শ্রীশ্রীচণ্ডী – অনুবাদ : পঞ্চানন তর্করত্ন
সারস্বত প্রকাশন
বিদ্যাবাচস্পতি অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়
পাণ্ডুয়া, ভারত
.
প্রকাশকের নিবেদন
শ্রীশ্রীচণ্ডী হিন্দুদের, বিশেষতঃ শাক্তদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, হিন্দুদের মূলত তিনটি শাখা বর্তমানে আছে— শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব। এদের মধ্যে শাক্ত হচ্ছে তারাই, যারা মাতৃশক্তির আরাধনা করে। বাঙালী হিন্দুরা মূলত শাক্ত; দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদি দেবীদের পুজো করে থাকে। এছাড়া চৈতন্যদেবের প্রভাবে এবং পরবর্তীকালে ‘ইস্কনের’ প্রভাবে (যা চৈতন্যদেবের ভাবধারাই প্রচার করে থাকে) কিছু বৈষ্ণব আছে।
এই শাক্তদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ হল শ্রীশ্রীচণ্ডী। শ্রীশ্রীচণ্ডী ‘দেবীমাহাত্ম্য‘ বা ‘দুর্গা-সপ্তশতী’ নামেও পরিচিত। এমন কোন হিন্দু বাঙালী বোধহয় নেই, যে দুর্গাপুজোর আগে মহালয়ার সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনেনি। বাঙালী হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর সময়ও চণ্ডীপাঠ করা হয়। এখন প্রশ্ন হল, যে গ্রন্থটি হিন্দু বাঙালীর জীবনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত সেটির পরিচয় কি? অন্যান্য ধর্মের মত হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ একটিমাত্র নয়। বেদ রয়েছে এবং রয়েছে তার আনুষঙ্গিক বেদাঙ্গ ও উপবেদ; তার পাশাপাশি রয়েছে আগম বা তন্ত্র। রয়েছে ষড়দর্শন। এছাড়াও রয়েছে ইতিহাস, যার মধ্যে পড়ছে রামায়ণ এবং মহাভারত। আর রয়েছে পুরাণ। অন্যগুলি সম্বন্ধে বিশদে বলছি না, তবে এক্ষেত্রে পুরাণ নিয়ে আমাদের দু-একটা কথা আরো বলতে হবে। মোট আঠারোটি মহাপুরাণ এবং আঠারোটি উপপুরাণ রয়েছে। আঠারোটি মহাপুরাণের মধ্যে সব থেকে আকারে ছোট পুরাণটি হল মার্কণ্ডেয় পুরাণ। শ্রীশ্রীচণ্ডী হল এই মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ। মার্কণ্ডেয় পুরাণে ১৩৭টি অধ্যায় রয়েছে; এরমধ্যে ৮১ থেকে ৯৩তম অধ্যায়, অর্থাৎ মোট ১৩টি অধ্যায় নিয়ে তৈরী হয়েছে শ্রীশ্রীচণ্ডী।
শ্রীশ্রীচণ্ডীর বিষয়বস্তু কি? দুর্গাপুজোর কাহিনীটি বর্ণিত আছে শ্রীশ্রীচণ্ডীতে। দুর্গাপুজোয় আমরা দেখি যে সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করছেন। কে এই মহিষাসুর? কেই বা দেবী দুর্গা? কালীপুজোতেও আমরা দেখি যে দেবী দানবদলনী। তার গলায় মুণ্ডমালা, হাতে ঝুলছে কাটা মুণ্ডু। জগজ্জননীর কেন এই ভয়ঙ্কর রূপ? কেমন করে কালী চণ্ড মুণ্ড বধ করে চামুণ্ডা নামে জগতে পরিচিতা হলেন। কেমন করে দুর্ধর্ষ রক্তবীজ নামক অসুর বিনাশ করলেন। এ জানতে হলে শ্রীশ্রীচণ্ডী পড়তে হবে। না জেনে কিছু করা খুব একটা কাজের কথা নয়। শাস্ত্রে বলে, না বুঝে কিছু করা মানে হচ্ছে চন্দনকাঠের ভারবাহী গর্দভের মত অবস্থা। বেচারা চন্দনকাঠের বোঝার ভারটা টের পায়; কিন্তু চন্দনের সুগন্ধ উপভোগ করার মত উন্নত মানসিক বৃত্তি তার