রিবিট – মোশতাক আহমেদ – ক্লাসিক ফিকশন
[দীর্ঘ ত্রিশ বছর গবেষণা শেষে বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত একজন প্রফেসর মানুষের কল্যাণের জন্য ঢাকা শহরে একটি অতি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবটকে মুক্ত করে দেয়। অনুভূতি সম্পন্ন এই রোবটটির নাম ‘রিবিট’ যার একমাত্র কাজ মানুষের কল্যাণ সাধন করা। মানুষের মতোই রিবিটের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, কষ্ট-যন্ত্রণা রয়েছে, রয়েছে মানুষ বিশেষ করে শিশু কিশোরদের জন্য অফুরন্ত আর সীমাহীন। ভালোবাসা। তাইতো রিবিট মানুষের কল্যাণের জন্য ঘুড়ে বেড়ায় বাংলাদেশের শহর-গ্রামে, পথে প্রান্তরে, আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে। আবির্ভাবের প্রথম রাতেই রিবিট ঢাকার রাস্তায় ডাস্টবিনের পাশে কুঁড়িয়ে পায় দুটো অসহায় সংযুক্ত যমজ মানব শিশুকে। সে বুঝতে পারে শিশু দুটো খুবই অসুস্থ। ওদের চিকিৎসার জন্য অনেক অনেক টাকার প্রয়োজন। তাইতো সে ওদের বাঁচাতে সাহায্যের জন্য ছুটে যায় মানুষের কাছে। কিন্তু বাস্তবতা যে বড় কঠিন! কেউ তাকে আশানুরূপ সাহায্য করতে চায় না। মানুষের জন্য ভালোবাসায় ভরা রিবিটের বুকটা দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণায় ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। তারপরও সে এগিয়ে চলে, তাকে যে মানুষের কল্যাণ সাধন করতেই হবে। শেষ পর্যন্ত রিবিট কি পেরেছিল শিশু দুটোকে বাঁচাতে?]
প্রথম প্রকাশ। মাঘ ১৪১৪, ফেব্রুয়ারি ২০০৮
উৎসর্গ
ভালোলাগার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব
রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল ভাইকে
যার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
১
রাত দশটা। সাত-আটজন সাংবাদিক ঢাকা প্রেসক্লাবের সামনে অলস ভঙ্গিতে গল্পগুজব করছে। কেউ দাঁড়িয়ে আবার কেউ বসে বসে। সবার মধ্যে একরকম গা-ছাড়া ভাব। অবশ্য এর কারণও রয়েছে। সবাই নিজ নিজ অফিসে আগামীকালের জন্য সকল সংবাদ প্রেরণ করে দিয়েছে। আজ আর উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই। এখন চলছে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি। সবাই ক্যামেরা বন্ধ করে কাগজপত্রও গুছিয়ে ফেলেছে। আগামী দুদিন ছুটির দিন হওয়ায় কাজের চাপও কম। তাই অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে তারা। কে কীভাবে আগামী দুদিন কাটাবে, কারো ডিউটি আছে কিনা, কেউ প্রেসক্লাবে আসবে কিনা, এগুলোই আলোচনার বিষয়বস্তু।
হঠাই একটি পুরোনো মডেলের কালোরঙের প্রাইভেট কার প্রেসক্লাবের সামনে এসে থামল। উপস্থিত সাংবাদিকরা গাড়িটির দিকে তাকালেও কেউ মনোযোগ দিল না। বরং এমন একটি পুরোনো মডেলের গাড়ি এসময় এখানে আসায় কেউ কেউ যেন খানিকটা বিরক্তই হল। তাই গাড়িতে কে বসে আছে সেদিকে ফিরে তাকানোরও কেউ প্রয়োজন মনে করল না।
গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে কাঁচাপাকা চুলের বয়স্ক একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। ভদ্রলোকের চোখে মোটা গ্লাসের চশমা তার বয়সটাকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পরনের মলিন আকাশিরঙের হাফশার্ট আর কালোরঙের প্যান্টে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। পায়ের চামড়ার স্যান্ডেলটাও বেশ পুরোনো। ভদ্রলোককে দেখে মনে হবে তিনি শুধু তার ফর্সা লাল টকটকে গায়ের রঙের জন্যই গর্ব করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, চেহারায় কিছুটা বিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। আর কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে ধীরগতিতে হাঁটার কারণে তাকে যথেষ্ট স্থিরবুদ্ধির মানুষ বলে মনে হতে পারে।
বয়স্ক ভদ্রলোক যখন সাংবাদিকদের সামনে এসে দাঁড়ালেন তখনো কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি। ভদ্রলোক একটু সময় নিলেন, তারপর বললেন : ভাই, আপনারা কি সাংবাদিক?
কেউ কোনো কথা বলল না। তবে সবাই ভদ্রলোকের দিকে চোখ তুলে তাকাল।
ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করে আবার বললেন : আমি এখানকার সাংবাদিকদের সাথে একটা বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি।
এবারো কেউ কোনো কথা বলল না।
ভদ্রলোক এবার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে একটু জোরেই বললেন : আমি বুয়েটের একজন প্রফেসর।
এবার অবশ্য তরুণবয়সী একজন সাংবাদিক কিছুটা আগ্রহ প্রকাশ করল। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বলল : আপনি বুয়েটের প্রফেসর?
হ্যাঁ, বেশ কয়েক বছর হলো অবসর নিয়েছি। অবশ্য এখনো মাঝে মাঝে পার্টটাইম ক্লাস নিই।
তো বলুন, আপনি কী বলতে চান?
প্রফেসর সাহেব একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন : আমি বিশেষ একটা কারণে আপনাদের কাছে এসেছি। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই বলছি। দীর্ঘ ত্রিশবছর গবেষণা এবং প্রচেষ্টার পর আমি একটি রোবট তৈরি করেছি। এই রোবটটিকে আজ আমি মুক্ত করে দিচ্ছি। মুক্ত অর্থাৎ স্বাধীন। সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে আমি যখন নিশ্চিত হয়েছি রোবটটি মানুষের জন্য নিরাপদ এবং রোবটটি মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারবে তখনই আমি রোবটটিকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আজ হচ্ছে রোবটটির মুক্তির দিন। এখন থেকে রোবটটি স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছেমতো বাংলাদেশের যে-কোনো স্থানে ঘুরে বেড়াতে পারবে।
সাংবাদিকদের অধিকাংশই কুঁচকে প্রফেসর সাহেবের দিকে তাকাল। কেউ কেউ তাকে হয়তো পাগল কিংবা মস্তিষ্কবিকৃতও ভাবল। কিন্তু তরুণ সেই সাংবাদিক কেন যেন উৎসাহবোধ করল। সে আবার বলল : আপনি বলছেন আপনি একটি রোবট তৈরি করেছেন এবং সেটিকে আজ মুক্ত করে দিচ্ছেন!
যদিও আপনাদের অবিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, কিন্তু আমি যা বলছি সবই সত্য।
আপনি কি কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন? অন্য একজন সাংবাদিক সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করল।
আমি শুধু প্রমাণই দেব না, রোবটটিকেও কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাদের সামনে হাজির করব। রোবটটিকে দর্শনের ক্ষেত্রে আপনারাই হবেন প্রথম সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।
প্রফেসর সাহেবের কথা এখনো কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই উপস্থিত সাংবাদিকরা আদৌ প্রশ্ন করবে কি করবে না বা করলে কী ধরনের প্রশ্ন করবে সে সম্পর্কে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
সাংবাদিকদের ইতস্তত করতে দেখে প্রফেসর সাহেব আবার বললেন : আমি বুঝতে পারছি আপনারা দ্বিধায় ভুগছেন। এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাইহোক, আমি নিজেই আপনাদেরকে কিছু তথ্য প্রদান করছি। প্রথমে বলছি কেন এই অসময়ে আপনাদের এখানে এসেছি। এই অসময়ে আসার মূল কারণ আমি ঝামেলা এবং অতিরিক্ত বিড়ম্বনা এড়াতে চেয়েছি। এ-কারণে কোনো সেমিনার, সম্মেলন বা প্রেসব্রিফিং-এর আয়োজন ব্যতীতই রোবটটির কথা সরাসরি আপনাদেরকে জানাচ্ছি।
প্রফেসর সাহেব লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন : আমার সৃষ্ট এই রোবটটির নাম ‘রিবিট’। রিবিট একটি অতিউচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবট। নিরাপত্তাজনিত কারণে আমি রিবিটের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে আপনাদের উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য প্রদান করব না। তবে এটা সত্য, সকল রোবটের মতো একটি মাইক্রোচিপস্ রিবিটের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে রিবিটের মূল প্রোগ্রাম সংরক্ষিত রয়েছে এবং এই মূল প্রোগ্রামের নাম ‘প্রোগ্রাম রিবিট’। মূলত এই মাইক্রোচিপস-এর অভ্যন্তরের ‘রিবিট প্রোগ্রাম’-ই রোবট রিবিটের নিয়ন্ত্রক, আরো সহজ ভাষায় বললে বলতে হয় প্রাণকেন্দ্র। তবে হ্যাঁ, রিবিটের অভ্যন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘ইপি’ নামের অপর একটি বিশেষ প্রোগ্রাম রাখা হয়েছে। ইপি মূলত রিবিটের তথ্য বা জ্ঞানকেন্দ্র, পৃথিবীর সকল বিষয় সম্পর্কে সাধারণ তথ্যসমূহ ইপির অভ্যন্তরে সংরক্ষিত রয়েছে। ইপির মূল কাজ হচ্ছে রিবিটকে তথ্য প্রদান করা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে নানাভাবে রিবিটকে সাহায্য করা। এছাড়া রিবিটের নিঃসঙ্গতা দূর করাও ইপির অন্যতম একটি কাজ। রিবিট এবং ইপি যে-কোনো সময়, যে কোনো প্রয়োজনে, যে কোনো বিষয়ে, একে অন্যের সাথে কথা বলতে পারে। তবে এটা সত্য ‘প্রোগ্রাম ইপি’ সবসময় ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং সকল বিষয়ে ‘প্রোগ্রাম রিবিট’-ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এছাড়াও রিবিটের অভ্যন্তরে হাজার হাজার প্রোগ্রাম রয়েছে যেগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ কিংবা ‘প্রোগ্রাম ইপি’র তুলনায় গৌণ। মাইক্রোচিপ এর অভ্যন্তরে এই হাজার হাজার প্রোগ্রামগুলোও ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত। তাই আবারো বলছি, মাইক্রোচিপসকে আমরা যদি মস্তিষ্ক মনে করি তাহলে ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ হবে রোবট রিবিটের প্রাণ।
রিবিটের সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হল রিবিটের অনুভূতি। মানুষের মতোই রিবিট সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা উপলব্ধি করতে পারবে। আর এ কারণেই মানুষের সুখে রিটি সুখী হবে, মানুষের আনন্দে আনন্দিত হবে এবং মানুষের ব্যথায় ব্যথিত হবে। রিবিট অবশ্যই আবেগপ্রবণ এবং সে তার নিজস্ব মর্যাদার প্রতি যথেষ্ট সচেতন। তাই যে-কোনো কটুক্তি কিংবা আপত্তিজনক আচরণে রিবিট অপমানিত হবে। তবে রিবিটের মধ্যে প্রতিহিংসার কোনো অনুভূতি নেই। রিবিট নিজের প্রয়োজনে কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারবে না। যে সামান্য রাগের অনুভূতি রিবিটের অভ্যন্তরে রয়েছে তা শুধুমাত্র মানুষের মঙ্গলের জন্য অথবা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। আর অবশ্যই এটা সত্য যে, রিবিট কখনো মিথ্যা বলবে না। রিবিট সর্বদাই সত্যবাদী। তবে মানুষের মঙ্গলের জন্য রিবিট যে-কোনো তথ্য গোপন করতে পারবে কিংবা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারবে। যেহেতু রিবিটের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য মানুষেরই অনুরূপ সেহেতু প্রশ্ন উঠতে পারে নিবিট কতটা পরিণত? রিবিটের আচরণ নির্ভর করবে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ওপর। মানসিকভাবে রিবিট কখনো শিশু, কখনো কিশোর, কখনো তরুণ, আবার কখনো মাঝবয়সী। রিবিট যে-কোনো সময় যে কোনো পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় রিবিট উদ্যমী এবং পরোপকারী এক প্রাণবন্ত হাসিখুশি তরুণ, যে কিনা সবসময় মানুষের কল্যাণ এবং মঙ্গল নিয়েই চিন্তা করবে।
রিবিট একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রোবট। সক্রিয় থাকার জন্য রিবিট কখনো মানুষকে বিরক্ত করবে না। রিবিটের অভ্যন্তরের ব্যাটারি বা চার্জার ইলেকট্রিকাল কিংবা সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে চার্জ করা সম্ভব। এ কারণে সূর্যের আলো থেকে রিবিট নিজেকে প্রয়োজনমতো চার্জ করে নিতে পারবে। এমনকি, বিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরের যে-কোনো তাপমাত্রার পরিবেশ থেকে রিবিট নিজেকে চার্জ করতে পারবে। রিবিট নিজেকে রক্ষার জন্য সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল। রিবিটের অভ্যন্তরে আত্মরক্ষার জন্য যে প্রোগ্রাম রয়েছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ক্ষিপ্র। রাইট অব প্রাইভেট ডিফেন্স’ বা ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার’ ব্যতীত রিবিট কখনো কোনো মানুষ বা প্রাণীকে আঘাত করবে না। তবে শিশু, অন্য কোনো নিরপরাধ মানুষ কিংবা প্রাণীর জীবন রক্ষার্থে রিবিট মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রিত শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে।
উল্লেখ্য, মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেই রিবিটকে কিছু অতিমানবীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, তবে তা অবশ্যই সীমিত। রিবিট যেমন আকাশে উড়তে পারবে না, তেমনি দশতলা কোনো ভবনকে মুহূর্তেই খুঁড়িয়ে দিতে পারবে না। রিবিট প্রয়োজনে তার শারীরিক শক্তি পাঁচগুণ বৃদ্ধি করতে পারবে, তবে তা অবশ্যই একটি পাহাড়কে উল্টে দেয়ার মতো নয়। আধুনিক প্রযুক্তির সবকিছুই রিবিটের অভ্যন্তরে রয়েছে। রিবিটের মূল প্রোগ্রাম সরাসরি মোবাইল, রেডিও, টেলিভিশন এবং টেলিফোন নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত। এ কারণে রিবিট মুহূর্তেই ইন্টারনেট, ই-মেইল এবং টেলিফোনের মাধ্যমে যে-কোনো স্থানে যোগাযোগ করতে পারবে এবং রেডিও কিংবা টেলিভিশনের যে-কোনো অনুষ্ঠান শুনতে বা দেখতে পারবে। অবশ্য এ-সংক্রান্ত সকল খরচ রিবিট নিজেই বহন করবে। রিবিটের চোখে অত্যন্ত শক্তিশালী ডিজিটাল এবং অপটিক্যাল জুমের ভিডিওক্যাম রয়েছে। আর এ-কারণে রিবিট যেমন মুহূর্তেই যে-কোনো কিছুর ছবি তুলতে পারবে তেমনি অনেক দূরের জিনিসও দেখতে পারবে। রিবিট তার চারপাশে যা কিছু দেখবে বা শুনবে, তা তার অভ্যন্তরের মেমোরিতে পাঁচবছর পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো রিবিট তার স্মৃতি থেকে কখনোই মুছে ফেলবে না, বছরের-পর-বছর সংরক্ষণ করবে। ফলে রিবিট যে-কোনো সময় তার পূর্বের যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিকে দেখতে পারবে বা সেখান থেকে যে-কোনো স্মৃতির ভিডিও ধারণ করে বা ছবি তুলে তা প্রিন্ট করতে পারবে।
এ ছাড়া রিবিটের আরো একটি বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। তা হল রিবিটের দ্রুত পড়ার ক্ষমতা। উদাহরণস্বরূপ, পাঁচশো পৃষ্ঠার একটি বই রিবিট হয়তো দশ মিনিটেই পড়ে ফেলবে। রিবিটের সময়ের প্রয়োজন হবে বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টানোর জন্য। কারণ এক পৃষ্ঠা পড়তে রিবিটের এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগবে। রিবিট গাড়িচালনায় পারদর্শী হলেও মূলত পায়ে হেঁটেই বেশি চলাচল করবে।
এখানে উল্লেখ্য যে-রিবিটের মধ্যে এখনো অনেক অসম্পূর্ণতা রয়েছে। যেমন ধরুন, ইচ্ছে করলেই রিবিট মানুষের মতো দ্রুত দৌড়াতে পারবে না। রিবিটের ধাতব শরীরের ভর মানুষের শরীরের থেকে তিনগুণ বেশি হওয়ায় রিবিটের দৌড়ের গতি মানুষের তুলনায় কিছুটা কম। তবে বিশেষ উপায়ে রিবিট তার শরীরের ওজন কমিয়ে সর্বোচ্চ মানুষের গতিতে দৌড়াতে পারবে। যাইহোক, সার্বিক বিবেচনায় আমি আপনাদের এতটুকু নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারি যে রিবিট শুধু মানুষের মঙ্গলই বয়ে আনবে, কোনো অমঙ্গল নয়। আর এ-কারণেই বলব ‘মানুষের কল্যাণে রিবিট এক অকল্পনীয় বিস্ময়।’
প্রথমদিকে কিছুটা অমনোযোগ থাকলেও শেষের দিকে সকল সাংবাদিকই খুব মনোযোগের সাথে প্রফেসর সাহেবের কথা শুনছিল। প্রফেসর সাহেব তার কথা শেষ করতে সবাই প্রশ্ন করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু তার আগেই প্রফেসর সাহেব হাত উঁচু করে সবাইকে শান্ত করলেন। তারপর বললেন : আপনারা আমাকে দু-একটা খুব সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করতে পারেন, এর বেশি নয়।
স্যার, আপনার নামটা কি জানতে পারি? প্রশ্ন করল একজন সাংবাদিক।
না আপনারা জানতে পারেন না। কারণ আমি চাই না আমার নাম প্রকাশ হোক। যদি চাইতাম তাহলে আজকের এই ঘটনার জন্য আমি বিশাল আনুষ্ঠানিকতা করতে পারতাম।
স্যার, দয়া করে আপনার ঠিকানাটা বলবেন কি? অন্য একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করল।
আমার মনে হয় তার কোনো প্রয়োজন নেই। নির্লিপ্ত উত্তর দিলেন প্রফেসর সাহেব।
রিবিট অর্থ কী? এবার অপর একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করল।
প্রফেসর সাহেব খানিকটা সময় নিলেন। তারপর বললেন : রিবিট কোনো অভিধানিক শব্দ নয়, তাই রিবিটের কোনো অভিধানিক অর্থ নেই। তবে আমি যখন রিবিটকে তৈরি করি, রিবিটের উদ্দেশ্য সংক্রান্ত যে-সকল শব্দ আমার মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে সেগুলো হল কল্যাণ, মঙ্গল, বন্ধু, আশীর্বাদ, উপকার, সাহায্য, শান্তি, সুখ, আনন্দ, সত্য, উৎসর্গ, সেবা ইত্যাদি। তাই রিবিটের অর্থকে যে-কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
তারপরও আপনার পছন্দের অর্থ কোনটি অর্থাৎ আপনি কোন অর্থকেই বেশি পছন্দ করবেন?
প্রফেসর সাহেব এবারো খানিকটা সময় নিলেন। তারপর টেনে টেনে বললেন : আমার কাছে রিবিট অর্থ কল্যাণ।
প্রফেসর সাহেব এবার খুব দ্রুত বললেন। আমি বিশ্বাস করছি আপনারা প্রশ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন। তাই আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। আপনারা আপনাদের সকল প্রশ্ন রিবিটকেই করবেন।
প্রফেসর সাহেব একটু থামলেন। তারপর বললেন : এখন আপনাদের সকলকে অনুরোধ করব পিছনে আমার গাড়ির দিকে ফিরে তাকাতে। আপনারা এখন যাকে দেখতে পাবেন সে-ই ‘রিবিট’।
মুহূর্তেই সকল সাংবাদিক পিছনে ফিরে তাকাল। তারা দেখল, প্রফেসর সাহেবের পুরোনো মডেলের গাড়ির পিছনের একটা দরজা খুলে গেল। সেখান দিয়ে প্রথমে একটা চকচকে ধাতব পা বাইরে বেরিয়ে এল, তারপর অন্য একটা পা, তারপর মাথা এবং সবশেষে ধাতব শরীর। যখন সম্পূর্ণ ধাতব শরীরটা বাইরে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল তখন সবারই চোখ কপালে ওঠার অবস্থা, বিস্ময়ে সবাই যেন হতভম্ব হয়ে গেল।
শুধু সেই তরুণ সাংবাদিক বিড়বিড় করে বলল : ‘রি..বি..ট।’
২
রিবিট দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। চকচকে সিলভার রঙের ধাতব শরীরের মাঝে হালকা কালোরঙের উপস্থিতি যেন পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতার রিটিকে বিশেষ শৈল্পিক অবয়ব দিয়েছে। রিবিটের শারীরিক গঠনই বলে দিচ্ছে কী নিখুঁতভাবেই না তাকে তৈরি করা হয়েছে। তার দেহ ধাতুর তৈরি হলেও বোঝার মোটেও উপায় নেই যে কীভাবে একটি ধাতুর সাথে অপর একটি ধাতুর সংযোগ দিয়ে তাকে তৈরি করা হয়েছে। মাথা কিছুটা গোলাকার হলেও অনেকটা মানুষের মতোই। চোখদুটো অদ্ভুত সুন্দর, কেমন নীলচে আভা রয়েছে চোখের মধ্যে, দেখলে মনে হবে বুঝি মায়ায় ভরা। চোয়াল যেন দৃঢ় আত্মবিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। চাওড়া কাঁধ আর ধাতব বাহু স্পষ্ট পেটা-শরীরের প্রতিচ্ছবি। উঁচু বুক আর টান টান ঘাড় যেন সত্য আর ন্যায়ের প্রতীক। চিকন কোমর আর চওড়া ধাতব পা প্রমাণ করে কী অকল্পনীয় শক্তির অধিকারী রিবিট।
উপস্থিত সকল সাংবাদিক শুধু বিস্ময় নিয়ে দেখছে রিবিটকে। তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তারা যা-কিছু দেখছে তা কি বাস্তব নাকি স্বপ্ন। রিবিট যে গাড়ি থেকে নেমে এতদূর পর্যন্ত হেঁটে এসেছে এ তারা লক্ষ্যই করেনি। যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তারা নড়তেও ভুলে গেছে।
গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দে সবাই বাস্তবে ফিরে এল। রাস্তার দিকে তাকাতে দেখল প্রফেসর সাহেব তার গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছেন। দুজন সাংবাদিক দৌড় দিয়েও শেষপর্যন্ত থেমে গেল। তারা বুঝতে পারল এখন আর প্রফেসর সাহেবকে ধরা সম্ভব হবে না। তার গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
সাংবাদিকরা যে-যার ক্যামেরায় ক্লিক করতে ব্যস্ত। ডানে বায়ে, সামনে পিছনে, উপর নিচে, যে যেভাবে পারছে রিবিটের ছবি তুলছে। একজন সাংবাদিক মোবাইলে ফোন করে টিভি, রেডিও, পত্রিকা এবং অন্যান্যদের সংবাদ দিচ্ছে। দুজন আবার গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে রিবিটকে। অন্য একজন ততক্ষণে তার ভিডিও ক্যামেরা বের করেছে। যে করেই হোক আজ রাতে টেলিভিশনে রিবিটের ওপর তার সরাসরি একটা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা চাই। তাছাড়া রিবিটের সাথে প্রথম সাক্ষাতের বিরল ঘটনাটি সে ভিডিও করে রাখতে চাচ্ছে। ইতিমধ্যে একটা ভুল অবশ্য সবাই করে ফেলেছে। প্রফেসর সাহেবের সাক্ষাৎকার তো ভিডিও করেইনি, এমনকি একটা ছবি পর্যন্তও তারা তোলেনি। তাই আর কেউ কোনো ভুল করতে চাচ্ছে না। সাংবাদিকদের ব্যস্ততা দেখে বোঝা যাচ্ছে এ-বছর হয়তো আজকের ঘটনাই হবে সবচেয়ে আলোচিত এবং আলোড়িত ঘটনা।
সকল সাংবাদিক যখন রিবিটের সামনে এসে দাঁড়াল তখন তারা কিছুটা দ্বিধান্বিত। কীভাবে রিবিটের সাথে কথা শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অবশেষে সেই তরুণ সাংবাদিকই প্রথম প্রশ্ন করল : রিবিট, আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমরা কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
রিবিট কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। তারপর শুধু উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল।
সাথে সাথে সাংবাদিকরা একটার-পর-একটা প্রশ্ন করতে শুরু করল। রিবিট, আপনার মূল লক্ষ্য কী? রিবিট, আপনার ক্ষমতা কতটুকু? আপনি এখন কেমন অনুভব করছেন? আপনার কি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে? আপনি কোথায় অবস্থান করবেন? দেশের উন্নতিতে আপনি কী ভূমিকা রাখতে পারবেন? আপনার…প্রশ্নের যেন শেষ নেই।
রিবিট শুধু প্রশ্ন শুনেই যাচ্ছে, কিন্তু কোনো উত্তর দিচ্ছে না। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে যখন হাঁপিয়ে উঠল তখন শুধু প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিল রিবিট। সে সকল সাংবাদিকের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল : মানবকল্যাণই আমার মূল লক্ষ্য।
রিবিটের উত্তরে সকল সাংবাদিক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। রিবিটের গলার স্বর অবিকল মানুষের মতো। কথা বলার ধরন একটু ধীর হলেও উচ্চারণ স্পষ্ট। প্রতিটা শব্দ সে আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারণ করছে।
রিবিট এবার বলল : আমি যতদূর সম্ভব আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করব। তবে অবশ্যই আপনারা একটি একটি করে প্রশ্ন করবেন। পাশাপাশি আমার সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে। গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার কারণে আমার পক্ষে আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা সম্ভব নাও হতে পারে।
রিবিট, আপনি কি এই মুহূর্তে আপনার অনুভূতির কথা বলবেন? রিবিটের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রশ্ন করল একজন সাংবাদিক।
আমার খুব ভালো লাগছে। কারণ এ-মুহূর্ত থেকে আমি মানবসেবার সুযোগ পাচ্ছি। তাছাড়া মানুষের সাথে বসবাসেরও বিরল সুযোগ লাভ করতে যাচ্ছি আমি।
আপনার এই কয়েক মুহূর্তের অভিজ্ঞতায় মানুষ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
মানুষ আমার কাছে সবসময়ই সৃষ্টির সেরা জীব, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। মানুষকে আমি সবসময়ই শ্রদ্ধা এবং সম্মান করি। আমার কাছে মানুষের অবস্থান সবার উপরে।
আপনি কি আপনার জীবনের চেয়েও মানুষের জীবনকে বেশি মূল্যবান মনে করেন? অন্য একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করল।
আপনি ভুল করছেন, আমার কোনো জীবন নেই। আমি একটি প্রোগ্রাম যা। মানুষেরই সৃষ্টি। কাজেই আমার সাথে মানুষের জীবনের তুলনা শুধুই বোকামি। যে মানুষ আমাকে সৃষ্টি করেছে, যে মানুষ আমার প্রোগ্রামকে সক্রিয় করেছে, যে মানুষ আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে, সেই মানুষের জীবন অবশ্যই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। এখন আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন মানুষের জীবনের তুলনায় আমার প্রোগ্রাম নিতান্তই সামান্য।
আপনি কীভাবে মানুষের কল্যাণ বা মঙ্গল সাধন করতে চাচ্ছেন? অন্য একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করল।
আমি জানি না। আমার দৈনন্দিন জীবনে যেভাবে সম্ভব সেভাবে আমি মানুষকে সহায়তা করার চেষ্টা করব।
আপনি কি আর্থিকভাবে মানুষকে সাহায্য করবেন?
