রোধ – গোলাম মাওলা নঈম
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৯
০১.
হোয়াইটস্টোন শহরটা ছোট, সব মিলিয়ে শখানেক লোকের বাস। মূল রাস্তার দুপাশে ফুটপাথ ছাড়িয়ে যথেষ্ট দূরে সারি সারি বাড়ি আর দোকান-ঘর। রাস্তাটা দক্ষিণে গির্জাতক আর উত্তরে রঙজ্বলা একটা সাইনবোর্ড পর্যন্ত দীর্ঘ। পশ্চিমে ঢালু জমি মাইলখানেক তফাতে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে মিশেছে। আর পুবে ফ্রগস রীভারের ওপারে দিগন্তজোড়া তৃণভূমি।
জেথ্রো ম্যাকলীন যখন হোয়াইটস্টোনে প্রবেশ করল তখন দুপুর। গ্রীষ্মের সূর্য সর্বত্র উত্তপ্ত হলকা ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রায় ফাঁকা মূল রাস্তা ধরে এগোল সে। বছর চার আগে একবার এসেছিল এখানে, একটা রাত কাটিয়ে সনোরার ট্রেইল ধরেছিল। শুরুতে এ শহরে একটা সেলুন কাম স্টোর, দুটো হোটেল আর একটা আস্তাবল ছিল কেবল। পশ্চিমে পাহাড়ের কোলে ছিল মাইনারদের আস্তানা। প্রকৃতির ভাণ্ডার ফুরিয়ে যেতে কেটে পড়েছে ভাগ্যান্বেষী লোকগুলো, আর ছোট্ট হোয়াইটস্টোন পরিণত হয়েছে ক্যাটল টাউনে। এর আশেপাশে এখন বেশ কটা বড়সড় বাথান।
কয়েক সারি দোকান পেরিয়ে বামে একটা আস্তাবল চোখে পড়ল। দূর থেকে পরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। সামনে এসে স্যাডল ছাড়ল জেথ। জোয়ান একটা ছেলে বেরিয়ে এসে ভেতরে নিয়ে গেল ঘোড়াটাকে। পোর্চে একটা বেঞ্চি, তাতে বসে সিগারেট রোল করল ও। ধরিয়েছে এ-সময় ফিরে এল তরুণ হসল্যার। চোখে একরাশ কৌতূহল নিয়ে দেখল ওকে, তারপর সহজ কণ্ঠে জানতে চাইল, দূর থেকে আসছ?
নড করল জেথ। অনর্থক প্রশ্ন, ওর ঘোড়াটার ক্লান্ত শরীর দেখে বুঝে নিয়েছে ছেলেটা। কিন্তু এটাকে আলাপ শুরুর উপায় ভেবেছে।
তোমার ঘোড়াটা দারুণ! বুনো ছিল একসময়, তাই না?
বোঝা যাচ্ছে সুযোগ পেলে ছেলেটা কথা বলতেই থাকবে। উত্তর না দিয়ে রাস্তার ওপাশের বাড়িগুলোর দিকে নজর দিল জেথ। গলা ভেজানো দরকার। দুশো মাইল পাড়ি দিয়েছে, শরীর জুড়ে কেবল ক্লান্তি।
ওর ঊরুতে বাধা হোলস্টার আর পিস্তলের দিকে তাকাল ছেলেটা, চোখে মুখে নগ্ন আগ্রহ। তুমি কি মিলারের আউটফিটে যোগ দিতে এসেছ?
মাথা নাড়ল সে।
তাহলে নিশ্চয়ই ম্যাকলীনরা তোমাকে ভাড়া করেছে?
এবারও না-সূচক জবাব জানাতে হলো।
তাহলে… হতাশ দেখাল ছেলেটাকে, চিন্তিত। একটা শো-ডাউন তো হবেই। জেরেমি মিলার এত সহজে ছেড়ে দেবে না। এজন্যে একগাদা লোকও আনিয়েছে সে, অথচ ম্যাকলীনদের লোকগুলো ঠিকমত পিস্তলও চালাতে পারে না।
ছেলেটার হাতে দুটো রুপোর ঈগল ধরিয়ে দিল জেথ। বুটের তলায় পিষে ফেলল সিগারেটের বাকি অংশ, তারপর হেঁটে চলে এল ফুটপাথে। একটা বাকবোর্ড পেরিয়ে যেতে ধুলোয় ঢেকে গেল চারপাশ। উৎকট গন্ধ এসে নাকে লাগছে, সেই সাথে চোখে-মুখে এসে পড়ছে ধুলো। ব্যানডানা টেনে নাকের গোড়া পর্যন্ত তুলে দিল ও। তারপর সাইডওঅক ধরে হেঁটে সরে এল জায়গাটা থেকে। ধুলো সরে যেতে দক্ষিণে এগোল। হাতের বামে একটা বড়সড় দালান চোখে পড়ল-দুপাশের বাড়িগুলোর চেয়ে আলাদা, শহরের গুটি কয়েক দালানের একটা। হোল্ডেন ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড এর উল্টোদিকে হোয়াইটস্টোনের সবচেয়ে পুরানো সেলুন-লুইফস কর্নার। আগের মতই আছে-বাইরে থেকে অগোছাল ও অপরিচ্ছন্ন। কিন্তু লুইফ বেক্সটারের আন্তরিক হাসি আর হুইস্কিই সেলুনটার বড় আকর্ষণ।
শূন্য রাস্তা পেরিয়ে সেলুনে ঢুকল জেথ। দুপুরের অলস সময় পার করছে জনা বারো লোক। বেশিরভাগই নিরীহ গোছের, কেবল কোণের তিনজন ছাড়া। এক নজর দেখেই বলে দেয়া যায় ঝামেলাবাজ।
বারের সামনে টুলের সারির একটায় বসে পড়ল ও। তিন পাঞ্চারকে পরিবেশন করে ফিরছিল লুইফ বেক্সটার, নতুন খদ্দেরের ওপর চোখ পড়তে থমকে গেল মুহূর্তের জন্যে। খুঁটিয়ে দেখল খানিক, তারপর হাসল। হাউডি, জেথ! ভেবেছিলাম মরে ভূত হয়ে গেছ! নিখাদ কৌতুক তার চোখে। বারের ওপাশে গিয়ে তাক থেকে বোতল আর পরিষ্কার গ্লাস নামাল, গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে সেটা ঠেলে দিল। পাক্কা চারটে বছর! অথচ কথা ছিল বছর ঘোরার আগেই এদিকে আরেকবার ঢুঁ মারবে…অন্তত নিজের বাড়িতে তো ফিরবে!
হুইস্কিতে চুমুক দিল ও। জানে সেরা জিনিসটাই দিয়েছে লুইফ। আড়চোখে তাকাল কোণের তিনজনের দিকে।
সেলুন-মালিক হাসল। ওরা আসার পর আমার বিক্রি বেড়েছে। খানিকটা ঝামেলা অবশ্য করেছে। একটু-আধটু সইতেই হয়, নইলে এটা সেলুন নাকি?
লুইফের স্বভাবের সাথে মিলছে না, আপসের সুরে কথা বলছে সে। এমনটা ও কখনোই ছিল না, ভাবছে জেথ। অনেক আগে থেকে চেনে ওকে, সনোরায় পরস্পরের প্রতিবেশী ছিল ওরা। এখানে এ শহরের শুরুতে জেথ তাকে দেখেছে আপসহীন এক মাইনার হিসেবে, সঙ্গীরা কেটে পড়ার পর সেলুনের ব্যবসা শুরু করে সে। তখনও, কেবল ভাল লোকের জন্যেই উন্মুক্ত ছিল এ সেলুনটি। সারা তল্লাটে বেপরোয়া লোক হিসেবে ওকে জানত সবাই, পারতপক্ষে কেউ ঘাটাত না। তবু ঝামেলা যে হত না তা নয়, কিন্তু লুইফ অনায়াসে সামাল দিত সেগুলো। বয়সের ভারে দুর্বল? ভাবল ও, উঁহু, চল্লিশ পেরোয়নি এখনও, ত্রিশ বছরের যুবকের মতই সুঠাম শরীর…মারিয়া? হবে হয়তো।
অভ্যস্ত হাতে কয়েকটা গ্লাস মুছছিল লুইফ। সবল হাতজোড়া দেখে বোঝা যায় অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে-ওর হাতের বুড়ো আঙুলে হ্যামার টানার দাগ নেই।
ধরে ফেলেছ না? তিক্ত হাসল সেলুন-মালিক, বয়স বেঈমানি করছিল, আর ওদিকে মারিয়ার চাপ…মারিয়াকে তো চেনোই, যা জেদী! তাই সব ছেড়ে…
পানীয় শেষ করল জেথ। নির্জলা হুইস্কি ক্লান্তি অনেকটাই তাড়িয়ে দিয়েছে। অস্বস্তিকর ভাবটা অবশ্য যায়নি, গোসল সেরে একটা লম্বা ঘুম দিলে কেটে যাবে।
রোয়ানা তোমাকে খবর দিয়েছে নাকি? চাপা স্বরে জানতে চাইল লুইফ, আড়চোখে একবার দেখল তিন ঝামেলাবাজকে। উঁহু, এমনিতে আসার লোক তুমি নও। তোমার পরিবার বসতি করল এখানে, তারপরও এলে না-অদ্ভুত মানুষ তুমি, জেথ!
চুপ করে থাকল জেথ।
কয়েকদিন থাকবে নাকি?
শ্রাগ করল ও।
একটুও বদলাওনি তুমি! স্পষ্ট হতাশা লইফের কণ্ঠে, যাকগে, রাতে এসো, একসাথে সাপার করব। জেথকে মানিবেল্টে হাত দিতে দেখে খেপে গেল এবার। খোদার কসম, ওকাজটা করলে তোমার মাথায় আস্ত একটা বোতল ভাঙব আমি!
ইঙ্গিতে শুভেচ্ছা জানিয়ে বারের ওপর থেকে টুপি তুলে মাথায় চাপাল জেথ। বেরোবার আগে খেয়াল করল ঝামেলাবাজদের একজন উধাও হয়েছে।
সেলুন থেকে বেরিয়ে পোর্চে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল জেথ্রো ম্যাকলীন। একটা সিগারেট রোল করল। দুপাশে যদূর চোখ যায় নিরীখ করল শহরটা ঝিম মেরে আছে যেন। অথচ আজ পে-ডে, পাঞ্চারদের ভিড়ে সরগরম থাকার কথা।
দক্ষিণে, শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে গির্জার দেয়ালের কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে কেউ, কোন ভবঘুরে বোধহয়। লোকটার সামনে একটা কুকুর ঘোরাঘুরি করছে। সারি সারি দোকান আর বাড়ির ওপর চোখ বুলাল সে, ম্যাকলীনদের ফ্লাওয়ার মিলের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল না। মিলটা হয়তো রাস্তার পশ্চিমে কিংবা গির্জা ছাড়িয়ে শহরের বাইরে।
দক্ষিণে মিনিট কয়েক হাঁটার পর ডানদিকে চোখে পড়ল দালানটা। একপাশে এক কামরার অফিস-ঘর, দরজার ওপর ছাদে সাইনবোর্ড ঝুলছে। নিশ্চিত হয়ে এগোল সেদিকে। কাঁচের দরজার ওপাশে আবছা আঁধার, বাইরে থেকে ভেতরের কিছু চোখে পড়ছে না। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল জেথ, চোখ সয়ে আসার পর টের পেল সাজানো একটা কামরায় উপস্থিত হয়েছে। পরিচ্ছন্ন দেয়ালে কয়েকটা পেইন্টিং। দরজার উল্টোদিকের জানালায় দিগন্ত আর পর্বতশ্রেণীর ধূসর অবয়ব। তবে সবচেয়ে চমৎকৃত করার মত ব্যাপার হচ্ছে বিশাল আয়তাকার টেবিলের ওপাশে আরামদায়ক চেয়ারে আসীন, এক মেম্বার উপস্থিতি।
রোয়ানাকে চিনতে একটু কষ্টই হলো।
অনেক কিছুই বদলেছে ওর, ভাবছে জেথ। পাঁচ বছর আগের নিখুঁত মুখটা আর নেই, রং ঝলসে গেলেও এখনও কমনীয়। বুদ্ধিদীপ্ত কালো চোখে কৈশোরের চপলতা নেই, আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পুরুষালি পোশাক, তবু যতটুকু দেখতে পাচ্ছে। মেয়েলি দেহের পুরোটাই আকর্ষণীয়।
রোয়ানার দৃষ্টি আটকে রইল আগন্তুকের মুখে যদিও সে অনাহুত নয়। সেকেন্ড কয়েক, তারপর উজ্জ্বল হলো সুন্দর মুখটা। চেয়ার ছেড়ে সহাস্যে এগিয়ে এল। জেথ খেয়াল করল হাটার ধরনটাও পাল্টে গেছে, প্রত্যয় মেশানো।
কেমন আছ, জেথ?
নড করে ভাল বোঝাতে চাইল জেথ, চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল।
ভাল না। যেটা আমার কাজ নয় তাই করতে হচ্ছে।
অস্বস্তি বোধ করল সে, একটা চেয়ারে বসে হ্যাটটা কোলের ওপর নামিয়ে রাখল।
জেথের অস্বস্তিটুকু আঁচ করতে পারল রোয়ানা, কারণটাও জানে। ফিরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল। কিছু মনে কোরো না। অভিযোগ করিনি, এমনিতেই বলেছি। ড্রয়ার খুলে কাগজ-কলম বের করে এগিয়ে দিল। সহজ হয়ে বসো, আমি তোমার অপরিচিত কেউ নই।
কাগজ নিয়ে লিখল জেথ: বাবা কেমন আছে?
ভাল, যতটুকু থাকা সম্ভব, পড়ার ফাঁকে জানাল রোয়ানা, লাঞ্চ করেছ?
মাথা ঝাঁকাল ও।
কফি?
সায় পেতে কামরার কোণে চলে গেল রোয়ানা, স্টোভে আগুন জ্বেলে কেতলি চড়াল। ড্রয়ার খুলে বের করল দুটো কাঁচের মগ। পানি ফোঁটার পর, কেতলিতে কফির গুড়ো ঢালার সময় ফিরে তাকাল। জেথ তখন দেখছিল ওকে। কিছুটা অস্বস্তি হলো রোয়ানার, মাথা নেড়ে মনোযোগ দিল মগে চিনি ঢালায়। তুমি আমাকে নতুন দেখছ না, পরিবেশনের সময় স্পষ্টভাবে অনুযোগ করল।
না, লিখল জেথ, কিন্তু অনেক বদলেছ।
কেমন কাটছে তোমার?
শ্রাগ করল সে।
তোমাকে আমার হিংসে হয়, জেথ!
প্রশ্ন ফুটে উঠল ওর চোখে।
তুমি খুব স্বাধীনচেতা, যেখানে ইচ্ছে চলে যাচ্ছে…কোন পিছুটান নেই। বাথান, মিল-এসব মানেই তো টাকা। অথচ এগুলো তোমাকে টানে না। তোমার সাহস…
হাত তুলে রোয়ানাকে থামিয়ে দিল জেথ। কাগজে লিখল: এখানকার, তোমাদের কথা বলো।
তুমি চলে যাওয়ার পর, শেষবার যখন এসেছিলে, চাচা ঠিক করল সনোরা ছেড়ে এখানেই বসতি করবে। লুইফ তো আগেই এসেছে, ওর পরামর্শে র্যাঞ্চটা কেনা হলো। একে তো পঙ্গু, তাছাড়া নতুন হিসেবে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না সে, তাই আমি এলাম। তার আগে অবশ্য তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কয়েকবার, তুমি ওকে নিরাশ করেছ। এবার আমি ডেকেছি, তবে পরামর্শটা ওর। এবং তোমাকে আর যেতে দিচ্ছি না। হাসছে রোয়ানা, দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ।
সমস্যার কথা বলোকাগজে লিখল জেথ। ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠছে, বরাবর এ চ্যালেঞ্জটাকে ভয় পেয়েছে সে এবং এজন্যেই এড়িয়ে চলা।
খানিকটা নিরাশ মনে হলো রোয়ানাকে, উঠে নিজের মগ কফিতে ভরে নিল। মৃদু চুমুক দিয়ে শুরু করল ফের, এ মিলের আয়ের অর্ধেকটাই আসে সেনাবাহিনীতে পাঠানো সাপ্লাই থেকে। প্রতি মাসে হাচিনসনে সাপ্লাই পাঠানো হয়, ওখান থেকে ট্রেনে করে একাডেমিতে। চুক্তির ব্যবসা, সময়মত না পাঠালে তা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা।…এর আগে যা হয়নি, হাচিনসন যাওয়ার পথে লুট হয়েছে শেষ দুটো সাপ্লাই। জানার পর অবশ্য আবার পাঠানো হয়েছে-তারমানে দ্বিগুণ খরচ। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে দ্বিতীয়বারে আর লুট হয়নি। প্রথমবার পাহারা দেয়ার জন্যে তোক না থাকলেও গতমাসে তিনজনকে নিয়োগ করেছিলাম। লুট করার সময় কারও গায়ে একটা আঁচড়ও লাগায়নি ওরা।
দুবারের জায়গায় চারবার সাপ্লাই পাঠানোয় প্রায় বিশ হাজার ডলার লোকসান হয়েছে আমাদের। এ ক্ষতিটুকু জেনে-শুনে স্বীকার করে নেয়া কেবল চুক্তিটা টিকিয়ে রাখার জন্যে। একাডেমি শেষ একটা সুযোগ দিয়েছে-এবারের সাপ্লাইটা সময়মত না পৌঁছালে চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হবে ওরা। থেমে কফিতে চুমুক দিল রোয়ানা, চোখ জেথের ওপর। বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কি ভাবছে সে।
তাহলে আমার কাজ হচ্ছে, ভাবছে জেথ, সাপ্লাইটা যাতে ঠিকমত পৌঁছায় তা নিশ্চিত করা-প্রয়োজনে বন্দুকবাজি করে হলেও।
এক অর্থে ব্যাপারটা ওরকমই, রোয়ানা আঁচ করতে পারল জেথের ভাবনা কোন পথে এগোচ্ছে। আমি কেবল একটা সমস্যার কথা বলেছি, আরও আছে-সেগুলোও জানাব। তোমাকেই সব সামাল দিতে হবে, কারণ দুদিন বাদে বাথান আর মিল তুমিই চালাবে। সব বুঝিয়ে দিতে পারলে আমার ছুটি।
ওকে দোষ দেয়া যায় না, ভাবছে জেথ, এসব কাজ একটা মেয়ের জন্যে কষ্টকর বটে। সনোরার আরামদায়ক জীবন ছেড়ে এসেছে মেয়েটা, এতে ওর। নিজের স্বার্থ খুব কমই। ফ্রেডারিক ম্যাকলীনের কাছে নিজের ছেলের চেয়ে। অনাথা ভাইঝিই বেশি কাছের, কারণ বড় হওয়ার পর থেকে বাউণ্ডুলের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। বাপের কাছে থাকার চেষ্টা করেনি, রোয়ানাই ওর অভাবটা পূরণ করেছে।
রোয়ানার চোখে-মুখে চাপা হাসি দেখতে পাচ্ছে জেথ, ওর নাজুক অবস্থাটা। উপভোগ করছে। বিরক্তি লাগল ওর, এরকম ফাপরে পড়বে জানলে আসতই না। ভুল হয়েছে, তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করার সময় ভাবল, এ মেয়েটির চিঠিতে বিপদের আভাস ছিল, গুরুত্ব দেয়া ঠিক হয়নি। দশ দিন আগে প্রেসকটে চিঠিটা পেয়েই হোয়াইটস্টোনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল।
তোমাদের আশা পূরণ হচ্ছে না, লিখল জেথ, আমি থাকব না।
আর কত দিন এভাবে সরে থাকবে, জেথ? এক সময় এসবের দায়িত্ব তোমাকে নিতেই হবে, সহানুভূতি রোয়ানার কণ্ঠে। দেরি করলে কেবল ক্ষতিই। বাথান বা মিল চালানো পুরুষদেরই কাজ। সবচেয়ে বড় কথা আমি কুলিয়ে উঠতে পারছি না। শুরুতে সবকিছু গুছিয়ে নিতে চাচা খুব পরিশ্রম করেছে, সামলে উঠতে পারেনি আর। আগে ওর কাছ থেকে পরামর্শ পেতাম, এখন তাও পাচ্ছি না। নিজের কামরা ছেড়ে খুব একটা বেলোয়ই না। তুমি ফিরে এসেছ এটা ওর জন্যে দারুণ খুশির খবর।
জেথ দ্বিধান্বিত, আনমনে অগোছাল চুলে আঙুল চালাল। বিস্বাদ লাগায় বুটের তলায় পিষে ফেলল সিগারেটটা।
তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চলো, বাথানে গিয়ে গোসল সেরে বিশ্রাম নেবে।
উঠল না জেথ, ভাবছে।
কফি দেব?
সায় দিতে মগটা ভরে দিল রোয়ানা।
খানিক পর কাগজে লিখল জেথ: সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে তুমি কেটে পড়তে পারবে না। যা আছ তা-ই থাকবে, আমি কেবল সাহায্য করব তোমাকে।
কত দিন?
হাসল জেথ, ভবিষ্যতের কথা বোঝাতে চেয়েছে মেয়েটা। যদ্দিন না তোমার। অধিকার পাচ্ছে কেউ, ফের লিখল জেথ, তার আগে যদি সরে পড়তে চাও তো আমিও কেটে পড়ব।
সহাস্যে এগিয়ে এল রোয়ানা। তুমি কিন্তু ফেঁসে গেলে…আমি আগে থেকে জানতাম। কেবল চেয়েছি-একবার তোমাকে পেলেই হলো…রাজি করাতে কষ্ট হবে না।
.
বাক টার্নার সর্বাগ্রে, তার পেছনে সাত জন।
কলোরাড ক্যানিয়নে কাটানো গত দুটো মাস মোটেও সুখকর ছিল না টার্নারের জন্যে। ঘঁাচোড় এক বাউন্টি হান্টার পিছু নিয়ে ঢুকে পড়েছিল ক্যানিয়নের গভীর পর্যন্ত, হাইড-আউটের একেবারে কাছাকাছি। বাধ্য হয়ে আঙুল বাকাতে হয়েছে তাকে। আর যাই হোক ওর চেয়ে বেশি তো আর কেউ কলোরাডো ক্যানিয়ন চেনে না।
বজ্জাত বাউন্টি হান্টার মারা যাওয়ার পর হাজির হয়েছিল তার বন্ধুরা। অবস্থা বেগতিক দেখে সবার চোখে ধুলো দিয়ে সটকে পড়েছে সে। এরপর রেডরকে মিলিত হয়েছে অন্যদের সাথে। ওখানেই স্থির করে হোয়াইটস্টোনে আসবে। শেষ দাও মারার পর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে, পকেটে রয়েছে কয়েকটা রুপোর ঈগল। রোজগারের পথ তো একটাই, সুতরাং…
বাক টার্নার লোভী তবে নিজেকে সংযত রাখতে জানে, সতর্কও। তাই এমন একটা সময় বেছে নিয়েছে যাতে কাজ হাসিল করতে কোন অসুবিধা না হয়।
দলের লোকগুলো ওকে যমের মত ভয় পায়, টার্নারের হিংস্রতা কারও অজানা নয়। একটা নীতিই পাঁচটি বছর ধরে রেখেছে সবাইকে-টার্নার সমবণ্টনে বিশ্বাসী। অপরাধ জগতে একমাত্র সে-ই দলের লোকদের সমান বখরা দেয়। আর এ কারণে সবাই ওর অনুগত এবং বিশ্বাসী। পাঁচ বছরে দলের সদস্য-সংখ্যার হের ফের হয়নি, একেবারে শুরুতে যারা ছিল তারাই রয়ে গেছে। আইনের হাতে ধরা পড়েনি কেউ, এর কারণ টার্নারের পরিকল্পনাগুলো নিখুঁত। নেতা হিসেবে নিজের কাজে সে সেরা।
বাক টার্নারের চওড়া মেক্সিকান হ্যাট তোবড়ানো। নোংরা ফ্লানেলের শার্ট, তার ওপর ভেস্ট চাপিয়েছে। ঝলসে গেছে ডেনিম প্যান্টের রং। কলোরাডো ক্যানিয়ন ত্যাগ করার পর আর ক্ষৌরি করা হয়নি মুখ। চাকচিক্য কেবল একটি জিনিসে-পিস্তলের বাটে। হলুদ ব্যানডানা গিঁট দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। বুটজোড়া দুর্গম যাত্রার জন্যে যুৎসই। দলের সেরা ঘোড়াটা তার।
আটজনের দলটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রবেশ করল হোয়াইটস্টোনে। কোথায় মিলিত হতে হবে জানা আছে সবার। তস্কর-নেতা আশ্বাস দিয়েছে সহজে কাজটা সারা যাবে। খুঁতখুঁতে স্বভাবের লেইভ পিটার্স নিয়ম মাফিক গোঁ ধরেছিল ঠিকই, কিন্তু নেতার চড়া গলা তাকে নিরস্ত করেছে শেষতক। সবার আগে এখন সে-ই হোল্ডেন ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড-এর সামনে পৌঁছাল, শহরে ঢোকার পর অবস্থা দর্শনে তার মধ্যেই উৎসাহ বেশি।
ব্যাংকের সামনে ওরা এমনভাবে অবস্থান নিয়েছে যে ওদের আসল উদ্দেশ্য কেউই বুঝতে পারবে না। টার্নারের ঘোড়ার খুরের দাপটে ফুটপাথ থেকে সরে গেল একটা নেড়ি কুকুর। স্যাডল ছেড়ে ধূলিময় রাস্তায় নামল সে, হ্যাট খুলে অবিন্যস্ত চুলে আঙুল চালাল। দুই তস্কর ইতোমধ্যে হাঁটতে শুরু করেছে লুইফস কর্নারের পানে, ঠিক তিন মিনিট পর বেরিয়ে আসবে। পুরো দলের আচরণে মনে হচ্ছে সপ্তাহান্তের ফুর্তি করতে শহরে এসেছে কোন আউটফিট, আর তাদের মালিক ব্যাংকে ঢুকছে টাকা তুলতে, বেরিয়ে এসে পাপ্পারদের পাওনা মেটাবে। সবচেয়ে বড় সুবিধে আজ পে-ডে।
স্লিম, পিট, বাইরে নজর রাখবে তোমরা। কার্লি, আমার সাথে এসো, চাপা স্বরে নির্দেশ দিল বাক টার্নার।
অলস ভঙ্গিতে স্যাডল ছাড়ল ওরা। পরিকল্পনা মাফিক টার্নার ছাড়া অন্যরা আপাতত নিরস্ত্র, স্যাডল বুটে একটা রাইফেলও নেই, তবে লুকানো অস্ত্র রয়েছে। তস্কর-নেতা চেয়েছে তার পরিকল্পনা নিখুঁত হোক-এ অবস্থায় দেখলে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করবে না কেউ। অস্ত্র ছাড়া কি ডাকাতি হয়?
স্লিম ও পিটার্স ব্যাংকের সিঁড়িতে বসে গল্প শুরু করল। টার্নারের পিছু নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল কালি রাফ।
চারজন কর্মচারী যার যার ডেস্কে কাজ করছে। একপাশে কাচ-ঘেরা কামরাটা জুলিয়াস হোল্ডেনের। টার্নার সামনে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত কিছুই টের পেল না ব্যাংকার। তস্কর-নেতার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকাতে সিক্সগানের। ভয়ঙ্কর নল চোখে পড়ল। অস্ত্রের পেছনের লোকটাকেও কম ভয়ঙ্কর মনে হলো না। ধাক্কাটা সামলাতে সময় লাগল, তারপর রাগে ফেটে পড়ল। কিন্তু মুখ ভোলার। আগেই হুমকি দিল টার্নার, বোকামি কোরো না, আমি তামাশা করছি না। বেচাল দেখলেই গুলি করব।
কি চাও?
এত সহজ ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না? টার্নারের কণ্ঠে বিদ্রূপ। ব্যাংকের মত জটিল ব্যবসা চালাও কি করে! শীতল চাহনি তার চোখে, একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল। স্রেফ খুলে সব টাকা ঢোকাও এটায়-শুধু নোট।
মনে হলো প্রতিবাদ করবে জুলিয়াস হোল্ডেন, কিন্তু টার্নার হ্যামার টানতে ব্যর্থতায় ঝুলে পড়ল তার কাঁধ। কাঁপা হাতে পকেট থেকে চাবি বের করে সেফ খুলল, ভেতরে ভঁজ করা নোটের বান্ডিল থলেয় ভরতে শুরু করল।
ঠিক এ-সময়ে বাইরে, সিগারেট ধরিয়ে সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করছে পিটার্স, এখান থেকে কত পাব ধারণা করতে পারছ, স্লিম?।
কঠিন চোখে তাকাল স্লিম বেকার। এত উতলা হচ্ছ কেন? সব কিছু আগে ভালয় ভালয় শেষ হোক।
চুপসে গেল তরুণ, বিচিত্র শব্দে বিরক্তি প্রকাশ করল। এক্কেবারে মরা শহর! বাড়ি আর দোকানগুলোর ওপর ওর চোখ।
সেলুনে গিয়ে একবার শুধু বলে এসো ব্যাংকে ডাকাতি হচ্ছে, সহাস্যে বলল বেকার, তারপর দেখবে কেমন যাদু দেখায় এখানকার লোকেরা।
সব, একটা নোটও যেন পড়ে না থাকে, ব্যাংকের ভেতরে, হোল্ডেনকে তাগাদা দিচ্ছে টার্নার, তার চুপসানো মুখ দেখে হাসল। তুমি একটা আস্ত গাধা! আমাকে দেরি করিয়ে দিতে গিয়ে মরতে চাও নাকি? তোমাকে গুলি করতে একটুও কাঁপবে না আমার হাত, বরং একটা সীসা অযথা খরচ হবে বলে দুঃখ পাব।
এর জন্যে পস্তাতে হবে! জেদের সুরে ঘোষণা দিল ব্যাংকার। সব কটাকে গারদে ঢুকিয়ে ডাকাতি করার মজা টের পাওয়াব।
তামাশা করছ? শীতল দৃষ্টি হানল বাক টার্নার, এ জিনিসটা আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা কোরো না! সব নোট ইতোমধ্যে থলেয় ঢোকানো হয়ে গেছে, তস্কর-নেতা সেটা কেড়ে নিল। বাক টার্নারকে ধরা এত সহজ নয়। চেহারা তো দেখিয়ে গেলাম, তোমাদের বুড়ো মার্শালকে জানিয়ো। দেখব ধরতে পারে কি-না।…কারও যদি মরার খায়েশ হয়ে থাকে, তো বাধা দাও আমাকে! বেরিয়ে যাওয়ার সময় পিস্তল নাচিয়ে ঘোষণা দিল সে।
টার্নার বেরিয়ে যাওয়ার পর ভেতরে রয়ে গেল কার্লি রাফ। কাঁচের দরজা গলে তাকাল সে, সবাই স্যাডলে চাপার পরও অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। যখন মনে হলো অন্যদের যথেষ্ট সময় দেয়া গেছে, শেষবারের মত নজর বুলাল ব্যাংকার আর স্টাফদের ওপর। সিক্সগান হাতে এরপর বেরিয়ে এল ফাঁকা রাস্তায়। দলটা সটকে পড়েছে।
ঘোড়াটা তৈরিই ছিল, ছুটে গিয়ে স্যাডলে চাপল কার্লি। ঊধ্বশ্বাসে ঘোড়া দাবড়াল উত্তর দিকে।
পেছনে, পোর্চে এসে দাঁড়িয়েছে জুলিয়াস হোল্ডেন, ক্রমাগত গাল বকছে। স্টাফদের একজন একটা রাইফেল এনে গুলি করল ছুটন্ত কার্লি রাফকে, লাগাতে পারল না।
হোয়াইটস্টোন থেকে মাইল পাঁচ দক্ষিণে নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হলো দলটা। এবার কোন দিকে, বাক? জানতে চাইল স্লিম।
পুমাস ক্যানিয়নে রাত কাটাব আমরা।
কিন্তু ওটা তো কানা! ঢোকার মুখে যদি একজন লোকও বসে থাকে তো আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়ব, হয় ধরা দিতে হবে নয়তো না খেয়ে মরতে হবে।
এ শহরের লোকগুলো সব ভীতুর ডিম! ওরা পাসি নিয়ে তাড়া করবে আমাদের!? মার্শাল বেটা নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় সারাদিন। এই যে কাজটা সেরে এলাম, গিয়ে দেখো টেরই পায়নি সে।
গোলমেলে ঠেকছে ব্যাপারটা, সন্তুষ্ট হতে পারছে না শ্লিম বেকার, কিন্তু তর্কও করল না সে।
.
০২.
ম্যাকলীনরা ডাকাতির খবরটা পেল বিকেলে শহরে ফিরে।
অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এসে উত্তরে এগোল বোয়ানা। ব্যাঙ্কের সামনে ভিড় করেছে শহরের তাবৎ লোকজন। ক্ষণিকের জন্যে থেমে সেদিকে একবার তাকাল ও, তারপর এগোল আবার। কয়েকটা বাড়ি পরেই মার্শালের অফিস। রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল রোয়ানা। জেথ অনুসরণ করল ওকে।
কামরাটার অবস্থা যাচ্ছেতাই। দরজার ঠিক উল্টোদিকে, দেয়ালের কাছে একটা টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার। পাশে স্টোভ আর একটা ঢাকনাবিহীন কেতলি। এককোণে গানরাকে পুরানো আমলের দুটো শটগান এবং কয়েকটা রিপিটার। সারা ঘরের দেয়ালে সাঁটা ওয়ান্টেড পোস্টারগুলো ধূলিমলিন। পেছনে সেল ও লিভিং রুম।
সবার আগে অবশ্য টেবিলের ওপাশে চেয়ারে বসা বুড়োর ওপর জেথের চোখ পড়ল। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে লোকটার বয়স। অবিন্যস্ত সাদা চুল। বিশাল গোঁফজোড়া অবহেলায় ঝুলে আছে ঠোঁটের পাশে। চর্বিবহুল গাল আর চিবুকে ছোট কাঁচা-পাকা দাড়ি। চাহনিতে স্পষ্ট জীবনযুদ্ধে পরাজিত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। বয়সের ভারে একাধারে দুর্বল ও অসহায়। একসময় হয়তো শৌর্য-বীর্য ছিল, এখন নেই। লোকটি ডীন থর্টন, হোয়াইটস্টোনের আইনের মানুষ।
কেমন আছ, রোয়ানা? ক্ষীণ কণ্ঠে জানতে চাইল বুড়ো।
প্রত্যুত্তরে মাথা ঝাঁকাল রোয়ানা, একটা চেয়ার টেনে বসল।
উঠে স্টোভে পানি চড়াল মার্শাল। ফিরে এসে আয়েশ করে বসল, তারপর দুমড়ানো একটা সিগার ধরাল। ভুসভুস করে ধোয়া ছেড়ে ফিরল জেথের দিকে।
ও জেথ, জানাল রোয়ানা।
ফেরারী ছেলেটা? কৌতুক বুড়োর চোখে, নড করল জেথের উদ্দেশে। তোমার কথা শুনেছি। আমার ধারণা কি জানো, তুমি আমার চেয়েও বিটকেলে।
মৃদু হাসল জেথ, মার্শালকে ভাল লেগেছে।
ওরা আসছে, না? রোয়ানার উদ্দেশে জানতে চাইল বুড়ো।
নিশ্চিত থাকতে পারো।
এই লোকগুলো আর শহরটাই আমাকে শেষ করে দিয়েছে। বিরক্তি প্রকাশ করল থর্টন, এমন মরা শহর আর দেখিনি! চেয়ারে বসে থেকে থেকে সবকিছু হারিয়েছি আমি।
পর পর তিনজন কামরায় প্রবেশ করল এ-সময়। প্রথম লোকটি থর্টনের মতই মোটাসোটা, সদ্য ক্ষৌরি করা মুখে ঘাম চিকচিক করছে। লোকটা ডগলাস গ্রীন, পরে জেনেছে জেথ, হোয়াইটস্টোনের বড় হোটেলটার মালিক।
আরেকজন বেশ লম্বা, ছফুটের বেশিই হবে। গম্ভীর মুখে অভিজ্ঞতা আর প্রত্যয়ের ছাপ। গাঢ় নীল চোখে বুদ্ধিদীপ্তি। পরনে দামী কাপড়। সবল ডানহাতে একটা পাইপ। বোঝা কষ্টকর নয় যে আভিজাত্য তার হাতের মুঠোয় নিজের গড়া। অপরিপাটি পোশাক আর তোবড়ানো হ্যাটে তাকে অবশ্য সাধারণ কোন বাথান-মালিক বা ব্যবসায়ীর মত মনে হতে পারে। সে উইলসন হলেন-জাজ।
অন্য লোকটি ব্যাঙ্কার জুলিয়াস হোল্ডেন। এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী। সুঠামদেহী লোকটির সারা মুখে ঘন কালো দাড়ি। ক্লিষ্ট মুখ, ভাবটা এমন যেন এখানে, এ শহরে কিংবা খোদ দেশটাতে আগ্রহী হয়ে দেখার কিছু নেই। বাক টার্নার তাকে ভালই চোট দিয়েছে, ভাবল জেথ্রো ম্যাকলীন।
একে একে আসন দখল করল হোয়াইটস্টোনের তিন শীর্ষপুরুষ।
নিশ্চয়ই শুনেছ হোল্ডেনের ব্যাঙ্কে ডাকাতি হয়েছে? জাজই শুরু করল, মার্শাল মাথা ঝাঁকাতে খেই ধরল। বেজন্মাগুলোকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। একটা পাসি নিয়ে বেরিয়ে পড়ো, উীন।
আমার সাথে কে যাবে?
ওরকম লোকের অভাব আছে, না হয় কখনও?
যে কেউ চাইলেই পাসির সদস্য হতে পারে না। এজন্যে ধৈর্য, সহনশীলতা লাগে। এমন মানসিকতা থাকতে হয় যেন নরক পর্যন্ত ছুটতে পারে। ঝুঁকির কাজ, কারণ আউটলরা কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। সত্যিকারে লড়াই করতে জানে এরকম লোকের সংখ্যা এ শহরে হাতে গোণা কয়েকজন। অন্যরা, আমার ধারণা…
তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ, অভিযোগ করল হোটেল-মালিক।
মোটেও না, সিগারে টান দিল মার্শাল। আমি কেবল ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝাতে চাইছি। আনাড়ী লোক দিয়ে কাজ তো হবেই না পদে পদে ঝামেলা হবে কেবল। তারচেয়ে…আমাকে গোটা চারেক শক্ত-সমর্থ লোক দাও, আমি যাব।
লোক জোগাড় করা কি আমাদের কাজ, ডীন? পাসির জন্যে একজন লোকও যদি পাওয়া না যায়, তোমাকে একাই যেতে হবে। কারণ তুমিই শহরের মার্শাল, এবং এখানে বসে বসে মদ গেলার জন্যে আমরা তোমাকে বেতন দেই না।
থর্টনকে খানিকটা বিচলিত দেখাল, উত্তর দেয়ার সময় গলায় দৃঢ়তা থাকল। এতগুলো বেপরোয়া লোকের মোকাবিলা করা একা কারও পক্ষে সম্ভব নয়, আমিও পারব না। তারচেয়ে, আমার কাছে যথেষ্ট অস্ত্র আছে, তোমরা এলে…
আমরা তোমার ডেপুটি নাকি?
