রূপমঞ্জরী – তৃতীয় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল
প্রথম প্রকাশ : অগ্রহায়ণ ১৪১২, ডিসেম্বর 2005
অলংকরণ : সুধীর মৈত্র, রঞ্জন দত্ত
প্রচ্ছদ : গৌতম দাশগুপ্ত
.
উৎসর্গ
ভারতপথিক
মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়
শ্রীচরণারবিন্দেষু
.
হটী বিদ্যালঙ্কারের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব তুমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলে। নারীজাতিকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলে। ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্ধকার দূর করে, পৌত্তলিকতার বেড়াজাল ভেঙে তাদের আলোয় আনার ব্রত গ্রহণ করেছিলে। সতীদাহ-প্রথার মতো বর্বর নিয়মকে তুমি দূর করেছিলে। নানাভাবে অসম্মানিত, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে জর্জরিত হয়েও নিজের পথ থেকে তুমি সরে আসোনি।
তোমার রেখে যাওয়া কাজ আমরা কি সমাপ্ত করতে পেরেছি?
তোমার চরণপ্রান্তে এই অর্ঘ্যটি সমর্পণের সৌভাগ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত কোরো না।
শ্রদ্ধাবিনম্র
নারায়ণ সান্যাল
.
কৈফিয়ৎ
রূপমঞ্জরীর প্রথম খণ্ডে আমার পিতৃদেব—লেখক শ্রীনারায়ণ সান্যাল—’কৈফিয়ৎ’-এ বলেছেন :
“রূপমঞ্জরী ও তার বাবা দুজনকেই অষ্টাদশ শতাব্দীর দুই অর্ধে দুই সংকটজনক অবস্থায় ফেলে রেখে অসমাপ্ত গানে আচমকা থামতে বাধ্য হয়েছি নিতান্ত বাধ্য হয়ে, ব্যক্তিগত কারণে।”
যমদূতের সঙ্গে হৃৎপিণ্ডটি নিয়ে সে অসমযুদ্ধ থেকে ছুটে পালিয়ে এসেছিলেন সেবার তিনি কলমটি বুকে করে। সেটা ১৯৯০। তারপর বারবার জীবন-মৃত্যুর টু..কি খেলার ফাঁকে আমাদের উপহার দিয়েছেন তিনটি খণ্ডে ‘রূপমঞ্জরী’র গল্প আর ফাউ হিসাবে ‘মৃত্যোর্মা’, ‘প্রেম’, ‘আর্টিমিসিয়া’ সহ আরও গোটা পনেরো বই।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘বাঙলা রেনেসাঁসে’র যে স্বর্ণময় যুগ সে সময়কালকে লেখক তুলনা করেছেন শরতের আকাশের সঙ্গে-
সাদায়-কালোয় মেশানো। যেন মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরি। একদিকে বাইজী- বেড়ালের বিয়ে—বুলবুল লড়াই—বাবু কালচার, ওদিকে রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথের অতন্দ্র সাধনার আশীর্বাদ। তুলনায় বক্ষ্যমাণ তার আগের শতাব্দীটি নীরন্ধ্র অন্ধকারাচ্ছন্ন শ্রাবণের অমারাত্রি ক্লেদাক্ত, পূতিগন্ধময় পুরীষ। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর সূর্যোদয় যখন প্রত্যক্ষ সত্য তখন কেউ-না-কেউ নিশ্চয় গোপনে করে গেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর অমানিশায় অতন্দ্র ‘রাত্রির তপস্যা’।
আশ্বাস রেখেছিলেন লেখক তাঁর কাহিনীর নায়ক সেই নিঃসঙ্গ ক্লান্ত বিহঙ্গটির মতো, যে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস করেছিল ‘আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ অঙ্গন।’
অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে আবিষ্কার করলেন—নায়ক তো নয়, নায়িকা। হটী-বিদ্যালঙ্কার, হটু বিদ্যালঙ্কার, দ্রবময়ী, চন্দ্রাবতীর মতো অসামান্যা বিদুষী, প্রতিভাদীপ্ত চরিত্র। প্রথম দুজনের জীবনের নির্যাসে রচিত হল লেখকের ‘কল্পনাসৃষ্ট মানস-কন্যা—তথা জননী : রূপমঞ্জরী।’
“রাজা রামমোহন যদি স্বয়ম্ভু লিঙ্গের মতো অলৌকিক ক্ষমতায় গজিয়ে উঠতে না পারেন তাহলে হটি বা হটু বিদ্যালঙ্কারও তা পারেন না। পারে না আমার মানসকন্যাও। তাঁদেরও প্রয়োজন এক-একজন পূর্বসূরী। শিক্ষা, দীক্ষা, প্রতিটি রক্তকণিকার প্রতিটি ‘জীন’-এ চাই সেই পূর্বসূরীর আশীর্বাদ। বাস্তব রূপমঞ্জরীর পিতৃদেব অষ্টাদশ শতাব্দীর নারায়ণ দাস ছিলেন পরম বৈষ্ণব। কিন্তু সেই তৃণাদপি সুনীচকে দেখা গেল কূপমণ্ডুক সমাজের বিরুদ্ধে বজ্রাদপি কঠোর হতে। হটীর পিতৃদেবের নাম মনে রাখতে পারেনি বুড়ো ইতিহাস। তবে এটুকু তার স্মরণে আছে—সমাজপতিদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তিনি আত্মজার অক্ষর-পরিচয় করিয়েছিলেন, সহমরণের চিতা থেকে নাবালিকাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে এনেছিলেন।
সে অজ্ঞাতনামা বজ্রাদপি কঠোর টুলো পণ্ডিতই আমার উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র।”
রূপমঞ্জরীর তৃতীয় খণ্ড সেই পিতা-পুত্রীর জীবনসংগ্রাম গাথা।
২০০৪-এর এপ্রিল মাসে আবার হাজিরা দিতে হল লেখককে হাসপাতালের দোরগোড়ায়। দু-তিন সপ্তাহ কাটল বন্দীদশায়। এরই মাঝে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, ডাক্তার-নার্সদের চোখ ফাঁকি দিয়ে লেখা হল রূপমঞ্জরীর তৃতীয় খণ্ড। প্রকাশিত হতে থাকল ‘নবকল্লোল’ পত্রিকায় ধারাবাহিক—১৪১১ বৈশাখ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত। বাকি ছিল একটি মাত্র সংখ্যা—’চৈত্র’ সংখ্যাটি। শেষ সংখ্যা।
৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫-এ ব্রাহ্মমুহূর্তে লেখক চিরকালের মতো তাঁর লেখার খাটটি ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা তোলপাড় করে খুঁজলাম—কোথায় চৈত্র সংখ্যার শেষ পাণ্ডুলিপি? এই খোঁজায় পেয়েছি অনেক অমূল্য সম্পদ। তাঁর অনেক হাতে-আঁকা ছবি, অযত্নে ধূলিমাখা। অনেক লেখার টুকরো, অনেক দরকারি-অর্থকরী সম্পত্তির কাগজপত্র। কিন্তু কোথায় রূপমঞ্জরীর শেষ?
কোথাও খুঁজে পাইনি। তাঁর ভাষায় ‘মগজস্থ’ থাকলেও এবং আমাদের তিন-চারজনকে বিভিন্ন সময়ে, আলাদা ভাবে শেষটা শুনিয়ে থাকলেও, শেষপর্যন্ত শেষপর্বটি তিনি নিজে হাতে লিখে যাননি।
এরপর শেষ করার ভার যখন আমার ওপর এসে পড়ল স্বীকৃত হতে পারিনি প্রথমে। সে দুঃসাহস ছিল না। বাকি তিনজনের কাছ থেকে শেষটা মিলিয়ে নিয়েছিলাম কেবল নিজের কাছে, পাঠিকা হিসাবে গল্পের শেষটা জানার তাগিদে।
