সরি, রং নাম্বার – অনীশ দেব
সরি, রং নাম্বার
৷৷এক৷৷
মিমোর শর্টস-এর পকেটে রাখা মোবাইল ফোনটা হঠাৎই বাজতে শুরু করল৷ চিনিং করতে-করতে থেমে গেল মিমো৷ মাথার ওপরের রডটা ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল মেঝেতে৷ জিমের ফ্লোরে ভালকানাইজড রাবারের ফ্লোর ম্যাট, তার ওপরে সবুজ রঙের জুট কার্পেট৷ তাই কোনও শব্দ হল না৷
নিশ্চয়ই মা ফোন করেছে৷ পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করতে-করতে ভাবল মিমো৷ কারণ, ওর মা একটুতেই উতলা হয়৷ সবসময় টেনশানে ভোগে৷ তাই ইনকামিং কলের নম্বরের দিকে না তাকিয়েই ফোনটা কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো’ বলল৷ এবং তখনই বুঝল, মা ফোন করেনি৷ তার বদলে অন্য একটা মেয়ের গলা৷
আজ জিমে মেম্বাররা বেশি আসেনি৷ অবশ্য শীতকালে এমনিতেই লোক কম হয়৷ এখন ‘শীতকাল’ চলে গেলেও শীতটা যেন পুরোপুরি যায়নি৷ ভোরের দিকে বেশ ঠান্ডা থাকে৷ তাই সাতসকালে জিমে এসে ব্যায়াম করার উৎসাহ বেশির ভাগেরই নেই৷ কিন্তু মিমোর ওসব ব্যাপার নেই৷ জিমে ভোরবেলা এসে শরীরটাকে তনদুরস্ত করা ওর নেশা৷ প্রায় বছরখানেক হল ও নিয়মিত এই জিমে আসছে৷
জিমের নাম শক্তি সংঘ জিমনাশিয়াম৷ ব্যায়ামের এই ক্লাবটার তদারকি অনেকে মিলে করলেও আসল লোক হল বিশ্বজিৎদা—বিশ্বজিৎ সাহা৷ যেমন সাহেবদের মতো টকটকে ফরসা গায়ের রং তেমনই আর্নল্ড সোয়ার্ৎজেনেগারের মতো বডি৷ জিমে প্রথমদিন ভরতি হতে এসে বিশ্বজিৎদাকে দেখেই ভরসা পেয়েছিল মিমো৷ ওর মনে হয়েছিল, এই জিমটায় ঢুকলে ওর বডির সত্যি কিছু হবে৷
আজ হালকা ওয়ার্ম-আপের পর মিমো চিনিং করছিল৷ স্লিভলেস গায়ে হলদে রঙের ওর বামচাম গেঞ্জি আর পায়ে কালো শর্টস৷ দু-হাতে কালো চামড়ার হাফ-দস্তানা৷ কবজিতে কালো রিস্টব্যান্ড৷
মাথার ওপরের রডটাকে আঁকড়ে ধরে ও নিজের শরীরটাকে ধীরে-ধীরে টেনে ওপরে তুলছিল৷ আবার একইভাবে শরীরটা নামিয়ে ঝুলে পড়ছিল৷
এই ব্যায়ামটায় অসম্ভব শক্তি খরচ হয়৷ কয়েকবার শরীরটা ওঠানামা করালেই হাঁপ ধরে যায়৷ কিন্তু মিমো মনে-মনে জেদ ধরে ছিল৷ আজ ও চিনিংটা সাতবার করবেই৷
জিমের ঘরটা প্রায় বিশ ফুট বাই তিরিশ ফুট৷ ঘরের সব দেওয়ালে সুন্দর করে আয়না বসানো৷ যেন হঠাৎ করে মনে হয় আয়নামহল৷ সেই সব আয়নার ফাঁকে-ফাঁকে কাচের শার্সি দেওয়া স্টিল উইন্ডো৷ সব আয়নাগুলোই জানলার মাথা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে৷ তার ওপরে দেওয়ালে পৃথিবীর বিখ্যাত সব ব্যায়ামবীরের রঙিন ছবি সার দিয়ে টাঙানো৷ তারই মাঝে এক জায়গায় লাগানো একটা বড় মাপের ইলেকট্রনিক দেওয়াল-ঘড়ি৷
জিমের ঘরে ডিভিডি প্লেয়ারে হিমেশ রেশমিয়ার গান বাজছিল৷ ব্যায়াম করার সময় সবসময়েই কোনও গান কিংবা মিউজিক বাজানো হয়৷ এতে নাকি ব্যায়ামের রিদম ঠিক থাকে৷ বিশ্বজিৎদা বলেছেন৷
মিমো ফোনে ‘হ্যালো’ বলতেই প্রথমে একটু কড়কড় শব্দ ভেসে এল৷ তারপরই শোনা গেল একটি মেয়ের উদভ্রান্ত স্বর : ‘কে, বাপি? আমি পিয়া বলছি—৷’
‘বাপি?’ অবাক হয়ে মিমো বলল, ‘সরি, রং নাম্বার…৷’
কথাটা বলেই ও লাইন কেটে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু মেয়েটা বিপর্যস্ত গলায় বলে উঠল, ‘লাইন কাটবেন না, প্লিজ৷ আপনি কে বলছেন? চট করে বলুন—৷’
মিমো একটু বিরক্ত হল৷ সাতসকালে ও মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে বেরোয় শুধুমাত্র মায়ের জন্য৷ কারণ, ওর কোনও বন্ধুবান্ধবই এ সময়ে ফোন-টোন করে না৷ আর এই উটকো মেয়েটা অসময়ে ফোন করে ওকেই জিগ্যেস করছে, ‘আপনি কে বলছেন?’ অদ্ভুত তো!
‘আপনি ফোন করেছেন, আপনি বলুন আপনি কে বলছেন৷ হঠাৎ এই অড টাইমে ফোন করে আমাকে ডিসটার্ব করছেন কেন?’ রুক্ষ গলায় বলে উঠল মিমো৷
‘প্লিজ—প্লিজ৷ আমার হাতে সময় নেই৷ আপনি একটু পুলিশে খবর দিন…প্লিজ…৷’
ডিভিডি প্লেয়ারের আওয়াজের জন্য কথাগুলো শুনতে মিমোর বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ ফোনটাকে ও এত জোরে কানে চেপে ধরেছিল যে, কান ব্যথা করছিল৷
পুলিশে খবর দেওয়ার কথাটা শুনেই মিমো চমকে উঠল৷ ব্যাপারটা মনে হল সিরিয়াস৷ কারণ, ওর কোনও বন্ধুবান্ধব এ সময়ে ফোন করে কিছুতেই এ ধরনের ইয়ারকি করবে না৷
‘আপনি কোত্থেকে বলছেন? আপনার নাম কী? পুলিশে খবর দেব কেন?’
‘আমি…আমাকে এখানে…৷’
কানেকশানটা পট করে কেটে গেল৷
মিমো বারবার ‘হ্যালো-হ্যালো’ করেও ও-প্রান্ত থেকে কোনও সাড়াশব্দ পেল না৷ তখন ও বোতাম টিপে ‘কলার আইডি’ দেখল৷ অচেনা একটা ফোন-নম্বর৷ ল্যান্ডলাইন—নম্বরটা 2573 দিয়ে শুরু৷
একটু দূরে বাবলি চিত হয়ে শুয়ে বেঞ্চ প্রেস করছিল৷ মিমো মোবাইলে কথা বলা শুরু করতেই ও ব্যায়ামটা থামিয়ে দিয়েছিল৷ নিশ্চয়ই মিমোর মা ফোন করেছে৷ বাড়িতে হয়তো কোনও ঝামেলা হয়েছে৷ হয়তো সাতসকালেই পিসিদের সঙ্গে কলতলার ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে৷ প্রায়ই এরকম হয়৷
কিন্তু মিমোর কথাবার্তা বাবলি যেটুকু শুনতে পেল তাতে বুঝল, কেসটা অন্যরকম৷ তাই ও বেঞ্চ প্রেস ছেড়ে উঠে পড়ল৷
জিমে ঢোকার বড় দরজাটার পাশেই একটা ক্যাবিনেটে ডিভিডি প্লেয়ারটা রাখা আছে৷ তার স্পিকার দুটো দুপাশের দেওয়ালে প্রায় সিলিং-এর কাছাকাছি বসানো৷ সেগুলো থেকে জোরালো আওয়াজ বেরোচ্ছিল৷ এই আওয়াজের মধ্যে কথাবার্তা বলা বেশ অসুবিধে৷ তাই বাবলি চেঁচিয়ে বলল, ‘এই পঞ্চাদা, গানটা একটু অফ করো তো—৷’
পঞ্চাদা এই মুহূর্তে জিমের কেয়ারটেকার৷ জিমের বকেয়া চাঁদার তাগাদা করা, কেউ চাঁদা দিলে তাকে বিল কেটে দেওয়া, খাওয়ার জলের ব্যবস্থা করা, ডিভিডি প্লেয়ারের সিডি পালটানো কিংবা ভলিয়ুম বাড়ানো-কমানো—সবই পঞ্চাদার দায়িত্বে৷
ডিভিডি প্লেয়ারের কাছেই একটা বড় টেবিল৷ টেবিলের একদিকে একটা শৌখিন রিভলভিং চেয়ার৷ বিশ্বজিৎদা এলে এই চেয়ারটাতেই বসেন৷ এখন সেখানে কেয়ারটেকার পঞ্চাদা বসে আছে৷
জিমে ভরতি হওয়ার সময় বিশ্বজিৎ সাহাকে দেখে যেমন মনে ভরসা হয়, কেয়ারটেকার পঞ্চাদাকে দেখলে সেই ভরসা ফরসা হয়ে যেতে পারে৷ কারণ, পঞ্চাদা টিংটিঙে রোগা, তালগাছের মতো ঢ্যাঙা৷ ওর গায়ের রং কালো, চুল খোঁচা-খোঁচা, ছানাবড়া চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা, আর গায়ে সবসময় ক্যাটক্যাটে রঙের জামা৷
এই পঞ্চাদা যখন জিমের মেম্বারদের ওপরে খবরদারি করে তখন মিমোর ভীষণ হাসি পায়৷
পঞ্চাদা চেয়ারে বডি এলিয়ে চোখ বুজে গানের তালে-তালে দোল খাচ্ছিল৷ বাবলির কথায় ওর ঘোর ভাঙল৷ তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসে হাত বাড়াল টেবিলে রাখা ডিভিডি প্লেয়ারের রিমোটের দিকে৷
গান থেমে গেল৷
মিমো অ্যাব কিং প্রো মেশিনটার কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছিল৷ বাবলি ওর কাছে এগিয়ে এসে জিগ্যেস করল, ‘কী রে, কেসটা কী? পিসিদের সঙ্গে ক্যাচাল হয়েছে?’
বাবলি উচ্চতায় মিমোর চেয়ে একটু খাটো৷ এই জিমে ও মিমোর তিনমাস আগে ভরতি হয়েছে৷ এর মধ্যেই বেশ মাসল বানিয়ে ফেলেছে৷ ওর ল্যাটতো দেখার মতো৷
বাবলির মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল৷ ফরসা কপালের একপাশে একটা কাটা দাগ৷ লেখাপড়ার চেয়ে জিম ঢের বেশি ভালোবাসে৷ আর সবসময়েই উৎসাহে টগবগ করছে৷
মিমো বাবলির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল : ‘না রে৷ কেসটা পিকিউলিয়ার৷ জানি না, কেউ মজাক করছে কি না…৷’
‘কে ফোন করেছে?’
‘জানি না৷ একটা মেয়ের গলা৷ আননোন মেয়ে—আননোন ফোন-নাম্বার…৷’
বাবলি ঠোঁটের কোণে হেসে চোখ টিপল : ‘শালা আননোন মেয়ে! বস, আমার কাছে লুকোলে কাকিমার কাছে কেস বিলা করে দেব…৷’
‘বিশ্বাস কর৷ গড ক্রস৷ মেয়েটা বলছিল পুলিশে খবর দিতে৷ তাই তো অবাক লাগছে৷’
কথাটা শুনে বাবলি চুপ করে গেল৷ চারপাশটা একবার দেখল৷ ওরা ছাড়া আরও তিনজন ব্যায়াম করছে৷ তুহিন চেন-পুলি নিয়ে ল্যাট তৈরি করছে৷ বিষাণ লেগ পুশ নিয়ে লড়ে যাচ্ছে৷ আর মাঝবয়েসি পুলিনবাবু ভুঁড়ি কমানোর জন্য টুইস্টারে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে কোমরে মোচড় দিচ্ছে আর আয়নায় নিজের ভুঁড়ির উন্নতি, কিংবা অবনতি আঁচ করার চেষ্টা করছে৷
না, মিমো আর বাবলির দিকে ওদের নজর নেই৷ তবে পঞ্চাদাটা ড্যাবডেবে চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ ভাবটা এমন, যেন চোখ দিয়েই ওদের সব কথা শুনে ফেলবে৷
বাবলি চাপা গলায় বলল, ‘চল, বাইরে চল—দেখি ফোনটা আবার আসে কিনা৷’
মিমো বাবলির কথায় সায় দিল৷ ওরা দুজনে তাড়াতাড়ি দেওয়ালের হুক থেকে জামাকাপড় নিয়ে জিমের এক কোণে চলে গেল৷ নিজেদের তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছে জলদি ড্রেস করে নিল৷ তারপর চলে এল পঞ্চাদার টেবিলের কাছে৷
টেবিলে রাখা অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার খুলে ‘আউট’ কলামে সই করে সময় লিখল মিমো৷
মিমোর পর বাবলি যখন সই করছে তখন পঞ্চাদা জিগ্যেস করল, ‘কী রে, আর ব্যায়াম করবি না? কুড়ি মিনিটেই হয়ে গেল!’
বাবলি জানে, পঞ্চাদার হেভি কৌতূহল৷ সবসময় সকলের হাঁড়ির খবরের খোঁজ করে বেড়ায়৷ ও শান্ত গলায় বলল, ‘না, মানে, শরীরটা খারাপ লাগছে—৷’
‘দুজনেরই?’ পঞ্চাদা চোখ কুঁচকে জিগ্যেস করল৷
‘হ্যাঁ, দুজনেরই৷ তোমার কোনও প্রবলেম আছে?’ মিমো বলল৷
সঙ্গে-সঙ্গে ওর মোবাইল ফোনটা আবার বাজতে শুরু করল৷
পঞ্চাদা কী যেন একটা জবাব দিচ্ছিল, কিন্তু সেদিকে মিমো আর বাবলি মন দিতে পারল না৷ ওরা তাড়াহুড়ো করে জিমের কাচের দরজার দিকে প্রায় ছুটে গেল৷ তারপর একটানে দরজা খুলে জিমের বাইরে৷ সেখানে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ বেশ কয়েকজোড়া নতুন-পুরোনো চটি৷ কারণ, জিমে খালি পায়ে ঢোকার নিয়ম, যাতে কার্পেট নোংরা না হয়৷
মিমো আর বাবলি তাড়াতাড়ি যার-যার চটিতে পা গলাতে লাগল৷ চটি পরতে-পরতেই মোবাইল ফোনের সুইচ টিপে ‘হ্যালো’ বলল মিমো৷ সিঁড়ি নামতে শুরু করল৷
আবার সেই মেয়েটির গলা৷
‘আমার নাম প্রিয়াংকা—প্রিয়াংকা মজুমদার৷ আমাকে এরা কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে৷ আটকে রেখেছে৷ শিগগির পুলিশে খবর দিন৷ প্লিজ! যে করে হোক…আমাকে…বাঁচান৷ এরা বোধহয় আমাকে মেরে ফেলবে৷ আপনি…৷’
প্রিয়াংকা ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল৷
মিমো বলল, ‘আমি এখুনি থানায় যাচ্ছি৷ আপনি ভয় পাবেন না৷ খবরটা দিলেই পুলিশ অ্যাকশান নেবে…৷’
মিমো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কড়কড় শব্দ করে টেলিফোনের লাইনটা হঠাৎ কেটে গেল৷
‘যাঃ, কেটে গেল৷’ বলে বাবলির দিকে তাকাল মিমো৷
বাবলি একরাশ কৌতূহল আর উৎকণ্ঠা নিয়ে মিমোর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ মিমো মোবাইল ফোনটা পকেটে ঢোকাতেই ও বলল, ‘কী করবি এখন? থানায় যাবি?’
‘এ ছাড়া তো আর কোনও পথ নেই—৷’
সিঁড়ি নামতে-নামতে ওরা দোতলা থেকে একতলায় চলে এল৷
একতলায় একটা মেঠো উঠোন৷ উঠোনের বাঁদিকে কলতলা৷ সেখানে বালতি, কলসি, হাঁড়ির লাইন লেগেছে৷ সেগুলো ঘিরে তাদের মালিকরা দাঁড়িয়ে৷ আর ডানদিকে একটা বড় ঘরে ছোট-ছোট বাচ্চাদের কিন্ডারগার্টেন স্কুল চলছে৷ তার লাগোয়া একটা সিমেন্ট বাঁধানো স্টেজ৷ সেখানে মাঝে-মাঝে জিমের অনুষ্ঠান হয়৷ আবার কখনও-বা কোনও ফাংশানের জন্য অল্প টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়৷
মিমো আর বাবলি কথা বলতে-বলতে উঠোন পেরিয়ে গেল৷
উঠোনের পরই একটা গ্রিলের গেট৷ গেট পেরোলেই বাইরে যাওয়ার পথ—সিমেন্ট বাঁধানো একটা সরু গলি—এঁকেবেঁকে চলে গেছে চওড়া রাস্তার দিকে৷
মিমোকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে বাবলি ব্যাপারটা বুঝতে চাইছিল৷ প্রিয়াংকা নিজের নাম বলেছে বটে কিন্তু কোথায় থাকে সেটা বলেনি৷ তা ছাড়া ‘এরা’ মানে কারা? প্রিয়াংকাকে ওরা কোথায়ই-বা আটকে রেখেছে? ওকে কিডন্যাপ করেছে কেন? মুক্তিপণের জন্য?
বাবলি হঠাৎ বলল, ‘অ্যাই, তুই এক্ষুনি মেয়েটার নাম্বারে ফোন করে দেখ তো—৷’
মিমোরও এই কথাটা মনে হচ্ছিল৷ একবার ফোন করে দেখলে তো হয়! মেয়েটা কেন বারবার লাইন কেটে দিচ্ছে সেটা অন্তত বোঝা যাবে৷
ইনকামিং কলের লিস্ট দেখে সেই নম্বরটায় ফোন করল মিমো৷
কয়েক সেকেন্ড পরেই ও-প্রান্তে রিং বাজতে শুরু করল৷ বাজছে তো বাজছেই৷ কেউ ফোন ধরছে না৷
বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও কোনও লাভ হল না৷ শুধু রিং বেজেই গেল৷
মিমো কপালে ভাঁজ ফেলে বাবলিকে বলল, ‘কেসটা কিছু বুঝতে পারছি না৷ কেউ ফোন ধরছে না…৷’
ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে মনে হল বাবলির৷ ফোন করলে ফোন ধরছে না, অথচ মাঝে-মাঝে মিমোর মোবাইলে ফোন করছে!
কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ মিমোর মোবাইলে ফোন করল কেন? ওর ফোন-নম্বর পেল কোথায়? আর কথা বলতে-বলতে হুট-হাট করে লাইনই-বা কেটে দিচ্ছে কেন?
এসব কথা আলোচনা করতে-করতে ওরা দুজনে গলি ধরে এগোচ্ছিল৷ বাবলি গালে হাত বোলাতে-বোলাতে বলল, ‘মিমো, এক্ষুনি একটা কাগজ আর পেন জোগাড় করি চল৷ প্রিয়াংকা আবার যদি ফোন করে তা হলে ওর কাছ থেকে কী-কী জানতে চাইব তার একটা লিস্ট করে ফেলি৷ তারপর ও যা-যা জবাব দেবে সেগুলো চটপট টুকে নেব৷ কারণ, বস, থানায় গিয়ে তোমাকে তো কিছু সলিড খবর দিতে হবে৷ তা না পারলে পুলিশ হয়তো আমাদেরই ভেতরে ভরে দেবে—৷’
কথাটা মিমোর মনে ধরল৷ কারণ, ল্যান্ডলাইনের ওই একটা নম্বর আর প্রিয়াংকার নাম ছাড়া আর কিছুই ওরা জানে না৷
ও এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে একটা ছোট্ট স্টেশনারি দোকান দেখতে পেল৷ দোকানটার একপাশে মাদার ডেয়ারির দুধের ট্যাঙ্ক৷ মালিক লুঙ্গি পরে উবু হয়ে বসে ট্যাঙ্কের কল খুলে পাবলিককে দুধ বিক্রি করছে৷ দোকানের বাকি অংশে ছোট কাউন্টার—সেখানে লজেন্স-বিস্কুট বোতলে সাজানো৷
মিমো পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করল৷ দোকানদারের কাছে গিয়ে বলল, ‘একটা সাদা কাগজ আর পেন দিন তো৷ কুইক!’
দোকানদার অবাক চোখে মিমো আর বাবলিকে দেখল৷ সাত-সকালে ছেলেদুটোর এত তাড়া কীসের!
এমন সময় মিমোর মোবাইল আবার বাজতে শুরু করল৷
ফোন ধরতে-ধরতেই মিমো দোকানদারকে ইশারায় তাড়া দিল৷
বাবলি দুধের খদ্দেরদের শুনিয়ে মন্তব্য ছুড়ে দিল, ‘জলদি করুন! এমার্জেন্সি৷ পুলিশ কেস—৷’
‘পুলিশ’ শব্দটা ম্যাজিকের মতো কাজ করল৷ দোকানদার ভদ্রলোক লুঙ্গি সামলে চট করে উঠে দাঁড়াল৷ লজেন্স-বিস্কুটের বোতলের ওপর ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে দিল কাউন্টারের ওপারে৷ একটু পরেই দিস্তে কাগজের একটা শিট আর একটা নীল রঙের বল পয়েন্ট পেন বাবলির হাতে তুলে দিল৷ বলল, ‘সাড়ে চার টাকা৷’
মিমো তখন ফোনে কথা বলছে৷ পাঁচ টাকার কয়েনটা ও দোকানদারের হাতে দিয়েই বাবলিকে লিখে নেওয়ার জন্য ইশারা করল৷ বাবলি পঞ্চাশ পয়সা ফেরত নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে লেখার সুবিধের জন্য একটা জুতসই জায়গা খুঁজতে লাগল৷ এবং পেয়েও গেল৷ সামনেই একটা ছোট মন্দিরের চাতাল৷ তার একপাশ দিয়ে একটা বটগাছ ওপরে উঠে গেছে৷
মিমোকে জামা ধরে টান মারল বাবলি৷ পা চালিয়ে চাতালের কাছে গিয়ে বসে পড়ল৷ পেন বাগিয়ে ধরল কাগজের ওপর৷ মিমোর দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘মেয়েটা যা-যা বলবে জোরে জোরে সেগুলো বলবি—যাতে আমি টুকে নিতে পারি…৷’
মিমো তখন টেলিফোনে বলছে, ‘আপনি কোথায় থাকেন? বাড়ির অ্যাড্রেসটা বলুন…৷’
৷৷দুই৷৷
বেনেবউ পাখিটাকে অনেক দূর থেকে দেখতে পেল প্রিয়াংকা৷ ভোরের আলো এসে পড়েছে পাখিটার গায়ে৷ হলুদ রং ঝকঝক করছে৷ কালো কুচকুচে মাথা৷ ডানার শেষদিকটা মাথার মতোই কালো৷
বাইনোকুলার চোখে দিল প্রিয়াংকা৷ ওঃ, দারুণ! মনে হচ্ছে, পাখিটা হাতের নাগালে এসে গেছে৷ এইবার একটা ফটো তোলা দরকার৷ সুতরাং বাইনোকুলার ছেড়ে হ্যান্ডিক্যাম তাক করল ও৷ ‘জুম’ মোডে গিয়ে চট করে বেনেবউটার ছবি ক্যামেরাবন্দি করে নিল৷
প্রিয়াংকা ওর ছোটভাই সোনমকে নিয়ে প্রতিদিন ভোরবেলা ময়দানে আসে৷ সোনম খেলা করে, ছুটোছুটি করে৷ আর প্রিয়াংকা জগিং৷ সেইসঙ্গে আছে ওর পাখির নেশা৷ ও পাগলের মতো পাখি দেখে বেড়ায়, পাখি খুঁজে বেড়ায়৷ তখন ওর গলায় ঝোলে বাইনোকুলার, আর হাতে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা থাকে সনি হ্যান্ডিক্যাম৷ এই বাইনোকুলার আর ভিডিয়ো ক্যামেরা—দুটোই এসেছে আমেরিকা থেকে৷ ওর ছোটকাকু ওকে প্রেজেন্ট করেছে৷
প্রিয়াংকা ঘড়ি দেখল৷ ছ’টা প্রায় বাজে৷ মাথার ওপরে ঘোলাটে আকাশ৷ গাছের পাতায়-পাতায় শিশিরের ফোঁটা৷ শীত চলে গেলেও ভোরবেলায় তার ছোঁয়া ভালোই রয়ে গেছে৷ সেইজন্য প্রিয়াংকা সোয়েট কাপড়ের একটা হলদে ফুলহাতা টপ আর জিনস পরে এসেছে৷
মাথা তুলে চারপাশের গাছগুলোর দিকে তাকাল৷ ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া বিশাল সব গাছ৷ একটা অশ্বত্থ বলে চিনতে পারল—বাকিগুলোর নাম ও জানে না৷ সবুজ পাতার ঘন ভিড়ের মধ্যে ও পাখির নড়াচড়া খুঁজতে লাগল৷ পাখিগুলো যদি নড়াচড়া না করে চুপটি করে পাতার ফাঁকে বসে থাকত তা হলে ওদের খুঁজে বের করাই মুশকিল হত৷
কখনও খালি চোখে কখনও বাইনোকুলার চোখে দিয়ে পাখির খোঁজ করে চলল প্রিয়াংকা৷ একবার চোখ ফিরিয়ে তাকাল দূরের মাঠের দিকে৷ সেখানে আট-দশজন ছেলে ব্যাট-বল নিয়ে ক্রিকেট খেলছে৷ তার মধ্যে সোনমও আছে৷ বাইনোকুলার চোখে দিয়ে সোনমের মুখটাকে খুঁজে বের করল ও৷ ফুটফুটে স্পষ্ট মুখ৷ ক্রিকেট খেলার উৎসাহে টগবগ করছে৷ খেলতে-খেলতে গা গরম হওয়ায় হাফ-হাতা সোয়েটারটা এখন খুলে রেখেছে৷
হঠাৎই কথাবার্তার শব্দ কানে এল৷ কারা যেন কাছেই কোথাও কথা বলছে৷
প্রিয়াংকা অবাক হয়ে গেল৷
পাখির খোঁজে ও যেদিকটায় এসেছে সেখানে শুধুই বড়-বড় গাছ, আর আশেপাশে কিছু খাটো ঝোপ৷ লোকজনের ভিড় এখানে নেই৷ খেলাধুলো করা ছেলেরা বা ভোরবেলা ময়দানে পায়চারি করতে আসা মানুষজনের ভিড় ওই মাঠের দিকে৷ তা হলে এখানে কথা বলছে কারা?
