রূপমঞ্জরী – ১ম খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল
রচনাকাল : 1988
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা, মাঘ ১৩৯৬, জানুয়ারি 1990
প্রচ্ছদ : গৌতম দাশগুপ্ত
.
উৎসর্গ
মহর্ষি
রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত
শ্রীচরণারবিন্দেষু,
রাজানুগ্রহমণ্ডিত নিষ্কর ব্রহ্মত্রা বা বৃত্তি, পণ্ডিতসমাজের উপাধিদানের প্রস্তাব আর ছাত্রদের সম্মানদক্ষিণা বা ‘সিধা’ তুমি ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে গিয়েছিলে।
দুশ’ বছর স্বর্গবাসের পর তোমার মতটা কি কিছু পালটেছে?
তাহলে
ধূলিধূসরিত চরণপ্রান্তে এই অর্ঘ্যটি সমর্পণের সৌভাগ্য
থেকে আমাকে বঞ্চিত কর না।
শ্রদ্ধাবিনম্র
নারায়ণ সান্যাল
১.১.৯০
.
কৈফিয়ৎ
স্বীকার্য—অষ্টাদশ শতাব্দীর চালচিত্রে একটি বৃহদায়তন উপন্যাস রচনার এই ইচ্ছেটা হঠাৎ কেন জাগল সে-বিষয়ে আপনাদের কৌতূহল হতেই পারে। বিশেষত আজ বছর-দশেক ধরে লেঅনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিষয়ে কাগজপত্র, বই ইত্যাদি সংগ্রহ করে চলেছি, নোট রাখছি, কাজে হাত দিতে পারিনি হঠাৎ একটা ‘না-মানুষী’ দরদ উথলে ওঠায়। সে ‘বিশ্বকোষ’ও অসমাপ্ত—শুধু ঐ অমেরুদণ্ডী পর্যায়টুকু পাড়ি দেওয়া গেছে। সেক্ষেত্রে—
কী জানেন? খেয়াল-বেখেয়ালে কোন গানের তান যে ধরে বসবে ঐ ‘সাধের লাউ’ তা কি বাউল নিজেই আগে-ভাগে টের পায়? আঙুলের সঙ্গে গুবগুবির আঁতাত, কণ্ঠকে গলা মেলাতেই হয়। শিবনাথ শাস্ত্রী যাকে বলেছেন ‘বঙ্গের নবযুগ’, পরে যার নাম হয় ‘বেঙ্গল রেনেসাঁস’, তার উপর যথেষ্ট গবেষণাগ্রন্থ আছে; অগুনতি গবেষক তাঁদের বজ্রমণিশলাকায় সেই সময়-এর অসংখ্য মণিমাণিক্য সমুৎকীর্ণ করে রেখেছেন। তাই সেই সময়ের মালা গাঁথা দুঃসাধ্য হতে পারে, অসাধ্য নয়। সাম্প্রতিককালে বৃহদাকারে সে-চেষ্টা করাও হয়েছে। আমি নৌকাটাকে ঠেলতে ঠেলতে আরও একশ বছর উজানে নিয়ে যেতে চেয়েছি। ঊনবিংশ শতাব্দীর তুলনায় প্রাক-রামমোহনের ‘সেই তর’ যুগের বঙ্গসমাজ তথা গৌড়-সংস্কৃতি গভীর তমসাচ্ছন্ন।
কোন ধারাবাহিক সাহিত্য-সাপ্তাহিকে অথবা দৈনিক পত্রিকার রবিবাসরীয়তে যদি এ রচনা প্রকাশ করা সম্ভবপর হত তাহলে যে-সব তথ্যগত বিচ্যুতি বা কালানৌচিত্যদোষ’ (অ্যানাক্রনিজম্) আমার অজ্ঞতাবশত রয়ে গেল তার অনেকটাই সংশোধন করা যেত। এ-জাতীয় বৃহৎ কাজে সেটা বাঞ্ছনীয়। তাহলে ধারাবাহিক প্রকাশকালে সতর্ক ও গবেষকমনা পাঠকের হুঁসিয়ারিতে লেখক মার্জনার সুযোগ পায়। উভয় অর্থেই ‘মার্জনা’। সম্পাদকের কাছে লেখা সতর্ক পাঠকের চিঠির কল্যাণে গ্রন্থাকারে প্রকাশ কালে সংশোধনগুলি করা চলে এবং লেখক মার্জনা চেয়ে নেবার অবকাশ পায়। দুর্ভাগ্যবশত সে সুযোগ পাইনি।
