শার্লক হোমস সমগ্র ২ : দ্বিতীয় খণ্ড – স্যার আর্থার কোনান ডয়েল
অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন
প্রথম প্রকাশ – ১ বৈশাখ ১৪১৯ / এপ্রিল ২০১২
.
ভূমিকা
অদ্রীশ বর্ধনের বিখ্যাত শার্লক হোমস অনুবাদের সটীক সংস্করণের দ্বিতীয় পর্যায়টি হাতে এসে গেল এবার। এই বই ডাউন মেমোরি লেনের মতো ঝটিতি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ছুটির দুপুরের টানটান রোমাঞ্চের অতীত দিনগুলিতে। আর সেটি যদি সটীক হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। আসলে গোয়েন্দার চোখ-কান খোলা থাকে শিকারি কুকুরের মতো। যদি সেই গোয়েন্দা আবার শার্লক হোমস হন তাহলে আমাদের রোমাঞ্চের কোনো ঊর্ধ্বসীমা থাকে না। দ্বিতীয় পর্বের এই ভূমিকার পাতায় আমি অকপটে স্বীকার করছি যে প্রথম খণ্ডটিই হোমস-মার্কা নেশা ধরাবার জন্য যথেষ্ট। স্যার আর্থার কন্যান ডয়াল স্কটিশ লেখক এবং চিকিৎসক। খেয়ালে খুশিতে নয় অনেক ভেবেচিন্তে তৈরি করেছিলেন হোমস-এর চরিত্র। লন্ডনের এই গোয়েন্দা কনসালটিং ডিটেকটিভ হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাঠক মানে লন্ডনের জনগণ তার সম্পর্কে জানতে পারেন ১৮৮৭ সাল থেকে। চারটি উপন্যাস এবং ছাপ্পান্নটি ছোটো গল্পের আড়ালে সেদিনের লন্ডনবাসী জেনেছিলেন যে কী অসম্ভব যুক্তির মারপ্যাঁচে একের পর এক রহস্যের কিনারা করেছিলেন হোমস।,হোমসের সমস্ত গল্পই আমরা পেয়ে যাই ডাক্তার ওয়াটসনের বয়ানে, শুধুমাত্র দুটি ঘটনার কথা হোমস নিজের বয়ানে ব্যাখ্যা করেছিলেন। আবার এমনও দেখা গিয়েছে যে, দুটি গল্প হোমস নিজের স্মৃতিকথা থেকে পড়ে শোনাচ্ছেন। পাঠক পড়তে পড়তেই বুঝতে পারবেন এই গল্পগুলির চলন। যে চলনগুলো একজন লেখকের ভাবনাচিন্তা বা পরীক্ষানিরীক্ষাকেও প্রতিফলিত করে। পাশাপাশি একজন মানুষকে বর্ণময় করে তুলতেও জুড়ি নেই লেখকের। যেমন লেখাগুলো খুঁটিয়ে পড়লে হয়তো আমরা ধারণা করতে পারব যখন শার্লক হোমসের মাথা কাজ করত না তখন তিনি কোকেন নিতেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন কোকেন তার মস্তিষ্কের জট পাকানো অবস্থাকে তরল করে ও তাকে চাঙ্গা করে। আবার কোকেনের সলিউশন (যা থাকত সাত শতাংশ) গ্রহণ করবার জন্য তিনি বিশেষ প্রকৃতির সিরিঞ্জ ব্যবহার করতেন। এই সিরিঞ্জটি তিনি আবার রেখে দিতেন একটি চামড়ার বাক্সে। গল্পগুলি পড়তে পড়তে এইসব ছোটো ছোটো খুঁটিনাটিকে যদি মস্তিষ্কে খেলা করার সুযোগ দেওয়া যায় তবে চরিত্রগুলি নিশ্চিতভাবে জীবনের স্পর্শ পেয়ে যায়। আর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে সেই ঘটনাগুলির আবহকে আমাদের আরও কাছের করে তোলার জন্যই টীকাকরণের কাজে হাত দিয়েছেন প্রসেনজিৎ আর সৌম্যেন। পাশাপাশি আমরা হাতে পেয়ে যাই আরও হরেক প্রকার তথ্য। গবেষণার যে চলন থাকে তাতে এই জাতীয় তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষায় সাহিত্যের এক পর্বে যদি গোয়েন্দা চর্চার ইতিহাস লেখা যায় তাহলেও এই জাতীয় তথ্য বিন্যাসের গুরুত্ব থাকবে। যেমন দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দি ইঞ্জিনিয়ার্স থাম্ব। এটি পড়তে শুরু করার আগে যদি জানা যায় যে এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯২-এর মার্চের স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে তখন লেখাটির সময়কাল ও সেই সময়ের চেহারার ধারণা যে আমরা গল্পে পাচ্ছি তা আমরা বুঝতে পারি।
