রোল নং ১৭ দোলা মিত্র (গল্প)
ফ্লাপ পেজ —
‘রোল নং ১৭ দোলা মিত্র’ কোয়েল তালুকদারের চতুর্থ গল্প গ্রন্থ। কোয়েল গল্প বলার মানুষ। কোয়েল গল্প লেখার মামুষ। সে দুশতাধিক ছোটগল্পের রচয়িতা। তার রচিত গল্পগুলির মধ্যে আছে মানবজীবনের ছোট বড়ো দুঃখ ব্যথা বেদনার কথা, আছে প্রকৃতির মধ্যে বিচরণশীল মানুষের অন্তর্গত পরিচয়ের কথা। কল্পনা ও সৌন্দর্যের অনুভূতিতে রহস্যময় জগতের কথাও আছে। এই গ্রন্থে ‘সন্ধ্যার মেঘমল্লার’ গল্পে এমনই শ্বাশত বাংলার চিরায়ত প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। গল্পে গত শতাব্দীর ত্রিশ দশকের বাংলা ও পল্লী সমাজ জীবনের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। গল্পটি পড়লে মনে হয় যেন বিভূতিভূষণ পড়ছি।
একটু উদ্ধৃত করছি — ”তারপর জীবনে কত কিছু পেলাম। কত ডিগ্রি নিলাম। কত বড়ো কর্তাব্যক্তি হলাম। কত বড়ো ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলাম। কত শিক্ষিত সে।
কত দেশ ঘুরেছি। কত মানুষ দেখেছি। কত মৌন নদী। কত পর্বতের গাত্রে দেখেছি কত লতাগুল্ম, পাহাড়ি ফুল। কত পূর্ণিমা রাত্রি উপভোগ করেছি।
সবকিছুর ভিতর একজন অনাদৃত, একজন উপেক্ষিত, একজন দলিত বিধবা মেয়ের মুখ মনে পড়েছে। কত রাশি রাশি আনন্দের মাঝে, সেই কবেকার কতদূরের এক পল্লীবালা অপার্থিব অশ্রু ঝরিয়ে গেছে আমার জীবনের সকল আনন্দ বেদনার উপর। এখনো কী সন্ধ্যার মেঘমল্লারে সেই অনাদরের সন্ধ্যামণি ফুলটি অশ্রু জলে ভিজে?”
এই বাংলার অকিঞ্চিৎকর গাছপালা, ফলমূল, পশু পাখি, নদী বিধৌত পলিমাটি ও পথের উপরের ধূলোর উপকরণ দিয়ে আপন চৈতন্যের অলৌকিক শক্তি মাধুর্য মিশিয়ে কোয়েল গল্প লিখে গেছে জীবন শিল্পীর মতো। সৃষ্টি করেছেন তার নিজস্ব সাহিত্যলোক। প্রেয়সী নারীর প্রেম প্রাকৃতিক পুষ্প-পত্রের মতোই সহজ ও স্বয়ংপুষ্ট। জীবন জটিলতায় ভারাক্রান্ত এক আনমনা লেখক সে। স্বপ্নলোকের ভারহীন স্বাদ আর অধরা সুরভিতে সমগ্র চেতনাকে অপূর্ব শিল্পশৈলীতে এঁকে গেছেন তার প্রতিটি গল্পে। কোয়েল যেন বাংলা ছোটগল্পের উজ্জ্বল শিল্পদূত।
আমাদের এই যানজটের শহরে যখন গাড়ির কর্কশ হর্ণ বাজে, শব্দ দূষণে অতিষ্ঠ হয় মানুষ, তখন আপনি ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়তে পারেন কোয়েলের গল্প। দেখতে পাবেন সেখানে — পদ্মা যমুনার কলকলিত ছলাৎছল জল, নীল আকাশ, উদাস চরাচর, মৌন বটবৃক্ষ। শুনতে পাবেন ভাটিয়ালী গান, ভোরের পাখিদের কিচিরমিচির। আর গন্ধে আকুল হবেন ঘাটফুল ও সোনাল ফুলের সুবাসে। বাংলার মাঠ, নদী, নিরালা বন প্রান্তরের সুমুখ জ্যোৎস্না রাত্রির যে মায়ারূপ কোয়েল অঙ্কিত করেছে তা আসলেই বিস্ময়কর!
কোয়েলের লেখা গল্প পাহাড়, নদী, অরণ্যের নির্জনতায় দিকচক্রবালে দীর্ঘ নীল রেখার মতো স্বপ্ন আনে মনে। প্রকৃতি ও মানুষ যেন একই গ্রন্থিতে সৃষ্টি। তার সব গল্পের কথার মালা গাঁথা- একই সুতোয় বাঁধা যেন। সাধারণভাবে তাঁর ভাষা বহুলাংশে কবিতাধর্মী বা কাব্যিক। কোয়েলের লেখায় কখনও অতি রোমান্টিক, কখনও আবার বিরহ বিষণ্ণতার ধূসরতা লক্ষণীয়। তার গল্পে বেদনার্ত প্রেমের রূপ পাওয়া যায়। তাই তিনি কল্যাণ কামনায় নারীকে সর্বোচ্চভাবে সম্মান দেখিয়েছে।
কোয়েল তালুকদারের ছোটগল্প পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে। ওর লেখা পড়ার পর পাঠক চলে যায় এক স্বপ্নীল জগতে। আর এই কারণেই প্রকৃতিপ্রেমী এই লেখক বাংলা কথাসাহিত্যে একটি আলাদা স্থান করে নেবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
— আফজালুল বাসার
সমাজচিন্তক ও প্রাবন্ধিক
২০ ডিসেম্বর, ২০২১, ঢাকা।
.
উৎসর্গ —
আমার দুই কন্যা
আমার দুই বিন্দু নয়নের জল
হৃদি ও ঐশ্বর্যময়ী
.
১. ইডিয়ট
একদিন অফিসের ঠিকানায় একটি চিঠি পাই। খামের উপর হাতের লেখা দেখে চিনতে পারিনি — চিঠিটি কে পাঠিয়েছে। খাম খুলে চিঠিটা পড়তে থাকি ।
কল্যাণীয়ষু রঞ্জন,
জানিনা তুমি কেমন আছো? অনেক কষ্ট করে তোমার ঠিকানা আমি যোগাড় করে এই পত্রখানা লিখছি। অনিশ্চিত মনে হচ্ছে, এই ঠিকানায় তুমি চিঠি পাবে কিনা? তবুও লিখলাম।
কতগুলো বছর চলে গেছে। তোমার সাথে আমার দেখা নেই। হিসাব করে দেখলাম পঁয়ত্রিশ বছর। এই পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তোমাকে দেখি না।
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ঠিকানা দিলাম। সময় করে যদি একবার আসতে খুব খুশি হতাম। ভালো থেকো।
ইতি — নীলোৎসী।
নীলোৎসী ছিল আমার সহপাঠী। ওর পুরো নাম কাজী নাদিরা বেগম। ক্লাসের সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে ছিল সে। তুলনামূলক ভাষা সাহিত্যের ছাত্রী ছিল। ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইত। আবৃত্তি, বিতর্ক, নাচও করত। ক্লাসের এক ডজন ছেলের মতো আমিও তার এক তরফা প্রেমিক ছিলাম।
আমিও আবৃত্তি করতাম, বিতর্কে অংশ নিতাম , সৌখিনভাবে নাটকেও অভিনয় করতাম। আমাকে তাই নীলোৎসী একটু পাত্তা দিত। অন্য ছেলেদের চেয়ে আমার সাথে সে বেশিই মিশত। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোনো দিন সাহস করে নীলোৎসীকে বলিনি — ”তোমাকে আমার ভালো লাগে”। আর — ”তোমাকে আমি ভালোবাসি” এই কথা বলা তো অনেক দূরের আকাশের চাঁদ ছোঁয়ার মতো ছিল । তাই ঐ ছায়াপথে কখনও হাঁটতাম না। ‘
নীলোৎসী ছিল অভিজাত পরিবারের মেয়ে। ঐ সময়ে সে গাড়িতে করে ইউনিভার্সিটিতে আসা যাওয়া করত। প্রতিদিন এক একটা নতুন জামা পরত। বেশির ভাগ সময় ব্যান্ড দিয়ে চুল বেঁধে খোলা চুলগুলো পিছনে ঝুলিয়ে রাখত। কোরিডোর দিয়ে যখন হীল জুতা পরে খটখট করে হাঁটত তখন চুলগুলো হাওয়ায় উড়ত।
সে যাই হোক — আমিই ওর ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। ক্লাস অবসরে আমার সাথেই ও কথা বলত। ক্যান্টিনে যেয়ে মাঝে মাঝে সিঙারা চা খেতাম। এই পর্যন্তই।
একদিন সেমিনার রুমের সামনে কোরিডোরে দাঁড়িয়ে নীলোৎসীকে বলেছিলাম — “তুমি নীল শাড়ি, কপালে নীল টিপ, নীলের সাথে মিলিয়ে চুড়ি, মালা, চুলের ক্লীপ পরে একদিন ক্লাসে আসবে। তোমাকে আশ্চর্য রকম রূপবতী লাগবে। এই রূপে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।” নীলোৎসী হঠাৎ এই কথা শুনে বিস্ময় চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলেছিল — ‘আচ্ছা, নীল শাড়ি, নীল টিপ পরে আসব একদিন।’
নীলোৎসী নীল শাড়ি পরে আর ক্লাসে আসেনি। কারণ, এর পরপরই বাবা মার পছন্দ মতো একটি অপরিচিত ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যায়। নীলোৎসী ছিল বুদ্ধিমতি মেয়ে। সে ভুল করে নাই। ওর স্বামী ছিল বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাদের পুরো পরিবার ছিল প্রতিষ্ঠিত ও বিত্তশালী। বিয়ের পর নীলোৎসী আর ইউনিভার্সিটিতে আসেনি। দেখাও হয়নি আর কোনদিন। ওর সাথে কোনো যোগাযোগও হয়নি আর।
নীলোৎসীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর খুব মনমরা হয়ে থাকতাম। কোনো কিছু ভালো লাগত না। ক্লাসে পড়ায় মন বসত না। সহপাঠীদের সাথে ভালোভাবে কথা বলতাম না। নিজের কাছে মনে হতো — “আমি মনে হয় নীলোৎসীকে ভুল করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।” আমার এই মনমরা ও উদাস অবস্থা দেখে সহপাঠীরা পরিহাস করে বলত — “তুই একটা ইডিয়ট। কোনো একটা মেয়ের একটু কথা বলাকে, একটু মেলামেশাকে, একটু বন্ধুত্বকে মনে করেছিস প্রেম। তুই নির্বোধ ছাড়া আর কিছু না ! ”
আমারও তাই মনে হয়েছে — আমি সত্যি একটা ইডিয়ট। একটা মায়া লাগা ঘোর, একটা মিছে স্বপ্ন দেখা, একটা অবাস্তব চাওয়া — আর না পাওয়ার বেদনায় নিজেকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছিলাম। ভুলে যেতে চাইলাম সব মিছে মায়া, মিছে স্বপ্ন। ভুলেও গেলাম। আমি যে একটা ইডিয়ট ছিলাম, এই ভেবে নিজেকে মনে মনে তিরস্কারও করলাম।
তারপর চলে গেছে পঁয়ত্রিশ বছর। নীলোৎসী কোথায় থাকে, কেমন আছে, কী করে কিছুই খোঁজ খবর জানতাম না।
আজ এত বছর পর সেই বিস্মৃত হয়ে যাওয়া নিলোৎসীর চিঠি পেলাম। কেমন যেন লাগছে আমার। একবার মনে হলো — কেন যাব? যেতে বলল দেখেই যেতে হবে? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, নীলোৎসী আমার কিছু না হোক, সে তো আমার সহপাঠী ছিল। এই একটি দায় তো আমার চিরকালের হয়ে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, নীলোৎসীকে দেখতে যাব। ওকে তাই একটা চিঠি লিখলাম —
কল্যাণীয়াসু নীলোৎসী,
আমি আগামী ২৭ আশ্বিন, বৃহস্পতিবার তোমার ওখানে আসছি। আমি এখান থেকে ভোরে রওনা হবো। রাস্তায় কোনো অসুবিধা না হলে তোমার ওখানে বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব। আমাকে আবার ঐদিন বিকালেই চলে আসতে হবে।
আমি যে তোমার ওখানে যাচ্ছি, এই কথা আমার স্ত্রীকে বলছি না। তুমি আমার কেউ না, তুমি আমার কিছু ছিলে না, তারপরও তোমার কাছে যাচ্ছি একথা শুনলে সে মনে কষ্ট পাবে। একটু মিথ্যা না হয় বললাম ওকে। বলব, একটা অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি, আজই ফিরে আসব।
ভালো থেকো তুমি।
ইতি — রঞ্জন।
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে একটি পাবলিক বাসে উঠে টাংগাইলের মধুপুর রওনা হই । মধুপুর গড় এলাকাতে একটি বাংলো বাড়িতে নীলোৎসী থাকে। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম — সেই কতকাল পড়ে নীলোৎসীকে দেখতে পাব। নীলোৎসী চিরকাল মানুষের কাছে থেকে ওর রূপের প্রসংশা কুড়িয়েছে। একটু ভয় লাগছিল — এক সময়ের এই মানস প্রতিমাটি তো বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যায়নি? মুখে কপোলে পড়েনি বলিরেখা? আবার ভাবলাম, দেবীরা কখনও বুড়ী হয় না, ওরা চিরকাল চির যৌবনা থাকে ।
একসময় মধুপুর যেয়ে বাসটি পৌঁছে। আমি বাস থেকে নেমে একটি চার দোকানে চা খেতে খেতে নিলোৎসীর বাড়িতে ষাওয়ার পথটি দোকানদারের কাছে থেকে জেনে নেই। দোকানদার বলছিল, আপনি একটি টমটম নিয়ে যেতে পারেন, কিংবা রিকশায়। আমি একটি টমটম নিয়েই নিলোৎসীর বাড়ির দিকে যেতে থাকি ।
এলাকাটি সম্পূর্ণ গড় এলাকা। আমি যে রাস্তা দিয়ে টনটমে করে যাচ্ছিলাম, তার একপাশে বিস্তীর্ণ শাল, গজারি, গামারী, মেহগনি, জারুল গাছের বন। বনের ফাঁকেে ফাঁকে ছোট বড়ো মাটির টিলা আছে, দেখতে অনেকটা মালভূমির মতো লাগছিল। রাস্তার আরেক পাশে সমতল ফসলের ক্ষেত।
কিছুদূর যাওয়ার পরই একটি একতলা বাংলো বাড়ি দেখতে পাই। বাড়িটার একদম কাছে গেলে গেটে একটি নাম ফলক দেখা গেল। ফলকে লেখা আছে — ‘নীলোৎসী’। বুঝতে পারলাম এটাই নীলোৎসীর বাড়ি। আমি টমটম থেকে নেমে পড়ি।
গেটের কাছে একজন দারোয়ানকে দেখতে পাই। এই বাড়ি যে নীলোৎসীর বাড়ি এটা জেনেও দাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করি, এটা কি মিসেস নাদিরা বেগমের বাড়ি?
— জ্বী। আপনার নাম কী? কোথা থেকে এসেছেন?
— আমার নাম রঞ্জন রহমান। ঢাকা থেকে এসেছি।
— ভিতরে আসুন। ম্যাডাম আপনার কথা আমাকে বলে রেখেছেন। বলেছে, ঢাকা থেকে আমার একজন মেহমান আসবে, তার নাম রঞ্জন রহমান।
দাড়োয়ান সোজা আমাকে বাংলোর ভিতরে নিয়ে যায়। ভিতর থেকে একজন পরিচারিকা বের হয়। দারোয়ান পরিচারিকাকে বলে, ইনি ম্যাডামের মেহমান। ড্রইংরুমে ওনাকে বসতে দাও। এবং ম্যাডামকে যেয়ে বলো — উনি চলে এসেছেন।
পরিচারিকা আমাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভিতরে চলে যায়। একটু পর ফিরে এসে বলে — ম্যাডাম আপনাকে ভিতরে যেতে বলেছে। উনি ওপাশে বারান্দায় বসে আছেন।
ভিতরে যেতে একটু দ্বিধাই করছিলাম। একটু শঙ্কাও লাগছিল , কোনো বিপদে পড়ব না তো ! এ কী সত্যি নীলোৎসী? নাকি অন্য কেউ? তবুও দুরু দুরু পায়ে ভিতরে বারান্দার দিকে চলে যাই। বারান্দাটির চারিদিকে গ্রিল দিয়ে ঘেরা। বাইরে ওপাশে শাল গজারির নিবিড় বন। আসন্ন দুপুরের তপ্ত সূর্যের আলো ঝরে পড়ছে বনের পাতার ফাঁক দিয়ে। কিচিরমিচির করছে বনের পাখিরা। দেখি, একটি হুইল চেয়ারে একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আমার আসার পথপানে করে বসে আছে। মুখখানি শুকনো এবং বিষণ্ণ সুন্দর। আমি চিনতে পারলাম, এই নীলোৎসী। আমাকে দেখে সে স্মিত হেসে বলে — ‘তুমি এসেছ রঞ্জন!’ পাশে একটা চেয়ার আগে থেকেই রাখা ছিল। আমাকে সেই চেয়ারটা দেখিয়ে বলল — তুমি এখানেই বসো।
নীলোৎসীর চেহারা আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমার চোখে আঁটকে ছিল। একটি প্রস্ফুটিত ফুলের মতো চেহারা ছিল ওর। আজ ওকে দেখে আমার মনটা হুহু করে উঠল। এই সেই নীলোৎসী যে কী না একসময় শত তরুনের হৃদয় কাঁপাত ! সেই নীলোৎসী এত রোগক্লিষ্ট, এত মলিন হয়ে গেছে।
এত ভগ্ন শরীর নিয়েও সে আজ হালকা নীল রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি পরে আছে। মুখে কোনো প্রসাধন করেনি। হাতে নীল পাথর বসানো চুড়ি পরেছে কেবল। আমার মনে পড়ে গেল– সেই কবে একদিন ইউনিভার্সিটির কোরিডোরে দাঁড়িয়ে ওকে বলেছিলাম —- তুমি একদিন নীল শাড়ি পরে ক্লাসে আসবে। নীলোৎসী বলেছিল — “আসব পরে একদিন।” কিন্তু নীলোৎসী আর নীল শাড়ি পরে আসতে পারেনি।
আজ কী আমাকে দেওয়া ওর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল?
খুব বেদনা ভরে নীলোৎসী আমাকে বলছিল —
তুমি কেমন আছো রঞ্জন? বললাম — আমি ভালো আছি।
— মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন?
— তোমাকে দেখার পরই হয়ত এমনটা হয়েছে আমার। তোমাকে দেখে কেমন যেন হয়ে গেছি আমি। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। তোমার কী হয়েছে নীলোৎসী?
— লিভার সিরোসিস। লিভার গলে পঁচে গেছে। দুইবার স্ট্রোকও করেছে। তারপর থেকে প্যারালাইজডৃ হয়ে গেছি। হাসপাতালে ছিলাম অনেক দিন। ডাক্তার ঔষধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে — বাড়িতেই বিশ্রামে থাকেন। মাঝে মাঝে টাংগাইল থেকে ডাক্তার ডেকে এনে ফলোআপ করিয়ে নেই।
— তোমার স্বামী ও ছেলেমেয়ে কোথায়? কাইকে যে দেখছি না।
— স্বামী গত বছর মারা গেছেন। এক ছেলে এক মেয়ে দুজনেই বিদেশে থাকে। মেয়ে কানাডাতে আর ছেলে আমেরিকায়। দেশে ওরা কেউই আসে না। মেয়েটা একটু খোঁজ খবর রাখে। ছেলেটি একদম না। মনে হয় ওরা ওদের মন থেকে শিকড় উপড়ে ফেলেছে।
নীলোৎসী বলছিল — থাক ঐসব কথা। তোমার বউ কেমন আছে?
— ভালো আছে।
— খুব সুন্দরীী মেয়ে বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই।
— হুম। তোমার মতোই দেখতে।
— কী নাম ওর?
— মায়া।
— মায়াবতী নিশ্চয়ই?
— হুম।
— ছেলেমেয়ে কজন?
— এক ছেলে দুই মেয়ে।
— ছেলেটা দেখতে নিশ্চয়ই তোমার মতো হয়েছে?
— হুম।
— মেয়ে দুটো কার মতো?
— মায়ের মতো।
আমি নীলোৎসীকে বললাম, তা এই বন নির্জনে কেন আছ? শহর ছেড়ে এত দূরে?
— আমার স্বামী বন বিভাগেই চাকুরি করত। দেশের কত বনারণ্যে ঘুরেছি, থেকেছি। এখানে এই মধুপুর রেঞ্জেও ওর পোস্টিং ছিল। ও এই জায়গাটা খুব পছন্দ করেছিল। পেনশনের টাকা থেকে এই জায়গাটা কিনে এই কাঠের বাংলাটা তৈরি করেছিল। বলেছিল — আমাদের শেষ জীবনটা এই বনকুঞ্জেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা আর কাটাতে পারল কই? আমাকে একা করে ফেলে রেখে বিধাতা ওকে আমার কাছে থেকে নিয়ে গেল। এখন তো আমি নিজেই মৃত্যুর প্রহর গুনছি।
আমি বললাম — জায়গাটা খুবই সুন্দর। একপাশে ঘন অরণ্য, আরেকপাশে ফসলের মাঠ। ছোট্ট সুন্দর একটি পুকুরও দেখলাম । পুকুর ভর্তি নীলপদ্ম ভরে আছে । সম্মুখে বাগান দেখলাম, রঙ্গন,জবা, চেরী , গোলাপ, বেলী ফুল সব ফুটে আছে।
নীলোৎসী বলছিল — পত্রে তুমি লিখেছ, আজই বিকেলে তুমি চলে যাবে। যদি তুমি থাকতে তাহলে বুঝতে পারতে এখানে কী সুন্দর রাত্রি নামে। সন্ধ্যার পরপরই আস্তে আস্তে পাখিদের কলকাকলি থেমে যায়। তারপর রাত নামতে থাকে। শাল গজারি মেহগনি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যায়। দূরে অজস্র নক্ষত্রবীথি। ঝোপে ঝাড়ে জোনাক জ্বলে। জ্যোৎসায় ভাসে বন প্রান্তর। ফুলের সুবাসে ভরে থাকে এই বারান্দা, চাঁদের আলোর রশনি এসে আমার চোখে মুখে লাগে। আমার কী যে ভালো লাগে তখন। আমি কান পেতে থাকি। কার যেন দূরাগত পদধ্বনি শুনতে পাই। মনে হয় কেউ যেন হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসছে। আসলে কেউ আসে না। সবই ভ্রম!
নীলোৎসী বলছিল — কথায় কথায় দুপুর গড়িয়ে গেল। চলো– চারটা ডাল ভাত খেয়ে নেবে।
ও ওর পরিচারিকাকে ডাকতে যাচ্ছিল। আমি বললাম, কী জন্য ডাকছ? নীলোৎসী বলছিল, মেয়েটা এসে আমাাকে একটু ডাইনিং পর্যন্ত নিয়ে যাক।
আমি মেয়েটিকে ডাকতে দিলাম না। আমি নিজেই হুইল চেয়ারের পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। এবং চেয়ারটা ধরে ঠেলে নীলোৎসীকে ডাইনিং রুমে নিয়ে আসি। নীলোৎসী হুইল চেয়ারে বসেই আমার সাথে খেতে বসে। কোনো রিচ খাবার নেই। সাদা ভাত, ডাল, ডাটা দিয়ে টেংরা মাছের তরকারি, উস্তা ভাজা, টাকি মাছ ভর্তা আর কচুর লতি ও কাঁঠালের বিঁচি দিয়ে পুঁটি মাছের তরকারি। আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, ও যখন আমার বন্ধু ছিল, তখন আলাপ প্রসঙ্গে নীলোৎসীকে আমার এই পছন্দের খাবারগুলোর কথা প্রায়ই বলতাম। ও কী সেই কথা আজ পর্যন্ত মনে রেখেছে তাহলে?
বিকাল হয়ে যায়। আমি নীলোৎসীকে বলি — আমার চলে যাবার সময় হয়ে গেছে। ও বলছিল — হ্যাঁ, তোমাকে থাকতে বলব না। তোমার মায়াবতীকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। তোমার প্রতি আমার অধিকার সেই কবেই হারিয়েছি। এখন শুধু মিছে মায়াটুুকু ছাড়া কিছু নেই। কয়দিন ধরে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল। সেই কত বছর চলে গেছে। কত হাহাকার করেছি তোমাকে একটু দেখবার জন্য। এখন মনে হচ্ছে– মরেও শান্তি পাব। পরপারে তুমিও যখন যাবে তখন তোমাকে ঠিকই চিনে নিতে পারব।
আমি নীলোৎসীর অলক্ষ্যে আমার চশমার ফ্রেমের নীচে আঙুল দিয়ে চোখের কোণটা মুছে নেই। ওকে বললাম — আসি এখন।
নীলোৎসী বলছিল– আমার হুইল চেয়ারটা একটু দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাবে? আমি চেয়ারটি ঠেলে ওকে দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাই। নীলোৎসী বলছিল -”আমার হাতটি একটু ধরে দাঁড় করাবে? আমি দরজাটা ধরে দাঁড়াব। দরজায় দাড়িঁয়ে তোমার চলে যাওয়া দেখব।” আমি ওর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দেই। ও কষ্ট করে দরজাটা ধরে থাকে। দেখলাম, ওর হাত পা কাঁপছে ।
নীলোৎসীর হাতটা ভীষণ গরম লাগল, কপাল ছুঁয়ে দেখি — সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমি ওকে বললাম — তোমার তো অনেক জ্বর। এতক্ষণ তুমি কোন্ শক্তিতে বসে আমার সাথে কথা বললে?
নীলোৎসী বলছিল — ও কিছু না। এই রকম জ্বর প্রায়ই হয়। ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যায়। আর, তোমার হাতটা খুব শীতল ছিল — তপ্ত জ্বর তাতেই চলে যাবে।
আমি নীলোৎসীর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। আসতে আসতে মনে হলো, পিছনে তাকিয়ে ওকে আর একবার দেখে নেই । বিদায় নিয়ে কারোর কাছে থেকে চলে আসার সময় নাকি পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। কিন্তু মন মানল না। আমি পিছনে মুখ ঘুরিয়ে নীলোৎসীকে আবার দেখলাম। ও দরজা ধরে আমার দিকে মায়া ভরে তাকিয়ে আছে।
ওর চোখে তখন কী জল ছিল? দূর হতে বোঝা গেল না।
২. মধুবালা
মাধুর যৌবনে এখন ভাটার টান। এই টানে ভেসে গেছে তার উতল রূপ যৌবন। যখন তার যৌবনে জোয়ার ছিল তখন চারদিক থেকে নৌকা এসে নোঙর করত দৌলতদিয়া ঘাটে। গোয়ালন্দ ঘাট রেল স্টেশন থেকেও আসত মধুকররা। এখন কারোরই তেমন আনাগোনা নেই। এখন আর কেউ আসে না। ভাটার জলে সব মৌ পাখিরা ভেসে গেছে।
এই মৌপল্লীতে মাধুর পুরো নাম মধুবালা। যমুনা পদ্মার সঙ্গম স্থলের স্রোতের ঘূর্ণির মতো তার দেহবল্লরীতে একসময় ছিল খরস্রোতধারা। মধুওয়ালি নিরুদ্বিগ্ন চিত্ত — এ যে যক্ষপ্রিয়া! আয়ত চোখ পথের দিকে চেয়ে থাকত, ঠোঁটে তার ক্ষীণ সুস্মিতরেখা। সে যেন “দেহ দাহন ক’র না দহন দাহে, ভাসায়ো না তাহা যমুনা প্রবাহে” কিংবা “প্রাণ যদি দেহ ছাড়া, না দ’হ বহ্নিতে মোরে না ভাসায়ো যমুনা সলিলে”।
কে এই মধুবালা ?
চিত্রা নদীর পারে ছোট্ট একটি ছায়া ঢাকা গ্রাম রূপাদিয়া। যেখানে হিজল বনে দোয়েল শীশ দেয় মিষ্টি রোদ্দুর ভোরে। যেখানে মৌমাছি চাক বেধে থাকে আম গাছের ডালে। বসন্ত বাতাসে বাঁশঝাড় থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। এই গ্রামেরই এক গরীব দিন মজুর নাম মতি মিয়া। এই মতি মিয়ার মেয়ে হচ্ছে মধুবালা। বাবা-মা ওর নাম রেখেছিল — সাহানা।
হলদে পাখির মতো সাহানা নামের এই বালিকাটি ঘুরত ফিরত বেড়াত চিত্রা নদীর পারে। সে সবারই ফয়ফরমাস করত। সবাই ওকে ভালোবাসত। বেশ সুন্দরী ছিল সে। কিন্তু তার রূপ লাবণ্য ঢাকা পড়ে থাকত মলিন কাপড়ে। পরিপাটি করে কখনো চুল আঁচড়াত না। বেণী বাঁধত না। পায়ে আলতা পরত না। হাতে পরত না চুড়ি।
সাহানা তৃতীয় ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল। তাদেরই গায়ের এক মুুরুব্বী জাতীয় লোক এসে একদিন মতি মিয়াকে বলে — মতি, তোমার মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দাও। ভালো একটা পাত্র আছে।’
— ভালো ছেলে পাইলে বিয়া দিয়া দিমু।
— পাত্র এই গায়েরই। শুক্কুর আলীর ছেলে সাহেদ আলী।
তুমি তো জানোই শুক্কুর আলীর মোটামুটি জমিজিরাত আছে।
— কিন্তু সাহেদ যে বাদাইমা, কিছু কইরা খায় না।
— ওহ্ কিছু হবে না। বিয়ার পর সব ঠিক হইয়া যাইব।
সাহানা তখন ছিল নিতান্তই চোদ্দ পনেরো বছরের একটি বালিকা। অগ্রহায়ণের এক চন্দ্ররাত্তির দিনে তার বিয়ে হয়ে যায় সাহেদ আলীর সাথে। সাহেদ আলী একটি বাউন্ডেলেও। নিজে গান না গাইলেও সে হাটে বাজারে বিভিন্ন গানের আসরে গান শুনে বেড়ায়। বন্ধুদের সাথে শহরে যেয়ে সিনেমা দেখে। রাজ্জাক ছিল তার প্রিয় নায়ক। রাজ্জাকের মতো করে চুল আঁচড়াত। সে একটু উদাসীন হলেও সাহানাকে সে খুব ভালোবাসত। এক বছরের মাথায় তাদের একটি ছেলেও হয়। সাহেদ তার পুত্রের নাম রাখে আব্দুর রাজ্জাক।
এক ভরা বর্ষার দিনে ফরিদপুর থেকে একটি যাত্রাপালার দল এসে ভেড়ে তাদের রূপাদিয়া বাজারের চিত্রা নদীর ঘাটে। এই যাত্রাপালা এখানে এক সপ্তাহ থাকে। সাহেদ প্রতি রাতে যাত্রা দেখতে যেত। সাহানা এই জন্য খুব মন খারাপ করে থাকত। একদিন রাতে ছিল ‘আলোমতি’র পালা। সাহেদ সাহানাকে বলে — ‘বউ, আজ আলোমতি হইবে।’
— আমারে সাথে নিবা? আমি দেখমু। আমি আলো হব আর তুমি হবে মতি।’
— ‘আইচ্ছা, তবে আমার সাথে চলো।’
সে রাতে তারা দুজনেই যাত্রা দেখতে গিয়েছিল। যাত্রা দলের ম্যানেজার তাদের দুজনকেই দেখতে পায়। যাত্রা পালা শেষ হলে, ম্যানেজার সাহেদকে বলে — তোমরা ইচ্ছে করলে আমাদের যাত্রা দলে যোগদান করতে পারো।’
যেদিন সন্ধ্যায় যাত্রা দলটি রূপাদিয়া বাজার ত্যাগ করে চলে যায়, সেদিন গোপনে সাহেদ আলী বাড়ির কাউকে না বলে সাহানাকে নিয়ে নৌকায় গিয়ে ওঠে।
নৌকায় ওঠার আগে বাড়িতে তাদের যে কথোপকথন হয়েছিল তা হলো —
— বউ, আমি ষাইতেছি।
— তুমি যাইও না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকিতে পারিব না।
— তাহলে তুমিও আমার সাথে চলো।
— রাজ্জাকের কী হইবে?
— বাজান আর মায়ে দেইখব।
— আমিও যামু তোমার লগে।
— আইচ্ছা, চলো।
যাত্রাদলের নৌকাটি ছিল বজরার মতো। তখন ছিল সন্ধ্যা রাত্রি। বাইরে ভরা বর্ষার মতো জোছনার প্লাবন। স্রোতের অনুকূলে নৌকাটি চলতে থাকে। ভিতরে দুই তিনটি হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে। যন্ত্রী দল খুঞ্জরী ও হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। যাত্রাদলের এক গায়েন গান ধরেছে —
‘আর কতকাল ভাসবো আমি
দুঃখের সারী গাইয়া
জনম গেল ঘাটে ঘাটে আমার
জনম গেল ঘাটে ঘাটে
ভাঙা তরী বাইয়া রে আমার
ভাঙ্গা তরী বাইয়া।।’
সাহানা বজরার এক কোণে বসে গানটি শুনতে থাকে। ওর মাথায় লম্বা ঘোমটা। যাত্রাদলের অন্য মেয়েরা মিটিমিটি করে হাসতে থাকে। কেউ বলে — ‘এ আমাদের নতুন নটী গো!’
কেউ বলে — ‘এ তো হিরোইন গো! এ যে মধুবালা।’
এই সাহানা, এই মধুবালা চিত্রা নদীর উপর দিয়ে নৌকায় ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে যায়। তার বালিকাবেলার রূপাদিয়া গ্রাম অনেক পিছনে পড়ে থাকে। পিছনে পড়ে থাকে তার শিশু পুত্র রাজ্জাক। কত ঘাটে, কত বাজারে, কত হাটে, কত মেলায় যে নৌকা ভিড়ল। তার শেষ নেই।
যাত্রা দলে যোগ দেওয়ার কয়েকদিন পরে খুব রহস্যজনক ভাবে গোয়ালন্দের কাছে একরাতে পদ্মা নদীতে পড়ে যেয়ে সাহেদ আলীর সলীল সমাধি হয়। পদ্মার খরস্রোতে তার লাশ কোথায় ভেসে যায়, কেউ তা জানে না।
সাহানা যাত্রা দলে বছরখানেক ম্যানেজারের রক্ষিতা হয়ে থাকে। সময়ে অসময়ে সে তাকে ভোগ করে। সাহানাকে দিয়ে দেহবৃত্তিও করানো হয়। তারপর একসময় খুব চরা দামে তাকে বিক্রি করে দেয় দৌলতদিয়া পতিতা পল্লীতে। এখানেও তার নাম হয় মধুবালা। পল্লীর সবাই ডাকে মাধু বলে।
মাধু আর কখনোই ফিরে যায়নি চিত্রা নদীর পারে তার রূপাদিয়া গ্রামে। কত জলসায় উদ্দাম ঘুঙুরের শব্দ বেজেছে। কত মধুময় গানে সে ঠোঁট মিলিয়েছে। কত পুরুষ কত ধ্রুপদী রাত কাটিয়েছে। কত উল্লাস, কত আনন্দ করেুছে তার দেহ নিয়ে। সুখের সেই আনন্দ ক্ষণে মনে পড়ত তার শিশু সন্তানের কথা। প্রিয়তম স্বামীর কথা। ছায়া ঢাকা, মায়া ঢাকা রূপাদিয়া গায়ের কথা।
খদ্দেররা যখন তার শরীর ভোগ করত, তখন সে নীচে শুয়ে বিষণ্ণ চোখে অনেক দূরে চেয়ে দেখত তার কৈশোর। দেখত খোকসা গাছে টোনাটুনিদের বাসা। পিয়ারা গাছে দেখত দুটো ধানশালিক বসে ঠোকাঠুকি করছে। দেখতে পেত সে হাঁস মুরগির খোয়ারের দুয়ার খুলে দিচ্ছে। ছুটাছুটি করে হাঁসগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে চিত্রা নদীর জলের দিকে।
মধুবালা এখন বিগত যৌবনা। পদ্ম নদীর ঘাটে ভিড়ানো নৌকাগুলো থেকে আগের মতো খদ্দের আর বেশি তার ঘরে আসেনা। কত দুঃখ সুখের বেদনার বছর চলে গেছে। কখন চলে গেছে পঁচিশটি বছর!
সেদিন সন্ধ্যায় মধুবালা জ্বেলেছিল তার ঘরে ধূপবাতি। ঠোঁটে লিপস্টিক মেখেছিল, মুখে গালে মেকআপ করেছিল পুরু করে। চোখে পরেছিল কাজল। চুল খোপা করেছিল। গাদা ফুলের মালাও বেঁধেছিল খোপায়। শরীরে মেখেছিল সুগন্ধি আতর। সর্দারনী চন্দনা এসে টিপ্পনী কেটে বলেছিল– ‘কী লো, তোকে দেখি আজ এক্কেবারে মধুবালার মতো লাগছে! তা কোন্ নাগর আসবে আজ তোর ঘরে?’
মাধু সুচিত্রার মতো মোহনীয় হাসি হেসে বলেছিল– ‘আসবে, কেউ একজন আজ আসবে গো।’
হ্যাঁ, সে রাতে একজন নাগর এসেছিল তার ঘরে।
সকালবেলা মাধুর কোনো সারা শব্দ না পেয়ে সর্দারনী চন্দনা ওর ঘরে ঢুকে। দেখে — ফ্যানে শাড়ি বেঁধে ফাঁসিতে মধুবালা আত্মহত্যা করেছে। ঠোঁটের লিপস্টিক এবড়োখেবড়ো, চুল আলুলায়িত, খোঁপায় বাঁধা গাঁদাফুলগুলো ছিঁড়ে ছিটে গেছে। গালে এবং গলার নীচে চুম্বনের জখম চিহ্ন। তার বিছানার উপর কিছু টাকা ছড়িয়ে আছে। আর পড়ে আছে একটি ন্যাশনাল আইডি কার্ড। আইডি কার্ডটি একজন চব্বিশ পঁচিশ বছরের যুবকের। নাম —
আব্দুর রাজ্জাক, পিতা – মৃত সাহেদ আলী, মাতা — সাহানা খাতুন, গ্রাম — রূপাদিয়া, জেলা — নরাইল।
খদ্দেরের পুলিশী হয়রানী হবে ভেবে চতুর চন্দনা তার আইডি কার্ডটি লুকিয়ে ফেলে।
৩. পিছনে ফেলে আসি
একদিন বিকালে আমার এক রুমমেটের সহপাঠী কৃষ্ণচন্দ্র রায় আমাদের রুমে আসে। রুমমেটের সহপাঠী সূত্রে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সাথে আমারও বেশ বন্ধুত্ব হয়। তখন ইউনিভার্সিটি গ্রীষ্মকালীন ছুটি হয়েছে। আমি বাড়িতে আসব জেনেই এই কৃষ্ণচন্দ্রের রুমে আগমন। কৃষ্ণ বলছিল — ‘দাদা, আপনার কাছে কিছু জিনিস দিতাম, এগুলো যদি আমার এক মাসীমার কাছে পৌঁছে দিতেন আমি খুব কৃতজ্ঞ হব। আপনার বাড়ি থেকে আমার মাসিমার বাড়ি মনে হয় খুব বেশি দূরে নয়।’
আমি কৃষ্ণকে বললাম — ‘দিয়ে দাও। পৌঁছে দিব। তোমার মাসী আমারও মাসী।”
কৃষ্ণ একটি কাপড়ের ব্যাগ আমার হাতে দেয়।
দেখলাম ব্যাগের ভিতর দুটো সাদা রঙের শাড়ি কাপড়। দুটো ব্লাউজ, আর দুজোড়া চটি জুতো। কৃষ্ণ একটি সাদা টুকরো কাগজে ঠিকানা লিখে দেয়। ঠিকানা —
শ্রীমতী সারদা রাণী বৈদ্য
স্বামী — স্বর্গীয় অরুণ কুমার বৈদ্য
ক্ষীরতলা, রায়গঞ্জ, পাবনা।
চৈত্র মাসের একদিন ভোরে আমাদের বাড়ি হতে ক্ষীরতলা রওনা হই। প্রায় ছয় ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। মাঝে একটি নদীও পার হতে হবে। আমি কোনো দিন ঐ পথে যাইনি। চিনিও না ঠিক মতো। তবুও রওনা হলাম।
আমি বাগবাটী স্কুলের ছাত্র ছিলাম। তাই ব্রহ্মগাছা পর্যন্ত পথ মোটামুটি আমার চেনা ছিল। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে ধুলো পথে ব্রহ্মগাছা পর্যন্ত যেতে আমার প্রায় তিন ঘন্টা লেগে যায়। এইটুকু আসতে রোদে পুড়ে ক্লান্ত হয়ে উঠি। দুতিন জায়গায় গাছের তলায় জিরিয়েও নেই। পথে খুব পানি তেষ্টা পেয়েছিল। এক বাড়িতে যেয়ে পানি চাই। একটি বালিকা পিতলের গ্লাসে করে কুয়ো থেকে ঠান্ডা পানি দিয়ে আমার তেষ্টা মিটিয়েছিল।
যেতে যেতে একসময় সামনে একটি নদী পড়ে। নদীটির নাম সম্ভবতঃ ফুলজোর। খেয়া নৌকা দিয়ে নদী পার হই। নদী পার হয়ে এক লোককে জিজ্ঞাসা করি — ‘ক্ষীরতলা কোন পথে যাব?’
সে আমাকে ক্ষীরতলা যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। এবার মেঠো পথ। পথের দুধারে সদ্য বিজ বোনা আউশধান ও পাট ক্ষেত। একসময় ক্ষীরতলা গ্রামটিতে পৌঁছে যাই।
গ্রামটিতে এসে একটু অবাকই হই। জায়গায় জায়গায় উঁচু মাটির ঢিপি। ঢিপির পাশ দিয়ে পাকুড় আর হিজল গাছ। তারই মধ্য দিয়ে পায়ে চলা ধুলার পথ। এই পথ গিয়েছে গ্রামের বাড়িগুলোর দিকে। কোথাও বা চাষের ক্ষেত। কোথাও মিষ্টি আলুর ক্ষেত, কোথাও বা কিছুই নেই—ফাঁকা।
এক লোককে জিজ্ঞাসা করে আমি সারদা মাসীর বাড়টি চিনে নেই। মাটির দুটি ঘর। ছোনের চালা। আমি উঠোনে যেয়ে দাঁড়াই। একজন শীর্ণকায় পঞ্চাশোর্ধ মহিলা ঘর থেকে বের হয় আসে। পরনে সাদা ধুতি কাপড়। মাথায় ঘোমটা দেওয়া। গায়ের রঙ গৌরিও। হাতে শাঁখা পত্তর কিছু নেই। আমাকে দেখে মহিলা বলে — তুমি কে গো? কোথায় থেকে আসিয়াছ।
— নমস্কার। আমার নাম রঞ্জন। আমি কৃষ্ণচন্দ্রের বন্ধু। আপাততঃ কুসুমপুর থেকে আসিয়াছি। আমি কৃষ্ণের মাসিমার সাথে দেখা করব।
— আমিই কৃষ্ণের মাসিমা। তা কি জন্য বাবা?
মাসিমা আমাকে বারান্দায় একটি কাঠের টুলে বসতে দেয়। আমি কৃষ্ণের দেওয়া ব্যাগটি তাঁর হাত তুলে দিয়ে বলি– ‘এগুলো কৃষ্ণ আপনাকে দেওয়ার জন্য আমার কাছে দিয়েছে।’
আমি যখন ঐ বাড়িতে পৌঁছি, তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম, উনি কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েছে। আমাকে এই অসময়ে কী খেতে দেবে?
মাসীমা কাউকে ডেকে বলছিল, যিনি ঘরের ভিতরে আছে। ডাকছিল — ‘অর্চনা, ও অর্চনা! এদিকে আয়!’
সাদা কাপড় পরা একজন বছর একুশের মেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়।
মাসী ঐ মেয়েটিকে বলছিল — ‘এই ছেলেটিকে কিছু জলপানি খেতে দাও। রোদে পুড়ে বড়োই পেরেসান হয়ে এসেছে।’
মেয়েটি ভিতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একটি বড়ো পিতলের থালায় করে বাতাসা, নারকেল কোরা, সন্দেশ আর একটা কাঁচের গেলাসে জল নিয়ে এসে আমার সামনে রাখে।
মাসীমা বলছিল — ‘এগুলো খেয়ে নাও বাবা।’
মেয়েটি উঠানের জাম্বুরা গাছতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে চুপিচুপি দেখছিল। তখন ঝাঁঝালো চৈত্রের পরন্ত দুপুর। দূরে হিজল গাছের ডালে বসে ঘুঘু আনমনে ডেকে চলছিল।
আমি জলপানি খেয়ে মাসিমাকে বলি– ‘আমি অদ্যই চলিয়া যাইব।’
— ‘এটা কী করে হয়, তুমি বড়োই ক্লান্ত। কিছুই তেমন খাও নাই। আজ থাকো। কাল প্রত্যুষে চলিয়া যাইবে।’
আমি মাসীমার কথা ফেলতে পারলাম না।
ভাটি দুপুরে বাড়ির দাওয়ায় শীতল পাটি বিছিয়ে আমাকে খেতে দেয়। ভাতের সাথে ছিল গন্ধরাজ লেবু, নিমপাতা ভাজা, সজনে ফুলের তরকারি আর মুসুর ডাল। অর্চনাই পরিবেশন করছিল। খেতে খেতে জেনে গিয়েছিলাম — অর্চনা অকাল বিধবা। একথা জানার পর আমার মন খারাপ লাগছিল, এত অল্প বয়সে মেয়েটি বিধবা হয়ে মায়ের ঘরে পড়ে আছে।
পরন্ত বিকালে অর্চনা এসে বলছিল — ‘দাদা ভাই, তুমি আমাদের গ্রামটি ঘুরে দেখে আসো। ভালো লাগবে। এখানে নদী আছে। মন্দির আছে। ভিরাট রাজার ভগ্ন রাজ প্রাসাদ আছে। হিজল তমাল গাছের সারি আছে। কবেকার এক সরজু বালা এখনও সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায় দিগচিহ্নহীন জয় দূর্গা মন্দিরে। দেখে আসো তুমি– আলোজ্বলা এক সন্ধ্যা রাত্রি।
আমি ঘুরতে বের হই। পথের দুধারে ঘাটফুলের উপর সাদা ডানা কালো ছিট ছিট প্রজাপতি উড়ে উড়ে এসে বসছে। ক্ষেতের আলপথ ধরে নিমগাছের সারি। নিমফুলের রেঁণু ছড়িয়ে আছে মাটির উপর। পুকুর পাড়ে কদম গাছ। পশ্চিম পাশটায় অন্ধকার বাঁশবন। আছে আম ঝোপ।
অদূরে জয় দূর্গা মন্দির। আজ থেকে আড়াইশত বছর আগে জমিদার নবীন কিশোর রায় চৌধুরী নাকি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল। যা এখন ভগ্নস্তূপ। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। আমি কান পেতে ছিলাম, যদি শুনতে পাই সরজু বালার পূজার সেই আরতির ধ্বনি। যদি কোথাও সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে ওঠে। নাহ্ কোনো আলো জ্বলে উঠল না।
রাতে খেয়ে পাট সোলার বেড়ার ওপাশের রুমে চোকির উপর শুয়ে আছি। ঘুম আসছিল না চোখে। রাত বাড়তে থাকে। রাতের পাখিদের অদ্ভুত কিছু ডাক মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল। মনটা এক অস্পষ্ট বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। রাতে খাবার সময় মাসীমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম — ‘মাসীমা আপনারা কী ভালো আছেন?’ কেরাসিন কূপীর আলোয় দেখেছিলাম মাসীমার মুখখানি। কেমন বিমর্ষ ছিল সেই মুখ, কেমন ভয় ছিল চোখে মুখে। মাসীমা বলেছিল — ‘ভালো নেই বাবা।’ কৃষ্ণকে বলো — ‘ও যেন এসে আমাদের একবার দেখে যায়। খুব শীঘ্রই হয়ত ওপারে চলে যেতে হবে।’ হঠাৎ রাতের স্তব্ধতায় কার যেন গুমরে গুমরে কান্নার শব্দ শুনতে পাই। মেয়ে মানুষের কান্না। মনে হলো, অর্চনা কাঁদছে।
ঘুমহীন রাত শেষ হয়। প্রত্যুষেই আমি মাসীমার কাছ থেকে বিদায় নেই। হেঁটে হেঁটে ষখন চলে আসছিলাম হিজল তমালের ছায়াপথ ধরে, তখন মনে হচ্ছিল — কোনো এক অভাগী অর্চনা চালতা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
৪. ঘাসফুল
বাড়ির পূর্ব পাশটায় বাহির উঠোন। তারপরই পুকুর। পুকুরের একপাশে আম কাঁঠাল গাছের সারি। আর দুপাশে চালা। আরেকপাশে শস্য ক্ষেত। পুকুরের চালায় সবুজ ঘাসে ভরে থাকে। নানান জাতের ঘাসফুল ফুটে স্তুপ হয়ে থাকে।
এক অপরাহ্ণ বেলায় আনোয়ার এসে বসেছিল সবুজ ঘাসের উপরে। কেউ নেই কোথাও। পাড়ের ছাতিম গাছটার ডালে বসেছিল কয়েকটি হলুদ রঙের ফিঙে পাখি। চ্রিরি চ্রিরি করে ডাকছিল ওরা। যে ঘাসের ঢিঁবির উপর আনোয়ার বসেছিল, সেই ঘাসগুলোও আলতো করে জড়িয়ে রেখেছিল ওকে। আর তখন ভাঁটফুলের জঙ্গল থেকে গন্ধ আসছিল ঝিরিঝিরি বাতাসে, যেন পুকুরের জল ছুঁয়ে শীতল করে তুলছিল আনোয়ারের শরীর।
আনোয়ার প্রকৃতি মানব। ও খালি গলায় গান গায় একাকী কোথাও নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ও প্রায়ই এবেলায় ওবেলায় হারিয়ে যায়, কিংবা এক রাত্রির জন্য কোথাও গুম হয়ে যায় । সংসারে ওর কোনো দায় নেই, কোনো টান নেই। ওর একটি সরল মুখশ্রীর স্ত্রী আছে, মর্জিনা। এখনো বালিকা বয়স সে পার করেনি। যত দায় এই বালিকার!
আনোয়ার বিরবির করে গান গাইতে চেয়েছিল। কিন্তু গাইল না। একটা নীল রঙের ছোট্ট প্রজাপতি এসে পড়ছিল ওর গায়ের উপর। গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে প্রজাপতি বসে পড়ে ওর কাধের উপর। আর আনোয়ার স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল পুকুরের শান্ত জলের দিকে।
তখন সূর্য অস্তমিত হচ্ছিল পশ্চিম দিগন্তের নীচে। নিরবে আঁধার নেমে আসছিল পুকুর পাড়ে। সন্ধ্যার পাখিরা এসে বসেছিল আম কাঁঠালের ডালে। রাত নামছে যত, তত সেই কিচিরমিচির স্তব্ধ হতে থাকে রাতের গভীরে। আনোয়ার পাড়ে বসেই আছে। পুকুরের পূর্ব পাশের ধানক্ষেতের ভিতর জোনাকিদের আলো জ্বলে উঠেছিল। উপরে আকাশ ভরা তারা জ্বলছিল। কী এক নিরবতায় অবশ হতে থাকে ওর শরীর। আনোয়ার শুয়ে পড়ে ঘাসের উপর। ভাঁটফুলের গন্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। আনোয়ার গুণগুণ করে গান গাইতে থাকে –
‘কার ঘরে বাতি জ্বলে
এ নিশি রাইতে
আমারে তুই তর মায়ায়
অরে আমারে তুই তর মায়ায়
রেখে দে এ নিশি রাইতে
কার ঘরে বাতি জ্বলে এ নিশি রাইতে…।’
মর্জিনা কচু শাক ও কাঁঠালের বিচি দিয়ে নাবরা রান্না করে রেখেছে। ওর স্বামীর জন্য কুপী জ্বেলে বসে অপেক্ষা করছে । আনোয়ার আসে না। মেয়েটি উৎকণ্ঠায় কুপী হাতে নিয়ে সেই আঁধার রাত্রিতে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাড়ির বড়ো উঠোন পেরিয়ে সে পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায়।
মর্জিনা দেখে আনোয়ার পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর শুয়ে আছে। ওর শরীরের চারপাশে সাদা ঘাসফুলের মঞ্জরি। অজস্র জোনাকি আলো ছড়াচ্ছে অদূরে ধানক্ষেতে। অজস্র তারার আলো এসে পড়েছে আনোয়ারের শরীরের উপর। প্রান্তরের মাঝখানে শিমুল গাছের উপর হুতোম পেঁচা কোঁৎ কোঁৎ করে ডাকছে। মর্জিনা দেখে, আনোয়ার চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওর চারপাশে ঝিঁঝি পোকারা ঘিরে ধরে ঝিঁও-ঝি শব্দে ডাকছে।
মর্জিনা আনোয়ারের সিওরে বসে। ওর গালে আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডাকতে থাকে — ‘এই উঠবা না? তোমার জইন্যে নাবরা রানদিছি। ওঠো, বাইত চলো।’
আনোয়ার কোনো কথা বলে না।
সে তখন পোকামাকড়দের সাথে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হেমন্ত শিশির পড়ে ওর মলিন জামাটি ভিজে গেছে। সে হয়ত স্বর্গের কোনো গানের পাখির সাথে কথা বলছে। ওর চেতনা চলে গেছে পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে অন্যত্র। মর্জিনা আবার ডাকে — ‘এই ওঠো, বাইত যাইবা না?’
৫. ফুলমতি
ছোটবেলার কথা। আমাদের গ্রামে একজন পাগলিনীকে দেখতাম, নাম ফুলমতি। আটপৌরে করে মলিন ছেঁড়া কাপড় পরে থাকত। চুল ছিল আলুথালু উঁকুনে ভরা। না আঁচড়ানোর কারণে জটা ধরে গিয়েছিল। মাসের মাস গোসল করত না। শরীর ভরা দুর্গন্ধ। তার এই দুর্গন্ধের কারণে কেউ তার কাছে দিয়ে হাঁটত না। সবাই নাকে কাপড় চেপে চলত।
ফুলমতি কেন পাগল হইল, এই কথা তারও কয়েক বছর পর জানতে পারি। আমাদের পাশের গ্রামের এক মাথাছিটা লোকের সাথে তার নাকি বিয়ে হয়েছিল। সেই লোক বিয়ের অনেক আগে থেকেই মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেত। উধাও হয়ে সে কখনও ছয় মাস, কখনও এক বছর, কখনও দুই তিন বছর পর বাড়ি ফিরে আসত।
লোকটির নাম ছিল জয়নাল। সবাই জয়নালের বাবা মাকে বুদ্ধি দিল — ‘জয়নালকে বিবাহ করাও। দেখবে, ওর মাথার ছিটা ভালো হয়ে গেছে।’
একদিন এক ভাদ্রের পঞ্চমী তিথীতে গরীব অনাথ এই মেয়েটির সাথে জয়নালের বিবাহ দেওয়া হয়। বিয়েতে কোনো উৎসব আয়োজন করা হয় নাই। মসজিদের হজুরকে ডেকে কালেমা পড়ানোর মাধ্যমে তাদের বিবাহ সম্পন্ন করা হয়।
তাদের জন্য ছোনের কুঁড়েঘরে বাসরসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু মধ্য রাত্রিতে জয়নাল তার নববধুকে ‘আসি’ বলে ঘরের দরজা খুলে যে বাহির হয়ে চলে যায়, তারপর জয়নাল আর ফিরে আসে নাই।
তার কয়েকদিন পর একরাত্রিতে গ্রামের এক টাউট ফুলমতিকে একা পেয়ে তার ঘরে ঢুকে বলাৎকার করে। এ কথা জানত শুধু কয়েক জনে। এই ঘটনার পর থেকেই ফুলমতি পাগল প্রকৃতির হয়ে যায়। তার শরীরে থেকে এখন পঁচা দুর্গন্ধ বেরয়। ঘেন্নায় তার থেকে সবাই দূরে থাকে।
তারও কয়েক বছর পরের কথা। তখন আমি হাইস্কুলে পড়ি। তখন ছিল গ্রীষ্মকাল, মর্নিং স্কুল। আমি সকালবেলা বই পত্তর হাতে করে স্কুলে যাচ্ছিলাম। কুন্ডুবাড়ি পার হতেই দূর হতে দেখি, একটি লোক ও একটি মেয়ে সুশিলা দেবীর পুকুর ঘাট হতে সদ্য স্নান সেরে আসছে। যখন কাছে আসে, মেয়েটিকে দেখে চিনতে পারি। এ যে ফুলমতি! তার মুখ হাস্যজ্বল, পরনে পরিপাটি কাপড়। চুলগুলো ভেজা হলেও গোছানো। গতরে যে সুগন্ধি সাবান মেখেছে, এটা বোঝা গেল। কিন্তু পাশের লোকটিকে আমি চিনতে পারলাম না। অনেকটা কৌতূহল মনে রেখে স্কুলে চলে যাই।
দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে জানতে পারি গতরাতে ফুলমতির স্বামী ফিরে এসেছে। আর পথে দেখা ঐ লোকটি ছিল জয়নাল। জয়নাল একটি টিনের বাক্সে করে ফুলমতির জন্য নতুন শাড়ি কাপড়, ব্লাউজ, সায়া, আয়না, সাবান, চূড়ি, নাকফুল, তিব্বত স্নো পাউডার, আতরের শিশি, আলতা কিনে নিয়ে এসেছে।
আজ রাতেও ফুলমতির ঘরে সন্ধ্যা শিখা জ্বলবে। আতরের গন্ধে ভাসবে কুসুমপুরের বাতাস। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ হবে। সে শব্দও থেমেও যাবে। চাঁদ উঠবে, চাঁদও ডুবে যাবে। গল্প করবে ফুলমতি জয়নালের সাথে। রাতের নিস্তব্ধে সে গল্পকথাও একসময় স্তিমিত হয়ে আসবে।
৬. অনাদৃতা
এই কাহিনির ঘটনাকাল বাংলা চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়েরও পরের।
মানুষের তার সুখের অথবা দুঃখের মুহুর্তে এমন
কারোর কথা মনে পড়ে, কিংবা এমন কাউকে দেখবার প্রবল ইচ্ছা করে, তা শুধু সেই জানে।
হায়দার আলীর আজ বি,এ পরীক্ষার রেজাল্ট হল।
সে পাশ করেছে। আজ তার সুখের দিন। আজকের এই সুখের দিনে তার মনে পড়ছে অনেক বছর আগের একজন অচ্ছুত মেয়ের কথা। যে তাকে শিশু কালে খুব আদর যত্ন করেছিল, তাকে বড়ো বোনের স্নেহ মমতা দিয়েছিল।
তখন তার বয়স ছিল তিন বছর। পিতৃহীন এই শিশু মায়ের সাথে থাকত খুলনার একটি পতিতালয় সংলগ্ন এক বস্তীতে। মা গ্রাম থেকে খুলনা এসেছিল ঝিয়ের কাজ করতে। কোন্ গ্রাম থেকে এসেছিল, সে কথা তখনকার কেউ বলতে পারে নাই।
হায়দারের মা শহরের বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ করত। তখন কাজের জন্য মজুরি পাওয়া যেত না। শুধু খেতে দিত। হায়দারের মা তার নিজের খাবার থেকে ছেলেকে খাওয়াত। দিন চলত দুঃখ কষ্টে। এই দুঃখ কষ্টের ভিতর দিয়েই তিন বছর চলে যায়। শিশু হায়দার এই বস্তিতেই বেড়ে উঠতে থাকে।
বালক হায়দার ঘুরতে ঘুরতে প্রায়ই পতিতালয়ের ভিতরে ঢুকে পড়ত। ওখানকার একটি মেয়ে ওকে কাছে ডেকে খুব আদর যত্ন করত।
হায়দার দেখতে খুব সুন্দর ছিল। ছোট্ট সুন্দর এই বালককে আনোয়ারা নাম্নী ঐ পতিতা ওকে বোনের স্নেহ দিত। ওকে এটা ওটা প্রায়ই খেতে দিত। চকলেট হাতে দিয়ে হায়দারের গাল টিপে বলত — তুমি আমার ছোট্ট লক্ষী ভাই।’
হায়দারের মা টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় বস্তিতে মারা যায়। তার গ্রামের বাড়ি কোথায় সে কথা বস্তির কেউ জানত না। তাকে তাই বেওয়ারিশ অবস্থায় খুলনার একটি কররস্থানে দাফন করা হয়।
মায়ের মৃত্যু দিনে হায়দার কাঁদতে কাঁদতে আনোয়ারার কাছে চলে আসে। পিতৃ-মাতৃহীন এই বালককে আনোয়ারা তার আশ্রয়ে রেখে দেয়। কিন্তু বেশি দিন তার কাছে রাখা সম্ভব হয়নি। সর্দারনী প্রায়ই আনোয়ারাকে এজন্য খুব গালমন্দ করত।
এক সহৃদয়বান খদ্দের হায়দারকে ঢাকায় নিয়ে আসে এবং একটি অনাথ আশ্রমে তাকে দিয়ে দেয়।
হায়দার এই আশ্রমে লালিত পালিত হতে থাকে । এখানেই তার কৈশোর ও তারুণ্যের সময় কাটে। আশ্রমের কঠিন নিয়ম পালন করেই সে লেখাপড়াও করতে থাকে।
আশ্রম নথিতে হায়দারের আপন কোনো মানুষের বৃত্তান্ত নেই। তার বাবার নাম নেই। মায়ের নাম নেই। তার কোনো ঠিকানা নেই। তাকে কোনো আপন মানুষ কোনোদিন দেখতে আসেনি। কিন্তু প্রায়ই তার মনে পড়ত তার মায়ের কথা। মনে পড়ত তার সেই বোনটির কথা।
হায়দার কিশোর সময় থেকেই খণ্ডকালীন কাজ করত।
অনেক পরিশ্রম ও কষ্ট করে নিজের লেখা পড়া চালিয়ে যেত। আশ্রমে থেকেই সে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে।
তার বয়স আঠারো পূর্ণ হলে সে নিজ দায়িত্বে আশ্রম ত্যাগ করে। সে একটি প্রেসে চাকুরি নেয়। সে মেসে থাকে। প্রেসে চাকুরি করা অবস্থায়ই নৈশ কলেজে পড়াশোনা করে সে বি,এ পাশ করে।
আজকেই তার পরীক্ষার ফল বের হয়। সে এখন গ্রাজুয়েট। মেসের রুমে বিছানায় সে শুয়ে আছে। কখন সন্ধ্যা হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেছেহ, বুঝতে পারেনি। অন্ধকারের ভিতর মায়ের মুখটি অস্পষ্ট করে দেখতে পেল। মা এত দূরে চলে গেছে যে, তাকে আর স্বচোক্ষে কখনো দেখতে পাবে না।
সেই আঁধারে মায়ের মুখটি ছাপিয়ে যে মুখটি সন্ধ্যার বিষণ্ণ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, সে হল তার আনোয়ারা বুবুর মুখ। তার খুব ইচ্ছে হল — এই বোনটির সাথে সে দেখা করবে।
পনেরো বছর চলে গেছে। অস্পষ্ট করে মনে পড়ে কত মেয়েদের মুখ। কত মেয়ে কত সুন্দর করে সেজে থাকত সন্ধ্যা বেলায়। কত হাসি খুশি ছিল তারা। কত হৈহুল্লুর।কত মানুষ আসত সেখানে। তাদের মাঝেই দেখেছে তার আনোয়ারা বুবুকে। কিন্তু মুখখানি কিছুতেই আজ মনে করতে পারছে না।
সেই অস্পষ্ট মুখটি তার বড়ই দেখতে ইচ্ছে করছে। কোথায় গেলে দেখতে পাবে তারে! কতদূর! কোথায় সেই নিষিদ্ধপল্লী। যেখানে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে তার আনোয়ারা বুবুকে।
একদিন সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে খুলনাগামি একটি স্টীমারে সে ওঠে। স্টীমারটি ভেঁপু বাজিয়ে ছেড়ে যায়। তার ইচ্ছে হল না রেলিঙেএ দাঁড়িয়ে নদীর জল দেখতে। দোতালার ডেকের উপর চাদর বিছিয়ে মাথার নিচে কাপড়ের ব্যাগটি রেখে সে শুয়ে পড়ে। এবং কখন ঘুমিয়ে যায় বুজতে পারেনি।
পরেরদিন দুপুরে স্টীমারটি খুলনার রূপসা ঘাটে গিয়ে পৌঁছে। পেটে প্রচণ্ড খিদে ছিল। ঘাটে নেমে সে একটি টিনের চালা হোটেলে ভাত খেয়ে নেয়। একটু জিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে শহরের দিকে এগুতে থাকে। এই শহরের সে কোনো কিছুই চেনে না। কাকে বলবে, কোথায় পতিতালয়।
তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ফুটপাত ধরে হাঁটছিল আর শহরের বাড়িঘর গুলো দেখছিল। এইসব কোনো কোনো বাড়িতেই হয়ত তার মা ঝিয়ের কাজ করেছে। চোখ ছলছল করে উঠল তার। পথ চলতে চলতে সে দেখতে পায় একটি পুরনো কবরস্থান। তার হঠাৎ মনে হল, এই কবরস্থানেই হয়ত তার মাকে দাফন করা হয়েছিল।
সে মৃদু পায়ে হেঁটে হেঁটে কবরস্থানের ভিতরে ঢুকে পড়ে। বিশাল কবরস্থান। হাজার হাজার কবর এখানে। কত শান বাধানো কবর, কত আবার বাঁশের বেড়া দেওয়া। কত কবর অযত্নে এমনি পড়ে আছে। কত রকম গাছ গাছরায় ভরা এই কবরস্থান। কত রকম ফুলের গাছ। কোথায় অচিন হয়ে পড়ে আছে মায়ের কবরটি! একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এসে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে।
তখন পরন্ত বিকাল। এক লোককে সে জিজ্ঞাডা করে– ”ভাই পতিতালয়ে যাব কোন্ পথ দিয়ে?’
লোকটি হতভম্ব হয়ে হায়দার আলীর দিকে একবার তাকায়। সে বিস্ময়ে তার পুরো অবয়ব দেখে নিয়ে বলে — ‘ ওখানে যাবে কেন? ‘
হায়দার আলী বলে — ‘ওখানে আমার বড়ো বোন থাকে।’ লোকটি আরও বিস্মিত হয়! এবং বলে দেয়, কোন্ পথ দিয়ে বেশ্যাবাড়ি যেতে হবে।
তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকেল। অনকটা ক্লান্ত হয়ে হায়দার আলী বেশ্যালয়ের গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে অদূরে চোখ মেলে খুঁজতে থাকে তাদের বস্তি ঘরটি। কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। ওখানে এখন দালান উঠেছে। সব কেমন অচেনা লাগছে।
আজ থেকে পনেরো বছর আগে একটি পাঁচ ছয় বছরের বালক পাশের বস্তি থেকে হেঁটে হেঁটে এসে ঢুকত এই পতিতালয়ে। সেই বালকটি আজ থমকে দাঁড়িয়ে আছে এর রাস্তার উপর। অনেক কথাই তার মনে আসছে, আবার অনেক কথাই সে মনে করতে
পারছে না।
খুব ভয় পাচ্ছিল হায়দার আলী। খুব দ্বিধা করছিল সে। ভিতরে ঢুকবে কী ঢুকবে না। গলির মুখ জুড়ে অনেক মেয়ে রংবেরঙের সাজে দাঁড়িয়ে আছে। যে সমস্ত পুরুষরা ভিতরে ঢুকছে তাদের সাথে তারা বিভিন্ন খিল্লি করছে।
হায়দার আলীর মন ও হৃদয় আজ উন্মূখ! তার আনোয়ারা বুবুকে দেখার জন্য চিত্ত অস্থির হয়ে উঠেছে। কী এক অদ্ভূত টানে গলিতে সে ঢুকে পড়ে। ওকে দেখে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কেউ ওর হাত ধরছে, কেউ ধরছে সার্টের আস্তিন। এক একজন এক এক কথা বলছে। বিচিত্র সব অঙ্গ ভঙ্গি করছে। কেউ বলছে — ‘আজ দেখি, দেবানন্দ এল’, কেউ বলে — ‘এত দেখছি — উত্তম কুমার’। কেউ বলে — ‘দারুণ নাগর’! আবার কেউ চোলি থেকে উপচে পড়া স্তন দেখিয়ে বলে –‘কী আমাকে পছন্দ হয় না’! কেউ চোখ মারছে, কেউ দিচ্ছে শীষ।
হায়দার আলী তাদেরকে কোনো কথাই বলার সুযোগ পায়নি। বলতে পারেনি সে তার বোনকে দেখতে এখানে এসেছে। নিজেকে অনেকটা টেনে হিঁচড়ে মেয়েদের থেকে মুক্ত করে সে বাইরে চলে আসে।
হায়দার আলীর আর দেখা হল না ওর আনোয়ারা বুবুকে। ঐদিনই সন্ধ্যায় চলে আসে রূপসা তীরে। নদীর ঘাটে ঢাকায় আসবার জাহাজটি দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। এখুনি ছেড়ে যাবে। হায়দার আলী যেয়ে জাহাজটিতে ওঠে। সে রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে জলের দিকে মুখ রেখে ভাবছিল — বহু বছর আগের বিস্মৃতপ্রায় ঝাপসা একটি মুখচ্ছবির কথা। আজ থেকে পনেরো বছর আগে একটি অচ্ছুত মেয়ে তার হাতে চকলেট দিয়ে বলেছিল —‘তুমি আমার লক্ষী ছোট্ট ভাই।’
হায়দার আলী কান্না করে স্বগোতক্তি করে তখন হয়ত বলছিল –‘তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল গো বুবু। তুমি আজও কি তেমনই আছ? দেখা হলে কি হাতে চকলেট দিয়ে বলতে — লক্ষী ভাইটি চকলেট খেয়ে নাও।’
ঘাট থেকে একটি পুরনো জীর্ণ স্টীমার কালা ধূয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আঁধার করে ভেঁপু বাজিয়ে ছেড়ে চলে গেল মাঝ দরিয়ায়। হায়দার আলী আঁধার হওয়া আকাশ দেখছিল স্তব্ধ নয়নে। সেখানেও সে তার বুবুকে দেখতে পাচ্ছিল আবছা করে।
রূপসার জল এমন করুণ করে এর আগে কখনো ছলাৎছল করেনি!
৭. রাতের ক্ষণিকা
ব্যবসায়িক কাজে সেইবার পর্যটন শহর কক্সবাজার গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে রাতের কোচে রওনা হই। আমাদের বাসটি কক্সবাজার বাসস্ট্যান্ডে যেয়ে যখন পৌঁছে তখন বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে যায়।
বাস থেকে ব্যাগ নিয়ে নেমে পাশেই একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতে ঢুকি। একটি মধ্য বয়স্ক লোক আমাকে অনুসরণ করছিল। সে বাইরে সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি চা নাস্তা খেয়ে সিগারেটের দোকানের সামনে এসে এক প্যাকেট সিগারেট কিনি। ও সিগারেট ধরাই। লোকটা তখন আমার পাশে দাঁড়ানো।
লোকটি দেখতে বেশ ভদ্রলোক। পরিচ্ছন্ন কাপড় চোপর পরা,পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো। পায়ে সুন্দর জুতা। সার্টের পকেটে চমৎকার একটি ফাউন্টেন কলম। সেই আগবাড়িয়ে আমাকে বলছিল-
— আপনি কী ঢাকা থেকে এসেছেন?
— জ্বী।
— হোটেল বুকিং করা আছে?
— না। খুঁজে নেব।
— আমাদের একটি কটেজ আছে। খুব সুন্দর। পাহাড়ের ঢালে। সাগর মুখো। মোটামুটি কম ভাড়া। আমরা অতিথিদের রান্না করে খাওয়াই। আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের কটেজে উঠতে পারেন।
লোকটির বাচনভঙ্গি ছিল চমৎকার। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছিল। আমি ওনাকে বললাম — আপনাদের কটেজের নাম কী?
— ‘ক্ষণিকা’।
— খুব সুন্দর নাম। রবি ঠাকুরের ক্ষণিকা। তা, চলুন আপনার কটেজে। ‘ক্ষণিকা’তেই থাকব।
রিক্সায় করে পথে যেতে যেতে ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নাম কী?
— মোহাম্মদ খোরশেদ আলম।
— আপনি এই কটেজের কী?
— আমি মালিক।
আমি একটু অবাক হলাম, মালিক নিজেই ব্যবসা ধরার জন্য বাসস্টান্ড পর্যন্ত চলে এসেছে।
উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল — কয়দিন থাকবেন?
আমি বললাম, ব্যবসায়িক কাজে এসেছি। তিন চার দিন থাকতে হতে পারে।
রিক্সাটি একসময় একটি পাহাড়ি টিলার কাছে এসে থামে।
টিলার সামান্য ঢাল বেয়ে একটু উপরে উঠতেই দেখতে পেলাম একটি কাঠের বাড়ি। ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড লাগানো আছে। লেখা — ‘ক্ষণিকা’।
একদম ঘরোয়া বাড়ি। সবশুদ্ধ চার পাঁচটি অতিথি রুম আছে। সামনে বারান্দা। ওখান থেকে সাগর দেখা য়ায়। যদিও অনেক দূরে।
আমি বারান্দার কাছে রুমটা পছন্দ করি এবং ঐ রুমেই উঠে পড়ি। খুব সুন্দর পরিপাটি রুম। পরিচ্ছন্ন বিছানা পত্র। কাপড় রাখার ওয়ারড্রব, ড্রেসিং গ্লাস, সাইট টেবিল, দেয়ালে তৈলচিত্র, ওয়াল ঘড়ি, টেলিভিশন, খাবারের গ্লাস, কাগজ কলম, এ্যাসট্রে, মিলারেল পানি সহ সবই আছে।
আলম সাহেব কলিং বেল দেখিয়ে বললেন — আপনার যখন যা লাগবে, কলিং বেল বাজাবেন। আমি অথবা আমার কেয়ার টেকার চলে আসবে।
আলম সাহেবকে বললাম — আচ্ছা। তাই করব।
তাকে বললাম, আমি শুধু সকালের নাস্তা ও রাতের খাবার এখানে খাব। অফিসের কাজে যেহেতু বাইরে বাইরে থাকতে হবে, তাই দুপুরের খাবার আমি অন্য কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিব।
খোরশেদ আলম সাহেব বললেন — আচ্ছা।
সেদিনের বিকেলটুকু ব্যবসায়িক কাজ সেরে সন্ধ্যায় কটেজে চলে আসি। ডাইনিং রুমে বসে রাতের খাবার খেয়ে নেই। মেনু ছিল রূপচান্দা ও কোরাল মাছ। সাথে সালাদ ও ডাল ছিল। বেশ সুস্বাদু ছিল সবকিছু।
সবকিছুতেই ভদ্রলোকের রুচির ছাপ আছে। সাউন্ড বক্সে খুব কোমল সুরে মান্না দে’র গান বাজছিল। ‘দাঁড়িয়ে আমার চোখের আগে
রাঙ্গালে এ মন পুস্পরাগে
কে গো চম্পাবরণী।
কে তুমি তন্দ্রাহরণী।’
আমি একটি জিনিস খেয়াল করলাম, কটেজের অন্য রুমগুলো ছিল খালি। কোনো গেস্ট ছিল না। কেমন যেন সুনসান নিরব পরিবেশ, কেমন যেন আলোছায়াময় অন্ধকার সারা কটেজ জুড়ে!
রাতে রুমে শুয়ে আছি। নতুন জায়গা ঘুম আসছিল না চোখে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি, রাত একটা। খুব ইচ্ছা হল দূরের রাতের সাগর দেখবার। খুব মন চাইল, কান পেতে শুনতে সাগরের গর্জন।
দরজা খুলে চলে আসি বারান্দায়। দাঁড়িয়ে থাকি সমুদ্রের দিকে চেয়ে। দূরে সমুদ্র, কাছেই আকাশ। ও পাশটায় ঝাউবন। ঝাউঝাড়ে তখনও জোনাকি জ্বলছিল। আর দুরে থেকে ভেসে আসছে জলের শব্দ।
আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, আকাশ ভরা তারা। কী স্বপ্নময় লাগছিল।
কবে কোন্ কবি আপন ভাবালুতায় লিখেছিল কবিতা।
যদি আজ রাতে সেই কবিতাখানি কেউ গানের সুরে গেয়ে শোনাত–
ঝাউবনের মাথার উপর
তবু জেগে রয় এক টুকরো মেঘের উচ্ছ্বাস!
রক্ত-চোখ খুনি কাঁকড়ারা আজ হাজার হাজার মাইল
সমুদ্র সৈকতে নিরব পাহাড়ায় ্
আমি আজ তোমাদের প্রাত্যহিকের নিয়ম ছেড়ে অনেক দূরে
এক কুয়াশাময় সম্পর্কহীন মাদকতায় অলস-কথা ভাষাহীন!
এখন রাত্রি নক্ষত্রের!
জানি তোমরা আজ মেলায় মাতোয়ারা
আমায় নির্জনতা ডাকে
আমি আজ সাগরে!
সাগরের দিক থেকে হিমেল বাতাস এসে লাগল গায়ে। তারারা এসে আমার চোখের পাতায় ছুঁয়ে দিল। কেমন যেন ঘুম পাচ্ছিল। ভাবলাম, যাই, শুয়ে পড়ি। পিছনে ঘুরতেই দেখি — বারান্দার আর এক পাশে একটি মেয়ে ঝাউ গাছের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। নীরবে নিঃশব্দে কখন এসে সে দাঁড়িয়েছিল, আমি বুঝতে পারিনি।
আমি ঐ মেয়ের সাথে কোনো কথা না বলে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ি।
দ্বিতীয় রাত্রি–
সারাদিন অফিসের কাজে বেশ পরিশ্রান্ত ছিলাম। রাতে খেয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ি এবং ঘুমিয়ে যাই। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। শুয়েই আছি। কী যেন দেখার জন্য চিত্ত অস্থির হতে থাকে। সাগর নাকি ঝাউগাছ! নাকি তারাভরা আকাশ! নাকি কালকের সেই মেয়ে! কিসের এক টানে বাইরে বারান্দায় চলে যাই। দেখি কেউ নেই। সাগরের দিকে তাকাই —
জলের শব্দ আজ নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে। জোনাকিরা জ্বলছে না ঝাউবনে। তারারা অনুজ্জ্বল হয়ে আকাশেতে জ্বলছে!