তবে সজ্ঞানে কিছু কিছু কালানৌচিত্য-দোষ উপেক্ষা করেছি কথাসাহিত্যের অনুরোধে। কথাসাহিত্যিককে এ জাতীয় ছাড়পত্র দিয়ে গেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ প্রবন্ধে। তাছাড়া স্বীকৃতিতে পাপের কিছুটা স্খালন হয়। তাই এখানে তা লিপিবদ্ধ করে যাই। ঐতিহাসিক চরিত্রের ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি তা গ্রন্থমধ্যেই স্বীকার করা গেছে যেমন ভারতচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী রাধার প্রথম সাক্ষাৎ, রামপ্রসাদের বাগানের বেড়াবাধা, জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের পরিবারে সতীদাহ ইত্যাদি। সজ্ঞান কালবিরোধ-দোষগুলি ইতিহাসের সামগ্রিক স্বরূপকে বিন্দুমাত্র কলুষিত করেনি বলেই আমাদের বিশ্বাস। তবে কট্টর ইতিহাসবিদদের মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে যতদূর মনে পড়ে স্বীকার করে যাই :
1. কাহিনী অনুসারে রূপেন্দ্রনাথ 1742 খ্রীষ্টাব্দে ভারতচন্দ্রের পর্ণকুটীরে ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর পাণ্ডুলিপি পড়ছেন; অথচ অধিকাংশ বাঙলা সাহিত্যের পণ্ডিতদের মতে (ডঃ সুকুমার সেন, ডঃ ভূদেব চৌধুরী সহ) অন্নদামঙ্গল রচনা শেষ হয়েছিল 1752 খ্রীষ্টাব্দে। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে আলিবর্দীর কাছ থেকে মুক্তি পাবার পর স্বপ্নাদেশে কৃষ্ণচন্দ্র ভারতচন্দ্রকে 1743 খ্রীষ্টাব্দে কালিকামঙ্গল লিখতে বলেন এবং রচনা সমাপ্ত হয় 1752-53তে। ডঃ অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় এবং ডঃ উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের মতেও ‘বিদ্যাসুন্দর’ সম্পূর্ণ হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে।
2. গবেষকদের মতে নদীয়া কৃষ্ণনগরে ‘বারোদোল’-এর মেলার সূচনা পলাশীযুদ্ধের পরবর্তীকালে। শতাব্দীর চতুর্থদশকে তার বর্ণনা : অ্যানাক্রনিজম্
3. রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যদি 1743 সালে স্বপ্নটা দেখে থাকেন তাহলে তার পূর্ব বৎসর রূপেন্দ্রনাথ কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রীপূজা দেখেন কোন সুবাদে?
4. ফরাসী গভর্নর ডুপ্লেক্স (আজ্ঞে হ্যাঁ, উচ্চারণটা ঐভাবেই দেখানো হয়েছে চেম্বার্স বাইওগ্রাফিকাল ডিক্সনারীতে—’দুপ্লে’ বা ‘ডুপ্লে’ নয়) চন্দননগরে যে বছর প্রথমে আসেন তার পূর্ববৎসর তাঁকে চন্দননগরে দেখানো হয়েছে।
এইসব ‘কালানৌচিত্যদোষ’গুলিকে পাত্তা দেওয়া হয়নি। এই অজুহাতে বিদ্যাসুন্দর, বারোদোল, জগদ্ধাত্রীপূজা বা ডুপ্লেক্সকে বাদ দেওয়ার ইচ্ছে হয়নি। ঠিক যে যুক্তিতে ‘দ্রবময়ী’র কথাও উপেক্ষা করা যায়নি।