কথাগুলো যেদিক থেকে আসছে বলে মনে হল অনুমানে সেদিকে কিছুটা এগিয়ে গেল প্রিয়াংকা৷ ওর সামনে দুটি বিশাল গাছের গুঁড়ি আর একমানুষ সমান আগাছার ঝোপ৷ তার আড়ালে দাঁড়িয়ে ও কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেল৷
‘হিরেগুলো এখন কোথায়?’ শক্ত গলায় কেউ জানতে চাইল৷
‘আ-আমি জানি না৷ বিশ্বাস করুন, আ-আমি জানি না৷’ কাতর অনুনয়ের সুর৷
‘এবার মনে পড়েছে?’
ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি মারল প্রিয়াংকা৷ এবং যা দেখল তাতে ওর মুখ থেকে হেঁচকি তোলার মতো শব্দ বেরিয়ে আসতে চাইছিল৷ কোনওরকমে মুখে হাত চাপা দিয়ে ও শব্দটাকে আটকাল৷ বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল, পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করল—ধক-ধক-ধক-ধক৷
প্রিয়াংকার মাথার ভেতরে সবকিছু যেন গোলমাল হয়ে যেতে চাইল৷ সামনে এ কী দৃশ্য দেখছে ও!
ঝোপের কাছ থেকে হাত-দশেক দূরে তিনজন মাঝবয়েসি মানুষ৷ একজন প্রিয়াংকার দিকে পিছন ফিরে মাঠের ওপরে হাঁটুগেড়ে বসে আছে৷ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুজন৷ তাদের মধ্যে একজন একটা মোটা নল লাগানো রিভলভার হাঁটুগেড়ে বসে থাকা লোকটির মাথার একপাশে ঠেকিয়ে রেখেছে৷ দেখে প্রিয়াংকা বুঝতে পারল, রিভলভারটা সাইলেন্সার লাগানো৷ কারণ, সিনেমায় ও এরকম হ্যান্ডগান অনেক দেখেছে৷
অন্য লোকটি কোমরে হাত দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল৷ তার ময়াল সাপের মতো ঠান্ডা চোখ হাঁটুগেড়ে বসে থাকা লোকটির দিকে স্থির৷
রিভলভার-হাতে লোকটা আবার প্রশ্ন করল, ‘এবার মনে পড়েছে, হিরেগুলো কোথায় আছে?’
হাঁটুগেড়ে বসে থাকা লোকটি ভিক্ষা চাওয়ার ভঙ্গিতে আঙুলে আঙুল জড়িয়ে দু-হাত মুঠো করে মাথা নামিয়ে প্রণামের ভঙ্গি করল৷ এপাশ-ওপাশ মাথা ঝাঁকিয়ে কান্না-ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি জানি না—আমি জানি না৷’
প্রিয়াংকার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল৷ ও কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না৷ এখানে দাঁড়িয়েই ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে চিৎকার করবে? নাকি এই মুহূর্তে সোনমদের মাঠের দিকে ছুট লাগাবে?
কিন্তু ওই লোকটা যদি গুলি চালায়?
প্রিয়াংকার জিভটা যেন নারকোল-দড়ির তৈরি পাপোশ—খড়খড়ে, শুকনো৷ ওর গলা দিয়ে কি এখন কোনও চিৎকার বেরোনো সম্ভব?
হঠাৎই প্রিয়াংকার মনে পড়ে গেল হ্যান্ডিক্যামটার কথা৷ অসাড় হাতে ওটা যে এখনও ধরা আছে সেটা ওর মনেই ছিল না৷
সুতরাং কাঁপা হাতে ভিডিয়ো ক্যামেরাটা তুলে ধরল৷ ঝোপের আড়াল থেকে সামনের লোকগুলোকে তাক করে ক্যামেরা চালু করে দিল৷ ওর কান ভোঁ-ভোঁ করছিল, ঢোঁক গিলতে গলা ব্যথা করছিল, পা দুটোও মনে হয় কাঁপছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর ক্যামেরা চলতে লাগল, ছবি উঠতে লাগল৷
পাঁচ-দশ সেকেন্ড কেটে যাওয়ার পর প্রিয়াংকা খানিকটা সুস্থির হল৷ ওর মধ্যে যেন ‘ফটোগ্রাফার’ প্রিয়াংকা জেগে উঠল৷ ছবি তুলতে-তুলতে লোকগুলোকে ও খুঁটিয়ে দেখতে লাগল৷
কোমরে হাত দিয়ে যে-লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সে-ই মনে হয় আসল লোক৷
লোকটার রং ফরসা৷ মাথায় টাক৷ জংলা ভুরু চোখে চশমা৷ পুরু গোঁফ৷ বেশ মোটাসোটা চেহারা৷ একটা মাঝারি মাপের মানানসই ভুঁড়ি কোমরের ওপরে উপচে পড়ছে৷
লোকটার গায়ে নীল-সাদা ট্র্যাকসুট৷ গলায় ঝুলছে ফিতেয় বাঁধা মোবাইল ফোন৷
যে-লোকটা শত্রুর মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে রেখেছে সে তুলনায় বেশ রোগা৷ তবে চোয়াল, কাঁধ, চওড়া কবজি আর হাতের শিরা দেখে বোঝা যায় তার শক্তি মোটেও কম নয়৷ আর মুখে বেশ একটা পোড়-খাওয়া ভাব৷ যেন এরকম দৃশ্য তার কাছে জলভাত৷
লোকটার গায়ে ঘিয়ে রঙের হাফহাতা টি-শার্ট৷ তার ওপরে একটা কালো রঙের বুকখোলা স্লিভলেস জ্যাকেট৷ পায়ে বাদামি রঙের কটন প্যান্ট৷ বাঁ-হাতের কবজিতে স্টিল ব্যান্ড লাগানো রিস্টওয়াচ, আর ডানহাতের মধ্যমায় একটা স্টিলের আংটি৷
লোকটার গায়ের রং তামাটে৷ মাথায় কাঁচা-পাকা কোঁকড়ানো চুল৷ চোখজোড়া মুখের তুলনায় বেশ বড় মাপের৷ বাঁ-গালে একটা ছোট জড়াল মতন রয়েছে৷
হাঁটুগেড়ে বসে থাকা লোকটার মাথায় কাঁচাপাকা চুল—তবে পাকার ভাগটাই বেশি৷ চেহারা মোটার দিকে৷ গায়ে গাঢ় নীল রঙের পোলো নেক টি-শার্ট, কোমরে কালো চামড়ার বেল্ট, তার নীচে ছাই রঙের ঢোলা প্যান্ট৷
প্রিয়াংকার দিকে পিছন ফিরে থাকায় ও মুখটা দেখতে পাচ্ছিল না৷ শুধু লোকটার ঘাড়ের কাছে, চুল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে দুটো চর্বির থাক আর একটা ভারী সোনার চেন ওর নজর টানছিল৷
লোকটার ‘আমি জানি না’ উত্তর শোনার পর রিভলভারওয়ালা চাপা গলায় হাসল৷ বলল, ‘তা হলে আর কী! কাম তামাম৷ খাল্লাস!’
রিভলভারের সেফটি ক্যাচ খোলার ‘ক্লিক’ শব্দ হল৷
সঙ্গে-সঙ্গে অসহায় লোকটা কঁকিয়ে উঠল, ‘বলছি, বলছি—প্লিজ, প্লিজ…৷’
রিভলভার-হাতে লোকটা ঠোঁট বেঁকিয়ে একবার হাসল৷ তারপর পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসল যার অর্থ হল : ‘দেখলেন তো, কীভাবে মুখ খোলাতে হয়!’
হাঁটুগেড়ে বসে থাকা লোকটা দু-হাত জোড় করে কান্নায় হাঁউমাঁউ করতে-করতে জড়ানো গলায় বলল, ‘আমার বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলে—একটা কোল্ড ক্রিমের কৌটোর ভেতরে হিরেগুলো আছে— সাতটা—ক্রিমের ভেতরে লুকোনো আছে…৷’
লোকটার কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই একটা চাপা ‘ফট’ শব্দ হল৷ পিচবোর্ডের দেওয়ালে একটা ছোট্ট ঢিল ছুড়ে মারলে যেরকম শব্দ হয়৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে নীল টি-শার্ট পরা মোটা লোকটা ঢলে পড়ল মাটিতে৷ ওর দেহটা কেমন যেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভাঁজ হয়ে ঘাসের ওপরে পড়ে রইল৷ মাথাটা বাঁ-দিকে কাত হয়ে থাকায় কপালের ডানপাশের ছোট কালো ফুটোটা প্রিয়াংকা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল৷
সামনাসামনি এই খুনের দৃশ্যটা দেখে প্রিয়াংকা একটা বিশাল ধাক্কা খেল৷ ওর গোটা শরীরটা কাঁপতে লাগল৷ ওর অজান্তেই মুখ দিয়ে একটা চাপা শব্দের টুকরো বেরিয়ে এল৷
লোকদুটো চকিতে শব্দ লক্ষ করে চোখ ফেরাল৷ তারপর দৌড়ে এগিয়ে আসতে লাগল আগাছার ঝোপের দিকে৷
প্রিয়াংকা আর দেরি করল না৷ ঘুরে দাঁড়িয়েই ছুট লাগাল সোনমদের খেলার মাঠের দিকে৷ আর একইসঙ্গে ‘সোনম! সোনম!’ করে পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগল৷
লোকদুটো আগাছার ঝোপ হাতে ঠেলে একপাশে সরিয়ে তার ফাঁক দিয়ে ছুটন্ত প্রিয়াংকাকে দেখতে লাগল৷
রোগা লোকটা রিভলভারটা জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে চালান করে দিল৷ তারপর মোটা সঙ্গীর দিকে না তাকিয়েই বিড়বিড় করে বলল, ‘মেয়েটার হাতে একটা হ্যান্ডিক্যাম আছে খেয়াল করেছেন?’
‘করেছি—৷’
‘নিশ্চয়ই আমাদের অপারেশানের ছবি তুলেছে৷ নাঃ, মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না৷’
‘তার চেয়েও জরুরি ওই হ্যান্ডিক্যামের মাইক্রো-ক্যাসেটটা৷ যেভাবে হোক ওটা আমাদের চাই-ই চাই৷ ওটা হাতে পেলে আর কোনও ভয় নেই৷ বাকি সব আমি ম্যানেজ করে নেব৷ তখন মেয়েটা কোর্টে হাজার চেঁচালেও কিছু লাভ হবে না৷ কোর্ট প্রমাণ চায়, প্রমাণ৷’
স্লিভলেস জ্যাকেট পরা লোকটা ঠোঁটের কোণে হাসল : ‘তখন ওই ছামিয়া বাঁচুক কি মরুক কিছু যায় আসে না—৷’
‘উঁহু—’ মাথা নাড়ল ট্র্যাকসুট পরা লোকটা : ‘কোনও রিসক নেওয়ার দরকার নেই৷ আগে মাইক্রো-ক্যাসেট হাতাও, তারপর মেয়েটাকে ওড়াও…৷’
‘কিন্তু মেয়েটার ডিটেইলস তো জানতে হবে৷ কী নাম, কোথায় থাকে…বাড়িতে আর কে-কে আছে…নইলে ওর খোঁজ পাব কী করে?’
‘ইজি—’ এবার ট্র্যাকসুটের বাঁকা হাসির পালা : ‘এখন থেকেই তোমার কাজ শুরু করে দাও৷ ফলো হার—৷’
ঝোপের আড়াল থেকে ওরা দেখতে পাচ্ছিল, প্রিয়াংকা সোনমকে ব্যস্তভাবে কী বলতে-বলতে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ আর ছোট ছেলেটা ওর খেলার কিটব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে একটা স্লিভলেস সোয়েটার হাতে মেয়েটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করছে৷
ওদের কয়েক সেকেন্ড লক্ষ করার পরই লোকদুটো বুঝতে পারল, প্রিয়াংকা আর সোনম মাঠ পেরিয়ে পিচের রাস্তার দিকে এগোচ্ছে৷ আর সেখানে রাস্তার ধার ঘেঁষে পার্ক করা রয়েছে মেরুন রঙের একটা মারুতি অলটো৷
মোটা লোকটা চাপা শিস দিয়ে উঠল, বলল, ‘থ্যাংক গড! মেয়েটা মনে হয় ওই মেরুন গাড়িটায় উঠবে৷ কুইক—ওদের গাড়ির নম্বরটা আমাদের দরকার৷ তারপর রুটিন এনকোয়ারি—দু-তিনদিনেই সব খবর বেরিয়ে পড়বে৷ শিগগির চলো—৷’
ঝোপ থেকে হাত সরিয়ে নিল মোটা লোকটা৷ তারপর দুজনে পা চালাল নিজেদের গাড়ির দিকে৷ যাওয়ার সময় রোগা লোকটা ঘাসের ওপরে পড়ে থাকা অসাড় মৃতদেহটা একলাফে টপকে গেল৷
চারপাশে ভোরের আমেজ তখনও ছড়িয়ে আছে৷ তবে মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্য এখন উঁকি মেরেছে৷ বড়-বড় গাছের পাতার আড়াল থেকে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে৷ গাছগাছালির কাছ থেকে কিছুটা দূরে খোলা জায়গায় ঘাসের শিষ ছন্নছাড়াভাবে গজিয়ে উঠেছে৷ সেই শিষের ওপরে ছোট-ছোট হিমের ফোঁটা৷ সকালের মিষ্টি আলো পড়ে চিকচিক করছে৷
এদিকটায় কোনও লোকজন নেই৷ যত ভিড় খেলার মাঠের দিকে৷ সেই কারণেই হিরেগুলো নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য ওরা দুজনে এই জায়গাটা বেছে নিয়েছিল৷ ট্র্যাকসুট পরা মোটা লোকটা রোজ ভোরে ময়দানে মর্নিং ওয়াক করতে আসে৷ সে জানে, এখনও অন্তত ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এই ডেডবডিটা কারও নজরে পড়বে না৷ শুধু ওই জিনস পরা মেয়েটা ব্যাপারটা আচমকা দেখে ফেলেছে, তাই৷ এখন চটপট গাড়িতে উঠে ওই মেরুন অলটোটাকে ধরতে হবে৷ ওটার নম্বর নিতে হবে৷
কিছুটা দূরে মাঠের ওপরে ওদের রুপোলি স্যান্ট্রো গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল৷ ওরা দুজনে আরও জোরে পা চালাল সেই গাড়ির দিকে৷
ভেজা ঘাস মাড়িয়ে যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকাল ট্র্যাকসুট৷ মৃতদেহটার পাশে তিনটে কাক এসে বসেছে৷ ডাকাডাকি করছে৷
৷৷তিন৷৷
মিমোর কথা শুনে-শুনে বাবলি প্রিয়াংকার ঠিকানাটা লিখে নিল৷
ঠিকানা জানার পর মিমো ওকে বলল, ‘আমরা এক্ষুনি থানায় যাচ্ছি৷ আপনার ফোন-নাম্বারটাও পুলিশকে দিচ্ছি৷ ওরা যদি আপনাকে কনট্যাক্ট করতে চায় তা হলে…৷’
প্রিয়াংকা উদভ্রান্তের মতো বলল, ‘কোনও লাভ নেই৷ আমার মোবাইল ওরা কেড়ে নিয়েছে৷ আমি ওদের একটা ভাঙা টেলিফোন থেকে ফোন করছি৷ আপনি বরং আমার বাবার মোবাইল নাম্বারটা লিখে…৷’
যাঃ, লাইনটা আবার কেটে গেল! বিরক্তির একটা শব্দ করে মিমো নিজের ঊরুতে একটা থাপ্পড় মারল৷
বাবলি জিগ্যেস করল, ‘কী হল?’
‘সেই এক কেস—লাইন কেটে গেল৷ চল, আমরা বরং থানায় যাই—৷’
‘কোন থানায় যাবি?’
‘কেন, মানিকতলা থানায়৷ আমাদের বাড়ি তো ওই এরিয়ায়৷’
মিমো আর বাবলি চটপট পা চালাল৷ এখান থেকে মিমোদের বাড়ি অন্তত আট-দশ মিনিটের হাঁটা পথ৷
মিমো মোবাইল ফোনটা হাতে ধরে রেখেছিল৷ ভাবছিল, এই বোধহয় প্রিয়াংকার ফোন আসবে৷
ওরা গলির নানান প্যাঁচ পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ল৷ সামনেই অরবিন্দ সেতু—সমতল রাস্তা ধীরে-ধীরে উঁচু হয়ে গেছে৷ অটো, বাস কিংবা গাড়ির সংখ্যা এখনও তেমন বাড়েনি৷ আর ঘণ্টাখানেক পরই এই রাস্তাটা ব্যস্ততায় উপচে পড়বে৷
খাল পেরিয়ে ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গায় এসে নীচে নামার সিঁড়ি ধরল ওরা৷ এখানে নেমে খালধারের রাস্তা বরাবর মিনিটদশেক হেঁটে গেলে মানিকতলা থানা৷ সেখানে একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে মিমোর সামান্য পরিচয় আছে৷ ভদ্রলোক কী পোস্টে চাকরি করেন মিমো জানে না৷ তবে মাসদুয়েক আগে অরবিন্দু সেতুর পশ্চিম প্রান্তে—মিমোদের বাড়ির কাছাকাছি—একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল৷ বলতে গেলে মিমোর চোখের সামনেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল৷ তারপর পুলিশ যখন স্পটে আসে তখন সেই অফিসার মিমোর এজাহার নিয়েছিলেন৷ মিমোর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথাও বলেছিলেন৷ এর পরে জিপে করে মিমোদের পাড়া দিয়ে যাতায়াতের সময় ওঁর সঙ্গে মিমোর কয়েকবার দেখা হয়েছে৷ দুবার তো তিনিই গাড়ি থামিয়ে কথা বলেছেন৷ কিন্তু ওঁর নামটা মিমোর জানা নেই৷ কে জানে, এখন ওঁকে থানায় পাওয়া যাবে কি না৷
ও আর বাবলি যখন থানার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে তখন মিমোর মোবাইল বেজে উঠল৷ ও তাড়াতাড়ি ফোনের উইন্ডোর দিকে তাকাল৷ না, প্রিয়াংকার নয়, মায়ের ফোন৷
ফোন ধরতেই মায়ের একরাশ কথা৷ জিমে এতক্ষণ লাগছে কেন? ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট খেয়ে পড়তে বসবি কখন? আর তো দু-সপ্তাহ পরেই পরীক্ষা—সে-খেয়াল আছে!
মায়ের কথার তোড়ের মুখে মিমো প্রিয়াংকা কিংবা পুলিশের কথা মাকে বলতে ভরসা পেল না৷ বললেই মা হয়তো ছুটে চলে আসবে মানিকতলা থানায়৷ তারপর দুনিয়া মাথায় করে ছাড়বে৷
মিমো জানে, বিশ্বজিৎদাকে মা বেশ পছন্দ করে, ভরসাও করে৷ জিমে মিমোকে ভরতি করার সময় মা এসেছিল, বিশ্বজিৎদার সঙ্গে আলাপও হয়েছিল৷ তা ছাড়া মিমোকে জুনিয়ার বডি-শো কম্পিটিশানে নানান জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিশ্বজিৎদা বেশ কয়েকবার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে৷
সুতরাং মায়ের কাছে জবাবদিহি করার এই বিপদের সময় মিমো বিশ্বজিৎদাকেই মনে-মনে আঁকড়ে ধরল এবং টেলিফোনে বলে বসল, ‘একটা বডি-শো কম্পিটিশানের ব্যাপারে আমরা বিশ্বজিৎদার সঙ্গে ডিসকাস করছি৷ চিন্তা কোরো না—আধঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি ফিরব৷’
বাবলি জিগ্যেস করল, ‘কে?’
মিমো ক্লান্ত গলায় বলল, ‘মা—আর কে!’
ততক্ষণে ওরা থানায় ঢুকে পড়েছে৷ সামনে চওড়া করিডরের একপাশে একটা লম্বা বেঞ্চি পাতা রয়েছে৷ সেখানে বসে আছে একজন কনস্টেবল৷
একটু এগিয়েই ডানদিকে লোহার দরজা লাগানো হাজতঘর৷ ভেতরে একটা লোক গারদ ধরে দাঁড়িয়ে৷ তার আর-একজন সঙ্গী দূরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে উবু হয়ে বসে আছে৷
অকারণেই মিমোর ভয়-ভয় করতে লাগল৷ এর আগে কখনও ও থানায় আসেনি৷
বাঁ-দিকে তাকাল মিমো৷ সাদা য়ুনিফর্ম পরা একজন অফিসার চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে আছেন৷ টেবিলে দুটো বড়-বড় খাতা, খাতার পাশে একটা বলপয়েন্ট পেন, আর একটা টেলিফোন৷ ইনিই বোধহয় ডিউটি অফিসার—ডায়েরি-টায়েরি লেখেন৷
মিমো আর বাবলি ওঁর কাছে এগিয়ে গেল৷ মিমো বারবার ভাবছিল, ইস, ওর সেই চেনা অফিসার থাকলে কত ভালো হত৷ কে জানে, তিনি হয়তো এর মধ্যে অন্য কোনও থানায় বদলি হয়ে গেছেন৷ সেই চেনা মানুষটার খোঁজে ও এপাশ-ওপাশ তাকাতে লাগল৷ কিন্তু তাঁকে দেখতে পেল না৷
মিমো আর বাবলিকে দেখে ডিউটি অফিসার ভুরু কুঁচকে ওদের দিকে তাকালেন৷ বছর ষোলো কি সতেরোর দুটো ছেলে৷ চোখে পড়ার মতো স্বাস্থ্য৷ একজন একটু লম্বা, অন্যজন উচ্চতায় খাটো৷
ডিউটি অফিসারের টেবিলের সামনে একটা ছোট বেঞ্চি পাতা ছিল৷ ‘বসছি’, বলে মিমো সেটাতে বসে পড়ল৷ দেখাদেখি বাবলিও৷
‘কী ব্যাপার?’ খানিকটা বিরক্ত ভাব দেখিয়ে ডিউটি অফিসার জানতে চাইলেন৷
‘আমরা—আমরা একটা…কিডন্যাপিং-এর ব্যাপারে রিপোর্ট করতে এসেছি৷’ মিমো বলল৷
‘কিডন্যাপিং?’ প্রশ্নের ঢঙে কথাটা বলে অফিসার একটা খাতা টেনে নিয়ে খুললেন৷ পাতা উলটে-উলটে ঠিকঠাক পৃষ্ঠায় এলেন৷ পেনটা তুলে নিয়ে লেখার জন্য বাগিয়ে ধরলেন৷
মিমো পুরো ঘটনাটা ওঁকে বলল৷ তারপর বাবলি পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজটা বের করে প্রিয়াংকার নাম-ঠিকানা বলল৷ অফিসার খাতায় লিখতে শুরু করলেন৷ ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বোঝার জন্য মাঝে-মাঝে ওদের প্রশ্ন করতে লাগলেন৷
লেখার কাজ মিটে গেলে অফিসার মিমো আর বাবলির নাম-ঠিকানা, গার্জেনের নাম, কোন স্কুলে ওরা পড়ে—এসব জেনে নিয়ে খাতায় লিখলেন৷ তারপর খাতাটা ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমরা মাইনর—মানে, আঠেরো বছর তো হয়নি—তবুও এই জায়গাটায় সই করে দাও—৷’
মিমো আর বাবলি সই করে দিল৷
তারপরই ওদের অবাক করে দিয়ে অফিসার ভদ্রলোক ওদেরই জেরা করতে শুরু করলেন৷
হঠাৎ মিমোর ফোনেই বা প্রিয়াংকা ফোন করতে গেল কেন?