বেশ কিছুদিন পর, আমেরিকায় ফিরে এসে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সামিল হলাম। আমার চারপাশে ইয়াঙ্কি বুলি, জগঝম্প সুর, জীবনে স্পুটনিকের গতি। তার মাঝে এক নিঝুম দুপুর এল। শূন্য বাড়িতে ‘রূপমঞ্জরী’ পড়তে পড়তে ভেসে এল শৈশবে শোনা আমার বাবার গলায় স্তোত্রপাঠের সুর। ফুটে উঠল দুশো বছর আগেকার সোঞাই গ্রামের ছবি। যেন শুনতে পেলাম-
“খেয়ালে-বেখেয়ালে কোন গানের তান যে ধরে বসবে ঐ সাধের লাউ তা কি বাউল নিজেই আগেভাগে টের পায়? আঙুলের সঙ্গে গুবগুবির আঁতাত, কণ্ঠকে গলা মেলাতেই হয়।”
নানান গবেষণার মাঝে গত পনেরো বছর ধরে ‘রূপমঞ্জরী’র গান গুনগুনিয়েছে তাঁর গলায়, বয়ে গেছে কলমের স্রোতে। তাতেই বিভোর ছিলেন। অসমাপ্তগানে যে আচমকা থামতে হবে আবার কোনদিন এ খেয়াল তো বাউলের হবার কথা নয়।
রূপমঞ্জরীর গাথা তো শেষ হবার নয়। শেষ নেই যে রূপমঞ্জরীদের সংগ্রাম- সমরের। এ গান যে থামতে দিতে নেই; ধুয়ো তুলেই নিতে হয়, এগিয়ে এসে গুবগুবিটি আঙুলে জড়িয়ে, চোখের জলে ভেসে।
তুলে নিই কলম। দেখি, জ্বলে ওঠে আগুন যেন বজ্র হেন ভারী, এ যে তোমার তরবারি।’
নিজেকে বোঝাই—হোক বেসুরো, তবু চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে—’আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।’
এই প্রচেষ্টায় কয়েকজন আমাকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছেন। শ্রীপ্রদীপ দত্ত লেখকের সঙ্গে শেষ ক’দিন ঘনিষ্ঠভাবে কাটাবার সুযোগ পান ও স্থিরনির্দিষ্ট করেন যে শেষাংশ লেখক নিজে হাতে লিখে যাননি। শ্রীপ্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত গল্পের শেষাংশ যেমন শুনেছিলেন স্বয়ং লেখকের মুখ থেকে তা মিলিয়ে নিতে আমাকে সাহায্য করেন এবং নানান তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করেন। ‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর শ্রীপ্রবীর মজুমদার এবং দে’জ পাবলিশিং-এর শ্রীসুধাংশুশেখর দে এবং পারফেক্ট লেজারগ্রাফিক্স-এর শ্রীঅনুপম ঘোষ ও শ্রীমতী সুব্রতা ঘোষ—সবাইকে আমার ধন্যবাদ জানাই তাঁদের সহযোগিতার জন্য। এবং সর্বশেষে আমার দাদা শ্রীসুবাস মৈত্র-তাঁর সাহচর্য ও উৎসাহ না পেলে আমার লেখাটি শুরু বা শেষ করার সাহস ও উদ্যম সম্ভব হতো না।
এঁদের সকলকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই।
অনিন্দিতা বসু
২৮ অক্টোবর ২০০৫
.
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার : মহামহোপাধ্যায় স্বনামধন্য পণ্ডিত শ্রী অনন্তলাল ঠাকুর স্বর্গীয় লেখকের প্রতি তাঁর সস্নেহ অনুরাগ প্রকাশ করে বেদ-উপনিষদ- ভাগবত-কালিদাসাদি উদ্ধৃতির পাঠনিশ্চয় ও বর্ণাশুদ্ধি সংশোধন করে দিয়েছেন।
সর্পবিষ-প্রতিষেধক বিষয়ে অধুনাতম তথ্য (পৃ: 291) সরবরাহ করেছেন ডাঃ অপরাজিতা চৌধুরী ও তথ্যসংগ্রহে সহযোগিতা করেছেন শ্রীমতী সুদক্ষিণা চট্টোপাধ্যায়।
.