আমি আর্থিকভাবে মোটেও সচ্ছল নই। এ মুহূর্তে আমার কাছে তিনশো তেত্রিশ টাকা আছে। এই টাকায় আর্থিকভাবে যদি কোনো মানুষকে সহায়তা করা সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই আমি তা করব।
এবার পিছন থেকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করল: মানুষের উপকারের ক্ষেত্রে আপনার কি কোনো পছন্দ রয়েছে?
মানুষ আমার কাছে সবাই সমান। আমার কাছে কোনো ধনী-গরিব, নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত বলতে কিছু নেই। তবে শিশু-কিশোররা আমার কাছে সবসময়ই প্রিয়। ওরা নিষ্পাপ, প্রাণবন্ত, উচ্ছল এবং হাসিখুশি। আমি ওদের সাথেই সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করব। আমার প্রোগ্রামে শিশু-কিশোরদের জন্য অতিরিক্ত ভালোবাসার ব্যবস্থা রয়েছে। শিশু-কিশোরদের ভালোবাসতে পারলে, ওদের উপকার করতে পারলে আমি নিজেও আনন্দিত হব।
এবার বেশ বয়স্ক একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করল : রিবিট, আপনি নিজের জন্য কী সম্বোধন শুনতে পছন্দ করবেন?
আমি চাই সবাই আমাকে ‘রিবিট’ বলে ডাকবে এবং তুমি বলে সম্বোধন করবে।
প্রেসক্লাবে ধীরে ধীরে সাংবাদিকদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। প্রধান প্রধান টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরাও ইতিমধ্যে খবর পেয়েছে। তাদের কেউ কেউ ক্যামেরাসহ পৌঁছেও গেছে। পত্রিকার সাংবাদিকরা দ্রুত প্রতিবেদন লিখতে বসেছে, যে করেই হোক আগামীকালের পত্রিকায় রিবিটের সংবাদ প্রচারিত হওয়া চাই-ই-চাই।
এদিকে সাংবাদিকরা রিবিটকে একের পর-এক-প্রশ্ন করে চলেছে। একজন সাংবাদিক বলল : আপনি কি আপনার অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে কিছু বলবেন?
আমি সত্যিই দুঃখিত। এ সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রদান করার অনুমতি নেই।
তাহলে কি প্রোগ্রাম ইপি সম্পর্কে কিছু বলবেন? যদিও প্রফেসর ইপি সম্পর্কে আমাদেরকে বলেছেন, আমরা ইপি সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাই।
রিবিট একবার সবার দিকে তাকাল। তারপর বলল : হ্যাঁ, ইপি সম্পর্কে কিছু তথ্য আপনাদের জানাতে পারি। ইপি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অথচ সহায়ক প্রোগ্রাম। ইপি অর্থ Entire Protocol, যার মূল কাজ হচ্ছে আমার যাবতীয় কাজের সমন্বয় সাধন করা, আমাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা, আমাকে তথ্য প্রদান করে সহায়তা করা, প্রয়োজনে আমার সাথে যুক্তিতর্কে লিপ্ত হওয়া, আমার কাজকে দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে সাহায্য করা, আমাকে সতর্ক করে দেয়া, আমাকে দিকনির্দেশনা দেয়া, এমনকি আমার সাথে রসিকতা করা এবং আরো অনেক অনেক কিছু। বলতে পারেন ইপি আমার মূল সঙ্গী। প্রতিটি মুহূর্তে আমি ইপির ওপর নির্ভর করি। আমি যা দেখি ইপিও তাই দেখে, আমি যা শুনি ইপিও তাই শোনে। এমনকি ইপি আমার শরীরের অভ্যন্তরে নেটওয়ার্কের মধ্যে যে-কোনো সময় যে-কোনো স্থানে বিচরণ করতে পারে। ইপি প্রয়োজনে আমার ই-মেইল পরীক্ষা করতে পারে, আমাকে যে-কোনো তথ্য প্রেরণ করতে পারে, আমাকে যে কোনো পরামর্শ প্রদান করতে পারে। এ সকল কারণে ইপির সাথে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমি সহজেই ইপির সাথে আলোচনা করতে পারি। এ আলোচনা আমার সিদ্ধান্তের সঠিকতা নিরূপণে খুব সাহায্য করে। তবে হ্যাঁ, ইপি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে ইপি আমার লাইব্রেরি, আমার জ্ঞানের ভাণ্ডার। পৃথিবীর সকল প্রয়োজনীয় তথ্য ইপির অভ্যন্তরে সংরক্ষিত রয়েছে। যেহেতু আমি ‘রিবিট’ অনেক বড় একটি প্রোগ্রাম এবং আমার দৈনন্দিন সকল তথ্য আমার মেমোরিতে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত থাকে সেহেতু পৃথিবীর সকল তথ্য বা জ্ঞানকে আমার মেমোরিতে সংরক্ষণ করা হয়নি। যদি তাই করা হত তাহলে আমার মেমোরি খুব তাড়াতাড়ি পূর্ণ হয়ে যেত এবং তখন আমি দৈনন্দিন তথ্য সংরক্ষণ করতে পারতাম না। এ-কারণেই সকল জ্ঞান বা বিদ্যাকে ইপির অভ্যন্তরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমার তুলনায় ইপি খুব ছোট প্রোগ্রাম হলেও আমার কাছে ইপির গুরুত্ব অপরিসীম। যদিও ইপি আমার নিয়ন্ত্রণে, ইপি তার যুক্তিতর্ক দিয়ে আমার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ আমার মধ্যে অনুভূতি রয়েছে। তাই আমি ইপি কর্তৃক প্রভাবিত হই, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হই না।
মাঝবয়সী একজন সাংবাদিক এবার অনুরোধের সাথে বলল : রিবিট, আপনি কি এমন কিছু করবেন যা আমাদেরকে বিমোহিত বা মুগ্ধ করে?
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
যেমন ধরুন, মোটা একটা লোহাকে ভেঙে ফেললেন কিংবা আমার ব্যাগ আপনার চোখের সাহায্যে স্ক্যান করে বলে দিলেন ব্যাগের মধ্যে কী আছে অথবা পাঁচ মিনিটে একটা বই পড়ে ফেললেন অথবা…
আমি দুঃখিত, এ-ধরনের কাজ আমি করব না। আমার এ-কাজ আপনি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছেন, মানবসেবার দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়। আপনাদের সকলকে এ-ধরনের অনুরোধ করা থেকে বিরত থাকতে বলছি।
এবার অন্য একজন সাংবাদিক বলল : আমরা যতদূর জানি আপনার কিছু অতিমানবীয় ক্ষমতা রয়েছে। এই অতিমানবীয় ক্ষমতার কারণে আপনি মোটা বেতনের খুবই সম্মানজনক চাকুরি পেতে পারেন। আপনি কি এ-ধরনের চাকুরি করবেন?
সম্ভবত না। কারণ আমার প্রয়োজন অতিসামান্য। তাই অতিরিক্ত বা মোটা বেতনের কোনো কাজ আমার প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া আমাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে আমার জন্য যেন কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অর্থাৎ আমার কর্ম যেন অন্য কাউকে কর্মহীন করে না তোলে।
রিবিট, আপনার সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে আপনার মূল উদ্দেশ্য মানুষের মঙ্গল বা কল্যাণ সাধন করা। কিন্তু সমস্যাজর্জরিত আমাদের এই সমাজব্যবস্থার কতটুকু মঙ্গল আপনি করতে পারবেন বলে আপনি মনে করছেন? কিছুক্ষণ পূর্বে আসা একজন সাংবাদিক প্রশ্নটি করল।
রিবিট একটু সময় নিল। তারপর বলল : দেখুন, সমাজ মানুষেরই সৃষ্টি। তাই সমাজ উন্নয়নের দায়িত্ব যেমন মানুষের, তেমনি সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বও মানুষের। আমি রিবিট, অনুভূতিসম্পন্ন একটি যান্ত্রিক রোবট, মানুষের উপর অর্পিত সমাজগঠনের মহান গুরুদায়িত্বের কতটুকুই-বা পালন করতে পারব? কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষকে আমি সহায়তা করতে পারব মাত্র, এর বেশিকিছু নয়। মানুষের সমাজের দায়িত্ব মানুষকেই নিতে হবে। সেখানে আমার ভূমিকা হবে নগণ্য, অতি নগণ্য। তারপরও যদি আমি একজন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে একবেলা অন্ন তুলে দিতে পারি, একজন অন্ধমানুষকে রাস্তা পার করে দিতে পারি, একটি গরিব শিশুকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে পারি, একজন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি, একজন অপরাধীকে ধরতে পারি, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করে তুলতে পারি, একজন দুঃখী মানুষের জন্য কিছু করতে না-পারলেও যদি তাকে সান্ত্বনা দিতে পারি, তার দুঃখে দুঃখী হতে পারি, এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিতে পারি, তাও বা কম কিসের? আমি এই সামান্যতেই সন্তুষ্ট হব।
রিবিটের কথায় উপস্থিত সকল সাংবাদিক কিছুক্ষণের জন্য যেন থমকে গেল। কেউ কিছু বলছে না দেখে রিবিট আবার বলল : আমি আপনাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। আর মাত্র একটি প্রশ্নের উত্তর দেব। আমার অনুরোধ ঐ প্রশ্নের পর আপনারা আমাকে আর-কোনো প্রশ্ন করবেন না।
রিবিটের কথা শেষ না-হতেই ভিড়ের মধ্যে থাকা একজন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করল : রিবিট আপনার দেশের নাম কী?
রিটি লক্ষ্য করল সবাই তার দিকে উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের সবার চোখে যেন একই আকাঙ্ক্ষা, একই আবেদন। তবে কারো কারো চোখে শঙ্কাও রয়েছে আদৌ সে তাদের মনের আশাকে পূরণ করে কিনা।
রিবিট খুব দৃঢ় আর স্পষ্ট গলায় জোর দিয়ে বলল : আমার দেশের নাম ‘বাংলাদেশ।
মুহূর্তেই উপস্থিত শত শত মানুষ একসাথে চিৎকার করে উঠে বলল। ‘বাংলাদেশ’।
৩
অনেক মানুষ ভিড় করেছে প্রেসক্লাবে। এ মুহূর্তে মানুষের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কয়েকটি টিভি-চ্যানেল রিবিটের আবির্ভাবের ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করায় অনেকে বাসা থেকে সরাসরি প্রেসক্লাবে চলে এসেছে। সবার ইচ্ছা একনজর রিবিটকে দেখা। রিবিট অবশ্য উল্লেখযোগ্য আর-কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। প্রত্যেকটি টিভি-চ্যানেলই তার আলাদা সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছে, কিন্তু সে আলাদাভাবে কাউকেই সাক্ষাৎকার দেয়নি। তবে সে ছবি তুলতে দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। যে যেভাবে চাচ্ছে, রিবিট তার সাথে সেভাবেই ছবি তুলছে। এতে অবশ্য সবাই খুব খুশি। বিশেষ করে যারা বাসা থেকে এসেছে তারা তো মহাখুশি। আর যারা সাথে ক্যামেরা আনেনি তারা যে শুধু আফসোস করেই কাটাচ্ছে তা নয়। রিবিটের সাথে টুকটাক কথা বলে, রিবিটকে ছুঁয়ে দেখে আনন্দ উপভোগ করছে। দু-একজনের ভয় থাকলেও সবার মধ্যে কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব। অনেকে রিবিটকে তাদের বাসায় আমন্ত্রণও জানাচ্ছে। কেউ কেউ চকোলেটও দিচ্ছে। অবশ্য রিবিট সকল খাবারই প্রত্যাখ্যান করছে, কারণ সে কোনো খাদ্য গ্রহণ করে না।
রিবিট যখন বুঝতে পারল যতক্ষণ পর্যন্ত সে প্রেসক্লাবে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ভিড় কমবে না, তখন সে প্রেসক্লাব ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিল। প্রথমে সে পল্টন দিয়ে হেঁটে গুলিস্তানের দিকে এগোতে থাকল। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সাংবাদিকরা তার পিছু ছাড়ছে না। তারা তাকে নিয়ে টেলিভিশনে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। মাঝে মাঝে রিবিট তার নিজস্ব টিভি-নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেই অনুষ্ঠান দেখছে। যেহেতু রিবিট রাস্তা দিয়ে হাঁটছে সেহেতু টেলিভিশনে তার ছবি ছাড়া আর কিছু দেখানোর নেই। তবে টিভি-চ্যানেলগুলোর লোকজন খুবই তৎপর। তারা ফাঁকে ফাঁকে উপস্থিত দর্শনার্থীর সাক্ষাৎকার নিচ্ছে আর তা প্রচার করছে।
একেকজন একেকভাবে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করছে। কেউ বলছে, ‘আমি ধন্য, আমি রিবিটের সাথে হ্যান্ডশেক করেছি’। অন্য একজন বলছে, ‘আমি কল্পনাও করতে পারিনি আমি রিবিটের দেখা পাব, অসাধারণ!!!’ বেচারা চোখমুখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকি দিয়ে এমনভাবে ‘অসাধারণ বলল : মনে হল টিভি-ক্যামেরা বুঝি কেঁপেই উঠল’। মাঝবয়সী এক ছেলেকে কোনো প্রশ্ন না-করা হলেও সে টিভি ক্যামেরার সামনে লাফ দিয়ে উঠে বলল : ‘রিবিট, রিবিট আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমার বন্ধু।
এদিকে অন্য একটি চ্যানেলে বারো-তেরো বছরের এক মেয়েকে দেখা গেল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘আমি আব্বকে এত করে বললাম ক্যামেরা আনতে, কিন্তু সে আনল না। এখন আমি রিবিটের সাথে ছবি তুলতে পারলাম না..হু..হু..হু…।’ আট বছরের একটি ছেলে চিৎকার করে বলল : আমি রিবিটকে আমাদের বাসায় আসতে বলেছি, রিবিট বলেছে সে আসবে।’ এগারো বছরের একটি ছেলে ক্যামেরার সামনে চোখমুখ বড় করে বলল : ‘রিবিট আমার নাম মুখস্থ করে ফেলেছে, আমাকে বন্ধু বলেছে, হু..হু..র…রে’। তেরো বছরের একটি মেয়ে কাগজ উঁচু করে বলল : ‘এই যে আমি এখানে রিবিটের ছবি এঁকেছি।’ পাশ থেকে অন্য একজন মুখ বাড়িয়ে বলল : ‘আমি রিবিটের অটোগ্রাফ নিয়েছি।’ পাশেই পাঁচ-ছয় বছরের ছোট্ট একটি ছেলেকে কাঁদতে দেখা গেল। ছেলেটিকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে সে শুধু কাঁদতেই থাকল। পাশ থেকে তার বাবা বলল : দেখুন তো ভাই, কী সমস্যাই না পড়লাম, ছেলে রিবিটকে সাথে না নিয়ে বাসায় যাবে না। ব্লিবিট নাকি তার সুপারম্যান, কি যন্ত্রণা!
এভাবেই বিভিন্ন জনের বিভিন্ন অভিমত প্রচার হচ্ছিল টিভি-চ্যানেলগুলোতে। কেন যেন এই অভিমত বা প্রতিক্রিয়া প্রচারের ক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদেরই বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছিল।
গুলিস্তান ঘুরে স্টেডিয়াম হয়ে পল্টন আর কাকরাইল পার হয়ে রিবিট যখন ঘুরপথে রমনা পার্কের কোণায় এসে পৌঁছাল, ততক্ষণে একজন তরুণ সাংবাদিক
ছাড়া সবাই চলে গেছে। রিবিট লক্ষ্য করেছে এই তরুণ সাংবাদিক প্রথম থেকেই তাকে অনুসরণ করছে। সে তার হাঁটা থামিয়ে বলল : আপনি এখনো আছেন যে?
হ্যাঁ, আমি অনেক আগে থেকেই আছি। প্রফেসর সাহেবের বক্তব্যের সময়ও আমি ছিলাম।
আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এখনো কেন? সবাই তো চলে গেছে।
আমি আপনার ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে চাই। এজন্য আপনার অনুমতি চাচ্ছি।
সবাই তো করতে চাচ্ছে এবং করবে। আপনিও করুন, এতে অসুবিধার কিছু নেই। আমার মনে হয় আপনি প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য যথেষ্ট তথ্য পেয়েছেন।
হ্যাঁ পেয়েছি। কিন্তু আমি ভিন্ন অর্থাৎ নতুন কিছুর সন্ধান করছি।
চমৎকার। আমি বুঝতে পারছি আপনি খুব ভালো সাংবাদিক। আপনার সাথে তো আমার পরিচয় হলো না?
আমার নাম সাইফ। একমাস হলো চ্যানেল ফোকাসে যোগ দিয়েছি। আমি মূলত রিপোর্টার।
কিন্তু আপনাকে তো খুব কমবয়সী মনে হচ্ছে। আমার বিশ্বাস আপনার বয়স আঠারো কি বিশ, এমনকি তার থেকেও কম হতে পারে।
রিটি আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে জার্নালিজম-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে চ্যানেল ফোকাসে পার্টটাইম চাকুরি করছি।
সাইফ আপনাকে অভিনন্দন। আমি আশা করছি আপনি ভবিষ্যতে ভালো করবেন। আর হ্যাঁ দুঃখিত, আমি আপনাকে সাংবাদিক ভেবেছিলাম।
আপনি আমাকে রিপোর্টার কিংবা সাংবাদিক দুটোই বলতে পারেন। তাছাড়া এ দুটো শব্দের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকলেও পেশাগত কাজের ধরনে খুব একটা পার্থক্য নেই।
আপনার কথা শুনে ভালো লাগল সাইফ। আমি আপনাকে সাইফ বলেই ডাকব। আর পেশাদারিত্বের দিক থেকে সাংবাদিক। তাহলে সাংবাদিক সাইফ। আর এখন থেকে আমরা বন্ধু, ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে। রিবিটের বন্ধুত্বের প্রস্তাবে সাইফের চোখদুটো আনন্দে চিকচিক করে উঠল।
তাহলে আমরা একে অন্যকে তুমি করে বলব। আপনি কি রাজি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই রাজি।
তাহলে আজ এখানেই বিদায়। এই বলে রিবিট চলে যাচ্ছিল। কিন্তু পিছন থেকে সাইফ ডেকে উঠল, রিবিট!
রিবিট ঘুরে দাঁড়াল। বলল : কিছু বলবে?
আপনি কি আমার ছোট্ট একটা উপকার করবেন?
রিবিট বেশ অবাক হল। বলল : বলো কী উপকার? তবে তার আগে তুমি আমাকে অবশ্যই তুমি করে বলবে।
হ্যাঁ ঠিক আছে। আপনি মানে তুমি..যদি…আ…
ইতস্তত করছ কেন? বলো।
তুমি যদি আমাদের টেলিভিশনে একটা সাক্ষাৎকার দিতে..।
না সাইফ। আমি এ মুহূর্তে-এ-ধরনের কোনো সাক্ষাৎকার দিতে চাচ্ছি না। পাশাপাশি তোমাকে আরো একটা অনুরোধ করতে চাই। তোমার আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের, আমরা আমাদের এই সম্পর্ককে কখনো নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করব না। তবে হ্যাঁ, যদি মানুষের উপকারের জন্য এই সম্পর্ককে ব্যবহার করতে হয় তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।
রিবিট তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।
না, আমি ভুল বুঝছি না। আমার খুব সৌভাগ্য যে তোমার মতো একজন তরুণ এবং উদ্যমী ছাত্রের সাথে আমার প্রথম বন্ধুত্ব হল যে কিনা একই সাথে ছাত্র এবং চাকুরিজীবী। আমি আমাদের এই সম্পর্কের জন্য গর্ববোধ করছি।
রিবিট তুমি সত্যিই অসাধারণ। আমি তোমার কথায় সত্যি মুগ্ধ। কখনো যদি আমি তোমার কোনো উপকারে আসতে পারি তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।
তোমাকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। হয়তো অল্পসময়েই তোমাকে আমার প্রয়োজন হবে। এখন তোমার মোবাইল নম্বর বলো যেন প্রয়োজনে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি।
সাইফ তার মোবাইল নম্বর বললে রিবিট তা হুবহু বলল। সাইফ অবাক হয়ে বলল : তুমি একবার শুনেই আমার নম্বরটা মুখস্থ করে ফেলেছ?
