সপ্তরিপু – রবিন জামান খান
প্রথম সংস্করণ: সেপ্টেম্বর ২০২১
উৎসর্গ
প্রিয় বন্ধু-প্রিয় মানুষ,
কামরুজ্জামান রুবেলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে
Always loved you, my brother … will always miss you
নতুন মুদ্রণের ভূমিকা
সপ্তরিপু বইটা নিঃসন্দেহে আমার লেখক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আইকনিক কাজ। আইকনিক বলছি এই অর্থে, যদি ২৫শে মার্চ বইটা দিয়ে আমার লেখক ক্যারিয়ার শুরু হয়ে থাকে তবে সপ্তরিপু দিয়ে আমার লেখক ক্যারিয়ার পরিপক্ব হয়েছে। ২৫শে মার্চ লেখা অনেক চ্যালেঞ্জিং হলেও বইটা শেষ করার পর যখন প্রকাশিত হয় সেটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই সময়ে প্রায় সবাই আমাকে বলেছিল এই বইটার সিক্যুয়াল লেখার জন্যে অথবা শুধু এই ধরনের বই লেখার জন্যে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যদিও লেখক হিসেবে আমার যাত্রা শুরু হয়েছে-কিন্তু এই যাত্রায় ভালো কিছু করতে হলে আমার নিজেকে আরো অনেক বেশি ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। তাই ২৫শে মার্চ-এর পর যে বইগুলোর কাজ করি, তার প্রতিটা- ই জনরায় ছিল আলাদা এবং লেখার ধরন একেবারেই ভিন্ন। এই উপন্যাসগুলো প্রথম বইয়ের মতো জনপ্রিয়তা না পেলেও প্রতিটা লেখায় আমি নিজেকে ভাঙার সুযোগ পেয়েছি এবং নতুন কিছু শিখেছি। আর এই কাজগুলো থেকে আমি যা শিখেছি, তার প্রায় পুরোটাই প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি সপ্তরিপু-ব্ল্যাক বুদ্ধা-মগরাজ লেখার সময়ে।
আমি সপ্তরিপু বইটার আইডিয়া পেয়েছিলাম ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবার পথে ট্রেনে বসে শ্রীপান্থের ‘ঠগী’ বইটা পড়ার সময়ে। এর আগে ভারত উপমহাদেশের খুনে গোত্র ঠগিদের নিয়ে আইডিয়া থাকলেও শ্রীপান্থের বইটা পড়ার সময়ে আমি এত বিশদ জানতে পারি, যা রীতিমতো ভয়ংকর! আমার পরিষ্কার মনে পরে বইটা পড়তে পড়তে যখন আমার নিজের লেখার আইডিয়াটা এলো আমি উত্তেজনায় সিটে বসে থাকতে পারছিলাম না, ট্রেনের সিটের সারির মাঝখান দিয়ে পায়চারি করতে শুরু করি। যাই হোক, এরপরে ঢাকায় ফিরে একে একে পড়তে শুরু করি ঠগিদের নিয়ে যা পাই সবকিছু। আমাদের দেশীয় ‘ফিরিঙ্গী ঠগী’ থেকে শুরু করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা সৈয়দ আমীর আলীর ‘কনফেশন অব আ থাগ’সহ যা পাই পড়ে ফেলি। সেইসঙ্গে দেখাও চলতে থাকে। সাবেক জেমস বন্ড তারকা পিয়ার্স ব্রসন্যান অভিনীত ‘দ্য ডিসিভার্স’ থেকে শুরু করে সাদা-কালো সিনেমা ‘স্ট্র্যাঙ্গলার্স অব বোম্বে’, স্যার ক্যারি গ্রান্ট অভিনীত রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের কবিতা থেকে বানানো সিনেমা ‘গুঙগা দ্বীন’, হ্যারিসন ফোর্ড অভিনীত ইন্ডিয়ানা জোনসের ‘টেম্পল অব ডুম’—কিছুই বাদ যায় না। চলতে থাকে বিশদ প্রস্তুতি। এর ভেতরে নিজের শহর ময়মনসিংহ ভ্রমণের সময়ে শশীলজে বেড়াতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিই—এই গল্পের সেটআপ হবে ময়মনসিংহে।