শ্ৰদ্ধাঞ্জলি
সাহিত্যপথিক
স্বর্গীয় নারায়ণ সান্যাল,
শ্রীচরণারবিন্দেষু
আজ আপনি অমৃতধামনিবাসী। কিন্তু সুদীর্ঘকাল পার্থিব জগতে থেকেও আপনি ঊর্ধ্বলোকের কোন্ আলোকধামের যাত্রী ছিলেন, কোন্ আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে আপনি ধরায় আমাদের ধরা দিয়েছিলেন, তা কাছে থেকেও আমরা ধরতে পারিনি। চিরজীবন কোন্ বিপুল সুদূরের বাজানো কোন্ ব্যাকুল বাঁশরী আপনাকে ‘অন্তেবাসী’ অনিকেত করেছে, সাহিত্যের দিদিগন্তে পথচারী করেছে, তা আমরা কেউই জানিনা।
এইটুকু শুধু জানি, সেই ব্যাকুল পথচারিতার পথেই আপনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মহীয়সী হটী বিদ্যালঙ্কারের অনালোকিত জীবনকে দুই বাংলার পাঠিকা-পাঠকের কাছে আলোকিত করার দায়িত্ব। ফলশ্রুতি ‘রূপমঞ্জরী’। কিন্তু যাঁরা বই পড়েন তাঁরা আপনার ‘সন্ধ্যাবেলা দীপ জ্বালার আগে সকালবেলার সলতে পাকানোর ‘ নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের খবর পাননা। তাঁদের জ্ঞাতার্থেও এই প্রয়াস।
আপনার মনে থাকবে বছর কুড়ি-পঁচিশ আগে ‘সাহিত্য সংসদ’-এর ‘বাঙালী চরিতাভিধানে’-এ চোখে পড়েছিল কয়েকটি অসাধারণ নারী চরিত্র—হটু ও হটী বিদ্যালঙ্কার; ভারতে প্রথম এম.বি. ভার্জিনিয়া মেরী মিত্র; হরিপ্রভা তাকেদা—যিনি একশো বছর আগে একজন জাপানীকে বিবাহ করে জাপানযাত্রা করেন ও ফিরে এসে ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ গ্রন্থ রচনা করেন; চণ্ডাল মহিলা দ্রবময়ী—যিনি প্রায় দেড়শো বছর আগে তাঁর গ্রাম-চৌকিদার স্বামীর মৃত্যুর পর ‘পুলিস-ম্যাজিস্ট্রেটকে তাঁর অসামান্য দৈহিক শক্তি ও লাঠিখেলার অপূর্ব নৈপুণ্য দেখিয়ে চৌকিদার-পদ লাভ করেন।’
আপনি তখন ‘কাঁটায় কাটায়’ নিজেকে বিক্ষত করে তুলছেন! আপনার শুভানুধ্যায়ী কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ী, শিল্প-সমালোচক দ্বিজেন্দ্রলাল মৈত্র, চিরবিপ্লবী আজিজুল হক ও অন্যান্য অনেকেই আপনাকে অনুরোধ করেন এই কণ্টকময় জগৎ থেকে বেরিয়ে আপনার ‘না-মানুষী বিশ্বকোষ’ শেষ করতে, মিকেলাঞ্জেলো ও লিওনার্দোকে নায়ক করে যে দুটি বই লেখবার জন্য আপনি প্রভূত তথ্যসংগ্রহ ও নোট করেছিলেন তার সদ্ব্যবহার করতে। আপনি হেসে বলেছিলেন ‘একটু relax করতে দিন’। শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি শেষজীবনে সারাদিন ভারতীয় দর্শন ও আধ্যাত্মিক সাধন নিয়ে ডুবে থাকতেন, আর ‘relax’ করতেন Integral Calculus এর দুরূহ সব অঙ্ক কষে! তেমনি আপনিও…
যাই হোক, তখন আপনি বলেছিলেন ‘চরিতাভিধান’-এর ঐ বিশেষ পাতাগুলোয় কাগজ লাগিয়ে রেখে দিতে—’পরে সময় হলে দেখা যাবে’। তারপর ৮-১০ বছর কেটে যায়। আমি সেগুলোর কথা ভুলেছিলাম। আপনি ভোলেননি। এইখানেই আপনি আপনি! রূপমঞ্জরীর প্রথম খণ্ড দেখেই বুঝেছিলাম আপনার ‘সময় হয়েছিল’ এবং হটু-হটীকে আপনি মনশ্চক্ষে জীবন্ত প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ‘চরিতাভিধান’ এর ১/৪ পাতা থেকেই ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশিয়ে রচনা করলেন সুদীর্ঘ তিন খণ্ডের ১,০০০ পাতা!! ‘অমাবস্যার গান’-এর অন্ধকার অষ্টাদশ শতাব্দী আলোকিত হলো আপনার রূপেন্দ্রনাথের চরিতালোকে আর দীপ্তিময়ী রূপমঞ্জরীর চরিত্রচিত্রণে।
