লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০০৬
একটি কুকুর উপকথা লেখার পরিকল্পনাটি আমার দীর্ঘদিনের যার পরিণতি ‘লুব্ধক’৷ কুকুর, বেড়াল, পাখি, মাছ – এদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছোটোবেলা থেকেই৷ তারা যেমন আনন্দ দিয়েছে আমাকে, তেমনই দুঃখ দিয়েছে চলে গিয়ে৷ শিখিয়েছে আমাকে অনেক কিছুই যা ঠিক বই পড়ে জানা যায় না৷ আমার ছোটোবেলার সঙ্গী জিপসির প্রতি আমার যে ঋণ থেকে গিয়েছে তার শোধ করার চেষ্ট হিসাবেও লেখাটিকে দেখা যেতে পারে৷ প্রাণমণ্ডলের অধিকার একা মানুষেরই নয়, সকলেরই৷ এই অধিকারের মধ্যেই নিহিত আছে প্রাণ ও মৃত্যুর নিয়ত ভারসাম্যের এক সমীকরণ যাকে বিঘ্নিত করলে মানুষের লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি৷
নবারুণ ভট্টাচার্য
১ ডিসেম্বর ২০০৫
.
১
সাত ঘন্টা, মাত্র সাতটা ঘন্টা আর বাকি আছে৷ সাত ঘন্টা মানে চারশো কুড়িটা মিনিট৷ খুব একটা অভাবনীয় মাপের কিছু নয়৷ মাত্র পঁচিশ হাজার দুশোটা সেকেন্ড৷ সময়-এর এই খণ্ড দৌড়ে পেরিয়ে যেতে একটা ঘুমই যথেষ্ট৷ তবে পুরোটাকে ঘুম বলা যাবে না৷ খুব সামান্য সময়ের জন্যে হলেও দু-একটা স্বপ্ন দেখতে হবেই৷ মোটের ওপর সাত ঘন্টার অপেক্ষা৷ আর ঘুমোতে যে হবেই বা ঘুম যে আসবেই এমন কোনো কথা নেই৷
রিখটার স্কেলে মাপা যায়নি যে ভূমিকম্পটা কত জোরালো ছিল৷ এর থেকে হাস্যকর কথা কী হতে পারে? আসলে এরকম কথা বলার কোনো মানেই হয় না৷ ঘেউ! ঘেউ! চার্লস এফ রিখটার তাঁর স্কেলটি বানিয়েছিলেন এই সেদিন৷ ১৯৩৫ সালে৷ আর ভূমিকম্পটা হয়েছিল ১৭৩৭-এ, মানে তার প্রায় দুশো বছর আগে৷ লোক মারা গিয়েছিল ৩,০০,০০০৷ দিনটা ছিল ১১ অক্টোবর৷ ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধরে ১৯৯৫ অবধি যে দুনিয়া কাঁপানো চুয়াল্লিশটি ভূমিকম্পের তালিকা করা হয়েছে তাতে কী অদ্ভুত, তারিখের সঙ্গে মিল দেওয়ার জন্যেই যেন ১১ নম্বরে এই ভূমিকম্পের কথা আছে৷ এই তালিকায় শেষ ভূমিকম্পটি হল ১৯৯৫-এর ১৭ জানুয়ারি, জাপানের কোবেতে, যাতে ৫,২৫০ জন মারা যায়৷ সে যাই হোক, ১১ নম্বর ভূমিকম্প, যাতে তিন লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল সেটা হয়েছিল কলকাতায়৷
তখন নিশ্চয়ই কলকাতায় এত লোক থাকত না৷ এত বাড়ি, সেতু, স্তম্ভ, মিনার, মেট্রো এসব কিছুই ছিল না৷ তাহলেও অত লোক থাকত যে মরেই গেল তিন লক্ষ৷ আর একটা শহরে নিশ্চয়ই শুধু মানুষই থাকে না৷ যেমন এখনকার কলকাতায় চিড়িয়াখানার প্রাণীদের কথা বাদ দিলেও যে অসংখ্য না-মানুষ প্রাণীদের আমরা দেখতে পাই তারাও নিশ্চয়ই ছিল৷ যেমন কুকুর, গোরু, ছাগল, বেড়াল, কাক, চড়াই, চামচিকে ও আরও কত প্রাণী৷ ভূমিকম্পই হোক, বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনাই হোক বা মহামারি অথবা শান্ত সময়েও কোনো পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ডুবোজাহাজের দুর্ঘটনাই হোক মানুষের বেলায় ঠিক হোক, ভুল হোক, মোটের ওপর একটা হিসেব থাকে৷ প্রাণহানি বললে কী বোঝায়? নিশ্চয়ই মানুষ৷ অনেক সময় বাসের ভেতরে লেখা দেখা যায় সময়ের চেয়ে জীবনের দাম বেশি৷ কার জীবনের দাম বেশি সেটা এর চেয়ে খুলে বলার দরকার হয় না৷ কী বলতে চাওয়া হয়েছে সেটা জানাই থাকে৷ জানা ব্যাপারটা জানানো হল৷ সকলেই জানে কিন্তু বড়ো বড়ো করে লেখাও থাকে৷ কেন এরকম করা হয়? যে সাত ঘন্টা বাকি আছে সে সময়টা না ঘুমিয়ে এরকম একটা প্রশ্ন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা যায়৷ এর মধ্যে সকলেই একটা কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়া নিস্তব্ধতা সম্বন্ধে এখনও বোধহয় সচেতন হয়নি৷ অথচ একটু খেয়াল করলেই জানা যাবে যে শহর শব্দময় হলেও তার মধ্যে কুকুরের ডাক নেই৷ চাকার শব্দ, পিস্টনের শব্দ, ইঞ্জিনের শব্দ, ফোনের শব্দ, টায়ার বা গ্যাসের সিলিন্ডার ফাটার শব্দ, টেলিভিশনে চেনা চেনা কন্ঠস্বর, চলন্ত গাড়িতে স্টিরিয়ো বাজার শব্দ, ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ার শব্দ, শরীরে শরীর ঘষা ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার রবার রবার শব্দ, দেশলাই কাঠি জ্বলে ওঠার শব্দ, চুল্লির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ, বঁটি ধোওয়ার শব্দ, খাওয়ার শব্দ, নিঃশব্দ ছাপা শব্দ, শবদেহ নিয়ে যাওয়া জানানোর শব্দ, ট্রামেদের গুমটিতে ফেরার শব্দ, টিউব আলোর তোতলাতে তোতলাতে জেগে ওঠার শব্দ, এক হাতওয়ালা টিউবওয়েলের জল ডাকার শব্দ – সব যেমন থাকে তেমন রয়েছে৷ কিন্তু কোনো কুকুরের ডাক নেই, কোনো গাড়িতে ধাক্কা খাওয়ার পরে তার রেশ রেখে যাওয়া আর্তনাদ নেই, ককিয়ে কান্না নেই৷ কুকুরের কোনো শব্দ নেই৷ কুকুর নেই৷ নাকি আছে অথচ ডাকছে না৷ সাত ঘন্টা সময় হাতে৷ এটা নিয়েও খোঁজ-খবর করা যায়৷ কুকুরগুলো সব কোথায় গেল? ফুলরা কোথায় যায়, ফুলকুড়ানি বালিকারা কোথায় যায়, তারা যে তরুণদের দেখে মুগ্ধ হয় তারা কোথায় যায় এবং তারা যে কবরে যায়, সে কবর আবার ফুলদল হয়ে যায় এসব নিয়ে যে গান বেঁধেছিল সেই বুড়োটা বলতে পারবে? কোথায় গেল কুকুরেরা?
এমনকি হতে পারে যে কুকুরদের ল্যাজে তারাবাজি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল! তাতে মজা পেয়ে তারা আকাশে ছুটে গেছে লাফাতে লাফাতে আর রাতের শূন্যে তাকিয়ে আমরা সেইসব তারাবাজির গমনাগমন বা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে ল্যাজ থেকে খসে পড়া অনেকক্ষণ বা অনেক যুগ, অনেক আলোকবর্ষ ধরে জ্বলতে থাকা দেখছি তো দেখছিই৷ আরও সাত ঘন্টা ধরেও দেখে যাওয়া যায়৷
অচেতন করে বেশ ধারালো অস্ত্র বা করাত দিয়ে যদি কুকুর চেরাই করা হয় তাহলে খুব একটা শব্দ হবে কি? করাতকলে দাঁড়িয়ে যারা গাছের গুঁড়ি চেরাই দেখেছে, দেখেছে ঝুরঝুর করে কাঠের গুঁড়োয় মাটি ঢেকে যেতে, তারা কি এত সূক্ষ্ম, এত সম্মোহিত শব্দ শুনতে পাবে? অচৈতন্য কুকুরদের চেরার শব্দ? ফাঁড়ার শব্দ! তারপর আরও সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণের শব্দ৷ এর আগেই তো আকাশগঙ্গার কথা হচ্ছিল যেখানে মহাকাশযানে লাইকাকে পাঠানো হয়েছিল৷ সেখান থেকে আমরা ইথার ও রক্তের গন্ধময় কুকুর ব্যবচ্ছেদের টেবিলে কীভাবে এলাম? কীভাবে এলাম, লাইকা? কীভাবে এলাম স্ত্রেলকা, বেল্কা? কীভাবে?
আমরা বরং এই রক্ত ও ইথারে মাখামাখি টেবিল ছেড়ে আকাশের ফুটো ফুটো তেরপলের নীচেই একটা বিকট দুর্গন্ধময় জায়গায় যেতে পারি, যার নাম, পিঁজরাপোল৷ অভিধানে বলা আছে যে পিঁজরাপোল হল- ‘অকর্মণ্য গোরু, ঘোড়া প্রভৃতির জন্য বৃহৎ পিঞ্জরাকারে ঘেরা স্থান৷’ সেখানে রাতে যায় রাত্রিচর রাক্ষস, চোর, প্যাঁচা বা বেড়াল৷ বৃষ্টি এখানে মৃত কুকুরদের পচাতে ও ফুলিয়ে ওঠাতে সক্রিয় হয়েছে, যেমন হয়েছে রোদ, ভ্যাপসা বাতাস, মাছি, মূষিক ও জীবাণু৷ এখানেই জন্মানো ও এখানেই মরে যাওয়া ওই কুকুর-শাবকটিকে দেখো যার চোখও ফোটেনি৷ এখন সে কিছুটা তুলোটে অবয়ব-এর৷ দেখো যে, পিঁপড়েরা তার চোখের বন্ধ, না ফোটা আস্তরণটি খেয়ে নেওয়ার ফলে তার চোখ খুলেছে৷ বড়োই অকিঞ্চিত্কর ওই ক্ষুদ্র একটি মৃত চোখ, যা ঘোলাটে৷ এইবার দেখো যে, সেই চোখে যার ছায়া পড়েছে, তার নাম মহাকাশ৷ ওই একটি মৃত চোখ বা দর্পণের বিন্দু ধরে রেখেছে ছায়াপথ, দূরে অপসৃয়মান গ্যালাক্সি, ক্রতু, পুলহ, শিশুমার তারামণ্ডল ও কত না ধূমকেতু ও বেকার, নিষ্প্রাণ কৃত্রিম উপগ্রহ৷ আরও আছে৷ কালপুরুষের দক্ষিণ-পূর্বে তাকাও৷ ক্যানিস মেজর বা বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের দেখা পাবে৷ এরই মধ্যে দেখো কী সুন্দর ওই আকাশের উজ্জ্বলতম তারাটি৷ ওরই নাম লুব্ধক বা সিরিয়াস৷ যারা নক্ষত্র-চর্চা করে তারা জানে যে ১ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টায় ও ১ নভেম্বর ভোর ৪টে নাগাদ লুব্ধক মধ্যগমন করে৷ তার কী ইচ্ছা তা আরও সাত ঘন্টা পরে জানা যাবে৷ তার নির্দেশ জারি করা হয়ে গেছে৷ যা আর ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না৷ তবে এখনও সাত ঘন্টা সময় রয়েছে৷
পিঁজরাপোল একটা নয়৷ এবং একটির ভেতরেই কম করে একশো সতেরোটা কুকুরের শবদেহ গুনে ফেলা যায় যার মধ্যে ওই চক্ষুষ্মান শাবকটিকে না ধরলেও চলবে৷ বিভিন্ন বিচিত্র ভঙ্গিতে তারা পড়ে আছে৷ কারও গলায় ছেঁড়া দড়ি পরানো৷ কেউ বুড়ো৷ কেউ জওয়ান৷ কেউ প্রথমবার মা হতে যাচ্ছিল৷ এখন কৃমির খাদ্য৷ আরও সাত ঘন্টা তাই থাকবে৷ চূড়ান্ত মুহূর্তে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করার আগে কেউ কামড়াতে গিয়েছিল৷ কেউ শেষবার থাবা তুলেছিল৷ কেউ থাবা গুটিয়ে নিয়েছিল৷ কেউ মরে যাওয়ার পরে শান্ত, ঘুমন্ত চেহারা নিয়েছিল৷ পিঁজরাপোল আপাতত ধৃত কুকুরদের মৃত্যুভূমি হয়ে অন্যান্য পিঁজরাপোলের মতোই শবস্তব্ধ হয়ে থাকুক৷ মহাকাশ থেকে দেখলে এই কলকাতাকে একটি অতি নগণ্য তারাপুঞ্জ বলেই মনে হবে৷ অন্তত সাত ঘন্টা দূর থেকে দেখলে তো বটেই৷ অন্ধকারের ধাওয়া খেয়ে কিছু দুর্বল জোনাকি এক জায়গায় জড়ো হয়েছে৷ এই অবশ আলোর ঘেঁষে থাকা দেখতে থাকলে একসময় ঘুম নেমে আসে৷ এবং সেই ঘুম সাত ঘন্টা ধরেও চলতে পারে৷
তবে একটা কথা স্বীকার না করে উপায় নেই৷ একাধিক পিঁজরাপোল ঘুরে ঘুরে সব কটি কুকুরের শবদেহ লক্ষ করলে দেখা যাবে আগে যে বৈচিত্রের কথা বলা হয়েছে তা মোটেও সাধারণ চিত্র নয়৷ অনেক কেন, বেশির ভাগ কুকুরই অসহায়ভাবে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছে৷ বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছে যে কুকুরদের অসহায়তা শেখানো যায়৷ আমরা শাটলবক্স পরীক্ষার কথা জানতে পারি৷ শাটলবক্স হল একটি দু-ভাগে ভাগ করা বাক্স যার মধ্যে আড়াআড়িভাবে একটি অস্বচ্ছ বাধা বা বিভাজিকা থাকে, যার উচ্চতা, ধরা যাক, এক কুকুর৷ শাটলবক্সের মেঝেটি ধাতব৷ সেখানে তীব্র ইলেকট্রিক শক্ দিলে কুকুরটা লাফায় এবং বাধা টপকে বাক্সের অন্য অংশে চলে আসতে পারে, যেখানে মেঝেতে বিদ্যুৎ থাকে না৷ কিন্তু কুকুরটি যে নিরাপদ অংশে এল সেখানেও বিদ্যুৎ শক্ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে৷ এরকম হলে কুকুরটি দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ এবার অস্বচ্ছ বাধাটি সরিয়ে যদি উঁচু একটা কাচ লাগানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে কুকুরটা লাফিয়ে কাচের গায়ে আছড়ে পড়ছে৷ অজান্তে বিষ্ঠা বা মূত্রত্যাগ করা, চেঁচিয়ে বা ককিয়ে ডাকা, কম্পন, বাক্সের গায়ে কামড়ানোর চেষ্টা – এরকম অনেক কিছুই তখন দেখা যাবে৷ কিন্তু দেখা গেছে যে এক-নাগাড়ে দশ-বারো দিন এই পরীক্ষা চালিয়ে গেলে কুকুরটি আর লাফাবার বা পালাবার চেষ্টা করে না৷ এইভাবে তাকে অসহায়তা শেখানো যায়৷ কুকুরেরা এই ভাবেই অসহায়তা শিখে নেয়৷ পরীক্ষার সময় দেখা গেছে যে কুকুরেরা হাল ছেড়ে দেয় এবং চুপটি করে শক্ নেয়৷ এইভাবে কুকুরেরা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং প্রমাণ করেছে যে, অসহায়তা মেনে নেওয়া শিখে ফেলা যায় ও শেখানো যায়৷ কুকুর উপকথায় যেহেতু কুকুরদেরই আনাগোনা বেশি, তাই বলে রাখা দরকার, যে অসহায়তা শেখানোর পরীক্ষায় শুধুমাত্র কুকুরদের ওপরেই পরীক্ষা চালানো হয়নি, অন্যান্য প্রাণীরাও ছিল – যেমন ইঁদুর ও গোল্ডফিশ৷
শাটলবক্স একটা জোটাতে পারলে হাতেনাতেই পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া যেতে পারে যে সত্যিই অসহায়তা শেখানো যায় কি না৷
হাতে তো এখনও সাত ঘন্টা সময় রয়েছে৷ ঘেউ! ঘেউ!