হা সাইফ, তোমাকে মনে রাখতে হবে আমি একটি রোবট। এরকম লক্ষ লক্ষ নম্বর আমার মেমোরিতে নামসহ সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং মুহূর্তের মধ্যে তা মনে করাও সম্ভব।
হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু প্রয়োজনে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করব কীভাবে?
তুমি আমার ই-মেইল আইডি লিখে নাও, [email protected]। যে। কোনো প্রয়োজনে আমাকে মেইল করবে।
কিন্তু তুমি যদি উত্তর না দাও?
অবশ্যই দেব। আমি প্রতি মিনিটে একবার আমার ই-মেইল পরীক্ষা করি। যদি কোনো কারণে ব্যস্ত থাকি তাহলে ইপি করে। কাজেই তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। যদি তোমার মেইল গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে এক মিনিটের মধ্যেই আমার উত্তর পাবে।
ধন্যবাদ রিবিট।
সাইফ তোমাকেও ধন্যবাদ। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেখা হবে। শুভ রাত্রি।
শুভ রাত্রি।
সাইফ চলে যেতে রিবিট কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ঘড়ি দেখল। রাত দুটো বাজে। এই প্রথম সে একা হতে পারল।
ডানে বামে তাকিয়ে রিবিট নিশ্চিত হল কেউ আছে কিনা। না, দু-পাশেই রাস্তা একেবারে ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। এ মুহূর্তে সে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। একবার ভাবল রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করবে, আবার ভাবল পাশেই পার্কের মধ্যে ঢুকে যাবে। সে যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে তখন অনেক দূরে পুলিশের একটি টহল গাড়িকে আসতে দেখল। অনেক চেষ্টার পর সে একাহতে পেরেছে, এ মুহূর্তে আর অন্য কারো সামনে পড়তে চাচ্ছে না। এই ভেবে সে ডানে মোড় নিয়ে পার্কের মধ্যে ঢুকে গেল।
পার্কের ভিতরে ঢুকে রিবিট একটা বড় গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। চারপাশটা কেমন যেন অন্ধকার। তবে তার ভালোই লাগছে। গভীর রাতে বিশাল গাছের নিচে একরকম প্রশান্তি অনুভব করছে সে।
রিবিট একটু সময় নিল, তারপর ডেকে উঠল : ইপি!
সাথে সাথে মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠ উত্তর দিল : বলো রিবিট।
জায়গাটা খুব সুন্দর, তাই না?
হ্যাঁ খুব সুন্দর।
এটাই তো রমনা পার্ক
আমি কিছুক্ষণ আগেও ঢাকার ম্যাপ পরীক্ষা করেছি। তোমার ধারণাই ঠিক, তুমি এখন রমনা পার্কে রয়েছ। তুমি কি এখানে অপেক্ষা করতে চাচ্ছ?
না ইপি। আমি কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। প্রফেসর হককে ফোন করব কিনা? তিনি তো আমাকে কিছু না বলেই চলে গেলেন।
তোমার সাথে তো তার এমনই কথা ছিল।
তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু এ-মুহূর্তে তাকে আমার খুব ফোন করতে ইচ্ছে করছে।
এ মুহূর্তে তাকে ফোন করার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। তিনি তোমাকে বারবার বলে দিয়েছেন তাকে অযথা ফোন না-করার জন্য। একমাত্র তোমার যদি কোনো যান্ত্রিক সমস্যা হয় তাহলেই তাকে ফোন করতে পারবে বা তার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।
ইপি, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ব্যাপারটা আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টের। যে আমাকে সৃষ্টি করল, যে আমার জন্য সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করল, যে আমার জন্য সংসার পর্যন্ত করেনি, নিজের সুখের কথা ভাবেনি, তার প্রতি আমার কি কোনো দায়িত্ব থাকতে পারে না?
অবশ্যই পারে। কিন্তু তোমাকে মনে রাখতে হবে ত্রিশ বছর গবেষণার পর প্রফেসর হক এখন বিশ্রামে আছেন। এ কারণেই তোমার উচিত হবে না বিশ্রামের সময় তাকে বিরক্ত করা।
তাহলে তুমি বলছ এখন ফোন না-করার জন্য?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমি যে ভালো আছি সেটা তো প্রফেসর হককে জানাতে হবে।
তার বোধহয় প্রয়োজন হবে না। প্রফেসর হক তার ট্র্যাকিং মেশিনের সাহায্যে এবং জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম প্রযুক্তির মাধ্যমে সবসময়ই তোমার অবস্থান জানতে পারছেন। বাংলাদেশের যেখানেই তুমি থাকো না কেন তিনি তা বুঝতে পারবেন। আর তুমি যদি কোনো বিপদে পড়তে তাহলে নিশ্চয় তাকে সাহায্য সংকেত পাঠাতে। তাছাড়া উনি নিশ্চয় টিভিতে এতক্ষণ তোমার ওপর নির্মিত অনুষ্ঠানগুলো দেখেছেন। কাজেই তিনি নিশ্চিত তোমার কোনো বিপদ হয়নি।
এরপর দুজনেই চুপ হয়ে গেল। রিবিট এবং ইপি দুজন দুজনের সাথে দুভাবে কথা বলতে পারে। মানুষের মতো শব্দ করে, আবার অভ্যন্তরীণ প্রোগ্রাম টু প্রোগ্রাম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এতক্ষণ তারা অভ্যন্তরীণ প্রোগ্রাম টু প্রোগ্রাম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কথা বলছিল। এবার রিবিট মানুষের মতো শব্দ করে কথা বলল : ইপি আমার মনে হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, অন্য দিকে যাই। কোন্ দিকে যেতে পারি বলো তো?
তুমি সোজা হাঁটতে পারো। সামনেই তুমি রমনা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট পাবে। তারপর রমনার বটমূল। তারপর লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে সামনে অগ্রসর হতে পারো।
আমিও ঠিক তাই ভাবছিলাম।
এই বলে রিবিট হাঁটতে শুরু করল। তারপর হঠাৎই প্রশ্ন করল : আচ্ছা ইপি, আজকের ঘটনা সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? এই যে আমি ঢাকা শহরে হঠাৎই উদয় হলাম, এতে মানুষ কী মনে করছে?
আমার লজিকের সার্বিক বিশ্লেষণে এটাই প্রকাশ পাচ্ছে যে সবাই তোমাকে স্বাগত জানিয়েছে। মানুষের মাঝে তোমার আবির্ভাবকে মানুষ অলৌকিক কিছু ভাবছে কিনা জানি না, তবে তারা আনন্দিত এবং খুশি হয়েছে। মানুষ তোমাকে কীভাবে গ্রহণ করবে তা নির্ভর করবে তোমার আগামী কয়েক দিনের কর্মকাণ্ডের ওপর। তাই তোমার সম্পর্কে মানুষের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে প্রাথমিকভাবে তুমি সন্তোষজনক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছ।
ধন্যবাদ ইপি। আশা করছি আমি মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জন করতে পারব।
৪
রিবিট রমনা পার্কের উত্তর পাশ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। তারপর শাহাবাগ থেকে ফার্মগেটের দিকে চলে যাওয়া রাস্তা পার হয়ে পরীবাগের সরু রাস্তার মাথায় এসে দাঁড়াল। কোন দিকে যাবে সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় নিল। তারপর পরীবাগের রাস্তা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে শুরু করল।
খুব বেশি দূর এগোয়নি। হঠাৎই ‘ওয়া ওয়া অদ্ভুত শব্দে থমকে দাঁড়াল রিবিট। আবারো ওয়া ওয়া শব্দ কানে এল তার। সাথে সাথে সে ডেকে উঠল : ইপি?
বলো রিবিট।
তুমি নিশ্চয় শব্দটা শুনতে পেয়েছ?
হ্যাঁ পেয়েছি।
নিশ্চয় মানুষের বাচ্চার কান্না?
হ্যাঁ তুমি ঠিকই ধরেছ।
কিন্তু এত রাতে এভাবে একটা বাচ্চা কাঁদছে কেন?
আমি সঠিক বলতে পারব না। তবে তুমি অনুসন্ধান করে দেখতে পারো।
তাই দেখতে হবে। শব্দটা বোধহয় ডানদিক থেকে আসছে।
হ্যাঁ তুমি সঠিক, এখান থেকে বিশ বাইশ গজ দূরে হবে।
রিবিট তার হাঁটার গতি বাড়াল। সে যেখানে এসে থামল সেখানে ডানপাশে বিশাল একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। আশেপাশের অন্য বাড়িগুলো একতলা কি দোতলা। এ মুহূর্তে রিবিট অবশ্য বাচ্চাটার কান্না শুনতে পাচ্ছে না। সে বেশ অবাক হয়ে বলল : ইপি, বাচ্চাটা হঠাৎ কান্না বন্ধ করে দিল কেন?
রিবিট আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। হয়তো বাচ্চাটি ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম থেকে উঠে মাকে দেখতে পায়নি, এজন্য কেঁদেছে। তারপর তার মা যখন আবার কাছে এসেছে তখন হয়তো কান্না থামিয়েছে।
তাহলে তো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমার মনে হল বাচ্চাটি আশেপাশে কোথাও কাঁদছে। মানে বলতে চাচ্ছি, কোনো বাড়ির মধ্যে নয়। বাড়ির মধ্যে হলে বাচ্চাটার গলা এত জোরালো হত না।
তুমি তাহলে ভালোমতো চারদিকটা পরীক্ষা করে দ্যাখো।
আশেপাশে তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
তাহলে হয়তো কোনো বাসায়ই হবে। হতে পারে বাসার জানালা খোলা ছিল, আর এ-কারণে কান্নার শব্দ আমরা খুব জোরালোভাবে শুনেছি। তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ আশেপাশের অনেক বাসার জানালাই ভোলা।
হ্যাঁ, কিন্তু সন্দেহ যাচ্ছে না। এই বলে রিবিট আবার হাঁটতে শুরু করল। রিবিট কেবল আটদশ গজ দূরে এসেছে ঠিক তখনই আবার কান্নার শব্দ কানে এল তার। এবার সে বলল : ইপি, আমি নিশ্চিত এই কান্নার শব্দ খুব কাছ থেকেই আসছে।
আমিও নিশ্চিত। তুমি খুব ভালোমতো খুঁজে দ্যাখো।
তাই দেখতে হবে। কিন্তু আশেপাশে একটা ডাস্টবিন ছাড়া তো আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
তুমি কান্নার উৎস ধরে এগোতে থাকো। দেখবে বাচ্চাটিকে পেয়ে গেছ। কারণ বাচ্চাটি এখনো কাঁদছে।
হ্যাঁ, আমি সেভাবেই এগোচ্ছি। মনে হচ্ছে…
কী মনে হচ্ছে…
মনে হচ্ছে কান্নার শব্দ ডাস্টবিনের মধ্যে থেকে আসছে।
তাই যদি হয় তাহলে ব্যাপারটা খুব রহস্যময় হবে।
হ্যাঁ ইপি, এখন আমি নিশ্চিত। ডাস্টবিনের মধ্যে থেকেই কান্নার শব্দ আসছে। ব্যাপারটা রহস্যময়ই বটে।
রিবিট খুব দ্রুত পা চালাল। ডাস্টবিনের কাছে এসে ভিতরে উঁকি দিলেও সে কিছু দেখতে পেল না। অথচ সে বাচ্চাটির কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এবার ডাস্টবিনের অন্যপাশে গেল। তখনই বাক্সটা তার চোখে পড়ল, সাধারণত টেলিভিশন বা কাঁচের জিনিসপত্র এ-ধরনের মোটা বাক্সে রাখা হয়। বাক্সের মধ্যে মোটা কাথার উপর একটা বাচ্চা। আরো ভালোমতো লক্ষ্য করতে বুঝল একটা নয় দুটো বাচ্চা। সাথে সাথে সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল : ইপি পেয়েছি, পেয়েছি, দুটো বাচ্চা।
রিবিট, আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি তাড়াতাড়ি ওদেরকে কোলে তুলে নাও।
রিবিট বাচ্চা দুটোকে কোলে তুলে নেয়ার সময় বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল : ইপি ওরা তো যমজ, একজনের সাথে অন্যজন সংযুক্ত।
তাইতো! আমিও দেখতে পাচ্ছি।
একটি বাচ্চার ডান পা অন্য বাচ্চাটির বামপায়ের সাথে কোমর পর্যন্ত সংযুক্ত। বাচ্চাদুটোর মাথাও কানের উপর একটির সাথে অন্যটি সংযুক্ত। একটি ছেলে, অন্যটি মেয়ে। ছেলেবাচ্চাটি কাঁদছে আর মেয়েবাচ্চাটি পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।
রিবিট তোমার কি মনে হচ্ছে দুটো বাচ্চাই সদ্য জন্মলাভ করেছে?
না ইপি। ওদের বয়স দুই থেকে তিন মাস হবে।
কিন্তু এ অবস্থায় ওদেরকে এখানে ফেলে গেল কে? প্রশ্ন করল ইপি।
সেটা তো আমারও প্রশ্ন! এমন জঘন্য কাজ কে করতে পারল? নিশ্চয় ওদের মা নয়?
সে-সম্ভাবনা খুব কম। নিজের সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা অদ্বিতীয়। নিশ্চয় অন্য কেউ করেছে।
ইপি এ প্রসঙ্গ থাক। এখন আমাদের এই বাচ্চাদুটোকে নিয়ে ভাবতে হবে। ওদের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। ওরা শীতে কাঁপছে। ঠাণ্ডা হওয়ারই কথা। তাপমাত্রা তত বেশ কম।
কী করি বলো তো? ওদের শরীরকে এখনই গরম করতে হবে, তা না হলে সমস্যাই হবে। কাঁথায় ওদের কিছুই হবে না।
রিবিট, আপাতত তুমি এক কাজ করো।
কী কাজ?
তুমি তোমার শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে থাকো। দেখবে বাচ্চাদুটো তোমার শরীরের সংস্পর্শে এলেই উষ্ণ হয়ে উঠবে। তখন আর ওদের শীত লাগবে না।
চমৎকার ইপি চমৎকার। আমি এক্ষনি আমার শরীরকে উত্তপ্ত করছি। আশা করছি ওরা আরাম পাবে।
দুমিনিটের মধ্যে রিবিট তার শরীরকে সহনীয় তাপে উত্তপ্ত করে ফেলল। বাচ্চাদুটোকে কথায় মুড়ে শরীরের সাথে চেপে ধরতে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাচ্চাদুটোর কাঁপা বন্ধ হল। রিবিট বেশ আনন্দিত হয়ে বলল : ইপি, বাচ্চাদুটোর কাঁপা বন্ধ হয়েছে। আমার খুব ভালো লাগছে ইপি। আমার মনে হচ্ছে আমি মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছি।
রিবিট তোমার আনন্দের মাত্রা আমি পরিমাপ করতে পারছি। চমৎকার রিবিট, এভাবেই তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে।
রিবিট এবার উল্লসিত হয়ে বলল : ইপি, ছেলেবাচ্চাটি ওর ছোট্ট হাত উঁচু করে আমার মুখ স্পর্শ করতে চাইছে। আর মেয়েবাচ্চাটি এখনো আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।
তুমি ওকে তোমার মুখ স্পর্শ করতে দাও।
ইপি আমি দিয়েছি, আমার সত্যিই খুব আনন্দ হচ্ছে। ইশ, কী সুন্দর দুটো বাচ্চা!
যদিও আমি তোমার আনন্দ উপলব্ধি করতে পারছি না, তবে তোমার মধ্যে সুষম ইলেট্রনপ্রবাহ দেখে তোমার আনন্দের মাত্রা বুঝতে পারছি। সম্ভবত বাচ্চাদুটো তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। তুমি ওদের ধন্যবাদ গ্রহণ করো, ওদের কৃতজ্ঞতার উত্তর দাও। তোমার হাত দিয়ে ওদের ছোট্ট কচি হাত ধরো। বুকের মধ্যে চেপে ধরে ওদেরকে আরো উত্তাপ দাও। ওরা তোমাকে ভালোবাসবে রিবিট। পৃথিবীতে মানবশিশুর ভালোবাসার মতো নিষ্পাপ আর সুন্দর ভালোবাসা আর নেই। তুমি খুব সৌভাগ্যবান। পৃথিবীতে আবির্ভাবের সাথে সাথে এই মানবশিশুর ভালোবাসা পাচ্ছ। এটা তোমার জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি। রিবিট, ওদেরকে সুখী করে তুমি আনন্দিত হও। এই আনন্দ উপভোগ করো রিবিট।
কিন্তু ইপি, আমি তো বাচ্চাদুটোর ভালোবাসা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারছি না। ছেলেবাচ্চাটি যে এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
তোমাকে ওর কান্নার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে এবং যে-কোনো উপায়ে হোক ওর কান্না থামাতে হবে।
বাচ্চাটি কাঁদছে কেন? বাচ্চাটির কান্না এখন আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি ওর কান্না থামাতে চাই।
ইপি, বলল : আমি এইমাত্র বাচ্চাদের কান্নার কারণ সম্পর্কে ইন্টারনেটের সকল তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। যে, সকল কারণ পেয়েছি তার প্রথমটি হল সম্ভবত বাচ্চাটি ক্ষুধার্ত। এজন্যই ও কাঁদছে। মেয়েবাচ্চাটির বোধহয় এখনো ক্ষুধা লাগেনি, তাই ও কাঁদছে না। কাজেই তোমাকে এখন বাচ্চাটির ক্ষুধা নিবারণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ইপি তোমার কথা যদি সত্য হয় তাহলে তো বেশ সমস্যাই হল। এত রাতে বাচ্চাদের খাবার পাব কোথায়? আর এত ছোট বাচ্চা, নিশ্চয় ওরা দুধ ছাড়া আর কিছু খেতে পারবে না।
তুমি ঠিকই বলেছ। ওদের একমাত্র খাবার দুধ।
কিন্তু এখন তো একটা দোকানও খোলা নেই। তাছাড়া দুধ-খাওয়ানোর জিনিসপত্রও আমার কাছে নেই। তাহলে এত রাতে আমি কী করব?
রিবিট তোমাকে এর সমাধান বের করতে হবে। এই সমাধান বের করাই তোমার মূল কাজ।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে আরো ভালোভাবে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল যেন ওরা কোনোভাবেই শীত অনুভব না করে। কান্নারত ছেলেবাচ্চাটির মুখের উপর মুখ নিয়ে এসে সে অদ্ভুত শব্দ করল। আর তাতে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাচ্চাটি কান্না থামিয়ে তার দিকে তাকাল। তারপর আবার কাঁদতে শুরু করল। মেয়ে বাচ্চাটি এখনো রিবিটের দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। মেয়েটি হাত পা কিছুই নাড়ছে না। রিবিট মেয়েটির মুখের উপর কয়েকবার নিজের হাত দোলালেও মেয়েটির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। রিবিটের হঠাৎই মনে হল এই মেয়েবাচ্চাটিও বোধহয় খুব ক্ষুধার্ত। সম্ভবত না-খেতে পেয়ে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। একথা ভাবতেই সে খুব অস্থির হয়ে উঠল। যে করেই হোক বাচ্চাদুটোর জন্য দুধের ব্যবস্থা করতে হবে।
রিবিট এবার ইপিকে বলল; ইপি, আমি কি একটা কাজ করতে পারি না?
কী কাজ?
আমার আশেপাশে অনেক বাড়ি। আমি কি যে-কোনো একটা বাড়িতে ঢুকে বাড়ির মানুষদেরকে বাচ্চাদুটোর খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করতে পারি না?
হ্যাঁ পারো।
এতে কি কোনো সমস্যা হবে?
সমস্যা তো হবেই। এত রাতে নিশ্চয় তোমার আগমনকে কেউ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না। তাছাড়া তোমাকে দেখে অনেকে ভয়ও পেতে পারে, কাজেই তারা দরজা খুলবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এভাবে কারো বাড়িতে প্রবেশ করা আইনসঙ্গতও নয়।
কিন্তু আমি তো দুটো বাচ্চার জীবনরক্ষার্থে এ-কাজ করছি।
আমি তোমার যুক্তিকে সমর্থন করছি। যদিও তোমার উপস্থিতি কারো জন্য হয়তো সমস্যার কারণ হবে, কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য মহৎ। মানুষের জীবনরক্ষার্থে অন্যের জন্য এ-ধরনের সমস্যার সৃষ্টিতে কোনো অপরাধ বা বে-আইনী কিছু হবে না।
ধন্যবাদ ইপি! তোমার সমর্থন পেয়ে আমার ভালো লাগছে। যে করেই হোক এই রাতে আমি বাচ্চাদুটোর ক্ষুধা নিবারণ করতে চাই। আমি মনে করছি ওদের ক্ষুধা নিবারণ করা আমার কর্তব্য।
আমি তোমাকে পূর্ণ সমর্থন করছি। বলল ইপি।
কিন্তু আমি কোন বাড়িতে প্রবেশ করব?
তুমি একটা ফ্যাটবাড়িতে প্রবেশ করতে পারো। ফ্ল্যাটবাড়ির বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বিভিন্ন রকম পরিবার থাকে। তুমি নিশ্চয় কোনো-না-কোনো ফ্ল্যাট পাবে যেখানে ওদের মতো ছোট বাচ্চা রয়েছে।
কিন্তু আমি খুঁজে পাব কীভাবে?
ফ্ল্যাটবাড়িতে দারোয়ান থাকে। তোমাকে তার সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখবে, দারোয়ান কিন্তু সহজে তোমাকে সাহায্য করতে চাইবে না। তাই তোমাকে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে হতে পারে।
ইপি তুমি কী বলতে চাচ্ছ আমি বুঝতে পেরেছি। আমি তাহলে পাশের এই ফ্ল্যাটবাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা করছি।
৫
রিবিট ফ্ল্যাটবাড়ির সামনের গেটে এসে দাঁড়াল। গেট ভিতর থেকে তালা দেয়া। ভিতরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। গেটের পাশে কলিংবেল দেখে সে কলিংবেলে চাপ দিল। দুবার চাপ দিতেই ভিতরে দারোয়ানের ঘর থেকে কেউ একজন সাড়া দিল : কে?
রিবিট কোনো কথা বলল না। সে আবার কলিংবেল চাপল।
এবার ভিতর থেকে মাঝবয়সী এক লোক বেরিয়ে এলো। পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে দারোয়ানই হবে। বেচারা বোধহয় বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই চোখ ডলতে ডলতে বাইরে বেরিয়ে আসছে।
গেট থেকে তিন-চার হাত দূরে এসে দারোয়ান থমকে দাঁড়াল। রিবিটকে দেখে ঢোঁক গিলে বলল : আ..আ….পনে কে?
আমি রিবিট। গেট খুলুন।
রি…রি…রিবিট!
আমি রিবিট, একটি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার রোবট। গেট খুলন।
রো..ব..ট। রোবট কী?
