সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০০১
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
উৎসর্গ : যারা সুখের ও শান্তির দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন গড়তে আগ্রহী তাদের খিদমতে।
ভূমিকা
‘পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি’
কাকলি প্রকাশনীর সত্বাধিকারী বন্ধুবর সেলিম সাহেব আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে” এই নামে একটা বই লেখার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। তারও আগে থেকে সমাজে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের করুণ পরিণতি দেখে আমিও এরকম একটা বই লেখার প্রেরণা অনুভব করছিলাম। সেলিম সাহেবের অনুরোধে সেই প্রেরণা আরো প্রবল হয়। কিন্তু লিখব লিখব করেও বিভিন্ন কারণে লেখা হয় নি। ইদানিং সেলিম সাহেব খুব তাগিদ দেওয়ায় লেখার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু এরকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমার পক্ষে খুব কঠিন মনে হল। তবু মহান রাব্বল আল-আমিনের কাছে সাহায্য চেয়ে লিখতে শুরু করি। তবে এ জন্যে আমাকে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলির সাহায্য নিতে হয়েছে। আল্লাহপাকের দরবারে এইসব গ্রন্থের লেখক ও অনুবাদকের ইহকালে মঙ্গল ও পরকালে মাগফেরাত কামনা করছি। কোনো ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আমাকে জানালে তা সংশোধন করব ইনশাআল্লাহ।
ওয়াস সালাম
কাশেম বিন আবু বাকার
৮ই কার্তিক ১৪০৮ বাংলা
৫ই শাবান ১৪২২ হিজরী
২৩শে অক্টোবর-২০০১ ইং।
সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থগুলির নামঃ
১) ইসলাহুর রুসুম (কুসংস্কার সংশোধন) মূলঃ হযরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবী (রঃ); অনুবাদকঃ মাওলানা সিরাজুল হক
২) ইসলাহুর মুসলিমীন ও মূল : হযরত মাওলানা আলি থানবী (রঃ); অনুবাদক ও এস, এম, আব্দুল গাফফার
৩) ইসলামী বিবাহ ও মূলঃ হযরত মাওলানা আলি থানবী (রঃ); অনুবাদক ও মাওলানা হেলাল উদ্দিন আহমাদ।
৪) নারী জীবনের সেরা উপহার ও মূল : মাওলানা আশেক ইলাহী বুলন্দশহরী; অনুবাদিকা : নূরুন নাহার (মুমতাজুল মুহাদ্দেসীন)।
৫) কুরআন হাদিসের আলোকে সঠিক পারিবারিক জীবন ও মূল : হযরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবী (রঃ); অনুবাদকঃ আশরাফুল ইসলাম।
৬) বিশ্ব নবীর (দঃ) পারিবারিক জীবন ও মাওলানা আব্দুস সালাম।
৭) মুসলিম পরিবার ও স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য : মাওলানা আব্দুস সালাম।
৮) মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য বা পারিবারিক জীবন ও মাওলানা আব্দুস সালাম।
৯) বিবাহ ও পারিবারিক প্রসঙ্গ ও মাওলানা মহিউদ্দিন খান।
১০) রমনীর মান ও মাওলানা মুহাম্মদ তাহের (কলিকাতা)।
.
১. “মহান পবিত্র সেই আল্লাহ্, যিনি সৃষ্টিলোকের সমস্ত জোড়া সৃষ্টি করিয়াছেন উদ্ভিদ ও মানবজাতির মধ্যে থেকে এবং এমন সব সৃষ্টি থেকে, যার সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না।”
(আল-কুরআন, সূরা-ইয়াসীন, আয়াত-৩৬)
২. “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, মেয়েলোকেরা যে পুরুষদের অর্ধাংশ কিংবা সহোদর এতে কোনো সন্দেহ নেই।”
(আহমদ, আবু দাউদ ও তিরমিযী)
৩. “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, বিবাহে স্ত্রীলোকের চারিটি বিষয় দেখিতে হইবেঃ ১) তাহার মাল, ২) তাহার গুণ, ৩) তাহার সৌন্দর্য এবং ৪) তাহার ধর্ম, যাহার ধর্মে মতি থাকে তাহাকে পছন্দ কর। তোমার হাত ধূলিতে পূর্ণ হউক।”
বর্ণনায়ঃ হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)-বুখারী, মুসলিম।
.
০১.
কাবিন লেখার সময় কাজি সাহেব কনের বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, মোহরানা কত টাকা হবে ঠিক করেছেন?
কনের বাবা নিয়াজ আহম্মদ কিছু বলার আগে তার বড় জামাই জনাব আলি বরের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমরা তিন লক্ষ টাকা ঠিক করেছি, আপনি কী বলেন?
টাকার অংক শুনে বরপক্ষের সবাই যেমন অবাক হলেন, তেমনি রেগেও গেলেন। বরের বাবা ইলিয়াস মির্জা কিছু বলার আগে তার বন্ধু ফজল আহম্মদ বললেন, মোহরানা এমন রাখা উচিত, যা স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব। কারণ স্বামী যদি মোহরানা আদায় করতে না পেরে মারা যায়, তা হলে হাশরের মাঠে জেনাকারদের দলভূক্ত হয়ে যাবে। তাই আমাদের জানা উচিত মোহরানার টাকা অতি অবশ্যই আদায় করতে হবে। আর তা বিয়ের আসরে অথবা বাসর রাতে আদায় করাই সর্বোত্তম। অবশ্য স্বামীর অপরাগতার কারণ জেনে স্ত্রী সন্তুষ্টচিত্তে যতটা ইচ্ছা কম নিয়ে স্বামীকে মুক্তি দিতে পারে অথবা কিছুই না নিয়ে মোহরানা মাফ করেও দিতে পারে। তবে স্বামী যদি টাকা না দেওয়ার মতলবে স্ত্রীকে ভালবাসার কথা বলে অথবা ছলা-কলার আশ্রয়ে মাফ করিয়ে নেয়, তা হলে তা আদায় হবে না। আপনাদের জামাই আব্দুল হান্নান বাসর রাতে মোহরানার টাকা আদায় করার কথা আমাকে জানিয়েছে। আরো জানিয়েছে, ঐ টাকার পরিমাণ যেন দু’লক্ষের মধ্যে হয়। তাই আমি মোহরানা দু’লক্ষ রাখার অনুরোধ করছি। আর একটা কথা আমাদের জানা উচিত, এই মোহরানার টাকাটা সম্পূর্ণ স্ত্রীর। মোহরানার টাকা আদায় করা যেমন আল্লাহর হুকুম, তেমনি ঐ টাকার উপর সম্পূর্ণ হকও স্ত্রীকে দিয়েছেন। স্বামী বা অন্য
কেউ ঐ টাকা দাবি করতে পারবে না। ঐ টাকা সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। শুধু তাই নয়, ঐ টাকা স্ত্রী যদি ব্যবসায় খাঁটিয়ে কোটিকোটি টাকার মালিকও হয়ে যায়, তবু স্বামী জোর খাঁটিয়ে তা থেকে কিছুই নিতে পারবে না। দাবি করতে পারবে না এবং আজীবন স্ত্রীর খোর-পোষ দিতে হবে। অনেকে মনে করেন, মোহরানা বেশি ধার্য করলে স্বামী সহজে স্ত্রীকে তালাক দিতে পারবে না, এটা মনে করা ঠিক নয়। কারণ যে তালাক দেওয়ার সে তালাক দেবে, তালাক দিলে কি হবে সেটা সে চিন্তা করে না। আর যে স্ত্রী মোহরানা দাবি করবে এই ভয়ে তালাক না দেয়, সে তো স্ত্রীকে আরো বেশি জ্বালা-যন্ত্রণা দেয় এবং স্ত্রীর হকও আদায় করে না। তালাক দিয়ে অনত্র বিয়ে বসতেও দেয় না। আর যদি কোন কারণে স্বামী-স্ত্রীর মিল না হয় এবং দু’জনে অথবা যে কেউ একজন তালাক দিতে বা নিতে চায়, তা হলে কি হবে চিন্তা করে দেখুন। তাই ইসলামে এমন মোহরানা ধার্য করতে বলা হয়েছে, যা স্বামীর পক্ষে আদায় করা সম্ভব। আর কেউ যদি মনে করে, মোহরানা কম হলে পুরুষরা ইচ্ছামতো তালাক দেবে, ইচ্ছামতো বার-বার বিয়ে করবে, তা হলে বলব ইসলামে ইচ্ছামতো তালাক দেওয়া কবিরা গুনাহ। আসলে তালাক ও মোহরানা সম্পর্কে ইসলামে কি বিধি-নিষেধ আছে, তা বেশিরভাগ মুসলমানরা জানে না। থাক, এ ব্যাপারে আর বেশি কিছু বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। এবার আপনারাই ঠিক করুন মোহরানা কত টাকা হবে।
কেউ কিছু বলার আগে কনের বাবা নিয়াজ আহম্মদ বললেন, এসব কথা আমরা জানি। আল্লাহ নারীকে পুরুষের হালাল করার জন্য শরীয়তে মোহরানার বিধান দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, স্বামী তালাক দিলে অথবা মারা গেলে স্ত্রী যাতে বিপদে না পড়ে সেজন্যও মোহরানার বিধান। তাই পাত্রের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে মোহরানা কম বা বেশি করা দোষণীয় নয় বলে বড় বড় ওলামায়ে কেরামগণ অভিমত প্রকাশ করেছেন। তারাও সেই বিবেচনার প্রেক্ষিতে মোহরানা সাব্যস্ত করেছেন। তারপর বললেন, আপনাদের কথাও থাক, আর আমাদের কথাও থাক, আড়াই লক্ষ টাকা ধার্য করা হল।
ইলিয়াস মির্জা মোহরানা আদায় করার ব্যাপারে ইসলামের হুকুম জানেন। আরো জানেন, আজকাল মানুষ এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। বেশির ভাগ মানুষ ছলে বলে কৌশলে স্ত্রীর কাছ থেকে মোহরানা মাফ করে নেয়। অনেকে গড়িমাসি করে আদায় না করে মরার আগে স্ত্রীর কাছে মাফ চায়। তখন আর স্ত্রী কি করবে, স্বামীর নাজুক অবস্থায় মাফ করে দেয়। এটা ইসলামের পরিপন্থি। তাই প্রত্যেক স্বামীর উচিত বিয়ের সময় না পারলেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মোহরানার টাকা আদায় করে দেওয়া। সম্পূর্ণ না দিতে না পারলেও অন্ততপক্ষে কিছু দিয়ে স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করে মাফ চেয়ে নেবে। বর্তমানে মানুষের মতিগতি দেখে ইলয়াস মির্জা বিয়ের দিনে তিন ছেলেকে মোহরানা আদায় করার জন্য টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন। এই ছেলের বেলায়ও তাই করেছেন। আর এই ছেলেও মোহরানা টাকা দিয়ে দেবে বলে বাবার বন্ধুকে জানিয়েছিল। এখন কনের বাবার কথা শুনে বললেন, ঠিক আছে কাজি সাহেব, তাই লিখুন।
বিয়ে পড়ান হয়ে যাওয়ার পর প্রায় সব জায়গায় বরকে মজলিস থেকে ঘরে নিয়ে গিয়ে কনের পাশে বসিয়ে আয়নায় বর-কনেকে একে অপরের মুখ দেখান হয়। এক গ্লাস দুধ বা সরবত এনে প্রথমে বরকে অর্ধেক খাইয়ে বাকিটা কনেকে খাওয়ান হয়। তারপর কনের বাবা জামাইকে সোনার আংটি পরিয়ে তার হাতে মেয়ের হাত রেখে বলেন, এতদিন মেয়ে আমাদের ছিল, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে আজ তোমার হাতে তুলে দিলাম। তারপর আরো অনেক কিছু বলেন। এটাকে সেপা বলে। সেখানে বরপক্ষের ও কনে পক্ষের সব বয়সের মেয়ে-পুরুষ থাকে। এতে যে পর্দাহীনতা হচ্ছে তা কেউ খেয়াল করে না।
এসব হল না দেখে বরপক্ষের একজন কনের বাবাকে বললেন, জামাইকে ঘরে নিয়ে গিয়ে মেয়ের সঙ্গে মিলন করাবেন না? জামাই এর হাতে আংটি পরিয়ে মেয়েকে সোঁপবেন না?
নিয়াজ আহম্মেদ বললেন, এসব সমাজের কুরীতি। ইসলামে এর কোনো দলিল নেই। তা ছাড়া এসব করতে গেলে মেয়েদের পর্দা থাকে না। তাই এই কুপ্রথা সমাজ থেকে দূর করা উচিত। আর সোনার আংটি জামাইকে পরিয়ে সোপবার কথা যে বললেন, তা একেবারেই অনুচিত। পুরুষদের সোনার যে কোনো অলঙ্কার পরা হারাম। তাই জামাইকে সোনার আংটি পরিয়ে দেওয়া শক্ত গুনাহ।
তার কথা শুনে লোকটি অসন্তুষ্ট হলেও কিছু বলতে পারল না।
.
ইলিয়াস মির্জার বাড়ি গ্রামে। গাড়ি চলার মতো রাস্তা-ঘাট এখনো হয় নি। শহরের বন্ধুর মেয়েকে পুত্রবধূ করে নিয়ে এসেছেন। বাসস্ট্যান্ড থেকে দু’টো পাল্কীতে বর ও কনে এসেছে। উঠোনের মাঝখানে বেহারারা পাল্কী নামিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর আব্দুল হান্নান একটা পাল্কী থেকে নামল।
এখানকার প্রথা হল, বিয়ের কনেকে বরের দুলাভাইদের একজন পাঁজাকোলা করে পাল্কী থেকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাবে। বড় দুলাভাই আসিফ খুব মোটা মানুষ। তার পক্ষে কনেকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তাই মেয়েরা যখন তাকে কনে ঘরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলল, তখন সে অপরাগতার কথা জানিয়ে মেজ ভাইরা খুরশীদকে বলল, তুমি ভাই আমার হয়ে কাজটা করে দাও।
কনে নিলুফার পাল্কীর ভিতর থেকে তাদের কথা শুনে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। খুরশিদ পাল্কীর দরজা খুলে যখন বলল, ছোট ভাবি নামবেন না, পাল্কী থেকেই তুলতে হবে? তখন ঘোমটার ভিতর থেকে নিলুফার বলল, আপনি সরে দাঁড়ান।
খুরশিদ সরে দাঁড়াবার পর নিলুফার পাল্কী থেকে নেমে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, খবরদার, আমার গায়ে হাত দেবেন না। জানেন না, মহাররাম বালেগ ছেলে-মেয়ে একে অপরকে স্পর্শ করাও হারাম?
নতুন বৌ এর মুখে এরকম কথা শুনে শুধু খুরশিদ নয়, সেখানে যারা ছিল সবাই খুব অবাক হয়ে কোনো কথা বলতে পারল না।
আব্দুল হান্নানের ছোট বোন গালিবা নতুন বৌ তোলার প্রথা যে নাজায়েজ, তা আব্বার কাছে শুনেছিল। তাই সেকথা সবাইকে বলেছিল। কিন্তু কেউ তার কথা কানে তোলেনি। নিলুফারের কথা শুনে সে খুব খুশী হল। এগিয়ে এসে তার একটা হাত ধরে বলল, আমি গালিবা, আপনার ছোট ননদ। ঘরে চলুন বলে এগোল।
দু’একজন বয়স্ক মহিলা রেগে উঠে বললেন, এ কেমন মেয়েরে বাবা, বিয়ের কনে হয়ে সবার সামনে বেহায়ার মতো ফটফট করে কথা বলে? শ্বশুর ভাসুর ও সবার সামনে নতুন বৌ হয়ে কথা বলতে লজ্জা পেল না?
তাদের কথা শুনতে পেয়ে নিলুফার থমকে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার হাতে টান দিয়ে গালিবা যেতে যেতে বলল, এরা সবাই অশিক্ষিত মেয়ে, আপনার কথা এদের মগজে ঢুকে নি।
আব্দুল হান্নানের মা জাহেদা বেগম এস.এস.সি. পাশ মহিলা। নতুন বৌ এর কথায় তিনিও অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে স্বামীকে দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে বললেন, এখন দেখলে তো নতুন বৌ-এর ব্যবহার? শুধু মেজ জামাইকে নয়, আমাদের সবাইকে কেমন অপমান করে নিজেই হেঁটে ঘরে চলে গেল? আমি আগেই বলেছিলাম মোল্লা বাড়ির মেয়ে এনো না। ওরা সমাজের কোনো প্রথাই মেনে চলে না।
ইলিয়াস মির্জা অন্য গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত গৃহস্থবাড়ির ছেলে ছিলেন। তাকে ছোট রেখে তার মা-বাবা মারা যান। চাচারা মাট্রিক পর্যন্ত পড়িয়ে গৃহস্থালীর কাজে লাগিয়েছিলেন। ইলিয়াস মির্জা ছোটবেলা থেকে ধর্মের সব কিছু মেনে চলেন। সৎ, ধার্মিক ও কর্মঠ ছেলে হিসাবে গ্রামে তার সুনাম ছিল। চাচা চাচিরাও তাকে খুব স্নেহ করতেন।
জাহেদা বেগম মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তার বাবা আব্দুস সবুর মির্জা খুব অবস্থাপন্ন গৃহস্থ ছিলেন। তিনিও খুব ধার্মিক লোক ছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী মায়মুনা বেগম স্বামীর ভয়ে নামায-রোযা করলেও ধর্মের অনান্য বিধি-বিধান যেমন জানতেন না, তেমনি মেনেও চলতেন না। খুব জেদী ও উগ্র মেজাজের মেয়ে ছিলেন। সামান্য ব্যাপার নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করতেন।
আব্দুস সবুর মির্জা হাদিসের বাংলা তরজমায় পড়েছেন, স্ত্রীর সহিত উত্তম ব্যবহার করিবে, তাহাকে ঘৃণা করিবে না, স্বামীর ইচ্ছামতো না চলিলে স্ত্রীর প্রতি কঠোর হইবে না, বিশেষ বিশেষ কারণে সামান্য প্রহার ব্যতীত বেদম প্রহার করিবে না। বরং স্ত্রীর সহিত সময় সময় নির্দোষ খেলা-ধূলা এবং আমোদ-প্রমোদ করিবে। স্ত্রীর গুপ্ত বিষয় গোপন রাখিবে। নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত সন্তুষ্টির জন্য কিছু বৈধ ব্যয় করিবে, স্ত্রীকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করিবে। স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রীকে তাহার অংশমতো উত্তরাধিকারী বলিয়া গণ্য করিবে।”
মায়মুনা বেগমের জিদ ও অন্যায় আচরণ খুব ধৈর্যের সঙ্গে মোকবেলা করে হাদিস মোতাবেক তাকে বুঝিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। তাদের একমাত্র সন্তান জাহেদা বেগম। তিনি মেয়েকে নিজের মতো করে মানুষ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু স্ত্রীর কারণেরই সফল হন নি। মেয়ে ঠিক তার মায়ের মতো হয়েছে। ছোটবেলায় তাকে মৌলবী রেখে কুরআন খতম করিয়েছেন, নামায শিখিয়েছেন। তখন সেসব মেনে চললেও মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর মেনে চলেনি। মাধ্যমিক পাশ করার পর মেয়ের স্বভাব ও আচার-আচরণে বেপরওয়া ভাব দেখে বাবা হিসাবে যতটা বোঝাবার বুঝিয়েছেন। কিন্তু মায়ের আস্কারা পেয়ে জাহেদা বেগম বাবার কথায় কান দেননি। তাই সিদ্ধান্ত নেন, ধার্মিক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই করে রাখবেন এবং তাকে দিয়ে মেয়েকে ধর্মের পথে নিয়ে আসবেন। তারপর অনেক খোঁজখবর করে আট মাইল দূরের এক গ্রামে ইলিয়াসের খোঁজ পান। তিনি ইলিয়াস ও তার বাপ চাচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঘর-জামাই করে রাখেন।
কিন্তু জাহেদা বেগম সুন্দর ও সুপুরুষ ইলিয়াস মির্জাকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে ঘর-সংসার করলেও মনেপ্রাণে ভালবাসতে পারেন নি। তিনি ভাবতেই পারেননি নিম্ন মধ্যবিত্ত এতিম ছেলের সঙ্গে বাবা তার বিয়ে দেবে। ধনীলোকের একমাত্র সন্তান, তার উপর সুন্দরী, স্বাস্থবতী ও শিক্ষিতা, তাই বেশ অহঙ্কারী। ভাবতেন, তার সঙ্গে যার বিয়ে হবে, সেও ধনীলোকের উচ্চশিক্ষিত ছেলে। তাই স্বামীর পরিচয় পেয়ে খুশী হতে পারেননি। স্বামীকে তেমন গ্রাহ্য করতেন না। নিজের ইচ্ছামতো সবকিছু করতেন। সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করতেন। জাহেদা বেগমের মাও জামাইকে দেখতে পারতেন না। স্বামী এরকম একটা ছেলেকে জামাই করবে, তিনিও ভাবতে পারেন নি। তাই মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে ঝগড়া হলে মেয়ের পক্ষ নিয়ে জামাইকে যা-তা কথা বলতেন। একবার জাহেদা বেগম ঝগড়ার সময় অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে স্বামীকে অপমান করেছিলেন। সেসময় ইলিয়াস মির্জা সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরকে বলেছিলেন, আপনি আপনার মেয়ের স্বভাব-চরিত্র জানেন, আমার মতো ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়া উচিত হয় নি। আমাকে যেমন সারাজীবন দুঃখে কাটাতে হবে, তেমনি আপনার মেয়েকেও সারাজীবন দুঃখে কাটাতে হবে।
আব্দুস সবুর মির্জা জামাইয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিয়ে বলেছিলেন, তুমি সবর কর বাবা। আল্লাহ তোমাকে সবর করার ফল ইহকালে ও পরকালে দেবেন। আমার মেয়ের স্বভাব-চরিত্র জানি বলেই তাকে ধর্মের পথে আনার জন্য তোমার মতো ধার্মীক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি। তুমি তার ব্যবহারে দুঃখ পেলেও তাকে যদি ধর্মের পথে আনতে পার, তা হলে আল্লাহ তার জাজা তোমাকে দেবেন। নিশ্চয় তিনি তোমাদেরকে সুখী করবেন। দোয়া করছি, আল্লাহ যেন আমাকে তোমাদের সুখ-শান্তি দেখান। একটা হাদিস বলছি শোন, নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, বিশ্বাসীদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসের অধিকারী ঐ ব্যক্তি যাহার স্বভাব-চরিত্র তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম। তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তাহার স্ত্রীর প্রতি ব্যবহারে উত্তম’। [বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)- মিশকাত] আরো একটা হাদিস বলছি শোন, রাসুলুল্লাহ(দঃ) বলিয়াছেন, “স্ত্রীগণকে উপদেশ প্রদান করিবে, কেননা পাঁজরের হাড় দ্বারা তাহারা সৃষ্টি। পাঁজরের হাড়ের মধ্যে উপরের হাড় সর্বাপেক্ষা বক্র। যদি ইহাকে সরল করিতে চাও তবে ইহা ভাঙ্গিয়া যাইবে। যদি ছাড়িয়া দাও, তবে ইহা আরো বক্র হইবে। সুতরাং স্ত্রীকে উপদেশ দিতে থাক’। [বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)- বুখারী] তাই তোমাকে বললাম, স্ত্রীর দুর্ব্যবহার সবরের সঙ্গে মোকাবেলা করে তাকে উপদেশ দিতে থাক। যদি তা পার, তা হলে ইনশাআল্লাহ তুমি কামিয়াব হবে।
শ্বশুরের কথা শুনে ইলিয়াস মির্জা আর কিছু বলেন নি। তারপর থেকে স্ত্রীর সব রকমের দুর্ব্যবহার সহ্য করে উপদেশ দিয়ে আসছেন। আল্লাহর রহমতে সম্পূর্ণ না পারলেও অনেকটা ধর্মের পথে আনতে পেরেছেন। কিন্তু উগ্রস্বভাবের তেমন পরিবর্তন হয় নি। তাদের চার ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে আব্দুল লতিফ হাইস্কুলের মাষ্টার। মেজ ছেলে আব্দুল মতিনের গঞ্জে মনোহারীর দোকান আর মেজ ছেলে আব্দুল মান্নানের রড-সিমেন্টের দোকান। ছোট আব্দুল হান্নান এম,এ,পাশ করে প্রায় একবছর হল সমবয়সি ছেলেদের সঙ্গে বোম বোম করে বেড়াচ্ছে। ইলিয়াস মির্জা তাকে বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা করার কথা বললে বলে, কিছু টাকা দাও শহরে গিয়ে ব্যবসা করব। তিনি ছেলেদের প্রতি সন্তুষ্ট নন। সব ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছেন। কিন্তু ছেলেরা কলেজে পড়াশোনা করার সময় থেকে ধর্মের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। তখন তিনি তাদেরকে অনেক বুঝিয়েছেন। তাতে কাজ না হতে রাগারাগিও করেছেন। তবু ছেলেরা আধুনিকতার স্রোতে ভেসে চলেছে। ছোট ছেলে আব্দুল হান্নান অন্য তিন ভাইয়ের থেকে ধর্মের প্রতি বেশি উদাসীন। অন্য ভাইয়েরা তবু জুম্মার নামায ও রমযান মাসে রোযা-নামায। করে। কিন্তু সে তাও করে না। তাই তাকে ব্যবসা করার টাকা ইলিয়াস মির্জা আজও দেন নি। তিন মেয়ের বড় দু’জন রোকেয়া ও যয়নাবের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে গালিবা গত বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। একমাত্র সেই একটু ধার্মিক। ক্লাস সেভেন থেকে গায়ে-মাথায় ওড়না জড়িয়ে স্কুলে যেত, এখন কলেজেও যায়।
বড় ছেলে আব্দুল লতিফ প্রতিমাসে বাবাকে একহাজার ও মাকে তিনশ টাকা করে দেয়। আর মেজ এবং সেজ ছেলে বাবাকে দেয় তিন হাজার আর মাকে দেয় পাঁচশ টাকা।
আব্দুল লতিফ মাষ্টারী পাওয়ার পর ইলিয়াস মির্জা মেজ ও সেজ ছেলেকে ব্যবসা করে দিয়েছেন। ছেলেরা রোজগারী হওয়ার পর ভোগবিলাসের দিকে যেমন ঝুঁকে পড়েছে, তেমনি ধর্মের প্রতি আরো বেশি উদাসিন হয়ে পড়েছে। তাদের মতিগতি ফেরাবার জন্য একের পর এক ভালো ও ধনী ঘরের শিক্ষিত তিনটে বৌ করে এনেছেন। কিন্তু তারাও স্বামীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে।
জাহেদা বেগম অনেকদিন থেকে স্বামীকে টিভি কেনার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। ইলিয়াস মির্জা বলেছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে টিভি ঘরে রাখা ঠিক নয়। কারণ টিভিতে অল্প কিছু শিক্ষনীয় জিনিস দেখালেও বেশিরভাগ যা কিছু দেখান হয়, তা ইসলামের পরিপন্থি। সে সব দেখে মানুষ বিশেষ করে ছেলেমেয়েরা ক্রমশঃ ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি টিভি না কিনলেও তিন বৌ বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। ফলে সবাই যেমন ধর্মের প্রতি আরো বেশি উদাসীন হয়ে পড়েছে, তেমনি ভোগ-বিলাসের দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়েছে।
ভাইয়েদের মধ্যে সদ্ভাব থাকলেও তিন জা-এর মধ্যে তা নেই। বাপের বাড়ি থেকে কে কত বেশি দান-দেহেজ নিয়ে এসেছে, তা নিয়ে তিন জায়ের মধ্যে বচসা হয়। সংসারের কাজ-কর্ম নিয়েও ঝগড়া হয়। কার স্বামী কত টাকা সংসারে দেয়, তা নিয়েও ঝগড়া হয়। বড় বৌ-এর স্বামী অন্য দুজনের স্বামীর চেয়ে কম দেয়। তার দুটো ছেলেমেয়ে আছে, খরচ বেশি, এসব নিয়েও মাঝে মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। ধনী ঘরের শিক্ষিত মেয়ে হলেও সবাই শাশুড়ীকে ভয় করে। তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হলে তিনি থামিয়ে দেন। তবে ছেলে বৌদের ভোগবিলাসের সঙ্গে তিনিও গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে ও বৌকে অন্যদের তুলনায় একটু বেশি স্নেহ করেন। তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের ঘরেই টিভি দেখেন। মেজ ও সেজ ছেলে-বৌ এর ঘরে এখনও ছেলেমেয়ে হয়নি। ইলিয়াস মির্জা স্ত্রীকে টিভি না দেখার জন্য অনেক বোঝান। কিন্তু জাহেদা বেগম স্বামীর কথায় কান দেন না। আগে স্বামীর কথায় প্রতিদিন ফজর মাগরিবের নামাযের পর কিছুক্ষন কুরআন তেলয়াত করতেন। ঘরে টিভি আসার পর সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।
সংসারের সবাই সুখে থাকলেও ইলিয়াস মির্জার মনে এতটুকু শান্তি নেই। তার কেবলই মনে হয়, তিনি মারা গেলে এ বাড়ি থেকে ইসলাম চলে যাবে। ভেবেছিলেন, সব ছেলের বিয়ে দিয়ে তাদের সংসার আলাদা করে দেবেন; কিন্তু তাদের ধর্মের প্রতি উদাসীনতা দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। শেষে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করলেন, এমন একজন আলেমা মেয়েকে ছোট ছেলে আবুল হান্নানের বৌ করে আনবেন, যে বাড়ির সবাইকে ধুর্মের পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে। তারপর প্রায় বছরখানেক ধরে খোঁজ করে সেরকম মেয়ে না পেয়ে বাল্য বন্ধু নিয়াজ আহম্মদের সরণাপন্ন হন। তাকে স্ত্রী ও ছেলে-বৌদের সবকিছু জানিয়ে তার কামিল পাশ মেয়ে নিলুফার ইয়াসমীনকে ছোট ছেলের বৌ করে আনার প্রস্তাব দেন।
ইলিয়াস মির্জা ও নিয়াজ আহম্মদ একই গ্রামের লোক। ছোটবেলা থেকে তাদের বন্ধুত্ব। প্রাইমারী থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত একসঙ্গে লেখাপড়া করেছেন। মাধ্যমিক পাশ করার পর চাচারা ইলিয়াস মির্জাকে আর লেখাপড়া না করিয়ে চাষাবাদের কাজে লাগালেও তাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। তারপর ইলিয়াস মির্জা যখন বিয়ে করে বেশ দূরের গ্রামে ঘরজুমাই হয়ে থাকার জন্য চলে গেলেন তখন নিয়াজ আহম্মদ মাঝে মাঝে গিয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতেন।
নিয়াজ আহম্মদ মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তার বাবার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল ছিল। তিনি যখন বি.এ. পাশ করেন তখন তার মা মারা যান। এবং তার বাবা এক বছরের মধ্যে আবার বিয়ে করেন। বাবার এই কাজের জন্য নিয়াজ আহম্মদ খুব মনে খুব কষ্ট পান। আগের মতো তাকে শ্রদ্ধা করতে পারলেন না। বাবা তার বিয়ে দিতে চাইলে রাজি হলেন না। বছরখানেক বাড়িতে থেকে চাকরির চেষ্টায় ঢাকা চলে যান এবং ছোট খাট একটা চাকরিও পেয়ে যান। দুই ঈদের সময় দু’তিন দিনের জন্য বাড়িতে আসতেন। এর মধ্যে বন্ধু ইলিয়াস মির্জার বিয়ে ও ঘরজামাই হয়ে যাওয়ার কথা শুনে ঐ সময় তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। আর চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। দু’তিন। বছর চাকরি করে বিতৃষ্ণা জন্মে যেতে এক ঈদের সময় বাড়িতে এসে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান এবং চাকরিতে বিতৃষ্ণার কথা জানিয়ে ব্যবসা করার জন্য কিছু টাকা হাওলাত চান।
ততদিনে ইলিয়াস মির্জার শ্বশুর-শাশুড়ী মারা গেছেন। তিনিই এখন শ্বশুরের সবকিছুর মালিক। বন্ধুর কথা শুনে তাকে বেশ কিছু টাকা কর্জে হাসানা দেন। সেই টাকায় ব্যবসা করে নিয়াজ আহম্মদ আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। অবশ্য ব্যবসা চালু হওয়ার পর বন্ধুর টাকা শোধ করে দিয়েছেন। ওঁর পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটা সবার ছোট। সে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। পাঁচ বোনের মধ্যে নিলুফার চার নম্বর। তারপরে যে বোন সেও মাদ্রাসায় পড়ে। শহরের শিক্ষিত ও ধনী ব্যসায়ী হলেও নিয়াজ আহম্মদ ধর্মের বিধি-নিষেধ নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন। স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদেরকেও সেইভাবে পরিচালিত করেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হজ্জ্ব করেছেন। দ্বীনের খিদমত করার জন্য বছরে দু’একবার তবলিগ জামাতের সঙ্গে চিল্লায় যান।
বাল্যবন্ধু ইলিয়াস মির্জা যে খুব সহজ সরল ও ঘর জামাই হয়ে থাকার ফলে স্ত্রীকে নিজের মতো করে নিতে পারেনি এবং দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি পাননি, তা নিয়াজ আহম্মদ জানতেন। এখন তার সবকিছু শুনে খুব সমস্যায় পড়ে গেলেন। তিনি শহরের কোনো বড় আলেম বা মুফতির সঙ্গে নিলুফারের বিয়ে দতে চেয়েছিলেন। কলেজ-ভার্সিটিতে পড়া পাড়াগাঁয়ের ছেলেকে জামাই করার কথা কখনও চিন্তা করেন নি। তাই বন্ধুর প্রস্তাবে হ্যাঁ না কিছু না বলে মেহেমানদারী করালেন।
আব্বার মন খারাপ দেখে নিলুফার জিজ্ঞেস করে যখন ঘটনা জানতে পারল তখন কিছুক্ষন চিন্তা করে বলল, চাচার প্রস্তাব আপনি মেনে নিন। হয়তো আল্লাহ পাকের ইচ্ছা, আমাকে দিয়ে তাদেরকে ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনার। তাই এই প্রস্তাব এসেছে।
কিন্তু মা, তুই শহরের মেয়ে, কত সুখে স্বচ্ছন্দে মানুষ হয়েছিস, পাড়াগাঁয়ে তুই কি থাকতে পারবি? গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে কি খাপ খাওয়াতে পারবি? তা ছাড়া একান্নবর্তি সংসারে অনেকে রকম ঝামেলা হয়। সেসব কি তুই সহ্য করতে পারবি?
সেখানে নিলুফারের মা আয়েশা বেগম ছিলেন। স্বামী থেমে যেতে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুই ছেলেমানুষ। তা ছাড়া তোর আব্বার মুখে শুনেছি, ছেলের বাবা ধার্মিক মানুষ হলেও ছেলেরা ও বৌরা ধর্মের কিছুই মেনে চলে না। তাদের মাও ছেলেদের মতো। তুই একা সবাইকে কি করে সামলাবি? আমার তো খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
নিলুফার বলল, আমার ভাগ্যে আল্লাহ যা লিখেছেন, তা তোমরা রদ-বদল করতে পারবে না। যারা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো কাজে করতে চায়, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। তোমরা দুশ্চিন্তা না করে শুধু দোয়া কর, আল্লাহ যেন আমাকে সফলতা দান করেন।
মেয়ের ভালো-মন্দ চিন্তা করে নিয়াজ আহম্মদ যেমন বন্ধুর প্রস্তাব মেনে নিতে পারছিলেন না, তেমনি তার মনে কষ্ট দিতেও চাচ্ছিলেন না। মেয়ের কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুই আমাকে অনেক বড় দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচালি মা। দোয়া করি, আল্লাহ তোর নেকবাসনা পূরণ করে দোজাহানে সুখ শান্তি দিক। তারপর বন্ধুকে মতামত জানালেন।
ইলিয়াস মির্জা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বিদায় নিয়ে ফিরে এলেন। তারপর একদিন স্ত্রী, বড় ছেলে ও বৌ, বড় মেয়ে ও জামাই ও আব্দুল হান্নানকে নিয়ে মেয়ে দেখতে ও বিয়ের দিন ঠিক করতে বন্ধুর বাসায় গেলেন।
আদর-আপ্যায়ন ও খাওয়া-দাওয়ার পর ইলিয়াস মির্জা বন্ধুকে মেয়ে দেখার কথা বললেন।
নিয়াজ আহম্মদ বললেন, সবাইকে মেয়ে দেখান যে ইসলামে নিষেধ, মুসলমান হিসাবে আপনাদের তা জানা উচিত ছিল। যাই হোক, মেয়েরা যার এসেছেন, তারা নিলুফারকে দেখেছেন, পুরুষদের মধ্যে আব্দুল হান্নান তাবে দেখতে পারে!
ইলিয়াস মির্জা বললেন, ইসলামের এই হুকুম আমার জানা ছিল না। ঠিক আছে, আব্দুল হান্নানই তা হলে দেখুক, সেই ব্যবস্থা কর।
আব্বার কথা শেষ হতে বড় ছেলে আব্দুল লতিফ নিয়াজ আহম্মদকে উদ্দেশ্য করে বলল, পাত্রের বাবাতো পাত্রীর বাবার মতো, তার দেখাও কি ইসলামে নিষেধ?
নিয়াজ আহম্মদ বললেন, হ্যাঁ নিষেধ। অবশ্য আজকাল ইসলামের এই হুকুম মুসলমানরা জেনে বা না জেনে পালন করে না। তারা সব ধরণের মেয়ে পুরুষের মজলিসে কনেকে এনে দেখায়। এটা যে শরীয়তের দৃষ্টিতে কত বড় অপরাধ, তা চিন্তা করে দেখে না। তারপর আব্দুল হান্নানকে বললেন, তুমি এস আমার সঙ্গে।
তাকে অন্য রুমে এনে বললেন, বস, আমি নিলুফারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আব্দুল হান্নান যখন ক্লাস সেভেনে পড়ত তখন আব্বার সঙ্গে এখানে। এসেছিল। সে সময় নিলুফার ছোট থাকলেও তাকে দেখেনি। কারণ সে নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। মায়ের মুখে শুনেছে, কনে দেখতে খুব সুন্দরী, স্বাস্থ্যও খুব ভালো। মাদ্রাসায় পড়া মেয়েকে বিয়ে করতে মন না চাইলেও আব্বার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেকথা বলার সাহস নেই। নিলুফার এলে কি জিজ্ঞেস করবে চিন্তা করতে লাগল। একটু পরে মেয়েলী কণ্ঠে সালাম শুনে সেদিকে তাকিয়ে অবাক। আপাদমস্তক ঢাকা বোরখাপরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে আব্বার বন্ধুর কথা শুনে বুঝতে পেরেছিল এরা খুব রক্ষণশীল পরিবার। তাই বলে শিক্ষিত বিয়ের পাত্রী এভাবে পাত্রের সামনে আসবে আব্দুল হান্নান ভাবতেই পারেনি। তাই তাকে দেখে এত অবাক হল যে, সালামের উত্তর দিতে ভুলে তার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
নিলুফার কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, মনে হচ্ছে অবিশ্বাস্য কিছু। দেখছেন? তাই সামামের উত্তর দিতে ভুলে গেছেন।
তার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে আব্দুল হান্নান সালামের উত্তর দিয়ে বলল, বসুন। বসার পর বলল, আপনাকে দেখার জন্য চাচা নিয়ে এলেন, কিন্তু– বলে থেমে গেল।
থেমে গেলেন কেন? যা বলতে চাচ্ছিলেন বলুন।
না, মানে বলছিলাম, মেয়েরা ছেলেদের সবকিছু দেখে পছন্দ কর। যেমন ছেলের গায়ের রঙ, স্বাস্থ্য, মুখ, হাত, পা, নাক, কান সব কিছুই মেয়েরা দেখতে পায়। সে ক্ষেত্রে, মেয়েদের ঐ সব দেখা ছেলেদের অধিকার আছে। নচেৎ মেয়ে কানা, খোঁড়া, লুলো অথবা মুখ, কান ও নাকে কোনো দোষ আছে কিনা জানবে কি করে?
ওসব ছেলে পক্ষের মেয়ে গার্জেনরা দেখবেন, পুরুষদের দেখা ইসলামে নিষেধ। মেয়ে গার্জেনরা পাত্রী দেখে যদি পছন্দ করেন এবং সেকথা পাত্রকে জানাবার পর পাত্র যদি বিয়ে করতে রাজি হন, তা হলে পাত্র পাত্রীকে দেখতে পারে এবং অল্প কিছু আলাপও করতে পারে। আর আপনার মেয়ে গার্জেনরাতো আমার সব কিছু জানেন। তারা নিশ্চয় আমার সম্পর্কে ভালোমন্দ কিছু আপনাকে বলেছেন?
হ্যাঁ বলেছেন। এবার তা হলে মুখের নেকাব সরান।
তার আগে বলুন, কোনো দোষ না পেলে বিয়ে করবেন?
আব্দুল হান্নান অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে।
নিলুফার মুখের নেকাব সরিয়ে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে দৃষ্টি নিচু করে নিল।
আব্দুল হানানানের চোখ ঝলসে গেল। সত্যি, এত রূপসী মেয়ে জীবনে আর দেখেনি। কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেক রূপসী মেয়ে দেখেছে; কিন্তু এর সঙ্গে তাদের কোনো তুলনাই হয় না। অপলক দৃষ্টিকে তার রূপসুধা পান করতে লাগল।
নিলুফার তার দিকে কম্পিত পাপড়ী তুলে বলল, এবার যাওয়ার অনুমতি দিন।
এখন অনিচ্ছাসত্বে বাধ্য হয়ে দিলাম; কিন্তু বিয়ের পর দেব না।
নিলুফার লজ্জায় রাঙা হয়ে ছুটে পালিয়ে গেল।
ইলিয়াস মির্জা ঐ দিনই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে সবাইকে নিয়ে ফিরে আসেন।
আজ পাল্কী থেকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নতুন বৌ যেসব কথা বলেছে, তা শুনে ইলিয়াস মির্জা খুব খুশী হয়েছেন। স্ত্রীকে নতুন বৌ তার বাপের বাড়ির সম্পর্কে অভিযোগ করতে দেখে মনের ভাব গোপন করে বললেন, তুমি রাগ করছ কেন? ছোট বৌ কুরআন হাদিসের কথা বলেছে। মাদ্রাসা থেকে কামিল, পাশ করেছে। বিয়াই সাহেব তবলীগ জামাত করেন। তার মেয়ে গ্রাম্য সমাজের খারাপ রীতিনীতি কি আর মেনে নিত পারে? কুরআন হাদিসের কথা বললে কাউকে আপমান করা হয় না। এখন লোকজনের সামনে এ নিয়ে হৈ চৈ করো না।
স্বামীর কথা শুনে জাহেদা বেগম রাগে গরগর করতে করতে সেখান থেকে চলে গেলেন।
.
০২.
আজ আব্দুল হান্নান ও নিলুফারের বাসর রাত। আব্দুল হান্নান দুলাভাইদের ও সমবয়সী আত্মিয়দের সঙ্গে ড্রইংরুমে বসে গল্প করছে আর একবার করে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তার মন বাসর ঘরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। লজ্জায় সেখান থেকে চলে যেতে পারছে না।
দেওয়াল ঘড়িতে যখন টংটং করে বারটা ঘোষণা করল তখন মামাত ভাই জামাল বলল, এবার আব্দুল হান্নানকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।
জামালের বন্ধু হামিদ বলল, হ্যাঁ, তুই ঠিক কথা বলেছিস। রাত বারটা বেজে গেছে। এমনিতেই বাসর রাত নাকি খুব ছোট হয়।
আব্দুল হান্নানের বন্ধু আব্বাস বলল, কিন্তু ও যাবে কি করে? মেয়েদের কেউ একজন এসে নিয়ে যাবে। হয়তো তাদের কাজই শেষ হয় নি।
মেজ দুলাভাই খুরশিদ বলল, এবার হয়তো কেউ এসে পড়বে।
তার কথা শেষ হতে না হয়ে মেজ বোন যয়নাব এসে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী কান্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই? বারটা বেজে গেছে, এখনো ওকে নিয়ে গল্প করছ? তারপর আব্দুল হান্নানকে বলল, আয় আমার সঙ্গে।
.
এদিকে আব্দুল হান্নানের ছোট বোন গালিবা সমবয়সী আত্মীয় মেয়েদের নিয়ে নতুন ভাবির সঙ্গে রসিকতা করছে। এক সময় গালিবা সবাইকে চুপ করতে বলে ছোট ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বলল, রূপ, গুণ, বিদ্যা ও বুদ্ধির কথা জেনে আপনাকে আব্বা এ বাড়ির ছোট বৌ করে এনেছে। রূপের প্রমাণ পেয়েছি। আশা করি গুণের প্রমাণ পরে নিশ্চয় পাব। এখন বুদ্ধির প্রমাণ দিতে হবে।
নিলুফার মৃদু হেসে বলল, কম বেশি বুদ্ধি আল্লাহ সবাইকেই দিয়েছেন।
গালিবা বলল, তা আমরাও জানি। তাই দু’চারটে শ্লোক বলব, উত্তর দিতে পারলে বুদ্ধির প্রমাণ পেয়ে যাব।
নিলুফার বলল, তার আগে দু’একটা কথা বলতে চাই।
বেশতো বলুন কি বলবেন।
ননদ-ভাজের মধ্যে আপনি করে কথা বললে আনন্দ জমে না। তাই আমরা যদি তুমি করে বলি, তা হলে ভালো হত না কি?
গালিবা বলল, আপনি, থুড়ি তুমি খুব ভালো কথা বলেছ।
তার মামাত বোন জামিলা বলল, কিন্তু আমরা জেনেছি আপনি কামিল পাশ। তুমি করে বলা কি উচিত হবে?
গালিবা বলল, হ্যাঁ হবে। ভাবিকে কেউ আপনি করে বলে নাকি?
নিলুফার বলল, গালিবা ঠিক কথা বলেছে। তা হলে আমরা কেউ আর কাউকে আপনি করে না বলে তুমি করে বলব। নচেৎ আমিও তোমাদেরকে আপনি করে বলব।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ঠিক আছে ছোট ভাবি, আমরা রাজি।
নিলুফার আবার মৃদু হেসে বলল, এবার তোমরা কি শ্লোক বলবে বলছিলে, বল। তবে তোমাদেরও বুদ্ধি-টুদ্ধি আছে কিনা জানার জন্য আমাকেও কিন্তু চান্স দিতে হবে।
কেউ কিছু বলার আগে পাড়ার মেয়ে হাফিজা বলল, তা হলে বাজি হোক, তুমি হেরে গেলে পাঁচশ টাকা দেবে আর আমরা হেরে গেলে তাই দেব।
দূর সম্পর্কের চাচাত বোন জামিলা হেসে উঠে বলল, নতুন ভাবির কাছে এখন অত টাকা আছে নাকি যে দেবে?
গালিবা বলল, না থাকলে আমাদের কাছ থেকে ধার নেবে।
হাফিজা বলল, তুই বোকার মতো কথা বলছিস কেন? ভাবিতো ভাইয়ার কাছ থেকে দেবে।
তাকে বোকা বলায় গালিবা রেগে মেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই নিলুফার বলল, তোমরা কিন্তু একটা নাজায়েজ ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছ।
তার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে একসঙ্গে বলে উঠল, আমরা নাজায়েজ ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছি?
হ্যাঁ, নাজায়েজ। যে-কোন বিষয়ে বাজি ধরা ইসলামে নাজায়েজ। এখন কি শ্লোক বলবে বলছিলে বল, উত্তর দিতে চেষ্টা করব।
গালিবার বান্ধবী সায়রা বলল, ছোট ভাবি ঠিক কথা বলেছে। আমি মায়ের মুখে কথাটা শুনেছি। তারপর বলল, আগে আমিই ছোট ভাবিকে একটা শ্লোক বলছি।
“এরা দু’বাপ বেটা ওরা দু’বাপ বেটা
তালতলা দিয়ে যায়,
একটা তাল পড়ে গেলে
সমান ভাগ পায়।”
নিলুফার হাসিমুখে বলল, তালতলা দিয়ে ছেলে, ছেলের বাপ ও ছেলের দাদাজী যাচ্ছিলেন। একটা পাকা তালে তিনটে আঁটি থাকে। তাই তারা প্রত্যেকে একটা করে আঁটি ভাগে পাবে।
হাফিজার চাচাত বোন রাজিয়া বলল, এই শ্লোক সবাই জানে। আমারটার উত্তর দাও
“রক্তে ডুবু ডুবু কাজলের ফোঁটা,
যে না বলতে পারে সে কালিদাসের পাঁঠা।”
নিলুফার বলল, কুঁচদানা।
নিহাল নামে একটা মেয়ে বলল, “সে কে? যাকে ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, এমন কি মামা-মামিও মামা বলে?
নিলুফার লল, চাঁদ মামা।
গালিবা বলল, তোরা আর কেউ বলবি না, এবার আমি বলছি, “যদি তার হাতে পায়ে ধরি, তবে কিছু কাটি”
নিলুফার বলল, যাতি।
গালিবা আবার বলল, এক বন্ধুর সঙ্গে অন্য বন্ধুর দেখা হতে বলল, শুনলাম তুমি মেলায় গিয়েছিলে, সেখান থেকে কি কিনে এনেছ?
বন্ধুটি বলল,
“কাসারির সারি ছাড়া পাঠার ছাড়া পা,
লবঙ্গের বঙ্গ ছাড়া কিনে এনেছি তা।”
নিলুফার বলল, কাঁঠাল
নিহাল বলল, আমরা খুব অবাক হচ্ছি, তুমি শহরের মেয়ে, পাড়াগাঁয়ের প্রচলিত শ্লোকের উত্তর দিতে পারছে কি করে?
নিলুফার বলল, আমি শহরের মেয়ে হলেও আম্মা ও দাদি আম্মা পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। ছেলেবেলায় তাদের কাছে এসব শ্লোক শুনেছি। তারপর বলল, এবার আমাকে চান্স দাও।
একটাতেও নতুন ভাবিকে ঠকাতে না পেরে গালিবা অপমান বোধ করে বলল, প্লীজ ছোট ভাবি, আর একটা, তারপর তোমাকে চান্স দেব।
“সেটা কি জিনিস, যে বানাল, সে ব্যবহার করল না, যে ব্যবহার করল, সে জানতে পারল না।”
এই শ্লোকটা শুনে নিলুফার মুখ নিচু করে রইল।
সবাই মনে করল, উত্তর দিতে না পেরে নতুন ভাবি লজ্জায় মুখ নিচু করে রয়েছে। রাজিয়া বলে উঠল, যাক একটাতে হলেও ছোট ভাবি হেরে গেল।
গালিবা ছোট ভাবির চিবুক ধরে মুখটা তোলার সময় বলল, এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? বলে দিচ্ছি। তারপর তার চোখে পানি দেখে আবার বলল, এত সামান্য ব্যাপারে কেঁদে ফেললে?
নিলুফার চোখ মুছে বলল, তোমরা যা ভাবছ তা নয়। তোমার শ্লোকটার উত্তর খাঁটিয়া। যাতে করে মৃত মানুষকে দাফন করার জন্য কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আর মৃত্যুর কথা মনে পড়লে চোখে পানি আসাই তো স্বাভাবিক।
তার কথা শুনে সবাই বিমর্ষমুখে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল।
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে গালিবা বলল, হ্যাঁ ছোট ভাবি, তোমার কথা ঠিক। মৃত্যুর কথা মনে পড়লে যাদের চোখে পানি আসে, তারাই প্রকৃত মুমিন। এমন আনন্দের রাতে এই শ্লোকটা বলা আমার ঠিক হয় নি। এবার তোমাকে চান্স দিলাম, বল। আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
নিলুফার বলল, “হাফ সার্কেল ফুল সার্কেল হাফ সার্কেল এ, হাফ সার্কেল ফুল সার্কেল রাইট এ্যাঙ্গেল এ।”
গালিবা ও তার সাথিরা পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। লেখাপড়া করলেও শ্লোকটার মানে বুঝতে পারল না। সবার থেকে গালিবা বুদ্ধিমতী। বলল, আমরা বাঙালি। বাংলা শ্লোক না বলে ইংরেজী শ্লোক বলছ কেন?
নিলুফার বলল, আমি শ্লোক ট্রোক তেমন জানি না। কয়েকটা প্রশ্ন করি তা হলে?
জামিলা বলে উঠল, প্লীজ ভাবি, ইংরেজী শ্লোকটার উত্তরটা আগে বলে দাও।
নিলুফার বলল, কোকোকোলা।
হাফিজা বলল, বুঝতে পারলাম না, বুঝিয়ে দাও।
তার কথা শেষ হতে গালিবা বলল, তুই একটু আগে আমাকে বোকা বললি না? এখন নিজেই বোকার পরিচয় দিচ্ছিস। আরে বোকা তুই ক্লাস টেনে পড়ছিস, আর হাফ সার্কেল, ফুল সার্কেল, রাইট এঙ্গেলের মানে জানিস না? ইংরেজী শব্দগুলো পরপর একটা কাগজে লিখে দেখিস, দেখবি Cocacola হবে। এখন চুপ থাক, ছোট ভাবিকে প্রশ্ন করতে দে।
নিলফার বলল, “কে মায়ের পেট থেকে পনের মতান্তরে আঠার পারার কুরআনের হাফেজ হয়ে জন্মেছিলেন?”
অন্যদের চুপ করে থাকতে দেখে গালিবা বলল, বড়পীর হযরত আব্দুল কাদীর জিলানী (রঃ)।
নিলুফার বলল, ঠিক বলেছ। এবার বল, “সেই এক কোনটি, যার কোনো দুই নেই?”
এবারও গালিবা বলল, “আল্লাহ”।
নিলুফার বুঝতে পারল, সবার থেকে গালিবা বেশি বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী। তাই তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি কিছু বলবে না, ওরা বলবে। বলতো, সেটা কি এমন জিনিস, যার দেহে গোস্ত নেই, রক্ত নেই, অথচ দৌড়ে যায়?
অন্যরা যখন উত্তর দিতে পারল না তখন নিলুফার গালিবাকে বলল, তুমি বল।
গালিবা বলল, জানি না, তুমি বলে দাও।
নিলুফার বলল, সেই জিনিসটা হল “হযরত মুসা (আঃ) এর লাঠি, যা মিসরের রাজা ফিরাউনের যাদুকরদের মোকাবেলায় আজদাহা (খুব বড় সাপ) হয়ে দৌড়েছিল। অথচ তার মধ্যে রক্ত বা গোস্ত ছিল না। এবার বল, সেই চারটে জিনিস কি কি, যার মূল এক অথচ তাদের আকৃতি, রঙ ও স্বাদ আলাদা।
এই প্রশ্নেরও কেউ উত্তর দিতে না পেরে সবাই চুপ করে রইল। গালিবা বলল, তুমি বলে দাও।
নিলুফার বলল, সেগুলো হল, চোখ, কান, নাক ও মুখ। এদের মূল হল মানুষ। মানুষের এই চারটি জিনিসের আকৃতি ভিন্ন। আর চোখের পানি নোনতা, নাকের পানি টক, মুখের লালা মিষ্টি ও কানের ভিতরে ভিজে মতো যা থাকে তা তেতো।
এমন সময় যয়নাব আব্দুল হান্নানকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে বলল, তোমরা এবার সবাই চলে যাও।
তার কথা শুনে গালিবা সবাইকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর যয়নাব বেরিয়ে এসে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।
আব্দুল হান্নান দরজা জানালায় ছিটকিনি দিয়ে খাটের কাছে এসে দাঁড়াল।
তাদের ঢুকতে দেখেই নিলুফার মুখের উপর ঘোমটা টেনে দিয়েছিল। এবার খাট থেকে নেমে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।
আব্দুল হান্নান বিবাহিত বন্ধুদের কাছে শুনেছিল, বাসর রাতে নতুন বৌ লজ্জায় কথা বলতে পারে না। ঘোমটা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। স্বামীকেই লজ্জা ভাঙ্গাতে হয়। তারপর কি করতে হয় না হয়, সেসব কথাও জেনেছিল। এখন তার উল্টো দেখে থতমত খেয়ে অল্পক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সালামের উত্তর দিয়ে ঘোমটা সরিয়ে মুখটা অঞ্জলী করে ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
ঘোমটা খুলতেই নিলুফার চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। অনেকক্ষণ স্বামী কিছু বলছে না দেখে চোখ খুলে দেখল,সে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লজ্জা পেয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নিল।
তাই দেখে আব্দুল হান্নান ফিস ফস করে বলল, এই, চোখ বন্ধ করে নিলে কেন? আমি তো তোমার মতো সুন্দর না। চোখ খুলে দেখে বল, আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা?