পিছনে ঘুরে তাকাতেই– দেখি, কালকের সেই মেয়ে। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরিহিত। বয়স তেইশ চব্বিশ বছর হবে। চুল খোঁপা বাঁধা। বেলী ফুলের মালা দিয়ে জড়ানো। আলো আঁধারে মুখখানি দেখলাম– দোলনচাঁপার মতো স্নিগ্ধ, হাত দুটি যুঁথিবদ্ধ, চোখের তারায় য়েন জোনাকি জ্বলছে!
বললাম — তুমি কে?
— আমি লাবণী। আমি তোমাকে দেখেছি দূর থেকে। চুপিচুপি। তুমি তা জানো না। কী বিশ্বাস তোমার প্রতি হল। তুমি যেন আমার কত ভরসার!
— তাই!
— আমাকে দেখতে খুব অপূর্ব লাগছে! না!
— হুম! খুব ভালো লাগছে!
— আমাকে তুমি সাথে করে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে?
— তুমি কে? তোমাকে চিনি না। জানি না।
— আমি খুব দুঃখী মেয়ে। ভালোবাসা আর দাম নিয়ে দিতে ইচ্ছা করে না, ভালোবাসা প্রাণে থেকে দিতে ইচ্ছা করে। আমি খুব কাঙাল। আমি যে বন্দিনী। আমাকে তুমি এখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাও।
— খোরশেদ আলম সাহেব তোমার কী হয়?
— সম্পর্কে উনি আমার মামা হন।
— দেখো, আমি এখানে পরদেশি। আমার খুব ভয় হচ্ছে।
তুমি রুমে চলে যাও। শুয়ে পড়ো। আমি তোমার কথা ভেবে দেখব।
তৃতীয় রাত্রি —
সারাদিন কাজের ভিতর ঘুরে ফিরে একটা কথাই কানে বাজছিল, ‘ আমাকে তুমি তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে? ‘ সন্ধ্যাবেলা কটেজে ফিরে বারান্দায় গিয়ে একাকী দাঁড়িয়েছিলাম। সাগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছিলাম বিনম্র দৃষ্টিতে — সূর্য ডুবে গিয়েছিল আগেই সমুদ্র জ্বলে। লাল আভাগুলো মায়াবী মনে না হয়ে বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল।
কেয়ারটেকার এসে বলছিল — স্যার, কফি দিব?
বললাম — না।
রাতে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুম আসছিল না কিছুতেই। রাত গভীর হতে থাকে। মনে পড়ছিল লাবণীর কথা। ওকে আমি আজ কী বলব? ও কী চায় আমার ? আমাকে বিয়ে করতে চায়? তা কী ভাবে সম্ভব! আমার যে মায়াবতী একটি মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। একটা স্বপ্ন দেখলাম ঐ মেয়েটিকে নিয়ে। কী এক অদ্ভুত স্বপ্ন। কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা অস্পষ্ট। লাবণী আর আমি হাত ধরে সমুদ্র তীর ধরে বালিয়াড়ির উপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছি দিগন্তের দিকে। চলে গিয়েছি দূর আকাশের নীলে। আমাদের দুজনকে রাশি রাশি সাদা মেঘ এসে ঢেকে দেয়। আমরা যেথায় হারিয়ে গেলাম, পৃথিবীর কেউ দেখতে পেল না।
যখন ঘুম ভাঙে, তখন স্বপ্নটাও ভেঙে গেল! দেখি, ভোর হয়ে গেছে। সারা বিছানা জুড়ে অজস্র বেলী ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। রক্তজবাগুলো ছিন্নভিন্ন। বিছানায় লোধ্ররেণুর দাগ!
সকালে ব্রেকফাস্ট করে খোরশেদ আলম সাহেবকে বলি — সামান্য কিছু কাজ বাকী আছে। কাজ সেরে আমি আজই ঢাকা চলে যাব।
‘ক্ষণিকা’ ছেড়ে যখন চলে আসি, তখন খোরশেদ আলম সাহেবকে একবার বলতে চেয়েছিলাম– লাবণীকে একটু ডাকুন — ওকে একটু বলে যাই। কিন্তু বলা হল না। রাতের লাবণী এখানে রাতের ক্ষণিকা হয়েই থাকল।
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। এখনও কোনো
রাত্রি প্রহরে ঘুম ভেঙে গেলে একাকী বারান্দায় যেয়ে পায়চারি করি — খুঁজি অনেক দূরের সমুদ্র, চোখ মেলে দেখবার চেষ্টা করি সাগর তীরের তারার আকাশ। আলো খুঁজি ঝাউবনের জোনাকির! শুনতে পাই বহু আগের নিরব জলের শব্দ! এই অস্তবেলায় একটু আফসোস তো হয়-ই! লাবণীর দুঃখটা কী ছিল? কেনই তা জানতে চাইনি?
৮. সন্ধ্যার মেঘমল্লার
মন্দিরে পূজা দিতে আসত সে। মন্দিরে এই আসা যাওয়ার মাঝে আর পথ চলতে চলতে পথের উপর তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।
সময়টা ছিল ১৯১১ ইংরেজি পরবর্তী কাল। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর রেল বিভাগে আমার সহকারী টিকেট মাস্টার হিসাবে চাকুরি হয়। পোস্টিং হয় রাজবাড়ির গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশনে।
একদিন এক হেমন্তের সকালে রানাঘাট জংশন থেকে একটি শাটল ট্রেনে করে প্রথমে কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশনে আসি। পরে ওখান থেকে আর একটি লোকাল ট্রেনে করে সোজা গোয়ালন্দ ঘাট। আমার জীবনে প্রথম বিদেশ বিভূঁইয়ে আসা। এর আগে শুধু কলিকাতা পর্যন্ত গিয়েছি। আসার সময় মাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! মা আমার কান্না দেখে বলেই ফেলেছিল — ‘তোমার চাকুরি করার দরকার নাই।’ কিন্তু বাবা ছিল নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত চাকুরিতে যোগদান করতেই হল।
স্টেশনে কর্মচারিদের থাকার কোনো আবাসস্থল ছিলনা। সেটশন মাস্টার মশাই তার এক পরিচিত পুরোহিতকে বলে স্টেশন থেকে প্রায় এক মাইল দূরে পদ্মা তীরবর্তী একটি গ্রামের মন্দিরের অব্যবহৃত একটি ছোট্ট ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করেন। রান্না বান্না নিজেকে করেই খেতে হবে।
স্টেশন থেকে পদ্মার তীর ধরে মেঠোপথে গ্রামটিতে যেতে হয়। রাস্তার দুপাশে আম কাঁঠালের বাগান। ঘন গাছের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে থাকে। আবার কখনো খোলা ফসলের মাঠ। সরিষা,কলাই, আখ আর আমন ধানের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আবার পদ্মার তীর ধরে ছোট ছোট গ্রাম। জেলে পাড়া, কুমার পাড়া, মালো পাড়া, ছুতার বাড়ি। এইসবের ভিতর দিয়েই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরের ঐ বাড়িটায়।
পুরোহিত মশাই আমার নাম ধাম জিজ্ঞাসা করলেন।
বললাম, নাম– শ্রী অরুণ চন্দ্র বসাক। সাকিন– মায়াপুর, নদীয়া।
পুরোহিত মশাই একটু করুণা করলেন। খুবই অভুক্ত ছিলাম। তিনি এইবেলায় নিরামিষ দিয়ে ভাত খাওয়ালেন। একটা মাটির ভাতের পাতিল ও একটি তরকারির পাতিল দিলেন। একটি মাটির কড়াইও দিলেন। মা আসার সময়ে বেডিং এ কাঁথা বালিশ দিয়েছিলেন। খুলে দেখলাম- একটি এ্যালুমিনিয়ামের প্লেট, একটি পিতলের গ্লাস, একটি চামচ ও লবনদানি দিয়ে দিয়েছেন।
মাটির ঘর। উপরে ছোনের চালা। ভিতরে একটি পুরাতন কাঠের চোকি পাতা আছে। এক কোণে মাটির হেঁসেল। কিছু পাট শোলা ও ঘসি রয়েছে। আমি কাঁথা বিছিয়ে নেই চোকিতে। খুব ক্লান্ত ছিলাম। বিছানায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নেই। কখন ঘুমিয়ে যাই জানতে পারিনি।
সন্ধ্যায় মন্দিরের শঙ্খধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙে যায়। জেগে দেখি- ঘর ভর্তি অন্ধকার। বিছানা থেকে উঠে হেঁটে মন্দিরের দিকে চলে যাই। একজন সেবকের কাছ থেকে একটি কেরোসিনের কুপী ও দেয়াশলাই চেয়ে নেই। ঘরে এসে নিজেই সন্ধ্যাবাতি জ্বালাই। এই সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানোর মধ্য দিয়েই একজন বিশ একুশ বছরের একাকী তরুণের সংসার যাত্রা শুরু হল।
প্রতিদিন স্টেশনে যাই। স্টেশন থেকে আবার এই মন্দির সংলগ্ন মাটির ঘরে ফিরে আসি। পথে যেতে আসতে কত বাড়ি দেখি। কত মানুষ, কত বৃক্ষের ছায়াতল দিয়ে কত পথ হাঁটি। কত পাখির ডাক শুনি। কখনো পথ চলতে চলতে মায়াপুরের কথা মনে পড়ত। মনে পড়ত মার কথা।
আমার ঘরটি মন্দির থেকে সামান্য দূরে পথের ধারে। ঘরের পাশ দিয়ে লোকজন হেঁটে মন্দিরে আসা যাওয়া করে । ঠিক একটু পরেই পুকুর। পুকুর পাড় জুড়ে আলম কাঁঠাল বেল লিচু ও জাম গাছ বেষ্টিত। ঘাটও আছে। পরিস্কার জল। এই পুকুরে কেউ গোসল করে না। সারা গায়ের মানুষ এর জল খাওয়ার জল হিসাবে ব্যবহার করে।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। ঘরে বসে বসে বাবার কাছে পত্র লিখলাম —
পরম পূজনীয় বাবা,
পত্রে আমার প্রণাম জানিবেন। মাকেও প্রণাম জানাইবেন। পর সমাচার এই যে, আমি এখানে ভালোভাবে পৌঁছিয়াছি। এখানে এক মন্দিরের পাশে একটি পরিত্যক্ত ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হইয়াছে। আমার একটুও ভালো লাগে না। নিজেকে রান্না করিয়া খাইতে হয়। মার কথা খুব মনে পড়ে।
আমার আরও কিছু চাকুরির দরখাস্ত ও ইন্টারভিউ দেওয়া আছে। যদি কোনো খবর হয় সত্বর জানাইবেন।আমার জন্য দোয়া করিবেন। ঠাকুর সবার মঙ্গল করুক।
ইতি — আপনার স্নেহের অরুণ।
সন্ধ্যায় ঘরের ছোট্ট কাঠের জানালাটি খুলে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি, কয়েকজন মহিলা মন্দিরের দিকে আসছে। তখন শঙ্খধবনি বেজে উঠেছে। আমার ঘরের পাশ দিয়ে তারা হেঁটে চলে গেল মন্দিরে। একজন শুধু জানালার কাছে থেমে গেল।
সে ছিল একজন বিধবা রমণী। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলছিল —
‘আমি তোমাকে দেখেছি। তুমি প্রতিদিন হেঁটে যাও, আমাদের বাড়ির আঙিনার পাশ দিয়ে। আমি প্রতিদিন তোমাকে দেখি। তুমি আমাকে দেখতে পাও না।’ এই কথা বলে, রমণীটি মন্দিরের দিকে চলে গেল।
আমি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। অন্ধকার হয়ে ঘরটি আঁধার হয়ে আসছিল। কেরোসিনের শিখাটি জ্বালিয়ে নেই । বিছানায় শুয়ে শুয়ে আলো আঁধারে ঐ রমণীর দেহ রূপটি দেখছিলাম– সুশ্রী গৌড় বর্ণ, হাত দুটি অনাবৃত অনন্ত শাঁখাহীন। সকালের কমলা রোদ্দুর ছিল গায়ে। পরনের শাড়ি রজনীগন্ধার মতো সূচি শুভ্র। তার নির্মল রূপ সন্ধ্যার সৌন্দর্যকে সীমারেখা টেনে দিয়েছে।
হৃদয়ের রক্তের স্পন্দন কেমন যেন থেমে থেমে আসছিল। আমি নিশ্চুপ হয়ে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে রইলাম।
পরের দিন পরিচিত পথ দিয়ে স্টেশনে না যেয়ে পদ্নার পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম। নদীর জল স্রোতের টানে ধেয়ে চলছিল। স্রোতের উজান বেয়ে গুণ টেনে মাঝিরা নৌকা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত নদীর উপর আকাশ জুড়ে ছিল নীল মেঘ। মেঘগুলো কখনো দেখতে লাগছিল ধূসর, পরেই আবার কালো হয়ে উঠতে লাগল।
কালকের সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যার একটি মুখ এই স্রোতের টানে, ঐ মেঘের ভিতর ভেসে ভেসে যাচ্ছিল। সবকিছুর ভিতর কেমন বিলুপ্তপ্রায় অন্ধকার আম কাঁঠালের ঘন অরণ্যের ভিতর হারিয়ে যাছিল সেই অপূর্ব সুন্দর নিষ্পাপ মুখখানি।
বিকালে মন্দিরে ফিরছিলাম চেনা পথ ধরে। আম কাঁঠাল আর শুপারি গাছের সারি ঘেরা মালো বাড়ির কাছে আসতেই কালকের সেই রমণী হঠাৎ আমার পথের পাশে এসে দাঁড়ায়, একটি খাবারের টোপলা আমার হাতে দিয়ে বলে — এখানে খেজুর গুরের সন্দেশ ও নারিকেলের নাড়ু আছে। ‘ তুমি এগুলো খুব পছন্দ করতে, তুমি খেয়ে নিও।’ এ কথা বলেই সে বাড়ির ভিতর চলে যায়।
বাকী পথটুকু আসতে আসতে আসতে ভাবলাম, আমি যে খেজুর গুরের সন্দেশ আর নারিকেলের নাড়ু পছন্দ করি, তা উনি জানল কী ভাবে?
এই অকাল বিধবা মেয়েটির সম্বন্ধে একটু জানবার চেষ্টা করলাম, তার নাম- সন্ধ্যা রাণী। স্বামী — স্বর্গীয় কার্তিক চন্দ্র কৈবর্ত। বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্বামী কলেরায় মারা যায়। একটা পুত্র সন্তান আছে। সে এখনও শ্বশুর বাড়িতেই থাকে।
পরেরদিন সন্ধ্যাবেলায় সন্ধ্যা রাণী মন্দিরে আসে প্রসাদ দিতে। তখন আবছা আলো, আবছা অন্ধকার। আজও সে আমার ঘরের জানালার কাছে এসে থেমে যায়। সে প্রসাদের একটি টোপলা আমার জন্য আলাদা করে এনেছিল। সেটি আমার হাতে দিয়ে বলে — ‘এর ভিতরে মালপোয়া পিঠা, প্যারার ছাতু আর খেজুর গুর আছে। তুমি এগুলো খেও। তুমি মালপোয়া পিঠা খুব পছন্দ করো, তাই নিয়ে এলাম।’
এগুলো দিয়ে সন্ধ্যা রাণী দ্রুত মন্দির ভিতর চলে যায়। চলে যাওয়ার পর ভাবছিলাম, আমি তো মালপোয়া পিঠা খুব পছন্দ করি। মাকে প্রায়ই বলতাম — মালপোয়া পিঠা বানিয়ে দিতে।
তখন অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিক। স্টেশন থেকে ফিরে আসতে সন্ধ্যা রাত্রি হয়ে যায়। বেশ শীত, এবং কুয়াশা পড়েছে। রাস্তার পাশের বনফুল, ভাঁট ও কুঁচচন্দনের গন্ধ আসছে। রাস্তা নির্জন, কেউ কোনো দিকে নেই। কৈবর্ত বাড়ির কাছে আসতেই দেখি, লিচু গাছের আড়ালে সন্ধ্যা রাণী দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই আমার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল —
‘বেশ শীত পড়েছে। তোমার ঠান্ডা লাগবে। এই কাঁথাটা দিলাম। তুমি গায়ে দিও।’
আমার এখান থেকে স্টেশনে যাওয়ার দুটো পথ। একটি পদ্মার পাড় ধরে, আর একটি গ্রামের ভিতর দিয়ে মাঠ পেড়িয়ে। যখন যেটা মন চায় আমি সেই পথ দিয়েই আসা যাওয়া করতাম। তবে বেশিরভাগ যেতাম পদ্মার কূল ধরে, আর ফিরে আসতাম গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে।
সন্ধ্যা রাণীর বাড়ির কাছে আসলেই মনটা একটু উতলা হয়ে উঠত। ভাবতাম সে হয়ত দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো দিন তার দেখা পেতাম, কোনো কোনো দিন দেখা হত না। বুঝতে পারতাম, বাড়ির লোক কাছাকাছি থাকলে সে পথের পাশে আসত না। হয়ত দূরে আড়াল থেকে আমাকে দেখত।
একবার খুব জ্বর হয় আমার। কয়েকদিন অফিসে যেতে পারি নাই। সন্ধ্যা রাণী হয়ত আমাকে দেখবার জন্য পথের ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছে। আমাকে দেখতে না পেয়ে কারোর কাছ থেকে জানতে পেরেছে আমার জ্বর হয়েছে। একদিন সে মন্দিরে পূজা দেওয়ার নাম করে চলে আসে। তখন কালী সন্ধ্যা। অন্য কারোর অলক্ষ্যে সে আমার ঘরে প্রবেশ করে। সিওরে তখন কেরোসিন শিখা জ্বলছিল। সেই আলোয় আমি সন্ধ্যার মুখখানি দেখতে পেলাম। কেমন বিমর্ষ ও শুকনো সে মুখ! কাঁদিলে চোখের পাতা যেমন ভারী হয়, তেমন তার মুখখানি মলিন হয়ে আছে।
সে কিছু পথ্য এনেছিল। কবিরাজের কাছে থেকে
জ্বরের বটিকাও এনেছে। আমার কপালে সে হাত রাখে। দেখে জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ সে কলসী থেকে বাটিতে জল ঢেলে তার শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ভিজিয়ে আমার কপালে জলপটি দিতে
থাকে।
সে সন্ধ্যা রাতে সন্ধ্যা রাণী আমাকে মায়ের মতো সেবা সুশ্রুষা করেছিল।
একদিন অপরাহ্ণে কৈবর্ত বাড়ির পথ ধরে ঘরে ফিরছিলাম। খুব সুনশান নির্জন লাগছিল চারদিক। আমবাগানে পাখিগুলো শ্রান্ত সুরে কিচিরমিচির করে ডাকছিল। মনে হল এই জীবন এমনই স্নিগ্ধ ছায়াশীতল পাখির গানে ভরা, অপরাহ্ণের ঐ পাখির গানের মতো স্নিগ্ধ শান্ত। চারদিকে বৃক্ষের পত্র পল্লবে উপর তখন বিকালের রৌদ্র পড়ে চিকচিক করছিল।
সন্ধ্যা রাণীর বাড়ির কাছে আসতেই আমার দুচোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাকে। দেখলামও, সে অর্ধেক ঘোমটা টেনে পুকুরের চালায় জবা ফুলের ঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে কাছে এগিয়ে আসে। ঘোমটা অনাবৃত করে ফেলে। শান্ত মায়াদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আজ এই অপরাহ্ণের আলোয় তার মুখ ঝিকমিক করছিল। ঠোঁট দুটো বিনম্র, কিন্তু কম্পিত।
এমন সুশ্রী মুখশ্রী আমি কখনো দেখিনি। মনে হল তাঁর ডাগর কালো চোখদুটির অন্তরালে অতল দীঘির জল। তার সমস্ত দেহ গড়নে বৈচিত্রে ভরা, সব মিলে সন্ধ্যা রাণীকে অপূর্ব সৌন্দর্য-শোভা-মন্ডিত লাগছিল। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ ছিলাম।
আমি একটু দ্বিধা করছিলাম, কেউ না আমাদের দেখে ফেলে। সেই বলছিল — ‘কেউ নেই। সবাই গেছে পদ্মায় ইলিশ ধরতে।’
সে আরও বলছিল, তোমাকে আমার মায়া লাগে কেন, জানো?
— না, আমি জানি না।
— তোমার মুখচ্ছবি অবিকল আমার মৃত স্বামীর মতো। তাই তোমাকে আমি চেয়ে দেখি। তোমাকে মায়া করি। তোমাকে সেবা যত্ন করতে ইচ্ছে করে।’
— তোমাকে আমার দিদির মতো লাগছিল। আমার তো কোনো দিদি নাই।
— তা ভাবো। আমি তোমাকে স্বামী দেবতা জ্ঞান করি।
— আমি কী তোমাকে দিদি ডাকব?
— না, তুমি আমাকে ‘সন্ধ্যামণি’ ডাকবে। আমার স্বামী আমাকে এই নামে ডাকত।
— আমি যাই।
— একটু দাঁড়াও।
সন্ধ্যামণি ঘোমটা টেনে আমার কাছে এসে আমাকে প্রণাম করে। আমি বলি– ‘কী করছ তুমি! আমি তোমার চেয়ে বয়সে ছোট। আমার পা ছুঁয়ো না। আমার পাপ হবে।’
— আমি পাপ পূন্য জানি না। আমি জানি তুমি আমার স্বামী।
ঘরে তেমন খাবার ছিল না আজ। খেলামও না কিছু। না খেয়েই শুয়ে পড়ি। ঘুম আসছিল না চোখে। রাত্রি গভীর হতে থাকে। পুকুর পাড়ের আমগাছে বসে প্যাঁচা ডাকছিল অমঙ্গল সুরে । বাইরে ঝিঁঝি পোকাদের ঝিঁঝি শব্দ কেমন ক্রন্দনধ্বনির মতো লাগছিল। আমি যখন সন্ধ্যামণির কাছে থেকে আসি, তখন তার চোখ জলে ভরা ছিল! মনে হয়েছিল কোন্ দেবালয়ের এক নিষ্পাপ দেবীমূর্তি সে। তার মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারিনি। আমিও অশ্রুসিক্ত ছিলাম।
সকালে পদ্মার কূল ধরে হেঁটে হেঁটে স্টেশনে চলে যাই। আজ পদ্মার জল, মাঝিদের ভাটিয়ালি গান, নদীর উপর নীল আকাশ, কোনো কিছু ভালো লাগছিল না। বিষণ্ণ চিত্তে অফিসে আসি।
টিকেট ঘরে বসে আছি। আজ যাত্রীদের তেমন ভীড় নেই। দু একটা করে টিকিট বিক্রি হচ্ছিল। কর্মের মধ্যেও বিষণ্ণতা কিছুতেই কাটাতে পারছিলাম না!
ঘুরে ফিরে শুধু সন্ধ্যামণির কথাগুলো কানে বাজছিল।ভাবছিলাম, এ কী করে সম্ভব?
ডাকপিয়ন একটি চিঠি দিয়ে যায়। বাবা লিখেছে —
কল্যাণীয়েষু অরুণ,
স্নেহ নিও। আশা করি ঠাকুরের কৃপায় ভালো আছো। তোমার একটি সুখবর আছে। তহশিলদার পদে আজই তোমার একটি নিয়োগ পত্র পাইলাম। কল্যাণীতে তোমার পোস্টিং। তুমি যদি এখানে যোগদান করতে চাও, পত্রপাঠ তুমি চলিয়া আসিবে। বাড়ির সবাই ভালো আছে।
ইতি — তোমার পিতা।
আমি সাথে সাথে স্টেশন মাস্টারের মাধ্যমে কোলকাতা আঞ্চলিক রেল আধিকারিকের বরাবর পদত্যাগ পত্র জমা দেই। পদত্যাগ পত্র গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত ছুটির দরখাস্ত দেই। বলি, পদত্যাগ পত্র গৃহীত হলে আমাকে পত্র দ্বারা অবগত করবেন।
আমার ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর হয়।
অফিসের যাবতীয় হিসাব নিকাশ ও কাগজপত্র বুঝিয়ে দিতে দিতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সহকর্মীদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যা রাত্রিতেই ঘরে চলে যাই।
মন্দিরে গিয়ে পুরোহিত মহাশয়ের কাছে থেকে বিদায় নেই। এবং বলি আমার নতুন চাকুরি হয়ে যাবার কথা। আরও বলি, আমি প্রত্যুষেই চলিয়া যাইব।
রাতেই বাক্স পেটরা গুছিয়ে রাখি। ভোরে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ভাবলাম, পদ্মার কূল ধরে না যেয়ে আজ গ্রামের মেঠো পথ দিয়েই স্টেশনে যাব। যদি সন্ধ্যামণির একটু দেখা পাই!
কৈবর্ত বাড়ির সামনে গিয়ে পা থেমে যায়। একটু দাঁড়ালাম। চারিদিকে চেয়ে দেখলাম, কোথাও সন্ধ্যামণি আজ দাঁড়িয়ে নেই। আমগাছের পিছনে, লিচু তলায়, পুকুর পাড়ে জবাফুল ঝাড়ের আড়ালে – কোথাও নেই।অন্য কোনো আড়াল থেকেও সে আমাকে হয়ত দেখছে না! এখন যে অসময়। এই পথ দিয়ে এখন আমার চলে যাবার কথা নয়।
ধীর পায়ে সামনের দিকে এগুতে থাকি। পা কেমন
যেন অসার হয়ে আসছিল। তাল-শুপারি বাগানে বসে আজ কোনো পাখি ডাকল না। চালতা, গাবফুল, ভাঁটফুল, কুচচন্দনের কোনো গন্ধ এল না কোথাও থেকে। আস্তে আস্তে হেঁটে বৃক্ষরাজির ছায়া পেড়িয়ে খোলা প্রান্তরে যেয়ে পৌছলাম।
পূবের সূর্যের রোদ পড়ে ঝলমল করছিল ফসলের ক্ষেত। দূর পদ্মা থেকে বয়ে আসছিল শীতল বাতাস। অসরতা ভেঙে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম স্টেশনের দিকে।
তারপর পঁয়ত্রিশ বছর চলে গেছে।
তারপর জীবনে কত কিছু পেলাম। কত ডিগ্রি নিলাম। কত বড়ো কর্তাব্যক্তি হলাম। কত বড়ো ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলাম। কত শিক্ষিত সে। কত দেশ ঘুরেছি।
কত মানুষ দেখেছি। কত মৌন নদী। কত পর্বতেের গাত্রে দেখেছি কত লতাগুল্ম, পাহাড়ি ফুল। কত পূর্ণিমা রাত্রি উপভোগ করেছি।
সবকিছুর ভিতর একজন অনাদৃত, একজন উপেক্ষিত, একজন দলিত বিধবা মেয়ের মুখ মনে পড়েছে। কত রাশি রাশি আনন্দের মাঝে, সেই কবেকার কতদূরের এক পল্লীবালা অপার্থিব অশ্রু ঝরিয়ে গেছে আমার জীবনের সকল আনন্দ বেদনার উপর।
এখনো কী সন্ধ্যার মেঘমল্লারে সেই অনাদরের সন্ধ্যামণি ফুলটি অশ্রু জলে ভিজে?
৯. রাণুদি
তখন কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ি। ঢাকায় থাকি। একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি যাই। বাড়িতে যেয়ে দেখি, মা একটু অসুস্থ। বাড়িতে তেমন কেউ নেই। আমার খাওয়া নাওয়া অসুবিধা হবে জেনে, মা বললেন, কয়েকদিনের জন্য রাণুকে নিয়ে আসি। ও এসে থেকে রান্নাবান্না গুলো করতে পারবে। এক কাজ করো, তুমি রাণুকে যেয়ে নিয়ে আসো।
রাণুদি মার এক দূর সম্পর্কের বোনের মেয়ে। খুবই দরিদ্র তারা। রাণুদি পঞ্চম ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছিল। তারপর আর করতে পারে নাই। মা তার এই বোনের মেয়েটিকে প্রায়ই বাড়িতে তার কাছে এনে রাখত। তাঁর বিপদে, রোগে, শোকে এবং তার একাকীত্বে।
রাণুদি আমার চেয়ে ছয় সাত বছরের বড়ো ছিল। আমাকে খুব আদর স্নেহ করত। আমি তাকে রাণু বুবু না বলে রাণুদি ডাকতাম। এই ডাকটি কী ভাবে যে হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারি নাই। সম্ভবত তখন ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম’ গানটির প্রভাব থেকে।
রাণুদি আমাকে কেমন স্নেহ আদর করত, তার একটি ঘটনা বলি, একবার এক চৈত্র মাসে আমাদের পুকুরে মাছ মারছিলাম। পানি অত ছিল না। হাত দিয়ে পুকুরের কাদা ছেনে ছেনে মাছ ধরতাম। পুঁটি, বাইম, টাকি,শিং, মেনি, টেংরা এই সব মাছ। এই মাছ মারতে যেয়ে আমার হাতে ঢোড়া সাপে কামর দিয়েছিল। আমি তো জানি না, ঐটা ঢোড়া সাপ ছিল। আমি হাউমাউ করে কেঁদে মার কাছে চলে এসেছিলাম। সেদিন রাণুদি বাড়িতেই ছিল। সে আমার সর্প দংশিত জায়গায় মুখ লাগিয়ে চুষে বিষ আনতে থাকে। বিষ এসেছিল কী না, সে কথা আজ আর মনে নেই।
তখন সিক্স সেভেনে পড়ি। সেইবার আমার জল বসন্ত হল। এটি একটি ছোঁয়াছে রোগ। এই রাণুদি আমার সেবা শুশ্রূষা করতে থাকে । গরম পানিতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে গা মুছে দিত। কী এক পাউডার জাতীয় ঔষধ ডাক্তার দিয়েছিল, সেগুলোও সারা শরীরে লাগিয়ে দিত।
এইরকম আরও অনেক স্নেহ ভালোবাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে রাণুদিকে নিয়ে।
রাণুদির বিয়ে হয়ে গেছে সেও চার পাঁচ বছর আগে। বিয়ের পরেও আমাদের বাড়ির বিভিন্ন উৎসব পার্বণে, বিপদে আপদে মা তাকে নিয়ে আসত। এবং তারও যখন মন চায়, সেও চলে আসত।
রাণুদির স্বামীর বাড়ি সুবর্ণগাঁতি। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ ছয় মাইল দূরে। অজ পাড়া গাঁও। কোনো গাড়িঘোড়া নেই। মেঠো ধূলি পথে যেতে হয়। আমি পরের দিন সকালে একটি ছাতা নিয়ে রোদ্র ধূলির পথ হেঁটে হেঁটে, ইছামতীর নদীর খেয়া পার হয়ে রাণুদিদের বাড়ি চলে যাই।
রাণুদি তো আমাকে দেখে যেন চন্দ্রতারা হাতে পেল। আমাকে ঘরের বিছানায় বসিয়ে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে থাকে। তালপাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। সে মুরগী ধরে তা জবাই করল। শীতল পাটিতে বসিয়ে নিজ হাতে আমাকে খাওয়ালো। সে এমনভাবে খাবার পরিবেশন করছিল যে, পুরো মুরগীটা যেন সে আমার জন্য রান্না করেছে।
রাণুদি জানত, মা আমাকে খাবারের পরে দুধকলা দিয়ে ভাত খাওয়াত। সেও তাই করল।
আমি রানুদিকে বললাম, মা তোমাকে আজই আমার সাথে যেতে বলেছে।
— খালামা যখন বলেছে, আমি অবশ্যই যাব। তা, আজকের দিন থাকো। কাল প্রত্যুষে আমরা রওনা হইব।
— না। মা আজকেই তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।
— আচ্ছ, আজই যাব।
রাণুদি ছোট্ট একটি টিনের বাক্সে তার কিছু কাপড়চোপড় তুলল।
পরন্ত বিকালে সূর্যের তীর্যক রোদ যখন ভাটা পড়েছিল, তখন আমি আর রাণুূদি বাড়ির পথে রওনা হই।
পল্লীগ্রামের মেঠো ধুলি পথ ধরে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম আমি আর রাণুূদি। বিকালের রোদ্দুর আস্তে আস্তে আরও কমে আসছিল। আকাশে কখনও সাদা মেঘ, কখনও ধূসর মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। মেঠো পথের দুধারে কখনও কাঁচা আউশ ধানের প্রান্তর। কখনও পাটক্ষেত, কখনও আখক্ষেত পড়ছিল প্রান্তেরের পর প্রান্তর। দিগন্ত থেকে ভেসে আসছিল সবুজ পাতার গন্ধ। কখনও গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে, কখনও হালোট পথ দিয়ে হাঁটছিলাম। ছাতিম আর আকন্দের ঝাড়ের ভিতর সোনাল গাছের হলুদ ফুলের মৌ মৌ গন্ধে মুখর ছিল !
কত বাড়ির গোয়ালে গরুর বাথান দেখি। ভিটায় ভিটায় আম গাছ, কাঁঠাল গাছ, সাজনা গাছ, লিচু গাছ ও কলা গাছের সারি। পথের ধারে কত নাম না জানা ঘাসফুল — এইসব দেখতে দেখতে, এইসবের গন্ধ নিতে নিতে, পথ চলতে চলতে রাণুদি একবার বলছিল — ‘রঞ্জু, তুমি আমার বাড়ি এসেছিলে! আমি কত খুশি হয়েছি। আমার বাড়িতে এ ছিল তোমার প্রথম আসা। আবার কবে আসবে তুমি ভাই !’
— আসব রাণুূদি। আবার তোমার বাড়ি আসব কোনো একদিন।
আমরা যখন ছোট ইছামতী নদীর খেয়া পার হয়ে এপার চলে আসি, তখন সন্ধ্যা হয়ে আসে। কিন্তু আকাশ জুড়ে দেখা দেয় কালো মেঘ। মেঘ ক্রমে এত কালো হয়ে আসছিল যে মুহুর্তে পথ ঘাট অন্ধকার হয়ে যায়।
অন্ধকারে দ্রুত একটি খোলা প্রান্তরের মাঝখানে চলে আসি। ততক্ষণে প্রবল বেগে বাতাস শুরু হয়ে গেছে। মুশুলধারে বৃষ্টি নামছে। বাতাস ক্রমে ঝড়ের রূপ নিতে থাকে। হাতের ছাতি উড়ে চলে যায়। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। দেখলাম রাণুদির হাত থেকে তার টিনের বাক্সটিও উড়ে চলে গেল। চারদিকে ঝড়ের শণশণ আওয়াজ হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘের গর্জনে কান তালা লেগে আসছিল।
প্রান্তরের মাঝখানে একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে এসে দাঁড়াই। গাছটির গোড়ায় আশ্রয় নেই। ঝড়ের গতি আরও বিকট রূপ নেয়। অশ্বত্থ গাছের ডাল ভেঙে উড়ে যাচ্ছিল। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাই। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাচ্ছিলাম।
রাণুূদি জানত বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসে। আর ভয়েও কাঁপছিলাম খুব। রাণুূদি আমাকে তার বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে।
তার শাড়ি অর্ধেক খুলে আমার মাথা ও শরীরে পেচিয়ে নিয়ে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখে। যেন আমি ভিজে না যাই। যেমন করে মা পাখি আগলে রাখে তার বাচ্চা পাখিকে পালকের ছায়ার তলে পরম মমতায়।
একসময় ঝড় থেমে যায়। বৃষ্টিও বন্ধ হয়। আমরা আবার পথে নেমে বিদ্যুতের আলো দেখে দেখে হাঁটতে থাকি।
বাড়ির কাছে যখন চলে আসি, তখন আকাশে কোনো মেঘ ছিল ন। আকাশ ভরে তারা উঠেছে। তারার সেই ম্রিয়মান আলো এসে পড়েছে রাণুদির মুখের উপর। সে আলোয় দেখলাম তার মুখখানি কী অপূর্ব জ্যোতির্ময়! কী পবিত্র।
১০. সামান্য আনন্দ
শহরের বাইরে একটি বাংলো বাড়িতে তখন একা থাকি। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে তখন কর্মরত ছিলাম।
বাংলো বাড়িটি সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশে অবস্থিত ছিল। আশেপাশে যারা বসবাস করতো তারা সবাই সহজ সরল মানুষ ছিল।
এলাকায় তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। রাতে হেরিকেন জ্বালাতে হতো ঘরে।
ঘরে কোনো রান্না বান্না হতো না আমার। খাবার খেয়ে আসতাম বাইরে হোিটেল থেকে।
প্রতিবেশি মানুষেরা আমাকে খুব ভালো জানতো। আমাকে ভালোও বাসতো। তারা আগলে রাখতো আমাকে সমস্ত সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দিয়ে। আমি একা থাকতাম, তাই আরো বেশি খেয়াল করতো আমার নিরাপত্তা ও প্রতিদিনের জীবন যাপনের উপর।
একদিন এক প্রতিবেশি লোক এসে অত্যন্ত মায়াপরবশ হয়ে বললো — আপনার ঘরদোর পরিস্কার রাখা ,বিছানাপত্র কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখার জন্য কাউকে দরকার। আমাদের জুলেখা এই কাজগুলো এসে করে দেবে।
আমি বললাম– ঠিক আছে। ও মাঝে মাঝে এসে টুকটাক কিছু কাজ করে দেবে না হয়।
জুলেখা সাত আট বছরের ছোট্ট বালিকা। সে কোনো কাজের মেয়ে নয়। ওর বাবা মা নিতান্তই ভালোবেসে, এবং আমাকে আপন মনে করে আমার অসুবিধার কথা ভেবে সাহায্য করার জন্য দিয়েছে মাত্র।
আসলে কাজ তেমন কিছুই না। আমি যখন অফিসে যেতাম, তখন জুলেখা এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি বেরিয়ে যাবার সময় ঘরের চাবিটি ওকে দিয়ে যেতাম। আমি যাবার পর ও ঘরে ঢুকে মেঝে ঝাড়ু দিতো। বিছানা গোছাতো। আলনায় আমার এলোমেলো কাপড়গুলো ভাজ করে রাখতো। টেবিলের বইপত্র খাতা, ফুলদানি গুছিয়ে রাখতো। এ্যসট্রে পরিস্কার করে রাখতো। জগে খাবারের পানি ভরে এনে রেখে দিতো।
আমি বেশির ভাগ সময় সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরতাম। জুলেখা বিকালে এসে হেরিকেনের চিমনি ও ফিতা মুছে কেরোসিন ভরে সন্ধ্যা বাতিটা জ্বেলে রেখে বাড়ি চলে যেতো।
রাতে আমি যখন বাড়ি আসতাম, তখন জুলেখা এসে ঘরের চাবিটা দিয়ে যেতো। আমি তালা খুলে যখন ঘরের ভিতর প্রবেশ করতাম, দেখতাম —
ঘর অন্ধকার নেই। আলো জ্বলছে।
একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছি। তখন জুলেখা বলছিল — ‘মামা, ছোট দেখে একটি ভাতের পাতিল, একটি কড়াই, একটি চামচ কিনে আনবেন। আমি ভাত রান্না করে রেখে দিব। আপনি এসে রাতে খাবেন। বাইরে কোথায় কী খান, অসুখ বিসুখ হবে।’ আমি বললাম, এসব রান্না বান্না হবে না। তুমি ছোট মানুষ রান্না করতে যেয়ে হাত পুড়ে ফেলবে।
জুলেখা আমার কথায় মন খারাপ করলো।
আমাকে এই কাজ করে দেয়ার বিনিময়ে জুলেখাকে কিংবা ওর বাবা মাকে কোনো আর্থিক সাহায্য করতাম না। এটা করলে জুলেখাকে এবং ওর বাবা মাকে ছোট করা হতো।
তবে ঈদের সময় ওকে নতুন জামা কিনে দিতাম। একজন মামা যেমন তার ভাগ্নীকে নতুন জামা কিনে দেয় তেমন।
এই ভাবেই দেড় দুবছর কেটে গেল। তারপর তো বিয়েই করলাম। ঘরে নতুন বউ এলো। জুলেখা ওর মামীকে দেখে সে কী খুশি। প্রায়ই এসে ওর মামীকে বিভিন্ন কাজে কর্মে সহায়তা করতো। আমার স্ত্রীও জুলেখাকে খুব স্নেহ করতো।
তারপর জুলেখা আরও বড়ো হলো। এবং ওর বিয়েও হয়ে গেল। একদিন ও শশুর বাড়ি চলে গেল।
অনেক দূরে ওর শশুর বাড়ি। আসেও না সে অনেক বছর। দেখাও হয়না বহুদিন। ওর বাবা মা ও অন্যত্র চলে গেছে। জুলেখা অনেকটাই বিস্মৃতি হয়ে গেছে।
একটি সামান্য স্মৃতিকথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, কাপড় চোপড় পরে সেন্ট স্প্রে করছিলাম আমার জামায় ও চুলে। জুলেখা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে বিস্ময় চোখে তা দেখছিল! আমি ওকে ডেকে বলি — ‘কী লাগিয়ে দিব একটু’! আমি ওর জামায় একটু স্প্রে করে দেই। সেন্টের গন্ধ পেয়ে ওর মুখে কী আনন্দের হাসি!
পথে নেমে সেদিন হেঁটে হেঁটে যখন বাস স্টান্ডের দিকে যাচ্ছিলাম, দেখি, সারা ভুবন জুড়ে ঝলমল করছে রোদ্দুর। আকাশ অথৈ নীল। সবকিছুর ভিতর আমি বালিকার মুখের হাসিটি দেখতে পাচ্ছিলাম। এক অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করছিলাম আমার অন্তরে ও বাইরে। কিছু আনন্দের বুঝি কোনো সীমারেখা নেই। তা যতোই তুচ্ছ হো। তা অসীম। বালিকার ঐ মুখের হাসির মতো নির্মল।
১১. অতিথি
একদিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে একজন লোক আসে। সে রাত্রি যাপন করে পরের দিন সকালেই চলে যাবে। এইরকম অতিথি লোক তখন আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসত। তারা রাত্রিযাপন করে ভোরেই চলে যেত।
আমাদের বাড়ি গঞ্জে থেকে পাঁচ মাইল দূরে। আবার অনেকেরই বাড়ি আছে গঞ্জে থেকে পনেরো ষোল মাইল দূরে। তখন পায়ে হেঁটে মানুষ শহরে আসা যাওয়া করত। দূরের মানুষরা সকালে হেঁটে হেঁটে শহরে আসত এবং কাজ শেষ করে বিকালেই তারা বাড়ি ফিরে যেত।
বাড়ি ফিরে যেতে অনেকেরই পথে রাত হয়ে যেত। এবং পথিমধ্যে তারা কোনো ধনী গেরস্থ বাড়িতে অতিথি হতো। তেমনই একজন পথিক অতিথি হয়ে সেদিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে এসেছিল। তিনি শুধু রাতটি থাকবেন।
আামাদের কাচারি ঘরের অতিথি রুমে লোকটির থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তাকে রাতের খাবারও দেয়া হয়।
লোকটি তার পরিচয় দিয়েছিল, নাম মো: হারেজ মন্ডল। গ্রাম– শিয়ালপোতা, কাজিপুর। থানার একেবারে শেষ প্রান্তে তার বাড়ি। কিন্তু আমাদের বাড়ির কেউই তার এই গ্রামটিকে চিনতে পারল
না।
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমার একটি স্বভাব কৌতূহল ছিল, এই সমস্ত মানুষের সাথে গল্প গুজব জুড়ে দেয়া।
লোকটির বয়স চল্লিশ হবে। গায়ের রঙ ফর্সা।
বেশ সুন্দর দেখতে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল গায়েনদের মতো লম্বা লম্বা। বাম হাতে পিতলের বালা পরা। গায়ে দুই পকেটওয়ালা ঢোলা চেক জামা। পরনে লুৃঙ্গি। দেখতে অনেকটা আবার তান্ত্রিকদের মতোও লাগে।
তখন সন্ধ্যারাত্রি পার হয়েছে। ঘরের ভিতর কেরোসিন কুপী জ্বলছে। হারেজ মন্ডল চোকির উপর বিছানায় বসে আছে। আমি পাশে একটি কাঠের বাদামি টুলে বসে ওনার সাথে গালগল্প জুড়ে দিয়েছি।
আমি তাকে প্রশ্ন করি — ‘ চাচা, আপনি কী রাতে পথ চলতে ভয় পান? এই যে রাত হয়েছে দেখে বাড়িতে গেলেন না। আমাদের বাড়িতে থেকে গেলেন।’
— আগে ভয় পেতাম না। যখন তরতাজা যুবক ছিলাম। এখন একটু ভয় পাই।
— ভয় পান কেন?
— সে অনেক কাহিনি। বলতে গেলে রাত্রি অনেক হয়ে যাবে।
— আপনি বলেন। আমি শুনব।
— আচ্ছা, তবে শোন।
তখন আমার বয়স চব্বিশ পঁচিশ। একটি কাজে সেইবার গঞ্জে এসেছিলাম। কাজ সেরে শহর থেকে বের হতে হতে আসর হয়ে গিয়েছিল। তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত আসতেই এশা ওয়াক্ত হয়ে যায়। ভাবলাম, আজ পূর্ণিমার চাঁদের রাত্রি। কোথাও অতিথি হয়ে রাত্রি যাপন করব না। রাতেই বাড়ি চলে যাব।
কার্তিক মাসের পূর্ণিমার চাঁদ ছিল ! রাত্রি ছিল দিনের মতো একদম ফকফকা। শুকনো পথঘাট। আমি পথ চলতে থাকি। জোর পায়ে হাঁটতে থাকি বাড়ির দিকে। বেশির ভাগ পথ ছিল মেঠো। দুপাশে আমন ধানের ক্ষেত। দুধ পাকা ধানের গন্ধে ভরে উঠছিল মন। জোছনার ঢেউ খেলছিল আধা পাকা ধানের উপর। আর ধানের সোনালি সবুজ পাতা দুলছিল রাত্রির বাতাসে।
কাছেই কুশাল ক্ষেতের ভিতর শিয়াল ডাকছিল হুক্কা হুয়া করে। আমার পায়ের পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে যায় দুটি কুকুর। ওরাও ভুগভুগ করেছিল। কুত্তার ডাক শুনে শিয়াল তার ডাক থামিয়ে দেয়। আমি নির্ভয়ে হাঁটতে থাকি। দুতিনটি গাঁও পেরোই মোটামুটি জন কোলাহলে।
তারপরের গ্রামটির ভিতরের পথ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, দেখি সমস্ত গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। মানুষেরও পথ চলার শব্দ নেই। কারোর কোনো সাড়া শব্দ নেই। আম গাছে বসে প্যাঁচা ডাকছিল। পুকুর থেকে ব্যাঙের ডাক আর পাশের ঝোঁপঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জনধ্বনি শোনা যাচ্ছিল কেবল।
গ্রামটি পেরিয়ে আবার খোলা মাঠের পথ দিয়ে হাঁটতে থাকি। কিছুদূর যেতেই দেখি– একটি ভিটের মতো জায়গা। এটি ছিল একটি কররস্হান। ভিতরে দেখি, পরনে ছেঁড়া ছালা পরে একটি জট পাগল লোক দাঁড়িয়ে আছে । ও সম্ভবত মরা মানুষের মাংস খায়। আমাকে দেখে সেই পাগলটি তেড়ে আসে। আমি দৌড় দেই। এক দৌড়ে চলে যাই একেবারে নদীর ঘাটে।
ঘাটে যেয়ে দেখি, খেয়া নৌকা নেই। খেয়ামাঝি নৌকা নিয়ে আগেই চলে গেছে। আমি গামছা পরে সাঁতরে নদী পার হই।
ওপার যেয়ে নদীর তীরে বসে একটু বিশ্রাম নেই। পেটে তখন ভীষণ খিদা। সেই কখন থেকে হেঁটে হেঁটে আসছি। উঠে যে আবার হাঁটবো, সেই শক্তি পাচ্ছিলাম না । আকাশে পূর্ণিমার ঝলমলে চাঁদ। কিন্তু ভালো লাগছে না জোছনাও।
নদীর ঘাট থেকে বেশ দুরে দেখতে পাই , একটি কুঁড়ে ঘরে আলো জ্বলছে। এই জনমানবহীন নদীর কূলে, এই খোলা নির্জন প্রান্তরে এই আলোটুকু দেখে মনে একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। ভাবলাম, ওখানে যেয়ে একটু বিশ্রাম নেব। যদি জলপানি কিছু খেতে দেয় তাহলে খেয়ে রাতটুকু ওখানেই ঘুমাব।
সেই জনহীন নিঝুম রাতে নদীর কূল ধরে ঐ আলো জ্বলে থাকা ঘরটির দিকে হাঁটতে থাকি। হাঁটছি যত ততই মনে হচ্ছে আলোটা দূরে সরে যাচ্ছে। কেমন যেন পোড়া কাঠের গন্ধ পাচ্ছিলাম। শ্মশানে মানুষ পোড়ালে যেমন গন্ধ, তেমন গন্ধ আসছিল তীব্র ভাবে। গা কেমন ছমছম করে উঠল। বুঝতে পারলাম এটি আসলেই একটি শ্মশান ঘাট।
সামনের দিকে হাঁটছি অবশ পায়ে। কিছু দূরে যেতেই পায়ে পড়ল মানুষের মাথার খুলি আর হাড়গোড়। কোথা থেকে শনশন শব্দ করে উড়ে আসে চারপাঁচটি শকুন। ওরা আমার সামনে পথ আটকে রাখে। কুৎসিত ঘরঘর আওয়াজ করে তেড়ে আসে শকুনগুলো । আমি চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলি।
কিছুক্ষণ পরে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পুনরায়
চোখ খুলি। দেখি শকুনগুলো নেই। দূরে তাকিয়ে দেখি, জীর্ণ কুটিরে তখনও মিটমিট করে আলো জ্বলছে।
আমি আবার হাটঁতে থাকি। কিছু দূর যেতেই পথের উপর দেখতে পাই , একটি মৃত মেয়ে মানুষের লাশ। বয়স পনের যোল হবে। অর্ধনগ্ন, চুল আলুথালু। লাশের তখনও গন্ধ বের হয়নি। আমি পাশে দিয়ে হেঁটে চলে যেতেই পিছনে থেকে নারী কণ্ঠে শুনতে পাই –‘এই! আমাকে ফেলে রেখে তুই কই যাস?’
আমি ভয়ে আৎকে উঠি। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি, লাশটি উঠে বসে আছে। বিকট কালী চেহারা। সাদা দাঁত বের করে কটমটিয়ে বলছে — ‘তোর জন্য আমি বসে আছি। আয় আমার সাথে। তোকে আমি জলে ডুবিয়ে মারব।’
আমি চকিত ঘুরে সামনের দিকে ঝাইরা দৌড় দেই। এক দৌড়ে চলে আসি কুঁড়ে ঘরটির কাছে। তখনও ঘরের ভিতর টিম টিম করে আলো জ্বলছে।
ঘরটির চালা ছোনের ও বেড়া পাট সোলার। আমি ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখি একটি স্ত্রীলোক খড়- পাতার বিছানার উপর বসে আছে। মাথায় ঘোমটা টানা। বয়স বোঝা গেল না। সামনে কুপী বাতি জ্বলছে। মনে হলো সে বসে বসে কী যেন ধ্যান করছে।
একটু ভয় পাচ্ছিলাম, ওনাকে ডাকব কী ডাকব না। খিদেয় এত ক্লান্ত ছিলাম যে, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। তাই বাইরে বেড়ার সাথে ঠেস দিয়ে বসে পড়ি। জোছনা তখনও থকথক করে ঢলে পড়ছিল প্রান্তরে ও নদীর কূলে কূলে ।
ঘরটি একদম নদীর কূল ঘেসে। পাশেই ছোট একটি ঘাট। চেয়ে দেখি, কয়েকজন সুন্দরী রমণী বুকের কাপড় ফেলে স্নান করছে। স্নান শেষে তারা নগ্ন অবস্থায় ঘাট বেয়ে ঘরটির দিকে এগিয়ে আসছে। আমি মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু পরই ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ শুনতে পাই। আমি মাথা তুলে তাকাতেই দেখি, এত ঘোড়ার পায়ের শব্দ নয়। মেয়েগুলোই ঐরকম শব্দ করে হেঁটে আসছে।
মুহূর্তেই দেখতে পেলাম কোনো মেয়েরই মাথা নেই। তাদের মাথা কাটা গলা থেকে তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে। আমি জোরে আর্ত চিৎকার দিয়ে ঘরটির বাঁশের চাটাইয়ের দরজা ঠেলে আচমকা ভিতরে ঢুকে পড়ি ।
স্ত্রীলোকটি আমাকে দেখে বিস্ময়ে বলে — ‘ তুমি কে? এত রাতে আমার ঘরে?’
কন্ঠ তার ভাঙা ভাঙা এবং বিকৃত। আমি হাত পা কাঁপতে কাঁপতে হাত জোড় করে বলি — ‘আমাকে তুমি বাঁচাও।’
আমার অসহায় অবস্থা দেখে, সে একটু দয়াপরবশ হলো। আমি বললাম — ‘আমাকে এক গ্লাস পানি খেতে দেবে?’ সে আমাকে একটি মাটির গ্লাসে করে পানি খেতে দেয়। কাঁদো কাঁদো করে আবার বললাম, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে , কিছু খাবার থাকলে খেতে দেবে?’ স্ত্রীলোকটি আমাকে তবাকে করে পোড়া মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে দেয়। আমি তা খেয়ে নেই ।
খাওয়া শেষ হলে স্ত্রীলোকটিকে বলি — ‘তুমি আজ রাতের জন্য আমাক একটু তোমার ঘরে অতিথি করে রাখবে?’ সে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলল — ‘আচ্ছা’।
এই পর্যন্ত বলে হারেজ চাচা থামলেন। পকেট থেকে টেন্ডু পাতার বিড়ি বের করে একটি বিড়ি ধরালেন। সে মনের সুখে, নাকি মনের দুঃখে বিড়ি টানছিলেন, আমি আমার সেই অল্প বয়সে তা বুঝতে পারিনি। আমি তাকে বলি — ‘তারপর কী হলো চাচা?’
সকালবেলা যখন চলে আসবো , তখন ঐ স্ত্রীলোকটিকে বলি, রাতে কুপিটি জ্বলে জ্বলে নিভে গেল হঠাৎ করে ! চাদের আলোও আসেনি ঘরে। তোমার মুখখানি দেখতে পারিনি। একটু ঘোমটা সরিয়ে মুখটি দেখাবে ?’
মেয়েটি আস্তে আস্তে মুখ থেকে তার ঘোমটা সরিয়ে ফেলে। আমি তার মুখ দেখে ভয়ে আৎকে উঠি! আমার অন্তর আত্মা কেপে উঠে। অস্ফুট কণ্ঠে শুধু বলি — তুমি???
হারেজ চাচা আমাকে বললেন, অনেক রাত হয়েছে। এবার যেয়ে তুমি ঘুমাও। বাকীটুকু সকালে বলব।
সকালে আমার ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে। কাচারি ঘরে যেয়ে দেখি — হারেজ চাচা চলে গেছে।
১২. প্রাণ ভরিয়ে
নতুন বিয়ে করেছি। মেস ছেড়ে দিয়ে কলাবাগানে বাসা ভাড়া নিয়েছি। বউকে নিয়ে উঠি সেই বাসায়। দুই রুমের ছোট্ট টিনসেডের একটি বাড়ি।
ছোট বাসা হলেও আঙিনা অনেক বড়ো। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। ঘরটা পিছনের দিকে। সামনে ডানে বামে খালি জায়গা। গলির দিকে বাসায় ঢোকার গেট।
ঘরের সামনের কোণে একটি ঝাঁকড়া আমগাছ থাকলেও বাকী খালি জায়গায় ঘাস ও বিভিন্ন লতা গুল্মে জঙ্গল হয়ে আছে। একদিন বাড়ির মালিককে আমি বললাম — ‘আমি কী জঙ্গল পরিস্কার করে খালি জায়গায় কয়েকটি ফুল গাছ লাগাতে পারি?’ মালিক বললেন, ‘অবশ্যই লাগাতে পারেন। এত ভালো কথা। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
আমার স্ত্রী থানা শহরের মেয়ে। স্থানীয় কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। বাবা স্কুল মাস্টার। মা গৃহিণী। দুই ভাই বোন। ছোট সুখী পরিবার। হারমনিয়াম বাজিয়ে সে ভালো রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে। স্কুল কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে গান গাইত।
তাকে এখানে পড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে অভিমানহীন ভাবে বলেছিল — আমি শুধু তোমার ঘর সংসার করব। আমাকে পারলে একটি হারমনিয়াম কিনে দিও। যখন মন খারাপ লাগবে তখন ঘরে বসে গান গাইব।’
বিয়ের প্রথম মাসে বেতন পেয়ে তাকে একটি হারমনিয়াম কিনে দেই। প্রথম দিনে প্রথম যে গানটি সে গেয়ে শোনায়েছিল —
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি
পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে
চাই নি।
একদিন অফিস থেকে এসে তাকে বলি, কী ফুল তুমি পছন্দ করো, সেই ফুল গাছ আঙিনায় লাগাব।
— আমার প্রিয় ফুল গন্ধরাজ। তোমার কী ফুল পছন্দ?’ আমি বললাম, আমার পছন্দ জবা। উল্লেখ্য আমার স্ত্রীর নাম জবা।
এক শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর দিনে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে আমরা দুজন বেশ কয়েকটি জবা আর গন্ধরাজের চারা রিক্সার হুডি ফেলে ভিজতে ভিজতে কিনে এনে আঙিনায় লাগিয়ে দেই।
খুব অল্প সময়েই ফুলগাছ গুলো বড়ো হতে থাকে। এবং একসময় গাছগুলোতে ফুুল ফুটতে থাকে। যেদিন প্রথম জবা ফুল ফোটে, সেদিন কাকতালীয় ভাবে জবার জন্মদিন ছিল।
অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বাসায় আসি।ফেরার পথে জবার জন্য গাওসিয়া মার্কেট থেকে একটি সবুজ রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি কিনে নিয়ে আসি।
বিকালে ওকে বললাম — শাড়িটি পরো। জবা শাড়িটি পরে। আমি দুটো জবা ফুল ছিঁড়ে এনে ওর খোঁপায় পরিয়ে দেই। সে হাতে কাঁচের চুড়ি পরে। কপালে লাল টিপ ও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। খুব ভালো লাগছিল ওকে। যেন কুমুদিনী।
আমরা একটা খোলা রিকশা করে শেরেবাংলা নগর চন্দ্রিমা উদ্যানে চলে যাই। পরন্ত বিকালের নীল আকাশ দেখতে দেখতে আর নাগরিক কোলাহল পেরিয়ে আমরা উদ্যানে চলে যাই। পথে যেতে যেতে জবা গুনগুন করে গেয়েছিল —
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি।
উদ্যানের সবুজ ঘাসে বসে সেদিন দুজন কত কথাই বললাম। কত স্বপ্নের কথা। জীবনের কথা। ঘর সংসারের কথা। সন্তান নেবার পরিকল্পনার কথা। আরো কত কথা। কথা বলতে বলতে একসময় সব কথা ফুঁড়িয়ে যায়। পাশে হাস্নাহেনার ঝাড় থেকে সুবাস ভেসে আসছিল। উদ্যানের সন্ধ্যার পাখিদের কলরব থেমে গেল।
নিরবতা ভেঙে আমি জবাকে বললাম — ‘এখানে আজ কোনো গান হল না যে!’
জবা আমার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলেছিল —
‘এখন গান নয় গো, আজ আমরা দুজন শুধু দুটো প্রাণের হব। চলো, ঘরে ফিরে যাই।’
আলো আঁধারে দুজন হাত ধরে হাঁটতে হাটঁতে উদ্যানের বাইরে চলে আসি। আবারও একটি খোলা রিকশা করে আকাশ ভরা তারা দেখতে দেখতে বাসায় চলে আসি।
রাতটি ছিল স্বপ্ন আর ঘুম জড়ানো। জানালা খোলা ছিল। জবাফুল গন্ধ বিলিয়েছিল গন্ধরাজের গায়ে। কী এক আশ্চর্য দ্যোতনা। বাতাস এসে কথা বলেছিল আমাদের কানে কানে। যেন —
দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ,
আমার চিত্তে মিলি একত্রে তোমার মন্দিরে উছাসে।
সকালে আমার আগে ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে এমনিতেই বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়াই৷ আঙিনায় চেয়ে দেখি– ঘাসের উপরে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল পড়ে আছে।
আমি জবাকে ডেকে বলি– ‘দেখ, কে যেন রেখে গেছে এই ফুল!’
জবাও বিস্মিত হয়! তবে ফুলগুলো দেখে তার মনে পড়ল — এক জন্মদিনে এমনই এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল তাকে দিয়েছিল তাদেরই ছোট্ট থানা শহরের এক উন্মূল তরুণ। ছেলেটি ওর সহপাঠী ছিল। সে ভালো গানও গাইত।
একদিন অফিস থেকে এসে দেখি, জবার খুব মন খারাপ। কথা বলছে ভারী কণ্ঠে। চোখ দেখে বোঝা গেল, এই চোখ একটু আগে অঝোর ধারায় কেঁদেছে। এখনও সিক্ত। এখনও চোখের দুই কোণ্ চিকচিক করছে।
জবার মনখারাপ থাকলে আমারও মনখারাপ লাগে। ও কাঁদলে আমারও চোখ ছলছল করে ওঠে। আমি ওকে বললাম, চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। জবা বলছিল– ‘কোথায় নিয়ে যাবে’। বললাম, ‘শিশু পার্কে। ওখানে শিশুদের দোলনায় দোল খাওয়া দেখবে। ঘোড়ায় চড়ে ওরা হাট্টিমাটিম গান গায়। সেই গান তুমি শুনবে। ওদের সাথে আমরাও রেলগাড়িতে উঠব।’
জবা বলল — আচ্ছা, নিয়ে চলো।
আমাদের প্রিয় যান খোলা রিকশায় করে সেদিন গিয়েছিলাম শিশু পার্কে। পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে দুজন ফুসকা খাই। একটি বালিকা এসে ওকে বলে, ‘আপা বকুল ফুলের মালা নিবেন?’ আমি জবাকে বললাম, নাও দুটো মালা। খোপায় পরিয়ে নাও। খুব ভালো লাগবে।
আমরা দুজন নাগরদোলায় উঠেছিলাম। নাগরদোলাটি যখন সুউচ্চ চূড়ায় পৌঁছে, তখন জবা আমার দুহাত চেপে ধরেছিল। আমি ওর দিকে চেয়ে মনে মনে বলেছিলাম — ভয় পেওনা তুমি। আমি তোমার জীবনেও আছি। আমি তোমার মরণেও পাশে আছি।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। দুপুরে খেয়ে বিছানায় দুজনই শুয়ে আছি। কোনো কথা নেই কারোরই। আম গাছটায় বসে দোয়েল শিস দিচ্ছিল খুব মায়া করে। জবা আমার হাত ধরে। ঠিক মনে হলো বাইরে ডাকা ঐ দোয়েলটির মতো মায়া করে আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল– তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, না!
— জ্বী বাসি।
— যদি দূরে চলে যাই, তোমার খুব মন খারাপ লাগবে?
— হে..
— জানো, আমি যে কলেজে পড়তাম, সে কলেজে স্কুলের মতো ঘন্টাধ্বনি বাজত। কলেজ ছুটি হলে আমরা রেললাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে জোরে জোরে হেঁটে বাড়ি চলে আসতাম।
— তাই!
— আমাদের বাড়ি থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যেত। বাড়ি থেকে একটু দূরে ছোট্ট একটি রেল ব্রিজ আছে খালের উপরে।
— আচ্ছা।
— ঐ ব্রিজটা আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি নিয়ে যাবে আমাকে ঐ ব্রিজ দেখাতে?
— নিয়ে যাব। একটা গান গেয়ে শোনাওনা শুয়ে শুয়ে খালি গলায়। জবা গাইছিল —
দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।
যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে।
সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায় দিনগুলো আমাদের ভালোই কাটছিল। কিন্তু জবার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না খুব একটা। দিনে দিনে সে খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলে। রাতে রাতে তার জ্বরও আসে। ডাক্তার দেখাই। চিকিৎসা চলতে থাকে।
আঙিনায় জবা ও গন্ধরাজ ফুলগাছ গুলো পরিচর্যার অভাবে দিনে দিনে শ্রীহীন হয়ে মরে যেতে থাকে। জবা ফুল গাছে আর ফুল আসে না। গন্ধরাজ আর কোনো গন্ধ বিলায় না সন্ধ্যারাতে। আঙিনায় লতাপাতা গুলো বেড়ে আগাছায় ভরে ওঠে।
সেদিন ছিল আমাদের বিয়ে বার্ষিকী। অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা রাত হয়ে যায়। জরুরি কাজে আটকে পড়েছিলাম। ফেরার পথে গাওছিয়া মার্কেট থেকে জবার জন্য একটি লাল বেনারসি শাড়ি কিনি। আর কিনে নিয়ে আসি একগুচ্ছ লাল গোলাপ।
গেট দিয়ে ঢুকতে আলোছায়ায় আঙিনার ঘাসের উপর একটি ভাজ করা কাগজ দেখতে পাই। হাতে উঠিয়ে গলি থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় কাগজটি খুলে পড়ি। দেখি, রবি ঠাকুরের একটি গান লেখা আছে। কাগজটি পড়ে আমার কাছেই রেখে দেই।
ঘরের ভিতর বিছানায় জবা শুয়ে আছে। খুব মায়া করে সে আমাকে তাকিয়ে দেখছিল। চোখের পাতা কেমন কালো হয়ে গেছে। যেন কত অশ্রুর দাগ লেগে আছে। যেন বলতে চাচ্ছে — ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।’
আমি ওকে বলি– একটু উঠে বসো, দেখো — তোমার জন্য আজ একটি বেনারসি শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছি। একটু পরে নাও।’
জবা পরম আনন্দে শাড়িটির দিকে চেয়ে বলে — ‘আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে আজ পরব না লক্ষীটি। আমি ভালো হয়ে উঠি, তখন পরব।’
— আচ্ছা, তাই পরবে।
আমি ঘরের জানালাটা খুলে দেই। আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে অপূর্ব সুন্দর চাঁদের আলো এসে পড়ে জবার মুখের উপর! আমি ওকে বলি — একটা গান গেয়ে শোনাও না! জবা আমাকে বলে কোন্ গানটি শুনবে তুমি?
আমি ওকে বলি — ‘প্রাণ ভরিয়ে’।
জবা গেয়ে শোনালো —
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।
গানটি গাইতে গাইতে জবার চোখের কোণ ভিজে উঠছিল। হয়ত তার মনে পড়ছিল — কবে এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় ছোট্ট থানা শহরের এক উন্মূল তরুণ এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল তাকে, বাড়ি থেকে দূরে একটি রেল ব্রিজের কাছে ঘাসের উপর বসে থেকে।
১৩. নয়নে বহে ধারা
আজই দীপ্তর এমবিবিএস পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। সে পাশ করেছে। কলেজে যেয়ে দীপ্ত এই সুখবরটা প্রথম জানতে পারে।
আর দীপ্ত এই সুখবরটি প্রথম জানায় তার মণিকে ফোনে —
মণি, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো আগে। আমার কপালে চুমু দাও। আমি পাশ করেছি মণি। আজ থেকে আমি ডাক্তার। তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পেরেছি মণি।
মণি দীপ্তর মা। দীপ্ত ওর মাকে একএকসময় এক একটা সম্বোধন করে ডাকে। কখনও মা, কখনও মামণি, কখনও মণিমা, কখনও শুধু মণি বলে ডাকে। তবে বেশি আনন্দে থাকলে, দীপ্ত ওর মাকে মণি বলে ডাকে।
দীপ্তর মা বিয়ের দুই বছরের মাথায় স্বামীকে হারায়। তখন দীপ্তর বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। দীপ্তর বাবাও ছিল একজন ডাক্তার। হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
দীপ্তর মা আর বিয়ে করেন নাই। দীপ্তর বাবার রেখে যাওয়া সীমিত সম্পদ থেকে তিনি সংসার আর দীপ্তর লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।
দীপ্ত বাসায় এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে — মণি তুমি খুশি হয়েছ? বাবা, মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা যেখানে রেখে গেছেন, আমি সেখানে থেকে আবার শুরু করব মা। তুমি আমাকে দোয়া করবে, আমি যেন তোমার স্বপ্ন ও বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।
দীপ্তর মা শাহনাজ বেগম তার ছেলেকে একটি আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তুলবার জন্য জীবনভর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সে আজ খুব খুশি। দীপ্তর অলক্ষ্যে ওয়ালে টানানো তার স্বামীর পোট্রের্ট এর সামনে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।
বলে — ওগো, তুমি আমাকে দোয়া করো ওপারে থেকে। আমি যেন দীপ্তকে তোমার আদর্শে গড়ে তুলতে কখনোই যেন ক্লান্ত না হই।
দীপ্ত পিছনে থেকে চুপিচুপি এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় কপাল রেখে বলে — মণি, তুমি না আমাকে প্রমিজ করেছিলে, আর কখনও কাঁদবে না। তুমি তোমার কথা রাখছ না। তুমি বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রায়ই কাঁদো। শাহনাজ বেগম চোখের জল মুছে বলে, ‘আবার প্রমিজ করছি, আর কাঁদব না। চলো, খেয়ে নাও। আমি এখনও খাইনি।’
দীপ্ত কিছুদিনের মধ্যেই শহরের একটি নামকরা ক্লিনিকে জুনিয়র ডাক্তার হিসাবে যোগদান করে। পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে।
একদিন খেতে বসে শাহনাজ বেগম দীপ্তকে বলে –
দীপ, তোমাকে একটা কথা বলব?
— বলো, মণি।
— তোমার কী কোনো মেয়ের সাথে জানাশোনা আছে? মানে, তোমার কী ভালোলাগার কেউ আছে?
— মণি, আমার কেউ থাকলে সে তো তুমিই আগে জানতে। কারণ, এই পৃথিবীতে তুমি আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু। আর…
— আর কী?
— আর, আমার বউকে পছন্দ করে তুমিই ঘরে আনবে। তুমি যাকে এনে দিবে, আমি তাকে নিয়েই সারা জীবন ঘর করব। এও আমার আর একটি স্বপ্ন।
আর একদিন এমনই খাওয়ার টেবিলে শাহনাজ বেগম তার ছেলেকে বলছিল — দীপ।
— বলো মা।
— আমার এক দূর সম্পর্কের বোনের একটা মেয়ে আছে। ও এবার গার্হস্থ অর্থনীতিতে গ্রাজুয়েট ফাইনাল সেমিস্টার শেষ করবে। শুনেছি মেয়েটি বেশ সুন্দরী। ভালো গানও গাইতে পারে। আমার সেই বোনটির সাথে ফোনে প্রাথমিক কথা হয়েছে। আমি তোমাকে নিয়ে ওখানে বেড়াতে যাব। তুমি মেয়েকে দেখবে। মেয়ে তোমাকে দেখবে। মেয়ের বাবা মা থাকবে। আর কেউ না।
— মণি, আমি তোমার উপর দিয়ে কোনো কথা কোনো দিন বলেছি? তুমি যা করবে, তুমি যা করতে বলবে, আমি তাই করব।
— আমি জানি। তুমি আমার অবাধ্য কোনো দিন হবে না।
— মণি।
— বলো বাপ।
— তুমি বললে, মেয়েটি গান গায়। এই জন্য আমার খুব ভালো লাগছে। তুমি হয়ত জানো না মণি। আমি তোমাকে আজ একটা কথা বলি।
— কী, বলো।
— তুমি প্রায়ই মাঝরাতে ওঠো। হয়ত হঠাৎ করেই তোমার ঘুম ভেঙে যায়। তুমি উঠে তখন ঘরের লাইট জ্বালাও। বাবার পোট্রের্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখ অনেকক্ষণ । চশমা খুলে চোখ মোছো। তারপর ব্যালকনিতে যেয়ে ইজি চেয়ারে বসে থাকো। ওখানে বসে দূর আকাশে তারার দিকে তাকিয়ে থাকো, হয়ত মেঘের ভিতর লুকিয়ে থাকা তারাদের মাঝে বাবার মুখ খোঁজো। কোথাও থেকে আসে তখন শীতল ঝিরিঝিরি হাওয়া। বেলী ফুলের ঝাড় থেকে আসে আকুলকরা গন্ধ! তুমি তখন গুনগুন করে সেই একলা রাত্রিতে একটি গান গাও —
‘একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো।’
জানো মণি, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপিচুপি তোমার সেই গান শুনতাম। তোমার গান গাওয়া শেষ হলে আমি যেয়ে শুয়ে পড়তাম। তুমি এইসব কিছুই জানতে না।
একদিন বিকালে শাহনাজ বেগম দীপ্তকে নিয়ে তার সেই বোনের বাসায় বেড়াতে যায়। সুন্দর পরিপাটি একটি ফ্ল্যাট বাড়ি। বাসায় তার বোন মমতাজ বেগম, তার স্বামী শওকত আলী আর তাদের মেয়ে মালবী ছাড়া আর কেউ নেই। মালবী দেখতে সুন্দরী, লম্বা ছিপছিপে গড়ন, যেন রজনীগন্ধা ফুল, চোখ দুটো টানাটানা, চুল নিবিড় কালো, তার নাকটি কাঁঠালিচাঁপার রেণুর মতো প্রস্ফুটিত। গায়ের রঙ উজ্জ্বল গৌরীয়, কপোতীর ডানার মতো মসৃণ দু’খানি হাত। পুরো মুখমন্ডল অদ্ভুত সৌন্দর্যময়, যেন একটি উপমায় ভরা গীতি কবিতার রূপ সারা অবয়বে।
সেদিন উভয় পরিবার একে অপরের মাঝে নানা কথা বললেন। নানা ভাব বিনিময় করলেন। মেয়ে দেখল ছেলেকে, ছেলে দেখল মেয়েকে। তারা দুজন টুকটাক কথাও বলল। মালবী হয়ত ভাবছিল মনে মনে, যে রাজপুত্রকে সে এতদিন চেয়েছিল, সেই এসে আজ এখানে হাজির। অপরদিকে দীপ্তও মনে মনে ভাবছিল, ‘এমনই একজন রাজকন্যাকে আমি এতদিন খুঁজেছিলাম।’
দীপ্তর মাও মালবীকে দেখে খুব খুশি। পারলে এখনই মালবীকে তার পুত্রবধূ করে ঘরে তুলে নিয়ে যাবে। অপরদিকে মালবীর বাবা মাও অনেক খুশি। তারাও পারলে এখনই তাদের মেয়েকে দীপ্তর সাথে বিয়ে দিয়ে ওর মায়ের হাতে তুলে দিবে।
দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে যায়। দীপ্ত ও মালবীর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। বিয়েটি হবে মালবীর ফাইনাল পরীক্ষার পর। সেও মাস দেড়েক দেরি আছে এখনও । এর মধ্যে একদিন পানচিনি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওদের একে অপরের হাতে আংটি পরানো হয়ে যায়।
দীপ্ত আর মালবী একদিন দেখা করে উত্তরার একটি আকাশ ছোঁয়া রেস্টুরেন্টে। কাঁচের জানালার পাশে বসে দেখছিল — নীল আকাশ। নীলের মাঝে থোকা থোকা শরতের সাদা মেঘ রাশি। দেখছিল এয়ারপোর্টের রানওয়ে। আর দূরের দিয়াবাড়ির শুভ্র কাশবন।
কথা বলছিল– দুজন দুজনের মুখের দিকে চেয়ে। দীপ্ত বলছিল, আমার ভুবনে এতদিন ছিলাম আমি আর আমার মণি। সেই ভুবনে তুমিও আসছ। জানো, কী যে আলোয় আলোয় ভরে উঠবে আমাদের সেই ভুবন। মালবী দীপ্তর হাতের উপর হাত রেখে বলেছিল — তোমাদের ভুবনে আমাকে স্থান দিও। কী দেবে তো আমাকে একটু স্থান?