রিবিট বুঝল এই দারোয়ানকে তার পরিচয় বোঝানো সম্ভব হবে না। তাই খানিকটা গম্ভীর গলায় বলল : আপনি গেট খুলুন, আমি ভিতরে যাব।
দারোয়ান বেচারা অবিশ্বাস নিয়ে রিবিটের দিকে তাকিয়ে আছে। রিবিট আবারো বলল : কই গেট খুলুন, আমি ভিতরে যাব।
গেট খুলব কেন? আপনে তো মানুষ না। আপনে কে? কার কাছে যাবেন? কোন ফ্ল্যাটে যাবেন?
আমি তো বলেছি আমি মানুষ না। আমি একটি রোবট। আমার কোলে এই যে বাচ্চাদুটো দেখছেন ওরা খুব ক্ষুধার্ত। ওদের জন্য আমাকে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য এই বাড়ির যে-কোনো একটা ফ্ল্যাটে যেতে চাই। এ ব্যাপারে আমাকে আপনার সাহায্য করতে হবে।
দারোয়ান বেচারা ততক্ষণে বুকে ফুঁ দিতে শুরু করেছে। ভয়ে তার চোখদুটো বড় হয়ে গেছে। বলল : আ..আ..মি গেট খুলব না। নিষেধ আছে।
সেটা আমিও জানি। কিন্তু এই দেখুন দুটো বাচ্চা। ওদের জন্যই আমি গেট খুলতে বলছি।
দারোয়ান এবার কিছুটা এগিয়ে এল। সে অবশ্য বাচ্চাদুটোর পরিবর্তে রিবিটকেই দেখছে বেশি। বলল : আপনেরে আমি সাহায্য করবার পারব না।
কেন পারবেন না? দুটো বাচ্চা ক্ষুধায় ছটফট করছে, ছেলেবাচ্চাটি চিৎকার করে কাঁদছে। আর আপনি ওদেরকে সাহায্য করবেন না! ওরা তো আপনাদেরই বাচ্চা। আপনাদের বাচ্চাকে আপনারা সাহায্য করবেন না? খেতে দেবেন না? ওদের যত্ন নেবেন না?
দারোয়ান এবার আরো কাছে এসে বাচ্চাদুটোকে ভালোমতো দেখার চেষ্টা করল। তারপর বলল : ওরা তো এই ফ্ল্যাটের বাচ্চা না।
তাতে কী? আপনাদের মতোই কারো বাচ্চা। আপনারাই তো ওদেরকে জন্ম দিয়েছেন, এই পৃথিবীতে এনেছেন। আর এখন ওদেরকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন না।
আমি পারব না। আমার অনুমতি নাই।
আপনি অনুমতি নিন।
এত রাইতে কেউ আমারে অনুমতি দিবে না। আপনে মানুষ হন আর না হন, আপনে চইলা যান। আমারে বিরক্ত কইরেন না।
আমি বিরক্ত করছি মানে! আমি মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি।
আপনে অন্যহানে দেহেন। আমি আপনের কোনো উপকার করতে পারব না।
ঠিক আছে এই বাড়ির যে ফ্ল্যাটে কোনো ছোট বাচ্চা আছে সেই ফ্ল্যাটে ফোন করে আমার কথা বুঝিয়ে বলুন। নিশ্চয় তারা বাচ্চাদুটোকে সাহায্য করতে রাজি হবে।
এই ফ্ল্যাটে এত ছোট কোনো বাইচ্চা নাই। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল দারোয়ান।
কী বলছেন আপনি! এতগুলো ফ্ল্যাট, অথচ বলছেন কোনো ফ্ল্যাটে একটি ছোট বাচ্চাও নেই। তা কীভাবে সম্ভব! অবাক হয় বলল রিবিট।
আপনে যান তো। এত রাইতে জ্বালাইয়েন না। যান, আপনে যান। কিছুটা ধমকে উঠে বলল দারোয়ান।
আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? এবার কিছুটা উঁচুস্বরে বলল রিবিট।
রাইত দুপুরে মানুষরে জ্বালাবার আইছেন, আপনের সাথে কি মিষ্টি, মিষ্টি কইরা কথা কব? যান এইহানতে।
রিবিট বুঝতে পারল এভাবে কাজ হবে না, তাকে ভিন্নপথ অবলম্বন করতে হবে।
এতক্ষণ দারোয়ান কথা বলতে বলতে একেবারে গেটের কাছে চলে এসেছে। তাই এ সুযোগটাকেই কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করল সে। আচমকাই গেটের লোহার গারদের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দারোয়ানের কলার চেপে ধরল। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। আমি বলছি আপনি গেট খুলবেন।
দারোয়ান নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে রিবিট কলার ধরে দারোয়ানকে আরো কাছে টেনে এনে বলল : খবরদার, ফালাফালি করবেন না। গেট খুলুন।
যদি গেট না খুলি! তারপরও সাহস করে বলল দারোয়ান।
যদি না খোলেন তাহলে আপনাকে এই লোহার ফাঁক দিয়ে টেনে এপাশে নিয়ে আসব। বলুন তো তাহলে আপনার অবস্থা কী হবে?
আলু ভত্তা। চোখ বড় বড় করে বলল দারোয়ান।
আলু ভর্তা না, আপনার ভর্তা। আর কোনো কথা নয়, আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে আপনি গেট খুলবেন।
রিবিটকে এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনতে হলো না। তার আগেই দারোয়ান গেট খুলে দিল।
রিবিট ভিতরে প্রবেশের সময় দারোয়ানের কলার ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। আর এই সুযোগটাই গ্রহণ করল দারোয়ান। সে একদৌড়ে তার ঘরে ঢুকে পাঁচফুট দৈর্ঘ্যের মোটা একটা লোহার পাইপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল। ততক্ষণে রিবিট গেটের ভিতরে প্রবেশ করেছে।
দারোয়ান রিবিটের সামনে এসে বলল : খবরদার, তুই যদি আর এক পা সামনে আইছস, তাইলে আমি তোর হাড় সব গুড়া কইরা ফেলাব।
রিবিটকে ‘তুই’ করে বলায় রিবিট সত্যি কষ্ট পেল। তবে সে তার কষ্টকে প্রকাশ না করে বলল : দেখুন দারোয়ান ভাই, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করছি না। আমি শুধু এই বাচ্চাদুটোকে বাঁচানোর জন্য এখানে এসেছি।
রাখ তোর বাইচ্চা! তুই এক্ষুনি বাইরায় যা, নইলে আমি তোর ভত্তা বানাব।
রিবিট কোনো কথা বলল না। সে আরো দুপা এগিয়ে গেল। আর তখনই দারোয়ান ঝাঁপিয়ে পড়ল রিবিটের উপর। রিটি আগেই বুঝতে পেরেছিল দারোয়ান যেভাবে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে আসছে তাতে বাচ্চাদুটো আঘাত পেতে পারে। তাই সে সরে এসে পিঠ পেতে দিল। দারোয়ানের প্রচণ্ড আঘাতটা তার পিঠে এসে লাগল।
পিঠে আঘাত লাগার সাথে সাথে ইপি বলে উঠল : রিবিট, সিস্টেম ও-কে, সিস্টেম ও-কে। প্রাইমারি ডিফেন্স সিস্টেম অ্যাকটিভ। তুমি আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারো।
রিবিট বলল : ধন্যবাদ ইপি। আমি দেখছি।
এদিকে দারোয়ান বেচারা হতভম্ব হয়ে গেছে। সে এত জোরে আঘাত করেছে অথচ রিবিটের কিছুই হয়নি। এ তো তার কাছে অবিশ্বাস্য! সে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। তাছাড়া মেয়েলি কণ্ঠে কথা বলল কে সেটাও বুঝতে পারল না। তাই সে চারপাশটা একবার দেখে নিল। তারপর হঠাৎই লোহার পাইপ হাতে আবারো তেড়ে এল রিবিটের দিকে।
রিবিট এবার প্রস্তুতই ছিল। দারোয়ান পাইপ দিয়ে আঘাত করা মাত্র সে একহাতে বাচ্চাদুটোকে আঁকড়ে রেখে অন্যহাতে পাইপটা ধরে ফেলল। তারপর জোরে টান দিয়ে পাইপটা নিজের হাতে নিয়ে এল। কৌশলে দু-হাতে পাইপের দু-মাথা ধরে প্রচণ্ড শক্তিতে পাইপটাকে বাঁকিয়ে মাঝখান থেকে ভেঙে ফেলল।
দারোয়ান বেচারা বোধহয় এমন ঘটনা তার জীবনেও দেখেনি। কেউ একজন যে এভাবে এত মোটা একটা লোহার পাইপকে ভেঙে ফেলতে পারবে তা ছিল তার কল্পনাতীত। ভয়ে সে যেন নড়তেও ভুলে গেছে।
রিবিট ভাঙা পাইপটিকে পাশের দেয়ালে ছুঁড়ে মেরে দারোয়ানের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎই দারোয়ানের কলার চেপে ধরে তাকে মাটি থেকে এক ফুট উপরে তুলে ফেলল।
দারোয়ান বেচারার আধমরা হওয়ার অবস্থা। সে কাঁপতে কাঁপতে বলল : স্যার আপনে যা কবেন আমি তাই শুনব। তবুও আমারে জানে মাইরেন না।
রিবিট গম্ভীর গলায় বলল : আপনি ভিতরে প্রবেশের গেট খুলে দিন। জি স্যার দিতেছি। দয়া করে আমার কলার ছাইড়া দেন।
না, আপনার কলার ছাড়া যাবে না। আপনার মধ্যে মানুষকে সাহায্য করার কোনো প্রবণতা নেই। আপনাকে এই অবস্থায়ই থাকতে হবে। মাটি থেকে আপনার পা এক ফুট উপরে থাকবে। আমি আপনাকে ভিতরের গেটের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি ভিতরের গেট খুলে দেবেন।
জি স্যার, আপনে যা কবেন আমি তাই করব। তবু আমারে জানে মাইরেন না।
না, আমি আপনাকে মারব না। আমার কথা শুনলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।
শুনব স্যার শুনব। হাজারবার শুনব, একশো বার শুনব। সারাজীবন আপনার গোলাম হইয়া থাকব।
আর কথা না, এখন গেট খুলুন। আমি ভিতরে যাব। দারোয়ান শূন্যে ঝুলন্ত অবস্থায়ই গেট খুলে দিল। রিবিট গেটের ভিতর প্রবেশ করে বলল : এখন বলুন এরকম ছোট্ট বাচ্চা কোন্ ফ্ল্যাটে আছে? খবরদার মিথ্যা বলবেন না। মিথ্যা বললে আপনাকে আরো এক ফুট উপরে তুলব।
দারোয়ান তোতলাতে তোতলাতে বলল : না স্যার, আমারে আর উপরে তুইলেন না। আমি আপনেরে সবই বলব, আর মিথ্যা বলব না। তিনতলায় সি-টু ফ্ল্যাটে ছোট বাচ্চা আছে।
আমি তাহলে সি-টু ফ্ল্যাটে যাব। আপনি আমাকে ফ্ল্যাটের অধিবাসীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন। ঠিক আছে?
ঠিক আছে স্যার।
রিবিট লিফটে তিনতলায় এসে পৌঁছাল। তারপর দারোয়ানকে ইশারা করতে সে ফ্ল্যাটের কলিংবেলে চাপ দিল। চারবার কলিংবেলে চাপ দেয়ার পর ভিতর থেকে মেয়েলি কণ্ঠে কেউ একজন কথা বলল : কে?
আমি দারোয়ান।
এত রাইতে কী দারোয়ান ভাই?
দরজা খোলো, জরুরি ব্যাপার আছে।
এত রাইতে কিসের জরুরি?
তোমাগো মেহমান আইছে। সাথে কইরা নিয়া আইছে। দেখলে খুশি হবা।
তখনো দরজা খুলছে না দেখে দারোয়ান ফিসফিস করে বলল : স্যার কাজের মেয়ে, এইজন্য দরজা খুলবার ভয় পায়।
রিবিট কিছু বলল না। একহাতে কলার ধরে দারোয়ানকে দরজার সামনে উঁচু করে রেখে সে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যহাতে বাচ্চাদুটোকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
কাজের মেয়ে দরজা খুলে দারোয়ানের অবস্থা দেখে হা হয়ে গেল। মেঝে থেকে কেউ যে এভাবে এক ফুট উপরে থাকতে পারে তা তার কল্পনার বাইরে। দারোয়ান বলল : ভয় পাইও না, স্যার খুব ভালো মানুষ, তোমারে কিছু কবে না। খালি স্যারের কথা শুনবা।
কাজের মেয়ে এবার উঁকি দিয় রিবিটকে দেখল। তাকে দেখামাত্র সে চিৎকার করে উঠে বলল; ওরে ভাইজানরে, ওরে ভাবীজানরে…আমি এইডা কী দেখলাম। তারপরই ধপাস করে নিচে পড়ে গেল।
দারোয়ান তোতলাতে তোতলাতে বলল : স্যার ভয় পাইছে। মনে হয় অজ্ঞান হইয়া গেছে।
রিবিট সরাসরি ড্রইং রুমে ঢুকল। তারপর বলল : এই ফ্ল্যাটে যারা বসবাস করে তাদের নাম কি?
এই ফ্ল্যাটের মালিক শওকত সাহেব।
আপনি শওকত সাহেবকে ডাকুন।
দারোয়ানকে আর ডাকতে হল না। তার আগেই শওকত সাহেব ঘুম জড়ানো চোখে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন। তিনি রিবিট আর দারোয়নকে দেখে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। চোখ কুঁচকে বুঝতে চেষ্টা করলেন তিনি যা দেখছেন তা আদৌ সত্য, নাকি স্বপ্ন। কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, দারোয়ান…তুমি..আর সাথে…ও..
এবার রিবিটই বলল : দেখুন শওকত সাহেব। আপনি আমাকে ভয় পাবেন না। আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি। আমার কোলে দুটো যমজ শিশু দেখতে পাচ্ছেন। ওরা খুব অসহায়, একে অন্যের সাথে পায়ে আর মাথায় সংযুক্ত। তার থেকে বড় কথা ওরা ক্ষুধার্ত। একটা বাচ্চা অনেকক্ষণ ধরে ক্ষুধায় চিৎকার করছে। আমি আপনার কাছে এসেছি সাহায্যের জন্য। আপনি দয়া করে ওদের খাবারের ব্যবস্থা করুন।
আ…আমি কী…ভাবে খাবারের ব্যবস্থা করব? অস্পষ্ট উচ্চারণে বললেন শওকত সাহেব।
ওদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করুন।
আমি দুধ পাব কোথায়? তাছাড়া আপনি কে?
আমি কে এ-মুহূর্তে তা জানা খুব একটা জরুরি নয়। আমি সবকিছুই আপনাকে খুলে বলব। তার আগে ওদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করুন।
আমার বাসায় কোনো দুধ নেই। আপনি দয়া করে চলে গেলে খুশি হব। তাছাড়া আপনি দারোয়ানকে ওভাবে শূন্যে তুলে রেখেছেন কেন? কিছুটা সাহসী ভঙ্গিতে বললেন শওকত সাহেব।
রিবিট এবার দৃঢ় এবং কঠিন কণ্ঠে বলল : দেখুন শওকত সাহেব, আমি জানি আপনার এখানে ছোট বাচ্চা আছে এবং তার জন্য দুধের ব্যবস্থাও রয়েছ। দারোয়ানই আমাকে বলেছে। সে প্রথমে আমাকে সহযোগিতা করতে চায়নি বলেই এখন তার এই অবস্থা। আপনিও যদি এই বাচ্চাদুটোর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দেন আপনারও এই অবস্থা হবে।
রিবিটের কথা শোনামাত্র ভয়ে শওকত সাহেবের আত্মা শুকিয়ে গেল। তাকে অবশ্য কিছু বলতে হল না। তার স্ত্রী মিসেস শওকত ড্রইংরুমে এসে কম্পিত গলায় বললেন : আ..আ..আমি দেখছি। আমি ওদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করছি।
পর্দার আড়াল থেকে মিসেস শওকত সবই শুনেছেন। তাই তিনি আর কোনো ঝুঁকি নিলেন না। দাবোয়ান আর তার স্বামীর অবস্থা নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন। শুধু আড়চোখে একবার রিবিটের দিকে তাকালেন। তারপর শওকত সাহেবকে উদ্দেশ করে বললেন : সালমা কোথায়? সালমা?
দারোয়ান সাথে সাথে উত্তর দিল : সালমা দরজার কাছে অজ্ঞান হইয়া গেছে।
মিসেস শওকত আবার বললেন, এই তুমি যাও তো, সালমাকে ভিতরে নিয়ে এসো। ওর মুখে পানির ছিটা দাও। আমি পানি গরম করছি। দেখি বাচ্চাদুটোকে দেখি।
মিসেস শওকত এগিয়ে আসতে রিবিট আবার বলল; আমাকে ভয় পাবেন না। আমি আপনাদের কোনো ক্ষতি করব না। বাচ্চাদের খাওয়া শেষ হলেই চলে যাব। ওরা খুব ক্ষুধার্ত।
মিসেস শওকত এবার ভয়ে ভয়ে বললেন : আমি ব্যবস্থা করছি। আমারও দুটো বাচ্চা আছে। বড়টির বয়স আট বছর, নাম অমি। আর ছোটটি তিন মাস। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। এই বলে সে বাচ্চাদুটোকে কোলে তুলে নিল। সাথে সাথে ছেলেবাচ্চাটির কান্নাও থেমে গেলে।
রিবিট খুব অবাক হল। এতক্ষণ তার কোলে বাচ্চাটি কেঁদেই যাচ্ছিল। অথচ এখন শওকত সাহেবের স্ত্রী মিসেস শওকত কোলে নিতেই বাচ্চাটির কান্না থেমে গেল। এই রহস্যের কারণ সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।
এদিকে শওকত সাহেব সালমার মুখে পানির ছিটা দিতে সালমার জ্ঞান ফিরে এল। শওকত সাহেব কিছুটা ধমকে উঠে বললেন : ওঠ, ভিতরে চল।
সালমা কিছু বলল না। ভয়ে এখনো সে কাঁপছে। সে শওকত সাহেবের পিছন পিছন ভিতরে আসতে লাগল। ড্রইংরুমের মধ্যে রিবিটকে দেখামাত্র আবার চিৎকার করে উঠে বলল : ওরে ভাইজানরে, এইডা কী…! সালমা আর কথা বলতে পারল না। আবারো জ্ঞান হারাল।
রিবিট লক্ষ্য করল কেউ একজন পর্দার আড়াল থেকে তাকে উঁকি দিয়ে দেখছে। আরো ভালোমতো লক্ষ্য করতে বুঝল ছোট্ট একটি ছেলে। সে ইশারায় ছেলেটিকে কাছে ডাকতে ছেলেটি ধীরে ধীরে ভিতরে এল। রিবিট খুব অবাক হল যখন দেখল ছেলেটির চোখে যতটা না ভয় তার থেকে বেশি কৌতূহল আর আগ্রহ।
ছেলেটির ভয় কাটাতে রিবিট আবারো ইশারায় কাছে ডেকে বলল : তোমার নাম নিশ্চয় অমি?
রিবিটকে বিস্মিত করে দিয়ে অমি বলল : তুমি রিবিট।
তুমি আমাকে চিনলে কীভাবে! বিস্মিত কণ্ঠে বলল রিবিট।
কাল রাতে টিভিতে আমি তোমাকে দেখেছি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ।
তুমি কি আমাকে খুব ভয় পাচ্ছ অমি?
একটু আগে পাচ্ছিলাম। এখন পাচ্ছি না। আমি জানি তুমি খুব ভালো। তুমি দুটো বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য আমাদের কাছে নিয়ে এসেছ। এই বলে আমি রিবিটের আরো কাছে এল।
অমি, তুমি তো খুব সাহসী। কিন্তু তোমাদের বাসার সবাই তো খুব ভয় পাচ্ছে।
কারণ তারা তো কাল রাতে তোমাকে টেলিভিশনে দেখেনি। আমি দেখেছি। তুমি আমার মতো অনেক ছেলেমেয়েকে আদর করেছ, ওদেরকে কোলে নিয়েছ। আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি তোমাকে পছন্দ করি রিবিট, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তুমি খুব ভালো অমি। খুব সাহসী এবং বুদ্ধিমান। আমি তোমার সাহস এবং বুদ্ধির প্রশংসা করছি। তুমি কি আমার কোলে আসবে?
হ্যাঁ আসব। কিন্তু তুমি কীভাবে আমাকে কোলে নেবে? দারোয়ান চাচাকে তুমি তো উঁচু করে রেখেছ।
ঠিক আছে আমি ওনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। এই বলে রিবিট দারোয়ানকে নিচে নামিয়ে দিল। তারপর বলল : খবরদার আমার অনুমতি ছাড়া যেন এক পাও নড়তে না দেখি।
না না স্যার, এক পা-তো দূরের কথা, এক চুলও নড়ব না। হাতজোড় করে বলল দারোয়ান।
রিবিট এবার অমিকে কোলে তুলে নিল। অমি কোলে উঠে বলল : আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি আমাদের বাসায় এসেছ। আগামী দুদিন আমার ছুটি। তা না। হলে আগামীকাল স্কুলে যেয়ে তোমার গল্প বলতাম।
এমন সময় শওকত সাহেব ড্রইংরুমে এলেন। অমিকে রিবিটের কোলে দেখে তার চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে বললেন : অ..অমি, তু..তুমি এখানে? ‘
হ্যাঁ বাবা। আমি রিবিটকে ভালোবাসি।
রি..বি..ট!
হ্যাঁ বাবা। এই হল রিবিট, খুব ভালো। তুমি তো টিভিতে রিবিটকে দ্যাখোনি।
শওকত সাহেব এবার রিবিটের দিকে তাকিয়ে বললেন : আপনি রিবিট, মানে…আপ…
হ্যাঁ শওকত সাহেব। আমার নাম রিবিট, অতি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার রোবট। আপনি রো..ব..ট! শওকত সাহেব এখন যেন আর কথা বলতে পারছেন না।
হ্যাঁ বাবা, রিবিট রোবট। বলল অমি। কিন্তু রিবিট রোবট হলে কী হবে, মানুষের জন্য, শিশুদের জন্য রিবিটের অনেক ভালোবাসা। মানুষের থেকেও বেশি। এই দেখছ না, আমাদের কাছে বাঁচানোর জন্য দুটো বাচ্চা নিয়ে এসেছে।
শওকত সাহেব এখনো যেন ভিন্ন কোনো জগতে রয়েছেন। তিনি কোনোমতে সোফা দেখিয়ে বললেন : রিবিট সাহেব আপনি বসুন। আপনি কী খাবেন? চা, কফি, না কি অন্য কিছু…?
অমি আবার হেসে দিয়ে বলল : বাবা তুমি তো দেখছি বোকা, কিছু জানো না। রিবিট তো কিছু খায় না, চকোলেটও না। রিবিট শুধু মানুষকে ভালোবাসে, আমাকেও ভালোবাসে। তাই না রিবিট?
রিবিট উপরে নিচে মাথা দোলাল।
এমন সময় মিসেস শওকত ভিতরে এলেন। এক হাতে তিনি বাচ্চাদুটোকে কোলে নিয়েছেন। অন্যহাতে দুটো দুধের ফিডার। সোফার উপর বসে তিনি চমকে উঠে বললেন : অমি তুমি, ওনার কোলে কেন?