আকৃতিগতভাবে সপ্তরিপুর প্লটটা খুবই জটিল এবং প্যাচালো। একে তো দুটো সময়ের দুটো গল্প চলছে প্যারালালি, তার ওপরে অতীতের গল্পটা বলা হয়েছে পাঁচজনের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে, সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে অসংখ্য চরিত্র। ফলে যখন আমি লিখছিলাম, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না পাঠকের জন্যে গল্পটা সহজবোধ্য হবে কি না। কিন্তু গল্পটা যেভাবে মাথায় ছিল সেভাবেই বলতে হতো আমাকে। যাই হোক অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং ঘটনার পর বইটা প্রকাশিত হলে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি হয়। থ্রিলার সাহিত্যের যে-ধারাটা বাংলা ভাষায় রীতিমতো অবহেলিত ছিল সেটা এপাড় এবং ওপাড় দুই বাংলাতেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথমত, ইতিহাস নিয়ে এতটা বড় পরিসরে জমজমাট থ্রিলার লেখা সম্ভব সেটা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আমাদের বাঙাল মুলুকের রহস্যময় ঘটনাবলি নিয়ে বিশ্বমানের থ্রিলার লেখা সম্ভব, পাঠকের ভালোবাসা অর্জন করা সম্ভব সেটা প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়।
সপ্তরিপু লেখার সময়ে আমার ইচ্ছে ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের তিনটি ইস্যু নিয়ে ঢাকার বাইরের তিনটি শহরে তিনটি কেন্দ্রীয় চরিত্র নিয়ে তিনটা বই লিখব কিন্তু সপ্তরিপু শেষ করার পর ব্ল্যাক বুদ্ধা লেখার সময়ে আইডিয়া আরো বিস্তৃত হয় এবং সেখান থেকে সিদ্ধান্তে আসি, তিনটি নয় ইতিহাসের সাতটি ভাগ নিয়ে সাতটি বই হবে এই সিরিজে। প্রথম বই সপ্তরিপু-ঠগী ও ব্রিটিশ রাজের সময়ের গল্প, দ্বিতীয় বই ব্ল্যাক বুদ্ধা—বুদ্ধের মিথ নিয়ে, তৃতীয় বই মগরাজ—মগ জলদস্যু, আরাকান ও মোঘলদের নিয়ে, রাজদ্রোহী-বারো ভূঁইয়াদের নিয়ে, সিপাহী-সিপাহী বিদ্রোহের গল্প, অশ্বারোহী-সাতচল্লিশের দেশ ভাগ নিয়ে এবং সিরিজের শেষ বই মুক্তি—১৯৭১ সালের গল্প নিয়ে। এর আগে সিরিজটার কোনো অফিসিয়াল নাম ছিল না, অন্যধারা থেকে নতুন করে বইটি পুনর্মুদ্রণ হবার সময়ে ঠিক করি, সিরিজটার নাম হবে ‘সময় উপাখ্যান’। ইতিহাস আর ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মানুষ নিয়েই এই সিরিজের গল্প, তাই সময়কে তুলে ধরার জন্যে এরচেয়ে সুন্দর নাম আর হতে পারে না। তো এই আমার পরিকল্পনা। সপ্তরিপু থেকে যে-যাত্রার শুরু হয়েছিল সেই যাত্রা চালিয়ে যেতে চাই সময় ও ইতিহাস নিয়ে। বাকিটা পাঠকের ভালোবাসা, বড়োদের আশীর্বাদ ও প্রকৃতির ইচ্ছা। সবাই ভালো থাকবেন।
—রবিন জামান খান
ডালাস, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র
পূর্বকথা
সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ
ফোর্ট উইলিয়াম, কোলকাতা
তলোয়ারের চকচকে ফলাটা যেন সম্মোহিত করে ফেলেছে তাকে।
উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান প্রহরীর উলটো করে ধরে থাকা তলোয়ারের ফলাটার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন ওটার ওপরেই নির্ভর করছে তার জীবন- মরণ। দূর থেকে তার তাকিয়ে থাকার ভঙ্গি দেখলে যে কেউ এমনটাই ভাববে।
তবে সত্যি কথা হলো হেনরি স্লিম্যান মোটেই এমনকিছু ভাবছে না। সে এমনকি দেখছেও না ফলাটা, শুধু তাকিয়েই আছে। তার মন জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে আসন্ন বিপজ্জনক সাক্ষাৎকার। যেটার জন্যে ভোপালের নর্মদা এলাকা থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে তাকে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানে, কোনো দাপ্তরিক কাজের উদ্দেশ্যে তাকে ডাকা হয়নি। কারণ সেরকম কোনো উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠালে এভাবে ডাকা হতো না। সে-ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে ডাকা হতো। সেটা যেহেতু হয়নি, তার মানে যে উদ্দেশ্যেই তাকে ডাকা হোক না কেন, সেটা ভালো কিছু নয়।
