লোহিতকিরণচ্ছটা (অণুকবিতা গ্রন্থ) – কোয়েল তালুকদার
লোহিতকিরণচ্ছটা (অণুকবিতা গ্রন্থ) – কোয়েল তালুকদার
উৎসর্গ –
সহপাঠী বন্ধু রবীন্দ্রনাথ অধিকারী,
তুমি কবি হতে পেরেছ, আমি পারিনি।
১.
ঝড় আসে, ঝড়ে উড়ে যায় পথের ধুলো
নির্ঝরে পাতা ঝরে, চৌচির হয়ে যায় সবুজ বৃক্ষ।
এই চরাচরে ধুলো উড়ে, পাতা ঝরে
রৌদ্র ক্লান্ত দুপুর শেষে বড়ই ম্রিয়মাণ আমি।
যদি কোনও রক্তিম আভার সিক্ত সন্ধ্যায়
তুমি আসতে আরক্ত দেহ সাজে, মোহনীয় করে দিতে পারতে উদ্বেলিত সকল মুহূর্ত!
২.
আমার যে প্রেম তুমি চেনো, আমার যে দেহ তুমি ভালবাসো, শরীরের যে পথঘাট অলিগলি তোমার মুখস্থ — সেখানে যদি বিদায়ের মূর্ছণা বেজে ওঠে, যদি আর না থাকি।
দিগন্ত জোড়া হলুদ মাঠে কোনও বটবৃক্ষ তলে নিঝুম দুপুরে কোনও রাখাল বালক বাজায় বাঁশি, যদি গায় লালনের গান, মনে করো — তার সেই গানে আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
৩.
স্বর্গের লোভ দেখিও না, পৃথিবীর কথা বলো,
হুর অপ্সরাদের শরীরী মদিরার কথা বলো না,
লোভ দেখিও না তাদের উত্তপ্ত স্পর্শের।
মায়া দাও, মমতা দাও,
ঘৃণা যন্ত্রণাও দিতে পারো। আমি দুটি প্রাণের সৃষ্টি উল্লাসের কাঙ্গাল।
৪.
কাল রাতে তোমার পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়,
তুমি থাকলে শব্দ হয়, না থাকলে নৈঃশব্দ।
কাল রাতে দেখি রাত-ঝুম-ঝুম বৃষ্টি, তুমি থাকলেই বৃষ্টি হয়,
না থাকলে মেঘ।
রাতের শেফালীকে ঘুমিয়ে যেতে দেখেছি-
তুমি ঘুমিয়ে থাকলেই আমাকে জেগে থাকতে হয়
সে এক ঘুমহীন,স্বপ্নহীন, দুঃসহবাস।
৫.
ভালবাসা হোক পুণ্যে স্নাত।
তুমি আমাকে দগ্ধ করো।
মেঘমল্লার আকাশকে বলি, তুমি বৃষ্টি ঢেলে দাও — নিভিয়ে দাও দহন।
নদীকে বলি, তুমি ভাসিয়ে নিয়ে যাও
শঙ্খনীল সাগরে।
৬.
অস্তরাগের সন্ধ্যায় তুমি এসো-
ধান ধুপে জ্বলবে প্রদীপ, জ্বলবে তারার বাতি
তারপর দোঁহা জ্বলব রাত ভর
কেউ নেভাতে আসবে না, ছাই ভস্ম হবো বর্বর আদি অনলে।
৭.
বলো, আর কত আঁধার হওয়া আছে বাকি?
আর কত আঁধার হলে জ্বলে উঠবে জোনাকি
আলো হবে, আলো আসবেই তোমরা শোনো
মানুষ আঁধারে থাকবে তাই কী হয় কখনো?
৮.
সারারাত টুপটাপ ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল ঝরেছে, নাকি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কোথাও কেউ কেঁদেছে।
কে জানে?
কে কোথায় কাঁদে, কে কোথায় চোখের জল মুছে
তার খবর নেওয়ার কে আছে।
তোমাকে ছেড়ে সেই কবে চলে এসেছি
বিচ্ছেদকালীন সে কান্নার জল এখনও চোখে লেগে আছে।
৯.