দীপ্ত বলেছিল — অবশ্যই।
‘এসো এসো আমার ঘরে এসো, বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে। স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে মুগ্ধ এ চোখে।’
কত দুঃখ বেদনা মানুষের জীবনে । কত ভাঙাগড়াও আবার এই জীবনে! এই পৃথিবী কত স্বপ্ন দেখায়। কত স্বপ্নকে আবার নিষ্ঠুর ভাবে ভেঙে দেয়। এমনই এক স্বপ্ন ভাঙার দিনে মালবী সেদিন আসছিল কলেজ থেকে। বাস স্টান্ডে নেমে বাসায় আসার জন্য রিকশায় উঠবে, ঠিক তখনই দুজন যুবক মোটরসাইকেল করে এসে মালবীর মুখে এসিড মেরে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
আর্ত চিৎকার করে মুখে দুহাত চেপে মালবী রাস্তার উপর বসে পড়ে। তারপর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
দীপ্ত খবর পায় মালবীর মুখে দুষ্কৃতকারীরা এসিড নিক্ষেপ করেছে। সে এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছে।
দীপ্ত ছুটে চলে যায় হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে একটি বেডে মালবী শুয়ে আছে। মালবীর মুখ মণ্ডল পাতলা ব্যান্ডেজ কাপড় দিয়ে ঢাকা। অসহ্য যন্ত্রণায় সে কাৎরাচ্ছে। দীপ্ত ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। খুব আস্তে করে মালবীর একটি হাত ধরে। এবং বলে —
‘ তুমি ভালো হয়ে যাবে, সত্যি তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি আছি তোমার সকল অসুখে, তোমার সকল বেদনায়। এই দেখ — আমি তোমার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছি।’
দুই মাস পর মালবীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে বাসায় নিয়ে আসে। মালবীর পুরো মুখ পোড়া দাগে বিকৃত, কুৎসিত ও ভয়ার্ত রূপ হয়ে গেছে। চোখে দেখতে পায়। কিন্তু চোখের পাতা ও ভ্রূ সব ঝলসে গেছে।
দীপ্ত ও দীপ্তর মাকে অনেকে এসে বলে এবং বোঝায়– দীপ্তর মতো এত সুন্দর একটি ছেলের সাথে মালবীকে যেন বিয়ে না করানো হয়। দীপ্ত ও দীপ্তর মা শোনেনি কারোর কথা। মালবীর সাথে আবারও বিয়ের তারিখ ধার্য করা হয়।
শাহনাজ বেগম খুব অল্প কজন মানুষ নিয়ে মালবীকে দীপ্তর বউ করে ঘরে নিয়ে আসে। বিয়েতে কোনো আড়ম্বর হল না, সানাই বাজল না, আলোকসজ্জা করা হল না। চারিদিকে কোনো হাসিরাশি নেই। কোনো উৎসব নেই। কোনো সঙ্গীত নেই। কেমন যেন এক বেদনার সুর কোথাও থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল।
জীবন থেমে থাকে না। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ জীবন গায় তার জয়গান। পৃথিবীতে আনন্দ এতই ভঙ্গুর যে, তা কাঁচের মতো কখন ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। আবার বেদনাও ঢেকে পড়ে যায় জীবন থেকে পাওয়া নির্মল কোনো আনন্দে।
একদিন মাঝরাতে শাহনাজ বেগমের ঘুম ভেঙে যায়। আস্তে আস্তে উঠে সে বারান্দায় যেয়ে পায়চারি করতে থাকে। ছেলে দীপ্তর ঘর থেকে তখন ক্ষীণ সুরে একটি গান ভেসে আসছিল, গানটি গাইছিল মালবী।
‘একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো।’
রিক্ত আমার ক্ষুদ্র প্রাণে তোমার আঁখিটি রেখো।’
এমনই এক নিঝুম শারদ রাতে আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে শাহনাজ বেগম এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল তার স্বামীকে। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে মালবীর গাওয়া গানটি শুনতে থাকে। নয়নে বয়েছিল তখন অশ্রু ধারা।
১৪. কেবা আপন কেবা পর
অনেক আগের এক জৈষ্ঠ্য দিনের কথা। আমি তখন বাগবাটী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। গরমের কারণে তখন মর্নিং শিফট স্কুল ছিল।
এগারোটায় স্কুল ছুটি হয়েছে। বাড়িতে চলে আসব। বই হাতে স্কুলের মাঠের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছিলাম। পা ফেলতে ফেলতে হঠাৎ করে জেবুন্নেসা বুবুর কথা মনে হল। একবার আমাদের বাড়ি থেকে আসার সময় আমাকে কাছে টেনে আদর করে জড়িয়ে ধরে বুবু বলেছিল — তোমার স্কুল থেকে আমার বাড়ি মাইলখানেক দূরে, যদিও বামদিকে উল্টো যেতে হয়, তবুও তুমি একদিন যেও। দেখে এসো আমাকে। আমি বুবুকে মাথা নেড়ে বলেছিলাম — আচ্ছা, যাব একদিন।
সেই প্রতিশ্রুতির কথা হঠাৎ মনে হল।
পিছনে তাকিয়ে দেখি — আমাদের ক্লাসের সাইফুল ও আমিনুল হেঁটে হেঁটে আসছে। আমি থেমে যাই।ওদের বাড়ি দত্তবাড়ি গ্রামে। ঐ গ্রামই হচ্ছে বুবুদের গ্রাম। আমি ওদেরকে বলি — ‘আমি তোদের সাথে আজ তোদের গ্রামে যাব।’
ওরা তো বেজায় খুশি। ওরা বলে — ‘তা কার বাড়িতে যাবি তুই?’ আমি বললাম, মোঃ আব্দুস সোবহান শেখের বাড়িতে যাব। উনি আমার দুলামিঞাভাই হন।’
আমি এর আগে কখনও এই পথ দিয়ে বুবুদের বাড়িতে যাই নাই। আজই প্রথম যাচ্ছি। কী সুন্দর এই পথ। ইউনিয়ন বোর্ডের তৈরি কাঁচা রাস্তা। দু’ধারে বাড়ি। গাছ আর গাছ। হেঁটে যেতে জৈষ্ঠ্যের রোদ একটুও গায়ে লাগে না। রাস্তাটি সরু হলেও টমটম চলে। কিন্তু গরুর গাড়ি চলে না। সেই জন্য ধুলো কম। দুপাশে ঘাসও আছে।
যেতে যেতে পথে কত বাড়িতে কত রকম গাছ যে দেখছিলাম! আম, কাঁঠাল, জাম, জারুল, সোনাল, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, খেজুর, ডুমুর, নিম, সাজনা, আকন্দ, জাম্বুরা, পিয়ারা, কলা গাছ, তেঁতুল, ছিটকি, বাবলা সহ আরও কত রকমের গাছ। পাখিও দেখছিলাম কত রকমের! ঘুঘু, ওরোল, ঘরবাদুনী, চড়ুই, শালিক, টুনটুনি, হলুদ ফিঙে, বুলবুলি, কাক, দোয়েল সহ আরও অনেক রকম পাখি।
এক জায়গায় দেখি — একটি বড়ো জামগাছ। সারা গাছ ভর্তি পাকা জামে নীল হয়ে আছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গাছ তলায় জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। পাখিরা ঠুকরে জাম খাওয়ার সময় অনেক সময় পাকা জাম নীচে পড়ে। কখনও আবার বাতাসেও টুপটুপ করে ঝরে পড়ে। সেইসব পাকা জামগুলো ওরা কুড়িয়ে খাচ্ছিল। আমরাও কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়ালাম। এবং কুড়িয়ে পাকা জাম খাই।
বেলা বারোটার মধ্যেই আমি দত্তবাড়ি গ্রামে জেবুন্নেসা বুবুদের বাড়িতে পৌঁছে যাই। বুবু তো আমাকে দেখে যারপরনাই খুশি হন। আমাকে কাছে টেনে তাঁর আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দিলেন । তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকেন। আমি বুবুকে বললাম – তোমার এইসব করতে হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা !
বুবু বাড়ির কামলা দিয়ে পুকুরপাড়ে ডাব গাছ থেকে ডাব পেড়ে ডাবের পানি খাওয়ালেন। মুড়ি খেতে দেন ঝুনা নারিকেল আর কুশালের গুর দিয়ে। কয়েকটি পাকা আম ছিলে আমাকে দিয়ে বলল — ‘গেদা, এই আমগুলো আমাদের গাছের। খুব মিষ্টি। খাও এগুলো।’
আমি এই বাড়িটিতে এর আগে আরও দুই একবার এসেছিলাম বাবার সাথে। তখন আরও ছোট ছিলাম। পাঁচ ছয় বছর বয়সের সময়। তেমন কিছু মনে নেই। আজ বাড়িটি দেখে খুব ভালো লাগছে।
বাড়ির তিন পাশে শস্যের ক্ষেত। পিছনে বড়ো বড়ো আম কাঁঠালের গাছ। অনেকটা জঙ্গলের মতো। পূর্ব পাশে ছোট্ট একটি পুকুরও আছে।
সবচেয়ে ভালো লেগেছে গ্রামটি। পুরো গ্রামটি একটি বাঁশ ঝাড়ের বাগান যেন। একে বাঁশ ঝাড়ের বনও বলা যেতে পারে। বুবুদের বাড়িটিও বাঁশ ঝাড়ে বেষ্টিত। বাড়ির সামনে এক দুটো ফসলের ক্ষেতের পরই এই বাঁশবন।
দুপুরে লিচুতলায় কাঠের হেলাঞ্চির উপর বসে ছিলাম। দেখি, দুটো বেজী বের হয়ে আসছে বাঁশ ঝাড়ের ভিতর থেকে। বেজী দুটো পিটপিট করে কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওদের ‘হো’ বলতেই দৌড়ে জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে যায়।
বুবুদের একটি পাখির ঘরও আছে । সেখানে কয়েকটি খরগোশ, দুটো টিয়াপাখি, অনেকগুলো মুনিয়া পাখি দেখলাম। পুকুর পাড়ে চারটি রাজহাঁস প্যাক প্যাক করে ঘাস খাচ্ছিল। পুকুরের জলে অনেকগুলো দেশি হাঁসও জলকেলি করছিল।
আর, সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছিল বাঁশ ঝাড়ের দিক থেকে আসা বিভিন্ন পাখপাখালিদের কিচিরমিচির শব্দ। বুবু এসে বলছিল — কুয়া থেকে ঠান্ডা পানি তুলে রেখেছি। চলো, গোসল করে নাও। আমি গোসল করবই না, বুবু আমাকে জোর করে গোসল করে দেয়। মাথায়, গায়ে, হাতে,পায়ে সাবান মেখে গোসল করে দিল। সে নিজেই আমার মাথা গা মুছে দিল। যেমন করে আমার মা আমাকে ছোট বেলায় গোসল করিয়ে দিত।
বুবু আমাকে শীতল পাটিতে বসিয়ে খেতে দেয়। আমার সাথে দুলামিঞাভাইও বসে। বুবু এরই ফাঁকে কখন মোড়গ জবাই করে ও পুকুর থেকে মাছ ধরে রান্না করেছে। জানতাম না। কাতল মাছ ভেজেছে, আবার রান্নাও করেছে। চাল কুমড়া ভাজি, কাতল মাছের মাথা দিয়ে মুগডালের ঘন্টো, ডিমের তরকারি, ডাল, কলার ক্যান দিয়ে নাবড়া, মিষ্টি কুমড়া ভর্তা, এইসব দিয়ে আমাকে খেতে দিল। আমি ছোট মানুষ! এত কিছু কী খেতে পারি? খাওয়া শেষে আবার আম দিয়ে দুধ ভাতও খেতে দেয়।
বিকালে বুবুকে বলি — আমি এখন বাড়ি চলে যাব।
বুবু বলছিল — আজ থাকো, কাল যেও।
আমি বললাম — না। আজই চলে যাব। মা বকবে। চিন্তা করবে।
আমি আমার বইখাতা হাতে নেই। বুবু বলল — আমি তোমাকে বাঁশ ঝাড়টা পার করে দিয়ে আসি। তারপর সোজা পথ, তুমি তখন একা চলে যেতে পারবে।
বুবু আমার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। বাঁশ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে পায়ে হাঁটার পথ। কি যে ভালো লাগছিল! আলোছায়ার সে এক মায়াবী পাতা ঝরার শব্দ । পাখিরা কিচিরমিচির করছিল। বাঁশ ঝাড়ের পথ পেড়িয়ে আমি ও বুবু খোলা জায়গায় এসে পড়ি।
আমি তো খোলা প্রান্তর দেখে বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। অনেক দূর পর্যন্ত খালি মাঠ। মাঠের পর মাঠ। ক্ষেতের পর ক্ষেত। সবুজ আউশ ধানক্ষেত! সবুজ পাতার গালিচা যেন মেলে রেখেছে। এই খোলা প্রান্তরটি প্রায় এক মাইলের মতো হবে। যাকে নির্জন পাথার বলে।
বুবু আমাকে বলছিল — একা এই পাথার পারি দিতে পারবে?
— পারব।
— ভয় পাবে না তো!
— না।
— তুমি যতক্ষণ এই পাথার পার হবে, ততক্ষণ আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব।
— আচ্ছা। আমি পিছনে ফিরে ফিরে তোমাকে দেখব।
— ওহ! আমার সোনার ভাইরে!
বুবু আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে —
তুমি আবার এসো।
— না, আমি আর আসব না।
— কেন, ভাই!
— তুমি আমাকে বেশি করে খাওয়াও কেন? আমি কী অত খেতে পারি নাকি?
— আচ্ছা, লক্ষী ভাইটা আমার! তুমি আবার যখন আসবে তখন একদম কম খাওয়াব।
— আচ্ছা।
আমি সেই পাথার একাকী হেঁটে পার হতে থাকি। হাঁটছি যত পিছনে তাকিয়ে বুবুকে দেখছিলাম তত। যত দূরে চলে আসি তত বুবুকে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম। আরও দূরে যখন চলে আসি তখন বুবুকে একটু বিন্দুর মতো দেখতে পাচ্ছিলাম। পাথার পার হয়ে যখন এপারে চলে আসি, দেখি — বুবু কোথায় যেন হারিয়ে গেল! আর দেখতে পাচ্ছিলাম না।
হ্যাঁ, আমার সেই বুবুটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। সেও আরও অনেক বছর পর।
আমি কী কখনও তার মতো করে তাকে মায়া করেছি? মায়া করলেও কেউ কী তা বিশ্বাস করবে? সে যে আমার সৎ বোন ছিল।
আজও যখন কোনো স্তব্ধ মুহূর্তে সুখ দুঃখের কোনো স্মৃতি বিস্মৃতি হাতড়াই, তখন মনে পড়ে — সেই কৈশোরে স্কুল থেকে ফেরা একটি বালককে আপন করে হাত ধরে বাঁশঝাড়ের পথ ধরে কেউ নিয়ে আসছে। সবুজ ধানক্ষেতের পাশে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, চেয়ে চেয়ে দেখছে সেই বালকের বাড়ি ফিরে আসা।
তখন তার চোখ কী একটুও বিষাদে ভরে ওঠেনি ! অন্তরে বাজেনি কী তখন কোনো আপন রক্তের স্পন্দন ! জানিনে, এই পৃথিবীতে কেবা আপন আর কেবা পর !
১৫. নদীর কূলে করি বাস
অভয় দাশ লেনের একটি গলিতে আলী হোসেন দুই রুম নিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে ভাড়া থাকেন। বিল্ডিংটি প্রায় শত বছরের পুরোনো। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। ফাটলও ধরেছে। পরগাছাও জন্মেছে। প্রতি রুমে একটি করে জানালা থাকলেও দিনের বেলায় সারা ঘর অন্ধকার থাকে। আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। কেমন গুমোট পরিবেশ।
আজ পনেরো বছর ধরে আলী হোসেন এই বাড়িতেই ভাড়া থাকে। বাংলাবাজারে একটি প্রেসে সে চাকুরি করে। চাকুরিও করছে সে একই জায়গায় পনরো বছর ধরে। এক বাড়িতে বছরের পর বছর বসবাস করা এবং একই চাকুরি বছরের পর বছর করে যাওয়া — দুটোর ভিতরই তার একঘেয়েমি এসে গেছে।
একঘেয়েমি এসে গেছে তার স্ত্রীরও। সে প্রায়ই তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে, বলে — জীবনে ভালো আর কোনো চাকুরি পেলে না। বাসাও পরিবর্তন করলে না, ড্রেনের দূর্গন্ধের মাঝে মশা-মাছি পোকামাকড়ের ভিতর সারাজীবন বসবাস করালে। একটু মুক্ত হাওয়া নেই। জানালা খুললে দখিনা বাতাস আসে না। নীল আকাশ দেখতে পাই না। দূরে কোথাও খোলা মাঠ নেই। কোথাও কোনো নদী নেই। গাছ নেই। পাখি নেই।
আলী হোসেনের বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটা। পড়াশোনা করেছিল কালীগঞ্জের নালতায় এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে লজিং থেকে। আর এই লজিং বাড়িরই রূপবতী মেয়ে রুমার সাথে তার প্রেম হয়। কিন্তু রুমার বাবা মা এই প্রণয় মেনে নেয়নি।
আলী হোসেন আইএ পাশ করে ঢাকায় চলে আসে। এবং বাংলাবাজারের একটি প্রেসে চাকুরি নেয়। একবার বাড়িতে যেয়ে রুমাকে পালিয়ে ঢাকায় নিয়ে এসে বিয়ে করে এবং অভয়দাশ লেনের এই বাড়িতে তোলে। আর সেই থেকেই এখানে তারা বসবাস করে আসছে।
তার জীবনে অনেক অপ্রাপ্তি ও অতৃপ্তি আছে। সে স্কুল কলেজ থেকেই ভালো কবিতা লিখত। তার স্ত্রী রুমা যখন প্রেমিকা ছিল, তখন তাকে নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখেছে। আর এইসব কবিতা চিঠির মতো করে রুমাকে দিত। রুমার মন ভুলে যেত সেইসব কবিতা পড়ে। একটা কবিতার কিছু কথা এখনও মনে আছে —
‘দূরে বহুদূরে চঞ্চল মেঘের মাঝে আকাশ ছাড়িয়ে যদি তুমি ভেসে যাও, ব্যাপ্তিও ছড়াও ঐ দূরালোকে। আমি গভীর গহনে আবর্তিত হই একাকী আমার ভূবন মাঝে। তুমি যতদূরেই যাও, আমার ভূবনেই তুমি ব্যাপ্ত হয়ে থাকো।’
আলী হোসেন এই মেয়েটিকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কখনও কবিতার শব্দের মায়াবুননে তাকে গেঁথেছে, কখনও রূপকথার গল্প কথা বলে তার মন ভুলিয়েছে, কিন্তু কোনো রূপকথা কখনোই আর নিজের গল্পকথা হয়ে ওঠেনি।
এই জীবনে সে কবি হতে পারেনি যেমন, তেমনি তার স্ত্রীকে সুন্দর পরিবশে একটি বাড়ি করে দিতে পারেনি এখনও। কিন্তু এই স্বপ্ন দুটো অনেক দিন ধরে এখনও সে দেখে আসছে।
অভাব অনটনের এই সংসারে অনেক গঞ্জনা সইতে হয় আলী হোসেনের। অবিশ্বাসী, চরিত্রহীন, লম্পট হওয়ার কথাও শুনতে হয় তার স্ত্রীর কাছে থেকে। অনেক বছর ধরে আলী হোসেন তার মাহিনার পুরো হিসাব তার স্ত্রীকে দিতে পারে না। প্রতি মাসেই কিছু না কিছু টাকা হিসাবে গরমিল থাকে। এই নিয়ে স্ত্রীর সাথে অনেক বছর ধরে ঝগড়া হয়ে আসছে।
স্ত্রী রুমার ধারণা আলী হোসেন অন্য কোনো মেয়ের পিছনে টাকা খরচ করে। সে খারাপ মেয়েদের কাছে যায়। স্ফূর্তি ও বিলাসিতা করে টাকা অপচয় করে।
একদিন স্ত্রীর সাথে তার এই ব্যাপারটি নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়। আলী হোসেন অফিসে চলে যায়। অফিসে যেয়ে তিন মাসের অবৈতনিক ছুটি নেয়। এবং ওখানেই বসে বসে রুমার কাছে একটি পত্র লেখে। বিকালে বাসায় চলে আসে। চুপিচুপি সেই পত্রখানি রুমার বালিশের নীচে রেখে দেয় এবং একটি ইনভিলপের ভিতর কিছু টাকা রেখে দিয়ে পূণরায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা হয়ে রাত্রি হয়ে যায়। আলী হোসেন আর ঘরে ফিরে আসে না। রুমা কী করবে কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারে না। সে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। তার কান্না দেখে নাবালক সন্তান দুটোও কান্না করতে থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত সে না খেয়ে বিছানায় বসে বসে অশ্রুপাত করে। হঠাৎ বালিশটা সরাতেই সে একটি চিঠি দেখতে পায়। চিঠিখানি খুলে সে পড়তে থাকে —
কল্যাণীয়াসু রুমা,
এই জীবনে তোমাকে যে আমি কত ভালোবাসিয়াছি, তা তুমি বুঝিতে পারো নাই। তোমার অনেক স্বপ্ন আমি পূরণ করিতে পারি নাই। এই জন্য আমারও গ্লানি কম হয় নাই। তুমি অনেক কষ্ট করিয়া আমার অভাব অনটনের সংসারে থাকিয়া গিয়াছ। তুমি আমাকে ফেলিয়া রাখিয়া বিত্তবান পিতার গৃহে ফিরিয়া যাও নাই। আমি জানি, তুমি আমাকে এখনও অনেক ভালোবাসো, এই সংসারকে ভালোবাসো, তোমার সন্তানদের ভালোবাসো।
আমি কিছুদিনের জন্য তোমাদের মায়া ত্যাগ করিয়া নিরুদ্দেশে চলিয়া গেলাম। বেঁচে থাকিলে আমি আবার তোমাদের কাছে ফিরিয়া আসিব। ইনভিলপের ভিতর কিছু টাকা রাখিয়া গেলাম। আমার ধারণা, কষ্ট করে তুমি মাস তিনেক চলিতে পারিবে।
আমি এখনও স্বপ্ন দেখি — তোমার সুন্দর একটি বাড়ি হইবে। কবিতা লেখার জন্য আমার একটি আলাদা কক্ষ থাকিবে। দক্ষিণের জানালা খুলিলেই দখিণা হাওয়া আসিয়া তোমার গায়ে লাগিবে। অদূরে নদী থাকিবে। নীল আকাশের ছায়াতল দিয়া হাঁটিয়া হাঁটিয়া আমরা দুজন নদীর কূলে বেড়াইতে যাইব। ওখানেই সন্ধ্যা নামিবে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠিবে। তারায় তারায় আকাশ ভরিয়া উঠিবে। আমরা জোছনা মাখিয়া মাখিয়া তারপর ঘরে ফিরিয়া আসিব।
জানিনা এই স্বপ্ন পূর্ণ হইবে কী না, তবু আমি সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে অভিযাত্রা করিলাম।
ইতি — তোমার আলী।
***** ***** *****
ঠিক দুই মাস পঁচিশ দিন পর….
একদিন সন্ধ্যারাতে আলী হোসেন গৃহে ফিরে আসে। মুখ ভর্তি তার দাড়ি। এই কয়দিনে সে দাড়ি কাটে নাই। চোখে, মুখে, শরীরে ক্লান্তির ছাপ। অনেক ধকল ও পরিশ্রমের ছাপ সুস্পষ্ট। রুমা তার স্বামীকে পেয়ে খুব খুশি হয়। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে তার ছেলেমেয়ে দুটোও। সে রাতে রুমা আলী হোসেনের বুকে মাথা রেখে আনন্দ অশ্রু জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
পরের দিন আলী হোসেন চাকুরি থেকে ইস্তফা দেয়। বাড়িওয়ালাকে নোটিশ করলেন বাড়ি ছেড়ে দেবার। আসবাব পত্র যাকিছু ছিল সব বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। রুমা, তার স্বামীকে বলে — তুমি এসব কী করছো?
— এখানে আর থাকব না। আমরা আবার দেবহাটা আমাদের গ্রামের বাড়ি ফিরে যাব।
অভয়দাশ লেনের এই ঘিঞ্জি গলির বাড়িতে সেদিন
ছিল শেষ রাত। আলী হোসেন ও রুমা বিছানায় শুয়ে আছে। কারোর চোখেই ঘুম আসছে না। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে। কত হাসি কান্না, কত দুঃখ-সুখ, কত ঝগড়া বিসম্বাদ, কত ভালোবাসার ক্ষণ কেটেছে এই বাড়িতে। কত মধুময় স্পর্শ ছিল দুজনের মধ্যে। কত প্রেম এসেছিল দুজনের জীবনের প্রান্তে।
মনে পড়ে, রুমা সবকিছু ছিন্ন করে তার হাত ধরে উঠেছিল এসে এই বাড়িতেই। বিষণ্ণ দুটো তরুণ তরুণী সেদিন স্বজনহীন একাকী বাসর রাত কাটিয়েছিল । রুমার পরনে কোনো লাল বেনারসি শাড়ি ছিল না, হাতে ছিল না মেহেদি। মুখে ছিল না চন্দন চিহ্ন। গায়ে মাখেনি কোনো আতরের গন্ধ। একটি ফুলও কেউ ছিটিয়ে দেয়নি তাদের বাসর শয্যায় । আয়নাতে দেখেনি দুজন দুজনের মুখ। কেউ মুখে তুলে খাওয়ানি একটুখানি মিষ্টি। কেউ কোনো প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে রাখেনি এই বন্ধ ঘরে।
এই বাড়ি এই ঘর, পনেরো বছরের গড়া সুখ দুঃখের এই খেলাঘর ভেঙে দিয়ে তারা পরেরদিন সকালবেলা দেবহাটার উদ্দেশ্যে স্ব-পরিবারে রওনা হলেন।
ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসটি যখন দেবহাটা এসে থামে তখন বিকাল হয়ে গেছে। রুমা এর আগে আসেনি কখনও এই উপজেলা শহরে। ওরা সবাই বাস থেকে নেমে একটি টমটমে ওঠে। গাড়োয়ান আলী হোসেনকে জিজ্ঞাসা করে — ‘ভাই কোথায় যাব?
আলী হোসেন বলে — হিজল ডাঙা।
টমটম চলছে আধা পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ করে। কী অপূর্ব দৃশ্য চারিদিকে। দূরে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ সবুজ বেষ্টনী। আরেক পাশে ইছামতী নদী বয়ে চলেছে। কী দারুণ শীতল হাওয়া বইছে !
রুমারও কী যে ভালো লাগছিল এই প্রকৃতি দর্শনে। পনেরোটা বছর সে বন্দী ছিল ঘিঞ্জি দুর্গন্ধময় গলির ভিতর এক জীর্ণ বাড়িতে। আজ যেন সে প্রাণ থেকে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চারিদিকে ঘন সবুজ ফসলের মাঠ, অনিঃশেষ দিগন্ত, ঝাউ বন, শুপারি বাগান, গাছগাছালি, পশু পাখি, খোলা নীল আকাশ, মানুষ, নারী ও নদী।
টমটমটি ইছামতী নদীর তীরে একটি কাঠের দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামে। তখন সন্ধ্যাপূর্ব বিকাল। কী সুন্দর এই কাঠের বাড়িটি। যেন রবি ঠাকুরের কুঠি বাড়ি। একদম ইছামতী নদীর তীর ঘেসে তৈরি এই বাড়িটি। সেই বিমুগ্ধ সন্ধ্যাবেলায় নদীর জল কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছিল সাগরের দিকে।
আলী হোসেন সবাইকে নিয়ে টমটম থেকে নামে। তারা হেঁটে চলে আসে — বাড়িটার সামনে। বাড়ির গেটে ছোট্ট একটি নেম প্লেটে লেখা, ‘রুমা ভিলা।’ আলী হোসেন পকেট থেকে চাবি বের করে রুমার হাতে দিয়ে বলে — এটি তোমার বাড়ি।
কাকতালীয়ভাবে সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমা রাত্রি। আলী হোসেন আর রুমা বসে আছে দোতালায় বারান্দায়। আকাশে কমলা সুন্দরীর মতো রূপময়ী চাঁদ। পাশে নদীর জল মৃদঙ্গ সুরে বয়ে চলেছে ঝিরিঝিরি দ্যোতনায়। রুমা, তার স্বামীর বুকে মাথা ঠেকিয়ে পরম আনন্দ চিত্তে বলে — ‘ওগো, তুমি এত টাকা কোথায় পেলে?’
আলী হোসেন রুমার গ্রীবা ছুঁয়ে মুখখানি উপরের দিকে উঠিয়ে বলে — আমি প্রতি মাসে কিছুকিছু করে টাকা ব্যাংকে জমিয়ে রাখতাম। তুমি তা জানতে না। জানলে আমাদের অভাবের সংসারে খরচ করে ফেলতে। আমাকে কতই না সন্দেহ করতে তুমি। জানো, বারো বছর ধরে আমি এই টাকা জমিয়েছিলাম!
রুমা সলজ্জিত হয়ে আলী হোসেনকে বুকে জড়িয়ে
ধরে বলে — আমাকে তুমি ক্ষমা করো, আমাকে তুমি অশেষ করেছ, আমার দেহখানি প্রদীপ করো ঐ চাঁদের মতোন, জোছনায় ভাসাও আমাকে। আমার ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমার যত গ্লানি …
সেদিন হেমন্তের চাঁদ ডুবতে চায়নি হিজল ডাঙার অন্ধকার বন-প্রান্তরে। নদীর কূল আকুল হয়ে ভেসেছিল জোছনার বন্যায়। দুটো মানব মানবীর দেহমনহৃদয় সেই রাতে একূল ওকূল করে ভেসে গিয়েছিল, …. এমন আরও কত অপরূপ প্রহর কেটেছে তাদের এই কাঠের কুটিরে। এই নদীর কূলে কত দিবস রাত্রি করেছে তারা বাস ।
১৬. ছোট্ট মায়া
তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। কার্তিক মাসের এক
ছুটির দিনে একাকী মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার বাড়ি ছিল গোপীনাথপুরে। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে। যমুনা নদীর তীর ঘেসে বাড়ি। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মাঝখানে একটা ছোট নদীও পড়ে। খেয়া নৌকায় পার হতে হয়।
রবিনহুডের মতো একদিন হেঁটে হেঁটে মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে পৌঁছে যাই গোপীনাথপুর আমার মামার
বাড়ি।
সারা বিকাল পর্যন্ত মামাতো ভাই ছাইদুলের সাথে পুরো গ্রাম চষে বেড়াই। যমুনার কূলে যাই বেড়াতে। দেখি, সেখানে মাটির পাড় ভেঙে পড়ছে নদীতে। বয়রা ঘাট থেকে ছেড়ে আসা বড়ো স্টীমারটি ভেঁপু বাজিয়ে চলে যাচ্ছে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের দিকে। চলছে লঞ্চ ও পাল তোলা সারি সারি নৌকা। জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরছে । দূরে মাঝ নদীতে জেগে ওঠা চর জুড়ে দেখতে পাচ্ছিলাম সাদাকেশি কাশবন।
মাঠে কার্তিকের রোদ্রতাপে কিষাণেরা কাজ করছিল। কেউ কেউ জারীগান গাইছিল আপন মনে। কেউ হুকোয় তামাক তুলে মনের সুখে গরগর শব্দ তুলে টান দিচ্ছিল। নদীর কূলে উপরে ছেয়ে আছে নীল আকাশ, সেই আকাশে বিভিন্ন পাখি উড়ছে। উড়ছিল চিলও। নদী থেকে বাতাস বয়ে আসছিল শন শন করে। কী যে ভালো লাগছিল — কূলে দাঁড়িয়ে জল দেখতে!
কিন্তু যমুনার একটি জিনিস দেখে আমার খুব
মনখারাপ হয়েছিল। দেখলাম, আধা পাকা ধানক্ষেত, সরিষা ক্ষেত, আখ ক্ষেত ভেঙে ভেঙে পড়ছে উত্তাল নদীতে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল — চোখের সামনে দেখলাম, একটি বহু প্রাচীন জীর্ণ মঠ মাটি উপড়ে নদীর জলে তলিয়ে যেতে ।
যমুনার পাড় থেকে ফেরার পথে ছাইদুল আমাকে বলছিল — ‘তুই তো খুব মন খারাপ করেছিস দেখছি। চল্ তোর মন ভালো করে দেই।’
আমি বললাম, কী সে !
ছাইদুল বলল – ‘ আলেয়া আপুর নাম শুনিস নাই? আমার চাচাতো ফুপুর মেয়ে। পূর্ব পাড়ায় ওদের বাড়ি। তোকে ওখানে ঐ বাড়িটায় নিয়ে যাব।’
আমি বললাম, ‘আলেয়া আপুর নাম শুনেছি মার কাছে থেকে। কিন্তু কোনো দিন দেখি নাই তাকে ।’
আম, জাম, কাঁঠাল, শুপারি ও নারিকেল গাছ বেষ্টিত ছিমছাম পরিবেশে আলেয়া আপুদের বাড়ি। আমরা বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলাম — আলেয়া আপুকে। এমন পল্লীর নিবিড় কোণে, এমন প্রতিমার মতো মেয়ে থাকে ! বিস্ময়ে চেয়ে দেখছিলাম। চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ,… চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি করে না। আমি তখন নিতান্তই কিশোর–উত্তর এক তরুণ। মেয়েদের রূপ লাবণ্য ঐ ভাবে তখন বুঝতাম না।
আমি যখন অনেক বড়ো হয়ে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হলাম — চন্দ্রাবতী, পদ্মাবতী, পার্বতী, লাবণ্যদের রূপ বর্ণনা যখন পড়েছি, তখন অনেক আগের — সবুজ পত্রপল্লব ঘেরা পল্লী গৃহকোণের একজন আলেয়া আপুকে দেখা তার অপূর্ব শ্রীময়ী মুখখানি মনে মনে মিলাতাম।
কী সুন্দর করে কত কথাই না বলেছিল আলেয়া আপু — ‘ তুমি কী পড়ো, কী হতে চাও জীবনে, কী ভালো লাগে তোমার, আমার কথা তোমার মনে থাকবে, তুমি অনেক ভালো ছেলে !’ এমন অনেক ভাঙা ভাঙা কম্পিত কথা।
আলেয়া আপুদের বাড়ি থেকে যখন চলে আসি — তখন আপু বলেছিল — ‘ফাল্গুনের চার তারিখে আমার বিয়ে হবে। তুমি এসো বিয়েতে। কী আসবে না তুমি? ‘
আমি মাথা নেরে বলেছিলাম — ‘ আসব আপু। আমি এসে সারা বাড়ির উঠোনে আলপনা আঁকবো আর নেচে নেচে হারমণিকা বাজাবো।’
পথে আসতে আসতে ছাইদুল আমাকে বলছিল — কী! আলেয়া আপুকে দেখে তোর মন ভালো হয়েছে তো ?’ আমি বলেছিলাম — ‘হয়েছে।’
কিন্তু, ছাইদুল জানতে পারেনি, সেদিন আমার কোমল কিশার তরুণ মন অনেকখানি খারাপও হয়েছিল। সেই মনখারাপের বিষণ্ণতা আজও মনের উপর অমাঙ্গলিক ছায়া ফেলে।
বিকালে যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন আমার সাথে খেয়া পার হচ্ছিল একজন বোষ্টুম ও একজন বোষ্টুমি। ওদের পরনে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়। দুজনের হাতে দোতারা! আমি বললাম — তোমরা একটা গান গেয়ে শোনাবে আমাকে! টাকা চাইলে টাকা নিবা। আমার কাছে দশ টাকা আছে। তাই দেব তোমাদের।
বোষ্টুমি বলছিল — ‘আমরা কত ঘাটে কত বাটে, কত চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে — কত গান গেয়ে শোনাই মানুষকে। কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা তোমাকে এমনি একটা গান শোনাব, কোনো পয়সা লাগবে না।’
বোষ্টুমি দোতারায় তান তুলল। বোষ্টুম বাজাচ্ছিল খুঞ্জরি টুংটাং করে —
দুজনেই একসাথে গেয়ে শোনাল গান।
‘…ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী
দিতে হবে ভব পাড়ি
চেয়ে দেখো মন-ব্যাপারী
দিন গেলে হয় সন্ধ্যা ..
আপনি যদি ভালো বুঝ
সুসময়ে মুর্শিদ ভজ
জ্ঞান থাকিতে পাগল সাজো
চোখ থাকতে হও আন্ধা ..
এই দুনিয়া মায়া জালে বান্ধা ..’
মানুষের জীবনে শুরু থেকে কত কিছুই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি থাকে ! কত সুখ অনুরণরিত হয় বোষ্টুমীর ঐ দোতারার তানের মতো চিরকাল। আবার কত ছোট্ট কোনো মায়া–বেদনা আটকে থাকে বুকের গভীরে অনন্ত জীবন ধরে, কান্না হয়ে তা ঝরে পড়েনা।
কী এক অদ্ভুত সন্ধ্যা ছিল সেদিন। ছোট্ট সেই নদীর জলের ক্ষীণ ধারা ছলাৎছল করছিল। সন্ধ্যা আকাশের সব সোনালি আভা যেন মেখে দিচ্ছিল আমার অন্তরের মাঝে!
কিছু রঙ তার এখনও মনকে রঙিন করে।
১৭. বাঁধন কেটে যায়
বিয়ের আগের কথা। আমি আমার বাংলো বাড়িতে তখন একা থাকি। একদিন দেখি বারান্দায় টিনের টুইয়ের ফাঁকে দুটো চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে। কখন ওরা খড়কুটো এনে বাসা তৈরি করেছে, আমি বুঝতেই পারিনি।
আমার ভালোই লাগত ওদের উড়াউড়ি ছোটাছুটি কিচিরমিচির। সকালবেলা ওদের কিচিরমিচির যেন বেড়ে যায়। মনে হতো, ওরা যেন বলছে — ‘ঘুমিয়ে থেকো না, ওঠো, তোমার অফিসে যাবার সময় হয়েছে।’
একদিন দেখলাম, মেয়ে চড়ুইটি বাসার ভিতর চুপটি করে বসে আছে। বুঝতে পারলাম, ডিম পেরেছে। সেই ডিমে তা দিচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগল — ওরা বাসা বাঁধল। এখন ওদের ছেলেমেয়েও হবে।
আমি জেনেছিলাম, মেয়েরা যখন পোয়াতি হয়, তখন নাকি তাদের ভালো মন্দ খাবার খেতে হয়। এই ভেবে আমি একদিন অফিস থেকে আসার সময় দোকান থেকে চালের খুঁদ ও বিস্কুট কিনে নিয়ে আসি। আমি প্রতিদিন উঠোনে চালের খুঁদ ও বিস্কুট গুঁরো করে ছিটিয়ে দিতাম, চড়ুই দুটো খুব মহানন্দে তা খেত।
তারও কিছুদিন পর দেখলাম, চড়ুয়ের ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফুটেছে। ছেলে চড়ুই ও মেয়ে চড়ুই দুজনের চোখে মুখে সে কি হাসি! ওদের নতুন ধরনের কিচিরমিচির শব্দ শুনেই আমি বুঝতে পারতাম ওদের আনন্দ অনুভব ।
ওদের পরিবারের সংখ্যা যেহেতু বেড়ে গেছে, তাই আমি খুঁদ ও বিস্কুটের গুঁরো বেশি করে উঠোনে ছিটিয়ে দিতাম।
বাচ্চা চড়ুইগুলো দিনে দিনে বড়ো হয়ে উঠল। আর একদিন দেখলাম, সেই বাচ্চা চড়ুইগুলো আর নেই। ওরা উড়ে চলে গেছে।
কয়দিন চড়ুই দুটোকে খুব মন খারাপ দেখলাম। ওরা আমার ছিটানো খাবারগুলো তেমন খাচ্ছে না।কিচিরমিচিরও তেমন করে না।
তারও কয়েকদিন পরে দেখি, ওরা আগের মতোই উড়াউড়ি ছুটাছুটি করছে। যেন সব দুঃখ বেদনা ভুলে গেছে। সকালবেলায় কিচিরমিচির করে আগের মতই বলত — ‘তুমি ওঠো, তোমার অফিসে যাবার সময় হয়ে গেছে।’
কতোদিন ধরে চড়ুই দুটো আমার ঘরের বারান্দায় বাসা বেঁধে আছে, আমার ভালই লাগত ওদের সাথে এই একাকী জীবন যাপন। মনে হতো, এই একাকী বাড়িতে কেউ না থাকলেও ওরা তো আমার সাথে আছে।
তার আরো পরে যেদিন আনন্দ উৎসব করে আমি বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসলাম। সেদিন চড়ুই দুটোও আমার সব আনন্দ উৎসব দেখল। ওদেরকেও খুব হাসি খুশি মনে হল। ওদের কিচিরমিচির আমার কাছে আনন্দ সঙ্গীতের মতো মনে হয়েছে।
পরের দিন সকালবেলা নতুন বউয়ের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম, নতুন বউকে বললাম — এই পাখি দুটো ছিল আমার একাকীত্বের সঙ্গী। ওরা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিত।
কিচিরমিচির করে পাখি দুটো কী যেন বলছিল তখন, বুঝতে পারিনি।
ঐদিন সারাদিন পাখি দুটোকে আর দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যায়ও ফিরে এল না। পরের দিন সকালেও না। আসলে ওরা বাঁধন কেটে উড়ে চলে গেছে। পরে মনে হয়েছিল — ওরা যে কাল যাবার বেলায় কিচিরমিচির করে যে কথা বলেছিল, তখন তা বুঝতে পারিনি ।
ওরা হয়ত বলেছিল — ‘তোমার ঘরে এখন নতুন মানুষ এসেছে। এখন থেকে সেই তোমায় সকালবেলা ঘুম ভাঙাবে। তোমাকে গান গেয়ে শোনাবে। তুমি তার সাথে গল্প করবে। আমাদের দায় শেষ। আমরা তাই উড়ে চলে গেলাম।’
১৮. রুক্সীণী উপাখ্যান
নাইনে পড়ি তখন। কার্তিক মাসের এক ছুটির দিনে একাকী মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার বাড়ি ছিল গোপীনাথপুরে। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে। যমুনা নদীর তীর ঘেসে বাড়ি। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মাঝখানে একটা ছোট নদীও পড়ে। খেয়া নৌকায় পার হতে হয়।
রবিনহুডের মতো একদিন হেঁটে হেঁটে মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে পৌঁছে যাই গোপীনাথপুর আমার মামার বাড়ি।
মামাতো ভাই ছাইদুলের সাথে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বিকালে যখন বাড়ি ফিরব, তখন ছাইদুল বলছিল, তুই কোন্ পথ দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবি?
আমি বললাম, আমি এসেছি নদীর কূলের পথ ধরে। ফিরে যাবও ঐ পথ দিয়েই।
ছাইদুল আমাকে বুদ্ধি দিল — তুই যে পথ দিয়ে এসেছিস, ঐ পথ দিয়ে যাবি না। আরও একটা সুন্দর পথ আছে, তুই ঐ পথ দিয়ে যাবি। খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারবি।
আমি বললাম — কোন্ পথ দিয়ে যাব ? বলে দে।
ছাইদুল পথ বলে দিল — প্রথমে খেয়া নৌকায় ছোট নদীটা পার হবি। নদী পার হয়ে বামদিকে পথ দিয়ে না যেয়ে সোজা পাঁচঠাকুরী গ্রামের পথ ধরে পশ্চিম দিকে চলে যাবি। তবে পাঁচঠাকুরী গ্রাম পর্যন্ত যাবি না। আধা মাইল যাওয়ার পর দেখবি, হাতের বাম দিকে একটা মেঠো পথ নেমে গেছে। ঐ মেঠো পথ ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর তিন রাস্তার মোড় দেখতে পাবি।
ঐ তিন রাস্তার মোড়ে তুই বামদিকের রাস্তায় যাবি না, ডানদিকেও যাবি না। সোজা চলে যাবি। কিছু দূর যাওয়ার পর একটি বড়ো আমগাছ দেখতে পাবি। ঐ আমগাছের তলা দিয়ে হেঁটে চলে যাবি সামনের গ্রামের দিকে। ঐ গ্রামের পরই তোদের কুসুমপুর গ্রাম।
বিকালে যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন ছাইদুলের বলে দেওয়া পথ ধরেই আসতে থাকি। প্রথমেই খেয়া পার হচ্ছিলাম। আমার সাথে খেয়া পার হচ্ছিল একজন বোষ্টুম ও একজন বোষ্টুমি। ওদের পরনে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়। দুজনের হাতে দোতারা! আমি বললাম — তোমরা একটা গান গেয়ে শোনাবে আমাকে! টাকা চাইলে টাকা নিবা। আমার কাছে দশ টাকা আছে। তাই দেব তোমাদের।
বোষ্টুমি বলছিল — ‘আমরা কত ঘাটে কত বাটে, কত চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে — কত গান গেয়ে শোনাই মানুষকে। কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা তোমাকে এমনি একটা গান শোনাব, কোনো পয়সা লাগবে না।’
বোষ্টুমি দোতারায় তান তুলল। বোষ্টুম বাজাচ্ছিল খুঞ্জরি টুংটাং করে —
দুজনেই একসাথে গেয়ে শোনাল গান।
‘ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী
দিতে হবে ভব পাড়ি
চেয়ে দেখো মন-ব্যাপারী
দিন গেলে হয় সন্ধ্যা ..
চোখ থাকতে হও আন্ধা ..
এই দুনিয়া মায়া জালে বান্ধা ..’
কী ভালো লাগছিল গানটা! এক অদ্ভুত বিকাল ছিল তখন। ছোট্ট সেই নদীর জলের ক্ষীণ ধারা ছলাৎছল করে উঠছিল। বিকালের আকাশের সব সোনালি আভা যেন মেখে দিচ্ছিল আমার অন্তরের মাঝে!
খেয়া নৌকায় পার হয়ে যখন এ পাড়ে আসি তখন আমি বৌষ্টুমীকে বলি — তোমরা কোথায় যাচ্ছো?
— আমরা ধলডোব গ্রামে যাব। ওখানে রায় বাড়িতে গানের আসর আছে। ওখানে আমরা গান শোনাব।
— আমারে সাথে নিবা?
— তুমি যাইবা?
— হু, যাব।
— তোমার বাবা মা তোমাকে বকবে না?
— তারা জানবে না।
— তাই? চলো তবে ।
নদী পার হয়ে পশ্চিম দিকে রাস্তা ধরে বৌষ্টুমীদের সাথে হাঁটতে থাকি। সূর্যের কড়া রোদ মুখে এসে পড়ছিল। খুব ভালোও লাগছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি — এক বাড়ির গাছ তলায় অনেক মানুষের জটলা। লাঠির বারির আওয়াজ আর শোরগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এক লোককে জিজ্ঞাসা করি , ওখানে কী হচ্ছে? লোকটি বলল — লাঠিখেলা হচ্ছে। ‘
আমি বোষ্টুমী দিদিকে ডাকলাম — ও দিদি!
— কী!
— লাঠিখেলা দেখবা?
— না, আমাদের সময় নেই।
— আমি দেখব।
— তুমি দেখ গে।
— তোমাদের সাথে আমার আর যাওয়া হলো না।
— আচ্ছা।
— তোমাদের আবার কোথায় দেখা পাব?
— আমরা পথের মানুষ। পথে পথে ঘুরি। এই পথেই দেখা পাবে কোনো একদিন ।
আমি চলে যাই লাঠি খেলা দেখতে। কী যে চমৎকার লাঠি খেলা হচ্ছিল। পালোয়ানের
মতো দুজন সুঠাম লোক লাঠি খেলছে । উঁচা লম্বা। পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। লুঙ্গি মালকোচা করে বান্দা। পোক্ত বাঁশের লাঠি। পোড়ানো এবং কালচে রঙ করা। সে কি তুমুল বাইরাবেরি। খটখট আওয়াজ হচ্ছে। লোকজন হুল্লোড় কড়ছে। কেউ শীষ দিচ্ছে। আমি বিস্ময় ভরে ওদের লাঠি খেলা দেখতে থাকি!
মাগরিবের আযানের আগ দিয়ে লাঠি খেলা শেষ হয়ে যায়। খেলা দেখা শেষ করে আমি পুণরায় আবার বাড়ির পথে চলতে থাকি।
ছাইদুল বলেছিল — পাঁচঠাকুরী গ্রামের আগেই বামদিকের একটি মেঠো পথ দিয়ে যেতে হবে। পাঁচঠাকুরী গ্রামের ঐ পর্যম্ত যেতেই কালী সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমার সাথে কোনো সঙ্গী সাথী নাই। খুব ভয় ভয় লাগছিল আমার ।
আমি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, ঠিক এই মেঠো পথ দিয়ে যেতে হবে কী না? পথটির দুধারে বিস্তৃর্ণ আখের ক্ষেত। কিছু দেখা যায় না। তার উপর সন্ধ্যা রাত্রির অন্ধকার! ঠিক তখনই আখের ক্ষেতের ভিতর থেকে মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে আসে একজন যুবতী নারী।
রমণীটিকে আমি চিনি। এ যে আমাদের গাঁয়ের ভোলা মন্ডলের সুন্দরী বউ। আমি একটু সাহস পেলাম — বললাম — তুমি কই যাও?
— ‘নরপাড়া বাপের বাড়ি যাইতাছি। তোমার ভোলা ভাই আমারে মাইরা খেদাইয়া দিছে!’
এই রাতে আমাকে একা দেখে ভোলা মন্ডলের বউ বলছিল — ‘তা তুমি একা যাইতে পারবা? সামনে একটা জায়গা আছে, খুব একটা ভালো না। তুমি তিন রাস্তার মোড়ে যেয়ে সোজা যাইও। ভুলেও ডান দিকে যাবা না।’
আমি বললাম — আচ্ছা।
ভোলা মন্ডলের বউ বলছিল, ‘আমি কী তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসব?’
এই নিশি রাতে এক পর সুন্দরী রমণী আখ ক্ষেতের ভিতর দিয়ে আমার সাথে গমন করবে, কেউ দেখলে আমার বদনাম হবে। এই ভেবে আমি ভোলা মন্ডলের বউকে বললাম — আমি একাই যেতে পারব।
ভোলা মন্ডলের বউ পাশের নরপাড়া গাঁয়ের দিকে চলে গেল। আমি আখ ক্ষেতের ভিতর দিয়ে মেঠো পথ ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। কিছুদূর আসার পর দেখি — আখ ক্ষেতের পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে। একটু ভয় পেলাম। যত হাঁটছি, ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝি পোকার ডাক বাড়ছে। আকাশে চাঁদ নেই। আখ পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশে চেয়ে যা দেখছি তা কয়েকটি অনুজ্জ্বল তারা।
হঠাৎ দেখি — কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মুনিয়া পাখি উড়ে আসছে। ওরা আমার মাথার উপর দিয়ে শন শন করে চলে যাচ্ছে। অদূরে শিয়ালও ডাকছে হুক্কাহুয়া করে। শিয়ালের ডাক শুনে আমি ভয় পেলাম না। আমি হাঁটতে থাকি সাহস করে সামনের দিকে।
কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি — সেই তিন রাস্তার মোড়। আমাকে মাঝের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু দেখি, মাঝের রাস্তার উপর অনেকগুলো কাক মরে পড়ে আছে। মরা কাকের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাকে যেতে হবে। খুব ভয় লাগছিল আমার।
আমি মাঝের রাস্তা দিয়ে না যেয়ে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে য়েতে থাকি। কী সুন্দর খোলা পথ! খুব ভালো লাগছিল হাঁটতে। কোথাও কোনো আখ ক্ষেত নেই। চারিদিকে সব সরিষার ক্ষেত। রাতের বেলায় হলুূদ ফুলের প্রান্তর দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কেমন এক মোহন আবেশে মন ভরে উঠছিল। গন্ধে আকুল করে রেখেছিল রাতের মিহি বাতাস। আমি সে গন্ধ মেখে হাঁটতে থাকি।
সামনের দিকে এগুতেই দেখতে পাই — একটি পরিত্যক্ত নীলকুঠি। নীলকুঠি তো নয়, পোড়ামাটির ধ্বংসস্তূপ। শুনেছি এই কুঠি এলাকায় কেউ ভয়ে দিনের বেলায় আসে না। এখানে নাকি ভূতের আড্ডা বসে দিনে ও রাত্রিতে।
হায় আল্লাহ! আমাকে কে যে এখানে টেনে নিয়ে এলো ! কোন্ জ্বীন পরী? পিছনে তাকিয়ে দেখি — কোথাও কোনো হলুদ সরিষার ক্ষেত নেই। সব মিছে ছিল। সব আখ ক্ষেত!
নীলকুঠির সামনে বাবলা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি এক দাড়িওয়ালা বুড়াকে। আমি বুড়াকে বলি — দাদু, আমি পথ ভুল করে এখানে এসেছি। আমাকে তুমি পথ দেখিয়ে দাও।
— তুই আর এখান থেকে যেতে পারবি না!
— কেন পারব না?
— তোকে বলি দিব।
বুড়ার পিছনে দেখি — পনের ষোল বছরের একটি রূপবতী মেয়ে। পরীর মতো চেহারা। অসম্ভব সুন্দরী। মাথার চুল দুই বেনী করা। বেনীতে বাবলা ফুল গাঁথা , আর গলায় কাঁঠালীচাঁপা ফুলের মালা। আমি বললাম — মেয়েটি কে?
বুড়া বলল — ওকে আমি যমুনার নদীর এক গহীন চর থেকে নিয়ে এসেছি। ওর নাম রুক্সীণী । ও আমার নাতীকে ভালো বাসত। কিন্তু আমার নাতী সাপে কেটে মারা গেছে।
তারপর থেকে রুক্সীণী পাগল হয়ে কাশবনে পড়ে থাকত। কিছু খেত না। কী করব? ওর জন্য আমার খুব মায়া হয়। পরে ওকে আমি এখানে এই নীলকুঠিতে নিয়ে আসি বিবাহ করব বলে । কিন্তু আমার তান্ত্রিক গুরু শর্ত দিয়েছে আমাকে আগে নরবলি দিতে হবে। তারপর আমি বিবাহ করতে পারব।
মেয়েটি আমার দিকে সেই অন্ধকার রাত্রিতে খুব মায়া করে তাকিয়ে দেখছিল। যেন কতকাল ধরে সে আমাকে চেনে। আমিও তাকে চিনি। আমি ইঙ্গিৎ করে — মেয়েটিকে বললাম — তুমি আমাকে বাঁচাও! আমিও তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব।
বুড়া আমাদের শলাপরামর্শ বুঝতে পারছিল। বুড়া বলে — ‘এখানে দাঁড়া তুই , আমি ভিতর থেকে রামদা নিয়ে আসি। এখনই তোর গর্দান মাটিতে ফেলে দিব।’ এই কথা বলে বুড়া নীলকুঠির ভিতরে চলে যায়।
আমি এই সুযোগে খপ করে রুক্সীণীর একটি হাত ধরি। এবং দুজন হাত ধরে ক্ষেত পাতাইলা ঝাইরা আমাদের গ্রামের দিকে দৌড় দেই।
এর পরের ঘটনা আমার আর মনে নেই।
তখন বেলা দশ ঘটিকা হবে । আমি আমাদের বাড়ির ঘরে পালঙ্কের উপর শুয়ে আছি। চারপাশে অনেক মানুষ! সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ভীড়ের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখতে পেলাম — ঠিক রাতে দেখা নীলকুঠির ঐ পরী মেয়েটির মতো। চুল দুই বেনী গাঁথা, বেনীতে বাবলা ফুল, গলায় কাঁঠালিচাঁপার মালা। এই মেয়েটিকে এর আগে কখনও আমাদের বাড়িতে দেখি নাই।
১৯. দ্বিধা
লায়লা আমার সহপাঠী ছিল। ইউনিভার্সিটিতে তিন বছর একসাথে অনার্স পড়েছি। আমরা দুজন একে অপরের ভালো বন্ধুও ছিলাম।
লায়লা আমাকে একটি চিঠি লিখেছিল। আমাদের অনার্স পরীক্ষা যেদিন শেখ হয়ে যায় সেদিন। তিন বছরে কত ক্ষণ ছিল, কত মুহূর্ত ছিল, কত আনন্দময় সময় ছিল, কত আকাঙ্খা করতাম কোনো নিবেদন পাওয়ার — তখন সে কিছু লেখেনি। ইউনিভার্সিটি যেদিন বন্ধ হয়ে গেল, যেদিন থেকে আর কোনো দিন ক্লাস হবে না, সেদিন সে আমাকে চিঠি লিখেছে। তাও বিদায় বেলায় যাবার সময়।
চিঠিটি দেওয়ার সময় লায়লা শর্তও দিয়েছিল একটা — ‘আমি যখন চলে যাব। স্টেশন থেকে ট্রেনখানি যখন ছেড়ে চলে যাবে অনেক দূর, তখন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তুমি পড়বে আমার চিঠিখানা, এর আগে নয়। ‘
আমি লায়লাকে বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে, তাই পড়ব।’
রাজশাহী এক্সপ্রেস ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে ঝিকঝিক করে প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যায়। এই ট্রেনেই চলে যায় লায়লা । কী সুন্দর হাসিখুশি ভাবে চলে গেল সে। মুখে কোনো মন খারাপ নেই। চোখে কোনো বিষণ্ণতাও নেই। জানালার কাছে বসে ছিল সে। তাই দেখতেও পেলাম ওর যাবার বেলাকার দু চোখ। ট্রেন আড়াল হয়ে যতদূর পর্যন্ত মিলিয়ে গেল, ততদূর পর্যন্ত ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলাম ।
পথে যেতে যেতে ওর চোখ থেকে একটুও কী কান্না ঝরে পড়েনি আমার জন্য? ও কী পাষাণী? নাকি আমি পাষাণ? কারোর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও ঝরে পড়ল না! তবে কী মিছে ছিল সব তিন বছরের মায়া মমতা !
লায়লা চলে যাবার পর প্লাটফর্মেের কোলাহল মুহূর্তেই যেন মুখরহীন হয়ে গেল। কতক্ষণ এমনি দাঁড়িয়ে থাকলাম একাকী । তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে একটি খালি কংক্রিটের বেঞ্চের উপর যেয়ে বসি। ফ্লাস্কে করে এক চা বিক্রেতা ছেরা বলছিল — স্যার চা খাইবেন?
বললাম — দে।
— লাল চা কিন্তু!
— তাই দে।
— সিগারেট দিব?
— দে।
— কোনটা খান?
— ছাত্তার।
— ছাত্তার কী স্যার!
— স্টার দে। স্টারকে ছাত্তার কই।
চা খেয়ে স্টার টানতে থাকি। একটু জোরে জোরেই টানলাম। মাথা ধরে গেল বেশ ! মাথা ধরা নিয়েই লায়লার চিঠিখানি বের করে পড়তে থাকি —
রঞ্জন,
আমি চলে যাচ্ছি। আবার কবে আসব জানি না। মাস্টার্স করা হয়ত আর হবে না। আবার হতেও পারে। যদি তুমি চাও।
আমার বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে আছে। আমি গেলেই আমার মতামত নিয়ে হয়ত কথা পাকাপাকি করে ফেলবে।
তুমি এমন কেন বলো তো? ছেলে মানুষের এত দ্বিধা থাকে? তিন বছরে কতগুলো দিন ছিল, সে কী তুমি গুণেছিলে কখনও? কত কথা বলেছি তোমার সাথে, কত ক্ষণ তোমার পাশে বসেছি, কত কিছু দিতে নিতে কত যে আঙুলের ছোঁয়া লেগেছে দুজনের ! কার শরীরের কেমন গন্ধ, তাও জানা হয়ে গেছে। চেহারার রূপ, অপরূপ, অরূপ — সবই দেখা হয়ে গেছে !
আমাকে কী তোমার ভালো লাগেনি? দ্বিধাটা ছিল তোমার কোথায়? কেন তুমি গত তিন বছরেও বলতে পারোনি — ‘ লায়লা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমি চাই। তোমাকে ছাড়া বাকী জীবন আমার চলতে চাইবে না। ‘
না কী, তুমি চেয়েছিলে আমি তোমাকে আগে বলি! তাই না?
কী আশ্চর্য! আমারও বলতে বলতে তিনবছর লেগে গেল। যখন এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ঠিক তখন। হঠাৎ করেই কেমন জানি লাগছে! মনে হচ্ছে — তুমি ছাড়া আমি খুব একা! তোমাকে ছাড়া আমার বাকী জীবন অর্থহীন।
এই শহরে কোথায় আমরা যাইনি বলো? পথে
পথে কত হেঁটেছি , কত বৃক্ষের সবুজে, ইউক্যালিপটাসের কত ছায়াতলে! কত সময় পার করেছি অহেতুক কোনো কথা না বলে। শুধু আসল কথাটাই তোমাকে বলা হয়নি — ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি রঞ্জন।’
হ্যাঁ — রঞ্জন, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই চিঠির অপর পৃষ্ঠায় আমার ঠিকানা লেখা আছে। তুমি আমাকে দ্রুত পত্র লিখে তোমার মতামত জানাবে। আমি তোমার পত্রের জন্য অপেক্ষা করব। ভালো থেকো।
—– লায়লা।
আমি চিঠিখানা পড়ে কংক্রিটের বেঞ্চের উপর রাখি। ঐ চা-ওয়ালা ছেরাকে আবার ডাকি। ওকে বলি — চা দে এক কাপ!
ছেরা চা দেয়। এবং বলে — ছাত্তার দিব?
— না, আবদুল লতিফ দে।
— স্যার আবদুল লতিফ কী?
— চিনোস না! গোল্ড লীফ! গোল্ড লীফ দে।
চা ওয়ালা ছেরাকে বলি — তোর নাম কী? ও বলে, এমডি আবুল কাসেম।
আমি এমডি আবুল কাসেমকে বলি — তুই আমাকে আরও দুই রাউন্ড চা সিগারেট খাওয়াবি। তারপর, বিল নিয়ে চলে যাবি। কাসেম মাথা নেড়ে বলে — আচ্ছা।
প্লাটফর্ম থেকে যখন চলে আসব তখন কংক্রিটের বেঞ্চের উপর রাখা চিঠিখানি খুঁজি। দেখি চিঠিটি নেই। ফাল্গুণের দমকা বাতাসে কখন চিঠিটি উড়ে যেয়ে প্লাটফর্মের নীচে রেললাইনের উপর পড়ে গেছে দেখতে পাইনি। ট্রেনের ঘূর্ণোন চাকায় সে চিঠি ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ছিন্ন চিঠি কুড়িয়ে চিঠির পিছনে লেখা লায়লার ঠিকানাটা যে উদ্ধার করব, তা আর ইচ্ছে হলো না !
প্লাটফরমের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম আর ভাবছিলাম, কী করব এই জীবনে? বিয়ে করে খাওয়াব কী? সেই একই দ্বিধা! একই অনীহা! চাল চুলোহীনদের বিয়ে করার সাধ হওয়া ঠিক না। ওর বিয়ে হয়ে যাক। ভালো থাক্ আমার আজীবন চির- সখা লায়লা। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না !
পাঁচ বছর পর……
একটা সরকারি কাজে চাঁপাই নবাবগঞ্জ গিয়েছিলাম। ওখানে কাজ সেরে একটি লোকাল বাসে করে ফিরছিলাম রাজশাহীতে। পথিমধ্যে গোদাগাড়ী থেকে একটি মেয়ে ওঠে। আমি দেখে তাকে চিনতে পাই, এ যে লায়লা।
সিট ছিল না! ওকে বসতে দেই। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বলে — তুমি, এখানে!
টুকটাক অনেক কথাই হল ওর সাথে। রাজশাহীতে এসে দুজনই নামি। লায়লা বলছিল — চলো আমার স্বামীর বাসায়।
— আমি বললাম, না — আজ না। আজই আমাকে ঢাকা চলে যেতে হবে।
— আচ্ছা।
— চলো তোমাকে এমনি একটু এগিয়ে দিয়ে আসি!
— এসো।
হাঁটতে হাঁটতে লায়লা আমাকে বলছিল — বিয়ে করেছ?
— না।
— কেন করো নাই?
হঠাৎ ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। লায়লা বলছিল — তুমি একটা রিকশা নিয়ে বাস স্টান্ডে চলে যাও। ঠান্ডা লাগবে। তোমার তো একটুতেই ঠান্ডা লাগে।
আমি বললাম — আচ্ছা।
লায়লা ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেল।
অনেক দূর পর্যন্ত যেয়ে লায়লা একবার পিছনে ফিরে তাকায়। ও দেখতে পায় — তখনও রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থেকে আমি ওর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে আছি, তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টিতে ভিজছি।
২০. সিল্কসিটি এক্সপ্রেস
সদানন্দপুর স্টেশন থেকে ষাটোর্ধ একটি লোক ও এক বৃদ্ধা রাজশাহীগামী সিল্কসিটি ট্রেনটিতে উঠে। তারা কোথায় যাবে, বা নামবে কেউ জানে না। লোকটার বয়স ষাটের উপর হলেও এখনও সে অনেক শক্ত সামর্থ্য। কিন্তু স্ত্রীলোকটি খুব অসুস্থ। পুরুষ লোকটা অনেকটা বোগল কোল করেই তাকে ট্রেনের কামড়াতে উঠিয়ে বসায়। লোকটির কথায় বোঝা গেল বৃদ্ধা তার স্ত্রী হয়।
বৃদ্ধাা মহিলাটির ঠোঁট মুখ বাঁকা হয়ে গেছে। কথা বলতে পারে না। শরীরের বাঁ পাশটা পুরো অবশ। তার যে দুতিন বার স্ট্রোক করেছিল, তাকে দেখলে তা বোঝা যায়।
কোনো শক্ত খাবার সে খেতে পারে না। নিজে হাত দিয়ে তুলে কোনো কিছু খেতে পারে না। তাকে তুলে খাওয়াতে হয়। তার আরও অসুবিধা আছে, তাহলো সে নিজে বাথরুমে যেতেও পারে না। অন্য কারোর সাহায্য নিতে হয়।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে দেখে মনে হলো ওনারা নিম্নবিত্তের গ্রামের মানুষ। ওনারা যেহেতু সদানন্দপুর থেকে উঠেছে এদের বাড়ি কামারখন্দ-ভদ্রঘাট- কোনাবাড়ি- সিরাজগঞ্জ সদরের কোনো এলাকার হয়ত হবে। আবার নাও হতে পারে। অন্য কোথাও থেকে এসে এই সদানন্দপুর স্টেশন থেকে তারা উঠতে পারে।
ট্রেনটি চলছে। ওনারা সাধারণ শোভন সিটে বসে আছে। লোকটা খুব সেবা সুশ্রুষা করছে ওনার স্ত্রীকে। তার সেবা সুশ্রুষা দেখে মনে হল — তাদের ভিতর একসময় খুব প্রেম মহব্বত ছিল। একটা শিশুকে যে ভাবে মা যত্ন করে খাওয়ায়, ঠিক সেইভাবে যত্ন করে স্ত্রীলোকটিকে সে খাওয়াচ্ছিল। কখনও তাকে দুহাত দিয়ে বুকের পাশে জড়িয়ে রাখছিল, কখনও তার কোলের উপর মাথা রেখে চুল বিলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছিল লোকটি।
কামড়ার অন্যান্য যাত্রীরা সবাই মুগ্ধ হয় স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এমন ভালোবাসা দেখে। বৃদ্ধা মহিলাটি একসময় তার প্রিয়তম স্বামীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। মনে হল, এমন কেউ একজন গান গেয়ে গেয়ে তাকে ঘুম পারাল —
‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার,
জীনন মরণ মাঝে…. ‘
লোকটির সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হল আমার। বললাম — আপনারা কোথায় যাবেন? লোকটি বলল — পাকসীর কাছেই, পদ্মার পাড়ে একটি গ্রামে।
— ওনাকে আপনি খুব ভালোবাসেন বুঝি?
— জ্বী, আমার পরানের চেয়ে বেশি।
— তাই? শুনে অনেক খুশি হলাম।
— জানেন, আমার সংসারে কিছু ছিলনা। সেই বাবার বাড়ির যা কিছু পেয়েছিল, সবই আমাকে এবং আমার সংসারের জন্য দিয়ে দিয়েছে। নিজের জন্য কিছু রাখেনি।’
— যাক, আপনিও অকৃতজ্ঞ হননি। স্ত্রীর এই অসুস্থতার সময় তার পাশে রয়েছেন।
লোকটি স্মিত হাসলো।
ট্রেনটি ইতোমধ্যে ঈশ্বরদী জংশনে এসে থামে। লোকটি — তার কোলের উপরে ঘুমিয়ে থাকা তার স্ত্রীকে ডাকে — ‘এই, ওঠো, এসে গেছি।’
বৃদ্ধা মায়া করে তার স্বামীর চোখের দিকে চোখ মেলে তাকায়।
লোকটি আবারও বৃদ্ধাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নামে। এবং তার স্ত্রীকে বামপাশ
করে আস্তে আস্তে করে হেঁটে বিশ্রামাগারের দিকে নিয়ে
যায়।
লোকটি তার অসুস্থ স্ত্রীকে বিশ্রামাগারের বেঞ্চের উপর শোয়ায়ে দেয়। তার মাথায় ও কপালে হাত বুলায়ে বলে– ‘খুব খারাপ লাগছে তোমার?’
বৃদ্ধা কথা বলতে পারছিল না। মাথা নেড়ে বলছিল শুধু , হে।
— ‘তুমি একটু শুয়ে থাকো। ভালো লাগবে।
আমি তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।’ এই কথা বলে সে বিশ্রামাগারের বাইরে চলে আসে।
প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা সিল্কসিটি ট্রেনটি তখন হুইসেল বাজিয়ে পুনরায় আস্তে আস্তে চলতে থাকে। লোকটি একবার এদিক সেদিক তাকায়। তারপর দৌড়ে গিয়ে পিছনের কামড়ার একটি দরজা দিয়ে ত্বরিৎ ট্টেনটিতে উঠে পড়ে।
সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঝিকঝিক করে দ্রুত বেগে ছুটে চলতে থাকে রাজশাহীর দিকে।
২১. রোল নং ১৭ দোলা মিত্র
১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের কোনো একটি দিন। আজ এতদিন পর সঠিক দিন তারিখ মনে নেই। দেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল।’
মুক্তিযুদ্ধের পরে আমাদের স্কুল প্রথম খোলার দিন ছিল সেদিন। দীর্ঘ দশমাস পর স্কুল খুলবে। দীর্ঘ দশ মাস পর সবার সাথে দেখা হবে। কেমন একটি উৎসব উৎসব মুহূর্ত ছিল সেদিন , কেমন একটি উত্তেজনা উত্তেজনা ভাব ছিল।
ক্লাস নাইনে পড়ি। প্রথম ক্লাসটি ছিল ওয়াহিদ স্যারের অংকের ক্লাস। আমাদের ক্লাসে প্রায় পঞ্চাশ জনের মতো ছাত্র ছাত্রী ছিল। এর মধ্যে ছাত্রী ছিল মাত্র সাতজন। তখন মেয়েরা স্যারদের পিছে পিছে ক্লাসে আসত। এবং ক্লাস শেষ হলে স্যারদের পিছেপিছে বেরিয়ে যেত।
দীর্ঘ দশ মাস পর স্যার প্রথম রোল কল করছে। ক্লাসে সেদিন অনেকেই আসেনি, ষারা আসেনি তারা কেন আসেনি, সহপাঠীরা যারা জানত তারা কেউ কেউ বলে দিচ্ছিল।
স্যার একসময় কল করে — ‘রোল নং ১৭, দোলা মিত্র।’ কোনো রেসপন্স নেই। কেউ বলছে না — ‘ইয়েস স্যার’। মেয়েদের বেঞ্চে ছয়জন ছাত্রী বসা ছিল। তাদের ভিতর দোলা মিত্র নেই।
ক্লাস কক্ষ নিরব নিস্তব্ধ। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। দোলাদের বাড়ি ছিল ধলডোব গ্রামে। ঐ গ্রামেরই একটি ছেলে ছিল, নাম বিমল। বিমল আমাদের সাথে পড়ত। স্যার ওকে জিজ্ঞাসা করে– ‘তুমি কী দোলার কোনো খবর বলতে পারো?’ বিমল বলছিল — ‘ স্যার, দোলা’ রা ভারতে চলে গিয়েছে। এখনও ফিরে আসেনি।’
দোলা’ রা ভারত থেকে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। কেন আসেনি। সে অনেক দুঃখের কথা। অনেক দাম দেওয়া কাহিনি।
কেমন ছিল দোলা নামের মেয়েটা? ক্লাসে চুপিচুপি ছেলেরা ওকে ডাকত কাননবালা বলে। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের এই মেয়েটির চোখ দুটো ছিল বিনোদিনীর মতো টানাটানা, কেশবতী ছিল সে। হাতে কঙ্কণ পরত। কিন্তু কিনিকিনি শব্দ হতো না হাতে। স্কুলের বারান্দা দিয়ে স্যারদের পিছনে পিছনে হেঁটে যখন সে ক্লাসে যেত, তখন সিনিয়র ছেলেরা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত ওকে। ‘বধূ তুমি চলে যাও গো বকুল বিছানো পথে পথে।’
দোলা ভালো গান গাইতে পারত। স্কুলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ও গানে প্রথম হত। সেই বার আমাদের ক্লাসে দুজন ছাত্র ছাত্রী পুরস্কার পেয়েছিল। একটি পেয়েছিল গানে দোলা মিত্র। আর একটি পেয়েছিলাম আমি — স্বরচিত কবিতা পাঠে। শহর থেকে ক্যামেরাম্যান এনে বিজয়ীদের স্টীল ছবিও তুলেছিল।
দোলা আমার সহপাঠী হলেও ওর সাথে আমার কিংবা অন্য ছেলেদের সাথে ওর তেমন কোনো কথা হত না। কারণ কথা বলার সুযোগ ছিল না তখন। ছুটির পরে একদিন বাড়ি যেতে যেতে দোলা আমাকে বলেছিল — ‘তুমি তোমার কবিতাটি কপি করে আমাকে দিও। খুব ভালো লিখেছ, একেবারে গানের মতো।’
আমি লাইনটানা একটি সাদা কাগজে আমার সেই কবিতাটি লিখে দোলাকে দিয়েছিলাম। তাও গোপনে, কেউ দেখতে পায়নি। সেদিনও ছুটির পর বাড়ি যেতে যেতে কথা হয়েছিল দোলার সাথে। কবিতাটি দেওয়ার সময় আমি ওকে বলেছিলাম — ‘তুমি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যে গানটি অনুষ্ঠানে গেয়েছিলে, ঐ গানটি আবার একদিন আমায় গেয়ে শোনাবে?’
দোলা বলেছিল — ‘গেয়ে শোনাব তোমাকে একদিন ‘।
তারপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। একদিন ভোরবেলা শহর থেকে ধলডোব গ্রামে মিলিটারি গেল। ম্যাসাখার করল বাগবাটি, হরিনাগোপাল ও ধলডোবসহ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো। জ্বালিয়ে দেওয়া হলো তাদের ঘরবাড়ি ও মন্দির। ঘর থেকে মানুষ ধরে নিয়ে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। ধর্ষণ করে মেয়েদের। পাক সৈন্যদের কালো হাতের থাবা থেকে সেদিন দোলাও রক্ষা পায়নি। সেও ধর্ষিত হয়েছিল।
লজ্জ্বায় আর গ্লানিতে দোলাদের পরিবার স্মরণার্থী হয়ে সেই যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারপর আর তারা ফিরে আসে নাই এই দেশে।
তারপর জীবন থেকে কত পৃষ্ঠা উল্টে গেছে। কতদিন কত বছর চলে গেছে কালের অতল তলে। আমিও চলে এসেছি গ্রাম থেকে শহরে। সেই কবে অজ পাড়াগাঁয়ের এক স্কুলের, ক্ষণকালের এক সহপাঠিনী ছিল দোলা মিত্র! তাকে জীবন ভর মনে রাখার দায় কী ছিল আমার? যে আবার চলে গেছে অন্য দেশে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কত গান শুনেছি কত জনের কাছ থেকে। কত সুরে সুরে ভেসে গেছে কত আনন্দের ক্ষণ ! সেই কবে পল্লীর এক স্কুলের অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে দোলা মিত্র নামে অখ্যাত কেউ একজন — কী এমন গান গেয়েছিল যে, তার সেই কণ্ঠ, তার সেই সুর এত দিন ধরে মনে রাখতে হবে ! কিংবা তা কী এখনও হৃদয় বীণায় অনুরণিত হবে চিরকাল !
অনেক বছর পর পিপুলবাড়িয়া বাজারে সহপাঠী বিমলের সাথে আমার একবার দেখা হয়। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দোলা এখন কোথায় থাকে? বিমল বলেছিল — ‘শুনেছি, দোলা শিলিগুড়িতে থাকে। ইসকন মন্দির রোডে ওদের বাসা। দোলা ওখানকার একটি স্কুলের গানের মাস্টার। ওর স্বামীর নাম — সুনীল চক্রবর্তী।
২০০৪ সালে আমি ও আমার স্ত্রী দার্জিলিং গিয়েছিলাম বেড়াতে। ফেরার পথে শিলিগুড়িতে দুইদিন ছিলাম। খুব ইচ্ছা হলো, দোলার সাথে দেখা করার। একদিন বিকালে আমার স্তীকে নিয়ে ইসকন মন্দির রোডে দোলাদের বাড়ি খুঁজতে বের হই। পেয়েও যাই ওর বাড়ি।
আধাপাকা টিনসেড ছোট্ট ছিমছাম একটি বাড়ি। বাড়ির গেটে নক করতেই গেটটি খুলে দেয় মধ্যবয়সী একটি লোক। বুঝতে পারছিলাম, ইনি দোলার স্বামী হবে। উনি বলছিলেন — কোথা থেকে আপনেরা এসেছেন?
— আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
— কার কাছে এসেছেন?
— এখানে দোলা মিত্র নামে কেউ থাকে?
— থাকে। তবে দোলা মিত্র নয়, সে এখন দোলা চক্রবর্তী। উনি আমার স্ত্রী।
— ওহ! আচ্ছা! আমরা দোলার সাথে একটু দেখা করব।
— আসুন, ভিতরে বসুন।
ছোট্ট সাজানো গোছানো একটি ড্রয়িং রুমে আমাদের বসতে দেয়। একটু পর একজন মহিলা প্রবেশ করে। দেখলাম তাকে! এ যে দোলা মিত্র !
সেই অপূর্ব সুন্দর মুখচ্ছবি! আজও তেমনই আছে লাবণ্যময় রূপ মাধুর্য! মার্জিত বাচনভঙ্গী, আনত নয়ন! কী যে দেবী দেবী লাগছিল ওকে!
আমি ওকে বললাম — চিনতে পারছ আমাকে?
— পারছি! তুমি রঞ্জন!
— হ্যাঁ, আমি রঞ্জন। তেত্রিশ বছর পর আমাদের দেখা হলো।
আমার স্ত্রীকে দেখিয়ে দোলা বলছিল, তোমার বউ নিশ্চয়ই!
— হুম! ওর নাম — মায়াবতী!
দোলা ওর স্বামীর সাথেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
দোলাকে দেখছিলাম আর বিষাদে মনটা ভারী হয়ে উঠছিল। ওর মায়াময় মুখখানি দেখে কান্না পাচ্ছিল খুব। বলতে ইচ্ছে করছিল, দোলা — ‘তুমিও তো আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছ। তোমার এই আত্মত্যাগ আমরা ভুলি কী করে?’
সেদিন রাত অবধি দোলার বাসায় ছিলাম। অনেক কথা হয়েছিল দোলা ও দোলার স্বামীর সাথে। দোলা না খেয়ে আসতে দেয়নি।
দোলার ড্রইংরুমে একটি জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম — ওয়ালে কাঁচের ফ্রেমে একটি ছবি যত্ন সহকারে সে টানিয়ে রেখেছে। ছবিটি আমাদের স্কুলের একটি পুরস্কার বিতরণীর। ছবিতে আমি ও দোলা পুরস্কার গ্রহণ করছি হেড স্যারের কাছে থেকে। সবুজ ছায়া সুনিবিড় স্কুল আঙিনা। আম সুপারির ঝাড়, খোলা মাঠ, খোলা আকাশ সবই ছবিতে দেখা যাচ্ছে। এ যেন বাংলাদেশের একটি চিরায়ত রূপ !
ওর বাড়ি থেকে যখন চলে আসব, তখন দোলা বলছিল — রঞ্জন, তুমি আমার গান শুনবে না?
— শুনব, গাও।
দোলা হারমোনিয়াম বাজিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই গানটি গেয়ে শোনায়। যে গানটি স্কুলের অনুষ্ঠানে সে গেয়েছিল, যে গানটি আমাকে গেয়ে শোনাবে বলে একদিন সে কথা দিয়েছিল —
‘তুমি না হয় রহিতে কাছে-
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে,
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে।
এই মধুক্ষণ মধুময় হয়ে নাহয় উঠিত ভরে-
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে,
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে……। ‘
তারপর আরও কত বছর চলে গেছে।
“রোল নং ১৭, দোলা মিত্র।” ক্লাস কক্ষের ভিতর রোল কলের সেই আওয়াজটি দিনে দিনে কেমন যেন অস্পষ্ট ও ক্ষীণ হয়ে আসছে !