আসন থেকে উঠে গভর্নর জেনারেলের দপ্তরের বাইরে পায়চারি শুরু করল সে। অস্থির লাগছে। স্থানীয় সরকারের অধীনে কর্মরত সর্বোচ্চ পদের লোকজন ডেকে পাঠিয়েছেন তাকে। কিছুতেই বুঝতে পারছে না এভাবে ডেকে পাঠানোর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। গুরুতর কিছু না ঘটলে এভাবে ডেকে পাঠানোর কথা নয়।
গত কয়েক মাস ধরে খুব অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে সময় কাটছে হেনরির। এর পেছনে একটা বড়ো কারণও আছে। সে যদি ভুল না ভেবে থাকে তবে সেই নির্দিষ্ট বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্যেই ডেকে পাঠানো হয়েছে তাকে। যদি তাই হয়ে থাকে তবে একদিক থেকে ব্যাপারটা ভালো, আবার অন্য দিক থেকে সেটা খুব খারাপও হতে পারে।
ভালো এই অর্থে, যে ব্যাপারটা নিয়ে সে চিন্তিত সে-ব্যাপারটা কোম্পানির হাই কমান্ডের কানে দিতে পারলে এই ব্যাপারে সাহায্যও পেতে পারে। আর খারাপ এই অর্থে, সে যদি তাদেরকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে না পারে তবে উলটো ফল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই মুহূর্তে তাদেরকে বোঝানোর মতো পরিস্থিতিতে নেই সে। কারণ ব্যাপারটা প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ সে এখনো সংগ্ৰহ করতে পারেনি।
ভাবতে ভাবতেই করিডর সংলগ্ন বড়ো জানালার সামনে এসে দাঁড়াল হেনরি স্লিম্যান।
ভারত উপমহাদেশের বুকে ইংরেজদের সর্ববৃহৎ স্থাপত্য ফোর্ট উইলিয়ামের সৌন্দর্য সবসময় বিমোহিত করে তাকে। হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত স্থাপনাটার একদিকে নদী, অন্যদিকে কোলকাতা শহর। দুর্গের সামনেই বিরাট ময়দান। এই মুহূর্তে কোম্পানির সৈন্যরা প্যারেড করছে ময়দানে। ময়দানের একটা অংশ বিকেলে খুলে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের জন্যে। ওই সময়টাতে কোলকাতা শহরের মানুষেরা মুক্ত হাওয়ার খোঁজে এখানে বেড়াতে আসে।
দুর্গ থেকে একটু দূরেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। হেনরির মনে পড়ল, বছরকয়েক আগে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে জুনিয়র অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে নর্মদা যাবার আগে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটতো তার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লাইব্রেরিতে।
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে হেনরির মনে হলো ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোড়াপত্তনের পেছনে এই দুর্গের প্রতিটি ধূলিকণার সম্পর্ক রয়েছে। এই দুর্গই ছিল ভারতের মাটিতে ইংরেজদের প্রথম শেকড়, যেটাকে তারা ভারতবর্ষের মাটির সবচেয়ে গভীরে পুঁতে দিতে সমর্থ হয়েছিল। ভারতে আসার পর অন্যান্য যেকোনো অফিসারের মতো হেনরির প্রাথমিক সময়ও কেটেছে এই দুর্গে। এই দুর্গের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক। আর একারণেই ফোর্ট উইলিয়ামের প্রতি তার মুগ্ধতা, বিস্ময় আর ভালোলাগা সীমাহীন।
তবে এই দুর্গ হেনরিকে যতটা না বিস্মিত করে তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্মিত করে তার স্বজাতি। হাজার-হাজার মাইল দূর থেকে জাহাজে করে ভিন্ন এক ভূখণ্ডে এসে স্রেফ বুদ্ধি আর কূটনীতির বলে যেভাবে তারা পুরো উপমহাদেশটা শাসন করছে সেটা বিস্মিত হবার মতোই বটে। আর এই বিরাট শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে মাত্র তিনটে দুর্গ থেকে।
কোলকাতা, বোম্বাই আর মাদ্রাজ। এত বিশাল ভূখণ্ড, আর মাত্র তিনটে নিজস্ব স্থাপনা! তিনটে পরিচালনা কেন্দ্র! ভাবা যায়!