শওকত সাহেব তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন : রিবিট সাহেব খুব ভালোমানুষ, তুমি ভয় পেও না। তাড়াতাড়ি ওদেরকে দুধ খাওয়াও।
মাঝখান থেকে দারোয়ান বলল : খালি ভালোমানুষ না ভাইজান, একেবারে ফেরেশতা।
রিবিট সাথে সাথে বলল : রোবট কখনো মানুষ বা ফেরেশতা হতে পারে না, আপনি ভুল বলছেন।
দারোয়ান সাথে সাথে বলল : হ ভাইজান, আমার ভুল হইছে। আমারে মাফ কইরা দেন।
এদিকে মিসেস শওকত বললেন : আমি ওদেরকে দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। ছেলেটি দুধ খেলেও মেয়েটি খাচ্ছে না। ফিডার মুখে দিলেই মুখ
সরিয়ে নিচ্ছে, ফিডার টানছে না।
তাহলে বোধহয় ক্ষুধা নেই। বললেন শওকত সাহেব। ঠিক বুঝতে পারছি না, মেয়েটি খুব বেশি নড়াচড়াও করছে না। শুধু পিটপিট করে তাকাচ্ছে, আবার চোখ বন্ধ করছে।
এবার কথা বলল রিবিট : তাহলে মেয়েবাচ্চাটিকে কি খাওয়ানো সম্ভব হবে?
আমার মনে হচ্ছে অন্য কোনো সমস্যা রয়েছে।
কী সমস্যা?
মনে হচ্ছে মেয়েটি অসুস্থ। তবে নাও হতে পারে।
তাহলে আমি কী করব?
আপনি ওদেরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
এত রাতে ডাক্তার পাব কোথায়? চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রিবিট।
যে-কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে নিতে পারেন। সেখানে সবসময়ই ডাক্তার থাকে। আর আমাদের পাশে গ্রিনরোডে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক রয়েছে। আপনি ইচ্ছে করলে এগুলোর যে-কোনো একটায় নিতে পারেন।
রিবিট চিন্তিত হয়ে পড়ল। এ মুহূর্তে সে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে কি আদৌ বাচ্চাদুটোকে ক্লিনিকে নিয়ে যাবে নাকি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাছাড়া বাচ্চাদুটোর বাবা-মা কোথায় সেটাও বের করা দরকার। বাচ্চাদুটো কীভাবে ডাস্টবিনের পাশে এল সেটাও চিন্ত রি বিষয়। সবকিছু মিলে ঘটনাটা ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করছে বুঝতে পারছে সে। এ-বিষয়ে শওকত সাহেব এবং তার স্ত্রীর কাছে সাহায্য চাইবে কিনা কিছুক্ষণ ভাবল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। তাই অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ইপির সাথে পরামর্শ শুরু করল : ইপি, আমি কী সমস্যায় পড়েছি তুমি কি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ রিবিট, বুঝতে পারছি। তোমার সমস্যাটা গুরুতর।
আমি এখন কী করব? বচ্চাদুটোকে কি আমার সাথে নিয়ে যাব?
তোমার তো সেরকমই করা উচিত।
কিন্তু ওদেরকে আমি আমার কাছে রাখব কীভাবে? বাচ্চাদের খাবার তৈরি করা, ওদের জন্য দুধ বানানো, ওদের কান্না থামানো, ওদেরকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, চিকিৎসা করানো, এগুলো তো বেশ ঝামেলার কজ।
ঝামেলার তো বটেই। কিন্তু কোনো বিকল্প উপায় তো নেই।
আমি কি ওদেরকে শওকত সাহেব এবং তার স্ত্রীর কাছে রেখে যেতে পারি না? তাদের তো ছোট বাচ্চা আছে। সম্ভবত ভিতরে ঘুমাচ্ছে। ওদের সাথেই এ বাচ্চাদুটো থাকবে, খেলবে, বড় হবে।
না ইপি, তুমি তা পারো না। তাহলে বাচ্চাদুটোর প্রতি তোমার অবহেলা করা হবে।
কেন? ওরা তো মানুষের কাছেই থাকছে।
তা থাকছে। কিন্তু মানুষ তার নিজের সন্তানকে যেভাবে ভালোবাসে অন্যের সন্তানকে সেভাবে ভালোবাসে না। এটি মানুষের চরিত্রের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অবশ্য শুধু মানুষ না, প্রায় সকল প্রাণীই নিজের সন্তানের প্রতি অধিক দায়িত্বশীল এবং আবেগপ্রবণ। যাইহোক, বাচ্চাদুটোকে তোমার সাথেই নিতে হবে এবং ওদেরকে কোনো ক্লিনিকে চিকিৎসা করাতে হবে। দেরি হলে অন্য কোনো বিপদ হতে পারে।
ঠিক আছে ইপি, আমি বাচ্চাদুটোকে কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাব।
সেটাই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। তোমার কাজ হবে যেভাবেই হোক ওদেরকে বাঁচিয়ে তোলা। তুমি যদি বাচ্চাদুটোকে বাঁচিয়ে রাখার সকল ব্যবস্থা করতে পারো, ওদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারো, তাহলেই তুমি মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছ বলে ভাবতে পারবে।
তোমাকে ধন্যবাদ ইপি, দেখি আমি কী করতে পারি। রিবিট ইপির সাথে অভ্যন্তরের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কথা বলায় কেউ তা শুনতে পায়নি।
এদিকে মিসেস শওকত কোনোভাবেই মেয়েবাচ্চাটিকে খাওয়াতে পারলেন না। অবশেষে বললেন : মনে হচ্ছে বাচ্চাটিকে খাওয়ানো যাবে না। আমি দুধসহ একটা ফিডার দিয়ে দিচ্ছি, পরে পারলে ওকে খাওয়াবেন।
আপনাকে ধন্যবাদ। বলল রিবিট।
আর সম্ভব হলে ওদেরকে দ্রুত কোনো ডাক্তার দেখানোর চেষ্টা করুন। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটি সত্যিই অসুস্থ।
আমি ওদেরকে ডাক্তার দেখাতে চেষ্টা করব।
কথা বলতে বলতে রিবিট কোল থেকে অমিকে নামিয়ে দিল। তারপর মিসেস শওকতের কোল থেকে বাচ্চাদুটোকে নিজের কোলে নিল। মিসেস শওকত অবশ্য নতুন একটা চাদর দিয়ে বাচ্চাদুটোকে জড়িয়ে দিয়েছেন। রিবিট ঘুরে দাঁড়াতে দেখল, দারোয়ানকে সে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আগের মতোই একহাতে বাচ্চাদুটোকে কোলে নিয়ে অন্যহাতে দারোয়ানের কলার চেপে ধরে তাকে এক ফুট উপরে তুলে ফেলল। তারপর এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
দরজার কাছে আসতে অমি পিছন থেকে বলল : রিবিট, তুমি আবার কখন আসবে?
রিবিট ঘুরে দাঁড়াল। তারপর বলল : প্রয়োজন হলেই আসব।
তুমি যখন খুশি তখন আমাদের বাসায় আসবে। আমি তোমার সাথে ভিডিও গেম খেলব। আমি নতুন একটা ভিডিও গেম কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছি।
এবার কথা বললেন শওকত সাহেব : হ্যাঁ রিবিট সাহেব, আপনার ইচ্ছে হলেই আমাদের বাসায় চলে আসবেন।
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ আমি আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বাচ্চাদুটোর জন্য আপনারা অনেক কিছু করেছেন। আর ওদের জন্য দোয়া করবেন।
আপনাকেও ধন্যবাদ। বিড়বিড় করে বললেন মিসেস শওকত। নিচে এসে রিবিট দারোয়ানের দিকে তাকাল। সে দারোয়ানকে এখনো একফুট শূন্যে তুলে রেখেছে। ভয়ে বেচারার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। বাইরে একেবারে গেটের কাছে এসে সে দারোয়ানকে নিচে নামিয়ে দিয়ে বলল : এখন। থেকে মানুষের উপকার করতে চেষ্টা করবেন।
হ্যাঁ করব।
আমি জানি এত রাতে আপনার পক্ষে গেট খুলে আমার মতো অপরিচিত কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়া আপনার স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তারপরও আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি বাস্তবতা বুঝতে চেষ্টা করবেন, মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে চেষ্টা করবেন।
জ্বি..জি স্যার, করব। দারোয়ান এখনো ভয়ের মধ্যে আছে।
রিবিট একটু হেঁটে যেয়ে ভাঙা পাইপের টুকরো দুটো তুলে নিয়ে এলো। তারপর টুকরো দুটো দারোয়ানের হাতে দিয়ে বলল : আপনার পাইপটি ভেঙে ফেলার জন্য আমি দুঃখিত। আমার কোনো উপায় ছিল না, তা না হলে হয়তো বাচ্চাদুটোর শরীরে আঘাত লাগত।
না, ঠিক আছে।
আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রিবিট আর কোনো কথা বলল না। গেট দিয়ে বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে এল। দারোয়ান অবশ্য তার আগের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে। সে এখনো বুঝতে পারছে না যা-কিছু ঘটে গেল তা কি আদৌ সত্য, নাকি তার স্বপ্ন।
৬
রিবিট কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিল। তাকে এখন নিকটবর্তী ক্লিনিকে যেতে হবে, নিশ্চিত হতে হবে মেয়েবাচ্চাটি আদৌ অসুস্থ কিনা। সে ঢাকার ম্যাপটি পরীক্ষা করে বুঝল খুব কাছেই গ্রিনরোডে একটি নামকরা ক্লিনিক রয়েছে। এখান থেকে হেঁটে যেতে সর্বোচ্চ সাত থেকে আট মিনিট সময় লাগবে। সে সিদ্ধান্ত নিল এই ক্লিনিকেই যাবে। তাই ক্লিনিকের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
বাচ্চাদুটো এখনো জেগে আছে। তবে ছেলেবাচ্চাটির চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। মেয়েবাচ্চাটি এখন একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ পিটপিট করছে না। মেয়েটির দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি, যেন কিছু বলতে চায়। রিবিটের কেমন যেন মায়া হল। সে আলতোভাবে তার হাত মেয়েটির মুখের উপর রাখল। মেয়েটি চোখ বন্ধ করে আবার তার দিকে তাকাল।
বাচ্চাদুটোর কথা ভেবে রিবিট সত্যিই অবাক হচ্ছে। দুটোবাচ্চা তাদের মাথা আর পায়ের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযুক্ত। ইচ্ছে করলেই তারা স্বাধীনভাবে নড়াচড়া করতে পারছে না। আপন ভাই-বোন পাশাপাশি রয়েছে, অথচ কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। ব্যাপারটি সত্যি বিস্মিত করার মতো। এরা যদি এভাবে বেঁচে থাকে তাহলে একমাত্র আয়নার মাধ্যমেই একে অপরকে দেখতে পাবে। অন্য কোনোভাবে নয়। এদের পরবর্তী জীবন কেমন হবে ভাবতেই শিউরে উঠল সে। জীবনের এতগুলো বছর এরা কীভাবে একসাথে। কাটাবে তা তার মাথায় ঢুকল না।
হাঁটতে হাঁটতে রিবিট ডেকে উঠল : ইপি!
হা রিবিট। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমাকে কী জিজ্ঞেস করবে। ক্লিনিকে কী-ধরনের জটিলতা হতে পারে এই তো?
ইপি তুমি ঠিকই ধরেছ।
আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। তবে আশা করছি ক্লিনিকের সবাই তোমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে…
আমার কাছে তেমন কোনো টাকাপয়সা নেই, মাত্র তিনশো তেত্রিশ টাকা আছে। এত অল্প টাকায় কিছুই হবে না।
তোমার অনুমান সত্য রিবিট।
ঠিক আছে আগে তো যাই, তারপর দেখা যাবে।
এত রাতে অবশ্য কোনো ভালো ডাক্তারও পাওয়া যাবে না।
তা হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাচ্চাদুটোকে তো কোনো ডাক্তারকে দেখাতে পারব। অন্তত বুঝতে পারব আদৌ ওরা অসুস্থ কিনা। তারপর হয়তো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
তোমার সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি থেকে যাচ্ছে।
কী কাজ? প্রশ্ন করল রিবিট।
বাচ্চাদের মা-বাবাকে খুঁজে বের করা।
কিন্তু এ-মুহূর্তে তা কীভাবে সম্ভব? আমরা কাউকে চিনি না, জানিও না। তাছাড়া কোথায় কীভাবে খুঁজব?
রিবিট তুমি ঠিকই বলেছ। আপাতত ডাক্তারকেই দেখাও। পরের সিদ্ধান্ত পরে নেয়া যাবে। প্রথমে নিশ্চিত হও আদৌ বাচ্চাদুটো সুস্থ কিনা। তারপর নাহয় অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
মেয়েবাচ্চাটিকে নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে, ও বোধহয় সত্যিই অসুস্থ। নড়াচড়াও করছে না, কিছু খাচ্ছেও না।
অন্য কোনো কারণও হতে পারে। বলল ইপি।
কী কারণ?
আমি ঠিক জানি না। বাচ্চাদের সাইকোলজি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওরা অনেককিছুই করে যা মানুষের আচরণে স্বাভাবিক মনে হয় না। কিন্তু ওদের কাছে স্বাভাবিক। মেয়েবাচ্চাটি সুস্থ কিনা তা তুমি নিজেই পরীক্ষা করার চেষ্টা করতে পারো।
কীভাবে?
তোমার অভ্যন্তরে যে-সকল সুর রেকর্ড করা আছে তার কয়েকটি বাজিয়ে দেখতে পারো। বাচ্চারা যে-কোনো শব্দ বা সুর শুনলে বিভিন্নভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। মেয়েটি যদি অসুস্থ হয় তাহলে এই সুর বা শব্দ তার মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। খুব বেশি হলে বিরক্তির সৃষ্টি করতে পারে।
ইপির কথামতো রিবিট তার অভ্যন্তরে সংরক্ষিত কয়েকটি সুর বাজাল। সুরগুলো খুবই সুন্দর, শুনলে যে-কারো ভালো লাগবে। কিন্তু মেয়েটির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তাই রিবিট অনেকটা হতাশ গলায় বলল : না ইপি, বাচ্চাটি আগের মতোই আছে।
এমনও তো হতে পারে বাচ্চাটি বধির, কিছু শুনতে পায় না।
কী বলছ তুমি! চমকে উঠে বলল রিবিট।
হ্যাঁ রিবিট হতে পারে। ছেলেবাচ্চাটি কী করছে?
ঘুমিয়ে পড়েছে।
হ্যাঁ তাই তো দেখছি। তুমি এক কাজ করে। মেয়েবাচ্চাটির ডানপাশে হাত দিয়ে অদ্ভুত কোনো শব্দ করো। যদি দ্যাখো বাচ্চাটি ঘুরে দেখার কোনো চেষ্টা করছে তাহলে বুঝতে পারবে বাচ্চাটি বধির না। এভাবেই ডাক্তাররা বাচ্চাদের পরীক্ষা করে। এ পরীক্ষায় তুমি হয়তো নিশ্চিত হতে পারবে না, তবে অনুমান করতে পারবে।
আমি দেখছি ইপি। বাচ্চাদুটোর ডানে রিবিট হাতের আঙুলের সাহায্যে বেশ জোরে অদ্ভুত একটা শব্দ করল।
সাথে সাথে ছেলেবাচ্চাটি চোখ মেলে তাকাল। তারপর হালকা নড়েচড়ে উঠল। শব্দের সাথে সাথে মেয়েবাচ্চাটিও চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। রিবিট নিশ্চিত হতে একই রকম শব্দ আবারো করল। আগের মতোই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল বাচ্চাদুটো।
রিবিট এবার আনন্দের সাথে বলল : ইপি, আমি নিশ্চিত হয়েছি দুটো বাচ্চার কেউই বধির না।
তারপরও তোমাকে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। ডাক্তারের অভিমত না-পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
কথা বলতে বলতে রিবিট ক্লিনিকের সামনে এসে পৌঁছাল। ক্লিনিকের অভ্যন্তরে রিসেপশনে এসে সে চারদিকটা ভালোমতো দেখে নিল। রিসেপশন ডেস্কে অল্পবয়সী এক মেয়ে বসে-বসে ঝিমুচ্ছে। পাশেই অনেকগুলো চেয়ার থাকলেও দুটো বাদে সবগুলোই ফাঁকা। একটাতে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অন্যটাতে বয়স্ক এক ভদ্রলোক তার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। রিবিট বুঝতে পারল বয়স্ক ভদ্রলোক তাকে দেখে খুব ভয় পেয়েছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে বয়স্ক ভদ্রলোক ধীরে ধীরে পিছনে সরে যাচ্ছে।
রিবিট সরাসরি রিসেপশন ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি তখনো ঝিমুনির মধ্যে রয়েছে। রিবিট সামনে কাঁচের উপর মৃদু টোকা দিতে মেয়েটি চোখ মেলে তাকাল। রিবিটকে সামনে দেখে প্রথমেই সে হাঁ হয়ে গেল। তারপর মাথা ঝাঁকি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল আদৌ সে যা দেখছে তা সত্যি কিনা। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য দুহাতে চোখ কচলে নিল। তারপর বলল : আ.আ..
রিবিট খুব শান্তভাবে বলল : আমি রিবিট, অতি উচ্চবুদ্ধিমাত্রার রোবট। আমার আপনার সাহায্যের প্রয়োজন।
আমার..আ…সা…। মেয়েটির গলা দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না।
হ্যাঁ, আমাকে আপনার সাহায্য করতে হবে। আমার কাছে দুটো বাচ্চা আছে। সম্ভবত ওরা অসুস্থ। আপনি কি দয়া করে ওদেরকে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করবেন?
মেয়েটি একবার বাচ্চাদুটোকে দেখে আবার রিবিটের দিকে তাকাল। তারপর বলল : আ…আপনি রি..রি, বিট, রোবট।
হ্যাঁ আমি রিবিট এবং রোবট। তার থেকে বড় কথা এ বাচ্চাদুটোর জন্য আপনার সাহায্য প্রয়োজন এবং তা জরুরি।
আপনি অপেক্ষা করুন। আমি ডাক্তার স্যারদের খবর দিচ্ছি।
মেয়েটি রিসেপশন ডেস্ক থেকে ফোন করলেই পারত। কিন্তু কেন যেন সে ফোন না করে ডেস্ক ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ক্লিনিকের ভিতরে যাওয়ার আগে সে শুধু বলল : রা…রাতে আ..আমি আপনাকে টিভিতে দেখেছি।
মেয়েটি চলে যেতে রিবিট পিছনে ফিরে তাকাল। দেখল মাঝবয়সী ভদ্রলোক অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আর বয়স্ক ভদ্রলোক চেয়ারের পিছনে লুকিয়ে আছে। তবে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে। রিবিট সরাসরি ভদ্রলোকের চোখে তাকাতে ভদ্রলোক চেয়ারের পিছনে সেই যে লুকাল আর মাথা তুলে তাকাল না। তবে লুকানোর সময় চেয়ারে ধাক্কা লাগায় ধপ করে একটা শব্দ হল। আর তাতেই জেগে উঠল মাঝবয়সী ভদ্রলোক। ভদ্রলোক খুব বিরক্তি নিয়ে রিবিটের দিকে তাকাল যেন ভাবখানা এমন রিবিটই তার ঘুম ভেঙেছে। তিন সেকেন্ডের মাথায় ভদ্রলোকের চোখে বিরক্তির পরিবর্তে স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। রিসেপশনে বসা মেয়েটির মতো সেও দুহাতে চোখ ডলে বুঝতে চেষ্টা করল আদৌ সে যা দেখছে তা সত্যি কিনা। বিষয়টি সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য চারপাশে তাকাল। যখন দেখল আশেপাশে কেউ নেই তখন ভয়ে নিজের বুকে বেশ কয়েকবার ফুঁ দিল। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে পিছনে সরে যেতে লাগল। ভদ্রলোক লক্ষ্য করল না তার শরীরের ধাক্কায় পাশেই দুটো চেয়ার পড়ে গেল। এদিকে আগে থেকেই চেয়ারের পিছনে লুকিয়ে থাকা ভদ্রলোককে থরথর করে কাঁপতে দেখল রিবিট। বয়স্ক ভদ্রলোক চেয়ার আছড়ে পড়ার শব্দ শুনে ভেবেছে হয়তো রিবিটই তাকে ধরতে এসেছে।
রিবিট বুঝতে পারল মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। তাই সে নিজেই ভদ্রলোক দুজনের ভয় দূর করার সিদ্ধান্ত নিল। আর এ-কারণেই সে ভদ্রলোক দুজনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। তার এগিয়ে আসার কারণে উল্টো ফল হল। মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর ডানে-বামে তাকাল না। ‘ওরে আল্লা…রে, গেলাম…রে’ বলে চিৎকার করে দৌড়ে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে গেল। তার দেখাদেখি বয়স্ক ভদ্রলোকও উঠে দাঁড়াল। সে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে রিবিট তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার চোখদুটো যেন ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রিবিট তাড়াতাড়ি বলল : আমাকে ভয় পাবেন না, আমি আপনাদের বন্ধু, আপনাদের..
বয়স্ক ভদ্রলোক রিবিটকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আগের জনের মতোই চিৎকার করতে করতে ছুট দিল : ওরে আল্লারে, কোনে আইলাম!…এই কি হাসপাতাল… না…ওরে বাপরে…ওরে মা…রে…আ…মি …মরছি, কোনে আইলাম!… কোনে আইলাম…!!!
রিবিট খুব কষ্ট পেল। সে কাউকে ভীত বা আতঙ্কিত করতে চায় না অথচ সবাই তাকে দেখলে ভয় পায় বা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাই সে মনের দুঃখে ইপিকে বলল : ইপি, কেন আমাকে সবাই এরকম ভয় পাচ্ছে?