২২. মৌয়াল
জব্বর মৌয়াল একজন ভূমিহীন প্রান্তিক মানুষ। সংসারে তার অভাব অনটন লেগেই থাকে । দুটো ছোট মেয়ে আছে তার। বয়স একজনের পাঁচ বছর, আর একজনের তিন বছর। একজনের নাম নূরী, আর ছোট জনের নাম — বুড়ী।
সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করে জব্বার সংসার চালায়। কিন্তু সবসময় সে বনে মধু পায় না। আর তখনই তার সংসারে অভাব লেগে থাকে। অভুক্ত থাকতে হয় তাদের প্রায় সময়।
জব্বারের বউ আছিয়া এই অভাব অনটন নিয়ে প্রায় দিনই জব্বার মিয়ার সাথে ঝগড়া করে। সেদিন দুপুরবেলা তুমুল ঝগড়া করছিল জামাই বউ দুজনে। একে অপরে তুই তোকারি করে কথা বলছিল । আর অশ্লীল যত গালি গালাজ করছিল। শুরুটা করেছিল জব্বার মিয়ার বউ।
— মরদ তুই আমারে বিয়া করছিলি ক্যা.. বউ পোলাপানরে খাওন দিতে পারবি না..
— চুপ কর মাগী, বেশি কতা কবিনা।
— চুপ করমু ক্যা.. মাইয়া দুউডা কাল থাইকা না খাইয়া রইচে..
— আমি কী করমু.. কই থেইকা দিমু?
— তো জন্ম দিছিলি ক্যা..
— তরে করেছিলাম। তাই হইয়া গেছে।
— করার সময় তো মজা লউছোস, হুস আছিল না।
— তুইও তো মজা লইছোস।
— চুপ কর্ মর্দা, বউরে খাওন দিতে পারোস না, আবার কতা কস্। তুই আবার আমারে করতে আসিস। তোর ঐটা কাইটা দিমু।
— মাগী চুপ কর! কইচি।
— মাইয়া দুইডা কখন থেকে ক্যানতাছে! তুই শোনস না! তুই ঘর থাইকা বের অইয়া যা মর্দ। তরে দেখতে চাই না।
আছিয়া জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
জব্বার মিয়া মাথায় গামছা বাঁধল। নূরী আর বুড়ীকে বলল — এই তোরা আমার সাথে আয়। নূরী বুড়ী খুব খুশি হয়। ওরা বলল — বাবা, তুমি আমাগো কই নিয়া যাইবা?
— চল্। খোন্তাকাটা বাজার থোন তোগোর খাওয়াইয়া লইয়া আসি।
নূরী ও বুড়ীকে নিয়ে জব্বার নৌকায় উঠল। ছোট ডিঙি নৌকার পাটাতনের উপর দুই বোন বসে আছে। ওদের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। জব্বার মিয়া বৈঠা চালাচ্ছে। ছোট্ট নৌকাটি চলছে বলেশ্বর নদীর উপর দিয়ে।
তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকাল। ভাটি স্রোতের টানে নৌকাটি সুন্দরবনের তীরে এসে থামে। জব্বার মিয়া নৌকাটি একটি গাছের গুরির সাথে বাঁধে। তারপর মেয়ে দুটোকে হাত ধরে কূলে নামায়। জব্বার মিয়া ওদের বনের গভীরে নিয়ে যায়। এক জায়গায় ওদের বসিয়ে রেখে বলে — ‘তোরা এখানে বসে থাক্। আমি আসছি।’
মেয়ে দুটো বলছিল — বাবা, তুমি কই যাও?
— আমি তোগোর জন্য খাবার নিয়া আসি।
— তাড়াতাড়ি আইসো বাবা, আমাগো খুব খিদা লাগছে।
— আচ্ছা।
জব্বার মিয়া মেয়ে দুটোকে জঙ্গলের ভিতর রেখে আস্তে আস্তে এসে নৌকায় ওঠে।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বনের ছোট্ট ছোট্ট পাখিরা সন্ধ্যার আকাশ জুড়ে চ্রিহি চ্রিহি শব্দ করছে। আঁধার নামছে ঘনঘোর করে। জব্বার মিয়া বলেশ্বর নদীর উজান বেয়ে বৈঠা চালাতে থাকে। কিন্তু বৈঠাটি চালাতে পারছিল না সে। নৌকা যেন চলছে না আর।
হাতে বল পাচ্ছিল না জব্বার মিয়া। তারও পেটে যে তখন প্রচন্ড খিদা ছিল ।
২৩. তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয়
বর্ষা মাসের এক মধ্যাহ্ণে আমাদের বাড়ির ঘাটে একটি ছোট ছইওয়ালা নৌকা এসে থামে। নৌকার ভিতর থেকে একজন মধ্যবয়সী লোক ও আর একজন মধ্যবয়সী মহিলা নামে। তারা দুজনেই বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করে।
মহিলাটি আমার মায়ের দূর সম্পর্কের বোন। নাম মোছাঃ শিরিনা খাতুন। আমরা তাকে শিরিন খালা বলে ডাকতাম। এই শিরিন খালা খুব কম আসত আমাদের বাড়িতে। সে কম আসলেও আমাদের ভাই বোনদের খুব স্নেহ করতেন তিনি ।
শিরিন খালার সাথে যে লোকটি এসেছেন, তিনি আমাদের খালু। মা, শিরিন খালা ও খালুকে দেখে খুব খুশি হন। এবং তাদেরকে দুপুরেই উপস্থিত মতো ভালো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেন।
শিরিন খালা মার তিন চার বছরের ছোট ছিল। শিরিন খালা মার আপন ছোট বোন না হলেও, মা তাকে ছোট বোনের অধিক স্নেহ করতেন।
দুপুরের খাওয়ার পরে শিরিন খালা মার কাছে একটি কথা পারলেন। সে মাকে বলল — ‘বুবু আমরা একটা শুভ প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।’
— কী প্রস্তাব এনেছ।
— ‘মঞ্জুর একটি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। মেয়ে আমাদের গায়েরই। বাবা মার একটাই মেয়ে আর কেউ নেই। মেয়ে খুব রূপবতী। ক্লাস সেভেনে পড়ে। বয়স তেরো চোদ্দ হবে।
আমি খুব আশা নিয়ে এসেছি। তোমরা মেয়েটিকে একবার দেখো। পছন্দ হবে তোমাদের। খুব সুন্দরী এবং অমায়িক। তাছাড়া, মেয়ের বাবা অনেক ধন সম্পদের মালিক। এই ধন সম্পত্তি সব একদিন মেয়ের হবে।
আমি মেয়ের বাবা মায়ের সাথে আলাপ করেছি। তারা বলেছে — আপনি ছেলের মায়ের সাথে আলাপ করে দেখেন। আমাদের এই সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি নেই। ‘
মা বলছিল – ‘ তোমরা তো জানো, মঞ্জুর মাস্টার্স করে কেবল সরকারি চাকুরিতে ঢুকেছে। ও এখানে থাকে না। ঢাকায় থাকে। ওর সাথে আলাপ না করে তোমাকে কোনো কিছু বলতে পারছি না।’
— ‘ঠিক আছে, মঞ্জুর সাথে তো আলাপ করবেই। কিন্তু তার আগে তোমরা মেয়েটিকে একবার দেখে রাখো, তোমাদের পছন্দ হলেই পরে না হয় মঞ্জুরকে মেয়ে দেখালে।’
— ‘কথাটি খারাপ বলো নাই। আমরা না হয় আগেই দেখে নিলাম। আমাদের পছন্দ হলেই মঞ্জুরকে দেখাব। মঞ্জুর পছন্দ হলেই আমরা বিয়ের কথা পাকাপাকি করব।’
— তাহলে কবে যাবে মেয়ে দেখতে?
— সামনের শুক্রবারই যাব। আমরা চার পাঁচজন যাব। তুমি মেয়ের বাবা মাকে বলে রেখো।
— আচ্ছা।
ঘটনাক্রমে আমার সবচেয়ে বড়ো বোন তখন বাড়িতেই ছিল। সে তখন বেড়াতে এসেছিল। আমার এই বোন আমাদের পরিবারের ভালো মন্দের সবকিছুতে মাকে পরামর্শ দিত। মাও তার পরামর্শ গ্রহণ করত।
একটি বড়ো ছইওয়ালা নৌকায় করে আমার মা, বড়ো বোন, এক জেঠাত ভাবি, ছোট বোন ও ছোট ভাই সামনের ঐ শুক্রবারেই মেয়ে দেখতে চলে য়ায়। তারা প্রথমে শিরিন খালার বাড়িতে যায়। তারপর ওখান থেকে কণে বাড়িতে যায়।
একদম ঘরোয়া ভাবে এবং কোনো প্রকার ফর্মালিটিস না করে আমাদের বাড়ির লোকজন মেয়েটিকে দেখে। মেয়ে অপ্রস্ফুটিত চন্দ্রমল্লিকার মতো দিগবালিকা। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রঙ। গোলাপি জবার মতো গাল, অবাক করা চোখে তার মায়া মায়া মাধুর্য লুকিয়ে আছে । আশ্বিনের বৃষ্টির রাতের মতো কালো মাথার চুল। এই তেরো চোদ্দ বছরের মেয়েটির উপরে হেমন্ত সকালের কমলা রঙের রোদের আলো এসে পড়েছে যেন। সবার দৃষ্টি ওর উপর স্থির হয়ে ছিল।
আমি এই মেয়ের কিছুই জানিনা, কিছুই দেখিনি আমি। নিষ্পাপ নিষ্কলুষ ছিল কী সে ! স্বচ্ছ জলের মতো নিবিড় ও পবিত্র? হয়ত তার অপ্র্স্ফুটিত পাপড়িগুলো আমার আঙুলের ছোঁয়ায় এক এক করে মেলিতে পারিত। হয়ত তার শরীর মন আমার অলৌকিক যাদুরকাঠীর স্পর্শে উদ্বেলিত হয়ে উঠত।
আমার মা মেয়েটিকে কাছে বসিয়ে বলেছিল —
‘তোমার নাম কী মা?’ মার মুখের দিকে চেয়ে মেয়েটি স্মিত বলেছিল — রেশমা আলী। আমার বাবা আমাকে ডাকে — রেশমী বলে।
রেশমীকে সবাই আমার বউ করার জন্য পছন্দ করে। এবং এই পছন্দ হওয়ার ব্যাপারটা তাৎক্ষণিক প্রকাশও হয়ে যায়। মেয়ের বাবা মা খুব খুশি হন। মেয়ের মা একপর্যায়ে তার মেয়েকে আমার মায়ের হাতের ভিতর সমর্পণ করে দিয়ে মাকে বলে — ‘বুবু, আজ থেকে আমার মেয়ে তোমার। তুমি ওকে তোমার বউমা করে ঘরে নিয়ে যেও।’ আমার মা ও বলেছিল — রেশমীকে আমরা যত দ্রুত আমাদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যাব। ওযে সাক্ষাৎ লক্ষী মেয়ে!’
রেশমীকে সবাই বলছিল — ‘তোমার শ্বাশুড়ি মাকে কদমবুসি করো।’ বালিকা সেদিন স্বলজ্জিত
হয়ে আমাদের বাড়ির গুরুজনদের কদমবুসি
করেছিল। মা, তার হাতের আঙুল থেকে একটি অঙ্গুরীয় খুলে পরিয়ে দিয়েছিল রেশমীর অনামিকায়।
একদিন অফিসের ঠিকানায় মার একটি চিঠি পাই। মা লিখেছিল —
‘স্নেহের মঞ্জুর,
আশা করি তুমি ভালো আছো। তোমার চাকুরি ভালোভাবেই হয়ত চলছে। পর সমাচার এই যে, আমরা তোমার বিবাহের পাত্রী দেখেছি। মেয়ে খুবই সুন্দরী। ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে রাণীগ্রামে। তোমার শিরিন খালার পরিচিত। আমরা মেয়েটিকে দেখেছি। তোমার বড়ো বুবুসহ আমাদের সবার পছন্দ হয়েছে।
তুমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একবার বাড়িতে আসবে। তুমিও মেয়েটিকে দেখবে। তোমার পছন্দ হলে আমরা বিয়ের পাকাপাকি কথা বলব ওনাদের সাথে। তুমি অবশ্যই বাড়ি চলে আসবে। কোনোরূপ গাফিলতি করবে না।
ভালো থাকবে। তোমার জন্য আমার দোয়া ও আশীর্বাদ রইল।
ইতি — তোমার মা।
মার পত্রখানি পড়ে একটাই খটকা মস্তিস্কে ঘুরপাক খাচ্ছিল — ‘ মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। তার মানে মেয়ের বয়স খুব জোর তেরো চোদ্দ বছর হবে। লেখাপড়ার কথা বাদই দিলাম, শেষ পর্যন্ত কী না একটি বালিকা কে বিয়ে করব? ‘
আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি কিছুতেই এই বালিকাকে বিয়ে করব না। অফিসের ব্যস্ততার কথা বলে ও নানা অযুহাত দেখিয়ে মেয়েটিকে আমি কখনোই দেখতে যাব না। আমি না দেখতে গেলে বিয়ে তো হবে না। একসময় এমনি এমনি বিয়ের প্রস্তাবটা ভেঙে যাবে। মেয়ে পক্ষ অন্তত এইভেবে শান্তি পাবে যে, তাদের মেয়েটিকে দেখে অপছন্দ করে ছেলেটা বিয়ে করেনি। ভাববে তারা তখন অন্য কথা।
আমি আর বাড়িতে যাই না। মা পর পর আরও কয়েকটি পত্র লেখে। প্রতি চিঠিতেই বাড়িতে যাবার কথা লেখা থাকে। আমি প্রতিবার উত্তর লিখে পাঠাই — ‘মা, অফিসের কাজে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে গেছি। বাড়িতে যাওয়ার কোনোরূপ সুযোগ পাচ্ছি না। সুযোগ পাইলেই চলে আসব।’
এইভাবে ছয়-সাত মাস চলে যায়। আমি আর বাড়িতে যাই না।
আমরা অফিসিয়াল ট্যুরে কয়েকজন কর্মকর্তা একবার নেত্রকোনার বারহাট্টা গিয়েছিলাম। কয়েকদিন ছিলাম ওখানে। আমাদের সাথে দুটো মেয়েও গিয়েছিল। সেদিন ছিল ছুটির দিন। আমরা একটি নৌকা করে কংশ নদীতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। কী মায়াময় অপরাহ্ণ। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছিল। বিমুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম কংশের দুকূলে ঘরবাড়ি, বৃক্ষ, শস্যের ক্ষেত। বিকালের সোনা রোদ্দুর বৃক্ষের পাতায় পড়ে ঝিকমিক করছিল। ঝলমল করছিল কংসের শান্ত জলও। কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলাম —
‘একবার এসেই দেখুন কংশ নদের সাথে সমুদ্রের বেশ মিল আছে।
হাসবেন না, দোহাই, আমাদের গাঁয়ের লোকেরা খুব কষ্ট পাবে।….
আরে, এ তো শুধু নদী নয়, এ যে সমুদ্রের ছদ্মবেশী রূপ।…..
কোনো দিন কাউকে বলিনি, শুধু সুদূর শৈশব থেকে মনে-মনে…..
মিলিয়েছি বারহাট্টার সাথে কক্সবাজার, কংশের সাথে বঙ্গোপসাগর।’
নৌকার পাটাতনের উপর চাদর বিছিয়ে আমরা বসেছিলাম, খালি কন্ঠে গান গেয়ে শোনায়েছিল সহকর্মী নাসরিন। — এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।
ফেরার পথে গৌরীপুর জংশনে অপেক্ষা করছিলাম ঢাকাগামী ট্রেনের জন্য। ট্রেন আসতে তখনও অনেক দেরি ছিল। নাসরিন কী যেন বলতে চাইছিল আমাকে। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিল না। তারপর এক পর্যায়ে বলছিল — ‘আমার খুব প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে ঐ দূরে ব্রিজটার কাছে। দুপাশে কী সুন্দর মহুয়া গাছ। বাবলাও আছে। ফুলও ফুটে আছে। তুমি যাবে আমার সাথে ঐ ব্রিজটার কাছে ?’
আমি বলেছিলাম — না, যাব না। সহকর্মীরা মন্দ বলবে।’
সেই গৌরীপুর জংশন, সেই মনুষ্য কোলাহলের প্লাটফর্ম, সেই মহুয়া গাছের সারি, সেই বাবলা ফুলের সুবাস নিতে আর যাওয়া হয়নি। কোনোদিন আর হেঁটে হেঁটে যেয়ে দেখা হয়নি দূরের সেই নির্জন ব্রীজটা।
একদিন আমার ঢাকার বাসায় শিরিন খালার ছেলে এসে হাজির হয়। সে আমার হাতে মার একটি চিঠি তুলে দিয়ে বলে — খালা তোমাকে আমার সাথে জরুরি ভাবে বাড়িতে যেতে বলেছে। আমি চিঠিখানা পড়ে একটি উত্তর লিখি —
শ্রদ্ধেয়া মা,
আমার কদমবুসি নিও। পর সমাচার এই যে —আমি তোমাদের পছন্দ করা এই বালিকাকে বিবাহ করতে পারব না। এত অল্প বয়সের একটি মেয়েকে বিবাহ করা আমার পক্ষে কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।
আমি এখানে একটি মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছি। তোমরা এসে এই মেয়েটিকে দেখে যেও । পছন্দ হলে এই মেয়ের সাথেই আমার বিবাহের ব্যবস্থা করবে।
ইতি — মঞ্জুর।
নাহ্ কাউকেই পাওয়া হয়নি এই জীবনে। না রেশমীকে, না নাসরিনকে। যাকে এই জীবনে জীবন সঙ্গিনী করে পেলাম সে অন্য আর একজন মায়াবতী। যাকে চাইনি, যে আমাকেও চায়নি কোনোদিন — সেই হলো আমার ভূবনের ভূবন বাসিনী।
কারোর জন্যই কোনো আফসোস নেই। কোনো আক্ষেপও কখনো ঠাঁই দেইনি অন্তরে। কে কোথায় ভালো আছে, কে কোথায় দুঃখে আছে — তারও কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। কতজন তো কতভাবে কতজনকে চায়, সব চাওয়া কী পাওয়া হয়? হয় না। কী যে লীলা ঈশ্বরের !
বাইশ বছর চলে গেছে। ২০১২ সালে মার মৃত্যুর পর বাড়িতে চল্লিশার একটি অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠান শেষে যখন ঢাকায় চলে আসব, কী মনে করে মার কাঠের সিন্দুকটা আমরা ভাই বোনরা খুলি। সিন্ধুকে মার অনেক কিছু ছিল। তার ব্যবহৃত কাপড়চোপড়, কিছু টাকা ও গহনা। একটি ছোট্ট কাপড়ের টোপলা ছিল আলাদা করে। টোপলার ভিতরে একটি বহু পুরনো জীর্ণ চিঠি দেখতে পাই। হলুদ রঙ হয়ে গেছে কাগজের। ধরলেই ছিঁড়ে যাচ্ছিল। চিঠিটার সাথে একটি সোনার অঙ্গুরী ছিল।
চিঠিটা রেশমীর মায়ের হাতে লেখা —
প্রিয় বুবু,
সালাম নিও। কত আশা বুকে বেঁধেছিলাম। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম — আমার মেয়েটি তোমাদের ঘরে যাবে। জানো বুবু, এত ছোট্ট একটা মেয়ে ! তারপরও তোমাদের জন্য ও খুব কান্না করে। কী যে এক অসীম ক্ষত ওর ছোট্ট প্রাণে দিয়ে দিলাম।
তোমার দেওয়া অঙ্গুরীটা ফেরত দিলাম। এই বেদনার ভারটি আমার মেয়েকে দিয়ে আর বইতে দিতে চাচ্ছি না। তোমার দেওয়া এই অভিজ্ঞান তোমার কাছেই থাক্।
ইতি — রেশমীর মা।
২৩ – ১– ১৯৮৯ ইং
রাণীগ্রাম, সিরাজগঞ্জ
২৪. মানভঙ্গ
বেশ কিছুদিন ধরে মেহনাজের সাথে আমার ঘন ঘন ঝগড়াঝাটি ও খুনসুটি হচ্ছে। নানান কারণে নানারূপ ঝগড়া । মাঝে মাঝে ঝগড়া তুমুল আকার ধারণ করে। প্রায়ই মেহনাজ আমাকে বলে — ‘তুমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। তোমার মতো স্বামীর আমার দরকার নাই।’
একদিন খুব তুমুল ঝগড়া হয় মেহনাজের সাথে আমার। সেদিনও মেহনাজ রাগে গর্জনে আমাকে বাড়ি হতে বের হয়ে যেতে বলে। আরও বলে — ‘তোমার মুখ আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। আই হেট্ ইউ।’
সেদিন সত্যি সত্যি বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। পকেটে তেমন কোনো টাকা ছিল না । বিভিন্ন সোর্স থেকে যে টাকা আয় হয়, তা মেহনাজই খরচ করে। আমার কোনো অধিকার নেই তাতে। আসলে আমার কাছে কোনো অধিকার রাখিনি। আমি চাইতাম — এই টানাটানির সংসারে মেহনাজই সব সামলাক। এ আমার কান্ডজ্ঞানহীন দায়িত্বহীনতাও বলা যেতে পারে।
বাজার করে এনে দেওয়ার পর কিছু খুচরো টাকা বাচতো, সেগুলো রেখে দিতাম বিছানার নিচে। গুণে দেখি — সেখানে ৪৫৩ টাকা আছে । তখন সকাল এগারোটা বাজে। এই কটা টাকা নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। মোবাইল ফোনটা সাথে নেই না। রেখে যাই বাড়িতে।
আমার একটি প্রিয় জায়গা বিমানবন্দর রেল স্টেশন। হাঁটতে হাঁটতে সেখানেই চলে যাই। প্লাটফর্মেের উত্তর মাথায় নিরিবিলি একটি পাকা কংক্রিটের বেঞ্চের উপর যেয়ে বসে থাকি।
আমার কাছে পান বিড়িওয়ালা একটা ছেরা আসে। ওকে বললাম, সিগারেট দে।
— কোন্ সিগারেট দিব স্যার?
আজ থেকে তিন বছর আগে চিরজনমের জন্য সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছাড়ার আগে তখন খেতাম বেনসন। আজ আবার শুরু করছি নতুন করে। বিড়িওয়ালা ছেরাকে বললাম — বেনসন এ্যান্ড হেজেস দে। ঐ ছেরা আমাকে তাই দিল।
কংক্রিটের বেঞ্চের উপর বসে পরপর দুই শলা সিগারেট মনের সুখে খেলাম।
প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে আরও একটু উত্তর দিকে যাই। ওখানে দেখি — একলোক পথের উপর কাপড় পেতে অনেকগুলো ইনভিলপ সারি করে বিছিয়ে রেখেছে। তার হাতের উপর একটি পোষা টিয়া পাখি বসে আছে। কাগজের সাইনবোর্ডে লেখা– “এখানে ভাগ্যলেখা দেখা হয়।” আমি লোকটিকে বললাম — ‘ভাগ্য লেখা দেখতে কত টাকা লাগবে?’
— দশ টাকা স্যার।
আমি লোকটিকে দশ টাকা দিয়ে বললাম — ভাগ্য লেখা দেখান।
লোকটি টিয়া পাখিকে বলল — ‘এই সাহেবের ভাগ্যে কী লেখা আছে? উঠাও।’
টিয়া পাখি ঘুরে ঘুরে একটি ইনভিলপ ঠোঁট দিয়ে উঠিয়ে লোকটির হাতে দিল। সে দিল আমার হাতে। আমি ইনভিলপটি হাতে নিয়ে ভিতর থেকে কাগজটি বের করে পড়লাম। কাগজটিতে লেখা আছে — ‘স্বামী–স্ত্রী / প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে আজ মহব্বত বাড়বে।’
হেঁটে হেঁটে আবার কংক্রিটের বেঞ্চের উপর এসে বসি। প্লাটফর্মের ওপাশে ডোবার মতো পুকুর। পুকুর পাড়ে দুটো শালিক আজাইরা ঠোকরাঠুকরি করছে। প্রেমে গদগদ হলে এমন নাকি লাফালাফি করে। খুব বিরক্ত লাগছিল, এর নাম নাকি ‘টু ফর জয়।’ মনে মনে বললাম — ‘ঘোড়ার ডিম। এই বুঝি আমার আনন্দ !’
কমলাপুরের দিক থেকে একটি লোকাল ট্টেন প্লাটফর্মে এসে থামে। যাবে ময়মনসিংহ। আমি ঐ ট্রেনটিতে উঠে পড়ি। তৃতীয় ক্লাসে টিকিট বিহীন যাত্রী আমি। ট্রেনটা ষখন জয়দেবপুর ছেড়েছে, তখন এক ছোকরা বয়সের চেকার এসে বলে — ‘টি-কে-ট।’
বললাম — নেই।
— কোথায় যাবেন?
— যেতে চেয়েছিলাম মশাখালি, গফরগাঁও। তা আর যাব না। সামনে রাজেন্দ্রপুর নেমে যাব।
— জরিমানা সহ একশত টাকা দিন।
আমি ছোকরাকে একশত টাকা গুণে দিয়ে পাকা রশিদ নিয়ে নিলাম।
রাজেন্দ্রপুর স্টেশনে নেমে পড়ি। পেটে তখন সাঙ্গাতিক খিদা। একটা টিনের চালার হোটেলে ঢুকে পড়ি। মালিককে বললাম — তরকারি কী?
মালিক বলল — ফার্মের মুরগী, পাকিস্তানি কক, দেশি মোরগ, আর কালিয়াকৈরের বিলের বাইলা মাছ।
আমি বললাম — দেশী মোরগ আর বাইলা মাছ দিবেন।
মালিক তার মেছিয়ারকে বলল — ঐ বেটা, প্লেট ভালো করে ধুইয়ে এই স্যারের জন্য বাইলা মাছ আর দেশি মুরগী লাগা।
হোটেলে খেয়ে বাইরে এসে একটি টং দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে আবারও বেনসন সিগারেট খেলাম পরপর দুই শলা। দ্বিতীয় শলা যখন টানছিলাম তখন হঠাৎ মনে পড়ল —
আজ থেকে সাতাশ বছর আগে মেহনাজকে নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে এই শালবনে বেড়াতে এসেছিলাম। তখন সবেমাত্র বিয়ে করেছি। বউকে নিয়ে শালবন দেখার খুব সাধ হয়েছিল। একদিন ছুটির দিনে লোকাল ট্রেনে করে টংগী স্টেশন থেকে এই রাজেন্দ্রপুর চলে আসি। এখানে স্টেশনে নেমে একটি চা’র দোকানে বসে দু’জন চা খাই। সাথে দুটো করে ডালপুরি ও গরম সিঙারাও খেয়েছিলাম।
স্টেশনটা আস্তে আস্তে এক সময় ফাঁকা হয়ে যায়। আমরা বসেই থাকি। দেখি — একটা লোক একটা বানর নিয়ে এগিয়ে আসছে। সে বানরের নাচের খেলা দেখায়। লোকটাকে দশ টাকা দিয়ে বানরের নাচ দেখি। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা শালবনের দিকে চলে যাই।
মেহনাজের পরনে ছিল হলুদ রঙের জর্জেট শাড়ি। পায়ে ছিল লাল রঙ্গের বাটার জুতা আর চুল ছিল সবুজ ভেলভেটের ফিতা দিয়ে খোপা বা্ঁধা। দেখতে একদম রূপবানের মতো রূপবতি লাগছিল। আমরা শালবনের অনেক ভিতরে চলে যাই। কা্ঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। ভাবছিলাম, ওর একটা হাত ধরি। কিন্তু লজ্জা লাগছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে। আরো কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি, একটি জলার মতো পুকুর। পুকুরের চারপাশে শালবনে ঘেরা। পাড়ে দূর্বা ঘাসের উপর দু’জন বসে পড়ি।
একটু পর দেখি, একটি বালিকা বকুল ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে আসছে। মেহনাজকে বলে — ‘আফা, একটা মালা নিবেন।’ আমি বালিকার কাছ থেকে চারটি মালা কিনে ওর খোঁপায় পরিয়ে দিয়েছিলাম।
তারও কিছু সময় পর একটি বৃদ্ধ লোক ময়ুরের পেখম এনে ওকে বলে — মা, ময়ুরের ফইরা নিবেন।’ আমি বৃদ্ধের কাছ থেকে সবগুলো পেখম কিনে নতুন বউকে দিয়ে বলেছিলাম, বাড়িতে যেয়ে আমার জন্য একটা ময়ুরপঙ্খী পাখা বানাইয়া দিও।
বালিকা ও লোকটি চলে যায়। পুকুরের পাড় তখন নির্জন। বক, ডা্হুক, হা্ঁস,পানকৌড়িরা তখন কিচিরমিচির করছিল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, জনমানব শূণ্য। আমি ওর মুখের দিকে একবার তাকাই। নির্জন দুপুরের রোদ্দুর ওর মুখে এসে পড়েছিল। খুব মোহনীয় লাগছিল ওকে। ভাবলাম- একটু কাছে টানি। আদর দেই ঐ মুখে। ওর মুখের দিকে ঝুঁকতেই কোত্থেকে একটি তীর এসে ওর শরীরে বিদ্ধ হয়। রক্তাক্ত হয় ওর শরীর, রক্তে ভিজে যায় ওর শাড়ি।
আর আহত হয় পানকৌড়ি। পানকৌড়ির রক্তাক্ত পালক পড়ে থাকে পুকুরের পাড়ে।
মনটা ভালো লাগছিল না। ভাবছিলাম কী করব, কোথায় যাব? একবার মনে হলো — হেঁটে হেঁটে পুকুর পাড়ে চলে যাই, যেয়ে বসি পাড়ের ঘাসের উপর। যেখানে আজ থেকে সাতাশ বছর আগে আমরা দুজন বসেছিলাম। সেই ঘাস হয়ত নেই, নেই আমাদের স্পর্শ কোথাও । তবু যেতে ইচ্ছে করছে। কেউ না থাকুক, শালবনের নিবিড় ছায়া তো সেখানে আছে। সেই ছায়ায় মিশে আছে কারোর ছায়াহীন মায়া।
কিন্তু একা একা যেতে আর ইচ্ছা করল না। বসে থাকি বেঞ্চের উপরই। বসে বসে আরও এক কাপ চা ও দুটো সিগারেট খাই। হঠাৎ অদূরে তাকিয়ে দেখি — স্টেশনের সবুজ সিগনাল বাতিটা জ্বলে উঠেছে। ঢাকামুখি একটি ট্রেন এসে স্টেশনে থামে। আমি টিকেট কেটে ট্রেনটাতে উঠে পড়ি, এবং ঢাকায় চলে আসি।
বিমানবন্দর স্টেশনে যখন নামি তখন বিকাল হয়ে যায়। প্লাটফর্মের উপর নেমে পায়চারি করতে থাকি। ভাবছিলাম এখন কোথায় যাব? আমার তো ঘর নেই। আমার কেউ নেই। যে একজন আছে, সে আমাকে ঘৃণা করে। আমাকে দেখতে পারে না।
স্টেশনের নির্জন পুকুর পাড়ের কাছে যেয়ে একটু দাঁড়াই। ছোট ছোট কচুরীপানার ফাঁকে মৃদুমন্দ ঢেউ ভাঙছিল। বিকালের বিষণ্ণ রোদ জলের উপর পড়ে ঝলমল করছিল।
সামনের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখি, সমান্তরাল রেল পথ। জীবনের অনেক কিছুই জলের ঐ রৌদ্রদীপ্ত ঢেউয়ের মতো ঝিলমিল করে, আবার ঐ পথের মতো সমান্তরাল। একটি অপরিচিত ট্রেনে উঠে দূরে কোনো অচিনপুরে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
স্টেশনের বাইরে এসে একটি অটো রিকশা নিয়ে চলে যাই শিয়ালডাঙ্গা। দুধারে কাশবনের ফাঁকে নির্জন পথের উপর নেমে রিকশা ছেড়ে দেই। জলাশয়ের কাছে বাবলা গাছটার তলে যেয়ে বসি। মন খারাপ হলে কত বিকাল, কত সন্ধ্যায় আমি আর মেহনাজ এসে বসে থাকতাম এই বাবলা গাছের নীচে । পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তমিত হতে দেখেছি কত দুজন, কত লাল আভার আবেশে ভরে উঠেছে আমাদের মন।
মেহনাজ আমার বুকের ছায়ায় মাথা লুকিয়ে বলত, ‘এই জীবনে তোমাকে আমি পেয়েছি, তাই কোনো দৌলত খুঁজি না কোথাও। আমি অন্য কিছু চাই না আর।’
দুই হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে একটা অনুযোগই শুধু করছিলাম — ‘ সেই তুমি কত বদলে গেছ !’
হাঠাৎ পিঠের উপর কার যেন কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করি। মুখ তুলে দেখি — মেহনাজ। ও বলছিল — ‘ আমি জানতাম, তোমার মন খারাপের দিনে তুমি এখানেই থাকবে। তাই এখানেই চলে এলাম তোমাকে খুঁজতে।’
সায়াহ্নের সেই সন্ধ্যায়, অস্ত-সূর্যের উদ্ভাসিত আলোয় চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম তার আনত মায়াবী মুখখানি।
২৫. টেন্ডু পাতার বিড়ি
আমার প্রথম ধূমপানখড়ি হয় পাতায় বানানো বিড়ি দিয়ে। স্কুলে টিফিনের সময় চার আনার বাতাম কিনে চারজন খেতাম। আমি সাইফুল, আমিনুল ও ফটিক। বাদাম খাওয়ার পর স্কুলের পাশে ভাঙা রথ ঘরের ভিতর আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে চারজন চারটা টেন্ডু পাতার বিড়ি ধরিয়ে টানতাম।
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। কালের বিবর্তনে ধূমপানের ব্রান্ডটিও আমার পরিবর্তন হয়েছে। তিস্তা, মিতালি, কিং স্ট্রং থেকে স্টার, ক্যাপস্টেন। গোল্ডলিফও খেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যেদিন বাবার পাঠানো মানি অর্ডার পেতাম, সেদিন মনের আনন্দে লন্ডন ব্রান্ড 555 কিনে খেতাম দুই এক শলা।
সহপাঠি বন্ধু ইকবাল হোসেন বাদল মাঝে মাঝে হলে আমার রুমে এসে থাকত, তখন ঐ কদিন রেগুলার লন্ডন 555 খেতাম। বাদল ছিল ঢাকার স্থানীয় বড়ো লোকের পোলা। গোড়ানের চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে। ও খেত 555 , বাদল যে কয়দিন থাকত, সে কয়দিন আমার আর সিগারেট কিনতে হতো না। ঐ-ই কিনত। আমি খেতাম মাংনা।
আমেরিকাতে ছিলাম মাস তিনেক। ওখানে খেতাম মার্লবরো হার্ড। লাস ভেগাস থেকে এসেছিল কোভা নামে একটি মেয়ে। কোভা আমার খুব ভালো বন্ধু হয়েছিল, ও খেত মার্লবরো লাইট। ওর কারণে ব্রান্ড বদল করে মার্লবরো লাইট ধরেছিলাম। হলিউডে সিনে মেকআপ আর্টিস্ট্রির উপর একটি ওয়ার্কশোপে আমরা যোগ দিয়েছিলাম। ওয়ার্কশপ শেষে উইলটার্ন বিল্ডিংয়ের সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসে স্মোকিং জোনে আমি আর কোভা সিগারেট ধরিয়ে টানতাম।
একদিন বিকালে কোভা বলছিল — হাবিব, চলো সান্তা মনিকা বীচে যাই। বললাম — কেন?
আজ আমার মন ভালো লাগছেনা।
আচ্ছা, চলো যাই।
বীচে দুজন বালু আর ছোটো ছোটো ঝিনুকের উপর পা মাড়িয়ে হাঁটছিলাম। কোভা খুব বেশি কথা বলছিল না। প্যাসিফিকের জল ছিল সেদিন শান্ত। ওর চোখের দিকে তাকাই। দেখলাম, চোখ দুটো সমুদ্রের নীল জলের মতো স্থির ও শান্ত হয়ে আছে। আমি ওকে বলি — ‘কী হয়েছে তোমার? মন খারাপ করে আছ কেন?’
ও ওর ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করে একটি সিগারেট ধরায়। আমাকেও বলে — ‘খাবে নাকি একটা?’
দেখলাম — আজকের সিগারেট মার্লবরো লাইট নয়। অন্য আর একটি ব্রান্ডের সিগারেট। আমি একটি স্টিক নিয়ে ধরালাম এবং টানতে থাকি। সিগারেটটি টান দেওয়ার পর আমার শরীর আস্তে আস্তে কেমন যেন হিম শীতল হয়ে আসছিল। আমার সকল ইন্দ্রিয়ে অদ্ভুত এক সুখানুভূতি অনুভূত হচ্ছিল।
মানুষ কত ভাবে দুঃখ সরিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সুখ খোঁজে কত কিছুর ভিতর। সেদিন সেই অস্ত-সন্ধ্যা বেলায় কোভা কী ওর সব দুঃখ সরিয়ে দিতে পেরেছিল সিগারেটে ! সে কথা আর ওর কাছে থেকে জানা হয়নি। শুধু মনে হয়েছিল — ‘ আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন– আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন।’
তো, যে কথা বলছিলাম — বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার প্রায় পনেরো বছর পরের কথা। কয়দিন ধরেই সেই স্কুলবেলার টেন্ডু পাতার বিড়ি খাওয়ার কথা খুব মনে পড়ছিল। খেতেও ইচ্ছে করছিল ভীষণ। ঢাকায় এই বিড়িটি কোথাও পাওয়া যায় না। কী করা যায় ! একদিন আমার সেই বাল্য সহপাঠি বন্ধু সাইফুলকে পত্র লিখলাম–‘সাইফুল, আমার খুব টেন্ডু পাতার বিড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। এখানে পাচ্ছি না। তুই টেন্ডু পাতার বিড়ি যোগার করে রাখবি। আমি খুব শীঘ্রই আসছি। একসাথে দুজনে বিড়ি টানব। ‘
কয়েক দিন পর আমি বাড়িতে যাই। সাইফুলের সাথে আমার দেখা হয় না সে অনেক বছর। আমি একদিন দ্বিপ্রহরের আগেই দুই মাইল দূরে আমিনপুর গ্রামে সাইফুলদের বাড়িতে সাইকেল চালিয়ে চলে যাই। সাইফুল আমাকে দেখে তো বেজায় খুশি। সেই কত বছর পরে দেখা। ও ম্যাট্রিক পাস করার পর অভাব অনটনের কারণে আর পড়ে নাই। জমি জমা যা আছে, তাই দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে।
ওর থাকার ঘরে বিছানার উপর আমাকে বসতে দেয়। একটু পর ওর স্ত্রীকে অনেকটা জোর করে টেনে আমার সামনে নিয়ে আসে। ওর স্ত্রীকে বলে– ‘এতদিন তো হাজারো বার আমার এই বন্ধুটির কথা তোমাকে বলেছি । আজ ওকে দেখো চক্ষু মেলিয়া।’
সাইফুল এগারো বারো বছরের একটি বালিকাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। বলে — ‘এই হচ্ছে আমার মেয়ে মরিয়ম। ক্লাস সিক্সে পড়ে। খুব ভালো ছাত্রী।
রোল নং ২, সাইফুল ওর মেয়েকে বলে — ইনি আমার বাল্য বন্ধু। তোমার চাচা হয়। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করো।’
মরিয়ম আদুরী আদুরী লক্ষ্মী একটা মেয়ে। দেখতেও খুব মায়াবী এবং রূপন্বিতা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি– তুমি বেঁচে থাকো মা, ভালো ভাবে লেখা পড়া করবে। ‘ সাইফুলের স্ত্রী ও মেয়ে অন্য ঘরে চলে গেলে আমি সাইফুলকে বললাম — ‘বিড়ি কই, বিড়ি দে।’ সাইফুল এক বান্ডিল টেন্ডু পাতার বিড়ি কই থেকে যেন যোগার করে এনেছিল। আমাকে বিড়ির বান্ডিল দিয়ে বলে — ‘নে, বসে বসে খা।’ এখানে এই বিড়ি পাওয়া যায় না। হিলি বর্ডার থেকে আনিয়েছি। যে কয়টা পারিস খা। বাকীগুলো নিয়ে যাবি।’
সেই কতকাল পরে দুই বন্ধু বসে বসে মনের সুখে বিড়ি টানতে থাকি। কী যে ভালো লাগছিল, কী যে ঘ্রাণ ছিল বিড়ির। সেই কত বছর আগের রথ ঘরে বসে বিড়ি খাওয়ার কথা মনে পড়ছিল। সেই অনাবিল ঘ্রাণ, সেই স্বর্গীয় আনন্দ।
দুপুরে সাইফুল না খেয়ে আসতে দেয়নি। ওর বউ ধনিদহ বিলের বোয়াল মাছ, আর ওদের নিজেদের পালন করা হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছিল। দারুণ সুস্বাদু ছিল ওর বউয়ের রান্না।
ভাত খেয়ে বিছানার উপর বসে আবারও দুজন বিড়ি ধরাই। দুইজনই বিড়ি টানতে থাকি। সাইফুল বিষাদ জড়িত কণ্ঠে বলছিল — ‘তোকে একটা কথা বলা হয় নাই। ‘
আমি বললাম — কী কথা, বল্ ?
— মরিয়মের খুব অসুখ।
— কী অসুখ!
— আজ দশ পনেরো দিন ধরে ভিতরে ভিতরে খুব জ্বর। রাতে বেশি হয়। ভালো হচ্ছে না।
— শহরে নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবি।
— আচ্ছা।
আমি ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, কোনো করুণা কিংবা দয়া না। তোর মেয়ে আমারও মেয়ে। টাকাগুলো রাখ্। মরিয়মের চিকিৎসা করাবি। ‘ আমি ওকে আরও বললাম — আল্লাহ খারাপ কিছু না করুক–যদি মনে করিস ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। তাহলে চলে আসিস আমার বাসায়।
আমি যখন চলে আসি, মরিয়ম কাছে এসে
বলেছিল —
চাচু, তুমি আবার এস।
আমি ঢাকায় চলে আসি। এরপর আরও কয়েকমাস চলে যায়। বিভিন্ন কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে যাই। সাইফুলের মেয়েটার আর খোঁজ নেওয়া হয় নাই। অনেকটা ‘পৃথিবীতে কে কাহার?’- এর মতো উপেক্ষা , এবং ভুলে থাকা ।
তারও অনেক পরে — একদিন জানতে পারি যে, সাইফুলের মেয়েটার নাকি লিউকেমিয়া হয়েছিল এবং সে মারা গেছে।
হঠাৎই কোনো ক্ষণে ঐ মেয়েটির কথা মনে হয়। একটা অপরাধ বোধ মনকে আজও বিষণ্ণ করে — আমার বিত্ত ছিল, প্রবল ইচ্ছে শুধু ছিল না। মেয়েটিকে ঢাকায় এনে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম। কিন্তু করিনি। তুচ্ছ কোনো বস্তর মতো অবহেলায় ফেলে রেখে দিয়েছিলাম।
২৬. অতিপ্রাকৃত গল্প
একটা ভয়ংকর ঘটনার কথা লিখছি। ১৯৮৫ সালের কথা। তখন বিয়ে সাদি কিছু করিনি। এক বাড়িতে একা থাকি। আশেপাশে তেমন বাড়ি ঘর নেই। বাড়ির পাশেই জঙ্গল। বাঁশ ঝাড়ও আছে ঘরের চাল ঘেষে।
সে বছর একুশের বইমেলা থেকে কোন্ কুক্ষণে কিছু অতিপ্রাকৃত ভূত পেত্নীর বই কিনেছিলাম। তার মধ্যে ছিল বিভূতিভূষণের তারানাথ তান্ত্রিক। তো কয়দিন সেই বইগুলো পড়লাম। পড়ার সময়ই আমার ভিতর কেমন যেন একটি পরিবর্তন অনুভব করলাম। কেমন অস্বাভাবিক সন্ন্যাস সন্ন্যাস ফকির ফকরান্তি ও পাগল পাগল ভাব। ভাবছিলাম এর কারণ কী? আমার কাছে মনে হলো যত গন্ডগোলের মূল — বিভূতিভূষণের এই তারানাথ তান্ত্রিক। ওকে যে করে হোক ঘর থেকে সরাতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম — ওকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে একদিন তুরাগ নদীতে ফেলে দিয়ে আসব।
কিন্তু তারানাথ তান্ত্রিককে বিসর্জনে পাঠানোর
আগেই ঘটে গেল এক ভয়ংকর ঘটনা।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মেঘ গুরুগম্ভীর বৃষ্টি হচ্ছিল । ঘরে আমার চাল চুলো জ্বলে না। আজিজ মিয়ার হোটেল থেকে বাজিতপুরের বিলের ঠ্যাংওয়ালা চিংড়ি মাছের ভুনা তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে আসি। সাথে আষাঢ়ের ডিমওয়ালা টেংরা মাছের তরকারিও ছিল।
কী করব? কোনো কাজ কাম নাই। টেবিল থেকে তারানাথ বের করে পড়তে থাকি। উইলিয়াম ওয়ার্ডওয়ার্থের লেখা দুষ্ট কবিতার মতো বৃষ্টির রাত ছিল। কী চমৎকার ঝরো হাওয়ার সাথে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে । শীতল হতে লাগল শরীর মন।
তারানাথ তান্ত্রিক পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই। হঠাৎ একটি শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। শব্দটা বারান্দার দিক থেকে আসছিল। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত পৌণে তিনটা। তারানাথে পড়েছিলাম — ভুত পেত্নী দেখে ভয় পেতে নেই। ভয় করলে ওরা নাকি মাথায় ওঠে এবং ঘার মটকিয়ে চিবিয়ে খায়।
শব্দটা আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল। আমি মনে সাহস আনলাম। দরজার কাছে এগিয়ে যাই। আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে বুকে ফু দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে দরজাটা খুলি। দরজা খুলে আমি তো বিস্ময়েে হতবাক! বাইরে মধ্য আকাশে পূর্ণিমাভূক বিশাল চাঁদ। চন্দ্রদাসী হয়ে সে আলো ছড়াচ্ছে আঙিনায়। যে মেঘ আর বৃষ্টি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে মেঘও নেই, সে বৃষ্টিও নেই। তার পরিবর্তে এই অবিস্মরণীয় চাঁদের আলোয় ভাসছে ভূবনলোক । সেই চন্দ্রালোকে একটি উপজাতীয় মেয়েকে দেখতে পাই। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটি বলছিল — আমি টিনটিন। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় থেকে এসেছি ।
ও আরও বলছিল — আমাকে তোমার মনে আছে? আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম। এবং তুমিও। তোমার কারণে আমি খুন হয়েছিলাম গাঙুর হাতে। এই দেখো আমার শরীর জুড়ে খুনের রক্ত।
— না, আমি তোমাকে চিনিনা। তুমি কে? চলে যাও তুমি।
অনেকটা অবজ্ঞা ও ধমক দিয়ে আমি এক নিমিষে ঘরের ভিতর চলে এসে দরজা বন্ধ করে দেই। ভিতর থেকে আবারও শব্দ শুনতে পাই। আবারও দেখি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। গুরুগম্ভীর করে মেঘ ডাকছে। কোথাও কোনো চাঁদের আলো নেই। একটু পর শুনতে গাই — টিনটিন গুমরে গুমরে কাঁদছে।
তখনও ঘরের চালে এক কোণে বাঁশের ঘষঘষ শব্দ হচ্ছিল। ভাবলাম, ‘টিনটিন কাঁদলে কাঁদুক। আমার কী? ও আমার কে?’ আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি এবং ঘুমিয়ে যাই।
সকালে ঘুম ভেঙে দরজা খুলে দেখি — উঠোনে বৃষ্টির জলের সাথে ছোপ ছোপ রক্ত ভাসছে। এবং বারান্দায় দেখি — টিনটিনের ফেলে যাওয়া ওর রক্তমাখা ওড়না পড়ে আছে ।
আমি ঐদিনই দেরি না করে তারানাথ তান্ত্রিক বইটি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে তুরাগ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আসি।
২৭. অপরাজিতা
আমি তখন মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নিয়মিত ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। পরীক্ষার পরই ইউনিভার্সিটি জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। হল থেকে খুব বেশি বের হতাম না। বোরিং লাগলে মাঝে মাঝে বিকাল বেলা হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম হাকিমের চায়ের দোকানে। ওখানে চা খেয়ে বন্ধু বান্ধবদের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার পরপরই হলে চলে আসতাম।
পরীক্ষার পর চাকুরি হোক বা না হোক, মা আমার বিবাহ ঠিক করে রেখেছে। আমিও সেই মেয়েকে দেখেছি, কথা বলেছি। ওর নাম নীলিমা। রূপশ্রী কলাবতী মেয়ে। ওড়না উড়ে তার করতোয়ার বক্ষ ছুঁয়ে আসা উতল বাতাসে। হেমন্ত জোছনায় চোখ আলো করে রাখে। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বাজে জল তরঙ্গের মতো। কী এক রহস্যময় জগৎ উন্মোচিত হবে, সেই ভাবনায় সেই অপেক্ষায় কখনও কখনও পরীক্ষার পড়া ভুল ভাবে মস্তিষ্কে ধরা দিত। মনে রাখতে পারতাম না। ‘মোর ভাবনারে একি হাওয়া লাগল দোলে মন দোলে অকারণ হরষে’।
সেদিন দুপুরে রুমে টেবিলে বসে পড়ছিলাম সোফোক্লিসের ইডিপাস। জটিল কমপ্লেক্সে মনটা যখন উথালপাতাল হচ্ছিল, ঠিক তখন ডাকপিওন একটি পত্র দরজার নীচে দিয়ে ফেলে রেখে যায়। মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। ভেবেছিলাম নীলিমার চিঠি। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ও তাই মাঝে মাঝে আমার কুশল জানতে চেয়ে চিঠি লেখে। ভেবেছিলাম নীলিমার চিঠি হবে।
কিন্তু না। এটি নীলিমার চিঠি ছিল না। অন্য আর একজনের চিঠি। চিঠির নীচে একটি মেয়ের নাম লেখা আছে — অপরাজিতা।
আমি অপরাজিতা নামে কোনো মেয়েকে চিনি না। কে এই অপরাজিতা? চিঠিতে লিখেছে —
প্রিয়জনেষু আনিস,
একটু অবাকই হচ্ছো অপরাজিতা মেয়েটি আবার কে? আমাকে তুমি দেখেছ অনেক। যদি কখনও আবার দেখ, ঠিকই চিনতে পারবে আমাকে। আমি কে, এই কথা বলব না তোমাকে। তুমি আমাকে জানলে আমার প্রতি তোমার আর আগ্রহ থাকবে না।
তোমাকে আমার কবে ভালো লেগেছিল জানো?
একদিন তুমি গাঢ় নীল রঙের জিন্স প্যান্টের সাথে হালকা নীল রঙের টি-সার্ট পরেছিলে। পায়ে ছিল সাদা কেডস্। তোমার মোছ সদ্য গজিয়ে ওঠা দূর্বা ঘাসের মতো সতেজ, চুল এলভিস প্রিসলীর মতো পিছনে ব্রাশ করে আঁচড়ান। স্নানের পর ললাটে নেমে আসে কেশদাম ৷ চোখ স্বপ্নচ্ছটা। কখনও মেঘলা আকাশের তারার মতো মণিদীপ। তুমি মাধুকর। ছেলে মানুষও দেখতে এত টান টান হয়। আমি বিস্ময়ে চেয়ে দেখেছিলাম । তোমাকে ভালো লাগা ওখান থেকেই। হৃদয়ে ভাঙন তখন থেকেই শুরু । কিন্তু প্রপোজ করিনি কখনও। কেন করিনি সে অনেক কারণ, অনেক ভাঙচুরের কথা।
তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি।
তোমার মতো আর কোনও ছেলে আমি দেখিনি। রূপে গুণে, গানে আর প্রাণের প্লাবনে তুমি যে অনন্য। তুমি স্বপ্নে দেখা রাজকুমার।
তোমার জন্য আমার মনের মধ্যে তৈরি হয় এক গভীর মায়াবোধ, কীসের যেন একটা অভাবও অনুভব করি। তোমাকে আমার করে কী পাওয়া হবে এই জীবনে? সারাক্ষণ মন কেমন করে। এক ধরনের ভারী বিষণ্ণতা বুক চেপে ধরে আছে ।
বড়ো অসময়ে আমি তোমাকে এই কথাটি বললাম। যখন তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ফিরে আসার কোনো পথ কি তোমার খোলা আছে? নাকি রুদ্ধ তোমার সকল দুয়ার?
ভালো থেকো তুমি।
ইতি — অপরাজিতা।
অপরাজিতা নামে কোনো মেয়ের সাথে কোনো দিন আমার পরিচয় ছিল না। তার নামও কোনও দিন শুনিনি। নিশ্চয়ই ছদ্মনাম দিয়ে কেউ এই চিঠিটি লিখেছে। যে আমাকে খুব কাছে থেকে জানে। আমার হলের রুম নং ও তার জানা আছে। কিন্তু কে এই মেয়ে? হাতের লেখাটিও চিনতে পারছি না। একটু দুশ্চিন্তাও করতে থাকি। সামনে আমার শুভ বিবাহ। একজন অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে আর কিছুদিন পর হাতে মেহেদি পরবে। কাঁচা হলুদ দেবে তার গায়ে। কপালে টিপ পরবে। খোপায় পরবে শুভ্র সন্ধ্যামালতী ফুল।
রাতে টেবিলে বসে যখন পড়ছিলাম, তখন শরীর মদির হয়ে চোখে ঘুম নেমে আসে। শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম আসে না। চেয়ে থাকি নিমগ্ন হয়ে। দূরে অনেক দূরে বন ঝাড়ে দেখতে পাই অজস্র অপরাজিতা ফুল ফুটে আছে। ফুলগুলো বেদনায় নীল। আমি জানি, এদের আয়ু খুব ক্ষণকালের। কে-ই বা ছুঁইবে তাদের। অনাদরে ওরা ঝরে যায় ।
একদিন দুপুরে ডাইনিং রুম থেকে খেয়ে এসে রবি ঠাকুরের কড়ি ও কোমল কবিতার বইটি বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে পড়ছিলাম। পরের দিন রবীন্দ্র সাহিত্য পরীক্ষা। পাশের জানালাটা খোলা ছিল। চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। দেখছিলাম দূরে অনন্ত আকাশের নীল। মনে হচ্ছিল জলেশ্বরী তলার আকাশ দেখছি আমি। যেন ”শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল। / আমার নিখিল / তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল। নাহি জানি, কেহ নাহি জানে–”
আমি জানি — নীলিমা আমার। নীলিমা আমার হবে।
রুমের দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। কড়ি ও কোমল বিছানার উপর রেখে দরজাটা যেয়ে খুলে দেই। দেখি — ডাকপিয়ন চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকেও অপরাজিতার চিঠি।
পরম কল্যাণীয়,
তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? এই সময়ে তোমাকে বিরক্ত করা আমার ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। কত কথা বলতে ইচ্ছে করে তোমার সাথে। অথচ এক সময় কত কথা তোমার সাথে বলতে পারতাম। আজ যখন ক্রমে অনেক দূর চলে যাচ্ছ, তখন মনে হয় — তোমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করি। তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলি তোমার কঠিন কোমল বুকে। আমার নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় যে ! কোথাও কোনও নন্দন কানন থেকে যদি তুমি একটি চাঁপা ফুল এনে আমায় দিতে, তবে নিঃশ্বাস নিতাম প্রাণ ভরে।
আমার পরম সৌভাগ্য যে তোমাকে আমি চেয়েছিলাম, আর আমার নিয়তি যে তোমাকে আমি কোনও দিন পাব না। তোমার জীবনময় আমি থাকব না, কিন্তু তোমার জীবনভর আমার অদৃশ্য ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকবে। আমার খুব কান্না পায়, কষ্ট হয়, হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে টান লাগে। দুঃখের মাধুরীতে আমাকে শুধু সিক্তই করলে। আমাকে কাছে নেবার কোনও দায় নিলে না। কাঁদিয়েই রাখবে কেবল জনমভর।
তোমাকে আমার জীবনের শেষ অব্দি পর্যন্ত মনে থাকবে। শুধু একটু আফসোস রয়ে গেল তোমার সাথে জলেশ্বরী তলায় তোমাদের বাড়ির আম্রকাননে দাঁড়িয়ে একটা সকাল দেখা হলো না, কাটাতে পারলাম না শোয়ার ঘরে একটি নিঝুম দুপুর, দক্ষিণের বারান্দায় একটা কমলা রঙের বিকেল, আর ছাদে পাটিতে বসে উপভোগ করতে পারলাম না একটি জ্যোৎস্নার রাত।
ভালো থেকো তুমি।
ইতি — অপরাজিতা।
পরীক্ষার কয়েকটি দিন বাকী ছিল। অনেকটা মন খারাপের ভিতরেই পরীক্ষা শেষ করি। হঠাৎ আনন্দময় ভাবনার ভিতর অজ্ঞাত কোন্ এক মেয়ে মনের উপর একটু বিষণ্ণতার ছায়া ফেলল। ভুলে যাই। মনের উপর জোর রাখলাম, ভাবলাম, এইসব কিছু না। এইসব মিছে মায়া। অন্তরের ভিতর এইসব ঠাঁই দিয়ে আসন্ন শুভক্ষণগুলোকে অসুখকর করা ঠিক হবে না।
যেদিন পরীক্ষা শেষ হয়, সেদিন রুমে এসে দেখি দরজার নিচে দিয়ে পিওন দুটো চিঠি ফেলে রেখে গেছে। একটি চিঠি নীলিমার। আর একটি চিঠি অপরাজিতার। আমি নীলিমার চিঠিখানি প্রথম পড়ি।
প্রিয়তম,
পরীক্ষার শেষ হওয়ার পর দেরি না করে তাড়াতাড়ি চলে আসিও। বাঁধ ভাঙা আবেগে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। সময়ে অসময়েই তোমার কথা আমার মনে পড়ে। দিন যত এগিয়ে আসছে, তত আমার শরীর মন কাঁপছে। ভাবি বসে বসে — কী সুন্দর দিন, কী মধুময় রাত হৃদয় পথগামি।
সকাল থেকেই এখানে আজ বৃষ্টি হচ্ছে । দমকা হাওয়ায় মাতিয়ে উঠেছে বৃক্ষরাজি। একটি ছাতা মাথায় দিয়ে দুজন করোতায়া নদীর পারে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। আমাকে তুমি বৃষ্টি দাও। ঝুমঝুম করে আমার সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে দাও।
তুমি এসো। চূর্ণ করে দাও আমার অপেক্ষা।কিছুতেই কাজে মন বসে না। তুমি আমাকে তোমার ঘরে তুলে নিয়ে বাজাও বর্ষার মল্লারের সুর।
ভালো থেক তুমি প্রতিদিন সারাক্ষণ।
— তোমার নীলিমা।
এরপরে পড়লাম অপরাজিতার চিঠিটি।
কল্যাণীয়েষু,
আমি জানি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিনই তুমি চলে যাচ্ছ। তোমাদের বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক হয়ে আছে। তোমার এই আসন্ন শুভক্ষণে আজ আর আমি কোনও অমঙ্গলের কথা লিখব না। তোমার এই শুভদিনে আমি শুধু তোমার মঙ্গল প্রার্থনাই করব।
কটা দিন ধরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কী দরকার ছিল তোমাকে অমন করে চিঠি লেখার। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে আমন্ত্রণ করব — বুড়িগঙ্গার পারে যেয়ে দুজন দেখা করব। ওখানে নদীর তীরে কোথাও ঘাসের ওপর বসব—তুমি আর আমি। তখন জলে বিরাজ করবে শুভ্র শান্তি। অন্ধকারে তীরের বৃক্ষ গুল্ম হয়ে উঠবে নিবিড়। অস্তমিত সূর্যের আবছায়ায় মুখ তুলে তাকিয়ে দেখব তোমাকে। লাল আভায় চিক চিক করবে আমার চোখের জল। যদি তোমারও কান্না পায়, যদি তোমারও চোখের জল ঝরে পড়ে আমার ললাটের উপর। তাহলে মরেও শান্তি পাব। কিন্তু তা হলো না। ভয়ও করল যদি তুমি না আসো। আমি নিজেই নিজেকে বারণ করলাম।
হয়ত আর চিঠি লিখব না। একা থাকা কী হবে? কেউ না কেউ আসবে জীবনে। তাকে নিয়েই হবে সংসার। সংসার কর্মের ভিতর তোমাকে যেন ভুলে থাকতে পারি। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার শেষ কটি চরণ দিয়ে এই চিঠিখানা শেষ করছি —
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়, ওগো বন্ধু বিদায়।
— অপরাজিতা।
মনটা কেমন যেন লাগছিল। বাড়িতে আসার আগের দিন এমনই একদিন বুড়িগঙ্গার পারে একাকী চলে যাই। কোথাও নির্জন কূল নেই। নদীতে কত নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার। ওদের আসা যাওয়ার ভেঁপু’র শব্দ। তীরে জনারণ্য। নেই কোথাও বনঝোপ। কোথাও কোনও বন অন্তরালে অপরাজিতা ফুটে নেই।
আমি বাড়িতে চলে যাই। এক ফাগুন দিনে আমার বিয়ের তারিখ হয়।
বিয়ের দুই দিন আগের কথা। সেদিন ঘরে আমি একাই ছিলাম। অনেক রাত্রি হয়েছে। ঘুম আসছিল না চোখে। অপরাজিতার চিঠি তিনটি ব্যাগে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। চিঠি তিনটির কথা মনে হলো। মনটা কেমন হুহু করে উঠল। একটি সিগারেট ধরাই। দরজার খিরকি খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে অন্ধকার। আকাশে একটি তারাও নেই । কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হাতের সিগারেটের পোড়া অর্ধেকটা উঠোনে ফেলে দিয়ে রুমে চলে আসি। টেবিলের উপর ল্যাম্পটি মিটমিট করে জ্বলছিল। ব্যাগের তলা থেকে চিঠি তিনটা বের করে ল্যাম্পের আলোয় আবার পড়তে থাকি। কবে কখন একটি মেয়ে এমন করে আমায় ভালো বেসেছিল, ভেবে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল।
দুইদিন পর বিয়ের সানাই বেজে উঠবে। ভাবলাম– অমঙ্গলের এই অভিজ্ঞান কেন ঘরে রাখব? চিঠি তিনটি তাই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করি। এবং ছে্ঁড়া টুকরাগুলি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেই। অন্ধকারে সে টুকরোগুলো দমকা বাতাসে উড়ে কোথায় ধূলোবালিতে মিশে হারিয়ে গেল।
প্রায় এগারো বছর পরে একদিন অপরাজিতার একটি চিঠি পাই। অপরাজিতা লিখেছে —
বন্ধু আমার,
এই শহরে তুমি থাকো। আমিও থাকি। তোমার কুশল আমি সব জানি। তোমাকে দেখিও মাঝে মাঝে। কী সুন্দর পরীর মতো বউ তোমার। বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে দূর থেকে তোমার সব সুখ আমি দেখি।
আমার কথা কী তোমার একবারও মনে পড়ে না? অবশ্য আমাকে তুমি মনে রেখো — এই দায় তোমাকে আমি কখনও দেইনি। তোমার উপর থেকে আমার ভালোবাসা একটুও যায়নি। আজও তোমাকে খুব ভালোবাসি।
যে মেয়েটি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল, তাকে একটিবারও দেখবার সাধ হয় না? আমাকে না দেখেই তুমি মরে যাবে? এমন অতৃপ্তি তুমি রেখ না। যদি আমাকে দেখবার ইচ্ছে হয় তাহলে দেখতে এসো। কেবিন নং ৫০৭, পঞ্চম তলা, পিজি হাসপাতাল, ঢাকা।
— অপরাজিতা।
দুইদিন পরই একদিন সকাল এগারোটার দিকে আমি পিজি হাসপাতালে চলে যাই। ৫০৭ নং কেবিনের দরজায় নক করি। কেউ খুলছে না। একজন নার্স এগিয়ে আসে। উনি বলছিলেন – ওনার তো আজ অপারেশন হচ্ছে । ওটি নং ৩ এর সামনে চলে যান। ওখানে ওনার স্বজনেরা আছেন। আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করি — কী হয়েছে ওনার? কিসের অপারেশন হচ্ছে।
— যকৃতে ক্যানসার। সম্ভবত শরীরের সারা রক্তে তা ছড়িয়ে গেছে।
আমি ৩ নং অপারেশন থিয়েটারের সামনে চলে যাই। ওটির সামনে বেশ কয়েকজন নারী পুরুষকে দেখতে পেলাম। কেউ আমাকে চেনে না। একজন লোককে দেখলাম সে একটি ছয় সাত বছরের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। মেয়েটি কাঁদছেে। বুঝতে পারলাম মেয়েটি অপরাজিতার মেয়ে। আর লোকটি অপরাজিতার স্বামী। ওনার চোখে মুখে চরম উদ্বিগ্নতার ছাপ। আরও যারা আছে, তারাও সবাই চিন্তাক্লিষ্ট ও বিষণ্ণ। কেউ কেউ অশ্রু সিক্ত।
আমি অনাহুতের মতো একটু দূরে কোরিডরে দাঁড়িয়ে থাকি। আধা ঘণ্টা পরে অপারেশন থিয়েটার থেকে কেউ একজন এসে জানায় — রোগিণী মারা গেছে। তারও কিছুক্ষণ পরে স্ট্রেচারে করে সাদা চাদরে ঢেকে মৃত রোগিণীকে ওটি থেকে বের করে আনে। কোরিডরে আত্মজনরা সবাই স্ট্রেচারের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সাদা কাপড় সরিয়ে সবাই তার মুখখানি দেখছে। আমিও নিঃশব্দে স্ট্রেচারের কাছে গিয়ে দাঁড়াই, দেখি অপরাজিতার মুখ।
কোরিডর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে আসি। পিছনে বাচ্চা মেয়েটির ক্রন্দনধ্বনি হাসপাতালের কংক্রিটের দেয়ালে বিদীর্ণ হচ্ছিল। শব্দহীন আত্মস্বরে বলছিলাম — অপরাজিতা, এত কাছে ছিলে তুমি। এত তোমায় দেখেছি। এত ভালো বেসেছিলে তুমি। আমি তা বুঝতে পারিনি। তুমি চোখ বন্ধ করে আছ, দেখলাম তোমার আর্তিময় আঁখিপাতের মায়া।
জীৎ তোমারই হলো। আমিই হেরে গেলাম। বাকী জীবন আফসোস করে কাটাতে হবে। ওপারে তুমি ভালো থেকো অপরাজিতা। রেস্ট ইন পিস।
২৮. তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে
একটা স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘড়িতে চেয়ে
দেখি — রাত তিনটে দশ। স্বপ্নটি খুব সুন্দর ছিল। সুন্দর স্বপ্ন নাকি হঠাৎ করে ভেঙে যায় না। পুরোটাই দেখতে পায় মানুষ। কিন্তু আমার দেখা স্বপ্নটি অসম্পূর্ণ রেখেই ভেঙে গেল। কিছু স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর স্বপ্নটির জন্য মানুষ আফসোস করে।
স্বপ্নটা ছিল — আমি একটি দুই ঘোড়ার টমটম গাড়িতে করে সাহানাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। টমটমটি লাল ঝালর কাপড়ে সাজানো। আমার পরনে রাজস্থানের শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি, চোখে সুরমা পরা। শরীরে বাগদাদের আতরের গন্ধ। পায়ে কোলাপুরী জুতো। টমটমটি চলছে একটি অচেনা বনপথ ধরে। অন্য কোনো বরযাত্রী নেই। আমি একা চলেছি। চারদিকে শাল পিয়াল আর আমলকীর বন ঝাড়। নির্জন সে পথ। ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ হচ্ছে।
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, সাহানা একটি লাল বেনারসি শাড়ি পরেছে। মুখে ট্রেডিশনাল বিয়ের সাজ। সিঁথিতে টিকলি। চোখে কাজল। কানে ঝুমকো। গলায় মতিহার। খোপায় বেলী ফুলের মালা জড়ানো। মাথায় ঘোমটা দিয়ে আনত চোখে বিয়ের আসনে সে বসে আছে।
স্বপ্নের পট দৃশ্যগুলো দ্রুত পরিবর্তন হতে লাগলো। দেখি — আমিও একটি বিয়ের আসনে বসে আছি। আমার সামনে মৌলানা সাহেব বসে আছেন। কোরান থেকে কিছু সুরা মুখস্থ পাঠ করলেন তিনি। তারপর আমার উদ্দেশ্য করে উনি বলতে লাগলেন– ‘….. … .. আপনি কী সাহানা বেগমকে বিবাহ করতে রাজি? ‘ রাজী থাকলে তবে বলুন — ‘কবুল’। ‘
কবুল বলার আগেই স্বপ্নটা ভেঙে যায়। স্বপ্ন ভাঙার সাথে সাথেই ঘুমও ভেঙে যায়। ঘরময় অন্ধকার। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করল না। একবার মনে হলো বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে একটু দাঁড়াই। যদি আকাশে চাঁদ থাকে, যদি জ্যোৎস্নায় ভাসে চরাচর। তবে মনটা একটু ভালো লাগতে পারে । কিন্তু, উঠতে পারছি না। অসুখটা আজ কয়েকদিন ধরে একটু বেশি। ক্রাচে ভর করে হেঁটে যেতে হবে। ক্রাচে হেঁটে যাওয়ার মতো শক্তি আমার এই মুহূর্তে নেই।
সাহানা আমার ছোট ফুফুর মেয়ে। ওর জন্ম হয়েছিল আমাদের বাড়িতেই। জন্মের সময় ফুপু মারা যান। দাদী সাহানাকে ওনার কাছেই রেখে দিয়েছিল। সে বেড়ে ওঠে দাদীর ক্রোড়ে। দাদীকেই সাহানা মা ডাকত। ও এমনই দুঃখী, দাদীও মারা যান ওর পাঁচ বছর বয়সের সময়। তারপর ওর সমস্ত দায়িত্ব নেয় আমার মা। আমার মা- ই ওর মা হয়ে ওঠে।
সাহানার বাবা অর্থাৎ আমার ফুপা কখনোই মেয়ের দাবি নিয়ে ওকে ফিরে নিয়ে যেতে চায়নি কখনো। তাছাড়া, তিনি পরবর্তীতে আর একটি বিয়ে করে সুখে সংসার করতে থাকেন। সাহানা নামে তার যে একটি মেয়ে আছে, তা সে ভুলেই যায়।
আমাদের ভাইবোনের মাঝে সাহানাও আর একজন বোনের মতো বড়ো হতে থাকে। ওকে আমরা সবাই আপন করে নিয়েছিলাম। বাবা আরও বেশি ভালো বাসত ওকে। বাবার সকল কাজে, তার সকল সেবায়, তার খাওয়া দাওয়ায় খেয়াল করা, তাকে যত্ন করা, সব সাহানাই করত।
এই সাহানার কয়েকদিন পর বিয়ে হয়ে যাবে। দিন তারিখ ঠিক হয়ে আছে। ৬ ই আশ্বিন, শুক্রবার। ওর বর একজন বেসরকারি কলেজের বাংলার প্রফেসর। ভালো কবিতাও লেখে। সে কবি। তার একটি কবিতার বইও বের হয়েছে, নাম — ‘মনে জাগে আশা।’ বরের এই কাব্য প্রতিভার গুণকে বাবা বেশ গুরুত্ব দিয়েছিল।
ছেলে পক্ষ আমাদের বাড়িতে এসে সাহানাকে দেখে। সাহানাকে সেদিন লাল সিল্কের শাড়ি পরানো হয়েছিল। বরের মা নিজে ঘোমটা খুলে সাহানার লম্বা লম্বা কালো চুল দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিল — ‘ও মা, আমাদের বউ মা কী সুন্দর! ডাগর ডাগর চোখ! কী সুন্দর হাতের নোখ। কাঞ্চিবরণ গায়ের রং।’ বরের মা খুশিতে আটখান হয়ে নিজের গলার মালাটি খুলে সাহানার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল, কন্যা পক্ষের কোনো মতামত না নিয়েই।
মা সাহানাকে ডেকে একদিন সকালবেলা বলে– ‘তোমার কী বর পছন্দ হয়েছে? তোমার মামা তোমার মত জানতে চেয়েছেন।’
— আমি কালকে আপনাকে আমার মতামত জানাবো।
— আচ্ছা, ভেবে চিন্তে কালকেই জানাও।
সাহানা সেদিনই সন্ধ্যায় আমার ঘরে এসেছিল। আমি বিছানায় শুয়ে আছি। ঘর অন্ধকার। পাকস্থলিতে প্রদাহ খুব বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল। সাহানা বলছিল — সাঈদ ভাই, ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দেই?
— দে।
— তোমার বুকে খুব ব্যথা করছে?
— হে।
— ঔষধ খাও নাই?
— দুপুরে খেয়েছি, রাতে আবার খাব।
— মামা, মামী আমার বর দেখে রেখেছে। আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে।
— খুব ভালো। তোর বর খুব সুন্দর, প্রফেসর, কবি।
সাহানা অঝোর ধারায় কাঁদছে। কোনো কথা বলতে পারছে না।
— এই তুই কাঁদছিস কেন?
— আমি এই বিয়ে করব না।
— কেন করবি না।
সাহানা আমার বুকের উপর মাথা ঝুকে অশ্রুপাত করে বলে — আমি তোমাকে ভালোবাসি সাঈদ ভাই।
— তুই তো এই কথা কখনও আমাকে বলিস নাই।
— তুমি বুঝতে পারো নাই?
— শোন্ এই শেষবেলায় তুই পাগলামি করিস না। আমি পঙ্গু একজন মানুষ। ক্রাচে ভর করে হাঁটি। কিডনি ফেইলর। কদিন পরে মরে যাব। আর তুই কী না আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস। এত বোকা মানুষ হয়? তোর সামনে কত অনন্ত সুখের সময়। আমাকে বিয়ে করলে তোকে তো বিয়ের পরপরই বৈধব্যের সাদা কাপড় পরতে হবে। তোকে আমার বিয়ে করা সম্ভব হবে না। আমি তোকে ছোট বোনের মতো সারাজীবন দেখে এসেছি। তুই আমার ছোট বোন হয়েই থাকবি।
সাহানা আর কোনো কথা না বলে সেদিন কাঁদতে কাঁদতে ঘর হতে বেরিয়ে গিয়েছিল।
পরের দিন সে মার কাছে যেয়ে বলে — মামী, আমার এই বিয়েতে আপত্তি নেই। আপনেরা এই বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।
বাড়িতে আমি খুবই অসুস্থ। এই কারণে ভিতরে ভিতরে একটা দুঃখের আবহ থাকলেও বাবা সাহানার বিয়ের ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করতে রাজি ছিল না। সে সব রকমের ধুমধামের আয়োজন করলেন। বর পক্ষ থেকে সাহানাকে গায়ে হলুদ দিয়ে যায়। কন্যা পক্ষ থেকেও বরকে গায়ে হলুদ দিয়ে আসে।
বিয়ের দিন শহর থেকে ব্যান্ড পার্টি আনা হলো। সানাই বেজে উঠল। সাহানার বান্ধবীরা, সহপাঠীরা, খেলার সাথীরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠল। আনন্দ উৎসবে আমার অন্যান্য ভাই বোনেরাও অংশ নিলো।
আমার এত ইচ্ছা করছিল সাহানার সব আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে। কিন্তু বিধাতা আমাকে সে আনন্দ করতে দিল না। ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম। একদিকে শরীর পুড়ে যাচ্ছিল, অনদিকে শীতে থরোথরো করে কাঁপছিলাম। ক্রাচে ভর করে যে একটু হেঁটে অনুষ্ঠান স্থলে যাব, তাও আর পারলাম না। সে শক্তি নেই। অন্তরের ভিতর সানাইয়ের সুর বেদনার মতো করে বাজছিল —
‘প্রমােদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে।
চারি দিকে হাসিরাশি, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে।’
সামিয়ানা টানিয়ে তার নিচে চেয়ার টেবিলে বসিয়ে আগত অতিথিদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই মহা ধুমধামে খেলেন, আনন্দ করলেন।
এরপর সন্ধ্যারাতে বর আর কনেকে পাশাপাশি বসিয়ে নানারকম আনুষ্ঠানিকতা করা হয়। সব কিছুর ভিতর ছিল নির্মল আনন্দ, আর অনাবিল প্রাণোচ্ছ্বাস। এত আনন্দ উৎসব হচ্ছে যে, তার কোনোটাই দেখার সুযোগ আমার হলো না।
রাতেই সাহানা ওর শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। যাবার বেলায় মা আর বাবাকে সাথে করে সাহানা আমার কাছে থেকে বিদায় নেবার জন্য ঘরে চলে আসে। আমি লেপের নিচে শুয়ে আছি। শরীর কাঁপছে। সাহানা আমার কপালে হাত রাখে। ও কেঁদে ফেলে। কান্না কন্ঠে বলে — তোমার এত জ্বর ! বুকে অনেক ব্যথা বুঝি। অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমার। তাই না! কে তোমায় কপালে জলপট্টি দেবে? আমি থাকলে আমি দিয়ে দিতাম। সাহানা মাকে ডেকে বলে –মামী আপনি সাঈদ ভাইয়ের মাথায় একটু পানি দিয়েন।
সাহানা আমার হাত ধরে বলে — আমি চলে যাচ্ছি সাঈদ ভাই। তুমি আমাকে আশীর্বাদ করে দেবে না?