২
ধারালো চাঁদ ঝলসায় রাতের গলায়
প্ল্যানেটোরিয়ামের ইলেকট্রনিক ঘড়িতে
তখন দারুণ জ্বর
অন্ধকার ফাঁকা ময়দানে
একটা ট্রাম টাল খায়
আচমকা চলে গেল পুলিশভ্যান
ঘুমন্ত কুকুরগুলোকে চমকে দিয়ে
রোজ চমকে দেয়৷
প্রথমেই উঠবে একেবারেই যা অলৌকিক নয় সেই কান গজিয়ে ওঠার ঘটনাটি৷ কলকাতা যতই মৃত চাকর-বাকর সমেত হৃষ্টপুষ্ট ও সেলফোনবাহী নিত্য যোগাযোগের মমি ও বেলুনদের শহর হয়ে উঠছে ততই এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও বাড়ছে৷ চারটি চাকার শূন্যের অর্থাৎ ০০০০-র ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ঝকঝকে মোটরগাড়ি যার ভেতরে মৃত মুখে প্রসাধন ও কলপ গলে গলে গড়িয়ে পড়ছে৷ অন্যদিকে ছেঁড়া ও তাপ্পি লাগানো ঘুড়ি যেমন বাতিল হয়ে গেলেও তারে আটকে কঙ্কালের মতো মরা-হাত নাড়ে তেমনই বেঘর বেপাত্তা হয়ে রয়ে গেছে সেই রোগা-প্যাঁটকা বা অপুষ্টিতে ফুলে যাওয়া পার্ট-নাম্বার, সিরিয়াল-নাম্বার, রেশন কার্ড, হাসপাতাল থেকে দেওয়া নোংরা চিরকুট, বেফয়দা দস্তাবেজ ও দমকা ঝড়ের লাঠিচার্জে এদিক-ওদিক ছুটতে থাকা পলিব্যাগ ও মুড়ির ঠোঙারা, কাদা-মাখা পালক ও হ্যান্ডবিল৷ এসব অগুনতির কোনো হিসেব নেই৷
এই কুকুরটার রঙ কালো, যদিও তার সামনের বাঁ-দিকের থাবাতে কিছুটা জায়গা সাদা লোমে ঢাকা ছিল৷ ওর নাম দেওয়া যাক কান-গজানো৷ কেন এই নাম সেটা একটু পরেই জানা যাবে৷ কান-গজানো কোনো সাহসী কুকুর ছিল না৷ নেহাতই ভীতু স্বভাবের একটি মেয়ে-কুকুর যার একবার পাঁচটা জ্যান্ত আর একটা মরা বাচ্চা হয়েছিল৷ দুটো বাচ্চা চুরি হয়েছিল৷ সে দুটো তো মরেনি! দুটো গাড়ি চাপা পড়ে৷ একটাকে ছোটো থাকতেই শকুন ছোঁ মেরে নিয়ে যায়৷ এর ফলে একটা আস্ত শীতকাল কান-গজানোর কান্না থামেনি৷ গোড়ার দিকে কান্নাটা বিঁধতে না পারলেও ভেসে বেড়াত৷ পরে সয়ে যাওয়ার ফলে আলাদা করে আর চেনা যেত না৷ আক্ষরিক অর্থে ‘সন অফ আ বিচ্’ বলে একটাও থাকল না৷ অন্তত সে-বার৷ এদিকে প্রত্যেকটা স্তন দুধে ফেটে পড়ছে৷ কিন্তু সবই সয়ে যায়৷
কুকুররা কতদিন তাদের মৃতদের স্মরণে রাখে বা রাখতে পারে এ নিয়ে হয়তো-বা কোনো গবেষণা হয়েছে৷ না-হওয়াটাই বরং অসম্ভব৷ যাই হোক, সেই কালো, কাফ্রি কুকুর-মা একটা একতলার ফ্ল্যাটের গ্রিলের বাইরে একদিন খাবারের গন্ধ পেয়ে অথচ খাবার খুঁজে না পেয়ে ঘাস সরিয়ে সরিয়ে সন্ধান করছিল৷ ঘাসে যে ছোট্ট ছাই ছাই রঙের প্রজাপতিরা থাকে তারা পালাল৷ উড়ে গেল পিঠের ওপরে দুই ডানা জোড়া রোগা পরীর মতো কাঠি-ফড়িং৷ উড়ে গেল গঙ্গা ফড়িঙের বাচ্চারা যারা জন্মেই হাইজাম্প প্র্যাকটিস শুরু করে৷ গন্ধটা রয়েছে কিন্তু খাবারটা নেই কেন-এই ব্যাপারটা নিয়ে কুকুর-মা যখন তন্ময়, তখন গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তার মাথার ওপরে মিউরিয়েটিক অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয়৷ সহসা ঝাঁকুনি দিয়ে পিছু হটেছিল বলে অ্যাসিডটা থেকে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে রাগী ধোঁয়া বেরোচ্ছে, লোমের ওপর পিছল খেয়ে একটা কানের দিকে গড়িয়ে গিয়েছিল৷ এবং কানটা গোড়ার দিক থেকে গলে যেতে থাকে৷
চিল-চিত্কার করতে করতে ছুটতে থাকা অ্যাসিড-আক্রান্ত কুক্কুরীটি তখন একদিকে মাথা হেলিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দৈবক্রমে একটি জল-জমা কাদা-জায়গা দেখতে পায় এবং সেখানে গলে যেতে থাকা কানটি কাত হয়ে শুয়ে ডুবিয়ে দেয়৷ সেই পচা কাদাজলের মধ্যে পৃথিবীর প্রাণশক্তি ছিল৷ সিক্ত, শীতল আরাম ছিল৷ অবশ করে দেওয়ার কুহক-মন্ত্র ছিল৷ ঘাস ও নানাবিধ উদ্ভিদের ওষুধ ছিল৷ সর্বোপরি আশ্রয় দেওয়ার একটি কোল ছিল৷ বস্তুত এমন জায়গাতেই কাদাজল জমে যেখানে ভূপৃষ্ঠ কিয়দংশে অবতল৷ ঘেউ! ঘেউ!
এরপর লোম-ওঠা, কান-গলা, খোবলানো জায়গাটা দেখতে এমনই হয়ে উঠেছিল যে তার প্রতি যে-পুরুষ-কুকুরদের টান, তারাও তাকে এড়িয়ে চলত৷ কিন্তু নানা মাত্রার প্রাণের অন্তর্বিষ্ট ক্ষমতা এক জাদু-বাস্তব৷ লোম ক্রমে ঢেকে ফেলল জায়গাটা৷ তারপর যেমন গাছের ফেকড়ি বেরোয়, তেমনই উঁচু হয়ে উঠল৷ এবং বর্ষার জলে কেমন করুণা রয়েছে যে ধীরে ধীরে অন্যটার চেয়ে একটু ছোটো মাপের হলেও, মানানসই গোছের একটা কানও গজাল৷ এই জন্যেই তার নাম কান-গজানো৷ ওর সঙ্গে পরে আবার দেখা হবে৷
কুকুরদের বিরুদ্ধে পর পর যে-ঘটনাগুলো কয়েক দিনের ফারাকে ঘটেছিল সেগুলো স্বল্পপরিসরে জানবার আগে এটাও মনে রাখা দরকার যে, সব ঘটনার পরিণতি কান-গজানোর মতো আনন্দের নয়৷ ঘটনার ওপরে কুকুর-উপকথার মতো আলটু-ফালটু জিনিস যারা লেখে তাদের কোনো হাত থাকে না৷ যারা এসব ছাই-পাঁশ পড়ে তাদের বরং থাকলেও থাকতে পারে৷
দ্বিতীয় ঘটনাটা নির্দিষ্ট একটি জায়গায় ঘটেছিল৷ যাদবপুর থানা থেকে আনোয়ার শাহ রোড ধরে কেউ যদি লেক গার্ডেন্স বা নবীনা সিনেমার দিকে যায় তাহলে ঠিক একটা স্টপের মাথায় ডানদিকে একফালি মাঠ পড়ে যার পেছনে হল ই.ই.ডি.এফ.৷ এই মাঠে বেশ বড়ো একটা পুজো হয়৷ খেলাও হয়, ভালো ম্যাচ-ট্যাচ থাকলে রাস্তায় বেশ ভিড়ও জমে যায়৷ এই মাঠের উলটোদিকের ফুটে যে চায়ের দোকান আছে সেখানে সাদাটে থাকত৷ সাদা হয়তো আগে ছিল কিস্তু তখন চোখে পড়েনি৷ চোখে যখন পড়ল তখন অনেক কিছু ঘটে গেছে৷
দুপুরবেলা৷ চড়া রোদ্দুরে পিচ নরম৷ এতে থাবা না-আটকে গেলেও নখের ছাপ পড়বে৷ সিমেন্ট জমে যাওয়ার পরে এরকম ছাপও অনেক সময় থেকে যায়৷ খেয়াল রাখলে চোখে পড়বেই৷ সেই রোদ্দুরের তাতে ঝলসাতে ঝলসাতে সাদা একটা অ্যাম্বাসাডার, ডবিলউ. বি ওয়াই নম্বরের, কম করে ষাট কিলোমিটার গতিতে আসছিল এবং সাদাটে তখন রাস্তা পেরোচ্ছিল৷ সাদাটে ছিল রোগা, হাড়-জিরজিরে, নিরীহ ও রাম ভীতু৷ গরমে মাথা গুলিয়ে যায়৷ সাদাটেরও বোধহয় সে-রকম কিছু হয়ে থাকবে৷ তা না হলে সে প্রায়-শব্দহীন ও আগুয়ান গাড়িটাকে লক্ষ করেনি কেন, যার মধ্যে বাজনা বাজছিল কিন্তু চালক বাদে কেউ ছিল না৷
স্টিয়ারিংটা বাঁদিকে সামান্য একটু কাটালে এটা হত না৷ এমনও নয় যে বাঁ-দিকে কোনো গর্ত বা গাড়ি বা সাইকেল কিছু ছিল৷ একটা ছোট্ট মোচড় যদি স্টিয়ারিং-এ পড়ত তাহলে গাড়িটার সামনের ডানদিকের বাম্পার থেকে সাদাটের মাথার দূরত্বটা ফুট দেড়েক বেড়ে যেত৷ এবং সামনে দিয়ে দুধ-সাদা চকচকে হলকাটা চলে যাওয়ার পরে সাদাটে হয়তো বুঝতে পারত যে কী হতে গিয়েও হল না৷ কিন্তু সাদাটে যে ডানদিক থেকে রাস্তা পেরিয়ে আসছে সেটা তো অনেক দূর থেকেই দেখতে পাওয়ার কথা৷ সাদাটে যে গতিতে আসছিল সেটা মোটেই দ্রুত নয়, অতএব বেশ কিছুটা সময় ধরেই তাকে দেখতে পাওয়ার কথা৷
গাড়িটার ওজন ও গতি গুণ করলে যা হয়, তার সঙ্গে সাদাটের ভীতু ও সর্বদাই নীচু মাথাটির ধাক্কা খাওয়ার শব্দটি, দুষ্টু বুটের চাপে ফাঁকা ফ্রুটির বাক্স ফাটার মতোই৷ গাড়িটা এত জোরে চলে যায় যে, অত সুন্দর মোমপালিশ করা গায়ে ঘিলু বা রক্ত ছিটকে লাগল কি লাগল না বুঝেই ওঠা গেল না৷ উঁচু, বাঁধানো রোড-ডিভাইডারের ওপারে ছিটকে গিয়েছিল সাদাটের দেহ৷ মাথাটা ছত্রখান৷ পেছনের পা দুটো কয়েকবার টান টান হল, গুটিয়ে গেল, আবার টান হয়ে কয়েকবার থেমে থেমে কাঁপতে কাঁপতে চুপচাপ হয়ে যাওয়ার, নিঃসাড় হয়ে যাওয়ার দিকে এগোয়৷ গাড়িটা দয়া করে একটু যদি বাঁদিকে কাটানো যেত, স্টিয়ারিংটা বাঁ-হাত দিয়ে একটু আলতো, প্রায় না-ঘোরার মতো বাঁ-দিকে যদি সামান্যতম ঘুরত – কিন্তু এটাও তো হতে পারে যে, সাদাটেকে লক্ষ করা হয়েছিল এবং সেইমতোই গাড়িটা চালানো হয়েছিল যে, ঠিক সময়ে ঠিক ব্যাপারটা ঘটে৷ এখানে কাকতালীয় কিছুই হয়নি, সবটাই স্পষ্ট, কাকজ্যোত্স্নার মতো ম্লান বোধহয় নয়৷ গাড়িটা হয়তো তার ওপরে যে লঘুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাই বাধ্য যন্ত্রের মতো পালন করেছে৷ ট্রিগার টানার সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক যেমন তার কাজ করে বা বিমান থেকে বোতাম টিপলে বোমা৷
তিন নম্বর ঘটনাটা ঘটেছিল উত্তর কলকাতায়৷ পাঁচমাথার মোড়ের কাছেই৷ ওখানে পাটকিলে একটা মায়ের চারটে বাচ্চা বেশ ভালোভাবেই বড় হচ্ছিল৷ দশদিনের পর যথারীতি চোখও ফুটেছিল৷ কলকাতায় তখন কলকাতার আন্দাজে বেশ শীত৷ কুকুরছানাগুলোর তখন তিন সপ্তাহ বয়স হয়েছে, অর্থাৎ তারা টলমল করে হাঁটতে পারে৷ একটু ডাকতেও পারে৷ খুব ভোর৷ একজনের ওপরে একজন চড়ে একটা জীবন্ত গরম পিরামিড বানিয়ে ওরা ঘুমোচ্ছিল৷ পাটকিলে তখন সেখানে ছিল না, যদিও একটু পরেই সে ফিরে আসে৷ ওদের
গায়ে এক বালতি ঠান্ডা জল ঢেলে দেওয়া হয়৷ ভিজে চুপসোনো বাচ্চাগুলো ঠক্-ঠক্ করে কাঁপে৷ কাঁউ কাঁউ করে সরু কান্না জানায়৷ কিন্তু পরে, রোদ ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল যে হিমঠান্ডা জলের সেই ধাক্কা তারা খুব একটা গায়ে মাখেনি৷ বরং এ-ওকে যথারীতি কামড়াচ্ছে, জড়াজড়ি করে খেলা করছে এবং মা এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুধ খাওয়ার জন্য৷ বালতির ঠান্ডা জলে কাজ হল না দেখে বেশ কিছুটা দূর থেকেই বাচ্চাগুলোকে লক্ষ করে একটা আধলা, কোণা-ভাঙা ইট ছোঁড়া হয়৷ ইটটা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়৷ পাটকিলে অনেক ইট-ছোঁড়া দেখলেও তার বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে এবারের এই এত বড়ো ইটটার উড়ে আসা এবং ফুট খানেক দূরে ফুটপাথে চিড় ধরিয়ে আছড়ে পড়ার মধ্যে সুস্পষ্ট একটা সংকেত, একটা ইঙ্গিত রয়েছে৷ যে-দিক থেকে আধলা ইটটা এসেছিল, সে-দিকে লক্ষ করে পাটকিলে কয়েকবার রাগী গলায় ডাকল৷ তারপরই কুঁই কুঁই শব্দ করতে করতে বাচ্চাগুলোকে শুঁকতে লাগল৷ কিন্তু পাটকিলে এখানে আর থাকেনি৷ চারটে বাচ্চা নিয়ে সে ওখান থেকে চলে যায়৷ বরাবরের জন্যে৷ কোথায় সেটা পরে জানা যাবে৷
আপাতদৃষ্টিতে এই তিনটি ঘটনার মধ্যে কোনো মিল কি ধরা পড়ে? নিশ্চয় পড়ে৷ এবং যোগসূত্রটা যে অশুভ সেটাও ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না৷ এরপরই শুরু হয়ে গেল কলকাতাকে কুকুর-শূন্য করার সর্বাত্মক অভিযান, কারণ নতুন সহস্রাব্দে নতুন সাজে যে মহানগরী মায়ারাক্ষসীর মতো সাজছে, সেখানে কুকুরদের কোনো জায়গা থাকতে পারে না৷ এটা যখন ঘোষিত নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং প্রয়োজনীয় অনুমোদন, সম্মতি ও শিলমোহর অর্জন করতে থাকে তখন এর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি শিবির সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছিল যদিও কোনো লাভ হয়নি৷ এক হচ্ছে, জীবদের প্রতি নির্মমতার বিরুদ্ধে যে সংগঠনগুলি সক্রিয় এবং দু-নম্বর হল, নানা দামের জলাতঙ্ক-প্রতিরোধক ওষুধ যে সব কোম্পানিগুলি বানায়৷ পৃথিবীতে এমন কোনো পরিকল্পনা হতে পারে না, তার মেয়াদ যাই হোক না কেন, যাতে সব পক্ষকে খুশি করে কাজে নামা যায়৷ এবং এই পরিকল্পনা কোনো ব্যক্তি বা দল বা দলের জোট যেই নিক না কেন কিছু এসে যায় না৷ প্রথমত, সবপক্ষের কথা শুনলে চলে না বা শোনা হয় না৷ দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনাটি চালু হবার পরে তার নিজস্ব ভরবেগে চলতে থাকে৷ এবং তৃতীয়ত, এ-রকমও হতে দেখা গেছে যে পরিকল্পনাটি লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো ছুটছে, সামনে যা কিছু পড়ছে তা হ্রেষায় ও উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে উড়িয়ে দিচ্ছে এবং পরিকল্পনা যারা করেছিল তারাই সেই ঘোড়ার ছুটন্ত পায়ের লাথিতে ছিটকে পড়ছে, নাল-বাঁধানো ক্ষুরে তাদের চশমা ও ক্যালকুলেটার চৌচির হয়ে যাচ্ছে এবং ধুলোর ঝড় উঠে দশদিক আড়াল করছে, যাকে আসন্ন সন্ধ্যা বলে ভুল করে পাখিরা বাসায় ফিরে আসছে৷ দিনকে রাত ও রাতকে দিন বানাবার এই ম্যাজিক, পরিকল্পনার আওতাতে পড়ে৷ নিছকই যা ম্যাজিক, ভেলকি বা ভোজবাজি, তার পেছনেও কিন্তু বজ্রকঠোর পরিকল্পনা থাকে৷ অপরিকল্পিত অলৌকিক বলে কিছুই সম্ভব নয়৷ এই নিয়ম মেনেই কুকুর-খেদা অভিযানে একাধিক পরিকল্পনা করা হয়েছিল৷
‘আমরা কি এই সত্যটি মানুষের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে পারি? কেন পারা যাবে না? মানুষ আর কুকুরের মধ্যে স্নায়বিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি যদি অভিন্ন হয়, তাহলে আমার মনে হয় না যে, মানুষের পক্ষে এটা অপমানজনক বলে মনে হবে৷ আজ জীববিদ্যায় আমরা যে শিক্ষালাভ করেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে কেউই এই তুলনা টানার বিরুদ্ধবাদী হতে পারে না৷’
‘ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ৷’
৩
‘বারবার থেমে, খুবই জঘন্য একটি গেরিলা পরিক্রমার পর, কাকভোরে আমরা একটা জঙ্গল পেলাম যার ধারেকাছেই কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিলো৷’
চে গুয়েভারা’র দিনলিপি, ৫ অক্টোবর, ১৯৬৭
কুকর খতম করার একাধিক পরিকল্পনা করার মধ্যে মধ্যে ছুটির দিন বা রবিবারের ফাঁক ছিল, যার মানে গাড়িঘোড়া কম৷ সে সময় কয়েকটি কুকুরকে খুবই ব্যস্তভাবে শহরের বিভিন্ন দিকে ধাবমান হতে দেখা যায়, যদিও সে গতি ঠিক স্বল্পপাল্লার দৌড়ের মতো ক্ষিপ্র ও ক্ষণস্থায়ী নয়, বরং দূরপাল্লার দৌড়বীরদের পদ্ধতিতে, কখনও কমিয়ে, আবার বাড়িয়ে … এবং সে সময় সেই কুকুরদের মুখমণ্ডলের কোনো উত্ফুল্লতা, চড়া মেজাজ বা বিষাদের লেশমাত্র দেখা যায়নি৷ তারা মোটের ওপর রাজপথ, থানা, স্কুল, রাজনৈতিক দলের দপ্তর, ক্লাব ইত্যাদি এড়িয়ে গলিপথ, ফাঁকা উঠোন, বস্তির মধ্যের অপ্রশস্ত রাস্তা, গাড়ির তৈলাক্ত স্বেদে ভেজা কালো মাটির চত্বর, জবাই করা মুরগির পালক ও পেঁয়াজের খোসা ছড়ানো ছেটানো বাজারখোলা, হাসপাতালের পেছন দিকের নোংরা রাস্তা যেখানে কাটা প্লাস্টার, রক্তমাখা তুলো ও বিবর্ণ ব্যান্ডেজের মধ্যে শিশুদের খেলার শব্দ ও বৃদ্ধবৃদ্ধাদের অপেক্ষা মিশে থাকে-এইসব এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল৷ এই প্রত্যেকটা জায়গাতেই সেখানকার কুকুরেরা নিজস্ব অধিকার কায়েম করে বাস করে৷ তাদের সঙ্গে এই গতিয়ান কুকুর-দূতদের চোখাচোখি বা কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা বিনিময় হয় অথচ কোনো কলহ হয়নি৷ কুকুরদের ক্ষেত্রে এ রকম সচরাচর হয় না৷ কোনো কুকুর-দলই তাদের এলাকা বা অঘোষিত সীমানার মধ্যে চেনা বা অচেনা কুকুরদের আগমন মেনে নেয় না৷ কুকুরেরা জেনে গিয়েছিল যে কলকাতা আর তাদের চায় না৷
পরিকল্পনা প্রস্তাব -১
কালক্ষেপ করা ঠিক হবে না৷ কুকুরদের গুলি করে মেরে ফেলা হোক৷
বিরুদ্ধে মত
সম্ভব নয়৷ বুলেটের দাম আছে৷ দ্বিতীয়ত, বন্দুকের শব্দ পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর৷ তৃতীয়ত, এ ধরনের অভিযান রাতেই চালানো সম্ভব, কিন্তু বন্দুকধারীরা তখন মদ্যপ অবস্থায় থাকে, ফলে গুলি অন্য কোথাও লাগতে পারে৷ চতুর্থত, আমাদের কুসংস্কারময় দেশে এ কাজ করতে অনেক বন্দুকধারী রাজি নাও হতে পারে৷
পরিকল্পনা প্রস্তাব -২
রাতের প্রথম প্রহরে বিষ মেশানো মাংস ছড়িয়ে দেওয়া হোক৷ পরে, ভোররাতে মনুষ্যেতর প্রাণীদের মৃতদেহ বহনকারী গাড়ি পাঠিয়ে, লোকজন জেগে ওঠার আগেই, লাশগুলো তুলে নিয়ে গেলেই হবে৷ বিষ যারা বানায়, তারা বিনা দামেই বিষ সরবরাহ করে পরিকল্পনাটির পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে এবং একইভাবে বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ ও কসাইখানা থেকে বাসি টোকো মাংস যোগাড় করা যায়৷ পচা মাছ হলেও চলবে৷
বিরুব্ধে মত