মিমোরা গল্পটা বানিয়ে বলছে না তো?
প্রিয়াংকা নামের মেয়েটিকে যে কিডন্যাপ করা হয়েছে সেটা ওরা বুঝল কেমন করে? এইসব কমবয়েসি ছেলেরা বা মেয়েরা অনেকসময় নানারকম মজা করে৷ এটাও হয়তো সেরকমই কিছু৷
এইসব পুলিশি প্রশ্নের আক্রমণের মুখে পড়ে মিমো আর বাবলি সাধ্যমতো আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে লাগল৷ মিমো ওর মোবাইলের বোতাম টিপে প্রিয়াংকার ল্যান্ডলাইন নম্বরটা আগেই অফিসারকে দেখিয়েছিল৷ সেটা তিনি ডায়েরির খাতায় লিখেও নিয়েছিলেন৷ কিন্তু এতসব সত্ত্বেও ভদ্রলোকের মুখ থেকে সন্দেহের ভাবটা যাচ্ছিল না৷
মিমো বারবার করে বলল, ‘দেখুন স্যার, মেয়েটার মনে হয় হেভি বিপদ৷ ও ফোন করলে লাইনটা বারবার কেটে যাচ্ছে৷ আর আমি ওই নাম্বারে ফোন করলে কোনও কানেকশান পাচ্ছি না৷ বিশ্বাস করুন, মেয়েটাই বারবার বলছে পুলিশে খবর দিতে৷ আপনারা প্লিজ কিছু একটা করুন—৷’
ডিউটি অফিসার একটা হাই তুললেন৷ তারপর ‘তেওয়ারি!’ বলে চেঁচিয়ে কাকে যেন ডাকলেন৷
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রোগা চেহারার একজন কনস্টেবল সামনে এসে দাঁড়াল৷ গাল বসা শুকনো মুখে একজোড়া পেল্লাই গোঁফ ভীষণ বেমানান লাগছে৷ উর্দি পরতে-পরতেই সে ‘স্যার’-এর ডাক শুনে ছুটে এসেছে৷ এখন জামাটাকে ব্যস্তভাবে প্যান্টের ভেতরে গুঁজে দিচ্ছে৷
ডিউটি অফিসার তখন চেয়ারে হেলান দিয়ে আড়মোড়া ভাঙছিলেন৷ একটা হাই তুলতে-তুলতে বললেন, ‘লাইটারটা দে—৷’
তেওয়ারি হুকুম শোনামাত্রই পালন করতে ঝট করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল৷ সে লাইটার বের করতে-করতেই ডিউটি অফিসারের ঠোঁটে একটা বিড়ি জায়গা করে নিয়েছে৷ তেওয়ারি ঝুঁকে পড়ে লাইটার জ্বেলে বিড়িটা ধরিয়ে দিল৷ অফিসার চোখ বুজে বিড়িতে টান দিলেন৷ বাঁ-হাতের আঙুল নেড়ে তেওয়ারিকে বুঝিয়ে দিলেন ওর কাজ আপাতত শেষ৷ ও এখন যেতে পারে৷
তেওয়ারি চলে গেল৷
ডিউটি অফিসারের এই কাণ্ড দেখতে-দেখতে মিমো আর বাবলি অধৈর্য হয়ে পড়েছিল৷ একইসঙ্গে এই গয়ংগচ্ছ ভাব ওদের অসহ্য লাগছিল৷
মিমো আশেপাশে তাকাল—যদি অন্য কোনও পুলিশ অফিসারকে দেখতে পায়৷ নাঃ, সেরকম কেউ নেই৷ থানার ও. সি-র ঘরও এখন খালি৷ নইলে ওঁর কাছে গিয়ে ব্যাপারটা…৷
যখন ও ভাবছে, কী করা যায়…ঠিক তখনই ওর মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷
ইনকামিং কলের নম্বরটা দেখেই মিমো বুঝল, প্রিয়াংকার ফোন৷ ও চটপট বোতাম টিপে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে প্রিয়াংকার ভয় পাওয়া গলা শোনা গেল : ‘আপনি পুলিশে খবর দিয়েছেন? জলদি! আর বেশি সময় নেই৷ এই ফোনটা খারাপ৷ বারবার লাইন কেটে যাচ্ছে…৷ যা করার জলদি করুন…৷’
মিমো তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আমরা এখন মানিকতলা থানায়৷ এই নিন, ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা বলুন—৷’
মিমোর ফোন বেজে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে অফিসার ভদ্রলোক সজাগ হয়েছিলেন৷ এখন মিমো ওর মোবাইলটা বাড়িয়ে দিতেই তিনি তাড়াতাড়ি সেটা কানে দিয়ে ‘হ্যালো’ বললেন৷ হাতের বিড়িটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে ঘষে নিভিয়ে দিলেন৷
প্রিয়াংকা তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছে৷ কাঁদতে-কাঁদতেই ও বলল, ‘স্যার, স্যার…আমাকে বাঁচান৷ এরা আমাকে খুন করে ফেলবে…৷’
‘কোনও ভয় নেই—আমরা এখুনি অ্যাকশান নিচ্ছি৷ আপনাকে কোথায় আটকে রেখেছে বলুন তো? জায়গাটা ডেসক্রাইব করতে পারেন?’
প্রিয়াংকা উত্তরে কী যেন বলছিল—কিন্তু তখনই ফোনে একটা ‘গোঁ-ও-ও’ শব্দ শোনা গেল৷ ওর কথা আর ভালো করে বোঝা গেল না৷
অফিসার অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কীসের শব্দ হচ্ছে?’
‘একটা প্লেন উড়ে গেল৷ আমাকে যে করে হোক বাঁচান…৷’
প্রিয়াংকার কথা শেষ হওয়ার আগেই লাইনটা কেটে গেল৷ বারকয়েক ‘হ্যালো! হ্যালো!’ করেও ডিউটি অফিসার আর কোনও সাড়া পেলেন না৷ তখন ফোনটা মিমোকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো তো, ওই নম্বরটায় লাগাতে পারো কি না—৷’
মিমো জানত চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই, তবুও তিনবার প্রিয়াংকার নম্বরটায় কল করল৷ প্রত্যেকবারই শুধু রিং বেজে গেল৷ কেউ ধরল না৷ হয়তো ফলস রিং হচ্ছে—মিমো ভাবল৷
ডিউটি অফিসার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ মিমো আর বাবলির দিকে সহজ চোখে দেখলেন৷ নাঃ, এই ছেলেদুটো তো সত্যি কথাই বলেছে! আর ফোনে মেয়েটার কান্নাকাটি শুনে মনে হয় না মজা করার জন্য এইরকম অভিনয় করছে৷ সুতরাং কিছু একটা করা দরকার৷
হঠাৎই মিমো আর বাবলি দেখল, ডিউটি অফিসার ওদের পিছনদিকে তাকিয়ে কাকে যেন সেলাম ঠুকলেন৷
পিছন ফিরে তাকিয়েই মিমোর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ ওর চেনা সেই পুলিশ অফিসার৷ গায়ে য়ুনিফর্ম৷ মাথার টুপিটা হাতে ধরা৷ পাশে একজন কনস্টেবল৷ মনে হয়, আউটডোর ডিউটিতে কোথাও বেরিয়েছিলেন—এইমাত্র ফিরেছেন৷
মিমোকে লক্ষ করে তিনিই প্রথম কথা বললেন, ‘কী ব্যাপার? তুমি থানায় কেন?’
ডিউটি অফিসার চটপট বললেন, ‘ওরা একটা রিপোর্ট লেখাতে এসেছিল৷’ তারপর অবাক হয়ে ওপরওয়ালাকে জিগ্যেস করলেন, ‘ওকে চেনেন নাকি, স্যার?’
‘খুউব চিনি—’ হেসে বললেন তিনি৷ তারপর মিমোর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘এসো—এ-ঘরে এসো৷ তোমাদের কথা শোনা যাক৷’ ডিউটি অফিসারের দিকে তাকিয়ে : ‘তুমিও এসো, পালচৌধুরী৷’
ও. সি.-র ঘরের লাগোয়া একটা ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি৷ ওঁর পিছন-পিছন মিমো, বাবলি আর ডিউটি অফিসার পালচৌধুরী৷
৷৷চার৷৷
কলেজ ছুটি হওয়ার পর ক্যাম্পাসের বাইরে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খানিকক্ষণ আড্ডা মারা প্রিয়াংকার রোজকার অভ্যেস৷ আজও ওরা সাতজন বন্ধু ক্যাম্পাসের মেনগেটের বাঁ-দিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তুমুল আড্ডা মারছিল৷ আড্ডা ঠিক নয়—আসলে বিতর্ক৷ ফিল্মের সবচেয়ে সুপুরষ নায়ক কে? এই বিতর্কে শেষ তিনজন প্রতিযোগীকে নিয়ে এখন লড়াই চলছে : সলমান খান, হৃতিক রোশন এবং জন আব্রাহাম৷
প্রিয়াংকা সলমানের অন্ধ ভক্ত—তাই সলমানকে ‘সেরা’ প্রমাণ করার জন্য গলা ফাটাচ্ছিল৷ হঠাৎই ওর হাতের মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷
‘হ্যালো—৷’
‘কী রে, এখনও ছুটি হয়নি?’ ও-প্রান্ত থেকে বাপি জিগ্যেস করল৷
চার বছর আগে আচমকা হার্ট অ্যাটাকে ওর মা চলে যাওয়ার পর থেকে সোনম আর ওর কাছে বাপি একাই ‘বাপি’ আর ‘মা-মণি’৷ সবসময়ে ওদের জন্য চিন্তা করে—কখনও কারণে, আর বেশিরভাগ সময়েই অকারণে৷
প্রিয়াংকা বাপিকে বলল, ‘এইমাত্র প্র্যাকটিক্যাল শেষ হয়েছে৷ তুমি চিন্তা কোরো না৷ বন্ধুদের সঙ্গে একটু কথা বলেই গাড়িতে উঠছি—৷’
বাপি বলল, ‘যাকগে, বেশি দেরি কোরো না৷ মণিরাম অনেকক্ষণ রওনা হয়ে গেছে৷ বোধহয় এতক্ষণে পৌঁছে গেছে৷’
মণিরাম প্রিয়াংকাদের ড্রাইভার৷ বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে৷ বহুবছর ধরে ওদের গাড়ি চালায়৷ খুব বিশ্বাসী৷ প্রিয়াঙ্কা আর সোনমকে বলতে গেলে নিজের ছেলেমেয়ের মতো ভালোবাসে৷ ওর কলেজে আসতে বা সোনমের স্কুলে যেতে মণিরাম আজ পর্যন্ত কখনও দেরি করেনি৷
বাপির সঙ্গে কথা শেষ করেই বন্ধুদের বলল, ‘অ্যাই, বাপি তাড়া দিচ্ছে৷ টা-টা৷ কাল আবার এই ইস্যুটা রিওপেন করে ঝগড়া করব৷ ও.কে.?’
বন্ধুদের হাত নেড়ে চটপট পা চালাল প্রিয়াংকা৷ সামনে ডানদিকে ঘুরেই যে-সাইডরোডটা পাওয়া যায়, মণিরাম বরাবর সেখানেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়ায়৷
সেদিকে এগোতে-এগোতে চারপাশের গাছপালার দিকে তাকাল ও৷ সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে, কিন্তু এর মধ্যেই আকাশ ছাইরঙা হয়ে গেছে৷ বড়-বড় গাছের ফাঁকফোকরে ছোট-ছোট অন্ধকার জমাট বেঁধেছে৷ সেখানে রাত্রিবাস করতে আসা পাখিদের দেখা না গেলেও তাদের ডাক শোনা যাচ্ছে৷
প্রিয়াংকাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটা সল্ট লেকে৷ কলেজের ক্যাম্পাসটা দারুণ—গাছপালা আর আধুনিক ছাঁদের ঘরবাড়ি দিয়ে একটা মিনি শহরের মতো করে সাজানো৷ ক্যাম্পাস ঘিরে চওড়া-চওড়া রাস্তা৷ রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমুল আর দেবদারু গাছ৷ কলেজের শুরু আর শেষের সময়টা ছাড়া রাস্তাগুলো প্রায় নির্জন থাকে৷ মাঝে-মাঝে ছুটে যাওয়া গাড়ির আওয়াজ যদি না থাকত তা হলে শুধু পাখির ডাকই শোনা যেত৷ কী দারুণ হত তখন!
প্রিয়াংকার বিষয় ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশান ইঞ্জিনিয়ারিং হলেও পাখির নেশা ওর ছোটবেলা থেকেই৷ পাখির ডাক নকল করে পাখিকে ঠকানোর জন্য ও বাপির কাছে শিস দেওয়া শিখেছে৷ বেশ মনে আছে, তখন ও ক্লাস নাইনে পড়ে৷
এখন রাস্তায় কলেজ ছুটির ব্যস্ততা৷ প্রিয়াংকা জানে, মিনিট-কুড়ি কি আধঘণ্টা পর এই ব্যস্ততা কমে যাবে৷ নেমে আসবে নির্জনতা এবং অন্ধকার৷
গাড়ির দিকে তাড়াতাড়ি পা চালাল ও৷ একটু পরে ডানদিকে ঘুরেই মেরুনরঙা মারুতি অলটোটা ওর চোখে পড়ল৷
গাড়ির কাছে গিয়ে রোজকার অভ্যেস মতো পিছনের দরজা খুলে কাঁধের ব্যাগটা ভেতরে ছুড়ে দিয়ে সিটে বসে পড়ল৷ এবং সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মণিরাম গাড়ি ছুটিয়ে দিল৷
প্রিয়াংকা মণিরামের দিকে কোনওরকম নজর না দিয়ে ওর ব্যাগটা টেনে নিল৷ ব্যাগ থেকে ক্লাসনোটের লম্বা খাতা বের করল৷ কাল সুনীতা ম্যাডাম কমিউনিকেশান সিস্টেমস-এর ক্লাস টেস্ট নেবেন৷ কমিউনিকেশান প্রিয়াংকার ফেভারিট সাবজেক্ট৷ তা ছাড়া সুনীতা ম্যাডাম ব্যাপক পড়ান৷ ক্লাসে যা বলেন সব যেন মনে গেঁথে যায়৷ এই টেস্টটায় প্রিয়াংকাকে হায়েস্ট পেতেই হবে৷ নইলে ম্যাডামের কাছে ওর প্রেস্টিজ থাকবে না৷
প্রিয়াংকা বেশ মন দিয়ে ক্লাস নোট দেখছিল৷ ফলে খেয়াল করেনি যে, গাড়ি জোরে ছুটছে৷ এও খেয়াল করেনি, গাড়ি ওর বাড়ির দিকে নয়, ছুটে চলেছে অন্য রাস্তা ধরে৷ আর গাড়ি মণিরাম চালাচ্ছে না, তার বদলে অন্য একজন লোক স্টিয়ারিং-এ বসে আছে৷
গাড়িটা হঠাৎ বেশ জোরে ব্রেক কষল৷ প্রিয়াংকা ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে৷ মণিরামকে লক্ষ করে ‘কী হল, মণিদা?’ বলতে গিয়েই ও প্রথম খেয়াল করল, অন্য লোক গাড়ি চালাচ্ছে৷
ও চিৎকার করতে যাবে অমনই গাড়ির দুপাশের দরজা খুলে দুটো লোক চটপট ওর পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল৷ রোগা মতন একজন ওর কোমরে একটা পিস্তল চেপে ধরে চাপা গলায় বলল, ‘স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকো৷ নইলে খতম৷’
আর অন্য লোকটা—সামান্য মোটাসোটা গালফোলা চেহারা—ওর ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল ফোনটা বের করে সুইচ অফ করে দিল৷ তারপর পকেটে পুরে নিল৷
ব্রেক কষার পর থেকে পুরো ব্যাপারটা ঘটতে সময় লেগেছে বড়জোর পাঁচ-সাত সেকেন্ড৷ তারপরই গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছিল৷ যেন কিছুই হয়নি৷
পিস্তল-ধরা লোকটা রুক্ষ গলায় প্রিয়াংকাকে বলল, ‘চোখে হাত চাপা দিয়ে কোলের ওপর মাথা ডাউন করো—জলদি৷’
লোকটা শুধু হুমুমই দিল না—হুকুমটাকে জোরদার করতে সেইসঙ্গে একটা পিস্তলের খোঁচাও দিয়েছে৷
প্রিয়াংকা সঙ্গে-সঙ্গে চোখে হাত চাপা দিয়ে মাথা নীচু করল৷ গাড়িটা ব্রেক কষার পর ও একপলক রাস্তার দিকে তাকাতে পেরেছিল৷ তাতে রাস্তাটা বা এলাকাটা ওর চেনা বলে মনে হয়নি৷ আর এখন এই অবস্থায় তো পথ চেনার কোনও প্রশ্নই নেই৷
গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল প্রিয়াংকা, আর গাড়ির হর্ন৷ এ ছাড়া পথচলতি গাড়ির হর্নের শব্দও পাচ্ছিল৷ কিন্তু লোকগুলোর কোনওরকম কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিল না—কারণ, অচেনা তিনটে লোক নিজেদের মধ্যে একটি কথাও বলছিল না৷
প্রিয়াংকা বুঝল, ওদের প্ল্যান এতই নিখুঁত যে, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার কোনও প্রয়োজন নেই৷
কিডন্যাপিং-এর ঘটনাটা এমন আচমকা ঘটেছে যে, প্রিয়াংকা হকচকিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু তারপর, সেই ঝোঁকটা কেটে যেতেই, একটা ঠান্ডা ভয় ওর মধ্যে চারিয়ে গেল৷ বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডের ছটফটানির শব্দ ও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল৷ ভয় আর চাপা কান্নায় ওর গলার কাছটা অসহ্য যন্ত্রণায় টনটন করছিল৷ সোনমের কথা মনে পড়ছিল, বাপির কথা মনে পড়ছিল, আর মনে পড়ছিল মা-মণির কথা৷ দম আটকানো কান্নায় ওর শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল৷
হঠাৎই গাড়িটা কোথাও একটা থামল৷ দুটো শক্ত হাত ওর কাঁধ চেপে ধরল৷ প্রিয়াংকা প্রতিবাদে ছটফট করে উঠতেই একটা কাঁধ থেকে হাত সরে গেল৷ তারপরই পিঠের ঠিক মাঝখানে একটা রুক্ষ খোঁচা টের পেল৷ সেই সঙ্গে হুকুম : ‘একদম চুপ৷ ফড়ফড় করলেই ওপরে ফুঁকে দেব৷’ একটু থেমে : ‘চোখ থেকে হাত সরাও—৷’
প্রিয়াংকা হাত সরাতেই অন্য লোকটা দুটো ইলাস্টিকের হেডব্যান্ড ওর চোখের ওপরে পরিয়ে দিল৷ ইলাস্টিকের চাপ টের পেল ও৷ তারপর একজন বলল : ‘গাড়ি থেকে নেমে পড়ো—৷’
ওর হাত ধরে টেনে কেউ গাড়ি থেকে ওকে নামাল৷
কয়েক পা এলোমেলো হাঁটানোর পর ওকে অন্য আর-একটা গাড়িতে তোলা হল৷ স্টার্ট দিয়েই গাড়িটা ছুটতে শুরু করল৷ আর প্রিয়াংকাদের অলটো গাড়িটা ‘ইউ’ টার্ন নিয়ে যে-রাস্তা দিয়ে এসেছিল সেদিকেই ছুটে চলল৷
নতুন গাড়িটা প্রায় আধঘণ্টা কি তার বেশিক্ষণ চলার পর একটা সাদামাঠা দোতলা বাড়ির কাছে এসে থামল৷ বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া বিশাল ফাঁকা জমি৷ সেখানে অগোছালোভাবে ছোট-বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে৷ প্রিয়াংকাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল ওরা দুজন৷
বাড়িতে ঢোকার পর ওর চোখের ওপর থেকে ইলাস্টিক ব্যান্ড খুলে দিল৷ ওর সাইডব্যাগটা ওর হাতে ফিরিয়ে দিল৷
প্রিয়াংকা চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকাল৷
কয়েক সেকেন্ড পর ওর দৃষ্টি স্বাভাবিক হল৷ তখন বুঝল, বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে৷ বাড়ির ভেতরে টিউবলাইট জ্বলছে৷
লাগেজ টানার ঢঙে ওকে করিডর দিয়ে টেনে নিয়ে চলল ওরা৷ প্রিয়াংকা নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল৷ ওর গাল বেয়ে জলের রেখা নেমে চলেছে৷ এতক্ষণে বাপি নিশ্চয়ই ওর খোঁজ করে-করে পাগল হয়ে গেছে৷
করিডরের শেষ প্রান্তে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা৷ একজন মোবাইল ফোন বের করে কাকে যেন ডায়াল করল৷ তারপর বলল, ‘পাখি খাঁচায় এসে গেছে৷’ বলেই ফোন অফ করে দিল৷
ততক্ষণে আর-একজন ঘরের দরজা ঠেলে প্রিয়াংকাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে৷
ঘরটা মাপে মাঝারি গোছের৷ দু-দিকের দেওয়ালে দুটো জানলা—কিন্তু দুটো জানলাই বন্ধ৷ ঘরটা দেখে মনে হয়, গোডাউন বা ভাঁড়ার ঘর৷ বাঁ-দিকের দেওয়াল ঘেঁষে কয়েকটা সিমেন্টের বস্তা আর প্লাস্টার অফ প্যারিসের প্যাকেট৷ তার পাশে দুটো প্লাস্টিকের ড্রাম আর রঙের টিন৷ এ ছাড়া বেশ কয়েকটা ভাঙা চেয়ার-টেবিল এদিক-ওদিক দাঁড় করানো রয়েছে৷ ডানদিকের মেঝেতে কয়েকটা জলের পাইপ আর লোহালক্কড়৷ তার পাশে নীল রঙের কয়েকটা পলিথিন শিট ভাঁজ করে রাখা৷ সবমিলিয়ে মনে হয়, ঘরটা কোনও কনস্ট্রাকশন কোম্পানির গোডাউন৷
ঘরের মেঝেটা নিট সিমেন্ট দিয়ে ফিনিশ করা নেই৷ দেখে বোঝা যায়, এ-ঘরটাকে প্রিয়াংকার অস্থায়ী আস্তানা করার জন্য মালপত্র এদিক-ওদিক সরিয়ে মেঝেটা ঝাঁট দিয়ে সাফ করা হয়েছে৷ ঘরের পিছনের দেওয়ালের কাছাকাছি মেঝেতে একটা বিছানা পাতা রয়েছে৷ সস্তা সবুজ রঙের বেডশিট দিয়ে বিছানাটা ঢাকা৷ পায়ের দিকে ভাঁজ করে রাখা একটা বেডকভার৷
প্রিয়াংকা বুঝল, এই গোডাউনে ওকে এখন থাকতে হবে৷ শুতে হবে এই জঘন্য বিছানায়৷ সঙ্গে-সঙ্গে নতুন একটা ঢেউ শরীরের ভেতর থেকে ওর কান্নাটাকে উথলে দিল৷
প্রিয়াংকাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে যে-লোকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল সে বলল, ‘এই ঘরটায় তুমি ক’দিন থাকবে৷ তোমার যা-যা দরকার ওই মাসিকে বলবে—মাসি ব্যবস্থা করবে৷’
লোকটা আঙুল তুলে ঘরের একদিকে দেখিয়েছিল৷ প্রিয়াংকা সেদিক লক্ষ করে তাকাল৷
প্রথমে ভেবেছিল কোনও মূর্তি৷ কিন্তু চোখের পাতা পড়তেই বুঝল মূর্তি নয়—এর প্রাণ আছে৷ প্লাস্টিকের ড্রামের পিছনে শরীরটাকে খানিক আড়াল করে মানুষটা উবু হয়ে মেঝেতে বসে আছে৷ রোগা, আদিবাসী টাইপের চেহারা, কুচকুচে কালো গায়ের রং, চোখ দুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, নাকে নথ, কানে দুল, গায়ে একটা ময়লা গোলাপি শাড়ি৷
লোকটা ইশারায় মাসিকে ডাকল৷
মাসি উঠে দাঁড়াল৷ একটু খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হেঁটে এগিয়ে এল প্রিয়াংকাদের কাছে৷
প্রিয়াংকা লক্ষ করল, মাসি পানপরাগ জাতীয় পানমশলা চিবোচ্ছে৷ গাল ফোলা, ঠোঁট শক্ত করে চেপে আছে৷
লোকটা বলল, ‘মেয়েটা রইল৷ ঠিকমতো নজর রেখো৷ দেখো, কোনও অসুবিধে না হয়—৷’
মাসি ‘উঁ’ শব্দ করে মাথা হেলাল৷ প্রিয়াংকাকে আপাদমস্তক খরচোখে জরিপ করল৷ ওর কেমন যেন অস্বস্তি হল৷
লোকটা দু-আঙুলে টুসকি বাজিয়ে প্রিয়াংকার মনোযোগ চাইল৷ তারপর বলল, ‘এবারে তোমার বাবার মোবাইল নম্বরটা ঝটপট দাও৷ আজ রাতে কথা বলতে হবে৷ তারপর দেখি কী বলে…তোমাকে ক’দিন এখানে রাখতে হয়…৷’
প্রিয়াংকা ওর বাপির মোবাইল নম্বর বলল৷ লোকটা পকেট থেকে একটা সেলফোন বের করে বোতাম টিপে নম্বরটা স্টোর করে নিল৷
প্রিয়াংকা কান্না-কান্না গলায় জিগ্যেস করল, ‘আমাকে এখানে…নিয়ে… এসেছেন কেন?’