আমি বিছানার উপর উঠে বসি। সাহানাকে বলি — ‘আমার ক্রাচ দুটো একটু এগিয়ে দে।’ সাহানা ক্রাচ আমার হাতে তুলে দেয়। ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াই। সাহানা আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। আমি ওকে বলি — এসব সালাম করিস না। আমি তোর জন্য এমনিতেই প্রাণ ভরে অনেক দোয়া করব।
সাহানা কাঁদছে। ওকে বলি — আমাকে ধরে একটু জানালার কাছে পর্যন্ত নিয়ে যাবি? ওখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকব। সাহানা আমাকে জানালা কাছে পর্যন্ত নিয়ে যায়।
সাহানা রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়। উঠোন দিয়ে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসে। বর-কনের গাড়িটি একসময় ছেড়ে চলে যায়। আমি জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আলো আঁধারের ভিতর ওদের চলে যাওয়া দেখলাম।
আকাশে ত্রয়োদশী চাঁদ উঠেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আচমকা স্রোতের মতো জ্যোৎস্না ধারা এসে আমার চোখ, মুখ, ললাট ধূয়ে দেয়। কোথাও আর একবিন্দু অশ্রুজল রইল না। ‘মুহূর্তের মধ্যে একটি সত্য বুঝতে পারি — অকূলে কেবল জেগে রয়, ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি আমার এ হৃদয়’।
রোল নং ১৭ দোলা মিত্র (গল্প)
ফ্লাপ পেজ —
‘রোল নং ১৭ দোলা মিত্র’ কোয়েল তালুকদারের চতুর্থ গল্প গ্রন্থ। কোয়েল গল্প বলার মানুষ। কোয়েল গল্প লেখার মামুষ। সে দুশতাধিক ছোটগল্পের রচয়িতা। তার রচিত গল্পগুলির মধ্যে আছে মানবজীবনের ছোট বড়ো দুঃখ ব্যথা বেদনার কথা, আছে প্রকৃতির মধ্যে বিচরণশীল মানুষের অন্তর্গত পরিচয়ের কথা। কল্পনা ও সৌন্দর্যের অনুভূতিতে রহস্যময় জগতের কথাও আছে। এই গ্রন্থে ‘সন্ধ্যার মেঘমল্লার’ গল্পে এমনই শ্বাশত বাংলার চিরায়ত প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। গল্পে গত শতাব্দীর ত্রিশ দশকের বাংলা ও পল্লী সমাজ জীবনের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। গল্পটি পড়লে মনে হয় যেন বিভূতিভূষণ পড়ছি।
একটু উদ্ধৃত করছি — ”তারপর জীবনে কত কিছু পেলাম। কত ডিগ্রি নিলাম। কত বড়ো কর্তাব্যক্তি হলাম। কত বড়ো ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলাম। কত শিক্ষিত সে।
কত দেশ ঘুরেছি। কত মানুষ দেখেছি। কত মৌন নদী। কত পর্বতের গাত্রে দেখেছি কত লতাগুল্ম, পাহাড়ি ফুল। কত পূর্ণিমা রাত্রি উপভোগ করেছি।
সবকিছুর ভিতর একজন অনাদৃত, একজন উপেক্ষিত, একজন দলিত বিধবা মেয়ের মুখ মনে পড়েছে। কত রাশি রাশি আনন্দের মাঝে, সেই কবেকার কতদূরের এক পল্লীবালা অপার্থিব অশ্রু ঝরিয়ে গেছে আমার জীবনের সকল আনন্দ বেদনার উপর। এখনো কী সন্ধ্যার মেঘমল্লারে সেই অনাদরের সন্ধ্যামণি ফুলটি অশ্রু জলে ভিজে?”
এই বাংলার অকিঞ্চিৎকর গাছপালা, ফলমূল, পশু পাখি, নদী বিধৌত পলিমাটি ও পথের উপরের ধূলোর উপকরণ দিয়ে আপন চৈতন্যের অলৌকিক শক্তি মাধুর্য মিশিয়ে কোয়েল গল্প লিখে গেছে জীবন শিল্পীর মতো। সৃষ্টি করেছেন তার নিজস্ব সাহিত্যলোক। প্রেয়সী নারীর প্রেম প্রাকৃতিক পুষ্প-পত্রের মতোই সহজ ও স্বয়ংপুষ্ট। জীবন জটিলতায় ভারাক্রান্ত এক আনমনা লেখক সে। স্বপ্নলোকের ভারহীন স্বাদ আর অধরা সুরভিতে সমগ্র চেতনাকে অপূর্ব শিল্পশৈলীতে এঁকে গেছেন তার প্রতিটি গল্পে। কোয়েল যেন বাংলা ছোটগল্পের উজ্জ্বল শিল্পদূত।
আমাদের এই যানজটের শহরে যখন গাড়ির কর্কশ হর্ণ বাজে, শব্দ দূষণে অতিষ্ঠ হয় মানুষ, তখন আপনি ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়তে পারেন কোয়েলের গল্প। দেখতে পাবেন সেখানে — পদ্মা যমুনার কলকলিত ছলাৎছল জল, নীল আকাশ, উদাস চরাচর, মৌন বটবৃক্ষ। শুনতে পাবেন ভাটিয়ালী গান, ভোরের পাখিদের কিচিরমিচির। আর গন্ধে আকুল হবেন ঘাটফুল ও সোনাল ফুলের সুবাসে। বাংলার মাঠ, নদী, নিরালা বন প্রান্তরের সুমুখ জ্যোৎস্না রাত্রির যে মায়ারূপ কোয়েল অঙ্কিত করেছে তা আসলেই বিস্ময়কর!
কোয়েলের লেখা গল্প পাহাড়, নদী, অরণ্যের নির্জনতায় দিকচক্রবালে দীর্ঘ নীল রেখার মতো স্বপ্ন আনে মনে। প্রকৃতি ও মানুষ যেন একই গ্রন্থিতে সৃষ্টি। তার সব গল্পের কথার মালা গাঁথা- একই সুতোয় বাঁধা যেন। সাধারণভাবে তাঁর ভাষা বহুলাংশে কবিতাধর্মী বা কাব্যিক। কোয়েলের লেখায় কখনও অতি রোমান্টিক, কখনও আবার বিরহ বিষণ্ণতার ধূসরতা লক্ষণীয়। তার গল্পে বেদনার্ত প্রেমের রূপ পাওয়া যায়। তাই তিনি কল্যাণ কামনায় নারীকে সর্বোচ্চভাবে সম্মান দেখিয়েছে।
কোয়েল তালুকদারের ছোটগল্প পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে। ওর লেখা পড়ার পর পাঠক চলে যায় এক স্বপ্নীল জগতে। আর এই কারণেই প্রকৃতিপ্রেমী এই লেখক বাংলা কথাসাহিত্যে একটি আলাদা স্থান করে নেবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
— আফজালুল বাসার
সমাজচিন্তক ও প্রাবন্ধিক
২০ ডিসেম্বর, ২০২১, ঢাকা।
.
উৎসর্গ —
আমার দুই কন্যা
আমার দুই বিন্দু নয়নের জল
হৃদি ও ঐশ্বর্যময়ী
.
১. ইডিয়ট
একদিন অফিসের ঠিকানায় একটি চিঠি পাই। খামের উপর হাতের লেখা দেখে চিনতে পারিনি — চিঠিটি কে পাঠিয়েছে। খাম খুলে চিঠিটা পড়তে থাকি ।
কল্যাণীয়ষু রঞ্জন,
জানিনা তুমি কেমন আছো? অনেক কষ্ট করে তোমার ঠিকানা আমি যোগাড় করে এই পত্রখানা লিখছি। অনিশ্চিত মনে হচ্ছে, এই ঠিকানায় তুমি চিঠি পাবে কিনা? তবুও লিখলাম।
কতগুলো বছর চলে গেছে। তোমার সাথে আমার দেখা নেই। হিসাব করে দেখলাম পঁয়ত্রিশ বছর। এই পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তোমাকে দেখি না।
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ঠিকানা দিলাম। সময় করে যদি একবার আসতে খুব খুশি হতাম। ভালো থেকো।
ইতি — নীলোৎসী।
নীলোৎসী ছিল আমার সহপাঠী। ওর পুরো নাম কাজী নাদিরা বেগম। ক্লাসের সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে ছিল সে। তুলনামূলক ভাষা সাহিত্যের ছাত্রী ছিল। ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইত। আবৃত্তি, বিতর্ক, নাচও করত। ক্লাসের এক ডজন ছেলের মতো আমিও তার এক তরফা প্রেমিক ছিলাম।
আমিও আবৃত্তি করতাম, বিতর্কে অংশ নিতাম , সৌখিনভাবে নাটকেও অভিনয় করতাম। আমাকে তাই নীলোৎসী একটু পাত্তা দিত। অন্য ছেলেদের চেয়ে আমার সাথে সে বেশিই মিশত। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোনো দিন সাহস করে নীলোৎসীকে বলিনি — ”তোমাকে আমার ভালো লাগে”। আর — ”তোমাকে আমি ভালোবাসি” এই কথা বলা তো অনেক দূরের আকাশের চাঁদ ছোঁয়ার মতো ছিল । তাই ঐ ছায়াপথে কখনও হাঁটতাম না। ‘
নীলোৎসী ছিল অভিজাত পরিবারের মেয়ে। ঐ সময়ে সে গাড়িতে করে ইউনিভার্সিটিতে আসা যাওয়া করত। প্রতিদিন এক একটা নতুন জামা পরত। বেশির ভাগ সময় ব্যান্ড দিয়ে চুল বেঁধে খোলা চুলগুলো পিছনে ঝুলিয়ে রাখত। কোরিডোর দিয়ে যখন হীল জুতা পরে খটখট করে হাঁটত তখন চুলগুলো হাওয়ায় উড়ত।
সে যাই হোক — আমিই ওর ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। ক্লাস অবসরে আমার সাথেই ও কথা বলত। ক্যান্টিনে যেয়ে মাঝে মাঝে সিঙারা চা খেতাম। এই পর্যন্তই।
একদিন সেমিনার রুমের সামনে কোরিডোরে দাঁড়িয়ে নীলোৎসীকে বলেছিলাম — “তুমি নীল শাড়ি, কপালে নীল টিপ, নীলের সাথে মিলিয়ে চুড়ি, মালা, চুলের ক্লীপ পরে একদিন ক্লাসে আসবে। তোমাকে আশ্চর্য রকম রূপবতী লাগবে। এই রূপে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।” নীলোৎসী হঠাৎ এই কথা শুনে বিস্ময় চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলেছিল — ‘আচ্ছা, নীল শাড়ি, নীল টিপ পরে আসব একদিন।’
নীলোৎসী নীল শাড়ি পরে আর ক্লাসে আসেনি। কারণ, এর পরপরই বাবা মার পছন্দ মতো একটি অপরিচিত ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যায়। নীলোৎসী ছিল বুদ্ধিমতি মেয়ে। সে ভুল করে নাই। ওর স্বামী ছিল বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাদের পুরো পরিবার ছিল প্রতিষ্ঠিত ও বিত্তশালী। বিয়ের পর নীলোৎসী আর ইউনিভার্সিটিতে আসেনি। দেখাও হয়নি আর কোনদিন। ওর সাথে কোনো যোগাযোগও হয়নি আর।
নীলোৎসীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর খুব মনমরা হয়ে থাকতাম। কোনো কিছু ভালো লাগত না। ক্লাসে পড়ায় মন বসত না। সহপাঠীদের সাথে ভালোভাবে কথা বলতাম না। নিজের কাছে মনে হতো — “আমি মনে হয় নীলোৎসীকে ভুল করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।” আমার এই মনমরা ও উদাস অবস্থা দেখে সহপাঠীরা পরিহাস করে বলত — “তুই একটা ইডিয়ট। কোনো একটা মেয়ের একটু কথা বলাকে, একটু মেলামেশাকে, একটু বন্ধুত্বকে মনে করেছিস প্রেম। তুই নির্বোধ ছাড়া আর কিছু না ! ”
আমারও তাই মনে হয়েছে — আমি সত্যি একটা ইডিয়ট। একটা মায়া লাগা ঘোর, একটা মিছে স্বপ্ন দেখা, একটা অবাস্তব চাওয়া — আর না পাওয়ার বেদনায় নিজেকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছিলাম। ভুলে যেতে চাইলাম সব মিছে মায়া, মিছে স্বপ্ন। ভুলেও গেলাম। আমি যে একটা ইডিয়ট ছিলাম, এই ভেবে নিজেকে মনে মনে তিরস্কারও করলাম।
তারপর চলে গেছে পঁয়ত্রিশ বছর। নীলোৎসী কোথায় থাকে, কেমন আছে, কী করে কিছুই খোঁজ খবর জানতাম না।
আজ এত বছর পর সেই বিস্মৃত হয়ে যাওয়া নিলোৎসীর চিঠি পেলাম। কেমন যেন লাগছে আমার। একবার মনে হলো — কেন যাব? যেতে বলল দেখেই যেতে হবে? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, নীলোৎসী আমার কিছু না হোক, সে তো আমার সহপাঠী ছিল। এই একটি দায় তো আমার চিরকালের হয়ে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, নীলোৎসীকে দেখতে যাব। ওকে তাই একটা চিঠি লিখলাম —
কল্যাণীয়াসু নীলোৎসী,
আমি আগামী ২৭ আশ্বিন, বৃহস্পতিবার তোমার ওখানে আসছি। আমি এখান থেকে ভোরে রওনা হবো। রাস্তায় কোনো অসুবিধা না হলে তোমার ওখানে বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব। আমাকে আবার ঐদিন বিকালেই চলে আসতে হবে।
আমি যে তোমার ওখানে যাচ্ছি, এই কথা আমার স্ত্রীকে বলছি না। তুমি আমার কেউ না, তুমি আমার কিছু ছিলে না, তারপরও তোমার কাছে যাচ্ছি একথা শুনলে সে মনে কষ্ট পাবে। একটু মিথ্যা না হয় বললাম ওকে। বলব, একটা অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি, আজই ফিরে আসব।
ভালো থেকো তুমি।
ইতি — রঞ্জন।
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে একটি পাবলিক বাসে উঠে টাংগাইলের মধুপুর রওনা হই । মধুপুর গড় এলাকাতে একটি বাংলো বাড়িতে নীলোৎসী থাকে। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম — সেই কতকাল পড়ে নীলোৎসীকে দেখতে পাব। নীলোৎসী চিরকাল মানুষের কাছে থেকে ওর রূপের প্রসংশা কুড়িয়েছে। একটু ভয় লাগছিল — এক সময়ের এই মানস প্রতিমাটি তো বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যায়নি? মুখে কপোলে পড়েনি বলিরেখা? আবার ভাবলাম, দেবীরা কখনও বুড়ী হয় না, ওরা চিরকাল চির যৌবনা থাকে ।
একসময় মধুপুর যেয়ে বাসটি পৌঁছে। আমি বাস থেকে নেমে একটি চার দোকানে চা খেতে খেতে নিলোৎসীর বাড়িতে ষাওয়ার পথটি দোকানদারের কাছে থেকে জেনে নেই। দোকানদার বলছিল, আপনি একটি টমটম নিয়ে যেতে পারেন, কিংবা রিকশায়। আমি একটি টমটম নিয়েই নিলোৎসীর বাড়ির দিকে যেতে থাকি ।
এলাকাটি সম্পূর্ণ গড় এলাকা। আমি যে রাস্তা দিয়ে টনটমে করে যাচ্ছিলাম, তার একপাশে বিস্তীর্ণ শাল, গজারি, গামারী, মেহগনি, জারুল গাছের বন। বনের ফাঁকেে ফাঁকে ছোট বড়ো মাটির টিলা আছে, দেখতে অনেকটা মালভূমির মতো লাগছিল। রাস্তার আরেক পাশে সমতল ফসলের ক্ষেত।
কিছুদূর যাওয়ার পরই একটি একতলা বাংলো বাড়ি দেখতে পাই। বাড়িটার একদম কাছে গেলে গেটে একটি নাম ফলক দেখা গেল। ফলকে লেখা আছে — ‘নীলোৎসী’। বুঝতে পারলাম এটাই নীলোৎসীর বাড়ি। আমি টমটম থেকে নেমে পড়ি।
গেটের কাছে একজন দারোয়ানকে দেখতে পাই। এই বাড়ি যে নীলোৎসীর বাড়ি এটা জেনেও দাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করি, এটা কি মিসেস নাদিরা বেগমের বাড়ি?
— জ্বী। আপনার নাম কী? কোথা থেকে এসেছেন?
— আমার নাম রঞ্জন রহমান। ঢাকা থেকে এসেছি।
— ভিতরে আসুন। ম্যাডাম আপনার কথা আমাকে বলে রেখেছেন। বলেছে, ঢাকা থেকে আমার একজন মেহমান আসবে, তার নাম রঞ্জন রহমান।
দাড়োয়ান সোজা আমাকে বাংলোর ভিতরে নিয়ে যায়। ভিতর থেকে একজন পরিচারিকা বের হয়। দারোয়ান পরিচারিকাকে বলে, ইনি ম্যাডামের মেহমান। ড্রইংরুমে ওনাকে বসতে দাও। এবং ম্যাডামকে যেয়ে বলো — উনি চলে এসেছেন।
পরিচারিকা আমাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভিতরে চলে যায়। একটু পর ফিরে এসে বলে — ম্যাডাম আপনাকে ভিতরে যেতে বলেছে। উনি ওপাশে বারান্দায় বসে আছেন।
ভিতরে যেতে একটু দ্বিধাই করছিলাম। একটু শঙ্কাও লাগছিল , কোনো বিপদে পড়ব না তো ! এ কী সত্যি নীলোৎসী? নাকি অন্য কেউ? তবুও দুরু দুরু পায়ে ভিতরে বারান্দার দিকে চলে যাই। বারান্দাটির চারিদিকে গ্রিল দিয়ে ঘেরা। বাইরে ওপাশে শাল গজারির নিবিড় বন। আসন্ন দুপুরের তপ্ত সূর্যের আলো ঝরে পড়ছে বনের পাতার ফাঁক দিয়ে। কিচিরমিচির করছে বনের পাখিরা। দেখি, একটি হুইল চেয়ারে একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আমার আসার পথপানে করে বসে আছে। মুখখানি শুকনো এবং বিষণ্ণ সুন্দর। আমি চিনতে পারলাম, এই নীলোৎসী। আমাকে দেখে সে স্মিত হেসে বলে — ‘তুমি এসেছ রঞ্জন!’ পাশে একটা চেয়ার আগে থেকেই রাখা ছিল। আমাকে সেই চেয়ারটা দেখিয়ে বলল — তুমি এখানেই বসো।
নীলোৎসীর চেহারা আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমার চোখে আঁটকে ছিল। একটি প্রস্ফুটিত ফুলের মতো চেহারা ছিল ওর। আজ ওকে দেখে আমার মনটা হুহু করে উঠল। এই সেই নীলোৎসী যে কী না একসময় শত তরুনের হৃদয় কাঁপাত ! সেই নীলোৎসী এত রোগক্লিষ্ট, এত মলিন হয়ে গেছে।
এত ভগ্ন শরীর নিয়েও সে আজ হালকা নীল রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি পরে আছে। মুখে কোনো প্রসাধন করেনি। হাতে নীল পাথর বসানো চুড়ি পরেছে কেবল। আমার মনে পড়ে গেল– সেই কবে একদিন ইউনিভার্সিটির কোরিডোরে দাঁড়িয়ে ওকে বলেছিলাম —- তুমি একদিন নীল শাড়ি পরে ক্লাসে আসবে। নীলোৎসী বলেছিল — “আসব পরে একদিন।” কিন্তু নীলোৎসী আর নীল শাড়ি পরে আসতে পারেনি।
আজ কী আমাকে দেওয়া ওর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল?
খুব বেদনা ভরে নীলোৎসী আমাকে বলছিল —
তুমি কেমন আছো রঞ্জন? বললাম — আমি ভালো আছি।
— মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন?
— তোমাকে দেখার পরই হয়ত এমনটা হয়েছে আমার। তোমাকে দেখে কেমন যেন হয়ে গেছি আমি। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। তোমার কী হয়েছে নীলোৎসী?
— লিভার সিরোসিস। লিভার গলে পঁচে গেছে। দুইবার স্ট্রোকও করেছে। তারপর থেকে প্যারালাইজডৃ হয়ে গেছি। হাসপাতালে ছিলাম অনেক দিন। ডাক্তার ঔষধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে — বাড়িতেই বিশ্রামে থাকেন। মাঝে মাঝে টাংগাইল থেকে ডাক্তার ডেকে এনে ফলোআপ করিয়ে নেই।
— তোমার স্বামী ও ছেলেমেয়ে কোথায়? কাইকে যে দেখছি না।
— স্বামী গত বছর মারা গেছেন। এক ছেলে এক মেয়ে দুজনেই বিদেশে থাকে। মেয়ে কানাডাতে আর ছেলে আমেরিকায়। দেশে ওরা কেউই আসে না। মেয়েটা একটু খোঁজ খবর রাখে। ছেলেটি একদম না। মনে হয় ওরা ওদের মন থেকে শিকড় উপড়ে ফেলেছে।
নীলোৎসী বলছিল — থাক ঐসব কথা। তোমার বউ কেমন আছে?
— ভালো আছে।
— খুব সুন্দরীী মেয়ে বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই।
— হুম। তোমার মতোই দেখতে।
— কী নাম ওর?
— মায়া।
— মায়াবতী নিশ্চয়ই?
— হুম।
— ছেলেমেয়ে কজন?
— এক ছেলে দুই মেয়ে।
— ছেলেটা দেখতে নিশ্চয়ই তোমার মতো হয়েছে?
— হুম।
— মেয়ে দুটো কার মতো?
— মায়ের মতো।
আমি নীলোৎসীকে বললাম, তা এই বন নির্জনে কেন আছ? শহর ছেড়ে এত দূরে?
— আমার স্বামী বন বিভাগেই চাকুরি করত। দেশের কত বনারণ্যে ঘুরেছি, থেকেছি। এখানে এই মধুপুর রেঞ্জেও ওর পোস্টিং ছিল। ও এই জায়গাটা খুব পছন্দ করেছিল। পেনশনের টাকা থেকে এই জায়গাটা কিনে এই কাঠের বাংলাটা তৈরি করেছিল। বলেছিল — আমাদের শেষ জীবনটা এই বনকুঞ্জেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা আর কাটাতে পারল কই? আমাকে একা করে ফেলে রেখে বিধাতা ওকে আমার কাছে থেকে নিয়ে গেল। এখন তো আমি নিজেই মৃত্যুর প্রহর গুনছি।
আমি বললাম — জায়গাটা খুবই সুন্দর। একপাশে ঘন অরণ্য, আরেকপাশে ফসলের মাঠ। ছোট্ট সুন্দর একটি পুকুরও দেখলাম । পুকুর ভর্তি নীলপদ্ম ভরে আছে । সম্মুখে বাগান দেখলাম, রঙ্গন,জবা, চেরী , গোলাপ, বেলী ফুল সব ফুটে আছে।
নীলোৎসী বলছিল — পত্রে তুমি লিখেছ, আজই বিকেলে তুমি চলে যাবে। যদি তুমি থাকতে তাহলে বুঝতে পারতে এখানে কী সুন্দর রাত্রি নামে। সন্ধ্যার পরপরই আস্তে আস্তে পাখিদের কলকাকলি থেমে যায়। তারপর রাত নামতে থাকে। শাল গজারি মেহগনি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যায়। দূরে অজস্র নক্ষত্রবীথি। ঝোপে ঝাড়ে জোনাক জ্বলে। জ্যোৎসায় ভাসে বন প্রান্তর। ফুলের সুবাসে ভরে থাকে এই বারান্দা, চাঁদের আলোর রশনি এসে আমার চোখে মুখে লাগে। আমার কী যে ভালো লাগে তখন। আমি কান পেতে থাকি। কার যেন দূরাগত পদধ্বনি শুনতে পাই। মনে হয় কেউ যেন হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসছে। আসলে কেউ আসে না। সবই ভ্রম!
নীলোৎসী বলছিল — কথায় কথায় দুপুর গড়িয়ে গেল। চলো– চারটা ডাল ভাত খেয়ে নেবে।
ও ওর পরিচারিকাকে ডাকতে যাচ্ছিল। আমি বললাম, কী জন্য ডাকছ? নীলোৎসী বলছিল, মেয়েটা এসে আমাাকে একটু ডাইনিং পর্যন্ত নিয়ে যাক।
আমি মেয়েটিকে ডাকতে দিলাম না। আমি নিজেই হুইল চেয়ারের পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। এবং চেয়ারটা ধরে ঠেলে নীলোৎসীকে ডাইনিং রুমে নিয়ে আসি। নীলোৎসী হুইল চেয়ারে বসেই আমার সাথে খেতে বসে। কোনো রিচ খাবার নেই। সাদা ভাত, ডাল, ডাটা দিয়ে টেংরা মাছের তরকারি, উস্তা ভাজা, টাকি মাছ ভর্তা আর কচুর লতি ও কাঁঠালের বিঁচি দিয়ে পুঁটি মাছের তরকারি। আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, ও যখন আমার বন্ধু ছিল, তখন আলাপ প্রসঙ্গে নীলোৎসীকে আমার এই পছন্দের খাবারগুলোর কথা প্রায়ই বলতাম। ও কী সেই কথা আজ পর্যন্ত মনে রেখেছে তাহলে?
বিকাল হয়ে যায়। আমি নীলোৎসীকে বলি — আমার চলে যাবার সময় হয়ে গেছে। ও বলছিল — হ্যাঁ, তোমাকে থাকতে বলব না। তোমার মায়াবতীকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। তোমার প্রতি আমার অধিকার সেই কবেই হারিয়েছি। এখন শুধু মিছে মায়াটুুকু ছাড়া কিছু নেই। কয়দিন ধরে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল। সেই কত বছর চলে গেছে। কত হাহাকার করেছি তোমাকে একটু দেখবার জন্য। এখন মনে হচ্ছে– মরেও শান্তি পাব। পরপারে তুমিও যখন যাবে তখন তোমাকে ঠিকই চিনে নিতে পারব।
আমি নীলোৎসীর অলক্ষ্যে আমার চশমার ফ্রেমের নীচে আঙুল দিয়ে চোখের কোণটা মুছে নেই। ওকে বললাম — আসি এখন।
নীলোৎসী বলছিল– আমার হুইল চেয়ারটা একটু দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাবে? আমি চেয়ারটি ঠেলে ওকে দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাই। নীলোৎসী বলছিল -”আমার হাতটি একটু ধরে দাঁড় করাবে? আমি দরজাটা ধরে দাঁড়াব। দরজায় দাড়িঁয়ে তোমার চলে যাওয়া দেখব।” আমি ওর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দেই। ও কষ্ট করে দরজাটা ধরে থাকে। দেখলাম, ওর হাত পা কাঁপছে ।
নীলোৎসীর হাতটা ভীষণ গরম লাগল, কপাল ছুঁয়ে দেখি — সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমি ওকে বললাম — তোমার তো অনেক জ্বর। এতক্ষণ তুমি কোন্ শক্তিতে বসে আমার সাথে কথা বললে?
নীলোৎসী বলছিল — ও কিছু না। এই রকম জ্বর প্রায়ই হয়। ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যায়। আর, তোমার হাতটা খুব শীতল ছিল — তপ্ত জ্বর তাতেই চলে যাবে।
আমি নীলোৎসীর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। আসতে আসতে মনে হলো, পিছনে তাকিয়ে ওকে আর একবার দেখে নেই । বিদায় নিয়ে কারোর কাছে থেকে চলে আসার সময় নাকি পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। কিন্তু মন মানল না। আমি পিছনে মুখ ঘুরিয়ে নীলোৎসীকে আবার দেখলাম। ও দরজা ধরে আমার দিকে মায়া ভরে তাকিয়ে আছে।
ওর চোখে তখন কী জল ছিল? দূর হতে বোঝা গেল না।
২. মধুবালা
মাধুর যৌবনে এখন ভাটার টান। এই টানে ভেসে গেছে তার উতল রূপ যৌবন। যখন তার যৌবনে জোয়ার ছিল তখন চারদিক থেকে নৌকা এসে নোঙর করত দৌলতদিয়া ঘাটে। গোয়ালন্দ ঘাট রেল স্টেশন থেকেও আসত মধুকররা। এখন কারোরই তেমন আনাগোনা নেই। এখন আর কেউ আসে না। ভাটার জলে সব মৌ পাখিরা ভেসে গেছে।
এই মৌপল্লীতে মাধুর পুরো নাম মধুবালা। যমুনা পদ্মার সঙ্গম স্থলের স্রোতের ঘূর্ণির মতো তার দেহবল্লরীতে একসময় ছিল খরস্রোতধারা। মধুওয়ালি নিরুদ্বিগ্ন চিত্ত — এ যে যক্ষপ্রিয়া! আয়ত চোখ পথের দিকে চেয়ে থাকত, ঠোঁটে তার ক্ষীণ সুস্মিতরেখা। সে যেন “দেহ দাহন ক’র না দহন দাহে, ভাসায়ো না তাহা যমুনা প্রবাহে” কিংবা “প্রাণ যদি দেহ ছাড়া, না দ’হ বহ্নিতে মোরে না ভাসায়ো যমুনা সলিলে”।
কে এই মধুবালা ?
চিত্রা নদীর পারে ছোট্ট একটি ছায়া ঢাকা গ্রাম রূপাদিয়া। যেখানে হিজল বনে দোয়েল শীশ দেয় মিষ্টি রোদ্দুর ভোরে। যেখানে মৌমাছি চাক বেধে থাকে আম গাছের ডালে। বসন্ত বাতাসে বাঁশঝাড় থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। এই গ্রামেরই এক গরীব দিন মজুর নাম মতি মিয়া। এই মতি মিয়ার মেয়ে হচ্ছে মধুবালা। বাবা-মা ওর নাম রেখেছিল — সাহানা।
হলদে পাখির মতো সাহানা নামের এই বালিকাটি ঘুরত ফিরত বেড়াত চিত্রা নদীর পারে। সে সবারই ফয়ফরমাস করত। সবাই ওকে ভালোবাসত। বেশ সুন্দরী ছিল সে। কিন্তু তার রূপ লাবণ্য ঢাকা পড়ে থাকত মলিন কাপড়ে। পরিপাটি করে কখনো চুল আঁচড়াত না। বেণী বাঁধত না। পায়ে আলতা পরত না। হাতে পরত না চুড়ি।
সাহানা তৃতীয় ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল। তাদেরই গায়ের এক মুুরুব্বী জাতীয় লোক এসে একদিন মতি মিয়াকে বলে — মতি, তোমার মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দাও। ভালো একটা পাত্র আছে।’
— ভালো ছেলে পাইলে বিয়া দিয়া দিমু।
— পাত্র এই গায়েরই। শুক্কুর আলীর ছেলে সাহেদ আলী।
তুমি তো জানোই শুক্কুর আলীর মোটামুটি জমিজিরাত আছে।
— কিন্তু সাহেদ যে বাদাইমা, কিছু কইরা খায় না।
— ওহ্ কিছু হবে না। বিয়ার পর সব ঠিক হইয়া যাইব।
সাহানা তখন ছিল নিতান্তই চোদ্দ পনেরো বছরের একটি বালিকা। অগ্রহায়ণের এক চন্দ্ররাত্তির দিনে তার বিয়ে হয়ে যায় সাহেদ আলীর সাথে। সাহেদ আলী একটি বাউন্ডেলেও। নিজে গান না গাইলেও সে হাটে বাজারে বিভিন্ন গানের আসরে গান শুনে বেড়ায়। বন্ধুদের সাথে শহরে যেয়ে সিনেমা দেখে। রাজ্জাক ছিল তার প্রিয় নায়ক। রাজ্জাকের মতো করে চুল আঁচড়াত। সে একটু উদাসীন হলেও সাহানাকে সে খুব ভালোবাসত। এক বছরের মাথায় তাদের একটি ছেলেও হয়। সাহেদ তার পুত্রের নাম রাখে আব্দুর রাজ্জাক।
এক ভরা বর্ষার দিনে ফরিদপুর থেকে একটি যাত্রাপালার দল এসে ভেড়ে তাদের রূপাদিয়া বাজারের চিত্রা নদীর ঘাটে। এই যাত্রাপালা এখানে এক সপ্তাহ থাকে। সাহেদ প্রতি রাতে যাত্রা দেখতে যেত। সাহানা এই জন্য খুব মন খারাপ করে থাকত। একদিন রাতে ছিল ‘আলোমতি’র পালা। সাহেদ সাহানাকে বলে — ‘বউ, আজ আলোমতি হইবে।’
— আমারে সাথে নিবা? আমি দেখমু। আমি আলো হব আর তুমি হবে মতি।’
— ‘আইচ্ছা, তবে আমার সাথে চলো।’
সে রাতে তারা দুজনেই যাত্রা দেখতে গিয়েছিল। যাত্রা দলের ম্যানেজার তাদের দুজনকেই দেখতে পায়। যাত্রা পালা শেষ হলে, ম্যানেজার সাহেদকে বলে — তোমরা ইচ্ছে করলে আমাদের যাত্রা দলে যোগদান করতে পারো।’
যেদিন সন্ধ্যায় যাত্রা দলটি রূপাদিয়া বাজার ত্যাগ করে চলে যায়, সেদিন গোপনে সাহেদ আলী বাড়ির কাউকে না বলে সাহানাকে নিয়ে নৌকায় গিয়ে ওঠে।
নৌকায় ওঠার আগে বাড়িতে তাদের যে কথোপকথন হয়েছিল তা হলো —
— বউ, আমি ষাইতেছি।
— তুমি যাইও না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকিতে পারিব না।
— তাহলে তুমিও আমার সাথে চলো।
— রাজ্জাকের কী হইবে?
— বাজান আর মায়ে দেইখব।
— আমিও যামু তোমার লগে।
— আইচ্ছা, চলো।
যাত্রাদলের নৌকাটি ছিল বজরার মতো। তখন ছিল সন্ধ্যা রাত্রি। বাইরে ভরা বর্ষার মতো জোছনার প্লাবন। স্রোতের অনুকূলে নৌকাটি চলতে থাকে। ভিতরে দুই তিনটি হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে। যন্ত্রী দল খুঞ্জরী ও হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। যাত্রাদলের এক গায়েন গান ধরেছে —
‘আর কতকাল ভাসবো আমি
দুঃখের সারী গাইয়া
জনম গেল ঘাটে ঘাটে আমার
জনম গেল ঘাটে ঘাটে
ভাঙা তরী বাইয়া রে আমার
ভাঙ্গা তরী বাইয়া।।’
সাহানা বজরার এক কোণে বসে গানটি শুনতে থাকে। ওর মাথায় লম্বা ঘোমটা। যাত্রাদলের অন্য মেয়েরা মিটিমিটি করে হাসতে থাকে। কেউ বলে — ‘এ আমাদের নতুন নটী গো!’
কেউ বলে — ‘এ তো হিরোইন গো! এ যে মধুবালা।’
এই সাহানা, এই মধুবালা চিত্রা নদীর উপর দিয়ে নৌকায় ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে যায়। তার বালিকাবেলার রূপাদিয়া গ্রাম অনেক পিছনে পড়ে থাকে। পিছনে পড়ে থাকে তার শিশু পুত্র রাজ্জাক। কত ঘাটে, কত বাজারে, কত হাটে, কত মেলায় যে নৌকা ভিড়ল। তার শেষ নেই।
যাত্রা দলে যোগ দেওয়ার কয়েকদিন পরে খুব রহস্যজনক ভাবে গোয়ালন্দের কাছে একরাতে পদ্মা নদীতে পড়ে যেয়ে সাহেদ আলীর সলীল সমাধি হয়। পদ্মার খরস্রোতে তার লাশ কোথায় ভেসে যায়, কেউ তা জানে না।
সাহানা যাত্রা দলে বছরখানেক ম্যানেজারের রক্ষিতা হয়ে থাকে। সময়ে অসময়ে সে তাকে ভোগ করে। সাহানাকে দিয়ে দেহবৃত্তিও করানো হয়। তারপর একসময় খুব চরা দামে তাকে বিক্রি করে দেয় দৌলতদিয়া পতিতা পল্লীতে। এখানেও তার নাম হয় মধুবালা। পল্লীর সবাই ডাকে মাধু বলে।
মাধু আর কখনোই ফিরে যায়নি চিত্রা নদীর পারে তার রূপাদিয়া গ্রামে। কত জলসায় উদ্দাম ঘুঙুরের শব্দ বেজেছে। কত মধুময় গানে সে ঠোঁট মিলিয়েছে। কত পুরুষ কত ধ্রুপদী রাত কাটিয়েছে। কত উল্লাস, কত আনন্দ করেুছে তার দেহ নিয়ে। সুখের সেই আনন্দ ক্ষণে মনে পড়ত তার শিশু সন্তানের কথা। প্রিয়তম স্বামীর কথা। ছায়া ঢাকা, মায়া ঢাকা রূপাদিয়া গায়ের কথা।
খদ্দেররা যখন তার শরীর ভোগ করত, তখন সে নীচে শুয়ে বিষণ্ণ চোখে অনেক দূরে চেয়ে দেখত তার কৈশোর। দেখত খোকসা গাছে টোনাটুনিদের বাসা। পিয়ারা গাছে দেখত দুটো ধানশালিক বসে ঠোকাঠুকি করছে। দেখতে পেত সে হাঁস মুরগির খোয়ারের দুয়ার খুলে দিচ্ছে। ছুটাছুটি করে হাঁসগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে চিত্রা নদীর জলের দিকে।
মধুবালা এখন বিগত যৌবনা। পদ্ম নদীর ঘাটে ভিড়ানো নৌকাগুলো থেকে আগের মতো খদ্দের আর বেশি তার ঘরে আসেনা। কত দুঃখ সুখের বেদনার বছর চলে গেছে। কখন চলে গেছে পঁচিশটি বছর!
সেদিন সন্ধ্যায় মধুবালা জ্বেলেছিল তার ঘরে ধূপবাতি। ঠোঁটে লিপস্টিক মেখেছিল, মুখে গালে মেকআপ করেছিল পুরু করে। চোখে পরেছিল কাজল। চুল খোপা করেছিল। গাদা ফুলের মালাও বেঁধেছিল খোপায়। শরীরে মেখেছিল সুগন্ধি আতর। সর্দারনী চন্দনা এসে টিপ্পনী কেটে বলেছিল– ‘কী লো, তোকে দেখি আজ এক্কেবারে মধুবালার মতো লাগছে! তা কোন্ নাগর আসবে আজ তোর ঘরে?’
মাধু সুচিত্রার মতো মোহনীয় হাসি হেসে বলেছিল– ‘আসবে, কেউ একজন আজ আসবে গো।’
হ্যাঁ, সে রাতে একজন নাগর এসেছিল তার ঘরে।
সকালবেলা মাধুর কোনো সারা শব্দ না পেয়ে সর্দারনী চন্দনা ওর ঘরে ঢুকে। দেখে — ফ্যানে শাড়ি বেঁধে ফাঁসিতে মধুবালা আত্মহত্যা করেছে। ঠোঁটের লিপস্টিক এবড়োখেবড়ো, চুল আলুলায়িত, খোঁপায় বাঁধা গাঁদাফুলগুলো ছিঁড়ে ছিটে গেছে। গালে এবং গলার নীচে চুম্বনের জখম চিহ্ন। তার বিছানার উপর কিছু টাকা ছড়িয়ে আছে। আর পড়ে আছে একটি ন্যাশনাল আইডি কার্ড। আইডি কার্ডটি একজন চব্বিশ পঁচিশ বছরের যুবকের। নাম —
আব্দুর রাজ্জাক, পিতা – মৃত সাহেদ আলী, মাতা — সাহানা খাতুন, গ্রাম — রূপাদিয়া, জেলা — নরাইল।
খদ্দেরের পুলিশী হয়রানী হবে ভেবে চতুর চন্দনা তার আইডি কার্ডটি লুকিয়ে ফেলে।
৩. পিছনে ফেলে আসি
একদিন বিকালে আমার এক রুমমেটের সহপাঠী কৃষ্ণচন্দ্র রায় আমাদের রুমে আসে। রুমমেটের সহপাঠী সূত্রে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সাথে আমারও বেশ বন্ধুত্ব হয়। তখন ইউনিভার্সিটি গ্রীষ্মকালীন ছুটি হয়েছে। আমি বাড়িতে আসব জেনেই এই কৃষ্ণচন্দ্রের রুমে আগমন। কৃষ্ণ বলছিল — ‘দাদা, আপনার কাছে কিছু জিনিস দিতাম, এগুলো যদি আমার এক মাসীমার কাছে পৌঁছে দিতেন আমি খুব কৃতজ্ঞ হব। আপনার বাড়ি থেকে আমার মাসিমার বাড়ি মনে হয় খুব বেশি দূরে নয়।’
আমি কৃষ্ণকে বললাম — ‘দিয়ে দাও। পৌঁছে দিব। তোমার মাসী আমারও মাসী।”
কৃষ্ণ একটি কাপড়ের ব্যাগ আমার হাতে দেয়।
দেখলাম ব্যাগের ভিতর দুটো সাদা রঙের শাড়ি কাপড়। দুটো ব্লাউজ, আর দুজোড়া চটি জুতো। কৃষ্ণ একটি সাদা টুকরো কাগজে ঠিকানা লিখে দেয়। ঠিকানা —
শ্রীমতী সারদা রাণী বৈদ্য
স্বামী — স্বর্গীয় অরুণ কুমার বৈদ্য
ক্ষীরতলা, রায়গঞ্জ, পাবনা।
চৈত্র মাসের একদিন ভোরে আমাদের বাড়ি হতে ক্ষীরতলা রওনা হই। প্রায় ছয় ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। মাঝে একটি নদীও পার হতে হবে। আমি কোনো দিন ঐ পথে যাইনি। চিনিও না ঠিক মতো। তবুও রওনা হলাম।
আমি বাগবাটী স্কুলের ছাত্র ছিলাম। তাই ব্রহ্মগাছা পর্যন্ত পথ মোটামুটি আমার চেনা ছিল। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে ধুলো পথে ব্রহ্মগাছা পর্যন্ত যেতে আমার প্রায় তিন ঘন্টা লেগে যায়। এইটুকু আসতে রোদে পুড়ে ক্লান্ত হয়ে উঠি। দুতিন জায়গায় গাছের তলায় জিরিয়েও নেই। পথে খুব পানি তেষ্টা পেয়েছিল। এক বাড়িতে যেয়ে পানি চাই। একটি বালিকা পিতলের গ্লাসে করে কুয়ো থেকে ঠান্ডা পানি দিয়ে আমার তেষ্টা মিটিয়েছিল।
যেতে যেতে একসময় সামনে একটি নদী পড়ে। নদীটির নাম সম্ভবতঃ ফুলজোর। খেয়া নৌকা দিয়ে নদী পার হই। নদী পার হয়ে এক লোককে জিজ্ঞাসা করি — ‘ক্ষীরতলা কোন পথে যাব?’
সে আমাকে ক্ষীরতলা যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। এবার মেঠো পথ। পথের দুধারে সদ্য বিজ বোনা আউশধান ও পাট ক্ষেত। একসময় ক্ষীরতলা গ্রামটিতে পৌঁছে যাই।
গ্রামটিতে এসে একটু অবাকই হই। জায়গায় জায়গায় উঁচু মাটির ঢিপি। ঢিপির পাশ দিয়ে পাকুড় আর হিজল গাছ। তারই মধ্য দিয়ে পায়ে চলা ধুলার পথ। এই পথ গিয়েছে গ্রামের বাড়িগুলোর দিকে। কোথাও বা চাষের ক্ষেত। কোথাও মিষ্টি আলুর ক্ষেত, কোথাও বা কিছুই নেই—ফাঁকা।
এক লোককে জিজ্ঞাসা করে আমি সারদা মাসীর বাড়টি চিনে নেই। মাটির দুটি ঘর। ছোনের চালা। আমি উঠোনে যেয়ে দাঁড়াই। একজন শীর্ণকায় পঞ্চাশোর্ধ মহিলা ঘর থেকে বের হয় আসে। পরনে সাদা ধুতি কাপড়। মাথায় ঘোমটা দেওয়া। গায়ের রঙ গৌরিও। হাতে শাঁখা পত্তর কিছু নেই। আমাকে দেখে মহিলা বলে — তুমি কে গো? কোথায় থেকে আসিয়াছ।
— নমস্কার। আমার নাম রঞ্জন। আমি কৃষ্ণচন্দ্রের বন্ধু। আপাততঃ কুসুমপুর থেকে আসিয়াছি। আমি কৃষ্ণের মাসিমার সাথে দেখা করব।
— আমিই কৃষ্ণের মাসিমা। তা কি জন্য বাবা?
মাসিমা আমাকে বারান্দায় একটি কাঠের টুলে বসতে দেয়। আমি কৃষ্ণের দেওয়া ব্যাগটি তাঁর হাত তুলে দিয়ে বলি– ‘এগুলো কৃষ্ণ আপনাকে দেওয়ার জন্য আমার কাছে দিয়েছে।’
আমি যখন ঐ বাড়িতে পৌঁছি, তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম, উনি কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েছে। আমাকে এই অসময়ে কী খেতে দেবে?
মাসীমা কাউকে ডেকে বলছিল, যিনি ঘরের ভিতরে আছে। ডাকছিল — ‘অর্চনা, ও অর্চনা! এদিকে আয়!’
সাদা কাপড় পরা একজন বছর একুশের মেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়।
মাসী ঐ মেয়েটিকে বলছিল — ‘এই ছেলেটিকে কিছু জলপানি খেতে দাও। রোদে পুড়ে বড়োই পেরেসান হয়ে এসেছে।’
মেয়েটি ভিতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একটি বড়ো পিতলের থালায় করে বাতাসা, নারকেল কোরা, সন্দেশ আর একটা কাঁচের গেলাসে জল নিয়ে এসে আমার সামনে রাখে।
মাসীমা বলছিল — ‘এগুলো খেয়ে নাও বাবা।’
মেয়েটি উঠানের জাম্বুরা গাছতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে চুপিচুপি দেখছিল। তখন ঝাঁঝালো চৈত্রের পরন্ত দুপুর। দূরে হিজল গাছের ডালে বসে ঘুঘু আনমনে ডেকে চলছিল।
আমি জলপানি খেয়ে মাসিমাকে বলি– ‘আমি অদ্যই চলিয়া যাইব।’
— ‘এটা কী করে হয়, তুমি বড়োই ক্লান্ত। কিছুই তেমন খাও নাই। আজ থাকো। কাল প্রত্যুষে চলিয়া যাইবে।’
আমি মাসীমার কথা ফেলতে পারলাম না।
ভাটি দুপুরে বাড়ির দাওয়ায় শীতল পাটি বিছিয়ে আমাকে খেতে দেয়। ভাতের সাথে ছিল গন্ধরাজ লেবু, নিমপাতা ভাজা, সজনে ফুলের তরকারি আর মুসুর ডাল। অর্চনাই পরিবেশন করছিল। খেতে খেতে জেনে গিয়েছিলাম — অর্চনা অকাল বিধবা। একথা জানার পর আমার মন খারাপ লাগছিল, এত অল্প বয়সে মেয়েটি বিধবা হয়ে মায়ের ঘরে পড়ে আছে।
পরন্ত বিকালে অর্চনা এসে বলছিল — ‘দাদা ভাই, তুমি আমাদের গ্রামটি ঘুরে দেখে আসো। ভালো লাগবে। এখানে নদী আছে। মন্দির আছে। ভিরাট রাজার ভগ্ন রাজ প্রাসাদ আছে। হিজল তমাল গাছের সারি আছে। কবেকার এক সরজু বালা এখনও সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায় দিগচিহ্নহীন জয় দূর্গা মন্দিরে। দেখে আসো তুমি– আলোজ্বলা এক সন্ধ্যা রাত্রি।
আমি ঘুরতে বের হই। পথের দুধারে ঘাটফুলের উপর সাদা ডানা কালো ছিট ছিট প্রজাপতি উড়ে উড়ে এসে বসছে। ক্ষেতের আলপথ ধরে নিমগাছের সারি। নিমফুলের রেঁণু ছড়িয়ে আছে মাটির উপর। পুকুর পাড়ে কদম গাছ। পশ্চিম পাশটায় অন্ধকার বাঁশবন। আছে আম ঝোপ।
অদূরে জয় দূর্গা মন্দির। আজ থেকে আড়াইশত বছর আগে জমিদার নবীন কিশোর রায় চৌধুরী নাকি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল। যা এখন ভগ্নস্তূপ। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। আমি কান পেতে ছিলাম, যদি শুনতে পাই সরজু বালার পূজার সেই আরতির ধ্বনি। যদি কোথাও সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে ওঠে। নাহ্ কোনো আলো জ্বলে উঠল না।
রাতে খেয়ে পাট সোলার বেড়ার ওপাশের রুমে চোকির উপর শুয়ে আছি। ঘুম আসছিল না চোখে। রাত বাড়তে থাকে। রাতের পাখিদের অদ্ভুত কিছু ডাক মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল। মনটা এক অস্পষ্ট বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। রাতে খাবার সময় মাসীমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম — ‘মাসীমা আপনারা কী ভালো আছেন?’ কেরাসিন কূপীর আলোয় দেখেছিলাম মাসীমার মুখখানি। কেমন বিমর্ষ ছিল সেই মুখ, কেমন ভয় ছিল চোখে মুখে। মাসীমা বলেছিল — ‘ভালো নেই বাবা।’ কৃষ্ণকে বলো — ‘ও যেন এসে আমাদের একবার দেখে যায়। খুব শীঘ্রই হয়ত ওপারে চলে যেতে হবে।’ হঠাৎ রাতের স্তব্ধতায় কার যেন গুমরে গুমরে কান্নার শব্দ শুনতে পাই। মেয়ে মানুষের কান্না। মনে হলো, অর্চনা কাঁদছে।
ঘুমহীন রাত শেষ হয়। প্রত্যুষেই আমি মাসীমার কাছ থেকে বিদায় নেই। হেঁটে হেঁটে ষখন চলে আসছিলাম হিজল তমালের ছায়াপথ ধরে, তখন মনে হচ্ছিল — কোনো এক অভাগী অর্চনা চালতা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
৪. ঘাসফুল
বাড়ির পূর্ব পাশটায় বাহির উঠোন। তারপরই পুকুর। পুকুরের একপাশে আম কাঁঠাল গাছের সারি। আর দুপাশে চালা। আরেকপাশে শস্য ক্ষেত। পুকুরের চালায় সবুজ ঘাসে ভরে থাকে। নানান জাতের ঘাসফুল ফুটে স্তুপ হয়ে থাকে।
এক অপরাহ্ণ বেলায় আনোয়ার এসে বসেছিল সবুজ ঘাসের উপরে। কেউ নেই কোথাও। পাড়ের ছাতিম গাছটার ডালে বসেছিল কয়েকটি হলুদ রঙের ফিঙে পাখি। চ্রিরি চ্রিরি করে ডাকছিল ওরা। যে ঘাসের ঢিঁবির উপর আনোয়ার বসেছিল, সেই ঘাসগুলোও আলতো করে জড়িয়ে রেখেছিল ওকে। আর তখন ভাঁটফুলের জঙ্গল থেকে গন্ধ আসছিল ঝিরিঝিরি বাতাসে, যেন পুকুরের জল ছুঁয়ে শীতল করে তুলছিল আনোয়ারের শরীর।
আনোয়ার প্রকৃতি মানব। ও খালি গলায় গান গায় একাকী কোথাও নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ও প্রায়ই এবেলায় ওবেলায় হারিয়ে যায়, কিংবা এক রাত্রির জন্য কোথাও গুম হয়ে যায় । সংসারে ওর কোনো দায় নেই, কোনো টান নেই। ওর একটি সরল মুখশ্রীর স্ত্রী আছে, মর্জিনা। এখনো বালিকা বয়স সে পার করেনি। যত দায় এই বালিকার!
আনোয়ার বিরবির করে গান গাইতে চেয়েছিল। কিন্তু গাইল না। একটা নীল রঙের ছোট্ট প্রজাপতি এসে পড়ছিল ওর গায়ের উপর। গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে প্রজাপতি বসে পড়ে ওর কাধের উপর। আর আনোয়ার স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল পুকুরের শান্ত জলের দিকে।
তখন সূর্য অস্তমিত হচ্ছিল পশ্চিম দিগন্তের নীচে। নিরবে আঁধার নেমে আসছিল পুকুর পাড়ে। সন্ধ্যার পাখিরা এসে বসেছিল আম কাঁঠালের ডালে। রাত নামছে যত, তত সেই কিচিরমিচির স্তব্ধ হতে থাকে রাতের গভীরে। আনোয়ার পাড়ে বসেই আছে। পুকুরের পূর্ব পাশের ধানক্ষেতের ভিতর জোনাকিদের আলো জ্বলে উঠেছিল। উপরে আকাশ ভরা তারা জ্বলছিল। কী এক নিরবতায় অবশ হতে থাকে ওর শরীর। আনোয়ার শুয়ে পড়ে ঘাসের উপর। ভাঁটফুলের গন্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। আনোয়ার গুণগুণ করে গান গাইতে থাকে –
‘কার ঘরে বাতি জ্বলে
এ নিশি রাইতে
আমারে তুই তর মায়ায়
অরে আমারে তুই তর মায়ায়
রেখে দে এ নিশি রাইতে
কার ঘরে বাতি জ্বলে এ নিশি রাইতে…।’
মর্জিনা কচু শাক ও কাঁঠালের বিচি দিয়ে নাবরা রান্না করে রেখেছে। ওর স্বামীর জন্য কুপী জ্বেলে বসে অপেক্ষা করছে । আনোয়ার আসে না। মেয়েটি উৎকণ্ঠায় কুপী হাতে নিয়ে সেই আঁধার রাত্রিতে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাড়ির বড়ো উঠোন পেরিয়ে সে পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায়।
মর্জিনা দেখে আনোয়ার পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর শুয়ে আছে। ওর শরীরের চারপাশে সাদা ঘাসফুলের মঞ্জরি। অজস্র জোনাকি আলো ছড়াচ্ছে অদূরে ধানক্ষেতে। অজস্র তারার আলো এসে পড়েছে আনোয়ারের শরীরের উপর। প্রান্তরের মাঝখানে শিমুল গাছের উপর হুতোম পেঁচা কোঁৎ কোঁৎ করে ডাকছে। মর্জিনা দেখে, আনোয়ার চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওর চারপাশে ঝিঁঝি পোকারা ঘিরে ধরে ঝিঁও-ঝি শব্দে ডাকছে।
মর্জিনা আনোয়ারের সিওরে বসে। ওর গালে আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডাকতে থাকে — ‘এই উঠবা না? তোমার জইন্যে নাবরা রানদিছি। ওঠো, বাইত চলো।’
আনোয়ার কোনো কথা বলে না।
সে তখন পোকামাকড়দের সাথে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হেমন্ত শিশির পড়ে ওর মলিন জামাটি ভিজে গেছে। সে হয়ত স্বর্গের কোনো গানের পাখির সাথে কথা বলছে। ওর চেতনা চলে গেছে পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে অন্যত্র। মর্জিনা আবার ডাকে — ‘এই ওঠো, বাইত যাইবা না?’
৫. ফুলমতি
ছোটবেলার কথা। আমাদের গ্রামে একজন পাগলিনীকে দেখতাম, নাম ফুলমতি। আটপৌরে করে মলিন ছেঁড়া কাপড় পরে থাকত। চুল ছিল আলুথালু উঁকুনে ভরা। না আঁচড়ানোর কারণে জটা ধরে গিয়েছিল। মাসের মাস গোসল করত না। শরীর ভরা দুর্গন্ধ। তার এই দুর্গন্ধের কারণে কেউ তার কাছে দিয়ে হাঁটত না। সবাই নাকে কাপড় চেপে চলত।
ফুলমতি কেন পাগল হইল, এই কথা তারও কয়েক বছর পর জানতে পারি। আমাদের পাশের গ্রামের এক মাথাছিটা লোকের সাথে তার নাকি বিয়ে হয়েছিল। সেই লোক বিয়ের অনেক আগে থেকেই মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেত। উধাও হয়ে সে কখনও ছয় মাস, কখনও এক বছর, কখনও দুই তিন বছর পর বাড়ি ফিরে আসত।
লোকটির নাম ছিল জয়নাল। সবাই জয়নালের বাবা মাকে বুদ্ধি দিল — ‘জয়নালকে বিবাহ করাও। দেখবে, ওর মাথার ছিটা ভালো হয়ে গেছে।’
একদিন এক ভাদ্রের পঞ্চমী তিথীতে গরীব অনাথ এই মেয়েটির সাথে জয়নালের বিবাহ দেওয়া হয়। বিয়েতে কোনো উৎসব আয়োজন করা হয় নাই। মসজিদের হজুরকে ডেকে কালেমা পড়ানোর মাধ্যমে তাদের বিবাহ সম্পন্ন করা হয়।
তাদের জন্য ছোনের কুঁড়েঘরে বাসরসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু মধ্য রাত্রিতে জয়নাল তার নববধুকে ‘আসি’ বলে ঘরের দরজা খুলে যে বাহির হয়ে চলে যায়, তারপর জয়নাল আর ফিরে আসে নাই।
তার কয়েকদিন পর একরাত্রিতে গ্রামের এক টাউট ফুলমতিকে একা পেয়ে তার ঘরে ঢুকে বলাৎকার করে। এ কথা জানত শুধু কয়েক জনে। এই ঘটনার পর থেকেই ফুলমতি পাগল প্রকৃতির হয়ে যায়। তার শরীরে থেকে এখন পঁচা দুর্গন্ধ বেরয়। ঘেন্নায় তার থেকে সবাই দূরে থাকে।
তারও কয়েক বছর পরের কথা। তখন আমি হাইস্কুলে পড়ি। তখন ছিল গ্রীষ্মকাল, মর্নিং স্কুল। আমি সকালবেলা বই পত্তর হাতে করে স্কুলে যাচ্ছিলাম। কুন্ডুবাড়ি পার হতেই দূর হতে দেখি, একটি লোক ও একটি মেয়ে সুশিলা দেবীর পুকুর ঘাট হতে সদ্য স্নান সেরে আসছে। যখন কাছে আসে, মেয়েটিকে দেখে চিনতে পারি। এ যে ফুলমতি! তার মুখ হাস্যজ্বল, পরনে পরিপাটি কাপড়। চুলগুলো ভেজা হলেও গোছানো। গতরে যে সুগন্ধি সাবান মেখেছে, এটা বোঝা গেল। কিন্তু পাশের লোকটিকে আমি চিনতে পারলাম না। অনেকটা কৌতূহল মনে রেখে স্কুলে চলে যাই।
দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে জানতে পারি গতরাতে ফুলমতির স্বামী ফিরে এসেছে। আর পথে দেখা ঐ লোকটি ছিল জয়নাল। জয়নাল একটি টিনের বাক্সে করে ফুলমতির জন্য নতুন শাড়ি কাপড়, ব্লাউজ, সায়া, আয়না, সাবান, চূড়ি, নাকফুল, তিব্বত স্নো পাউডার, আতরের শিশি, আলতা কিনে নিয়ে এসেছে।
আজ রাতেও ফুলমতির ঘরে সন্ধ্যা শিখা জ্বলবে। আতরের গন্ধে ভাসবে কুসুমপুরের বাতাস। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ হবে। সে শব্দও থেমেও যাবে। চাঁদ উঠবে, চাঁদও ডুবে যাবে। গল্প করবে ফুলমতি জয়নালের সাথে। রাতের নিস্তব্ধে সে গল্পকথাও একসময় স্তিমিত হয়ে আসবে।
৬. অনাদৃতা
এই কাহিনির ঘটনাকাল বাংলা চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়েরও পরের।
মানুষের তার সুখের অথবা দুঃখের মুহুর্তে এমন
কারোর কথা মনে পড়ে, কিংবা এমন কাউকে দেখবার প্রবল ইচ্ছা করে, তা শুধু সেই জানে।
হায়দার আলীর আজ বি,এ পরীক্ষার রেজাল্ট হল।
সে পাশ করেছে। আজ তার সুখের দিন। আজকের এই সুখের দিনে তার মনে পড়ছে অনেক বছর আগের একজন অচ্ছুত মেয়ের কথা। যে তাকে শিশু কালে খুব আদর যত্ন করেছিল, তাকে বড়ো বোনের স্নেহ মমতা দিয়েছিল।
তখন তার বয়স ছিল তিন বছর। পিতৃহীন এই শিশু মায়ের সাথে থাকত খুলনার একটি পতিতালয় সংলগ্ন এক বস্তীতে। মা গ্রাম থেকে খুলনা এসেছিল ঝিয়ের কাজ করতে। কোন্ গ্রাম থেকে এসেছিল, সে কথা তখনকার কেউ বলতে পারে নাই।
হায়দারের মা শহরের বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ করত। তখন কাজের জন্য মজুরি পাওয়া যেত না। শুধু খেতে দিত। হায়দারের মা তার নিজের খাবার থেকে ছেলেকে খাওয়াত। দিন চলত দুঃখ কষ্টে। এই দুঃখ কষ্টের ভিতর দিয়েই তিন বছর চলে যায়। শিশু হায়দার এই বস্তিতেই বেড়ে উঠতে থাকে।
বালক হায়দার ঘুরতে ঘুরতে প্রায়ই পতিতালয়ের ভিতরে ঢুকে পড়ত। ওখানকার একটি মেয়ে ওকে কাছে ডেকে খুব আদর যত্ন করত।
হায়দার দেখতে খুব সুন্দর ছিল। ছোট্ট সুন্দর এই বালককে আনোয়ারা নাম্নী ঐ পতিতা ওকে বোনের স্নেহ দিত। ওকে এটা ওটা প্রায়ই খেতে দিত। চকলেট হাতে দিয়ে হায়দারের গাল টিপে বলত — তুমি আমার ছোট্ট লক্ষী ভাই।’
হায়দারের মা টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় বস্তিতে মারা যায়। তার গ্রামের বাড়ি কোথায় সে কথা বস্তির কেউ জানত না। তাকে তাই বেওয়ারিশ অবস্থায় খুলনার একটি কররস্থানে দাফন করা হয়।
মায়ের মৃত্যু দিনে হায়দার কাঁদতে কাঁদতে আনোয়ারার কাছে চলে আসে। পিতৃ-মাতৃহীন এই বালককে আনোয়ারা তার আশ্রয়ে রেখে দেয়। কিন্তু বেশি দিন তার কাছে রাখা সম্ভব হয়নি। সর্দারনী প্রায়ই আনোয়ারাকে এজন্য খুব গালমন্দ করত।
এক সহৃদয়বান খদ্দের হায়দারকে ঢাকায় নিয়ে আসে এবং একটি অনাথ আশ্রমে তাকে দিয়ে দেয়।
হায়দার এই আশ্রমে লালিত পালিত হতে থাকে । এখানেই তার কৈশোর ও তারুণ্যের সময় কাটে। আশ্রমের কঠিন নিয়ম পালন করেই সে লেখাপড়াও করতে থাকে।
আশ্রম নথিতে হায়দারের আপন কোনো মানুষের বৃত্তান্ত নেই। তার বাবার নাম নেই। মায়ের নাম নেই। তার কোনো ঠিকানা নেই। তাকে কোনো আপন মানুষ কোনোদিন দেখতে আসেনি। কিন্তু প্রায়ই তার মনে পড়ত তার মায়ের কথা। মনে পড়ত তার সেই বোনটির কথা।
হায়দার কিশোর সময় থেকেই খণ্ডকালীন কাজ করত।
অনেক পরিশ্রম ও কষ্ট করে নিজের লেখা পড়া চালিয়ে যেত। আশ্রমে থেকেই সে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে।
তার বয়স আঠারো পূর্ণ হলে সে নিজ দায়িত্বে আশ্রম ত্যাগ করে। সে একটি প্রেসে চাকুরি নেয়। সে মেসে থাকে। প্রেসে চাকুরি করা অবস্থায়ই নৈশ কলেজে পড়াশোনা করে সে বি,এ পাশ করে।
আজকেই তার পরীক্ষার ফল বের হয়। সে এখন গ্রাজুয়েট। মেসের রুমে বিছানায় সে শুয়ে আছে। কখন সন্ধ্যা হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেছেহ, বুঝতে পারেনি। অন্ধকারের ভিতর মায়ের মুখটি অস্পষ্ট করে দেখতে পেল। মা এত দূরে চলে গেছে যে, তাকে আর স্বচোক্ষে কখনো দেখতে পাবে না।
সেই আঁধারে মায়ের মুখটি ছাপিয়ে যে মুখটি সন্ধ্যার বিষণ্ণ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, সে হল তার আনোয়ারা বুবুর মুখ। তার খুব ইচ্ছে হল — এই বোনটির সাথে সে দেখা করবে।
পনেরো বছর চলে গেছে। অস্পষ্ট করে মনে পড়ে কত মেয়েদের মুখ। কত মেয়ে কত সুন্দর করে সেজে থাকত সন্ধ্যা বেলায়। কত হাসি খুশি ছিল তারা। কত হৈহুল্লুর।কত মানুষ আসত সেখানে। তাদের মাঝেই দেখেছে তার আনোয়ারা বুবুকে। কিন্তু মুখখানি কিছুতেই আজ মনে করতে পারছে না।
সেই অস্পষ্ট মুখটি তার বড়ই দেখতে ইচ্ছে করছে। কোথায় গেলে দেখতে পাবে তারে! কতদূর! কোথায় সেই নিষিদ্ধপল্লী। যেখানে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে তার আনোয়ারা বুবুকে।
একদিন সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে খুলনাগামি একটি স্টীমারে সে ওঠে। স্টীমারটি ভেঁপু বাজিয়ে ছেড়ে যায়। তার ইচ্ছে হল না রেলিঙেএ দাঁড়িয়ে নদীর জল দেখতে। দোতালার ডেকের উপর চাদর বিছিয়ে মাথার নিচে কাপড়ের ব্যাগটি রেখে সে শুয়ে পড়ে। এবং কখন ঘুমিয়ে যায় বুজতে পারেনি।
পরেরদিন দুপুরে স্টীমারটি খুলনার রূপসা ঘাটে গিয়ে পৌঁছে। পেটে প্রচণ্ড খিদে ছিল। ঘাটে নেমে সে একটি টিনের চালা হোটেলে ভাত খেয়ে নেয়। একটু জিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে শহরের দিকে এগুতে থাকে। এই শহরের সে কোনো কিছুই চেনে না। কাকে বলবে, কোথায় পতিতালয়।
তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ফুটপাত ধরে হাঁটছিল আর শহরের বাড়িঘর গুলো দেখছিল। এইসব কোনো কোনো বাড়িতেই হয়ত তার মা ঝিয়ের কাজ করেছে। চোখ ছলছল করে উঠল তার। পথ চলতে চলতে সে দেখতে পায় একটি পুরনো কবরস্থান। তার হঠাৎ মনে হল, এই কবরস্থানেই হয়ত তার মাকে দাফন করা হয়েছিল।
সে মৃদু পায়ে হেঁটে হেঁটে কবরস্থানের ভিতরে ঢুকে পড়ে। বিশাল কবরস্থান। হাজার হাজার কবর এখানে। কত শান বাধানো কবর, কত আবার বাঁশের বেড়া দেওয়া। কত কবর অযত্নে এমনি পড়ে আছে। কত রকম গাছ গাছরায় ভরা এই কবরস্থান। কত রকম ফুলের গাছ। কোথায় অচিন হয়ে পড়ে আছে মায়ের কবরটি! একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এসে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে।
তখন পরন্ত বিকাল। এক লোককে সে জিজ্ঞাডা করে– ”ভাই পতিতালয়ে যাব কোন্ পথ দিয়ে?’
লোকটি হতভম্ব হয়ে হায়দার আলীর দিকে একবার তাকায়। সে বিস্ময়ে তার পুরো অবয়ব দেখে নিয়ে বলে — ‘ ওখানে যাবে কেন? ‘
হায়দার আলী বলে — ‘ওখানে আমার বড়ো বোন থাকে।’ লোকটি আরও বিস্মিত হয়! এবং বলে দেয়, কোন্ পথ দিয়ে বেশ্যাবাড়ি যেতে হবে।
তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকেল। অনকটা ক্লান্ত হয়ে হায়দার আলী বেশ্যালয়ের গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে অদূরে চোখ মেলে খুঁজতে থাকে তাদের বস্তি ঘরটি। কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। ওখানে এখন দালান উঠেছে। সব কেমন অচেনা লাগছে।
আজ থেকে পনেরো বছর আগে একটি পাঁচ ছয় বছরের বালক পাশের বস্তি থেকে হেঁটে হেঁটে এসে ঢুকত এই পতিতালয়ে। সেই বালকটি আজ থমকে দাঁড়িয়ে আছে এর রাস্তার উপর। অনেক কথাই তার মনে আসছে, আবার অনেক কথাই সে মনে করতে
পারছে না।
খুব ভয় পাচ্ছিল হায়দার আলী। খুব দ্বিধা করছিল সে। ভিতরে ঢুকবে কী ঢুকবে না। গলির মুখ জুড়ে অনেক মেয়ে রংবেরঙের সাজে দাঁড়িয়ে আছে। যে সমস্ত পুরুষরা ভিতরে ঢুকছে তাদের সাথে তারা বিভিন্ন খিল্লি করছে।
হায়দার আলীর মন ও হৃদয় আজ উন্মূখ! তার আনোয়ারা বুবুকে দেখার জন্য চিত্ত অস্থির হয়ে উঠেছে। কী এক অদ্ভূত টানে গলিতে সে ঢুকে পড়ে। ওকে দেখে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কেউ ওর হাত ধরছে, কেউ ধরছে সার্টের আস্তিন। এক একজন এক এক কথা বলছে। বিচিত্র সব অঙ্গ ভঙ্গি করছে। কেউ বলছে — ‘আজ দেখি, দেবানন্দ এল’, কেউ বলে — ‘এত দেখছি — উত্তম কুমার’। কেউ বলে — ‘দারুণ নাগর’! আবার কেউ চোলি থেকে উপচে পড়া স্তন দেখিয়ে বলে –‘কী আমাকে পছন্দ হয় না’! কেউ চোখ মারছে, কেউ দিচ্ছে শীষ।
হায়দার আলী তাদেরকে কোনো কথাই বলার সুযোগ পায়নি। বলতে পারেনি সে তার বোনকে দেখতে এখানে এসেছে। নিজেকে অনেকটা টেনে হিঁচড়ে মেয়েদের থেকে মুক্ত করে সে বাইরে চলে আসে।
হায়দার আলীর আর দেখা হল না ওর আনোয়ারা বুবুকে। ঐদিনই সন্ধ্যায় চলে আসে রূপসা তীরে। নদীর ঘাটে ঢাকায় আসবার জাহাজটি দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। এখুনি ছেড়ে যাবে। হায়দার আলী যেয়ে জাহাজটিতে ওঠে। সে রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে জলের দিকে মুখ রেখে ভাবছিল — বহু বছর আগের বিস্মৃতপ্রায় ঝাপসা একটি মুখচ্ছবির কথা। আজ থেকে পনেরো বছর আগে একটি অচ্ছুত মেয়ে তার হাতে চকলেট দিয়ে বলেছিল —‘তুমি আমার লক্ষী ছোট্ট ভাই।’
হায়দার আলী কান্না করে স্বগোতক্তি করে তখন হয়ত বলছিল –‘তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল গো বুবু। তুমি আজও কি তেমনই আছ? দেখা হলে কি হাতে চকলেট দিয়ে বলতে — লক্ষী ভাইটি চকলেট খেয়ে নাও।’
ঘাট থেকে একটি পুরনো জীর্ণ স্টীমার কালা ধূয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আঁধার করে ভেঁপু বাজিয়ে ছেড়ে চলে গেল মাঝ দরিয়ায়। হায়দার আলী আঁধার হওয়া আকাশ দেখছিল স্তব্ধ নয়নে। সেখানেও সে তার বুবুকে দেখতে পাচ্ছিল আবছা করে।
রূপসার জল এমন করুণ করে এর আগে কখনো ছলাৎছল করেনি!
৭. রাতের ক্ষণিকা
ব্যবসায়িক কাজে সেইবার পর্যটন শহর কক্সবাজার গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে রাতের কোচে রওনা হই। আমাদের বাসটি কক্সবাজার বাসস্ট্যান্ডে যেয়ে যখন পৌঁছে তখন বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে যায়।
বাস থেকে ব্যাগ নিয়ে নেমে পাশেই একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতে ঢুকি। একটি মধ্য বয়স্ক লোক আমাকে অনুসরণ করছিল। সে বাইরে সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি চা নাস্তা খেয়ে সিগারেটের দোকানের সামনে এসে এক প্যাকেট সিগারেট কিনি। ও সিগারেট ধরাই। লোকটা তখন আমার পাশে দাঁড়ানো।
লোকটি দেখতে বেশ ভদ্রলোক। পরিচ্ছন্ন কাপড় চোপর পরা,পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো। পায়ে সুন্দর জুতা। সার্টের পকেটে চমৎকার একটি ফাউন্টেন কলম। সেই আগবাড়িয়ে আমাকে বলছিল-
— আপনি কী ঢাকা থেকে এসেছেন?
— জ্বী।
— হোটেল বুকিং করা আছে?
— না। খুঁজে নেব।
— আমাদের একটি কটেজ আছে। খুব সুন্দর। পাহাড়ের ঢালে। সাগর মুখো। মোটামুটি কম ভাড়া। আমরা অতিথিদের রান্না করে খাওয়াই। আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের কটেজে উঠতে পারেন।
লোকটির বাচনভঙ্গি ছিল চমৎকার। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছিল। আমি ওনাকে বললাম — আপনাদের কটেজের নাম কী?
— ‘ক্ষণিকা’।
— খুব সুন্দর নাম। রবি ঠাকুরের ক্ষণিকা। তা, চলুন আপনার কটেজে। ‘ক্ষণিকা’তেই থাকব।
রিক্সায় করে পথে যেতে যেতে ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নাম কী?
— মোহাম্মদ খোরশেদ আলম।
— আপনি এই কটেজের কী?
— আমি মালিক।
আমি একটু অবাক হলাম, মালিক নিজেই ব্যবসা ধরার জন্য বাসস্টান্ড পর্যন্ত চলে এসেছে।
উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল — কয়দিন থাকবেন?
আমি বললাম, ব্যবসায়িক কাজে এসেছি। তিন চার দিন থাকতে হতে পারে।
রিক্সাটি একসময় একটি পাহাড়ি টিলার কাছে এসে থামে।
টিলার সামান্য ঢাল বেয়ে একটু উপরে উঠতেই দেখতে পেলাম একটি কাঠের বাড়ি। ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড লাগানো আছে। লেখা — ‘ক্ষণিকা’।
একদম ঘরোয়া বাড়ি। সবশুদ্ধ চার পাঁচটি অতিথি রুম আছে। সামনে বারান্দা। ওখান থেকে সাগর দেখা য়ায়। যদিও অনেক দূরে।
আমি বারান্দার কাছে রুমটা পছন্দ করি এবং ঐ রুমেই উঠে পড়ি। খুব সুন্দর পরিপাটি রুম। পরিচ্ছন্ন বিছানা পত্র। কাপড় রাখার ওয়ারড্রব, ড্রেসিং গ্লাস, সাইট টেবিল, দেয়ালে তৈলচিত্র, ওয়াল ঘড়ি, টেলিভিশন, খাবারের গ্লাস, কাগজ কলম, এ্যাসট্রে, মিলারেল পানি সহ সবই আছে।
আলম সাহেব কলিং বেল দেখিয়ে বললেন — আপনার যখন যা লাগবে, কলিং বেল বাজাবেন। আমি অথবা আমার কেয়ার টেকার চলে আসবে।
আলম সাহেবকে বললাম — আচ্ছা। তাই করব।
তাকে বললাম, আমি শুধু সকালের নাস্তা ও রাতের খাবার এখানে খাব। অফিসের কাজে যেহেতু বাইরে বাইরে থাকতে হবে, তাই দুপুরের খাবার আমি অন্য কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিব।
খোরশেদ আলম সাহেব বললেন — আচ্ছা।
সেদিনের বিকেলটুকু ব্যবসায়িক কাজ সেরে সন্ধ্যায় কটেজে চলে আসি। ডাইনিং রুমে বসে রাতের খাবার খেয়ে নেই। মেনু ছিল রূপচান্দা ও কোরাল মাছ। সাথে সালাদ ও ডাল ছিল। বেশ সুস্বাদু ছিল সবকিছু।
সবকিছুতেই ভদ্রলোকের রুচির ছাপ আছে। সাউন্ড বক্সে খুব কোমল সুরে মান্না দে’র গান বাজছিল। ‘দাঁড়িয়ে আমার চোখের আগে
রাঙ্গালে এ মন পুস্পরাগে
কে গো চম্পাবরণী।
কে তুমি তন্দ্রাহরণী।’
আমি একটি জিনিস খেয়াল করলাম, কটেজের অন্য রুমগুলো ছিল খালি। কোনো গেস্ট ছিল না। কেমন যেন সুনসান নিরব পরিবেশ, কেমন যেন আলোছায়াময় অন্ধকার সারা কটেজ জুড়ে!
রাতে রুমে শুয়ে আছি। নতুন জায়গা ঘুম আসছিল না চোখে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি, রাত একটা। খুব ইচ্ছা হল দূরের রাতের সাগর দেখবার। খুব মন চাইল, কান পেতে শুনতে সাগরের গর্জন।
দরজা খুলে চলে আসি বারান্দায়। দাঁড়িয়ে থাকি সমুদ্রের দিকে চেয়ে। দূরে সমুদ্র, কাছেই আকাশ। ও পাশটায় ঝাউবন। ঝাউঝাড়ে তখনও জোনাকি জ্বলছিল। আর দুরে থেকে ভেসে আসছে জলের শব্দ।
আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, আকাশ ভরা তারা। কী স্বপ্নময় লাগছিল।
কবে কোন্ কবি আপন ভাবালুতায় লিখেছিল কবিতা।
যদি আজ রাতে সেই কবিতাখানি কেউ গানের সুরে গেয়ে শোনাত–
ঝাউবনের মাথার উপর
তবু জেগে রয় এক টুকরো মেঘের উচ্ছ্বাস!
রক্ত-চোখ খুনি কাঁকড়ারা আজ হাজার হাজার মাইল
সমুদ্র সৈকতে নিরব পাহাড়ায় ্
আমি আজ তোমাদের প্রাত্যহিকের নিয়ম ছেড়ে অনেক দূরে
এক কুয়াশাময় সম্পর্কহীন মাদকতায় অলস-কথা ভাষাহীন!
এখন রাত্রি নক্ষত্রের!
জানি তোমরা আজ মেলায় মাতোয়ারা
আমায় নির্জনতা ডাকে
আমি আজ সাগরে!
সাগরের দিক থেকে হিমেল বাতাস এসে লাগল গায়ে। তারারা এসে আমার চোখের পাতায় ছুঁয়ে দিল। কেমন যেন ঘুম পাচ্ছিল। ভাবলাম, যাই, শুয়ে পড়ি। পিছনে ঘুরতেই দেখি — বারান্দার আর এক পাশে একটি মেয়ে ঝাউ গাছের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। নীরবে নিঃশব্দে কখন এসে সে দাঁড়িয়েছিল, আমি বুঝতে পারিনি।
আমি ঐ মেয়ের সাথে কোনো কথা না বলে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ি।
দ্বিতীয় রাত্রি–
সারাদিন অফিসের কাজে বেশ পরিশ্রান্ত ছিলাম। রাতে খেয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ি এবং ঘুমিয়ে যাই। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। শুয়েই আছি। কী যেন দেখার জন্য চিত্ত অস্থির হতে থাকে। সাগর নাকি ঝাউগাছ! নাকি তারাভরা আকাশ! নাকি কালকের সেই মেয়ে! কিসের এক টানে বাইরে বারান্দায় চলে যাই। দেখি কেউ নেই। সাগরের দিকে তাকাই —
জলের শব্দ আজ নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে। জোনাকিরা জ্বলছে না ঝাউবনে। তারারা অনুজ্জ্বল হয়ে আকাশেতে জ্বলছে!