তবে বর্তমান সময়টা হেনরির পছন্দ নয়। যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভারতের মাটিতে কোম্পানি তার শাসনের শেকড় বিস্তারে রত। অন্যভাবে বলতে গেলে কোম্পানির বেশিরভাগ লোকজন লুটপাট আর শোষণে ব্যস্ত।
অন্যদিকে দিল্লিতে মোঘল সাম্রাজ্যের অবস্থা তাদের ঘোলাটে রঙের সুরার মতোই ঘোলাটে আর দুর্বল। ভারতের সম্পূর্ণ দক্ষিণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে নিজামুদ্দিন বাহাদুর, তারও যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বক্সারের যুদ্ধ, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ, সবশেষে সাম্প্রতিক ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের ডামাডোলে সবচেয়ে অসহায় আর নিপীড়িত এখন সাধারণ মানুষ
তাদের কেউই নেই। না আছে ভালোটা দেখার, না আছে মন্দটা দেখার। আর এ-সুযোগেই…মনের কথা মনেই রয়ে গেল, সাদা কুর্তা আর লাল পাগড়ি পরিহিত আরদালি এসে জানাল ভেতর থেকে বড়ো সাহেবরা তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
সঙ্গে সঙ্গে হেনরির শরীর টান-টান হয়ে গেল। মাথায় বেরেট পরে নিয়ে হাতের কাগজগুলো ঠিক করে দৃঢ় পদক্ষেপে নির্দিষ্ট কক্ষের দিকে রওনা দিল সে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বড়ো করে দম নিয়ে সে আরদালিকে ইশারা করল পথ দেখানোর জন্যে। আরদালি সামান্য টোকা দিয়ে ভেতরে ঢোকার জন্যে দরজাটা মেলে ধরল।
কক্ষটার ভেতরে ঢুকেই পলকে একবার ভেতরের পরিস্থিতি দেখে নিলো হেনরি। বিরাট কামরাটার মাঝখানে বড়ো বড়ো দুটো টেবিল পাতা। সেগুলোর পেছনে তিনজন মানুষকে বসে থাকতে দেখল সে। তাদের সামনে থাকা টেবিল দুটো পরিষ্কার করছে আরদালিরা।
এখন বৈকালিক চা-পানের সময়। নিশ্চয়ই তারা এতক্ষণ চা পান করছিলেন যে কারণে তাকে ভেতরে ডাকতে দেরি হয়েছে।
হেনরি আরেকবার নিশ্চিত হয়ে গেল তাকে ভালো কোনো উদ্দেশ্যে ডেকে আনা হয়নি। তাই যদি হতো তবে তাকে চা পানের সময়ই ভেতরই ডাকা হতো। এটা অনেক পুরনো ব্রিটিশ কেতা।
হেনরি ভেতরে ঢুকলেও কোনো কথা বলল না। কারণ কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের ভেতরে আলোচনা করছেন, আর আরদালিদের উপস্থিতিতে কথা শুরু করাটা কোনো অফিসারের জন্যে শোভনীয় নয়। হেনরি অপেক্ষা করতে লাগল।
এরই মধ্যে সে টেবিলের অন্যপাশে বসে থাকা মানুষ তিনজনকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো এক দফা। তিনজনের ভেতরে একজন তার খুবই পরিচিত। বলা চলে ব্রিটিশ ভারতে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, কর্নেল গ্রেগরি। উনি বসে আছেন মাঝখানে। কর্নেল গ্রেগরির বাঁয়ে বসা মানুষটিকেও চিনতে পারল সে। ফোর্ট উইলিয়ামসহ এই বাঙ্গাল প্রদেশের অধিকর্তা জেনারেল এডগার। তার সঙ্গে হেনরির খুব খাতির না থাকলেও পরিচয় আছে ভালোই। তবে সে অবাক হলো অন্য মানুষটিকে দেখে।
এই মানুষটি কর্নেল গ্রেগরির ডানে বসে আছে। এই মুহূর্তে সে তার পাইপ ধরাতে ব্যস্ত। হেনরি এই মানুষটাকে দেখে অবাক হলো কারণ তার পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব ওপর-মহলের কেউ হবে। তবে হেনরি তাকে চিনতে পারল না। আর এটাই তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। এই অঞ্চলের সব বড়ো অফিসারদেরকে সে চেনে, তবে এই মানুষটিকে চিনতে পারছে না কেন?
সদ্য ইংল্যান্ড থেকে এসেছে এরকম কেউ? কিন্তু মানুষটার রোদে পোড়া বাদামি চামড়া তো সে-কথা বলে না।
‘শুভ বিকেল, স্যার,’ আরদালিরা চলে যেতেই মাথা থেকে টুপি খুলে পরিষ্কার ব্রিটিশ উচ্চারণে বলে উঠল হেনরি। উদ্দেশ্য দুটো; সম্বোধন করা, সেই সঙ্গে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া।
‘শুভ বিকেল, মিস্টার স্লিম্যান,’ বলে উঠলেন কর্নেল গ্রেগরি। তার কথা শুনে হেনরি একটু অবাক হলো। কর্নেল সাধারণত তাকে উইলিয়াম নামে ডাকে। যদি তাকে দাপ্তরিক কাজে নাই ডেকে পাঠানো হয় তবে এই আনুষ্ঠানিক নাম বলার কারণ কি? ‘বসুন, প্লিজ।’
হেনরি দেখল টেবিল দুটো থেকে খানিকটা সামনে একটা চেয়ার পেতে রাখা হয়েছে। সেটাতেই বসল সে। তার কাছে মনে হলো চেয়ারের নরম গদিতে কেউ যেন গেঁথে ফেলল তাকে। মে মাসের গরমে এমনিতেই উত্তপ্ত চারপাশ, মাথার ওপরে দুলতে থাকা টানা পাখার বাতাস শুধুমাত্র টেবিলের ওপাশে বসা লোকজনের ওপরেই যা একটু প্রবাহিত হচ্ছে। গরমে সিদ্ধ হতে থাকা হেনরি অস্বস্তির সঙ্গে অনুভব করল তার পিঠের চামড়ার ওপরে একদিকে গড়াতে থাকা ঘামের স্রোত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, অন্যদিকে শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত ওপরের দিকে উঠে আসছে।
‘মিস্টার স্লিম্যান, কেমন আছেন আপনি?’ বলে উঠলেন কর্নেলের বাঁয়ে বসা জেনারেল এডগার। তার ইংরেজিতে সামান্য আইরিশ টান। উচ্চারিত শব্দগুলো শেষদিকে এসে অদ্ভুতভাবে বেঁকে যায়। হেনরির জানা আছে জেনারেল এডগারের পূর্ব পুরুষেরা আইরিশ।
‘জি, স্যার। ভালো আছি। ধন্যবাদ।’
‘আপনার এলাকা নর্মদার অবস্থা কেমন এখন? কিছুদিন আগেও নাকি স্থানীয় তল্পিবাহকদের সঙ্গে আইনের লোকজন আর টোলঘরের কর্মচারীদের সমস্যা হয়েছিল?’
