শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র – শাহ আবদুল করিম। সঙ্কলন ও গ্রন্থন – শুভেন্দু ইমাম। প্রকাশকাল – ২২ মে, ২০০৯। উৎসর্গ – বাউলগানের ভক্তদের উদ্দেশে।
শাহ আবদুল করিম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ – ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯) – বাংলাদেশী কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত শিক্ষক।
ফ্লাপের লেখা
এ এক অন্য পৃথিবী, এ এক অন্য ভাষার কথকতা। হাজার বছর ধরে বাংলার লোকগান অবলীলায় ধারণ করেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক সহজিয়া তান্ত্রিক-বৈষ্ণব-সুফি ভাবনাকে। একই দেহে লীন হয়েছে নানা উৎসজাত অধ্যাত্ম-ভাবনা। খনি থেকে তোলা আকাটা হীরার মতো অপরিশীলিত বাচন সোদা মাটির বুকে নামিয়ে আনে বিপুল আকাশটাকে। তাই বাউল করিম বিভোর হয়ে তার গানের ডালি সাজিয়েছেন। আপনমনে সুরে কথা বসিয়েছেন আর কথাকে করেছেন বিহ্বল ভাবের অনুগামী। তাই তার রচনায় পুনরাবৃত্তির অভাব নেই। যেন প্রিয় পরমের ছবি হৃৎকমলে আঁকতে গিয়ে কিছুতেই সাধ মিটছে না তার। শব্দের সিঁড়ি দিয়ে চেতনার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে চাইছেন তিনি এবং প্রতিপলে অনুপলে অনুভব করছেন, শব্দাতীতকে শব্দ দিয়ে বাঁধা যাচ্ছে না। কিন্তু ভাবুক বাউলের কাছে উপকরণ তো বড় নয়; অভ্যস্ত শব্দসজ্জাকে বারবার ব্যবহার করছেন এই বিশ্বাসে যে এর মধ্যে ‘আশিকের ধন পরশরতন’ এর সাক্ষাৎ মিলবে। সন্ত-কবিতার কিছু কিছু পরিচিত শব্দবন্ধ বাউল করিমের প্রগাঢ় অনুভবের দ্যুতিতে নতুন সুরে-তালে-লয়ে বেজে উঠেছে।
রচনাসমগ্রের পাঠকেরা নিশ্চয় লক্ষ করবেন এইসব। নানা উৎস থেকে উৎসারিত অজস্র নদী। যেমন আপন বেগে পাগলপারা হয়ে স্বতন্ত্র উপস্থিতি ঘোষণা করে তবু সাগর-মোহনায় পৌঁছে অসামান্য ঐক্যবোধে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, শাহ আবদুল করিমের রচনাসম্ভারও তেমনি বহুমাত্রিক লোকায়ত চেতনার সংশ্লেষণে সমৃদ্ধ হয়েই অদ্বিতীয় অনুভবের আলো বিচ্ছুরণ করে। ‘নিধনের ধন রে বন্ধু আঁধারের আলোক’, ‘নাম সম্বলে ছাড়লাম তরী অকূল সাগরে’, ‘শতবর্ণের গাভী হলে একই বর্ণের দুগ্ধ মিলে’, ‘বন্ধু রে তিলেক মাত্র না দেখিলে কলিজায় আগুন জ্বলে’ এবং এরকম অজস্র পঙক্তি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে শাহ আবদুল করিম বাংলার আবহমান লোকায়ত পরম্পরার-ই সৃষ্টি। বিখ্যাত সেই গ্রিক দার্শনিকের মতো তিনিও মানুষ খুঁজে বেড়ান। এই খোঁজার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা যেমন আছে, তেমনি বন্ধন-ভীরু মুক্ত মানুষের। কথকতায় রয়েছে আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিরুদ্ধে উচ্চারিত প্রতিস্পর্ধা। ধর্মীয় উন্মাদনা ও শাসকের নগ্ন পীড়নের বিরুদ্ধে তাইতো তিনি নিজের স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করেন। এইজন্যে কেবল বাউল করিমের জীবন। ব্যাপ্ত সাধনার তাৎপর্য পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়।
শাহ আবদুল করিমের রচনাসমগ্র প্রত্যেকের কাছেই অমূল্য সাংস্কৃতিক চিহ্নায়ক হিসেবে গণ্য হবে। কেননা আত্মবিস্মৃতির অন্ধকার প্রহরে ঐতিহ্যের বাতিঘরই আমাদের চূড়ান্ত আশ্রয়।
ভাটিবাংলার বাউল সাধক শাহ আবদুল করিম। ভাটির জল-হাওয়া-মাটির গন্ধ আর কালনী-তীরবর্তী জনজীবন, মানুষের সুখ-দুঃখ, দারিদ্র্য-বঞ্চনা, জিজ্ঞাসা, লোকাচার, স্মৃতি প্রভৃতি তাঁর গানে এক বিশিষ্ট শিল্পসুষমায় পরিস্ফুট। জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলাধীন ধল-আশ্রম গ্রামে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার। তাঁর বাবা ইব্রাহিম আলী, মা নাইওরজান বিবি। ১৯৫৭ সাল থেকে উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস। কাগমারী সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন আর মৌলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাহচর্য তাঁর জীবনের মধুরতম স্মৃতি। ১৯৬৪, ১৯৮৫ ও ২০০৭ সালে তিনবার বিলাত ভ্রমণ করেন। ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক প্রদান করে। এছাড়াও মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা (২০০৪), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক এওয়ার্ড (২০০৫) সিলেট সিটি কর্পোরেশন নাগরিক সংবর্ধনা (২০০৬), বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা (২০০৮), খান বাহাদুর এহিয়া সম্মাননা পদক (২০০৮) ॥ দেশ-বিদেশ থেকে বহু পদক, সম্মাননা ও সংবর্ধনা পেয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত বইগুলো হলো: ‘আলতাব সঙ্গীত’ (আনু. ১৯৪৮), ‘গণসঙ্গীত’ (আনু. ১৯৫৭), ‘কালনীর ঢেউ’ (১৯৮১), ‘ধলমেলা’ (১৯৯০), ‘ভাটির চিঠি’ (১৯৯৮) ও ‘কালনীর কূলে’ (২০০১)।
.