‘বস জানে৷’ বলে লোকটা গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷
মাসি পিছন-পিছন গিয়ে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিল৷ প্রিয়াংকা লক্ষ করল দরজাটায় ভেতর থেকে খিল কিংবা ছিটকিনি লাগানোর কোনও ব্যবস্থা নেই৷
মাসি আঙুল তুলে ওকে ইশারা করে বিছানাটা দেখাল৷ প্রিয়াংকা কোনও কথা না বলে বিছানার কাছে গিয়ে ব্যাগটা নামিয়ে রাখল৷ তারপর ধপ করে বসে পড়ল৷ কান্নাটা ভেতর থেকে আরও জোরে উথলে উঠল৷ মুখে হাত চাপা দিয়ে প্রিয়াংকা শব্দ করে কেঁদে উঠল৷ কান্নার সঙ্গে-সঙ্গে ওর শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল৷
কান্নার মধ্যেই প্রিয়াংকা প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ পেল৷ একবার নয়—বেশ কয়েকবার৷ ওর মনে হল, জায়গাটা নিশ্চয়ই এয়ারপোর্টের কাছাকাছি৷ ওর মাথার মধ্যে নানান চিন্তা ঘুরপাক খেয়ে-খেয়ে গুলিয়ে যাচ্ছিল৷
বাপি নিশ্চয়ই ওর খোঁজ না পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছে৷ হয়তো পুলিশকেও জানিয়েছে৷ পুলিশ ওর কলেজ, বন্ধুদের বাড়ি, আত্মীয়ের বাড়ি—কোনও জায়গাতেই বোধহয় খোঁজ করতে বাকি রাখেনি৷ তারপর তারা হয়তো কিডন্যাপারদের ফোনকলের জন্য অপেক্ষা করছে৷
কিন্তু এরা মণিরামকে কোথায় সরাল, কী করেই-বা সরাল? প্রিয়াংকাদের গাড়িটাই-বা এখন কোথায়?
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিয়াংকার উথালপাথাল মন শান্ত হয়ে এল৷ ও বুঝল রাগ বা জেদ দেখিয়ে এদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে না৷ আর কান্নাকাটি করেও কোনও লাভ নেই৷ বরং কীভাবে বাপিকে একটা খবর দেওয়া যায় সেই বুদ্ধি বের করতে হবে৷
ওকে কেন কিডন্যাপ করা হয়েছে সেই কারণটা প্রিয়াংকা মনে-মনে বুঝতে চাইছিল৷ ময়দানে খুনের ঘটনাটা আটদিন আগের কথা৷ ভয়ে ব্যাপারটা ও কাউকে জানায়নি—বাপিকেও না, সোনমকেও না৷ শুধু সেই মাইক্রো-ক্যাসেটটা হ্যান্ডিক্যাম থেকে বের করে একটা অদ্ভুত জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে৷ বহুবার ভেবেছে, বাপিকে সঙ্গে নিয়ে ও থানায় যাবে—সব জানাবে৷ কিন্তু তারপরই একটা ভয় ওকে থামিয়ে দিয়েছে৷ যদি পুলিশ ওদের ঝামেলায় জড়িয়ে দেয়, হ্যারাস করে?
বেশ মনে আছে, সেইদিনটা খুব ভয়ে-ভয়ে দুরুদুরু বুকে কাটিয়েছে ও৷ রাতে সোনমের পাশে শুয়ে সারাটা রাত ছটফট করেছে—একফোঁটা ঘুমোতে পারেনি৷ পরদিন খবরের কাগজে ময়দানে খুনের খবরটা ছোট্ট করে বেরিয়েছে : ‘…অজ্ঞাতপরিচয় একজন মাঝবয়েসি লোকের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া গেছে৷ পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে…৷’
হতে পারে এই লোকগুলো সেই খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে৷ তাই সেই মাইক্রো-ক্যাসেটটার খোঁজে প্রিয়াংকাকে তুলে এনেছে৷ কিন্তু এরা প্রিয়াংকার খোঁজ পেল কী করে? কীভাবে জানতে পারল ও কোন কলেজে পড়ে, কখন কোন গাড়ি করে বাড়ি ফেরে? তবে যে-তিনজন লোককে প্রিয়াংকা এ পর্যন্ত দেখেছে—দুজন কিডন্যাপার আর ড্রাইভার—তাদের কাউকেই ও চেনে না৷
তবে কি এই লোকগুলো ময়দানের খুনের ব্যাপারটার কিছুই জানে না? স্রেফ ওর বাপির কাছ থেকে মোটা টাকা আদায়ের জন্য ওকে ধরে নিয়ে এসেছে?
প্রিয়াংকার মাথার ভেতরে আবার চিন্তার ঝড় বইতে শুরু করল৷ ও মাসির দিকে আড়চোখে তাকাল৷ ওকে বিছানায় পাঠানোর পর থেকে মাসি দেওয়ালের কাছে গিয়ে ছবি হয়ে বসে আছে৷ চোখ দুটো আধবোজা৷ ওর নিশ্চিন্ত ভাব দেখে বোঝা যায়, ও জানে প্রিয়াংকার এখান থেকে পালানোর কোনও পথ নেই৷ এই ঘরটার দরজা খোলা থাকলেও বাড়ির সদরে নিশ্চয়ই তালা দেওয়া আছে৷
প্রিয়াংকা ওর ব্যাগটা টেনে নিল৷ জিপ খুলে একটা খাতা আর পেন বার করে নিল৷ তারপর এ পর্যন্ত যা-যা হয়েছে, যা-কিছু ও দেখেছে, সব ইংরেজিতে লিখে ফেলল৷ এমনকী লোকগুলোর চেহারার বর্ণনাও বাদ দিল না৷
ও ঠিক করল, যখনই ও প্লেনের শব্দ শুনবে তখনই সময়টা টুকে রাখবে৷ এই তথ্যটা পরে কাজে লাগলেও লাগতে পারে৷
লেখার কাজ যখন শেষ হল তখন প্রিয়াংকার মন অনেক শান্ত হয়ে গেছে৷ প্রথমদিকের ভয় আর মনখারাপের ঝোঁকটাও অনেক কমে গেছে৷
ও খাতা-পেন রেখে উঠে দাঁড়াল৷ হাতঘড়িতে চোখ রাখল : আটটা দশ৷ তারপরই ওর নজর গেল ওর পাহারাদারের দিকে৷ দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকা মূর্তিটা কখন যেন সজাগ হয়ে উঠেছে, পিটপিট করে প্রিয়াংকাকে দেখছে৷
প্রিয়াংকা মাসিকে লক্ষ করে জিগ্যেস করল, ‘এ জায়গাটা কোথায়? এয়ারপোর্টের কাছে মনে হচ্ছে…৷’
মাসি মুখে কোনও জবাব দিল না৷ শুধু হাত ঘুরিয়ে বোঝাল, কে জানে কোথায়!
‘আমাকে এখানে আটকে রেখেছে কেন? টাকার জন্যে?’
স্থির চোখে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার একই ভঙ্গিতে হাত ঘোরাল মাসি৷
প্রিয়াংকা কাঁধ ঝাঁকাল৷ আচ্ছা বোবা-কালার পাল্লায় পড়া গেছে!
ও ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করল৷ কী করে যে সময় কাটায় এখন! দু-একটা গল্পের বই সঙ্গে থাকলে বেশ হত৷ কিংবা একটা কম্পিউটার থাকলে দিব্যি কম্পিউটার গেমস খেলা যেত৷
প্রিয়াংকা এলোমেলোভাবে ঘোরাঘুরি করছিল আর ঘরটাকে খুঁটিয়ে জরিপ করছিল৷ দুটো চেয়ারকে পাশ কাটিয়ে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা একটা টেবিলের কাছে পৌঁছল প্রিয়াংকা৷
টেবিলটা ধুলো মাখা৷ একটা পায়া জোড়তালি দেওয়া৷ টেবিলের নীচে চার-পাঁচটা খালি সিমেন্টের বস্তা আর ছ’-সাতখানা ইট৷ কিন্তু তার পাশে ওটা কী?
একটা পুরোনো আমলের টেলিফোন৷
কিন্তু টেলিফোনটা যে বাতিল সেটা তার চেহারা দেখলেই বোঝা যায়৷ হাতলের প্লাস্টিক কভারটা ভাঙা—কভারের বেশ খানিকটা উধাও৷ ভেতরের যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে৷ বেস ইউনিটটার অবস্থাও একইরকম—তবে নম্বর লেখা মেটাল ডায়ালটা এখনও অক্ষত আছে৷
যন্ত্রটার সর্বাঙ্গে ধুলো৷ বোঝাই যায়, বহুকাল ওটা কেউ ব্যবহার করেনি৷ হ্যান্ডসেট থেকে বেরিয়ে থাকা টেলিফোনের তারটা মরা কেঁচোর মতো মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে৷
মাসির দিকে একবার তাকাল প্রিয়াংকা৷ একটা প্লাস্টিকের ড্রামের পাশ দিয়ে মহিলার শরীরের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে৷ প্রিয়াংকা হঠাৎই একটা গান ধরল—‘ঝুম বরাবর ঝুম—৷’ লক্ষ করল, মাসি সামনে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে প্রিয়াংকাকে একবার দেখল৷ তারপর তার মুখটা আবার ড্রামের আড়ালে সরে গেল৷
গান গাইতে-গাইতে খানিকটা ঝুঁকে পড়ল প্রিয়াংকা৷ টেবিলের নীচ দিয়ে লাগোয়া দেওয়ালের দিকে তাকাল৷ টেলিফোন কানেকশানের একটা প্লাগ দেখা যাচ্ছে৷ সেটা থেকে তার উঠেছে দেওয়াল বেয়ে৷ তারপর একটা জানলার ফ্রেমের কাঠ ফুটো করে তারটা বেরিয়ে গেছে বাইরে৷
এই ভাঙা টেলিফোনটা দিয়ে কিছু একটা করা যায় না?
প্রিয়াংকার বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠল৷
কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করেই ও টুপ করে বসে পড়ল৷ কিন্তু গুনগুন করে গান করার ব্যাপারটা থামাল না৷ টেলিফোনের তারের ডগাটা ধরে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ল টেবিলের নীচে৷ তারপর তারের দুটো প্রান্ত প্লাগের গর্তে গুঁজে দিল৷
এবার শরীরটাকে বেঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিল৷ কানে চেপে ধরেই বুঝতে পারল যা ভেবেছিল তাই—কোনও ডায়াল টোন নেই—টেলিফোনটা ডেড৷ তারটা আবার খুলে দিয়ে টেবিলের নীচ থেকে ও বেরিয়ে এল৷
গান গাইতে-গাইতেই আবার বিছানার কাছে ফিরে এল প্রিয়াংকা৷ আড়চোখে দেখল, মাসির কোনও হেলদোল নেই৷ ও সামান্য গলা তুলে বলল, ‘আমার খিদে পেয়েছে৷’
দেওয়াল ঘেঁষে বসে থাকা পাথরের মূর্তি ড্রামের আড়ালে গুটখার পিক ফেলে বলল, ‘দশটায় খেতে পাবে৷’
প্রিয়াংকা বারবার করে বলল যে, ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে, কিন্তু মাসি আর কোনও জবাবই দিল না৷
এমন সময় প্লেনের শব্দ পেল৷ ও তাড়াতাড়ি বিছানার কাছে এল৷ খাতায় সময়টা টুকে নিল৷ সবে আটটা দশ বাজে৷ কিন্তু খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে৷ দশটা বাজতে এখনও ঢের দেরি৷ প্রায় দু-ঘণ্টা ওকে এই খিদে চেপে বসে থাকতে হবে৷ জীবনে কখনও এই হেনস্থা কল্পনাও করেনি প্রিয়াংকা৷ ওর চোখে জল এসে গেল৷ সেই অবস্থাতেই ওর মনে হল, টেলিফোনটা নিয়ে একটা মরিয়া চেষ্টা ওকে করতেই হবে৷ মনে-মনে কিডন্যাপার লোকগুলোর ওপরে ভীষণ রাগ হল ওর৷ কিছু একটা করে ওদের শায়েস্তা করা যায় না? ওই টেলিফোনটা…৷
হঠাৎই ঘরের দরজা খুলে গেল৷
রোগা মতন যে-লোকটা পিস্তল উঁচিয়ে ওকে ভয় দেখিয়েছিল সে ঘরে এসে ঢুকল৷ তার হাতে প্রিয়াংকার মোবাইল ফোন৷
লোকটাকে দেখে মাসি উঠে দাঁড়াল৷ চটপটে পায়ে লোকটা প্রিয়াংকার কাছে এগিয়ে এল৷ মোবাইল ফোনটা ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার বাবা লাইনে আছে—কথা বলো৷’
ফোনটা হাতে নিয়ে প্রিয়াংকা উঠে দাঁড়াল৷ ও ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে বাপি বলল, ‘পিয়া! তুই ভালো আছিস তো?’
প্রিয়াংকা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না৷ ওর মনে হল, কয়েকঘণ্টা নয়—যেন কয়েকবছর পর ও বাপির গলা শুনতে পেয়েছে৷ ও হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷ শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল৷ অনেক—অনেক কথা ও বলতে চাইছিল, কিন্তু মুখ দিয়ে কান্না আর গোঙানি ছাড়া কিছুই বেরোল না৷ আর দু-গাল বেয়ে জল গড়াতে লাগল৷
প্রিয়াংকা জীবনে কখনও এরকম করে কাঁদেনি৷
বেশ কিছুক্ষণ পর ও শান্ত হল৷ ধরা গলায় বলল, ‘বাপি…বাপি… আমাকে এরা এখানে আটকে রেখেছে৷ তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও…শিগগির নিয়ে যাও৷ নইলে দিজ বাস্টার্ডস উইল কিল মি…৷’
‘পিয়া, লিসন কেয়ারফুলি৷ ওরা আমার কাছে টাকা চায়নি৷ কী একটা মাইক্রো-ক্যাসেট চাইছে৷ ওটা নাকি তোর কাছে আছে৷ ওটা দিলেই ওরা তোকে ছেড়ে দেবে৷ পিয়া, তুই আমাকে বল ওটা কোথায় রেখেছিস—আমি ওদের দিয়ে দিচ্ছি৷ তারপরই ওরা তোকে ছেড়ে দেবে৷ শিগগির বল, ওটা কোথায় আছে…৷’
‘বললেও তুমি খুঁজে পাবে না, বাপি৷ ওটা আমি এমন জায়গায় রেখেছি যে, আমি নিজে না বের করে দিলে আর কেউ ওটা খুঁজে পাবে না৷ ইট ইজ অ্যাবসোলিউটলি ইমপসিবল৷’
‘তা হলে কী করি বল তো এখন!’ বাপির গলা বিভ্রান্ত শোনাল, ‘ওরা আমাকে তোর মোবাইল থেকে দু-তিনবার ফোন করেছে৷ বারবার একই কথা বলছে৷ বলছে…ওই ক্যাসেটটা না দিলে ওরা…ওরা তোকে…শেষ করে দেবে৷’ কথা বলতে-বলতে বাপির গলা ভেঙে গেল৷
প্রিয়াংকার মধ্যে কী একটা যেন হয়ে গেল৷ ও শক্ত গলায় বলল, ‘ক্যাসেটটা কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না, বাপি৷ আমি একদম ভুলে গেছি—৷’ তারপর হঠাৎই ওর কান্না পেয়ে গেল৷
এক থাবা মেরে প্রিয়াংকার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা ছিনিয়ে নিল লোকটা৷ বোতাম টিপে লাইন কেটে দিল৷
প্রিয়াংকার চোখে জল৷ কিন্তু সেই অবস্থাতেই ও দাঁতে-দাঁত চেপে বলল, ‘জানোয়ার—৷’
সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা সপাটে এক চড় কষিয়ে দিল ওর গালে৷ প্রিয়াংকা ছিটকে পড়ে গেল বিছানায়৷ ওর ফরসা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ পড়ে গেছে৷ গালটা অসহ্য জ্বালা করছে৷ ও গালে হাত চেপে জ্বালাযন্ত্রণা কমাতে চাইল৷
লোকটা দাঁত বের করে অসহায় প্রিয়াংকাকে দেখতে লাগল৷ কিছুক্ষণ পর বলল, ‘মাইক্রো-ক্যাসেটটা বসের চাই৷ নয়তো তোমাকে ছিবড়ে করে ছাড়ব৷ তুমি খরচ হয়ে গেলে তোমার বাপি আর সোনমের কী হাল হবে ভেবে দেখেছ!’ লোকটা একবার মাসির দিকে তাকাল, তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘বসকে রিপোর্টটা দিই…তারপর দেখি তোমাকে নিয়ে কী করতে বলে…৷’
লোকটা হঠাৎই ঘুরে দাঁড়াল৷ কী একটা যেন আচমকা মনে পড়ে গেছে এরকম ভঙ্গিতে চটপট বেরিয়ে গেল ঘর থেকে৷
প্রিয়াংকা কষ্ট পাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে ওর ভেতরে একটা রাগ টগবগ করে উঠল৷ লোকগুলো ভেবেছে কী! যখন খুশি যাকে-তাকে খুন করবে, যখন খুশি যাকে-তাকে কিডন্যাপ করবে৷ নাঃ, পালটা কিছু একটা করতে হবে৷ কিছু একটা…৷
বিছানায় শুয়ে নানান কথা ভাবছিল প্রিয়াংকা, আর মাঝেমধ্যেই মায়ের স্মৃতি মনে পড়ছিল, বাপির কথা মনে পড়ছিল, মনে পড়ছিল সোনমের কথা৷ আর বুকের ভেতরের কষ্ট আর যন্ত্রণা কান্না হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসছিল৷
এইভাবে শুয়ে থাকতে-থাকতে কখন যেন ও ঘুমিয়ে পড়েছিল৷
মাসির ধাক্কায় ওর ঘুম ভাঙল৷ ও ধড়মড় করে উঠে বসল৷ অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা ধড়াস-ধড়াস করতে লাগল৷ টিউবলাইটের আলো চোখে পড়ায় চোখ পিটপিট করে তাকাল৷
মাসি বলল, ‘খেয়ে নাও—খাবার এনেছি…৷’
মাসির ইশারা মতো তাকাল প্রিয়াংকা৷ ওর বিছানার কাছেই মেঝেতে স্টিলের থালা আর গ্লাস৷ থালায় চারখানা রুটি৷ তার সঙ্গে কী একটা ভাজা আর সবজি৷
খাবারের চেহারা দেখে গা গুলিয়ে উঠল ওর৷ এইরকম খাবার ও জীবনে কখনও খায়নি৷ কিন্তু এখন তো আর কোনও বিকল্প নেই!
প্রিয়াংকা খাওয়া শুরু করতেই মাসি দেওয়ালের কাছে নিজের জায়গায় ফিরে গেল৷ সেখানে প্রাণহীন স্ট্যাচুর ভঙ্গিতে বসে নিজের খাওয়া শুরু করল৷ আর মরা মাছের চোখে প্রিয়াংকাকে দেখতে লাগল৷
প্রিয়াংকার খাওয়া শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আগের লোকটা আবার এসে ঘরে ঢুকল৷ সঙ্গে-সঙ্গে মাসি অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল৷ প্রিয়াংকা বিছানায় বসে ছিল, বসেই রইল৷
লোকটা মাসির দিকে তাকালই না৷ সোজা প্রিয়াংকার কাছে এসে বলল, ‘ক্যাসেটটা কোথায় রেখেছ মনে পড়েছে?’
প্রিয়াংকা চোয়াল শক্ত করে অন্যদিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইল৷
লোকটা আবার একই কথা জিগ্যেস করল৷
প্রিয়াংকা কাঠ-কাঠ গলায় বলল, ‘মনে পড়েনি—মনে পড়বে না৷’
লোকটা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল—কী যেন ভাবতে লাগল৷ তারপর পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে বোতাম টিপে কার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল৷
‘হ্যালো—৷’
…
‘না, এখনও গোঁ ধরে রয়েছে৷ কোনও চেঞ্জ নেই৷’
…
‘হ্যাঁ—সেটা ঠিক৷ ও ছাড়া আর কেউ জানে না ক্যাসেটটা কোথায়৷ তা হলে একে খালাস করে দিলে আর কোনও প্রবলেম নেই৷ ক্যাসেটটা আর কেউ হাতে পাবে না৷ এটা ছাড়া আর কোনও…হ্যাঁ, হ্যাঁ—দিচ্ছি—৷’
মোবাইল ফোনটা প্রিয়াংকার দিকে এগিয়ে দিল লোকটা৷ চাপা গলায় বলল, ‘নাও, বসের সঙ্গে কথা বলো…৷’
একটু ইতস্তত করে প্রিয়াংকা ফোনটা নিল৷ ‘হ্যালো’ বলল৷
সঙ্গে-সঙ্গে ওপাশ থেকে একটা মিহি গলা কথা বলতে শুরু করল৷ প্রিয়াংকার মনে হল, কেউ যেন ইচ্ছে করে গলাটাকে মেয়েলি করে কথা বলছে৷ যাতে ও আসল গলার স্বরটাকে চিনতে না পারে৷
সেই গলা তখন বলছে,
‘প্রিয়াংকা, তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি বলে মার্জনা চাইছি…৷’
প্রিয়াংকার মনে হল, জীবনে কখনও ও এত মোলায়েম স্নেহমাখানো কথা শোনেনি৷ কোনও জাদুকর কাউকে হিপনোটাইজ করার সময় যেভাবে ধীরে-ধীরে কথা বলে, এই কথাগুলোর ঢং ঠিক সেইরকম৷
‘…কিন্তু কী করব বলো, আমার যে আর কোনও কর্মপন্থা জানা নেই৷ তুমি কি চাও, একটা হিরে-চোরকে বিনাশ করার জন্যে আমার সাজা হোক? আমি জানি, তুমি সেটা চাও না৷ লক্ষ্মীসোনা মেয়ে, এরকম গোঁয়ার্তুমি করে না৷ এতে কী লাভ বলো? তোমার মতো একটা সুন্দরী ফুটফুটে মেয়েকে অপচয় করতে আমার যথেষ্ট মনোকষ্ট হবে৷ তুমি অকপটে প্রকাশ করে দাও কোথায় আছে সেই মাইক্রো-ক্যাসেটটা৷ বলে ফ্যালো, সোনা মেয়ে আমার, প্লিজ, বলে ফ্যালো…৷’
প্রিয়াংকা যেন একটা ঘোরের মধ্যে এই মিষ্টি-মিষ্টি কথাগুলো শুনছিল৷ ওর মনে হচ্ছিল, ওর কানে কে যেন মধু ঢালছে৷ স্নেহ আর মমতা ঝরে পড়ছে লোকটার গলায়৷ অথচ এই লোকটাই বস!
প্রিয়াংকা বলল, ‘আমাকে একটু ভাবার সময় দিন, প্লিজ…৷’
মিহি গলা হেসে উঠল : ‘এই তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে৷ আমি সবাইকে বলে দিচ্ছি, কেউ আর তোমাকে উত্ত্যক্ত করবে না৷ তুমি প্রশান্ত মনে বিশ্রাম নাও, কেমন? এবার ফোনটা আমার লোকের হাতে প্রত্যর্পণ করো…৷’
‘প্রত্যর্পণ করো’! তখন থেকে কীসব অদ্ভুত-অদ্ভুত শব্দ মিশিয়ে কথা বলছে এই বস লোকটা! ‘মার্জনা’, ‘কর্মপন্থা’, ‘বিনাশ’, ‘অপচয়’, ‘মনোকষ্ট’—আরও কত কী!