না, তা নও, মেঝেয় সিগার ফেলে বুটের তলায় পিষল মার্শাল। আমার ডেপুটিরা কোথায়, জাজ? অনেকদিন থেকেই তোমাদের বলে আসছি দুজন ডেপুটির জন্যে। কিন্তু তোমরা রাজি হওনি এ কারণে যে হোয়াইটস্টোনে এরকম কিছু ঘটেনি, ঘটবেও না এবং এটা কেবল বাড়তি খরচ।
এখন তো হলো। এবার তোমার দায়িত্ব পালন করো।
ড্রয়ার থেকে ছোট একটা বোতল বের করে, ছিপি খুলে গলায় রঙিন পানীয় ঢালল থর্টন। বিরক্তিতে কুঁচকে গেছে তার কপাল। গোল্লায় যাও কৃপণের দল! আমাকে কয়েকজন ডেপুটি দাও, নয়তো আমি উঠছি। হতচ্ছাড়া এ শহরটায় কাজ করে…
আমরা এখান থেকে না ওঠা পর্যন্ত কোথাও যাচ্ছ না তুমি, ডীন, বাধা দিল জাজ, নির্দেশের মত শোনাল তার কথাগুলো। উঠতে যাচ্ছিল মার্শাল, জাজের তীক্ষ্ণ স্বরে নিরস্ত হলো।
সন্তুষ্টচিত্তে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল জাজ, তারপর স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দেখল থর্টনকে। তোমার মনে রাখা উচিত কোথায় কে উপরওয়ালা। আমরাই তোমাকে বেতন দেই, ডীন, আর তুমি তা বোতল কিনে কিনে শেষ করছ।
বিড়বিড় করে কি যেন বলল মার্শাল, বোঝা গেল না।
শিগগির একটা পাসি গঠন করতে হবে, খানিক বাদে বলল জাজ। নইলে অনেক দূরে চলে যাবে শয়তানগুলো। শত চেষ্টা করেও তখন আর ধরা যাবে না। একটা পাসি যদি আমরা তৈরি করিও, সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ পাসির লোক যেমন দরকার, এরা মোটেও সেরকম হবে না। এরা না জানে ট্র্যাকিং, না পারে ঠিকমত অস্ত্র চালাতে। খুব বেশি হলে কয়েক মাইল এগোতে পারবে, তারপর ফিরে আসবে।…একটু অন্যভাবে চেষ্টা করলে কিন্তু সবকিছু এভাবে ভেস্তে যাবে না-যদি আমরা মিলারের সাহায্য নিই। ওর লোকেরা ট্র্যাকিং বা অস্ত্রে যথেষ্ট পারদর্শী।
এতক্ষণ চুপ করে ছিল রোয়ানা, জাজের দিকে ফিরল। হোয়াইটস্টোনের কোন ব্যাপারে জেরেমি মিলারের আসা উচিত নয়-অন্তত এভাবে, চাপা ক্ষোভ আর জেদ প্রকাশ পেল ওর কণ্ঠে। সে এখন আর শহর কমিটির কেউ নয়, সবাই একমত হয়ে তাকে বাদ দিয়েছি আমরা এবং সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে তাকে কখনোই কোন ব্যাপারে আর ডাকা হবে না।
শীতল দৃষ্টিতে ওকে দেখছে জাজ উইলসন হলেন। আমাদের সামনে একটা সমস্যা। সেটার সমাধান করাই আসল কথা, কিভাবে হলো তা দেখা কেবল। বোকামিই। তাছাড়া, রোয়ানা, মিলারের আউটফিটের সাথে বিতোমার নিজের সমস্যা, শহর কমিটি কেন তাতে পিছিয়ে যাবে?
বিমূঢ় দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। জাজকে বোঝার চেষ্টা করছে, আনমনে মাথা নাড়ল, হয়তো হতাশায়। তারপর ফিরল জেথের পানে।
দেয়ালে শরীর ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেথ, আগ্রহ নিয়ে দেখছে এবং শুনছে। রোয়ানার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতে ওর মনে হলো মেয়েটা হয়তো পরামর্শ চাইছে। কিন্তু জেরেমি মিলারের ব্যাপারে কিছুই জানা নেই ওর, এমনকি এর আগে নামও শোনেনি। রোয়ানাই এখানে ম্যাকলীনদের প্রতিনিধিত্ব করছে, ভাবছে জেথ, কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার হলে সে-ই নেবে। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার-জেরেমি মিলারের সহযোগিতা চাওয়ার সিদ্ধান্তটা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে জাজ এবং আর কেউ না হোক, রোয়ানা তা পছন্দ করতে পারছে না।
এতগুলো টাকা! ব্যাঙ্কারের কণ্ঠে আক্ষেপ। অন্তত এক লাখ। কারও ব্যক্তিগত অপছন্দের কারণে টাকাগুলো খোয়া যেতে দেয়া যায় না।
মি. হোল্ডেন, শুধু তোমার নয়, খানিকটা রুক্ষ শোনাল রোয়ানার গলা। মি. গ্রীন এবং আমারও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। লুট হওয়া টাকার বেশির ভাগই আমাদের দুজনের। এছাড়া ছোট ছোট র্যাঞ্চার, ব্যবসায়ী আর হোমস্টিডারদের টাকাও। আছে এতে।
এ টাকা তো আমাকেই ফিরিয়ে দিতে হবে।
সেজন্যে তোমরা একটা অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতে পারো না।
কি করে এটা অন্যায় হলল, তোমার পছন্দ হয়নি বলে? সরোষে রোয়ানাকে আক্রমণ করল ডগলাস গ্রীন। তোমার পছন্দের যথার্থতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমাদের। কয়েকটা বুড়ো ভামের সাথে ঘুরে বেড়াও-ঘরকুনো স্যাম জারভিস আর মদপোর এই থটনটা হলো তোমার বন্ধু! অথচ মিলারের মত সুদর্শন যুবকের সঙ্গ তোমার ভাল লাগে না, ওকে প্রতিবেশী হিসেবেও পছন্দ হয় না। এ কেমন পছন্দ?
হোটেল-মালিকের মন্তব্যে আহত বোধ করল রোয়ানা, গম্ভীর মুখে দেখল তাকে। তারপর কঠোর হয়ে গেল মুখ-জেদ আর প্রত্যয় সেখানে। ঠিক আছে, জেরেমি মিলারকে ডাকো। আমার আপত্তি নেই। আমি পদত্যাগ করলাম। শহরের কোন ব্যাপারে ম্যাকলীনদের আর কোন অধিকার থাকল না।
বসো, রোয়ানা! মেয়েটা ওঠার উপক্রম করতে জাজ প্রায় ধমকে উঠল, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো, এছাড়া আমাদের কি-ই বা করার আছে। মিলারের লোকগুলো ছাড়া এ শহরে এমন কে আছে যে আউটলদের সামনে দাঁড়াতে পারবে?
ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে রোয়ানা। তোমরা যা ইচ্ছে করো, আমি আর নেই এরমধ্যে। ম্যাকলীনদের ছাড়াও তোমাদের চলবে। জেরেমি মিলার তো আছেই!…একটা ব্যাপার না বলে পারছি না-আমার পিছু লেগেছে লোকটা, তাকে কোনমতেই ছাড়ব না আমি। ম্যাকলীনরা মরা এ শহরটাকে জ্যান্ত করেছে একসময়, তাদেরকে এখান থেকে হটানোর অধিকার নেই কারও। ওরা এখানেই থাকবে, কেউ যদি তাতে বাধা দিতে চায় তো সে বোকা আর দুর্ভাগা।
আমাদেরকে এসব বলছ কেন? বিরক্তি প্রকাশ পেল জাজের কণ্ঠে। তোমার দুশ্চিন্তার কারণটাও অহেতুক। হোয়াইটস্টোন থেকে কে তোমাদের সরাবে শুনি? মিলারের সাথে তোমার এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে দেশছাড়া করতে চাইবে সে। পাশাপাশি দুটো বাথানে এরকম হয়েই থাকে।
কথাগুলো ওই কপট লোকটার জানা দরকার, এজন্যেই তোমাদের বললাম। ঝটিতি ঘুরেই হাঁটতে শুরু করল রোয়ানা। পেছনে চারটে হতভম্ব মুখ, কেউ কিছু বলার আগেই বেরিয়ে গেল মেয়েটা।
জেথ খেয়াল করল জাজের প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে অপমানিত বোধ করছে। আমি বুঝতে পারছি না মেয়েটা এভাবে… হতাশায় কয়েকবার মাথা নাড়ল সে, কিন্তু শেষ করল না।
বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল রোয়ানা, জেথ বেরিয়ে আসতে হাঁটতে শুরু করল। মিল পর্যন্ত একটা কথাও বলল না।
ফেরার পথে দুটো ব্যাপার খেয়াল করেছে জেথ। কয়েকজনের উৎসাহী একটা দল লঅফিসের বাইরে অপেক্ষা করছিল, পাসির সদস্য হয়ে ডাকাতদের তাড়া করতে চাইছে। সব কজন নিরীহ গোছের, এদেরকে সঙ্গে নিয়ে থটনের সাফল্যের সম্ভাবনা কম। বড়সড় আরেকটা দল ব্যাঙ্কের প্রবেশমুখে জটলা করেছে, জুলিয়াস হোল্ডেনের পাওনাদার এরা। ব্যাঙ্কারকে খুজছে লোকগুলো।
অফিসে ফিরে নিজের চেয়ারে অনেকক্ষণ ঠায় বসে থাকল রোয়ানা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল জেথ, তেষ্টা পাওয়ায় স্টোভে পানি চড়িয়ে দিল। সময় নিয়ে কফি তৈরি করল। তীজা কফির ঘ্রাণে সংবিৎ ফিরল রোয়ানার, লাজুকভাবে হাসল। ধন্যবাদ, জেথ। দয়া করে এবার মনোযোগ দিয়ে শোনো, হালকাভাবে নিয়ো না। কফিতে চুমুক দিয়ে শুরু করল ও, চাচা এখানে বসতি করেছিল শান্তিপূর্ণ জীবনের আশায়, ওর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। প্রথম দুবছর চলে গেল বাথানটাকে দাঁড় করাতেই, এরপর মিলটা হলো। জেরেমি মিলার শুরু থেকে লেগে ছিল ওর পেছনে, মিল তৈরি হওয়ার সময় সরাসরি বাধা দেয় সে-চায়নি শহর বা তার কাছে মিলটা তৈরি হোক। এরপর থেকে হোয়াইটস্টোনে নতুন কিছু ঘটতে গেলে দুজনকে দুদিকে দেখা গেছে। আমি আসার পর সম্পর্কটা আরও খারাপ হয়েছে।
মিল আর বাথান চালাতে এমনিতে হিমশিম খাচ্ছিলাম, তারওপর উটকো ঝামেলা হিসেবে মিলার-দিশেহারা বোধ করলাম। গত গ্রীষ্মে রাউন্ড আপের সময় বাধল সত্যিকার গণ্ডগোল। আমাদের কয়েকটা গরুর গায়ে নিজের মার্কা বসাল সে। চাক্ষুষ প্রমাণ নেই, কাজটা শেষ হওয়ার পর আমার ফোরম্যান ওখানে, উপস্থিত হয় এবং চ্যালেঞ্জ করে ওর তিনজন কাউহ্যান্ডকে। বন্দুকযুদ্ধে ওদের একজন মারা পড়ল, আরেকজন আহত হলো। এর দুদিন পরেই নিখোঁজ হয়ে গেল ফোরম্যান লোকটা। কোন প্রমাণ নেই তবু আমি নিশ্চিত যে এটা মিলারের নোংরা হাতের কাজ।
এবার, সামনের রাউন্ড আপে ঝামেলা হবেই। শুরু থেকেই গরু হারাচ্ছিলাম আমরা-ঠিক রাউন্ড আপের সময়। আগে গোপনে হত কাজটা, কিন্তু এবার আর পরোয়া করবে না মিলার। কয়েকজন বন্দুকবাজ আনিয়েছে সে, সৎ উদ্দেশ্যে যে নয় তা পরিষ্কার। সাপ্লাই দুট হওয়ার পেছনে যদি ওর হাত থাকে একটুও অবাক হব না আমি।
এত ঝামেলা আর সমস্যার পর উপরি হিসেবে ব্যাঙ্কে ডাকাতির ব্যাপারটা যোগ হলো। ওখানে প্রচুর টাকা ছিল আমাদের। ক্ষতিটা কোনক্রমেই আর পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়, কারণ জুলিয়াস হোল্ডেন এক বছরের মধ্যেও টাকা শোধ দিতে পারবে না। এতটা সামর্থ্য ওর আর নেই। উল্টো সিটি ব্যাঙ্ক থেকে বিরাট অঙ্কের দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ পাবে ও। একসময় যদি পরিশোধ করার সুযোগ হয়ও, ততদিনে ভরাডুবি হয়ে যাবে। এখন যে-টাকা আমাদের হাতে আছে তাতে বাথান ও মিল চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। সবচেয়ে বড় কথা এখানে টিকে থাকতে হলে দুর্বল হওয়া চলবে না।
লুট হওয়া টাকাগুলো কেবল একটা উপায়ে পাওয়া সম্ভব-যদি আউটলদের ধরা যায়। একটা পাসি হয়তো ডাকাতগুলোর পিছু নেবে, কিন্তু শহরের আশেপাশের এলাকার যে অবস্থা তাতে বিফল হয়েই ফিরতে হবে। জাজ মনে করে মিলারের সাহায্য নিয়ে আউটলদের শায়েস্তা করা সম্ভব। কিন্তু সে এরমধ্যে আসবে কেন? এ ব্যাঙ্কে তার টাকা নেই, লাভ ছাড়া কে ঝুঁকি নেয়? হয়তো সাহায্য করবে ও, করলেও তাতে গৃঢ় কোন উদ্দেশ্য থাকবেই। নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করার লোক জেরেমি মিলার নয়। থামল রোয়ানা, অনবরত কথা বলায় হাঁপিয়ে উঠেছে। খেই ধরার আগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে কফি শেষ করল।
আমি নিজের তাগিদে ডাকাতগুলোকে ধরতে চাই। পাসি বা মিলারের আশায় বসে না থেকে নিজে মাঠে নামতে চাইছি। অন্যের চেয়ে নিজের ওপর নির্ভর করা কি ভাল নয়? জেথ, বাথানের পাঞ্চারেরা শহরের লোকের মতই শান্তি প্রিয়, তাছাড়া র্যাঞ্চিং ছাড়া অন্য কোথাও ওদেরকে ব্যবহার করার অধিকার আমার নেই। ওরা যা পারবে না, তাই করতে পারবে তুমি। টাকাটা উদ্ধার করা কঠিন হবে, কিন্তু দেখে-শুনে এগোতে পারলে আমরা সফল হব।
আমি দুঃখিত, জেথ। একটার পর একটা সমস্যার কথা বলে একদিনেই তোমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছি। এই মুহূর্তে আমার পাশে একজন নির্ভরযোগ্য লোকের থাকা প্রয়োজন। জোর করব না, তবে এ-ও ঠিক যে এগুলো তোমার নিজেরই সমস্যা। বাথান ও মিলের মালিক তুমিই, আমি নই।
রোয়ানা তাকিয়ে আছে, চোখজোড়ায় বিপুল প্রত্যাশা। জেথ টের পেল বাইরে থেকে যত শক্ত মনে হোক না কেন আসলে মেয়েটা তা নয়। দুবছর ধরে বাথান ও মিল চালিয়ে এসেছে, একটা সমর্থ পুরুষের কাজ সামলেছে, শুধু এ কারণে ওকে আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়ী মনে হয়েছিল। এখন আর তা মনে হচ্ছে না, ক্লান্ত-অসহায় দেখাচ্ছে। অবশ্য একেবারে ভেঙেও পড়েনি, এ মেয়ে সহজে হাল ছাড়বে না, ওর ধাতটা ভালই জানা আছে জেথের।
শক্ত কাজ, তায় একা, ভাবল জেথ্রো ম্যাকলীন। তাতে কি? পিছিয়ে যাওয়া ওর অপছন্দ।
ওহ্, জেথ! সম্মতি পেতে আনন্দে উজ্জ্বল হলো রোয়ানার চোখ-মুখ, দৃষ্টিতে খুশি উপচে পড়ছে। কি করে তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাব…
জেথ অনুভব করল সমস্যাগুলোকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে, নিজের করে ভাবছে রোয়ানা। একটা মেয়ে হয়ে এতদিন আমার দায়িত্ব সামলেছে, ভাবল জেথ, অথচ আমি দূরে থেকে কেবল এড়িয়ে গেছি। বোকামি হয়েছে এবং অনিন্দ্যসুন্দর এ মেয়েটাকে এত ঝামেলায়, কষ্টে ফেলা মোটেও উচিত হয়নি। এবার থেকে ঝামেলাবিহীন কাটবে ওর দিনগুলো, সিদ্ধান্ত নিল ও। দায়িত্ব নিতে ভয় পায় এমন লোকের ওপর যার এত আস্থা, এরকম সুবিধে পাওয়ার অধিকার সে রাখে। বৈকি।
***
পুমাস ক্যানিয়ন হোয়াইটস্টোন থেকে আড়াআড়ি ছয় মাইল দূরে, যেতে হলে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। অসংখ্য খাড়া পাহাড় আর গভীর সঙ্কীর্ণ উপত্যকার সহাবস্থান এমন যে পেরোনো দুঃসাধ্য। বেশিরভাগই শক্ত পাথরে গড়া, চোখা চাই আর খাড়াইয়ে পূর্ণ। প্রাণের চিহ্ন নেই বলতে গেলে, কদাচিৎ দুএকটা ক্যাকটাস। দেখা যায় শুধু।
সমতল একটা মেসায় উঠে আসার পর রাশ টানল বাক টার্নার। ধুলো উড়িয়ে তার পাশে থামল অন্যরা। স্যাডল বুটে দুহাতের ভর রেখে ফেলে আসা পথের ওপর নজর বুলাল টার্নার, খানিক বাদে প্রসারিত হলো তার ঠোঁটের কোণ। যা ভেবেছে-ধাওয়া করে আসছে না কেউ।
ওরা কি আসবে, বাক? ক্লিমের জিজ্ঞাসা।
আজ আর নয়, ঢালু প্রান্তর দিয়ে ঘোড়া ছোটাল তস্কর-নেতা। মেসা থেকে উৎপন্ন বিশাল রুক্ষ ঢাল মাইলখানেক তফাতে ক্যাপেশাস ক্যানিয়নের পাশে গিয়ে শেষ হয়েছে। এখান থেকে ওটার লালচে-বাদামী দেয়াল চোখে পড়ছে। ডানে পুমাস ক্যানিয়ন। যে ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে ওরা সেটা ঘুরপথের। দুটো কারণে এটা বেছে নিয়েছে টার্নার-ট্র্যাক পড়ার সম্ভাবনা কম এবং কোন পাসি যদি পিছু নেয়ও, দুর্গম প্রান্তর পাড়ি দিয়ে শেষাবধি পৌঁছার ধৈর্য রাখতে পারবে না।
পুরো প্রান্তরে লাগাতার সবুজের চিহ্ন কেবল ট্যালন ভ্যালিতে। তার পাশে অনুর্বর ক্রীক, শুকনো খটখটে। তলার শক্ত মাটি রোদ্দুরে ফেটে চৌচির। এরপর ওভম্যান মাউন্টেন। ওটার চুড়া তুষারাবৃত, দুধ-সাদা। এর উত্তরের ট্রেইল ধরে মাইল খানেক এগোলে পুমাস ক্যানিয়নের পার্শ্ব-মুখ-প্রবেশ পথ চোখে পড়বে। টার্নার যে কেন এখানে আশ্রয় নিতে চাইছে বুঝতে পারছে না স্লিম বেকার। তবে এ নিয়ে সে খুব একটা চিন্তিতও নয়।
গিরিখাতের সম্মুখ প্রান্তরটি মোটামুটি সমতল হলেও ভেতরটা তারচেয়ে দুর্গম। সর্বত্র বিশাল বোন্ডার ও পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ত্রিশ গজের মত আসার পর ঢালু হতে শুরু করল ট্রেইলটা, তাতে বালি আর ঘোট ঘোট নুড়ি পাথর। পাশে নিচু একটা জায়গায় বৃষ্টির পানি জমেছে।
ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠল চলার পথ। দশ মিনিটের মাথায় খাড়াইয়ে উঠে এল দলটা। কোনরকমে টিকে আছে কয়েকটা জওয়া, বিবর্ণ হয়ে গেছে ওগুলোর পাতা। এমন পরিবেশে টিকতে পারে কেবল ক্যাকটাস।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়, ঘোড়া থামিয়ে ঘোষণা করল টার্নার, রাতে এখানেই থাকছি। স্যাডল ছেড়ে কাপড়ে লেগে থাকা ধুলো ঝাড়ল প্রথমে, তারপর স্যাডল ব্যাগ হাতে গিয়ে বসল একটা পাথরের ওপর।
একটু পর রান্নার আয়োজনে বসল লেইভ পিটার্স। ক্যাকটি ঝোঁপের পাশে আগুনের কুণ্ডটাকে ঘিরে বসেছে তিনজন। কার্লি গেছে পেছনের শৈলশ্রেণীতে, এ বেলা নজর রাখার দায়িত্ব তার। ডরম্যান ও পিট ঘোড়াগুলোর যত্ন সেরে এসে যোগ দিল অন্যদের সাথে। নিজেদের শেষ সম্বল নিয়ে পোকার খেলতে বসেছে ওরা। হাতে হুইস্কির বোতল নয়তো কফির মগ। লেইভ পিটার্স সবার জন্যে পাইকারি হারে সিগারেট রোল করে চলেছে, প্রতিটির জন্যে সে পাচ্ছে পঁচিশ সেন্ট। আজকের দিনটা চিন্তা করলে তা মোটেও বেশি নয়।
এখন পর্যন্ত খেলায় জিতছে টার্নার ও ডরম্যান। সাপারের পর অবশ্য পরিস্থিতি বদলে গেল। বাক টার্নার যখন টের পেল তার নিজের পকেট থেকে দুই ডলার গচ্ছা গেছে, খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। বোর্ডে পাঁচ ডলার ফেলে দানবটা জিতে নিলেও খুশি হতে পারল না। বিরক্তি চেপে উঠে পড়ল ও, দিনের শেষ সিগারেট ধরিয়ে বেডরোল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। শিয়রের পাশে রাখল টাকার থলেটা, নিশ্চন্ত বোধ করছে।
টাকাগুলো ভাগ করবে কখন? জানতে চাইল পিটার্স।
সকালে। নাখোশ হলেও তা চেপে রাখল টার্নার।
কত আছে?
লাখের কিছু বেশি হবে।
মুখের ওপর হ্যাট চাপানোর আগে স্লিমকে ডাকল টার্নার।
ঘুরে তাকাল দুর্বৃত্ত, খেলায় মন নেই।
মাঝ রাত পর্যন্ত তোমার পালা, স্লিম, ঘুম জড়ানো কণ্ঠে নির্দেশ দিল টার্নার। কোন গাফিলতি চাই না। তোমার পর পিটকে জাগিয়ে দেবে, ভোর থেকে ডরম্যানের পালা।
ঠিক আছে, বাক, হাসল স্লিম। সঙ্গীদের পানে তাকাল, আড়চোখে একবার দেখে নিল টাকার থলেটা। এক লাখ ডলারের চেয়ে ঝুঁকিটা মোটেই বেশি নয়, ভাবছে ও, বাক টার্নার যত ভয়ঙ্কর লোকই হোক-হারবে এবার।
মিনিট দশ পর আসর ভাঙল। অন্যরা যখন শোয়ার আয়োজন করছে রিপিটার হাতে শৈলশ্রেণীর দিকে এগোল স্লিম বেকার। কার্লি ছিল সেখানে, তাকে, পাঠিয়ে দিয়ে বোল্ডারের পাশে বসে পড়ল। চারপাশে নজর বুলাল কিছুক্ষণ, মনোযোগ রাখতে পারছে না। নিজের অতীত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বেকার। টার্নারের দলে যোগ দেয়ার আগে খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছে ওর জীবন। তারও আগে তরুণ বয়সে, একেকটা দিন কি করে কাটবে এ নিয়ে ভাবতে হত। এখন, সবার মত যে বখরা পায় অপচয় না করলে এতদিনে তা লাখের কাছে গিয়ে ঠেকত। কিন্তু নিজেকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে সঞ্চয়ে বিশ্বাস নেই ওর। ওটা বোকা আর কৃপণদের কাজ।
অন্তত এক লাখ ডলার! ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না। নিউ ইয়র্কে গিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারে কিংবা অন্য কেথাও যেখানে বাক টার্নারের শকুনে দৃষ্টি প্রসারিত হবে না। হ্যাঁ, ভাবছে স্লিম বেকার, কেবল একটা কাজই করতে হবে। বিধ্বস্ত পশ্চিমে থাকার প্রয়োজন তাহলে ফুরিয়ে যাবে, নোংরা কাপড়ের বদলে পরবে দামী কাপড়, বড় বড় অনুষ্ঠানে থাকবে তার অবাধ চলাফেরা। আশেপাশে ঘুরঘুর করবে সুন্দরীরা। প্রাসাদোপম বাড়িতে রাজার হালে দিন কাটবে। সত্যি রোমাঞ্চকর!
কঠোর হস্তে ভাবাবেগ দমন করল বেকার। বাক টার্নার বড্ড ভয়ঙ্কর মাষ! ধরা পড়লে পৈত্রিক প্রাণটা খোয়াতে হবে। ভয়ে শুকিয়ে এল ওর গলা। তার পর মনে হলো-তাকে ধরতে পারলে তো? সকালে টার্নার যখন টের পাবে ততক্ষণে অনেক দূরে চলে যাবে সে, আয়ত্তের বাইরে। বাক টার্নার কেন, তখন স্বয়ং শয়তানও ওর টিকিটি ছুঁতে পারবে না।
একঘণ্টা বাদে নিশ্চিন্ত হয়ে ক্যাম্পে ফিরে এল বেকার। ঘুমন্ত টার্নারের পানে এগোল। এরই মধ্যে ঘেমে গোসল করে ফেলেছে। থলেটা যখন হাতে নিল আতঙ্কে পা ফেলতে পারল না। মনে হচ্ছে এখুনি জেগে উঠে গলা চেপে ধরবে তস্কর-নেতা, দৈত্যাকার হাতে ভবলীলা সাঙ্গ করার আগে ভসনার সুরে বলবে: গাধা, কখন কিভাবে চুরি করতে হয় তাও জানো না!
থলেটা নিয়ে সরে এসেও নিশ্চিন্ত হতে পারল না স্লিম। মনে হচ্ছে আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ করছে কেউ। একে একে সবার ঘুমন্ত মুখগুলো খুঁটিয়ে দেখল। ও। তারপর পিছিয়ে ঘোড়াগুলোর কাছে এসে সবচেয়ে তেজীটায় স্যাডল চাপাল। এটা তাকে একটানা অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
অনেকটা পথ ঘোড়াকে হটিয়ে নিয়ে এল স্লিম, তারপর স্যাডলে চাপল। পুমাস ক্যানিয়ন কানা বলে বেরোবার পথ একটাই। গিরিখাত থেকে বেরিয়ে আসার পর কিছুটা সুস্থির বোধ করলেও টার্নারের ভূত মাথা থেকে নামেনি এখনতক। থেমে ক্যান্টিন থেকে পানি পান করল দুবৃত্ত। কত সহজে শেষ হলো কাজটা, ভাবল সে, অযথাই ভয় পাচ্ছিল।
প্রথম গুলিটা সরাসরি তার কপালে ঢুকল, পরেরটা বুকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা গেল তস্কর। থমকে দাঁড়িয়েছে ঘোড়াটা। ত্রিশ গজ দূরের ঝোপ। থেকে বেরিয়ে এল স্লিমের আততায়ী। দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে চলে এল মৃতদেহের পাশে। স্যাডল ব্যাগ থেকে থলেটা বের করে নিশ্চিন্ত হলো সে। তৃতীয় গুলি ছুঁড়ে এবার ঘোড়াটার প্রাণ হরণ করল লোকটা। তারপর ঝোঁপের দিকে ফিরে চলল। লুকিয়ে রাখা ঘোড়ায় চেপে পরিতৃপ্তির সাথে একটা সিগার ধরাল। ঠিক যা যা ভেবেছে, তা-ই হয়েছে।
.
হোয়াইটস্টোনের লোকেরা বেশিরভাগই রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে, নয়তো সেলুনে বসে আড্ডা মারছে। পাসির ফেরার অপেক্ষায় আছে সবাই। বিকেলে লঅফিসের সামনের রাস্তায় ছোটখাট একটা সভা হয়ে গেছে, পাসিতে যোগ দেয়ার জন্যে সাহসীদের আহ্বান করেছিল জাজ উইলসন হলেন। হাতে গোণা কয়েকজন এগিয়ে এসেছিল। ডীন থর্টন আনাড়ী লোকগুলোর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার পরপরই শহর ছাড়ে দলটা।
সন্ধ্যার একটু আগে বাথানে ফিরে গেছে রোয়ানা। চেয়েছিল জেথও সাথে যাক, কিন্তু রাজি হয়নি জেথ। থটন কতটুকু করতে পারে জেনে যাওয়াই ওর শহরে থাকার কারণ।
দুঘণ্টা পর ব্যর্থ হয়ে ফিরল লোকগুলো। লঅফিসের উল্টোদিকে ছোট্ট ক্যাফেতে বসে তখন সবে সাপার শেষ করেছে জেথ, সামনে ধূমায়িত কফির মগ। উৎসাহী লোকজন হেঁকে ধরল পাসির ক্লান্ত মানুষগুলোকে, বিশেষ করে থর্টনকে। কিছু না বলে অফিসে ঢুকে দরজা আটকে দিল মার্শাল, তীব্র গাল বল কেউ। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল জাজ, থর্টন দরজা খুলতে ডগলাস গ্রীনকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
সিগারেট রোল করল জেথ। এখানকার কয়েকটা ব্যাপার অস্পষ্ট লেগেছে ওর কাছে। রুক্ষ পশ্চিমের যে কোন শহর ঝামেলামুক্ত রাখতে হলে আইনের হাতকে শক্ত হতে হয়, অথচ এখানে আইনের অস্তিত্ব বলতে গেলে নেইই। ডেপুটি ছাড়া বুড়ো একজন মার্শালের পক্ষে আর কতটুকু করা সম্ভব?
যতটুকু বোঝা যাচ্ছে রোয়ানার সাথে শহর কমিটির অন্যান্যদের সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে। ওদের কাউকে সুস্থভাবে চিন্তা করতে দেখেনি জেথ, নিজেদের দ্বন্দু নিয়েই বেশি ব্যস্ত। জেরেমি মিলারের প্রসঙ্গ আসায় রোয়ানা হঠাৎ এভাবে খেপে গেল কেন? ওর কথায় মনে হয়েছে মিলারের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এদের কারও, কিংবা সবারই। শহরে লোকটার কর্তৃত্ব ছিল একসময়, এখন না থাকলেও কমিটির সদস্যদের ওপর তার প্রভাব থাকতে পারে। হয়তো সে কারণে এদের কাউকেই পছন্দ করে না মেয়েটা। তেমন হলে অবশ্য ওকে দোষ দেয়া যায় না। শত্রুর বন্ধু শত্রুর মতই।
কফি শেষ করে লঅফিসের ওপর আরেকবার নজর বুলাল জেথ। ভিড় লেগে আছে এখনও। বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল ও। হিচ রেইলে বাঁধা ছিল গ্রে-টা, স্যাডলে চেপে দক্ষিণে এগোল। শহরে থেকে আর লাভ নেই। বিশ্রাম দরকার। টানা কদিন ধরে ছোটার মধ্যে আছে। মিল পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই বাথানে। যাওয়ার ট্রেইল পড়বে।
অন্ধকার রাস্তা। বেশিরভাগ বাড়িতে আলো নিভে গেছে। গির্জার কাছে চলে এসেছে ও, হঠাৎ করে ঘাড়ের পেছনে শিরশিরে অনুভূতি হলো। বিপদ!
কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্ধকার কুঁড়ে বেরিয়ে এল চারজন। এদের তিনজনকে দুপুরে লুইফের সেলুনে দেখেছে। আমাদের সাথে এসো, অচেনা লোটা, বিশালদেহী বলল, জেথের কানে সেটা আদেশের মত শোনাল। বেচাল দেখলেই গুলি করব। মনে রেখো আমরা চারজন।
একটা সুযোগ এখনও নেয়া যায়, ভাবল জেথ, কিছু বোঝার আগে দুজনকে পেড়ে ফেলা যাবে…অন্যরা? নাহ, বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে যায়। তারচেয়ে এদের সাথে যাওয়াই ভাল, সিদ্ধান্ত নিল ও, পরে কোন সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।
জেরেমি মিলারের সাথে কি এদের কোন সম্পর্ক আছে?
গির্জার পাশে খোলা জায়গা। পেছনে কয়েকশো গজ দূরে পাহাড়ের আবছা অবয়ব। খোলা জায়গাটায় ঢুকে পড়ল ওরা। চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে জেথকে। ভবিষ্যৎ বা গন্তব্য নিয়ে ভাবছে না জেথ। চারজনে মিলে যখন গার্ড অভ অনার দিচ্ছে তা ব্যাপারটা গুরুতর।
মিনিট দশ পর থামল ওরা। জেথ ধারণা করল একটা স্টোরের পেছনে উপস্থিত হয়েছে। সামনের দরজা গলে মৃদু আলো এসে পড়েছে বাইরে।
এবার সিংহাসন থেকে নামো, মি, ডাষ! ব্যঙ্গ করল বিশালদেহী।
অন্যরা হেসে উঠতে রাগে পিত্তি জ্বলে গেল জেথের। নিজেকে সামলে নিয়ে স্যাডল ছাড়ল। গ্রেটার কেশরে হাত বুলাল, ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবে ঘোড়াটা।
কোল্টের নল দিয়ে ওর পিঠে গুতো মারল একজন। ভেতরে ঢুকল জেথ। একটা স্টোর রূমে উপস্থিত হয়েছে। বিশাল কামরার অর্ধেকটা জুড়ে অনেকগুলো বাক্স সাজিয়ে রাখা। শেষ মাথায় কাঠের সিঁড়ি। ফের কোল্টের খোঁচা মেরে ওকে উপরে ওঠার ইঙ্গিত করল লোকটা।
দোতলায়, বারান্দায় উঠে এল জেথ। দরজার কাছে দেখতে পেল আরেকজনকে, হাতে শটগান। কামরাটার দরজায় স্বচ্ছ কাপড়ের পর্দা ভেদ করে ভেতরের আলো মেঝেতে এসে পড়েছে। ইতস্তত করার সুযোগ পেল না জেথ, বিশালদেহীর ধাক্কায় ভেতরে ঢুকতে হলো।
গোছানো কামরা। মাঝখানে বিশাল গোলাকার টেবিল, গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি করা হয়েছে। চারপাশে কয়েকটা চেয়ার। এক কোণে ছোট শেলফের ওপর কাগজপত্র। উল্টোদিকে, তাকে হুইস্কির ঝকঝকে বোতল আর সুদৃশ্য গ্লাস। জানালার পর্দাগুলো নামানো। ছাতের সাথে ঝোলানো লণ্ঠন সারা ঘরে মিষ্টি আলো বিলাচ্ছে। এছাড়াও কোণের ঘোট একটা টেবিলে কয়েকটা মোম জ্বলছে।
এ ঘরের মালিক, অভিজাত সন্দেহ নেই, ভাবল জেথ। সে, দরজার উল্টোদিকে জানালায় অন্ধকার বা পাহাড়শ্রেণী দেখছে। আসলে কি তাই? ওর মনে হলো নিজের ভাবমূর্তি গড়তে চাইছে। অনুমতির তোয়াক্কা না করে হাতলহীন একটা চেয়ারে বসে পড়ল, এমনভাবে যাতে প্রয়োজনে অনায়াসে ড্র করা যায়।
ধীরে ঘুরল লোকটা। তাকে আর্ল বা সিনেটরের মত মনে হলো, চেহারা ও পরিচ্ছদে। কিন্তু জেথের কাছে একটা ধেড়ে শয়তান ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে অফার করল সে, মাথা নেড়ে প্রত্যাখ্যান করল জেথ।
তুমি নাকি শুনতে পাও? সন্দেহ নেই এটা একটা দারুণ ব্যাপার। মুখ খুলল সে। সিগার ধরাল এবার, মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল সারা ঘর।
তাকিয়ে আছে জেথ, জানে খোশ-গল্প করার জন্যে ওকে ধরে আনা হয়নি।
জেথ্রো ম্যাকলীন, বুড়ো ম্যাকলীনের একমাত্র বোবা ছেলে এবং সম্ভবত দুঃখী, জিভ আর টাকরা সহযোগে চুক চুক শব্দ করল লোকটা, করুণ দেখাচ্ছে মুখ। নিজের অক্ষমতার দুঃখে যে ঘরছাড়া হয়েছে। সনোরার লোকেরা তোমাকে নিয়ে মজা করত, কাজটা অমানবিক কিন্তু তারা তো আর কোমাঞ্চিদের মত তোমার অঙ্গহানি করেনি কিংবা তোমার মা-কে রক্ষিতা বানায়নি।
মেজর ম্যাকলীন, তোমার বাবা, বড় একগুঁয়ে লোক, আলাপী ঢঙে বলে চলেছে সে, সত্যিই যেন খোশ-গল্প করছে। ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশনে যখন দায়িত্ব পালন করছিল, বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি কোমাঞ্চিদের। পাল্টা আক্রমণ করল ওরা, তোমার মা আর তোমাকে তুলে নিয়ে গেল। আহা, ছয়টা বছর কি নির্যাতনই না চালানো হয়েছে তোমার ওপর। মিসেস ম্যাকলীনের দুর্ভাগ্য কোমাঞ্চিদের সোহাগ। সে বেশিদিন পায়নি, বছর পেরোনোর আগেই পটল তুলেছে। আর তুমি, অসীম ধৈর্য ধরে সইলে ওদের আদর। তারপর বেরিয়ে এলে কোমাঞ্চিদের গ্রাম ছেড়ে, পেছনে নিজের জিভটা ফেলে-মর্মান্তিক!
কি বলা যায় লোকটাকে, ভাবছে জেথ-পিশাচ? না হলে কেউ এভাবে তামাশা করে?
কোমাঞ্চিদের বদান্যতায় একটা পা হারিয়েছে তোমার বাবা, আর তুমি হারিয়েছ জিভ, থেমে গ্লাসে চুমুক দিয়ে ফের শুরু করল সে। সবাই মিলে ভর করেছ অবলা ঘুড়িটার ওপর। কি করতে পারবে ও? পশ্চিমে দুর্বলের জায়গা নেই, আমার সাথে টক্কর দেয়ার দুঃসাহস তোমাদের মোটেও মানায় না।
শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বলছে, অনুভব করল জেথ। লোকটার টুটি চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে। এ-ও জানে সেটা ঠিক হবে না, অযথা বিপদ ডেকে এনে কি লাভ। তার হাতের কাছে নিশ্চয়ই অস্ত্র আছে, আর বাইরে দুএকজন তো আছেই। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিল ও। প্রতিজ্ঞা করল প্রথম সুযোগেই মনের আয়েশ মিটিয়ে পেটাবে লোকটাকে। এমনও বে মারবে যাতে অন্তত কয়েকটা দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয়।
সম্ভবত এ লোকই জেরেমি মিলার, ধারণা করল জেথ। ধূর্ত, কুশলী এবং কপট। শত্রু হিসেবে এরা শক্তপাল্লা।
ছুঁড়িটা আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে! কদিন আগেও বেড়ালের মত সরে থাকত, এত সাহস পেল কি করে? হাসল সে, জেথের চোখে চোখ রাখল। তুমি, তাই না? কিন্তু এতটা ভরসা করা কি ঠিক হয়েছে যেখানে আমি প্রতিদ্বন্দীকে দুর্বল দেখতে পছন্দ করি? মি. ম্যাকলীন, ফিরে আসা কি তোমার ঠিক হয়েছে? দুদিন পর ট্রেইলে পড়ে থাকবে তোমার লাশ, শকুন খুবলে খাবে ম্যাকলীনদের ভরসাকে। বুড়ো কি এ আঘাত সইতে পারবে?
পকেট থেকে তামাক ও কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল জেথ, সময় নিয়ে ধীরে আয়েশ করে ধরাল। মুখের চেহারার অভিব্যক্তি শান্ত, বিকারহীন, মিলারের হুমকিতে যেন ওর কিছু আসে যায় না।
প্রস্তুত থেকো, ম্যাকলীন, তোমার এ সাহস ধুলোয় মিশিয়ে দেব আমি! রাগে শক্ত হয়ে গেছে লোকটার মুখ, চোখে ঘৃণা। খানিক আগের আয়েশী ভাবটা উধাও হয়েছে। গ্লাসে চুমুক দিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল যেন এখুনি ঝাপিয়ে পড়রে ওর ওপর। আবার যখন দেখা হবে, তুমি বেঁচে থাকবে না, ম্যাকূলীন!