পূর্বকথন
হজরত শাহজালাল (র.) ও শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতিবিজড়িত পূণ্যভূমি সিলেট সম্পর্কে এক মুগ্ধ আকর্ষণ পূর্ব থেকেই আমার মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল। বিশেষ করে নিসর্গ-নির্ভর সিলেটভূমির ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, এখানকার মানুষের মরমি সাধনার প্রতি আমার পরোক্ষ সংযোগ থাকলেও কর্মসুবাদে যখন এখানে আসি তখন গভীরভাবে তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটে। সুদীর্ঘকাল থেকে সিলেটের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে রয়েছে সম্প্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন। এখানকার বাউল-সাধকদের সৃষ্টিকর্ম দেশের অপরাপর অঞ্চল থেকে কিছুটা আলাদা। হাওর-নদী-ঝর্ণা, পাহাড়-সমতল, সবুজাভ বনরাজি মানুষের চিত্তকে দোলায়িত করে। আর সেই চিত্তশিহরণে মামি বাউলদের স্বতঃস্ফূর্ত মনে লোকগানের উতল সুর ও কথা, হাওর-নদীর ঢেউয়ের দোলায় দুলতে থাকে। ভাটিবাংলার প্রকৃতিই যেন এখানকার মানুষের কানে-কানে প্রাণে-প্রাণে চিরন্তন সেই ভাবের ছন্দ আর সুরের মুনায় আবেশিত করে তোলে। এমনি এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সিলেটের লোকসঙ্গীতের ধারা সুফি-মরমি ও বৈষ্ণব-সহজিয়া মতের সঙ্গে একীভূত হয়ে স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহমান। দীন ভবানন্দ, সৈয়দ শাহনুর, শীতালংশাহ, শেখভানু, রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজা, দীনহীন, আরকুম শাহ, নূর মোহাম্মদ, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ মরমি-বাউল কবির গানে এখানকার আকাশ-বাতাস মুখরিত। তাঁদের চিত্তহরণকারী গানের ভেতর মানুষের আশা মাক্ষা, বিচ্ছেদ-বেদনা, প্রেম-বিরহ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিস্ফুট।
২.
বিভাগীয় কমিশনার হিসাবে যোগদানের পর খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেটের পক্ষ থেকে সিলেট বিভাগের প্রতিটি উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে শিক্ষা ও সমাজকল্যাণে বিশেষ অবদানের জন্য খান বাহাদুর এহিয়া সম্মাননা পদক প্রবর্তন করি। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমকে সুনামগঞ্জ জেলা থেকে খান বাহাদুর পদকের জন্য মনোনীত করা হয়। অসুস্থ এ মহান সাধনকে এক নজর দেখতে এবং খান বাহাদুর এস্টেটের মোতাওয়াল্লি হিসেবে নিজ হাতে তাকে সম্মাননা পদক তুলে দেওয়ার জন্য আমি ২০০৮ সালের ২১ অক্টোবর দিরাই উপজেলায় তার নিজ গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত হই। বাউল সম্রাট তখন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। আমি গিয়ে তার শয্যাপাশে বসলাম। তিনি আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আমরা তাঁকে ধরাধরি করে উঠোনে নিয়ে বসালাম। তাঁর ছেলে শাহ নূরজালাল এবং কবির কিছু ভক্ত উঠোনে মাদুর পেতে হারমনিয়াম নিয়ে বাউল ঢঙ্গে নেচে নেচে গান ধরল–কোন মেস্তরি নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়; আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম; গাড়ি চলে না চলে না…। বাউল সম্রাটের পাশে বসে জীবনঘনিষ্ঠ এই গানগুলো শুনে আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম। ফেরার সময় বাউল সম্রাট তার ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে কালনী নদীর ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমাদের বিদায় জানান। তার সৌম্য, শান্ত এবং পবিত্র অবয়ব স্থায়ীভাবে আমার মানসপটে অঙ্কিত হয়ে রইল। পথে আসতে আসতে এই মরমি সাধকের অমর সৃষ্টিগুলো সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার গভীর তাগিদ অনুভব করলাম।
৩.
বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ আফতাব সঙ্গীত, গণসঙ্গীত, কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮) ও কালনীর কূলে (২০০১) ছাড়াও অনেক মূল্যবান অগ্রন্থিত গান এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার এসব সৃষ্টি যেন কালের অতলে হারিয়ে না যায় সেজন্য আমি তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলো একত্র করে খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেটের পক্ষ থেকে শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি। সে লক্ষ্যে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. ফজলুর রহমানকে আহ্বায়ক করে একটি প্রকাশনা পর্ষদ গঠন করি। এই পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন–মদনমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আলম, সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার আবদুল হান্নান, খান বাহাদুর ওয়াকফ এস্টেটের বিশেষ সহায়ক কর্মকর্তা খালেদ মোবারক, শাহ আবদুল করিমের ছেলে শাহ নূরজালাল এবং শাহ আবদুল করিমভক্ত ও গবেষক সুমনকুমার দাশ। সিনিয়র সহকারী কমিশনার এবং খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেটের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী এই পর্ষদের সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। প্রকাশনা পর্ষদ দ্রুততম সময়ে তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে রচনাসমগ্রটি পাঠকের হাতে তুলে দেবার সুযোগ সৃষ্টির জন্য তাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বাউলসম্রাটের ঘনিষ্ঠজন বিশিষ্ট সাহিত্যতাত্ত্বিক ড. তপোধীর ভট্টাচার্য মূল্যবান ভূমিকা লিখে এই গ্রন্থকে ঋদ্ধ করছেন। দেশের প্রতিথযশা প্রচ্ছদশিল্পী সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষ প্রচ্ছদ এঁকে গ্রন্থটির সৌকর্য বৃদ্ধি করেছেন। আমি এই গ্রন্থের প্রকাশ মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই।
৪.
সিলেটের লোকসঙ্গীত অঙ্গনে তথা বাংলা লোকসঙ্গীত পরিমণ্ডলে বাউল কবি শাহ আবদুল করিম স্বমহিমায় ভাস্বর। তাঁর নামের সঙ্গে নানা অভিধা যুক্ত হলেও সব মহলে তিনি ‘বাউল সম্রাট’ নামেই বেশি পরিচিত। সুনামগঞ্জ জেলার ধল গ্রামে তাঁর জন্ম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কালনী নদী ও তার কুল ঘেষে বিস্তৃত হাওর, সুবিশাল ঢেউ আর দিগন্ত ছোঁয়া জলরাশি খুব সহজভাবেই তাঁর মন কাড়ে। তাই একতারা হাতে মাটির বাউল বেরিয়ে পড়েন সহজ মানুষের সন্ধানে। রাখাল বালকবেশে পৃথিবীর পথে যিনি বেরিয়ে পড়েন–তিনি আজ খ্যাতির শীর্ষে। বাংলা লোকসঙ্গীতকে যেসব সাধক কবি তাঁদের গানের মধ্য দিয়ে অপূর্ব শিল্প-সুষমায় মহিমান্বিত করে তুলেছেন কালের বিচারে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম তাঁদের অন্যতম। তিনি আজ বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষের প্রিয়জনপ্রিয় মানুষ। বয়সের ভারে নজ বাউল কবি আজ শয্যাশায়ী, দৃষ্টি তাঁর স্পষ্ট হলেও স্মৃতিশক্তি অনেকটা ক্ষীণ।
৫.
একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননাসহ অসংখ্য পদকে ভূষিত বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম এখন আর কেবল সিলেটের কবি নন। তিনি গোটা বাঙালির গর্বের ধন–হৃদয়ের সম্রাট। শাহ আবদুল করিমের জীবনদর্শন ও শিল্প-ভাবনা বৃহত্তর পাঠক-শ্রোতার কাছে শাশ্বত আবেদন নিয়ে উপস্থাপিত হোক–এই আশা পোষণ করি। বাঙালি পাঠকমহলে শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র বিপুলভাবে সমাদৃত হলেই আমাদের সকলের শ্রম সার্থক হবে।
ড. জাফর আহমেদ খান
বিভাগীয় কমিশনার, সিলেট
ও
মোতাওয়াল্লি, খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেট
সিলেট, ২৫ বৈশাখ ১৪১৬ / ৮ মে ২০০৯
.
