লে মিজারেবল – ভিক্টর হুগো / অনুবাদ – সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ
LE MISEREB Bengali translation of the French historical novel “Les Miserables” by Victor Hugo Translated from English by Sudhanshu Ranjan Ghosh
.
ভূমিকা
প্রায় দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে লিখিত ভিক্টর হুগোর ‘লে মিজারেবল’ (১৮৪৫-৬২)। উপন্যাসখানি আয়তনের বিশালতায়, চরিত্রচিত্ৰনের বৈচিত্র্যে ও গভীরতায়, কাহিনীগত রূপকল্পনার সুউচ্চ উতুঙ্গতায়, ঘটনা সমাবেশের সুবিপুল সমারোহে ও কেন্দ্রগত যোগসূত্রের অবিচ্ছিন্ন গ্রন্থনৈপুণ্যে শুধু পাশ্চাত্য জগতের কথাসাহিত্যে নয়, সারা বিশ্বের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি হিসেবে কালোত্তীর্ণ মহিমায় মূর্ত ও অধিষ্ঠিত হয়ে আছে আজও। একমাত্র লিও টলস্টয়ের সুবৃহৎ ও প্রায় সমআয়তনবিশিষ্ট উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ হুগোর ‘লে মিজারেবল’-এর সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে এক তুলনীয় মর্যাদার দাবি করতে পারলেও উপন্যাস আর্টের গৌরব, গভীরতা ও শিল্পসৌকর্ষের দিক থেকে ‘লে মিজারেবল’ যে আরও উন্নত ধরনের সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ফরাসি ভাষায় ‘লে মিজারেবল’ কথাটির শব্দগত অর্থ ‘দীন-দুঃখীরা’ হলেও লেখক ঊনবিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সের সাম্রাজ্যতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের অধীনে সমাজের নিচতলার সেসব মানুষের এক সকরুণ জীবনকাহিনীর চিত্র এঁকেছেন, দুঃখ-দৈন্যের অভিশাপে বিকৃত যাদের জীবনচেতনা দারিদ্র্যসীমার শেষ প্রান্ত পার হয়ে ন্যায়নীতির সব জ্ঞান হারিয়ে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আর অপরাধপ্রবৃত্তির অতল অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যায়। জনদ্ৰেত্তে নামধারী থেনার্দিয়ের ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তাদের মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন, দারিদ্র্যের অভিশাপজনিত মানুষের দেহগত ও মনোগত বিকৃতি তাদের প্রকৃতিকে এমন এক পাশবিক হিংস্রতা দান করে, যা তাদের সমস্ত প্রাণ-মন ও কর্মপ্রবৃত্তিকে শুধু অস্তিত্বরক্ষার এক সর্বাত্মক ও প্রাণবন্তকর প্রয়াসের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে।
কোনও কোনও সমালোচকের মতে ‘লে মিজারেবল’ উপন্যাসের মূল কাহিনী বা আখ্যানবস্তু ও অজস্র উপকাহিনী আর চরিত্রগুলোর মধ্যে কেন্দ্রগত ঐক্য রক্ষিত হয়নি। দিগনের যে বৃদ্ধ বিশপ মিরিয়েল বা বিয়েনভেনু’র জীবন-কাহিনী নিয়ে এ গ্রন্থের শুরু, সেই বিশপের জীবন যত পুণ্যময়ই হোক না কেন, মূল কাহিনীর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে খ্রিস্টীয় জীবনচৈতন্য ও নীতিবোধের চূড়ান্ত আদর্শটিকে বিশপ মিরিয়েলের মধ্যে রূপায়িত করে তুলতে চেয়েছেন লেখক, বিশপের মৃত্যু হলেও সে আদর্শের মৃত্যু হয়নি। তাঁর অবিনশ্বর অমিতপ্ৰভব আত্মার আলো তাঁর প্রদত্ত দুটি রুপোর বাতিদানের মধ্যে এক শুচিশুভ্র অধ্যাত্মচেতনায় মূর্ত হয়ে উঠে নায়ক ভল’র আত্মিক সংকটের মধ্যে সারাজীবন তাকে পথ দেখিয়ে এসেছে। বিশপের আত্মিক উপস্থিতির প্রতীকস্বরূপ এই বাতিদান-দুটিকে সযত্নে নিজের কাছে। রেখে সারাজীবন বয়ে নিয়ে গেছে সে, একটি দিনের জন্যও তার প্রভাবকে সে অস্বীকার করতে বা এড়িয়ে যেতে পারেনি। এই দুটি বাতিদানের মধ্যে জ্বলতে থাকা মোমবাতির আলো তার মৃত্যুকালে তার মুখের উপর পড়ে এবং সে আলোর জ্যোতি মৃত্যুর অন্ধকার মহাসমুদ্রের উপর দিয়ে তার আত্মাকে পার করে নিয়ে যায় স্বর্গলোকের পথে। ওয়াটার লু যুদ্ধের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এ উপন্যাসে সংযোজিত হয়েছে, তা পাঠকদের কাছে