টেবিলের ওপর কাঠের একটা ছাইদানি ছিল, ওটা টেনে নিয়ে ছাই ঝাড়ল। জেথ। ক্ষীণ হাসি লেগে আছে ওর ঠোঁটে, সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মৃদু মাথা ঝাঁকাল। তারপর তাকাল মিলারের দিকে, দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা। ভঙ্গিটা এমন যেন জানতে চাইছে লোকটার আর কিছু বলার আছে কিনা।
মনে কোরো না তোমাদের খুব পরোয়া করি আমি, শীতল শোনাল জেরেমি মিলারের গলা। ইচ্ছে করলেই দুদিনের মধ্যে তাড়াতে পারি। কি আছে তোমাদের, ওই জমিটা ছাড়া? ওটাই চাই আমার! শেষ সুযোগ দিচ্ছি, সময় থাকতে কেটে পড়ো, নইলে প্রাণসহ সব হারাবে। থেমে নিভে যাওয়া সিগার ধরাল, কিছুটা শান্ত দেখাচ্ছে এখন তাকে। পঁচিশ হাজার পর্যন্ত দিতে রাজি আছি, এর এক পয়সাও বেশি না।
টেবিলে কাগজ-কলম ছিল, টেনে নিয়ে লিখল জেথ: কোন গরু চোরের কাছে। ম্যাকলীনরা জমি বিক্রি করবে না।
জেরেমি মিলার যেন ফেটে পড়বে, রাগে লাল হয়ে গেছে ফর্সা মুখ। ঝটিতি হাত বাড়াল ড্রয়ারের দিকে। তৈরিই ছিল জেথ, জানত এরকম কিছু হতে পারে। মিলার ড্রয়ার থেকে হাত বের করার আগেই সিক্সগানের নলে তাকে নিশানা করল। চুপসে গেছে সে, কিছুটা বিস্মিতও। ধীরে খালি হাত বের করে আনল।
এর জবাব তুমি পাবে, ম্যাকলীন। তোমাদের কেউই পার পাবে না।
মাথা ঝাঁকাল জেথ। সহসা টের পেল পেছনে দরজার পর্দা সরে গেছে। প্রায় সাথে সাথে শটগান কক করার শব্দ হলো। ইত্যবসরে সহজেই গুলি করতে পারত মিলারকে, কিন্তু নিরস্ত্র সে। মুহূর্তের ব্যবধানে, ওর মনোযোগ সরে গিয়েছিল, পেছন থেকে গুলি করল কেউ। বদ্ধ ঘরে বোমা ফাটল যেন, ছাতের লণ্ঠন নিভে গিয়ে আছড়ে পড়ল টেবিলের ওপর। মোমের ম্লান আলোয় দেখা গেল না মিলারকে, টেবিলের ওপাশে বসে পড়েছে।
পরিস্থিতি বিচার করল জেথ-লণ্ঠনটা পড়েছে পিস্তলের গুলিতে, তারমানে শটগানঅলা ছাড়াও আরেকজন আছে। নাহ্, কোন সুযোগ নেই। ধীরে সিক্সগানটা হাত থেকে ছেড়ে দিল ও, গাল দিল নিজেকে। প্রথম সুযোগেই মিলারকে গুলি করা উচিত ছিল।
উঠে দাঁড়িয়েছে জেরেমি মিলার, মুখটা হাসিতে উদ্ভাসিত। হাতে একটা কোল্ট শোভা পাচ্ছে। দুঃখিত, মি. ডাম্ব! দেখতেই পাচ্ছ পরিস্থিতি তোমার অনুকূলে নেই। কোন ঝামেলী চাই না আমি। বোকামি কোরো না, তোমাকে গুলি করতে আমার হাত একটুও কাপবে না।
হাসল জেথ, মিলার ঠিকই বলেছে-তার পক্ষে সবই সম্ভব।
ওরা তোমাকে পৌঁছে দেবে, ম্যাকলীন। আর, শেষবারের মত বলছি, আমার সাথে লাগতে আসবে না। ওই জমিটা বেচে দিয়ে কেটে পড়াই ভাল হবে তোমাদের জন্যে। এক টুকরো জমি আর কয়েকটা গরুর দাম কি প্রাণের চেয়ে বেশি? আমি আরও দুটো দিন দেখব, তারপর খেলা শুরু হবে। হাসল মিলার, চোখ দুটো দেখে জেথের মনে হলো লোকটা উন্মাদ বা তার কাছাকাছি।
বেরিয়ে এল জেথ। পেছনে শটগানঅলা মাজল চেপে ধরেছে ওর শিরদাঁড়ার ওপর। অন্য লোকটা ভেতরে রয়ে গেছে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসতে দেখতে পেল ওদের। নিমেষে ওকে ঘিরে ফেলল লোকগুলো।
প্রথম আঘাতটা এল পেছন থেকে, কিছু টের পাওয়ার আগেই। প্রচণ্ড ঘুসিতে মনে হলো মেরুদণ্ড বোধহয় খুঁড়িয়ে গেছে, টলে উঠল শরীর। আঘাতের চোটে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে জেথ। ঝাঁপসা দৃষ্টিতে দেখল নাক বরাবর ছুটে আসছে একটা মুঠি, সরতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। ঘুসিটা ওর নাক থেঁতলে দিল, যন্ত্রণায় দিশেহারা বোধ করছে। টের পেল নাক থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। সামলে নেয়ার সুযোগ পেল না জেথ, পেটে মোম একটা ঘুসি পড়ায় চাপা আর্তনাদ করে উঠল। মনে হলো ফুসফুস খালি হয়ে গেছে, বাতাসের জন্যে হাঁস-ফাস শুরু করলেও পরের ঘুসিটা কোন রকমে এড়াতে পারল। ঝাঁপসা দৃষ্টিতে দেখল লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে বুকে পড়েছে সামনের লোকটা। সুযোগটা ছাড়ল না জেথ, আঘাত করল। তেমন যুৎসই না হলেও নাক ফেটে গেল লোকটার, নাক চেপে ধরে বসে পড়ল সে। সময় ব্যয় না করে এবার পা চালাল জেথ। ছিটকে গিয়ে মেঝের ওপর পড়ল লোকটা।
আরেকটা আঘাত করার তীব্র ইচ্ছে ছিল, পারল না পেছনের লোকটার জন্যে। শটগানের মাজল দিয়ে ওর কাঁধে আঘাত করল সে, জেথের কাছে মনে হলো অবশ হয়ে গেছে শরীরের ডান পাশ। চারপাশ থেকে এবার একের পর এক ঘুসি আসতে লাগল, কোন বাধাই দিতে পারল না জেথ।
আঁধার হয়ে আসছে সব। মেঝেয় লুটিয়ে পড়ার পরও মারতে থাকল ওরা, কিন্তু মাথায় আঘাত করছে না। জেথ অনুভব করল খুব বেশি হলে আর কয়েকটা মিনিট টিকতে পারবে। অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে সারা শরীর, মাংসপেশীগুলো বোধহয় সব থেঁতলে গেছে।
একসময় টের পেল আর মারছে না। টেনে হিচড়ে ওকে বাইরে এনে ফেলল দুজন। শেষ আঘাতটা করল কানের পাশে, জ্ঞান হারাল জেথ।
মুখে খসখসে একটা অনুভূতি চেতনা ফিরিয়ে আনল জেথ্রো ম্যাকলীনের। চোখ খুলে দেখতে পেল ওর জ্ঞান ফেরাতে এভাবেই চেষ্টা করছে গ্রে-টা। উদ্দেশ্য সিদ্ধি হওয়ায় সরে গেল ঘোড়াটা। পড়ে থেকে শক্তি সঞ্চয় করল ও।
মাথার ওপর মেঘে ঢাকা আকাশ, খণ্ড খণ্ড মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে। জেথ ধারণা করল মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। ফুরফুরে বাতাস প্রশান্তি এনে দিল শরীরে। বিন্দুমাত্র সাড়া নেই কোথাও। নডতে যেতে সব কিছু মনে পড়ে গেল ওর। জীবনে এরচেয়ে বেশি মার খেয়েছে কিনা মনে করতে পারল না। কৈশোরে, কোমাঞ্চি গ্রামে আটকে থাকার সময়, ওর জিভ কেটে নিয়েছিল কোমাঞ্চি। তাদের হাতে মার খাওয়ার সময়ও এতটা অসহায় বোধ করেনি, যতটা আজ অনুভব করেছে।
বেশ কসরত করার পর স্যাডলে চাপল জেথ। শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। জনশূন্য রাস্তার ওপর শুয়ে পড়ার ইচ্ছে বহু কষ্টে সামলে রেখেছে, নরম একটা বিছানার জন্যে মন হাহাকার করছে। নিজ থেকে ফিরতি পথে এগোচ্ছে গ্রে-টা, ঘোড়ার ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই ওর। আসলে স্যাডলে বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। এক সময় খেয়াল করল মূল রাস্তায় চলে এসেছে।
শরীরে শক্তি পাচ্ছে না জেথ, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ওর মনে হলো পাজরের একটা হাড়ও বোধহয় আস্ত নেই। হুড়মুড় করে স্যাডল থেকে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। একরাশ ধুলো এসে লাগল মুখে। ফের স্যাডলে চাপতে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মত জ্ঞান হারাল জেথ।
০৩.
কারও হাঁটার শব্দে ধীরে চোখ মেলল জেথ। কোথায় আছে জানে না, কিন্তু আরামদায়ক একটা বিছানায় যে শুয়ে আছে এটা বুঝতে পারছে। মাথার ওপর চুনকাম করা ছাত, মিলছে না-খোলা আকাশ থাকার কথা, ভাবল সে। মনে পড়ল: একটা স্টোরে নিয়ে গিয়ে ওকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়েছে চারজন। প্রায়। মাঝরাতে একটা আশ্রয় খুজতে মূল রাস্তায় চলে এসেছিল, সম্ভবত ডগলাস গ্রীনের গ্রীনস প্যালেসই ওর লক্ষ্য ছিল। কিন্তু পৌঁছতে পারেনি।
পাশ ফিরতে উদ্বিগ্ন একটা মুখ চোখে পড়ল-রোয়ানা। চোখাচোখি হতে হাসল, তারপর শিয়রে বসে ওর কপালে হাত রাখল। জেথের মনে হলো গতরাতের ঘটনা জানতে চাইবে মেয়েটা, তা না করে কামরার একপাশে চলে গেল। ফিরে এল খাবার নিয়ে। পিঠের নিচে দুটো বালিশ গুঁজে দিয়ে আধ-শোয়া করে বসাল ওকে। দেহভঙ্গি বদলানর সময় শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হলেও ভাল লাগছে এখন।
যত্ন নিয়ে ওকে ভরপেট খাওয়াল বোয়ানা। কয়েকটা বড়ি খাইয়ে ছোট একটা গামলায় গরম পানি, তুলো এবং নরম এক টুকরো কাপড় নিয়ে এল এরপর। তোমার ভাগ্য ভাল, ক্ষতগুলোর পরিচর্যা করার সময় বলল মেয়েটা। শরীরের কোন হাড় ভাঙেনি। কয়েক জায়গায় অবশ্য মাংসপেশী থেঁতলে গেছে। তবু সেরে উঠতে অল্প কটা দিন লাগবে।…ভাবতেই পারিনি এত তাড়াতাড়ি হামলা করবে ওরা। আমি জানি কে আছে এসবের পেছনে…খুব শিগগিরই পাওনা বুঝে পাবে সে। প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় দেখাল ওর চোখ-মুখ।
অপরাধবোধে ভুগছে রোয়ানা, শুধু শুধুই। ওর নিজের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল, ভাবল জেথ। সহানুভূতি আর পরিচর্যার জন্যে রোয়ানার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করছে।
গ্রীনস প্যালেসের দোতলার একটা কামরায় আছ তুমি। রাতে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তোমাকে এখানে নিয়ে আসে দুই মাতাল ভবঘুরে। সকালে এসে জেনেছি আমি। খবর পেয়ে চাচা এসেছিল, তোমার এ দুরবস্থার জন্যে একচোট বকেছে আমাকে। উঠে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দিল রোয়ানা যাতে বাইরের আলো এসে জেথের চোখে না পড়ে। এবার বিকেল পর্যন্ত টানা ঘুমোবে, ডাক্তার পিকার্ড আসবে তখন। নির্দেশের মত শোনাল, যদিও বলছে সহাস্যে।
দুর্বল শরীরে টানা ঘুমাল জেথ। জেগে দেখল কামরার একমাত্র টেবিলটা খাটের পাশে সরিয়ে আনা হয়েছে। লণ্ঠনের আলোয় অন্ধকার দূর হয়নি পুরোপুরি। বুকের ওপর দুহাত বেঁধে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে রোয়ানা। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। ক্লিষ্ট হেসে খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। আগের মত উঠে বসতে সাহায্য করল। মাথায় খানিক যন্ত্রণা ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও অসুবিধা হলো না জেথের, অনেকটা সুস্থ লাগছে। খাবার বিস্বাদ লাগলেও পেট পুরে খেল। যত দ্রুত সম্ভব বিছানা ছাড়ার ইচ্ছে ওর, সেজন্যে সবার আগে হারানো শক্তি ফিরে পেতে হবে।
নিয়ম মাফিক ওষুধও গিলতে হলো। শেষে কফির পেয়ালা হাতে ধরিয়ে দিল রোয়ানা। নিজেও নিয়েছে। পানীয় শেষ করে শুয়ে পড়ল জেথ। ঘরের অখণ্ড নীরবতাটুকু ভাল লাগছে।
পাতলা একটা কম্বল ওর গায়ের ওপর চাপিয়ে দিল রোয়ানা। ঠিক দশটায় জাগাব, তার আগে যেন ঘুম না ভাঙে।
চোখ বোজার পর মুখে কোমল হাতের ছোঁয়া পেল জেথ। গরম পানিতে ভেজা তুলো দিয়ে ক্ষতগুলো পরিষ্কার করছে রোয়ানা, পুরানো ব্যান্ডেজ খুলে নিয়েছে তার আগে। অজানা একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল জেথের শরীরে। চোখ খুলে দেখতে পেল ঝুঁকে কাজ করছে মেয়েটা, পুরোমাত্রায় মনোযোগী। সারাদিন এখানেই ছিল ও, ভাবছে জেথ, হয়তো রাতেও থাকবে। ওর আগলে রাখার মানসিকতা কেবল জেথের অক্ষমতাকেই মনে করিয়ে দেয়।
.
খুব বেশি মদ্যপানের কারণে গাঢ় হয়েছে ঘুম। জেগে, চোখ খোলার পর নির্মল আকাশ দেখতে পেল বাক টার্নার। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস ঝাঁপটা মারছে মুখে। সে ই প্রথম জেগেছে। গতকাল এভাবে মদ গেলা উচিত হয়নি, মাথা ভারী-ভারী বোধ হওয়ায় ভাবল তস্কর-নেতা, অবশ্য কারণও ছিল-কালকের দিনটা ছিল সাফল্যের। চকিতে থলের কথা মনে হতে শিয়রের পাশে তাকাল-নেই ওটা! টার্নার যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না।
সেকেন্ড কয়েক স্থির বসে থাকল ও, তারপর উল্টেপাল্টে দেখল নিজের বেডরোল। ঘুমের ঘোরে হয়তো বেখেয়ালে সরিয়ে রেখে থাকবে কোথাও, এ আশঙ্কায় তাকাল চারপাশে-নেই। এবার সঙ্গীদের দিকে মনোযোগ দিল টার্নার, অকাতরে ঘুমাচ্ছে সবাই। ডরম্যান, পিট…ওঠো। থলেটা চুরি গেছে!
জেগে ওঠার পর একে একে সবার মুখ খুঁটিয়ে দেখল টার্নার। কারও প্রতিক্রিয়ায় খুঁত নেই। এবার উন্মাদে পরিণত হলো সে। অন্যদের বেডরোল এমনভাবে পরখ করতে শুরু করল, হতাশায় রাগে-দুঃখে, জ্বালিয়ে দেবে যেন। নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে ওরা, ভয়ে চুপ করে আছে। এ মুহূর্তে টার্নার যমদূতের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
ব্যর্থ হয়ে মাটিতে বসে পড়ল দুবৃত্ত-নেতা। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। টার্নার কখনও কল্পনাও করতে পারেনি তার সাথে বেঈমানি করবে কেউ-বেশি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ হিসেবে এটাই মনে ধরল দুবৃত্তদের। স্লিম বেকারের অনুপস্থিতি সবার আগে টের পেল কার্লি রাফ। সরোষে নেতাকে জানাল।
বেজন্মা! ওর প্রতিটা হাড় গুড়ো করে ফেলব, বাজার্ডকে দিয়ে খাওয়াব ওর মাংস! অনুপস্থিত তস্করের ওপর গিয়ে পড়ল টার্নারের সমস্ত রাগ। পিটিয়ে পাই পাই পয়সার শোধ তুলব! প্রচণ্ড আক্রোশে কাঁপছে ওর গলা। চোখগুলো এমনিতে বড়, রাত্রিযাপন ও অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে সেগুলো আরও বড় দেখাচ্ছে এখন। নিজেকে সামলে ঘোড়ার দিকে এগোল টার্নার। আরে, কুত্তাটা দেখছি আমার ঘোড়াটা নিয়ে গেছে!
শেষমেশ কালো একটা রোয়ানে চাপল টার্নার। এত জোরে পার কষাল যে ঘোড়াটা হকচকিয়ে গেল প্রথমে, তারপর লাফিয়ে ছুটল। পিছু নিয়েছে অন্যরা। স্লিম বেকারের প্রতি সহানুভূতি আছে এমন কেউ নেই এখানে, বরং বেকারের ওপর ওদের আক্রোশ নেতার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
গিরিখাত থেকে বেরিয়ে ট্রেইলের ওপর চোখ পড়তে চুপসে গেল সবাই। স্যাডল ছেড়ে ট্রাক খুঁজল টার্নার, জানে লাভ নেই তবু মৃত স্লিমের দেহ ও স্যাডল ব্যাগে তল্লাশি চালাল। এক নজর দেখে বলে দেয়া যায় অ্যাম্বুশ করা হয়েছে। কিন্তু কে জানবে টাকা চুরি করে গভীর রাতে এখানে আসবে স্লিম?
শহরে যাব, ওখানকার কেউ স্লিমকে খুন করে টাকাগুলো হাতিয়ে নিয়েছে, শান্ত দেখাচ্ছে টার্নারকে, চোখে ধূর্ত চাহনি! শহরের লোক ছাড়া এ ট্রেইলে আসবে না কেউ। লোকটাকে ধরে টাকা ফেরত আনতে হবে। বেচাল হলে, জ্বালিয়ে ছারখার করে ফেলব সব।
বাক, হয়তো একটা পাসি এসেছিল। রাতে অবকরে বসে ছিল ক্যানিয়নের মুখে। স্লিম বেরিয়ে আসতে গুলি করেছে, পরের ব্যাপারটা খুব সহজ। নিজের মতামত জানাল কার্লি।
যদি তাই হয়, আমাদের ধরার সুযোগ হাতছাড়া করল কেন? কেউ যাতে সহজে অনুসরণ না করতে পারে আমরা সেভাবেই এসেছি। সন্ধ্যার পর পিটার্স নিজে পাসিট্রাকে ফেরত যেতে দেখেছে। ছড়িয়ে পড়ো সবাই, ট্র্যাক পেতে সময় লাগবে না, কারণ রাতের বেলা ঠিকমত ট্র্যাক লুকাতে পারেনি লোকটা।
ঘণ্টা দুই পর আলাদা হয়ে হোয়াইটস্টোনে প্রবেশ করল ওরা। লেইভ পিটার্সকে নিয়ে ব্যাংকের দিকে এগোল টার্নার। কার্লি আর মরগান ডিনামাইট কিনতে জেনারেল স্টোরে যাবে প্রথমে, তারপর গ্রীনস প্যালেস ও কাছাকাছি বাড়িগুলোর ওপর নজর রাখবে। অন্য তিনজন-পিট, হ্যাগেন ও ড্যান, উত্তর দিকটা সামলাবে।
একটা ক্যাফে চোখে পড়তে টার্নারের মনে পড়ল সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি এখনও। ঘোড়ার গতিমুখ বদলে সেদিকে এগোল সে। স্যাডল ছেড়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ল প্রথমে, তারপর হিচিং রেইলে ঘোড়ার লাগাম বেঁধে ভেতরে ঢুকল।
ভরপেট খেয়ে পোর্চে এসে দাঁড়াল টার্নার। চোখ কুঁচকে রাস্তা আর বাড়িগুলোর ওপর নজর বুলাল। একেবারে উত্তরে রয়েছে হ্যাগেন, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সিগারেট রোল করছে। ত্রিশ গজ সামনে ডাক্তার পিকার্ডের বাড়ির গলিমুখে, আস্তাবলের সামনে আছে মরগান। ওদের দেখে কিছু আঁচ করার উপায় নেই। পিট হারামজাদাটা গেল কোথায়? মিনিট পূর্ণ হওয়ার আগে গ্রীনস প্যালেস থেকে বেরোল সে। কতক্ষণ ধরে গিলেছে বেটা?
কিছু না বলে ফ্লাওয়ার মিলের দিকে সরে গেল লেইভ পিটার্স। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ল, হাঁটুজোড়া গুটিয়ে এনেছে বুকের কাছে। মনে হচ্ছে অসতর্ক কোন ভবঘুরে। কিন্তু দলের মধ্যে ওই দক্ষ ট্র্যাকার, পিস্তলে চালু হাত।
পোর্চ থেকে নেমে রাস্তায় এসে দাঁড়াল টার্নার। একে একে সঙ্কেত এল-তৈরি সবাই। শিগগির বেরিয়ে এসো সবাই, চেঁচাল তস্কর-নেতা, জানে ওর কথায়। পাত্তা দেবে না কেউ, শুনলেও ভাববে মাতাল কোন ভবঘুরের প্রলাপ। কিন্তু শহরবাসীকে আকৃষ্ট করার উপায় ওর ভাল করে জানা আছে। গতকাল ডাকাতি হয়েছিল তোমাদের ব্যাংকে, টা নিয়ে পুমাস ক্যানিয়নে গেছে ডাকাতেরা, আলাপী ঢঙে বলে চলেছে টার্নার। রাতে, এখানকার কেউ, ডাকাতদের একজনকে মেরে টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে। টাকা আর ওই লোকটাকে চাই আমি। নইলে ধ্বংস করে দেব শহরটা…একটা বাড়িও আস্ত রাখব না। দুপুর পর্যন্ত সময় দিলাম। পৈশাচিক হাসি ছড়িয়ে পড়ল ওর মুখে। রাস্তায় যারা ছিল, দাঁড়িয়ে কথা শুনছে। বেশিরভাগ বাড়ির জানালা খোলা, ফুটপাথ আর বাড়ির আঙিনায় অসংখ্য কৌতূহলী মুখ।
হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে অনর্থক সিলিন্ডার খালি করল টার্নার-ব্যাংকের উল্টোদিকের বাড়ির জানালার কাঁচ ভাঙল, আস্তাবলের সামনে দাড়ানো দুই পাঞ্চারের পাশে মাটিতে ধুলো উড়াল। দুটো গুলি ব্যাংকের সাইনবোর্ড ফুটো করল। এটা শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ। পিস্তলে টোটা ভরার সময় টার্নার দেখল ব্যাংকের সামনের সাইডওঅকে এসে দাঁড়িয়েছে জুলিয়াস হোল্ডেন আর ডগলাস গ্রীন।
টাকাগুলো কে নিয়েছে জানো তুমি? হোটেল-মালিকের প্রশ্ন।
না।
তাহলে আমরা জানব কিভাবে?
ওসব বুঝি না আমি। লোকটাকে যদি খুঁজে না পাও নিজেরা ভাগাভাগি করে টাকা জোগাড় করো। পরিষ্কার?
ধাপ্পা মারার আর জায়গা পাওনি? চড়া সুরে বলল ব্যাংকার, রাগে গলা কাঁপছে। গতকাল ব্যাংক লুট করার পর ফিরে এসেছ আবার, মরার ভয় নেই, না? গির্জার পেছনের কটনউডে অনেকদিন ঝোলানো হয় না কাউকে, সব কটাকে ধরে…।
থামো, আহাম্মক! সরোষে ব্যাংকারকে থামিয়ে দিল টার্নার। ধরতে এসে দেখো না, কুকুরের মত কি করে গুলি করে মেরে ফেলি! সবার আগে তোমার কপাল ফুটো করব।
হকচকিয়ে গেল জুলিয়াস হোল্ডেন। মুখে কথা সরছে না।
ভয়ে টাকা দিয়ে দেব এরকম যদি ভেবে থাকো, তোমাকে তাহলে আস্ত বেকুব বলব আমি। পাশ থেকে নতুন একটা কণ্ঠ শোনা গেল।
ঘুরে সেদিকে তাকাল দুবৃত্ত। ক্ষীণ হাসল জাজকে দেখে, তারপর আঙুল দিয়ে হ্যাটের কিনারা উঁচিয়ে মৃদু নড করল। আমি তা মনে করি না। এ শহর রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের, কি করলে ভাল হয় তোমরাই বেশি জানো। মনে রেখো, এক টার্নারের কথার নডচড় হয় না। দুপুরের পর একটু একটু করে ধস নামবে শহরটার। অসহায় লোকজনের চাপে বাধ্য হয়ে একসময় আমার দাবি মেনে নিতেই হবে।
উঁহু, মোটেও তা নয়। তেমন হলে বরং তোমাকে চাবুকপেটা করবে ওরা, তারপর ঝুলিয়ে দেবে কোথাও।
হুমকি দিচ্ছ, জাজ? শুনে রাখো, তিন ঘণ্টা পর আসল খেলা শুরু হবে। ভাল oাইলে সময় থাকতে খুঁজে বের করো লোকটাকে, নয়তো টাকা জোগাড় করো।
.
উপায় কেবল একটাই, দৃঢ় স্বরে জানাল রোয়ানা ম্যাকলীন। ওদের তাড়িয়ে দিতে হবে, নয়তো নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। হোয়াইটস্টোন একটা সাদামাঠা শহর আর এর অধিবাসীরা শান্তিকামী হতে পারে, কিন্তু টার্নার ভুল করেছে এটা তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিতে হবে।
জরুরী সভাটা জুলিয়াস হোল্ডেনের কামরায় বসেছে। জাজের ব্যক্তিগত অনুরোধে যোগ দিয়েছে রোয়ানা, যদিও জানে কোন লাভ হবে না। ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে এরা, এবং আতঙ্কিত মানুষ কিছু করার সাহস পায় না।
বিশাল ডেস্কের এপাশে, ব্যাংকারের মুখোমুখি বসেছে জাজ ও গ্রীনস প্যালেস মালিক। জুলিয়াস হোল্ডেন আগে থেকে বিধ্বস্ত, গ্রীন হতাশা বোধ করছে। শুধু জাজকে কিছুটা সুস্থির লাগছে।
আমার বিশ্বাস টার্নার ভাওতা দিচ্ছে, খেই ধরল রোয়ানা। টাকা হারানোর ব্যাপারটা আসলে কিছু নয়। বাড়তি লাভের আশায় এখানে এসেছে সে। এবং সফল হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে বুকিটা নিচ্ছে। পরোক্ষভাবে আমরাই তাকে সুযোগ করে দিয়েছি। গত দুটো বছরে হোয়াইটস্টোনে এমন অবস্থা চলেছে যে একটা আনাড়ি লোক এসে শহর দখল করার হুমকি দিলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার মত সাহস কারও ছিল না। আইনের হাত যথেষ্ট দুর্বল বলে এটা হয়েছে। আমি আগেও বলেছি, তোমরা কখনও গুরুত্ব দাওনি।
এতদিন কোন ঝামেলা হয়নি। মনে করিয়ে দিল ডগলাস গ্রীন।
তা হয়নি। কিন্তু তোমরা ভেবেছ কখনও হবেও না। যাকগে, আসল কথায় আসি… আউটল-রা হামলা করার আগেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে পারি আমরা। টার্নার জানে এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ খেপে যেতে পারে, তাই সম্ভাব্য চোরাগোপ্তা হামলা ঠেকাতে দলের সবাইকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখবে-আসলে তাই করেছে সে। তোমরা একা তার সাথে কথা বলেছ। ওর দলের লোকগুলোকে শহরবাসীদের থেকে আলাদা করা তেমন কঠিন হবে না, ওদের অবস্থান জেনে পাল্টা আঘাত হানা যেতে পারে। কিছু সময় হয়তো লাগবে, কিন্তু এরমধ্যে গুছিয়ে নিতে পারব আমরা।
ঝুঁকি বেশি, তাছাড়া এতে কাজ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কোন পরিকল্পনাই তোমাদের মনে ধরছে না। তোমরা বরং টাকার ব্যবস্থা করো।
এক লাখ গচ্ছা যাওয়ার পর আবার? জুলিয়াস হোল্ডেন যেন কেঁদে ফেলবে।
কিন্তু এত টাকা আসবে কোত্থেকে?
যদি দিতে হয়, সবাইকে একনজর দেখে রোয়ানার ওপর স্থির হলো গ্রীনের দৃষ্টি। ধরো, আমরা টার্নারকে যদি টাকা দিতে বাধ্য হই, তাহলে সবাই মিলে দিতে হবে। তুমি কত দিতে পারবে, রোয়ানা?
ওরকম ইচ্ছে আমার নেই। আমি বরং লুট হওয়া টাকাগুলো ফেরত আনতে চাই।
বসে আছ কেন? যাও না, ডিক টেবরের সেলুনে আছে টার্নার।
ডগলাস গ্রীনের কটাক্ষ গায়ে মাখল না রোয়ানা। মি. হোল্ডেন, তুমি মোটেও দায়মুক্ত নও। আমরা কেউই নিজেদের দাবি ছাড়ব না। ছোট ছোট র্যাঞ্চার আর ব্যবসায়ীরা কোন অজুহাত মানবে না। সিটি ব্যাংক থেকে ঋণ পাবে তুমি, ইচ্ছে করলে তখন সবার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু এত সময় তুমি পাবে না। আমরা আশা করব নিজ উদ্যোগে আউটলদের ধরার চেষ্টা করবে তুমি। সফল না হলেও এটুকু অন্তত সবাই জানুক যে চেষ্টার ত্রুটি করা হয়নি। তেমন হলে পুরো ব্যাপারটাকে আমরা সহজভাবে নিতেও পারি।
তুমি একটা লোভী মেয়ে! টেবিল চাপড়ে মন্তব্য করল ব্যাংকার, কণ্ঠে বিদ্রূপ। এত টাকা খোয়ানোর পরও বলতে গেলে তোমার কোন ক্ষতিই হয়নি। মিল, বাথান থেকে যে আয় হয় তাতে শহরের তাবৎ লোককে বছরকে বছর খাওয়াতে পারো তুমি।
অপ্রস্তুত বোধ করছে রোয়ানা। ব্যাংকারের সাথে কখনোই ওর শত্রুতা ছিল, সদ্ভাবও ছিল না। তবু এ ধরনের মন্তব্য ওর কাছে অপ্রত্যাশিত। তুমি বোধহয় আমাকে অপদস্থ করতে চাইছ, সামলে নিয়ে বলল ও, কারণটা বুঝতে পারছি না। মনে রেখো, দুমাসের মধ্যে আমার পুরো টাকা ফেরত চাই, শনিবার সকালে…
আমার পাওনাও ওই সময়ের মধ্যে দেবে, রোয়ানাকে থামিয়ে দিয়ে জানাল হোটেল-মালিক।
কি শুরু করেছ তোমরা! প্রায় ধমকের সুরে বলল জাজ। এখানে একটা সমস্যার সমাধান করতে এসেছি আমরা, অথচ তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করেছ। মৃদু ভর্ৎসনা তার গলায়, থেমে কেশে গলা পরিষ্কার করে ফের শুরু করল। রোয়ানী ঠিকই বলেছে। জুলিয়াস, তোমার উচিত টার্নারের পেছনে লোক লাগানো। আমি অবশ্য পাওনাদার নই, পরামর্শটা তবু একতরফা মনে হতে পারে।…থর্টন অক্ষম মানুষ আমাদের উচিত ছিল ওর জায়গায় শক্ত একজন লোক নিয়োগ করা। টার্নারকে ঠেকাতে হলে এখন নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। শহর ও শহরবাসীদের রক্ষা করার জন্যে এ কমিটি, সুতরাং আমাদের দায়িত্বই বেশি।
রাইফেল হাতে নিয়ে আমাকে সঙ সাজতে বলছ?
সমস্যা বাড়াচ্ছ শুধু, বিরক্তি চেপে রাখল না জাজ। শনিবার সকালে কাউহ্যান্ডদের বেতন দিতে পারবে তুমি? বেতন না পেলে তোমার ওপর চড়াও। হবে ওরা। থেমে সহানুভূতির চোখে তাকাল ব্যাংকারের পানে। মাথা গরম হয়ে আছে তোমার। ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু ভেবে দেখো। কোটের পকেট থেকে ঘড়ি। বের করে সময় দেখল। টার্নার বোধহয় এসে পড়েছে। এখন আমাদের কাজ হবে যে করে থোক ওর কাছ থেকে সময় আদায় করা।
হারামজাদাটা কেন যে ফিরে এল! আর্তনাদের মত শোনাল জুলিয়াস হোস্থেনের আক্ষেপটুকু। দুম করে ডেস্কে কিল বসাল সে, খেয়াল করল কামরা থেকে বেরিয়ে গেছে সবাই। সব কটা হারামী, স্বার্থপর! আমাকে সাহায্য করার ইচ্ছে কারও নেই। ঝামেলাটা শেষ হোক, দেখে নেব এরপর।
বলা বাহুল্য কথাগুলো বেরিয়ে যাওয়া তিনজনই শুনেছে। ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হলো তাদের। ব্যাংকারের প্রতি করুণা অনুভব করল জাজ, রোয়ানা তার অসহায়ত্বে মৃদু পুলকিত হলো, এবং হোটেল-মালিক, স্বার্থপর বলায় অপমানিত বোধ করল।
ডিক টেবরের সেলুনের সামনে খোশ-মেজাজে দাঁড়িয়ে আছে বাক টার্নার। হাতে হুইস্কির বোতল। শীতল দৃষ্টিতে দেখল মাঝ রাস্তায় দাঁড়ানো জাজ আর হোটেল-মালিককে। একটু পেছনে উভ্রান্ত ব্যাংকার। একপাশে সরে থাকা রোয়ানা ম্যাকলীনের ওপর আটকে থাকল ওর দৃষ্টি-মেয়ে বটে একখানা! লালসা ফুটে উঠল দুবৃত্তের চোখে। মেয়েটা ভয়ঙ্কর, এর পরপরই ভাবল টার্নার, লাইলাক বা চারমিয়নের মত সুন্দর হলেও র্যাটলের মত বিপজ্জনক।
আর…জজ লোকটা বুদ্ধিমান।
লোকটাকে পেয়েছ? জানতে চাইল টার্নার।
ভাওতা দেয়ার চেষ্টা কোরো না আর, দৃঢ় স্বরে বলল জাজ, শহরের কেউ তোমার টাকা আনেনি। কোথায় কখন টাকা থাকবে সেটা কে জানত? ঘটনাটা যদি সত্যিও হয়, লোকটা এ শহরেরই তা নিশ্চিত হচ্ছ কি করে? শোনো, টার্নার, কোন কিছু দাবি করার যোগ্যতা কি তোমার আছে? না, নেই। ব্যাংকে ডাকাতি করেও খায়েশ মেটেনি, এখন এসেছ নতুন ফন্দি এটে। সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, টাকাগুলো ফেরত দাও, নইলে পিছু নেব। একেবারে নরক পর্যন্ত ধাওয়া করব।
তোমরা বুড়োখোকারা পিছু নেবে? হেসে উঠল টার্নার।
টাকা হলে এদেশে তোক পাওয়া যায়।
ঠিক আছে, জাজ, লোক ভাড়া করো। চাইলে সারা কাউন্টিতে ওয়ান্টেড পোস্টারও ছাড়তে পারো। উদার কণ্ঠে ঘোষণা করল টার্নার, চোখগুলো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হুইস্কির বোতলে চুমুক দিয়ে ওপর দিকে ছুঁড়ে দিল ওটা, নিমেষে ওর হাতে উঠে এল একটা কোল্ট। গুলি করতে শূন্যে ফেটে চৌচির হয়ে গেল বোতলটা। কাঁচের ছোট ছোট কণা ছড়িয়ে পড়ল রাস্তায়, সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। উপস্থিত দর্শকদের চোখের পলক পড়ল না ক্ষণিকের জন্যে। টার্নারকে ড্র করতে দেখেনি বললে চলে, গুলির শব্দ শুনেছে কেবল। কটা গুলি করেছি বলতে পারবে? হেসে জানতে চাইল টার্নার, গলায় সন্তুষ্টি।
দুটো, দ্রুত জানাল গ্রীন।
চারটা…বিশ্বাস হয় না? কোল্টের সিলিন্ডার খুলে দেখাল দুবৃত্ত, মাত্র একটা বুলেট পড়ল মাটিতে, সিলিন্ডার ঘোরানোর পরও আর পড়ল না। নিজেকে ভয়ঙ্কর লোক হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা তার সফল হয়েছে, লোকজনের বিস্মিত দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারল টার্নার।
তিনটা গুলি রেখেছ তুমি, হোটেল-মালিক মানতে নারাজ।
আস্ত আহাম্মক দেখছি! সিক্সগানে কেউ তিনটে গুলি রাখে না-কি? গানবেল্ট থেকে পাঁচটা বুলেট বের করে সিলিন্ডারে পুরল টার্নার, তারপর হোলস্টারে ফেরত পাঠাল কোল্ট। পাচটা রাখে, খেই ধরল সে, আর, সিক্সগান কখনও খালি রাখে না। জাজ, লোক ভাড়া করবে, তাই না? এমন লোক বেছে নিয়ে যাতে আমার চেয়েও টাফ হয়, নইলে ব্যর্থ হবে।
বোতল কি মানুষের দিকে গুলি ছোঁড়ে, টার্নার? রোয়ানা ম্যাকলীনের প্রশ্ন।
মেয়েটির দিকে ঘুরল দুবৃত্ত। মানতেই হচ্ছে বেশ স্মার্ট তুমি, এই গাধাগুলোর চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখো মাথায়। ওয়েল, মিস ম্যাকলীন, টাকাটা কোথায়? রুক্ষ শোনাচ্ছে তার গলা, খানিক আগের আয়েশী ভাবটা নেই। শহর কমিটির সদস্য হিসেবে তোমার দায়িত্ব কম নয়।
সস্তা একটা গল্প শুনিয়ে আসলে কি চাইছ তুমি?
বাক টার্নার হাসল, বেঁকে গেছে ঠোঁটের কোণ। ধীরে আমুদে কন্ঠে বলল, মাত্র এক লক্ষ ডলার, ম্যাম এবং তা না পাওয়া পর্যন্ত আস্তে আস্তে এ শহরটা ধ্বংস করার আনন্দ। তিন ঘণ্টা সময় দিয়েছিলাম, তোমরা কিছুই করোনি। এবার আমার পালা। দেখো প্রথম ধাক্কাটা সহ্য হয় কি-না, বিশেষত তোমার, ম্যাম।
মিনিট পূর্ণ হওয়ার আগে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। কেঁপে উঠল। শহরের মাটি-দক্ষিণ প্রান্তে বাড়ি আর দোকানের ওপর অসংখ্য কাঠের টুকরো দেখা গেল, আতসবাজির মত উড়ে গিয়ে দূরে আছড়ে পড়ছে। পরপর আরও তিনবার বিস্ফোরণের ধাক্কায় কেঁপে উঠল সারা শহর। ঘন ধুলোর মেঘ জমেছে গির্জার কাছে। কি হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছে না কেউ। স্থাণুর মত দাড়িয়ে আছে সবাই, সচকিত হলো টার্নারের উল্লসিত ঘোষণায়।
রোয়ানা ম্যাকলীন, তোমার ফ্লাওয়ার মিলটা শেষ!