নিলুফা চোখ খুলে বলল, শুধু পছন্দ নয়, আপনার মতো সুন্দর ও সুপুরুষ আর দেখি নি।
আব্দুল হান্নানের গায়ের রঙ ঠিক কালো নয়, উজ্জ্বল শ্যামলা। তবু অনেকেই তাকে কালো বলে ডাকে। তাই নিলুফারের কথা শুনে বলল, আমার। মন রাখার জন্য তুমি এরকম বলছ। আসলে আমি তো কালোই।
পৃথিবীশুদ্ধ মানুষের কাছে আপনি কালো হলেও আমার কাছে সুন্দর ও সুপুরুষ। এখন ওসব কথা রেখে দু’রাকাত নফল নামায পড়ে দোয়া করি আসুন, “আল্লাহ যেন আমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ও শান্তির করেন এবং আমরা যেন তার ও তার পেয়ারা হাবিব (দঃ)-এর প্রদর্শিত পথে জীবন অতিবাহিত করে ঈমানের সঙ্গে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারি।” তারপর বলল, আপনার অযু আছে তো?
বাসর রাতে আল্লাহ-বিল্লাহ করার কথা শুনে আব্দুল হান্নান অসন্তুষ্ট হল। বৌকে জড়িয়ে ধরে আদর করার জন্য তার মন ছটফট করছিল। হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, না নেই।
নিলুফার স্বামীর মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, কি জানেন, মুসলমানদের যে-কোন কাজ শুরু করার আগে আল্লাহকে স্বরণ করতে হয়। আমরা আজ থেকে জীবনযাত্রার পথে পাড়ি দেব। সেই পথ যেন ন্যায়ের পথে থেকে নির্বিঘ্নে পাড়ি দিতে পারি, সেজন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বল আল-আমিনের নাম স্বরণ করে ও তাঁর কাছে দোয়া চেয়ে যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, আমার কথায় যদি আপনি অসন্তুষ্ট বা বিরক্ত হয়ে থাকেন, তা হলে মাফ চাইছি বলে বসে তার পায়ে হাত রাখল।
নিলুফারের কথা শুনে ও তার আচরনে আব্দুল হান্নান খুশী হল। আরে একি করছ বলে তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে বলল, একটু অপেক্ষা কর, অযু করে আসি। তারপর বেরিয়ে গেল।
ফিরে এলে নিলুফার জিজ্ঞেস করল, এখানে দু’টো নামাযের মসাল্লা আছে?
না একটা আছে। ঐ তো আলনায় দেখা যাচ্ছে।
নিলুফার মসাল্লাটা নিয়ে বিছিয়ে দিয়ে বলল, আপনি এখানে পড়ুন, আমি আপনার পিছনে মেঝেতেই পড়ছি।
পিছনে মেঝেতে পড়বে কেন? মসাল্লাতো বেশ চওড়া। আমার পাশে দাঁড়িয়ে পড়।
নারী-পুরুষ পাশাপাশি নামায পড়া শরীরতে নিষেধ।
শুনেছি, পর-পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েদের নামায পড়া নিষেধ। আমি তো তোমার স্বামী, তবু নিষেধ?
মনে হয়, আপনি কথাটা ঠিকমতো বুঝতে পারেন নি। পর-পুরুষতো দূরের কথা, যাদের সঙ্গে বিয়ে হারাম, তাদের পাশে দাঁড়িয়েও নামায পড়া নিষেধ এবং স্বামীর পাশেও নিষেধ। এটাই শরীয়তের হুকুম।
নামায ও দোয়া শেষ হওয়ার পর আব্দুল হান্নান আলমারী থেকে পাঁচশ টাকার পাঁচটা বান্ডিল এনে নিলুফারের হাতে দিয়ে বলল, তোমার মোহরানার টাকা গুনে নাও।
নিলুফার টাকা গোনার পর দু’লাখ টাকা তার হাতে দিয়ে বলল, এই টাকা দিয়ে আমার নামে ফসলি জমি কিনবেন এবং আপনি চাষ করবেন। ফসল অর্ধেক আমার আর অর্ধেক আপনার। আপাতত ফসলি জমি যতটা পাওয়া যায় কিনবেন। বাকি টাকা দিয়ে বিভিন্ন শষ্য কিনে রাখবেন। দাম যখন বাড়বে তখন বিক্রি করে যা লাভ হবে, সেটারও অর্ধেক আপনার আর আমার অর্ধেক। মোট কথা আমার ব্যবসার আপনি অর্ধেক পার্টনার। চাষাবাদ করতে প্রথমে যত টাকা লাগবে আমি আপনাকে হাওলাত দেব। ফসল উঠার পর বিক্রি করে আপনার লভ্যাংশ থেকে হাওলাত শোধ করে দেবেন। আব্বার কাছে শুনেছি, আপনি ওঁনার কাছে ব্যবসা করার জন্য টাকা চেয়েছিলেন, উনি দেননি বলে তার উপর আপনি অসন্তুষ্ট। এটা কিন্তু ঠিক নয়। তিনি অন্য ছেলেদের ব্যবসা করতে টাকা দিয়েছেন, অথচ আপনাকে কেন দেননি চিন্তা করেন নি কেন? যাই হোক, আমি সেসব জানতে চাই না। এখন আমি তো আপনাকে টাকা দিলাম, এবার ব্যবসা শুরু করুন, আব্বার উপর রাগ মনে কষ্ট রাখবেন না। মনে রাখবেন প্রত্যেক মা-বাবা ছেলেমেয়ের সুখ দেখতে চান। ব্যবসা শুরু করার আগে আব্বা-আম্মাকে সালাম করে তাদের দোয়া চেয়ে নেবেন।
বাসর রাতে স্ত্রীর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে আব্দুল হান্নান অবাক হয়ে হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তাই দেখে নিলুফার মৃদু হেসে বলল, অমন করে কী দেখছেন?
দেখছি তোমার রূপ, আর ভাবছি, আল্লাহ তোমাকে যেমন রূপবতী করেছেন, তেমনি বুদ্ধিমতীও করেছেন। আচ্ছা, এসব কথা তোমাকে কি কেউ শিখিয়ে দিয়েছে?
কোনো মানুষ শেখায় নি, শিখিয়েছেন মহান রাব্বল আল-আমিন।
আমি তো জানি, আল্লাহ তাঁর প্রেরিত নবী-রাসুল (দঃ)দেরকে সবকিছু শিক্ষা দেন। অন্য কোনো মানুষকে নয়।
আপনি ঠিকই জেনেছেন? কিন্তু এটা বোধ হয় জানেন না, আল্লাহ সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআনকে বিশ্বাস করে যে মনোযোগ সহকারে পড়বে, সে সবকিছু জ্ঞানলাভ করতে পারবে। এবার এসব কথা থাক, আজকের এই শুভরাত মানুষের জীবনে একবারই আসে। এসব কথা বলার অনেক সময় পাব। অযথা শুভরাতটা নষ্ট করতে চাই না।
ঠিক আছে, এবার তা হলে আমি একটা কথা বলে ইতি টানব।
বলুন।
তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন?
কারণ স্ত্রীর কাছে আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর পরেই স্বামীর স্থান। এমন কি মা-বাবা ও শ্বশুর-শাশুড়ীর থেকে মেয়েদের কাছে স্বামীর স্থান উপরে। একমাত্র শরীয়তের পরিপন্থি কোনো হুকুম ছাড়া স্বামী যা বলবে সব মেনে চলতে হবে। এমন কি স্বামী যদি স্ত্রীকে দু’হাতে বেঁধে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকতে হুকুম করে, তা হলে তাই করতে হবে।
আব্দুল হান্নান মৃদু হেসে বলল, তাই যদি হয়, তা হলে আমি হুকুম করছি আমাকে আপনি করে না বলে তুমি করে বল।
নিলুফার প্রতিবাদ করতে না পেরে মাথা নিচু করে রইল।
কই কিছু বললে না যে? এটা তো শরীয়তের পরিপস্থি নয়? তবু যখন নিলুফার কিছু বলল না তখন তাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল,
আমাকে তুমি করে না বললে আমিও তোমাকে আপনি করে বলব।
নিলুফার লজ্জা পেলেও বলল, ঠিক আছে, তোমার হুকুম মেনে নিলাম।
জাষ্ট লাইক এ গুড গার্ল বলে আব্দুল হান্নান তাকে জড়িয়ে ধরে আদর সোহাগে ভরিয়ে তুলল।
নিলুফার প্রথম দিকে লজ্জায় চুপ করে থাকলেও অল্পক্ষণ পরে সেও প্রতিদানে মেতে উঠল।
বাসর রাতে কোনো দম্পতিই ঘুমায় না। তারাও ঘুমাল না। সারারাত প্রেমলীলা করে কাটাল।
ফজরের আজান হতে শুনে আব্দুল হান্নান বলল, বাসর রাত খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, এতদিন শুনেই এসেছি, আজ প্রত্যক্ষ করলাম।
নিলুফার হেসে ফেলে বলল, কথাটা ঠিক নয়। এই রাতে সবাই এতই আনন্দে মেতে থাকে যে, সময়ের জ্ঞান থাকে না। তাই সবাই ঐ কথা বলে। আসলে কিন্তু এই রাতটাও অন্য রাতেরই মতো। তারপর বলল, রাত যখন শেষ তখন আর কি করা পরবর্তি কাজগুলো করে ফেলা উচিত।
আব্দুল হান্নান দুষ্টুমী করে বলল, পরবর্তি কাজগুলো আবার কি?
নিলুফার তার দুষ্টুমী বুঝতে পেরে বলল, অত ন্যাকামী করে লাভ নেই। কেউ জেগে ওঠার আগে গোসল করতে হবে। তারপর নামায পড়তে হবে।
আব্দুল হান্নান বলল, গোসলখানায় টিউবওয়েল আছে। সেখানে করবে, না খিড়কী পুকুরে করবে?
টিউবওয়েল চাপ দিলে সবাই শব্দ শুনতে পাবে, খিড়কী পুকুরেই চল। ওখানে ঘাট আছে তো?
হ্যাঁ, সান বাধান ঘাট আছে। কিন্তু তুমি তো শহরের মেয়ে, পুকুরে নেমে গোসল করতে পারবে? তা ছাড়া পুকুরের পানি যদি তোমার সহ্য না হয়? তখন তো আবার অসুখ বাধিয়ে বসবে।
আমি পুকুরে নামব না। ঘাটে বসে মগ ডুবিয়ে গোসল করব। এখানে যখন আজীবন থাকতে হবে তখন তো পুকুরের পানি শরীরে সইয়ে নিতে হবে। পুকুর ঘাটে যাওয়ার সময় তুমি গোসলখানা থেকে মগ নিয়ে নেবে। চল, আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না, সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়বে। তখন লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারব না।
আব্দুল হান্নান বলল, সে চিন্তা নেই। ভাইয়া ও ভাবিরা সূর্য উঠার আগে ঘুম থেকে জাগে না। শুধু আব্বা আজানের পরপর মসজিদে চলে যান। সেখানে অযুর ব্যবস্থা আছে। এতক্ষণ তিনি হয়তো চলে গেছেন।
নিলুফার আব্বার মুখে এদের সকলের সবকিছু শুনেছে। তবু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, তারা নামায পড়েন না?
গালিবা ও আব্বা ছাড়া এ বাড়ির কেউ-ই পড়ে না। তারপর মগ নিয়ে এসে বলল, চল।
যেতে যেতে নিলুফার বলল, আম্মাও নামায পড়েন না?
আব্বার তাগিদে মাঝে মধ্যে পড়লেও ফজরের নামায কোনোদিন পড়ে না। জোহরের সময় কাযা পড়ে নেয়।
তুমিও তা হলে নামায পড় না?
স্কুল লাইফে পড়তাম, কলেজে ঢোকার পর আর পড়ি নি।
নিলুফার আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
পুকুর ঘাটে এসে নিলুফারের মনটা জুড়িয়ে গেল। অন্ধকার থাকলেও ভোরের আবছা আলোতে দেখতে পেল, পুকুরটা বেশ বড়। সানবাধান ঘাট। চারপাশের পাড়ে নানারকম গাছপালা। ঘাটের ধাপে বসে মগ ডুবিয়ে গোসল করার সময় বলল, পরে পুকুরে নেমে গোসল করব, সাঁতারও কাটব।
আব্দুল হান্নান বলল, তুমি সাঁতার জান?
জানি, ছোটবেলায় নানাবাড়িতে সাঁতার শিখেছি।
তা হলে পরে কেন? এখনই নেমে এস দু’জনে একসঙ্গে সাঁতার কাটি।
না বাবা না, এখন ভয় করছে। আস্তে আস্তে যখন ভয় কেটে যাবে তখন। দেখা যাবে।
গোসল করে ঘরে এসে নিলুফার বলল, তুমি কি জান, ইসলাম নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দিয়েছে?
জানাতো দূরের কথা, এমন কথা কখনও শুনি নি। নারী পুরুষের সমান অধিকার যদি ইসলামে থাকত, তা হলে মৌলবীরা তাদের মেয়েদের ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখতেন না।
এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে পরে আলাপ করব। এখন একটা অনুরোধ করব, বল রাখবে?
মাদ্রাসা পড়ুয়া নিলুফারকে সেকেলে ও জবুথুবু ভেবে আব্দুল হান্নান প্রথমে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। মায়ের কাছে তার রূপ গুণের কথা শুনে বলেছিল, মেয়ে দেখে মতামত জানাবে। তারপর তাকে দেখতে গিয়ে যখন তার সঙ্গে আলাপ করল তখন মুগ্ধ না হয়ে পারেনি। সেদিন যতটা না মুগ্ধ হয়েছিল, আজ বাসর রাতে তার কথাবার্তায় ও আচার-আচরণে আরো মুগ্ধ হয়েছে। এখন তার অনুরোধের কথা শুনে বলল, বলেই দেখ না রাখি কিনা।
ও কথা বললে হবে না, ওয়াদা কর রাখবে?
ঠিক আছে ওয়াদা করলাম।
আজ থেকে নিয়মিত ওয়াক্তিয়া নামায পড়বে।
মৃদু হেসে আব্দুল হান্নান বলল, যদি না পড়ি?
মনে খুব কষ্ট পাব। তা ছাড়া ওয়াদা ভঙ্গ করার জন্য তোমার গোনাহ হবে। তোমাকে গোনাহগার করার জন্য আমি পরোক্ষভাবে দায়ী হব, সেজন্যও মনে খুব ব্যথা পাব।
এতে তোমার মনে কষ্ট পাওয়ার কি আছে? ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। যার ইচ্ছা হয় মানবে, ইচ্ছা না হলে মানবে না। তা ছাড়া শুনেছি, ধর্মের কাজে জোর-জবরদস্তি নেই।
আমি তো জোর-জবরদস্তি করি নি, অনুরোধ করছি। আর ধর্মে জোর জবরদস্তি না থাকলেও প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ধর্মের বিধি-নিষেধ মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। নচেৎ প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে না। তা ছাড়া ধর্মের বিধি-নিষেধ না মেনে চললে, একদিকে যেমন আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন এবং তাদের উপর নানান ধরণের বিপদ-আপদে পাঠিয়ে জীবন অশান্তি ও দুর্বিসহ করে দেবেন, অপরদিকে তেমনি পরকালে অনন্তকাল অগ্নিকুন্ডে জ্বালাবেন। বর্তমানে আল্লাহর বিধি-নিষেধ মুসলমানরা মেনে চলছে না বলে মন থেকে শান্তি চলে গেছে, আর সারা দুনিয়ার কাছে চরমভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে, উৎপীড়িত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। তুমিও নিশ্চয় ইংলিশ প্রবাদ বাক্যটা জান, “ডু ইউর ডিউটি।” মুসলমানরা ধর্মের ডিউটি পালন না করে বর্তমানে মানব সমাজে নিকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ আগের যুগের মুসলমানরা সেই। ডিউটি পালন করে বিশ্বের মুখ ও অসভ্য বর্বর মানবজাতিকে শিক্ষা ও সভ্যতার পথ দেখিয়ে দিয়ে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন। জ্ঞানীরাই জ্ঞানীদের সম্মান করেন। আল্লাহপাক মহাজ্ঞানী। কোনো জ্ঞানী লোকই মহাজ্ঞানীকে অসম্মান করতে পারেন না। তারা জ্ঞানীদের কথা নিশ্চয় মেনে চলেন। মানুষ শিক্ষা লাভ করে জ্ঞানবান হয়। তুমিও শিক্ষালাভ করে জ্ঞানী হয়েছ। তোমার কি উচিত নয় মহাজ্ঞানী আল্লাহর হুকুম মেনে চলা? আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “হে আদম সন্তানগণ, আমি কি তোমাদিগকে বিশেষ ভাবে বলিয়া দিই না যে, তোমরা শয়তানের উপাসনা করিও না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু এবং যেন তোমরা আমারই ইবাদত কর, ইহাই সরল সুপথ এবং নিশ্চয়ই সে তোমাদের মধ্যে হইতে বহু সৃষ্টিকে গুমরাহ করিয়াছে, তবু কি তোমরা বুঝিবে না।” [সূরা-ইয়াসন, আয়াত-৬১/৬২, পারা-২৩]
মানুষ সব সময় শক্তিশালীর কাছে মাথা নত করে, তার সব কথা মেনে চলে। আল্লাহ মহাশক্তিশালী ও সারা বিশ্বব্রহ্মাভের একমাত্র মালিক। আর শয়তান তার লক্ষ লক্ষ বছরের ইবাদতের বদলে আল্লাহর কাছ থেকে কিছু শক্তি চেয়ে নিয়েছে। সে সবের মধ্যে একটি হল, মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দিয়ে মন্দ কাজ করিয়ে জাহান্নামের পথে চালিত করা। আল্লাহ মানুষকে বিবেক অর্থাৎ ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন। সেই বিবেকবান মানুষের কি উচিত, মহাশক্তিশালী আল্লাহর হুকুম না মেনে শয়তানের হুকুম মানা?
আল্লাহপাক আরো বলিয়াছেন, “তোমরা শয়তানের পথ অনুসরণ না করে আমার ও আমার রাসূল (দঃ)-এর পথে চল। তা হলে ইহকালে ও পরকালে সুখ-শান্তিতে থাকতে পারবে।” আল্লাহ কুরআনপাকে অনেক জায়গায় বলিয়াছেন, “জ্ঞানিরাই আমাকে মানে ও ভয় করে।” এখন তুমিই বল, এসব কথা জানার পর কোনো জ্ঞানী মানুষ, বিশেষ করে কোনো মুসলমান কি আল্লাহর বিধি-নিষেধ অমান্য করতে পারে? হাদিসে আছে, “নামায পরিত্যাগ করাকে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কুফরী কাজ বলে মনে করতেন।” [হযরত মাওলানা থানবী (রঃ)কৃত ইসলাহুর রুসুম কেতাবের বাংলা অনুবাদের ৮২ পৃষ্ঠা]
স্ত্রীর কথা শুনতে শুনতে আব্দুল হান্নান বুঝতে পারল, শয়তান তাকে এতদিন ধর্মের পথ থেকে ফিরিয়ে রেখেছে। সে থেমে যেতে বলল, না, কোনো মানুষেরই বিশেষ করে কোনো মুসলমানের আল্লাহর বিধি-নিষেধ অমান্য করা উচিত নয়।
নিলুফার আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি দুই রাকায়াত সুন্নত নামায পড়ে মসজিদে গিয়ে ফরয নামায জামাতের সঙ্গে পড়ে এস।
আব্দুল হান্নানকে বাসর রাতে ফজরের নামায মসজিদে পড়তে দেখে ইলিয়াস মির্জা চোখের পানি ফেলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর মনে মনে দোয়া করলেন, “যে উদ্দেশ্যে মা নিলুফারকে পুত্রবধূ করে এনেছেন, তা যেন আল্লাহ পূরণ করেন।”
ছোট ভাইয়াকে টুপি মাথায় দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে গালিবাও খুব খুশী হল। ভাবল, ছোট ভাবি নিশ্চয় তাকে নামায পড়তে পাঠিয়েছে। কথাটা ভেবে ছোট ভাবির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বেড়ে গেল।
.
০৩.
এখানকার সমাজের রীতি হল, বিয়ের দিন বৌ নিয়ে ফেরার সময় বরের বাবা কনের বাবাকে ওলিমায় দাওয়াত দেবেন। সঙ্গে কতজন যাবে তাও বলে দেবেন। বিয়ের পরের দিন কনেপক্ষের বেশ কিছু লোক অবস্থা বুঝে পাঁচ, দশ বা বিশ কেজি মিষ্টি ও মেয়ে জামাই গোসল করে পরার জন্য নতুন জামা-কাপড় নিয়ে আসেন। মিষ্টিটা পাড়ায় বিতরণ করা হয়। এটাকে চৌথী বলে।
বিয়ের দিনে ইলিয়াস মির্জা বিয়াইকে ওলিমায় দাওয়াত দিয়ে চৌথির কথা বলেছিলেন। নিয়াজ আহম্মদ ওলিমায় দাওয়াতের ব্যাপারে কিছু না বললেও চৌথী প্রথার ব্যাপারে বলেছিলেন, এসব সমাজের কুপ্রথা। এটাকে সাধারণ মানুষ বিয়ের অংশ হিসাবে মনে করবে। তাই এই কুপ্রথা সমাজ থেকে বিদায় করার ব্যবস্থা আমাদের করা উচিত। তবে আপনারা যে কয়েকজনকে ওলিমায় দাওয়াত দেবেন, আমরা সেই কয়েকজন ইনশাআল্লাহ যাব।
.
আজ ওলিমা। সকালে নাস্তা খাওয়ার পর গালিবা নিলুফারকে বলল, জান ছোট ভাবি, আমাদের এলাকায় ওলিমার দিন একটা কুপ্রথার প্রচলন আছে। সেটা হল, আত্মিয়-কুটুম ও পাড়ার ময়-মুরুব্বীরা টাকা দিয়ে নতুন বৌ-এর মুখ দেখবে।
নিলুফার বলল, তারা সবাই যদি মেয়ে হন; তা হলে কোনো বাধা নেই। তবে টাকার ব্যাপারটা ঠিক নয়। গরিব ঘরের মেয়েরা তা হলে নতুন বৌ-এর মুখ দেখবে কি করে? আর মুহাররম পুরুষ ছাড়া অন্য যে কেউ হোক না কেন, মেয়েদের মুখ দেখা শরীয়তে নিষেধ। যে দেখবে ও যারা দেখাবার ব্যবস্থা করবে, সবাই কঠিন গুনাহগার হবে। আমি এই কুপ্রথা নিজেও মানব না, আর কাউকে মানতেও দেব না।
কিন্তু তোমার চাচাশ্বশুর, মামাশ্বশুর, খালুশ্বশুর, ফুফাশ্বশুর, ভাসুর ও নন্দাইরা যখন দেখতে আসবে তখন কি করবে?
কি আবার করবো? কাউকেই মুখ দেখাব না। প্রয়োজনে কুরআন-হাদিসের নিষেধের কথা শোনাব।
কাল তুমি পাল্কী থেকে নেমে হেঁটে এসেছ বলে আব্বা ও আমি ছাড়া বড়ির সবাই তোমার উপর চটে গিয়ে অনেক খারাপ মন্তব্য করেছে। আজ আবার যদি মুখ দেখতে না দাও, তা হলে কি যে ঘটবে আল্লাহকে মালুম।
যাই ঘটুক না কেন, তবু আমি এই বেশরীয়তী কুপ্রথার প্রতিবাদ করবই। এবং সমাজ থেকে এই কুপ্রথা দূর করার চেষ্টা করবই।
বড় তিন ভাইয়ের বিয়ের সময় আমি ছোট ছিলাম, আর এটা যে শরীয়তের নিষেধ তা জানতাম না। বড় হয়ে শরীয়তের বিধি-নিষেধ জেনেছি। তাই ছোট ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে এ প্রথার বিরুদ্ধে বাড়ির সবাইকে বলেছি; কিন্তু একমাত্র আব্বা ছাড়া কেউ আমার কথায় কান দেয় নি। এখন তোমার কথা শুনে খুব খুশী হয়েছি। এ ব্যাপারে যতটা সম্ভব তোমাকে সাহায্য করব।
নিলুফার আলহামদুলিল্লাহ বলে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, খাতা কলম দাও। যখন সবাই মুখ দেখতে আসবে তখন তাদের কি বলব লিখে রাখি।
গালিবা খাতা কলম নিয়ে এলে নিলুফার তাকে বলল, তুমি গিয়ে আব্বাকে বল, ওলিমায় যেন গ্রামের গরিবদেরও দাওয়াত দেন।
সে চলে যাওয়ার পর নিলুফার লিখতে শুরু করল।
“শ্রদ্ধেয় ময়-মুরুব্বী ও অন্যান্য আত্মীয়বর্গ, প্রথমে আপনাদের পবিত্র কদমে সালাম জানাচ্ছি। পরে জানাই যে, এই এলাকায় ওলিমার দিন নতুন বৌ এর মুখ দেখানোর যে প্রথার প্রচলন আছে, তা শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয অর্থাৎ শক্ত গুনাহ। আল্লাহ কুরআন পাকে যে চৌদ্দজনের সঙ্গে বিয়ে হারাম করেছেন, তারা ছাড়া কোনো পুরুষই কোনো মেয়েকে দেখা ইসলামে নিষেধ। এটা বিজাতীয় সমাজ থেকে এসেছে। তাই আপনাদের কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, এই নাজায়েয প্রথা বন্ধ করে দিন। রাসুলুল্লাহ (দঃ) এরশাদ করিয়াছেন, “তিন ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার বিরাগভাজন হবে, যে ইসলাম গ্রহণ করার পরও জাহিলিয়াতের কুপ্রথাসমূহ পালন করতে আগ্রহী, সে ঐ তিন ব্যক্তির অন্তর্ভূক্ত।” [হযরত মওলানা থানবী (রঃ) ইসলাহুর রুসুম কিতাবের বঙ্গানুবাদ; পৃষ্ঠা-৮২] অবশ্য মেয়েরা নতুন বৌ-এর মুখ দেখতে পারেন। তবে টাকা বা অন্য কোনো উপহার দিয়ে নয়, এমনিই দেখবেন। তা না হলে যারা গরিব, যাদের হাতে টাকা নেই, তারা কি নতুন বৌ-এর মুখ দেখতে পাবেন না?
এবার মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলছি, ওলিমার দিনই নতুন বৌ-এর মুখ দেখতে হবে, এটাও ঠিক নয়। বৌ-এরা তো মা-বাপের বাড়ি ছেড়ে আজীবন স্বামীর বাড়িতে থাকে। আমিও থাকব। পরে সময় সুযোগ মতো আপনারা আমাকে দেখে যেতে পারবেন। এখন ভীড়ের মধ্যে আপনারা বেপর্দা হচ্ছেন। তা ছাড়া আমাকে শুধু দেখবেন, আলাপ করার সুযোগ পাবেন না। তাই বলছি, পরে সময় সুযোগ মতো এলে আলাপ হবে এবং আমরা একে অপরের সম্পর্কেও জানতে পারবো।
আপনারা আমাকে ভালোমন্দ যা কিছু ভাবতে পারেন। তবু অনুরোধ করব, সমাজের এই নতুন বৌ-এর মুখ দেখার কুপ্রথা বন্ধ করুন। আশা করি, আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন না। আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার ও নাজায়েয যে কোন কাজ থেকে বাঁচার তওফিক দান করুন। আমার আর কিছু বলার নেই। আসোলামুআলায়কুম।”
লেখা শেষ করে কাগজটা ভাঁজ করে রাখল। তারপর গালিবা এলে তার হাতে দিয়ে বলল, পড়তে পার কিনা দেখ।
গালিবা কাগজটা খুলে বলল, এত সুন্দর লেখা আবার পড়তে পারব না? তারপর পড়া শেষ করে বলল, খুব সুন্দর হয়েছে। প্রত্যেক নতুন বৌ-এরা যদি তোমার মতো সব ধরনের নাজায়েয প্রথার বিরদ্ধে প্রতিবাদ করে, তা হলে অচিরেই সমাজ থেকে সমস্ত কুপ্রথা দূর হয়ে যাবে।
নিলুফার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক। তবে সেজন্য প্রত্যেক মেয়েকে যেমন ইসলামের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে, তেমনি ছেলেদেরকেও করতে হবে। আজকালতো বেশিরভাগ মা-বাবা ছেলেমেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকে এমন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাচ্ছেন, যেখানে ইসলামের মৌলিক জ্ঞানের শিক্ষাতো দেওয়াই হয়নি, এমন কি শিক্ষক-শিক্ষিকাগণেরও সেই জ্ঞান নেই। আর বড় হয়ে স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটিতে লেখাপড়া করে। সেসব জায়গাতেও ঐ একই অবস্থা।
গালিবা বলল, কিন্তু ঐসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া শতশত মাদ্রাসায় ছাত্র ছাত্রীরা তো ঐ সব জ্ঞান লাভ করছে, তারা কেন সমাজের কুসংস্কারগুলো দূর করার চেষ্টা করছে না?
নিলুফার বলল, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা শুধূ ডিগ্রী নেওয়ার জন্য লেখাপড়া করছে। তারা যদি অর্জিত জ্ঞানের প্রতিফলন নিজের বাস্তব জীবনে ঘটাত, তা হলে সমাজে এত অবক্ষয় হত না। আর এত কুসংস্কারও প্রবেশ করতে পারত না। নিজের বাস্তব জীবনে জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটানোর সৎসাহসও অনেকের নেই। এ ব্যাপারে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।
এমন সময় ছোট ভাইয়াকে আসতে দেখে গালিবা সেখান থেকে চলে গেল।
নিলুফার বসে ছিল। স্বামী ঘরে ঢুকতে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুল হান্নান বলল, সকালে তো একবার সালাম দিলে, এখন আবার দিলে যে?
নিলুফার তার হাত ধরে খাটে বসিয়ে নিজেও পাশে বসল। তারপর বলল, সালামের অর্থ, কেন দিতে হয় এবং কখন কে কাকে সালাম দেবে তা কি জান?
অতসব না জানলেও এতটুকু জানি, দুজন মুসলমানের সঙ্গে দেখা হলে সালাম বিনিময় করতে হয়।
হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক। এটা ইসলামের একটা সুন্নত এবং সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজিব। এবার আমি সালামের অর্থ বলছি, “আপনার বা আপনাদের উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক।” সালামের উত্তরের অর্থও তাই। সালাম কেন দিতে হয় বলছি, “এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। তাই দেখা হলে সালাম বিনিময় করতে আমাদের নবী (দঃ) বলেছেন এবং তিনি নিজের জীবনেও করেছেন। হাদিসে আছে, নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “যখন তোমাদের পরস্পর সাক্ষাৎ হয় তখন তোমাদের মধ্যে সালামের আদায়-প্রদান হওয়া বাঞ্ছনীয়। যদি কোনো বৃক্ষ, প্রাচীর বা প্রস্তর উভয়ের মধ্যে প্রতিবন্ধক থাকে তবু সালাম দেওয়া বাঞ্ছনীয়। [বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়া (রাঃ)-আবু দাউদ] হাদিসে আরো আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “তোমরা যখন গৃহে প্রবেশ কর তখন গৃহের অধিবাসীগণকে সালাম করিও। (আবার) যখন বাহির হইয়া আস, (তখনও) গৃহের অধিবাসীগণকে সালাম করিয়া গৃহ ত্যাগ করিও। [বর্ণনায় : হযরত কাতাদাহ (রাঃ)-বাইহাকী]
আব্দুল হান্নান মৃদু হেসে বলল, তা হলে তো আমারই সালাম দেওয়া উচিত ছিল? তুমি দিলে কেন?
নিলুফারও মৃদু হেসে বলল, এর পিছনে তিনটি কারণ আছে। প্রথমটা হল, যে আগে সালাম দেয়, সে উত্তরদাতার চেয়ে বেশি সওয়াব পায়। দ্বিতীয় কারণ হল, হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “প্রথম যে ব্যক্তি সালাম দেয় মানুষের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই উত্তম। [বর্ণনায় হযরত আবু ওমামাহ (রাঃ)- তিরমিযী, আবু দাউদ] তৃতীয় কারণ তোমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
এবার কে কাকে সালাম দিবে বলছি। ছোটরা বড়দের সালাম দিবে। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “আরোহী পথিককে, পথিক উপবিষ্টকে এবং ছোট দল বড় দলকে প্রথমে সালাম দিবে। [বর্ণনায় হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)- বুখারী মুসলিম]
ছোটরা বড়দের সালাম দেওয়ার নিয়ম থাকলেও বড়রা ছোটদের সালাম দেবে না, এটা ভাবা ঠিক নয়। কারণ বড়রা যদি অহঙ্কারবশত ছোটদের সালাম দিতে না চায়, তা হলে গুনাহগার হবে। হাদিসে আছে রাসুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে প্রথমে সালাম দেয়, সে অহঙ্কারমুক্ত। [বর্ণনায়: হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-বাহহাকী]
এবার এসব কথা থাক, যা বলছি শোন, তারপর নতুন বৌ-এর মুখ দেখানোর ব্যাপারে লেখা কাগজটা তার হাতে দিল।
কাগজটা পড়ে আব্দুল হান্নান বলল, কালকের ঘটনায় তোমার উপর সবাই অসন্তুষ্ট। আজ আরো অসন্তুষ্ট হবে। এটা করা কি তোমার ঠিক হবে?
হবে। কারণ নাজায়েয কাজের প্রতিবাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। না করলে বরং গুনাহ হবে। তুমিও কি চাও, তোমার স্ত্রীর মুখ সবাই দেখুক?
না চাই না। সামাজিক রীতি, তাই বলছিলাম আর কি? তা তুমি নিজে এটা পড়ে শোনাবে?
না। গালিবাকে বলেছি, সে পড়ে শোনাবে। এ ব্যাপারে বাড়ির সবাই আমাকে যা কিছু মন্দ বলুক না কেন, আমি কিছু মনে করবো না। শুধু তুমি। আমাকে ভুল বুঝো না।
.
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজন ও মুরুব্বী মেয়ে-পুরুষেরা যখন নতুন বৌ-এর মুখ দেখার জন্য ঘরের বারান্দায় এল তখন গালিবা দরজার কাছে এসে বলল, আপনারা যে উদ্দেশ্যে এসেছেন, সে ব্যাপারে নতুন ভাবি কিছু কথা এই কাগজে লিখে আমাকে পড়ে শোনাতে বলেছে। তারপর কাগজটা খুলে পড়ে শোনাল।
পড়া শেষ হতে কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। সেখানে গালিবার মা জাহেদা বেগমও ছিলেন। প্রথমে তিনি রাগের সঙ্গে বলে উঠলেন, এরকম কথা বাপ দাদা চৌদ্দপুরুষেও শুনিনি। মুরুব্বীলোকেরা বাপ-দাদার মতো। তারা নতুন বৌ-এর মুখ দেখলে দোষ কোথায় বুঝতে পারছি না। আর দেবর, নন্দাই ও ভাসুররা ঘরের লোক। তারা দেখলেই বা দোষ কিসের?
জাহেদা বেগমের চাচাত ভাবি আফরোজা বিবি বললেন, ও জাহেদা, এরকম বৌ নিয়ে ঘর-সংসার করবি কি করে? ঘর সংসারের কাজ-কাম করতে হলে বৌকে তো সবাই দেখবে। তা হলে কি বৌ সারাদিন ঘরে বসে ইবাদত করবে, আর তুই খেটে মরবি? আমিও দুটো বৌ করেছি, তোর নিজের আরও তিনটে বৌ আছে; কই, তারা তো কেউ সমাজের রীতি-নীতি নিয়ে কিছু বলে নি।
মুরুব্বীদের মধ্যে যারা কিছু কিছু ধর্মের জ্ঞান রাখেন, তারা কিছু না বলে চলে গেলেন। মুরুব্বী মেয়েরাও অনেকে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় তাদের একজন বলে গেলেন, আজ নতুন বৌ কাউকে মুখ দেখল না, কিন্তু কিছুদিন পর সবাই তার পোঁদ দেখতে পাবে।
তার কথায় সায় দিয়ে অন্যান্য মেয়েরাও চলে গেল।
সবাইকে চলে যেতে দেখে জাহেদা বেগম খুব রেগে গিয়ে নতুন বৌকে উদ্দেশ্য করে বড় গলায় বললেন, তুমি মির্জা বাড়ির ইজ্জত ধূলোয় মিশিয়ে দিলে। তোমার বাপের কাছে এর বিচার চাইব।
স্ত্রীর বড় গলা শুনে ইলিয়াস মির্জা এসে তাকে বললেন, কি হয়েছে? এত চেঁচাচ্ছ কেন? চারদিকে লোকজন রয়েছে না?
স্বামীকে দেখে ও তার কথা শুনে জাহেদা বেগমের মেজাজে আগুনে ঘি ঢালার মতো হল। আরো বড় গলায় বললেন, খুব আউস করে তো বন্ধুর
মাদ্রাসা পড়ুয়া মেয়েকে বৌ করে এনেছ; সে যে মির্জা বাড়ির ইজ্জৎ বারবার। ধূলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে তা লক্ষ্য করেছ? তুমি এর বিহিত কর, নচেৎ আমিই ওর বাপের কাছে মেয়ের গুণের কথা জানিয়ে বিহিত করতে বলব।
ইলিয়াস মির্জা স্ত্রীর বদমেজাজের কথা ভালোভাবেই জানেন। তাই তার কথা শুনে রেগে গেলেও সংযত কণ্ঠে বললেন, আস্তে কথা বল, নতুন বৌ কি করেছে বলবে তো?
মা কিছু বলার আগে গালিবা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে কাগজটা আব্বার হাতে দিয়ে বলল, নতুন ভাবি মুখ দেখানোর ব্যাপারে এটা লিখে আমাকে দিয়ে পড়িয়ে সবাইকে শুনিয়েছে।
ইলিয়াস মির্জা পড়ে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ছোট বৌমাতো কুরআন হাদিসের কথা সবাইকে জানিয়েছে। এতে তার কি দোষ হল? আর মির্জা বাড়ির ইজ্জতই বা ধূলোয় মিশাল কি করে? বরং ইজ্জত আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মনে হয়, ব্যাপারটা তুমি ঠিক বুঝতে পার নি, তাই রেগে গিয়ে এরকম কথা বলছ। তারপর তখনও যেসব পুরুষ সেখানে ছিল, তাদেরকে চলে যেতে বললেন। তারা চলে যাওয়ার পর মেয়েদেরকে বললেন, আপনারা একজন একজন করে নতুন বৌ-এর মুখ দেখে যান। কোন টাকাপয়সা দেওয়া লাগবে না।
স্বামীর কথায় জাহেদা বেগম সবার সামনে খুব অপমান বোধ করলেন। রাগে ও দুঃখে তার চোখে পানি চলে এল। মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে গেলেন।
জাহেদা বেগম সেই যে রাগ করে রুমে এসে শুয়ে রইলেন, পরের দিন ছেলে-বৌ ফিরনীতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত উঠলেন না। খাওয়া-দাওয়াতো করলেনই না, এমনকি নামাযও পড়লেন না।
বড় তিন বৌ ও তিন মেয়ে বাড়ির ও আব্দুল হান্নানের শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করল।
ফিরনীতে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে আব্দুল হান্নান স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মাকে সালাম করতে গেল। জাহেদা বেগম ঘুমের ভান করে শুয়েছিলেন। আব্দুল হান্নান মা- মা বলে কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে স্ত্রীকেও করতে বলল।
নিলুফার শাশুড়ির দুপা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমি যা কিছু করেছি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ)-এর বিধানমতো করেছি। তবু মাফ চাইছি, আমাকে মাফ করে দিন আম্মা।
জাহেদা বেগম একইভাবে শুয়ে রইলেন, কোনো কথা বললেন না।
গালিবা তাদের সঙ্গে এসেছিল। অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে ছোট ভাইয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, আম্মা ছোট ভাবির উপর খুব রেগে আছে। তোমরা এখন যাও, বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। আমার বিশ্বাস, পরে ছোট ভাবি যখন আসবে তখন সে আম্মাকে ম্যানেজ করতে পারবে।
.
শ্বশুর বাড়িতে এক সপ্তাহ থেকে আব্দুল হান্নান ফিরে আসার পর একদিন আব্বাকে নিলুফার মোহরানার দুলাখ টাকা দিয়ে ব্যবসার করার জন্য যা কিছু বলেছিল বলল।
ইলিয়াস মির্জা ছোট বৌমার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। বললেন, বৌমা খুব ভালো কথা বলেছে। তা তুমি তাকে কি বলেছ?
হ্যাঁ না কিছু বলিনি।
তোমার কি ইচ্ছা?
ঐ টাকায় ওর নামে জমি কিনে দেব। জমি আমরা বা অন্যের দ্বারা চাষ হবে। ফসল অর্ধেক সে পাবে। ফসল বিক্রির টাকা তার যা ইচ্ছা তাই করবে। আপনি আমাকে টাকা দেবেন ব্যবসা করার জন্য।
হ্যাঁ, তোমার যুক্তিও ভালো। তবে আমার ইচ্ছা, আমিও তোমাকে দুলাখ টাকা দেব। এই দুলাখ ও বৌমার দুলাখ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করো। তবে, তার আগে বৌমার সাথে আলাপ করবে। দুজনের সমপরিমাণ টাকা ব্যবসায় খাটবে। লভ্যাংশও সমান সমান। যেহেতু তুমি ব্যবসা চালাবে, সেহেতু তুমি মাসিক বেতন হিসাবে কিছু নেওয়ার কথাও বলবে। আর সেটার পরিমাণ কত তাও দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করবে। বৌমার সঙ্গে সবকিছু পরামর্শ করার পর সে যদি রাজি থাকে তা হলে প্রথমে গঞ্জে একটা গোডাউন ভাড়া নেবে। ধান, পাট ও অন্যান্য রবিশষ্য কিনে সেখানে রাখবে এবং পাইকারী বিক্রিরও ব্যবস্থা করবে। প্রয়োজনে দুএকজন কর্মচারী রাখতে পার। তাদের বেতনও দুজনের লভ্যাংশ থেকে দেওয়া হবে তাও আলাপ করে নেবে। আল্লাহ ব্যবসার উন্নতি দিলে পরে আস্তে ধীরে তোমরা জমি কিনতে পারবে। প্রথমে ব্যবসাটা যাতে উন্নতি হয় সেই চেষ্টা চালাবে। মনে রেখ, ব্যবসার ব্যাপারে যা কিছু করবে বৌমার সঙ্গে পরামর্শ করে করবে। যদি কখনও তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ হয় তখন আমাকে জানাবে। ইনশাল্লাহ আমি তোমাদের সুপরামর্শ দিতে পারব।
আব্দুল হান্নান বলল, আপনি যা বললেন, তাই করব।
.
০৪.
ফিরনীতে গিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে আসার কয়েকদিন পর আব্দুল হান্নান গঞ্জে গিয়েছিল গুদামঘর ভাড়ার খোঁজে। ফেরার পথে বন্ধু আব্বাস ও মুসতাকীমের সঙ্গে দেখা হতে সালাম বিনিময় করে বলল, কিরে, তোরা কেমন আছিস?
প্রথমে আব্বাস বলল, আমরা ভালো আছি। তা তুই কেমন আছিস বল।
আব্দুল হান্নান বলল, আমিও ভালো আছি।
মুসতাকীম বলল, বিয়ে করেছিস, ভালো তো থাকবিই। তারপর বলল, শুনলাম তোর বৌ নাকি কামিল পাস, এই ক’দিন তোকে নিশ্চয় অনেক কুরআন-হাদিস শুনিয়েছে?
সে থেমে যেতে আব্বাস বলল, তা আবার শোনায় নি। তা না হলে কয়েকদিন আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এলেও ক্লাবে আসে নি কেন বুঝতে পারছিস না? নিশ্চয় ক্লাবে আসতে নিষেধ করে দিয়েছে বৌ।
আব্দুল হান্নান কিছু না বলে চুপ করে রইল।
মুসতাকীম বলল, কিরে, কিছু বলছিস না যে? আমাদের কথায় মাইন্ড করলি না কি?
আব্দুল হান্নান বলল, আরে না, মাইন্ড করব কেন? তোরা তো সত্যি কথাই বলেছিস। তবে ক্লাবে আসতে বৌ নিষেধ করে নি। আব্বা একটা কাজ দিয়েছে। সেই ব্যাপারে এই ক’দিন ব্যস্ত আছি। তাই ক্লাবে আসতে পারি নি।
আব্বাস বলল, কাজটা কি শুনি।
আব্দুল হান্নান বলল, এখন বলা যাবে না। কাজটা শেষ করার পর বলব।
মুসতাকীম বলল, তাই বলিস। তারপর জিজ্ঞেস করল, বৌকে কেমন লাগল বল। শুনলাম, ওলিমার দিন তোর বৌ কাউকে মুখ দেখতে দেয় নি। কুরআন-হাদিসের বাণী শুনিয়ে সবাইকে বিদায় করে দিয়েছে।
ঠিকই শুনেছিস। যে মেয়ের পেটে কুরআন-হাদিসের জ্ঞান থাকে, সে কি এরকম একটা সমাজের কুরীতি মেনে নিতে পারে?
আব্বাস বলল, তোর মুখে এরকম কথা শুনব ভাবতেই পারছি না। সত্যিই তা হলে তোর বৌ তোকে এই ক’দিনে হেদায়েত করে ফেলেছে?
তোরা যখন বলছিস তখন তা হলে তাই। পরে ক্লাবে গিয়ে তোদের সঙ্গে আলাপ করব। এখন একটু তাড়া আছে, যাই বলে আব্দুল হান্নান হাঁটতে শুরু করল।
মুসতাকীম বলল, “বিয়ের পর ছেলেরা বৌ এর গোলাম হয়ে যায়” কথাটা এতদিন শুনে এসেছি। আজ আব্দুল হান্নানের কথা শুনে তার প্রমান পেলাম।
আব্বাস বলল, তোর কথা ঠিক, তবে সব ছেলেরা হয় না। যাকগে, ওর কথা বাদ দে। আমরা ক্লাবে যাই চল।
কয়েকদিনের মধ্যে গঞ্জে গুদামঘর ভাড়া নেওয়ার পর ইলিয়াস মির্জা একটা চিঠি লিখে আব্দুল হান্নানকে দিয়ে বললেন, তুমি আজই শ্বশুরবাড়ি গিয়ে এটা তোমার শ্বশুরকে দেবে। তোমার সঙ্গে বৌমাকে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা লিখেছি। যদি না পাঠান, তা হলে তুমি ফিরে আসার পর আমি গিয়ে নিয়ে আসব। আর তুমি বৌমার সঙ্গে ব্যবসার ব্যাপারে যে সব কথা আলাপ করতে বলেছিলাম করবে।
ঐদিন আব্দুল হান্নান শ্বশুরবাড়ি গেল। প্রথমেই শ্বশুরের সঙ্গে দেখা। সালাম ও কুশল বিনিময় করে চিঠিটা দিয়ে বলল, আব্বা দিয়েছেন।
নিয়াজ আহম্মদ পড়ে বললেন, ঠিক আছে। কয়েকদিন বেড়াও। তারপর নিলুফারকে নিয়ে যাবে। তারপর একজন কাজের মেয়েকে ডেকে বললেন, জামাই এসেছে ভিতরে খবর দাও।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর নিলুফার বলল, তোমাকে ব্যবসা ও জমি কেনার কথা বলেছিলাম, সে ব্যাপারে কিছু চিন্তা-ভাবনা করেছ?
আব্দুল হান্নান বলল, হ্যাঁ করেছি। তারপর নিজের ও আব্বার মতামত জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বল?
নিলুফার বলল, আব্বা খুব ভালো কথা বলেছেন? আমি তার সঙ্গে একমত। তুমি সুবিধেমতো জায়গায় গোডাউন ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দাও।
আব্দুল হান্নান মৃদু হেসে বলল, গোডাউনের ব্যবস্থা করেই এসেছি।
নিলুফার খুশী হয়ে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তবু বলল, নিজেই যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করেছ তখন আবার আমার মতামত জানতে চাইলে কেন?
খুব অল্প সময় সান্নিধ্য পেলেও তোমার প্রতি আমার যে ধারণা বা বিশ্বাস জন্মেছে, তাতেই মনে হয়েছে আমার সিদ্ধান্তকে তুমি মেনে নেবে।
গুড, ভেরী গুড। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাস থাকা একান্ত জরুরী। নচেৎ তাদের জীবন ক্রমশঃ দুর্বিসহ হয়ে উঠে। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কয়েকটা কথা বলতে চাই। অবশ্য তুমি যদি অনুমতি দাও।
আব্দুল হান্নান বলল, অনুমতি দিলাম। বল কি বলতে চাও।
নিলুফার বলল, আজকাল মুসলমান ঘরের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষা লাভ করলেও খুব কমসংখ্যক ছেলেমেয়ে ইসলাম সম্পর্কে লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে আবার শুধু ডিগ্রী নেওয়ার জন্য লেখাপড়া করছে। তাই তাদের বাস্তব জীবনে যতটা ইসলামের অনুসরণ করা উচিত, তা করছে না। তারা ফলহীন বৃক্ষের মতো। প্রত্যেক মুসলমানের জানা উচিত, শুধু নামায, রোযা, ও কিছু আচার অনুষ্ঠানের নাম ইসলাম নয়। ইসলাম শব্দের অর্থ যেমন শান্তি, তেমনি আত্মসমর্পণও। তাই ইসলাম যেমন শান্তির ধর্ম, তেমনি নিজেকে আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) এর বিধি-নিষেধের মধ্যে নিজের মতামতকে উৎসর্গ করার নামও ইসলাম। মানব জাতির আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে ইসলাম প্রচার হয়ে আসছে। ইসলাম এসেছে তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত করতে, সারা পৃথিবী থেকে মূর্তিপূজা বিলীন করতে, মানুষকে অসৎ পথ থেকে সৎ পথে পরিচালিত করে মানবতার শ্রেষ্ঠ গুণগুলো বিকশিত করতে। তাই ইসলামে এমন কোনো বিষয় নেই, যার সমাধান দিতে পারে না। এই যে তুমি ব্যবসা করতে নামবে এ সম্পর্কে ইসলাম কি বলছে, তুমি জান কি না জানি না। তাই কয়েকটা কথা বলছি, (১) সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, (২) ওজনে কম দেবে না, (৩) মিথ্যে বলবে না, (৪) খারাপ মালকে ভালো বলে বিক্রি করবে না, (৫) খারাপকে খারাপ, ভালোকে ভালো বলে বিক্রি করবে, (৬) “হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, যে দোষত্রুটিপূর্ণ দ্রব্য প্রকাশ না করিয়া বিক্রয় করে, সে আল্লাহর ক্রোধের মধ্যে থাকে বা ফেরেস্তাগণ তাহাকে অভিসম্পাত করিতে থাকে। [বর্ণনায় হযরত ওয়াসেলা (রাঃ)-ইবনে মাযাহ] (৬) খারাপ মালকে ভালো মালের সঙ্গে মিশিয়ে ভালো বলে বিক্রি করবে না। (৭) বেশি মুনাফা করার লোভে মাল বেশি দিন গুদামজাত করে বাজারে ক্রাইসীস তৈরি করবে না। (৮) খরিদ্দারের সাথে কোনো প্রকার প্রতারণা করবে না। এ ব্যাপারে হাদিসে আছে, “রাসুলুল্লাহ (দঃ) “একটি খাদ্য শষ্যের স্তূপের নিকট দিয়া যাইবার কালে স্বীয় হস্ত স্তূপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করাইয়া দিলে তাহার অঙ্গুলী ভিজিয়া গেল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, হে শষ্যের মালিক, ইহা কি? সে বলিল, বৃষ্টিতে ভিজিয়াছে। তিনি বলিলেন, তুমি ইহা শস্যের উপরিভাগে রাখিতে পারিলে না?, তাহা হইলে লোকে দেখিতে পাইত। যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নহে।” [বর্ণনায় : হযরত আবু হোরাইয়া (রাঃ)-মুসলিম]
আল্লাহর প্রকৃত মুমীন বান্দাদের মধ্যে যারা ব্যবসা করতেন, তাঁদের মধ্যে ইমাম আজম আবু হানিফা (রাঃ)-এর জীবনের একটা ঘটনা বলছি, উনি কুফার অধিবাসী ছিলেন। শহরে ওঁনার কাপড়ের ব্যবসা ছিল। উনি সব সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসতেন না। প্রতিদিন সন্ধ্যের পর হিসাবপত্র দেখতেন ও ব্যবসার ভালো-মন্দ খবর নিতেন। একদিন একজন কর্মচারী বলল, একটা থান কাপড়ের মধ্যে কিছু অংশ খারাপ আছে। তিনি বললেন, ঐ থান কাপড়ের খারাপ অংশটা খরিদ্দারকে দেখিয়ে বিক্রি করবে। পরের দিন দোকানে এসে জানতে পারলেন, কর্মচারীটা ভুলে ঐ খারাপ কাপড়ের থানটি ভালো কাপড়ের সঙ্গে বিক্রি করে দিয়েছে। তিনি সেইদিনের আমদানীকৃত সহস্রাধিক স্বর্ণমুদ্রা সবটাই দান করে দিয়ে বললেন, ঐ খারাপ মাল বিক্রিত হারাম টাকা কোনগুলি তাহাতো আমার জানা নাই।
আজকাল মানুষ হালাল-হারাম বাছ বিচার না করে বিভিন্ন পন্থায় অর্থ উপার্জন করে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করছে। ফলে দুনিয়াতে অল্প কিছুদিনের জন্য সুখে থাকলেও পরকালে অনন্ত জীবন আগুনে জ্বলবে। তা ছাড়া হারাম উপার্জনের টাকা খেয়ে যে ছেলেমেয়ে জন্ম দেবে, তারা কোনোদিন সত্যের পথিক ও ধার্মিক হতে পারে না। তারা পিতা-মাতার কথা অমান্য করে নিজের ইচ্ছা মতো চলে। তাইতো আমাদের প্রজন্মরা ক্রমশঃ সন্ত্রাসী, বদমাশ ও চরিত্রহীন হচ্ছে এবং দিন দিন সমাজের অবক্ষয় বেড়েই চলেছে। আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন। তাই এতে খুব বরকত দান করেছেন। কিন্তু মানুষ মিথ্যা ও প্রতারণা অবলম্বন করে ব্যবসার উপার্জিত হালাল অর্থ হারাম করে ফেলছে। তুমিই বল না শিক্ষিত ও সামর্থবানদের এটা করা কি উচিত?
আব্দুল হান্নান খুশী হতে পারল না। বলল, ব্যবসাসংক্রান্ত যা কিছু বললে, সে সব মেনে চললে ব্যবসার উন্নতি করাতো দুরের কথা, অল্পদিনের মধ্যে লালবাতি জ্বলে যাবে? আজকাল কেউ সত্তাবে ব্যবসা করে না। আমি সৎ থেকে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব কেন?
