সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান – মাইক জান
০১. মার্লিন এবং ইভান বেকিকে দেখে
মার্লিন এবং ইভান বেকিকে দেখে কিন্তু মোটেই বিজ্ঞানী মনে হয় না। অবশ্য দুর্বল দেহ, সাদা চুল পেছন দিকে উল্টে আঁচড়ানো, কথায় জার্মান টান, গোমড়ামুখো এবং অত্যন্ত পুরু লেন্সের ভারি চশমা পরা হতেই হবে বিজ্ঞানীকে, অমন ধারণা অনেকদিন আগেই পাল্টে গেছে।
মার্লিন এবং ইভান দুজনেই সুদর্শন। বয়েস সবে তিরিশে পড়েছে। দুজনেরই মাথায় বাদামী চুলের গোছা। ইভানের লম্বা চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। ওদিকে স্বামীর চেয়ে অনেক ছোট মার্লিনের চুল, পুরুষালী কায়দায় ছোট ছোট করে ছাটা। চুল ছোটই হোক কিংবা বড়, দেখে মনে হয় আঁচড়ানোর সময় করে উঠতে পারে না কেউই। লাইব্রেরীতে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকার চাইতে বাইরে প্র্যাকটিক্যাল ওয়ার্কই বেশি পছন্দ তাদের।
জুন মাস। ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরাঞ্চলে স্যামন পর্বতমালার পাদদেশ ঘেঁষে ইন্ডিয়ানদের আনাগোনার চিহ্ন। এখানেই কাজ করছে বেকি দম্পতি।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভূতত্ত্ববিদ, আপাতত ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যানলো পার্কের ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্থকোয়েক রিসার্চ-এর হয়ে কাজ করছে।
দুর্গম পার্বত্য এলাকায় একটা ভূমিধসের কারণ অনুসন্ধান করতে এসেছে বেকি-দম্পতি। এলাকাটার বদনাম হয়ে গেছে। ইদানীং প্রায়ই ধস ঘটে এখানে। আর এরই জন্যে নাকি ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। এই ধসের ওপর থিসিস লিখেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট নেবার ইচ্ছে মার্লিন-ইভানের। কাজেই স্যামন-ট্রিনিটি আল্পসের বুনো এলাকা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছে তারা।
পর্বতের উপত্যকা থেকে শুরু করে ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে কনিফারের জঙ্গল। দূর থেকে দেখতে চমৎকার লাগে। বসতিশূন্য বনের ভেতর থেকে ভেসে আসে পাইন-নীডল-এর মাতাল করা গন্ধ। ডানে, আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেছে নহাজার ফুট উঁচু থম্পসন পীক। আরও অনেক নিচে, পর্বতের গা ঘেঁষে ভেসে বেড়ায় মেঘের ভেলা, দৃষ্টিশক্তি চুড়া পর্যন্ত পৌঁছতে দেয় না। এর উত্তর পূর্বে খানিকটা সরে এসে ব্যাটল মাউনটেন। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চোখের সামনে। ওদিককার দিগন্তের অনেক খানিই পাহাড়টার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। দুটো পর্বতের মাঝ বরাবর থেকে রওনা হয়ে উত্তরে ট্রিনিটি সেন্টারের ছোট্ট ইন্ডিয়ান-গ্রামের দিকে এগিয়ে গেছে সাউথ ফর্ক ক্রীক। আগে বসতি ছিল এখানে, কিন্তু ইদানীং ক্রমাগত ভূমিধসের ফলে ভয়ে পালিয়েছে ইন্ডিয়ানরা। এই গ্রামের প্রান্তেই তাঁবু খাটিয়েছে বেকি-দম্পতি।
ক্রীকের দিকে চলে যাওয়া একটা ক্ষুদে নদী পেরিয়ে ইন্ডিয়ানদের পায়ে হাঁটা পথ ধরে কয়েকশো গজ নিচে একটু খোলামত জায়গায় এসে দাঁড়াল মার্লিন আর ইভান। অঞ্চলটা ঢালু। ঘাসে ছাওয়া। থম্পসন ক্রীক এবং ব্যাটল মাউনটেন দুটোই চোখে পড়ে এখান থেকে। মাঝে মধ্যে কানে ভেসে আসছে পশ্চিমা তানাজার পাখির ডাক আর পাহাড়ী ঘুঘুর বিলম্বিত বিলাপ। চলতে চলতে হঠাৎই থেমে দাঁড়াল ইভান। আশেপাশের টিলার এবং নিচে জমির দিকে তাকিয়ে মনে মনে কি অনুমান করে নিল। তারপর কাঁধে ঝোলান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ঠাসা ভারি ব্যাগটা নামিয়ে রাখল পায়ের কাছে। শ্বাস নিল লম্বা করে।
এক্কেবারে আদিম জঙ্গল। বলল সে।
কাঁধের অপেক্ষাকৃত হালকা বোঝাটা নামিয়ে রাখছে মার্লিন।
হুঁ।
আমার ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীতে এসে পড়েছি।
ঠিকই বলেছ। আশেপাশের ঝোপঝাড় আর গাছপালা দেখে এমনই লাগছে। কেমন যেন বেশি নির্জন। কাছে পিঠে লোকবসতির চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না।
এতে একটা ব্যাপারে কিন্তু সুবিধে হয়েছে, পেছন থেকে বৌয়ের কাঁধে হাত রাখল ইভান।
কি? দূরের পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে আছে মার্লিন।
দুকাঁধ ধরে নিজের দিকে ফেরাল ইভান বৌকে, কেউ ডিস্টার্ব করবে না আমাদের।
এটা কি নতুন নাকি? স্যান আন্দ্রিজের উত্তর ধার ঘেঁষে বসালাম বাইশটা সেন্সর, ট্রিনিটি ফল্টে আঠারটা। কিন্তু কোনটা বসানোর সময়ে ডিস্টার্ব করল লোকে? লোকের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, সেন্সর বসান দেখতে আসবে। আসলে একঘেয়ে কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে মার্লিন।
সেকথা বলছি নাকি আমি? মিটি মিটি হাসছে ইভান।
তো কোন ক …! হঠাৎই বুঝে ফেলল মার্লিন কি বলতে চাইছে ইভান। নাহ, তোমাকে নিয়ে পারা যাবে না। এটা একটা সময় হল নাকি, না জায়গা?
খারাপ জায়গা কি? একটু আগেই তো বললে চমৎকার? আর সময়, সেটা করে নিলেই হল। তা ছাড়া প্রাগৈতিহাসিক জায়গায় প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মত প্রেম করব আমরা। ওই নদীটায় গোসল করব, ফাঁদ পেতে ঘুঘু ধরে আগুনে ঝলসে খাব, রাতে ঘুমাব খোলা আকাশের নিচে। ওফ, যা দারুণ জমবে না, নতুন করে হানিমুন করা হয়ে যাবে আরেকবার। বৌকে জড়িয়ে ধরেছে ইতিমধ্যেই ইভান।
আরে আরে দেখে ফেলবে কেউ, ছাড়, ছাড়! স্বামীর আলিঙ্গন থেকে ছাড়া পাবার চেষ্টা করতে লাগল মার্লিন।
কেউ দেখবে না। অবশ্য যদি পাখিরা দেখে ফেললে লজ্জা পাও, তো আলাদা কথা। মুখ নামিয়ে আনছে ইভান।
এর জন্যে এসেছ তুমি এখানে? ধমক লাগাল মার্লিন। ওদিকে কত কাজ পড়ে আছে। উনিশ নম্বর সেন্সরটা বসাতে হবে না? জোর করে নিজেকে মুক্ত করে নিল সে। আগে হাতের কাজ শেষ কর।
বসে পড়ে ব্যাগ খুলতে শুরু করল মার্লিন।
হুঁহ, কাজ আর কাজ। বিড় বিড় করতে লাগল ইভান, ঠিক আছে। উনিশ নম্বরটা বসাই আগে।
উপরের খোপ থেকে চকচকে স্টিলের সিলিন্ডারের মত একটা জিনিস বের করে আনল মার্লিন। লম্বায় দশ ইঞ্চি, বেড় ইঞ্চি পাঁচেক। নিরাসক্ত চোখে বৌয়ের কাজকর্ম দেখছে ইভান। যেন নিতান্তই হতাশ হয়েছে সে।
স্বামীর গোমড়া মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল মার্লিন। হাসল। ওমা, দাঁড়িয়ে আছ কেন এখনো?
তুমি একাই বসাওগে। ইভানের গলায় ঝাঁঝ।
অমন করে না, লক্ষ্য্মী। আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। এস, কাজটা সেরে নিই আগে… স্বামীর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসল মার্লিন।
মনে থাকে যেন… বসে পড়ে ব্যাগ খুলতে শুরু করল ইভান।
ব্যাগ থেকে বের করে একটা বেজ-লোডেড ভি, এইচ, এফ, টেলিমেট্রি অ্যানটেনা লাগাল মার্লিন সিলিন্ডারের ওপর। নিচে লাগাল তিন ফুট লম্বা একটা স্টেনলেস স্টিলের তৈরি প্রোব।
এতগুলো সেন্সর বসালাম, কিন্তু এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল মার্লিন।
কি? ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে ইভান। একটা হ্যাঁন্ড ড্রিলের সাহায্যে মাটিতে ছিদ্র করছে।
এগুলো ভূমিকম্পের পূর্বসংকেত জানাবে কিনা।
জানাবে, জানাবে।
না জানালে কষ্টটাই মাঠে মারা গেল। প্রোবটা ঠিকমত লাগল কিনা পরীক্ষা করে দেখছে মার্লিন।
ছিদ্র করা শেষ হল ইভানের। মাটির গভীর থেকে ড্রিলের ফলাটা তুলে আনল। ফলায় মাটির কণা লেগে আছে। মাটিতে আস্তে করে টোকা দিয়ে ড্রিলের গা থেকে কণা পরিষ্কার করতে করতে বলল, এস, প্রোবটা ঢোকাও গর্তে। দেখ, আরও গভীর করতে হবে কিনা।
এগিয়ে এসে প্রোবটা ছিদ্রে ঢুকিয়ে দিল মার্লিন। ঠিকই হয়েছে। নরম মাটির ওপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সিলিন্ডার আকৃতির সেন্সর রেডিওটা। থির থির করে মৃদু মৃদু কাঁপছে ওপরের অ্যানটেনা।
বেস-এ কল দিয়ে দেখত এবার, নির্দেশ দিল ইভান।
স্যামন-ট্রিনিটি আল্পস ওয়াইল্ডারনেসের উত্তর দিকের প্রান্ত ঘেঁষে একটা ছোট্ট শহর। বেসের জন্যে নির্ধারিত স্থান। শহরের প্রান্তে কয়েকটা তাঁবু ফেলা হয়েছে। গাড়িও আছে গোটা তিনেক। এই নিয়েই বেস। তিনটে গাড়ির একটা ওয়্যারলেস ভ্যান, টেলিমেট্রি ভ্যানও বলা হয় এটাকে। ভ্যানের ছাদ ছাড়িয়ে কয়েক ফুট উঠে গেছে রেডিও অ্যানটেনা। প্রায় একই রকম দেখতে আরেকটা গাড়িতে জেনারেটর বসান হয়েছে। ক্যাম্পে আলো এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি চালানোর জন্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় এখান থেকে। তৃতীয় গাড়িটা একটা আধটনী আর্মি পিকআপ। শহরের ভেতরে চলে যাওয়া ধূলিধূসরিত পথটার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন ঝিমোচ্ছে কিম্ভুত দর্শন গাড়িটা।
রেডিও ভ্যান থেকে বেরিয়ে আসা কতগুলি তার নিয়ে আসা হয়েছে গজ দশেক দূরের একটা ফর্মিকার তৈরি টেবিল পর্যন্ত। যোগ করা হয়েছে টেবিলে রাখা একটা রেডিও ট্রানসিভার, একটা ভ্রাম্যমাণ টেলিফোন এবং একটা রেকর্ডিং সাইসমোগ্রাফের সঙ্গে। ট্রিনিটি ফল্ট এবং তার আশেপাশে বসান সিলিন্ডার রেডিওগুলোর পাঠান সংকেত একটা সরু কাগজের ফিতের ওপর ধরে রাখার কাজ করে এই শেষোক্ত যন্ত্রটা।
টেবিলের সামনে রাখা একটা মেটাল ফোল্ডিং চেয়ারে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে একজন অতি সুদর্শন লোক। বয়েস তিরিশ। নাম স্টিভ অস্টিন।
হাত দুটো পিছনে বাঁকিয়ে, আঙ্গুলগুলো খাঁজে খাঁজে আটকে, দুই তালুর ওপর আরাম করে মাথা রেখেছে অস্টিন। দৃষ্টি, গজ পাঁচেক দূরের একটা ডগলাস ফার গাছের ডালে। ছোট্ট ব্লু বার্ড পাখিটার নাচানাচি দেখছে তন্ময় হয়ে। ওদিকে একটানা গুন গুন করছে জেনারেটর। পেছনের জঙ্গল একেবারে নিস্তব্ধ। প্রকৃতির এই খোলামেলা পরিবেশ দারুণ ভাল লাগছে তার।
লোকবসতি শূন্য খোলামেলা বুনো কিংবা পার্বত্য এলাকা খুবই পছন্দ অস্টিনের। ট্রিনিটি ফল্টে বৈজ্ঞানিক অভিযানের সঙ্গে আসার প্রস্তাবটা তাই লুফে নিয়েছে সে। মাত্র কিছুদিন আগে, এই অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক অভিযানে এসে রহস্যজনকভাবে অচেনা শক্রর হাতে আক্রান্ত হয়েছে দুটো দল। কাজেই এবারের দলটার সঙ্গে দেয়া হয়েছে অস্টিনকে। শত্রুর ওপর নজর রাখার দায়িত্ব তার। এরকমই একটা কাজ চাইছিল অস্টিন মনে মনে। অ্যাডভেঞ্চার খুবই ভাল লাগে তার।
টেবিলে রাখা সাইসমোগ্রাফটার দিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে অস্টিনকে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়ালই নেই। একমনে লক্ষ্য করছে গাছের ডালের অপূর্ব সুন্দর নীল পাখিটাকে।
হঠাৎই যেন পাখিটার মনে হল, যথেষ্ট দর্শন দেয়া হয়েছে নিচের আধশোয়া মানুষটাকে। কোনরকম জানান না দিয়েই ফুড়ুৎ করে উড়াল দিল ওটা। অনেক দূরের একটা গাছে গিয়ে বসল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জীবন্ত হয়ে উঠল টেবিলে রাখা রেডিও। পরিষ্কার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে মার্লিন বেকির।
ট্রিনিটি মোবাইল টু ট্রি নিটি বেস, বলল মার্লিন, শুনতে পাচ্ছো, স্টিভ?
নিরুৎসুকভাবে সোজা হয়ে বসল অস্টিন। আড়মোড়া ভাঙল। তারপর হাত বাড়িয়ে তুলে নিল মাইক্রোফোন। শুনতে পাচ্ছি, মার্লিন। গুড মর্নিং।
মর্নিং, স্টিভ।
তা খবর কি? কোত্থেকে বলছ?
পজিশন নাইনটিন। ট্রিনিটি ফল্ট। লাস্ট সেন্সরটা এই মাত্র বসালাম।
কোন গোলমাল?
না। তোমার ওখানে?
ভাল। ভালই কাজ করছে টেলিমেট্রি। পাঁচ নম্বর সেন্সরটার সঙ্গে টেলিমেট্রির যোগাযোগ মিনিট পাঁচেকের জন্যে বন্ধ হয়ে গেছিল অবশ্য একটু আগে। কিছু না, শর্ট সার্কিট। কি করে যেন এক টুকরো তার খসে পড়েছিল সার্কিট বোর্ডের ওপর। তেমন কিছু না।
ওই পাঁচ মিনিটে তাহলে সেন্সর ফাইভ থেকে কোন সংকেত রেকর্ড করতে পারেনি কম্পিউটার?
না।
খারাপ কথা। যাকগে, যা হবার হয়েছে। একটু থামল মার্লিন, হ্যাঁ, শোন, আমাদের কাজ শেষ।
ভেরি গুড। জলদি ফিরে এস। ডাটা কালেকশন আর ভাল লাগছে না আমার। নদীতে মাছ ধরতে যেতে চাই এবার আমি।
কাজ শেষ বলেছি। ফিরে আসার কথা তো কিছু বলিনি।
ঠোঁট বাঁকাল অস্টিন।
কিন্তু দুদিন হয়েছে গেছে তোমরা। কাজও শেষ বললে। ফিরে আসতে বাধা কোথায়?
হেসে উঠল মার্লিন।
নতুন বিয়ে করেছি আমরা, ভুলে যাচ্ছ কেন?
আরে সেজন্যেই তো আরও বেশি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। কোথায় ক্যাম্পে ফিরে শান্তিতে রাত কাটাবে, না বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। কেমন তরো লোক তোমরা, অ্যাঁ?
ভুল বলছ তুমি। এখানে, জঙ্গলেই তো হানিমুন জমছে, ভাল। কেউ ডিস্টার্ব করছে না।
করছে না, না? হুঁশিয়ার করল অস্টিন, ভুলে যেও না, আমার সামনের রেডিওটা সাংঘাতিক সেনসিটিভ। তোমাদের পজিশন জানা আছে আমার। ইচ্ছে করলেই তোমাদের ওখানকার যে কোন শব্দ, যে কোন ধরনের…বুঝেছ তো? নিখুঁতভাবে ধরতে পারে। কাজেই ডিস্টার্ব করতে অসুবিধে হবে না। হাঃ হাঃ হাঃ…
এখানকার রিসিভার অফ করে রাখব।
এবং সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভূকম্পন সংকেত ধরতে পারবে না। সুতরাং…
অর্থাৎ আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না?
এখন থেকে তোমাদের প্রতিটি নড়াচড়া রেকর্ড করব!…তাতে তোমাদের শান্তি বিঘ্নিত হলে… একটা ধাতব শব্দে থেমে গেল অস্টিন। টেলিমেট্রি ভ্যানটার দিকে চোখ তুলে তাকাল। ভ্যানের ছাদের এক প্রান্তে বসান বিশাল অ্যান্টেনাটা ট্রিনিটি ফল্টের দিক থেকে আসা সেন্সরগুলোর সংবাদ রিসিভ করে রেডিওতে পাঠায় যেটা, একশো চল্লিশ ডিগ্রী কোণ করে বেঁকে গেছে। পড়েই যাবে হয়ত। এক মিনিট, মার্লিনকে বলল অস্টিন, অ্যান্টেনাটা আবার বেঁকে গেছে। কিছুতেই কারণটা বুঝতে পারছি না। ধরে থাক, ঠিক করে রেখে আসছি ওটা।
একটু আগে বললে তেমন কোন সমস্যাই নেই ওখানে! বলল মার্লিন।
এই অ্যান্টেনার গন্ডগোলটা তো গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে। একটু ধর, আসছি আমি।
পরে কথা বলব। ছেড়ে দিচ্ছি এখন।
নীরব হয়ে গেল রেডিও। মাইক্রোফোনটা টেবিলে নামিয়ে রাখল অস্টিন। ঠেলে পেছনে সরাল চেয়ারটা। ঘুরে রওনা দিল টেলিমেট্রি ভ্যানের দিকে।
ভ্যানের পেছনে পৌঁছে চারদিকে একবার দ্রুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিল অস্টিন। এটা তার স্বভাব। কেউ নেই। শরীরের উপরের অংশ সোজা রেখে হাঁটুটা কয়েক ইঞ্চি ভাঁজ করল সে। তারপর আচমকা স্প্রিঙের মত লাফ দিল। হালকা পালকের মত উঠে গেল শূন্যে। তারপর পালকের মতই বাতাসে ভাসতে ভাসতে নেমে এল ভ্যানের ছাদে, মাটি থেকে দশ ফুট উপরে। স্টিভ অস্টিন সম্পর্কে যারা কিছু জানে না, ব্যাপারটা স্বপ্নের মতই মনে হবে তাদের কাছে।
আসলে ঠিকমত বসান হয়নি অ্যান্টেনাটা। কোন শিক্ষানবিশ কারিগর বসিয়েছে হয়ত। খুব কাঁচা হাতে লুব্রিকেট করা হয়েছে। বিয়ারিঙের ঠিক ওপরে অ্যান্টেনার দন্ডটা মুঠো করে ধরল অস্টিন, তার অসামান্য শক্তিশালী বায়োনিক আঙ্গুল দিয়ে। অন্য যে কেউ হলে, দুহাতে চেপে ধরেও এক চুল নড়াতে পারত না ভারি অ্যান্টেনাটা। কিন্তু স্টিভ অস্টিনের কথা আলাদা। সে তো আর দশজনের মত সাধারণ মানুষ নয়।
তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ উঠল। আস্তে আস্তে সোজা হতে শুরু করল অ্যান্টেনা। আবার আগের জায়গায় এসে গেল দন্ডটা। উঠে দাঁড়াল অস্টিন। চোখের সামনে মেলে ধরে তার বায়োনিক আঙ্গুলগুলো দেখল। ইচ্ছে করলে, এই আঙ্গুলের এক মোচড়ে কঠিন ইস্পাতের দন্ডটা ভেঙে দিতে পারে সে। চাই কি, দুআঙ্গুলে টিপে ধরে চ্যাপ্টা পর্যন্ত করে দিতে পারে।
কম্পিউটার না বানিয়ে, আসলে আমার মত আরও কিছু বায়োনিক ম্যান বানান উচিত বিজ্ঞানীদের, ভাবল অস্টিন।
০২. বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য পুনঃসৃষ্টি
বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য পুনঃসৃষ্টি স্টিভ অস্টিন পৃথিবীর প্রথম সফল সাইবর্গ। আধা মানুষ, আধা যন্ত্র। মানুষের স্বাভাবিক স্বভাবচরিত্র, আবেগ প্রবণতা, চিন্তাধারা সবই আছে তার। এর পাশাপাশিই আছে অপরিসীম যান্ত্রিক শক্তি। দৈহিক শক্তিতে তার সমকক্ষ তো দূরের কথা, কাছাকাছিও আসতে পারে এমন মানুষ পৃথিবীতে একজনও নেই। যে কোন রেসের ঘোড়াকে দৌড়ে হারিয়ে দিতে পারে সে, সাঁতারে তার তুলনায় ডলফিন কিছুই না।
জীবন্ত যান্ত্রিক মানুষে পরিণত হওয়ার আগেও স্টিভ অস্টিন কিন্তু আর দশজন সাধারণ মানুষের মত ছিল না। বুদ্ধি ছিল তার অতি প্রখর। খুবই অল্প বয়েসে বিমান চালনা শিখেছে। কলেজে, যে কোন খেলাধুলা বিশেষ করে ফুটবলের যাদুকর বলা হত তাকে। অ্যারোডাইনামিকস, অ্যাসট্রোনমিক্যাল ইনঞ্জিনীয়ারিং এবং ইতিহাস, তিনটে বিষয়েই মাস্টার ডিগ্রী নিয়েছে। লেখাপড়া করার সময়েই কুস্তি শিখেছে, ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছে কারাত এবং জুডোতে। পড়ালেখার পালা সাঙ্গ হতেই যোগ দিয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে, ফাইটার প্লেনের পাইলট হিসেবে।
বেপরোয়াভাবে শত্রু এলাকায় ঢুকে পড়ে একদিন অস্টিন। গুলি খেয়ে জঙ্গলের মাঝে পড়ে যায় তার প্লেন। কিন্তু ধরতে পারেনি তাকে শত্রুপক্ষ। মারাত্মক আহত অবস্থায় কোনমতে মিত্রশিবিরে ফিরে আসে সে। সঙ্গে সঙ্গে পাঠান হয় তাকে আমেরিকায়, হাসপাতালে। সেরে উঠেই অ্যাসট্রোনট ট্রেনিং প্রোগ্রামে যোগ দেবার জন্যে দরখাস্ত করে সে। নির্বাচিতও হয়ে যায়। দু সপ্তাহের ট্রেনিং দেরার পর সোজা তুলে দেয়া হয় তাকে অ্যাপোলো-র কমান্ডার হিসেবে। ১৯৭৩ সালের ৭ই ডিসেম্বর সকাল ১২:৫৩ মিনিটে চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল মহাকাশযান। সাফল্যের সঙ্গে সমস্ত বৈজ্ঞানিক অভিযান শেষ করে ফিরে এল অ্যাপোলো-১৭।
এই অভিযানের ফলে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল অস্টিনের চাঁদে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মাইল দূরের সাদাটে-নীল বলের আকৃতির পৃথিবীর রূপ দেখেছে সে। হঠাই সাংঘাতিক ভালবেসে ফেলেছে এই মাটির পৃথিবীটাকে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে, আর ভিয়েতনামে যুদ্ধের নামে শুধু শুধু মানুষ খুন নয়, বরং এদের রক্ষা করার কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। আর শুধু মানুষই নয়, পৃথিবীর প্রতিটি জীবন্ত প্রাণী, সে কুৎসিত কিলবিলে কেঁচোই হোক আর অপরূপ সুন্দর ব্লু বার্ডই হোক, রক্ষা করায় আত্মনিয়োগ করবে সে।
চাঁদ অভিযানের ফলে মহাকাশ ভ্রমণের নেশায় পেয়ে বসল অস্টিনকে। নাসায় যোগ দিয়ে মহাকাশ এবং মহাকাশযান সম্পর্কিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় সক্রিয়ভাবে সাহায্য করল সে। ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই আকাশযান নিয়ে উড়াল দেয় আকাশে। সাধারণ যান নিয়ে উঠে যায় বিপদসীমার অনেক অনেক উপরে। তার মত দুঃসাহস এর আগে আর কোন পাইলটের মাঝে দেখা যায়নি।
এই সময়ই তৈরি হল H3 F5। এই আকাশযানটার বৈশিষ্ট্য হল, এর কোন ডানা নেই। অস্বাভাবিক দ্রুতগতি সম্পন্ন এই যানটির চেহারা দেখেই আঁতকে উঠল পাইলটেরা। এ কি জিনিস? এটা আকাশে উড়বে কি করে? এ তো বুলেটাকৃতির বিশালকায় কামানের গোলা। জুল ভার্নের কল্পনা (ফ্রম দি আর্থ টু দি মুন বইয়ে অনেকটা এই ধরনের মহাকাশযানেরই কল্পনা করেছেন জুল ভার্ন) কি বাস্তবে রূপ দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন বিজ্ঞানীরা?
ফ্লাইট টেস্ট হবে অদ্ভুত যানটার। কিন্তু মহড়া দিতে এগিয়ে এল না কোন পাইলটই। আসলে সাহসই করল না কেউ। বিশেষ ধরনের একটা কামানের মতই জিনিস মহাকাশে ছুঁড়ে দেবে এই বিশেষ যানটাকে। নির্দিষ্ট পাল্লায় পৌঁছে আবার আপনাআপনি এসে ল্যান্ড করবে যানটা (এভাবেই তৈরি করা হয়েছে একে) আরোহীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। কিন্তু বিশ্বাস কি? কোন কিছুর বিনিময়েই ঝুঁকি নিতে এগিয়ে এল না কোন পাইলট।
তবে কি যানটা তৈরিই বৃথা গেল? বৃথা গেল বিজ্ঞানীদের অত পরিশ্রম, সাধনা? না। হাসিমুখে এগিয়ে এল স্টিভ অস্টিন। গভীর মনোযোগের সঙ্গে বাইরে ভেতরে পরীক্ষা করে দেখল যানটার। তারপর হাসিমুখেই ত্রিকোণ ককপিটে উঠে বসল। বিশেষ কামানের মুখ দিয়ে অতিকায় বুলেটের মত তীব্রবেগে বেরিয়ে গেল স্পেস ক্যাপসুল। উঠে গেল আরও, আরও উপরে। আরেকবার নিচের নীল সাদা পৃথিবী নামক বলটার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকল অস্টিন।
হঠাৎই চমকে উঠল অস্টিন। ধক করে উঠল হৃৎপিন্ড। ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারল গোলমাল দেখা দিয়েছে। নতুন ধরনের ইঞ্জিন। খুব একটা ধারণা নেই জিনিসটা সম্পর্কে অস্টিনের। তবু গোলমালটা কোথায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারল না। পৃথিবীর দিকে ফিরে চলেছে আবার যানটা। এয়ার ফোর্স বেসে ক্রমাগত রেডিও যোগাযোগ করে চলল অস্টিন। কিন্তু নিচে থেকেও নিয়ন্ত্রণ করা গেল না ক্যাপসুলটাকে, আসলে নিয়ন্ত্রণ করার তেমন কোন ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। আঙ্গুল কামড়াতে লাগলেন বিজ্ঞানীরা। ইস, এতবড় ভুল করার কোন মানে হয়! কেন যে আগেই সম্ভাবনাটার কথা ভাবলেন না কেউ।
মাটির কাছে এসে যাচ্ছে ক্রমেই আকাশযান। টেলিভিশনের পর্দায় দেখল অস্টিন নিচে ব্যস্তভাবে ছুটোছুটি করছে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ারবিগ্রেডের গাড়ি ইত্যাদি।
তীরবেগে নিচে নেমে যাচ্ছে ক্যাপসুল। মাটি থেকে মাত্র আর কয়েকশো গজ উপরে আছে। আর মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিল অস্টিন।
নাক নিচের দিকে করে মাটিতে এসে পড়ল ক্যাপসুল। নাকটা ফুট দুয়েক গেঁথে গেল মাটিতে। সাংঘাতিক গতিবেগ সইতে না পেরে পেছন দিকটা বসে গেল। এতে ফুলে গেল বুলেটাকৃতি যানের মাঝখানটা। তারপরই ফেটে গেল। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ল ধাতবদেহ আর যন্ত্রপাতিগুলো। পর পর ঘটনাগুলো ঘটতে বড়জোর আধসেকেন্ড সময় লাগল।
দ্রুত এগিয়ে এসেছে অ্যাম্বুলেন্স আর ফায়ারব্রিগেড ভ্যান। গাড়িগুলোর দরজা খুলে টপটপ নেমে এল কর্মীরা। প্রথমেই ধ্বংস কূপের ভেতর থেকে টেনে বার করল ওর স্টিভ অস্টিনকে।
দুটো পায়েরই উরু থেকে নিচের অংশ গুঁড়ো হয়ে গেছে অস্টিনের। বাঁ হাতটাও শেষ। একটা ধাতুর টুকরোর খোঁচায় বা চোখটা গলে বেরিয়ে গেছে। চাপ লেগে ভেঙে গেছে পাঁজরার কয়েকটা হাড়। ধাতুর চোখা একটা পাত ঢুকে গেছে বুকের ভেতরে, একেবারে হৃৎপিন্ড ঘেঁষে একটা হার্ট ভালভ কেটে দিয়েছে। নিচের চোয়াল গুড়ো হয়ে গেছে। দুই পাটির অধিকাংশ দাঁত নেই। কয়েকটা মারাত্মক ফাটল খুলিতে।
তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে স্টিভ অস্টিনের রক্তাক্ত দেহ নামক মাংসপিন্ডটা।
আশ্চর্যভাবে বেঁচে গেছে স্টিভ অস্টিন। সোজা তাকে নিয়ে আসা হয়েছে বায়োনিক রিসার্চ সেন্টারে। কলোরাডো স্প্রিংয়ের উত্তরে বুকি মাউনটেনে বিপুল টাকা খরচে প্রতিষ্ঠিত একটা টপসিক্রেট সরকারী গবেষণাগার এটা। যদি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে অস্টিন তো এই প্রতিষ্ঠানের দৌলতেই থাকবে। যেরকম মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে সে, পৃথিবীর আর কোন হাসপাতাল কিংবা গবেষণাগারই বাঁচাতে পারবে না তাকে।
দ্রুত কিন্তু গভীর মনোযোগের সংগে অস্টিনকে পরীক্ষা করে দেখলেন বায়োনিক রিসার্চ সেন্টারের নেতৃস্থানীয় ডাক্তার বিজ্ঞানীরা। অদ্ভুত এক চিন্তা স্থান নিল তাদের অতি উন্নত মস্তিষ্ক। তাইতো, এতদিন যা ভাবছিলেন, এই বিশেষ লোকটাকে দিয়েই সেটা কার্যে পরিণত করে দেখার চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়? কিন্তু তার জন্যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। সরকার কি দেবেন? তবু তারা চাইলেন। টাকার অংকের কথা শুনে চমকে উঠলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। একটা লোকের পেছনে অত টাকা ব্যয় করবেন? অনেক ভেবে চিন্তে মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে অবশ্য শেষ পর্যন্ত টাকা দেয়াই স্থির করলেন তিনি।
স্টিভ অস্টিনই হবে পৃথিবীর প্রথম সাইবর্গ-মানুষ আর যন্ত্রের সংমিশ্রণ। পৃথিবীর প্রথম বায়োনিক ম্যান। মানবিক ক্ষমতা আর যন্ত্রের সহাবস্থানে সৃষ্টি হবে এক অতি আশ্চর্য জীব, যে কাজ করবে আমেরিকান ইনটেলিজেন্সের হয়ে।
একটা বিশেষ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের স্পেশাল অপারেশন বিভাগের চিফ অসকার গোল্ডম্যান। বায়োনিক রিসার্চ স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হবার পক্ষে যে কজন ভোট দিয়েছেন, তিনিও তাদের মধ্যে একজন। প্রতিষ্ঠানটা গড়ে ওঠার পর থেকেই একটা বিশেষ আশা মনে মনে পোষণ করে আসছেন তিনি। অভূতপূর্ব ক্ষমতাশালী এবং শক্তিধর একজন বায়োনিক ম্যান যদি তৈরি করা যেত।
গোল্ডম্যানের মনের আশা পূরণ করার জন্যেই যেন স্টিভ অস্টিন-সাইবর্গ তৈরিতে মন দিলেন রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানীরা। খবরটা চাপা থাকল না গোল্ডম্যানের কাছে। একেবারে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। ছুটলেন রিসার্চ সেন্টারে। জ্যান্ত সাইবর্গ কেমন কেমন হলে ভাল হয়, একটা ধারণাও দিলেন বিজ্ঞানীদের।
বায়োনিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান ডঃ রুডি ওয়েলস। নামকরা বিজ্ঞানী। অস্টিনের বিশেষ বন্ধু। গভীর সহানুভূতি আর কৌতূহল নিয়ে কাজে মন দিলেন তিনি। ইলেকট্রোসীপ পদ্ধতিতে ঘুম পাড়ানো হল অস্টিনকে। একের পর এক অজস্র অপারেশন চলল তার দেহে।
প্রথমেই অস্টিনের নষ্ট হয়ে যাওয়া হার্ট ভালভটা বদলে কৃত্রিম হুফনাজেল ভালভ লাগান হল। ভাঙাচোরা খুলি খুলে ফেলে দেয়া হল। তার স্থান নিল সিজিয়ামের তৈরি কৃত্রিম খুলি। ভেতরে বাইরে দুই দিকেই স্পঞ্জ জাতীয় পদার্থের আস্তরণ, ব্রেন এবং চামড়া নষ্ট হবার ভয় রইল না এতে। আসলে একটা সার্বক্ষণিক হেলমেট বসান হয়ে গেল অস্টিনের মাথায়। ভয়ানক রকম আঘাতেও সহজে আর ব্রেনে চোট লাগবে না।
বুকের ভাঙাচোরা রিবগুলো কেটে বের করে নিয়ে আসা হল। তার জায়গায় বসিয়ে দেয়া হল ধাতব অ্যালয়-ভিটালিয়ালের তৈরি রিব। সিলিকন রাবারের তৈরি কৃত্রিম পেশী দিয়ে ঢেকে দেয়া হল বক্ষপঞ্জর। তার আগেই কৃত্রিম রিবের সঙ্গে সূক্ষ্ম তারের অ্যান্টেনা আর অন্যান্য রেডিও-সামগ্রী আটকে দেয়া হয়েছে। অ্যান্টেনার তারটা একটা রিব বেয়ে গিয়ে মেরুদন্ড ধরে নেমে গেছে একটা বায়োনিক পা পর্যন্ত।
সিজিয়ামের সাহায্যেই তৈরি হয়েছে কৃত্রিম চোয়াল, আসল চোয়ালের চাইতে অন্তত দশগুণ বেশি টেকসই। কঠিন নাইলনের তৈরি দাঁত বসান হল এই চোয়ালে। নষ্ট হয়ে যাওয়া বাঁ চোখের অবশিষ্ট বের করে নিয়ে অক্ষিকোটরে বসিয়ে দেয়া হল অতি ক্ষুদে কিন্তু অসাধারণ শক্তিশালী মিনিয়েচার ক্যামেরা লাগান চক্ষুগোলক। পুরোপুরি অন্ধকারেও এই চোখের সাহায্যে দেখতে পাবে অস্টিন। চাইলেই চোয়ালে বসান একটা ক্ষুদে বোতাম টিপে এই ক্যামেরার সাহায্যে যে কোন সময় যে কোন লাইটিং-এ যে কোন জিনিসের ছবি তুলতে পারবে সে। চোখের ভেতরের ক্যামেরাতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রসেসিং হয়ে যাবে ছবি। ইচ্ছে করলে বের করে নিয়ে আসা যাবে ফিল্ম-এই ফিল্মও বিশেষ পদার্থে তৈরি, কোনসময়েই শেষ হবে না। ক্যামেরার ভেতরেই তৈরি হতে থাকবে। একটা ফিল্ম বের করে আনার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে জায়গামত বসে যাবে আরেকটা ফিল্ম। অদ্ভুত সৃষ্টি এই বাঁ চোখটা। অতগুলো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জটিল যন্ত্রপাতির সমাবেশ অথচ বাইরে থেকে দেখে আসল ডান চোখটা থেকে এটাকে আলাদা করে চেনার জো নেই। কেউ ধারণাই করতে পারবে না, এটা একটা বায়োনিক চোখ। শুধু ছবি তোলা আর দেখাই নয় অণুবীক্ষণেরও কাজ করবে এই চোখ। যে কোন জিনিসকে অন্তত বহুগুণ বড় দেখতে পারবে অস্টিন ইচ্ছে করলেই। কোন সুইচ টেপাটেপির দরকার নেই। অস্টিনের কৃত্রিম খুলির ভেতর দিকে বসান আছে কম্পিউটার, ব্রেনের সঙ্গে যোগ আছে এর। অর্থাৎ অস্টিনের ইচ্ছের সঙ্গেও যোগ আছে। সুতরাং সে চাইলেই বিশেষ বিশেষ কাজ করে দেবে কম্পিউটার, তার হয়ে।
অস্টিনের বায়োনিক হাত-পাগুলোও কম বিস্ময়কর নয়। ভেতরের হাড় বিশেষ ধরনের ধাতব অ্যালয় দিয়ে তৈরি, ভাঙা কঠিন। রাসায়নিক পদার্থে তৈরি কৃত্রিম পেশী দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে এই হাড়। অদ্ভুত মিনি জেনারেটর বসান হয়েছে হাড়ের ভেতরে। সারাক্ষণই বিদ্যুৎ তৈরি করতে থাকবে জেনারেটর। ছড়িয়ে দেবে কৃত্রিম পেশীতে। অসাধারণ ক্ষমতা আর শক্তি এসে যাবে পেশীগুলোতে। অস্টিন চাইলেই কম্পিউটার আদেশ দেবে পেশীগুলোকে রেডিওর সাহায্যে। একটা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে যে কোন গতিবেগে দৌড়াতে পারবে অস্টিন বায়োনিক পায়ের সহায়তায় কৃত্রিম বাহুটায় এসে যাবে বায়োনিক শক্তি। আসল হাতের মতই এই বায়োনিক হাতে ডিমের মত ভঙ্গুর জিনিসকেও তুলে নিতে পারবে অস্টিন আবার ইচ্ছে করলে ইস্পাতের ফাঁপা বলকেও চিপে থেতলে দিতে পারবে।
এমনি সব আরও আজব আজব জিনিস আর যন্ত্রপাতি ভরে ভরে অদ্ভুত এক রোবটে পরিণত করা হল স্টিভ অস্টিনকে। শত্রুর জন্যে এক ভয়াবহ ধ্বংসমেশিন। অতসব কাজ শেষ করতে পুরো একটি বছর লেগে গেল। এই একটি বছর হাসপাতালের বিছানায় আর অপারেশন টেবিলে কাটাতে হল অস্টিনকে এবং এই সময়ে প্রায় রোজই এসে অস্টিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছেন গোল্ডম্যান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাহচর্য দিয়েছেন।
স্টিভ অস্টিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেছেন স্পেশাল অপারেশন চিফ অসকার গোল্ডম্যান।
০৩. উনিশ নম্বর সেন্সরটার কাছে
উনিশ নম্বর সেন্সরটার কাছে বসে আছে ইভান বেকি। কাছেই ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে মার্লিন। কোলের ওপর রাখা পোর্টেবল টেস্ট ইকুইপমেন্ট। সেন্সর থেকে আসা সংকেত ধরছে একটা যন্ত্র, সঙ্গে সঙ্গেই রিডিং দিচ্ছে ডায়ালে। ভুরু কুঁচকে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে আছে সে। অবাক হয়ে গেছে।
আরও আধ মিনিট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল মার্লিন, তারপর পুরো সেটটার বিশেষ বিশেষ অংশ পরীক্ষা করে দেখল। নাহ্ যন্ত্রটা তো ঠিকই আছে। তাহলে?