এসবের সাথে সাথে নানা ধরনের কু নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন এই দুই টীকাকার। সেগুলিও চোখে পড়ার মতো। পাঠকদের জন্য বাকিটা রেখে দিয়ে একটির প্রসঙ্গ আলোচনা করি। এই যে ইঞ্জিনিয়ারের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নেই গল্পটি, এটির কোথাও কন্যান ডয়াল লেখেননি লোকটির কোন হাতের বুড়ো আঙুল নিয়ে ঘটনাটি এগোচ্ছে, সেটি ডান হাত না বাম হাত। উত্তরটি লেখক দেননি। উত্তরটি তৈরি করেছিলেন শিল্পী। স্ট্র্যান্ডে প্রকাশিত সিডনি প্যাগেটের আঁকা ছবিতে দেখা যায় শিল্পী দেখিয়েছেন বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলটি কাটা পড়েছিল। অথবা ওঁদের টীকাকরণ থেকেই আমরা জানতে পারি যোসেফ লিস্টার নামের এক ব্যক্তি ব্যান্ডেজে অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহারের প্রচলন করেন। আবার ডয়াল
একটি জায়গার নাম লিখছেন আইফোর্ড। কিন্তু টীকাকারের গবেষণায় আমরা জানতে পারছি ইংল্যান্ডে এই নামের কোনো জায়গা নেই। এই তথ্যটি আমাদের সেই সূত্র দেয় যে, লেখক নিজের প্রয়োজনে জায়গার নামও তৈরি করেছেন তার কল্পনা দিয়ে। টীকাকরণের কলাকৌশল আমাদের এভাবেই নানা অজানা দিকের প্রতি দিকনির্দেশ করে।
এইসঙ্গে আরও বলতে হয় যে এই টীকাকরণের আড়ালে রয়েছে সমাজচর্চারও নানা দিক। যেমন শার্লক হোমস-এর গল্প পড়তে পড়তেই আমরা জেনে নিতে পারি ভিক্টোরীয় যুগে ইংল্যান্ডে নকল মুদ্রা ছেয়ে গিয়েছিল ও ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে এ-রকম একটা আশঙ্কায় ১৭৯১ সালে ইংল্যান্ডের বোর্ড অব অর্ডিন্যান্স দক্ষিণ ব্রিটেনে জরিপ শুরু করে সামরিক ম্যাপ বানানোর জন্য। প্রথম ম্যাপটি ছিল কেন্ট কাউন্টির। এইভাবে সটীক সংস্করণ শুধুমাত্র নিছক টীকাকরণে আটকে থাকে না। এরই পাশে পাশে হয়ে ওঠে গবেষণার আকর গ্রন্থ।
আমাদের দেশের ব্যোমকেশ কিম্বা ফেলুদাকে নিয়েও এ ধরনের দূরন্ত গবেষণার সুযোগ আছে। হোমস নিয়ে এই চমৎকার গবেষণা আমাদের সেই দিকটির কথাও মনে করায়। টীকাকরণ মানে যে পরিশ্রম আর গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গির যোগফল তা প্রমাণ করলেন এই দুই টীকাকার। আর সেইসঙ্গে বলতেই হবে লালমাটির প্রকাশক নিমাই গরাইয়ের কথা। যিনি নিরলসভাবে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন যেকোনো ধরনের দূরন্ত গবেষণামূলক ভাবনাকে। যার ফলে তার প্রকাশনা বাজারি তকমার আওতায় পড়ে না। এই ধরনের প্রকাশ ভাবনা বাংলা প্রকাশনাকে নিঃসন্দেহে অন্য পর্যায়ে পৌঁছে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। আসলে মাটি দিয়ে গড়তে হয়। গড়বার জন্য ভাবতে হয়। যে গড়নের অন্তরে থাকবে জীবন স্পন্দনের রক্তজাত প্রাণ।
দেবদত্ত গুপ্ত
১৪ এপ্রিল ২০১২ কলকাতা
Leave a Reply