ইনশাআল্লাহ পারবে। ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে ও সৎ উদ্দেশ্যে যারা যে-কোনো কাজ করতে চাইবে, আল্লাহ তাদেরকে সব রকমের সাহায্য করেন। এটা কুরআন-পাকের কথা। আর কুরআনের কথা মিথ্যা হতে পারে না। কুরআনকে যারা বিশ্বাস করে না, তারা মুসলমান নয়। মুসলমান হিসাবে তুমিতো কুরআন বিশ্বাস কর। তাই আবার বলছি, ইসলাম যেভাবে করতে বলেছে, সেভাবে করলে নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন এবং ব্যবসায় উন্নতি করতে পারবে। আর একটা কথা জেনে রেখ, তকদীরকে মুসলমানদের বিশ্বাস করতেই হবে। যে করবে না, সে মুসলমান থেকে বাদ হয়ে যাবে। মানুষের কর্তব্য হল, আল্লাহর উপর ভরসা করে সবকিছু করা। তিনি বান্দাদের। তক্বদীরে যা রেখেছেন, তা দেবেন। যাই হোক, আমার মনে হয় তুমি ইসলাম সম্পর্কে তেমন পড়াশোনা কর নি। যদি করতে, তা হলে এরকম কথা বলতে। পারতে না। আল্লাহ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীকে জ্ঞান অর্জন ফরয (অবশ্য কর্তব্য) করেছেন। সেই জ্ঞানের মূল হল ইসলামের মৌলিক জ্ঞান। এই হুকুম সাধারণ মানুষের জন্য। যারা সাধারণ মানুষের উপরে, তাদের ইসলামের সব ধরণের জ্ঞান, বিশেষ করে কুরআন-হাদিসের গভীরে প্রবেশ করে যতটা জ্ঞান অর্জন করবে তা সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। আগের যুগের মুসলমানরা তাই করেছিলেন বলে ইবনে সীনা ও আল-কিরমানীর মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানী, ওমর খৈয়াম, আল-মাগনি, আজ জাফর ও আল-ফাজরীর মতো পদার্থবিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী, আল-হাবরারী, নাসিরউদ্দিন তুসী ও কামাল উদ্দীন ইবনে ইউসুফের মতো গণিত বিজ্ঞানীর নাম আজও সারা পৃথিবীতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বিরাজ করছে। অথচ আজকালের মুসলমানরা এইসব মনীষিদের নামও শোনে নি।
আমার একান্ত অনুরোধ সংসার ধর্ম ও জীবিকা অর্জনের সাথে সাথে ইসলামের উপর পড়াশোনা করবে। আল্লাহ রাজি থাকলে আমরা বাড়িতে একটা লাইব্রেরী করব এবং সেখানে বাড়ির, পড়ার ও গ্রামের মেয়ে-পুরুষদের পড়াশোনা করাব। যারা লেখাপড়া করেনি, তাদেরকে লেখাপড়া করানোর এবং পরে গরিব ও দুঃস্থ মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য কুটিরশিল্পেরও ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ আমরা করব। এসব করা আমাদের উচিত কিনা তুমিই বল?
স্ত্রীর জ্ঞান ও বুদ্ধির কাছে আব্দুল হান্নান হেরে গেল। বলল, হ্যাঁ উচিত; কিন্তু আমরা সবেমাত্র বিয়ে করেছি, এখন আনন্দ-ফুর্তির সময়। অত কিছু চিন্তা করে কাজ-কর্ম করার সময় এখন কোথায়?
নিলুফার মৃদু হেসে বলল, আনন্দ-ফুর্তি করতে তোমাকে বাধা দিচ্ছে কে? ইসলাম কোনো কিছুতেই বাধা সৃষ্টি করে নি। তবে সবকিছুতেই সীমা ও বিধান বেধে দিয়েছে। এটা বোধ হয় জান না, মুসলমানরা যে-কোনো কাজ ইসলামের বিধান মতো করলে, সবকিছুই ইবাদত হিসাবে গন্য হবে?
এমন সময় নিলুফারের ছোট ভাই জামিল দরজার বাইরে থেকে বলল, নসেজ আপা, দুলাভাইকে ভাত খাওয়ার জন্য আম্মা তোমাকে ডাকছে।
নিলুফার বলল, আম্মাকে ভাত বাড়তে বল, আমি আসছি। তারপর স্বামীকে বলল, খাওয়ার পর আলাপ করা যাবে। এখন আম্মা ডাকছে যাই।
.
দু’দিন শ্বশুর বাড়িতে থেকে আব্দুল হান্নান স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে এল। তারপর ব্যবসার কাজে নেমে পড়ল।
নিলুফার জায়েদের সঙ্গে সংসারের কাজ-কর্ম করলেও পর্দা করে করছে। ভাসুররা কেউ তার মুখ দেখতে পায় না। সে সব সময় দুটো চোখ ছাড়া সারা শরীর ঢেকে রাখে। ইলিয়াস মির্জা খিড়কী পুকুরের ঘাট আগেই ঘিরে দিয়েছিলেন। ছোট বৌমা আসার পর সংস্কার করে আরো ভালো করে ঘিরে দিয়েছেন, যাতে করে ঘাটের মেয়েদেরকে কোনো পুরুষই দেখতে না পায়। দুপুরে খাওয়ার পর থেকে বিকেল পর্যন্ত ও সন্ধ্যের পর থেকে রাত বারটা পর্যন্ত। বড় তিন বৌ-এর ঘরে টিভি চলে। ইলিয়াস মির্জা গালিবা ও নিলুফার ছাড়া সবাই টিভি দেখে।
আব্দুল হান্নান দিনে ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর বড় ভাবির ঘরে টিভি দেখে।
নিলুফার তখন কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিভিন্ন হাদিসের বই পড়ে। বারটা সাড়ে বারটার সময় স্বামী ঘরে এলে সে সব রেখে তার সঙ্গে ঘুমায়।
এইভাবে কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন গালিব ছোট ভাবিকে বলল, টিভি দেখা নিয়ে তোমার কিছু করা উচিত।
এখানে আসার পর থেকে নিলুফারও এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছে। গালিবার কথা শুনে বলল, কিছু করাতো উচিত, কিন্তু কিভাবে এগোবো, চিন্তা করে ঠিক করতে পারছি না। বড় তিন জা যে আমাকে রোজ টিভি দেখার জন্য তাদের ঘরে নিয়ে যেতে আসে তাতো তুমি জান। আর যাইনি বলে তারা যে আমার উপর অসন্তুষ্ট, তাও জান। আম্মাও একদিন আমাকে সঙ্গে করে বড় বুবুর ঘরে টিভি দেখার জন্য নিয়ে যেতে এসেছিলেন, আমি তার কথা রাখিনি বলে তিনিও আমার উপর খুব অসন্তুষ্ট। সরাসরি তোমার ছোট ভাইয়াকে টিভি দেখতে নিষেধ করলে সেও আমার উপর খুব অসন্তুষ্ট হবে।
গালিবা বলল, ছোট ভাইয়া তোমাকে যেতে বলে নি?
না। কারণ সে জানে আমি টিভি দেখি না।
কেন দেখ না বলবে ছোট ভাবি?
তুমি যে কারণে দেখ না, সেই একই কারণে আমিও দেখি না।
এবার গালিবা হেসে উঠে বলল, তা হলে ছোট ভাইয়াকে নিষেধ কর নি। কেন?
নিষেধ করলে শুনবে না বলে। তা ছাড়া বললাম না, আমার উপর অসন্তুষ্ট হবে?
তাই বলে স্বামী দিনের পর দিন পাপ করে যাবে, স্ত্রী তাকে নিষেধ করবে না?
স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে ইসলাম কি বলেছে, তা তুমি জান না। স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ ধর্মের বিধান মেনে না চললে একে অপরের প্রতি কি কর্তব্য এবং সংসার ধর্ম পালন করতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে হাদিসে নবী করিম (দঃ) কি বলিয়াছেন তাও জান না। তা ছাড়া বড় বড় মুসলিম মনিষীগণ ও এ ব্যাপারে অনেক বই পুস্তক লিখেছেন। বিয়ের বয়স হলে সেগুলো পড়া প্রত্যেক নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে পরে তোমার সঙ্গে আলাপ করব। এখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। যে-কোনো কাজ মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে করলে তা যেমন সুষ্ঠভাবে হয় না, তেমনি মনে শান্তিও পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ধর্মের কাজে জোর জবরদস্তি নেই। ধর, তোমাকে আমি এমন একটা কাজ করতে বললাম, যা করার জন্য তোমার মন এতটুকু সায় দিল না। আমরা কথা ফেলতে না পেরে হয়তো অনিচ্ছাসত্ত্বেও করবে; কিন্তু আমার প্রতি তুমি যেমন রুষ্ট হবে তেমনি নিজেও অশান্তি পাবে। আর আমি যদি ঐ কাজটা করার উপকারিতা ও না করার অপকারিতা বুঝিয়ে বলার পর করতে বলি, তা হলে তুমি কাজটা যেমন সুষ্ঠভাবে করবে, তেমনি মনে শান্তি পাবে। আর আমার উপর রুষ্টও হবে না। আল্লাহ তার প্রিয় হাবিব (দঃ) কে হিকমতের সঙ্গে ধর্মের কথা মানুষকে শোনাতে বলেছেন। তাই ভেবেছি, প্রতি শুক্রবার ফজরের নামাযের পর বাড়ির সবাইকে নিয়ে একটা বৈঠক করব। বৈঠকে কুরআন হাদিসের কিছু কিছু ব্যাখ্যা এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে ইসলাম কি বলেছে, সে সব আলোচনাও করব। আমি এ বাড়ির নতুন বৌ। তার উপর সবাই আমার উপর সন্তুষ্ট নন। তাই আব্বাকে দিয়ে এই বৈঠকের ব্যবস্থা করতে হবে। কাল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর তোমার ছোট ভাইয়া যখন ব্যবসার কাজে বেরিয়ে যাবে তখন তুমি আব্বাকে আমার ঘরে নিয়ে আসবে। আশা করি, তুমি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে?
গালিবা বলল, তোমার আইডিয়া খুব ভালো। ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় সাহায্য করব।
আব্দুল হান্নান প্রতিদিন দুপুরে ঘরে খেতে এলেও যেদিন দূরের কোনো গ্রামে ধান, চাল বা পাট কেনার জন্য যায়, সেদিন আসে না। অবশ্য সকালে নাস্তা খেয়ে বেরোবার সময় সেকথা নিলুফারকে বলে যায়। ঐ কাজের জন্য নিলুফার লোক নিযুক্ত করার জন্য বলেছিল। উত্তরে আব্দুল হান্নান বলেছে, উপযুক্ত লোকের খোঁজ করছি, পেলেই রাখব। যাকে তাকে নিযুক্ত করলে তো হবে না, বিশ্বাসী হতে হবে।
আজ সকালে নাস্তা খেয়ে বেরোবার সময় আব্দুল হান্নান দুপুরে খেতে আসবে না বলে গেছে। সেকথা গালিবাকে জানিয়ে নিলুফার বলল, কাল যা বলেছিলাম মনে আছে তো?
গালিবা মৃদু হেসে বলল, তোমার মতো সব বিষয়ে গুণবতী আল্লাহ আমাকে না করলেও স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো দিয়েছেন। গতকাল রাতেই খাওয়ার পর তোমার প্ল্যান আব্বাকে জানিয়েছি। শুনে আব্বা তোমার খুব গুনগান করল।
.
দুপুরে খাওয়ার পর ইলিয়াস মির্জা কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে সুন্নত আদায় করেন। তারপর ক্ষেত-খামারের কামলাদের কাছে যান। আজ খাওয়ার পর। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সেখানে না গিয়ে গালিবাকে সঙ্গে নিয়ে ছোট বৌমার ঘরে এসে বললেন, তোমার পরিকল্পনার কথা শুনে খুব খুশী হয়েছি। শুধু এ ব্যাপারেই নয়, দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করা এবং পরিবার, সমাজ থেকে কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতিনীতি দূর করার জন্য আমি তোমাকে সাহায্য করব। দোয়া করছি, আল্লাহ তোমাকে কামিয়াব করুন। তুমি প্রতি শুক্রবার বৈঠক করতে চাচ্ছ কেন? আমার মতে প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর করলে আরো ভালো হবে।
নিলুফার বলল, আমিও আপনার সঙ্গে একমত। তবে কি জানেন আব্বা, প্রথম দু’এক মাস- সপ্তাহে একদিন বৈঠক করে সবার মনে দ্বীনকে জানার আগ্রহ তৈরি করতে হবে। তারপর দেখবেন ওঁরা নিজেরাই প্রতিদিন বৈঠক করার কথা বলবেন।
হ্যাঁ মা, তুমি ভালো কথাই বলেছ। আমি আজই শুক্রবার বৈঠক করার কথা জানিয়ে দেব।
নিলুফার বলল, এর মধ্যে আপনার সঙ্গে কিছু আলাপ করতে চাই। সময় মতো আপনি আমাকে খবর দেবেন, আমি আপনার কাছে আসব।
ঠিক আছে মা, তাই হবে। এখন যাই কামলাদের কাছে যেতে হবে বলে ইলিয়াস মির্জা চলে গেলেন।
.
বৃহস্পতিবার রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ইলিয়াস মির্জা স্ত্রী, ছেলে ও তাদের বৌদের ডেকে বললেন, কাল সকাল ছটার সময় সবাই আমার কাছে আসবে। জানি, অত সকালে তোমাদের ঘুম ভাঙে না, তবু আসতে হবে। আমি তোমাদের সঙ্গে কিছু আলাপ-আলোচনা করব।
বাবার কথা শুনে বড় তিন ছেলে ও বৌরা অত সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে বলে অসন্তুষ্ট হল। কিন্তু সাহস করে কেউ কিছু বলতে পারল না। সেজ। আব্দুল মতিন খুব ঘুমকাতুরে। সবার শেষে ঘুম থেকে উঠে। তাই সে বলে উঠল, আলাপ-আলোচনাটা এখন করলে হত না?
সবাই টিভিতে একটা সাপ্তাহিক নাটক দেখাছিল, আব্বা ডেকেছেন বলে এসেছে। সবার মন নাটক দেখার জন্য ছটফট করছে। তার কথা শুনে বড় আব্দুল লতিফ বলল, আব্বা যখন সকালের কথা বলছেন, তখন তুই আবার এখন আলাপ করার কথা বলছিস কেন? তারপর আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে আব্বা, আমরা সকালেই আসব।
ইলিয়াস মির্জা বললেন, এবার তোমরা যাও।
.
পরেরদিন ইলিয়াস মির্জা মসজিদ থেকে ফজরের নামায পড়ে এসে স্ত্রীকে জাগিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি নামায পড়ে নাও, বেলা উঠে যাবে। তা ছাড়া ছেলে-বৌরা একটু পরে এসে পড়বে।
জাহেদা বেগম রাত সাড়ে বারটা পর্যন্ত টিভি দেখে এসে ঘুমিয়েছেন। স্বামী জাগাতে খুব বিরক্ত হলেন। বললেন, ছোট বৌকে নিয়ে তুমি কি আরম্ভ করলে বলতো? ঘুমটা পুরো হতে দিলে না।
ইলিয়াস মির্জা স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী কিরূপ ব্যবহার করতে হয়, তা অল্প কিছু জানতেন। তাই স্ত্রীর বিপরীত আচরণ অনেক সময় ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখলেও মাঝে মাঝে রাগারাগি করতেন। তখন জাহেদা বেগমও স্বামীর সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করতেন। এসব কথা নিলুফার নিজের বাবার কাছে ও স্বামীর কাছে জেনেছে। তাই এবারে আসার সময় ইসলামিক পারিবারিক জীবনের উপর কয়েকটা বই নিয়ে এসেছে। আসার পরপর তা থেকে মুজাহিদ মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলি নবী (রঃ) এর “হুকুমে মু’আশরাত” কিতাবের মাওলানা আবু তাহের রাহমানী কৃত বঙ্গানুবাদ “কুরআন হাদিসের আলোকে পারিবারিক জীবন” বইটি শ্বশুরকে পড়তে দিয়েছিল। সেই বইটা পড়ে ইলিয়াস মির্জা যেমন খুব অবাক হয়েছেন, তেমনি বুঝতে পেরেছেন, কেন মুসলিম সমাজে তালাকের ছড়াছড়ি? কেন নারী আজ পুরুষের হাতে এত নির্যাতিত? কেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের নির্যাতিত ও অসহায় নারীরা এনজিওদের পাল্লায় পড়ে পর্দা ত্যাগ করে তাদের কাছে চাকরি নিচ্ছে এবং খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করছে? কেন দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবনে এত অশান্তি? কেন মুসলমানরা আজ বিজাতীয়দেরকে অনুসরণ করছে? তারপর থেকে তিনি নিজের জীবনে মেনে। চলার চেষ্টা করছেন। তাই এখন স্ত্রীর কথা শুনে রাগ করলেন না। মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে, আর কোনোদিন তোমার ঘুম পুরো না হলে জাগাব না। এবারের মতো মাফ করে দাও।
জাহেদা বেগমও এই কয়েকদিন স্বামীর পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। আগে কিছু ন্যায়-অন্যায় বললে বা করলে তাকে রেগে যেতে দেখেছেন। ইদানিং তার বিপরীত দেখে একটু অবাক হন। এখন মাফ চাইতে শুনে লজ্জা পেলেন। কিন্তু রাগটা সামলাতে পারলেন না। বললেন, বুড়ো বয়সে মাফ চেয়ে নিজেকে আর ছোট করো না। তারপর অযু করার জন্য বেরিয়ে গেলেন।
ইলিয়াস মির্জা কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। স্ত্রীকে ফিরে এসে নামাযের মসাল্লা বিছাতে দেখে অনুচ্চস্বরে তিলাওয়াত করতে লাগলেন। তারপর স্ত্রীর নামায পড়া শেষ হতে বললেন, আগে তুমি কি সুন্দরভাবে প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত করতে, আমার শুনতে খুব ভালো লাগত। অনেকদিন হল তিলাওয়াত কর নি, আজ একটু কর না? ততক্ষণে ছেলেও বৌমারা এসে যাবে।
জাহেদা বেগম ছোটবেলায় যে ওস্তাদের কাছে কুরআন পড়া শিখেছিলেন, তিনি কারী ছিলেন। তা ছাড়া আর গলার এলহানও খুব ভালো। তাই ওস্তাদ তাকে খুব স্নেহের চোখে দেখতেন। তিনি যখন কুরআন পড়তেন তখন বাড়ির সবাই কান লাগিয়ে শুনতো। বিয়ের পর ও বৌয়েরা টেলিভিশন আনার পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিয়মিত তিলাওয়াত করতেন। তখন ইলিয়াস মির্জা তিলাওয়াত বন্ধ করে স্ত্রীর সহি পড়া ও সুন্দর এলাহানের তিলাওয়াত শুনতেন। তেলাওয়াত শেষ হলে বলতেন, তোমার মতো সহি পড়া ও সুন্দর এলহান জীবনে কখনো শুনি নি।
আজ স্বামীর কথা শুনে জাহেদা বেগমের সে কথা মনে পড়তে কুরাআন তিলাওয়াত শুরু করলেন।
গালিবা নামায পড়ে কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে আব্বার ঘরে এসে মাকে তিলাওয়াত করতে দেখে তার পাশে বসে শুনতে লাগল।
পৌনে ছ’টার সময় নিলুফার স্বামীর সঙ্গে একটা বিছানার চাদর হাতে করে শ্বশুরের ঘরের দরজার কাছে এসে সহী ও সুমধুর এলহানে শাশুড়ীর তিলাওয়াত শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, আম্মার তিলাওয়াত খুব সুন্দর। কিছুক্ষণ শুনি এসো।
ছ’টা বেজে যেতে ইলিয়াস মির্জা স্ত্রীকে সে কথা জানিয়ে বললেন, এবার তিলাওয়াত বন্ধ কর। ছেলে ও বৌমাদের আসার সময় হয়ে গেছে।
জাহেদা বেগম কুরআন শরীফ নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে এসে বসেছেন এমন সময় নিলুফার সালাম দিল।
ইলিয়াস মির্জা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন কে? নিলুফার? আগে তিনি তাকে ছোট বৌমা বলতেন। নিলুফার নাম ধরে ডাকতে বলার পর থেকে নাম ধরেই ডাকেন। তবে অন্য তিন ছেলের বৌকে বৌমা বলেই ডাকেন।
নিলুফার বলল, জি, আপনার ছেলেও এসেছেন।
এসো মা তোমরা ভিতরে এস।
নিলুফার স্বামীকে বলল, তুমি আগে যাও। তারপর বলল, ঢুকে সালাম দিবে।
আব্দুল হান্নান ঢুকে সালাম দিল।
ইলিয়াস মির্জা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমরা বস।
নিলুফার ঢুকে শাশুড়ীকে উদ্দেশ্য করে বলল, আম্মা, আপনার গলার এলহান খুব সুন্দর আর পড়াও খুব সহী। আপনার তিলাওয়াত যেই শুনবে সেই মোহিত হয়ে যাবে। তারপর শাশুড়ীর গলা জড়িয়ে আব্দারের সুরে বলল, এবার থেকে প্রতিদিন এই সময়ে তিলাওয়াত করবেন, আমিও আপনার ছেলে এসে শুনব। হযরত দাউদ (আঃ)-এর গলার এলহান এত সুমধুর ছিল যে, উনি যখন যব্দুর কিতাব নদীর কিনারে বসে তিলাওয়াত করতেন তখন নদীর মাছেরা কিনারে এসে শুনত।
নিলুফার থেমে যেতে ইলিয়াস মির্জা বললেন, জান নিলুফার, আগে যখন তোমার শাশুড়ী কুরআন তিলাওয়াত করত তখন আমি তিলাওয়াত বন্ধ করে মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। এক হাফেজ সাহেবের কাছে শুনেছিলাম, নিজে তিলাওয়াত করলে যে সওয়াব, অন্যজনের তিলাওয়াত শুনলেও সেই একই সওয়াব।
নিলুফার বলল, হ্যাঁ আব্বা, হাফেজ সাহেব ঠিক কথা বলেছেন। তাই তো নিজে তিলাওয়াত না করে আম্মারটা শুনতে আসার কথা বললাম।
ইলিয়াস মির্জা বললেন, এই কিছুদিন হল তোমার শাশুড়ী তিলাওয়াত করেনি। আগে নিয়মিত করত। তুমি যখন বলছ, এখন থেকে নিশ্চয় আবার নিয়মিত করবে। তারপর তার হাতে বিছানার চাদর দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ওটা এনেছ কেন?
নিলুফার বলল, আপনিতো জানেন, ইসলাম যে চৌদ্দ জনকে বিয়ে করা চিরকালের জন্য হারাম করেছে তাদেরকে ছাড়া নারী-পুরুষ উভয়কেই সবার সঙ্গে পর্দা করতে বলেছে। তারপর গালিবাকে বলল, এই চাদরটা বারান্দার মাঝ বরাবর টাঙ্গাবার ব্যবস্থা করি এস। একদিকে আম্মার সঙ্গে আমরা মেয়েরা বসব, অন্যদিকে তোমার ভাইয়ারা আব্বার সঙ্গে বসবেন।
চাদর টাঙ্গান শেষ হয়েছে, এমন সময় বড় তিন ছেলে তাদের স্ত্রীদের নিয়ে এসে পর্দা টাঙ্গান দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তাদেরকে দেখে ইলিয়াস মির্জা বৌমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা ওদিকে তোমার শাশুড়ীর কাছে গিয়ে বস। ততক্ষণে আব্দুল হান্নান পর্দার এপারে এসে দরজার সামনে বসেছে। তারপাশে ইলিয়াস মির্জা বসে ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা আমাদের সঙ্গে বস।
বড় তিন ছেলে ও তাদের বৌ-এরা আরো বেশি অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল।
তাদের অবস্থা বুঝতে পেরে ইলিয়াস মির্জা বললেন, এতে অবাক হওয়ার কি আছে? এটাই শরীয়তের হুকুম। তারপর বৌমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, যাও মা, তোমরা তোমাদের শাশুড়ীর কাছে গিয়ে বস।
সবাই বসার পর ইলিয়াস মির্জা আবার বললেন, তোমাদেরকে যে আলাপ আলোচনা করার জন্য আসতে বলেছি, সে ব্যাপারে যা বলার নিলুফার বলবে। তার আগে আমি দু’একটা কথা বলছি। “পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আদি পিতা-মাতা হযরত আদম (আঃ) ও মা হাওয়া (আঃ) এর বংশধর। আর হযরত আদম (আঃ) থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) পর্যন্ত এক লক্ষ বা দুই লক্ষ নবী ও রাসুল আল্লাহ পাঠিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী। তার পরে কৃীয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী রাসুল পাঠাবেন না। আল্লাহর সৃষ্টি জগতের মধ্যে মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আমরা একদিকে যেমন আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তেমনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবীরও শ্রেষ্ঠ উম্মত। আমাদের মর্যাদা অন্যান্য নবী-রাসুলদের উম্মতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাই শ্রেষ্ঠত্বের কারণে আমাদের উচিত হবে আল্লাহর ও তাঁর প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর প্রদর্শিত পথে চলা, তাঁদের বিধি-নিষেধ পালন করা। কিন্তু আমরা কি তা করছি? করছি না? কেন করছি না তার কারণ অনেক। সেসব নিলুফার তোমাদেরকে বলবে। আমি শুধু একটা কথা বলব। তোমরা প্রতি শুক্রবার এই সময়ে এখানে আসবে। আমি আর কিছু বলব না, এবার মা। নিলুফার কি বলে শোন।
নিলুফার আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুল (দঃ) এর উপর দরূদ পেশ করে বলতে শুরু করল, শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আব্বা যা বললেন, তা যেমন অকাট্য, তেমনি চিরসত্য। আর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসাবে মহান স্রষ্ঠার হুকুম মেনে চলাও মানুষের অবশ্য কর্তব্য। যারা আল্লাহর তওহীদ ও রিসালাতের উপর বিশ্বাস করে ও তাঁদের বিধান মেনে চলে তারা মুসলমান। মুসলমানরা আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) এর বিধান ছাড়া অন্য কারো বিধান মানতে পারে না। যদি কেউ অন্যের বিধান। মানে আর সেই বিধান যদি আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ)-এর বিধানের পরিপন্থি না হয়, তা হলে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে না। আল্লাহ কুরআন মজিদে বলিয়াছেন, “তোমরা পুরোপুরি মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করে না।” [সুরা বাকারা; আয়াত-১৩২; পারা-১] আল্লাহ কুরআন মজিদের অন্যত্র সমগ্র বিশ্ববাসীকে উদ্দেশ্য করিয়া আরো বলিয়াছেন, “আজ তোমাদের অন্য তোমাদের ধর্ম (ইসলাম) পূর্ণাঙ্গ করিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম মনোনীত করিলাম। [সুরা-আল-ইমরান, আয়াত-৮৫, পারা-৩] আল্লাহ অন্যত্র বলিয়াছেন, “যে ইহাকে ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করিবে, সে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হইবে।”
যারা নাস্তিক অথবা যারা ইসলামকে অস্বীকার করে নিজেদের ধর্মের উপর রয়েছে, তাদের কথা বাদ দিলাম। আমরা যারা মুসলমান বলে দাবি করি, তাদের কি উচিত নয় কুরআনের রাণী মোতাবেক ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে পুরোপুরি মুসলমান হওয়া? আমি বলব নিশ্চয় উচিত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমরা বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করলেও ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করি না, করার ইচ্ছাও করি না। যার ফলে ইসলাম কি জিনিস যেমন জানি না, তেমনি মেনেও চলি না। ছোটবেলা থেকে পারিবারিক ও সামাজিক কিছু আচার-অনুষ্ঠান দেখেশুনে সেগুলোকেই ইসলাম মনে করে পালন করে থাকি। আমাদের মধ্যে আবার অনেকে ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে মনে করে। আরো মনে করে, যার যতটুকু ইচ্ছা ধর্ম মেনে চলবে। তাতে কারো কিছু বলার নেই। কথাটা একেবারেই ভুল। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এরকম বলে থাকে। মুসলমান মাত্রই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হুকুম মানতেই হবে। নচেৎ মুসলমান বলে দাবি করলেও আসলে সে প্রকৃত মুসলমান নয়। আল্লাহ কুরআন পাকে বিরাশী জায়গায়, নামায কায়েম করার ও যাকাত আদায় করার। কথা বলিয়াছেন। তা ছাড়াও অনেক জায়গায় শুধু নামায কায়েম করার কথা বলিয়াছেন। এখন আপনারা বলুন, যে নামাযের কথা আল্লাহ এতবার আদেশ। করেছেন, সেই নামায কি কোনো মুসলমানের ত্যাগ করা উচিত? হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “তাহাদের মধ্যে এবং আমাদের মধ্যে নামাযই পার্থক্যের বিষয়। যে ইহা ত্যাগ করে সে কাফির। [বর্ণনায় হযরত বোরায়দা (রাঃ)-তিরমিযী, নেসায়ী]
প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের নামাযে অভস্ত করা। এ ব্যাপারে হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “তোমাদের সন্তানগণ সাত বৎসরে পদার্পন করিলে তাহাদিগকে নামাযের জন্য আদেশ কর এবং তাহাদের দশ বৎসর বয়স হইলে জন্য তাহাদিগকে প্রহার কর এবং পরস্পরকে শয্যা হইতে পৃথক কর।” [বর্ণনায়: হযরত আমর বিন শোয়ায়েব (রাঃ)]
আশা করি, এইসব জানার পর কোনো মুসলমানই নামাযের প্রতি অবহেলা করবেন না। নামায পড়লে এবং না পড়লে কি হয়, সে আলোচনা ইনশাআল্লাহ। পরে করব। এখন পর্দা ও সমাজের কুসংস্কারের কথা কিছু বলছি। বিভিন্ন উৎসব ও বিয়ে শাদিতে আমাদের সমাজে যে সমস্ত রীতিনীতি চালু রয়েছে, সেসবের শতকরা প্রায় নব্বই থেকে পঁচানব্বই ভাগই ইসলামের পরিপন্থি। মুসলমান হিসাবে সেগুলো সমাজ থেকে দূর করা প্রতিটি মুসলমাননের কর্তব্য। বিশেষ করে বিয়ে শাদিতে মেয়েদের পর্দা লঙ্ন হয়। অথচ পর্দা করা আল্লাহর হুকুম। আর এটা আমরা অনেকেই জানি না, পর্দা শুধু মেয়েদের জন্য নয়, পুরুষদের জন্যও। গায়ের মুহররম পুরুষদেরকে মেয়েদের যেমন পর্দা করতে হবে, তেমনি গায়ের মুহাররাম মেয়েদেরও পুরুষদের পর্দা করতে হবে। পর্দা বলতে আমরা মেয়েদেরকে শুধু বোরখা পরা বুঝি। এটাও ঠিক নয়। আমার কথা শুনে হয়তো আপনারা অবাক হচ্ছেন। তাই এ ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কি তা মাওলানা আশরাফ আলি থানবীর ইসলাহুর রুসুম থেকে বলছি
একঃ পুরুষের নাভী থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখা ফরয। কোনো পুরুষ অথবা নারীর সামনে তা খোলা নাজায়েয। আর গোড়ালীর নিচে পরা হারাম। অনেকে লুঙ্গী-পায়জামা বা পীরানের ঝুল গোড়ালীর নিচে পরে। অনেকে আবার শুধু নামায পড়ার সময় কাপড়ের ঝুল গোড়ালীর উপর পর্যন্ত গুটিয়ে নেয় এবং নামাযের পর আবার তা খুলে গোড়ালীর নীচে ঝুলিয়ে দেয়। এটা ঠিক নয়। লুংগী, পায়জামা বা পীরানের ঝুল সব সময় পায়ের গোড়ালীর উপরে থাকতে হবে। এটাই শরীয়তের হুকুম। তা ছাড়া গোড়ালীর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরলে মনের মধ্যে অহঙ্কার আসে। হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে ব্যক্তি অহঙ্কারের সহিত তাহার পায়জামা লম্বা করিয়া দেয়, আল্লাহ কীয়ামতের দিন তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিবেন না। [বর্ণনায়: হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-বুখারী মুসলিম] হাদিসে আরো আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “পায়ের গোড়ালীর নিম্নে পায়জামার যে অংশ ঝুলিতে থাকে উহা দোযখের অগ্নিতে অবস্থিত। [বর্ণনায়: হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-বুখারী]
দুইঃ স্ত্রীলোকের পক্ষে গাঁয়ের মুহাররম (যাদের সঙ্গে বিবাহ জায়েয) পুরুষদের সামনে মাথা, বাহু, হাঁটুর নিচের অংশ ইত্যাদি খোলা রাখা হারাম। বিশেষ কারণে যেমন কোনো নিকটআত্মীয়কে ঘন ঘন ঘরে আসতে হয় অথচ ঘরের ভিতর সব সময় পর্দা করার মতো পরিসর নেই, এমতাবস্থায় চেহারা, উভয় হাতের কব্জি ও উভয় পায়ের উপরের পাতা খোলা রাখা জায়েয। এরকম পরিস্থিতিকে মেয়েদের উচিত হবে, ভালো করে পুরো মাথা ঢেকে রাখা, লম্বা হাতাওয়ালা জামা পরা, আটশাট পায়জামা না পরা, হাতের কব্জি ও পায়ের গোড়ালী খোলা না রাখা, কোনো জরুরী প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় বোরখা পরে বের হওয়া।
তিনঃ শরয়ী মুহাররম (যাদের সঙ্গে বিবাহ হারাম) তাদের সামনে নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং পেট-পিঠ খোলা রাখা স্ত্রীলোকদের জন্য হারাম। শরীরের অন্যান্য অংশ যেমন মাথা, মুখ, বাহু ও হাঁটুর নিচের অংশ খোলা রাখা জায়েয থাকলেও বিনা প্রয়োজনে খোলা রাখা উচিত নয়। শরয়ী মহাররম বলতে ঐ সমস্ত পুরুষকে বোঝায় যাদের সঙ্গে কোনোদিনই বিবাহ বৈধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেমন, পিতা, পুত্র, সহোদর ভাই, সতেলা ভাই, বৈপিত্রেয় ভাই ও তাদের সন্তানাদি এবং অন্যান্য যাদের সঙ্গে চিরদিনের জন্য বিবাহ করা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আর যাদের সঙ্গে জীবনে কখনো বিবাহ বৈধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তারা শরয়ী মুহাররম নন, বরং গায়ের মুহাররাম। তারা যতই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হোক না কেন, অপরিচিত বা ভিন্ন পুরুষের বেলায় শরীয়তের যে নির্দেশ, এদের বেলায়ও সেই নির্দেশ। নিকট আত্মীয় বলতে চাচাতো, ফুফাতো, মামাতো ও খালাতো ভাই, দেবর, ভাশুর, দুলাভাই ও নন্দাই এদেরকেই বোঝায়। এদের সঙ্গে আমরা মোটেই পর্দা করি না। কিন্তু এদের সঙ্গেও ভিন্ন পুরুষদের মতো পর্দা করা শরীয়তের হুকুম।
চারঃ পুরুষ স্ত্রীলোকের কিংবা স্ত্রীলোক পুরুষের গান শোনা শরীয়তের নিষেধ।
পাঁচঃ ফিকাহবীদগন মুহাররমা যুবক যুবতীদের মধ্যে সালাম বিনিময় করিতে নিষেধ করেছেন।”
এখন আপনারাই বলুন, মুসলমান হয়ে আমাদের শরীয়তের হুকুমের বরখেলাপ করা নিশ্চয় উচিত নয়? তাই আমি বিয়ের দিন মেজ নন্দাইকে পাল্কি থেকে তুলে নিয়ে আসতে নিষেধ করে নিজেই হেঁটে এসেছিলাম এবং ওলিমার দিন গায়ের মুহাররম পুরুষদের মুখ দেখতে দিই নাই। এটা সমাজে একটা কুরীতি। এই রীতি সমাজ থেকে দূর হওয়া উচিত। তাই আমাদেরকেই এজন্য সচেষ্ট হতে হবে। নচেৎ কাল হাশরের মাঠে জওয়াবদিহি করতে হবে। আজ এই পর্যন্ত থাক, বেলা হয়েছে। সংসারের কাজ পড়ে আছে, নাস্তা ও রান্নার আয়োজন করতে হবে। তারপর নিলুফার চুপ করে গেল।
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে ইলিয়াস মির্জা বললেন, নিলুফার যা কিছু বলল, সেসব আমরা জানতাম না, জানার পর ইনশাআল্লাহ সবাই যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করব।
.
০৫.
গালিবাদের কলেজ একমাস বন্ধ ছিল। আগামীকাল খুলবে। এতদিন ওড়না গায়ে-মাথায় দিয়ে কলেজ করেছে। নিলুফারের কাছে মেয়েদের পর্দার আলোচনা শুনে ভেবেছে, এবার বোরখা পরে কলেজ যাবে। তার বোরখা নেই। তাই আব্বাকে সেকথা জানিয়ে বোরখা কিনে দিতে বলেছিল। দুদিন আগে ইলিয়াস মির্জা বোরখা কিনে দিয়েছেন। একসময় নিলুফারকে বলল, জান ছোট ভাবি, আমাদের কলেজের মেয়েরা ওড়না গায়ে-মাথায় দিয়ে যায় না। সবাই শুধু বুকের উপরে দেয়। আমি গায়ে-মাথায় দিয়ে যাই বলে মেয়েরা নানারকম কথা বলে, হাসি ঠাট্টা করে। তোমার কাছে পর্দা সম্পর্কে কুরআন হাদিসের বাণী শুনে ভেবেছি, এবার থেকে বোরখা পরে যাব। কিন্তু ঐসব মেয়েরাতো আরো বেশি ঠাট্টা বিদ্রূপ করবে? তাদের মুখ কি করে বন্ধ করা যায়, সে সম্পর্কে কিছু। বলে দাও না ছোট ভাবি।
নিলুফার বলল, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ)-এর বিধি-নিষেধ মেনে চলে, তাদেরকে অন্যদের অনেক ঠাট্টা বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়। কারণ এটাও তোমার ঈমানের পরীক্ষা। যারা পরীক্ষায় পাশ করতে পারে, তারা মহাসৌভাগ্যবান। তোমাকে বোরখা পরতে দেখে কেউ কিছু বললে বলবে, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) বিধি-বিধানকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, তারা মুসলমান থেকে বাদ হয়ে যাবে। আর আরেকটা কথাও বলতে পার, মানুষের শরীরের যেসব অংশ সব সময় ঢাকা থাকে, সেসব অংশের সৌন্দর্য যতটা বজায় থাকে, যেসব অংশ খোলা থাকে, সেসব অংশের সৌন্দর্য ততটা থাকে না। তোমরা তোমাদের শরীরের ঢাকা অংশ ও খোলা অংশ দেখে পরীক্ষা করতে পার। মেয়েদের আপাদমস্তক সৌন্দর্যের প্রতীক। আর সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার মালিক একমাত্র তাদের স্বামী। তাইতো আল্লাহ কুরআন পাকে মেয়েদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে ঘরের বাইরে যাতায়াত করতে নিষেধ করেছেন। আরো একটা কথা বলতে পার, “যে সব মেয়েরা বোরখা পরে ঘরের বাইরে যাতায়াত করে, তাদের প্রতি পুরুষরা একবার তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। অপরপক্ষে যেসব মেয়েরা বোরখা না পরে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে ঘরের বাইরে যাতায়াত করে, তাদের দিকে পুরুষরা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সৌন্দর্য সুধা পান করে। একদিকে নিজেরা ইসলামের বিধান লংঘন করে পাপী হচ্ছে, অন্যদিকে পুরুষদেরকেও পাপী করছে।”
যারা তোমাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে তারা এসব শোনার পর মনে হয় আর তা করবে না। তারপরও যদি করে, আমাকে জানিও, আমি তাদের কথার প্রতিউত্তর তোমাকে শিখিয়ে দেব।
.
গালিবাদের কলেজ, গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার। ওদের পাড়া থেকে নাফিসা ও রাফিয়া নামে দুটো মেয়ে একই কলেজে বি.এ. ক্লাসে পড়ে। তিনজন একসঙ্গে যাওয়া-আসা করে। নাফিসা ও রাফিয়া ধনী ঘরের আপন চাচাত বোন। তাদের বাড়ির সবাই বর্তমান সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। তাই তাদের মেয়েরা পর্দা প্রথা পছন্দ করে না। গালিবা গায়ে মাথায় ওড়না দিয়ে কলেজে গেলেও এতদিন তেমন কিছু বলত না। কিন্তু আজ তাকে বোরখা পরতে দেখে নাফিসা বলল, কি রে, তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাকি?
গালিবা বলল, বিয়ে ঠিক হলে তোমরাও জানতে পারতে?
হ্যাঁ, তা অবশ্য জানতাম। ওড়না ছেড়ে বোরখা পরেছিস, তাই বললাম আর কি?
গালিবা বলল, এতদিন জানতাম বিয়ের পর মেয়েরা বোরখা পরে, কিন্তু ছোট ভাবির কাছে জানাতে পারলাম সাবালিকা কুমারীই হোক আর বিবাহিতাই হোক সব মেয়েদেরকে পর্দা করে ঘরের বাইরে যাতায়াত করতে আল্লাহ বলেছেন। আর পর্দার করার শ্রেষ্ঠ উপাদান হল বোরখা। অবশ্য বড় চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকেও মেয়েরা ঘরের বাইরে যাতায়াত করতে পারে।
রাফিয়া এতক্ষণ চুপ করে হাঁটছিল। গালিবা থেমে যেতে বলল, ওলিমার দিন নতুন বৌ-এর মুখ দেখার ব্যাপারে তোর ছোট ভাবির লেকচার শুনে যা ধারণা করেছিলাম, এখন তোর মুখে পর্দা সম্পর্কে তার কথা শুনে সেই ধারণা দৃঢ় হল। তা হ্যাঁ রে, তোর ভাইয়াতো ধর্ম-কর্ম কিছুই করে না, তার সঙ্গে মিলমিশ হয়েছে তো?
মিলেমিশ হবে না কেন? ধার্মিক মেয়েরাই তো স্বামীকে বেশি ভালবাসে, সম্মান করে। ছোট ভাবিতে মাত্র মাসখানেক হল এসেছে, এরই মধ্যে শুধু ছোট ভাইয়াকে নয়, বড় তিন ভাইয়া ও ভাবিদের নামায ধরিয়ে ভোরে উঠার অভ্যাস করিয়েছে। প্রতি শুক্রবার ফজরের নামাযের পর বাড়ির সবাইকে নিয়ে বৈঠক করে। বৈঠকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা হয়। সামনের শুক্রবার থেকে বেলা তিনটের সময় ও বিভিন্ন মসলা-মাসায়েলের উপর আলোচনা হবে। পাড়ার মেয়েদের কথাটা জানিয়ে ঐ সময়ে আসার জন্য আমাকে বলতে বলেছে। তোমরাও ইচ্ছা করলে আসতে পার।
রাফিয়া বলল, আমি কিন্তু মেয়েদের পর্দা প্রথার ঘোর বিরোধী। পর্দা পর্দা করে মুসলমান নারীরা অন্যান্য জাতির চেয়ে যেমন অনেক পিছিয়ে আছে, তেমনি পুরুষদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে।
রাফিয়া থেমে যেতে নাফিসা বলল, আমিও তোর সঙ্গে একমত।
গালিবা বলল, এ সম্পর্কে আমি তোমাদের সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। শুধু এতটুকু বলতে পারি, তোমাদের ধারণা ঠিক নয়। তোমরা যদি শুক্রবার বৈঠকে এসে ছোট ভাবিকে কথাটা বল, তা হলে সে হয়তো তোমাদের ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দিতে পারবে।
রাফিয়া বলল, ঠিক আছে, আসব।
.
ইলিয়াস মির্জার চাচাত ভাই-এরা নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক। চাষবাস করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। ছেলেদের প্রাইমারী পর্যন্ত পড়িয়ে চাষের কাজে লাগিয়ে দেন। আর মেয়েদেরকেও প্রাইমারী পর্যন্ত পড়িয়ে গৃহস্থালীর কাজ করান। আর একটু বড় হলে বিয়ে দিয়ে দেন। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর থেকে ইলিয়াস মির্জা চাচাত ভাইয়েদের বিপদ-আপদে অনেকভাবে সাহায্য করে আসছেন। মেয়েদের বিয়ে খরচ একরকম তিনিই দিয়েছেন। যা কিছু করেছেন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের গোপন করে। চাচাত ভাইয়েদের মধ্যে হাফিজউদ্দিনের একটাই ছেলে, নাম নাযিম উদ্দিন। সবাই নাযিম বলে ডাকে। নাযিম খুব ভালো ছাত্র। প্রাইমারী পাস করে হাইস্কুলে পড়ার জন্য জিদ ধরে। হাফিজ উদ্দিনের সংসার ছোট। তাই অন্য ভাইয়েদের তুলনায় একটু সচ্ছল অবস্থা। ছেলের পড়ার জন্য জিদ ধরলে হাইস্কুলে ভর্তি করেন। নাযিম এস.এস.সি-তে ভালো রেজাল্ট করে কলেজে পড়ার জন্য মা-বাবাকে বলে। ছেলেকে কলেজে পড়াবার মতো অবস্থা হাফিজউদ্দিনের নেই। তাই ছেলেকে সঙ্গে করে ইলিয়াস মির্জার কাছে এসে তার কলেজে পড়ার কথা বলেন।
ইলিয়াস মির্জা নাযিমকে জিজ্ঞেস করলেন, কলেজতো অনেক দূর, যাতায়াত করবে কী করে?
নাযিম বলল, কলেজের কাছাকাছি কোনো বাড়িতে লজিং-এ থাকার চেষ্টা করবে।
ইলিয়াস মির্জার নিজের বাড়িতে রেখে ভাইপোকে পড়াবার ইচ্ছা থাকলেও স্ত্রীর কথা ভেবে তা বলেন নি এবং স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নি। তার কথা শুনে বলেছিলেন, ঠিক আছে, তুমি সেই ব্যবস্থা কর। আমি তোমার কলেজের সব খরচ দেব। তুমি মাসে মাসে এসে টাকা নিয়ে যেও।
নাযিম যখন মাসে মাসে টাকার জন্য যেত তখন একদিন দৈবক্রমে গালিবার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং দুজন দুজনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। তাই নাযিম যেমন গালিবাকে দেখার জন্য একমাস অধীর আগ্রহ নিয়ে দিন গুনত, তেমনি গালিবাও অধীর আগ্রহে দিন গুনত। গালিবা অবশ্য খুব চালাকির সঙ্গে জেনেছে, নাযিম ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ আব্বা দেয়। সেই খরচ নেয়ার জন্য সে প্রতিমাসে আসে। তারপর গালিবা যখন কলেজে ভর্তি হয় তখন নাযিম ডিগ্রীতে পড়ে। সেই তাকে কলেজে ভর্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করে। তারপর ক্রমশঃ তারা একে অপরকে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু সে কথা কেউ কাউকে জানায় নি। সেও আব্দুল হান্নানের ওলিমাতে গিয়েছিল এবং তার বৌ সেদিন মেয়েদের পর্দা সম্পর্কে যা কিছু বলেছিল, শুনেছে। ঐদিন ইলিয়াস মির্জা বাড়ির সবার সঙ্গে নাযিমের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
আজ কলেজে এসে গালিবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অবাক হয়ে বলল, নিশ্চয় ছোট ভাবির চাপে বোরখা পরে এসেছ?
গালিবা বলল, তোমার ধারণা ভুল। ছোট ভাবির মুখে মেয়েদের পর্দা সম্পর্কে কুরআন হাদিসের বাণী শুনে আমি নিজের ইচ্ছায় বোরখা পরে এসেছি। কেন, তুমি কী মেয়েদের বোরখা পরা পছন্দ কর না?
তা ঠিক নয়, তবে আমিতো জানি বিয়ের পর মেয়েরা বোরখা পরে। তা ছাড়া তুমি এখন ছাত্রী। এসময় বোরখা পরা তোমার ঠিক হয় নি।
তোমার জানাটাও ভুল। মেয়েরা সাবালিকা হওয়ার পর বোরখা বা বড় চাদর দিয়ে মাথাসহ সারা শরীর ঢেকে ঘরের বাইরে যাতায়াত করবে। তা সে কুমারীই হোক বা বিবাহিতাই হোক, এটাই কুরআন-হাদিসের বাণী।
আমিতো কুরআন-হাদিস পড়ি নি। তাই কথাটা জানা ছিল না।
এখন যখন জানলে তখন আর নিশ্চয় ছাত্রী অবস্থায় বোরখা পরা ঠিক হয় নি বলবে না?
নাযিম কিছু না বলে চুপ করে রইল।
গালিবা বলল, বোরখা পরেছি বলে তুমি যে অসন্তুষ্ট হয়েছ, তা তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি। কী জান, আমরা মুসলমান হয়ে সওয়াবের আশায় শুধু তোতা পাখির মতো কুরআন পড়ি। কিন্তু পড়ার আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ কুরআনের অর্থ বুঝি না এবং বোঝার চেষ্টাও করি না। তাই আল্লাহর বিধি নিষেধ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না। আব্বাকে ব্যাখ্যাসহ কুরআন কিনে দিতে বলেছি। আর তোমাকে বলছি, তুমিও একটা কিনে পড়। এই এক দেড় মাসের মধ্যে ছোট ভাবির কাছে কুরআন-হাদিসের বাণী শুনে মনে হয়েছে, আমরা শুধু নামে মুসলমান। ধর্ম সম্পর্কে একরকম কিছুই জানি না এবং মানিও না।
নাযিম বলল, ছোট ভাবি দেখছি, এই কয়েকদিনে তোমাকে হেদায়েত করে ফেলেছে?
শুধু আমাকে নয়, বাড়ির সবাইকেই। তার কাছে কয়েকদিন কুরআন হাদিসের বাণী শুনলে তুমিও হেদায়েত হয়ে যাবে।
নাযিম হেসে উঠে বলল, হেদায়েত হই আর না হই, যাবতো বটেই। তবে ছোট ভাবির একটা জিনিস আমি মেনে নিতে পারি নি।
বল সেটা কি জিনিস?
আমিতো তার ছোট ভাইয়ের মতো, তবু আমাকে মুখ দেখাল না। এটা কি তার উচিত হয়েছে?
এ ব্যাপারে সেদিন ছোট ভাবি যা কিছু বলেছে, শোন নি?
হ্যাঁ শুনেছি।
তা হলে আবার ওকথা বলছ কেন? তবু যদি তোমার মনের খটকা দূর না হয়, তা হলে যেদিন আমাদের বাড়িতে আসবে সেদিন ছোট ভাবির কাছেই কথাটা বলো। তারপর হাতঘড়ি দেখে বলল, চলি ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।
গালিবা চলে যেতে উদ্যত হলে নাযিম বলল, এই শোন, আজ ক্লাস হয়ে সাসপেন্ড হয়ে যাবে। আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হবে কি করে?
কেন, তুমি আমাদের বাড়িতে আসবে।
তা আসব। কিন্তু প্রতিদিনতো আর দেখা হবে না? তোমাকে বেশি দিন না দেখলে আমার খুব খারাপ লাগবে। তোমার লাগবে না?
ক্লাস সাসপেন্ডের কথা শুনে গালিবারও মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু তা প্রকাশ না করে এতক্ষণ কথা বলছিল। এখন তার কথা শুনে মনের আবেগ সামলাবার জন্য মুখে না বলে মাথা নিচু করে শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
নাযিম বলল, আমি যে তোমাকে ভালবাসি, তা কি তুমি জান?
গালিবা লজ্জা পেয়েও এবারও মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল।
তুমি আমাকে ভালবাস কিনা বলবে?
গালিবা আরো বেশি লজ্জা পেয়ে বলল, তা কি তুমি বুঝতে পার নি?
পেরেছি, তবু তোমার মুখে শুনতে চাই।
ভালবাসা মুখের কথায় নয়, অন্তরের।
ঠিক আছে, পরীক্ষার পর মাকে বলব তোমাকে বৌ করে আনার জন্য। কী, রাজি আছ তো?
বিয়ের কথা শুনে গালিবা লজ্জায় লাল হয়ে জানি না যাও বলে দ্রুত ক্লাসের দিকে চলে গেল।
.
নাযিমের মুখে ভালবাসা ও বিয়ের কথা শুনে খুশীর আমেজ নিয়ে গালিবা বাড়ি ফিরল।
তার চোখে মুখে আনন্দের আভা নিলুফারের চোখ এড়াল না। একসময় বলল, আজ যেন তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে।
গালিবা বলল, কেমন দেখাচ্ছে মানে?
মানে, কোনো দুর্লভ জিনিস মানুষ হঠাৎ পেয়ে গেলে যেমন খুব খুশী হয়, চোখে মুখে খুশীর আমেজ ফুটে উঠে, তোমাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে।
কথাটা শুনে গালিবা যেমন লজ্জা পেল, তেমনি ভয়ও পেল। ভাবল, ছোট ভাবির কাছে আসল কথা গোপন করে মিথ্যে কিছু বলা ঠিক হবে না। সামলে নিয়ে তবু ভনিতা করে বলল, কই, তেমন কিছুতো পাই নি?
নিলুফার মৃদু হেসে বলল, তুমি মুখে অস্বীকার করলেও তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আমার অনুমান সত্য। তারপর বলল, দেখ ছোট বুবু, তোমাদের বয়স আমি পার করে এসেছি। ঐ বয়সে ছেলেমেয়েরা স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করে, তারা গার্জেনদের কাছে অনেক কিছু গোপন করে। আমিতো তোমার গার্জেন নই, বরং বন্ধু। আমাকে বলতে পার। ভালো বুঝলে সাহায্য করব। আর মন্দ বুঝলে ফেরাবার চেষ্টা করব। তবে এই ক’দিনে তোমাকে যতটুকু জেনেছি তুমি মন্দ কোনো কিছু করতে পার না।
গালিবা বলল, তোমাকে আমিও বন্ধুর মতো মনে করি। আমার জীবনের ভালো মন্দ যা কিছু ঘটুক না কেন তোমাকে বলবই। না জিজ্ঞেস করলেও একসময় না একসময় বলতাম। বলার আগে তোমাকে দু’একটা প্রশ্ন করতে চাই।
বেশ তো কর।
প্রেম-ভালবাসা কি ইসলামে নিষিদ্ধ?
হ্যাঁ, বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মেলামেশা যেমন ইসলামে নিষিদ্ধ তেমনি তাদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসাও নিষিদ্ধ। তবে একে অপরকে পছন্দ করতে পারে এবং বিয়ের প্রস্তাবও দিতে পারে। এবার তোমার খুশীর কারণটা বল।
আমার এক চাচাত ভাই আমাদের কলেজে পড়ে। সে আমাকে পছন্দ করে।
কি করে জানলে সে তোমাকে পছন্দ করে?
সে আজ বলেছে।
তুমি তাকে কিছু বল নি?
গালিবা লজ্জায় কিছু বলতে না পেরে মাথা নিচু করে রইল।
তা হলে তুমিও তাকে পছন্দ কর তাই না?
গালিবা কিছু না বলে একইভাবে রইল।
আরে এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? বললাম না, ইসলাম ছেলে-মেয়েকে পছন্দ করার অধিকার দিয়েছে? তবে তা যেন সৎপাত্র বা সৎপাত্রী হয়। একটা হাদিস বলছি শোন, “জনৈকা ভদ্রমহিলা রাসূল (দঃ) এর দরবারে হাজির হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (দঃ) আমি নিজেকে আপনার খিদমতে সমর্পণ করার জন্য এসেছি। (অর্থাৎ বিবাহের প্রস্তাবের জন্য এসেছি)। রাসূল (দঃ) তাঁর দিকে তাকালেন এবং চক্ষু অবনমিত করলেন। ভদ্রমহিলা যখন দেখলেন এ ব্যাপারে রাসূল (দঃ) কোন ফয়সালা দিচ্ছেন না তখন তিনি বসে পড়লেন। [বর্ণনায়: হযরত সাহল বিন সায়াদ (রাঃ) সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম]
গালিবা মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমিও তাকে পছন্দ করি।
সে কথা তোমার চাচাত ভাই জানে?