প্রিয়াংকা মোবাইলটা লোকটার হাতে ফিরিয়ে দিল৷
লোকটা ফোন কানে দিয়ে কিছুক্ষণ কী শুনল৷ তারপর ছোট্ট করে ‘ও. কে., বস,’ বলে বোতাম টিপে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল৷
‘এখন ঘুমোও—কাল সকালে তোমার ব্যাপারে ডিসিশান জানা যাবে৷ গুড নাইট৷’
লোকটা চটপট পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ মাসি পা টেনে-টেনে দরজা পর্যন্ত গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল৷ তারপর প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে ‘শুয়ে পড়ো—’ বলে দেওয়ালের কাছে গিয়ে নিজের বিছানা পাতার কাজ শুরু করল৷
একটু পরেই মাসি কয়েকবার হাই তুলে শুয়ে পড়ল৷ প্রিয়াংকা বুঝল, ঘরের আলো জ্বালাই থাকবে—কারণ, তাতে মাসির নজরদারির সুবিধে হবে৷ তবে এটা একদিক থেকে ভালোই হল৷ প্রিয়াংকা মাঝরাতে সুযোগমতো উঠে ওই ভাঙা টেলিফোনটা নিয়ে খুটুরখুটুর করতে পারবে৷ যদি কপালজোরে বাপিকে একটা ফোন করতে পারে৷ একবার যোগাযোগ করতে পারলেই…৷
বেডকভারটা গায়ের ওপর টেনে নিয়ে প্রিয়াংকা চুপচাপ শুয়ে পড়ল৷ আলোর দিকে পিছন ফিরে ওর সাইডব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোনোর চেষ্টা করল৷ কিন্তু ঘুম কি সহজে আসে! ওর শরীর ক্লান্ত হলেও একটা চাপা উত্তেজনার ঢেউ বুকের ভেতরে দপদপ করতে লাগল৷
*
প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ পেল প্রিয়াংকা৷ ওর ইচ্ছে ছিল, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিয়ে বিদেশে যাবে৷ কত নতুন-নতুন দেশে ঘুরে বেড়াবে৷ এখন মনে হচ্ছে, স্বপ্ন স্বপ্নই৷ কাল সকালে এরা হয়তো ওকে খতমই করে দেবে৷ কিন্তু ক্যাসেটটা কোথায় লুকোনো আছে সেটা বলে দিলেই কি এরা ওকে ছেড়ে দেবে? মনে হয়, না৷ ক্যাসেটটা হাতে পাওয়ার জন্য এরা এখন এইসব কথা বলছে৷ পরে উলটো কাজ করবে৷ খবরের কাগজে এইরকম বহু ঘটনার কথা পড়েছে ও৷ সিনেমাতেও দেখেছে৷
নাঃ, ওদের হাতে মারা যাওয়ার আগে প্রিয়াংকা ওই ভাঙা টেলিফোনটা নিয়ে একটা মরিয়া চেষ্টা করে দেখবে৷ মরার আগে কিছুতেই ও মরবে না৷
অনেক ডাকাডাকি করেও ঘুম প্রিয়াংকার কাছে আসেনি৷ ও চোখে হাত চাপা দিয়ে আলো আড়াল করে শুয়ে ছিল৷ আর মাঝে-মাঝেই মাসির দিকে দেখছিল৷
একসময় ও মাসির নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেল৷ তখন ধীরে-ধীরে উঠে বসল বিছানায়৷ তারপর খুব সাবধানে পা টিপে-টিপে চলে গেল টেবিলের নীচে রাখা টেলিফোনটার কাছে৷ খোলা তারটা প্লাগে গুঁজে দিয়ে যন্ত্রটা নিয়ে কারিকুরি করতে লাগল৷ একবার ডায়াফ্রামটা খুলে ইলেকট্রোম্যাগনেটটা চেক করল৷ তারপর রিসিভারটা কানে দিয়ে অন্যান্য তার, লিভার, জয়েন্ট নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল৷ ডায়ালটোনের বদলে একটা কড়কড় শব্দ কাটা-কাটাভাবে শোনা গেল৷
কিছুক্ষণ চেষ্টার পর প্রিয়াংকা হতাশ হয়ে বিছানায় ফিরে এল৷ ওর ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা কোনও কাজে লাগাতে পারল না দেখে নিজের ওপর বিরক্ত হল৷ কিন্তু হাল ছাড়লে তো চলবে না৷
সারা রাত ধরে বেশ কয়েকবার টেলিফোন-অভিযান চালাল৷ একবার চেষ্টা করে, তারপর বিছানায় ফিরে এসে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেয়৷ তারপর আবার চেষ্টা চালায়…৷
এইভাবে যখন ও ভীষণ হতাশ এবং ক্লান্ত, তখনই কী করে যেন ও হঠাৎ করে ডায়ালটোনের শব্দ শুনতে পেল৷ ওর হাত- ঘড়িতে তখন সাড়ে ছ’টা বাজে৷ জানলা বন্ধ থাকায় ভোরের আলো চোখে পড়ার উপায় নেই৷ কিন্তু পাখির ডাক কানে আসছে৷ কয়েকটা ডাক চিনতে পারল প্রিয়াংকা৷ বউ কথা কও, বুলবুলি, কোকিল—আর কাক তো আছেই৷
ডায়ালটোন পাওয়ামাত্রই প্রিয়াংকার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে উঠল৷ ও কাঁপা হাতে বাপির মোবাইল নম্বরটা ডায়াল করল৷
একটু পরেই অবাক হয়ে শুনল, ওপাশে রিং বাজছে৷
একজন পুরুষের গলা ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই প্রিয়াংকা উদভ্রান্ত স্বরে বলে উঠল, ‘কে, বাপি? আমি পিয়া বলছি—৷’
‘বাপি?’ ও-প্রান্ত থেকে অচেনা গলায় কে যেন বলে উঠল, ‘সরি, রং নাম্বার…৷’
৷৷পাঁচ৷৷
মিমোর চেনা সেই অফিসারের নাম অনুজ দাশগুপ্ত৷
ডিউটি অফিসার পালচৌধুরীর বক্তব্য শোনার পর তিনি মিমো আর বাবলির কথা ধৈর্য ধরে শুনলেন৷ তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে পরপর চার-পাঁচটা ফোন করলেন৷ তার মধ্যে প্রথম ফোনটা যে মানিকতলা থানার ও.সি-কে করলেন সেটা ওঁর কথাবার্তা শুনেই মিমো বুঝতে পারল৷
দাশগুপ্ত ডিউটি অফিসারকে বললেন, ‘ইমপরট্যান্ট ডেটাগুলো একটা ডায়েরিতে টুকে নিয়ে মহেন্দ্র শর্মাকে বলুন প্লেন ড্রেসে তৈরি হয়ে নিতে৷ ডেটাগুলোর একটা কপি মহেন্দ্রকে দিয়ে দিন৷—আমাদের পাঁচমিনিটের মধ্যে বেরোতে হবে৷ দেরি করলে মেয়েটাকে হয়তো বাঁচানো যাবে না৷’
পালচৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন৷
দাশগুপ্ত ওঁর টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে মিমোকে বললেন, ‘মিমো, তোমার মোবাইলটা আমাদের সঙ্গে থাকা দরকার—কারণ, প্রিয়াংকার টেলিফোনটা গোলমেলে থাকায় ও আর কারও ফোনে কানেক্ট করতে পারছে না—শুধু তোমার ফোনেই লাইন লাগছে…কী যে করি!’
মিমোর মনে একটা সাধ ডানা মেলে দিল৷ ও অনেকসময় ভেবেছে, ও বড় হয়ে পুলিশ হবে—কিন্তু ভয়ে কখনও কথাটা মাকে বলেনি৷ এখন সাহস করে সেই সাধটা উগরে দিল৷
‘আমাকে আপনার সঙ্গে নেবেন, স্যার?’
অনুজ মুখ ফিরিয়ে মিমোকে দেখলেন৷ বয়েস সতেরো কি আঠারো হবে৷ গোঁফের রেখা সবে জানান দিচ্ছে৷ চোখে চকচক করছে প্রত্যাশা, আর পুলিশি অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনা৷ এ-বয়েসটা এরকমই৷
প্রিয়াংকা মেয়েটা সকাল থেকে মিমোর সঙ্গেই কথা বলেছে৷ মাঝে একবার শুধু ডিউটি অফিসার পালচৌধুরীর সঙ্গে৷ মিমোর সঙ্গে মেয়েটা হয়তো সহজভাবে কথা বলতে পারবে৷ ও গাড়িতে সঙ্গে থাকলে মন্দ কী!
কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ কী চিন্তা করার পর দাশগুপ্ত বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আমার সঙ্গে চলো—৷’
কথাটা বলামাত্রই মিমো আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল, ‘থ্যাংক য়ু, স্যার৷ থ্যাংক য়ু, স্যার৷’
আর বাবলি দাশগুপ্তর পায়ের কাছে হাতজোড় করে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল৷ কাতর গলায় বলল, ‘আমাকে বাদ দেবেন না, স্যার৷ সক্কাল থেকে আমি ওর সঙ্গে আছি, স্যার৷ দয়া করুন, স্যার, দয়া করুন—প্লিজ!’
‘আরে, কী করছ! ওঠো, ওঠো—’ বাবলিকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন দাশগুপ্ত৷ আপনমনেই বললেন, ‘কাজটা বেআইনি৷ তবে তোমাদের দুজনকে উইটনেস হিসেবে রেকর্ডে দেখিয়ে দেব৷’ তারপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘চলো, দুজনেই চলো৷ তবে কাজটায় কিন্তু রিসক আছে৷ যা অর্ডার করব অক্ষরে-অক্ষরে শুনবে৷ কোনও জায়গায় এনকাউন্টারের পসিবিলিটি থাকলে যেখানে দাঁড়িয়ে ওয়েট করতে বলব সেখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে—৷’
দাশগুপ্তর কথায় মিমো আর বাবলি এতবার করে ঘাড় কাত করতে লাগল যে, দাশগুপ্তর হাসি পেয়ে গেল৷
এরপর বাকি ছিল মিমো আর বাবলির বাড়িতে খবর দেওয়া৷
মিমো ওর মাকে ফোন করল৷ লাইন পেতেই দাশগুপ্ত ওর মায়ের সঙ্গে কথা বললেন৷
‘…না, না, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না৷ একটা ইমপরট্যান্ট আইডেন্টিফিকেশানের কাজে ওকে সঙ্গে নিচ্ছি৷ কোনও ভয় নেই৷ সেফ অ্যান্ড সাউন্ড৷ ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে৷ আমাদের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করবে৷…হ্যাঁ, হ্যাঁ—সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরে আসবে৷ মাঝে-মাঝে ফোনে আপনার সঙ্গে কথা বলবে…৷’
বাবলি বলল যে, ওর বাড়িতে ফোন-টোন নেই৷ বরং জিমে একটা মেসেজ দিয়ে রাখলেই হবে যে, ও একজন বন্ধুর বাড়িতে গেছে৷ মা কিংবা বাবা যদি জিমে খোঁজ করতে আসে তা হলে পঞ্চাদা যা বলার বলে দেবে৷
দাশগুপ্ত ওদের ‘একমিনিট—আসছি’, বলে চলে গেলেন৷
একটু পরেই সাদা পোশাকে তৈরি হয়ে ফিরে এলেন৷ ডান হাতে ধরা একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ডাবল অ্যাকশান ০.৩৮ ক্যালিবারের চিফস স্পেশাল রিভলভার৷ সেটা জামা তুলে কোমরের কাছে গুঁজে নিলেন৷
মহেন্দ্র শর্মা নামের একজন অফিসার মিমো আর বাবলির কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন৷ দোহারা ফরসা চেহারা৷ মাথায় লম্বা-লম্বা চুল৷ ধারালো চোখ-মুখ৷ পানের রসে ঠোঁট রঙিন৷
দাশগুপ্ত ওঁকে জিগ্যেস করলেন, ‘আর্মস নিয়েছ তো?’
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ, নিয়েছেন৷
‘চলো—’ বলে অনুজ থানার গেটের দিকে এগোলেন৷
থানার বাইরে বাঁ-দিক ঘেঁষে একটা লাল রঙের টাটা সুমো দাঁড়িয়ে ছিল৷ মিমো দেখল, সেটার গায়ে ‘পুলিশ’ লেখা নেই৷ সেটা করে ওরা সবাই রওনা হল৷ দাশগুপ্ত মিমোকে ড্রাইভারের পাশে বসালেন, তারপর নিজে জানলা ঘেঁষে বসলেন৷ বাবলি আর মহেন্দ্র বসলেন ওঁদের ঠিক পিছনের সিটে৷
গাড়ি খালপাড়ের রাস্তা ধরে রওনা হতেই দাশগুপ্ত ড্রাইভারকে বললেন, ‘এয়ারপোর্টের দিকে চলো—৷’
কিছুক্ষণ পর দাশগুপ্তর মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷ তিনি ফোন ধরে কথা বলতে লাগলেন৷ মিমো কান খাড়া করে কথাবার্তাগুলো শুনতে লাগল৷
কথা শেষ হলে মিমো আর কৌতূহল চাপতে পারল না৷ সরাসরি জিগ্যেস করে বসল, ‘স্যার, আর কোনও খবর পাওয়া গেল?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাশগুপ্ত বললেন, ‘নাঃ, সেরকম কোনও খবর নেই৷ প্রিয়াংকার বাড়ির ঠিকানা তো তুমি জানো…কনভেন্ট রোডে…মানে, এন্টালি থানা এলাকায়৷ সেখানে খবর দিয়েছিলাম৷ ওঁরা প্রিয়াংকার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন৷ ওর বাবার হাই কানেকশান থাকায় লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টও ব্যাপারটার মধ্যে ঢুকে পড়েছে৷ এখন ওরা মিস্টার মজুমদারের মোবাইল ফোন ট্যাপ করে কনভারসেশান টেপ করার জন্যে মোবাইল ফোন সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে কথা বলছে৷ হয়তো আর আধঘণ্টা কি এক ঘণ্টার মধ্যে টেপ করার কাজটা শুরু হয়ে যাবে৷ দেখি, তখন যদি নতুন কিছু জানা যায়…৷’
ওদের গাড়ি ততক্ষণে উলটোডাঙ্গার আন্ডারপাসে এসে পড়েছে৷ অফিসটাইমের জ্যাম ভালোমতোই জাঁকিয়ে বসেছে৷ বাস, প্রাইভেট কার, অটো সব একেবারে জট পাকিয়ে গেছে৷ অকারণেই গাড়িগুলো হর্ন দিচ্ছে৷
দাশগুপ্ত বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন৷ আর মিমো মনে-মনে প্রিয়াংকার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ একইসঙ্গে ও টের পাচ্ছিল, খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে৷ কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে সে-কথা অনুজ দাশগুপ্তকে বলতে পারছিল না৷
জ্যামজট ছাড়িয়ে উলটোডাঙ্গা-ভি. আই. পি-র মোড়ে আসতে প্রায় মিনিট-পনেরো লেগে গেল৷ তারপরই বাঁ-দিকে ঘুরে বেশ ফাঁকা রাস্তা৷ রাস্তায় গাড়ি থাকলেও গতি আছে৷ দাশগুপ্ত চাপা গলায় পাইলটকে বললেন, ‘ধনিয়া, থোড়া তেজ চালাও…৷’
বাবলি হঠাৎ পিছনের সিট থেকে মিমোর কাঁধে চাপ দিল৷ মিমো ফিরে তাকাতেই ও মাথা ঝুঁকিয়ে মিমোর কানের কাছে মুখ এনে খুব চাপা গলায় বলল, ‘বস, পেটে চুঁহা দৌড়চ্ছে৷ আর পারছি না৷ তুই স্যারকে বল৷’
অনুজ দাশগুপ্ত মিমোর দিকে ফিরে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার?’
মিমো আমতা-আমতা করে বলল, ‘সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি—৷’
‘ওঃ হো!’ একটু লজ্জা পেয়ে দাশগুপ্ত বললেন, ‘ধনিয়া, একটা খাবারের দোকান দেখে গাড়ি লাগাও…৷’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টাটা সুমোটা লেক টাউনের মোড়ে এসে গেল৷ ধনিয়া বাঁ-দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে কয়েকটা খাবারের দোকানের সামনে এসে গাড়িটা দাঁড় করাল৷
আর ঠিক তখনই মিমোর মোবাইল বাজতে শুরু করল৷ মিমো মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকাল৷
প্রিয়াংকা৷
দাশগুপ্তর দিকে তাকিয়ে ‘প্রিয়াংকা’ বলে মিমো ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলল৷
‘ওঃ, অনেক কষ্টে আবার লাইন পেয়েছি৷’ ওপাশ থেকে প্রিয়াংকা চাপা গলায় বলল৷ ‘যা বলছি, ভালো করে শুনুন…৷’
‘হ্যাঁ, বলুন…৷’
‘তিনটে লোক কলেজের কাছ থেকে আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে৷ তার মধ্যে একজন ড্রাইভার৷ পথে গাড়ি চেঞ্জ করেছে৷ আমার চোখে পটি বেঁধে এখানে নিয়ে এসেছে৷ আমি একটা গোডাউনের মতো ঘরে রয়েছি৷ একতলায়৷ ঘরে সিমেন্ট, বালি, স্টোনচিপের বস্তা৷ একজন মাসি আমাকে পাহারা দিচ্ছে৷ এখন মাসি ঘরে নেই৷ ট্রাই করতে-করতে লাইনটা হঠাৎ পেয়ে গেছি৷ এই জায়গাটা এয়ারপোর্টের কাছে৷ খুব ফ্রিকোয়েন্টলি প্লেন ওঠা-নামা করছে৷ তা ছাড়া একটু আগেই টয়লেটে যাওয়ার নাম করে আমি ঘরের বাইরে বেরিয়েছিলাম৷ দিনের বেলা এই ফার্স্ট টাইম৷ যা-যা দেখেছি বলছি—ভালো করে শুনুন…৷’
‘শুনছি, বলুন…৷’ মিমো রুদ্ধশ্বাসে বলল৷
‘বাড়িটার সঙ্গে একটা বাগান মতো আছে৷ এ ছাড়া ইস্টের দিকে—মানে, সূর্য এখন যেদিকে—সেদিকে তাকিয়ে একটা সবুজ রঙের তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়ি—মানে, বাড়ির পেছনদিকটা—দেখতে পেয়েছি৷ বাড়িটার ছাদের ওপর একটা টাওয়ার—লাল আর সাদা রঙের৷ মানে, মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার যেমন হয়৷ আর এদের একজন বস আছে৷ আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে৷ আমার কাছে একটা মাইক্রো-ক্যাসেট চাইছে—হ্যান্ডিক্যামের মাইক্রো-ক্যাসেট৷ সেটা কোথায় আছে বলছি না বলে আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে৷ শুনছি, আজ সকালে আমার ব্যাপারে ফাইনাল ডিসিশান নেবে৷ যা করার জলদি করুন—৷’
‘আপনি ভয় পাবেন না৷ পুলিশ আপনার বাবার সঙ্গে কনট্যাক্ট করেছে৷ ওঁর মোবাইল ট্যাপ করার ব্যবস্থা করেছে৷ এ ছাড়া পুলিশ অফিসাররা এর মধ্যেই গাড়ি নিয়ে আপনার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন৷ সেই গাড়িতেই আমি বসে আছি—৷’
‘আপনার নাম কী?’
মিমোর খেয়াল হল, সকাল থেকে নিজের নামটাই প্রিয়াংকাকে কখনও বলা হয়নি৷ ও ফোনে নাম বলল৷ তারপর আরও বলল, ‘ভয় পাবেন না৷ একটু ওয়েট করুন৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আপনাকে খুঁজে বের করব…৷’
হঠাৎই দাশগুপ্ত মিমোর কাছ থেকে মোবাইল ফোনটা চেয়ে নিলেন৷ প্রিয়াংকাকে বললেন, ‘প্রিয়াংকা, মানিকতলা থানার অ্যাডিশনাল ও.সি. অনুজ দাশগুপ্ত বলছি৷ য়ু আর রিয়েলি আ ব্রেভ গার্ল৷ যা করার আমরা করছি৷ এয়ারপোর্ট এরিয়ার থানাগুলোকে আমরা অ্যালার্ট করে দিয়েছি৷ লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট এর মধ্যেই অ্যাকশানে নেমে পড়েছে৷ মনে হয় আর এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যেই আমরা তোমাকে রেসকিউ করতে পারব৷ য়ু জাস্ট হ্যাং অন৷ ডোন্ট গেট নার্ভাস৷ আচ্ছা, ওই লোকগুলোর কাছে কি আর্মস আছে?’
‘হ্যাঁ—আছে৷ রিভলভার৷’
‘ডোন্ট উয়ারি, প্রিয়াংকা৷ আমরাও তৈরি আছি৷ তুমি একটুও ভয় পেয়ো না৷ আর ড্রাস্টিক কিছু করতে যেয়ো না৷ ও. কে.?’
‘যা করার তাড়াতাড়ি করুন৷ আজ সকালের মধ্যেই আমার ব্যাপারে ওরা যা হোক একটা ফাইনাল ডিসিশান নিয়ে…এই রে, মাসি এসে গেছে৷’ কথাটা বলেই টেলিফোনের লাইন কেটে দিল প্রিয়াংকা৷
দাশগুপ্ত মিমোকে মোবাইলটা ফেরত দিতে-দিতে জিগ্যেস করলেন, ‘মাসিটা কে?’
মিমো বলল৷ তারপর ওর সঙ্গে প্রিয়াংকার যা-যা কথাবার্তা হয়েছে সেগুলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জানাল৷ পিছনের সিটে বসা মহেন্দ্র কাগজ পেন বের করে পয়েন্টগুলো সংক্ষেপে টুকে নিলেন৷
মিমোর মুখে ‘মাইক্রো-ক্যাসেট’-এর কথা শুনে দাশগুপ্তর ভুরু কুঁচকে গেল৷ তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘এই মাইক্রো-ক্যাসেটের ব্যাপারটা কী?’
মিমো ঠোঁট উলটে বলল, ‘কী জানি—জানি না৷ এই ফার্স্ট টাইম শুনছি৷ পরের বার ফোন করলে জিগ্যেস করব৷’
গাড়িতে বসে কিছুক্ষণ আলোচনার পর দাশগুপ্ত পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে মহেন্দ্রকে বললেন সামনের দোকানগুলো থেকে কিছু খাবার কিনে নিতে, আর সঙ্গে স্প্রাইটের একটা দু-লিটারের বোতল৷ তা হলে চলন্ত গাড়িতে বসেই খাওয়ার কাজটা সেরে নেওয়া যাবে৷ শুধু-শুধু আর সময় নষ্ট হবে না৷
মহেন্দ্র খাবার কিনে নিয়ে ফিরে আসতেই ধনিয়া গাড়ি ছুটিয়ে দিল৷ অনুজ দাশগুপ্ত ওদের সবাইকে খাবার ভাগ করে নিতে বললেন৷ নিজেও নিলেন৷ তারপর খাওয়া শুরু করার আগেই কোথায় যেন ফোন করে কথা বলতে লাগলেন৷
মিমো হাঁ করে দাশগুপ্তর কথাগুলো গিলতে লাগল৷ ওর ভেতরে-ভেতরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা চারিয়ে যাচ্ছিল৷ ও বুঝতে পারছিল, দাশগুপ্ত অন্য কোনও থানার পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে কথা বলছেন৷
‘…হ্যাঁ, আপনারা এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এলাকায় চক্কর দিন৷ আর এটা লক্ষ রাখবেন—সবুজ রঙের তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়ি…বাড়ির ছাদে মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডারের লাল আর সাদা রঙের টাওয়ার…মানে, ভোডাফোন, এয়ারটেল, টাটা ইন্ডিকম—এইসব কোম্পানির টাওয়ার৷ লোকেট করতে পারলেই লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে জানাবেন৷ ওরাই ব্যাপারটা সেন্ট্রালি ডিল করছে৷ …এই অপারেশানটার নাম হচ্ছে ‘‘অপারেশান ব্ল্যাক’’৷ ওরা আমাকে এই অপারেশানের কো-অর্ডিনেটর করেছে৷…হ্যাঁ, আমিই ইন্সট্রাকশন দেব, তবে ইনফরমেশান আপনারা যা পাবেন সবই লালবাজারে জানাবেন৷ ওরা আমাকে সবসময় আপডেট করবে৷…হ্যাঁ, হ্যাঁ—ও. কে.৷’
দাশগুপ্ত ফোন শেষ করে সিটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন৷ শুরু থেকেই মানুষটার বিশ্রাম নেই—একের পর এক ফোন—হয় আসছে, নয় যাচ্ছে৷ এখন একটু ফুসরত পেয়ে খেতে শুরু করলেন৷
মিমো, বাবলি, ধনিয়া আর মহেন্দ্রর খাওয়া প্রায় শেষের দিকে৷ স্প্রাইটের বোতলটা ওদের হাতে-হাতে ঘুরছিল৷ মহেন্দ্র এবার বোতলটা দাশগুপ্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নিন, স্যার৷’
দাশগুপ্ত মুখ উঁচু করে খুব সাবধানে দু-ঢোঁক স্প্রাইট খেলেন৷ মিমো লক্ষ করল, স্যারের যাতে ওভাবে কোল্ড ড্রিংক খেতে অসুবিধে না হয় সেজন্য পাইলট ধনিয়া গাড়ির স্পিড অনেক কমিয়ে দিল৷
মহেন্দ্র মাথা চুলকে বললেন, ‘স্যার, লগতা হ্যায় বহত সারে ক্রিমিনাল লোগ ব্যাপারটার মধ্যে জড়িয়ে আছে৷ প্রথমে তিনটে লোক—তারপর ওই ‘‘বস’’৷ আর পাহারাদার মাসি৷’
দাশগুপ্ত একটা বড় শ্বাস ফেলে বললেন, ‘হুঁ৷ তার ওপর মহেন্দ্র, আর-একটা ব্যাপার নোট করো : কিডন্যাপাররা টাকা চাইছে না—চাইছে স্রেফ হ্যান্ডিক্যামের একটা মাইক্রো-ক্যাসেট৷’ বাইরের ছুটে যাওয়া রাস্তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন দাশগুপ্ত৷ তারপর আপনমনেই বললেন, ‘কী আছে ওই মাইক্রো-ক্যাসেটে—যেটা এত ডেসপারেটলি ওদের দরকার?’