স্বামীর দিকে মুখ তুলে তাকাল মার্লিন, ওয়্যারিংগুলো ঠিকমত করেছিলে?
সেন্সরের অ্যান্টেনা আরও ওপরের দিকে তুলে দিতে ব্যস্ত ইভান। স্ত্রীর দিকে তাকিয়েই পাল্টা প্রশ্ন করল সে, কেন?
ওয়্যারিংগুলো ঠিকঠাক মত করেছিলে কিনা জানতে চাইছি।
নিশ্চয়ই! কিন্তু কেন?
সন্দেহ হচ্ছে আমার!
যন্ত্রটার ওপর আবার ঝুঁকে পড়ল মার্লিন। দক্ষহাতে ডায়ালটা খুলে নিল। টেনেটুনে ওয়্যারিং দেখে নিয়ে শ্রাগ করল। অদ্ভুত রিডিং দিচ্ছে ডায়াল, বলল মার্লিন, আশেপাশেই কোথাও আগ্নেয় গহবর জাতীয় কিছু আছে মনে হচ্ছে?
কি বললে? ফিরে তাকাল ইভান।
হ্যাঁ, তাইই! ব্যাটল মাউনটেনের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল মার্লিন, ওদিকেই কোথাও।
পর্বতটার দিকে তাকাল ইভান। মুখের ওপর খাড়া এসে পড়ছে রোদ। দুহাত কপালের ওপর তুলে আড়াল করে রাখতে হচ্ছে।
আশ্চর্য তো!
অথচ ওদিকে আগ্নেয়গিরি আছে, শুনিনি তো কখনো!
কিন্তু সেন্সরের রিডিং তো ভুল হতে পারে না।
যন্ত্রটায় কোন দোষ নেই তো?
জোরে এদিক ওদিক মাথা দোলাল মার্লিন, ভালমত দেখেছি আমি। কোন গোলমাল নেই।
এক কাজ কর। সেন্সরটার পজিশন জানিয়ে ট্রিনিটি বেস এর টেস্ট ইকুইপমেন্টে রিডিং দেখতে বল তো অস্টিনকে। শোনা যাক কি রিডিং পাচ্ছে ও।
মাইক্রোফোনটা তুলে নিল মার্লিন। রেডিওর সুইচ অন করল। ট্রিনিটি মোবাইল টু ট্রি নিটি বেস।
কড় কড় করে উঠল রেডিও। দুএকবার ঝড় বওয়ার শব্দ উঠল। কথা শোনা গেল এরপর, ট্রিনিটি বেস। বলে যাও। অস্টিনের গলা।
স্টিভ, জিজ্ঞেস করল মার্লিন, উনিশ নম্বর সেন্সরের রিডিং পাচ্ছ?
রিডিং টেপ হচ্ছে, কিন্তু আমি দেখছি না এখন। গোল্ডম্যান আর, রেনট্রির অপেক্ষায় আছি। ওরা এলেই এখান থেকে সরে যাব। বেস চেঞ্জ করব।
অ্যান্টেনার গোলমাল সেরেছে?
এখন তো ঠিকই আছে।
বেশ, বলল মার্লিন, এক কাজ কর। রিডিং ডায়ালটা অন কর। উনিশ নম্বর থেকে পাঠাব। দেখ তো কোন গন্ডগোল আছে কিনা?
সেন্সরের ট্রান্সমিটার সেকশনটা অন করল ইভান।
সংকেত যাচ্ছে? মাইক্রোফোনে বলল মার্লিন।
হ্যাঁ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে আছে অস্টিন। রেনট্রি আর গোল্ডম্যান এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে, টের পেয়ে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, তারপর আবার মন দিল ডায়ালের দিকে। মার্লিনের গন্ডগোল শব্দটা আগন্তুক দুজনেরও কানে গেছে।
এন. সি. ই. আর-এর একজন বিজ্ঞানী টম রেনট্রি। জাতে রেড ইন্ডিয়ান। হু ভ্যালির ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশনে জন্ম। ট্রিনিটি ফল্টের আশপাশটা তাই নিউ ইয়র্কের অধিবাসীদের চাইতে অনেক বেশি চেনে সে। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানে অগাধ জ্ঞান। অথচ বয়েস একেবারে কম, মাত্র বিশ। সবদিক বিবেচনা করেই ট্রিনিটি ফল্টের বৈজ্ঞানিক অভিযানে সঙ্গে নেয়া হয়েছে তাকে।
অসকার গোল্ডম্যানের আগমন কিন্তু রহস্যজনক। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলছেন বটে, স্টিভ অস্টিনকে সঙ্গ দেবার জন্যেই তার আগমন। কিন্তু স্পেশাল ইনটেলিজেন্সের অপারেশন বিভাগের একজন চিফ শুধুই একজন জ্যান্ত রোবটকে সঙ্গ দিতে এসেছেন, ঠিক মেনে নেয়া যায় না। তবে কে জানে, সিক্স মিলিয়ন ডলার তো সোজা কথা নয়। অমন দামী সাইবর্গকে আগলে রাখার কিংবা তার সত্যিকারের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করার দায়িত্বটা হয়ত গোল্ডম্যানের ওপরই অর্পণ করেছেন সরকার।
মিনিটখানেক গভীর মনোযোগে ডায়ালের রিডিং দেখল অস্টিন। তারপর উঠে গিয়ে তাঁবু থেকে একটা ছোট টি. ভি. জাতীয় সেট নিয়ে এল। জেনারেটরের সঙ্গে কানেকশন দিয়ে চালু করে টিউনিং করতেই কতগুলো আঁকাবাঁকা রেখা ফুটে উঠল স্ক্রীনে।
ভুরু কুঁচকে উঠল অস্টিনের। মাইক্রোফোনটা ঠোঁটের কাছে এনে বলল, ট্রিনিটি মোবাইল মনে হচ্ছে কোন আগ্নেয়গুহার কাছাকাছি আছ তোমরা!
অবিশ্বাস্য! এ কি করে সম্ভব? ফিসফিস করে বলল রেনট্রি।
ট্রিনিটি মোবাইল শুনতে পাচ্ছ তো তোমরা? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
পাচ্ছি। এই গোলমালটাই অবাক করেছে আমাদের, বলল বার্লিন। ছেড়ো না। ধরে থাক।
একটু সরিয়ে বসিয়ে দেখা দরকার, কি রিডিং দেয় সেনসর, বলল ইভান। এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ল সে। কাজ শুরু করল। সেনসরটা তুলে আনল। অ্যান্টেনা আর প্রোব খুলে নিয়ে সার্কিট পরীক্ষা করায় মন দিল।
ডান হাতের তালুর ওপর থুতনি রেখে বসে বসে স্বামীর কাজ দেখছে মার্লিন।
নাহ্ কোথাও কোন গোলমাল নেই, এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে আপন মনেই বলল ইভান।
দেখ তো সার্কিটের কোথাও ক্রস কানেকশন হয়ে গেছে কিনা? সন্দেহ যাচ্ছে না মার্লিনের, টিনের টুকরো-টাকরা লেগে থাকতে পারে সার্কিট বোর্ডের পেছনে। বাড়তি তার বেরিয়ে থাকাও বিচিত্র নয়।
বিচিত্র নয়, স্বীকার করল ইভান। কিন্তু তাতে সার্কিট অচল হয়ে যেতে পারে, জ্বলে যেতে পারে, গোটা এক আগ্নেয়গিরি আবিষ্কার করে ফেলতে পারে না।
শ্রাগ করল মার্লিন। একটু নড়েচড়ে বসল। বাঁ হাতের তালুও এনে ঠেকাল থুতনিতে।
ওদের কয়েকগজ দূরে রেডউডের এক টুকরো ঘন বনের মধ্যে চুপচাপ দুজনের দিকেই লক্ষ্য রাখছে বিশাল এক ভয়ংকর জীব। ইভান কিংবা মার্লিন টেরই পাচ্ছে না।
জীবটার স্থানীয় নাম সাসকোয়াচ। লম্বায় আট ফুটের কাছাকাছি। অনেকটা গরিলার মত দেখতে। পায়ের পাতা, হাতের তালু আর মুখমন্ডল ছাড়া বাকি শরীর লম্বা বাদামী রোমে ঢাকা। দুদিকে ছড়ালে এক হাতের মধ্যমা থেকে অন্য হাতের মধ্যমার দূরত্ব ফুট দশেক হবে। ইচ্ছে করলে দুহাতে দুজন শক্তসমর্থ জোয়ান লোককে অনায়াসে তুলে নিতে পারে। চেহারায় গরিলা আর মানুষের সংমিশ্রণ, অনেকটা আমাদের আদি পূর্বপুরুষদের মত। দুপায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে ইচ্ছে করলে, কিন্তু সাধারণত একটু কুঁজো হয়ে চলাই এর স্বভাব। চলার সময় কাঁধ থেকে ঝুলে থাকে দুই হাত, হঠাৎ দেখলে মনে হবে প্রাণ নেই ও দুটোয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী সাসকোয়াচের কথা চালু আছে ওসব এলাকার রেড ইন্ডিয়ানদের মাঝে, হিমালয়ের ইয়েতীর মতই। তবে আগে কোনদিন চোখে দেখেনি দানবটাকে কেউ। ইদানীং কারও কারও চোখে পড়েছে সাসকোয়াচ। তারা গিয়ে গাঁয়ে বলেছে। প্রথম প্রথম হেসেই উড়িয়ে দেয় গাঁয়ের লোকে। তারপর এই অঞ্চলে শিকার কিংবা আউটিং-এ এসে যখন শহরে কিছু শিক্ষিত লোক সাসকোয়াচের কবলে পড়ল, হাসাহাসির পর্যায়ে থাকল না আর ব্যাপারটা। একান ওকান হতে হতে জীববিজ্ঞানীদের কানে গিয়ে খবর পৌঁছল। ব্যস, তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তাঁরা। জানোয়ারটার দেখা পেলেন না, তবে অস্বাভাবিক বড় পায়ের ছাপ আবিষ্কার করলেন ট্রিনিটি ফল্ট আর আশেপাশের পাহাড়, পর্বতের ঢাল আর জঙ্গলে। সাসকোয়াচের নাম দিলেন বিগ ফুট।
সেন্সরের সিলিকনের তৈরি সার্কিট পরীক্ষা করতে ব্যস্ত ইভান। বসে বসে তাই দেখছে মার্লিন। পেছনের রেডউডের জঙ্গলের দিকে নজর নেই কারোই। এই সুযোগে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল সাসকোয়াচ। ভারি পায়ের তলায় শুকনো কুটোপাতা ভাঙার ক্ষীণ আওয়াজ উঠল। জঙ্গলে ছোটখাট অনেক জন্তু জানোয়ার আছে। ও ধরনের খুটখাট শব্দ প্রায় সর্বক্ষণই করে ওরা। বাদামের শক্ত খোসা কাটছে হয়ত কাঠবেড়ালী, কিংবা শুকনো ঘাস পাতা মাড়িয়ে ছুটোছুটি করছে ঘেসো ইঁদুর। তাই শব্দটা শুনে থাকলেও খুব একটা কেয়ার করল না স্বামী-স্ত্রী।
বড়জোর দুই কদম বাড়িয়েছে সাসকোয়াচ, এমন সময় রেডিও কথা বলে উঠল। পরিষ্কার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে অস্টিনের। ধরে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পড়েছে সে।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সাসকোয়াচ। রেডিওতে ভেসে আসা কথা শুনছে কান পেতে।
ট্রিনিটি বেস টু ট্রিনিটি মোবাইল, বলল অস্টিন, কাজ এগিয়েছ?
পায়ের কাছে ফেলে রাখা মাইক্রোফোনটা তুলে নিল মার্লিন। চোখ ইভানের হাতের সেন্সরের দিকে।
স্টিভ, সার্কিটটা আরেকবার পরীক্ষা করছে ইভান।
সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেছে?
এখন পর্যন্ত না। ধরে থাক, পেলে সঙ্গে সঙ্গে জানাব।
ঠিক আছে, বলল অস্টিন।
সবে টেবিলে মাইক্রোফোনটা নামিয়ে রেখেছে অস্টিন, তিনজনকে চমকে দিয়ে গর্জন করে উঠল রেডিও। আজব কোন জানোয়ারের গলা থেকে বেরিয়ে আসা কুৎসিত ভয়ংকর চাপা গর্জন। পরক্ষণেই নারী কণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকার। চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছে অস্টিন। নিমেষে সতর্ক হয়ে উঠেছে তার বায়োনিক ব্রেন। লাফ দিয়ে টেবিলের একেবারে ধার ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে গোল্ডম্যান আর রেনট্রি।
গর্জন শুনেই চোখ তুলে তাকিয়েছে ইভান, ফিরে চেয়েছে মার্লিন। তাদের একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে সাসকোয়াচ। নিজের অজান্তেই গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে মার্লিনের বিকট চিৎকার। স্থির বসে বোবা বিস্ময়ে শুধু চেয়ে আছে ইভান। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কথা বলার শক্তিও হারিয়েছে যেন।
মার্লিন আর ইভান, দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার করে সাসকোয়াচ। তারপর ঝুঁকে হাত বাড়াল। একই সঙ্গে ঘাড় চেপে ধরল দুজনের।
মাইক্রোফোন ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছে অস্টিন। মার্লিন…মার্লিন, চেঁচিয়ে বলল সে, কথা বলছ না কেন?…কি হয়েছে?
ইভান আর মার্লিনের ঘাড় ধড়ে রেখেই রেডিওটার দিকে তাকাল সাসকোয়াচ। নিঃশব্দে, ধীরে ডান পা-টা তুলল রেডিওর ওপর। তারপর চোখের পলকে নামিয়ে আনল। পা-টা সরিয়ে নিতেই দেখা গেল, দুমড়ে মুচড়ে চেপ্টে মাটিতে বেশ কিছুটা গেড়ে গেছে যন্ত্রটা।
মার্লিন… দাঁড়িয়ে পড়েছে অস্টিন, কি হল?…রেডিও চুপচাপ কেন?… হ্যালো …মার্লিন… ইভান…
নিজের রেডিও আর সুইচগুলো খটাখট করে টিপল অস্টিন। আবার চেষ্টা করল, ট্রিনিটি বেস টু ট্রিনিটি মোবাইল মার্লিন, ইভান, জবাব দাও…শুনতে পাচ্ছ?…হ্যালো…হ্যালো…
ওপাশ থেকে সাড়া দিল না কেউ।
০৪. অসকার গোল্ডম্যানের জীপ চালাচ্ছে অস্টিন
অসকার গোল্ডম্যানের জীপ চালাচ্ছে অস্টিন। পেছনে আসছে পিকআপ এবং দুটো ট্রাক। অস্টিনের পাশে বসে পথ নির্দেশ দিচ্ছে টমরেনট্রি। ক্লেয়ার অ্যাঙ্গেল লেকের উত্তর ধার ঘেঁষে কাঁচা রাস্তা ধরে চলেছে চার গাড়ির ক্যারাভানটা।
অপেক্ষাকৃত সরু আরেকটা কাঁচা রাস্তায় এসে পড়েছে প্রথম রাস্তা। ছোট বড় পাথরে বোঝাই এই দ্বিতীয় রাস্তাটা ক্রমেই উঠে গেছে পর্বতের উপরের দিকে। এটা ধরে মাইল দুয়েক এগোলেই পাওয়া যাবে বেকি দম্পতির ক্যাম্প।
পথ খুবই খারাপ। খাড়াই তো বটেই, তার ওপর কাঁচা পাহাড়ী রাস্তা ঘোট বড় পাথরে বোঝাই। সপ্তাহখানেক আগে বেশ বড়সড় এক ঝড় হয়ে গেছে এদিকটায়। মাঝেমধ্যে রাস্তার ওপর ভেঙে পড়ে আছে রেডউডের বিশাল সব ডাল। পায়ে হেঁটে চলাই কষ্টকর। গাড়ি নিয়ে ওঠা তো অসম্ভব। চেষ্টা করে করে শেষকালে হাল ছেড়ে দিল অস্টিন। পায়ে হেঁটেই যেতে হবে, এছাড়া উপায় নেই।
জীপ থামিয়ে নেমে পড়ল অস্টিন। একে একে নেমে এলেন গোল্ডম্যান আর রেনট্রি। পেছনে পিকআপ আর ট্রাক দুটোও থেমে পড়েছে।
জনা ছয়েক গার্ডকে সঙ্গে নেয়া ঠিক করলেন গোল্ডম্যান। অন্যদের গাড়ি নিয়ে বেস ক্যাম্পে ফেরত যাবার নির্দেশ দিলেন।
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে অস্টিন। বেকি দম্পতিকে পছন্দ করে সে। বন্ধু। ওদের সাহায্য করার আন্তরিক ইচ্ছে তার। কিন্তু এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই।
এদিককার পথ ঘাট জানা নেই অস্টিনের। চেনে একমাত্র রেনট্রি। ওর সঙ্গে হেঁটে যেতে হলে এক দেড় ঘণ্টার ধাক্কা। পথ জানা থাকলে জীপের চেয়েও দ্রুত বেকি দম্পতির ক্যাম্পে পৌঁছে যেতে পারত অস্টিন। অবশ্য চেনা না থাকলেও খুঁজে বের করার ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু খোঁজাখুঁজি করতে সময় আরও বেশি লেগে যেতে পারে। তাই রেনট্রির সঙ্গে যাওয়াই ভাল মনে করল সে।
এগিয়ে চলল ওরা। সাধ্যমত দ্রুত চলার চেষ্টা করছে রেনট্রি, সঙ্গে গোল্ডম্যান আর গার্ডেরা। কিন্তু অস্টিনের জন্যে এটা শম্বুকগতির সামিল। ক্রমেই বিরক্ত হয়ে পড়ছে সে।
প্রায় সোয়া ঘণ্টা পর বেকি দম্পতির ক্যাম্পের তাঁবুটা চোখে পড়ল। এখনো অন্তত একশো গজ দূরে আছে। আর থাকতে পারল না অস্টিন। ছুটতে শুরু করল। বায়োনিক গতিবেগ। সামনের রাস্তায় ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে থাকা একটা বিশাল রেড উড গাছ স্বছন্দে লাফিয়ে পেরিয়ে গেল। দেখে হাঁ হয়ে গেল রেনট্রি। অস্টিন যে বায়োনিক ম্যান, জানা নেই তার।
আশ্চর্য তো! থেমে দাঁড়াল রেনট্রি। গোল্ডম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল সে, অতজোরে ছুটছে কি করে লোকটা? তা ছাড়া অতবড় গাছটা এভাবে লাফিয়ে ডিঙাল… ব্যাপারটা কি?
বোঝাতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। এড়িয়ে গেলেন গোল্ডম্যান। আসলে এখন অত কথা বলার সময় বা ধৈর্য কোনটাই নেই তার। আরও অনেক আজব কান্ড করতে পারে স্টিভ। পরে সব কথা বুঝিয়ে বলব খন। এখন চল, যাই।
যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতার জন্যে তৈরি হয়েই ক্যাম্পের সামনে এসে দাঁড়াল অস্টিন। কিন্তু তেমন কোন বাধা এল না। বেকি দম্পতির ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যন্ত্রপাতি জায়গা মতই পড়ে আছে। শুধু মানুষ দুজন অনুপস্থিত। যেন কয়েক মিনিট আগেই কোথাও গেল, আবার ফিরে আসবে। বায়োনিক চোখটা ব্যবহার করল অস্টিন। কাছে পিঠে কোথাও কিছু নেই। দিগন্তের দিকে তাকাল। কিছু থাকলে দুরবীন দিয়ে দেখার মতই পরিষ্কার দেখতে পাবে সে বহুদুর থেকেও। কিন্তু নাহ্! কিছু নেই। কয়েকবার জোরে বেকি দম্পতির নাম ধরে ডাকল সে। বায়োনিক মাইক্রোফোনে জোর আওয়াজ উঠল। কিন্তু সাড়া দিল না কেউ।
পৌঁছে গেল রেনট্রি, গোল্ডম্যান আর গার্ডেরা। প্রায় দুমাইল বিচ্ছিরি পথ হেঁটে এসে দর দর করে ঘামছে সবাই। হাঁপাচ্ছে।
বেকি দম্পতির আশ্চর্য ব্যবহারের চেয়ে অস্টিনের কান্ডকারখানা কম আজব ঠেকছে না রেনট্রির কাছে। সোজা অস্টিনের কাছে এসে দাঁড়াল সে। এই যে সাহেব, অত জোরে ছুটলেন কি করে আপনি? হেঁটে তো নয়, যেন উড়ে এসেছেন। ঘোড়ার মাংসপেশী লাগিয়েছেন নাকি পায়ে?
হি-টেস্ট, গোল্ডম্যানের মতই প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল অস্টিন। তার আসল পরিচয় যত কম লোকে জানে, ততই ভাল। বায়োনিক ম্যান হলেও একজন সিক্রেট এজেন্টের কাজ করতে হয় তাকে। টপ কোয়ালিটি ড্রিংক। গ্যালন এক ডলার দশ পেন্স। খেয়ে দেখুন, আপনিও অমন ছুটতে পারবেন।
কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন গোল্ডম্যানও। জিজ্ঞেস করলেন, অস্টিন, ওদের কোন সাড়া পেলে? কি হল, বুঝছ কিছু?
নাহ! এদিক ওদিক মাথা দোলাল অস্টিন। অত চেঁচালাম, কোন সাড়া নেই! কোথায় গেল, তাও বুঝতে পারছি না!
হু…! কি যেন একটু ভাবলেন গোল্ডম্যান। তারপর রেনট্রির দিকে ফিরে বললেন, টম, এদিককার পথ ঘাট জঙ্গল তো তোমার চেনা। গার্ডদের নিয়ে খুঁজে দেখ তো একটু ভাল করে, প্লীজ!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাচ্ছি আমি। ঘাড় নেড়ে চলে গেল রেনট্রি।
ফিরে চাইলেন গোল্ডম্যান। ততক্ষণে বেকি দম্পতির পড়ে থাকা জিনিসপত্রগুলোর দিকে নজর দিয়েছে অস্টিন। এগিয়ে গেলেন তিনি।
কোনরকম ধস্তাধস্তির চিহ্ন তো দেখছি না, বললেন গোল্ডম্যান।
মার্লিনের ব্যাগটা তুলে নিল অস্টিন। চেন খোলাই আছে। ফাঁক করে ভেতরে তাকাল সে। একে একে সমস্ত জিনিস বের করল ভেতর থেকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু খোয়া যায়নি।
ব্যাগটা নামিয়ে রেখে আশপাশটা দেখায় মন দিল অস্টিন। পনের সেকেন্ডের মধ্যেই আবিষ্কার করল রেডিওটা। আঙ্গুল তুলে গোল্ডম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার কারণ এটাই।
এগিয়ে গিয়ে দুজনেই ঝুঁকে বসল দোমড়ানো রেডিওটার কাছে।
কাজটা কার? তোমার মত আরও কেউ আছে নাকি? অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে অস্টিনের দিকে তাকালেন গোল্ডম্যান।
স্লেজহ্যামার দিয়ে মেরে করা যেতে পারে অমন, বলল অস্টিন। কিন্তু আশেপাশে কোথাও তো দেখছি না জিনিসটা!
উঠে দাঁড়ালেন গোল্ডম্যান। আশেপাশের মাটিতে নজর বোলাতে লাগলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গর্তটা আবিষ্কার করলেন। এটাতেই সেন্সর বসিয়েছিল বেকি দম্পতি।
শুধু স্লেজহ্যামারটাই নয়, আরও একটা জিনিস নেই। বললেন গোল্ডম্যান।
কি? ফিরে তাকাল অস্টিন।
সেন্সর। কোথায় ওটা?
উঠে এসে গর্তটার কাছে বসল অস্টিন। ঠিকই বলেছেন। অন্যান্য টেস্ট ইকুইপমেন্টগুলো পড়ে আছে দেখছি, কিন্তু সেন্সরটা…
সেন্সরটা খুঁজে পেতেই হবে, জোর গলায় বললেন গোল্ডম্যান।
এবং আমার দুই বন্ধুকেও। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এভাবে কোথায় গায়েব হয়ে গেল ওরা!
কিডন্যাপ হতে পারে!
তা পারে!
সেন্সরটাও গায়েব। কেন?
বুঝলাম না। আরও অনেকগুলো সেন্সর ট্রিনিটি ফল্টে বসিয়েছে ওরা। স্যান আন্দ্রিজেও। কেউ শুধু এই জিনিস চাইলে সহজেই ওগুলো চুরি করতে পারত। তার জন্যে দুজন লোককে কিডন্যাপ করাটা…
হুমম।
এই সময়েই রেনট্রির চিৎকার শোনা গেল, স্টিভ, অসকার!
পাই করে ঘুরে দাঁড়ালেন গোল্ডম্যান। বসা অবস্থায়ই চরকির মত ঘুরল অস্টিন। রেনট্রিকে দেখা যাচ্ছে না।
টম, কোথায় তুমি? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
এই যে, এখানে, পুবের রেডউডের জঙ্গল থেকে ভেসে এল রেনট্রির কণ্ঠস্বর।
বাঁ চোখের ইনফ্রারেড সিস্টেম চালু করে দিল অস্টিন। শব্দের উৎস বরাবর চাইতেই, জঙ্গলের মধ্যে বসা রেনট্রিকে দেখতে পেল। বিজ্ঞানীর চোখ মাটির দিকে।
উঠে পড়ল অস্টিন। গোল্ডম্যানকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে চলল।
কি হল? রেনট্রির কাছে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলেন গোল্ডম্যান, ওদের পেয়েছ নাকি?
না, জবাব দিল রেনট্রি, কিন্তু আরেকটা জিনিস পেয়েছি। আঙ্গুল তুলে মাটির দিকে দেখাল। নরম মাটিতে বসে গেছে পায়ের ছাপটা। বিশাল। লম্বায় আঠার ইঞ্চি, চওড়ায় ছয়।
কোন জানোয়ারের? জিজ্ঞেস করলেন গোল্ডম্যান। পার্বত্য সিংহ?
অতিকায় গ্রিজলী ভালুক? জানতে তাকাল অস্টিন।
এদিক ওদিক মাথা নাড়াল রেনট্রি। ছেলেবেলায় দিদিমার কাছে গল্প শুনেছে সে। বড় হয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে অনেক খুঁজেছে জীবটাকে। কিন্তু ছায়াও দেখেনি কখনো। না না, সিংহ না। ভালুকও না।
তাহলে? জানতে চাইলেন গোল্ডম্যান।
এদিককার পাহাড়ে জঙ্গলে একটাই জীব আছে ও ধরনের পায়ের ছাপ ফেলে। আমার গায়ের লোকেরা এর নাম দিয়েছে সাসকোয়াচ। শ্বেতাঙ্গরা, মানে তোমরা বল একে…
বিগফুট, রেনট্রির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল অস্টিন।
অবিশ্বাস্য! সত্যিই, একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার! বললেন গোল্ডম্যান।
অবিশ্বাসের কিছুই নেই, বলল রেনট্রি। উঠে দাঁড়িয়েছে। রেনট্রির চোখে চোখে চাইলেন গোল্ডম্যান।
সত্যিই অবিশ্বাসের কিছু নেই, আবার বলল রেনট্রি। পুরুষানুক্রমে সাসকোয়াচের কাহিনী জেনে আসছে আমার গায়ের লোকেরা।
ওরা তো কুসংস্কারাচ্ছন্ন। হাজারে একজন শিক্ষিত নেই।
কিন্তু বিগফুট নামটা তো দিয়েছে তোমাদেরই অতিশিক্ষিত বিজ্ঞানীরা। তারাও কি কুসংস্কারাচ্ছন্ন?
জবাব দিতে পারলেন না গোল্ডম্যান।
অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনাই ঘটে পৃথিবীতে, যার কোন ব্যাখ্যা নেই। এটা নিশ্চয়ই অজানা নয় তোমার। খুবই ছোট আমি তখন, বলে চলল রেনট্রি। ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়াই। গাঁয়েরই একটা লোককে এই রেডউডের জঙ্গলে বেমালুম গায়েব হয়ে যেতে দেখেছি। কয়েকদিন পরে অবশ্য খুঁজে পাওয়া গেছে তাকে। আমার দাদুই খুঁজে পেয়েছেন। ঠিক বুঝতাম না তখন, কিন্তু ফিরে আসার পর লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠেছিলাম। কেমন এক ধরনের শূন্য দৃষ্টি। গাঁয়ের পাড় মাতালগুলোর মত অনেকটা। দাদু বলেছেন, লোকটাকে যেখানে খুঁজে পাওয়া গেছে, তার পাশেই সাসকোয়াচের পায়ের ছাপ ছিল।
রেনট্রির কথা শেষ হওয়ার পরেও কয়েক সেকেন্ড নীরব রইলেন গোল্ডম্যান। অন্য সবাইও নীরব। তন্ময় হয়ে রেনট্রির গল্প শুনেছে ওরা।
যা হবার হয়েছে, ছড়িয়ে পড় সবাই, আদেশ দিলেন গোল্ডম্যান। এদিককার জঙ্গলটাকে ঘিরে ফেল। বিশাল পদচিহ্নটার দিকে চাইলেন গোল্ডম্যান, সন্দেহজনক কিছু দেখলেই হুইসেল বাজাবে।
কে কোন দিকে যাবে নির্দেশ দিতে শুরু করল রেনট্রি।
এক সেকেন্ড পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল অস্টিন আর গোল্ডম্যান। তারপর মাথা ঘুরিয়ে ব্যাটল মাউনটেনের দিকে ইঙ্গিত করে বলল অস্টিন, ওদিকে যাচ্ছি আমি।
পর্বতে? অবাক হলেন গোল্ডম্যান, কেন?
ওপরে উঠব না, মানে চূড়ায় নয়। একটু থেমে বলল, দুটো কারণে যাব। এক একটা আগ্নেয়গুহার কথা জানিয়েছে ইভান আর মার্লিনের বসান সেন্সর। ওই এলাকায়ই আছে কোথাও ওটা। দুই, ওদিককার জঙ্গলের ভেতরই বিগফুটের বেশি আনাগোনার কথা শোনা যায়…। তৃতীয় আরেকটা কারণও অবশ্য আছে। ওদিক যেতে চাওয়ার। তেমন কিছু না…তবে আমার মন বলছে অসাধারণ কিছু একটা পাবই।
ইনফ্রারেডে কিছু দেখতে পেয়েছ?
না। ব্যাটল মাউনটেনের দিকে তাকিয়ে বলল সে, গুহাটা খুঁজে বের করবই। নিজের চোখে দেখতে চাই আমি। ওটা আছেই, আমি শিওর। আর্থ রিসোর্স স্যাটেলাইট, টেলিমেট্রি অ্যানালাইসিস কম্পিউটার ভুল করতে পারে না।
নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
হয়নি। তাহলে রিডিংই দিত না।
বেশ, যাও, বললেন গোল্ডম্যান। কিন্তু নিজের দিকে খেয়াল রেখো।
এখন আর সাধারণ মানুষ নই আমি…
তবু…অসাধারণ শত্রু তো থাকতে পারে।
কথা দিচ্ছি, আগ্নেয়গুহায় আচমকা পড়ে গিয়ে পা ভাঙব না, হাসল অস্টিন। বিগফুট ব্যাটাকেও আমার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে দেব না। মার্লিনের রেডিওটার যে অবস্থা করেছে ব্যাটা…নাহ্ আমার সিক্স মিলিয়ন ডলার দামের দেহটাকে অত সহজে নষ্ট হতে দেব, ভাবছেন কি করে?
ব্যাটল মাউনটেনের দিকে রওনা হল অস্টিন। বায়োনিক গতিবেগ ব্যবহার করল। রাস্তা ভাল হলে ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে ছুটতে পারে সে। কিন্তু এখানে রাস্তা খারাপ, ঘন জঙ্গলে ছাওয়া চড়াই। প্রাণপণ চেষ্টায় গতিবেগ বড়জোর পনের থেকে বিশের মধ্যে রাখতে পারল অস্টিন।
যতই ওপরে উঠছে, তাপমাত্রা কমছে। পাতলা হয়ে আসছে গাছপালা। বেকি দম্পতি যেখানে ক্যাম্প করেছিল তার কয়েক হাজার ফুট ওপরে উঠে একটু থামল অস্টিন। সামনে রাস্তা মোটামুটি ভাল। বনজঙ্গল তেমন নেই। যদিও খাড়া, কিন্তু বেশি এঁকেবেঁকে না গিয়ে খাড়া উঠে গেছে পথ। যতটা মনে হয় এলক হরিণেরা নিয়মিত যাতায়াত করে এ পথে।
আবার ছুটতে শুরু করল অস্টিন। গতিবেগ দ্রুত। চলতে চলতেই চোখ তুলে তাকাল। মাথার ওপরে এক জায়গায় শেষ হয়ে গেছে বনের সীমানা, তারপরেই বরফ ঢাকা চুড়ার শুরু। চড়া রোদে ঝক ঝক করছে। চোখ ঝলসে যেতে চায়। অবশ্য সাধারণ মানুষের। অস্টিনের বায়োনিক চোখে এসব কোন প্রতিক্রিয়াই ঘটল না।
বনের প্রান্ত সীমানার কাছাকাছি এসে আবার থামল অস্টিন। এদিক ওদিক চেয়ে একটা বিরাট গাছ পছন্দ করে নিল মনে মনে। এগিয়ে গিয়ে গাছটার নিচে দাঁড়াল। ওপরের দিকে তাকাল। গোড়া থেকে প্রায় বিশ ফুট ওপরে মোটাসোটা একটা ডাল, তার ভার সইতে পারবে।
লাফ দিল অস্টিন। শাঁ করে উঠে গেল শূন্যে। নিঃশব্দে এসে নামল ডালটায়। যেন ওজন নেই তার, হালকা তুলো। ডালটা একটু কাপল না পর্যন্ত। মাথার ওপরের একটা সরু ডাল ধরে টাল সামলে দাঁড়াল সে। সামনের ঝোপঝাড়ে ছাওয়া জমির দিকে তাকাল। তার সাধারণ চোখে কিছুই দেখল না। কিন্তু ফাঁকিতে পড়ল না বায়োনিক চোখটা। ঠিকই দেখতে পেল জিনিসটা। পঞ্চাশ থেকে ষাট গজ দূরে একটা কাঁটা লতায় লেগে ছিড়ে আটকে আছে কাপড়ের ছোট্ট একটা টুকরো।
হাওয়ায় ভেসে আবার নিচে নেমে এল অস্টিন। ছুটল। কাপড়ের টুকরোটার কাছে এসে থামল। হাত বাড়িয়ে ছাড়িয়ে নিল কাঁটায় আটকান কাপড়ের ছেড়া টুকরোটা। এক নজর দেখেই চিনল। ইভান বেকির শার্ট থেকে ছিড়েছে। কি মনে করে টুকরোটা পকেটে রেখে দিল অস্টিন।
তাহলে সে যা অনুমান করেছে, ঠিকই। এদিকেই নিয়ে আসা হয়েছে বৈকি দম্পতিকে। আগ্নেয়গুহা থাক আর না থাক, এদিকে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে। কিংবা ঘটতে চলেছে, ভাবল অস্টিন।
পর্বতের আরও ওপরে উঠে চলল সে।
তাকে লক্ষ্য করা হচ্ছে টের পেল না অস্টিন। না, সাসকোয়াচটা দেখছে না তাকে। বিশাল টি ভি-র পর্দায় তার গতিবিধি ফুটে উঠেছে। ব্যাটল মাউনটেনের বরফ ঢাকা চূড়ার নিচের দিকে পাহাড় খুঁড়ে কৃত্রিম গহ্বর সৃষ্টি করে তাকে তৈরি করা হয়েছে অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। এই গবেষণাগারেরই একটা কক্ষে বসে টিভি-র পর্দায় তাকে দেখছে দুজন পুরুষ আর একজন মেয়েলোক।
আজব ধরনের পোশাক ওদের পরনে। চেহারাটা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে ঠিক যেন মেলে না। টেলিভিশনের পর্দাটা তিন বাই পাঁচ ফুট। কোণগুলো সমকোণ। সারা ঘর বিচিত্র সব যন্ত্রপাতিতে ঠাসা।
অবাক হয়ে অস্টিনকে দেখছে তিনজনই। আর দশজন সাধারণ মানুষ যে সে নয়, ঠিকই বুঝে নিয়েছে ওরা।
আশ্চর্য! দীর্ঘক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর নীরবতা ভাঙল একজন পুরুষ। লোকটার গতি দেখেছ?