পূর্বোল্লিখিত অন্যান্য নারী চরিত্রগুলিকেও আপনি এই বইয়ের শেষে উদ্ভাসিত করবেন বলেছিলেন—কোথায় কীভাবে জানিনা—তা করে উঠতে পারলেন না। বলেছিলেন অ্যানি বেসান্ত আর মার্গারেট স্যাংগারের ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন’ নিয়েও আলোচনা করবেন পরিশিষ্টে। বিশেষত মার্গারেট স্যাংগার। আপনার কাছেই শুনেছি তাঁর বইগুলির কথা—‘What Every Mother Should Know’, ‘My Fight for Birth Control’, ‘Motherhood in Bondage’। আজ থেকে আশি বছর আগে তিনি নাকি ভারতে আসেন জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে ভারতবাসীকে সচেতন করতে। প্রথম দেখা করেন তখনকার ভারতের ‘মুকুটহীন সম্রাট’ মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে—তিনিই পারবেন ভারতের কোটি কোটি জনগণকে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে। কিন্তু গান্ধীজি তাঁর সঙ্গে একমত হলেন না। ভারতবাসীর পক্ষে ব্রহ্মচর্যই যথেষ্ট বলে তিনি মনে করতেন। বিফলমনোরথ স্যাংগার এলেন শান্তিনিকেতনে।
আপনি বলেছিলেন, “এইখানে দ্যাখো রবীন্দ্রনাথের আধুনিকমনস্কতা ও ভবিষ্যৎদৃষ্টি। তিনি বিষয়টি শুধু বুঝলেন তাই নয়, Birth Control না হলে ভারতবাসীর ভবিষ্যৎ বিড়ম্বনার কথাও বললেন। আজ আমরা তাঁর দূরদৃষ্টির তারিফ করি। স্যাংগারকে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন :
‘I am of opinion that the Birth Control movement is a great movement not only because it will save women from enforced and undesirable maternity… In a hunger-stricken country like India it is a cruel crime thoughtlessly to bring more children to existence than could properly be taken care of…To wait till the moral sense of man becomes a great deal more powerful than it is now and till then to allow countless generations of children to suffer privations and untimely death for no fault of their own is a great social injustice which should not be tolerated.’
আপনার মনে আছে বোধহয়, এর পর আপনাকে একটু অপদস্থ করার চেষ্টা করেছিলাম! বলেছিলাম, “রবীন্দ্রনাথের লিপিকা’ থেকে ‘সভ্যতার সংকট’, ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ থেকে B.C.র চিঠি মুখস্থ রেখেছেন অথচ আজ পর্যন্ত একটা বইও তো তাঁকে উৎসর্গ করেননি!!’
উত্তরে আপনি কান ধরে টেনে একটি থাপ্পড় ক্যালেন! অন্তত আমার সেইরকমই মনে হয়েছিল। অথচ হেসেই বললেন, “অবাক করলে তুমি! এরপর তো বলবে বরুণদেব আর পবনদেবকে একটা করে বই উৎসর্গ করতে—কারণ জল-হাওয়া না হলে তো আমি বাঁচবো না। তাহলে সূর্যদেবকেও একটা বই উৎসর্গ করতে হয়, তিনি না থাকলে তো আমরা কেউই নেই! শোনো, রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে জল-হাওয়া-সূর্যালোকের মতোই।’ বলেছিলেন বটে, কিন্তু পরের বইটি—’অনির্বচনীয়া’-আপনি উৎসর্গ করেছিলেন সেই শাশ্বতধ্রুবনক্ষত্র’কেই!
