সংসার – ইসলামিক উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
নাদিমের বিয়েটা অ্যাকসিডেন্টের মতো হঠাৎ করে হয়ে গেল। এখন তার বিয়ে করার মোটেই ইচ্ছা ছিল না। দাদির কথা রাখতে গিয়ে একরকম বাধ্য হয়ে রাজী হয়েছে। তাই বিয়ে পড়ানোর সময় অসন্তুষ্ট মনে তিনবার কবুল উচ্চারণ করেছে। সেই সময় তার মনে হয়েছে, যে কাজ অনিচ্ছায় ও অসন্তুষ্টির সঙ্গে করা হয়, তার পরিণতি কি ভালো হয়? না সেই কাজ ভালভাবে সমাধা হয়? কথাটা মনে হতে শিহরিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহপাকের কাছে দিলে দিলে ফরিয়াদ করল, তুমি সর্বশক্তিমান ও সব কিছুর মালিক। তুমি সমস্ত জীবের অন্তরের কথা জান। তোমার ঈশারাতেই এই কাজ সম্পন্ন হল। তুমি আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের ও শান্তির করো।আমাদেরকে তোমার ও তোমার হাবিবে পাকের প্রদর্শিত পথে চালিত করে ইহকাল ও পরকালে কামিয়াব করো।
রাজশাহী টাউনের প্রায় বিশ-বাইশ মাইল উত্তরে সারেংপুর গ্রাম। গ্রামটার পশ্চিম দিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মা। এই গ্রামে বেশ কয়েক ঘর ধনী ও মানী লোকের বাস। তাদের মধ্যে চৌধুরী বংশের খুব নাম-ডাক। তবে চৌধুরীদের এখন পড়ন্ত বেলা। নাদিম এই বংশের ছেলে। নাদিমের দাদাজীরা পাঁচ ভাই। বিরাট এলাকা নিয়ে তাদের বসতবাড়ি। সবার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী ও আত্মীয়-স্বজন যে কত, কে তার হিসাব রাখে। একই বাড়িতে পাঁচ ভাইয়ের সংসার। তবে তা ভাগাভাগি হয়ে যে যার প্রয়োজন মতো বাড়ি-ঘর করেছে। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে বিরাট বিরাট উঠোন। সেই উঠোনে চাষের মৌসুমি ধান ঝাড়াই-মাড়াই হয়। মেয়ে ও পুরুষের জন্য সেফটি ট্যাংকের ভিন্ন ভিন্ন পায়খানা আছে। প্রত্যেকের উঠোনের একপাশে একটা করে চাপকলও আছে। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বাড়ি ঘর তৈরি করলেও এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা আছে। বাইরে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকের পাঁচিলের গায়ে সদর দরজা আছে। নাদিমের দাদাজী সবার ছোট। পাঁচ ভাইয়ের কেউ বেঁচে নেই। এক সময় এই চৌধুরী বাড়ির খুব নাম ডাক ছিল। পাঁচ ভাইয়ের পাঁচটা দহলিজ ছিল। যে কোন আত্মীয়-স্বজন এলে দহজিলে থাকতে দেয়া হত। শুধু রাতের বেলা এক সময় কেউ সাথে করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে তার আপনজনের সঙ্গে দেখা করিয়ে আনত। কালের পরিবর্তনে সে সব আর নেই। তবে ঐ যে একটা কথা প্রচলিত আছে, তাল পুকুরে ঘটি ডুবে না। সেই রকম অবস্থা এখন চৌধুরী বংশের। যে কোন আত্মীয়-স্বজন এলে এখন বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে মেহমানদারী করান হয়। নাদিমের দাদাজীর নাম ছিল আবদুস সোবহান চৌধুরী। তিনি খুব সৎ ও ধার্মিক ছিলেন। উনার স্ত্রী কবিরন বিবি চৌকস মহিলা। সংসার গুছানোয় যেমন পারদর্শিনী তেমনি স্বামীর সঙ্গে ছিল গভীর সম্পর্ক। ধর্ম কর্মও খুব মেনে চলেন। চার বৌয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া হতে দেখে সংসারের কাজ চার ভাগ করে চার বৌয়ের উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন। পনের দিন অন্তর অন্তর বৌদের উপর ন্যস্ত কাজের পরিবর্তন হয়। স্বামী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলে রহিম সংসারের হাল ধরলেও আয়-ব্যয়ের হিসাব কবিরন বিবি রাখতেন। রহিমের বিয়ের ছমাসের মধ্যেই বৌ আফ্রিদার গুণে মুগ্ধ হয়ে সংসারের হিসাবপত্র তাকে বুঝিয়ে সিন্দুকের চাবি তার আচঁলে বেঁধে দিয়ে বললেন, মা, আজ থেকে এই সংসারের ভাল মন্দ সবকিছুর দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিলাম। এই দায়িত্ব যতদিন তোমার উপর থাকবে ততদিন সংসারের কারো সঙ্গে বেঈমানী করো না। কারো প্রতি অবিচার করো না।
আফ্রিদা শাশুড়ীর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলেছিল, আপনি দোয়া করুন আম্মা, আল্লাহ পাক যেন আমাকে আপনার উপদেশ মেনে চলার তওফিক দেন। সেই থেকে আফ্রিদা ও রহিম দুজনে সংসার চালিয়ে আসছে। তিন ভাই ও দুবোনকে মানুষ করে বিয়ে দিয়েছে।
নাদিমরা দুভাই ও পাঁচ বোন। পাঁচ বোনের মধ্যে দুবোন জমজ। তাদের একজন। পাঁচ বছর বয়সে পুকুরে ডুবে মারা গেছে। আর অন্যজন সাত বছর বয়সে ধনুষ্টংকর হয়ে মারা গেছে। বাকি তিন বোনের বাকেরা ও ফৌজিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মমতাজ ক্লাস নাইনে পড়ে। আর ছোট ভাই আবুল খায়ের ক্লাস সেভেনের ছাত্র। নাদিমের মেজ চাচার তিন ছেলে এক মেয়ে। সেজ চাচার দুছেলে দুমেয়ে। আর ছোট চাচার তিন বছরের ও এক বছরের শুধু দুটো ছেলে। আগের থেকে সংসার অনেক বড় হয়েছে। ছেলেদের মধ্যে নাদিম বড়। সেই জন্য এবং চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য সে সকলের প্রিয়পাত্র। তার মা আফ্রিদা এই গ্রামের ধনী হাজী আকবর আলীর কন্যা। যেমন রূপবতী তেমনি গুণবতী। চৌধুরী বাড়ির সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। যে। কোন ঘরে কোন উৎসব বা কাজ-কর্ম হলে আফ্রিদার উপস্থিতি থাকা চাই। তার কথামতো সবকিছু হয়। সব ঘরের ছেলে-মেয়েরা তাকে বড়মা বলে ডাকে।
নাদিম কলেজে পড়ার সময় থেকে আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে তাকে জামাই করার জন্য চেষ্টা করে আসছে। নাদিমের আব্বা রহিমের সাথে চাচাতো ভাই রহমত আলীর গাঢ় সম্পর্ক। রহমত আলী ও তার স্ত্রী হুসনেআরা নাদিমকে জামাই করতে খুব আগ্রহী। নাদিমকে তারা ছোটবেলা থেকে খুব স্নেহ করত। বিয়ের পর অনেক দিন তাদের কোন সন্তানাদি না হওয়ায় তারাই এক রকম নাদিমকে মানুষ করেছে। পরে তাদের মাত্র একটা মেয়ে হয়েছে। তার নাম রশিদা। রশিদা এখন ক্লাস এইটে পড়ছে। নাদিমকে জামাই করবে ভেবে তাকে আগের থেকে অনেক বেশি স্নেহ করে। রহমত আলী সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট। সে যেমন সাংসারিক প্রয়োজনীয় কোন জিনিস কারো কাছ থেকে নেয় না, তেমনি নিজের জিনিসও কাউকে দেয় না। কিন্তু নাদিমের জন্য সাত খুন মাফ। যখন যা প্রয়োজন নাদিম এসে চাইলেই খুশি মনে দিয়ে দেয়। নাদিম হুসনেআরাকে ছোট বৌ বলে ডাকে। রহমত আলী সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র একটা ঘরে চাবি দিয়ে রাখে। নাদিমের যখন কোন কিছুর দরকার হয় হুসনেআরার কাছে এসে বলবে, ছোট বৌ চাবিটা দাও। হুসনেআরা আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে তার হাতে দিয়ে দেয়। যেদিন রহমত আলীর ঘরে মেহমান কুটুম আসে অথবা ভাল কিছু রান্না হয়, সেদিন নাদিমকে দাওয়াত করে খাওয়াবে। নাদিমও ছোটবেলা থেকে তাদেরকে খুব শ্রদ্ধা করে।
রশিদার গায়ের রং কাল হলেও দেখতে-শুনতে ভাল। বাপ-মার একমাত্র সন্তান বলে হয়ত একটু উগ্র ধরনের। তাকে কেউ কিছু বলে পার পায় না। একটা বললে সাতটা শুনিয়ে দেয়। তবে নাদিমকে খুব ভয় পায়। এই রকম স্বভাবের জন্যে সে ছোট বেলা থেকে তার চড়-চাপটা খেয়ে আসছে।
নাদিম বি.এ. পাস করে যখন গোদাগাড়িহাই স্কুলে মাস্টারি করতে লাগল তখন রহমত আলী একদিন নাদিমের আব্বাকে বলল, আমি রশিদাকেনাদিমের হাতে দিতে চাই।
রহিম বলল, আমার মেজ ও ছোট শালী নাদিমকে জামাই করবে বলে অনেক দিন আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া আমার মামাতো ভাই আফসু ও খালাত ভাই কাদের এবং বড় বুবুও প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তোমাকে এখন কিছু বলতে পারছি না, পরে জানাব।
রহমত আলী চিন্তা করল, ওরা হয়ত অনেক কিছু যৌতুক দেয়ার কথা বলেছে, তাই এরকম বলছে। বলল, রশিদা আমাদের একমাত্র মেয়ে। পরে ওরাই তো আমাদের সব কিছু পাবে, তবু আমি এখন নাদিমের নামে পাঁচ বিঘা ধানী জমি লিখে দেব।
রহিম বলল, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। যৌতুকের কথা যা বললে তা আর কোনদিন মুখে উচ্চারণ করো না। জান না, বিয়েতে লেনদেন হারাম? নাদিম এসব কথা শুনলে খুব রেগে যাবে। সে কি ধরনের ছেলে, তা তো জান। আমি ওর মায়ের সাথে কথা বলে দেখি। তা ছাড়া নাদিমেরও মতামত নিতে হবে, আম্মাকেও জানাতে হবে। সেদিন আর এ ব্যাপারে কোন কথা হল না।
ঐ দিন রাতে রহিম স্ত্রীকে রহমত আলীর কথা জানাল।
আফ্রিদা বলল, রশিদা একটু খরখরি আর রং কাল। নাদিম যদি মত দেয়, তা হলে আমার কোন অমত নেই। তবে তুমিও তো জান, বড় বুবু ও জয়নাব অনেক আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে।
রহিম বলল, শুধু তারা কেন, আমাদের আত্মীয়দের মধ্যেও অনেকে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। ওসব কথা বাদ দিয়ে বল, রহমত আলীকে কি বলব?
আফ্রিদা বলল, আমরা যাই বলি না কেন সবার আগে নাদিমের মতামত নিতে হবে তার উপর আম্মা রয়েছেন। ওনাকে না জানিয়ে, মতামত না নিয়ে আমরা কিছু করতে পারি না।
রহিম বলল, আমি সে কথা রহমত আলীকে বলেছি।
আফ্রিদা বলল, আমার মতে কোন আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে না দেয়াই ভাল। কারণ একজনের মেয়েকে বৌ করলে অন্যজন মনে কষ্ট পাবে।
রহিম বলল, কথাটা তুমি মন্দ বলনি। তবে কি জান, যার যেখানে হুকুম আছে তার সেখানেই হবে।
আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে নাদিমের মা-বাপের কাছে সুবিধে করতে না পেরে তার দাদী কবিরন বিবির কাছে প্রস্তাব দিতে লাগল।
কবিরন বিবি খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। একদিন চার ছেলেকে ডেকে নাদিমের বিয়ের প্রস্তাবের কথা বলে আলোচনা করে ঠিক করলেন, কোন আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে দেবেন না। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় অন্য জায়গায় বিয়ের ব্যবস্থা করতে ছেলেদেরকে বললেন, তাই প্রায় আঠার-বিশ মাইল দূরের এক গ্রামের জানাশোনা বংশের একটা ভাল মেয়ের খোঁজ পেয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে নাদিমের বিয়ে দিয়ে দিলেন।
মেয়ের বাবা শিহাব নাদিমের মেজ দাদাজীর মেজ ছেলে বাতেনের ক্লাসফ্রেণ্ড ছিল। গোদাগাড়িতে তখন হাইস্কুল থাকলেও কলেজ ছিল না। তাই বাতেন রাজশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়েছে। সেই সময় সে প্রেমতলী গ্রামের বাড়িতে লজিং থাকত। সেই বাড়ির ছেলে শিহাবও ইন্টারে পড়ত। ফলে দুজনের মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর দুজনেরই বাবা মারা যান। তাই বাতেন যেমন পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়, তেমনি শিহাবও বন্ধ করে দেয়। সে সব অনেক আগের ব্যাপার হলেও তারা আজও সখ্যতা বজায় রেখেছে। বছরের বিভিন্ন সময় পিঠা, ফল-পাকাড়ি নিয়ে দুজন দুজনের বাড়িতে যাতায়াত করে। শিহাব নাদিমের সম্বন্ধে সব কিছু জেনে তাকে জামাই করার জন্য একদিন বন্ধু বাতেনকে বলল।
বাতেন বলল, ভাইপো বলে বলছি না, ছেলে হিসাবে নাদিম সত্যিই খুব ভাল। উপযুক্ত মেয়ে থাকলে আমি তাকে জামাই করতাম। ছেলের বাপের সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাব।
শিহাব বাড়ি চলে যাওয়ার পর একদিন বাতেন রহিমকে শিহাবের কথা বলে বলল, তোমরা তো জান আমি একসময় তাদের বাড়িতে থেকে কলেজে পড়েছি। ওদের অবস্থা ভালো বংশও ভালো। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা ছোট। ক্লাস থ্রী না ফোরে পড়ে। মেয়েটাই বড়। গত বছর ম্যাট্রিক পাস করেছে। দেখতে-শুনতে খুব ভাল। আর শিহাবকে তো তোমরা সবাই চেন।
চাচাতো ভাইয়ের কথা শুনে রহিমের মায়ের ও স্ত্রীর কথা মনে পড়ল, আত্মীয়দের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে না দেয়াই ভাল। কারণ একজনের মেয়েকে বৌ করলে অন্যরা মনে কষ্ট পাবে। চিন্তা করল, এখানে বিয়ে হলে কোন আত্মীয়ই মনে কষ্ট পাবে না। বলল, আমার কোন অমত নেই। তুমি আম্মার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বল।
বাতেন একসময় ছোট চাচীর কাছে এসে প্রস্তাবটা পাড়ল।
কবিরন বিবি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তিনিও শিহাবকে চেনেন। যতবার শিহাব এসেছে ততবার বাতেনের সাথে এসে কদমবুসি করে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করেছে। ভাবলেন, এখানে নাদিমের বিয়ে দেয়া চলে। হঠাৎ ওনার মনে হল, কোন আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে হলে বোধ হয় ভাল হত। শেষমেষ মনকে শক্ত করে বাতেনকে বললেন, তুমি তো ওদের বাড়িতে থেকে দুবছর লেখাপড়া করেছ। এখনও যাতায়াত কর। মেয়েকে নিশ্চয় দেখেছ? আর ওদের বংশপরিচয়ও জেনেছ?
বাতেন বলল, জি, আমার কাছে সবকিছু ভাল মনে হয়েছে বলেইতো আপনার কাছে প্রস্তাব দিলাম। নাদিম আমাদের ছেলে। যেখানে-সেখানে বা যেমন-তেমন মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে পারি না।
তুমি কি রহিমকে কথাটা বলেছ?
জি, বলেছি। শুনে আপনাকে বলতে বলল।
ঠিক আছে, তুমি এখন যাও। ভেবে চিন্তে পরে তোমাকে জানাব।
বাতেন চলে যাওয়ার পর কবিরন বিবি রহিম ও আফ্রিদাকে ডেকে তার কথা বলে মতামত জিজ্ঞেস করলেন।
রহিম বলল, আম্মা, আপনি ভাল বুঝবেন কাকেন; তাতে আমার কোন দ্বিমত নেই।
বড়মা কিছু বলবে? কবিরন বিবি আফ্রিদাকে বড়মা বলে ডাকেন।
জি না আম্মা, আমার কিছু বলার নেই। তবে নাদিমকে একবার জিজ্ঞেস করলে ভাল হয়।
নাদিম কি তার কোন আত্মীয়ের বা অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ করে?
এ ব্যাপারে সে আমাকে কোন দিন কিছু বলে নি। আমার মনে হয়, সে এসব নিয়ে এখনও মাথা ঘামায়নি।
তোমরা এবার যাও। এসব কথা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করো না। আর নাদিমকেও কিছু বলল না। যা বলার তাকে আমি বলব।
কয়েকদিন পরে কবিরন বিবি সব ছেলেদের সাথে আলাপ করে বাতেনকে ডেকে বললেন, তুমি দুচার দিনের মধ্যে প্রেমতলী যাও। গোপনে গ্রামের পাঁচজনের কাছে শিহাবদের নানিয়েল ও দাদিয়েলদের খোঁজ-খবর নাও। উভয় বংশের লোকজন কোন গর্হিত কাজ করেছে কিনা, কেউ সুধখোর ও মদখোর ছিল কিনা, কোন মেয়ে বংশের মুখে কলঙ্ক দিয়েছে কিনা সব কিছু জানার চেষ্টা করবে। যদি এইসব তাদের মধ্যে কেউ করে না থাকে, তা হলে শিহাবকে শুধু তার মেয়েকে নিয়ে আসতে বলবে। আমি কাজটা গোপনে করতে চাই। পরে তারা ধুমধাম করে যা করতে চায় করবে।
বাতেন বলল, ঠিক আছে চাচি, তাই হবে বলে ওনার কাছ থেকে চলে এল।
একদিন কবিরন বিবি নাদিমকে ডেকে পাঠালেন।
নাদিম এসে বলল, আমাকে ডেকেছেন দাদি?
কবিরন বিবি বললেন, হ্যাঁ ভাই, বস। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
নাদিম দাদির পাশে বসে বলল, কি কথা বলবেন বলুন।
তুমি উপযুক্ত হয়েছ, এবার আমি তোমার বিয়ে দিতে চাই।
বিয়ের কথা শুনে নাদিম লজ্জা পেয়ে মথা নিচু করে বলল, এ ব্যাপারে আমাকে বলছেন কেন? আব্বা-আম্মাকে বলুন। তবে আমার ইচ্ছা-বলে থেমে গেল।
কি হল, থামলে কেন? বল তোমার কি ইচ্চা? আমি কিন্তু একটা ভাল মেয়ের খোঁজ পেয়ে লোক লাগিয়েছি। যদি সবকিছু মনের মতো হয়, তা হলে কয়েকদিনের মধ্যে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করব। তোমার আব্বা, আম্মা ও চাচাদেরকে জানিয়েছি। তারাও তোমাদের বিয়ে দিতে চায়। তাই তোমার মতামত জানার জন্য ডেকেছি।
আপনারা যা করবেন তাতে আমার কোনো অমত নেই। তবে আমার ইচ্ছা, ভালো বংশের কোন গরিব ঘরের মেয়েকে বিয়ে করব।
কেন দাদু? বড়লোকের মেয়েরা কি ভাল না? হয়তো তাদের মধ্যে অনেকে ধর্মীয় শিক্ষা না পেয়ে একটু-আধটু খারাপ হতে পারে। তাই বলে সবাই খারাপ, একথা ভাবছ।
কেন?
না দাদি, বড়লোকের মেয়েরা খারাপ একথা বলছি না। আমার চিন্তাধারাটা একটু অন্যরকম।
বল, কি তোমার চিন্তাধারা?
বড়লোকের মেয়েরা যেমন বেশি আরামপ্রিয় হয় তেমনি খাওয়া-পরার ব্যাপারেও বাছ-বিচার করে। সে মেয়েকে যদি স্বামীর ঘরে এসে পরিশ্রম করতে হয় অথবা খাওয়া-দাওয়া ও পোশাক-পরিচ্ছদ বাপের বাড়ির তুলনায় নিম্নমানের হয়, তা হলে অনেক দুঃখ পায়। উপায়ান্তর না দেখে অনেকে হয়ত নিজের ভাগ্যের কথা মনে করে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে; কিন্তু মনের দুঃখটা তার চিরসাথী হয়ে থাকে। ফলে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ী ও বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গে ঝগড়া করে। কাউকে সে খুশি মনে গ্রহণ করতে পারে না। তখন সংসারে অশান্তি নেমে আসে। অপরপক্ষে যদি কোন ভাল বংশের গরিব মেয়েকে বিয়ে করা যায়, তা হলে মেয়েটা বাপ-মার ঘরে যা খেয়েছে। পরেছে তার চেয়ে স্বামীর বাড়িতে ভাল খাওয়া-পরা পেয়ে খুব শান্তি পায় এবং শ্বশুর বাড়ির সবাইকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। এরা সাধারণত পরিশ্রমী ও খুব স্বামীভক্ত হয়। আমি মনে করি, প্রত্যেক বাপ-মার উচিত মেয়েদেরকে বিলাসিতায় আরামপ্রিয় না করে মানুষ করা।
তোমার চিন্তাধারাটা মন্দ নয়। তবে কি জান ভাই, সুখ-শান্তি তকদিরের ব্যাপার। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরিবদের চালচলন খুব নিম্নমানের হয়। তাদের। মনমানসিকতাও নিম্নমানের। তা ছাড়া প্রত্যেক বংশের মান-সম্মান বলে একটা কথা আছে। সব থেকে উত্তম হল সমপর্যায়ে আত্মীয়তা করা।
এটা অতি সত্য কথা আপনি বলেছেন।
তা তুমি তেমন কোন মেয়ের সন্ধান পেয়েছ নাকি?
না দাদি, আমি ওসব ব্যাপার নিয়ে এখনও কোন চিন্তা করিনি। আপনাকে শুধু আমার মনের ইচ্ছাটা জানালাম।
নাদিম দাদির কাছ থেকে মায়ের কাছে এসে বলল, দাদি আমার বিয়ের ব্যবস্থা। করছেন, এ ব্যাপারে তুমি কি কিছু জান?
আফ্রিদা বলল, তোর মেজ চাচা তার বন্ধুর মেয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। তুই কার কাছে শুনলি?
একটু আগে দাদি আমার মতামত জিজ্ঞেস করলেন।
কি বললি?
বললাম, আপনাদের মতামতই আমার মত।
আফ্রিদা ছেলেকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
কয়েকদিন পর বাতেন ছোট চাচির কথামতো প্রেমতলী গিয়ে শিহাবদের বাড়িতে থেকে গোপনে গ্রামের লোকজনদের কাছে সবকিছু খোঁজ-খবর নিল। কোন দোষ পেল। না। শিহাব তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করেছে। দুতিন দিন থেকে শিহাব ও তার স্ত্রীকে বিয়ের কথা বলে শিহাবকে ও তার মেয়ে সাজেদাকে নিয়ে ফিরে এল।
সাজেদাকে দেখে বাড়ির ছোট বড় সবাই অবাক। এত সুন্দর মেয়ে তারা এর আগে দেখেনি। এক কথায় অপরূপা। শালওয়ার-কামিজের উপর বোরখা পরে এসেছিল। বোরখা খুলতে যারা সেখানে ছিল সবাই চমকে উটল। সাজেদাকে নাশতা খাইয়ে বাতেনের স্ত্রী জোহরা তাকে সাথে করে কবিরন বিবির কাছে নিয়ে এসে সাজেদার পরিচয় দিল। তারপর সাজেদাকে বলল, কদমবুসি কর-ইনি আমার ছোট শাশুড়ী।
সাদেজা কদমবুসি করতে কবিরন বিবি তার হাত ধরে পাশে বসালেন। তারপর দোয়া করে সাজেদার আপাদমস্তক দেখে আলহামদু লিল্লাহ বলে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?
মোসাম্মৎ সাজেদা বেগম।
লেখাপড়া কতদূর করেছ।
গত বছর ম্যাট্রিক পাস করেছি।
শুনে খুশি হলাম। তারপর জোহরাকে বললেন, বড়মার কাছে নিয়ে যাও।
জোহরা আসবার সময় সাজেদাকে বলল, এবার যার কাছে নিয়ে যাচ্ছি তাকেও কদমবুসি করবে।
আফ্রিদা রান্নাঘরে রান্না করছিল। জোহরা সাজেদাকে তার ঘরে নিয়ে এসে একটা মেয়েকে দিয়ে আফ্রিদাকে ডেকে পাঠাল। সে ঘরে এলে জোহরা বলল, তোমার ভাসুরের বন্ধু শিহাব ভাইয়ের মেয়ে সাজেদা।
আফ্রিদা সাজেদাকে দেখে খুব খুশি হল। সে কদমবুসি করতে এলে জড়িয়ে ধরে মাথায় ও মুখে চুমো খেয়ে বলল, থাক মা থাক, বেঁচে থাক সুখী হও। তারপর জোহরাকে বলল, বুবু, তুমি একে নিয়ে একটু বস, আমি কিছু নাশতা নিয়ে আসি।
জোহরা বলল, আমি এখন কিছু খাব না। আর সাজেদাকেও নাশতা খাইয়ে নিয়ে এলাম। তোর পছন্দ হয়েছে কিনা বল।
আফ্রিদা বলল, এমন মেয়ে কার না পছন্দ হবে? আল্লাহ আল্লাহ করে কাজটা মিটে গেলে হয়।
জোহরা সাজেদাকে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল।
বাতেনের চার ছেলে দুমেয়ে। বড় মেয়ে আয়েশা ও বড় ছেলে রফিকের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজ ছেলে রিয়াজুলের সঙ্গে নাদিমের খুব ভাব, এক সঙ্গেই বি.এ. পাশ করেছে। রিয়াজুল বাজারে কাপড়ের দোকান দিয়েছে। ইন্টারে পড়ার সময় ছোট ফুপুর মেয়ে হালিমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। হালিমা তখন ক্লাস টেনে পড়ত। সেজ ছেলে রেজাউল ক্লাস টেনে আর ছোট ছেলে রশিদুল সেভেনে পড়ে। ছোট বোন আমেনা ক্লাস ফোরের ছাত্রী।
পরের দিন বৃহস্পতিবার। নাদিম স্কুল ছুটির পর ঘরে এসে ভাত খেয়ে বিছানায় কাত হতে তন্দ্রামতো এসেছিল। কারো ডাকে তন্দ্রাভাব কেটে যেতে তাকিয়ে দেখল, রফিক ভাইয়ের স্ত্রী জুলেখা দাঁড়িয়ে। বলল কি ব্যাপার ভাবি, ডাকাডাকি করছ কেন?
জুলেখা বলল, হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমার সঙ্গে কনে দেখতে যাবে।
নাদিম এসব ব্যাপার কিছুই জানে না। জুলেখার চাচাতো বোন সায়লা প্রায় তাদের বাড়ি বেড়াতে আসে। বেশ কিছুদিন আগে একদিন নাদিম কি-একটা দরকারে রফিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে সায়লাকে দেখে। সায়লা দেখতে মোটামুটি সুন্দর। বি.এ. পড়ছে। নাদিমকে দেখে সায়লা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নাদিম জুলেখা ভাবিকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া কোথায়?
জুলেখা বলল, কোথায় গেছে বলে যায়নি। কেন, কোন দরকার আছে নাকি?
নাদিম বলল, হ্যাঁ, একটু দরকার ছিল। যাক পরে আসব বলে সে ফিরে আসতে লাগল।
জুলেখা বলল, নাদিম ভাই, শোন। না
দিম দরজার বাইরে চলে এসেছিল, সেখানে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কিছু বলবে?
জুলেখা বলল, হ্যাঁ, ভিতরে এস বলছি। নাদিম ভিতরে এলে বলল, তুমি তো সায়লাকে কয়েকবার দেখেছ, পছন্দ হলে বল, বিয়ের ব্যবস্থা করব।
নাদিম বলল, আমি এখনও বিয়ে করার কথা ভাবি নি। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
জুলেখার মনে হল সায়লাকে নাদিমের পছন্দ হয়নি।
আজ জুলেখা ভাবির মুখে কনে দেখার কথা শুনে নাদিম ভাবল, সায়লা হয়ত এসেছে, তাই ডাকতে এসেছে। বলল, কনে আমার দেখার দরকার নেই। সে কাজ মুরব্বিরা করছেন।
মুরুব্বিদের হুকুমে তাদেরই নিবার্চিত কনেকে দেখাবার জন্য আমার সঙ্গে যেতে বলছি।
নাদিম উঠে বসে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই।
আমি আর কনে দেখে কি করব? মুরব্বিরা যখন দেখে নির্বাচিত করেছেন।
বা-রে, তাই বলে যে তোমার জীবনসঙ্গিনী হবে তাকে দেখে পছন্দ করবে না, এ কেমন কথা?
দেখে আমার যদি পছন্দ না হয়?
আগে দেখ, তারপর পছন্দ-অপছন্দের কথা। সত্যি কথা বলতে কি এত সুন্দরী মেয়ে আর দেখিনি।
অত পাম দিতে হবে না, চল যাচ্ছি।
জুলেখা তাকে সঙ্গে করে নিজের ঘরে নিয়ে এল।
বাতেন শিহাবদের বাড়িতে যাতায়াত করে বলে সাজেদা ছোটবেলায় চাচা বলে ডেকেছে। বড় হয়ে আব্বার বন্ধু জেনে তাকে আব্বার মত সম্মান করে। এবারে বাতেন চাচা গিয়ে যখন আব্বা, আম্মা ও দাদির সঙ্গে তার বিয়ের কথা বলে তখন সে আড়াল থেকে শুনেছে। তারপর এখানে আসবার সময় দাদি তাকে ঘটনাটা বলে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। নাদিমের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য আব্বা যে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তাও জানে। জুলেখা ভাবির কাছে নাদিমের নাম শুনে তাকে দেখার জন্য মনের মধ্যে তাগিদ অনুভব করেছে। তাই আজ যখন জুলেখা ভাবি বলল, কি ভাই, বিয়ের আগে বরকে একবার দেখতে ইচ্ছা করছে নাকি? তখন হ্যাঁ বলার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লজ্জায় তা বলতে পারে নি, মাথা নিচু করে ছিল। জুলেখা ভাবি তার চিবুক তুলে ধরে বলল, আরে ভাই এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? তোমাদের মতো বয়স আমাদেরও একদিন ছিল। চুপ করে থাকাটাই কিন্তু সম্মতির লক্ষণ বলে চিবুক ছেড়ে দিয়ে ছোট ননদ আমেনাকে পাশে দেখে বলল, তুই এখানে থাক, আমি নাদিম ভাইকে নিয়ে আসি।
জুলেখা চলে যাওয়ার পর সাজেদা এতক্ষণ দুরুদুরু বুকে নাদিমের কথা চিন্তা করতে করতে আমেনার সঙ্গে কথা বলছিল। জুলেখা ঘরে ঢুকলে তার দিকে তাকাতে গিয়ে দরজায় একজন সুদর্শন যুবককে দেখে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ভাবল, নিশ্চয় নাদিম।
নাদিম ভাবীর সঙ্গে এসে সাজেদাকে দেখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাজেদা মাথা নিচু করে নিলে তাকে ভাল করে দেখে খুব অবাক হল। সত্যি মেয়েটা অত্যন্ত সুন্দরী।
জুলেখা দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে নাদিমকে বলল, একেই মুরব্বিরা তোমার জন্য নির্বাচিত করেছেন। তারপর একটা হাত ধরে ভিতরে এনে বলল, কি ব্যাপার, দুজনেই যে চুপচাপ? ঠিক আছে, আমরা চলে যাচ্ছি। তোমরা দুজন দুজনকে ভাল করে দেখ, কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস কর। আমি তোমাদের জন্যে নাশতা নিয়ে আসি। তারপর আমেনাকে সাথে করে বেরিয়ে গেল।
সাজেদাকে দেখে নাদিমের একটা হাদিস মনে পড়ল, আল্লাহ পাকের রসুল (দঃ) বলেছেন, যার বেশি ধন সম্পত্তি থাকে, সে ধনের অহঙ্কার করে। যে খুব শক্তিশালী, সে শক্তির অহংকার করে। যার রূপ থাকে, সে রূপের অহংকার করে। এই মেয়ে খুব রূপসী, এরও নিশ্চয় রূপের অহংকার আছে। এই কথা ভেবে সে এতক্ষণ শংকিত মনে চিন্তা করছিল, এর যদি রূপের অহংকার থাকে তা হলে একে বিয়ে করে আমি কি সুখী হতে পারব? না আমি ওকে সুখী করতে পারব?
ভাবি ও আমেনা চলে যাওয়ার পর নাদিম সালাম দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করল।
সাজেদা একবার মাথা তুলে নাদিমের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে নাম বলল।
নামের অর্থ জানেন?
না, আপনি বলে দিন।
ধার্মিক। ধার্মিক কাকে বলে জানেন?
জানব না কেন? যে ধর্মের আইন মেনে চলে তাকে ধার্মিক বলে।
আপনি কি ধর্মের আইন মেনে চলেন?
যতটা সম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করি। আপনার নামের অর্থটা বলুন।
আমার নাম জানেন দেখছি। পুরো নাম জানেন?
না।
আসেফ নাদিম।
এবার অর্থটা বলুন।
যোগ্য সঙ্গী।
দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।
ঠিক আছে, বসা লাগবে না। আরো দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করব। কিছু মনে করবেন না তো?
মনে করার কি আছে। করুন, কি জিজ্ঞেস করবেন।
মাথায় কাপড় দেননি কেন? মেয়েদের মাথার চুল গায়ের মোহররাম লোককে দেখান হারাম এটা কি জানেন?
সাজেদা ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বলল, মেয়েদের মাথায় কাপড় দিতে হয় জানতাম, কিন্তু যা বললেন তা জানতাম না।
নাদিম বলল, মেয়েদের শুধু মাথায় কাপড় দিলেই আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ)-এর হুকুম মানা হয় না। এমনভাবে মাথা ঢাকতে হবে যেন চুল পরপুরুষের নজরে না পড়ে। সেই জন্যেই উত্তম পন্থা হল, আলাদা রুমাল দিয়ে চুলসহ পুরো মাথা বেঁধে রাখা। যাক, নিশ্চয় লেখাপড়া করেছেন?
এস.এস.সি. পাশ করেছি।
বেহেশতী জেওর পড়েছেন?
না।
বেহেশতী জেওর প্রত্যেক সাবালক নর-নারীর পড়া অবশ্য কর্তব্য। পড়ে দেখবেন, আমার কথা কতটা সত্য।
এতক্ষণ কথা বলতে বলতে সাজেদার সাহস বেড়ে গেছে। বলল, এবার আমি দুএকটা প্রশ্ন করতে পারি?
নিশ্চয়।
কুরআন শরীফে প্রত্যেক সূরার আগে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লেখা আছে। কিন্তু একটা সূরার আগে তা নেই, সেই সূরাটার নাম কি? আর সেই সূরাটা কত পারায়? (এটা সে যার কাছে কুরআন পড়া শিখেছে তার কাছে জেনেছিল)।
দশ পারায়, সূরা তওবা।
এমন সময় জুলেখা নাশতা নিয়ে এসে নাদিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আরে তুমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছ? বস বস, নাশতা খাবে?
নাদিম বলল, না ভাবি, আমি এখন কিছু খাব না। তুমি মেহমানকে নাশতা করাও, আমি যাই বলে চলে যেতে উদ্যত হল।
জুলেখা বলল, দাঁড়াও, যাওয়ার আগে বলে যাও কেমন দেখলে?
পরে বলব, বলে নাদিম চলে গেল।
জুলেখা সাজেদাকে নাশতা খাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, নাদিম ভাইকে কেমন মনে হল?
সাজেদা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ভাল।
ঐদিন রাতেই সাজেদার সঙ্গে নাদিমের বিয়ে হয়ে গেল।
.
নাদিমের খুব বই পড়ার নেশা। ছোটবেলা থেকে স্কুলের পাঠ্যবই পড়ার পর ধর্মীয় বই ও উপন্যাস পড়ে আসছে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় আইনের অনুশীলনও করে আসছে। সে দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়ার সময় নজীবর রহমানের আনোয়ারা পড়ে। তৃতীয় শ্রেণীতে শরৎচন্দ্রের দেবদাস পড়ে তিন দিন কেঁদে কেঁদে ভাত খায়নি।
তার মা আফ্রিদা জানতে পেরে অতটুকু ছেলের অনুভূতির কথা চিন্তা করে খুব অবাক হয়ে ছেলেকে বুঝিয়ে বললেন, দেবদাসের কাহিনী সত্য নয়। ওটা তো গল্প। লেখকরা কল্পনা করে গল্প-উপন্যাস লিখে। তারপর থেকে ছেলে স্কুলের বই ছাড়া অন্য বই যাতে না পড়ে সেদিকে খুব লক্ষ্য রাখল। কিন্তু কতক্ষণ আর লক্ষ্য রাখবে? সংসারের কাজের ঝামেলায় তা সম্ভব হয় না। নাদিম শব্দ করে পড়তে পারে না। খুব তেজী ছেলে। যে কোন পড়া দুএকবার পড়লেই হয়ে যায়। সেই জন্যে সে সকাল ও সন্ধ্যেয় বড়জোর এক ঘণ্টা করে দুঘণ্টা পড়ে। তাও মা এবং বাপ-চাচাদের ভয়ে। নচেৎ তার পড়া কিন্তু সন্ধ্যের পর এক ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যায়। সকালে শুধু অঙ্ক করে। যখন ক্রমশঃ উপরের ক্লাসে উঠতে লাগল তখন তার মাও বাপ চাচারা বেশিক্ষণ পড়ার জন্য তাকে চাপ দিতে লাগল। নাদিম সেই সুযোগে স্কুলের পাঠ্য বইয়ের পড়া তৈরি করে সেই বইয়ের উপর গল্পের বই রেখে পড়ত। মাঝে মাঝে আফ্রিদা ছেলের অপকীর্তি ধরে ফেলে শাসন করত। কিন্তু ছেলের গল্প, উপন্যাস ও অন্যান্য আউট বই পড়ার অভ্যাস ছাড়তে পারল না। এ ব্যাপারে বাপ-চাচারা তাকে অনেক শাসন করেও কোন লাভ হয়নি। নাদিম যদি আউট বই না পড়ে শুধু স্কুলের পাঠ্যবই পড়ত, তা হলে প্রতি বছর স্ট্যান্ড করত। তবু তার রোল নাম্বার চার-পাঁচের মধ্যে উঠানামা করেছে। স্কুলেও সে ব্যাগে করে পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে আউট বই নিয়ে যেত। ক্লাসের ফার্স্ট বয় এর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। ছেলেটার নাম সুভাষ। তাদের গ্রামেরই ছেলে। তার পাশে ফাস্ট বেঞ্চে বসত। তক্তপোসের উপর স্যারের টেবিল-চেয়ার। নাদিম টেবিলের আড়ালে বসে হাই বেঞ্চের নিচে দুই ঊরুর উপর আউট বই রেখে পড়ত। সুভাষ তাকে অনেকবার বলেছে, তুই এখন এত আউট বই পড়িস না। পাঠ্য বই পড়লে অনেক ভাল রেজাল্ট করতে পারতিস। আমার চেয়ে তোর মাথা অনেক ভাল। নাদিম হেসে বলে, আমি বেশি ভাল রেজাল্ট করতে চাই না। পাস করা নিয়ে কথা। তা তো প্রত্যেক বছর করছি। একবার দশম শ্রেণীতে ক্লাস চলাকালে ইংলিশের স্যার তাকে একটা প্রশ্ন করলেন। নাদিম তখন কোলের উপর একটা উপন্যাস রেখে পড়ছিল। স্যার যে তাকে প্রশ্ন করেছেন বুঝতে পারল না। সুভাষ তাকে কুনুইয়ের গুতো মেরে ফিসফিস করে বলল, এই নাদিম, স্যার তোকে প্রশ্ন করেছেন। নাদিম তাড়াতাড়ি করে বইটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার প্রশ্নটা আর একবার বলুন।
ইংলিশ স্যারের নাম জিয়াদ। তিনি ক্লাসে ভীষণ কড়া। কিন্তু অন্য সময় মাটির মানুষ। নাদিমের কথা শুনে বললেন, ক্লাসের সব ছেলে শুনতে পেল আর তুমি পেলে না, মন কোন দিকে ছিল?