আমরা দু’তিন বছর আগে থেকে একে অপরকে পছন্দ করি। কিন্তু সে কথা কেউ কাউকে জানাই নি। আজ থেকে তার ক্লাস সাসপেন্ড হয়েছে। আর দেখা। সাক্ষাৎ হবে না জানিয়ে সেই-ই প্রথমে কথাটা জানায় এবং আমাকে জিজ্ঞেস করে আমিও তাকে পছন্দ করি কিনা। আমি লজ্জায় মুখে বলতে না পেরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে বলল, পরীক্ষার পর তার মা-বাবাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।
তাই নাকি? এটাতো দারুণ খুশীর কথা। বোঝা যাচ্ছে, তোমরা শুধু একে অপরকে পছন্দ কর না, ভালও বাস। মনে হচ্ছে তুমি খুব ভাগ্যবতী, হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, পরস্পর দুইজন প্রেমিকের পক্ষে বিবাহের ন্যায় আর কিছুই নাই। [বর্ণনায়: হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-ইবনে মাযাহ] তা তোমার চাচাত ভাইয়ের নাম কি?
নাযিম উদ্দিন, ডাক নাম নাযিম।
ওদের আর্থিক অবস্থা কেমন?
ভালো না। নাযিম অন্যের বাড়িতে লজিং-এ থেকে পড়াশোনা করছে। আর আব্বা তার সব খরচ দিচ্ছে কথাটা বলতে গিয়েও বলল না। বলল জান ছোট ভাবি, আমার খুব ভয় হয়, চাচা প্রস্তাব নিয়ে এলে গরিব ভেবে আব্বা যদি ফিরিয়ে দেন?
তুমি কোনো চিন্তা করো না। চাচা প্রস্তাব নিয়ে এলে নিশ্চয় জানতে পারব। তখন আমি তোমার পক্ষে আব্বার সঙ্গে কথা বলব। তা ছাড়া আল্লাহ তোমাদের জোড়া করে থাকলে কেউ বাধা দিয়েও কিছু করতে পারবে না।
সত্যি বলছ ছোট ভাবি, তুমি আমার হয়ে আব্বার সঙ্গে কথা বলবে।
হ্যাঁ, সত্যি বলছি। ছেলে-মেয়ের অমতে গার্জেনদের বিয়ে দিতে ইসলাম নিষেধ করেছে। যাই হোক, এ ব্যাপারে যা বলার আমি আব্বাকে বলব। এখন তোমার প্রেমিকের দোষ-গুণগুলো বল দেখি।
তার আগে বল, এটা যে আমাদের নানাবাড়ি, আব্বা নানার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই আছেন, এসব কি জান?
হ্যাঁ জানি। আরো জানি তোমার এবং আমার আব্বার বাড়ি একই গ্রামের ও তারা বাল্যবন্ধু। এবার যা জিজ্ঞেস করলাম বল।
আমিতো আব্বার দেশের বাড়িতে কখনও যাই নি। তাই তাদের সম্পর্কে একরকম কিছুই জানি না। আব্বার মুখে এবং নাযিম ভাইয়ের মুখে একটু আধটু যা শুনেছি, নাযিম ভাই ধর্মের তেমন কিছু জানে না। তবে নামায রোযা করে। আর খুব চরিত্রবান ছেলে।
সে যে চরিত্রবান, জানলে কি করে? তার বাড়ি তো অনেক দূরে?
কলেজে তাকে কোনোদিন কোনো মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করতে বা কথা বলতে দেখিনি।
তার ধর্মের জ্ঞান নেই জানলে কি করে?
আজ বোরখা পরে কলেজে যেতে দেখে যা বলেছে তাতেই বুঝেছি।
কি বলেছে শুনি।
নাযিম যা কিছু বলেছে গালিবা সেসব বলে বলল, তাকে আমাদের বাড়িতে এসে তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলেছি।
নিলুফার বলল, তাকে আসতে বলে খুব ভালো করেছ। তারপর বলল, তোমাকে যে পাড়ার মেয়েদের শুক্রবার তিনটের সময় আসবার জন্য বলতে বলেছিলাম, সে কথা মনে আছে তো?
হ্যাঁ আছে। জান ছোট ভাবি, আমাদের পাড়ার নাফিসা ও রাফিয়া ডিগ্রীতে পড়ে। আমরা একসঙ্গে কলেজে যাই। তারপর বোরখা পরা নিয়ে তারা যা কিছু বলেছিল সে সব বলে বলল, তাদেরও আসার জন্য বলেছি।
নিলুফার বলল, খুব ভালো করেছ। এমন সময় আসরের আযান হচ্ছে শুনে আবার বলল, চল, ঘাট থেকে অযু করে আসি।
.
০৬.
এক শুক্রবার বেলা দশটার সময় নাযিম চাচার বাড়িতে এসে প্রথমে চাচা চাচীর সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করল।
ইলিয়াস মির্জা জিজ্ঞেস করলেন, পড়াশোনা কেমন চলেছে?
নাযিম বলল, জি ভালো, দোয়া করবেন যেন ভালো রেজাল্ট করতে পারি।
তাতো করবই, আরো করব আল্লাহ যেন তোমাকে মানুষের মতো মানুষ করেন। তোমার বাপ যে সেই তিন চার বছর আগে এসেছিল, আর এল না। তোমার চাচারাও অনেক দিন আসেনি। তাদেরকে আসতে বলো।
জি বলব।
গালিবা কি একটা দরকারে মায়ের কাছে এসে নাযিমকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, নাযিম ভাই কেমন আছ? বাড়ির সবাই ভালো আছে?
সালামের উত্তর দিয়ে নাযিম বলল, হ্যাঁ সবাই ভালো আছে।
জাহিদা বেগম মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নাযিমকে মেহমানখানায় নিয়ে গিয়ে নাস্তা দে।
গালিবা নাযিমকে মেহমান খানায় নিয়ে এসে নাস্তা খেতে দিয়ে বলল, তোমার আমার সম্পর্কের কথা ছোট ভাবিকে বলেছি।
সেদিন কলেজে গালিবার মন বোঝার জন্য কথাটা বললেও নাযিম জানে চাচা-চাচি ও চাচাত ভাইয়েরা কিছুতেই তার সঙ্গে গালিবার বিয়ে দেবেন না। তাই ঐদিন গালিবা চলে যাওয়ার পর চিন্তা করেছে কথাটা বলা উচিত হয় নি। তার বাবা টাকা না দিলে কলেজে পড়ার আকাক্ষা শুধু স্বপ্নই থেকে যেত। তাদের সম্পর্কের কথা চাচা জানতে পারলে ভাববেন, দুধ দিয়ে কাল সাপ পুষেছি।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে গালিবা বলল, কি ভাবছ?
ভাবছি, সেদিন কথাটা বলা ঠিক হয় নি। গরিবদের স্বপ্ন কখনো সফল হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রেম-ভালবাসা তাদের জন্য অভিশাপ ডেকে আনে। তুমি কি মনে কর, তোমার গার্জেনরা আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবেন?
তোমার কথাগুলো হয়তো ঠিক, তারা মেনে নেবেন না; কিন্তু আল্লাহ যদি আমাদেরকে জোড়া করে পয়দা করে থাকেন, তা হলে শত বাধা দিলেও তা আটকাতে পারবেন না।
নাযিম একটা ছোট দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, ভাগ্যে থাকলে সিকা ছিঁড়ে দই এর হাঁড়ি বেড়ালের সামনেও পড়ে। আমার কিন্তু বেশ ভয় করছে, চাচা শুনলে কি করবেন?
তুমি অত দুশ্চিন্তা করছ কেন? আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। ছোট ভাবিকে তোমাদের আর্থিক অবস্থার কথা এবং আব্বা ও ভাইয়ারা যে আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবেন না, সে কথাও বলেছি। তারপর নিলুফার যা কিছু বলেছে বলল।
মনের আশা পূরণ হওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা দেখে নাযিম বলল, আল্লাহ ছোট ভাবির ভালো করুক। তার সঙ্গে এখন দেখা করা যাবে না?
তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন? সময় মতো সেই তোমার সঙ্গে দেখা করবে। তারপর বলল, গতকাল বড় ও মেজ দুলাভাই এসেছেন। তাদেরকে ডেকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিই। কথা শেষ করে গালিবা নাস্তার খালি প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে আসিফ ও খুরশীদকে নিয়ে এসে নাযিমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, আপনারা গল্প করুন আমি যাই বলে গালিবা চলে গেল।
.
বেলা তিনটের পর পাড়ার কয়েকজন বৌড়ী-ঝিউড়ী যখন গালিবাদের বাড়িতে এল তখন নিলুফার গালিবাকে নিয়ে বারান্দায় পর্দা টাঙিয়ে বসার জন্য মাদুর বিছাচ্ছে।
গালিবা তাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে ছোট ভাবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বসতে বলল।
এমন সময় নাফিসা ও রাফিয়া দু’তিনজন সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে করে এলে গালিবা তাদের সঙ্গেও ছোট ভাবির পরিচয় করিয়ে দিয়ে বসতে বলল। তারপর বলল, আমি আব্বা, মা, ভাইয়া-ভাবি ও বুবু-দুলাভাইদের ডেকে নিয়ে আসি। তারপর সবাইকে কথাটা জানিয়ে নাযিমকেও আসতে বলে ফিরে এল।
আজ সকালে কুরআন-হাদিসের আলোচনা শেষে গালিবা যখন ছোট ভাবির কথামতো সবাইকে উদ্দেশ্য করে এখনকার বৈঠকের কথা জানিয়ে ছিল তখন ইলিয়ান মির্জা বলেছিলেন, নিলুফার খুব ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতি, শুক্রবারে এই বৈঠক করলে আমি খুশী হব।
সবাই আসার পর নিলুফার আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (দঃ)-এর উপর কয়েকবার দরূদশরীফ পাঠ করে বলল, আমরা এখানে সমবেত হয়েছি আমাদের পরিবারে, সমাজে তথা দেশে যে অশান্তির আগুন জ্বলছে তার কারণ ও সেগুলোর প্রতিকার সম্পর্কে কুরআন-হাদিসের আলোকে আলোচনা করার জন্য। এই আলোচনা একদিন দু’দিন বা একমাস দু’মাস নয়, বছরের পর বছর করলেও শেষ হবে না। তাই যতটুকু সম্ভব প্রধান প্রধান কিছু কথা বলার চেষ্টা করব। আর আপনাদেরকে অনুরোধ করব, বিভিন্ন ধর্মীয় বই বাংলায় অনুবাদ হয়েছে, সেগুলো পড়ার জন্য। আমি প্রথমত পরিবার সম্পর্কে আলোচনা করব। তার আগে একটা কথা বলতে হচ্ছে “ডু ইওর ডিউটি” অর্থাৎ তোমার কর্তব্য তুমি কর। আপনারা হয়তো বলবেন আমরাতো আমাদের কর্তব্য করেই চলেছি। আমিও আপনাদের সঙ্গে একমত। কিন্তু মুসলমানরা নিজেদের কর্তব্য নিজেরা ঠিক করতে পারে না। সেই কর্তব্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কুরআনের মাধ্যমে ও তার প্রেরিত পুরুষ হযরত মুহাম্মদ (দঃ) দ্বারা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। সেগুলো প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর জানা ও মানা অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর উপর কুরআনের যে পাঁচ আয়াত প্রথম নাযিল করেন তা হল “পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন, সৃষ্টি করিয়াছেন মানুষ, আলাকু থেকে, পড় তোমার প্রভু মহা মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়াছেন, শিক্ষা দিয়াছেন মানুষকে যা সে জানত না।” [সূরা-আলাক্ব, ১/২/৩/৪/৫ আয়াত, পারা-৩০]
তা হলে আমরা জানতে পারছি আল্লাহর প্রথম হুকুম হল, ইক্রা, অর্থাৎ পড়। এখান থেকে ইসলামের যাত্রা শুরু। “ইকুরা” ব্যাপক অর্থে জ্ঞানার্জন। ইসলামে জ্ঞানার্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয। [বর্ণনায় মুসলিম] আর কুরআন-হাদিসের জ্ঞান সর্বোত্তম জ্ঞান। এই জ্ঞান অর্জন করলে মানুষ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে চিনবে। আল্লাহকে চিনলে তাঁর আদেশ ও নিষেধ মানতে বাধ্য হবে। আজ মুসলমানরা কুরআন-হাদিস পড়ছে না বলে আল্লাহকে চিনছে না। তাই তাঁর আদেশ-নিষেধও মানছে না। আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যারা কুরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন করেছেন, তারা কেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ)-এর বিধি-নিষেধ মেনে চলছে না? এর উত্তর দিতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। ইনশাআল্লাহ পরে এ সম্পর্কে আলোচনা করব। এখন শুধু এতটুকু বলতে পারি, বর্তমানে বেশির ভাগ আলেমরা পার্থিব ভোগ-বিলাস ও সুখ স্বাচ্ছন্দের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। তাই তাঁদের মধ্যে তাক্ওয়ার অভাব অর্থাৎ আল্লাহভীতি কমে গেছে। স্বার্থের বশবর্তী হয়ে প্রচলিত কুসংস্কার ও বেদায়াতের প্রতিবাদ না করে সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন। অবশ্য শয়তান এই সমস্ত আলেমদেরকে দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন করে তাদের ইমানকে দুর্বল করে ফেলেছে। যাই হোক, আমি কিন্তু আলেমদের দুর্নাম করছি না। বাস্তবে যা দেখছি, যা জেনেছি- তাই বলছি। আসলে আলেমরাই পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় প্রতিদিন বিধর্মীরা ইসলাম কবুল করছেন। বিভিন্ন মক্তব ও মাদ্রাসা পরিচালনা করে ইসলামকে জিন্দা রাখার ব্যবস্থা করছেন।
আব্দুল হান্নান বলল, তোমার কথা শুনে অনেক প্রশ্ন মনে আসছে। অন্য দিন সে সব আলোচনা করব। পরিবার বা সংসার সম্পর্কে কি বলবে বলেছিলে, সেটা বল। আমিতো জানি, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এই কথাটা ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কতটা সত্য আলোচনা কর।
নিলুফার বলল, “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে” কথাটা বহুল প্রচলিত। ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কথাটা কতটা সত্য, তা আমার আলোচনা শোনার পর আপনারাই বিবেচনা করবেন। বিয়ের পরেই যখন সংসার জীবন শুরু হয় তখন সংসার জীবনের কথা বলার আগে বিয়ে সম্পর্কে দু’চারটে কথা বলছি। বিয়ে হল সংসার জীবনের সাথী নির্বাচন। এই সাথী নির্বাচন খুব হুঁশিয়ারের সঙ্গে করা একান্ত কর্তব্য। যারা এই নির্বাচনে ভুল করবে, তারা যেমন সারাজীবন অনুশোচনার আগুনে জ্বলবে এবং জাহান্নামের স্বাদ দুনিয়াতেই ভোগ করবে। আর যাদের নির্বাচন সঠিক হবে, তারা তেমনি সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাবে এবং দুনিয়াতেই বেহেস্তের স্বাদ অনুভব করবে। জনৈক উর্দু কবি বলেছেন,
সাদী জিন্দেগীকা সাওয়াল হ্যায়,
জো জীত গ্যায়া
উসকো জান্নাত মিল গেয়া
জো হারগেয়া উসকো
জাহান্নাম মিল গেয়া।
আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, বিবাহে স্ত্রীলোকের চারটি বিষয় দেখিতে হইবে (১) তাহার মাল, (২) তাহার গুণ, (৩) তাহার সৌন্দর্য এবং (৪) তাহার ধর্ম। যাহার ধর্মে মতি থাকে তাহাকে পছন্দ কর। তোমার হাত ধূলিতে পূর্ণ হউক।” [বর্ণনায়: হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)-বুখারী মুসলিম]
তোমরা মেয়ের ধার্মিকতা দেখে বিয়ে কর। মেয়ের গার্জেনদের উচিত ধার্মিক পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। বিয়ের আগে কনেকে দেখে নেওয়ার অনুমতি ইসলামে থাকায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, শরীয়তের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে পুরুষ তার ভাবী স্ত্রীকে এবং মেয়ে তার ভাবী স্বামীকে বাছাই করার (মনোনীত করার) অধিকার রয়েছে। কুরআন মজিদে পুরুষদের সম্বোধন করে আল্লাহ বলিয়াছেন, “অনন্তর তোমরা বিয়ে কর যে সব মেয়ে লোক তোমাদের জন্য ভালো হবে ও ভালো লাগবে।” [সূরা- নেসা, আয়াত-৩, পারা-৪]
এই আয়াতের শানেনজুল হচ্ছে, তখনকার লোকেরা বাপ-দাদার লালিত পালিতা ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ে করত শুধু তাদের রূপ-যৌবন ও ধন-মালের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। ফলে বিবাহিত জীবনে ঐসব মেয়েদের প্রতি উপেক্ষা, বিরাগ ও অযত্ন দেখাত। কারণ মনের আকর্ষণে বা ভালোলাগার কারণে বিয়ে করত না, করত রূপ-যৌবন ও ধন-মাল অবাধে ভোগ করার জন্য। ফলে ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি যে অবিচার ও জুলুম হত, তারই নিরসন দূর করার উদ্দেশ্যে আল্লাহপাক এই নির্দেশ দিয়েছেন।
উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর বিভিন্ন তাফসীরকারীগণ বিভিন্ন তাফসীর করেছেন। যেমন আল্লামা জালাল উদ্দিন আল-কাসেমই লিখেছেন, “অর্থাৎ রূপ-সৌন্দর্য, জ্ঞান-বুদ্ধি ও পারিবারিক ব্যবস্থাপনা ও কল্যাণ ক্ষমতার দিক দিয়ে যেসব মেয়ে তোমাদের নিজেদের জন্য ভালো বিবেচিত হবে, মন মতো হবে, তোমরা তাদের বিয়ে কর।”
বিয়ের জন্য একটি মেয়েলোক হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং তাকে দুটো দিক দিয়ে যোগ্য হতে হবে। প্রথম দিক এই যে, সে নিজে হবে পবিত্র, চরিত্রবতী ও কল্যাণময়ী। আর দ্বিতীয় এই যে, যে পুরুষ তাকে বিয়ে করবে, তার জন্যও সে হবে প্রেমময়ী, কল্যাণময়ী ও সর্বগুণে গুনান্বিতা এবং তার মন মতো। এ ধরনের মেয়ে বাছাই করে বিয়ে করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে উপরোক্ত আয়াতে।”
শায়খ মুহাম্মদ নববী (রঃ) এই আয়াতের তফসীরে লিখেছেন, “অর্থাৎ অপরিচিতা বা সম্পর্কহীন মেয়েলোকের মধ্যে যাদের প্রতি তোমার মন আকৃষ্ট হয় এবং যাদের পেলে তোমাদের দীল সন্তুষ্ট এবং আনন্দিত হবে ও যাদের ভালো বলে গ্রহন করতে পারবে, তোমরা তাদেরকেই বিয়ে কর।
আসলে মেয়েদের ধার্মিকতা ও গুণগরিমা দেখে বিয়ে করা উচিত। নচেৎ নিছক লাভ কিংবা রূপ-যৌবন ভোগের লালসায় পড়ে যে সব বিয়ে হয়, তা কিছুদিনের মধ্যে ভোগ সম্ভোগী তৃপ্তিলাভের পর বিয়ে ভেঙ্গে যায় অথবা অশান্তির আগুনে জ্বলতে জ্বলতে ঘর-সংসার অতিবাহিত করতে হয়।
ইসলাম কনে বাছাই করার অধিকার শুধু যে পুরুষদেরকে দিয়েছে তা নয়, মেয়েদেরকেও দিয়েছে। পুরুষ যেমন নিজের দিক দিয়ে বিবেচনা করবে কনেকে, তেমনি কনেরও উচিত অনুরূপভাবে বুঝে-শুনে একজন পুরুষকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করবে। এজন্য বিয়ের ব্যাপারে ছেলেমেয়ের ইচ্ছা, পছন্দ, সন্তোষ ও অসন্তোষের অভিমত বা সমর্থন ব্যক্ত করার অধিকার ইসলাম তাদের দিয়েছে। পিতামাতা বা নিকট আত্মীয়রা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে পরামর্শ অবশ্যই দেবেন, কিন্তু তাদের মতামতই যে চুড়ান্ত, তা হতে পারে না। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ছেলে-মেয়েদের কোথাও বিয়ে দিতে বাধ্য করতে পারেন না। বয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে তাদের স্পষ্ট মত ছাড়া সম্পন্ন হতেই পারে না। নবী করিম (দঃ) এ ব্যাপারে খুব স্পষ্ট ও জোরালো ঘোষণা দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, “পূর্বে বিবাহিত এমন জুড়িহীন ছেলেমেয়েদের বিয়ে হতে পারে না, যতক্ষণ না তাদের কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যাবে এবং পূর্বে অবিবাহিত ছেলেমেয়ের বিয়ে হতে পারে না, যতক্ষণ না তার কাছ থেকে স্পষ্ট অনুমতি পাওয়া যায়। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (দঃ), তার অনুমতি কিভাবে পাওয়া যাবে?” তিনি তখন বলিলেন, জিজ্ঞেস করার পর চুপ থাকাই তার অনুমতি।” [বর্ণনায়: বুখারী মুসলিম।]
অন্য হাদিসে আছে, বিবাহিত ছেলে-মেয়েদের স্পষ্ট মতামত নিতে হবে, আর অবিবাহিত ছেলেমেয়েরা চুপ করে থাকলেই তাদের মত আছে, জানা যাবে। বিয়ের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা স্ত্রীলোকদেরকে মতামত জানানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন নি; বরং তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা পছন্দ-অপছন্দ ও মতামতকে পূর্ণমাত্রায় স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদের অমতে কোনো পুরুষের সঙ্গে জোর জবরদস্তি করে বিয়ে দেওয়া শরীয়তে আদৌ জায়েয নেই। এজন্য গার্জেনদের কর্তব্য হচ্ছে, ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তাদের মতামত জেনে তারপর বিয়ের কথাবার্তা চালান বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর জামানার একটা ঘটনা বলছি। “চাচাত ভাইয়ের সাথে পিতা কর্তৃক বিয়ে দেওয়া কোনো মেয়ে রাসুল (দঃ) এর দরবারে হাজির হয়ে বলল, “আমার পিতা আমাকে তার ভাতুস্পুত্রের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। সে নীচ শ্রেণীর লোক, আমাকে বিয়ে করে তার নীচতা দূর করতে চায়। রাসুলুল্লাহ (দঃ) তাকে বিয়ে বহাল রাখার না রাখার স্বাধীনতা দান করলেন। তারপর মেয়েলোকটি বলল, “আমি তো পিতার করা বিয়েতেই অনুমতি দিয়েছি। কিন্তু তবু এ অভিযোগ নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হল, আমি চাই যে, মেয়েলোকেরা একথা ভালো করে জেনে নিক যে, বিয়ের ব্যাপারে পিতাদের কিছুই করণীয় নেই।” [ইবনে মাযা]
আপনারা জানেন কিনা জানি না, নর ও নারী দু’জনে একত্রে মানবজাতি। আল্লাহপাক মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-কে প্রথমে সৃষ্টি করে বেহেশতে রেখেছিলেন। তিনি সেখানে খুব সুখে ছিলেন। কিন্তু মনে যেন কেমন একটা অশান্তি অনুভব করতে লাগলেন। আল্লাহপাক সর্বজ্ঞাতা। তিনি আদম (আঃ) এর মনের অশান্তির কারণ জানেন। তাই তাঁর বামদিকের পাঁজরের একটা হাড় থেকে মা হযরত হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করে দু’জনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। ফলে হযরত আদম (আঃ)-এর মনের অশান্তি দূর হয়ে গেল। তারপর কিভাবে তারা বেহেশত থেকে দুনিয়াতে এলেন, সে কথা আমরা প্রায় সবাই জানি। তাঁদেরই বংশধর সারা দুনিয়ার মানুষ। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, নর ও নারী একত্রে মানবজাতি। এই মানবজাতি কিভাবে সংসারধর্ম পালন করবে আল্লাহ কুরআনপাকে ও তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর দ্বারা সারা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। মানবজাতি যদি সেই জ্ঞান অর্জন করে অনুসরণ করত, তা হলে সারা বিশ্ববাসীকে এতটুকু অশান্তি ভোগ করতে হত না। লক্ষ-লক্ষ দাম্পত্য জীবন পুড়ে ছারখার হয়ে যেত না। ভিন্ন ধর্মালম্বীদের কথা বাদ দিলাম, মুসলমানরা আজ কুরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন করে অনুসরণ করে কি? করে না। কেন করে না বলতে পারেন? পারবেন না। কারণ আমরা শুধু নামে মুসলমান, তা না হলে মুসলমান হয়ে কেন ইসলামকে জানছি না? যারা জানছি তারা কেন মানছি না। এ সবের অনেক কারণ। সে সব বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। ইনশাআল্লাহ আমরা পরে আলোচনা করব। এখন দাম্পত্য জীবনের কথায় আসা যাক। তার আগে পুরুষ ও নারীকে নিজের পরিচয় এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও পারিবারিক জীবনের বিস্তারিত বিধান জানা অতি আবশ্যক। আমরা তা জানি না বলেই আমাদের দাম্পত্য জীবন বিয়ের কিছুদিন পর থেকে ফাটল ধরতে শুরু করে এবং সেই ফাটল ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মধুর সম্পর্ক থাকে না। সারাজীবন কলহ ও অশান্তিতে কাটাতে হয়। তাই স্বামী ও স্ত্রীকে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিয়ের আগে অবশ্যই জানতে হবে। প্রথমে পুরুষ ও নারীকে মনে রাখতে হবে তারা মুসলিম। আর মুসলিম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণকারী। তাই প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উচিত ইসলামের বিধানের উপর আত্মসমর্পণ করা। দাম্পত্য জীবন ও সাংসারিক জীবন সুখময় ও শান্তিময় করার জন্য ইসলাম যে সব বিধান দিয়েছে, সে সব মুসলমান নর-নানীদের মেনে চলা। উচিত। আমরা সে সব যেমন জানি না, তেমনি মেনেও চলি না। এখন আমি কিভাবে দাম্পত্য জীবন ও সাংসারিক জীবন সুখের ও শান্তির হয়, সে সম্পর্কে ইসলামের কি বিধান, সে সম্পর্কে আলোচনা করব।
স্বামী ও স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন মাধুর্যময় ও সুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্য ইসলামে কতকগুলো জরুরী বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমে স্বামী-স্ত্রীর জীবনের প্রধান কয়েকটা দিকের কথা বলছি।
বিয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌন উত্তেজনায় নারী-পুরুষ যেন চরিত্রহীন হয়ে না যায়। প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা ও মনের প্রশান্তি পাওয়া ও বংশবৃদ্ধি করা। বস্তুতঃ বিয়ের প্রকৃত বন্ধন হচ্ছে প্রেম, প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধন। এ বন্ধন নষ্ট হয়ে গেলে অন্যান্য সকল বন্ধন ছিন্ন হতে দেরি হয় না। এজন্য যাতে পরস্পরের প্রতি প্রেম ও ভালবাসা সৃষ্টি হয় এবং তা গভীর ও স্থায়ি হয় সেজন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই বিশেষভাবে যত্ন নিতে হবে। আমাদের আর একটা কথা জানা উচিত, কোনো জিনিসের অর্ধেক দুটো অংশ একসঙ্গে করলে যেমন জিনিসটা পূর্ণ একটিতে পরিণত হয়, তেমনি নারী ও পুরুষ মানবজাতির দুটো অর্ধ্বেক অংশ। তাই ইসলাম পুরুষ ও নারীকে সমান সমান অধিকার দিয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আল্লাহর অনুগত পুরুষ ও স্ত্রীলোক, ঈমানদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহর দিকে মনোযোগকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, সত্য ন্যায়বাদী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, সত্যের পথে দৃঢ়তা প্রদর্শনকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহর নিকট বিনীত নম্র পুরুষ ও স্ত্রীলোক, দানশীল পুরুষ ও স্ত্রীলোক, রোযাদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহতায়ালা এদের জন্যে স্বীয় ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন। কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার স্ত্রীলোকের জন্যে আল্লাহর ও তাঁর রাসুল (দঃ) যখন কোনো বিষয়ে চূড়ান্তভাবে ফায়সালা করে দেন তখন সেই ব্যাপারে তার বিপরীত কিছুর ইখতিয়ার ও স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করার কোনো অধিকার নেই। আর যে লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) এর নাফরমানী করে, সে সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে লিপ্ত হয়। [সূরা-আল আযহাব, আয়াত-৩৫/৩৬, পারা-২২]
আল্লাহ কুরআনে অন্যত্র বলিয়াছেন, “মেয়েরা হচ্ছে পুরুষদের পোষাক, আর তোমরা পুরুষরা হচ্ছ মেয়েদের পোষাক।” [সূরা-বাকারাহ, আয়াত-১৮৭, পারা-২]
আল্লাহ কুরআনের অন্যত্র আরো বলিয়াছেন, আর নারীদেরও (পুরুষদের উপর) দ্রুপ দাবি আছে যদ্রুপ ঐ নারীদের উপর (পুরুষদের দাবি) আছে (শরিয়তের) নিয়ম অনুযায়ী, আর পুরুষদের অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠত্ব রহিয়াছে নারীদের উপর। [সূরা-বাক্বারাহ, আয়াত-২২৮, পারা-২]
আসলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণ সমান। তাদের অধিকারও অভিন্ন। মৌল অধিকারের দিক দিয়ে কেউ কম নয়, কেউ বেশিও নয়।
কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা মতে নারীকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা কি আমরা তাদের দিচ্ছি? দিই নি। বরং তাদেরকে তাদের অধিকারের কথা জানতেও দিই নি। দাম্পত্যজীবন ও সংসার তখনই সুখের ও শান্তির হবে যখন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তাদের অধিকারের কথা জানবে এবং তাদের করনীয় কর্তব্য জেনে উভয়েই মেনে চলবে। আমাদের জানা উচিত শুধু স্বামী অথবা স্ত্রী তার কর্তব্য জেনে ও মেনে চললে হবে না; দু’জনকেই জানতে ও মানতে হবে। এক হাতে যেমন তালি বাজে না, তেমনি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনের দ্বারা দাম্পত্য জীবন ও সংসার সুখের হয় না।
দাম্পত্য জীবন ও সংসার সুখের করতে হলে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই একে অপরের অধিকারকে সম্মান দিতে হবে এবং সব রকমের বাধা-বিপত্তি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। আর স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য ও স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে শরীয়ত কি বলেছে, সে সব জানতে হবে ও মেনে চলতে হবে।
আমরা চাষ-বাস, চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করার আগে ঐসব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার পর কাজ আরম্ভ করি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমরা দাম্পত্য জীবন, সংসার জীবন ও সন্তান উৎপাদন ক্ষেত্রে ইসলামিক জ্ঞান অর্জন না করেই প্রবেশ করি। ফলে বিয়ের কিছুদিন পর দাম্পত্য জীবন ও সংসার জীবন যেমন অশান্তিময় হয়ে উঠে, তেমনি কানা, খোঁড়া, অন্ধ, অপুষ্ট সন্তান জন্ম দিচ্ছি এবং সন্তান মানুষ করার ইসলামিক জ্ঞান না থাকার ফলে তাদেরকে এমনভাবে মানুষ করছি, যারা নাকি ধর্মের প্রতি উদাসীন, সন্ত্রাসী, ধর্ষণকারী ও মাতাল হয়ে সমাজকে তথা দেশকে অশান্তিময় করে তুলছে।
পাড়ার নাফিসা ও রাফিয়া নামে যে দুজন ডিগ্রী ক্লাসের ছাত্রী এসেছে তাদের মধ্যে নাফিসা বলল, স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে কুরাআন-হাদিসে কি বলেছে, সেগুলো আমরা জানতে চাই।
নিলুফার বলল, এ ব্যাপারে হযরত আশরাফ আলি থানবী (রঃ)কৃত কুরআন হাদিসের আলোকে সঠিক পারিবারিক জীবন সম্পর্কে যা কিছু লিখেছেন, তার কিয়দংশ বলছি, বিয়ের আগেই প্রথমে স্ত্রীর জন্য পৃথক একটা ঘর ঠিক করে রাখতে হবে। পৃথক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীকে নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে থাকা মোটেই সঙ্গত নয়, কারণ এর ফলে কিছুদিনের মধ্যে পারিবারিক জীবনে বহু রকমের সমস্যা সৃষ্টি হয়। পারিবারিক ঝগড়া-কলহ থেকে বাঁচার জন্য এটা একটা উৎকৃষ্ট পথ। একাধিক মহিলা এক ঘরে থাকলে ঝগড়া-কলহ হবেই। তাই বিয়ে করার সাথে সাথে ছেলে মা-বাবা হতে পৃথক হয়ে যাওয়াই বর্তমান যুগের জন্য অধিক সমীচীন। এতে ছেলে-বৌ ও মা-বাবা সবাই শান্তির সঙ্গে জীবন কাটাতে পারবে। বর্তমান যুগের নারীরা এত বেশি স্বাধীনতা প্রিয় যে, বিয়ের পর স্বামীর ঘরে আসার কিছুদিনের মধ্যে শ্বশুর-শাশুড়ী থেকে পৃথক হওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্বামীর অল্প টাকাকে শ্বশুরের হাজার হাজার টাকার থেকে অধিক মূল্যবান মনে করে। ফলে সংসারে শুরু হয়ে যায় ঝগড়া কলহ ও বিবাদ-বিশৃঙ্খলা। আর যদি একাধিক ভাইয়ের যৌথ পরিবার হয়, তা হলে কার পোষ্য বেশি, কার রোজগার বেশি, এসব নিয়ে জায়েদের মধ্যে ঝগড়া-কলহ শুরু হয়।
অনেকে সমাজে দুর্নাম হওয়ার ভয়ে মা-বাবা থেকে পৃথক হতে চায় না। ফলে মা-বাবার সঙ্গে একসাথে থেকে সর্বদা বিভিন্ন সমস্যা সংকট ও মানষিক যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকে। এটা মোটেই সমীচীন নয়। কেননা, শান্তি ও সুনাম একসাথে পাওয়া যায় না। শান্তি পেতে হলে কিছু দুর্নাম কামাতেই হবে। আর সুনাম লাভ করার থেকে শান্তিতে থাকা সাংসারিক জীবনে অধিক জরুরী। তবে যে কথাটা শুধু মনে রাখলেই হবে না সেই মতো কাজ করা অবশ্যই কর্তব্য। তা হল স্ত্রীকে নিয়ে পৃথক থেকে নিজের উপার্জন হতে সাধ্যমতো মা-বাবার খিদমত করা।
মা-বাবা থেকে স্ত্রী পৃথক থাকতে চাইলে তাকে পৃথক রাখা স্বামীর উপর ওয়াজীব। এটা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর হক। অথচ কুরআনুল করীমের নির্দেশ হল, “শীরকের নির্দেশ ব্যতীত মা-বাবার যে-কোন নির্দেশ পালন করা ফরয। এমতাবস্থায় মা-বাবা যদি স্ত্রীকে পৃথক রাখতে সম্মত না হন, আর স্ত্রী যদি পৃথক থাকতে চায় একই বাড়িতে কিংবা ভিন্ন বাড়িতে, তা হলে স্ত্রীকে পৃথক থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে স্বামীকে। কারণ যেহেতু স্ত্রীকে তার ইচ্ছানুযায়ী পৃথক ঘরে রাখা স্বামীর উপর ওয়াজীব। এবং স্বামীর প্রতি তার অধিকার, সেহেতু উক্ত ওয়াজীব ত্যাগ করে মা-বাবার আনুগত্য হওয়া যাবে না। মা-বাবা এ ওয়াজীব ত্যাগ করার নির্দেশ দিলে, তা পালন করা জায়েয হবে না। মহানবী (দঃ) বলিয়াছেন “স্রষ্টার নাফরমানী করে সৃষ্টির আনুগত্য করা যায় না।” সুতরাং স্ত্রীকে পৃথক রাখাই উচিত।
স্ত্রী ভরণ-পোষণ ও যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করা স্বামীর উপর ওয়াজীব। স্ত্রীর জন্য পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, তার অনিবার্য প্রয়োজন সমূহেরই একটি প্রধান অংশ। অনেকে স্ত্রীকে পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া নিজের দায়িত্ব মনে করে না। তাকে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনদের সঙ্গে একসাথে রাখতে অধিক পছন্দ করে। অথচ শরীয়তের নির্দেশ হল, স্ত্রী যদি সকলের সঙ্গে একসাথে থাকতে সম্মত হয়, তা হলে তো ভালো। অন্যথায় তাকে পৃথকভাবে রাখার ব্যবস্থা করা স্বামীর উপর ওয়াজীব। সম্মত হওয়ার অর্থ হল, পূর্ণ আন্তরিকতা ও স্বতস্ফূর্ততার সঙ্গে রাজি হওয়া। স্বামী যদি সুস্পষ্ট আকার ইঙ্গিত দ্বারা বুঝতে পারে যে, স্ত্রী পৃথক থাকতে চায়; কিন্তু মুখে ব্যক্ত করতে পারছে না, তা হলেও তাকে সবার সঙ্গে একসাথে রাখা জায়েজ হবে না। তা ছাড়া যৌথ পরিবারে মেয়েদের পর্দা মেনে চলা সম্ভব হয় না।
অনেকে স্ত্রীকে মা-বাবার বাধ্যগত ও অধিনস্থ বানিয়ে রেখে এটাকে নিজের জন্য বড় সৌভাগ্যের বিষয় মনে করে। ফলে স্ত্রী বিভিন্নভাবে নির্যাতীত হতে থাকে। আমাদের জানা ও মনে রাখা উচিত, শ্বশুর-শাশুড়ীর খিদমত করা স্ত্রীর দায়িত্ব নয়। মা-বাবার খিদমত করে সৌভাগ্য লাভ করতে চাইলে নিজে খিদমত করবে, কিংবা তাদের খিদমতের জন্য চাকরানী নিয়োগ করবে। রান্না বান্না করাও শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে স্ত্রীর দায়িত্ব নয়। কারণ আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করিয়াছেন, “এবং তার নির্দেশনাবলীর মধ্য হতে একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করিয়াছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের উভয়ের মধ্যে ভালবাসা ও সহানুভুতি সৃষ্টি করিয়াছেন।” [সূরা-রুম, আয়াত-২১, পারা-২১]
সুতরাং স্ত্রী হল স্বামীর হৃদয়ের প্রশান্তি ও আনন্দ লাভ করার জন্য। রান্নাবান্না ও খাবার প্রস্তুত করার জন্য নয়।
স্ত্রীর জন্য সম্পূর্ণ পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যদি সম্ভব না হয়, তা হলে অন্ততপক্ষে মূল ঘরের একটি কামরা সম্পূর্ণরূপে পৃথক করে দেবে। যেন তাতে সে যেকোনো প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। নিজের যাবতীয় আসবাবপত্র হেফাজত করে রাখতে পারে এবং স্বামীর সঙ্গে স্বাধীনভাবে মেলামেশা, উঠাবসা ও কথাবার্তা বলতে পারে। ওয়াজীব হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ঠ। একই ঘরে পৃথক কামরায় থাকলেও চুলা অবশ্যই ভিন্ন হওয়া উচিত। কারণ ঝগড়া কলহের সূত্রপাত হয় চুলা থেকে।
পুত্রবধু পৃথক থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করা সত্ত্বেও শ্বশুর-শাশুড়ী তাকে পৃথক থাকার ব্যবস্থা না করে দেওয়া তার প্রতি অবিচার করার সামিল। এ ধরণের অবিচার থেকে অনেক দ্বীনদার লোকও মুক্ত নয়। বিশেষত আগেরকালের মহিলাগণ এটাকে বরদাশতই করতে পারেন না। তাদের মতে এর ফলে ঘরের বরকত নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন রকম কাল্পনিক মন্তব্য করে থাকেন। আমাদের মনে রাখা উচিত, আল্লাহতায়ালার হুকুম অমান্য করে কারো অনুগত্য হতে পারে না।
স্ত্রী পৃথক থাকতে চাইলে তাকে পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া স্বামীর দায়িত্ব। কারণ এটা তার অধিকার। উপরন্তু স্ত্রীকে পৃথক রাখার মধ্যেই শান্তি ও কল্যাণ নিহিত। যৌথভাবে থাকার ফলে বহুরকমের সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি হয়। পুত্র এবং পুত্রবধুদেরকে একান্নভুক্ত পরিবারে রেখে তাদের প্রতি অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালান আগের কালের শ্বাশুড়ীদের একটা সাধারণ অভ্যাস। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ছেলে যদি স্ত্রীর প্রতি একটু মনোযোগী হয়, তখন পরিবারের সকলে চরম প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। আবার যদি অমনোযোগী হয়, তা হলে লবণ পড়া, চিনিপড়া ও বিভিন্ন প্রকারের দোয়া তাবিজের আশ্রয় নেয়। সুতরাং পৃথক থাকাই শ্রেয়। পৃথক থাকলে এ ধরনের সমস্যাসমূহের মুখোমুখি হতে হয় না।
যদি বলা হয় যে, বর্তমান যুগের স্ত্রীরা বুদ্ধির স্বল্পতা ও চিন্তার অপরিপক্কতার কারণে শাশুড়ীর সাথে দুর্ব্যবহার, ঝগড়া-বিবাদ করে এবং শ্বাশুড়ীকে বিভিন্নভাবে জ্বালাতন করে, তা হলে তো তাদেরকে পৃথক করে দেওয়াই যুক্তির দাবি। মোটকথা, পৃথক করে দেওয়া বউ-শাশুড়ী উভয়ের জন্য নিরাপদ।
আবার অনেক স্ত্রী, স্বামীর ঘরে এসেই তাকে মা-বাবা থেকে বিছিন্ন করে ফেলতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটা যদিও চরম অশোভনীয় কাজ, তবু বিয়ের পরপরই মা-বাবা থেকে পৃথক হয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে তা অবশ্যই যথাযথ ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। আর স্ত্রীদের জেনে রাখা উচিত, স্বামীর বাড়িতে এসেই অশোভনীয় পদ্ধতিতে স্বামীকে মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কোনই অধিকার তার নেই।
স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকের আসবাবপত্র পৃথক থাকা আবশ্যক। প্রত্যেকে আপন আপন জিনিসপত্রই শুধু ব্যবহার করবে। বর্তমানে ইউরোপে এ প্রথা অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। মেম সাহেবের জিনিসপত্র আলাদা এবং সাহেবের জিনিসপত্র আলাদা। গৃহে প্রতিটি বস্তুর মালিকানা সুস্পষ্ট থাকার প্রথা যা ইউরোপে রয়েছে, একসময় তা মুসলমানদের মধ্যে ছিল। আমাদের দেশে যদি এ প্রথা চালু হত, তা হলে কতই না ভালো হত।
বর্তমানে আমাদের সমাজ এমন কলুষিত হয়ে গেছে যে, কেউ কারো হক বা অধিকারের প্রতি সামান্যতম ভ্রূক্ষেপও করে না। অজ্ঞতা ও মুখতা এ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, আমরা বিস্মৃত হয়ে গিয়েছি লেন-দেনের স্বচ্ছতা, মালিকানার স্পষ্টতা ও অপরের অধিকার রক্ষা করার আদর্শ, যা আজ ইউরোপে বিরাজ করছে। একসময় এসব ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে ছিল।
লেন-দেন ও মালিকানার স্বচ্ছতার দাবি হল, স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকের মালিকানাধীন জিনিসপত্র পৃথক পৃথক থাকবে। অথচ আমাদের সমাজের অবস্থা হল, পরিবারের কোনটি কার জিনিস তা কারোরই জানা থাকে না। একজনের জিনিসের উপর অপরজনের অন্যায় হস্তক্ষেপ দ্বিধাহীনভাবে চলছে। স্ত্রীর অলঙ্কার সমূহে একথা স্পষ্ট থাকে না যে কোনটি তার বাবার দেওয়া ও কোনটি স্বামীর দেওয়া হয়েছে এবং স্বামীর দেওয়া অলঙ্কার কি তাকে মালিক বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, না কি শুধু ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি গৃহে ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিজের ও স্ত্রীর পৃথক মালিকানা নির্ধারণ করে দিতে চায়, তা হলে তার উপর নিন্দা ও তিরস্কারের ঝড় বইতে শুরু করে। গোটা সমাজ তার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে যে, অমুক ব্যক্তি তার ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ জিনিসেও কারো হাত স্পর্শ করতে দিতে চায় না। এটাকে চরম সংকীর্ণতা ও কৃপণতা ছাড়া আর কি বলা যায়? তাদের মতে উদার ও দানশীল হতে হলে নিজের ও অপরের জিনিসের মধ্যে ভেদাভেদ থাকতে পারবে না।
উল্লিখিত তথাকথিত উদারতার অশুভ পরিণতি তখনই প্রকাশ পায় যখন পরিবারের যে-কোন একজন মৃত্যুবরণ করে এবং মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত জিনিসপত্র বণ্ঠন করা হয়। তখন কেউ বলে মৃত ব্যক্তি এটা আমাকে দিয়ে গেছে, কেউ বলে, এটা তার নয়, বরং আমার। স্ত্রী বলে, এ সমস্ত জিনিস আমার বাপের বাড়ির থেকে আনা। ফলে এ বিরোধ নিস্পত্তির কোনো সুযোগ থাকে না। উপরন্তু তা নিয়ে পরিবারের মধ্যে এমন ঝগড়া-কলহ শুরু হয়ে যায়, যা দেখে শুনে অন্যদের হাসির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে সুশিক্ষিত ও সুসভ্য পরিবারে ঝগড়া-কলহ সৃষ্টি না হলেও আপোষের মধ্যে মনোমালিন্য ও হিংসা বিদ্বেষ তো অবশ্যই দেখা দেয়। কখনও কখনও তা আদালতে পর্যন্ত গড়ায়। এসব হল জাগতিক ক্ষতি। আর পারলৌকিক ক্ষতি আরো ভয়াবহ। কেননা অনুমতি ছাড়া অপরের মালিকানায় হস্তক্ষেপের কারণে গুনাহগার হতে হয়। অপরের জিনিসে হস্তক্ষেপের ফলে যদি তা নষ্ট হয়ে যায়, তা হলে তাকে পরিশোধ না করা পর্যন্ত উক্ত বস্তুর দাবি থেকে যায়। কিয়ামত দিবসের হিসাব নিকাশ বড়ই কঠিন। তিন পয়সার দাবি কারো উপর থেকে গেলে কিয়ামত দিবসে তার সাতশ মাকবুল নামাযের সওয়াব উক্ত পয়সার দাবিদারকে দেওয়া হবে। সারাজীবন যা কিছু নামায আদায় করা হল, তার সওয়াব থেকে বঞ্চিত হওয়া কেবল দুর্ভাগ্যের কথা? দুনিয়াও বরবাদ হল এবং পরকালও বরবাদ হল।
স্বামী-স্ত্রীকে সংসার খরচ বাবদ যা কিছু দেয় সেক্ষেত্রেও উল্লিখিত অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। স্বামী তার সমস্ত উপার্জন স্ত্রীর হাতে অর্পন করে। স্ত্রী নিজেকে তার মালিক মনে করে যথেচ্ছা খরচ করে এবং নিজের ইচ্ছামতো দান খয়রাত করে। অনেকে এই টাকা থেকে ইচ্ছামতো পিত্রালয়েও পাঠাতে থাকে। তারপর তার স্বামী যখন দেখে, তার কষ্টার্জিত টাকা নির্দয়ভাবে অপচয় হচ্ছে তখন সে এ ব্যাপারে স্ত্রীকে প্রশ্ন করে। স্ত্রী উত্তর দেয় টাকা-পয়সা তুমি আমাকে দিয়েছ, অতএব আমি যেখানে ইচ্ছা খরচ করব, যাকে ইচ্ছ। তাকে দেব। স্বামী বলে, আমি তোমাকে যথেচ্ছা খরচ করার জন্য দিই নি, তোমার কাছে আমানত রেখেছি। মোট কথা এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব-কলহ শুরু হয়ে যায়। এজন্য স্ত্রীকে টাকা দেওয়ার সময় স্বামীর বলা উচিত, এই টাকা থেকে সংসার খরচ এত টাকা করবে আর এত টাকা তোমার হাতখরচ বাবদ নেবে এবং বাকি টাকা জমা রাখবে। প্রয়োজন মতো আমি চাইলে যেন পাই। টাকা পয়সার মতো স্ত্রীকে স্বর্ণালঙ্কারের অধিকার সম্পর্কে ধারণাও স্বচ্ছ করে দিতে হবে। নচেৎ যাকাত আদায়ে সমস্যা হয়। স্ত্রীর ব্যবহৃত স্বর্ণালঙ্কার যাকাতের নেসাব পরিমাণ হলে তার যাকাত আদায় করা শরীয়তের উক্ত নির্দেশ পালনে অবহেলার সুযোগ থেকে যায়। স্বামী মনে করে, স্ত্রীর ব্যবহৃত স্বর্ণালঙ্কার তার কোনো কাজে আসে না। সুতরাং যাকাত কেন তার উপর ওয়াজীব হবে? আর স্ত্রী মনে করে, এই স্বর্ণালঙ্কার আমার পূর্ণ মালিকানা নেই। অতএব আমার উপর যাকাত ওয়াজীব নয়। ফলে যাকাত অনাদায় থেকে যায়। অথচ স্বামী মারা যাওয়ার পর স্ত্রী দাবি করে বসে যে, এ স্বর্ণালঙ্কার আমার। আমাকে আমার স্বামী জীবদ্দশায় মালিক বানিয়ে গেছেন।
কি অদ্ভুত ব্যাপার? স্ত্রী জানে, এই স্বর্ণালঙ্কার আজীবন সে-ই ব্যবহার করবে, তবু যাকাতের দায়ভার স্বামীর উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তার পূর্ণ মালিকানা দাবি করে। মোট কথা যাকাতের দায়ভার বহন করার জন্য স্বামী, আর মালিক বনার জন্য স্ত্রী। বস্তুতঃ মালিকানা স্পষ্ট না থাকার কারণেই যাকাত আদায়ে এ ফাঁকিবাজির সুযোগ সৃষ্টি হয়। অলঙ্কার বানানোর পরপরই যদি তার মালিকানা স্পষ্ট করে দেওয়া হত, তা হলে যাকাত আদায়ে সমস্যা কিংবা যাকাত আদায় থেকে বাঁচার এ কৌশল গ্রহণের সুযোগ পাওয়া যেত না। এজন্য লেনদেন স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। স্ত্রীকে অলঙ্কারের মালিক বানিয়ে দেওয়া হলে যাকাত আদায়ের দায়-দায়িত্ব স্ত্রীর উপর। আর যদি তাকে শুধু মাত্র পরার জন্য দেওয়া হয়, তা হলে যাকাত স্বামীকে আদায় করতে হবে। স্ত্রী মালিক হওয়ার কারণে তার উপর অলঙ্কারের যাকাত ওয়াজীব হওয়া সত্বেও তার অনুমতি সাপেক্ষে স্বামী আদায় করে দিলে ভিন্ন কথা।
অলঙ্কারের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে আর একটা ভ্রান্ত ধারণা এই যে, স্ত্রীকে হাজার হাজার টাকার অলঙ্কার দেওয়া হয়, অথচ একথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয় না যে, তা মহরের অন্তভুক্ত কিনা। ফলে স্ত্রীকে সব কিছু দেওয়া সত্ত্বেও তার মহরের একটি পয়সাও আদায় হয় না। মহরের দাবি থেকেই গেল। মোহর বান্দার হক। আর বান্দার হক দুনিয়াতে আদায় না করলে আল্লাহও মাফ করবেন না। কেমন নিবুদ্ধিতার কথা, স্ত্রীর জন্য তার প্রাপ্য মহরের চেয়ে অধিক অর্থের অলঙ্কার দিয়েও তার মহরের দাবি স্বামীর উপর পূর্ববৎ বহাল থেকে গেল। তবে হ্যাঁ, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর যখন তার ওয়ারিসগণ মোহর পরিশোধের দাবি করে, কিংবা স্ত্রী তালাকপ্রাপ্ত হয়ে নিজেই মহর দাবি করে তখন স্বামী দাবি করে যে, তাকে প্রদত্ত স্বর্ণালঙ্কারসমূহ মহর বাবদ দেওয়া হয়েছে। তার কাছে প্রশ্ন, আপনার নিয়তের খবর মানুষ না জানলেও আল্লাহ অবশ্যই অবগত আছেন। আপনি কি কখনও বলেছিলেন, অলঙ্কার সমূহ মহর বাবদ দিয়েছ?