জানিনা আপনার পাঠিকা পাঠকবৃন্দ আপনার এই সব নেপথ্যকথনে কতখানি উৎসাহিত। তবু বোধহয় রূপমঞ্জরীকে চিনতে হলে তার স্রষ্টাকেও কিছুটা চিনতে হবে, মেয়েদের প্রতি আপনার অপরিসীম শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ তাঁদের কিছুটা বুঝতে হবে।
আর এই জন্যই রাজা রামমোহনের প্রতি ছিল আপনার অনন্য ভক্তি। আপনি একবার বলেছিলেন, “দ্যাখো, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘first man of new regenerate India’ মনে করেন, বিবেকানন্দ বলেন ‘রামকৃষ্ণ আমার দীক্ষাগুরু, রাজা রামমোহন আমার শিক্ষাগুরু।’ সত্যিই তিনি ভারতের গত দুশো বছরের নবজাগরণের আদিপুরুষ। ডস্টয়ভস্কি নাকি একবার বলেছিলেন যে টলস্টয়, তুর্গেনিয়েফ, চেখফ, তিনি নিজে—সবাই বেরিয়েছিলেন রুশ সাহিত্যের আদিপুরুষ গোগোলের ‘ওভারকোট’-এর পকেট থেকে! আমি বলি ভারতে রামমোহন-পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের প্রতিটি প্রতিভা বেরিয়েছেন রাজা রামমোহনের ঐ বিশিষ্ট শিরোভূষণের ভাঁজ থেকে!!”
“আমার পাঠক-পাঠিকাদের আমি মনে করিয়ে দেবো কবিগুরুর মূল্যায়ন- ‘Rammohun rose up a luminous star in the firmament of India’s history, with prophetic purity of vision, and unconquerable heroism of soul. He shed radiance all over the land…he is the great path-maker.’
“তারা যেন মনে রাখে, শুধু সতীদাহ নিবারণ আর নারী-জাগরণই তাঁর অবদান নয়। আধুনিক জগতের সঙ্গে তাল রেখে চলতে গেলে যে সবথেকে বেশি দরকার আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষার সেকথা তিনি দুশো বছর আগেই বুঝতে পেরেছিলেন—‘promote a more liberal and enlightened system of instruction, embracing Mathematics, Natural Philosophy, Chemistry, Anatomy with other useful sciences.’ এরই ফলশ্রুতি জগদীশচন্দ্র-প্রফুল্লচন্দ্র রামেন্দ্রসুন্দর, সত্যেন বোস থেকে সাহা ইন্সটিটিউট, ‘বিশ্বপরিচয়’ থেকে আজকের software engineering ।
আপনার এই বিজ্ঞানমনস্কতার প্রকাশ ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা’ ও অন্য বহু লেখায়। শুধু তাই নয়, বহু বইতে আপনি পরবর্তী সংস্করণে অধুনাতন তথ্য জানিয়েছেন—যেমন ‘বিশ্বাসঘাতক’-এ ফুটনোটে কাপিৎজা বিষয়ে।
‘রূপমঞ্জরী’ ‘নবকল্লোলে’ বেরোবার সময়ও আপনি বলেছিলেন, “রূপেন্দ্রনাথের সর্পদংশন সম্বন্ধে একটা ফুটনোট দিলাম। বই বেরোবার সময় ও বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা দেখো।” দেখেছিলাম। পেয়েও ছিলাম। তবে একটু দেরীতে—আপনাকে দেখাতে পারলাম না। তবু আপনার পাঠক-পাঠিকার জন্যে তা এখানে দিলাম—এই প্রার্থনা সমেত যে এটা যেন কখনো তাঁদের দরকার না লাগে!
আপনি লিখেছিলেন (পৃ: 186) : ‘শঙ্খচূড়ের প্রতিষেধক… ভারতে …আজও অলভ্য’। কিন্তু বর্তমানে (জানুয়ারি 2006) সব রকমের সর্পবিষের প্রতিষেধক ভারতে সহজলভ্য :
‘POLYVALENT ANTI-SNAKE VENOM (Price about Rs. 400/-) is prepared in Haffkine’s Institute in Mumbai by injecting horses with snake venom of both cobra and viper variety. If anti-snake venom is not available, or, the patient is hypersensitive to it, then POLYVALENT ANTI-VENENE, a drug prepored at Kasauli, is used as substitute. CORTISONE, ADRENALIN, ANTI-HISTAMINIC and NIKETHAMIDE are used as supportive treatment.’