করোনাকালীন কবিতা-
তুমি নও
তোমার ছায়া পড়ুক আমার প্রাণে
স্পর্শ নয়
তোমার চেয়ে থাকা তান তুলুক আমার গানে।
এখন একটু দূরেই থাকো–
আবার একদিন
বকুলঢাকা বনে হাঁটব দুজনে
আবার একদিন
শ্রাবণআকাশ নীলাদ্রি হবে হৃদ স্পন্দনে।
১০.
কত পথ কত প্রান্তর, কত বন্দর কত লোকালয় ঘুরেছি,
কত অন্ধকারে চোখ রেখে এতকাল যাকে খু্ঁজতেছিলাম —
আর তারই কী-না দেখা পেয়ে গেলাম সিরাজগঞ্জের জামতৈল স্টেশনের কাছে এক নির্জন শ্রান্ত শান্ত কুটীরে।
১১.
কত অন্তহীন পথ হেঁটে এসে শেষে দাঁড়ালাম তোমার দ্বারে। আমি পানি চাইলাম।
তুমি দেখালে নদী। এত জল কার?
এত ঝিনুক সেখানে। জলে নামতেই দেখি, শ্যাওলাদামের ভিতরে অসংখ্য মুক্তা।
স্রোতে ভেসে যাই। ডুবে যাই।
আমার কোথাও কূলও নাই, কিনারা নাই।
১২.
গল্পে কেউ থাকে কেউ থাকে কবিতায়
কেউ থাকে জনম জনম
কেউ হয় ক্ষণিকা
কেউ থাকে মেঘে ঢেকে
কেউ আবার নদী হয়ে অকূলে যায় ভেসে ।
১৩.
যত দূরেই যাই, থাকি তোমার কাছেই
চোখে চোখ পড়ে না, তোমাকে ছুঁয়েও নেই,
কিন্তু তোমাকে ছুঁয়ে আসা মেঘেরা বৃষ্টি
ঝরায় আমার উপরেই।
১৪.
কোথায় চলে যাবে? কোন্ পথ দিয়ে।
সব পথে পথে কবিতা লিখে এসেছি।
আমার কবিতাই তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে আমার ঘরে।
১৫.
পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে থাকা বিষাদগুলি
আনন্দে রূপান্তরিত হয়ে চলে গেল
ঐ শেষ অস্তরাগে।
দূরে ছড়িয়ে থাকা মেঘকণাগুলি অশ্রু হয়ে উড়ে এল আমার চোখের ‘পরে।
১৬.
চিরদিনের আকাশ চিরদিনের জোৎস্না
কুসুমপুর থেকেই দেখা যায়। গীতিগন্ধ ভরা দখিনা বাতাস,
ঝরে পড়া শিমুলের মাতাল সুবাস, কুসুমপুর গেলেই পাওয়া যায়।
সেখানে হিজলের বন আছে, ঝুমঝুম নদী আছে
সেখানে সমির আলী আজো গান গায়
ভাটিয়ালি মনহরা,
আমার কুসুমপুর গাঁও, সবসময় চির বসুন্ধরা।
১৭.
বহু বছর আগে এই বঙ্গেতে এক কবি জন্মেছিল। যমুনা কূলে ছিল তাঁর নিবাস। মৃৎপাত্রে লাল মাটি গুলিয়ে বাঁশের শলা দিয়ে তালপাতার উপর সে কয়েকটি চরণ লিখেছিল।
আমার আঙিনাতে আন্ধার কেনে
তোমার হেথায় যে চান্দের আলো ।।
আমার কাননে ফুল ফোটে নাই
তোমার বাগানে কে ফুল ফুটালো।।
কবি ছিল যশহীন, খ্যাতিহীন। তার নাম কেউ মনে রাখেনি।
১৮.
