈরি করে দিয়েছে। শ্রদ্ধেয় ডঃ নাজমুল করিম মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি অধ্যায় দীর্ঘ রাত্রি ধরে আমাকে দিয়ে পাঠ করিয়ে শুনেছেন এবং এতে মনে করেছি দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম কিছুটা যেনো হাল্কা হয়েছে। কবি আসাদ চৌধুরী অনুগ্রহ করে মলাটের পেছনের পৃষ্ঠার গ্রন্থ পরিচিতিটি লিখে দিয়েছেন। ধীমান ইতিহাসবিদ ডঃ মমতাজুর রহমান তরফদার পরিচায়িকা লিখেছেন এই বইয়ের। এটা তার স্বভাবসঞ্জাত উদারতা, গ্রন্থের কোনো গুণ নয়। চেনা জানা কতো মানুষ যে সাহায্য করেছেন, সকলের নাম উল্লেখ করার ক্ষমতা আমার নেই। সকলের কথা বলে শেষ করতে পারবো না।
আহমদ ছফা
১০৭, আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২২ শে অক্টোবর, ১৯৭৯
ঢাকা।
তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা
এই গ্রন্থটা লিখেছিলাম দেশ স্বাধীন হবার আগে। ছাপা হয়েছিলো ষোল বছর পর। এ-সময়ের মধ্যে বইটির দু’টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। কোলকাতায়ও বইটির একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। নতুন করে বইটি ছাপার প্রাক্কালে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা শুরু করেছিলাম একটি বাক্য দিয়ে আমার যৌবনধর্মের অপরাধের প্রমাণ এই গ্রন্থ। লিখেছিলাম বিএ পাশ করার আগে। মাঝে মাঝে বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার আকাঙ্ক্ষাও জেগেছিলো। কারণটা স্পষ্ট করে বলি, বর্তমানে অতো অমানুষিক পরিশ্রম করে এ রকম একটি রচনা লেখার ক্ষমতা আমার হবে না। তা ছাড়া যদি লিখতেই হতো আমি সিপাহী যুদ্ধের আনুপূর্বিক ঘটনা বর্ণনা করার বদলে সিপাহী যুদ্ধের কতিপয় কুশীলবকে নিয়ে একটি ভিন্ন রকমের গ্রন্থ রচনা করতে চেষ্টা করতাম।
দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ্ থেকে শুরু করে যে-সমস্ত রাজা মহারাজা তাঁদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেপাইদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে নতুন কথা বলার অবকাশ নেই। তাঁরা পরাজিত হবার জন্যই লড়াই করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানে দীক্ষিত, আধুনিক মননে সমৃদ্ধ, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বৃটিশ বাহিনীকে মুখোমুখী যুদ্ধে পরাজিত করার মানসিক শক্তি এবং সামরিক পারঙ্গমতা ভারতীয় সামন্ত সমাজের প্রতিভূ রাজা মহারাজ- নওয়াব-দিল্লীর সম্রাট কারো ছিলো না।
ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁটিয়ে অনুসন্ধান করলে সিপাহী যুদ্ধের ওপর তথ্যের পাহাড় গড়া যায়। অনেক অকথিত কাহিনীও প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু সেই সত্যটির ব্যত্যয় কখনো ঘটবে না। সামন্ত প্রভুরা পরাজিত হবার জন্য যুদ্ধের দায়দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন। সিপাহী যুদ্ধের নায়কদের একের পর এক পরাজয়ের করুণ স্মৃতি মনকে বেদনা ভারাক্রান্ত করে এ কথা সত্য বটে, কিন্তু এ সামন্তদের থেকে শ্রদ্ধা করার মতো একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না একজন ব্যতিক্রম ছাড়া।
আসলে ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ইত্যাদি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে দখল করে তাদের সাম্রাজ্যের অংশ করে নিয়েছিলো, বৃটিশের ভারত অধিকার তার একটা পর্যায়কে সূচিত করে মাত্র। ভারতবর্ষ যদি ইংরেজরা দখল না করতো তাহলে ফরাসিরা ভারতবর্ষে অধিকার বিস্তার করতো।
ভারতীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে যাঁরা বৃটিশের সৈন্যকে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন প্রায় সকলেরই মর্মান্তিক পরাজয় বরণ করে নিতে হয়েছে। একমাত্র সে সকল রাজন্যবর্গই টিকে থাকতে পেরেছেন যাঁরা বৃটিশের দাসত্ব কবুল করে নিয়েছিলেন। মহীশূরের শার্দুল টিপু সুলতানই ছিলেন একমাত্র সম্মানজনক ব্যতিক্রম। তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইংরেজের সাফল্যজনকভাবে প্রতিরোধ করে আসছিলেন, তার প্রধান কারণ টিপু সুলতান আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন নরপতি ছিলেন। তিনি আধুনিক যুগের মর্মবাণী অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং রাষ্ট্র নায়কের আধুনিক ভূমিকা কি হওয়া উচিত মোটামুটি সে সম্পর্কেও একটা স্পষ্ট ধারণা তার ছিলো। তিনি নতুন শাসনপদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন, অর্থনীতির নতুন বিলিবন্টন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, সেনাবাহিনীকে ইউরোপীয় ধাঁচে ঢালাই ও সুশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। এ সকল কারণেই টিপু সুলতান দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইংরেজ শক্তিকে সাফল্যজনকভাবে প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন। টিপু সুলতানকে পরাজিত করে মহীশূর দখল করার জন্য বৃটিশের মতো বিশ্বের একটি প্রথম শ্রেণীর শক্তিকে তাদের মিত্র রাজন্যবর্গের সহায়তা সত্ত্বেও যথেষ্ট রকম বেগ পেতে হয়েছে। ছল-বল কল-কৌশল সব কিছু একযোগে প্রয়োগ করে টিপু সুলতানকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিলো। টিপু সুলতানের পরাজয় মহৎ পরাজয়। তাঁর আত্মদানের ট্র্যাজিক মহত্ব কোনোদিন ম্লান হবার নয়।
২.
সিপাহী যুদ্ধের কতিপয় কুশীলবের প্রতি আমার মনে এমন এক ধরনের শ্রদ্ধা ঘনীভূত হয়েছে। যদি সময় এবং সুযোগ থাকতত এই মহান চরিত্রসমূহের গুণকীর্তন করে আমি আরেকটা নতুন বই লিখতাম এবং বর্তমান গ্রন্থটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিতাম। সিপাহী বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনাকার আজিমুল্লাহর জীবনের ঘটনাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তুলে ধরতাম। এ অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিটির জন্ম অভিজাতকুলে নয়। পাঁচক হিসাবেই তিনি জীবন শুরু করেছিলেন। তারপর নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখে সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তিনি নানা সাহেবের উপদেষ্টার আসন অলংকৃত করেছিলেন এবং নানা সাহেবই তাঁকে তাঁর পক্ষে ওকালতি করার জন্য বিলাতে পাঠিয়েছিলেন। বিলাতের অভিজাত সমাজ আজিমুল্লাহকে গ্রহণ করেছিলো এবং মহিলারা প্রিন্স আজিমুল্লাহর প্রতি আসক্তও বোধ করতেন। সমস্ত আকর্ষণ, সমস্ত যোগ্যতা এবং প্রতিভা সত্ত্বেও আজিমুল্লাহ বৃটিশ প্রভুদের মনে তার মনিবের প্রতি অনুকম্পা সৃষ্টি করতে পারেননি। তাই বলে আজিমুল্লাহ ব্যর্থতাকেও মেনে নেননি। তিনি দেশে ফেরার পথে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেটা হলো এই বৃটিশরাও পরাজিত হয় এবং তাদের পরাজিত করা সম্ভবও বটে। বৃটিশকে পরাজিত করা যায় এ মন্ত্র নিয়েই তিনি দেশে ফিরেছিলেন। প্রকৃত প্রস্তাবে সিপাহী যুদ্ধের বীজটি আজিমুল্লাহই বপন করেছেন। সে মহীরুহকে পরিণত করার পেছনে আজিমুল্লাহ যে ভূমিকা পালন করেন, এক কথায় সেটাকে অনন্য বললে যথেষ্ট বলা হবে না। অথচ আজিমুল্লাহর জীবনের পুরো কাহিনী আমরা কেউ জানিনে।
তাঁতিয়া টোপী ছিলেন নানা সাহেবের সামান্য একজন কর্মচারী মাত্র। সামরিক অভিজ্ঞতাও তার ছিলো না। কিন্তু তিনি গেরিলা যুদ্ধের নব নব কলা-কৌশল উদ্ভাবন করে বৃটিশ সেনাবাহিনীকে যেভাবে বারে বারে পর্যদস্ত করেছিলেন তার সবটুকু গৌরব এখনো তাকে দেয়া হয়নি।