পিছনে ঘুরে তাকাতেই– দেখি, কালকের সেই মেয়ে। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরিহিত। বয়স তেইশ চব্বিশ বছর হবে। চুল খোঁপা বাঁধা। বেলী ফুলের মালা দিয়ে জড়ানো। আলো আঁধারে মুখখানি দেখলাম– দোলনচাঁপার মতো স্নিগ্ধ, হাত দুটি যুঁথিবদ্ধ, চোখের তারায় য়েন জোনাকি জ্বলছে!
বললাম — তুমি কে?
— আমি লাবণী। আমি তোমাকে দেখেছি দূর থেকে। চুপিচুপি। তুমি তা জানো না। কী বিশ্বাস তোমার প্রতি হল। তুমি যেন আমার কত ভরসার!
— তাই!
— আমাকে দেখতে খুব অপূর্ব লাগছে! না!
— হুম! খুব ভালো লাগছে!
— আমাকে তুমি সাথে করে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে?
— তুমি কে? তোমাকে চিনি না। জানি না।
— আমি খুব দুঃখী মেয়ে। ভালোবাসা আর দাম নিয়ে দিতে ইচ্ছা করে না, ভালোবাসা প্রাণে থেকে দিতে ইচ্ছা করে। আমি খুব কাঙাল। আমি যে বন্দিনী। আমাকে তুমি এখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাও।
— খোরশেদ আলম সাহেব তোমার কী হয়?
— সম্পর্কে উনি আমার মামা হন।
— দেখো, আমি এখানে পরদেশি। আমার খুব ভয় হচ্ছে।
তুমি রুমে চলে যাও। শুয়ে পড়ো। আমি তোমার কথা ভেবে দেখব।
তৃতীয় রাত্রি —
সারাদিন কাজের ভিতর ঘুরে ফিরে একটা কথাই কানে বাজছিল, ‘ আমাকে তুমি তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে? ‘ সন্ধ্যাবেলা কটেজে ফিরে বারান্দায় গিয়ে একাকী দাঁড়িয়েছিলাম। সাগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছিলাম বিনম্র দৃষ্টিতে — সূর্য ডুবে গিয়েছিল আগেই সমুদ্র জ্বলে। লাল আভাগুলো মায়াবী মনে না হয়ে বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল।
কেয়ারটেকার এসে বলছিল — স্যার, কফি দিব?
বললাম — না।
রাতে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুম আসছিল না কিছুতেই। রাত গভীর হতে থাকে। মনে পড়ছিল লাবণীর কথা। ওকে আমি আজ কী বলব? ও কী চায় আমার ? আমাকে বিয়ে করতে চায়? তা কী ভাবে সম্ভব! আমার যে মায়াবতী একটি মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। একটা স্বপ্ন দেখলাম ঐ মেয়েটিকে নিয়ে। কী এক অদ্ভুত স্বপ্ন। কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা অস্পষ্ট। লাবণী আর আমি হাত ধরে সমুদ্র তীর ধরে বালিয়াড়ির উপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছি দিগন্তের দিকে। চলে গিয়েছি দূর আকাশের নীলে। আমাদের দুজনকে রাশি রাশি সাদা মেঘ এসে ঢেকে দেয়। আমরা যেথায় হারিয়ে গেলাম, পৃথিবীর কেউ দেখতে পেল না।
যখন ঘুম ভাঙে, তখন স্বপ্নটাও ভেঙে গেল! দেখি, ভোর হয়ে গেছে। সারা বিছানা জুড়ে অজস্র বেলী ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। রক্তজবাগুলো ছিন্নভিন্ন। বিছানায় লোধ্ররেণুর দাগ!
সকালে ব্রেকফাস্ট করে খোরশেদ আলম সাহেবকে বলি — সামান্য কিছু কাজ বাকী আছে। কাজ সেরে আমি আজই ঢাকা চলে যাব।
‘ক্ষণিকা’ ছেড়ে যখন চলে আসি, তখন খোরশেদ আলম সাহেবকে একবার বলতে চেয়েছিলাম– লাবণীকে একটু ডাকুন — ওকে একটু বলে যাই। কিন্তু বলা হল না। রাতের লাবণী এখানে রাতের ক্ষণিকা হয়েই থাকল।
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। এখনও কোনো
রাত্রি প্রহরে ঘুম ভেঙে গেলে একাকী বারান্দায় যেয়ে পায়চারি করি — খুঁজি অনেক দূরের সমুদ্র, চোখ মেলে দেখবার চেষ্টা করি সাগর তীরের তারার আকাশ। আলো খুঁজি ঝাউবনের জোনাকির! শুনতে পাই বহু আগের নিরব জলের শব্দ! এই অস্তবেলায় একটু আফসোস তো হয়-ই! লাবণীর দুঃখটা কী ছিল? কেনই তা জানতে চাইনি?
৮. সন্ধ্যার মেঘমল্লার
মন্দিরে পূজা দিতে আসত সে। মন্দিরে এই আসা যাওয়ার মাঝে আর পথ চলতে চলতে পথের উপর তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।
সময়টা ছিল ১৯১১ ইংরেজি পরবর্তী কাল। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর রেল বিভাগে আমার সহকারী টিকেট মাস্টার হিসাবে চাকুরি হয়। পোস্টিং হয় রাজবাড়ির গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশনে।
একদিন এক হেমন্তের সকালে রানাঘাট জংশন থেকে একটি শাটল ট্রেনে করে প্রথমে কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশনে আসি। পরে ওখান থেকে আর একটি লোকাল ট্রেনে করে সোজা গোয়ালন্দ ঘাট। আমার জীবনে প্রথম বিদেশ বিভূঁইয়ে আসা। এর আগে শুধু কলিকাতা পর্যন্ত গিয়েছি। আসার সময় মাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! মা আমার কান্না দেখে বলেই ফেলেছিল — ‘তোমার চাকুরি করার দরকার নাই।’ কিন্তু বাবা ছিল নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত চাকুরিতে যোগদান করতেই হল।
স্টেশনে কর্মচারিদের থাকার কোনো আবাসস্থল ছিলনা। সেটশন মাস্টার মশাই তার এক পরিচিত পুরোহিতকে বলে স্টেশন থেকে প্রায় এক মাইল দূরে পদ্মা তীরবর্তী একটি গ্রামের মন্দিরের অব্যবহৃত একটি ছোট্ট ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করেন। রান্না বান্না নিজেকে করেই খেতে হবে।
স্টেশন থেকে পদ্মার তীর ধরে মেঠোপথে গ্রামটিতে যেতে হয়। রাস্তার দুপাশে আম কাঁঠালের বাগান। ঘন গাছের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে থাকে। আবার কখনো খোলা ফসলের মাঠ। সরিষা,কলাই, আখ আর আমন ধানের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আবার পদ্মার তীর ধরে ছোট ছোট গ্রাম। জেলে পাড়া, কুমার পাড়া, মালো পাড়া, ছুতার বাড়ি। এইসবের ভিতর দিয়েই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরের ঐ বাড়িটায়।
পুরোহিত মশাই আমার নাম ধাম জিজ্ঞাসা করলেন।
বললাম, নাম– শ্রী অরুণ চন্দ্র বসাক। সাকিন– মায়াপুর, নদীয়া।
পুরোহিত মশাই একটু করুণা করলেন। খুবই অভুক্ত ছিলাম। তিনি এইবেলায় নিরামিষ দিয়ে ভাত খাওয়ালেন। একটা মাটির ভাতের পাতিল ও একটি তরকারির পাতিল দিলেন। একটি মাটির কড়াইও দিলেন। মা আসার সময়ে বেডিং এ কাঁথা বালিশ দিয়েছিলেন। খুলে দেখলাম- একটি এ্যালুমিনিয়ামের প্লেট, একটি পিতলের গ্লাস, একটি চামচ ও লবনদানি দিয়ে দিয়েছেন।
মাটির ঘর। উপরে ছোনের চালা। ভিতরে একটি পুরাতন কাঠের চোকি পাতা আছে। এক কোণে মাটির হেঁসেল। কিছু পাট শোলা ও ঘসি রয়েছে। আমি কাঁথা বিছিয়ে নেই চোকিতে। খুব ক্লান্ত ছিলাম। বিছানায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নেই। কখন ঘুমিয়ে যাই জানতে পারিনি।
সন্ধ্যায় মন্দিরের শঙ্খধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙে যায়। জেগে দেখি- ঘর ভর্তি অন্ধকার। বিছানা থেকে উঠে হেঁটে মন্দিরের দিকে চলে যাই। একজন সেবকের কাছ থেকে একটি কেরোসিনের কুপী ও দেয়াশলাই চেয়ে নেই। ঘরে এসে নিজেই সন্ধ্যাবাতি জ্বালাই। এই সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানোর মধ্য দিয়েই একজন বিশ একুশ বছরের একাকী তরুণের সংসার যাত্রা শুরু হল।
প্রতিদিন স্টেশনে যাই। স্টেশন থেকে আবার এই মন্দির সংলগ্ন মাটির ঘরে ফিরে আসি। পথে যেতে আসতে কত বাড়ি দেখি। কত মানুষ, কত বৃক্ষের ছায়াতল দিয়ে কত পথ হাঁটি। কত পাখির ডাক শুনি। কখনো পথ চলতে চলতে মায়াপুরের কথা মনে পড়ত। মনে পড়ত মার কথা।
আমার ঘরটি মন্দির থেকে সামান্য দূরে পথের ধারে। ঘরের পাশ দিয়ে লোকজন হেঁটে মন্দিরে আসা যাওয়া করে । ঠিক একটু পরেই পুকুর। পুকুর পাড় জুড়ে আলম কাঁঠাল বেল লিচু ও জাম গাছ বেষ্টিত। ঘাটও আছে। পরিস্কার জল। এই পুকুরে কেউ গোসল করে না। সারা গায়ের মানুষ এর জল খাওয়ার জল হিসাবে ব্যবহার করে।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। ঘরে বসে বসে বাবার কাছে পত্র লিখলাম —
পরম পূজনীয় বাবা,
পত্রে আমার প্রণাম জানিবেন। মাকেও প্রণাম জানাইবেন। পর সমাচার এই যে, আমি এখানে ভালোভাবে পৌঁছিয়াছি। এখানে এক মন্দিরের পাশে একটি পরিত্যক্ত ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হইয়াছে। আমার একটুও ভালো লাগে না। নিজেকে রান্না করিয়া খাইতে হয়। মার কথা খুব মনে পড়ে।
আমার আরও কিছু চাকুরির দরখাস্ত ও ইন্টারভিউ দেওয়া আছে। যদি কোনো খবর হয় সত্বর জানাইবেন।আমার জন্য দোয়া করিবেন। ঠাকুর সবার মঙ্গল করুক।
ইতি — আপনার স্নেহের অরুণ।
সন্ধ্যায় ঘরের ছোট্ট কাঠের জানালাটি খুলে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি, কয়েকজন মহিলা মন্দিরের দিকে আসছে। তখন শঙ্খধবনি বেজে উঠেছে। আমার ঘরের পাশ দিয়ে তারা হেঁটে চলে গেল মন্দিরে। একজন শুধু জানালার কাছে থেমে গেল।
সে ছিল একজন বিধবা রমণী। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলছিল —
‘আমি তোমাকে দেখেছি। তুমি প্রতিদিন হেঁটে যাও, আমাদের বাড়ির আঙিনার পাশ দিয়ে। আমি প্রতিদিন তোমাকে দেখি। তুমি আমাকে দেখতে পাও না।’ এই কথা বলে, রমণীটি মন্দিরের দিকে চলে গেল।
আমি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। অন্ধকার হয়ে ঘরটি আঁধার হয়ে আসছিল। কেরোসিনের শিখাটি জ্বালিয়ে নেই । বিছানায় শুয়ে শুয়ে আলো আঁধারে ঐ রমণীর দেহ রূপটি দেখছিলাম– সুশ্রী গৌড় বর্ণ, হাত দুটি অনাবৃত অনন্ত শাঁখাহীন। সকালের কমলা রোদ্দুর ছিল গায়ে। পরনের শাড়ি রজনীগন্ধার মতো সূচি শুভ্র। তার নির্মল রূপ সন্ধ্যার সৌন্দর্যকে সীমারেখা টেনে দিয়েছে।
হৃদয়ের রক্তের স্পন্দন কেমন যেন থেমে থেমে আসছিল। আমি নিশ্চুপ হয়ে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে রইলাম।
পরের দিন পরিচিত পথ দিয়ে স্টেশনে না যেয়ে পদ্নার পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম। নদীর জল স্রোতের টানে ধেয়ে চলছিল। স্রোতের উজান বেয়ে গুণ টেনে মাঝিরা নৌকা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত নদীর উপর আকাশ জুড়ে ছিল নীল মেঘ। মেঘগুলো কখনো দেখতে লাগছিল ধূসর, পরেই আবার কালো হয়ে উঠতে লাগল।
কালকের সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যার একটি মুখ এই স্রোতের টানে, ঐ মেঘের ভিতর ভেসে ভেসে যাচ্ছিল। সবকিছুর ভিতর কেমন বিলুপ্তপ্রায় অন্ধকার আম কাঁঠালের ঘন অরণ্যের ভিতর হারিয়ে যাছিল সেই অপূর্ব সুন্দর নিষ্পাপ মুখখানি।
বিকালে মন্দিরে ফিরছিলাম চেনা পথ ধরে। আম কাঁঠাল আর শুপারি গাছের সারি ঘেরা মালো বাড়ির কাছে আসতেই কালকের সেই রমণী হঠাৎ আমার পথের পাশে এসে দাঁড়ায়, একটি খাবারের টোপলা আমার হাতে দিয়ে বলে — এখানে খেজুর গুরের সন্দেশ ও নারিকেলের নাড়ু আছে। ‘ তুমি এগুলো খুব পছন্দ করতে, তুমি খেয়ে নিও।’ এ কথা বলেই সে বাড়ির ভিতর চলে যায়।
বাকী পথটুকু আসতে আসতে আসতে ভাবলাম, আমি যে খেজুর গুরের সন্দেশ আর নারিকেলের নাড়ু পছন্দ করি, তা উনি জানল কী ভাবে?
এই অকাল বিধবা মেয়েটির সম্বন্ধে একটু জানবার চেষ্টা করলাম, তার নাম- সন্ধ্যা রাণী। স্বামী — স্বর্গীয় কার্তিক চন্দ্র কৈবর্ত। বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্বামী কলেরায় মারা যায়। একটা পুত্র সন্তান আছে। সে এখনও শ্বশুর বাড়িতেই থাকে।
পরেরদিন সন্ধ্যাবেলায় সন্ধ্যা রাণী মন্দিরে আসে প্রসাদ দিতে। তখন আবছা আলো, আবছা অন্ধকার। আজও সে আমার ঘরের জানালার কাছে এসে থেমে যায়। সে প্রসাদের একটি টোপলা আমার জন্য আলাদা করে এনেছিল। সেটি আমার হাতে দিয়ে বলে — ‘এর ভিতরে মালপোয়া পিঠা, প্যারার ছাতু আর খেজুর গুর আছে। তুমি এগুলো খেও। তুমি মালপোয়া পিঠা খুব পছন্দ করো, তাই নিয়ে এলাম।’
এগুলো দিয়ে সন্ধ্যা রাণী দ্রুত মন্দির ভিতর চলে যায়। চলে যাওয়ার পর ভাবছিলাম, আমি তো মালপোয়া পিঠা খুব পছন্দ করি। মাকে প্রায়ই বলতাম — মালপোয়া পিঠা বানিয়ে দিতে।
তখন অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিক। স্টেশন থেকে ফিরে আসতে সন্ধ্যা রাত্রি হয়ে যায়। বেশ শীত, এবং কুয়াশা পড়েছে। রাস্তার পাশের বনফুল, ভাঁট ও কুঁচচন্দনের গন্ধ আসছে। রাস্তা নির্জন, কেউ কোনো দিকে নেই। কৈবর্ত বাড়ির কাছে আসতেই দেখি, লিচু গাছের আড়ালে সন্ধ্যা রাণী দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই আমার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল —
‘বেশ শীত পড়েছে। তোমার ঠান্ডা লাগবে। এই কাঁথাটা দিলাম। তুমি গায়ে দিও।’
আমার এখান থেকে স্টেশনে যাওয়ার দুটো পথ। একটি পদ্মার পাড় ধরে, আর একটি গ্রামের ভিতর দিয়ে মাঠ পেড়িয়ে। যখন যেটা মন চায় আমি সেই পথ দিয়েই আসা যাওয়া করতাম। তবে বেশিরভাগ যেতাম পদ্মার কূল ধরে, আর ফিরে আসতাম গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে।
সন্ধ্যা রাণীর বাড়ির কাছে আসলেই মনটা একটু উতলা হয়ে উঠত। ভাবতাম সে হয়ত দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো দিন তার দেখা পেতাম, কোনো কোনো দিন দেখা হত না। বুঝতে পারতাম, বাড়ির লোক কাছাকাছি থাকলে সে পথের পাশে আসত না। হয়ত দূরে আড়াল থেকে আমাকে দেখত।
একবার খুব জ্বর হয় আমার। কয়েকদিন অফিসে যেতে পারি নাই। সন্ধ্যা রাণী হয়ত আমাকে দেখবার জন্য পথের ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছে। আমাকে দেখতে না পেয়ে কারোর কাছ থেকে জানতে পেরেছে আমার জ্বর হয়েছে। একদিন সে মন্দিরে পূজা দেওয়ার নাম করে চলে আসে। তখন কালী সন্ধ্যা। অন্য কারোর অলক্ষ্যে সে আমার ঘরে প্রবেশ করে। সিওরে তখন কেরোসিন শিখা জ্বলছিল। সেই আলোয় আমি সন্ধ্যার মুখখানি দেখতে পেলাম। কেমন বিমর্ষ ও শুকনো সে মুখ! কাঁদিলে চোখের পাতা যেমন ভারী হয়, তেমন তার মুখখানি মলিন হয়ে আছে।
সে কিছু পথ্য এনেছিল। কবিরাজের কাছে থেকে
জ্বরের বটিকাও এনেছে। আমার কপালে সে হাত রাখে। দেখে জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ সে কলসী থেকে বাটিতে জল ঢেলে তার শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ভিজিয়ে আমার কপালে জলপটি দিতে
থাকে।
সে সন্ধ্যা রাতে সন্ধ্যা রাণী আমাকে মায়ের মতো সেবা সুশ্রুষা করেছিল।
একদিন অপরাহ্ণে কৈবর্ত বাড়ির পথ ধরে ঘরে ফিরছিলাম। খুব সুনশান নির্জন লাগছিল চারদিক। আমবাগানে পাখিগুলো শ্রান্ত সুরে কিচিরমিচির করে ডাকছিল। মনে হল এই জীবন এমনই স্নিগ্ধ ছায়াশীতল পাখির গানে ভরা, অপরাহ্ণের ঐ পাখির গানের মতো স্নিগ্ধ শান্ত। চারদিকে বৃক্ষের পত্র পল্লবে উপর তখন বিকালের রৌদ্র পড়ে চিকচিক করছিল।
সন্ধ্যা রাণীর বাড়ির কাছে আসতেই আমার দুচোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাকে। দেখলামও, সে অর্ধেক ঘোমটা টেনে পুকুরের চালায় জবা ফুলের ঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে কাছে এগিয়ে আসে। ঘোমটা অনাবৃত করে ফেলে। শান্ত মায়াদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আজ এই অপরাহ্ণের আলোয় তার মুখ ঝিকমিক করছিল। ঠোঁট দুটো বিনম্র, কিন্তু কম্পিত।
এমন সুশ্রী মুখশ্রী আমি কখনো দেখিনি। মনে হল তাঁর ডাগর কালো চোখদুটির অন্তরালে অতল দীঘির জল। তার সমস্ত দেহ গড়নে বৈচিত্রে ভরা, সব মিলে সন্ধ্যা রাণীকে অপূর্ব সৌন্দর্য-শোভা-মন্ডিত লাগছিল। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ ছিলাম।
আমি একটু দ্বিধা করছিলাম, কেউ না আমাদের দেখে ফেলে। সেই বলছিল — ‘কেউ নেই। সবাই গেছে পদ্মায় ইলিশ ধরতে।’
সে আরও বলছিল, তোমাকে আমার মায়া লাগে কেন, জানো?
— না, আমি জানি না।
— তোমার মুখচ্ছবি অবিকল আমার মৃত স্বামীর মতো। তাই তোমাকে আমি চেয়ে দেখি। তোমাকে মায়া করি। তোমাকে সেবা যত্ন করতে ইচ্ছে করে।’
— তোমাকে আমার দিদির মতো লাগছিল। আমার তো কোনো দিদি নাই।
— তা ভাবো। আমি তোমাকে স্বামী দেবতা জ্ঞান করি।
— আমি কী তোমাকে দিদি ডাকব?
— না, তুমি আমাকে ‘সন্ধ্যামণি’ ডাকবে। আমার স্বামী আমাকে এই নামে ডাকত।
— আমি যাই।
— একটু দাঁড়াও।
সন্ধ্যামণি ঘোমটা টেনে আমার কাছে এসে আমাকে প্রণাম করে। আমি বলি– ‘কী করছ তুমি! আমি তোমার চেয়ে বয়সে ছোট। আমার পা ছুঁয়ো না। আমার পাপ হবে।’
— আমি পাপ পূন্য জানি না। আমি জানি তুমি আমার স্বামী।
ঘরে তেমন খাবার ছিল না আজ। খেলামও না কিছু। না খেয়েই শুয়ে পড়ি। ঘুম আসছিল না চোখে। রাত্রি গভীর হতে থাকে। পুকুর পাড়ের আমগাছে বসে প্যাঁচা ডাকছিল অমঙ্গল সুরে । বাইরে ঝিঁঝি পোকাদের ঝিঁঝি শব্দ কেমন ক্রন্দনধ্বনির মতো লাগছিল। আমি যখন সন্ধ্যামণির কাছে থেকে আসি, তখন তার চোখ জলে ভরা ছিল! মনে হয়েছিল কোন্ দেবালয়ের এক নিষ্পাপ দেবীমূর্তি সে। তার মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারিনি। আমিও অশ্রুসিক্ত ছিলাম।
সকালে পদ্মার কূল ধরে হেঁটে হেঁটে স্টেশনে চলে যাই। আজ পদ্মার জল, মাঝিদের ভাটিয়ালি গান, নদীর উপর নীল আকাশ, কোনো কিছু ভালো লাগছিল না। বিষণ্ণ চিত্তে অফিসে আসি।
টিকেট ঘরে বসে আছি। আজ যাত্রীদের তেমন ভীড় নেই। দু একটা করে টিকিট বিক্রি হচ্ছিল। কর্মের মধ্যেও বিষণ্ণতা কিছুতেই কাটাতে পারছিলাম না!
ঘুরে ফিরে শুধু সন্ধ্যামণির কথাগুলো কানে বাজছিল।ভাবছিলাম, এ কী করে সম্ভব?
ডাকপিয়ন একটি চিঠি দিয়ে যায়। বাবা লিখেছে —
কল্যাণীয়েষু অরুণ,
স্নেহ নিও। আশা করি ঠাকুরের কৃপায় ভালো আছো। তোমার একটি সুখবর আছে। তহশিলদার পদে আজই তোমার একটি নিয়োগ পত্র পাইলাম। কল্যাণীতে তোমার পোস্টিং। তুমি যদি এখানে যোগদান করতে চাও, পত্রপাঠ তুমি চলিয়া আসিবে। বাড়ির সবাই ভালো আছে।
ইতি — তোমার পিতা।
আমি সাথে সাথে স্টেশন মাস্টারের মাধ্যমে কোলকাতা আঞ্চলিক রেল আধিকারিকের বরাবর পদত্যাগ পত্র জমা দেই। পদত্যাগ পত্র গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত ছুটির দরখাস্ত দেই। বলি, পদত্যাগ পত্র গৃহীত হলে আমাকে পত্র দ্বারা অবগত করবেন।
আমার ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর হয়।
অফিসের যাবতীয় হিসাব নিকাশ ও কাগজপত্র বুঝিয়ে দিতে দিতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সহকর্মীদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যা রাত্রিতেই ঘরে চলে যাই।
মন্দিরে গিয়ে পুরোহিত মহাশয়ের কাছে থেকে বিদায় নেই। এবং বলি আমার নতুন চাকুরি হয়ে যাবার কথা। আরও বলি, আমি প্রত্যুষেই চলিয়া যাইব।
রাতেই বাক্স পেটরা গুছিয়ে রাখি। ভোরে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ভাবলাম, পদ্মার কূল ধরে না যেয়ে আজ গ্রামের মেঠো পথ দিয়েই স্টেশনে যাব। যদি সন্ধ্যামণির একটু দেখা পাই!
কৈবর্ত বাড়ির সামনে গিয়ে পা থেমে যায়। একটু দাঁড়ালাম। চারিদিকে চেয়ে দেখলাম, কোথাও সন্ধ্যামণি আজ দাঁড়িয়ে নেই। আমগাছের পিছনে, লিচু তলায়, পুকুর পাড়ে জবাফুল ঝাড়ের আড়ালে – কোথাও নেই।অন্য কোনো আড়াল থেকেও সে আমাকে হয়ত দেখছে না! এখন যে অসময়। এই পথ দিয়ে এখন আমার চলে যাবার কথা নয়।
ধীর পায়ে সামনের দিকে এগুতে থাকি। পা কেমন
যেন অসার হয়ে আসছিল। তাল-শুপারি বাগানে বসে আজ কোনো পাখি ডাকল না। চালতা, গাবফুল, ভাঁটফুল, কুচচন্দনের কোনো গন্ধ এল না কোথাও থেকে। আস্তে আস্তে হেঁটে বৃক্ষরাজির ছায়া পেড়িয়ে খোলা প্রান্তরে যেয়ে পৌছলাম।
পূবের সূর্যের রোদ পড়ে ঝলমল করছিল ফসলের ক্ষেত। দূর পদ্মা থেকে বয়ে আসছিল শীতল বাতাস। অসরতা ভেঙে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম স্টেশনের দিকে।
তারপর পঁয়ত্রিশ বছর চলে গেছে।
তারপর জীবনে কত কিছু পেলাম। কত ডিগ্রি নিলাম। কত বড়ো কর্তাব্যক্তি হলাম। কত বড়ো ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলাম। কত শিক্ষিত সে। কত দেশ ঘুরেছি।
কত মানুষ দেখেছি। কত মৌন নদী। কত পর্বতেের গাত্রে দেখেছি কত লতাগুল্ম, পাহাড়ি ফুল। কত পূর্ণিমা রাত্রি উপভোগ করেছি।
সবকিছুর ভিতর একজন অনাদৃত, একজন উপেক্ষিত, একজন দলিত বিধবা মেয়ের মুখ মনে পড়েছে। কত রাশি রাশি আনন্দের মাঝে, সেই কবেকার কতদূরের এক পল্লীবালা অপার্থিব অশ্রু ঝরিয়ে গেছে আমার জীবনের সকল আনন্দ বেদনার উপর।
এখনো কী সন্ধ্যার মেঘমল্লারে সেই অনাদরের সন্ধ্যামণি ফুলটি অশ্রু জলে ভিজে?
৯. রাণুদি
তখন কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ি। ঢাকায় থাকি। একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি যাই। বাড়িতে যেয়ে দেখি, মা একটু অসুস্থ। বাড়িতে তেমন কেউ নেই। আমার খাওয়া নাওয়া অসুবিধা হবে জেনে, মা বললেন, কয়েকদিনের জন্য রাণুকে নিয়ে আসি। ও এসে থেকে রান্নাবান্না গুলো করতে পারবে। এক কাজ করো, তুমি রাণুকে যেয়ে নিয়ে আসো।
রাণুদি মার এক দূর সম্পর্কের বোনের মেয়ে। খুবই দরিদ্র তারা। রাণুদি পঞ্চম ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছিল। তারপর আর করতে পারে নাই। মা তার এই বোনের মেয়েটিকে প্রায়ই বাড়িতে তার কাছে এনে রাখত। তাঁর বিপদে, রোগে, শোকে এবং তার একাকীত্বে।
রাণুদি আমার চেয়ে ছয় সাত বছরের বড়ো ছিল। আমাকে খুব আদর স্নেহ করত। আমি তাকে রাণু বুবু না বলে রাণুদি ডাকতাম। এই ডাকটি কী ভাবে যে হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারি নাই। সম্ভবত তখন ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম’ গানটির প্রভাব থেকে।
রাণুদি আমাকে কেমন স্নেহ আদর করত, তার একটি ঘটনা বলি, একবার এক চৈত্র মাসে আমাদের পুকুরে মাছ মারছিলাম। পানি অত ছিল না। হাত দিয়ে পুকুরের কাদা ছেনে ছেনে মাছ ধরতাম। পুঁটি, বাইম, টাকি,শিং, মেনি, টেংরা এই সব মাছ। এই মাছ মারতে যেয়ে আমার হাতে ঢোড়া সাপে কামর দিয়েছিল। আমি তো জানি না, ঐটা ঢোড়া সাপ ছিল। আমি হাউমাউ করে কেঁদে মার কাছে চলে এসেছিলাম। সেদিন রাণুদি বাড়িতেই ছিল। সে আমার সর্প দংশিত জায়গায় মুখ লাগিয়ে চুষে বিষ আনতে থাকে। বিষ এসেছিল কী না, সে কথা আজ আর মনে নেই।
তখন সিক্স সেভেনে পড়ি। সেইবার আমার জল বসন্ত হল। এটি একটি ছোঁয়াছে রোগ। এই রাণুদি আমার সেবা শুশ্রূষা করতে থাকে । গরম পানিতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে গা মুছে দিত। কী এক পাউডার জাতীয় ঔষধ ডাক্তার দিয়েছিল, সেগুলোও সারা শরীরে লাগিয়ে দিত।
এইরকম আরও অনেক স্নেহ ভালোবাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে রাণুদিকে নিয়ে।
রাণুদির বিয়ে হয়ে গেছে সেও চার পাঁচ বছর আগে। বিয়ের পরেও আমাদের বাড়ির বিভিন্ন উৎসব পার্বণে, বিপদে আপদে মা তাকে নিয়ে আসত। এবং তারও যখন মন চায়, সেও চলে আসত।
রাণুদির স্বামীর বাড়ি সুবর্ণগাঁতি। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ ছয় মাইল দূরে। অজ পাড়া গাঁও। কোনো গাড়িঘোড়া নেই। মেঠো ধূলি পথে যেতে হয়। আমি পরের দিন সকালে একটি ছাতা নিয়ে রোদ্র ধূলির পথ হেঁটে হেঁটে, ইছামতীর নদীর খেয়া পার হয়ে রাণুদিদের বাড়ি চলে যাই।
রাণুদি তো আমাকে দেখে যেন চন্দ্রতারা হাতে পেল। আমাকে ঘরের বিছানায় বসিয়ে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে থাকে। তালপাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। সে মুরগী ধরে তা জবাই করল। শীতল পাটিতে বসিয়ে নিজ হাতে আমাকে খাওয়ালো। সে এমনভাবে খাবার পরিবেশন করছিল যে, পুরো মুরগীটা যেন সে আমার জন্য রান্না করেছে।
রাণুদি জানত, মা আমাকে খাবারের পরে দুধকলা দিয়ে ভাত খাওয়াত। সেও তাই করল।
আমি রানুদিকে বললাম, মা তোমাকে আজই আমার সাথে যেতে বলেছে।
— খালামা যখন বলেছে, আমি অবশ্যই যাব। তা, আজকের দিন থাকো। কাল প্রত্যুষে আমরা রওনা হইব।
— না। মা আজকেই তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।
— আচ্ছ, আজই যাব।
রাণুদি ছোট্ট একটি টিনের বাক্সে তার কিছু কাপড়চোপড় তুলল।
পরন্ত বিকালে সূর্যের তীর্যক রোদ যখন ভাটা পড়েছিল, তখন আমি আর রাণুূদি বাড়ির পথে রওনা হই।
পল্লীগ্রামের মেঠো ধুলি পথ ধরে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম আমি আর রাণুূদি। বিকালের রোদ্দুর আস্তে আস্তে আরও কমে আসছিল। আকাশে কখনও সাদা মেঘ, কখনও ধূসর মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। মেঠো পথের দুধারে কখনও কাঁচা আউশ ধানের প্রান্তর। কখনও পাটক্ষেত, কখনও আখক্ষেত পড়ছিল প্রান্তেরের পর প্রান্তর। দিগন্ত থেকে ভেসে আসছিল সবুজ পাতার গন্ধ। কখনও গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে, কখনও হালোট পথ দিয়ে হাঁটছিলাম। ছাতিম আর আকন্দের ঝাড়ের ভিতর সোনাল গাছের হলুদ ফুলের মৌ মৌ গন্ধে মুখর ছিল !
কত বাড়ির গোয়ালে গরুর বাথান দেখি। ভিটায় ভিটায় আম গাছ, কাঁঠাল গাছ, সাজনা গাছ, লিচু গাছ ও কলা গাছের সারি। পথের ধারে কত নাম না জানা ঘাসফুল — এইসব দেখতে দেখতে, এইসবের গন্ধ নিতে নিতে, পথ চলতে চলতে রাণুদি একবার বলছিল — ‘রঞ্জু, তুমি আমার বাড়ি এসেছিলে! আমি কত খুশি হয়েছি। আমার বাড়িতে এ ছিল তোমার প্রথম আসা। আবার কবে আসবে তুমি ভাই !’
— আসব রাণুূদি। আবার তোমার বাড়ি আসব কোনো একদিন।
আমরা যখন ছোট ইছামতী নদীর খেয়া পার হয়ে এপার চলে আসি, তখন সন্ধ্যা হয়ে আসে। কিন্তু আকাশ জুড়ে দেখা দেয় কালো মেঘ। মেঘ ক্রমে এত কালো হয়ে আসছিল যে মুহুর্তে পথ ঘাট অন্ধকার হয়ে যায়।
অন্ধকারে দ্রুত একটি খোলা প্রান্তরের মাঝখানে চলে আসি। ততক্ষণে প্রবল বেগে বাতাস শুরু হয়ে গেছে। মুশুলধারে বৃষ্টি নামছে। বাতাস ক্রমে ঝড়ের রূপ নিতে থাকে। হাতের ছাতি উড়ে চলে যায়। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। দেখলাম রাণুদির হাত থেকে তার টিনের বাক্সটিও উড়ে চলে গেল। চারদিকে ঝড়ের শণশণ আওয়াজ হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘের গর্জনে কান তালা লেগে আসছিল।
প্রান্তরের মাঝখানে একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে এসে দাঁড়াই। গাছটির গোড়ায় আশ্রয় নেই। ঝড়ের গতি আরও বিকট রূপ নেয়। অশ্বত্থ গাছের ডাল ভেঙে উড়ে যাচ্ছিল। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাই। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাচ্ছিলাম।
রাণুূদি জানত বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসে। আর ভয়েও কাঁপছিলাম খুব। রাণুূদি আমাকে তার বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে।
তার শাড়ি অর্ধেক খুলে আমার মাথা ও শরীরে পেচিয়ে নিয়ে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখে। যেন আমি ভিজে না যাই। যেমন করে মা পাখি আগলে রাখে তার বাচ্চা পাখিকে পালকের ছায়ার তলে পরম মমতায়।
একসময় ঝড় থেমে যায়। বৃষ্টিও বন্ধ হয়। আমরা আবার পথে নেমে বিদ্যুতের আলো দেখে দেখে হাঁটতে থাকি।
বাড়ির কাছে যখন চলে আসি, তখন আকাশে কোনো মেঘ ছিল ন। আকাশ ভরে তারা উঠেছে। তারার সেই ম্রিয়মান আলো এসে পড়েছে রাণুদির মুখের উপর। সে আলোয় দেখলাম তার মুখখানি কী অপূর্ব জ্যোতির্ময়! কী পবিত্র।
১০. সামান্য আনন্দ
শহরের বাইরে একটি বাংলো বাড়িতে তখন একা থাকি। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে তখন কর্মরত ছিলাম।
বাংলো বাড়িটি সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশে অবস্থিত ছিল। আশেপাশে যারা বসবাস করতো তারা সবাই সহজ সরল মানুষ ছিল।
এলাকায় তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। রাতে হেরিকেন জ্বালাতে হতো ঘরে।
ঘরে কোনো রান্না বান্না হতো না আমার। খাবার খেয়ে আসতাম বাইরে হোিটেল থেকে।
প্রতিবেশি মানুষেরা আমাকে খুব ভালো জানতো। আমাকে ভালোও বাসতো। তারা আগলে রাখতো আমাকে সমস্ত সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দিয়ে। আমি একা থাকতাম, তাই আরো বেশি খেয়াল করতো আমার নিরাপত্তা ও প্রতিদিনের জীবন যাপনের উপর।
একদিন এক প্রতিবেশি লোক এসে অত্যন্ত মায়াপরবশ হয়ে বললো — আপনার ঘরদোর পরিস্কার রাখা ,বিছানাপত্র কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখার জন্য কাউকে দরকার। আমাদের জুলেখা এই কাজগুলো এসে করে দেবে।
আমি বললাম– ঠিক আছে। ও মাঝে মাঝে এসে টুকটাক কিছু কাজ করে দেবে না হয়।
জুলেখা সাত আট বছরের ছোট্ট বালিকা। সে কোনো কাজের মেয়ে নয়। ওর বাবা মা নিতান্তই ভালোবেসে, এবং আমাকে আপন মনে করে আমার অসুবিধার কথা ভেবে সাহায্য করার জন্য দিয়েছে মাত্র।
আসলে কাজ তেমন কিছুই না। আমি যখন অফিসে যেতাম, তখন জুলেখা এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি বেরিয়ে যাবার সময় ঘরের চাবিটি ওকে দিয়ে যেতাম। আমি যাবার পর ও ঘরে ঢুকে মেঝে ঝাড়ু দিতো। বিছানা গোছাতো। আলনায় আমার এলোমেলো কাপড়গুলো ভাজ করে রাখতো। টেবিলের বইপত্র খাতা, ফুলদানি গুছিয়ে রাখতো। এ্যসট্রে পরিস্কার করে রাখতো। জগে খাবারের পানি ভরে এনে রেখে দিতো।
আমি বেশির ভাগ সময় সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরতাম। জুলেখা বিকালে এসে হেরিকেনের চিমনি ও ফিতা মুছে কেরোসিন ভরে সন্ধ্যা বাতিটা জ্বেলে রেখে বাড়ি চলে যেতো।
রাতে আমি যখন বাড়ি আসতাম, তখন জুলেখা এসে ঘরের চাবিটা দিয়ে যেতো। আমি তালা খুলে যখন ঘরের ভিতর প্রবেশ করতাম, দেখতাম —
ঘর অন্ধকার নেই। আলো জ্বলছে।
একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছি। তখন জুলেখা বলছিল — ‘মামা, ছোট দেখে একটি ভাতের পাতিল, একটি কড়াই, একটি চামচ কিনে আনবেন। আমি ভাত রান্না করে রেখে দিব। আপনি এসে রাতে খাবেন। বাইরে কোথায় কী খান, অসুখ বিসুখ হবে।’ আমি বললাম, এসব রান্না বান্না হবে না। তুমি ছোট মানুষ রান্না করতে যেয়ে হাত পুড়ে ফেলবে।
জুলেখা আমার কথায় মন খারাপ করলো।
আমাকে এই কাজ করে দেয়ার বিনিময়ে জুলেখাকে কিংবা ওর বাবা মাকে কোনো আর্থিক সাহায্য করতাম না। এটা করলে জুলেখাকে এবং ওর বাবা মাকে ছোট করা হতো।
তবে ঈদের সময় ওকে নতুন জামা কিনে দিতাম। একজন মামা যেমন তার ভাগ্নীকে নতুন জামা কিনে দেয় তেমন।
এই ভাবেই দেড় দুবছর কেটে গেল। তারপর তো বিয়েই করলাম। ঘরে নতুন বউ এলো। জুলেখা ওর মামীকে দেখে সে কী খুশি। প্রায়ই এসে ওর মামীকে বিভিন্ন কাজে কর্মে সহায়তা করতো। আমার স্ত্রীও জুলেখাকে খুব স্নেহ করতো।
তারপর জুলেখা আরও বড়ো হলো। এবং ওর বিয়েও হয়ে গেল। একদিন ও শশুর বাড়ি চলে গেল।
অনেক দূরে ওর শশুর বাড়ি। আসেও না সে অনেক বছর। দেখাও হয়না বহুদিন। ওর বাবা মা ও অন্যত্র চলে গেছে। জুলেখা অনেকটাই বিস্মৃতি হয়ে গেছে।
একটি সামান্য স্মৃতিকথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, কাপড় চোপড় পরে সেন্ট স্প্রে করছিলাম আমার জামায় ও চুলে। জুলেখা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে বিস্ময় চোখে তা দেখছিল! আমি ওকে ডেকে বলি — ‘কী লাগিয়ে দিব একটু’! আমি ওর জামায় একটু স্প্রে করে দেই। সেন্টের গন্ধ পেয়ে ওর মুখে কী আনন্দের হাসি!
পথে নেমে সেদিন হেঁটে হেঁটে যখন বাস স্টান্ডের দিকে যাচ্ছিলাম, দেখি, সারা ভুবন জুড়ে ঝলমল করছে রোদ্দুর। আকাশ অথৈ নীল। সবকিছুর ভিতর আমি বালিকার মুখের হাসিটি দেখতে পাচ্ছিলাম। এক অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করছিলাম আমার অন্তরে ও বাইরে। কিছু আনন্দের বুঝি কোনো সীমারেখা নেই। তা যতোই তুচ্ছ হো। তা অসীম। বালিকার ঐ মুখের হাসির মতো নির্মল।
১১. অতিথি
একদিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে একজন লোক আসে। সে রাত্রি যাপন করে পরের দিন সকালেই চলে যাবে। এইরকম অতিথি লোক তখন আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসত। তারা রাত্রিযাপন করে ভোরেই চলে যেত।
আমাদের বাড়ি গঞ্জে থেকে পাঁচ মাইল দূরে। আবার অনেকেরই বাড়ি আছে গঞ্জে থেকে পনেরো ষোল মাইল দূরে। তখন পায়ে হেঁটে মানুষ শহরে আসা যাওয়া করত। দূরের মানুষরা সকালে হেঁটে হেঁটে শহরে আসত এবং কাজ শেষ করে বিকালেই তারা বাড়ি ফিরে যেত।
বাড়ি ফিরে যেতে অনেকেরই পথে রাত হয়ে যেত। এবং পথিমধ্যে তারা কোনো ধনী গেরস্থ বাড়িতে অতিথি হতো। তেমনই একজন পথিক অতিথি হয়ে সেদিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে এসেছিল। তিনি শুধু রাতটি থাকবেন।
আামাদের কাচারি ঘরের অতিথি রুমে লোকটির থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তাকে রাতের খাবারও দেয়া হয়।
লোকটি তার পরিচয় দিয়েছিল, নাম মো: হারেজ মন্ডল। গ্রাম– শিয়ালপোতা, কাজিপুর। থানার একেবারে শেষ প্রান্তে তার বাড়ি। কিন্তু আমাদের বাড়ির কেউই তার এই গ্রামটিকে চিনতে পারল
না।
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমার একটি স্বভাব কৌতূহল ছিল, এই সমস্ত মানুষের সাথে গল্প গুজব জুড়ে দেয়া।
লোকটির বয়স চল্লিশ হবে। গায়ের রঙ ফর্সা।
বেশ সুন্দর দেখতে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল গায়েনদের মতো লম্বা লম্বা। বাম হাতে পিতলের বালা পরা। গায়ে দুই পকেটওয়ালা ঢোলা চেক জামা। পরনে লুৃঙ্গি। দেখতে অনেকটা আবার তান্ত্রিকদের মতোও লাগে।
তখন সন্ধ্যারাত্রি পার হয়েছে। ঘরের ভিতর কেরোসিন কুপী জ্বলছে। হারেজ মন্ডল চোকির উপর বিছানায় বসে আছে। আমি পাশে একটি কাঠের বাদামি টুলে বসে ওনার সাথে গালগল্প জুড়ে দিয়েছি।
আমি তাকে প্রশ্ন করি — ‘ চাচা, আপনি কী রাতে পথ চলতে ভয় পান? এই যে রাত হয়েছে দেখে বাড়িতে গেলেন না। আমাদের বাড়িতে থেকে গেলেন।’
— আগে ভয় পেতাম না। যখন তরতাজা যুবক ছিলাম। এখন একটু ভয় পাই।
— ভয় পান কেন?
— সে অনেক কাহিনি। বলতে গেলে রাত্রি অনেক হয়ে যাবে।
— আপনি বলেন। আমি শুনব।
— আচ্ছা, তবে শোন।
তখন আমার বয়স চব্বিশ পঁচিশ। একটি কাজে সেইবার গঞ্জে এসেছিলাম। কাজ সেরে শহর থেকে বের হতে হতে আসর হয়ে গিয়েছিল। তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত আসতেই এশা ওয়াক্ত হয়ে যায়। ভাবলাম, আজ পূর্ণিমার চাঁদের রাত্রি। কোথাও অতিথি হয়ে রাত্রি যাপন করব না। রাতেই বাড়ি চলে যাব।
কার্তিক মাসের পূর্ণিমার চাঁদ ছিল ! রাত্রি ছিল দিনের মতো একদম ফকফকা। শুকনো পথঘাট। আমি পথ চলতে থাকি। জোর পায়ে হাঁটতে থাকি বাড়ির দিকে। বেশির ভাগ পথ ছিল মেঠো। দুপাশে আমন ধানের ক্ষেত। দুধ পাকা ধানের গন্ধে ভরে উঠছিল মন। জোছনার ঢেউ খেলছিল আধা পাকা ধানের উপর। আর ধানের সোনালি সবুজ পাতা দুলছিল রাত্রির বাতাসে।
কাছেই কুশাল ক্ষেতের ভিতর শিয়াল ডাকছিল হুক্কা হুয়া করে। আমার পায়ের পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে যায় দুটি কুকুর। ওরাও ভুগভুগ করেছিল। কুত্তার ডাক শুনে শিয়াল তার ডাক থামিয়ে দেয়। আমি নির্ভয়ে হাঁটতে থাকি। দুতিনটি গাঁও পেরোই মোটামুটি জন কোলাহলে।
তারপরের গ্রামটির ভিতরের পথ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, দেখি সমস্ত গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। মানুষেরও পথ চলার শব্দ নেই। কারোর কোনো সাড়া শব্দ নেই। আম গাছে বসে প্যাঁচা ডাকছিল। পুকুর থেকে ব্যাঙের ডাক আর পাশের ঝোঁপঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জনধ্বনি শোনা যাচ্ছিল কেবল।
গ্রামটি পেরিয়ে আবার খোলা মাঠের পথ দিয়ে হাঁটতে থাকি। কিছুদূর যেতেই দেখি– একটি ভিটের মতো জায়গা। এটি ছিল একটি কররস্হান। ভিতরে দেখি, পরনে ছেঁড়া ছালা পরে একটি জট পাগল লোক দাঁড়িয়ে আছে । ও সম্ভবত মরা মানুষের মাংস খায়। আমাকে দেখে সেই পাগলটি তেড়ে আসে। আমি দৌড় দেই। এক দৌড়ে চলে যাই একেবারে নদীর ঘাটে।
ঘাটে যেয়ে দেখি, খেয়া নৌকা নেই। খেয়ামাঝি নৌকা নিয়ে আগেই চলে গেছে। আমি গামছা পরে সাঁতরে নদী পার হই।
ওপার যেয়ে নদীর তীরে বসে একটু বিশ্রাম নেই। পেটে তখন ভীষণ খিদা। সেই কখন থেকে হেঁটে হেঁটে আসছি। উঠে যে আবার হাঁটবো, সেই শক্তি পাচ্ছিলাম না । আকাশে পূর্ণিমার ঝলমলে চাঁদ। কিন্তু ভালো লাগছে না জোছনাও।
নদীর ঘাট থেকে বেশ দুরে দেখতে পাই , একটি কুঁড়ে ঘরে আলো জ্বলছে। এই জনমানবহীন নদীর কূলে, এই খোলা নির্জন প্রান্তরে এই আলোটুকু দেখে মনে একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। ভাবলাম, ওখানে যেয়ে একটু বিশ্রাম নেব। যদি জলপানি কিছু খেতে দেয় তাহলে খেয়ে রাতটুকু ওখানেই ঘুমাব।
সেই জনহীন নিঝুম রাতে নদীর কূল ধরে ঐ আলো জ্বলে থাকা ঘরটির দিকে হাঁটতে থাকি। হাঁটছি যত ততই মনে হচ্ছে আলোটা দূরে সরে যাচ্ছে। কেমন যেন পোড়া কাঠের গন্ধ পাচ্ছিলাম। শ্মশানে মানুষ পোড়ালে যেমন গন্ধ, তেমন গন্ধ আসছিল তীব্র ভাবে। গা কেমন ছমছম করে উঠল। বুঝতে পারলাম এটি আসলেই একটি শ্মশান ঘাট।
সামনের দিকে হাঁটছি অবশ পায়ে। কিছু দূরে যেতেই পায়ে পড়ল মানুষের মাথার খুলি আর হাড়গোড়। কোথা থেকে শনশন শব্দ করে উড়ে আসে চারপাঁচটি শকুন। ওরা আমার সামনে পথ আটকে রাখে। কুৎসিত ঘরঘর আওয়াজ করে তেড়ে আসে শকুনগুলো । আমি চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলি।
কিছুক্ষণ পরে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পুনরায়
চোখ খুলি। দেখি শকুনগুলো নেই। দূরে তাকিয়ে দেখি, জীর্ণ কুটিরে তখনও মিটমিট করে আলো জ্বলছে।
আমি আবার হাটঁতে থাকি। কিছু দূর যেতেই পথের উপর দেখতে পাই , একটি মৃত মেয়ে মানুষের লাশ। বয়স পনের যোল হবে। অর্ধনগ্ন, চুল আলুথালু। লাশের তখনও গন্ধ বের হয়নি। আমি পাশে দিয়ে হেঁটে চলে যেতেই পিছনে থেকে নারী কণ্ঠে শুনতে পাই –‘এই! আমাকে ফেলে রেখে তুই কই যাস?’
আমি ভয়ে আৎকে উঠি। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি, লাশটি উঠে বসে আছে। বিকট কালী চেহারা। সাদা দাঁত বের করে কটমটিয়ে বলছে — ‘তোর জন্য আমি বসে আছি। আয় আমার সাথে। তোকে আমি জলে ডুবিয়ে মারব।’
আমি চকিত ঘুরে সামনের দিকে ঝাইরা দৌড় দেই। এক দৌড়ে চলে আসি কুঁড়ে ঘরটির কাছে। তখনও ঘরের ভিতর টিম টিম করে আলো জ্বলছে।
ঘরটির চালা ছোনের ও বেড়া পাট সোলার। আমি ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখি একটি স্ত্রীলোক খড়- পাতার বিছানার উপর বসে আছে। মাথায় ঘোমটা টানা। বয়স বোঝা গেল না। সামনে কুপী বাতি জ্বলছে। মনে হলো সে বসে বসে কী যেন ধ্যান করছে।
একটু ভয় পাচ্ছিলাম, ওনাকে ডাকব কী ডাকব না। খিদেয় এত ক্লান্ত ছিলাম যে, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। তাই বাইরে বেড়ার সাথে ঠেস দিয়ে বসে পড়ি। জোছনা তখনও থকথক করে ঢলে পড়ছিল প্রান্তরে ও নদীর কূলে কূলে ।
ঘরটি একদম নদীর কূল ঘেসে। পাশেই ছোট একটি ঘাট। চেয়ে দেখি, কয়েকজন সুন্দরী রমণী বুকের কাপড় ফেলে স্নান করছে। স্নান শেষে তারা নগ্ন অবস্থায় ঘাট বেয়ে ঘরটির দিকে এগিয়ে আসছে। আমি মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু পরই ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ শুনতে পাই। আমি মাথা তুলে তাকাতেই দেখি, এত ঘোড়ার পায়ের শব্দ নয়। মেয়েগুলোই ঐরকম শব্দ করে হেঁটে আসছে।
মুহূর্তেই দেখতে পেলাম কোনো মেয়েরই মাথা নেই। তাদের মাথা কাটা গলা থেকে তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে। আমি জোরে আর্ত চিৎকার দিয়ে ঘরটির বাঁশের চাটাইয়ের দরজা ঠেলে আচমকা ভিতরে ঢুকে পড়ি ।
স্ত্রীলোকটি আমাকে দেখে বিস্ময়ে বলে — ‘ তুমি কে? এত রাতে আমার ঘরে?’
কন্ঠ তার ভাঙা ভাঙা এবং বিকৃত। আমি হাত পা কাঁপতে কাঁপতে হাত জোড় করে বলি — ‘আমাকে তুমি বাঁচাও।’
আমার অসহায় অবস্থা দেখে, সে একটু দয়াপরবশ হলো। আমি বললাম — ‘আমাকে এক গ্লাস পানি খেতে দেবে?’ সে আমাকে একটি মাটির গ্লাসে করে পানি খেতে দেয়। কাঁদো কাঁদো করে আবার বললাম, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে , কিছু খাবার থাকলে খেতে দেবে?’ স্ত্রীলোকটি আমাকে তবাকে করে পোড়া মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে দেয়। আমি তা খেয়ে নেই ।
খাওয়া শেষ হলে স্ত্রীলোকটিকে বলি — ‘তুমি আজ রাতের জন্য আমাক একটু তোমার ঘরে অতিথি করে রাখবে?’ সে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলল — ‘আচ্ছা’।
এই পর্যন্ত বলে হারেজ চাচা থামলেন। পকেট থেকে টেন্ডু পাতার বিড়ি বের করে একটি বিড়ি ধরালেন। সে মনের সুখে, নাকি মনের দুঃখে বিড়ি টানছিলেন, আমি আমার সেই অল্প বয়সে তা বুঝতে পারিনি। আমি তাকে বলি — ‘তারপর কী হলো চাচা?’
সকালবেলা যখন চলে আসবো , তখন ঐ স্ত্রীলোকটিকে বলি, রাতে কুপিটি জ্বলে জ্বলে নিভে গেল হঠাৎ করে ! চাদের আলোও আসেনি ঘরে। তোমার মুখখানি দেখতে পারিনি। একটু ঘোমটা সরিয়ে মুখটি দেখাবে ?’
মেয়েটি আস্তে আস্তে মুখ থেকে তার ঘোমটা সরিয়ে ফেলে। আমি তার মুখ দেখে ভয়ে আৎকে উঠি! আমার অন্তর আত্মা কেপে উঠে। অস্ফুট কণ্ঠে শুধু বলি — তুমি???
হারেজ চাচা আমাকে বললেন, অনেক রাত হয়েছে। এবার যেয়ে তুমি ঘুমাও। বাকীটুকু সকালে বলব।
সকালে আমার ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে। কাচারি ঘরে যেয়ে দেখি — হারেজ চাচা চলে গেছে।
১২. প্রাণ ভরিয়ে
নতুন বিয়ে করেছি। মেস ছেড়ে দিয়ে কলাবাগানে বাসা ভাড়া নিয়েছি। বউকে নিয়ে উঠি সেই বাসায়। দুই রুমের ছোট্ট টিনসেডের একটি বাড়ি।
ছোট বাসা হলেও আঙিনা অনেক বড়ো। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। ঘরটা পিছনের দিকে। সামনে ডানে বামে খালি জায়গা। গলির দিকে বাসায় ঢোকার গেট।
ঘরের সামনের কোণে একটি ঝাঁকড়া আমগাছ থাকলেও বাকী খালি জায়গায় ঘাস ও বিভিন্ন লতা গুল্মে জঙ্গল হয়ে আছে। একদিন বাড়ির মালিককে আমি বললাম — ‘আমি কী জঙ্গল পরিস্কার করে খালি জায়গায় কয়েকটি ফুল গাছ লাগাতে পারি?’ মালিক বললেন, ‘অবশ্যই লাগাতে পারেন। এত ভালো কথা। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
আমার স্ত্রী থানা শহরের মেয়ে। স্থানীয় কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। বাবা স্কুল মাস্টার। মা গৃহিণী। দুই ভাই বোন। ছোট সুখী পরিবার। হারমনিয়াম বাজিয়ে সে ভালো রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে। স্কুল কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে গান গাইত।
তাকে এখানে পড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে অভিমানহীন ভাবে বলেছিল — আমি শুধু তোমার ঘর সংসার করব। আমাকে পারলে একটি হারমনিয়াম কিনে দিও। যখন মন খারাপ লাগবে তখন ঘরে বসে গান গাইব।’
বিয়ের প্রথম মাসে বেতন পেয়ে তাকে একটি হারমনিয়াম কিনে দেই। প্রথম দিনে প্রথম যে গানটি সে গেয়ে শোনায়েছিল —
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি
পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে
চাই নি।
একদিন অফিস থেকে এসে তাকে বলি, কী ফুল তুমি পছন্দ করো, সেই ফুল গাছ আঙিনায় লাগাব।
— আমার প্রিয় ফুল গন্ধরাজ। তোমার কী ফুল পছন্দ?’ আমি বললাম, আমার পছন্দ জবা। উল্লেখ্য আমার স্ত্রীর নাম জবা।
এক শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর দিনে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে আমরা দুজন বেশ কয়েকটি জবা আর গন্ধরাজের চারা রিক্সার হুডি ফেলে ভিজতে ভিজতে কিনে এনে আঙিনায় লাগিয়ে দেই।
খুব অল্প সময়েই ফুলগাছ গুলো বড়ো হতে থাকে। এবং একসময় গাছগুলোতে ফুুল ফুটতে থাকে। যেদিন প্রথম জবা ফুল ফোটে, সেদিন কাকতালীয় ভাবে জবার জন্মদিন ছিল।
অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বাসায় আসি।ফেরার পথে জবার জন্য গাওসিয়া মার্কেট থেকে একটি সবুজ রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি কিনে নিয়ে আসি।
বিকালে ওকে বললাম — শাড়িটি পরো। জবা শাড়িটি পরে। আমি দুটো জবা ফুল ছিঁড়ে এনে ওর খোঁপায় পরিয়ে দেই। সে হাতে কাঁচের চুড়ি পরে। কপালে লাল টিপ ও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। খুব ভালো লাগছিল ওকে। যেন কুমুদিনী।
আমরা একটা খোলা রিকশা করে শেরেবাংলা নগর চন্দ্রিমা উদ্যানে চলে যাই। পরন্ত বিকালের নীল আকাশ দেখতে দেখতে আর নাগরিক কোলাহল পেরিয়ে আমরা উদ্যানে চলে যাই। পথে যেতে যেতে জবা গুনগুন করে গেয়েছিল —
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি।
উদ্যানের সবুজ ঘাসে বসে সেদিন দুজন কত কথাই বললাম। কত স্বপ্নের কথা। জীবনের কথা। ঘর সংসারের কথা। সন্তান নেবার পরিকল্পনার কথা। আরো কত কথা। কথা বলতে বলতে একসময় সব কথা ফুঁড়িয়ে যায়। পাশে হাস্নাহেনার ঝাড় থেকে সুবাস ভেসে আসছিল। উদ্যানের সন্ধ্যার পাখিদের কলরব থেমে গেল।
নিরবতা ভেঙে আমি জবাকে বললাম — ‘এখানে আজ কোনো গান হল না যে!’
জবা আমার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলেছিল —
‘এখন গান নয় গো, আজ আমরা দুজন শুধু দুটো প্রাণের হব। চলো, ঘরে ফিরে যাই।’
আলো আঁধারে দুজন হাত ধরে হাঁটতে হাটঁতে উদ্যানের বাইরে চলে আসি। আবারও একটি খোলা রিকশা করে আকাশ ভরা তারা দেখতে দেখতে বাসায় চলে আসি।
রাতটি ছিল স্বপ্ন আর ঘুম জড়ানো। জানালা খোলা ছিল। জবাফুল গন্ধ বিলিয়েছিল গন্ধরাজের গায়ে। কী এক আশ্চর্য দ্যোতনা। বাতাস এসে কথা বলেছিল আমাদের কানে কানে। যেন —
দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ,
আমার চিত্তে মিলি একত্রে তোমার মন্দিরে উছাসে।
সকালে আমার আগে ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে এমনিতেই বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়াই৷ আঙিনায় চেয়ে দেখি– ঘাসের উপরে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল পড়ে আছে।
আমি জবাকে ডেকে বলি– ‘দেখ, কে যেন রেখে গেছে এই ফুল!’
জবাও বিস্মিত হয়! তবে ফুলগুলো দেখে তার মনে পড়ল — এক জন্মদিনে এমনই এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল তাকে দিয়েছিল তাদেরই ছোট্ট থানা শহরের এক উন্মূল তরুণ। ছেলেটি ওর সহপাঠী ছিল। সে ভালো গানও গাইত।
একদিন অফিস থেকে এসে দেখি, জবার খুব মন খারাপ। কথা বলছে ভারী কণ্ঠে। চোখ দেখে বোঝা গেল, এই চোখ একটু আগে অঝোর ধারায় কেঁদেছে। এখনও সিক্ত। এখনও চোখের দুই কোণ্ চিকচিক করছে।
জবার মনখারাপ থাকলে আমারও মনখারাপ লাগে। ও কাঁদলে আমারও চোখ ছলছল করে ওঠে। আমি ওকে বললাম, চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। জবা বলছিল– ‘কোথায় নিয়ে যাবে’। বললাম, ‘শিশু পার্কে। ওখানে শিশুদের দোলনায় দোল খাওয়া দেখবে। ঘোড়ায় চড়ে ওরা হাট্টিমাটিম গান গায়। সেই গান তুমি শুনবে। ওদের সাথে আমরাও রেলগাড়িতে উঠব।’
জবা বলল — আচ্ছা, নিয়ে চলো।
আমাদের প্রিয় যান খোলা রিকশায় করে সেদিন গিয়েছিলাম শিশু পার্কে। পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে দুজন ফুসকা খাই। একটি বালিকা এসে ওকে বলে, ‘আপা বকুল ফুলের মালা নিবেন?’ আমি জবাকে বললাম, নাও দুটো মালা। খোপায় পরিয়ে নাও। খুব ভালো লাগবে।
আমরা দুজন নাগরদোলায় উঠেছিলাম। নাগরদোলাটি যখন সুউচ্চ চূড়ায় পৌঁছে, তখন জবা আমার দুহাত চেপে ধরেছিল। আমি ওর দিকে চেয়ে মনে মনে বলেছিলাম — ভয় পেওনা তুমি। আমি তোমার জীবনেও আছি। আমি তোমার মরণেও পাশে আছি।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। দুপুরে খেয়ে বিছানায় দুজনই শুয়ে আছি। কোনো কথা নেই কারোরই। আম গাছটায় বসে দোয়েল শিস দিচ্ছিল খুব মায়া করে। জবা আমার হাত ধরে। ঠিক মনে হলো বাইরে ডাকা ঐ দোয়েলটির মতো মায়া করে আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল– তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, না!
— জ্বী বাসি।
— যদি দূরে চলে যাই, তোমার খুব মন খারাপ লাগবে?
— হে..
— জানো, আমি যে কলেজে পড়তাম, সে কলেজে স্কুলের মতো ঘন্টাধ্বনি বাজত। কলেজ ছুটি হলে আমরা রেললাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে জোরে জোরে হেঁটে বাড়ি চলে আসতাম।
— তাই!
— আমাদের বাড়ি থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যেত। বাড়ি থেকে একটু দূরে ছোট্ট একটি রেল ব্রিজ আছে খালের উপরে।
— আচ্ছা।
— ঐ ব্রিজটা আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি নিয়ে যাবে আমাকে ঐ ব্রিজ দেখাতে?
— নিয়ে যাব। একটা গান গেয়ে শোনাওনা শুয়ে শুয়ে খালি গলায়। জবা গাইছিল —
দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।
যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে।
সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায় দিনগুলো আমাদের ভালোই কাটছিল। কিন্তু জবার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না খুব একটা। দিনে দিনে সে খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলে। রাতে রাতে তার জ্বরও আসে। ডাক্তার দেখাই। চিকিৎসা চলতে থাকে।
আঙিনায় জবা ও গন্ধরাজ ফুলগাছ গুলো পরিচর্যার অভাবে দিনে দিনে শ্রীহীন হয়ে মরে যেতে থাকে। জবা ফুল গাছে আর ফুল আসে না। গন্ধরাজ আর কোনো গন্ধ বিলায় না সন্ধ্যারাতে। আঙিনায় লতাপাতা গুলো বেড়ে আগাছায় ভরে ওঠে।
সেদিন ছিল আমাদের বিয়ে বার্ষিকী। অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা রাত হয়ে যায়। জরুরি কাজে আটকে পড়েছিলাম। ফেরার পথে গাওছিয়া মার্কেট থেকে জবার জন্য একটি লাল বেনারসি শাড়ি কিনি। আর কিনে নিয়ে আসি একগুচ্ছ লাল গোলাপ।
গেট দিয়ে ঢুকতে আলোছায়ায় আঙিনার ঘাসের উপর একটি ভাজ করা কাগজ দেখতে পাই। হাতে উঠিয়ে গলি থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় কাগজটি খুলে পড়ি। দেখি, রবি ঠাকুরের একটি গান লেখা আছে। কাগজটি পড়ে আমার কাছেই রেখে দেই।
ঘরের ভিতর বিছানায় জবা শুয়ে আছে। খুব মায়া করে সে আমাকে তাকিয়ে দেখছিল। চোখের পাতা কেমন কালো হয়ে গেছে। যেন কত অশ্রুর দাগ লেগে আছে। যেন বলতে চাচ্ছে — ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।’
আমি ওকে বলি– একটু উঠে বসো, দেখো — তোমার জন্য আজ একটি বেনারসি শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছি। একটু পরে নাও।’
জবা পরম আনন্দে শাড়িটির দিকে চেয়ে বলে — ‘আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে আজ পরব না লক্ষীটি। আমি ভালো হয়ে উঠি, তখন পরব।’
— আচ্ছা, তাই পরবে।
আমি ঘরের জানালাটা খুলে দেই। আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে অপূর্ব সুন্দর চাঁদের আলো এসে পড়ে জবার মুখের উপর! আমি ওকে বলি — একটা গান গেয়ে শোনাও না! জবা আমাকে বলে কোন্ গানটি শুনবে তুমি?
আমি ওকে বলি — ‘প্রাণ ভরিয়ে’।
জবা গেয়ে শোনালো —
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।
গানটি গাইতে গাইতে জবার চোখের কোণ ভিজে উঠছিল। হয়ত তার মনে পড়ছিল — কবে এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় ছোট্ট থানা শহরের এক উন্মূল তরুণ এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল তাকে, বাড়ি থেকে দূরে একটি রেল ব্রিজের কাছে ঘাসের উপর বসে থেকে।
১৩. নয়নে বহে ধারা
আজই দীপ্তর এমবিবিএস পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। সে পাশ করেছে। কলেজে যেয়ে দীপ্ত এই সুখবরটা প্রথম জানতে পারে।
আর দীপ্ত এই সুখবরটি প্রথম জানায় তার মণিকে ফোনে —
মণি, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো আগে। আমার কপালে চুমু দাও। আমি পাশ করেছি মণি। আজ থেকে আমি ডাক্তার। তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পেরেছি মণি।
মণি দীপ্তর মা। দীপ্ত ওর মাকে একএকসময় এক একটা সম্বোধন করে ডাকে। কখনও মা, কখনও মামণি, কখনও মণিমা, কখনও শুধু মণি বলে ডাকে। তবে বেশি আনন্দে থাকলে, দীপ্ত ওর মাকে মণি বলে ডাকে।
দীপ্তর মা বিয়ের দুই বছরের মাথায় স্বামীকে হারায়। তখন দীপ্তর বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। দীপ্তর বাবাও ছিল একজন ডাক্তার। হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
দীপ্তর মা আর বিয়ে করেন নাই। দীপ্তর বাবার রেখে যাওয়া সীমিত সম্পদ থেকে তিনি সংসার আর দীপ্তর লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।
দীপ্ত বাসায় এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে — মণি তুমি খুশি হয়েছ? বাবা, মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা যেখানে রেখে গেছেন, আমি সেখানে থেকে আবার শুরু করব মা। তুমি আমাকে দোয়া করবে, আমি যেন তোমার স্বপ্ন ও বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।
দীপ্তর মা শাহনাজ বেগম তার ছেলেকে একটি আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তুলবার জন্য জীবনভর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সে আজ খুব খুশি। দীপ্তর অলক্ষ্যে ওয়ালে টানানো তার স্বামীর পোট্রের্ট এর সামনে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।
বলে — ওগো, তুমি আমাকে দোয়া করো ওপারে থেকে। আমি যেন দীপ্তকে তোমার আদর্শে গড়ে তুলতে কখনোই যেন ক্লান্ত না হই।
দীপ্ত পিছনে থেকে চুপিচুপি এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় কপাল রেখে বলে — মণি, তুমি না আমাকে প্রমিজ করেছিলে, আর কখনও কাঁদবে না। তুমি তোমার কথা রাখছ না। তুমি বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রায়ই কাঁদো। শাহনাজ বেগম চোখের জল মুছে বলে, ‘আবার প্রমিজ করছি, আর কাঁদব না। চলো, খেয়ে নাও। আমি এখনও খাইনি।’
দীপ্ত কিছুদিনের মধ্যেই শহরের একটি নামকরা ক্লিনিকে জুনিয়র ডাক্তার হিসাবে যোগদান করে। পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে।
একদিন খেতে বসে শাহনাজ বেগম দীপ্তকে বলে –
দীপ, তোমাকে একটা কথা বলব?
— বলো, মণি।
— তোমার কী কোনো মেয়ের সাথে জানাশোনা আছে? মানে, তোমার কী ভালোলাগার কেউ আছে?
— মণি, আমার কেউ থাকলে সে তো তুমিই আগে জানতে। কারণ, এই পৃথিবীতে তুমি আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু। আর…
— আর কী?
— আর, আমার বউকে পছন্দ করে তুমিই ঘরে আনবে। তুমি যাকে এনে দিবে, আমি তাকে নিয়েই সারা জীবন ঘর করব। এও আমার আর একটি স্বপ্ন।
আর একদিন এমনই খাওয়ার টেবিলে শাহনাজ বেগম তার ছেলেকে বলছিল — দীপ।
— বলো মা।
— আমার এক দূর সম্পর্কের বোনের একটা মেয়ে আছে। ও এবার গার্হস্থ অর্থনীতিতে গ্রাজুয়েট ফাইনাল সেমিস্টার শেষ করবে। শুনেছি মেয়েটি বেশ সুন্দরী। ভালো গানও গাইতে পারে। আমার সেই বোনটির সাথে ফোনে প্রাথমিক কথা হয়েছে। আমি তোমাকে নিয়ে ওখানে বেড়াতে যাব। তুমি মেয়েকে দেখবে। মেয়ে তোমাকে দেখবে। মেয়ের বাবা মা থাকবে। আর কেউ না।
— মণি, আমি তোমার উপর দিয়ে কোনো কথা কোনো দিন বলেছি? তুমি যা করবে, তুমি যা করতে বলবে, আমি তাই করব।
— আমি জানি। তুমি আমার অবাধ্য কোনো দিন হবে না।
— মণি।
— বলো বাপ।
— তুমি বললে, মেয়েটি গান গায়। এই জন্য আমার খুব ভালো লাগছে। তুমি হয়ত জানো না মণি। আমি তোমাকে আজ একটা কথা বলি।
— কী, বলো।
— তুমি প্রায়ই মাঝরাতে ওঠো। হয়ত হঠাৎ করেই তোমার ঘুম ভেঙে যায়। তুমি উঠে তখন ঘরের লাইট জ্বালাও। বাবার পোট্রের্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখ অনেকক্ষণ । চশমা খুলে চোখ মোছো। তারপর ব্যালকনিতে যেয়ে ইজি চেয়ারে বসে থাকো। ওখানে বসে দূর আকাশে তারার দিকে তাকিয়ে থাকো, হয়ত মেঘের ভিতর লুকিয়ে থাকা তারাদের মাঝে বাবার মুখ খোঁজো। কোথাও থেকে আসে তখন শীতল ঝিরিঝিরি হাওয়া। বেলী ফুলের ঝাড় থেকে আসে আকুলকরা গন্ধ! তুমি তখন গুনগুন করে সেই একলা রাত্রিতে একটি গান গাও —
‘একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো।’
জানো মণি, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপিচুপি তোমার সেই গান শুনতাম। তোমার গান গাওয়া শেষ হলে আমি যেয়ে শুয়ে পড়তাম। তুমি এইসব কিছুই জানতে না।
একদিন বিকালে শাহনাজ বেগম দীপ্তকে নিয়ে তার সেই বোনের বাসায় বেড়াতে যায়। সুন্দর পরিপাটি একটি ফ্ল্যাট বাড়ি। বাসায় তার বোন মমতাজ বেগম, তার স্বামী শওকত আলী আর তাদের মেয়ে মালবী ছাড়া আর কেউ নেই। মালবী দেখতে সুন্দরী, লম্বা ছিপছিপে গড়ন, যেন রজনীগন্ধা ফুল, চোখ দুটো টানাটানা, চুল নিবিড় কালো, তার নাকটি কাঁঠালিচাঁপার রেণুর মতো প্রস্ফুটিত। গায়ের রঙ উজ্জ্বল গৌরীয়, কপোতীর ডানার মতো মসৃণ দু’খানি হাত। পুরো মুখমন্ডল অদ্ভুত সৌন্দর্যময়, যেন একটি উপমায় ভরা গীতি কবিতার রূপ সারা অবয়বে।
সেদিন উভয় পরিবার একে অপরের মাঝে নানা কথা বললেন। নানা ভাব বিনিময় করলেন। মেয়ে দেখল ছেলেকে, ছেলে দেখল মেয়েকে। তারা দুজন টুকটাক কথাও বলল। মালবী হয়ত ভাবছিল মনে মনে, যে রাজপুত্রকে সে এতদিন চেয়েছিল, সেই এসে আজ এখানে হাজির। অপরদিকে দীপ্তও মনে মনে ভাবছিল, ‘এমনই একজন রাজকন্যাকে আমি এতদিন খুঁজেছিলাম।’
দীপ্তর মাও মালবীকে দেখে খুব খুশি। পারলে এখনই মালবীকে তার পুত্রবধূ করে ঘরে তুলে নিয়ে যাবে। অপরদিকে মালবীর বাবা মাও অনেক খুশি। তারাও পারলে এখনই তাদের মেয়েকে দীপ্তর সাথে বিয়ে দিয়ে ওর মায়ের হাতে তুলে দিবে।
দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে যায়। দীপ্ত ও মালবীর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। বিয়েটি হবে মালবীর ফাইনাল পরীক্ষার পর। সেও মাস দেড়েক দেরি আছে এখনও । এর মধ্যে একদিন পানচিনি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওদের একে অপরের হাতে আংটি পরানো হয়ে যায়।
দীপ্ত আর মালবী একদিন দেখা করে উত্তরার একটি আকাশ ছোঁয়া রেস্টুরেন্টে। কাঁচের জানালার পাশে বসে দেখছিল — নীল আকাশ। নীলের মাঝে থোকা থোকা শরতের সাদা মেঘ রাশি। দেখছিল এয়ারপোর্টের রানওয়ে। আর দূরের দিয়াবাড়ির শুভ্র কাশবন।
কথা বলছিল– দুজন দুজনের মুখের দিকে চেয়ে। দীপ্ত বলছিল, আমার ভুবনে এতদিন ছিলাম আমি আর আমার মণি। সেই ভুবনে তুমিও আসছ। জানো, কী যে আলোয় আলোয় ভরে উঠবে আমাদের সেই ভুবন। মালবী দীপ্তর হাতের উপর হাত রেখে বলেছিল — তোমাদের ভুবনে আমাকে স্থান দিও। কী দেবে তো আমাকে একটু স্থান?
