পূর্বকথা ও বাল্যজীবন
প্রথম খণ্ড – ভূমিকা
ঈশ্বরকৃপায় আবির্ভাব-প্রয়োজনের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বাল্যজীবনের সবিস্তার বিবরণ প্রকাশিত হইল। নানা লোকের মুখ হইতে তাঁহার ঐ কালের ঘটনাসমূহ অসম্বদ্ধভাবে শ্রবণ করিয়া আমাদিগের চিত্তে যে চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে, পাঠককে তাহার সহিত পরিচিত করিতেই আমরা ইহাতে সচেষ্ট হইয়াছি। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাগিনেয় শ্রীযুক্ত হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায় ও ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযুক্ত রামলাল চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি ব্যক্তিগণ আমাদিগকে ঘটনাবলীর সময়নিরূপণে যথাসাধ্য সাহায্য প্রদান করিলেও কোন কোন স্থলে উহার ব্যতিক্রম হইবার সম্ভাবনা থাকিয়া গিয়াছে। কারণ, তাঁহারা আমাদিগকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পিতা ও অগ্রজ প্রভৃতির জন্মকোষ্ঠীসকল প্রদান করিতে পারেন নাই; কিন্তু ‘শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মকালে তাঁহার পিতার বয়স ৬১।৬২ বৎসর ছিল’ ‘তাঁহার অগ্রজ রামকুমার তাঁহার অপেক্ষা ৩১।৩২ বৎসরের বড় ছিলেন’, এইভাবে সময় নিরূপণ করিয়া বলিয়াছিলেন।
সে যাহা হউক, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্ম সম্বন্ধে যে সন ও তারিখ আমরা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিলাম, তৎসম্বন্ধে যে কোন ব্যতিক্রমের সম্ভাবনা নাই, ইহা পাঠক ‘মহাপুরুষের জন্মকথা’ নামক এই গ্রন্থের পঞ্চমাধ্যায় পাঠ করিয়া নিঃসংশয়ে বুঝিতে পারিবেন। তাঁহার স্বীয় উক্তি হইতেই আমরা উহা নিরূপণে সক্ষম হইয়াছি, সুতরাং ঐ বিষয়ের জন্য তিনিই স্বরূপতঃ সর্বসাধারণের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। গ্রন্থস্থ ঘটনাবলীর অনেকগুলিই আমরা তাঁহার নিজমুখে শ্রবণ করিয়াছিলাম। শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনের লীলাবলী লিপিবদ্ধ করিবার প্রারম্ভে আমরা তাঁহার বাল্য ও যৌবনের ঘটনাসমূহকে যে এত বিশদ এবং সম্বদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ করিতে পারিব, এরূপ আশা করি নাই। সুতরাং, যিনি মূককে বাগ্মী করিতে এবং পঙ্গুকে বিশালগিরি-উল্লঙ্ঘন-সামর্থ্য-প্রদানে সক্ষম, একমাত্র তাঁহার কৃপাতেই উহা সম্ভবপর হইল ভাবিয়া আমরা তাঁহাকে বারংবার প্রণাম করিতেছি। উপসংহারে ইহাও বক্তব্য যে, পাঠক বর্তমান গ্রন্থ পাঠ করিবার পরে ‘সাধকভাব’ ও ‘গুরুভাব’ গ্রন্থ পাঠ করিলে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মকাল হইতে সন ১২৮৭ সাল বা ইংরাজী ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁহার জীবনেতিহাস ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ দেখিতে পাইবেন। ইতি –