‘আকাশ হারিয়ে যায় দূরের আকাশে
তুমি হারিয়ে থাকো তার নীলে।
আমি ভ্রমে খুঁজি তখন অপরাজিতার নীলে।
ঝিনুক লুকিয়ে থাকে সাগর বালুকাবেলায়,
তুমি থাকো অতলান্তে,
আমি ভ্রমে খুঁজি তখন সুপ্ত কোনও
দীঘির কালো জলে।
এই দুইয়ের কোথাও তুমি নেই।’
১৯.
সব প্রেমের মধ্যেই প্রেম থাকে না
সব আনন্দই আনন্দ নয়
সব ঘুমেই স্বপ্ন আসে না।
সব তারা ডুবে গেছে আকাশ নিশীথে।
আমার দেহখানি নির্ভার করে দাও
মলিন দুঃখগুলোকে মুছিয়ে দাও
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে দু’হাতে ধরো।
২০.
হঠাৎ হঠাৎই অনেকের কথা মনে পড়ে। অনেক প্রিয় মানুষের মুখ। যারা চলে গেছে অনন্তের পথ
ধরে বহু দূরে। প্রায় সময়ই চোখ বন্ধ করে সেই সব মুখগুলো দেখি।
কেন যে জন্ম হয় মানুষের।
কেনই যে মৃত্যু আসে সে জীবনের ।
২১.
প্রায়শই এই কোলাহল থেকে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছা করে। নিবিড় কোনও বন জঙ্গলে কিংবা কোনও মাজারে। সামিয়ানার নীচে বসে সারারাত কাওয়ালি শুনি। অথবা নির্জন সাগরকূলে বসে সমুদ্রের গর্জন। সারারাত বৃষ্টি নামুক। বৃষ্টির সাথে সাগরের সঙ্গম। বৃষ্টি ও জলের প্রজনন।
আমি রহিনু পড়ে এই কোলাহলে,
একা। প্রেম ও বিরহ এখানে এক বিন্দুতে আহত হয়।
২২.
মধ্যরাতে কিছু অবাধ্য বাতাস জানালার কাছে
এসে শব্দ করে বলে — খুলে দাও।
জ্যোতির্ময় এক আলোর বিভায় ঝলমলিয়ে উঠি —
কানের কাছে গুণগুণ করে জোনাকি।
তখনও নিশ্চুপ এক তরুণী —
তখনও রাজকন্যা সিন্ড্রেলার ঘুম কিছুতেই ভাঙানো গেল না।
২৩.
এই জ্যোৎস্না মাধবী রাতে, ঐ নীল জলধি আমাদের ডাকে
ঐ অতল তলে কিসের গান বাজে-
কি সুর ধ্বনিত হয় দীর্ঘশ্বাসে, বিসর্জন দিতে মন চায় যে !
‘ অতুল মাধুরী ফুটেছে আমাদের মাঝে,.
চরণে চরণে সুধাসঙ্গীত বাজে- এ কি সত্য।’
২৪.
তোমার অকম্পিত হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলে —
পরম নির্ভর বাহুডোর। আলিঙ্গণে জড়িয়ে নাও, উষ্ণতা পাবে।
ছায়াবীথির মতো বুক দেখিয়ে বলেছিলে —
এখানে হৃদয়। জমাট বেঁধে আছে লাল রক্তের ছোপ !
যত্ন করো, পরিচর্যা করো, নিজের স্থানকে নিরাপদ করে রাখো…..
২৫.
শ্রাবণ জ্যোৎস্নারাতে
বহুদিন এই গ্রাম থেকে ঐ গ্রামে
গোপনে নৌকা নিয়ে ঘাটে ঘাটে ঘুরেছি
দেখেছি কত উপচে পড়া জল —
আর নদীর স্রোতবক্ষে ভেসেছি সারারাত।
সব ঘাটই জলকে কাছে টেনেছিল,
আমাকে নয় —
নদী আর আমাতে ছিল যত অভিমান।
২৬.
যতোদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায় তাকিয়ে দেখলাম
কোথাও তোমার ছায়া নেই,
শুধু আকাশের ছায়াটি পড়ে আছে।
২৭.
