শ্বাপদ সনে – নাবিল মুহতাসিম
বাতিঘর প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৬
প্রচ্ছদ : ডিলান
.
লেখকের কথা :
তখন দু’হাজার বারো সাল, কারমাইকেল কলেজের এইচএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। বাসা থেকে কাছেই কলেজ, হেটেই যাওয়া আসা করতাম বেশিরভাগ সময়। গ্রীষ্মের এক দুপুরে কলেজ থেকে ফিরছি। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। রোদে মাথার চাঁদি এমন তেতে গেছে যে ডিম ভেঙে দিলে অমলেট হয়ে যাবে। এমন সময় হঠাৎ চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো—যেন সিনেমার ক্লিপিংস-রোদে দরদরিয়ে ঘামতে ঘামতে একটা শুকনো ভুট্টো খেতের মাঝে রাইফেল উঁচিয়ে ঘুরছে এক লোক। এখনই মারাত্মক কিছু ঘটবে ভয়ঙ্কর কিছু একটা এসে দাঁড়াবে তার সামনে।
আর কিছু না। এইটুকুই। এই একটা দৃশ্য থেকেই শুরু। তিন বছর ধরে দৃশ্যটা মাথার ভেতরে নাড়িয়ে চাড়িয়ে নিয়ে যখন প্রথম পেশাগত পরীক্ষার পরে পড়াশোনার চাপ কমলো, তখন লিখে ফেললাম গল্পটা। একটা দৃশ্য থেকেই ডালপালা ছড়িয়ে কল্পনাটি এখন আস্ত একটা উপন্যাস শ্বাপদ সনে।
শ্বাপদ সনে একটা হরর-থুলার। হররের প্রতি বাঙালি পাঠকের অনেকেরই বিতৃষ্ণা আছে-আর এজন্যে দোষ দেয়া যায় না তাদেরকে। হরর বলতে অনেকে ধরে নেন সস্তা প্রেডিক্টেবল ভুত-প্রেতের গল্প, আবার অনেকের কাছে ইংরেজি থেকে দুর্বলভাবে অনুবাদ করা একই ধাঁচের ভ্যাম্পায়ার, অয়্যারউলফ আর জোম্বির কাহিনী। হয়তো বাংলায় ভালো হররের অভাবই এর কারণ। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে অবশ্য।
শ্বাপদ সনে যদি হররের ব্যাপারে আপনাকে অন্যরকম একটা ধারণা দিতে পারে তাহলে আমার কি-বোর্ডের খটখটানি সফল হয়েছে ধরে নেব।
তবে শ্বাপদ সনে’তে পাবেন সুপারন্যাচারাল আর ন্যাচারালের মাঝে একটি সংঘাত। কোনটা জিতলো, সেটা বুঝবেন বইয়ের শেষে। শুভেচ্ছা রইলো।
নাবিল মুহতাসিম
শহীদ ডাক্তার ফজলে রাব্বি হল
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
.
উৎসর্গ :
১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুক, বল্লম আর মরিচের গুঁড়া নিয়ে অত্যানুধিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপরে আক্রমণে অংশ নেয়া প্রায় দু-হাজার শহীদ ও গাজী বাঙালি ও সাঁওতাল শিশু-বৃদ্ধ-রমনী-যুবকদেরকে….
গ্রেকো-রোমান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, ঈজিপ্সিয়ান, জাপানিজ, পারসিয়ান, ইন্ডিয়ান মিথলজি পড়ে দেখেছি শুধু তাদের বীরত্বের সাথে তুলনা করা যায় এমন কিছুর খোঁজে। পাইনি। সেই পবিত্রভূমি নিশবেতগঞ্জের কয়েক কিলোমিটার দূরে জন্ম আমার। কত বড় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছি আমি।
হে বীরেরা, এই বই আপনাদেরকে উৎসর্গ করলাম। আর তাদেরকে, যারা রংপুরকে ভালোবাসেন। যাদের আত্মায় রংপুর।
.
মুখ বন্ধ
জামশেদের জবানবন্দি থেকে
কাকটা ডাকতে ডাকতে আমার মাথার এত কাছ দিয়ে উড়ে গেল যে ওটার ডানা ঝাপটানোর শব্দ পরিস্কার শুনতে পেলাম।
“কা! কা! কা!”