সাবের নামে একটা ছেলে বলে উঠল, স্যার, ও গল্পের বই পড়ছিল।
জিয়াদ স্যার শুনে রেগে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ড কথা বলতে পারলেন না। তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, স্ট্যান্ডআপ অন দা বেঞ্চ।
সেদিন সারা পিরিয়ড নাদিমকে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হল। ক্লাস শেষ হতে জিয়াদ স্যার যাওয়ার সময় নাদিমকে বললেন, আবার যদি কোনদিন এই কথা শুনি তা হলে চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেব।
এরপরও নাদিম ক্লাসে আউট বই পড়া বন্ধ করে নি। তবে জিয়াদ স্যারের ক্লাসে আর কোনদিন পড়েনি।
ক্লাস সিক্স, সেভেন ও এইটে পড়ার সময় নাদিমের পর পর তিন বছর টাইফয়েড় হয়। প্রতিবারই মরতে মরতে বেঁচে গেছে। শেষবারে ডাক্তার বলেছিল, এই ছেলে বেঁচে থাকলে হয় পাগল হয়ে যাবে, না হয় যে কোন একটা অঙ্গহানী হবে। কিন্তু তার কোনটাই হয়নি। তবে সে ভীষণ একগুয়ে ও রাগী হয়েছে। নিজের মতের বাইরে কোন কিছু করে না। জোর করলে অত্যন্ত রেগে যায়। আর তার কথা না শুনলে একটা না একটা অঘটন ঘটিয়ে ছাড়ে। বড় হয়ে প্রচুর ধর্মের বই পড়ে ও ধর্মের অনুশীলন করে হঠাৎ রাগে না বটে, কিন্তু একবার যদি রেগে যায় তখন অঘটন ঘটিয়ে বসে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় একটা অঘটন ঘটিয়েছিল। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখল, তার ইমিডিয়েট ছোট বোন ফৌজিয়া তালের আঁটি কেটে গজা করে বের করে খাচ্ছে। নাদিম বই রেখে এসে তার গজা চাইল। ফৌজিয়া বলল, আমারগুলো দেব না, তুই কেটে খা। নাদিম তার কাছে দা চাইল। ফৌজিয়া বলল, দাঁড়া, আমি আগে এইগুলো। কেটে নিই, তারপর দেব। নাদিম বলল, যেগুলো কেটেছিস, সেগুলো খা। আমার কাটা শেষ হলে তারপর তোরগুলো তুই কেটে খাস। ফৌজিয়া বলল, না আগে আমারগুলো। কেটে নিই। নাদিম তখন রেগে গিয়ে তার হাত থেকে দাটা কেড়ে নিয়ে তার মাথায়। এক কোপ বসিয়ে দিল। ফৌজিয়া ভয়ে নিজের মাথায় হাত দিয়েছিল বলে সে যাত্রা। বেঁচে গেল। নচেৎ তার মাথার ঘিলু বেরিয়ে পড়ত। দায়ের কোপ তার হাতের উপর পড়েছিল। ফলে অনেকটা কেটে গিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। ফৌজিয়া তখন বাবারে মরে গেলাম রে বলে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তার চিৎকার শুনে মা-চাচীরা ছুটে এল। ফৌজিয়ার অবস্থা দেখে তারা ডাক্তার আনতে পাঠাল। ডাক্তার এসে হাতের কেটে-যাওয়া জায়গাটা সেলাই করেছিল। নাদিম ভয়ে পালিয়ে যায়। রাতে ফিরলে তার আব্বা তাকে সেদিন ভীষণ মেরেছিল। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় এরকম এক ঘটনা। ঘটিয়েছিল, যা শুনলে প্রত্যেক মানুষ যেমন অবাক না হয়ে পারবে না, তেমনি তার একগুঁয়েমির পরিচয় পেয়েও অবাক হবে। এই ঘটনার সঙ্গে নাদিমের ছোট নানার সেজ জামাই নওশের জড়িত। তাই নওশেরের কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে।
নওশের একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। দেখতে খুব সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান। মডার্ন যুবক। ধর্মকর্ম করা তো দূরের কথা, ধার্মিক লোকদের সে মোটেই দেখতে পারত না। ডাক্তার হিসেবে অল্পকিছু সুনাম থাকলেও কলেরা-বসন্তের চিকিৎসার জন্য খুব সুনাম ছিল। কলেরা-বসন্তের রোগী তার হাতে গেলে বেঁচে যাবেই-এরকম ধারণা ঐ গ্রামের ও আশেপাশের গ্রামের লোকদের ছিল। হিন্দুপাড়ার লোকেরা তাকে দেবতার মত সম্মান করত। হিন্দুদের সঙ্গে তার বেশি চলাফেরা। হিন্দুদের অনেক কুমারী যুবতী তাকে বিয়ে করার জন্য পাগল। সে মুসলমান বলে তারা মনের বাসনা প্রকাশ করতে পারে না। নওশের ডিসপেনসারী বন্ধ হবার পর হিন্দু পাড়ায় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে প্রতিদিন অনেক রাতে বাসায় ফিরত। তার আসল বাড়ি রাজরাড়ী। রাজশাহীর শহরতলী মহেশবাথানে তার ডিসপেন্সারী। বিয়ের পর সে স্ত্রীকে নিয়ে এখানে বাসা ভাড়া করে থাকে।
নওশেরের স্ত্রী মায়মুনা অত্যন্ত ধার্মিক। কিন্তু দেখতে তেমন ভাল না। লম্বা, রোগা ও গায়ের রং কাল। তার আব্বা অনেক টাকা-পয়সা ও জিনিসপত্র যৌতুক দিয়ে নওশেরকে জামাই করেছেন। তারপরেও তিনি এই ডিসপেনসারী করার খরচ দিয়েছেন। তবু মায়মুনা স্বামীকে নিজের করে পায়নি। সে ভাবে তার স্বামী দেখতে খুব সুন্দর আর সে দেখতে খারাপ তাই স্বামী তাকে পছন্দ করে না। মায়মুনা স্বামী কি জিসিন এবং স্বামীর মন জয় করার মতো শিক্ষা, কুরআন-হাদিস এবং বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়ে অর্জন করেছে। সেই শিক্ষা অর্জনের ফলে স্বামীকে যেমন মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে, তেমনি তার সেবাযত্নও করে। স্বামী যে সময় মত ঘরে আসে না, খাওয়া-দাওয়া করে না, গভীর রাতে নেশা করে বাসায় ফিরে, সেজন্যে কোনদিন তার কাছে এতটুকু কৈফিয়ত চায় না, এতটুকু রাগও দেখায় না। বরং নেশাগ্রস্ত স্বামীর সেবাযত্ন করে। স্বামী যেদিন বাসায় খায় না, সেদিন মায়মুনাও খায় না। সে যতক্ষণ না ফিরে ততক্ষণ কুরআন পড়ে, হাদিস পড়ে, বিভিন্ন ধর্মীয় বই ও ভাল গল্প উপন্যাস পড়ে। স্বামী ফেরার পর তার জামা-জুতো খুলে দিয়ে ঘুমাবার ব্যবস্থা করে দেয়। তারপর তাহাজ্জুদের নামায পড়ে আল্লাহপাকের দরবারে দুহাত তুলে দরবিগলিত চক্ষে দোয়া করে-হে গফুরুর রহিম, তুমি এই ভূমণ্ডল ও আকাশমণ্ডলীর একমাত্র প্রভু। এই দুই জাহানের মধ্যে সমক্ষক কেউ নেই। তুমি সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ। তুমিই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও পালন কর্তা। তোমার ইচ্ছা ব্যতিরেকে কারো এতটুকু কিছু করার অধিকার নেই। তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তোমার কোন কাজে এতটুকু বাধা দেয়ার কারো ক্ষমতা নেই। তুমি তোমার সৃষ্ট জীবের মনের কামনা-বাসনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকেফহাল। হাদিসে পড়েছি- তোমার পেয়ারা নবী (দঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাঁর বান্দার মনের নেক মকসুদ পূরন করেন। তোমার কালাম পাকে পড়েছি, তুমি যাকে ইচ্ছা কর। তাকে হেদায়েৎ দান কর। তোমার ইচ্ছা ব্যতীত কেউ হেদায়েৎ প্রাপ্ত হয় না। আমি তোমার এক গোনাহগার বান্দী এবং তোমার পেয়ারা হাবিবের (দঃ) নগণ্য উম্মত। আমি তোমার কাছে ফরিয়াদ করছি, আমার স্বামীকে হেদায়েৎ দান করে তোমার ও তোমার হাবিবে পাকের (দঃ) প্রদর্শিত পথে চালিত কর। আমি তোমার কাছে ঐশ্বর্যের সুখভোগ চাই না। চাই শুধু আমার স্বামীর হেদায়েৎ। হাদিসে আরো পড়েছি, কোন মুসলমান যদি অন্য মুসলমানের জন্য দোয়া করে, তা হলে তুমি তা কবুল করে থাক। আমি কুরআন-হাদিসের উপর পূর্ণ একিন রেখে ফরিয়াদ করছি, আমার দোয়া কবুল করে আমাকে ধন্য কর।
মায়মুনা বিয়ের পর থেকে একইভাবে স্বামীর সেবাযত্ন ও আল্লাহপাকের কাছে ঐভাবে ফরিয়াদ করে আসছে।
একদিন নওশেরের ঘুম ভেঙে যেতে দেখল, মায়মুনা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঐসব মোনাজাত করছে। নওশের বেশ রেগে গিয়ে বলল, অত কান্নাকাটি কিসের, আমার পিয়াস লেগেছে, পানি খাব।
স্বামীর গলা শুনতে পেয়ে মায়মুনা তাড়াতাড়ি মোনাজাত শেষ করে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে এনে দিল।
নওশের ঢকঢক করে পানি খেয়ে গ্লাস দেবার সময় বলল, আমার নিষেধ সত্ত্বেও নামায-রোযা কর, আমি কিছু বলি না। কিন্তু রাতে না ঘুমিয়ে যে সারারাত এইসব কর তাতে কি লাভ হচ্ছে?রং নিজের শরীর নষ্ট করছ। কঠিন অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়বে।
মায়মুনা বলল, হলে আর কি হবে, মরে যাব-এই তো? তাতে কি হয়েছে, মরতে তো একদিন সবাইকে হবে।
নওশের বলল, আচ্ছা বল তো, আজ কত বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে?
চার বছর।
সেই থেকে তো রাত জেগে জেগে নামায পড়ে কুরআন পড়ে কতরকম দোয়া কর। কই তোমার একটা দোয়াও কি আল্লাহরুল করেছে? করেনি। তবু কেন ঐসব কর?
তুমি কুরআন-হাদিস বা ধর্মীয় কোন বই পড়নি, তাই ঐ রকম বলছ। হাদিসে আছে, হযরত নবী পাক (দঃ) বলেছেন, আল্লাহপাক ঈমানদার বান্দাদের কোন ইবাদত যেমন বিফল করেন না, তেমনি তাদের দোয়াও বিফল করেন না। তবে বান্দারা যা চায়, তা তার জন্যে অমঙ্গল হবে জেনে তৎক্ষণাৎ কিছু দেন না। তিনি যখন দোয়াটা ভাল মনে করেন তখন দেন। সেটা ইহকালেও হতে পারে অথবা পরকালেও হতে পারে।
নওশের বলল, তুমি তোমার কুরআন-হাদিস নিয়ে থাক, আমার ওসব দরকার নেই। কথা শেষ করে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
আল্লাহপাক কাকে কখন কোন অসিলায় হেদায়েত করেন তা মানুষের বোঝার অসাধ্য। একদিন নওশেররা কয়েকজন মিলিত হল এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে। খাওয়া দাওয়ার পর নেশা করার জন্য সিদ্ধি বেঁটে ঘোলের সঙ্গে মিশিয়ে খেল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে তাস খেলে বাসায় ফিরল। ঐভাবে সিদ্ধি খেয়ে বন্ধুর বাড়িতেই নেশা ধরেছিল। এতক্ষণে সেটা আরো বেশি ধরেছে।
বাসায় এলে মায়মুনা বলল, আজ তোমাকে যেন অন্য রকম দেখাচ্ছে, তোমার কি শরীর খারাপ?
নওশের মাঝে মধ্যে মদ খেলেও বাসায় এসে কোনদিন মাতলামি করে না। চুপচাপ শুয়ে পড়ে। সে আজ প্রথম মদ না খেয়ে সিদ্ধি খেয়েছে। সিদ্ধি যারা শখ করে। খায়, তারা পানের সঙ্গে চিবিয়ে খায়। তাতে অল্প নেশা হয়। আর বেঁটে শরবত করে খেলে ভীষণ নেশা হয়। তাই সবার মতো নওশেরেরও তাই হয়েছে। সিদ্ধি খেয়ে নেশা হলে চুপচাপ থাকে। কিন্তু একবার যদি কোন কারনে কথা বলতে আরম্ভ করে, তা হলে শুধু হাসতেই থাকবে। কেউ কেউ হাসতে হাসতে হার্টফেল করে। অবশ্য যাদের হার্ট খুব দুর্বল থাকে তারাই হার্টফেল করে। আবার অনেকে বমি করে অজ্ঞান হয়ে যায়।
বাসায় ফিরে নওশের স্ত্রীর কথা শুনে নেশার ঘোরে বলল, আমার শরীর খারাপ। হয়নি প্রিয়তমা। এস, তোমাকে নিয়ে আজ ফুর্তি করি। এই কথা বলে সে মায়মুনাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল।
মায়মুনা বুঝতে পারল, সে নেশার ঘোরে এরকম বলছে। কারন আজ চার বছরের মধ্যে সুস্থ অবস্থায় কোনদিন এভাবে কথাও বলেনি আর আদরও করেনি। বলল, ঠিক আছে অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আগে জামা-কাপড় পাল্টাও।
নওশের সব সময় ইস্ত্রিকরা দামী জামা-কাপড় পরে। কোন জামা-কাপড় একবারের বেশি দুবার পরে না। স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি লুঙ্গি দাও। সেদিন সে সাদা পাজামা-পাঞ্জামীর উপর উলের জ্যাকেট পরেছিল। মায়মুনা আলনা থেকে লুঙ্গি আনতে গেলে নওশের জ্যাকেট খুলে আলনার দিকে ছুঁড়ে দিল। তারপর প্রথমে পাঞ্জাবীটা ও পরে গেঞ্জীটা টান দিয়ে ফড়ফড় করে ছিঁড়ে গা থেকে খুলে মেঝেয়। ছুঁড়ে দিয়ে খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল, কই-লুঙ্গি দাও।
মায়মুনা বেশ অবাক হয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলল, এত হাসছ কেন?
নওশের বলল, হাসব না তো কি কাঁদব? তারপর মায়মুনার শাড়ী ধরে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, কি দারুণ আনন্দ লাগছে। তোমার শাড়ি-ব্লাউজও ছিঁড়ে দিই, তুমিও আনন্দ পাবে।
মায়মুনা ভয় পেয়ে তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, না-না ছিড়ো। এগুলো তো আজ কিনে এনেছ।
নওশের তার বাধা মানল না। জোর করে শাড়ি-ব্লাউজ খুলে হাসতে হাসতে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল।
মায়মুনা বিবস্ত্র হয়ে লজ্জায় ও ভয়ে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে আলনা থেকে অন্য একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে খাটের কাছে যখন এল তখন নওশের বমি করতে শুরু করল। মায়মুনা স্বামীকে ধরে খাটের কিনারে এনে দুহাতে মাথাটা ধরে রাখল। নওশের অনেকটা বমি করে নেতিয়ে শুয়ে পড়ল। মায়মুনা শাড়িটা ভালো করে পরে প্রথমে স্বামীর মুখ ও শরীর পরিষ্কার করল। তারপর বিছানা ও ঘরের মেঝে পরিষ্কার করে হাত পাখা দিয়ে তার মাথায় বাতাস করতে লাগল। তখন শীতকাল। তাই বৈদ্যুতিক পাখা চালাল না। ফজরের আযান হতে নামায পড়ে এসে পাশে বসে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার হেদায়েতের জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করতে লাগল। এক সময় তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে নওশেরের গালে কয়েক ফোঁটা পড়ল। মায়মুনা তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে মুছে দিল।
নওশেরের ঘুম পাতলা হয়ে এসেছিল। মায়মুনা আঁচল দিয়ে গাল মুছে দেয়ার সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাকিয়ে মায়মুনাকে পাশে বসে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার-কাঁদছ কেন? মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমোওনি।
মায়মুনা চোখ মুছে বলল, না এমনি একটু। তারপর কয়েক সেকেণ্ড বিরতি দিয়ে আবার বলল, গত রাতে বাসায় ফিরে তুমি বমি করছিলে। তোমার শরীর খারাপ দেখে ঘুম আসেনি। তাই বসে বসে তোমার মাথায় বাতাস করছিলাম।
নওশের ঘরের মেঝেয় নতুন জামা-কাপড়ের স্তূপ দেখে আবার জিজ্ঞেস করল, ওগুলো ঐরকম অবস্থা হল কি করে?
তুমি নেশার ঘোরে করেছ। তারপর বমি করে ঘুমিয়ে পড়েছ।
নওশের খুবই আশ্চর্য হয়ে বলল, সত্যি বলছ, আমি ঐ সব করেছি?
আমাকে কি কোনদিন মিথ্যে বলতে শুনেছ?
নওশের অনেক্ষণ মায়মুনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ভাবান্তর হল। বলল, কাল খুব শখ করে ঐসব জামা-কাপড় কিনেছিলাম। যখন আমি ঐগুলো নষ্ট করছিলাম তখন বাধা দিলে না কেন?
আজ চার বছরের মধ্যে তোমার কোন কাজে বাধা দিয়েছি কি?
নওশের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার যে ভাবান্তর শুরু হয়েছিল এখন তার কথা শুনে মনের মধ্যে অনুশোচনার উদ্রেক হতে শুরু করল। তখন তার বিগত দিনের কথা মনে পড়তে লাগল।
নওশের অবস্থাপন্ন বাবার তৃতীয় সন্তান। আই.এ. পাস করে হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রী নিয়ে প্রথমে নিজেদের গ্রামে প্র্যাকটিস শুরু করে। বছর খানেকের মধ্যে বিয়ে করে শ্বশুরের টাকায় মহেশবাথানে ডিসপেনসারী করেছে। মেয়ে কাল বলে শ্বশুরের কাছে যখন যা আবদার করেছে তিনি তা দিয়েছেন। তবু নওশের স্ত্রীকে ভালোবাসা তো দূরের কথা তার সঙ্গে এতটুকু ভাল ব্যবহারও করেনি। সব সময় অবহেলা করে এসেছে। স্বজ্ঞানে কোনোদিন তার সঙ্গে দৈহিক মিলনও করেনি। অথচ মায়মুনা কোনদিন ভুলেও তার প্রতি কোনো কটুবাক্য বলেনি, কোনদিন রাগ করেও কিছু বলেনি। সব সময় মধুর ব্যবহার করে এসেছে। কোন কোনদিন নেশার ঘোরে কত অত্যাচার করেছে, তার শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে, কখনো টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। আশ পাশের বাসার কাউকে স্বামীর দুর্ব্যবহারের কথা এতটুকু জানতে দেয়নি। দেশ থেকে বাপ ভাই অথবা আত্মীয় স্বজন কেউ এলে তাদের কাছে হাসিমুখে থাকে। এমনভাব দেখায় যেন স্বামীর কাছে কত সুখে আছে। অথচ সে খুব ধনী ঘরের মেয়ে। ইচ্ছা করলে বাপ-ভাইকে স্বামীর অত্যাচারের কথা বলে ছাড়কাট করিয়ে নিতে পারত। অশিক্ষিতও নয়। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে। হঠাৎ নওশেরের মনে হল, এই মেয়ে কি মানবী, না অন্য কিছু? মানবী না হলে এতদিন এতকিছু সহ্য করেছে কি করে? কোনদিন তার মুখে বিরক্তি, বিষাদ কিংবা রাগের চিহ্ন দেখেনি কেন?
তার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, তোমার স্ত্রী মানবী। এতদিন ঘর করছ অথচ তাকে বোঝার চেষ্টা করনি কেন? তখন তার মনে হল, আমি ওর প্রতি এতদিন খুব অন্যায় ও অবিচার করেছি। এই সব ভাবতে ভাবতে অনুশোচনায় নওশেরের চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
মায়মুনা বিয়ের পর থেকে স্বামীকে কোনদিন তার মুখের দিকে ভাল করে চাইতে দেখে নি, ভাল করে কথা বলতেও দেখেনি। ভেবেছে, সে কাল ও দেখতে খারাপ বলে এরকম করে থাকে। মায়মুনা মনে দুঃখ পেলেও বাইরে তা কখনও প্রকাশ না করে ভাগ্যের কথা ভেবে হাসিমুখে সব কিছু সবর করে চলেছে, আর মনে মনে আল্লাহর কাছে সবর করার তওফিক চেয়ে স্বামীর হেদায়েত প্রার্থনা করেছে। আজ স্বামীকে তার মুখের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেখে ও ভালভাবে কথা বলতে শুনে, খুশি হয়ে মনে মনে এতক্ষণ আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করছিল। এবার তার চোখে পানি দেখে বলল, তোমার কি কোন কষ্ট হচ্ছে?
নওশের কোন কথা বলতে পারল না, শুধু না-সূচক মাথা নাড়ল।
তা হলে তোমার চোখে পানি কেন-বলে মায়মুনা নিজের চোখের পানি মুছল।
মায়মুনাকে চোখের পানি মুছতে দেখে নওশের বলল, আমার কিছু হলে তোমার খুব কষ্ট হয়, তাই না?
মায়মুনা আজ স্বামীর আচরণে উত্তরোত্তর যত অবাক হচ্ছে তত তার মন এক অজানা আনন্দে ভরে উঠছে। স্বামীর প্রশ্নের উত্তরে সেও কোন কথা বলতে পারল না। আনন্দের আতিশয্যে তার গলা বুজে এল। চোখ থেকে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, সেই অবস্থায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
নওশের বলল, কিন্তু কেন, কেন, কেন-বলে সে থেমে গেল। অনুশোচনায় তারও গলা বুজে এল। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি কি জান, আমি তোমাকে পছন্দ করি না, শুধু টাকার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি।
হ্যাঁ, জানি। আরো জানি, রসুল্লাহ বলিয়াছেন, যদি কোন ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তির সিজদা করিবার আদেশ দিতাম, তবে আমি স্ত্রীকে বলিতাম তার স্বামীকে সিজদা করিতে। স্বামীর এতটুকু দোষ কোন মুমীন স্ত্রী ধরে না, ধরতে পারে না। সব সময় স্বামীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে।
আর আমি যদি তোমাকে সারাজীবন পছন্দ না করে এভাবে কাটাই?
তবুও আমি তোমাকে সারাজীবন স্বামীর মর্যাদা দিয়ে কর্তব্য পালন করে যাব। ভাবব, আল্লাহ পাক আমার তকদিরে দুনিয়াতে স্বামীর সুখ রাখেন নি। মোমেনা বান্দী কোনদিন স্বামীর অমর্যাদা করে না। সে আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দঃ) কে খুশি রাখার জন্য সবকিছু সবর করে সহ্য করে। আল্লাহ কুরআন পাকে বলেছেন, আল্লাহ সাবেরিনদের সঙ্গে থাকেন। নওশেরের দিব্যচোখ আল্লাহ খুলে দিলেন। তাই স্ত্রীর কথা শুনে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, মায়মুনা, তোমার নামের অর্থটা বলবে?
মায়মুনা বলল, ভাগ্যবতী।
নওশের বলল, সত্যিই তুমি ভাগ্যবতী। তোমার নামের অসিলায় আমার দিব্যচোখ খুলে গেছে। তুমি মানবী নও। কোন মানবীর এত ধৈর্যশক্তি থাকতে পারে না। তোমাকে অবেহলা করে, তোমার উপর অত্যাচার করে আমি খুব অন্যায় করেছি। জানি আল্লাহ আমাকে মাফ করবে কিনা-এখন বল মায়মুনা, তুমি আমাকে মাফ করেছ?
স্বামীর কথা শুনতে শুনতে মায়মুনার মনে চির আকাঙ্ক্ষিত ধন পাওয়ার আনন্দ সাগরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে লাগল। সেও স্বামীকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, মাফ চেয়ে আমাকে গোনাহগার করো না। আমি মানুষ। আমারও অনেক দোষত্রুটি আছে। তুমি বরং আমাকে মাফ করে দাও। আর আমার প্রতি তুমি যা কিছু করেছ, তাতে আমি মানবিক কারণে অনেক সময় অসন্তুষ্ট হলেও সেসব মনে রাখিনি। তুমি আল্লাহপাকের হুকুম অমান্য করে অনেক অন্যায় করেছ। তাই বলব, তওবা করে তাঁর কাছে মাফ চাও। তিনি রাহমানুর রাহিম। বান্দাদের তওবা কবুল করে থাকেন।
নওশের বলল, মায়মুনা তুমি সত্যি আল্লাহর খাস বান্দী। এই তোমাকে জড়িয়ে ধরে আজ থেকে সবকিছু ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করে তওবা করছি, জীবনে আর কোনদিন আল্লাহর হুকুম অমান্য করব না।
মায়মুনা প্রথমে বলল, আমিন! তারপর শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, আল্লাহ গো, তুমি আমার স্বামীর তওবা কবুল কর।
সেদিন থেকে নওশেরের জীবনযাত্রার পরিবর্তন শুরু হল। সব রকমের নেশা ছেড়ে দিল। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিল। অবসর সময়ে ধর্মীয় বই কিনে পড়তে লাগল। সেই সঙ্গে নামায পড়তে শুরু করল।
বন্ধুরা তার পরিবর্তন দেখে তার কাছে এসে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আড্ডা দেয়ার জন্য নিয়ে যেতে চেষ্টা করল। সফল হতে না পেরে তারা আস্তে আস্তে যাতায়াত বন্ধ করে দিল। শুধু বিমল ও সুখেন্দু নামে দুজন হিন্দু যুবক মাঝে মাঝে আসত। একদিন তারা জিজ্ঞেস করল, তোর এই পরিবর্তন হল কি করে বলবি? :
নওশের বলল, সে কথা পরে বলব। তারপর গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বইটা একজনের হাতে দিয়ে বলল, এটা তোরা পড়।
বিমল ও সুখেন্দু দুজনেই এম.এ.। দুজনেই মহেশবাথান হাইস্কুলের শিক্ষক। বিমল ইংলিশের আর সুখেন বাংলার। এক সপ্তাহের মধ্যে তারা বইটা ফেরত দেয়ার সময় বলল, বইটা পড়ে তোদের ধর্ম ও ধর্ম প্রবর্তকের জীবনী সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
নওশের বলল, কি জানলি, ভাল না মন্দ?
বিমল বলল, যে কোন ধর্মের আইন-কানুন সব ভাল।
সুখেন্দু বলল, যে কোন ধর্মের প্রবর্তকের চরিত্রও উত্তম।
নওশের তাদের সাহাবা চরিত বইটা দিয়ে বলল, এটাও পড়ে দেখ।
সাহাবা চরিত পড়ে তারা ফেরত দিতে এসে বলল, এত উন্নত চরিত্রের নমুনা আমাদের ধর্মগ্রন্থে নেই।
নওশের বিমলকে আল্লামা ইউসুফ আলির কুরআনের ইংলিশ ট্রানস্লেট দিল। আর সুখেন্দুকে আব্দুল হাই ও আলি হোসেনের বাংলা অনুবাদ দিয়ে বলল, এগুলোও পড়।
কুরআন ব্যাখ্যা পড়ে তাদের মন ইসলামকে আরো জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। তারা নওশেরের কাছ থেকে আরো বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় বই নিয়ে পড়তে পড়তে ছমাসের মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। শুধু তারা নিজেরা নয়, তাদের বাড়ির সবাইকে নিজেদের মতামত জানিয়ে দুজনের বাড়ির সবাইকে নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করল।
বিমল ও সুখেন্দ, শুধু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ক্ষান্ত রইল না। নওশেরের কথা মতো পীরের মুরীদ হয়ে তিন বন্ধুতে মাত্র দুতিন বছরের মধ্যে তরীকতের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেল।
নওশেরের ডিসপেনসারীর আলমারীতে এখন ওষুধের চেয়ে হাদিস ও অন্যান্য ধর্মীয় বই বেশি। তিন বন্ধু সংসারের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ছাড়া সব সময় হাদিস কেতাব অধ্যয়ন করে, আর রাত জেগে আল্লাহ পাকের ইবাদত করে।
মায়মুনা সবকিছু দেখেশুনে কেঁদে কেঁদে আল্লাহপাকের শোকর গুজারী করে।
.
নাদিম তার চাচাত ছোট মামা ফজলুলের সঙ্গে পড়ে। ফজলুল নাদিমের চেয়ে তিন-চার বছরের বড়। কিন্তু সে প্রতি ক্লাসে এক বছর করে ফেল করে করে যে বছর। ক্লাস এইটে ফেল করল, সেই বছর নাদিম ক্লাস এইটে উঠল। মামা ভাগ্নে হিসাবে আগে যতটা সুসম্পর্ক ছিল, ক্লাস এইটে উঠে সেটা আরো বেড়ে গেল। তার মুখে নাদিম নওশের খালুর পরিবর্তনের কথা শুনে ফজলু মামার সাথে দুতিন বার তাদের বাড়িতে তাকে দেখতে গিয়েছিল। নাদিম যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন তার এই নওশের খালু একবার তাদের বাড়িতে এসেছিল। সেদিন নাদিম স্কুল থেকে ফিরে নওশের খালুকে দেখে কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, খালু কেমন আছেন?
নওশের সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তা বাবাজী স্কুল থেকে এলে মনে হচ্ছে, কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস নাইনে।
আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভাল, শুনে খুশি হলাম। এমন সময় আযান শুনে বলল, তুমি তো নামায পড়; মসজিদে চল-আযান হচ্ছে।
নামায পড়ে নাদিম তাকে বলল, খালু, আমি আপনাদের ওখানে দুতিনবার গিয়েছি। আপনার ডিসপেনসারীতে অনেক বাংলায় হাদিসের বই দেখেছি। আমাকে পড়তে দেবেন?
নওশের বলল, হাদিস পড়বে এটা তো খুব ভাল কথা, দেব না কেন? তুমি মাঝে মাঝে গিয়ে নিয়ে এসে পড়।
তারপর থেকে নাদিম স্কুলে যাওয়ার নাম করে খালুর কাছে গিয়ে সারাদিন ডিসপেনসারীতে বসেবসেহদিস পড়ত। বিকেলে স্কুল ছুটির সময় নিয়মিত ঘরে ফিরে আসত।
নাদিমের বাড়ি থেকে প্রায় পনের-বিশ মাইল দূরে মহেশবাথানে নওশেরের ডিসপেন্সারী। বাসে করে নাদিম যাতায়াত করে। সারেংপুর গ্রামের ভিতর থেকে বাস রাস্তা গেছে। প্রথম প্রথম নাদিম মায়ের কাছ থেকে বাস ভাড়া চেয়ে নিত তখন বাসের ভাড়া কম ছিল।
প্রতিদিন ছেলেকে পয়সা চাইতে দেখে তার মা আফ্রিদা একদিন জিজ্ঞেস করল, রোজ রোজ পয়সা দিয়ে কি করিস?
নাদিম কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
আফ্রিদা বলল, কি রে, কিছু বলছিস না কেন? স্কুলে যা, আজ পয়সা হবে না।
এরপর থেমে নাদিম স্কুলের বেতন না দিয়ে সেই টাকায় বাস ভাড়া দিয়ে নওশের খালুর কাছে হাদিস পড়তে যেত। বছরের শেষে বার্ষিক পরীক্ষার সময় গভীর রাতে গোপনে গোলা থেকে ধান পেড়ে পাড়ার একজনের কাছে বিক্রি করে স্কুলের বেতন পরিশোধ করল। কিন্তু পরীক্ষায় পাস করতে পারল না। সারা বছর স্কুলে যায়নি। তার উপর ভাল করে পড়াশোনাও করেনি, পাস করবে কি করে। নাদিমের রেজাল্ট শুনে ঘরের সবাই অবাক হয়ে গেল। সে ফেল করবে এটা কেউ ভাবতে পারল না। বাপ চাচারা রাগারাগি করল।
আফ্রিদা ছেলেকে তেমন কিছু বলল না। বরং ছেলের মন খারাপ দেখে বলল, ফেল করেছিস তো কি হয়েছে, এবার ভাল করে লেখাপড়া কর, যাতে করে সামনের বছর স্ট্যান্ড করতে পারিস।
নাদিম কিন্তু ঘরের কারুর কথায় কান দিল না। এ বছরও স্কুলে যাওয়ার নাম করে নওশের খালুর কাছে গিয়ে কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে লাগল। ফলে এ বছরও সে ফেল করল।
এবার তার বাপ চাচারা তার সাথে ভীষন রাগারাগি করল, শুধু মারতে বাকি রাখল। নাদিমের ছোট চাচা স্কুলে গিয়ে হাজিরা খাতা দেখে এসে ভাইদের জানাল, নাদিম গত দুবছর স্কুলে যায়নি বললেই চলে। তারা তখন নাদিমকে জিজ্ঞেস করল, তুই স্কুলে যাওয়ার নাম করে কোথায় যাস?
নাদিম কোন উত্তর করল না।
অনেক বকাবকি করেও যখন তার কাছে কোন উত্তর পেল না। তখন তারা খোঁজ নিতে লাগল, নাদিম তা হলে কোথায় যায়?
এর মধ্যে নাদিমের সমস্ত শরীরে চাকাঁচাকা দাগ ও খোস-পাঁচড়া হল। সকলের ধারণা হল সে নিশ্চয় কোন নিষিদ্ধ পল্লীতে যায়। তাই তার শরীরে পার ফুটেছে। তার মা আফ্রিদা কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করল না। একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, তুই স্কুলে না গিয়ে কোথায় যাস আমাকে বল, আমি তোকে কিছু বলব না। তাকে চুপ করে। থাকতে দেখে আবার বলল, তুই যদি আমার পেটে হয়ে থাকিস, তা হলে আমার কথার। জবাব দে।
নাদিম বলল, নওশের খালুর কাছে।
আফ্রিদা খুব অবাক হয়ে বলল, কেন?
কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে।
কি বলছিস তুই।
হ্যাঁ আম্মা, খালুর আলমারী ভর্তি হাদিসের বই। আমি এই দুবছরের মধ্যে বহু হাদিস পড়ে ফেলেছি।
হাদিস পড়া ভালো। কিন্তু তোকে স্কুল কামাই করে স্কুলের পড়া না পড়ে হাদিস পড়তে কে বলেছে?
কেউ বলেনি, আমি নিজেই তার কাছে গিয়ে পড়ি।
তুই যে স্কুল কামাই করে যাস, তোর খালু কিছু বলে না?
না।
আফ্রিদার চাচাতো বোনের স্বামীর উপর খুব রাগ হল। চিন্তা করল, অমন জ্ঞানী গুণী আল্লাহওয়ালা লোক হয়ে নাদিমকে কিছু বলেনি কেন? তা হলে এর ভিতরে কি কোন রহস্য আছে? নাদিমকে বলল, আর কোনদিন যাবি না। আগে লেখাপড়া শেষ। কর তারপর হাদিস-কালাম পড়বি।
নাদিম প্রায় দুমাস ভুগে ভাল হল। তারপর আবার নওশের খালুর কাছে যাতায়াত আরম্ভ করল। এবারে ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-এর একটা বইয়েতে রেযেক সম্বন্ধে একটা ঘটনা পড়ে তার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। সব সময় একটা কথা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, রেযেক যখন আল্লাহপাকের হাতে তখন শুধু মানুষ কেন রুজী রোজগারের জন্য হালাল হারাম বিচার না করে পরিশ্রম করছে? সে সিদ্ধান্ত নিল-স্কুলে পড়ে মাদ্রাসায় পড়বে। রেযেক সম্বন্ধে যে ঘটনাটা নাদিম পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিল, সেটা হল
হযরত মুসা (আঃ) শফর শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইল (আঃ) তাঁকে সালাম দিয়ে পরওয়ানা শোনালেন। হযরত মুসা (আঃ) তখন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের রিযিকের কথা ভেবে একটু চিন্তিত হলেন। আল্লাহপাক হযরত মুসা (আঃ) এর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। সেই জন্য হযরত মুসা (আঃ)-কে কলিমুল্লাহ বলা হয়। আল্লাহ হযরত মুসা (আঃ) এর চিন্তার কারণ বুঝতে পেরে বললেন, হে মুসা! তোমার হাতে ওটা কি?
হযরত মুসা (আঃ) বললেন, একটা আসা (লাঠি)। আল্লাহ বললেন, তোমার সামনে যে পাহাড়টা রয়েছে তাতে তোমার হাতের আসাটা ঠেকাও। হযরত মুসা (আঃ) আসাটা পাহাড়ে ঠেকাতে সেখানে একটা কূয়া হয়ে গেল। আল্লাহ বললেন, আসাটা কূয়ার পানিতে ঠেকাও। হযরত মুসা (আঃ) তা করতেই একটা সিন্দুক উঠে এল। আল্লাহ বললেন, সিন্দুকের উপর আসা ঠেকাও। উনি তাই করতে সিন্দুক খুলে গেল, আর তার ভিতরে একটা ছোট পাথর দেখা গেল। আল্লাহ বললেন, ঐ পাথরে আসাটা ঠেকাও। হযরত মুসা (আঃ) পাথরে আসাটা ঠেকাতে দুভাগ হয়ে গেলে সেখানে একটা জীবন্ত ফড়িং দেখা গেল। আর সেই ফড়িং-এর মুখে একখন্ড সবুজ ঘাস। আল্লাহ বললেন, তুমি মৃত্যুর পরওয়ানা পেয়ে স্ত্রী-ছেলেমেয়ে কি খাবে চিন্তা করছ, জেনে নাও, এই ফড়িংটা সাত তবক জমিনের নিচে ছিল। দেখ, তাঁকেও আমি কিভাবে আহার দান করি। এই কথা শুনে হযরত মুসা (আঃ) সিজদায় গিয়ে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
এই ঘটনাটা পড়ে নাদিম ঐ রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবল, আল্লাহ ও তার রসুলকে (দঃ) চিনতে হলে ধর্মীয় বড় বড় বই পড়তে হবে। সে সব বই আরবি ভাষায়। আরবি ভাষা শিখতে হলে মাদ্রাসায় পড়তে হবে। সে এই সিদ্ধান্ত নিলেও সাহস করে কাউকে জানাতে পারল না।
সেই সময় আফ্রিদা অনেকদিন জ্বরে ও পায়খানায় ভুগে দুর্বল হয়ে পড়ে। নাদিমের নানা আকবর আলী বছর পাঁচেক আগে হজ্ব করে আসার মাস খানেক পরে মারা গেছেন। ওনার চার ছেলে, ছয় মেয়ে। মেজ ও সেজ ছেলে এবং এক মেয়ে ছোটবেলায় মারা গেছে। বড় ও ছোট বেঁচে আছে। আকবর আলী খুব ধনী লোক। ছিলেন। তিনি ছেলেদেরকে বি.এ. পর্যন্ত পড়িয়েছেন। আর মেয়েদেরকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত। পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। দুছেলেই চাকরি করে। ভাইয়েরা বোনের অসুখের কথা শুনে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে এসে ভালো করে চিকিৎসা করাতে লাগল। নাদিমরা সব ভাইবোন মায়ের সঙ্গে মামাদের বাড়িতে এসেছে। তারা সেখানে থেকে স্কুলে যাতায়াত করতে লাগল।
নাদিম মামা বাড়িতে আসার পর একদিন মাকে বলল, আমি আর স্কুলে পড়ব না; মাদ্রাসায় পড়ব।
আফ্রিদা খুব অবাক হয়ে বলল, সে কি রে? আর দুবছর পড়লে তুই ম্যাট্রিক পাস করবি। এ রকম কথা মুখে আনবিনা। তোর বাপ-চাচারা শুনলে তোকে আস্ত রাখবে না।
নাদিম সে কথা জানে। তাই ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি আব্বাকে ও চাচাদেরকে বুঝিয়ে বললে, তারা কিছু বলবে না।
আফ্রিদা বেশ রেগে গিয়ে বলল, আমি তাদেরকে বলতে পারব না। তোকে এই যুক্তি কে দিয়েছে বল তো?