এছাড়া অন্তেবাসী হওয়ায় হাতের কাছে ভালো গ্রন্থাগার ছিল না—তা অবশ্য কোন কালেই ছিল না। কিন্তু যত বয়স বাড়ছে ততই দেখছি ওয়ারেন হেস্টিংস্-এর সেই বেলভেডিয়ার প্রমোদভবনটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। কালের দূরত্বে নয়, ভৌগোলিক বিচারে। জাতীয় গ্রন্থাগারগামী পাবলিক-বাসের হাতল আরও পিচ্ছিল, পা-দানি আরও সঙ্কীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে বঙ্গসাহিত্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস-আশ্রিত যে গ্রন্থটি নানা পুরস্কারে অভিনন্দিত এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তাতে এই চতুর্মাত্রিক বিশ্বপ্রপঞ্চের ঘন জ্যামিতির প্রথম তিনটি মাত্রা ছিল ধ্রুবক; শুধুমাত্র চতুর্থমাত্রাটি ছিল পরিবর্তনশীল : ‘সময়’! লেখকের স্বীকৃতিমতে যে তাঁর নায়ক। সেই সময়-এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছিল শহর কলকাতার চৌহদ্দী; উচ্চতা—যেহেতু গোবিন্দ মিত্তিরের ‘ব্ল্যাক-প্যাগোডা’ ধূলিসাৎ—তাই 1828 সালে নির্মিত নেপালজয়-স্মারকের চূড়া। অধমের ক্ষেত্রে শুধু ‘সময়’ নয়, ভৌগোলিক মাত্রা তিনটিও সর্বদা পরিবর্তনশীল। ডিহি-গোবিন্দপুর-সুতানুটি তখন আঁতুড় ঘরে। তাই এ অধমকে দাবড়ে বেড়াতে তদানীন্তন হয়েছে বৃহত্তর-বঙ্গের–অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের—এ-প্রান্ত থেকে ও প্ৰান্ত। কখনো বা বঙ্গ-সংস্কৃতির উপনিবেশ—কাশীধাম! পাঠক-পাঠিকা যাতে লেখকের মতো দিশেহারা না হয়ে পড়েন তাই মার্জিনে স্থান-কালের ইঙ্গিত রাখা গেছে।
শেষ কথা: ঊনবিংশ শতাব্দী সাদায় কালোয় মেশানো। সে যেন শরৎকালের আকাশ। মেঘরৌদ্রের লুকোচুরি। এদিকে বাইজী-বেড়ালের বিয়ে-বুলবুল-বাবুকালচার, ওদিকে রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথের অতন্দ্র সাধনার আশীর্বাদ। তুলনায় বক্ষ্যমাণ ঐতিহাসিক উপন্যাসের’সেই-তর সময়’ নীরন্ধ্র অন্ধকারাচ্ছন্ন শ্রাবণের অমারাত্রি। শুধুমাত্র তথ্যের অপ্রতুলতা নয়, যেটুকু দৃষ্টিগোচর তাও পঙ্কিল, ক্লেদাক্ত, আদ্যন্ত পূতিগন্ধময় পুরীষ! ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল অথবা রামপ্রসাদের বিশুদ্ধ কালীভক্তি সমকালীন গৌড়জনের সঙ্গে সম্পর্কবিমুক্ত। সতীদাহ প্রথাটাকে তখনো কারও আপত্তিকর বলে মনে হয়নি, বিধবাবিবাহ একটা অলীক দিবাস্বপ্ন, ‘কুলীনপাত্রের ধর্মপত্নীর সংখ্যা গুতি করা হত “কুড়ি’-র এককে। স্ত্রীশিক্ষা এবং বৈধব্যযোগ বাগর্থের মতো সম্পৃক্ত!
জাতীয় উন্মাদনায় প্রাকস্বাধীনতাকালে সিরাজ বা মহারাজ নন্দকুমারকে আদর্শ নায়ক খাড়া করার প্রচেষ্টা হয়েছিল বটে কিন্তু আজ আমরা বুঝি—তার অনেকটাই ফাঁকা বুলি। তাহলে? এমনটা তো হবার কথা নয়? বিবর্তনের একটি ফল্গুধারা যে থাকতেই হবে। লোকচক্ষুর অন্তরালে কেউ-না-কেউ নদীয়ার সেই প্রেমানন্দে-পাগল বিদ্রোহী পণ্ডিতের পর্ণকুটীর থেকে হোমাগ্নি শিখাটি নিশ্চয় পৌঁছে দিয়েছিলেন রাধানগরের রাজপ্রাসাদে জ্ঞানগরিমার দার্ঢ্যে সমুন্নতশির নবীন ঋত্বিকের হাতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূর্যোদয় যখন প্রত্যক্ষ সত্য তখন কেউ-না-কেউ নিশ্চয় গোপনে করে গেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর অমানিশায় অতন্দ্র ‘রাত্রির তপস্যা’। বুড়ো ইতিহাস কথাটা বে-মালুম ভুলে বসে আছে!