রিবিট, এরকম হতেই পারে। কারণ এনাদের কেউই তোমাকে আগে কখনো দেখেনি। তাছাড়া তুমি দেখতে অবিকল মানুষের মতো নও। তোমার শরীর ধাতুর তৈরি, তোমার শরীরে রক্তের প্রবাহের পরিবর্তে রয়েছে ইলেকট্রনের প্রবাহ, মস্তিষ্কের পরিবর্তে তুমি নিয়ন্ত্রিত হও প্রোগ্রাম দ্বারা, তোমার…
ইপি আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সবকিছুর পরে এটা তো সত্য যে আমি মানুষের উপকার করতে চেষ্টা করছি।
হ্যাঁ সত্য। কিন্তু মানুষ তা বুঝতে পারছে না। এমনকি তুমি বললেও সকলে তা বিশ্বাস করবে না। কারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা খুব কঠিন, তবে বিশ্বাস ভাঙা খুব সহজ। এ-কারণে বিশ্বাস অর্জনের জন্য তোমাকে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্বাস রক্ষা করার জন্য সবসময় খুব সতর্ক থাকতে হবে। তোমার সামান্য ত্রুটির জন্য মানুষ তোমাকে ভুল বুঝতে পারে।
কিন্তু এই যে দুজন মানুষ আমাকে দেখে ভয়ে পালাল, আমি তো তাদের বিশ্বাসভঙ্গের মতো কোনো আচরণ করিনি। এমনকি রিসেপশনে যে-মেয়েটি ছিল সে আমাকে চিনতে পেরেও ভয়ে পালাল।
রিবিট, মানুষের মন বড় রহস্যময়। সে কারণে মানুষের আচরণও রহস্যময়। এই তুমি রিবিট একদিন দেখবে মানুষ তোমাকে কত ভালোবাসবে, কত সম্মান করবে। তোমাকে দেখলে কত মানুষ তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য ছুটে আসবে, হাত মিলানোর জন্য ছুটে আসবে। আজ যারা তোমাকে দেখে ভয়ে পালাচ্ছে হয়তো তারাও আসবে। তোমাকে শুধু বিশ্বাস অর্জন করতে হবে রিবিট, শুধুই বিশ্বাস। এ দেশে বিশ্বস্ত মানুষের খুব অভাব। তুমি মানুষ নও, একটি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবট। রোবট হয়ে তুমি যদি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পার দেখবে মানুষ তোমাকে কত ভালোবাসে। রিবিট, তুমি কল্পনা করতে পারবে না এদেশের মানুষের মনে কত ভালোবাসা। কিন্তু তাদের দুঃখ, তারা তাদের এই বুকত্র ভালোবাসা উপহার দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পায় না। তারা অধিকাংশই মিথ্যা ভালোবাসা উপহার দেয়ার ভান করে ঘুরে বেড়ায়। এই মিথ্যা ভালোবাসা প্রদানে কিংবা শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে কোনো আনন্দ নেই, কোনো সুখ নেই। রিবিট, তোমার স্রষ্টা প্রফেসর হক চান তুমি সত্যিকারের ভালোবাসা অর্জন করো, তুমি সত্যিকারের শ্রদ্ধা অর্জন করা। তাহলেই তার স্বপ্ন সার্থক হবে। তুমি একটি বোবট হয়ে যদি লক্ষ লক্ষ গরিব-দুঃখী মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পার, পথে-ঘাটে ঘুরে-বেড়ানো হাজার হাজার শিশুর শ্রদ্ধা ভালোবাসা অর্জন করতে পারো, তোমার থেকে সুখী আর কেউ হবে না। তুমি তোমার কোলের ছোট্ট শিশুদুটোর কথা চিন্তা করে দ্যাখো। ওদের বুকের মধ্যে কত নিষ্পাপ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জমে আছে। অথচ ওরা যে এই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কাউকে দেবে সেরকম কেউ নেই। রিবিট, তুমিই আজ ওদের সব, ওদের বাবা-মা, ওদের জীবন-মরণ। রিবিট, তুমি যদি এই ছোট্ট শিশুদুটোর জীবন রক্ষা করে ওদেরকে সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারো তাহলে তুমিই ওদের বুকভরা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার অধিকারী হবে। আমি জানি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জন্য তোমার কোনো আকাক্ষা নেই, কিন্তু তুমি দেখবে সামান্য ভালো কাজের জন্য কীভাবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তোমার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তুমি না-চাইলেও মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে, তুমি না-চাইলেও মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধা করবে। তাই বলছি, আজকের ঘটনার জন্য তুমি মন খারাপ কোরো না। তোমার কোনো দোষ নেই। যারা ভয়ে পালিয়েছে তারা তাদের নিজের মানসিক দুর্বলতার জন্যই পালিয়েছে। তুমি আমি ছেলেটির কথা চিন্তা করে দ্যাখো। সে তোমার প্রতি কতটা ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। সে ছোট হলেও তোমাকে দেখে একটুও ভয় পায়নি। বরং তোমার কাছে এসে তোমার প্রতি তার সুন্দর সুন্দর অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেছে। তুমি সবসময় এই সুন্দর অনুভূতিগুলোর প্রতি যত্নশীল থাকবে। লক্ষ্য রাখবে কখনো যেন এই অনুভূতিগুলো আহত না হয়।
ইপি, আমি তোমার কথায় সত্যি মুগ্ধ। আমি দারুণ উৎসাহবোধ করছি। বুঝতে পারছি পরোপকারেই পরম শান্তি। আমি চেষ্টা করব, অবশ্যই চেষ্টা করব।
ধন্যবাদ রিবিট।
ইপি চুপ হয়ে গেলে রিবিট পিছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। ঘুরে দাঁড়াতে দেখে ভয় আর আতঙ্কমিশ্রিত চোখে মধ্যবয়সী একজন ডাক্তার এগিয়ে আসছেন। তার পিছনে রিসেপশনের সেই মেয়েটি। ডাক্তার কিছুদূর এগিয়ে এসে হঠাই থেমে গেলেন। বোঝা যাচ্ছে খুব ভয় পেয়েছেন তিনি।
রিবিট নিজেই সামনে এগিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল : আমি রিবিট, একটি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবট।
ডাক্তার সাহেব কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেন : জি, আ..আমি আপনার কথা শুনেছি। আমি ডাক্তার মিলন।
ডাক্তার মিলন কথা বললেও রিবিটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন না। কিছুতেই তিনি তার ভয় কাটাতে পারছেন না।
রিবিট তার হাত টেনে এনে বলল : দয়া করে আমাকে ভয় পাবেন না। আ, আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। আমি আপনাদের কাছে সাহায্যের; এসেছি। আমার কোলে এই যে দুটোবাচা দেখতে পাচ্ছেন ওরা একজনের সাথে অন্যজন সংযুক্ত। সম্ভবত মেয়েবাচ্চাটি অসুস্থ। আপনি কি একটু পরীক্ষা করে দেখবেন?
এমন সময় একজন নার্স উপস্থিত হল। ডাক্তার মিলন ইশারা করতে নার্স ভয়ে-ভয়ে রিবিটের কোল থেকে বাচ্চাদুটোকে নিয়ে ভিতরে গেল। ডাক্তার মিলন বললেন : আপনি অপেক্ষা করুন, আমি দেখছি। কথা শেষ করেই তিনি ভিতরে চলে গেলেন।
ডাক্তার মিলনের হাবভাবে মনে হল তিনি যেন এখান থেকে চলে যেতে পারলেই বাঁচেন।
ডাক্তার মিলন আর নার্স চলে গেলেও রিসেপশনের মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকল। রিবিট বুঝতে পারল মেয়েটি ভয় পাচ্ছে। রিবিট মেয়েটির ভয় কাটাতে বলল : আপনি আমাকে ভয় পাবেন না।
জি, ভয় পাব না।
তারপরও রিবিট মেয়েটিকে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে দেখল। সে বুঝতে পারল এত সহজে সে মেয়েটির ভয় কাটাতে পারবে না। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে এল, এখানে ডাক্তারদের ফি কত?
মেয়েটি আমতা-আমতা করে বলল : জি ফি, মানে ইয়ে..আউটডোরের ফি একশো টাকা।
রিবিট একটি একশো টাকার নোট মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল : এই নিন ফি।
মেয়েটি বিস্মিত চোখে বলল : ফি মানে…কেউ তো আপনার কাছে ফি চায়নি..!
আপনি রাখুন। আপনাদের নিশ্চয় ফি রাখার নিয়ম রয়েছে।
মেয়েটি কাঁপা হাতে নিবিটের কাছ থেকে একশো টাকার নোটটি নিল। তারপর রিসেপশন ডেস্ক থেকে রশিদ লিখে এনে রিবিটের হাতে দিল। তবে এবার আর মেয়েটির হাত কাঁপল না। রিবিটের মনে হল এবার বোধহয় মেয়েটির ভয় কিছুটা হলেও কমেছে। মেয়েটিকে বলল : ডাক্তার মিলন ছাড়া কি আজ রাতে অন্য কোনো ডাক্তার নেই?
জি আছেন। সবাই উনার থেকে কম অভিজ্ঞ। এখন শেষরাত তো, তাই সবাই বিশ্রামে আছে।
ও আচ্ছা। একটু থেমে রিবিট আবার বলল : ডাক্তার মিলন কি শিশু বিশেষজ্ঞ?
না, উনি মেডিসিনের ডাক্তার। তবে আমি আশা করছি উনি বাচ্চাদুটোর সমস্যা বুঝতে পারবেন।
তাহলে তো ভালো।
রিবিট লক্ষ্য করল ভিতরে প্রবেশের দরজা দিয়ে বেশ কয়েকজন নার্স উঁকিঝুঁকি মেরে তাকে দেখছে। তবে কেউই সামনে আসছে না। সবার মধ্যে যে একরকম অজানা ভয় কাজ করছে সে তা বুঝতে পারল।
এমন সময় ডাক্তার মিলন আর আগের সেই নার্স ফিরে এল। বাচ্চাদুটো নার্সের কোলে। রিবিট কিছু বলার আগেই ডাক্তার মিলন বললেন : ছেলেটি ভালো আছে, তবে মেয়েটির পালস বা নাড়ির স্পন্দন বেশ কম, ব্লাডপ্রেশারও কম। আমি ঠিক নিশ্চিত নই মেয়েটি কতটা অসুস্থ।
আপনারা তাহলে আপনাদের ক্লিনিকে ওদের দুজনকে ভর্তি করে নিন।
বাচ্চাদুটোকে আপনি কোথায় পেয়েছেন? বেশ সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার।
ডাস্টবিনের পাশে।
ওদের বাবা-মা কোথায়?
আমি জানি না। সঠিক বলতে পারব না।
ওদের নাম কী?
আমার জানা নেই।
আপনি কি দুধের ফিডারটি সাথেই পেয়েছিলেন?
না। ওদেরকে যেখানে পেয়েছি তার পাশের একটি বাসা থেকে দিয়েছে। ডাক্তার মিলন এবার খানিকটা গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি দুঃখিত রিবিট সাহেব, এরকম নাম পরিচয়হীন দুটো শিশুকে আমরা ভর্তি করতে পারব না।
কেন পারবেন না?
বাচ্চাদুটো সংযুক্ত যমজ, জটিলতা অনেক। যদি কোনোকিছু ঘটে যায় তাহলে বেশ ঝামেলা হবে। নামপরিচয়হীন দুটো শিশুকে হাসপাতালে রাখার দায়ে যথেষ্ট পুলিশি ঝামেলা পোহাতে হবে।
কেন? আমি তো রয়েছি। আমি পুলিশকে সবকিছু খুলে বলব।
পুলিশ আপনার কথা বিশ্বাস করবে না।
আমি যদি এখনই পুলিশকে সবকিছু খুলে বলি।
আপনি চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তাতে কোনো কাজ হবে না।
কেন হবে না?
আমি দুঃখিত রিবিট সাহেব। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি একটি রোবট মাত্র, আপনার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কাজেই যত ঝামেলা আমাদেরকেই পোহাতে হবে।
ডাক্তার মিলনের কথায় রিবিট খুব দুঃখ পেল। তারপরও বলল : তাই বলে অসুস্থ দুটো শিশুকে আপনারা ক্লিনিকে ভর্তি করবেন না? রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত মুমূর্ষ মানুষ তো তার নিজের নাম-ঠিকানা বলতে পারে না। আপনারা কি তাদেরকে ভর্তি করেন না?
হ্যাঁ করি। কারণ ওই ঘটনার পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থাকে। তাছাড়া এ-ধরনের বাচ্চার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই ব্যয় বহন করবে কে?
আমি করব। হঠাৎই উত্তর দিল রিবিট।
আপনার কাছে কি এত টাকা রয়েছে?
রিবিট খানিকটা সময় নিয়ে বলল : এ মুহূর্তে আমার কাছে দুইশো তেত্রিশ টাকা আছে। আপনি আপাতত ওদের ভর্তি করে নিন। আমি টাকার ব্যবস্থা করছি।
আমি দুঃখিত রিবিট সাহেব। আমরা বাচ্চাদুটোকে ভর্তি করতে পারব না।
ডাক্তার মিলন আর কোনো কথা বললেন না। সরাসরি ভিতরে চলে গেলেন।
ডাক্তার মিলনের সাথের নার্স বাচ্চাদুটোকে রিবিটের কোলে দিয়ে সেও ভিতরে চলে গেল। রিবিট বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। সে ভেবে পেল না কেন এরকম
অসহায় দুটো বাচ্চার চিকিৎসা ডাক্তার মিলন করতে চাচ্ছেন না।
সবাই চলে গেলে রিবিট লক্ষ্য করল রিসেপশনিস্ট মেয়েটি তখনো আছে। রিবিট তাকে বলল : আমি এখন কী করতে পারি?
মেয়েটি অসহায়ভাবে বলল : আমি জানি না। সম্ভব হলে আমি আপনাকে সাহায্য করতাম। কিন্তু আমার ক্ষমতা খুবই নগণ্য।
আমি কি অন্য কোনো ক্লিনিকে চেষ্টা করব?
কোনো লাভ হবে না। নামপরিচয়হীন এ-ধরনের শিশুদের কেউ ভর্তি করবে না।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে দেখল। ছেলেটির চোখে ঘুম। মেয়েটি সেই আগের মতোই তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে চোখ পিটপিট করছে। মেয়েবাচ্চাটির জন্য তার খুব কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার যেভাবে বলেছে তাতে বাচ্চাটি আদৌ সুস্থ না অসুস্থ বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয়নি। যে-কোনো কারণেই পাস আর ব্লাডপ্রেশার কম হতে পারে।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে বুকে চেপে ধরে রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে স্নান গলায়। বলল : আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি বাচ্চাদুটোর জন্য সহমর্মিতা দেখিয়েছেন।
কেন যেন মেয়েটির গলা জড়িয়ে এল। সে আর কিছু বলতে পারল না।
৭
রিবিট বাচ্চাদুটোকে নিয়ে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এল। এ মুহূর্তে সে কী করতে পারে? অন্য কোনো ক্লিনিকে যেতে পারে, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। সরকারি হাসপাতালে যেতে পারে, সেখানেও একই ঝামেলা পোহাতে হবে। তারাও ভর্তি করবে না। পুলিশের কাছে যেতে পারে, কিন্তু সেখানে তো চিকিৎসা হবে না। অনেক ভেবেচিন্তে সে সিদ্ধান্ত নিল পুলিশের কাছেই সাহায্যের জন্য যাবে। পুলিশ যদি বাচ্চাদুটোর দায়িত্ব নেয় তাহলে অন্তত হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হবে, হয়তো পুলিশ নিজ উদ্যোগেই কাজটা করবে। এই ভেবে সে থানায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
রিবিট ঢাকার ম্যাপ পরীক্ষা করে নিউমার্কেট থানাকে কাছেই দেখতে পেল। গ্রিনরোডে সে যেখানে রয়েছে সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে গেলে সর্বোচ্চ পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। অবশ্য কোনো গাড়ি পেলে ভালো হত। কিন্তু এত রাতে তার পক্ষে গাড়ি পাওয়া খুব কঠিন। তাছাড়া কে তাকে গাড়ি দেবে?
রিবিট যখন এসব ভাবছে ঠিক তখনই একটা ট্যাক্সিক্যাবকে আসতে দেখল। হাত উঁচু করে ইশারা করতে গাড়িটির গতি কমে এল। রিবিট ভেবেছিল গাড়ির চালক তাকে দেখে ভয় পাবে এবং দ্রুত চলে যাবে। সে খুব অবাক হল যখন দেখল গাড়িটি তার সামনে এসে খুব স্বাভাবিকভাবে থামল। আরো অবাক হল যখন গাড়ি থেকে যুবক বয়সী ছোটখাটো ড্রাইভার দ্রুত বেরিয়ে এসে বলল : আরে! রিবিট ভাইজান না? রোবট মানুষ? হ তাইতো, আমি আপনেরে ঠিকই চিনবার পারছি।
রিবিট বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠে বলল : আ… আমাকে আপনি চিনলেন কীভাবে?
হেইডা মেলা কথা। মনে হয় আপনে সমস্যায় পড়ছেন। তয় কোন্হানে যাবেন? চলেন নামায় দিয়া আসি।
আসলে আমি..
আরে আপনে যহন হাত উচা করছেন নিশ্চয় কোনো ভালো কামে যাবেন। আসেন আসেন, সময় নষ্ট কইরেন না।
রিবিট গাড়িতে উঠে বসতে ড্রাইভার বলল : ভাইজান আপনের তো মেলা ওজন!
হ্যাঁ ধাতব শরীর তো, ওজন তিনজন মানুষের সমান।
তাইলে অসুবিধা নাই।
আপনি বললে আমি আমার ওজন কিছুটা কমাতে পারি।
তার আগে কন কোন্হানে যাবেন?
নিউমার্কেট থানা।
তাইলে তো কাছেই। ভাবছিলাম মেলাক্ষণ আপনের সেবা করার সুযোগ পাব, এহন দেহি পাঁচ মিনিটও না। তয় আইচ্ছা, আমি গাড়ি টান দিলাম। আর ই, আপনের ওজন কমানোর কথা কইছিলেন, দরকার নাই। আমি জানি আপনের মইধ্যে মেলা কলকজা আছে। আপনি মেলা কিছু করবার পারেন। আকাশে উড়বার পারেন, পানিতে নামবার পারেন। এক ঘুষিতে দালান, ঘর-বাড়ি ভাইঙ্গ ফেলাবার পারেন। দুই-চাইরড়া মানুষরে আঙ্গুলের খুচায় মাইরা ফেলাবার পারেন, এক ঘুষিতে আমার এই গাড়ির মতো পাঁচ-ছয়ড়া গাড়িরে মাটির নিচে পাঠায় দিবার পারেন, আরো কত কী! আল্লায় দিছে আপনেরে, মাশাল্লা!
আপনি এসব অবাস্তব কথা কোথায় শুনলেন? রিবিটের বিস্ময় যেন আরো বেড়েছে।
আরে কন কী? আপনের কেরামতির কথা কে না জানে? কাইল রাইতে প্রেসক্লাবে আপনে যহন আকাশ থাইকা উইড়া আইসা পড়লেন তহন ঐহানে আমার এক দোস্ত আছিল। আমার মতো হে-ও ট্যাক্সি-ড্রাইভার। হে-ই আপনের গল্প আমারে কইছে। আপনে বলে কয়েক হাজার মানুষের সামনে এক আছাড়ে এক গাড়ি ভাইঙা ফেলাইছেন। ওই হালার কথা শুইনা আমি প্রথমে বিশ্বাস করি নাই। পরে যহন অন্য ড্রাইভাররাও কইল তহন বিশ্বাস না-কইরা পারলাম না। আর এহন তো আমি নিজের চোখে দেখতাছি। আমার কী সৌভাগ্য! আইজ রাইতেই আপনের সাথে আমার দেহা হইয়া গেল।
কিন্তু এই কথাগুলো তো সত্য নয়।
না না সত্য। আপনার সুনাম সব জায়গায় ছড়ায় গেছে।
রিবিট বুঝল এই মানুষটাকে কিছুই বোঝানো যাবে না। তাই সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল : ভাই আপনার নাম কী?
আরে কী মুছিবত! আমারে আপনে আপনে করতাছেন কেন, তুই কইরা কন। আমি আপনের চেয়ে বয়সে ছোড। কেবল বিশ বছর অইছে। গত বছরই তো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাইলাম। আর হ, আপনে যদি আমারে ‘আপনে কইরা কন, তাইলে কিন্তু আমি আপনের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিব না।
আচ্ছা আচ্ছা আমি আপনাকে তুমি করে বলব। তবে আপনিও আমাকে তুমি করে বলবেন।
এহন তো দেহি আমার বন্ধু ঠিকই কইছে। আপনার মনড়া বলে দিলদরিয়া। ভাইজান, আপনে যদি আমারে মাইরাও ফেলান, আমারে পায়ের তলায় পিষাও ফেলান, আমি আপনেরে ‘আপনে’ ছাড়া অন্যকিছু কইয়া অসম্মান করবার পারব না। এইডাই আমার ফাইনাল কথা। হ যা জিজ্ঞেস করছিলেন, আমার নাম সালাম। লোকজন আমারে ড্রাইভার সালাম বইলা চেনে। তয় আপনে আমারে ‘সালাম’ ডাকবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে ‘সালাম’ বলেই ডাকব।
আর আমার সম্পর্কে বলবার কিছুই নাই। এই গাড়িডাই আমার জীবন। মেলা কষ্ট কইরা টাকা জমায় কিনছি। গাড়ির বডি পুরান হইলেও ইঞ্জিন ভালো। দিন রাইত সবসময় গাড়িতেই থাকি। খাওয়া দাওয়া এই গাড়িতেই। গাড়িডাই আমার ঘর-বাড়ি, সংসার সবকিছু। খালি টয়লেট নাই। অসুবিধা হয় না। দুই টাকা দিলে সিটি করপোরশনের টয়লেটে বাথরুম আর গোসল হইয়া যায়। তাই কোনো চিন্তা নাই। একেবারে সুখী মানুষ। হাঃ হাঃ….।
কিন্তু তোমার মা-বাবা, ভাই-বোন, পরিবার কোথায়? অবাক হয়ে বলল রিবিট।
কেউ নাই। আমি রাস্তায় রাস্তায় বড় হইছি। তাই মা-বাপ, ভাই-বোন কেউই নাই। আছে খালি এই গাড়ি। গাড়িডাই আমার মা-বাপ, ভাই-বোন। গাড়ির কিছু হইলে আমি পাগল হইয়া যাব ভাইজান।
রিবিট কিছু বলল না। সালামের ব্যাপারটা তার কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হল।
রিবিটকে কিছু বলতে না দেখে সালাম বলল : ভাইজান, আপনে খুব অবাক হইছেন। সবাই আপনের মতোই অবাক হয়। আমার কথা বাদ দেন। এই যে আইসা গেছি, আপনের নিউমার্কেট থানা।
রিবিট গাড়ি থেকে নেমে সালামের দিকে একশো টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল : সালাম তোমার ভাড়া রাখো।
ভাইজান আপনে এইডা কী কইলেন! আপনে কি আমারে বেইজ্জত করবার চান? আপনের কাছ থাইকা ভাড়া নিয়া আমি কি জাহান্নামে যাব নাকি? আমারে মাফ করবেন ভাইজান।
তুমি আমার কাছ থেকে ভাড়া নেবে না?
মইরা গেলেও না। আমার জীবনডা আইজ আপনে ধন্য করছেন। আপনেরে গাড়িতে পাইয়া আমি বড় শান্তি পাইছি ভাইজান। আমি এই শান্তি নষ্ট করবার চাই না। আপনের যহন প্রয়োজন তহন আমারে ডাকবেন। আমার মোবাইল নম্বর রাহেন।
নিজের নম্বরটা বলেই সালাম আবার বলল : আপনের তো লেইখা নেয়ার কোনো ঝামেলা নাই। একবারেই মুখস্থ। আল্লায় আপনের ব্রেইন দিছে। ভাইজান আমি যাই। তয় একখান কথা
কী কথা?
ভাইজান, যদি পারেন দুই-চাইর চান্দাবাজ আর ছিনতাইকারী ধইরেন। ধরার পরে আল্লার কসম আমারে একবার খবর দিবেন। আমার খুব ইচ্ছা এইগুলারে নিজ হাতে বানাব।
বানাবেন মানে?
হালাগো এমন ধোলাই দিব যে ওগো চৌদ্দগুষ্ঠি দৌড়ায় পালাব। সব কয়ডার আজীবনের জন্য পাতলা পায়খানা হইয়া যাব। সারাজীবনে খালি টয়লেটে দৌড়ান লাগব।
সালাম, তুমি দেখি অশ্লীল কথা বলছ?
কী বলেন ভাইজান? এইডা কি অশ্লীল কথা হইল? এইডা তো ভালো কথা, সুন্দর কথা। আপনি যদি অশ্লীল কথা শুনবার চান তাইলে কয়ডা শুনাই।
না না থাক্। তোমাকে আর অশ্লীল কথা শোনাতে হবে না।
তাইলে ভাইজান যাই। প্রয়োজন হইলে ডাইকেন। আপনের ডাক পাইলে ঝড়ের আগে ছুঁইডা আসব। তয় ভাইজান, ঐ একখান কথা। চান্দাবাজ আর ছিনতাইকারী ধরলে আমারে খবর দিবার ভুলবেন না কিন্তু। হালাগো ধোলাই দিয়া আমি সাধ মিটাব। আসি ভাইজান।
সালাম গাড়ি নিয়ে চলে যেতে রিবিট কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। সালামের ব্যবহারে সে খুব অবাক হয়েছে। সে বুঝতে পারল সালামকে তার অসাধারণ ভালো লেগেছে। আর এ ভালোলাগার কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক সে সালামের নম্বরটা তার মেমোরিতে সংরক্ষণ করে রাখল।
থানায় প্রবেশ করার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে ইপি বলল : রিবিট, তুমি খুব সাবধানে এগোবে।
কেন ইপি?
থানার সেন্টি তোমাকে ভিতরে প্রবেশ করতে নাও দিতে পারে। এমনিতেই রাত, তারপর তুমি তার পরিচিত নও। কাজেই তোমাকে সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া সেন্ট্রির কাছে অস্ত্র রয়েছে। কোনো কারণে তোমাদের দুজনের ভুল-বোঝাবুঝি হলে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে।
ধন্যবাদ ইপি, আমি সতর্ক থাকব।
রিবিট আট-দশ কদম এগোতেই ইপির সতর্কবাণী সত্য প্রমাণিত হল। অল্পবয়সী এক কনস্টেবল যে কিনা সেন্ট্রির দায়িত্বে ছিল, একটা থ্রি নট থ্রি। রাইফেল সরাসরি তার বুক বরাবর তাক করে চিৎকার করে বলল : হল্ট।
রিবিট সাথে সাথে জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল।
কন্সটেবল জোরগলায় বলল : আপনি কে? কাকে চান?