অস্বাভাবিক, সত্যি! দ্বিতীয় লোকটা বলল।
অবিশ্বাস্য! বলল মেয়েটা, এমন কি আমাদের জন্যেও।
নাহ্, ওকে পরীক্ষা করে দেখতে হচ্ছে। বলল প্রথম জন।
উঠে পর্দার আরও কাছে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। তীক্ষ্ণ চোখে অস্টিনের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। সাংঘাতিক খাড়াই বেয়ে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে অস্টিন। বিন্দুমাত্র হড়কাচ্ছে না। অজানা পথে চলছে, সামান্যতম দ্বিধা নেই।
ঠিকই বলেছ, বলল মেয়েটা। কণ্ঠস্বরে তীব্র কৌতূহল, গুড আইডিয়া! ওকে পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
নিশ্চয়ই নিজের সঙ্গীদের খুঁজতে এসেছে লোকটা। সেন্সরটাও ফেরৎ চায় হয়ত। হয়ত জানতে চায় সঙ্গীরা এবং সেন্সর গায়েব হবার পেছনে কারণটা কি? টিভির পর্দার দিকে তাকিয়েই মুচকে হাসল প্রথম জন, টোপ ফেলা যাক।
সাসকোয়াচ? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে প্রথম জনের দিকে তাকাল দ্বিতীয় লোকটা।
সাসকোয়াচ টোপ না। ওই লোকটা যেই-ই হোক, আমার ধারণা সাসকোয়াচ তার জন্যে যথেষ্ট নয়।
তাহলে? জানতে তাকাল মেয়েটা।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত কি ভাবল প্রথম জন। তারপর হঠাৎই ডান হাত তুলে দুআঙ্গুলে চুটকি বাজাল।
ড. ইভান বোককে ফেরৎ পাঠাব। কিন্তু মেয়েটাকে রেখে দেব। কি বল?
চমৎকার প্রস্তাব! সমস্বরে বলল মেয়ে এবং দ্বিতীয় লোকটা।
বনের একেবারে প্রান্তে পৌঁছে গেছে অস্টিন। গাছপালা শেষ। এরপর থেকে শুরু হয়েছে ঘাসবন।
চোখ তুলে ঘাসজমির ওপারে জমাট বরফের দিকে তাকাল অস্টিন। অনুমান করল, ওই বরফের ভেতরে কিছু থাকতে পারে না। ঘাস আর গাছে ছাওয়া বনের সীমানার কাছাকাছি অঞ্চটাই সন্দেহজনক। বায়োনিক চোখের সাহায্যে চারদিকটা একবার পরীক্ষা করে দেখল সে। ভেবেচিন্তে উত্তরে যাওয়াই ঠিক করল।
আধমাইল পরেই জায়গাটা পেল অস্টিন। প্রথমে আর দশটা সাধারণ ঝোপের মতই মনে হল। সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু অস্টিনের বায়োনিক চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না ব্যাপারটা।
থমকে থেমে দাঁড়াল অস্টিন। উবু হয়ে বসল। ছোট ছোট কয়েকটা ভাঙা ডাল অস্বাভাবিক ঠেকেছে তার কাছে।
বিশাল ঝোপটার সত্তর-পঁচাত্তর ফুট ভেতরে বায়োনিক চোখের দৃষ্টি ফেলল অস্টিন। মাতালের মত টলছে লোকটা। ইভান বেকি। ঝোপের ভেতর দিয়ে বনের প্রান্তসীমার দিকে চলেছে।
ইভান! চেঁচিয়ে ডেকে উঠেই ঝোপঝাড় ভেদ করে ছুটল অস্টিন। চিৎকার শুনে ফিরে তাকাল ইভান। চোখে অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টি। ইভান, ইভানের দু কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিল অস্টিন, ঠিক আছ তো তুমি?
বার দুয়েক জোরে জোরে মাথা ঝাড়ল ইভান। ভেতরটা পরিষ্কার করতে চাইছে যেন।
কে?…ও স্টিভ? এখানে কি করে এলে?…
তোমাদের খুঁজতে এসেছি। গোল্ডম্যান, রেনট্রি আর গার্ডেরাও এসেছে। নিচে আছে ওরা।
পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা গাছের গুঁড়ি। মরা। ঝড়ে উল্টে পড়েছিল হয়ত। ধপ করে ওটাতে বসে পড়ল ইভান। বোকা বোকা চোখে তাকাল অস্টিনের দিকে।
আমাদের খুঁজছ? এই তো কয়েক মুহূর্ত আগে রেডিওতে কথা বলছিলে…নাহ্, কিছু বুঝতে পারছি না!
স্তব্ধ হয়ে গেল অস্টিন। বেস ক্যাম্প থেকে কয়েক মাইল দূরে, ব্যাটল মাউনটেনের চূড়ার কাছাকাছি স্ত্রী আর মহামূল্যবান সাইসমিক সেন্সর হারিয়েও যেন কিছুই হয়নি, এমন ভাবে কথা বলছে কেন লোকটা?
যেন অস্টিনের মনের কথা বুঝতে পেরেই এদিক ওদিক তাকাতে লাগল ইভান।
মার্লিন গেল কোথায়?
এ প্রশ্ন তো আমি করব তোমাকে! বলল অস্টিন। ইভানের মতই চারদিকে তাকাতে লাগল সে। পুরো ক্ষমতা ব্যবহার করছে বায়োনিক চোখের। উত্তরে, বায়োনিক দূরবীনের ক্ষমতাসীমারও ওপারে একটা অস্বাভাবিক নড়াচড়া লক্ষ্য করল অস্টিন। কিন্তু ভাল মত দেখা না যাওয়ায় বুঝতে পারল না ব্যাপারটা ঠিক কি? মানুষ? ইনফ্রারেড ম্যাগনিফিকেশন পুরো ব্যবহার করল অস্টিন। হ্যাঁ, কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে এবার। মানুষের মতই দুপেয়ে জীবটা, কিন্তু আরও বড়। ছুটছে। মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বেশি দ্রুত।
এখানেই থাক, বলেই ছুটল অস্টিন! জঙ্গলের আরও গভীরে ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে জীবটা। পিছু নিল সে।
স্টিভ, টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল ইভান। অস্টিনকে অনুসরণ করার চেষ্টা করতে করতে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, মার্লিন কোথায়, মার্লিন…?
হঠাৎই মাথা ঘুরে উঠল ইভানের। চোখে অন্ধকার দেখছে। কিছু একটা অবলম্বনের জন্যে হাত বাড়াল। কিন্তু শুধুই বাতাস ঠেকল হাতে। কাটা কলাগাছের মত দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল সে। অজ্ঞান।
পাঁই করে ঘুরল অস্টিন। ঝড়ের গতিতে ছুটে এল। উপুড় হয়ে পড়ে আছে ইভান। ধরে তাকে চিৎ করে শোয়াল অস্টিন। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল জঙ্গলের দিকে। কিন্তু জীবটার ছায়াও দেখা যাচ্ছে না আর।
আপাতত সাসকোয়াচের চিন্তা বাদ দিল অস্টিন। ঝুঁকে বসে ইভানের একটা হাত তুলে নিল নিজের হাতে। নাড়ি দেখল। গতি কম, কিন্তু দুর্বল নয়। তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অস্টিন। অস্বাভাবিক কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। নেই। আস্তে করে হাতটা নামিয়ে রেখে প্যান্টের ডান পা-টা উরু পর্যন্ত গুটিয়ে নিল সে।
সাধারণ মানুষের চোখে অদৃশ্য একটা খোপ বসান আছে অস্টিনের ডান উরুতে। টুল বক্স রাখা আছে এখানে। ক্ষুদে একটা অক্সিজেন ট্যাংক আছে এই বাক্সে। আর আছে শ্বাস ফেলার নল যুক্ত একটা মাস্ক। একটা অত্যন্ত শক্তিশালী ক্ষুদে ট্রানসিভারও আছে। যন্ত্রটা এতই শক্তিশালী, পৃথিবীর যে কোন জায়গায় খবর আদান প্রদান করা যাবে এর সাহায্যে। মাঝে মধ্যে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে গেলে এই চেম্বারে একটা ৩.৮-ও একটা নিয়ে নেয় অস্টিন।
টুলস রাখার চেম্বারের ওপরের প্লাস্টিকের আবরণ সরাল অস্টিন। ভেতরে কয়েকটা ক্ষুদে সুইচ। একটা সুইচ টিপতেই একটা প্লাস্টিকের দরজা সরে গেল। ভেতর থেকে টুল বক্স বের করে ট্রানসিভারটা নিয়ে নিল। একটা বিশেষ সুইচ টিপতেই গোল্ডম্যানের সঙ্গে রাখা রিসিভারে সংকেত পাঠাতে শুরু করল ট্রানসিভার। কয়েক সেকেন্ড পরেই উত্তর এল।
ট্রিনিটি বেস টু অস্টিন, কথা বললেন গোল্ডম্যান। অস্টিনই তো, নাকি?
হ্যাঁ! ব্যাটল মাউনটেনের পশ্চিম ঢালে আছি আমি, বনরেখা বরাবর। ইভানকে পেয়েছি। অজ্ঞান হয়ে গেছে সে।
মার্লিন? ওকে পাওনি? আর সেন্সরটা?
না।
ইভানকে জঙ্গল থেকে বের করে আনতে পারবে?
পারব। মাইল দুই ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে আনতে সময় একটু বেশি লাগবে অবশ্য। ততক্ষণে একটা কপ্টার পাঠান সম্ভব?
সম্ভব, জবাব দিলেন গোল্ডম্যান। মেন বেসের সঙ্গে এখুনি কথা বলছি। বিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবে। কিন্তু কোথায় পাবে ওরা তোমাকে?
ইভানকে নিয়ে সোজা খোলা জায়গায় নেমে আসব আমি। তিন-সাড়ে তিন হাজার ফুট ওপরে একটা লম্বা খাদ মত আছে। এর লাগোয়া দক্ষিণে থাকব।
গুড। এখুনি কপ্টার পাঠানর ব্যবস্থা করছি। তা, ইভান আর মার্লিনের কি হয়েছে বলে তোমার ধারণা?
বুঝতে পারছি না। ইভানের সঙ্গে কথা বলেছি আমি, কিন্তু কিছুই যেন জানে সে। কিছু যেন ঘটেনি। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতই ভাবসাব দেখাচ্ছে।
ঠিক আছে, ডাক্তাররা পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন। ভাল কথা, কপ্টারের সঙ্গে কি আমাদের স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের যোগাযোগ রাখতে বলব?
দরকার নেই। শুধু ফড়িঙটাকেই দরকার আমার। বোঝাটা আমার কাঁধ থেকে নামিয়ে দেবে।
ঠিক আছে, যা ভাল বোঝ। হ্যাঁ, আরেকটা কথা। রেনট্রিকে বলুন, তার পূর্বপুরুষরা মিছে কথা বলেনি।
আঁ…
বিশালদেহী জীবটা আমার আশেপাশেই কোথাও আছে, বলল অস্টিন। আর শুধু বিশাল নয়, ভারি দেহটা বইবার মত প্রচন্ড শক্তিও আছে শরীরে।
আঁ… আবারও এই একটা শব্দই বেরিয়ে এল গোল্ডম্যানের মুখ থেকে।
তাই-ই। এবং চেহারা দেখেই বুঝেছি, অতি ভয়ংকর ওই জীবটা।
০৫. ট্রিনিটি আল্পস ওয়াইল্ডারনেস আর রুট থ্রি
রাত্রি। ট্রিনিটি আল্পস ওয়াইল্ডারনেস আর রুট থ্রি এই দুটো পথের সঙ্গমস্থলে ক্যাম্প ফেলেছে অসকার গোল্ডম্যানের লোকেরা। হেলিকপ্টারে করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে অস্টিন আর ইভান বেকিকে। ইভানের দেখাশোনা করছেন এয়ার ফোর্সের একজন ডাক্তার। ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে ভূতত্ত্ববিদকে।
ছোট্ট এক চিলতে খোলা জায়গা, চারপাশটা এর জঙ্গলে ঘিরে আছে। এই খোলা জায়গাটুকুতেই ক্যাম্প ফেলা হয়েছে। উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে তিনটে কোলম্যানল্যাম্প। রাইফেল কাঁধে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে সান্ত্রীরা। খোলা জায়গাটুকুর কেন্দ্রস্থলে আগুন জ্বালান হয়েছে, ক্যাম্পফায়ার। স্থির হয়ে আছে। পাহাড়ী বাতাস। সরলরেখা সৃষ্টি করে খাড়া আকাশে উঠে যাচ্ছে ক্যাম্পফায়ারের হালকা ধোয়া।
আগুনের কাছে শুইয়ে রাখা হয়েছে ইভানকে। নীল পিপিং ব্যাগটার বাইরে শুধু মাথাটা বেরিয়ে আছে তার। বালিশের অভাবে মাথার নিচে দেয়া হয়েছে একটা দোমড়ান জ্যাকেট। আগুনের পাশে বসে আছে অস্টিন। একটু দূরে রেডিও নিয়ে বসেছেন গোল্ডম্যান। বেসক্যাম্পে অধীনস্থ কোন কর্মচারীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন রেডিওতে। চেয়ে চেয়ে তাই দেখছে অস্টিন।
শোন, কাটা কাটা শোনাল গোল্ডম্যানের কণ্ঠস্বর, তোমাদের অসুবিধে বুঝতে পারছি আমি, কিন্তু আমার অসুবিধেটাও বোঝার চেষ্টা কর। একজন মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন এখান থেকে। একটা অতি মূল্যবান যন্ত্রও গেছে তার সঙ্গে। কাজেই রাতের বেলা অনুসন্ধান কাজ চালানোর জন্যে নাইট-ভিশন। ইকুইপমেন্টগুলো আমার চাই, এবং জলদি!
ইয়েস, স্যার, উত্তর দিল একটা হাল ছেড়ে দেয়া কণ্ঠ। বেস ক্যাম্পে তো ওগুলো নেই এখন, হাতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেব আপনার ওখানে।
মনে থাকে যেন কথাটা… যোগাযোগ কেটে দিলেন গোল্ডম্যান।
মনে হচ্ছে জিনিসগুলো পৌছুতে কিছুটা দেরি হবে। বলল অস্টিন।
হুঁ… চিন্তিত দেখাচ্ছে গোল্ডম্যানকে।
ঘুমের মধ্যেই নড়েচড়ে উঠল ইভান। গোল্ডম্যান এবং অস্টিন দুজনেই তাকাল একবার সেদিকে।
হ্যাঁ, ভাল কথা, আবার কথা বলল অস্টিন। আবার ওই পর্বতে চড়ব আমি। ইভানকে যেখানে পেয়েছি, জায়গাটা আরেকবার ভালমত দেখতে চাই।
ঠিকই বলেছ। ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে। হ্যাঁ, রেডিওতে বলেছিলে কি একটা জীব দেখেছ? কি ওটা?
চিনি না। তা ছাড়া দূর থেকে দেখেছি তো, চেহারাটা ভালমত খেয়াল করতে পারিনি।
কি ধরনের জীব?
দুপেয়ে। বিশাল একটা গ্রিজলী ভালুক যেন হঠাৎ করেই শিখে গেছে কি করে দুপায়ে ভর দিয়ে ছুটতে হয়।
কতটা বিশাল?
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অস্টিন, হঠাৎ সেখানে এসে হাজির হল টম রেনট্রি। হাতে কাপড়ে জড়ান একটা কি যেন। বিজ্ঞানীর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন গোল্ডম্যান, কি, টম?
ধীরে ধীরে কাপড়ের মোড়ক খুলল রেনট্রি। প্লাস্টার কাস্ট, বলল সে। মাটিতে বসে যাওয়া সাসকোয়াচের পায়ের ছাপ থেকে করেছি।
সাদা প্লাস্টিকে তৈরি বড়সড়, ভারি পায়ের ছাপের ছাঁচটা মাটিতে নামিয়ে রাখল, রেনটি। অবাক হয়ে ছাঁচটার দিকে তাকালেন গোল্ডম্যান।
বিশাল পা, মৃদু মাথা নেড়ে বলল অস্টিন, অবিশ্বাস্য!
কিন্তু রেনট্রি, ধরে নিলাম বিশালদেহী একটা আজব জানোয়ার এই এলাকার পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বললেন গোল্ডম্যান, সেক্ষেত্রে অনেকেরই চোখে পড়তে বাধ্য ওটা। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে ওটার কথা শোনা যাচ্ছে যখন।
কেউ কেউ তো দেখেছেই, বলল রেনট্রি। এবং তার… হঠাৎ থেমে গেল সে। ঘাড় ফিরিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। চোখ মেলেছে ইভান। পায়ের ছাঁচটার দিকেই তাকিয়ে আছে।
দৈহিক, মানসিক দুটো শক্তিই রেনট্রির অসাধারণ। বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে অসংখ্য প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে মানুষ হয়েছে। সহজে ভয় পেতে জানে না। কিন্তু ইভান বেকির অবস্থায় ভয় পেয়েছে।
ও…ওর চোখ দুটো দেখেছ? প্রায় ফিসফিস করে কথা বলছে রেনট্রি, ঠিক আমার দাদা বনের ভেতরে কুড়িয়ে পাওয়া লোকটার কথা যেমন বলেছিলেন…আসলে, আসলে ইভান সাসকোয়াচকে দেখেছে, অসকার!
ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে অস্টিন। দেহটা পিপিং ব্যাগের ভেতরে, কিন্তু মুখ দেখেই বুঝতে পারছে সে সাংঘাতিক কাঁপছে ইভান। চোখ দুটো স্থির নিবদ্ধ পায়ের ছাঁচটার ওপর।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে কিন্তু দ্রুত এগিয়ে আসছে পায়ের ছাঁচের মালিক। লক্ষ্য সুভোন স্ট্যান্ডে বসান দুটো উজ্জ্বল ইলেকট্রিক আলো।
বেস ক্যাম্পের একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল সাসকোয়াচ। একটা গাছের আড়াল থেকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করল, কোন্ দিক থেকে এগোলে সুবিধে হবে।
ক্যাম্পের পাশে পথের ধারে আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে টেলিমেট্রি ভ্যানটা, তার পাশেই জেনারেটর ট্রাক। একটানা চাপা গুঞ্জন করছে জেনারেটর। ট্রাকের কয়েক গজ দূরে টেবিলটা। বিচিত্র সেন্সরগুলো নেই এখন ওটার ওপর, সরিয়ে রেখে গেছে অস্টিন। কিন্তু ট্র্যানসিভারটা আছে। আর আছে কন্টেইনার সহ কফি বানানোর অন্যান্য সরঞ্জাম। মৃদু আলো বেরুচ্ছে ট্রানসিভারের ডায়ালে বসান ক্ষুদে বালব থেকে। ক্যাম্প থেকে একটু দূরে জঙ্গলের কিনারায় রাখা হয়েছে পিকআপ আর গোল্ডম্যানের জীপটা।
ক্যাম্পের সীমানায় পাহারা দিচ্ছে এখন একজন গার্ড। হাতে একটা ছোট লাঠি। কোমরে গোঁজা .৩৮ কোল্ট অটোমেটিক।
গাছের আড়ালে স্থির হয়ে থাকল সাসকোয়াচ। দুটো বাতির আলোক সীমানার একেবারে শেষ প্রান্তে আছে সে। আর এক কদম এগোলেই ভেতরে এসে পড়বে।
আগুনের কাছ থেকে দূরে বসে বসে তাস খেলছে আরও ছয়জন গার্ড। ডিউটি অফ ওদের। চক্কর মারতে মারতে সঙ্গীদের কাছে এসে প্রতিবারেই অন্তত পনের সেকেন্ড করে ওদের খেলা দেখে যায় কর্তব্যরত গার্ড।
আস্তে করে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল সাসকোয়াচ। সোজা হেঁটে এগিয়ে এল তার সবচেয়ে কাছের আলোর স্ট্যান্ডটার কাছে। বিশাল একটা রোমশ হাত বাড়িয়ে আলতো করে ঠেলা দিল স্ট্যান্ডের গায়ে। আলোসহ কাত হয়ে পড়ে গেল ওটা।।
চমকে ফিরে তাকাল গার্ডরা। আতংকিত চোখে দেখল বিশালদেহী রোমশ একটা জানোয়ার ঝড়ের গতিতে ছুটে যাচ্ছে দ্বিতীয় লাইটস্ট্যান্ডটার দিকে।
এক ধাক্কায় লাইট স্ট্যান্ডটা ফেলে দিল সাসকোয়াচ। ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল ক্যাম্প এলাকা। এক মুহূর্ত দ্বিধা করল কর্তব্যরত গার্ড। তারপর সাহসে বুক বাধল। লাঠিটা কোমরের বেল্টে গুঁজে রেখে টান মেরে খাপ থেকে রিভলভার বের করে আনল। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল দ্বিতীয় লাইটস্ট্যান্ডটার দিকে। তাস ফেলে উঠে দাঁড়াল তার সঙ্গীরাও। সার বেঁধে এগোল তার পিছু পিছু।
ওদিকে জেনারেটর ট্রাকের কাছে এগিয়ে গেছে সাসকোয়াচ। অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। এগিয়ে আসা গার্ডদের দিকে একবার তাকাল। তারপর ঝুঁকে ট্রাকের পেছনে তলার দিকের কিনারা চেপে ধরল। পরক্ষণেই ভয়ংকর এক গর্জন ছেড়ে হাঁচকা টান মারল উপর দিকে। ঝাকুনি খেয়ে শূন্যে উঠে গেল ভারি ট্রাকের পেছনটা। একেবারে সাসকোয়াচের মাথা ছাড়িয়ে গেল। হাতের দুই তালু ট্রাকের পেছন দিকের তলায় ঠেকিয়ে জোরে ঠেলে দিল সাসকোয়াচ। নাকের ওপর খাড়া হয়ে গেল ট্রাকটা। আধসেকেন্ড স্থির থাকল। তারপরই ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে পড়ল দড়াম করে। জেনারেটরের সঙ্গে যুক্ত তারগুলো ছিড়ে যেতেই ছেড়া মাথা থেকে তীব্র নীল স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে গেল। ওদিকে ট্যাংক থেকে গল গল করে মাটিতে পড়ছে পেট্রল। এতে বৈদ্যুতিক ফুলিঙ্গের ছোঁয়া লাগতেই দপ করে জ্বলে উঠল আগুন।
দেখতে দেখতে জেনারেটর ট্রাকটাকে গ্রাস করল আগুন। অন্ধকার দূর হয়ে গেল ক্যাম্প এলাকা থেকে। দাউ দাউ জ্বলছে লাল আগুন।
পালাচ্ছে গার্ডের দল! পড়িমরি করে গিয়ে ঢুকছে জঙ্গলের ভেতরে। সবার পেছনে হাতে .৩৮ নিয়ে কর্তব্যরত গার্ড। পিছু নিল সাসকোয়াচ। ছোঁ মেরে অবলীলায় তুলে নিল পিস্তলধারীকে। মাথার ওপর তুলে ছুঁড়ে দিল জঙ্গলের দিকে, যেন একটা হালকা ছোট্ট পুতুল ছুঁড়ল।
ফিরে দাঁড়াল সাসকোয়াচ। দ্রুত এগিয়ে এল। তাঁবু দুটো লক্ষ্য। টেনে খুঁটিসুদ্ধ উপড়ে আনল একটা তাঁবু। কাগজ ভেঁড়ার মত ফড়ফড় করে টেনে ছিড়ল অতি সহজে। দ্বিতীয় তাঁবুটারও একই গতি করে এগিয়ে গেল টেলিমেট্রি ভ্যানের দিকে।
বনের ভেতর থেকে জ্বলন্ত জেনারেটর ভ্যানের আলোয় আতংকিত চোখে এই ধ্বংসলীলা দেখছে ছয়জন গার্ড। একটা ঝোপের ভেতরে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে হতভাগ্য গার্ডটা। তার হাতের পিস্তল ছিটকে গিয়ে পড়েছে আরও দশ হাত দূরে মাটিতে।
টেলিমেট্রি ট্রাকটা ধবংস করে দিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল সাসকোয়াচ। এক ধার খামচে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল ভারি টেবিলটা। ঝন ঝন শব্দে মাটিতে পড়ে ভাঙল কফি কন্টেইনার, আর যন্ত্রপাতি। টেবিলটা মাটিতে আছড়ে ফেলল সাসকোয়াচ। তারপর চারপাশে একবার চোখ বুলাল। জীপ আর পিকআপটা দেখতে পেয়েই এগিয়ে গেল ওদিকে। এক এক করে উল্টে দেখল দুটোই। আর কিছু ভাঙার নেই। নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে যেদিক থেকে বেরিয়েছিল আবার সেদিক দিয়েই বনের ভেতরে ঢুকে গেল সে।
ধীরে ধীরে নিভে আসছে জ্বলন্ত ট্রাকের আগুন। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল গার্ডেরা। গাছপালার আড়াল থেকে বাইরে বেরোতে যাবে, হঠাৎ এক বিস্ফোরণে চমকে উঠে আবার দ্রুত গিয়ে ঢুকল বনের ভেতরে। পেট্রল ট্রাংক ফেটেছে। আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন! প্রচন্ড হয়ে উঠছে উত্তাপ। বিস্ফোরণের ফলে ধাতু আর কাঠের ছোট বড় অসংখ্য টুকরো ছিটকে পড়েছে এদিক ওদিক। কয়েকটা জ্বলন্ত টুকরো গিয়ে পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা ছেড়াখোড়া তাঁবুর কাপড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে গেল ওগুলোতেও। সাংঘাতিক উত্তাপ সইতে না পেরে বনের আরও গভীরে ঢুকে গেল গার্ডের দল।
ওদিকে দ্রুত ব্যাটল মাউনটেনের দিকে ছুটছে সাসকোয়াচ। নিজের কাজ ভালমতই সমাধা করেছে সে। যথেষ্ট খোঁচান হয়েছে স্টিভ অস্টিনকে, এতে কোন সন্দেহ নেই তার।
সবে ভোর হয়েছে। সূর্য উঠতে দেরি এখনো। ধূসর ছায়াটুকু সরি সরি করেও সরছে না বনভূমির ওপর থেকে। বেস ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে চলেছে অস্টিন, সঙ্গে গোল্ডম্যান আর রেন্ট্রি। রাতের ধ্বংসলীলার খবর পেয়েছে তারা মাত্র ঘন্টা দেড়েক আগে। রাতের বেলায়ই একজন গার্ড খবর দিয়েছে ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসে। অফিসের ফায়ার ডিভিশনের লোকেরা এসে বেস ক্যাম্পের আগুন নিভিয়েছে। আশেপাশে শুকনো গাছপালা নেই তাই রক্ষা, নইলে দাবানল লেগে যেত।
যে গার্ডটাকে ছুঁড়ে ফেলেছিল সাসকোয়াচ, অজ্ঞান অবস্থায় তুলে এনেছে তাকে তার সঙ্গীরা। কপাল ভাল লোকটার, একটা ঘন ঝোপের ওপর গিয়ে পড়েছিল। শরীরে বেশ কিছু কাটাছেড়া আর মেরুদন্ডে সামান্য চোট লাগা ছাড়া তেমন কোন মারাত্মক আঘাত পায়নি সে। সেরে উঠতে সাত দিনও লাগবে না।
পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে জেনারেটর ট্রাকটা। ওয়র্ক টেবিলে রাখা যন্ত্রপাতিগুলোও আর কোন কাজে আসবে না, বেঁকেচুরে ভেঙে শেষ। এখনও অল্প অল্প ধোঁয়া উড়ছে পোড়া ট্রাকটার শরীর থেকে।
ধ্বংস হয়ে যাওয়া বেস ক্যাম্পের আঙিনায় এসে দাঁড়ালেন গোল্ডম্যান। তাঁর একটু তফাতে অস্টিন আর রেনট্রি।
আশ্চর্য! ভুরু কুঁচকে পোড়া ট্রাকটার দিকে তাকিয়ে আছেন গোল্ডম্যান।
জেনারেটর ট্রাকটার ওপাশে সামান্য একটু জায়গায় জমাট কাদা। হাঁড়ি পাতিল আর বাসনপেয়ালা ধুয়েছে ওখানে বাবুর্চি (গার্ডদেরই একজন), গত কয়েক দিনে অনেকখানি পানি ঢেলেছে, তাই কাদা হয়ে গেছে একেবারে। প্যাচপ্যাচেই হয়ে গিয়েছিল, আগুনের প্রচন্ড উত্তাপে জমে এসেছে।
কি ভেবে ওই কাদাটুকুর কাছেই এগিয়ে গেল অস্টিন। যা ভেবেছিল, ঠিকই। কাদায় বসে আছে সাসকোয়াচের পায়ের ছাপ।
এদিকে আসুন, হাত তুলে ডাকল অস্টিন।
তিন লাফে পৌঁছে গেলেন গোল্ডম্যান। কি?
দেখুন, আঙ্গুল তুলে সাসকোয়াচের পায়ের ছাপ দেখাল অস্টিন। সাসকোয়াচ ইন্ডিয়ানদের অলীক কল্পনা নয়, বাস্তব সত্য।
ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পায়ের ছাপগুলো দেখলেন গোল্ডম্যান। ঈশ্বরই জানেন, কেমন দানবের পায়ের ছাপ ওগুলো!
পেছনের গভীর জঙ্গল দেখিয়ে বলল অস্টিন, ওই পায়ের ছাপের মালিকই তুলে নিয়ে গিয়েছে ইভান আর মার্লিনকে। ইভানকে আবার ওই-ই ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, কেন, কে জানে! মার্লিনকে আটকে রেখেছে কেন তাই বা কে জানে! ও জ্যান্ত আছে কি নেই তাও জানি না।
অস্টিনের স্বর অদ্ভুত রকম বদলে গেছে। এই স্বর চেনেন গোল্ডম্যান। কোন একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ভয়ংকর বিপদে এগিয়ে যাবার আগে অমন হয় এই যন্ত্র-মানবের। খপ করে অস্টিনের হাত চেপে ধরলেন গোল্ডম্যান।
কি বলতে চাইছো?
গোল্ডম্যানের চোখে চোখে তাকাল একবার অস্টিন। তারপর আবার ঘাড় ফেরাল বনের দিকে। আপন মনেই বলল, চলার পথে নিজের চিহ্ন রেখে যেতে বাধ্য অতবড় দানব! ঝটিতি মুখ ফেরাল আবার গোল্ডম্যানের দিকে, আমি নিশ্চিত, সাসকোয়াচকে অনুসরণ করলেই মার্লিনের খোঁজ পাব। এবং এটাই একমাত্র উপায়।
অস্টিনের কব্জিতে গোল্ডম্যানের হাতের চাপ বাড়ল। আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল অস্টিন। ঘুরে দাঁড়াল। পরক্ষণেই রওনা হয়ে গেল বনের দিকে।
স্টিভ, চেঁচিয়ে ডাকলেন গোল্ডম্যান। কিন্তু বৃথা। বায়োনিক গতিতে ছুটেছে অস্টিন। নিমেশে অদৃশ্য হয়ে গেছে বনের ভেতর।
পরিষ্কার চিহ্ন রেখে গেছে সাসকোয়াচ। জায়গায় জায়গায় গাছের ছোট ঘোট ডাল ভেঙে আছে, পায়ের তলায় ঘাস মাটি মাড়ান। বায়োনিক চোখটা ব্যবহার করছে অস্টিন। এতে আশেপাশের অতি সামান্য অস্বাভাবিকতাও নজর এড়াচ্ছে না তার। দ্রুত গতিতে সাসকোয়াচের গতিপথ অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে সে।
ভিডিও সেন্সর ব্যবহার করছে ওরা তিনজনে। অস্টিনের গতিবিধির ওপর পরিষ্কার নজর রাখছে। বিশেষ টেলিভিশনের পর্দায় দেখছে, সাসকোয়াচের ফেলে আসা চিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে বায়োনিক ম্যান। ওরা কিন্তু জানে না, অস্টিন যন্ত্রমানব।
ওরেব্বাবা, লোকটার টেলিফটো ভিশন পর্যন্ত আছে! বলল একজন পুরুষ।
হ্যাঁ, বলল মেয়েটা, দেখছ না, দুশো গজ দূরে থেকেও অতি হালকা পায়ের ছাপ চোখ এড়াচ্ছে না ওর! এমন কি ডাল পাতায় লেগে থাকা সূক্ষ্মতম আঁচড়টুকু পর্যন্ত ঠিক দেখছে পাচ্ছে!
ওর দেহের ভেতরে কোন ধরনের থার্মাল সেন্সর আছে মনে হচ্ছে! স্পীড দেখেছ? তা ছাড়া খালি চোখে এভাবে চিহ্ন দেখতে পাওয়ার কথা নয়। তা সে যত উন্নত মানের টেলিফটোভিশনই থাকুক না কেন।
ইনফ্রারেড? জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।
তা তো আছেই মনে হচ্ছে।
অতি উন্নতমানের প্রায় সমস্ত রকম যন্ত্রের সংমিশ্রণ নাকি ও। নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল দ্বিতীয় পুরুষ।
তার কথার কোন জবাব দিল না কেউ।
কোন ধরনের সৃষ্টি? প্রথম লোক জিজ্ঞেস করল মেয়েটাকে, নায়োসিনথেটিক?
জানি না, বলল মেয়েটা। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের পর্দার দিকে।
অর্থাৎ, ওকে পরীক্ষা করে দেখা একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমারও তাই মত, বলল মেয়েটা, পরীক্ষাই করতে হবে ওকে।
তাহলে আর দেরি কেন? সাসকোয়াচকে পাঠাই? এক মুহূর্ত কি ভাবল মেয়েটা। হারাব না তো ওটাকে?
শ্রাগ করল প্রথম লোকটা, সেটাও দেখা উচিত।
সোজা ব্যাটল মাউনটেনের দিকে এগিয়ে গেছে সাসকোয়াচ। জীবটাকে অনুসরণ করে যতই এগোচ্ছে, হালকা অস্বস্তি জোরদার হচ্ছে অস্টিনের মনে। ওখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে একবার গিয়েছে সে, সাসকোয়াচকে দেখেছে, এখন আবার যাচ্ছে জীবটার নিজের এলাকায় হয়ত তার সঙ্গে লাগতেই। চলার গতি ধীর করে আনল অস্টিন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশেপাশের জঙ্গলের দিকে নজর রাখতে রাখতে এগোল। ক্রমেই আরও বেশি আদিম হয়ে আসছে জঙ্গল। আরও কয়েক সেকেন্ড পরে হঠাৎই থমকে দাঁড়াল সে।
ইনফ্রারেডে কোন কিছুর অস্তিত্ব টের পায়নি এখন অস্টিন। কিন্তু সেন্সরের সাহায্যে একটা বিরাট জন্তুর উপস্থিতি টের পাচ্ছে। আশেপাশে গভীর জঙ্গল। ঝোপঝাড়গুলো ঘন লতায় আচ্ছন্ন। তলার দিকটা আবার লম্বা শ্যাওলার আস্তরণে ঢাকা। এই অঞ্চলে তেমন একটা কাজ করবে না ইনফ্রারেড। কাজেই এটাকে আর এখন চালু রাখার কোন মানে হয় না। সুইচ অফ করে দিল সে।
অতি তীক্ষ্ণ বায়োনিক শ্রবণ যন্ত্রে মৃদুভাবে একটা শব্দ ধরা পড়ছে এখন। ডাল ভাঙছে কেউ। পাতায় গা ঘষছে। এগিয়ে আসছে কোন বড় জানোয়ার।
কান পেতে শুনছে অস্টিন। ক্রমেই আওয়াজ স্পষ্ট হচ্ছে। শব্দের উৎস বরাবর তাকাল সে। কিন্তু চোখের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতি ঘন জঙ্গল। টেলিফটো ভিশন পর্যন্ত সুবিধে করতে পারছে না।
হঠাৎ থেমে গেল শব্দ। একটা ঘন ঝোপের আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছে সাসকোয়াচ। সামনের দিকে আর দুপাশে একবার তাকিয়েই আস্তে করে বসে পড়ল। অপেক্ষা করবে।
বাড়তে বাড়তে আওয়াজ হঠাৎ থেমে যাওয়ায় কৌতূহলী হয়ে পড়ল অস্টিন। অতি ধীরে এগিয়ে গেল কয়েক পা। উঁকিঝুঁকি মারল। কিন্তু কিছুই নজরে পড়ল না। এগিয়ে গেল আরও খানিকটা। বিশাল ঝোপটার ওপর চোখ পড়তেই থেমে গেল। সন্দেহ হচ্ছে। এক সেকেন্ড কি ভাবল, তারপর এগিয়ে গেল ঝোপটার দিকে। কয়েক পা এগিয়েই আবার থেমে গেল। কি ভেবে পিছিয়ে আসতে লাগল আবার। তারপর ঘুরে রওনা দিল ঝোপটার দিকে। গজ দশেক গিয়ে থেমে পড়ল। অপেক্ষা করে দেখতে চায় কি ঘটে।
মিনিট দশেক পর আর অপেক্ষা করতে তাকাল না সাসকোয়াচ। উঠে পড়ে রওনা হল আবার। ডালপাতা ভাঙার আওয়াজ উঠল। ঝোপটার ডান পাশে ছোট্ট এক চিলতে জায়গায় গাছপালা আশেপাশের চাইতে হালকা হয়ে জন্মেছে। এক ছুটে এই জায়গাটুকুতে এসে দাঁড়াল অস্টিন। সাসকোয়াচের সঙ্গে লাগতে হলে এখানে লাগাই ভাল।
আধ সেকেন্ড থেমে গিয়েছিল শব্দ, আবার শুরু হল। মোড় নিয়ে অস্টিনের দিকেই এগোচ্ছে সাসকোয়াচ। দুই কি তিন সেকেন্ড পরই ঝোপঝাড় ঠেলে বেরিয়ে এল সে। ভয়ংকর শব্দে গর্জন করে উঠল আচমকা। পর্বতের গায়ে ধ্বনিপ্রতিধ্বনি উঠল। কেঁপে উঠল বনভূমি।
স্থির দৃষ্টিতে সাসকোয়াচের দিকে তাকিয়ে আছে অস্টিন। আট ফুট লম্বা দানবটার সাদা চোখ দুটো জ্বলছে দপ দপ করে, ইলেকট্রিক বালবের মত। এই মাত্র যেন নরক থেকে উঠে এসেছে সাক্ষাৎ শয়তান। বড় করে একবার শ্বাস নিল অস্টিন।
আরেকবার প্রচন্ড গর্জন করেই তীব্র গতিতে ছুটে এল সাসকোয়াচ।
০৬. চোখের পলকে খোলা জায়গাটুকু
চোখের পলকে খোলা জায়গাটুকুর মাঝখানে চলে এল সাসকোয়াচ। অস্টিনের ফুট দশেক সামনে থমকে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত স্থির চোখে দেখল অস্টিনকে। যেন তার শক্তির পরিমাণ বুঝে নেবার চেষ্টা করছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল জানোয়ারটা। ধীরে ধীরে সামনের দিকে ঝুঁকছে। কোমর বাঁকা করে দুহাতের আঙ্গুলের ডগা মাটিতে ছোঁয়াল। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিটা অনেকটা গরিলার মত।
সাসকোয়াচ ঠিক কতখানি বুদ্ধিমান, জানা নেই অস্টিনের। হয়ত বা মানুষের পর পরই ওর স্থান। কিন্তু কি করে বোঝা যাবে সেটা? মানুষের কথা বুঝতে পারে কিনা, কে জানে। কথা বলল অস্টিন, মানুষের কথা বোঝ তুমি?