(PRINCIPLES OF FORENSIC MEDICINE-Dr. Apurba Nandi)
* * *
‘রূপমঞ্জরী’র এই খণ্ডে শেষের দিকে আপনি দুটি সংস্কৃত শ্লোক ব্যবহার করবেন বলেছিলেন। করে উঠতে পারেননি। বিশেষত আপনার পাঠিকাদের জন্য শ্লোক দুটি উদ্ধৃত করলাম :
‘ভার্যা শ্রেষ্ঠতমঃ সখা’।—(মহাভারত ১.৭৪.৪১)
‘ন চ ভার্যা সমং কিঞ্চিদ বিদ্যতে ভিযজম মতম
ঔষধং সর্বদুঃখেষু সত্যমেতদ ব্রবীমি তে’।।—(মহাভারত ৩.৬১.২৯)
দ্যূতে পরাজিত রাজা নল একা বনে যাইবার সময় রানী দময়ন্তী তাঁহার সঙ্গে যাইতে চাহিয়া এই শ্লোকটি নলরাজাকে বলিয়াছিলেন :
‘মহারাজ, আপনাকে এই সত্য কথাটি বলিতেছি, শুনুন :
—সর্বদুঃখে বৈদ্যসম্মত ঔষধ হইল স্ত্রী।
অর্থাৎ, স্ত্রীর মতো সহানুভূতিশীলা, সুখদায়িনী আর কেহ হইতে পারে না।
(অনুবাদ : শ্রীঅনন্তলাল ঠাকুর)
* * *
পিতার আরব্ধ কর্মযজ্ঞ অসমাপ্ত থাকলে সাধারণত উপযুক্ত পুত্রই পূর্ণাহুতি প্রদান করে। বহুবারই তা ঘটেছে। মহর্ষির ব্যক্তিগত শান্তির নিকেতন তাঁর পুত্রের হাতে হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিশ্রুত ‘শান্তিনিকেতন’; মহাকবি বানভট্টের অসমাপ্ত ‘কাদম্বরী’-কাব্যের পূর্ণরূপ দেন তাঁর পুত্র ভূষণভট্ট; বিভূতিভূষণের ট্রিলজি ‘অপু’র ‘পথের পাঁচালী’ আর ‘অপরাজিত’ জীবনদর্শনকে পরিপূর্ণতা দেন তাঁর পুত্র তারাদাস—সমাপ্ত করেন ‘কাজল’। আপনার ‘রূপমঞ্জরী’ ট্রিলজির পূর্ণাহুতি দিলেন আপনার উপযুক্ত সুকন্যা অনিন্দিতা। তাঁর লেখা তাঁর নাম সার্থক করে কিনা তার বিচারক -আপনার ভাষায়—’পাঠক-পাঠিকা জুরীবৃন্দ!”
এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা আপনাকে নিবেদন করি। আপনার সুযোগ্য প্রকাশক শ্রীসুধাংশুশেখর দে, আপনার সহধর্মিণী শ্রীমতী ‘সবিতা সান্যাল, আপনার পুত্র শ্রীমান তীর্থরেণু ও কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী মৌ নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে এই তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ করার নিরঙ্কুশ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন অনিন্দিতা ও আমার ওপর। তাঁরা কেউই কোনো খবরদারি করেননি। সেজন্য তাঁরা আমাদের দুজনের ধন্যবাদার্হ। তাঁদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারলাম কিনা জানিনা। ভালো-মন্দর বিচারে প্রশংসা ভাগ আপনার আর অনিন্দিতার প্রাপ্য, অঙ্কুশ-ভাগ আমার রইলো!
* * *
5 ফেব্রুয়ারি 2005, শনিবার, ভোরবেলা আপনি ডেকে বলেছিলেন :
“এরপর আমার আর কোনো বইয়ের প্রুফ আমি দেখবোনা। সব দায়িত্ব তোমার। যে কটা দিন আছি সে’কটা দিন শুধু লেখা নিয়েই থাকবো—না-মানুষী, ভারতীয় ভাস্কর্যে মিথুন, লিওনার্দো…–সবকটা একটা একটা করে শেষ করবো।”
পঞ্চাশ বছরের সাহচর্যেও আপনার কথার কোনোদিন নড়চড় হতে দেখিনি। এবারও আপনার কথার প্রথমাংশটা আপনি রক্ষা করলেন-
দুদিন পরেই ব্রাহ্মমুহূর্তে হলেন অনন্তধামযাত্রী।
আমাকে নাহয় অথৈ জলে ফেলে গেলেন। কিন্তু আপনার কথার শেষ অংশটা তো আপনি রক্ষা করলেন না! কথার খেলাপ করলেন!! আপনি!!!