প্রস্তাবটি ভালো কিন্তু এর প্রধান বিপদ হল, ওই বিষাক্ত মাংস যে শুধু কুকুররাই খাবে এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না৷ উলটোপালটা কিছু ঘটে গেলে বিশ্বের সামনে কলকাতাকে হেয় হতে হবে এবং নিন্দুকেরা অনেক কিছু মুখোমুখি বা সোজাসাপটা বা কথায় কথায় বলার সুযোগ পেয়ে যাবে৷ আর একটি সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ বিনা পয়সায় পাওয়া বিষ যদি ভেজাল হয়, তাহলে উদ্দেশ্য তো চরিতার্থ হবেই না, উপরন্তু কুকুরেরা বাড়তি শক্তি পেয়ে যাবে৷
পরিকল্পনা প্রস্তাব -৩
কুকুর মারার ব্যাপারে আমরা যদি কোনো দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করি তাহলে আমাদের সম্মানহানির প্রশ্ন বোধহয় ওঠে না৷ যে দেশটাকে সবাই বিশ্ব-ফুটবলের একনম্বর দেশ বলে জানে সেই ব্রেজিলের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি পর্ব ব্রেজিলিয়ান মির্যাকল্’ (১৯৬৭-১৯৭৩) বলে পরিচিত৷ ওই সময় ব্রেজিলের বড়ো বড়ো গয়নার দোকানের মালিকেরা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর লোকদের দিয়ে একটি দল বানিয়েছিল, যাদের কাজ ছিল রাতের রাস্তায় ঘুমন্ত ভিখারি শিশু ও বালক-বালিকাদের গুলি করে মারা৷ এর পেছনে একটা গভীর ও সারবান যুক্তি ছিল৷ আজকে যারা ছোটো লুম্পেন তারাই কিন্তু কাল দামড়া হয়ে ডাকাবুকো গুন্ডায় পরিণত হবে এবং গয়নার দোকানে ডাকাতি করবে৷ ‘ব্রেজিলিয়ান মির্যাকল্’-এর বহু আগে, রাশিয়াতে বিপ্লবের পরেই, উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন যে, দুনিয়াভর বলশেভিক মুরগির বাচ্চাগুলোকে তাড়া করে বেড়ানোর চেয়ে বলশেভিক ডিমগুলোকে থেঁতলে দেওয়াই ভালো৷ মহাজন-প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে আমরাও ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারি৷ কুকুরের বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলতে গুলি বা বিষ, কোনো কিছুরই দরকার নেই৷ ঘাড় মুচড়ে বা আছড়ে বা পিটিয়ে বা জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলা খুবই সহজ৷ আরও সহজ হল বড়ো সাইজের পলিব্যাগের মধ্যে দলা পাকিয়ে অনেকগুলোকে ঢুকিয়ে মুখটা জবরদস্ত করে বেঁধে দেওয়া৷ ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা ও চিলি থেকে এ বিষয়ে প্রেরণা পাওয়া যায়৷ বড়োগুলোকে মারলে লাশগুলোর হিল্লে করা ঝামেলা৷ কিন্তু কিছুদিন পরপর বাচ্চাগুলোকে মারলে এরা আর সংখ্যায় বাড়বে না৷ আমরা এক্ষেত্রে বড়োগুলোকে প্রাপ্তবয়স্ক মশা ও বাচ্চাগুলোকে লার্ভার সঙ্গে তুলনা করতে পারি৷ সুচারুরূপে প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত করলে জানাজানি বা কেচ্ছার সুযোগও কম৷
বিরুদ্ধে মত
প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে ভাবনার খোরাক যোগায়৷ শুধু তাই নয়, বিংশ শতকের ইতিহাস থেকে যেভাবে এখানে সদর্থক শিক্ষা নেওয়া হয়েছে, তা চমকে দেওয়ার মতোই৷ এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমরা শুধু দিতেই জানি না, নিতেও জানি৷
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল বাচ্চাদের ওইভাবে মারার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হবে তারা দয়াপরবশ হয়ে কিছু বাচ্চাকে মারবে না৷ এর প্রমাণ আমাদের বিগত তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের ইতিহাসের মধ্যেই রয়েছে৷ বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই৷ তা ছাড়া বেড়ালের মতো গুপ্তচরসুলভ মেজাজের না হলেও কুকুররাও বাচ্চাদের লুকোতে জানে৷ আর একটা কথা সম্ভবত ভাবাই হয়নি৷ বাচ্চাদের চোখের সামনে যে ভাবেই হোক মারতে দেখলে তাদের মা-বাবারা চুপচাপ শুধু দেখে যাবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই৷ ওরা বিকট চিত্কার করতে পারে, অন্য কুকুরদের ডেকে জড়ো করতে পারে এবং এমনকী মরিয়া হয়ে আক্রমণও করতে পারে৷ এর ফলে শহরে শব্দ ও অন্যবিধ দূষণ বাড়বে এবং কুকুররা মারমুখী হয়ে উঠবে৷ সেই অবস্থা আমরা কীভাবে সামাল দেব? কুকুরের সঙ্গে লড়াই চালাতে শেষে কি প্যারামিলিটারি ফোর্স নামাতে হবে? ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের দরকার সুখী গৃহকোণ, অসুখী গৃহযুদ্ধ নয়৷ তাই গোড়াতে সাধুবাদ জানালেও শেষ-বিশ্লেষণে প্রস্তাবটি আমরা নাকচই করলাম৷ নাকচ করার আর একটি কারণ হল শিশু-কুকুর হত্যার ওপরে জোর দেওয়া৷ ব্যাপারটা কেমন লাগেই৷ কেমন কি না?
‘নৈষ্কর্মা সিদ্ধি’-তে আচার্য শ্রীসুরেশ্বর বলেছিলেন,
‘বুদ্ধাদ্বৈতসতত্ত্বস্য যথেষ্টাচরণং যদি৷
শুনাং তত্ত্বদৃশাং চৈব কো ভেদোহশুচিভক্ষণে৷’
(নৈঃ সিঃ, ৪/৬২)
-অদ্বৈততত্ত্ব সাক্ষাত্কারী পুরুষেরও যদি যথেষ্টাচরণ হয়, তবে অপবিত্র পদার্থভক্ষন বিষয়ে তত্ত্বজ্ঞানী ও কুকুরে কী প্রভেদ?
পরিকল্পনা প্রস্তাব – ৪
আমরা ঠিক ভোজসভা বা একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা অথবা সুন্দরীদের ফ্যাশন প্যারেডের আয়োজন নিয়ে বোধহয় আলোচনা করছি না৷ এখানে স্পষ্ট দুটি পক্ষ আছে৷ একটিতে রয়েছি আমরা৷ অন্যটিতে কলকাতার রাস্তার কুকুর বা নেড়িকুত্তা যাদের বলা হয়৷ এখানে ধানাই-পানাই, দীর্ঘসূত্রতা বা দয়া প্রদর্শনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷ সহজ কথাটা হল কুকুর ধরতে হবে৷ এবং ধরে আদরে রাখা নয়, মেরে ফেলতে হবে৷ এতেই কিন্তু হাত ধুয়ে ফেলা যাবে না৷ যেভাবে আমরা হাজারে হাজারে কুকুর মারার পরিকল্পনা করেছি তাতে মৃতদেহ একটি পাহাড়ে পরিণত হবে এবং সেই পাহাড় পচতে থাকবে৷ ভূমিকম্প হলে আমরা দেখেছি ইঁদুরদের গায়ে যে মাছি থাকে তারা ইদুর মরার ফলে মানুষকে কামড়াতে শুরু করে, যার পরিণতি হল প্লেগ৷ পচা কুকুর থেকে কী অসুখ ছড়াবে আমরা জানি না৷ এখনও মানুষ জানে না এমন কোনো মহামারীও শুরু হয়ে যেতে পারে৷ এইসব নানাদিক চিন্তাভাবনা করে আমাদের প্রস্তাব হল –
ক) যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নামতে হবে৷ কে কী বলল, কার চোখে কী লাগল, দুনিয়া কী ভাববে এসব ছেঁদো ব্যাপার নিয়ে, ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না৷ দয়ামায়া দেখাবার অনেক জায়গা আছে – অনাথআশ্রম আছে, প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয় আছে, যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সমস্যা আছে – সেখানে গিয়ে ওসব দেখান৷ কুকুরদের ক্ষেত্রে ওসব ছিঁচকাঁদুনে মনোভাব দেখানোর কোনো অর্থই হয় না৷
খ) আমরা দেখেছি যে সাঁড়াশি দিয়ে কুকুর ধরার একটা চলনসই ব্যবস্থা চালু রয়েছে৷ নির্দিষ্ট এক একটি এলাকা অতর্কিতে ঘেরাও করে চিরুনি অভিযান চালাতে হবে৷
গ) কুকুরগুলোকে ধরে আনা ও মেরে ফেলার মধ্যে ব্যবধান বেশি হলে চলবে না৷ এর জন্যে আমরা গ্যাস-ভ্যান ব্যবহার করতে পারি, যেখানে সরাসরি ইঞ্জিন থেকে কার্বন-মনোক্সাইড গ্যাস ওই ভ্যানে দেওয়া যায়৷ কিন্তু আমরা জানি যে কার্বন-মনোক্সাইডে মানুষ হলে মরতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগে৷ অথচ গত শতাব্দীর ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে খুবই উদঞ্জবায়ী হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস এই সময়টাকে পনেরো মিনিটে নামিয়ে আনতে পারে৷ এটাও অবশ্য মানুষেরই হিসেবে৷
ঘ) এবার আমাদের শেষ কাজ৷ মৃতদেহের গতি৷ এর জন্য আমরা জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটি বিদ্যুৎ-চুল্লি তৈরি করতে পারি যেগুলো পরে অন্য কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে৷ দেখা যাচ্ছে যে তৃতীয় ধাপটি শেষ হওয়ার পরে সেবারের মতো আমাদেরও কাজ শেষ৷ এবং শেষ কুকুরদের দলটি এই তিন ধাপ পদ্ধতি অতিক্রম করলেই আমাদের কাজ একেবারেই সমাপ্ত ও সম্পূর্ণ হবে৷
বিরুদ্ধে মত
এটা আমরা করতে পারি না৷ কারণ পুরো মডেলটাই হচ্ছে নাত্সি মৃত্যু-শিবিরের যা আমাদের দুর্নাম ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না৷ পরিকল্পনাটি ভেবেচিন্তেই করা এবং কার্যকর নয় এমনও বলা যায় না৷ বোঝাই যায় যে নাত্সি-পর্বে মৃত্যু-শিবিরের খুঁটিনাটি ভালোভাবেই বিচার করা হয়েছে এবং ত্রেবলিনকা, সবিবর, বেলজেক, অসউইত্জ-১ বা সেন্ট্রাল এবং অসউইত্জ-২ অর্থাৎ বিরকেনাউ-এর ঢঙে কুকুর মারা ও পুড়িয়ে ফেলার ছকটি করা হয়েছে৷ প্রস্তাবটি লোভনীয় হলেও গ্রহণযোগ্য নয় এবং এই প্রসঙ্গে প্রস্তাবকারীদের আমরা জানাচ্ছি যে নাত্সিদের মতো পরিকল্পনা-মনস্করাও কিন্তু আগেভাগে সবটা বুঝতে পারেনি৷ একটি উদাহরণই যথেষ্ট৷ অসউইত্জ (বিরকেনাউ)-এ চারটে মড়া পোড়াবার চুল্লি ছিল যেগুলো বানিয়েছিল এরফুর্তের জে.এ.টফ্ অ্যান্ড সন্স্৷ এর মধ্যে বড়ো দুটি চুল্লি প্রতি ২৪ ঘন্টায় ৬৫০০ মড়া পোড়াতে পারত৷ ওই দুটি চুল্লি ১৮ মাস একনাগাড়ে চলেছিল অর্থাৎ ১৮,০০,০০০ মড়া পুড়েছিল৷ এটা পুরো হিসেব নয়৷ পুরো হিসেব হল ৪ মিলিয়ান বা ৪০,০০,০০০৷ যাইহোক এত বড়ো ব্যবস্থার মধ্যেও অ্যাডলফ্ আইসম্যান যখন ৪,০০,০০০ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদিকে হত্যা করে তখন চুল্লিগুলো সামাল দিতে পারেনি৷ চুল্লির ইটে ফাটল ধরতে শুরু করে৷ তখন বিশেষ দহনখাদ খোঁড়া হয় যেখানে কংক্রিটের নর্দমা দিয়ে মানুষের চর্বি বয়ে যেত এবং সেই চর্বি জ্বলন্ত মৃতদেহের ওপরে বেলচা দিয়ে তুলে ঢেলে দেওয়া হত৷ এ কাজ করত বন্দিরাই৷ অতএব দেখা যাচ্ছে যে, সব পরিকল্পনার মধ্যেই অভাবনীয় নানা গলদ থেকে যায়৷ প্রস্তাবটি আমরা খারিজ করলেও এটি সংরক্ষণযোগ্য৷
বিরুদ্ধে মত (সংযোজনের জন্য)
প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে তরুণদের চিন্তা ভাবনা আমাদের ফেলনা মনে করা উচিত হবে না৷ উপরোক্ত প্রস্তাব-বিরোধী বক্তব্যের সঙ্গে মোটের ওপর একমত হয়েও জানাচ্ছি যে, মাত্র ২৯ বছর বয়সি এস. এস. অফিসার অটো মল অশউইত্জ-এ দহন খাদের নকশা করেছিল৷ নর্দমা দিয়ে যখন মানুষের ফুটন্ত চর্বি বয়ে যেত তখন অটো মল তার মধ্যে বাচ্চাদের ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলত৷ প্রস্তাবটি অবশ্যই সংরক্ষণযোগ্য এবং গোপন রাখলেই ভালো হয়৷
পরিকল্পনা প্রস্তাব -৫
অনেকগুলো প্রস্তাব এসেছে৷ কোথাও বিজ্ঞানেরও কৃৎকৌশলের জয়জয়কার৷ কোথাও একপেশে সামরিক মনোভাব৷ কোথাও ভ্রষ্ট শতাব্দীর ইতিহাসের যান্ত্রিক প্রভাব৷ আমাদের বক্তব্য হল নিজেদের ক্ষমতা বিচার করে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ উদ্ভট খরচ যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে৷ সাপও (অর্থাৎ কুকুরও) মরে, লাঠিও না ভাঙে সেটা দেখতে হবে৷
ক) সাঁড়াশি দিয়েই কুকুর ধরা হোক৷ কারণ এর কিছু ব্যবস্থা ও অভিজ্ঞ কর্মী অন্তত আমাদের হাতে আছে৷
খ) কুকুর মারার জন্যে এক নয়া পয়সাও খরচ হবে না৷ ব্রিটিশ শাসকরা যে পিঁজরাপোলগুলো বানিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে কুকুরদের ছেড়ে দিলেই চলবে৷ খাবার বা জল কিছু দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷ শুকিয়ে কয়েকদিনেই মরে যাবে৷ এবং এভাবে মরলে মৃতদেহে স্নেহপদার্থ ও জলের ভাগ যথেষ্ট হ্রাস পাবে৷ পচে গেলেও ভয়ানক কিছু হবে না৷ শকুন, চিল, কাক এরা আছে৷ অতএব কঙ্কালে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না৷ এর চেয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থার কথা বর্তমানে আমরা কী ভাবতে পারি?
প্রস্তাবের পক্ষে মত
এর চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থার কথা এই মুহূর্তে আমরা ভাবতে পারি না৷ পয়সা গাছে ফলে না৷ দেশের হালও বেহাল৷ এখন যদি কলকাতা অলিম্পিক বা বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করতে চায়, সেটা যেমন সম্ভব নয়, তেমনই সম্ভব নয় কুকুর মারার জন্যে এমন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা যা আমাদের সাধ্যাতীত৷ তাই সবকিছু বিচার করে আমরা ‘পরিকল্পনা প্রস্তাব-৫’ সুপারিশ করছি৷ এরপর প্রয়োজনীয় অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি ওপর-মহলে পাঠানো হবে৷ ওপর-মহলে আবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা চূড়ান্ত সম্মতির জন্য পাঠাবেন…
আগেই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে পাড়ি দেওয়া কুকুরদের কথা বলা হয়েছে৷ রাস্তার শানের ওপরে, বাঁধানো জায়গার ওপরে তাদের চারটে থাবা যখন ছন্দ মিলিয়ে পড়ে তখন নখের সামান্য শব্দ হয়৷ মধ্যে থেমে থেমে একটু জিরিয়ে নিতে হয়৷ জল খেতে হয়৷ ফের ছুটতে হয় খবর নিয়ে৷ নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে৷ মাঝপথে যে কুকুররা খবর পায় তারাও সবাই চুপ করে বসে থাকে না৷
কুকুর কীভাবে তার অভীষ্ট খুঁজে বের করে তা নিয়ে অনেক সত্যি ঘটনা আছে যার মধ্যে জাদুর ছোঁয়া রয়েছে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে গ্রেট ব্রিটেনের ফার্স্ট নর্থ স্ট্যাফোর্ডশায়ার রেজিমেন্টের সৈন্য জেমস ব্রাউন যুদ্ধ করতে ফ্রান্সে গিয়েছিল৷ ১৯১৪ সালের আগস্টে৷ ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রাউনের স্ত্রী তাঁকে চিঠিতে এই দুঃসংবাদ দেয় যে, তার প্রিয় আইরিশ টেরিয়ার ‘প্রিন্স’-কে পাওয়া যাচ্ছে না৷ ব্রাউন তাঁর স্ত্রীকে জবাবে লেখে, ‘দুঃখের ব্যাপার যে তুমি প্রিন্স-কে খুঁজে পাওনি৷ পাওয়ার কথাও নয়৷ কারণ সে আমার কাছেই রয়েছে৷’ এর মানে প্রিন্স ইংল্যান্ডের দক্ষিণেই ২০০ মাইল পথ পেরোয়৷ ইংলিশ চ্যানেল কোনোভাবে অতিক্রম করে৷ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ফ্রান্সের ৬০ মাইল পেরিয়ে আর্মেন্তেয়ের-এ একটি ট্রেঞ্চে তার প্রভুকে খুঁজে বের করে৷
৪
অলৌকিক ভিক্ষাপাত্রের মতো চাঁদ
দাঁতে কামড়ে ছুটে যাচ্ছে রাতের কুকুর
কান গজিয়ে ওঠার পরে কান-গজানো পুরনো থাকার জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় নোংরা ফেলার বড়ো ভ্যাট-এর আশপাশটা বেছে নিয়েছিল৷ কয়েকদিনের নোংরা জমে ওঠার পরে এখানে বড়ো বড়ো লরি আসে৷ তাতে করে নোংরা ধাপায় চলে যায়৷ জায়গাটা নোংরা বলে বেড়াল, কুকুর ও কাক বাদে খুব একটা কেউ আসে না৷ তবে ডানদিকে হাত বিশেক দূরে একটা ভাঙাচোরা বাতিল পেচ্ছাপখানা আছে যাকে ঘিরে এমন লতা আর কাঁটাগাছের জঙ্গল যে কেউ যেতে পারে না৷ ওই ভাঙা পেচ্ছাপখানার ছাতে অনেকদিন আগে একটা পাগল সাইকেল রিক্সার পর্দার ছেঁড়া পলিথিনে জড়ানো বালিশ রেখে গিয়েছিল৷ কিন্তু আর নিতে আসেনি৷ কোনো কিছুই ফেলা যায় না, কোনো না কোনো কাজে লেগে যায়৷ বাতাসে পলিথিনটা উড়ে গেছে৷ বালিশটা বৃষ্টিতে ভেজে, আবার রোদে শুকিয়েও যায়৷ শুকনো থাকলে ওই বালিশের ওপরে নিরীহ একটা বেড়াল ঘুমোয়৷ কান-গজানোর সঙ্গে তার বিশেষ সদ্ভাব না থাকলেও ঝগড়া অন্তত নেই৷ এক ধরনের মায়াবী শেষ দুপুর আছে যখন নিরীহ বেড়ালেরা ঘুমোয়৷ ঘুম থেকে উঠে বেড়ালটা দুই থাবা ঝুলিয়ে নীচে কী হচ্ছে তা নির্লিপ্তভাবে দেখে৷ সে দেখতে পায় কান-গজানো হয় নোংরা ঘাঁটছে বা কিছু একটা তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে৷ এখানে অন্য কুকুররাও আসে, তবে সবই ধারে-কাছের৷ তারা আসে, আবার চলেও যায়৷ শুধু কান-গজানো এখানে থেকে যায়, কারণ সে অ্যাসিডে কান গলে যাওয়ার ব্যাপারটা ভোলেনি৷ বরং কোথাও আয়নার মতো জল-টল জমলে বা ঝকমকে গাড়ির গায়ে সে পরে-গজানো কানটা মাঝে মাঝে দেখে নেয়৷ একদিন বিকেলে কাছাকাছি টহলদারি করে ফিরে কান-গজানো দেখতে পেল যে ফেলে যাওয়া একটা থার্মোকলের বাক্সের ওপরে তারই মতো কালো কিন্তু থাবায় নয়, বুকের ওপরে সাদা নদী, একটা কান-ঝোলা বিলিতি কুকুর বসে আছে৷ ওকে দেখেই কান-গজানো দাঁত অল্প খিঁচিয়েছিল, কিন্তু ও বিশেষ পাত্তা দিল না৷ এই কুকুরটা একে তো নেড়ি নয়, তার ওপরে আশপাশের কোনো বাড়িরও নয়৷ হলে কান-গজানো ঠিক জানতে পারত৷ কান-গজানো তাকে বলল,
– তুই কে?