উত্তরে দপ করে জ্বলে উঠল সাসকোয়াচের চোখ। দৃষ্টি দিয়েই অস্টিনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেবে যেন।
কোন জাতের জীবন তুমি? আবার জিজ্ঞেস করল অস্টিন। বিকট দাঁত বের করে ভেঙুচাল সাসকোয়াচ।
রাগ কর না, সাসকোয়াচ, নরম গলায় বলল অস্টিন। বুঝে থাকলে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
নড়ে উঠল জীবটা। সরাসরি আক্রমণ করল না। অস্টিনকে কেন্দ্র করে চক্কর দিতে আরম্ভ করল।
কি হল, এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছ? বুঝল অস্টিন, জীবটা টের পেয়ে গেছে, সে সাধারণ মানুষ নয়। একটা ব্যাপারে অস্টিন নিশ্চিত হল, সাসকোয়াচ অত্যন্ত বুদ্ধিমান।
অস্টিনের কথায় আরেকবার বিকটভাবে দাঁত ভেঙচাল সাসকোয়াচ।
হ্যাঁ, ভাল কথা, আমাদের মার্লিন নিশ্চয়ই তোমার কাছে আছে? ওই মেয়েটা, যাকে ক্যাম্প থেকে…
হঠাৎ এক লাফে একেবারে সামনে চলে এল জীবটা। হাত বাড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করল অস্টিনকে।
হুঁশিয়ার হয়েই আছে অস্টিন। বিদ্যুৎ গতিতে ছিটকে পেছনে সরে গেল সে। সামনে ছুটে এল সাসকোয়াচ। পাশ কাটাল অস্টিন। তার পাশ দিয়ে দমকা হাওয়ার মত ছুটে গেল জীবটা।
পাল্টা আক্রমণ করল না অস্টিন। কথা বুঝতে পারলে, বুঝিয়ে শুনিয়ে জীবটাকে কায়দা করার ইচ্ছে তার।
ঘুরে দাঁড়িয়েছে সাসকোয়াচ।
দেখ, মারপিট মোটেই পছন্দ না আমার। কথা বললেও আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে তৈরি হয়েই আছে অস্টিন। তবে ইচ্ছে করলে তোমার মত এক আধজনকে পিটিয়ে লাশ করতে পারি। এখন দয়া করে বল, মানুষের কথা বোঝ তুমি?
লাফিয়ে কাছে চলে এল সাসকোয়াচ। অস্টিনকে ধরতে চায়। কায়দা করে তার নাগালের বাইরে থাকল অস্টিন।
দেখ, আমরা দুজনে বন্ধু হয়ে যেতে পারি…
এবারে আর লাফ দিল না জীবটা। ধাঁ করে সোজা ছুটে এল। পৌঁছতে গিয়ে একটা ছোট্ট গাছের চারায় পা বেধে গেল অস্টিনের। পড়ল না, কিন্তু বাধা পাওয়ায় সময় মত সরে যেতে পারল না। তার একটা হাত ধরে ফেলল সাসকোয়াচ। টান মেরে ছুঁড়ে দিল ওপর দিকে।
শূন্যে থাকতেই ভারসাম্য ঠিক করে ফেলেছে অস্টিন। আলতো ভাবে এসে নামল মাটিতে। ছাড়া পাওয়া স্প্রিঙের মত লাফ দিল পরক্ষণেই। একেবারে সসকোয়াচের সামনে এসে নামল। মুখখামুখি হল দুজনে।
বুঝলাম, বলল অস্টিন। ধোলাই দরকার তোমার…
লাফিয়ে এসে তাকে ধরতে চেষ্টা করল সাসকোয়াচ। সামান্য একটু পাশে সরে গেল অস্টিন। পরক্ষণেই বায়োনিক হাতে প্রচন্ড জোরে জীবটার পেটে ঘুসি মারল। বাতাস ভরা রবারের টায়ারের ওপর যেন আঘাত পড়ল। কোন প্রতিক্রিয়া নেই আজব জীবটার। অথচ এই আঘাতে গরিলার মত জানোয়ারও মাটিতে শুয়ে পড়ার কথা। শুধু হাপর থেকে বাতাস বেরোনোর মত একটা আওয়াজ করে উঠল সাসকোয়াচ। এ কোন ধরনের জীবরে বাবা, ভাবল অস্টিন।
তড়াক করে পিছনে সরে এল অস্টিন। আবার মারার জন্যে তৈরি হল।
তীব্র গতিতে সামনে ছুটে আসছে সাসকোয়াচ। লাফ দিল অস্টিন। শূন্যে ডিগবাজি খেল। চক্কর পুরো হতেই সোজা করল দুপা। ভয়ংকর ফ্লাইং কিক লাগল জীবটার সোলার প্লেক্সাসে। ঠেসে ভরা ময়দার বস্তায় লাফ মারল যেন সে। পেছনে উল্টে পড়ল সাসকোয়াচের ভারি শরীরটা। তার দেহের ভারে চেপ্টে গেল বিশাল এক ঝোপ।
লাথি মেরেই কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল অস্টিন, কিন্তু চোখের পলকে উঠে দাঁড়াল আবার।
ভারি শরীরটা টেনে তোলার চেষ্টা করছে সাসকোয়াচ।
মারপিটের শখ মজেছে? জিজ্ঞেস করল অস্টিন। এবার বল তো, জীবটা আসলে কি তুমি?
উঠে দাঁড়িয়েছে সাসকোয়াচ। ভয়ংকর এক হাঁক ছাড়ল। আওয়াজটা কেমন যেন যান্ত্রিক মনে হল অস্টিনের। ক্রমেই তাকে আরও বিস্মিত করছে আজব জীবটা। ওটা কি, তাই বুঝতে পারছে না এখনও।
আবার এগিয়ে আসছে সাসকোয়াচ। কিন্তু এবারে আর একরোখার মত নয়। বুঝে শুনে, গার্ড রেখে। অপেক্ষা করছে অস্টিন। তার তিন ফুটের মধ্যে এসেই হঠাৎ বাঁয়ে সরল জীবটা, পরক্ষণেই ডানে। এবং ডানে সরার সময়ই প্রচন্ড ঘুসি চালাল।
অস্টিনের বুকে লাগল আঘাতটা। উড়ে গিয়ে একটা রেডউডের চারার ওপর পড়ল। শব্দ করে ভাঙল চারাটা। হাত পা ছড়িয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল অস্টিন।
এগিয়ে আসছে সাসকোয়াচ। সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অস্টিন। মুখোমুখি হল দুজনে। আবার অস্টিনের বুকে মারার চেষ্টা করল সাসকোয়াচ। কিন্তু এবারে আর সুযোগ দিল না অস্টিন। চট করে বসে পড়ল। ঘুষিটা তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। ভারসাম্য হারাল সাসকোয়াচ। একটু কাত হয়ে গেল। বেকায়দা অবস্থায় থেকে ভয়ানক ঘুসি খেল পেটে। সামনের দিকে একটু কুঁজো হয়ে গেল তার শরীর। কায়দামত পেয়ে জীবটার ডান চোয়ালে বায়োনিক হাতের এক সাংঘাতিক ঘুষি লাগাল অস্টিন। ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল সাসকোয়াচ। কিন্তু আশ্চর্য! সামান্যতম গোঙানি কিংবা ওই ধরনের কোন আওয়াজ বেরোল না তার মুখ থেকে এবারও। ব্যথা পাবার কোন লক্ষণই নেই।
অস্টিনের অবচেতন মনে ছিল চিন্তাটা এতক্ষণ, এবারে স্বচ্ছ হতে আরম্ভ করল। তারই মত বায়োনিক কোন সৃষ্টি নয়ত জীবটা? গরিলা সাইবর্গ? কিন্তু গরিলা তো এত লম্বা হতে পারে না।
অন্ধকার সেন্সর ডিসপ্লে রুমে বসে টেলিভিশনের পর্দায় যুদ্ধ দেখছে তিনজনে।
দারুণ…চমৎকার…! হেসে বলল প্রথম পুরুষ।
শক্তিতে কেউ কারও চাইতে কম না, বলল দ্বিতীয়জন।
আমার সন্দেহ আছে, বলল মেয়েটা।
এখনও বাজি রাখতে পারি, সাসকোয়াচই জিতবে। জোর দিয়ে বলল প্রথমজন।
আরেকটা আক্রমণ ঠেকাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে অস্টিন। আচমকা তেড়ে এল সাসকোয়াচ। কিন্তু অর্ধেক এসেই কি মনে করে থেমে গেল। আড়চোখে ডানে তাকাল। প্রায় আধমন ওজনের একটা বিশাল পাথর পড়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে পাথরটা তুলেই ধাই করে ছুঁড়ে মারল সে। বায়োনিক হাতের তালু দিয়ে অতি সহজেই পাথরটাকে ঠেকাল অস্টিন, তারপর শটপুটে বর্শা ছোঁড়ার মত করে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
আরে, বলল অস্টিন, যুদ্ধে টুলস ব্যবহারও জানা আছে দেখছি তোমার?
উত্তরে মাথা নিচু করে ডাইভ দিল সাসকোয়াচ। দড়াম করে মাথা দিয়ে মারল অস্টিনের পেটে। পড়ে গেল অস্টিন। পেটের চামড়ার নিচে রবারের পেশী লাগান থাকায় ব্যথা পেল না। কিন্তু উঠতে আধ সেকেন্ড বেশি সময় লাগল। এই সময়টুকুতেই তৈরি হয়ে গেল সাসকোয়াচ। অস্টিন উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। অস্টিনকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে দানবীয় হাতের চাপ বাড়াল সে।
আরে ছাড়, ছাড়। হাড়গোড় ভেঙে ফেলবে নাকি আমার? ভয়ংকর চাপে দম ফেলতে পারছে না সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান। ঝাড়া মেরে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল অস্টিন, পারল না। অনেক কষ্টে সাসকোয়াচের আলিঙ্গন থেকে বাঁ হাতটা বের করে এখনই পিস্টনের মত তীব্র বেগে পেছন দিকে চালাল। একটু ঢিল হল আলিঙ্গন। এই সুযোগে ঝাড়া মেরে নিজেকে মুক্ত করল অস্টিন।
অস্টিনের বায়োনিক কনুয়ের এই ভয়ংকর খোচায় সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারাবে যে কোন গরিলা, কিন্তু সাসকোয়াচের কিছুই হল না। দুপা পিছিয়ে গেছে সে। চোখ দুটো আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে।
আধ সেকেন্ড অস্টিনের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকল সাসকোয়াচ, তারপর ঘুরেই হাঁটতে শুরু করল। না, যুদ্ধে হেরে চলে যাচ্ছে না সে। একটা ইঞ্চি চারেক পুরু গাছের চারার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দুই বিশাল থাবায় চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে উপড়ে আনল চারাটা। এটা দিয়েই অস্টিনকে পেটানোর ইচ্ছে। স্থির দাঁড়িয়ে অদ্ভুত জীবটার গতিবিধি লক্ষ্য করছে অস্টিন।
কাছে এসে গাছটা দিয়ে মারল সাসকোয়াচ, বেসবল ব্যাট দিয়ে বল মারার মত করে। তৈরিই ছিল অস্টিন। বায়োনিক বাহু দিয়ে আঘাতটা ঠেকাল। তারপর গাছটা চেপে ধরল দুহাতে। কিন্তু রাখতে পারল না। গর্জন করে উঠে হ্যাঁচকা টানে গাছটা ছাড়িয়ে নিল সাসকোয়াচ। টানের চোটে সামনে ঝুঁকে গেল অস্টিন। সামলে নেবার আগেই গাছ ঘুরিয়ে আবার মারল দানবটা। এবারে অন্যপাশে। বাড়িটা লাগল অস্টিনের রক্তমাংসের হাতে। তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল বাহুতে। অস্ফুট একটা শব্দ করে পড়ে গেল সে।
সেন্সর ডিসপ্লে রুমের তিনজনে একটু অবাক হল। অস্টিনের পতনটাকে যেন ঠিক মেনে নিতে পারছে না ওরা। কৌতূহল আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
আরে, বলল প্রথম পুরুষ, ওর বাঁ হাতটাই শুধু বিশেষভাবে তৈরি মনে হচ্ছে!
ওরকমই তো লাগছে, বলল মেয়েটা।
ডান হাতে গাছের চারাটা উঁচু করে ধরল সাসকোয়াচ। গোড়া সামনের দিকে। বল্লম ছোড়ার মত ছুঁড়ল অস্টিনের দিকে।
গড়িয়ে একপাশে সরে গেল অস্টিন। তার পেছনের একটা গাছের গুঁড়িতে গিয়ে প্রচন্ড জোরে লাগল চারাটা।
উঠে দাঁড়িয়েছে আবার অস্টিন। এগিয়ে এসেছে সাসকোয়াচ। দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে গার্ড রেখে ঘুরতে লাগল।
কি শুরু করেছ? বলল অস্টিন। পরিচয় দিতে এত আপত্তি কেন?
সেই একই উত্তর। গর্জন করে ছুটে এল সাসকোয়াচ।
যা শালা! বলেই পাশে সরে নুয়ে গেল অস্টিন। তার পাশ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যাবার সময় খপ করে সাসকোয়াচের ডান হাতটা ধরে ফেলল। হ্যাঁচকা টান খেয়ে থেমে গেল সাসকোয়াচ। মুচড়ে হাতটা ওটার পেছনে নিয়ে এল অস্টিন, ঠেলে দিল ওপর দিকে। হাঁপর থেকে জোরে বাতাস বেরিয়ে যাবার মত এক ধরনের আওয়াজ করল সাসকোয়াচ এবারেও।
সাসকোয়াচের পেছনে দাঁড়িয়ে ওর হাতটা আরও ওপর দিকে ঠেলে দিল অস্টিন। এখনও বল, তুমি আসলে কি?
নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করল সাসকোয়াচ। অস্টিন যেমনভাবে তাকে মেরেছিল পেছনে কনুই চালাবার চেষ্টা করল। পারল না। এতক্ষণ শুধু আত্মরক্ষা করে এসেছে অস্টিন। মনে মনে ঠিক করল, আর না। এবারে এর পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। বেকায়দা অবস্থায় ফেলে, ব্যাটা কি ধরনের জীব জানতে হবে। প্রচন্ড জোরে সাসকোয়াচের হাতটা ওপরের দিকে ঠেলে দিল সে।
চিৎকার করে উঠবে সাসকোয়াচ, ভেবেছিল অস্টিন। কিন্তু কিছুই করল না দানবটা। তার বদলে আশ্চর্য একটা ব্যাপার ঘটল। ফাপা ধাতব শব্দ করে হাতটা কাধের কাছ থেকে ছিড়ে এল সাসকোয়াচের। রবার ছেড়ার শব্দ হল। কয়েকটা তীক্ষ্ণ শব্দ করে ওটার ভেতরে ইলেকট্রিক কানেকশন জ্বলে যাবার আওয়াজ হল বার কয়েক।
ভুরু কুঁচকে সাসকোয়াচের ছেড়া হাতটার দিকে তাকিয়ে রইল অস্টিন। ছেড়া জায়গায় চামড়া নেই, মাংস নেই, রক্ত নেই, হাড় নেই। বদলে আছে জটপাকান অসংখ্য তার, পুলি ইত্যাদি। রবারের তৈরি কৃত্রিম মাংসপেশী। ভেতর থেকে হালকা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। পোড়া রবারের গন্ধ নাকে লাগছে অস্টিনের। গরিলাসাইবর্গ নয় সাসকোয়াচ, অতি উন্নতমানের গরিলা-রোবট।
নিজের ছেড়া হাতটার দিকে তাকিয়ে আছে সাসকোয়াচ। হঠাৎই ফিরে তাকাল ওটা অস্টিনের দিকে। হাপর থেকে বাতাস বেরোনর জোর আওয়াজ করে ছুটে এল। অস্টিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাত থেকে নিজের ভেঁড়া হাতটা ছিনিয়ে নিয়ে বনের দিকে ছুটে পালাল দ্রুত গতিতে।
পিছু নিল অস্টিন। মনে হাজারো চিন্তা এসে ভর করেছে। সাসকোয়াচের কিংবদন্তী অনেক পুরনো কমপক্ষে আড়াইশো বছর আগে থেকেই এই এলাকার ইন্ডিয়ানদের মাঝে এর কথা প্রচলিত। কিন্তু তখনকার পৃথিবীর কোন মানুষের পক্ষে অতি উন্নতমানের এই রোবট বানানো একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তাহলে? তাহলে কি অদ্ভুত একটা চিন্তা খেলে গেল অস্টিনের মনে। ভাবতে ভাবতেই সাসকোয়াচের পিছু পিছু ছুটছে সে। যে করেই হোক ধরতে হবে রোবটটাকে।
দ্রুত ছুটছে অস্টিন। তার থেকে বড়জোর পঁচিশ তিরিশ গজ দূরে আছে সাসকোয়াচ। একটা হাত হারিয়ে গতির দ্রুততাও যেন অনেকখানি কমে গেছে ওটার। কোন ধরনের পাওয়ার লস নিশ্চয়ই।
ব্যাটল মাউনটেনের পশ্চিম ঢালের দিকে ছুটেছে সাসকোয়াচ। বনসীমার হাজার ফুট নিচে, এক জায়গায় পড়ে থাকা কয়েকটা গাছ লাফিয়ে ডিঙাল সে। একটা খাদ ডিঙাল, তারপর হারিয়ে গেল আরেকটা বিশাল খাদের ভেতরে। খাদটার পাড়ে পৌঁছে দেখল অস্টিন, তলা ধরে দ্রুত ছুটছে সাসকোয়াচ। পাহাড়ী ঢল সৃষ্টি করেছে কয়েকশো গজ দৈর্ঘ্যের এই খাদটা। এপারে দাঁড়িয়েই খাদের ওপারে পাহাড়ের গায়ের বিশাল গুহামুখটা দেখতে পাচ্ছে অস্টিন। বেশ কিছু রেডউড জন্মে আছে ওখানটায়, কয়েকটা পড়ে আছে মাটিতে। বায়োনিক চোখ ব্যবহার না করলে গুহামুখটা দেখতেই পেত না সে।
গুহামুখের কাছে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়াল সাসকোয়াচ। তারপর ঢুকে পড়ল ভেতরে।
লাফিয়ে খাদের তলায় নামল অস্টিন। তীব্র গতিতে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল গুহামুখে। ভেতরে উঁকি দিল।
পাথুরে খাদ। দশ ফুট মত উঁচু, পাশেও এতটাই হবে। তিরিশ ফুট সোজা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে। ঢালু হয়ে একটা পাথরের দেয়াল নেমে এসেছে ওপাশে। কিন্তু অস্টিনের ধারণা ওখানেই শেষ হয়নি সুড়ঙ্গ।
চোখের ইনফ্রারেড স্ক্যানার চালু করল অস্টিন। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু দেখল না। সাবধানে গুহামুখের ভেতরে পা রাখল সে। ইনফ্রারেড পরিবর্তন করে ফটোমালটিপ্লায়ার চালু করল। অস্টিনের চোখের সামনে একেবারে দূর হয়ে গেল গুহার অন্ধকার, কয়েক হাজার ক্লিয়েগ লাইট জ্বলে উঠেছে যেন।
একেবারে খালি গুহাটা।
০৭. স্তব্ধ হয়ে গুহার ভেতরে দাঁড়িয়ে
স্তব্ধ হয়ে গুহার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে অস্টিন। পরিষ্কার দেখেছে, এই গুহাটাতেই ঢুকেছে সাসকোয়াচ। বেরোনর একটাই পথ দেখতে পাচ্ছে। তাহলে গেল কোথায় রোবটটা? নিশ্চয়ই আরও কোন মুখ আছে।
একদিকের দেয়ালের ধার ঘেঁষে গিয়ে ওপাশের ঢালু দেয়ালটার কাছে এসে দাঁড়াল সে। বায়োনিক হাতের আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিল দেয়ালে ফাঁপা জায়গা আছে কিনা খুঁজছে। কিন্তু পেল না। আবার গুহামুখে ফিরে এল সে। ইনফ্রা-রেড সেন্সরটা আবার চালু করল। এবারে সাসকোয়াচকে খোঁজার চেষ্টা করল না। আবহাওয়ায় কোন অস্বাভাবিকতা আছে কিনা বের করার চেষ্টা চালাল। বেশিক্ষণ লাগল না, পেল। সুড়ঙ্গের পাশের দেয়ালের চাইতে পেছনের দেয়ালটা দুই ডিগ্রী বেশি গরম।
আবার এগিয়ে গেল অস্টিন। একপাশের দেয়ালে একবার নক করে দেখল। তারপর পেছনের দেয়ালে নক করতেই পরিবর্তনটা টের পেল। ফাঁপা নয়, কিন্তু শব্দে পার্থক্য আছে। অপেক্ষাকৃত জোরে বায়োনিক হাতে আবার নক করল। ক্ষুদে এক টুকরো পাথর খসে পড়ল দেয়ালের গা থেকে। আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে ছিদ্রটা বড় করল। টোকা দিয়ে দেখল, শব্দ আরও বদলে গেছে। খোচাতে খোচাতে এক ফুট গভীর করে ফেলল সে ছিদ্রটা। আছে। একটা ধাতব দরজার অংশ চোখে পড়ছে এখন।
হাসল অস্টিন। পিছিয়ে এল কয়েক পা। তারপর ছুটে গিয়েই শূন্যে লাফ দিল। জোড়া পায়ে লাথি মারল দেয়ালের গায়ে। মেরেই ডিগবাজি খেয়ে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল মাটিতে। ধাতব দরজার এপাশের পাথর চৌচির হয়ে মাটিতে খসে পড়ল। আবার পিছিয়ে এল সে। আবার ছুটে গিয়ে একই পদ্ধতিতে লাথি চালাল ধাতব দরজার গায়ে। বিচ্ছিরি শব্দ করে কব্জা থেকে ছুটে গিয়ে ছিটকে পড়ল দরজা। ওপাশে সুড়ঙ্গ।
ক্রিস্টালে তৈরি সুরঙ্গের দেয়াল, মেঝে, ছাদ। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। মেঝেটা সমতল। কিন্তু এর একপাশ থেকে উঠে গিয়ে ছাদ হয়ে অর্ধবৃত্তাকারে অন্য পাশে এসে মিশেছে দেয়াল। ছাদের কয়েক ইঞ্চি পর পরই ট্রি ক্লিনিক ক্রিস্টাল জ্বলছে। আইস টানেল বলে মনে হল অস্টিনের। মানুষের বানানো। এ ধরনের জিনিস প্রকৃতির সৃষ্টি হতেই পারে না।
প্রচন্ড কৌতূহল জাগল অস্টিনের। কি আছে ভেতরে? ঢুকে দেখবে? ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটার সম্ভাবনা আছে এতে। সে নিশ্চিত, এই সুরঙ্গ পথেই গেছে সাসকোয়াচ, হয়ত তার স্রষ্টাদের কাছেই। যারা সাসকোয়াচের মত জিনিস সৃষ্টি করতে পারে, তাদের অসাধারণ শক্তি সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই অস্টিনের। ঢুকলে হয়ত প্রাণ নিয়ে আর বেরোতে পারবে না কখনও। শেষ পর্যন্ত কৌতূহলেরই জয় হল। ভেতরে ঢোকাই স্থির করল সে। দেখতে হবে, কি আছে ভেতরে। কারা সৃষ্টি করছে সাসকোয়াচের মত রোবট। কেন? তাদের উদ্দেশ্য কি?
আইস টানেলে পা দিল অস্টিন। সাবধানে এগিয়ে চলল।
পঞ্চাশ ফুটের মত এগিয়ে শেষ হয়েছে আইস টানেল। ওপাশে হালকা অন্ধকার। সুড়ঙ্গের মাঝামাঝি এসে থামল অস্টিন। অদ্ভুত একটা শব্দ কানে গেছে। হঠাৎই ঘটতে শুরু করল ঘটনাগুলো। সুড়ঙ্গের আলোগুলো কাঁপতে শুরু করেছে। প্রথমে ধীরে, তারপর আস্তে আস্তে দ্রুত হতে লাগল। সেই সঙ্গে সাইরেনের মত তীক্ষ্ণ শব্দ উঠল। ঘুম ঘুম অনুভূতি হল অস্টিনের। টলে উঠল। নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে প্রাণপণে। অবশ হয়ে আসছে দেহ। কিন্তু কোন ব্যথা নেই শরীরের কোথাও। শংকিত হয়ে পড়ল সে।
টলতে টলতে আরও তিন পা এগিয়ে গেল অস্টিন। আর পারল না। হাঁটু ভেঙে বসল, পরক্ষণেই গড়িয়ে পড়ে গেল। আবছাভাবে চোখে পড়ল, হালকা অন্ধকারে ভেতর থেকে আলোয় এসে দাঁড়িয়েছে দুজন পুরুষ আর একজন মেয়ে।
চোখ মেলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে অস্টিন। কিন্তু কিছুতেই পারল না। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ঘুম পাড়ান হচ্ছে তাকে। ইলেকট্রোস্লীপ।
অবিশ্বাস্য! অস্টিনের ওপর ঝুকে দাঁড়িয়ে বলল মেয়েটা।
এই পৃথিবীর সবচেয়ে আজব মানুষ ও, বলল প্রথম পুরুষ।
তাইই, বলল মেয়েটা।
ভালমত পরীক্ষা করে দেখতে হবে ওকে।
মেরে না ফেলে ঘুম পাড়ান হয়েছে তাকে এজন্যেই।
দুপুর। যথারীতি আবার কাজ শুরু হয়েছে ট্রিনিটি বেস এ। দেখে মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে বেসের লোকেরা। আর্মি জীপ আসছে যাচ্ছে। আশেপাশের বন অঞ্চল চষে ফেলা হচ্ছে যেন। নতুন একটা জেনারেটর ট্রাক আনা হয়েছে। পোড়া ট্রাকটাকে ট্রাক্টর দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে জঙ্গলের পাশে। আধ ডজন সশস্ত্র লোক পাহারা দিচ্ছে বেস এলাকা। আগে ছিল না, কিন্তু এখন কাটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে জায়গাটুকু। আবার হামলা আসার আশংকা করছেন গোল্ডম্যান। কিন্তু এবারে আর যাতে সহজেই কৃতকার্য হয়ে ফিরে যেতে না পারে আক্রমণকারী, তার জন্যেই এতসব ব্যবস্থা।
কর্কবোর্ডের বিশাল এক টপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপ আটকে নিয়েছেন গোল্ডম্যান। তার আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে রেনট্রি সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন এবং ইউ.এস ফরেস্ট সার্ভিসের একজন রেঞ্জার।
এই অঞ্চলের দিকে গেছে কর্নেল অস্টিন, ম্যাপের এক জায়গায় পেন্সিলের চোখা মাথা ছুঁইয়ে বললেন গোল্ডম্যান। ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, সার্চ পার্টিতে কজন লোক আছে এখন?
চুরানব্বই জন, উত্তর দিল ক্যাপ্টেন।
আমার লোক আছে আরও সাতাশজন, বলল রেঞ্জার। ওরাও খুঁজছে।
গুড। আকাশ থেকে খোঁজার ব্যবস্থা হয়েছে?
দুটো ফরেস্ট সার্ভিস হেলিকপ্টার ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে, বলল রেঞ্জার। বনবিভাগের সেরা দুজন পাইলট আছে দুটোতে।
রাতের আগেই, দৃঢ় গলায় বলল ক্যাপ্টেন, ওদের খুঁজে বের করব আমরা।
ধন্যবাদ। খোঁজ পেলেই জানাবেন আমাকে।
পেনসিলটা বোর্ডে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন গোল্ডম্যান। তারপর রেনট্রিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তাঁবু থেকে।
অস্টিনের জন্যে ভাবনা হচ্ছে, না? গোল্ডম্যানের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল রেনট্রি।
সহজে হাল ছেড়ে দেবার লোক নয় ও।
কি জানি, অনিশ্চিয়তা গোল্ডম্যানের গলার স্বরে।
মিস্টার গোল্ডম্যান, আরেকটা সমস্যা কিন্তু মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
কি?
ব্যাপারটা সিরিয়াসই।
সিরিয়াস! দাঁড়িয়ে পড়লেন গোডম্যান। রেনট্রির দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার?
সেন্সরে বেশির ভাগ ডাটা কালেকশন হয়ে গেছে আমাদের ইতিমধ্যেই। টেলিমেট্রি বলছে… কথাটা কিভাবে বোঝাবে নিজেই বুঝতে পারছে না রেনট্রি। উসখুস করতে লাগল সে।
কি বলছে?
এখনও শিওর নই আমি। আমাদের ব্যবহৃত ইনস্ট্রমেন্টসগুলোতে কোন গোলমাল না থাকলে, অর্থাৎ ভুল রিডিং না দিলে, ভয়ের ব্যাপারই।
ভয়? কিসের ভয়? ভুরু কোঁচকালেন গোল্ডম্যান।
ব্যাপারটা ভৌগলিক। মহাদেশগুলোর ক্রমবিবর্তনের কথা তো জানেনই আপনি?
হ্যাঁ, কোথায় যেন পড়েছিলাম, হয়ত কোন সাইন্স ম্যাগাজিনেই, প্রতিটি মহাদেশ একটা করে রকপ্লেটে চড়ে আছে। এই প্লেট আবার অন্য আরেকটা মহাদেশের রকপ্লেটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। শুনেছি, নিউইংল্যান্ডের উপকূল এক সময় আফ্রিকা মহাদেশের সঙ্গে লেগেছিল?
ঠিকই শুনেছেন। এই প্লেটগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে অনবরত ঘষা খাচ্ছে। বলে গেল রেনট্রি, চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এতে। আর এটাই পর্বতগুলোর উৎপত্তির কারণ। বর্তমানে, ক্যালিফোর্নিয়াকে উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি ভাবে কেটেছে একটা ফল্ট এবং এটা যুক্ত হয়েছে প্যাসিফিক আর নর্থ আমেরিকান প্লেটের সঙ্গে। এই দুটো প্লেটের জংশনের নাম দিয়েছি আমা স্যান আজি ফল্ট।
কিন্তু এসব ভূবিজ্ঞানীদের ব্যাপার স্যাপার আমার শুনে লাভ কি?
বলছি। নর্থ আমেরিকান প্লেটের তুলনায় প্যাসিফিক প্লেটটা বছরে এক ইঞ্চি বেশি সরছে। তার মানে, ক্যালিফোর্নিয়ার একটা অংশ সরছে উত্তরে, অন্য অংশটা দক্ষিণে। যদি নড়াচড়াটা স্বাভাবিক আর সহজভাবে হয় তো ভয়ের কিছুই নেই।
যদি না হয়? জানতে চাইলেন গোল্ডম্যান।
হঠাৎ প্রচন্ড ঠোকাঠুকি শুরু করবে দুটো প্লেট। ঠেকে যাবে, চাপ বাড়বে, তারপর হঠাৎই একে অন্যের থেকে আলগা হয়ে যাবে।
এবং ঘন ঘন মারাত্মক ভূমিকম্প হতে থাকবে?
ঠিক ধরেছেন। এই অঞ্চলে কেন অত ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে, অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে এসেছে এখন আমার কাছে। এটা এড়ানর বন্দোবস্ত করা যায়। উচ্চ চাপে পানির ধারা ছাড়তে হবে ফল্টগুলোতে, কিম্বা ফল্টের কাছাকাছি মাটির গভীরে নিউক্লিয়ার এক্সপ্লেশন ঘটাতে হবে। এতে করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে প্লেটগুলো পরস্পরের গা থেকে সরিয়ে দিতে পারি আমরা। পো মুভমেন্ট ঘটবে। এতে অতি সামান্যভাবে ভূমিকম্প হবে কয়েকবার। কারও কোন ক্ষতি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, একটা প্রলংকর ভূকম্পন এড়াতে পারব আমরা।
কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না, এসব আমাকে বরে লাভ কি? অধৈর্য হয়ে পড়েছেন গোল্ডম্যান।
সবটা না বললে বুঝতে পারবেন না। আবার বলে চলল রেনট্রি, আসলে স্যান ফ্রানসিসকোর সঙ্গে ঠেকে গেছে স্যান আজি ফল্ট এবং ঠেকেছে ভালমতই। উনিশশো দশ সালে এই ফল্টের একধারে একটা শেড তৈরি হয়েছিল। যদি স্বাভাবিকভাবে প্লেট সরে থাকে তো এখন শেডটা আগের পজিশনের চাইতে তের ফুট সরে যাবার কথা। কিন্তু মোটেই সরেনি ওটা। তের ফুট, সোজা কথা নয় এবং এর জন্যে দায়ী একটা ফল্ট।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন গোল্ডম্যান। কোন কথা বললেন না।
মাত্র কিছুক্ষণ আগে, লেটেস্ট সেন্সর রিডিং পড়ে জানলাম, ওটা ট্রিনিটি ফল্ট। মাঝামাঝি বসে গিয়ে এটাই জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে স্যান ফ্রান্সিসকো আর স্যান আজি ফন্টের নিচের প্লেট দুটো। একটু থামল রেনট্রি। গোল্ডম্যানের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, জানেন, ওই প্লেট দুটো হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কি ঘটবে।
এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন গোল্ডম্যান, না। এতক্ষণে সত্যি সত্যি কৌতূহলী হয়ে পড়েছেন তিনি, কি ঘটবে?
সেন্সর রিডিং দিয়েছে, শিগগিরই ধ্বংস হয়ে যাবে ট্রিনিটি ফল্ট।
কি করে?
ভয়ঙ্কর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এই ফল্টের তলায়। প্লেটগুলো সরে যাবার চেষ্টা করছে সাংঘাতিক ভাবে। শিগগিরই বিস্ফোরিত হবে ট্রিনিটি ফল্ট।
বিস্ফোরিত হবে! কপালের পাশের শিরাটা সামান্য ফুলে উঠেছে গোল্ডম্যনের।
হ্যাঁ। এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে প্লেট দুটো। এরপর কয়েক মিনিটও আর টিকবে না স্যান আন্দ্রিজ। স্যান ফ্রানসিসকোও বিপদটা এড়াতে পারবে বলে মনে হয় না।
ক্রিস্ট! চাপা গলায় প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন গোল্ডম্যান। কোন দিকে এগিয়ে চলেছে ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে পারছেন না তিনি।
টানেলের তিন কতগুলো ঠেলনের সহকাট। প্রথম পুরুষারেটিং টেবিলে।
০৮. মেয়েটির নাম শ্যালন
মেয়েটির নাম শ্যালন। অপরূপ সুন্দরী। একটা ধবধবে সাদা অপারেটিং টেবিলে শুয়ে আছে অস্টিন, তার ওপর ঝুঁকে আছে মেয়েটি। প্রথম পুরুষটির নাম এপ্লয়, দ্বিতীয়জন ফলার। দুজনেই শ্যালনের সহকারী। টেবিলটার দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে। কিম্ভুত দর্শন কতগুলো টেস্ট ইকুইপমেন্ট ঘরের দেয়ালে বসান হয়েছে। আইস টানেলের ক্রিস্টাল-আলোর মতই আলো বেরুচ্ছে যন্ত্রপাতিগুলো থেকেও।
কাজ শুরু করব? জিজ্ঞেস করল এপ্লয়।
হ্যাঁ, বলল শ্যালন। ওর কনশাসনেস লেভেল থারটিটুতে স্থির হবে।
চোখ খুল অস্টিন। ঘুম ঘুম ভাব। ইলেকট্রোস্লীপ পদ্ধতিতে তাকে আধো ঘুম অবস্থায় রাখা হয়েছে। অচেতন নয়, আবার পুরোপুরি চেতনাও নেই।
কতটা নায়াসিনথেটিক, বের করতে হবে আগে, বলল শ্যালন।
ঠিক আছে, বলল এপ্লয়।
কাপড় জামাগুলোতে বায়োনিক কিছু আছে কিনা, আমার মনে হয় তাও দেখা উচিত, বলল ফলার। সব ব্যাপারেই অত্যন্ত সতর্ক সে।
কারেক্ট, সায় দিল শ্যালন।
ঘরটা পরীক্ষাগার। অদ্ভুত এক ধরনের ক্রিস্টালে তৈরি দেয়াল, মেঝে, সিলিং। উজ্জ্বল আলো বিকিরিত হচ্ছে ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা থেকে। ফলারের নির্দেশে অস্টিনের গা থেকে সমস্ত পোশাক খুলে নিল এপ্লয়। পরীক্ষা করে দেখবে ওগুলো।
কালোগ্লাভস পরে নিয়েছে শ্যালন। অ্যান্টেনাযুক্ত একটা চ্যাপ্টা প্রোব নিয়ে অস্টিনের ডান পায়ে চেপে ধরল। ছোট্ট ডায়ালে রিডিং দেখল। একই ভাবে বা পা-টাও পরীক্ষা করল মেয়েটা।
পুরো ডান পা-টা নায়োসিনথেটিক, ঘোষণা করল শ্যালন, কিংবা ফাস্টজেনারেশন বায়োনিক। বাঁ পা-টাও ডান পায়ের মতই। বাঁ হাতটাও।
মারজারন পাওয়ার? জিজ্ঞেস করল এপ্লয়।
না, নিউক্লিয়ার।
চোখ?
স্পেকট্রানলেজারটা চালু কর তো, আদেশ দিল শ্যালন।
কয়েকটা সুইচ টিপল এপ্লয়। সিলিঙের এক জায়গা থেকে একটা তীব্র উজ্জ্বল আলোকরশ্মি সোজা এসে পড়ল অস্টিনের ডান চোখে। চোখটা পরীক্ষা করল শ্যালন। অস্টিনের মাথাটা সামান্য একটু ডানে কাত করে ধরে আলোকরশ্মি ফেলল বাঁ চোখে। পরীক্ষা করল এই চোখটাও।
ইনফ্রা-রেড, সঙ্গীদের জানাল শ্যালন।
নিজের দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা নেই অস্টিনের। চিন্তা করতে পারছে ঠিকই, কিন্তু একটা আঙ্গুল পর্যন্ত নড়ানর ক্ষমতা নেই। এমন কি চোখের পাতা পর্যন্ত নড়াতে পারছে না। পুরোপুরি ঘুম আসছে, এমন একটা অনুভূতি আছে সারাক্ষণই, কিন্তু ঘুমোচ্ছে না। আসলে পারছেই না। ইলেকট্রোস্লীপ মেশিনই এর জন্যে দায়ী। ওটার মিটার হাফ স্লীপ নির্দেশ করছে।
ওর মাংসপেশীর স্পর্শকাতরতা পরীক্ষা করে দেখা যাক এবার, বলল শ্যালন। এপ্লয়কে আদেশ দিল সে, লোহার বার নিয়ে এস। অস্টিকন স্কোলোমিটার চালু আছে?