দীপ্ত বলেছিল — অবশ্যই।
‘এসো এসো আমার ঘরে এসো, বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে। স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে মুগ্ধ এ চোখে।’
কত দুঃখ বেদনা মানুষের জীবনে । কত ভাঙাগড়াও আবার এই জীবনে! এই পৃথিবী কত স্বপ্ন দেখায়। কত স্বপ্নকে আবার নিষ্ঠুর ভাবে ভেঙে দেয়। এমনই এক স্বপ্ন ভাঙার দিনে মালবী সেদিন আসছিল কলেজ থেকে। বাস স্টান্ডে নেমে বাসায় আসার জন্য রিকশায় উঠবে, ঠিক তখনই দুজন যুবক মোটরসাইকেল করে এসে মালবীর মুখে এসিড মেরে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
আর্ত চিৎকার করে মুখে দুহাত চেপে মালবী রাস্তার উপর বসে পড়ে। তারপর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
দীপ্ত খবর পায় মালবীর মুখে দুষ্কৃতকারীরা এসিড নিক্ষেপ করেছে। সে এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছে।
দীপ্ত ছুটে চলে যায় হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে একটি বেডে মালবী শুয়ে আছে। মালবীর মুখ মণ্ডল পাতলা ব্যান্ডেজ কাপড় দিয়ে ঢাকা। অসহ্য যন্ত্রণায় সে কাৎরাচ্ছে। দীপ্ত ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। খুব আস্তে করে মালবীর একটি হাত ধরে। এবং বলে —
‘ তুমি ভালো হয়ে যাবে, সত্যি তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি আছি তোমার সকল অসুখে, তোমার সকল বেদনায়। এই দেখ — আমি তোমার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছি।’
দুই মাস পর মালবীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে বাসায় নিয়ে আসে। মালবীর পুরো মুখ পোড়া দাগে বিকৃত, কুৎসিত ও ভয়ার্ত রূপ হয়ে গেছে। চোখে দেখতে পায়। কিন্তু চোখের পাতা ও ভ্রূ সব ঝলসে গেছে।
দীপ্ত ও দীপ্তর মাকে অনেকে এসে বলে এবং বোঝায়– দীপ্তর মতো এত সুন্দর একটি ছেলের সাথে মালবীকে যেন বিয়ে না করানো হয়। দীপ্ত ও দীপ্তর মা শোনেনি কারোর কথা। মালবীর সাথে আবারও বিয়ের তারিখ ধার্য করা হয়।
শাহনাজ বেগম খুব অল্প কজন মানুষ নিয়ে মালবীকে দীপ্তর বউ করে ঘরে নিয়ে আসে। বিয়েতে কোনো আড়ম্বর হল না, সানাই বাজল না, আলোকসজ্জা করা হল না। চারিদিকে কোনো হাসিরাশি নেই। কোনো উৎসব নেই। কোনো সঙ্গীত নেই। কেমন যেন এক বেদনার সুর কোথাও থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল।
জীবন থেমে থাকে না। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ জীবন গায় তার জয়গান। পৃথিবীতে আনন্দ এতই ভঙ্গুর যে, তা কাঁচের মতো কখন ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। আবার বেদনাও ঢেকে পড়ে যায় জীবন থেকে পাওয়া নির্মল কোনো আনন্দে।
একদিন মাঝরাতে শাহনাজ বেগমের ঘুম ভেঙে যায়। আস্তে আস্তে উঠে সে বারান্দায় যেয়ে পায়চারি করতে থাকে। ছেলে দীপ্তর ঘর থেকে তখন ক্ষীণ সুরে একটি গান ভেসে আসছিল, গানটি গাইছিল মালবী।
‘একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো।’
রিক্ত আমার ক্ষুদ্র প্রাণে তোমার আঁখিটি রেখো।’
এমনই এক নিঝুম শারদ রাতে আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে শাহনাজ বেগম এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল তার স্বামীকে। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে মালবীর গাওয়া গানটি শুনতে থাকে। নয়নে বয়েছিল তখন অশ্রু ধারা।
১৪. কেবা আপন কেবা পর
অনেক আগের এক জৈষ্ঠ্য দিনের কথা। আমি তখন বাগবাটী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। গরমের কারণে তখন মর্নিং শিফট স্কুল ছিল।
এগারোটায় স্কুল ছুটি হয়েছে। বাড়িতে চলে আসব। বই হাতে স্কুলের মাঠের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছিলাম। পা ফেলতে ফেলতে হঠাৎ করে জেবুন্নেসা বুবুর কথা মনে হল। একবার আমাদের বাড়ি থেকে আসার সময় আমাকে কাছে টেনে আদর করে জড়িয়ে ধরে বুবু বলেছিল — তোমার স্কুল থেকে আমার বাড়ি মাইলখানেক দূরে, যদিও বামদিকে উল্টো যেতে হয়, তবুও তুমি একদিন যেও। দেখে এসো আমাকে। আমি বুবুকে মাথা নেড়ে বলেছিলাম — আচ্ছা, যাব একদিন।
সেই প্রতিশ্রুতির কথা হঠাৎ মনে হল।
পিছনে তাকিয়ে দেখি — আমাদের ক্লাসের সাইফুল ও আমিনুল হেঁটে হেঁটে আসছে। আমি থেমে যাই।ওদের বাড়ি দত্তবাড়ি গ্রামে। ঐ গ্রামই হচ্ছে বুবুদের গ্রাম। আমি ওদেরকে বলি — ‘আমি তোদের সাথে আজ তোদের গ্রামে যাব।’
ওরা তো বেজায় খুশি। ওরা বলে — ‘তা কার বাড়িতে যাবি তুই?’ আমি বললাম, মোঃ আব্দুস সোবহান শেখের বাড়িতে যাব। উনি আমার দুলামিঞাভাই হন।’
আমি এর আগে কখনও এই পথ দিয়ে বুবুদের বাড়িতে যাই নাই। আজই প্রথম যাচ্ছি। কী সুন্দর এই পথ। ইউনিয়ন বোর্ডের তৈরি কাঁচা রাস্তা। দু’ধারে বাড়ি। গাছ আর গাছ। হেঁটে যেতে জৈষ্ঠ্যের রোদ একটুও গায়ে লাগে না। রাস্তাটি সরু হলেও টমটম চলে। কিন্তু গরুর গাড়ি চলে না। সেই জন্য ধুলো কম। দুপাশে ঘাসও আছে।
যেতে যেতে পথে কত বাড়িতে কত রকম গাছ যে দেখছিলাম! আম, কাঁঠাল, জাম, জারুল, সোনাল, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, খেজুর, ডুমুর, নিম, সাজনা, আকন্দ, জাম্বুরা, পিয়ারা, কলা গাছ, তেঁতুল, ছিটকি, বাবলা সহ আরও কত রকমের গাছ। পাখিও দেখছিলাম কত রকমের! ঘুঘু, ওরোল, ঘরবাদুনী, চড়ুই, শালিক, টুনটুনি, হলুদ ফিঙে, বুলবুলি, কাক, দোয়েল সহ আরও অনেক রকম পাখি।
এক জায়গায় দেখি — একটি বড়ো জামগাছ। সারা গাছ ভর্তি পাকা জামে নীল হয়ে আছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গাছ তলায় জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। পাখিরা ঠুকরে জাম খাওয়ার সময় অনেক সময় পাকা জাম নীচে পড়ে। কখনও আবার বাতাসেও টুপটুপ করে ঝরে পড়ে। সেইসব পাকা জামগুলো ওরা কুড়িয়ে খাচ্ছিল। আমরাও কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়ালাম। এবং কুড়িয়ে পাকা জাম খাই।
বেলা বারোটার মধ্যেই আমি দত্তবাড়ি গ্রামে জেবুন্নেসা বুবুদের বাড়িতে পৌঁছে যাই। বুবু তো আমাকে দেখে যারপরনাই খুশি হন। আমাকে কাছে টেনে তাঁর আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দিলেন । তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকেন। আমি বুবুকে বললাম – তোমার এইসব করতে হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা !
বুবু বাড়ির কামলা দিয়ে পুকুরপাড়ে ডাব গাছ থেকে ডাব পেড়ে ডাবের পানি খাওয়ালেন। মুড়ি খেতে দেন ঝুনা নারিকেল আর কুশালের গুর দিয়ে। কয়েকটি পাকা আম ছিলে আমাকে দিয়ে বলল — ‘গেদা, এই আমগুলো আমাদের গাছের। খুব মিষ্টি। খাও এগুলো।’
আমি এই বাড়িটিতে এর আগে আরও দুই একবার এসেছিলাম বাবার সাথে। তখন আরও ছোট ছিলাম। পাঁচ ছয় বছর বয়সের সময়। তেমন কিছু মনে নেই। আজ বাড়িটি দেখে খুব ভালো লাগছে।
বাড়ির তিন পাশে শস্যের ক্ষেত। পিছনে বড়ো বড়ো আম কাঁঠালের গাছ। অনেকটা জঙ্গলের মতো। পূর্ব পাশে ছোট্ট একটি পুকুরও আছে।
সবচেয়ে ভালো লেগেছে গ্রামটি। পুরো গ্রামটি একটি বাঁশ ঝাড়ের বাগান যেন। একে বাঁশ ঝাড়ের বনও বলা যেতে পারে। বুবুদের বাড়িটিও বাঁশ ঝাড়ে বেষ্টিত। বাড়ির সামনে এক দুটো ফসলের ক্ষেতের পরই এই বাঁশবন।
দুপুরে লিচুতলায় কাঠের হেলাঞ্চির উপর বসে ছিলাম। দেখি, দুটো বেজী বের হয়ে আসছে বাঁশ ঝাড়ের ভিতর থেকে। বেজী দুটো পিটপিট করে কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওদের ‘হো’ বলতেই দৌড়ে জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে যায়।
বুবুদের একটি পাখির ঘরও আছে । সেখানে কয়েকটি খরগোশ, দুটো টিয়াপাখি, অনেকগুলো মুনিয়া পাখি দেখলাম। পুকুর পাড়ে চারটি রাজহাঁস প্যাক প্যাক করে ঘাস খাচ্ছিল। পুকুরের জলে অনেকগুলো দেশি হাঁসও জলকেলি করছিল।
আর, সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছিল বাঁশ ঝাড়ের দিক থেকে আসা বিভিন্ন পাখপাখালিদের কিচিরমিচির শব্দ। বুবু এসে বলছিল — কুয়া থেকে ঠান্ডা পানি তুলে রেখেছি। চলো, গোসল করে নাও। আমি গোসল করবই না, বুবু আমাকে জোর করে গোসল করে দেয়। মাথায়, গায়ে, হাতে,পায়ে সাবান মেখে গোসল করে দিল। সে নিজেই আমার মাথা গা মুছে দিল। যেমন করে আমার মা আমাকে ছোট বেলায় গোসল করিয়ে দিত।
বুবু আমাকে শীতল পাটিতে বসিয়ে খেতে দেয়। আমার সাথে দুলামিঞাভাইও বসে। বুবু এরই ফাঁকে কখন মোড়গ জবাই করে ও পুকুর থেকে মাছ ধরে রান্না করেছে। জানতাম না। কাতল মাছ ভেজেছে, আবার রান্নাও করেছে। চাল কুমড়া ভাজি, কাতল মাছের মাথা দিয়ে মুগডালের ঘন্টো, ডিমের তরকারি, ডাল, কলার ক্যান দিয়ে নাবড়া, মিষ্টি কুমড়া ভর্তা, এইসব দিয়ে আমাকে খেতে দিল। আমি ছোট মানুষ! এত কিছু কী খেতে পারি? খাওয়া শেষে আবার আম দিয়ে দুধ ভাতও খেতে দেয়।
বিকালে বুবুকে বলি — আমি এখন বাড়ি চলে যাব।
বুবু বলছিল — আজ থাকো, কাল যেও।
আমি বললাম — না। আজই চলে যাব। মা বকবে। চিন্তা করবে।
আমি আমার বইখাতা হাতে নেই। বুবু বলল — আমি তোমাকে বাঁশ ঝাড়টা পার করে দিয়ে আসি। তারপর সোজা পথ, তুমি তখন একা চলে যেতে পারবে।
বুবু আমার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। বাঁশ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে পায়ে হাঁটার পথ। কি যে ভালো লাগছিল! আলোছায়ার সে এক মায়াবী পাতা ঝরার শব্দ । পাখিরা কিচিরমিচির করছিল। বাঁশ ঝাড়ের পথ পেড়িয়ে আমি ও বুবু খোলা জায়গায় এসে পড়ি।
আমি তো খোলা প্রান্তর দেখে বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। অনেক দূর পর্যন্ত খালি মাঠ। মাঠের পর মাঠ। ক্ষেতের পর ক্ষেত। সবুজ আউশ ধানক্ষেত! সবুজ পাতার গালিচা যেন মেলে রেখেছে। এই খোলা প্রান্তরটি প্রায় এক মাইলের মতো হবে। যাকে নির্জন পাথার বলে।
বুবু আমাকে বলছিল — একা এই পাথার পারি দিতে পারবে?
— পারব।
— ভয় পাবে না তো!
— না।
— তুমি যতক্ষণ এই পাথার পার হবে, ততক্ষণ আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব।
— আচ্ছা। আমি পিছনে ফিরে ফিরে তোমাকে দেখব।
— ওহ! আমার সোনার ভাইরে!
বুবু আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে —
তুমি আবার এসো।
— না, আমি আর আসব না।
— কেন, ভাই!
— তুমি আমাকে বেশি করে খাওয়াও কেন? আমি কী অত খেতে পারি নাকি?
— আচ্ছা, লক্ষী ভাইটা আমার! তুমি আবার যখন আসবে তখন একদম কম খাওয়াব।
— আচ্ছা।
আমি সেই পাথার একাকী হেঁটে পার হতে থাকি। হাঁটছি যত পিছনে তাকিয়ে বুবুকে দেখছিলাম তত। যত দূরে চলে আসি তত বুবুকে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম। আরও দূরে যখন চলে আসি তখন বুবুকে একটু বিন্দুর মতো দেখতে পাচ্ছিলাম। পাথার পার হয়ে যখন এপারে চলে আসি, দেখি — বুবু কোথায় যেন হারিয়ে গেল! আর দেখতে পাচ্ছিলাম না।
হ্যাঁ, আমার সেই বুবুটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। সেও আরও অনেক বছর পর।
আমি কী কখনও তার মতো করে তাকে মায়া করেছি? মায়া করলেও কেউ কী তা বিশ্বাস করবে? সে যে আমার সৎ বোন ছিল।
আজও যখন কোনো স্তব্ধ মুহূর্তে সুখ দুঃখের কোনো স্মৃতি বিস্মৃতি হাতড়াই, তখন মনে পড়ে — সেই কৈশোরে স্কুল থেকে ফেরা একটি বালককে আপন করে হাত ধরে বাঁশঝাড়ের পথ ধরে কেউ নিয়ে আসছে। সবুজ ধানক্ষেতের পাশে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, চেয়ে চেয়ে দেখছে সেই বালকের বাড়ি ফিরে আসা।
তখন তার চোখ কী একটুও বিষাদে ভরে ওঠেনি ! অন্তরে বাজেনি কী তখন কোনো আপন রক্তের স্পন্দন ! জানিনে, এই পৃথিবীতে কেবা আপন আর কেবা পর !
১৫. নদীর কূলে করি বাস
অভয় দাশ লেনের একটি গলিতে আলী হোসেন দুই রুম নিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে ভাড়া থাকেন। বিল্ডিংটি প্রায় শত বছরের পুরোনো। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। ফাটলও ধরেছে। পরগাছাও জন্মেছে। প্রতি রুমে একটি করে জানালা থাকলেও দিনের বেলায় সারা ঘর অন্ধকার থাকে। আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। কেমন গুমোট পরিবেশ।
আজ পনেরো বছর ধরে আলী হোসেন এই বাড়িতেই ভাড়া থাকে। বাংলাবাজারে একটি প্রেসে সে চাকুরি করে। চাকুরিও করছে সে একই জায়গায় পনরো বছর ধরে। এক বাড়িতে বছরের পর বছর বসবাস করা এবং একই চাকুরি বছরের পর বছর করে যাওয়া — দুটোর ভিতরই তার একঘেয়েমি এসে গেছে।
একঘেয়েমি এসে গেছে তার স্ত্রীরও। সে প্রায়ই তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে, বলে — জীবনে ভালো আর কোনো চাকুরি পেলে না। বাসাও পরিবর্তন করলে না, ড্রেনের দূর্গন্ধের মাঝে মশা-মাছি পোকামাকড়ের ভিতর সারাজীবন বসবাস করালে। একটু মুক্ত হাওয়া নেই। জানালা খুললে দখিনা বাতাস আসে না। নীল আকাশ দেখতে পাই না। দূরে কোথাও খোলা মাঠ নেই। কোথাও কোনো নদী নেই। গাছ নেই। পাখি নেই।
আলী হোসেনের বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটা। পড়াশোনা করেছিল কালীগঞ্জের নালতায় এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে লজিং থেকে। আর এই লজিং বাড়িরই রূপবতী মেয়ে রুমার সাথে তার প্রেম হয়। কিন্তু রুমার বাবা মা এই প্রণয় মেনে নেয়নি।
আলী হোসেন আইএ পাশ করে ঢাকায় চলে আসে। এবং বাংলাবাজারের একটি প্রেসে চাকুরি নেয়। একবার বাড়িতে যেয়ে রুমাকে পালিয়ে ঢাকায় নিয়ে এসে বিয়ে করে এবং অভয়দাশ লেনের এই বাড়িতে তোলে। আর সেই থেকেই এখানে তারা বসবাস করে আসছে।
তার জীবনে অনেক অপ্রাপ্তি ও অতৃপ্তি আছে। সে স্কুল কলেজ থেকেই ভালো কবিতা লিখত। তার স্ত্রী রুমা যখন প্রেমিকা ছিল, তখন তাকে নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখেছে। আর এইসব কবিতা চিঠির মতো করে রুমাকে দিত। রুমার মন ভুলে যেত সেইসব কবিতা পড়ে। একটা কবিতার কিছু কথা এখনও মনে আছে —
‘দূরে বহুদূরে চঞ্চল মেঘের মাঝে আকাশ ছাড়িয়ে যদি তুমি ভেসে যাও, ব্যাপ্তিও ছড়াও ঐ দূরালোকে। আমি গভীর গহনে আবর্তিত হই একাকী আমার ভূবন মাঝে। তুমি যতদূরেই যাও, আমার ভূবনেই তুমি ব্যাপ্ত হয়ে থাকো।’
আলী হোসেন এই মেয়েটিকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কখনও কবিতার শব্দের মায়াবুননে তাকে গেঁথেছে, কখনও রূপকথার গল্প কথা বলে তার মন ভুলিয়েছে, কিন্তু কোনো রূপকথা কখনোই আর নিজের গল্পকথা হয়ে ওঠেনি।
এই জীবনে সে কবি হতে পারেনি যেমন, তেমনি তার স্ত্রীকে সুন্দর পরিবশে একটি বাড়ি করে দিতে পারেনি এখনও। কিন্তু এই স্বপ্ন দুটো অনেক দিন ধরে এখনও সে দেখে আসছে।
অভাব অনটনের এই সংসারে অনেক গঞ্জনা সইতে হয় আলী হোসেনের। অবিশ্বাসী, চরিত্রহীন, লম্পট হওয়ার কথাও শুনতে হয় তার স্ত্রীর কাছে থেকে। অনেক বছর ধরে আলী হোসেন তার মাহিনার পুরো হিসাব তার স্ত্রীকে দিতে পারে না। প্রতি মাসেই কিছু না কিছু টাকা হিসাবে গরমিল থাকে। এই নিয়ে স্ত্রীর সাথে অনেক বছর ধরে ঝগড়া হয়ে আসছে।
স্ত্রী রুমার ধারণা আলী হোসেন অন্য কোনো মেয়ের পিছনে টাকা খরচ করে। সে খারাপ মেয়েদের কাছে যায়। স্ফূর্তি ও বিলাসিতা করে টাকা অপচয় করে।
একদিন স্ত্রীর সাথে তার এই ব্যাপারটি নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়। আলী হোসেন অফিসে চলে যায়। অফিসে যেয়ে তিন মাসের অবৈতনিক ছুটি নেয়। এবং ওখানেই বসে বসে রুমার কাছে একটি পত্র লেখে। বিকালে বাসায় চলে আসে। চুপিচুপি সেই পত্রখানি রুমার বালিশের নীচে রেখে দেয় এবং একটি ইনভিলপের ভিতর কিছু টাকা রেখে দিয়ে পূণরায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা হয়ে রাত্রি হয়ে যায়। আলী হোসেন আর ঘরে ফিরে আসে না। রুমা কী করবে কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারে না। সে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। তার কান্না দেখে নাবালক সন্তান দুটোও কান্না করতে থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত সে না খেয়ে বিছানায় বসে বসে অশ্রুপাত করে। হঠাৎ বালিশটা সরাতেই সে একটি চিঠি দেখতে পায়। চিঠিখানি খুলে সে পড়তে থাকে —
কল্যাণীয়াসু রুমা,
এই জীবনে তোমাকে যে আমি কত ভালোবাসিয়াছি, তা তুমি বুঝিতে পারো নাই। তোমার অনেক স্বপ্ন আমি পূরণ করিতে পারি নাই। এই জন্য আমারও গ্লানি কম হয় নাই। তুমি অনেক কষ্ট করিয়া আমার অভাব অনটনের সংসারে থাকিয়া গিয়াছ। তুমি আমাকে ফেলিয়া রাখিয়া বিত্তবান পিতার গৃহে ফিরিয়া যাও নাই। আমি জানি, তুমি আমাকে এখনও অনেক ভালোবাসো, এই সংসারকে ভালোবাসো, তোমার সন্তানদের ভালোবাসো।
আমি কিছুদিনের জন্য তোমাদের মায়া ত্যাগ করিয়া নিরুদ্দেশে চলিয়া গেলাম। বেঁচে থাকিলে আমি আবার তোমাদের কাছে ফিরিয়া আসিব। ইনভিলপের ভিতর কিছু টাকা রাখিয়া গেলাম। আমার ধারণা, কষ্ট করে তুমি মাস তিনেক চলিতে পারিবে।
আমি এখনও স্বপ্ন দেখি — তোমার সুন্দর একটি বাড়ি হইবে। কবিতা লেখার জন্য আমার একটি আলাদা কক্ষ থাকিবে। দক্ষিণের জানালা খুলিলেই দখিণা হাওয়া আসিয়া তোমার গায়ে লাগিবে। অদূরে নদী থাকিবে। নীল আকাশের ছায়াতল দিয়া হাঁটিয়া হাঁটিয়া আমরা দুজন নদীর কূলে বেড়াইতে যাইব। ওখানেই সন্ধ্যা নামিবে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠিবে। তারায় তারায় আকাশ ভরিয়া উঠিবে। আমরা জোছনা মাখিয়া মাখিয়া তারপর ঘরে ফিরিয়া আসিব।
জানিনা এই স্বপ্ন পূর্ণ হইবে কী না, তবু আমি সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে অভিযাত্রা করিলাম।
ইতি — তোমার আলী।
***** ***** *****
ঠিক দুই মাস পঁচিশ দিন পর….
একদিন সন্ধ্যারাতে আলী হোসেন গৃহে ফিরে আসে। মুখ ভর্তি তার দাড়ি। এই কয়দিনে সে দাড়ি কাটে নাই। চোখে, মুখে, শরীরে ক্লান্তির ছাপ। অনেক ধকল ও পরিশ্রমের ছাপ সুস্পষ্ট। রুমা তার স্বামীকে পেয়ে খুব খুশি হয়। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে তার ছেলেমেয়ে দুটোও। সে রাতে রুমা আলী হোসেনের বুকে মাথা রেখে আনন্দ অশ্রু জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
পরের দিন আলী হোসেন চাকুরি থেকে ইস্তফা দেয়। বাড়িওয়ালাকে নোটিশ করলেন বাড়ি ছেড়ে দেবার। আসবাব পত্র যাকিছু ছিল সব বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। রুমা, তার স্বামীকে বলে — তুমি এসব কী করছো?
— এখানে আর থাকব না। আমরা আবার দেবহাটা আমাদের গ্রামের বাড়ি ফিরে যাব।
অভয়দাশ লেনের এই ঘিঞ্জি গলির বাড়িতে সেদিন
ছিল শেষ রাত। আলী হোসেন ও রুমা বিছানায় শুয়ে আছে। কারোর চোখেই ঘুম আসছে না। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে। কত হাসি কান্না, কত দুঃখ-সুখ, কত ঝগড়া বিসম্বাদ, কত ভালোবাসার ক্ষণ কেটেছে এই বাড়িতে। কত মধুময় স্পর্শ ছিল দুজনের মধ্যে। কত প্রেম এসেছিল দুজনের জীবনের প্রান্তে।
মনে পড়ে, রুমা সবকিছু ছিন্ন করে তার হাত ধরে উঠেছিল এসে এই বাড়িতেই। বিষণ্ণ দুটো তরুণ তরুণী সেদিন স্বজনহীন একাকী বাসর রাত কাটিয়েছিল । রুমার পরনে কোনো লাল বেনারসি শাড়ি ছিল না, হাতে ছিল না মেহেদি। মুখে ছিল না চন্দন চিহ্ন। গায়ে মাখেনি কোনো আতরের গন্ধ। একটি ফুলও কেউ ছিটিয়ে দেয়নি তাদের বাসর শয্যায় । আয়নাতে দেখেনি দুজন দুজনের মুখ। কেউ মুখে তুলে খাওয়ানি একটুখানি মিষ্টি। কেউ কোনো প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে রাখেনি এই বন্ধ ঘরে।
এই বাড়ি এই ঘর, পনেরো বছরের গড়া সুখ দুঃখের এই খেলাঘর ভেঙে দিয়ে তারা পরেরদিন সকালবেলা দেবহাটার উদ্দেশ্যে স্ব-পরিবারে রওনা হলেন।
ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসটি যখন দেবহাটা এসে থামে তখন বিকাল হয়ে গেছে। রুমা এর আগে আসেনি কখনও এই উপজেলা শহরে। ওরা সবাই বাস থেকে নেমে একটি টমটমে ওঠে। গাড়োয়ান আলী হোসেনকে জিজ্ঞাসা করে — ‘ভাই কোথায় যাব?
আলী হোসেন বলে — হিজল ডাঙা।
টমটম চলছে আধা পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ করে। কী অপূর্ব দৃশ্য চারিদিকে। দূরে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ সবুজ বেষ্টনী। আরেক পাশে ইছামতী নদী বয়ে চলেছে। কী দারুণ শীতল হাওয়া বইছে !
রুমারও কী যে ভালো লাগছিল এই প্রকৃতি দর্শনে। পনেরোটা বছর সে বন্দী ছিল ঘিঞ্জি দুর্গন্ধময় গলির ভিতর এক জীর্ণ বাড়িতে। আজ যেন সে প্রাণ থেকে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চারিদিকে ঘন সবুজ ফসলের মাঠ, অনিঃশেষ দিগন্ত, ঝাউ বন, শুপারি বাগান, গাছগাছালি, পশু পাখি, খোলা নীল আকাশ, মানুষ, নারী ও নদী।
টমটমটি ইছামতী নদীর তীরে একটি কাঠের দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামে। তখন সন্ধ্যাপূর্ব বিকাল। কী সুন্দর এই কাঠের বাড়িটি। যেন রবি ঠাকুরের কুঠি বাড়ি। একদম ইছামতী নদীর তীর ঘেসে তৈরি এই বাড়িটি। সেই বিমুগ্ধ সন্ধ্যাবেলায় নদীর জল কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছিল সাগরের দিকে।
আলী হোসেন সবাইকে নিয়ে টমটম থেকে নামে। তারা হেঁটে চলে আসে — বাড়িটার সামনে। বাড়ির গেটে ছোট্ট একটি নেম প্লেটে লেখা, ‘রুমা ভিলা।’ আলী হোসেন পকেট থেকে চাবি বের করে রুমার হাতে দিয়ে বলে — এটি তোমার বাড়ি।
কাকতালীয়ভাবে সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমা রাত্রি। আলী হোসেন আর রুমা বসে আছে দোতালায় বারান্দায়। আকাশে কমলা সুন্দরীর মতো রূপময়ী চাঁদ। পাশে নদীর জল মৃদঙ্গ সুরে বয়ে চলেছে ঝিরিঝিরি দ্যোতনায়। রুমা, তার স্বামীর বুকে মাথা ঠেকিয়ে পরম আনন্দ চিত্তে বলে — ‘ওগো, তুমি এত টাকা কোথায় পেলে?’
আলী হোসেন রুমার গ্রীবা ছুঁয়ে মুখখানি উপরের দিকে উঠিয়ে বলে — আমি প্রতি মাসে কিছুকিছু করে টাকা ব্যাংকে জমিয়ে রাখতাম। তুমি তা জানতে না। জানলে আমাদের অভাবের সংসারে খরচ করে ফেলতে। আমাকে কতই না সন্দেহ করতে তুমি। জানো, বারো বছর ধরে আমি এই টাকা জমিয়েছিলাম!
রুমা সলজ্জিত হয়ে আলী হোসেনকে বুকে জড়িয়ে
ধরে বলে — আমাকে তুমি ক্ষমা করো, আমাকে তুমি অশেষ করেছ, আমার দেহখানি প্রদীপ করো ঐ চাঁদের মতোন, জোছনায় ভাসাও আমাকে। আমার ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমার যত গ্লানি …
সেদিন হেমন্তের চাঁদ ডুবতে চায়নি হিজল ডাঙার অন্ধকার বন-প্রান্তরে। নদীর কূল আকুল হয়ে ভেসেছিল জোছনার বন্যায়। দুটো মানব মানবীর দেহমনহৃদয় সেই রাতে একূল ওকূল করে ভেসে গিয়েছিল, …. এমন আরও কত অপরূপ প্রহর কেটেছে তাদের এই কাঠের কুটিরে। এই নদীর কূলে কত দিবস রাত্রি করেছে তারা বাস ।
১৬. ছোট্ট মায়া
তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। কার্তিক মাসের এক
ছুটির দিনে একাকী মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার বাড়ি ছিল গোপীনাথপুরে। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে। যমুনা নদীর তীর ঘেসে বাড়ি। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মাঝখানে একটা ছোট নদীও পড়ে। খেয়া নৌকায় পার হতে হয়।
রবিনহুডের মতো একদিন হেঁটে হেঁটে মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে পৌঁছে যাই গোপীনাথপুর আমার মামার
বাড়ি।
সারা বিকাল পর্যন্ত মামাতো ভাই ছাইদুলের সাথে পুরো গ্রাম চষে বেড়াই। যমুনার কূলে যাই বেড়াতে। দেখি, সেখানে মাটির পাড় ভেঙে পড়ছে নদীতে। বয়রা ঘাট থেকে ছেড়ে আসা বড়ো স্টীমারটি ভেঁপু বাজিয়ে চলে যাচ্ছে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের দিকে। চলছে লঞ্চ ও পাল তোলা সারি সারি নৌকা। জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরছে । দূরে মাঝ নদীতে জেগে ওঠা চর জুড়ে দেখতে পাচ্ছিলাম সাদাকেশি কাশবন।
মাঠে কার্তিকের রোদ্রতাপে কিষাণেরা কাজ করছিল। কেউ কেউ জারীগান গাইছিল আপন মনে। কেউ হুকোয় তামাক তুলে মনের সুখে গরগর শব্দ তুলে টান দিচ্ছিল। নদীর কূলে উপরে ছেয়ে আছে নীল আকাশ, সেই আকাশে বিভিন্ন পাখি উড়ছে। উড়ছিল চিলও। নদী থেকে বাতাস বয়ে আসছিল শন শন করে। কী যে ভালো লাগছিল — কূলে দাঁড়িয়ে জল দেখতে!
কিন্তু যমুনার একটি জিনিস দেখে আমার খুব
মনখারাপ হয়েছিল। দেখলাম, আধা পাকা ধানক্ষেত, সরিষা ক্ষেত, আখ ক্ষেত ভেঙে ভেঙে পড়ছে উত্তাল নদীতে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল — চোখের সামনে দেখলাম, একটি বহু প্রাচীন জীর্ণ মঠ মাটি উপড়ে নদীর জলে তলিয়ে যেতে ।
যমুনার পাড় থেকে ফেরার পথে ছাইদুল আমাকে বলছিল — ‘তুই তো খুব মন খারাপ করেছিস দেখছি। চল্ তোর মন ভালো করে দেই।’
আমি বললাম, কী সে !
ছাইদুল বলল – ‘ আলেয়া আপুর নাম শুনিস নাই? আমার চাচাতো ফুপুর মেয়ে। পূর্ব পাড়ায় ওদের বাড়ি। তোকে ওখানে ঐ বাড়িটায় নিয়ে যাব।’
আমি বললাম, ‘আলেয়া আপুর নাম শুনেছি মার কাছে থেকে। কিন্তু কোনো দিন দেখি নাই তাকে ।’
আম, জাম, কাঁঠাল, শুপারি ও নারিকেল গাছ বেষ্টিত ছিমছাম পরিবেশে আলেয়া আপুদের বাড়ি। আমরা বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলাম — আলেয়া আপুকে। এমন পল্লীর নিবিড় কোণে, এমন প্রতিমার মতো মেয়ে থাকে ! বিস্ময়ে চেয়ে দেখছিলাম। চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ,… চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি করে না। আমি তখন নিতান্তই কিশোর–উত্তর এক তরুণ। মেয়েদের রূপ লাবণ্য ঐ ভাবে তখন বুঝতাম না।
আমি যখন অনেক বড়ো হয়ে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হলাম — চন্দ্রাবতী, পদ্মাবতী, পার্বতী, লাবণ্যদের রূপ বর্ণনা যখন পড়েছি, তখন অনেক আগের — সবুজ পত্রপল্লব ঘেরা পল্লী গৃহকোণের একজন আলেয়া আপুকে দেখা তার অপূর্ব শ্রীময়ী মুখখানি মনে মনে মিলাতাম।
কী সুন্দর করে কত কথাই না বলেছিল আলেয়া আপু — ‘ তুমি কী পড়ো, কী হতে চাও জীবনে, কী ভালো লাগে তোমার, আমার কথা তোমার মনে থাকবে, তুমি অনেক ভালো ছেলে !’ এমন অনেক ভাঙা ভাঙা কম্পিত কথা।
আলেয়া আপুদের বাড়ি থেকে যখন চলে আসি — তখন আপু বলেছিল — ‘ফাল্গুনের চার তারিখে আমার বিয়ে হবে। তুমি এসো বিয়েতে। কী আসবে না তুমি? ‘
আমি মাথা নেরে বলেছিলাম — ‘ আসব আপু। আমি এসে সারা বাড়ির উঠোনে আলপনা আঁকবো আর নেচে নেচে হারমণিকা বাজাবো।’
পথে আসতে আসতে ছাইদুল আমাকে বলছিল — কী! আলেয়া আপুকে দেখে তোর মন ভালো হয়েছে তো ?’ আমি বলেছিলাম — ‘হয়েছে।’
কিন্তু, ছাইদুল জানতে পারেনি, সেদিন আমার কোমল কিশার তরুণ মন অনেকখানি খারাপও হয়েছিল। সেই মনখারাপের বিষণ্ণতা আজও মনের উপর অমাঙ্গলিক ছায়া ফেলে।
বিকালে যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন আমার সাথে খেয়া পার হচ্ছিল একজন বোষ্টুম ও একজন বোষ্টুমি। ওদের পরনে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়। দুজনের হাতে দোতারা! আমি বললাম — তোমরা একটা গান গেয়ে শোনাবে আমাকে! টাকা চাইলে টাকা নিবা। আমার কাছে দশ টাকা আছে। তাই দেব তোমাদের।
বোষ্টুমি বলছিল — ‘আমরা কত ঘাটে কত বাটে, কত চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে — কত গান গেয়ে শোনাই মানুষকে। কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা তোমাকে এমনি একটা গান শোনাব, কোনো পয়সা লাগবে না।’
বোষ্টুমি দোতারায় তান তুলল। বোষ্টুম বাজাচ্ছিল খুঞ্জরি টুংটাং করে —
দুজনেই একসাথে গেয়ে শোনাল গান।
‘…ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী
দিতে হবে ভব পাড়ি
চেয়ে দেখো মন-ব্যাপারী
দিন গেলে হয় সন্ধ্যা ..
আপনি যদি ভালো বুঝ
সুসময়ে মুর্শিদ ভজ
জ্ঞান থাকিতে পাগল সাজো
চোখ থাকতে হও আন্ধা ..
এই দুনিয়া মায়া জালে বান্ধা ..’
মানুষের জীবনে শুরু থেকে কত কিছুই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি থাকে ! কত সুখ অনুরণরিত হয় বোষ্টুমীর ঐ দোতারার তানের মতো চিরকাল। আবার কত ছোট্ট কোনো মায়া–বেদনা আটকে থাকে বুকের গভীরে অনন্ত জীবন ধরে, কান্না হয়ে তা ঝরে পড়েনা।
কী এক অদ্ভুত সন্ধ্যা ছিল সেদিন। ছোট্ট সেই নদীর জলের ক্ষীণ ধারা ছলাৎছল করছিল। সন্ধ্যা আকাশের সব সোনালি আভা যেন মেখে দিচ্ছিল আমার অন্তরের মাঝে!
কিছু রঙ তার এখনও মনকে রঙিন করে।
১৭. বাঁধন কেটে যায়
বিয়ের আগের কথা। আমি আমার বাংলো বাড়িতে তখন একা থাকি। একদিন দেখি বারান্দায় টিনের টুইয়ের ফাঁকে দুটো চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে। কখন ওরা খড়কুটো এনে বাসা তৈরি করেছে, আমি বুঝতেই পারিনি।
আমার ভালোই লাগত ওদের উড়াউড়ি ছোটাছুটি কিচিরমিচির। সকালবেলা ওদের কিচিরমিচির যেন বেড়ে যায়। মনে হতো, ওরা যেন বলছে — ‘ঘুমিয়ে থেকো না, ওঠো, তোমার অফিসে যাবার সময় হয়েছে।’
একদিন দেখলাম, মেয়ে চড়ুইটি বাসার ভিতর চুপটি করে বসে আছে। বুঝতে পারলাম, ডিম পেরেছে। সেই ডিমে তা দিচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগল — ওরা বাসা বাঁধল। এখন ওদের ছেলেমেয়েও হবে।
আমি জেনেছিলাম, মেয়েরা যখন পোয়াতি হয়, তখন নাকি তাদের ভালো মন্দ খাবার খেতে হয়। এই ভেবে আমি একদিন অফিস থেকে আসার সময় দোকান থেকে চালের খুঁদ ও বিস্কুট কিনে নিয়ে আসি। আমি প্রতিদিন উঠোনে চালের খুঁদ ও বিস্কুট গুঁরো করে ছিটিয়ে দিতাম, চড়ুই দুটো খুব মহানন্দে তা খেত।
তারও কিছুদিন পর দেখলাম, চড়ুয়ের ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফুটেছে। ছেলে চড়ুই ও মেয়ে চড়ুই দুজনের চোখে মুখে সে কি হাসি! ওদের নতুন ধরনের কিচিরমিচির শব্দ শুনেই আমি বুঝতে পারতাম ওদের আনন্দ অনুভব ।
ওদের পরিবারের সংখ্যা যেহেতু বেড়ে গেছে, তাই আমি খুঁদ ও বিস্কুটের গুঁরো বেশি করে উঠোনে ছিটিয়ে দিতাম।
বাচ্চা চড়ুইগুলো দিনে দিনে বড়ো হয়ে উঠল। আর একদিন দেখলাম, সেই বাচ্চা চড়ুইগুলো আর নেই। ওরা উড়ে চলে গেছে।
কয়দিন চড়ুই দুটোকে খুব মন খারাপ দেখলাম। ওরা আমার ছিটানো খাবারগুলো তেমন খাচ্ছে না।কিচিরমিচিরও তেমন করে না।
তারও কয়েকদিন পরে দেখি, ওরা আগের মতোই উড়াউড়ি ছুটাছুটি করছে। যেন সব দুঃখ বেদনা ভুলে গেছে। সকালবেলায় কিচিরমিচির করে আগের মতই বলত — ‘তুমি ওঠো, তোমার অফিসে যাবার সময় হয়ে গেছে।’
কতোদিন ধরে চড়ুই দুটো আমার ঘরের বারান্দায় বাসা বেঁধে আছে, আমার ভালই লাগত ওদের সাথে এই একাকী জীবন যাপন। মনে হতো, এই একাকী বাড়িতে কেউ না থাকলেও ওরা তো আমার সাথে আছে।
তার আরো পরে যেদিন আনন্দ উৎসব করে আমি বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসলাম। সেদিন চড়ুই দুটোও আমার সব আনন্দ উৎসব দেখল। ওদেরকেও খুব হাসি খুশি মনে হল। ওদের কিচিরমিচির আমার কাছে আনন্দ সঙ্গীতের মতো মনে হয়েছে।
পরের দিন সকালবেলা নতুন বউয়ের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম, নতুন বউকে বললাম — এই পাখি দুটো ছিল আমার একাকীত্বের সঙ্গী। ওরা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিত।
কিচিরমিচির করে পাখি দুটো কী যেন বলছিল তখন, বুঝতে পারিনি।
ঐদিন সারাদিন পাখি দুটোকে আর দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যায়ও ফিরে এল না। পরের দিন সকালেও না। আসলে ওরা বাঁধন কেটে উড়ে চলে গেছে। পরে মনে হয়েছিল — ওরা যে কাল যাবার বেলায় কিচিরমিচির করে যে কথা বলেছিল, তখন তা বুঝতে পারিনি ।
ওরা হয়ত বলেছিল — ‘তোমার ঘরে এখন নতুন মানুষ এসেছে। এখন থেকে সেই তোমায় সকালবেলা ঘুম ভাঙাবে। তোমাকে গান গেয়ে শোনাবে। তুমি তার সাথে গল্প করবে। আমাদের দায় শেষ। আমরা তাই উড়ে চলে গেলাম।’
১৮. রুক্সীণী উপাখ্যান
নাইনে পড়ি তখন। কার্তিক মাসের এক ছুটির দিনে একাকী মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার বাড়ি ছিল গোপীনাথপুরে। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে। যমুনা নদীর তীর ঘেসে বাড়ি। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মাঝখানে একটা ছোট নদীও পড়ে। খেয়া নৌকায় পার হতে হয়।
রবিনহুডের মতো একদিন হেঁটে হেঁটে মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে পৌঁছে যাই গোপীনাথপুর আমার মামার বাড়ি।
মামাতো ভাই ছাইদুলের সাথে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বিকালে যখন বাড়ি ফিরব, তখন ছাইদুল বলছিল, তুই কোন্ পথ দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবি?
আমি বললাম, আমি এসেছি নদীর কূলের পথ ধরে। ফিরে যাবও ঐ পথ দিয়েই।
ছাইদুল আমাকে বুদ্ধি দিল — তুই যে পথ দিয়ে এসেছিস, ঐ পথ দিয়ে যাবি না। আরও একটা সুন্দর পথ আছে, তুই ঐ পথ দিয়ে যাবি। খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারবি।
আমি বললাম — কোন্ পথ দিয়ে যাব ? বলে দে।
ছাইদুল পথ বলে দিল — প্রথমে খেয়া নৌকায় ছোট নদীটা পার হবি। নদী পার হয়ে বামদিকে পথ দিয়ে না যেয়ে সোজা পাঁচঠাকুরী গ্রামের পথ ধরে পশ্চিম দিকে চলে যাবি। তবে পাঁচঠাকুরী গ্রাম পর্যন্ত যাবি না। আধা মাইল যাওয়ার পর দেখবি, হাতের বাম দিকে একটা মেঠো পথ নেমে গেছে। ঐ মেঠো পথ ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর তিন রাস্তার মোড় দেখতে পাবি।
ঐ তিন রাস্তার মোড়ে তুই বামদিকের রাস্তায় যাবি না, ডানদিকেও যাবি না। সোজা চলে যাবি। কিছু দূর যাওয়ার পর একটি বড়ো আমগাছ দেখতে পাবি। ঐ আমগাছের তলা দিয়ে হেঁটে চলে যাবি সামনের গ্রামের দিকে। ঐ গ্রামের পরই তোদের কুসুমপুর গ্রাম।
বিকালে যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন ছাইদুলের বলে দেওয়া পথ ধরেই আসতে থাকি। প্রথমেই খেয়া পার হচ্ছিলাম। আমার সাথে খেয়া পার হচ্ছিল একজন বোষ্টুম ও একজন বোষ্টুমি। ওদের পরনে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়। দুজনের হাতে দোতারা! আমি বললাম — তোমরা একটা গান গেয়ে শোনাবে আমাকে! টাকা চাইলে টাকা নিবা। আমার কাছে দশ টাকা আছে। তাই দেব তোমাদের।
বোষ্টুমি বলছিল — ‘আমরা কত ঘাটে কত বাটে, কত চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে — কত গান গেয়ে শোনাই মানুষকে। কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা তোমাকে এমনি একটা গান শোনাব, কোনো পয়সা লাগবে না।’
বোষ্টুমি দোতারায় তান তুলল। বোষ্টুম বাজাচ্ছিল খুঞ্জরি টুংটাং করে —
দুজনেই একসাথে গেয়ে শোনাল গান।
‘ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী
দিতে হবে ভব পাড়ি
চেয়ে দেখো মন-ব্যাপারী
দিন গেলে হয় সন্ধ্যা ..
চোখ থাকতে হও আন্ধা ..
এই দুনিয়া মায়া জালে বান্ধা ..’
কী ভালো লাগছিল গানটা! এক অদ্ভুত বিকাল ছিল তখন। ছোট্ট সেই নদীর জলের ক্ষীণ ধারা ছলাৎছল করে উঠছিল। বিকালের আকাশের সব সোনালি আভা যেন মেখে দিচ্ছিল আমার অন্তরের মাঝে!
খেয়া নৌকায় পার হয়ে যখন এ পাড়ে আসি তখন আমি বৌষ্টুমীকে বলি — তোমরা কোথায় যাচ্ছো?
— আমরা ধলডোব গ্রামে যাব। ওখানে রায় বাড়িতে গানের আসর আছে। ওখানে আমরা গান শোনাব।
— আমারে সাথে নিবা?
— তুমি যাইবা?
— হু, যাব।
— তোমার বাবা মা তোমাকে বকবে না?
— তারা জানবে না।
— তাই? চলো তবে ।
নদী পার হয়ে পশ্চিম দিকে রাস্তা ধরে বৌষ্টুমীদের সাথে হাঁটতে থাকি। সূর্যের কড়া রোদ মুখে এসে পড়ছিল। খুব ভালোও লাগছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি — এক বাড়ির গাছ তলায় অনেক মানুষের জটলা। লাঠির বারির আওয়াজ আর শোরগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এক লোককে জিজ্ঞাসা করি , ওখানে কী হচ্ছে? লোকটি বলল — লাঠিখেলা হচ্ছে। ‘
আমি বোষ্টুমী দিদিকে ডাকলাম — ও দিদি!
— কী!
— লাঠিখেলা দেখবা?
— না, আমাদের সময় নেই।
— আমি দেখব।
— তুমি দেখ গে।
— তোমাদের সাথে আমার আর যাওয়া হলো না।
— আচ্ছা।
— তোমাদের আবার কোথায় দেখা পাব?
— আমরা পথের মানুষ। পথে পথে ঘুরি। এই পথেই দেখা পাবে কোনো একদিন ।
আমি চলে যাই লাঠি খেলা দেখতে। কী যে চমৎকার লাঠি খেলা হচ্ছিল। পালোয়ানের
মতো দুজন সুঠাম লোক লাঠি খেলছে । উঁচা লম্বা। পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। লুঙ্গি মালকোচা করে বান্দা। পোক্ত বাঁশের লাঠি। পোড়ানো এবং কালচে রঙ করা। সে কি তুমুল বাইরাবেরি। খটখট আওয়াজ হচ্ছে। লোকজন হুল্লোড় কড়ছে। কেউ শীষ দিচ্ছে। আমি বিস্ময় ভরে ওদের লাঠি খেলা দেখতে থাকি!
মাগরিবের আযানের আগ দিয়ে লাঠি খেলা শেষ হয়ে যায়। খেলা দেখা শেষ করে আমি পুণরায় আবার বাড়ির পথে চলতে থাকি।
ছাইদুল বলেছিল — পাঁচঠাকুরী গ্রামের আগেই বামদিকের একটি মেঠো পথ দিয়ে যেতে হবে। পাঁচঠাকুরী গ্রামের ঐ পর্যম্ত যেতেই কালী সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমার সাথে কোনো সঙ্গী সাথী নাই। খুব ভয় ভয় লাগছিল আমার ।
আমি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, ঠিক এই মেঠো পথ দিয়ে যেতে হবে কী না? পথটির দুধারে বিস্তৃর্ণ আখের ক্ষেত। কিছু দেখা যায় না। তার উপর সন্ধ্যা রাত্রির অন্ধকার! ঠিক তখনই আখের ক্ষেতের ভিতর থেকে মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে আসে একজন যুবতী নারী।
রমণীটিকে আমি চিনি। এ যে আমাদের গাঁয়ের ভোলা মন্ডলের সুন্দরী বউ। আমি একটু সাহস পেলাম — বললাম — তুমি কই যাও?
— ‘নরপাড়া বাপের বাড়ি যাইতাছি। তোমার ভোলা ভাই আমারে মাইরা খেদাইয়া দিছে!’
এই রাতে আমাকে একা দেখে ভোলা মন্ডলের বউ বলছিল — ‘তা তুমি একা যাইতে পারবা? সামনে একটা জায়গা আছে, খুব একটা ভালো না। তুমি তিন রাস্তার মোড়ে যেয়ে সোজা যাইও। ভুলেও ডান দিকে যাবা না।’
আমি বললাম — আচ্ছা।
ভোলা মন্ডলের বউ বলছিল, ‘আমি কী তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসব?’
এই নিশি রাতে এক পর সুন্দরী রমণী আখ ক্ষেতের ভিতর দিয়ে আমার সাথে গমন করবে, কেউ দেখলে আমার বদনাম হবে। এই ভেবে আমি ভোলা মন্ডলের বউকে বললাম — আমি একাই যেতে পারব।
ভোলা মন্ডলের বউ পাশের নরপাড়া গাঁয়ের দিকে চলে গেল। আমি আখ ক্ষেতের ভিতর দিয়ে মেঠো পথ ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। কিছুদূর আসার পর দেখি — আখ ক্ষেতের পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে। একটু ভয় পেলাম। যত হাঁটছি, ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝি পোকার ডাক বাড়ছে। আকাশে চাঁদ নেই। আখ পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশে চেয়ে যা দেখছি তা কয়েকটি অনুজ্জ্বল তারা।
হঠাৎ দেখি — কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মুনিয়া পাখি উড়ে আসছে। ওরা আমার মাথার উপর দিয়ে শন শন করে চলে যাচ্ছে। অদূরে শিয়ালও ডাকছে হুক্কাহুয়া করে। শিয়ালের ডাক শুনে আমি ভয় পেলাম না। আমি হাঁটতে থাকি সাহস করে সামনের দিকে।
কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি — সেই তিন রাস্তার মোড়। আমাকে মাঝের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু দেখি, মাঝের রাস্তার উপর অনেকগুলো কাক মরে পড়ে আছে। মরা কাকের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাকে যেতে হবে। খুব ভয় লাগছিল আমার।
আমি মাঝের রাস্তা দিয়ে না যেয়ে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে য়েতে থাকি। কী সুন্দর খোলা পথ! খুব ভালো লাগছিল হাঁটতে। কোথাও কোনো আখ ক্ষেত নেই। চারিদিকে সব সরিষার ক্ষেত। রাতের বেলায় হলুূদ ফুলের প্রান্তর দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কেমন এক মোহন আবেশে মন ভরে উঠছিল। গন্ধে আকুল করে রেখেছিল রাতের মিহি বাতাস। আমি সে গন্ধ মেখে হাঁটতে থাকি।
সামনের দিকে এগুতেই দেখতে পাই — একটি পরিত্যক্ত নীলকুঠি। নীলকুঠি তো নয়, পোড়ামাটির ধ্বংসস্তূপ। শুনেছি এই কুঠি এলাকায় কেউ ভয়ে দিনের বেলায় আসে না। এখানে নাকি ভূতের আড্ডা বসে দিনে ও রাত্রিতে।
হায় আল্লাহ! আমাকে কে যে এখানে টেনে নিয়ে এলো ! কোন্ জ্বীন পরী? পিছনে তাকিয়ে দেখি — কোথাও কোনো হলুদ সরিষার ক্ষেত নেই। সব মিছে ছিল। সব আখ ক্ষেত!
নীলকুঠির সামনে বাবলা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি এক দাড়িওয়ালা বুড়াকে। আমি বুড়াকে বলি — দাদু, আমি পথ ভুল করে এখানে এসেছি। আমাকে তুমি পথ দেখিয়ে দাও।
— তুই আর এখান থেকে যেতে পারবি না!
— কেন পারব না?
— তোকে বলি দিব।
বুড়ার পিছনে দেখি — পনের ষোল বছরের একটি রূপবতী মেয়ে। পরীর মতো চেহারা। অসম্ভব সুন্দরী। মাথার চুল দুই বেনী করা। বেনীতে বাবলা ফুল গাঁথা , আর গলায় কাঁঠালীচাঁপা ফুলের মালা। আমি বললাম — মেয়েটি কে?
বুড়া বলল — ওকে আমি যমুনার নদীর এক গহীন চর থেকে নিয়ে এসেছি। ওর নাম রুক্সীণী । ও আমার নাতীকে ভালো বাসত। কিন্তু আমার নাতী সাপে কেটে মারা গেছে।
তারপর থেকে রুক্সীণী পাগল হয়ে কাশবনে পড়ে থাকত। কিছু খেত না। কী করব? ওর জন্য আমার খুব মায়া হয়। পরে ওকে আমি এখানে এই নীলকুঠিতে নিয়ে আসি বিবাহ করব বলে । কিন্তু আমার তান্ত্রিক গুরু শর্ত দিয়েছে আমাকে আগে নরবলি দিতে হবে। তারপর আমি বিবাহ করতে পারব।
মেয়েটি আমার দিকে সেই অন্ধকার রাত্রিতে খুব মায়া করে তাকিয়ে দেখছিল। যেন কতকাল ধরে সে আমাকে চেনে। আমিও তাকে চিনি। আমি ইঙ্গিৎ করে — মেয়েটিকে বললাম — তুমি আমাকে বাঁচাও! আমিও তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব।
বুড়া আমাদের শলাপরামর্শ বুঝতে পারছিল। বুড়া বলে — ‘এখানে দাঁড়া তুই , আমি ভিতর থেকে রামদা নিয়ে আসি। এখনই তোর গর্দান মাটিতে ফেলে দিব।’ এই কথা বলে বুড়া নীলকুঠির ভিতরে চলে যায়।
আমি এই সুযোগে খপ করে রুক্সীণীর একটি হাত ধরি। এবং দুজন হাত ধরে ক্ষেত পাতাইলা ঝাইরা আমাদের গ্রামের দিকে দৌড় দেই।
এর পরের ঘটনা আমার আর মনে নেই।
তখন বেলা দশ ঘটিকা হবে । আমি আমাদের বাড়ির ঘরে পালঙ্কের উপর শুয়ে আছি। চারপাশে অনেক মানুষ! সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ভীড়ের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখতে পেলাম — ঠিক রাতে দেখা নীলকুঠির ঐ পরী মেয়েটির মতো। চুল দুই বেনী গাঁথা, বেনীতে বাবলা ফুল, গলায় কাঁঠালিচাঁপার মালা। এই মেয়েটিকে এর আগে কখনও আমাদের বাড়িতে দেখি নাই।
১৯. দ্বিধা
লায়লা আমার সহপাঠী ছিল। ইউনিভার্সিটিতে তিন বছর একসাথে অনার্স পড়েছি। আমরা দুজন একে অপরের ভালো বন্ধুও ছিলাম।
লায়লা আমাকে একটি চিঠি লিখেছিল। আমাদের অনার্স পরীক্ষা যেদিন শেখ হয়ে যায় সেদিন। তিন বছরে কত ক্ষণ ছিল, কত মুহূর্ত ছিল, কত আনন্দময় সময় ছিল, কত আকাঙ্খা করতাম কোনো নিবেদন পাওয়ার — তখন সে কিছু লেখেনি। ইউনিভার্সিটি যেদিন বন্ধ হয়ে গেল, যেদিন থেকে আর কোনো দিন ক্লাস হবে না, সেদিন সে আমাকে চিঠি লিখেছে। তাও বিদায় বেলায় যাবার সময়।
চিঠিটি দেওয়ার সময় লায়লা শর্তও দিয়েছিল একটা — ‘আমি যখন চলে যাব। স্টেশন থেকে ট্রেনখানি যখন ছেড়ে চলে যাবে অনেক দূর, তখন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তুমি পড়বে আমার চিঠিখানা, এর আগে নয়। ‘
আমি লায়লাকে বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে, তাই পড়ব।’
রাজশাহী এক্সপ্রেস ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে ঝিকঝিক করে প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যায়। এই ট্রেনেই চলে যায় লায়লা । কী সুন্দর হাসিখুশি ভাবে চলে গেল সে। মুখে কোনো মন খারাপ নেই। চোখে কোনো বিষণ্ণতাও নেই। জানালার কাছে বসে ছিল সে। তাই দেখতেও পেলাম ওর যাবার বেলাকার দু চোখ। ট্রেন আড়াল হয়ে যতদূর পর্যন্ত মিলিয়ে গেল, ততদূর পর্যন্ত ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলাম ।
পথে যেতে যেতে ওর চোখ থেকে একটুও কী কান্না ঝরে পড়েনি আমার জন্য? ও কী পাষাণী? নাকি আমি পাষাণ? কারোর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও ঝরে পড়ল না! তবে কী মিছে ছিল সব তিন বছরের মায়া মমতা !
লায়লা চলে যাবার পর প্লাটফর্মেের কোলাহল মুহূর্তেই যেন মুখরহীন হয়ে গেল। কতক্ষণ এমনি দাঁড়িয়ে থাকলাম একাকী । তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে একটি খালি কংক্রিটের বেঞ্চের উপর যেয়ে বসি। ফ্লাস্কে করে এক চা বিক্রেতা ছেরা বলছিল — স্যার চা খাইবেন?
বললাম — দে।
— লাল চা কিন্তু!
— তাই দে।
— সিগারেট দিব?
— দে।
— কোনটা খান?
— ছাত্তার।
— ছাত্তার কী স্যার!
— স্টার দে। স্টারকে ছাত্তার কই।
চা খেয়ে স্টার টানতে থাকি। একটু জোরে জোরেই টানলাম। মাথা ধরে গেল বেশ ! মাথা ধরা নিয়েই লায়লার চিঠিখানি বের করে পড়তে থাকি —
রঞ্জন,
আমি চলে যাচ্ছি। আবার কবে আসব জানি না। মাস্টার্স করা হয়ত আর হবে না। আবার হতেও পারে। যদি তুমি চাও।
আমার বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে আছে। আমি গেলেই আমার মতামত নিয়ে হয়ত কথা পাকাপাকি করে ফেলবে।
তুমি এমন কেন বলো তো? ছেলে মানুষের এত দ্বিধা থাকে? তিন বছরে কতগুলো দিন ছিল, সে কী তুমি গুণেছিলে কখনও? কত কথা বলেছি তোমার সাথে, কত ক্ষণ তোমার পাশে বসেছি, কত কিছু দিতে নিতে কত যে আঙুলের ছোঁয়া লেগেছে দুজনের ! কার শরীরের কেমন গন্ধ, তাও জানা হয়ে গেছে। চেহারার রূপ, অপরূপ, অরূপ — সবই দেখা হয়ে গেছে !
আমাকে কী তোমার ভালো লাগেনি? দ্বিধাটা ছিল তোমার কোথায়? কেন তুমি গত তিন বছরেও বলতে পারোনি — ‘ লায়লা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমি চাই। তোমাকে ছাড়া বাকী জীবন আমার চলতে চাইবে না। ‘
না কী, তুমি চেয়েছিলে আমি তোমাকে আগে বলি! তাই না?
কী আশ্চর্য! আমারও বলতে বলতে তিনবছর লেগে গেল। যখন এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ঠিক তখন। হঠাৎ করেই কেমন জানি লাগছে! মনে হচ্ছে — তুমি ছাড়া আমি খুব একা! তোমাকে ছাড়া আমার বাকী জীবন অর্থহীন।
এই শহরে কোথায় আমরা যাইনি বলো? পথে
পথে কত হেঁটেছি , কত বৃক্ষের সবুজে, ইউক্যালিপটাসের কত ছায়াতলে! কত সময় পার করেছি অহেতুক কোনো কথা না বলে। শুধু আসল কথাটাই তোমাকে বলা হয়নি — ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি রঞ্জন।’
হ্যাঁ — রঞ্জন, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই চিঠির অপর পৃষ্ঠায় আমার ঠিকানা লেখা আছে। তুমি আমাকে দ্রুত পত্র লিখে তোমার মতামত জানাবে। আমি তোমার পত্রের জন্য অপেক্ষা করব। ভালো থেকো।
—– লায়লা।
আমি চিঠিখানা পড়ে কংক্রিটের বেঞ্চের উপর রাখি। ঐ চা-ওয়ালা ছেরাকে আবার ডাকি। ওকে বলি — চা দে এক কাপ!
ছেরা চা দেয়। এবং বলে — ছাত্তার দিব?
— না, আবদুল লতিফ দে।
— স্যার আবদুল লতিফ কী?
— চিনোস না! গোল্ড লীফ! গোল্ড লীফ দে।
চা ওয়ালা ছেরাকে বলি — তোর নাম কী? ও বলে, এমডি আবুল কাসেম।
আমি এমডি আবুল কাসেমকে বলি — তুই আমাকে আরও দুই রাউন্ড চা সিগারেট খাওয়াবি। তারপর, বিল নিয়ে চলে যাবি। কাসেম মাথা নেড়ে বলে — আচ্ছা।
প্লাটফর্ম থেকে যখন চলে আসব তখন কংক্রিটের বেঞ্চের উপর রাখা চিঠিখানি খুঁজি। দেখি চিঠিটি নেই। ফাল্গুণের দমকা বাতাসে কখন চিঠিটি উড়ে যেয়ে প্লাটফর্মের নীচে রেললাইনের উপর পড়ে গেছে দেখতে পাইনি। ট্রেনের ঘূর্ণোন চাকায় সে চিঠি ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ছিন্ন চিঠি কুড়িয়ে চিঠির পিছনে লেখা লায়লার ঠিকানাটা যে উদ্ধার করব, তা আর ইচ্ছে হলো না !
প্লাটফরমের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম আর ভাবছিলাম, কী করব এই জীবনে? বিয়ে করে খাওয়াব কী? সেই একই দ্বিধা! একই অনীহা! চাল চুলোহীনদের বিয়ে করার সাধ হওয়া ঠিক না। ওর বিয়ে হয়ে যাক। ভালো থাক্ আমার আজীবন চির- সখা লায়লা। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না !
পাঁচ বছর পর……
একটা সরকারি কাজে চাঁপাই নবাবগঞ্জ গিয়েছিলাম। ওখানে কাজ সেরে একটি লোকাল বাসে করে ফিরছিলাম রাজশাহীতে। পথিমধ্যে গোদাগাড়ী থেকে একটি মেয়ে ওঠে। আমি দেখে তাকে চিনতে পাই, এ যে লায়লা।
সিট ছিল না! ওকে বসতে দেই। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বলে — তুমি, এখানে!
টুকটাক অনেক কথাই হল ওর সাথে। রাজশাহীতে এসে দুজনই নামি। লায়লা বলছিল — চলো আমার স্বামীর বাসায়।
— আমি বললাম, না — আজ না। আজই আমাকে ঢাকা চলে যেতে হবে।
— আচ্ছা।
— চলো তোমাকে এমনি একটু এগিয়ে দিয়ে আসি!
— এসো।
হাঁটতে হাঁটতে লায়লা আমাকে বলছিল — বিয়ে করেছ?
— না।
— কেন করো নাই?
হঠাৎ ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। লায়লা বলছিল — তুমি একটা রিকশা নিয়ে বাস স্টান্ডে চলে যাও। ঠান্ডা লাগবে। তোমার তো একটুতেই ঠান্ডা লাগে।
আমি বললাম — আচ্ছা।
লায়লা ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেল।
অনেক দূর পর্যন্ত যেয়ে লায়লা একবার পিছনে ফিরে তাকায়। ও দেখতে পায় — তখনও রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থেকে আমি ওর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে আছি, তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টিতে ভিজছি।
২০. সিল্কসিটি এক্সপ্রেস
সদানন্দপুর স্টেশন থেকে ষাটোর্ধ একটি লোক ও এক বৃদ্ধা রাজশাহীগামী সিল্কসিটি ট্রেনটিতে উঠে। তারা কোথায় যাবে, বা নামবে কেউ জানে না। লোকটার বয়স ষাটের উপর হলেও এখনও সে অনেক শক্ত সামর্থ্য। কিন্তু স্ত্রীলোকটি খুব অসুস্থ। পুরুষ লোকটা অনেকটা বোগল কোল করেই তাকে ট্রেনের কামড়াতে উঠিয়ে বসায়। লোকটির কথায় বোঝা গেল বৃদ্ধা তার স্ত্রী হয়।
বৃদ্ধাা মহিলাটির ঠোঁট মুখ বাঁকা হয়ে গেছে। কথা বলতে পারে না। শরীরের বাঁ পাশটা পুরো অবশ। তার যে দুতিন বার স্ট্রোক করেছিল, তাকে দেখলে তা বোঝা যায়।
কোনো শক্ত খাবার সে খেতে পারে না। নিজে হাত দিয়ে তুলে কোনো কিছু খেতে পারে না। তাকে তুলে খাওয়াতে হয়। তার আরও অসুবিধা আছে, তাহলো সে নিজে বাথরুমে যেতেও পারে না। অন্য কারোর সাহায্য নিতে হয়।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে দেখে মনে হলো ওনারা নিম্নবিত্তের গ্রামের মানুষ। ওনারা যেহেতু সদানন্দপুর থেকে উঠেছে এদের বাড়ি কামারখন্দ-ভদ্রঘাট- কোনাবাড়ি- সিরাজগঞ্জ সদরের কোনো এলাকার হয়ত হবে। আবার নাও হতে পারে। অন্য কোথাও থেকে এসে এই সদানন্দপুর স্টেশন থেকে তারা উঠতে পারে।
ট্রেনটি চলছে। ওনারা সাধারণ শোভন সিটে বসে আছে। লোকটা খুব সেবা সুশ্রুষা করছে ওনার স্ত্রীকে। তার সেবা সুশ্রুষা দেখে মনে হল — তাদের ভিতর একসময় খুব প্রেম মহব্বত ছিল। একটা শিশুকে যে ভাবে মা যত্ন করে খাওয়ায়, ঠিক সেইভাবে যত্ন করে স্ত্রীলোকটিকে সে খাওয়াচ্ছিল। কখনও তাকে দুহাত দিয়ে বুকের পাশে জড়িয়ে রাখছিল, কখনও তার কোলের উপর মাথা রেখে চুল বিলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছিল লোকটি।
কামড়ার অন্যান্য যাত্রীরা সবাই মুগ্ধ হয় স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এমন ভালোবাসা দেখে। বৃদ্ধা মহিলাটি একসময় তার প্রিয়তম স্বামীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। মনে হল, এমন কেউ একজন গান গেয়ে গেয়ে তাকে ঘুম পারাল —
‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার,
জীনন মরণ মাঝে…. ‘
লোকটির সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হল আমার। বললাম — আপনারা কোথায় যাবেন? লোকটি বলল — পাকসীর কাছেই, পদ্মার পাড়ে একটি গ্রামে।
— ওনাকে আপনি খুব ভালোবাসেন বুঝি?
— জ্বী, আমার পরানের চেয়ে বেশি।
— তাই? শুনে অনেক খুশি হলাম।
— জানেন, আমার সংসারে কিছু ছিলনা। সেই বাবার বাড়ির যা কিছু পেয়েছিল, সবই আমাকে এবং আমার সংসারের জন্য দিয়ে দিয়েছে। নিজের জন্য কিছু রাখেনি।’
— যাক, আপনিও অকৃতজ্ঞ হননি। স্ত্রীর এই অসুস্থতার সময় তার পাশে রয়েছেন।
লোকটি স্মিত হাসলো।
ট্রেনটি ইতোমধ্যে ঈশ্বরদী জংশনে এসে থামে। লোকটি — তার কোলের উপরে ঘুমিয়ে থাকা তার স্ত্রীকে ডাকে — ‘এই, ওঠো, এসে গেছি।’
বৃদ্ধা মায়া করে তার স্বামীর চোখের দিকে চোখ মেলে তাকায়।
লোকটি আবারও বৃদ্ধাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নামে। এবং তার স্ত্রীকে বামপাশ
করে আস্তে আস্তে করে হেঁটে বিশ্রামাগারের দিকে নিয়ে
যায়।
লোকটি তার অসুস্থ স্ত্রীকে বিশ্রামাগারের বেঞ্চের উপর শোয়ায়ে দেয়। তার মাথায় ও কপালে হাত বুলায়ে বলে– ‘খুব খারাপ লাগছে তোমার?’
বৃদ্ধা কথা বলতে পারছিল না। মাথা নেড়ে বলছিল শুধু , হে।
— ‘তুমি একটু শুয়ে থাকো। ভালো লাগবে।
আমি তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।’ এই কথা বলে সে বিশ্রামাগারের বাইরে চলে আসে।
প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা সিল্কসিটি ট্রেনটি তখন হুইসেল বাজিয়ে পুনরায় আস্তে আস্তে চলতে থাকে। লোকটি একবার এদিক সেদিক তাকায়। তারপর দৌড়ে গিয়ে পিছনের কামড়ার একটি দরজা দিয়ে ত্বরিৎ ট্টেনটিতে উঠে পড়ে।
সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঝিকঝিক করে দ্রুত বেগে ছুটে চলতে থাকে রাজশাহীর দিকে।
২১. রোল নং ১৭ দোলা মিত্র
১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের কোনো একটি দিন। আজ এতদিন পর সঠিক দিন তারিখ মনে নেই। দেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল।’
মুক্তিযুদ্ধের পরে আমাদের স্কুল প্রথম খোলার দিন ছিল সেদিন। দীর্ঘ দশমাস পর স্কুল খুলবে। দীর্ঘ দশ মাস পর সবার সাথে দেখা হবে। কেমন একটি উৎসব উৎসব মুহূর্ত ছিল সেদিন , কেমন একটি উত্তেজনা উত্তেজনা ভাব ছিল।
ক্লাস নাইনে পড়ি। প্রথম ক্লাসটি ছিল ওয়াহিদ স্যারের অংকের ক্লাস। আমাদের ক্লাসে প্রায় পঞ্চাশ জনের মতো ছাত্র ছাত্রী ছিল। এর মধ্যে ছাত্রী ছিল মাত্র সাতজন। তখন মেয়েরা স্যারদের পিছে পিছে ক্লাসে আসত। এবং ক্লাস শেষ হলে স্যারদের পিছেপিছে বেরিয়ে যেত।
দীর্ঘ দশ মাস পর স্যার প্রথম রোল কল করছে। ক্লাসে সেদিন অনেকেই আসেনি, ষারা আসেনি তারা কেন আসেনি, সহপাঠীরা যারা জানত তারা কেউ কেউ বলে দিচ্ছিল।
স্যার একসময় কল করে — ‘রোল নং ১৭, দোলা মিত্র।’ কোনো রেসপন্স নেই। কেউ বলছে না — ‘ইয়েস স্যার’। মেয়েদের বেঞ্চে ছয়জন ছাত্রী বসা ছিল। তাদের ভিতর দোলা মিত্র নেই।
ক্লাস কক্ষ নিরব নিস্তব্ধ। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। দোলাদের বাড়ি ছিল ধলডোব গ্রামে। ঐ গ্রামেরই একটি ছেলে ছিল, নাম বিমল। বিমল আমাদের সাথে পড়ত। স্যার ওকে জিজ্ঞাসা করে– ‘তুমি কী দোলার কোনো খবর বলতে পারো?’ বিমল বলছিল — ‘ স্যার, দোলা’ রা ভারতে চলে গিয়েছে। এখনও ফিরে আসেনি।’
দোলা’ রা ভারত থেকে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। কেন আসেনি। সে অনেক দুঃখের কথা। অনেক দাম দেওয়া কাহিনি।
কেমন ছিল দোলা নামের মেয়েটা? ক্লাসে চুপিচুপি ছেলেরা ওকে ডাকত কাননবালা বলে। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের এই মেয়েটির চোখ দুটো ছিল বিনোদিনীর মতো টানাটানা, কেশবতী ছিল সে। হাতে কঙ্কণ পরত। কিন্তু কিনিকিনি শব্দ হতো না হাতে। স্কুলের বারান্দা দিয়ে স্যারদের পিছনে পিছনে হেঁটে যখন সে ক্লাসে যেত, তখন সিনিয়র ছেলেরা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত ওকে। ‘বধূ তুমি চলে যাও গো বকুল বিছানো পথে পথে।’
দোলা ভালো গান গাইতে পারত। স্কুলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ও গানে প্রথম হত। সেই বার আমাদের ক্লাসে দুজন ছাত্র ছাত্রী পুরস্কার পেয়েছিল। একটি পেয়েছিল গানে দোলা মিত্র। আর একটি পেয়েছিলাম আমি — স্বরচিত কবিতা পাঠে। শহর থেকে ক্যামেরাম্যান এনে বিজয়ীদের স্টীল ছবিও তুলেছিল।
দোলা আমার সহপাঠী হলেও ওর সাথে আমার কিংবা অন্য ছেলেদের সাথে ওর তেমন কোনো কথা হত না। কারণ কথা বলার সুযোগ ছিল না তখন। ছুটির পরে একদিন বাড়ি যেতে যেতে দোলা আমাকে বলেছিল — ‘তুমি তোমার কবিতাটি কপি করে আমাকে দিও। খুব ভালো লিখেছ, একেবারে গানের মতো।’
আমি লাইনটানা একটি সাদা কাগজে আমার সেই কবিতাটি লিখে দোলাকে দিয়েছিলাম। তাও গোপনে, কেউ দেখতে পায়নি। সেদিনও ছুটির পর বাড়ি যেতে যেতে কথা হয়েছিল দোলার সাথে। কবিতাটি দেওয়ার সময় আমি ওকে বলেছিলাম — ‘তুমি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যে গানটি অনুষ্ঠানে গেয়েছিলে, ঐ গানটি আবার একদিন আমায় গেয়ে শোনাবে?’
দোলা বলেছিল — ‘গেয়ে শোনাব তোমাকে একদিন ‘।
তারপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। একদিন ভোরবেলা শহর থেকে ধলডোব গ্রামে মিলিটারি গেল। ম্যাসাখার করল বাগবাটি, হরিনাগোপাল ও ধলডোবসহ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো। জ্বালিয়ে দেওয়া হলো তাদের ঘরবাড়ি ও মন্দির। ঘর থেকে মানুষ ধরে নিয়ে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। ধর্ষণ করে মেয়েদের। পাক সৈন্যদের কালো হাতের থাবা থেকে সেদিন দোলাও রক্ষা পায়নি। সেও ধর্ষিত হয়েছিল।
লজ্জ্বায় আর গ্লানিতে দোলাদের পরিবার স্মরণার্থী হয়ে সেই যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারপর আর তারা ফিরে আসে নাই এই দেশে।
তারপর জীবন থেকে কত পৃষ্ঠা উল্টে গেছে। কতদিন কত বছর চলে গেছে কালের অতল তলে। আমিও চলে এসেছি গ্রাম থেকে শহরে। সেই কবে অজ পাড়াগাঁয়ের এক স্কুলের, ক্ষণকালের এক সহপাঠিনী ছিল দোলা মিত্র! তাকে জীবন ভর মনে রাখার দায় কী ছিল আমার? যে আবার চলে গেছে অন্য দেশে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কত গান শুনেছি কত জনের কাছ থেকে। কত সুরে সুরে ভেসে গেছে কত আনন্দের ক্ষণ ! সেই কবে পল্লীর এক স্কুলের অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে দোলা মিত্র নামে অখ্যাত কেউ একজন — কী এমন গান গেয়েছিল যে, তার সেই কণ্ঠ, তার সেই সুর এত দিন ধরে মনে রাখতে হবে ! কিংবা তা কী এখনও হৃদয় বীণায় অনুরণিত হবে চিরকাল !
অনেক বছর পর পিপুলবাড়িয়া বাজারে সহপাঠী বিমলের সাথে আমার একবার দেখা হয়। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দোলা এখন কোথায় থাকে? বিমল বলেছিল — ‘শুনেছি, দোলা শিলিগুড়িতে থাকে। ইসকন মন্দির রোডে ওদের বাসা। দোলা ওখানকার একটি স্কুলের গানের মাস্টার। ওর স্বামীর নাম — সুনীল চক্রবর্তী।
২০০৪ সালে আমি ও আমার স্ত্রী দার্জিলিং গিয়েছিলাম বেড়াতে। ফেরার পথে শিলিগুড়িতে দুইদিন ছিলাম। খুব ইচ্ছা হলো, দোলার সাথে দেখা করার। একদিন বিকালে আমার স্তীকে নিয়ে ইসকন মন্দির রোডে দোলাদের বাড়ি খুঁজতে বের হই। পেয়েও যাই ওর বাড়ি।
আধাপাকা টিনসেড ছোট্ট ছিমছাম একটি বাড়ি। বাড়ির গেটে নক করতেই গেটটি খুলে দেয় মধ্যবয়সী একটি লোক। বুঝতে পারছিলাম, ইনি দোলার স্বামী হবে। উনি বলছিলেন — কোথা থেকে আপনেরা এসেছেন?
— আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
— কার কাছে এসেছেন?
— এখানে দোলা মিত্র নামে কেউ থাকে?
— থাকে। তবে দোলা মিত্র নয়, সে এখন দোলা চক্রবর্তী। উনি আমার স্ত্রী।
— ওহ! আচ্ছা! আমরা দোলার সাথে একটু দেখা করব।
— আসুন, ভিতরে বসুন।
ছোট্ট সাজানো গোছানো একটি ড্রয়িং রুমে আমাদের বসতে দেয়। একটু পর একজন মহিলা প্রবেশ করে। দেখলাম তাকে! এ যে দোলা মিত্র !
সেই অপূর্ব সুন্দর মুখচ্ছবি! আজও তেমনই আছে লাবণ্যময় রূপ মাধুর্য! মার্জিত বাচনভঙ্গী, আনত নয়ন! কী যে দেবী দেবী লাগছিল ওকে!
আমি ওকে বললাম — চিনতে পারছ আমাকে?
— পারছি! তুমি রঞ্জন!
— হ্যাঁ, আমি রঞ্জন। তেত্রিশ বছর পর আমাদের দেখা হলো।
আমার স্ত্রীকে দেখিয়ে দোলা বলছিল, তোমার বউ নিশ্চয়ই!
— হুম! ওর নাম — মায়াবতী!
দোলা ওর স্বামীর সাথেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
দোলাকে দেখছিলাম আর বিষাদে মনটা ভারী হয়ে উঠছিল। ওর মায়াময় মুখখানি দেখে কান্না পাচ্ছিল খুব। বলতে ইচ্ছে করছিল, দোলা — ‘তুমিও তো আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছ। তোমার এই আত্মত্যাগ আমরা ভুলি কী করে?’
সেদিন রাত অবধি দোলার বাসায় ছিলাম। অনেক কথা হয়েছিল দোলা ও দোলার স্বামীর সাথে। দোলা না খেয়ে আসতে দেয়নি।
দোলার ড্রইংরুমে একটি জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম — ওয়ালে কাঁচের ফ্রেমে একটি ছবি যত্ন সহকারে সে টানিয়ে রেখেছে। ছবিটি আমাদের স্কুলের একটি পুরস্কার বিতরণীর। ছবিতে আমি ও দোলা পুরস্কার গ্রহণ করছি হেড স্যারের কাছে থেকে। সবুজ ছায়া সুনিবিড় স্কুল আঙিনা। আম সুপারির ঝাড়, খোলা মাঠ, খোলা আকাশ সবই ছবিতে দেখা যাচ্ছে। এ যেন বাংলাদেশের একটি চিরায়ত রূপ !
ওর বাড়ি থেকে যখন চলে আসব, তখন দোলা বলছিল — রঞ্জন, তুমি আমার গান শুনবে না?
— শুনব, গাও।
দোলা হারমোনিয়াম বাজিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই গানটি গেয়ে শোনায়। যে গানটি স্কুলের অনুষ্ঠানে সে গেয়েছিল, যে গানটি আমাকে গেয়ে শোনাবে বলে একদিন সে কথা দিয়েছিল —
‘তুমি না হয় রহিতে কাছে-
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে,
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে।
এই মধুক্ষণ মধুময় হয়ে নাহয় উঠিত ভরে-
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে,
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে……। ‘
তারপর আরও কত বছর চলে গেছে।
“রোল নং ১৭, দোলা মিত্র।” ক্লাস কক্ষের ভিতর রোল কলের সেই আওয়াজটি দিনে দিনে কেমন যেন অস্পষ্ট ও ক্ষীণ হয়ে আসছে !