– যেই হই তোর মতো নেড়ি নই৷ আর কথা নেই বার্তা নেই, শুরুতেই তুই তোকারি৷ জংলি কি আর এমনি বলে!
– ঠিক আছে, ঠিক আছে, এটা আমার জায়গা৷ এখানে আস্তানা গাড়া আমি বরদাস্ত করব না৷
– কী করবি? কামড়াবি? ভয় দেখাবি?
– না৷
– তাহলে কী করবি?
– আমাকে কিছুই করতে হবে না৷ তুই যাদের পোষা তারা ঠিক তোকে ধরে নিয়ে যাবে৷ ঘেঁটি ধরে৷
– তারাই বড়ো গাড়ি করে ঘুরে ঘুরে আমাকে দিক ভুলিয়ে ছেড়ে দিয়ে গেল, খুঁজে নিয়ে যেতে তাদের ভারি বয়েই গেছে৷
-মানে?
– মানেটা বোঝার বুদ্ধি তোর আছে? বুড়ো হয়ে গেছি৷ আগের মতো টরটরে নেই৷ কারণে-অকারণে ঘুম পায়৷ তাই আর রাখবে না৷ ইচ্ছে হলে আমি নিজেই তো ফিরে যেতে পারতাম৷
– বুঝলাম, কিন্তু এত বড়ো কলকাতাটা থাকতে তুই মরতে আমার এই জায়গাটায় এলি কেন?
– কেন এলাম সেটা তুই তো বুঝবি৷ এ তল্লাটটা এখনও একটু ফাঁকা ফাঁকা৷ এখনই ওদের নজর এদিকে পড়বে না৷ অবশ্য বলা যায় না –
-কাদের?
-কলকাতায় কুকুর ধরা চলছে৷ জানিস না?
ভাঙা পেচ্ছাপখানার ছাদ থেকে বেড়ালটা বলল, – বেড়ালদেরও ধরছে নাকি?
-এখনও ধরছে না৷ তবে কুকুরদের পরে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ালদের দিকে নজর পড়বে৷ কথাতেই বলে কুকুর-বেড়াল৷
-আমার নাম কান-গজানো৷
-কান-গজানো? ঠিক আছে৷
-তোর নাম?
-আমার নাম জিপসি৷
-কী করছে ওরা কুকুরদের ধরে?
-পিঁজরাপোলে নিয়ে যাচ্ছে৷
-তারপর?
-তারপর আবার কী? না-খাইয়ে শুকিয়ে মারছে৷ উত্তরের দিকে অনেক কুকুর ধরা পড়েছে৷ আমি তো সেখান থেকেই আসছি৷ তবে কাকেরা যে উড়ো খবর ছড়াচ্ছে তা মোটেই ভালো নয়৷
-যেমন?
-বলছে পুরনো, জং-ধরা কুকুর-ধরবার গাড়িগুলোকে আবার নাকি রংচং করে, ঝালাই মেরে ফের রেডি করছে৷ গণ্ডায় গণ্ডায় কুকুর ধরার সাঁড়াশি অকেজো অবস্থায় ডাঁই করে রাখা ছিল৷ সেগুলোকে ঝেড়েমুছে ফের তেল-টেল দিয়ে নতুনের মতো করে ফেলা হচ্ছে৷
-কিন্তু উত্তর থেকে তুমি পালিয়ে কোথায় গেলে?
-আড়াআড়ি এলে চৌরঙ্গি পড়বে৷ আমি শেয়ালদা দিয়ে রেললাইন ধরে ফেলি৷ রেললাইনের পাথরে পা কেটে গেছে৷ একটু পর পর বড়ো বড়ো রেলগাড়ি যাচ্ছে৷ কিন্তু থামিনি৷ আর এই আমায় দেখছিস তো৷ এরপর দেখবি আরও আসছে৷
-এটাও কি কাকরা জানিয়েছে?
-না৷ এটা নিজের চোখে দেখা৷ কানে শোনা৷ এখান থেকে মিনিট কুড়ি দৌড়লে একটা বাজার আছে না?
-হ্যাঁ৷ ওখানে মাছের কাঁটা আছে৷
-তা থাকতে পারে৷ ওখানে বাজারের বাইরে তিন-চারটে বড়ো বড়ো চা-বিস্কুটের দোকান আছে?
-আছে৷
-ওখানে তিনটে কুকুর বলাবলি করছিল যে, এবারে এদিকটায় সরে আসবে৷ তবে দল বেঁধে নয়৷ একজন একজন করে৷ তাহলে নজরে পড়বে না৷
-এরকম কি আগে কখনও হয়েছে?
-হয়েছে কিন্তু এই মাপে নয়৷ গরমকালে কুকুররা একটু তিরিক্ষে হয়ে থাকে৷ খ্যাঁকখ্যাঁকে৷ তখন দু-চারটেকে ধরত৷ এবার কোনো বাছাবাছির বালাই নেই৷ কুকুর হলেই হল৷ পেলেই ক্যাঁক্৷
-উঃ, সাঁড়াশি? ঘাড় আর গলাটা কেমন শিরশির করে উঠল৷
-শুধু কি তাই? সাঁড়াশি দিয়ে ধরে হিঁচড়ে হিঁচড়ে খাঁচার গাড়ির কাছে নিয়ে যাবে৷ তারপর ছুঁড়ে গাড়ির ভেতরে৷ এরকম করে করে গাড়িতে যখন আর কুকুর তোলা যাবে না তখন পিঁজরাপোল৷
ওদের এই কথাবার্তার মধ্যে একটা দমকা হাওয়া এল যাকে আর-একটু রাগিয়ে দিলে ছোটোখাটো একটা ঝড় বলা যেতে পারে৷ ওরা ওপরদিকে তাকাল৷
বেড়ালটা বলল,
-কী হচ্ছে৷ কিছু বুঝলে?
-ঝোড়ো বাতাস বইছে৷
-ঘেঁচু বইছে৷ বিশতলা, তিরিশতলা ওপর দিয়ে ছায়া-কুকুরেরা দৌড়চ্ছে৷ কেন দৌড়চ্ছে বলতে পারব না৷ তবে জন্ম থেকে শুনে আসছি এরকম হওয়া ভালো নয়৷
-আমরা তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না৷
-পাবে৷ চেষ্টা করো, পাবে৷ দেখতে ভুলে গেছ তাই৷ ফের মনে পড়ে যাবে৷
ছায়া-কুকুরেরা কবে মরে গেছে কেউ বলতে পারে না৷ কালান্তক সময় এলে তারা মেঘের আড়াল ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷ সরাইল হাউন্ডের মতো ক্ষিপ্রতায় লাফ দিয়ে ছুটতে থাকে৷ তাদের থাবার আঘাতে থরথর করে কাঁপে ছায়া-শহর, ছায়া-অট্টালিকা ও ছায়া-রাজপথ৷ সামনের দুটো পা একসঙ্গে ছোঁ মেরে নেমে আসে মারাত্মক ঢেউ-এর মতো, জ্বলন্ত ফেনায় বুদবুদ ও তরল আগুন ঝলকে ওঠে, তখন পেছনের দুটি পা ছায়া-মরুতে ধাক্কা দিয়ে বালি ওড়ায়৷ তাদের ডাক বড়োই গম্ভীর৷ ক্কচিত্কখনও যুদ্ধবিমানের চালকেরা দেখেছে যে তাদের ম্যাক-২ বা অধিকতর শক্তিধর বিমানকে হেলায় পেছনে ফেলে আকাশ বেড় দিয়ে ছুটে চলেছে ছায়া-কুকুরের দল৷ কেউ কেউ বলে মারণ-জ্যোত্স্নায় ছায়া-কুকুরেরা চান্দ্র শশক শিকার করতে বেরোয়৷ তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে৷ যদিও কেউই ছায়া-কুকুরদের অন্তরীক্ষ অতিক্রমণকে তুচ্ছ বলে মনে করেন না৷ ছায়া-কুকুরদের দলপতি হল একটি শুভ্র পবিত্র কুকুর৷ তার নাম হল লাইকা৷ কুকুর-উপকথা ‘লুব্ধক’ চারপায়ে নতজানু হয়ে লাইকাকে প্রণাম জানাচ্ছে৷
হাওয়ার ঝাপটাটা কেটে যেতে কান-গজানো বলল,
-তাহলে একটা কিছু হবেই, বলছ?
-সে তো বটেই৷ হবে না, হচ্ছে৷
-রাতে কি ধরতে আসতে পারে?
-এখনও অতটা বুদ্ধি ওদের হয়নি৷ তার ওপরে ভয়ও আছে৷ সব কুকুর তো আর সাঁড়াশির হাঁ-তে গলা এগিয়ে দেবে না৷ লড়ে যাবে৷
-তা তো বটেই৷ যাইহোক, তুমি এলে বলে খোঁজখবর সব পাওয়া গেল৷ একটেরে হয়ে থাকি৷ কারও সঙ্গে মিশি না৷ ওই বেড়ালটাই যা দু-একটা খবর-টবর এনে দেয়৷ দিন পাঁচেক আগে এসে বলল ও নাকি একটা মরা বাদুড় দেখেছে৷
-তো?
-বাদুড়ের মুখটা নাকি অনেকটা কুকুরের মতো৷ এ বিষয়ে তোমার কোনো ধারণা আছে৷
-না৷ আমি বাদুড়দের উড়তে দেখেছি৷ বাদুড়বাগান বলে একটা জায়গা আছে, জানো?
-সেখানে কি শুধু বাদুড়রাই থাকে?
-দূর! আদ্যিকালে হয়তো থাকত৷ এখন চামচিকেও থাকে কিনা সন্দেহ৷ ঘুম পেয়ে যাচ্ছে৷
-ঘুমোবে৷ কিন্তু তার আগে একটা কথা বলতে পারো?
-কী?
-দিনের বেলায় যদি আমাদের ধরতে আসে তাহলে আমরা কী করব?
জিপসি কিছু বলার আগেই বেড়ালটা বলল,
-আমি বলব?
-বলো৷
-এই ভাঙা পেচ্ছাপখানাটার দেওয়ালের পেছনে একটা ফাঁক আছে৷ বেশ বড়ো৷ ঝোপঝাড় হয়ে গেছে বলে বোঝা যায় না৷ ওখানে ঢুকতে পারো৷ কেউ খুঁজে পাবে না৷
কান-গজানো বলল,
-সে হয়তো যাওয়া যায়৷ কিন্তু ওখানে বোলতার চাক আছে৷
-আছে না, ছিল৷ বোলতারা কবে চলে গেছে৷ এখন শুধু চাকটাই আছে৷
-তাহলে তো চুকেই গেল হ্যাপা৷
এই বলে কান-গজানো জিপসির দিকে তাকিয়ে দেখল জিপসি ঘুমিয়ে পড়েছে৷ আর শুধু তাই নয়, স্বপ্নও দেখছে৷ কারণ শরীরটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে৷ সামনের থাবাদুটোও কখনও কখনও নড়ছে৷ জিপসির ঘুমোনো দেখে কান-গজানো ভাবল একটু গড়িয়ে নিলে মন্দ হয় না৷
নাহি মার কুক্কুরেরে, শুন দ্বিজবর৷
শুনিয়া বিপ্রের ক্রোধ বাড়িল বিস্তর৷৷
হাতে দণ্ড ধরি বলে নৃপতির প্রতি৷
মোর হাতে কুক্কুরের নাহি অব্যাহতি৷৷
পুণ্যহীন কুক্কুরের নাহি পরিত্রাণ৷
পুণ্য-বিনা স্বর্গে বাস নহে মতিমান্৷৷
৩ নম্বর পিঁজরাপোলে তখন একটা তাণ্ডব চলছিল৷ কুকুরদের কাঁই কাঁই বা ঘ্যাঁকাও করে চিত্কার, প্রতিবাদী শুকনো ঘেউ, চাপা রাগে গর্ গর্ করা-সব মিলেমিশে এক মহা-ঐকতান৷ এরই মধ্যে কামড়া কামড়ি, জায়গা নিয়ে দখলে রাখার চেষ্টা, দেহ শুকিয়ে আসায় প্রাণপণ তেষ্টা ও পায়ের তলায় বালি মেশানো কাঁকর-মাটি যা তখনও ঠান্ডা হয়নি এবং এখানে ওখানে মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে পাঁজর, করোটি, শুকনো ক্ষুর বা শিং৷ গতকাল যাদের আনা হয়েছিল তারা সারাদিন রোদে তেতে নিভে এসেছে, কেউ তলিয়ে গেছে আচ্ছন্নতায় যা অবধারিত প্রক্রিয়াতে অন্তিম প্রচ্ছায়ায় প্রবেশ করবে বা কেউ নির্বাক, শান্ত, কানও নড়ছে না যার অর্থ হল সে অসহায়তার শিক্ষা নিতে পেরেছে৷ মুখে-নাকে বালি ঢুকে গেছে কারও৷ এদের মধ্যে একটি কুকুর ট্যাক্সি চাপা পড়ে বহুদিন ধরে পঙ্গু৷ পেছনের পা দুটো অকেজো৷ সামনের দুই থাবায় ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলে৷ রয়েছে বৃদ্ধ কুকুরেরা যারা বহু যুদ্ধ ও সন্ধির সাক্ষী৷ সারা গায়ে প্রাচীন ক্ষতচিহ্ন৷ যেভাবে থেবড়ে মাটিতে পড়ে আছে তারা, দেখলে মনে হবে মৃতপ্রায় কুমির বা নিথর ডাইনোসর যুগের মথ৷ সারাদিন ধরে কুঁই কুঁই করে ধুঁকতে ধুঁকতে শিশুরা মরেছে৷ মা তাদের শুষ্ক জিভ দিয়ে চেটে চেটে আর্দ্রতা দিতে চেষ্টা করেছে৷ অসহায়তায় এলোমেলো ছোটাছুটি করেছে৷ মৃত্যুর পরেও মৃত শিশুরা দেয়ালা করছে ভেবে মায়াতাড়িত হয়েছে৷ কিন্তু এই মায়াই হল মৃত্যুর প্রথম সোপান৷ ওই তো নিঃশ্বাস নিচ্ছে৷ ওই তো ওঠানামা করছে ছোট্ট বুক৷ এই তো শোনা যাচ্ছে সেই হৃদস্পন্দন যা জরায়ুর মধ্যে প্রথম ক্ষীণ কম্পন হয়ে দেখা দিয়েছিল৷
এই মৃত, মৃতপ্রায় ও অর্ধমৃতদের চেয়ে আজ যারা এসেছে তারা স্বাভাবিক কারণেই অধিকতর সজীব ও সরব৷ কিন্তু মৃতের সঙ্গে থাকলে মৃত্যুর চৌম্বকক্ষেত্রের চোরা ঠান্ডা টান না চাইলেও অনুভব করতে হয় ও স্নায়ুতে স্নায়ুতে ধীর লয়ে অবশ সঙ্গীতের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে আত্মসমর্পণ৷
ছায়া-কুকুরদের দৌড়ের সময় এখানেও বালি ও কাঁকুরে-মাটির ওপরে এক ধুলোর আঁধি উঠেছিল, কিস্তু তা থিতিয়ে গেছে মৃত কুকুর-শিশুদের নরম লোমে ঢাকা শরীরের ওপর৷ এই ধুলোর চাদর হল ঢাকা পড়ে যাওয়ার, গভীরে চলে যাওয়ার এক আয়োজন৷ ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে এভাবেই ডাইনোসরদের ওপরে ধুলো জমতে শুরু করেছিল যার মধ্যে ছিল ইরিডিয়াম৷ এই ইরিডিয়াম এসেছিল মহাকাশ থেকে প্রেরিত উল্কাপিণ্ডের শরীরে মিশে৷ কে পাঠিয়েছিল এই মহাসংহারের অস্ত্র? এর আগেও বারবার পৃথিবী থেকে প্রাণ মুছে গেছে প্রলয়ের স্পর্শে৷ ৪৫০, ৩৫০, ২২৫, ও ১৯০ মিলিয়ন বছর আগেও এই অভিশাপ এসেছিল৷ কেন? কী হেতু এই মরণোত্সবের? সপ্তর্ষিমণ্ডলের প্রশ্নচিহ্নে সমাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে সার্কাসের এরিনার মতো গোল পিঁজরাপোলের জমিতে দাঁড়িয়ে দেখা কলকাতার আকাশ৷
মস্ত বড়ো টাটা সুমোটা এসে দাঁড়াতে প্রায় একই সঙ্গে কান-গজানো আর জিপসির ঘুম ভেঙে গেল৷ গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার পেচ্ছাপ করতে নামল৷ গাড়ির মধ্যে এফ-এম রেডিয়োতে খবর হচ্ছে-
‘আজ চারশো আটচল্লিশটা কুকুর ধরা পড়েছে৷ এই নিয়ে মোট প্রায় সাড়ে সাতশো কুকুর ধরা সম্ভব হয়েছে৷ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র জানান যে আকড়া ফটকের কাছে কিছু দুষ্কৃতি কুকুর ধরার কাজে বাধা দেয় ও যথেচ্ছ ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে৷ অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য এলাকায় পুলিশ নামানো হয় ও বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতি কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তিনি আরও জানান যে, আগামীকাল থেকে সশস্ত্র পুলিশ ও র্যাফ কুকুর ধরার সময়ে হাজির থেকে শান্তি রক্ষা করবে৷ আরও স্থির করা হয়েছে যে, শিশুরা যে-সময়টা স্কুলে থাকে সেই সময়ে কুকুর ধরার অভিযান জোরদার করা হবে৷ এ ব্যাপারে শিশু-মনস্তত্ত্ববিদদের বক্তব্য সরকার মেনে নিয়েছেন যে, চোখের সামনে সাঁড়াশি দিয়ে কুকুর ধরা দেখলে শিশুদের কোমল মনে বিরূপ প্রতিক্রয়ার সৃষ্টি হতে পারে৷ আপনারা কলকাতা বেতারকেন্দ্রের এফ এম চ্যানেলে সংবাদ শুনছেন৷’
‘প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে একটি অজানা বিদেশি বিমান আজ ভারতের সীমানা লঙ্ঘন করলে ভারতীয় জঙ্গিবিমান ওই বিদেশি বিমানটিকে ধাওয়া করে…’
টাটা সুমোটা চলে যাওয়ার পরে কান-গজানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-আমাদের কি কিছুই করার নেই? এইভাবে মরতে হবে?