উল্লাসে সংকটে গান চাই
ভাটির দেশের বাউল শাহ আবদুল করিমের অনুপম সৃষ্টির কথা ভাবতে গিয়ে কেন যে নাগরিক কবি বিষ্ণু দে-র কয়েকটি পঙক্তি মনে এল, জানি না। হ্যাঁ, ধ্যানের নীল আকাশই তো চাই। সেই সঙ্গে চাই পারাপারহীন হাওরের বৈরাগ্য আর উদাসীন নিষ্ঠুর সৌন্দর্য। চাই সুধাশ্যামলিম ভালোবাসার জীবনের জন্য আর্তি, আদিগন্ত ব্যাপ্ত বিষাদের স্বাভিমান কান্না-হাসির খড়ির গণ্ডি পেরিয়ে-যাওয়া বাচনাতীত অনুভব। অজস্র ধরনের কৃত্রিমতা ও মরীচিকায় ঠাসা নাগরিক আধুনিকতা কি দিতে পারে এতসব? মেকি আভিজাত্যের প্রতারক ভাষায় অভ্যস্ত আমরা; কীভাবে চিরকালীন জীবনস্পন্দনের সজীব উচ্চারণে সাড়া দেব, ভেবেও পাই না অনেক সময়। সম্ভবত অনাগরিক বা গ্রামীণ বলে পরিচিত হওয়ার আশঙ্কায় কুঁকড়ে থাকি। এখন তো আধুনিকোত্তর অভিজ্ঞানের জন্যে মরিয়া তৃতীয় বিশ্বের উলুখাগড়ার দল। ঐতিহ্য প্রত্নস্মৃতি ভাবাদর্শ ইত্যাদি ধারণা মহাসন্দর্ভ বলে পরিত্যক্ত ও উপহসিত। তাহলে, একুশ শতকের প্রথম নয় বছর কাটিয়ে দিয়েও আমরা কেন স্বেচ্ছাকৃত চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছি? কেন ফিরে ফিরে আসছি বাউল শাহ আবদুল করিমের কাছে।
ফিরে আসতেই হচ্ছে কেননা এছাড়া আমাদের মতো দ্বিধাগ্রস্ত ভণ্ড নাগরিক কালিমালিপ্ত ধ্বস্ত অবসন্ন আধামানুষদের অন্য কোনো উপায় নেই পুনরুজ্জীবনের। পদে-পদে মৃত্যু-শাসিত ক্ষয়-লাঞ্ছিত আমরা। অসুন্দর ও আগ্রাসী লোভের কাছে সমর্পিত আমাদের সম্ভোগ-লোলুপ অপজীবন। টুকরো-মানুষেরা পুঁজিবাদের সীমাহীন নির্লজ্জতা ও কুশ্রীতাকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করে। যারা চোখ থাকতেও অন্ধ, তাদের কাছে জমি ও আকাশের যুগলবন্দি কোন তাৎপর্য নিয়ে আসতে পারে? তাহলে কি করণীয় নেই কিছু! সাময়িকতার ফেনিল উচ্ছ্বাসের কাছে কি হার মানবে বিশ্বাস, লাবণ্য, পরম্পরার চিরকালীন ঐশ্বর্য! এইসব জিজ্ঞাসার মীমাংসা করার জন্যেই করিমভাইয়ের অনুরাগী জনেরা তাঁর চিত্তবিত্তের অফুরান প্রচুর ভাড়ারকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সামাজিক দায় নিজেদের চওড়া কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
শাহ আবদুল করিম আউল-বাউল মানুষ-রতন। তাঁর আফতাব সঙ্গীত, গণসঙ্গীত, কালনীর ঢেউ, ধলমেলা, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে পুণ্যভূমি সিলেটের চিরস্থায়ী সম্পদ। কিন্তু আফতাবুন্নেসার মতো আফতাব সঙ্গীতও ইদানিং কিংবদন্তি মাত্র। তাই রচনাসমগ্র প্রকাশ করে করিমভাইয়ের সৃষ্টি সম্ভারকে সুলভ করার আগ্রহ বোধ করেছেন অনুরাগীজনেরা। ভরা বর্ষার হাওরের ঢেউয়ের মতো তাঁর গান অথৈ জলের বার্তা বয়ে আনে। মন-মাতানো প্রাণ-মজানো এই গান রাষ্ট্রের কৃত্রিম ভূগোল মানে না। তাই তো সুরমা উপত্যকার পূর্বদিকে, ভিন্ন রাষ্ট্রের আঙিনায়, বরাক উপত্যকায় সিলেট সন্ততিদের মধ্যে এবং লোকমন সম্পকে উৎসুক অন্যান্য সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে করিমের গান অহরহ অনুরণন তোলে। রুহি ঠাকুর-জামালউদ্দিন হাসান বান্না-শুভপ্রসাদ নন্দীমজুমদার-কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের মতো কৃতী শিল্পীদের গায়ন-শৈলীতে তাঁর গান ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালির প্রতিটি বসতে। শাহ আবদুল করিম এখন অনাড়ম্বর সারল্য, সহজিয়া অনুভব ও মানবিক সম্প্রীতির সংস্কৃতি-দূতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