‘স্যার, ওটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। স্থানীয় সরকারের শাসনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই,’ কথাটা বলতে পেরে একটু হলেও সুস্থির লাগল, কিন্তু মনের ভেতরে সে জানে এসব আলতু-ফালতু কথা। মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে ভণিতা মাত্র।
‘তাহলে আপনি বলতে চাইছেন আপনার নর্মদা এলাকায় এই মুহূর্তে পরিপূর্ণ শান্তি বজায় আছে?’ কর্নেল গ্রেগরি তাকে সাহস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন।
‘স্যার…’ হেনরি কথা শুরু করার আগেই কর্নেলের ডানে বসা মানুষটা তাকে থামিয়ে দিল। ব্যাপারটা খুবই অবাক করল হেনরিকে। কারণ এটা ব্রিটিশ কেতার একেবারেই বাইরে। একজন জেন্টেলম্যান কখনোই আরেকজন জেন্টেলম্যানের কথার মাঝখানে কথা বলবে না। এরকম আনুষ্ঠানিক পরিস্থিতিতে তো একদমই নয়।
‘আপনি সেনাবাহিনী ছাড়লেন কেন?’ পাইপের ভেতর থেকে নির্গত ধোঁয়ায় তার চেহারা প্রায় অন্ধকার হয়ে থাকলেও লোকটার কথা শুনে বেশ চমকে উঠল হেনরি। মানুষটার কথা বলার ভঙ্গি খুবই অদ্ভুত। প্রতিটি শব্দের শুরু যেন বিকৃত। মানুষটা এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি কিন্তু কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পেরেছে হেনরি। পুরো ব্রিটিশ ভারতে একজন মানুষই এভাবে কথা বলে। আর একারণে তার একটা বিশেষ নামও আছে। ‘তোতলা কর্নেল’। তবে এই নামের চেয়ে অন্য একটা নামেই সে বেশি পরিচিত। সে নামটা হলো ‘দক্ষিণের কসাই’। সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধে মারাঠাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে এই নামটা অর্জন করেছে সে।
এই তাহলে সেই দক্ষিণের কসাই ‘তোতলা কর্নেল’, মনে মনে ভাবল হেনরি। যে প্রশ্নটা তাকে করা হয়েছে সেটার জবাব গুছিয়ে নিয়ে শুরু করলও, ‘স্যার আমার আসলে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা করার ইচ্ছে ছিল। সে-কারণেই সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নিয়েছিলাম; কিন্তু স্যার গ্রেগরি চাননি আমি দাপ্তরিক কাজ থেকে বিরতি নিয়ে পুরোপুরি শিক্ষক বনে যাই। যে কারণে উনিই আমাকে নর্মদা ও সগর এলাকায় গভর্নরের জুনিয়র অ্যাসিটেন্ট হিসেবে কাজ করতে বলেন।
‘আপনি কতদিন যাবৎ সেখানে কাজ করছেন?’ আবারো তোতলা সুরে জানতে চাইল দক্ষিণের কসাই। লোকটার ভয়ংকর অবয়ব আর হাস্যকর গলার স্বরের মধ্যে অদ্ভুত এক অসামঞ্জস্য বিদ্যমান। এই অসামঞ্জস্য বাকিদের ওপরে খুবই বাজে প্রভাব সৃষ্টি করে। যে বাজে প্রভাবে হেনরি এই মুহূর্তে ভুগছে।
‘স্যার, দুই বছরের ওপরে,’ যতটা সম্ভব অস্বস্তি কাটিয়ে শান্ত স্বরে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল সে।
‘দাপ্তরিক হিসেব অনুযায়ী বলতে গেলে দুই বছর সাত মাস,’ তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠল দক্ষিণের কসাই। ‘আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না আপনি যখন ওখানে গেলেন তখন ভারতবর্ষের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল অনেক খারাপ; কিন্তু আপনার এলাকা নর্মদা ও সগরের অবস্থা ছিল সবদিক থেকে ভালো। কিন্তু গত এক বছরের অধিক সময় ধরে আপনার এলাকার অবস্থা ক্রমশই খারাপ হচ্ছে,’ বলে সে হেনরির দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচু করে জানতে চাইল। ‘ব্যাপারটা কী?