প্রণত
গ্রন্থকার
প্রথম খণ্ড – অবতরণিকা
ধর্মই ভারতের সর্বস্ব
ভারত ও তদিতর দেশসমূহের আধ্যাত্মিক ভাব ও বিশ্বাসসকল তুলনায় আলোচনা করিলে, উহাদিগের মধ্যে বিশেষ প্রভেদ উপলব্ধি হয়। দেখা যায়, ঈশ্বর, আত্মা, পরকাল প্রভৃতি ইন্দ্রিয়াতীত বস্তুসকলকে ধ্রুবসত্যজ্ঞানে প্রত্যক্ষ করিতে অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারত নিজ সর্বস্ব নিয়োজিত করিয়াছে এবং ঐরূপ সাক্ষাৎকার বা উপলব্ধিকেই ব্যক্তিগত এবং জাতিগত স্বার্থের চরম সীমারূপে সিদ্ধান্ত করিয়াছে। উহার সমগ্র চেষ্টা এক অপূর্ব আধ্যাত্মিকতায় চিরকালের জন্য রঞ্জিত হইয়া রহিয়াছে।
মহাপুরুষসকলের ভারতে প্রতিনিয়ত জন্মগ্রহণই ঐরূপ হইবার কারণ
ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়সকলে ঐরূপ একান্ত অনুরাগ কোথা হইতে উপস্থিত হইল, এ কথার মূল-অন্বেষণে বুঝিতে পারা যায়, দিব্যগুণ এবং প্রত্যক্ষসম্পন্ন পুরুষসকলের ভারতে নিয়ত জন্মগ্রহণ করাই উহার একমাত্র কারণ। তাঁহাদিগের বিচিত্র দর্শন ও অসাধারণ শক্তি-প্রকাশ সর্বদা প্রত্যক্ষ এবং আলোচনা করিয়াই সে ঐসকলে দৃঢ়বিশ্বাস এবং অনুরাগসম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছিল। ভারতের জাতীয় জীবন ঐরূপে বহু প্রাচীনকাল হইতে আধ্যাত্মিকতার সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সংস্থাপিত হইয়া, প্রত্যক্ষ ধর্মলাভরূপ লক্ষ্যে দৃষ্টি স্থির রাখিয়া অদৃষ্টপূর্ব, অভিনব সমাজ এবং সামাজিক প্রথাসকল সৃজন করিয়াছিল। জাতি এবং সমাজস্থ প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ প্রকৃতিগত গুণাবলম্বনে দৈনন্দিন কর্মসকলের অনুষ্ঠানপূর্বক ক্রমশঃ উন্নীত হইয়া যাহাতে চরমে ধর্মলাভ বা ঈশ্বরকে সাক্ষাৎ করিতে পারে, ভারতের সমাজ একমাত্র সেইদিকে লক্ষ্য রাখিয়া নিয়ম এবং প্রথাসকল যন্ত্রিত করিয়াছিল। পুরুষানুক্রমে বহুকাল পর্যন্ত ঐসকল নিয়ম প্রতিপালন করিয়া আসাতেই ভারতে ধর্মভাবসকল এখনও এতদূর সজীব রহিয়াছে, এবং তপস্যা, সংযম ও তীব্র ব্যাকুলতা-সহায়ে প্রত্যেক ব্যক্তিই যে জগৎকারণ ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করিতে এবং তাঁহার সহিত নিত্য-যুক্ত হইতে পারে, ভারতের প্রত্যেক নরনারী এ কথায় এখনও দৃঢ়বিশ্বাসী হইয়া রহিয়াছে।
ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ দর্শনের উপরে ভারতের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত – উহার প্রমাণ