সেকেন্ড কয়েক সেদিকে তাকিয়ে থাকল মেয়েটা, তারপর ধীরে ফিরল তস্করের পানে। কঠিন দেখাচ্ছে মুখটা, চোখে শীতল চাহনি। দৃষ্টিতে বিদ্ধ করল টার্নারকে, মৃদু স্বরে বললেও জেদ, প্রতিজ্ঞা বা রাগ কোনটাই চাপা থাকল না। এর জন্যে তোমাকে মাসুল গুনতে হবে, টার্নার! জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করলে এইমাত্র।
বাক টার্নার হাসল, এ ধরনের পরিস্থিতির জন্ম নেবে, আগে থেকেই জানত। তার দল এসবকে পরোয়া করে না। এরচেয়ে অনেক কঠিন বিপদও মোকাবিলা করেছে। অবশ্যই, ম্যাম, সহাস্যে বলল টার্নার, একবার নজর বুলাল সবার ওপর। যে কোন সময়ে, আমি তৈরি থাকব। বাড়তি আরেকটা জিনিসের জন্যেও। ক্ষণিকের জন্যে লালসা ফুটে উঠল ধূর্ত চোখজোড়ায়। জাজ উইলসন হলেনের দিকে ফিরল এবার। কাল সকালে আসব আবার। ততক্ষণে লোকটাকে খুঁজে বের কোরো, নয়তো টাকার জোগাড় রেখো। কি করে জোগাবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। একে একে শহরের প্রত্যেকে গ্রিস্ত হবে যদ্দিন না আমার দাবি মেটানো হয়।
.
০৪.
হোয়াইটস্টোনের পরিস্থিতি মোটেও সুবিধের নয়। সময় গড়ানোর সাথে সাথে লোকজনের মধ্যে উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। কেবল মহিলা আর শিশুরা ঘর আড়ে বেরোয়নি-প্রতিটি লোক রাস্তা, স্টোর নয়তো সেলুনে ভিড় করেছে। তবে যার যার বাড়ির কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছে যাতে প্রয়োজনে নিরাপদ আশ্রয় নেয়া যায়। সাহস করে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়েছে দুএকজন, যার বেশিরভাগই পুরানো, মরচে ধরা। হয়তো একসময় গানম্যান বা অস্ত্রে পারদর্শী ছিল এরা, কিন্তু শান্তিপূর্ণ জীবনে এতদিন ছুঁয়েও দেখেনি।
আবারও আলোচনায় বসেছে শহর কমিটির সদস্যরা, রোয়ানা ম্যাকলীনকে ছাড়াই। এবারও কোন স্থির সিদ্ধান্ত তো নেয়া হইনি বরং তাদের নিজেদের। মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এদের মধ্যে ব্যাংকারের মানসিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে।
বিকেলে, সদস্যরা জানতে পারল খানিক আগে শহরে এসেছে বাক টার্নার, সদলে পান করতে গেছে ডিক টেবরের সেলুনে। জাজ সেখানে যাওয়ার প্রস্তাব করতে নাক কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করল ডগলাস গ্রীন, ভেস্টের ভেতরের পকেট থেকে হুইস্কির বোতল বের করে এক চুমুক পান করে এগিয়ে দিল জাজের দিকে। রোদ তো কম পড়ছে না, মনে হচ্ছে তোমারও তেষ্টা পেয়েছে। চেখে দেখো, উইলি। তেষ্টা মেটানোর জন্যে এরচেয়ে ভাল কিছু হতচ্ছাড়া এ শহরে তুমি পাবে না। আর জুলিয়াস, তোমাকে মানতেই হবে গরমের সময় সিগারের চেয়ে এ জিনিসটাই বেশি কাজের।
কোন মন্তব্য না করে বেরিয়ে গেল ব্যাংকার। অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের মাঝে। গ্রীনের অফিস রূম ছেড়ে বেরিয়ে এল ওরা। লবিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজন পথ ছেড়ে দিল ওদের। পোর্চে এসে দাঁড়াতে রোদের প্রখর আঁচ ঘেঁকে ধরতে ফের নাক সিঁটকে ঋতুকে গাল দিল হোটেল-মালিক।
ফাঁকা রাস্তার ওপর চোখ বুলাল জাজ উইনসন হলেন, একটু আগেও প্রচুর লোক ছিল। একেবারে দক্ষিণে গির্জার কাছে ছোটখাট একটা ভিড় দেখা যাচ্ছে কেবল।
ডিক টেবরের সেলুনটা ডাক্তার পিকার্ডের হাসপাতালের দুই বাড়ি পরে। সেদিকে যাচ্ছিল হোল্ডেন, কিন্তু হঠাৎ করে পাশের গলি থেকে টার্নারকে সদলে বেরোতে দেখে থমকে দাঁড়াল। দ্রুত এগোল জাজ, পেছনে গ্রীন প্রায় ছুটে চলেছে।
বিশ কদম দূরে থাকতে থামল টার্নারের কালো বোয়ানটা। দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে অন্যরা। লোকটা কোথায়? জাজের উদ্দেশে জানতে চাইল টার্নার, মুখে হাসি। শহরের ঝিমানো পরিস্থিতি উপভোগ করছে।
জানি না।
টাকা?
জাহান্নামে যাও!
টার্নারের হাসি প্রসারিত হলো। ঠিক আছে, জাজ। মিল ধ্বংস করার পরও যখন তোমাদের টনক নড়েনি, এবার আমার পালা। ছেলেরা, দরাজ গলায় অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কাজ শুরু করে দাও। চকিতে কোল্টটা চলে এসেছে তার হাতে। কেউ নড়াচড়া করলেই কপাল ফুটো করব!
গ্রীনস প্যালেসের সামনে চলে গেছে পিটার ডুয়েল ও ড্যানি মরিসন, স্যাডল থেকে দুটো বড়সড় বস্তা নামাল। ওগুলোর ভেতর থেকে বের করল ছেড়া কাপড় আর কেরোসিনের কৌটা। হোটেলের ভেতরের লোকগুলো, কি হতে যাচেছ আঁচ করতে পেরে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিবিষ্ট মনে কাপড়ে তেল মেখে খোলা জানালা দিয়ে হোটেলের ভেতরে ছুঁড়ে ফেলছে তস্কর দুজন। একটু পর আগুন লাগাল ওরা। ততক্ষণে ফাঁকা হয়ে গেছে লবি, আর বাইরে যোবা হয়ে আছে দর্শকেরা–এদের মাঝে সবচেয়ে চটপটে যে লোকটি, জাজ, সে-ও।
সবার আগে সচল হলো ডগলাস গ্রীন। রাগে ফেটে পড়ল হোটেল-মালিক। বাস্টার্ড! কোন অধিকারে আমার হোটেল পুড়িয়ে দিচ্ছ? প্রচণ্ড আক্রোশে স্বাভাবিক বোধটুকু উবে গেছে, তাই ভয়ঙ্কর ভুলটা করে বসল। সাধারণত নিরস্ত্রই থাকে গ্রীন, কিন্তু কোমরে একটা পিস্তল ঝুলিয়েছে আজ। হোলস্টারে হাত বাড়ানোর সময় এটুকুও খেয়াল করল না, টার্নার তারচেয়ে একে তো দ্রুত তার ওপর খোলা পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যরা তো আছেই।
দুর্বোধ্য হাসি খেলে গেল টার্নারের ঠোঁটে, গ্রীন পিস্তল বের করা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। দশ গজ দূরের টার্গেট, সহজ নিশানা। ছুটে আসছিল হোটেল মালিক, গুলির ধাক্কায় প্রথমে স্থির হয়ে গেল দেহটা, তারপর ধীরে গড়িয়ে পড়ল। কপালের ফুটো থেকে রক্ত উপচে পড়ছে।
পিস্তলে টোটা ভরার সময় চারপাশে তীব্র গুঞ্জন টের পেল টার্নার। উন্মাদনা গ্রাস করেছে কয়েকজনকে, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ছুটে আসছে। কার্লি ও হ্যাগেন। অনায়াসে সাফল্যজনক শূটিং প্র্যাকটিস করল তাদের ওপর। দলটার সাথে গুঞ্জনও থেমে গেছে। শহরের উত্তর প্রান্তে জেরেমি মিলারের জেনারেল স্টোরটি বিধ্বস্ত হলো এসময়। অসহায় মানুষগুলোর জন্যে ওটা দিনের দ্বিতীয় চমক।
কিছুক্ষণ পর, হঠাৎ করেই রাস্তায় দেখা গেল স্টোর মালিককে। রাগে লাল হয়ে গেছে মুখ। ধীরে এগোচ্ছে টার্নারের পানে। এতবড় দুঃসাহস তোমার হলো কি করে? যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছ, ভেবেছ আমরা কিছু করতে পারব না?
টাকা দিতে পারবে, মিলার, এক লাখ?
ওটাই তোমার জীবনের শেষ চাওয়া।
তাই নাকি? টার্নারের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা গেল। ঝটিতি সিক্সগান উচিয়ে ধরল। ওখানেই দাঁড়াও! নিজেকে যতটা চালাক ভেবেছ, ততটা তুমি নও, মিলার। তোমার চেলাদের বেরিয়ে আসতে বলো, নয়তো তোমার পেট ফুটো করব।
অসহায় দেখাল জেরেমি মিলারকে। হালকা ইশারা করতে গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে পাশাপাশি দাঁড়াল চারজন। সশস্ত্র।
শোনো, মিলার, আমি সামনাসামনি লড়তে পছন্দ করি। মনে হচ্ছে এর উল্টোটা তোমার পছন্দ। তুমি একটা কাপুরুষ! বলে গুলি করল সে, একই সাথে পিট আর ডরম্যানও গুলি করেছে। জেরেমি মিলারের চারজন লোকই ঢলে পড়ল। বোকার মত কাজ করেছ, খেই ধরল দুবৃত্ত-নেতা। তাই খেসারত দিতে হলো। মিলার, কোন নিরস্ত্র লোককে গুলি করতে আমার বাধে, তাই এযাত্রায় বেঁচে গেলে তুমি। এ-ও ঠিক এটাই ছিল তোমার শেষ সুযোগ।
এত সহজে সব শেষ হয়ে যেতে পারে না। মনে করেছ ভুলে যাব, বা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাব? তোমাকে নিজ হাতে খুন করব আমি।
টার্নার হাসল, দৃষ্টিতে অবজ্ঞা ফুটে উঠেছে। আমি জানি তুমি তা পারবে-পেছন থেকে। পিস্তলে টোটা পুরে হোলস্টারে ফেরত পাঠাল। হোটেলের দিকে তাকিয়ে দেখল ড্যানের সাথে পিটার্স যোগ দিয়েছে এখন। কেরোসিনের। শেষ কৌটাটা হোটেলের ভেতর উজাড় করার পর দেখা গেল একতলাতেই ভাল করে আগুন ধরেনি এখনও, তবে দেরিও নেই আর। ইতোমধ্যে দোতলার একটা অংশে ছড়িয়ে পড়েছে।
হোটেলের সামনে জুলন্ত হিচিং রেইলটা দেখে পুলকিত হলো টার্নার। এ ফাঁকে ঘোড়াগুলোর কেরামতি পরীক্ষা হয়ে যাক, ভাবল সে। দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা। দিতে ড্যান, কার্লি এবং পিটার্স এগিয়ে এল, স্যাডলে চেপে টার্নারের পেছনে সারি করে দাঁড়াল। দ্রুত ঘোড়া ছোটাল তস্কর-নেতা, কাউহ্যাডরা গরু দাবড়ানোর সময় যেভাবে চিৎকার করে, চেঁচাচ্ছে সেভাবে। ছুটে এসে জ্বলন্ত রেইলটা টপকাল। টার্নার, সোৎসাহে হাততালি দিল ওর সঙ্গীরা। এবার একে একে অন্যরাও নিজেদের ঘোড়ার কেরামতি দেখাল। একপাশে দাঁড়িয়ে হাসছে টার্নার, অনুচরদের উৎসাহ জোগাচ্ছে।
রেইলটা অনড় থাকা পর্যন্ত খেলাটা চালিয়ে গেল ওরা। অসহায় দৃষ্টিতে দেখছে শহরবাসী। তস্করদের চারজন ফুর্তি করলেও অন্যরা পুরোমাত্রায় সতর্ক।
যাত্রার উদ্যোগ নিল টার্নার। হঠাৎ দেখতে পেল রোয়ানা ম্যাকলীনকে, শহরে ঢুকেছে এইমাত্র। মিস্ করলে, ম্যাম, সহাস্যে বলল সে, সব মজা অবশ্য শেষ হয়ে যায়নি। কথা দিচ্ছি খুব বেশি দেরি করব না, কাল সকালেই দেখতে পাবে এরচেয়ে মজার দৃশ্য। হ্যাটের ব্রিমে আঙুল ছুঁইয়ে নড করল টার্নার। স্পার দাবাতে লাফিয়ে এগোল ঘোড়াটা।
দুবৃত্তেরা চলে যেতে হোটেলের দিকে ছুটল লোকজন। কেউ গেল ডগলাস গ্রীনের কাছে, লাশটা ধরাধরি করে এনে রাখল সাইডওঅকের ওপর। উৎসাহী অনেকে চলে গেছে আশেপাশের বাড়িগুলোতে, বালতি বা অন্য কোন পাত্র ভরে পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে।
গ্রীনস প্যালেসের সামনে এসে স্যাডল ছাড়ল রোয়ানা। চারপাশের লোকজনের মধ্যে খুঁজল পরিচিত মুখটা, হয়তো কোনভাবে বেরিয়ে থাকবে-নেই। চকিতে ওর দৃষ্টি চলে গেল দোতলায় সবচেয়ে দক্ষিণের কামরার ওপর, দরজাটা বন্ধ। হায় খোদা, জ্বলন্ত হোটেলের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল রোয়ানা, ও যে ঘুমিয়ে আছে!
.
জেথ্রো ম্যাকলীন নিশ্চিত গুলির শব্দে ঘুম ভেঙেছে ওর।
হৈ হল্লা কানে আসছে। জোর কদমে ঘোড়া দাবড়ানোর শব্দ ধীরে সরে যাচ্ছে দক্ষিণে। অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে এখানে, কিন্তু বুঝতে পারছে না ও। বিছানায় উঠে বসল, সুস্থ লাগছে নিজেকে। দুদিনে হাঁটার মত শক্তি অর্জন করেছে। বুটজোড়া পায়ে গলিয়ে দরজার দিকে এগোল জেথ। হঠাৎ করে টের পেল অসহ্য গরম লাগছে, গ্রীষ্মের ভরদুপুরেও এত গরম লাগে না।
দরজা খুলে বাইরে তাকাতে থ হয়ে গেল জেথ। বারান্দার ওপাশে আগুন জ্বলছে। ওর কামরা একপ্রান্তে বলে এখনও আগুন ছড়িয়ে পড়েনি, তবে খুব বেশি দেরিও নেই। আতঙ্কে হিম হয়ে যেতে চাইছে শরীর। বারান্দা ধরে সিঁড়িতে যাওয়া যাবে না, বিকল্প কোন পথও নেই। শুধু একটাই উপায়-বারান্দা থেকে লাফ দেয়া। কিন্তু একে তো দালানটা বেশ উঁচু তার ওপর দুর্বল শরীরে তা করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এত বড় হোটেলে কি করে আগুন লাগল ওর মাথায় ঢুকছে না।
ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্টা করল জেথ। ধোঁয়া আর পোড়া কাঠের টু গন্ধে ভারী হয়ে গেছে ঘরের বাতাস। বারান্দার ওপাশে হুড়মুড় করে পড়ল কিছু একটা। লোকজনের চিৎকার কানে আসতে আশান্বিত হলো জেথ। সামনের রাস্তায় কেউ না কেউ আছেই, ভাবল ও, ওরা হয়তো সাহায্য করতে পারবে, একটা মই বা নিদেনপক্ষে এক তাড়া রশি দিয়ে।
দৌড়ে বারান্দায় চলে এল জেথ। নিচে অনেক লোকের মাঝে দেখতে পেল রোয়ানাকে। চোখাচোখি হতে উদ্বিগ্ন মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
লাফ দিয়ো না, জেথ, দ্রুত বলল মেয়েটা, একটা মিনিট অপেক্ষা করো। আসছি আমি। আস্তাবলের দিকে ছুটল, একটু পরই একগোছা দড়ি হাতে ফিরে এল।
ততক্ষণে আগুন বেশ কাছিয়ে এসেছে।
সাইডওঅক থেকে দড়িটা ছোড়ার আয়োজন করল রোয়ানা। জেথের আশঙ্কা হলো শেষ পর্যন্ত ওটা বোধহয় ওর হাতে এসে পৌঁছুবে না, একটা মেয়ে কতটুকু আর দক্ষ হবে অন্তত এরকম উত্তেজনার সময়ে? কিন্তু প্যাচানো দড়িটা যখন। বারান্দায় এসে পড়ল মনে মনে হাজারটা ধন্যবাদ জানাল মেয়েটাকে।
হোটেলের পেছনে একটা অ্যাসপেন আছে, জানাল রোয়ানা, জানালা ভেঙে ওটা দিয়ে নামার চেষ্টা করো।
অস্বীকার করার উপায় নেই সহজে ঝামেলা সামাল দেয়ার গুণ মেয়েটার আছে। ওর জায়গায় জেথ নিজে হলে এ ব্যাপারটা মাথায় আসত কি-না জেথের নিজেরই সন্দেহ আছে। অথচ যেভাবে দড়ি আনল এবং পরামর্শ দিল যেন সবকিছু আগে থেকে জানত।
দরজায় আগুন ধরে গেছে। বারান্দার ও-পাশটা সশব্দে ধসে পড়ল এসময়। সমস্বরে আঁতকে উঠল নিচের লোকেরা। বারান্দা থেকে ওকে লাফ দেয়ার পরামর্শ দিল একজন। কিন্তু সে-সম্ভাবনা আগেই নাকচ করে দিয়েছে জেথ। পুরো দালানের কাঠামো নড়ে উঠল হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও, দেয়াল ধরে কোনরকমে সামলে নিল। ভেজানো দরজার পাল্লায় লাথি হাঁকাল, জ্বলন্ত পাল্লা সরে যেতে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
পেছনের দেয়ালে আগুন, তবে কাঠের মেঝেতে লাগেনি এখনও। বিছানার ওপর ছিল রাইফেলটা, ওটা নিয়ে জানালার কাছে চলে এল। কুঁদো চালিয়ে ভেঙে ফেলল কাঠের গরাদ। দশহাত দূরে দেখতে পেল অ্যাসপেনের মাথা। প্রথমবারে সফল হতে হবে, ভাবছে জেথ, নইলে…
অপরিসর জায়গায় দড়ি ঘোরানোর সুযোগ নেই, তবু সমস্ত মনোযোগ এক করে ছুঁড়ে দিল। বড়সড় বৃত্ত এঁকে অ্যাসপেনের একটা শাখায় গিয়ে পড়ল, দ্রুত টেনে ছোট করে ফেলল ফাসটা। তারপর জানালার চৌকাঠে এসে বসল। ওর ভয় হচ্ছে এখুনি বুঝি ধসে পড়বে দালানটা।
প্রায় বিশ ফুট উপরে আছে ফাসটা। ওটার এমন এক জায়গায় ধরল, ঝুলে থাকলেও শরীর যাতে মাটি থেকে উঁচুতে থাকে। দোল খাওয়ার মত শূন্যে ভাসিয়ে দিল শরীর। নিচে, শক্ত মাটিতে নামার পরক্ষণে ধসে পড়ল হোটেলের কাঠামো। এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আগুন লাগেনি। মাত্র কয়েকটা সেকেন্ডের হের ফেরে বেঁচে গেল! সুস্থির হওয়ার পর সামনে দেখতে পেল রোয়ানাকে, ছুটে আসছে। কাছে এসে থামল, হাঁপাচ্ছে।
তুমি ঠিক আছ তো?
হেসে মেয়েটাকে আশ্বস্ত করল জেথ।
ওহ, কি আতঙ্কেই না ছিলাম! তোমার কিছু হলে বুড়ো আমাকে আস্ত রাখত। কয়েকবার বলেছে বাথানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে, আমি রাজি হইনি।
এ মেয়েটি বার বার তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করছে কিংবা প্রয়োজনে সহযোগিতার পুরো হাতটা প্রসারিত করে দিচ্ছে, অবছে জেথ। ঠিক করেছিল ওকে আগলে রাখবে অথচ রোয়ানাই ওর চারপাশে প্রতিরক্ষার একটা দেয়াল তৈরি করেছে।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল রোয়ানা, ওর একটা হাত মুঠোয় নিয়ে মৃদু চাপ দিল জেথ। চোখ তুলে থেকে দেখল ও, বুঝে নিল ঋণের বোঝা কতটুকু, কিন্তু স্বীকার করল না। স্রেফ ভুলে যাও, জেথ। এটা এমন কিছু নয়। তোমার জায়গায় আমি হলে মনে রাখতাম না।
হাতটা ছেড়ে দিল জেথ।
চলো, একটা সেলুনে গিয়ে বসি। ধকলটা কাটাতে তোমার ড্রিঙ্ক দরকার। হাঁটতে পারবে?
মাথা ঝাঁকিয়ে এগোল জেথ গলি ধরে চলে এল মূল রাস্তায়।
উত্তরে ডিলান উডম্যানের সেলুনে চলো, প্রস্তাব এল। ওদিকে ভিড় কম।
ডিলান উডম্যানের সেলুনটি শহরের একেবারে উত্তর প্রান্তে। জেরেমি মিলারের স্টোর, কোর্ট হাউস, ডাক্তার পিকার্ডের বাড়িরও পরে ভূমি বণ্টন অফিস। এরপর একটা হোটেল ছাড়িয়ে আবাসিক এলাকার শুরুতে বড়সড় সেলুনটা। এ মুহূর্তে একেবারে নির্জন, ওরা ছাড়া আর মাত্র দুজন খদ্দের। হোয়াইটস্টোনের। বেশিরভাগ লোক এখন গ্রীনস প্যালেসের কাছে।
কয়েকটা ব্যাপার ঘটে গেছে এ দুদিনে, জেথ। বাক টার্নার, ব্যাংকে ডাকাতি করেছিল যে লোকটা, দুই পেগ হুইস্কির ফরমাশ দিয়ে বলতে শুরু করল। রোয়ানা। ফিরে এসেছে আবার। টালবাহানা করে এক লাখ ডলার আদায় করতে চাইছে। নইলে ধ্বংস করে দেবে পুরো শহরটা। গতকাল ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে। দিয়েছে আমাদের মিল। আজ হোটেল পুড়িয়েছে, মিলারের স্টোর ধ্বংস করেছে। কাল আবার আসবে সে এবং যথারীতি ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে।
কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না জেথ। বাক টার্নারের সাহস আছে, ডাকাতি করার পরও নতুন দাবি নিয়ে এসেছে, প্রাণের মায়া নেই নাকি? এ শহরের লোকগুলো গরুর ঘাস কাটছে?
তুমি হয়তো ভাবছ কি করে এসব করেছে সে, ক্লিষ্ট হাসল রোয়ানা। এখানকার বেশিরভাগ লোকই শান্তিপ্রিয়, ঝামেলা এড়াতে পছন্দ করে। অস্ত্র চালাবে কি, অনেকে স্যাডলেই চড়ে না অনেকদিন। আশেপাশের বাথানের পাঞ্চাররা হয়তো অস্ত্র চালাতে জানে, কিন্তু এগিয়ে আসবে না। শহরের সাধারণ লোকের মত ওদেরও কোন ক্ষতি হয়নি, তো সেধে ঝামেলায় জড়াবে কেন? এগিয়ে এলেও দুর্ধর্ষ একটা দলের বিরুদ্ধে কি-ইবা করতে পারবে। জেরেমি মিলার দলবল নিয়ে চেষ্টা করেছিল, পারেনি। সব মিলিয়ে অন্তত সাতজন মারা পড়েছে। থেমে চুমুক দিল হুইস্কির গ্লাসে, অভ্যস্ত নয় বলে মুখ-চোখ কুঁচকে গেল। অত্যধিক মানসিক চাপে আছে বলে পান করতে চেয়েছে। এখন কেবল একটা পথই আছে। আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকা লোকগুলোকে সংঘবদ্ধ করতে পারলে আউটলদের মোকাবিলা করা সম্ভব।
নীরবতা। হুইস্কি শেষ করতে খানিকটা চাঙা বোধ করল জেথ।
নিজেকে খুব অসহায় লাগছে, জেথ। পরের সাপ্লাইটা পাঠাব কিভাবে? মিলের কোন কিছু যে আবার ব্যবহার করব সে উপায় ওরা রাখেনি। কাছে গিয়ে সবকিছু দেখার পর কিভাবে যে নিজেকে সামলেছি, জানি না। থামল রোয়ানা, পুরোপুরি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে। দ্রুত গ্লাস খালি করল, মদের প্রভাবে খানিক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে মুখটা। ফের খেই ধরল। ভাগ্য বরাবর আমাদের বিরুদ্ধে থাকছে, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কোন সুযোগই পাচ্ছি না। কয়টা দিক সামলাব? তবু আমি হারতে রাজি নই।…ম্যাকলীনরা কখনও হাল ছাড়ে না, আর আমি তো তাদেরই একজন, তাই না? প্রতিজ্ঞায় জ্বলজ্বল করছে ওর চোখজোড়া। বাক টার্নার…উচিত শিক্ষা পাবে সে।
হাতের শূন্য গ্লাসের পানে তাকিয়ে থেকে সেটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। রোয়ানা, সামলে নিয়েছে নিজেকে, খানিক আগের আবেগ আর নেই। এখন বিশ্রামই তোমার জন্যে সবচেয়ে বড় ওষুধ, প্রসঙ্গ বদলাল, গ্রীনস প্যালেস ছাড়া ভাল হোটেল এখানে আর নেই। কোন হোটেলের চেয়ে বাথানেই বেশি আরাম বোধ করবে। তাছাড়া, টার্নারকে তাড়া করার আগে কিছু আলোচনাও করা দরকার। বাথানে যাবে?
নড করল জেথ।
সেলুন থেকে বেরিয়ে সাইডওঅক ধরে এগোল ওরা। হোয়াইটস্টোন যেন মৃতের শহর। সেলুনে হৈ-হল্লা নেই, সন্ধ্যা হওয়ার পরও বেশিরভাগ বাড়িতে আলো জ্বলেনি। তবে অন্যান্য দিনের চেয়ে রাস্তায় লোক বেশি, মহিলা ও শিশুরাও আছে। প্রায় সবার পরনেই কালো পোশাক। একটুপর মৃতদের সৎকার করা হবে।
ওয়ালেস বেনেট, এখানে আসার পর যে-আস্তাবলে গ্রে-টার যত্ন নিতে দিয়েছিল জেথ সেটার মালিক, রাস্তায় পেয়ে ঘোড়াটাকে নিয়ে গিয়েছিল দুদিন আগে। বেনেটের কাছ থেকে ঘোড়াটা ছাড়িয়ে এনে গোরস্থানের দিকে এগোল। ফিউনেরাল শেষে বাথানের পথ ধরল। একটা মাসট্যাঙে চেপেছে রোয়ানা।
শহর ছাড়িয়ে ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে ওরা। রাত নেমেছে প্রেইরির বুকে, জ্যোৎস্নার আলোয় চারপাশ সয়লাব, ফুরফুরে বাতাস বইছে। মাথা থেকে হ্যাট খুলে স্যাডল বুটে রাখল রোয়ানা, নেড়েচেড়ে লম্বা কালো চুলের জট ছাড়াল। মূড নেই তবু জেথের চোখ পড়ে গেল ওর ওপর। বাতাসে উড়ছে রেশমী চুল, আর মায়াবী আলোয় রহস্যময়, সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।
ভেবে দেখলাম, অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙল রোয়ানা। বেশ কিছু টাকা রোজগার করতে পারো তুমি। সবটাই বাড়তি পাওনা।
বুঝতে পারছে না জেথ, তাকাল রোয়ানার দিকে।
আগে বাথানে পৌঁছে নিই, তারপর বলব সবকিছু।
না বললেও জেথ বুঝতে পারছে এজন্যে ঝুঁকি নিতে হবে। পরিশ্রম আর ঝুঁকি ছাড়া পশ্চিমে একসঙ্গে অনেক টাকা রোজগার করা যায় না।
০৫.
বাক টার্নার পরদিন সকালে এল না।
হোয়াইটস্টোনে এটাই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ ভাবছে টার্নার ভয় পেয়েছে, নয়তো তস্করদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। অন্য একটা দল ভাবছে ইচ্ছে করেই আসেনি সে, অল্প সময়ের একটা সুযোগ দিয়েছে কেবল।
সূর্য ওঠার দুঘণ্টা পর শহরে এসেছে জেথ। সেলুনে গিয়ে গলা ভেজাল প্রথমে, স্টোর থেকে প্রচুর বুলেট, একটা হেনরী আর একটা পুরানো কোল্ট কিনল এরপর।
ডিলান উডম্যানের সেলুনের সামনে অবস্থান নিয়েছে শহর পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। ছোটখাট একটা ভিড় ঘিরে আছে তাদের। এ মুহূর্তে সবার কি করণীয়, তা ব্যাখ্যা করছে জাজ। লোকগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে, জেথের কাছে মনে হলো হোয়াইটস্টোনের এ সঙ্কটে এদের অনেকেই এগিয়ে আসবে। দুর্ধর্ষ একটা দলের বিরুদ্ধে লড়তে হলে যে ধরনের লোক দরকার এরা কেউই তেমন নয়। বেশিরভাগই নিরীহ গোছের বুড়িয়ে যাওয়া, ব্যবসা করে পেট চালায়। দুএকজন ভবঘুরেও আছে। কাছে যাওয়ার পর দর্শক-শ্রোতার সারিতে উনি। থর্টনকে দেখতে পেল ও, বুকে টিনের তারাটা নেই।
ভিড় ঠেলে জাজের দিকে এগোল জেথ। বক্তৃতার ওই পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক আহ্বান করছিল সে। ওকে এগোতে দেখে, থেমে হাসল। সামনে গিয়ে চিরকুটটা বাড়িয়ে দিল জেথ।
কিছুটা বিস্মিত মনে হলো তাকে, কিছুক্ষণ দেখল ওকে, তারপর চোখ নামাল হাতের কাগজে। পাগল হয়েছ তুমি! সামান্য কাজের জন্যে এত টাকা? এবার পুরোপুরি বিস্মিত দেখাচ্ছে তাকে, খানিকটা বিরক্তও।
সামান্য কাজ? জাজের বা শহর কমিটির কাছে হতে পারে, কিন্তু ওর কাছে মোটেও তা নয়, ভাবছে জেথ-ওয়াইল্ড বিল হিকককে ড্রয়ে হারানোর মত কঠিন। এই যে এখানে এতগুলো লোক আছে, কেউ কেউ হুজুগে কোমরে পিস্তলও ঝুলিয়েছে, এদের কেউ তো এমন প্রস্তাব নিয়ে আসেনি! তাহলে এটা কি করে সামান্য কাজ হলো?
জেথের ভবঘুরে জীবনে ঝুঁকিই একমাত্র বৈচিত্র্য। বাক টার্নারকে ধরতে পারলে বেশ কিছু টাকা পাবে, যদি শহর কমিটি ওর সাথে চুক্তিতে আসে। সত্যি কথা বলতে গেলে পাঁচ হাজার কেন পাঁচশো ডলারও কখনও একসাথে রোজগার করেনি জেথ। টাকার চেয়ে কঠিন এ-কাজটা সারার জেদই ওর বেশি। টার্নার ওকে রোস্ট বানাতে চেয়েছিল, ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি ওর। তস্করদের ধরতে গেলে যেটুকু ঝুঁকি নিতে হবে টাকাটা তার তুলনায় কোনভাবেই বেশি নয়। মারা পড়তে পারে ও। আর এরা হারাবে টাকা। পাঁচ হাজার বা এক লাখ, যে কোন একটার আশা ত্যাগ করতে হবে। ওরা রাজি না হলেও কিছু আসে-যায় না, বাক টার্নারকে এমনিতেও ধাওয়া করতে হবে-ম্যাকলীনদের নিজেদের স্বার্থেই। শহর কমিটির সাথে চুক্তিটা তাই জেথের কাছে বাড়তি পাওনা।
জাজের ওপর নজর বুলাল জেথ, পাঁচ হাজার ডলার যেন অপাত্রে দান করা হবে এমন মুখভঙ্গি। খানিকটা নিরাশই হলো ও, গতরাতে রোয়ানা বলেছিল রাজি না হয়ে এদের উপায় নেই। শ্রাগ করে ফিরতি পথ ধরল জেথ।
শুধুই বড়াই, আর কিছু নয়! জুলিয়াস হোল্ডেনের শ্লেষপূর্ণ গলা শোনা গেল। বোবা এ বীরপুরুষ টার্নারের সামনে পড়লে নির্ঘাত প্যান্ট খারাপ করে ফেলবে।
হাসির হিড়িক পড়ল সাথে সাথে।
ব্যাংকারের ওপর রাগ হলো জেথের। রোয়ানাকে যেমন, ওকেও তেমনি অপদস্থ করতে চাইছে। ম্যাকলীনরা তার কি ক্ষতি করেছে? ঝটিতি ঘুরে দেখল ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে, একেবারে সহজ নিশানা। জেথের ডানহাতে কোল্ট উঠে এসেছে। মাত্র একটা গুলি করল। হোল্ডেনের সদ্য ধরানো সিগার দ্বিখণ্ডিত হয়ে এক টুকরো পড়ল ফুটপাথে, অন্য টুকরো আটকে থাকল দুঠোঁটের মাঝখানে।
তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছ! আমি…আমি তোমাকে… শেষ করতে পারল না ব্যাংকার। তার চোখে নিখাদ আতঙ্ক, রাগে চেঁচাতে সিগারের টুকরো পড়ে গেল ঠোঁট থেকে।
হোল্ডেনের চোখে চোখ রেখে মাথা নাড়ল জেথ। সেরকম ইচ্ছে থাকলে বুলেটটা বুকে বেঁধাত। হোল্ডেনও শেষে বোধহয় তা উপলব্ধি করতে পেরে চুপ মেরে গেল। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে কোল্টে টোটা ভরল জেথ, অথচ ব্যাংকারের প্রতিক্রিয়া দেখে ভেতরে ভেতরে মজা পাচ্ছে। দারুণ ভীতু লোক, এবং সময়ে সময়ে বেপরোয়া। আড়চোখে লক্ষ করল জাজকে, কিছু একটা ভাবছে সে।
পারলে ও-ই পারবে, মার্শালের তারাটা ওকেই দাও, জাজ, বলল একজন। দুজন সমর্থন করল তাকে।
ঠিক আছে, ম্যাকলীন, জাজের আপসী গলা। তোমার কথাই থাকল। এখন থেকেই কাজে নেমে পড়ো। আমরা চাই এ শহরের আর একটা লোকও যেন মারা না পড়ে কিংবা কোন দোকান বা বাড়ির যাতে ক্ষতি না হয়। এসব সামলানোর। পরেও টার্নারকে ধরবে তুমি এবং লুটের টাকা উদ্ধার করবে। আর হ্যাঁ, কাজ শেষে পাবে তোমার পাওনা।
ভাল গ্যাড়াকলে পড়েছে, ভাবল জেথ। একটু আগেও মনে হয়েছিল দুএকজনের সাহায্য পাবে, এখন আর সে-সম্ভাবনা রইল না। লোকগুলোর ওপর খানিকটা বিতৃষ্ণা অনুভব করছে, নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকবে এরা। অনেকেই ধরে নিয়েছে অসম্ভব এ কাজটি ওর দ্বারা সম্ভব হবে না, এদের একজন স্বয়ং জাজ।
তঙ্কররা হোয়াইটস্টোনে কয়েকবার এসেছে, ওদের ঘোড়াগুলো দেখে মনে হয়নি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। তারমানে কাছাকাছি কোথাও ওদের হাইড আউট। এটা অবশ্য রোয়ানার ধারণা। হোয়াইটস্টোনের আশেপাশে প্রতিটি পর্বতশ্রেণী, গিরিখাত আর উপত্যকা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে মেয়েটা, এঁকে দেখিয়েছে। ওর মতে লুকানোর উপযুক্ত জায়গা পুমাস ক্যানিয়ন অথবা তার কাছাকাছি কোন জায়গা যেটা ট্যালন ভ্যালি বা ক্যাপেশাস ক্যানিয়নও হতে পারে। টার্নার নিশ্চয়ই উপযুক্ত স্থানটি বেছে নিয়েছে। ডাকাতির পর দুবৃত্তরা ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন দিকে এবং শেষে কোথাও গিয়ে মিলিত হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। জেথ ঠিক করেছে উত্তরের ট্রেইল ধরে পুমাস ক্যানিয়নের কাছে যাবে প্রথমে। নতুন কেনা হেনরীটার পরীক্ষাও নেয়া যাবে কোন এক ফাঁকে। স্যাডলে চেপে উত্তরে এগোল ও। কিছু লোক চিৎকার করে আর টুপি নেড়ে ওকে উৎসাহ দিচ্ছে। একটু আগের বিরক্তি আর রাগ চলে গেল ওর।
শহর ছাড়িয়ে এসে দেখতে পেল বিবর্ণ ট্রেইলটা। ডানে থালার ন্যায় প্রসারিত মাঠে সবুজ ঘাস, তবে র্যাঞ্চিংয়ের জন্যে উপযুক্ত নয়। ঘাসের বৃদ্ধি এত কম যে গরু একবার খেয়ে গেলে দুই সপ্তাহেও ফের খাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠবে না। তেমন ঘন হয়েও জন্মায়নি। এপাশে বিশাল ঢালু জমি অনেক দূরে উঁচু পর্বতের। চূড়ায় গিয়ে মিশেছে, বালি আর কাঁকরপূর্ণ, রয়েছে অসংখ্য খুদে খুদে বোল্ডার, গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা কিছু সাইক্যামোর ঝোপ।
ট্রেইলটা পশ্চিমে নাক বরাবর চলে গিয়ে দিগন্তের ও-মাথায় বাঁয়ে বাক নিয়েছে। সেখানে ঘন সবুজের অ্যাসপেনের বন। পেছনে মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়ে চোঙাকার জারকান পিস্, এখানকার সবচয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। ট্রেইলে মাত্র একজন ঘোড়সওয়ারের ট্র্যাক, সম্ভবত দুদিন আগের। অস্পষ্ট তবু এগিয়ে যাওয়া যাবে।
নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই ওর। দুর্বত্তদের সাথে শুরুতে একটা লড়াই হোক এবং তাতে ওদের দুএকজন হতাহত হোক, এটাই চাইছে। এরপর টার্নার দলবল নিয়ে শহরে এলে মোকাবিলা করবে। কাজটা কঠিন, ওর ইচ্ছে মাফিক সবকিছু ঘটবে না এটাই স্বাভাবিক। সবকিছু আসলে নির্ভর করছে টার্নারের মর্জির ওপর। এমন হতে পারে তস্করদের হাইড আউট খুঁজে পাবে না জেথ, উল্টো ওকে দেখে একটা সীসা কপালে সেঁধিয়ে দেবে শুধু।
তবু আশাবাদী জেথ, যে সন্দেহ মনে ধুকপুক করছে তা খতিয়ে দেখতে চায়।
ইতোমধ্যে অনেকখানি চলে এসেছে। এদিকটা বেশ খোলামেলা। বাম দিকের ঢালে উঠে এল। লম্বাটে রুক্ষ এক টুকরো জায়গা, অদূরে পর্বতের বিশাল কাঠামো। কাছাকাছি অনেকগুলো ঝোপ। ঘোড়াটাকে তারই একটার আড়ালে রেখে স্যাডল ছাড়ল হেনরীর হাতে। বক্স এলডারের একটা ডালে নিশানা করে অনুশীলন করল কিছুক্ষণ, তারপর অসন্তুষ্ট হয়ে কোল্ট নিয়ে বিভিন্ন অবস্থানে। কসরত করল। জেরেমি মিলার ওর পিস্তল ছিনিয়ে নিয়েছিল, বদলে তার কান কেটে নেবে, ঠিক করল জেথ।
সূর্য ধীরে তেতে উঠছে, ঘামছে ও। ঘোড়ার কাছে এসে পানি পান করল। তারপর স্যাডলে চেপে ইচ্ছেমত এগোতে দিল গ্রে-টাকে।
এই জেথ, দাঁড়াও! পেছন থেকে চেঁচাল কেউ।
থেমে, পেছনে তাকাল জেথ। ছুটে আসছে এক অশ্বারোহী, কে হতে পারে? গলাটা মেয়েলি। রোয়ানাই বোধ হয়। কিন্তু মিলের কাছে থাকার কথা মেয়েটার, গতরাতে তাই বলেছিল। হয়তো শহরে আবারও কিছু ঘটেছে, কিংবা জরুরী কোন তথ্য জানাতে এসেছে।
ওর পরনে রাইডিং পোশাক-লেভাইসের প্যান্ট, তারওপর চ্যাপস, ফ্লানেলের শার্ট, ভেস্ট আর ব্যানডানা। লম্বা চুলগুলোকে ঢাকতে পারেনি কাউবয় হ্যাট। মোটেও পুরুষের মত লাগছে না, ভাবল জেথ, বরং নারীত্বের লক্ষণগুলো ফুটে উঠেছে বিভিন্ন অঞ্চলে।
তোমার সাথে যাব, সহাস্যে ঘোষণা দিল রোয়ানা।
ওর স্যাডল বুটে একটা লী এনফিল্ড। অবাক হলো জেথ, আসলে সপ্রতিভ এ মেয়েটিকে এভাবে কখনও কল্পনা করেনি। এর কারণ রোয়ানা বরাবর এ ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে এবং ও আদ্যোপান্ত পুবের মেয়ে-জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে সেখানেই। মাত্র তিনটে বছরে পশ্চিম ওকে বদলে দিয়েছে।
জেথের অনুসন্ধানী দৃষ্টি আঁচ করতে পারল রোয়ানা। এদিকটা ভাল করে চিনি, অস্বস্তিতে স্যাডলে নড়েচড়ে বসল। ঝামেলা করব না বরং তোমাকে সাহায্য করতে পারব। রাইফেল দেখে অবাক হয়েছ, না? আর সবার মত হুজুগে পড়ে নিইনি, ভালই চালাতে পারি। যদি বলো তোমার সাথে ডুয়েল লড়তে পারি। চোখে চোখ রেখে হাসল ও, কৌতুক ফুটে উঠেছে কালো চোখে। সেটা অবশ্য আমার জন্যে মোটেও ভাল হবে না। তোমার কিছু হলে বুড়ো আমাকে খুন করবে।
শ্রাগ করে ঘোড়া ছোটাল জেথ। রোয়ানা পিছু নিল।
কিছুদূর আসার পর দুপাশে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর চোখে পড়ল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক গরু চরছে। জমিতে বেড়া বা কাটাতার নেই, ট্রেইলের এ-পাশের জমিও সম্ভবত একই মালিকের। খানিক দূরে বিশাল এক জশুয়ার নিচে একটা কেবিন। পেছন হাঁটু অবধি লম্বা ঘাস, আর সামনে কাঠ দিয়ে তৈরি ছোট ছোট কয়েকটা খোপ, গবাদি পশু রাখার জন্যে। পাশে দুটো দৈত্যাকার ওঅটর ট্রাফ।
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগোল রোয়ানা। এটা ট্রিপল ক্রস, স্যাম জারভিসের বাথান। খুব শিগগির ধনী হতে যাচ্ছে বুড়ো। কদিন আগে ওর জমিতে তেল পাওয়া গেছে। সার্ভেয়াররা ঘোষণা করার পর থেকে ব্যাপারটা নিয়ে সাড়া পড়ে গেছে সবখানে।
ইদানীং সোনার মত তেলও মানুষকে আলোড়িত করছে। এরপর হয়তো আলোড়িত করবে কয়লা, রত্ন বা অন্য কোন খনিজ পদার্থ। প্রকৃতিতে এসব পাওয়া না গেলেই ভাল হত-মানুষে মানুষে অযথা শত্রুতা বা রেষারেষি হত না।
বিশালদেহী এক বুড়ো বেরিয়ে এল কেবিন থেকে, হাতে রিপিটার। লম্বা দাড়ি বুক ছাড়িয়ে পেট অবধি পৌঁছেছে। ভাবলেশহীন মুখ, কিন্তু শীতল চোখে রাজ্যের সন্দেহ। পাকা গাথুনির শরীর, ময়লা কাপড় ভেদ করে সদপে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করছে পেশীগুলো। সত্তর হবে বয়স, কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের বদৌলতে শরীরের ভাঙন আটকে রেখেছে।
সুপ্রভাত, রোয়ানা। এসো কফি আছে। ঘুরে কেবিনে ঢুকে পড়ল বুড়ো।
স্যাডল ছেড়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। গোছানো কেবিন-একপাশে খাটিয়া, মাঝে টেবিল আর দুটো চেয়ার। দেয়ালে কয়েকটা বাফেলো ও কুগারের করোটি ৭ জেথ ধারণা করল অদ্ভুত এ বুড়োর সাথে রোয়ানার সম্পর্ক ভালই, যদিও লোকটাকে সুবিধের মনে হয়নি ওর কাছে। ওদের পরিচয়ের সময়েও ভাবলেশহীন থাকল সে, তবে দৃষ্টি থেকে সন্দেহের ছায়া বিদায় নিয়েছে। যাকে তাকে নিশ্চয়ই শত্রু ভাবছে না?