কেউ কারো কাছে একটা পয়সাও যদি পাওনা থাকে, তা হলে উক্ত দেনাদার পাওনাদারকে লাখ টাকা দান করে দিলেও তার এক পয়সার ঋণ পরিশোধ হবে না। ঋণ পরিশোধ তখনই হবে, যদি সে দেওয়ার সময় স্পষ্ট করে বলে দেয় যে, এটা তার প্রাপ্য ঋণ পরিশোধ বাবদ। যদি অলঙ্কার মহরের অংশ হিসাবে দিতে হয়, তা হলে দেওয়ার সময় সুস্পষ্টরূপে বলে দিতে হবে যে, এটা মহরের অংশ বাবদ। যেন স্ত্রীর তার হিসাব রাখতে পারে। এ জন্য যে-কোনো লেন-দেন সুস্পষ্ট, পরিচ্ছন্ন ও নিয়মতান্ত্রিক হওয়া উচিত।
পরিবারের কাউকে কিছু দিতে হলে তার জন্যও ইসলামে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। যেমন–
এক: যখন কোনো অলঙ্কার, খাট, ফার্ণিচার বা অন্য যে-কোন গৃহসামগ্রী খরিদ করবে তখন সাথে সাথে স্পষ্ট করে বলে দেবে কার জন্য কেনা হচ্ছে। তা হলে সেই বস্তুর মালিকানা নিয়ে বিভ্রাট সৃষ্টি হবে না।
দুই: স্ত্রীকে সংসার খরচের জন্য যা কিছু খরচ দেবে তা সুস্পস্টভাবে নির্ধারণ করে দেবে এবং আলাদাভাবে তার হাত খরচ দেবে।
তিন: অলঙ্কার খরিদ করে স্ত্রীকে দেওয়ার সময় বলে দিতে হবে, এটার মালিক তুমি, আর তাকে যদি মালিক বানিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে, তা হলেও স্পষ্টরূপে বলে দিতে হবে যে, এ অলঙ্কারের মালিক আমি, শুধু পরার জন্য তোমাকে দেওয়া হচ্ছে।
পারিবারিক জীবন সুন্দর ও সুখকর হওয়ার জন্য এটাই শরীয়ত নির্দেশিত পথ। আর এতে স্বামী-স্ত্রীর দ্বীনও রক্ষা হয়।
এতক্ষণ যা কিছু বললাম, হযরত থানবী (রঃ) কৃত “কুরআন হাদিসের আলোকে পারিবারিক জীবন” বই থেকে।
এবার সংসার সুখের জন্য স্ত্রীদের প্রতি আরো যেসব স্বামীর কর্তব্য রয়েছে বলছি, নবী করিম (দঃ) এ ব্যাপারে স্বামীদের উদ্দেশ্যে বলিয়াছেন, “তোমরা স্ত্রীদের সহিত সব সময় উত্তম ব্যবহার করার জন্য আমার এ নসীহত কবুল করো। কেন না নারীরা জন্মগতভাবেই বাঁকা স্বভাবের হয়ে থাকে। তুমি যদি জোরপূর্বক তাকে সোজা করতে যাও, তা হলে তাকে তুমি চূর্ণ করে দেবে। আর যদি এমনি ছাড়িয়া দাও, তা হলে সেসব বাঁকা থেকে যাবে। অতএব বুঝে শুনে তাদের সাথে ব্যবহার করার আমার এ উপদেশ অবশ্যই গ্রহণ করবে।”
এই হাদিস থেকে প্রমাণিত হল যে, নারীদের স্বভাবে বক্রতা স্বভাবগত ও জন্মগত। এ বক্রতা পুরোপুরি দূর করা কখনো সম্ভব নয়। তাই তাদের স্বভাবকে মেনে নিয়ে সুমধুর পারিবারিক জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। তাদের সঙ্গে সহানুভুতি, নম্রতা ও সদিচ্ছাপূর্ণ ব্যবহার করা এবং তাদের মন রাখার জন্য শরীয়তের শেষ সীমানা পর্যন্ত যেতে রাজি থাকতে হবে। সেই সঙ্গে স্ত্রীদের অনেক দোষ ক্ষমা করে দেওয়ার গুণ স্বামীদের অর্জন করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “প্রতিদিন মেয়েদের একশত দোষ ক্ষমা করিবে।” আরো বলিয়াছেন, “স্ত্রীদের দোষগুলো তোমার মনে কষ্ট বা রাগ হলে, তাদের গুণগুলোর কথা চিন্তা করলে মনে কষ্ট বা রাগ থাকবে না।” স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মন কষাকষি হওয়া খুব স্বাভাবিক। আর এই সুযোগে শয়তান পরস্পরের মনে নানারকম কুমন্ত্রণা দেয়। এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরতে দেরি হয় না। এমন কি অনেক সময় জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মেয়েরা সাধারণত নাজুক স্বভাবের হয়ে থাকে। অল্পতেই রেগে যাওয়া, অভিমানে ক্ষুব্ধ হওয়া ও স্বভাবগত অস্থিরতায় চঞ্চল হয়ে উঠা মেয়েদের চরিত্রের একটা বিশেষ দিক। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালা এসব জানেন। তাই তিনি কুরআনে নির্দেশ দিয়াছেন, “তোমরা স্ত্রীদের সাথে খুব ভালভাবে ব্যবহার ও বসবাস করবে। তোমরা যদি তাদের অপছন্দ কর, তা হলে এ হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিসকে অপছন্দ করছ অথচ আল্লাহ তার মধ্যে অনেক কল্যাণ নিহিত রেখে দেবেন।” [সূরা- নেসা, আয়াত-১৯, পারা-৪]
এই আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ স্বামীদেরকে হেদায়েত দিয়েছেন। স্বামীদের প্রতি আল্লাহর প্রথম নির্দেশ, তোমরা যাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এলে, যাকে নিয়ে সংসার বাঁধলে তার প্রতি সব সময় খুব ভালো ব্যবহার করবে।
পুরুষদের চিন্তা করা উচিত, মেয়েরা গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবজনিত কঠিন ও দুঃসহ যন্ত্রণার কথা এবং সন্তানের লালন-পালনের ঝক্কি-ঝামেলাও চিন্তা করা উচিত। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ক্ষমাশীলতা দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য ও স্থায়িত্বের জন্য একান্ত দরকার। যে স্বামী স্ত্রীকে ক্ষমা করতে পারে না, কথায় কথায় দোষ ধরা স্বামীর স্বভাব, শাসন ও ভয় প্রদর্শন করাই যার অভ্যাস, তার পক্ষে স্ত্রীকে নিয়ে সুখী দাম্পত্য জীবন ও সংসার গড়া কখনই সম্ভব নয়। স্ত্রীদের প্রতি অত্যাচার জুলুম করা তো দূরের কথা, বারে বারে তালাক দিয়ে আবার ফেরত নিয়ে স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়াও দাম্পত্য জীবনকে বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত করাও ইসলামের নিষেধ। এ সম্পর্কে কুরআনপাকে আল্লাহ বলিয়াছেন, “তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের নানাভাবে কষ্টদান ও উৎপীড়নের উদ্দেশ্যে আটক করে রাখিবে না। যে লোক এরূপ করিবে, সে নিজের উপরেই জুলুম করিবে। আর তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকে খেলনার বস্তুতে পরিণতি করিও না।” [সুরা-বাকারা, আয়াত-৩৩, পারা-১]
যদিও তৎকালীন আরবের প্রচলিত কুসংস্কার- স্ত্রীকে বারবার তালাক দিয়ে বারবার ফেরত নেওয়ার রেওয়াজ নিষিদ্ধ করে এই আয়াত নাযিল হয়েছিল, তবু এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মোফাসসেরীনগণ বলিয়াছেন, স্ত্রীকে কোনো প্রকার অকারণ কষ্ট দেওয়া বা ক্ষতি করা নিষেধ। যে নিজের স্ত্রীকে কষ্ট দেবে, জুলুম পীড়ন করবে, পরিণামে তার নিজের জীবন নানাভাবে জর্জরিত হয়ে উঠবে। নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “তোমার স্ত্রী অঙ্গশায়িনীকে নির্মমভাবে মারিবে না, যেমন করে তোমরা মারিয়া থাক তোমাদের ক্রীতদাসীদের।” [আবু দাউদ]
নবী করিম (দঃ) আরো বলিয়াছেন, “তোমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীকে ক্রীতদাসদের মারার মতো না মারে, আর মারার পর দিনের শেষে তার সাথে যেন যৌনসঙ্গম না করে।” [হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জামায়তা (রাঃ)-বুখারী]
নবী করিম (দঃ) আরো বলিয়াছেন, “তোমাদের স্ত্রীদের মুখের উপর মারিবে না, মুখমন্ডলের উপর আঘাত দিবে না। তাদের মুখের শ্রী বিনষ্ট করিবে না, অকথ্য ভাষায় তাদের গালাগালি করিবে না। এবং নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও তাদের বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ফেলিয়া রাখিবে না।” [আবু দাউদ]
স্ত্রীকে মারধর করা নিষেধ হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষেধ নয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আর যে সব স্ত্রীলোকের অনানুগত্য ও বিদ্রোহের ব্যাপারে তোমরা ভয় কর, তাদের ভালোভাবে বোঝাও, নানা উপদেশ দিয়ে তাদের বিনয়ী বানাতে চেষ্টা কর, পরবর্তী পর্যায়ে মিলনশয্যা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখ। আর শেষ উপদেশ হিসাবে তাদের প্রহার কর। এর ফলে যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তা হলে তাদের উপর অন্যায় ব্যবহারের নতুন কোনো পথ খুঁজে বেড়িও না। নিশ্চয় আল্লাহই হচ্ছেন সর্বোচ্চ সর্বশ্রেষ্ঠ। [সুরা-নেসা, আয়াত-৩, পারা-৫]
মোফাসসেরিনগণ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ভয় করা মানে, জানতে পারা অথবা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারা যে, স্ত্রী স্বামীকে মানছে না, অথচ স্বামীকে মেনে চলাই স্ত্রীর কর্তব্য। এ অবস্থায় স্বামী কি করবে এই আয়াতে সেকথাই আল্লাহ বলিয়াছেন, প্রথমে স্বামী স্ত্রীকে ভালভাবে বোঝাবে, উপদেশ দিবে এবং আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে যা কিছু বলিয়াছেন সে সব জানাবে। দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, অমান্যকারী স্ত্রীকে মিলনশয্যা থেকে সরিয়ে রাখা মানে যৌনসম্পর্ক না রাখা, তাতে কাজ না হলে, মারধর করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই মারধরের একমাত্র উদ্দেশ্য অবশ্যই শিক্ষামূলক হতে হবে। ক্রীতদাস ও জন্তু-জানোয়ারকে যেমন মারা হয়, সে রকম মারার অধিকার কারো নেই। স্ত্রীদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে স্বামীদের বিশেষভাবে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে, তারা যেন অবলা নারীর প্রতি কোনোরূপ দুর্ব্যবহার ও অন্যায় না করে। কথাটা প্রত্যেক স্বামীকে মনে রাখতে হবে।
হাদিসে আছে, স্ত্রীর খোরাক-পোশাকের যাবতীয় খরচ বহন করা স্বামীর উপর ওয়াজীব। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই। প্রচলনমতো করতে হবে। তবে তা স্বামীর সামর্থ অনুসারে। আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “যে লোককে অর্থ-সম্পদে স্বাচ্ছন্দ্য দান করা হইয়াছে, তার কর্তব্য সেই হিসাবেই তার স্ত্রী পরিজনের জন্য ব্যয় করিবে। আর যার আয় উৎপাদন স্বল্প ও পরিমিত, তার সেভাবেই আল্লাহর দান থেকে খরচ করিতে হইবে। আল্লাহ প্রত্যেকের উপর তার সামর্থ অনুসারেই দায়িত্ব অর্পন করে থাকেন। [সুরা-তালাক, আয়াত-৭, পারা-২৮]
উপরের আলোচনা থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে, স্ত্রীর সঙ্গে শুধু ভালো ব্যবহার ও চলতি নিয়মে স্ত্রীর কেবল খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে দেওয়াই দাম্পত্য জীবনে মধুর সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়। সেই সঙ্গে স্বামীর তওফিক অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে অথবা মাসে হাতখরচা বাবদ কিছু টাকা স্ত্রীকে দেওয়া কর্তব্য। যেন স্ত্রী নিজের ইচ্ছা, কামনা ও রুচি অনুযায়ী সময়ে অসময়ে সেই টাকা থেকে খরচ করতে পারে। এতে করে স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি ভালবাসা, আস্থা ও নির্ভশীলতা দৃঢ় ও গম্ভীর হবে। স্বামী সম্পর্কে তার মনে কোনো সংশয় বা উদ্বেগ হবে না।
সাংসারিক বা সামাজিক কোনো গুরুতর ব্যাপারে স্বামীর উচিত স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করা। অনেক সময় গুরুতর ব্যাপারগুলো স্ত্রী সহজেই সমাধান করে দিতে পারে। এতে করে স্ত্রীর প্রতি যেমন স্বামীর আস্থা, বিশ্বাস ও ভালবাসা বেড়ে যায়, তেমনি স্বামীর প্রতিও স্ত্রীর মনে ভালবাসা ও আন্তরিক আনুগত্যমূলক ভাব গম্ভীর হয়। কুরআন মজিদে সব ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করার কথা বলা হয়েছে। যেমন সন্তানকে কতদিন দুধ পান করান হবে তা স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআন মজিদে বলা হয়েছে, “স্বামী ও স্ত্রী যদি পরস্পর পরামর্শ ও সন্তোষের ভিত্তিতে শিশুর দুধ ছাড়াতে ইচ্ছা করে, তবে তাতে কোনো দোষ হবে না তাদের। [সুরা-বাকারা, আয়াত-২৩৩, পারা-২]
আমাদের নবী করিম (দঃ) এর জীবনে এ ব্যাপারে অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে। তার মধ্যে দু’একটা বলছি, সর্ব প্রথম যখন হেরা গুহায় অহি নাযিল হয় তখন তার হৃদয়ে যে ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল তখন ঘরে গিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদীজাতুল কুবরার (রাঃ) কাছে সবকিছু জানিয়ে বলেছিলেন, “আমি এ ব্যাপারে খুব ভয় পাচ্ছি।”
সব কথা শোনার পর হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) বলেছিলেন “আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনিতো কখনও কারো প্রতি খারাপ আচরণ করেন নি বা কারো এতটুকু ক্ষতি করেন নি। বরং মানুষের বিপদে-আপদে সাহায্য করেন, কারো আমানত খেয়ানত করেন নি। এজন্য আল্লাহ শয়তানদের আপনার উপর কখনই জয়ী হতে দেবেন না। কোনো অমূলক চিন্তা-ভাবনা আপনার উপর চাপিয়ে দেবেন না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আল্লাহ আপনাকে আপনার জাতির লোকজনের হেদায়েতের জন্যই মনোনিত করেছেন।
হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ)-এর সান্তনাবাণী শুনে নবী করিম (দঃ) অনেকখানি আশ্বস্ত হয়েছিলেন। আর একটা ঘটনা বলছি, হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে যখন মক্কায় যেতে পারলেন না ও বায়তুল্লাহ তওয়াফ করা সম্ভব হল
তখন রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর সঙ্গী চৌদ্দশত সাহাবী (রাঃ) নানান কারণে হতাশ হয়ে পড়লেন। রাসুলুল্লাহ (দঃ) তাঁদেরকে এখানেই কুরবানী করতে আদেশ করলেন; কিন্তু এ ব্যাপারে সাহাবী (রাঃ)গণ কোনো আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। তাঁদের অবস্থা দেখে নবী করিম (দঃ) যেমন অবাক হলেন, তেমনি খুব মর্মাহত হলেন। তখন তিনি অন্দরমহলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে অবস্থানরত স্ত্রী হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) কাছে সব কথা খুলে বললেন।
হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) সাহাবী (রাঃ) দের এরূপ করার কারণ বিশ্লেষন করে বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল (দঃ) আপনি যা করতে চাচ্ছেন, তা বের হয়ে নিজেই শুরু করে দিন। দেখবেন, আপনাকে সে কাজ করতে দেখে সাহাবীগণ নিজ থেকে আপনার অনুসরণ করবেন এবং সেকাজে করতে লেগে যাবেন।”
নবী করিম (দঃ) উম্মে সালমা (রাঃ)-এর কথা মতো কাজ করেছিলেন এবং তাই দেখে সাহাবীরাও তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন। দেখলেন তো, উম্মে সালমা (রাঃ)-এর পরামর্শে এরকম গুরুতর সমস্যার সমাধান হয়েছিল?
এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এমনিভাবে সব স্বামীই তাদের স্ত্রীদের কাছ থৈকে এ ধরনের কল্যাণময় পরামর্শ লাভ করে সংসারের বা সমাজের জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারেন।
আর একটা কথা বলে স্বামীদের প্রসঙ্গ শেষ করব। প্রত্যেক স্বামীকে মনে রাখতে হবে, দাম্পত্য জীবনে পুরুষের প্রাধান্য স্বীকার সত্ত্বেও ইসলাম স্ত্রীকে পুরুষের দাসী-বাঁদী বানিয়ে দেন নি। যদি কেউ তা মনে করে, তবে তিনি মারাত্মক ভুল করবেন। পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতবিরোধ হলে ইসলাম বলছে, স্বামীর মতই প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার পাবে। তখন স্ত্রীর কর্তব্য হবে স্বামীর মতকেই মেনে নেওয়া ও স্বামীর কথা মতো কাজ করা। কেননা তাকে মনে করতে হবে যে, স্বামী তার থেকে বেশি জ্ঞানী, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অধিকারী। এজন্য পারিবারিক জীবনসংক্রান্ত সভাপতিত্বের মর্যাদা স্বামীরই প্রাপ্য। এ ব্যাপারে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য পরবর্তীতে আলোচনা করব। এখন স্বামীদের সম্পর্কে আরো দু’একটা কথা বলব। সামান্য দোষ ত্রুটির জন্য স্বামীরা স্ত্রীদের অনেক গঞ্জনা দেয়। যেমন রান্না হতে যদি একটু দেরি হয় অথবা রান্নার মধ্যে যদি কোনো দোষ হয়ে থাকে, তা হলে অনেকে স্ত্রীকে রাগারাগি করে। আবার অনেকে গালাগালি এমন কি মারধরও করে। কিন্তু তারা চিন্তা করে দেখে না, নিজেরা কাজের অবসরে বিশ্রাম নিচ্ছে। আর তাদের স্ত্রীরা সকাল থেকে রাত দশটা এগারটা পর্যন্ত একটানা কাজ করে চলেছে। এমন কি সংসারের কাজের চাপে সময় মতো গোসল ও খাওয়া-দাওয়া করতে পারে না। শুধু তাই নয়, সন্তান পেটে আসার পর থেকে সন্তান প্রসব করা পর্যন্তও তাদেরকে বিশ্রামহীন কাজ করতে হচ্ছে। এতকিছু করার পরও যেসব স্বামীরা স্ত্রীদের ছোটখাট দোষ-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখে না, তারা কি ধরণের মানুষ আপনারাই চিন্তা করুন। ঐ সমস্ত কারণে স্ত্রী মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তখন স্বামীর একান্ত কর্তব্য স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করা। তা যদি সম্ভব নাও হয়, তবে স্ত্রীর প্রতি সহমর্মিতা দেখান উচিত। ভালো কথা ও ভালো ব্যবহার করা উচিত। অসুস্থ অবস্থায় স্ত্রীকে যৌন মিলনে বাধ্য করা। উচিত নয়। স্ত্রীর আপদে-বিপদে, রোগ-শোকে তার প্রতি সহানুভুতি দেখান স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রী রোগাক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করাও স্বামীর দায়িত্ব। আর একটা কথা না বলে পারছি না, স্বামীরা চায়, স্ত্রীরা সাজসজ্জা করে তার সামনে আসুক। স্ত্রীদের তাই করাও উচিত। কিন্তু স্ত্রীরাও যে চায়, স্বামীরা সাজ-সজ্জা করে তাদের সামনে আসুক। সে কথা স্বামীরা ভেবে দেখেন না। তাই তাদেরও উচিত সাজসজ্জা করে স্ত্রীর কাছে যাওয়া। এ সম্পর্কে হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, “আমি স্ত্রীর জন্য সাজসজ্জা করা খুবই পছন্দ করি, যেমন পছন্দ করি স্ত্রী আমার জন্য সাজসজ্জা করুক।”
আজ এই পর্যন্ত থাক। অন্যদিন আবার বসা যাবে।
গালিবার মেজ দুলাভাই খুরশীদ বলল, ছোট ভাবী শুধু স্ত্রীর প্রতি স্বামীদের কর্তব্যের কথা বললেন, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য একটাও বলেন নি।
নিলুফার বলল, নিশ্চয় বলব, আসরের নামাযের সময় হয়ে গেছে, আপনারা চাইলে কালই আলোচনায় বসা যাবে।
এবার গালিবার বড় দুলাভাই আসিফ বলল, কাল আমাদের বাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্যের কথা না শুনে যাচ্ছি না। সেজন্য যদি আরো দু’চারদিন থাকতে হয় থাকব।
গালিবা হেসে উঠে বলল, বড় দুলাভাই যখনই আসেন তখনই পরেরদিন চলে যাওয়ার কথা বললেও এক সপ্তাহের আগে যান নি।
নিলুফার মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, আহ ছোটবুবু, সবার সামনে দুলাভাইদের সঙ্গে এরকম ইয়ার্কি করবে না। তারপর আসিফকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি ছোট বুবুর কথায় কিছু মনে করবেন না। যতদিন ইচ্ছা হয় থাকবেন।
এমন সময় আযান হচ্ছে শুনে পুরুষরা একে একে চলে গেল।
রাফিয়া ও নাফিসা যাওয়ার সময় বলল, আমরাও কাল আসব।
নিলুফার বলল, এলে খুব খুশী হব। আর পারলে ঘরের ও পাড়ায় অন্য মেয়েদেরও নিয়ে এস কেমন?
ঠিক আছে, তাই নিয়ে আসব বলে তারা চলে গেল।
রোকেয়া নিলুফারকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে স্বামীরা যদি স্ত্রীর প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করত, তা হলে দুনিয়াতেই বেহেশতের সুখ পাওয়া যেত। আরো কি মনে হচ্ছে জান, ইসলাম পুরুষদেরকে মেয়েদের গোলাম বানিয়ে দিয়েছে।
নিলুফার মৃদু হেসে বলল, আপনার প্রথম কথাটা ঠিক মনে হলেও দ্বিতীয়টা ঠিক না। কাল যখন স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্যের কথা শুনবেন তখন মনে হবে ইসলাম মেয়েদেরকে পুরুষের বাদি বানিয়ে দিয়েছে।
রোকেয়া বলল, তাই না কী?
নিলুফার বলল, হ্যাঁ তাই। আসলে কি জানেনা, স্বামী-স্ত্রী কেউ কারো গোলামও নয় আর বাঁদিও নয়। একে অপরের জীবন সঙ্গিনী ও সহধর্মিনী ও অঙ্গশায়িনী। রোকেয়া আবার কিছু বলতে চাচ্ছে দেখে আবার বলল, এখন আর কোনো প্রশ্ন নয়, পরে যা জানার জানবেন। নামায পড়ে নাস্তা বানাতে হবে।
.
মাগরিবের নামায ও নাস্তা খাওয়ার পর আব্দুল হান্নান স্ত্রীকে বলল, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যের কথা যা বললে, তা করলে স্ত্রীরা তো স্বামীদের গ্রাহ্যই করবে না।
নিলুফার বলল, তোমার কথা ঠিক; কিন্তু স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্যের কথা জানা থাকলে তারা তা করতে পারবে না। বরং স্বামীকে সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালবাসবে, তাদের কথার অবাধ্য হবে না। এমন কি স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য নিজের ভালোমন্দ চিন্তাও করবে না। ইনশাআল্লাহ সেই আলোচনা কাল করব। তুমি কিন্তু কাল থাকবে। আর গালিবাকে দিয়ে বড় ভাইয়াদেরও থাকতে বলব।
ঠিক আছে, অনেকদিন ক্লাবে যাই নি। আজ একটু ঘুরে আসি, বলে আব্দুল হান্নান বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে নিলুফার একটু দাঁড়াও বলে তিন ব্যাটারীর টর্চ লাইট এনে তার হাতে দিয়ে বলল, এবার যাও।
আব্দুল হান্নান স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর দিয়ে বলল, শুকরিয়া, আজ চার ঘন্টা পরে চাঁদ উঠবে মনে ছিল না।
নিলুফার আদরের প্রতিদান দিয়ে বলল, এশার নামায পড়েই ফিরবে কিন্তু।
তাই হবে বলে আব্দুল হান্নান সালাম বিনিময় করে বেরিয়ে এসে ক্লাবের পথ ধরল।
ক্লাবটা গ্রামের শেষ প্রান্তে মাঠের ধারে। আব্দুল হান্নানই গ্রামের সমবয়সী ছেলেদের নিয়ে করেছে। অবশ্য জায়গাটা তাদেরই। ক্লাবঘরটা বেশ বড়। একপাশে দেওয়াল ঘেঁষে দুটো বড় কাঠের আলমারী, তাতে দেশি-বিদেশী লেখকের অনেক বই। ঘরের অর্ধেকটা টেবিল চেয়ার পাতা। সন্ধ্যের পর ক্লাব খোলা হয়। অনেকে চেয়ার-টেবিলে বসে বই পড়ে। আবার অনেকে কেরাম খেলে। বিয়ের আগে আব্দুল হান্নান ক্লাব পরিচালনা করত এবং তার কাছেই ক্লাবের চাবি থাকত। বিয়ের আগের দিন বন্ধু-আব্বাসের হাতে চাবি দিয়ে ক্লাবে পরিচালনার ভার দিয়েছিল। আজও সেই-ই পরিচালনা করছে।
আব্দুল হান্নান ক্লাবে এসে দেখল, আব্বাস ও মুশতাকিম গল্প করছে। আর চারজন ছেলে কেরাম খেলছে। সালাম দিয়ে বলল, কি রে, তোরা কেমন আছিস?
তাকে দেখে সবাই একসঙ্গে সালামের উত্তর দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
আব্দুল হান্নান বলল, তোরা আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? কেমন আছিস বলবি না?
তাদের মধ্যে আব্বাস বলল, আমরা সবাই ভালো আছি। তুই কেমন আছিস বল। তোর ব্যবসাই বা কেমন চলছে? বিয়ে করে ক্লাবে আসা ছেড়ে দিলি? আমি আর ক্লাবের দায়িত্ব নিতে পারব না। হয় তুই নিজে দায়িত্ব নে, না হয় অন্য কাউকে দে।
পাশের চেয়ারে বসে আব্দুল হান্নান বলল, বুঝতে পারছি তোরা আমার উপর খুব রেগে আছিস। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। আসলে কি জানিস, বিয়ের আগের লাইফ আর বিয়ের পরের লাইফ অনেক তফাৎ। কথাটা এখন হয়তো মেনে নিতে পারছিস না, তবে বিয়ের পর মানতে বাধ্য হবি।
আব্বাস বলল, তোর কথা অবিশ্বাস করি নি। তাই তো ক্লাবের দায়িত্ব আমিও ছেড়ে দিতে চাচ্ছি।
তার মানে?
মানে আমারও বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে।
তাই নাকি? এটাতো মস্ত বড় সুখবর। তা বিয়ের দিন কবে ঠিক হয়েছে?
এই আগামী মাসের দশ তারিখ।
মুশতাকীমের দিকে তাকিয়ে আব্দুল হান্নান বলল, তা হলে তুই দায়িত্বটা নে না?
মুশতাকীম কিছু বলার আগে আব্বাস বলল, ওরওতো সামনের মাসের পঁচিশ তারিখে বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে, দায়িত্ব নেবে কি করে? তার চেয়ে এক কাজ কর, নতুন বিয়ে করলেও কিছুটা তোর পুরনো হয়েছে। তাই বলছি, আপাতত তুই দায়িত্ব নে। আমারটা পুরনো হয়ে গেলে তখন না হয় আমিই নেব।
মুসতাকীম আব্বাসকে উদ্দেশ্য করে বলল, ও তো ব্যবসা করে, সবদিন আসতে পারবে না। তার চেয়ে একদিন ক্লাবের সব সদস্যদের নিয়ে মিটিং করে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা যাবে কাকে দায়িত্ব দেওয়া যায়।
আব্দুল হান্নান বলল, কথাটা ভালোই বলেছিস। তারপর আব্বাসকে বলল, একটা দিন ঠিক করে সবাইকে মিটিং-এর কথা বলে আসতে বল।
আব্বাস বলল, অন্য কোনো উপায় যখন নেই তখন তাই করতে হবে। এখন বল, তোর দাম্পত্য জীবন কেমন চলছে?
আল্লাহর ইচ্ছায় ভালই চলছে। দোয়া করি, তোদেরও যেন ভালো চলে।
রাফিয়া মুশতাকীমের বোন। রাফিয়া যে আজ বিকেলে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল তা মুশতাকীম জানে। তাই রাফিয়া ফিরে এলে নিলুফার যা কিছু বলেছে তার কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছে।
আব্দুল হান্নানের দোয়া শুনে বলল, রাফিয়ার কাছে শুনলাম, তোর বৌ নাকি স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যের ব্যাপারে অনেক কথা বলেছে। সে সব শুনে মনে হয়েছে, ইসলাম স্বামীদেরকে স্ত্রীদের হুকুমের চাকর করেছে? তুইও সেসব কথা শুনেছিস নাকি?
হ্যাঁ, শুনেছি। আমারও তাই মনে হয়েছে এবং কথাটা তাকে বলেও ছিলাম। বলল, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য শুনলে স্ত্রীরা মনে করবে, তাদেরকে স্বামীদের দাসী করেছে ইসলাম। আরো বলল, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে হযরত আশরাফ আলি থানবী (রাঃ)-এর লেখা “কুরআন হাদিসের আলোকে সঠিক পারিবারিক জীবন” বইটি পড়া প্রত্যেক বয়স্ক মুসলমান নর নারীর, এমনকি বিশ্বের সমস্ত নর-নারীর পড়া উচিত। বিশেষ করে যেসব ছেলেমেয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তারা ও তাদের মা-বাবাদের পড়া একান্ত কর্তব্য। ভাবছি আমিও বইটা পড়ব। আর তোদেরকে বলছি, তোদেরতো বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে, তোরাও দুটো করে কিনবি। একটা নিজে পড়বি এবং তোর মা-বাবাকেও পড়তে বলবি। আর অন্যটা হবু বৌ-এর কাছে পাঠিয়ে তাকে ও তার মা-বাবাকে পড়তে বলবি।
তার কথা শুনে আব্বাস ও মুসতাকীম হেসে উঠে বলল, তুই যে দেখছি, তোর বৌ-এর মতো মৌলবীগিরী শুরু করলি? তুইতো আগে মৌলবীদের একদম দেখতেই পারতিস না।
আব্দুল হান্নান বলল, এখনও আমি ঐসব মৌলবীদের দেখতে পারি না, যারা কুরআন-হাদিসের কথা বলে মানুষকে ওয়াজ করে, অথচ নিজেরা তা মেনে চলে না। এমন সময় এশার আযান হচ্ছে শুনে বলল, এখন চলি। মসজিদে নামায পড়ে ঘরে যেতে হবে।
আব্বাস বলল, কেন রে, এটা তোর বৌ-এর হুকুম, না আদেশ? না বৌকে কাছে পাওয়ার জন্য তোর মন অস্থির হয়ে উঠেছে?
তোরাও বিয়ে কর, তা হলেই কোনটা ঠিক জানতে পারবি। তারপর চলি বলে সালাম বিনিময় করে আব্দুল হান্নান সেখান থেকে বেরিয়ে মসজিদের পথে হাঁটা দিল।
.
০৭.
স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পর নিলুফার গালিবার রুমে গেল।
গালিবা পড়ছিল। তাকে দেখে বলল, কিছু বলবে ছোট ভাবি?
নিলুফার বলল, নাযিম ভাই কোথায়?
মনে হয় মেহমানখানায়।
তাকে ডেকে নিয়ে এস।
ইলিয়াস মির্জার বাস্তুটা বেশ বড়। শ্বশুরের আমলে তিন কামরা পাকা টিনশেড ঘর ও বৈঠকখানা ছিল। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার আগে ইলিয়াস মির্জা আরো চার কামরা ঘর করেছেন। তার মধ্যে সদর গেটের দিকে রুমটা মেহমানখানা।
গালিবা মেহমানখানায় গিয়ে বলল, নাযিম ভাই, তোমাকে ছোট ভাবি ডাকছে, চল।
নাযিম গালিবার সঙ্গে এসে রুমে ঢুকেই সালাম দিল।
নিলুফার সালামের উত্তর দিয়ে নাযিমকে বসতে বলে গালিবাকে বলল, তুমি যাও।
গালিবা একবার তাদের দু’জনের দিকে একপলক তাকিয়ে নিয়ে চলে গেল।
নিলুফার নাযিমের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ও তোমাদের বাড়ির সবকিছু গালিবার কাছে শুনেছি। গালিবার সঙ্গে তোমার সম্পর্কের কথাও শুনেছি। তুমি নাকি গালিবাকে পরীক্ষার পর বিয়ে করতে চাও?
বিয়ের কথা শুনে নাযিম লজ্জা পেয়ে কিছু না বলে মুখ নিচু করে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল।
এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাচ্ছ কেন? কতই বা তোমার বয়স? তা ছাড়া রুজী রোজগার করে স্বাবলম্বী না হয়ে ছেলেদের বিয়ে করা মোটেই উচিত নয়।
মুখ নিচু করেই নাযিম বলল, ভালো পাত্র পেয়ে চাচা যদি ওর বিয়ে দিয়ে দেন। সে কথা ভেবে বলেছি।
তুমি কি মনে কর তোমার বাবা প্রস্তাব দিলে তোমার চাচা মেনে নেবেন?
মেনে না নেওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।
তাই যদি জান, তা হলে এখন গালিবাকে বিয়ে করার চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করে পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করার চেষ্টা কর। ভালো রেজাল্ট করতে পারলে মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরি-বাকরি কর। তখন প্রস্তাব দিলে তোমার চাচা ফিরিয়ে দেবেন না।
নাযিম এতক্ষণ মুখ নিচু করেছিল। এবার নিলুফারের দিকে তাকিয়ে বলল, খুব মূল্যবান কথা বলেছেন; কিন্তু তা করতে হলে আমার সামনে দুটো সমস্যা। একটা হল, আর্থিক, আর দ্বিতীয়টা হল, অতদিন কি গালিবার বিয়ে না দিয়ে চাচা রেখে দেবেন?
নিলুফার বলল, আমি তোমার প্রথম সমস্যার দায়িত্ব নেব। আর দ্বিতীয় সমস্যাটাও চিন্তা-ভাবনা করে কিছু করতে পারব ইনশাআল্লাহ। কি এবার পারবে তো আমি যা বললাম?
আপনার সঙ্গে আমার আজই প্রথম পরিচয়। তবু আপনার কথা বিশ্বাস করে কথা দিচ্ছি পারব।
শুধু পারব বলতে নেই, বলবে ইনশাআল্লাহ পারব।
নাযিম বলল, ইনশাআল্লাহ পারব।
নিলুফার বলল, মারহাবা। তারপর বলল, কোনো কাজ শুরু করার আগে বিসমিল্লাহ বলতে হয় এবং ভবিষ্যতে কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বলতে হয় ইনশাআল্লাহ। মোট কথা আল্লাহকে সব সময় স্মরণ রেখে সব কিছু করা মুসলমানদের উচিত। আর একটা কথা গালিবার মুখে শুনলাম, তুমি না কি কুমারী মেয়েদের পর্দা পছন্দ কর না?
নাযিম বলল, ওকে বোরখা পরে কলেজে যেতে দেখে বলেছিলাম, ছাত্র অবস্থায় বোরখা পরা ঠিক নয়। আরো বলেছিলাম, “আমি তো ছোট ভাইয়ের মতো, তবু ছোট ভাবি আমাকে মুখ দেখাল না, এটা তার ঠিক হয় নি।”
নিলুফার গায়ে মাথায় ওড়না দিয়ে ও মুখের নাক পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। তার কথা শুনে মৃদু হেসে বলল, বর্তমানে সমাজের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তুমি ঠিক বলেছ; কিন্তু ইসলামিক বিধানে যে ঠিক নয়, তা ঐদিন সবাইয়ের সামনে বলেছি। তুমিও তো সেদিন ছিলে, নিশ্চয় শুনেছ? তারপরও তোমার মনে যে সন্দেহ রয়েছে, তা দূর করতে হলে কুরআনের তফসীর পড়তে হবে। তা ছাড়া পর্দা সম্পর্কে অনেক বই আছে, সে সব পড়লে বুঝতে পারবে মেয়েদের পর্দা করা অত্যন্ত দরকার। শুধু প্রত্যেক মুসলমান নয়, যারা আল্লাহকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা এবং কুরআনকে তাঁর বাণী বলে স্বীকার করে, তাদের জানা উচিত, আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের জন্য যে সব বিধি-বিধান দিয়েছেন, সে সব সঠিক ও অভ্রান্ত। বিশেষ করে মুসলমানদেরকে তো মনে প্রাণে স্বীকার করতে ও মেনে চলতে হবে। যদি কেউ কুরআন ও হাদিসের কোনো বিধি-বিধান খারাপ অথবা এ যুগে অচল অথবা বিধি-বিধানের সংস্কার করা উচিত বলে মনে করে, তবে তৎক্ষণাৎ তার ঈমান চলে যাবে অর্থাৎ মুসলমান থেকে বাদ হয়ে যাবে। তাই পৃথিবীর সব মুসলমানদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য কুরআন-হাদিসের জ্ঞান-অর্জন করা। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, মুসলমানরা প্রথম ও প্রধান কর্তব্যের প্রতি উদাসীন তো হয়েছেই, তার উপর বিধর্মীদের মধ্যে যারা নাকি ইসলামের দুশমন, তাদের লেখা বইপুস্তক পড়ে উচ্চ-ডিগ্রী নিয়ে ইসলাম ও কুরআন-হাদিসের বিপরীতে মতামত দিচ্ছে এবং সেইসব মতামত অশিক্ষিত মুসলমানদেরকে জানিয়ে তাদেরকেও নিজেদের মতো ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। অথচ তারা মুসলমান বলে দাবিও করছে। কুরআন-হাদিসের বিপরীত কথা বলে তারা যে মুসলমান থেকে বাদ হয়ে পড়ছে তাও তারা জানে না। আর একদল স্বার্থান্বেষী বেঈমান আলেমরাও তাদেরকে সাপোর্ট করছে। সারা পৃথিবীর মুসলমানরা যদি ইসলামকে সঠিকভাবে জানত, তা হলে আবার তারা নতুনভাবে খাঁটি মুসলমান হতে পারত। যেমন নাকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ উচ্চশিক্ষিত বিধর্মীরা ইসলামকে জেনে ইসলাম ধর্ম কবুল করে খাঁটি নতুন মুসলমান হচ্ছে।
এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, ইসলাম সম্পর্কে মুসলমানরা জ্ঞান অর্জন না করার ফলে ইসলামের কথা বললে কেন তাকে গোড়া মুসলমান অথবা মৌলবাদী বলে। তাই তাদের উচিত, গোঁড়া ও মৌলবাদীরা যা কিছু বলেন, সেগুলো ইসলামে অর্থাৎ কুরআন-হাদিসে আছে কিনা যাচাই করে দেখা। যাই হোক, অনেক কথা বললাম, মনে কিছু নিও না। তুমি কি করবে না করবে সেটা তোমার ব্যাপার। তবু বলব, আমার কথাগুলো চিন্তা করে অগ্রসর হলে ভবিষ্যৎ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে এবং তোমার ও গালিবার স্বপ্ন সফল হবে ইনশাআল্লাহ। তারপর জিজ্ঞেস করল, কাল সকালে চলে যাবে নাকি?
নাযিম বলল, যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যাব না। পরশু সকালে যাব। কাল বিকেলে আপনার কাছ থেকে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য শুনব।
ঠিক আছে এখন আসি, বলে নিলুফার সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
.
০৮.
আজ নাফিসা ও রাফিয়া পাড়ার অনেক বৌ, শাশুড়ী ও ঝিউড়ীদের নিয়ে এসেছে। তাই দেখে গালিবা, রোকেয়া ও যয়নাব তাদের বসার ব্যবস্থা করল। তারপর গালিবা সে কথা জানিয়ে প্রথমে ছোট ভাবিকে ও পরে ঘরের সবাইকে আসতে বলল। নাযিমকেও বলতে ভুলল না।
সবাই আসার পর নিলুফার বলতে শুরু করল, আজ আমি স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে যে কথা বলব, তা শুধু শুনলেই হবে না, সেগুলো মনে বেখে মেনে চলার চেষ্টা করবেন। প্রথমে স্বামীর অধিকার সম্পর্কে কয়েকটি হাদিস বলছি।
আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়িবে, রমযানের রোযা আদায় করিবে, নিজের ইজ্জত ও সতীত্ব রক্ষা করিবে এবং স্বামীর পূর্ণ আনুগত্য করিবে, সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করিতে পারিবে। [বর্ণনায়: মিশকাত, পৃষ্ঠা-২০১]
হুজুর (দঃ) বলিয়াছেন, “যে নারীর মৃত্যুর সময় তাহার স্বামী তাহার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, মৃত্যুর পরে সেই নারী জান্নাতে প্রবেশ করিবে। [বর্ণনায়: আবু হোরাইয়া (রাঃ)-তিরমিজী]
হযরত (দঃ) বলিয়াছেন, “যদি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম, তা হলে স্ত্রীকে হুকুম দিতাম সে যেন তার স্বামীকে সিজদা করে। যদি স্ত্রীকে এই পাহাড়ের পাথরসমূহ ঐ পাহাড়ে এবং ঐ পাহাড়ের পাথরসমূহ এই পাহাড়ে বহন করে নিয়ে আসার হুকুম করে, তা হলে তা পালন করা তার উপর ওয়াজীব হয়ে যায়।” [মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৮১]
হুজুর (দঃ) ইরশাদ করিয়াছেন, “স্বামী যদি স্ত্রীকে কোনো কাজের জন্য ডাকে তখন তার ডাকে সাড়া দেওয়া তার উপর ওয়াজীব হয়ে যায়, যদিও সে চুলার উপর থাকে। অর্থাৎ স্ত্রী যত জরুরী কাজেই থাকুক না কেন, স্বামী ডাকা মাত্র সবকিছু ত্যাগ করে তার ডাকে সাড়া দেওয়া জরুরী।
রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যখন কোনো রমণীকে তাহার স্বামী শয্যায় আহবান করে এবং সে অস্বীকার করে এবং তজন্য তাহার স্বামী ক্ষেপে রাত কাটায়, সেই রমনীকে প্রভাত পর্যন্ত ফেরেশতাগণ অভিশাপ দেয়। অন্য বর্ণনায়, যাহার হাতে আমার জীবন তাহার শপথ, কোনো রমণীকে তাহার স্বামী শয্যায় আহবান করিলে, সে যদি তাহা অস্বীকার করে, তাহা হইলে যিনি আকাশে আছেন, তিনি তাহার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তাহার স্বামী সন্তুষ্ট না হয়।” [বর্ণনায়: হযরত আবু হোরাইয়া (রাঃ)-বুখারী, মুসলিম]
হুজুর (দঃ) ইরশাদ করিয়াছেন, “কোনো স্ত্রী যখন দুনিয়াতে তার স্বামীকে কষ্ট দেয় তখন জান্নাতে উক্ত স্বামীর জন্য নির্ধারিত নূর বলতে থাকে, আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন। অচিরেই সে তোমাকে ছেড়ে আমার সান্নিধ্যে চলে আসবে?”
হুজুর (দঃ) ইরশাদ করিয়াছেন, “তিন ব্যক্তির নামায এবং আযান গৃহিত হয় না। পলায়নকারী দাস যে পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন না করে, যে নারীর স্বামী তার উপর সারারাত্রি অসন্তুষ্ট ছিল, এবং যে নেতার প্রতি তাহার সম্প্রদায়ের লোক সন্তুষ্ট নহে।” [বর্ণনায়: আবু উমামাহ (রাঃ)-তিরমিজী]
এক ব্যক্তি হুজুর (দঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসুলুল্লাহ, সর্বোত্তম নারী কে? উত্তরে তিনি বলিলেন, ঐ নারী যে তার স্বামীকে আনন্দ দেয়, যখন সে তার দিকে তাকায়। স্বামীর কথা মান্য করে এবং তার জীবন ও সম্পদের ক্ষেত্রে এমন কিছু করে না, যা সে অপছন্দ করে?”
উপরের হাদিসগুলো দ্বারা আমরা জানতে পারলাম, স্ত্রীর উপর স্বামীর কত মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব। যেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা জায়েয হলে স্ত্রীর জন্য তার স্বামীকে সিজদা করা জায়েয হত, সেখানে আজকালের নারীরা এ মর্যাদার রক্ষা করা তো দুরের কথা বরং তাকে সমকক্ষ বা তার চেয়ে কম বুদ্ধিমান মনে করে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতে দ্বিধা করে না। যদি কোনো নারী বলে আমাদের রাগ ও উত্তেজিত হওয়ার কারণ স্বামীর রাগ ও উত্তেজনা, তা হলে শোন, রাগ ও উত্তেজনা প্রকাশের ক্ষেত্র তো এমন ব্যক্তি, যে নিজের চেয়ে ছোট কিংবা সমকক্ষ। মানুষ যাকে নিজের চেয়ে বড় ও মর্যাদাশীল মনে করে তার উপর কখনও রাগ বা উত্তেজিত হয় না। যেমন। পিতার উপর পুত্র ক্রুদ্ধ হয় না। তবে আজকালকার ছেলেরা পিতা ন্যায়-অন্যায় কিছু বললে, ক্রুদ্ধ হয়ে মুখে মুখে তর্ক করে কারণ ঐ একই। তারা পিতার মর্যাদা সম্বন্ধে অজ্ঞ অথবা নিজেকে পিতার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান মনে করে। তাই। তারা পিতা-মাতার সঙ্গে রাগারাগি ও তর্ক করে। এরকম মনে করা যে কত বড় জঘন্য অপরাধ তা তারা জানে না। তেমনি স্বামীর ক্রোধের কারণে নারীদের ক্রুদ্ধ হওয়া একথাই প্রমাণ করে যে, নিজেদেরকে স্বামীর চেয়ে বড় কিংবা তার সমকক্ষ মনে করে। অথচ এটা তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। যদি নিজেকে স্বামীর চেয়ে ক্ষুদ্র ও অধিনস্থ মনে করত, তা হলে তারা তার প্রতি ক্রুদ্ধ হতে পারত না। নারীদের উচিত, আল্লাহতায়ালা তাদেরকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা এবং স্বামীর ক্রোধের ও উত্তেজনার সময় নিজেকে সম্পূর্ণ সংযত রাখা।
আজকাল নারীরা স্বামীর আনুগত্য করাকে অপমানকর মনে করে। স্বামীর আদেশ পালন করাকে শরীয়তের হুকুম মনে করে না। মেয়েদের অনেকে দোয়া-দরূদ পড়া ও জিকির করাকে আজকাল অনেক ফজিলত মনে করে। কিন্তু তার চেয়ে আরো অনেক বেশি ফজিলত স্বামীর হুকুম মেনে চলা।
আবার অনেক পুরুষ মনে করে স্বামীর উপর স্ত্রীর কোনো শ্রেষ্ঠত্বই থাকতে পারে না। এটা তাদের ভুল। সর্বাবস্থায় স্ত্রীর উপর স্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব, স্বামীর তুলনায় স্ত্রী তুচ্ছ, এটাও ভুল ধারণা। কোনো কোনো বিষয়ে স্ত্রী-স্বামীর সমতুল্ল, এমন কি তার চেয়েও অগ্রগামী হতে পারে। যেমন স্ত্রী যদি নামায, রোযা, ইবাদত বন্দেগী ও আল্লাহর হুকুম আহকাম পালনে স্বামীর তুলনায় অধিক যত্নবান হয়, তা হলে অবশ্যই তার মর্যাদা স্বামীর চেয়ে অধিক হবে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, স্বামীর তুলনায় ইবাদত গুজার ও ধর্মপরায়ণ হওয়ার কারণে তার উপর স্বামীর আনুগত্য ওয়াজীব থাকবে না। বরং স্বামীর আনুগত্য ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন স্ত্রীকে সর্বাবস্থায় করতে হবে। কেননা স্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব দুদিক থেকে।
এক: বৈবাহিক সম্পর্কের দিক থেকে। এ সম্পর্কের দাবি অনুযায়ী স্বামীর উপর স্ত্রীর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। বরং সর্বাবস্থায় স্ত্রীর উপর স্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব। শরীয়তে স্বামীর উপর স্ত্রীর যে অধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা দ্বারা স্বামীর এ শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুণ্ণ হবে না।
দুই: ইবাদত ও ধার্মিকতার দিক থেকে। ইবাদত ও ধার্মিকতায় স্ত্রী স্বামীর চেয়ে অগ্রগামী হতে পারে এবং মহান আল্লাহর কাছেও মর্যাদা শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হল ইবাদত ও ধার্মিকতা। কিন্তু তাই বলে এই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সুবাদে স্ত্রী স্বামীর মাখদুম (খিদমতগার) হতে পারে না। বরং তাকে স্বামীর খাদেম হয়েই থাকতে হবে।
আপনারা হয়তো হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর বিবি রহিমার পতিভক্তির কথা জানেন। কিন্তু উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)-এর পতিভক্তি ও পতিকে কতটা মর্যাদা দিতেন তা বোধহয় জানেন না। বলছি শুনুন, আপনারা তো জানেন, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এতীম ছিলেন এবং প্রথমে দাদা আব্দুল মাতুলেবের কাছেও পরে চাচা আবু তালেবের তত্ত্বাবধানে লালিত পালি হন। হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) বিশিষ্ট ধনী ও প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী খুওয়াইলিদের মেয়ে ছিলেন। তিনি বিদুষী, রূপবতী ও গুণবতী ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে তাঁর তিনবার বিয়ে হয়েছিল। তিন স্বামীই বিয়ের কিছুকাল পর মারা যান। তারপর তিনি বৈধব্য জীবন-যাপন করছিলেন। তিনিও লোক মারফত বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করে আরো বিপুল ঐশ্বর্যশালী হয়েছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর চারিত্রিক গুণাবলী শুনে তাকে বিয়ে করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল চল্লিশ বছর। আর হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর বয়স পঁচিশ বছর। যাই হোক, বিয়ের দিন রাত্রে অর্থাৎ বাসর রাত্রে তিনি বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী করে দিয়েছিলেন স্বামীকে। পরে যখন নবী করিম (দঃ) ঐ সব ঐশ্বর্য অকাতরে দান করে দিয়েছিলেন তখন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ) এতটুকু প্রতিবাদ করাতো দূরের কথা বরং সন্তুষ্ট চিত্তে সে সব মেনে নিয়ে স্বামীর ভালোমন্দের দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখতেন, আর মন প্রাণ উজাড় করে তাঁকে ভালবেসেছিলেন ও সেবাযত্ন করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (দঃ)ও হযরত খাদীজাতুল কুবরাকে এত ভালবেসেছিলেন যে, আরো অনেকগুলো বিয়ে করলেও তার কথা আজীবন ভুলতে পারেন নি। তাই অন্যান্য বিবিদের কাছে তাঁর গুণগান করতেন। একবার বিবিদের কাছে যখন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)-এর গুণগান করছিলেন তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছিলেন, ঐ বৃদ্ধার মধ্যে এমন কি ছিল, যে কারণে আজও তার কথা ভুলতে পারেন নি? যিনি মারা গেছেন, সেই বৃদ্ধার গুণগান প্রায়ই আমাদের কাছে। করেন। আল্লাহতায়ালা তো তার চাইতেও উত্তম যুবতী স্ত্রী আপনাকে দান করিয়াছেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) এই মন্তব্য শুনিয়া রাসুলুল্লাহ (দঃ) ভীষণ মর্মাহত হয়ে বললেন, “হে আয়েশা (রাঃ) আল্লাহর শফত, হযরত খাদীজার (রাঃ)-এর চাইতে উত্তম স্ত্রী আমি দ্বিতীয় একজনও পাই নি। সারা বিশ্বের লোক যখন আমাকে অবিশ্বাস করিয়াছিল তখন এই খাদীজা (রাঃ) আমার উপর ঈমান আনিয়াছিল। সে তাহার সমস্ত ঐশ্বর্য আমাকে উৎসর্গ করিয়াছিল। সে আমাকে সন্তান-সন্ততীও দান করিয়াছে। তাহার এই সন্তান-সন্ততীর মাধ্যমেই জগতে আমার বংশ বিস্তার লাভ করিবে। হে আয়েশা (রাঃ) খাদীজা (রাঃ) এর সঙ্গে অন্য কোনো নারীর তুলনা হয় না। তার মতো উত্তম স্ত্রী আল্লাহতায়ালা আমাকে আর দান করেন নাই।
রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর কথা শুনে হযরত আয়েশা (রাঃ) লজ্জিত হয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি জীবনে আর এমন কথা মুখে উচ্চারণ করব না।”
মেয়েদের মনে রাখা উচিত, দ্বীন ও শরীয়তের হুকুম-আহকাম ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রেই স্বামীর অধিকার সকলের থেকে বেশি। তার স্বামী যদি দ্বীন ও শরীয়তের বিরোধী কোনো হুকুম করে, তা হলে স্ত্রী তা অমান্য করে আল্লাহর হুকুম মানবে। মেয়েদের আরো মনে রাখতে হবে, আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর পর স্বামীর অধিকার সকলের উর্ধে। সব মেয়েদের জেনে রাখা উচিত, কারো স্বামী তাকে যদি নামায না পড়ার, যাকাত আদায় না করার, দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ না করার কিংবা এ জাতীয় শরীয়ত বিরোধী কোনো আদেশ করে, তা হলে তা পালন করা তার জন্য হারাম, বরং উক্ত অন্যায় হুকুম অমান্য করা তার উপর ফরয। তবে যদি মুস্তাহাব বা নফল কাজ করতে নিষেধ করে, তা হলে তা পালন করা জরুরী। স্বামীর খিদমত ও সেবাযত্নের বিঘ্নতা সৃষ্টিকারী কোনো জায়েয কাজও স্ত্রীর জন্য করার অনুমতি নেই। ইসলাম স্ত্রীর উপর স্বামীর যে হক নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা আর কারো জন্য করে নি। সেই হকগুলো হচ্ছে
এক: স্বামীর খিদমত ও সেবাযত্নে সদা সচেষ্ট থাকা এবং তার কাম চাহিদা পূরণ করা।
দুই: স্বামী যখন কাছে থাকবে তখন তার অনুমতি ছাড়া নফল নামায ও নফল রোযায় মগ্ন হতে পারবে না।
তিন: স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া চলবে না। এমন কি আত্মীয়-স্বজনের ঘরেও না।
চার: নিজের বেশভূষা পরিবর্তন করে ময়লা-দুর্গন্ধময় এবং অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন থাকবে না। বরং স্বামীর সামনে সর্বদা সুসজ্জিতা হয়ে থাকবে। এখানে একটা কথা না বলে পারছি না, অধিকাংশ স্ত্রীরা ঘরে সাধারণ বেশভূষা অবস্থায় স্বামীর কাছে আসে। অথচ তারা যখন কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বা অন্য কোথাও বেড়াতে যায় তখন নিজেকে সুসজ্জিতও সুশোভিত করে যায়। এটা তাদের একটা বড় দোষ। কারণ হাদিসে বলা হয়েছে, “মেয়েরা যখন ঘরের বাইরে যাবে, তখন যেন সাধারণ বেশভূষা করে যায়। আর স্বামীর কাছে। যখন যাবে, তখন সুন্দর ও দামী বেশভূষা করে যায়।
পাঁচ: সকল বিষয়ে স্বামীর আনুগত্য করে চলা, যদি তা শরীয়ত বিরোধী হয়।
ছয়: স্বামীর আর্থিক ক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত কোনো কিছু তার কাছে দাবি করবে না।
সাত: স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ঘরে প্রবেশ করতে দেবে না।
আট: স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার সম্পদ থেকে কাউকে কোনো কিছু দেবে না।
নয়: স্বামী দৈহিক মিলনের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে (শরীয়তের কোনো অন্তরায়, যেমন-হায়েজ নেফাস ছাড়া) তাতে অস্বীকার করবে না। অবশ্য অসুখ-বিসুখ থাকলে স্বামীকে সে কথা বুঝিয়ে বলবে।
দশ: স্বামীকে তার অভাব অনটন কিংবা দৈহিক অবয়ব দৃষ্টিকটু হওয়ার কারণে তাকে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য করবে না।
এগার: স্বামীর মধ্যে দ্বীন ও শরীয়ত বিরোধী কোনো কাজ দেখলে, তা থেকে তাকে আদব ও সম্মানের সঙ্গে বুঝিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতে হবে। কোনোরকম কথা কাটাকাটি বা গলাবাজি করে তাকে নিবৃত্ত করার টেষ্টা করবে না।
বার: স্বামীর নাম ধরে ডাকলে গুনাহ হয় না, তবে বেয়াদবি হয়। তা ছাড়া তার শ্রেষ্ঠত্ব ছোট করা হয়। তাই নাম ধরে ডাকবে না।
তের: কারো কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে না। চৌদ্দ: স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ ও উচ্চস্বরে কথা কাটাকাটি করবে না।
পনের: স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে ঝগড়া-বিবাদ না করে সব সময় ভালো ব্যবহার করবে।
মেয়েদের মনে রাখতে হবে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এমন এক সম্পর্ক, যা নিয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সুখকর হলে, উভয়ের মনের মিল হলে এবং একজনের প্রতি অপর জনের ভালবাসা থাকলে এর চেয়ে বড় নেয়ামত পৃথিবীতে আর নেই। আর যদি উভয়ের সম্পর্ক খারাপ হয়, মনের মিল
হয় এবং তাদের মধ্যে ভালবাসা না থাকে, তা হলে এর চেয়ে আযাব আর কিছু নেই। তাই স্ত্রীর উচিত স্বামীর মন জুগিয়ে ও তার মনোরঞ্জন করে চলা এবং স্বামীর প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া। অবশ্য স্বামীকেও এ ব্যাপারে একইরকম হতে হবে। এই জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। তা না করলে শুধু স্বামী বা স্ত্রী একার দ্বারা কোনোদিন সংসার সুখের হয় না। তবে অনেক মেয়ে এমন মুখরা, হিংসুটে ও বদমেজাজী আছে, যাদের জন্য অনেক ভালো ভালো পরিবার ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। তাই হয়তো অনেকে মনে করেন, “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।”
ভালো জমিন ও ভালো বীজ না হলে যেমন ভালো ফসল হয় না, তেমনি ভালো স্বামী ও ভালো স্ত্রী না হলে সংসার সুখের হয় না। তবে এমন কিছু ভালো মহিলাও আছেন, যারা নাকি স্বামী, দেবর, ননদ, শ্বশুর ও শাশুড়ীর খারাপ হওয়া সত্বেও ধৈর্য, জ্ঞান ও সহিষ্ণুতার দ্বারা সংসার সুখের করেছেন। এরকম মেয়ে বিরল হলেও তাকে দেখেও হয়তো কেউ কেউ বলেছেন, “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।”
তবে এ ব্যাপারে মেয়েদের আরো মনে রাখতে হবে, স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য তার মন জুগিয়ে চলতে হবে। তার হাতের ও চোখের ইশারার উপর চলতে হবে। স্বামীর মেজাজ ও তবীয়তের উপর লক্ষ্য রেখে সে অনুযায়ী চলতে হবে। এটা করাও তার আনুগত্যের অংশ। স্ত্রীরা স্বামীর আর্থিক অবস্থা জানা সত্ত্বেও অনেকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু আবদার বা দাবি করে। এটা মোটেই সমীচীন নয়। ডাল, ভাত, চাটনি-রুটি যা কিছু মিলবে তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে। কখনও কোনো কাপড়, অলঙ্কার বা এজাতীয় কোনো জিনিস পছন্দ হলে যদি স্বামীর কাছে টাকা না থাকে, তা হলে তা কিনে দেওয়ার জন্য আব্দার করবে না। এমন কি মুখ দিয়ে বেরও করবে না এবং সেজন্য কোনোরূপ আক্ষেপও করবে না। কারণ অক্ষমতার কারণে স্বামী যদি কিনে দিতে না পারে, তবে সে দুঃখ পাবে আর ভাববে, আমার অবস্থার প্রতি তার দরদ নেই। স্বামীর কিনে দেওয়ার সামর্থ থাকলে অবশ্য বলতে পারে। তবে না বলাটাই বাঞ্চনীয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো থাকলে স্বামী তো স্ত্রীকে খুশী করার জন্য নিজেই কিনে দেবে। নিজের থেকে চাওয়া উচিত নয়। কারণ চাওয়ার দ্বারা মানুষ অন্যের দৃষ্টিতে খাটো হয়ে যায় এবং নিজের ওজনও কমে যায়।
স্বামী সফর থেকে ফিরে আসার সাথে সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করবে। তারপর সেখানে কেমন ছিল, কোনো কষ্ট হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করবে, বিশ্রাম ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবে। মোটকথা, কথা ও ব্যবহারের দ্বারা তাকে সন্তুষ্ট করবে। টাকা পয়সার কথা, কি এনেছ না এনেছ, জিনিসপত্রের ব্যাগ কোথায়? এসব জিজ্ঞেস করবে না। স্বামী কোনো জিনিস আনলে তা পছন্দ হোক বা না হোক, আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে। কখনও বলবে না, এটা আমার পছন্দ হয় নি। এটা তুমি কি এনেছ? এতে স্বামীর মন ভেঙ্গে যায়। ভবিষ্যতে কখনও কিছু আনতে আগ্রহ বোধ করবে না। আর যদি তার আনা জিনিসের প্রশংসা করে সানন্দে ও কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ কর, তা হলে স্বামীর দীল খুশী হবে এবং ভবিষ্যতে আরো আনতে উদ্বুদ্ধ হবে। এজন্যে স্বামী কিছু দিলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। অকৃতজ্ঞতাসুলভ কথা বললে, স্বামীর মনে কষ্ট হয়। হাদিসে আছে, “আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, আমি জাহান্নামে অধিক নারী দেখলাম, তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, “হে আল্লাহর রাসূল (দঃ) জাহান্নামে নারীর সংখ্যা অধিক কেন? তিনি বলিলেন, “এরা অধিক লানত দেয় এবং স্বামীর অধিক না-শোকরী করে।”
স্বামী কোনো কারণে যদি রাগ করে মুখ কালো করে থাকে অথবা কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়, তা হলে তুমিও তার মতো রাগ করে মুখ কালো করে থাকবে না। বরং তোষামোদ করে, অনুনয়-বিনয় করে ও হাতজোড় করে যেভাবে সম্ভব, রাজি খুশী করে নেবে। তোমার যদি দোষ না হয়েও থাকে, তবু তার। উত্তেজনার জওয়াবে তুমি উত্তেজিত হবে না। বরং করজোড়ে নতিস্বীকার করে তার কাছে ক্ষমা চাওয়াকে নিজের জন্য গর্ব ও মর্যাদার বিষয় মনে করবে। আর যদি দোষ-ত্রুটি তোমার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তা হলে তো তোমার অসন্তুষ্ট হয়ে মুখ কালো করে রাখা চরম বোকামী ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। এ জাতীয় আচরণের ফলেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনের দূরত্ব, মন কষি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। স্বামী রেগে গেলে স্ত্রীও রেগে গিয়ে এমন কথা বল। মোটেই উচিত নয়, যার কারণে স্বামীর রাগ আরো বেড়ে যায়। সে রেগে গিয়ে অনেক কিছু বললেও স্ত্রীর কর্তব্য চুপ করে থাকা। রাগ পড়ে গেলে দেখবে, সে নিজেই তোমার কাছে লজ্জিত হবে। উপরন্তু তোমার প্রতি তার আকর্ষণ ও ভালবাসা আগের থেকে আরো বেড়ে যাবে। ভবিষ্যতে তোমার প্রতি আর উত্তেজিত হবে না।
আল্লাহপাক কুরআন মজিদে রক্তের সম্পর্কের সাথে সাথে শ্বশুরালয়ের সম্পর্কও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করিয়াছেন।
এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, শ্বশুর-শাশুড়ীর সম্পর্ক ও তাদের অধিকারের বিষয়টি পারিবারিক জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই তাঁদের সঙ্গে সব থেকে ভালো আচরণ করতে হবে। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকবেন, তাদের খিদমত, সেবাযত্ন ও তাঁদের অনুগত্য করাকে নিজের জন্য অনিবার্য মনে করবে। কারণ, এতে একদিকে রয়েছে নিজের সম্মান ও মর্যাদা, অপরদিকে তারা তোমার সেবাযত্ন সন্তুষ্ট হয়ে দোয়া করলে ইহজগতে এবং পরজগতে সুখ-শান্তি পাবে। একান্নবর্তি পরিবার হলে ভাসুর, দেবর, ননদ ও জায়েদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে, যেন সবাই তোমাকে আপন করে নিতে পারে। যদিও শরীয়তের নির্দেশ হলো, স্ত্রীকে মা-বাবা, ভাই-বোন থেকে পৃথক রাখার ব্যবস্থা করা, তবু নৈতিক ও মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে এসব কথা বলা হল। যে সব মেয়েরা বিয়ের পরপর স্বামীকে নিয়ে তার মা-বাবা থেকে পৃথক থাকতে চায়, তাদের চিন্তা করা উচিত, মা-বাবা তোমাদের স্বামীকে কত কষ্ট করে লালন-পালন করেছেন। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, এখন বুড়ো বয়সে তারা একটু আরাম ও সুখ শান্তিতে থাকার জন্য ছেলের বিয়ে করালেন। আর সেই ছেলের নতুন বৌ আসার সাথে সাথে অথবা কিছুদিনের মধ্যে পৃথক হওয়ার জন্য স্বামীর কানভারী করতে শুরু করে। এটা নৈতিক ও মানবতা বিরোধী নয় কি? এদিকে বৌ ছেলেকে ফুসলিয়ে তাদের থেকে পৃথক থাকার চেষ্টা করছে জেনে বৌ-শাশুড়ীর মধ্যে ঝগড়াও বিশৃঙখলা শুরু হয়ে যায়। ছেলে ও বৌদের জেনে রাখা উচিত, মা-বাবা থেকে পৃথক হয়ে গেলেও তাদের ভরণ-পোষণ ও সেবাযত্ন করা নৈতিক দায়িত্ব। ছেলের কর্তব্য মা বাবার খিদমত ও সেবাযত্ন করা। নিজে না পারলে স্ত্রীকে দিয়ে করান। অবশ্য এ ব্যাপারে স্ত্রীকে জোর-জবরদস্তি করতে পারবে না। তবে স্ত্রীর উচিত স্বামী যদি তাকে তার মা-বাবার খিদমত করতে বলে, তা পালন করা। এটাও স্বামীর আনুগত্যের অংশ। স্ত্রী করতে না চাইলে এবং নিজে করতে না পারলে চাকর বা চাকরাণী দিয়ে করাতে হবে। আর বৌ যদি স্বেচ্ছায় শ্বশুর ও শাশুড়ির খিদমত ও সেবাযত্ন করে, তা হলে তার ফজিলতের কথা তো একটু আগে বললাম, আর বৌদের এটা করা মানবতার পরিচায়ক।
দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) যা কিছু বলিয়াছেন, সেসব পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সব সদস্যদের জানা অবশ্য কর্তব্য। নচেৎ সবাইকে অশান্তিতে জীবন কাটাতে হবে। আর বর্তমানে তা যে হচ্ছে, সেটা আমরা ভালো করেই জানি।
এমন সময় আসরের আযান হচ্ছে শুনে নিলুফার বলল, আজ এইখানে শেষ করছি।
বড় বৌ-আসমা বলল, এত কথার পরও কিন্তু অনেক প্রশ্ন মনে আসছে। সেগুলো আমাদের জানাতে হবে।
নিলুফার বলল, নিশ্চয় জানাব। আমাদের সাহেবরাতে এশার নামাযের পর প্রতিদিন ঘরে আসেন। আমরা মাগরিবের নামাযের পর অথবা ফজরের নামাযের পর বসে আলাপ করতে পারি।
মেজ বৌ সাহিদা বলল, বড় বুবু ঠিক কথা বলেছে। আমারও মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে, সেগুলোও জানতে হবে।
এবার ইলিয়াস মির্জা বলে উঠলেন, আমার মনে হয় নিলুফারের কাছে আমাদের সবারই আরো অনেক কিছু জানার আছে।
নিলুফার বলল, আমি জানি, আমার কথা শুনে আপনাদের কিছু না কিছু প্রশ্ন থাকবেই। তা ছাড়া আমারও আরো অনেক কিছু বলার রয়ে গেছে। তাই তো মাগরিবের ও ফজরের নামাযের পর আলোচনায় বসার জন্য বললাম।
ইলিয়াস মির্জা বললেন, মাগরিবের নামাযের পর মেয়েদের অনেক রকম কাজ থাকে, গালিবারও পড়াশুনা আছে, তা ছাড়া আমিও থাকতে পারব না। তাই যা কিছু আলোচনা ফজরের নামাযের পর করাই ভালো।
নিলুফার বলল, জি, তাই হবে।
সাজেদা নামে পাড়ার একটা বৌ বলল, আমরা সেসব জানব কি করে?