-ভাগ্যে থাকলে মরতে হবে৷ কী করা যাবে৷ সাড়ে সাতশোর দলটা তো আরও বাড়বে৷ অনেক বাড়বে৷ ভাগ্যে যদি পিঁজারাপোলে গিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরাই লেখা থাকে তো তাই হবে৷ আমরা পারব ঠেকাতে? নিয়তি কেউ ঠেকাতে পারে না৷ কুকুর না, মানুষ না, কেউ না৷
-তুমি ভাগ্য মানো?
-না মেনে উপায়? ছোটোবেলায় তিন সপ্তাহ বয়সে কালো-ভাই আর আমি বিক্রি হয়েছিলাম হাতিবাগানে৷ সেখান থেকে ট্যাক্সি করে বউবাজারে এলাম৷ আমার জন্যে ডাক্তার আসত৷ একবার পড়ে গিয়েছিলাম৷ নড়তে পারতাম না৷ তখন বেলগাছিয়ার জন্তুদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল৷ রোজ দুধ খেতাম, মাংসের ছাঁট খেতাম৷ চকোলেট, আইসক্রিম – কী না খেয়েছি? আর আজ! নোংরার গাদায় বসে বেড়ালের লেকচার শুনতে হচ্ছে৷ এর পরেও বলতে হবে ভাগ্য মানি না?
বলাই বাহুল্য, বেড়ালটা রেগে গিয়েছিল৷ অন্ধকারে চোখ চকমকি পাথরের মতো জ্বেলে সে বলল,
-ভালো ভেবে লুকোবার জায়গাটা বলে দিলাম৷ শুনি কুকুররা কৃতজ্ঞতা জানে আর বেড়ালরা অকৃতজ্ঞের হদ্দ৷ এখন বোঝাই যাচ্ছে কোনঞ্জটা কী৷
-আরে বাবা, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে৷ নিছকই কথার কথা৷ আমি অন্য বেড়ালদের কথা বলছিলাম৷ তুমিই কি একলা বেড়াল নাকি? কত বলে বেড়াল রয়েছে৷
-সে থাকুগগে৷ এখানে বেড়াল বলতে আমিই৷ কাজেই বেড়ালের নামে কিছু বললে আমার গায়েই লাগার কথা৷
-আরে বাবা, মাফ চাইছি৷ হয়েছে? চালচুলো কিছু নেই৷ কী বলতে কী বলে ফেলি৷ অত ধরলে চলে?
এই মৃদু ঝগড়াটা দুম্ করে থেমে গেল, কারণ প্রচণ্ড জোরে কিছুটা দূরে একটা বোমা ফাটল আর ঝলকে অন্ধকারটা এক লহমার জন্যে চমকে উঠল, যেন কারও ফোটো তোলা হল৷ বোমার আওয়াজটা মিলিয়ে যেতে না যেতে কয়েকটা হালকা শব্দ৷ গুলির৷ বেড়ালটা বলল,
-লেগে গেল৷
-কার সঙ্গে কার?
-অত জানলে আর বেড়াল হয়ে জন্মাতে হত না৷
কান-গজানো হঠাৎ বলে উঠল,
-না৷ একটা খবর আসবে৷
-কী খবর?
-একটা খবর৷ আমাদের খবর৷ কুকুরদের খবর৷ আমার মন বলছে একটা খবর আসবেই৷
-ভালো না খারাপ?
-সেটা বলতে পারব না৷ কিন্তু একটা খবর আসছে৷ আসতে তাকে হবেই!
৫
প্রথম বিমানহানা করে গেছে শীত
বসন্তের কথা বা ভাবনা এখন দূর
রাস্তায় মানচিত্র হয়ে ঘুমায়
কয়েকটি ক্লান্ত কুকুর
কান-গজানো ভুল বলেনি৷ আগে আমরা শহরের এ-মাথা ও-মাথা ছুটে যাওয়া ব্যস্ত কুকুরদের কথা বর্ণনা করেছি৷ প্রথম (আসলে দ্বিতীয়) হাওড়া ব্রিজের এপার থেকে সে এসেছিল৷ তার নাম বাদামী৷ কান-গজানো আর জিপসি দেখেছিল দূর পেরিয়ে একটা হন্যে কুকুর আসছে৷ তার লোমে ডিজেলের ধোঁয়ার গন্ধ৷ চোখ একটু ভিজে৷ ওটা কান্না নয়৷ ধোঁয়ার আক্রমণ ঠেকাবার ব্যবস্থা৷ নামের সঙ্গে রঙের মিল থাকলেও চোখ দুটো একটু লালচে বলে অনেকেই ভেবে নিতে পারে যে, বাদামী বেশ রাগী ধাঁচের, কিন্তু এর চেয়ে ভুল আর কিছুই হতে পারে না৷ বাদামী এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
– আমার আগে আর কেউ এসেছিল?
– না তো৷
– আসার কথা ছিল৷ তাহলে হয়তো মাঝরাস্তায় ধরা পড়ে গেছে৷ অবশ্য চাপাটাপাও পড়তে পারে৷ একটু জল খাওয়া দরকার৷
– উলটোদিকে যে বাড়িটা দেখছ ওর বাগানে গাছে জল দেওয়ার পাইপটা খোলা আছে৷ জলটা গেট দিয়ে বেরোচ্ছে৷ খেয়ে এসো৷
বাদামী রাস্তার ডানদিক-বাঁদিক দেখে রাস্তা পেরিয়ে জল খেতে গেল৷
– আচ্ছা, হঠাৎ ওরা আমাদের নিয়ে পড়ল কেন বলতে পারো? আমরা কি খুব ঝামেলা করছিলাম?
– বুঝতে পারছি না৷ আমার তো এক-একসময় মনে হয় যে অজান্তেই কোনো ভুল বোধহয় আমরা করে ফেলেছি৷ যে কারণে ওরা এত ক্ষমাহীন হয়ে উঠেছে৷
– আসলে কলকাতাকে যেভাবে ওরা সাজাতে চাইছে সেই ছবিটার মধ্যে আমরা খুবই বেমানান৷
– সে না হয় হল, কিন্তু আগেই প্রশ্ন উঠবে যে কলকাতাটা কী কেবল ওদের? হঠাৎ ওরা বাদে অন্যরা ফেলনা হয়ে গেল?
– আবার অন্য একটা কথাও থেকে থেকে ভাবছি৷ মানে, বলা যায় যে কথাটা আমাকে ভাবাচ্ছে৷
– কী সেটা শুনি?
– আসলে হয়তো ব্যাপারটা তত কিছু নয়৷ এমনও হতে পারে যে আমরা যাতে নিজেদের মতো করে আরও গুছিয়ে আরও ভালোভাবে থাকতে পারি তারই জন্যে ওরা করছে৷ হয়তো … হয়তো… আমাদের নিয়েই একটা চিড়িয়াখানা বানাতে চায় ওরা৷ যেখানে আমাদের ভালো খেতে দেবে৷ অসুখ হলে ডাক্তার দেখাবে৷ কত কীই তো হতে পারে…
বাদামী জল খেয়ে ফিরে এসেছে৷ তার গোঁফে ও কালো নাকের ওপরে বিন্দু বিন্দু জল লেগে আছে৷
– তোমাদের এই কথাবার্তা শুনে আমার গল্পটা মনে পড়ে গেল৷ ছাগলছানা হাততালি দিচ্ছে আর নাচছে – কী মজা, সামনে সরস্বতী পুজো, কী মজা৷ তার মা তখন তাকে বকুনি দিয়ে বলছে যে আগে কালীপুজোটা যেতে দে, তারপর সরস্বতী পুজোর কথা ভাববি৷ তোমাদের হাল ওই ছাগলছানার মতো৷ কী কারণে কী হচ্ছে আমরা ভেবেচিন্তে কুলোতে পারব না৷ কাজেই সাত-পাঁচ ভেবে সময় নষ্ট কোরো না৷ যা বলছি শোনো৷ আমাকে এখনও অনেক জায়গায় যেতে হবে৷
– বলো৷
– একটা ব্যাপার মাথায় রাখবে৷ ওরা ওদের মতো করে ফন্দি আঁটছে৷ সে-ক্ষমতা আমাদের নেই৷ তাই আমাদের নিজেদেরই ব্যবস্থা করতে হবে৷ হাতে সময় বেশি নেই৷
– বলো না৷ পিঁজরাপোলে শুখা-ভুখা হয়ে মরার চেয়ে সবকিছু করতে রাজি আছি৷
– তুই কে?
– আমি জিপসি৷
– আর আমি কান-গজানো৷
– এখন আমাদের একমাত্র কাজ হল যেখানে ওরা হুট করে হানা দেবে না সেই সব জায়গায় দল বেঁধে লুকোনো৷ তারপর হল রওনা৷
– কোথায়?
– অত কথা বলা যাবে না৷ তোমাদের এই রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা বাস-গুমটি আছে৷ চিনিস?
– চিনব না কেন? তবে ওখান থেকে আর বাস ছাড়ে না৷ আগে ছাড়ত৷
– ঠিক৷ ওই গুমটিটার উলটোদিকে একটা দরজা আধখোলা সিইএসসি-র ট্রান্সফরমারের ঘর আছে৷
– হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার আগুন লেগেছিল৷ দুটো দমকল এসেছিল৷
– বিকেলে আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর ভেতরে ঢুকে যাবি৷ মেসিন-টেশিন ছুঁবি না৷ পেছনটায় চলে যাবি৷ দেখবি অন্তত চল্লিশটা কুকুর ওখানে লুকোতে আসবে৷ আপাতত এই৷ পরের কথা পরে৷ একটাই কাজ, পারলে খাবার-দাবার কিছু নিয়ে যাস৷ কেউ কোনো শব্দ করবি না৷ বাচ্চাগুলোকেই নিয়ে ঝামেলা৷ যতটা পারা যায় ওদের চুপ করিয়ে রাখতে হবে৷
– সে না হয় হল, কিন্তু তারপর?
– বললাম না পরের কথা পরে৷ এইটুকু শুধু জেনে রাখ যে রওনার আগে নির্দেশ আসবে৷ আর এখানে ন্যাড়া রাস্তার ধারে কচ্ছপের মতো বসে থাকিস না৷ গাড়ি থেকে দেখলেই নেমে তেড়ে আসবে৷
– এখন তুমি কোথায় যাবে?
– নানা জায়গায় হাল্লাক হয়ে খবর দিয়ে দিয়ে বেড়াব৷ আজ রাতের মধ্যেই বেশিরভাগ কুকুরের লুকোনোর ব্যবস্থা করতে হবে৷
– যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাবে?
– কী?
– ছায়া-কুকুররা কি সত্যি?
– তোদের কী মনে হয়?
– আমরা ব্যাপারটা বুঝিনি৷ ওই বেড়ালটা বলল… তাই… ওরা বাদামীকে বেড়ালটাকে দেখাবে ভেবেছিল, কিন্তু বেড়ালটা ওখানে তখন ছিল না৷
– সত্যি তো বটেই৷ এরপর নিজেদের চোখেই সব দেখতে পাবি৷ পরের মুখে আর ঝাল খেতে হবে না৷
যা খবর দেওয়ার ছিল দিয়ে বাদামী চলে গেল৷ জিপসি আর কান-গজানো দেখল বাদামী দূরে ছোটো হয়ে যাচ্ছে৷ আর তার কানদুটো না-হাঁটা না-দৌড়ের তালে তালে লাফাচ্ছে৷
কুকুর ধরার অভিযান যে এভাবে ঝিমিয়ে পড়তে পারে সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি৷ এমন নয় যে সাঁড়াশি-বাহিনীর সঙ্গে শহরের ঝড়তি পড়তি মানুষদের সংঘর্ষ বাড়তে বাড়তে আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং তার ফলে বৃহত্তর বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছিল৷ এমনও নয় যে সাঁড়াশী-বাহিনীর কর্মীরা বিশেষ কোনো দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে কাজে ঢিলে দিচ্ছিল বা অন্য কিছু৷ তবে আগের কথাটার খেই ধরে এটা বলাই যায় যে কুকুর-ধরাদের মজুরি নিয়ে দীর্ঘদিনই কোনো চিন্তাভাবনা হয়নি৷ কারণ কুকুর ধরাই হত না৷ পিঁজরাপোলগুলোর অবস্থাও ছিল তথৈবচ৷ আসল ব্যাপারটা হল যখন, যেদিকে বেশি নজর দেওয়া হয়, তখন অন্যদিক থেকে নজর সরে যায়৷ পোলিও নির্মূল করার অভিযান চলছে৷ ওদিকে সঙ্গত কারণেই প্লেগ-এর দপ্তর খোলে কিনা সন্দেহ৷ কিন্তু একজন বিকৃতমস্তিষ্ক লোক যদি কার্জন পার্কের ইঁদুরদের বিষ খাওয়ায় তাহলে ওদের গায়ে যে মাছিরা থাকে তারা বাধ্য হয়ে বেরিয়ে মানুষকে কামড়াবে৷ প্লেগ দেখা দেবে৷ তখন আবার দেখা যাবে পোলিও নিয়ে কেউ ভাবছে না৷ এসব আকাশ-পাতাল না ভেবে আমরা যখন কুকুর নিয়ে পড়েছি তখন সেই আসল কথাতেই ফিরে যাওয়া যাক৷
কুকুরদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না৷ উপরন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখা গেল৷ বিভিন্ন পাড়ায়, গুরুত্বপূর্ণ সব মোড় ও দরকারি রাস্তার মাঝখানে ধরা দেবার জন্যে জ্ঞানবৃদ্ধ কিছু কুকুর হয় বসে বসে ঝিমোচ্ছে, গায়ে মাছি বসলেও তাড়াচ্ছে না বা সামনের দুই থাবার মধ্যে মাথাটা রেখে দু-চোখ মেলে নির্লিপ্তভাবে বিশ্ব-সংসারে কী ঘটে চলেছে দেখছে এবং অজানা কোনো শব্দতরঙ্গের সংকেত ধরার জন্যই যেন তাদের কানগুলো রাডারের মতো দিক পালটাচ্ছে৷ কুকুর ধরার একটা বিশাল অভিযান চলছে৷ সেটা সকলেরই জানা৷ তার মধ্যে এই প্রবীণ কুকুরদের আগ বাড়িয়ে ধরা দিতে আসা কারও কারও চোখে তাজ্জব ঠেকলেও ঠেকতে পারে৷ এবং সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের সেটা হল কুকুর-ধরা গাড়ি এসে দাঁড়াতেই এরা গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল৷
-‘এটা খুবই স্বাভাবিক৷ এরা কুকুরদের কোনো বৃদ্ধাশ্রম থাকলে সেখানে চলে যেত৷ অথচ দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এদের শিখিয়েছে যে প্রতিবাদ বা কামড়াকামড়ি করে কোনো লাভ নেই৷ এমনিতেও মরবে অমনিতেও মরবে৷ এই বয়সে আর হুজ্জুতি পাকাতে চায় না৷ এই আত্মসমর্পণের মধ্যে অন্য কিছু খোঁজার চেষ্টা বাতুলতা৷’
-‘কোনোমতেই এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যায় না৷ মানুষের বেলায় দেখা গেছে যে, সে যত অভিজ্ঞ ও প্রবীণ হয়ে ওঠে, ততই ধীর স্থির হয়ে ওঠা মনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তার বিচারধারাও তদনুরূপ হয়ে যায়৷ কাজেই টালাপার্ক থেকে টালিগঞ্জ, বেলেঘাটা থেকে বাঘাযতীন – নানা জায়গায় আমরা যখন প্রবীণ কুকুরদের একইরকমের রহস্যময় ব্যবহার দেখছি তখন পুরো ঘটনাটাকে স্রেফ কাকতালীয় বা অপারগ হয়ে আত্মসমর্পণ বলে না ভাবলেই বোধহয় ভালো৷ সব ঘটনার অতিসরলীকৃত ব্যাখ্যা হয় না৷ যদিও মানুষের প্রবণতাই হল তাই৷’
-‘আমাদের মনে হয় বিষয়টি নিয়ে অযথা বিতর্ক চলতে দেওয়া ঠিক হবে না৷ এতে মূল্যবান সময় নষ্ট হবে এবং কলকাতাকে কুকুর-শূন্য করার আমাদের যে সাধু-পরিকল্পনা তার বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে৷ মাথা যদি ঘামাতেই হয় তাহলে অনেক ব্যাপার রয়েছে৷ কতগুলো বুড়ো কুকুরের হাবভাব নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তা বা বিতর্ককে আর যেন আমল না দেওয়া হয়৷’
-‘আমরা সম্পূর্ণ অন্য প্রস্তাব দিচ্ছি এবং কোনো বিতর্কের অবতারণা ঘটানো আমাদের লক্ষ্য নয়৷ পিঁজরাপোল-৩ মৃত ও অর্ধমৃত কুকুরে ভর্তি৷ বস্তুতই সেখানে আর কুকুর ছাড়া যায় না৷ পিঁজরাপোল-১-এ মেরামতি চলছে৷ পিঁজরাপোল-২-তেও যথেষ্ট সংখ্যক কুকুর রয়েছে৷ আমাদের বক্তব্য হল এই আত্মসমর্পণকারী বৃদ্ধ কুকুরদের পিঁজরাপোল-১-এ রেখেও মেরামতির কাজ চলতে পারে৷ বিজ্ঞানের স্বার্থে কয়েকটা দিন ওদের ওপরে নজর রাখা প্রয়োজনীয় বলে আমরা মনে করছি৷’
সন্ধের মুখে ফিরে এসে বেড়ালটা দেখল জিপসিও নেই, কান-গজানোও নেই৷ সারাটা দিনই আজকে ওকে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে৷ এদিকটায় কী ঘটেছে কিছুই জানা নেই৷ তবে কি কান-গজানো আর জিপসিকে ধরে নিয়ে গেল কুকুর-ধরা গাড়ি?