ঘরের ভিতরে কেউ নেই। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ গুমরে গুমরে করে কান্নার শব্দ শুনতে পাই। মনে হলো পায়ের উপর টপ টপ করে শীতল জল ঝরে পড়ছে।
আলো জ্বালাই। ঘরের ভিতরে কেউ নেই। ভাবলাম — বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিনা? জানালা খুলে দেখি, চরাচর জুড়ে পাগল করা জ্যোৎস্নার রাত।
২৮.
হাত ছুঁয়ে দেখলাম। রেখাগুলো আছে আগের মতোই। চোখের তারা তেমনি ঝলমলে। ঠোঁটের পৃষ্ঠে কাঁপন। বুকের নীচে উতল ভালোবাসা। ইচ্ছাগুলোও মায়াবদ্ধ।
চলো আমরা অনাগতের পথে হাঁটতে থাকি। সেই প্রথম অনুভবের মতো।
২৯.
তুমি যেন নদী। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আছো। এই নদীর ভাঙ্গন চূর্ণ করে দুপারের মৃত্তিকা, এর জলতরঙ্গ আমাকে ভেসে নিয়ে যায়।
আমার শূন্যতার ভেতর তুমি পূর্ণতায় ভরিয়েছ।
তুমি দিয়েছ আর আমি পূর্ণ হয়েছি।
কী ভাবে আমি তোমাকে প্রবঞ্চিত করে রাখি?
আমি ভিখারি হলেও না।
৩০.
তুমি যেন নদী। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আছো। এই নদীর ভাঙ্গন চূর্ণ করে দুপারের মৃত্তিকা, এর জলতরঙ্গ আমাকে ভেসে নিয়ে যায়।
আমার শূন্যতার ভেতর তুমি পূর্ণতায় ভরিয়েছ।
তুমি দিয়েছ আর আমি পূর্ণ হয়েছি।
কী ভাবে আমি তোমাকে প্রবঞ্চিত করে রাখি?
আমি ভিখারি হলেও না।
৩১.
সকালও এমন ঘন ঘোর আঁধারের হয়!
মেঘ ভেঙে বৃষ্টি হবে তাই হয়ত এমন আয়োজন তার।
“আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ অন্ধ করা,
তোমার পরশ থাকুক আমার হৃদয়ভরা৷”
সব কেমন আনন্দে ভরে গেল যে !
‘দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ,
আমার চিত্তে মিলি একত্রে তোমার মন্দিরে উছাসে।’
৩২.
যদি আর বৃষ্টি না ঝরায় মেঘে ঢাকা আকাশ,
যদি আর কোনো ফুল না ফোটে।
যদি মরে যাই একদিন, যেন মরি ফুলের বনে।
৩৩.
কতো রাত পোহালো তবু তার সঙ্গে দেখা হলো না।
তুমি কি ছিলে এই রাত্রিতে , এই চন্দ্রপক্ষে নিজেকে বিসর্জনরত?
যেখানে মাটির সঙ্গে প্রেম,
যেখানে দেহের বিষে প্রেম আলিঙ্গনবদ্ধ হয়।
ভালোবাসার ফুলে ভরে ওঠে জল, তবুও জল স্পন্দন শুনলো না কেউ ।
৩৪.
একটাই জীবন জেনেও জড়াইনি অন্য আর কারোর জীবনে —
যতটুকু সময় আছে, আছি তোমার সাথে সুখ দুঃখের এই ভূবনে,
জীবনে যা পেয়েছি অমৃত সুধায় ভরে থাক আর কিছু চাহিনে।
৩৫.
পুড়ে যতই হয়ে যাই ছাই…..
তোমার ছোঁয়া পেলে প্রাণ ফিরে পাই।
৩৬.
এখনও ভালোবাসি
এখনও কাছে আসি নিঃশব্দ চরণে,
এখনও স্মরি তোমায় অনিঃশেষ
অশ্রু ক্ষরণে।
৩৭.
