শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজ / বিনয় ঘোষ / প্রথম প্রকাশ : মে ১৯৮০
উৎসর্গ
বৈজ্ঞানিক সুচিন্তা যাঁদের অগ্রগতির পথে
একমাত্র অস্ত্র
মানুষের শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজের ক্রমবিকাশে
যাঁরা বিশ্বাস করেন
নিজেদের সংগ্রামে নির্ভীক হয়েও যাঁরা
অসমসাহসিক নন
আত্মবিশ্বাসী হয়েও যাঁরা
কল্পনাবিলাসী নন
ভবিষ্যতের শ্রেণিশূন্য সমাজ গঠনের গুরুভার
যাঁদের উপর ন্যস্ত
বাংলাদেশের সেই পুরোগামী বিপ্লবী
সেনাবাহিনীকে দিলাম
সহযাত্রী ও সহকর্মীর আন্তরিক অর্ঘ
স্বীকৃতি ১৯৪০
বন্ধু শ্রীপ্রসাদ উপাধ্যায়, সুবোধ চৌধুরী, অরুণ মিত্র, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, মন্মথনাথ সান্যাল, পুলকেশ দে সরকার, পরেশনাথ সান্যাল, সুবোধ ঘোষ, শুভেন্দু ঘোষ, বিজন ভট্টাচার্য, এঁরা আমার সঙ্গে কয়েকটি বিষয় একত্রে আলোচনা করে যে—উৎসাহ দিয়েছেন, তার জন্যে সকলকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও গোপাল হালদার, প্রয়োজনীয় পুস্তকাদির উল্লেখ করে রচনা সমৃদ্ধ করবার জন্য আমাকে যথেষ্ট অবকাশ দিয়েছেন। কতদূর তাঁদের উপদেশ পালন করতে পেরেছি জানি না, তবু তাঁদের কাছে আমার ঋণ অস্বীকার করবার নয়।
স্বীকৃতি ১৯৮০
তরুণ বন্ধুরা যাঁরা গত তিন—চার বছর ধরে এই বইখানি পুনরমুদ্রণের জন্য ক্রমাগত আমাকে অনুরোধ করেছেন, তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
ভূমিকা ১৯৪০
রিচার্ডস বলেন যে “Over whole tracts of natural emotional response we are to-day like a bed of dahlias whose sticks have been removed.” আজ আমাদের কোনো কিছুতে বিশ্বাস নেই। বিশ্বাসকে আমরা মন থেকে দ্বীপান্তর দিয়েছি। মরুভূমির মতো শূন্য মন ধু ধু করছে। অবিশ্বাস আজ শিল্পীর মনকে আত্মসাৎ করেছে, ইয়েটসের ভাষায়, “Mere anarchy is loosed upon the world.” কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে এই অবিশ্বাসের প্রেতপুরী থেকে শিল্পী বিশ্বাসের কোনো শ্যামল ভূমির সন্ধান পেতে পারেন কি না? এ—প্রশ্নের উত্তর আজ সমস্ত লেখকেরাই দাবি করবেন, কারণ তাঁরা শুধু জীবনধারণের জন্য মুক্ত আলো—বাতাস চান না, সত্য কিছু প্রকাশ করতে চান, জীবন্ত সত্য, মঙ্গলময়, সুন্দর সত্য। তাই আজ যে—নৈরাশ্যের বা অবিশ্বাসের প্রাসাদ আমাদের মাথার উপর ধসে পড়ছে, তার সেই ধসে পড়াটাকেই সত্য ভেবে হতবাক হয়ে থাকলে আমাদের চলবে না, বুঝতে হবে কীসের আঘাতে আজ এই ভাঙন শুরু হল, যে—ভাঙন শুধু যে বহির্জগৎকেই চুরমার করল তা নয়, মনের মধ্যেও ভীষণ তোলপাড় করে দিল। তা যদি বুঝতে পারি তাহলে আবার বিশ্বাস আমরা ফিরে পাব, সত্যের সন্ধান পাব, আমাদের কন্ঠোৎসারিত সংগীত নৈশ স্তব্ধতার জনশূন্য পরিত্যক্ত গ্রামের মধ্যে প্রেতের কান্নার মতো ভয়ংকর—করুণ শোনাবে না।