ক্লান্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও ইউরোপ ও বিশ্বের ইতিহাসে এ যুদ্ধের গুরুত্ব এবং নেপোলিয়ঁনের চরিত্র ও তার শেষ পরিণতির যে ব্যাখা দান করেছেন লেখক, তা সত্যিই বিস্ময়কর। তাছাড়া এ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র মেরিয়াসের পিতা কর্নেল মতপার্সি এই যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং তাকে মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করে অন্যতম চরিত্র থেনার্দিয়ের মেরিয়াসের মনে যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব আনে, কাহিনীর মধ্যে তার একটি সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে।
উপন্যাসের নায়ক জাঁ ভলজাঁ’র মতো এমন বিবর্তনধর্মী চরিত্র সারা বিশ্বসাহিত্যের মধ্যে বিরল। সে তার জীবনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এমন চারটি চরিত্রের সংস্পর্শে আসে, যারা তার আত্মিক সংকটকে ঘনীভূত করে তুলে তার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দেয়। এই চারটি চরিত্র হল বৃদ্ধ বিশপ মিরিয়েল, ইনসপেক্টার জেভার্ত, ফাঁতিনের মেয়ে কসেত্তে আর তার প্রেমিক যুবক মেরিয়াস।
যে সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রে চোর ও অপরাধীদের জন্য নির্মম শাস্তির বিধান আছে, অথচ গরিবদের রুজিরোজগার ও অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা নেই, উনিশ বছরের কারাদণ্ড শেষে জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর সেই নিষ্ঠুর সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এক চরম ঘৃণা আর বিদ্রোহাত্মক প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে যখন ভলজাঁ’র সমগ্র অন্তরাত্মা, তখন বিশপ মিরিয়েলের অহেতুক এবং অপরিসীম দয়া সমস্ত বিদ্রোহের বিষ ও ঘৃণার গরল নিঃশেষে অপসারিত করে তার মন থেকে, হতাশা আর মৃত্যুর অন্ধকারের মাঝে এক
সৃষ্টিশীল আশাবাদে তাকে সঞ্জীবিত করে এক মহাজীবনের পথ দেখিয়ে দেয় তাকে। এরপর সমাজের আইন-শৃঙ্খলার প্রতিভূ কর্তব্যপরায়ণ ও নীতিবাদী ইনসপেক্টার জেভাৰ্ত আসে তার জীবনে। মন্ত্রিউল-সুর-মের অঞ্চলে কাঁচের কারখানার মালিক হিসেবে প্রভূত ধনসম্পদ ও যশমান অর্জন করে এবং সেখানকার মেয়র হয়ে ভলজাঁ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন একদিন জেভার্ত এসে তাকে বলে শ্যাম্পম্যাথিউ নামে একটি লোকের কথা, যাকে জাঁ ভলজাঁ ভেবে সেইসব অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হচ্ছে যেসব অপরাধে ভলজাঁ নিজে অপরাধী। ফলে আবার এক আত্মিক সংকটের সম্মুখীন হয় ভলজাঁ। সে ভাবতে থাকে, ক্রমবর্ধমান সম্পদ ও সম্মানে পরিপূর্ণ আপাতস্বর্গসুখসমৃদ্ধ তার বর্তমান জীবনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিলে তিলে মৃত্যু তথা নরকযন্ত্রণা ভোগ করে যাবে, না শ্যাম্পম্যাথিউকে মুক্ত করে তার জায়গায় ধরা দিয়ে জেলে গিয়ে নরক ভোগ করতে করতে এক চরম আত্মতৃপ্তির অতিসূক্ষ্ম এক স্বর্গসুখের সুবাসিত সুষমায় বিভোর হয়ে থাকবে মনে মনে। অবশেষে আবার স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে কারাদণ্ড ভোগ করে সে। তার পর কয়েদি হিসেবে একটি জাহাজে কাজ করার সময় একটি বিপন্ন লোককে বাঁচাবার পর জাহাজ থেকে পড়ে গিয়ে সাঁতার কেটে পালিয়ে যায় ভলজাঁ। ঘটনাসূত্রে উপস্থিত লোকরা ভাবে সে সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে। এরপর সে মঁতফারমেলে গিয়ে ফাঁতিনের অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য তার মেয়ে কসেত্তেকে থেনার্দিয়েরের হোটেল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এই কসেত্তের আবির্ভাবই ভল’র জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার আশ্রয়হীন আত্মীয়স্বজনহীন উষর মরুজীবনে শিশু কসেত্তেই