তার গান যেন বিশল্যকরণী, অন্ধজনে দেয় আলো আর মৃতজনে প্রাণ। যিনি গাইতে পারেন, তার তো কথাই নেই; যিনি বিভোর হয়ে গান শোনেন—তাঁর কাছেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে কাকে বলে অভিব্যক্তির বহুস্বর :
মুর্শিদ ধন হে, কেমনে চিনিব তোমারে।
দেখা দেও না কাছে নেও না আর কত থাকি দূরে ॥
…
তন্ত্রমন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই না
শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ি যত আরো দূরে সরে যাই
কোন সাগরে খেলতেছ লাই ভাবতেছি তাই অন্তরে ॥
সত্যের গত রূপ কত রঙ। অজস্র মিথ্যায় প্রতিদিন আক্রান্ত আমরা; সেই গহনে যাওয়ার পথ জানা নেই আমাদের। শাহ আবদুল করিমের মতো সৃষ্টিছাড়া বাউল সেই পথের সন্ধান জানেন; কিন্তু তিনিও ইশারার সন্ধাভাষায় কথা বলেন আপন মনে। চোখে যতটুকু তার সহজ সরল জীবন দেখতে পাই, চোখের আড়ালে রয়ে যায় পরাজীবনের ঢের বেশি পরিসর। টীকা-টিপ্পনী-ভাষা দিয়ে তার কি নাগাল পাওয়া যায়? মুর্শিদ কী, তা তো জানি; কিন্তু এই ‘মুর্শিদ’ অভিধার আড়ালে বাউল যে বহুস্বরিক সত্যের সঙ্গে একান্ত নিজস্ব দ্বিরালাপে মজে রয়েছেন, তার হদিশ কতখানি পাই? বাউলের আনন্দ-বেদনা যেমন বাস্তব, তেমনই চিহ্নায়িত। তাঁর গানে যখন উচ্চারিত হয় ‘আশা করি আলো ডুবে যাই অন্ধকারে’–তাকে আক্ষরিক অর্থে নিতে পারি না। আমরা তো জলের জলের উপরে ফাৎনাকে দেখি, কুচো-ঢেউয়ে তার সামান্য নাড়াচড়া দেখি–জলাশয়ের কোন গভীরে লুকিয়ে রয়েছে সুতোয়-গাঁথা মাছ। তা তো জানি না।
২
এ এক অন্য পৃথিবী, এ এক অন্য ভাষার কথকতা। হাজার বছর ধরে বাংলার লোকগান অবলীলায় ধারণ করেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক সহজিয়া-তান্ত্রিক-বৈষ্ণব সুফি ভাবনাকে। একই দেহে লীন হয়েছে নানা উৎসজাত অধ্যাত্ম-ভাবনা। খনি থেকে তোলা আকাটা হীরার মতো অপরিশীলিত বাচন সোঁদা মাটির বুকে নামিয়ে আনে বিপুল আকাশটাকে। তাই বাউল করিম বিভোর হয়ে তাঁর গানের ডালি সাজিয়েছেন। আপনমনে সুরে কথা বসিয়েছেন আর কথাকে করেছেন বিহ্বল ভাবের অনুগামী। তাই তার রচনায় পুনরাবৃত্তির অভাব। নেই। যেন প্রিয়পরমের ছবি হৃৎকমলে আঁকতে গিয়ে কিছুতেই সাধ মিটছে না তার। শব্দের সিঁড়ি দিয়ে চেতনার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে চাইছেন তিনি। এবং প্রতিপলে অনুপলে অনুভব করছেন, শব্দাতীতকে শব্দ দিয়ে বাঁধা যাচ্ছে না। কিন্তু ভাবুক বাউলের কাছে উপকরণ তো বড় নয়; অভ্যস্ত শব্দসজ্জাকে বারবার ব্যবহার করছেন এই বিশ্বাসে যে এর মধ্যে ‘আশিকের ধন পরশরতন’ এর সাক্ষাৎ মিলবে। সন্ত-কবিতার কিছু কিছু পরিচিত শব্দবন্ধ বাউল করিমের প্রগাঢ় অনুভবের দ্যুতিতে নতুন সুরে-তালে-লয়ে বেজে উঠেছে।