শ্রীভগবানের দর্শনলাভের উপরেই যে ভারতের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত, একথা সহজেই অনুমিত হয়। ধর্মসংস্থাপক আচার্যগণকে বৈদিক যুগ হইতে আমরা যে-সকল পর্যায়ে নির্দেশ করিয়াছি, সেইসকল বাক্যের অর্থ অনুধাবন করিলেই ঐ কথা হৃদয়ঙ্গম হইবে, যথা – ঋষি, আপ্ত, অধিকারী বা প্রকৃতি-লীন পুরুষ ইত্যাদি। অতীন্দ্রিয় পদার্থের সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া অসাধারণ শক্তির পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন বলিয়াই যে তাঁহারা ঐসকল নামে নির্দিষ্ট হইয়াছিলেন, একথা নিঃসন্দেহ। বৈদিক যুগের ঋষিগণ হইতে আরম্ভ করিয়া পৌরাণিক যুগের অবতার-প্রথিত পুরুষসকলের প্রত্যেকের সম্বন্ধেই পূর্বোক্ত কথা সমভাবে বলিতে পারা যায়।
ভারতে অবতারবিশ্বাস উপস্থিত হইবার কারণ ও ক্রম। সাংখ্যদর্শনোক্ত ‘কল্পনিয়ামক ঈশ্বর’
আবার বৈদিক যুগের ঋষিই যে, কালে পৌরাণিক যুগে ঈশ্বরাবতার বলিয়া পরিগণিত হইয়াছিলেন, একথা বুঝিতে বিলম্ব হয় না। বৈদিক যুগে মানব কতকগুলি পুরুষকে ইন্দ্রিয়াতীত পদার্থসকল দর্শন করিতে সমর্থ বলিয়া বুঝিতে পারিলেও, তাঁহাদিগের পরস্পরের মধ্যে ঐ বিষয়ের শক্তির তারতম্য উপলব্ধি করিতে না পারিয়া তাঁহাদের প্রত্যেককে একমাত্র ‘ঋষি’-পর্যায়ে নির্দেশ করিয়াই সন্তুষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু কালে মানবের বুদ্ধি ও তুলনা করিবার শক্তি যত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল, ততই সে উপলব্ধি করিতে লাগিল – ঋষিগণ সকলেই সমশক্তিসম্পন্ন নহেন; আধ্যাত্মিক জগতে তাঁহাদিগের কেহ সূর্যের ন্যায়, কেহ চন্দ্রের ন্যায়, কেহ উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায়, আবার কেহ বা সামান্য খদ্যোতের ন্যায় দীপ্তি প্রদানপূর্বক জ্যোতিষ্মান হইয়া রহিয়াছেন। তখন ঋষিগণকে শ্রেণীবদ্ধ করিতে মানবের চেষ্টা উপস্থিত হইল এবং তাঁহাদিগের মধ্যে কতিপয়কে সে আধ্যাত্মিক শক্তিপ্রকাশে বিশেষ সামর্থ্যবান বা ঐ শক্তির বিশেষভাবে অধিকারী বলিয়া সিদ্ধান্ত করিল। ঐরূপে দার্শনিক যুগে কয়েকজন ঋষি ‘অধিকারি-পুরুষ’-পর্যায়ে অভিহিত হইলেন। ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহবান সাংখ্যকার আচার্য কপিল পর্যন্ত ঐরূপ পুরুষসকলের অস্তিত্বে সন্দেহ করিতে পারেন নাই; কারণ, সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষকে কে কবে সন্দেহ করিতে পারে? সুতরাং শ্রীভগবান কপিল ও তৎপদানুসারী সাংখ্যাচার্যগণের গ্রন্থে ‘অধিকারি-পুরুষ’-সকলকে ‘প্রকৃতি-লীন’-পর্যায়ে অভিহিত হইয়া স্থান প্রাপ্ত হইতে দেখা গিয়া থাকে। ঐরূপ অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষসকলের উৎপত্তিবিষয়ে কারণ নির্ণয় করিতে যাইয়া তাঁহারা বলিয়াছেন –