‘স্যার, খারাপ বলতে আপনি আসলে কী বোঝাচ্ছেন? নির্দিষ্টভাবে বললে আমার জন্যে বুঝতে সুবিধে হতো,’ হেনরি অনুভব করতে পারছে তার চারপাশ থেকে জাল গুটিয়ে আনা হচ্ছে। একটু পরেই আটকা পড়বে সে। কাজেই সে-ও শক্ত হবার চেষ্টা চালাল, যাতে সময় এলে গুটিয়ে আসতে থাকা জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
‘রিপোর্ট অনুযায়ী যদি আপনার রেকর্ড নিরীক্ষা করে দেখা হয় তবে প্রথমেই বলা যেতে পারে খাজনা আদায়ের ব্যাপারটা…’
‘কিন্তু স্যার, সেটা তো সরাসরি আমার অধীনে নয়,’ অসহায়ভাবে কর্নেল গ্রেগরির দিকে তাকাল সে। কর্নেল তাকিয়ে আছেন তোতলার দিকে।
‘হ্যাঁ, আমি জানি খাজনা আদায়ের ব্যাপারটা সরাসরি আপনার অধীনে নয় কিন্তু সেটা আপনার এলাকারই ব্যাপার। এখানে দেখা যাচ্ছে খাজনা আদায়ের পরিমাণ যেখানে বৃদ্ধি পাবার কথা ছিল, সেখানে গত এক বছর ধরে আগের চেয়ে সেটা আরো কমে গেছে। আর আপনার অধীনে কর্মরত লোকজনের জবানীতে জানা গেছে আপনি তাদেরকে এই ব্যাপারে সহায়তাও করছেন না…
‘স্যার, গত বছর খরার কারণে…’
‘ঠিক আছে, সেটা বাদ দিন,’ বলে সে পাইপ থেকে টেনে নিয়ে ক্রমাগত ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়তে ছাড়তে বলে চলল। ‘আপনার এলাকায় গত ছয় মাস ধরে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি তো হচ্ছেই। সেই সঙ্গে দাপ্তরিক সব কাজেও গাফিলতি দেখা দিয়েছে। অন্তত আপনার অধীনে কর্মরত প্রত্যেকে এমনটাই বলছে।’
হেনরি কোনো জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। এবার সময় উপস্থিত। ‘স্যার, কী বলেছে আমার অধীনে কর্মরত লোকজন?’ বাক্যের শেষ অংশটুকু সে খুব কঠিন স্বরে উচ্চারণ করল।
‘তারা বলেছে—’ কর্নেল গ্রেগরি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে তোতলা কসাই বলে উঠল। ‘আপনি নাকি নিজের কাজ-কর্ম সব বাদ দিয়ে কাদের পিছু নিয়ে বেড়াচ্ছেন। সত্যি কথা হলো এব্যাপারে কথা বলার জন্যেই ডেকে পাঠানো হয়েছে আপনাকে। ব্যাপারটা আসলে কী, আমরা আপনার মুখ থেকে সেটা জানতে চাই।’
তিনজনেই তাকিয়ে আছেন হেনরির দিকে।
বড়ো কর্তাদের কঠিন চোখের দিকে তাকিয়ে বড়ো করে একবার নিশ্বাস নিলো হেনরি। সময় উপস্থিত, হয় এসপার আর না হয় ওসপার।
‘স্যার, আপনারা যা শুনেছেন সেটা পুরোপুরি ভুল নয়। আমি সত্যি সত্যি সংঘবদ্ধ অপরাধীদের একটি চক্রকে সনাক্ত করার চেষ্টা করছি
‘সংঘবদ্ধ অপরাধী বলতে কি বোঝাচ্ছেন আপনি?’ কসাইয়ের প্রশ্ন।
‘এরা কি ডাকাত?’ তার সঙ্গে যোগ করল জেনারেল এডগার।
‘না স্যার, এরা ডাকাত নয়,’ একবাক্যে জবাব দিল হেনরি। যদিও পথিকদের সর্বস্ব লুট করাই এদের উদ্দেশ্য তবু এরা ডাকাত নয়। এরা আরো অনেক বেশি কিছু।’
‘এর মানে কী, মিস্টার স্লিম্যান? একবার বলছেন পথিকদের সর্বস্ব লুট করাই এদের কাজ। আবার বলছেন এরা ডাকাত নয়। সঠিক জবাব দিন।’
‘স্যার, আমি যাদের কথা বলছি এরা ডাকাত নয়। এরা অনেক বেশি ভয়ংকর আর সংঘবদ্ধ একটা গোপন সংঘের মতো। আমি এখনো এদের ব্যাপারে খুব বেশি জানতে পারিনি কিন্তু যতটুকু শুনেছি তা খুবই ভয়ংকর,’ হেনরি উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ‘স্যার, আমার গবেষণা যদি সঠিক হয় তবে বলা চলে প্রতি বছর ভারতবর্ষের পথে-প্রান্তর থেকে হাজার হাজার মানুষ হারিয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের একটা বড়ো অংশকে এই সংঘবদ্ধ খুনিরা গায়েব করে, স্যার।’
‘কে কোথা থেকে হারিয়ে যায়, সেটা বিবেচনা করার আপনি কে? ভারতবর্ষ বিরাট দেশ। এখানে শত-শত মানুষ বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, আবার ফেরতও আসে। এ আর নতুন কি?’