রচনাসমগ্রের পাঠকেরা নিশ্চয় লক্ষ করবেন এইসব। নানা উৎস থেকে উৎসারিত অজস্র নদী যেমন আপন বেগে পাগলপারা হয়ে স্বতন্ত্র উপস্থিতি ঘোষণা করে তবু সাগর-মোহনায় পৌঁছে অসামান্য ঐক্যবোধে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, শাহ আবদুল করিমের রচনাসম্ভারও তেমনি বহুমাত্রিক লোকায়ত চেতনার সংশ্লেষণে সমৃদ্ধ হয়েই অদ্বিতীয় অনুভবের আলো বিচ্ছুরণ করে। ‘নির্ধনের ধন রে বন্ধু আঁধারের আলোক’, ‘নাম সম্বলে ছাড়লাম তরী অকূল সাগরে’, ‘শতবর্ণের গাভী হলে একই বর্ণের দুগ্ধ মিলে’, ‘বন্ধু রে তিলেক মাত্র না দেখিলে কলিজায় আগুন জ্বলে’ এবং এরকম অজস্র পঙক্তি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে শাহ আবদুল করিম বাংলার আবহমান লোকায়ত পরম্পরার-ই সৃষ্টি। বিখ্যাত সেই গ্রিক দার্শনিকের মতো তিনিও মানুষ খুঁজে বেড়ান। এই খোঁজার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা যেমন আছে, তেমনি বন্ধন-ভীরু মুক্ত মানুষের। কথকতায় রয়েছে আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিরুদ্ধে উচ্চারিত। প্রতিস্পর্ধা। ধর্মীয় উন্মাদনা ও শাসকের নগ্ন পীড়নের বিরুদ্ধে তাইতো তিনি নিজের স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করেন। এইজন্যে কেবল বাউল করিমের জীবন ব্যাপ্ত সাধনার তাৎপর্য পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়।
‘তত্ত্বজ্ঞান জাগে যার মুছে যায় আঁধার’–-এই উচ্চারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে-বিশ্বাস, তা হলো, হিন্দু-মুসলমান-শাক্ত-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেই সমান। প্রেমের বাজারে। তাই তো তিনি সাকার-নিরাকার সম্পর্কিত বিবাদে বিশ্বাসী নন। তাঁর চির অন্বিষ্ট সেই সত্য–যা ‘মানুষের মাঝে মানুষের কাজে/মানুষের সাজে বিরাজ করে’ করিম ভাইয়ের সেসব উচ্চারণ ইতোমধ্যে প্রবাদে পরিণত হয়েছে, তাদের মধ্যে মানুষের তত্ত্ব-বিষয়ক বাণী সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘মানুষ হলে মানুষ মিলে, নইলে মানুষ মিলে না’–এই পঙক্তিতে রয়েছে উর্ধ্বায়িত চেতনার ইন্দ্রজাল। গভীরতম উপলব্ধির নির্যাস অনুরণিত হয়েছে সহজিয়া সুরের গ্রন্থনায়। এমন উচ্চারণ আরও রয়েছে তার :
মানুষ হয়ে তালাশ করলে মানুষ পায়
নইলে মানুষ মিলে না রে বিফলে জনম যায় ॥
…
যে মানুষ পরশরতন সেই মানুষ গোপনের গোপন
দেয় না ধরা থাকতে জীবন, পথে গেলে পথ ভোলায় ॥
যাঁরা লোক-সাহিত্যের গবেষক, তাঁদের দেখার ধরনের সঙ্গে বাউলতত্ত্বের গবেষকদের দেখার ধরন পুরোপুরি মিলবে না। তেমনি গীতরসপিপাসুজনদের শৈল্পিক চাহিদার সঙ্গেও অন্য জিজ্ঞাসুদের পার্থক্য থাকবেই। তবে এটা নিশ্চিত যে শাহ আবদুল করিমের রচনাসমগ্র প্রত্যেকের কাছেই অমূল্য সাংস্কৃতিক চিহ্নায়ক হিসেবে গণ্য হবে। কেননা আত্মবিস্মৃতির অন্ধকার প্রহরে ঐতিহ্যের বাতিঘরই আমাদের চূড়ান্ত আশ্রয়।
তপোধীর ভট্টাচার্য
.
