রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল
দে’জ পাবলিশিং
রচনাকাল : 1992 1996
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ১৪০৪, জানুয়ারি
অলংকরণ : সুধীর মৈত্র, লেখক
প্রচ্ছদ : গৌতম দাশগুপ্ত
আলোকচিত্র : বিপুল বসু
প্রকাশক : সুধাংশুশেখর দে, দে’জ পাবলিশিং
.
উৎসর্গ
করুণাসাগর
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
শ্রীচরণারবিন্দেষু,
নারীজাতিকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিতা করতে তুমি প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছিলে—তাদের শিক্ষিত করতে, স্বনির্ভর হতে, বৈধব্যযোগের অপরিসীম সামাজিক নির্যাতন থেকে তাদের মুক্তি দিতে। প্রতিদানে সমাজ তোমাকে নানাভাবে অসম্মান করেছে। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ করেছে। শেষ জীবনে তুমি সাঁওতাল-পরগণার কার্মাটারে অন্ত্যেবাসীর একান্তচারী জীবন বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিলে।
একশ বছর স্বর্গবাসের পর তুমি কি আমাদের ক্ষমা করতে পেরেছ?
তাহলে
ধূলিধূসরিত বিদ্যাসাগরী চটির প্রান্তে এই অর্ঘ্যটি সমর্পণের সৌভাগ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত কর না।
শ্রদ্ধাবিনম্র
নারায়ণ সান্যাল
.
কৈফিয়ৎ
আজ্ঞে হ্যাঁ। প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি : অত্যন্ত অন্যায় হয়ে গেছে। এই দ্বিতীয়খণ্ডটা প্ৰকাশ করতে প্রচুর দেরি হয়ে গেল। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল নব্বই সালে—আটবছর আগে। প্রথম খণ্ডের গ্রন্থ-ক্রমিক সংখ্যা ছিল বিরাশি; তারপর খানত্রিশেক বই ছাপা হয়ে গেছে
রূপমঞ্জরীর দ্বিতীয় খণ্ডটা প্রকাশিত হয়নি! অমার্জনীয় অপরাধ! তবে একথাও বলব, এজন্য শাস্তিও বড় কম পাইনি! পথেঘাটে যত্রতত্র এ জন্য আমাকে কথা শুনতে হয়েছে। প্রথম ধমক খেয়েছিলাম পুত্রের কাছে। বইটা তাকে ‘বুকপোস্টে’ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পড়ে সে জবাবে লিখেছিল, “তুমি তো আচ্ছা মানুষ! পাঠকের কাছ থেকে নগদ আশিটা টাকা হাতিয়ে নিয়ে অম্লানবদনে বলেছ: পড়ুন, পড়ুন! অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন। আর গল্পটা? সেটা পরে বলব!—ডিউ-পার্ট-এ!”
ইদানীং পথে-ঘাটে কত লোক যে তাগাদা দিয়েছে তার আর লেখাজোখা নেই। আমি তাঁদের বুঝিয়ে বলতে চেয়েছি, ‘দেখুন, হটি বা হটু বিদ্যালঙ্কার, অর্থাৎ বাস্তব রূপমঞ্জরীর জীবনে কী ঘটেছিল সেটুকু তো আমি প্রথমখণ্ডেই জানিয়ে দিয়েছি’। এ মেয়েটি তো আমার আত্মজা-
শ্রোতা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ধমকে উঠেছে, সেই অধিকারে গল্পটা আপনি শেষ করবেন না? এটা কেমন যুক্তি?
কেউ জানতে চেয়েছেন : ‘আমাদের জিজ্ঞাস্য রূপমঞ্জরী কোন সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন? ‘রূপমতী’র মতো আত্মহননের পথ, না কি সত্যবতীর মতো স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ধর্ষিতা হওয়া?
কেউ বললেন, ব্যাসকাশীতে ত্রৈলঙ্গস্বামী হটী বিদ্যালঙ্কারকে হঠাৎ ও-কথা বললেন কেন?
‘জীবাত্মাকে বন্দী করে রাখতে নেই—মুক্ত নীলাকাশের দিকে, পরমাত্মার দিকে মিলিত হবার সাধনা তার। ক্যা রে বেটি? কুছ সমঝি?’
হটীর অধিকারে সেই দুর্লভ বিপরীতবর্ত শঙ্খটাই বা এল যেমন করে? কী তার অর্থ, তা তো এখনো অনুক্ত?