মিমো মনে-মনে ভাবল, মাইক্রো-ক্যাসেটটা কি কোনও গুপ্তধনের খোঁজ দেবে? নইলে একটা সামান্য ক্যাসেটের জন্য এত হইচই হাঙ্গামা!
ওদের টাটা সুমো বাগুইআটির জমজমাট মোড় পেরিয়ে গেল৷ জায়গাটা অটোরিকশো, সাইকেল, সাইকেল রিকশোয় একেবারে থিকথিক করছে৷ তার ওপরে অফিসটাইমের মানুষজন, গাড়ি, বাস আর মিনিবাসের ভিড়৷
মোড়টা পেরোনোর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মিমোর মোবাইল বেজে উঠল৷ বাবলি চাপা গলায় বলে উঠল, ‘প্রিয়াংকা!’
কিন্তু না—মিমোর মায়ের ফোন৷
উতলা মাকে ঠান্ডা করতে মিমোকে বেশ কষ্ট করতে হল৷ ও বারবার করে বলল, পেট ভরে টিফিন খেয়েছে৷ কোনও ভয় নেই৷ ‘স্যার’ ওদের সঙ্গেই গাড়িতে বসে আছেন৷ মা যেন ওর জন্য বসে না থেকে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে নেয়৷
মিমো ফোন ছাড়তে-না-ছাড়তেই দাশগুপ্তর ফোন বেজে উঠল৷
এপাশের কথা শুনে বোঝা গেল, লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ফোন৷
‘…ওরা মিস্টার মজুমদারকে ফোন করেছিল?…কার ফোন থেকে?…ও, প্রিয়াংকার ফোন থেকে?…কী বলছে?…ওঃ, সেই একই মাইক্রো-ক্যাসেট! তো লাইনটা ট্যাপ করা গেছে? বাঁচালেন—মেনি থ্যাংকস! কিন্তু প্রিয়াংকার মোবাইল থেকে করা কলটা কোন এরিয়ার টাওয়ারের টাই-আপ থেকে আসছে সেটা জানা যায়নি? মানে…এয়ারপোর্টের কাছাকাছি কোন টাওয়ার-বেস-স্টেশান থেকে…মানে…৷ তাই নাকি? ও. কে. ও. কে.৷ আমরা এখুনি সেই টার্গেট ধরে এগোচ্ছি৷ আ লট অফ থ্যাংকস!…হ্যাঁ, হ্যাঁ—দরকার হলেই আমি রিং করে নেব৷ ডিসি ডিডি ওয়ান কেসটায় দারুণ ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছেন? সেটা আমাদের গুডলাক বলতে হবে৷ হ্যাঁ—ঠিক আছে৷ ওভার অ্যান্ড আউট৷’
দাশগুপ্তর ফোন শেষ হতেই মিমো আগ্রহ নিয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকাল৷ একদিকের কথাবার্তা শুনে ব্যাপারটা মোটামুটি বোঝা গেলেও শেষদিকের ওই টাওয়ারের ব্যাপারটা পুরো জানা যায়নি৷ তাই কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর ও জিগ্যেস করল, ‘স্যার, মোবাইল ফোনে তো এরিয়ার নাম ওঠে৷ আর ভোডাফোন, এয়ারটেল—এসব কোম্পানির কাছে শুনেছি নানান মডার্ন যন্ত্রপাতি আছে৷ ওরা সব জানে৷ কথাবার্তাও টেপ করে রাখতে পারে৷ প্রিয়াংকার মোবাইল ফোন থেকে কিডন্যাপাররা ওর বাবাকে ফোন করেছিল শুনলাম৷ তা হলে সেই কল থেকে…৷’
হাতের ইশারায় মিমোকে থামিয়ে দিলেন দাশগুপ্ত৷ তারপর সামনের রাস্তার দিকে আড়চোখে নজর রেখে বললেন, ‘ঠিকই প্রশ্ন করেছ৷ ওটা জানা গেছে৷ প্রিয়াংকা কৈখালি এরিয়ায় আছে৷ অন্তত ওর মোবাইল ফোনের টাওয়ার তাই বলছে৷ যদি না বদমাশগুলো আমাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্যে ওর ফোনটা নিয়ে কৈখালি এলাকায় এসে ফোন করে থাকে৷ প্রিয়াংকার মোবাইলে ভোডাফোনের কানেকশান৷ ওরা নিজেদের ডিপার্টমেন্টে এনকোয়ারি করে কৈখালি এরিয়ায় ওদের টাওয়ারটা এগজ্যাক্টলি কোন বাড়ির ছাদে বসানো আছে সেটা চেক করে একটু পরেই জানাচ্ছে৷ ততক্ষণে আমরাও ট্রাই করে দেখি…৷’
ওদের গাড়ি তেঘরিয়ার নতুন ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে৷ সামনে ফাঁকা মসৃণ রাস্তা৷ গাড়ি ঘণ্টায় নব্বইতে চলছে৷ জানলা দিয়ে হু-হু করে বাতাস ঢুকছে৷ মহেন্দ্রর লম্বা চুল পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে৷
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অনুজ দাশগুপ্ত আবার মুখ খুললেন৷ পাইলটকে লক্ষ করে বললেন, ‘ধনিয়া, আর-একটু পরেই আমরা কৈখালির মোড়ে এসে পড়ব৷ ওই মোড়ে ডানদিক নেবে৷ তারপর চিড়িয়ামোড় পার করে গাড়ি সাইড করবে৷’
পাইলট ধনিয়া গাড়ি চালাতে-চালাতেই ঘাড় নাড়ল৷
দাশগুপ্ত এবার মোবাইল ফোন নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ বোতাম টিপে ফোন করতে শুরু করলেন৷
‘হ্যালো, ইন্সপেক্টার অনুজ দাশগুপ্ত বলছি৷ অপারেশান ব্ল্যাকের কো-অর্ডিনেটর৷…কৈখালি এরিয়া থেকে কিডন্যাপাররা প্রিয়াংকার বাবাকে কনট্যাক্ট করেছিল৷ আমরা চিড়িয়ামোড়ের কাছে যাচ্ছি৷ আপনারাও কনভার্জ করুন৷ তারপর তিনতলা সবুজ রঙের ফ্ল্যাটবাড়ি, মোবাইল ফোনের টাওয়ার—রেড অ্যান্ড হোয়াইট—আর লাস্ট পয়েন্টার হল সিমেন্ট, বালি, স্টোনচিপের গোডাউনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে মেয়েটা রয়েছে৷ পসিবলি কোনও বিল্ডার, মানে, সিভিল কন্ট্রাক্টরের বাড়ি৷ সেই বাড়িতে বিল্ডারের অফিসও থাকতে পারে৷ তবে সার্ভিস প্রোভাইডারের—মানে, ভোডাফোন কোম্পানির কাছ থেকেও যখন-তখন আমরা মোবাইল টাওয়ারটার এগজ্যাক্ট লোকেশান পেয়ে যেতে পারি৷ পেলেই আপনাদের ইনফরম করব৷…আপনারা কেয়ারফুলি কনভার্জ করুন৷ লালবাজার থেকেও গাড়ি আসছে৷ টপ লেভেল থেকে ইনস্ট্রাকশন আছে, যে-করে-হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে৷ দরকার হলে এনকাউন্টার করতে হবে৷ তবে আমি ফাইনাল ‘‘ও. কে.’’ সিগন্যাল দেওয়ার পর৷ …হ্যাঁ, ঠিক আছে৷ ওভার অ্যান্ড আউট৷’
গাড়ি কৈখালির মোড়ে এসে ডানদিকের রাস্তায় ঢুকল৷ অনুজ দাশগুপ্ত মহেন্দ্র শর্মাকে লক্ষ করে বললেন, ‘মহেন্দ্র, আর্মস রেডি রাখবে৷ লোকগুলো মনে হয় ডেঞ্জারাস৷ যদি দরকার হয়, শুট টু কিল৷’
ছোট্ট করে হাসলেন মহেন্দ্র৷ বললেন, ‘আপ বেফিকর রহিয়ে, স্যার৷ সোজা দু-চোখের মাঝখানে…৷’
মহেন্দ্রর কথায় মিমো ভেতরে-ভেতরে কেঁপে উঠল৷ মহেন্দ্র কত সহজে দু-চোখের মাঝখানে গুলি করে ক্রিমিনাল খতম করার কথা বলছেন! মিমো টের পেল ওর বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ শুরু হয়ে গেছে৷
চিড়িয়ামোড় যতই এগিয়ে আসছিল, অনুজ দাশগুপ্ত ততই ওঁর মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন৷ ক্রমশ উত্তেজনার পারা যে বাড়ছে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল৷
চিড়িয়ামোড়ে পিচের রাস্তার বাঁকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওদের টাটা সুমো বাঁ-দিকে বাঁক নিল৷ তারপর আবার ডানদিকে৷ তারপর বেশ খানিকটা এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাশগুপ্ত ধনিয়াকে গাড়ি সাইড করতে বললেন৷ ধনিয়া গাড়ি থামাতেই অনুজ দাশগুপ্ত নেমে পড়লেন৷ ওঁর ইশারায় মিমো, বাবলি আর মহেন্দ্রও নামলেন৷
দাশগুপ্ত আপনমনেই বিড়বিড় করলেন, ‘সবুজ রঙের তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়ি, তার সঙ্গে মোবাইল ফোনের টাওয়ার…৷’ তারপর মহেন্দ্রকে লক্ষ করে বললেন, ‘শর্মা, চলো দোকান-টোকানগুলোয় জিগ্যেস করি—কোথায় আছে ওই ফ্ল্যাটবাড়ি আর ওই টাওয়ার৷ যদি কপাল ভালো থাকে তা হলে এর মধ্যেই হয়তো ভোডাফোন কোম্পানি থেকে টাওয়ারের ইনফরমেশান এসে পড়বে…৷’
মিমো বলল, ‘স্যার, আমি আর বাবলিও একটু এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে খোঁজ করি?’
অনুজ ঠোঁট কামড়ে কয়েক লহমা কী ভাবলেন৷ তারপর বললেন, ‘বি কেয়ারফুল—বেশি দূরে যেয়ো না৷ কোনও প্রবলেম হলেই গাড়িতে ফিরে আসবে৷ তা ছাড়া যে-কোনও সময় আমরা টাওয়ারটার খোঁজ পেয়ে যেতে পারি…৷’
মিমো ঘাড় কাত করে বলল, ঠিক আছে৷ তারপর ও আর বাবলি টাওয়ার আর ফ্ল্যাটবাড়ির সন্ধান করতে রওনা হয়ে গেল৷
রাস্তার দুপাশে ছোট-বড় দোকান৷ একটা বড়সড় মিষ্টির দোকানে গিয়ে বাবলি টাওয়ারটার কথা জিগ্যেস করল৷ দোকানদার এমনভাবে ওর মুখের দিকে তাকাল যে, মিমোর মনে হল ভদ্রলোক মঙ্গলগ্রহের কিম্ভূতকমাকার এক প্রাণী দেখছে৷ তাই ওরা আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি সরে এল৷
এরপর একটা স্টেশনারি দোকান আর একটা ওষুধের দোকানে খোঁজ করে হতাশ হওয়ার পর ওরা একটা মোবাইল ফোনের দোকান খুঁজে পেল৷
মিমো বলল, ‘এই দোকানটায় নিশ্চয়ই ঠিক খবর পাওয়া যাবে৷’
দোকানটায় ঢুকে সবে জিগ্যেস করতে যাবে, এমন সময় মিমোর মোবাইল বেজে উঠল৷
প্রিয়াংকার ফোন ভেবে ও চটপট বোতাম টিপে ফোন কানে চেপে ‘হ্যালো’ বলল৷
ফোনটা করেছেন অনুজ দাশগুপ্ত৷
‘মিমো, এক্ষুনি গাড়িতে চলে এসো৷ আমরা টাওয়ারটার খোঁজ পেয়ে গেছি৷ কুইক৷’
সঙ্গে-সঙ্গে মিমো আর বাবলি পিছনে ফেলে আসা রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করল৷
যখন ওরা টাটা সুমোর প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে তখনই প্রিয়াংকার ফোন এল৷
‘হ্যালো…হ্যালো…প্রিয়াংকা বলছি…৷’
‘বলুন—৷’
টেলিফোনে এমন কড়কড় শব্দ হচ্ছিল যে, মিমোর ভয় হল লাইনটা এক্ষুনি কেটে না যায়৷
‘আপনারা কোথায়?’
‘আপনার আস্তানার খুব কাছাকাছি৷’
‘ওরা আমাকে শিফট করার কথা ভাবছে৷ শুনলাম, এক্ষুনি গাড়ি আসবে৷ তা ছাড়া মাসির সঙ্গে টাকাপয়সার হিসেব মেটাচ্ছে৷ আপনারা তাড়াতাড়ি করুন৷’
‘মনে হয় আর দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা আপনার কাছে পৌঁছে যাব৷’
‘হাতে আর বেশি সময় নেই৷ ওই ‘‘বস’’ লোকটা আবার ফোন করেছিল৷ ক্যাসেটটা ওর চাই-ই চাই৷ আমার ভীষণ ভয় করছে৷ আর কতক্ষণ এভাবে টেনশান নিয়ে থাকতে পারব জানি না৷ প্লিজ, তাড়াতাড়ি করুন…৷’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—করছি৷ কিন্তু ওই ক্যাসেটটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন? কী আছে ওই ক্যাসেটে?’ কৌতূহল চাপতে না পেরে জানতে চাইল মিমো৷
‘সরি৷ আপনি আমার অনেক উপকার করছেন কিন্তু তবুও এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না৷ ওই ক্যাসেটটায় কী আছে, ওটা কোথায় রেখেছি—এসব কাউকেই বলব না৷ এগুলোই আমার বেঁচে থাকার লাইসেন্স৷ আগে এখান থেকে পুলিশ আমাকে রেসকিউ করুক—আমি স্টেবল লাইফে ফিরে যাই—তারপর টপ লেভেলে ওই ক্যাসেট জমা দেব…৷’
প্রিয়াংকার কথাবার্তায় একটা জেদি ভাব ছিল৷ সেটা বুঝতে পেরে মিমো আর ঘাঁটাল না৷
এমন সময় একটা প্লেনের শব্দ শোনা গেল৷ কাছেই এয়ারপোর্ট থেকে একটা প্লেন আকাশে উড়েছে৷
প্রিয়াংকা বলল, ‘একমিনিট ওয়েট করুন৷ একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে—বড্ড শব্দ হচ্ছে—কোনও কথা শোনা যাবে না…৷’
‘এই তো! প্লেনটা আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে৷ ওটার পেটে লাল আর সবুজ রঙের পটি আঁকা—৷’
‘আমি ঘরের ভেতরে৷ প্লেনটা দেখতে পাচ্ছি না—শুধু শব্দ শুনতে পাচ্ছি৷ মনে হয় আমরা একই প্লেনের কথা বলছি৷ ওঃ, আপনারা তা হলে এত কাছে এসে গেছেন৷ আমার…৷’
প্রিয়াংকার কথার মাঝখানে লাইনটা কেটে গেল৷
গাড়ির কাছে পৌঁছে মিমো আর বাবলি রীতিমতো হাঁপাতে লাগল৷ অনুজ আর মহেন্দ্র গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন৷ ওরা আসামাত্র সবাই চটপট গাড়িতে উঠে পড়লেন৷ ধনিয়া এক ঝটকায় গাড়িটা ছুটিয়ে দিল৷
দাশগুপ্ত মোবাইলে কথা বলতে শুরু করলেন৷ ওঁর কথা শুনে বোঝা গেল আরও দুটো গাড়ি আর্মড অফিসারদের নিয়ে একই টার্গেট লক্ষ্য করে এগোচ্ছে৷ সবমিলিয়ে আর কয়েক মিনিটের মামলা৷
মহেন্দ্র শর্মা কোমর থেকে রিভলভারটা বের করে একবার আগেপিছে খটাখট করে দেখে নিলেন অস্ত্রটা রেডি আছে কি না৷ ফোনে কথা বলতে-বলতেই মহেন্দ্রকে লক্ষ করলেন দাশগুপ্ত৷ সামান্য হেসে চোখের ইশারায় যেন বলতে চাইলেন, ‘এই তো চাই! অলওয়েজ বি প্রিপেয়ারড বিফোর অ্যাকশান৷’
একটু পরেই মিমোরা পৌঁছে গেল তিনতলা একটা ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে৷ বাড়িটার রং হালকা সবুজ৷ আর ছাদে মোবাইলের টাওয়ার৷
দাশগুপ্ত মিমোকে বললেন, ‘মিমো, তুমি বলেছিলে, ইস্টের দিকে তাকিয়ে প্রিয়াংকা এই ফ্ল্যাটবাড়িটার পেছনদিক দেখতে পেয়েছিল—তাই না?’
‘হ্যাঁ স্যার—৷’
‘তা হলে আমাদের এখন পেছনদিকে যেতে হবে৷’ বলেই ধনিয়ার দিকে তাকালেন দাশগুপ্ত : ‘ধনিয়া, কুইক৷’
গাড়ি আবার স্টার্ট দিল৷ সুযোগ পেয়ে মিমো দাশগুপ্তকে প্রিয়াংকার শেষ ফোনটার কথা বলল৷ বলল, ‘ওরা প্রিয়াংকাকে শিফট করবে৷ এখুনি গাড়ি আসবে৷’
এদিক-ওদিক গাড়িটা ঘুরিয়ে ধনিয়া এক জায়গায় গাড়িটা এনে দাঁড় করাল৷ দরজা খুলে একলাফে নেমে পড়লেন অনুজ৷ মোবাইল ফোনে আবার ব্যস্তভাবে কথা বলতে শুরু করলেন৷ বোঝা যাচ্ছিল, তিনি রাস্তার ডিরেকশান দিচ্ছেন৷
ওঁর কথা বলার মধ্যেই আরও দুটো গাড়ি এসে হাজির হল৷ গাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ ব্যস্তভাবে নেমে পড়ল৷ অনুজ দাশগুপ্ত ফোনে কথা বলা শেষ করে ওঁদের কাছে এগিয়ে গেলেন৷ কয়েকজনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দ্রুত পরিচয়ের পালা শেষ করলেন৷ তারপর হাত নেড়ে-নেড়ে ইশারা করে নানারকম নির্দেশ দিতে লাগলেন৷
মিমো আর বাবলি বুঝতে পারছিল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝোড়ো অ্যাকশান শুরু হবে৷
৷৷ছয়৷৷
আসল বাড়িটা খুঁজে পেতে ওঁদের বেশিক্ষণ সময় লাগল না৷ হাঁটা পথে বাড়িটা মিনিটখানেক৷ বাড়ির সামনে সরু পিচের রাস্তা৷ রাস্তার অবস্থা ভালো নয়৷ এখানে-ওখানে গর্ত আর ফাটল৷ আর যানবাহন বলতে সাইকেল রিকশো আর সাইকেল—কখনও একটা কি দুটো মোটরবাইক৷
নানান দিকে সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা করে চারজনের একটা দল নিয়ে এই সরু রাস্তাটায় ঢুকে পড়েছেন দাশগুপ্ত৷ সঙ্গে মিমো আর বাবলি৷
বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা ফাঁকা জমির পাশে মিমোদের অপেক্ষা করতে বললেন অনুজ৷ আরও বললেন, প্রিয়াংকা যদি ফোন করে তা হলে ওকে বলতে যে, ও যেন ভয় না পায়৷ আর যদি কোনও বিপদের আভাস দেখা দেয় তা হলে মিমোরা যেন সোজা টাটা সুমোর দিকে ছুট লাগায়৷
মিমোরা বাড়িটা দেখতে পাচ্ছিল৷ বাড়ির পাশ ঘেঁষে ইটের পাঁজা৷ তার পাশে স্তূপাকার স্টোনচিপ আর বালি৷ একটা সাইনবোর্ডও বাড়ির দেওয়ালে দেখা যাচ্ছে৷
বাড়ির কাছে গিয়ে পকেটের মোবাইল ফোনটা অফ করে দিলেন অনুজ৷ ওঁর দেখাদেখি অন্য অফিসাররাও তাই করলেন৷ এনকাউন্টারের সময় মোবাইলের আওয়াজ অন্যমনস্ক করে দিতে পারে৷
চাপা গলায় ‘রেডি’ বলে অনুজ দরজার ফ্রেমে লাগানো কলিংবেলের বোতাম টিপলেন৷
কোনও সাড়া নেই৷
আবার বোতাম টিপতেই একজন মহিলা দরজা খুললেন৷ কুচকুচে কালো গায়ের রং, চোখজোড়া অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, নাকে নথ৷
একটা শব্দও খরচ না করে মহিলাকে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের গতিতে ঢুকে গেলেন ওঁরা চারজন৷ আর্মস হাতে তুলে নিয়ে চিতার ক্ষিপ্রতায় এদিক-ওদিক ছিটকে গেলেন৷ অনুজ চেঁচিয়ে বললেন, ‘শুট অ্যাট সাইট৷’
অফিসারদের কে একজন বললেন, ‘ও. কে., স্যার৷’
বাড়িটা দোতলা৷ সামনে ফাটল ধরা সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন৷ পাশে খানিকটা খোলা জায়গা৷ তারপরই বাগান৷ বাগান বলতে কয়েকটা কলাগাছ, আর তার সঙ্গে গোটাতিনেক পেয়ারা আর তেঁতুল গাছ৷
বাগানের পাশ ঘেঁষে একটা বড়সড় ঘর৷ মাথায় টালির দোচালা৷ ওটা গোডাউন হতে পারে ভেবে অনুজ সেদিকে ছুটলেন৷ একইসঙ্গে ‘প্রিয়াংকা! প্রিয়াংকা!’ বলে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন৷
মহেন্দ্র শর্মা রিভলভার উঁচিয়ে বাগানটা একদৌড়ে পরখ করে নিয়েই ছুটলেন বাড়ির দিকে৷ অন্য দুজন অফিসার তখন যে বাড়ির অন্য ঘরগুলো সার্চ করছেন সেটা লাথি মেরে দরজা খোলার ‘দড়াম! দড়াম!’ আওয়াজে ভালোই বোঝা গেল৷
গোডাউনের দরজা বন্ধ কিংবা ভেজানো ছিল৷ অনুজ ছোটার গতি এতটুকুও না কমিয়ে বাঁ-কাঁধের ধাক্কায় দরজার পাল্লা ছিটকে দিয়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে পড়লেন৷ দুটো পাক গড়িয়ে যখন সামনে রিভলভার তাক করে উপুড় হয়ে তাকালেন তখন পাথর হয়ে গেলেন৷
ঘরটাকে গোডাউনই বলা যায়৷ দেওয়ালে ঘেঁষে কয়েকটা সিমেন্টের বস্তা, প্লাস্টার অফ প্যারিসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের ড্রাম, আরও কত কী! তা ছাড়া বাতাসে হালকাভাবে চুনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে৷
ঘরের মেঝেতে পাতা বিছানায় একটি একুশ-বাইশ বছরের ফরসা সুন্দরী মেয়ে হাঁটুগেড়ে বসে আছে৷ গায়ে গাঢ় নীল আর হালকা সবুজ মেশানো সালোয়ার কামিজ৷ ওর দু-চোখ ভয়ে গোল-গোল হয়ে আছে৷ কারণ, ওর ঠিক পিছনেই ঘাপটি মেরে বসে আছে রোগামতন একটা লোক—মেয়েটার বাঁ-কাঁধের কোণ থেকে উঁকি মারছে, আর ডানহাতের পিস্তলটা মেয়েটার ডান কানের নীচে চেপে ধরে আছে৷
লোকটা চাপা গলায় হাসছিল৷ ওর ছোট-ছোট চোখে তির-বেঁধানো দৃষ্টি৷
অনুজ হালকা গলায় বললেন, ‘প্রিয়াংকা?’