পবিত্রতা, সংযমাদিগুণে ভূষিত হইয়া পূর্ণজ্ঞানলাভে সমর্থ হইলেও ঐরূপ পুরুষসকলের মনে লোককল্যাণসাধন-বাসনা তীব্রভাবে জাগরিত থাকে, সেজন্য তাঁহারা অনন্তমহিমামণ্ডিত স্ব-স্বরূপে কিয়ৎকাল লীন হইতে পারেন না; কিন্তু ঐ বাসনাবলে সর্বশক্তিমতী প্রকৃতির অঙ্গে লীন হইয়া তাঁহারা তাঁহার শক্তিসমূহকে নিজ শক্তিরূপে প্রত্যক্ষ করিতে থাকেন, এবং ঐরূপে ষড়ৈশ্বর্যসম্পন্ন হইয়া এক কল্পকাল পর্যন্ত অশেষ প্রকারে জনকল্যাণসাধনপূর্বক পরিণামে স্ব-স্বরূপে অবস্থান করেন।
‘প্রকৃতি-লীন’ পুরুষসকলের মধ্যে শক্তির তারতম্যানুসারে সাংখ্যাচার্যগণ আবার দুই শ্রেণীর নির্দেশ করিয়াছেন, যাহা – ‘কল্পনিয়ামক ঈশ্বর’ ও ‘ঈশ্বর-কোটি’।
ভক্তিযুগের বিরাট ব্যক্তিত্ববান ঈশ্বর
দার্শনিক যুগের অন্তে ভারতে ভক্তি-যুগের বিশেষভাবে আবির্ভাব হইয়াছিল। বেদান্তের তীব্র নির্ঘোষে ভারত-ভারতী তখন সর্ব ব্যক্তির সমষ্টিভূত এক বিরাটব্যক্তিত্ববান ঈশ্বরে বিশ্বাসী হইয়া কেবলমাত্র অনন্যভক্তিসহায়ে তাঁহার উপাসনায় জ্ঞান এবং যোগের পূর্ণতাপ্রাপ্তি-বিষয়ে শ্রদ্ধাবান হইয়াছে। সুতরাং সাংখ্যদর্শনোক্ত ‘কল্পনিয়ামক ঈশ্বরকে’ তখন নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাববিশিষ্ট বিরাট ব্যক্তিত্ববান ঈশ্বরের আংশিক বা পূর্ণ প্রকাশে পরিণত করিতে বিলম্ব হইল না। ঐরূপেই পৌরাণিক যুগে অবতারবিশ্বাসের উৎপত্তি এবং বৈদিক যুগের বিশিষ্টগুণশালী ঋষির ঈশ্বরাবতারত্বে পরিণতি অনুমিত হয়। অতএব, স্পষ্ট বুঝা যায়, অসাধারণ আধ্যাত্মিকশক্তিসম্পন্ন পুরুষসকলের আবির্ভাবদর্শনেই ভারত ক্রমে ঈশ্বরাবতারত্বে বিশ্বাসবান হইয়াছিল, এবং ঐরূপ মহাপুরুষসকলের অতীন্দ্রিয় দর্শন ও অনুভবাদির উপরেই ভারতীয় ধর্মের সুদৃঢ় সৌধ ধীরে ধীরে উত্থিত হইয়া তুষারমণ্ডিত হিমাচলের ন্যায় গগন স্পর্শ করিয়াছিল। ঐরূপ পুরুষসকলকে ভারত মনুষ্যজীবনের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্যলাভে কৃতার্থ জ্ঞান করিয়া ‘আপ্ত’-সংজ্ঞায় নির্দেশপূর্বক তাঁহাদিগের বাণীসমূহে জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা দেখিয়া ‘বেদ’ শব্দে অভিহিত করিয়াছিল।
অবতারবিশ্বাসের অন্য কারণ – গুরূপাসনা
বিশিষ্ট ঋষিগণের ঈশ্বরাবতারত্বে পরিণতির অন্য প্রধান কারণ – ভারতের গুরু-উপাসনা। বেদোপনিষদের যুগ হইতেই ভারত-ভারতী বিশেষ শ্রদ্ধার সহিত জ্ঞানদাতা আচার্য গুরুর উপাসনা করিতেছিল। ঐ পূজোপাসনাই তাহাদিগকে কালে দেখাইয়া দেয় যে, মানবের ভিতর অতীন্দ্রিয় ঐশী শক্তির আবির্ভাব না হইলে সে কখনও গুরুপদবীগ্রহণে সমর্থ হয় না। সাধারণ মানবজীবনের স্বার্থপরতা এবং যথার্থ গুরুগণের অহেতুক করুণায় লোকহিতাচরণ তুলনায় আলোচনা করিয়া তাহারা তাঁহাদিগকে প্রথমে এক বিভিন্ন উচ্চশ্রেণীর মানবজ্ঞানে পূজা করিতে থাকে। পরে আস্তিক্য, শ্রদ্ধা ও ভক্তি তাহাদিগের মনে ঘনীভূত হইয়া যথার্থ গুরুগণের অলৌকিক শক্তিপ্রকাশ তাহারা যত প্রত্যক্ষ করিয়াছিল, তাঁহাদিগের দেবত্বে তাহারা