কোথায় যাচ্ছ? শুকনো খটখটে গলা ট্রিপল ক্রস মালিকের।
পুমাস ক্যানিয়নের ওদিকটায়।
ওদিকে আবার কি দরকার পড়ল? বাথান আর মিল ছেড়ে তুমি তো নড়োই না।
তুমি আসলেই কুঁড়ের বাদশা, স্যাম! শহরের কোন খবরই দেখি রাখছ না। শনিবার বিকেলে ডাকাতি হয়েছে ব্যাংকে। এক লাখ লুট করার পর বাক টার্নার। ওদিকেই সরে পড়েছে, মানে আমার ধারণা আর কি… পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল রোয়ানা।
শুনতে শুনতে চিন্তিত হয়ে পড়ল স্যাম জারভিস। মলিন দেখাচ্ছে মুখ। ওখানে হোল্ডেন আর তোমার টাকাই বেশি ছিল, তাই না? তিক্ত কণ্ঠে বলল বুড়ো। পরোক্ষভাবে আমারও ক্ষতি হয়ে গেল। তোমরা কেউই জমিটা কিনতে পারবে না। নগদ টাকা তো হারিয়েছই, উপরন্তু যার যার সম্পত্তি-যেগুলো মর্টগেজ রেখে সিটি ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে। বাকি রইল উইলি আর ইস্টার্ন পেট্রোল কোম্পানি। অবশ্য মিলারও অংশ নিতে পারে, স্টোর ধ্বংস হওয়ার পর আদৌ যদি কুলিয়ে উঠতে পারে। সাফ কথা, আমি আশানুরূপ দাম পাব না। হোল্ডেন সবচেয়ে বেশি অফার দিয়েছিল, তারপর তুমি, তাই না? উল্টোদিকের দরজা দিয়ে ভেতরের কামরায় চলে গেল জারভিস, ফিরে এল মিনিট খানেক পর। কফি আর ঘরে তৈরি বিস্কুট পরিবেশন করল।
হোল্ডেন জমি কিনতে পারবে, সম্ভাবনা বাতলে দিল রোয়ানা। ব্যাংক মর্টগেজ রেখে ঋণ পাবে সে। তাছাড়া আমার ধারণা সব টাকা লুট হয়নি। সে নিজেই বলেছে এক লাখের কিছু বেশি।
আরেকজন বাড়ল, নিস্পৃহ কণ্ঠে মন্তব্য করল জারভিস।
পুমাস ক্যানিয়ন এখান থেকে মাইল চারের কিছু বেশি, ভাবছে জেথ। তস্করদের একজন টাকা চুরি করেছিল এবং মারা গেছে খুবই ভাগ্যবান একজন অজ্ঞাত লোকের হাতে, যাকে কিনা ধরতে চাইছে বাক টার্নার। সে নোক কি ধারে-কাছেই থাকে? কি করে জানল ওই সময়ে ওখানে উপস্থিত হবে দুবৃত্ত, একেবারে টাকাসহ? লোকটি কি জারভিস? হতে পারে, না-ও হতে পারে। তবে এটা ঠিক বুড়োর আচরণ কেমন অস্বাভাবিক। দেখে যে কেউ বিরূপ ধারণা পোষণ করতে পারে।
জেথ আসলে সন্দেহের ওপর নির্ভর করছে। ওর ধারণা দুর্বত্ত চোরটির কথা আগে থেকে জানত খুনি, ওঁৎ পেতে ছিল। হতে পারে দৈবাৎ যোগাযোগ কিন্তু তাহলে কতগুলো প্রশ্ন থেকে যায় কিভাবে সে জানল টাকাসহ পালাচ্ছে তস্কর কখন? যদি আগে থেকে না-ই জানত তবে স্যাডল ব্যাগ হাতড়ে এতগুলো টাক পেয়ে যাওয়া-নাহ, কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তাছাড়া দুর্বত্তকে কেন খুন। করবে সে, টাকার কথা নিশ্চয়ই নিজ থেকে বলেনি লোকটা। সবচেয়ে বড় কথা বাক টার্নার সত্যি বলছে কি-না। জেথ আশা করছে জায়গাটা খুঁজে পেলে, ওখানে। হয়তো এমন কোন চিহ্ন বা সূত্র পাওয়া যাবে যাতে পুরো ব্যাপারটা কিছুটা হলেও খোলসা হবে।
ট্রিপল ক্রস ছেড়ে ফের রওনা দিল ওরা।
কিছুদূর এগিয়ে দক্ষিণে মোড় নিল ট্রেইল। প্রচুর গরুর খুরের দাগের মধ্যে আসল ট্রাক খুঁজে বের করতে বেশ কষ্ট হলো, মাইল খানেক আসার পর অবশ্য আর অসুবিধা হলো না। জেথ নিশ্চিত যে-ট্রাক ধরে এগোচ্ছে, ওটা ট্রেস করেই শহর থেকে এসেছে। চলার পথে অ্যাম্বুশ করার মত জায়গা দেখতে পেলে এড়িয়ে যাচ্ছে নয়তো সতর্ক থাকছে। ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলছে মাথায়। ডাকাতির পর। ছড়িয়ে পড়েছিল দলটা, তারপর মিলিত হয়েছে কোথাও, এসব ক্ষেত্রে তাই হয়। যদি পুমাস বা ক্যাপেণাস নিয়ন হয়ে থাকে, পৌঁছুতে বিকেল হয়ে যাওয়ার কথা। ক্যাম্প করতে সময় লেগেছে, সন্ধ্যায় ফুর্তি করা খুব স্বাভাবিক। রাতে এমন একজন পাহারায় ছিল বা পাহারায় না থাকলেও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল যে এতগুলো টাকার লোভ সামলাতে পারেনি। যে করে হোক টাকা নিয়ে সটকে পড়ে সে, সম্ভবত মাঝরাতে। হাইড আউট থেকে বেরোনোর সময় কিংবা এর পর আক্রান্ত হয় লোকটা। যোগাযোগটা কোনক্রমেই কাকতালীয় হতে পারে না। খুনী নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছিল, জানত কোন পথে কখন আসবে দুবৃত্ত।
সবকিছুই জেথের অনুমান আর খানিকটা যুক্তির সমন্বয় কেবল। এর পেছনে নির্দিষ্ট কোন সূত্র নেই, তবে ওর স্থির বিশ্বাস ঠিক এটাই ঘটেছে। টার্নারও শহরে গিয়ে ভাওতা মারছে না। এতগুলো টাকা পাওয়ার পরও ঝুঁকি নেয়া অস্বাভাবিক। জেথ তার জায়গায় হলে ভুলেও শহরমুখো হত না। যত ভয়ই দেখাক না কেন সাধারণ মানুষ একবার খেপে গেলে রক্ষা নেই, ভাল করে জানে টার্নার। যার। নামে এক ডজন হুলিয়া আছে, তার পক্ষে আরেকটা ওয়ান্টেড পোস্টার বাড়ানো কোন ব্যাপার না হলেও, সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার ঝুঁকি কেউই নেয় না। পশ্চিমের মানুষ হুজুগে ও বেপরোয়া, একবার খেপে গিয়ে পিছু নিলে গায়ের চামড়া আস্ত থাকবে না। হোয়াইটস্টোনে এখনও তা ঘটেনি এজন্যে যে টার্নার বেছে বেছে প্রতিষ্ঠিত কিছু লোকের ক্ষতি করেছে যাদের প্রতি সাধারণ হোয়াইটস্টোনবাসীর সহানুভূতি খুব কমই আছে।
ঘাতক লোকটা টার্নার নিজে হতে পারে, বা দলের অন্য কেউ। সে নিজে হয়ে থাকলে বাড়তি লাভের আশায় শহরে হামলা করবে না। এতটা বোকা সে নয়। এক ডজন হুলিয়া থাকার পরও যে বেঁচে থাকে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। টার্নার যদি ঘাতক হত, টাকা নিয়ে সটকে পড়ত। অন্য কেউ করেছে কাজটা। রাতের বেলা ট্র্যাক লুকানো কঠিন কাজ, সুতরাং তা থাকবেই। জেথ ঠিক এ কারণে আশাবাদী, দুএকটা সূত্র পেয়েও যেতে পারে। অন্তত সন্দেহটা যদি নিরসন হয় তো মন্দ কি, ভাবল ও।
পুমাস ক্যানিয়নের মুখে পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন দেহটা। চারপাশে প্রচুর ট্রাক দেখতে পেল জেথ। খুঁটিয়ে দেখল সব। দুজনের বুটের ছাপ মৃতের কাছে এসে ডানদিকে ফিরে গেছে। এদের একজন সম্ভবত শহুরে মানুষ, ধারণা করল জেথ, যে বলতে গেলে ঘোড়ায় চড়েই না। দুপায়ের পাতার দূরত্ব অপেক্ষাকৃত কম। এ লোকের ট্র্যাকের প্রতি আগ্রহবোধ করল ও।
ত্রিশ গজ এগোতে আধ ঘণ্টার মত লেগে গেল। উঁচু ঢালের ওপর ঝোঁপের আড়ালে ট্রাক চলে এসেছে। একটা নাল লাগানো ঘোড়ার ছাপ পাওয়া গেল সেখানে। লোকটা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল। সিগারের কয়েকটা অর্ধাংশ পড়ে আছে। সব লোক সিগার খায় না এবং কেবল প্রভাবশালীরাই বার বার এভাবে অর্ধাংশের বেশি ফেলে দিতে পারে। তারমানে যে সে তোক নয়, পুলক। অনুভব করছে জেথ, অভিজাত কোন লোক খুন করেছে দুর্বত্তকে-কোন সুযোগ না দিয়েই, কারণ মৃতের হোলস্টার আর সিক্সগান পরখ করেছে ও, গুলি ছোড়া দূরে থাক অস্ত্রটা হোলস্টার থেকে বের করতে পারেনি হতভাগ্য লোকটা।
দুবৃত্তের ট্র্যাক ধরে পুমাস ক্যানিয়নে ঢুকে পড়ল জেথ। ট্র্যাক লুকানোর চেষ্টা করেনি টার্নার, চারদিন আগের ট্রাকগুলোও স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। ক্যাম্প পর্যন্ত অনায়াসে পৌঁছে গেল। মিনিট দশ পর ফিরতি পথ ধরল। ভাবছে, কানা একটা ক্যানিয়নে কেন আশ্রয় নিয়েছিল টার্নার? অবরোধের আশঙ্কা তার মাথায় আসেনি? আরেকটা ব্যাপার, ওই একটা রাতই কাটিয়েছে এখানে। কেউ তাদের তাড়া করেনি বা পিছুও নেয়নি। তাহলে সরে পড়ল কেন? শুধু শনিবার রাতটা এখানে থাকার কি আলাদা কোন গুরুত্ব আছে?
জেথের সন্দেহ, গূঢ় কোন কারণে কানা এই ক্যানিয়নে শনিবার রাতটা কাটিয়েছে বাক টার্নার।
বেরিয়ে এসে ঘাতক লোকটার ট্র্যাক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল জেথ। নিজের অনুমানের পক্ষে সূত্র পাওয়ায় দারুণ উৎসাহ বোধ করছে। মৃতদেহের কাছ থেকে ঝোঁপের কাছে ফিরে ঘোড়ায় চেপে পুবে এগিয়েছে লোকটা। জায়গাটা দুৰ্গম, চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে যেতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটা তথ্য জেনেছে ও-ঘোড়াটার রঙ কালো, কাটা গাছে লোম লেগেছিল; ওটা বুনো আর চঞ্চল স্বভাবের, যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমত ঘাস মাড়িয়েছে; ঘোড়াটা লম্বা ও উঁচু, সামনে-পেছনে পায়ের দূরত্ব সাধারণ ঘোড়ার চেয়ে বেশি, লম্বা ঘোড়া উচ্চতায়ও বেশি হয়ে থাকে। কয়েকদিনের পুরানো ট্র্যাক। জায়গাটা রুক্ষ বলে অস্পষ্ট, নরম মাটিতে পড়লে হয়তো বোঝা যেত। ওর ধারণা শেষ পর্যন্ত হয়তো নিরাশ হতে হবে না।
গনগনে তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। প্রচণ্ড তাপে চাদি ফেটে যাওয়ার জোগাড়। ঘেমে গেছে জেথ, শরীরের সাথে শার্ট লেপ্টে আছে। একটা মেসায় উঠে আসার পর মেসকিট ঝোঁপের আড়ালে ছায়া দেখতে পেয়ে থামল। দারুণ ক্লান্তি লাগছে ওর। ছায়ায় বসে মাথা থেকে হ্যাট সরিয়ে দিতে খানিকটা হালকা লাগল। ব্যানডানার গিট আলগা করে কপাল, ঘাড় আর মুখ মুছল।
ঘোড়া দুটোর লাগাম হাতে অনুসরণ করছিল রোয়ানা। স্যাডল ব্যাগ থেকে খাবার বের করে পাশে বসল। খেয়ে নাও, প্যাকেট খুলে এগিয়ে দিল। ট্র্যাকিংয়ের ছাই-পাঁশ কিছুই বুঝি না আমি। এতক্ষণ ধরে যা জেনেছ, খেয়ে জানাবে আমাকে। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু?
জেথ কথা বলতে পারে না, মেয়েটা বোধহয় তা ভুলে গেছে, ভাবল ও।
মিনিট দশ বিশ্রাম নিয়ে ফের কাজে নামল। মেসার ঢাল বেয়ে নেমে গেছে লোকটা। কাজটা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে গেল এবার। প্রচুর ঘাস এদিকে, তেমন কোন চিহ্ন এখন আর অবশিষ্ট নেই। কিছু ঘাস দলে গেলেও আড়াই দিনে ফের সোজা হয়ে গেছে। চটকানো মাটি আর ঈষৎ নুয়ে পড়া ঘাস দেখে, তার সাথে অনুমান ও সম্ভাবনা মিলিয়ে এগোনো ছাড়া উপায় নেই।
ঘন্টাখানেক বাদে বেশ কিছু দূরে একটা অ্যাসপেনের নিচে এসে ক্লান্ত দেহে বসে পড়ল জেথ। চারদিক কেমন নীরব, শূন্য মনে হলো। শুভ্র মেঘ থমকে আছে আকাশে, নডছে না গাছের একটা পাতাও। গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে। নাহ, জেরেমি মিলারের স্টোরে মারের ধকলটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনও, ভাবল জেথ।
পানির ক্যান্টিন এগিয়ে ধরল রোয়ানা। জেথ, আমি দুঃখিত, আন্তরিক শোনাল ওর কণ্ঠ। মাঝে মাঝে আমি ভুলে যাই যে তুমি কথা বলতে পারো না। তোমার আর সবকিছু এত স্বাভাবিক যে…
হেসে ওকে আশ্বস্ত করার প্রয়াস পেল জেথ। সহসা সামনে দুটুকরো কাগজ পেয়ে খুশি হয়ে উঠল ও। কিছু ছাই পড়ে আছে ওগুলোর সাথে। পুলকিত হলো জেথ, এত পরিশ্রম বৃথা যায়নি। পেন্সিল সাথে ছিল, বের করে কাগজ দুটোয় লিখে রোয়ানাকে জানাল সবকিছু।
ডাকাতি করার জন্যে শহরেরই এক লোক ভাড়া করেছে বাক টার্নারকে। রাতে এক দুবৃত্ত চুরি করল টাকাগুলো। পুমাস ক্যানিয়নের বাইরে অপেক্ষা করছিল শহরের সেই লোক অথবা তারই নিযুক্ত কেউ, যদিও তার নিজের থাকার সম্ভাবনা বেশি। দুবৃত্তকে খুন করে টাকা হাতিয়ে নেয় সে। পরদিন থেকে শহরে আক্রমণ করল টার্নারের দল, সবই পূর্ব পরিকল্পিত। ক্ষতি হলো রোয়ানা ম্যাকলীন, ডগলাস গ্রীন, জুলিয়াস হোল্ডেন আর জেরেমি মিলারের। পুরো পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কেবল প্রতিদ্বন্দীদের আর্থিকভাবে দুর্বল করা নয় বরং লোকটা পানির দামে ট্রিপল ক্রস কিনতে চাইছে। এখানকার বেশিরভাগ ক্রেতাকে আর্থিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে সে, বন্ধকী রেখে যাতে ব্যাংক ঋণ পেতে না পারে সেজন্যে কয়েকজনের সম্পত্তিও ধ্বংস করেছে।
ওহ গড! বিস্ফারিত হয়ে গেছে রোয়ানার চোখ। পুরোটাই সত্যি মনে হচ্ছে, মিলে যাচ্ছে সব! জেথ, তেমন লোক… ভাবছে ও। ধনী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী…ডাকাতি বা টার্নারের দ্বারা ক্ষতি হয়নি বরং বাড়তি এক লাখ ডলার এখন তার হাতে, এমন একজন যে হোল্ডেনের ব্যাংকে টাকা রাখেনি…পেয়েছি! উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ, অস্ফুট স্বরে বলল, তেমন লোক একজনই….জাজ উইলসন হলেন!
.
০৬.
তুমি যা ধারণা করেছ, হয়তো সত্যি তাই ঘটেছে। কিন্তু প্রমাণ করবে কিভাবে? চিন্তিত দেখাল রোয়ানাকে।
পরিষ্কার কোন পরিকল্পনা জেথের নেই। আপাতত কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। বাক টার্নারকে বাগে পেলে অবশ্য পেছনের লোকটার মুখোশ খুলে দিতে পারবে। কিন্তু ওটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। স্যাম জারভিসের কথা মনে পড়তে কাগজে লিখল: ট্রিপল ক্রসের নিলাম কবে?
আগামীকাল হওয়ার কথা ছিল। এখন নিশ্চয়ই পিছাবে। ক্যান্টিন থেকে পানি পান করল রোয়ানা, মুখে ছিটাল এরপর। হ্যাট খুলে ছেড়ে দিল অবিন্যস্ত চুল। জেথ, তুমিও কিন্তু কম বুদ্ধিমান নও,মুগ্ধতা ওর কণ্ঠে। কয়েকদিন আগের চিহ্ন দেখে এতকিছু আঁচ করা সহজ ব্যাপার নয়। জেথের চোখে স্থির হলো ওর। দৃষ্টি, কি যেন ভাবল। আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত সফল হবে তুমি, সেটা অবশ্য বেশ কঠিন হবে।
কাগজের টুকরো আর পেন্সিল পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল জেথ। দুবৃত্তরা কি ধারেকাছেই আছে, ভাবছে ও, হয়তো দেখেছে ওদের। যদি দেখে থাকে, হামলার আশঙ্কা হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাক টার্নার এতক্ষণে বুঝতে না পারলেও আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টের পেয়ে যাবে তার জন্যে বিপদের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে জেথ। এখানে না হলেও শহরে অন্তত দেখা হবে, অন্তস্তল থেকে টের পাচ্ছে ও।
ফিরতি পথ ধরল ওরা।
শহরে পৌঁছে লুইফ বেক্সটারের সেলুনের দিকে এগোল। চমঙ্কার বিকেল, পরিষ্কার আকাশ। মৃদু বাতাস বইছে। কৌতূহল নিয়ে ওদের দেখছে শহরের লোকেরা। মাঝ রাস্তায় জাজকে দেখে ঘোড়ার রাশ টানল জেথ।
টার্নারের খোঁজ পেলে? জানতে চাইল উইলসন হলেন।
মাথা নাড়ল-জেথ।
পাঁচ হাজার ডলারের আশা কি এখনও আছে?
তীক্ষ দৃষ্টিতে জাজকে দেখছে জেথ। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তাচ্ছিল্যের সাথে কথাগুলো বলেছে কি-না।
নিজের টাকা তুমি কোথায় রাখো, জাজ? জানতে চাইল রোয়ানা।
হাচিনসনের ব্যাংকে, হাসল সে। এ-তো সবাই জানে।
ডাকাতিতে তোমার কোন ক্ষতি হয়নি। তুমি সত্যি ভাগ্যবান।
একটা সিগার ধরিয়ে রোয়ানার কথাগুলোর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছে সে।
নিলামে দর হাঁকাবে?
ওটা কেনার মত টাকা আমার আছে।
ধন্যবাদ দিয়ে ঘোড়ার রাশ ঢিলে করল রোয়ানা। জাজ সামনে থেকে সরে যেতে এগোল। সেলুনে এসে বসল ওরা। জেথের জন্যে হুইস্কি আর নিজের জন্যে জুসের ফরমাশ দিল। কিছু বুঝতে পারলে? লুইফ পানীয় দিয়ে যেতে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল। ওর সবকিছু একেবারে স্বাভাবিক।
মাথা নাড়ল জেথ।
চলো, তোমার জন্যে কাপড় কিনব, জুস শেষ করে উঠে দাঁড়াল রোয়ানা। সব তো পুড়ে গেছে।
কাগজ-পেন্সিল বের করে লিখল জে: কোন কিছু জানতে চেয়ো না। কিছুক্ষণ থাকব এখানে। সন্ধ্যার পর কাপড় কিনব। এ সুযোগে মিলের কাছে যাও, সারাদিনে মেরামতের কাজ তদারক করতে পারোনি।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল রোয়ানা, চোখে ভয়। তুমি ওদের আশা করছ, তাই না? জেথ, তুমি একা!
হেসে ওকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করল জেথ।
কি যেন ভাবল মেয়েটা, তারপর শ্রাগ করে বেরিয়ে গেল।
টার্নার আসবে, এটা একরকম নিশ্চিতই। জেথ বাক টার্নার হলে একটা কাজই করত এখন-জেথ্রো ম্যাকলীনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিত।
সময় নিয়ে সিগারেট রোল করল ও। ধরিয়েছে, এ সময়ে সামনে এসে দাড়াল লুইফ। তোমাকে আরেকবার দেব নাকি? নিষেধ করতে চলে গেল সে।
নিজের অবস্থানটা দেখল জেথ। সেলুনের এককোণে বসে আছে, দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে। এখানে ঢোকার পর ওকে খুঁজবে টার্নার, ডানে তাকালে দেখতে পাবে…প্রচুর সময়। ঢুকেই গুলি করতে পারে এমন সুযোগ দেয়ার ইচ্ছে ওর নেই।
.
বাক টার্নারের কাজ আপাতত একটাই-বোবা ওই ছোকরাকে খুন করা। ছেলেটা অবশ্য খুব স্মার্ট, পিস্তলেও বোধহয় চালু। কিন্তু তিনজনকে একা সামলাতে পারবে না। কার্লি, মরগান আর পিটকে মনোনীত করেছে এ-কাজে। যোগ্য লোক।
দুপুর পর্যন্ত দিনটা সে কাটিয়েছে হোয়াইটস্টোন থেকে মাইল খানেক দূরে এক উপত্যকায়। ঘুরে-ফিরে নজর রেখেছে শহরের ওপর। জানত জেথ্রো ম্যাকলীন পুমাস ক্যানিয়নের দিকে আসবে, তাই ক্যাপেশাস ক্যানিয়নে রাত, কাটানোর পর সরে এসেছে দলবল নিয়ে। কেবল ডরম্যান ছাড়া। ম্যাকলীনের ওপর নজর রাখার জন্যে রয়ে গেছে সে, এবং সুযোগ পেলে নিকেশ করে। ফেলবে। ডরম্যান তা পারেনি, খুব বেশি সতর্ক বোবা ছেলেটা, ট্র্যাকিংয়ের সময়েও চারপাশে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে।
তিনজনকে মনোনীত করার পরও খুব নিশ্চিন্ত হতে পারছে না টার্নার। ভরসার কথা-জেথ্রো ম্যাকলীন একা। তাকে সাহায্য করার মত হোয়াইটস্টোনে নেই কেউ, অন্তত এখন। এখানকার ঘটনা কাউন্টির বাইরে জানাজানি হলে ইউ। এস মার্শাল বা শেরিফ চলে আসতে পারে, বলা যায় না অবস্থা গুরুতর আঁচ করতে পারলে এক ডজন আমিও চলে আসতে পারে। সেরকম কিছু হওয়ার আগেই কেটে পড়তে চায় টার্নার। এই প্রথম একটু ভিন্ন ধরনের কাজে জড়িত হয়েছে ও-বেশি মুনাফার আশায়। চেহারা দেখানোর ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাই।
নিজের মাথায় পাথর ভাঙার ইচ্ছে ওর নেই, তাই সকালে শহরে আসেনি। শহরে ঢোকার পর সহিংসতা এড়ানো তার নিজের পক্ষেও কষ্টকর। কিন্তু উপর্যুপরি হামলায় হিতে বিপরীত হতে পারে। ভয়-আতঙ্কের বদলে তখন নিরীহ লোকগুলোর মধ্যে জন্ম নেবে সাহস, প্রতিহিংসা। উন্মত্ত লোকেরা তখন ওকে খুঁজে বেড়াবে, খুঁজবে ভয়ঙ্কর টেক্সাস রেঞ্জাররা বা বাউন্টি হান্টাররা। তেমন হলে ধরা পড়তে বাধ্য। শহর কমিটি এরমধ্যে ভাড়া করে ফেলেছে বোৰা ছেলেটাকে, আর সে-ই ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোকরার বয়স কম হলে কি হবে যা তেজ! ট্র্যাকিংয়ে যাদু জানে। স্লিম বেকারসহ সবার ট্র্যাক ঠিক ঠিক খুঁজে পেয়েছে। অথচ তার জায়গায় টার্নার নিজে হলে আড়াই দিনের পুরানো ট্র্যাক খুঁজে পেত কি-না ওর নিজেরই সন্দেহ আছে। শুধু ভয়ঙ্কর সেজন্যেই নয়, শহরের পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখার জন্যেও ছেলেটাকে খুন করা দরকার। ভয়-আতঙ্ক-সাহস, এগুলো খুব দ্রুত ছড়ায়। আজকের রাতটা পেরোলে জেথ্রো। ম্যাকলীন যে অন্তত কয়েকজন সঙ্গী পাবে তা হলফ করে বলে দিতে পারে সে। সেরকম হলে পরিকল্পনা তো ভেস্তে যাবেই শেষতক পৈত্রিক প্রাণ নিয়ে পিঠটান দিতে হতে পারে।
পুমাস ক্যানিয়ন থেকে ফিরে এসে ক্লান্ত দেহে সেলুনে ঢোকাই স্বাভাবিক, ভাবছে টার্নার, ধরে নেয়া যায় ব্যাংকের উল্টোদিকের লুইফস কর্নারে আছে ছোকরা। খুব সম্ভব এখন দ্বিতীয় পেগ পান করছে।
টার্নার যা ভেবেছিল, দলটাকে দেখে সিঁটিয়ে গেল শহরের লোকজন। প্রত্যেকটা আস্ত গাধা! আনমনে হাসল ও, সকালে আসেনি বলে ধরে নিয়েছে আর আসবে না। একেকটা মুখ পাংশুর মত, বাচ্চারা চিৎকার করছে। হুড়োহুড়ি পড়ে। গেছে রাস্তায়। কেউ বাড়ির ভেতর ঢুকছে, কেউ আবার বেরিয়ে আসছে। চুটিয়ে তা দেখে মজা লুটছে টার্নার।
রাস্তার এক পাশে, ব্যাংক থেকে চল্লিশ গজ দূরে একটা বাকবোর্ড ফেলে সবচেয়ে কাছের বাড়িটার উদ্দেশে ছুটল এক দম্পতি। সিক্সগান বের করে তাদের দুজনকেই ভূপাতিত করল টার্নার। এতে সহজ হয়ে গেল ওদের কাজ। নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেল রাস্তা, একটা কুকুর বা মোরগ পর্যন্ত নেই। বাড়ির জানালাগুলোয় আতঙ্কিত, কৌতূহলী মুখ। বাড়িগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার লোভ বহুকষ্টে সামলে রাখল ও, নাহলে ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ্য হত!
নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে পুরো সজাগ দুবৃত্তেরা। সবার হাতে কক করা রাইফেল। চোখ বাড়ির জানালা বা ছাদ কিংবা গলিতে। খানিক আগে ছাদের। ওপর এক বুড়োকে রাইফেল হাতে দেখে গুলি করে ফেলে দিয়েছে পিটার্স। রাস্তায় পড়ে আছে বুড়োর প্রাণহীন দেহ।
কার্লি, ডরম্যান, পিট, ফাঁকা রাস্তার ওপর নজর বুলিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে নির্দেশ দিল টার্নার। সেলুনে ঢুকে দেখামাত্র গুলি করবে ছোকরাকে, কোন সুযোগ দেবে না।
এগোল নির্দিষ্ট তিনজন। সেলুনের সামনে হিচিং রেইলে বাঁধল ঘোডার লাগাম। তারপর শেষবারের মত ঠিক করে নিল গানবেন্ট আর হোলস্টার। সবার আগে কার্লিই পোর্চে উঠে এল, পেছনে পাশাপাশি অন্য দুজন। মিটিমিটি হাসি খেলা করছে কার্লির ঠোঁটে, বোবা ছেলেটাকে মোকাবিলা করতে সে একাই যথেষ্ট। টস্টোনে একবার তিনজনকে একসাথে মোকাবিলা করেছিল ও, তাদের মধ্যে কেবল একজন গুলি করার সুযোগ পেয়েছিল। ম্যাকলীন কি ওর চেয়েও ফাস্ট হবে? তাছাড়া লড়াই তো হবে একতরফা। দেখামাত্র ড্র করবে ও, অন্যরাও ওর নির্দেশ মত পিস্তল বের করবে। তারপর সহজতম কুপোকাত!
বাইরে থেকে সেলুনের ভেতরকার গুমোট ভাব আঁচ করতে পারল কার্লি। ভেতরে যারা আছে, অবস্থা বেগতিক দেখে সরে গেছে একপাশে। কার্লির আশঙ্কা হলো কেউ হয়তো বোবাটাকে সাহায্য করতে পারে। তাতে অবশ্য অসুবিধে নেই, পিট ও ডরম্যান তাদের সামলাবে।
ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা। ডান পাশে বারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেথ্রো ম্যাকলীন, পা ফাঁক করে। সতর্ক। হেলান দিয়ে থাকায় দ্রুত ড্র করতে পারবে না সে, জানে কার্লি। টের পেল পাশে এসে দাড়িয়েছে ডরম্যান আর পিট।
এবার বয়েজ! হুঙ্কার ছেড়ে কোমরে হাত বাড়াল কার্লি রাফ।
০৭.