ভয়ার্ত মেয়েটা ওপর-নীচে মাথা নেড়ে বলতে চাইল, ‘হ্যাঁ—হ্যাঁ৷’
ওর পিছনে লুকিয়ে থাকা শত্রু ব্যঙ্গ করে হাসল৷ মেয়েটাকে বলল, ‘প্রিয়াংকা তোমার টিকটিকি কাকুকে বলো ওই লোহার যন্ত্রটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিতে—৷’
প্রিয়াংকা থরথর করে কাঁপতে লাগল৷ ওর মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না৷
লোকটা এবার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে অনুজকে হুমকি দিল, ‘শিগগির রিভলভারটা ছুড়ে ফেলে দে৷ নইলে এই মেয়েটাকে উড়িয়ে দেব৷’
অনুজ আর ইতস্তত করলেন না৷ ঘরের একপাশে কতকগুলো লোহার পাইপ পড়েছিল—রিভলভারটা সেদিকে ছুড়ে দিলেন৷ লোহায়-লোহায় টক্কর হল৷ ‘ঠং’ শব্দ উঠল৷
এমন সময় একটা এরোপ্লেনের গর্জন শোনা গেল৷ তারমধ্যেই পরপর দুটো ফায়ারিং-এর শব্দ৷ শব্দগুলো বাড়ির দোতলার দিক থেকে এল৷
অনুজ দ্রুত ভাবছিলেন৷ দোতলায় কী হল কে জানে! ওঁর গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছিল৷ এত কাণ্ড করে, এত কষ্ট করে, প্রিয়াংকাকে যদিও-বা খুঁজে পাওয়া গেল, শেষ পর্যন্ত হয়তো শেষরক্ষা হল না৷
রিভলভার ধরা লোকটাকে জরিপ করছিলেন অনুজ৷ লোকটার চোখে একটা ঠান্ডা পেশাদার ভাব৷ মনে হচ্ছিল, এরকম পরিস্থিতি ওর কাছে নতুন কিছু নয়৷
তবুও চেষ্টা না করলেই নয়৷
তাই বললেন, ‘পুলিশ বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে৷ আর কোনও পথ নেই৷’
ভুরু উঁচিয়ে লোকটা বলল, ‘নেই?’ তারপর চাপা গলায় হেসে উঠল৷ প্রিয়াংকার নরম গলায় রিভলভারের নলটা আরও জোরে ঠেসে দিয়ে বলল, ‘তা হলে আমাকে অ্যারেস্ট করুন, স্যার৷’ বাঁ-হাতের আঙুল নেড়ে অনুজকে ইশারা করে ডাকল শত্রু : ‘আয়—আয়, আমাকে অ্যারেস্ট করবি আয়…৷’
বাড়িটার অন্যান্য অংশ থেকে নানান তীব্রতার শব্দ ছিটে আসছিল৷ তার সঙ্গে মিশে ছিল ‘অপারেশান ব্ল্যাক’-এর অফিসারদের কথাবার্তার টুকরো৷ ওঁরা এই গোডাউনটার দিকে আসছেন না কেন? মহেন্দ্ররই বা কী হল?
এমন সময় মহেন্দ্র শর্মা ছুটতে-ছুটতে গোডাউনের দরজায় এসে হাজির হলেন৷ পরিশ্রমে বেশ হাঁপাচ্ছেন৷ ওঁর বাঁ-হাতের কনুইয়ের কাছটা লাল হয়ে আছে—বোধহয় গুলিতে চোট পেয়েছেন৷ ডানহাতে রিভলভার৷
ঘরের দৃশ্যটা দেখেই মহেন্দ্র থমকে গেলেন৷ অনুজকে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল৷ একলহমা চোখ বুলিয়েই পরিস্থিতি আঁচ করে নিলেন৷
একটু সময় নিয়ে তারপর অনুজকে মহেন্দ্র জিগ্যেস করলেন, ‘স্যার, ইয়ে লড়কি…প্রিয়াংকা মজুমদার?’
অনুজ মাথা নেড়ে বোঝালেন, হ্যাঁ৷
এই আহত অবস্থাতেও মহেন্দ্র হাঁপাতে-হাঁপাতে অনুজের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন : ‘তা হলে, স্যার, দু-চোখের মাঝখানে…৷’
এবং মহেন্দ্র গুলি করলেন৷ বদ্ধ ঘরে বিকট শব্দ হল৷
ঠিক দু-চোখের মাঝখানে নয়—একটু ওপরে গুলিটা লাগল৷ লোকটার কপালে একটা কালো টিপ তৈরি হয়ে গেল৷ চোখের পলকে লোকটা প্রিয়াংকার পিছনে চিত হয়ে উলটে পড়ল৷
‘শাবাশ, মহেন্দ্র!’ বললেন অনুজ দাশগুপ্ত৷ টার্গেট শুটিং-এ মহেন্দ্র শর্মার কোনও জুড়ি নেই৷ তাই যে-কোনও এনকাউন্টারে ওকে সঙ্গে নেন অনুজ৷
প্রিয়াংকা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল৷
অনুজ ছুটে গিয়ে নিজের রিভলভারটা কুড়িয়ে নিলেন৷ তারপর চটপট পৌঁছে গেলেন প্রিয়াংকার কাছে৷ ওর হাত ধরে টেনে তুললেন৷ বললেন, ‘কোনও ভয় নেই৷ য়ু আর সেফ৷’ মহেন্দ্রকে লক্ষ করে চেঁচিয়ে বললেন, ‘শিগগির চলো, প্রিয়াংকাকে নিয়ে আমরা এখুনি বেরিয়ে যাব৷ আমি লালবাজারে ইনফর্ম করছি৷ তোমারও জলদি ডাক্তার দেখানো দরকার৷’
মহেন্দ্র সামান্য হেসে বললেন, ‘তেমন সিরিয়াস কিছু নয়, স্যার—৷’ কথা বলতে-বলতে মেঝেতে পড়ে থাকা ডেডবডিটার দিকে একবার তাকালেন শুধু৷ তারপর ওঁরা প্রিয়াংকাকে নিয়ে সাবধানে রওনা হলেন৷
গোডাউনের বাইরে এসে সদরের দিকে কয়েক পা এগোতেই অন্য দুজন অফিসার একটা লোককে পাকড়াও করে অনুজদের মুখোমুখি হলেন৷ লোকটার পায়ের কাছটা লাল রঙে মাখামাখি৷
একজন অফিসার আমতা-আমতা করে বললেন, ‘একটা হুডলাম ছিটকে পালিয়ে গেছে, স্যার৷ এক্সট্রিমলি সরি৷’
অনুজ বললেন, ‘ইটস ও. কে.৷ আজ না হয় কাল জালে পড়বেই৷ এই অপারেশানে প্রিয়াংকাই আমাদের মেন কনসার্ন৷ আমরা দুজন এখন প্রিয়াংকাকে নিয়ে সোজা মানিকতলা থানায় যাচ্ছি৷ আপনারা এখানকার চ্যাপ্টার ক্লোজ করে যাঁর-যাঁর হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করুন৷ আমি সব জায়গায় ইনফর্ম করে দিচ্ছি৷ ও—ভালো কথা৷ ওই গোডাউনটায় একটা বডি আছে৷’ ইশারায় গোডাউনের দিকে দেখালেন অনুজ : ‘টেক কেয়ার অ্যাবাউট ইট…৷’
ততক্ষণে আরও তিনজন অফিসার বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছেন৷ প্রত্যেকের হাতেই খোলা রিভলভার৷
অনুজ তাঁদের হাতের ইশারা করে বললেন, ‘এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল—৷’
তারপর প্রিয়াংকাকে নিয়ে মহেন্দ্রকে সঙ্গে করে বাড়ির বাইরে এলেন৷ সেখানে তখন কৌতূহলী জনতার ভিড়৷ নানা গুঞ্জন৷ ডিজিটাল ক্যামেরা আর ভিডিয়ো ক্যামেরা নিয়ে কেউ-কেউ ছবি তুলছে৷
ভিড় ঠেলে অনুজ এগিয়ে চললেন৷ সামনে এখন অনেক কাজ৷
মিমো আর বাবলি বাড়িটার দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল৷ দরজার দিকে নজর রাখছিল৷ হঠাৎই দেখল, একজন কালোমতন মহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় দৌড়নোর ভঙ্গিতে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে৷
মহিলা যখন ওদের খুব কাছাকাছি এসে গেছে তখনই পরপর দুটো জোরালো শব্দ শোনা গেল৷ বোধহয় গুলির শব্দ৷
মিমোর কী মনে হল, বাবলিকে বলল, ‘এই মেয়েটাকে শিগগির ধর৷ ধরে অন্য অফিসারদের কাছে জমা করে দে৷’
বাবলি অবাক হয়ে বলল, ‘কীসব আলফাল বকছিস! ধরি, তারপর কেস খেয়ে যাই…৷’
‘বলছি ধর৷ কেউ কিছু বললেই স্মার্টলি বলবি ‘‘পুলিশ’’৷’
ব্যস, বাবলি ওর পাসওয়ার্ড পেয়ে গেল৷ একদৌড়ে মহিলার কাছে গিয়ে ‘পুলিশ’ বলেই খপ করে হাত চেপে ধরল৷ তারপর টানতে-টানতে নিয়ে চলল রাস্তার মোড়ের দিকে৷
মহিলা হাউমাউ করে কাঁদছিল৷ তাই দেখে দু-একজন লোক কৌতূহলে এগিয়ে আসতেই বাবলি হাত নেড়ে সরে যেতে ইশারা করে তেড়ে উঠে বলল, ‘সাইড৷ সাইড৷ কুইক৷ পুলিশ৷ কিডন্যাপিং-এর কেস৷’
আশ্চর্য! মন্ত্রের মতো কাজ হল৷ বাবলি নির্বিঘ্নে একজন অফিসারের কাছে পৌঁছে গেল৷ মহিলাকে জমা করে বলল, ‘স্যার, আমি ইন্সপেক্টার দাশগুপ্তর সঙ্গে এসেছি৷ ওই বাড়িটা থেকে গুলির আওয়াজ পেলাম—৷’
সঙ্গে-সঙ্গে অফিসারটি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷
বাবলি কাজ শেষ করে ফিরে চলল মিমোর কাছে৷
মিমো বাড়ির দরজার দিকে নজর রাখছিল৷ হঠাৎ দেখল, একটা লোক সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভিড় করতে থাকা লোকজনকে হাতের ধাক্কায় সরিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে৷
সঙ্গে-সঙ্গে ছুট লাগাল মিমো৷ একটু পরেই লোকটাকে প্রায় ধরে ফেলল৷ পিছন থেকে এক ধাক্কা মারতেই লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তায়৷ মিমো ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল৷ কিন্তু লোকটা ততক্ষণে চিত হয়ে জোড়া পায়ের লাথি ছুড়ে দিয়েছে মিমোর ঝুঁকে পড়া শরীরের দিকে৷
লাথিটা মিমোর পেটে এসে লাগল৷ কিন্তু তার আগেই মিমো পেটের মাসল শক্ত করে ফেলেছে৷ ফলে লাথিতে তেমন কাজ হল না৷ মিমোর শরীরটা খানিকটা টলে গেল শুধু৷ ও চট করে লোকটার ডান পায়ের গোড়ালি চেপে ধরল৷ তারপর সেটাকে প্রবল মোচড় দিয়ে নিজের শরীরটাকে পাশে ঝুঁকিয়ে দিল৷
লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল৷ মিমো সেই চিৎকারটা জোরালো করতে লোকটার তলপেটে একটা নিষ্ঠুর লাথি কষিয়ে দিল৷
জিমের বিশ্বজিৎদার কথা মনে পড়ল মিমোর৷ বিশ্বজিৎদা বলে, ‘বডি তৈরি করার সবচেয়ে বড় কারণ হল সেলফ-ডিফেন্স—আত্মরক্ষা৷’ তার মানে, নিজের ডিফেন্স—এবং শত্রুর প্রতি অফেন্স৷ নাঃ, মিমোর কিছু করার নেই৷ সেই সকাল থেকে ও চুপচাপ অনেক কিছু দেখেছে, শুনেছে—কিন্তু কিছু করেনি৷ এখন সেই করার সুযোগ এসেছে৷
সুতরাং, বাঁ-হাতের এক থাবায় লোকটার জামা খামচে ধরল মিমো৷ ওকে টেনে তুলেই ডানহাতের এক ঘুষিতে নাক-মুখ রক্তাক্ত করে দিল৷ লোকটা আত্মরক্ষার চেষ্টায় মিমোর জামা আঁকড়ে ধরেছিল৷ সেই অবস্থায় লোকটা রাস্তায় পড়ে যেতেই মিমোর শার্টটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে গেল৷
মিমোদের ঘিরে ভিড় জমে গিয়েছিল৷ নানান জল্পনা চলছিল৷ কিন্তু কেউ কিছু করে ওঠার আগেই বাবলি ভিড় ঠেলে ‘মিমো! মিমো!’ বলে ডাকতে-ডাকতে ঢুকে পড়ল৷ তারপর অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে বলল, ‘সবাই সরে যান৷ এটা পুলিশ-কেস৷ এই লোকটা ক্রিমিনাল—৷’
একটু আগেই যে গুলির শব্দ হয়েছে সেটা জনতার কেউ-কেউ শুনেছে৷ তাই বাবলির কথায় কাজ হল৷ ভিড়ের বৃত্তটা মাপে একটু বড় হল৷
বাবলি আর মিমো নেতিয়ে পড়া লোকটাকে বলতে গেলে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল৷ তারপর পুলিশের গাড়ির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল৷
খানিকটা পথ যেতে না যেতেই অনুজ দাশগুপ্তর সঙ্গে ওদের দেখা৷ তিনি ব্যস্তভাবে বললেন, ‘তোমরা কোথায় গিয়েছিলে? এই লোকটাই বা কে?’
‘ওই বাড়িটা থেকে বেরিয়ে পালাচ্ছিল, স্যার৷’ হাঁপাতে-হাঁপাতে মিমো বলল৷ তারপর এক ঝটকায় লোকটাকে দাঁড় করিয়ে দিল৷
প্রিয়াংকা লোকটাকে দেখে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল৷
অনুজ অবাক হয়ে প্রিয়াংকার দিকে তাকালেন৷ ওঁর চোখে জিজ্ঞাসা৷
প্রিয়াংকা কাঁপা গলায় বলল, ‘এই লোকটা আমাকে চড় মেরেছিল৷’
মিমো সঙ্গে-সঙ্গে লোকটার গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে দিল৷ লোকটার মাথা চকিতে পাশে ঘুরে গেল৷
তারপর ছেঁড়া জামাটাকে সাধ্যমতো ঠিকঠাক করে প্রিয়াংকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিমো বলল, ‘হাই, প্রিয়াংকা৷ আমি মিমো—৷’
‘আমি বাবলি৷’ বাবলিও হেসে হাত বাড়াল প্রিয়াংকার দিকে৷
প্রিয়াংকা মিমোর হাত চেপে ধরে বলল, ‘হাই৷ আমি প্রিয়াংকা৷ মিমো, য়ু আর গ্রেট৷ তুমি হেলপ না করলে আমি হয়তো মরেই যেতাম—৷’
মিমোর হাত ছেড়ে এবার বাবলির হাতে হাত মেলাল প্রিয়াংকা : ‘বাবলি, য়ু অলসো ডিজার্ভ মেনি-মেনি থ্যাংকস৷ আই ও য়ু মাই লাইফ৷’
বাবলি ইংরেজি কথাগুলোর উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না৷
পরিচয়ের প্রথম ধাপ শেষ হতেই অনুজ ওদের তাড়া দিলেন৷ মিমোদের হাত থেকে ক্রিমিনালটাকে নিয়ে মহেন্দ্রকে বললেন লোকটাকে অন্য অফিসারদের কাছে জমা করে দিতে৷ মিমো লক্ষ করল, মহেন্দ্রর বাঁ-হাতে কনুইয়ের ঠিক ওপরে কাপড় জড়িয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা৷
এবার মিমোদের তাড়া লাগালেন অনুজ৷ বললেন, ‘চটপট গাড়িতে চলো৷ পথে যেতে-যেতে কথা বলা যাবে৷’
ওরা সবাই তাড়াতাড়ি পা চালাল গাড়ির দিকে৷
ধনিয়া গাড়ি স্টার্ট দিতেই অনুজ নিজের মোবাইল ফোনটা প্রিয়াংকার দিকে এগিয়ে দিলেন৷ বললেন, ‘এবার তুমি তোমার বাবাকে ফোন করো৷ কথা বলার পর লাইনটা আমাকে দিয়ো…৷’
গাড়ির দ্বিতীয় সিটে বাবলি আর মহেন্দ্রর মাঝে প্রিয়াংকা বসেছিল৷ এখন ও অনেক স্বাভাবিক হয়েছে৷ একটু আগেও ওর চোখে-মুখে যে-ভয়ের কাঠ-কাঠ ভাবটা ছিল এখন সেটা আর নেই৷ ওকে এখন বেশ কোমল আর সুন্দর দেখাচ্ছে৷
বাবাকে লাইনে পাওয়ার পর কথা বলতে গিয়ে ও ‘বাপি! বাপি!’ বলে আবেগে কেঁদে ফেলল৷ আনন্দ আর খুশিতে ওর দু-চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল৷
বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সোনম লাইনে এল৷ প্রিয়াংকা ভাইয়ের সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলল৷
কিছুক্ষণ পর কথা বলা শেষ করে অনুজ দাশগুপ্তকে ফোনটা ফিরিয়ে দিল প্রিয়াংকা৷
অনুজ মিস্টার মজুমদারকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘…দেখুন, মিস্টার মজুমদার, থানায় গিয়ে আমাদের কিছু ফরমালিটি—মানে, পেপারওয়ার্ক—বাকি আছে৷ তারপরই প্রিয়াংকাকে আমি নিজে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব৷ আপনি কোনও চিন্তা করবেন না৷ মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আমার এই নম্বরটায় যখন খুশি ফোন করবেন৷…ও. কে.৷’
ফোন ছাড়তে না ছাড়তেই অনুজের মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷ ফোনে ‘হ্যালো’ বলার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অনুজ নড়েচড়ে তটস্থ হয়ে বসলেন৷ ডিসি ডিডি ওয়ান নিজে ফোন করেছেন৷
‘হ্যাঁ, স্যার—বলুন৷ আমি অনুজ দাশগুপ্ত৷ মানিকতলা থানার অ্যাডিশন্যাল ও. সি.—৷’
‘হ্যাঁ, জানি৷’ ওপাশ থেকে গম্ভীর গলা ভেসে এল : ‘আপনার কথা শুনেছি৷ আপনি তো আগে কাশীপুর থানায় ছিলেন—৷’
‘হ্যাঁ স্যার৷’
‘মেয়েটাকে রেসকিউ করার জন্যে কনগ্র্যাচুলেশানস৷’
‘থ্যাংক য়ু, স্যার৷’
‘মেয়েটাকে নিয়ে এক্ষুনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে চলে আসুন৷ ওর স্টেটমেন্ট নেওয়ার সময় আমি থাকতে চাই৷ আর ওই মাইক্রো-ক্যাসেট…৷’
‘ইয়েস, স্যার—৷’
‘আমার কিডন্যাপিং সেকশানের এ. সি. সাহেব—মানে, চঞ্চল সরকার—উনি ওই ক্যাসেটটা দেখার জন্যে একেবারে উতলা হয়ে পড়েছেন৷ তা ছাড়া আমারও ইন্টারেস্ট আছে৷ আপনি মেয়েটাকে নিয়ে—আর ওই ক্যাসেটটা নিয়ে—হেডকোয়ার্টারে চলে আসুন, কেমন?’
অনুজ ইতস্তত করতে লাগলেন৷
ও-প্রান্ত থেকে অধৈর্য গলা শোনা গেল, ‘কী হল?’
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর অনুজ বললেন, ‘ক্যাসেটটার খোঁজ এখনও আমরাই জানি না, স্যার৷ প্রিয়াংকাকে অনেকবার জিগ্যেস করেছি৷ কিন্তু ও খুব সেনসিবল মেয়ে৷ ও বলছে, ক্যাসেটটাই ওর বেঁচে থাকার লাইসেন্স৷ টপমোস্ট লেভেল ছাড়া ওই ক্যাসেট ও জমা দেবে না…ও খুব কশাস…৷’
‘দ্যাটস গুড৷ সত্যিই খুব সেনসিবল মেয়ে৷ কিডন্যাপারদের ডেন থেকে যেভাবে ও টেলিফোনে বাইরের ওই ছেলেটার সঙ্গে কনট্যাক্ট করেছে…কী যেন নাম? মিমো…রিয়েলি, ভাবা যায় না৷ আপনি প্রিয়াংকাকে আমার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে দিন—ও যখন খুশি আমার সঙ্গে কনট্যাক্ট করে নেবে…নাঃ, আপনি বরং ফোনটা একমিনিটের জন্যে মেয়েটিকে দিন…আমি একটু কথা বলি…৷’
অনুজ ‘ইয়েস, স্যার—,’ বলে মোবাইলটা প্রিয়াংকার দিকে এগিয়ে দিলেন৷ ওকে নীচু গলায় বললেন, ‘ডিসি ডিডি ওয়ান৷ তোমার সঙ্গে পারসোনালি কথা বলতে চান…৷’
প্রিয়াংকা ফোন নিয়ে কথা বলল, ‘স্যার, আমি প্রিয়াংকা বলছি৷’
‘কনগ্র্যাটস, ব্রেভ লেডি৷ এ বছরের সেরা সাহসী মেয়ে বলে তোমার নাম আমি গভর্নমেন্টের কাছে রেকমেন্ড করব৷ ওই ক্যাসেটটা তোমার কাছে সেফ জায়গায় রাখা আছে তো?’
‘হ্যাঁ, স্যার৷ জায়গাটা মোর দ্যান সেফ—আমি ছাড়া কেউ খুঁজে পাবে না৷’
‘গুড৷ তা হলে ক্যাসেটটা নিয়ে আমরা কখন বসছি? তুমি কি ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে লালবাজারে আসতে পারবে? আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব৷ আর তোমার সবরকম প্রোটেকশানের বন্দোবস্ত করব৷ কোনও চিন্তা নেই—৷’
প্রিয়াংকার ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল৷ চোখের পাতা ঘুমে যেন জড়িয়ে আসছিল৷ ও আলতো গলায় বলল, ‘স্যার, আজ আমার ভীষণ টায়ার্ড লাগছে৷ তা ছাড়া আমি এখনও বাড়ি যাইনি৷ বাপি বা ভাইয়ের সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি৷ যদি…মানে, কাল বা পরশু আপনার সঙ্গে কথা বলতে গেলে কি খুব অসুবিধে হবে?’
‘না, না—ঠিক আছে, ঠিক আছে৷ কোনও অসুবিধে হবে না৷’ ওপাশ থেকে হেসে বললেন ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের চিফ, ‘শুধু একটা কথা৷ ক্যাসেটটা কোথায় আছে কাউকে বলবে না৷ ওটা কাউকে দেখাবে না৷ মোটকথা, ওটা নিয়ে কারও সঙ্গে একটি কথাও বলবে না৷ আন্ডারস্টুড?’
‘পারফেক্টলি আন্ডারস্টুড, স্যার৷’ বলল প্রিয়াংকা৷
‘গুড গার্ল৷ আমি এক্ষুনি তোমার টপ প্রায়োরিটি প্রোটেকশানের ব্যবস্থা করছি৷ কোনও চিন্তা কোরো না৷ য়ু উইল বি অ্যাবসোলিউটলি সেফ৷ কেউ তোমাকে ডিসটার্ব করবে না৷’
‘থ্যাংক য়ু, স্যার৷’
‘আর একটা কথা৷ ইন্সপেক্টার দাশগুপ্ত তোমার সঙ্গে আমাদের টপ সিক্রেট মিটিং-এর ব্যাপারটা কো-অর্ডিনেট করবেন৷ তবুও তুমি ওঁর কাছ থেকে আমার মোবাইল নম্বরটা নিয়ে রাখো৷ দরকার মনে করলেই ফোন করবে৷ ও. কে.?’