শিল্পী মানুষ। মানুষ বলেই তিনি তাঁর জীবনকে অবহেলা করতে পারেন না। গারদের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে উন্মাদের প্রলাপ বকবার অধিকার আছে, আত্মতৃপ্তির জন্য যা—খুশি করবার ফুরসত আছে, কিন্তু সমাজের মধ্যে বাস করে আর যা—ই থাক, এই উন্মাদের মতো আত্মতৃপ্তির অবাধ স্বাধীনতা মানুষের নেই। ‘শিল্পের খাতিরে শিল্প’ উন্মাদের প্রলাপ ভিন্ন কিছু না। ‘খাওয়ার খাতিরে খাওয়া’, ‘চলার খাতিরে চলা’ প্রভৃতির প্রলাপের অর্থ নিয়ে আশ্রমবাসী সমালোচকেরা গবেষণা করতে পারেন, কিন্তু আমরা এসব উপেক্ষা করব শুধু মানুষ বলে। শিল্পীজীবনকে অগ্রাহ্য করতে পারেন না বলেই জীবনের প্রতি তাঁর নির্দিষ্ট কোনো মনোভাব থাকা স্বাভাবিক। তিনি যে—সমাজে বাস করেন, যে—সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে জীবনকে দেখতে পান, সেই সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে একটি বিশেষ কোণ থেকেই তিনি দেখবেন। জীবনের প্রতি শিল্পীর এই মনোভাবই হচ্ছে সব চেয়ে বেশি মূল্যবান। এই মনোভাবই শিল্পে ও সাহিত্যে অভিব্যক্ত হয়।
জীবন, সমাজ, মানুষ প্রভৃতি কোনো কিছুকেই যাঁরা মূল্য দেন না, সব ভুয়ো, অর্থহীন বলে প্রকাশ করেন, সেইসব ছন্নছাড়া কয়েকজন individual-anarchist—দের বাদ দিলে, বাকি যাঁরা থাকেন, তাঁদের বিশেষ কিছু ব্যক্ত করবার থাকে। বিশ্বাসই তাঁদের প্রধান সহায় হয়। জীবনের প্রতি যেকোনো কারণেই হোক তাঁদের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা থাকবেই। তাঁদের মন কোনোদিন শ্মশানে পরিণত হয় না। তাঁরা যে—যুগে বাস করেন, সে—যুগের সত্যের চারণ সেইজন্য তাঁরাই হন। তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনকে প্রকাশ করেন না। তাঁরা রূপায়িত করেন “the whole life of the time”, যুগের জীবন। যুগের জীবন অনুভব করে শিল্পী যখন প্রকাশ করেন তখন তার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেরও পূর্ণ বিকাশ হয়, কারণ যুগজীবন বহুমুখী বিচিত্র ধারার সমন্বিত প্রবাহ ভিন্ন কিছু নয়, এঙ্গেলস যাকে বলেছেন, “one resultant—the historical event” এবং : ‘‘each contributes to the resultant and is to this degree involved in it.’’
বর্তমানের এই নৈরাশ্য ও অবিশ্বাস কলুষিত প্রতিবেশের মধ্যে শিল্পী সেইজন্য বাস করতে পারেন না। বিশ্বাস তাঁর চাইই। সে—বিশ্বাসের জন্য আজ হয় তাঁকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে অতীতের দিকে, তা না হলে দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে ভবিষ্যতের দিকে। অতীতের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর দায়িত্ব অনেক। ধনতন্ত্রের সে গৌরবময় শৈশব বা যৌবন আজ আর ফিরে আসতে পারে না, শুধু তার নকল রূপ আমরা পেতে পারি। নকল রূপ হবে আরও বীভৎস—ফ্যাসিজম—‘‘Literary Fascism goes with Political Fascism”। নিরপেক্ষ থাকাও সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি আমাদের তাই মেলাতেই হবে। কবি সিসিল ডে—ল্যুইস বলেছেন :
Yet living here,
As one between two massive powers I live
Whom neutrality cannot save
Nor occupation cheer.
