শী – হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড
শী – হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড
মূল: হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড
রূপান্তর: নিয়াজ মোরশেদ
প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৫
.
শুরুর আগে
প্রথমেই পাঠকদের একটা কথা বলে নিতে চাই, যে অবিশ্বাস্য ইতিহাস আপনাদের শোনাতে যাচ্ছি, তার লেখক আমি নই—আমি সম্পাদক মাত্র। কি করে আমি জানতে পারলাম এ ইতিহাস, তা যদি না বলি, খচ খচ করতে থাকবে আমার মনের ভেতর-বুঝি পাঠকরা প্রতারক ডাবলেন আমাকে।
কয়েক বছর আগের কথা। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়-ধরুন কেব্রিজে (আসল নামটা গোপন রাখছি) নিজের কিছু কাজ উপলক্ষে এক বন্ধুর বাসায় কিছুদিন থাকতে হয়েছিলো। সে সময় একদিন বন্ধুর সাথে হাঁটছি রাস্তা দিয়ে। এমন সময় দেখি, দুজন নোক হাত ধরাধরি করে আসছে। এরকম তো কত লোকই যায় আসে, কিন্তু ওদের কথা বিশেষ ভাবে আমার মনে গেঁথে গেল। কারণ ওদের একজন অসম্ভব সুপুরুষ। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, জীবনে অমন সুপুরুষ আমি কখনো দেখিনি, সম্ভবত আর দেখবোও না। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। বুনো মর্দা হরিণের মাঝে যেমন দেখা যায়, অনেকটা তেমন অদ্ভুত এক শক্তি আর মহিমার আভাস তার চোখে-মুখে। অপূর্ব সুন্দর চেহারা, নিখুঁত-নিভাঁজ মুখের ত্বক হেঁটে যাওয়া এক মেয়েকে যখন টুপি খুলে অভিবাদন জানালো, দেখলাম, ছোট ছোট কোঁকড়া সোনালি চুলে ছাওয়া তার মাথা।
কি চেহারা, দেখেছো? বন্ধুকে বললাম আমি। সাক্ষাৎ অ্যাপোরলার মূর্তি, যেন প্রাণ পেয়ে নেমে এসেছে মর্তে!
হ্যাঁ, জবাব দিলো বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুপুরুষ ব্যক্তি, স্বভাব চরিত্রও সেরকম। সবাই ওকে গ্রীক দেবতা বলে। আর অন্যজনের দিকে তাকাও, ও হলো ভিনসির (দেবতার নাম এটা) অভিভাবক—দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ে পণ্ডিত, চলন্ত বিশ্বকোষ বলতে পারো, কিন্তু চেহারা দেখ–ঠিক উল্টো।
সত্যিই তাই, ভিনসি যেমন সুপুরুষ এই লোকটা ঠিক তেমন কদাকার। বছর চল্লিশেক হবে বয়েস। ছোট ছোট পাগুলো বাইরের দিকে বাঁকানো ধনুকের মতো, চাপা বুক, শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক লম্বা হাত। কালো চুল লোকটার মাথায়, কুতকুতে চোখ, কপালেও চুল গজিয়েছে তার, আর গাল ভর্তি দাড়ি উঠে গেছে চুল পর্যন্ত। একমাত্র গরিলার সাথেই তুলনা করা যেতে পারে এ চেহারার। বন্ধুকে বললাম, লোকটার সাথে পরিচিত হতে চাই আমি।
ঠিক আছে, জবাব দিলো বন্ধু, আমি চিনি ভিনসিকে, এক্ষুণি আলাপ করিয়ে দোবো তোমার সাথে।
আলাপ হলো। কিছুদিন আগে আফ্রিকায় এক অভিযান শেষে ফিরেছি আমি। সে সম্পর্কে কথা বললাম কয়েক মিনিট। এমন সময় মোটাসোটা এক মহিলা এগিয়ে এলো আমাদের দিকে, সঙ্গে সুন্দরী একটা মেয়ে। সম্ভবত আগে থেকেই ওদের সাথে পরিচয় আছে ভিনসির, কারণ ওদের দেখেই ও এগিয়ে গেল আলাপ করার জন্যে। আর বয়স্ক লোকটার মুখের ভাব বদলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ইতিমধ্যে তার নাম জেনে ফেলেছি—হলি। আচমকা আলাপ থামিয়ে দিলো সে। আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে হেঁটে চলে গেল ক্ৰস্ত ভঙ্গিতে। বন্ধু জানালো, বেশির ভাগ মানুষ পাগলা কুকুরকে যতখানি ভয় পায় ঐ লোকটা মেয়ে মানুষকেও ঠিক ততখানিই ভয় পায়।