এগিয়ে গিয়ে দেয়ালে বসান ইন্টারকমের সুইচ টিপল এপ্লয়। কাউকে ডাকল। ঘরে এসে ঢুকল একজন টেকনিশিয়ান। তাকে লোহার বার আর অন্যান্য দুয়েকটা যন্ত্রপাতি আনার নির্দেশ দিল এপ্লয়।
একটা দুইঞ্চি ডায়ামিটারের লোহার বার এনে অস্টিনের বায়োনিক হাতের পাশাপাশি রাখল টেকনিশিয়ান। অ্যানের পকেট থেকে একটা কালো ধাতব বাক্স বের করে রাখল বাহুর পাশে, লোহার বারের কাছেই।
রেডি, বলল এপ্লয়। সিকোয়েন্স শুরু। মেজারিং, হা…এইবার…
আপনাআপনি অস্টিনের বায়োনিক হাতের মুঠো চেপে ধরল লোহার বারটা, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। কোন ধরনের চুম্বক যেন টেনে নিয়ে গিয়ে তার মুঠোকে লোহার বার চেপে ধরতে বাধ্য করেছে। ক্রমেই বারের ওপর শক্ত, আরও শক্ত হচ্ছে হাতের চাপ। আশ্চর্য! তার হাতের ভয়ানক চাপে ক্রমেই চেপ্টা হয়ে যাচ্ছে বারটা।
ফরটি-ফাইভ ল্যাটস, মিটারের রিডিং পড়ে যাচ্ছে শ্যালন, ফিফটি…ফিফটি ফাইভ…সিক্সটি…সিক্সিটি ফাইভ…সিক্সিটি সেভেন…সিক্সিটি এইট পয়েন্ট ফোর… ফোর, ম্যাক্সিমাম…
দারুণ, চমৎকৃত হল এপ্লয়।
ভিজুয়্যাল ম্যাক্রোডিনামিকস দেখতে হবে এবার।
চিত হয়ে টেবিলে পড়েই আছে অস্টিন। নিজেকে সাহায্য করতে পারছে না। তার মাথার একপাশে আরেকটা ধাতব বাক্স রাখল টেকনিশিয়ান। দেয়ালে বসান একটা আই চার্টে বিচিত্র সব রেখা ফুটে উঠতে লাগল।
জুম চালু কর, টেকনিশিয়ানকে আদেশ দিল এপ্লয়, এখুনি…
রেখাগুলোর রং পরিবর্তিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আধমিনিট চেয়ে থাকল শ্যালন। টোয়েন্টি টু ওয়ান, বলল সে। মান অতি উন্নত।
অবিশ্বাস্য! অবাক কণ্ঠে বলল ফলার।
এমন কি আমাদের জন্যেও! সত্যি একটা আজব সৃষ্টি লোকটা। নিউরোইউনাসিক স্ক্যান দেখতে হবে এখন।
অস্টিনের চাঁদিতে দুটো যন্ত্র ঠেকানো হল। রেডি, বলল ফলার।
মৃদু গুঞ্জন উঠল একটা বিশেষ কম্পিউটারে। দেয়ালের এক জায়গায় আবরণ সরে গেল। ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এল একটা মেটাল বোর্ড। কয়েকটা ইলেকট্রোনিক ইকুইপমেন্ট বসান তাতে। কোনটার দেহে, কোনটার মাথায় টুপটাপ জ্বলছে নিভছে রঙিন আলো। একটানা দশ সেকেন্ড আলোগুলো জ্বলল নিভল। তাপর আচমকা থেমে গেল।
সিকোয়েন্স শেষ, ঘোষণা করল মেয়েটি। ভেন্টিকুলার প্রোব করব এখন। ওর চেতনাসীমা বিশের নিচে নামিয়ে দাও।
একটা যন্ত্রের গোটা তিনেক সুইচ টিপল ফলার। নামছে।
টের পাচ্ছে অস্টিন, পুরো ঘুমিয়ে পড়ছে সে। জেগে থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
কয়েক ঘণ্টা পর জেগে উঠে দেখল অস্টিন, পরীক্ষাগার খালি। একটা যন্ত্রপাতিও চোখে পড়ল না কোথাও। সব জায়গামত সরিয়ে রাখা হয়েছে নিশ্চিয়ই। টের পেল, আবার কাপড় জামা পরিয়ে দেয়া হয়েছ তাকে। বার কয়েক চোখের পাতা মিটমিট করল সে, তারপর দুহাতে রগড়াল।
হঠাৎই মনে পড়ল তার, হাত দুটো বাঁধা ছিল, এখন খোলা। একলাফে উঠে বসল অস্টিন। প্রথমেই বাঁ পাশে তাকাল। তারপর থেকে দশ ফুট দূরে আরেকটা একই ধরনের অপারেটিং টেবিলে শুয়ে আছে সাসকোয়াচ। আবার জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তার ছেড়া হাতটা।
ঘুম ভেঙেই ওই বদখত চেহারা দেখতে চায় কেউ! আপন মনেই বিড় বিড় করল অস্টিন। কণ্ঠে বিরক্তি। একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। অন্যপাশে তাকাল। দেয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। তার দিকেই চেয়ে আছে। উজ্জ্বল পিঙ্গল মেয়েটার হাত মুখের চামড়ার রঙ। গলায় একটা হীরের নেকলেস। পরনে জাম্প সুট। সপ্রশংস দৃষ্টিতে শ্যালনের দিকে তাকাল অস্টিন।
হ্যাঁ, এমন চেহারা দেখলে তবেই না ভাল লাগে, বলল অস্টিন।
থ্যাংক ইউ, কর্নেল। হাসল শ্যালন।
কয়েক ঘণ্টা আগেও এঘরে ছিলে নিশ্চয়ই?
ছিলাম।
কে তুমি?
শ্যালন।
পুরো পরিচয়?
ওসব পরে শুনবেন, আবার হাসল মেয়েটা। এখন শুধু জেনে রাখুন, আপনার কোন ক্ষতি করা হবে না।
সেটা বুঝতেই পারছি। নইলে এতক্ষণে লাশ হয়ে যেতাম আমি। এদিক ওদিক তাকাল অস্টিন, মার্লিন বেকি কোথায়?
আছে। ভাববেন না, ভালই আছে সে।
ওকে নিয়ে কি করেছ তোমরা?
আপনাকে নিয়ে যা করেছি। পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে ওকে।
ওর কোন ক্ষতি না হলেই ভাল। শ্যানের চোখে চোখে তাকাল অস্টিন। তা বললে না, তুমি কে? কি কাজ কর? ওই দানবটাই বা কার সৃষ্টি? সাসকোয়াচকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে।
ওকে সাসকোয়াচ ডাকি আমরা, হেসে বলল শ্যালন। সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল অস্টিনের দিকে, বহুদিন আগে থেকেই ইন্ডিয়ানরা জানে ওর নাম। আমাদের সহায়তা করে সে, এমন কি কোন কোন ব্যাপারে রক্ষাকারীও বলতে পারেন। অস্টিনের আসল প্রশ্নের জবাবটা এড়িয়ে গেল মেয়েটা।
রোবট না?
হ্যাঁ।
বায়োনিক?
মাথা নাড়াল শ্যালন। নায়োসিনথেটিক, বলল সে। কয়েকটা বেসিক জিনিস আপনারই মত, কিন্তু অনেক নীরস।
আমাদের বেস ক্যাম্প ধ্বংস করতে পাঠান হয়েছিল কেন ওকে?
আপনাদের বসান সেন্সরে আমাদের অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছিল প্রায়। বলল মেয়েটা। নিজেদের রক্ষা করার জন্যেই আপনাদের ক্যাম্পটা ধ্বংস করতে পাঠিয়েছি সাসকোয়াচকে।
এবং পরে আমাকে ধ্বংস করতেও পাঠিয়েছিলে?
না, আপনাকে ধরে আনতে, কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম আমরা। সাধারণ মানুষের চাইতে আপনি আলাদা, দেখেই বুঝেছিলাম। কাজেই পরীক্ষা করে দেখার লোভটা সামলাতে পারিনি। একটু থামল শ্যালন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল, আপনার মত আর কেউ আছে, কর্নেল অস্টিন?
নিশ্চয়ই, হালকা গলায় বলল অস্টিন, একটা পুরো বায়োনিক আর্মি আছে আমাদের।
হঠাৎ দেয়ালের এক জায়গায় বসান একটা লাল বাতি দপ দপ করে জ্বলে উঠল। সেদিকে একটা আঙ্গুল তুলে অস্টিনকে দেখাল শ্যালন, হাসল।
আপনি মিছে কথা বললেন। বাতিটা এই কথাই জানাল।
মিছে কথা বললেই বুঝি জানান দেয় বাতিটা? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
বাইরের লোক হলে। অস্টিনের পুরো দেহের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে আনল শ্যালন। বিশ্রাম নিন এখন। পরে আপনার ওপর আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাব। আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর জানা হয়ে গেলেই আপনার প্রশ্নের উত্তর দেয়া হবে।
তা ভাল, বলল অস্টিন। কিন্তু আমাকে তোমাদের গোপন কথা জানালে, বাইরের লোককে জানিয়ে দিতে পারি আমি?
তা পারবেন না কোনদিনই, রহস্যময় হাসি হাসল শ্যালন।
অতটা শিওর হচ্ছো কি করে? বন্দীদের মুক্তি দাও না নাকি কখনও?
অস্টিনের একেবারে গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল শ্যালন। যেন কতকালের পরিচয় তার সঙ্গে।
অস্টিনের চুলে আঙ্গুল চালাতে শুরু করল শ্যালন। হঠাৎই মুখ নিচু করে চুমু খেল তার গালে। তারপ কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বলল, বুঝতেই পারছ, তোমাকে মেরে ফেলার সামান্যতম ইচ্ছেও নেই আমার।
হাত বাড়িয়ে শ্যালনকে ধরতে চাইল অস্টিন। কিন্তু ততক্ষণে তার নাগালের বাইরে চলে গেছে মেয়েটা। অস্টিনের দিকে তাকিয়ে একবার হাসল, তারপরই অদৃশ্য হয়ে গেল। ভোজবাজি যেন।
এদিক ওদিক তাকাল অস্টিন। কিন্তু ঘরের কেথাও নেই শ্যালন। কি করে কোন পথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে?
তিন সেকেন্ড পরই আবার আগের জায়গায় শ্যালনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল অস্টিন। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আরে, আশ্চর্য ত! ভুরু কোঁচকাল অস্টিন, যাদু জান নাকি তুমি?
উত্তরে শুধু হাসল শ্যালন।
একটা কথা বলবে? জানতে তাকাল অস্টিন, কোন্ দেশে বাড়ি তোমার?
কোন দেশ নয়, অস্টিন, বল কোন্ জগৎ।
হ্যাঁ, কোন্ জগৎ?
আসছি আমি, আবার ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেল শ্যালন।
০৯. টেলিমেট্রি টেবিলটার সামনে বসে
টেলিমেট্রি টেবিলটার সামনে বসে আছেন অসকার গোল্ডম্যান। চিন্তিতভাবে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন। এই সময় সেখানে এসে হাজির হল রেনট্রি। সাংঘাতিক উত্তেজিত। চোখ তুলে চাইলেন গোল্ডম্যান। রেনট্রির চেহারা দেখেই অনুমান করলেন, খারাপ খবর আছে।
বলে ফেল, বললেন গোল্ডম্যান।
সেন্সর রিডিঙে কোন গোলমাল নেই, কনফার্ম করেছে আমাদের মেন কম্পিউটার।
তার মানে সত্যিই ধ্বংস হতে যাচ্ছে ট্রিনিটি ফল্ট, সঙ্গে টেনে নিয়ে যাবে স্যান আজিকেও?
মাথা ঝাঁকাল রেনট্রি।
কম্পিউটার বলছে, আগামী পনের ঘণ্টার মধ্যেই ভয়ংকর ভূমিকম্প হবে স্যান আজি ফল্টে।
পুরো স্যান আন্দ্রিজে? মানে আমি বলতে চাইছি, বাজা ক্যালিফোর্নিয়া উপকূল পর্যন্ত?
কম্পিউটারের মতে, স্যান আজি আর ট্রিনিটি ফল্ট জংশন ধ্বংস হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তের ফুট লস মেকআপ করার চেষ্টা করবে রকপ্লেটগুলো এবং তাহলেই গেছি আমরা। আর শুধু আমরাই নই, স্যান ফ্রানসিসকো, লস এঞ্জেলস, স্যান ডিয়েগোর নিশানা মুছে যাবে ম্যাপ থেকে।
আংশিক মহাপ্রলয়, ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছে গোল্ডম্যানকে।
আরও একটা খবর জানিয়েছে কম্পিউটার।
এরপর আরও আছে নাকি? ব্ল্যাক প্লেগ ফিরে আসার কথা বলছে নাকি বোকা যন্ত্রটা?
না, না ওসব কিছু নয়, তাড়াতাড়ি বলল রেনট্রি। ওই ভূমিকম্পটাকে দুর্বল করার, চাই কি একেবারে বন্ধ করে দেবারও উপায় একটা আছে।
তুমি যে বলেছিলে, ওভাবে?
কম্পিউটার বলছে, একটু অন্যভাবে হলে ভাল হয়। একটা জায়গায় মিশেছে স্যান আজি আর ট্রিনিটি ফল্ট। কৃত্রিম ছোটখাট ভূকম্পন ঘটিয়ে স্যান আন্দ্রিজের ওপর ট্রিনিটির চাপ সরিয়ে দিতে পারলে কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না আর।
কিন্ত ভূকম্পন ঘটাবে কি করে?
ওই তো, নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন।
একটা কথা বল তো, এই এলাকায় ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণ কি এই চাপ? জিজ্ঞেস করলেন গোল্ডম্যান।
হ্যাঁ। আগেও বলেছি একথা।
ব্যাপারটা পুরোপুরি প্রাকৃতিক?
তা ছাড়া আর কি?
ঠিক আছে, কফির কাপটা টেবিলে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন গোল্ডম্যান। এই ভূমিকম্প-টস্প ঘটান আমার দায়িত্ব নয়। কিন্তু তোমার কথাও ফেলা যায় না। ব্যাপারটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছি। যা করার, তারাই করবেন। হাত তুলে একজন গার্ডের দিকে ইশারা করলেন তিনি। ছুটে এল লোকটা।
স্যার? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল গার্ড।
রেডিওম্যানকে বল, পেন্টাগনে জেনারেল ডেভিসের সঙ্গে যোগাযোগ করুক। আমার টপ প্রায়োরিটি কোড ব্যবহার করতে বল। যাও।
যাচ্ছি, স্যার, বলেই ছুটে চলে গেল লোকটা।
মিস্টার গোল্ডম্যান… বলল রেনট্রি।
কি?
অস্টিন এবং মার্লিন। ওই এলাকাতেই আছে ওরা, না?
হঠাই কঠিন হয়ে গেল গোল্ডম্যানের মুখ। ধপাস করে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি।
যদি ঠিক ওই এলাকায় না-ও থাকে, এর আশেপাশেই কোথাও আছে। বিস্ফোরণের ফলে পাথর ধস ঘটতে পারে। চাপা পড়ে মারা যেতে পারে ওরা। এদিক ওদিক তাকালেন গোল্ডম্যান। একটা তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে রেঞ্জার। হাত তুলে ইশারা করলেন গোল্ডম্যান।
দ্রুত এগিয়ে এল লোকটা, কিছু বলবেন, মিস্টার গোল্ডম্যান?
কর্নেল অস্টিন আর ডকটর মার্লিন বেকির কোন খোঁজ পাওয়া গেছে?
ওদের কোন চিহ্নই খুঁজে পাচ্ছে না সার্চ পার্টি।
মিস্টার গোল্ডম্যান, আমাদের হাতে কিন্তু সময় আর বেশি নেই। বলল রেনট্রি।
পানির ধারা ছুঁড়লে কেমন হয়, রেনট্রি? এতেও কাজ হবে, বলেছিলে না?
এখন আর সময় নেই। পাঁচ মাইল পাইপ ফেলে পাম্পে জুড়ে পানি ছোড়া…
নাহ, মিস্টার গোল্ডম্যান, এদিক ওদিক মাথা নাড়াল রেনট্রি, অত সময় দেবে না টিনিটি ফল্ট।
মুখ কালো হয়ে গেছে গোল্ডম্যানের। বনের দিকে চেয়ে আছেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। তোমারা কোথায়, অস্টিন! আপন মনেই বিড় বিড় করলেন তিনি।
দীর্ঘ কয়েক মনিট নীরবতা। তারপর দুজন লোক এসে দাঁড়াল সেখানে। হাতে পোর্টেবল রেডিও রিসিভার।
জেনারেল ডেভিস লাইনে আছেন, স্যার, রিসিভারটা গোল্ডম্যানের দিকে বাড়িয়ে ধরল রেডিওম্যান।
রিসিভারটা হাতে নিলেন গোল্ডম্যান। রেনট্রির দিকে তাকালেন। তাহলে নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন ছাড়া আর কিছু কারর নেই?
না। মাথা নিচু করল রেনট্রি, আমি দুঃখিত, মিস্টার গোল্ডম্যান।
হু… রিসিভার কানে ঠেকালেন গোল্ডম্যান।
আবার আধো ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে অস্টিনকে। কিন্তু এবারে অপারেশন টেবিলে নয়, ইজি চেয়ারের মত একটা চেয়ারে আধশোয়া করে রাখা হয়েছে। দেখতে অনেকটা হেয়ার ড্রাইয়ারের মত যন্ত্র তার মাথায়। আগের জায়গাতেই শুয়ে আছে সাসকোয়াচ। তার মাথায়ও একই ধরনের একটা যন্ত্র লাগান।
পরীক্ষাগারে দারুণ কর্মব্যস্ততা। টেকনিশিয়ানরা ব্যস্তভাবে আসছে যাচ্ছে। দুধ সাদা অদ্ভুত একটা আভা বেরচ্ছে ঘরের দেয়ালগুলো থেকে। দুহাতে দুমুঠো রেকর্ডিং ক্যাসেট নিয়ে শান্তভাবে ঘরে ঢুকল শ্যালন। একপাশের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। সারি সারি কম্পিউটার কনসোল বসানো দেয়ালে। একটা পটে একটা ক্যাসেট বসিয়ে দিল শ্যালন। যন্ত্রটার পাশের তিনটে বোতাম টিপল। সঙ্গে সঙ্গেই দেয়ালে বসান বিশাল এক টি.ভি. মনিটরের পর্দায় কতগুলো আঁকাবাঁকা রেখা ফুটে উঠল। দীর্ঘ এক মিনিট রেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখল সে। মৃদু হাসল। সুট থেকে ক্যাসেটটা বের করে পাশে দাঁড়ান একজন সহকারীর হাতে নিল। হাতের অন্য ক্যাসেটগুলোও দিয়ে দিল কি ভেবে।
কাউন্সিল চেম্বারে নিয়ে যাও এগুলো, নির্দেশ দিল শ্যালন। হাতে তুড়ি দিয়ে ঘরে তার লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল শ্যালন।
আমাদের কাজ শেষ, লোকেরা ফিরে চাইতেই বলল সে। যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে যাও।
কেউ কোন প্রশ্ন করল না। কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আধ মিনিটের মধ্যেই ভোজবাজির মত সমস্ত যন্ত্রপাতিগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল ঘর থেকে। অস্টিন, সাকোয়াচ আর শ্যালন বাদে সবাই চলে গেছে।
ধীরে ধীরে পুরো জেগে উঠল অস্টিন। যন্ত্রের আবেশ সরিয়ে নেয়া হয়েছে তার ওপর থেকে। শ্যালনের দিকে তাকাল সে।
ওঠো। চল যাই আমরা, বলল শ্যালন। এখানে আর থাকার দরকার নেই তোমার।
ও, বসে থেকেই সাসকোয়াচকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল অস্টিন। ওকে জাগাচ্ছ না কেন? সঙ্গে নেবে না?
আপাতত দরকার নেই ওকে…
বুঝেছি, ড্রাই ডকে রেখেছ। আমাকে এভাবে ফেলে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল দুয়েকজনে। দরকার পড়লেই ব্যাটারি চার্জ করে জাগিয়ে দেয়া হবে।
এই পরামর্শে নিশ্চয়ই কান দেননি বিশেষজ্ঞরা?
না।
এস, হাত বাড়াল শ্যালন। আমার হাতটা ধরে এগোও।
শ্যালনের হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াল অস্টিন। টলছে। পায়ে জোর পাচ্ছি না কেন?
যান্ত্রিক ঘুমের প্রতিক্রিয়া, বলল শ্যালন। ভয় নেই, মিনিট খানেকের মধ্যেই চলে যাবে।
এ ধরনের ঘুমের নাম দিয়েছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা, ইলেকট্রোস্লীপ।
জানি।
প্রায় একটা বছর ইলেকট্রোস্লীপ পদ্ধতিতে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল আমাকে।
তোমাকে বায়োনিক ম্যান বানানোর সময়ে?
হ্যাঁ, বায়োনিক রিসার্চ ল্যাবরেটরীতে অবস্থানের দিনগুলোর কথা ভাবছে অস্টিন।
হাত ধরে অস্টিনকে দরজার কাছে নিয়ে গেল শ্যালন। নিঃশব্দে আপনাপনি খুলে গেল দরজা। কম্পাউন্ডে বেরিয়ে এল দুজনে।
পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শ্যালন অস্টিনকে। ভূগর্ভে জটিল এক রহস্য গড়ে তোলা হয়েছে। আশ্চর্য, অদ্ভুত! দেখেশুনে অস্টিনও অবাক না হয়ে পারছে না। কঠিন পাথর খুঁড়ে বিশাল এক গুহা বানিয়ে তা দেয়ালে ক্রিস্টালের আস্তরণ লাগান হয়েছে। এরপর ওই গুহায় তৈরি হয়েছে বাড়িঘর।
শ্যালনের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে অস্টিন। একের পর এক অসংখ্য করিডোর পেরোচ্ছে। দুপাশে সারি সারি ঘর। কোনটা ইলেকট্রোনিক ইকুইপমেন্টে ঠাসা, কোনটায় ভরে রাখা হয়েছে শাকসব্জি আর অন্যান্য খাবার, কোনটা মেডিক্যাল রুম, কোনটা লিভিং রুম।
অবশেষে একটা বিশাল ডিম্বাকৃতি ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে।
কাউন্সিল চেম্বার, বলে অস্টিনকে ভেতরে ঠেলে দিল শ্যালন।
বিরাট এক টেবিল ঘিরে বসে আছে সাতজন নারীপুরুষ। দুজনকে চেনে অস্টিন। একজন এপ্লয়। মাথায় আর আবরণ নেই এখন তার। ধূসর সাদা চুল। ঘরের লোকদের মধ্যে সে-ই বয়স্ক। টেবিলের এক মাথায় বসে আছে।
অস্টিনের চেনা দ্বিতীয়জন ফলার। বয়েসে তরুণ। অস্টিনের দিকে একবার চেয়েই ক্লান্তভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। অন্যেরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। অস্টিনের দিকে।
টেবিলের একপাশে, মাঝামাঝি জায়গায় রাখা একটা চেয়ার এনে অস্টিনকে বসিয়ে দিল শ্যালন। তারপর ঘুরে গিয়ে টেবিলের অন্য মাথায় রাখা একটা খালি চেয়ারে বসল।
দাঁড়িয়ে অস্টিনের দিকে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত নাড়াল এপ্লয়। বুঝল অস্টিন, আজব এই লোকগুলো বাইরের কাউকে এভাবেই অভ্যর্থনা জানায়। এটাই ওদের রীতি।
আমি এপ্লয়, বল সে। আমাদের কলোনীতে আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল অস্টিন। মৃদু হাসল এপ্লয়ের দিকে তাকিয়ে।
স্বাগতম, কর্নেল অস্টিন, বলল এপ্লয়, আপনিও আমাদের মত স্পেস ট্রাভেলর। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালই লাগবে।
পৃথিবীর লোক নন আপনারা, না? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
মহাকাশ থেকে এসেছি।
মহাকাশের কোন গ্রহ থেকে?
হাসল এপ্লয়, তা তো নিশ্চয়ই। তবে আপনাদের আর আমাদের গ্যালাক্সি একটাই। পৃথিবীর উল্টো দিকে এই গ্রহটা। স্যাজিট্যারিয়াস আর্মে অবস্থিত, এখান থেকে ষাট হাজার আলোক-বছর দূরে।
ষাট হাজার আলোক-বছর! ভুরু কোঁচকাল অস্টিন। তার মানে ওখান থেকে আসতে সুপারলাইট গতিবেগের দরকার।
হ্যাঁ, বলল শ্যালন।
আসতে কোন অসুবিধে হয়নি আপনাদের? এপ্লয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অস্টিন।
না।
তোমাদের মত ভোতা স্পেসক্র্যাফট নিয়ে তো চলাফেরা করি না আমরা, বলল ফলার।
পৃথিবীতে কি উদ্দেশ্যে এসেছেন? এপ্লয়কে জজ্ঞেস করল অস্টিন। ফলারের কথায় কানই দিল না।
আপনাদের জীবজগৎ পরীক্ষা করে দেখতে এসেছি, এপ্লয়ের কণ্ঠে মৃদু উত্তেজনা। বিশেষ করে আদিম জীবের বংশধর কিছু আছে কিনা জানা প্রয়োজন আমাদের। দুটো গ্রহেরই লাইফ সাইকেল পায় এক। ইভলুশনও নিশ্চয়ই এক হবে।
বিজ্ঞানে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছেন আপনারা, ধরে নিতে পারি। বলল অস্টিন।
অনেক! বলল এপ্লয়।
দেখেশুনে বিরক্তি ধরে গেছে আমার। বাইরের যে কোন গ্রহ থেকে লোক আসছে, দেখি আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান। এই গ্যালাক্সিতে আমরাই সবচেয়ে পিছিয়ে আছি।
এমনভাবে কথা বলছেন, কর্নেল, কৌতূহলী হয়ে উঠেছে এপ্লয়, যেন রোজই পৃথিবীতে বাইরের গ্রহ থেকে লোক আসছে যাচ্ছে।
আসলে, আসলে আপনারা সবাই… বলতে গিয়েও থেমে গেল সে। তারপর একটু ঘুরিয়ে বলল, এ পর্যন্ত অনেক লোককেই পরীক্ষা করে দেখার জন্যে আমাদের ল্যাবরেটরীতে এনেছি। কম বেশি সবাই অস্বাভাবিক ছিল।
আট ফুট লম্বা, ভয়ঙ্কর এক বিশাল দানবকে দিয়ে টেনে হিচড়ে আনালে মানুষ ভয় পেতে বাধ্য। প্রতিবাদ করল অস্টিন, এই সহজ কথাটা বুঝছেন না, এটা কিন্তু রীতিমত অস্বাভাবিক ঠেকছে আমার কাছে।
খোঁচা খেয়ে চুপ করে গেল এপ্লয়।
বেরিয়ে যাবার আগে কিন্তু ওদের মেমোরি থেকে আমাদের কথা মুছে দেয়া হয়, বলল শ্যালন।
তাতে কি? বল অস্টিন। আসলে এখানে ঢোকানোর আগেই সাংঘাতিক ভয় পাইয়ে দেয়া হয় ওদের। এরপর যদি মাথা ঠিক রাখতে না পারে ওরা, তো দোষ দেয়া যায় না। যেভাবে জন্তু জানোয়ারের মত ধরে নিয়ে আসা হয়…
কর্নেল অস্টিন।
জু-কীপারদের দুচোখে দেখতে পারি না আমি। ক্ষেপে উঠেছে অস্টিন।
চেয়ারে ঝুঁকে বসেছে এপ্লয়। সমগোত্রীয় অন্য সবার চাইতে আপনি আলাদা, কর্নেল…
সমগোত্রীয় কোটি কোটি পৃথিবীবাসীর সবাইকে ল্যাবরেটরীর গিনিপিগ এখনও বানাতে পারেননি কিন্তু।
বিশিষ্ট বেশ কিছু লোককে অবশ্য পরীক্ষা করেছি। বলল শ্যালন। কিন্তু কাউকেই তেমন উল্লেখযোগ্য মনে হয়নি।
ফলার তো বলে, এরা এক্কেবারে আদিম। যোগ করল এপ্লয়।
পৃথিবীতে একটা প্রবাদ আছে, বলল অস্টিন, সেটা হল, পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়।
কর্নেল, থমথমে গলায় বলল ফলার, বললেনই যখন, পৃথিবী ছাড়ার আগে আপনাদের একটা বড় শহরে পাগলামি দেখিয়ে যাবার খুবই ইচ্ছে আমার। সেটা আপনাদের লস এঞ্জেলসও হতে পারে।
ধন্যবাদ, ব্যঙ্গের হাসি হাসল অস্টিন। পাগলদের এড়িয়ে যেতে জানে লস এঞ্জেলসের লোকেরা।
থাক থাক, ঝগড়া বিবাদ করে লাভ নেই। বাধা দিল এপ্লয়। তা কর্নেল অস্টিন, একটা কথার জবাব দেবেন? আমাদের এত আন্ডার এস্টিমেট করছেন কি করে?
প্রথমত, অনেক অদ্ভুত এবং আশ্চর্য জিনিস দেখেছি আমি জীবনে। দ্বিতীয়ত, বর্বর হলেও মহাকাশ সম্পর্কে অতি সামান্য জ্ঞান আমাদের আছে। তাই জানি, মহাকাশের অসংখ্য গ্রহে অতি বুদ্ধিমান জীবের বাস সম্ভব। তৃতীয়ত, আপনারাই প্রথম নন।
প্রথম নই মানে?
আপনারাই শুধু নন, এর আগেও ভিনগ্রহবাসী বুদ্ধিমান জীবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে আমাদের। একটু আগেই তো বললাম।
টেবিলের চারধারে বসা প্রতিটি লোক অবাক হয়ে অস্টিনের মুখের দিকে তাকাল। ওরা যেন ভেবে রেখেছিল, পৃথিবীর বাজার ওরাই প্রথমে দখল করেছে।
অনগ্রহবাসী আগেই এসেছে? জিজ্ঞেস করল শ্যালন।
জানি না। তবে তোমাদের এখানে আসার আগেই ওদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে আমাদের, বলল অস্টিন। কেপ কেনেডীতে। বছর দেড় কি দুই আগে!
কোন গ্রহবাসী ছিল ওরা? জিজ্ঞেস করল এপ্লয়।
কাছাকাছি একটা গ্যালাক্সি থেকেই এসেছিল। গ্রহটার নাম তাউ সেতী।
ওহ্ ওরা! নাক সিটকাল ফলার, ওরা তো সবাই পাগল। গ্ৰহটার নামই দিয়েছি আমরা পাগলা গ্রহ। অদ্ভুত একটা রেডিয়েশন দিয়ে সারাক্ষণ গ্রহটাকে ঘিরে রেখেছে ওরা। বাইরের কেউ যেন যেতে না পারে তারজন্যে এই ব্যবস্থা।
ঠিকই তো করেছে। দেখছি আরও কিছু লোক আছে, যারা জু কীপারদের পছন্দ করে না।
মাথামোটারা!
তুমি থাম, ফলার! এবারেও বাধা দিল তাকে এপ্লয়ই। হ্যাঁ কর্নেল, কি করে সেতীয়ানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল আপনাদের?
একটা স্পেস শাটল ভেঙে পড়েছিল সাগর উপকূলে। চারজন লোক ছিল ভেতরে। একজন আগেই প্যারাসুট জাতীয় একটা জিনিস পরে লাফিয়ে নামে। কোন ক্ষতি হয়নি তার। অন্য তিনজন মারা গেছে র্যারিয়েশনে আমাদের মহাকাশযানে করে লোকটাকে তার মাদার শিপে পৌঁছে দিয়েছি আমিই।
সে যাই হোক, কথার মোড় ঘোরাল এপ্লয়। আপনি একটা অসাধারণ সৃষ্টি, কর্নেল, অস্টিন।
কিন্তু বুঝতে পারছি না আমি কিছুতেই, শ্যালনের দিকে চোরা দৃষ্টি হানল অস্টিন, অত খাতির তোয়াজ করা হচ্ছে কেন আমাকে?
আপনাকে বেশ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাস্য আছে শ্যালনের। অস্টিনের প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল এপ্লয়। ওর স্পেশালিটি নায়োসিনথেনিক-অতি উন্নত বায়োনিক কনস্ট্রাকশন। সাসকোয়াচ ওরই সৃষ্টি।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে শ্যালনের দিকে তাকাল অস্টিন। ট্যালেন্টেড লেডী। পরীক্ষার জন্যে এতদিনে নিজের সাবজেক্ট পেয়েছে।
১০. বেস ক্যাম্প
বেস ক্যাম্প। কাঁটাতারের বেড়ার একপাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটা জীপ। জোরে হর্ন বাজাল। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন গোল্ডম্যান। জীপটা দেখেই ছুটে গেলেন। সার্চ পার্টির জনাপাঁচেক লোক বসে আছে জীপে। ড্রাইভিং সীটের পাশে বসে মার্লিন বেকি। মুখ শুকনো, চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। কিন্তু দেহ অক্ষতই আছে।
মার্লিন! গোল্ডম্যানের কণ্ঠে খুশির আমেজ।
ভোঁতা দৃষ্টিতে গোল্ডম্যানের দিকে তাকাল মার্লিন। কোন অভিব্যক্তি নেই চেহারায়। যেন গোল্ডম্যানকে চিনতেই পারছে না সে।
মার্লিন, চিনতে পারছ না, আমি অসকার। কোন প্রতিক্রিয়া নেই মার্লিনের।
অবাক হলেন গোল্ডম্যান। ওদিকে পাঁচজন লোকই জীপ থেকে নেমে এসেছে। একজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি, ওকে কোথায় পেয়েছ?
ব্যাটল মাউনটেনের পশ্চিম দিকের ঢালে। হারিয়ে যাওয়া সেন্সরটাও ওঁর সঙ্গেই ছিল। এগিয়ে গিয়ে জীপের ড্যাশবোর্ড থেকে কালো কাগজের একটা প্যাকেট নিয়ে এল লোকটা। ওঁকে অপ্রকৃতিস্থ দেখে সামলে রেখেছি জিনিসটা। হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা গোল্ডম্যানের হাতে দিতে গেল লোকটা।
নিলেন না গোল্ডম্যান! শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক আছে তো?
তা তো জানি না, স্যার। যেভাবে পেরেছি, রেখে দিয়েছি।
টেকনিশিয়ানরা দেখলেই বুঝতে পারবে, খারাপ হয়ে গেছে কিনা। আবার মার্লিনের দিকে ফিরলেন গোল্ডম্যান, কোথায় ছিলে তুমি, মার্লিন? এগিয়ে গিয়ে আলতোভাবে তার হাত স্পর্শ করলেন। দুচোখ বড় বড় করে তাকাল মার্লিন। যেন গোল্ডম্যানকে ভয় পাচ্ছে সে।
কোথায় ছিলাম? আপন মনেই বিড় বিড় করছে যেন মার্লিন, তা তো জানি না। সেন্সরটা বসিয়ে রিডিং নিচ্ছিলাম আমরা…
হ্যাঁ, তারপর? মনে করার চেষ্টা কর। নরম গলায় বললেন গোল্ডম্যান।
মনে করার চেষ্টা করছে মার্লিন। রিডিং নিচ্ছিলাম…তারপর…তারপর…নাহ্, কিছুই জানি না আমি…ইভান কোথায়?
ওর কাছে যাবে, মার্লিন? ঠিক আছে নিয়ে যাবে ওরা তোমাকে। তা, অস্টিন কোথায় বলতে পার?
কেন, ও তো বেস ক্যাম্পেই ছিল! আমাদের সঙ্গে কথা বলছিল রেডিওতে… থেমে গেল মার্লিন।
ও-কে, জোর করে হতাশা ঢাকার চেষ্টা করলেন গোল্ডম্যান। ওরা তোমাকে ইভানের কাছে নিয়ে যাবে।
গোল্ডম্যানের আদেশ পেয়ে আবার জীপে উঠে বসল পাঁচজন লোকই।
ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে জীপটা। সেদিকে তাকিয়ে ভাবছেন গোল্ডম্যান। স্বামীর কাছে ফিরে যাচ্ছে মার্লিন। ওদের দুজনের জন্যে এই অভিযান শেষ। কিন্তু তার জন্যে, টম রেনটির জন্যে সবে শুরু। আরও একজনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না গোল্ডম্যান। সে স্টিভ অস্টিন।
ভূগর্ভকক্ষে ভিনগ্রহবাসীদের সঙ্গে অস্টিনের দীর্ঘ মীটিং চলছে।
কতদিন ধরে আছেন আপনারা পৃথিবীতে? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
দুবছর, জবাব দিল এপ্লয়। এই দুবছরে পরীক্ষার জন্যে অনেক লোককে ধরে এনেছে সাসকোয়াচ। ওদের দেহের ভেতরে বাইরে প্রতিটি মিলিমিটার পরীক্ষা করে দেখেছি আমরা। ওদের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলেছি, যেমন আপনার সঙ্গে বলছি এবং তাদের নিরাপদে আবার ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে সাসকোয়াচ, যেখান থেকে তুলে এনেছে সেখানে।
মার্লিনের কি অবস্থা?
ওকেও ছেড়ে দেয়া হয়েছে, বলল শ্যালন।
ফিরে যাবার পর ইভান কিন্তু এখানকার কোন কথাই বলতে পারেনি।
মার্লিনও পারবে না। কারণ সাসকোয়াচ তাদের তুলে আনার পর থেকে ছেড়ে দেয়া পর্যন্ত, মাঝখানের এই সময়টুকু মুছে দেয়া হয়েছে তাদের স্মৃতি থেকে, এপ্লয় বলল।
ফিরিয়ে দেবার আগে আমার স্মৃতি থেকেও নিশ্চয়ই আপনাদের কথা মুছে দেয়া হবে?
ঠিকই ধরেছেন।
আচ্ছা, বলল অস্টিন, বললেন, আপনারা মাত্র দুবছর হল পৃথিবীতে এসেছেন। সাসকোয়াচ আপনাদেরই সৃষ্টি। তাহলে এর কিংবদন্তী শত শত বছর আগে ইন্ডিয়ানরা জানত কি করে?
দৃষ্টি বিনিময় হল শ্যালন আর এপ্লয়ের মধ্যে। মুচকে হাসল দুজনেই।
কারণটা সহজ, বলল এপ্লয়। কিন্তু আগে একটা জিনিস দেখুন।
পকেট থেকে ছোট্ট একটা জিনিস বের করল এপ্লয়। আকারে সিগারেটের প্যাকেটের সমান ওটা।
আমাদের বিজ্ঞানীদের সৃষ্টি একটা চমৎকার জিনিস, বাক্সমত জিনিসটা অস্টিনকে দেখিয়ে বলল সে, উন্নতমানের স্পেসক্র্যাফট নিয়ে গবেষণার সময়েই এটা আবিষ্কার করে তারা।
যে স্পেসক্র্যাফট আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে ছুটতে পারে? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
অনেকগুণ দ্রুত গতিতে, হ্যাঁ। এখন এটা দেখুন, এর নাম দিয়েছি আমরা টাইম লাইন কনভার্টার। সংক্ষেপে টি.এল.সি। এটা একধরনের টাইম মেশিন। এর সাহায্যে ইচ্ছে করলে অতীত-ভবিষ্যৎ যে কোন সময়ে চলে যেতে পারবেন আপনি।
বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকে উঠেছে অস্টিনের। কপালে ভাঁজ পড়েছে কয়েকটা। তার মানে, এক দিনের আলোক পথ অতিক্রম করতে মাত্র সাত মিনিটখানেক লাগে আপনাদের?