নিলুফার বলল, আপনারা প্রতি শুক্রবার তিনটের দিকে এসে যা জানার জেনে নেবেন। এখন সবাই আসুন, নামায পড়তে হবে।
.
মাগরিবের নামায পড়ে গালিবা নিলুফারকে বলল, নাযিম ভাইয়ের সঙ্গে কাল অতক্ষণ ধরে কি কথা বললে?
নাযিমের সঙ্গে যে সব কথা হয়েছে, সেসব বলে নিলুফার জিজ্ঞেস করল, কি ঠিক বলি নি?
সবকিছু শুনে গালিবা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি ছোট ভাবি, তোমার মতো মেয়ে হয় না। তোমার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না। তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষাও আমার নেই।
নিলুফার হেসে উঠে বলল, এখনও তুমি ঋণী হও নি। আর এখন কৃতজ্ঞতা জানাতেও হবে না। আল্লাহ যেদিন তোমাদের মনের আশা পূরণ করবেন, সেদিন জানিও।
গালিবা তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা ছোট ভাবি, নাযিম ভাইকে বলেছ লেখাপড়া শেষ করে উপার্জন করার পর বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে, আর এদিকে যদি আব্বা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে, তা হলে কিভাবে ঠেকাবে?
ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। যখন আব্বা তোমার বিয়ের কথা উঠাবেন তখন যা কিছু বলার বলে ঠেকাব। এখন যাও নিজের চরকায় তেল দাও। নচেৎ নাযিম ভাইয়ের কথা বেশি চিন্তা করলে পরীক্ষায় ডাব্বা মারবে।
নাযিম ভাইয়ের কথা চিন্তা করলেও ডাব্বা মারব না। বরং রেজাল্ট ইনশাআল্লাহ ভালই করব বলে গালিবা ছোট ভাবির ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে পড়তে বসল। কিন্তু পড়ায় মন বসাতে পারল না। কেবলই নাযিমের কথা মনে পড়তে লাগল। ভাবল, নাযিম ভাইয়ের মাস্টার্স শেষ করে রুজী রোজগার করতে কমপক্ষে চার বছর লাগবে। এর মধ্যে আব্বা ও ভাইয়ারা। নিশ্চয় তার বিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেবে এবং ভালো সম্বন্ধ পেলে ছাড়বে না। তখন ছোটভাবি কিভাবে ঠেকাবে চিন্তা করে ঠিক করতে না পেরে পড়াতে মন বসাবার চেষ্টা করল।
রাত সাড়ে এগারটায় ঘুমাতে যাওয়ার সময় গালিবা চিন্তা করল, কাল ভোরে নাযিম ভাই চলে যাবে। তার সঙ্গে একাকি কথা বলার সুযোগ হবে না। এখন দেখা করলে কেমন হয়? সে কি ঘুমিয়ে পড়েছে? আবার চিন্তা করল, কেউ যদি দেখে ফেলে, তা হলে কি হবে ভেবে দমে গেল। কিন্তু ইচ্ছাকে দমন করতে না পেরে দরজা খুলে চারদিক তাকিয়ে সবার ঘরের দরজা বন্ধ দেখে নিজের দরজা আস্তে করে বন্ধ করে মেহমানখানায় গিয়ে দরজায় নক করল।
গালিবার মতো নাযিমও ঐসব চিন্তা করতে করতে তার চোখে তন্দ্ৰামতো এসেছিল। দরজা ঠক ঠক শব্দ শুনে তন্দ্রা ছুটে গেল। উঠে বসে বলল, কে?
আমি গালিবা, দরজা খোল।
নাযিম দরজা খুলে গালিবাকে দেখে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, তুমি?
গালিবা বলল, হ্যাঁ আমি। মনে হচ্ছে খুব ভয় পেয়েছে?
ভয় পাওয়ারইতো কথা। কেউ দেখে ফেললে কি ঘটবে ভেবেছে?
ভেবেছি, তবু থাকতে না পেরে এলাম। দু’চারটে কথা বলেই চলে যাব।
ঠিক আছে, বল কি বলবে।
ছোট ভাবির সঙ্গে তোমার যে সব কথা হয়েছে, সেসব তার কাছে শুনেছি। তার কথামতো কাজ করার জন্য আমি তোমাকে অনুরোধ করছি। এরমধ্যে আব্বা ও ভাইয়ারা আমার বিয়ে দিতে চাইলে ছোট ভাবি কি করবে না করবে আমি জানতে চেয়েছিলাম, বলে নি। শুধু বলল, সে সময় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবে। তবে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, যেমন করে তোক আমি বাধা দেব এবং তোমার জন্য অপেক্ষা করব। আর এতে আমি কামিয়াব হব ইনশাআল্লাহ। তুমি তো মাসে একবার করে আসবে, তখন ইনশাআল্লাহ দেখা হবে। আমার কথা ভেবে পড়াশোনার গাফলাতি করবে না। ভোরে তুমি চলে যাবে…।
নাযিম তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, ছোট ভাবি ও তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। কোন ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেলাম, প্লীজ, তুমি এবার যাও। আমার ভীষণ ভয় করছে।
ঠিক আছে, যাচ্ছি। তুমি কিন্তু মাঝে মাঝে কলেজে আমার সঙ্গে দেখা করবে বলে গালিবা নিজের রুমে ফিরে এল।
.
পরের দিন ফজরের নামাযের পর আলোচনায় বসে জাহেদা বেগম ছোট বৌকে বলল, কাল তুমি যে বললে, ছেলের বিয়ে দেওয়ার পরপর ছেলে-বৌকে পৃথক করে দিতে হবে। একথাটা ঠিক বুঝতে পারি নি।
নিলুফার বলল, আমি ইসলামের কথা বলেছি। আর ইসলাম সারা পৃথিবীর মানুষ কি করলে ইহকালে ও পরকালে সুখ-শান্তি পাবে, সেই পথের নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম ছেলে-বৌকে পৃথক করে দেওয়ার কথা বলেছে পারিবারিক সুখ-শান্তির জন্য। কেননা দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে অল্পসংখ্যক ছাড়া প্রায় সব মানুষেরই ইসলামিক কোনো জ্ঞান নেই। ফলে ঘরে বৌ আসার কিছুদিন পর শুরু হয়ে যায় স্বামী-স্ত্রী ও শ্বশুর শাশুড়ীর সঙ্গে মন কষাকষি ও ঝগড়া বিবাদ। তবে পৃথক হয়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, ছেলে মা-বাবার দিকে লক্ষ্য রাখবে না, তাদের খিদমত করবে না। বৌও শ্বশুর-শাশুড়ীর কিছু করবে না। আল্লাহ কুরআন মজিদে বলিয়াছেন, “তোমার পরওয়ারদেগার আদেশ করিয়াছেন যে, তোমরা তাহাকে ব্যতীত অন্য কাহারও ইবাদত করিও না এবং তুমি মা-বাবার সহিত সদ্ব্যবহার করিও, যদি তোমার সম্মুখে তাহাদের একজন কিংবা উভয়ে বার্ধক্যে উপনীত হন তবে তাহাদিগকে উহ্ পর্যন্ত বলিও না, আর তাহাদিগকে ধমক দিও না এবং তাদের সঙ্গে খুব আদবের সহিত কথা বলিও।” [সূরা-বনী ইসরাইল, আয়াত-২৩, পারা ১৫]
এ ব্যাপারে হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “তাহার নাক ধূলিতে মলিন হউক, তাহার নাক ধূলিতে মলিন হউক।” প্রশ্ন করা হইল, কাহার? তিনি বলিলেন, “ঐ ব্যক্তির যাহার বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তাহার পিতা-মাতা (একজন বা উভয়েই) জীবিত থাকে এবং তবুও বেহেশত যাইতে পারে না।” [বর্ণনায়: আবু হোরায়রা (রাঃ)-মুসলিম]
হাদিসে আরো আছে,”এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (দঃ) কে জিজ্ঞেস করিল, সন্তানের উপর তাহার পিতা-মাতার কি হক (দাবি) আছে? তিনি বলিলেন, তাহারা উভয়েই তোমার বেহেশত ও তোমার দোযখ। [বর্ণনায়: আবু ওমামাহ (রাঃ)-মিশকাত]
আল্লাহ ও রাসুল (দঃ)-এর বাণী দ্বারা প্রত্যেক মানুষের বোঝা উচিত, পিতা-মাতার দিকে কতটা লক্ষ্য রাখতে হবে এবং তাদের খিদমত কতটা ও কিভাবে করতে হবে।
আজকাল অধিকাংশ পরিবারে স্বামী ও তার মা-বাবার সঙ্গে মেয়েরা খুব খারাপ ব্যবহার করে। আবার এমন অনেক ছেলে আছে, যারা সাংসারিক ব্যাপারে স্ত্রী ও মা-বাবার সঙ্গে কলহ ও ঝগড়া-বিবাদ করে। এসবের একমাত্র কারণ তাদের পেটে দ্বীনি এলেম ও আল্লাহর ভয় নেই।
এজন্য প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত, ছোটবেলা থেকে ছেলে-মেয়েদের ইসলামের আদেশ-নিষেধ জানিয়ে তাদের দীলে আল্লাহর ভয় জাগিয়ে তোলা। কথাটা বলতে বুক ফেটে যায়, “আসলে পিতা-মাতারাই দ্বীনি এলেম হাসিল না করার ফলে নিজেরা আল্লাহকে ভয় করে না এবং আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর হুকুমের তোয়াক্কা না করে নিজের নফসের বশীভূত হয়ে যা ইচ্ছা তাই করে। পিতা-মাতাকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে তাদের ছেলেমেয়েরাও তাই করছে। ফলে, ছেলে মেয়েরা পিতা-মাতার কথা শোনে না।”
এক লোক একজন গুণীব্যক্তির কাছে জিজ্ঞেস করল, আজকাল ছেলেমেয়েরা মা-বাবার কথা শোনে না কেন বলতে পারেন? তিনি বললেন, মা বাবারা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ)-এর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতেন, তা হলে ছেলেমেয়েরা অবশ্যই তাদের আদেশ ও নিষেধ মেনে চলত। পিতা মাতার প্রতি ছেলেমেয়ের এবং ছেলেমেয়ের প্রতি পিতা-মাতার কর্তব্য সম্পর্কে যদি উভয়ে জানত এবং মেনে চলত, তা হলে সমাজের এত অবক্ষয় হত না।
জাহেদা বেগম বললেন, কারো যদি একটি মাত্র ছেলে থাকে, বিয়ের পর তাকেও কি পৃথক করে দিতে হবে?
নিলুফার বলল, বৌ-যদি পৃথক হতে চায়, তা হলে অবশ্যই পৃথক করে দিতে হবে। আর যদি তা না চায়, তা হলে তো পৃথক করার প্রশ্নই উঠে না। তবে ছেলে-বৌ-এর উপর সংসারের দায়িত্ব আস্তে-ধীরে দিয়ে দেওয়া উচিত। তা হলে সংসারে অশান্তি হওয়ার আশংকা থাকে না। অবশ্য ছেলে-বৌকে সেরকম উপযুক্ত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব মা-বাবার। এক ছেলে-বৌ এর উচিতও নয়, মা-বাবা থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া। অনেক ক্ষেত্রে ছেলে পৃথক হতে না চাইলেও বৌ হতে চায়। সে ক্ষেত্রে ছেলের কর্তব্য স্ত্রীকে নিয়ে পৃথক হয় যাওয়া। এটাই ইসলামের হুকুম। তবে পৃথক হয়ে গেলেও মা-বাবার সব রকমের খিদমত করা ছেলের কর্তব্য। এসব কথা আগেও বলেছি। আর যদি দুই, তিন বা ততোধিক সন্তানের একান্নবর্তি পরিবার হয়, তা হলে বিয়ের পরপরই ছেলে-বৌদের পৃথক করে দেওয়া উচিত। সেইজন্য বিয়ের আগে তাদের সংসার নির্বাহ করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে অথবা ছেলে নিজে অর্থ উপার্জনের পথ করে নেবে।
গালিবার বড় ভাবি বলল, আমার এক চাচাত বোনের স্বামী খুব রাগী। আমার বোন সাংসারিক ব্যাপারে কোনো দোষ করে ফেললে তার স্বামী রেগে গিয়ে মারধর ও গালিগালাজ করে। তখন আমার বোন সহ্য করতে না পেরে সেও রেগে গিয়ে স্বামীকে গালি দেয়। এক্ষেত্রে আমার বোনেরই কি শুধু গুনাহ হবে, স্বামীর হবে না?
নিলুফার বলল, ইসলাম স্বামীকে যে স্ত্রীর অভিভাবকের দায়িত্ব অর্পন করেছে এবং স্ত্রীকে পারিবারিক জীবনের অর্থনৈতিক সকল দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে, সেকথা গতকালের আলোচনায় বলেছি। আর এও বলেছি, শরীয়তের গন্ডির বাইরে ছাড়া স্বামীর আদেশ উপদেশ মেনে চলা এবং সংসার জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর সমান অধিকার ইসলাম দিয়েছে। সংসার ক্ষেত্রে অনেক সময় মত-বিরোধ বা ঝগড়া-ঝাটি হতে পারে। তখন উভয়কেই ধৈর্যের সঙ্গে সমঝতার মাধ্যমে সেগুলো মিটমাট করে ফেলতে হবে। ঝগড়া-বা মনোমালিন্য যদি চরম সীমায় পৌঁছে যায়, তা হলে উভয়পক্ষের অভিভাবকদের সাহায্য নিয়ে মিটমাট করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যদি এমন পরিস্থিতির হয়, উভয়ের প্রতি একেবারেই মনের মিল না হয় এবং কেউ কাউকে নিয়ে সংসার করতে না চায়, তখনও অভিভাবকদের মধ্যস্থতায় দ্রভাবে ছাড়াছাড়ি করার নির্দেশ কুরআনে আছে। ইতরের মত উঠতে-বসতে গালাগালি, মারধর কিংবা অন্য কোনোরকম দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন করা শরীয়তে নিষেধ অর্থাৎ হারাম করেছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে-কোনো একজন অন্যায়ভাবে অন্যকে গালি বা মানসিক কষ্ট দিলে সমান অপরাধে অপরাধি হবে। স্বামীর অপরাধ কম এবং স্ত্রীর অপরাধ বেশি হবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়।
দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর অধিকারের কথা স্বামীদের জানা অতি আবশ্যক। সংসার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নারীর। অনেক স্বামী মনে করে স্ত্রী সংসারের দাসী। এ ধরণের মনোভাব পোষণ করাও অপরাধ।
হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে এবং তাদেরও অধিকার রয়েছে তাদের উপর” কেবল একটি ব্যাপারে পুরুষ, স্ত্রীর তুলনায় অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। এক্ষেত্রে স্ত্রী পুরুষের সমান নয়। এ ব্যাপারে আল্লাহ কুরআন মজিদে বলিয়াছেন, “পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্বও ও নেতৃত্বসম্পন্ন।”
এই একটি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রেই, যেমন ইবাদত বন্দেগী, আল্লাহর রহমত ও ক্ষমালাভ, নৈতিকতা, কর্মফল প্রাপ্ত, মানবিক অধিকার ও সাধারণ মান-সম্মান প্রভৃতি ব্যাপারে স্ত্রীলোক পুরুষের সমান। ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম নারীকে এরকম মর্যাদা দেয় নি। ইসলাম পুরুষকে সংসারে কর্তা করে দেওয়া সত্ত্বেও সংসারের যাবতীয় বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্ত্রীর পরামর্শ নিতে বলেছে। কারণ এর ফলে পারিবারিক জীবনে শান্তি-সন্তুষ্টি, মাধুর্য ও পরস্পরের প্রতি গভীর আস্থা ও নির্ভরতা বজায় থাকে। যেমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি, জন্মের পর থেকে মাকে দু’বছর বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ার হুকুম ইসলাম দিয়েছে। এর আগে যদি দুধ ছাড়াতে চায়, তবে স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ করে তা করতে পারে। এ সম্পর্কে আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “স্বামী স্ত্রী যদি সন্তুষ্ট ও পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে দুধ ছাড়াতে চায়, তবে তাতে তাদের কোনো গুনাহ হবে না।” [সূরা নিসা, আয়াত-৩৪, পারা-৫]
ইসলাম নারী-পুরুষের কর্ম ও কর্মক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। পুরুষের জন্য কর্মক্ষেত্র হল, বাইরে জগত আর নারীর জন্য ঘর। পুরুষ বাইরের জগতে নিজের কর্মক্ষমতার দ্বারা যেমন রুজি-রোজগার করবে, তেমনি সমাজ, রাষ্ট্র, শিল্প ও সভ্যতা গড়ার কাজ করবে। আর নারী ঘরে থেকে একদিকে যেমন ঘরের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করবে, অপরদিকে তেমনি গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব, লালন-পালন ও ভবিষ্যতের উপযুক্ত নাগরিক গড়ে তুলবে।
জাহেদা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কোনো মেয়ে যদি একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে তার মা-বাবার সমস্ত সম্পত্তি পেয়ে থাকে, তা হলে কি ঐ সম্পত্তিতে তার স্বামীর হক আছে? কিংবা স্বামী জোর করে ঐ সম্পত্তি ভোগ দখল করতে পারে?
নিলুফার বলল, স্ত্রীর পৈতৃক সম্পত্তি অথবা বিয়ের সময় যে সব অলঙ্কার বাবার কাছ থেকে পায় এবং দেনমহরের টাকার উপর স্বামীর কোনো হক নেই। তবে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় তাকে কিছু দেয় অথবা ভোগদখল করতে দেয়, তা হলে ভিন্ন কথা। স্ত্রী পৈতৃক সূত্রে হোক অথবা অন্য যে-কোনো সূত্রে যদি কোটি কোটি টাকার মালিকও হয়, তবু স্বামীকে তার খোর-পোষ ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে হবে। এমন কি স্ত্রীর মা-বাবা, ভাই ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়-স্বজন যদি বাড়িতে আসে, তা হলে তাদেরও মেহমানদারী স্বামীকেই করতে হবে।
এই কথা শুনে ইলিয়াস মির্জা যেমন লজ্জা পেলেন, তেমনি ইসলামের আইন অমান্য করে ভীষণ গুনাহর কাজ করে ফেলেছেন ভেবে ভয়ও পেলেন। বিয়ের পর দশ বিঘে ধানী জমি শ্বশুর তার নামে করে দিয়েছিলেন। আর বাকি সমস্ত জমি-জায়গা, পুকুর-ডোবা, আগান-বাগান, এমন কি বাস্তুভিটে পৈতৃক সূত্রে স্ত্রী জাহেদা বেগমের।
ব্যাপারটা সব ছেলেমেয়েরা জানলেও নিলুফার ছাড়া অন্য তিন বৌ ও দুই জামাই জানে না। নচেৎ বৌও জামাইদের সামনে ইলিয়াস মির্জা অপমানিত হতেন। যারা জানে, তারা মায়ের এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য বুঝতে পারল। কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে নিলুফার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, মানুষ না। জেনে অনেক ভুল করে। মানুষ মাত্রেই জেনে না জেনে অনেক অন্যায় কাজ করে থাকে। জানার পর ভুলের সংশোধন করে আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে হয়। তিনি গফুরর রহিম, বান্দা মাফ চাইলে মাফ করে দেন। তারপর বলল, আজ এ পর্যন্ত থাক, ইনশাআল্লাহ কাল আবার বসা যাবে।
.
আজ আসিফ ও খুরশীদ স্ত্রীদের নিয়ে চলে যাবে। সকাল ন’টার সময় চার সম্মন্ধি ও শালার সঙ্গে নাস্তা খেতে বসেছে। বড় বৌ আসমা খাওয়াচ্ছে। গালিবা সবকিছু এনে দিচ্ছে। মেঝ ও সেঝ বৌ সাহিদা ও শাকিলা আর দু’বোন রোকেয়া ও যয়নাব একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
বড় ভাই আব্দুল লতিফ দু’বোনকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোরা আমাদের সঙ্গে খেয়ে নে।
রোকেয়া বলল, আমরা ভাবিদের সঙ্গে খাব।
খেতে খেতে আসিফ বলল, ছোট ভাবি এ বাড়ির পরিবেশ পাল্টে দিল। তার মতো মেয়ে যদি প্রতি ঘরে একজন করে জন্মত, তা হলে কোনো সংসারেই অশান্তি থাকত না।
সে থেমে যেতে খুরশীদ বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমিও কথাটা বলব ভাবছিলাম। আব্দুল হান্নান খুব ভাগ্যবান ছোট ভাবির মতো বৌ পেয়েছে।
মেজ আব্দুল মতিন বলল, ওতো প্রথমে মাদ্রাসা পড়া মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। শুধু ও ভাগ্যবান নয়, ছোট বৌ এর জন্য এ বাড়ির সবাই ভাগ্যবান।
সেজ আব্দুল মান্নান বলল, হ্যাঁ, সেজ ভাই ঠিক কথা বলেছে। ছোট বৌ এ বাড়িতে না এলে ইসলামী দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারতাম না।
আব্দুল লতিফ বলল, ভাবতে খুব অবাক লাগে, এ-সম্পর্কে মৌলবী বা আলেম উলামাদের কোথাও ওয়াজ নসীহত করতে শুনি নি।
রোকেয়া বলল, বিয়ের ও অলিমার দিন ছোট ভাবির কথায় ও কাজে মনে হয়েছিল অল্পদিনের মধ্যে এ বাড়িতে অশান্তির আগুন জ্বলবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এ বাড়ির মতো শান্তির সংসার দ্বিতীয় কোথাও নেই।
রোকেয়া থেমে যেতে আব্দুল হান্নানকে উদ্দেশ্য করে খুরশিদ বলল, কি হে, তুমি কিছু বলছ না কেন? ছোট ভাবির মতো মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে পেয়ে। তুমিইতো সবার চেয়ে ভাগ্যবান।
স্ত্রীর এই ধরনের সমালোচনা শুনে আব্দুল হান্নান খুশী হলেও বড় ভাইদের সামনে সেজ দুলাভাই এরকম প্রশ্ন করতে খুব লজ্জা পেল। কোনো কথা না বলে খাওয়া শেষ করে যাওয়ার সময় বলল, নিজের স্ত্রীর কথা অন্যের কাছে বলা হাদিসে নিষেধ। এটা এ বাড়ির ছোটবৌ-এর কাছেই শুনেছি।
বড় বৌ আসমা ঝুটো থালা-বাসন গোছাবার সময় বলল, সবার সামনে সেজ দুলাভাইয়ের কথাটা বলা ঠিক হয়নি।
তারপর আর কেউ কিছু বলল না।
.
ঐদিন রাতে ইলিয়াস মির্জা স্ত্রীকে বললেন, সকালে নিলুফারের কাছে স্ত্রীর নিজস্ব সম্পত্তিতে স্বামীর হকের কথাটা সবার সামনে তোলা যদিও তোমার উচিত হয়নি, তবু বলব, তুলে ভালই করেছ। ঐ ব্যাপারে ইসলামের বিধান আমি জানতাম না। এখন যখন জেনেছি তখন তোমার সবকিছুর আয়-ব্যয় বুঝিয়ে দেব। তোমার কোনোকিছুই আমি আর ভোগ-দখল করব না। এতদিন যা কিছু করেছি, সেজন্য আল্লাহর কাছে মাফ চেয়েছি। এখন তোমার কাছেও চাইছি, বল, তুমি মাফ করে দিয়েছ?
জাহেদা বেগম বিয়ের পর প্রথম দিকে ইলিয়াস মির্জাকে মনে প্রাণে স্বামী হিসাবে মেনে নিতে পারেন নি। তাই তার সঙ্গে যা-তা বলে অপমানসূচক ব্যবহার করতেন। তারপর স্বামীর চারিত্রিক গুণ ও ধার্মিকতা জানতে পেরে এতদিন ঘর সংসার করে আসছেন। তবে মনেপ্রাণে ভালবাসতে পারেন নি। তাই সামান্য ব্যাপার নিয়ে স্বামীর মুখে মুখে তর্ক ও ঝগড়া কলহ করতেন। ইলিয়াস মির্জা ধৈর্যের সঙ্গে সবকিছু সহ্য করে আসছেন। তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে নিলুফারের মতো মেয়েকে ছোট ছেলের বৌ করে এনেছেন, তা সফল হতে দেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন।
এই কয়েক মাসে নিলুফার ঘরের সবার মন জয় করতে পেরেছে। সবাই প্রমাণ পেয়েছে, সে যা বলে সেসব মেনেও চলে। জাহেদা বেগমও বিয়ের দিন ও ওলিমার দিন নিলুফারের আচরণে ও কথায় তার উপর খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে চিল্লাচিল্লীও করেছিলেন। পরে নিলুফারের সব কিছু দেখে শুনে তিনিও তাকে যেমন আল্লাহর খাসবান্দি ভাবতে শুরু করেছেন, তেমনি ভালবাসতেও শুরু করেছেন। জাহেদা বেগম শিক্ষিত মেয়ে। তিনি এত বছর জেনে এসেছেন, যারা কুরআন-হাদিসের কথা বলে তারা নিজেরা সেসব মেনে চলে না, কিন্তু নিলুফারকে ব্যতিক্রম দেখছেন। শ্বশুর ভাশুরদের পর্দা করে জায়েদের সঙ্গে সংসারের সব কাজকর্ম করছে। শাশুড়ীকে সংসারের কোনো কাজ করতে দেয় না। জাহেদা বেগম অভ্যাস মতো সংসারের কাজ করতে গেলে বলে, আমরা থাকতে আপনি কাজ করবেন কেন? এতদিন সংসারের ঝামেলায় ঠিক মতো আল্লাহর ইবাদত করতে পারেন নি, ঠিক মতো আব্বার খিদমত করার সময় পান নি। এখন সংসারের কোনো কাজ আপনাকে করতে হবে না। শুধু আমাদের কাজ কামের ভুল-ত্রুটি শুধরে দেবেন, আব্বার খিদমত করবেন আর আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করবেন। এই সব কারণে এবং তার কাছে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ও স্ত্রীর প্রতি স্বামীর হকের কথা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। আজ সকালের আলোচনার বৈঠকে স্ত্রীর সম্পত্তির ব্যাপারে যে কথা নিলুফারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তা স্বামীকে অপমান করার জন্য নয়, বরং জানার জন্য। পরে অবশ্য মনে হয়েছিল, সবার সামনে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হয় নি। এখন স্বামীকে মাফ চাইতে শুনে অনুতপ্ত হলেন। যা জীবনে করেন নি তাই করে ফেললেন। ইলিয়াস মির্জার দুই পা জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বললেন, আমিও না জেনে সারাজীবন তোমাকে অনেক অবহেলা করেছি, তোমার মনে অনেক দুঃখ দিয়েছি, মুখে মুখে তর্ক করে অনেক অন্যায় করেছি। তুমি আমার সব কিছু ভোগদখল করলেও আমার ও ছেলেপুলেদের জন্য করেছে, এতে তোমার কতটা অন্যায় হয়েছে জানি না, কিন্তু আমি তোমাকে স্বামী হিসাবে যে মর্যাদা ও সম্মান করা উচিত, তা করে আল্লাহর কাছে অনেক বেশি গুনাহগার হয়েছি। এখন আবার স্বামী হয়ে আমার কাছে মাফ চাইছ। এতেও আমি গুনাহগার হচ্ছি। তাই আমার কৃত অন্যায়ের জন্য আমিই তোমার কাছে মাফ চাইছি। বল, আমাকে মাফ করে দিয়েছ?
ইলিয়াস মির্জা স্ত্রীর মাথায় চুমো খেয়ে তিনিও ভিজে গলায় বললেন, আব্দুল লতিফের মা, এই দিনটার জন্য বিয়ের পর থেকে অপেক্ষা করছিলাম। এর জন্যে আমাকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে আল্লাহর কাছে। তিনি আমার সেই আশা পূরণ করলেন। সেজন্য তার পাকদরবারে জানাই হাজার হাজার শুকরিয়া। আল্লাহ নিলুফারকে অসিলা করে আমাদেরকে হেদায়েত দিয়েছেন। তিনি তাকে হায়াত তৈয়েবা দিক। দোয়া করি, নিলুফারের মতো মেয়ে যেন ঘরে ঘরে জন্মায়।
জাহেদা বেগম বললেন, হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক। আল্লাহ নিলুফারকে আমাদের বৌ করে আমাদেরকে ধন্য করেছেন। সেজন্য আমিও তার দরবারে জানাই হাজার হাজার শুকরিয়া। তারপর বললেন, কই, আমাকে মাফ করেছ বললে না যে?
ইলিয়াস মির্জা বললেন, আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুক।
জাহেদা বেগম বললেন, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সমস্ত সম্পত্তি আমি লিখিতভাবে তোমাকে দিয়ে দিতে চাই। কালকেই তুমি সেই ব্যবস্থা করবে।
ইলিয়াস মির্জা বললেন, তা আর করা লাগবে না। পিতার সম্পত্তিতে ছেলেমেয়েদের যেমন হক, মায়ের সম্পত্তিতেও তাদের সে রকমই হক। ভাবছি, আমরা বেঁচে থাকতে ছেলেমেয়েদের পাওনামতো তাদের নামে দলিল করে রাখব। সে কথা ওদের কাউকেই জানাব না। আমরা মারা যাওয়ার পর দলিল মতো ওদেরটা ওরা বুঝে নেবে। তার আগে তোমার ও আমার সম্পত্তি থেকে কিছু অংশ মসজিদ মাদ্রাসার নামে ওয়াকফ করে দেব। এতে তোমার কোনো অমত নেই তো?
জাহেদা বেগম বললেন, এতো খুব ভালো কথা। অমত করব কেন?
ইলিয়াস মির্জা বললেন, আরো একটা কথা ভেবেছি, ছেলেদের কিছু কিছু বিষয় সম্পত্তি দিয়ে তাদেরকে পৃথক করে দেব। এ ব্যাপারে তোমার কি মত?
জাহেদা বেগম বললেন, নিলুফার তো বলল, ইসলামের নিয়ম বিয়ের পর ছেলেদের সংসার পৃথক করে দেওয়া, তা হলে আবার আমার মতামত জানতে চাচ্ছ কেন?
ইলিয়াস মির্জা বললেন, নিলুফার বলল না? সংসারের যে-কোনো ব্যাপারে স্বামীর উচিত স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। সেকথা এরই মধ্যে ভুলে গেলে?
জাহেদা বেগম বেগম বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে, তা হলে তাই কর।
ইলিয়াস মির্জা বলল, এ ব্যাপারে নিলুফারের সঙ্গে আলাপ করলে কেমন হয়?
জাহেদা বেগম বললেন, সেটাও ভালো কথা। তারপর বললেন, একটা কথা মনে পড়ল, ছেলে-বৌদের পৃথক করে দেওয়ার আগে গালিবার বিয়ের কাজটা মিটিয়ে ফেললে হত না?
খুব ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। গালিবার বিয়েটা দিয়ে তারপর ছেলেদের পৃথক করে দেব। তবে এ ব্যাপারেও নিলুফারের সঙ্গে আলাপ করলে মনে হয় ভালো হবে।
বেশ তো আলাপ করে দেখ, সে কি বলে। ঠিক আছে, এবার ঘুমাবার ব্যবস্থা কর অনেক রাত হয়েছে। এই কথা বলে ইলিয়াস মির্জা ছোট বাথরুমের কাজ সারার জন্য বেরিয়ে গেলেন।
.
০৮.
একদিন ইলিয়াস মির্জা স্ত্রীর কাছে নিলুফারকে ডেকে বসতে বলে বললেন, আমরা ছেলেদের সংসার পৃথক করে দেওয়ার ইচ্ছে করেছি। এব্যাপারে তোমার। পরামর্শ চাই।
নিলুফার বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে একমত। আর এ সম্পর্কে ইসলাম কি বলেছে, তা আপনাদেরকে জানিয়েছি। ছেলেদের পৃথক করে দিলে তারা তাদের সংসারের দায়-দায়িত্ব বুঝবে। কিভাবে উন্নতি হবে, সে চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করবে। ভুল ত্রুটি করলে অথবা অসৎ উপায়ে উপার্জন করতে চাইলে পিতা-মাতা হিসাবে আপনারা তাদের ভুল ত্রুটি শুধরে দেবেন, অসৎ পথ থেকে ফিরিয়ে আনবেন।
ইলিয়াস মির্জা বললেন, আমার ইচ্ছা ছিল সব ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পর পৃথক করে দেওয়ার। সবারইতো আল্লাহর ইচ্ছায় দিয়েছি। এখন বাকি শুধু গালিবা। ওরটা দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
নিলুফারের তখন নাযিমকে দেওয়া কথা মনে পড়ল। বলল, গালিবার। বিয়ের সঙ্গে ছেলেদের পৃথক করার কি সম্পর্ক? ও এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। আর বয়সই বা কত হয়েছে? বি.এ. পাশ করুক তারপর বিয়ে দেবেন। অবশ্য কোনো ব্যাপারেই আমি জোর দিয়ে কিছু বলব না। আপনারা যা ভালো মনে করেন করবেন।
কিন্তু মা তুমি তো জান, ছেলেমেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে মা-বাবার কর্তব্য তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া। নচেৎ তারা যদি তেমন কোনো পাপ করে ফেলে, তা হলে মা-বাবাও সেই পাপের ভাগী হবে। আর আজকাল শুধু শহরে নয়, গ্রামে গঞ্জেও ছেলে-মেয়েরা প্রেম-ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ছে। ফলে কত ভালো ভালো ছেলে-মেয়েরা দুর্ভোগের স্বীকার হচ্ছে।
হ্যাঁ আব্বা, এটা আপনি ঠিক বলেছেন। এটা হাদিসের কথা। তাই তো ইসলাম ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে লেখাপড়া ও মেলামেশা নিষিদ্ধ করেছে। তবে যদি কোনো ছেলে-মেয়ে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলে উচ্চ ডিগ্রী নিতে চায়, তা হলে তাতে বাধা সৃষ্টি না করে বরং উৎসাহ দেওয়া উচিত।
তোমার কথাটা অস্বীকার করছি না। তবে কি জান মা, মেয়েরা উচ্চ ডিগ্রী নিলে গ্রামদেশে বিয়ে দেওয়া অসুবিধে হয়ে পড়ে। এই ধরণের মেয়ের উপযুক্ত পাত্রও পাওয়া যায় না। তা ছাড়া মেয়ে তখন নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করতে চায়। মা-বাবার পছন্দ করা ছেলেকে পছন্দ করতে চায় না। আমাদের গ্রামের আজিজ সেখ খুব ধনী। সে তার একমাত্র মেয়েকে ঢাকায় রেখে এম.এ. পাশ করিয়েছে। গ্রামে তার উপযুক্ত পাত্র না পেয়ে ঢাকায় বিয়ে দিয়েছে। শুনেছি, সে ছেলের বাবাও খুব ধনী। কিন্তু ছেলে অনেক রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে বৌকে মারধর করে। এইসব দেখে শুনে গালিবাকে বেশি পড়াতে চাই না।
হা আব্বা, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। কিন্তু হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান নয়, তেমনি সব মানুষও সমান নয়। ভালোমন্দ দুনিয়ার সব জায়গায় আছে। শুধু শহরের ছেলেরাই কি খারাপ? গ্রামেও খারাপ ছেলে আছে। ওসব কথা থাক আব্বা, আমি গালিবার জন্য একটা ছেলে পছন্দ করেছি। ছেলের বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না হলেও বংশ ভালো, ছেলেও ভালো। আমি চাই, ছেলে এম.এ. পাশ করে রুজী-রোজগার করুক তারপর ছোট বুবুর সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা আপনারাই করবেন। ততদিন ছোট বুবু ঘরে বসে না থেকে লেখাপড়া করে বি.এ. পাশ করুক। তাই ওকে পড়াবার কথাটা বলেছি।
ইলিয়াস মির্জা নিলুফারের কথা শুনে খুশী হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে শহরের না গ্রামের?
গ্রামের।
এবার ইলিয়াস মির্জা অবাক হয়ে বললেন, গ্রামের ছেলে?
হ্যাঁ আব্বা, গ্রামের ছেলে এবং আমাদের আত্মীয়।
ইলিয়াস মির্জা কিছুটা অনুমান করতে পারলেও আরো অবাক হয়ে বললেন, ছেলের সবকিছু খুলে বল তো মা।
আপনার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে নাযিম। কথা শেষ করে নিলুফার শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কোনো ভাবান্তর হয় কিনা দেখার জন্য।
কথাটা শুনে ইলিয়াস মির্জার কপালে কয়েকটা ভাজ পড়ল। কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
কথাটা শুনে জাহেদা বেগম যতটা না অবাক হলেন, তার চেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হলেন। অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, এ তুমি কি বলছ ছোট বৌ? নাযিমের সম্পর্কে তুমি কতটুকু জান? তার বাপের কি আছে? আমার মেয়েকে খাওয়াবে কি? না-না এ কখনই হতে পারে না। তুমি যে কেন এরকম কথা বললে বুঝতে পারছি না। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কিছু বলছ না কেন?
নিলুফারের কথা শুনে ইলিয়াস মির্জা সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট কোনোটাই হন নি। তবে অবাক হয়েছেন এই ভেবে যে, নিলুফার হঠাৎ নাযিমকে গালিবার জন্য পছন্দ করার কথা বলল কেন? স্ত্রীর কথা শুনে বললেন, নাযিম দেখতে শুনতে ভাল, বি.এ. পরীক্ষা দেবে, তার উপর আমাদের আত্মীয়, তাই হয়তো নিলুফার কথাটা বলেছে। ওসব কথা এখন থাক, ছেলেদের সঙ্গে আলাপ করে যা করার। করা যাবে। তারপর নিলুফারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমরা আর একটা ব্যাপারে আলাপ করতে চাই। তারপর সম্পত্তি ছেলেমেয়েদের নামে দলিল করে রাখার ও কিছু ওয়াকফ করার কথা বললেন।
নিলুফার বলল, তা করতে পারেন। তবে ইসলামের ফারায়েজ মতো করতে হবে। আর এটা করাও খুব কঠিন। যেমন জমি-জায়গা ফারায়েজ মতো করলেও বাস্তুভিটে ও মা-বাবার আসবাবপত্র ও মায়ের অলঙ্কার, এমন কি হাঁড়ি পাতিলের উপরও সব ছেলেমেয়েদের হক আছে। সেগুলোর ব্যাপারে কী করবেন?
ইলিয়াস মির্জা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, এগুলো আমাদের মাথায় আসে নি। আমরা শুধু জমি-জায়গার ব্যাপারে চিন্তা করেছি। এগুলোর ব্যাপারে কি। করব তুমিই বলে দাও না মা।
নিলুফার বলল, অলঙ্কার ও আসবাবপত্র এবং হাড়ি পাতিলের ব্যাপারে সব ছেলেমেয়েদের একত্রিত করে ওসিয়াত করতে পারেন, “আমরা মারা যাওয়ার। পর তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবে।”
জাহেদা বেগম বললেন, মা-বাবা কি কোনো ছেলেমেয়েকে কম-বেশি কিছু দিতে পারে?
নিলুফার বলল, না দিতে পারেন না। কারণ আল্লাহ কুরআনপাকে মা বাবার সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এমন কি কোনো ছেলে যদি মা-বাবার অবাধ্য হয় অথবা ইসলামের কোনো বিধি-বিধান মেনে না চলে, তবে তাকে ত্যাজ্য করলেও সম্পত্তি থেকে না-মাহরুম করতে পারবেন না। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ঐ ছেলে শরীয়ত মতো তার অংশ সে পাবে।
ইলিয়াস মির্জা বললেন, ঠিক আছে মা, এবার তুমি যাও।
.
ঐদিন রাতে নিলুফার স্বামীকে বলল, আব্বা বলছিলেন তোমাদেরকে পৃথক করে দেবেন।
আব্দুল হান্নান বলল, তাই নাকি? তা কতদিনে দেবেন কিছু বলেন নি?
স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। তবে কথাবার্তায় বুঝলাম, এতদিন করেই দিতেন, ছোট বুবুর কারণে দেন নি।
বুঝলাম না।
না বোঝার কি আছে? ছোট বুবুর বিয়ে দেওয়ার পর পৃথক করে দিতে চান।
আব্বা তোমাকে তাই বলেছেন বুঝি?
জি হ্যাঁ।
বলবেনই তো, তুমি এ ব্যাপারে ইসলামের যে সব কথা শুনিয়েছ, তার ফলেই আব্বা এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জি না। উনি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে ছেলেদের পৃথক করে দেবেন। ছোট বুবুর বিয়ে হয়ে গেলে হয়তো এতদিন করেই দিতেন।
আব্বা তা হলে গালিবার বিয়ে তাড়াতাড়ি দিতে চান তাই না?
জি, তাইতো বললেন।
গালিবা এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। অন্ততঃ ইন্টারমিডিয়েট পাশ করুক। তারপর বিয়ে দিলে ভালো হত না?
আমি তো ওকে বি.এ. পর্যন্ত পড়াবার কথা বলেছিলাম। শুনে আব্বা অনেক হাদিস-কালাম শুনিয়ে দিলেন।
আব্দুল হান্নান হেসে উঠে বলল, জেনে শুনে তোমার মতো আলেমাকেও তা হলে কেউ হাদিস কালাম শোনাতে পারে?
তা পারবে না কেন? যার এলেম আছে, তার হাদিস-কালাম শোনানই তো উচিত।
শেষ পর্যন্ত গালিবার বিয়ের ব্যাপারে কি কথা হল বল।
আমি বলেছি নাযিম ভাইকে গালিবার জন্য পছন্দ করেছি।
স্ত্রীর কথা শুনে আব্দুল হান্নান এত অবাক হল যে, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না, তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
নিলুফার মৃদু হেসে বলল, কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছ বুঝতে পারছি। অবশ্য হওয়ারই কথা। আব্বা-আম্মাও অবাক হয়েছেন।
আব্দুল হান্নান একটু গম্ভীর স্বরে বলল, নাযিমের সঙ্গে তোমার কত দিনের পরিচয়?
স্বামীর কণ্ঠের স্বর শুনে নিলুফার বুঝতে পারল, শুধু অবাক নয় খুব অসন্তুষ্টও হয়েছে। বলল, এইবার এসে নাযিম ভাই দু’তিন দিন ছিল। এর মধ্যে মাত্র একদিন কিছুক্ষণের জন্য আলাপ হয়েছিল। তাতেই মনে হয়েছে তার সঙ্গে ছোট বুবুর বিয়ে হলে দুজনেই সুখী হবে। তাই কথাটা বললাম, আব্বা আম্মাকেও বলেছি। আম্মা অমত প্রকাশ করলেও আব্বা করেন নি। বললেন, “ছেলেদের সঙ্গে আলাপ করে যা করার করা যাবে।” নাযিম ভাইকে জানার আমার ভুল হতে পারে, তাই বলে তুমি আমার উপর রাগ করছ কেন? ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি, বলে স্বামীকে জড়িয়ে ধরল।
স্ত্রীর কথা শুনে আব্দুল হান্নানের রাগ পড়ে গেল। তার মুখে কয়েকটা আদরের পরশ বুলিয়ে বলল, হঠাৎ নাযিমকে গালিবার জন্য তোমার কেন পছন্দ হল বল তো?
গালিবা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, ওরা একে অপরকে পছন্দ করে।
কথাটা শুনে আব্দুল হান্নান রেগে গেলেও তা প্রকাশ না করে জিজ্ঞেস। করল, ওদের ব্যাপারটা তুমি জানলে কেমন করে?
কিছুদিন আগে ছোট বুবু কলেজের প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে নাযিম ভাইয়ের কথা উঠলে কৌশলে তার কাছ থেকে জেনেছি। তারপর নাযিম ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার দিন আলাপের সময় তার কাছ থেকেও কৌশলে কথাটা জেনেছি।
কাজটা দুজনের কেউ ভালো করে নি। ব্যাপারটা কেউ যে মেনে নেবে না, তা তুমিও নিশ্চয় জান। জানার পর ওদেরকে সাবধান করে দেওয়া তোমার উচিত ছিল। তা না করে ওদের হয়ে ওকালতি করা তোমার ঠিক হয় নি। তা ছাড়া নাযিমদের বাড়ির পরিবেশ ও তাদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না। নাযিম আমাদের আত্মীয় হলেও ওদের বংশ আমাদের থেকে অনেক নিচু। ব্যাপারটা কেউ মেনে নেবে না। যা বলার বলেছ, দ্বিতীয়বার আর বল না। ভাইয়ারা শুনলে তোমার উপর খুব অসন্তুষ্ট হবে।
আমার আব্বা ও তোমার আব্বা যে একই গ্রামের লোক ও তারা যে বাল্যবন্ধু তা কি তুমি জান?
হ্যাঁ জানি।
আমিও জানি। আরো জানি তোমাদের ও নাযিম ভাইদের বংশ একই এবং আব্বা তোমার নানা-নানীর একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়েছিলেন এবং নিজের দক্ষতায় শ্বশুরের বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করে আরো বাড়িয়েছেন। শুধু শুধু নাযিম ভাইদের বংশকে নিচু বলছ কেন? তবে হ্যাঁ, তোমাদের চেয়ে ওদের আর্থিক অবস্থা নিচু। তারপর বলল, একটা কথা বলব, রাগ করবে না বল?