None such shall be left alive :
The innocent wing is soon shot down
And private stars fade in the blood-red dawn
Where two worlds strive.
The red advance of life
Contracts pride, calls out the common blood,
Beats song into a single blade,
Makes a depth-charge of grief
Move then with new desires.
For where we used to build and love
Is no man’s land, and only ghosts can live
Between two fires.
দুটি জগতের অস্তিত্বকে কবি স্বীকার করছেন। বিরোধী দুটি জগৎ হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রামেরই রূপ, বিপ্লব ও প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব এত জটিল যে নিরপেক্ষ থাকা অসম্ভব। যেকোনো একদিকে যোগ দিতেই হবে। ডে—ল্যুইস “The red advance of life”—এর দিকে ঝুঁকেছেন, কারণ তিনি মনে করেন “only ghosts can live between two fires.”।
এই কবিতায় সাম্যবাদকে সমর্থন করা হয়েছে, সুতরাং অনেকে বলবেন প্রপাগ্যান্ডা। কিন্তু সাম্যবাদ বা অন্য কোনো ”—বাদ” কি না, প্রশ্ন তা নয়। যে—সত্য আজ আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সে—সত্য, অর্থাৎ আমরা দেখব আমাদের যুগজীবন ঠিক ব্যক্ত হয়েছে কি না। আমরা দেখেছি যে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতাই হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প ও সাহিত্যের উৎস। আজ সেই ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা এককথায় মানুষের জীবনের সৌন্দর্য ও শান্তি যখন ক্ষয়িষ্ণু ধনতান্ত্রিক সভ্যতার কবলে পড়ে ধ্বংসোন্মুখ, তখন একমাত্র সাম্যবাদই তাদের পুনরুজ্জীবনের আশা দিচ্ছে। সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সঞ্চয় লোপ পাবে, জাতিতে জাতিতে স্বার্থের সংঘাতে যুদ্ধ বাধবে না, মানুষের সামনে মানুষ সংস্কৃতির ও সভ্যতার প্রাচীর তুলবে না, হীন প্রতিযোগিতা দূর হয়ে যাবে, মানুষের স্বাধীনতা ফিরে আসবে। আজ বিশ্বাস তাই একমাত্র ভবিষ্যতের সাম্যবাদী সমাজের মধ্যে ফিরে পাওয়াই সম্ভব। পৃথিবীর বৃহত্তম মানবগোষ্ঠী শ্রমজীবী শ্রেণি আজ সেই বিশ্বাসে বিপ্লবের পথে এগিয়ে চলেছে। আজকের জীবনের ‘elemental forces’ এইগুলি, এই শ্রেণিবিরোধ, ভবিষ্যতের শ্রেণিশূন্য সমাজে বিশ্বাস, এবং লেনিনের মতে শিল্পীর কর্তব্য জীবনের ‘elemental force’—গুলিকে ব্যক্ত করা।
এই বইয়ের মধ্যে এই কথাই আমি বলতে চেয়েছি। উপাদান সংগ্রহ করেছি ইংরেজি সাহিত্য থেকে দুটি কারণে। প্রথমত সব দেশের সাহিত্য আলোচনা করবার শক্তির অভাব; দ্বিতীয়ত ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে এ—দেশের যোগাযোগ খুব বেশি, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের, এবং সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের। পৃথকভাবে বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা অন্য খণ্ডে করবার ইচ্ছা রইল। ‘অষ্টম’ ও ‘নবম’ অধ্যায় দুটি সম্পূর্ণ আলোচনা হিসাবে না পড়ে, ভূমিকা হিসাবে পড়তে হবে।
বিনয় ঘোষ
৭ মে, ১৯৪০
কলকাতা
ভূমিকা ১৯৮০