অসম্ভব মনখারাপ করে ভাঙা পেচ্ছাপখানার ছাদে শুয়ে শুয়ে বেড়ালটা আকাশ দেখতে লাগল৷ কান-গজানো বা জিপসি – কোনোটারই লড়াই করার মুরোদ নেই৷ দুটোই ক্যাবলা, ভালোমানুষ৷ ওদের কি সত্যিই ধরে নিয়ে গেল? রাত বাড়ল৷ আকাশের উজ্জ্বলতম তারা লুব্ধকের নীলচে আলোর রকমফের দেখতে দেখতে বেড়ালটা একসময় ঘুমিয়ে পড়ল৷ ঘুমিয়ে পড়লে সকলেই ছোটোবেলায় ফিরে যেতে পারে৷ বেড়াল দেখল সে তখন বেড়ালছানা৷ বেশি লাফালাফি করার সেই সুন্দর ছোটোবেলা৷ তখন সে প্রজাপতিদেরও লাফ দিয়ে দিয়ে ধরার চেষ্ট করত৷ একদিন হয়েছিল কী, হঠাৎ অ্যালামোন্ডা ফুলের ওপরে কালো ডানায় সাদা, হলদে ও নীল ছিট ছিট একটা মস্ত প্রজাপতি বসে ছিল সকালবেলায়৷ আলতো শীতের পশ্চিমি বাতাসে হলদে ফুলটা একটু একটু দুলছে আর প্রজাপতিটার ডানা দুটো লুকোনো একটা আমেজের ছন্দে একবার করে পুরো মেলে যাচ্ছে আবার বন্ধ হচ্ছে৷ রোদ ঝলমলে শীতের সকাল৷ এর মধ্যে আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি৷ স্বপ্নে যা ইচ্ছে তাই হয়, যা ইচ্ছে হয় না তাও৷ ঘুম ভেঙে বেড়ালটা দেখল সত্যিই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে৷ আকাশের সব তারা লালচে একটা গুমোট মেঘ আড়াল করেছে৷ রাস্তাটা ডানদিকে বাঁদিকে জলে ভিজে চকচকে হতে শুরু করেছে৷ এবারে নেমে একটা আড়াল খুঁজতে হবে৷ কিন্তু নামার জন্যে টানটান হয়েও সে লাফ দিল না৷ তলায় কিছুটা বুক সাদা জ্যান্ত অন্ধকার বসে৷
– কে?
– আমি জিপসি৷
– বলবি তো৷ আমি ভাবলাম কী রে বাবা৷ ভূত-টুত নাকি?
-শোন, আমি আর কান-গজানো একটা জায়গায় চলে গেছি৷ বাদামী বলে একটা কুকুর এসে আমাদের ওখানে যেতে বলছে তাই৷ তা ভাবলাম তুই নির্ঘাৎ ভাববি যে আমাদের ধরে নিয়ে গেছে৷
-ভাববো কী, আমি তো তাই ধরেই নিয়েছিলাম৷
-আমরা ওখানে প্রায় একচল্লিশটা কুকুর আছি৷ দুটো বেড়ালও এসেছে৷
-সে কী?
-ওদের পাড়ার কুকুররা এসেছে, সঙ্গে ওরাও চলে এসেছে৷ তোকে বলতে এলাম যে তুইও আমাদের সঙ্গে চল৷
-তারপর?
-দিনদুয়েকের মধ্যে আমাদের শহর ছাড়তে হবে৷ মারাত্মক একটা কিছু হবে৷ কী তা জানি না৷ আমরা নির্দেশ পেলেই দল বেঁধে শহর ছেড়ে পালাব৷ তুই এখন চলে আয়৷ কান-গজানোও খুব করে বলেছে৷
-তাহলে বলছিস যে গেলেই ভালো৷
-এখন অবধি যা শুনেছি তাতে আমারও তো তাই মনে হচ্ছে৷ নেমে আয়৷ চল্৷
-সে না হয় যাচ্ছি কিন্তু মারাত্মক ঘটনাটা কী?
-সবই কানাঘুঁষো৷ কেউ বলছে যুদ্ধ লেগে যাবে৷ কেউ বলছে ভূমিকম্প হবে৷ কুকুরদের বাঁচাবার জন্যে পাতাল থেকে নাকি কিছু উঠে আসতেও পারে৷ ঠিক করে কিছু বলা যায় না৷ চল্, যেতে যেতে বাকিটা বলছি৷
টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে জিপসি আর বেড়াল চলে গেল৷ নোংরার গাদার মধ্যে একটা গলায় দড়ি বাঁধা পুতুলও পড়েছিল৷ বিদ্যুৎ চমকালে এক লহমায়- মনে হতে পারে যে পুতুলটা এই ভিজে নোংরার মধ্যে বেশ আরাম করে বসে আছে৷ হাসছে কি?
পিঁজরাপোল-১-এ প্রবীণ কুকুরদের ঢুকিয়ে দিতে দেখা গেল তারা কোনো শব্দ না করে চক্রাকার জায়গাটার মধ্যে গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে একবার নাক শোঁকাশুঁকি করে নিল৷ তারপর নিজের নিজের জায়গাতেই আধশোয়া হয়ে বসে থাকল৷ ওদের যখন ওখানে ছাড়া হয় তখন বেশ একরোখা রোদ্দুর৷ পিঁজরাপোলের বধ্যভূমির একাংশে একটি বাজে-পোড়া মরা গাছ তার কয়লার ডালপালা মেলে কিছুটা ছায়ার সৃষ্টি করেছে৷ বৃদ্ধ কুকুরেরা যদি ওই ছায়ার জায়গাটায় সরে যেত তাহলে প্রখর উত্তাপ থেকে কিছুটা অন্তত রেহাই পেতে পারত৷ কিন্তু সেরকম কোনো চেষ্টাই ওরা করেনি৷ রোদ্দুরের মধ্যে অন্ধ সূর্য-উপাসক বা জেদি পাথরের মতো বসেছিল ওরা৷ চড়া রোদ্দুরে সব কুকুরই জিভ বার করে হ্যা-হ্যা করে৷ সেরকমও তারা করেনি৷ রোদ, গরম, জলাভাব, ক্লান্তি, খিদে, অবধারিত অমোঘ মৃত্যু, কঙ্কালসার হতে হতে ঢলে পড়া, অবলুপ্তি- কোনোকিছুকেই তারা তিলমাত্র আমল দেয়নি৷ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এদের ওপরে নজর রাখা হয়েছিল৷ সন্ধেবেলা যখন টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ল তখন সন্ধানী-আলো ফেলে দেখা গেল যে তারা একইভাবে বসে আছে এবং একফোঁটা বৃষ্টির জলও তাদের শুকনো জিভ দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে না৷
এরপরে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরে আকাশ যখন একটু পরিষ্কার হল তখন দেখা গেল যে সেই একই জায়গাতে উঠে বসে সেই প্রবীণ কুকুরেরা তাদের ঘোলাটে ছানিপড়া চোখগুলো অন্তরীক্ষের দিকে মেলে তাকিয়ে রয়েছে৷ একযোগে৷ বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের আলো ওই৷ ওই তার মধ্যে লুব্ধক৷ ঘেউ! ঘেউ!
৬
… একটা কুকুর যখন বাস চাপা পড়ার পরে রাস্তায়,
চাঁদের আলোয় রক্তে ভিজে শুয়ে থাকে আর
তার শেষ চিত্কার টেপরেকর্ড করে
ইস্কুলের বাচ্চাদের শোনানো হয়…
‘আমরা মোটের ওপরে বুড়ো কুকুরগুলোর ওপর নজর রেখে এবং মোটের ওপর ওদের লক্ষ্যবসত্তর একটা আন্দাজ করে অনুমান করছি যে ওরা বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের দিকেই তাকিয়ে আছে৷ এর কারণ আমরা জানি না৷ সন্ধানী-আলোয় দেখা গেছে যে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়টা ওদের মুখটা একটু হাঁ করে থাকছে এবং জিভগুলো থরথর করে কাঁপছে৷ ওরা কি কোনো প্রার্থনা জানাচ্ছে? কুকুররা কি প্রার্থনা জানাতে পারে? বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের কী আছে যে ওরা কিছু চাইতে পারে? এখন ওই বুড়ো কুকুরগুলো যদি মরে যায় তাহলে আমরা এই অনুমানভিত্তিক পরীক্ষা আর চালাতে পারব না৷ তাই আমরা অনুরোধ করছি পিঁজরাপোল-১-এ অন্তত কিছু খাবারদাবার ও জল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক৷ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারবেন যে বুড়ো কুকুরদের প্রতি মমত্ববোধ থেকে এই প্রস্তাব আমরা করছি না৷ আমরা যা কিছু বলছি সবই অমিত শক্তিধর বিজ্ঞানের স্বার্থে৷’
ঘেউ! ঘেউ!
লুব্ধক ওরফে কুকুর তারা ওরফে সিরিয়াস ওরফে আলফা ক্যানিস মেজরিস হল একটি যুগ্ম তারা৷ জার্মান জ্যোতির্বিদ ফ্রিডরিশ ভিলহেলম বেসেল ১৮৪৪ সালে এই তারকাটির কথা প্রথম বলেন এবং যুগ্ম তারকাটিকে চাক্ষুষ দেখা যায় ১৮৬২-তে৷ দেখেছিলেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ অ্যালভান ক্লার্ক৷ প্রাচীন মিশরীয়রা লুব্ধককে বলত ‘সোথিস’৷ রোমে, সবচেয়ে গরমের সময় এই তারা দেখা দিত৷ ইংরেজি ‘ডগ ডেজ’ কথাটির মধ্যে সেই রোমক অভিজ্ঞাতার রেশ রয়ে গেছে৷ লুব্ধকের যুগ্ম তারা হল সিরিয়াস-বি৷ তারাদের দুনিয়ায় এ হল একটি সাদা বামন অর্থাৎ এর পরমাণুরা ঘন সনিনবিষ্ট হতে হতে আশ্চর্য ঘনত্ব অর্জন করেছে৷ আফ্রিকার ডোগন উপজাতির লোকেরা লুব্ধক ও সিরিয়াস-বি সম্বন্ধে খুঁটিনাটি অনেক খবর জানে৷ কীভাবে ‘জংলিরা এসব জানল (যেমন সিরিয়াস-বি হল সবচেয়ে ছোটো আর ভারি তারা) তা হদিশ করা যায়নি৷ নীলচে-সাদা লুব্ধক সৌর পরিবার থেকে ৮০৬ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে৷ লুব্ধক সূর্যের চেয়ে বড়ো এবং ২৩ গুণ বেশি উজ্জ্বল৷ সাদা বামন সিরিয়াস-বি-র ভরও প্রায় সূর্যের সমান কিন্তু ঘনত্ব অনেক বেশি৷ ঘেউ! ঘেউ!
কান-গজানো, জিপসি, বেড়াল এরা সবাই যে ট্রান্সফরমার ঘরের মধ্যে লুকিয়েছিল সেখানকার নেতার নাম বাহান্ন৷ হলদেটে মাদি কুকুর বাহান্ন-র এরকম নাম হওয়ার কারণ, মোটের ওপরে তখন অবধি সে বাহান্নজনকে কামড়িয়েছে৷ অবশ্য এর জন্যে ওকে দোষ দেওয়ার কোনো মানে হয় না৷ প্রতি বছরই বাচ্চা হওয়ার সময়টাতে লোকেরা ও কম বয়সের মানুষেরা কারণে-অকারণে মা ও বাচ্চাদের বিরক্ত করে বলে মায়েরা কামড়াতে বাধ্য হয়৷ সেখানে একটা কুকুর ছিল যার নাম তিনপেয়ে৷ ছোটোবেলাতেই মোটর সাইকেল একটা পা উড়িয়ে দিয়েছিল৷ কলকাতায় এরকম অসংখ্য জায়গার মধ্যে কুকুরেরা লুকিয়ে ছিল৷
প্রত্যেকটা ট্রামডিপো ও পাম্পিং স্টেশনে, দুধের বুথের পেছনে ও ভাঙাচোরা গ্যারেজে, থানার মধ্যে যেখানে অ্যক্সিডেন্টে চুরমার গাড়িদের রাখা হয় সেখানে, কবরখানা, বাসগুমটি, রোলের দোকানের তলায়, বেড়ার পেছনে, খোলা ম্যানহোলের মধ্যে, আধ-বানানো বাড়ির সিঁড়ির তলায়, বিরাট জায়গা জুড়ে দোতলা বাসের ভাগাড়ে, সুলভ শৌচালয়ের পেছনে, পার্কের মধ্যে, গাড়ি ঢুকতে পারবে না এরকম অপ্রশস্ত গলিতে, দুর্গাপুজোর জন্য বানানো পাকা বেদির পেছনে, শ্মশানে, আদিগঙ্গার ধারে বুনোকচুর জঙ্গলে, সেতুর তলায় নানা ফাঁকফোকরে – কুকুররা লুকোয়নি এমন কোনো জায়গা ছিল না৷ সকলেই জানে যে বড়ো বড়ো পাইপ-এর ভেতরে মানুষ ঘরসংসার করে৷ কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় এমন মাপের পাইপ পড়ে থাকে যার মধ্যে মানুষের পক্ষে ঢোকা সম্ভব নয়৷ কলকাতার কুকুরেরা সেগুলোকেও কাজে লাগিয়েছিল৷ যেমন কাজে লাগিয়েছিল রাতের বাসের তলা, ইটের পাঁজা, স্টেডিয়ামের আশপাশের পরিত্যক্ত এলাকা ও বাতিল মালগাড়ির ওয়াগন৷ এইসব জায়গায় কুকুর-ধরা গাড়ি কখনও পৌঁছতে পারবে না৷ কোনো সাহসী কুকুর-ধরা যদি একা একা সাঁড়াশি হাতে যায় তাহলে তাকে বিপদের মুখে পড়তে হবে৷ বাঁধা মাইনের চাকরিতে অত ঝুঁকি নেওয়া চলে না৷ সবাই তো আর মিলিটারি নয়৷
কুকুর-উপকথার মধ্যে গল্পের সঙ্গে সঙ্গে সত্যি বা চিরন্তন ঘটনার মিশেল থেকেই যাচ্ছে৷ শুধু সিমেন্ট দিয়ে কোনো কাঠামো বানানো যায় না৷ বালি, জল, লোহার রড – অনেক কিছু লাগে৷
প্রচণ্ড গরমের মধ্যে (৯৫, ১১৩, ও ১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) কুকুরদের ট্রেডমিল ব্যায়াম করিয়ে অনেক পরীক্ষা করা হয়েছে৷ আরও যে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা কুকুরদের ওপরে চালানো হয়েছে তা বিভিন্ন ফাইলের শিরোনাম দেখলেই বোঝা যাবে-
Accleration, Aggression, Asphyxiation, Blinding, Burning, Centrifuge, Compression, Concussion, Crowding, Crushing, Decompression, Drug Tests, Experimental Neurosis, Freezing, Heating, Hemorrhage, Hindleg Beating, Immobilization, Isolation, Multiple Injuries, Prey Killing, Protein Deprivation, Punishment, Radiation, Starvation, Shock, Spinal Chord Injuries, Stress, Thirst… – এই তালিকার কোনো শেষ নেই৷ আর আছে – চিমটে দিয়ে শরীরের কোনো অংশ ছিঁড়ে নেওয়া, থ্যাঁত্লানো, হাতুড়ির বাড়ি মারা, ঘুরন্ত ড্রামের মধ্যে গড়ানো, গুলি করা, ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করা ইত্যদি৷ সবই বিজ্ঞানকে সর্বশক্তিমান করার জন্যে৷
পাঁচমিনিট পরে কাঁপুনি দমকে দমকে শুরু হল৷ ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম মিনিটের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসের সংখ্যা বেড়ে গেল৷ ১১শ থেকে ১৩শ মিনিটের মধ্যে শ্বাসের সংখ্যা কমে মিনিটে তিনটিতে নেমে এল এবং এই পর্বটির শেষেই শ্বাসক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল৷ এর আধঘন্টা পরে ব্যবচ্ছেদ শুরু হল’ – এই পরীক্ষা কিন্তু কুকুরের ওপর হয়নি৷ হয়েছিল কোনো ইহুদি, রুশ বা পোল যুদ্ধবন্দির ওপরে৷ বাতাসের চাপ কমাতে থাকলে মানুষের কী হয় তা জানার জন্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটি করেছিল নাত্সি ডাক্তারেরা৷ অতএব মানুষ যে শুধু কুকুর ও অন্যান্য প্রাণীদের ওপরেই পরীক্ষা চালিয়েছে এমন নয়৷ বিজ্ঞানের জয় হোক৷ ঘেউ! ঘেউ!
দেওয়ালের ওপরের দিকে একটা গর্ত ছিল৷ কিন্তু সেটা মানুষের ঢোকার৷ ওই গর্তটা করেছিল পাতাখোর চোরেরা৷ ওরা ওখান দিয়ে লোহালক্কড়, তার, টুকটাক যন্ত্রপাতি – এসব টুকরো মাল ঝাড়বে ভেবেছিল৷ খুব একটা লাভ হয়নি৷ সে-সব যা টানার মতো ছিল সে তো কবে উধাও হয়ে গিয়েছিল৷ জগু আর ভজুয়া গিয়ে দেখল গর্তটা নীচের দিকে বাড়াতে না পারলে দুবলা বা বুড়ো, বাচ্চা বা কমজোরী মায়েরা ঢুকতে পারবে না৷ পুরো একটা রাত্তির ওদের লেগেছিল গর্তটা বাড়াতে৷ মেট্রোরেলের সীমানাটা টালিগঞ্জের দিকে শেষ হয়েছে সেখানে রেললাইন ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও অনেক, অনেক জায়গা রয়েছে৷ সেখানে কেউ যায় না৷ অনেক বছর ধরে গাছ ও আগাছা, ইট, রেলের স্লিপার, জমাট বেঁধে যাওয়া সিমেন্টের বস্তা – এইসব মিলেমিশে সেখানে একটা দুর্ভেদ্য পরিবেশ তৈরি হয়েছে৷ তেলাকুচো ও অন্যান্য লতানো গাছ জায়গাটাকে এমনভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে ঢেকেছে যে কোথাও কোথাও রোদ্দুর বা আলো, কিছুই ঢোকে না৷ বরং সবুজ অন্ধকার থাকে যার সঙ্গে পচা পাতা, গাছের কষ ও ভিজে মাটির গন্ধ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ হাওয়া ঢোকে কম৷ এই আদ্রর ছায়ায় অসংখ্য পাতালকোঁড় হয় এবং গোল গোল গেঁড়ি অবাধে ঘুরে বেড়ায়৷ পরের রাতে ওই গর্ত দিয়ে প্রায় দেড়শো কুকুর মেট্রোরেলের এলাকায় ঢুকে আশ্রয় নেয়৷ এদেরই মধ্যে ছিল পাটকিলে আর তার চারটে বাচ্চা৷ কলকাতার কুকুরদের বাঁধা এলাকা থাকে৷ জায়গার দখলদারি রাখতে ঝগড়া থেকে সংঘর্ষ, গর্গর করে রাগ দেখানো থেকে শুরু করে রক্তক্ষয়ী কামড়াকামড়ি সবই হয়৷ কিন্তু কুকুর ধরার অভিযানের সময় এসব আর মাথায় রাখা সম্ভব হয়নি৷ তাড়া খেয়ে কুকুরদের দঙ্গল বেঁধে শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পালাতে হয়েছে৷ সবাই পালাতে পারেনি৷ কোনো কোনো অন্ধ বা চোখে কম দেখতে পাওয়া কুকুর ফ্লাইওভার বানাবার জন্যে খোঁড়া, গভীর জলজমা গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে৷ হয় জলে ডুবে মারা গেছে বা কাদার ঢালের ওপর দিয়ে বারবার ওঠার চেষ্টা করে পিছলে নেমে গেছে৷ সারা রাত ধরে কলকাতার বাজারে যে লরির কনভয় আসে তার হেডলাইটের রাক্ষুসে আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে অনেক কুকুর রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ছে৷ লরির পর লরি, চাকার পরে চাকা তাকে পিষে পিষে, গুঁড়িয়ে, রাস্তার পিচের সঙ্গে লেই-এর মতো মিশিয়ে দিয়েছে৷ ঠাঁইনাড়া বা হটাবাহার হলে সকলেই কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ কলকাতার কুকুরদের বেলাতেও এর অন্যথা ঘটেনি৷
ট্রান্সফরমারের ঘরে সব কুকুরই, এমনকি বাচ্চাগুলোও চুপচাপ বসেছিল৷ শুধু একটা পাঁজরভাঙা রোগা কুকুর ঘুমের ঘোরেই গোঙাচ্ছিল৷ জিপসি আর কান-গজানো ফিসফিস করে গল্প করছিল আর তাদের দুজনের মধ্যে, দুজনেরই গায়ের গরম থেকে আরাম পেয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছিল বেড়াল৷ দরজার দিকটায় শুয়ে শুয়ে বাহান্ন বাইরের দিকটায় নজর রাখছিল আর বাতাস শুঁকে শুঁকে বা কান পেতে প্রায় অস্ফুট সব কম্পন থেকে কোনো খবর বা অন্যকিছুর জন্য সজাগ সন্ধান চালাচ্ছিল৷ কান-গজানো জিপসিকে বলল,
-তোকে তো ভদ্দরলোকেরা অনেকদিন পুষেছিল৷
-পুষেছিলই তো৷
-তাহলে নির্ঘাৎ টিভি-ও অনেক দেখে থাকবি৷
-দেখব না কেন?