নাদিম বলল, কেউ দেয়নি। আমি হাদিস পড়ে বুঝেছি, স্কুল-কলেজে পড়ে আল্লাহ ও রসুল (দঃ)-কে চেনা যায় না। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আফ্রিদা বলল, তুই এখন ছেলেমানুষ। তোর বুঝশক্তি কম। আমি যা বলছি শোন, দুবছর মন দিয়ে পড়ে ম্যাট্রিক পাস করে নে। তারপর আমি তোকে মাদ্রাসায় পড়বার ব্যবস্থা করে দেব।
নাদিম বলল, ম্যাট্রিক পাস করে কোন লাভ নেই। কত বি.এ. এম.এ. পাস ছেলেরা চাকরি পাচ্ছে না। শুধু শুধু দুটো বছর নষ্ট করব না।
আফ্রিদা ছেলেকে আরো অনেক কিছু বলে বোঝাল, তাতে ফল না হতে শেষে বাপ-চাচাদের মারধর করার কথা বলে ভয়ও দেখাল। কিন্তু নাদিমের এক কথা, সে আর স্কুলে পড়বে না-মাদ্রাসায় পড়বে।
নাদিম আর স্কুলে যায় না খবর পেয়ে তার বাপ রহিম একদিন শ্বশুর বাড়ি এসে স্ত্রীকে ছেলের স্কুলে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করল।
রহিমের শ্বশুর বাড়ি একই গ্রামের অন্য পাড়ায়।
আফ্রিদা নাদিমের মতামত জানাল।
স্ত্রীর মুখে ছেলের কথা শুনে রহিম খুব রেগে গেল। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না করে বাড়ি ফিরে গেল।
রহিম ভাইদের মধ্যে বড়। গম্ভীর ও শান্ত ধরনের লোক। পাড়ার বা গ্রামের সাথে পাঁচে নেই। তাকে রেগে যেতে কেউ কোনোদিন দেখেনি। কথা খুব কম বলে। অন্যান্য ভাইদের চেয়ে একটু বেশি ধার্মিক। পাড়ার ছোটবড় ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে রাস্তা থেকে সরে যায়। তার সামনে কোনো ছেলেমেয়ে দুষ্টুমি করে না। খেলাধুলা করতেও সাহস পায় না। সে কোনোদিন কোনো ছেলে মেয়েকে বকাবকি না করলেও তার চেহারা ও বড় বড় লাল চোখ দেখে তারা ভয় পায়। রহিমরা চার ভাই ও তিন বোন। সব ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজ ভাইয়ের নাম সুলতান। সেজ ভাইয়ের নাম আজিজ। আর ছোটর নাম কুদ্দুস। রহিম ও কুদ্দুস ম্যাট্রিক পাস। আর আজিজ ও সুলতান নাইনে উঠে আর পড়েনি। আব্দুস সোবহান চৌধুরীর অনেক না হলেও জমি জায়গা যা ছিল তাতে চার ভাই মিলেমিশে বেশ স্বচ্ছন্দে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। চার ভাইয়ের একান্নবর্তি পরিবার। সবাই চাষবাস করে। রহিম যে বছর ম্যাট্রিক পাস করে, সে বছর আব্দুস সোবহান চৌধুরী মারা যান। সংসারের হাল বড় ছেলে হিসাবে রহিমকে ধরতে হয়। তাই আরো পড়াশুনার ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। সে ভাইদের ও বোনদের মানুষ করেছে। তাদের মা কবিরন বিবি বেঁচে আছেন। তিনি ছেলেদের বিয়ে হওয়ার পর সংসারের সব দায়-দায়িত্ব ছেলে-বৌদের হাতে বুঝিয়ে দিলেও সংসারে ভাঙ্গন যাতে না ধরে সেদিকে খুব লক্ষ্য রাখেন।
সেদিন রাতে রহিম তিন ভাইকে নাদিমের কথা জানাল। ততদিনে তারা নাদিম গত দুবছর স্কুলে না গিয়ে নওশেরের কাছে হাদিস পড়তে যেত তা জেনে গেছে।
সুলতান বলল, ওর নওশের খালু ওকে নষ্ট করেছে। নাদিমকে শাসন করা দরকার। আর নওশেরকেও বলা দরকার, সে যেন ওকে প্রশ্রয় না দেয়।
রহিম বলল, ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়।
পরের দিন সকালে রহিম পাড়ার দূর-সম্পর্কের চাচাতো ভাই হানিফের কাছে গিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে তো নাদিমের খুব ভাব। তুমি আজ জোহরের নামাযের পর তাকে তার মামার বাড়ি থেকে ডেকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। সে স্কুলে আর পড়বে না, মাদ্রাসায় পড়বে। সে ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলব।
হানিফ সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ও খুব কর্মঠ ছেলে। ধর্মকর্মও বেশ মেনে চলে। সেই জন্যে নাদিম চার-পাঁচ বছরের ছোট এবং চাচা-ভাইপো সম্পর্ক হলেও বন্ধুর মতো তাদের দুজনের সম্বন্ধ। হানিফরা দুভাই। ছোট হালিম স্কুলে পড়ে। হানিফদের সংসারে অভাব। তাই সে ক্লাস নাইনে উঠে আর পড়েনি। অন্যের চাষবাসে কাজ করে বাপকে সাহায্য করে। যখন দেশ-গ্রামে কাজ থাকে না তখন শহরে গিয়ে রং-এর কাজ করে। সে একা দুতিন জনের কাজ করতে পারে। সেই জন্য যে কোনো কাজ সে রোজে করে না। ফুরোনে করে। যেমন খাটতে পারে তেমনি খেতেও পারে। শারীরে শক্তিও প্রচুর। অবসর সময়ে সে নাদিমের কাছে কুরআন-হাদিসের কথা শুনে এবং সেগুলো যথাসম্ভব মেনে চলে। সেও শুনেছে, নাদিম স্কুলে না পড়ে মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছে। রহিমের কথা শুনে বলল, আপনি যদি কথা দেন, নাদিমকে মারধর করবেন না, তা হলে আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসতে পারি।
রহিম বলল, না মারধর করব না। তোমাকে তো বললাম, তার সঙ্গে মাদ্রাসায় পড়ার ব্যাপারে কথা বলব।
হানিফ বলল, ঠিক আছে, আমি তাকে নিয়ে আসব।
নাদিম দুপুরে খেয়েদেয়ে মসজিদে নামায পড়তে যাওয়ার জন্য পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়েছে, এমন সময় হানিফ এসে নাদিমকে ও তার মাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, বড় ভাবি কেমন আছেন?
আফ্রিদা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? চাচা চাচী ভালো আছেন?
হানিফ বলল, আল্লাহপাকের রহমতে আমরা ভালো আছি।
আফ্রিদা বলল, তা এমন সময় কি মনে করে? ভাত খেয়েছো? না খেয়ে থাকলে একমুঠো খেয়ে নাও।
হানিফ বলল, ভাত খেয়েই এসেছি আর খাব না। বড় ভাই নাদিমকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠালেন।
আফ্রিদা যেদিন স্বামীকে নাদিমের মতামত জানিয়েছিল, সেদিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিল খুব রেগে গেছে। তাই আজ হানিফের কথা শুনে বলল, আমি ওকে যেতে দেব না। ওর বাপ-চাচারা মারধর করবে।
হানিফ বলল, বড় ভাবি আপনি এ কথা ভাবতে পারলেন, আমি নাদিমকে মার খাওয়াবার জন্য নিয়ে যেতে এসেছি? নাদিমকে মারলে ও যত না কষ্ট পাবে, তার চেয়ে যে আমি বেশি কষ্ট পাব, একথা নিশ্চয় জানেন?
আফ্রিদা ওদের দুজনের গভীর সম্পর্কের কথা জানে। বলল, জানি, কিন্তু তবু আমার যেন কেমন ভয় করছে। তুমি তো জান, তোমার বড় ভাই রেগে গেলে কি রকম হয়।
হানিফ বলল, তা জানি বড় ভাবি। তবু একথা জোর গলায় বলতে পারি, আমার গায়ে এক বিন্দু রক্ত থাকতে নাদিমের গায়ে কাউকে হাত তুলতে দেব না। শুধু বড় ভাই কেন, তারা চার ভাই একসঙ্গে যদি মারতে চায় তবু পারবে না, এ বিশ্বাস রাখবেন।
আফ্রিদা বলল, সে বিশ্বাস আমার আছে। তবু তোমাকে ওয়াদা করতে হবে, যে অবস্থায় নাদিমকে নিয়ে যাবে সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে।
হানিফ বলল, তা তো নিশ্চয়। তারপর নাদিমকে বলল, চল, তোর কোনো ভয় নেই। নাদিমকে ওর মামাদের পাড়ার মসজিদের দিকে যেতে দেখে হানিফ বলল, আমাদের মসজিদে নামায পড়ব।
চাচা-ভাইপো জোহরের নামায পড়ে হানিফ নাদিমকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ঘরে এসে উঠোন থেকে বড় ভাই বলে ডাকল।
তখন বৈশাখ মাস। রোদের প্রচণ্ড তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। রহিমদের বাড়িটা দোতলা। সে দোতলার সিঁড়ির দিকের রুমে থাকে।
রহিম দরজা অল্প ভিড়িয়ে ঘরের ভিতর দরজার পাশে বসে জাল বুনছিল। হানিফের গলা শুনতে পেয়ে বলল, এস, উপরে এস।
হানিফ নাদিমকে নিয়ে উপরে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে ভিতরে যেতে বলল। আসবার সময় সে তাকে সাহস দিয়ে বলেছে, আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই। সে দাঁড়িয়ে রইল।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হানিফ তার একটা হাত ধরে ভিতরে ঠেলে দিয়ে বলল, বড় ভাই নাদিম এসেছে।
রহিম জাল বুনতে বুনতে নাদিমের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্কুলে পড়তে চাচ্ছনা কেন? রহিম ছোটবড় সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুমি করে কথা বলে।
আব্বার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে ভয়ে নাদিমের গলা শুকিয়ে গেল। কোনো কথা বলতে পারল না।
কয়েক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে রহিম বলল, কি হল কিছু বলছ না কেন?
আমি মাদ্রাসায় পড়ব।
এ যুক্তি তোমাকে কে দিয়েছে?
কেউ দেয়নি।
দুবছর পড়ে ম্যাট্রিক পাস করে নাও, তারপর মাদ্রাসায় পড়।
নাদিম এর আগে আব্বার সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা সামনে যেতে খুব ভয় পেত। আজ এত কথা বলার পরও আব্বা কিছু করছে না দেখে তার সাহস হল। বলল, আমি আর স্কুলে পড়ব না।
নাদিমের কথা শুনে রহিম জাল থেকে ছড়িটা টেনে নিয়ে নাদিমকে মারতে মারতে বলল, এত বড় বেয়াদব হয়েছ, বাপের কথা অগ্রাহ্য করে নিজের খেয়াল মতো চলতে চাচ্ছ?
দুতিন ঘা মার খেয়ে নাদিম ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এল।
রহিম তাকে মারার জন্য বেরিয়ে এলে হানিফ তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বড় ভাই, আপনি ওকে মারবেন বলে তো ডেকে আনতে বলেননি।
রহিম তখন রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও হানিফ, নাদিম নষ্ট হয়ে গেছে; শাসন না করলে আরো নষ্ট হয়ে যাবে।
হানিফ তাকে ছাড়ল না। বলল, আমি বেঁচে থাকতে ওর গায়ে আর একটা চাবুকও মারতে পারবেন না।
কুদ্দুস নিচের তলার একটা রুমে থাকে। সে হানিফের গলা পেয়ে দরজা ফাঁক করে নাদিমকে হানিফের সাথে আসতে দেখেছে। তারা উপরে চলে যেতে বেরিয়ে এসে সিঁড়ির উপরের ধাপে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। হানিফ বড় ভাইকে ছাড়ছে না দেখে তাড়াতাড়ি এসে হানিফকে ধরে বড় ভাইকে মুক্ত করে দিল।
রহিম ছাড়া পেয়ে নাদিমকে মারতে গেল।
নাদিম ঘর থেকে বারান্দায় এসে পালাবার জন্য সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে ছোট চাচাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ছোট চাচা যখন হানিফকে ধরে আব্বাকে মুক্ত করে দিল এবং আব্বা তাকে মারতে এল তখন সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর গেটের দিকে ছুট দিল। গেটের কাছে এসে দেখল, মেজ চাচা গেট লাগিয়ে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিম মেজ চাচার কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ততক্ষণে রহিম এসে জালছড়ি দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে চলল।
নাদিম মারের আঘাত সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলতে লাগল, আব্বাগো আর মারবেন না, আমি মরে যাব।
রহিম তবু মেরে চলেছে। শেষে নাদিমের যখন জ্ঞান হারাবার উপক্রম হল তখন তার কানে দাদির গলা ভেসে এল, আর মারিস না রহিম, মরে যাবে যে। তারপর নাদিমের কিছু মনে নেই।
আজিজ সেদিন ঘরে ছিল না। দুদিন হল ছোট বোনের বাড়ি গেছে। নাদিমের দাদি কবিরন বিবি মেজ বৌ আয়মনের অসুখ বলে তার কাছে ছিলেন। নাদিমের কান্নার চিৎকার শুনে যখন বেরিয়ে এসে ঐ কথা বলতে বলতে তার কাছে এলেন তখন নাদিম অজ্ঞান হয়ে গেছে।
এদিকে হানিফ কুদ্দুসের সঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছে। কিছুতেই তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছিল না। কারণ কুদ্দুসও খুব শক্তিশালী যুবক। রোজ ভোরে উঠে ফজরের নামায পড়ে দুটো সাড়ে সাত সের করে পনের সের ওজনের মুগুর নিয়ে ব্যায়াম করে। শেষমেশ হানিফ যখন কুদ্দুসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নাদিমের কাছে এল তখন নাদিম জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তার রক্তাক্ত অজ্ঞান দেহটা দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বলল, বড় ভাই, মেজ ভাই, আপনারা যে নাদিমকে এভাবে শাসন করবেন, তা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতাম, তা হলে নিয়ে আসতাম না। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ভিজে গলায় বলল, এর কিছু হলে আল্লাহ আপনাদের ক্ষমা করবেন না। কথা শেষ করে সে গেটের দিকে যেতে লাগল।
কবিরন বিবি বললেন, ওকে তুই কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
হানিফ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এর মাকে কথা দিয়েছিলাম; ওকে যে অবস্থায় নিয়ে এসেছি সেই অবস্থায় তার কাছে ফিরিয়ে দেব। আমি সেই ওয়াদা রাখতে পারলাম না। জানি না আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন কিনা, আর এর মাও হয়ত আমাকে ক্ষমা করবেন না। তবু যার কাছ থেকে এনেছি তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছি। তারপর সে হনহন করে চলে গেল।
ছেলেকে হানিফের সাথে পাঠিয়ে দিয়ে আফ্রিদা তাদের ফিরে আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। যত দেরি হচ্ছে তত তার মন বিপদের আশংকায় ছটফট করছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে-নাদিমকে নিশ্চয় মারধর করছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে জানাতে লাগল, আল্লাহ তুমি আমার নাদিমকে হেফাজত করো, তাকে আমার কোলে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে এনে দাও। রক্তাক্ত নাদিমকে পাঁজাকোলা করে হানিফকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে তার মন আতঙ্কে ধক করে উঠল। তাড়াতাড়ি নেমে এসে নাদিমের অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে হানিফকে বলল, তুমি আমার জ্যান্ত ছেলে নিয়ে গিয়ে মরা ছেলে ফেরত দিতে এসেছ কেন? তুমি এত বড় ধূর্ত ও নাদান, আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে চালাকি করে মেরে ফেলতে নিয়ে গিয়েছিলে। নাদিমের কিছু হলে তোমাকে ছেড়ে কথা বলব না।
হানিফের চোখ দিয়ে তখনও পানি পড়ছিল। বলল, বড় ভাবি আপনি আমাকে যা শাস্তি দেন দিবেন, আগে নাদিমের চিকিৎসা করা দরকার। ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। ততক্ষনে বাড়ির অন্যান্য মেয়ে-পুরুষ ও ছেলেমেয়েরা এসে ভীড় করেছে। হানিফ তাদেরকে পাশ কাটিয়ে উপরে এসে বারান্দার চৌকিতে শুইয়ে দিয়ে বলল, আপনারা ওর মাথায় পানি ঢালুন, আমি ডাক্তার আনতে যাচ্ছি। তারপর সে ছুটে চলে গেল।
হানিফ চলে যাওয়ার পর আফিদা কঁদতে কাঁদতে নাদিমের মাথায় পানি ঢালতে লাগল।
নাদিমের নানি সুরাতন বিবি সব নাতি-নাতনিদের চেয়ে নাদিমকে বেশি ভালোবাসেন। নাদিমের অবস্থা দেখে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগলেন। সবাই বলাবলি করতে লাগল, বাপ হয়ে যে ছেলেকে এভাবে মারে তা আমরা কখনও দেখিনি ও শুনিনি।
নাদিমের মামারা অফিস থেকে ফিরে নাদিমকে দেখে ও মারার কথা শুনে বলল, কোনো মানুষ কখনো কোনো জন্তু-জানোয়ারকেও এভাবে মারেনি।
ডাক্তার এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে গেল। সন্ধ্যের পর নাদিমের জ্বর একশ পাঁচ ডিগ্রীতে উঠল। ডাক্তারের নির্দেশ মতো মাথায় বরফ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। জ্বর একটানা তিন দিন তিন রাত রইল। এর মধ্যে নাদিমের জ্ঞান ফিরল না। চার দিনের দিন জ্বর কমার পর নাদিমের জ্ঞান ফিরল। এই কদিন আফ্রিদা ও সুরাতন বিবি খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করে রোযার উপর রোযা রেখে নাদিমকে ভালো করে দেওয়ার জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া চেয়েছে। নাদিমের মামীরা অনেক বলে-কয়ে শুধু ইফতারের সময় কিছু নাশতা খাওয়াতে পারলেও ভাত খাওয়াতে পারেনি।
প্রায় দশ-বারো দিন পর নাদিম সুস্থ হল। এ পর্যন্ত নাদিমের বাপ চাচারা কেউ দেখতে আসেনি।
ঐদিন ডাক্তার নাদিমকে দেখে চলে যাওয়ার পর আফ্রিদা হানিফের কাছে সবকিছু শুনে স্বামী ও দেবরদের ব্যবহারে ভীষণ মনে কষ্ট পেল।
হানিফ আফ্রিদার পায়ে হাত দিয়ে কেঁদে কেঁদে মাফ চেয়েছে। আফ্রিদা তাকে মাফ করে পারেনি।
মাসখানেক পর নাদিম নওশের খালুর কাছে গিয়ে সবকিছু জানিয়ে বলল, আমি মাদ্রাসায় পড়তে চাই, আপনি ব্যবস্থা করে দিন।
নওশের বলল, তা না হয় করে দেব, কিন্তু থাকা-খাওয়ার খরচ দেবে কে? তুমি যা বললে, তাতে তো মনে হচ্ছে, তোমার বাপ-চাচারা খরচপত্র দেবে না।
নাদিম বলল, আমি ওসব নিয়ে চিন্তা করি না। আপনি শুধু ভর্তি করে দিন, আমি লজিং খুঁজে নেব।
নওশের বলল, ঠিক আছে, তুমি তোমার মাকে বলে বেডিংপত্র নিয়ে এস।
নাদিম ফিরে এসে মাকে নিজের মতামত বলে খালুর কথা বলল।
আফ্রিদা বলল, মাদ্রাসায় যে পড়বি বলছিস, খরচপত্র দেবে কে? তোর বাপ-চাচারা তো দেবে না।
সে কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি কারো বাড়িতে লজিং থাকব।
তা না হয় থাকলি, কিন্তু আরও খরচ আছে।
আল্লাহ সে সব চালিয়ে দেবে।
আফ্রিদা ভেবেছিল, এত মারধর খাওয়ার পর সে আর মাদ্রাসায় পড়তে চাইবে না, স্কুলেই মন দিয়ে পড়বে। কিন্তু তাকে মাদ্রাসায় পড়ার কথা বলতে শুনে বেশ অবাক হলেও বিরোধিতা করল না। বলল, তুই এক কাজ কর, তোর দাদিকে গিয়ে বল; তিনি যেন তার ছেলেদের বলে খরচপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
নাদিম সেই দিনই বাড়িতে গিয়ে দাদিকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে আম্মা যা বলতে বলেছিল বলল।
কবিরন বিবি বললেন, এতকিছু হওয়ার পরও যখন তুমি মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছ। তখন আর কি করা। তারপর ছেলেদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি নাদিমের মাদ্রাসায় পড়ার কথা বলে খরচের ব্যাপারে কি করবে জিজ্ঞেস করলেন।
বড় ভাই কিছু বলছে না দেখে সুলতান বলল, নাদিম যখন আমাদের অমতে মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছে তখন আমরা তার খরচ দেব না। দেখি ও কি করে পড়ে। তারপর ভাইদের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা কি বল?
রহিম বলল, তোমার কথা ঠিক। যে ছেলে মুরুব্বিদের কথা শুনে না, সে ছেলের জন্যে আমরা টাকা খরচ করব না। ও যদি নিজে পড়তে পারে পড়ুক, তাতে আমাদের। কোনো আপত্তি নেই।
কবিরন বিবি বললেন, তা কি করে সম্ভব? বিদেশে টাকা-পয়সা না হলে ওর খুব কষ্ট হবে।
আজিজ বলল, ও নিজে যদি কষ্টের পথে পা বাড়ায় তাতে আমরা কি করব? কিছুদিন কষ্ট করলে আপনা-আপনি ফিরে আসতে পথ পাবে না।
কবিরন বিবি চিন্তা করলেন, এখন নাদিমের উপর জোর খাটালে কিছু হবে না। ও নিজে যতক্ষণ না নিজের ভুল বুঝতে পারবে ততক্ষণ কারো কথা শুনবে না। তাই তিনি নাদিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার বাপ-চাচাদের কথা তো শুনলে; আর তোমাকে সাহায্য করার মতো আমার কিছু নেই। তারপরও যদি তুমি মাদ্রাসায় পড়তে চাও, তা হলে পড়তে পার।
নাদিম ফিরে এসে মাকে তাদের কথা জানাল।
আফ্রিদা শাশুড়ী, স্বামী ও দেবরদের কথা শুনে তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারল। বলল, আমার কাছে মাত্র ত্রিশ টাকা আছে, তোকে দিতে পারি।
নাদিম মায়ের কাছ থেকে সেই ত্রিশ টাকা নিয়ে নওশের খালুর কাছে এল।
নওশের নাদিমকে খরচপত্রের কথা জিজ্ঞেস করে সবকিছু জেনেও কিছু বলল না। পরের দিন তাকে নিয়ে রাজশাহী টাউনে এসে একটা মাদ্রাসায় সোমে (ক্লাস থ্রিতে) ভর্তি করে দিয়ে আপাতত মাদ্রাসার এতিমখানায় থাকার ব্যবস্থা করে ফিরে এল।
এতিম খানায় থেকে নাদিম পড়াশুনা করতে লাগল, আর লজিং খুঁজতে লাগল। এদিকে এতিমখানার সীমিত খাবার খেয়ে নাদিম দিনের পর দিন শুকিয়ে যেতে লাগল। যারা এতিমখানায় থাকে তাদের গার্জেনরা মাঝে মাঝে এসে তাদেরকে মুড়ি, চিড়ে, মুড়কী কিনে দিয়ে যায়। কেউ কেউ ঘর থেকে ঐসব জিনিস দিয়ে যায়। আবার অনেকে টাকা-পয়সা দিয়ে যায়। নাদিমের কাছে যা ছিল তা দিয়ে ভর্তি হওয়ার পর একটা মশারি কিনতে প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
এতিম খানায় শুধু দুবেলা ভাত দেয়া হয়। তাও আধপেটা, তার উপর কোনো ছাত্রের যদি কোনো মেহমান আসে তা হলে ভাগে আরো কম পড়ে। কারন মেহমানের জন্যে বেশি করে রান্না হয় না। অন্য ছেলেরা যখন নাশতা খায় তখন নাদিমের ক্ষিধের চোটে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। সে তখন বাইরে চলে যায়। অনেক চেষ্টা করেও বাড়িতে লজিং পেল না।
ওদের ক্লাসচিটার, নাদিম ভালো পড়াশুনা করে বলে একটু স্নেহের চোখে দেখেন। দিন দিন তার চেহারা শুকিয়ে যাচ্ছে এবং সব সময় মনমরা হয়ে থাকে দেখে একদিন তিনি নাদিমকে জিজ্ঞেস করে সব কিছু জানতে পেরে তার মনে নাদিমের জন্য দুঃখ হল। তিনি নাদিমকে বুঝিয়ে বললেন, বাপ-চাচাদের মনে কষ্ট দিলে কোনো কাজে সফলতা আসে না। আল্লাহপাকও অসন্তুষ্ট হন। তুমি তাদের কথামতো ম্যাট্রিক পাস করে মাদ্রাসায় ভর্তি হলে ভালো করতে। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে হলে বই-খাতা কেনার জন্য টাকা লাগবে। সেসব তোমাকে কে দেবে? তারপর তাকে আরো অনেক কথা বলে বুঝিয়ে তার গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বললেন।
সেদিন রাতে নাদিম ক্লাসটিচারের কথা চিন্তা করে নিজের ভুল বুঝতে পারল। পরের দিন সে মামাদের বাড়িতে ফিরে এল।
আফ্রিদা ছেলেকে কাঁথা-বালিশ নিয়ে ফিরে আসতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। তবু জিজ্ঞেস করলেন, কি রে সব কিছু নিয়ে এলি কেন?
নাদিম ক্লাসটিচারের কথা বলল, আমি স্কুলে পড়ব।
আফ্রিদা বলল, ঠিক আছে, তোর দাদিকে সে কথা বলবি।
নাদিম বলল, এখন অক্টোবর মাস, ভর্তি হয়ে কোনো কাজ হবে না। সামনের বছর জানুয়ারিতে ভর্তি হব।
আফ্রিদা বলল, তাই হবে।
নাদিম মাদ্রাসায় পড়তে চলে যাওয়ার পর রহিম স্ত্রীকে আনার জন্য ছোট ভাই কুদ্দুসকে পাঠিয়েছিল। ভাইয়েরা সাবই মিলে নাদিমকে মেরেছিল এবং মারার পর কেউ একজনও দেখতে আসেনি। বলে স্বামী দেবরদের প্রতি আফ্রিদার প্রচণ্ড অভিমান। তাই আফ্রিদা কুদ্দুসকে ফিরিয়ে দেয়।
এরপর সুলতান ও আজিজ একে একে নিয়ে যেতে এলে আফ্রিদা তাদেরকেও ফিরিয়ে দেয়।
এর মধ্যে কবিরন বিবির খুব জ্বর হল। ছেলেরা ডাক্তার নিয়ে এল। রাতে ছেলেদেরকে বললেন, বড়মাকে তোমরা আনছ না কেন? তিনি আফ্রিদাকে ভীষণ ভালোবাসেন। তাই অন্য বৌদেরকে মেঝ বৌ, সেজ বৌ ও ছোট বৌ বলে ডাকলেও আফ্রিদাকে বড়মা বলে ডাকেন।
মায়ের কথার জবাবে সুলতান বলল, আমরা বড় ভাবিকে আনতে গিয়েছিলাম, সে আসেনি।
কবিরন বিবি বললেন, তোমরা নাদিমকে ঐভাবে মেরেছ বলে বড়মার মনে কষ্ট হয়েছে, তাই আসেনি। তারপর রহিমকে বললেন, তুমি গিয়ে আমার অসুখের কথা বলে বলবে, আমি তাকে নিয়ে আসার জন্য তোমাকে পাঠিয়েছি।
পরের দিন রহিম নাশতা খেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল।
আফ্রিদা স্বামীকে কমদবুসি করে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, আম্মা কেমন আছেন? আমি ভালো, তুমি কেমন আছ?
আমার খবর এতদিন যখন নাওনি তখন আর জানার দরকার নেই। আম্মা কেমন আছেন বললে না যে?
আজ দুদিন আম্মার খুব জ্বর। ডাক্তার এনে দেখান হয়েছে। আম্মা তোমাকে নিয়ে যেতে পাঠালেন।
আফ্রিদা নাস্তা, শরবত ও পান দিয়ে বলল, আম্মার কথায় নিয়ে যেতে এসেছ? নিজের ইচ্ছায় আসনি তা হলে?
তা কেন? আমি তো তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওদেরকে বারবার পাঠিয়েছি।
তাদের আসা আর তোমার আসা কি এক?
তুমি এত জ্ঞানী হয়েও স্বামীর ভুল ক্ষমা করতে পারলে না?
আফ্রিদা ছলছল নয়নে বলল, তুমিই বা কি করে ভাইদের সঙ্গে যুক্তি করে সবাই মিলে নিজের ছেলেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে? সেটা বুঝি খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছ? বাপ হয়ে ছেলের অন্যায় ক্ষমা করতে পারলে না কেন? শাসন করবে ভালো কথা, তাই বলে মেরে ফেলার মতো শাসন কোনো বাপ কোনো দিন করেছে কিনা জানি না। এই কথা বলার পর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে আবার বলল, ছেলেটা মরল না বাঁচল একবার দেখতেও এলে না।
রহিম বলল, দেখতে না এলেও খবর ঠিকই নিয়েছি। তুমি তো জান, আমি হঠাৎ কখনও রাগি না। দুবছর ছেলেটা লেখাপড়ায় ফাঁকি দিয়ে ফেল করল। তারপর মাদ্রাসায় পড়ার কথা শুনে সামলাতে পারলাম না। আর মানুষ রেগে গেলে শয়তান ঘাড়ে চাপে। তাই সেদিন ঐ রকম একটা কাণ্ড করে ফেলেছি। আমিও তো মানুষ। আমারও পিতৃস্নেহ আছে। সেদিন রাগ পড়ে যাওয়ার পর মনে যে কত ব্যাথা অনুভব করেছি তা আল্লাহপাক জানেন। আজও সে কথা মনে হলে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাই। স্ত্রীকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে বলল, আমাকে কি তুমি ক্ষমা করে দিতে পার না?
আফ্রিদা আঁচলে চোখ মুছে স্বামীকে আর একবার কদমবুসি করে বলল, বারবার ক্ষমা চেয়ে আমাকে গোনাহগার করো না। আমাকে নিয়ে যেতে তুমি ভাইদেরকে পাঠিয়েছিলে। আমি তোমার উপর অভিমান করে না গিয়ে অন্যায় করেছি, তুমি বরং আমাকে মাফ করে দাও।
রহিম বলল, আল্লাহপাক আমাদেরকে মাফ করুন। আচ্ছা, নাদিম তো মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে, চিঠিপত্র দিয়েছে? নাদিম যে কয়েক দিন আগে ফিরে এসেছে রহিম তা জানে না।
আফ্রিদা বলল, সে চার-পাঁচদিন হল ফিরে এসেছে। তারপর তার ফিরে আসার কারণ ও স্কুলে পড়ার ইচ্ছার কথা জানাল।
রহিম শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, আমরা সবাই চেয়েছিলাম সে তার নিজের ভুল নিজে বুঝুক। তাই আম্মা যখন মাদ্রাসায় পড়ার খরচের কথা বললেন তখন আমরা তাকে পড়ার অনুমতি দিলেও খরচপত্র দিতে চাইনি। আল্লাপাকের কাছে শুকরিয়া জানাই, তিনি ওকে তাড়াতাড়ি ভুল বোঝার তওফিক দিলেন। নাদিম কোথায়? ওকে কাউকে দিয়ে ডাক তো, অনেক দিন দেখিনি।
আফ্রিদা রুম থেকে বেরিয়ে ভাইপো সাইদুলকে দেখতে পেয়ে নাদিমকে ডেকে দিতে বলল।
নাদিম জানে না তার আব্বা এসেছে, সাইদুল ডেকে দিতে ঘরে ঢুকে আব্বাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আফ্রিদা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি হল, বেয়াদবের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সালাম দিয়ে কদমবুসি কর।
নাদিম সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।
রহিম সালামের উত্তর দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে ভিজে গলায় বলল, তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ শুনে খুশি হয়েছি। এবার মন দিয়ে পড়াশোনা কর।
ঐদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আফ্রিদা ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বাড়ি ফিরল।
বাড়িতে এসে আফ্রিদা যখন শাশুড়ীর কাছে এসে কদমবুসি করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছিল তখন রহিম ছাড়া অন্য তিন ভাই সেখানে ছিল।
কবিরন বিবি বড় বৌকে দোয়া করে বললেন, তুমি তোমার দেবরদেরকে ছোট ভাই মনে করে মাফ করে দাও। ওদেরকে তো তুমি ছেলের মতো মানুষ করেছ। তারপর ছেলেদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা বড়মার পা ধরে মাফ চেয়ে নাও।
আফ্রিদা যখন এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসে তখন সুলতারে বয়স আট, আজিজের পচ আর কুন্দুসের দুবছর। আফ্রিদাই তাদেরকে এক রকম মানুষ করেছে। তারাও বড় ভাবিকে মায়ের মতো জ্ঞান করে। মা না বললেও তারা বড় অব্রি পা ধরে ক্ষমা চাইত।
শাশুড়ীর কথা শুনে আফ্রিদা বলল, না না আমাকে কদমবুসি করতে হবে না। এদেরকে মাফ করে দিয়েছি।
তিন ভাই তা শুনল না। একে একে কদমবুসি করে মাফ চাইল। আফ্রিদা তাদের মাথায় হাত দিয়ে চুমো খেয়ে বলল, আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুক।
পরের বছর নাদিম স্কুলে ভর্তি হয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগল। ম্যাট্রিক চার বিষয়ে লেটার নিয়ে পাস করে চাঁপাই নবাবগঞ্জ কলেজে ভর্তি হল। সেখান থেকে ভালোভাবে বি.এ. পাস করে কিছুদিন বেকার ছিল। তারপর গোদাগাড়ি হাইস্কুলে মাস্টারি করছে। ম্যাট্রিক পাস করার পর কলেজে পড়লেও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে তার কখনও শিথিলতা আসেনি। সেই সঙ্গে পাড়ার ও গ্রামের অশিক্ষিত লোকদের কুরআন হাদিসের জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়েছে। তার সাহচর্যে এসে গ্রামের অনেকে যারা তাড়ি খেত, চুরি করত, নামায-রোযা করত না, তারা এই সব গর্হিত কাজ ছেড়ে দিয়ে নামায-রোযা করছে। মাস্টারিতে জয়েন করার এক বছর পর আজ নাদিমের বিয়ে হল।
বিয়েতে রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর নাদিম মসজিদে গিয়ে দুরাকাত শোকরানার নফল নামায পড়ে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ-শান্তির জন্য দোয়া চাইল। তারপর ঘরে এসে দেখল, তার রুমের বারান্দায় মেয়েদের ভিড়। তাদের সঙ্গে জুলেখা ভাবিও রয়েছে। রুমের ভিতর হাসির রোল শুনে নাদিম বুঝতে পারল, নতুন বৌকে নিয়ে নানারকম কৌতুক চলছে। নাদিম মায়ের রুমের দিকে আসতে লাগল।
কুদ্দুসের স্ত্রী ফাহমিদা বড় জায়ের সঙ্গে বসে পান খাচ্ছিল। সে নাদিমকে আসতে দেখে উঠে গিয়ে জুলেখাকে বলল, বৌ এবার ওদেরকে ঘরের ভিতর থেকে ডেকে নিয়ে সব চলে যাও, নাদিম এসেছে।
জুলেখা সবাইকে ডেকে বিদায় করে দিয়ে নাদিমের কাছে এসে বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? বিয়ের দিন কেউ বুঝি এত রাত বাইরে থাকে? চল, ঘরে চল। নাদিমের। রুমেই বাসরশয্যা হয়েছে। জুলেখা তাকে সাথে করে রুমের দরজার কাছে এসে বলল, ভিতরে যাও। দোয়া করি আল্লাহ যেন আজকের রাত তোমাদের জন্য শুভ করেন, আনন্দের করেন, দুজন দুজনকে চিনবার তওফিক দেন। তারপর সে চলে গেল।
নাদিম কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তক্তপোষের কাছে। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে সাজেদার দিকে তাকিয়ে রইল।
সাজেদা তক্তপোসের উপর থেকে নেমে নাদিমকে কদমবুসি করল।
নাদিম তাকে দুহাত দিয়ে ধরে দাঁড় করিয়ে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, আল্লাহ তোমাকে তোমার নামের অর্থমতো ধার্মিক করুক। তারপর ঘোমটা সরিয়ে চিবুক ধরে বেশ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
সাজেদা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ পর কম্পিত পাপড়ি খুলে বলল, এতক্ষণ ধরে কি দেখছেন?
নাদিম বলল, আল্লাহপাকের এক অপূর্ব সৃষ্টি দেখছি। সত্যি, তিনি তোমাকে। সৌন্দর্যের রানী করে গড়েছেন।
ছোটবেলা থেকে রূপের প্রশংসা শুনে শুনে সাজেদার বেশ গর্ব ছিল। আজ স্বামীর মুখে সেই প্রশংসা শুনে আরো গর্বিত হল। স্বামীকে খুশি করার জন্য বলল, আপনিও কম কিসে।
নাদিম বলল, আপনি করে না বলে তুমি করে বল। তারপর তাকে বসিয়ে নিজেও পাশে বসে তার নমর নিটোল হাত দুটো ধরে বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই, তুমি বিরক্ত বোধ করবে না তো?
সাজেদা বলল, না করব না, বল কি বলবে।
নাদিম বলল, জেনেছি তুমি ধনী ঘরের মেয়ে। খুব আদরে মানুষ হয়েছ। আমরা কিন্তু মধ্যবিত্ত। এখানে তোমার হয়ত সবকিছুতে বেশ একটু অসুবিধে হবে। সেগুলো মেনে নেয়ার চেষ্টা কর। আর আমার আব্বা-আম্মা এবং চাচা-চাচীদেরকে আপন। আব্বা-আম্মা ও চাচা-চাচি মনে করবে। তাদের সঙ্গে ঝগড়া তো দূরের কথা সামান্য কথা কাটাকাটিও করবে না। বিশেষ করে আম্মার সঙ্গে কোনো বেয়াদবি করো না। আম্মা আমাদের পুরো ফ্যামিলির বড় মা। ছোট-বড় সবাই তাকে মেনে চলে, ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তুমিও তাই করবে। যা বলবে বিনা দ্বিধায় তৎক্ষণাৎ তা পালন করবে। নানাদের অবস্থার তুলনায় আমরা কিছুই না। মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি এবং আমার জ্ঞান। হওয়ার পর থেকে আম্মাকে যতটুকু জেনেছি, তার মতো মেয়ে পৃথিবীতে বিরল। ঐ যে দেখছ আলমারী, ওতে বিভিন্ন ধরনের প্রচুর বই আছে। সব আম্মা পড়েছে। তুমিও অবসর সময়ে পড়বে। প্রচুর জ্ঞান পাবে। আজ আর বেশি কিছু বলে বিরক্ত করব না। এবার ঘুমান যাক বলে নাদিম বালিশে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
সাজেদা টাউনঘেঁষা মেয়ে। প্রেমতলী গ্রাম রাজশাহী টাউনের পাশে। তার উপর ম্যাট্রিক পাস। খুব চালাক-চতুর ও বাকপটু এবং হঁচড়েপাকা। চাচাতো ভাবিদের কাছে এবং যে সব চাচাতো বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের কাছ থেকে স্বামী-স্ত্রীর অনেক ঘটনা শুনে শুনে পাকা হয়ে গেছে। তার উপর নানা রকম আজেবাজে উপন্যাস পড়ে আরো ঝুনো হয়েছে।
নাদিম ঘুমোবার কথা বলতে বলল, আজকের রাতে কেউ ঘুমায় নাকি? এই শুভরাত তো মানুষের জীবনে মাত্র একবার আসে।
নাদিম এমনি কথার ছলে ঘুমাবার কথা বলেছিল। সাজেদার কথা শুনে ভাবল, সে নিশ্চয় বাসর রাত সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে। কতটা জানে পরীক্ষা করার জন্য বলল, তোমার কথা ঠিক; এই রাত মানুষের জীবনে একবারই আসে; কিন্তু শুধু শুধু রাত জেগে কি লাভ? তার চেয়ে ঘুমালে অনেক লাভ।
জেগে থাকলেও লাভ আছে।
কি লাভ যদি বল তা হলে জেগে থাকতে পারি।
সে লাভ মুখে বলা যায় না।
যেভাবে বলা যায় সেভাবে বল।
মেয়েরা সেভাবেও বলতে পারে না।
কোন ভাবেই যখন বলতে পারবে না তখন আর সেই লাভের কথা না তোলাই ভালো ছিল।
নাদিমের কথা শুনে সাজেদা ভাবল, সে কি তা হলে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের কথা জানে না? সাজেদা জেনেছে, স্বামীরা বাসর রাতে স্ত্রীর দেহ ভোগ করার জন্য নানা রকম মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে কাজ হাসিল করে। সে ব্যাপারে নাদিমের কোনো আগ্রহ নেই দেখে বেশ অবাক হল। হঠাৎ তার চাচাতো ভাবি কুলসুমের কথা মনে পড়ল, তার চাচাতো ভাই ইউনুস বাসর রাতে কেমন কৌশলে তাকে ভোগ করেছিল; সেই কথা চিন্তা করতে লাগল।
সাজেদার মতো অপূর্ব রূপসীকে স্ত্রীরূপে পেয়ে নাদিমের পঁচিশ বছরের যৌবন ক্ষুধা বাধভাঙা বন্যার পানির মতো সমস্ত শরীরে ছুটে চলেছে। এতক্ষণ লজ্জা ও সম্মানের ভয়ে এবং তাকে জানার জন্য নিজেকে কঠোরভাবে দমন করে রেখেছিল। সাজেদার কথা শুনে বুঝতে পারল, দুজনেরই অবস্থা এক। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, কিছু বলছ না কেন? চুপ করে থাকলে তো ঘুমিয়ে পড়ব।
সাজেদা তার কথা শুনে চিন্তা করল, মেয়েছেলে হয়ে এতটা যা বলেছি, তা অন্য কেউ শুনলে বেহায়া ভাববে। আর কি বলবে, ভাবতে লাগল।
নাদিম এবার দুষ্টুমি করে বলল, ঠিক আছে, কিছুই যখন কলার নেই তখন ঘুমিয়ে পড়ছি।
সাজেদা চিন্তা করে চলেছে, সে সত্যি কিছু জানে না, না জেনেও না জানার ভান করছে? বলল, তুমি তো আলমারী ভর্তি বই পড়ে কতকিছু জেনেছ, আর আজকের রাতের সামান্য ব্যাপারটা জান না?