১৯৪০ সালে ‘শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮—৩৯ সালে এই গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধগুলি লিখি। প্রবন্ধের বিষয়গুলি নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদি। এগুলি যে গুরুগম্ভীর বিষয় তা সকলেই স্বীকার করবেন। লেখকের বয়সের দিক থেকে এইসব বিষয় নিয়ে এমনিতেই সাধারণভাবে আলোচনা করা অনেকের কাছে অনধিকারচর্চা বলে মনে হবে। বাস্তবিকই তা—ই। প্রথমত ১৯৩৮—৩৯ সালের একটি কুড়ি বছরের তরুণের সঙ্গে ১৯৮০—৮১ সালের একটি কুড়ি বছরের তরুণের পার্থক্য বিরাট। সুশিক্ষিত তরুণদের কথাই বলছি। বর্তমানকালে এই বয়সের তরুণদের বিদ্যাবুদ্ধি—প্রতিভা অনেক বেশি প্রখর ও বহুমাত্রিক। সেটা অবশ্য সামাজিক গতিবেগের চাপেই হয়েছে। ১৯৩৮—৩৯ সালের একজন তরুণের বোধবুদ্ধির এতটা প্রখরতা ও ব্যাপকতা থাকার কথা নয়। সেই কথা মনে করে বিচার করলে এইসব বিষয় নিয়ে লেখা সত্যিই অনধিকারচর্চা বলে মনে হয়। তা—ও আবার লেখার জন্য লেখা নয়, যেনতেনপ্রকারে সাহিত্য—শিল্প নিয়ে ‘সাহিত্যিক’ আলোচনা নয়। লেখার একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং সেই দৃষ্টিটাও আধ্যাত্মিক—আধিভৌতিক দৃষ্টি নয়, মার্কসবাদসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি। তার জন্য অনধিকার ও দুঃসাহসের মাত্রা স্বভাবতই অনেক বেড়ে গিয়েছে। বর্তমানে যেমন যতজন ‘মার্কসবাদী’ আছেন প্রায় তত রকমের ‘মার্কসবাদ’ গজিয়ে উঠেছে, ১৯৩০—এর দশকে, আমাদের ‘টিনএজ’ থেকে তারুণ্যে ও যৌবনে উত্তীর্ণ হবার কালে, ১৯৪০—এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এরকম বিতর্কবাণে শতচ্ছিন্ন বস্ত্রের মতো মার্কসবাদের অবস্থা হয়নি। তখনকার মার্কসবাদ তাৎকালিক ঐতিহাসিক—সামাজিক প্রতিবেশে একটা নিটোল পরিপূর্ণ আদর্শ ছিল। সেই আদর্শে আমরা কিশোর—তরুণ বয়স থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আজ সে—কথা গভীর বিষণ্ণতার মধ্যেও ভাবতে ভালো লাগে, এমনকী বেশি বয়সেও রোমাঞ্চ হয়।
মার্কস—এঙ্গেলস—লেনিন—স্ট্যালিন মাও—সে তুং প্রমুখ মনীষীদের রচনা আমরা তখন ক্লাস পালিয়ে অথবা ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে পড়তাম। দু—একজন যারা বইপত্র সরবরাহ করত তারা গোপনে কাগজে জড়িয়ে সেগুলি নিয়ে আসত। বাড়িতেও পাঠ্যবই ফেলে সেগুলি নিশ্চিন্তে পড়া সম্ভব হত না। এই অবস্থায় ১৯৩৮—৩৯ সাল পর্যন্ত ‘মার্কসিজম’ পড়েছি। সুতরাং তার বিদ্যা কত দূর পর্যন্ত গভীর হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তার সঙ্গে সাহিত্যপাঠ তো আছেই এবং সাহিত্য বলতে তখন আমাদের কাছে বামপন্থী তো বটেই, মার্কসবাদী লেখকদের রচিত সাহিত্যেরই আবেদন ছিল সবচেয়ে বেশি। সাহিত্য—শিল্পের আলোচনায় তখন আমাদের ‘মডেল’ লেখক ছিলেন কডওয়েল, র্যালফ ফক্স, অডেন, স্পেণ্ডার, ডে—ল্যুইস এবং আরও দু—চারজন। কডওয়েল, ফক্স এঁরা স্পেনের ফ্যাসিস্ট—বিরোধী গৃহযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামও করেছেন, কেউ কেউ প্রাণও দিয়েছেন। কাজেই তাঁরা যে আমাদের সাহিত্যজীবনের আদর্শ হবেন তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, বিশেষ করে তরুণ সাহিত্যিকদের কাছে।