আমি জানি, আমাকে রাগাবার মতো কথা তুমি বলতে পার না।
তোমাকে না জানিয়ে একজনকে একটা কথা দিয়েছি।
তাতে কি হয়েছে, কথাটা যদি তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে থাকে, তা হলে তো রাগ করার প্রশ্নই উঠে না।
নাযিম ভাইকে মাস্টার্স করতে ও সেজন্য যত খরচ লাগবে আমি দেব বলেছি। আরো বলেছি, মাস্টার্স নিয়ে রুজী-রোজগার করার পর তার হাতে ছোট বুবুকে তুলে দেব। আর এই কাজের জন্য তোমার সাহায্য দরকার। কথা শেষ করে নিলুফার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তার মনের ভাব বোঝার জন্য।
কথাটা শুনে আব্দুল হান্নান ভাবল, তা হলে কি নাযিম ও গালিবার সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে? সেকথা জেনেই কি নিলুফার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
স্বামীকে চিন্তা করতে দেখে নিলুফার বুঝতে পারল, অসন্তুষ্ট হয়েছে। বলল, অনেক আগে থেকে ওরা একে অপরকে ভালবাসে জেনে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই কথা বলার পরও তাকে চুপ করে থাকতে দেখে নিলুফার বসে পড়ে দুপা জড়িয়ে ধরে আবার বলল, এতে যদি আমার অন্যায় হয়ে থাকে, তা হলে মাফ করে দাও।
আব্দুল হান্নান তার হাত ধরে তুলে পাশে বসিয়ে বলল, তোমার টাকা দিয়ে তুমি নাযিমকে সাহায্য করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও, এতে তোমার কোনো অন্যায় হয় নি, আমারও বাধা দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু গালিবার জন্য নাযিমকে আব্বা, আম্মা ও ভাইয়ারা কিছুতেই মেনে নেবে না। তা ছাড়া নাযিম প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত গালিবাকে তারা ঘরেও রাখবে না।
তা আমিও জানি। এ ব্যাপারে ওঁদের সবাইকে আমি সামলাব। তুমি শুধু আমাকে সাহায্য করবে বল?
কিন্তু আব্বা-আম্মা ও ভাইয়ারা ওদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে নাযিমের উপর অত্যাচার করবে। আর গালিবাকেও কম করবে না। আমার মনে হয়, নাযিমকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও কর, কিন্তু ওদের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে না এগোনোই ভালো।
ঠিক আছে, এবার কিছু আলাপ করার অনুমতি দাও।
আব্দুল হান্নান হেসে উঠে বলল, আলাপ তো অলরেডি হচ্ছেই, আবার অনুমতি চাচ্ছ কেন?
গালিবা তোমার সহোদর বোন, আর নাযিম তোমার চাচাত ভাই। গালিবা আমার ননদ, আর নাযিম ভাই আমার চাচাত দেবর। নিকট সম্পর্ক কার? তোমার না আমার?
আমার।
তা হলে দূরসম্পর্ক হওয়া সত্বেও কেন এটা চাচ্ছি বলতো দেখি?
গালিবাকে হয়তো খুব বেশি ভালবেসে ফেলেছ? তাই সে যাকে পছন্দ করে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাকে সুখী করতে চাচ্ছ?
গালিবাকে তুমি ভালবাস না?
বাসি।
তবে তুমি কেন তাকে সুখী করতে চাচ্ছ না?
আব্দুল হান্নান একথার উত্তর দিতে না পেরে তার গাল টিপে ধরে রেখে বলল, এই দুষ্টু মেয়ে, বুদ্ধির জোরে স্বামীকে হারিয়ে আনন্দ পাও বুঝি? তারপর ঠোঁটে আদর দিয়ে বলল, আগের যুগে রাজা-বাদশাহরা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিজেতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তার কথামতো রাজ্য শাসন ও খাজনা প্রদান করত। আজকের যুগে স্বামীরা বিভিন্ন কারণে স্ত্রীর কাছে পরাজিত হয়ে তাদের কথামতো চলে। আমি যখন একজন স্বামী, তখন হার স্বীকার করে তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছি।
নিলুফার কটাক্ষ হেনে বলল, এরকম কথা দ্বিতীয়বার বলবে না বলছি। তোমাকে না জানিয়ে ছোট বুবুর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে না হয় আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি, সেজন্য মাফও চেয়েছি। তাই বলে এরকম কথা বলে আমাকে শাস্তি দিতে পারলে? আমি কোনোদিন নিজেকে তোমার চেয়ে বুদ্ধিমতী বলে ভাবি নি, তোমার চরণের দাসী বলে মনে করি। আর তুমি কিনা–কথাটা শেষ না করেই কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠল।
আব্দুল হান্নান তার মুখ অঞ্জলী করে ধরে বলল, আমিতো কথাটা এমনি একটু ইয়ার্কি করে বলেছি, তোমাকে কাঁদাবার জন্য বলি নি। তারপর তার চোখ মুছে দিয়ে বলল, তবু যদি অন্যায় হয়ে থাকে, মাফ—।
নিলুফার স্বামীর মুখে হাত চাপা দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার কথা বুঝতে না পেরে এমনিই অপরাধী, তার উপর মাফ চেয়ে আমাকে আরো অপরাধী করো না।
আব্দুল হান্নান তাকে আদর করতে করতে বলল, আমার মনে হয় আমরা কেউই কোনো অপরাধ করি নি। এখন ঘুমাবার ব্যবস্থা কর, অনেক রাত হয়েছে।
.
০৯.
আজ শুক্রবার। জুম্মার নামাযের পর পুরুষদের খাইয়ে মেয়েরা খেতে বসেছে। এমন সময় নাফিসাকে আসতে দেখে গালিবা উঠে গিয়ে সালাম বিনিময় করে বলল, তুমি একা যে? রাফিয়া ও তোমাকে ছোট ভাবি পাড়ার মেয়েদেরকে নিয়ে আসতে বলে দিয়েছিল না?
নাফিসা বলল, গতবারের চেয়ে আজ অনেক বেশি মেয়ে আসবে। তাই তাদের বসার ব্যবস্থা করে রাখার জন্য রাফিয়া আমাকে আগে পাঠিয়ে দিল। সে সবাইকে নিয়ে আসবে।
গালিবা জিজ্ঞেস করল, তুমি খেয়েছ? না খেয়ে থাকলে এসো আমরা খাচ্ছি, আমাদের সঙ্গে খেয়ে নেবে?
নাফিসা বলল, আমি খেয়ে এসেছি। তোমরা খেয়ে নাও।
গালিবা তাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে বলল, তা হলে তুমি এখানে বস, আমি খেয়ে আসছি।
সবাই আসার পর নিলুফার সব মেয়েদের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, আপনারা এসেছেন দেখে আমি খুব খুশী হয়েছি। এখন আপনাদের কার কি জানার আছে বলুন, ইনশাআল্লাহ আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
নাফিসা ও রাফিয়া নারীদের পর্দার বিরুদ্ধে। তারা যুক্তি করে এসেছে প্রথমে নারীদের পোশাক ও নারী-স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে চাইবে। তাই কেউ কিছু বলার আগে রাফিয়া বলল, নারী-পুরুষদের পোশাক ও নারীদের পর্দা এবং নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলাম কি বলেছে জানতে চাই।
নিলুফার বলল, আপনি খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন। প্রথমে পোশাক সম্পর্কে বলছি। আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “হে বনি আদম, আমি তোমাদের জন্য পোশাক সৃষ্টি করিয়াছি, যাহা তোমাদের দেহের আবৃতাঙ্গকেও আবৃত করে এবং সৌন্দর্যের উপকরণও হয়। আর পরহেজগারীর পোষাক উহা হইতে উত্তম। ইহা আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত, যেন তাহারা স্মরণ রাখে। [সুরা-আরাফ, আয়াত-২৫, পারা-৮]
মানব জাতির জন্য পোশাক নির্ধারণ করাও আল্লাহপাকেরই একটা অনুগ্রহের দান। লজ্জা নিবারণ এবং শীত গ্রীস্মের প্রকোপ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে পোষাকের ব্যবহার। আবহাওয়ার তারতম্য অনুপাতে বিভিন্ন দেশে পোষাকের তারতম্য হবে। তাই ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট পোশাককে মুসলমানদের জন্য ঘোষণা করে নি, তবে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন পুরুষদের জন্য টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা ও রেশমী কাপড় ব্যবহার করা এবং নারীদের পোষাক পুরুষদের ও পুরুষদের পোশাক নারীদের পরা নিষিদ্ধ করেছে। নারীদের হাতের কব্জি, মাথাসহ পায়ের পাতার উপর পিঠ পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে। এই সীমা বজায় রেখে সব ধরণের পোশাক সবার জন্য বৈধ। তবে আল্লাহ মুক্তাকীদের (আল্লাহওয়ালাদের) পোশাক অধিক শ্রেষ্ঠ বলেছেন। সেজন্য মুক্তাকীদের পোশাক অনুসরণ করাই মুসলমানদের কর্তব্য। অন্য কোনো ধর্মালম্বীদের বৈশিষ্টসূচক যে-কোনো পোশাক পরিত্যাগ করাও মুসলমান মাত্রেই কর্তব্য।
আব্দুল লতিফ স্কুলে শিক্ষকতা করে। সব সময় লুংগী, পায়জামা-পাঞ্জাবী পরলেও স্কুলে ফুলপ্যান্ট-শার্ট পরে যায়। সে জিজ্ঞেস করল, আজকাল কি শহরে, কি গ্রামে প্রায় সবাই ফুলপ্যান্ট-শার্ট পরে। এই পোশাক পরা কি ইসলামে নিষেধ? যদি তাই হয়, তা হলে মহাকবি আল্লামা ইকবালকে কেন বই পুস্তক ও পেপারে প্যান্ট-শার্ট পরা অবস্থায় দেখি?
নিলুফার বলল, প্রশ্নটা খুব বিতর্কমূলক। তবু উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। পুরুষদের জন্য নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত সতর। অর্থাৎ এই অংশ ঢেকে রাখা ফরয। আর মেয়েদের সতর কতটা তা একটু আগে বলেছি। যেই অংশটুকু ঢেকে রাখা ফরয, সেই অংশটুকু অন্যের চোখে পড়তে দেওয়া নিষিদ্ধ। এই মূলনীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং আবহাওয়া ও শালীনতার প্রতি লক্ষ্য রেখে যে-কোনো পোষাক পরতে ইসলামে মানা নেই। তবে একটু আগে যে কথা বললাম, অন্য কোনো বিধর্মীদের বৈশিষ্ট্যসুচক যে-কোনো পোশাক মুসলমান মাত্রেই পরিত্যাগ করা উচিত। যেমন যে পোশাক পরলে অমুসলিম কোনো ধর্মসম্প্রদায় বলে মনে হতে পারে, এরকম পোশাক পরা মুসলমানদের পক্ষে অবৈধ। আর আল্লামা ইকবালের কথা যে বললেন, তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় মুসলিম দার্শনিক কবি ছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে অনেক আমলই শরীয়তের মাপকাঠিতে ঠিক ছিল না। যেমন তিনি দাড়ী রাখেন নি। অথচ দাড়ী রাখা অধিকাংশ আলেমের মতে ওয়াজীব।
আব্দুল হান্নান বলল, ফরয নামায পড়ার সময় অনেক মসজিদের ইমাম সাহেবকে বলতে শুনেছি, “পায়জামা বা লুংগীর ঝুল টাখনুর উপরে গুটিয়ে নেন।” কই, তাঁরা তো সব সময় টাখনুর উপরে কাপড় পরতে বলেন না। এর কারণ কি বলতে পার?
নিলুফার বলল, কারণটা ইমাম সাহেবকেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। তা যখন কর নি তখন আমিই বলছি, এ ব্যাপারে প্রথম দিন আলোচনার বৈঠকে বলেছিলাম। তবু আরো কিছু বলছি–
হাদিসে আছে, “আল্লাহ বলিয়াছেন, অহঙ্কার আমার পরিচ্ছদ এবং আমার শৌর্য আমার পায়জামা। যে একটি আমার দেহ হইতে খুলিয়া নেয়, তাহার জন্য বেহেশতের দরজা খোলা হইবে না এবং যে পর্যন্ত উট সুঁচের ছিদ্রের ভিতর দিয়া যাইবে না। সে পর্যন্ত বেহেশতে যাইবে না।” [বর্ণনায়: হযরত হোরায়রা (রাঃ)-মিশকাত (২) সূরা-নূর, আয়াত-৩০, পারা-১৮]
অনেকে বলে থাকেন, আমরা তো অহঙ্কারবশত কাপড়ের ঝুল টাখনুর নিচে পারি না, তা হলে বাধা কোথায়?
তাদেরকে আমি বলব, আপনারা টাখনুর উপরে একবার কাপড় পরে দেখুন, তা হলেই আপনার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারবেন। এবার মেয়েদের পর্দা সম্পর্কে বলছি। আজকাল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়েরা বলেন, পর্দা প্রথার জন্য মুসলমান মেয়েরা শিক্ষা ও সভ্যতা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পর্দার কথা বলে পুরুষরা মেয়েদেরকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রেখেছে। কোনো মেয়ে যদি পর্দা ভেঙ্গে বাইরে আসতে চায়, তার উপর অত্যাচার করা হয়। মনে রাখবেন আল্লাহ পর্দা শুধু মেয়েদেরকে করতে বলেন নি, পুরুষদেরকেও বলেছেন। কুরআনপাকে তিনি বলিয়াছেন, “মুসলমান পুরুষদেরকে বলিয়া দিন তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে এবং আপন আপন লজ্জাস্থানের হেফাজাত করে। এটা তাদের জন্য অধিক পবিত্রতার বিষয়। নিশ্চয় আল্লাহ খবর রাখেন যা কিছু তারা করে।” [সুরা-আরাফ, আয়াত-২৫, পারা-৮]
তারপর নারীদেরকে আদেশ করা হয়েছে, “আপনি মুসলমান নারীদেরকে বলিয়া দিন তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে এবং আপন আপন লজ্জাস্থানের হেফাজাত করে এবং তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। কেবল সেই স্থানসমূহ ব্যতীত, যাহা সাধারণভাবে ভোলা থাকে। আর যেন নিজের চাদর স্বীয় বক্ষের উপর জড়াইয়া রাখে, আর যেন স্বীয় সৌন্দর্য সমূহ প্রকাশ হইতে না দেয়।” [সূরা-নূর, আয়াত-১৮, পারা-১৮]
এ সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলিয়াছেন, “হে নবী, আপনার স্ত্রীগণকে ও আপনার কন্যাগণকে এবং অন্যান্য মুমীনদের নারীদিগকে বলিয়া দিন যে, তারা যেন তাদের চাদরগুলি নিজেদের (মুখমন্ডলের) উপর (মাথা হইতে) নিম্নদিকে একটু ঝুলাইয়া দেয়, ইহাতে তাহারা পরিচিত হইবে, ফলতঃ তাহারা নির্যাতিত হইবে না। এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।” [সূরা-আযহাব, আয়াত-৫৯, পারা-২২]
উপরে প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে মুসলমান পুরুষ ও নারীকে চোখের পর্দা করতে বলা হয়েছে। কারণ চোখের দৃষ্টি কোনো লোভাতুর ও কামাতুর জিনিসের উপর পড়লে মানুষের মনকে সেদিকে প্রলুব্ধ করিয়ে পাপ কাজ করায়।
আর তৃতীয় আয়াতে মুসলমান নারীদেরকে চাদর দ্বারা শরীরের পর্দা করতে বলা হয়েছে। এই আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, পর্দার জন্য মুখমন্ডলের উপর চাদর টানা জরুরী। যারা বলে নারীদের জন্য মুখমন্ডল ঢেকে বাইরে বের হওয়ার নির্দেশ ইসলামে নেই, এই আয়াতের দ্বারা তাদের দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়ে যায়।
এই আয়াতে বলা হয়েছে, নারীরা ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় পরিধেয় বস্ত্রের উপর যেন জিলবাব ব্যবহার করে এবং জিলবাবের কিয়দংশ যেন মুখমন্ডলের উপর টেনে দেয়। জিলবাব বড় চাদরকে বলা হয়। আগে মুসলিম মহিলারা এই চাদর ব্যবহার করতো। অনেক এলাকায় নারীদের এখনও এভাবে চাদর জড়ানোর প্রচলন রয়েছে। বোরখা এই জিলবাবেরই একটা উন্নত আকার। অতএব, শরীয়তে বোরখার প্রমাণ নেই বলা নেহায়েত মুখতা।
রাফিয়া জিজ্ঞেস করল, বোরখা পরে মুখমন্ডল খোলা রেখে চলাফেরা, অফিস-আদালত করা ও অবাধে পরপুরুষের সঙ্গে কথাবার্তা বা উঠা বসা জায়েয হবে কিনা?
নিলুফার বলল, না জায়েয হবে না। কারণ, পুরুষের জন্য যেমন নাভীর থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত সতর এবং এটুকু ঢেকে রাখা ফরয, তেমনি নারীর জন্য হাত, পা ও মুখমন্ডল ব্যতীত সর্বশরীরই সতর। এটুকু যত্নের সঙ্গে ঢেকে রাখা প্রাপ্তবয়স্কা সকল নারীর উপর ফরয। যে চৌদ্দজনের সঙ্গে বিয়ে হারাম তাদের সামনে তারা যেতে পারেন, দেখা সাক্ষাত করতে পারেন। যেমন বাবা-চাচা, সন্তান, ভাই, মামা প্রমুখ, তবে তাদের সামনে উঠাবসা করার সময়ও মেয়েদের পক্ষে সতর ঢেকে রাখা ফরয।
কোনো বিশেষ প্রয়োজনে, যেমন হজ্বের সময়, জেহাদে বা শরীয়তসম্মত অন্য কোনো ওজরে কিংবা নিজের অতি প্রয়োজনীয় কাজকর্মে বাইরে যাতায়াতের সময় মেয়েরা মুখমন্ডল ঢেকে রাখবে কিনা। এ ব্যাপারে ইমামগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ ইমামের মতে, প্রয়োজনে বাইরে যাতায়াত করার সময় এমন কি হজ্বের এহরামের সময়ও মেয়েদের চেহারা (মুখমন্ডল) আড়াল করে রাখা জরুরী। অবশ্য কোনো কোনো ইমামের মতে মুখমন্ডল খোলা রেখে বাইরে যাতায়াত করলে ফরয তরকের গুনাহ হবে না। কিন্তু ইমাম ও ফকীহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, নারীর পক্ষে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজের সৌন্দর্য ও যৌবন আড়াল করে রাখা ফরয। কুরআন শরীফে ওয়ালা তুকদিনা যীনাতাহুন্না” অর্থাৎ তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না দ্বারা একথা বুঝান হয়েছে।
এখন কথা হল, যেসব মহিলা মুখমন্ডল খোলা রেখে, বোরখা পরে পরপুরুষের সামনে অবাধে চলাফেরা করেন, তারা কি কুরআন শরীফে উল্লিখিত তাদের যীনাত অর্থাৎ আকর্ষনীয়তা পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে সক্ষম হন? সাধারণ বিবেক কি বলে? অনেক সময় আঁটসাঁট বোরখা তো কোনো কোনো মহিলার আকর্ষণীয়তা আরো বাড়িয়ে তোলে। সুতরাং বোরখা পরে মুখমন্ডল খোলা রেখে মহিলাদের পক্ষে পরপুরুষদের সঙ্গে অবাধে দেখা সাক্ষাৎ ও চলাফেরা শরীয়ত সিদ্ধ হবে, এটা কোনো বিবেকবান লোকের পক্ষে স্বীকার করা সম্ভব বলে মনে করি না। সব থেকে বড় কথা, এ দেশে যে বোরখা মহিলারা ব্যবহার করেন, এটা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল না। এটা ইরানী কৃষ্টির সৃষ্টি। প্রথম তিন যুগের মুসলিম মহিলাগণ পর্দা করার জন্য বড় চাদর ব্যবহার করতেন।
মোটকথা, পর্দার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মহিলাগণকে তাদের রূপ ও যৌবন পরপুরুষের আকর্ষণীয় দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে হবে। তাদের চাল চলন, কথাবার্তা ও উঠা বসার মধ্যে কোনো অবস্থাতেই অন্যের মনে কোনো প্রকার আকর্ষণ অনুভব করার সুযোগ দেবেন না। সচেনতার সাথে নিজের মানসিক পবিত্রতার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টির কোনো সুযোগ দেবেন না, এটাই ইসলামী পর্দা এবং এ পর্দা রক্ষা করার প্রয়াসই তাদের উপর আল্লাহ ফরয করিয়াছেন। তাই তাদের পক্ষে আপন সহোদর ভাইয়ের সামনেও এমন পোশাকে বের হওয়া হারাম হবে, যে পোশাক বা অভিব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক ভাইয়ের মনে কোনো প্রকার কু-ধারণা সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে।
রাহেলা নামের পাড়ার এক বৌ জিজ্ঞেস করল, শ্বশুরবাড়িতেও কি মেয়েদের পর্দা করতে হবে?
নিলুফার বলল, হ্যাঁ, করতে হবে। শ্বশুরবাড়িতেও মেয়েদেরকে পর্দা করার কথা ইসলাম বলেছে। হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “তোমরা গায়ের মহাররাম নারীদের কাছে যেও না। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসুলুল্লাহ (দঃ); নারীর মুশুরালয়ের পুরুষদের সম্পর্কে কি বলেন? তিনি জওয়াবে বলিলেন, শ্বশুরালয়ের পুরুষরা তো মৃত্যুতুল্য। [বর্ণনায়: হযরত ওকবা ইবনে আমের (রাঃ)-বুখারী, মুসলিম]
এই হাদিস দ্বারা প্রমাণ হয় যে, রাসুলুল্লাহ (রাঃ) নারীর শ্বশুরালয়ের পুরুষদের মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করিয়াছেন। এর উদ্দেশ্য এই যে, নারী তার ভাসুর, দেবর, নন্দাই ও শ্বশুরালয়ের অন্যান্য পুরুষ থেকে এমনভাবে বেঁচে থাকবে, যেমন মৃত্যু থেকে বেচে থাকাকে জরুরী মনে করা হয়। কারণ, এসব। লোককে আপন মনে করে অন্দরমহলে ডেকে আনা হয়। ফলে অধিক মেলামেশা হয়, এমন কি রং-তামাশাও হয়। স্বামী মনে করে, এরাতো আপনজন, এদের কাছে যেতে বাধা কি? কিন্তু যখন উভয় তরফে একে অপরকে ভালো লাগে তখন বেশি পরিমাণে যাতায়াত করে এবং যখন স্বামী অনুপস্থিত থাকে তখন অশুভ ঘটনা ঘটে যায়। একজন প্রতিবেশী কোনো নারীকে এত দ্রুত ও সহজে অপহরণ বা নির্লজ্জ কাজ করাতে পারে না, যতটুকু দ্রুত ও সহজে দেবর তার ভাবিকে অপহরণ বা নির্লজ্জ কাজে সম্মত করার ক্ষমতা। রাখে।
কোনো কোনো নারী দেবরকে শৈশবে লালন-পালন করে। এরপর বড় হয়ে গেলে তার থেকে পর্দা করাকে খারাপ বা উচিত নয় মনে করে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। শরীয়তের আদেশকে খারাপ বা উচিত নয় মনে করার অধিকার কোনো মুসলমানেরাই নেই। এরকম মনোভাবের কারণে প্রায়ই দেবর-ভাবির মধ্যে অঘটন ঘটে যাওয়ার কথা শোনা যায়।
আবার অনেকে মনে করে, স্বামী যার সঙ্গে পর্দা করতে বলবে, তার কাছ থেকে পর্দা করতে হবে এবং স্বামী যার সামনে যেতে বলে, তার সামনে যেতে বাধা নেই। এটাও অত্যন্ত ভুল ধারণা। স্বামী হোক অথবা অন্য কেউ তোক, তার কথায় শরীয়তের হুকুম অমান্য করা জায়েয হয়ে যাবে না। কারণ পর্দা শরীয়তের হুকুম, স্বামীর নয়।
আমাদের দেশে দেবর ভাবি, চাচাত, মামাত, ফুফাত সেয়ানা ভাইবোন এক রিক্সায় চেপে যাতায়াত করে। এটা যে শরীয়তের হুকুম অমান্য করা হচ্ছে, তা যারা জানে তারাও করে, আর যারা জানে না, তারাও, করে। আর স্কুল কলেজের মেয়েরা তো মাথায় কাপড়ই দেয় না। মাথায় কাপড় দেওয়াকে তারা। লজ্জাবোধ করে। তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের যে সব অঙ্গ শরীয়ত ঢেকে রাখতে বলেছে, মাথার চুলও সে সবের একটা অংশ। মেয়েদের মাথার চুল পরপুরুষকে দেখানো শরীয়তে নিষিদ্ধ।
নাফিসা বলে উঠল, তা হলে যেসব মেয়েরা খালি মাথায় স্কুল-কলেজে পড়ে, তাদের মধ্যে তো অনেকে ঠিকমত নামায পড়ে, রমযান মাসে রোযা রাখে, দুবেলা কুরআন পড়ে, তাদের পরিণাম বেহেশত না দোযোখ?
নিলুফার বলল, স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করাতো কোনো দোষের কাজ নয়, তবে সাবালিকা হওয়ার পর সতর ঢেকে রাখা ফরয। মেয়েদের মাথাও সতরের অন্তর্ভুক্ত। নারী-পুরুষ যে কেউ ফরয হুকুমের প্রতি উপেক্ষা দেখালে সে আযাবেরই ভাগী হবে। তাদের কোনো ইবাদতই আল্লাহর নিকট গ্রহনীয় হবে না বলে হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে।
আরো একটা জিনিস আমাদের সমাজে দেখা যায়, বোরখা পরা একজন বৃদ্ধার সঙ্গে উদভিন্ন যৌবনা নাতনি অথবা বৌকে রাস্তায় যাতায়াত করতে দেখা যায়। ভেবে দেখুন, বৃদ্ধার রূপ যৌবন অথবা পুরুষদের আকর্ষণ করার মতো কিছুই নেই। অথচ তিনি বোরখা করে যাতায়াত করেন। আর তার সঙ্গিনী, যার নাকি রূপ-যৌবন ও অন্য সবকিছু পুরুষদের আকর্ষণ করার মতো রয়েছে, সে কিনা লজ্জা-সরমের মাথা খেয়ে, বোরখা বা চাদর ছাড়া ঐ বৃদ্ধার সঙ্গে ঘরের বাইরে যায়। খুব অবাক হওয়ার কথা নয় কি? যার বোরখা পরা একান্ত অপরিহার্য, সে পরল না, অথচ যার বোরকা না পরলেও চলত, সে বোরখা পরে। যেসব নারী নিজেদের রূপ-যৌবন পরপুরুষকে দেখায়, তাদের লজ্জা বলতে কিছু নেই। অথচ লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। হাদিসে আছে, “যার লজ্জা নেই, তার ঈমান নেই”। হাদিসে আরো আছে, “আল হায়াতু নেসফুন ঈমান।” অর্থাৎ লজ্জা ঈমানের অর্ধেক। আর যে সমস্ত পুরুষ স্ত্রী-পরিজনকে পর্দা মেনে চলার চেষ্টা না করে এভাবে ঘরের বাইরে যাতায়াত করতে দেয়, ঐ সমস্ত পুরুষ দাইয়ুস। হাদিস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী, এইরূপ নারী-পুরুষের কোনো ইবাদতই আল্লাহর নিকট কবুল হয় না। হাদিসে আছে, “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, দাইয়ুস পরকালের জীবনে কোনোদিন বেহেশতের সুগন্ধও লাভ করিবে না, যদিও বেহেশতের সুগন্ধ বহুদূর থেকে পাওয়া যায়।”
রাফিয়া বলল, নারীর অধিকার ও নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলাম কি বলেছে জানতে চাই।
নিলুফার বলল, ইসলাম কোনো শ্রেণী বিশেষের জন্য আসে নাই, শুধু নরের কিংবা শুধু নারীর জন্যও আসে নি। ইসলাম এসেছে নর-নারী নির্বিশেষে সারা বিশ্বমানবের কল্যাণের ব্যবস্থা নিয়ে সমগ্র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য। নর-নারী কাউকেই একতরফাভাবে সুখ বা দুঃখ ভোগ করার অধিকার দেয় নি। দিয়েছে, উভয়কেই সবকিছুর সমান অধিকার। নারীরা চিরদিন সর্বাবস্থায়ই পুরুষের কৃপায় পাত্রী হয়ে থাকবে অথবা পুরুষের দয়ার দান ছাড়া নারীর জীবনযাত্রার কোনো উপায় নেই, এমন কথাও ইসলাম ধর্ম বলে না। সে নারীর জন্যও স্বাবলম্বী হওয়ার পথ চির উন্মুক্ত করে, পুরুষের কণ্ঠরোধ করার যথাযোগ্য ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নারীকে দিয়েছে স্বামীর সম্পত্তিতে ও পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার। অবস্থা বিশেষে বোনের ও ভাইয়ের সম্পত্তিতেও ন্যায্য অধিকার দিয়েছে। নারীর নিজের উপার্জন করা অর্থ, তাহার নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত অধিকার স্বীকার করে তাকে প্রতিষ্ঠা ও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। নারী নিজের নারীত্বের মর্যাদা রক্ষা করে ইসলামের সীমার মধ্যে থেকে প্রযোজনে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি করার অধিকার ইসলাম তাকে দিয়েছে। স্ত্রীর উপার্জনের টাকা অথবা সম্পত্তি স্বামী জোর করে দাবি করতে পারবে না। কুরআনপাকে আল্লাহতালা বলিয়াছেন, “পুরুষের উপার্জনে পুরুষের অংশ, নারীর উপার্জনে রহিয়াছে নারীর অংশ।” সূরা-নিসা, আয়াত-৩২, পারা-৫
আল্লাহপাক কুরআনে আরো বলিয়াছেন, “অল্প হউক, বিস্তর হউক, পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নর-নারী উভয়ের অংশ নির্ধারিত রহিয়াছে।” [সূরা-নিসা, আয়াত-৭, পারা-৪]
নারীর অধিকার সম্পর্কে গত শুক্রবারে অনেক আলোচনা করেছি, এবার নারী-স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এ সম্পর্কে মাওলানা মুহাম্মদ তাহের (কলিকাতা) কৃত “রমণীর মান” বইয়ের কিছু অংশ তুলে ধরছি।
পশ্চিমাদের দেখাদেখি আমাদের দেশেও নারী স্বাধীনতার ঝড় উঠেছে। প্রবলভাবে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারী-পুরুষ ইসলামকে না জেনে, সভ্যতা ও প্রগতির নামে নারীকে ঘরের বাইরে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য ও লোভনীয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কল্পনা আর বাস্তব এক নয়। শুধু কল্পনায় উড়ে বেড়িয়ে বাস্তবের তৃপ্তিলাভ সম্ভব নয়। প্রকৃতির সমর্থন ও বাস্তবের অনুমোদন ছাড়া আমাদের কোনো খেয়ালই কার্যকরী হওয়ার নয়, হতেও পারে না। যদি আমরা কল্পনার তেপান্তরের মাঠে আকাশচুম্বি ইমারত তৈরি করতে চাই, তা হলে মনে রাখতে হবে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধে ও বাস্তবের নিষ্ঠুর আঘাতে সেই কল্পনার শীষমহল যে-কোনো মুহূর্তে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে বাধ্য। আজকাল অনেকেই বলে থাকেন, মধ্যযুগীয় পর্দা প্রথার বাড়াবাড়ির কারণে নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। মন্তব্যটা ইয়াহুদী, খৃস্টান ও উচ্চবর্ণের কুলীন হিন্দুদের বেলায় প্রযোজ্য। পর্দা প্রথার নামে ওরা নারীদেরকে চাঁদ-সুরুজেরও স্পর্শের বাইরে রাখতে চাইত। ইয়াহুদী ও খৃস্টানরা নারীদের শয়তানের আড়কাঠি রূপে জ্ঞান করত এবং সমাজের সমস্ত কর্মকান্ড থেকে দূরে সরিয়ে রাখত। ফলে উল্লিখিত জাতিগুলোর নারীসমাজে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইসলামের পর্দা নারীকে অসূর্যস্পর্শা করে রাখে নাই, বরং নারীজাতির প্রকৃত মর্যাদার আসন সুনিশ্চিত করেছে। ফলে ইসলামী সমাজে নারীদের পর্দার কারণে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এমন ঘটনার খবর কেউ দিতে পারবে না। আমাদের দেশে এক শ্রেণীর স্ত্রীলোকের মধ্যে পর্দার প্রতি উপেক্ষা দেখান আসলে রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র। আসল রোগ- যারা অজ্ঞতা ও পরিবেশের দোষ বা পাশ্চাত্যের চটকদার প্ররোচনায় ইসলামের সকল বিধি-বিধান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে ফেলেছে। একমাত্র তারাই তথাকথিত নারী- যারা, স্বাধীনতার নামে পর্দার বিরুদ্ধাচরণ করে থাকে। এরা মুসলমান ঘরে জন্মালেও এবং এদের নাম, সুফিয়া বেগম, হাসিনা বেগম, খালেদা খাতুন, তসলিমা নাসরীন যাই হোক না কেন, বিশ্বাসের দিক দিয়ে কিন্তু কেউ মুসলমান নয়। শুধু পর্দার বিরুদ্ধে এরা বিদ্রোহী নয়, নামায, রোযা ও ইসলামের অন্যান্য বিধানের অবাধ্যতামূলক আচরণ করে থাকে। এদের মধ্যে আবার যাদের বয়সের উন্মাদনা স্তিমিত হয়ে আসার পর যখন মৃত্যুর কথা স্মরণ হয় তখন নামায, রোযা ও ইসলামের অন্যান্য বিধানের সঙ্গে পর্দার বিধানও মেনে চলতে শুরু করে। সুতরাং মুসলিম নারীরা পর্দাপ্রথার বাড়াবাড়ির প্রতি বিদ্রোহী হয়ে নারী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেছে, কথাটি ঠিক নয়। ঠিক কথা হচ্ছে, নানা প্ররোচনায় এরা প্রথমে ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়। তারপর ইসলামবিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়।
নারীকে পর্দার জাল ছিন্ন করে ঘরের বাইরে আনলেই যদি তাদের সত্যিকার স্বাধীনতা লাভ হত এবং তাদের সকল সমস্যার সমাধান ও দুর্দশার অবসান হত, তবে নারী প্রগতির পীঠস্থান সভ্যতার চূড়ামণি পাশ্চাত্য জগতে নারীর কোনো মূল্য নেই কেন? সেখানে মায়ের জাতির অপমান, প্রিয়ার জাতির অনাদর ও লাঞ্ছনা কেন? প্রগতির নামে, স্বাধীনতার নামে ঘরের বাইরে এনে ঘরবিমুখ করে, কঠোর পরিশ্রম ও অন্তর্জালার অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে, নারীত্বের দায়িত্ব ও মান-মর্যাদা বঞ্চিত করে, না ঘরের না ঘাটের করে রেখেছে। এ কূল ও কূল দুকূল বিনষ্ট করার নামই কি সভ্যতা? এরই নাম কি নারী প্রগতি ও নারী স্বাধীনতা?
মিঃ জুয়েল সীম্যান, ফ্রান্স, বৃটেন ও আমেরিকার মধ্যে সর্ববরেণ্য ও সম্মানীত লেখক। ফ্রান্সের বিখ্যাত পন্ডিত ‘মসিয়ো লুজো’র বইয়ের উপর রিভিউ করতে গিয়ে মিঃ সীম্যান রিভিউ অফ রিফিউজে লিখেছেন, “নারীকে নারীই থাকতে হবে। নারী একমাত্র নারী হিসাবেই সৌভাগ্য-সার্থকতা লাভ করবে এবং অপরকে সৌভাগ্যের অবদানে সমৃদ্ধ করতে পারে। এজন্য নারী সমাজের প্রয়োজনীয় সংসার করতে হবে। তাদের আমূল পরিবর্তন নয়, নারীকে নরে পরিনত করার নারকীয় প্রয়াস থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। নারীকে নরে পরিনত করার অপচেষ্টায় নারী হারাবে তাহার মহিমা ও সৌন্দর্য, আমরাও হারাব জীবনের যাবতীয় কল্যাণ। প্রকৃতি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকেই পূর্ণ পরিনত করে সৃষ্টি করেছে। সেই প্রাকৃতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টিমূলের প্রতি নজর রেখে আমরা তাহাকে মেজে-ঘষে সুন্দর ও সমুন্নত করার চেষ্টা করবো মাত্র। আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টাই প্রকৃতির নিয়ম-বিরোধিতা থেকে সতত বিরত থাকতে হবে।”
সুবিখ্যাত ইংরেজ মনীষী মিঃ স্যামুয়েল স্মাইলস তদীয় গ্রন্থ “কারেকটার” এ তথাকার নারী প্রগতির চিত্র পরিবেশন করতঃ বলেন,
“যে রাষ্ট্রীয় সংবিধান নারী জাতিকে রাষ্ট্রীয় কারখানার কাজ করতে দিয়েছে, তা হয়ত কিছু পরিমাণে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করতে পেরেছে, কিন্তু পারিবারিক জীবনের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে, একেবারে চুরমার করে দিয়েছে গার্হস্থ্য ও সাংসারিক জীবনের সুকঠিন ইমারত। ছিন্ন করে দিয়েছে ন্যায়-নীতির বাধা বন্ধন হতে কোনো সন্দেহ নাই। এহেন ব্যবস্থার শোচনীয় পরিনাম স্ত্রীকে কেড়ে নিয়েছে স্বামীর প্রতিবন্ধন ও বাহুবেষ্টন থেকে সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে মায়ের স্নেহ, মমতা ও আদরের কোল থেকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মেয়েদের নৈতিক অধঃপতন যে অনিবার্য সত্য কথা অস্বীকার করা যায় না।”
বায়রনকেও তিক্ত অভিজ্ঞতার পর শেষ পর্যন্ত বলতে হয়েছে, তওরত এবং পাকপ্রণালী সংক্রান্ত বই-পুস্তক ছাড়া মেয়েদের লাইব্রেরীতে অন্য কোনো বই রাখতে নেই।”
আমেরিকার নারীশিক্ষা সম্বন্ধে সচিত্র ভাষণে মিঃ লুশ্যান বলেন, “লেডি ডাক্তার, লেডি ইঞ্জিনিয়ার এবং শিক্ষায়িত্রী গড়বার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তনগুলোতে তহজিব-তমুদ্দিন সভ্যতা-শালীনতার নাম গন্ধ পর্যন্ত নেই। মহিলারা অত্যন্ত কঠোর অধ্যবসায় সহকারে রসায়ন এবং অঙ্কশাস্ত্র অধ্যায়ন করেন কিন্তু দেখা যায় অধিক বিদ্যায় যে সমস্ত যুবতী মেয়েরা কৃতিত্বের সাথে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন, পরিবারিক জীবনে অতি মামুলী এবং সামান্যতমম বিষয়েও তারা অনভিজ্ঞ এবং অপটু বলে প্রতিয়মান হচ্ছেন।”
দার্শনিত সীম্যান সাধে কী আর বলেছেন, “আগে আমরা নারী শিক্ষার অভাবের অভিযোগ করতাম। কিন্তু আজ নারী-শিক্ষার বাড়াবাড়ি হেতু বিলাপ কান্না কাঁদছি।”
বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী, সাহিত্যিক, প্রখ্যাত দার্শনিক মিঃ প্রাডউন বলেন, ‘নারী তার অন্তর্নিহিত অমূল্য গুন-সম্পদে পুরুষকেও ডিংগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার এই অন্তর্নিহিত শোভা-সৌন্দর্যের বিকাশ পুরুষের অধীনে থেকেই সম্ভব। প্রকৃতির এই অমূল্য দান এবং অনন্য সাধারণ রত্নের হেফাজত ও সংরক্ষণই নারীর দায়িত্ব। এটা শুধু নারীর কর্তব্যই নয়, বরং এমনই এক অবস্থা ও পরিরিস্থিতি যাতে স্বামীর আধিপত্য মেনে চলতে সে বাধ্য। এমতাবস্থায় নারীর পক্ষে পুরুষের সমকক্ষতার দাবী যে অত্যন্ত বিশ্রী, বিসাদৃশ, কলঙ্কজনক, দাম্পত্য সম্পর্কের পক্ষে অভিশাপ, প্রেম, ভালবাসার প্রতিবন্ধক, মানবজাতির জীবন্ত সর্বনাশ, এ নির্মম সত্য আজ আর অস্বীকার করবার উপায় নাই।” (রিভিউ অফ রিভিউজ)।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সত্যই বলিয়াছেন, “বিধাতার দোষ দিই না, তিনি মেয়ে-পুরুষকে যথেষ্ট ভিন্ন করিয়াই সৃষ্টি করিয়াছিলেন। কিন্তু সভ্যতায় সে ভেদ আর থাকে না। এখন মেয়েও পুরুষ হইতেছে, পুরুষও মেয়ে হইতেছে। সুতরাং ঘরের শান্তি বিদায় লইল। এখন শুভবিবাহের পূর্বে পুরুষ বিবাহ করিতেছে না মেয়ে বিবাহ করিতেছে তাহা কোনোমতে নিশ্চিত করিতে না পারিয়া বর-কন্যা উভয়েরই চিত্ত আশঙ্কায় দুরু দুরু করিতে থাকে।”
পাশ্চাত্যের এরকম আরো বহু জ্ঞানী, গুণী, পণ্ডিত, দার্শনিক, প্রফেসর, সাহিত্যিক ও মনীষী তথাকথিত নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছেন। আসল কথা আমরা পাশ্চাত্যের এত ভক্ত ও অন্ধ অনুরক্ত হয়ে পড়েছি যে, তাদের মাঝে দোষ থাকতে পারে, তাদের মাঝেও গলদ থাকতে পারে, তাদের কোনো অবদানও নিন্দনীয় হতে পারে, এরকম ধারণা বা কল্পনা করতেও আমাদের বাধে। এই জন্যই আমরা পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ করতে যাই। পদে পদে পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শকে বরণ করি নির্বিচারে। কথায় কথায় দিই পাশ্চাত্য সভ্যতার দোহাই। [মাওলানা মুহাম্মদ তাহের (কলিকাতা) কৃত]
আমরা নারী স্বাধীনতার বিরোধী নই। ইসলাম নারীকে যে স্বাধীনতা দিয়েছে সেটাই নারীদের জানতে হবে। তার অতিরিক্ত স্বাধীনতা মুসলমান নারীরা পেতে পারে না। পাওয়া উচিত নয়। কারণ আল্লাহপাক সৃষ্টিকর্তা হিসাবে তার সৃষ্ট নারীকে কতটা স্বাধীনতা দিলে তার নিজের, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণ বয়ে আনবে তা তিনি খুব ভালভাবে জানেন। তাই তিনি নারীদের স্বাধীনতার সীমা বেঁধে দিয়েছেন। তিনি কুরআনপাকে
বলিয়াছেন, “এবং তোমরা তোমাদের ঘরের অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে বসবাস করিতে থাক এবং পূর্বকালীন জাহিলিয়াতের যুগের ন্যায় নিজেদের রূপ সৌন্দর্য ও সৌন্দর্যদীপ্ত দেহের অঙ্গসমূহ প্রদর্শন করিয়া বেড়াইও না।” [সূরা-আযহাব, আয়াত-৩৩, পারা-২২]
নারীর পক্ষে সর্বাপেক্ষা উত্তম বিষয় কি? প্রিয় নবী (দঃ) এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সাহাবারা অপারগ থাকিলে হযরত আলি (রাঃ) ফাতেমা (রাঃ)-কে ইহার উত্তর জিজ্ঞেস করেন, হযরত ফাতেমা (রাঃ) বললেন, ‘পুরুষের দৃষ্টি এড়াইয়া চলা।”
তাই মুসলমান নারী হিসাবে আল্লাহ প্রদত্ত নারী স্বাধীনতাকে অভিনন্দন জানাই। মায়ের জাতির, প্রিয়ার জাতির দুঃখ-কষ্ট ও দুগর্তি-দুর্দশা দেখে আমার মন কাঁধে। তাদের স্বাধীনতার ও ন্যায্য অধিকারে অনধিকার হস্তক্ষেপ অমার্জনীয়, অন্যায় ও অবিচার বলে মনে করি। আমি চাই নারী নারী থাক, অক্ষুণ্ণ থাক মায়ের মর্যাদা, অলঙ্কৃত থাক প্রিয়ার সৌন্দর্য, প্রেম-ভালবাসা। নারীকে দেখতে চাই তার আপন মহিমায়। শুধু যারা পাশ্চাত্য জগতের নারী প্রগতি ও তথাকথিত নারী-সভ্যতা ও নারী স্বাধীনতাকেই সত্যিকার নারী স্বাধীনতার মানদন্ড হিসাবে অনিবার্য অনুকরণীয় আদর্শ বলে মনে করে, তাদের সঙ্গে একমত হতে পারি না। একমত হওয়া উচিতও নয়। পাশ্চাত্যের নারী স্বাধীনতার প্রশংসায় যারা পঞ্চমুখ, এটাকে যারা মায়ের জাতির, প্রিয়ার জাতির সুখ-শান্তি, সম্মান ও মর্যাদার রক্ষার কবচ মনে করে, তাদের প্রশংসা করতে পারি না। তারিফ করতে পারি না তাদের জ্ঞান বুদ্ধির। রিভিউ অফ রিফিউজতে পরিবেশিত পাশ্চাত্য সভ্যতা ও নারী স্বাধীনতার চিত্র, পাশ্চাত্যের মনীষীমহলে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট অভিমত ও মন্তব্যের পর একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, নারী স্বাধীনতার নামে পাশ্চাত্যজগতের নারী স্বাধীনতার অনুকরণ নিঃসন্দেহে ‘টকের ভয়ে তেঁতুলতলায় যাত্রা। পাশ্চাত্য নারী স্বাধীনতা নারীর জীবনে মূর্তিমান অভিশাপ। নারীর স্বাধীকার, নারীর আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, নারীর সুখ-শান্তি এক কথায় নারীর ও নারীত্বের পক্ষে এর চেয়ে সর্বনাশা বিপদ আর কিছুই নেই। আর একটা কথা মনে রাখবেন, পর্দার জন্য আল্লাহ নারীদেরকে যেমন ঘরে থাকতে বলিয়াছেন, তেমনি পুরুষদের বলিয়াছেন, “সালাম ও অনুমতি ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করিও না।”
চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে, তেমনি নর-নারীকে ও নারী-নরকে আকর্ষণ করে। তাই আল্লাহপাক নর-নারীর পৃথক কর্ম ও কর্মস্থান নির্দিষ্ট করে দিয়াছেন। পুরুষরা অর্থ উপার্জনের জন্য বাইরে কাজ-কর্ম করবে। আর নারীরা ঘরের মধ্যে থেকে গার্হস্থ্য জীবনের কর্তব্য সম্পাদন করবে। বাসগৃহের পরিচ্ছন্নতা, সংসারের শ্রীবৃদ্ধি, ছেলেমেয়েদের ধার্মিক ও আদর্শবান করে গড়ে তুলবে এবং ভবিষ্যতের প্রতি নজর রেখে জীবিকা ও অর্থের সদ্যবহার করবে। স্বামীরা বাইরে থেকে ক্লান্ত হয়ে এলে আচার-ব্যবহারের দ্বারা ক্লান্তি দূর করবে। যারা পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলকারখানায়, অফিস, আদালতে চাকরি করে, তারা কি করে ছেলেমেয়েদের স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে মানুষ করবে? কি করে পরিশ্রান্ত স্বামীর ক্লান্তি দূর করবে? কারণ সে নিজেই তখন দেহ ও মনে ক্লান্ত।
বিবেকবান নারীরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে, পুরুষ তার নিজের গরজে নারীকে ফুসলিয়ে, সরলা নারীকে স্বাধীনতার সবুজ বাগান দেখিয়ে ঘরের বাইরে এনে সহস্র যন্ত্রণার অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করছে। স্বাধীনতার মধুর নামে নারীকে দিয়েছে বিষ। সরলা নারীরা সেই বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হচ্ছে। তারা নারীত্বের কবর রচনা করছে নিজের হাতে। পুরুষ আত্মপ্রসাদ লাভ করছে, নারীকে যথেচ্ছা যত্রতত্র ব্যবহার করতে পেরে। পুরুষ তার নিজের কাজে নারীকে ব্যবহার করছে নারীর দায়িত্ব লাঘব না করে। নারী ভাবছে, সে স্বাধীনতা লাভ করেছে। পুরুষ দেখছে, তার ভোগের রসদ জুটছে। মাছের আনন্দ আহার জুটেছে আর শিকারী নিশ্চিন্ত টোপ গিলেছে। অথচ একটুখানি খেয়াল করলেই নারী বুঝতে পারত, স্বাধীনতার নামে সে যা লাভ করেছে, তাও পুরুষের দান, পুরুষের অনুগ্রহ।
যে সৃষ্টিকর্তা জগৎ-মহাজগৎ ও তাদের মধ্যে যত কিছু সে সব শুধু সৃষ্টিই করেন নি, সেসব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য নীতি, কর্তব্য ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নিজ নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব হিসাবেই নির্দিষ্ট রেখেছেন প্রত্যেকের অনুকুল পরিবেশ। নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসাবেই প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে যথাযোগ্য যথাসমীচীন আসবাবপত্র, সাজ-সরঞ্জাম, রসদ ও উপকরণ। চিরশ্বাশত এই নীতি শুধু মানবজগতেই নয়, বরং সমস্ত প্রাণীজগতে, এমন কি সমগ্র সৃষ্টিজগতেই পরিলক্ষিত হয়।
আসলে সৃষ্টির মূলে প্রত্যেকটি দেওয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার নামই সভ্যতা বা তাহযীব তমুদুন এবং ন্যায় বিচারের মূল ভিত্তি। সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বল আল আমিনের বিধি-বিধান মেনে, সৃষ্টিমূলের এই সংবিধানকে “তসলীম” করে মানবতা, তাহযীব তমুদুন ও সভ্যতার বিকশিত ও রূপায়নে আত্মনিয়োগের অবাধ অধিকারের নামই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা মৌলিক অধিকারে নর-নারী নির্বিশেষে সকল মানুষেরই সমান। মানুষ হিসাবে নর-নারী এক হলেও উভয়ের মাঝে যেমন আছে শ্রেণীগত ব্যবধান, তেমনি স্বাধীনতার মাঝেও আছে ব্যবধান, এটাই প্রকৃতির অমোঘ বিধান। তাই নর-নারী মানুষ হিসাবে এক হলেও তারা ভিন্ন শ্রেণী, তাদের দায়িত্ব ভিন্ন এবং তাদের দায়িত্ব হিসাবেই দেওয়া হয়েছে দেহ-মন, আকৃতি-প্রকৃতি ও অনুকূল পরিবেশ। নর নারীর এই স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ অন্যায় ও অবিচার সর্বকালে সর্বত্র নিন্দিত। এতে হস্তক্ষেপ কিংবা ত্রুটি বের করা অথবা বাড়াবাড়ি এবং নির্দিষ্ট সীমারেখা লংঘন যেমন প্রকৃতির সঙ্গে বিরোধিতা ও সংঘর্ষ বাধবে, তেমনি বিড়ম্বিত হবে মানুষের জীবন, অবক্ষয় হবে সমাজ সভ্যতার। আর তা যে হচ্ছে, তা আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন।
এই জন্য এ ব্যাপারে আল্লাহপাক কুরআন মজিদে ঘোষণা করিয়াছেন, “তিনিই আমাদের প্রভু, যিনি প্রত্যেকটি বিষয় বস্তুকেই পরিণত অস্তিত্ব প্রদান করিয়াছেন, বাতলাইয়া দিয়াছেন, তাহাকে প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পাদনে যথা কর্তব্য।”
তিনি পবিত্র কুরআনে আরো ঘোষণা করিয়াছেন, “প্রত্যেকটি সৃষ্টিকেই আমি নির্দিষ্ট পরিমাপ মতো তৈরী করিয়াছি।” [সুরা- কামর, আয়াত-৪৯, পারা-২৭]
জনৈক দার্শনিকও ঐ একই কথা বলেছেন, “Nature never breaks her own laws.”
নিশ্চয় মানুষ জন্মগত স্বাধীন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তাহার জন্ম ও তাহার অস্তিত্বের উপর কাহারও অধিকার নেই। কিংবা ছিল না? যিনি জীবন দিয়েছেন, জীবনের উপর যদি তাহারই অধিকার অস্বীকৃত হয় এবং অস্বীকৃতির নামই যদি স্বাধীনতা হয়, তা হলে সৃষ্টিকর্তাকেই তো অস্বীকার করা হল। যারা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে তারা তো কাফির। মুসলমানরা কোনোদিন সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করতে পারে না। যদি করে, তা হলে তারা আর মুসলমান থাকবে না। তাই সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্দুল আল আমিন মানুষের ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের জন্য মানুষের জীবনযাত্রা, সভ্যতা-অসভ্যতা ভালোমন্দ, পাপ-পূন্য, স্বাধীনতা-পরাধীনতা প্রভৃতি প্রত্যেক বিষয়েরই নিয়ম ও নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই নিয়ম ও নীতি মেনে এই বিধানের চির অনুগত থেকে এবং এই সংবিধানের নিকট আত্মসমর্পণ করে মানুষ করবে তার দায়িত্ব পালনে সার্থক অভিযান। এই সীমারেখা ও নিয়ম নীতির গন্ডির ভিতরে থেকে অবাধে যথা কর্তব্য করার অধিকারের নামই স্বাধীনতা। এর অন্যথা স্বাধীনতা নয়, স্বেচ্ছাচারিতা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা।
এই পর্যন্ত বলে নিলুফার বলল, আজকের আলোচনায় অনেক কিছু বললাম, আর একটা কথা বলে শেষ করব। সেটা হল, নারীর স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলাম কি বলেছে, তা নারী-পুরুষ উভয়কেই জানতে হবে এবং উভয়কেই উভয়ের মান-মর্যাদা ও তার ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে সেই মতো জীবন পথে চলার চেষ্টা করতে হবে। তা হলেই সংসার যেমন সুখ-শান্তির হবে, তেমনি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনও সুখ শান্তির হবে।
পাড়ার একজন শিক্ষিত বৌ বলল, ইসলামের এসব বিধি-বিধান স্কুল কলেজে শিক্ষা দেয় না। মাদ্রাসায় দেয় কিনা তা জানি না। মৌলবীদেরকে কোনো মাহফিলে ওয়াজ করতে শোনা যায় না। তা হলে সাধারণ মুসলমান নর-নারী এসব জানবেই বা কি করে? আর মানবেই বা কি করে?
