শূন্য খাম – প্রচেত গুপ্ত
প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০১০
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ সুদীপ্ত দত্ত
.
উৎসর্গ
আমার বেকারদশা চলছে। টাকা পয়সার ভয়াবহ অবস্থা। ছেলের স্কুলের মাইনের দিনগুলোতে দার্শনিক ধরনের চিন্তা ভাবনার গভীরে চলে যাই। সকালে কাজ খুঁজি, সন্ধেবেলা ভাঙা কম্পিউটারে গল্প, উপন্যাসের নামে হাবিজাবি লিখি। সেসব লেখা ছাপতে দেওয়া তো দূরের কথা, কাউকে বলিও না। সবাইকে কাজের কথা বলি। কোনও লাভ হয় না। বিজ্ঞাপন দেখে রাজ্য সরকারের চাকরির পরীক্ষায় বসলাম। ভালোভাবে পাশও করলাম (যতদূর জানি ফার্স্ট হলাম)। এবার ইন্টারভিউ। সেই ইন্টারভিউ যেন লোম খাড়া করা ভূতের গল্প। মনে পড়লে আজও গা ছমছম করে। সে গল্প পরে বলব। গল্পের নাম ঠিক করে রেখেছি—একটি ভুতুড়ে ইন্টারভিউ। যাই হোক, এমন কঠিন সময় পরিচিত একজন পরামর্শ দিল—’ওনাকে একবার বলে দেখতে পারো।’ আমি বললাম, ‘অসম্ভব। ”উনি” কিছুতেই আমাকে কাজ দেবেন না। শুনেছি ”উনি” খুবই রেগে আছেন। আমার মুখই দেখবেন না, কাজ দেওয়া তো দূরের কথা। আমি বলব না।’ তবু কিছুদিনের মধ্যে ফোন করলাম।
‘উনি’ ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আচ্ছা, শুনলাম।’
ব্যস এই পর্যন্ত। সময় যেতে লাগল। আমার অবস্থা ভয়াবহ থেকে অতি ভয়াবহ হল। নিয়ম হল, বেকারের অবস্থা অতি ভয়াবহ হলে সাজগোজে ফিটফাট ভাব বাড়াতে হয়। আমিও বাড়ালাম। সবসময় ইস্তিরি করা জামা প্যান্ট, চকচকে জুতো, পকেটে পেন, হাতে ফাইল। ফাইলে চাকরির আবেদন। সেই সঙ্গে আলপিন, সেফটিপিন জাতীয় ব্যবসার নানাবিধ প্রকল্প। শুনলাম, বরানগরের কোন অফিসে গেলে নাকি ছোট ব্যবসায় টাকা দেয়। সেই অফিসের নাম কী? ঠিকানা কোথায়? পরিচিতরা দেখলে পালায়। প্রায় কেউ-ই ফোন করে না এবং ধরে না। লেখালিখি মাথায় উঠল। কাগজ কেনায় খরচখরচা আছে। তাছাড়া সময় কই? সকাল বিকেল দু-বেলাই ফাইল নিয়ে বেরোতে হয়।
এরকম একটা সময় ‘উনি’ আমায় ডেকে পাঠালেন এবং মাত্র আড়াই মিনিটের মাথায় আমার চাকরি হয়ে গেল। বাড়ি ফিরলাম এক দিস্তে কাগজ কিনে। সেদিনও টাকা ছিল না। তবে ধার করলাম নিশ্চিন্তে।
এই পর্যন্ত ঘটনা আহামরি কিছু নয়। এরকম হতেই পারে। বেকার কি কখনও চাকরি পায় না? অবশ্যই পায়। যিনি চাকরি দিতে পারেন তিনিও চাকরি দেন। দেওয়ার সময় কখনও কাজের প্রয়োজন দেখেন, কখনও প্রার্থীর যোগ্যতা দেখেন, কখনও ধরাকরা দেখেন, কখনও অনুগ্রহ করেন। এমন হয়।
কিন্তু যা হয় না সেটা ঘটতে শুরু করল আমি কাজ শুরু করার তিনদিন পর থেকে।
একদিন রাত বারোটার সামান্য কিছু আগে ‘উনি’ ফোন করলেন। বললেন, ‘কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? হলে কিন্তু আমাকে অবশ্যই জানাবে।’ আমি সামান্য চমকে উঠেও নিজেকে সামলালাম। নিশ্চয় হঠাৎ মনে পড়েছে। ‘বড়’দের ‘হঠাৎ একদিন’ মনে পড়ার অসুখ থাকে। আর করবেন না। দশদিন পরে আবার রাতে ‘উনি’ ফোন করলেন। একই রকম ভরসা দেওয়া গলা। ‘কোনও অসুবিধে হচ্ছে না? হলে বলবে।’ এবার আমি বেশি চমকালাম। তারপরও নিজেকে বোঝালাম, এটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদি ‘হঠাৎ একদিন’ মনে পড়তে পারে, দুদিন পড়বে না কেন? সেই কারণেই ‘উনি’ দুদিন ফোন করলেন। আর করবেন না। ঠিক ষোলো কী সতেরো দিনের মাথায় গভীর রাতে আবার বেজে উঠল টেলিফোন! ‘উনি’ বললেন—’কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? হলে জানিও।’
আর পারলাম না। উত্তর দিতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে উঠল। চোখে কি অল্প জলও এল?
জীবনের সব ব্যক্তিগত ঘটনা প্রকাশ করা উচিত নয়। তবু কিছু করতে হয়। নইলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
‘উনি’ অশোক দাশগুপ্ত। উনি ভালো থাকুন।
প্রচেত গুপ্ত
১০ নভেম্বর ২০১০
কলকাতা
সৈয়দ মোঃ জাফরেছ সাদী লাব্বু
এটি নিয়ে প্রচেত গুপ্ত’র দুটি উপন্যাস পড়লাম। প্রথমটি ছিল “একটু পরে রোদ উঠবে” আর দ্বিতীয়টি “শূন্য খাম”। অসাধারণ লেখনি।