কথা ছিল মেঘ গুুরুগম্ভীর বর্ষারাতে আমরা নদীতে ভাসব। রাতের মধ্য্ প্রহরে তুমি এমন হলে তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত আমি। তুমি পাশ ফিরে মুখ ঘুরিয়ে মেঘ হয়ে গেলে। তোমার এমন মেঘ হওয়া দেখে বিষাদগ্রস্থ হই। দেখি — সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরছে।
তুমি এসো, আষাঢ়ের মেঘের মতো
এসো, আমার বর্ষালিপি।
টুপটাপ ঝরতে ঝরতে
একটি আনন্দ নদী পার হই, এসো সাঁতার দেই।
৩৮.
বৃষ্টি ঝরঝর এক বর্ষা রাতে
এসেছিল সে বাতাসের মর্মর ধ্বনিতে
আকাশ দীর্ণ করা আলোর ঝলকানিতে
জড়িয়েছিল বুকে রিমঝিম সঙ্গীতে।
৩৯.
ক্রমশঃ গহীনতম পথে চলতে থাকে আমাদের লীলাপর্ব
জলের ঢেউ ভেঙে নাবিক নোঙ্গর ফেলে আরো অতলে
আমরা বুঁদ হয়ে থাকি জলের নির্মাণে —
নিঃসঙ্গ বালিয়ারীতে তখন মুক্তা ফলায় ঝিনুক
জলধির গভীরে যে কথা হয় তার সাথে
তার বুকে কান রেখে সে কথা শুনি আমারই প্রাণে।
৪০.
অভিমান তুমি আমাদের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও
কেউ থেকো না আজ
থাকবে না কোনো বৃক্ষের ছায়া, থাকবে না উপত্যকার কোনো ঘাসও।
লক্ষিনদারের বাসর ঘরের মতো সবকিছু নিশ্ছিদ্র।
আমরা দুজন আজ একজন হবো।
৪১.
কেন যে গানের কথা লিখি,
কেন যে সুরে সুরে ভরে যায় সন্ধ্যার আঁধারে এই মন, কেন যে দুচোখ জলে ভরে ওঠে, কেন যে বুকের গহীনে মর্মরিত বেদনা বাজে, জানিনে জানিনে…।
৪২.
যদি প্রেমহীন হয়ে থাকো, মেঘদূতের সম্ভোগের শ্লোক পড়েও যদি নির্বিকার থেকে যাও
যদি না থাকে তোমার রাগ-অনুরাগ-
যদি বিহ্বল না হয় কস্তরীনাভি, যদি রাগ না ওঠে কোমলগান্ধার,
যদি কেঁপে না ওঠে তোমার শরীর,
রক্তে শোণিতে যদি না ভেজে তোমার পরনবাস, তাহলে তুমি আমার কবিতা পড়ো না।
৪৩.
যত ঘৃণাই কর, যত দূরেই ঠেলে দাও। আমি জানি, অনেক দূরের স্বপ্ন হয়ে গেলে, তুমিই সবার আগে ক্লান্তিহীন দৌড়ে দৌড়ে ছুটে চলে যাইতে চাইবে জীবন সীমানার ওপারে।
৪৪.
যখন আমি গল্প লিখি, শেষ লাইনে এসে থেমে যাই। তখনও কাহিনিতে জীবনের রেশ থাকে। তখনও জীবন্ত তুমি। সেই তুমি আরেক রূপে এসে ধরা দাও। তখন শুরু হয় অন্য আর একটি গল্প।
৪৫.
কিছুটা সম্পূর্ণ কিছুটা অসম্পূর্ণ একটি আকাশ
কয়েক’শ কোটি তারার আয়োজনে
আসে একটি মাত্র রাত।
তোমাকে ভালোবাসি এই আকাশ তলে
আমরা মেঘ হবো, নীল মেঘ, খয়েরী মেঘ, রঙবেরঙের মেঘ।
৪৬.
তোমার চুল আমাকে টানে
তোমার কন্ঠস্বর রাগ ভৈরবী হয়
মুখের মাদকতা আমাকে টানে —
নির্বাক, বুভুক্ষু আমি পায়চারি করি
চন্দ্রালোকের খাঁ-খাঁ রাস্তায়।
৪৭.