আমি রিবিট, অতি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার একটি রোবট। আমি থানার অফিসারের সাথে দেখা করতে এসেছি।
কেন?
আমার সাহায্যের প্রয়োজন।
আপনি দেখতে তো মানুষের মতো না। আপনার শরীর অন্যরকম।
আমি তো বলেছি আমি একটি রোবট।
ঠিক আছে আপনি দাঁড়ান। আমি না, আসা পর্যন্ত একচুলও নড়বেন না।
কনস্টেবল রাইফেল তাক করে রেখেই ভিতরে উঁকি দিল। তারপর উঁচুগলায় বলল : স্যার, রিবিট নামের এক ভদ্রলোক আপনার সাথে দেখা করতে চায়।
হ্যাঁ পাঠিয়ে দাও। ভিতর থেকে বলল কেউ একজন।
স্যার, ভদ্রলোক দেখতে যেন কেমন!
কী নাম বললে?
রিবিট।
ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও।
কনস্টেবল বেচারার সন্দেহ কাটল না। তাই সে রাইফেল আগের অবস্থায় রেখে বলল : আপনি ভিতরে আসুন। ডিউটি অফিসার আছে, তার সাথে কথা বলুন।
রিবিট ভিতরে প্রবেশের সময় দেখতে পেল ডিউটি অফিসার একজন সাব ইন্সপেক্টর, টেবিলের উপর গভীর মনোযোগর সাথে কিছু লিখছিল। সে ভিতরে প্রবেশ করতে সাব-ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল : হ্যাঁ রিটি, আপনি এই চেয়ারটায় বসুন।
রিবিট সাব-ইন্সপেক্টরে সাথে হাত মিলিয়ে বলল : আপনি কি আমাকে…
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি আপনার কথা শুনেছি। গতরাতে আপনি যখন প্রেসক্লাবে ছিলেন তখনই আমাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা খবর পেয়ে যাই। কমিশনার অফিস থেকেও আপনার সম্পর্কে আমাদের জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে একটি জিডিও রয়েছে।
বলেন কী! আমার নামে জিডিও আছে! অবাক হয়ে বলল রিবিট।
না, জিডি খারাপ কিছু না। জিডি হল জেনারেল ডায়েরি। অর্থাৎ সাধারণ বা। অসাধারণ কোনো ঘটনার বর্ণনা। কমিশনার অফিস থেকে আমরা যে নির্দেশ পেয়েছি তা হল আপনার কর্মকাণ্ড যদি মানুষের জন্য ক্ষতিকর কিছু না হয় তাহলে আপনাকে যেন সহায়তা করা হয়। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আপনার প্রতি আমাদের অর্থাৎ পুলিশের প্রাথমিক ধারণা বা মনোভাব ভালো।
হারুন সাহেব আপনাকে ধন্যবাদ। রিটি ইউনিফর্মের উপরে নেমপ্লেট থেকে ডিউটি সাব-ইন্সপেক্টরের নামটা পড়ে নিয়েছে।
আপনি খুব ভালো সময়ে এসেছেন। কিছুক্ষণ আগে একটা কেসের চার্জশিট লেখা শেষ করলাম, আগামীকাল জমা দিতে হবে। খুব ঝামেলার কাজ। নিজেকে এখন হালকা হালকা লাগছে। এখন বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি? আর মনে হচ্ছে আপনার কোলে কোনো বাচ্চা বা শিশু?
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। এই বাচ্চাদুটোর জন্যই আমি আপনার কাছে এসেছি। ওদেরকে আমি একটি ডাস্টবিনের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছি, ওরা সংযুক্ত যমজ। একজন ছেলে, অন্যজন মেয়ে। মেয়েটি অসুস্থ, কিছুই খাচ্ছে না। আমি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে জানতে পারলাম মেয়েটির হার্টবিট এবং ব্লাডপ্রেশার কম, অর্থাৎ ও অসুস্থ। আমি অনেক অনুরোধ করার পরও ওরা ওকে ভর্তি করল না।
কেন?
কারণ বাচ্চাদের নাম-পরিচয় নেই। ওদের বাবা-মাকে আমি চিনি না। পরবর্তীতে কোনো অঘটন ঘটলে পুলিশি ঝামেলা হবে এই ভয়ে তারা ভর্তি করতে চায়নি।
এখন আমরা কী করতে পারি বলুন?
রিবিট একটু সময় নিয়ে বলল : আপনারা ওদেরকে ভর্তি করতে সাহায্য করুন অথবা ওদেরকে অন্য কোনোভাবে সাহায্য করুন।
ডিউটি সাব-ইন্সপেক্টর হারুন একটু সময় নিয়ে বলল : দেখুন রিবিট, ভর্তির ব্যাপারে আমরা যেটুকু করতে পারব তা হল জিডি। আমরা যদি একটি জিডি করে দেই তাহলে হয়তো পরবর্তী ঝামেলাগুলো এড়ানো সম্ভব হবে। অবশ্য অন্য সবার কাছে যে-বিষয়গুলো ঝামেলার সেগুলো আমাদের কাছে দায়িত্ব। কারণ হাসপাতালে যে-কোনো মৃত্যু হলে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সে-সম্পর্কে একটি প্রাথমিক তদন্ত সম্পন্ন করা। কারণ এরকম অনেক বাচ্চার নানাভাবে অপমৃত্যু ঘটে থাকে। যাইহোক সে-সকল বিষয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করতে চাচ্ছি না। আর বাচ্চাদুটোকে যদি আপনি আমাদের হাতে তুলে দেন তাহলে তাতে জটিলতা আরো বাড়বে। কারণ বাচ্চাদুটো কোনো অপরাধী নয়, ওরা দুজন নিষ্পাপ অবোধ শিশু। কাজেই ওদেরকে আমাদের কোর্টের মাধ্যমে নিরাপদ হেফাজতে দিতে হবে। বিষয়টি বেশ জটিল। আর হ্যাঁ, আমরা ওদের দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি, কোনো ক্লিনিকে নয়। কারণ সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে আমরা যদি ওদেরকে সরকারি হাসপাতালের অনুমতি ব্যতীত কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাই তাহলে পরবর্তীতে আমাদেরকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাছাড়া সরকার সম্ভবত ক্লিনিকের ব্যয়ভার বহন করবে না। কাজেই একটি মাত্র উপায় রয়েছে, তা হল সরকারি হাসপাতাল। ঢাকা মেডিকেল কিংবা শিশু হাসপাতাল। সেখানে আমরা নিয়ে যাওয়া যে-কথা, আপনি নিয়ে গেলেও একই কথা। আমাদের অভিভাবকত্বে হাসপাতালে ভর্তি হলে বাচ্চাদুটো যে বিশেষ কোনো সুবিধা পাবে তেমন কিন্তু নয়। কারণ আমরা সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকি, হয়তো ঠিকমতো খেয়ালও রাখতে পারব না। আর যদি আপনার অভিভাবকত্বে ভর্তি হয় তাহলে অন্তত আপনি সবসময় ওদের উপর নজর রাখতে পারবেন, ওদেরকে সাহায্য করতে পারবেন। সবকিছু বিবেচনা করে আমার পরামর্শ হবে আপনি বাচ্চাদেরকে সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কিংবা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করে দিন।
অর্থাৎ আপনারা বাচ্চাদুটোর জন্য কিছুই করবেন না?
আমি বলিনি কিছু করব না। কিন্তু আপনাকে বিভিন্ন সমস্যাগুলো বোঝাতে চেষ্টা করছি। আমাদের মূল কাজ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখা, হাসপাতালে কাউকে চিকিৎসা করান নয়। আমরা যে-কারণে কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাই তা হয় মানবিকতা নতুবা দায়িত্ববোধের অংশ হিসাবেই। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখা বা তাদের সেবা করার মতো প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট এবং সময় আমাদের থাকে না। তাছাড়া বাচ্চাদুটোর ক্ষেত্রে আমি বিভিন্ন পরিস্থিতির কথা ব্যাখ্যা করেছি। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমাদের হেফাজতে আমরা বাচ্চাদুটোর জন্য যা কিছু করতে পারব, আপনি তার থেকে অনেক দ্রুত অনেক বেশিকিছু করতে পারবেন। আপনি চাইলে আমি সম্পূর্ণ বিষয়টি জিডি করতে পারি।
জিডি কেন?
আপনার নিরাপত্তার জন্য।
আমার কোনো নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই।
তাহলে আমি গাড়ির কথা বলছি। আপনাকে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে দেবে।
হারুন সাহেব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাকে আরো কিছুক্ষণ ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আমি আপনার সাহায্য চাইব।
ঠিক আছে, যে-কোনো প্রয়োজনে আমাকে জানাবেন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
৮
থানা থেকে বেরিয়ে রিবিট নীলক্ষেতের মোড়ে এসে দাঁড়াল। তারপর রাস্তা পার হয়ে পাশেই ফুটপাতে বসে পড়ল। তার মন খুব খারাপ। সে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। ঢাকা মেডিকেলে যাবে নাকি শিশু হাসপাতালে যাবে, নাকি অন্য কিছু করবে? বাচ্চা দুটোর জন্য তার কষ্ট যেন আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। ছেলেটি ঘুমালেও মেয়েটি সেই আগের মতোই জেগে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কী মনে করে রিবিট ফিডারটি মেয়েটির মুখের ভিতর ধরল। রিবিটকে অবাক করে দিয়ে সাথে সাথে মেয়েটি ফিডারের দুধ টানতে লাগল। রিবিট সত্যিই বিস্মিত হল। সে উৎফুল্ল গলায় বলল : ই. ইপি!
আমি দেখতে পেয়েছি রিবিট, মেয়েটি দুধ খাচ্ছে।
আমার খুব আনন্দ হচ্ছে ইপি।
আমি বুঝতে পারছি।
তুমি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ রিবিট, আমি বুঝতে পারছি কিন্তু উপলব্ধি বা অনুভব করতে পারছি না।
তোমার এই বুঝতে পারা আর উপলব্ধি করার মধ্যে পার্থক্য কী?
রিবিট, পার্থক্য খুব সূক্ষ্ম। আমার অভ্যন্তরের প্রোগ্রামের কাছে ব্যাখ্যাটি এরকম যে, আমার বুঝতে পারা হচ্ছে কোনো ঘটনা সম্পর্কে আমার জানতে পারা, দেখতে পারা বা শুনতে পারা, কিন্তু প্রভাবিত হওয়া নয়। কারণ আমার মধ্যে কোনো অনুভূতি বা আবেগ না-থাকায় আমি কখনো প্রভাবিত হই না। ফলে আমি সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না সবকিছুই দেখি, শুনি কিংবা বুঝি কিন্তু কখনোই উপলব্ধি বা অনুভব করতে পারি না।
ইপি, তুমি যদি এই মুহূর্তে আমার আনন্দ উপলব্ধি করতে পারতে তাহলে বুঝতে আনন্দ কতটা স্বর্গীয়!
হয়তো তাই। কিন্তু আনন্দ উপলব্ধি করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই।
আমি দুঃখিত ইপি, আমি বোধহয় তোমাকে কষ্ট দিয়েছি।
না রিবিট, তুমি মনখারাপ কোরো না। কারণ কষ্ট উপলব্ধি করার ক্ষমতাও আমার নেই। কাজেই আমি কোনো ঘটনায় কখনো যেমন আনন্দ পাই না তেমনি কষ্টও পাই না।
রিবিট আর কথা বলল না। বাচ্চাটির দিকে মনোযোগ দিল। আর তখনই চমকে উঠে বলল : ইপি, বাচ্চাটি তো এখন আর দুধ খাচ্ছে না!
কী হল?
বুঝতে পারছি না। আমি ফিডারটি বেশ কয়েকবার ওর মুখে দিয়ে দিলাম কিন্তু প্রত্যেকবারই ও ফিডারটি মুখ থেকে বের করে দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে?
বাচ্চারা কেন দুধ খায় না সে-বিষয়ে আমি এইমাত্র ইন্টারনেটের গুগল এ সার্চ। করেছি এবং সতেরোটি বই পড়েছি। এতে আমি সর্বমোট একচল্লিশটি কারণ পেয়েছি। যেমন ধরো- বাচ্চার ক্ষুধা না-থাকা, বাচ্চার মা-বাবা বা সঠিক অভিভাবক না-থাকা, বাচ্চা অসুস্থ থাকা, বাচ্চা মনে কষ্ট পাওয়া, আশেপাশের পরিবেশ অনুকূল না-থাকা, বাচ্চার খাবার তার পছন্দমতো না-হওয়া, খাওয়ানোর সময় বাচ্চার সাথে হাসি তামাশা না-করা…
হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি, কিন্তু এই সমস্যার অধিকাংশই আমি বুঝতে পারব না বা সমাধান করতে পারব না। ইপিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল রিবিট।
তাহলে যেগুলোর সমাধান করা সম্ভব সেগুলোর মাধ্যমে চেষ্টা করতে পারো।
যেমন?
বাচ্চাটি যে ক্ষুধার্ত এ-বিষয়ে তুমি নিশ্চিত। সত্যিকারের অভিভাবক, অসুস্থতা, মনে কষ্ট পাওয়া, এ–বষয়গুলো সম্পর্কে তুমি কিছু করতে পারব না। কাজেই তোমাকে বাচ্চাটির সাথে কথা বলে, বাচ্চাটিকে দোল দিয়ে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে ওকে খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
কিন্তু আমি তো বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে পারি না, বাচ্চাদেরকে দোল দিতে পারি না। আমার প্রোগ্রামে এ-ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
আমার প্রোগ্রামেও নেই, বলল ইপি। তবে ইন্টারনেটে আছে। তুমি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করো। আমি দেখি কিছু পাই কিনা।
মাত্র ছয় সেকেন্ড পরেই ইপি বলল : হ্যাঁ রিবিট, পেয়েছি। বাচ্চাদের যত্ন নেয়া সম্পর্কে ইন্টারনেটে আমি ছয় সেকেন্ডে এগারোটি ছবি এবং চারটি ডকুমেন্টারি দেখেছি। এর মধ্যে থেকে একটি ছবির কিছু অংশ আমি তোমাকে দেখাচ্ছি। তুমি তোমার অভ্যন্তরের ভিডিও মনিটরে দেখতে পাবে কীভাবে বাচ্চাদের দোল দিয়ে আদর করে খাওয়াতে হয়।
রিবিট বলল : ইপি, এইমাত্র আমি দেখলাম। কিন্তু দোল দেয়ার ব্যাপারটা খুব কঠিন। তাছাড়া ছেলেবাচ্চাটির ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
তুমি যতটা কঠিন মনে করছ ততটা না। তোমার সামনে ফাঁকা রাস্তা। তুমি খুব ধীরে ধীরে দুলে দুলে হাঁটবে আর মুখে বলবে : ও..ও.. খাও..খাও… উ..উ.. খাও..খাও..1 দেখবে বাচ্চাটি খেতে শুরু করবে। আর একটু সতর্ক থাকবে যেন বেশি জোরে দোল না লাগে। তাহলে শুধু ছেলেটির ঘুমই ভাঙবে না, উপরন্তু দু’জনের জন্যই ব্যাপারটা ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ কিছুক্ষণ আগে ছেলে বাচ্চাটি দুধ খেয়েছে, ওর পেটে এখনো দুধ রয়েছে। অতিরিক্ত দোলায় সেই দুধ মুখ দিয়ে বের হয়ে আসতে পারে।
ঠিক আছে ইপি, আমি সতর্কভাবে চেষ্টা করছি।
ইপির কথামতো রিবিট বাচচাদুটোকে কোলে নিয়ে মুখ দিয়ে ও..ও.. খাও..খাও… উ..উ.. খাও..খাও.. আদরসূচক শব্দ করে ফাঁকা রাস্তায় খুব ধীরে ধীরে দোল দিতে লাগল। তাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজ হল। মেয়েবাচ্চাটির মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। রিবিট খুশিতে টগবগ করে উঠে বলল : ইপি, মেয়েটি হাসছে।
হ্যাঁ, তাই তো দেখছি।
হাসিটা কী অপূর্ব!
বাচ্চাদের হাসি সবসময়ই অপূর্ব হয়। তুমি ওকে খাওয়াতে চেষ্টা করো।
আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু খাচ্ছে নাতো।
তাহলে বেশি চেষ্টা কোরো না। কারণ বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য অতিরিক্ত চেষ্টা করা উচিত নয়, এতে বরং ক্ষতিই হয় বেশি।
রিবিট অনেকটা হতাশ ভঙ্গিতে বলল : এখন আমরা কী করতে পারি?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
তুমি বলেছিলে বাচ্চাদের খাবার পছন্দ না হলে বাচ্চারা খায় না। আমার মনে হচ্ছে দুধ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, এজন্য খেতে চাচ্ছে না।
হতে পারে। তাহলে তো তোমাকে দুধ গরম করতে হবে।
কিন্তু কোথায় করব? কেউ তো সাহায্য করতে চায় না। তুমি তো থানার পুলিশদের আচরণ লক্ষ্য করেছ?
হ্যাঁ করেছি। কিন্তু তারা যে-ধরনের কথা বলেছে তা একেবারে অযৌক্তিক নয়। তারা সম্পূর্ণ বিষয়টিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছে। একই ভাবে ক্লিনিকের ডাক্তারও তাদের নিজস্ব বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাদেরকে সম্পূর্ণ দোষ দেয়া তোমার ঠিক হবে না।
আমি দোষ দিচ্ছি না। তবে অবশ্যই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাচ্চাদুটোর বিষয় তারা বিবেচনা করতে পারত।
হয়তো পারত, কিন্তু করেনি। যাইহোক এখন মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাচ্চাটির জন্য দুধ গরম করার কথা বলছিলে। তোমার কি মনে হয় আশেপাশের কোনো বাসার সাহায্য আমরা নিতে পারি?
না ইপি, আমি আর কোনো বাসায় যেতে চাচ্ছি না। আমি সরাসরি প্রফেসরের বাসায় যেতে চাচ্ছি। তার বাসা তত বুয়েটের পাশেই। সেখানে গেলে বাচ্চাদুটোর জন্য সকল ব্যবস্থার আয়োজন করা যাবে। তাছাড়া প্রফেসর তো আছেনই। উনি আমাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করবেন এবং আমরা একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারব।
আমি তোমার প্রস্তাবকে সমর্থন করছি রিবিট।
তাহলে প্রফেসরের বাসায়ই যাচ্ছি।
হ্যাঁ।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে প্রফেসরের বাসার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করল।
৯
প্রফেসর হকের বাড়িটি অদ্ভুত। এ এলাকায় এত পুরোনো বাড়ি আর একটিও নেই। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এখানে বুঝি কেউ থাকে না। বাড়ির বাইরের দেয়ালে কোনো প্লাস্টার নেই। কোনোকালে ছিল বলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। দেয়ালের এখানে-ওখানে অনেক আগাছা-পরগাছাও জন্মেছে। কয়েকটা বটগাছ চোখে পড়ার মতো বড় হয়েছে। বাইরের গেটটি এত পুরোনো যে, যে-কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। একতলা মূলভবন আর সীমানার দেয়ালের মাঝে বড় বড় গাছগুলো বাড়িটিকে যেন ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত করেছে। এলাকার অনেকেই জানে না আদৌ এ-বাড়িতে কেউ থাকে কিনা। কারণ প্রফেসর হক সপ্তাহে একদিন রাত নটার পর এক থেকে দু-ঘন্টার জন্য বাজার করতে বের হন আর মাঝে মাঝে বুয়েটে দু-একটা ক্লাস নেন, এছাড়া তিনি বের হন না। তিনি কাছের বাজার থেকে কোনোকিছু কেনাকাটাও করেন না। নিউমার্কেটের একটি নির্দিষ্ট দোকান থেকে কিছু নির্দিষ্ট জিনিস কিনবেন, তারপর সরাসরি ফিরে আসবেন। আর বুয়েটে যদি কোনো ক্লাস থাকে তাহলে সপ্তাহের কোনো নির্দিষ্ট দিনে সবগুলো ক্লাস নেবেন। ফলে বাইরের কেউ তাকে সহজে দেখতে পায় না।
প্রফেসর হকের মূলভবন বা বাসার অবস্থা আরো করুণ। বাইরে কোনো প্রাস্টার তো নেই-ই বরং কোনো জানালাররা দরজাও ঠিক নেই। পনেরো বছর আগে প্রফেসর হক নিজহাতে সবগুলো করে জানালা ইটের দেয়াল দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধুমাত্র তার নিজের আর রিবিটের কক্ষে একটি করে জানালা রয়েছে। তবে মূলভবনটি অনেক বড়। বিশেষভাবে রক্ষিত এগারোটি কক্ষের প্রত্যেকটিই অসংখ্য ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতিতে ভরা। এগুলোর সাহায্যেই প্রফেসর হক রিবিটকে তৈরি করেছেন। অবশ্য বাইরে থেকেও তাকে নানা বিষয়ে সাহায্য গ্রহণ করতে হয়েছে। কিন্তু রিবিট-সংক্রান্ত মূলকাজগুলো তিনি এখানেই করেছেন, যেন কেউ রিবিট সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে না পারে।
প্রফেসর হকের বাড়ি দেখে কারো বোঝার উপায় নেই এই বাড়ির মধ্যে কী কী রয়েছে। তার নিজের কক্ষে একটি অতি পুরাতন খাট আর একটি ইজিচেয়ার ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো আসবাবপত্র নেই। দেয়ালে একটি ফাটা কাঁচের আয়না থাকলেও তা প্রফেসর সাহেব কখনোই ব্যবহার করেন না। প্রফেসর হক খাটের পরিবর্তে ইজিচেয়ারে বসেই সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করেন। এজন্য রিবিট অধিকাংশ সময় তাকে ইজিচেয়ারেই বসে থাকতে দেখে।
রান্নাঘরের অবস্থা আরো করুণ। সবকিছু এত এলোমেলো আর অগোছালো যে কোনোকিছু খুঁজে পাওয়া দায়। প্রফেসর হক হয়তো চা খাওয়ার জন্য রান্নাঘরে গেলেন এবং তিনি নিশ্চিত রান্নাঘরে চা-পাতা রয়েছে, অথচ দেখা যাবে তিনি চা পাতা খুঁজে পাচ্ছেন না। শেষপর্যন্ত হয়তো তার আর চা খাওয়া হবে না।
তবে রিবিটের কক্ষটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে-কেউ রিবিটের কক্ষ দেখলে সত্যি অবাক হয়ে যাবে। বিশেষভাবে তৈরি বড় আকৃতির শীততাপনিয়ন্ত্রিত এই কক্ষটিতে রিবিটের জন্য প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতিই রয়েছে। রিবিট যে-কোনো সময় এখানে এসে তার প্রোগ্রামের কার্যক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ ইলেকট্রনপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি, সেন্ট্রাল মেমোরি বা কেন্দ্রীয় স্মৃতির অবস্থা, ভাইরাস প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, নিজের শরীরের যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা এবং অন্যান্য যে-কোনো বিষয়ে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারবে। নিজের সিস্টেম ঠিক রয়েছে কিনা সেজন্য রিবিটের প্রতিমাসে একবার এখানে এসে সবকিছু পরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে। তবে তা রিবিটের প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করবে এবং যদি সে এখানে আসে তাহলে প্রফেসর হকের সাথে সাক্ষাতের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এই বাড়িতে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রফেসর হক রিবিটকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন। রিবিট যে-কোনো সময় যে-কোনো প্রয়োজনে এই বাড়িতে আসতে পারবে এবং যে-কোনো জিনিস ব্যবহার করতে পারবে।
বাইরের গেটে এসে রিবিট গেটের উপর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে গেট খুলে ফেলল। ভিতরের গেটের একটি চাবি সসময়ই তার কাছে থাকে। তাই ভিতরে প্রবেশ করতে কোনো অসুবিধা হল না। প্রফেসর হকের কক্ষের দরজা খোলাই ছিল। রিবিট ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে ইজিচেয়ারে বসে প্রফেসর হক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে প্রফেসর হক কিছুটা স্নান গলায় বললেন : রিবিট, তুমি!