খুঁজতে শুরু করলাম অন্ধকারে হাৎড়ে হাৎড়ে। একটি অলোকসামান্য ঐতিহাসিক নায়কোচিত চরিত্রকে খুঁজেও পেলাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর কালীপ্রসন্ন সিংহ শুধু নয়, বীরসিংহের সিংহশিশুর পাশাপাশিও তাঁকে বেমানান লাগত না—কী পাণ্ডিত্যে, কী সরলতায়, কী চারিত্রিক দার্ঢ্যে! কিন্তু পরে মনে হল—যে বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁকে আদর্শ নায়ক করে অষ্টাদশ শতাব্দীকে কব্জা করতে চাইছি, সেই ‘গুণ’টাই তাঁর ‘দোষ’! তাঁর কোন প্রামাণিক জীবনী নেই। ‘বাঙালী চরিতাভিধান’-এর পণ্ডিতেরা না খুঁজে পেয়েছেন তাঁর জন্ম তারিখ, না তিরোধান দিবস! ওমা, সেকি! কেন? সমকালীন পণ্ডিতদের বিস্তারিত পরিচয় সমন্বিত একাধিক পুথি তো আছে? হ্যাঁ তা আছে। তিন-গোষ্ঠিভুক্ত দলেরইঃ নবদ্বীপকেন্দ্রিক, ভাটপাড়াকেন্দ্রিক এবং ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম কেন্দ্রিক। নেই শুধু সেই অন্তেবাসী, অসামাজিক, অরণ্যচারীর পরিচয়! সঙ্গত হেতুতে। সেই আত্মাভিমানী পণ্ডিত সমকালীন মহামহোপাধ্যায়দের পদাঙ্ক অনুসরণে—নবদ্বীপের জ্যোতিষ্ক শঙ্কর তর্কবাগীশ থেকে ত্রিবেণীর ক্ষণজন্মা জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মতো—’লাঙ্গুলহীন শৃগাল’ হতে স্বীকৃত হননি! মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং উপযাচক হয়ে তাঁর পর্ণকুটীরে এসেছিলেন বৃত্তিদানের প্রস্তাব নিয়ে, রাজানুগ্রহ প্রত্যাখ্যান করে তিন্তিড়ি-পত্রপ্রেমী সেই আজীবন অরণ্যচারী ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে রইলেন : ‘বুনো’ রামনাথ নামে!
ইতিহাস রচনা করে রাজার বেতনভুক্ত একডালে-বসা ‘হম-সব-পঞ্জী’। ইদানীং যেমন রাজনৈতিক দলের পার্টি-ফান্ড অথবা বৃহৎ পত্রিকা-গোষ্ঠীর অর্থানুকূল্যে সাহিত্যের বিচার-সমালোচনা-ইতিহাস রচিত হয়, সে-কালেও তাই হত। যুগে-যুগে একডালে বসা একই রঙের পালকধারী পার্শ্ববর্তীর কর্ণকুহরে গেয়ে চলে, “তোর গানে পেঁচি রে/সব ভুলে গেছি রে!”
ঐ ‘বুনো বামুনের’ নামটা ইতিহাসের পাতা থেকে একেবারে মুছে ফেলা যায়নি। উপায় কী? কিছু কিছু তথ্য যে চাপা দেওয়া যায় না। যেমন রাজা নবকৃষ্ণের সেই ‘আন্তর্জাতিক’ বিচারসভার ইতিবৃত্তটা! ভারতজয়ী দক্ষিণ ভারতের পণ্ডিতের সঙ্গে তর্কযুদ্ধ করতে সবাই যখন অধোবদন–মায়, নবদ্বীপের শঙ্কর তর্কবাগীশ, শান্তিপুরের গোস্বামীপাদ রাধামোহন বিদ্যাবাচস্পতি, এমনকি ত্রিবেণীর সেই ‘শতাব্দীর-শ্রেষ্ঠ-পণ্ডিত’ জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন স্বয়ং, তখন গৌড়দেশকে ভরাডুবি হতে রক্ষা করতে বিচারসভায় উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ঐ অন্তেবাসী ‘বুনো’ রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত! দাক্ষিণাত্যের পণ্ডিত পরাজয় স্বীকার করে ফিরে গেলেন দাক্ষিণাত্যে, চীরধারী চির-অপরাজেয় ‘বুনো’-পণ্ডিত ফিরে গেলেন বনে।
তথ্যের অপ্রতুলতাজনিত কারণে ইতিহাসে উপেক্ষিত সেই অন্তেবাসী এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের নায়ক হবার অনুপযুক্ত!
না! ভুল হল! বরং বলা উচিত: অর্থলোভী, যশোলোভী বিংশ শতাব্দীর কোনও শহুরে কথাসাহিত্যিক তাঁকে নায়করূপে লাভ করার অনুপযুক্ত!