২২. মৌয়াল
জব্বর মৌয়াল একজন ভূমিহীন প্রান্তিক মানুষ। সংসারে তার অভাব অনটন লেগেই থাকে । দুটো ছোট মেয়ে আছে তার। বয়স একজনের পাঁচ বছর, আর একজনের তিন বছর। একজনের নাম নূরী, আর ছোট জনের নাম — বুড়ী।
সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করে জব্বার সংসার চালায়। কিন্তু সবসময় সে বনে মধু পায় না। আর তখনই তার সংসারে অভাব লেগে থাকে। অভুক্ত থাকতে হয় তাদের প্রায় সময়।
জব্বারের বউ আছিয়া এই অভাব অনটন নিয়ে প্রায় দিনই জব্বার মিয়ার সাথে ঝগড়া করে। সেদিন দুপুরবেলা তুমুল ঝগড়া করছিল জামাই বউ দুজনে। একে অপরে তুই তোকারি করে কথা বলছিল । আর অশ্লীল যত গালি গালাজ করছিল। শুরুটা করেছিল জব্বার মিয়ার বউ।
— মরদ তুই আমারে বিয়া করছিলি ক্যা.. বউ পোলাপানরে খাওন দিতে পারবি না..
— চুপ কর মাগী, বেশি কতা কবিনা।
— চুপ করমু ক্যা.. মাইয়া দুউডা কাল থাইকা না খাইয়া রইচে..
— আমি কী করমু.. কই থেইকা দিমু?
— তো জন্ম দিছিলি ক্যা..
— তরে করেছিলাম। তাই হইয়া গেছে।
— করার সময় তো মজা লউছোস, হুস আছিল না।
— তুইও তো মজা লইছোস।
— চুপ কর্ মর্দা, বউরে খাওন দিতে পারোস না, আবার কতা কস্। তুই আবার আমারে করতে আসিস। তোর ঐটা কাইটা দিমু।
— মাগী চুপ কর! কইচি।
— মাইয়া দুইডা কখন থেকে ক্যানতাছে! তুই শোনস না! তুই ঘর থাইকা বের অইয়া যা মর্দ। তরে দেখতে চাই না।
আছিয়া জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
জব্বার মিয়া মাথায় গামছা বাঁধল। নূরী আর বুড়ীকে বলল — এই তোরা আমার সাথে আয়। নূরী বুড়ী খুব খুশি হয়। ওরা বলল — বাবা, তুমি আমাগো কই নিয়া যাইবা?
— চল্। খোন্তাকাটা বাজার থোন তোগোর খাওয়াইয়া লইয়া আসি।
নূরী ও বুড়ীকে নিয়ে জব্বার নৌকায় উঠল। ছোট ডিঙি নৌকার পাটাতনের উপর দুই বোন বসে আছে। ওদের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। জব্বার মিয়া বৈঠা চালাচ্ছে। ছোট্ট নৌকাটি চলছে বলেশ্বর নদীর উপর দিয়ে।
তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকাল। ভাটি স্রোতের টানে নৌকাটি সুন্দরবনের তীরে এসে থামে। জব্বার মিয়া নৌকাটি একটি গাছের গুরির সাথে বাঁধে। তারপর মেয়ে দুটোকে হাত ধরে কূলে নামায়। জব্বার মিয়া ওদের বনের গভীরে নিয়ে যায়। এক জায়গায় ওদের বসিয়ে রেখে বলে — ‘তোরা এখানে বসে থাক্। আমি আসছি।’
মেয়ে দুটো বলছিল — বাবা, তুমি কই যাও?
— আমি তোগোর জন্য খাবার নিয়া আসি।
— তাড়াতাড়ি আইসো বাবা, আমাগো খুব খিদা লাগছে।
— আচ্ছা।
জব্বার মিয়া মেয়ে দুটোকে জঙ্গলের ভিতর রেখে আস্তে আস্তে এসে নৌকায় ওঠে।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বনের ছোট্ট ছোট্ট পাখিরা সন্ধ্যার আকাশ জুড়ে চ্রিহি চ্রিহি শব্দ করছে। আঁধার নামছে ঘনঘোর করে। জব্বার মিয়া বলেশ্বর নদীর উজান বেয়ে বৈঠা চালাতে থাকে। কিন্তু বৈঠাটি চালাতে পারছিল না সে। নৌকা যেন চলছে না আর।
হাতে বল পাচ্ছিল না জব্বার মিয়া। তারও পেটে যে তখন প্রচন্ড খিদা ছিল ।
২৩. তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয়
বর্ষা মাসের এক মধ্যাহ্ণে আমাদের বাড়ির ঘাটে একটি ছোট ছইওয়ালা নৌকা এসে থামে। নৌকার ভিতর থেকে একজন মধ্যবয়সী লোক ও আর একজন মধ্যবয়সী মহিলা নামে। তারা দুজনেই বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করে।
মহিলাটি আমার মায়ের দূর সম্পর্কের বোন। নাম মোছাঃ শিরিনা খাতুন। আমরা তাকে শিরিন খালা বলে ডাকতাম। এই শিরিন খালা খুব কম আসত আমাদের বাড়িতে। সে কম আসলেও আমাদের ভাই বোনদের খুব স্নেহ করতেন তিনি ।
শিরিন খালার সাথে যে লোকটি এসেছেন, তিনি আমাদের খালু। মা, শিরিন খালা ও খালুকে দেখে খুব খুশি হন। এবং তাদেরকে দুপুরেই উপস্থিত মতো ভালো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেন।
শিরিন খালা মার তিন চার বছরের ছোট ছিল। শিরিন খালা মার আপন ছোট বোন না হলেও, মা তাকে ছোট বোনের অধিক স্নেহ করতেন।
দুপুরের খাওয়ার পরে শিরিন খালা মার কাছে একটি কথা পারলেন। সে মাকে বলল — ‘বুবু আমরা একটা শুভ প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।’
— কী প্রস্তাব এনেছ।
— ‘মঞ্জুর একটি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। মেয়ে আমাদের গায়েরই। বাবা মার একটাই মেয়ে আর কেউ নেই। মেয়ে খুব রূপবতী। ক্লাস সেভেনে পড়ে। বয়স তেরো চোদ্দ হবে।
আমি খুব আশা নিয়ে এসেছি। তোমরা মেয়েটিকে একবার দেখো। পছন্দ হবে তোমাদের। খুব সুন্দরী এবং অমায়িক। তাছাড়া, মেয়ের বাবা অনেক ধন সম্পদের মালিক। এই ধন সম্পত্তি সব একদিন মেয়ের হবে।
আমি মেয়ের বাবা মায়ের সাথে আলাপ করেছি। তারা বলেছে — আপনি ছেলের মায়ের সাথে আলাপ করে দেখেন। আমাদের এই সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি নেই। ‘
মা বলছিল – ‘ তোমরা তো জানো, মঞ্জুর মাস্টার্স করে কেবল সরকারি চাকুরিতে ঢুকেছে। ও এখানে থাকে না। ঢাকায় থাকে। ওর সাথে আলাপ না করে তোমাকে কোনো কিছু বলতে পারছি না।’
— ‘ঠিক আছে, মঞ্জুর সাথে তো আলাপ করবেই। কিন্তু তার আগে তোমরা মেয়েটিকে একবার দেখে রাখো, তোমাদের পছন্দ হলেই পরে না হয় মঞ্জুরকে মেয়ে দেখালে।’
— ‘কথাটি খারাপ বলো নাই। আমরা না হয় আগেই দেখে নিলাম। আমাদের পছন্দ হলেই মঞ্জুরকে দেখাব। মঞ্জুর পছন্দ হলেই আমরা বিয়ের কথা পাকাপাকি করব।’
— তাহলে কবে যাবে মেয়ে দেখতে?
— সামনের শুক্রবারই যাব। আমরা চার পাঁচজন যাব। তুমি মেয়ের বাবা মাকে বলে রেখো।
— আচ্ছা।
ঘটনাক্রমে আমার সবচেয়ে বড়ো বোন তখন বাড়িতেই ছিল। সে তখন বেড়াতে এসেছিল। আমার এই বোন আমাদের পরিবারের ভালো মন্দের সবকিছুতে মাকে পরামর্শ দিত। মাও তার পরামর্শ গ্রহণ করত।
একটি বড়ো ছইওয়ালা নৌকায় করে আমার মা, বড়ো বোন, এক জেঠাত ভাবি, ছোট বোন ও ছোট ভাই সামনের ঐ শুক্রবারেই মেয়ে দেখতে চলে য়ায়। তারা প্রথমে শিরিন খালার বাড়িতে যায়। তারপর ওখান থেকে কণে বাড়িতে যায়।
একদম ঘরোয়া ভাবে এবং কোনো প্রকার ফর্মালিটিস না করে আমাদের বাড়ির লোকজন মেয়েটিকে দেখে। মেয়ে অপ্রস্ফুটিত চন্দ্রমল্লিকার মতো দিগবালিকা। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রঙ। গোলাপি জবার মতো গাল, অবাক করা চোখে তার মায়া মায়া মাধুর্য লুকিয়ে আছে । আশ্বিনের বৃষ্টির রাতের মতো কালো মাথার চুল। এই তেরো চোদ্দ বছরের মেয়েটির উপরে হেমন্ত সকালের কমলা রঙের রোদের আলো এসে পড়েছে যেন। সবার দৃষ্টি ওর উপর স্থির হয়ে ছিল।
আমি এই মেয়ের কিছুই জানিনা, কিছুই দেখিনি আমি। নিষ্পাপ নিষ্কলুষ ছিল কী সে ! স্বচ্ছ জলের মতো নিবিড় ও পবিত্র? হয়ত তার অপ্র্স্ফুটিত পাপড়িগুলো আমার আঙুলের ছোঁয়ায় এক এক করে মেলিতে পারিত। হয়ত তার শরীর মন আমার অলৌকিক যাদুরকাঠীর স্পর্শে উদ্বেলিত হয়ে উঠত।
আমার মা মেয়েটিকে কাছে বসিয়ে বলেছিল —
‘তোমার নাম কী মা?’ মার মুখের দিকে চেয়ে মেয়েটি স্মিত বলেছিল — রেশমা আলী। আমার বাবা আমাকে ডাকে — রেশমী বলে।
রেশমীকে সবাই আমার বউ করার জন্য পছন্দ করে। এবং এই পছন্দ হওয়ার ব্যাপারটা তাৎক্ষণিক প্রকাশও হয়ে যায়। মেয়ের বাবা মা খুব খুশি হন। মেয়ের মা একপর্যায়ে তার মেয়েকে আমার মায়ের হাতের ভিতর সমর্পণ করে দিয়ে মাকে বলে — ‘বুবু, আজ থেকে আমার মেয়ে তোমার। তুমি ওকে তোমার বউমা করে ঘরে নিয়ে যেও।’ আমার মা ও বলেছিল — রেশমীকে আমরা যত দ্রুত আমাদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যাব। ওযে সাক্ষাৎ লক্ষী মেয়ে!’
রেশমীকে সবাই বলছিল — ‘তোমার শ্বাশুড়ি মাকে কদমবুসি করো।’ বালিকা সেদিন স্বলজ্জিত
হয়ে আমাদের বাড়ির গুরুজনদের কদমবুসি
করেছিল। মা, তার হাতের আঙুল থেকে একটি অঙ্গুরীয় খুলে পরিয়ে দিয়েছিল রেশমীর অনামিকায়।
একদিন অফিসের ঠিকানায় মার একটি চিঠি পাই। মা লিখেছিল —
‘স্নেহের মঞ্জুর,
আশা করি তুমি ভালো আছো। তোমার চাকুরি ভালোভাবেই হয়ত চলছে। পর সমাচার এই যে, আমরা তোমার বিবাহের পাত্রী দেখেছি। মেয়ে খুবই সুন্দরী। ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে রাণীগ্রামে। তোমার শিরিন খালার পরিচিত। আমরা মেয়েটিকে দেখেছি। তোমার বড়ো বুবুসহ আমাদের সবার পছন্দ হয়েছে।
তুমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একবার বাড়িতে আসবে। তুমিও মেয়েটিকে দেখবে। তোমার পছন্দ হলে আমরা বিয়ের পাকাপাকি কথা বলব ওনাদের সাথে। তুমি অবশ্যই বাড়ি চলে আসবে। কোনোরূপ গাফিলতি করবে না।
ভালো থাকবে। তোমার জন্য আমার দোয়া ও আশীর্বাদ রইল।
ইতি — তোমার মা।
মার পত্রখানি পড়ে একটাই খটকা মস্তিস্কে ঘুরপাক খাচ্ছিল — ‘ মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। তার মানে মেয়ের বয়স খুব জোর তেরো চোদ্দ বছর হবে। লেখাপড়ার কথা বাদই দিলাম, শেষ পর্যন্ত কী না একটি বালিকা কে বিয়ে করব? ‘
আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি কিছুতেই এই বালিকাকে বিয়ে করব না। অফিসের ব্যস্ততার কথা বলে ও নানা অযুহাত দেখিয়ে মেয়েটিকে আমি কখনোই দেখতে যাব না। আমি না দেখতে গেলে বিয়ে তো হবে না। একসময় এমনি এমনি বিয়ের প্রস্তাবটা ভেঙে যাবে। মেয়ে পক্ষ অন্তত এইভেবে শান্তি পাবে যে, তাদের মেয়েটিকে দেখে অপছন্দ করে ছেলেটা বিয়ে করেনি। ভাববে তারা তখন অন্য কথা।
আমি আর বাড়িতে যাই না। মা পর পর আরও কয়েকটি পত্র লেখে। প্রতি চিঠিতেই বাড়িতে যাবার কথা লেখা থাকে। আমি প্রতিবার উত্তর লিখে পাঠাই — ‘মা, অফিসের কাজে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে গেছি। বাড়িতে যাওয়ার কোনোরূপ সুযোগ পাচ্ছি না। সুযোগ পাইলেই চলে আসব।’
এইভাবে ছয়-সাত মাস চলে যায়। আমি আর বাড়িতে যাই না।
আমরা অফিসিয়াল ট্যুরে কয়েকজন কর্মকর্তা একবার নেত্রকোনার বারহাট্টা গিয়েছিলাম। কয়েকদিন ছিলাম ওখানে। আমাদের সাথে দুটো মেয়েও গিয়েছিল। সেদিন ছিল ছুটির দিন। আমরা একটি নৌকা করে কংশ নদীতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। কী মায়াময় অপরাহ্ণ। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছিল। বিমুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম কংশের দুকূলে ঘরবাড়ি, বৃক্ষ, শস্যের ক্ষেত। বিকালের সোনা রোদ্দুর বৃক্ষের পাতায় পড়ে ঝিকমিক করছিল। ঝলমল করছিল কংসের শান্ত জলও। কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলাম —
‘একবার এসেই দেখুন কংশ নদের সাথে সমুদ্রের বেশ মিল আছে।
হাসবেন না, দোহাই, আমাদের গাঁয়ের লোকেরা খুব কষ্ট পাবে।….
আরে, এ তো শুধু নদী নয়, এ যে সমুদ্রের ছদ্মবেশী রূপ।…..
কোনো দিন কাউকে বলিনি, শুধু সুদূর শৈশব থেকে মনে-মনে…..
মিলিয়েছি বারহাট্টার সাথে কক্সবাজার, কংশের সাথে বঙ্গোপসাগর।’
নৌকার পাটাতনের উপর চাদর বিছিয়ে আমরা বসেছিলাম, খালি কন্ঠে গান গেয়ে শোনায়েছিল সহকর্মী নাসরিন। — এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।
ফেরার পথে গৌরীপুর জংশনে অপেক্ষা করছিলাম ঢাকাগামী ট্রেনের জন্য। ট্রেন আসতে তখনও অনেক দেরি ছিল। নাসরিন কী যেন বলতে চাইছিল আমাকে। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিল না। তারপর এক পর্যায়ে বলছিল — ‘আমার খুব প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে ঐ দূরে ব্রিজটার কাছে। দুপাশে কী সুন্দর মহুয়া গাছ। বাবলাও আছে। ফুলও ফুটে আছে। তুমি যাবে আমার সাথে ঐ ব্রিজটার কাছে ?’
আমি বলেছিলাম — না, যাব না। সহকর্মীরা মন্দ বলবে।’
সেই গৌরীপুর জংশন, সেই মনুষ্য কোলাহলের প্লাটফর্ম, সেই মহুয়া গাছের সারি, সেই বাবলা ফুলের সুবাস নিতে আর যাওয়া হয়নি। কোনোদিন আর হেঁটে হেঁটে যেয়ে দেখা হয়নি দূরের সেই নির্জন ব্রীজটা।
একদিন আমার ঢাকার বাসায় শিরিন খালার ছেলে এসে হাজির হয়। সে আমার হাতে মার একটি চিঠি তুলে দিয়ে বলে — খালা তোমাকে আমার সাথে জরুরি ভাবে বাড়িতে যেতে বলেছে। আমি চিঠিখানা পড়ে একটি উত্তর লিখি —
শ্রদ্ধেয়া মা,
আমার কদমবুসি নিও। পর সমাচার এই যে —আমি তোমাদের পছন্দ করা এই বালিকাকে বিবাহ করতে পারব না। এত অল্প বয়সের একটি মেয়েকে বিবাহ করা আমার পক্ষে কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।
আমি এখানে একটি মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছি। তোমরা এসে এই মেয়েটিকে দেখে যেও । পছন্দ হলে এই মেয়ের সাথেই আমার বিবাহের ব্যবস্থা করবে।
ইতি — মঞ্জুর।
নাহ্ কাউকেই পাওয়া হয়নি এই জীবনে। না রেশমীকে, না নাসরিনকে। যাকে এই জীবনে জীবন সঙ্গিনী করে পেলাম সে অন্য আর একজন মায়াবতী। যাকে চাইনি, যে আমাকেও চায়নি কোনোদিন — সেই হলো আমার ভূবনের ভূবন বাসিনী।
কারোর জন্যই কোনো আফসোস নেই। কোনো আক্ষেপও কখনো ঠাঁই দেইনি অন্তরে। কে কোথায় ভালো আছে, কে কোথায় দুঃখে আছে — তারও কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। কতজন তো কতভাবে কতজনকে চায়, সব চাওয়া কী পাওয়া হয়? হয় না। কী যে লীলা ঈশ্বরের !
বাইশ বছর চলে গেছে। ২০১২ সালে মার মৃত্যুর পর বাড়িতে চল্লিশার একটি অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠান শেষে যখন ঢাকায় চলে আসব, কী মনে করে মার কাঠের সিন্দুকটা আমরা ভাই বোনরা খুলি। সিন্ধুকে মার অনেক কিছু ছিল। তার ব্যবহৃত কাপড়চোপড়, কিছু টাকা ও গহনা। একটি ছোট্ট কাপড়ের টোপলা ছিল আলাদা করে। টোপলার ভিতরে একটি বহু পুরনো জীর্ণ চিঠি দেখতে পাই। হলুদ রঙ হয়ে গেছে কাগজের। ধরলেই ছিঁড়ে যাচ্ছিল। চিঠিটার সাথে একটি সোনার অঙ্গুরী ছিল।
চিঠিটা রেশমীর মায়ের হাতে লেখা —
প্রিয় বুবু,
সালাম নিও। কত আশা বুকে বেঁধেছিলাম। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম — আমার মেয়েটি তোমাদের ঘরে যাবে। জানো বুবু, এত ছোট্ট একটা মেয়ে ! তারপরও তোমাদের জন্য ও খুব কান্না করে। কী যে এক অসীম ক্ষত ওর ছোট্ট প্রাণে দিয়ে দিলাম।
তোমার দেওয়া অঙ্গুরীটা ফেরত দিলাম। এই বেদনার ভারটি আমার মেয়েকে দিয়ে আর বইতে দিতে চাচ্ছি না। তোমার দেওয়া এই অভিজ্ঞান তোমার কাছেই থাক্।
ইতি — রেশমীর মা।
২৩ – ১– ১৯৮৯ ইং
রাণীগ্রাম, সিরাজগঞ্জ
২৪. মানভঙ্গ
বেশ কিছুদিন ধরে মেহনাজের সাথে আমার ঘন ঘন ঝগড়াঝাটি ও খুনসুটি হচ্ছে। নানান কারণে নানারূপ ঝগড়া । মাঝে মাঝে ঝগড়া তুমুল আকার ধারণ করে। প্রায়ই মেহনাজ আমাকে বলে — ‘তুমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। তোমার মতো স্বামীর আমার দরকার নাই।’
একদিন খুব তুমুল ঝগড়া হয় মেহনাজের সাথে আমার। সেদিনও মেহনাজ রাগে গর্জনে আমাকে বাড়ি হতে বের হয়ে যেতে বলে। আরও বলে — ‘তোমার মুখ আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। আই হেট্ ইউ।’
সেদিন সত্যি সত্যি বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। পকেটে তেমন কোনো টাকা ছিল না । বিভিন্ন সোর্স থেকে যে টাকা আয় হয়, তা মেহনাজই খরচ করে। আমার কোনো অধিকার নেই তাতে। আসলে আমার কাছে কোনো অধিকার রাখিনি। আমি চাইতাম — এই টানাটানির সংসারে মেহনাজই সব সামলাক। এ আমার কান্ডজ্ঞানহীন দায়িত্বহীনতাও বলা যেতে পারে।
বাজার করে এনে দেওয়ার পর কিছু খুচরো টাকা বাচতো, সেগুলো রেখে দিতাম বিছানার নিচে। গুণে দেখি — সেখানে ৪৫৩ টাকা আছে । তখন সকাল এগারোটা বাজে। এই কটা টাকা নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। মোবাইল ফোনটা সাথে নেই না। রেখে যাই বাড়িতে।
আমার একটি প্রিয় জায়গা বিমানবন্দর রেল স্টেশন। হাঁটতে হাঁটতে সেখানেই চলে যাই। প্লাটফর্মেের উত্তর মাথায় নিরিবিলি একটি পাকা কংক্রিটের বেঞ্চের উপর যেয়ে বসে থাকি।
আমার কাছে পান বিড়িওয়ালা একটা ছেরা আসে। ওকে বললাম, সিগারেট দে।
— কোন্ সিগারেট দিব স্যার?
আজ থেকে তিন বছর আগে চিরজনমের জন্য সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছাড়ার আগে তখন খেতাম বেনসন। আজ আবার শুরু করছি নতুন করে। বিড়িওয়ালা ছেরাকে বললাম — বেনসন এ্যান্ড হেজেস দে। ঐ ছেরা আমাকে তাই দিল।
কংক্রিটের বেঞ্চের উপর বসে পরপর দুই শলা সিগারেট মনের সুখে খেলাম।
প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে আরও একটু উত্তর দিকে যাই। ওখানে দেখি — একলোক পথের উপর কাপড় পেতে অনেকগুলো ইনভিলপ সারি করে বিছিয়ে রেখেছে। তার হাতের উপর একটি পোষা টিয়া পাখি বসে আছে। কাগজের সাইনবোর্ডে লেখা– “এখানে ভাগ্যলেখা দেখা হয়।” আমি লোকটিকে বললাম — ‘ভাগ্য লেখা দেখতে কত টাকা লাগবে?’
— দশ টাকা স্যার।
আমি লোকটিকে দশ টাকা দিয়ে বললাম — ভাগ্য লেখা দেখান।
লোকটি টিয়া পাখিকে বলল — ‘এই সাহেবের ভাগ্যে কী লেখা আছে? উঠাও।’
টিয়া পাখি ঘুরে ঘুরে একটি ইনভিলপ ঠোঁট দিয়ে উঠিয়ে লোকটির হাতে দিল। সে দিল আমার হাতে। আমি ইনভিলপটি হাতে নিয়ে ভিতর থেকে কাগজটি বের করে পড়লাম। কাগজটিতে লেখা আছে — ‘স্বামী–স্ত্রী / প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে আজ মহব্বত বাড়বে।’
হেঁটে হেঁটে আবার কংক্রিটের বেঞ্চের উপর এসে বসি। প্লাটফর্মের ওপাশে ডোবার মতো পুকুর। পুকুর পাড়ে দুটো শালিক আজাইরা ঠোকরাঠুকরি করছে। প্রেমে গদগদ হলে এমন নাকি লাফালাফি করে। খুব বিরক্ত লাগছিল, এর নাম নাকি ‘টু ফর জয়।’ মনে মনে বললাম — ‘ঘোড়ার ডিম। এই বুঝি আমার আনন্দ !’
কমলাপুরের দিক থেকে একটি লোকাল ট্টেন প্লাটফর্মে এসে থামে। যাবে ময়মনসিংহ। আমি ঐ ট্রেনটিতে উঠে পড়ি। তৃতীয় ক্লাসে টিকিট বিহীন যাত্রী আমি। ট্রেনটা ষখন জয়দেবপুর ছেড়েছে, তখন এক ছোকরা বয়সের চেকার এসে বলে — ‘টি-কে-ট।’
বললাম — নেই।
— কোথায় যাবেন?
— যেতে চেয়েছিলাম মশাখালি, গফরগাঁও। তা আর যাব না। সামনে রাজেন্দ্রপুর নেমে যাব।
— জরিমানা সহ একশত টাকা দিন।
আমি ছোকরাকে একশত টাকা গুণে দিয়ে পাকা রশিদ নিয়ে নিলাম।
রাজেন্দ্রপুর স্টেশনে নেমে পড়ি। পেটে তখন সাঙ্গাতিক খিদা। একটা টিনের চালার হোটেলে ঢুকে পড়ি। মালিককে বললাম — তরকারি কী?
মালিক বলল — ফার্মের মুরগী, পাকিস্তানি কক, দেশি মোরগ, আর কালিয়াকৈরের বিলের বাইলা মাছ।
আমি বললাম — দেশী মোরগ আর বাইলা মাছ দিবেন।
মালিক তার মেছিয়ারকে বলল — ঐ বেটা, প্লেট ভালো করে ধুইয়ে এই স্যারের জন্য বাইলা মাছ আর দেশি মুরগী লাগা।
হোটেলে খেয়ে বাইরে এসে একটি টং দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে আবারও বেনসন সিগারেট খেলাম পরপর দুই শলা। দ্বিতীয় শলা যখন টানছিলাম তখন হঠাৎ মনে পড়ল —
আজ থেকে সাতাশ বছর আগে মেহনাজকে নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে এই শালবনে বেড়াতে এসেছিলাম। তখন সবেমাত্র বিয়ে করেছি। বউকে নিয়ে শালবন দেখার খুব সাধ হয়েছিল। একদিন ছুটির দিনে লোকাল ট্রেনে করে টংগী স্টেশন থেকে এই রাজেন্দ্রপুর চলে আসি। এখানে স্টেশনে নেমে একটি চা’র দোকানে বসে দু’জন চা খাই। সাথে দুটো করে ডালপুরি ও গরম সিঙারাও খেয়েছিলাম।
স্টেশনটা আস্তে আস্তে এক সময় ফাঁকা হয়ে যায়। আমরা বসেই থাকি। দেখি — একটা লোক একটা বানর নিয়ে এগিয়ে আসছে। সে বানরের নাচের খেলা দেখায়। লোকটাকে দশ টাকা দিয়ে বানরের নাচ দেখি। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা শালবনের দিকে চলে যাই।
মেহনাজের পরনে ছিল হলুদ রঙের জর্জেট শাড়ি। পায়ে ছিল লাল রঙ্গের বাটার জুতা আর চুল ছিল সবুজ ভেলভেটের ফিতা দিয়ে খোপা বা্ঁধা। দেখতে একদম রূপবানের মতো রূপবতি লাগছিল। আমরা শালবনের অনেক ভিতরে চলে যাই। কা্ঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। ভাবছিলাম, ওর একটা হাত ধরি। কিন্তু লজ্জা লাগছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে। আরো কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি, একটি জলার মতো পুকুর। পুকুরের চারপাশে শালবনে ঘেরা। পাড়ে দূর্বা ঘাসের উপর দু’জন বসে পড়ি।
একটু পর দেখি, একটি বালিকা বকুল ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে আসছে। মেহনাজকে বলে — ‘আফা, একটা মালা নিবেন।’ আমি বালিকার কাছ থেকে চারটি মালা কিনে ওর খোঁপায় পরিয়ে দিয়েছিলাম।
তারও কিছু সময় পর একটি বৃদ্ধ লোক ময়ুরের পেখম এনে ওকে বলে — মা, ময়ুরের ফইরা নিবেন।’ আমি বৃদ্ধের কাছ থেকে সবগুলো পেখম কিনে নতুন বউকে দিয়ে বলেছিলাম, বাড়িতে যেয়ে আমার জন্য একটা ময়ুরপঙ্খী পাখা বানাইয়া দিও।
বালিকা ও লোকটি চলে যায়। পুকুরের পাড় তখন নির্জন। বক, ডা্হুক, হা্ঁস,পানকৌড়িরা তখন কিচিরমিচির করছিল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, জনমানব শূণ্য। আমি ওর মুখের দিকে একবার তাকাই। নির্জন দুপুরের রোদ্দুর ওর মুখে এসে পড়েছিল। খুব মোহনীয় লাগছিল ওকে। ভাবলাম- একটু কাছে টানি। আদর দেই ঐ মুখে। ওর মুখের দিকে ঝুঁকতেই কোত্থেকে একটি তীর এসে ওর শরীরে বিদ্ধ হয়। রক্তাক্ত হয় ওর শরীর, রক্তে ভিজে যায় ওর শাড়ি।
আর আহত হয় পানকৌড়ি। পানকৌড়ির রক্তাক্ত পালক পড়ে থাকে পুকুরের পাড়ে।
মনটা ভালো লাগছিল না। ভাবছিলাম কী করব, কোথায় যাব? একবার মনে হলো — হেঁটে হেঁটে পুকুর পাড়ে চলে যাই, যেয়ে বসি পাড়ের ঘাসের উপর। যেখানে আজ থেকে সাতাশ বছর আগে আমরা দুজন বসেছিলাম। সেই ঘাস হয়ত নেই, নেই আমাদের স্পর্শ কোথাও । তবু যেতে ইচ্ছে করছে। কেউ না থাকুক, শালবনের নিবিড় ছায়া তো সেখানে আছে। সেই ছায়ায় মিশে আছে কারোর ছায়াহীন মায়া।
কিন্তু একা একা যেতে আর ইচ্ছা করল না। বসে থাকি বেঞ্চের উপরই। বসে বসে আরও এক কাপ চা ও দুটো সিগারেট খাই। হঠাৎ অদূরে তাকিয়ে দেখি — স্টেশনের সবুজ সিগনাল বাতিটা জ্বলে উঠেছে। ঢাকামুখি একটি ট্রেন এসে স্টেশনে থামে। আমি টিকেট কেটে ট্রেনটাতে উঠে পড়ি, এবং ঢাকায় চলে আসি।
বিমানবন্দর স্টেশনে যখন নামি তখন বিকাল হয়ে যায়। প্লাটফর্মের উপর নেমে পায়চারি করতে থাকি। ভাবছিলাম এখন কোথায় যাব? আমার তো ঘর নেই। আমার কেউ নেই। যে একজন আছে, সে আমাকে ঘৃণা করে। আমাকে দেখতে পারে না।
স্টেশনের নির্জন পুকুর পাড়ের কাছে যেয়ে একটু দাঁড়াই। ছোট ছোট কচুরীপানার ফাঁকে মৃদুমন্দ ঢেউ ভাঙছিল। বিকালের বিষণ্ণ রোদ জলের উপর পড়ে ঝলমল করছিল।
সামনের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখি, সমান্তরাল রেল পথ। জীবনের অনেক কিছুই জলের ঐ রৌদ্রদীপ্ত ঢেউয়ের মতো ঝিলমিল করে, আবার ঐ পথের মতো সমান্তরাল। একটি অপরিচিত ট্রেনে উঠে দূরে কোনো অচিনপুরে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
স্টেশনের বাইরে এসে একটি অটো রিকশা নিয়ে চলে যাই শিয়ালডাঙ্গা। দুধারে কাশবনের ফাঁকে নির্জন পথের উপর নেমে রিকশা ছেড়ে দেই। জলাশয়ের কাছে বাবলা গাছটার তলে যেয়ে বসি। মন খারাপ হলে কত বিকাল, কত সন্ধ্যায় আমি আর মেহনাজ এসে বসে থাকতাম এই বাবলা গাছের নীচে । পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তমিত হতে দেখেছি কত দুজন, কত লাল আভার আবেশে ভরে উঠেছে আমাদের মন।
মেহনাজ আমার বুকের ছায়ায় মাথা লুকিয়ে বলত, ‘এই জীবনে তোমাকে আমি পেয়েছি, তাই কোনো দৌলত খুঁজি না কোথাও। আমি অন্য কিছু চাই না আর।’
দুই হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে একটা অনুযোগই শুধু করছিলাম — ‘ সেই তুমি কত বদলে গেছ !’
হাঠাৎ পিঠের উপর কার যেন কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করি। মুখ তুলে দেখি — মেহনাজ। ও বলছিল — ‘ আমি জানতাম, তোমার মন খারাপের দিনে তুমি এখানেই থাকবে। তাই এখানেই চলে এলাম তোমাকে খুঁজতে।’
সায়াহ্নের সেই সন্ধ্যায়, অস্ত-সূর্যের উদ্ভাসিত আলোয় চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম তার আনত মায়াবী মুখখানি।
২৫. টেন্ডু পাতার বিড়ি
আমার প্রথম ধূমপানখড়ি হয় পাতায় বানানো বিড়ি দিয়ে। স্কুলে টিফিনের সময় চার আনার বাতাম কিনে চারজন খেতাম। আমি সাইফুল, আমিনুল ও ফটিক। বাদাম খাওয়ার পর স্কুলের পাশে ভাঙা রথ ঘরের ভিতর আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে চারজন চারটা টেন্ডু পাতার বিড়ি ধরিয়ে টানতাম।
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। কালের বিবর্তনে ধূমপানের ব্রান্ডটিও আমার পরিবর্তন হয়েছে। তিস্তা, মিতালি, কিং স্ট্রং থেকে স্টার, ক্যাপস্টেন। গোল্ডলিফও খেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যেদিন বাবার পাঠানো মানি অর্ডার পেতাম, সেদিন মনের আনন্দে লন্ডন ব্রান্ড 555 কিনে খেতাম দুই এক শলা।
সহপাঠি বন্ধু ইকবাল হোসেন বাদল মাঝে মাঝে হলে আমার রুমে এসে থাকত, তখন ঐ কদিন রেগুলার লন্ডন 555 খেতাম। বাদল ছিল ঢাকার স্থানীয় বড়ো লোকের পোলা। গোড়ানের চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে। ও খেত 555 , বাদল যে কয়দিন থাকত, সে কয়দিন আমার আর সিগারেট কিনতে হতো না। ঐ-ই কিনত। আমি খেতাম মাংনা।
আমেরিকাতে ছিলাম মাস তিনেক। ওখানে খেতাম মার্লবরো হার্ড। লাস ভেগাস থেকে এসেছিল কোভা নামে একটি মেয়ে। কোভা আমার খুব ভালো বন্ধু হয়েছিল, ও খেত মার্লবরো লাইট। ওর কারণে ব্রান্ড বদল করে মার্লবরো লাইট ধরেছিলাম। হলিউডে সিনে মেকআপ আর্টিস্ট্রির উপর একটি ওয়ার্কশোপে আমরা যোগ দিয়েছিলাম। ওয়ার্কশপ শেষে উইলটার্ন বিল্ডিংয়ের সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসে স্মোকিং জোনে আমি আর কোভা সিগারেট ধরিয়ে টানতাম।
একদিন বিকালে কোভা বলছিল — হাবিব, চলো সান্তা মনিকা বীচে যাই। বললাম — কেন?
আজ আমার মন ভালো লাগছেনা।
আচ্ছা, চলো যাই।
বীচে দুজন বালু আর ছোটো ছোটো ঝিনুকের উপর পা মাড়িয়ে হাঁটছিলাম। কোভা খুব বেশি কথা বলছিল না। প্যাসিফিকের জল ছিল সেদিন শান্ত। ওর চোখের দিকে তাকাই। দেখলাম, চোখ দুটো সমুদ্রের নীল জলের মতো স্থির ও শান্ত হয়ে আছে। আমি ওকে বলি — ‘কী হয়েছে তোমার? মন খারাপ করে আছ কেন?’
ও ওর ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করে একটি সিগারেট ধরায়। আমাকেও বলে — ‘খাবে নাকি একটা?’
দেখলাম — আজকের সিগারেট মার্লবরো লাইট নয়। অন্য আর একটি ব্রান্ডের সিগারেট। আমি একটি স্টিক নিয়ে ধরালাম এবং টানতে থাকি। সিগারেটটি টান দেওয়ার পর আমার শরীর আস্তে আস্তে কেমন যেন হিম শীতল হয়ে আসছিল। আমার সকল ইন্দ্রিয়ে অদ্ভুত এক সুখানুভূতি অনুভূত হচ্ছিল।
মানুষ কত ভাবে দুঃখ সরিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সুখ খোঁজে কত কিছুর ভিতর। সেদিন সেই অস্ত-সন্ধ্যা বেলায় কোভা কী ওর সব দুঃখ সরিয়ে দিতে পেরেছিল সিগারেটে ! সে কথা আর ওর কাছে থেকে জানা হয়নি। শুধু মনে হয়েছিল — ‘ আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন– আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন।’
তো, যে কথা বলছিলাম — বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার প্রায় পনেরো বছর পরের কথা। কয়দিন ধরেই সেই স্কুলবেলার টেন্ডু পাতার বিড়ি খাওয়ার কথা খুব মনে পড়ছিল। খেতেও ইচ্ছে করছিল ভীষণ। ঢাকায় এই বিড়িটি কোথাও পাওয়া যায় না। কী করা যায় ! একদিন আমার সেই বাল্য সহপাঠি বন্ধু সাইফুলকে পত্র লিখলাম–‘সাইফুল, আমার খুব টেন্ডু পাতার বিড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। এখানে পাচ্ছি না। তুই টেন্ডু পাতার বিড়ি যোগার করে রাখবি। আমি খুব শীঘ্রই আসছি। একসাথে দুজনে বিড়ি টানব। ‘
কয়েক দিন পর আমি বাড়িতে যাই। সাইফুলের সাথে আমার দেখা হয় না সে অনেক বছর। আমি একদিন দ্বিপ্রহরের আগেই দুই মাইল দূরে আমিনপুর গ্রামে সাইফুলদের বাড়িতে সাইকেল চালিয়ে চলে যাই। সাইফুল আমাকে দেখে তো বেজায় খুশি। সেই কত বছর পরে দেখা। ও ম্যাট্রিক পাস করার পর অভাব অনটনের কারণে আর পড়ে নাই। জমি জমা যা আছে, তাই দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে।
ওর থাকার ঘরে বিছানার উপর আমাকে বসতে দেয়। একটু পর ওর স্ত্রীকে অনেকটা জোর করে টেনে আমার সামনে নিয়ে আসে। ওর স্ত্রীকে বলে– ‘এতদিন তো হাজারো বার আমার এই বন্ধুটির কথা তোমাকে বলেছি । আজ ওকে দেখো চক্ষু মেলিয়া।’
সাইফুল এগারো বারো বছরের একটি বালিকাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। বলে — ‘এই হচ্ছে আমার মেয়ে মরিয়ম। ক্লাস সিক্সে পড়ে। খুব ভালো ছাত্রী।
রোল নং ২, সাইফুল ওর মেয়েকে বলে — ইনি আমার বাল্য বন্ধু। তোমার চাচা হয়। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করো।’
মরিয়ম আদুরী আদুরী লক্ষ্মী একটা মেয়ে। দেখতেও খুব মায়াবী এবং রূপন্বিতা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি– তুমি বেঁচে থাকো মা, ভালো ভাবে লেখা পড়া করবে। ‘ সাইফুলের স্ত্রী ও মেয়ে অন্য ঘরে চলে গেলে আমি সাইফুলকে বললাম — ‘বিড়ি কই, বিড়ি দে।’ সাইফুল এক বান্ডিল টেন্ডু পাতার বিড়ি কই থেকে যেন যোগার করে এনেছিল। আমাকে বিড়ির বান্ডিল দিয়ে বলে — ‘নে, বসে বসে খা।’ এখানে এই বিড়ি পাওয়া যায় না। হিলি বর্ডার থেকে আনিয়েছি। যে কয়টা পারিস খা। বাকীগুলো নিয়ে যাবি।’
সেই কতকাল পরে দুই বন্ধু বসে বসে মনের সুখে বিড়ি টানতে থাকি। কী যে ভালো লাগছিল, কী যে ঘ্রাণ ছিল বিড়ির। সেই কত বছর আগের রথ ঘরে বসে বিড়ি খাওয়ার কথা মনে পড়ছিল। সেই অনাবিল ঘ্রাণ, সেই স্বর্গীয় আনন্দ।
দুপুরে সাইফুল না খেয়ে আসতে দেয়নি। ওর বউ ধনিদহ বিলের বোয়াল মাছ, আর ওদের নিজেদের পালন করা হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছিল। দারুণ সুস্বাদু ছিল ওর বউয়ের রান্না।
ভাত খেয়ে বিছানার উপর বসে আবারও দুজন বিড়ি ধরাই। দুইজনই বিড়ি টানতে থাকি। সাইফুল বিষাদ জড়িত কণ্ঠে বলছিল — ‘তোকে একটা কথা বলা হয় নাই। ‘
আমি বললাম — কী কথা, বল্ ?
— মরিয়মের খুব অসুখ।
— কী অসুখ!
— আজ দশ পনেরো দিন ধরে ভিতরে ভিতরে খুব জ্বর। রাতে বেশি হয়। ভালো হচ্ছে না।
— শহরে নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবি।
— আচ্ছা।
আমি ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, কোনো করুণা কিংবা দয়া না। তোর মেয়ে আমারও মেয়ে। টাকাগুলো রাখ্। মরিয়মের চিকিৎসা করাবি। ‘ আমি ওকে আরও বললাম — আল্লাহ খারাপ কিছু না করুক–যদি মনে করিস ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। তাহলে চলে আসিস আমার বাসায়।
আমি যখন চলে আসি, মরিয়ম কাছে এসে
বলেছিল —
চাচু, তুমি আবার এস।
আমি ঢাকায় চলে আসি। এরপর আরও কয়েকমাস চলে যায়। বিভিন্ন কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে যাই। সাইফুলের মেয়েটার আর খোঁজ নেওয়া হয় নাই। অনেকটা ‘পৃথিবীতে কে কাহার?’- এর মতো উপেক্ষা , এবং ভুলে থাকা ।
তারও অনেক পরে — একদিন জানতে পারি যে, সাইফুলের মেয়েটার নাকি লিউকেমিয়া হয়েছিল এবং সে মারা গেছে।
হঠাৎই কোনো ক্ষণে ঐ মেয়েটির কথা মনে হয়। একটা অপরাধ বোধ মনকে আজও বিষণ্ণ করে — আমার বিত্ত ছিল, প্রবল ইচ্ছে শুধু ছিল না। মেয়েটিকে ঢাকায় এনে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম। কিন্তু করিনি। তুচ্ছ কোনো বস্তর মতো অবহেলায় ফেলে রেখে দিয়েছিলাম।
২৬. অতিপ্রাকৃত গল্প
একটা ভয়ংকর ঘটনার কথা লিখছি। ১৯৮৫ সালের কথা। তখন বিয়ে সাদি কিছু করিনি। এক বাড়িতে একা থাকি। আশেপাশে তেমন বাড়ি ঘর নেই। বাড়ির পাশেই জঙ্গল। বাঁশ ঝাড়ও আছে ঘরের চাল ঘেষে।
সে বছর একুশের বইমেলা থেকে কোন্ কুক্ষণে কিছু অতিপ্রাকৃত ভূত পেত্নীর বই কিনেছিলাম। তার মধ্যে ছিল বিভূতিভূষণের তারানাথ তান্ত্রিক। তো কয়দিন সেই বইগুলো পড়লাম। পড়ার সময়ই আমার ভিতর কেমন যেন একটি পরিবর্তন অনুভব করলাম। কেমন অস্বাভাবিক সন্ন্যাস সন্ন্যাস ফকির ফকরান্তি ও পাগল পাগল ভাব। ভাবছিলাম এর কারণ কী? আমার কাছে মনে হলো যত গন্ডগোলের মূল — বিভূতিভূষণের এই তারানাথ তান্ত্রিক। ওকে যে করে হোক ঘর থেকে সরাতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম — ওকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে একদিন তুরাগ নদীতে ফেলে দিয়ে আসব।
কিন্তু তারানাথ তান্ত্রিককে বিসর্জনে পাঠানোর
আগেই ঘটে গেল এক ভয়ংকর ঘটনা।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মেঘ গুরুগম্ভীর বৃষ্টি হচ্ছিল । ঘরে আমার চাল চুলো জ্বলে না। আজিজ মিয়ার হোটেল থেকে বাজিতপুরের বিলের ঠ্যাংওয়ালা চিংড়ি মাছের ভুনা তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে আসি। সাথে আষাঢ়ের ডিমওয়ালা টেংরা মাছের তরকারিও ছিল।
কী করব? কোনো কাজ কাম নাই। টেবিল থেকে তারানাথ বের করে পড়তে থাকি। উইলিয়াম ওয়ার্ডওয়ার্থের লেখা দুষ্ট কবিতার মতো বৃষ্টির রাত ছিল। কী চমৎকার ঝরো হাওয়ার সাথে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে । শীতল হতে লাগল শরীর মন।
তারানাথ তান্ত্রিক পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই। হঠাৎ একটি শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। শব্দটা বারান্দার দিক থেকে আসছিল। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত পৌণে তিনটা। তারানাথে পড়েছিলাম — ভুত পেত্নী দেখে ভয় পেতে নেই। ভয় করলে ওরা নাকি মাথায় ওঠে এবং ঘার মটকিয়ে চিবিয়ে খায়।
শব্দটা আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল। আমি মনে সাহস আনলাম। দরজার কাছে এগিয়ে যাই। আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে বুকে ফু দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে দরজাটা খুলি। দরজা খুলে আমি তো বিস্ময়েে হতবাক! বাইরে মধ্য আকাশে পূর্ণিমাভূক বিশাল চাঁদ। চন্দ্রদাসী হয়ে সে আলো ছড়াচ্ছে আঙিনায়। যে মেঘ আর বৃষ্টি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে মেঘও নেই, সে বৃষ্টিও নেই। তার পরিবর্তে এই অবিস্মরণীয় চাঁদের আলোয় ভাসছে ভূবনলোক । সেই চন্দ্রালোকে একটি উপজাতীয় মেয়েকে দেখতে পাই। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটি বলছিল — আমি টিনটিন। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় থেকে এসেছি ।
ও আরও বলছিল — আমাকে তোমার মনে আছে? আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম। এবং তুমিও। তোমার কারণে আমি খুন হয়েছিলাম গাঙুর হাতে। এই দেখো আমার শরীর জুড়ে খুনের রক্ত।
— না, আমি তোমাকে চিনিনা। তুমি কে? চলে যাও তুমি।
অনেকটা অবজ্ঞা ও ধমক দিয়ে আমি এক নিমিষে ঘরের ভিতর চলে এসে দরজা বন্ধ করে দেই। ভিতর থেকে আবারও শব্দ শুনতে পাই। আবারও দেখি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। গুরুগম্ভীর করে মেঘ ডাকছে। কোথাও কোনো চাঁদের আলো নেই। একটু পর শুনতে গাই — টিনটিন গুমরে গুমরে কাঁদছে।
তখনও ঘরের চালে এক কোণে বাঁশের ঘষঘষ শব্দ হচ্ছিল। ভাবলাম, ‘টিনটিন কাঁদলে কাঁদুক। আমার কী? ও আমার কে?’ আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি এবং ঘুমিয়ে যাই।
সকালে ঘুম ভেঙে দরজা খুলে দেখি — উঠোনে বৃষ্টির জলের সাথে ছোপ ছোপ রক্ত ভাসছে। এবং বারান্দায় দেখি — টিনটিনের ফেলে যাওয়া ওর রক্তমাখা ওড়না পড়ে আছে ।
আমি ঐদিনই দেরি না করে তারানাথ তান্ত্রিক বইটি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে তুরাগ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আসি।
২৭. অপরাজিতা
আমি তখন মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নিয়মিত ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। পরীক্ষার পরই ইউনিভার্সিটি জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। হল থেকে খুব বেশি বের হতাম না। বোরিং লাগলে মাঝে মাঝে বিকাল বেলা হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম হাকিমের চায়ের দোকানে। ওখানে চা খেয়ে বন্ধু বান্ধবদের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার পরপরই হলে চলে আসতাম।
পরীক্ষার পর চাকুরি হোক বা না হোক, মা আমার বিবাহ ঠিক করে রেখেছে। আমিও সেই মেয়েকে দেখেছি, কথা বলেছি। ওর নাম নীলিমা। রূপশ্রী কলাবতী মেয়ে। ওড়না উড়ে তার করতোয়ার বক্ষ ছুঁয়ে আসা উতল বাতাসে। হেমন্ত জোছনায় চোখ আলো করে রাখে। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বাজে জল তরঙ্গের মতো। কী এক রহস্যময় জগৎ উন্মোচিত হবে, সেই ভাবনায় সেই অপেক্ষায় কখনও কখনও পরীক্ষার পড়া ভুল ভাবে মস্তিষ্কে ধরা দিত। মনে রাখতে পারতাম না। ‘মোর ভাবনারে একি হাওয়া লাগল দোলে মন দোলে অকারণ হরষে’।
সেদিন দুপুরে রুমে টেবিলে বসে পড়ছিলাম সোফোক্লিসের ইডিপাস। জটিল কমপ্লেক্সে মনটা যখন উথালপাতাল হচ্ছিল, ঠিক তখন ডাকপিওন একটি পত্র দরজার নীচে দিয়ে ফেলে রেখে যায়। মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। ভেবেছিলাম নীলিমার চিঠি। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ও তাই মাঝে মাঝে আমার কুশল জানতে চেয়ে চিঠি লেখে। ভেবেছিলাম নীলিমার চিঠি হবে।
কিন্তু না। এটি নীলিমার চিঠি ছিল না। অন্য আর একজনের চিঠি। চিঠির নীচে একটি মেয়ের নাম লেখা আছে — অপরাজিতা।
আমি অপরাজিতা নামে কোনো মেয়েকে চিনি না। কে এই অপরাজিতা? চিঠিতে লিখেছে —
প্রিয়জনেষু আনিস,
একটু অবাকই হচ্ছো অপরাজিতা মেয়েটি আবার কে? আমাকে তুমি দেখেছ অনেক। যদি কখনও আবার দেখ, ঠিকই চিনতে পারবে আমাকে। আমি কে, এই কথা বলব না তোমাকে। তুমি আমাকে জানলে আমার প্রতি তোমার আর আগ্রহ থাকবে না।
তোমাকে আমার কবে ভালো লেগেছিল জানো?
একদিন তুমি গাঢ় নীল রঙের জিন্স প্যান্টের সাথে হালকা নীল রঙের টি-সার্ট পরেছিলে। পায়ে ছিল সাদা কেডস্। তোমার মোছ সদ্য গজিয়ে ওঠা দূর্বা ঘাসের মতো সতেজ, চুল এলভিস প্রিসলীর মতো পিছনে ব্রাশ করে আঁচড়ান। স্নানের পর ললাটে নেমে আসে কেশদাম ৷ চোখ স্বপ্নচ্ছটা। কখনও মেঘলা আকাশের তারার মতো মণিদীপ। তুমি মাধুকর। ছেলে মানুষও দেখতে এত টান টান হয়। আমি বিস্ময়ে চেয়ে দেখেছিলাম । তোমাকে ভালো লাগা ওখান থেকেই। হৃদয়ে ভাঙন তখন থেকেই শুরু । কিন্তু প্রপোজ করিনি কখনও। কেন করিনি সে অনেক কারণ, অনেক ভাঙচুরের কথা।
তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি।
তোমার মতো আর কোনও ছেলে আমি দেখিনি। রূপে গুণে, গানে আর প্রাণের প্লাবনে তুমি যে অনন্য। তুমি স্বপ্নে দেখা রাজকুমার।
তোমার জন্য আমার মনের মধ্যে তৈরি হয় এক গভীর মায়াবোধ, কীসের যেন একটা অভাবও অনুভব করি। তোমাকে আমার করে কী পাওয়া হবে এই জীবনে? সারাক্ষণ মন কেমন করে। এক ধরনের ভারী বিষণ্ণতা বুক চেপে ধরে আছে ।
বড়ো অসময়ে আমি তোমাকে এই কথাটি বললাম। যখন তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ফিরে আসার কোনো পথ কি তোমার খোলা আছে? নাকি রুদ্ধ তোমার সকল দুয়ার?
ভালো থেকো তুমি।
ইতি — অপরাজিতা।
অপরাজিতা নামে কোনো মেয়ের সাথে কোনো দিন আমার পরিচয় ছিল না। তার নামও কোনও দিন শুনিনি। নিশ্চয়ই ছদ্মনাম দিয়ে কেউ এই চিঠিটি লিখেছে। যে আমাকে খুব কাছে থেকে জানে। আমার হলের রুম নং ও তার জানা আছে। কিন্তু কে এই মেয়ে? হাতের লেখাটিও চিনতে পারছি না। একটু দুশ্চিন্তাও করতে থাকি। সামনে আমার শুভ বিবাহ। একজন অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে আর কিছুদিন পর হাতে মেহেদি পরবে। কাঁচা হলুদ দেবে তার গায়ে। কপালে টিপ পরবে। খোপায় পরবে শুভ্র সন্ধ্যামালতী ফুল।
রাতে টেবিলে বসে যখন পড়ছিলাম, তখন শরীর মদির হয়ে চোখে ঘুম নেমে আসে। শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম আসে না। চেয়ে থাকি নিমগ্ন হয়ে। দূরে অনেক দূরে বন ঝাড়ে দেখতে পাই অজস্র অপরাজিতা ফুল ফুটে আছে। ফুলগুলো বেদনায় নীল। আমি জানি, এদের আয়ু খুব ক্ষণকালের। কে-ই বা ছুঁইবে তাদের। অনাদরে ওরা ঝরে যায় ।
একদিন দুপুরে ডাইনিং রুম থেকে খেয়ে এসে রবি ঠাকুরের কড়ি ও কোমল কবিতার বইটি বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে পড়ছিলাম। পরের দিন রবীন্দ্র সাহিত্য পরীক্ষা। পাশের জানালাটা খোলা ছিল। চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। দেখছিলাম দূরে অনন্ত আকাশের নীল। মনে হচ্ছিল জলেশ্বরী তলার আকাশ দেখছি আমি। যেন ”শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল। / আমার নিখিল / তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল। নাহি জানি, কেহ নাহি জানে–”
আমি জানি — নীলিমা আমার। নীলিমা আমার হবে।
রুমের দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। কড়ি ও কোমল বিছানার উপর রেখে দরজাটা যেয়ে খুলে দেই। দেখি — ডাকপিয়ন চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকেও অপরাজিতার চিঠি।
পরম কল্যাণীয়,
তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? এই সময়ে তোমাকে বিরক্ত করা আমার ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। কত কথা বলতে ইচ্ছে করে তোমার সাথে। অথচ এক সময় কত কথা তোমার সাথে বলতে পারতাম। আজ যখন ক্রমে অনেক দূর চলে যাচ্ছ, তখন মনে হয় — তোমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করি। তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলি তোমার কঠিন কোমল বুকে। আমার নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় যে ! কোথাও কোনও নন্দন কানন থেকে যদি তুমি একটি চাঁপা ফুল এনে আমায় দিতে, তবে নিঃশ্বাস নিতাম প্রাণ ভরে।
আমার পরম সৌভাগ্য যে তোমাকে আমি চেয়েছিলাম, আর আমার নিয়তি যে তোমাকে আমি কোনও দিন পাব না। তোমার জীবনময় আমি থাকব না, কিন্তু তোমার জীবনভর আমার অদৃশ্য ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকবে। আমার খুব কান্না পায়, কষ্ট হয়, হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে টান লাগে। দুঃখের মাধুরীতে আমাকে শুধু সিক্তই করলে। আমাকে কাছে নেবার কোনও দায় নিলে না। কাঁদিয়েই রাখবে কেবল জনমভর।
তোমাকে আমার জীবনের শেষ অব্দি পর্যন্ত মনে থাকবে। শুধু একটু আফসোস রয়ে গেল তোমার সাথে জলেশ্বরী তলায় তোমাদের বাড়ির আম্রকাননে দাঁড়িয়ে একটা সকাল দেখা হলো না, কাটাতে পারলাম না শোয়ার ঘরে একটি নিঝুম দুপুর, দক্ষিণের বারান্দায় একটা কমলা রঙের বিকেল, আর ছাদে পাটিতে বসে উপভোগ করতে পারলাম না একটি জ্যোৎস্নার রাত।
ভালো থেকো তুমি।
ইতি — অপরাজিতা।
পরীক্ষার কয়েকটি দিন বাকী ছিল। অনেকটা মন খারাপের ভিতরেই পরীক্ষা শেষ করি। হঠাৎ আনন্দময় ভাবনার ভিতর অজ্ঞাত কোন্ এক মেয়ে মনের উপর একটু বিষণ্ণতার ছায়া ফেলল। ভুলে যাই। মনের উপর জোর রাখলাম, ভাবলাম, এইসব কিছু না। এইসব মিছে মায়া। অন্তরের ভিতর এইসব ঠাঁই দিয়ে আসন্ন শুভক্ষণগুলোকে অসুখকর করা ঠিক হবে না।
যেদিন পরীক্ষা শেষ হয়, সেদিন রুমে এসে দেখি দরজার নিচে দিয়ে পিওন দুটো চিঠি ফেলে রেখে গেছে। একটি চিঠি নীলিমার। আর একটি চিঠি অপরাজিতার। আমি নীলিমার চিঠিখানি প্রথম পড়ি।
প্রিয়তম,
পরীক্ষার শেষ হওয়ার পর দেরি না করে তাড়াতাড়ি চলে আসিও। বাঁধ ভাঙা আবেগে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। সময়ে অসময়েই তোমার কথা আমার মনে পড়ে। দিন যত এগিয়ে আসছে, তত আমার শরীর মন কাঁপছে। ভাবি বসে বসে — কী সুন্দর দিন, কী মধুময় রাত হৃদয় পথগামি।
সকাল থেকেই এখানে আজ বৃষ্টি হচ্ছে । দমকা হাওয়ায় মাতিয়ে উঠেছে বৃক্ষরাজি। একটি ছাতা মাথায় দিয়ে দুজন করোতায়া নদীর পারে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। আমাকে তুমি বৃষ্টি দাও। ঝুমঝুম করে আমার সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে দাও।
তুমি এসো। চূর্ণ করে দাও আমার অপেক্ষা।কিছুতেই কাজে মন বসে না। তুমি আমাকে তোমার ঘরে তুলে নিয়ে বাজাও বর্ষার মল্লারের সুর।
ভালো থেক তুমি প্রতিদিন সারাক্ষণ।
— তোমার নীলিমা।
এরপরে পড়লাম অপরাজিতার চিঠিটি।
কল্যাণীয়েষু,
আমি জানি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিনই তুমি চলে যাচ্ছ। তোমাদের বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক হয়ে আছে। তোমার এই আসন্ন শুভক্ষণে আজ আর আমি কোনও অমঙ্গলের কথা লিখব না। তোমার এই শুভদিনে আমি শুধু তোমার মঙ্গল প্রার্থনাই করব।
কটা দিন ধরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কী দরকার ছিল তোমাকে অমন করে চিঠি লেখার। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে আমন্ত্রণ করব — বুড়িগঙ্গার পারে যেয়ে দুজন দেখা করব। ওখানে নদীর তীরে কোথাও ঘাসের ওপর বসব—তুমি আর আমি। তখন জলে বিরাজ করবে শুভ্র শান্তি। অন্ধকারে তীরের বৃক্ষ গুল্ম হয়ে উঠবে নিবিড়। অস্তমিত সূর্যের আবছায়ায় মুখ তুলে তাকিয়ে দেখব তোমাকে। লাল আভায় চিক চিক করবে আমার চোখের জল। যদি তোমারও কান্না পায়, যদি তোমারও চোখের জল ঝরে পড়ে আমার ললাটের উপর। তাহলে মরেও শান্তি পাব। কিন্তু তা হলো না। ভয়ও করল যদি তুমি না আসো। আমি নিজেই নিজেকে বারণ করলাম।
হয়ত আর চিঠি লিখব না। একা থাকা কী হবে? কেউ না কেউ আসবে জীবনে। তাকে নিয়েই হবে সংসার। সংসার কর্মের ভিতর তোমাকে যেন ভুলে থাকতে পারি। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার শেষ কটি চরণ দিয়ে এই চিঠিখানা শেষ করছি —
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়, ওগো বন্ধু বিদায়।
— অপরাজিতা।
মনটা কেমন যেন লাগছিল। বাড়িতে আসার আগের দিন এমনই একদিন বুড়িগঙ্গার পারে একাকী চলে যাই। কোথাও নির্জন কূল নেই। নদীতে কত নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার। ওদের আসা যাওয়ার ভেঁপু’র শব্দ। তীরে জনারণ্য। নেই কোথাও বনঝোপ। কোথাও কোনও বন অন্তরালে অপরাজিতা ফুটে নেই।
আমি বাড়িতে চলে যাই। এক ফাগুন দিনে আমার বিয়ের তারিখ হয়।
বিয়ের দুই দিন আগের কথা। সেদিন ঘরে আমি একাই ছিলাম। অনেক রাত্রি হয়েছে। ঘুম আসছিল না চোখে। অপরাজিতার চিঠি তিনটি ব্যাগে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। চিঠি তিনটির কথা মনে হলো। মনটা কেমন হুহু করে উঠল। একটি সিগারেট ধরাই। দরজার খিরকি খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে অন্ধকার। আকাশে একটি তারাও নেই । কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হাতের সিগারেটের পোড়া অর্ধেকটা উঠোনে ফেলে দিয়ে রুমে চলে আসি। টেবিলের উপর ল্যাম্পটি মিটমিট করে জ্বলছিল। ব্যাগের তলা থেকে চিঠি তিনটা বের করে ল্যাম্পের আলোয় আবার পড়তে থাকি। কবে কখন একটি মেয়ে এমন করে আমায় ভালো বেসেছিল, ভেবে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল।
দুইদিন পর বিয়ের সানাই বেজে উঠবে। ভাবলাম– অমঙ্গলের এই অভিজ্ঞান কেন ঘরে রাখব? চিঠি তিনটি তাই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করি। এবং ছে্ঁড়া টুকরাগুলি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেই। অন্ধকারে সে টুকরোগুলো দমকা বাতাসে উড়ে কোথায় ধূলোবালিতে মিশে হারিয়ে গেল।
প্রায় এগারো বছর পরে একদিন অপরাজিতার একটি চিঠি পাই। অপরাজিতা লিখেছে —
বন্ধু আমার,
এই শহরে তুমি থাকো। আমিও থাকি। তোমার কুশল আমি সব জানি। তোমাকে দেখিও মাঝে মাঝে। কী সুন্দর পরীর মতো বউ তোমার। বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে দূর থেকে তোমার সব সুখ আমি দেখি।
আমার কথা কী তোমার একবারও মনে পড়ে না? অবশ্য আমাকে তুমি মনে রেখো — এই দায় তোমাকে আমি কখনও দেইনি। তোমার উপর থেকে আমার ভালোবাসা একটুও যায়নি। আজও তোমাকে খুব ভালোবাসি।
যে মেয়েটি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল, তাকে একটিবারও দেখবার সাধ হয় না? আমাকে না দেখেই তুমি মরে যাবে? এমন অতৃপ্তি তুমি রেখ না। যদি আমাকে দেখবার ইচ্ছে হয় তাহলে দেখতে এসো। কেবিন নং ৫০৭, পঞ্চম তলা, পিজি হাসপাতাল, ঢাকা।
— অপরাজিতা।
দুইদিন পরই একদিন সকাল এগারোটার দিকে আমি পিজি হাসপাতালে চলে যাই। ৫০৭ নং কেবিনের দরজায় নক করি। কেউ খুলছে না। একজন নার্স এগিয়ে আসে। উনি বলছিলেন – ওনার তো আজ অপারেশন হচ্ছে । ওটি নং ৩ এর সামনে চলে যান। ওখানে ওনার স্বজনেরা আছেন। আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করি — কী হয়েছে ওনার? কিসের অপারেশন হচ্ছে।
— যকৃতে ক্যানসার। সম্ভবত শরীরের সারা রক্তে তা ছড়িয়ে গেছে।
আমি ৩ নং অপারেশন থিয়েটারের সামনে চলে যাই। ওটির সামনে বেশ কয়েকজন নারী পুরুষকে দেখতে পেলাম। কেউ আমাকে চেনে না। একজন লোককে দেখলাম সে একটি ছয় সাত বছরের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। মেয়েটি কাঁদছেে। বুঝতে পারলাম মেয়েটি অপরাজিতার মেয়ে। আর লোকটি অপরাজিতার স্বামী। ওনার চোখে মুখে চরম উদ্বিগ্নতার ছাপ। আরও যারা আছে, তারাও সবাই চিন্তাক্লিষ্ট ও বিষণ্ণ। কেউ কেউ অশ্রু সিক্ত।
আমি অনাহুতের মতো একটু দূরে কোরিডরে দাঁড়িয়ে থাকি। আধা ঘণ্টা পরে অপারেশন থিয়েটার থেকে কেউ একজন এসে জানায় — রোগিণী মারা গেছে। তারও কিছুক্ষণ পরে স্ট্রেচারে করে সাদা চাদরে ঢেকে মৃত রোগিণীকে ওটি থেকে বের করে আনে। কোরিডরে আত্মজনরা সবাই স্ট্রেচারের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সাদা কাপড় সরিয়ে সবাই তার মুখখানি দেখছে। আমিও নিঃশব্দে স্ট্রেচারের কাছে গিয়ে দাঁড়াই, দেখি অপরাজিতার মুখ।
কোরিডর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে আসি। পিছনে বাচ্চা মেয়েটির ক্রন্দনধ্বনি হাসপাতালের কংক্রিটের দেয়ালে বিদীর্ণ হচ্ছিল। শব্দহীন আত্মস্বরে বলছিলাম — অপরাজিতা, এত কাছে ছিলে তুমি। এত তোমায় দেখেছি। এত ভালো বেসেছিলে তুমি। আমি তা বুঝতে পারিনি। তুমি চোখ বন্ধ করে আছ, দেখলাম তোমার আর্তিময় আঁখিপাতের মায়া।
জীৎ তোমারই হলো। আমিই হেরে গেলাম। বাকী জীবন আফসোস করে কাটাতে হবে। ওপারে তুমি ভালো থেকো অপরাজিতা। রেস্ট ইন পিস।
২৮. তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে
একটা স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘড়িতে চেয়ে
দেখি — রাত তিনটে দশ। স্বপ্নটি খুব সুন্দর ছিল। সুন্দর স্বপ্ন নাকি হঠাৎ করে ভেঙে যায় না। পুরোটাই দেখতে পায় মানুষ। কিন্তু আমার দেখা স্বপ্নটি অসম্পূর্ণ রেখেই ভেঙে গেল। কিছু স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর স্বপ্নটির জন্য মানুষ আফসোস করে।
স্বপ্নটা ছিল — আমি একটি দুই ঘোড়ার টমটম গাড়িতে করে সাহানাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। টমটমটি লাল ঝালর কাপড়ে সাজানো। আমার পরনে রাজস্থানের শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি, চোখে সুরমা পরা। শরীরে বাগদাদের আতরের গন্ধ। পায়ে কোলাপুরী জুতো। টমটমটি চলছে একটি অচেনা বনপথ ধরে। অন্য কোনো বরযাত্রী নেই। আমি একা চলেছি। চারদিকে শাল পিয়াল আর আমলকীর বন ঝাড়। নির্জন সে পথ। ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ হচ্ছে।
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, সাহানা একটি লাল বেনারসি শাড়ি পরেছে। মুখে ট্রেডিশনাল বিয়ের সাজ। সিঁথিতে টিকলি। চোখে কাজল। কানে ঝুমকো। গলায় মতিহার। খোপায় বেলী ফুলের মালা জড়ানো। মাথায় ঘোমটা দিয়ে আনত চোখে বিয়ের আসনে সে বসে আছে।
স্বপ্নের পট দৃশ্যগুলো দ্রুত পরিবর্তন হতে লাগলো। দেখি — আমিও একটি বিয়ের আসনে বসে আছি। আমার সামনে মৌলানা সাহেব বসে আছেন। কোরান থেকে কিছু সুরা মুখস্থ পাঠ করলেন তিনি। তারপর আমার উদ্দেশ্য করে উনি বলতে লাগলেন– ‘….. … .. আপনি কী সাহানা বেগমকে বিবাহ করতে রাজি? ‘ রাজী থাকলে তবে বলুন — ‘কবুল’। ‘
কবুল বলার আগেই স্বপ্নটা ভেঙে যায়। স্বপ্ন ভাঙার সাথে সাথেই ঘুমও ভেঙে যায়। ঘরময় অন্ধকার। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করল না। একবার মনে হলো বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে একটু দাঁড়াই। যদি আকাশে চাঁদ থাকে, যদি জ্যোৎস্নায় ভাসে চরাচর। তবে মনটা একটু ভালো লাগতে পারে । কিন্তু, উঠতে পারছি না। অসুখটা আজ কয়েকদিন ধরে একটু বেশি। ক্রাচে ভর করে হেঁটে যেতে হবে। ক্রাচে হেঁটে যাওয়ার মতো শক্তি আমার এই মুহূর্তে নেই।
সাহানা আমার ছোট ফুফুর মেয়ে। ওর জন্ম হয়েছিল আমাদের বাড়িতেই। জন্মের সময় ফুপু মারা যান। দাদী সাহানাকে ওনার কাছেই রেখে দিয়েছিল। সে বেড়ে ওঠে দাদীর ক্রোড়ে। দাদীকেই সাহানা মা ডাকত। ও এমনই দুঃখী, দাদীও মারা যান ওর পাঁচ বছর বয়সের সময়। তারপর ওর সমস্ত দায়িত্ব নেয় আমার মা। আমার মা- ই ওর মা হয়ে ওঠে।
সাহানার বাবা অর্থাৎ আমার ফুপা কখনোই মেয়ের দাবি নিয়ে ওকে ফিরে নিয়ে যেতে চায়নি কখনো। তাছাড়া, তিনি পরবর্তীতে আর একটি বিয়ে করে সুখে সংসার করতে থাকেন। সাহানা নামে তার যে একটি মেয়ে আছে, তা সে ভুলেই যায়।
আমাদের ভাইবোনের মাঝে সাহানাও আর একজন বোনের মতো বড়ো হতে থাকে। ওকে আমরা সবাই আপন করে নিয়েছিলাম। বাবা আরও বেশি ভালো বাসত ওকে। বাবার সকল কাজে, তার সকল সেবায়, তার খাওয়া দাওয়ায় খেয়াল করা, তাকে যত্ন করা, সব সাহানাই করত।
এই সাহানার কয়েকদিন পর বিয়ে হয়ে যাবে। দিন তারিখ ঠিক হয়ে আছে। ৬ ই আশ্বিন, শুক্রবার। ওর বর একজন বেসরকারি কলেজের বাংলার প্রফেসর। ভালো কবিতাও লেখে। সে কবি। তার একটি কবিতার বইও বের হয়েছে, নাম — ‘মনে জাগে আশা।’ বরের এই কাব্য প্রতিভার গুণকে বাবা বেশ গুরুত্ব দিয়েছিল।
ছেলে পক্ষ আমাদের বাড়িতে এসে সাহানাকে দেখে। সাহানাকে সেদিন লাল সিল্কের শাড়ি পরানো হয়েছিল। বরের মা নিজে ঘোমটা খুলে সাহানার লম্বা লম্বা কালো চুল দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিল — ‘ও মা, আমাদের বউ মা কী সুন্দর! ডাগর ডাগর চোখ! কী সুন্দর হাতের নোখ। কাঞ্চিবরণ গায়ের রং।’ বরের মা খুশিতে আটখান হয়ে নিজের গলার মালাটি খুলে সাহানার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল, কন্যা পক্ষের কোনো মতামত না নিয়েই।
মা সাহানাকে ডেকে একদিন সকালবেলা বলে– ‘তোমার কী বর পছন্দ হয়েছে? তোমার মামা তোমার মত জানতে চেয়েছেন।’
— আমি কালকে আপনাকে আমার মতামত জানাবো।
— আচ্ছা, ভেবে চিন্তে কালকেই জানাও।
সাহানা সেদিনই সন্ধ্যায় আমার ঘরে এসেছিল। আমি বিছানায় শুয়ে আছি। ঘর অন্ধকার। পাকস্থলিতে প্রদাহ খুব বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল। সাহানা বলছিল — সাঈদ ভাই, ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দেই?
— দে।
— তোমার বুকে খুব ব্যথা করছে?
— হে।
— ঔষধ খাও নাই?
— দুপুরে খেয়েছি, রাতে আবার খাব।
— মামা, মামী আমার বর দেখে রেখেছে। আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে।
— খুব ভালো। তোর বর খুব সুন্দর, প্রফেসর, কবি।
সাহানা অঝোর ধারায় কাঁদছে। কোনো কথা বলতে পারছে না।
— এই তুই কাঁদছিস কেন?
— আমি এই বিয়ে করব না।
— কেন করবি না।
সাহানা আমার বুকের উপর মাথা ঝুকে অশ্রুপাত করে বলে — আমি তোমাকে ভালোবাসি সাঈদ ভাই।
— তুই তো এই কথা কখনও আমাকে বলিস নাই।
— তুমি বুঝতে পারো নাই?
— শোন্ এই শেষবেলায় তুই পাগলামি করিস না। আমি পঙ্গু একজন মানুষ। ক্রাচে ভর করে হাঁটি। কিডনি ফেইলর। কদিন পরে মরে যাব। আর তুই কী না আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস। এত বোকা মানুষ হয়? তোর সামনে কত অনন্ত সুখের সময়। আমাকে বিয়ে করলে তোকে তো বিয়ের পরপরই বৈধব্যের সাদা কাপড় পরতে হবে। তোকে আমার বিয়ে করা সম্ভব হবে না। আমি তোকে ছোট বোনের মতো সারাজীবন দেখে এসেছি। তুই আমার ছোট বোন হয়েই থাকবি।
সাহানা আর কোনো কথা না বলে সেদিন কাঁদতে কাঁদতে ঘর হতে বেরিয়ে গিয়েছিল।
পরের দিন সে মার কাছে যেয়ে বলে — মামী, আমার এই বিয়েতে আপত্তি নেই। আপনেরা এই বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।
বাড়িতে আমি খুবই অসুস্থ। এই কারণে ভিতরে ভিতরে একটা দুঃখের আবহ থাকলেও বাবা সাহানার বিয়ের ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করতে রাজি ছিল না। সে সব রকমের ধুমধামের আয়োজন করলেন। বর পক্ষ থেকে সাহানাকে গায়ে হলুদ দিয়ে যায়। কন্যা পক্ষ থেকেও বরকে গায়ে হলুদ দিয়ে আসে।
বিয়ের দিন শহর থেকে ব্যান্ড পার্টি আনা হলো। সানাই বেজে উঠল। সাহানার বান্ধবীরা, সহপাঠীরা, খেলার সাথীরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠল। আনন্দ উৎসবে আমার অন্যান্য ভাই বোনেরাও অংশ নিলো।
আমার এত ইচ্ছা করছিল সাহানার সব আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে। কিন্তু বিধাতা আমাকে সে আনন্দ করতে দিল না। ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম। একদিকে শরীর পুড়ে যাচ্ছিল, অনদিকে শীতে থরোথরো করে কাঁপছিলাম। ক্রাচে ভর করে যে একটু হেঁটে অনুষ্ঠান স্থলে যাব, তাও আর পারলাম না। সে শক্তি নেই। অন্তরের ভিতর সানাইয়ের সুর বেদনার মতো করে বাজছিল —
‘প্রমােদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে।
চারি দিকে হাসিরাশি, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে।’
সামিয়ানা টানিয়ে তার নিচে চেয়ার টেবিলে বসিয়ে আগত অতিথিদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই মহা ধুমধামে খেলেন, আনন্দ করলেন।
এরপর সন্ধ্যারাতে বর আর কনেকে পাশাপাশি বসিয়ে নানারকম আনুষ্ঠানিকতা করা হয়। সব কিছুর ভিতর ছিল নির্মল আনন্দ, আর অনাবিল প্রাণোচ্ছ্বাস। এত আনন্দ উৎসব হচ্ছে যে, তার কোনোটাই দেখার সুযোগ আমার হলো না।
রাতেই সাহানা ওর শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। যাবার বেলায় মা আর বাবাকে সাথে করে সাহানা আমার কাছে থেকে বিদায় নেবার জন্য ঘরে চলে আসে। আমি লেপের নিচে শুয়ে আছি। শরীর কাঁপছে। সাহানা আমার কপালে হাত রাখে। ও কেঁদে ফেলে। কান্না কন্ঠে বলে — তোমার এত জ্বর ! বুকে অনেক ব্যথা বুঝি। অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমার। তাই না! কে তোমায় কপালে জলপট্টি দেবে? আমি থাকলে আমি দিয়ে দিতাম। সাহানা মাকে ডেকে বলে –মামী আপনি সাঈদ ভাইয়ের মাথায় একটু পানি দিয়েন।
সাহানা আমার হাত ধরে বলে — আমি চলে যাচ্ছি সাঈদ ভাই। তুমি আমাকে আশীর্বাদ করে দেবে না?
আমি বিছানার উপর উঠে বসি। সাহানাকে বলি — ‘আমার ক্রাচ দুটো একটু এগিয়ে দে।’ সাহানা ক্রাচ আমার হাতে তুলে দেয়। ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াই। সাহানা আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। আমি ওকে বলি — এসব সালাম করিস না। আমি তোর জন্য এমনিতেই প্রাণ ভরে অনেক দোয়া করব।
সাহানা কাঁদছে। ওকে বলি — আমাকে ধরে একটু জানালার কাছে পর্যন্ত নিয়ে যাবি? ওখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকব। সাহানা আমাকে জানালা কাছে পর্যন্ত নিয়ে যায়।
সাহানা রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়। উঠোন দিয়ে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসে। বর-কনের গাড়িটি একসময় ছেড়ে চলে যায়। আমি জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আলো আঁধারের ভিতর ওদের চলে যাওয়া দেখলাম।
আকাশে ত্রয়োদশী চাঁদ উঠেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আচমকা স্রোতের মতো জ্যোৎস্না ধারা এসে আমার চোখ, মুখ, ললাট ধূয়ে দেয়। কোথাও আর একবিন্দু অশ্রুজল রইল না। ‘মুহূর্তের মধ্যে একটি সত্য বুঝতে পারি — অকূলে কেবল জেগে রয়, ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি আমার এ হৃদয়’।
Leave a Reply