আবার একজন পাঠক প্রশ্ন তুলেছিলেন, প্রথম খণ্ডের কৈফিয়তে আপনি লিখেছিলেন, “ঐতিহাসিক চরিত্রের ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি তা গ্রন্থমধ্যেই স্বীকার করা গেছে। যেমন ভারতচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী রাধার প্রথম সাক্ষাৎ, রামপ্রসাদের বাগানের বেড়াবাঁধার প্রসঙ্গ, অথবা জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের পরিবারে সতীদাহ।”—এই শেষোক্ত বিষয়টি গ্রন্থমধ্যে কোথাও খুঁজে পেলাম না কিন্তু।
সবিনয়ে অপরাধ স্বীকার করছি। কৈফিয়তে আমি আরও বলেছিলাম “আলোকচিত্রগুলি কোথা থেকে সংগৃহীত সে বিষয়ে গ্রন্থশেষে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা গেছে।” দুর্ভাগ্যবশত তা বাস্তবে করা হয়নি। আমি এছাড়াও লিখেছিলাম, অষ্টাদশ শতাব্দীর নারায়ণদাসের আত্মজা হটু এবং সোঞাই গাঁয়ের হটী বিদ্যালঙ্কারের পূর্ণপরিচয় পরিশিষ্টে সংযুক্ত করা গেছে, যাতে ঐ দুইজন অসামান্যার বাস্তবজীবনের উপাদানের মিশ্রণে এই বিংশশতাব্দীর নারায়ণদাসের মানসকন্যার জীবনীটা আপনাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।” সে প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করা যায়নি। কিন্তু কেন যায়নি তাও আমি জানিয়ে দিলাম—”ডিসেম্বরের (1989) প্রথম সপ্তাহে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। দ্বিতীয়বার নার্সিং হোম থেকে ফিরে আসার পর সিদ্ধান্ত নিতে হল—আপাতত ‘অসমাপ্ত গানে’ই থামতে হবে।”
দ্বিতীয় খণ্ডের কৈফিয়তে যতদূর সম্ভব পাপস্খালন করি :
ব্যাসকাশীতে ত্রৈলঙ্গস্বামী বিপরীতবর্ত দুর্লভ শঙ্খের প্রসঙ্গ কেন তুলেছিলেন সে-কথা এখনো অনুক্তই রইল। যেটা তৃতীয় খণ্ডে বোঝা যাবে। তবে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের পরিবারে সতীদাহর কথা কেন বলেছিলাম তা এবার নিশ্চয় বোঝা যাবে। হটী এবং হটু বিদ্যালঙ্কারের তথ্যনির্ভর বাস্তব জীবনী এবার পরিশিষ্টে দিলাম। সেটুকুই প্রামাণ্য ইতিহাস। প্রথম খণ্ডের আলোকচিত্রগুলি ইস্টার্ন রেলওয়ে কর্তৃক চল্লিশের দশকে প্রকাশিত ‘বাঙ্গলায় ভ্রমণ’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত; শুধু দুটি মাত্র আলোকচিত্র—মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ধ্যানে পাওয়া জগদ্ধাত্রী-মূর্তি’ (পৃ: 263) এবং ‘কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজামণ্ডপে জগদ্ধাত্রী (পৃ: 265) আমাকে সরবরাহ করেছে বাল্যবন্ধু, কৃষ্ণনগরের সমীরেন্দ্রনাথ সিংহরায়।
প্রথম খণ্ড প্রকাশকালে যাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলাম এবারও তাদের সহৃদয় সাহায্য পেয়েছি। তদুপরি দুজনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হবে। প্রথমজন ব্রহ্মচারী অচ্যুদানন্দ প্রামাণিক। তার গবেষণা-গ্রন্থ অবলম্বন করেই শ্রীচৈতন্যদেবের পদচিহ্ন রেখা ধরে রূপেন্দ্রনাথকে শ্রীক্ষেত্রে নিয়ে যেতে পেরেছি। দ্বিতীয়ত শ্ৰীমান অনুপম ঘোষ—যত্ন নিয়ে সে প্রুফ দেখেছে এবং বইটি সাজিয়েছে। তার সাহায্য না পেলে হয়তো এই দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশে আরও বিলম্ব ঘটত।
আমি মর্মান্তিকভাবে দুঃখিত: দ্বিতীয় খণ্ডে রূপমঞ্জরীর কাহিনীটি সমাপ্ত করতে পারলাম না। দোষ আমার নয়—দোষ ওঁদের দুজনের। প্রথমত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ভাগিনেয় ঘনশ্যাম সার্বভৌম। দ্বিতীয়ত সোঞাই গাঁয়ের সেই মেয়েটি: পীতু-ঠাকুরের কন্যা মৃন্ময়ী। যে মেয়েটি আগবাড়িয়ে রূপেন্দ্রনাথের বিয়েতে ঘটকালি করেছিল। এঁদের দুজনের কথা বলতে বলতে এতই আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম যে, কালের মাপে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যায়নি। পরিকল্পনা ছিল, দ্বিতীয় খণ্ডে অন্তত রূপমঞ্জরীর পিতৃবিয়োগ পর্যন্ত অগ্রসর হব; অর্থাৎ তার বিবাহ ও বৈধব্যযোগ পার করে দেব। হল না। বেটির বিয়েটা পর্যন্ত দিয়ে উঠতে পারলাম না এবার।
বয়ঃজ্যেষ্ঠদের আশীর্বাদে আর বয়ঃকনিষ্ঠদের প্রার্থনায় যদি আরও বছর পাঁচেক টিকে থাকতে পারি তাহলে নিশ্চিত তৃতীয় খণ্ডে কাহিনীর যবনিকা টানব। উইথ নো রিগ্রেটস্, অ্যান্ড নো ডিউ পাৰ্ট!
জানুয়ারি 1998
.
Leave a Reply