‘ও. কে., স্যার৷’ প্রিয়াংকার এবার সত্যি-সত্যিই ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল৷
ও ফোনটা অনুজ দাশগুপ্তকে ফিরিয়ে দিল৷ দাশগুপ্ত চিফের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোন ছাড়লেন৷ মিমোকে লক্ষ করে বললেন, ‘মিমো, থানায় গিয়ে আমরা খাওয়া-দাওয়া করব৷ তা ছাড়া তোমার আর বাবলির সঙ্গেও কিছু পেপারওয়ার্কের কাজ আছে৷ দরকার হলে তোমার মাকে একবার ফোন করে দেব৷’
খাওয়ার কথায় মিমো একটু লজ্জা পেয়ে গেল৷ তবে সত্যিই ওর খিদে পাচ্ছিল৷ পাওয়ারই কথা—কারণ, বেলা প্রায় দুটো বাজে৷
একটু পরেই মানিকতলা থানায় পৌঁছে গেল ওরা৷ সেখানে মহেন্দ্র শর্মা ও আরও দুজন অফিসারকে নিয়ে দাশগুপ্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ বাবলি, মিমো আর প্রিয়াংকা একপাশে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে লাগল৷
বেশ কিছুক্ষণ পর দাশগুপ্ত প্রিয়াংকাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন৷ সঙ্গে মিমো আর বাবলিকেও তুলে নিলেন৷ বললেন, ওদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে তারপর প্রিয়াংকাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন৷
প্রিয়াংকা মিমো আর বাবলিকে বলল, ‘এসব ঝামেলা মিটলে তোমরা আমাদের বাড়িতে একদিন আসবে৷ বাপি আর সোনম তোমাদের দেখতে চেয়েছে৷ সেদিন খুব জমিয়ে গল্প করা যাবে—’
মিমো বাড়ির কাছে নেমে যাওয়ার আগে প্রিয়াংকা মিমোর মোবাইল নম্বরটা নিল৷ প্রিয়াংকার মোবাইল ফোন এতক্ষণে নিশ্চয়ই পুলিশের জিম্মায়৷ বাপিকে বলে আগে ও একটা নতুন ফোন কিনবে৷
বাড়িতে ওকে নামিয়ে দেওয়ার সময় অনুজ দাশগুপ্ত যথেষ্ট ভরসা দিলেও প্রিয়াংকার মাথা থেকে ভয়টা কিছুতেই যাচ্ছিল না৷ আর একইসঙ্গে মাইক্রো-ক্যাসেটের দুশ্চিন্তাটা মনের ভেতরে পাগলের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল৷
৷৷সাত৷৷
ঘরে হালকাভাবে এসি চলছিল৷
ঘরের একদিকের দেওয়ালের কাছে মেটাল স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো রয়েছে একটা প্রোজেকশান স্ক্রিন৷ তার কাছাকাছি একটা টেবিলে বসানো একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার আর এলসিডি প্রোজেক্টার৷ টেবিলের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছে একজন অপারেটর৷ তার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে নির্দেশ পেলেই সে কাজ শুরু করবে৷ এলসিডি প্রোজেক্টার চালু হয়ে যাবে৷ সামনের পরদায় ফুটে উঠবে ছবি৷
নির্দেশ যিনি দেবেন তিনি বাঁ-দিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা সোফায় বসে আছেন৷ ডিসি ডিডি ওয়ান সুন্দরলাল প্রধান৷ ফরসা মাঝারি চেহারা৷ মাথায় ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা চুল৷ পরিষ্কার করে গোঁফ-দাড়ি কামানো৷ চোখে ছোট লেন্সের চশমা৷
‘সিনেমা’-র দর্শকদের জন্য তিনটে লম্বা-লম্বা সোফা সমান্তরাল-ভাবে পাতা রয়েছে৷ তার প্রথম সারিতে বসেছেন অনুজ দাশগুপ্ত, ডানপাশে প্রিয়াংকা৷
প্রিয়াংকাকে দেখেই বোঝা যায় ও বেশ টেনসড হয়ে রয়েছে৷ মুখে কোনও কথা নেই৷ ‘সিনেমা’ কখন শুরু হবে সেজন্য অপেক্ষা করছে৷
অনুজ দাশগুপ্তর বাঁ-পাশে বসে আছেন আর-এক পুলিশকর্তা চঞ্চল সরকার৷ মিস্টার প্রধানের তুলনায় বেশ রোগা৷ গায়ের রং মাঝারি৷ কপালের দুপাশে চুল কমে এসেছে৷ বয়েস অবশ্যই পঞ্চাশ পেরিয়েছে৷ চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা৷ মুখে একটা নির্বিকার উদাসীন ভাব৷
এই পাঁচজন ছাড়া ঘরে আর কোনও লোক নেই৷ মিস্টার প্রধানের নির্দেশে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
প্রিয়াংকা ওর মাইক্রো-ক্যাসেটটা সত্যিই এক অদ্ভুত জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল৷ ওটা একটা পলিথিন প্যাকেটে মুড়ে ওর কলেজের ক্যাম্পাসের বাইরে একটা শিমুল গাছের কোটরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ও৷ গতকাল বিকেলে লালবাজার থেকে তিনজন অফিসার আর মানিকতলা থানার অনুজ দাশগুপ্ত প্রিয়াংকা আর ওর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে প্রিয়াংকার কলেজের কাছে গেছেন৷ ক্যাসেটটা উদ্ধার করে লালবাজারে ডিসি ডিডির কাছে জমা দিয়েছেন৷ আজ তিনি প্রিয়াংকাকে ডেকেছেন সে-ব্যাপারে কথা বলার জন্য৷ ওর বাবাও সঙ্গে এসেছেন, কিন্তু ওঁকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে৷
মিস্টার প্রধান এবার কথা বললেন, ‘যা আমরা দেখতে চলেছি, শুনতে চলেছি—সবই হাইলি কনফিডেনশিয়াল৷ এ-ঘরের একটি কথাও যেন বাইরে না যায়৷ দিস ইজ মাই অর্ডার৷ কী বলেন, মিস্টার সরকার?’
শেষ প্রশ্নটা চঞ্চল সরকারকে লক্ষ করে৷
তিনি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘একদম ঠিক বলেছেন৷ এই মাইক্রো-ক্যাসেটটা নিয়েই এত গণ্ডগোল৷ নিশ্চয়ই এর মধ্যে এক্সপ্লোসিভ কোনও মেটিরিয়াল আছে৷ ব্যাপারটা দেখার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব—তার আগে নয়৷’
মিস্টার প্রধান বললেন, ‘কাল ক্যাসেটটা হাতে পাওয়ার পর আমি ওটা একটা সিডিতে রাইট করিয়ে নিয়েছি৷ এখন সেই সিডিটাই সুশান্ত চালাবে৷’ এবার কম্পিউটারের পাশে চেয়ারে বসা ছেলেটির দিকে তাকালেন মিস্টার প্রধান : ‘সুশান্ত, স্টার্ট—৷’
কম্পিউটার চালু হল৷ পরদায় আলোছায়া দিয়ে ছবি তৈরি হল৷
কিন্তু এ কী! এ কী দেখছে প্রিয়াংকা? কোথায় সেই ভোরবেলার ময়দানে নৃশংস খুনের ছবি? তার বদলে নানান রঙের রঙিন ফুল৷ কোনও ফুলের প্রদর্শনীতে গিয়ে কেউ যেন হাসিখুশি ফুলের সুন্দর-সুন্দর ছবি তুলেছে৷
প্রিয়াংকা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এসব কী ব্যাপার, স্যার? আমার ক্যাসেটে তো অন্য ছবি ছিল— একটা রুথলেস মার্ডারের ছবি৷ সেসব পালটে গেল কেমন করে!’
মিস্টার প্রধান রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়লেন৷ চঞ্চল সরকারের দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘সরকার, দিস ইজ আউটরেজিয়াস! ডিপার্টমেন্টে এসব হচ্ছেটা কী!’ বিরক্তিতে দু-হাত ছুড়ে বলে উঠলেন, ‘এখন কী করে আমরা জানতে পারব ওই ক্যাসেটে কী ছিল? ডিপার্টমেন্টেই আমি তা হলে সিরিয়াস প্রোব চালাব—তাতে সি. এম. যদি আমাকে শো-কজ করেন করবেন৷ আমি কিন্তু ছাড়ব না…৷’
দাশগুপ্ত চুপচাপ বসে সব দেখছিলেন৷ ওঁর সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল৷ একবার পরদার ফুলের ছবির দিকে, একবার সুন্দরলাল প্রধানের দিকে, আর-একবার প্রিয়াংকার দিকে দেখছিলেন৷
প্রিয়াংকার সুন্দর মুখ লালচে দেখাচ্ছিল, ওর কপালে সন্দেহের কয়েকটা ভাঁজ৷
হঠাৎই ও সোফা থেকে ওর সাইডব্যাগটা তুলে নিল৷ ওটার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা সিডি বের করে নিল৷ সেটা হাতে নিয়ে ডিসি ডিডির কাছে এগিয়ে গেল৷
‘স্যার, আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়ে অনেকদিন আগেই ওই ক্যাসেটটার একটা ব্যাকআপ সিডি তৈরি করে রেখেছিলাম৷ নিন, এটা চালালেই সব দেখতে পাবেন৷ মনে হয়, আর কোনও প্রবলেম হবে না…৷’
প্রধান বেশ অবাক হয়ে গেলেন৷ সিডিটা নিয়ে হেসে বললেন, ‘স্মার্ট গার্ল৷ তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়৷ আমার মনে হয়, ক্যাসেট থেকে সিডিতে কনভারশনের সময় আমার ডিপার্টমেন্টের লোকেরা কোনও গণ্ডগোল করেছে৷ যদি না তোমার ক্যাসেটটাতেই ওরিজিন্যালি কোনও প্রবলেম থেকে থাকে…৷’
প্রিয়াংকা কোনও উত্তর দিল না৷ ফিরে এসে সোফায় বসল৷
ক্যাসেটটাতে যে কোনও প্রবলেম ছিল না সেটা সিডিটা চালাতেই বোঝা গেল৷
সবাই রুদ্ধশ্বাসে খুনের ‘সিনেমা’ দেখতে লাগলেন৷ এসি মেশিনের ভ্রমর-গুঞ্জন ছাড়া ঘরে আর কোনও শব্দ নেই৷ অনুজ দাশগুপ্ত ভাবতেই পারেননি মাইক্রো-ক্যাসেটে এরকম মারাত্মক কিছু থাকতে পারে৷
মনে-মনে প্রিয়াংকার সাহসের তারিফ করলেন তিনি৷
ছবির কথাবার্তাগুলো ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না৷ তবে ‘…কৌটোর ভেতরে হিরেগুলো আছে…’ এই কথাটা বেশ বোঝা গেল৷
মিস্টার প্রধান সোফায় নড়েচড়ে বসলেন—কিন্তু কোনও কথা বললেন না৷
ছবি দেখানো শেষ হলে তিনি সুশান্তকে বললেন সিডিটা আবার চালাতে৷
দ্বিতীয়বার ‘সিনেমা’ শেষ হওয়ার পর মিস্টার প্রধান সুশান্তর কাছ থেকে সিডিটা চেয়ে নিলেন৷ তারপর ওকে ছুটি দিয়ে দিলেন৷ সুশান্ত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ৷
চঞ্চল সরকার চোয়ালে হাতে বোলাচ্ছেন৷ সুন্দরলাল প্রধান সোফার হাতলে আঙুলের টোকা মারছেন৷ অনুজ দাশগুপ্ত মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছেন৷ আর প্রিয়াংকা তিনজন পুলিশকর্তার দিকে প্রত্যাশা নিয়ে দেখছে৷
বেশ কয়েক মিনিট পরে মিস্টার প্রধান বললেন, ‘ছবির এই দুটো লোকের ফটোগ্রাফ প্রিন্ট করে আমাদের ডকুমেন্টেশান সেলকে দিতে হবে…যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায়৷ আর হেস্টিংস থানা থেকে এই মার্ডারের ফাইলটা আনাতে হবে৷ তারপর আমাদের টোটাল ইনভেস্টিগেশানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে৷ মনে হচ্ছে, একটা বড়সড় ক্রিমিনাল নেটওয়ার্ক এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে৷’
‘আমারও তাই ধারণা—’ চঞ্চল সরকার বললেন৷
মিস্টার প্রধানকে লক্ষ করে অনুজ দাশগুপ্ত বললেন, ‘স্যার, আমাদের কী করতে হবে বলবেন৷ আপনি যেমন-যেমন ইনস্ট্রাকশন দেবেন আমরা ঠিক সেইভাবেই এগোব…৷’
‘ঠিক আছে৷ সময়মতো সব জানাব৷ এবার আপনি যেতে পারেন৷ প্রিয়াংকা একটু থাকুক৷ ওর সঙ্গে সিডির কনটেন্ট নিয়ে আমার কিছু কথা আছে৷ আপনি যাওয়ার সময় ওর বাবাকে বলুন ওয়েট করতে৷ কথা হয়ে গেলে আমি স্পেশাল প্রোটেকশানের ব্যবস্থা করে ওদের বাড়ি পৌঁছে দেব৷ আপনি কোনও চিন্তা করবেন না৷ ও. কে.? আর বাইরের পাহারাকে একটু বলুন, আমাদের যেন কেউ ডিসটার্ব না করে…৷’
‘ও. কে., স্যার—’ বলে প্রিয়াংকার দিকে একপলক তাকিয়ে অনুজ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন৷
মিস্টার প্রধান এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ পায়ে-পায়ে চঞ্চল সরকারের কাছাকাছি এগিয়ে এলেন৷ বেশ মোলায়েম গলায় অনুরোধের সুরে বললেন, ‘মিস্টার সরকার, যদি কিছু মনে না করেন…মানে, আমি প্রিয়াংকার সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলতে চাই৷ হোপ য়ু উডন্ট মাইন্ড…৷’
চঞ্চল সরকার সঙ্গে-সঙ্গে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ আড়চোখে প্রিয়াংকার দিকে একবার দেখলেন৷ তারপর ‘অফ কোর্স আই ডোন্ট মাইন্ড—’ বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷
কয়েক সেকেন্ড ওঁর চলে যাওয়া দেখলেন প্রধান৷ তারপর আপনমনেই বললেন, ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা৷’ প্রিয়াংকার দিকে তাকালেন : ‘দেখলে তো, ডিপার্টমেন্টের মধ্যেই তোমার মাইক্রো-ক্যাসেটের ডেটা সিডিতে ট্রান্সফার করতে গিয়ে কীরকম হর্টিকালচার শো-র ছবি হয়ে গেল! কাউকে বিশ্বাস করার জো নেই৷ সেইজন্যে আর সবাইকেই চলে যেতে বললাম৷’
ঘরের দরজার কাছে চলে গেলেন৷ ছিটকিনি এঁটে দিলেন ভেতর থেকে৷ তারপর হাতে হাত ঘষে হাত ঝাড়তে-ঝাড়তে চলে এলেন প্রিয়াংকার কাছে৷
‘তুমি খুব ইনটেলিজেন্ট বলে একটা ব্যাকআপ সিডি তৈরি করে রেখেছিলে৷ য়ু আর রিয়েলি স্মার্ট৷ তোমার মতো শার্প মেয়েরা পুলিশ ফোর্সে জয়েন করলে পুলিশ ফোর্স ইনটেলেকচুয়ালি আরও স্ট্রং হত৷ সত্যিই তোমাকে পুরস্কার দেওয়া দরকার—৷’
প্রিয়াংকা ওঁর দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলল, ‘থ্যাংক য়ু, স্যার৷’
মিস্টার প্রধান এবার কম্পিউটারের কাছে গেলেন৷ মনিটরের কয়েকটা আইকনে মাউস ক্লিক করে সিডিটা আবার চালালেন৷ প্রিয়াংকার তোলা সিনেমা আবার শুরু হল৷
ছবিটা আবার কেন চালানো হল প্রিয়াংকা ঠিক বুঝতে পারছিল না৷ চোখে প্রশ্ন নিয়ে মিস্টার প্রধানের দিকে তাকাতেই তিনি স্নেহমাখানো হাসি হেসে বললেন, ‘ডোন্ট বি উয়ারিড৷ এই ছবি নিয়ে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে৷’ পায়ে-পায়ে হেঁটে ছবির পরদার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন : ‘ছবির এই লোকদুটোকে তুমি কি চেনো?’
প্রিয়াংকা এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল৷ বলল, ‘না—চিনি না৷’
‘তোমাকে কিডন্যাপ করে যেখানে আটকে রেখেছিল সেখানেও এই দুজনের কাউকে দ্যাখোনি?’
‘না, স্যার—দেখিনি৷’
‘যে-লোকটা ভিকটিম—মানে, যাকে মার্ডার করা হল—তাকে কি তুমি চেনো?’
আবার মাথা নাড়ল প্রিয়াংকা : ‘না—চিনি না৷’
‘তা হলে তোমার কাছ থেকে তো বাড়তি কোনও হেলপ আমরা পাব বলে মনে হয় না৷’ মিস্টার প্রধানের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল৷
প্রিয়াংকা খুব দ্রুত ভাবছিল, কীভাবে ও পুলিশকে হেলপ করতে পারে৷ ও কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর বলে উঠল, ‘স্যার, এই সিডি থেকে আমি এই তিনজন লোকের এনলার্জড ফটোগ্রাফ প্রিন্ট করে দিতে পারি৷ সেগুলো আপনারা খবরের কাগজে, টিভিতে, ইন্টারনেটে সারকুলেট করতে পারেন৷ তখন কেউ যদি এদের চিনতে পারে তখন তার কাছ থেকে আরও ইনফরমেশান পাওয়া যেতে পারে…৷’
‘গুড আইডিয়া…৷’ মিস্টার প্রধানের কপালের ভাঁজগুলো নরম হল কিন্তু পুরোপুরি মিলিয়ে গেল না৷
‘…তারপর এই ভিডিয়োর সাউন্ড ট্র্যাকটা রেস্টোর করা যেতে পারে৷ তা হলে কথাগুলোর স্পষ্ট রেকর্ডিং পাওয়া যাবে৷ তখন সেগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি অ্যানালিসিস করে…মানে, স্যার, টেকনোলজির হেলপ নিয়ে উই ক্যান ডু আ লট৷ এই ক্রিমিনালগুলো ভাবতেও পারবে না আমরা কতদূর যেতে পারি৷’ উৎসাহ আর উদ্দীপনায় একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল প্রিয়াংকা৷
নাঃ, এই মেয়ে সহজে থামবার নয়৷ সুন্দরলাল প্রধান ভাবলেন৷
পরদায় ছবি শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ প্রধান ধীরে-ধীরে পা ফেলে প্রিয়াংকার কাছে এলেন৷ আচমকা ওর পাশে বসে পড়লেন৷ বললেন, ‘রিল্যাক্স, গার্ল৷ এবারে বলো তো, সেদিন ভোরবেলা তুমি কী দেখেছ, কী শুনেছ৷ মার্ডারটা ঠিক কীভাবে হল? মোট ক’জন লোক ছিল? তুমি কীভাবে ব্যাপারটা দেখে ফেললে? একেবারে গোড়া থেকে সব ডিটেইলসে বলো…৷’
প্রিয়াংকা বলতে শুরু করল৷ ও মনে-মনে সেই ভয়ংকর ভোরবেলায় ফিরে গেল৷ সেদিনকার প্রতিটি দৃশ্য প্রতিটি ঘটনা ওর মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে৷ সুতরাং ওর বর্ণনায় কোনও ফাঁক ছিল না৷
শেষে ও বলল, কীভাবে ওর মুখ দিয়ে একটা চাপা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল৷ তাতেই ওই ভয়ংকর লোকদুটো ওকে দেখতে পায়, ওর দিকে ছুটে আসে৷ তখন ও ছুটে পালায়৷
ওর কথার মাঝে-মাঝে মিস্টার প্রধান কথা বলছিলেন, নানান প্রশ্ন করছিলেন৷ তাতে টেনশন কেটে গিয়ে স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পাচ্ছিল প্রিয়াংকা৷ প্রধানকে ওর ডিসি ডিডি ওয়ান নয়, অভিভাবক বলে মনে হচ্ছিল৷
প্রধান বললেন, ‘সেদিন তুমি খুব জোর বেঁচে গেছ৷ আর-একটু হলেই লোকগুলো—৷’
‘হ্যাঁ, আমি বাপিকে বলছিলাম৷ যদি অন্য ড্রেস পরে থাকতাম…৷’
‘ভাগ্যিস তুমি সেদিন জিনস পরেছিলে! নইলে অত জোরে ছুটতে পারতে না৷’
সুন্দরলাল প্রধান হেসে এই কথা বলামাত্রই বুলেটের মতো ছিটকে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রিয়াংকা৷ চোখ গোল-গোল করে প্রধানকে দেখতে-দেখতে পিছিয়ে গেল৷ শেষ পর্যন্ত ঘরের দেওয়ালে পিঠ ঠেকতেই দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ও বড়-বড় শ্বাস ফেলছিল৷
প্রধানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বিস্ময়ে হোঁচট খেয়ে ও বলল, ‘আ—আপনি কী করে জানলেন আমি জিনস পরেছিলাম? ক্যাসেটে তো আমার কোনও ছবি নেই! আর—আর একবারও তো সে-কথা আমি বলিনি! কী করে জানলেন আপনি?’
প্রধানের মুখের রক্ত পলকে শুষে নিয়েছিল কেউ৷ বুঝতে পারছিলেন, বেখেয়ালে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন৷ তির ছুটে বেরিয়ে গেছে হাত থেকে৷ আর ফেরানোর কোনও উপায় নেই৷
কথা বলতে গিয়ে ওঁর কথা আটকে যাচ্ছিল৷ হাত তুলে প্রিয়াংকাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে কোনওরকমে বললেন, ‘প্লিজ, প্রিয়াংকা, প্লিজ৷ কিপ ইয়োর কুল৷ ডোন্ট গেট মি রং৷ আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি…লক্ষ্মী মেয়ে…৷’
প্রিয়াংকা কোণঠাসা বেড়ালের মতো আক্রমণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিল৷ প্রধানের শেষ কথাটা ওর শরীরে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ ছড়িয়ে দিল৷ ঠিক এইরকম ভঙ্গিতেই না কথা বলেছিল সেই ‘বস’!
প্রিয়াংকা পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি! তুমি! তুমি!’
এবার সুন্দরলাল ওঁর ভদ্রতার পোশাকটা ঝেড়ে ফেললেন৷ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চট করে পকেট থেকে একটা কালো রঙের রিভলভার বের করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি৷ সিনেমার ওই টাকমাথা লোকটা আমি৷ ওই টাক আর গোঁফ হল ডিসগাইজ—ছদ্মবেশ৷’ তারপর মিহি এবং মোলায়েম গলায় স্নেহ-মাখানো সুরে বলতে শুরু করলেন, ‘কী অসম্ভব বুদ্ধিমতী মেয়ে! যেমন রূপ তেমনই গুণ৷ রূপে-গুণে একেবারে নজিরবিহীন মাখামাখি৷ বড়ই তৃপ্তিদায়ক—এবং বেদনাগম্ভীর৷ তোমাকে নিয়ে এখন কী করি বলো তো? এই অফিসে তো আর হত্যাকাণ্ড ঘটানো যায় না…তবে তার কাছাকাছি কিছু করা যায়৷ এই ধরো ক্ষুদ্র একটি ইনজেকশান প্রয়োগ করে তোমাকে ঘুম পাড়ানো যায়৷ তাতে তোমার জ্ঞান ফিরবে কমপক্ষে চবিবশ ঘণ্টা পর৷ ততক্ষণে তোমার ‘‘বাপি’’ আর সোনম পগার পার— সোজা আকাশে…৷’
প্রিয়াংকা বারবার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছিল৷ আশা করছিল ওর চিৎকার শুনে কেউ-না-কেউ ঘরে আসবে৷
সেটা লক্ষ করে প্রধান ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন৷ গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললেন, ‘কেউ আসবে না৷ অর্ডার আছে, কেউ আমাদের ডিসটার্ব করবে না৷ তাই বলছি, মুখ বুজে থাকো৷ তোমাকে তার জন্যে পুরস্কার দেব—প্রচুর টাকা…৷’
প্রিয়াংকা ভয় পাচ্ছিল৷ কিন্তু একইসঙ্গে একটা ভয়ংকর জেদ ওর মধ্যে কাজ করছিল৷ ও শব্দ করে ঘেন্নার থুতু ফেলল মেঝেতে৷ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘তোমার টাকা তোমার থাক৷ আমার চাই না৷ আর আমার যদি এখানে কিছু হয় তা হলে ওই সিডির ছবি এম এম এস করে ছড়িয়ে যাবে ইন্টারনেটে আরও হাজার-হাজার লোকের মোবাইলে৷ তোমার ফটোটা এনলার্জ করলেই ওই নকল টাক ধরা পড়বে৷ আর বাকি শাগরেদগুলোর কাছ থেকেও প্রচুর ইনফরমেশান পাওয়া যাবে৷ তুমি কিছুতেই বাঁচবে না—৷’
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল প্রিয়াংকা৷ বোতাম টিপে কল করল মিমোকে৷
প্রধানের চোখেমুখে দ্বিধার ছাপ ফুটে উঠেছিল৷ তিনি ভাবছিলেন, মেয়েটা হয়তো ব্লাফ দিচ্ছে৷
প্রিয়াংকা সেটা আন্দাজ করতে পারল কি না কে জানে৷ ও মোবাইল ফোনের লাউডস্পিকার অন করে দিল৷ তারপর বলল, ‘মিমো, এম এম এস-এর কথাগুলো বলো…৷’
মিমোর সঙ্গে আগে থেকে কথা বলাই ছিল৷ মিমো গড়গড় করে বলে গেল কীভাবে সিডির ছবি আমজনতার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে৷ কীভাবে ওরা প্রচারে-প্রচারে ছেয়ে দেবে গোটা কলকাতা৷ কীভাবে ওরা সব ব্যবস্থা নিয়েছে৷
প্রিয়াংকা প্রধানকে বলল, ‘শুনলে তো! আমি বারবার বলেছি, এই ক্যাসেটটা আমার বেঁচে থাকার লাইসেন্স৷ ওটা কখনও আমি কপি না রেখে হাতছাড়া করতে পারি!’
এবার সুন্দরলালের চোয়াল ঝুলে পড়ল৷ ঘরে এসি চলা সত্ত্বেও ওঁর কপালে ঘামের ফোঁটা৷
প্রিয়াংকা মোবাইল ফোন পকেটে রেখে বলল, ‘তোমার সব খেলা শেষ৷ চোরাই হিরে, খুন…খোঁজ করলে আরও কত কী বেরোবে৷ এখন কেঁচোর গর্ত খুঁড়ে সাপ বের করার সময়…৷’ ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে গেল প্রিয়াংকা৷ শব্দ করে ছিটকিনি খুলে দরজাটা হাট করে খুলে দিল৷ সবাই আসুক—এসে সাপটাকে দেখুক৷
Rana
আমার একটা কালার রং দরকার কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না আপনার কাছে কি আছে কিভাবে পাব জানাবেন
San
Ekta color nie tate wrong mesate hobe. Tarpor seta gnuter agune garam korte hobe. Gonga jole thanda korlei coloe rong peye jabe.