একদিন মনখারাপ হবে খুব, অথচ কান্না নেই।
সে মুখোমুখি এসে দাঁড়ানোর পর হয়ত কান্না এসে যাবে
বড্ড অচেনা লাগবে তখন সারা পৃথিবী,
একদিন সবকিছু ফুরাবার আগেই আমিও হারিয়ে যাবো..
তখন কারও চোখে আমার কান্না রয়ে যাবে।
৪৮.
প্রায়ই মনে পড়ে…আজ তো আরো বেশি করে।
মহুয়া বনের মাতাল আমি…
৪৯.
বিশ্বাস রেখো বুকে, কোথাও কোনো নদীর ঘাটে একটি কালো নৌকা আমাকে তুলে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।
৪৯.
তোমাকে ফেলে দিয়ে
পথে নেমে একা একা পথে পথে ঘুরি। যাযাবর সন্ধ্যা বেলায় পথ ভুল করে আবার তোমার কাছেই ফিরে আসি।
কবে একদিন আমার জন্য তোমার দুই ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়েছিল, তারই ঋণ শোধ করার জন্য এমন করে বারে বারে ফিরে আসা।
৫০.
আসব তোমার কাছেই যদি মেলে দাও
তোমার আকাশ,
যদি ভিজাও বহতা নদীর কূলকূল জল ধারায়।
যদি দেখাও উপত্যকা, হামাগুড়ি দেব তার ঢালে,
পুকুর নালায় উপচে পড়বে ঝর্ণার জল।
যদি নিয়ে যাও পূর্ণিমার আলোয় পথ ধরে
নিরুদ্দেশ কোথাও।
যেখানে সন্ধ্যা রাত্রিতে থেকে থেকে জোনাকি জ্বলে। যেখানে রাতভোর স্নাত হওয়া যায় শিশিরে।
৫১.
জীবনের মধুরতম সময়গুলোর আয়ু ক্ষণকালের, উপভোগ করতে না করতেই শেষ হয়ে যায়। আমাদের বসন্তদিনও শেষ হয়ে গেল। এত ভালবাসলাম তারে, তবুও ধরে রাখা গেল না।
৫২.
এই পথ দিয়ে তুমি এসেছিলে
তখন আলো জ্বলে উঠেছিল,
এই পথ দিয়েই তুমি চলে যাবে
সব আলো নিভে দিয়ে।
বিধাতার কী নিয়ম।
৫৩.
পথে যেতে যেতে সন্ধ্যা হলো,
চারদিকে এতো নীলাভ ছায়া কেন?
তুমি তো আলোই ছিলে —
তবে কেন এই অন্ধকার হয়ে আসা!
৫৪.
বিচ্ছেদ চাইনি কখনো —
আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে রয়েছে তার হাতেই
আকাশে চেয়ে দেখি নক্ষত্রও নিঃস্ব,
বাতাসেও কোনো সিম্ফণী নেই।
৫৫.
তোমাকে ছো্ঁয়ার আগেই চাঁদ পশ্চিম আকাশে ডুবে গেছে,
সব আলো নীভে গেছে তোমার বন্ধ চোখের নীচে। সেই উষ্ণতার আনন্দ আর পাওয়া হলো না।
সব জ্যোৎস্না তোমাকে পাওয়ার আগেই আকাশলীনে হারিয়ে গেলো।
জোৎস্না বিধোত হয়ে তুমি কি আবার চাঁদ হয়ে ফিরে আসবে ?
৫৬.
তুমি চলে যাও, যাবার বেলায় বলে যাও–
‘এবার চললাম চিরদিনের জন্যে।’
তারপর কী হয়! হয়ত তুমি দূর থেকে আমাকে দেখো
দূর থেকে কাছের করে দেখো –
চোখ বন্ধ করে দেখো, চোখ মেলে দেখো।
তারপর আবার মায়া ভরে ফিরে আসো
আমার কাছেই।
৫৭.
আমার প্রাণ ছুঁয়ে গেল কে, শারদীয় রোদ্রের মতো, আমি আবেশে অবশ হয়ে যাই,
তুমি আজ যেই গানই গাও , তোমার সেতার জানে আমি কী গান শুনিতে চাই।
৫৮.