‘না স্যার, এরা বাড়ি থেকে পালানো কিংবা বনে-জঙ্গলে বাঘে খেয়ে ফেলা মানুষ নয়,’ বলে সে নিজের হাতের ফাইল থেকে একটা কাগজ বের করে পড়তে শুরু করার আগেই আবারো তাকে থামিয়ে দিল একজন।
‘আপনি যাদের কথা বলছেন এরা কি আপনার এলাকায় অবস্থান করে?’
‘না, স্যার। আমি আপনাদের এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি। এরা পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে আছে। আমার হিসেব মতে এই গোপন সংঘ প্রতি বছর ভারতবর্ষের পথে-প্রান্তর থেকে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার মানুষ খুন করে তাদেরকে গায়েব করে ফেলে।
হেনরির কথাটা শেষ হওয়ামাত্র মুহূর্তের জন্যে নীরবতা ঝুলে রইল কক্ষে। তারপর যেন ছোটোখাটো একটা বোমা বিস্ফোরিত হলো।
তিন বড়োকর্তা নড়েচড়ে উঠে একে অপরের দিকে তাকালেন। ‘আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন নাকি?’ উত্তেজনার চোটে জেনারেল এডগার দাঁড়িয়ে গেছেন। ‘কর্নেল গ্রেগরি, আপনার এই অফিসার কি পাগল হয়ে গেছে নাকি? কী বলতে চাইছে সে? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ শাসনরত অবস্থায় প্রতি বছর বিরাট এক সংঘবদ্ধ অপরাধী দল হাজার-হাজার মানুষ খুন করছে আর এদের অস্তিত্বের ব্যাপারে কোনো প্রমাণ নেই আমাদের কাছে। এমনকি আমাদের কোনো ধারণাও নেই এই ব্যাপারে। কী বলছে সে এসব! এসব কথা যদি ইংল্যান্ডের রাজ দরবারের লোকজন জানতে পারে তারা কোম্পানির শাসনের ব্যাপারে কী ভাববে! আপনার অফিসার পাগল হয়ে গেছে।’
‘অফিসার স্লিম্যান, আপনি যা বলছেন সেটা কতটুক সত্যি?’ কর্নেল গ্রেগরিই এখনো একটু শান্ত আছেন।
‘স্যার, আমার কথা পুরোপুরি সত্য,’ স্যার গ্রেগরির শান্ত ভাবটা যেন হেনরির ভেতরেও প্রবাহিত হচ্ছে।
‘আপনি বলছেন এই সংঘবদ্ধ অপরাধীদের ব্যাপারে কোম্পানির কোনো ধারণাই নেই, তবে আপনি কীভাবে জানতে পারলেন এদের কথা?
‘স্যার, ব্যাপারটা আমি প্রথম পড়েছিলাম ফরাসি পর্যটক থিভেনটের এক ভ্রমণ কাহিনিতে। সে তার ভ্রমণ কাহিনিতে বর্ণনা করেছে; পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে নাকি একটি অদ্ভুত গোত্র ছড়িয়ে আছে যারা…’
‘হাহ্! এক পাগল ফরাসি মাতাল হয়ে উলটোপালটা কীসব লিখে গেল আর আপনি তার কথা পড়ে এসব প্রলাপ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন,’ জেনারেল এডগারের চোখের দিকে তাকিয়ে হেনরি অনুভব করল, ইংরেজ আর ফরাসিদের মাঝের শতবর্ষব্যাপী বিরাজমান যুদ্ধের ঘৃণা এখনো এতটুকু কমেনি। ইংরেজরা আজো ফরাসিদের একইরকম ঘৃণা করে।
‘অবশ্যই না, স্যার। আমি গত ছয় মাস ধরে এদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর করার…’
‘মিস্টার স্লিম্যান, অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর তোতলা কসাই কথা বলে উঠল ‘আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে এদের অস্তিত্বের ব্যাপারে?’