ততই দৃঢ়বিশ্বাসী হইয়াছিল। তাহারা বুঝিয়াছিল যে, ভবরোগ হইতে মুক্ত হইবার জন্য তাহারা এতকাল ধরিয়া শ্রীভগবানের করুণাপূর্ণ দক্ষিণামূর্তির নিকট যে সহায়তা প্রার্থনা করিতেছিল – “রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যং” – গুরুগণের ভিতর দিয়া তাহাই এখন তাহাদিগের নিকট উপস্থিত হইয়াছে, শ্রীভগবানের করুণাই মূর্তিমতী গুরুশক্তিরূপে তাহাদিগের সমক্ষে প্রকাশিত রহিয়াছে।
বেদ এবং সমাধি-প্রসূত দর্শনের উপর অবতারবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত
আবার গুরূপাসনায় মানবমন যখন এতদূর অগ্রসর হইল, তখন যাঁহাদিগকে আশ্রয় করিয়া ঐ শক্তির বিশেষ লীলা প্রকটিত হইতে লাগিল, তাঁহাদিগকে শ্রীভগবানের জ্ঞানপ্রদা দক্ষিণামূর্তির সহিত অভিন্নভাবে দেখিতে তাহার বিলম্ব হইল না। ঐরূপে আচার্যোপাসনা কালে ভারতে অবতারবাদের আনয়নে ও পরিপুষ্টিতে সহায়তা করিয়াছিল বলিয়া প্রতীতি হইয়া থাকে। অতএব, অবতারবাদের স্পষ্ট অভিব্যক্তি পৌরাণিক যুগে উপস্থিত হইলেও, উহার মূল যে বৈদিক যুগ পর্যন্ত অধিকার করিয়া রহিয়াছে, ইহা আর বলিতে হইবে না। বেদ, উপনিষদ্ এবং দর্শনের যুগে মানব ঈশ্বরের গুণ, কর্ম ও প্রকৃতি সম্বন্ধে যে-সকল অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিল, পৌরাণিক যুগে সেই সকলই স্পষ্ট আকার ধারণ করিয়া অবতারবিশ্বাসরূপে অভিব্যক্ত হইল। অথবা, সংযম তপস্যাদিসহায়ে ঔপনিষদিক যুগে মানব ‘নেতি নেতি’-মার্গে অগ্রসর হইয়া নির্গুণব্রহ্মোপাসনায় সাফল্যলাভপূর্বক সমাধিরাজ্য হইতে বিলোমমার্গাবলম্বনে অবতরণ করিয়া সমগ্র জগৎকে ব্রহ্মপ্রকাশ বলিয়া যখন দেখিতে সমর্থ হইল, তখনই সগুণ বিরাট ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের প্রতি তাহার প্রেম-ভক্তি উপস্থিত হইয়া, সে তাঁহার উপাসনায় প্রবৃত্ত হইল – এবং তখনই সে তাঁহার গুণ, কর্ম, স্বভাবাদি সম্বন্ধে একটা স্থিরসিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়া, তাঁহার বিশেষভাবে অবতীর্ণ হওয়ায় বিশ্বাসবান হইল।
ঈশ্বরের করুণার উপলব্ধি হইতেই পৌরাণিক যুগে অবতারবাদপ্রচার
পূর্বে বলা হইয়াছে, পৌরাণিক যুগেই ভারতে অবতারবিশ্বাস বিশেষভাবে প্রকটিত হইয়াছিল। ঐ যুগের আধ্যাত্মিক বিকাশে নানা দোষ উপলব্ধ হইলেও, একমাত্র অবতার-মহিমা-প্রকাশে উহার বিশেষত্ব এবং মহত্ত্ব স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম হয়। কারণ, অবতার-বিশ্বাস আশ্রয় করিয়াই মানব সগুণব্রহ্মের নিত্যলীলাবিলাস বুঝিতে সমর্থ হইয়াছে। উহা হইতেই সে বুঝিয়াছে যে, জগৎকারণ ঈশ্বরই আধ্যাত্মিক জগতে তাহার একমাত্র পথপ্রদর্শক; এবং উহা হইতেই তাহার হৃদয়ঙ্গম হইয়াছে যে, সে যতকাল পর্যন্ত যতই দুর্নীতিপরায়ণ হউক না কেন, শ্রীভগবানের অপার করুণা তাহাকে কখনই চিরদিন বিনাশের পথে অগ্রসর হইতে দিবে না – কিন্তু বিগ্রহবতী হইয়া উহা যুগে যুগে আবির্ভূত হইবে এবং তাহার প্রকৃতির উপযোগী নব নব আধ্যাত্মিক পথসমূহ আবিষ্কারপূর্বক তাহার পক্ষে ধর্মলাভ সুগম করিয়া দিবে।
