শার্লক হোমস সমগ্র ১ : প্রথম খণ্ড – স্যার আর্থার কোনান ডয়েল
শার্লক হোমস সমগ্র ১ : প্রথম খণ্ড – স্যার আর্থার কোনান ডয়েল
অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন
প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৪১৭ / মার্চ ২০১১
.
ভূমিকা
শার্লক হোমস চর্চায় প্রদীপের আলো পড়ল। চেনা মুখের অচেনা দিক, শোনা রাস্তার নামের ঠিকুজি কুষ্ঠি, চেনা স্থান নামের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় আবার নূতন করে জানবার সুযোগ হল এখানে। হোমস রচয়িতা ডয়াল শার্লককে জীবন্ত করে তুলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই টীকাকারেরা হোমসকে বাস্তবের একজন করে তুলেছেন। এই বাস্তবতা হোমস কাহিনি পড়বার সময় আমাদের খেয়াল থাকবার বিষয় নয়, আবার এইসব খবর ও তথ্য অনেক সময় আমাদের অবগতও থাকবার কথা নয়। স্বাভাবিকভাবেই এই টীকাকরণ বাঙালির হোমস চর্চায় প্রদীপের আলো ফেলল। এই দুই প্রদীপবাহক তদন্তকারী হলেন প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত ও সৌম্যেন পাল। হোমসের তদন্তের উপর তদন্ত করে তার আপাদমস্তক, চলাফেরার মানচিত্র ও ঘরবাড়ির ইতিহাস হাজির করে দিয়েছেন সাবলীলভাবে। তা না-হলে ডাক্তার ওয়াটসন যখন বলছেন আনন্দের চোটে তক্ষুনি একটা ছ্যাকড়াগাড়ি নিয়ে রওনা হলাম হলবর্ন অভিমুখে লাঞ্চ খাওয়ার জন্যে এই প্রসঙ্গের অভ্যন্তরে যে-ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা কী আমরা জানতে পারি? টীকাকারেরা জানাচ্ছেন লন্ডন শহরের সেকালের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ হলবর্ন। যা ছিল প্রিন্স অব ওয়েলস-এর পছন্দের জায়গাগুলির একটি। অথবা সেযুগের লন্ডনে ছ্যাকড়াগাড়িকে হ্যানসম বলা হত। কারণ ইয়র্ক নিবাসী স্থপতি যোশেফ হ্যানসম (১৮০৩-১৮৮২) এই গাড়ির নকশা করেন এবং ১৮৩৪ সালে লিস্টার্সশায়ারে এই গাড়ি প্রথম চালানো হয়। আর পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যে প্রতি ছত্রে, প্রতি পদক্ষেপে এভাবেও ইতিহাস ও বাস্তব লুকিয়ে থাকতে পারে? তাই এই সংস্করণ হোমস কাহিনির এক নূতন সম্প্রসারণ, যা বাংলা ভাষায় গোয়েন্দা সাহিত্যের ইতিহাসকেও সমৃদ্ধ করল।
বাংলা ১৩৮৪ সন, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড-এর মাধ্যমে পাঁচ খণ্ডে এই বাংলায় প্রকৃত অর্থে শার্লক হোমস পাকাঁপাকিভাবে বসতি স্থাপন করেন। এই আয়োজনের অনুবাদক স্থপতি অদ্রীশ বর্ধন। লেখনীর ধারাগতি দেখে মনে হয় যে পেঙ্গুইন প্রকাশনার ইংরেজি সংস্করণ অদ্রীশ বর্ধনের মূল কাঠামো হিসেবে কাজ করেছে। বাকাউল্লা, জয়ন্ত, ব্যোমকেশ, ফেলু মিত্তিরের বাংলায় হোমসও প্রকৃত একজন ভালোবাসার গোয়েন্দা হয়ে উঠলেন। তখন আমরা বুঝলাম ব্যোমকেশ, ফেলু মিত্তিররাও যে হোমসের রাস্তা তদন্তে অনুসরণ করেননি এমন নয়। আনুমানিক ১৯৩২-৩৩ সালে বাস্কারভিলের কুকুর ও শার্লক হোমসের বিচিত্র কীর্তি গল্প দুটির অনুবাদ করেছিলেন কুলদারঞ্জন রায়। এবং তার পর প্রেমাঙ্কুর আতর্থী হাউন্ড অব বাস্কারভিল গল্পের অনুবাদ করতে গিয়ে সে-গল্পের নাম দিয়েছিলেন জলার পেতনি। এসব প্রচেষ্টার পরে বাংলা ভাষায় হোমস চর্চার মাইল ফলক স্থাপন করেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন। ততদিনে বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশানের গল্পকে জনপ্রিয় করেছেন। সাহিত্যের আসরে ব্রাত্যকে উপেক্ষার থেকে মুক্তি দিয়েছেন, ফ্যানটাস্টিক ও আশ্চর্য নামক দুটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করে প্রমাণ করেছেন এ-জাতীয় গল্প সাহিত্যকে পিছনে টানে না, নূতন মাত্রা দেয় ও সাহিত্যের অগ্রগতি ঘটায়। সেই বর্ধন মশাই হাত দিয়েছিলেন শার্লক হোমসের অনুবাদে। যে-অনুবাদ অনুসরণ নয়। এ হল ট্রান্সক্রিয়েশান। সেই অনবদ্য সাহিত্যকর্মটিকে এই টীকাকরণ নূতন মাত্রা দিয়ে দিল। সঙ্গে তারা ফিরিয়ে আনলেন অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদ কর্মটিকে। টীকাকারেরা ভারি যত্ন নিয়ে স্ট্যান্ড ম্যাগাজিন এবং লিপিনকট ম্যাগাজিন ঘেঁটে প্রথম যুগে শার্লক হোমসের গল্পের যে সকল ইলাস্ট্রেশন বেরিয়েছিল সেগুলিকে জুড়ে দিলেন অদ্রীশবাবুর রচনার ফাঁকে ফাঁকে। ফলে একটা বিলিতি গন্ধ পাওয়া গেল বাঙালি আমেজে। সেইসঙ্গে কন্যান ডয়ালের যুগের রিচার্ড গুডস্মিড, হাচিসন, জ্যাক উইলস প্রমুখদের অনবদ্য স্কেচগুলিকে পর্যন্ত ফিরিয়ে আনলেন এঁরা। ১৯ শতকের শেষ ও ২০ শতকের গোড়ায় হোমস কাহিনির সঙ্গে কী ধরনের স্কেচ প্রকাশিত হত এই গ্রন্থে তার একটি পরিচয় পেয়ে যাবেন পাঠকরা।
এখানে পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ করা হয়েছে প্রথম দুটি খণ্ডের। বাকিগুলির তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান ও প্রকাশিতব্য। এ ধরনের একটি প্রকাশনা বাংলা ভাষায় প্রথম এ-কথা অকপটেই বলা যায়। আসলে এই দৃষ্টান্ত দেখতে দেখেতে আরও কিছু কথা মনে আসতে চাইছে। আধুনিক ক্রাইম কাহিনির যে প্রকৃত খসড়া তা তৈরি করেছিলেন ভলটেয়ার। সেই খসড়াকে সামনে রেখে কবি এডগার অ্যালেন পো (১৮০৯-৪৯) একটি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেন। এঁর নাম আঁসিয়ে দুপা। যিনি একটি হারানো চিঠি খুঁজে বার করেন বৈঠকখানা ঘরে লুকিয়ে রাখা দেওয়ালে টাঙানো একটি ছবির পিছন থেকে। কন্যান ডয়াল নিজে বলছেন এডগার অ্যালেন পো… তিনি ডিটেকটিভ গল্পেরও জনক। এ স্টাডি ইন স্কারলেট, দি সাইন অফ ফোর, অ্যাডভেঞ্চারস অফ শার্লক হোমস, মোেয়ারস অফ শার্লক হোমস, দি হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস এই
পাঁচখানি বই নিয়ে ডায়ালের প্রথম ডিটেকটিভ গ্রন্থাবলি প্রকাশিত হয় ১৯০৩-এ। এই বইয়ের জন্য ডয়াল নিজে একটি ভূমিকা লিখেছিলেন। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়বার সময় তার অধ্যাপক ড. যোশেফ বেলকে তিনি পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছেন যে, রোগীদের ব্যাপারে ডাক্তার বেলের অনুধাবন ক্ষমতা অসামান্য। এই যোশেফ বেলের আধারেই হোমসের নির্মাণ। একটি রোগীর পাতলুনের হাঁটুর কাছে ভিতরের অংশের ছেড়া জায়গা দেখিয়ে ডাক্তার বেল বলতে পারতেন মুচিদের এইটা বৈশিষ্ট্য। ওরা ওই জায়গাতেই ল্যাপস্টোন রাখে। কন্যান ডয়াল লিখছেন তিনি যেন সর্বদাই আমার চোখের সামনে থাকতেন। তার চোখ তীক্ষ্ণ, নাক খাড়া। তিনি চেয়ারে বসে দু-হাতের আঙুল জড়ো করেন। হাতের কাজে তিনি খুব চটপটে ছিলেন। সামনের দিকে কেউ থাকলে সেদিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত সহৃদয় এবং ধৈর্যশীল। আমি যখন ডিগ্রি নিয়ে আফ্রিকা চলে যাই তখন আমার এই পুরানো অধ্যাপকের স্মৃতি জাগরূক ছিল। যদিও তখনও আমি জানতুম না যে এই স্মৃতিই একদিন আমাকে ডাক্তারি ব্যবসা ছাড়িয়ে দিয়ে গল্প লিখতে বাধ্য করবে। (ক্রাইম কাহিনির কালক্রান্তি, সুকুমার সেন)। এরপর ১৯০৩ কন্যান ডয়্যালের প্রথম ডিটেকটিভ গ্রন্থাবলি। ভূমিকা লেখক হিসেবে এবার তুলে দিলাম সেই গ্রন্থাবলির ভূমিকাটিকে, রচয়িতা স্বয়ং স্যার আর্থার কন্যান ডয়াল।
এডগার অ্যালেন পো তাঁর নিজস্ব বেহিসাবি ভঙ্গিতে যেসব বীজ ছড়িয়েছিলেন তার থেকে এই গ্রন্থে সংকলিত রচনাগুলি শস্যরূপে উৎপন্ন হয়েছে। তিনি ডিটেকটিভ গল্পেরও জনক। ডিটেকটিভ সাহিত্যের সমস্ত পরিমণ্ডলটিকে তিনি এমন বেড়া দিয়ে ঘিরে গেছেন যে পরবর্তীকালের কোনো লেখকই বলতে পারবেন না যে এই অংশটি তার নিজস্ব। ডিটেকটিভ গল্পের সূক্ষ্মতা ও আকর্ষণ নির্ভর করে একটি গুণের উপর। সেটি হল নায়কের বুদ্ধিবৃত্তির তীক্ষ্ণতা। আর সব কিছুই এই পরিধির বাইরে যা মূল রচনাকে ব্যাহত করে। সমস্যা ও সমস্যাপূরণই গল্পের থিম, চরিত্রচিত্ৰণ অবান্তর। এই সংকীর্ণ পথ দিয়ে লেখককে হাঁটতে হবে। সেখানে তিনি সর্বদাই পো-এর পদচিহ্ন দেখতে পাবেন। যদি কখনো এই বাঁধা পথের বাইরে তিনি কোনো গলিরাস্তার সৃষ্টি করতে পারেন তো তাঁর আনন্দের অবধি থাকে না।
আমার পরম সৌভাগ্য যে বাস্তব জীবনে আমি এমন একজনকে দেখেছি যাঁর চারিত্রিক বিশিষ্টতা আমার নায়কের মতো। যদিও তিনি তার প্রতিভার সদ্ব্যবহার করেছেন রোগ নিরাময়ে, অপরাধ নির্ধারণে নয়। আমি আমার ছাত্রাবস্থায় দেখেছি ও শুনেছি যে কত তুচ্ছ সূত্র, যা প্রায় সকলের চোখ এড়িয়ে যেত, তা ধরে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত করতেন। এর থেকে আমার দৃঢ় ধারণা হয়েছে যে মানব মস্তিষ্কের এই যে ক্ষমতা এর বিষয়ে যথাযথ চর্চা হয়নি এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির অনুসরণ করলে এমন অত্যাশ্চর্য ফল পাওয়া যাবে যার সঙ্গে গল্পের ডিটেকটিভের আকস্মিক এবং ব্যাখ্যাহীন সাফল্যের তুলনা হয় না। মসিয়ে দুপা অবশ্য এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন। আমি এইটুকু বলতে পারি যে আমার সীমিত ক্ষমতার এই নূতন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও নূতন মডেলের আধারে এই কাজ করতে পেরেছি (ক্রাইম কাহিনির কালক্রান্তি, সুকুমার সেন)।
শার্লক হোমসের প্রকাশক হিসেবে যাঁরা এইভাবে টীকাকরণ যোগে পাঠকের দরবারে পেশ করবার কথা ভাবেন, কলেবর বৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা এক ঢিলে দুই পাখি নয়, তিনটি পাখি মারার কৃতিত্ব দেখালেন। প্রথমত গবেষকের প্রদীপের আলো ফেলা পৃষ্ঠাগুলিকে সূর্যালোকে মেলে ধরলেন, দ্বিতীয়ত পাঠককে কন্যান ডয়াল দিয়ে হোমসিয়ানায় মাতিয়ে তুললেন আর তৃতীয়ত স্ট্রান্ড ম্যাগাজিন, লিপিনকট ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে আজকের দিনে হোমস ছেপে যাঁরা গর্ব করেন তাঁদের দেখিয়ে দিলেন বাংলা ভাষাতেও বিশ্বতালিকায় ভালো কাজে নিজেদের যোগ করা যায়। আর এই পক্ষীহত্যার শাস্তির সাধুবাদসহ জরিমানা ধন্যবাদ, পুরোটাই প্রাপ্য লালমাটি প্রকাশনের কর্ণধারের।
দেবদত্ত গুপ্ত
Leave a Reply