-তাহলে একটা বেশ ভালো গল্প বল্ না৷ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ব৷
-টিভির গল্পগুলো একেবারেই ফালতু৷ একটা ভালো গল্প শুনবি তো বলতে পারি৷
-বল৷
বাইরে কারা যেন টহলদারি করছে৷ তাদের বুটের শব্দ কাছে আসে৷ ট্রান্সফরমারের ঘরে টর্চের আলো পড়ে৷ টহলদাররা চলে যায়৷ পাঁজর-ভাঙা কুকুরের গোঙানির আওয়াজটা ওদের কানে যায়নি৷ ওদের বুটের আওয়াজটা দূরে মিলিয়ে যাওয়ার পরে বাহান্ন বলল-
-জিপসি!
-কী?
-তুই বরং গল্পটা জোরেই বল৷ যারা জেগে আছে তারা সকলেই শুনবে৷ আমারও শুনতে ইচ্ছে করছে৷
-দাঁড়া৷ তাহলে উঠে বসে বলি৷ আমাদের এই গল্পটার নাম হচ্ছে ‘ক্ষুধার্ত কুকুর’৷ এক মস্ত বড়ো রাজা ছিল৷
-উফ্, ফের সেই রাজা-গজা৷
-শোনোই না, কী হয় তারপর৷ সেই রাজা ছিল অসম্ভব অত্যাচারী৷ বিনা কারণে অত্যাচার করাতেই সে আনন্দ পেত৷ তা একবার হল কী, বুদ্ধদেব সেই অত্যাচারী রাজার রাজ্যে এলেন৷ সেই রাজা তখন বুদ্ধকে বলল, হে তথাগত, তুমি কি আমাকে এমন শিক্ষা দিতে পারো যাতে করে আমার মনটা অন্যভাবে ভাবতে পারে? বুদ্ধদেব তখন বললেন, আমি তোমাকে ‘ক্ষুধার্ত কুকুরের’ গল্পটা বলছি৷ মন দিয়ে শোনো-
এক ছিল অত্যাচারী সম্রাট৷ তাকে শিক্ষা দেবার জন্য ইন্দ্র শিকারি সেজে তার রাজ্যে এলেন৷ সঙ্গে ছিল ভীষণ এক বিশাল কুকুরের রূপে মাতালি রাক্ষস৷ শিকারি আর কুকুর সম্রাটের প্রাসাদে ঢুকল৷ কুকুরটা এমন জোরে ডাকতে লাগল যে গোটা প্রাসাদটা ভিত্ অবধি থরথর করে কেঁপে উঠল৷ সম্রাট তখন সেই শিকারিকে ডেকে ওই ভয়াবহ ডাকের কী কারণ তা জানতে চাইল৷ শিকারি বলল, ওর খিদে পেয়েছে তাই ডাকছে৷ ভীত সম্রাট তখন কুকুরকে খেতে দিতে বলল৷ পুরো রাজবাড়ির সব খাবার শেষ হয়ে গেল৷ কুকুরের ডাক থামে না৷ সম্রাটের খাদ্য-ভাণ্ডার শেষ হয়ে গেল৷ কিন্তু কোথায় কী? সম্রাট তখন বলল, এই ভয়াবহ জানোয়ারটার খিদে কি কিছুতেই মেটানো সম্ভব নয়? শিকারি বলল, না যতক্ষণ না ও ওর শত্রুদের মাংস, হাড়, সব চিবিয়ে না খাবে ওর খিদে মিটবে না৷ সম্রাট তখন বলল, কারা ওই বিশাল কুকুরের শত্রু? শিকারি বলল, এই রাজ্যে যতদিন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে ততদিন ওর ডাক বন্ধ হবে না এবং গরিবদের ওপরে যারা অত্যাচার করে, অন্যায় করে তারাই হল ওর শত্রু৷ ভীত সম্রাট তখন নিজের কুকর্ম সম্বন্ধে সচেতন হল এবং প্রজাদের ওপরে জুলুম করা বন্ধ করল৷
গল্পটা শেষ করে বুদ্ধদেব ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া সেই রাজাকে বললেন, যখনই শুনবে যে ওই কুকুরাটা ডাকছে তখনই বুদ্ধের শিক্ষার কথা মনে কোরো৷ এতে করে তোমার ভালো বই মন্দ হবে না৷
গল্পটা শেষ হওয়ার পরে সকলেই চুপ করে ছিল৷ বাহান্ন বলে উঠল, -গল্পটা খুবই ভালো৷ কিন্তু আমার কথা একটাই৷ আমাদের ওপরে যে নিষ্ঠুর অত্যাচার চলছে তা বন্ধ করার কি কোনো উপায়ই নেই? বুদ্ধদেব, ইন্দ্র, মাতালি অথবা অন্য কেউ কি আমাদের হয়ে একটাও কথা বলবে না?
কান-গজানো হঠাৎ চিত্কার করে ডেকে উঠল৷ সবাই চমকে গেছে৷
-আমি শুনতে পাচ্ছি৷
-কী!
-অনেক কিছু হচ্ছে, একই সঙ্গে৷
-কী? কী হবে?
-বলো!
-চুপ করে থাকিস্ না৷
-ম্যাঁও৷
-বলছি৷ ছায়া-কুকুরেরা এবার দৃশ্যমান হবে৷ ওরা যাকে পাঠিয়েছিল সে বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে৷
বাইরে বিদ্যুৎ চমকাল৷ আকাশ চিরে বাজ পড়ার শব্দ হল৷ বৃষ্টি নামল৷ ঘেউ! ঘেউ!
-কে বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে?
কান-গজানোর ওপরে কিছু একটা ভর করেছে৷ তা না করলে সে এসব কথা জানবে কী করে? কিন্তু সর্বশক্তিমান বিজ্ঞান কি ভর মানে? না৷ বিজ্ঞান ভর না মানলেও আবেশ মানে৷ না মানলেই বা কী এসে গেল?
-বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে অনুবিস৷
-অনুবিস?
-হ্যাঁ, অনুবিস৷ পোড়ামাটির র- তার গায়৷ তার প্রতীক হল পাথরের শবাধার বা কাঠের কফিন৷ অনুবিস হল সেই মিশরীয় হাউন্ড যে এ-পৃথিবী থেকে পরবর্তী বিশ্বে যাতায়াত করতে পারে৷ অবশ করে দেওয়ার জাদু সে জানে৷ সে হারানো জিনিস খুঁজে দিতে পারে৷ আত্মা বা ‘বা’- কে সে রক্ষা করে৷ রহস্য উন্মোচনকারী নপথিস বা বিচারক ওসাইরিসের কাছে সে প্রার্থীকে নিয়ে যায়৷ অনুবিস বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে৷ বাইরে যে ঝড় উঠছে দেখছ তা হল বার্তা পেয়ে ছায়া কুকুরদের উল্লাস৷
-কিন্তু কী আছে সেই বার্তায়?
-জানি না৷ তবে আমাদের জন্যে নির্দেশ আসছে৷
-কে আনছে?
-বাদামী৷ আমি তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি৷ বাদামী আসছে৷
ছায়া-কুকুররা দৌড়চ্ছে৷ বিদ্যুৎ চমকালে তাদের ছায়া গোটা শহরের ওপরে চমকে উঠছে৷ ওই তো সবার আগে দৌড়চ্ছে লাইকা৷ তার পেছনে ভেলু৷ পাশে দৌড়চ্ছে কারা? ওরা হল শ্মশানের কুকুর৷ কালু, ভুলু, জামভোলা, বড়োশ্বেতফুল, মড়িমা, সাবলিদিদি, বুড়োবাবা, বুড়িমা, ছোটোশ্বেতফুল, দুর্গা, পদি, হরির মা, থরথরি, ফুলটুসি, হরহরি, বাঘা, রাঙ্গুবাবু – সবাই দৌড়োচ্ছে৷
কান-গজানো ভুল বলেনি৷ সারা গা চুপচুপে ভিজে৷ সমস্ত লোম লেপটে রয়েছে সারা গায়৷ বাদামী এল৷
-সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?
-সবাই আছি৷ ঠিকই আছি৷
-আজ মাঝরাতে, সবাই মন দিয়ে শোনো, হঠাৎ তোমরা দেখতে পাবে যে কুকুরদের একটা বিশাল দল কাছে আসছে৷ তোমরা শয়ে শয়ে পায়ের শব্দ পাবে৷ পেলেই তোমরা বেরিয়ে আসবে৷ -কোথায়?
-রাস্তায়৷ তারপর সেই দল যেদিকে যাবে তোমরাও চলতে থাকবে৷ মোদ্দা কথা আমাদের কলকাতা ছেড়ে দূরে চলে যেতে হবে৷
-কোথায় যাব আমরা?
-দূরে৷ অনেক দূরে৷ আর শোনো, সবাইকে ছুটতে হবে৷ দরকার হলে পালা করে বাচ্চাদের মুখে নিয়ে ছুটতে হবে৷ যারা দুর্বল, অসুস্থ বা চোট পেয়েছে তাদেরও সঙ্গে কাঁধ লাগাতে হবে৷
-অনুবিস কী বার্তা এনেছে তুমি জানো?
-তুমি অনুবিসের কথা জানলে কী করে?
-কী করে তো বলতে পারি না৷ কেমন একটা ভরের মতো হয়েছিল৷
-কী বার্তা সেটা আমিও জানি না৷ আমাকে যতটা জানাতে বলা হয়েছে ততটাই আমি বললাম৷
-এখন তুমি কোথায় যাবে?
-আমি? আমাকে এখন অনেকগুলো জায়গায় খবর দিতে হবে৷ আমি বরং আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যাই৷
বাদামী তুমুল ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল৷
বাহান্ন একবার ফাঁকায় বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকাল৷ অন্ধকার ফুঁড়ে লক্ষ লক্ষ তির হয়ে বৃষ্টি নামছে৷ বাহান্ন ঘরে ফিরে এল৷ জিপসি বলল,
-আমরা সবাই যাব কিন্তু পাঁজর-ভাঙা আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না?
-কেন?
-গোঙাচ্ছিল৷ কোনঞ্জ ফাঁকে মরে গেছে আমরা বুঝতে পারিনি৷
৭
জ্বেলেছ কি জ্বালাব
আগুন খুনের বদলা জেনো খুন
নাচালেই বেয়াদব ঝুঁটি
ঝুলব কামড়ে ধরে টুঁটি
-হ্যালো! হ্যালো! শুনতে পাচ্ছেন৷ ১ নম্বর পিঁজরাপোল থেকে বলছি৷
-শোনা যাচ্ছে তবে লাইনে ঝড়ের মতো শব্দ হচ্ছে৷
-এখানে একের পর এক আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটছে৷
-সারা কলকাতা জুড়েই আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে৷ সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে কুকুরেরা৷ ওখানকার কী অবস্থা৷
-এমনিতে খারাপ কিছু নয়, কিন্তু ঝোড়ো বাতাসে আমরা কুকুরের কান্না শুনতে পাচ্ছি৷ ওদিকে বুড়ো কুকুরেরা সবাই একসঙ্গে সামনের থাবাগুলো ওপরে তুলে আকাশে কী যেন সব বলছে যদিও কোনো বোধগম্য শব্দ আমাদের কানে আসেনি৷
-ওখানে যা হচ্ছে সব ভিডিয়োতে তোলা থাকছে তো? এদিকে বি-বি-সি আর সি-এন-এন ওদের খবরে কুকুরদের মিছিলের ছবি দেখিয়েছে৷ বাধ্য হয়ে আমাদেরও দেখাতে হচ্ছে৷
-এবারে শুনুন৷ ওই বুড়ো কুকুরদের মধ্যে আমরা হঠাৎ দেখলাম একটি বিশাল কুকুর যার চোখ দুটো আগুনের আলো নিয়ে জ্বলছে৷ একজন এখানে বলছে যে ইজিপশিয়ান মিথলজির বইতে অনুবিস-এর যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে পুরো মিলে যাচ্ছে৷ সেই টেরাকোটা রং, লম্বাটে শিকারি হাউন্ডের গড়ন৷ পিঁজরাপোল-১ তিনদিন ধরে তালাবন্ধ৷ কোথা দিয়ে অতবড়ো কুকুরটা ঢুকল আমরা ভেবে পাচ্ছি না৷
-অন্যান্য অনেক জায়গাতেই নাকি ওই কুকুরটিকে, যাকে আপনারা অনুবিস বলছেন, দেখা যাচ্ছে৷
-এদিকে সহসা অনুবিসকে আর দেখা যাচ্ছে না৷ গোটা পিঁজরাপোল জুড়ে ওরা গোল হয়ে নাচছে৷ ধুলোতে ওদের থাবা এত জোরে ঘষছে যে ফুলকি ঠিকরে বেরোচ্ছে…
-অসম্ভব শব্দ হচ্ছে… অসংখ্য শেকল আছড়ালে যেমন…
-আমরা ১ নং পিঁজরাপোল খুলে দিচ্ছি৷
-এখানে কিছু শোনা যাচ্ছে না…
-আমরা ২ ও ৩ নম্বর পিঁজরাপোলও খুলে দেবার নির্দেশ পাঠাচ্ছি…
-কিছু শোনা যাচ্ছে না…
-হ্যালো! হ্যালো!