নাদিম আবার দুষ্টুমি করে বলল, জানি না বলেই তো জিজ্ঞেস করছি। জানলে তোমার সঙ্গে এতক্ষণ বকবক করতাম না।
সাজেদারও নাদিমের সৌন্দর্যপূর্ণ সুন্দর স্বাস্থ্য দেখে তার বিশ বছরের যৌবন, চাওয়া পাওয়ার আনন্দে অধীর হয়ে উঠল। তাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের উপর মাথা রেখে বলল, আমি জেনেও যে লজ্জায় বলতে পারছি না।
নাদিমও তাকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, তুমি বলতে না পারলেও আমি পারি।
বিয়ের চার দিন পর শিহাব মেয়ে জামাই নিয়ে বাড়ি ফিরল। দুদিন পর খুব ধূমধামের সঙ্গে খানা করে আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের লোকদের খাওয়াল। সবাই জামাই দেখে খুব আনন্দিত।
শ্বশুর বাড়িতে এসে নাদিম সাজেদার আসল রূপ দেখে যেমন খুব অবাক হল তেমনি মনে মনে খুব শংকিত হয়ে পড়ল। সে বাপ-চাচাদেরকে তুমি করে বললেও মা, চাচি ও দাদির সঙ্গে তুই-তোকারি করে কথা বলছে। দোতলায় বারান্দা থেকে সবাইকে হুকুম করছে। আর একটা জিনিস নাদিম লক্ষ্য করল, ছোট-বড় সবাই যেন সাজেদাকে ভয় ভয় করছে। তার হুকুম মানার জন্য সবাই যেন তটস্থ হয়ে থাকে। এমন কি নাদিমকে খাওয়াবার সময়ও সে নিজে কোনো কিছু নিয়ে আসে না, বারান্দা থেকে অন্যকে নিয়ে আসতে বলে। তার কথা পালন করতে কেউ যদি দেরি করে, তা হলে ছোট হোক আর বড় হোক, তাকে খুব গরম মেজাজে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেয়। সাজেদার এহেন রূপ দেখে নাদিমের দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে গেল। চিন্তা করল, এরকম স্বভাবের মেয়েকে নিয়ে কি করে আমি সারা জীবন কাটাব? এইসব ভেবে নাদিমের মন খুব খারাপ হয়ে গেল।
নাদিমের সঙ্গে বন্ধু রিয়াজুল ও তার এক দুলাভাই এসেছিল। দুলাভাই দুদিন থেকে বাড়ি ফিরে গেছে, রিয়াজুল আছে। নাদিমের মন খারাপ দেখে সে জিজ্ঞেস করল, কি রে, তোর মন খারাপ কেন? বৌয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে বুঝি?
নাদিম বলল,না রে, তুই যা ভাবছিস তা নয়, তবে-বলে থেমে গেল।
থামলি কেন, বল।
কি আর বলব, সবই আমার ভাগ্য।
ভাগ্যের হাতে আমরা যখন বন্দি তখন আর মন খারাপ করছিস কেন? কি হয়েছে বল।
নাদিম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জানিস, ছেলেবেলা থেকে যে আশা আকাঙ্খা পোষণ করে রেখেছিলাম, তা স্বপ্নই রয়ে গেল।
রিয়াজুল বলল, মানুষ চেষ্টার দ্বারা স্বপ্নকে সফল করে। তোর কি স্বপ্ন ছিল শুনি।
নাদিম পাত্রী নির্বাচনের ব্যাপারে দাদিকে যে কথা বলেছিল, সেকথা এবং সাজেদার এখানকার সকলের প্রতি ব্যবহারের কথা বলে বলল, আমার মনে হয় আমি দাম্পত্য জীবনে কোনোদিন সুখ-শান্তি পাব না।
রিয়াজুল বলল, আরে দূর, দুদিন বৌয়ের সঙ্গে চলে সারাজীবনের কথা বলছিস কি করে? সব মেয়েরাই বাপের বাড়িতে একটু বেপরোয়া হয়ে চলে। স্বামী ঘরে কি আর সেরকম করতে পারে? তা ছাড়া তোর বৌকে নিজের মতো করে গড়ে নিবি। তুই তো হাদিস-কালাম অনেক জানিস। সেসব বলে তাকে নিজের মতো করে নেয়ার চেষ্টা করবি।
নাদিম বলল, তা তো করবই। কিন্তু তবু যেন মনে কি রকম একটা আতঙ্ক লাগছে। বড়লোকের মেয়েদের সম্বন্ধে যতটুকু জানি, সাজেদা যদি সে ধরণের হয় তা হলে আমার আশা কোনদিন পূরণ হবে না।
রিয়াজুল বলল, তুই বড় সেন্টিমেন্টাল। এত সেন্টিমেন্টাল হলে দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি হয় না। তুই কি এমন স্বামী-স্ত্রী দেখাতে পারবি, যাদের মধ্যে কোনোদিন মনোমালিন্য বা ঝগড়াঝাটি হয় না? নাদিম কিছু বলছে না দেখে আবার বলল, তুই কেন-কেউই দেখাতে পারবে না, থাকলে তো দেখাবে। তোর বৌ খুব সুন্দরী এবং বড়লোকের মেয়ে। সব ছেলেই এরকম মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। মেয়েরা বাপের বাড়িতে যাই থাকুক না কেন, স্বামীর বাড়িতে গেলে ঠিক হয়ে যায়।
নাদিম বলল, অনেক ক্ষেত্রে তোর কথা ঠিক হলেও সব ক্ষেত্রে নয়। কম হলেও অনেকে এমন আছে যারা ঐ রকম মেয়েকে বিয়ে করতে চায় না। আমি ঐ কম দলের মধ্যে।
তা হলে তুই একে বিয়ে করলি কেন?
ভাগ্য করিয়েছে।
তা হলে এখন আফসোস করছিস কেন? ভাগ্যকে মেনে নে।
তা তো নিতেই হবে। কিন্তু ভাগ্যের আঘাত বড় নির্মম হয়।
মানুষ চেষ্টার দ্বারা ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।
ততটুকু পারে যতটুকু তার ভাগ্যে থাকে।
তাই যদি জানিস, তাহলে মন খারপ করছিস কেন? আমি একটা কথা বলি শুন, ভাগ্যে যা আছে তা যখন হবেই তখন আর তাকে নিয়ে চিন্তা না করে ডু ইউর ডিউটি, খাও-দাও আর বৌকে নিয়ে মৌজ কর।
নাদিম হেসে উঠে বলল, তুই বুঝি তাই করিস?
তা করি বই-কি। তোর মতো আমি অত চিন্তা করে কোনো কিছু করি না।
তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুই যে বললি, ডু ইউর ডিউটি, সেটা কি তুই ঠিক মতো পালন করিস? খাচ্ছিস-দাচ্ছিস দোকানদারি করছিস, আর বৌকে নিয়ে ফুর্তি করছিস-এখানেই কি ডিউটি শেষ? পরকাল বলে যে একটা কথা আছে সেখানকার কথা চিন্তা করে কিছু করা-সেটাও যে ডিউটির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে; সেদিকে খেয়াল করেছিস? শুধু দুনিয়ার ডিউটি পালন করার জন্য আল্লাহপাক আমাদেরকে পাঠাননি। আখেরাতের ডিউটির জন্যও পাঠিয়েছেন।
তোর কথা অস্বীকার করব না। সব মানুষ কি সব ডিউটি পালন করতে পারে? না পেরেছে?
সব মানুষ কি করে না করে বলছিস কেন? আগে নিজে কর তারপর অন্যদের কথা বলবি। অন্যরা অন্যায় করলে তুই করবি কেন?
তোর সঙ্গে তর্কে পারব না। তবে তোর কথাগুলো খুব দামী। আল্লাহর কাছে তুই আমার জন্য দোয়া করিস, তিনি যেন আমাকে সব ডিউটি পালন করার তওফিক দেন।
শুধু তোর জন্য নয়, পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্য প্রত্যেক নামাযের পর। মোনাজাতের সময় দোয়া করি। আর এটা করা পৃথিবীর সব মুসলমানের কর্তব্য। তুই দুছেলের বাপ হলি এখনো ঠিকমত নামায পড়িস না। আগে কি করেছিস না করেছিস, এবার থেকে ঠিকমত ধর্মের সব কিছু মেনে চলবি। ছেলেমেয়েরা বাপ-মাকে ধর্মের আইন মেনে চলতে দেখলে তারাও মেনে চলার প্রেরণা পাবে, জানিস না বুঝি, ছোটবেলায় ছেলেমেয়েরা বাপ মাকে যা করতে দেখবে তারাও তা অনুকরন করবে?
আমি তো সব সময় নামায পড়তে চাই; কিন্তু কেন জানি তা পারি না। এর কারণ কি বলতে পারিস?
এর কারণ এমন কিছু নয়, শুধু গাফিলতি অর্থাৎ অলসতা। আর এর পিছনে কাজ করছে শয়তান। তুই যদি একটা কাজ করতে পারিস, তা হলে জীবনে কোনোদিন নামায ছাড়তে পারবি না।
বল কি কাজ?
তুই যদি একচল্লিশ দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায এক ওয়াক্তও কাজা না করে জামাতে তকবীরে উলার সঙ্গে পড়তে পারিস, তা হলে নামায ছাড়তে চাইলেও নামায তোকে ছাড়বে না। আর শয়তানও পাফিলতিতে গ্রেফতার করতে পারবে না।
সত্যি বলছিস?
সত্যি না মিথ্যা তা করলেই জানতে পারবি।
ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ কাল থেকে শুরু করব।
না কাল থেকে নয় আজ থেকেই। কোনো কাজ কাল করব বলে ফেলে রাখতে নেই। এটা মনীষীদের কথা।
ঐ দিন যোহর থেকে রিয়াজুল সেই যে নামায পড়তে শুরু করল তারপর সারাজীবনে আর কোনোদিন পরিত্যাগ করেনি।
সেদিন রাতে ঘুমাবার সময় নাদিম স্ত্রীকে বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি, সেগুলো মনে রেখে মেনে চলার চেষ্টা করবে।
সাজেদা যে কদিন শ্বশুর বাড়িতে ছিল, সে কদিন স্বামীর কাছ থেকে হিতোপদেশ শুনে শুনে বিরক্ত হয়েছে। তখন ভয়ে লজ্জায় কিছু বলেনি। আজ স্বামীর কথা শুনে বুজতে পারল, এখন আবার হিতোপদেশ দিবে। তাই বিরক্ত বোধ করে বলল, তুমি শুধু আমাকে কুরআন-হাদিসের কথা বলে উপদেশ দাও। আমি কি তোমার সঙ্গে বা তোমাদের বাড়ির সকলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি? বিয়ের রাত থেকে অনেক উপদেশ শুনিয়েছ, আর কত শোনাবে?।
নাদিম স্ত্রীর কথা শুনে মনে আঘাত পেয়ে দীঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কুরআন হাদিসের কথা শুনতে তোমার ভালো লাগে না।
ভলো লাগবে না কেন? কিন্তু তুমিই বল, ভালো কথা কি সব সময় শুনতে ভালো লাগে?
ভালো সব সময় মানুষের কাছে ভালো লাগে। তবে তাদের কাছে ভালো লাগে না, যারা ভালোকে গ্রহণ করতে চায় না। যাকগে, এ প্রসঙ্গ এখন থাক, আমার ঘুম পাচ্ছে। বলে সে পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করল।
নাদিমের কথায় সাজেদা অসন্তুষ্ট হল। সে বড় লাইট অফ করে ডিম লাইট জ্বেলে এসে তার পাশে শুয়ে পড়ল।
চারদিন পর নাদিম শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এল। যদিও শ্বশুর, শাশুড়ী, দাদি শাশুড়ী ও সাজেদা তাকে এত তাড়াতাড়ি আসতে দিতে চায়নি। ওনারা অনেক বাধা দিয়ে আরো কয়েকদিন থাকতে বলেছিল; কিন্তু নাদিম সাজেদার স্বভাব চরিত্র দেখে-শুনে মনে খুব আঘাত পেয়েছে বলে সেখানে তার এক দণ্ড থাকতে মন চাইল না। সবার অনুরোধে রিয়াজুলও তাকে আরো দুএকদিন থাকতে বলেছিল, সে শুনেনি।
আসার সময় সাজেদা স্বামীকে অনেকবার থাকতে বলে যখন বিফল হল তখন। কদমবুসি করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমি যদি কোনো দোষ করে থাকি তবে মাফ করে দিও। তারপর জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, কবে আসবে। বল?
সাজেদার কথায় ও কান্নায় নাদিমের মন একটু নরম হল। বলল, আল্লাহ যখন রাজি হবেন তখন আসব। তারপর তাকে আদর করে চলে এসেছে।
মাস দুয়েক পর নাদিমের শালা লিয়াকত তার ফুপাতো ভাই ইয়াকুবকে সাথে করে নাদিমকে নিয়ে যেতে এল।
নাদিম যখন তাদের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি গেল তখন আফ্রিদা ছেলেকে বৌমাকে নিয়ে আসার কথা বলে দিল।
নাদিম শ্বশুরবাড়িতে তিনদিন থেকে সাজেদাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। এবার তাকে নিজের মতো করে গড়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল।
সাজেদা ধনী ঘরের সন্তান। তার উপর সে হওয়ার পর অনেক বছর আর কোনো ভাইবোন হয়নি। ফলে বাপ মার ও বাড়ির সকলের কাছে খুব আদরের। যখন যা আবদার করেছে পেয়েছে। ঘরের কোনো কাজকর্ম করা তো দূরের কথা, এক গ্লাস পানি পর্যন্ত নিজে ঢেলে খায়নি। কারো হুকুম পালন করে সে মানুষ হয়নি, বরং হুকুম চালিয়ে মানুষ হয়েছে। মাছ-মাংস ছাড়া একবেলাও ভাত খায়নি। দামি দামি জামা কাপড় পরে মানুষ হয়েছে। রান্না-বান্নাও কিছু শিখেনি। বিয়ের পর এই দুমাসের মধ্যে তার মা তাকে কিছু কিছু রান্নার কাজ শিখিয়েছে। সেই সাজেদা শ্বশুরবাড়িতে এসে খুব অসুবিধে বোধ করতে লাগল। নাদিমের কথায় ভোরে উঠে ফজরের নামাযের পর কুরআন শরীফ পড়তে হচ্ছে। বাড়িতে সে মাঝে মাঝে পড়লেও কোনোদিন ফজরের নামায পড়েনি। শীতকালে তো অনেক বেলা পর্যন্ত লেপের তলায় ঘুমিয়ে থাকত। একান্নবর্তী পরিবারে বৌ হয়ে এসে তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। নাদিমদের মুদি বাজার ছাড়া অন্য কোনো বাজার করা হয় না। সব রকমের তরকারী নিজেরা চাষ করে। যে মৌসুমে যে তরকারী চাষ হয়, সে সময় সেই তরকারী খায়। যেমন-বেগুনের সময় বেগুন, তেঁড়সের সময় বেঁড়শ, পুঁইশাকের সময় পুঁইশাক, ডাটা শাকের সময় ডাটা শাক, আলুর সময় আলু। তবে আলু ওদের প্রচুর হয়। কিছু বিক্রি করে বাকিটা সারা বছর ধরে খায়। মেহমান-কুটুম এলে পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে, ঘরের মুরগি জবাই করে। তা ছাড়া মাছ মাংস বড় একটা হয় না। তবে বর্ষার মৌসুমে মগরীতে নানারকম মাছ পড়ে। সে সময় প্রতিদিন মাছের তরকারী রান্না হয়। সাজেদা যখন শ্বশুরবাড়ি এল তখন পুঁইশাকের সময়। যেমন বিক্রি করা হচ্ছে তেমনি দুবেলা পুঁইশাকের তরকারী রান্না হচ্ছে। পুইশাক সে কোনোদিন খায়নি। এখন বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে। কিন্তু এই তরকারী দিয়ে ভাত খেতে খুব কষ্ট হয়। দুচার গাল খেয়ে উঠে পড়ে। প্রথম আফ্রিদা বুঝতে পেরে ডিম ভেজে দিত।
সাজেদার সঙ্গে তার দাদি এসেছিলেন। তিনি যতদিন ছিলেন, ততদিন ঐ তরকারীর সাথে আলাদা কিছু ভাল তরকারী রান্না করে দেয়া হয়েছে। উনি খাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকত, তা দিয়ে সাজেদা ভাত খেত। তিনি পনের দিন থেকে চলে গেছেন। তারপর থেকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সাজেদার খুব অসুবিধা হতে লাগল। সকালে আলাদা কোনো নাশতা তৈরি হয় না। সবাই বাসি ভাত খায়। নাদিম স্কুলে যাবে বলে গরম ভাত হয়। সাজেদার ভাত খাওয়ার অভ্যেস নেই। সে জন্য না খেয়ে থাকে।
নাদিম জানতে পেরে একদিন সাজেদাকে বলল, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমি কি করব বল, আলাদাভাবে কিছু করা সম্ভব নয়। এক কাজ কর, ঘরে তো মুড়ি থাকেই; সকালে সরষের তেল মাখিয়ে মুড়ি খেও। তারপর আমি যখন স্কুলে যাওয়ার সময় ভাত খাব তখন আমার সঙ্গে তুমি গরম ভাত খেয়ে নিও।
সাজেদার ছোটবেলা থেকে চা খাওয়ার অভ্যেস। নাদিমদের বাড়িতে কেউ চা খায়। বলে তর ব্যবস্থা নেই। স্বামীর কথা শুনে বলল, তুমি চা-চিনি এনে দিও; আমি শুধু মুড়ি খেতে পারি না, চা দিয়ে খাব।
নাদিম বলল, ঠিক আছে, আমি আম্মাকে বলে তার ব্যবস্থা করব।
সাজেদা বলল, কেন তুমি কিনে এনে আমাকে দিতে পার না?
না, পারি না, কারণ আমি বেতনের সব টাকা আম্মার হাতে দিয়ে দিই।
বিয়ের আগে না হয় দিয়েছ, এবার কিছু কিছু হাতে রাখলেই পার।
কথাটা শুনে নাদিম একটু রেগে গেল। বলল, না তাও পারি না, কারণ গোটা সংসারের আয় যেমন আম্মার কাছে জমা থাকে, তেমনি সমস্ত খরচের দায়-দায়িত্ব আম্মার হাতে। আর কখনও এরকম কথা বলবে না।
তা হলে তুমি তোমার স্ত্রীর শখ-সাধও মেটাতে পারবে না?
যখন তোমার কোনো শখ-সাধ হবে তখন চেয়ে দেখো, মেটাতে পারি কিনা।
কি আর দেখব, আম্মার কাছ থেকে টাকা চেয়ে মেটাবে-এই তো?
নাদিম আরো রেগে গিয়ে বলল, কিভাবে কি করব, সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে ভাবতে হবে না।
সাজেদা স্বামীকে রেগে যেতে দেখে আর কিছু বলল না।
নাদিম আম্মাকে সাজেদার চা খাওয়ার অভ্যাসের কথা বলায় আফ্রিদা সকালে ও সন্ধ্যায় তার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করল।
কুদ্দুসের স্ত্রী ফাহমিদার বাপের বাড়িতে চায়ের প্রচলন আছে। ফাহমিদাও চাখোর ছিল। শ্বশুরবাড়িতে এসে অনেক কষ্টে সে অভ্যাস ছেড়েছে। বৌয়ের জন্যে দুবেলা চা হচ্ছে দেখে তার পুরোন অভ্যাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সেও সাজেদার সঙ্গে দুবেলা চায়ের পার্টনার হয়ে গেল। তাই দেখে মেজ আয়মন ও সেজ আবিদার হিংসা হতে লাগল। একদিন সকালে সাজেদা ও ফাহমিদা যখন চা-মুড়ি খাচ্ছিল তখন তাদেরকে শুনিয়ে আয়মন সেজ জা আবিদাকে বলল, হোটেল খুললেই তো ভালো হত সবাই চা খেতে পেতাম।
সাজেদা শুনতে পেয়ে ফাহমিদাকে বলল, দেখলে ছোট মা, আমরা একটু চা খাচ্ছি তাও মেজ মা সহ্য করতে পারছে না।
ফাহমিদা বলল, মেজ বুবুর কথা ধরো না, সে সব সময় ওরকম। এইভাবে দিন গড়িয়ে চলল। সেই সঙ্গে নাদিম সাজেদাকে নানারকম উপন্যাস ও ধর্মীয় বই পড়ার জন্য তাগিদ দিতে লাগল। সৎ উপদেশ দিয়ে নিজের মনের মতো গড়ার যত চেষ্টা করতে লাগল তত সাজেদা স্বামীর প্রতি রুষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। প্রায়ই দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
সাজেদা স্বামীর প্রতি দুটো কারণে দিন দিন রুষ্ঠ হয়ে উঠছে। প্রথম কারণ বই পড়ার তাগিদ। বিয়ের আগে বই পড়ার নেশা কিছু কিছু থাকলেও বিয়ের পর বই যেন তার কাছে দুচোখের বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বই পড়ার কথা শুনলে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। যে কারনে এখন তার বইয়ের প্রতি এত অনীহা তা হল, বিয়ের আগে গল্প উপন্যাস পড়ে স্বামী ও সংসারের যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, বিয়ের পর তার এক কণাও বাস্তবে না দেখে এ রকম হয়েছে। আর দ্বিতীয়টা হল, সাজেদার ধারণা সে রূপসী বলে নাদিম শুধু তার দেহ ভোগ করার জন্য তাকে ভালবাসে, তা না হলে সব সময় তার দোষ ধরে কেন? কুরআন হাদিসের কথা বলে উপদেশ দেয় কেন? কোনোদিন এতটুকু গুণগান করে না কেন? প্রথমদিকে স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির সকলের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করলেও ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। একদিকে যেমন প্রতি রাতে স্বামীর কাছে উপদেশ শুনে কান ঝালাপালা, অপরদিকে প্রথম দিকে সবাই তাকে যে চোখে দেখত, এখন তারা অন্য চোখে দেখছে। এত খেটেও তার দুর্ণাম। মেজ শাশুড়ী প্রায়ই বলে, বড়লোকের মেয়েকে গৃহস্থ ঘরের বৌ করা ঠিক হয়নি। সেজ শাশুড়ীও তাকে দেখতে পারে না। শুধু ছোট শাশুড়ীর সঙ্গে তার মিলমিশ। ছোট শ্বশুরও বেশ স্নেহ করেন।
আফ্রিদা বৌয়ের উগ্র স্বভাব দেখে বুঝতে পেরেছে, এই বৌ নিয়ে সে যেমন সুখী হতে পারবে না, তেমনি নাদিমও জীবনে সুখ-শান্তি পাবে না। তবু নতুন বৌ; জ্ঞান কম সেই কথা ভেবে তাকে নিজেদের মতো করে গড়ে নেয়ার জন্য সংসারের কাজকর্ম ধৈর্যের সঙ্গে শেখাতে লাগল। কোনো কিছু ভুল করলে তা সংশোধন করে দেয়। কিন্তু মেজ শাশুড়ী কট কট করে সাজেদাকে কথা শুনিয়ে দেয়। সেজ শাশুড়ীও বলতে কম করে না। কোনো কাজ করতে একটু দেরি করলে বড়লোকের নবাবজাদী বলে খোটা দেয়। সেজ শাশুড়ী খুব মোটা। সংসারের কাজকর্ম তেমন করতে পারে না। কবিরন বিবি চার বৌকে তাদের কাজ নির্দিষ্ট করে দিলেও আবিদা মোটা বলে কিছু করতে পারে না। অন্য জায়েরা করে দেয়। সাজেদা বৌ হয়ে আসার পর আবিদা আগে যতটুকু করত, এখন সে সব সাজেদাকে দিয়ে করায়। আর সে শুয়ে-বসে শুধু আতখাই করে, আল্লাহ আমাকে এমন করল যে, কোনো কাজ করতে গেলে দম বেরিয়ে আসে। আয়মন তাকেও ছেড়ে কথা বলে না। তার আতখাই শুনে বলে, শুয়ে-বসে খেলে মোষের মতো গতর হবে না তো কি হবে!
একদিন আয়মনের কোলের বাচ্চাটা ক্ষিধের চোটে খুব কান্নাকাটি করছে। আয়মন তখন ধান সিদ্ধ করতে চুলোয় জ্বাল দিচ্ছিল। আর আবিদা ঘরের বারান্দায় বসে খেজুর পাতার চাটাই বুনছিল। ছেলের কান্না শুনে আয়মন আবিদাকে শুনিয়ে বলল, চুলোয় জ্বাল দেয়ার মতো লোকও নেই, ছেলেটা ক্ষিধের জ্বালায় কেঁদে কেঁদে খুন হয়ে যাচ্ছে কারো যদি নজরে পড়ে। এই কথা বলে সে দোলনা থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে চুলোয় জ্বাল দিতে দিতে বুকের দুধ খাওয়াতে লাগল। কিন্তু ছেলেটার তখন খুব জিদ উঠে গেছে। সে দুধ মুখে না নিয়ে চিল্লাতে লাগল।
তাই দেখে সাজেদা হাতের কাজ ফেলে রেখে সেখানে এসে বলল, মেজমা আমি জ্বাল দিচ্ছি, আপনি ওকে দোলায় বসে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আসুন।
আয়মনের রাগ আবিদার উপর। সেই রাগ সাজেদার উপর ঝাড়ল। ঝংকার দিয়ে বলল, নিজের কাজ ফেলে রেখে কে তোমাকে দরদ দেখাতে আসতে বলেছে? তুমি তোমার কাজে যাও। আরো তো লোক আছে, তারা কি চোখে কানা, না কানে কালা?
সাজেদা আর কিছু না বলে ফিরে এসে নিজের কাজ করতে লাগল। আবিদা এবার উঠে চুলোর কাছে এসে বলল, মেজ বুবু, তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। আমাকে তো জ্বাল দিতে ডাকলেই পারতে। যাও, বাচ্চাকে থামিয়ে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এস।
আয়মনের রাগ তবু পড়ল না। বলল, ডাকতে হবে কেন, তুই কি বাচ্চার কান্না শুনতে পাস নি। বসে-শুয়ে তো গতরটা দিন দিন ফোলাচ্ছিস।
আবিদা তার হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল, আমার অন্যায় হয়েছে মেজবুবু। তুমি যাও, বাচ্চাটা কেঁদে কেঁদে গলা শুকিয়ে ফেলল।
আয়মন গজর গজর করতে করতে চলে গেল।
আয়মন বিয়ের পর বেশকিছু দিন মৃগী রোগে ভুগেছে। চিকিৎসা করানোর ফলে এবং প্রথম ছেলে হওয়ার পর ভালো হয়েছে। কিন্তু তারপর থেকে সে ভীষণ রাগী হয়েছে। এমনি সে হিংসুটে ধরণের মেয়ে। তারপর মৃগী রোগ হওয়ার পর থেকে সামান্য কারণে খুব রেগে যায়। আর রেগে গেলে কাউকে কিছু বলতে বাকি রাখে না। তাই সে রেগে গেলে সবাই চুপ করে থাকে। তার কথায় কেউই তেমন কিছু মনে করে না। আবিদাও হিংসুটে কিন্তু হঠাৎ রাগে না। তবে বড় অলস। আফ্রিদা সাজেদাকে মেজ শাশুড়ীর মেজাজের কথা বলে তার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে কথা কাটাকাটি করতে নিষেধ করে দিয়েছে।
সাজেদার দাদি হামিদা বানু ফিরে গিয়ে শিহাবকে বললেন, তুই তোর মেয়েকে যেভাবে মানুষ করেছিস সেই রকম ঘরে তার বিয়ে দেয়া উচিত ছিল। সেখানে তাকে অনেক খাটাখাটনি করতে হচ্ছে। বিরাট সংসার। তাদের সংসারে যে সব তরকারী রান্না হয়, সে সব সাজেদা কখনও খায় নি। তোর মেয়ে ঐ সব না খেতে পেরে বেশ রোগা হয়ে গেছে। তুই বোধ হয় কাজটা ভালো করিসনি।
শিহাব বলল, আম্মা, আপনি ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। সব কিছু আস্তে আস্তে সহ্য হয়ে যাবে। মেয়েদের ভালোমন্দ নির্ভর করে স্বামীর উপর। নাদিমকে তো দেখেছেন, অমন ছেলে কয়টা দেখেছেন বলুন দেখি? তাছাড়া ওর শ্বশুর-শাশুড়ীও খুব ভালো।
হামিদা বানু বললেন, তা অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস। অমন স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ী কটা মেয়ের কপালে জোটে। তবে সাজেদার মেজ ও সেজ শাশুড়ীকে তেমন ভালো মনে হল না। তুই কিছুদিন পর গিয়ে সাজেদাকে নিয়ে আসবি।
শিহাব বলল, তাই নিয়ে আসব।
প্রায় দুআড়াই মাস পর শিহাব সারেংপুর গিয়ে মেয়েকে নিয়ে এল। জামাইকেও নিয়ে আসতে চেয়েছিল, তার ছুটি নেই বলে আসেনি। সাজেদার মা সালেহা মেয়ে রোগা হয়ে গেছে দেখে শ্বশুরবাড়ির অনেক কথা জিজ্ঞেস করল। সাজেদা মায়ের কথার উত্তরে যা বলল, তা সবই ভালো। শুধু তরকারী ও খাটা-খাটনি ছাড়া সালেহার খারাপ কিছু মনে হল না। মেয়েকে বুঝিয়ে বলল, সব গৃহস্থবাড়ি সমান না। মেয়েরা বাপের বাড়িতে যেভাবেই মানুষ হোক না কেন স্বামীর বাড়িই তার আসল বাড়ি। প্রত্যেক মেয়ের উচিত নিজেকে স্বামীর বাড়ির সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তোকে সহ্য করার ও সবার সঙ্গে মানিয়ে চলার তওফিক দান করেন।
মাসখানেক পরে স্কুলে ছুটি পড়তে নাদিম শ্বশুরবাড়িতে এসে দুদিন থেকে। সাজেদাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
কবিরন বিবি সংসারের সব দায়িত্ব আফ্রিদাকে বুঝিয়ে দিয়ে সিন্দুকের চাবি তার হাতে তুলে দেয়ার পর থেকে সংসারে যা কিছু আয় হয়, তা সব চার ভাই মিলে আফ্রিদার হাতে দেয়। তারপর সংসারের খরচের দরকার মতো টাকা-পয়সা চেয়ে নেয়। আফ্রিদা কাকে কোন্ খানে কত টাকা দেয় এবং কি কি ফসল বিক্রি করে কত। টাকা জমা রাখে, সে সব প্রতিদিন ঘুমাবার আগে জমা-খরচের খাতায় লিখে রাখে। তাকে সংসারের সব দিক লক্ষ্য রাখতে হয়। সকলের কাপড়-চোপড় কেনা থেকে অসুখ-বিসুখ ডাক্তার ও ওষুধপত্রের খরচ, ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি হওয়া ও তাদের। বই–খাতা কেনা, এমন কি মেহমান-কুটুমের যত্নের দিকেও তাকে লক্ষ্য রাখতে হয়। প্রতিদিন রাতে চার ভাই একসঙ্গে খাবে। তারপর চাষবাসের ব্যাপারে ও সংসারের কেনাকাটার ব্যাপারে বারান্দায় আলোচনা করবে। ততক্ষণে চার জা খাওয়ার কাজ শেষ করে ঘরের মধ্যে এসে বসবে। টাকা-পয়সার দরকার থাকলে ভাইয়েরা আফ্রিদাকে জানাবে। আফ্রিদা আগে খরচের খাতায় লিখবে তারপর দরকার মতো সিন্দুক থেকে বের করে দেবে। কোননা কোনো দিন আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে ছোট জা ফাহমিদার হাতে দিয়ে বলবে, আমি লিখছি তুই সিন্দুক খুলে টাকাটা বের করে দে। আফ্রিদা মাঝে মাঝে ফাহমিদাকে জমা-খরচের হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে খাতা লেখা। শেখায়। ফাহমিদা বনেদী ঘরের জ্ঞানী মেয়ে হয়েও বাপের আর্থিক দুরাবস্থার জন্য ক্লাস এইট থেকে ভালভাবে পাস করে নাইনে উঠে আর পড়তে পারে নি। দুচারদিনের মধ্যে জমা খরচের হিসাব বুঝে নিয়ে বেশির ভাগ দিন সে-ই খাতা লিখে।
নাদিম সকালে ও সন্ধ্যায় কয়েকটা ছেলেকে প্রাইষ্টে পড়ায়। সেই টাকাও এতদিন মায়ের হাতে দিয়ে এসেছে। এবার যখন প্রাইস্টে পড়ানোর টাকা মাকে দিতে গেল তখন আফ্রিদা বলল, ঐ টাকাটা তুই রেখে দে। তোর নিজেরও তো একটা খরচ আছে।
নাদিম বলল, সব খরচ তো তুমিই দাও, আমার আবার খরচ কিসের?
আফ্রিদা হেসে উঠে বলল, পাগল ছেলের কথা শোন। বৌমার কিছু শখ-সাধ হলে কিনে দিবি। সে সব কি আর বৌমা আমাকে বলবে।
তারপর থেকে নাদিম ঐ টাকা নিজের কাছে রাখে। সেই টাকা থেকে সাজেদাকে নানারকম প্রসাধনী ও অন্যান্য টুকটাক জিনিস কিনে দেয়।
এবারে সাজেদা যখন বাপের বাড়িতে ছিল তখন তার সই দীলরুবাও শশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে এসেছে। তার বিয়ে সাজেদার বিয়ের ছমাস আগে হয়েছে। দুজনের বাড়ি কাছাকাছি। তাই বাপের বাড়িতে এসে দুজন দুজনকে পেয়ে মহাখুশি। একে অন্যের স্বামীর কথা, শ্বশুর-শাশুড়ীর কথা এবং শ্বশুর বাড়ির নানান কথা বলাবলি করতে লাগল। দীলরুবার যখন বিয়ের সম্বন্ধ আসে তখন সাজেদা শুনেছিল, পাত্র বাপ মার একমাত্র ছেলে। জমি-জায়গাও অনেক। পাত্র ম্যাট্রিক পাস করে টাউনে ব্যবসা করে। এক সময় সে দীলরুবাকে বলল, তুই তো খুব সুখে আছিস তাই না? অন্য শাশুড়ী নেই, কোনো ননদ নেই, বেশ নির্ঝঞ্ঝাট সংসার।
দীলরুবা বলল, তা যা বলেছিস আল্লাহ আমাকে খুব সুখে রেখেছে। সে জন্য তার দরবারে জানাই লাখ লাখ শুকরিয়া। তারপর বলল, শুনেছি তোর শ্বশুররা চার ভাই এক সংসারে আছে। খুব বড় সংসার তাই না? হ্যাঁ রে, তোর বর তো বি.এ. পাস। খুব চরিত্রবান। তুই ঐদিক দিয়ে খুব ভাগ্যবতী।
সাজেদা বলল, সে শুধু চরিত্রবান নয় গোড়া ধার্মিক। বিয়ে হওয়ার পর থেকে তার কাছে ধর্মের বাণী শুনে শুনে কান ভোতা হয়ে গেছে। একটু এদিক-ওদিক হলেই অমনি কুরআন-হাদিসের কথা আওড়াতে থাকে। আচ্ছা, তুই-ই বল, কেউ কোনো দিন কুরআন-হাদিসের কথা সব মেনে চলতে পারে? না চলেছে। মাঝে মাঝে এইসব নিয়ে বেশ মনোমালিন্য হয়। তবে আমাকে খুব ভালবাসে।
দীলরুবা বলল, তোর ব্ল কি কি ব্যাপারে কুরআন হাদিসের কথা বলে বল তো শুনি?