নিয়ে আসে সবুজ সজল এক আশ্বস, যে আশ্বাস থেকে ভলজাঁ’র শুষ্ক সতৃষ্ণ অন্তরবৃত্তিগুলো তাদের প্রাণরস আহরণ করে আশান্বিত ও উধ্বায়িত হয়ে উঠতে থাকে এক নতুন আশায়। জীবনের এক নতুন অর্থ ও মূল্যবোধ খুঁজে পায় সে কসেত্তের মধ্যে। একাধারে পিতা, ভ্রাতা ও স্বামীর সমন্বিত স্নেহ ভালোবাসার সুতো দিয়ে এমন এক জটিল ও দুচ্ছেদ্য সম্পর্ক জাল রচনা করে কসেত্তেকে ঢেকে রাখে, যে জাল ছিন্ন করে পৃথিবীর কোনও শক্তি কোনওদিন তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না তার জীবন থেকে। তাই সে যখন জানতে পারল। মেরিয়াস নামে এক যুবককে ভালোবাসে কিশোরী কসেত্তে, তখন এক নীরব নিরতিশয় মর্মবেদনার আঘাতে তার অন্তরাত্মার ভিত্তিমূলটি কেঁপে উঠল। তবে আবার সে যখন দেখল বিপ্লবী যুবক মেরিয়াস ব্যারিকেডে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং তার মৃত্যু অবধারিত তখন সে কসেত্তের কথা ভেবেই নিজে ব্যারিকেডে গিয়ে আহত অচেতন মেরিয়াসকে ব্যারিকেড থেকে উদ্ধার করে তার মাতামহ মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। সহসা কসেত্তের প্রতি ভলজাঁ’র সর্বগ্রাসী সর্বাত্মক স্বার্থান্ধ ভালোবাসা আত্মত্যাগের এক বিরল মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে কসেত্তেকে স্বেচ্ছায় তুলে দেয় মেরিয়াসের হাতে। তার সঙ্গে যৌতুক হিসেবে দেয় তার সারাজীবনের সব সঞ্চিত অর্থ। সেই সঙ্গে তাদের সুখের সংসারে থেকে বাকি জীবনটা অনাবিল শান্তিতে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য কসেত্তে ও মেরিয়াসের কাছ থেকে এক সাদর আহ্বান আসে ভলজাঁ’র কাছে। এই আহ্বানই আবার এক চরম আত্মসংকট নিয়ে আসে ভলজাঁ’র জীবনে এবং তার শেষ পরিণতিকে ত্বরান্বিত করে তোলে। একদিকে ন্যায় আর সত্যভিত্তিক আত্মত্যাগ, অন্যদিকে মিথ্যা আর প্রতারণাভিত্তিক জীবনের ভোগ-উপভোগ। ভলজাঁ’র জীবনে এই হল শেষ আত্মিক সংকট এবং এ সংকটে ন্যায় ও সত্যের খাতিরে চরম আত্মত্যাগ, আত্মনিগ্রহ ও স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে ধীরে ধীরে নিজেকে ঠেলে দেয় ভলজাঁ। এইভাবে একে একে তার জৈবজীবনের সব কামনা-বাসনাকে জয় করে চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে পরম আত্মোপলব্ধির সর্বোচ্চ শিখরে উঠে গিয়ে মৃত্যুহীন এক মহাজীবনের দিগন্তবিসারী আলোকমালাকে উদ্ভাসিত দেখতে পায় সে তার চোখের সামনে।
ভলজাঁ ও বিশপ মেরিয়েল ছাড়া যে কয়টি চরিত্র রেখাপাত করে আমাদের মনে সেগুলো হল নিঃসীম অভাব আর অর্থলোলুপতার দ্বারা নিয়ত তাড়িত থেনার্দিয়ের, কর্মফলাকাঙ্ক্ষাহীন উদাসীন মেবুফ, উগ্র আভিজাত্যবোধ ও রাজনৈতিক মতবাদ আর স্নেহমমতাকেন্দ্রিক হৃদয়বৃত্তির দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ, মেরিয়াসের প্রতি অতৃপ্ত ও আত্মঘাতী প্রেমের আগুনে জ্বলতে থাকা পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া এপোনিনে আর তুলনাহীন বালকচরিত্র গাভ্ৰাশে। তার আত্মা যেন জীবন ও মৃত্যুর থেকে অনেক বড়। সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের মাঝে নাচগানের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে পরিহাস করতে করতে যেভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেয় সে, একই সঙ্গে মৃত্যুকে জয় করে আবার পরাজিত হয়ে এবং পরিশেষে সমস্ত জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে সেই আত্মার বিজয়গৌরব যেভাবে ঘোষণা করে, তা দেখে আমরা বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারি না।
‘লে মিজারেবল’ যেন উপন্যাস নয়, অর্ধশতাব্দীকালীন এক জাতীয় জীবনের জয়পরাজয়, উত্থানপতন, সুখদুঃখ ও আশা-আকাঙ্ক্ষাসংবলিত এক মহাকাব্য। মহত্তর কোনও সৃষ্টির গৌরব এই অনন্যসাধারণ উপন্যাসের কালোত্তীর্ণ মহিমাকে খর্ব করতে পারেনি আজও।
Leave a Reply