কুকুরদের মিছিল কেন, এই কুকুরের সচল নদী, কুকুরের এই লাভাস্রোত যাই বলা হোক না কেন এ দৃশ্যকে প্রকাশ করার ভাষা আমাদের জানা নেই৷ পৃথিবীর কোথাও, কখনও এরকম কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের কেউ বলেনি৷ জীবজন্তুদের মধ্যে এরকম ব্যাপক মাইগ্রেশন হতেই পারে বলে কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করছেন৷ কিন্তু আমেরিকাতে লেমিংদের গণ-আত্মহত্যার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই৷ সুশৃঙ্খল, সংঘবদ্ধ হাজার হাজার কুকুর প্রায় নীরবে, গম্ভীর মুখে কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে৷ এই যে বিশাল আলোকিত সেতুটি আপনারা দেখছেন এটি হল গঙ্গার উপরে নির্মিত দ্বিতীয় সেতু৷ কুকুরদের মহামিছিল এই সেতু দিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ আত্মহত্যার কোনো অভিপ্রায় থাকলে ওরা ওপর থেকে লাফ দিতেই পারত৷ নীচেই গভীর জল৷ বোঝা যাচ্ছে যে ওরা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে৷ খেয়াল করে দেখুন-পুলিশের একটি পাইলট-ভ্যান এবং কোনো মাননীয় মন্ত্রীর গাড়ি কুকুর-সমুদ্রের মধ্যে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ পাইলট-ভ্যানটির মাথায় নীল আলো জ্বলছে নিভছে৷ মন্ত্রীর গাড়ির ওপরে জ্বলছে লাল আলো৷ কলকাতার এই সচল কুকুর-সমুদ্র আপনাদের দেখাচ্ছে সি-এন-এন৷ একটি ছোট্ট ব্রেকের পর আমরা আবার এই আশ্চর্য দৃশ্যে ফিরে আসব…
গড়িয়াহাট রোডের দুটি লেনই কুকুরের স্রোতে বন্ধ৷ কুকুর-নদী বয়ে চলেছে বাইপাসের দিকে৷ চারপাশের যত গলি ও ছোটোখাটো রাস্তা- সবদিক দিয়েই কুকুররা আসছে৷ কেউ ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে আসছে৷ কেউ মাঝে মধ্যে থেমে গিয়ে ল্যাজে বসা মাছিকে ধাওয়া করছে৷ আসছে ছোটো ছোটো কুকুর-ছানারা যারা এখনও চিন্তাই করে উঠতে পারছে না যে কত দীর্ঘ পথ তাদের যেতে হবে৷ বড়ো বড়ো বাড়ি, বুটজুতো-পরা পা, গাড়ির রাক্ষুসে চাকা, কোনোদিনও ওপারে পৌঁছোন যাবে না এমন রাস্তা, ট্রাক, বড়ো বড়ো আলোওয়ালা দোকান যার সামনের হাতে জিনিস-ভর্তি লোকেরা খালি মাড়িয়ে দেয়, সাইকেল, হিংস্র মোটরবাইক, মিনিবাস – এই সবকিছু, যার মধ্যে পরতে পরতে ভয় মিশে আছে, যা সবসময় বুঝিয়ে দেয় যে তোরা ফালতু, দুবলা, ভীতু, তোদের চোখে ভয়ের পিচুটি – সেই ভয়-দেখানো সবকিছু কেমন চুপ, কোণঠাসা ও অচল হয়ে পড়েছে৷ কাঁউ! কাঁউ! এই তো আমরা ছোটো ছোটো গলাতেই ডাকছি৷ হ্যাঁ, সবকিছু আজ আমাদের দখলে৷ ফুটপাতের কোনো প্রায়ান্ধকার কোণে, মায়ের পেট ঘেঁষে শুয়ে ড্যাবডেবে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমরা তোমাদের কেরামতি অনেক দিন, অনেক যুগ, অনেক জন্মজন্মান্তর ধরে দেখছি৷ এবারে বারান্দায় ভিড় করে বা পর্দা সামান্য সরিয়ে বা গাড়ির ভেতরে বসে জানালার কাচ অসহায়ভাবে তুলে দিয়ে বা টিভির পর্দায় তোমরা আমাদের দেখো৷ আমরা কোথায় যাচ্ছি জানি না৷ বড়োরা যেতে বলেছে, যাচ্ছি৷ হ্যাঁ, তোমাদের শহর, তোমাদের দোকানপাট, তোমাদের বাজার, হোটেল, মুরগি কাটার বঁটি, মাংস ঝলসাবার লৌহশলাকা, টিভি টাওয়ার, কসাইখানা, থানা, বন্দুক, লাঠি, পতাকা, সি ডি প্লেয়ার, তোমাদের সার্জন, অ্যানাসথেটিস্ট, নেতা – সব তোমাদেরই থাকছে৷ আমরাই চলে যাচ্ছি৷ তবে মাথা নিচু করে নয়৷ সসম্মানে৷ তোমরা বসে বসে আমাদের প্রত্যাখ্যানে অভিশপ্ত শহরে অন্ধ যখের মতো এবার তোমাদের ধন-সম্পদ আগলাও৷ চলে যাচ্ছি ট্রামলাইন, চলে যাচ্ছি ফোয়ারা, চলে যাচ্ছি জেব্রা ক্রসিং, বিকল হয়ে যাওয়া ট্রাফিকের আলো, বর্শা দিয়ে বানানো রেলিং, চলে যাচ্ছি আকাশে কাটাকুটি খেলা কেবলের তার, রোলের দোকানে তাওয়ার এরিনাতে খণ্ড খণ্ড ক্লাউন মাংসের ওলট-পালট খাওয়া, চলে যাচ্ছি হতভম্ব জলের কল, ঝাঁঝরি, পিঁপড়েতে খেয়ে নেওয়া গাছের গুঁড়ি, দাঁত উপড়ে নেবার চেয়ার, চলে যাচ্ছি, চলে চলে যাচ্ছি দলে দলে, বড়োদের সঙ্গে, আমরা ছানা-কুকুরেরা৷ তোমরা তোমাদের পিঁজরাপোল নিয়ে আনন্দে থাকো, বিকেলে ভেতরে বেড়াতেও পারো বা নিজেরা নিজেদের আটকে রেখে, না খেতে দিয়ে, না জল দিয়ে মজা করতে পারো৷ আমাদের ছোটো ছোটো পা খুব একটা জোরে ছুটতে পারে না৷ কিন্তু চেষ্টা করছি আমরা বড়োদের সঙ্গে সমানতালে থাকার৷ তোমাদের নিষ্ঠুরতা, অবজ্ঞা, তোমাদের নির্মমতা, তোমাদের লোভ, তোমাদের অজ্ঞতা বুযমেরাং হয়ে ফিরে আসছে বুঝতে পারছ না? হ্যাঁ, যাওয়ার সময়ে সগর্বে, মাথা উঁচু করে বলে যাচ্ছি কথাগুলো, কিন্তু কোনো কিছুই বোঝার ক্ষমতা তোমাদের নেই৷ মরুভূমির চোরাবালিতে বা মেরুর তুষারঝড়ে তলিয়ে যাওয়ার সময়, চাপা পড়ার সময়, অন্তিমলগ্নে বিশ্বাসঘাতকদের এরকমই হয়৷ আমাদের ছোটো ছোটো কানগুলো লাফাতে লাফাতে তোমাদের ওপরে যা নেমে আসছে তাকে সম্মতি জানাচ্ছে৷ এত সংখ্যায় আমরা, ছোটো কুকুরছানারা, কখনও এক জায়গায় হইনি৷ হলামই বা যদি খেলা করার বা এর ওর সঙ্গে চেনাশোনা করার কোনো ফুরসতনেই৷ এর জন্যে দায়ি কারা? তোমরা৷ এই যে আমাদের খিদে পাচ্ছে, জল তেষ্টা পাচ্ছে, শক্ত রাস্তায় নরম থাবা আর নখ ব্যথা ভুলে অবশ একাগ্রতায় এগিয়ে চলেছে, এই কুকুর-সমুদ্রের ঢেউ, এই কুকুর-রাত্রি এর জন্য দায়ি কারা? তোমরা৷ হ্যাঁ, হাতে ওয়াকিটকি, কোমরের হোলস্টারে রিভলভার, চোখে কালো চশমা, পা ফাঁক করে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সার্জেন্ট, তুমি খিলান বা দরজার মতোই দাঁড়িয়ে থাকো৷ নড়লেই আমাদের গায় পা লাগবে৷ এবং ঘটনাটা যদি একবার ঘটে তাহলে আজ কেন, আর তোমার কখনোই বাড়ি ফেরা হবে না৷ মাছ, মাংস, তরি-তরকারি, ফল, কোল্ড ড্রিংকস্ বোঝাই যত লরি আটকে গেছে তার চালকেরা সাবধান৷ একটা চাকাও যদি একটুও গড়ায় তাহলে এই বিশাল শান্ত সমুদ্র কিন্তু একটা বিরাট হাঙর হয়ে হাঁ করবে যার মধ্যে প্রবেশ করলে আর বেরোবার রাস্তা নেই৷ হেডলাইটগুলো নিভিয়ে দাও৷ আমাদের চোখে লাগছে৷ কাঁউ! কাঁউ!
হেডলাইটগুলো পর পর নিভে যায়৷ যেন দৈত্যরা একে একে অন্ধ হয়ে গেল৷ সার্জেন্টও তিলমাত্র নড়ে না৷ তার কালো চশমায় কুকুর-মিছিলের প্রতিফলন৷ হোলস্টারের ভেতরে রিভলভার ঘামছে৷ স্ট্যাচু! অবশ্য এমনই অভব্য যে সহসা ‘হাইল হিটলার’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে পারে৷ এবং কে বলতে পারে যে আরও বহু গলনালি ও মুখের কোটর থেকে এই চিত্কারকে অনুরূপ হুংকার দিয়ে সমর্থন জানানো হবে না? কলকাতা এখন মাফিয়ার শহর৷ এই শহরে কুকুরদের পক্ষে থাকা অসম্মানজনক৷ তাই এই শহরকে চারপায়ে লাথি মারতে মারতে তারা চলে যাচ্ছে৷ ঘেউ! ঘেউ!
কান-গজানো বলল,
-জিপসি, এরকম দৃশ্য কলকাতা কখনও বাপের জন্মে দেখেনি৷
-দেখেনি, আর দেখবেও না৷
-মুখগুলো দেখেছিস৷ কেমন কাঁচুমাচু হয়ে গেছে৷ আমতা আমতা করেও একটা কথা মুখে সরছে না৷
-আসলে ভেবেই পাচ্ছে না যে বাপারটা কী হচ্ছে৷ বেশি বুদ্ধি যারা ধরে তাদের শেষে এরকম বোবা মেরে যেতে হয়৷
-আমার কিন্তু ওদের জন্যে একটু খারাপও লাগছে৷ কেমন নিয়তির হাতে নিজেদের সঁপে দিয়েছে৷
-ব্রয়লার৷ দেখতে মানুষের মতো৷ আসলে ব্রয়লার৷ আমার কিন্তু ওদের জন্যে এতটুকু খারাপও লাগছে না৷
-ওরা কিন্তু এখনও জানে না যে কী হতে চলেছে৷
-ঠিক এরকমই হয়৷ অনেক কিছুই জানা থাকে না৷ হঠাৎ আকাশ ভাঙার মতো নেমে আসে৷
ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে খেয়ালই করেনি যে বাদামী আর বেড়ালও এই ম্যারাথন যাত্রায় ওদের পাশে এসে পড়েছে৷
-এই! তোরা বেকার কথা বলে দম নষ্ট করছিস কেন? আমাদের আরও জোরে চলতে হবে৷ জোরসে…
-কোথায় যাচ্ছি আমরা? সেটাই তো মাথায় ঢুকছে না৷ জায়গাটা জানা থাকলে সুবিধে হত না?
-কোনো জায়গা নেই৷ যতটা পারা যায় দূরে চলে যেতে হবে৷ যতটা পারা যায়৷
দুনিয়ার খবর জানাচ্ছে বি.বি.সি৷ দুনিয়ায় যা কিছু ঘটছে৷ সে যেখানেই হোক৷ আমাদের ভ্রাম্যমান সংবাদদাতারা প্রতি ঘন্টায় খবর পৌঁছে দিচ্ছে আপনাদের ঘরে… আমরা কলকাতাকে জানি ‘সিটি অফ দা ড্রেডফুল নাইট’ হিসেবে বা ‘দা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর সুবাদে৷ কিন্তু ভবিষ্যতের পৃথিবী কুকুরদের এই মহা এক্সোডাস-এর জন্যেই ক্যালকাটাকে জানবে৷ কলকাতা থেকে বাইরের দিকে যত রাস্তা বেরিয়েছে, সব রাস্তা, সব জাতীয় সড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ে চলমান কুকুরের দঙ্গল দখল করে নিয়েছে৷ অসমর্থিত খবরে প্রকাশ যে ‘নাসা’-র জনৈক বিজ্ঞানী নাকি লাতিন আমেরিকার একটি টিভি চ্যানেলে বলেছেন যে কলকাতার ওপরে মহাবিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে৷ এর বেশি তিনি কিছু বলতে রাজি হননি৷ জেনিভাতে জনৈক দেশত্যাগী রুশ জ্যোর্তিবিজ্ঞানী বলেছেন যে এই বিপর্যয় সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য ‘নাসা’-র কাছে রয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা কোনো খবর জানাচ্ছে না৷
আমাদের ক্যামেরা এখন রাস্তার পাশে৷ কুকুরদের উচ্চতাতেই রাখা৷ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে যে মাঝে মধ্যে পাপি-দের কাঁই! কাঁই! কাউ! কাউ! এছাড়া একমাত্র যে-শব্দ তা কুকুরদের হাঁপানোর৷ জানা গেছে যে মুষ্টিমেয় বেড়ালও এই শহরত্যাগী কুকুরদের দলে রয়েছে৷ পিঁজরাপোল-১, ২, ও ৩ খুলে দেওয়া হয়েছে৷ তবে ২ ও ৩-এ অসংখ্য কুকুরের মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই নেই৷ কলকাতাবাসী যে বিজ্ঞানীর আবেদনে শেষ অবধি পিঁজরাপোল খুলে দেওয়া হয় আমাদের প্রতিনিধিকে তিনি একটি সাক্ষাত্কারে একটু আগেই বলেছেন… (ঝিরিঝিরি পর্দা ও যান্ত্রিক কোলাহল)…
বি-বি-সি : আপনি তো এই গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে গোড়া থেকেই জড়িত৷ কী মনে হচ্ছে আপনার?
বিজ্ঞানী : আমার মনে হচ্ছে কুকুরদের ওপরে নিপীড়নমূলক অভিযান চালানো খুবই অন্যায় হয়েছে৷ এতটা স্পষ্টভাবে না বললেও আগেই আমি প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম… এখন সত্যি বলতে আমি আর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না?
বি-বি-সি: কীসের ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না?
বিজ্ঞানী : এই কুকুরটির ফোটোগ্রাফ দেখুন৷ টেরাকোটা র-৷ বিশাল চেহারা৷ সাধারণ বড়ো কুকুরের অন্তত তিনগুণ৷ এবার দেখুন, মিশরীয় মিথোলজির বইতে অলৌকিক কুকুর-দেবতা অনুবিসের ছবি৷ কী করে এরকম ঘটা সম্ভব?
বি-বি-সি : এই ফোটোটি যে জাল নয় তার প্রমাণ কী?
বিজ্ঞানী : তার মানে? আমি নিজে ছবিটা তুলেছি৷
বি-বি-সি : আপনার কী মনে হয়? কী হতে চলেছে?
বিজ্ঞানী : আমি জানি না৷ বিশ্বাস করুন আমার কোনো আন্দাজই নেই এ ব্যাপারে৷ তবে আমার মন বারবার বলছে যে ভালো কিছু হবে না, হতে পারে না…
আমাদের প্রতিনিধি বলেছেন যে এই অসংলগ্ন কথার থেকে কোনো স্পষ্ট হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়৷
এইমাত্র খবর পাওয়া গেল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউনাইটেড কিংডম ও জার্মান দূতাবাস থেকে কলকাতা দূতাবাসের কর্মীদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ কুকুরদের এক্সোডাস সম্বন্ধে নতুন খবর পাওয়া মাত্র আমরা আপনাদের জানাব… স্টে টিউনড্…
কুকুর-সমুদ্রের ওপরে উড়ছিল ছায়াপথ ধরে ছায়া-কুকুরেরা৷ সেখানে মেঘে মেঘে পা রেখে এগোতে হয়৷
লাইকা বলল,
-ওদের গতি আরও বাড়ানো উচিত৷ এখনও ওরা বিপদসীমা পেরোয়নি৷
অনুবিস জবাব দিল,
-তবে পেরিয়ে যাবে৷ এখনও সাত ঘন্টা বাকি আছে৷
৮
উজ্জ্বল সূর্য গিয়েছিল নিভে, আর তারারা
অনন্ত মহাশুন্যে অন্ধ হাতড়ে বেড়ায়,
রশ্মিহীন ও পথবিহীন এবং বরফ পৃথিবী
দৃষ্টিহীন, কৃষ্ণতর, চন্দ্রবিহীন আকাশে;
সকাল আসে ও যায়, ফের আসে,
কিন্তু আনে না কোনো দিন…
-জর্জ গর্ডন বায়রন
সাত ঘন্টা, মাত্র সাতটা ঘন্টা আর বাকি আছে৷ সাত ঘন্টা মানে চারশো কুড়িটা মিনিট৷ খুব একটা অভাবনীয় মাপের কিছু নয়৷ মাত্র পঁচিশ হাজার দুশোটা সেকেন্ড৷ সময়-এর এই খণ্ড দৌড়ে পেরিয়ে যেতে একটা ঘুমই যথেষ্ট৷ তবে পুরোটাকে ঘুম বলা যাবে না৷ খুব সামান্য সময়ের জন্যে হলেও দু-একটা স্বপ্ন দেখতে হবেই৷ মোটের ওপর সাত ঘন্টার অপেক্ষা৷ আর ঘুমোতে যে হবেই বা ঘুম যে আসবেই এমন কোনো কথা নেই৷ ঘেউ! ঘেউ!
আগেই জানানো হয়েছে যে তিনটি পিঁজরাপোলই খুলে দেওয়া হয়েছিল৷ এর মধ্যে ২ ও ৩ নম্বর পিঁজরাপোলে বলতে গেলে সব কুকুরই মরে গিয়েছিল৷ পিঁজরাপোল-১-এ যে প্রার্থনার ও বুড়ো কুকুরেরা ছিল তারা কিন্তু সশব্দে দরজা খুলে দেওয়ার দিকে ভ্রুক্ষেপও করেনি৷ চড়া আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে ও বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করে তাদের সচকিত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়৷ শেষ সময়টাতে কী ঘটেছিল তা জানা যাবে না কিন্তু আন্দাজ করা যায় যে অন্তিম সাত ঘন্টা তারা তাদের জায়গা ছেড়ে নড়েনি৷ শেষ মুহূর্তে তারা একসঙ্গে হেসে উঠেছিল কি না হদিশ করার আর কোনো উপায় নেই৷
কুকুরেরা কলকাতা থেকে সরে যাচ্ছে৷ কারণ সেরকমই নির্দেশ এসেছে তাদের ওপর৷ কলকাতা বাঁচবে না৷ কলকাতা ধ্বংস হয়ে যাবে৷ ডোগোনরা জানে যে কুকুর-তারা লুব্ধক তার অমোঘ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু অসভ্য ডোগোনদের সঙ্গে সভ্য কলকাতার কোনো যোগাযোগ নেই৷ সেই নির্মম সিদ্ধান্ত সম্মতি পেয়েছে তার যুগ্ম অংশ সাদা বামন সিরিয়াস-বি-র৷ লুব্ধকের ব্যাস ৪৮ লক্ষ কিলোমিটার৷ সূর্যের ব্যাস ১৪ লক্ষ কিলোমিটার৷ লুব্ধকের র- নীলচে সাদা৷ তার প্রভা সবার চেয়ে বেশি -১.৪৫৷ ছোটো কুকুরমণ্ডল বা ক্যানিস মাইনর৷ এই তারামণ্ডলে রয়েছে প্রশ্বন৷ পৃথিবী থেকে প্রশ্বনের দূরত্ব ১১.৩ আলোকবর্ষ৷ সে-ও জানিয়ে দিয়েছে যে লুব্ধকের সিদ্ধান্ত সঠিক৷ বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের সবকটি তারাকে নিয়ে যে-কুকুর সে হল কালপুরুষের সঙ্গী৷ কালপুরুষও সম্মত হয়েছে৷ এবং লুব্ধক হিংস্র কুকুরকে লেলিয়ে দেবার সেই শব্দটিই উচ্চারণ করেছে – লুঃ
এবং সেই শব্দে উত্তেজিত হয়েছে একটি গ্রহাণু, নেমে আসছে কলকাতার ওপর৷ কোনো ওজর, কোনো প্রার্থনা, কোনো আপিল তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে না৷ ঘেউ! ঘেউ!৷
৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ১০ কিলোমিটার মাপের একটি গ্রহাণু বা অ্যাস্টেরয়েড পৃথিবীর ওপরে আছড়ে পড়েছিল এবং সেই মহাবিস্ফোরণে ডাইনোসররা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়৷ গোটা পৃথিবী থেকে৷ আগেই বলা হয়েছে এরকম মহাধ্বংস, মহাসংহার ৪৫০, ৩৫০, ২২৫, ১৯০ মিলিয়ন বছর আগেও হয়েছিল৷ ১৯৮৯ সালে পৃথিবীর কক্ষপথে ১০০০ মিটারের একটি গ্রহাণু এসেছিল৷ মাত্র ৬ ঘন্টা আগে পৃথিবী সেখানে ছিল৷ ১৯৯৬-এর মে মাসে ওই একই মাপের একটি গ্রহাণু মাত্র ৪ ঘন্টার জন্য পৃথিবীকে আঘাত হানতে পারেনি৷
কলকাতার ওপরে যে হিংস্র কুকুরটিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে সে ঘন্টায় ১ লক্ষ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে আসছে৷ তার মাপ ও ওজন এখনই সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না৷ উন্মত্ত কুকুরটি কলকাতার ওপরে আছড়ে পড়ে ভস্ম হয়ে উবে যাবে, কিন্তু যে মহা-গহ্বরটির সৃষ্টি হবে তা কুকুরটির ব্যাসের দশগুণ এবং গভীরতা দুগুণ৷ কুকুরটির যা ওজন তার থেকে একশো গুণেরও বেশি পাথর সে আকাশে উড়িয়ে দেবে৷ প্রথম আঘাত ও বিস্ফোরণের পর কয়েক লহমা কোনো বাতাস থাকবে না৷ চাপা আগুন হয়ে ধক্ ধক্ করে জ্বলবে কলকাতা৷ তার পরই আসবে লক্ষ ঝড়ের শেষ নিশ্বাস৷ দাউ দাউ করে জ্বলে, গলে, পুড়ে, ছাই হয়ে খাক্ হয়ে যাবে কলকাতা৷ এর পরে ধুলোর মেঘ বর্মের মতো সূর্যকে আড়াল করবে৷ কতদিন সেই হিমরাত্রি থাকবে তা বলা যাবে না৷ ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাইনাস ২০০ সেন্টিগ্রেডে নেমে যাবে৷ এবং অনেক মাস ধরে হিমাঙ্কের নিচেই থাকবে৷ প্রলয়ান্ধকারে কলকাতাকে ঢেকে রাখবে প্রলয়মেঘ৷ এই নির্মম ভবিষ্যদঞ্জবাণী মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে করতে কুকুর-উপকথা ‘লুব্ধক’ তার অন্তিম পর্বে পৌঁছিয়েছে৷ কলকাতা এখন এক অসাড়, অপেক্ষমান পিঁজরাপোল৷ তার শাস্তি মৃত্যু৷
তবে হাতে তো এখনও সাত ঘন্টা সময় রয়েছে৷ ঘেউ! ঘেউ!
Leave a Reply