এই যেমন নামায পড়া নিয়ে। এক ওয়াক্ত নামায কাযা করার উপায় নেই। মাসিক হওয়ার পর পাক হতে এক-আধদিন দেরি করলে, ভি-গলা ব্লাউজ ও পাতলা কাপড় পরলে, ভোরে উঠে ফজরের নামাযের পর কুরআন তেলোয়াত না করলে, প্রতিদিন কিছু কিছু কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা এবং অন্য কোনো বইপত্র না পড়লে। কত আর বলব? এ রকম কত ব্যাপারে যে কত উপদেশ হজম করতে হয় তার ইয়ত্তা নেই।
সাজেদা ও দীলরুবা ছোট বেলা থেকে সই পাতিয়েছে। দুজনে এক সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেছে। কিন্তু দীলরুবা খুব ধার্মিক। ছোটবেলা থেকে ধর্মের যতটুকু জেনেছে ততটুকু মেনে এসেছে। জ্ঞান হওয়ার পর সে আল্লাহর কাছে ধার্মিক স্বামী কামনা করে এসেছে। কিন্তু আল্লাহপাকের কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। তাই যার সঙ্গে তার। বিয়ে হয়েছে সে বেনামাযি, বেরোযাদার, টি ভি, ও টেপের পোকা। বাসায় যতক্ষণ থাকবে ফুল ভলিউমে টেপে গান শুনবে। রাতে টিভি প্রোগ্রাম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘুমাবে না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাঝে-মধ্যে মাগী পাড়ায় যায়। যেদিন যায় সেদিন মদ খেয়ে ঘরে ফেরে। দীলরুবা স্বামীকে কতবার বুঝিয়ে নামায পড়তে বলে টেপ টি.ভি. চালালেও আস্তে চালাতে বলে। এমন কি যখন আযান হয় তখন সে সব বন্ধ করা তো দূরের কথা ভলিউম কমায়ও না। প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখা চাই। কোনো ভালো ছবি হলে চার-পাঁচবার দেখে। একবার দীলরুবাকে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে যখন বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে নিয়ে গেল তখন সে খুব বাধা দিয়ে বলেছিল, আমি কখনও সিনেমা দেখিনি, এখনও দেখব না। এটা খুব গোনাহর কাজ। তার স্বামী শুনেনি। সেদিন দীলরুবা সিনেমা হলের ভিতরে সারাক্ষন কেঁদেছে। বাড়িতে এসে তার স্বামী চড়, কিল ও ঘুঁসি মেরে বলেছিল, তোমার জন্য আজ আমি বন্ধুদের কাছে অনেক অপমান হয়েছি। দীলরুবা স্বামীর মার খেয়ে একটুও প্রতিবাদ করেনি। পায়ে ধরে বলেছিল, তুমি আর কখনও আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেও না, যেখানে গেলে আমি তোমার সম্মান রাখতে পারব না। তারপর কেঁদে কেঁদে মাফ চেয়েছে। তারপর থেকে তার স্বামী তাকে কোথাও নিয়ে যায় না। স্বামীকে ঐসব বদ অভ্যাস ছেড়ে দিয়ে নামায পড়ার কথা বললে মেজাজ দেখিয়ে বলে, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা ঘামিও না। আমি তোমার স্বামী। তুমি আমার স্ত্রী। তোমার কথা আমি শুনব, না-তুমি আমার কথা শুনবে? এত নামায-কালাম পড় আর এটা জান না, স্ত্রীর প্রধান কর্তব্য স্বামীর হুকুম মেনে চলা? কোনোদিন আর আমাকে কোনো উপদেশ দিবে না। নচেৎ তোমার কপালে খারাবি নেমে আসবে। এরপর থেকে সে সুখী। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী তাকে খুব ভালবাসে। এমন কি তার স্বামীর স্বভাব-চরিত্র ঐরকম হলেও ঐ একদিন ছাড়া আর কোনোদিন মারধর করেনি। তাকে অবহেলাও করেনি। দীলরুবার এক এক সময় মনে হয়, তার স্বামী যদি ধার্মিক হত, তা হলে তার মতো ভাগ্যবতী মেয়ে বুঝি আর পৃথিবীতে কেউ হত না।
আজ সাজেদার স্বামী ধার্মিক জেনে দীলরুবার নিজের স্বামীর কথা মনে পড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোর স্বামীর কথা শুনে খুবই আনন্দিত হলাম। কিন্তু তুই অসন্তুষ্ট হচ্ছিস কেন? বরং খুশি হওয়ার কথা। জানিস না বুঝি সংসারের সব রকমের সুখ-শান্তি র চেয়ে স্ত্রীর কাছে স্বামীর চরিত্র ও ধার্মিকতা লক্ষগুন বেশি সুখ-শান্তির? যে মেয়ে এমন স্বামী পায় সে মহাসৌভাগ্যবতী।
সাজেদা বলল, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে-তোর বর তোর মন মতো হয়নি। আমার বরের কথা তো শুনলি, এবার তোর বরের কথা বল শুনি।
দীলরুবা স্বামীর কথা আদ্যোপান্ত সব বলল।
সাজেদা বলল, তা হলে এক কাজ করলে হয় না? আমরা আমাদের স্বামীদেরকে বলে স্বামী-স্ত্রী বদল করার ব্যবস্থা করি আয়। কথা শেষ করে সে হাসতে লাগল।
দীলরুবা রেগে গিয়ে বলল, তোর দীলে কি আল্লাহর ভয় একটুও নেই? এরকম কথা ইয়ার্কি করে বলাও কঠিন গোনাহ।
সাজেদা হাসি থামিয়ে বলল, কি জানি ভাই, ইয়ার্কি করলেও যে গোনাহ হয় তা জানতাম না। তারপর তার নাকে নোলক দেখে বলল, এটা আবার কে দিল? বিয়ের সময় তো তোর শ্বশুররা নোলক দেয়নি?
দীলরুবা বলল, আমার উনি দিয়েছে। নোক পরলে নাকি আমাকে খুব সুন্দরী দেখায়।
সাজেদা ভাবল, আমি যদি মোলক পরি, তা হলে আমাকে আরও বেশি সুন্দরী দেখাবে। তাই নাদিম যখন তাকে নিতে এল তখন তাকে এক সময় জিজ্ঞেস করল, তুমি নোলক পরা পছন্দ কর?
নাদিম বলল, করি। নোলক পরলে তোমাকে আরও সুন্দরী দেখাবে।
তা হলে আমাকে একটা বানিয়ে দেবে? আমি পরব।
ঠিক আছে, চেষ্টা করব।
স্বামীর বাড়িতে এসে সাজেদা স্বামীকে নোলক বানিয়ে দেয়ার জন্য প্রায়ই তাগিদ দিতে লাগল।
.
নাদিমের সাজেদাকে নোলক বানিয়ে দেবার ইচ্ছা থাকলেও টাকার জন্য পারছে। টিউশনীর টাকা থেকে এটা-ওটা কিনে দিয়ে যা বাঁচে সেই টাকা জমিয়ে বানাতে গেলে দেরি হবে। তাই দেব দেব করে কাটিয়ে দেয়।
একদিন রাতে ঘুমাবার সময় মোলক বানিয়ে দেয়ার কথা বলতে নাদিম যখন বলল, দেব তখন সাজেদা স্বামীর মুখে একই কথা বারবার শুনে বলল, দেব দেব তো অনেক দিন বলছ, এখনও কি দেয়ার সময় হয়নি?
নাদিম বলল, বানিয়ে দিতে হলে আরও দেরি হবে। নোলক বানাতে অনেক টাকা লাগবে। অত টাকা আমার কাছে নেই।
কেন, আম্মাকে বললেই তো বানিয়ে দেবে।
আম্মাকে বলেছিলাম। আম্মা বলল, পরে সময় মতো বানিয়ে দেবে।
পরে কেন? আম্মার কাছে তো সংসারের সব টাকা জমা থাকে, সেই টাকা দিয়ে। বানিয়ে দিতে পারেন।
সংসারের সব টাকা যেমন জমা থাকে তেমনি সংসারের সব খরচও তাকে খুব বুঝেসুঝে করতে হয়। কখন কি দরকার হয় তার কোনো ঠিক আছে? আম্মার কথা থাক, আমি টাকা জমিয়ে তোমাকে বানিয়ে দেব।
সাজেদা বেশ রাগের সঙ্গে বলল, বিয়ের সময় এবং আজ পর্যন্ত তোমরা আমাকে গয়না তো দূরের কথা, একটা ভালো জামা-কাপড়ও দাওনি। আমার কি শখ হয় না, স্বামীর বাড়ি থেকে ঐসব পাওয়ার।
নাদিম আহতস্বরে বলল, তোমার কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমাদের একান্নবর্তী সংসার। আব্বা-আম্মা নিজেদের ইচ্ছামতো কিছু করতে পারেন না। তা ছাড়া আমাদের এমন সচ্ছলতাও নেই যে, হঠাৎ করে একসঙ্গে বেশি টাকা খরচ করবে। আম্মা যে কত হিসাব করে সংসার চালাচ্ছে তা তো তুমি দেখতে পাচ্ছ।
সাজেদা বলল, তাই বলে নুতন বৌকে শ্বশুর-শাশুড়ীরা কিছু দেবে না-এ কেমন কথা? এবারে আব্বাদের বাড়িতে অনেকে জিজ্ঞেস করছিল, আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে কি কি গয়না পেয়েছি। আমার তখন যা লজ্জা পেয়েছিল। বুদ্ধি করে বললাম হঠাৎ বিয়ে হয়েছে, তাই তারা গয়না গড়াবার সময় পায়নি। এবারে আব্বাদের ওখানে যাওয়ার আগে কিন্তু দুএকখানা সোনার জিনিস বানিয়ে দিতে হবে। আর সেই সঙ্গে ভালো জামা-কাপড়ও দিতে হবে।
এখন ওসব দিতে পারব না।
দিতে পারবে না কেন? না দিলে আব্বাদের বাড়িতে তোমাদের মান-ইজ্জত থাকবে না।
একটা কাজ করলে থাকবে।
কি কাজ?
যতদিন তোমাকে ঐ সমস্ত জিনিস দেয়া হচ্ছে না, ততদিন আর আব্বাদের বাড়িতে যাওয়ার নাম মুখে আনবে না।
এটা একটা কথা হল নাকি? তোমরা যদি পাঁচ বছর দিতে না পার, তা হলে আমি কি অতদিন আব্বাদের বাড়ি যাব না?
হ্যাঁ, তাই।
আব্বা নিয়ে যেতে এলে কি বলবে?
আমাদের হয়ে তুমি বুদ্ধি করে কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেবে।
কতদিন ঐভাবে আব্বাকে ফেরাব?
যতদিন তুমি ঐসব ছাড়া যেতে পারবে না।
তা হলে বোঝা যাচ্ছে, তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাও।
তা যদি বুঝে থাক, তা হলে তাই।
কিন্তু কেন?
সব কিছু জেনেও ঐসবের বায়না ধরছ বলে?
আমার বায়না ধরা কি অন্যায় হয়েছে?
না, বায়না ধরাটা অন্যায় হয়নি, অন্যায় হয়েছে তড়িঘড়ি চাওয়ার জন্য।
ঠিক আছে, আর কোনোদিন কোনো কিছুর জন্য তোমাকে বলব না।
এটা তুমি রাগের কথা বললে। আচ্ছা, তুমি অত অবুঝ কেন? আমারও কি সখ হয় না, তোমাকে ভালো জামা-কাপড় কিনে দেয়ার? দুখানা গয়না বানিয়ে দেয়ার? আল্লাহপাক যখন রাজি হবেন তখন মনের সাধ পূরণ করব।
ততদিনে বুড়ী হয়ে যাব, তোমার মনের সখ মনেই থাকুক।
নাদিম স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলল, তুমি যখন বুড়ী হবে তখন আমিও বুড়ো হব। সেই সময় দুবুড়োবুড়িতে মনের শখ মিটিয়ে খুব ফুর্তি করব।
সাজেদা স্বামীর মতলব বুঝতে পেরে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, অত আদর আর ইয়ার্কি করতে হবে না, আমার শরীরটা ভালো নেই, ঘুমাব।
নাদিম তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি কি তোমাকে ঘুমাতে বাধা দিচ্ছি নাকি? তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।
সাজেদা চৌধুরী বাড়ির বৌ হয়ে আসার কয়েক মাসের মধ্যে তাকে সবাই অহঙ্কারী ও অসল টাইপের মেয়ে বলে বুঝতে পারল। সাজেদা সবার কাছে বাপের বাড়ির বড়াই করে কথা বলে। এখানে যা খাচ্ছে-পরছে- সেসব বাড়িতে কখনো খাইনি-পরেনি সে কথাও বলে। সংসারে খেটে খেটে সে অনেক ময়লা হয়ে গেছে, তাও বলে। নাদিমের ছোট বোন মমতাজ কোনো সময় ভাবির সঙ্গে গল্প করতে এলে নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যায়। কয়েকবার এরকম হতে মমতাজ ভাবির মনোভাব বুঝতে পেরে চোখভরা অশ্রু নিয়ে চলে যায়।
একদিন আফ্রিদা মেয়েকে ভাবির কাছ থেকে চোখ মুছতে মুছতে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কি রে, কাঁদছিস কেন?
মমতাজ বলল, আমি ভাবির একটু স্নো পাউডার মুখে দিয়েছি বলে যা-তা করে বলল, স্নো-পাউডার মেখে কি আর রূপসী হওয়া যায়? আর কোনদিন যেন না মাখি, ভাইয়া এসে পড়ল, সেও ভাবিকে কিছু বলল না।
আফ্রিদা বৌয়ের আসল রূপ অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে। বৌ যে এরকম করবে তাও টের পেয়েছে। এখন মেয়ের কথা শুনে বলল, কেন ঐ সব ছাই-পাস মাখতে যাস? আর কখনও যাবি না।
বৌকে নিয়ে আফ্রিদার অনেক চিন্তা মাঝে মাঝে তাকে পাশে বসিয়ে কার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে হয় বুঝিয়ে বলে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না। বরং উল্টো শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেয়। আফ্রিদা বুঝতে পেরে বৌমা বৌমা করে ডেকে কথা বলে। একদিন ছেলেকে বলল, তুই বৌমাকে কুরআন-হাদিসের কথা বলে তার কর্তব্য বোঝাবি, নচেৎ তোদের ভবিষ্যৎ জীবনে অশান্তি আসবে। ঠিকমতো নামাযও পড়ে না। আমি বললে দুএকদিন পড়ে। তারপর যেইকে সেই। তুই কি কিছু লক্ষ্য করিস না? তাকে সকলের সঙ্গে নরম মেজাজে মিষ্টি ব্যবহার করতে বলি। কিন্তু সে কথাও সে মোটেই কানে তুলে না। নিজের ইচ্ছামতো সব কিছু করে। মমতাজ ও আবুল খায়েরকে মোটেই দেখতে পারে না। আমি কত বোঝাই, তুইও বোঝাবি।
নাদিম বলল, আম্মা, আমি তোমাদের বৌকে বহুবার কুরআন-হাদিসের কথা বলে বুঝিয়েছি। মহিলা সাহাবীদের ও পুণ্যবতী মহিলাদের কত ঘটনা শুনিয়ে সেইভাবে চলার চেষ্টা করতে বলেছি। কোনো কোনো রাতে এইসব কথা বলে বোঝাতে বোঝাতে ফজরের আযান হয়ে গেছে। কিন্তু যে বুঝতে চায় না, তাকে আর কেমন করে বোঝাব। আজ ছমাস হয়ে গেল, বুঝিয়ে-বুঝিয়ে আমি বিফল হয়েছি। সে কিছুই বুঝতে চায় না। সে খুব একগুঁয়ে স্বভাবের মেয়ে। যেটা নিজে ভালো মনে করে সেটা ছাড়া অন্য কোনো কিছু মানতে চায় না। ঐদিন মমতাজ তার স্নো-পাউডার মেখেছিল বলে তার সাথে রাগারাগি করছিল। আমি সে সময় এসে মমতাজকে রাগারাগি করার কারণ জেনে তার কদর্য মনের পরিচয় পেয়ে হতবাক হয়ে যাই। মমতাজের চোখে পানি দেখে আমি খুব রেগে যাই। রেগে গেলে আমি কি রকম অমানুষ হয়ে যাই তা তো তুমি জান। কিছু অঘটন ঘটিয়ে ফেলতাম। কিন্তু হঠাৎ আল্লাহপাকের রসুল (দঃ)–এর রাগের উপর একটা হাদিস মনে পড়ে যেতে রাগটা দমন করে নিই। মমতাজ চলে যাওয়ার পর তাকে অনেক বোঝালাম। এতদিন তুমিও যেমন বুঝিয়েছ, আমিও কম বোঝাইনি। দিন দিন সে যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ওকে তালাক দেব। আফ্রিদা চমকে উঠে বেশ রাগের সঙ্গে বললেন, কি বললি? আর একবার বল, দেখি বলে তার গালে চড় মারতে গিয়ে হাত তুলে রয়ে গেল। তারপর হাতটা নামিয়ে নিয়ে রাগটা সংযত করার জন্য মাটির দিকে চেয়ে রইল।
নাদিম ভেজা গলায় বলল, মারতে গিয়ে থেমে গেলে কেন আম্মা? বিয়ে করার পর থেকে যে অশান্তির আগুনে জ্বলছি, তোমার হাতের মার খেলে সেই আগুন হয়ত কিছুটা নিভে যেত। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলল, এটা ছাড়া আমি অন্য কোনো পথ দেখছি না, আম্মা। নচেৎ তোমরা যেমন কোনোদিন শান্তি পাবে না তেমনি আমিও পাব না। ওর রূপই ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জান আম্মা, মমতাজ একটু কালো বলে একদিন আমাকে বলল, তোমার ঐ কালোপেত্নী বোনকে বিদায় করবে কি করে? তখন আমি রেগে ওর গালে কয়েকটা চড় মেরে বলেছিলাম, আবার যদি কোনোদিন ঐ রকম কথা বলো, তাহলে চিরজীবনের মতো তার মুখ বন্ধ করে দেব। সে মারের কথা হয়ত তোমরা জেনেছিলে। কিন্ত কেন মেরেছিলাম জাননি। আমি ওকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছি।
আফ্রিদা ততক্ষণে রাগ সংযত করে নিয়েছে। বলল, বৌমার সবকিছু আমি অনেক আগেই বুঝেছি। সেই জন্যে তাকে বোঝাই। আর তুইও বোঝাস। তাতে কোন ফল হচ্ছে না ঠিক কথা, তাই বলে তুই যে সিদ্ধান্তের কথা বললি, তা আর কোনোদিন মুখে উচ্চারণ করবি না। স্ত্রীকে তালাক দেয়া অতি ঘৃণিত কাজ। হাদিসে তালাকের ব্যাপারে আল্লাহপাকের রসুল (দঃ) বলিয়াছেন, সমস্ত হালাল জিনিসের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা অপ্রিয় হল তালাক। খবরদার, ঐ কথা আর কখনও মনে স্থান দিবি না। যদি কখনও মনে উদয় হয়, তখন আউজুবিল্লাহ হি মিনাস শায়তোয়ানের রাজীম ও দোয়া আস্তাগফার পড়বি। নচেৎ শয়তান তোর মনে ঐ কাজের ওয়াস ওয়াসা দিবে। আর শোন, মানুষ জঙ্গলের হিংস্র পশুকে ধরে এনে নিজেদের কথামতো চলার জন্য শিক্ষা দিতে কত রকমের খেলা দেখাচ্ছে। আর তুই একটা মেয়েকে শিক্ষা দিয়ে বসে আনতে পারবি না, এটা কেমন কথা?
নাদিম বলল, কিন্তু,যে নিজেকে অহঙ্কারী ও বেশি জ্ঞানী মনে করে তাকে যতই নসিহত কর না কেন, সে হেদায়েত হয় না।
আফ্রিদা বলল, হেদায়েত করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনি কাকে কখন কোন অসিলায় হেদায়েত করবেন তা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। তুই তার হেদায়েতের জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া চাইবি। আর খুব মিষ্টি কথায় বোঝাবি। হাজার হোক মুসলমানের মেয়ে। কুরআন-হাদিসের কথা শুনতে শুনতে একদিন না একদিন শুধরে যাবেই।
নাদিম বলল, ঠিক আছে-আম্মা, আমি তাই করব।
এরপর থেকে নাদিম সাজেদার পিছনে উঠেপড়ে লাগল। রাতের টিউশনি বন্ধ করে দিয়ে তাকে নানারকম বই পড়াতে চেষ্টা করল। বই পড়ার নেশা ধরাবার জন্য ঘরে যে সমস্ত প্রেমের উপন্যাস ছিল সেগুলো পড়িয়ে শোনাতে লাগল। তারপর পাঠাগার থেকে খুব রসাল প্রেম-কাহিনী এনে তাকে পড়তে বলল। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য সম্বন্ধে বিভিন্ন হাদিস পড়েও শোনাতে লাগল। কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা বিফলে গেল।
একদিন মা ফাতেমা (রাঃ) ও কাঠুরিয়ার স্ত্রীর স্বামীভক্তির কথা বলে তাকে তাঁদের অনুকরণ করার কথা বলতে সাজেদা রেগে গিয়ে বলল, তুমি আমার স্বামী। স্বামী যে পদে পদে স্ত্রীর দোষ ধরে তা কখনো কারো কাছে শুনিনি। আমার সব কিছুই দোষের, আমার কি কোনো গুণ নেই? দোষগুণ নিয়েই তো মানুষ। আমার যেমন দোষ আছে, তেমনি নিশ্চয় গুণও আছে। আর মানুষ হিসাবে তোমারও তো অনেক দোষগুণ আছে। কই, আমি তো তোমার কোনোদিন কোনো দোষ ধরিনি। তা হলে তুমি আমার দোষ ধর কেন? তুমি যদি সব সময় আমার দোষ ধর, তা হলে সারাজীবন আমি তোমার সঙ্গে কাটাব কেমন করে? এইসব বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
নাদিম বলল, তোমাকে দোষী করার জন্য তোমার দোষ ধরিনি। বরং তোমাকে নিজের মনের মতো করে গড়বার জন্য দোষ ধরে সৎ উপদেশ দিই। পুণ্যবতী রমণীদের জীবন চরিত এনে দিই। প্রত্যেক স্বামী চায়, তার স্ত্রী তার মনের মতো হোক। তাই তোমাকে সৎ উপদেশ দিই। সেই উপদেশগুলো আমার নিজের কথা নয়, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (দঃ) এবং মনীষীদের কথা। কোনো সৎ উপদেশ দিলেই তুমি রেগে যাও কেন বলতে পার? তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, জানি তুমি উত্তর দিতে পারবে না। আমি বলে দিচ্ছি শোন, তোমার মধ্যে দ্বীনি এলেম কম, আল্লাহ ও রসুলের (দঃ) পরিচয়ও ঠিকমতো জান না। তাই তাদের কথা শুনলে রেগে যাও। আর সাংসারিক জীবনে তোমার চাচা, চাচি, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপড়শীদের আচার ব্যবহার দেখে যা শিখেছ, তাকেই যথেষ্ট বলে মনে কর। এটা মনে করা ঠিক নয়। আমি তোমার স্বামী। তোমাকে মনেপ্রাণে ভালবাসি। তাই ঐসব বলে তোমার জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিয়ে এবং সেইভাবে চালিত করে তোমাকে আদর্শ বধূ করতে চাই। আর তুমি মনে কর, আমি তোমাকে দেখতে পারি না, ভালবাসি না। তাই তোমার দোষ ধরে সব সময় উপদেশ দিই। এটা তোমার ভুল ধারণা। মানুষ দুশমনকে দেখতে পারে না। তাই সব সময় তার দোষ-ক্রটি অন্বেষণ করে। তুমি তো আমার দুশমন নও। তোমাকে আমি ভালবাসি কিনা তা তুমি নিশ্চয় জান। তবু তুমি আমার কোনো উপদেশে কান দাও না কেন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো।
সাজেদা কাঁদতে কাঁদতে বলল, শুধু তুমি আমাকে ভালবাস? আমি কি বাসি না? তোমার কোন হুকুম শুনিনি বলতে পার?
নাদিম বলল, আমি তো বলিনি, আমার হুকুম মান না, আমাকে ভালবাস না। তবে যে ভালবাসার কথা আমি বলছি তা তোমার জানা নেই। ভালবাসা কাকে বলে শুনবে? কেউ কাউকে ভালবাসলে, একে অপরের কথা মেনে চলা তো দূরের কথা, প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার একটা বাস্তব ঘটনা বলছি, আমার সেজ খালাদের গ্রামে একবার ভীষণ কলেরা দেখা দেয়। যে বাড়িতে যার কলেরা হচ্ছে সে-ই মারা যাচ্ছে। সেই সময় আমার মেজ খালার এক দেবরের কলেরা হল। ভয়ে গোটা বাড়ি ছমছম করছে।.দুপুরের দিকে দুতিনবার পায়খানা হওয়ার পর বমি করতে লাগল। সেজ খালা রান্না করছিল। রান্না হয়ে যাওয়ার পর দেবরকে দেখতে গিয়ে যা দেখল তাতে সে ভয়ে ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। স্বামী খাটে বসে বমি করছে আর তার স্ত্রী মেঝেয় বসে দুহাত পেতে সেই বমি ধরছে আর খেয়ে নিচ্ছে। বিস্ময় ভাবটা কাটিয়ে মেজ খালা ছুটে শাশুড়ীকে কথাটা বলল। শাশুড়ী তাড়াতাড়ি এসে বৌয়ের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনবার সময় বললেন, এ কি করছিস হতভাগী, তোর কি জানে ভয় নেই? মেজ খালার জা শাশুড়ীর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্বামীর কাছে ছুটে এসে বলল, আপনাদের জানের ভয় থাকলেও আমার নেই। আমার স্বামী বাঁচবে না, আর আমি বেঁচে থাকব, এটা হতে দেব না। আল্লাহ পাকের কি অপার কুদরত সে যাত্রা মেজ খালার দেবর বেঁচে গেল আর তার স্ত্রীরও কিছু হল না। এই ঘটনা আমার মেজ খালার মুখে শুনেছি। দেখলে তো স্বামী-স্ত্রীর কি গভীর সম্পর্ক! আজকালের মেয়েরা স্বামীকে কি এত গভীরভাবে ভালবাসতে পারে? যদি পারত তা হলে তারা এ দুনিয়াতেই বেহেশতের নমুনা দেখতে পেত।
সাজেদা বলল, আগের যুগে ওরকম লাখে এক-আধটা দেখা গেছে। এখনকার মানুষ ঐ সব শুনলে গালগল্প মনে করবে।
নাদিম বলল, স্বামী-স্ত্রীর গভীর প্রেমের কাহিনী আগের যুগে যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে। তবে তাদের সংখ্যা কম। তাই মানুষ তাদের খোঁজ খবর পায় না। এসব থাক, ঘুমিয়ে পড় অনেক রাত হয়েছে।
এরপর থেকে নাদিম স্ত্রীর জন্য যা কিছু কিনে সব ডবল। বাড়িতে এসে মমতাজের হাতে দিয়ে বলে এগুলো তোর ভাবির কাছে নিয়ে যা। সে তার পছন্দমতো নেয়ার পর তুই নিবি।
হঠাৎ একদিন নাদিমের দাদি কবিরন বিবি জ্বর হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ছেলেরা ডাক্তার নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতে লাগল। কিন্তু কিছুই হল না। জ্বরে অজ্ঞান থাকা অবস্থায় তিন দিনের দিন তিনি মারা গেলেন। উনি মারা যাওয়ার দুমাস পর রমজান মাস এসে গেল।
প্রতি বছর রমজান মাসের তিন তারিখে একবার বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব নিকাশ হয়। হিসাবের পর কত টাকা জাকাত দিতে হবে, কত টাকা ফেতরা দিতে হবে এবং সবার জামা-কাপড় কেনার ব্যাপারে বাজেট তৈরি হয়। এ বছরও রমজানের তিন তারিখে তারাবীর নামাযের পর চার ভাই ও চার জা হিসাব-নিকাশে বসল। আগে নাদিম কোনোদিন এর মধ্যে থাকেনি। এবার তাকেও ডাকা হয়েছে।
জাকাত-ফেতরার হিসাবের পর যখন জামা-কাপড় কেনার বাজেট হচ্ছিল তখন কুদ্দুসের স্ত্রী ফাহমিদা বলল, বৌমাকে ঈদে ভালো জামা-কাপড় দিতে হবে। আর সেই সঙ্গে হাতের দুগাছা সোনার বালাও দিতে হবে। বিয়ের সময় বৌমাকে তো গয়না দেয়া হয়নি। বড় বুবু তার নিজের কানের দুল বৌমাকে দিয়েছে।
তার কথা শুনে কেউ কিছু বলার আগে সুলতান বলল, অবশ্যই দিতে হবে। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা কি বল?
আজিজ বলল, কিন্তু একসঙ্গে এতকিছু করলে তহবিল শূন্য হয়ে যাবে।
কুদ্দুস বলল, হোক শূন্য। তবু করতে হবে। আজ প্রায় সাত-আট মাস হল ও বৌ হয়েছে। এখনও যদি তাকে আমরা কিছু না দিই, তা হলে লোকে কি বলবে? তাছাড়া বাপের বাড়িতে বৌমার একটা প্রেসটিজ বলে কথা আছে।
এরপর আর কেউ কিছু না বলে সম্মতি দিল।
সবকিছু মিটে যওয়ার পর আফ্রিদা বলল, আমি এখন তোমাদের কাছে যে কথা বলব তা তোমরা ভেবে-চিন্তে উত্তর দেবে। আমি সংসারের সব দিক লক্ষ্য রাখতে হিমশিম খেয়ে যাই। তার উপর এই টাকা-পয়সা ও আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে মাঝে জমা-খরচ লিখতে ভুলে যাই। আম্মা ইন্তেকাল করার পর আমার মনের অবস্থা ভালো নেই। এ সমস্ত ঝক্কি ঝামেলা আর সামলাতে পারছি না। তাই আম্মা যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন, সেই দায়িত্ব অন্যকে দিতে চাই। কাকে দেব তোমরা ঠিক কর।
রহিম ছাড়া অন্য তিন ভাই চমকে উঠে একসঙ্গে বলে উঠল, তোমাকে সংসারের কোনো দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে না। তুমি শুধু হিসাব-নিকাশের দিকটা সামলাবে।
আফ্রিদা মৃদু হেসে বলল, তোমরা তো বলেই খালাস। আমি না দেখলে এত বড় সংসারের সবকিছু কে দেখবে? মেজ, সেজ ও ঘোটর কাজ আম্মা নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন? তারা সেগুলো সামলাবে, না ঐসব দিকে লক্ষ্য রাখবে? তার চেয়ে আমি যেভাবে সংসারের সবকিছু দেখছি, সেভাবেই দেখে যাব। শুধু জমা-খরচের ও টাকা পয়সার হিসাব অন্য কাউকে দেয়ার ব্যবস্থা কর।
বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।
আফ্রিদা বলল, কি হল? তোমরা কিছু বলছ না কেন?
সুলতান বলল, ভাবি তুমি যখন আমাদের কথা শুনবে না তখন তুমি যাকে উপযুক্ত মনে কর তাকেই এই কাজের ভার দাও।
সাথে সাথে আজিজ ও কুদ্দুস বলে উঠল, মেজ ভাই, তুমি ঠিক কথা বলেছ।
আফ্রিদা বলল, আমি ছোটকে জমা-খরচের হিসাব শিখিয়েছি। তোমরা যদি রাজি থাক, তা হলে এই কাজের ভার আমি তার উপর দিতে চাই।
নাদিম এতক্ষশ কোনো কথা বলেনি। এবার সে বলল, আম্মার কথা আমি সমর্থন করলাম।
নাদিমের কথা শেষ হতে না হতে ভাইয়েরা ও জায়েরা কলল, আমরাও মেনে নিলাম।
শুধু সুলতানের স্ত্রী আয়মন চুপ করে রইল।
কুদ্দুস তা লক্ষ্য করে বলল, মেজ ভাবি কিছু বলছ না কেন?
আয়মন মনে করেছিল, বড় বুবু তার উপর ঐ কাজের ভার দিবে। তাকে না দিয়ে ছোটকে দিতে সে খুব রেগে গেছে।
কুদ্দুস বলার পরও যখন আয়মন কিছু বলল না তখন আফ্রিদা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিরে মেজ, কিছু বলছিস না কেন? সবার নিজস্ব মতামত বলার অধিকার আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) দিয়েছেন। তার কিছু বলার থাকলে বল, চুপ করে আছিস কেন? তবু যখন আয়মন কিছু বলল না তখন আফ্রিদা তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বলল, তুই যদি এই কাজের ভার নিতে চাস তা হলে আমি দিতে রাজি আছি।
সুলতান বলল, তা কি করে হয়? ও এত হিসাবপত্র রাখতে পারবে না। না-না, ও কিছু নাই বলুক। তুমি ও আমরা সবাই ছোট বৌয়ের হাতে এই কাজের ভার যখন দিতে চাই তখন একজন না চাইলেও কোনো অসুবিধে নেই।
আফ্রিদা বলল, এতে মনে কষ্ট পাওয়ার কি আছে? যে যে কাজের উপযুক্ত, তাকে সেই কাজের ভার দেয়া উচিত। মেজ ভাবি সে কথা নিশ্চয় জানে।
কুদ্দুস বরাবর একটু ঠোঁটকাটা। বলল, মেজ ভাবি যা রাগি, যদি তার কাছে ক্যাশ থাকে তা হলে কেউ টাকা-পয়সা চাইলে তাকে লাঠি নিয়ে দৌড়াবে।
তার কথা শুনে আফ্রিদা ছাড়া সবার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
আফ্রিদা গম্ভীর স্বরে বলল, বড় ভাইদের সামনে ফাজলামি করছিস। সেজ ভাই ওর কানটা ভালো করে মলে দাও তো বেয়াদব কোথাকার!
সেজ ভাইকে আর কষ্ট করতে হবে না বলে কুদ্দুস নিজের কান নিজে মলে বলল, দোহাই বড় ভাবি, মেজ ভাবিকে ক্যাশের চাবি দিও না। কথা শেষ করে উঠে চলে গেল। কারন সে জানে ভাইয়েরা কখনও তার কান মলেনি। ন্যায়-অন্যায় করলে বড় ভাবি ছোটবেলা থেকে কান মলে লাল করে দেয়। বিয়ের পর দুছেলের বাপ হয়েও তাকে মাঝে-মধ্যে বড় ভাবির হাতের কান মলা খেতে হয়। এখানে থাকলে সবার সামনেই বড় ভাবি উঠে এসে কান মলে দেবে। তাই সে সরে গেল।
কুদ্দুসকে উঠে চলে যেতে দেখে আফ্রিদা বলল, ওটা বরাবর জানোয়ার রয়ে গেল। দুছেলের বাপ হল, তবু মানুষ হল না। তারপর চাবির গোছা নিজের আঁচল থেকে খুলে আয়মনের হাতে দিয়ে বলল, হয় তুই রাখ, নচেৎ তোর যাকে মন চায় তাকে দে।
আয়মন সাংসারিক ব্যাপারে অনেক সময় সামান্য কারনে পায়ের উপর পা দিয়ে সব জাদের সঙ্গে ঝগড়া করে। সব জায়েরা মাতলেও আফ্রিদা কোনোদিন মাতেনি এবং রাগও করেনি। অনেক সময় বড় জায়ের সঙ্গে শুধু শুধু ঝগড়া করে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আফ্রিদা যখন বেঁচে তার সঙ্গে কথা বলতে যায় তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে মাফ চেয়ে নেয়। আসলে আয়মনের বুঝশক্তি কম আর মাথা গরম। এখন বড় জা যখন হিসাব-নিকাশ ও সিন্দুকের চাবি ফাহমিদাকে দিতে চাইল তখন সে স্বভাবগত কারণে হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। স্বামীর কথা শুনেও খুব রেগে গিয়েছিল। তাই আফ্রিদা তার মতামত জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতে পারেনি। শেষে চাবির গোছা হাতে দিয়ে বড় জা যে কথা বলল তা শুনে ভুল বুঝতে পারল। আরও বুঝতে পারল, সারা বছর জমা খরচের হিসাব-নিকাশ রাখা খুব কঠিন ব্যাপার। তা না হলে বড় বুবু এই কাজ অন্যকে দিতে চাচ্ছে কেন? নিজের ভুল বুঝতে পেরে চাবির গোছা আফ্রিদার হাতে ফেরত দিয়ে বলল, অত ঝক্কি-ঝামেলার কাজ আমার দ্বারা হবে না। আমাদের সবার মধ্যে ছোটই উপযুক্ত। তুমি এটা ওকেই দাও।
নাদিম বলে উঠল, মেজ মা, তুমি ঠিক কথা বলেছ। ছোট মার মতো মেয়েই এই কাজ ঠিকমতো করতে পারবে। তাই তো আমি আম্মাকে প্রথম সমর্থন করি।
কুদ্দুস ও নাদিম সাত বছরের ছোট-বড়। চাচা-ভাইপো যখন এক সঙ্গে থাকে তখন একটু-আধটু ইয়ার্কি-ফাজলামিও করে। কুদ্দুস এতক্ষণ বড় ভাবির কানমলা খাবার ভয়ে উঠে গিয়ে উঠোনের একদিকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল। নাদিমের কথা শুনে এগিয়ে এসে বলল, ভাইপো বি.এ. পাস করে মাস্টারি করলে কি হবে, বুদ্ধিশুদ্ধি এখনও হল না। তারপর নাদিমের নাম ধরে বলল, তুই যে ছোট মার অত সাপোর্ট করছিস, তার কোয়ালিফিকেশান জানিস?
ছোট চাচার বৌ দেখতে নাদিমও গিয়েছিল। সে সময় জেনেছিল ম্যাট্রিক ফেল। তাই বলল, কেন জানব না, ছোট মা তো ম্যাট্রিক ফেল।
কুদ্দুস বলল, দুর বোকা, কার কাছে শুনেছিস? তোর ছোট মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, ক্লাস এইট পাস।
আফ্রিদা রেগে উঠেকুন্দুসকে বলল, নাদিমের বুদ্ধি শুদ্ধি হয়নি, আর তুই বুঝি খুব জ্ঞানী হয়েছিস? তারপর স্বামী ও দেবরদের উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা যদি ওর কান মলতে না পার, তা হলে ধরে নিয়ে এস, আমি ওর কান মলে দেখব ও কতটা জ্ঞানী হয়েছে।
কুদ্দুস তাড়াতাড়ি বলে উঠল, কথাটা বলে অন্যায় করে ফেলেছি। মাফ করে দাও বড়ভাবি। আর কখনও এরকম অন্যায় করব না।
আফ্রিদা বলল, কথাটা মনে রাখবি। তারপর ছোট জায়ের আঁচলে চাবির গোছা বেঁধে দিয়ে বলল, আমি বৌ হয়ে আসার ছমাস পর আম্মা যে কাজের ভার আমার উপর দিয়েছিলেন তা ঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি কিনা আল্লাহ পাক জানেন। তোকে আমি আজ সেই কাজের ভার দিলাম। তুই আল্লাহকে হাজীর-নাজীর জেনে এই দায়িত্ব ঈমানদারীর সাথে পালন করবি।
ফাহমিদা অন্য জাদেরকে বড় বোনের মতো মনে করলেও বড় জাকে মায়ের মতো মনে করে। আঁচল গুছিয়ে গায়ে দিয়ে ভাসুরদেরকে, স্বামী ও জাদেরকে কদমবুসি করে বলল, আপনারা দোয়া করুন, আমি যেন বড়বুবুর কথামতো এই কাজ করতে পারি।
আফ্রিদা বলল, এবার সব যাও ঘুমিয়ে পড়। আবার তো সেহরী খেতে উঠতে হবে।
এরপর আর কেউ কিছু না বলে একে একে সবাই উঠে চলে গেল।
ঘুমাবার সময় কুদ্দুস স্ত্রীকে বলল, তুমি খুব ভাগ্যবতী। চৌধূরী বাড়ির ক্যাশের চাবি এখন তোমার হাতে। তারপর দুষ্টুমি করে বলল, যাক ভালই হল, মাঝে মাঝে তোমার কাছ থেকে টাকা ঝাড়া যাবে।
ফাহমিদা জানে তার স্বামী সব ভাইয়ের চেয়ে খুব হিসেবী। সংসারের উন্নতির দিকে তার খুব লক্ষ্য। তাই স্বামীর কথা শুনে বুঝতে পারল, দুষ্টুমি করছে। সে দুষ্টুমি করার ইচ্ছাটা চেপে রেখে অভিমান কণ্ঠে বলল, সবার সামনে আমি এইট পাস বলে অপমান করলে কেন?
কুদ্দুস খুব সরল ও সাদাসিধে। তাই তখন কোনো কিছু চিন্তা না করে বলে ফেলে বুঝতে পেরেছিল, কথাটা বলা ঠিক হয়নি। এখন স্ত্রীর কথা শুনে বলল, ভুল করে বলে ফেলেছি। তাই তো সবার সামনে মাফ চেয়েছি। তুমিও মাফ করে দাও।
ফাহমিদা বলল, যাও; স্বামী বলে মাফ করে দিলাম, কিন্তু টাকা ঝাড়ার কথা যে বললে সে গুড়ে বালি।
কেন?
টাকা ঝাড়তে হলে ক্যাশিয়ারকে তোষামোদ করে চলতে হবে। সে যা বলবে তক্ষুনি তা পালন করতে হবে।
কুদ্দুস স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলল, তা হলে এক্ষুনি হুকুম করে দেখ পালন করি কিনা।
শুধু আদর করলে কি আর কাজ হয়? তার সঙ্গে আরো কিছু করতে হয়।
সেই কাজটা কি বলে দেখ না করি কিনা।
এই দুষ্টু, সে কাজের কথা বুঝি মুখে বলা যায়?
না বললে বুঝব কি করে?
না যদি বুঝতে পার, তা হলে চুপচাপ শুয়ে পড় বলে ফাহমিদা স্বামীকে ঠেলে পাশ ফিরে শুয়ে বলল, এটাই আমার প্রথম হুকুম।
এতবড় শাস্তি দিতে পারলে?
না দিয়ে উপায় নেই। রোযার মাস মনে নেই বুঝি।
কুদ্দুস বলল, সরি, সে কথা আমার খেয়াল ছিল না।
.
বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা, একদিন সাজেদা মেজ শ্বশুরের বড় ছেলে ইলিয়াসের সঙ্গে খুব ইয়ার্কি করছিল আর হেসে হেসে উল্টে পড়ে যাচ্ছিল।
ইলিয়াস এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। আজ কলেজ বন্ধ। তাই সকালে নাশতা খাওয়ার পর সাজেদার ঘরে এসে গল্প করছিল। সাজেদার সাথে ইলিয়াসের বেশ ভাবসাব। প্রায়ই তারা অবসর সময়ে গল্প করে। সেদিন গল্প করতে করতে ইলিয়াস কলেজের একটা ঘটনা বলার সময় দুজনেই হাসছিল। কিন্তু সাজেদা একটু বেশি হাসছিল।
আয়মন ছেলেকে সাজেদার সঙ্গে নিরিবিলিতে গল্প করতে আগে অনেকবার দেখেছে। তখন কিছু না বললেও মনে মনে অসন্তুষ্ট হয়েছে। আজ তাদের অট্টহাসি শুনে খুব রেগে গিয়ে রুমের বাইরে ছেলেকে ডেকে বেশ রাগারাগি করে বলল, তুই তোর ভাবির সঙ্গে অত ইয়ার্কি করসিস কেন? বেহায়ার মতো অত হাসাহাসিই বা করছিস কেন? তোর বাপ-চাচারা দেখলে কি মনে করবে। সাজেদাকে দরজার কাছে আসতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাকেও বলি বৌমা, ঘরের বৌ হয়ে এরকম হাসতে তোমার লজ্জা করে না, তোমার শ্বশুররা শুনলে কি মনে করবে? লেহাজ-তামিজ বলতে তোমার কি কিছুই নেই? তারপর ছেলেকে বললেন, তুই লেখাপড়া করে অমানুষ হচ্ছিস। আর কোনদিন বৌমার সঙ্গে ইয়ার্কি-ফাজলামি করবি না। চলে যা এখান থেকে।
ইলিয়াস বলল, আম্মা ভাবির সঙ্গে একটু হাসিঠাট্টা করলে দোষ হবে কেন?
হাসিঠাট্টারও একটা সীমা আছে।
আমরা কি সীমা ছাড়িয়ে গেছি?
তুই কলেজে পড়ে বহুৎ বেয়াদব হয়েছিস। মায়ের মুখে মুখে তর্ক করছিস।
সাজেদা মেজ শাশুড়ীর কথায় খুব রেগে গিয়ে বলল, মেজ মা, আপনাদের মন এত নীচ তা জানতাম না।
সাজেদার কথা শুনে আয়মনের মাথা গরম হয়ে গেল। বেশ জোর গলায় বলল, তুমি বৌ হয়ে শাশুড়ীর দোষ ধরছ, এতবড় সাহস তোমার? যোয়ান দেবরের সঙ্গে হাসাহাসি ঢলাঢলি করা খুব বাহাদুরি, তাই না? নাদিম ঘরে আসুক তোমার বেহায়াপনা বের করব।
সাজেদা আরো রেগে গিয়ে বলল, সে আমার কি করবে?
নাদিম যখন তার মাকে সাজেদাকে তালাক দেয়ার কথা বলেছিল তখন আয়মন সেখান থেকে যাওয়ার সময় সে সব কথা শুনেছিল। এখন সে কথা মনে পড়তে রাগের মাথায় বলে ফেলল, একবার তো নাদিম তোমাকে তালাক দিতে চেয়েছিল, বড় বুবু বুঝিয়েছে বলে তোমাকে নিয়ে ঘর করছে। এইসব শুনলে যা করবে তা বুঝতে পারবে।
সাজেদা বলল, দিক না তালাক, আপনাদের ছেলে যদি আমাকে তালাক দিয়ে নতুন বৌ পায়, তা হলে আমারও নতুন স্বামী পেতে অসুবিধে হবে না।
আফ্রিদা রান্না করছিল। তাদের কথা কাটাকাটি শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি সেখানে আসার সময় বৌয়ের কথা শুনে যেমন খুব অবাক হল তেমনি রেগে গেল। কাছে এসে সাজেদাকে ধমক দিয়ে বলল, এ কি কথা বলছ? এত বড় স্পর্ধা তোমার? ছিঃ ছিঃ তুমি লেখাপড়া জানা মেয়ে হয়ে এই কথা বলতে পারলে? শাশুড়ীদের সঙ্গে কি রকমভাবে কথা বলতে হয় তাও জান না?
সাজেদা শাশুড়ীর কথা শুনে আরো রেগে গিয়ে বলল, আমরা লেখাপড়া করেছি বলে আমাদের মন অত নীচ নয়। আপনারা যদি লেখাপড়া করতেন তা হলে আপনাদের মন অত নীচ হত না।
আফ্রিদা বৌয়ের সাহস দেখে খুব রেগে গেল। বলল, আর তুমি বুঝি কলেজে ইউনিভার্সিটির সব ডিগ্রী নিয়ে এসে বেহায়াপনা ও বেয়াদবি করে উচ্চ মনের পরিচয় দিচ্ছ? এতদিন ছেলেমানুষ ভেবে তোমার অনেক অন্যায় ক্ষমা করেছি, আর নয়। এবার মুখ সামলে কথা বলো, নচেৎ-বলে কথাটা আর রাগে শেষ করতে পারল না।
নাদিমের ছোট ভাই রউফ বাতেনের স্ত্রী রহিমাকে গিয়ে বলল, বড় চাচি জলদি চল, ভাবী, আম্মার সঙ্গে ঝগড়া করছে।
রহিমা শুনে তাড়াতাড়ি করে যখন এল তখন সাজেদা বলছে, নচেৎ কি করবেন? মারবেন? আগের যুগে মুর্থ শাশুড়ীরা বৌদের উপর অনেক অত্যাচার করেছে কিন্তু এখন আর সেসব চলবে না।
রহিমাও এতদিনে স্বামীর বন্ধুর মেয়ের স্বভাব-চরিত্র জেনেছে। কাছে এসে তার একটা হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, চুপ কর বেয়াদব মেয়ে। তুমি বৌ হয়ে শাশুড়ীদের দোষ ধরে তাদের সঙ্গে ঝগড়া করছ? তোমার সাহসের বলিহারি। শাশুড়ীর মুখের উপর কথা বলতে তোমার এতটুকু বাঁধল না? তুমি কি জান তোমার শাশুড়ীর পরিচয়? এখানকার সব থেকে ধনী লোকের মেয়ে। ম্যাট্রিকে পাঁচটা লেটার নিয়ে ফাস্ট ডিভিশানে পাস করেছে। এই বংশের শ্রেষ্ঠ গৃহিণী, আমরা ছোট-বড় সবাই তাকে মেনে চলি। আর তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে দুদিন বৌ হয়ে এসে তার সঙ্গে ঝগড়া করছ? আজ পর্যন্ত সে কারো সঙ্গে ঝগড়া করা তো দূরের কথা, কথা কাটাকাটি পর্যন্ত করে না। কেউ তার গলার আওয়াজ শুনেনি। আজ প্রথম আমরা শুনলাম। তোমার বাপকে খবর দিয়ে আনিয়ে এর একটা বিহিত করব। নাদিম যে ধরনের ছেলে, এসব শুনলে তোমাকে আস্ত রাখবে না।
সাজেদা রহিমাকে চাচি আম্মা বলে ডাকে, তাকে একটু ভয়ও করে। তার কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল। আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
রহিমা তাকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে অনেক বোঝাল, শেষে শাশুড়ীর ও মেজ শাশুড়ীর পায়ে ধরে মাফ চাইতে বলে চলে গেল।
নাদিম ছাত্র পড়িয়ে ফিরে এলে আয়মন ভাসুরপেপাকে ঘটনাটা জানাল।
শুনে নাদিম অত্যন্ত রেগে গেল। স্কুলে পরীক্ষা চলছে, তাকে যেতেই হবে। তাই রাগটা সামলে নিয়ে বলল, আমার এখন সময় নেই। স্কুলে যেতে হবে। স্কুল থেকে ফিরে যা করার করব।
নাদিম গোসল করে ভাত খেয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় সাজেদাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি মেজ মা ও আম্মার সঙ্গে নাকি ঝগড়া করেছ?
সাজেদা ভেবে রেখেছিল, স্বামী ফিরলে তাকে সত্য-মিথ্যা করে ঘটনাটা বলে নিজের সাফাই গাইবে। কিন্তু তার আগেই শাশুড়ী ছেলেকে জানিয়েছে জেনে খুব রেগে গেলেও নরম সুরে বলল, হ্যাঁ,করেছি। কিন্তু কেন করেছি তা কি শুনেছ? আমি ইলিয়াস ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলছিলাম বলে…
নাদিম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সে কথাও আমি শুনেছি। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই এখন কিছু বললাম না। যা বলার, যা করার এসে করব। তবে তোমাকে একটা কথা বলে যাচ্ছি, আমি চলে যাওয়ার পর আম্মা ও মেজ মার পায়ে ধরে মাফ চেয়ে নিও। তারা যদি কিছু বলে, তা হলে তুমি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকবে আর যদি তা না কর, তা হলে তোমার পরিণতি খুব খারাপ হবে। কথাটা দুতিনবার রিপিট করে স্কুলে চলে গেল।
নাদিম চলে যাওয়ার পর সাজেদা বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাগে ফুলতে লাগল। সংসারের কাজ তো করলই না, এমন কি গোসল ও খাওয়া-দাওয়া না করে শুয়ে রইল।
সকলের খাওয়া দাওয়ার পর চার জা যখন একসঙ্গে খেতে বসল তখন বৌ আসছে না দেখে আফ্রিদা ছোট জাকে বলল, যা তো বৌকে ডেকে নিয়ে আয়।
ফাহমিদা নাদিমের ঘরে এসে দেখল, সাজেদা ঘুমোচ্ছে। পাশে বসে গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে বলল, সাজেদা উঠে পড়ে মা ভাত খাবে চল। সাজেদার সঙ্গে ফাহমিদার খুব ভাব, তার উপ্র দুজনের বয়সও প্রায় কাছাকাছি। তাই ফাহমিদা তার নাম ধরে ডাকে। সাজেদা জেগে গিয়ে বলল, ছোট মা, তোমরা খেয়ে নাও, আমি খাবনা।
আফ্রিদা জাদেরকে বলল, তোরা খাওয়া শুরু কর, আমি বৌকে ডেকে নিয়ে আসি। তারপর ঘরে এসে সাজেদাকে শুয়ে থাকতে দেখে বলল, এস বৌমা, ভাত খাবে এস। ভাতের উপর রাগ করতে নেই।
স্বামী স্কুলে যাবার সময় যখন ঝগড়ার কথা জিজ্ঞেস করে তখন সাজেদা মনে করেছিল, ছেলে ঘরে আসতেই শাশুড়ী তাকে সবকিছু লাগিয়েছে। তাই শাশুড়ীর উপর রেগে ছিল। এখন ডাকতে এলে কিছু না বলে চুপ করে রইল।
আফ্রিদা বলল, বৌমা তুমি কি আমার কথা শুনবে না?
সাজেদা রাগের সঙ্গে বলল, বৌমা বৌমা করছেন কেন? আমাকে আপনারা এ বাড়ির বৌ বলে মনে করেন নাকি? করলে এরকম হেনস্থা করতে পারতেন না। আমি কি এমন করেছিলাম, যার জন্য এতকিছু আমাকে শুনতে হল?
আফ্রিদা বৌয়ের কথা শুনে রেগে গেলেও সংযত স্বরে বলল, তুমি ছেলেমানুষ তোমার বুদ্ধি শুদ্ধি কম। তা ছাড়া নিজের দোষ নিজে কেউ ধরতে পারে না। তাই আমরা…।
সাজেদা তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে উঠে বসে ঝংকার দিয়ে বলল, আমি হয় ছেলেমানুষ, বুদ্ধি-শুদ্ধি আমার কম। কিন্তু আপনারা তো বড় এবং জ্ঞানী, তবে কেন আমাকে যা-তা বলে ঝগড়া করলেন? আসলে আপনারা কেউ আমাকে দেখতে পারেন না। তাই সব সময় আমার দোষ খুঁজে বেড়ান। আব্বা কি দেখে যে এ বাড়িতে আমার বিয়ে দিল, ভেবে পাচ্ছি না।
আফ্রিদা এতক্ষণ রাগ সামলে রেখে কথা বলছিল। এবার বেশ রাগের সঙ্গে বলল, তুমি এক ফোঁটা দুধের বাচ্চা মেয়ে হয়ে বেয়াদবের মতো বড়বড় কথা বলতে শিখেছ, তোমার বাপ-মা কি তোমাকে আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়নি?
সাজেদা রাগে চিৎকার করে বলল, আমার বাপ-মা তুলে কথা বলবেন না। আপনারা যে রকম মানুষ, আপনাদের সঙ্গে আবার কি আদব রেখে কথা বলব?
আফ্রিদা ভাবল, এই অবুঝ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলা বৃথা। বলল, ঠিক আছে, আমাদের সঙ্গে তোমার কথা বলার দরকার নেই, নাদিম আসুক, যা করার সে করবে।
সাজেদা বলল, হা হা, তাকে তো একবার সত্য-মিথ্যা বানিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, এলে আবার বলবেন। কি করে আমিও দেখব।
আফ্রিদা বলল, আমি নাদিমকে বলেছি, একথা তোমাকে কে বলল?
সাজেদা বলল, কে আবার বলবে? আমি কি এতই বোকা, এই সামান্য জিনিসটা বুঝব না?
আফ্রিদা বলল, আমি বলিনি, তবে এবার বলব।
সাজেদা বলল, তাই বলুনগে যান।
আফ্রিদা রাগে গরগর করতে করতে ফিরে এসে দেখল, জাদের খাওয়া শেষ। সে শুধু এক গ্লাস পানি খেয়ে কাউকে কিছু না বলে চলে গেল।
আবিদা বলল, বৌ বোধ হয় বড় বুবুকে যা-তা করে কিছু বলেছে; তাই ভাত খেল না।
ফাহমিদা বলল, বৌটার কপালে আজ কি আছে কি জানি। তারপর তারা যে যার ঘরে চলে গেল।
নাদিমের স্কুলে পরীক্ষার পর একটা মিটিং ছিল। মিটিং শেষ হতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। মাগরিবের নামায পড়ে সে টিউশনি পড়াতে গেল। তারপর ফেরার পথে বন্ধু। আসাদের সঙ্গে দেখা। সে ঢাকায় একটা ভাল চাকরি করছে। তার সঙ্গে সালাম বিনিময় ও কোলাকুলি করার পর নাদিম বলল, কেমন আছিস বল, তোর সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা।
আসাদ বলল, হ্যাঁ এবারে প্রায় চার মাস পর বাড়ি এলাম। তা হ্যাঁ রে, আমি তো একরকম আছি। শুনলাম তুই বিয়ে করেছিস, খুব সুন্দরী বৌ পেয়েছিস। ভালই আছিস কি বলিস?
নাদিম বলল, আল্লাহপাকের রহমতে এক রকম চলে যাচ্ছে। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, না জানিয়ে বিয়ে করেছি বলে মনে কষ্ট পেয়েছিস। অবশ্য পাওয়ার কথা। কি জানিস, বিয়েটা হঠাৎ করে হয়ে গেল। তাই শুধু তোদেরকে কেন, কোনো আত্মীয়স্বজনকেও জানান হয়নি।
আসাদ বলল, তাই নাকি? যাকগে, তুই আজ আমাদের বাড়িতে চল। রোজী তোর কথা বলছিল। তুই নাকি বিয়ে করার পর আর আমাদের বাড়ি যাস নি?
রোজী ঠিক কথাই বলেছে। কিন্তু দোস্ত, আজ যেতে পারব না, অন্যদিন যাব। গেলে খালাআম্মা, রোজী না খাইয়ে ছাড়বে না। আজ বাড়িতে একটু তাড়াতাড়ি ফেরার কথা, কাজ আছে।
কবে আসবি বল?
কাল-পরশু যাব।
কাল না, পরশু আসিস। কাল একটু টাউনে যাব। আমি আম্মাকে ও রোজীকে তোর আসার কথা বলব। ভাবিকেও সাথে করে নিয়ে আসিস। কি রে, আসবি তো?
নাদিম আসাদের পিঠ চাপড়ে বলল, এত করে বলতে হবে না, বললাম তো আসব। তারপর সালাম বিনিময় করে যে যার পথ ধরল। শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নাদিম বাড়িতে অশান্তির জন্য আসাদকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারল না।
বড়রা ছাড়া ছোটরা সবাই খেয়ে নিয়েছে। তারা নাদিমের ফেরার অপেক্ষায় আছে। প্রতিদিন নাদিম ফিরলে তাকে নিয়ে একসাথে চার ভাই খায়। আজ নাদিমের ফিরতে একটু দেরি হল। সে ফেরার পর সবাইকে খেতে দেওয়া হল। আফ্রিদা খাওয়াচ্ছে, আর অন্য জায়েরা এনে দিচ্ছে।
সব ভাইয়েরা তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে আজকের বৌ-শাশুড়ীদের ঝগড়ার কথা শুনেছে।
রহিম শুনে স্ত্রীকে বলেছে, বৌমা ছেলেমানুষ, বুদ্ধিশুদ্ধি কম। তোমাদের উচিত তাকে বুঝিয়ে নিয়ে চলা।
সুলতানও স্ত্রীকে ঐ একই কথা বলেছে।
আজিজ বলেছে, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না, বড় ভাই ও ভাবি কি করে চুপচাপ দেখে যাও।
কুদ্দুস বলেছে, বৌটার জন্য দুঃখ হয়। দেখতে-শুনতে ও লেখাপড়া জানা মেয়ে এ রকম করবে ভাবতে পারছি না। যদি একটু নম্র ও বুঝদার হত, তা হলে কতই না ভালো হত।
ফাহমিদা তখন স্বামীকে বলেছে, তুমি নাদিমকে একটু বঝিয়ে বলল, সে যেন বৌটাকে মারধর না করে।
এখন ভাত খাওয়াবার সময় আফ্রিদা ছেলের পাতে তরকারী দেয়ার সময় বলল, তুই চলে যাওয়ার পর বৌ শুয়েছিল। দুপুরে খাওয়ার সময় আমি ডাকতে গেলে আবার আমাকে যা-তা করে বলেছে। সকালেও সবার সামনে আমাকে অপমান হতে হল। তুই যদি আমার পেটে জন্মে থাকিস, তা হলে এর একটা বিহিত করবি। কথা শেষ করে আঁচলে চোখ মুছল।
নাদিম এক লোকমা ভাত মুখের কাছে তুলেছিল, সেটা না খেয়ে প্লেটে রেখে দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে বাইরে চলে গেল।
তাই দেখে রহিম স্ত্রীকে বলল, খাওয়া হয়ে গেলে কথাটা বলতে পারতে।
তখন গরমকাল। নাদিম বেরিয়ে এসে মসজিদের সিঁড়িতে বসে কি করা উচিত চিন্তা করতে লাগল। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর রাত বারটার সময় ঘরে ফিরে এল।
সদর গেট দিয়ে ঢুকলেই প্রথমে কুদ্দুসের ঘর। কুদ্দুস গরমের জন্য ছেলেদের নিয়ে বারান্দায় বিছানা করে মশারি খাটিয়ে ঘুমায়। আজ সে স্ত্রীর সঙ্গে মশারির বাইরে বসে নাদিমের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে ফিরতে দেখে কুদ্দুস ডেকে কাছে বসাল।
ফাহমিদা কাগজীলেবুর রস দিয়ে এক গ্লাস শরবত করে রেখেছিল। উঠে গিয়ে সেটা এনে নাদিমের হাতে দিয়ে বলল, এটা খাও তো বাবা।
নাদিম গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, তোমারা খাবে না?
কুদ্দুস বলল, আমরা একটু আগে খেয়েছি, তুই খেয়ে নে।
নাদিম শরবত খেয়ে গ্লাসটা ছোটমার হাতে ফেরত দিল।
ফাহমিদা গ্লাসটা পাশে রেখে নাদিমের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, বাবা। নাদিম, তুমি খুব বুঝদার ছেলে। বৌ ছেলেমানুষ, জ্ঞানও কম। তাই আজ একটা। অন্যায় করে ফেলেছে। তাকে মারধর না করে বুঝিয়ে বলো। সে দুপুর থেকে কিছু খায়নি।
স্ত্রী থেমে যেতে কুদ্দুস বলল, হ্যাঁ নাদিম, আমরা তোকে এই কথা বলব বলে অপেক্ষা করছিলাম। তোর ছোট মা ঠিক কথা বলেছে। মারধর করা ভালো নয়। সে। কথা তুই আমার চেয়ে ভালো জানিস। তোকে আর আমরা কি বলব। যা এবার ঘরে যা।
নাদিম জানে তার ছোট চাচা ও ছোট মা তাকে অন্যান্য চাচা-চাচিদের চেয়ে বেশি ভালবাসে এবং সেই কারনে তার স্ত্রী সাজেদাকেও ভালবাসে। তাদের কথা শুনে
ক্ষণিকের জন্য তার মন সাজেদার প্রতি একটু নরম হয়েছিল। তাই কিছু না বলে উঠে যখন নিজের ঘরের দিকে আসছিল তখন আম্মার কথাগুলো ও তার চোখের পানির কথা মনে পড়তে মন শক্ত হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে দেখল, মশারি না খাটিয়ে সাজেদা বিছানায় শুয়ে আছে। সে জেগে আছে বুঝতে পেরে দরজা জানালা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানার কাছে এসে বলল, আমি স্কুলে যাওয়ার সময় আম্মা ও মেজ মার পায়ে ধরে মাফ চাইতে বলেছিলাম, মাফ চেয়েছিলে?
সাজেদা বলল, না।
কেন?
সাজেদা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
আমি যে তোমাকে তখন বলেছিলাম, আম্মা কিছু যদি বলে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করবে না, তবু করেছ কেন?
আমার শরীর ভাল নেই, আমি অত কেনর উত্তর দিতে পারব না।
নাদিম আর রাগকে কন্ট্রোল করতে পারল না, সে আলমারীর কাছে গিয়ে তার মাথা থেকে বেতটা নিতে গিয়ে দেখল, নেই।
নাদিম ছোট ছোট ভাইবোনদের ভয় দেখাবার জন্য অনেক আগে শহর থেকে একটা বেতের ছড়ি কিনে এনেছিল। সেটা দিয়ে মাঝে মাঝে তাদেরকে দুএক ঘা মেরে শাসন করে।
আজ স্কুলে যাওয়ার আগে এক ফাঁকে বেতটা দেখেছে। এখন নেই দেখে মনে করল, নিশ্চয় সাজেদা সরিয়ে দিয়েছে। কোথায় সরিয়ে রাখতে পারে ভেবে সম্ভাব্য জায়গাগুলো খুঁজেও পেল না। ফলে আরো রেগে গেল। হঠাৎ বিছানার দিকে নজর পড়তে ভাবল, বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখেনি তো? বিছানার চারপাশ খুঁজে দেখেও পেল না।
পাবে কি করে? স্কুলে যাওয়ার সময়কার নাদিমের কথাগুলো ভেবে সাজেদার মনে হয়েছে, সে যা রাগী, মারধর করতে পারে। আলমারীর মাথায় বেত আছে সে জানে। তাই বেতটা নিয়ে বিছানার নিচে ঠিক মাঝখান থেকে গড়িয়ে সরে যেতে নাদিম বেতটা দেখতে পেল। নাদিমের রাগ ততক্ষণে চরমে উঠে গেছে। বেতটা নিয়ে পাগলের মতো সাজেদাকে মারতে লাগল।
সাজেদা ভয়ে ও মারের আঘাতে চিৎকার করে বলতে লাগল, তোমরা কে কোথায় আছ, আমাকে বাঁচাও। ও বাবারে আমাকে মেরে ফেলল রে।
নাদিম তখন মারতে মারতে বলল, আমাকে স্বামী বলে মনে করনি কেন? যদি করতে, তা হলে আমার কথামতো চলতে। যে মেয়েমানুষ স্বামীর কথা শুনে না, তার বেঁচে না থাকাই ভাল।
সাজেদা মারের আঘাত সহ্য করতে না পেরে একসময় আলমারীর ছিপনে ঢুকে গেল। সে মোটা তাই পুরো শরীর ঢুকল না। যে পাশটা বাইরে রইল, সেই পাশে নাদিম আঘাতের পর আঘাত করে চলল। শেষে বেতটা আলমারীর সঙ্গে বাড়ি খেয়ে দুতিন টুকরো হয়ে যেতে ক্ষ্যান্ত দিল।
এদিকে সাজেদার আর্তনাদে তাদের বাড়ির ও অন্যান্য চাচাদের বাড়ির সবাই উঠোনে এসে জমা হয়েছে।
আফ্রিদা ও ফাহমিদা বৌয়ের চিৎকার শুনে ছেলের রুমের দরজা ধাক্কা দিতে দিতে অনেকবার মারতে নিষেধ করে দরজা খুলতে বলেছে। নাদিম তাদের কথা শোনেনি। যখন নাদিম মারে ক্ষ্যান্ত দিয়ে দরজা খুলে বেরোল তখন তারা রুমের ভিতরে ঢুকে বৌয়ের অবস্থা দেখে শিউরে উঠল। তার গায়ের সমস্ত জামা-কাপড় ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন। হয়ে গেছে। আলমারীর পিছনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। শরীরের এক সাইডের অনেক জায়গা ফেটে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।
আফ্রিদা ও ফাহমিদা তাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আলনা থেকে একটা শাড়ি নিয়ে দুভাজ করে সাজেদার গায়ে ঢাকা দিল। তারপর আফ্রিদা বাইরে এসে নাদিমকে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গর্জে উঠল, এ রকমভাবে কেউ কাউকে মারে? তুই। লেখাপড়া করে হাদিস-কালাম পড়ে মানুষ না হয়ে জানোয়ার হয়েছিস। তোকে আমি পেটে ধরেছি ভাবতে ঘেন্না হচ্ছে।
ঘর থেকে বারান্দায় আসার পর থেকে নাদিমের রাগ পড়তে শুরু করার সাথে সাথে সাজেদাকে এভাবে মারার জন্য মনে অনুশোচনা হচ্ছিল। মায়ের কথার কোনো জবাব দিতে পারল না। তখন তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠেছে।
লোকজনের কোলাহল শুনে রহিমা ও বাতেন এতক্ষণ অন্যান্যদের সঙ্গে উঠোনে ছিল। আফ্রিদা কথাগুলো বলে ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর বাতেন সেখান থেকে নাদিমকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুই যদি বৌ নিয়ে ঘর করতে না চাস, তা হলে ছেড়ে দে। তুই কি মনে করেছিস, এখানে ওর কেউ নেই। পরের মেয়ের উপর অত্যাচার করার দরকার নেই। তোর মতো একটা শিক্ষিত ছেলে হয়ে এভাবে বৌকে পেটাবে তা ভাবতেই পারছি না।
নাদিম চোখের পানি মুছে বলল, আপনি যে কথা বললেন তা কত বড় ভয়ানক চিন্তা করে দেখেছেন? আমার স্ত্রীকে আমি শাসন করব আপনারা বলার কে?
বাতেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, নাদিম তোকে আমরা বংশের গৌরব মনে করি। তুই আজ যা করলি, তাতে পাঁচজনের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেল। স্ত্রীকে শাসন করার অধিকার সকলের আছে। তাই বলে একরম শাসন করার অধিকার আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) দেয়নি। তুইও সে কথা ভালো করে জানিস।
নাদিম আগেই নিজের অন্যায় বুঝতে পেরে মনে যে অনুশোচনা হয়েছিল, বড় মেজ চাচার মুখে আল্লাহ ও রসুল (দঃ)-এর কথা শুনে তা আরো বেড়ে গেল।
ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবীটা নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অজু করে মসজিদে ঢুকল। সেখানে সারারাত নফল নামায পড়ে আল্লাহপাকের কাছে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে লাগল।
এদিকে আফ্রিদা ও ফাহমিদা সাজেদার আঘাত পাওয়া জায়গাগুলো তুলোতে ডেটল লাগিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে অন্য জামা-কাপড় পরিয়ে বৌয়ের কাছে সারারাত বসে রইল।
পরের দিন সকালে নাদিম ফজরের নামাজ পড়ে ঘরে এল না। মসজিদ থেকে বেরিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য রওয়ানা দিল।
নাদিম যে ডাক্তারকে আনতে গেল, তার নাম অলোক ঘোষ। তাদের বাড়ি সারেংপুর থেকে দুমাইল পূর্বদিকে। সে নাদিমের ছোট মামা মহসীনের বন্ধু। একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছে। অসংখ্যবার দুজন দুজনের বাড়িতে যাতায়াত করেছে। দুজন দুবাড়ির ছেলের মতো। অলোক ডাক্তারের বাবার সঙ্গে মহসীনের বাবারও বন্ধুত্ব ছিল।
অলোক ডাক্তার মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়েছিল। নাদিমকে ভালভাবে চিনে। রাস্তায় তাকে জিজ্ঞেস করল, কি খবর ভাগনা? মন খারাপ করে কোথায় যাচ্ছিস?
নাদিম বলল, আপনার কাছে যাচ্ছিলাম। এক্ষুনি আমাদের বাড়িতে আপনাকে একবার যেতে হবে।
কেন, কারো কিছু হয়েছে নাকি?
না-মানে, আপনার বৌমার শরীর খুব খারাপ। বৌমার কি হয়েছে, বলবি তো?
নাদিম কি হয়েছে বলতে না পেরে আমতা আমতা করে বলল, আপনি তাড়াতাড়ি চলুন। গেলেই জানতে পারবেন।
আমার সঙ্গে আয় বাসা থেকে ব্যাগটা নিতে হবে; সেই সঙ্গে ড্রেসটাও পাল্টে নেব। তারপর যেতে যেতে বললেন, কি হয়েছে বলছিস না কেন? বললে সেই রকম প্রিপারেশন নিয়ে যেতে হবে তো।
নাদিম বাধ্য হয়ে বলল, মামা, আপনাদের বৌমা মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছিল বলে তাকে আমি মেরেছি। রাগের মাথায় মারটা একটু বেশি হয়ে গেছে।
স্কুলে পড়ার সময় যখন পরপর তিন বছর নাদিমের টাইফয়েড় হয়েছিল তখন এই অলোক ডাক্তার তাকে চিকিৎসা করে ভালো করেছিল। সেই শেষবারে চিকিৎসা করার সময় বলেছিল, তিনবার টাইফয়েড় হলে কোনো রোগী বাঁচে না। যদিও বেঁচে যায়, তা হলে হয় পাগল হয়ে যাবে, নচেৎ কোন্ একটা অঙ্গহানী হবে কিন্তু তা না হয়ে সে যে খুব বদরাগী হয়েছে, সে কথা অলোক ডাক্তার জানে। তাই এখন তার কথা শুনে বলল, হু, বুঝতে পেরেছি। নিশ্চয় বৌমার গুরুতর কিছু হয়েছে। তা না হলে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছিস কেন? কিন্তু তুই একটা শিক্ষিত ছেলে, তার উপর ধার্মিক। তোর এটা করা ঠিক হয়নি। বৌমাকে সৎ উপদেশ দিয়ে ভালভাবে বুঝিয়ে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে পারতিস। ততক্ষণে তারা বাড়িতে পৌঁছে গেল।
অলোক ডাক্তার ড্রেস চেঞ্জ করে ডাক্তারি ব্যাগটা নাদিমের হাতে ধরিয়ে মটর সাইকেলে করে দুজনে রওয়ানা দিল।
আফ্রিদা সাজেদার জ্বর উঠেছে দেখে বসে বসে তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিল, অলোক ডাক্তার নাদিমকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকে তাকে দেখে বলল, দিদি, নাদিম আমাকে ডেকে নিয়ে এল। সে নাকি বৌমাকে গতরাতে মারধর করেছে?
আফ্রিদা মহসীনের চেয়ে অনেক বড়। তাই ছোট ভাইয়ের বন্ধুকে বরাবর তুই তোকারি করে বলে এসেছে। এখন তার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ রে, দেখ না ছেলের কাণ্ড। গতকাল আমার মেজ জার ও আমার সঙ্গে বৌমা কথা কাটাকাটি করেছিল বলে আমি বৌমাকে একটু শাসন করতে বলেছিলাম। কিন্তু ও যে এরকম জঘন্য কাজ করবে তা কল্পনা করি নাই। তুই ওকে একটু শাসন করে দিস তো। জানোয়ারটা রেগে গেলে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে কেন?
অলোক ডাক্তার বলল, আমি ওর কাছে শুনেই এরকম কিছু-একটা অনুমান করে অনেক বকাবকি করেছি। তারপর সাজেদার আঘাত পাওয়া জায়গাগুলো দেখাতে বলল।
আফ্রিদা কাপড় সরিয়ে সরিয়ে শুধু আঘাত পাওয়া জায়গাগুলো দেখাল। আঘাতের চিহ্নগুলো সব দগদগে হয়ে গেছে দেখে অলোক ডাক্তার আঁতকে উঠে বলল, দিদি, নাদিমের মতো ছেলে যে এরকমভাবে মারবে চিন্তা করতে পারছি না। তখন ওর কথা শুনে মনে করেছিলাম, সেই অসুখের পর থেকে বদরাগী হয়েছে, তাই হয়ত রেগে গিয়ে একটু বেশি মারধর করেছে। কিন্তু হিংস্র জানোয়ারের মতো কাজ করবে ভাবিনি। তারপর জ্বর দেখে প্রেসক্রিপশান করে নাদিমকে বলল, বৌমা যত বড় অপরাধই করে থাকুক না কেন, তুই যা করেছিস তা ক্ষমার অযোগ্য। চাবকে তোর পিঠের ছাল তুলে নিতে ইচ্ছে করছে। চল, আমার সঙ্গে ওষুধগুলো নিয়ে আসবি। বৌমার যদি কিছু হয়ে যেত তখন টের পেতিস।
ডাক্তারকে আফ্রিদা যখন মারের জায়গাগুলো দেখাচ্ছিল তখন নাদিমও দেখেছে। দেখে খুব মর্মাহত হয়ে নিজের প্রতি ঘৃণা বোধ করছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, এই জন্যে আল্লাহপাকের রসুল (দঃ) রাগকে হারাম বলেছেন। অনুশোচনায় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। অলোক ডাক্তারের কথা শুনে তাকে অনুসরণ করল।
ঘণ্টা দেড়েক পর নাদিম ওষুধ নিয়ে ফিরে এসে মাকে সংসারের কাজ করতে দেখে নিজে সাজেদাকে ওষুধ খাওয়াবার সময় ভিজে গলায় বলল, আমি রেগে গেলে অমানুষ হয়ে যাই। সেই সময় আমার কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
সাজেদা কোনো কথা বলল না। ওষুধ খেয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল। এমন সময় আফ্রিদার গলা শোনা গেল, নাদিম বৌমাকে ওষুধ খাইয়ে এখানে আয়, নাশতা খাবি, অনেক বেলা হয়েছে।
নাদিম মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি নাশতা বের কর, আমি আসছি। তারপর সাজেদার দুটো হাত ধরে বলল, তোমাকে এভাবে মেরে কাল থেকে আমিও কম কষ্ট পাচ্ছি না। বল, মাফ করে দিয়েছ?
সাজেদার চোখ থেকে আরো বেশি পানি পড়তে লাগল। বলল অন্যায় আমি করেছি, তুমি মাফ চাইছ কেন?
নাদিম স্ত্রীর গালে গাল ঠেকিয়ে বলল, শাসন যখন জুলুমের পর্যায়ে চলে যায়, তখন অন্যায় হয়। আমি তোমার উপর জুলুম করেছি। সেই জন্যে মাফ চাইছি।
সাজেদা তার প্রতি স্বামীর যে ভালবাসার কথা এতদিন বুঝেছিল, এখন তাকে চোখের পানি ফেলে বারবার মাফ চাইতে দেখে সে ভুল ভাঙল। বুঝতে পারল, নাদিম তাকে তার দেহ ভোগ করার জন্য শুধু ভালবাসে না, সত্যিকার ভালবাসে। ভিজে গলায় বলল, তুমি স্বামী হয়ে স্ত্রীর কাছে মাফ চাইছ কেন? তোমার কথা না শুনে আমি অন্যায় করেছি। বরং তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
নাদিম উঠে বসে নিজের চোখ-মুখ মুচে সাজেদার চোখ-মুখ মুছে দিতে দিতে বলল, আমরা দুজনেই অন্যায় করেছি, আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করুক।
.
০৫.
এই ঘটনার দিন পনের পর শিহাব মেয়েকে নিয়ে যেতে এল। সে মেয়ের বাড়িতে এলেও বন্ধু বাতেনের কাছে ঘুমায় এবং বেশিরভাগ সময় তার সঙ্গে থাকে।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর এক সময় শিহাব সাজেদাকে বলল, তোকে নিয়ে যেতে এসেছি। তোর শুশুর-শাশুড়ীকে বলতে তারা নাদিমকে বলার জন্য বলল।
সাজেদা সুস্থ হলেও তার শরীরের দুতিন জায়গার ঘা এখনও ভালো হয়নি। তাই বলল, আমি এখন যাব না, কয়েকদিন পর যাব। তুমি তোমার জামাইকে কয়েকদিন পরে আমাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার কথা বল।
এবারে এসে শিহাব মেয়ের মুখে বিষণ্ণতার ছাপ দেখে এবং বেশ একটু রোগা হয়ে গেছে দেখে জিজ্ঞেস করল, তোর মুখ এত শুকনো কেন? রোগাও হয়ে গেছিস।
সাজেদা বলল, কয়েকদিন আগে জ্বর হয়েছিল, এখন ভালো আছি।
শিহাব বলল, ঠিক আছে, জামাইকে তাই বলব। ততদিনে তোর শরীরটা আরো একটু সুস্থ হোক।
এক সময় শিহাব মেয়ের সামনে জামাইকে বলল, আমি সাজেদাকে নিয়ে যেতে চাই, তোমার আব্বা-আম্মা তোমাকে বলতে বলল।
শ্বশুরের কথা শুনে নাদিম চিন্তা করতে লাগল, এ অবস্থায় পাঠান ঠিক হবে না। সেখানকার মেয়েরা ওর শরীরের ঘা দেখে জিজ্ঞেস করলে সাজেদা কি বলতে কি বলবে।
জামাইকে চুপ করে থাকতে দেখে শিহাব বলল, কিছু বলছ না কেন বাবাজী? তুমি ওকে পাঠাতে চাচ্ছ না?
নাদিমের অবস্থা বুঝতে পেরে সাজেদা বলল, কয়েকদিন জ্বরে ভুগে আমার শরীরটা খুবই দুর্বল কিছুদিন পরে এসে নিয়ে যেও।
শিহাব বলল, এখন চাষের মৌসুম। চাষ তুলে আসতে অনেক দেরি হবে। তারপর জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, বাবাজী, তুমি যদি কয়েকদিন পর সাজেদাকে সাথে করে নিয়ে যেতে, তাহলে খুব ভাল হত।
নাদিম এতক্ষণ শ্বশুরকে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এখন তার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাই হবে আব্বা। কয়েকদিন পর আমাদের স্কুলে ছুটি পড়বে। সেই সময় আমি নিয়ে যাব।
শিহাব বলল, বেশ, তাই নিয়ে যেও। মেয়ের বাড়ি দুদিন থেকে শিহাব ফিরে এসে বাড়িতে জানাল, কয়েকদিন পর জামাই সাজেদাকে সাথে করে নিয়ে আসবে।
ছেলের মনটা একটু ভার ভার দেখে সাজেদার দাদি হামিদা বানু জিজ্ঞেস করলেন, তোর মেয়েকে না হয় জামাই নিয়ে আসবে, কিন্তু মেয়ের বাড়ি থেকে মন খারাপ করে ফিরে এলি কেন?
শিহাব বন্ধু বাতেনের কাছে সাজেদা শাশুড়ীদের সঙ্গে ঝগড়া করেছিল বলে জামাই। তাকে খুব মেরেছে, সে কথা শুনেছে। সে কথা মাকে বলা ঠিক হবে কিনা ভাবতে লাগল।
ছেলে কিছু বলছে না দেখে হামিদা বানু বললেন, কি রে, কিছু বলছিস না কেন?
শিহাব মাকে মিথ্যা বলতে পারল না। বলল, সাজেদা শাশুড়ীদের সঙ্গে ঝগড়া করেছিল বলে জামাই মেরেছে।
শুনে হামিদা বানু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কার কাছে। শুনেছিস?
বাতেনের কাছে।
তোর মেয়ে কিছু বলে নি।
না।
তুই মেয়ে জামাইকে বা অন্য কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলিস নি তো?
না আম্মা, কাউকে কিছু বলিনি।
খুব ভালো করেছিস। তোর জামাইকে যতটুকু জেনেছি আমার মনে হয় সামান্য কারণে সে মারধর করেনি। নিশ্চয়ই তোর মেয়ে কোনো গুরুতর অন্যায় করেছিল। মেয়ে জামাইয়ের মিল দেখে এসেছিস তো?
