শাহজাদা দারাশুকো – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
শাহজাদা দারাশুকো – অখন্ড সংস্করণ / শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
[লেখক পরিচিতি : জন্ম ১৯৩৩-এর ২ মার্চ, খুলনায়। শৈশবের স্মৃতি বলতে এখনকার বাংলাদেশের খুলনা, বরিশাল। গলানো ইস্পাতের বেলচা হাতে দাঁড়িয়ে ফার্নেসের আগুনে জীবনকে যেমন চিনেছেন, তেমনই তার নানান পাতা পড়েছেন দক্ষিণবঙ্গের প্রায় বসতিহীন অঞ্চলে বাড়ি, জমি, ফসল, গোরু, আয়ু, লোভ, আকাঙ্ক্ষা, দখলের খেলায় মেতে।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার ভূগোল কখনও একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে থমকে থাকে নি। আকাশ চাটা বাড়ির হাই এগজিকিউটিভ থেকে শুরু করে ইঁদুরের গর্তের জমানো ধান চুরি করা মানুষ তাঁর বিষয় হয়েছে। প্রেমে অথবা প্রেমহীনতায়, বিষাদে এবং আনন্দে তিনি সব্যসাচী। জীবনের নানান বাঁকে লুকিয়ে থাকা মজা, বিপন্নতা আলো-অন্ধকারে তিনি সমান সাহসী, একই রকম বেপরোয়া-এসবই তাঁর লেখায় এসেছে।]
.
[হিন্দুস্থানের বাদশা শাহজাহান তার বড়ছেলে শাহজাদা দারাশুকোকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। কয়েকবার তিনি বলেছেন, আল্লাতালার অসীম করুণা–তাই এমন ছেলে আমি পেয়েছি। সেই ছেলে দারাশুকো সব ধর্মের ভেতর দিয়ে মানুষের ধর্ম খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
বাদশার সেজো ছেলে শাহজাদা আওরঙ্গজেব তার আব্বা হুজুরের স্নেহ ভালবাসা তো তেমন পানই নি বরং প্রাণপণ লড়াই করেও বাদশার কাছ থেকে পেলেন কঠিন বাক্যবাণ, বদলির হুকুম, অপমান। আর লড়াই না করেও দারা পেলেন বিজয়ীর সংবর্ধনা।
কট্টর মোল্লারা হিন্দুস্থানের পহেলা শাহজাদা দারাশুকোর মতিগতি বুঝত না পেরে আঁতকে উঠলেন ভাবলেন, দারার হাতে ইসলাম বিপন্ন। এমন শাহজাদা যদি হিন্দুস্থানের বাদশা হন তো ঘোর বিপদ। মুঘল শাহী তো যাবেই–ইসলামও হিন্দুস্থানে তলিয়ে যাবে।
তাই মোল্লারা এসে দাঁড়ালেন আওরঙ্গজেবের পাশে। হিন্দুস্থানের মসনদকে ঘিরে ক্ষমতা, ধর্ম, ভালবাস, ঈর্ষার এক গোল্লাছুট খেলা শুরু হয়ে গেল। খেলা ভাঙলে দেখা গেল মানুষে ধর্ম খুঁজতে গিয়ে শাহজাদা দারা তার মাথাটি হারিয়েছেন। হিন্দুস্থানে মুক্তদৃষ্টি, মুক্তবোধির স্বচ্ছন্দ চলাচল বন্ধ হয়ে গেল।
বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়ার জন্যে এ লেখাটি কত জরুরী ছিল।]
.