সঙ্কলন ও গ্রন্থন প্রসঙ্গে
ভাটিবাংলার আপোসহীন এক বাউল সাধকের নাম শাহ আবদুল করিম (জন্ম ১৯১৬)। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, বাউলতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, আল্লা-নবি-ওলি-পির মুর্শিদ স্মরণে প্রচুর গান লেখার পাশাপাশি লিখেছেন শোষিত মানুষের দুঃখ দুর্দশার গান, শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পঙক্তিমালা। এজন্যে লোকগানের সমজদার সুধীর চক্রবর্তী তাঁকে ‘ভাটি অঞ্চলের গণগীতিকার’ আখ্যা দিয়েছেন; যতীন সরকার তাঁর গানকে বলেছেন ‘সর্বহারার দুঃখজয়ের মন্ত্র’ আর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাকে অভিহিত করেছেন ‘গণমানুষের বাউল’ বলে।
তাঁর প্রকাশিত বই ছয়টি–আফতাব সঙ্গীত (আনু. ১৯৪৮), গণসঙ্গীত (আনু. ১৯৫৭), কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮) ও কালনীর কূলে (২০০১)। সম্প্রতি কালনীর ঢেউ গ্রন্থটির চতুর্থ সংস্করণ বেরোলেও তার অন্য বইগুলো প্রথম সংস্করণের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। এ কারণে তার সৃষ্টিকর্মের একটি বড় অংশ লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে। প্রথম বই আফতাব সঙ্গীত তো এখন এক কিংবদন্তি; কারো কাছে পাওয়া যায় না–স্বয়ং রচয়িতার সংগ্রহেও নেই।
২
শাহ আবদুল করিমের নবতিতম জন্মদিনকে সামনে রেখে তার সমস্ত গান ও অন্যান্য লেখা এক মলাটভুক্ত করার চিন্তা থেকে এবং তাঁর গানের মূল্যায়নধর্মী একটি প্রবন্ধসংগ্রহ বের করার অভিপ্রায়ে আমরা কতিপয় করিম-অনুরাগী ২০০৩ সালের ২৮ জুন আমার বাসায় সমবেত হয়েছিলাম। এক পর্যায়ে শাহ আবদুল করিম স্বয়ং উপস্থিত হন এবং সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এই আড্ডায় অন্যান্যের মধ্যে অংশ নিয়েছিলেন তপোধীর ভট্টাচার্য, স্বপ্ন ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ সাদিক, জেসমিন আরা বেগম, সেলিমা সুলতানা, প্রয়াত রুহি ঠাকুর, আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, জামালউদ্দিন। হাসান বান্না, শাহ নূরজালাল, আবদুর রহমান, মোস্তাক আহমাদ দীন, সুমনকুমার দাশ প্রমুখ। তপোধীর ভট্টাচার্য একটি কাগজে ২০০৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহ আবদুল করিমের নবতিতম জন্মদিন উদ্যাপনের প্রাক্কালে আমাদের কী করণীয় তা লিপিবদ্ধ করেন। শাহ আবদুল করিমের আগ্রহে আমাকে দেওয়া হয় রচনাসমগ্রের সঙ্কলনের দায়িত্ব। স্থির হয় তপোধীর ভট্টাচার্য এর ভূমিকা লিখবেন। এরপর চলে সংগ্রহ ও সঙ্কলনের কাজ।
রচনাসমগ্র সঙ্কলনের শুরুতে হোঁচট খেতে হলো; অনেক খোঁজাখুজির পরও আফতাব সঙ্গীত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রচয়িতা ব্যতীত কারো স্মৃতিতেও এই বইয়ের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। শাহ আবদুল করিম তার ‘আত্মস্মৃতি’-তে আফতাব সঙ্গীত প্রসঙ্গে লিখেছেন, “ছোটো একটি বই ছাপার উদ্যোগ নিলাম। /সুনামগঞ্জের রায় প্রেসে বই ছাপায় দিলাম ॥ /আফতাব সঙ্গীত ছিল বইখানার নাম।/ আবদুল করিমের গান বার আনা দাম ॥’ তিনি এক সাক্ষাৎকারে আরো বলেছিলেন ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে এই বই বেরোয় এবং তাতে গানের সংখ্যা ৪০।
রচনাসমগ্র প্রকাশের জন্য অনেকেই আগ্রহ দেখান। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে যথাসময়ে বইটি প্রকাশিত হয়নি। সম্প্রতি সিলেটের বিভাগীয়। কমিশনার ও খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেট-এর মোতাওয়াল্লি ড, জাফর আহমদ খান বিষয়টি জানার পর খুব সহৃদয়তা ও দ্রুততার সাথে বইটি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এজন্য তাকে করিম-অনুরাগীদের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। এছাড়া প্রকাশনা পর্ষদের আহ্বায়ক মো. ফজলুর রহমান ও সদস্য সচিব মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরীর পরিশ্রম ও আগ্রহ বইটির প্রকাশনাকে ত্বরান্বিত করেছে। তাদের প্রতিও রইল কৃতজ্ঞতা।