অনুসন্ধানকার্যে ক্ষান্ত হইনি তা বলে।
খুঁজতে-খুঁজতে-খুঁজতে অবশেষে হাতে এল চব্বিশ-পৃষ্ঠার একটি চটি বই। ক্ষুদ্র, কিন্তু প্রামাণিক। প্রকাশক: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। লেখক : ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্যসাধক চরিতমালার ঊননব্বইতম পুস্তিকাটি: চতুষ্পাঠীর যুগে বিদুষী মহিলা।
তিনজন অসামান্যা বিদুষীর কথা লিখে গেছেন গবেষক: হটী বিদ্যালঙ্কার (17432-1810), হটু বিদ্যালঙ্কার (1775?-1875?) এবং দ্রবময়ী ( 1837? -? )
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। যা খুঁজছি এতদিন! নায়ক নয়, নায়িকা।
তৃতীয়জন ঊনবিংশ শতাব্দীর; কিন্তু প্রথম দুজনের জীবনের অনেকটাই অষ্টাদশ শতাব্দীর। দুজনেরই আদি নিবাস বর্ধমাভুক্তিতে। হটীর পিতৃপরিচয় জানা যায় না। জন্ম : সোঞাই, বর্ধমান। পিতার কাছে সংস্কৃত ব্যাকরণাদি শেখেন। বিধবা হবার পর তাঁর পিতৃদেব তাঁকে সহমরণে যেতে দেননি। পিতৃবিয়োগের পরে তিনি কাশীধামে চলে যান, সেখানে স্মৃতি, ব্যাকরণ ও নব্যন্যায় অধ্যয়ন করে অসাধারণ জ্ঞানার্জন করেন। কাশীর পণ্ডিত সমাজ তাঁকে ‘বিদ্যালঙ্কার’ উপাধি দান করেন। সেখানেই চতুষ্পাঠী স্থাপন করে অধ্যাপনা করতেন, প্রকাশ্যে পণ্ডিতসভায় তর্কাদিতে যোগ দিতেন এবং চতুষ্পাঠীর পণ্ডিতদের মতো দক্ষিণা গ্রহণ করতেন।
অপরপক্ষে হটু বিদ্যালঙ্কার, ওরফে ‘রূপমঞ্জরী’ হটী অপেক্ষা প্রায় তিন দশকের অনুজা। জন্ম: কলাইঝুটি, বর্ধমান। পিতা পরমবৈষ্ণব নারায়ণ দাস। কন্যার অসাধারণ বুদ্ধি ও মেধার পরিচয় লাভ করে তিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আত্মজার বাল্যবিবাহ দিতে অস্বীকার করেন। পরিবর্তে তাঁকে নানা বিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলেন ব্যাকরণ, সাহিত্য, নব্যন্যায় এবং চিকিৎসাবিদ্যা। রূপমঞ্জরী পরে সরগ্রামনিবাসী আচার্য গোকুলানন্দ তর্কালঙ্কারের কাছে সাহিত্য এবং চরক, সুশ্রুত, নিদান ইত্যাদি জটিল চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ইনি চিরকুমারী। আশ্চর্যের কথা, ইনি পুরুষদের মতো মস্তক-মুণ্ডন, শিখাধারণ এবং উত্তরীয় পরিধান করতেন।
এই দুজন অলোকসামান্য মহিলার পূর্ণ পরিচয় পরিশিষ্টে সংযুক্ত করা গেছে, যাতে ঐ দুই অসামান্যার বাস্তবজীবনের উপাদানের মিশ্রণে এই বিংশশতাব্দীর নারায়ণদাসের মানসকন্যার জীবনীটা আপনাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়! বিশ্বাস করা শক্ত বই কি! রাজা রামমোহন যখন হামাগুড়ি দিতে শেখেননি তখন কোন পিতৃহীন বালবিধবা চিতাভ্রষ্টা বারাণসীধামে ‘বিদ্যালঙ্কার’ উপাধি নিয়ে বিচারসভায় পুরুষদের সঙ্গে তর্ক করছেন, লেখকের কল্পনায় নয়, বাস্তবে এটা সহজে মেনে নেওয়া কঠিন! কিংবা রামমোহনের প্রায় সমবয়সী একটি বাঙালী মহিলা পুরুষের বেশে স্বগ্রামে নরনারী নির্বিশেষে চিকিৎসা করছেন, ছাত্রদের চিকিৎসাবিদ্যা শেখাচ্ছেন এ কি সহজে বিশ্বাসযোগ্য?
না! ‘রূপমঞ্জরী’র নায়ক ‘সময়’ নয়।
কারণ গোটা অষ্টাদশ শতাব্দীব্যাপী মহাকাল এ গৌড়দেশে বড় একদেশদর্শী! শতাব্দীর শুরু থেকে দক্ষিণাঞ্চলে মগ-আরাকান-পর্তুগীজ বোম্বেটের অত্যাচার, তার পরেই বর্গীর হাঙ্গামা; মিটতে-না-মিটতেই পলাশী প্রান্তরে যৌথ বিশ্বাসঘাতকতা! এরপর ক্রমান্বয়ে মীরজাফর রেজা খাঁ-দেবীলালের নির্মম শোষণ; ওদিকে বেনিয়া ইংরাজের রাজ্যলাভে শেষ হয়ে গেল বাঙলার তাঁতশিল্প, কুটির শিল্প, লবণের ব্যবসা। অনিবার্য ফল : ছিয়াত্তরের মন্বন্তর!