এ অনুযোগও আপনাকে ছাড়া আর কাকেই বা জানাবো?
সব শেষে গঙ্গাজলেই গঙ্গাপূজা করি।—
জানিনা, আপনার রেখে যাওয়া কাজ আমরা কি সমাপ্ত করতে পেরেছি?
তবু, আপনার চরণপ্রান্তে এই অর্ঘ্যটি সমর্পণের সৌভাগ্য থেকে আমাদের বঞ্চিত করবেন না।
শ্রদ্ধাবিন
সুবাস মৈত্র
.
প্রাককথন
[ প্রথম খণ্ডে হটী বিদ্যালংকারকে আমরা শেষ দেখেছি 1763 খ্রিস্টাব্দে। কাশীতে নিজ চতুষ্পাঠীতে বন্দিনী রূপে। তখন তাঁর বয়স পঞ্চবিংশতি বর্ষ। গুরু দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের নিকটে তিনি সদ্য বিদ্যালংকার উপাধি লাভ করে কাশীধামেই একটি চতুষ্পাঠী খুলে বসেছিলেন। সেই অপরাধে কাশীনরেশ রাজাসাহেব পুরন্দর ক্ষেত্রী তাঁর কঠিন শাস্তিবিধান করেছেন। আমরা আরও জেনেছিলাম বৃদ্ধ বিদ্যার্ণব তাঁর আদরিণী কন্যাটিকে নিয়ে গঙ্গার অপরপারে ব্যাসকাশীতে গিয়েছিলেন মহর্ষি ত্রৈলঙ্গস্বামীর শরণ নিতে মুক্তিপথের সন্ধানে। মহাসাধক বিদ্যার্ণবকে যে কী নির্দেশ দিলেন তা আমাদের বোধগম্য হয়নি। তিনি রূপমঞ্জরীকে তির্যকভাষায় ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন “তু ঔরৎ হো-কর শঙ্খ বজানা ভুল গয়ী? ইয়ে তো হ্যায় তেরি অপ্নি বনায়ি হুয়ি বসিবি।” তার অর্থ দ্বারকেশ্বর বা তাঁর পণ্ডিত কন্যা প্রণিধান করতে পারেননি। আমরাও কিছু বুঝিনি। মহাসন্ন্যাসী আরও বলেছিলেন, “জীবাত্মাকে অসীম নীলাকাশে মুক্ত করে দেওয়াই সাধকের কৃত্য!” তারই বা অর্থ কী?
এরপর কাহিনির ঘূর্ণাবর্তে আমরা উপনীত হয়েছিলাম পূর্ববর্তী প্রজন্মে। রূপমঞ্জরীর পিতামাতার যৌবনে। 1742-43 খ্রিস্টাব্দে।
দ্বিতীয় খণ্ডে আমরা জেনেছি, রূপেন্দ্রনাথ তাঁর মাতৃহারা কন্যাটিকে নিয়ে সোঞাই গ্রামে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তখন হটীর বয়স মাত্র চার। রূপেন্দ্রনাথ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ঘনশ্যাম সার্বভৌমের সদ্যবিধবা গর্ভবর্তী মালতীকে। আধুনিকমনা রূপেন্দ্রনাথ নিজগ্রামে একটি মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। সেই অপরাধে সোঞাই গ্রামের সমাজপতিরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা। পঞ্চায়েতে ষোলোআনার ডাকে রূপেন্দ্রনাথের বিচারের ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু পীতাম্বর মুখুজ্জের বালবিধবা দিদি গিরিবালা এমন প্রচণ্ডভাবে রুখে দাঁড়ান যে, পঞ্চায়েত-প্রধান নন্দ চাটুজ্জের সব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়।
এটুকু ধরতাই থেকে যদি আপনারা কাহিনির সূত্র তুলে নিতে না পারেন তাহলে আমি নাচার। সে-ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার থেকে সংগ্রহ করে ওই দুটি খণ্ড আপনাদের নেড়েচেড়ে দেখতে হবে।]
Leave a Reply