জীবন যদি থেমে যায় ধূলি পথের দীপ্ত প্রান্তরে।
জারুল তমাল নিম নাগেশ্বরের মাঝে ব্যপ্ত যে মুখখানি দেখতে পাবো নক্ষত্র আলোকে, তাকে ঠিকই চিনে নিতে পারব।
আমার জীবনের সকল দায়ভার তোমাতেই গচ্ছিত। আমি যাকে পেয়েছিলাম, শেষপর্যন্ত শেষ মুহূর্তেও তাকেই কাছে পাইলাম। আমার আর খেদ রইল না…।
৫৯.
তুমি ভোরের চাঁপা ফুল আর জুঁই,
এত সুবাস আমি কোথায় থুই। তুমি দিতে চাও না কিছুই্,
তবুও তোমাকে আমি ছুঁই।
নির্বিকার থাক সে আমি বুঝি, তবুও তোমার মাঝেই নিমগ্নতা খুঁজি।
৬০.
তোমার পুজোর থালায় ফুল দিয়ে রেখো ঢেকে যখন সন্ধ্যা নামে,
কোনো অনুযোগ নেই, তোমার থেকে যা আমি পেয়েছি তা রেখেছি অনেক অশ্রু দামে… …।
৬১.
মনটা হয়ে আছে মেঘের মতো ধূসর
সামনের পথ আর রয়েছে কত বাকি?
যেতে যেতে পথে যদি আঁধার নামে
পথ দেখাবে না হয় কোনো জোনাকি।
৬২.
চন্দনের গন্ধ নিতে গিয়ে বুকের গন্ধ পেয়েছি
এইরকম আরো কত কিছু ভুল করে নিয়েছি
চন্দন নেব না তোর থেকে আবীর দে
ভালোবাসা জমেছে যত সবই লুটিয়ে নে।
৬৩.
উপেক্ষা করে দূরে দূরে সরিয়ে রেখেছি যাকে
দিনশেষে সেই আমার জন্য অপেক্ষায় থাকে
আদর তো দূরের কথা হাতখানি ধরিনি যার
সেই আমায় ভালোবাসা করে দিয়েছে উজার।
৬৪.
ফিরে যেতে বলেছিলে তাই মুখ ফিরিয়ে চলে গেছি। পৃথিবীর সমস্ত কক্ষপথ ঘুরে এসে দেখি, তুমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছ দুহাত পেতে।
ঐ হাত আমি ফিরিয়ে দেই কী করে ?
৬৫.
ধরতে চেয়েছি আঙ্গুল তুমি এগিয়ে দিলে হাত,
ধরতে গিয়েছি হাত, তুমি এগিয়ে দিলে বক্ষ,
বলেছিলে — বুভুক্ষু আমি, এই বুক চৌচির প্রান্তর।
শীতল করো, অমৃত সুধা করো পান।
৬৬.
উঠেছে কোজাগরী,
ভূবন জুড়ে আলোয় আজ ভরেছে ,
আমি দেখিনি সেই চাঁদ, যারা দেখবার তারা দেখেছে।
আমার ঘরেই ছিল চাঁদ মেখেছি তার আলো
গৃহ ত্যাগ তাই হলোনা আমার
জেগেছি রাত, বেসেছি তারে ভালো, এই রাত ছিল যে শুধু পূর্ণিমার।
৬৭.
কখনও যদি নিজেকে খুব একা লাগে, যদি তোমার কাছে কেউ না থাকে, যদি নিঃসঙ্গতার ধূপ আগুনে পুড়তে থাকো সারাক্ষণ । তবে তুমি লেখার কাছে চলে যেও। তখন তুমি কবিতার সাথে কথা বলো , গল্পের সাথে গল্প করো।
৬৮.
ঘোর লাগা নির্জন পাতার গায়ে
লিখে রাখি তোমার নাম,
উদ্বেলিত রাত্রির আকাশে জ্বলে ওঠে বিগলিত চাঁদ।
তারা’রা যে যার মতো ভেসে যায় ,
রাতখোর যুগলেরা মিটায় তখন তাদের আরাধ্য সর্গীয় স্বাদ।
৬৯.