‘সুসময়’ আদৌ এল না সেই-তর গোটা শতাব্দীতে, সবটাই—’দুঃসময়’!
তাই আমার কাহিনীর নায়ক সেই নিঃসঙ্গ ক্লান্ত বিহঙ্গটি যে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস রেখেছিল : ‘আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ অঙ্গন!’
তাঁকে খুঁজে পেয়েছি একই চিন্তাসূত্রে। রাজা রামমোহন যদি স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের মতো অলৌকিক ক্ষমতায় গজিয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে হটী বা হটু বিদ্যালঙ্কারও তা পারেন না। পারে না আমার মানসকন্যাও। তাঁদেরও প্রয়োজন এক-একজন পূর্বসূরী। শিক্ষা, দীক্ষা, প্রতিটি রক্তকণিকার প্রতিটি ‘জীন’-এ চাই সেই পূর্বসূরীর আশীর্বাদ। বাস্তব রূপমঞ্জরীর পিতৃদেব অষ্টাদশ শতাব্দীর নারায়ণ দাস ছিলেন পরম বৈষ্ণব। কিন্তু সেই তৃণাদপি সুনীচকে দেখা গেল কূপমণ্ডূক সমাজের বিরুদ্ধে বজ্রাদপি কঠোর হতে। হটীর পিতৃদেবের নামটা মনে করে রাখতে পারেনি বুড়ো ইতিহাস। তবে এটুকু তার স্মরণে আছে—সমাজপতিদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তিনি আত্মজার অক্ষর-পরিচয় করিয়েছিলেন, সহমরণের চিতা থেকে নাবালিকাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে এনেছিলেন।
সেই অজ্ঞাতনামা বজ্রাদপি কঠোর টুলো পণ্ডিতই আমার উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র।
এ-গ্রন্থ রচনার সময় নানাভাবে তথ্য সরবরাহ করে আমাকে সাহায্য করেছেন ব্যারাকপুর নিবাসী চণ্ডীদাস চট্টোপাধ্যায়, সুবর্ণরেখা প্রকাশনীর ইন্দ্রনাথ মজুমদার, জাতীয় গ্রন্থাগারের অপর্ণা বসু। প্রয়োজন মতো গ্রন্থ সরবরাহ করে কৃতজ্ঞতা পাশে বেঁধেছেন প্রকাশক মহলের সুধাংশুকুমার দে, প্রসূন বসু এবং বামাচরণ মুখোপাধ্যায়।
পাণ্ডুলিপি পাঠ করে নানা পরামর্শে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে আমাকে সাহায্যে করেছে দুজন—দে’জ প্রকাশনীর সুবীর ভট্টাচার্য এবং ভাগিনেয় সুবাস মৈত্র। তাদের দুজনের কাছে আমি বিশেষভাবে ঋণী।
শিল্পী সুধীর মৈত্র অলঙ্করণের দায়িত্ব নিয়ে আমাকে নিশ্চিন্ত করেছেন। আশা হয়েছে লেখার গুণে আকৃষ্ট না হলেও রেখার আকর্ষণে এ-বই পাতা উল্টে দেখতে হবে। আলোকচিত্রগুলি কোথা থেকে সংগৃহীত সে বিষয়ে গ্রন্থ-শেষে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা গেছে।
সবশেষে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনাদের কাছে! আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি আপনাদের কথাই বলছি—– আমার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং/অথবা শ্রদ্ধেয় পাঠক-পাঠিকার কাছে। কী জানেন? এই”কৈফিয়ৎটি লিখবার সময়েই হঠাৎ আপনাদের কথা মনে পড়েছে। গ্রন্থরচনাকালে সারাক্ষণ আমার মানসচক্ষে উপস্থিত ছিল আমার দিদিভাইয়েরা—’সমবয়সী’ হওয়ার সুবাদে যেসব নাতনিদের সঙ্গে আমার কোন জেনারেশান-গ্যাপ্ নেই। আপনারা অনুমতি দিলে সব শেষে তাদের সঙ্গে জনান্তিক আলাপচারীটুকু সেরে নিতে পারি :