‘স্যার, আজ থেকে দুবছর আগে চিতোরে দুটি দল ধরা পড়েছিল।’
‘আমরা ওই দল দুটোর ব্যাপারে জানি। একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল ওদের নিয়ে। সেটা মিটে যাবার পর ওদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
‘স্যার, মাস কয়েক আগে দোয়াব জেলায় কুয়োর ভেতরে প্রায় বিশটির মতো মৃতদেহ পাওয়া যায়। ওদেরকে…
‘মিস্টার স্লিম্যান, আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? দোয়াবের ওই মৃতদেহগুলো মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধের পরবর্তী ফলাফল ছিল।’
‘স্যার, ওদেরকে যেভাবে মারা হয়েছে মারাঠারা ওভাবে খুন করে না। বরং…’
‘আর কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?’ এবার কর্নেল গ্রেগরি সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
মাথা নিচু হয়ে গেল হেনরির। ‘না, স্যার। আমি এখনো তেমন কোনো প্ৰমাণ সংগ্রহ করতে পারিনি,’ বলে সে মাথা উঁচু করে বলল। ‘স্যার, আমি এখনো তেমন কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু আমি জানি এই খুনে গোত্রের অস্তিত্ব আছে। ওরা কারা, ওদের ধর্ম কী? কীভাবে মানুষ মারে, কোথায় বসবাস করে সব আমি বের করে ফেলব যদি…’
‘কোনো যদি নেই,’ জেনারেল এডগার তার সামনেই ফাইলটা বন্ধ করলেন। ‘মিস্টার স্লিম্যান, আপনাকে সরাসরি নির্দেশ করছি আমি। আপনি আজ থেকে এসব কিছু ভুলে গিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিবেন। আপনি একজন সৎ ও যোগ্য অফিসার, সেটা প্রমাণ করে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করুন। পথে প্রান্তরে কে কাকে মারছে, কে কার মাল লুট করছে এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা আপনার কাজ নয়। আর আপনাকে পরিষ্কার বলে দেই, এমন কিছু করবেন না, বা বলবেন না যাতে করে ইংরেজ রাজ পরিবারের কাছে কিংবা ইংল্যান্ডের দরবারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদনাম হয়। এমনিতেই কোম্পানি আর রাজ দরবারের মাঝে বিদ্যমান জটিল সম্পর্কের ব্যাপারে আশা করি আপনি অবগত আছেন। কাজেই নেটিভদের সামান্য কিছু ক্ষতির কথা বিবেচনা করে আমরা কোম্পানির মান সম্মান ধুলোয় লুটাতে দিতে পারি না। অতএব, আজ থেকে এসব ভুলে নিজের কাজে মনোযোগ দিন।’
চুপ করে বসে রইল হেনরি।
‘আমার কথা বোঝা গেছে, অফিসার?’
‘জি, স্যার।’
‘এখন বিদায় নিন। ‘
উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে রওনা দিয়েও হঠাৎ কর্তাদের দিকে ফিরে তাকাল হেনরি। ‘স্যার, যদি আমি এদের অস্তিত্বের ব্যাপারটা প্রমাণ করতে পারি? যদি আমি প্রমাণ করে দিতে পারি ভারতবর্ষের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার ছদ্মবেশী খুনির দল। যাদের কাছ থেকে শুধু নেটিভরাই না এমনকি ইংরেজরাও নিরাপদ নয়, তবে কী হবে?’
তিনজনে নিজেদের ভেতরে ফিসফাস করে জেনারেল এডগার বলে উঠলেন, যদি আপনি মজবুত প্রমাণ নিয়ে আসতে পারেন, তবে এদেরকে দমন করার ব্যাপারে আপনাকে সার্বিক সহায়তা করা হবে। এখন আপনি বিদায় নিন।’
হেনরি কোনো জবাব না দিয়ে বেরিয়ে এলো গভর্নরের অফিস কক্ষ থেকে। যদিও সে বড়োকর্তাদের সামনে পুরো ব্যাপারটা প্রমাণ করতে পারেনি কিন্তু মনের গহিনে সে জানে ভয়ংকর কিছু খুনি ঘুরে বেড়াচ্ছে এই ভারতবর্ষের পথে- প্রান্তরে। এদেরকে খুঁজে বের করতে হবে তার। এদের ব্যাপারে সব জানতে হবে।
সেইসঙ্গে সম্ভব হলে ধ্বংস করতে হবে এই খুনি গোত্রকে।
Ridita
লতিফুল ইসলাম শিবলীর দখল আর অন্তিম বই দুটো পারলে দিবেন প্লিজ…