‘শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজ’—এর সমস্ত রচনা এঁদের রচনা পড়ে লেখা। মার্কসবাদই হোক অথবা এঁদের লোখাই হোক, পরিণত বুদ্ধি দিয়ে বিচার—বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা তখন হয়নি। এ—কথা স্বীকার করতে কোনো সংকোচ নেই, দ্বিধাও নেই। কিন্তু অপরিণত বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন এই লেখকের বইখানি যখন প্রকাশিত হল, তখন তরুণ ছাত্রমহলে বিশেষ করে তার প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছিল। লেখক হিসেবে আমিও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। তখনকার দিনে তিন টাকার বই, এবং প্রবন্ধের বই, এবং নীরস প্রবন্ধের বই, খুবই দুর্মূল্য ছিল। তৎসত্ত্বেও, আমার মনে আছে, খুব দ্রুত বইখানি বিক্রি হয়ে যায়, এবং ক্রেতারা বেশির ভাগই কলেজের ছাত্র। বিখ্যাত পত্রিকাদিতে সবিস্তারে ভালো সমালোচনাও করা হয়। এই নতুন সংস্করণের ‘সংযোজন’ অংশে কয়েকটি সমালোচনা উদ্ধৃত করেছি। উল্লেখ্য হল, যে—পত্রিকাতে কখনও কোনো বাংলা বই—এর উল্লেখ বা আলোচনা করা হয়নি, সেই পত্রিকাতে (The Statesman) এই বইখানির উল্লেখ ও সমালোচনা করা হয়। কেন করা হয় তা কার্ল মার্কসই জানেন। আর তখন যাঁরা মার্কসবাদী ছিলেন তাঁরা জানেন এবং বর্তমানে যাঁরা মার্কসবাদী তাঁরা একটু চিন্তা করলেই জানতে পারবেন। ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সমালোচনাতে বেশ ধারালো খোঁচা ছিল। বয়সের জন্য দেহের চামড়া তখনও খুব পুরু হয়নি বলে, খোঁচাটা লেখকের গায়েও বিঁধেছে। তবে যাঁরা বাণটি মেরেছিলেন তাঁরা লেখককে ধরাশায়ী করতে পারেননি এবং তাঁরা অত্যন্ত হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন যখন ছ—মাসের মধ্যে লেখকের দ্বিতীয় মার্কসীয় সাহিত্য—সমালোচনার বই প্রকাশিত হয় (‘নূতন সাহিত্য ও সমালোচনা’—এই বইটিরও দ্বিতীয় সংস্করণ শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।)
মার্কসবাদের জ্ঞান অগভীর হলেও আজকের দিনে লেখাগুলি একাধিকবার পড়ে দেখেছি, খুব খারাপ লিখিনি এবং ভুলও মারাত্মক কিছু করিনি। তবে লেখার মধ্যে কিছুটা জড়তা ও অস্পষ্টতা আছে। মূল প্রতিপাদ্য, ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ প্রায় ঠিকই আছে। নির্ভুল এমন কথা বলব না, কোনো মার্কসবাদীই তা বলতে পারেন না। বর্তমানে মার্কসীয় সাহিত্য—শিল্পের আলোচনা নানাদিকের দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে ও হচ্ছে। সমাজের বাস্তব অর্থনৈতিক ভিত্তি (Base) এবং উপরের সাহিত্য—শিল্পকলার সৌধ (Superstructure) নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন লুকাচ, রেমণ্ড উইলিয়ামস, মরিস গদেলিয়ের এবং আরও অনেকে। গ্রামসিও এ বিষয়ে তাঁর জেলখানার নোটবুকে আলোচনা করেছেন (বইয়ের শেষে ‘গ্রন্থপঞ্জি’ দ্রষ্টব্য)। এইসব আলোচনার ফলে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics) ও সাহিত্য—শিল্পালোচনা অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। তার পরিচয় দিতে গেলে নতুন করে বড়ো একটি বই লিখতে হয়।
বিনয় ঘোষ
জুন ১৯৮০
Leave a Reply