***
—তো, যে-কথা বলছিলাম, দিদিভাই : ওটা, তোমাদের ভুল ধারণা। নারীমুক্তি বল, স্ত্রী-স্বাধীনতা অথবা ‘উইমেন্স লিব্ তোমরা নতুন কিছুই করছ না। এ লড়াই আগেও ছিল, পরেও থাকবে। তোমাদের মা-ঠাকুমা-দিদিমা, তাঁদের-তাঁদের-তাঁদের ‘পূর্বনারী’–’এন-এথ টার্ম’ পর্যন্ত পিছিয়ে যাও—একই ছবি। ওদেশে ‘জোন অব আর্ক’ তো এ-দেশে ঝাঁসির রানী। রণচণ্ডীর ‘উত্তরসূরিণী’। বাণকের মানদণ্ড যখন রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হচ্ছে তখন আদিমতমা যে নারী-বিদ্রোহিণী ইংরেজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর নামটাই আমরা জানি না। শুধু অস্তিত্বটা টের পাই—গ্লেজিয়ার-সাহেবের ‘রিপোর্ট অন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব রঙপুর’-এর 42 পৃষ্টাতে! লেখা আছে এই মহিলা-ডাকাত ‘দেবী’ সন্ন্যাসীবিদ্রোহের নায়ক মজনু শাহ্র সহযোগী এবং সম্ভবত ভবানী পাঠকের মন্ত্রশিষ্যা। তিনি নাকি মহিলা, ডাকাত, জমিদার! ইতিহাসে লেখা নেই, কিন্তু তিনি নিশ্চয় কারও কন্যা, কারও স্ত্রী বা ‘মা’ না হলেও! আমরা ভুল করে ভাবি তিনি বঙ্কিমের মানসকন্যা, বঙ্কিমের ‘কল্পনা’।
তারও আগের কালে আর একজনের কথা বলি। পাটবাড়ী—ময়মনসিংহের কবি বংশীদাস ভট্টাচার্যের আত্মজা: চন্দ্রাবতী। জন্ম তাঁর ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি। চৈতন্যদেব তিরোহিত হবার পর দুই দশকও অতিক্রান্ত হয়নি। ভট্টাচার্য-মশাই নিজে কবি, অষ্টমবর্ষে গৌরী দান করতে সম্মত হলেন না। স্মাতুজাকে ভর্তি করে দিলেন চতুষ্পাঠীতে। সেখানে কিশোরী চন্দ্রাবতীর রূপেগুণে মুগ্ধ এক এমর এগিয়ে এল প্রেম নিবেদন করতে। ওরই সহপাঠী জয়চন্দ্র। কিশোর-কিশোরী। তোমাদের ভাষায় ‘কাফ-লাভ’। কিন্তু দুজনেই দুজনের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ! তারপর কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল এক যবনীর রূপে মুগ্ধ হয়ে জয়চন্দ্র গ্রাম ত্যাগ করল। চন্দ্রাবতীর দিকে ফিরেও তাকালো না! মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে বিবাহ করল সেই যবনীকে। বংশীদাস স্বভাবকবি, বুঝলেন সবই। সুপাত্রে বিবাহ দিতে চাইলেন চন্দ্রাবতীর। ততদিনে চন্দ্রাবতী আর কিশোরী নয়, যুবতী। প্রত্যাখ্যান করল সে। পিতাকে জানালো, চিরকুমারী থেকে গৃহদেবতার পূজার্চনা আর সাহিত্যসেবা করে জীবনটা কাটিয়ে দেবে। কন্যাপণের টাকায় বংশীদাস একটি মন্দির নির্মাণ করে দিলেন। সেই দেবতার সেবাতেই জীবন অতিবাহিত করতে বসলেন চন্দ্রাবতী! কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস একেই বলে! কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামে প্রত্যাবর্তন করলেন জয়চন্দ্র। জানালেন, যবনীর মৃত্যু হয়েছে; এখন তিনি চন্দ্রাবতীকে বিবাহ করতে প্রস্তুত, প্রয়োজনে নাথ-পন্থী হয়ে, অথবা বৈষ্ণব! প্রত্যাখ্যান করলেন চন্দ্রাবতী! জয়চন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে জানতে চাইলেন, তুমি আমাকে আর ভালোবাস না?
চন্দ্রাবতী ম্লান হেসে বললেন, সেটাই তো সব চেয়ে বেদনার! বাসি!
—তাহলে কোথায় তোমার আপত্তি? ‘ধর্ম’ ত্যাগ করতে?
—হ্যাঁ। কিন্তু ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের’ কথা বলছি না আমি। আমার ‘নারীত্বধর্মের মর্যাদা’! সেটা ত্যাগ করতে পারব না!