তা দেখেছি আম্মা।
যাক, তা হলে ওসবে তুই মন খারাপ করিস না। সব সংসারেই ওরকম হয়ে থাকে।
সাজেদার মা সালেহা সেখানে ছিল শাশুড়ীর কথা শুনে তখন কিছু বলতে সাহস করেনি। এক সময় স্বামীকে একাকী জিজ্ঞেস করল, জামাই কি সাজেদাকে খুব বেশি মেরেছে।
শিহাব সবকিছু জেনেও চেপে গিয়ে বলল, তা আমি কি করে বলব? বাতেনের মুখে শুনলাম, মেরেছে।
মায়ের জান, মেয়েকে জামাই মেরেছে শুনে সালেহা মনে খুব কষ্ট অনুভব করছিল। স্বামীর কথায় মন বোধ মানল না। আবার জিজ্ঞেস করল, তোমাকে দেখে সাজেদা খুব কান্নাকাটি করেছিল নাকি?
এই মেয়েকে শিহাব কখনো চোখ রাঙিয়ে মানুষ করেনি। ছোটবেলা থেকে যত রকম জিদ করেছে, সব পূরণ করেছে। বড় আদরের সঙ্গে মানুষ করেছে। সেই মেয়েকে জামাই ভীষণ মারধর করেছে শুনার পর রাতে চোখের পানি ফেলেছে। পরে মনকে শক্ত করে নিয়েছে। সাজেদা যে সালেহার জান, সে কথা শিহাব জানে। তাই স্ত্রীকে বারবার তার কথা জিজ্ঞেস করতে বিরক্ত না হয়ে ভালো মুখে বলল, কান্নাকাটি করবে কেন? জামাইয়ের সঙ্গে বেশ মিলমিশ দেখলাম। সেই তো তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার কথা জামাইকে বলার জন্য আমাকে শিখিয়ে দিল। আমি সে কথা জামাইকে বলতে সে খুশি মনে রাজি হল।
কয়েকদিন পর স্কুলে ছুটি পড়তে নাদিম আব্বা-আম্মার মতামত নিয়ে সাজেদাকে সাথে করে শ্বশুরবাড়ি রওয়ানা দিল। পথে চিন্তা করল, যদি শ্বশুর মেয়েকে মারার কথা কারো কাছে শুনে থাকেন এবং তিনি সে কথা বাড়িতে গিয়ে বলে থাকেন, তা হলে তারা আমাকে নিশ্চয় খুব খারাপ ছেলে ভেবেছেন। সেখানকার কেউ কিছু এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেব, সেই কথা ভেবে খুব লজ্জা পেতে লাগল। এক সময় সাজেদাকে জিজ্ঞেস করল, আব্বা কি তোমাকে মারার কথা শুনে গেছেন?
সাজেদা বলল, আমি আব্বাকে কিছু বলিনি। তোমার মেজ চাচা কিছু বলেছেন কিনা জানি না।
তোমার শরীর খারাপ দেখে আব্বা কিছু জিজ্ঞেস করেন নি?
করেছিল। বলেছি, কয়েকদিন আগে আমার জ্বর হয়েছিল।
নাদিম আর কিছু না বলে চুপ করে গেল।
শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে নাদিম প্রতিবারের মতো দুশ্বশুর, শাশুড়ী ও দাদি শাশুড়ীকে কদমবুসি করে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করল।
তারা দোয়া করে নাদিমের বাড়ির ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল।
এবারে নাদিমের খাতির-যত্ন আগের থেকে বেশি হতে দেখে তার কেবল মনে হতে লাগল, এখানকার সবাই সাজেদাকে মারার কথা জেনে গেছে। নিজের অপকর্মের কথা চিন্তা করে নাদিম যেমন লজ্জা পেতে লাগল, তেমনি মনে একটু ভয় ভয় অনুভব করল।
রাতে ঘরের মেঝেয় পাঠির সব বিছিয়ে দূরখানা পেতে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা হল। নাদিম এলে তার শালা লিয়াকত সব সময় নাদিমের সাথে থাকে। একসঙ্গে নাশতা ও অত খায়। এবারে কাছে এলেও বেশিক্ষণ থাকে নি। খাওয়ার সময় তাকে দেখতে না পেয়ে সাজেদাকে জিজ্ঞেস করল, লিয়াকত কোথায়? তাকে ডাক, এক সাথে খাব।
সাজেদা তাকে ডেকে নিয়ে এল।
সাজেদার দাদাজীর দুছেলে দুমেয়ে বড় ছেলের নাম শিহাব আর ছোট ছেলের নাম হাবিব। বড় মেয়ে কুলসুম পাঁচ বছরের একটা ছেলে রেখে মারা গেছে। প্রায় পনের মাইল দূরে তার বিয়ে হয়েছিল। সেই ছেলে এখন যুবক। ছোট মেয়ে জয়নাব। তার বিয়ে নিজেদের পাড়ায় এক আত্মীয়ের ছেলের সঙ্গে হয়েছে। তারও এক ছেলে। ছেলেটার নাম ইয়াকুব। তার বয়স এখন চৌদ্দ-পনের বছর। ইয়াকুব হওয়ার পর থেকে জয়নাব সূতিকা রোগে ভুগছে। শিহাব ও দুভাই এক সংসারে। দুভাইয়ের মধ্যে এত ভালবাসা যে, একজনের কোনো অসুখ-বিসুখ হলে অন্যজন খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। দুজায়ের মধ্যেও খুব ভাব। মাঝে-মধ্যে যদিও বা কিছু হয়, তখন ছোট একটু রেগে গেলে বড় তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে রাগ মানিয়ে নেয়। বিয়ের পর ছোটর অনেক বছর ছেলেপুলে হয়নি। সে সাজেদা ও লিয়াকতকে মানুষ করেছে। তারপর তার ছেলে হলে বড় তাদেরকে মানুষ করেছে। শিহাবের ইন্টারের ফাইনাল পরীক্ষার পর তার বাপ মারা যান। তখন হাবিব সিক্সে পড়ত। বাপ মারা যাওয়ার পর শিহাব পড়াশোনা বন্ধ করে সংসার দেখাশুনা করতে থাকে। হাবিব লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছিল না। তাই সেও পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ভাইয়ের সাথে সংসারের কাজে লেগে যায়। শিহাব তাকে লেখাপড়া করাবার চেষ্টা করে। কিন্তু হাবিব করল না। শেষে দুভাই মিলে বাপ যা জমি-জায়গা রেখে গিয়েছিল তা দেখাশোনা করতে লাগল। তাদের বাপের বেশ কিছু জমি-জায়গা ছিল। সেগুলোর পিছনে দুভাই কঠোর পরিশ্রম করে আরো অনেক জমি-জায়গা করেছে। গ্রামের মধ্যে এখন তারাই সব চেয়ে বড় গৃহস্থ বাপ মারা যাওয়ায় নিজে বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি বলে শিহাবের খুব ইচ্ছা ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষা দিবে। তাই সাজেদাকে ম্যাট্রিক পাস করিয়ে কলেজে ভর্তি করতে চেয়েছিল। কিন্তু রাস্তার বখাটে ছেলেদের জন্যে তা সম্ভব হয়নি। সাজেদা খুব সুন্দরী বলে স্কুলে যাওয়ার সময় বখাটে ছেলেদের অনেক উৎপাত সহ্য করেছে। তাই মেয়েকে কলেজে পড়াবার শত ইচ্ছা থাকলেও পড়ায়নি। তারপর বি.এ. পাস ধার্মিক ছেলে নাদিমকে জামাই করে সবাই খুব আনন্দিত। কিন্তু জামাই মেয়েকে মেরেছে জেনে তাদের মন খারাপ হয়েছিল। মেয়ে জামাইকে হাসি-খুশিতে আসতে দেখে তাদের মন অনেকটা হালকা হয়েছে। তবু দুভাই মাকে একসময় বলল, আম্মা, তুমি তোমার নাত-জামাইকে একটু বুঝিয়ে বলল সে যেন আর তোমার নাতনি কে মারধর না করে।
হামিদা বিবি বললেন, রাতে খাওয়ার সময় বলব।
সাজেদা হাত ধুইয়ে বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরে হামিদা বানু ভাতের প্লেট নিয়ে ঢুকলেন।
তাই দেখে নাদিম বলল, দাদি, আপনি কষ্ট করছেন কেন? আপনার নাতনি কোথায়?
হামিদা বানু বললেন, সে রান্নাঘর থেকে এনে আমার হাতে দিল। তারপর হাসিমুখে বললেন, কেন ভাই, আমার হাতে খেতে বুঝি ভালো লাগবে না। নাত জামাইকে খাওয়াতে আমার বুঝি শখ হয় না?
নাদিম লজ্জা পেয়ে বলল, কি যে বলেন, আপনার হাতে খাওয়া তো আমার সৌভাগ্য। আপনার কষ্ট হবে ভেবে বলেছি।
হামিদা বানু ভাতের প্লেট দস্তরখানার উপর রেখে দরজার কাছে গিয়ে কয়েক পদের তরকারী এনে বললেন, নাও ভাই শুরু কর, কষ্ট আবার কি! তোমার মতো নাত জামাই কজনের ভাগ্যে জুটে?
নাদিম বুঝতে পারল সাজেদা ও দুশাশুড়ী রান্নাঘর থেকে সবকিছু নিয়ে এসে যোগান দিচ্ছে। বলল, আপনিও আসুন।
হামিদা বানু বললেন, খাব, তবে আজ নয়। তুমি শুরু কর তো।
খেতে খেতে নাদিমের মনে হল, দরজার কাছে বারান্দায় বেশ কয়েকজন মেয়ে ও পুরুষ রয়েছে। দাদির হাবভাব দেখে নাদিম বুঝতে পারল, সাজেদাকে মেরেছি জেনে কিছু বলতে চান। ভেবে রাখল, খাওয়ার পর দাদি কিছু বলার আগে সে নিজেই কথা তুলবে। কিভাবে কথাটা তুলবে খেতে খেতে তাও ভেবে রাখল। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে খাটে বসে নাদিম বলল, দাদি, আমি দুএকটা কথা আপনাদেরকে বলতে চাই।
হামিদা বানু সাজেদার নাম ধরে ডেকে বললেন বাসনপত্র নিয়ে যাও। তারপর নাত-জামাইয়ের পাশে বসে নাদিমকে বললেন, বেশ তো ভাই, বল কি বলবে।
নাদিম বলল, কথাটা ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে। তাই আপনাদের কাছে প্রথমে মাফ চেয়ে নিচ্ছি।
আব্বা আমাদের ফ্যামিলির সবাইকে চেনেন। আমাকেও ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছেন। আমাদের অবস্থা এবং আমার স্বভাবচরিত্র কেমন তাও ভালোভাবে জানেন। আর আপনার নাতনি ওনার নিজের মেয়ে। তার স্বভাব-চরিত্র, মন-মেজাজ কি রকম তাও নিশ্চয় জানেন, এবং এটাও জানতেন, আমি ওনার মেয়ের অনুপযুক্ত। নিজের মেয়ের স্বভাব-চরিত্র ও মন-মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রেখে প্রত্যেক বাবা-মার জামাই পছন্দ করা উচিত। ওনার চোখে হয়ত আমি ভালো ছেলে। কিন্তু ওনার মেয়ের চোখে কেমন লাগবে তা চিন্তা করা উচিত ছিল। আপনাদের মতো সংসারের সচ্ছলতা আমাদের নেই। আপনাদের কর্তব্য ছিল, আপনার নাতনির বিয়ে কোনো বড়লোকের ছেলের সঙ্গে দেয়া। কারণ তার মতো মেয়ে আমাদের সংসারে খাপ খায় না। সে উচ্চভাষিণী ও আরামপ্রিয়। আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরে কোনোদিন হয়ত তার আশা আকাংক্ষা পূরণ হবে না। প্রত্যেক গার্জেনের উচিত তাদের মেয়েকে যেভাবে, যে পরিবেশে মানুষ করবে, তাকে সেইভাবে সেই পরিবেশে বিয়ে দেয়া। আপনার নাতনিকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অথচ এখানে সে একটা কুটো নেড়ে মানুষ হয়নি। এখানে ভালো ভালো খেয়ে পরে মানুষ হয়েছে। সে তুলনায় আমাদের বাড়িতে কিছুই পায় না। এতে সে যেমন খুব কষ্ট পাচ্ছে, তেমনি তার মনে খুব টর্চারিং হচ্ছে। মনের সেই টর্চারিং সহ্য করবে, না সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করবে? আর একটা কাজ প্রত্যেক পিতামাতার করা একান্ত কর্তব্য। সেটা হল, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, তাকে স্কুলে-কলেজে লেখাপড়া করানোর সাথে সাথে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে তার অনুশীলন করান। সেদিকটাও আপনারা অবহেলা করেছেন। আল্লাহপাক আমাকে যতটুকু এলেম দিয়েছেন, সেই সব দিয়ে আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঐ মানসিক টর্চারিং-এর জন্য কোনো সৎ উপদেশ গ্রহণ করতে পারেনি। আমিও তো মানুষ। আমারও দোষ-ত্রুটি আছে। আমার কথামতো না চললে মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বকাঝকা করি, কখনও বেশি রেগে গেলে দুএকটা চড়-চাপড়ও মারি। এবারে শয়তান ঘাড়ে চেপেছিল, আর আপনার নাতনিও বেশ বড় রকমের অন্যায় করে ফেলেছিল। তাই রাগ সামলাতে না পেরে একটু বেশি মারধর করে ফেলি। আপনারা হয়ত সে কথা শুনে থাকবেন। তবে সে জন্য আমি খুব অনুতপ্ত।
নাদিমের কথা শুনে হামিদা বানু চিন্তা করলেন, নাদিম যেমন খুব বুদ্ধিমান তেমনি খুব ভালো ছেলে। বললেন, হ্যাঁ, ভাই শুনেছি। শুনে ভেবেছি, সাজেদা নিশ্চয় কোনো গুরুতর অন্যায় করেছে। নচেৎ তোমার মতো ছেলে তাকে মারধর করবে কেন? অন্যায় করেছে মেরেছ, তা বেশ করেছ। সে জন্য তোমাকে কিছু বলব না। শুধু বলব, ঐ গাধাটাকে যেমন করে হোক তোমার মনের মতো করে গড়ে নিও। আর উচিত অনুচিতের যে সমস্ত কথা বললে, সেগুলো খুব খাঁটি কথা। তবে কি জান ভাই, তোমার শ্বশুর নিজের স্বভাব-চরিত্র জানে বলেই তাকে কোনো বড় ঘরে বিয়ে দেয়নি। কত বড় বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছিল। ওর ঐ স্বভাবের কথা চিন্তা করে সেসব ঘরে বিয়ে দিতে শিহাব রাজি হয়নি। তোমার সব কিছু জেনেই তোমাকে জামাই করেছে। বিয়ের আগে তোমাদের বাড়ির ও তোমার সম্বন্ধে আমাকে সবকিছু জানিয়ে বলেছে। সাজেদার কপালে যদি সুখ থাকে, তা হলে তোমার মতো ছেলের হাতেই হবে। তুমি কুরআন হাদিসের কথা বলে বোঝাবে।
নাদিম বলল, বিয়ের পর থেকে তাই করে আসছি। আপনি দোয়া করুন। আল্লাহপাক যেন আমার মনের বাসনা পূরণ করেন। আর আপনার নাতনিকে বুঝিয়ে বলবেন, ও যেন আমার কথামতো চলে। সে তো নিজের মতের বাইরে একটুও চলে না। এই কথা বলে নাদিম হেসে উঠল।
হামিদা বানুও হেসে ফেললেন। বললেন, এটা তুমি ঠিক কথা বলেছ ভাই। ওর ঐ একগুঁয়েমির জন্য ছোটবেলা থেকে আমার ও ওর মায়ের হাতে কম মারধর খায়নি। এখন আবার তোমার হাতে মার খেতে শুরু করেছে। কথা না শুনলে মেরে মেরে শোনাবে। কথা শেষ করে তিনি আবার হেসে ফেললেন।
নাদিম হাসতে হাসতে বলল, দাদি, মারধর করে অথবা জোর করে কারো মন পাওয়া যায় না, ভালবেসে পাওয়া যায়। আমি ভালবেসে যত ওর মনকে জয় করতে চাই ও সেটাকে খোশামোদ মনে করে তত বেশি লাই পেয়ে যায়। কি করব বলে দেবেন দাদি?
হামিদা বানুও হাসিমুখে বললেন, যাকে ভালবাসা দিয়ে জয় করা যায় না তাকে শাসন করে শায়েস্তা করতে থাকলে একদিন না একদিন সে নিজের ভুল বুঝতে পারবে। তুমি ভাই বিদ্বান লোক, আমি মুখ মানুষ, তোমাকে আমি আর কি বলব? যা ভালো বুঝবে তাই করবে।
বাইরে বারান্দায় নাদিমের দুশ্বশুর, শাশুড়ী এবং তাদের চাচাতো ভাই ও ভাইদের বউরা ছিল। নাদিমের কথা শুনে তাদের সকলের মনের দুঃখ দূর হয়ে গেল। তারা জামাইয়ের কোনো দোষ দেখতে পেল না। সাজেদার সম্বন্ধে জামাই যা বলল তা তারা জানে। তাই সাজেদারই দোষ ভেবে একে একে চলে গেল।
নাদিমকে চুপ করে থাকতে দেখে হামিদা বানু বললেন, তুমি আমার কথায় মনে কষ্ট পেলে নাকি ভাই?
নাদিম ওনাকে কদমবুসি করে বলল, আপনার কথায় মনে কষ্ট পাব কেন? বরং আমি আপনার নাতনির ও আপনাদের ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলে বেয়াদবি ও অন্যায় করেছি। সেজন্যে আপনাদের সকলের কাছে মাফ চাইছি।
শিহাব ও হাবিব তখনও বারান্দায় ছিল। জামাইয়ের কথা শুনে তারা ভিতরে এল। তারপর হাবিব বলল, আমরা তোমাকে ভুল বুঝে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। এখন তোমার কথা শুনে আমাদের ভুল ভেঙে গেছে?
নাদিম খাট থেকে নেমে তাদেরকে কদমবুসি করে বলল, আমি অনেক বেয়াদবি করে ফেলেছি, আপনারা মাফ করে দিন।
দুভাই একে একে জামাইকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করল। হাবিব জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, বেয়াদবি হলেও তুমি খুব দামি কথা বলেছ। তারপর তারা বেরিয়ে গেল।
নাদিম দাদি শাশুড়ীকে চলে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, আম্মারা কি বারান্দায় আছেন?
হামিদা বানু বারান্দায় এসে বউরা রয়েছে দেখে বললেন, আছে।
নাদিম বারান্দায় এসে দুশাশুড়ীকে কদমবুসি করে বলল, আপনারাও মাফ করে দিন।
কেন? আল্লাহ তোমাকে ও সাজেদাকে সুখী করুক, এই দোয়া করি।
নাদিম ঘরে ঢুকে চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, সাজেদা এই সব কথা শুনে কি মনে করছে আল্লাহ মালুম।
স্বামী, দাদি, বাপ, চাচা ও মা-চাচির কথা শুনে সাজেদা নিজেকে চিনতে পারল। সেই সাথে স্বামীর উন্নত মনের পরিচয় পেয়ে এবং তার উদ্দেশ্য জানতে পেরে নিজের অন্যায় দিকগুলোও বুঝতে পারল। ভাবল, এবার থেকে স্বামীর কথা সব সময় মেনে চলব। তখন তার সই দীলরুবার কথা মনে পড়ল, তোর স্বামী ধার্মিক বলে তুই অসন্তুষ্ট হচ্ছিস কেন? বরং খুশি হওয়ার কথা। জানিস না বুছি, সংসারে সব রকমের সুখ-শান্তির চেয়ে স্ত্রীর কাছে স্বামীর চরিত্র, ধার্মিকতা ও ভালবাসা লক্ষগুণ বেশী সুখ শান্তির। যে মেয়ে এমন স্বামী পায়, সে শুধু ভাগ্যবতী নয়, মহাভাগ্যবতী। মা-চাচীর সঙ্গে ভাত খেয়ে ঘরে বসে নাদিম ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে তার মুখের উপর ঝুঁকে ঘুম ভাঙাবার জন্য ডাকল, এই শুনছ?
নাদিম ঘুমায়নি। তার একটু তন্দ্রাভাব এসেছিল। সাজেদার ডাক শুনে তন্দ্রা ছুটে গেল। চোখ মেলে দেখল সাজেদার মুখ তার মুখের চার কড়া উপরে। আর তার চোখ দুটোতে পানি টলটল করছে। নাদিম কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সাজেদার চোখের পানি তার মুখের উপর পড়ল। নাদিম সাজেদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার কান্নাভেজা সারামুখে চুমো দিয়ে বলল, আমার কথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছ তাই না? আল্লাহপাকের কসম খেয়ে বলছি, তোমাকে অপমান করার জন্য অথবা তোমার মনে কষ্ট দেয়ার জন্য কথাগুলো বলিনি। তবু যদি কষ্ট পেয়ে থাক, তাহলে মাফ চাইছি।
আল্লাহপাকের অসীম দয়ায় এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাজেদা স্বামীকে যতটা না চিনতে পেরেছিল, এখন তার কথা শুনে আরো বেশি চিনতে পারল। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে স্বামীর সারা মুখে চুমোর প্রতিদান দিতে লাগল।
নাদিমের তখন মনে হল, সাজেদা বিয়ের পর থেকে আজকের আগে পর্যন্ত এত আন্তরিকতার সাথে আবেগপ্রবণ হয়ে এরকমভাবে চুমো খায়নি।
সাজেদা চুমো খাওয়ার বিরতি দিয়ে বলল, আমার একগুঁয়েমির জন্য তোমাকে চিনতে অনেক দেরি করে ফেলেছি তাই এতদিন তোমার মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমার এইসব কথা শুনে মনে কষ্ট হয়নি বরং আল্লাহ আমার জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিয়ে তোমাকে চিনবার, জানবার এবং নিজের ভুল ধরার সুযোগ করে দিলেন। সাজেদার কথা শুনে নাদিম মনে এক অনাবিল শান্তি অনুভব করল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তোমার কথা শুনে আমার এত আনন্দ লাগছে যা আমি জীবনে কোনোদিন পাইনি। আমি রাগ করলে তুমি সব সময় রাগ মানিয়ে আমাকে খুশি কর। আজ আমি তোমাকে এত বেশি আদর করে খুশি করব যে, খুশিতে পাগল না হয়ে যাও। কথা শেষ করে সাজেদাকে আদর করতে করতে অস্থির করে তুলল।
সাজেদা জানে নাদিম যেদিন তাকে ভোগ করতে চাইবে, সেদিন ইচ্ছে করে সামান্য কথায় রাগ করবে। তখন তাকে খুশি করার জন্য সাজেদাকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হয়। এখন স্বামীর মুখে খুশি করার কথা শুনে এবং তাকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে দেখে বেশ লজ্জা পেল। তবু আদরের প্রতিদান দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল, এই কি হচ্ছে- আস্তে বলবে তো কেউ বারান্দায় থাকতে পারে, শুনলে কি মনে করবে?
নাদিমও ফিসফিস করে বলল, শুনলে কি হয়েছে? আমরা তো অন্যায় কিছুকরছিনা।
সাদেজা স্বামীর ঠোঁটে আস্তে করে কামড়ে দিয়ে ঠোঁটের উপর গাল রেখে বলল, অসভ্য।
নাদিম ও তার নরম তুলতুলে গালে কামড়ে দিয়ে বলল, আমি অসভ্য, না তুমি? একটা পুরুষের বুকের উপর শুয়ে কামড়াকামড়ি করছ, এটাতে অসভ্যতা হয়নি বুঝি?
ঠিক আছে, আর অসভ্যতা করব না, বলে সাজেদা স্বামীর বুক থেকে নেমে যেতে চাইল।
নাদিম বুঝতে পেরে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, আমিও আর তোমাকে অসভ্য বলব না।
এ বছর মমতাজের ম্যাট্রিক পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর তার বিয়ে দেবার জন্য বাপ চাচারা পাত্রের সন্ধান করতে লাগল। ছেলে পছন্দ হলে তাদের বংশ পছন্দ হয় না। আবার বংশ পছন্দ হলে ছেলে পছন্দ হয় না। নাদিমের অনেক দিন থেকে ইচ্ছা বন্ধু আসাদের সঙ্গে বোনের বিয়ে দেবার। তাই মমতাজের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে জেনে একদিন সেকথা আব্বা-আম্মাকে জানিয়ে বলল, আসাদকে তো তোমরাও জান, কতবার এসেছে।
রহিম বলল, তা জানি। কিন্তু তাদের বাড়ির ও বংশের খবর তো আর জানি না।
নাদিম বলল, আমি ওদের বাড়িতে অনেকবার গেছি। সবকিছু জেনেই কথাটা বলেছি।
রহিম বলল, ওদের বাড়ির সব খবর বল শুনি। ছেলেটা দেখতে-শুনতে ও তার ব্যবহার বেশ ভালো বলে মনে হয়েছে।
নাদিম বলল, আসাদের আব্বা নেই। ওরা দুভাই এক বোন। বোটনা সবার ছোট। বছর দুই আগে ম্যাট্রিক পাস করেছে। ভাইটা ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছে। দুচাচা আছে, তারা আলাদা। চাষে যা ধান হয় সারা বছর খাওয়ার পর কিছু বিক্রি করে। আর আসাদ তো আমার সাথে বি.এ. পাস করে ঢাকায় একটা ভালো চাকরি করছে। ওর আব্বা বছর পাঁচেক আগে চার কামরা পাকা বাড়ি করার পর মারা গেছেন। বেশ ছোটখাট সংসার। মমতাজ সুখী হবে। আসাদের মায়ের ব্যবহারও খুব ভালো।
এবার আফ্রিদা বলল, সব তো ভালো শুনলাম। কিন্তু আসাদের সাথে তোর অনেক দিনের বন্ধুত্ব। সে বন্ধুর বোনকে বিয়ে করবে কিনা সে কথা জেনেছিস?
নাদিম বলল, না, জানি নি। তবে তাকে যতটা জানি, সে অরাজি হবে না।
রহিম বলল, ঠিক আছে, আগে তার মতামত নাও; তারপর আমরা তাদের বাড়িতে গিয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলব।
নাদিম বলল, জি, তাই নেব।
পরের দিন নাদিম স্কুলে যাওয়ার সময় চিন্তা করল, আসাদ বাড়ি এসেছে কিনা খালেককে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। খালেকও গোদাগাড়ি হাইস্কুলের মাস্টার। তার বাড়ি আসাদদের গ্রামে সুলতানগঞ্জে। সে তাদের চেয়ে দুতিন বছরের সিনিয়র। আবার ভাবল, গত বছর আসাদের সাথে দেখা হতে দুদিন পর তাদের বাড়িতে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু স্ত্রীকে মারধরের ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ ছিল বলে যাওয়া হয়নি। পরে অবশ্য যেতে চেয়েছিল, আসাদ ঘরে নেই জেনে আর যায়নি। তারপরও আসাদের খবর খালেকের কাছে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু এমনি দুর্ভাগ্য, যখনই জিজ্ঞেস করেছে, তখনই আসাদ ঘরে থাকে না।
স্কুল-কলেজে পড়ার সময়, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আসাদের সঙ্গে প্রায়ই তাদের বাড়িতে যেত। সুলতানগঞ্জ সারেংপুর থেকে মাত্র এক মাইল। সারেংপুর ও সুলতানগঞ্জের মধ্যস্থলে সুলতান শাহ পীরের মাজার আছে। প্রতি বছর মাজারের পাশে মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সাত দিনের জন্য মেলা বসে। কিন্তু মেলা ভাঙতে ভাঙতে আরো সাতদিন লেগে যায়। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় নাদিম বন্ধু আসাদের সঙ্গে প্রতিদিন মেলাতে ঘুরে বেড়াতো আর ক্ষিধে পেলে কোনো কোনোদিন নাদিম তাকে বাড়িতে নিয়ে এসে খাওয়াতো। সুলতানগঞ্জের পাশ দিয়ে মহানন্দা নদী বয়ে গেছে। অনেক সময় দুবন্ধুতে এত মিল থাকা সত্ত্বেও এবং মাত্র এক মাইলের ব্যবধান হলেও কেউ কারো বাড়ি একা একা ছোট বেলায় গেলেও বড় হওয়ার পর থেকে যায়নি। নাদিম বড় হবার পর বুঝতে পেরেছিল, আসাদের বোন রোজী তাকে ভালবাসে। কিন্তু রোজী কোনোদিক দিয়ে কোনো অংশে খারাপ নয় জেনেও রোজীকে সে ভালবাসতে পারেনি। তাই সে একা কোনো দিন তাদের বাড়িতে যায়নি। বড় হওয়ার পর আসাদও বুঝতে পেরেছিল নাদিমের বোন মমতাজ তাকে ভালবাসে।
মমতাজকেও আসাদের খুব পছন্দ। কিন্তু বন্ধুর বোন বলে সে কথা মনের মধ্যে চেপে রেখেছে। তাই সেও একা কোনোদিন নাদিমের বাড়িতে যায় নি। নাদিম যেমন বন্ধুর মনের খবর আঁচ করতে পেরেছে, তেমনি আসাদও বন্ধুর মনের খবর আঁচ করতে পেরেছে। এখন আসাদ ঢাকায় চাকরি করে। দুমাস পর বাড়িতে এলে ঐ কারণে সারেংপুর গিয়ে বন্ধুর খোঁজ নিতে সাহস করে না।
নাদিমও ঐ একই কারণে সুলতানগঞ্জে গিয়ে বন্ধুর খোঁজ নিতে সাহস করে না। তার উপর সে তাদেরকে না জানিয়ে বিয়ে করে লজ্জায় আরো যেতে পারে না। তাই খালেককে মাঝে মাঝে আসাদ বাড়ি এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করে।
আজ স্কুলে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল।
খালেক বলল, হ্যাঁ, এসেছে। গতকাল এশার নামাযের সময় মসজিদে দেখা হয়েছে।
নাদিম বলল, আপনি তার সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, আমি কাল সন্ধ্যের পর তার সঙ্গে দেখা করতে যাব। আর তার সঙ্গে যদি আপনার দেখা না হয়, তা হলে তার। আম্মাকে বলবেন তিনি যেন আসাদকে বলে রাখেন, আমি যাব।
আসাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে খালেক স্কুলে আসে। বলল, আজ বাড়ি যাবার সময় ওদের বাড়িতে খবরটা দিয়ে দেব।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে নাদিম স্ত্রীকে বলল, তোমাকে একদিন মমতাজের ব্যাপারে যে বন্ধুর কথা বলেছিলাম, আজ আসরের নামায পড়ে তাদের বাড়িতে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাব। তুমি নামায পড়ে তৈরি হয়ে থেকো, আমি আব্বা আম্মাকে বলেছি।
সাজেদা হাসিমুখে বলল, তা না হয় যাব। কিন্তু শুধু বেড়াতে যাবে, না বোনের পয়গাম নিয়ে যাবে?
নাদিমও হাসিমুখে বলল, তোমার বুদ্ধি তো দারুণ, কি করে বললে বুঝতে পারছি না।
সাজেদা হাসতে হাসতে বলল, তোমার বেতের আঘাতে যেমন বিবেকের দুয়ার খুলে গেছে, তেমনি বুদ্ধির দুয়ার খুলে গেছে।
নাদিম স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল, প্লীজ সাজেদা, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমাকে লজ্জা দিনও না। এমনি আমার যখন সে কথা মনে পড়ে তখন নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে যাই।
সাজেদা বলল, কসম খেয়ে বলছি, আমি এমনি কথার ছলে বলেছি। তোমাকে লজ্জা দেয়ার জন্য অথবা অন্য কোনো কারনে বলিনি।
নাদিম বলল, তা আমিও বুঝেছি, ভবিষ্যতে কথার ছলেও বলো না।
সেই মার খাবার পর থেকে সাজেদার স্বভাব-চরিত্র পাল্টে গেছে। তারপর থেকে সে স্বামীর প্রতিটা আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এর মধ্যে বহু ধর্মীয় ও অন্যান্য বই পড়ে নিজেকে স্বামীর মনের মতো করে গড়ার চেষ্টা করছে। এখন তার কথায় স্বামী মনে ব্যাথা পেয়েছে বুঝতে পেরে বসে তার দুপা বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কথাটা কথাচ্ছলে বলে তোমার মনে ব্যথা দিয়ে অন্যায় করেছি, মাফ করে দাও।
নাদিমও সেই থেকে স্ত্রীর পরিবর্তন লক্ষ্য করে আনন্দে আপ্লুত হয়ে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করেছে, তাকে আরো গভীরভাবে ভালবাসছে। পা ধরে মাফ চাইতে দেখে তাকে তুলে বুকে চেপে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, এই কথায় পায়ে ধরে মাফ চাইতে হয় না। তারপর কয়েকটা আদর দিয়ে বলল, আমি নামায পড়তে যাচ্ছি, ফিরে এসে তোমাকে যেন রেড়ি দেখি।
সেদিন নাদিম সাজেদাকে সঙ্গে নিয়ে যখন আসাদদের বাড়িতে পৌঁছাল তখন আসাদ ছিল না।
আসাদের বোন রোজী ছোটবেলায় নাদিমকে ভাইয়ার বন্ধু হিসাবে শ্রদ্ধা করত। বড় হয়ে সে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই নাদিম যখন ভাই যার সঙ্গে আসত তখন মুখে না বললেও আচার-ব্যবহারে ও কথাবার্তায় নিজের মনের দুর্বলতা প্রকাশ করত। তারপর নাদিম তাদের বাড়িতে এসে তাকে এড়িয়ে চলতে দেখে বুঝতে পারল, সে তাকে ভালবাসে না। তখন মনে খুব আঘাত পেলেও কখনও নাদিমকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। নিজেকে সামলে রেখে তার সাথে কথা বলত। ভাইয়া চাকরি করতে ঢাকা চলে যাওয়ার পর আজ দীর্ঘদিন সে তাদের বাড়িতে আসেনি। নাদিমের বিয়ে হয়ে গেছে শুনে গোপনে চোখের পানি ফেলেছে। আর ভাগ্যে নেই ভেবে মনকে বুঝ দিয়েছে। প্রায় বছরখানেক আগে ভাইয়ার মুখে নাদিম ও তার স্ত্রী আসবে শুনে পুরানো ব্যথাটা মনে একবার কাঁটার মতো বিধলেও খুশি মনে তাদের আসার অপেক্ষা করেছে। আজ তাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে সামাল দিয়ে বলল, কোন দিকের চাঁদ কোন দিকে। উঠল, একেবারে ভাবিকে নিয়ে এসে পড়লে?
নাদিম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, চাঁদ আল্লাহর হুকুম মতো নির্দিষ্ট পথেই উদিত হয়। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোরা সব কেমন আছিস? শুনলাম আসাদ এসেছে, সে কোথায়?
রোজী সাজেদার একটা হাত ধরে বলল, ভাবি তো দারুণ সুন্দরী? তারপর তাদেরকে ভাইয়ার ঘরে নিয়ে এসে বসতে বলে বলল, একটু আগেও ছিল। তোমরা আসবে সে কথা আমাকে বলছিল। বোধ হয় নামায পড়তে গেছে।
রোজীর মা আনোয়ারা অন্য ঘরে ছিল। রোজী কারো সঙ্গে কথা বলছে শুনে জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কথা বলছিস?
রোজী বলল, দেখবে এস না আম্মা, নাদিম ভাই ভাবিকে নিয়ে এসেছে।
আনোয়ারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় বলল, ওমা তাই নাকি? খালেক যে বলে গেল, ওরা সন্ধ্যের পর আসবে।
আনোয়ারা সেখানে এলে, নাদিম সাজেদাকে ইশারা দিয়ে কদমবুসি করে উঠে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন চাচি আম্মা?
আনোয়ারা দোয়া করে বলল, আল্লাহর ফজলে ভাল আছি। তোমাদের বাড়ির খবর সব ভালো তো?
জি ভালো।
সাজেদা কদমবুসি করলে আনোয়ারা তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে চিবুক ধরে বললেন, নাদিম, তোর বৌ খুব সুন্দরী। দোয়া করি, আল্লাহ তোদেরকে সুখী করুক। এমন সময় মাগরিবের আযান শোনা গেল।
নাদিম রোজীকে বলল, তুই তোর অবিকে নিয়ে নামায পড়, আমি মসজিদে যাচ্ছি।
নাদিম মসজিদে নামায পড়ে আসাদকে দেখতে না পেয়ে ফিরে এসে দেখল, রোজী সাজেদার সঙ্গে গল্প করছে।
নাদিমকে একা দেখে রোজী বলল, ভাইয়াকে মসজিদে পেলে না?
নাদিম বলল, না রে, কোথায় গেল বল তো?
রোজী বলল, তোমরা সন্ধ্যের পর আসবে বলেছিলে, তাই হয়ত কোথাও গেছে। এক্ষুনি এসে পড়বে। তোমরা দুজনে বসে কথা বল। আমাকে আম্মা ডাকছিল কেন দেখে আসি। কথা শেষ করে সে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর রোজী যখন ফিরে এল তার কয়েক মিনিটের মধ্যে আসাদ এসে তাদেরকে দেখে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, এতদিন পর, তা হলে সত্যিই এলে? তারপর সাজেদার দিকে চেয়ে তাকে মুখে নেকাব দিতে দেখে বলল, কি ভাবি, খালি হাতে মুখ দেখাবেন না বুঝি?
রোজী বলে উঠল, হ্যাঁ, ভাইয়া। আগে কিছু মালপানি ছাড়।
আনোয়ারা ওরা আসবে জেনে আসরের নামায পড়ে নাস্তা তৈরি করে রেখেছিল। নামায পড়ে নাশতা নিয়ে ঘরে ঢুকল।
আসাদমাকে দেখে কলল, আম্মা কিছুটাকা দাও তো, নাদিমের বৌয়ের মুখ দেখব।
নাদিম বলল, কি পাগলামি করছিস? না চাচী আম্মা টাকা দেয়া লাগবে না। তারপর আসাদকে বলল, তোকে চিনে না তাই মুখে নেকাব দিয়েছে। তুই তো একদিনও আমাদের বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে পরিচয় করলি না।
আনোয়ারা বলল, নাদিম ঠিক কথা বলেছে। তারপর তাদেরকে নাশতা করতে বলে রোজীকে বলল, নাশতা খাওয়ানো হয়ে গেলে রান্নাঘরে আসবি।
আনোয়ারা চলে যাওয়ার পর সাজেদা মুখের নেকাব সরিয়ে আসাদকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার বন্ধুর কাছে আপনার অনেক গুণগান শুনেছি। আরও শুনেছি। আপনাদেরকে বিয়ের কথা জানায়নি বলে মনে কষ্ট পেয়েছেন।
আসাদ হেসে উঠে বলল, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না, সব বাজে কথা।
এখানে আসার সময় নাদিম সাজেদাকে বলেছিল, তুমি কথায় কথায় মমতাজকে বিয়ে করার ব্যাপারে আসাদের মতামত জেনে নিও। তাই আমাদের কথা শুনে বলল, বাজে কথাও অনেক সময় সত্য হয়। যাক গে, আমি কিন্তু আপনার জন্য একটা বিয়ের পয়গাম নিয়ে এসেছি। যদি মনে কিছু না করেন এবং বলার অনুমতি দেন, তা হলে বলব। নচেৎ…..
সাজেদাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে আসাদ বলে উঠল, এতবড় সুসংবাদ শুনে মনে কিছু করব কেন? আপনি নিঃসংকোচে বলুন।
আমার ননদ মমতাজকে আপনার হাতে দিতে চাই।
কথাটা শুনে আসাদ বন্ধুর সামনে খুব লজ্জা পেল। কিন্তু মনে তখন তার আনন্দের জোয়ার বইছে। সে নাদিমের বাড়িতে অনেকবার গেছে। তার সাথে খাওয়া-দাওয়া। করেছে। ঢাকাতে চাকরি পাওয়ার খবরটা জানাতে গেলে নাদিম ও তার মা না খাইয়ে ছাড়েনি। খাওয়ার সময় মমতাজ বলেছিল, আসাদ ভাই, ঢাকায় গিয়ে আমাদের কথা ভুলে যাবে। ঐ যে কথায় বলে চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল। আসাদ তখন কিছু বলার জন্য তার মুখের দিক চাইতে গিয়ে দেখল, মমতাজের চোখ দুটো পানিতে ভরা। তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নাদিমের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুই কি মমতাজের কথাটা বিশ্বাস করিস?