যা হোক, সেদিন রাতেই আমি কেব্রিজ থেকে চলে এলাম। এবং ঐ-ই আমার শেষ দেখা ভিনসি এবং হলির সাথে। প্রায় ভুলতে বসেছিলাম ওদের কথা, এমন সময় মাসখানেক আগে একটা চিঠি আর দুটো প্যাকেট এসে হাজির আমার ঠিকানায়। চিঠিটা খুলে দেখলাম লেখকের নাম হোরেস হলি। তাতে লেখা:
কলেজ, কেমব্রিজ, মে, ১৮
প্রীতিভাজনেষু,
এ চিঠি পেয়ে সম্ভবত আপনি আশ্চর্য হবেন। এত কম সময়ের জন্যে আমাদের আলাপ হয়েছিলো যে, আমার কথা আপনার মনে না থাকাই স্বাভাবিক। সুতরাং আগে পরিচয়টা দিয়ে নেয়াই বোধহয় ভালো। বেশ কবছর আগে আমি এবং আমার পালিত পুত্র লিও ভিনসির সাথে আপনার আলাপ হয়েছিল, কেমব্রিজের এক পথে। এবার আশা করি চিনতে পেরেছেন।
ভূমিকা দীর্ঘ না করে কাজের কথায় আসি। সম্প্রতি মধ্য আফ্রিকায় এক অভিযানের বর্ণনা দিয়ে লেখা আপনার একটা বই পড়লাম। বেশ কৌতূহল নিয়েই পড়লাম। আমার ধারণা, ওতে আপনি যা যা বলেছেন তা আংশিকভাবে সত্যি আর আংশিক আপনি কল্পনার রং চড়িয়ে রচনা করেছেন। যা হোক, আপনার ঐ বইটা পড়ার পরই আমার মাথায় বুদ্ধিটা আসে। আমার অভিজ্ঞতা আমি লিখে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই (এই চিঠির সাথে পাণ্ডুলিপিটা পাঠাচ্ছি আপনার কাছে)। আমি এবং আমার পালিত পুত্র লিও ভিসি সম্প্রতি এক অভিযানে আফ্রিকা গিয়েছিলাম। ঐ সময় আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা আপনার বইয়ের বর্ণনার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চমকপ্রদ। সত্যি কথা বলতে কি, জিনিসটা আপনার কাছে পাঠাতে আমি সঙ্কোচ বোধ করছি-পাছে আপনি অবিশ্বাস করেন আমার গল্পটা। এই ভয়েই আমি-বলা ভালো আমার, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমাদের জীবনকালে আমাদের ঐ অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করবো না। কিন্তু কদিন আগে এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে, আমার মত না বদলে পারলাম না। পাণ্ডুলিপিটা পড়া শেষ হলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। হ্যাঁ, আবার আমরা রওনা হচ্ছি। এবার মধ্য এশিয়ার দিকে। এবার হয়তো আরো বেশি দিন দেশের বাইরে থাকতে হবে, হয়তো কোনোদিনই ফিরে আসা হবে না। সুতরাং যে অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি দুনিয়ার মানুষকে তার ভাগ দেবো না কেন? জানি, মানুষ অবিশ্বাস করতে পারে, গালগল্প মনে করতে পারে, তবু ঘটনাটা প্রকাশ করা দায়িত্ব মনে হয়েছে আমাদের কাছে। লিও আর আমি অনেক আলোচনার পর পাণ্ডুলিপিটা আপনার কাছেই পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনার হাতে পুরো কর্তৃত্ব থাকছে, যোগ্য মনে হলে এটা প্রকাশ করবেন, অযোগ্য মনে হলে করবেন না। কেবল একটা অনুরোধ, আমাদের আসল নামগুলো গোপন রাখবেন।
বিশেষ আর কি? সত্যিই বলছি, যা ঘটেছিলো শুধুমাত্র তা-ই লিখেছি পাণ্ডুলিপিতে, কোনো ঘটনাই বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জিত করিনি। ‘সে’ সম্পর্কে বলতে পারি, যা লিখেছি তার চেয়ে বেশি কিছু আমরা জানতে পারিনি। কে সে? কোর এর গুহায় কোত্থেকে, কিভাবে সে এসেছিলো, কি তার ধর্ম? কিছুই আমরা জানতে পারিনি, সম্ভবত পারবোও না কোনোদিন।
কাজটা নেবেন আপনি? আপনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। বিনিময়ে, আমাদের ধারণা, চমকপ্রদ এক ইতিহাস পৃথিবীর সামনে উপস্থিত করার গৌরব আপনি অর্জন করবেন। দয়া করে পাণ্ডুলিপিটা পড়বেন, এবং আপনার সিদ্ধান্ত জানাবেন।
বিশ্বাস
করুন, আপনার একান্ত বিশ্বস্ত,
এল. হোরেসু হলি*।