কোনো একদিন বসন্তবায় উড়ে চলে যাব। দূরে বহুদূরে, শূন্যে চিল হয়ে, মেঘের আড়ালে। ঠিক হারিয়ে যাব একদিন। কেউ আমায় ছুঁতে পাবে না। কেউ খুঁজেও পাবে না।
৭০.
যার ভিতরে মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। তার সাথে জড়িয়ে পড়তে বা সম্পর্ক করতে ইচ্ছা করে না। আর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেও তাকে ছেড়ে আসতে অসুবিধা হয় না।
৭১.
কাউকে ভালোই যখন বাসলাম, তার শরীরটাকে ভালো বাসতাম। মনটাকে কেন ভালোবাসতে গেলাম। শরীরটা ত্যাগ করে রেখে আসা যায়, মনটাকে আসা যায়না। মনটা পড়ে থাকে মনের কাছে।
৭২.
যে আমাকে ছাড়া এক মূহূর্তকাল থাকতে পারেনা। বলে- তুুমি ছাড়া এই পৃথিবী মিথ্যা।
সেই একদিন শিখে নেবে — আমাকে ছাড়া কিভাবে তার মৃত্যু মুহূর্তকাল পর্যন্ত থাকতে হবে।
৭৩.
যখন কাছে থাকো তখন তোমাকে দেখি –
যখন দূরে চলে যাও, উৎকণ্ঠিত আঁখি মেলে
তখন আরও বেশি করে তোমাকে দেখি।
৭৪.
তুমি যদি তার শরীর চাও, খুলে বলো তাকে। ভালোবাসার অভিনয় করে তার শরীর নিও না। নিজেকে সৎ রাখো।
.
৭৫.
কাল রাতে হেঁটেছিলাম চন্দ্র তারার
নীচ দিয়ে একা।
পথ আর কতটুকু বাকি।
পথ চলার সেই সময়টুকুতে আমার সাথেই না হয় পথ চললে।
থেকেও গেলে আমার অন্তরতম অন্তরস্থলে।
তুমি তোমার ভালোবাসার ঝর্নাধারা
বইয়ে দাও।
৭৬.
আমিতো সমর্পণ করতে চাই, তুমি থাকো সহস্র আলোকবর্ষ দূরে …!
এ শহর ফাঁকা হয়ে গেছে। রাস্তায় বের হয়ে ভালো লাগেনি এমন শূন্যতা। জনারণ্যময় রাজপথই আমার বেশী প্রিয়। কোলাহলে অনেক দুঃখই ভুলে থাকা যায়।
হে প্রভু, এমন শূন্যতা নয়
আমাকে মুখর মুহূর্ত সমর্পণ করো।
৭৭.
বৃষ্টির শব্দ আঁখি পল্লবে
জলের ধ্বনি তোমার আরক্ত ঠোঁটে,
এই রাত্রিতে শব্দগুলো আজ কবিতা হয়ে ওঠে।
৭৮.
রাতের দিকে ঘন মেঘ এলে,
বুকের ভিতর সকরুণ বাঁশি বাজতে থাকে, আবছা আঁধারের মধ্যে তখন ভেসে ওঠে তার মুখ …
৭৯.
ভালোবাসার কাছেই আমি নমিত হই। সে যদি বলে, ‘চলো নরকে যাব’। তাহলে নরকেই যাব। আর যদি বলে, ‘স্বর্গে যাব’। তবে স্বর্গেই।
যেখানেই যেতে বলে, সেখানেই যাব — দ্বিধাহীন নিঃশঙ্ক চিত্তে।
৮০.
এই পৃথিবীতে কত শত মুখ দেখেছি আমি। দেখেছি অনেক জনের চোখও। সব ছাড়িয়ে একটি মাত্র মুখই সবসময চোখে ভেসে থাকে। সেই একজনেরই চোখ এখনও তীব্র ভাবে আলো ছড়ায়। তার সেই বিচ্ছুরিত আলোয় আমি আমার জীবন চলার পথ খুঁজে নেই।
Leave a Reply