নেই। সংক্ষেপে এখানে শুধু এটুকু বলি যে একই জগন্মাতা—তিনি কখনো শ্রী ও সমৃদ্ধিদায়িনী লক্ষ্মীরূপে বিরাজ করছেন; আবার দুর্বৃত্তদের অত্যাচার থেকে মানুষকে, পৃথিবীকে বাঁচাতে খড়্গহাতে রুদ্ররূপে প্রলয় আনছেন! দেবীর এই করাল রূপ অপশক্তির হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য। সেইজন্য যখন কোন ভুত-প্রেত ইত্যাদি অশুভশক্তির প্রভাব কোথাও দেখা যায় তখন মায়ের এই করালরূপকে আমরা স্মরণ করি। চণ্ডীপাঠ করা হয়। যেকোন পুজোতেও যখন কোন দেবতাকে আবাহন করার আগে সেই স্থানটিকে অশুভ শক্তির ছায়া থেকে মুক্ত করে নেওয়ার ব্যাপার পূজা প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে—একে বলে ভূতাপসারণ। ভূতাপসারণ প্রক্রিয়াতেও আমরা দেবী চণ্ডিকাকে স্মরণ করি, কারণ তিনি যাবতীয় অশুভ শক্তি ও ভয় থেকে মানুষকে রক্ষা করেন। তার জন্যই তিনি এই ভয়াল ও অত্যন্ত শক্তিশালী রূপ গ্রহণ করেছেন। তিনি মোক্ষপ্রদায়িনী। তাঁর জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, তবু তিনি বারবার আবির্ভূতা হচ্ছেন যখন তাকে নিপীড়িতজন ডাকছে। দেবতারা জগন্মাতাকে ডেকেছেন, তাঁর বন্দনা করেছেন চারটি অসাধারণ সুন্দর স্তবের দ্বারা। এই স্তবগুলিই আমরা মহালয়ার সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কন্ঠে শুনতে পাই।
এবারে অনুবাদ প্রসঙ্গে আসি। বাংলায় মার্কণ্ডেয় পুরাণের অনুবাদ পঞ্চানন তর্করত্নের (১৮৬৬-১৯৪০) সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু মার্কণ্ডেয় পুরাণই নয়, প্রায় পঞ্চাশটির আশেপাশে হিন্দু ধর্মগ্রন্থের বাংলায় অনুবাদ তিনি করে গেছেন অথবা তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতে বর্তমানে সেই সমস্ত বই ‘পাবলিক ডোমেনের’ অন্তর্গত। আমাদের এই বইটিতে আমরা সেই অনুবাদই মুদ্রিত করেছি। কয়েকটি জায়গায় আমরা তার অনুবাদিত ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’, যেটি বিস্তৃত ব্যাখ্যা ও টীকাসহ, সেটির থেকেও সাহায্য নিয়েছি। এবং কতকগুলি জায়গায় মহেশচন্দ্র পাল কর্ত্তৃক প্রকাশিত ও সংকলিত মার্কণ্ডেয় পুরাণেরও সাহায্য নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল যেন বাংলা অনুবাদটি সহজবোধ্য হয়। আমরা শুধুমাত্র বাংলা অনুবাদ অংশটি রেখেছি। তবে পরিশিষ্টে স্তবগুলি কেবলমাত্র সংস্কৃতে এবং বাংলা অর্থসহ সংস্কৃতে দিয়ে দিয়েছি, যাতে পাঠ করতে সুবিধা হয়। বাংলা কঠিন শব্দের অর্থও আমরা বন্ধনীর মধ্যে দিয়ে দিয়েছি পাঠকের সুবিধার্থে। এছাড়াও যেখানে মনে হয়েছে কিছু বিষয় বিশদে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, তা বইয়ের শেষভাগে টীকা অংশে যোগ করা হয়েছে। এই যাবতীয় বিষয়গুলি আমাদের সংযোজন।
আর বিশেষ কিছু বলার নেই। আপামর হিন্দু বাঙালী মায়ের ভাষায় মাকে জেনে মায়ের পুজোয় মেতে উঠুক, এই উদ্দেশ্যেই এই ‘ডিজিটাল’ সংস্করণটি বিনামূল্যে প্রকাশ করা। যদি কারোর উপকারে লাগে, পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব।
Leave a Reply