পুনশ্চ: পাণ্ডুলিপিটা প্রকাশ করার পর যদি, মুনাফা হয়, সে টাকা দিয়ে আপনার যা ইচ্ছে তাই করতে পারবেন। আর যদি ক্ষতি হয়, আমার আইনজ্ঞ মেসার্স জিওফ্রে অ্যাণ্ড জর্ডান-এর প্রতি নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি, ওরা পুষিয়ে দেবে। যতদিন না আমরা দাবি করছি ততদিন পোড়ামাটির ফলক, গোলমোহর এবং পার্চমেন্টগুলো আপনার কাছেই থাকবে।
-এল, এইচ, এইচ.।
চিঠিটা পড়ে বেশ অবাক হলাম। কিন্তু পাণ্ডুলিপিটা যখন শেষ করলাম তখন শুধু অবাক বললে ভুল হবে, রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার ধারণা, পাঠকরাও হবেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি ওটা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম, এবং সেকথা লিখে জানালাম মিস্টার হলিকে। জবাব এলো এক সপ্তাহ পর। তবে মিস্টার হলির কাছ থেকে নয়, তার আইনজ্ঞদের কাছ থেকে। তারা জানালেন, তাঁদের মক্কেল এবং মিস্টার লিও ভি. সি. ইতিমধ্যে রওনা হয়ে গেছেন তিব্বতের পথে।
এ-ই আমার বক্তব্য, বাকিটা পাঠকরা বিচার করবেন। গৌণ দু-একটা বিষয়ে সামান্য পরিবর্তন ছাড়া পাণ্ডুলিপিটার সম্পূর্ণই তুলে দিলাম আপনাদের জন্যে। আয়শা এবং কোর-এর গুহাগুলোর রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব থাকলো আপনাদেরই ওপর।
–সম্পাদক।
(* লেখকের অনুরোধে আসল নাম বদলে দেয়া হয়েছে।–সম্পাদক।)
.
লেখক পরিচিতি
ইংল্যাণ্ডের নরফোকে জন্মগ্রহণ করেন স্যর হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, ১৮৫৬ সালের ২২শে জুন তারিখে। দশ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। … আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে ভাল কোনও স্কুল-কলেজে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি।তাঁর। মাত্র উনিশ বছর বয়সে নেটাল। সরকারের চাকরি নিয়ে চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়। দুবছর ওখানে কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন ইংল্যাণ্ডে, আইনশাস্ত্রে লেখাপড়া শুরু করেন, পাশাপাশি মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে। ফলে পৃথিবী পায় ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত লেখকদের একজনকে। একের পর এক চমকপ্রদ কাহিনি তিনি উপহার দিতে থাকেন পাঠকদের জন্য। চাকরিসূত্রে আফ্রিকা মহাদেশ সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান লাভ করেন হ্যাগার্ড, সেসব অভিজ্ঞতাই ছিল তার বইগুলোর প্রধান উপজীব্য।
হ্যাগার্ডের বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে কিং সলোমনস মাইনস, শী, রিটার্ন অভ শী, অ্যালান কোয়াটারমেইন, এবং দ্য পিপল অভ দ্য মিস্ট অন্যতম। টগবগে উত্তেজনায় ভরা বইগুলো পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠার উপায় থাকে না। ভাইয়ের সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন হ্যাগার্ড–ট্রেজার আইল্যাণ্ড-এর চেয়ে রোমাঞ্চকর বই লেখার ক্ষমতা তার আছে, এবং কিং সলোমনস মাইনস্ লিখে সত্যিই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সেটা। বইটি প্রকাশ পাবার পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে মন্টেজুমাস ডটার, মর্নিং স্টার, পার্ল মেইডেন, দ্য ব্রেরেন, অ্যালান অ্যাণ্ড দ্য হোলি ফ্লাওয়ার, ইত্যাদি।
নানা সময় নানা রকম পেশায় জড়িত ছিলেন হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, রাজনীতির প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ ঝোঁক। ১৯১২ সালে স্যর উপাধি পান। ১৯২৫ সালের ১৪ মে পরলোকগমন করেন এই কালজয়ী সাহিত্যিক।
Leave a Reply