নাদিম বলল, এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তাই লোকে বলে। তবে কথাটা অনেক ক্ষেত্রে ঘটে থাকলেও সব ক্ষেত্রে ঘটে না। অনেক সময় দেখা গেছে, চোখের আড়াল হলে আরো বেশি মনে পড়ে।
ঢাকায় চাকরি হওয়ার পর আসাদের বিয়ের অনেক সম্বন্ধ এসেছে। কিন্তু সে মমতাজের কথা ভেবে এখন বিয়ে করবে না বলে কাটিয়ে দিয়েছে। রোজীর জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। আসাদের মায়ের খুব ইচ্ছা, ছেলে ও মেয়ের বিয়ে একসঙ্গে দেয়ার। গতকাল এক জায়গা থেকে ছেলের তিন চারজন গার্জেন এসে রোজীকে দেখে পছন্দ করে গেছে। কথাবার্তাও প্রায় পাকা। শুধু বিয়ের দিনটা বাকি। আসাদের জন্য মেয়ে পছন্দ হলে দিন ঠিক হবে।
আজ নাদিমের স্ত্রীর কথা শুনে আসাদ লজ্জায় কিছু বলতে না পেরে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
নাদিম আসাদের অবস্থা বুঝতে পেরে তার লজ্জা কাটাবার জন্য বলল, কি রে, তোর ভাবির কথায় উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
আসাদ নাদিম বলে তাকে জড়িয়ে ধরে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ভাবিকে মায়ের কাছে প্রস্তাব দিতে বল।
সাজেদা বলল, আরে ভাই তা তো দেবই। কিন্তু তুমি অত লজ্জা পাচ্ছ কেন? লজ্জা তো মেয়েদের ব্যাপার। তারপর বলল, এই যা, আপনাকে তুমি করে বলে ফেললাম।
আসাদ নাদিমকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তাতে কি হয়েছে বরং এটাই তো স্বাবাভিক। এতক্ষণ আপনি করে বলে দূরে রেখেছিলেন, এখন কাছে টেনে নিলেন।
সাজেদা বলল, কাছে টানার জন্যই তো এসেছি, তাই হঠাৎ করে ঐ রকম বলে ফেললাম।
নাদিম বলল, জানিস কর্তারা মমতাজের জন্য ছেলের সন্ধান করছে জানতে পেরে তোর কথা মনে পড়ল। তাই সে কথা আব্বা-আম্মাকে বললাম। বন্ধুর বোনকে তুই বিয়ে করবি কিনা তারা আমাকে জানতে বলল। তোর মনের খবর আমি অনেক আগেই একটু বুঝতে পেরেছিলাম। আমি বললে তুই লজ্জা পাবি, তাই ভাবলাম তোর ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে যাই। তাতে এক কাজে দুকাজ হবে। তোর ভাবি তোর মতামত জানবে আর তোদের সঙ্গে ওর পরিচয়ও হবে।
আসাদ বলল, রোজীরও বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আম্মার ইচ্ছা, আমাদের দুজনের বিয়ে একসঙ্গে দেবে। সেই জন্যে শুধু বিয়ের দিন ঠিক হতে বাকি আছে।
নাদিম স্ত্রীকে বলল, সবই তো শুনলে, আর দেরি করছ কেন? যাও চাচি আম্মার কাছে গিয়ে প্রস্তাবটা দাও।
সাজেদা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলে আনোয়ারা বলল, বৌমা তুমি এখানে এলে কেন? ঘরে যাও, আমরা আসছি। তারপর আচ্ছা ঠিক আছে বলে রোজীকে বলল, তুই তরকারীটা দেখ, অল্প একটু বাকি আছে। আমি বৌমাকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছি। আর শোন তরকারী নামিয়ে আমাকে ডাকবি, ওদেরকে খেতে দেব।
সাজেদাকে নিজের রুমে নিয়ে এসে আনোয়ারা তার বাপের বাড়ির সব খবরাখবর নিতে লাগল।
সাজেদা সে সবের উত্তর দিতে দিতে এক সময় প্রস্তাবটা দিল।
আনোয়ারা আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, এটা তো খুব ভালো কথা। আমি মমতাজকে দেখেছি। সে আগে কয়েকবার নাদিমের সঙ্গে এসেছে। আমার কোনো অমত নেই। আসাদকে জিজ্ঞেস করে তোমাদের জানাব।
সাজেদা বলল, চাচি আম্মা, আমি আসাদ ভাইয়ের মতামত নিয়ে আপনাকে প্রস্তাব দিয়েছি।
আনোয়ারা বলল, ওমা, তাই নাকি? তা হলে তো কোনো কথাই নেই। এমন সময় রোজী তরকারীর হাঁড়ি চুলো থেমে নামিয়ে রেখে মাকে ডাকতে এসে সাজেদার কথা শুজে জিজ্ঞেস করল, কিসের প্রস্তাব মা?
আনোয়ারা বলল, বৌমা আসাদের জন্য মমতাজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
রোজীরও মমতাজকে খুব পছন্দ। সে ভাবি হবে শুনে আনন্দে টগবগিয়ে উঠে। বলল, সত্যি বলছ মা?
হ্যাঁ রে সত্যি।
ভাইয়া জানে?
তার মতামত নিয়েই বৌমা প্রস্তাব দিয়েছে।
জান মা, মমতাজ আমার চেয়ে দুক্লাস নিচে পড়ত। ওর সাথে আমার খুব ভাব। ভাবি হলে যা মজা হবে না! মমতাজের সঙ্গে কতবার ওদের বাড়িতে গেছি।
আনোয়ারা বলল, আল্লাহপাক রাজি থাকলে হবে মা। তুই বৌমাকে ও-ঘরে দিয়ে রান্নাঘরে আয়। আমি ভাত বাড়ছি। ওদেরকে খাইয়ে দে, রাত হয়ে যাচ্ছে।
খাওয়া-দাওয়ার পর নাদিম বাড়ি ফিরতে চাইলে আনোয়ারা বলল, আজ থেকে যাও না বাবা, কাল সকালে যাবে। এত রাতে বৌমাকে নিয়ে যেতে অসুবিধে হবে।
নাদিম বলল, না চাচি আম্মা থাকতে পারব না। বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে। এই এক মাইলের রাস্তা রিকশায় যেতে কতক্ষণ আর সময় লাগবে?
নাদিম স্ত্রীর কাছে আসাদের মায়ের মতামত শুনেছে। ফেরার আগে তাকে বলল, আমাদের কর্তারা একদিন কথাবার্তা বলার জন্য আসবে। কবে আসবেন, আমি জানাব। তারপর আসাদকে জিজ্ঞেস করল, তুই কতদিন থাকবি?
আর এক সপ্তাহ আছি।
ঠিক আছে, এর ভিতরেই ওনাদেরকে আসতে বলব।
আনোয়ারা বলল, তুমিও সঙ্গে এস।
জি আসব বলে সাজেদাকে নিয়ে রওয়ানা দিল।
আসাদ বড় রাস্তা পর্যন্ত এসে তাদেরকে রিকশায় তুলে দিল। মাস দুয়েকের মধ্যে আসাদের সঙ্গে মমতাজের বিয়ে হয়ে গেল।
মমতাজ শ্বশুর বাড়িতে এসে বছর পাঁচেক বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে ছিল। তারপর তাদের সংসারে কালোছায়া নেমে এল। প্রথমে আসাদের চাকরি চলে গেল। আসাদ সৎ ও ধার্মিক। সহকর্মীরা ও নিম্নতম কর্মচারীরা তার জন্য ঘুষ খেতে পারত না। উপরওয়ালারাও এ ব্যাপারে তার উপর অসন্তুষ্ট। এবারে সে বসের বিরাট অংকের ঘুঘ খাওয়ার ব্যাপার নিয়ে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছিল। আর অফিসের দুএকজন ছাড়া সবাই তার উপর অসন্তুষ্ট ছিল। এই সুযোগে সবাই মিলে যুক্তি করে বসের ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারটা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে দিল। ফলে তার চাকরি চলে যায়। অন্য কোথাও অনেক চেষ্টা করেও কোনো কিছু জোগাড় করতে না পেরে বাড়ি ফিরে এল।
ঘটনাটা জেনে আসাদের মা বলল, আজকাল শিক্ষিত লোকেরা যদি এরকম হয় তা হলে অশিক্ষিত থাকাই ভালো। সরকার রেডিও-টিভিতে যে দেশের লোককে শিক্ষা গ্রহনের জন্য এত গলাবাজি করছে, এত স্কুল-কলেজ তৈরি করছে, সে সব করে কি লাভ হচ্ছে? দেশের সব লোক শিক্ষিত হলে তো সবাই চরিত্রহীন হয়ে দেশটাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবে।
আসাদ বলল, তোমার কথাটা যদিও ঠিক নয়, তবু একেবারে অস্বীকার করতে পারছি না। আসল কথা কি জান আম্মা, যারা দেশের লোককে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে এতকিছু করছে তারাই চরিত্রহীন ও দুর্নীতিবাজ। আর তারা শিক্ষিত হলেও শুধু ডিগ্রী নেয়ার জন্য লেখাপড়া করেছে, শিক্ষা গ্রহন করার জন্য করেনি। সেই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা না পেয়ে এবং না মেনে আল্লাহ ও রসুলকে (দঃ) ভুলে গেছে।
আনোয়ারা বলল, তোর দাদাজী বলতেন, ছেলেমেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা ও সেইমতো অনুশীলন দিয়ে মানুষ না করলে শুধু স্কুল-কলেজের বিদ্যার্জন করালে ক্রমশ তারা বিজাতীয়দের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তারা, চরিত্রবানও হতে পারবে না।
আসাদ বলল, দাদাজী খুব খাঁটি কথা বলেছিলেন।
আসাদ বাড়িতে থেকে চাষবাস দেখাশোনা করতে লাগল। কিন্তু তাতে করে সংসারে আগের মতো সচ্ছলতা রইল না। ছোট ভাই জাকির মাস্টার ডিগ্রী পড়ার সময় এক বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে গোপনে লাভ ম্যারেজ করেছিল। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে একটা ছোটখাট অফিসে চাকরি নিয়েছিল। শ্বশুর বিয়ের কথা জানতে পেরে এবং জাকিরের পরিচয় পেয়ে প্রথমে মেয়েকে রাগারাগি করে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলেন, মেয়ে কিছুতেই রাজি হয়নি। শেষে বাধ্য হয়ে তিনি জামাইকে একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জাকির স্ত্রীকে নিয়ে গুলশানের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। বেতন মোটামুটি বেশ ভালো হলেও স্ত্রীর সব খায়েশ মেটাতে পারে না। তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই কলহ লেগে থাকে। এরপর আর দেশে মা-ভাইকে পাঠাবে কি।
আসাদ জানতে পেরে ঢাকায় জাকিরের বাসায় একবার গিয়েছিল। জাকির ভুল স্বীকার করে বড় ভাইয়ের কাছে মাফ চেয়ে টাকা-পয়সা দেয়ার অপারগতার কারণ খুলে বলেছে। সেদিন জাকির ভালো ব্যবহার করলেও তার স্ত্রী আসাদের সঙ্গে কথাও বলেনি। তারপর আসাদ আর ছোট ভাইয়ের কাছে যায়নি।
আসাদের বাপ বাড়ি করার সময় দশ বিঘে জমি গ্রামের এক ধনাঢ্য লোকের কাছে দশ বছরের জন্য সাফকওলা রেখে বিশ হাজার টাকা নিয়েছিল। আসাদ সে খবর জানত না। সে তখন কলেজে পড়ে। সাফকওলার মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে সেই লোক কাগজপত্র নিয়ে আসাদের বাড়িতে এসে সব কথা জানিয়ে বলল, গত বছর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আমরা এ বছর জমির দখল নিয়ে চাষাবাদ করব। দলিল মোতাবেক আমরা এখন আপনাদের জমির মালিক। তবে আপনি যদি এক মাসের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করতে পারেন তা হলে আপনাদের জমি আপনাদের থেকে যাবে। আমি দলিল ফিরিয়ে দেব। আপনার বাবা খুব ভালো লোক ছিলেন, আপনিও শিক্ষিত। যা ভালো বুঝবেন করবেন।
এইসব শুনে আসাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কোনো কথা বলতে পারল না।
আসাদের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে ঐ লোক বলল, মনে হচ্ছে আপনার বাবা আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। আপনি কাগজপত্র দেখুন, তারপর আপনার মায়ের সঙ্গে কথা বলুন। উনি বোধ হয় সবকিছু জানেন।
আসাদ দলিল পড়ে ফেরত দেয়ার সময় বলল, আপনার অনুমান সত্য। আব্বা আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। আপনি এখন যান, আমি আম্মার সঙ্গে কথা বলে পরে আপনাকে জানাব।
লোকটি চলে যাওয়ার পর আসাদ মাকে সব কথা জানাল।
আনোয়ারা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোর আব্বা যখন দোতলা বাড়ি করতে চাইল তখন অত টাকা কোথায় পাবে জিজ্ঞেস করতে জমি সাফকওলা রেখে টাকা নেয়ার কথা বলেছিল। তবে কতটা জমি, কত বছরের জন্য, কত টাকা নিয়েছিল তা আমাকে বলেনি।
আসাদ বিষণ্ণ গলায় বলল, কিন্তু আম্মা, আব্বা মারা যাওয়ার পরও আমাকে জানাওনি কেন? এতদিনে হয়ত কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। এখন কি হবে? কোল কাদালের বিঘে দেড়েক জমি ছাড়া সব জমি আব্বা সাফকওলা করে গেছে। এখন আমি কি করে এত টাকা জোগাড় করব?
আনোয়ারা ছেলের হতাশা দেখে বলল, এত ভেঙে পড়ছিস কেন? ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই। তুই একবার জাকিরের কাছে যা। তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে টাকাটা জোগাড় করে দিতে বলবি।
আসাদ বলল, সে কোথা থেকে দেবে? চাকরি করে যা পায় তাতে বাসা ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এতদিনে হয়ত ছেলেমেয়ে হয়ে সংসার আরও বড় হয়েছে।
আনোয়ারা জাকির ছোট বলে তাকে বেশি ভালবাসত। প্রথম যখন তার কীর্তিকলাপ শুনে তখন মনে খুব আঘাত পেয়ে খোঁজ খবর করেনি। তবে মাঝে মাঝে তার কথা মনে পড়লে চোখের পানিতে বুক ভাসায়। এখন আবার তার কথা আমাদের মুখে শুনে চোখের পানি রাখতে পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, জাকির যে এরকম হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। তুই আমাকে নিয়ে চল, অনেক বছর তাকে দেখিনি।
আসাদ ছোট ভাইকে অত্যন্ত স্নেহ করত। আজও করে। যদিও সে বড় ভাইয়ের ও মায়ের কোনো খোঁজ-খবর রাখেনি। মায়ের কথা শুনে বলল, জাকিরের বৌ খুব বড়লোকের মেয়ে, তোমাকে সে সহ্য করতে পারবে না। জাকির হয়ত কিছু বলবে না, কিন্তু তার বৌ আমাদেরকে দেখলে খুব অসন্তুষ্ট হবে। তার উপর যখন জানবে আমরা টাকার জন্য এসেছি তখন আমাদেরকে কি বলবে জানি না, তবে জাকিরের সঙ্গে তার খুব মনোমালিন্য হবে। তার চেয়ে আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছে তাই হোক।
আনোয়ারা দৃঢ়স্বরে বলল, বৌ যাই করুক না কেন আমি যাবই। আর টাকা দেবে নাই বা কেন? সে কি বাপের সন্তান নয়? আমি কি তাকে পেটে ধরিনি? তুই যদি নিয়ে যাস, তা হলে আমি খালেককে নিয়ে যাব।
আসাদ বলল, সেখানে গেলে তুমি দুঃখ পাবে। তাই নিয়ে যেতে চাইনি। একান্তই যখন যেতে চাচ্ছ তখন আমিই তোমাকে নিয়ে যাব। খালেককে বলতে হবে না।
পরের দিন আসাদ মাকে নিয়ে ঢাকায় জাকিরের বাসায় গেল। কিন্তু সেখানে তাকে পেল না। যারা সেই বাসায় আছে তারা তার কথা জানে না বলে বলল। আসাদ জাকিরের অফিসের ঠিকানা জানত। মাকে একটা হোটেলে রেখে অফিসে গিয়ে শুনল, সে আজ থেকে এক বছর আগে চাকরি নিয়ে ফ্যামিলিসহ আমেরিকা চলে গেছে।
হোটেলে ফিরে এসে মাকে জাকিরের আমেরিকা চলে যাওয়ার কথা বলল।
আনোয়ারা বলল,আমেরিকার ঠিকানা জেনেছিস?
আসাদ বলল, জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা জানে না বলল।
আনোয়ারা আবার বলল, ওর শ্বশুরের ঠিকানা জানিস না?
আসাদ বলল, না।
আনোয়ারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সব কিছু আল্লাহপাকের ইচ্ছা। একদিন হোটেলে থেকে আসাদ মাকে নিয়ে বাড়ি ফিলে এল। তারপর আসাদ মহাজনের বাড়িতে গিয়ে তাকে অপারগতার কথা জানিয়ে এল। এরপর থেকে আসাদের সংসারে চরম দুর্দিন নেমে এল। এতদিনে তার দুটো ছেলে ও একটা মেয়ে হয়েছে। মেয়েটা হওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে মমতাজ কঠিন অসুখে ভুগছে। আসাদ এতগুলো মুখের আহার জোটাবে, না স্ত্রীকে ভালোভাবে চিকিৎসা করাবে? শেষে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে রাজশাহী টাউনে এসে চেষ্টা-চরিত্র করে একটা বড় লাইব্রেরীতে সেলসম্যানের কাজ নিল। নতুন বলে মাসে দেড় হাজার টাকা বেতন। সেই টাকাতেই থাকা-খাওয়া করতে হয়। তারপর যা বাঁচে, সেই টাকা নিয়ে মাসে মাসে বাড়িতে আসে।
মেয়ে জামাইয়ের ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা শুনে নাদিমের বাড়ির সকলে দুঃখ পেল। কিন্তু তাদের জন্য কিছু করারও তাদের ক্ষমতা নেই। তবু চাষের সময় যখন যে ফসল হয় তা থেকে কিছু কিছু মমতাজকে দেওয়া হয়।
নাদিম মাঝে মাঝে যতটা পারে ছোট বোনের হাতে টাকা-পয়সা দিয়ে আসে।
আফ্রিদা ছোট মেয়ে মমতাজকে সব থেকে বেশি ভালবাসে। সে মেয়ের সংসারের দুরবস্থার কথা জেনে এবং মেয়ের কঠিন অসুখের কথা শুনে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। গোপনে ছোট ছেলে আবুল খায়েরের হাতে চাল, ডাল, তরী-তরকারী মাঝে মাঝে পাঠায়।
একদিন সাজেদা শাশুড়ীর এই ব্যাপারটা জানতে পেরে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবল, অন্য শ্বশুর বা শাশুড়ীরা জানতে পারলে তারা কি সহ্য করবে?
ভয়ে শাশুড়ীকে যেমন কিছু বলতে পারল না, তেমনি স্বামীকেও বলতে পারল না।
একবার আফ্রিদা যখন বাড়ির চাকরের হাতে সের দশেক চাল পাঠাল তখন ছোট জা ফাহমিদা দেখে ফেলে। এক ফাঁকে সে কথাটা সাজেদাকে জানিয়ে বলল, এটা যদি মেজ বুবু দেখত তা হলে খুব খারাপ হত।
সাজেদা শুনে কোনো কথা বলল না। চিন্তা করল, এবার যখন অন্যের চোখে পড়েছে তখন নাদিমকে জানান উচিত। রাতে ঘুমাবার সময় সাজেদা স্বামীকে বলল, তুমি যদি সাহস দাও, তা হলে একটা কথা বলতে চাই।
নাদিম বলল, কি এমন কথা যার জন্য সাহস দিতে বলছ? বল কি বলবে?
তার আগে তুমি বল, কথাটা শুনে রেগে যাবে না।
নাদিম ভাবল, নিশ্চয় সাংসারিক ব্যাপারে কারো সঙ্গে কিছু হয়েছে। বলল, রাগের কথা বললে রেগে যাওয়াটা কি অন্যায় হবে?
না, তা কেন হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, রাগ করব না, এবার বল।
আম্মা যে গোপনে মমতাজকে প্রায়ই সবকিছু দিয়ে পাঠান, তা আমি অনেক আগে জেনেছি। কিন্তু আজ যখন চাকর জামালকে দিয়ে চাল পাঠাচ্ছিল তখন ছোট মা দেখে ফেলেছে।
নাদিম কথাটা শুনে খুব অবাক হল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আম্মা এরকম করবে সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাজেদা মনে করল, হয় সে খুব রেগে গেছে, নচেৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। কারণ সাজেদা জানে, নাদিম রেগে গেলে চুপ করে রাগটা হজম করে। আর সে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই কথা ভেবে স্বামীর গায়ে হাত দিয়ে বলল, কি হল, কিছু বলছ না যে?
নাদিম বলল, মমতাজকে যতটা সাহায্য করার আমরা করি। তারপরও আম্মা এ রকম করবে তা কল্পনাও করতে পারছি না। ছোটমা কাউকে বলবে না ঠিক। কিন্তু পরে অন্যেরা জানতে পারলে আম্মার মান-সম্মান এতটুকু থাকবে না। আম্মা মমতাজকে ভীষণ ভালবাসে। তাই তার অভাব দেখে সহ্য করতে না পেরে স্নেহের দুর্বলতার কারণে এই কাজ করছে। কথাটা বলে তুমি খুব ভালো করেছ। চিন্তা করে দেখি, কি করা যায়।
দুদিন পর নাদিম ছোটমাকে ঐ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হল তারপর আব্বা ও চাচাদেরকে মমতাজকে এনে চিকিৎসা করানোর কথা বলল।
সবাই তার কথায় সায় দিল।
নাদিম একদিন সুলতানগঞ্জ গিয়ে মমতাজকে নিয়ে এসে অলোক ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করাতে লাগল। প্রায় ছমাস চিকিৎসা করেও সম্পূর্ণ ভালো হল না। যতদিন ওষুধ খায় ততদিন একটু ভালো থাকে। ওষুধ খাওয়া বন্ধ করলে যেইকে সেই। শেষে এক পীর সাহেবের তদবীর করাতে কিছুটা উন্নতি হল। কিন্তু পুরোপুরি ভালো হল না। এবার আসাদ রাজশাহী থেকে এসে মমতাজকে নিয়ে গেল।
মমতাজ চলে যাওয়ার মাস দুই পর আফ্রিদা গোপনে তাকে চাল পাঠাবার সময় মেজজা আয়মন দেখে ফেলল। দেখার পর বড় জাকে বলল, মমতাজকে যা দেয়ার তার বাপ চাচারা দেয়, তুমি আবার সবাইকে গোপন করে দাও কেন? কারটা দাও? এক সংসারের জিনিস দাও কি করে? এরকমভাবে আরও কত কি কতদিন ধরে দিচ্ছ তা আল্লাহই জানে। এই সব বলে ঝগড়া করতে চাইল।
কিন্তু আফ্রিদা তার একটা কথারও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
আয়মন কাউচাতে কাউচাতে এক সময় চুপ করে গেল। কিন্তু সব জায়েরা জেনে গেল।
রাতে আয়মন স্বামীকে কথাটা জানিয়ে বলল, এবার আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া দরকার। এক সংসারে থাকলে বড় বুবু মমতাজকে সব কিছু দিয়ে দিয়ে সংসারের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।
সুলতান বলল, অত কথা বলছ কেন? যা বলছি শুন আমিও কিছুদিন থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। দেখি, অন্য ভাইদের সঙ্গে কথা বলে, তারা কি বলে। আমি একা প্রথমে বলে দোষী হতে যাব কেন?
সুলতানের এই রকম ভাবার কারণ আছে। তার বড় ছেলে ইলিয়াস এম. এ. পাস করে একটা ভালো চাকরি করছে। সংসার এক জায়গায় আছে বলে বেতনের টাকা ছোট মায়ের হাতে দিয়ে দিতে হয়। ছেলের টাকা পাচ্ছে না। তাই সে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করছে।
আবিদা যখন স্বামীকে ঘটনাটা জানাল তখন আজিজ স্ত্রীকে বলল, এ ব্যাপারে তুমি বড় ভাবিকে কিছু বলল না। চুপ করে দেখ, মেজ ভাই ও মেজ ভাবী কি করে।
কুদ্দুস স্ত্রীর কাছে শুনে সেজ ভাই আজিজের মতো বলল, মমতাজের খুব অভাব, তার উপর সে চিররুগ্ন। তাই হয়ত বড় ভাবি তাকে এটা-ওটা দিয়ে সাহায্য করে। কই, অন্য কোনো মেয়েকে তো দেয় না। খবরদার, এ নিয়ে তুমি, বড় ভাবিকে কিছু বলা তো দূরে থাক, মেজভাবি ও সেজ ভাবির সঙ্গে কখনও আলোচনাও করবে না। বড় ভাবি মায়ের মতো আমাদেরকে মানুষ করেছে। তার কোনোদিন কোনো দোষ ধরবে না।
ফাহমিদা এ বাড়িতে যখন বৌ হয়ে আসে তখন আফ্রিদা তাকে সবকিছু বুঝিয়ে পড়িয়ে শিখিয়েছে। কাজে-কামে দোষ করলে অন্য জায়েরা ট্যাক ট্যাক করলেও বড় জা কোনদিন কিছু বলেনি। বরং অন্য জাদের বলেছে, নতুন বৌ, তার উপর কতই বা বয়স, এরকম একটু-আধটু দোষ হবেই। তোরা যখন নতুন বৌ হয়ে এসেছিলি তখন তো আমি তোদেরকে কিছু বলিনি। তারপর ফাহমিদাকে কাঁদতে দেখে আপন বোনের মতো তাকে প্রবোধ দিয়েছে আর যাতে ঐরকম দোষ না হয়, সে জন্যে কত বুঝিয়েছে। বড় জা যে দেবরদের গু-মুত নেড়ে মানুষ করেছে তা ফাহমিদা জানে। আর দেবররা যে বড় ভাবিকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে তাও জানে। এখন স্বামীর কথা শুনে বলল, বড় বুবু যে অনেকদিন থেকে মমতাজকে সবকিছু গোপনে দেয়, তা আমি অনেক আগে থেকে জানি। কই, কোনোদিন কি তোমাকে কিছু বলেছি? বড় বুবু কাকে কি দিল না দিল ওসব নিয়ে কখনও ভাবিনি। আজ মেজ বুবু দেখে ফেলে তাকে অনেক কথা। শুনিয়েছে।
কুদ্দুস বলল, সে বলুক গে তাতে আমাদের কি? বড় অবিকে যখন মায়েরমতো জানি তখন সে যা খুশি করুন, আমি কোনো দিন কিছুকলবনা। আর তুমিও বলবেনা।
পরের দিন দুপুরে সাজেদা খিড়কী পুকুরে গোসল করতে গিয়ে দেখল, মেজ ও সেজ শাশুড়ী গোসল করে ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি-সব কথা বলাবলি করছে। সাজেদাকে দেখে তারা চুপ করে গেল।
এই পুকুরটা বাড়ির পিছন দিকে। পুরুষদের সেদিকে যাওয়া নিষেধ। যদি কোনো কারণে যেতে হয়, তা হলে সেদিকে মেয়েরা কেউ আছে কিনা জেনে তারপর যায়। তবু ঘাটের তিন দিকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা।
সাজেদা ঘাটে আসার পর মেজ ও সেজ চলে গেল। সে হাতে-পায়ে সাবান মাখছিল এমন সময় ফাহমিদা গোসল করতে এল। প্রায় সময় তারা দুজনে একসঙ্গে গোসল করে।
সাজেদা তাকে জিজ্ঞেস করল, ছোট মা, কি ব্যাপার বল তো, মেজ মা ও সেজ মা কি-সব কথা বলাবলি করছিল; আমাকে দেখে আলাপ বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
ফাহমিদা অনুমান করে বলল, গতকালের ব্যাপারটা নিয়ে হয়ত বলাবলি করছিল।
আমার শ্বশুর কি শুনেছে?
তা বলতে পারব না। তুমি নাদিমকে কিছু বলেছ নাকি?
না বলিনি। ভাবছি আজ বলব।
তারপর তারা আর কোনো কথা না বলে দুজন দুজনের গায়ে সাবান মাখিয়ে গোসল করে ফিরে এল।
রাতে নাদিম ঘরে এলে সাজেদা ঘটনাটা তাকে জানাল।
নাদিম শুনে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, দেখছি। আমাকেই এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
সেই রাতেই খাওয়া-দাওয়ার পর সব চাচা-চাচিরা চলে যেতে নাদিম আব্বা আম্মাকে বলল, একটা কথা তোমাদেরকে বলতে চাই। কথাটা বললে বেয়াদবি হবে, তাই মাফ চেয়ে নিচ্ছি।
রহিম কিছু না বলে চুপ করে রইল।
তাই দেখে আফ্রিদা বলল, কি বলবি বল।
এবার আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত।
আফ্রিদা খুব অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কেন? তোকে কি কেউ এ কথা বলতে বলেছে?
না আম্মা, আমাকে কেউ বলেনি। আমি মনে করি, চাচা-চাচিদের সাথে আমাদের কোনো বিষয়ে গোলমাল হওয়ার আগে আলাদা হয়ে গেলে সবার ইজ্জত রক্ষা হবে। তা ছাড়া আজ হোক কাল হোক, একদিন না একদিন তো আলাদা হতেই হবে। চিরকাল কি কেউ এক সংসারে থাকে?
আজ এশার নামাযের পর রহিম যখন মসজিদ থেকে বেরোচ্ছিল তখন সুলতান তাকে গতকালের ঘটনাটা বলে। এখন নাদিম যা বলল ঠিক সেই কথাই বলেছে। রহিম তাকে তখন বলেছে, ঠিক আছে, একদিন সব ভাই বসে সে ব্যাপারে আলাপ করে যা করার করা যাবে।
এখন নাদিমের কথা শুনে রহিম তাকেও ঐ একই কথা বলল।
নাদিম বলল, তাই করেন আব্বা। তারপর সে নিজের রুমে চলে গেল।
ছেলের ও স্বামীর কথা শুনে আফ্রিদা ভাবল, আমি মমতাজকে মাঝে মাঝে এটা ওটা দিই বলে কি নাদিম জানতে পেরে ঐ কথা বলল? আর নাদিমের আব্বাও কি এ ব্যাপারে শুনে এই কথা বলল? না দেবররা তাদেরকে আলাদা হওয়ার কথা বলেছে? স্বামীকে চুপ করে ভাবতে দেখে বলল, কি ভাবছ, আমার মনে হয় নাদিম টিক কথাই বলেছে।
রহিম বলল, আমার কাছেও তাই মনে হল বলে তো ঐ কথা বললাম।
নাদিম নিজের রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, আম্মা কি আমার কথা শুনে মনে কষ্ট পেল? মনে মনে বলল, আম্মা আমাকে মাফ করে দিও। এছাড়া তোমার ইজ্জত বাঁচাবার অন্য কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছ থেকে ফিরে এসে স্বামীকে চুপ করে শুয়ে থাকতে দেখে সাজেদা মনে করল, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবু ঘাড় তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, জেগে আছে। বলল, কিছু ভাবছ মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, ভাবছি।
কি ভাবছ?
সবাই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা আব্বা-আম্মাকে বললাম। কি, ঠিক করিনি?
হ্যাঁ, ঠিক করেছ। কিন্তু…বলে সাজেদা থেমে গেল।
কি হল, কিন্তু বলে থেমে গেলে কেন?
আমার মনে হয় আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আম্মা আরও বেশি মমতাজকে ঐ সব দিবে।
তাতে কি হয়েছে? তখন তো আর কারো কিছু বলার থাকবে না।
তা থাকবে না, তবে সংসারের কোনোদিন উন্নতি হবে না এই কথা শুনে নাদিম খুব রেগে গেল। রাগ সামলাবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
সাজেদা তা বুঝতে পেরে চিন্তা করল, কথাটা বলা ঠিক হয়নি। ভয়ে ভয়ে বলল, কথাটা বলে বোধ হয়ে আমি ভুল করেছি, সে জন্যে মাফ চাইছি। নাদিম ততক্ষণে রাগ সামলে সাজেদার কথায় খুশি হয়ে বলল, ভুল করলেও কথাটা ঠিক বলেছ। তবে
এরকম কথা আর কোনোদিন মাথার মধ্যে এনো না। সংসারের উন্নতি-অবনতি মানুষের ভুল কাজের দ্বারা হলেও ভাগ্যের উপর তার চাবিকাঠি। আমাদের ভাগ্যে যদি উন্নতি থাকে, তা হলে যেমন করে হোক তা হবেই। আর যদি তা না থাকে, তা হলে আম্মাকে অসিলা করে আমাদের দুঃখ-কষ্ট হবে। সব কিছু আল্লাহপাকের ইশারা। বাবা মার দোষ কোনোদিন ধরবে না। যদি তারা দোষ করে থাকে, মনে করবে এটাই ভাগ্য। বাবা-মার দোষ ধরা কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিষেধ। যদি তারা ইসলামের পরিপন্থী কোনো কাজে লিপ্ত থাকে, তবে তাদেরকে আলাদা করে দিয়ে তাদের ভরণপোষণ করে যেতে হবে। কোনো ব্যাপারেই তাদের মনে এতটুকু কষ্ট দেয়া চলবে না। জেনে রেখো, পিতামাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত। তাদেরকে সন্তুষ্ট রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় করতে পারলে আল্লাহপাক বেহেশতের ওয়াদা করেছেন। তোমাকে আবার বলছি, আব্বা-আম্মার দোষ যেমন কোনোদিন ধরবে না, তেমনি তা অন্য কাউকেও বলবে না। তারপর সে চুপ করে গেল।
সাজেদা বুঝতে পারল, এবার নাদিম ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই সেও ঘুমিয়ে পড়ল।
কয়েকদিন পর একদিন রহিম সব ভাই ও ভাইদের বৌকে নিয়ে বসল। সেদিন স্কুল বন্ধ থাকায় নাদিম ঘরে ছিল। তাকেও ডাকা হল। সকলে আসার পর রহিম বলল, আল্লাহপাকের অসীম রহমতে আমরা বহুদিন সবাই মিলেমিশে এক সংসারে কাটালাম। এখন আমাদের প্রত্যেকের সংসার বড় হয়েছে। লোক-সংখ্যাও বেড়েছে। এতবড় সংসার সুষ্ঠ ভাবে চালানো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের বিয়ে-শাদি দিতে হবে। নুতন বাড়িঘর করাও দরকার। তা ছাড়া একদিন না একদিন তো আমাদেরকে আলাদা হতেই হবে। আব্বা সে কথা জানতেন। তাই তিনি নিজে সব জায়গা জমি আগান-বাগান, পুকুর-ডোবা বাড়ি-ঘর প্রত্যেকের নামে নামে ভাগ বাটোয়ারা করে খাতায় লিখে রেখে গেছে। আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেবেন, সে কথা হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে যাতে আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য না হয় সে ব্যবস্থা করে রেখে গেছেন। এমন কি বোনদের অংশও লিখে রেখেছেন। সেই খাতাটা সিন্দুকে ছিল। নাদিমের মা পেয়ে সেটা এতদিন নিজের কাছে রেখে দিয়েছে, আমি সে কথা জানতাম না। গতকাল আমার হাতে দিয়ে পড়তে বলে বলল, আমি এতদিন এটা গোপন রেখেছিলাম। কারন তখন সংসার ভাগাভাগি করতে আমার মন চায় নি। এখন আর এত বড় সংসার একসঙ্গে থাকলে ঝগড়াঝাটি সৃষ্টি হতে পারে। তাই এবার সবাইকে যে যার অংশ বুঝিয়ে দিয়ে আলাদা করে দেয়ার ব্যবস্থা কর। আমিও তাই চিন্তা করে সেই ব্যবস্থা করার জন্য তোমাদেরকে নিয়ে বসেছি। তারপর সে খাতাটা সুলতানের হাতে দিয়ে বলল, তোমরা একে একে সবাই পড়ে দেখ।
খাতাটা সবাই পড়ার পর রহিম বলল, আব্বা যেভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন, তাতে কি তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?
সব ভাইয়েরা একসঙ্গে বলে উঠল, না। ইলিয়াস ঘরে ছিল না। সেও এক সময় সেখানে এসেছে। চাচারা পড়ার পর নাদিম পড়ে ইলিয়াসের হাতে দিল। সেও পড়ল।
রহিম নাদিম ও ইলিয়াসকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের কিছু বলার থাকলে বল।
ইলিয়াস শুধু না বলল।
নাদিম বলল, বিষয়-সম্পত্তি দাদাজীর। আপনারা সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। আপনারা সবাই যখন একমত তখন আমরাও একমত। আমার মনে হয়, দাদাজী যেভাবে বাটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন, আপনারা করলে এত নিখুঁতভাবে করতে পারতেন না।
রহিম বলল, সবার মতামত শুনে খুশি হলাম। কারণ আমাদের মধ্যে কেউ আপত্তি করলে ভাগ-বাটোয়ারা করতে বাইরের পাঁচজনকে ডাকতে হত। এখন আমি আব্বার লেখামতো তোমাদেরকে সবকিছু দিয়ে আলাদা করে দেব। এবার তোমরা তোমাদের সংসারপত্র গুছিয়ে চালাবার চেষ্টা কর। আর একটা কথা, এই ভাগ-বাঁটোয়ারার ব্যাপারে আমি অন্য কাউকে ডাকতে চাই না। আমরা নিজেরা করে নেব। এতে তোমাদের কোনো আপত্তি নেই তো?
সবাই বলল, না নেই। শুধু কুদ্দুস চুপ করে রইল।
রহিম ফাহমিদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ছোট বৌ, তোমার হিসাবের খাতাটা নিয়ে এস। আর সেই সাথে সিন্দুকে যা টাকা আছে নিয়ে এস।
সিন্দুকটা বরাবর আব্দুস সোবহান চৌধুরীর রুমে ছিল উনি ও উনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও ঐ রুমে আছে। ফাহমিদা উঠে গিয়ে হিসাবের খাতা ও সব টাকা পয়সা নিয়ে এসে বড় ভাসুরের সামনে রেখে দিল।
রহিম হিসাবের খাতায় চোখ বুলিয়ে ফাহমিদাকে জিজ্ঞেস করল, জমা-খরচের পর যে পরিমাণ টাকা লেখা আছে সব টাকা এখানে আছে?
ফাহমিদা বলল, জি আছে।
রহিম বলল, টাকাগুলো চার ভাগ কর।
ফাহমিদা বড় ভাসুরের কথামত চার ভাগ করল।
রহিম প্রত্যেক ভাইয়ের হাতে এক ভাগ টাকা তুলে দেয়ার সময় বলল, এখন এগুলো নাও, পরে সবকিছু ভাগ করার ব্যবস্থা করছি।
কুদ্দুসকে টাকা দিতে গেলে সে টাকা না নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, টাকার ভাগ তো। দিচ্ছ, তারপর উঠে এসে বড় ভাবির দুপা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, এর ভাগ দেবে না? বড় ভাবি আমাদের মায়েরমতো ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছে। মায়ের ভাগ না দিলে আমি শুধু টাকা কেন সম্পত্তিরও ভাগ নেব না। কথা শেষ করে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কয়েক সেকেণ্ড পর আবার বলল, আমাদের আব্বার কথা মনে নেই। তুমিও আমাদেরকে আব্বার মতো শাসন করে, স্নেহ দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে, লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছ; তোমাকেও ভাগে পেতে চাই।
কুদ্দুসের কথা শুনে সবার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। রহিম হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, অত অবুঝের মতো কথা বলিস না ভাই। আমরা তো তোদেরই আছি এবং যতদিন বাঁচব ততদিন থাকব। এত বড় সংসার একসাথে থাকায় কত রকমের অসুবিধে হচ্ছে। এরকম যে হবে-আব্বা জানতেন। তাই তিনি সেইরকম ব্যবস্থা করে গেছেন। এবার নিজেদের সংসার নিজেরা গুছিয়ে নিয়ে উন্নতির চেষ্টা কর। আমরা তো তোদের কাছেই রয়েছি। তোদের সুবিধে-অসুবিধে হলে। আমরাই দেখব। নে টাকাগুলো নে।
কুদ্দুস বলল, না, আমার টাকার দরকার নেই; আমি তোমার সঙ্গে থাকব আলাদা হব না।
আফ্রিদা বলল, কুদ্দুস, তুই বড় ভাইয়ের কথা না শুনে বেয়াদবি করছিস। আমি কি তোকে সেইভাবে মানুষ করেছি? টাকা নে বলছি। কুদ্দুস চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বড় ভাইয়ের হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে আফ্রিদার পায়ের কাছে রেখে বলল, তোমাদেরকে আমি আব্বা-আম্মা মনে করি। আমি মরে যাওয়ার পর ফাহমিদাকে আলাদা করে দিও। তারপর সে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে গেল।
Leave a Reply