নিরীহ লোকজন যাতে ক্রস ফায়ারে না পড়ে তাই শেষ মুহূর্তে মত বদলে বারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে জেথ। অল্প কয়েকজন খদ্দের ছিল, তিন দুবৃত্ত সেলুনে ঢোকার আগেই সরে গেছে নিরাপদ দূরত্বে।
প্রথম লোকটা, সেলুনে ঢুকেই সরাসরি তাকাল জেথের দিকে। চোখে বেপরোয়া চাহনি সতর্ক করল ওকে। বাক টার্নারের নির্দেশ মত, কোন সুযোগ দেবে না-এটাই স্বাভাবিক। ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি হাতে কে দাঁড়িয়ে আছে? তাছাড়া ওরা সেটার পরোয়াও বোধহয় করে না।
অপেক্ষা করছে জেথ। কার্লি হুঙ্কার ছাড়তে বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর হাতে। সমস্ত মনোযোগ তস্করদের, বিশেষ করে কার্লির ওপর কেননা এখানে শক্তপান্না সে-ই। তারপর কমবয়সী ছেলেটা, তার অস্থির চাহনি মানে বিপদ সঙ্কেত।
জেথ অনুভব করল কোল্টটা হাতে উঠে এসেছে। হোলস্টার থেকে বের। করার মুহূর্তে হ্যামার টেনে নিয়েছে। বেশিরভাগ লোক এটা জানে না, এতে দ্রুত পিস্তল বের করেই গুলি করা যায়। সবাই অবশ্য বের করার পর হ্যামার টানে, নয়তো ডুয়েলের আগে হ্যামার টেনে রাখে। সময়ের হেরফের খুব বেশি না, কিন্তু এটাই জেথের কাছে স্বচ্ছন্দের, সময়ও কম লাগে। ডুয়েলের সময় সেকেন্ডের ভগ্নাংশও অতি মূল্যবান।
কার্লি রাফের বাম বুকে ছোট্ট একটা ফুটোর সৃষ্টি হলো, গুলির ধাক্কায় ব্যাটউইং দরজার ওপর ছিটকে পড়ল সে। হোলস্টার থেকে বের করেছে জোড়া পিস্তল। শুধু ডানহাতের সিক্সশটার তুলে নিশানা করার চেষ্টা করল। তার চওড়া কপালের জন্যে দ্বিতীয় বুলেটটা বরাদ্দ করল জেথ। মেঝেয় আছড়ে পড়ল বিশাল দেহ, পিস্তলধরা হাতগুলো ধীরে দেহের পাশে জায়গা করে নিল, তারপর শিথিল হয়ে গেল মুঠি।
একটা টেবিল লক্ষ্য করে ঝাঁপ দেয়ার সময় জেথ খেয়াল করল সক্রিয় হয়ে উঠেছে অন্যরা। ওর প্রশস্ত কাঁধের ধাক্কায় একদিকে কাত হয়ে পড়ল টেবিলটা, জেথ তার আড়ালে। আধশোয়া অবস্থায়, পড়তে পড়তে গুলি করেছে তরুণকে, হাঁটুর নিচে যাতে হাড় ভেঙে যায়। হোঁচট খাওয়ার মত সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল ছেলেটা, ব্যথায় নীল হয়ে গেছে মুখ। সামলে নিয়ে নিশানা করল সে। আরেকটা বুলেট তার উরুতে বেঁধাল জেথ। ধীরে হাঁটু ভেঙে মেঝেতে পড়ে গেল, প্রার্থনায় বসেছে যেন কোন প্রীস্ট। সিক্সগান পড়ে রয়েছে পাশে, ধরার চেষ্টা করেও পারল না।
তৃতীয়জন, বন্ধুদের পতনে যদিও হতচকিত ঠিক সময়েই ড্র করেছে। ওর পাঠানো গুলিটা জেথের আধ হাত দূর দিয়ে গিয়ে বারে বিধল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় বিরক্তিতে কুঁচকে উঠল কপাল, ফের নিশানা করার চেষ্টা করল। তার হাতের কজিতে গুলি করল জেথ। পিস্তল ফেলে দিয়ে অন্যহাতে কজি চেপে ধরল সে। চোখে-মুখে নিখাদ আতঙ্ক। জখম থেকে চুইয়ে পড়া রক্তের ওপর বসে পড়ল।
পিস্তলে টোটা ভরে উঠে দাঁড়াল জেথ। ডরম্যানের পেছনে এসে ঘাড়ের কাছে পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করল। লুটিয়ে পড়ল লোকটা।
খোদার কসম, এরচেয়ে দ্রুত কাউকে ড্র করতে দেখিনি আমি! সবিস্ময়ে চেঁচাল লুইফ বেক্সটার। ওরা যা ভাবেনি ঠিক তাই ঘটেছে।
গুঞ্জন উঠল-এখন যা, যাকে নিয়ে হওয়া উচিত।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করল জেথ। বাইরে বোধহয় টার্নার দলবল নিয়ে ওঁৎ পেতে আছে, ভাবল ও। ঝুঁকিটা নিতেই হবে। কাজ শেষে তিন দুবৃত্তকে ফিরতে না দেখে ঘটনা আঁচ করে ফেলবে সে। ওকে না পেয়ে আক্রোশে দোকান বা বাড়িগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দেয়া বিচিত্র কিছু নয়।
খোলা পিস্তল হাতে মেঝেতে শুয়ে পড়ল জেথ। ব্যাটউইং দরজার নিচ দিয়ে দ্রুত পোর্চে বেরিয়ে এল। ক্ষীণ আশা ফাঁকি দিতে পেরেছে দুর্বত্তদের, প্রতিপক্ষ হয়তো ভাববে বীরত্ব ফলাতে দরজায় এসে দাঁড়াবে ও।
ব্যাংকের কাছে আছে একজন। দেরি সইছে না, গুলি করে সেলুনের কাঁচ ভাঙছে, জেথ যে বেরিয়ে এসেছে তা-ও টের পায়নি। কোল্টের আওতায় আছে সে, দেরি না করে গুলি করল ও। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করল রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে লোকটা আর ওর গুলি ব্যাংকের দেয়ালে চল্টা তুলেছে। ধ্যাত্তেরি! গুলি করল কে? ভাবছে জেথ। সেলুনের দিকে ফিরে ছিল দুবৃত্ত, তার বাম বুকে বিঁধেছে গুলিটা। তারমানে ডানদিকে কোথাও আছে অদৃশ্য স্নাইপার। রাস্তা ধরে দক্ষিণে তাকাল জেথ। কয়েকশো গজ দূরে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে লড়াইটা দেখছে পনেরো-বিশজনের একটা দল। ওদের কারও হাতে অস্ত্র। নেই, তাছাড়া এতদূর থেকে লক্ষ্যভেদ করাও কঠিন। সেলুন আর আস্তাবলের সামনে বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলো ছটফট করছে। রাস্তার পশ্চিম পাশে একটা বাকধোর্ড পড়ে আছে। জেথ ধারণা করল ওটার পেছনে আছে লোকটা।
সুর তুলে কানের পাশ দিয়ে একটা সীসা চলে যেতে হুশ হলো ওর। বোকামি করে ফেলেছে। চকিতে ডানদিকে গড়িয়ে দিল শরীর, পোর্চ থেকে শক্ত মাটিতে এসে পড়ল। এবারকার অবস্থানটা দারুণ, মাথা নিচু করে পড়ে থাকলেই হলো। ব্যাংকের ওদিক থেকে দেখা যাবে না ওকে। কিন্তু এভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকার ইচ্ছে নেই ওর, দুতিনটা গুলি ছুটে যাওয়ার পর মাথা তুলে দেখল। রাইফেলের একটা ব্যারেল বেরিয়ে আসছিল আড়াল থেকে গুলি করল। কিছু দূরে খোলা জায়গায় গিয়ে পড়ল রাইফেলটা, এমন এক জায়গায়-আনতে গেলে ঝুঁকি নিতে হবে।
চোখ সরাল না জেথ। একটু একটু করে সময় এগোচ্ছে। আড়চোখে তাকাল দক্ষিণে, বাকবোর্ডের পেছনে কোন নড়াচড়া নেই। শহরটা একেবারে শান্ত। উত্তরে ভূমি বণ্টন অফিসের কাছে ভিড় করেছে কিছু লোক। রেঞ্জের বাইরে, তস্করেরা খেপে গিয়ে নিরীহদের ওপর গুলি করলেও লাগাতে পারবে না।
হঠাৎ করে, ছোঁ মারল বলিষ্ঠ একটা হাত। ওর দেরি হলেও বাকবোর্ডের পেছন থেকে রাইফেল গর্জে উঠল। স্পষ্ট দেখতে পেল জেথ, বিধেছে গুলিটা, ওরটাও। তৎক্ষণাৎ আড়ালে চলে গেল হাতটা, কাজ উদ্ধার করতে পারেনি।
অখণ্ড নীরবতার মধ্যে কেটে গেল কয়েকটা মিনিট। লোকজনের সাড়া পাওয়া। গেল এবার, ভয়ে অবশ্য এগিয়ে আসছে না কেউ। দূরে ধেয়ে যাওয়া ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল, এর পরপরই ব্যাংকের দরজায় দেখা গেল জুলিয়াস হোল্ডেনের প্রসন্ন মুখ। এই প্রথম তাকে হাসতে দেখছে জেথ। ওরা চলে গেছে, পরিতৃপ্তির সাথে ঘোষণা করল সে।
উঠে দাঁড়াল জেথ। কোন সীসা ছুটে এল না। পিস্তলে টোটা পুরছে, আর ভাবছে তস্করদের নিয়ে। সুবিধা করতে না পেরে পালালেও আবার ফিরে আসতে পারে। এখন পর্যন্ত লড়াইয়ের ফলাফল সন্তোষজনক-দুজন করে আহত ও মৃত। এবার খেপে যাবে টানার, সুযোগ পেলেই হামলা করবে। তবে এটা ঠিক দারুণ একটা শিক্ষা পেয়েছে সে আজ, তাই পরের বার হামলা করবে ভেবে-চিন্তে। কোন কারণেই শহর ছাড়া যাবে না, সিদ্ধান্ত নিল জেথ।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে নারী-পুরুষের দল, হুল্লোড় করছে।
বাকবোর্ডের দিকে এগোল জেথ। মাত্র পাঁচ কদম এগোতে টের পেল উরুর ওপর থেকে উড়ে গিয়ে রাস্তার ধুলোয় পড়ল ওর হোলস্টার, কোল্টটা তখনও হাতে। থেমে ওটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সোজা কপালে গুলি করেনি, তারমানে পরিচিত এবং শুভাকাক্ষী। লোকটা কে?
ঘুরে, এমনভাবে বাকবোর্ডের পেছনে চলে এল যাতে টের না পায় লোকটি। পৌঁছানোর পর ঝটিতি ঘুরল সে, হাতে রাইফেল।
রোয়ানা!
জেথ বিস্মিত, কিছুটা অপ্রস্তুতও। আর যে-ই হোক ওকে আশা করেনি। তারপর বিরক্তি লাগল। দুনিয়ার সব তামাশা কেবল আমার সাথে, তিক্ত মনে ডাবল জেথ। কৈশোরে, এমনকি এখনও ওর অক্ষমতা নিয়ে অনেকেই তামাশা করেছে এবং করছে। এই একটা জিনিস দারুণভাবে ঘৃণা করে ও।
রোয়ানার কাঁধ ধরে চাপ দিল জেথ, ইঙ্গিত করল ঊরুর দিকে।
উঁহু, লাগছে! ব্যথায় কুঁচকে উঠল মেয়েটার মুখ।
জেথ ছাড়ল না। জবাব চাই-ই ওর।
মজা করার লোভ সামলাতে পারিনি।
রোয়ানার কাঁধ ছেড়ে দিয়ে পড়ে থাকা হোলস্টারের দিকে এগোল জেথ। একটা জিনিস অস্বীকার করার উপায় নেই, ভাবছে, মেয়েটার হাতের টিপ সত্যি। দারুণ। হোলস্টার যথাস্থানে বাঁধার পর রাগ পড়ে গেল।
সামনে এসে দাঁড়াল রোয়ানা। মলিন দেখাচ্ছে, মুখ। মাফ চাইছি, জেথ! ম্লান স্বরে বলছে। তুমি রাগ করেছ? আমি ভাবতে পারিনি…আসলে এ মুহূর্তে হোয়াইটস্টোনের সবচেয়ে সাহসী লোকটিকে পরখ করে দেখার লোভ হলো। তাছাড়া তোমার উদ্বেগটুকু দেখতেও আমার ভাল লেগেছে।
হেসে ফেলল জেথ। ওর তো ধন্যবাদ পাওনা হয়েছে, ভাবল, সম্ভবত শহরবাসীদের পক্ষ থেকেও।
মেঘ কেটে গেল, হাসল রোয়ানা। চলো, সেলুনে যাই। অরেঞ্জ জুসে হবে না, হুইস্কি দরকার। বাক টার্নারকে হটিয়ে দিয়েছি আমরা, সে-উপলক্ষেও তো পান করা উচিত, না-কি? ফের হাসল ও, মুগ্ধ হয়ে রোয়ানাকে দেখছে জেথ। তাকিয়ে থাকল, ভাবছে এত সুন্দর করে হাসে মেয়েটা!
বুকের গভীরে একটা কষ্ট খোঁচা মারল। মেয়েটাকে পাওয়ার লোভ হয় প্রায়ই, ভবঘুরে জীবন ছেড়ে ছুটে আসতে ইচ্ছে করে জেথের। কিন্তু বাদ সাধে ওর মুখের খালি অংশটা। রোয়ানার পাশে সে বড়ই বেমানান। বোবা এক ভবঘুরে রোয়ানার মত সুন্দরী মেয়েকে কখনোই সুখী করতে পারবে না।
কি হলো, চলো! তাড়া দিল রোয়ানা। জেথের মুগ্ধ দৃষ্টি এড়িয়ে গেল।
সবাই এসো, হাঁক ছাড়ল লুইফ বেক্সটার, পোর্চে বেরিয়ে এসেছে। সবার জন্যে এক রাউন্ড করে ফ্রী! সাহসী ম্যাকলীনদের সুস্বাস্থ্য কামনায়!
.
তিন দিন পেরিয়ে গেছে।
কার্লি রাফ আর অন্য লোকটাকে বুটহিলে কবর দেয়া হয়েছে। পিট ও ডরম্যানকৈ পাঠানো হয়েছে ডাক্তার পিকার্ডের ছোট্ট হাসপাতালে। এ কদিনে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে, জেথের অন্তত তা-ই ধারণা। পিটের পায়ে প্লাস্টার, ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে আরও কয়েক সপ্তাহ লাগবে। উরুর জখমটা গভীর, প্রায় হাড় পর্যন্ত। বুলেটটা ভেতরে রয়ে গিয়েছিল, দুঘণ্টা পরিশ্রম করে ওটা বের করেছে পিকার্ড।
পিটকে না হোক, ডরম্যানকে সেলে ঢোকানো দরকার। দুবৃত্তের ক্ষতটা মারাত্মক কিছু নয়, দুদিন বাদে একটা দাগ থাকবে কেবল। এ অবস্থায় ঝুঁকি। নেয়া যায় না। কে বলতে পারবে টার্নার ওদেরকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবে না? জেলের চেয়ে হাসপাতাল থেকে ওদের বের করে নেয়া অনেক সহজ।
কয়েকবার ওদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে জেথ, কেউই মুখ খোলেনি। এবার অবশ্য একটু কৌশল খাটাতে হয়েছে, তাতে কাজ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেবল ওদের তথ্যের আশায় বসে থাকেনি জেথ। টার্নারকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিল, এখান থেকে নাক বরাবর পুবে চলে গিয়েছিল সে। প্রথমে সমতল ট্রেইল আর তৃণভূমি থাকলেও শেষতক ক্রমশ রুক্ষ দুর্গম হয়ে উঠেছিল। তবু থামেনি জে, এমনকি একটা পাথুরে জমিতে প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর ট্র্যাক না পেয়েও আন্দাজের ওপর এগিয়েছে এবং শেষে বেশ কিছু দূরে গিয়ে খুঁজে পেয়েছে। মাইল দশ পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল ওরা, এরপর আর এগোয়নি জেথ। কাকে ট্রেস করবে? সন্দেহ করেছিল হয়তো সামনে অভ্যর্থনার আয়োজন করে রেখেছে টার্নার, তাছাড়া মনে হচ্ছিল হাল ছেড়ে দিয়েছে লোকটা।
জেথ তা বিশ্বাস করে না। জানে ঘুরে-ফিরে এখানেই আসবে টার্নার। হোয়াইটস্টোনে এ পর্যন্ত যা-কিছু ঘটেছে তার সবই পূর্ব পরিকল্পিত, এ ষড়যন্ত্রে টার্নারের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। পাওনা বুঝে নেবেই সে।
সবকিছুর পেছনে যে লোক, পিট ও ডরম্যান বোধহয় তার পরিচয় জানে না, ভাবল ও। লোকটা সাবধানী ও চতুর, নিজের পরিচয় যদূর সম্ভব আড়াল করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তাকে মুলোর লোভ দেখাতে চাইছে জেথ। তাই ঘোষণা করেছে এক সপ্তাহের মধ্যে মবের হাতে তুলে দেবে পিট আর ডরম্যানকে। শহরে। দারুণ আলোড়ন তুলেছে ব্যাপারটা। বাঁচতে চাইলে এখন আর মুখে কুলুপ এঁটে রাখতে পারবে না দুই দুর্বত্ত। পেছনের লোকটা নিশ্চিত হচ্ছে কি করে যে ওরা কিছুই জানে না? একটী চাল হয়তো দেবে সে, আর তা ধরে এগোতে চায়। জেথ।
ডীন থর্টনের সাথে আলোচনা সেরে মার্শাল অফিস থেকে বেরিয়ে এল জেথ। আবার বহাল হয়েছে বুড়ো। সেলের তালা খুলে অপেক্ষা করছে সে।
হাসপাতালে চলে এল ও।
হাউডি, জেথ, হাসল পিকার্ড। আসামী নিতে এসেছ?
মাথা ঝাঁকাল ও।
আরও কদিন পর নাও।
ইঙ্গিতে স্লিঙে ঝোলানো হাত দেখাল জেথ, বোঝাতে চাইছে ডরম্যানকে নিতে এসেছে। কাঁধ উঁচিয়ে অসহায় ভঙ্গি করল ডাক্তার। পেছনের কামরায় চলে এল জেথ। ফাঁকা!
নিজেকে অসহায় মনে হলো ওর, কি করবে বুঝতে পারছে না। সামলে নিতে খানিকটা সময় লাগল, তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করল পুরো কামরা। বিছানার চাদর নেই, জানালার গরাদ ভাঙা…আর কিছু দেখার প্রয়োজন নেই। প্রচণ্ড রাগ হলো পিকার্ডের ওপর, ডরম্যানকে চোখে চোখে রাখার জন্যে পাশের কামরায় থাকতে চেয়েছিল জেথ, ডাক্তার রাজি হয়নি। তার স্থির বিশ্বাস ছিল ডরম্যান পালাবে না, চেষ্টা করলে সে-তো আছেই।
অথচ খুব সহজে পালিয়েছে ডরম্যান, এবং খানিক আগে। সকালে নাশতা দেয়ার পর বোধহয় আর এ-কামরায় আসেনি পিকার্ড। দারুণ বোকামি হয়েছে, লোকটাকে প্রথম থেকে সেলে রাখা উচিত ছিল।
হঠাৎ উল্টো একটা সম্ভাবনা খেলে গেল জেথের মাথায়…
জানালার কাছে চলে এল ও। ছেড়া চাদর পাকিয়ে চৌকাঠের সাথে গিট দিয়েছে ডরম্যান। নিচে, পরিষ্কার মাটিতে কোন ছাপ নেই। থাকবে এমন কোন কথাও নেই। কিন্তু বাঁধনটা কেমন যেন অস্বাভাবিক-একজন পূর্ণ বয়স্ক লোকের ভার সইতে হলে আরও মজবুত করে এবং একটা শক্ত অবলম্বনে বাধা উচিত ছিল। কাঠের গরাদ যদি ডরম্যানের হাতের আঘাতে ভেঙে যেতে পারে তবে পুরানো চৌকাঠটি কি করে ওর আড়াইমণী শরীরের ভার সয়? তারমানে এটা একটা ভাওতা…আশেপাশে আছে সে।
দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল জেথ, হাতে কোল্ট উঠে এসেছে। পিটের কামরায় চোখ পড়তে দরজায় দেখতে পেল ডরম্যানকে। ধরা পড়ায় বরফের মত জমে গেছে। হাতে একটা লোহার রড, কোত্থেকে পেয়েছে আল্লা মালুম। সে ভেবেছে জানালার ভাঙা গরাদ আর পাকানো চাদর দেখে ছুটে নিচে চলেযাবে জেথ, এবং সম্ভবত পিকার্ডও। এ ফাঁকে সটকে পড়বে, অথবা আক্রমণ করবে। হাহ, এত সোজা! মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে, লোকটার কণ্ঠনালীতে নিশানা করল।
পাংশুর মত সাদা দেখাচ্ছে ডরম্যানের মুখ, তাকিয়ে আছে কিন্তু দৃষ্টিতে হতাশা বা ব্যর্থতার অভিব্যক্তি নেই। ধীরে ছেড়ে দিল রডটা, গড়িয়ে কামরার একপাশে চলে গেল। জেথ দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে ইঙ্গিত করলে তা পালন করল। পিঠে কোল্টের মাজল চেপে ধরে তার পুরো দেহে তল্লাশি চালাল জেথ।
বোবা কুত্তা! ঘুরে থুথু ছিটাল ডরম্যান।
লোটার ফোলা গালে কোল্টের নল দিয়ে আঘাত করল জেথ। ব্যথায়। কুঁচকে উঠল তস্করের মুখ, রক্তপাত শুরু হলে সাথে সাথেই। বাম হাতে গাল চেপে ধরল সে। একদলা থুথু ফেলল মেঝেতে, দুটো দাঁতও পড়ল। ঠেলে তাকে পিকার্ডের কামরায় নিয়ে এল জেথ।
তুমি ওকে মারছ কেন? চোখ কপালে উঠেছে ডাক্তারের।
পাত্তা দিল না জেথ। উরম্যানের পাজরে কোল্টের নল চেপে ধরে এগোতে বাধ্য করল। হাসপাতাল থেকে বেরোতে কয়েকজন ঘিরে ধরল ওদের। একের পর এক প্রশ্ন করছে, পরামর্শও দিচ্ছে ঝামেলা চুকিয়ে দিতে। চুপ করে আছে। ডরম্যান, কপালে ঘাম, চোখে আতঙ্ক। লোকজনের হাতে পড়লে কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছে।
অফিসে এসে তাকে সেলে ঢোকাল জেথ।
জেথ ভাবছে পিট আর ডরম্যানের সাথে আরেকবার আলাপ করবে। লিখে জানাতে হবে প্রশ্নগুলো, ওরা পড়তে জানলেই হলো। পিটকে দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। ফাঁসির ভয়ে এমনিতে আধমরা হয়ে আছে ছেলেটা, কে-ইবা কটনউডে ঝুলতে চায়! মুখ খুলবে বোধহয়। ডরম্যানের চেয়ে ওকে বাঁকানো। সহজ হবে।
কাগজ-পেন্সিল নিয়ে বসেছে ওরা কি বলতে পারে তা ভেবে প্রশ্ন লিখছে।
স্টোভে কেতলি চাপিয়েছে থর্টন। সস্তা দুমড়ানো একটা সিগার ধরিয়ে লিখছে।
ভুসভুস করে ধোয়া ছাড়ল। এরকম রাখ-ঢাকের মানে কি? স্পষ্ট বিরক্তি মার্শালের কণ্ঠে। মার্শাল হয়ে গেলেই পারো! এ মুহূর্তে হোয়াইটস্টোনের হিরো তুমি, প্রস্তাব করলে নিদ্বিধায় মেনে নেবে ওরা। অথচ উল্টো কিনা আমার ব্যাপারে সুপারিশ করেছ, কেন?
বুড়োকে পাত্তা দিল না জেথ।
বেশি ডাঁট দেখিয়ো না, ছোকরা। আমি কাউকে কেয়ার করি না। আরও কিছু বলতে চেয়েছিল সে, দরজায় নক হওয়ার শব্দে থেমে গেল। ঘুরে তাকাল, রোয়ানাকে দেখে হাসি ফুটল গম্ভীর মুখে। শুভেচ্ছা বিনিময় করে উঠে স্টোভের কাছে চলে গেল।
ডরম্যান ঝামেলা করেছে? জানতে চাইল রোয়ানা।
মাথা ঝাঁকাল জেথ।
লোকটা এখন কোথায়?
সেলে। জানাল থর্টন।
ঝুঁকে লেখাগুলো পড়ল রোয়ানা। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। মার্শালের এগিয়ে দেয়া কফির মগ তুলে নিয়ে চুমুক দিল। জেথ সায় দিতে ধন্যবাদ জানাল।
একটু পর পিকার্ডের হাসপাতালে চলে এল দুজনে।
আবার এসেছ! এবার কি ওটাকেও নিয়ে যাবে? জেথকে দেখে খেপে গেল ডাক্তার, ঝাঝাল স্বরে বিদ্রূপ করল। রোগীর গায়ে হাত তোলায় খেপে গেছে। তোমাকে ওর কাছে যেতে দেব না আমি। এখান থেকে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলো আর কি!
রোয়ানা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তুমি কি জানো ডরম্যান পালাচ্ছিল, ডক? নিজ দায়িত্বে ওদের রাখতে চেয়েছ তুমি। ডরম্যান পালাতে পারলে শহরের লোকদের কি বোঝাতে? লোকটা রড পেল কোত্থেকে?
সে পালালে আমার দোষ হবে কেন?
অবশ্যই তোমার দোষ হবে। শহরের লোকেরা সেটাই মনে করবে। জেথ পাশের কামরায় থাকতে চেয়েছিল, তুমি রাজি হওনি কেন?
একটা লোক সারাক্ষণ কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে ঘুরবে আমার হাসপাতালে, এটা সহ্য করার মত?
ডরম্যান পালানোর সময় যদি তুমি সামনে পড়ে যেতে, অক্ষত থাকতে? দশটা খুন করেছে সে, ডক। হোয়াইটস্টোনের ব্যাংকে ডাকাতি করেছে, কিছু নিরীহ মানুষের মৃত্যুর পেছনে এ লোকটারও হাত আছে। শান্ত দেখাচ্ছে। রোয়ানাকে, যদিও পিকার্ডের আনাড়িপনায় কিছুটা বিরক্ত।
চিন্তা করছে ডাক্তার, যুক্তিতে ধরেছে।
মাত্র দশ মিনিট, কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করে চলে যাব আমরা।
ঠিক আছে। কিন্তু এর বেশি নয়।
পিটের কামরায় ঢুকল ওরা। চোখ বুজে শুয়ে ছিল ছেলেটা, চোখ মেলে তাকাল। ছাদ থেকে দড়ি বেঁধে প্লাস্টার মোড়া ডান পা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অন্য পায়ে ব্যান্ডেজ। চোখাচোখি হতে দেয়ালের দিকে মুখ সরিয়ে নিল সে।
শোনো, পিট, এ শহরে তোমার প্রতি সহানুভূতি আছে এমন একজনকেও খুঁজে পাবে না, মৃদু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে শুরু করল রোয়ানা। বরং তোমাকে নাগালের মধ্যে পেলে খুশিই হবে ওরা। তোমাদের ছিনিয়ে নেয়ার চিন্তা করছে অনেকেই, শহরের দক্ষিণে বড় কটনউডে ঝুলিয়ে দেবে। আমরা সেটা ঠেকিয়ে আদালতে তোমাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে পারি, যদি তোমরা সহযোগিতা করো। আমার কথা শুনছ তো? আরেকবার কিন্তু বলব না।
দ্বন্দে ভুগছে ছেলেটা, ওর মুখ দেখে জেথের তাই মনে হলো। উন্মত্ত লোকজনের হাতে পড়লে কটনউডে ঝুলতে হবে, নয়তো আদালতের সাজা-সেটা ফাঁসি বা জেল হতে পারে। ফাঁসি হলেও কয়েকটা দিন তো বেশি বাঁচবে।
ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে রোয়ানার দিকে ফিরল পিট। কি জানতে চাও, ম্যাম? আমি অবশ্য বেশি কিছু জানি না।
এখানকার কেউ ভাড়া করেছে তোমাদের। কে সে?
আমরা সত্যি জানি না। মাস খানেক আগে হাচিনসনে টার্নারের সাথে দেখা করে লোকটা, ঘণ্টা দুই আলাপ করেছে ওরা। টার্নার একাই ছিল। আমরা গেলে নির্ঘাত খুন করত।
টাকাগুলো ভাগ হয়েছে তোমাদের মধ্যে?
কোত্থেকে! রাতে স্লিম চুরি করে ভেগে গেল, ওকে খুন করে এখানকার কেউ হাতিয়ে নিয়েছে পুরো টাকা।
গুনে দেখেছিলে কত ছিল?
থলে থেকে বেরই করা হয়নি। টার্নার বলেছিল এক লাখের বেশি হবে।
সে জানল কিভাবে?
আন্দাজ করেছিল বোধহয়। এ লাইনে তো সে নতুন নয়।
মৃদু হেসে জেথের দিকে ফিরল রোয়ানা, ওর প্রশ্ন শেষ। সদ্য লেখা একটা চিরকুট এগিয়ে দিল জেথ। শহর আক্রমণ করার বুদ্ধিটা কার? পড়ে ফের জানতে চাইল ও।
টার্নারের।
ও কোথায় থাকতে পারে, জানো কিছু?
মাথা নাড়ল পিট। ওর মতিগতি বোঝা ভার। কখন কোথায় থাকবে আগে থেকে বলা যায় না।
টার্নার তোমাদের উদ্ধারের চেষ্টা করবে?
উত্তর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ভাবল ছেলেটা। আমাদের দলটা কখনও হোঁচট খায়নি, এই প্রথম কয়েকজন মারা পড়ল। এটা নিয়ে টার্নারের জেদ থাকতে পারে। তবে এটাও ঠিক যথেষ্ট সাবধানী সে, ফের এখানে আসার ঝুঁকি ও নেবে বলে মনে হয় না। কারণ ও ভাল করে জানে আমরা তেমন কিছু জানি না বা যা জানি তাতে ওর বিপদ নতুন করে আর বাড়বে না। আমি নিশ্চিত গা ঢাকা দেবে
ওর হাইড আউট কোথায়?
সারা বছর ট্রেইলে কাটিয়ে দেয় ও, হাঁপিয়ে উঠলে কলোরাডো ক্যানিয়নে চলে যায়।
পিটকে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে রেখে বেরিয়ে এল ওরা।
আমার মনে হচ্ছে ও সত্যি কথা বলেছে, ফেরার সময় বলল রোয়ানা। যাচাই করার জন্যে ডরম্যানকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। কিন্তু ওই লোকটা মুখ। খুলবে না বোধহয়। যা হোক, আমার মনে হয় ছেলেটার একটা সুযোগ পাওয়া উচিত।
পিটের কাছ থেকে নতুন কিছুই জানা গেল না, ভাবছে জেথ, তবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাক টার্নারের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়, কেবল সে-ই সবকিছুর সমাধান দিতে পারে। পেছনের লোকটার মুখোশ খুলে দিতে হলে যে করে থোক ধরতে হবে টার্নারকে। কিন্তু দুবৃত্তনেতা কোথায় আছে এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ওর।
.
০৮.
হোয়াইটস্টোনে এ কদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর জন্যে অভিযুক্ত আসামী এখন দুজন-পিট আর ডরম্যান। জেথের মতে তা বেড়ে চার হওয়া উচিত, বাকিরা বাক টার্নার আর পেছনের লোকটা।
ধুরন্ধর এ লোকটির পরিচয় জানে জেথ, কিন্তু নিচ্ছিদ্র কোন প্রমাণ ওর হাতে নেই। একমাত্র বাক টার্নারই তাকে সনাক্ত করতে পারে। অবস্থা এমন আগামীকালই ট্রিপল ক্রসের নিলাম, পরিস্থিতি দ্রুত আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিলামে অংশগ্রহণ করার মত তিনটা পক্ষ রয়ে গেছে এখনও। পেছনের লোকটা। বোধহয় সরাসরি বাথানটা কিনবে না, ভাবছে জেথ। পরোক্ষভাবে লোকটা যদি ট্রিপল ক্রস কেনে, নতুন কোন ক্রেতা আর না এলে, তার কাভার একটাই, ওহ গড, পেট্রোল কোম্পানিটা! ইস্টার্ন পেট্রোল কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করতে এখনতক আসেনি কেউ। এলে নজর রাখতে হবে, সিদ্ধান্ত নিল জেথ।
একটা খসড়া পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছে ও। নিলামের আগে আর কিছু না ঘটলে আগামীকাল নিলামের সময় সে অনুযায়ী করবে সবকিছু। তবে সদ্য আবিষ্কৃত সূত্রটি নিঃসন্দেহে চমৎকার, তেল কোম্পানির প্রতিনিধিকে চেপে ধরলে অনেক কিছু জানা যাবে।
রোয়ানাসহ ল অফিস থেকে বেরিয়ে এল জেথ। ভারী এক সকাল। নীল আকাশে পুঞ্জীভূত শুভ্র মেঘ, ফুরফুরে বাতাস আর সূর্যের আলসেমি-সব মিলিয়ে চমৎকার। হাচিনসন থেকে হোয়াইটস্টোনে স্টেজ চলাচল করে, জানা দরকার আজ কোন স্টেজ আসবে কি-না। সেটা জানতে বেরিয়েছে ওরা, উত্তরে শহরের শেষ মাথায় স্টেজ কোম্পানির অফিস।
যাওয়ার পথে, জেরেমি মিলারের স্টোরের সামনে থমকে দাঁড়াল জেথ। নতুন বিশাল একটা দালান তুলে ফেলেছে এরইমধ্যে। বোঝা যাচ্ছে লোকটা প্রচুর টাকার মালিক, রোয়ানার কথায়ও তাই মনে হয়েছিল ওর। হঠাৎ মনে হলো স্টোর ধ্বংস হওয়ার পরও ট্রিপল ক্রস কেনার ক্ষমতা রাখে মিলার। শালা বজ্জাত! মনে মনে তীব্র গাল বকল জেথ। একগাদা লোক লেলিয়ে দিয়েছিল ওর পেছনে, যারা অসহায় অবস্থায় ওকে পিটিয়ে আধমরা করে রাস্তায় ফেলে গেছে। শরীর জ্বলে। উঠল ওর, দিশেহারা বোধ করছে।
এখানে দাঁড়িয়েছ কেন? ওকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল রোয়ানা। জেথ, স্টেজ কোম্পানির অফিসে যাচ্ছিলাম আমরা। ওখানে চলো, প্লীজ!
হোলস্টার থেকে কোল্ট বের করে পরখ করছে জেথ, দরকার ছিল না, তবু। ভেতরের উত্তেজনা সামলে রেখেছে। জেরেমি মিলারকে দেখতে পেয়েছে স্টোরের ভেতর। ঠাণ্ডা মাথায় এগোতে হবে, ভাবল ও, শোধ-বোধটুকু আজ এখুনি চুকিয়ে ফেলবে।
জোর করে ওকে টেনে সরিয়ে আনতে চাইছে রোয়ানা। অস্থির দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ওদিকে জেথের সমস্ত মনোযোগ স্টোরের ভেতর, মিলার না পালিয়ে যায়!
পাগলামি কোরো না, জেথ, কর্তৃত্বের সুরে বলছে রোয়ানা, কণ্ঠে শ্লেষ। মরার সাধ হয়েছে না-কি? সেদিন টার্নার চারজনকে শেষ করেছে বলে ভেবো না মিলারের লোক নেই আর। আমার ধারণা ভেতরে গিয়ে অন্তত এক গণ্ডা ভয়ঙ্কর লোকের সামনে পড়বে তুমি। ওরা তোমাকে কোন সুযোগ দেবে না।
জেথের রক্তে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। প্রতিপক্ষের ভয়ঙ্করত্ব বা সংখ্যা। ওকে ঠেকাতে পারবে না। দাড়িঅলা লোকটাকে হাতের নাগালে পেতে উদগ্রীব হয়ে আছে ও।
জেথ, দয়া করে আমার কথা শোনো! মনোযোগ আকর্ষণ করতে ওর হাত ধরে ঝাঁকাল রোয়ানা। লোকটাকে পরেও একা পাবে।
জেরেমি মিলার ওকে বলেছিল এরপর আবার যখন দেখা হবে খাটিয়ায় শুয়ে থাকবে জেথ। হয়তো তাই হবে এখন, ভাবছে ও, কাছে যাওয়ার আগেই তার লোকেরা ওকে পেড়ে ফেলবে। কিন্তু নিজেকে নিরস্ত করার উপায় ওর জানা নেই। রোয়ানা কি বুঝতে পারছে না ওর সারা শরীর জুড়ে কেবল ঘৃণা, কোমাঞ্চিদের প্রতি যেটা অনুভব করত? বিদ্বেষ, অবহেলা বা অবজ্ঞার তিক্ততা নয়-কেবলই ঘৃণা। ঠিক এ জিনিসটাই ওকে প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করেছিল একদিন, র্যাটল সাপের মত ফুসে উঠেছিল জেথ, পেছনে চারটা লাশ ফেলে কোমাঞ্চিদের গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছিল।
জেথ জানে আজও ব্যর্থ হবে না।
কাপুরুষ, শুধু সেজন্যে মিলারের প্রতি এত ঘৃণা অনুভব করছে না, এর আসল কারণ লোকটা ওর সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করেছে। রোয়ানার তো খুশি হওয়া উচিত, ভাবছে জেথ, শত্রুকে ধরাশায়ী করতে যাচ্ছে ও। অথচ মেয়েটা প্রাণপণে বাধা দিচ্ছে।
তুমি বাড়াবড়ি করছ, জেথ!
রোয়ানাকে ঠেলে সামনে থেকে সরিয়ে দিল জেথ। হেঁটে রাস্তার ও-পাশে চলে এল। একটা সিগারেট রোল করার ফাঁকে স্টোরের ভেতরটা দেখে নিচ্ছে। কাঠ দিয়ে তাক তৈরি করছে ছুতোর, সাথে এক তরুণ সহকারী। পেছনের যে কামরায় মিলারকে দেখতে পেয়েছে জেথ, তার দরজার এ-পাশে দুজন লোক দাড়িয়ে, সশস্ত্র। ভাবটা এমন যেন ছুতোরের কাজের তদারক করছে। রোয়ানার কথাই বোধহয় ঠিক, ভাবল ও, প্রতিপক্ষ সংখ্যায় অনেক বেশি।
আধ-খাওয়া সিগারেট বুটের তলায় পিষে স্টোরের ভেতর ঢুকে পড়ল জেথ। সশস্ত্র দুজন দেখছে ওকে, ছুতোর আর তার সহকারী নিজেদের কাজে ব্যস্ত। ডানদিকের লোকটা ত্রিশ পেরিয়েছে, সমর্থ শরীর, সুদর্শন। অন্যজন পঁচিশ পেরোয়নি এখনও, রুক্ষ চেহারা। চোখে বেপরোয়া চাহনি।
ঢোকার মুখে পথ আটকাল ছেলেটা। মি. মিলারের সাথে কাজ আছে?
মাথা ঝাঁকাল জেথ।
মি. মিলার তোমার কথা জানে?
এবার নাড়তে হলো।
তাহলে যাওয়া যাবে না। যেভাবে এসেছ ঠিক ঠিক চলে যাও।
আরেক পা এগোল জেথ। আসলে ফাঁদ ওটা।
ঝটিতি ওর শার্টের সামনের দিকটা আঁকড়ে ধরে পেছনে ধাক্কা দিতে চাইল ছেলেটা, ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে মুগুরের মত তার পেটে হাত চালাল জেথ। হুঁক শব্দ করে ঝুঁকে পড়ল সে, সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ায় হাঁ হয়ে গেছে মুখ। ঘাড়ে রদ্দা মারতে আলগোছে ঢলে পড়ল দেহটা, ঠিক ময়দার বস্তার মত।
অন্য লোকটা ওর নাক লক্ষ্য করে ঘুসি চালিয়েছে টের পেয়ে মাথা নিচু করল জেথ। বাতাস কেটে চলে গেল হাতটা, ফেরত যাওয়ার আগে ধরে ফেলল ও। ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে এল লোটা, সুযোগের সদ্ব্যবহার করুল জেথ। গায়ের জোরে হাতে আর গলায় ধাক্কা দিল একই সঙ্গে, ছিটকে গিয়ে। দেয়ালের ওপর আছড়ে পড়ল সে। চটপট নাকে দুটো ঘুসি বসিয়ে দিল ও। গোপন অঙ্গে পা চালাতে ককিয়ে উঠে দুহাতে জায়গাটা চেপে ধরল লোকটা। হাতের ওপর দিয়ে সজোরে হাঁটু চালাল জেথ। শেষ আঘাতটা করল কানের পাশে।
দরজা থেকে সরে এল জেথ, হাতে কোল্ট চলে এসেছে। দড়াম করে খুলে গেল ভেতরের দরজা, খোলা পিস্তল হাতে বেরিয়ে এল একজন। বামে ঘোরার পর দেখতে পেল ওকে, এবং গুলি করল। তার আগেই গুলি করেছে জেথ। বুলেটের ধাক্কায় মেঝেতে আছড়ে পড়ল সে, ফের চেষ্টা করল, কিন্তু নিশানা ঠিক করার আগেই ঢলে পড়ল।
হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙে পড়ল ওর মাথায়, চোখে অন্ধকার দেখছে। আঘাতটা পেছন থেকে এসেছে। চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে তিন হাত দূরে দেখতে পেল ছুতোরকে, হাতে কাঠের চেলা। গুলি করতে ধীরে হাত থেকে খসে পড়ল চেলাটা, একটু পর নিজে মেঝেতে গুড়িয়ে পড়ল। তরুণ সহকারীর পানে তাকাল জেথ, রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। চোখাচোখি হতে আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল প্রথমে, তারপর ছুটতে শুরু করল।
ঘুরে ভেতরের দিকে নজর দিল জেথ। মাথার পেছনটা দপদপ করছে। বেজন্মা ছুতোরটা কাঠের চেলা দিয়ে বাড়ি মেরেছিল, ঠিকমত লাগলে মাথাই ফেটে যেত।
দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করে ডাইভ দিল জেথ। শূন্য, পাখি উড়ে গেছে! উঠে দাঁড়াল। মিলার সবে পালিয়েছে। সারা কামরায় লক্ষণীয় জিনিস একটা, টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ছাইদানিতে গোঁজা সিগারেট থেকে ধোঁয়া উঠছে। ওপাশের দরজা খোলা। আবারও, বাইরে ডাইভ দিল জেথ, হাতখানেক ওপর দিয়ে ছুটে গেল একটা তপ্ত সীসা। ছুটে এলে নির্ঘাত ওকে বিদ্ধ করত গুলিটা।
একটা বে-র পাশে দাঁড়িয়ে আবার গুলি করার জন্যে নিশানা করছে জেরেমি মিলার। এবার ডানদিকে ঝাঁপ দিল জেথ, যেটুকু সময় পেয়েছে তাতে অনায়াসে গুলি করতে পারত মিলারকে। কিন্তু লোকটাকে পিটিয়ে শায়েস্তা করতে চায় ও। মিলার আরেকবার সুযোগ পাওয়ার আগেই রাইফেলের ব্যারেল লক্ষ্য করে গুলি করল। দূরে ছিটকে পড়ল ওটা।
জেথ উঠে দাঁড়াতে পিছিয়ে গেল মিলার। ফ্যাকাসে মুখ, চোখের মণিগুলো যেন ঠিকরে বেরিয়ে পড়বে। সময় নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল ও, চোখে। চোখ। কোল্টটা হোলস্টারে ঢুকিয়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিল। সারা শরীরে ক্লান্তি অনুভব করছে, কেন জানে না। ওর চোখে আগুন দেখতে পেয়ে পিছিয়ে গেল মিলার। হেসে উঠল জেথ, হায়েনার হাসির মত শোনাল সেটা। লক্ষ করল কাঁপছে জেরেমি মিলার।
শার্টের কলার চেপে ধরে প্রচণ্ড ঘুসি হাঁকাল জেথ। বাধা দিতে হাত তুলেছিল মিলার, তারই একটা ধরে দাড়িঅলার পতন ঠেকাল। ফের মারতে ময়লা আবর্জনার ওপর পড়ল সে। এত জোরে মেরেছে যে কয়েকটা দাঁত নডবড়ে হয়ে যাওয়ার কথা। মিলারকে টেনে উঠাল ও, তারপর পেটে ঘুসি চালাল। মুখ দিয়ে। সব বাতাস বেরিয়ে গেল একই জায়গায় আরেকটা ঘুসি হাঁকাতে, নিঃসাড় হয়ে পড়ল। প্রতিরোধের কোন ইচ্ছে আর অবশিষ্ট নেই।
কোন বাছ-বিচার করা ছাড়াই মারতে থাকল জেথ। পাজরে একের পর এক ঘুসি চালাচ্ছে, চাইছে মিলারের মুখে রক্ত উঠে আসুক-তা দেখে ওর উন্মত্ততা কাটবে, বিদ্বেষ প্রশমিত হবে, ঘৃণা অবদমিত হবে। মিলার কষ্ট পেয়ে তিলে তিলে মারা গেলে ওর চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।
পায়ে পা বাধিয়ে তাকে ফেলে দিল জেথ। বুটের আগা দিয়ে মিলারের কানে আঘাত করতে আর্তনাদ করে দুহাতে কান চেপে ধরল সে। অরক্ষিত বগলে এবার বুট চালাল ও, এরপর কোমরে। ঠিক এভাবে মিলারের লোকেরা মেরেছিল ওকে-অসহায় অবস্থায়, ভাবল জেথ, বিন্দুমাত্র প্রতিরোধের সুযোগ দেয়নি। যদি বাকশক্তি থাকত তো মিলারকে বলত, তোমার নির্দেশে আমাকে মেরেছিল ওরা, ঠিক এভাবে। পাঁচজনের বিরুদ্ধে একা, শটগান বাগিয়ে ধরে রেখেছিল একজন। কাপুরুষ! তোমার সাথে আমি একাই লড়ব, সমানে-সমান।
মিলারকে টেনে উঠাল জেথ, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না স্টোর-মালিক। কষে দুটো চড় লাগাল তার গালে, তারপর আবার যেখানে-সেখানে মারতে শুরু করল। জানে না কখন ওর ভেতরে একটা পশু জেগে উঠেছে। রক্তাক্ত হয়ে গেছে। মিলারের মুখ, জেখের হাতেও রক্ত।
জেথ, কি করছ! পেছনে রোয়ানার গলা শোনা গেল। দৌড়ে এসে মুমূর্ষ মিলারকে ছিনিয়ে নিল ওর হাত থেকে। হায় খোদা, আমি ভাবতেও পারিনি অসহায় একটা লোককে এভাবে মারবে তুমি! এ কেমন অন্যায়? কোন ম্যাকলীনের কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না। তোমার সম্পর্কে আমার অন্যরকম ধারণা ছিল, আর সবার চেয়ে আলাদাভাবে দেখেছি তোমাকে। মেয়েটার কণ্ঠে হতাশা।
মাথার ঠিক নেই, তাই জেথ নিজেও জানে না কি করছে। অন্তস্তল থেকে বেরিয়ে এল কথাগুলো, কিন্তু শব্দ হলো না। এ লোকটি তো তোমার আপনজন নয়। আমাকে বাধা দিচ্ছ কেন? অসহায় অবস্থায় আমাকে পিটিয়েছিল ওর লোকেরা, তখন তো কেউ বাধা দেয়নি, আমাকে সাহায্যও করেনি। তাহলে ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?