অবতারপুরুষের দিব্যস্বভাব সম্বন্ধে শাস্ত্রোক্তির সারসংক্ষেপ
অমিতগুণসম্পন্ন অবতারপুরুষসকলের দিব্যজন্মকর্মাদি সম্বন্ধে স্মৃতি ও পুরাণসকলে যাহা লিপিবদ্ধ আছে, তাহার সারসংক্ষেপ এখানে উল্লেখ করিলে মন্দ হইবে না। তাঁহারা বলেন, অবতারপুরুষ ঈশ্বরের ন্যায় নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাববান। জীবের ন্যায় কর্মবন্ধনে তিনি কখনও আবদ্ধ হয়েন না। কারণ, জন্মাবধি আত্মারাম হওয়ায় পার্থিব ভোগসুখলাভের জন্য জীবের ন্যায় স্বার্থচেষ্টা তাঁহার ভিতর কখনও উপস্থিত হয় না, শরীরধারণপূর্বক তাঁহার সমগ্র চেষ্টা অপরের কল্যাণের নিমিত্ত অনুষ্ঠিত হয়। আবার, মায়ার অজ্ঞানবন্ধনে কখনও আবদ্ধ না হওয়ায় পূর্ব পূর্ব জন্মে শরীরপরিগ্রহ করিয়া তিনি যে-সকল কর্মানুষ্ঠান করিয়াছিলেন, সেই সকলের স্মৃতি তাঁহাতে লুপ্ত হয় না।
অবতারপুরুষের অখণ্ড স্মৃতিশক্তি
প্রশ্ন হইতে পারে, ঐরূপ অখণ্ড স্মৃতি কি তবে তাঁহাতে আশৈশব বিদ্যমান থাকে? উত্তরে পুরাণকার বলেন, অন্তরে বিদ্যমান থাকিলেও শৈশবে তাঁহাতে উহার প্রকাশ থাকে না; কিন্তু শরীর-মনোরূপ যন্ত্রদ্বয় সর্বাঙ্গসম্পন্ন হইবামাত্র স্বল্প বা বিনায়াসে উহা তাঁহাতে উদিত হইয়া থাকে। তাঁহার প্রত্যেক চেষ্টাসম্বন্ধেই ঐকথা বুঝিতে হইবে; কারণ, মনুষ্যশরীরধারণ করায় তাঁহার সকল চেষ্টা সর্বথা মনুষ্যের ন্যায় হয়।
অবতারপুরুষের নবধর্ম স্থাপন
ঐরূপে শরীর-মন পূর্ণতাপ্রাপ্ত হইবামাত্র অবতারপুরুষ তাঁহার বর্তমান জীবনের উদ্দেশ্য সম্যক্ অবগত হন। তিনি বুঝিতে পারেন যে, ধর্মসংস্থাপনের জন্যই তাঁহার আগমন হইয়াছে। আবার ঐ উদ্দেশ্য সফল করিতে যাহা কিছু প্রয়োজন হয়, তাহা কোথা হইতে অচিন্ত্য উপায়ে তাঁহাদিগের নিকট স্বতঃ আসিয়া উপস্থিত হয়। মানবসাধারণের নিকট যে পথ সর্বদা অন্ধকারময় বলিয়া উপলব্ধ হয়, তিনি সেই মার্গে উজ্জ্বল আলোক দেখিতে পাইয়া অকুতোভয়ে অগ্রসর হন এবং উদ্দেশ্যলাভে কৃতার্থ হইয়া জনসাধারণকে সেই পথে প্রবর্তিত করেন। ঐরূপে মায়াতীত ব্রহ্মস্বরূপের এবং জগৎকারণ ঈশ্বরের উপলব্ধি করিবার অদৃষ্টপূর্ব নূতন পথসমূহ তাঁহার দ্বারা যুগে যুগে পুনঃপুনঃ আবিষ্কৃত হয়।
অবতারপুরুষের আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে শাস্ত্রোক্তি