৩
বাউল করিম রচয়িতা হিসেবে খুবই খুঁতখুঁতে স্বভাবের। বানানের ভুল সংশোধন ব্যতীত তিনি তাঁর লেখার সামান্য পরিবর্তনও সহ্য করতে পারেন না। তবে নিজের লেখা নিজে বারবার পরিবর্তন করেছেন, কখনোবা গানগুলো নতুনভাবে বিন্যস্ত করেছেন। এই স্বভাবটা তার স্মৃতি-দৌর্বল্যের পূর্ব পর্যন্ত বজায় ছিল। আশির দশকের প্রথমদিকে তার সাথে পরিচয়। ততদিনে তার ‘কালনীর ঢেউ’-এর প্রথম সংস্করণ বেরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় সংস্করণ বের করার পর তিনি বারবার আফসোস করে বলেছেন, ‘আপনাকে কেন বইটা দেখালাম না?’ এরপর ‘ধলমেলা’ থেকে তার একান্ত আগ্রহে পরবর্তী বইগুলো আমার তদারকিতে বেরিয়েছে। আফতাব সঙ্গীত ব্যতীত তাঁর যাবতীয় বই তিনি আমাকে প্রদান করেন। প্রদত্ত বইগুলোতে কিছু কিছু গান তার নিজের হাতে সংশোধন ও পুনর্বিন্যাস করা। রচনাসমগ্র সঙ্কলন ও গ্রন্থনের সময় তাঁর সংশোধনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
৪
তিনি তাঁর গানে লিখেছেন যে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা বিপক্ষে থাকায় লেখাপড়া করতে পারেননি। দারিদ্র্যের কারণে বাল্যকালেই লেখাপড়ার পরিবর্তে রাখালের চাকরিতে ঢুকতে হয় তাকে। এ এমন এক চাকরি যাতে ‘ঈদের দিনেও ছুটি নাই’। ‘ধলবাজার’ প্রতিষ্ঠার পর বর্ষার সময় যখন বেকার ছিলেন তখন বাজারের এক ‘ভুশিমালের দোকান’-এ বালক করিম চাকরি নেন। সে সময় নৈশবিদ্যালয়ে কয়েকদিন শিক্ষাগ্রহণ করেন। সে বিদ্যালয়ে তিনি বিনামূল্যে পান একটি ‘বড়দের বই’। কিন্তু এ স্কুল নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় দ্রুত। ‘আত্মস্মৃতি’-তে তিনি এ প্রসঙ্গে লেখেন : ‘বড়দের বই আমার হয়ে গেল সাথি।/প্রয়োজন আছে তাই পড়ি দিবারাতি ॥/অক্ষরজ্ঞান হলো আমার তাড়াতাড়ি।/পুঁথিপুস্তক তখন পড়তে আমি পারি ॥/জানার জন্য বিভিন্ন বই পুস্তক পড়ি।/গান গাই উপস্থিত রচনা করি ॥’ তার যে শুধু বাংলা অক্ষরজ্ঞান ছিল তা নয়—’সিলেটি নাগরি’ হরফে লেখা নানা সাধকের তত্ত্বগ্রন্থ তিনি পড়তেন। সৈয়দ শাহনুরের ‘নুরনসিহত’ পাণ্ডুলিপিটি তাঁর সংগ্রহে আছে এখনও।
তিনি কোনও কোনও সময় খাতায়, কখনোবা বিচ্ছিন্ন কাগজে তাঁর গান টুকে রাখতেন। পরে আলাদা খাতায় প্রথমদিকে তাঁর ঘনিষ্ঠজন দেবেন্দ্রকুমার চৌধুরী এবং পরবর্তীতে শিষ্য আবদুর রহমান ও ভাগনে আবদুল তোয়াহেদকে দিয়ে লিপিবদ্ধ করিয়ে নিতেন।
এই সমগ্রে তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গানের বই আমরা প্রথমে রেখেছি। তারপর পর্যায়ক্রমে পেছন-ফেরা। সবশেষে সংযোজিত হলো তার অগ্রন্থিত ১৫টি গান এবং পয়ারে লেখা ‘আত্মস্মৃতি’। অগ্রন্থিত গানগুলি বিভিন্ন সময়ে রচিত। নানা আসরে গানগুলো গীত হলেও কোনো বইয়ে স্থান পায়নি। বাউলপুত্র শাহ নুরজালাল এগুলো কপি করিয়ে দিয়েছেন। এই প্রথম এ ১৫টি গান গ্রন্থবদ্ধ হলো। ‘আত্মস্মৃতি’-তে পাঠকেরা তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গী হবেন। পরিশিষ্ট অংশে শাহ আবদুল করিমের গ্রন্থপরিচিতি দেওয়া হলো। সমগ্রের বাইরে বিভিন্ন শিল্পীর খাতায়, বাংলাদেশ বেতারে ধারণকৃত বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানসহ অন্যত্র আরও কিছু গান বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারে। এগুলো সংগ্রহ ও সঙ্কলনভুক্ত করা সময়সাপেক্ষ কাজ। ভবিষ্যতে তাঁর রচনাসমগ্র পূর্ণতা পাবে–এই আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।
রচনাসমগ্র সঙ্কলন ও গ্রন্থনায় স্বয়ং শাহ আবদুল করিমের নির্দেশনা ও অকুণ্ঠ সহায়তা পেয়েছি। এছাড়া বিভিন্নভাবে তপোধীর ভট্টাচার্য, আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, মোস্তাক আহমাদ দীন, শাহ নূরজালাল, আবদুর রহমান, আবদুল তোয়াহেদ, নাজমুল হক নাজু ও সুমনকুমার দাশ সহযোগিতা করেছেন। সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
শুভেন্দু ইমাম
Leave a Reply