আরও কম। এক সেকেন্ড। হাসছে এপ্লয়। গত আড়াইশো বছর ইন্ডিয়ানরা জানে সাসকোয়াচের কথা। বুঝতেই পারছেন, আড়াইশো বছর পিছিয়ে যাওয়াটা আমাদের জন্যে কঠিন কিছুই না।
টেবিলের চারপাশে বসা সব কজনের দিকে একবার করে তাকাল অস্টিন। সবারই মুখে হাসি। ফলারের মুখের ওপর গিয়ে দৃষ্টি আটকে গেল অস্টিনের।
আড়াইশো বছর আগে ইন্ডিয়ান ভূতগুলো আমাদের দেখে যা চমকে উঠেছিল, কি বলব। এমনভাবে বলল কথাটা, যেন এই মাত্র মজা উপভোগ করে এসেছে ফলার।
ফলারের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল এপ্লয়। তারপর অস্টিনের উদ্দেশ্যে লেকচার চালিয়ে গেল আবার, শুধু সময়ের মধ্যে বিচরণই না, আরও কিছু করতে পারে টি.এল.সি। যেমন এর সাহায্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া যায়…
এপ্লয়ের কথা শেষ হবার আগেই পকেট থেকে তার টি.এল.সি. বের করে একটা সুইচ টিপল ফলার! চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। এদিক ওদিক চেয়ে তাকে দরজার কাছে দাঁড়ান দেখতে পেল অস্টিন। দাঁত বের করে হাসছে ফলার।
অবাক হয়ে গেছ, না? অস্টিনের দিকে চেয়ে বলল ফলার। বলেই আবার সুইচ টিপে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকাল অস্টিন। তার পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে টিটকারির হাসি হাসছে ফলার। লোকটার ওপর বিষিয়ে গেছে অস্টিনের মন। এক চড়ে ওর সব কটা দাঁত খসিয়ে দেবার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রোধ করল সে।
নিজের চেয়ারে গিয়ে বস, ফলার। গম্ভীর গলায় আদেশ দিল এপ্লয়।
এপ্লয়ের কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারল না ফলার। খনখনে গলায় বলল, দেখ এপ্লয়, তুমি বস..
বসগে! কড়া গলায় হুকুম দিল এপ্লয়। তীব্র চোখে দুজনের দিকে তাকাল দুজনে। শেষ পর্যন্ত হার মানল ফলার। চোখ নামিয়ে নিযে টি.এল.সি-র সুইচ টিপে ফিরে গেল নিজের চেয়ারে। যন্ত্রটা পকেটে রেখে দিয়ে টেবিলে টাটটু বাজাতে শুরু করল। এই দলের দুষ্টু ছেলে সে, আকারে ইঙ্গিতে এটাই যেন জানাচ্ছে।
যাই বলুন, কর্নেল অস্টিন, এপ্লয়ের গলায় ক্ষোভ। ইয়ং জেনারেশনটাই এমন উদ্ধত। পাঁচ বছরের মিশন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি। এমনিতেই কঠিন কাজ। তার ওপর এদের সামলাতে… চোখ আর মুখের ভঙ্গিতে বাকি কথাটা বুঝিয়ে দিল সে।
এসব বলে আর লাভ নেই। আমাদের ইয়ং জেনারেশনটাও এমনি, বলল অস্টিন।
আসলে সব গ্রহের মানুষেরই স্বভাব-চরিত্র কমবেশি একই রকম। মন্তব্য করল শ্যালন।
সবাই দু পেয়ে ত…
দুজনেই দুজনের দিকে চেয়ে হাসল অস্টিন আর এপ্লয়। তিন মাসে ষাট হাজার আলোক-বছর পেরিয়েছেন। অথচ আমাদের সবচেয়ে দ্রতগামী স্পেসক্রাফটেও লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যাবে। গতিবেগ কত ছিল আপনাদের যানের?
সাবলাইট টার্মে সুপারলাইট গতিবেগের হিসেব দেয়া যায় না, বলল এপ্লয়। তা ছাড়া পৃথিবীতে এর কোন প্রতিভাষা নেই। আমাদের মাপটা বলতে পারি কিন্তু দুর্বোধ্য লাগবে আপনার কাছে। আরও অন্তত দুহাজার বছর পরে এই মাপ শিখবে পৃথিবীর লোকে।
এক কাজ করুন না, হালকা গলায় বল অস্টিন, আপনাদের ওই টি.এল.সি-র সাহায্যে দয়া করে আমাকে দুহাজার বছর ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দিন না। যদি দরকার মনে করেন, আমাকে সাসকোয়াচের মত রোবট বানিয়ে পাঠালেও আপত্তি করব না। শুধু ভবিষ্যতের পৃথিবীতে এবং এর অগ্রগতি দেখতে চাই আমি।
অস্টিনের কথার ধরনে ফলার ছাড়া সবাই হেসে উঠল।
সাসকোয়াচের কথা যখন এসেই পড়ল, বলি, বলল অস্টিন, ওর হাত ছিড়ে ফেলার জন্যে সত্যিই দুঃখিত আমি। আসলে ছিড়তে চাইনি। ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। ও কেমন জীব জানতে চেয়েছি। কিন্তু ও কোন উত্তরই দেয়নি। আক্রমণের তালেই ছিল শুধু।
তার জন্যে ভেবো না, অভয় দিল শ্যালন। আবার ঠিক করে ফেলা হয়েছে তাকে। দরকার পড়লেই ঘুম থেকে জাগিয়ে দেব। এপ্লয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এখনকার মত ওঠা যাক, নাকি?
মাথা নেড়ে সায় দিল এপ্লয়।
১১. মার্লিন বেকিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে জীপটা
মার্লিন বেকিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে জীপটা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন গোল্ডম্যান এই সময়ে পাশে এসে দাঁড়াল রেনট্রি।
নিউক্লিয়ার ডিভাইস এসে গেছে, বলল রেনট্রি। ছোট্ট, এক মেগাটন। কিন্তু এটাই মাঝারি আকারের একটা পাহাড় উড়িয়ে দিতে যথেষ্ট।
ঠিক কোন জায়গায় বসান হবে বোমাটা? জানতে চাইলেন গোল্ডম্যান।
ব্যাটল মাউনটেনের মাইল দুয়েক উত্তর-পশ্চিমে, ফল্ট লাইন ঘেঁষে। হাইইনটেনসিটি লেজার ড্রিলের সাহায্যে গর্ত খোঁড়া হবে মাটিতে। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই বসান হয়ে যাবে বোমা। সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণ ঘটাব।
মার্লিনকে তো পেলাম, থমথমে গোল্ডম্যানের গলা। শুধু অস্টিনকে পাওয়া গেলেই নিশ্চিন্তে বোমা ফাটান দেখতাম আমি।
উপায় নেই, মিস্টার গোল্ডম্যান, সান্তনা দেবার মত করে বলল বিজ্ঞানী, কিন্তু জোর নেই গলায়। কম্পিউটার প্রিন্টআউট তো নিজের চোখেই দেখেছেন।
দেখেছি, টম, কিন্তু…! আশা ছাড়তে পারছেন না গোল্ডম্যান। স্যান আজি ফল্টে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের ধারণা তো ভুলও হতে পারে। ধর, এইবারের মত ভুল করে বসল কম্পিউটার? ওটা তো যন্ত্র। সব সময়ই নির্ভুল সমাধান নাও তো দিতে পারে?
তা পারে, বলল রেনট্রি। কিন্তু সে সম্ভাবনা লাখে এক ভাগ। তবু অন্য একটা টেস্টের ব্যবস্থা করেছি।
কি, কি টেস্ট? আগ্রহে ঝুঁকে এলেন গোল্ডম্যান।
সেন্সর জানাচ্ছে, ট্রিনিটি ফল্ট সংলগ্ন আরও কয়েকটা সাব ফন্টে আগে ছোটখাট ভূকম্পন শুরু হবে। এগুলো থেকেই কম্পনটা মূল ফল্টে ছড়িয়ে পড়বে। আর…
হাতঘড়ির দিকে তাকাল রেনট্রি।
আর সতের মিনিটের মধ্যেই শুরু হবে প্রথম কম্পন। এবং তাহলেই।
তাহলে কি হবে?
বুঝব, প্রচন্ড ভূমিকম্প হবেই।
রেনট্রির চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন গোল্ডম্যান।
কাজেই, আর সতের মিনিট পরেই পুরো শিওর হব আমরা কম্পিউটার মিথ্যে তথ্য দিয়েছে কিনা।
করিডোর ধরে এগিয়ে চলেছে শ্যালন আর স্টিভ। খুশি খুশি লাগছে শ্যালনকে। এক হাতে অস্টিনের বাহু জড়িয়ে ধরেছে। পৃথিবীবাসী পুরুষের ছোঁয়ায় কেমন যেন পুলক অনুভব করছে ভিনগ্রহবাসিনী।
আর কতদিন পৃথিবীতে থাকবে তোমরা? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
কমপক্ষে তিন বছর। তার আগে শিপ আসবে না।
তোমাদের শিপটা দেখতে ইচ্ছে করছে আমার।
তাহলে তিনটে বছর অপেক্ষা করতে হয় তোমাকে, হাসল শ্যালন। অস্টিনের বাহুতে নিজের বাহুর চাপ বাড়াল।
পৃথিবীতে, পুরুষের কাছে কেমন মেয়ে আকর্ষণীয়? আচমকা জিজ্ঞেস করল শ্যালন।
কেন, দুবছর ধরেই তো পৃথিবীর মানুষকে পরীক্ষা করছ। এখনও বোঝনি এখানকার পুরুষদের স্বভাব? পাল্টা প্রশ্ন করল অস্টিন।
প্রশ্ন আমি আগে করেছি, জেদি মেয়ের মত বলল শ্যালন। বল।
অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে ব্যাপারটা। তবে নিজের কথা বললে, বুদ্ধিমতি মেয়ে পছন্দ আমার। হাসিখুশি আর আর…
স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী… অস্টিনের চোখে চোখে তাকাল শ্যালন।
তা তো অবশ্যই, তা তো অবশ্যই, শ্যালনের দিকে তাকিয়ে হাসল অস্টিন। হ্যাঁ, তা তোমাদের কেমন পুরুষ পছন্দ?
তোমাদের মত, নির্দ্বিধায় জবাব দিল শ্যালন। হাসল।
শ্যালনের দিকে তাকিয়ে আছে অস্টিন। অস্বস্তি বোধ করছে।
ডক্টর, বলল অস্টিন, ল্যাবরেটরীতে তোমার ব্যবহারে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম আমি।
দুগালে রক্ত জমছে শ্যালনের। কথা বলল না।
এভাবেই রোগীদের আদরযত্ন কর নাকি তোমরা? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
আরও লাল হয়ে উঠেছে শ্যালনের গাল। হঠাৎই শব্দ করে হাসল সে। সহজ হতে চাইছে।
না, না, তা নয়, কৈফিয়ত দেবার মত করে বলল শ্যালন, আসলে দুটো বছর একদল কাজপাগল বিজ্ঞানীর সঙ্গে কাজ করে করে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। এরপর তুমি এলে দমকা তাজা হাওয়ার মত। শুধু বুদ্ধিমানই না, বায়োনিক-আমার স্পেশালিটি। তা ছাড়া, তা ছাড়া সুপুরুষ…
হা হা করে হাসল অস্টিন। তার দিকে স্থির চেয়ে আছে শ্যালন। হঠাৎ অস্টিনের বাহুর নিচ থেকে নিজের হাতটা বের করে এনে তার হাত ধরল সে। চাপ দিল আলতো করে। অনেক কথাই প্রকাশ পেল এতে।
একটা ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কবে তুমি? কথার মোড় ঘোরাল শ্যালন।
কি ব্যাপার? একটু অবাক হল অস্টিন।
ভালই লাগবে তোমার, আবার গাল লাল হয়ে উঠেছে শ্যালনের। আর হ্যাঁ, সাসকোয়াচের অপারেশনেও আমাকে সাহায্য করলে খুশি হব।
ট্রিনিটি বেস। একটা ওয়র্ক টেবিল ঘিরে উদ্বিগ্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে গোল্ডম্যান, রেনট্রি এবং আরও কয়েকজন। প্রথম ভূকম্পনের অপেক্ষা করছে সবাই।
পনের সেকেন্ড আর, ঘড়ি দেখে বলল ইন্ডিয়ান বিজ্ঞানী। মৃদু হাত কাঁপছে তার। ডান হাতটা একটা কফি কন্টেইনারের ওপর রাখা।
কাঁধ আর গালের মাঝখানে টেলিফোন রিসিভার চেপে ধরে আছেন গোল্ডম্যান।
হ্যাঁ, জেনারেল, জেনারেল ডেভিসের সঙ্গে কথা বলছেন গোল্ডম্যান, যদি প্রথমে এই ছোটখাট ভূকম্পন ঘটে, তো রেনট্রি বলছে, মেজর আর্থকোয়েকে আর সাত ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই কয়েকটা বড় বড় শহর হারাব আমরা।
আট সেকেন্ড, ঘোষণা করল ওদিকে রেনট্রি।
প্লীজ, স্ট্যান্ড বাই, জেনারেল, অনুরোধ করলেন গোল্ডম্যান।
ছয় সেকেন্ড, হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েই আছে রেনট্রি, পাঁচ…চার…তিন… দুই…এক…
অস্বস্তিকর নীরবতা। থমথম করছে টেবিল ঘিরে দাঁড়ান লোকগুলোর মুখ। কিন্তু কিছুই ঘটছে না। পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল রেনট্রি আর গোল্ডম্যান।
আরও এক সেকেন্ড দেখল রেনট্রি। তারপর এগিয়ে গিয়ে খটাখট কয়েকটা বোতাম টিপল কম্পিউটারের। রিডিং ডায়ালের দিকে এক নজর দেখেই গোল্ডম্যানের দিকে তাকাল। ঠিকই আছে। কম্পন অনুভব করব আমরা, কনফার্ম করেছে কম্পিউটার।
ভোঁতা যন্ত্রটা ভুল বকছে, বললেন গোল্ডম্যান।
কি জানি। অনিশ্চিত রেনট্রির গলা।
কোন ধরনের ভূমিকম্পই হবে না, দৃঢ় গলায় বললেন গোল্ডম্যান। না এখন, না সাত-আট ঘণ্টা পরে।
হয়ত বা, জোর নেই রেনট্রির গলায়।
থ্যাংক গড, বললেন গোল্ডম্যান। নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডগুলো আর্সেনালে ফিরিয়ে নেবার আদেশ দিচ্ছি আমি এখুনি। রিলিজ পেপার সই করে দিচ্ছি।
স্বস্তির শ্বাস ফেলেছে টেবিল ঘিরে দাঁড়ান সব কজন লোক।
রিলিজ পেপারটার দিকে তাকিয়ে আছে রেনট্রি। তার ধারণা ঠিক হল না, এতে বরং খুশিই সে। অস্টিনের জন্যে ভাবনা অনেকখানি কমে গেল ভূমিকম্প না হওয়ায়।
জেনারেল, ফোনে আবার কথা বলছেন গোল্ডম্যান, সুসংবাদ! খুশি উপচে পড়ছে তার গলায়, ভূকম্পন হল না! মনে হচ্ছে কম্পিউটার ভুল…
আচমকা থেমে গেলেন গোল্ডম্যান। পাহাড়ের দিক থেকে একটা অদ্ভুত চাপা ব্দ শোনা যাচ্ছে। ভয় পেয়ে আকাশে উঠে গেছে পাখির দল। রেডিওর ওপরে কফিভর্তি কাপ রেখেছিল রেনট্রি, কাঁপতে শুরু করেছে কাপটা। ছলকে রেডিওর ওপর পড়ল বাদামী তরল পদার্থ। কম্পন শুরু হয়ে গেছে। ছোট ছোট লাফে রেডিওর একেবারে কিনারায় চলে এল, তারপর কাত হয়ে টেবিলে গড়িয়ে পড়ে গেল কাপটা। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কফিতে ভিজে গেল রিলিজ পেপার।
মিনিট তিনেক থাকল কাঁপুনি। শুধু রেনট্রিরটাই নয়, টেবিলে রাখা আরও অনেকের কফির কাপ স্থানচ্যুত হয়েছে। এছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গোল্ডম্যান। কানে ঠেকানোই আছে টেলিফোন রিসিভার। ওপাশ থেকে সমানে চেঁচাচ্ছেন জেনারেল ডেভিস, কি ঘটছে এদিকে, জানতে চাইছেন।
জেনারেলকে নয়, নিজেকেই ফিসফিস করে বললেন গোল্ডম্যান, অস্টিনকে আর বাঁচান গেল না। ঈশ্বর…!
শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে রেনট্রি।
ভূগর্ভের রহস্যপুরীতে অস্টিন এবং ভিনগ্রহবাসীরাও অনুভব করল কম্পন। বেস ক্যাম্পের মত এরা কিন্তু অত সহজে রেহাই পেল না। মাটির গভীরে কম্পনের পরিমাণ অনেক বেশি তীব্র, চাপা গর্জন অসহ্য। দেয়ালের গা থেকে ঝুর ঝুর করে ক্রিস্টাল খসে পড়ল। থির থির করে কাপতে লাগল আলগা যন্ত্রপাতি আর অন্যান্য জিনিসপত্র। মেঝেয় পড়ে গিয়ে কিছু কাঁচের তৈজসপত্রও ভাঙল।
মেন করিডোরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে অস্টিন এবং আরও কয়েকজন স্থির থাকার চেষ্টা করছে। নিজেকে সোজা রাখতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল একজন মহিলা। সমস্ত জিনিসপত্র, মানুষ আর মেঝের ওপর হালকা ধুলোর আস্তরণ, যেন একটা ফিনফিনে পাতলা ধূসর চাদর বিছিয়ে দেয়া হয়েছে সব কিছুর ওপরে। মহিলার পতন দেখল অস্টিন, ধুলোর চাদরের দিকে তাকাল। ওপরের দিকে চেয়ে ক্রিস্টাল খসে পড়াও দেখল। এরই ভেতরে ব্যাপারটা চোখে পড়ল তার। ইনফ্রা রেড চালু করল সঙ্গে সঙ্গে। ঠিক মাথার ওপরে, সিলিঙে অতি সূক্ষ্ম চিড় ধরেছে। কম্পনের সঙ্গে ক্রমেই বড় হচ্ছে ফাটল, ফাঁক হচ্ছে। শংকিত হয়ে পড়ল অস্টিন। যে কোন সময়ে পাথরের ছাদ মাথায় ভেঙে পড়তে পারে।
ফাটল বড় হয়ে যেতেই দুদিকের কিনারা থেকে পাথরের ছোট ছোট টুকরো টুপটাপ খসে পড়তে লাগল। তারপরই ঘটল ঘটনাটা। অনেকখানি জায়গা নিয়ে ভাঙল পাথর। ওজন মন ছয়কের কম হবে না। খুব ধীরে নেমে আসছে। খালি চোখে ভাঙনটা বুঝতে পারল না অস্টিন, কিন্তু বায়োনিক চোখে ঠিকই দেখেছে সে। ছাদে চিড় ধরার পর থেকে পনের সেকেন্ড কেটে গেছে। এই সময়টা ছাদের দিকেই তাকিয়েছিল অস্টিন।
সোজা পাথরটা এসে পড়বে মেঝেতে পড়ে থাকা মহিলার ওপর। লাফ দিল অস্টিন। চোখের পলকে পড়তে থাকা পাথরটার নিচে এসে দাঁড়াল। বায়োনিক হাত বাড়িয়ে ঠেলে ধরল পাথরটা ওপরের দিকে।
ভীত দৃষ্টিতে পাথরটার দিকে তাকিয়ে আছে শ্যালন। নিজেকে অনেক কষ্টে স্থির রাখার চেষ্টা করছে সে। বিশাল পাথরটা ধরে রাখতে পারবে তো আজব লোকটা? যদি ছুটে যায় তো মাটিতে পড়ে থাকা মহিলা এবং অস্টিন দুজনেই মরবে।
আরও দুই মিনিট পর আস্তে আস্তে থেমে এল কম্পন। পাথরটা একই ভাবে ঠেলে রেখেছে অস্টিন।
ভূমিকম্প থামতেই দুজন লোক ছুটে গিয়ে পড়ে থাকা মহিলাকে টেনে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে আনল।
জলদি, চেঁচিয়ে আদেশ দিল শ্যালন, জলদি ঠেক দেবার একটা পিলার নিয়ে এস!
একজন টেকনিশিয়ান ছুটে চলে গেল করিডোর থেকে। তিরিশ সেকেন্ড পরেই একটা হালকা কিন্তু মজবুত পিলারের মত জিনিস নিয়ে এল। পরে শুনেছে অস্টিন, এই বিশেষ জিনিসগুলো আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হয়েছে। ভূগর্ভকক্ষে এ ধরনের দুর্ঘটনা যে কোন সময় ঘটতে পারে, তাই এই সাবধানতা সত্যিই কাজে লেগে গেল এখন জিনিসটা।
টেকনিশিয়ানের সহায়তায় এগিয়ে এল শ্যালন। দুজনে মিলে পাথরের ঠিক মাঝামাঝি জায়গা থেকে মেঝের সঙ্গে ঠেক দিয়ে বসিয়ে দিল পিলারটা। হাতের চাপ হালকা করল অস্টিন। তারপর পাথরটা আর পড়বে না বুঝতে পেরে হাত নামিয়ে আনল।
ঘুরে দাঁড়াতেই দুহাতে অস্টিনকে জড়িয়ে ধরল শ্যালন। তোমার, তোমার কোন ক্ষতি হয়নি তো?
না।
কি ভূমিকম্পটাই না হল!
সামান্য একটু কম্পন মাত্র, ঠেস দিয়ে আটকে রাখা পাথরটার দিকে তাকিয়ে আছে অস্টিন। এতে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু আমি ভাবছি, পাথর থাকবে ত!
ট্রিনিটি বেস। একটু আগের ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা করছে রেনট্রি আর গোল্ডম্যান।
ভুল। ভুরু কোঁচকালেন গোল্ডম্যান, কম্পিউটার ভুল করেছে?
একটা ফিগারে একটু গন্ডগোল ছিল, ঠিক করে দিয়েছি, বলল রেনট্রি। আর এই ভুলের জন্যেই আসল সময়ের কয়েক সেকেন্ড আগে সময় নির্দেশ করেছে যন্ত্রটা।
তাহলে? মেজর আর্থকোয়েক ঠিক কখন ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে আঘাত হানবে?
ঘড়ি দেখল রেনট্রি, এখন থেকে ঠিক সাত ঘণ্টা ছত্রিশ মিনিট পর।
হুঁ। হতাশ দৃষ্টি গোল্ডম্যানের চোখে, কোন উপায় নেই আর, না। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটাতেই হচ্ছে। ঠিক আছে, কাজ শুরু করে দিতে বল, টম।
ঠিক আছে, চেয়ার থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল রেনট্রি। তারপর কি মনে হতেই ফিরে তাকাল, অস্টিনের আর কোন খবর পাওয়া যায়নি, তাই না মিস্টার গোল্ডম্যান?
রেনট্রির দিকে চাইলেন গোল্ডম্যান। মুখে কোন কথা বললেন না, এদিক ওদিক মাথা নাড়ালেন শুধু।
আর কোন কথা না বলে হাঁটতে শুরু করল রেনট্রি।
পরীক্ষাগারে, সাসকোয়াচকে শুইয়ে রাখা টেবিলটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে অস্টিন আর শ্যালন।
কি চেহারা! ঠোঁট ওল্টাল অস্টিন।
আসলে কিন্তু ভারি মিষ্টি ছেলে ও, বলল শ্যালন। ভারি মিশুক?
ঠিক। বনের ভেতরে আসলে ও আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিল, তাই না? মৃদু শ্লেষ অস্টিনের গলায়।
আসলে তোমাকে ধরে আনার নির্দেশ ছিল ওর ওপর তখন, গম্ভীর শ্যালন। যাকগে ওসব কথা। এখন এসো তো, ওকে জাগিয়ে তোলার আগে কয়েকটা কাজ সেরে ফেলি।
একটা টেবিলে রাখা কন্ট্রোল সুইচবোর্ডের একাধিক বোতাম টিপল শ্যালন। ইলেকট্রোনিক যন্ত্রপাতির বিচিত্র আওয়াজ উঠল। একমনে কাজ করে গেল শ্যালন। মাঝেমধ্যেই এটা ওটার নির্দেশ দেয় অস্টিনকে। চিফ নার্সের কাজ করছে যেন অস্টিন।
কাঁধ আর জোড়া লাগান হাত নিয়ে আবার নাড়াচাড়া করছ কেন? জিজ্ঞেস করল অস্টিন। ওটা নাকি ঠিক করে ফেলেছিলে?
ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন নতুন আইডিয়া ঘুরছে মাথায়। আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে ওর হাত। যখন বানিয়েছিলাম, তোমার মত বায়োনিক ম্যানের পাল্লায় পড়বে ভাবিনি।
ওর মত আরও রোবট আছে নাকি তোমাদের?
না। ওই আমার প্রথম সৃষ্টি। প্রথম খোকা।
কাঁচি, অস্টিনের দিকে না তাকিয়েই হাত বাড়াল শ্যালন। হাতে তুলে দিল অস্টিন।
অপারেশনের উপযুক্ত পোশাক পরছি না কেন আমরা? জিজ্ঞেস করল অস্টিন। আমাদের হাসপাতালে ছোট্ট কোন কাটাছেড়ার সময়েও বিশেষ পোশাক পরে সার্জনরা।
আমাদের এই পরীক্ষাগারের বাতাস হাইপার স্টেরিলাইজড়। জীবাণু পরিবাহী কোন কিছু কিংবা এক বিন্দু ময়লা নেই এঘরে। আর কোন অলৌকিক উপায়ে জীবাণু ঢুকে পড়লেও নিউট্রাক্সিন থ্রি ওদিকটা সামলাবে।
নিউ…কি বললে? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
নিউট্রাক্সিন থ্রি, অহংকার শ্যালনের গলায়। তোমাকে এর একটা শিশি দেখাবখন। এটা এক ধরনের ইলেকট্রোলাইটিক নিউরোপ্রোবেসিস, আমাদের দেহের ডি.এন.এ কণার সঙ্গে মিশে কাজ করে। রোগ ছড়াতে বাধা দেয়।
কোন্ রোগ?
সমস্ত রোগ। এ এক আশ্চর্য মহৌষধ!
ঝুঁকে সাসকোয়াচের বুকে মৃদু চাপড় দিল শ্যালন। নিজীব রোবটটার উদ্দেশ্যে বলল, আর বেশি দেরি নেই খোকা। এই কয়েক মিনিট। তারপরই ঘুম ভাঙাব।
আসলে ওর মা বলা চলে তোমাকে, না?
এই নিরানন্দ ল্যাবরেটরীতে ও না থাকলে সময়ই কাটত না আমার। অস্টিনের দিকে তাকাল শ্যালন। মৃদু হাসল। তারপর আবার কাজে মন দিল।
যন্ত্রপাতির ট্রেটা আঁতিপাতি করে খুঁজছে শ্যালন। কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিসটা কিছুতেই পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত একটা নীডল-নোজড প্লয়ার্স তুলে নিল। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ জিনিসটার দিকে, ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।
জিভ আর টাকরার সাহায্যে চুক জাতীয় একটা শব্দ করল শ্যালন। বলল, এই প্লায়ার্সেরই নাক দুটো যদি ভেতরের দিকে সামান্য বাকান থাকত, চমৎকার হত।
দাও তো দেখি, শ্যালনের হাত থেকে প্লায়ার্সটা নিল অস্টিন। বায়োনিক আঙ্গুলে চেপে ভেতর দিকে একটু বাঁকিয়ে দিল নাক দুটো। প্লায়ার্সটা আবার শ্যালনকে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, দেখ, এতে কাজ চলে কিনা!
প্লায়ার্সটার দিকে একবার তাকাল শ্যালন। তারপর অস্টিনের দিকে তাকাল। হাসল। ধন্যবাদ, বলে আবার ঝুঁকে কাজে মন দিল।
কাজ শেষ করে প্লয়ার্সটা ট্রেতে রাখল শ্যালন। তারপর ট্রেটা নিয়ে টেবিলের নিচে যন্ত্রপাতি থাকার বাক্সে রেখে দিল।
হয়েছে, বলল শ্যালন, ওর হাতটা জোড়া লেগেছে। শক্তিও অনেক বাড়ান হয়েছে আগের চেয়ে। তুমিও আর এখন টেনে ছিড়তে পারবে না।
দরকারও নেই, বলল অস্টিন। তবে লাগতে এলে চেষ্টা করে দেখব।
পারবে না, বলল শ্যালন। আর একটু বাকি। এই যে এখানে, সাসকোয়াচের পিঠের একটা জায়গা দেখিয়ে বলল সে, মারজানন পাওয়ার সেলটা বসিয়ে দিলেই কাজ শেষ।
টেবিলের একপাশে রাখা একটা প্লাস্টিকের বাক্স খুলল শ্যালন। ভেতর থেকে ছোট ব্যাটারির আকৃতির চৌকোনা কালো একটা বাক্স মত জিনিস বের করল।
এটা! কালো বাক্সটার দিকে নির্দেশ করে বলল অস্টিন, এটাই অতবড় দানবটার চলার শক্তি জোগাবে? এত ছোট জিনিস! তা এই মারজানন আসলে কি?
এক ধরনের অ্যান্টিম্যাটার পাওয়ার সোর্স, জানাল শ্যালন। আগামী একশো বছরের মধ্যে তোমাদের বিজ্ঞানীরাও এই জিনিস আবিষ্কার করে ফেলবে হয়ত।
হয়ত, অনিশ্চিতভাবে মাথা দোলাল অস্টিন। আবার সাসকোয়াচের দিকে মন দিল শ্যালন।
এই মারজাননের চাইতে তোমাদের নিউট্রাক্সিন সিরাম অনেক বেশি কাজের জিনিস মনে হচ্ছে, বলি বলি করে বলেই ফেলল অস্টিন কথাটা, এই ওষুধ পেলে পৃথিবীবাসীর খুব উপকার হত। এক আধ শিশি উপহার পাবার আশা করতে পারি কি?
সাসকোয়াচের পিঠে একটা মিটার জাতীয় যন্ত্র বসিয়ে রিডিং দেখছে শ্যালন। অস্টিনের কথায় ফিরে তাকাল। দেখ, তোমাকে এক শিশি ওষুধ উপহার দেয়াটা বড় কথা নয়। আমরা এখানে থেকে রিসার্চ করছি, আসলে এটাই জানতে দিতে চাই না পৃথিবীবাসীকে।
হাসল অস্টিন। শ্যালন, কথা দিচ্ছি, শিশিটা কোথায় পেয়েছি জানাব না কাউকে। তোমাদের কথাও বলব না। যত খুশি মানুষ ধরে নিয়ে পরীক্ষা চালাও তোমরা। বিন্দুমাত্র বাধা দিতে আসব না। এক শিশি নিউট্রাক্সিন পৃথিবীবাসীর যে উপকার করবে, তার বিনিময়ে কয়েকজন মানুষকে গিনিপিগ বানাতে চাওয়া তখন অন্যায় হবে না তোমাদের জন্যে। যদি বল, আবার হাসল সে, তোমাদের ছুরিকাচির তলায় আমিও নির্দ্বিধায় নিজেকে বলি দিতে রাজি আছি।
দুঃখিত, অস্টিন। তোমার কথা রাখা সম্ভব নয়, সত্যিই দুঃখিত আমি।
ও, গম্ভীর হয়ে গেল অস্টিন। কি যেন ভাবল। তারপর বলল, হ্যাঁ, ভাল কথা, আমি যে এখানে নিরাপদে আছি আমার লোকদের জানাতে পারলে ভাল হয়। তোমাদের কথা কিছু বলব না অবশ্যই। জানে অস্টিন, সরাসরি মানা করবে শ্যালন, তবু বলল সে। আসলে অন্য একটা ভাবনা মাথায় ঢুকেছে তার।
সম্ভব না, মানাই করল শ্যালন। এপ্লয় রাজি হবে না।
মর্স কোড পাঠাতে মাত্র দশ সেকেন্ড লাগবে।
মর্স তো দূরে কথা, স্মোক সিগন্যালও না।
কিন্তু…
এখন কোন কিন্তু না, লক্ষ্মী, পরে দেখা যাবে। হাতের কাজ রেখে এগিয়ে এসে অস্টিনের গালে চুমু খেল শ্যালন।
ঠিক আছে। আশা করছি শুধু বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যেই এতসব করছ তোমরা? হাল ছেড়ে দেয়ার ভান করল অস্টিন।
বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যেই শুধু।
পরিস্থিতি সহজ করার জন্যেই শব্দ করে হাসল অস্টিন। শ্যালনও হাসল তার দিকে তাকিয়ে। তারপর আবার সাসকোয়াচের দিকে ফিরল। ঠিক এই সময় সিলিঙে বসানো মাইক্রোফোনে একটা শব্দ হল। মেসেস পাঠানোর পূর্বসংকেত।
সুইচবোর্ডের একটা সুইচ টিপল শ্যালন। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের গায়ে টেলিভিশনের পর্দা বেরিয়ে এল। তাতে এপ্লয়ের ছবি।
শ্যালন, ছবিটা তার দিকে তাকিয়ে ডাকল, জলদি চলে এস।
কেন ডাকছে, কিছুই জানতে চাইল না শ্যালন। শুধু বলল, আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল এপ্লয়ের ছবি।
অস্টিনের দিকে তাকাল শ্যালন, এখানেই থাক। আমি আসছি। বলেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
একটু ইতস্তত করল শ্যালন। একটু যেন লজ্জা পেল। তারপর বলেই ফেলল, আচ্ছা স্টিভ, থেকে গেলে হয় না?
হাসল অস্টিন। তুমিও চল না আমার সাথে।
সেটা কি সম্ভব?
মাথা ঝাঁকাল অস্টিন। হু, অসম্ভব। কাজেই…
দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকাল কয়েক মুহূর্ত। চোখ নামিয়ে নিল শ্যালন। ঠিক আছে? তোমাকে কোনদিন ভুলব না, স্টিভ।
তোমাকেও ভুলব না।
অস্টিন ঘুরে দাঁড়াবার আগেই চট করে বলল শ্যালন, আরেকটা কথা। আবেগপ্রবণ পৃথিবীর মানুষের কাছে শিখলাম জ্ঞান সাধনাই সব নয়, সহানুভূতি, সাহায্য এসবেরও অনেক দাম আছে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ঘুরে দাঁড়াল অস্টিন।
১২. শ্যালন চলে যেতেই
শ্যালন চলে যেতেই দ্রুত ক্যুনিকেটরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল অস্টিন। বোতাম টিপতেই ছবি ফুটল টেলিভিশনের পর্দায়। করিডোরের একটা অংশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কি ভেবে আরও দুটো টেলিভিশনের বোতামও টিপল সে। কাউন্সিল চেম্বার দেখা গেল একটায়। তৃতীয় টেলিভিশনটা ভূগর্ভের বাইরের দৃশ্য দেখার জন্যে। বুঝল, এর সাহায্যেই ট্রিনিটি বেসের ওপর নজর রেখেছে শ্যালন আর এপ্লয়।
ট্রিনিটি বেসের ওপরই এখন সেট করা আছে টেলিভিশন। ওয়ার্কিং টেবিলের সামনে অসকার গোল্ডম্যান আর টম রেনট্রিকে বসে থাকতে দেখল অস্টিন। টেলিভিশনের প্রেরক যন্ত্রটা খুঁজতে লাগল সে। বেশিক্ষণ লাগল না, দেয়ালের গায়ের একটা গুপ্ত কুঠুরি থেকে যন্ত্রটা বের করে নিল। ওটা টি.ভি. সেটে লাগিয়ে অ্যাডজাস্ট করতে করতেই দেখল, ক্যাপ্টেন এগিয়ে যাচ্ছে গোল্ড-ম্যান আর রেনট্রির দিকে।
ডায়াল সেট করতেই কথা ভেসে এল টি.ভি-র মাইক্রোফোনে।
বোমা বসান কদূর? জিজ্ঞেস করল গোল্ডম্যান।
বোমা! অবাক হল অস্টিন।
মাত্র তো গ্রিভগুলো নিয়ে গেছে, জবাব দিল রেনট্রি।
ছবি এবং কথার প্রেরণ-গ্রহণ দুটো কাজই করতে পারে কিনা টি.ভি. গেজেটটা পরীক্ষা করতে লাগল অস্টিন।
মিস্টার গোল্ডম্যান, গেজেটের মাইক্রোফোনে মুখ লাগিয়ে বলল সে, মিস্টার রেনট্রি…আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
কিন্তু শুনল না ওরা। নিজেদের কথাই বলে চলেছে।
নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডটা বসান হয়ে গেছে, বলল রেনট্রি।
কি বলছে ওরা! বোম…নিউক্লিয়ার ওয়রহেড…, বিড় বিড় করল অস্টিন।
মাইক্রোফোনে মুখ লাগিয়ে আবার ডাকল, মিস্টার গোল্ডম্যান, মিস্টার রেনট্রি…আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
এবারেও শুনল না ওরা।
আসলে ঠিক কখন, কোন পজিশনে বিস্ফোরণ ঘটবে? জানতে চাইল আর্মি ক্যাপ্টেন।
গোল্ডম্যানের দিকে তাকাল রেনট্রি। তিনিও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
ওয়ান সিক্স জিরো এইট আওয়ারে উনিশ নম্বর স্টেশনে ডেটোনেশন ঘটবে, বলল রেনট্রি। বিস্ফোরণের দুই কি তিন সেকেন্ড পরেই ভূমিকম্প হবে ব্যাটল মাউনটেনের চুড়ার আশেপাশে। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাপ উঠবে সেভেন পয়েন্ট নাইন।
সেভেন পয়েন্ট নাইন! ভুরু কুঁচকে গেছে অস্টিনের।
যেন তার কথার জবাবেই বলে গেল রেনট্রি, প্রথমে যা ভেবেছিলাম, কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, ও জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটান উচিত হবে না এখন কিছুতেই। কারণ, একটু আগের ভূকম্পনে মারাত্মকভাবে নড়তে শুরু করেছে রকপ্লেট। কাজেই পর্বতের একটু ধার ঘেঁষে কৃত্রিম পদ্ধতিতে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে এখন। এতে জোর ভূমিকম্প হবে, কিন্তু জনবসতি পর্যন্ত পৌঁছতে পৌছতে কম্পনের শক্তি একেবারেই কমে যাবে। কারও কোন ক্ষতি হবে না এতে। আর পাঁচ ঘণ্টা পরেই বিস্ফোরণ ঘটান হবে।
কি? চেঁচিয়ে উঠল অস্টিন।
অস্টিনের চিৎকারে সাসকোয়াচের ঘুম ভেঙে গেল। শ্যালন যাবার আগেই ওর যান্ত্রিক স্লপিং-প্রসেসের কানেকশন কেটে দিয়ে গেছে। অস্বাভাবিক চিৎকার রোবটটার কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সচেতন হয়ে উঠেছে তার ইলেকট্রোনিক ব্রেন। হুকুম দিতে শুরু করেছে যান্ত্রিক দেহকে। চোখ মেলেই কাত হয়ে অস্টিনের দিকে তাকাল সাসকোয়াচ। তার দিকে পেছন ফিরে আছে অস্টিন।
অ, অ, বুঝেছি, বলল ক্যাপ্টেন। এজন্যেই ব্যাটল মাউনটেনের পশ্চিম ধারে যাতে কেউ না যায়, দেখতে বলেছেন। কিন্তু ওখানে আর কে যাবে। কয়েকজন মেষ পালক মেষ চরাচ্ছিল, সরিয়ে দিয়েছি। মাঝে মধ্যে শিকারীরা যায় ওদিকে, আজ যায়নি একজনও। গোল্ডম্যানের দিকে তাকাল সে, কিন্তু মিস্টার গোল্ডম্যান, সবাইকে তো সরিয়ে রাখছি, ওদিকে কর্নেল অস্টিনই বেরিয়ে গেলেন! পাহাড়ের ঠিক ওই দিকেই তো গেছেন উনি।
পরস্পরের দিকে চাইলেন গোল্ডম্যান আর রেনট্রি।
আধ সেকেন্ড চেয়ে থেকেই চোখ নামাল রেনট্রি।
টেবিলে রাখা একটা ডিজিটাল কাউন্টারের দিকে তাকাল। রিডিং দেখল। তারপর রেডিও মাইক্রোফোনে কাকে আদেশ দিল, নিউক্লিয়ার ডেটোনেশন বার মিনিট মার্ক করে রাখ।
দ্রুত পরিষ্কার হয়ে এল বিগফুটের ইলেকট্রোনিক ব্রেন। পুরোপুরি কাজ করতে শুরু করেছে। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল সাসকোয়াচ। অস্টিন কি করছে ভাল মত দেখতে চায়।
তাকে লক্ষ্য করা হচ্ছে, টের পেল না অস্টিন। গভীর মনোেযোগে টি.ভি-র প্রেরক যন্ত্রটা পরীক্ষা করছে সে। মিনিটখানেক পরেই বুঝল, কয়েকটা বিশেষ যন্ত্রাংশ খুলে নেয়া হয়েছে, লাগিয়ে নিলেই আবার কাজ করবে। আপাতত অকেজো। অগত্যা নিজের পায়ের চেম্বারে রাখা ভি.এইচ.এফ. ট্রানসিভারটা বের করে নিল। অ্যান্টেনা তুলে সুইচ টিপল। কিন্তু কোন সাড়া নেই। আরও বার দুই সুইচ টেপাটেপি করেই বুঝে গেল, কাজ করবে না। তার দেহের ভেতরের পাওয়ার সোর্স থেকে রেডিওটার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। আবার জোড়া লাগাতে পারে সে, কিন্তু অত সময় হাতে নেই এখন। যন্ত্রটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সাসকোয়াচের দিকে চাইবার কথা পর্যন্ত মনে হল না একবার।
মিনিট তিনেকের চেষ্টায় কাউন্সিল চেম্বার খুঁজে পেল সে। সোজা ঢুকে পড়ল ভেতরে। টেবিল ঘিরে বসে কথা বলছে এপ্লয়, ফলার এবং আরও কয়েকজন। শ্যালন অনুপস্থিত।
এপ্লয়, সরাসরি বলল অস্টিন। ক্যালিফোর্নিয়া কোস্ট ধরে একটা মেজর আর্থকোয়েক ঘটতে যাচ্ছে আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। এটাকে রোধ করতে চাইছে আমার সঙ্গীরা। একটা কৃত্রিম ভূমিকম্প ঘটাবে ওরা আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। আর ঘটাবে পর্বতের এদিকটাতেই।
জানি আমরা, বলল এপ্লয়।
জান!