অবতারপুরুষের গুণ, কর্ম, স্বভাবাদির ঐরূপে নির্ণয় করিয়াই পুরাণকারেরা ক্ষান্ত হয়েন নাই, কিন্তু তাঁহার আবির্ভাবকাল পর্যন্ত স্পষ্ট নিরূপণ করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, সনাতন সর্বজনীন ধর্ম যখন কালপ্রভাবে গ্লানিযুক্ত হয়, যখন মায়াপ্রসূত অজ্ঞানের অনির্বচনীয় প্রভাবে মুগ্ধ হইয়া মানব ইহকাল এবং পার্থিব ভোগসুখলাভকেই সর্বস্ব জ্ঞানপূর্বক জীবন অতিবাহিত করিতে থাকে এবং আত্মা, ঈশ্বর, মুক্তি প্রভৃতি অতীন্দ্রিয় নিত্য পদার্থসকলকে কোন এক ভ্রমান্ধ যুগের স্বপ্নরাজ্যের কবিকল্পনা বলিয়া ধারণা করিয়া বসে – যখন ছলে-বলে-কৌশলে পার্থিব সর্বপ্রকার সম্পদ ও ইন্দ্রিয়সুখ লাভ করিয়াও সে প্রাণের অভাব দূর করিতে না পারিয়া অশান্তির অন্ধতমসাবৃত অকূল প্রবাহে নিপতিত হয় এবং যন্ত্রণায় হাহাকার করিতে থাকে – তখনই শ্রীভগবান স্বকীয় মহিমায় সনাতন ধর্মকে রাহুগ্রাসমুক্ত শশধরের ন্যায় উজ্জ্বল করিয়া তুলেন এবং দুর্বল মানবের প্রতি কৃপায় বিগ্রহবান হইয়া তাহার হস্তধারণপূর্বক তাহাকে পুনরায় ধর্মপথে প্রতিষ্ঠিত করেন। কারণ না থাকিলে কার্যের উৎপত্তি কখন সম্ভবপর নহে – তদ্রূপ সর্বজনীন অভাব দূরীকরণরূপ প্রয়োজন না থাকিলে ঈশ্বরও কখন লীলাচ্ছলে শরীরপরিগ্রহ করেন না। কিন্তু ঐরূপ কোন অভাব যখন সমাজের প্রতি অঙ্গকে অভিভূত করে, শ্রীভগবানের অসীম করুণাও তখন ঘনীভূত হইয়া তাঁহাকে জগদ্গুরুরূপে আবির্ভূত হইতে প্রযুক্ত করে। ঐরূপ প্রয়োজন দূর করিতে ঐরূপ লীলাবিগ্রহের বারংবার আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করিয়াই যে পুরাণকারেরা পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন, একথা বলা বাহুল্য।
বর্তমানকালে অবতারপুরুষের পুনরাগমন
অতএব দেখা যাইতেছে, নবীন ধর্মের আবিষ্কর্তা জগদ্গুরু, সর্বজ্ঞ অবতারপুরুষ যুগ-প্রয়োজন সাধনের জন্যই আবির্ভূত হন। ধর্মক্ষেত্র ভারত নানা যুগে বহুবার তাঁহার পদাঙ্ক হৃদয়ে ধারণ করিয়া পবিত্রীকৃত হইয়াছিল। যুগ-প্রয়োজন উপস্থিত হইলে অমিতগুণসম্পন্ন অবতারপুরুষের শুভাবির্ভাব এখনও তাহাতে দৃষ্ট হইয়া থাকে। কিঞ্চিদূর্ধ্ব চারিশত বৎসরমাত্র পূর্বে ঐরূপে শ্রীভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতীর অদৃষ্টপূর্ব মহিমায় শ্রীহরির নামসংকীর্তনে উন্মত্ত হইবার কথা লোকপ্রসিদ্ধ। আবার কি সেই কাল উপস্থিত হইয়াছে? আবার কি বিদেশীর ঘৃণাস্পদ, নষ্টগৌরব, দরিদ্র ভারতে যুগ-প্রয়োজন উপস্থিত হইয়া শ্রীভগবানের করুণায় বিষম উত্তেজনা আনয়নপূর্বক তাঁহাকে বর্তমানকালে শরীরপরিগ্রহ করাইয়াছে? হে পাঠক, অশেষকল্যাণগুণসম্পন্ন যে মহাপুরুষের কথা আমরা তোমাকে বলিতে বসিয়াছি, তাঁহার জীবনালোচনায় বুঝিতে পারা যাইবে, ঘটনা ঐরূপ হইয়াছে – শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণাদিরূপে পূর্ব পূর্ব যুগে যিনি আবির্ভূত হইয়া সনাতন ধর্ম সংস্থাপিত করিয়াছিলেন, বর্তমানকালের যুগ-প্রয়োজন সাধিত করিতে তাঁহার শুভাগমন প্রত্যক্ষ করিয়া ভারত পুনরায় ধন্য হইয়াছে।
Leave a Reply