জনশ্রুতি, জয়চন্দ্র আত্মহত্যা করেন এবং চন্দ্রাবতী সেই নিদারুণ সংবাদশ্রবণে মূর্ছিতা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সে মূর্ছা আর তাঁর ভাঙেনি। ‘ময়মনসিংহগীতিকার কবি হিসাবেই তাঁর খ্যাতি; কিন্তু তিনিই কি ‘দেবী-চৌধুরাণী’র পূর্বসূরিণী’ নন? এবং রূপমঞ্জরীর?
* * * *
রূপমঞ্জরী এবং তার বাবা দুজনকেই অষ্টাদশ শতাব্দীর দুই অর্ধে দুই সংকটজনক অবস্থায় ফেলে রেখে অসমাপ্ত গানে আচমকা থামতে বাধ্য হয়েছি নিতান্ত বাধ্য হয়ে, ব্যক্তিগত কারণে।
বর্তমান বছরের (1989) বইমেলার শেষাশেষি ঐ বইমেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে একদিন কিছু ‘চিত্তচাঞ্চল্য’ অনুভব করি। একটি নার্সিং হোমের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে এক কালো মুখোশধারীর সঙ্গে কিছু তার হয় একটি প্রত্যঙ্গের দখলদারী নিয়ে। সওয়া-তিনকুড়ি বছরের স্বত্বাধিকার অগ্রাহ্য করে সে আমার হৃদপিণ্ডটি জবরদখল করতে চাইছিল। যাহোক, শেষ-মেষ হামলাদারটা ক্ষমাঘেন্না করে বলে গেল, “এখনো আমার সময় হয়নি, আজি তাই পেলে ছুটি/সময় যেদিন আসিবে আপনি ধরিব তোমার টুটি।” সে-সব কথা বিস্তারিত লিখেছি আমার পূর্বপ্রকাশিত গ্রন্থে: ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া।
ফিরে এলাম নিজের ডেরায়। এসে দেখি, ইত্যবসরে আমার অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিখানি ছিন্তাই হয়ে গেছে। এবার অপরিচিত জবরদখলকারী নয়, সুপরিচিত ‘হামলাদারনী’ : তোমাদের দিদা!
ন্যাপথালিন-সুরভিত আমার সে পাণ্ডুলিপি আলমারিতে বন্দিনী। এখনো পর্যন্ত তার দিকে দেখি নাই ফিরে। যেটুকু আগেই লিখেছি তাই ছেপে ফেলা গেল।
এসব খবর তোমরা অনেকেই জান না। জানবে কোথা থেকে? ‘খানদানি’ খবরের কাগজে সে খবর তো ছাপা হয়নি। আর সেসব কাগজকেও দোষ দেওয়া যায় না। অহন্যহনি কত কত ভেন্ন-রঙের সাহিত্য-যশোপ্রার্থী অখ্যাত চিড়িয়া নার্সিং হোমে ‘গচ্ছন্তি’ এবং সেখান থেকে সৎকার-সমিতির আানে অন্যত্র ‘পুনর্গচ্ছন্তি’, অত সব খবর কি ছাপা সম্ভব?
তবু ‘আজকাল’ পত্রিকায় সংবাদটা ছাপা হয়েছিল। তাই তোমাদের মধ্যে অনেকে আবার জানতে পেরেছিলে। তার ভিতর কেউ-কেউ খামে ভরে আমাকে প্রসাদী নির্মাল্য পাঠিয়েছ, আমার রোগমুি কামনা করেছ।
তাদের শুভেচ্ছায় আশা রাখি এ কাহিনীর দ্বিতীয় খণ্ডটি শেষ করে যেতে পারব।
নারায়ণ সান্যাল
2.10.89
পুনশ্চ :
পরিকল্পনা ছিল প্রথম খণ্ডটির যবনিকাপাত ঘটবে সূতিকাগারে কুসুমমঞ্জুরীর প্রয়ানে অর্থাৎ রূপমঞ্জরীর আবির্ভাবে। কিন্তু ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। দ্বিতীয়বার নার্সিং-হোম থেকে ফিরে আসার পর সিদ্ধান্ত নিতে হল : ‘অসমাপ্ত গানে’ই আপাতত থামতে হবে। ময়দানে যখন নব্বই দশকের বইমেলা জমজমাট তখন আমাকে একটি অস্ত্রোপচার করাতে হবে। প্রতিশ্রুত নির্ঘণ্ট, ফটো-ক্রেডিট প্রভৃতি দ্বিতীয় খণ্ডের পরিশিষ্টে সংযক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
ভাবলে এ কিছু ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা নয়।
গঙ্গাপুত্রের মতো ‘ইচ্ছামৃত্যু’র পুঁজি তো আমার তূণীরে নেই!
আগে অস্ত্রোপচার করে ফিরে তো আসি।
নারায়ণ সান্যাল
1.1.90
Leave a Reply