হ্যাঁ।
কিন্তু তাহলে যে ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটবে! তোমাদের এই আন্ডারগ্রাউন্ড কমপ্লেক্স পুরো ধ্বংস হয়ে যাবে।
না, শান্ত কণ্ঠে বলল এপ্লয়, যাবে না। কৃত্রিম ভূমিকম্পটা ঘটতেই দেয়া হবে না।
মানে? ভুরু কোঁচকাল অস্টিন।
ডেটোনেশান সাইটে চলে গেছে শ্যালন। ডেটোনেটরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে সে।
কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ না, প্রতিবাদ করল অস্টিন। কৃত্রিম ভূকম্পনের সাহায্যে প্রেশার না কমালে ক্যালিফোর্নিয়া কোস্ট ধরে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়ে যাবে।
বললাম তো, জানি আমরা।
এর ফলে কয়েকটা বড় বড় শহর ধ্বংস হয়ে যাবে! হাজার …না না, লাখ লাখ লোক মারা যাবে।
কিন্তু আমাদের করার কিছু নেই।
নিশ্চয়ই আছে, চেঁচিয়ে উঠল অস্টিন। শ্যালনকে থামাও।
দুঃখিত, বলল এপ্লয়, সম্ভব নয়।
সম্ভব নয়। কি বলতে চাইছ তুমি? কঠোর হয়ে উঠল অস্টিনের দৃষ্টি। বুঝেছি। সাসকোয়াচকে দিয়ে ধরে এনে বহু লোককে আধপাগল করে ছেড়ে দিয়েছ তোমরা। ওদেরকে গিনিপিগ বানিয়েছ। এখন আবার লাখ লাখ নিরপরাধ লোককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছ। কোন জাতের সভ্য তোমরা?
স্যাক্রিফাইস শব্দটা তোমাদের অভিধানেই দেখেছি। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যে, বিশেষ করে কোটি কোটি মানুষের উপকারের জন্যে সাধারণ কয়েক লাখ কিছুই না।
রাগে জ্বলে উঠল অস্টিন। চেঁচিয়ে বলল, দেখ, এই পৃথিবীটা আমাদের তোমরা এখানে অনধিকার প্রবেশ করেছ। অনুপ্রবেশকারীদের কি করে ঘাড় ধরে বের করতে হয় ভালমতই জানা আছে আমাদের। তোমরা পৃথিবীতে বসে পৃথিবীর লোকদেরই চিড়িয়াখানার জীব বানাবে, তা আর হতে দিচ্ছি না কিছুতেই।
চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল অস্টিন। দরজার দিকে ছুটল।
সাবধান, পিছন থেকে ডেকে বলল এপ্লয়, পালানোর চেষ্টা করলে ফল ভাল হবে না।
বাধা দিয়ে দেখ, বলেই বেরিয়ে গেল অস্টিন। ছুটল করিডোর ধরে। এঁকেবেঁকে, পাক খেয়ে এগিয়ে গেছে করিডোর। অসংখ্য সাব-করিডোর বেরিয়ে গেছে আবার এটা থেকে। ঠিক কোনদিকে এগোলে আইস টানেলটা পাওয়া যাবে জানে না সে। অনুমানেই এগিয়ে চলেছে। প্রধান করিডোর থেকে সরছে না। এখানে এসে অবধি কোন ধরনের অস্ত্র চোখে পড়েনি অস্টিনের। তবে কি অস্ত্রের ব্যবহার প্রয়োজন মনে করে না এরা? বুঝতে পারছে অস্টিন, নিজেদের অসম্ভব ক্ষমতাশালী মনে করে এরা। মনে করে, পৃথিবীবাসীর সঙ্গে লাগতে অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। একটা কল্পিত আদিম জীবের যান্ত্রিক সংস্করণ বানিয়ে ছেড়ে দিলেই মানুষকে কব্জা করা যাবে অনায়াসে। নিজেদের সমস্ত অকাজ কুকাজ করে যেতে পারবে নির্বিঘ্নে। যতই ভাবছে, রাগে পাগল হয়ে উঠছে অস্টিন। হাঁটার গতি বেড়ে যাচ্ছে নিজের অজান্তেই।
শখানেক ফুট কিংবা তারও কিছু বেশি এগিয়ে, পাথর খুঁড়ে বের করা সরু লম্বা অন্ধকারাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গে এসে মিশেছে প্রধান করিডোর। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় উজ্জ্বল আলো। ক্রিস্টাল। ওখানে থেকেই শুরু হয়েছে আইস টানেল। সুড়ঙ্গে নেমে এল অস্টিন। বড় জোর তিন কদম এগিয়েছে, হঠাৎ প্রচন্ড দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেল যেন তার শরীর। ভারি কিছু ছুটে গেল তার গা ঘেঁষে, অকল্পনীয় গতিতে। তারপরই, তার সামনে যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হল এপ্লয়, ফলার এবং আরও কয়েকজন। টি.এল.সির সাহায্যে এসেছে। অস্টিনের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে ওরা। দূরত্ব তিরিশ ফুট।
প্লীজ, কর্নেল, থামতে বলা ভঙ্গিতে হাত তুলল এপ্লয়, আপনার নিজের এবং আমার লোকদের স্বার্থে দয়া করে চলে যাবার চেষ্টা করবেন না।
শোন, ধমকে উঠল অস্টিন, তোমাদের সঙ্গে নোবল স্যাভেজ খেলায় বিরক্ত হয়ে গেছি আমি। পথ ছাড়, নইলে জোর করে বেরোব।
কর্নেল…
বুঝেছি, দাঁতে দাঁত চাপল অস্টিন, ভায়োলেন্স স্টাডি করতে এসেছ। বেশ… বায়োনিক, ভয়ঙ্কর গতিতে সামনে ছুটে গেল অস্টিন। সরে যাবার সময় পেল না এপ্লয় আর ফলার। অস্টিনের দুই কনুইয়ের ধাক্কায় প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল পাথুরে দেয়ালের গায়ে। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল দুজনেই। ময়দার বস্তার মত ধপাস্ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। জ্ঞান হারাল সঙ্গে সঙ্গেই।
ফিরে দাঁড়াল অস্টিন। অন্য লোকগুলো আক্রমণ করতে আসছে কিনা দেখল। তেমন কোন ইচ্ছেই দেখা যাচ্ছে না ওদের মাঝে। চোখ বড় বড় করে একবার এপ্লয়-ফলার, আরেকবার অস্টিনের দিকে তাকাচ্ছে।
তারপর? মুচকে হাসল অস্টিন। ডান হাতের তর্জনীর ইঙ্গিতে ডাকল, আর কারও সখ আছে? নাকি ছাগল দুটোর মাজা ভেঙেছে দেখেই আক্কেল হয়েছে?
কেউ কিছু বলল না। আচমকা সুড়ঙ্গে এসে ঢুকল আরও দুজন লোক। একেবারে অস্টিনের সামনে এসে থামল। আক্রমণ করবে কি না দ্বিধা করছে।
এসব ঝামেলায় নিশ্চয়ই জড়াতে চাও না? ইঙ্গিতে এপ্লয় আর ফলারের পড়ে থাকা দেহ দুটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
কিন্তু আমাদের কর্তব্য করতেই হবে, আগম্ভক দুজনের একজন বলল। কিন্তু গলায় জোর নেই।
ভেরি গুড। এস তাহলে, শার্টের হাতা গুটাচ্ছে অস্টিন। কার আগে দরকার?
পিছিয়ে এল দুজনেই। দ্বিতীয়জন বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, মারপিটের দরকার কি। আমরা শুধু বোঝাতে এসেছি…
তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি বুঝি আমি। গেট আউট… তাড়া করার ভঙ্গি করল অস্টিন। বিদ্যুৎগতিতে ঘুরেই ছুটল দুজনে। নিরাপদ দূরত্বে নিজের সঙ্গীদের কাছে এসে থামল। ফিরে তাকাল, যেন খুন হতে হতে বেঁচে ফিরে এসেছে এমনি ভাবসাব। দাঁত বের করে হাসছে অস্টিন।
এই সাহস নিয়েই পৃথিবীর মানুষকে গিনিপিগ বানাতে এসেছ? বলল সে, অথচ কেঁচোর চেয়ে অধম তোমরা।
আর কিছু না বলে ঘুরে দাঁড়াল অস্টিন। দ্রুত ছুটে গিয়ে আইস টানেলে ঢুকল। এক ছুটে চলে গেল পঞ্চাশ ফুট মত। থামল। বায়োনিক চোখ ব্যবহার করে পরীক্ষা করতে শুরু করল দেয়াল, সিলিঙ, মেঝে। তার ইনফ্রারেড পদ্ধতি সিগন্যাল দিচ্ছে, এখানেই দুর্বল জায়গা আছে কোথাও। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খুঁজে পেল সে জায়গাটা। সিলিঙে। বায়োনিক হাতটা তুলে সিলিঙের ওই জায়গায় ঘুষি মারল সে। ঝন ঝন শব্দে ক্রিস্টাল ভেঙে পড়ল। তারপরই ঝুর ঝুর করে ঝরল ক্রিস্টাল স্তরের ওপাশের আলগা ধুলো। এবারে আর ঘুসি নয়। সিলিঙে হাত ঠেকিয়ে ওপরের দিকে ঠেলা দিল সে। চাপা, অদ্ভুত গোঙানি বেরোল যেন পাথরের বুক চিরে, এমনি আওয়াজ উঠল পাথরে পাথরে ঘষা খেয়ে। আরও জোরে ঠেলল অস্টিন। গোঙানিও জোরাল হল। কিন্তু পুরো সরছে না আলগা পাথরটা। হাত নামিয়ে নিল অস্টিন। ইনফ্রা-রেডের সাহায্যে পরীক্ষা করে বুঝল, সিলিঙের এই অংশটা নিরেট নয়। বেশ কয়েকটা আলগা পাথর গায়ে গা ঠেকিয়ে আটকে আছে শুধু। যে কোন একটা পাথর সরে গেলেই হুড়মুড় করে নিচে পড়বে সব কটা। আবার হাত তুলে ঠেলতে শুরু করল অস্টিন। তার বায়োনিক শক্তিকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে ভারি পাথর। দাঁতে দাঁত চেপে, জোরে, আরও জোরে ঠেলতে লাগল সে। হঠাৎই ঘটল ঘটনা। আচমকা ওপর দিকে আধ হাত উঠে গেল পাথরটা। গায়ের ওপর থেকে চাপ সরে যেতেই ওটার পাশের অপেক্ষাকৃত ছোট পাথরটা ছুটে গিয়ে নিচে পড়ে গেল। মহাপ্রলয় শুরু হয়ে গেল যেন সঙ্গে সঙ্গে। প্রচন্ড কান ফাটান শব্দ করে আইস টানেলের মেঝেতে গড়িয়ে পড়তে লাগল আলগা পাথরগুলো! একেকটা দুই তিন মনের কম হবে না। প্রথম পাথরটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাইভ দিয়েছে অস্টিন। পাথরটা ডিঙিয়ে চলে এসেছে। তারপর এক বিরাট লাফে এগিয়ে গেছে আরও ফুট দশেক সামনে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে পাথর পড়া দেখছে অস্টিন। দ্রুত বুজে যাচ্ছে আইস টানেলের এক মাথা। অস্টিন আর আন্ডারগ্রাউন্ড কমপ্লেক্সের মাঝে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। এই পাথরের দেয়াল সরিয়ে টানেল পরিষ্কার করতে প্রচুর সময় লাগবে এপ্লয়ের টেকনিশিয়ানদের।
হাতের উলেটা পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল অস্টিন, তারপর হাতটা প্যান্টের পাছায় মুছে ঘুরে দাঁড়াল। স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলল টানেলের শেষ প্রান্তের দিকে।
অপরূপ আলো ক্রিস্টালের। কিন্তু অস্টিনের এখন এসব দেখার সময় নেই। এগিয়ে চলেছে সে। হঠাৎই কমে আসতে লাগল আলো। আবার বাড়ালো। বিচিত্র শব্দ শুরু হল সেই সাথে। থমকে দাঁড়াল অস্টিন। ইলেকট্রোস্লীপের কথা ভুলেই গিয়েছিল সে।
মাথার ভেতরে ইতিমধ্যেই ঝিম ঝিম শুরু হয়ে গেছে অস্টিনের। চেতনা আচ্ছন্ন হবার পূর্বলক্ষণ দেখা দিয়েছে। যা করার এক্ষুনি করতে হবে। এর আগের বার টানেলের ভেতরে ঠিক কতটা প্রবেশ করার পর ঘুমিয়ে পড়েছিল সে মনে করার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। টানেলের ঠিক মাঝামাঝি আসার পর পুরো কাজ করেছে ইলেকট্রোস্লীপ।
টানেলের মাঝামাঝি পৌঁছুতে আর কতখানি বাকি, দেখে নিল অস্টিন। খুব বেশি না, বড়জোর ফুট দশেক হবে। যদি বায়োনিক গতিবেগে ছুটে যায়, বিপদ ঘটার আগেই হয়ত বিপদসীমা পেরোন সম্ভব। রওনা হতে যাবে, হঠাৎ খুলে গেল টানেলের ওমাথার ধাতব দরজা। মেরামত করে ফেলা হয়েছে ওটা আগেই। ভেতরে এসে ঢুকল বিগফুট। পেছনে দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে যেতেই পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল রোবট সাসকোয়াচ। অস্টিনের দিকে চেয়ে তীব্র যান্ত্রিক গর্জন করল।
থমকে দাঁড়াল অস্টিন। ব্যাটা বেরোল কখন! বিড় বিড় করল সে।
অস্টিন পরীক্ষাগার থেকে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে টেবিল থেকে নেমে বেরিয়ে পড়ে সাসকোয়াচ। তার ইলেকট্রোনিক ব্রেনে প্রথম চিন্তাটা আসে, অস্টিন পালাচ্ছে। অতএব তাকে ধর। সোজা আইস টানেল ধরে বাইরে বেরিয়ে যায় রোবটটা। আশেপাশে কোথাও অস্টিনকে না পেয়ে আবার এসে ঢুকছে এখানে।
পেছনে শব্দ হতেই ফিরে তাকাল অস্টিন। পাথরের দেয়ালের ওপাশ থেকে আসছে আওয়াজ। পাথর সরানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে টেকনিশিয়ানরা। সাসকোয়াচ এবং টানেলের ইলেকট্রোস্লীপ, দুটোকে এক সঙ্গে সামলান সম্ভব নয় অস্টিনের পক্ষে। কি করে সাসকোয়াচকে ফাঁকি দেয়া যায় ভাবছে অস্টিন। সেই সঙ্গে পিছিয়ে এল কয়েক পা। আশ্চর্য! কমে যাচ্ছে ইলেকট্রোম্লীপের ক্রিয়া। তার মানে টানেলের দুই প্রান্ত যান্ত্রিক ঘুম থেকে নিরাপদ।
এই যে খোকা, চেঁচিয়ে বলল অস্টিন, এবারে কোন অঙ্গ খসাতে চাও? একটা পা?
গর্জন করে উঠল আবার সাসকোয়াচ। কয়েকটা হর্ন ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ওর ভেতরে। ইচ্ছেমত যেটা খুশি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ভয় পাওয়াতে এইই যথেষ্ট।
অস্টিনের ইচ্ছে, রোবটটা আগে আক্রমণ করুক তাকে। সেজন্যে তাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে। মাথার ওপর দুহাত তুলে বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচল একবার অস্টিন। তারপর বুক চাপড়াল। বনের ভেতরে তাকে আক্রমণ করার আগে এভাবেই নেচেছে সাসকোয়াচ। বার দুই বুক চাপড়েই সাসকোয়াচের অনুকরণে চাপা গর্জন করে উঠল অস্টিন।
গোঁ গোঁ করে উঠল সাসকোয়াচ। রেগে কাঁই হয়ে গেছে। কিন্তু দরজার কাছ থেকে নড়ল না।
ব্যাটারা আসছে না কেন? বিড় বিড় করে নিজেকেই প্রশ্ন করল অস্টিন। অন্যভাবে চেষ্টা করা স্থির করল সে।
আরেক পা পিছিয়ে এসে মাটিতে বসে পড়ল অস্টিন। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল সাসকোয়াচ। রোবটটা আক্রমণ কিংবা ভয় পাওয়ার আশা করেছিল। কিন্তু এরকম অদ্ভুত ব্যবহার দেখে ঠিক কি করতে হবে বুঝতে পারল না। বুঝল অস্টিন, রোবটটার ব্রেন খুব একটা পাকা নয়। কাজেই বুদ্ধির জোরেই পরাস্ত করতে হবে ওটাকে এখন।
পুরো এক মিনিট দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকল। বসেই আছে অস্টিন। বসে বসেই বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছে। শেষ পর্যন্ত এই আজব ব্যবহার আর সহ্য হল না সাসকোয়াচের। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে শুরু করল সে। রোবটটার বিশ ফুট দূরে থাকতেই হঠাৎ লাফিয়ে উঠল অস্টিন। চোখে মুখে প্রচন্ড ভয়ের চিহ্ন ফুটিয়ে তুলে পিছোতে থাকল দ্রুত। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর গর্জন করে উঠল সাসকোয়াচ। ছুটে এল তীব্র গতিতে।
সাসকোয়াচ একেবারে গায়ের ওপর এসে পড়তেই থমকে দাঁড়াল অস্টিন। থাবা মেরে বোবটের দুই কব্জি চেপে ধরল। বিদ্যুৎ গতিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। প্রচন্ড ঝটকা খেয়ে অস্টিনের ওপরই পড়ে গেল সাসকোয়াচ। দুই পা গুটিয়ে ওটার পেটের তলায় নিয়ে এল অস্টিন। বিন্দুমাত্র দেরি না করে পা দিয়ে প্রচন্ড জোরে ঠেলে দিল ওপর দিকে। সেই সঙ্গে দুই কব্জি ধরা হাতে টান মারল সামনে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চড়ে গেল রোবটটা। গিয়ে পড়ল পাথরের দেয়ালের ওপর।
পাথরে ভয়ানকভাবে মাথা ঠুকে গেছে রোবটটার। একটা যান্ত্রিক গোঙানি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে, তারপরই স্থির হয়ে গেল। ইলেকট্রোনিক ব্রেনে চোট পেয়েছে।
উঠে দাঁড়াল অস্টিন। সাসকোয়াচের দিকে একবার তাকাল। রোবটটাকে সামলানো গেছে। এবারে ইলেকট্রোস্লীপকে ফাঁকি দিতে পারলেই বেরিয়ে যেতে পারবে সে এই যান্ত্রিক মায়াপুরী থেকে।
ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলল অস্টিন। ঘুম ঘুম ভাবটা অনুভব করে থমকে দাঁড়াল। তৈরি হয়ে নিয়েই ছুটল। ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল গতিবেগ। টানেলের মাঝামাঝি আসতেই প্রচন্ডভাবে আঘাত হানলো ইলেকট্রোস্লীপ। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিল অস্টিন। একেবারে উড়াল দিয়েই যেন এসে নামল ধাতব দরজার সামনে। ঘুম এবার পরাস্ত হল তার কাছে। দুই সেকেন্ড স্থির দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নিয়েই দরজা লক্ষ্য করে লাফ দিল। আগের বারের মতই গোটা দুই ফ্লাইং কিক ঝেড়ে দরজাটা ভেঙে ফেলল সে। বাইরে এসে পড়ল।
মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, উঠেই গুহামুখের দিকে ছুটল অস্টিন। এক ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে গায়ে আঘাত হানলো তীব্র সূর্যালোক। কিন্তু ভালই লাগল অস্টিনের। খোলা পাহাড়ী বাতাস টানল বুক ভরে। জুড়িয়ে গেল শরীর মন।
দেরি করল না অস্টিন। শ্যালনকে খুঁজে বের করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ছুটল সে।
১৩. স্তব্ধ হয়ে গেছে ট্রিনিটি বেস
স্তব্ধ হয়ে গেছে ট্রিনিটি বেস। সবাই পাথরের মত স্থির। কারও মুখে কথা নেই। অপেক্ষা করছে সবাই। আর মাত্র দুই মিনিট তিরিশ সেকেন্ড পরেই বিস্ফোরণ ঘটান হবে। প্রথমে একটা চাপা গুম গুম শব্দ শোনা যাবে। তারপর কাঁপতে শুরু করবে মাটি। প্রথমে খুবই ধীরে, আস্তে আস্তে বাড়বে কম্পন। আরও বাড়বে, আরও। ভয়ে গাছপালা মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে যাবে পাখির দল। আতংকিত গলায় চেঁচাতে থাকবে ওরা।
থির থির করে কাঁপবে পিরিচে রাখা কাপ। কাপতে কাঁপতে গড়িয়ে পড়বে টেবিলে, সেখান থেকে মাটিতে। বিস্ফোরিত এলাকার কেন্দ্র থেকে কয়েকশো গজ ব্যাস নিয়ে মাটি ফোড়ার মত ফুলে উঠবে। উপড়ে পড়বে বড় বড় সব গাছপালা। দিন যাবে এর পর। আস্তে আস্তে আবার বসে যাবে ফোঁড়াটা। আশেপাশের চাইতে আরও নিচে বসে যাবে মাটি। নতুন গাছপালা জন্মাবে।
বিস্ফোরণের পরে শুধু গাছপালা ধ্বংস হওয়াই নয়, অনেক ধরনের আণবিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কেন্দ্রের কাছে অন্তত একশো গজ ব্যাসের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে গাছপালা ঘাস মাটি। এখানটায় কোনদিই আর সবুজের চিহ্ন দেখা যাবে না। কিন্তু এই একশো গজ ব্যাসের মাটি সরে গিয়ে বাঁচিয়ে যাবে উত্তর আমেরিকার বিশাল এক জনবহুল অংশ।
টেলিমেট্রি ট্রাকের পাশে ওয়অর্ক টেবিলের সামনে বসে আছেন গোল্ডম্যান। তাঁর পাশে রেনট্রি। টাইমওয়াচে সময় গুনছে। শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন গোল্ডম্যান। একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। অস্টিনের চিন্তা কিছুতেই মন থেকে দূর করতে পারছেন না। ফিরে গিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে কি জবাব দেবেন তিনি? রহস্যজনকভাবে স্থানীয় লোক গায়েব হয়ে যাচ্ছিল ব্যাটল মাউনটেনের আশেপাশের অঞ্চল থেকে। গায়েব হচ্ছিল ভ্রমণকারী, শিকারী। মাঝেমধ্যে দু একজন বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় ফিরে আসে, অধিকাংশই আসে না। শেষ পর্যন্ত যখন কয়েকজন নামকরা বিজ্ঞানী এই অঞ্চলে ভৌগলিক কারণ অনুসন্ধান করতে এসে হারিয়ে গেলেন, আর চুপ করে থাকতে পারলেন না সরকার। গোল্ডম্যানের উপর নির্দেশ এল, জলদি অনুসন্ধান না করে এর কারণ বের করা হোক। কি ভেবে অস্টিনকেই ইনভেস্টিগেটর হিসেবে সরকারের কাছে চেয়ে নিলেন গোল্ডম্যান। প্রথমে রাজি হতে চাননি প্রেসিডেন্ট। কিন্তু গোল্ডম্যান বুঝিয়েছেন, শুধু লোক গায়েব হওয়াই নয়, একটা আজব কিংবদন্তীও আছে এই এলাকায়। পুরাণে কথিত সাসকোয়াচকে নাকি দেখা যায় এখানে। বিজ্ঞানীরা তার পায়ের ছাপ আবিষ্কার করেছেন, নাম দিয়েছেন বিগফুট। এই রহস্য ভেদ করতে হলে অস্টিনের মত অতি মানবই দরকার। এভাবেই নানারকমে বুঝিয়ে শুনিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সিক্স মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের অতি-মানবকে চেয়ে নিয়েছেন গোল্ডম্যান। বুঝতে পারছেন, জবাব দেবার কিছুই নেই তার। একমাত্র পথ আত্মহত্যা। মানস চোখে দেখলেন, তার লাশ দাফন করার সময়ে কোন সামরিক সম্মান দেখান হচ্ছে না। সিলভার স্টার বা অন্য কোন সম্মান পদক রাখা হচ্ছে না কফিনের ডালায়। আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই কোন অখ্যাত গির্জায় কাঠের বাক্সে ভরে তাঁর লাশ পুঁতে রেখে আসছে সামরিক বাহিনীর নিম্নস্তরের কিছু লোক।
রেনট্রির কথায় চমক ভাঙল গোল্ডম্যানের। কিন্তু তাকে কিছু বলছে না রেনট্রি। রেডিও মাইক্রোফোনে আদেশ দিচ্ছে, মার্ক ঠিক রাখ। আর দুই মিনিট তিরিশ সেকেন্ড।
সুইচ অফ করে গোল্ডম্যানের দিকে তাকাল রেনট্রি। কি বলবে বুঝতে পারল না। তবু আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, কফি খাবেন?
এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন গোল্ডম্যান। রেনট্রির দিকে তাকাবারও প্রয়োজন বোধ করলেন না।
খুব ভাল কফি আছে, আবার বলল রেনট্রি। আসলে গোল্ডম্যানের এই নীরবতা পীড়া দিচ্ছে তাকে। অস্টিনের মৃত্যুটা যেন তার দোষেই ঘটতে যাচ্ছে, এমনি মনে হচ্ছে রেনট্রির।
অন্য সময়, শান্ত শোনাল গোল্ডম্যানের গলা।
মিস্টার গোল্ডম্যান…আমি, আমি দুঃখিত।
নিজেকে অযথা দোষী ভাবছ কেন?
মিস্টার গোল্ডম্যান, বলে গেল রেনট্রি, আমার মনে হয় ওই এলাকায় নেই অস্টিন। থাকলে তাকে পাওয়া যেতই, যেভাবে গরুখোঁজা হয়েছে। মাত্র তিন-চার মাইলের মধ্যে শয়ের ওপরে লোক খুঁজছে। কোন চিহ্নই পায়নি ওরা। তার মানে, ওই এলাকায় নেই সে। সাসকোয়াচের পিছু নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে হয়ত।
আমাদের জানিয়ে যেতে পারত, বলনে গোল্ডম্যান। তার কাছে রেডিও তো আছেই।
কই, না ত!
গোল্ডম্যানের মনে পড়ল, অস্টিনের উরুর গুপ্ত কুঠুরিতে রেডিও আছে, জানা নেই রেনট্রির। জানানোর প্রয়োজনও মনে করলেন না তিনি। জানালেই আরও হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। কথা বলতে মোটেই ভাল লাগছে না এখন তাঁর।
টাইম-ওয়াচের দিকে তাকাল রেনট্রি! আবার রেডিওর সুইচ অন করে মাইক্রোফোন তুলে নিল। একবার খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, আর দুই মিনিট।
কোথায় ডেটোনেশন ঘটান হবে, রেনট্রির মুখে শুনেছে অস্টিন। জায়গাটা বেকি দম্পতি যেখানে শেষ সেন্সর বসিয়েছিল, তার কাছাকাছিই। ছুটছে সে। গতিবেগ ষাটের কাছাকাছি।
পেছন থেকে আক্রান্ত হবার কোন আশংকা নেই। নিজেদের আস্তানাতেই সাহস করেনি, বাইরে বেরিয়ে অস্টিনের সঙ্গে লাগার দুঃসাহস ওদের হবে না। সাসকোয়াচ আসতে পারত, কিন্তু তাকে তো আহত করে ফেলে এসেছে সে।
বিস্ফোরণ-এলাকার কাছাকাছি একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় এসে দাঁড়াল অস্টিন। সামনে, খোলা উপত্যকার দিকে তাকাল। কয়েকটা আজব যন্ত্রপাতি চোখে পড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে বোম ফাটান নয়, তেল উত্তোলনের কাজ চলছে ওখানে। মোটাসোটা একটা পাইপের এক মাথা মাটির তিন ফুট ওপরে বেরিয়ে আছে। মাথায় বসান একটা বাক্স। কন্ট্রোল ইকুইপমেন্ট সব এতে। ট্রিনিটি বেস থেকে রেডিও সিগন্যাল পাবার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করবে বাক্সের ভেতরে বসান কম্পিউটার। বিস্ফোরণ ঘটাবে।
শ্যালনের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাল অস্টিন। উপত্যকায় কোথাও নেই। ইনফ্রারেড চালু করল সে। সামনের দিকে অর্ধবৃত্তাকারে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনল। দেখে ফেলেছে সে শ্যালনকে। অর্ধবৃত্তের এক মাথায় একটা পাহাড়ের চূড়ায় ছোট ছোট কয়েকটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে শ্যালন। দৃষ্টি বিস্ফোরণ এলাকার দিকে। বিন্দুমাত্র দেরি না করে রওনা দিল অস্টিন। যত দ্রুত সম্ভব পাইপটার কাছে পৌঁছতে হবে।
পাইপটা শ্যালনও দেখেছে। কিন্তু তার বায়োনিক চোখ নেই, তাই অস্টিনকে দেখতে পেল না। রিস্টওয়াচ দেখল। বিস্ফোরণ ঘটতে মাত্র আর এক মিনিট পনের সেকেন্ড বাকি। আর দেরি করা যায় না। এমনিতেই বিস্ফোরণ এলাকা খুঁজে বের করতে অনেক সময় গেছে। টি.এল.সি. ব্যবহার করে চোখের পলকে পাইপটার কাছে এসে দাঁড়াল সে। এগিয়ে গিয়ে এক পাশের এক্সেস প্যানেল টান মেরে খুলল। ধাতব বাক্সের ভেতর অসংখ্য জট পাকান তার। দুটো বিশেষ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ও দুটোর ওপর আলতো করে আঙ্গুল ছোয়ালো সে। অত্যন্ত সতর্ক। একটু এদিক ওদিক হলে রক্ষা নেই। দরদর করে ঘামছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম রোদের আলোয় মুক্তাবিন্দুর মত চকচক করছে। ঝুঁকে বাক্সের ভেতরে আরও ভালোমত তাকাল সে। কিন্তু আসল জিনিসটা খুঁজে পাচ্ছে না। সময়ও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। বাক্সের অন্যপাশে চলে এল। আরেকটা এক্সেস প্যানেলের ডালা খুলল। ঠিক এই সময় পেছনে শুকনো ডাল ভাঙার আওয়াজ শুনল শ্যালন। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল সে। আস্তে করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। স্তব্ধ হয়ে গেল চেয়েই।
প্রচন্ড বায়োনিক গতিতে সোজা তার দিকে ছুটে আসছে অস্টিন। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে চেহারা। আতংকে শিউরে উঠল শ্যালন। যত শক্তিশালীই হোক, পরীক্ষাগারে টেবিলে শুইয়ে বায়োনিক ম্যানকে পরীক্ষা করা এক কথা, আর খোলা জায়গায় ওই দানবীয় ক্ষমতার মুখখামুখি দাঁড়ান পুরো ভিন্ন ব্যাপার। এক লাফে কন্ট্রোল বক্সের কাছ থেকে সরে এল শ্যালন।
শ্যালনের ছয় ফুট দূরে এসে দাঁড়াল অস্টিন।
প্লীজ, প্লীজ অস্টিন, আমাকে ছুঁয়ো না! অনুরোধের ভঙ্গিতে একটা হাত তুলল শ্যালন।
কিন্তু তোমাকে ডেটোনেশন বন্ধ করতে দেব না আমি কিছুতেই।
বন্ধ আমাকে করতেই হবে, হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত দেখাচ্ছে শ্যালনকে।
না, কঠিন হয়ে উঠেছে অস্টিনের গলা। আচমকা ডাইভ দিল সে। চকিতে ডান হাতটা উরুর কাছে চলে এল শ্যালনের। উরুতে আটকান টি.এল.সি-র সুইচ টিপে দিল। চোখের পলকে নেই হয়ে গেল সে সেই জায়গা থেকে। কন্ট্রোল বক্সের আরও কাছাকাছি এসে দাঁড়াল।
লক্ষ্যবস্তু হারিয়ে দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল অস্টিন। এমনিতেই মেয়েমানুষের সঙ্গে লাগতে ভীষণ খারাপ লাগছে তার। এর ওপর আবার সেই মেয়েমানুষই তাকে কলা দেখাল, এটা সহ্যের অতীত। উঠে দাঁড়িয়ে পাইপের কাছে দাঁড়ান শ্যালনের দিকে তাকাল সে। দুচোখ জ্বলছে রাগে।
প্লীজ, স্টিভ…
না, ধমকে উঠল অস্টিন।
দোহাই তোমার, স্টিভ আমার লোকদের রক্ষা করতেই হবে…
আমার লোকদের কি হবে?
দুঃখিত, স্টিভ, মাথা নিচু করল শ্যালন।
চমৎকার! শুকনো অস্টিনের গলা। চমৎকার কথা বলেছ। তোমাদের মুষ্টিমেয় কয়েকজন হারামী লোকের জন্যে আমাদের লাখ লাখ নিরপরাধ লোক মারা যাবে! সত্যিই চমৎকার!