হে মহান দিশারী
এমন উপন্যাস আগে কখনো লিখিনি। ভেবেছি। সাহসে কুলোয়নি। তীরে দাঁড়িয়ে ভয় পেয়েছি। এত বিরাট। এত জটিল। মানুষের মন। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। দেশের ধর্ম। দেশের মানুষ।
একদম অথৈ সাগর।
সাপ্তাহিক ‘বর্তমান’-এর শ্রীমান অশোক বসু বলতে গেলে আমায় ধাক্কা মেরে এই জলে ফেলে দেন। তার সঙ্গে উসকানি ছিল শ্রীমতী অনুভা করের।
ডুবে মরে যাওয়ার ভয়ে সাঁতার কেটেছি। ভেসে থাকার জন্যে। তীরে পৌঁছতে পেরেছি কিনা পাঠক বলবেন। আমায় অথৈ জলে ফেলে দেওয়ার জন্যে আমি অশোকের কাছে আজ ঋণী। ঋণী অনুভার কাছে।
সময়ে সময়ে তথ্য যুগিয়ে ভরসা দিয়ে সাহায্য করেছেন শ্রীমতী সাহানা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমতী ছন্দবাণী মুখোপাধ্যায়।
মাঝেমধ্যে শ্রীমতী নন্দিনী গঙ্গোপাধ্যায় ইতিহাসের তথ্যের রাস্তা আমায় দেখিয়ে দিয়েছেন। দিয়েছেন শ্রীমতী হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায়ও। বিশেষ করে লোর-চন্দ্রাণীর কথা।
কালিকারঞ্জন কানুনগো, অমিয়কুমার মজুমদার, ক্ষিতিমোহন সেন, রাজ্যেশ্বর মিত্র, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, গৌতম ভদ্র, শেখর চট্টোপাধ্যায় এবং যদুনাথ সরকার পড়তে পড়তে পথ খুঁজেছি। আবুল ফজলও আমার দিশারী। দিশারী ট্যাভারনিয়ার এবং বার্নিয়ের।
গোড়ার দিকে আওরঙ্গজেবকে বুঝতে শ্রীমতী শান্তা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক পড়ে তবে আমার চোখের সামনে নির্যাসটুকু তুলে ধরেছেন।
গল্পকার, ঔপন্যাসিক, পরোপকারী কিন্নর রায় আগাগোড়া পড়ে ছাপতে দিয়েছেন। বানান, বাড়তি কথা–সবদিকেই তার নজর। কি বলে তার ঋণের কথা স্মরণ করি!
শাহজাদা দারাশুকো হিন্দুস্থানে হিন্দু-মুসলমানের ধর্মচিন্তায় মিলনবিন্দুটি খুঁজতে গিয়ে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে যান। তাই তিনি হিন্দুস্থানের ইতিহাসে একটি কালো গোলাপ। ব্যথা, সৌন্দর্য, কালের ইতিহাসের সঙ্গে এই গোলাপ জড়িয়ে গেছে। হিন্দুস্থান যুগে যুগে তাকে বার বার আবিষ্কার করবে। আমি এই ইতিহাস-পুরুষে যাবার রাস্তায় একজন ভবঘুরে মুসাফির মাত্র। আমি তার সালিক। আধুনিক হিন্দুস্থানে তিনি রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুরও দিশারী।
হিন্দুস্থানের ভাবী বাদশা শাহজাদা মহম্মদ দারাশুকো খাঁটি মুসলমান হিসেবে ইসলামে বিশ্বাসী হয়েও বারবার বলেছেন, সত্য কোন ধর্মের একচেটিয়া নয়। ঈশ্বরে যাওয়ার রাস্তাও অনেক। মানবধর্মী দারাশুকোই প্রথম নানান ধর্মের তুল্যমূল্য বিচারে নেমে মানুষের ধমটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বমনীষার সামনে এসেছে উপনিষদ তারই চেষ্টায়।
প্রেমিক দারা ধার্মিক দারা হাত ধরাধরি করে চলেছেন। মানবীপ্রেমে তার ঈশানুভূতি একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু চতুর জগতে কুটকৌশলের অভাবে যোদ্ধা দারা সুবিধা করে উঠতে পারেন নি। তিনি অলৌকিকে ঘোর বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধতা ছিল না বলে ওমরাহদের প্রায় সবাইকে চটিয়ে বসেছিলেন। যে রাজপুতদের তিনি একসময় বাঁচিয়েছেন–তারাই তাঁকে প্রবল উৎসাহে তাড়া করে আওরঙ্গজেবের হাতে তুলে দিয়েছেন। ধর্মান্ধ ক্ষমতালোভীর ধর্মদ্রোহের মিথ্যা বদনাম দিয়ে তাকে ঘাতকের কাছে ঠেলে দিয়েছেন।
হিন্দুস্থানের ইতিহাসে বিষাদ মাখানো এমন কালো গোলাপ আর নেই। ব্ল্যাক প্রিন্স মানুষের ভাল চেয়েছিলেন। মানুষের ধর্ম খুঁজে বেড়িয়েছিলেন। তাঁর মত ইতিহাসে উপেক্ষিত আর কে আছেন?
ইতিহাসের সন তারিখ, যুদ্ধ, অভিষেকের ফাঁকে ফাঁকে যেসব জায়গায় মহাকালের না বলা অন্ধকার পড়ে আছে–সেখানে মাথা খুঁড়লেও আজ আর জানার উপায় নেই শাহজাদী, উজিরে আজম থেকে শুরু করে সামান্য গানেওয়ালী, ভিখারি, কয়েদী, কবি কীভাবে ভাবতেন, নিয়তিকে নসিব বলে মেনে নিতেন। আমি সেইসব ভাবনা, সম্পর্ককে ফের জাগিয়ে তুলেছি মাত্র। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৩০ জানুয়ারি ১৯৯১
ব্রহ্মপুর, বটতলা
গড়িয়া, কলকাতা-৮৪
Leave a Reply