সবটা বলার পর জেথ টের পেল বিদঘুঁটে কিছু শব্দ ছাড়া ওর মুখ থেকে আর কিছু বেরোয়নি। রোয়ানা বিস্ময়-মাখানো দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। জিভকাটা কোন লোক কথা বলার চেষ্টা করলে সে-দৃশ্য কি খুব করুণ হয়ে ওঠে? ভাবছে জেথ, নাহলে সব ভুলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কেন রোয়ানা? মেয়েটার চোখে যুগপৎ সহানুভূতি আর কষ্ট। জেথের মনে পড়ল কৈশোরে ওকে নিয়ে কেউ তামাশা করলে এ দৃষ্টি ফুটে উঠত রোয়ানার চোখে। সেটার অর্থ তখন বুঝত না ও, আজ উপলব্ধি করল-ওর অক্ষমতা রোয়ানাকেও কষ্ট দেয়!
ভূপতিত জেরেমি মিলারকে দেখল জেথ, নিথর পড়ে আছে। মনে হলো বুকে স্পন্দন নেই। লোকটা মরে গেলেও ওর কিছু আসে-যায় না, ভাবছে ও। ঘুরে হাঁটতে শুরু করতে সামনে এসে দাঁড়াল রোয়ানা।
কোথায় যাচ্ছ? মিলার মারা গেলে আদালতে যেতে হবে তোমাকে। বাক টার্নারকে ধরার জন্যে যথেচ্ছ ক্ষমতা তোমাকে দেয়া হয়েছে ঠিকই, তাই বলে শহরের একজন লোককে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারো না তুমি!
রোয়ানা এসব কি বলছে! বোকার মত তাকিয়ে থাকল জেথ, ভাবছে, মিলার মারা গেলে সবচেয়ে খুশি হওয়ার কথা তো ওরই। অথচ, উল্টো জেথের ওপর দোষ চাপাতে চাইছে। এর মানে কি?
জেথের কাছে বিরক্তিকর লাগল রোয়ানার ন্যায়সঙ্গত কথাবার্তা। ঠেলে মেয়েটাকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে এগোল। নিজেকে অসহায় লাগছে ওর। জানে স্টোরের সামনে লোকজন ভিড় করেছে, ওখান দিয়ে গেলে অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। স্টোরের পেছন দিয়ে উত্তরে এগোল। কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে মূল রাস্তায় চলে এল। ক্লান্তি লাগছে, সারা শরীর রক্তে আর ঘামে মাখামাখি। সত্যি কি ভুল করেছে ও? ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করল জেথ, কিন্তু চিন্তাগুলো ঠিকমত এগোচ্ছে না। আত্মস্থ হওয়ার জন্যেও খানিকটা নীরবতা দরকার ওর, চাই নিরিবিলি একটা জায়গা।
তেমন জায়গা একটাই-ডিলান উডম্যানের সেলুন।
হাউডি, জেথ, সেলুনে ঢোকার পর সহাস্যে সম্ভাষণ জানাল ডিলান, কিন্তু জেথের রক্তমাখা হাত আর কাপড় দেখে থমকে গেল। আর কোন প্রশ্ন না করায়। তার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করল জেথ।
বেসিনের কাছে চলে এল ও, সময় নিয়ে শরীরের রক্ত পরিষ্কার করল, হাত মুখ ধুয়ে ব্যানডানা দিয়ে মুছে ফেলল। এককোণে একটা টেবিল দখল করে বসল এরপর। মাত্র দুজন খদ্দের, আড়চোখে ওকে দেখছে। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ওর দৃষ্টি চলে গেল রাস্তায়, জেরেমি মিলারের স্টোরের সামনের ভিড়টা বড় হচ্ছে।
জেথ অনুভব করল কিছুটা সুস্থির লাগছে এখন, ধীরে ধীরে অস্থিরতা কেটে যাচ্ছে। ঘুরে-ফিরে রোয়ানার কথাগুলোই মনে আসছে, এখন থেকে মিলার আর ওর মধ্যে কোন পার্থক্য দেখবে না মেয়েটা, কাপুরুষ হিসেবে ঘৃণা করবে। ওকে।
হুইস্কির গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখে সামনের চেয়ারে বসল ডিলান। কিছু একটা ঘটেছে ওদিকে। গোলাগুলির শব্দ শুনলাম, লোকজনের ভিড়ও দেখতে পাচ্ছি। মিলার ঝামেলা করেছিল?
মাথা ঝাঁকাল জেথ। ডিলানকে বলার উপায় নেই যে ঝামেলাটা আগ বাড়িয়ে ও-ই শুরু করেছিল।
আর কিছু না বলে উঠে চলে গেল সেলুন-মালিক।
গ্লাস তুলে চুমুক দিল জেথ। অস্থির লাগছে আবার। খাপছাড়া চিন্তাগুলো ভোগাচ্ছে। ইঙ্গিত করতে ফের হুইস্কি দিয়ে গেল ডিলান। দ্রুত তা শেষ করে ফেলল ও।
মিনিট দশ পর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এখানে থাকার আর কোন মানে হয় না। হোয়াইটস্টোনের লোকেরা হয়তো ওকে কাপুরুষ ভাববে, তাতে কি! হারানোর কিছু নেই ওর। অক্ষমতার জন্যেই হয়তো সারা জীবনে ন্যূনতম দ্রতা কারও কাছ থেকে পায়নি ও, এখন কাপুরুষ অপবাদে ওর মুখে চুনকালি পড়বে এটা বিশ্বাস করে না জেথ। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, জেরেমি মিলারকে পেটানোর। পর ওর সম্পর্কে পাল্টে গেছে রোয়ানার ধারণা। না পাওয়ার আশঙ্কায় এতদিন মেয়েটাকে এড়িয়ে চলেছে জেথ, এখন আর রোয়ানার সামনেই দাঁড়াতে পারবে না।
হোয়াইটস্টোনে জেথ্রো ম্যাকলীনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তবে আর কি? ভাবছে জেথ, মার্শালের অফিসে রেখে এসেছে রাইফেলটা, আপনমনে নিজেকে শুধাল ও, নিয়ে এসে স্যাডলে চাপো। দুর্গম ট্রেইল ধরে চলে যাও ফিরতি পথে। যাওয়ার আগে ধন্যবাদ জানাও রোয়ানাকে, এটা ওর প্রাপ্য। একটা চিঠি লিখে মার্শালের অফিসে রেখে গেলে চলবে।
ভাবনার লাগাম টেনে উঠে পড়ল জেথ। বিল পরিশোধ করে বেরিয়ে এল সেলুন থেকে। উদ্দেশ্য লঅফিস। ওকে দেখে অনেকেই কিছুক্ষণ আগের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জেরেমি মিলারকে পেটানোর ঘটনা এরা পছন্দ করতে পারছে না। পাত্তা দিল না জেথ। ওর মধ্যে কোন দ্বিধা নেই, একটা ধেড়ে শয়তানকে শায়েস্তা করেছে, ঠিকই করেছে।
লঅফিসের দরজায় পা রাখতে জেথের মনে হলো মাটি সরে যাচ্ছে পায়ের তলা থেকে। একটু আগে যেমন দেখে গেছে ঠিক তেমনি আরাম করে চেয়ারে বসে আছে ডীন থর্টন। মুখের সিগারটা অনেকক্ষণ ধরে টানায় নিভে গেছে। তার কপালে ছোট্ট একটা ফুটো, তা থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে এখনও, থুতনি পেরিয়ে গলা হয়ে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। একটা জিনিস বেখাপ্পা লাগছে ওর কাছে, মৃত মার্শালের চোখে বিস্ময় লেগে আছে এখনও।
সেলের দিকে ছুটল জেথ। বিপুল প্রত্যাশা মিইয়ে গেল দৃশ্যটা দেখার পর। সেলের মেঝেতে পড়ে আছে ডরম্যান। এক নজর দেখে বুঝল মৃত।
০৯.
পুরো শরীরে রাজ্যের অবসাদ অনুভব করছে জেথ্রো ম্যাকলীন। জেরেমি মিলারের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার পর যে প্রশান্তি ওকে ঘিরে ধরেছিল তা নিমেষে উবে গেছে। লাশগুলো দেখার পর থেকে ঘামতে শুরু করেছে, কি করবে ভেবে। পাচ্ছে না। এক ধরনের ভয় যে ওকে তাড়া করছে না, তা-ও নয়। বলা যায় ওর অবহেলার কারণে মারা গেছে মানুষগুলো।
বৃথা জেনেও সূত্র খোজার চেষ্টা করল জেথ। নেই। ওর ওপর কড়া নজর রেখেছিল খুনী, মিলারের স্টোরে ঢোকার পরপর এখানে এসে কাজ সেরে ফেলেছে। দ্রুত, কিন্তু নিশ্চিন্তে। ডরম্যানের ব্যাপারে ঝুঁকি নিতে চায়নি, হয়তো জেনে থাকবে কোন তথ্য-এ কারণে মরতে হলো দুবৃত্তকে। খুনের সাক্ষী রাখা যায় না বলে রেহাই পায়নি মার্শাল। ডীম থর্টনের চোখে যে বিস্ময়, তার কারণ লোকটার পরিচয়। এমন কেউ তাকে খুন করেছে যাকে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেনি থর্টন, পেছনের লোকটা নিজে এ কাজ করেছে। শহর কমিটির লোক হলে কিভাবে সন্দেহ করবে মার্শাল?
হোয়াইটস্টোন ছেড়ে চলে যাবে, একটু আগেও ভেবেছিল জেথ, অথচ দো টানায় পড়ে গেছে এখন। সাফল্যের দোরগোড়ায় এসেও পাঁচ হাজার ডলারের আশা সহজে ত্যাগ করেছে। টার্নারকে ধরতে পারেনি এবং চলে গেলে লোকজন ওকে কাপুরুষ ভাবত, তা-ও মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এখন যদি চলে যায় তো এ দুটো খুনের দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। জেদ চেপে গেছে, লোকটাকে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। দরকার হলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দেবে তবু লোকটার মুখোশ উন্মোচন করবেই।
স্টোভে কফির পানি চড়িয়ে দিয়ে সিগারেট ধরাল জেথ। লোকজন যদি মিলারের ওপর হামলা করার কারণ জানতে চায় তো আসল ব্যাপারটাই জানাবে, সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু এদের মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে কি জবাব দেবে? সত্যিকার অর্থে এজন্যে ও-ই দায়ী। এ দায় থেকে যে করে তোক মুক্তি পেতে হবে, ভাবল ও, পুরো ব্যাপারটা প্রমাণ করে আসল অপরাধীকে ধরতে হবে, নইলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে থাকতে হবে।
টেবিলের ওপর কিছু রাখার শব্দে সংবিৎ ফিরল জেথের। ডিলান উডম্যান কফির মগ রেখেছে ওর সামনে। এখানে এসে কখন কফি তৈরি করেছে সেলুন মালিক, টেরই পায়নি ও।
জাজ আর রোয়ানা আসবে এখুনি। অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে হাসল ডিলান।
ওরা খবর পেল কিভাবে?
তুমি যখন আমার সেলুনে, এখানে এসেছিল রোয়ানা। এরপর জাজের কাছে গেছে, ফেরার সময় খবর দিল আমাকে। একটা চেয়ারে বসল ডিলান। তোমাকে সেলুনে দেখেই বুঝেছি কিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু ভাবতে পারিনি পরিস্থিতি এত খারাপ। তোমার হিতাকাক্ষী হিসেবে বসে থাকতে পারিনি, তাই চলে এলাম। আরেকটা কারণ অবশ্য আছে, শহর কমিটিতে গ্রীনের জায়গায় আজ থেকে দায়িত্ব পালন করছি আমি। মিলার আবার নাক গলাতে চেয়েছিল, জাজ সাফ না বলে দিয়েছে।
কোন কারণ ছাড়াই ডিলানের কথা ও উপস্থিতি বিরক্তিকর লাগছে জেথের। আসলে পুরো বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ওর মন, কোন কিছু নিজের অনুকূলে থাকছে না বলে নিজের ওপরই বিরক্ত। জেরেমি মিলারের ব্যাপারে এত উৎসাহ দেখানো ঠিক হয়নি।
দরজা খুলে গেল। জাজ আর রোয়ানা ঢুকল।
লাশগুলো দেখে একটা চেয়ারে বসল জাজ। ডীন থর্টনকে সরিয়ে ফাঁকা একটা সেলের ভেতরে রেখে এল ডিলান। ফিরে এসে বেসিনে হাত ধুয়ে কফি পরিবেশন করল দুজনকে। রোয়ানা এসে সেই যে একটা চেয়ারে বসেছে, খেয়াল করল জেথ, এখন পর্যন্ত একটা কথা বলেনি, বোধহয় নড়েনি।
শোনা যাক কি বলার আছে তোমার, প্রস্তাব করল জাজ।
জেরেমি মিলারের সাথে প্রথম দেখার পর থেকে আজকের ঘটনা পর্যন্ত লিখে জানাল জেথ।
কি যেন ভাবল উইলসন হলেন। স্বেচ্ছায় অতি উৎসাহে হামলা করার ব্যাপারটা ছাড়া আর সবই ঠিক আছে। তবে ওই কারণেও আমরা তোমাকে অভিযুক্ত করতে পারি না, এমনকি এ দুটো মৃত্যুর ব্যাপারেও। ভীনের ব্যর্থতায় সে নিজে তো মরেছেই, ডাকাতটাও মারা গেছে। তোমার ওপর কিছুটা দায়িত্ব ছিল, তবু এককভাবে তোমাকে দায়ী করা চলে না। তবে হ্যাঁ, মিলার মারা গেলে সত্যি বিপদে পড়বে তুমি-আদালতে যেতে হবে। একতরফাভাবে ওকে মেরেছ তুমি। শহরের লোকেরাও ব্যাপারটা পছন্দ করবে না। সবকিছুর পরেও আমরা কিছু করতে পারব না এজন্যে যে পশ্চিমের আইন খুব দুর্বল।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল জেথ, বড় একটা বোঝা নেমে গেছে বুক থেকে। আড়চোখে দেখল রোয়ানাকে, থমথমে মুখ, হাতের নখ খুটছে। জেথ অভিযুক্ত হলো না বলে ওর খারাপ লাগছে?
বাক টার্নারের ব্যাপারে শেষ কি করলে? প্রসঙ্গ বদলাল জাজ।
নিলামের সময় জানাব সব-কাগজে লিখল জেথ।
ঠিক আছে, ম্যাকলীন, উঠে দাঁড়াল জাজ। কাজ পড়ে আছে ওদিকে। রোয়ানার অনুফেলতে পারিনি, আসতে হলো তাই। রোয়ানার দিকে তাকিয়ে হাসল। দুজন লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি, সক্কারের ব্যবস্থা করবে ওরা। ডিলান, আমার সাথে এসো।
জাজকে অনুসরণ করে বেরিয়ে গেল সেলুন-মালিক।
মিনিট কয়েক পরে এল লোকগুলো, লাশ নিয়ে ফিরে গেল।
রোয়ানা বসে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না জেখ, নিদেনপক্ষে ওকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। বুদ্ধি করে জাজকে না জানালে পরিস্থিতির ফিকিরে পড়ে হয়তো ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যেত।
জেথ? অনেকক্ষণ পর ডাকল রোয়ানা।
চোখ তুলে তাকাল ও।
তুমি আমার নিষেধ শোনননি কেন? জেদটাই বড় হয়ে গেল? ওদের হাতে মারা পড়তে পারতে! তোমার কিছু হয়ে গেলে… থেমে গেল রোয়ানা, মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকে।
তোমার খুশি হওয়া উচিত-একটা কাগজে লিখে এগিয়ে দিল জেথ।
পড়ার আগ্রহ তো দেখালই না বরং ঠায় একইভাবে বসে থাকল রোয়ানা। জেথ, আমার ধারণা ছিল তুমি আমাকে বুঝতে পারো, যেমনটা আমি পারি। তোমাকে নিয়ে আমার অহঙ্কার ছিল, তুমি তা ভেঙে দিয়েছ। থামল ও, তাকাল জেথের দিকে, কাঁপা গলায় বলল পরের কথাগুলো। অহেতুক নিজেকে ফেলনা ভাবার দিন তোমার কবে শেষ হবে, জেথ? আমি আর কবছর অপেক্ষা করব?
কি করবে বুঝতে পারছে না জেথ। পকেট থেকে তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করতে শুরু করল। হাত কাঁপছে, তাকাচ্ছে না রোয়ানার দিকে। একটু পরেই তাকাতে বাধ্য হলো ও, উঠে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। চোখে পানি, আশাহতের বেদনায় মুখটা ম্লান। ঘুরে হাঁটতে শুরু করেছে দরজার দিকে।
সিগারেট ফেলে ছুটল জেথ। এ মেয়েকে চেনে সে, ওর শরীরে ম্যাকলীনদেরই রক্ত, একবার জেদ চাপলে কিছুতেই আর ফেরানো যাবে না। ছুটে সামনে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়াল।
চোখ তুলে সরাসরি তাকাল রোয়ানা, দেখল ওকে। জেথের চোখে কি যেন খুঁজছে। তারপর এগিয়ে এসে দুহাতে জাপটে ধরে, ডুকরে কেঁদে উঠল। তুমি খুব নিষ্ঠুর, জেথ! অনুযোগ ঝরে পড়ল কণ্ঠে। ছোট্ট এই সিদ্ধান্তটা নিতে তোমার যতদিন লাগল, অথচ আমরা সবসময়ই পরস্পরকে চেয়েছি!
নিবিড়ভাবে ওকে বেষ্টন করল জেথ। প্রশান্তি লাগছে, নিজেকে কখনও এতটা সুখী মনে হয়নি এর আগে। এ মেয়ে আমার কষ্টের ভাগ নিতে জানে, ভাবছে জেথ ওকে এড়িয়ে চলা ভুল হয়েছে।
আলাদা হয়ে চোখ মুছল রোয়ানা। কফি তৈরি করব? খেতে ইচ্ছে করছে। জেথ সায় দিতে স্টোভের কাছে চলে গেল। আমরা খুব স্বার্থপর! একটু আগে দুটো মানুষ খুন হয়েছে এখানে, অথচ আমরা প্রতিশ্রুতি বিনিময় করলাম!
মৃত্যুর মত এটাও জীবনের একটা অংশ, মনে হলো জেথের, সবচেয়ে চমৎকার অংশ।
এবার আর যাওয়া হবে না তোমার, কফির মগ এগিয়ে দেয়ার সময় বলল রোয়ানা। প্রতিবারই তো লুকিয়ে চলে যাও!…চাচা যে কত খুশি হবে তুমি ভাবতেও পারবে না। ও তোমাকে এত ভালবাসে! হাসল ও, আর জেথের বুকে আলোড়ন উঠল। দায়িত্ব নিতে তোমার এত ভয়, অথচ নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায় তোমার ওপর। একাই সবকিছুর কিনারা করে ফেলেছ। আর, আমাকে অলস বানিয়েছ, তোমার সঙ্গ ছাড়া একটা কাজও ভাল লাগে না আমার!
সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে ফুকছে জেথ।
সকালে যেখানে বিরতি দিয়েছিলাম, সেখান থেকে শুরু করব আমরা, প্রস্তাব করল রোয়ানা। স্টেজ কোম্পানির অফিসে যাবে তুমি, আর আমি যাব মিলের কাছে। প্রচুর কাজ পড়ে আছে। সারাটা দিন তোমার সাথে থেকে কাজ একটুও এগোচ্ছে না। সন্ধেয় ডিলানের সেলুনে এসো, একসঙ্গে বাথানে ফিরব।
মাথা নাড়ল জেথ। আজকের রাতটাকে কাজে লাগাতে চায় ও। যে করে হোক টার্নারকে খুঁজে বের করবে, নইলে পার পেয়ে যাবে পেছনের লোকটা।
রোয়ানা চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর বেরোল জেথ। লাঞ্চ করে স্টেজ কোম্পানির অফিসে চলে এল। কেরানি জানাল দুপুরের পর একটা স্টেজ আসবে।
অনেক ভেবে খণ্ড খণ্ড ঘটনাগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টায় সময়টা কাজে লাগাল। নিচ্ছিদ্র প্রমাণ না থাকায় কোন কিছুই ধোপে টিকবে না। টার্নারকে ধরতে হলে আজকের রাতটাই আদর্শ, তস্করের পাওনা বুঝে নেয়ার সময় হয়েছে। পেছনের লোকটা তাকে প্রাপ্য বখরা দেবে। লোকটাকে চোখে চোখে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।
বিকেলে গ্রীনস প্যালেসের সামনে চলে এল জেথ। হোটেলটাকে কোনরকমে দাঁড় করানো হয়েছে দুএকজন আগন্তুক শহরে এলে যাতে আশ্রয় নিতে পারে। গ্রীন পরিবারের সম্বল এখন ওটাই, আর লুট হওয়া বিশ হাজার ডলার, যদি উদ্ধার করা যায়।
দক্ষিণে পাহাড়শ্রেণী যেখানে মালভূমির আকার নিয়েছে, ধুলোর মেঘ দেখা গেল। একটু পর স্টেজের অবয়ব ফুটে উঠল সেখানে। কৌতূহলী লোকেরা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। অনেকে এসেছে চিঠি বা প্রিয়জনের প্রত্যাশায়। মিনিট তিন পর হোটেলের সামনে এসে থামল স্টেজটা, ঘড়ঘড় শব্দ শেষদিকে ছন্দ তুলেছে। ক্রমাগত হাঁপাচ্ছে ঘোড়াগুলো, ঘামে চিকচিক করছে ওগুলোর রেশমী লোম। চাবুক ফেলে আসন ছেড়ে লাফিয়ে নামল চালক, পেছনে এসে দরজা খুলে দিল।
দুজন মহিলা নামল প্রথমে, ভিড়ের মধ্যে পরিচিত মুখ খুঁজছে। এরপর যে লোকটি নামল তার দৃষ্টি পড়ল পোড়া হোটেলের ওপর। জেথ তার এতটা কাছে যে অনায়াসে পড়তে পারল লোকটার চোখের ভাষা-সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে তাকে। অথচ উল্টো হওয়ার কথা। জেথের কাছে বেখাপ্পা লাগল ব্যাপারটা, আগ্রহবোধ। করছে।
নোকটার মাথায় ফেল্ট হ্যাট। বাম হাতে আয়তকার ব্যাগ, অন্য হাতে ছড়ি। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির সাথে গোল রিমের চশমা চেহারায় আভিজাত্য এনে দিয়েছে। পরিপাটি পোশাক যেন এই মাত্র পরেছে। বাকা নাক, চাপা গাল দেখে বোকা বলে ভুল হতে পারে, পুব ধাচের হাঁটার ভঙ্গি ধারণাটা বদ্ধমূল করবে। কিন্তু লোকটিকে ধূর্ত, কপট মনে হলো জেথের। এরকম দ্রলোকদের পুবের বড় কোন শহরে দেখা যায়, হোয়াইটস্টোনের মত রুক্ষ অখ্যাত জায়গায় এসেছে কেন?
শেষ যাত্রীটি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল জেথকে, ক্ষণিকের জন্যে উজ্জ্বল হলো তার মুখ। ভাবলেশহীন মুখে এগিয়ে এল এরপর। হাঁটার মধ্যে দৃঢ়প্রত্যয়ী ভাব আছে-চোখ কাড়ে।
গুড ডে, ম্যান, হালকা সুরে সম্ভাষণ জানাল সে।
মৃদু নড করল জেথ।
আমি ক্যারল উইলিয়ামস, একজন আইনজ্ঞ, হেসে নিজের পরিচয় দিল লোকটা। ইস্টার্ন পেট্রোল কোম্পানির হাচিনসন শাখা থেকে এসেছি। ওটার প্রধান অফিস সনোরায়। আমার সাথে প্রচুর টাকা আছে। সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বোধহয় ব্যাংক, তাই না? ওটা কোথায়?
ব্যাংকটা দেখিয়ে দিল জেথ।
ধন্যবাদ। আগামীকাল ট্রিপল ক্রসের নিলাম হবে তো, না আবার পিছাবে?
মাথা নাড়ল ও।
আজকের রাতটা কাটানোর জন্যে একটা ভাল হোটেলে উঠতে হবে আমাকে। সবচেয়ে ভালটা।
গ্রীনস প্যালেসের দিকে ইঙ্গিত করল জেথ।
অশেষ ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে। ঘুরে ব্যাংকের দিকে এগোল আইনজ্ঞ।
লোকটার পেছনে সেঁটে আছে জেথের দৃষ্টি, ভাবছে। ক্যারল উইলিয়ামসকে মোটেও ভাল লাগেনি। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে হোটেল পুড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সে জানত এবং দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে। ওকে দেখে চোখ উজ্জ্বল হওয়ার কারণ জেথের বর্ণনা তাকে দেয়া হয়েছে। আইনজ্ঞের সাথে পেছনের লোকটার মোগাযোগ না থেকে পারে না। ইস্টার্ন পেট্রোল কোম্পানি তার একটা কাভার। কোম্পানির হয়ে পানির দামে ট্রিপল ক্রস কিনবে আইনজ্ঞ। এর কারণ ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে, স্বভাবতই দর বেশি উঠবে না।
আইনজ্ঞকে চোখে চোখে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে জেথ। টার্নারকে যদি ধরতে না পারে তো ক্যারল উইলিয়ামস হবে ওর তুরুপের তাস। কথা বের করার জন্যে দরকার হলে তাকে ধোলাই দেবে।
***
হোয়াইটস্টোনের এ রাতটা চমৎকার। আকাশে রূপালি চাঁদ, ঝিরঝিরে বাতাস। দ্রুত একের পর এক সরে যাচ্ছে মেঘের সব বিশাল পাহাড়, চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে মাঝে মাঝে, সেই সাথে আলো-ছায়ার মনোরম পরিবেশ। চমৎকার না বলে উপায় আছে?
বেশির ভাগ দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, কেবল কাছের সেলুন থেকে হৈ-হল্লার শব্দ ভেসে আসছে এখনও। হোটেলের শেষ বাতিটা নিভে গেছে একটু আগে। একপাশে সরে এল জেথ, গলির ভেতর দাড়িয়ে আছে যে-টা। একটা স্টোরের পেছনে হেঁটে চলে এল ওরা। চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে, কান সজাগ। যে কোন সময়ে বেরিয়ে আসতে পারে সে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মাথায় কাউবয় হ্যাট, গায়ে পনচো পরে। গ্রীনস প্যালেস থেকে বেরিয়ে এল লোকটা। আকাশের দিকে তাকাল জেথ। উহ, বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই। তাহলে পনচো পরল কেন? ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল ও। হোটেলের হিডিং রেইলে বাধা একটা বাকস্কিন দেখতে পাচ্ছে, লোকটা নিশ্চয়ই এ ঘোড়াটায় চড়বে। বিকেলে ঘোড়াটাকে ভাড়া করতে দেখে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল জেথ।
স্যাডলে চেপে উত্তরে এগোল ক্যারল উইলিয়ামস।
নিরাপদ দূরত্বে থেকে তাকে অনুসরণ করল জেথ। শহরের মূল রাস্তা ধরে এগোচ্ছে ও, আইনজ্ঞ যাচ্ছে রাস্তার পুব দিকের বাড়ি আর দোকানের পেছন দিয়ে। কারও চোখে পড়ার ইচ্ছে নেই তার।
গতি বাড়িয়ে শহরের শেষপ্রান্তে চলে এসে একটা বাড়ির ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকল ও। একটু পর ওকে পেরিয়ে গেল ক্যারল উইলিয়ামস। লোকটা কোথায় যাচ্ছে জানা না থাকলেও জেথ এটুকু জানে কেন মাঝরাতে বেরিয়েছে। সে। দুশো গজ পেছনে আছে ও। খুরের অস্পষ্ট শব্দ আর আন্দাজই ভরসা। ধূর্ত লোকটা বাকস্কিনকে প্রায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাছাড়া সন্দেহ নিরসনের জন্যে। মাঝে মাঝে থামছে। সে থামলে জেথও থামছে যদিও জানে ফাঁকি দিতে পারেনি। দুএকবার হয়তো শুনে ফেলেছে গ্রে-র খুরের শব্দ, কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই তার।
হঠাৎ গতি বাড়াল সে।
এদিকটা ওর অচেনা, তায় রুক্ষ জায়গা। ছড়ানো-ছিটানো বোল্ডার, কাঁটা। ঝোপ আর ঘন অ্যাসপেনের ছড়াছড়ি। মাঝে-মধ্যে পাথুরে টিবিও দেখা যাচ্ছে। ট্রেইলটা বার বার বাঁক নিচ্ছে। জেথ সহসা টের পেল হারিয়ে ফেলেছে লোকটাকে।
ঘোড়ার রাশ টানল ও। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল-নাহ, চারদিকে অটুট নীরবতা। দুটো পাতা খসে পড়েছে, একটা খরগোশ ক্যাকটাসের খোঁচা খেয়ে ককিয়ে উঠেছে, তারপর ছুটে পালাল-শুধুই প্রকৃতির সাড়া। বাকস্কিনের খুরের শব্দ না পাওয়ার কারণ একটাই-লোকটা গন্তব্যে পৌঁছেছে।
নিজের ওপর ভীষণ রাগ হলো ওর, আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
আইনজ্ঞকে ঠিক কোথায় হারিয়েছে নিশ্চিত নয় জেথ। আলো-ছায়ার মধ্যে ট্রাক থাকলেও ট্রেস করা সম্ভব নয়, ওর পৌঁছুতে যে সময় লাগবে তাতে অনায়াসে কাজ সেরে চলে যেতে পারবে লোকটা। মিনিট খানেক অপেক্ষা করে সামনের পাথুরে ঢিবির ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল। চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর বুলাল, শোনার চেষ্টা করল অস্বাভাবিক কোন শব্দ।
প্রান্তরের অটুট নীরবতা ভেঙে দিয়ে খুব কাছে গর্জে উঠল একটা পিস্তল। শব্দে জেথের মনে হলো ডেরিঞ্জার জাতীয় কিছু।
শব্দের উৎস লক্ষ্য করে ঘোড়া ছোটাল জেথ। দ্রুত পেরিয়ে গেল ষাট গজের মত। সামনে জুনিপারে ঘেরা একটা ভোলা জায়গা। কাছে যেতে পশ্চিমে ছুটে পালাতে দেখল এক ঘোড়সওয়ারকে, পেছনে বাতাসে ফুলে-ফেঁপে উঠছে তার পনচো।
পাথুরে মাটিতে পড়ে আছে হতভাগ্য লোকটি। পাশে একটা রোয়ান দাঁড়িয়ে। সব লেনদেন চুকিয়ে ফেলা হয়েছে, ভাবল জেথ। লাভের আশায় সাহায্য করেছিল লোকটা, কিন্তু কিছুই পেল না। হতাশা গ্রাস করল ওকে, এ লোকটি অকাট্য প্রমাণ হতে পারত। একটু আগে পৌঁছুতে পারলে হয়তো ঠেকানো যেত আইনজ্ঞকে। সুযোগ পেয়েও তা হারানোর জন্যে নিজেকে মনে মনে গাল দিল ও।
খুনীর পিছু নিয়ে লাভ নেই। পালিয়ে যাবে না সে, এখান থেকে হোটেলে ফিরবে। সকালে ট্রিপল ক্রসের নিলামে পাওয়া যাবে তাকে।
স্যাডল ছেড়ে পড়ে থাকা লোকটাকে পরীক্ষা করল জেথ। তার ডান হাত চলে গিয়েছিল পিস্তলের ব্যাটে। লোক চিনতে এবার ভুল করেছে সে, লোভের খেসারত দিতে হয়েছে তাই। পনচোর আড়াল থেকে গুলি করেছে আইনজ্ঞ, শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরে হাত বাড়িয়েও লাভ হয়নি। মাত্র একটা গুলি, কিন্তু সেটাই বাক টার্নারের মাথায় আঘাত করেছে।
.
১০.
নিলাম অনুষ্ঠানটা আদালত ভবনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসেছে জাজ উইলসন হলেন আর ব্যাংকার জুলিয়াস হোল্ডেন, উল্টোদিকে দরজামুখো হয়ে ক্যারল উইলিয়ামস। কারও দিকে তাকাচ্ছে না সে, ভাবলেশহীন মুখ। আইনজ্ঞের চেয়ে কিছু দূরে একটা বেঞ্চে স্যাম জারভিসের সাথে বসেছে রোয়ানা।
জেরেমি মিলার মারা যায়নি। ডাক্তার পিকার্ডের হাসপাতালে আছে এখন। নিলামে যে লোকটা স্টোর-মালিকের প্রতিনিধিত্ব করছে তার চেহারা সার্কাস বা থিয়েটারের ক্লাউনের মত।
পেছনে দর্শকের সারিতে বসা জনা-পঞ্চাশেক নারী-পুরুষ। স্রেফ মজা দেখার জন্যে আর উৎসাহ দিতে এসেছে তারা। দরজার কাটে কাঁধ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে জেথ, নজর রাখছে সবার ওপর। এখানে একটুপর এমন একটা ঘটনা ঘটবে অনেকদিন ধরে যা মনে রাখবে হোয়াইটস্টোনের লোকেরা, ভাবল ও।
ডিলান উডম্যান নিলাম পরিচালনা করছে।
এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ চল্লিশ হাজার হাঁকিয়েছে জাজ। অন্যরা চিন্তা করছে বা ভান করছে আরও এগোবে কি-না। রোয়ানার দিকে তাকাল জেথ। স্নান দেখাচ্ছে। মেয়েটাকে, জানালা পথে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে হয়তো নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করছে, ভাবল জেথ। ব্যাংকে ডাকাতি বা মিলটা ধ্বংস না হলে ট্রিপল ক্রস কেনার সুযোগ হত ওর, চমকার সম্পর্কের কারণে ক্রেতা হিসেবে স্যাম জারভিসের প্রথম পছন্দ ও-ই।
চুপ করে আছে সবাই। জারভিস ম্লান কণ্ঠে ঘোষণা দিল বেশি হলে আর দুই মিনিট চিন্তা করার সুযোগ, এরমধ্যে কেউ না বাড়ালে জাজই বাথানটা কিনে নেবে। স্যাম জারভিসের তাড়াহুড়োর কারণ হাচিনসনগামী স্টেজটা। ওটা ধরে হাচিনসন যাওয়ার পর আগামীকাল নিউ ইয়র্ক রওনা হবে, শেষ বয়সটা কাটিয়ে দেবে ভাতিজার সাথে।
এক হাজার গরু, জমি আর তেল…নেহায়েতই কম দামে বিক্রি হচ্ছে বাথানটা, ভাবল জেথ। একে একে সবার দিকে তাকাল ও। ব্যাংকারের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে আর আগে বাড়বে না। ডাকাতিতে ক্ষতি হয়েছে তার, এখন তাই ঝুঁকি নিতে নারাজ। জেরেমি মিলারের ক্লাউন শুরুতে বিশ হাজার হাঁকিয়েছিল, এখন ফলাফলের অপেক্ষায় আছে শুধু। যা ধারণা করেছিল ও-ফলে যাচ্ছে। ক্যারল উইলিয়ামস ভাবছে। জেথ নিশ্চিত শেষ মুহূর্তে পয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ হাজার প্রস্তাব করবে। এর উপরে যাওয়ার ক্ষমতা বোধহয় জাজের নেই, খুব জোর পঞ্চান্ন পর্যন্ত যেতে পারে তা-ও যদি জেদ চেপে যায়, এরপর হাল ছেড়ে দেবে।
তাহলে শেষতক কোম্পানির হয়ে জমিটা কিনতে যাচ্ছে ক্যারল উইলিয়ামস।
পেছনে সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে।
জেথের একবার ইচ্ছে হলো ও নিজে নিলামে অংশগ্রহণ করে, জাজ হাল ছেড়ে দেয়ার পর দাম হাঁকাবে। এতে পরোক্ষভাবে স্যাম জারভিসের লাভ, আশানুরূপ দাম পাবে সে কারণে ওকে দর বাড়াতে দেখলে আইনজ্ঞও বাড়াবে। হোয়াইটস্টোনে এতদিন যা ঘটেছে তার মূল উদ্দেশ্য সস্তায় ট্রিপল ক্রস কেনা, যে করে হোক বাথানটা কিনবে আইনজ্ঞ, জেথ এ ব্যাপারে একরকম নিশ্চিতই। দাম বাড়িয়ে লোকটার পরিকল্পনায় কিছুটা হলেও বাদ সাধা যেতে পারে।
তারপর মনে হলো এমনিতেই তার ষড়যন্ত্র ভেস্তে যাবে, কি দরকার ঝুঁকি নেয়ার! বলা তো যায় না দাম হাঁকিয়ে জেথ নিজেই ফেঁসে যেতে পারে। এত টাকা ওর কাছে নেই, সবগুলো পকেট হাতড়ে হয়তো বিশ-ত্রিশ ডলার পাওয়া যাবে।
রোয়ানার সাথে চোখাচোখি হতে ইঙ্গিত করল জেখ। ওর পিছু নিয়ে আদালত ভবন থেকে বেরিয়ে এল মেয়েটা। ফাঁকা রাস্তার ওপর চোখ বুলিয়ে চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকাল। পকেট থেকে একতাড়া কাগজ বের করে এগিয়ে দিল জেথ, গতরাতের ঘটনাসহ সবকিছু লেখা আছে। ওগুলো কেউ পড়ে শোনানোর চেয়ে রোয়ানা নিজে উপস্থাপন করুক, এটাই ভাল হবে।
দ্রুত, মনোযোগ দিয়ে পড়ল রোয়ানা। পাঁচ হাজার ডলার তাহলে পাচ্ছ শেষ পর্যন্ত, পড়া শেষ করে হালকা সুরে মন্তব্য করল। আর হ্যাঁ, একটা ব্যাপার স্বীকার না করে পারা যাবে না, পেছনের ওই লোকটার চেয়ে কোন অংশে কম নও তুমি। ভাগ্যিস জেথ্রো ম্যাকলীনকে হোয়াইটস্টোনে আনিয়েছিলাম আমি, নইলে বুদ্ধিতে কে তার সাথে টেক্কা দিত? হাসল ও, জেথের বুকে বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হলো, মেয়েটাকে কাছে টানার ইচ্ছে হলো। টের পেয়ে পিছিয়ে গেল রোয়ানা। তার মত তোমার মাথায়ও শয়তানি বুদ্ধিটা একটু বেশি! দৃষ্টিতে জেথকে শাসাল ও, তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করেও ফিরল আবার। সাবধানে থেকো, প্লীজ! সবকিছু ভেস্তে যাওয়ায় বেপরোয়া হয়ে পড়বে ওরা, তোমার ওপর হামলা করতে পারে। আমি তোমাকে হারাতে চাই না!