আমি সত্যিই দুঃখিত, বলল শ্যালন। মাথা নিচু করে আছে। আসলে অস্টিনের চোখের দিকে চাইতে সাহসই হচ্ছে না তার।
হাসি পাচ্ছে আমার শুনে, আচমকা লাফ দিল অস্টিন। উড়াল দিয়ে এসে পড়ল শ্যালনের গায়ের ওপর। মাথা নিচু করে থাকায় সময় মত হুশিয়ার হতে পারল না শ্যালন। ওর হাত টি.এল.সির সুইচ স্পর্শ করার আগেই কব্জিতে প্রচন্ড চাপ অনুভব করল।
শ্যালনের হাতটা বাঁকিয়ে পিঠের ওপর নিয়ে গেল অস্টিন। ধাক্কা মেরে কয়েক পা পেছনে সরিয়ে নিল তাকে। বাঁ-হাতে উরুতে বাধা টি.এল.সির সুইচ নাগাল পাবে না শ্যালন। তাড়া খেয়ে আটকা পড়া বেড়ালের মত ফোঁস করে উঠল সে। ছাড়, ছেড়ে দাও আমাকে, চেঁচিয়ে উঠল।
সেদিকে কানই দিল না অস্টিন। ডান হাতে প্রায় থাবা মেরে শ্যালনের উরু টি.এল.সি-টা বাধন ছিড়ে নিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে মুখে পুড়ে দিল ছোট্ট যন্ত্রটা। এটাই সব চেয়ে নিরাপদ জায়গা মনে হল তার।
টি.এল.সি-টা বাগিয়ে নিয়েই শ্যালনকে তুলে নিজের কাঁধের ওপর ময়লার বস্তার মত বুলিয়ে নিল অস্টিন। ছুটতে শুরু করল পরক্ষণেই। বিপদসীমা থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরে যেতে হবে। সমানে চেঁচিয়ে চলেছে শ্যালন, অনুরোধ উপরোধ করছে। কিন্তু কানই দিল না অস্টিন।
বিপদসীমা ছাড়িয়ে একটু উঁচু জায়গায় এসে পৌছতেই গুরুগম্ভীর শব্দটা কানে এল অস্টিনের। চাপা মেঘগর্জন শোনা যাচ্ছে একটানা। কয়েক সেকেন্ড পরেই অস্টিনের পায়ের নিচে মাটি আচমকা ফুলে উঠল। তাল সামলাতে না পেরে চিত হয়ে পড়ে গেল অস্টিন। তার বুকের ওপর পড়ল শ্যালন।
না না, পাগলের মত এদিক ওদিক মাথা ঝাঁকাচ্ছে শ্যালন, আর চেঁচাচ্ছে, সব শেষ। সবাই শেষ ওরা…
মাটি কাঁপছে। পাউরুটির পিঠের মত ফুলে উঠছে ওপর দিকে। অস্টিন আর শ্যালনের মাথার উপরে পাতার ঝড় উঠেছে। প্রচন্ড কাঁপুনিতে শুকনো, আধ শুকনো সমস্ত পাতা খসে গেছে গাছ থেকে। তীব্র হাওয়ায় উড়ছে। আরও ওপরে দিকবিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে উড়ছে পাখির দল। আতংকিত গলায় সমানে চেঁচাচ্ছে ওরা।
উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে অস্টিন, কিন্তু পারছে না। মাটির প্রচন্ড কাঁপুনিতে পড়ে যাচ্ছে বার বার। মুখের ভেতর এদিকে খোচাচ্ছে টি.এল.সি-র তীক্ষ্ণ কোণগুলো। অগত্যা ওটা মুখ থেকে বের করে প্যান্টের পকেটে ভরলো সে। তারপর উবু হয়ে বসে কাঁধে তুলে নিল আবার শ্যালনকে। পরক্ষণেই লাফিয়ে উঠে ছুটতে শুরু করল। দাঁড়াবার চেষ্টা করছে না। তাহলেই আবার মাটিতে আছড়ে পড়বে।
সমানে কাঁদছে শ্যালন। ধরেই নিয়েছে ওর সঙ্গীসাথীরা কেউ বেঁচে নেই।
আরও কয়েক সেকেন্ড পরে হঠাৎ থেমে গেল মাটির কাঁপুনি। থামল অস্টিন। কাঁধ থেকে শ্যালনকে নামাল। ভূমিকম্প শেষ, বলল সে।
কিন্তু তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই বুঝল ভুল বলেছে। আসলে ভূমিকম্প নয়, বিস্ফোরণ শেষ হয়েছে। ভূমিকম্প আসবে এবার।
আস্তে আস্তে এল কাঁপুনি, দ্বিতীয়বার। দ্রুত এগিয়ে আসছে তীব্র, চাপা মেঘগর্জন। এক ধাক্কায় শ্যালনকে মাটিতে ফেলে দিল অস্টিন, নিজেও উবু হয়ে শুয়ে পড়ল তার পাশেই। পড়ে থাকা পাতার পুরু গালিচায় মুখ ঢাকল।
গোল্ডম্যান ছাড়া ট্রিনিটি বেসের অন্য সবাইও মাটিতে শুয়ে পড়েছে। তিনি শুধু মেটাল ফোল্ডিং চেয়ারটা ছেড়ে মাটিতে বসেছেন। দুহাতে চেপে ধরে রেখেছেন দুই কান। মাটির সঙ্গে সঙ্গে থর থর করে কাঁপছেন তিনিও।
ঈশ্বর তোমার সহায় হোন, স্টিভ, বিড়বিড় করে প্রার্থনা করলেন গোল্ডম্যান। কতদিন পর নিজেই বলতে পারবেন না, আবার তার দুচোখের কোল বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমেছে।
১৪. বনসীমার দিকে এগিয়ে চলেছে অস্টিন
বনসীমার দিকে এগিয়ে চলেছে অস্টিন। কাঁধে শ্যালন। পায়ের নিচে এখনও মাটি কাঁপছে, কিন্তু কম। বনের কাছে পৌঁছে ফিরে দাঁড়াল সে। ইনফ্রারেড স্ক্যানার ব্যবহার করে দেখল, বিস্ফোরিত এলাকার কেন্দ্রে প্রায় শখানেক গজ বৃত্তাকার জায়গায় মাটি লালচে দেখাচ্ছে। কালো ধোঁয়া উড়ছে আকাশে। ওই অংশে যত গাছপালা-ঘাস ছিল, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জায়গাটার আশেপাশে গাছপালা তেমন নেই, নইলে দাবানল শুরু হয়ে যেত এতক্ষণে।
কাঁধ থেকে শ্যালনকে নামিয়ে দিল অস্টিন। তাকে জড়িয়ে ধরে রেখে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। পুরো নির্ভরশীল এখন তার ওপর। বিস্ফোরণের পরের বিপদ এখনও শেষ হয়নি, জানে অস্টিন। ইনফ্রা রেড চালু করে ঘুরে ঘুরে দিগন্তের দিকে চাইতে লাগল সে। ব্যাটল মাউনটেনের পশ্চিম ধারের ঢালের দিকে তাকাতেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল তার।
ছোট একটা চড়া ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। বড় বড় পাথর গড়িয়ে নামছে, এগিয়ে আসছে এদিকেই। আচমকা খসে পড়ল চূড়াটা। হিমবাহের মত যেন পাথরবাহ ছুটে ছুটে আসছে পাথরের স্তৃপ! হ্যাঁচকা টানে শ্যালনকে আবার কাঁধে তুলে নিল অস্টিন। দ্রুত ঢুকে গেল বনের ভেতরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পেছনে ভয়ঙ্কর গতিতে গাছপালার ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাথরের স্তৃপ। বিরাট বিরাট গাছগুলোকে পাটখড়ির মত ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসছে ক্রমশ।
বনের ভেতরে গাছপালার জন্যে খুব একটা দ্রুত ছুটতে পারছে না অস্টিন। তার ওপর কাঁধে বোঝা। পেছনে ক্রমেই এগিয়ে আসছে পাথর। প্রায় তিন-মনি একটা পাথর হঠাৎ এসে বাড়ি খেল তার পায়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল অস্টিন। তার সামনের মাটিতে ধপাস করে গিয়ে আছড়ে পড়ল শ্যালনের দেহ। ব্যথায় ককিয়ে উঠল মেয়েটা।
দ্রুত আবার উঠে দাঁড়াল অস্টিন। ছুটে গিয়ে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল শ্যালনকে। আবার ছুটল। তার আশপাশ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে বড় বড় পাথর।
প্রাণপণে ছুটল অস্টিন। যে করেই হোক এই পাথরবাহের কবল থেকে বেরোতেই হবে।
ভূমিকম্পের প্রচন্ডতা সবচেয়ে বেশি অনুভব করল ভূগর্ভ আস্তানার ভিনগ্রহবাসীরা। চারদিকে বিশৃঙ্খলা। জায়গায় জায়গায় ক্রিস্টালের দেয়াল, সিলিং ভেঙে পড়েছে। মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে যন্ত্রপাতি। কোন কোন ঘরের সিলিং ভেঙে নিচে পড়েছে বিশাল পাথর। যন্ত্রপাতি, আসবাব আর অন্যান্য জিনিসপত্র ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
মেইন করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে সাসকোয়াচ। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে তার ইলেকট্রোনিক ব্রেন কয়েক সেকেন্ডের জন্যে অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিল, তারপর আবার ঠিক হয়ে গেছে আপনা আপনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাথর পড়া দেখছে সে। পায়ের ওপর এসে পড়ছে একটা আধটা। কিন্তু কোন ক্ষতি করতে পারছে না ওর কৃত্রিম দেহের।
সাসকোয়াচের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে একজন পুরুষ আর একজন মহিলা। আতংকে, বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে দুজনেই।
কাউন্সিল চেম্বারে ভয়ঙ্কর কম্পনের মধ্যে নিজেদের সামলানর চেষ্টা করছে এপ্লয় আর ফলার। ওদিকে মিট মিট করতে শুরু করেছে ক্রিস্টাল আলো। ওদের শক্তির উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই দপ করে নিভে গেল সমস্ত কৃত্রিম ক্রিস্টাল। আতংকে চিৎকার করে উঠল ফলার।
হামাগুড়ি দিয়ে একপাশের দেয়ালের কাছে চলে এল এপ্লয়। সমানে কাঁপছে মাটি। দেয়ালের সঙ্গে কাঁধ ঠেকিয়ে বসল সে। অন্ধকারে দেখতে পেল না, তার মাথার ওপরে পাথরের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। আধ সেকেন্ডের মধ্যেই বড় হল ফাটলটা, ধসে পড়ল বিকট শব্দে। নিজেকে বাঁচাতে কিছুই করতে পারল না এপ্লয়। শেষ মুহূর্তে পাথরটা ঠেকাতে একটা হাত তুলেছিল, কিন্তু দেশলাইয়ের কাঠির মত ভেঙে গেল হাতটা। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠেছে সে, পরমুহূর্তেই চাপা পড়েছে পাথরের তলায়।
পাথুরে গুহাটার ভেতরে গুটিয়ে বসে আছে অস্টিন আর শ্যালন। মাথার ওপরে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে একটা বিরাট চ্যাপ্টা পাথর। এটার জন্যে পাখরবাহের আঘাত থেকে বেঁচে গেছে ওরা।
ধীরে ধীরে কমে এল আওয়াজ। পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকির শব্দ কমতে কমতে একেবারে থেমে গেল। শ্যালনকে বসে থাকতে বলে বেরিয়ে এল অস্টিন। পায়ের তলায় শুধু পাথরের কুচি। ধুলোর মেঘে ছেয়ে আছে এখনও চারদিক। শ্যালনকে গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে ডাকল সে।
কিন্তু শ্যালন বেরোল না। উঁকি দিল অস্টিন। গোঁজ হয়ে একটা পাথরের ওপর বসে আছে মেয়েটা। ভেতরে নেমে তার হাত ধরতে গেল অস্টিন। ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে নিল শ্যালন, খবরদার, ছোবে না আমাকে!
শ্যালন… ডাকল অস্টিন। তোমাকে সাহায্য করতে চাই আমি।
কি সাহায্য করবে? কঠোর দৃষ্টিতে অস্টিনের দিকে তাকাল শ্যালন, যা হবার তো হয়েই গেছে। কেউ কি আর বেঁচে আছে ওরা!
সবাই মারা নাও যেতে পারে, বলল অস্টিন।
শালনের চোখে দ্বিধা।
হ্যাঁ, শ্যালন, বলল আবার অস্টিন, কেউ কেউ হয়ত বেঁচে আছে এখনও। তাহলে ওদের সাহায্য দরকার নিশ্চয়ই। হাত বাড়াল অস্টিন, এস, যাই।
ওদের থেঁতলান লাশগুলো দেখতে পারব না আমি, দুহাতে মুখ ঢাকল শ্যান।
তাহলে ওদের সাহায্য করতে চাও না তুমি?
অস্টিনের চোখে চোখে তাকাল শ্যালন। সিদ্ধান্ত নিল। তারপর বাড়ানো হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল অস্টিন। হাত দিয়ে ধুলো ঝাড়ল শ্যালনের কাপড় জামা থেকে। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে টি.এল.সিটা বের করে বাড়িয়ে ধরল, এটা ব্যবহার করবে তুমি।
হাত বাড়িয়ে যন্ত্রটা নিল শ্যালন।
ঠিক আছে, বলল অস্টিন। চল, যাই।
ছুটতে শুরু করল অস্টিন। স্লো মুভমেন্টে এডজাস্ট করে তার সঙ্গে একই গতিবেগে চলল শ্যালন। তবু গুহামুখের কাছে অস্টিনের আগেই এসে পৌঁছুল সে। অপেক্ষা করতে লাগল। এখন ওই গুহায় একা প্রবেশ করতে সাহস পাচ্ছে না সে।
অস্টিনের হাত ধরে গুহায় ঢুকল শ্যালন। পুরু ধুলো জমে আছে গুহার মেঝেতে। আইস টানেলের প্রবেশমুখে এসে দাঁড়াল দুজনে। অবাক হয়ে ভাঙা ধাতব দরজাটার দিকে তাকাল শ্যালন। অস্টিনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, নিশ্চয়ই তোমার কাজ?
দরজা ভাঙা আমার স্পেশালিটি, হালকা গলায় বলল অস্টিন। বিশেষ করে বায়োনিক হবার পর।
লাথি মেরে সামনে থেকে কয়েকটা পাথর সরিয়ে শ্যালনের হাত ধরে ভেতরে ঢুকল অস্টিন। অন্ধকার টানেল। ঝিরঝির মৃদু আওয়াজ করে কি যেন ঝরে পড়ছে। পানিই হবে হয়ত।
অন্ধকার কেন? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
নিশ্চয়ই পাওয়ার চেম্বারের ক্ষতি হয়েছে, বলল শ্যালন। অন্ধকারে দেখতে পাও তো? এক কাজ কর, কয়েক গজ এগোলেই টানেলের গায়ে বসান একটা গুপ্ত কুঠুরি পাবে। ওতে লণ্ঠন আছে।
ইনফ্রারেড চালু করল অস্টিন। চোখে বসানো বিশেষ নাইট গ্লাসটাও। অন্ধকার দূর হয়ে গেল তার চোখের সামনে থেকে। শ্যালনের হাত ধরে এগিয়ে চলল সে। দুপাশে সুড়ঙ্গের দেয়াল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে চলেছে। দশ গজ মত গিয়ে কুঠুরির ডালাটা দেখতে পেল সে। বাঁ হাতে ঘুসি মেরে লক ভেঙে খুলে ফেলল ডালা। সত্যিই, ভেতরে লণ্ঠন আছে। আরও কয়েকটা টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিসও আছে।
চৌকোনা লন্ঠনটা বের করে আনল অস্টিন। ব্যাটারিতে জ্বলে। সুইচ টিপতেই আলো জ্বলে উঠল। এতে শ্যালনের সুবিধে হল। অস্টিনের আলো ছাড়াই চলে।
আইস টানেলের দুই তৃতীয়াংশ এসে থমকে দাঁড়াল অস্টিন। এখানেই পাথর ফেলে দেয়াল তুলেছিল সে। এখন আর নেই। তবে পাথরগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। একটা বিশাল পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে একজন মানুষ। ঝুঁকে লোকটার মুখের কাছে লণ্ঠন ধরল অস্টিন। লোকটা জীবিত কি মৃত বোঝা যাচ্ছে না। লণ্ঠনটা শ্যালনের হাতে তুলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল অস্টিন। লোকটার একটা হাত হাতে তুলে নিল। দুই সেকেন্ড দেখেই ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, শ্যালন, তোমাদের বডি কনট্রাকশনে পালস্ আছে নিশ্চয়ই, না?
মাথা ঝাঁকাল শ্যালন, হ্যাঁ।
লোকটার হাত আবার আস্তে করে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল অস্টিন, মারা গেছে।
কয়েক ফুট দূরে একজন টেকনিশিয়ানকে পাথরের নিচে চাপা পড়ে থাকতে দেখা গেল। এগিয়ে গিয়ে পাথরটা ঠেলে সরিয়ে লোকটাকে বের করে আনল অস্টিন। মরেনি।
লোকটার কাছে গিয়ে উবু হয়ে বসল শ্যালন। পরীক্ষা করল। ডান পায়ে হাত দিতেই ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল লোকটা।
একটা পা ভেঙেছে, ঘোষণা করল শ্যালন। লোকটাকে বলল, আপাতত এখানেই থাক। ভেতরে গিয়ে দেখি, মেডিক্যাল টীম পাঠাতে পারি কিনা।
আইস টানেল পেরিয়ে এল শ্যালন আর অস্টিন। এরপরের পাথুরে সুড়ঙ্গটায় কোন মানুষ দেখা গেল না। সারা পথে পাথরের ছড়াছড়ি। পুরু ধূলোর আস্তরণ।
প্রধান করিডোরও পাথরে ছেয়ে আছে, আর ধুলো। ধুলোয় ভারি হয়ে আছে বাতাস। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
কাউন্সিল চেম্বারে এসে ঢুকল ওরা। অস্টিনের হাতের লণ্ঠনটার মত আরেকটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে পাথরের ওপর রাখা হয়েছে। ঘরে হলদেটে মৃদু আলো। দুটো লণ্ঠনের আলোয় অন্ধকার আরেকটু দূর হল। ঘরের একটা জিনিসও আস্ত নেই। ভেঙেচুরে একাকার। পাথর আর ধুলো তো আছেই।
একটা বিশাল চ্যাপ্টা পাথরকে টেনে তুলে সরাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে সাসকোয়াচ। পারছে না। তার পাশেই দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে দেখছে ফলার।
দ্রুত ফলারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল অস্টিন আর শ্যালন।
এপ্লয়, আঙুল তুলে দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল ফলার। পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে।
জীবিত আছে? জিজ্ঞেস করল শ্যালন।
হ্যাঁ, বলল ফলার, কিন্তু পাথরটা সরাতে না পারলে…
সরানো যাবে, বলল অস্টিন। লণ্ঠনটা শ্যালনের হাতে তুলে দিয়ে সাসকোয়াচের পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। সন্দিহান চোখে অস্টিনের দিকে তাকাল রোবটটা।
এগিয়ে গিয়ে উবু হয়ে পাথরটার কার্নিশ ধরে ওপরে টানতে শুরু করল অস্টিন। কিন্তু পাষাণ অনড়। আরও বার দুই ঠেলে এক ইঞ্চিও সরাতে না পেরে ঘাড় ফিরিয়ে সাসকোয়াচের দিকে তাকাল সে। একভাবে তারই দিকে তাকিয়ে আছে রোবট।
হাঁ করে দেখছ কি? বলল সে, এস, হাত লাগাও।
ঘোৎ জাতীয় একটা শব্দ করে এগিয়ে এল সাসকোয়াচ। অস্টিনের পাশাপাশি উবু হয়ে দাঁড়িয়ে পাথরে হাত লাগাল। একই সঙ্গে টানতে শুরু করল দুজনে। এইবার আর গ্যাট হয়ে থাকতে পারল না পাথর, নড়ে উঠল। উঠছে ইঞ্চি ইঞ্চি করে। আরও জোরে টান লাগাল অস্টিন আর সাসকোয়াচ। পাথরটা ফাঁক হতেই এগিয়ে গেল শ্যালন আর ফলার। টেনে হিঁচড়ে নিচ থেকে এপ্লয়কে বের করে নিয়ে এল। আস্তে করে আবার পাথরটা নামিয়ে রাখল সাসকোয়াচ আর অস্টিন।
এপ্লয়ের বুকে কান ঠেকিয়ে হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনল শ্যালন। মাথা তুলে ফলারের দিকে তাকিয়ে বলল, এখনও বেঁচে আছে। জলদি টি.এল.সি-টা খোল।
এপ্লয়ের কোমরের বেল্ট থেকে যন্ত্রটা নিয়ে শ্যালনের হাতে দিল ফলার।
কি করবে? জানতে চাইল অস্টিন।
ওর দেহের মেটাবলিজমের সঙ্গে টি.এল.সি. অ্যাডজাস্ট করে দেব। অপারেশন করা পর্যন্ত ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ত। কথা বলতে বলতেই যন্ত্রটা এপ্লয়ের দেহে সেট করে দিল শ্যালন।
হঠাৎ জ্বলে উঠল ক্রিস্টাল। কিন্তু আগের উজ্জ্বলতা নেই, টিমটিমে। করিডোরে বেরিয়ে এল অস্টিন। দ্রুত ছুটে আসছে একজন টেকনিশিয়ান। অস্টিনকে দেখেও দেখল না। তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে বলল, শ্যালন, আরও অনেকে আহত হয়েছে।
আচ্ছা শ্যালন, এই সব আহতদের বাঁচান সম্ভব? দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে অস্টিন।
জানি না, অনিশ্চিত শ্যালনের গলা, তরে ইলেকট্রোমেডিক্যাল টেকনিকে কাজ করতে পারলে হয়ত সম্ভব। নিউট্রাক্সিন কম্পাউন্ড তো আছেই। কিন্তু তার জন্যে পাওয়ার দরকার।
পাওয়ার চেম্বারটা কোথায়? টেকনিশিয়ানকে জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
কমপ্লেক্সের তলায়। জবাব দিল শ্যালন। থার্মাল কনভার্টারের সাহায্যে ভূগর্ভের উত্তাপকে কাজে লাগিয়ে ইলেকট্রিক্যাল এনার্জি তৈরি করি আমরা।
কিন্তু পাথর পড়ে এক্সেস টানেল বুজে গেছে, বলল টেকনিশিয়ান। যাওয়ার উপায় নেই।
টানেলটা কোথায়? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
ওর ভেতর দিয়ে যাওয়া অসম্ভব, বলল টেকনিশিয়ান।
যা বলছি উত্তর দাও! সাসকোয়াচকে দেখিয়ে বলল অস্টিন, ও আর আমি দুজনে মিলে পাথর সরাতে পারব না?
কি জানি! নিশ্চিত হতে পারছে না টেকনিশিয়ান।
চল, আমিও যাচ্ছি, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল শ্যালন। সাসকোয়াচের দিকে ফিরে ডাকল, সাসকোয়াচ।
অস্টিনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল শ্যালন। পাশে হাঁটছে সাসকোয়াচ। কি ভেবে ওদের পিছু নিয়েছে ফলার। অস্টিনের হাতে হাত রাখল শ্যালন। হঠাৎ মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা স্টিভ, এসব কেন করছ, বল তো?
থমকে দাঁড়াল অস্টিন। অবাক হয়ে তাকাল শ্যালনের মুখের দিকে। কেন করছি মানে? নইলে মারা যাবে তো ওরা।
তাতে তোমার কি? আমরা তো তোমাদের লক্ষ লক্ষ লোক মেরে ফেলার জন্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম।
হেসে উঠল অস্টিন। আবার সামনে এগোল। পৃথিবীর মানুষ এমনি। আমাদের আবেগ অনুভূতি একটু বেশিই।
স্প্রিঙের মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে মাটির একশো ফুট গভীরে নেমে গেছে মেন করিডোরের এক মাথা। দুপাশে এর সারি সারি সাব করিডোর। মেন করিডোরের এদিককার শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে এক্সেস টানেল। সরু, তিনজন লোক পাশাপাশি হাঁটতে পারবে। মেঝে থেকে সিলিঙের উচ্চতা আট ফুট।
সত্যিই, ঢোকার মুখেই বড় বড় পাথর পড়ে পথ একেবারে বন্ধ হয়ে আছে। এটাই এক্সেস টানেল, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল শ্যালন।
দুই হাতের তালু একবার ডলল অস্টিন। এগিয়ে গেল। সাসকোয়াচও সঙ্গে এগোল।
পেছনে সরে যাও তোমরা, শ্যালন আর ফলারের উদ্দেশ্যে বলল অস্টিন।
পিছিয়ে গিয়ে এক পাশের দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়াল দুজনে। ওদিকে কাজ শুরু করে দিয়েছে সাসকোয়াচ আর অস্টিন। অবলীলায় দুমনি তিনমনি পাথরগুলো তুলে নিয়ে সুড়ঙ্গের বাইরে ছুঁড়ে ফেলছে। মিনিটখানেকের মধ্যেই একটা অতি বিশাল পাথরের চাঙর ছাড়া সবই সরিয়ে ফেলল দুজনে। খাড়াভাবে দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে চৌকোনামত পাথরটা।
এটা সরাতে খাটতে হবে, সবাইকে শুনিয়ে বলল অস্টিন।
কাঁধ লাগিয়ে ঠেলা দিল অস্টিন। তার দেখাদেখি পাথরটায় কাঁধ লাগাল সাসকোয়াচও। নড়তে শুরু করল বিশমনি পাথর, কিন্তু অতি ধীরে। আধ মিনিটের চেষ্টায় মাত্র কয়েক ইঞ্চি সরান গেল। থামল অস্টিন। সাসকোয়াচের দিকে তাকাল। দেখ খোকা, পাথরটা সরাতেই হবে আমাদের। নইলে মান থাকবে না। বলেই আবার পাথরে কাধ লাগাল।
কি বুঝল সাসকোয়াচ, কে জানে। কিন্তু আরও জোরে ঠেলতে লাগল সে। আরও কয়েক ইঞ্চি সরল পাথরটা, আরও কয়েক ইঞ্চি। একজন মানুষ কোনরকমে গলে ওপাশে বেরোনর মত ফাঁক করে থামল অস্টিন। ফাঁকে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল ভেতরে।
পাওয়ার রূম দেখা যাচ্ছে। বিশাল জেনারেটরের আশেপাশে শুধু নীল আগুনের ফুলকি। নীল আলোতে ভরে গেছে টানেলের অন্য মাথা। ছেঁড়াখোঁড়া তারের মাথাগুলো একনাগাড়ে বিদ্যুৎ-ফুলিঙ্গ ছিটাচ্ছে। এগুলোর তীক্ষ্ণ ছট ছট শব্দ ছাপিয়ে আরেকটা একটানা হিস হিস শব্দ কানে আসছে। যেন বিশাল এক চায়ের কেটলিতে পানি ফুটছে।
একটা মোটা স্টিলের পাইপ ঢোকান হয়েছে পাথরের ভেতর। এটাকে অবলম্বন করে চারপাশ থেকে আটকে দেয়া হয়েছে বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি। কয়েকটা যন্ত্রের গায়ে বসান লাল আলো জ্বলছে নিভছে। অজগরের মত মোটা একটা বৈদ্যুতিক তারের এক মাথা ছিড়ে সিলিঙ থেকে ঝুলছে, দুলছে, বাড়ি খাচ্ছে পাইপের গায়ে। স্টিলের পাইপের গায়ে তারের বেরিয়ে থাকা মাথাগুলোর ছোঁয়া লাগামাত্র ছড় ছড় শব্দে ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে যাচ্ছে। পাইপের একটা জয়েন্ট ছুটে গেছে। জোরে বাষ্প বেরোচ্ছে ওপথে। হিস হিস শব্দ আসছে ওখান থেকেই।
এগিয়ে এসে অস্টিনকে সরিয়ে ফাঁক দিয়ে টানেলের ভেতরে উঁকি দিল শ্যালন। হতাশ হয়ে বলল, ওখানে যেতে পারবে না। ওই পাইপ দিয়েই মাটির নিচ থেকে গরম বাষ্প উঠে আসছে। সুপার হিটেড স্টিম।
তার মানে সতর্ক হয়ে এগোতে হবে আমাকে, শ্যালনের দিকে তাকাল অস্টিন। হাসল, যাতে আঙুল না পুড়ে যায়। বলেই ফাঁক গলে ওপাশে চলে গেল সে।
স্টিভ! ভয়ার্ত গলায় প্রায় আর্তনাদ করে উঠল শ্যালন। ভেতরে ঢোকার ফাঁকটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সে। দেখছে।
পাওয়ার হাউসের দরজায় এসে দাঁড়াল এস্টিন। ঢুকতে যাবে, কানে এল শ্যালনের ডাক। স্টিভ, আগে ওই মোটা তারটা রিপ্লেস কর। ওই যে, কমলা রঙের জাংশন বক্স, ওর ভেতরেই ফিউজ।
ভেতরে ঢুকেই এক পাশের দেয়ালে বসান কমলা বাক্সটার দিকে এগিয়ে গেল অস্টিন। বাক্সের তলায় একটা প্লাগ। বুঝল সে, ওতেই তারটা লাগবে। বায়োনিক হাতের কড়ে আঙুলের নখ দিয়ে প্লাগের ভেতরে ছেড়া তারের মাথা খুঁচিয়ে বের করে আনল সে। পরিষ্কার করল। এগিয়ে গিয়ে ঝুলন্ত তারটা ধরল। বায়োনিক আঙুলের নিচে বিদ্যুৎ-ফুলিঙ্গের ছড়াছড়ি শুরু হয়ে গেল। তারের মাথাটা প্লাগের ভেতরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল সে। স্কুলিঙ্গ ছিটান বন্ধ হয়ে গেল। সেট হয়ে গেছে তারটা।
স্টিম পাইপের দিকে নজর দিল এবার অস্টিন। জয়েন্টের কাছে এগিয়ে গেল। তীক্ষ্ণ চোখে একবার পরীক্ষা করে দেখল। পাথর পড়ে নয়, ভূকম্পনের প্রচন্ড চাপ সইতে পারেনি স্ক্রুগুলো। ছুটে গেছে।
টুলস্ বক্সটা খুঁজে বের করল অস্টিন। একটা রেঞ্চ বের করে নিয়ে আবার গেল জয়েন্টের কাছে। মোট দশটার মধ্যে মাত্র চারটে স্ক্রু জয়েন্টের ছিদ্রগুলোতে আটকান গেল, কিন্তু ঢিল হয়ে আছে প্যাচ। বাকি স্ক্রুগুলো নেই। বাষ্পের ধাক্কায় কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে। আপাতত চারটে স্ক্রু দিয়েই জয়েন্টটা জোড়া লাগাল অস্টিন। ছোট ছোট ফাঁক রয়েই গেল। স্টিম লিক করছে, কিন্তু খুবই সামান্য। জেনারেটর চালাতে অসুবিধে হবে না।
রেঞ্চটা আবার টুলস বক্সে রেখে দিয়ে পাইপের গায়ে বসান যন্ত্রগুলোর দিকে ফিরে তাকাল অস্টিন। নিভে গেছে লাল আলোগুলো। জ্বলছে না আর। বিপদ সংকেত শেষ।
পাওয়ার হাউস থেকে বেরিয়ে এল অস্টিন।
১৫. পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে মেডিক্যাল রুমে
পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে মেডিক্যাল রুমে। শ্যালন অপারেশন করছে। তাকে সাহায্য করতে টেবিল ঘিরে দাঁহিয়ে আছে কয়েকজন মেডিক্যাল ওয়ার্কার। শ্যালনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দেখছে অস্টিন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সাসকোয়াচ।
একটা ছোট্ট শিশির ভেতরে ইনজেকশনের ছুঁচ ঢুকিয়ে দিল শ্যালন। নীল ওষুধ দিয়ে সিরিঞ্জ ভরে নিয়ে শিশিটা একজন সহকারীর হাতে তুলে দিল।
অপারেশন টেবিলে এপ্লয়কে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সেদিকে নির্দেশ করে আস্তে জিজ্ঞেস করল অস্টিন, কেমন মনে হচ্ছে?
বেঁচে যাবে, জবাব দিল শ্যালন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাড়গুলো জোড়া লেগে যাবে। ছুঁচ ওপরের দিকে তুলে সিরিঞ্জের পেছনটা ঠেলল শ্যালন। তির তির করে কয়েক বিন্দু নীল ওষুধ ছিটকে বেরোল। যে কোন ধরনের রোগ ইনফেকশন সারাতে আমাদের নিউট্রাক্সিন অতুলনীয়। সারায়ও খুবই দ্রুত।
অথচ যেভাবে জখম হয়েছে এপ্লয়, বলল অস্টিন, মরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
তোমারও তো মরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, ছুঁচটা এপ্লয়ের মাংসে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল শ্যালন। অথচ বেঁচে আছ। সব বিজ্ঞানের দান।
হাসল অস্টিন। এপ্লয়ের দেহে নিউট্রাক্সিন পুশ করছে শ্যালন।
ম্যাজিক ম্যাডিসিন, না! বলল অস্টিন।
মাথা ঝকাল শ্যালন। ছুঁচটা এপ্লয়ের মাংসের ভেতর থেকে টান মেরে বের করে এনে একজন সহকারীর হাতে তুলে দিল। বলল, ভেনট্রিকুলারের ওপর চোখ রাখবে।
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল সহকারী। অস্টিনের দিকে ফিরল শ্যালন। এক্ষুণি ফিরবে?
হ্যাঁ, ফিরতে তো হবেই।
কিন্তু যাবার আগে তোমার স্মৃতি থেকে আমাদের কথা তো মুছে দিতে হবে, বলল ফলার।
ওহ হো, ভুলেই গিয়েছিলাম। তা, কি করে মুছবে?
রেডিয়েশনের সাহায্যে। এক্স-রে-এর মতই এক ধরনের রশ্মি ব্রেনে ঢুকিয়ে। কোন ক্ষতি হবে না শরীরের। সাসকোয়াচের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে, এখান থেকে বেরোন পর্যন্ত কোন কথা মনে থাকবে না তোমার।
ভারি মজার ব্যাপার, হাসল অস্টিন।
একজন সহকারীকে ইঙ্গিত করল ফলার।
এগিয়ে এসে অস্টিনের হাত ধরল লোকটা। টানল। বলল, কিছু মনে করবেন না, কর্নেল।
আমার তরফ থেকেও তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত, অস্টিন, বলল ফলার।
বাড়ি যাবে না? রহস্যময় হাসি হাসল অস্টিন।
তা তো যাবই। এখানে চিরদিন থাকব নাকি?
কবে যাবে?
আমি আগেই চলে যাব। তিন বছর অনেক লম্বা সময়। একটু থামল ফলার। তারপর বলল, দুতিন দিনের মধ্যেই একটা শিপ আসছে।
তোমরা সবাই যাবে তো?
না, উত্তরটা দিল ফলার। আমি অধৈর্য্য হয়ে পড়েছি। আমি যাব। ওরা মিশন শেষ করে যাবে। এখনও তিন বছর।
তোমাদের দুবছর যেতেই আমাদের আড়াইশ বছর পার হয়ে গেল।
তার মানে আরও কয়েকশ বছর পৃথিবীতে আছ তোমরা?
থাকতে হচ্ছে।
সাসকোয়াচকে দিয়ে লোক ধরে এনে টেস্ট টিউবে ভরবে তো আরও?
উপায় নেই। পরীক্ষা শেষ হয়নি এখনও।
শ্রাগ করল অস্টিন। আর কিছু না বলে টেকনিশিয়ানের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে ওর নির্দেশিত একটা রিক্লিনিং চেয়ারে বসল। একটা চ্যাপ্টা ইলেকট্রোড অস্টিনের মাথায় বসিয়ে দিল টেকনিশিয়ান। যন্ত্রটা থেকে এক গোছা তার বেরিয়ে গিয়ে ঢুকেছে একটা কম্পিউটারে। নিঃশব্দে হেঁটে অস্টিনের কাছে এসে দাঁড়াল শ্যালন। গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ঝুঁকে চুমু খেল। ইচ্ছে করেই একটু বেশি সময় নিয়ে। তার একটা হাত অস্টিনের হাতের তালুতে নেমে এল। একটা ছোট্ট নীল শিশি গুঁজে দিল। পকেটে ঢুকিয়ে রাখল অস্টিন শিশিটা। ঘরের অন্য সবার অলক্ষ্যে ঘটল ব্যাপারটা।
গুড বাই, স্টিভ, অস্টিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল শ্যালন। পিছিয়ে দাঁড়াল। মুখটা ঘুরিয়ে নিল একপাশে। সুইচ অন করল টেকনিশিয়ান। মৃদু গুঞ্জন উঠল ইলেকট্রোডের ভেতরে। চোখ মুদল অস্টিন। মিনিট খানেক পরেই থেমে গেল শব্দ। যন্ত্রটা অস্টিনের চাঁদি থেকে সরিয়ে নিল টেকনিশিয়ান। কাজ শেষ।
চোখ খুলল না অস্টিন। যেন ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
সাসকোয়াচ, ডাকল শ্যালন। এর বেশি কিছু বলতে হল না। এগিয়ে এসে পাঁজাকোলা করে অস্টিনকে চেয়ার থেকে তুলে নিল রোবটটা। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
বনসীমার কাছে এসে অস্টিনকে আস্তে করে মাটিতে শুইয়ে দিল, সাসকোয়াচ। এক মুহূর্ত দেখল তাকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে আস্তানায় রওনা দিল।
সাসকোয়াচকে আন্ডারগ্রাউন্ড কমপ্লেক্সে ফিরে যাবার সময় দিল অস্টিন। তারপরই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ।
টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছে শ্যালন আর ফলার। অস্টিনকে এভাবে লাফিয়ে উঠতে দেখে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল যেন দুজনেই।
এমন তো হবার কথা না। ভুরু কুঁচকে টি.ভির পর্দার দিকে তাকিয়ে বলল ফলার, আগামী পনের মিনিটের মধ্যে জ্ঞানই ফেরার কথা না ওর।
আমি জানি, আমাকে দেখছ তুমি। নিশ্চয়ই আমার কথাও শুনছ। আন্ডারগ্রাউন্ড কমপ্লেক্সটা যেদিকে, সেদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল অস্টিন।
আমাদেরকেই বলছে ও, বলল ফলার।
হ্যাঁ, শুকনো শ্যালনের কণ্ঠ। কিন্তু কি করে এটা সম্ভব! আমাদের যন্ত্র কাজ করেনি?
এত দূর থেকে ফলারের কথা শুনতে পাচ্ছে না অস্টিন। কিন্তু তবু যেন তার কথার জবাব দিয়েই চলল সে, খুব অবাক হয়েছ, না ফলার? ঘটনাটা কি জান? আমার খুলিটা এক ধরনের মেটাল অ্যালয়ে তৈরি। এক্স-রে কিংবা অন্য কোন রশ্মিই একে ভেদ করতে পারে না।
হাঁ করে টেলিভিশনের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে ফলার।
সুতরাং বুঝতেই পারছ, বলে চলেছে অস্টিন, তোমাদের মেমোরি ইরেজার আমার ওপর কাজ করেনি। ইচ্ছে করেই তখন চুপ করে ছিলাম। সাসকোয়াচের সঙ্গে মারামারি আর কত করব। পকেট থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনল হাতটা। নীল শিশিটা ছুঁড়ে দিল ওপর দিকে। পরক্ষণেই লুফে নিল আবার। হাসল সে। দুআঙুলে তুলে ধরল নীল শিশিটা, আর হ্যাঁ…
নিউট্রাক্সিনের একটা শিশিও চুরি করেছে ও, ফিসফিস করে বলল ফলার। জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে যেন। চুপ করে রইল শ্যালন।
শোন ফলার, গত আড়াইশ বছর মানুষকে গিনিপিগ বানানোর জন্য কঠোর শাস্তি পাওনা হয়ে আছে তোমাদের। তবে এই শিশিটা পেয়ে যাওয়াতে, ওষুধটুকুতে মানুষের যে উপকার হবে তার বিনিময়ে তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করা যায়। আশা করছি এই অতুলনীয় ওষুধ আমাদের চিকিৎসা জগতের প্রচুর উন্নতি ঘটাবে। শিশিটা পকেটে রেখে দিল আবার অস্টিন। এবার আসল কথা শোন। আমি এখন যাচ্ছি। কিন্তু ঠিক চারদিন পরে ফিরে আসব আবার। একা নয়, পুরো এক ব্রিগেড সৈন্য সাথে নিয়ে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকবে ওদের কাছে। যদি দেখি তখনও আছ, গত আড়াইশো বছরে তোমাদের বর্বরতার কথা আবার মনে পড়ে যাবে আমার। বিশ্বাস কর, প্রয়োজনে আমাদের সেনাবাহিনী খুবই নিষ্ঠুর। তোমাদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করতে দারুণ মজা পাবে ওরা।
শ্যালনের দিকে তাকাল ফলার। চোখে হতাশা। জিজ্ঞেস করল, শিপটা তিনদিনের মধ্যে আসবে তো?
মাথা ঝাঁকাল শ্যালন।
শেষ আরেকটা ফল, মিষ্টি হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল অস্টিনের মুখ। শ্যালন, চিরকাল মনে রাখব আমি তোমাকে। বিদায়।
হাত বাড়িয়ে টি.ভির সুইচটা অফ করে দিল ফলার। লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। লাল হয়ে উঠেছে তার মুখ। একজন পৃথিবীবাসীর কাছে পরাজিত হবার অপমানে বোধ হয়।
যা বলার বলে ঘুরে দাঁড়াল অস্টিন। ছুটতে শুরু করল। বায়োনিক গতিবেগ। লক্ষ্য বেস ক্যাম্প।
***
Leave a Reply