একই কথা ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কেও বলবো। রাজকুলে এই মহীয়সী নারীর জন্ম হয়নি; যদিও রাজার সঙ্গে তার পরিণয় ঘটেছিলো। যুদ্ধের সময় এই অসাধারণ তেজস্বী মহিলা যে সাহস কৌশল এবং দেশপ্রেম প্রদর্শন করেছিলেন তা ইতিহাসের এক গর্বের বস্তু।
মাওলানা আহমদউল্লাহও অভিজাতদের কেউ ছিলেন না। তিনি নিতান্তই সাধারণ মানুষের সন্তান এবং নিজেও ছিলেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু যুদ্ধের সময় সেপাইদের যেভাবে সংগঠিত করতে পেরেছিলেন, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও একের পরে এক যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেছেন। সেই কাহিনীও কোনোদিন ভুলে যাবার নয়।
কুমার রাম সিং ছিলেন একজন সামন্ত ভূস্বামী। সিপাহী যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিলো আশি বছর। এ বয়সেও বুড়ো সিংহ সিংহের বিক্রম নিয়ে লড়াই করে গেছেন। নৌকাযোগে গঙ্গা পার হবার সময় বৃটিশ কামানের গোলায় তার ডান হাত অকেজো হয়ে গেলে বাঁ হাতে তলোয়ার ধরে এক কোপে ডান হাত কেটে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, মা গঙ্গা তোমার বুকে আমার দক্ষিণ হস্ত অঞ্জলি দিলাম।
বাবর, আকবর, আওরঙ্গজেব যে বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, প্রায় পাঁচশ বছর স্থায়ী সেই তৈমুর বংশের উত্তরাধিকারীরা কোনো সাহস, কোনো বীরত্ব, কোনো রকম রণচাতুর্য প্রদর্শন করতে পারেনি। একমাত্র শাহজাদা ফিরোজ শাহই ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বাবর-আকবরের বংশের সব মোগল যে কাপুরুষ নয়, একজন তার ব্যতিক্রম আছে এটা শাহজাদা ফিরোজ শাহ্ প্রমাণ করে মোগল বংশকে কিছুটা কলংকের হাত থেকে রক্ষা করে গেছেন।
সিপাহী যুদ্ধের ঘটনাটি ব্যাপ্তিতে এবং গভীরতায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে অতুলনীয়। এই যুদ্ধের গুরুত্ব মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের মতোই ভয়াবহ এবং তাৎপর্য সম্পন্ন। এই যুদ্ধের ফলে ভারতের সামন্ত প্রভুরা ঝাড়ে বংশে ধ্বংস হয়েছে এবং বৃটিশ শাসন সম্পূর্ণরূপে নিষ্কন্টক হয়েছে। বৃটিশ ঐতিহাসিকেরা সিপাহী যুদ্ধ ঘটে যাওয়ার অনেকদিন পর পর্যন্ত এ যুদ্ধকে তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে যখন জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের উন্মেষ ঘটতে আরম্ভ করে ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা সিপাহী যুদ্ধের মধ্যে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগামের উৎস অনুসন্ধান করতে থাকেন। অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করেন এমন ঐতিহাসিকও যথেষ্ট রয়েছেন।
আমি আজিমুল্লাহ, তাঁতিয়া টোপী, ঝাঁসির লক্ষ্মীবাঈ, মাওলানা আহমদউল্লাহ এ সমস্ত সাধারণ মানুষের অসাধারণ পুত্র কন্যাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার উদ্দেশ্যে এ নতুন ভূমিকা রচনা করলাম। সামন্তবাদের জগদ্দল ঠেলে এ অসাধারণ মানুষ মানুষীরা যদি যথার্থ ভূমিকায় অভিনয় করতে পারতেন তাহলে এই যুদ্ধের ইতিহাস ভিন্নভাবে লিখিত হতো।
আমার বন্ধু উবিনীগ প্রধান কবি ফরহাদ মজহার আমার গ্রন্থের এ সংস্করণটি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তারিফ করে তাঁকে বেকায়দায় ফেলা উচিত হবে না।
বিনীত
আহমদ ছফা
১২/১ ময়মনসিংহ রোড
ঢাকা ১০০০
১-২-৯৬
সূচীপত্র
এক. বিদ্রোহের কারণ
দুই. ঘটনা পরম্পরা
তিন. এই সে দিল্লী–এই সে নগরী
চার. কানপুর ও ধাবমান দাবানল
পাঁচ. অযোধ্যা : গজল কাননের অগ্নি-গোধুলি
ছয়. বিহার ও ওহাবী-সিপাহী যুগল সম্মিলন
সাত. ‘মেরে ঝাঁসী নেহী দেওঙ্গী’
আট. অবনমিত রোহিলা ঝাণ্ডা
Leave a Reply