নিলুফার বলল, আপনার কথা শুনে খুব খুশী হয়েছি। মাদ্রাসায় নিচের ক্লাসে এসব শিক্ষা না দেওয়া হলেও, যারা উচ্চডিগ্রী নেয় তারা এসব বিষয়ে পড়াশোনা করে। তা ছাড়া বাস্তব জীবনে যা কিছু জানা দরকার, সেসব মাদ্রাসার কিতাবে থাকলেও সিলেবাসে থাকে না। তাই ছেলেমেয়েরা পুরো কিতাব না পড়ে পাশ করার জন্য শুধু সিলেবাসের অংশ পড়ে। আর মৌলবীদের মাহফিলে ওয়াজ করার কথা যে বললেন, তাও ঠিক নয়। অনেক মাওলানা এসব ব্যাপারে ওয়াজ করে থাকেন। আপনি হয়তো সেসব মাহফিলে যান নি, তা ছাড়া একদিকে মেয়েরা যেমন ওয়াজ মাহফিলে সচরাচর যায় না, অপরদিকে তেমনি তাদের যাওয়ার সুযোগও হয় না। তাই আমাদের উচিত প্রত্যেক পাড়ায় অথবা গ্রামে এমন একটা পাঠাগার থাকা উচিত, যেখানে অন্যান্য বইয়ের সাথে ধর্মীয় বইও থাকবে এবং মেয়েরাও যেন সেখান থেকে বই ঘরে নিয়ে পড়তে পারে, সেরকম ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর যারা পড়াশোনা জানে না, তাদের উচিত হবে, যে এসব বই পড়বে- তার কাছে বসে শোনা। তা ছাড়া প্রত্যেক ঘরে ঘরে প্রতিদিন বা সপ্তাহে একদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে, ধর্মীয় বইপুস্তক ও মসলা-মাসায়েলের কিতাব একজন পড়বে আর বাকি সবাই শুনবে, এইরকম ব্যবস্থা করলে বিশেষ করে মেয়েরা অনেক কিছু জানতে পারবে। তারপর বলল, এবার আপনারা আসুন। যখন যার যা কিছু জানার প্রয়োজন হবে, সময় মতো এসে জেনে যাবেন। তা ছাড়া প্রতি শুক্রবার এসময়ে এলে আরো অনেক কিছু জানতে পারবেন। ইলিয়াস মির্জা একদিন চার ছেলে ও বৌদের ডেকে পৃথক করে দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে বললেন, ভেবেছিলাম, গালিবার বিয়ে দিয়ে কাজটা করব; কিন্তু এখন ভাবছি, গালিবার বিয়ে আল্লাহর যখন ঈশারা হবে তখন হবে। তাই ঠিক করেছি তোমাদের প্রত্যেককে কিছু কিছু জমি-জায়গা দিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারি পৃথক করে দেব। এতে তোমাদের কিছু বলার থাকলে বলতে পার।
পৃথক করে দেওয়ার কথা শুনে বৌ-এরা খুশী হলেও কেউ কিছু বলল না। স্বামীরা কি বলে শোনার জন্য চুপ করে রইল। ছোট আব্দুল হান্নান ছাড়া বড় তিন ভাই পৃথক হতে চাইলেও এত তাড়াতাড়ি আব্বা তাদেরকে পৃথক করে দেবেন, ভাবতেই পারে নি। তাই সবাই চুপ করে রইল।
ইলিয়াস মির্জা বললেন, তোমরা কেউ কিছু বলছ না কেন? আমি মারা যাওয়ার পর তো তোমরা পৃথক হবেই। সেই কাজটা আমি বেঁচে থাকতে করে দিতে চাই।
আব্দুল হান্নান বড় ভাইয়েরা কি বলে শোনার জন্য কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, আমার কোনো অমত নেই।
স্বামী থেমে যেতে নিলুফার বলল, আমারও কোনো অমত নেই, তবে আপনি ও আম্মা আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
অন্য তিন ভাই চিন্তা করল, আমাদের জমি জায়গা দেওয়ার পর বাকি জমি জায়গা নিয়ে আব্বা-আম্মা যার সঙ্গে থাকবে, সে ঐসব ভোগ দখল করবে। তাই একে একে তিনজনে ছোট ভাই ও তার বৌ-এর মতো একই কথা বলল।
ইলিয়াস মির্জা এবার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিছু বলবে না?
জাহেদা বেগম বললেন, তুমি তোমার সম্পত্তি ছেলেদের দিয়ে পৃথক করে দিতে চাও, দাও। আমি কোনো ছেলে বৌ-এর সংসারে থাকব না। আর আমার সম্পত্তিও কাউকে দেব না। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমার সম্পত্তি আমি নিজেই ভোগ-দখল করব। মরে যাওয়ার পর শরামতে ছেলেমেয়েরা যে যার পাওয়ার পাবে।
ইলিয়াস মির্জা মৃদু হেসে বললেন, মনে হচ্ছে, ছেলেদের সংসার পৃথক করে দিচ্ছি বলে তুমি অসন্তুষ্ট হয়েছ? আজ হোক, কাল হোক, দুদিন পরে হলেও তো ওরা পৃথক হবেই। তখন হয়তো যে-কোনো ব্যাপারে ভাই ভাই-এর মধ্যে মনোমালিন্য হতে পারে। তার চেয়ে আমরা যদি ওদের পৃথক করে দিই, সেটাই তো ভালো। আর সম্পত্তির ব্যাপারে যা বলেছ খুব ভালো কথা বলেছ। ইচ্ছা করলে আমিও আমার সম্পত্তি এখন না দিতে পারতাম। দিচ্ছি, ওরা যা পাবে তা দিয়ে যেন আরো বাড়াতে পারে।
জাহেদা বেগম বুঝতে পারলেন, অসন্তুষ্ট হওয়াটা ঠিক হয় নি। নরম স্বরে বললেন, তুমি যা ভালো মনে করেছ তাই কর, আমার কোনো আপত্তি নেই।
ইলিয়াস মির্জা স্ত্রীর পরিবর্তন দেখে খুশী হলেন। বললেন, মা-বাবার কর্তব্য হিসাবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে রুজী-রোজগারের ব্যবস্থা করেছি, বিয়ে দিয়েছি। শান্তিপূর্ণভাবে ছেলেদের পৃথক করে দেওয়াও মা-বাবার কর্তব্য। তাই পৃথক করে দিচ্ছি। আমাদের কর্তব্য আমরা করলাম। এবার ছেলে-বৌদের কর্তব্য তারা করবে। না করলে তারা আল্লাহর কাছে জওয়াব দেবে। তাতে আমাদের কোনো দায়-দায়িত্ব থাকবে না।
.
মাসখানেকের মধ্যে ইলিয়াস মির্জা চার ছেলের জন্য চারটা রান্নাঘর, পায়খানা ও গোসলখানা তৈরী করে এবং প্রত্যেককে নিজের সম্পত্তি থেকে তিন বিঘা করে ফসলী জমি দিয়ে পৃথক করে দিলেন। তারপর একদিন স্ত্রীকে বললেন, তোমাকে কয়েকটা কথা বলব, মন দিয়ে শোন। ভেবে-চিন্তে পরে উত্তর দিও। ছেলেদেরকে দেওয়ার পর যে সম্পত্তি আছে, ইনশাআল্লাহ তাতে আমার ও তোমার ভরণ-পোষণ চলে যাবে। তোমার সম্পত্তির জমি আমি ভাগ চাষ করব। আর আগান-বাগান ও পুকুরের আয় ব্যয় বাদে তোমার হাতে তুলে দেব। জমি ফসলের অঋেক আমি পাব আর বাকি অর্ধ্বেক তুমি পাবে। অবশ্য তুমি ইচ্ছা করলে অন্য কাউকে দিয়ে ভাগ চাষ করাতে পার।
জাহেদা বেগম স্বামী যে ধার্মিক জানতেন। কিন্তু নিলুফার এ বাড়িতে আসার পর থেকে তার ধর্মভীরুতা ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে লক্ষ্য করেছেন। সেই সাথে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সংশোধন হওয়ার চেষ্টা করছেন। এখন স্বামীর কথা শুনে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুমি তা হলে আমার আগের ব্যবহার মাফ করতে পার নি? আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে তিনি মাফ করেন, আর তুমি স্বামী হয়ে স্ত্রীকে মাফ করতে পারছ না?
ইলিয়াস মির্জাও স্ত্রীর অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। তার কথা শুনে বললেন, আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুক। সারাজীবন তুমি আমার সঙ্গে যা কিছু করেছ, তা মনে না রেখে মাফ করে দিয়েছি। তারপরও সেদিন তুমি মাফ চাইতে মাফ করে দিয়েছি। তবু একথা বলছ কেন?
জাহেদা বেগম চোখ মুখে বললেন, তা হলে জমি-জায়গার ব্যাপারে ওরকম কথা বললে কেন?
আমি ইসলামের কথা বলেছি, এতে আমার দোষ কোথায়?
আর আমি যে সেদিন বললাম, আমার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি তোমাকে দিয়ে দিলাম, তুমি দলিল করে নাও। তারপরও আজ এরকম কথা বলা বুঝি ঠিক হয়েছে? নিলুফার একদিন তো বলল, “ইসলাম বলেছে স্ত্রীর সম্পত্তি স্বামী জোর করে ভোগদখল করতে পারবে না; কিন্তু স্ত্রী ইচ্ছা করলে কিছু অংশ অথবা সবটাই স্বামীকে দিয়ে দিতে পারে।” আমি আবার বলছি, আমার সবকিছু তোমাকে দলিল করে দেব। তুমি সেই ব্যবস্থা কর।
স্ত্রী ঝোঁকের মাথায় সেদিন কথাটা বলেছে কিনা জানার জন্য ইলিয়াস মির্জা আজ কথাটা তুলেছেন। বুঝতে পারলেন, না সে ঝোঁকের মাথায় বলে নি, ধর্মভীরুতার কারণে বলেছে। স্ত্রী থেমে যেতে বলল, তা আর করা লাগবে না। শরীয়তের নির্দেশ মতো ছেলেমেয়েদের অংশ হিসাব করে ওদের নামে তোমার আমার সব সম্পত্তি উইল করে রাখার ব্যাপারে নিলুফারের সঙ্গে যে আলাপ করেছিলাম, সে-ই ব্যবস্থা করব।
জাহেদা বেগম বললেন, তুমি যা ভালো বুঝ করবে? এ ব্যাপারে আমাকে আর কখনও কিছু বলবে না।
.
স্ত্রীর অনুরোধে পর্দার জন্য আব্দুল হান্নান মা-বাবার অনুমতি নিয়ে রান্নাঘর ও গোসলখানাসহ ঘরের চারপাশে মুলীবাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিল।
তার দেখাদেখি অন্য তিন ভাইও তাই করল।
পৃথক হয়ে গেলেও নিলুফার আগের মতো শ্বশুর-শাশুড়ীর দিকে খুব লক্ষ্য রাখে। তাদের রান্না-বান্না ও অন্যান্য সব কাজ করে দেয়। শাশুড়ীকে কোনো কাজ করতে দেয় না। যখন ভাসুররা ঘরে থাকে না তখন মাঝে মাঝে জায়েদের কাজেও সাহায্য করে। প্রতি শুক্রবার খাওয়ার পর, আর প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর শ্বশুরের ঘরের বারান্দায় সবাই কুরআন হাদিসের আলোচনায় বসে।
অন্য তিন জাও শ্বাশুড়ীর যত্ন করে। তবে নিলুফারের মতো অতটা কেউ করে না। কারণ বড় জায়ের দুটো ছেলেমেয়ের ঝামেলা আছে। মেজ জায়ের একটা বাচ্চা হয়েছে। সেজ জায়ের পেটে বাচ্চা এসেছে। তাই তারা নিলুফারের মতো শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা-যত্ন করতে পারে না।
মেয়েরা সহজ সরল হলেও সাংসারিক ব্যাপারে খুব বুদ্ধিমতী। সাধারণতঃ তারা হিংসুটে হয়ে থাকে। শ্বশুর-শাশুড়ীর প্রতি নিলুফারকে খুব বেশি লক্ষ্য রাখতে দেখে তিন জায়েরই মনে সন্দেহ হল, ভাবল, তাদের কাছ থেকে বেশি সম্পত্তি ও শাশুড়ীর গহনা পাওয়ার জন্য সে আমাদের থেকে বেশি তাদের সেবা-যত্ন করছে।
নিলুফার এ বাড়িতে ছোট বৌ হয়ে আসার আগে জাহেদা বেগমের বড় বৌ-এর প্রতি টান ছিল। জায়েদের মধ্যে ঝগড়া বাধলে তিনি বড় বৌ-এর পক্ষ নিয়ে কথা বলতেন। ফলে বড় বৌ-এর ধারণা ছিল, শাশুড়ী তিন জায়ের চেয়ে তাকে বেশি ভালবাসেন। এখন নিলুফারের প্রতি টান দেখে তারও হিংসা হয়েছে। একদিন তিন জা পরামর্শ করে ঠিক করল, প্রত্যেকেই যে যার স্বামীকে বলবে, শ্বশুর-শাশুড়ীর কাজ-কর্ম ও সেবা-যত্ন প্রত্যেক বৌ এক মাস করে করবে।
স্ত্রীরা যখন রাতে যে যার স্বামীকে কথাটা জানাল তখন তারাও রাজি হল। পরের দিন বড় জা স্বামী দেবর ও সব জায়েদের নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীকে কথাটা জানাল।
ইলিয়াস মির্জা কথাটা শুনে খুশী হলেও আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মনে মনে হাসলেন; কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না করে স্ত্রী কি বলে শোনার জন্য চুপ করে রইলেন।
জাহেদা বেগম খুশী না হলেও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তিনিও মনে মনে হাসলেন। স্বামী কিছু বলার আগেই বললেন, তোমাদের কাউকেই আমার কিছু করে দিতে হবে না। আল্লাহ যতদিন সক্ষম রেখেছেন, ততদিন আমি নিজেই সবকিছু করতে পারব। যখন অক্ষম হব তখন না হয় তোমরা করো।
কেউ কিছু বলার আগে নিলুফার বলল, আল্লাহ আপনাকে মউতের আগে পর্যন্ত সুস্থ রাখুক এই কামনা করি। আপনি হয়তো ঠিক কথা বলেছেন; কিন্তু আম্মা, মা-বাবার সেবা-যত্ন ও তার ভালোমন্দ সবকিছুর দিকে লক্ষ্য রাখা শরীয়তের নির্দেশ। এই নির্দেশ পালন না করলে ছেলেমেয়ে গুনাহগার হবে। তা ছাড়া “পিতা-মাতার পায়ের তলায় ছেলেমেয়েদের জান্নাত” এটা হাদিসের কথা। তাই বলছি, আপনাদের সেবা-যত্ন করে আমরা জান্নাত কিনতে চাই। মা হয়ে আমাদেরকে সেই জান্নাত কেনার পথ বন্ধ করবেন না। বড় বুবু যা বললেন, তা মেনে নিন আপনারা।
স্ত্রীকে চুপ থাকতে দেখে ইলিয়াস মির্জা তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নিলুফার হাদিসের কথা বলল, তবু কিছু বলবে না?
জাহেদা বেগম বললেন, ঠিক আছে, বড় বৌ-এর কথা মেনে নিলাম। পৃথক হওয়ার পরের মাস থেকে বড় তিন ছেলে স্ত্রীদের পরামর্শ অনুযায়ী সংসার খরচের কথা জানিয়ে মাকে আগে যা দিত, তার চেয়ে কম দিতে লাগল। ছোট আব্দুল মতিন ব্যবসা শুরু করার মাসতিনেক পর থেকে মাকে এক হাজার ও বাবাকে এক হাজার টাকা দিত। আর নিলুফার শ্বশুর-শাশুড়ীকে পাঁচশ টাকা করে দিত। এখনও তাই দেয়।
একবার যখন আব্দুল হান্নান ও নিলুফার টাকা দিতে এল তখন জাহেদা বেগম ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোর বড় ভাইয়েরা সংসার খরচের কথা বলে টাকা কম দিচ্ছে? তোদেরও দুদিন পর ছেলেমেয়ে হবে, তখন খরচ বাড়বে। আমাদেরকে না দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য জমা কর, তখন কাজে লাগবে।
স্বামী কিছু বলার আগে নিলুফার বলল, আম্মা কি যে বলেন, ভবিষ্যতে কি হবে না হবে সে কথা আল্লাহ জানেন। যাদেরকে দুনিয়াতে পাঠাবেন, তারা জন্মাবার আগেই তিনি তাদের সবকিছুর ব্যবস্থা করে রাখেন।
এবার ইলিয়াস মির্জা বললেন, কিন্তু মা, আমাদের তো টাকা-পয়সার দরকার নেই। তবু দিচ্ছে কেন?
নিলুফার বলল, মা-বাবা কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও ছেলে-মেয়ের কর্তব্য, মা-বাবাকে সাধ্যমতো সাহায্য করা ও তাদের ভালোমন্দ সব কিছুর প্রতি লক্ষ্য রাখা। এটা ইসলামের নির্দেশ।
.
১০.
পরীক্ষার পর নাযিম বাবার সঙ্গে ক্ষেতে-খামারে কাজ করছে। একদিন তার বাবা সাহাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, এবার কি করবি কিছু ভেবেছিস?
নাযিম বলল, এম.এ. পড়ব।
সাহাবুদ্দিন বললেন, কিন্তু বাবা, তুই তো জানিস, তোকে পড়াবার ক্ষমতা আমার নেই। মির্জা ভাই সাহায্য না করলে তোর কলেজে পড়াই হত না। সে প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে তোর পড়ার খরচ দিয়েছে। এখন আবার তাকে পড়াবার কথা বলব কোনো মুখে? পরীক্ষার ফল বেরোবার পর শহরে গিয়ে চাকরি-বাকরির চেষ্টা কর।
শহরে যাব, চাকরির চেষ্টাও করব। তবে সেই সাথে পড়াশোনা করে এম.এ. পাশ করব ইনশাআল্লাহ। তোমরা শুধু দোয়া করো, আল্লাহ যেন। আমার আশা পূরণ করেন।
সেখানে নামিযের মা মাহিলা খাতুনও ছিলেন। বললেন, কিন্তু শহরে গিয়েই তো তুই চাকরি পাবি না। শুনেছি, তোর চেয়ে অনেক বেশি লেখাপড়া করেও তারা চাকরি পাচ্ছে না। চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত ততদিনের খরচ পাবি কোথায়? আমাদের যা অবস্থা, তোকে তো খরচ-পাতি দিতে পারব না।
নাযিম বলল, ওসব নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না, আর মির্জা চাচাকেও এব্যাপারে কিছু বলতে হবে না। ছোট ভাবি, মানে আব্দুল হান্নান ভাইয়ের বৌ আমার সব খরচ দেবেন বলেছেন।
মাহিলা খাতুন নিলুফারের সুনাম নাযিমের কাছে আগেই শুনেছিলেন। স্বামীর কাছেও তার অনেক গুণের কথা শুনেছিলেন। এখন আবার ছেলেকে এম.এ. পড়াবে শুনে খুব আনন্দিত হয়ে বললেন, ও আল্লাহ তাই নাকি? তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে কত করে বললাম, একবার আমাকে তোমার ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে চল, বৌটাকে দেখব। অমন আল্লাহওয়ালা মেয়েকে দেখলেও সওয়াব হয়।
আব্বাকে চুপ করে থাকতে দেখে নাযিম বলল, ছোট ভাবি সত্যিই আল্লাহর খাস বান্দী। শ্বশুর বাড়িতে আসার কিছুদিনের মধ্যে ঘরের সবাইকে কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে হেদায়েত করে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, এই কয়েকমাসের মধ্যে ঐ গ্রামের বহু মেয়েকেও হেদায়েত করে ফেলেছে। আর ছোট ভাবি, ভাইয়াকে দিয়ে গ্রামের পুরুষদেরকে হেদায়েত করার ব্যবস্থা করেছে। ছোট ভাইয়াদের গ্রামে একটা ক্লাব আছে। ছোট ভাবি নিজের টাকায় কুরআন-হাদিসের তফসীর ও অনেক ধর্মীয় বই কিনে দিয়েছে। সেখানে প্রতিদিন রাতে ছোট ভাইয়া গ্রামের লোকজনদের সেসব পড়ে শোনায়। তারপর মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আব্বা তোমাকে ছোট ভাবিকে দেখতে না গিয়ে গেলেও আমি নিয়ে যাবে। অবশ্য আব্বা যদি অনুমতি দেয়।
সাহাবুদ্দিনরা তিন ভাই। অন্য দু’ভাই বিপদে-আপদে ইলিয়াস মির্জার কাছে সাহায্য চাইতে গেলেও সাহাবুদ্দিন একবার মাত্র গিয়ে ছিলেন ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে। আব্দুল হান্নানের বিয়ের ওলিমার ইলিয়াস মির্জা নিজে গিয়ে চাচাত ভাইয়েদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। অন্য দু’ভাই গেলেও সাহাবুদ্দিন নিজে না গিয়ে ছেলে নাযিমকে পাঠিয়েছিলেন। তার মুখে আব্দুল হান্নানের বৌ এর গুণাগুনের কথা শুনে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বড়লোক ভাইয়ের ছেলের বৌ দেখতে গেলে কিছু না কিছু না দিলে কেমন হয়? কি দেবেন? কত দামের দেবেন? কমদামের কিছু দিলে ভাবি, ভাইপো ও তাদের বৌ-এরা কি মনে করবে। বেশি দামের কিছু দেওয়ার ও সামর্থ নেই, এইসব ভেবে যান নি।
এখন আবার ছেলের মুখে তাকে সেই বৌ এম.এ. পড়ার খরচ দেবে শুনে। তিনিও খুব আনন্দিত হয়েছেন। সেই সাথে বৌ-টাকে দেখার খুব আগ্রহ হয়। ছেলে থেমে যেতে বললেন, তোর মাকে আমিই নিয়ে যাব।
নাযিম বলল, সেটাই ভালো হবে আব্বা। তোমরা গেলেই বুঝতে পারবে ছোট ভাবির সম্পর্কে যা বলছি তা কতটা সত্য।
ঐদিন এক ফাঁকে নাযিম মাকে বলল, গালিবার কথা তোমার মনে আছে? মাহিলা খাতুন চিন্তিত মুখে বললেন, গালিবা আবার কে? কই মনে পড়ছে না তো?
নাযিম বলল, তুমি এত ভুলা না মা? গালিবা মির্জা চাচার ছোট মেয়ে। তোমাকে একদিন বললাম না, মির্জা চাচার মেয়ে গালিবা আমাদের কলেজে পড়ে?
ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কি করে মনে থাকবে বল? ঐ রকম নাম আবার মেয়েদের হয়?
হয় মা হয়। গালিবা নামের মানে জান?
ঐ রকম নাম বাপের বয়সেও শুনি নি, মানে জানবো কি করে?
তোমার বাপ তো ছিল সেকেলে অশিক্ষিত বুড়ো। সে এসব নাম জানবে কি করে? গালিবার মানে হল বিজয়িনী।
আমার বাপ না হয় সেকেলে অশিক্ষিত বুড়ো; কিন্তু তুই এযুগের একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে মুরুব্বী লোকের সম্পর্কে বেয়াদবের মতো কথা বলছিস কেন? তোর বাপকে যদি কেউ একরম বলতো, তা হলে তুই কি করতিস?
নাযিম লজ্জা পেয়ে বলল, ভুল হয়ে গেছে মা, আর বেয়াদবি করব না। নানা, তাই ঠাট্টা করে বলে ফেলেছি।
কথাটা মনে রাখিস। তারপর বললেন, তা হঠাৎ গালিবার কথা বললি কেন?
গালিবার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলবে বলে নাযিম কথাটা তুলেছে। কিন্তু লজ্জায় ও ভয়ে বলতে না পেরে মুখ নিচু করে রইল।
মাহিলা খাতুন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু অনুমান করতে পারলেন। বললেন, কি রে, চুপ করে আছিস কেন?
নাযিম কিছুক্ষণ ঐভাবে থেকে বলল, ওকে আমার খুব পছন্দ।
মাহিলা খাতুন রেগে উঠে বললেন, তাতে কি হয়েছে? ভালোকে সবাই পছন্দ করে।
গালিবাও আমাকে পছন্দ করে।
তা করতে পারে, তুই তো আর খারাপ না। দেখতে সুন্দর, পড়াশোনায়ও ভালো।
মা, আমি কি বলছি, তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না।
ছেলের কথা শোন, মা হয়ে ছেলের কথা বুঝব না তো অন্য কেউ বুঝবে?
বুঝতেই যখন পেরেছ তখন এত কথা বলছ কেন?
মাহিলা খাতুন গম্ভীর স্বরে বললেন, গালিবা হয়তো দেখতে শুনতে ভালো। তাই তুই না হয় তাকে পছন্দ করিস, কিন্তু সেও যে তোকে পছন্দ করে, তা জানলি কেমন করে?
গালিবা বলেছে, কথাটা নাযিম লজ্জায় বলতে না পেরে মুখ নিচের দিকে করে চুপ করে রইল।
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে মাহিলা খাতুন একটু রাগের সঙ্গে বললেন, কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
নাযিম ঐ অবস্থাতেই নিচু স্বরে বলল, গালিবা বলেছে।
নিশ্চয় তার সঙ্গে মেলামেশা করিস?
মেলামেশা করি নি, তবে কলেজে দেখা হলে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করি, ওদের ঘরের সবাই এর কথা জিজ্ঞেস করি। সেও তাই করে। আর যখন মির্জা চাচার কাছে টাকা নিয়ে আসতে ওদের ঘরে যাই তখন একটু আধটু যা কথাবার্তা হয়।
মাহিলা খাতুন যা বোঝার বুঝে গেলেন। বললেন, কাজটা তুই ভালো করিস নি। একবারও ভেবে দেখলি না, তুই যার দয়ায় লেখাপড়া করেছিস, তার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করা যে বেঈমানি, সেকথা একবারও ভেবে দেখলি না? বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে তোর বিবেকে বাধল না? তোর মির্জা চাচা কত বড়লোক, আর তোর বাপ তাদের কামলার মতো। কি করে ভাবলি মির্জা ভাই তার মেয়েকে তোর হাতে দেবে?
মা, তুমি সব কথা না শুনে রেগে যাচ্ছ। যা বললে, আমি কি সেসব চিন্তা করি নি মনে করেছ? মির্জা চাচা তো আমাদেরই আত্মীয়। এখানে থাকলে হয়তো আমাদের মতো তার অবস্থা থাকত। তার ভাগ্য ভালো, তাই আল্লাহ তাকে আজ এত বড় করেছে। আমরাও যে চিরকাল গরিব থাকব, তা কি কেউ বলতে পারে? আল্লাহ ভাগ্যে রাখলে আমাদের অবস্থাও মির্জা চাচার মতো হতে পারে। গরিব বড়লোক সব কিছু আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা গরিব ও যাকে ইচ্ছা বড়লোক করতে পারেন। একটা কথা জেন রাখ মা, আল্লাহ যদি। গালিবাকে আমার জোড়া করে থাকেন, তা হলে গরিব বড়লোকের বাধা আর বাধা থাকবে না। যেমন করে হোক, ঘটনা ঘটবেই।
তুই যে দেখছি, লেখাপড়া করে অনেক কিছু শিখে ফেলেছিস। কিন্তু বাস্তব খুব কঠিন রে বাবা। এত কঠিন যে, অনেকে সেই বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে বিবেক হারিয়ে কত রকমের অঘটন ঘটিয়ে ফেলে।
তোমার কথা অস্বীকার করব না মা, তবে আমার ব্যাপারটায় মনে হয় আল্লাহ পাকের ইশারা আছে। তা না হলে গালিবার ছোট ভাবি আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে বাধা না দিয়ে কেন আমাকে এম.এ. পড়ার সব খরচ দিতে চাইলেন? কেন বললেন, “এম.এ. পাশ করে রুজী-রোজগার কর তখন আমিই তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব?”
মাহিলা খাতুন খুব অবাক হয়ে বললেন, এ তুই কি বলছিস? সত্যি বলছিস, না বানিয়ে বলছিস?
না মা, বানিয়ে বলছি না, একদম সত্যি। ছোট ভাবি যে কত ভালো তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না, গেলে নিজেই জানতে পারবে।
কিন্তু বাবা, তোর মির্জা চাচা, তোর চাচী ও তাদের ছেলেরা কি রাজি হবে? তা ছাড়া অতদিন তারা কি গালিবার বিয়ে না দিয়ে বসে থাকবে?
ওসব নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। ছোট ভাবি বলেছে, সে সব কিছু সামলাবে। আব্বা তোমাকে নিয়ে গেলে এ ব্যাপারে কোনো কথা ছোট ভাবি বা অন্য কাউকেই কিছু জিজ্ঞেস করো না, তবে ছোট ভাবি যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তা হলে বুঝে সুঝে উত্তর দেবে।
মাহিলা খাতুন ছেলের কথা বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করতে পারলেন না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মানুষের মন কখন পাল্টায় তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আমার খুব ভয় করছে। তোর আব্বা শুনলে কি করবে কি জানি।
তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আল্লাহ আমার তকৃদিরে যা লিখেছেন, তা তো হবেই।
মাহিলা খাতুন আবার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহ তোর তক্বদীরে কি লিখেছেন, তা আল্লাহই জানেন। তা হ্যাঁরে, ওদের বাড়িতে যাওয়ার আগে তোর আব্বাকে কিছু বলব?
না বলল না। ওখান থেকে ফিরে এসে না হয় বলল।
তুইও কি আমাদের সঙ্গে যাবি?
না, তোমরা যাও। আমি রেজাল্ট বেরোবার পর যাব।
রাত্রে মাহিলা খাতুনের ঘুম আসছে না, শুধু ছেলের কথাগুলো মনে পড়ছে। আর সেই সাথে মনে খুব টেনশান অনুভব করছেন। তা ছাড়া মেয়েরা কোনো কথা পেটে চেপে রাখতে পারে না। বিশেষ করে কেউ যদি কথাটা কাউকে জানাতে নিষেধ করে, সেই কথাটা বলার জন্য মন ছটফট করে। মাহিলা খাতুনেরও সেই অবস্থা। একদিকে তাদের জন্য কথাটা সুখবর। অপর দিকে কথাটা মেয়ের মা-বাপও ভাইয়েরা জেনে গেলে ছেলের বিপদ হতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছেন। তাই এপাশ-ওপাশ করছেন।
সাহাবুদ্দিন স্ত্রীর অস্থিরতা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি হয়েছে? এপাশ ওপাশ করছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
মাহিলা খাতুন বললেন, শরীর ভালো আছে, মনের মধ্যে কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।
মন অস্থির লাগবে কেন? নিশ্চয় ছেলের কথা চিন্তা করছ?
বেখেয়ালে মাহিলা খাতুন বলে ফেললেন, হ্যাঁ, ওর ভালোমন্দ চিন্তায় ঘুম আসছে না। আজ যে সব কথা বলেছে, সে সব শুনলে তোমারও ঘুম আসবে না।
কই, তেমন কথা তো বলে নি। সে সময় আমিও তো ছিলাম।
তখন না বললেও সন্ধ্যের পর যা বলেছে, সে কথা তুমি তো শোন নি?
কি বলেছে শুনি।
নিযাম এখন তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছে। মির্জা মিয়া ভাইয়ের বাড়ি থেকে আসার পর জানাতে বলেছে।
তাই নাকি? তা হলে তো শুনতেই হয়। বল, কি বলেছে।
মাহিলা খাতুন ছেলে যা কিছু বলেছে বললেন।
শুনে সাহাবুদ্দিন অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
কি হল, ঘুমিয়ে গেলে নাকি কিছু বলছ না কেন?
সাহাবুদ্দিন চিন্তা করছিলেন, তাদের কি এত সৌভাগ্য হবে, গালিবা ছেলের বৌ হয়ে এই গরিবের কুঁড়ে ঘরে আসবে? আব্দুল হান্নানের বৌ যে আল্লাহর খাস বান্দি তা ছেলের মুখে তার সম্পর্কের কথা শুনে অনুমান করেছিলেন। এখন সেই অনুমান আরো দৃঢ় হল। স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মির্জা ভাই কি নাযিমকে জামাই করবেন? এত সৌভাগ্য কি আল্লাহ আমাদের তত্ত্বদীরে রেখেছেন? কথাটা বলে ভালই করলে, এ ব্যাপারে মির্জা ভাই কিছু জিজ্ঞেস করলে ভেবে চিন্তে উত্তর দেওয়া যাবে।
মাহিলা খাতুন ভেবেছিলেন, নিজাম ও গালিবার সম্পর্কের কথা শুনে স্বামী রেগে যাবে; কিন্তু রাগের বদলে যা বলল, তা শুনে ভয় কেটে গেল। বললেন, হ্যাঁ, তক্বদীরে থাকলে হবেই। আমার চিন্তা, তক্বদীরে না থাকলে নাযিমের কি দশা হবে।
কি আর হবে নাযিমের মা,আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে। ও নিয়ে চিন্তা করে মন খারাপ করো না। সবকিছু যখন আল্লাহর মর্জিতে হয় তখন আমরা চিন্তা করে আর কি করব? দোয়া করা ছাড়া আমাদের করার কিছু নেই। এখন ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়, রাত অনেক হয়েছে। নিলুফার গালিবার জন্য নাযিমকে পছন্দ করেছে শোনার পর থেকে ইলিয়াস মির্জা অনেক চিন্তা করেছেন। ছেলেটা ভালো, ভাইপো হিসাবে একটু টান থাকলেও কাজটা ভালো হবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি। স্ত্রী ও ছেলেরা যে রাজি হবে না, তাও চিন্তা করেছেন, কিন্তু হ্যাঁ না, কোনো সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে পারেন নি। এর মধ্যে একটা ভালো সম্বন্ধ পেয়েছেন। তাই একদিন নিভৃতে নিলুফারকে ডেকে কথাটা বলে বললেন, তুমি গালিবার জন্য নাযিমকে কেন পছন্দ করেছ বলত মা।
নিলুফার কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, একমাত্র আর্থিক অবস্থা ছাড়া নাযিম ভাই সব দিক দিয়ে ছোট বুবুর উপযুক্ত। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, ছেলে শিক্ষিত ও সুন্দর, রোজগার ও বংশ ভালো দেখে মেয়ের বিয়ে। দেওয়া হল; কিন্তু পরে জানা গেল, ছেলেটার চরিত্র ভালো না অথবা শাশুড়ী খুব দজ্জাল। তখন শুধু মেয়ে দুঃখ ভোগ করে না, সে কথা জেনে মেয়ের মা বাবাও আত্মীয়-স্বজনেরাও দুঃখ ভোগ করে। নাযিম ভাই আপনাদের বংশেরই। ছেলে। শিক্ষিত, সুন্দর ও ধর্মের আইন মেনে চলার চেষ্টা করে। শুধু তার বাবা গরিব। ধন-সম্পদ স্থায়ী নয়, আজ যার আছে, কিছুদিন পর তার থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থ, অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাই হোক, আমি শুধু নাযিম ভাইকে ছোট বুবুর জন্য যে পছন্দ করেছি তা নয়, তার হাতে ছোট বুবুকে তুলে দিতেও চাই। তাই তাকে ছোট বুবুর উপযুক্ত করার জন্য এম.এ. পাশ করিয়ে রোজগারের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কথাটা একদিন আপনাকে জানাব ভেবে ছিলাম, তার আগেই আপনি ডেকে জিজ্ঞেস করলেন।
কিন্তু মা, গালিবা যে পরিবেশে মানুষ, ওদের পরিবেশ মেনে নিতে ওর কি কষ্ট হবে না? তা ছাড়া গালিবা যদি রাজি না হয়?
বেয়াদবি নেবেন না আব্বা, আমি কি ছোট বুবুর মতামত না নিয়ে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি? ওরা যে একে অপরকে পছন্দ করে তা জানার পর আমি সিদ্ধান্ত নিই এবং আপনাদের জানাই ছোট বুবুর জন্য নাযিম ভাইকে আমি পছন্দ করেছি।
কিন্তু গালিবার ভাইয়েরা কি রাজি হবে? আর তোমার মা তো গরিবদেরকে একদম দেখতে পারে না। সে তো একদমই রাজি হবে না। তোমার মায়ের গো কি রকম তা তো এতদিনে জেনেছ। তা ছাড়া সব–বাবাই যে কনিষ্ঠ সন্তানকে অন্য সন্তানদের চেয়ে একটু বেশি স্নেহ করে, তা তুমি বোধ হয় জান?
জি, জানি। আপনার ছোট ছেলেকে কথাটা বলেছি, উনি শুনে আমার উপর রেগে গিয়েছিলেন। পরে সব কিছু যখন বুঝিয়ে বললাম তখন রাজি হয়েছেন। অন্য ছেলেদেরও সবকিছু বুঝিয়ে বললে রাজি না হলেও বাধা দেবেন না। আর আম্মার কথা যে বললেন, আপনি তাকে বুঝিয়ে বলবেন। একান্ত রাজি না হলে আমি আম্মাকে সামলাতে পারব। আপনার সহযোগিতা পেলে ইনশাআল্লাহ। কেউ বাধা দিতে পারবে না। সবকিছু নির্ভর করছে আপনার উপর। আর আপনি যদি নাযিম ভাইয়ের সঙ্গে ছোটবুবুর বিয়ে দিতে না চান, তা হলে যেমন করে হোক আপনাকেও রাজি করাব ইনশাআল্লাহ।
ইলিয়াস মির্জা নিলুফারের কথা শুনে ভাইপোকে জামাই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। মৃদু হেসে বললেন, যদি আমি রাজি না হই, তা হলে কি করে তুমি রাজি করাবে বলতো মা?
শ্বশুরের কথা শুনে নিলুফার বুঝতে পারল, উনি রাজি আছেন। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, বিয়ের ব্যাপারে ইসলাম ছেলে মেয়েদের যে অধিকার দিয়েছে, তা একদিন আপনাদের জানিয়েছি। আশা করি, একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে আপনি তা মেনে নেবেন। ইসলাম ছেলেমেয়েকে বিয়ের ব্যাপারে স্বাধীন মত প্রকাশ করার অধিকার দিয়েছে। পছন্দ করারও অধিকার দিয়েছে। বিয়ের আগে একে অপরকে দেখারও অনুমতি দিয়েছে। তবে সবকিছুর সীমাও ইসলাম বাতলে দিয়েছে। বর্তমান যুগের মতো প্রেম করে বিয়ে, যৌন উন্মাদনায় যার-তার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে অথবা বিধর্মীকে বিয়ে ইসলাম অনুমোদন করে নি। ইসলাম যা অনুমোদন করে নি, নাযিম ভাই বা ছোট বুবু তেমন কোনো কাজ করে নি। নাযিম ভাই মাতাল নয়, লুচ্চা নয়, গুন্ডা নয়, ধর্মের প্রতি উদাসীনও নয়। তবে কেন আপনি রাজি হবেন না। যদি একান্ত রাজি না হন, তা হলে আপনার ও আম্মার পায়ে ধরে কেঁদে কেঁদে রাজি করাব।
ইলিয়াস মির্জা বললেন, তা আর করতে হবে না। তোমাকে যখন মা করে নিয়েছি তখন মায়ের ইচ্ছা পূরণ করা ছেলের উচিত জেনে করব। এখন আর একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে, আমাদের মতামত না জেনেই গালিবাকে নাযিমের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে কেন?
নিলুফার বলল, ওরা একে অপরকে পছন্দ করে জানার পর আমি নাযিম ভাইয়ের সব কিছু খোঁজ-খবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিই। আর আমার বিশ্বাস নাযিম ভাইকে ছোটবুবুর উপযুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে আপনারা অমত করতে পারবেন না। কনিষ্ঠ সন্তান হিসাবে আপনারা যেমন ছোট মেয়েকে অন্য সন্তানদের চেয়ে বেশি ভালবাসেন, ছোট ননদ হিসাবে আমিও তাকে অন্য ননদদের চেয়ে বেশি ভালবাসি। আপনারা যেমন ওকে স্বচ্ছল ও ভালো পরিবারের ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সুখী দেখতে চান, আমিও তেমনি চাই। নাযিম ভাই ভালো বংশের ভালো ছেলে হলেও তার পরিবার স্বচ্ছল নয়। তাই তাকে স্বচ্ছল করার জন্য যা কিছু করার আমি করব এবং ইনশাআল্লাহ তাতে আমি কামিয়াবও হব।
কিন্তু সেজন্য তো বেশ সময়ের দরকার। তুমি কি চাও, অতদিন গালিবার বিয়ে না দিয়ে ঘরে রেখে দেব? এটা শহর নয়, গ্রাম। এখানে বেশি বয়সের আইবুড়ী মেয়ে ঘরে থাকলে নানালোক নানান কথা বলবে। লোকজনের কাছে মুখ দেখান ভার হয়ে উঠবে।
তার বিকল্প ব্যবস্থা ভেবে রেখেছি।
বল কি বিকল্প ব্যবস্থা ভেবে রেখেছ?
নাযিম ভাইয়ের এখন বয়সই বা কত? গালিবা সাবালিকা হলেও সাংসারিক জীবন সম্পর্কে এখনও তেমন জ্ঞান হয় নি। গ্রামের লোকের মুখ বন্ধ করতে হলে ওদের আকদ করে রাখুন। নাযিম ভাই লেখাপড়া শেষ করে রুজী রোজগার করার পর ছোটবুবুকে স্বামীর ঘরে পাঠাবেন। ততদিনে ছোটবুবু বি.এ. পাশ করার সাথে সাথে সংসারকে সুখী করার জন্য আমি তাকে তালিম দিয়ে জ্ঞানী করে তুলব।
ইলিয়াস মির্জা বললেন, তোমার কথা শুনে আল্লাহ আমার চিন্তা দূর করলেন। নাযিমকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তুমি যা কিছু করতে চাও, তাতে আমিও তোমাকে সাহায্য করব। তুমি ভালো কথা বলেছ। তবে কি জান মা, আজকাল উঁচু ডিগ্রী নিয়েও ছেলেরা একটা ভালো চাকরি পাচ্ছে না। তাই আমার মনে হয়, নাযিমের আর পড়াশোনা করার দরকার নেই। দু’তিন বছর সময় ও টাকাপয়সা নষ্ট না করে যে-কোনো ব্যবসা করার চেষ্টা করুক। চাকরির চেয়ে ব্যবসায় আল্লাহ বরকত দেন বেশি। তুমি কি জান, আমিই ওর কলেজের সব খরচ দিয়েছি।
জানি।
এখন ব্যবসা করার জন্য যত টাকা পয়সা লাগে দেব, তোমার কিছু দেওয়া লাগবে না।
আরো পড়াশোনা না করে ব্যবসা করার কথা যে বললেন, তাতে আমি একমত হলেও ব্যবসা করার জন্য টাকা-পয়সার কথা যে বললেন, তাতে একমত হতে পারলাম না। কারণ নাযিম ভাইকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব যে আমি নিয়েছি, সেকথা আপনাকে বলেছি এবং আপনার ছেলেকেও বলেছি। আর নাযিম ভাইকে—।
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে ইলিয়াস মির্জা মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে মা, তোমার দায়িত্ব তুমিই পালন করবে, তবে তাতে আমিও শরীক হতে চাই। এবার নিশ্চয় এই বুড়ো ছেলের কথা তুমি রাখবে?
নিলুফারও মৃদু হেসে বলল, ছেলের কথা মা কি না রেখে পারে?
ইলিয়াস মির্জা খুশী হয়ে বললেন, আমার মনে হয়, এই ব্যাপারটা এখন কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। যখন বলার মতো সময় আসবে তখন আমিই সবাইকে যা বলার বলব।
হ্যাঁ আব্বা, সেটাই ভালো হবে। আর নাযিম ভাইয়ের ব্যাপারে যা কিছু করার আপনার ছোট ছেলেকে দিয়েই করাব। তিনি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেই করবেন। আপনি নাযিম ভাই বা তার মা-বাবার কাছে এমন কিছু বলবেন না, ওনারা যেন বুঝতে না পারেন আপনি নাযিম ভাইকে জামাই করার জন্য তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন।
তাই হবে মা, বলে ইলিয়াস মির্জা বললেন, অনেকক্ষণ হল এসেছ, এবার যাও।
নিলুফার শ্বশুরকে রাজি করাতে পেরে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে করতে ফিরে এসে দেখল, স্বামী বসে বসে একটা হাদিসের বই পড়ছে। সালাম দিয়ে বলল, কখন এসেছ? আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?
সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুল হান্নান বলল, প্রায় আধঘন্টা হল এসেছি। তোমার কথা মনে পড়তে থাকতে না পেরে তাড়াতাড়ি চলে এলাম। কথা শেষ করে হাত ধরে কোলে বসিয়ে আদর করতে করতে বলল, তোমার রূপ ও গুণ আমাকে যাদু করেছে। কাজের মধ্যে যখন তোমার কথা মনে পড়ে, তখন ভাবি, সব কিছু ত্যাগ করে সব সময় এভাবে তোমাকে নিয়ে থাকি, বলে বুকে চেপে ধরল।
নিলুফার স্বামীকে কয়েকটা আদর দিয়ে বলল, এতক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত হৃদয়ে মাফ চাইছি। তারপর বলল, আমারও ঐ একই রকম মনে হয়। কিন্তু ‘ডু ইউর ডিউটি’ কথাটা মনে করে মনকে প্রবোধ দিই। তুমিও তাই করবে। তা হলে আমার জন্য মন উতলা হলেও ডিউটি ফেলে আসতে পারবে না।
আব্দুল হান্নান বলল, জানালা দিয়ে দেখলাম, আব্বার ঘরের দিক থেকে এলে, এতক্ষণ সেখানে কি করছিলে?
ছোট বুবুর বিয়ের একটা ভালো প্রস্তাব এসেছে। সে ব্যাপারে আব্বা আমার সঙ্গে আলাপ করছিলেন।
আম্মাও ছিল?
না, পাশের বাড়ির বৌ-এর প্রসব ব্যথা উঠেছে। তারা আম্মাকে ডেকে নিয়ে গেছে।
গালিবার বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনে তুমি কি বললে?
সেদিন তোমাকে যা বলেছি, আব্বাকেও সে সব বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে বলেছি।
তোমার কথা শুনে আব্বা কি বললেন?
তোমার মতো নাযিম ভাইয়ের আর্থিক অবস্থার কথা, তুমি ও বড় ভাইয়ারা এবং আম্মা রাজি না হওয়ার কথা বললেন। আমি যে প্ল্যান-প্রোগ্রামের কথা বলে তোমাকে রাজি করিয়েছি, সেই সব বলে আব্বাকেও রাজি করিয়েছি। শেষে উনি বললেন, “আর পড়াশোনা না করিয়ে নাযিমকে ব্যবসায় নামানই ভালো।” তারপর আকদ করে রাখার কথা ও অন্যান্য যে সব কথা হয়েছে বলে বলল, আমার মনে হয়, নাযিম ভাইকে আপাতত তোমার ব্যবসায় লাগিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করাও। বছরখানেক পর ওকে আলাদা ব্যবসা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। অবশ্য তুমি যা ভালো বুঝবে করবে।
কথাটা মন্দ বল নি। অভিজ্ঞতা থাকলে নাযিম ব্যবসায় তাড়াতাড়ি উন্নতি করতে পারবে। তারপর জিজ্ঞেস করল, আকদ কবে হবে? কিভাবে হবে? আম্মা ও ভাইয়াদের কিভাবে রাজি করাবে; সে সব কিছু আব্বার সঙ্গে আলাপ করেছ?
আব্বাও আমাকে ঐ প্রশ্ন করেছিলেন। বলেছি, নাযিম ভাই ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আকদ করলে তখন আর কেউ অমত করবে না।
আল্লাহ তোমাকে শুধু রূপসী করে সৃষ্টি করেন নি, সেই সাথে সবগুণে গুণান্বিতা করেও সৃষ্টি করেছেন বলে, আবার জড়িয়ে ধরে আদর দিতে দিতে বলল, এই গোনাহগার তোমার মতো মেয়েকে সহধর্মিনী হিসাবে পেয়ে ধন্য। সেজন্য তার পাক দরবারে জানাই লাখো কোটি শুকরিয়া।
নিলুফারও আদরের প্রতিদান দিতে দিতে বলল, আমাকে অতবড় করে বলো না, আমি যে তোমার চরণের দাসি। দাসি কি কোনোদিন মালিকের চেয়ে বড় হতে পারে? আমি তো নিজেকে সবদিক থেকে তোমার চেয়ে অনেক…।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে আব্দুল হান্নান তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, আর কখনো নিজেকে আমার চরণের দাসি বলবে না। তোমার কাছেই জেনেছি, একটা বিষয়ে ছাড়া স্বামী-স্ত্রী সব বিষয়ে সমান, একে অপরের বন্ধু, একে অপরের প্রেমিক-প্রেমিকা এবং সুখ-দুঃখের অংশীদার। তবে কেন চরণের দাসি বলছ?
বলছি এই কারণে যে, নিজের নফসকে আয়ত্তে রাখার জন্য। নচেৎ যদি সববিষয়ে স্বামীকে সমকক্ষ ভাবি, তা হলে মনে অহঙ্কার আসবে। ফলে তোমার সব কিছুর ভালো-মন্দ বিচার করার জন্য নফস উৎসাহিত করবে এবং অচিরেই স্বামী ও স্ত্রীর মধুর সম্পর্কে শয়তান গরল ঢুকিয়ে দিয়ে শান্তিময় জীবনকে অশান্তিময় করে তুলবে। আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর পরে স্ত্রীর কাছে স্বামীর স্থান। সেই স্বামীকে কোনো মুমীনা স্ত্রী অসম্মান সূচক কোনো কথা বলতে ও অসম্মানজনক কোনো আচার-আচরণ করতে পারে না, আর পারাও উচিত নয়। ঐ যে ছোটদের বইয়েতে একটা কবিতা আছে না, “বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।” আমার মতে স্ত্রীরা যদি স্বামীকে সব বিষয়ে বড় মনে করে সম্মান করে, তা হলে কোনো মুমীন স্বামী সেই স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারে না। বরং তাকে আরো বেশি ভালবাসবে এবং তার মনোরঞ্জন করে সব সময় চলবে। তারপর বলল, প্লীজ একটু ছাড়, সেই কখন এসেছ, তোমাকে নাস্তা দেওয়া হয় নি।
যখন সবাই এক সংসারে ছিল তখন পুরুষদের খাওয়ার শেষে নিলুফার জায়েদের সঙ্গে খেত। পৃথক হওয়ার পর সব সময় স্বামীর সঙ্গে খায়। আজও নাস্তা নিয়ে এসে একসঙ্গে খেতে বসল।
খাওয়া শুরু করার আগে আব্দুল হান্নান বলল, তুমি প্রত্যেক সময় প্রথম লোকমা আমাকে খাইয়ে খেতে শুরু কর, আজ আমি তোমাকে প্রথম লোকমা খাওয়াব। তারপর খাইয়ে দিলে নিলুফারও তকে খাইয়ে দিল।
.
১১.
আজ দূরের এক গ্রামে পাট কিনতে যাবে। সে কথা আব্দুল হান্নান গালিবাকে রাতে বলেছিল। তাই গালিবা ফজরের নামায পড়ে নাস্তা তৈরি করেছে।
স্বামী নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিলুফার খাটে বসে ছেঁড়া পেটিকোট সেলাই করছিল।
এমন সময় গালিবা এসে দরজার বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বলল, আসতে পারি?
নিলুফার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এস।
গালিবা ভিতরে এসে তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, ছোট ভাইয়া চলে গেছে?
হ্যাঁ, এই তো একটু আগে গেল।
গালিবা তার হাত থেকে পেটিকোটটা ছোঁ মেরে নিয়ে খাটের শেষপ্রান্তে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে তুমি একজন ব্যবসায়ী ও একজন ব্যবসায়ীর স্ত্রী। তোমার কিসের অভাব যে, তুমি ছেঁড়া পেটিকোট সেলাই করে পরবে?
নিলুফার হাত বাড়িয়ে পেটিকোটটা নিয়ে আবার সেলাই করতে করতে মৃদু হেসে বলল, আমাদের নবী (দঃ) ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে না পরা পর্যন্ত নুতন কাপড় ব্যবহার করতেন না। তাই ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে পরা সুন্নত। মুসলমান হিসাবে আমাদের প্রত্যেককে সুন্নতের অনুসরণ করা উচিত। এসব। কথা রেখে আসল কথাটা বলে ফেল।
আসল কথা আবার কি? এমনই এলাম।
বিশ্বাস হচ্ছে না?
কেন?
তুমি জান, তোমার ভাইয়া এত সকালে আড়তে যায় না। তবু যখন এসেছ তখন তো বোঝাই যাচ্ছে কোনো মতলবে এসেছ।
মতলব ছাড়া তোমার কাছে আর কখনো আসি নি?
তা এসেছ, তবে এরকম অসময়ে আস নি।
এতই যদি বোঝ, তা হলে কি মতলবে এসেছি বলতে শুনি।
ততক্ষণে নিলুফারের সেলাই-এর কাজ শেষ হয়েছে। পেটিকোটটা আলনায় রেখে এসে আগের জায়গায় বসে বলল, অনেক দিন নাযিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় নি বলে তোমার মন খারাপ। পড়াশোনা ভালো করে করতে পারছ না। তাই সময়ের কথা ভুলে আমার কাছে এসেছ মনটাকে ভালো করার জন্য।
গালিবাগত রাতে নাযিমের উপর একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে স্বপ্নের মধ্যেই কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তারপর আর ঘুমাতে পারে নি। ফজরের নামায পড়ে তার জন্য আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে অনেকক্ষণ দোয়া করেছে। নাযিমের অমঙ্গল আশঙ্কায় তখন থেকে মন খারাপ। ছোট ভাবির কাছে স্বপ্নের তাবির জানার জন্য ছোট ভাইয়া আড়তে যাওয়ার অপেক্ষায় জানালা দিয়ে তাদের ঘরের দিকে তাকিয়ে ছিল। এত সকালে তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে এসেছে। ছোট ভাবির কথা শুনে ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোমার অনুমান ঠিক। গত রাতে নাযিম ভাইয়ের উপর একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। তার তাবির জানার জন্য সময়ের কথা ভুলে তোমার কাছে এসেছি।
বেশ তো, স্বপ্নটা বল।
নাযিম ভাই জমিতে ধান রুইতেছিল। হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। কাজ শেষে ঘরে ফেরার সময় তার উপর বাজ পড়ে মারা যায়। সঙ্গে তার বাবা ছিলেন। তিনি বেঁচে যান। কথা শেষ করে গালিবা চোখে ওড়না চেপে দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল।
নিলুফার তার চোখ থেকে ওড়না সরিয়ে দিয়ে বলল, কাঁদছ কেন? স্বপ্নটা খারাপ হলেও তাবির খুব ভালো।
গালিবা চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, সত্যি বলছ? না আমাকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য বলুছ?
সত্যি বলছি। কারো মৃত্যুর স্বপ্ন দেখলে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়। তোমার স্বপ্নের তাবির হল, “অল্প সময়ের মধ্যে নাযিম ভাইয়ের আর্থিক উন্নতি হবে।” দোয়া করি আল্লাহ যেন তাই করেন। তারপর বলল, এবার নিশ্চয় মন ভালো হয়ে গেছে?
এ রকম কথা শুনলে তো মন ভালো হবেই।
মন ভালো হওয়ার আরো একটা খবর আছে।
কি কথা বল না ছোট ভাবি।
এ খববরটা শুধু মুখে বলা যাবে না, কিছু বিনিময় দিতে হবে।
খবরটা শোনার আগেই দিয়ে দিচ্ছি বলে গালিবা তার মুখ ধরে দু’গালে কয়েকটা চুমো খেয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্লাহ তোমাকে দ্বীন-দুনিয়ায় সুখী করুক। গ্রামের মানুষের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করার তওফিক দিক। এখন এর বেশি আর কিছু দিতে পারছি না। পরে মিষ্টি মুখ করাব।
নিলুফার বলল, আরে করো কি? ছাড় ছাড়।
গালিবা ছেড়ে দিয়ে বসল।
নিলুফার বলল, মিষ্টি মুখ করাতে হবে না। দোয়াটাই আমার বড় পাওয়া। তারপর আব্বার সঙ্গে নাযিমের ব্যাপারে যে সব কথা হয়েছে সে সব বলে বলল, তোমার ছোট ভাইকেও আব্বার ইচ্ছার কথা বলেছি। আরো বলেছি, নাযিমকে তার সঙ্গে রেখে ব্যবসা শেখাতে এবং বছর খানেক পরে তাকে আলাদা ব্যবসা করে দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে। তোমার ছোট ভাইয়া রাজি হয়েছে।
কথাগুলো শুনে গালিবা আনন্দে কয়েক সেকেন্ড কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। তারপর কদমবুসি করে আবার জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমাকে ভালবাস জানতাম; কিন্তু এত ভালবাস জানতাম না। মনে হচ্ছে, আমার প্রতি এ বাড়ির সবাই-এর ভালবাসা এক পাল্লায় দিয়ে অন্য পাল্লায় তোমার ভালবাসা দিলে, তোমার পাল্লাটাই ভারি হবে। তোমার ভালবাসার ঋণ জীবনে শোধ করতে পারব না। বল ছোট ভাবি, কি করলে তুমি খুশী হবে।
নিলুফার তাকে ছেড়ে দিয়ে বসতে বলল। বসার পর বলল, ইসলামী জ্ঞান অর্জন করে সেইমতো নিজের জীবন গড়ে অন্য মেয়েদের মধ্যে সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরকেও সেইভাবে গড়ার কাজ করলে এবং স্বামীর সংসার সুখের করেছ জানতে পারলে আমি খুশী হব।
গালিবা বলল, কথা দিলাম, তুমি যা-যা বললে, ইনশাআল্লাহ আমি। তা করব। তুমি দোয়া করো, আল্লাহ যেন আমাকে তোমার কথা রাখার তওফিক দেন।
Leave a Reply