জোরেশোরে তালি পড়ল। আইনজ্ঞ বোধহয় দাম হাঁকিয়েছে।
একটু সবুর করো, ডিলান, ঢুকে শুরু করল রোয়ানা, দর্শকদের দেখল। প্রিয় হোয়াইটস্টোনবাসী, কিছু ব্যাপার তোমাদের জানানো প্রয়োজন মনে করছি আমি।…বাক টার্নারের আউটফিট পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দুই অনুচরসহ সেদিন শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল টার্নার, কিন্তু গতকাল সে নিজে মারা গেছে।
কিন্তু লুটের টাকা তার কাছ থেকে উদ্ধার করা যায়নি, মনে করিয়ে দিল জাজ।
টাকাগুলো টার্নারের কাছে থাকলে তো ফিরিয়ে আনা যাবে! ওগুলো কোথায় আছে আমি আর জেথ ছাড়া আরও দুজন তা জানে, দুজনেই এখানে উপস্থিত আছে। দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল, ঘরের প্রতিটি লোকের মনোযোগর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে রোয়ানা। দর্শকরা একটু নীরব হতে ফের শুরু করল
হাচিনসন গিয়ে বাক টার্নারকে ভাড়া করে এ শহরের একজন অভিজাত নাগরিক। ডাকাতি করে পুমাস ক্যানিয়নে আশ্রয় নেয় টার্নার, অথচ ওটা কানা আর সে তা ভাল করেই জানত। এ-ও জানত শহরের কেউ তার পিছু নেবে না, বা নিলেও ঠিকমত ট্রেস করতে পারবে না। অলিখিত একটা চুক্তি সফল করার জন্যে ওই বক্স ক্যানিয়নে সে-রাতে আশ্রয় নিয়েছিল ডাকাতেরা, পরে কিন্তু সেখানে আর একটা রাতও কাটায়নি। রাতে টার্নার এমন একজনকে পাহারার দায়িত্ব দিয়েছিল যে সুযোগ পেলেই বেঈমানি করবে। টাকা নিয়ে পালাল স্লিম বেকার। ক্যানিয়ন থেকে বের হওয়ার পথ একটাই, বেরিয়েই অ্যাম্বুশে পড়ল বেচারা। টাকাগুলো চলে এল আমাদের সেই লোকের হাতে যাকে পরে শহরে এসে খোঁজ করেছে টার্নার।
বাক টার্নার সবকিছু জানত এবং এভাবেই সাজিয়েছিল। ক্যানিয়ন থেকে বেরোবার একাধিক পথ থাকলে স্লিমকে ধরা যেত না ধরতে অসুবিধা হত। পুমাস ক্যানিয়নে আশ্রয় নেয়ার মূল কারণ ওটাই। টাকাগুলো দুভাগ হওয়ার কথা ছিল, টার্নারের অনুচরেরা কিছু পেত না, পেলও না। থেমে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল রোয়ানা, অনবরত কথা বলায় হাঁপিয়ে উঠেছে। একটু আগে থেকে শুরু করি…বিপত্তির শুরু স্যাম জারভিসের জমিতে তেল পাওয়ার পরপরই। আমার মিল থেকে একাডেমিতে পাঠানো দুটো সাপ্লাই লুট হলো, অনেক টাকার ব্যাপার, তবু প্রতিবার নতুন করে সাপ্লাই পাঠাতে হয়েছে। কিন্তু পরপর দুমাসে দ্বিতীয়বারের সাপ্লাইগুলো লুট হয়নি। আমার আর্থিক ক্ষতি হোক এটাই চেয়েছে লুটেরারা।
এরপর লোকটা ভাবল ব্যাংকে ডাকাতি হলে একসাথে শহরের কয়েকজন প্রভাবশালীকে আর্থিকভাবে ক্ষগ্রিস্ত করা যাবে। মোক্ষম সময়ে ডাকাতি করল টার্নার। ডাকাতির পরে কি হয়েছে তা আগেই বলেছি, এবার টাকা চুরির পর থেকে শুরু করা যাক। থামল রোয়ানা।
থেমো না, ম্যাম, দর্শকের সারি থেকে চেঁচাল একজন। তোমার গল্পটা সত্যি দারুণ!
উজ্জ্বল হলো রোয়ানার চোখ, হেসে শুরু করল। বেহাত হয়ে যাওয়া টাকা আর লোকের খোঁজে শহরে এসে হামলা করল টার্নার। এবারও ক্ষতিগ্রস্ত হলাম আমি, গ্রীন আর জেরেমি মিলার। স্থাবর কোন সম্পত্তি আমাদের থাকল না যেটা মর্টগেজ রেখে ব্যাংক ঋণ পেতে পারি। সুতরাং ট্রিপল ক্রস কেনার সামর্থ্য আমরা হারালাম।
একদিন পর জেথ আর আমি আউট লদের হাইড আউটের খোঁজে বেরোলাম। বিকেলে দলবলসহ শহরে হামলা করল টার্নার, সুবিধে করতে না পেরে পালিয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা অবশ্য খোলসা হয়ে যায় দুপুরেই, জেথ আমাকে জানাল এমন একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন লোক আছে সবকিছুর পেছনে যার কোন ক্ষতি হয়নি। সে অবশ্যই প্রভাবশালী এবং ট্রিপল ক্রস কেনা ছাড়াও একগাদা আউট ল ভাড়া করার সামর্থ্য রাখে।
রোয়ানা থামতে লাফিয়ে চেয়ার ছাড়ল জাজ। তুমি কি মনে করো আমিই সেই লোকটা? রুক্ষ স্বর, রেগেছে বোঝাই যায়। এ জন্যেই সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলে কোথায় টাকা রাখি আমি?
খানিকটা অপ্রতিভ দেখাল রোয়ানাকে, ক্ষীণ হেসে বলল, আমার ধারণা অবশ্য তাই ছিল, কারণ তোমার টাকা হাচিনসনের ব্যাংকে থাকে এবং এরকম। পরিকল্পনা করার মত বুদ্ধি তোমার আছে। তাছাড়া আছে গণ্ডায় গণ্ডায় লোক ভাড়া করার ক্ষমতা, মানে টাকা। কিন্তু একটু আগে জেথ ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছে।…পুমাস ক্যানিয়নের কাছে কিছু ছাই আর দুই টুকরো কাগজ পেয়েছিল। ও, আকারে ঠিক ব্যাংক নোটের মত। তখন বুঝতে পারিনি, অথচ ওগুলোয় লিখে পুরো ব্যাপারটা আমাকে জানিয়েছিল ও। চোখাচোখি হতে জেথের দিকে একরাশ অভিযোগ ছুঁড়ে দিল বোয়ানা, কাগজের টুকরো দুটো বের করে দেখাল।
কিন্তু এগুলো কি প্রমাণ করে? জারভিসও উত্তেজিত।
ওখানে অনেকগুলো কাগজের টুকরো পোড়ানো হয়েছে, ঠিক এ রকমই। এ দুই টুকরো ভুল করে পোড়ানো হয়নি, সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়েছে। এ থেকে কিছু হিসাব-নিকাশ করেছে জেথ। বাক টার্নার যে টাকা লুট করেছিল সে নোটগুলোর কেবল প্রথম আর শেষ কয়েকটিই আসল ছিল। দুর্বত্তকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে এটা করা হয়েছে, কিন্তু টার্নার তা জানত না। কারণ চুক্তিমত টাকা পরখ করে দেখার কথা ছিল না।
লোকটা ইস্টার্ন পেট্রোল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে কখন? স্যামের জমিতে তেল পাওয়ার পরপর। কোম্পানিটা আসলে তার কাভার। ক্যারল উইলিয়ামসকে জিজ্ঞেস করলে এর সত্যতা জানা যাবে। এ-ও জানা যাবে গত রাতে বুলেট দিয়ে সে টার্নারের বখরা মিটিয়ে দিয়েছে কি-না। মি. উইলিয়ামস, আমি কি ঠিক বলিনি?
কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে আইনজ্ঞের মুখ। কাউকে বলে দিতে হলো না কে বাক টার্নারের হত্যাকারী। তার অবস্থা এমন হয়েছে এখান থেকে পালাতে পারলে যেন বাঁচে। কিন্তু সন্দেহ আরও ঘনীভূত করে দিয়ে উঠে পড়ার জো নেই, তাহলে নির্ঘাত লোজন তাকে কটনউডে লটকে দেবে। তাই, আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে।
মিস ম্যাকলীন, লোকটা কে তুমি জানো? পেছন থেকে চেঁচাল কেউ।
নোটের ফাঁকি দেয়া কেবল একজনের পক্ষে সম্ভব-ব্যাংকার, মি. জুলিয়াস হোল্ডেন। ডাকাতির আগে কাগজ কেটে টাকার বান্ডিল তৈরি করে রেখেছিল সে, টার্নার এসে নির্দেশ করতে থলেয় ভরে দিয়েছে ওগুলো। যাচাই করে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি টার্নার, কারণ ব্যাংকারকে বিশ্বাস করেছিল সে।
ঘরে বোমা ফাটলেও বোধহয় এতটা চমকাত না কেউ। সেকেন্ড কয়েক স্তব্ধ হয়ে থাকল গোটা আদালত ভবন, কারও মুখে কথা সরছে না। তারপর একসঙ্গে বিস্ময় প্রকাশ করতে শুরু করল সবাই। এক পাঞ্চার শিস দিতে তাল মেলাল আরও কয়েকজন।
রাগে ফেটে পড়ল হোল্ডেন, দাঁড়িয়ে পড়েছে। বোঝা যাচ্ছে নিজেকে সামলে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে, জ্বলন্ত অঙ্গারের মত মনে। হচ্ছে চোখজোড়া। একটু পর দারুণ শান্ত দেখাল তাকে, বসে পড়েছে নিজের আসনে। বাজে বকছ, রোয়ানা, বাঁকা হাসি তার ঠোঁটে, কিন্তু গলাটা ঠিকই শীতল শোনাল। তুমি কখনোই আমার শত্রু ছিলে না। তাছাড়া কোন দুঃখে নিজের ব্যাংকে ডাকাতি করাতে যাব আমি?
ডাকাতি আদৌ কি হয়েছে? ব্যাংকের একটা টাকাও গচ্ছা যায়নি। এই এক লাখ ছাড়াও বাড়তি লাভের আশায় নিজের ব্যাংকে ডাকাতি করিয়েছ তুমি, মি. হোল্ডেন! কতটা লাভ হয়েছে তা তুমিই ভাল জানো। তোমার প্রধান টার্গেট ছিলাম আমি। আমার সাথে গ্রীনকেও কানা করে দিয়েছ। জেরেমি মিলার তোমার। লোক, টার্নারকে দিয়ে তার স্টোর ধ্বংস করিয়ে আর চারজনকে হত্যা করে ধাপ্পা। দিতে চেয়েছ। এ স্টোরের পেছনের কামরায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া দোকানের মালামাল এখনও পাওয়া যাবে। এর মানে কি? স্টোরটা ধ্বংস করা হবে আগে থেকে জানত সে, তাই দামী জিনিসপত্র সরিয়ে রেখেছে। বাক টার্নার বা তোমার সাথে যোগাযোগ থাকলেই কেবল মিলারের পক্ষে তা আগাম জানা সম্ভব। আমার সাপ্লাইগুলো লুট করতে লোক দিয়ে তোমাকে সাহায্য করেছে সে।
কি দারুণ পরিকল্পনা! এক লাখ ডলারেরও বেশি লুট হয়ে গেছে, ঘোষণা দিয়েছ তুমি, যার বেশিরভাগ টাকা আমার আর গ্রীনের। এ টাকা হয়তো কোন একদিন ফিরিয়ে দিতে, কিন্তু ততদিনে আসল কাজ হয়ে যেত। সিটি ব্যাংক থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ পেতে তুমি আর এদিকে পানির দামে ট্রিপল ক্রস কিনে সেটা পরে চড়া দামে অন্য কারও কাছে বিক্রি করতে। সব টাকা নিয়ে তুমি নিশ্চয়ই এখানে থাকার চিন্তা করোনি? আমার ধারণা দেশত্যাগী এক লাখপতি হত আমাদের ব্যাংকার। ইস্টার্ন পেট্রোল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছ তুমি যার কোন অস্তিত্বই নেই। মি. উইলিয়ামস, আমি কি ঠিক বলেছি?
আইনজ্ঞের মুখ দেখে এর সত্যতা বোঝা যাচ্ছে। ফ্যাকাসে মুখ, ভীত চাহনি হানছে ব্যাংকারের দিকে। তুমুল শোরগোল উঠল এবার, তা থিতিয়ে আসতে সময় লাগল। রোয়ানার প্রতিটি কথা জুলিয়াস হোল্ডেনের মধ্যে যে-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে তাতে বোঝা যায় একবর্ণ মিথ্যে বলেনি মেয়েটা। এখন আর রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করছে না ব্যাংকার, বরং তা কতদূর প্রসারিত হতে পারে তাই যেন জানাতে চায়। তার চোখে শীতল দৃষ্টি, সেখানে খুনের নেশা দেখতে পেল জেথ। হোলস্টারের কাছে চলে গেল ওর হাত। এসব লোকের ধাত ভাল করে জানা আছে, সাম্রাজ্য টলে উঠলে বেপরোয়া হয়ে যায়। কোন কিছু তখন তাদের আটকাতে পারে না।
ক্যারল উইলিয়ামসের অবস্থা আরও করুণ। ভয়ে-শঙ্কায় মুখের আদল এমন হয়েছে, গম্ভীরতম লোকও হেসে ফেলবে। চোরা চোখে মাঝে মাঝে দেখছে ব্যাংকারকে, হয়তো ভাবছে ওই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির লোকটা কোন ভেলকি দেখিয়ে নিজে উদ্ধার পাবে, তাকেও উদ্ধার করবে।
পাগল, বদ্ধ পাগল তোমরা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল হোল্ডেন, বিদ্রূপ তার কণ্ঠে। প্রমাণ কোথায়? সস্তা একটা গল্প আর দুই টুকরো কাগজ মোটেই যথেষ্ট নয়। ওরকম গল্প আর কাগজ যে কেউ তৈরি করতে পারে। নাকি প্রমাণ করতে না পেরে শেষে পিটিয়ে কথা আদায় করবে?
দয়া করে তোমাদের মধ্যে কেউ কি জেরেমি মিলারের স্টোরে যাবে। একবার? দর্শকদের উদ্দেশে বলল যোয়ানা। ভেতরের কামরায় গেলে গাছের। গুড়ি কেটে তৈরি একটা টেবিল দেখতে পাবে, একেবারে অক্ষত। কয়েকদিন আগেও স্টোরের দোতলায় ছিল ওটা। টেবিলটার ভাগ্য বটে, বাক টার্নার পুরো স্টোর উড়িয়ে দিল অথচ কিছুই হলো না ওটার! বাক্সভরা কিছু মালপত্র পাওয়া যাবে। তো কি প্রমাণিত হলো? মিলারের সাথে বাক টার্নারের সম্পর্ক। রোয়ানা খেয়াল করল দর্শকের সারি থেকে কেউই ওঠেনি, স্টোরে তল্লাশি চালাতে গিয়ে এখানকার মজা হারাতে রাজি নয়।
এক ঘণ্টার মধ্যে প্রমাণ করে দিতে পারব ইস্টার্ন পেট্রোল কোম্পানি বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই, ক্যারল উইলিয়ামস কোন আইনজ্ঞ নয়, স্রেফ সাধারণ মানুষ। তাহলে কেন সে ভিত্তিহীন একটা কোম্পানির লোক হিসেবে নিজেকে জাহির করবে? মি. উইলিয়ামস, কি বলার আছে তোমার?
বাজে কথা! কোম্পানির সব বৈধ কাগজ পেশ করে আমি ওটার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারি। হাতের ব্যাগ খুলতে উদ্যত হলো আইনজ্ঞ। আমাদের হেড অফিস সনোরায়, আর শাখা হাচিনসনে…
মানলাম, কাগজপত্র আছে তোমার সাথে, তাকে বাধা দিল বোয়ানা। কিন্তু নিজের প্রতিষ্ঠানের অবস্থানরত প্রমাণ দিতে পারবে?
ওটা তো সবে হলো… থেমে গেল সে, বুঝতে পেরেছে ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে।
দুই মাস, তাই না? কৌতুক রোয়ানার চোখে। মি. উইলিয়ামস, তুমি কি জানো আইনজ্ঞ সেজে প্রতারণার দায়ে কি শাস্তি হয়?
চুপসে গেল লোকটা। আ-আমি জানি না….সত্যি জানি না।
আসলে তুমি কোন আইনজ্ঞই নও, মি. উইলিয়ামস।
তালি পড়তে লাগল, সেই সাথে শিস।
এটা কোন প্রমাণ হলো? এর সাথে শহরের ঘটনা মেলানোর চেষ্টা বোকামি ছাড়া কিছু নয়, শান্ত দেখাচ্ছে হোল্ডেনকে। দুমাস আগে নিজের টাকায়। কোম্পানিটা প্রতিষ্ঠা করেছি আমি। ওটার কাগজপত্র তৈরি হলেও কোন অফিস নেয়া হয়নি। সনোরায় উইলিয়ামসের বাড়িটাকে হেড অফিস হিসেবে ব্যবহার করছি আমরা। শাখা অফিসের জন্যে হাচিনসনে এ মাসে বাড়ি ভাড়া নেয়ার কথা। এরপরও কোন জাজ যদি আমার বিরুদ্ধে রায় দেয় তো সেটা হবে পক্ষপাত।
আর আটকানো যাবে না তাকে, বুঝতে পারল রোয়ানা। তবে হতাশ দেখাচ্ছে না ওকে, বরং হাসল ব্যাংকারের দিকে তাকিয়ে। মি. হোল্ডেন, আমার সাথে এসো। প্রমাণ অবশ্যই আছে, খুব সাচ্চা!
কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না ব্যাংকার। অনড় দাড়িয়ে।
কি হলো? আসুন! তাড়া দিল রোয়ানা।
কে কার আগে বেরোবে তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে দর্শকদের মধ্যে। এবার ভূমিকা নিল জেথ। পকেট থেকে হাতকড়া বের করল, বলা যায় মার্শালের দায়িত্ব পালন করছে। ও এগোতে থমকে গেল ব্যাংকার, পিছিয়ে গেল এক পা। জেথ শীতল দৃষ্টিতে তাকাতে আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেল। এত কম সাহস নিয়ে সবকিছু। ওলট-পালট করে দিয়েছে লোকটা, ভাবছে জেথ, অবশ্য নিজেকে এরা কখনও। ভীরু ভাবে না, একটা জিনিস এদের প্রচুর আছে-আত্মবিশ্বাস। কিন্তু সেটা যখন অতিরিক্ত হয়, অবধারিত পতন ঘটে।
দুজনকে একই হাতকড়ায় বেঁধে চাবিটা পকেটে ঢোকাল জেথ। ওদেরকে সামনে রেখে এগোল। বাইরে জনতার ভিড়, কিন্তু নিজেরাই ওদেরকে পথ করে দিচ্ছে। জেথের হাতে কোল্ট, কাউকে বিশ্বাস করে না ও। দুই অপরাধীর একটা করে হাত মুক্ত, বলা তো যায় না ভিড়ের মধ্যে কারও হোলস্টার থেকে পিস্তল তুলে নিতে পারে।
জেরেমি মিলারের ক্লাউন কোন্ ফাঁকে সটকে পড়েছে টের পায়নি কেউ।
জুলিয়াস হোল্ডেনকে দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। মাথা নিচু করে হাঁটছে। লজ্জা? হাহ, এতদিন কোথায় ছিল? ভাবল জেথ। শহরের লোকজন তাদেরকে নিয়ে ইচ্ছেমত মন্তব্য করছে। কয়েকজন তো এখুনি ঝুলিয়ে দেয়ার পক্ষে। আশার কথা সীমা অতিক্রম করছে না কেউ। তবে লোকজন বাড়ার সাথে সাথে হট্টগোলও বাড়ছে। মেয়েরাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। হোয়াইটস্টোনের ইতিহাসে আজকের দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আসামীদের নিয়ে অফিসে ঢুকল জেথ।
ডিলান পাশে এসে দাঁড়াল। দারুণ দেখিয়েছ হে! দেখেছ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে সবাই? উত্তরে তাকাও-উইন্ডমিল পর্যন্ত আর দক্ষিণে গির্জাতক। মনে হয় না এখনও ঘরের ভেতরে বসে আছে কেউ। হাসছে সেলুন-মালিক, খুশি উপচে পড়ছে তার কণ্ঠে। আমার উচিত ছিল তোমার ডেপুটি হওয়া, তাহলে এ মজার অংশীদার হতে পারতাম।
শহরবাসীরা অফিসে ঢোকার দাবি জানাচ্ছে, দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার হুমকি দিচ্ছে কেউ কেউ। দশ মিনিটের চেষ্টায় তাদের শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে রফা। করতে বাধ্য হলো জাজ, ওদের মধ্যে দুজন ভেতরে আসবে এবং সবসময়। জানাবে ভেতরে কি হচ্ছে।
আসামীদের নিয়ে সেলের দিকে এগোল জেথ, সাথে রোয়ানা, ডিলান, জারভিস আর জাজ। সেলের ভেতরের লোকটিকে দেখে দারুণ চমকে উঠল ব্যাংকার ও আইনজ্ঞ। ঘা-তে লবণের পানির ছিটা পড়েছে যেন, কুঁচকে গেছে। সারা মুখ। স্কুলে পড়েছে কাঁধ, একটু আগের আত্মবিশ্বাসী ভাবটা উধাও হয়ে। গেছে।
উল্টো প্রতিক্রিয়া হয়েছে বাক টার্নারের। রাগে ফুসছে সে, থমথমে মুখ হিংস্র দেখাচ্ছে। ব্যাংকারকে যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। বেঈমান, মিথ্যুক! তোমাকে। মরার আগে মরব না আমি।
চুপ করে থাকল হোল্ডেন, চোখে-মুখে নিখাদ আতঙ্ক।
ব্যাংকারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার প্রস্তাবে এক বাক্যে রাজি হয়ে গিয়েছিল টার্নার, জেথ তাকে শহরে এনে সেলে ঢুকিয়েছে এরপর। আগের মত ভুল আর করেনি, সারারাত ধরে পাহারা দিয়েছে যদিও ক্যারল উইলিয়ামস বা হোল্ডেন ধরেই নিয়েছিল মারা গেছে তস্কর-নেতা। আইনজ্ঞের গুলি তার মাথার চামড়া ছড়ে চলে গেছে। তাড়াহুড়োর কারণে ঠিকমত বেঁধাতে পারেনি উইলিয়ামস। উদ্বেগের মধ্যে ছিল সে, জানত অনুসরণ করছে জেথ। টার্নারকে খুন না করেও উপায় ছিল না, তাই রাতের অভিযান বাদ দেয়নি।
মি, হোল্ডেন, টার্নার কেমন ভয়ঙ্কর মানুষ জানো তুমি, তস্করের ব্যাপারে। অন্যদেরকে ব্যাখ্যা দেয়ার পর বলল রোয়ানা। এ-ও ভাল করে জানো একই সেলে তোমাকে পেলে কি করতে পারে সে। সবকিছু স্বীকার করবে না ওর সেলে ঢুকবে? অবশ্য রাজি না হলেও কিছু আসবে-যাবে না, কারণ প্রমাণ হিসেবে টার্নার তো আছেই। তোমার বেঈমানির গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলবে ও।
ওখানে ঢোকার চেয়ে, হতাশায় মিইয়ে গেল হোল্ডেনের কণ্ঠ। সবকিছু স্বীকার করে জরিমানা দেয়া অনেক ভাল। দয়া করে আমাদের আলাদা সেলে ঢোকাও।
অনেকগুলো খুন করিয়েছ তুমি, অভিযোগ করল, রোয়ানা। বিশেষ করে গ্রীনের মত একজন ভদ্রলোককে। তাছাড়া….ডরম্যান আর থর্টনকে তুমিই খুন করেছ, তাই না?
গ্রীন নিজে পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়েছিল, তোমরা তা দেখেছ। ওই অবস্থায় টার্নারের কিছু করার ছিল না। গ্রীন আমার বন্ধু ছিল, তাকে মারার নির্দেশ আমি দেইনি।
বিচার হবে, ঘোষণা করল জাজ, এই আইনজ্ঞ এবং জেরেমি মিলারেরও। হোল্ডেন, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব ব্যাপারটা যাতে তোমার জন্যে হালকা হয়। আন্তরিক শোনাল তার কণ্ঠ।
ধন্যবাদ, নিস্তেজ শোনাল ব্যাংকারের গলা। তোমাদের সাহায্য না হলেও চলবে।
কিন্তু মরতে, হিংস্র কুগারের মত গর্জে উঠল টার্নার। …মরতে গেলে আমার সাহায্য তোমার অবশ্যই লাগবে!
ভিন্ন একটা সেলে তাদের ঢুকিয়ে অফিসে এসে বসল সবাই। স্টোভে কফির পানি চড়িয়ে দিল রোয়ানা।
ম্যাকলীনের কাছে একটা প্রস্তাব আছে, কফিতে চুমুক দিয়ে বলল জাজ।
তার দিকে তাকাল জেথ।
ডীন তো নেই, ওর দায়িত্বটা তুমিই পালন করো না! শহরের কারও আপত্তি করার প্রশ্নই আসে না। এ মুহূর্তে হোয়াইটস্টোনের সবচেয়ে জনপ্রিয় লোক তুমি। পাঁচ হাজার আর ডাকাতদের ধরার জন্যে রিওয়ার্ডের টাকা তো পাচ্ছই, মার্শাল হিসেবে দেড়শো করে পাবে।
প্রস্তাবটা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করল জেথ।
তোমার যা ইচ্ছে, শ্রাগ করল জাজ, উঠে দাঁড়িয়েছে। কাল সকালে এসে টাকাটা নিয়ে যেয়ো। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। আমার মনে হয় তুমি থেকে গেলে আমাদের বন্ধুমহলে ডগলাস গ্রীনের জায়গাটা পূরণ হত।
জাজের প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করছে জেথ, লোকটা তাকে আশাতীত সম্মান দিচ্ছে।
থাকবে না মানে? মুখিয়ে উঠল ডিলান। এটাই তো ওর বাড়ি। টো-টো করে ঘোরার দিন ওর শেষ! এবার থিতু হওয়ার সময়।
কয়েকজন ভলান্টিয়ারের ব্যবস্থা করছি, সহাস্যে বলল উইলসন হলেন, ডিলানের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। কেউ মার্শাল নিযুক্ত হওয়া পর্যন্ত পাহারা দেবে ওরা। ওদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। পারবে না?
নড করল জেথ।
ডিলান ছাড়া সবাই একে একে বিদায় নিল। জানালা পথে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে সেলুন-মালিক, হাতে দুমড়ানো সিগার। ধূমপানের ইচ্ছে হলো জেধের। ডিলানের সামনের চেয়ারে বসে তামাক ও কাগজ বের করে সিগারেট রোল করতে শুরু করল। আড়চোখে একবার দেখল তাকে, মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোন একটা ব্যাপারে ফন্দি আঁটছে।
নিলামের কি হলো? জানতে চাইল রোয়ানা।
কি আর হবে! জানালা থেকে চোখ না সরিয়ে ঠোঁট উল্টাল সেলুন-মালিক। ভিড় করা লোকজন আস্তে আস্তে ফিরে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেছে। টেলিগ্রাফ অফিসে গেছে জারভিস, ভাতিজাকে জানাবে আজ রওনা দিচ্ছে না ও। আমি বুঝি না এত টাকা দিয়ে কি করবে বুড়ো ভামটা! থেমে রোয়ানার দিকে তাকাল। আজকের নিলামে শেষ পর্যন্ত দর উঠেছিল পঞ্চাশ হাজার। তুমি ওকে ষাটের অফার দাও, বেটা চলে যাক এখান থেকে!
ডিলানের হেয়ালিতে জেথের হাসি পেল।
তোমাকে আমার হিংসে হচ্ছে! এবার জেথের উদ্দেশে বলল সে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ও।
বুঝতে পারছ না, বোকা হাদারাম! কোত্থেকে উড়ে এসে জয় করে নিয়েছ এ তল্লাটের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে। তোমার সাহস আছে বলতে হয়! আমার বয়স আরেকটু কম হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতাম! যাকগে, রোয়ানা, কবে বিয়ে করছ তোমরা?।
রোয়ানার মুখে রক্তিম আভা ছড়াল, সামলে নেয়ার চেষ্টা করছে।
ভুল বলেছে ডিলান, ভাবল জেথ, মেয়েটাকে জয় করেনি ও। রোয়ানা বরাবর ওরই ছিল, এবার এখানে এসে তা-ই উপলব্ধি করেছে ও।
সন্তুষ্ট হয়ে উঠে দাঁড়াল ডিলান। আমাদের বুড়ো খোকাদের কপালটাই খারাপ! যা-ও একটা যৌথ-বৌ পেয়েছিলাম, হারাতে হলো! গুড লাক, জেথ। দ্রুত বেরিয়ে গেল সে, মিটিমিটি হাসছে।
আনমনে সিগারেট ফুকছে জেথ। এ কদিনে কম ধকল যায়নি। লম্বা একটা বিশ্রাম দরকার এখন। জাজের ভলান্টিয়ারদের হাতে আসামীদের বুঝিয়ে দিয়ে ওর ছুটি। তারপর সোজা বাথানে গিয়ে গোসল সেরে একটা লম্বা ঘুম দেবে।
রোয়ানার দিকে তাকাল ও, চোখাচোখি হতে ফের রক্তিমাভা ছড়াল মেয়েটার গালে। এগিয়ে এসে পাশের চেয়ারে বসে ওর বাহুতে হাত রাখল। নিজেকে আমি সবসময় স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবতাম, কারও ওপর নির্ভর করতে মন চাইত না। অথচ এখন তোমার ওপর নির্ভর করতে এত ভাল লাগছে!…জেথ, তুমি না এলে কি যে হত! সবকিছু হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যেতাম আমরা। বাথানটা বিক্রি করে হয়তো অন্য কোথাও চলে যেতে হত… দরজা খোলার শব্দে থেমে গেল ও।
জেরেমি মিলার বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের জন্যে। স্টোর-মালিকের মুখের প্রায় পুরোটাই ব্যান্ডেজে মোড়া। কাপড় বদলানো হয়নি, গতকালের কাপড়গুলো পরে আছে-ছেড়া, কয়েক জায়গায় শুকনো রক্ত লেগে আছে। শীতল চোখজোড়া বিদ্ধ করল জেথকে, টের পেল খুনের নেশায় পেয়েছে লোকটাকে। সারা শরীরে ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি হলো, গুলিয়ে উঠছে পেটের ভেতরটা।
দরজার কবাটের সাথে হেলান দিয়ে দাড়াল মিলার। এ শরীর নিয়ে কিভাবে পিকার্ডের হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছে আল্লা মালুম। যে মার খেয়েছে তাতে অন্তত তিনটে দিন বিছানায় পড়ে থাকার কথা।
জেথ্রো ম্যাকলীন, অপার্থিব শোনাল তার কণ্ঠ। জড়ানো, ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে গলায়। হাতের রাইফেলের লেভার টানল। আমি কথা রাখতে এসেছি। দ্বিতীয়বারে না পারলেও এই বার তোমার লাশ দেখব! প্রথমবার আমি জিতেছি, তারপর তুমি। সমান-সমান। কিন্তু কোন জিনিসই সমান-সমান থাকতে নেই, আমি সেটা পছন্দও করি না। মিস্টার ডাম্ব, তুমি কি বুঝতে পারছ এবারকার খেলায় তোমার ভরাডুবি হতে যাচ্ছে?
নিজেকে দারুণ অসহায় মনে হলো জেথের। রাইফেলের নলের দিকে তাকাল, এক চুল নড়েনি। নাহ্, কোন আশা নেই।
অনেক বাহাদুরি দেখিয়েছ, বলে চলেছে মিলার। কিন্তু আর নয়। তুমিই সব ওলটপালট করে দিয়েছ! হোল্ডেন বা টার্নার যা পারেনি আমি ঠিক তাতেই সফল হব। খুন করব তোমাকে, তারপর এই মেয়েটাকে। দুজনে হাড়ে হাড়ে টের পাবে আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর মজা। উঠে দাঁড়া, শুয়োরের বাচ্চা! লাট সাহেবের মত বসে আছিস কেন?
দাঁড়াতে দাঁড়াতে ড্র করার কথা ভাবল জেথ, কিন্তু সেটা কেবল মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করবে। জেরেমি মিলার শুধু ট্রিগার টানবে, রাইফেলের নিশানা করতে বা লেভার টানতে হবে না। অথচ ওকে হোলস্টার থেকে কোল্ট বের করে, হ্যামার টেনে নিশানা করার পর….নাহু, প্রচুর সময়! পিস্তলে হাত দেয়ার আগেই তপ্ত সীসা বিদ্ধ হবে শরীরে। লোকটা কোনক্রমেই অ্যামেচার নয়, নিঃসঙ্কোচে গুলি করবে। তারচেয়ে দেখা যাক মিলার বেচাল হয় কি-না, ভাবল জেথ।
কিছুটা পাশে সরে এল ও।
ওদিকে স্থাণুর মত দাড়িয়ে আছে রোয়ানা, নডতেও যেন ভুলে গেছে। ওর চোখে এখনও বিস্ময়, ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি। জেথের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করল জেথ। ধীরে সরতে শুরু করল ও, দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে।
একবার, মাত্র একটা সুযোগ চাই:…ভাবছে জেথ। ও কোর্ট মার্শাল হয়ে যাওয়া আসামী নয় যে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে গুলি খাবে, কিংবা কোন ঘোড়া চোরও নয়। খেয়াল করল রোয়ানা অনেকটা সরে যেতে পেরেছে। দুজনকে একটা গুলিতে তো মারা যায় না, সুতরাং দুটো গুলি করতে হবে মিলারকে। ওকে গুলি করার পর রোয়ানাকে করবে….বেশ দূরে আছে মেয়েটা…এই ফাঁকে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে যদি ও মারা না যায় তবে একটা সুযোগ আসবে…অন্তত রোয়ানাকে যদি বাঁচানো যায় শয়তানটার হাত থেকে!
উঁহু, রোয়ানা, পাশে সরার চেষ্টা কোরো না, টের পেয়ে গেল জেরেমি মিলার। ওখানেই থাকো, এক ইঞ্চিও নডবে না! মিস্টার ডাম্ব, হোল্ডেন বা টার্নারের মত ভুল করি না আমি, ক্ষণিকের জন্যে থামল সে, চোখ বন্ধ করল। দুর্বল বোধ করছে। শত্রু জিইয়ে রাখা পাপেরই নামান্তর। তোমার সব বাহাদুরি খতম! এক পা এগোল মিলার, ধীরে বদলে যাচ্ছে চোখের চাহনি, আড়চোখে একবার দেখল রোয়ানাকে। তারপর পিশাচের মত হাসল। তুমি আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছ, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখি কি করে!
ইঞ্চির ভগ্নাংশ পরিমাণে এগোচ্ছে জেথের হাত। চোখে মুখে দিশেহারা, অসহায় ভাব ফুটিয়ে তুলেছে। মিলার দারুণ দুর্বল, নিজেকে ঠিকমত খাড়া রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। জেথের চালাকি ধরতে পারছে না সে। আরেকটু, ভাবল জেথ, তারপরই মোক্ষম সময়! মরার আগে একটা চেষ্টা করবে।
জেথ্রো ম্যাকলীন, কোমর থেকে হাত সরাও! আদেশ করল জেরেমি মিলার।
রোয়ানা সবই দেখছিল, জেথকে ব্যর্থ হতে দেখে ফোঁস করে চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল। চকিতে ওর দিকে ঘুরে গেল মিলারের দৃষ্টি, পরক্ষণে ভুলটা বুঝতে পারল সে এবং গুলি করল।
ডানে ঝাঁপ দিয়েছে জেথ, মাটিতে পড়ার আগেই ট্রিগার টিপল। জীবনে এরচেয়ে দ্রুত ড্র করার চেষ্টা করেনি ও। মিলারের গুলিটা কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে চলে গেছে। এদিকে ওর বুলেটের ধাক্কায় দরজার ভেজানো পাল্লার ওপর ছিটকে পড়েছে স্টোর-মালিক, জেথের শরীর মাটি স্পর্শ করার মুহূর্তে তার বুকে লাগল পরের গুলিটা, আগেরটার একটু পাশে। দ্বিতীয়বারের মত ট্রিগার টিপেছিল মিলার, বুলেটটা ছাদ ফুটো করেছে।
গড়িয়ে একপাশে সরে গেল জেথ। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসল। জেরেমি মিলার তখন শেষ চেষ্টা করছে, নির্দ্বিধায় তার কপালে একটা বুলেট পাঠাল ও। দুই ভুরুর ঠিক মাঝখানে একটা ফুটো তৈরি হলো। সেকেন্ড কয়েক বাদে ওটা থেকে রক্ত গড়িয়ে, নাক বেয়ে ব্যান্ডেজ ভিজিয়ে দিতে শুরু করল। মিলারের নিথর চোখজোড়ায় এখনও প্রতিহিংসার আগুন।
পিস্তলে টোটা ভরে উঠে দাঁড়াল জেথ।
রোয়ানা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর বুকে। দুহাতে গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। হোলস্টারে কোল্ট ফেরত পাঠিয়ে ওকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করল জেথ। আহ, কি প্রশান্তি! বুক ভরে বাতাস টেনে নিল ও। ভাবছে, ভাগ্যের জোরে শেষরক্ষা হলো শেষতক।
রোয়ানা ওর বুকে মুখ ঘষছে, কাঁদছে।
দরজাটা সশব্দে খুলে গেল, মিলারের লাশটা গড়িয়ে কামরার আরও ভেতরে চলে এল। ডিলানকে দেখা গেল দরজায়। পুরো কামরায় চোখ বুলিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল সেলুন মালিক, নিশ্চিন্ত হয়ে হাসল এরপর। ঠিক আছে, তোমাদের দুজনকেই পাহারা দিচ্ছি আমি, হাতের শটগানটা উঁচিয়ে দেখল সে। কেউ এলে সোজা ভাগিয়ে দেব।
দরজাটা ভিড়িয়ে দিল ডিলান।
হেসে উঠে জেথের দিকে ফিরল রোয়ানা, দরজা খোলার শব্দে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, ফের জাপটে ধরল ওকে। বোবার নাকি শত্রু থাকে না, কিন্তু তোমার দেখছি শত্রুর অভাব নেই।
জেথের ইচ্ছে হলো রোয়ানাকে বলে, বোবার বন্ধুও আছে, আছে মনের মানুষ।
দারাশিকো (darashiko.com)
ওয়াও! এই গল্পের সবচেয়ে বড় চমক হলো জেফ, বোবা নায়ক এই প্রথম কোন ওয়েস্টার্নে দেখলাম। অবশ্য গল্পটা আরও টাইট হতে পারতো, কেমন আগোছালোভাবে এগিয়েছে মনে হইলো। তবে পড়ে ভালো লেগেছে