চোখের ওপরের কোণা দিয়ে লম্বাটে একটা কালচে ঝলক দেখলাম শুধু। কাকটা। কি কাক ওটা? জানতে ইচ্ছা করছে। সাধারণ পাতিকাক? না গম্ভির, রাজকীয় র্যাভেন? দাঁড়কাক? জানতে ইচ্ছা করছে কেন যেন। মাথাটা সম্ভবত কাজ করছে না আমার। হয়, এমনটা হয় অনেকসময়। বিশেষ করে চরম উত্তেজনার মুহূর্তে। যেমন এখন।
হাত কিন্তু ঠিকই কাজ করছে আমার। রাইফেলের ব্যারেলটা কাঁপছে না। মার্লিন কোম্পানির রাইফেল। অনেক পুরনো। বোল্ট অ্যাকশন। মনের মধ্যে বহুবার ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নটা জেগে উঠলো আবার-দরকারের সময় অস্ত্রটা ঠিকমত কাজ করবে তো?
কাকটা বিদায় নেবার পরে চারপাশটা আবার নিরব। ঠিক যেন মিউট করা একটা সিনেমা। একটুও বাতাস নেই। চারপাশের ভুট্টা গাছগুলোর একটাও কাঁপছে না। আমার চারপাশ ঘিরে একদম স্থির ভুট্টা গাছগুলো। দরদরিয়ে ঘামছি আমি। নিজের মাথায় আর মুখে হাত বোলালাম। আমার সারা মুখ ঘামে ভেজা। যত্ন করে রাখা গোঁফজোড়া আর মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি হাতে ঠেকলো।
মাথার ওপরে ঝাঁ ঝাঁ করছে সূর্যটা। তীব্র রোদ। কিন্তু এই মরা ভুট্টা খেতের গাছগুলোর মাঝে তবুও ছায়া-ছায়া অন্ধকার। দরদর করে ঘামছি
রুমাল বের করে ঘাম মুছবো কি? না, ঝুঁকিটা নেয়া ঠিক হবে না। বন্দুকে হাত রাখাটাই সবচেয়ে নিরাপদ ঠেকছে আমার কাছে। রাইফেল নামানো যাবে না।
এদিক-ওদিকে তাকিয়ে নিলাম একবার। কোনদিকে যাবো, বুঝতে পারছি না। পথ হারিয়ে ফেলেছি ভালোভাবেই। অনিশ্চিতভাবে সামনে বাড়লাম এক পা।
প্রচন্ড রোদ মাথার ওপরে। মগজ ফোটানোর মত গরম রোদ। চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মত রোদ।
সামনের একটুখানি জায়গার ভুট্টাগাছ দু-দিকে সরে আছে যেন খানিকটা। পায়ে চলার পথ?
কার?
মানুষের, না অন্যকিছু?
মানুষের, না…
তবে সন্দেহ নেই, এই পথে যাওয়া আসা করে কোনোকিছু।
আরেকটু সামনে এগোলাম। পায়ের নিচে মচমচ করছে ভুট্টার শুকনো পাতা। অসহ্য নিরবতার মাঝে সেটাই বড় বেশি হয়ে কানে বাজছে।
হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম হঠাৎ। যা হয় হবে, আমি এদিক দিয়েই যাবো। বন্দুকের বাট কাঁধে ঠেকিয়ে নিয়েছি। আমার ভরসা এখন একটাই, আমার গোল্ডমেডেল-জেতা নির্ভুল নিশানা।
দশ পা গিয়েই থমকে গেলাম। আরেকটা পায়ের শব্দ কানে এসেছে। কেউ এদিকেই আসছে। আমি তৈরি। কাঁধে রাইফেল। একেকটা সেকেন্ডকে একেকটা ঘন্টার মতো লাগছে।
পায়ের শব্দটা কাছিয়ে আসছে। বাড়তে বাড়তে সেটা যেন গির্জার ঘন্টার মতো জোরালো হয়ে আমার কানের পর্দা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
এখনই আমার সামনে এসে দাঁড়াবে জিনিসটা।
Leave a Reply