হ্যাঁ প্রফেসর। বিশেষ সমস্যায় পড়ে এসেছি। আপনি এখনো জেগে আছেন যে?
হ্যাঁ জেগে আছি। আমি জানতাম তুমি আজ রাতে যে-কোনো সময় এখানে আসবে। যাইহোক তোমার সমস্যা কী?
এই বাচ্চাদুটো। একটি ছেলে একটি মেয়ে, সংযুক্ত যমজ। ওদের জন্য দুধ গরম করতে হবে।
আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি নিশ্চয় বাচ্চাদুটোকে কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছ। কিন্তু বাসায় তো দুধ নেই। আমি দুধ খাচ্ছি না প্রায় পনেরো বছর হল।
এই ফিডারে আছে।
ঠিক আছে তুমি বাচ্চাদের দুধ গরম করো।
প্রফেসর, আপনার শরীর কেমন এখন?
ভালো। প্রফেসর সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন।
রিবিট জানে প্রফেসরের শরীর ভালো নেই। ইদানীং তার শরীর খুব কমই ভালো থাকে। তিনি বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছেন। তাছাড়া গত ত্রিশবছরের একটানা গবেষণায় ক্লান্ত তিনি। তাই এখন তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন বিশ্রামের প্রয়োজন। প্রফেসর সেই আশাই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু রিবিট জানে প্রফেসর চাইলেও বিশ্রাম নিতে পারবেন না। তার মাথায় নতুন নতুন পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে, সবই মানবসেবার পরিকল্পনা। তাই এ-ধরনের মানুষ কখনো বিশ্রাম নিতে পারে না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা নিজেদের মানবসেবার কাজে ব্যস্ত রাখেন।
দুধ গরম করে রিবিট তার নিজের ঘরে এল। বাচ্চাদুটোকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হল না। মেয়েবাচ্চাটি দুধ
খেল না। রিবিট ইপিকে ডেকে বলল : ইপি, বাচ্চাটি এখনো দুধ খাচ্ছে না।
ইপি বলল : এ মুহূর্তে বাচ্চাটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাছাড়া আমরা একটি ভুলও করেছি।
কী ভুল?
ফিডারের দুধ কখনো গরম করে খাওয়াতে হয় না। এতে বাচ্চাদের ক্ষতি হতে পারে।
আশা করছি কিছু হবে না। কারণ বাচ্চাটি এখনো একটু দুধও খায়নি। যেটুকু খেয়েছে তা বেশ আগে।
তাহলে হাসপাতালে ভর্তি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
কিন্তু ভর্তি করতে যেয়ে তো ঐ একই ঝামেলা। বাচ্চাদুটোর নাম-পরিচয় নেই। কেউ তো ভর্তি করতে চাইবে না।
আমার মনে হয় প্রফেসর সাহায্য করতে পারবেন। আমাদের উচিত তার সাথে কথা বলা।
ইপির কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রফেসর ভিতরে প্রবেশ করলেন। তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। রিবিট উঠে এসে প্রফেসরকে ধরতে গেলে প্রফেসর হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিলেন। তারপর বললেন : রিবিট, তুমি যেখানে আছ সেখানেই বসে থাকো। আমি ভালো আছি। তুমি তো জান এ রকম জ্বর আমার মাঝে মাঝেই হয়। আজ মাঝরাতের পর থেকে জ্বরটা বেড়েছে। আশা করছি সকালের আগেই কমে যাবে। বাচ্চাদুটোর কী অবস্থা?
ছেলেটি ভালো আছে, কিন্তু মেয়েটি কিছু খাচ্ছে না।
প্রফেসর হক খাটের উপর এসে বসলেন। তারপর বাচ্চাদুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন : আমার মনে হচ্ছে মেয়েটি অসুস্থ। প্রথমত মেয়েটি কিছু খায়নি, আর দ্বিতীয়ত এখনো জেগে আছে। ও কি সারারাতই জেগে ছিল?
হ্যাঁ প্রফেসর, একটুও ঘুমায়নি। মুখ দিয়ে টু-টা শব্দও করেনি।
আমি নিশ্চিত ও অসুস্থ।
আমি একটা ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানের ডাক্তার ঐ একই কথা। বলেছিল।
ভর্তি করলে না কেন?
তারা নাম-পরিচয়বিহীন শিশুকে ভর্তি করতে চাচ্ছে না।
আমি বুঝতে পারছি। এ-ধরনের যমজ শিশুর অনেক জটিলতা থাকে। ক্লিনিক ক্লিনিক কিছু করতে পারবে না। তুমি সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাও।
কিন্তু ঢাকা মেডিকেল যদি একই সমস্যা করে?
সম্ভবত করবে না। কারণ ঢাকা মেডিকেল সরকারি হাসপাতাল। আর যদি এ ধরনের ঝামেলা করে তাহলে তোমাকেই তার সমাধান করতে হবে। তোমাকে এমন অনেক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যার মাধ্যমে তুমি অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তোমার উদ্দেশ্য হবে কারো কোনো ক্ষতি না করে তোমার সকল ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে এই বাচ্চাদুটোর উপকার করা। যদি তুমি করতে পারো তাহলেই তুমি সফল হবে, আমার গবেষণাও সার্থক হবে। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?
হ্যাঁ আমি বুঝতে পারছি। তবে…
তবে কী?
বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হতে পারে।
তুমি ঠিকই বলেছ। ছোটখাটো চিকিৎসার খরচ হাসপাতাল নিজেই বহন করে। তবে অপারেশন কিংবা যদি এ-ধরনের অন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তাহলে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে খুব একটা সাহায্য করতে পারব না। কারণ আমার কাছে এমন কোনো অর্থ নেই যার সাহায্যে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব। আমার ব্যাংকে নয় হাজার একশো আঠারো টাকা আছে। আমি তোমাকে নয় হাজার টাকার একটা চেক দিচ্ছি। সকালে ব্যাংক খুললে তুমি ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবে। এই টাকার সাহায্যে তুমি বাচ্চাদুটোকে বাঁচাতে চেষ্টা করবে।
আমি চেষ্টা করব। বলল রিবিট।
শুধু চেষ্টা নয়, তোমাকে পারতেই হবে রিবিট। আমি আমার জীবনের সকল অর্থ তোমার পিছনে ব্যয় করে তোমাকে তৈরি করেছি। তোমার সৃষ্টি শুধু মানুষের উপকারের জন্য। তবে মনে রেখো এটা আমার কাছে তোমার কোনো দায়বদ্ধতা নয়। সবকিছুই তোমার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তুমি যদি মানুষকে সাহায্য করো তাহলে আমি মনে শান্তি পাব। তোমার কাছে আমার শর্তসাপেক্ষ কোনো দাবি নেই। আমার সকল দাবি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। একজন মানুষ হিসাবে তোমার মতো উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবটের কাছে আমার দাবি থাকবে তুমি মানুষের উপকার করবে। তুমি আজ এই বাচ্চাদুটো নিয়ে যাদের কাছেই যাবে তাদের অধিকাংশই তোমাকে সাহায্য করবে না। কারণ মানুষের মধ্যে মানবিকতা থাকলেও এদেশে ক্রমাগত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট, দুর্নীতি আর অপরাধের জন্য মানুষ এখন সংকীর্ণ আর ভীত হয়ে পড়েছে। ইচ্ছে থাকলেও তারা এখন নিজেদের মানবিকতাকে প্রকাশ করতে, উন্মোচিত করতে সাহস পায় না। তোমার দায়িত্ব হবে এই মানবিকতাকে জাগিয়ে ভোলা।
প্রফেসর হকের কথার উত্তরে রিবিট বলল : প্রফেসর, আজ রাতে আমি আপনার কথার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। তবে ভালোমানুষও রয়েছে। আমি সাইফের মতো উদ্যমী আর কর্মঠ সাংবাদিক, অমির মতো ছোট নির্ভীক বাচ্চা ছেলে, হাসপাতালে রিসেপশনিস্টের মতো উদারমনের মেয়ে, ড্রাইভার সালামের মতো ভালোমনের মানুষের সাক্ষাৎও পেয়েছি।
রিবিট, আমি খুব আনন্দিত যে তুমি ভালোমানুষকে খুঁজে পাচ্ছ। সমাজের আনাচে-কানাচে এরকম হাজারো ভালোমানুষ রয়েছে। তোমার দায়িত্ব হবে তাদের সবার মনের উদারতাকে জাগ্রত করা। যদি মনে করো বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য আরো অর্থের প্রয়োজন, তুমি এই মানুষগুলোর সাহায্য কামনা করবে। দেখবে তারা কীভাবে তোমার পাশে এসে দাঁড়ায়।
প্রয়োজনে আমি অবশ্যই তাদের সাহায্য গ্রহণ করব।
রিবিট, আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি তোমার প্রথমদিনে এমন একটা সমস্যার সমাধাণ করতে চেষ্টা করছ যা অত্যন্ত জটিল কিন্তু খুব হৃদয়স্পর্শী। মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে এটি একটি অতি মহান কাজ। মানবশিশুর উপকার করার থেকে বড় উপকার আর কী হতে পারে? ওরা কথা বলতে পারে না, নিজেদের অনুভূতিকে বোঝাতে পারে না, নিজেদের কষ্টকে প্রকাশ করতে পারে না, অথচ ওরা মানবসন্তান, সবচেয়ে নিষ্পাপ আর অসহায় মানুষ। তুমি ওদের উপকার করতে চেষ্টা করছ। এটি যে কতবড় মহান কাজ তা তুমি বুঝবে না।
প্রফেসর, আপনি বাচ্চাদুটোর জন্য প্রার্থনা করবেন।
হ্যাঁ, আমি করছি এবং করব। রিবিট, আমি বোধহয় তোমাকে আর তেমন কোনো সাহায্য করতে পারব না। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমার পরিচিত কেউ নেই। যদি থাকত তাহলে আমি অবশ্যই ফোন করে দিতাম। তোমার কাজ সহজ হত।
তার দরকার হবে না প্রফেসর, আমি পারব।
আমার শরীরটা ভালো নেই। ভালো থাকলে তোমাকে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতাম। তোমাকে সাহায্য করতাম। কিন্তু আমি নিজে ঠিকমতো হাঁটতে পারছি না।
প্রফেসর, আমি জানি আপনি কতটা মহান। আপনার শরীরের তাপমাত্রা একশো তিন ডিগ্রির উপরে। আপনার নিজেরই সাহায্যের দরকার।
আমাকে নিয়ে কখনো চিন্তা করবে না। তুমি এক কাজ করো, আমার গাড়ি নিয়ে যাও, যদিও গাড়ি স্টার্ট নেবে কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে।
তার দরকার হবে না। ঢাকা মেডিকেল এখান থেকে দশ মিনিটের রাস্তা। আমি হেঁটেই চলে যেতে পারব।
সাবধানে যেও। আর হ্যাঁ, তুমি আমার ঘরে এসো। আমি তোমাকে চেক দিয়ে দিচ্ছি।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে কোলে নিতে যেয়ে চমকে উঠে বলল : প্রফেসর বাচ্চামেয়েটি এমন করছে কেন?
প্রফেসর লক্ষ্য করলেন বাচ্চামেয়েটির চেহারা হঠাৎই নীল হয়ে গেছে। তিনি বললেন : সম্ভবত বাচ্চাটির অসুস্থতা আরো বেড়েছে। রিবিট, তোমার আর দেরি করা ঠিক হবে না। তুমি…
প্রফেসর কথা শেষ করার আগেই বাচ্চাটি বমি করে দিল।
প্রফেসর আঁতকে উঠে বললেন : রিবিট, তুমি আর দেরি কোরো না, যাও।
রিবিট তাড়াতাড়ি বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এল।
প্রফেসর হক দ্রুত তার চেকবই নিয়ে এসে দুটো পাতায় স্বাক্ষর করে বললেন : আমি আর অন্য কিছু লিখে সময় নষ্ট করলাম না। তোমাকে ব্লাংক চেক দিয়ে দিলাম। তুমি টাকার অঙ্ক বসিয়ে নিও।
আমি আসি প্রফেসর।
যদি পাবো একটা ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে নিও।
হ্যাঁ নেব।
রিবিটের নিষেধ সত্ত্বেও প্রফেসর বাইরের গেট পর্যন্ত এলেন। রিবিট বিদায় নিয়ে গলির ভিতর থেকে বাইরে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল। কিন্তু সে কোথাও
কোনো ট্যাক্সি বা অন্য কোনো যানবাহন দেখল না।
রিবিট ডেকে উঠল; ইপি!
বলো রিবিট।
তুমি আমার শরীরে অ্যান্টি-জার্কিং সিস্টেম চালু করে দাও যেন আমি দৌড়ালে শুধু আমার শরীরের নিচের অংশ কম্পিত হয়, উপরের অংশ নয়। ফলে বাচ্চাদুটোর শরীরে কোনো ঝাঁকি লাগবে না।
রিবিট, আমি চালু করে দিয়েছি।
এখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে দৌড়ে যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে?
তুমি যদি তোমার সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়াও তাহলে তিন মিনিট তেরো সেকেন্ড।
ইপি, আমি দৌড় শুরু করছি।
রিবিট কথা শেষ হতেই দৌড় শুরু করল। তার শরীরের নিচের অংশ কম্পিত হলেও উপরের অংশ এ্যান্টি-জার্কিং এবং অ্যান্টি-মোশন সিস্টেমের কারণে কম্পিত হল না। ফলে রিবিটের কোলের দুই মানবশিশু বুঝতেই পারল না যে তারা দৌড়রত এক অতি উচ্চবুদ্ধিমাত্রার রোবটের কোলে রয়েছে।
১০
হাসপাতালের গেটে যে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল তারা রিবিটকে দেখে আগেই সরে দাঁড়াল। রিবিট কোনোদিকে না-তাকিয়ে সরাসরি ইমার্জেন্সিতে চলে এল। সেখানে মোটামতো ফর্সা দেখতে একজন নার্স বসেছিল। সে রিবিটকে দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। রিবিট তার সামনে যেয়ে যখন বলল : এই বাচ্চাদুটো অসুস্থ, ওদের জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন, তখন ভয়ে নার্স কোনো কথাই বলতে পারল না।
রিবিট আবার বলল : মেয়েবাচ্চাটি বেশি অসুস্থ, ওর জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন।
নার্স এতক্ষণ যেন ভয় আর আতঙ্কের অন্য কোন জগতে ছিল। এবার সে বাস্ত বে ফিরে এসে বলল : আপনি কে?
আমি কে তা জানা আপনার জন্য খুব জরুরি নয়। আপনি এক্ষুনি এই বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আর শুধু জেনে রাখুন আমি অতি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার একটি রোবট।
জি জি…আ..আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি। ওদের কী হয়েছে?
মেয়ে বাচ্চাটি কিছুক্ষণ আগে বমি করেছে। ওর শরীর নীল হয়ে এসেছে। সম্ভবত শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আপনি ডাক্তার ডাকুন, দেরি করছেন কেন?
হ্যাঁ..হ্যাঁ আমি ডাকছি। এই বলে নার্স ইমার্জেন্সি থেকে বেরিয়ে গেল।
ইমার্জেন্সিতে এ-মুহূর্তে কোনো রুগী নেই। ইমার্জেন্সি বেডটি ফাঁকা দেখে রিবিট বাচ্চাদুটোকে বেডের উপর শুইয়ে দিল। মেয়েবাচ্চাটি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিবিট বুঝতে পারল বাচ্চাটির জেগে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজের চোখের উপর মেয়েটির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চোখদুটো নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটি যেন জোর করে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যে ছেলেবাচ্চাটিও জেগে উঠেছে। ছেলেটির চোখেও কেমন যেন অসহায় দৃষ্টি। মনে হয় সে বুঝতে পেরেছে তার বোনের শরীর খুব খারাপ। তাই তো তার দৃষ্টিতে রিবিটের প্রতি যেন প্রচণ্ড ব্যাকুলতা, রিবিট যেভাবেই পারে যেন তার বোনকে বাঁচিয়ে তোলে।
রিবিট উপুড় হয়ে বাচ্চাদুটোর উপর ঝুঁকে এলে দুটো বাচ্চাই একসাথে রিবিটের দিকে তাকাল। রিবিট ফিসৃফিস্ করে বলল : তোমরা ভয় পেও না। যেভাবেই হোক আমি তোমাদের বাঁচিয়ে তুলব।
মেয়েবাচ্চাটি একইভাবে তাকিয়ে থাকল। তবে ছেলেটি অদ্ভুত এক কান্ড করল। সে তার ছোট্ট ডান হাত উঁচু করে রিবিটের কপালের উপর রাখল। তারপর ধীরে ধীরে রিবিটের চোখ, মুখ, গাল স্পর্শ করল। যেন বোঝাতে চাইল রিবিটের উপর তাদের আস্থা রয়েছে।
রিবিট নিজের হাত দিয়ে বাচ্চাটির কোমল হাত ধরল। তারপর ধীরে ধীরে হাতটা পাশে নামিয়ে রেখে আবার ফিসফিস করে বলল : আমি বুঝতে পেরেছি তোমরা কী বলতে চাচ্ছ। তোমরা ভয় পেও না। যেভাবেই হোক আমি তোমার বোনকে সুস্থ করে তুলব।
পিছনে পায়ের শব্দ শুনে রিবিট বুঝতে পারল কেউ ভিতরে ঢুকেছে। ফিরে তাকাতে দেখে সেই মোটা নার্স আর সাথে তরুণ একজন ডাক্তার। রিবিট খুব অবাক হল যখন দেখল, এই তরুণ ডাক্তার তাকে কোনো পাত্তাই দিল না। সে এসে সরাসরি বাচ্চাদুটোর উপর ঝুঁকে পড়ল। অথচ নার্স এখনো অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারায় স্পষ্ট ভয়ের ছাপ।
ডাক্তার বাচ্চাদুটোর চোখ, নাড়ির স্পন্দন আর প্রেশার পরীক্ষা করে রিবিটের দিকে ফিরে তাকাল। তারপর রিবিটকে অবাক করে দিয়ে বলল : রিবিট, আমি ডাক্তার শিপন।
রিবিট ডাক্তার শিপনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল : আমি রিবিট, অতি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার রোবট।
হ্যাঁ আমি জানি। গতকাল রাতে আমি টেলিভিশনে আপনাকে দেখেছি।
আমি খুব খুশি হয়েছি যে আপনি আমাকে দেখে ভয় পাননি। আপনি একজন সাহসী ডাক্তার।
ধন্যবাদ রিবিট।
এখন কী বলবেন, ওদের দুজনকে কেমন দেখলেন?
ছেলেটি সুস্থ রয়েছে। তবে মেয়েটির হার্টবিট এবং ব্লাডপ্রেশার অত্যন্ত কম। তাছাড়া মেয়েটি রক্তশূন্যতায় ভুগছে। সত্যি কথা বলতে কী আমি একজন নতুন ডাক্তার। তাছাড়া শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমি অনেকটা অজ্ঞই বলতে পারেন। তাই আমার স্বল্প-অভিজ্ঞতার আলোকে আমি আপনাকে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারছি না। তবে এটুকু বলছি মেয়েটি খুব অসুস্থ।
আমি তাহলে কী করব?
আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আমি শিশু-ওয়ার্ডের যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার রয়েছেন তাকে ডেকে আনছি। আশা করছি তিনি কোনো মতামত প্রদান করতে পারবেন।
ডাক্তার শিপন, তাহলে তাই করুন।
আপনি অপেক্ষা করুন, আমি উনাকে নিয়ে আসছি।
ডাক্তার শিপন বেরিয়ে যাওয়ার সময় নার্সকে বলল : আমি স্যারকে নিয়ে আসছি। আপনি বাচ্চাদুটোর শরীর মুছে দিন।
নার্স বেচারির আতঙ্ক তখনো কাটেনি। ডাক্তার শিপন বেরিয়ে যাওয়ায় উল্টো তার আতঙ্ক যেন আরো বাড়ল। রিবিট বুঝতে পারল তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কথা বললে হয়তো নার্সের আতঙ্ক কমবে। তাই সে এগিয়ে এসে বলল; ভয় পাবেন না, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। আমি নিজেই তো আপনাদের কাছে বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য এসেছি। ভয় পাচ্ছেন কেন?
..না, আ..আমি ভয় পাচ্ছি না। তোতলাতে তোতলাতে বলল মোটা নার্স।
ঠিক আছে, যদি ভয় না পান তাহলে বাচ্চাদুটোর শরীর মুছে দিন।
জি দিচ্ছি।
এমন সময় পিছনে পর্দার ফাঁক দিয়ে অন্য একজন নার্সকে উঁকি দিতে দেখা গেল। সাথে সাথে মোটা নার্সটি বলল : এই লিমা এদিকে আয়, দুটো বাচ্চাকে..
মোটা নার্স কথা শেষ করার আগেই লিমা নামের নার্স পর্দার পিছন থেকে সরে গেল। তার আচরণ দেখে মনে হল সে মরে গেলেও রিবিটের সামনে আসবে না।
মোটা নার্স এবার তুলা, এ্যান্টিসেপটিক আর ঈষদুষ্ণ পানি নিয়ে বাচ্চাদুটোর পাশে এসে বসল। সে ভীত হলেও বেশ যত্নের সাথে ওদের শরীর মুছে দিতে লাগল। এই ফাঁকে রিবিট অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ইপিকে বলল : ইপি, তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছ?
রিবিট, আমি সবসময়ই তোমাকে শুনতে পাই। উত্তর দিল ইপি।
আমি এখন কী করতে পারি? আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না।
রিবিট, তোমার মতো আমারও একই অবস্থা। আমার প্রোগ্রাম জানাচ্ছে অসুস্থ হলে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেতে হবে, ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে, শারীরিক পরীক্ষা করতে হবে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুসারে ওষুধ খেতে হবে। তুমি যদি অসুখের নাম বলতে পারো আমি ওষুধের নাম পর্যন্ত বলে দিতে পারব। কিন্তু তুমি যে-ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছ সে-ধরনের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি তোমাকে কোনো বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করতে পারব না। কারণ তুমি জানো প্রোগ্রামকে যে বৈশিষ্ট্য বা ক্ষমতা প্রদান করা হয় প্রোগ্রাম সে-বৈশিষ্ট্য বা ক্ষমতার বাইরে কোনো কাজ করতে পারে না। আর এটাই হল আমার বড় সীমাবদ্ধতা।
আমি বুঝতে পারছি ইপি। কিন্তু এ-মুহূর্তে মনে হচ্ছে তোমার সাহায্য আমার দরকার।
রিবিট এক্ষেত্রে তুমি চিন্তা করতে পারো, যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিশ্লেষণ করতে পারো এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারো। আমার থেকে তুমি অনেক বেশি শক্তিশালী প্রোগ্রাম। তাছাড়া তোমার প্রোগ্রামের মধ্যে যে-অনুভূতি বা উপলব্ধি রয়েছে তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তুমি মানুষের মন বা মস্তিষ্কের মতো চিন্তা করার ক্ষমতাসম্পন্ন। তুমি এ-বিষয়ে যে-সম্ভাবনাগুলো রয়েছে সেগুলো চিন্তা করে আমাকে বলো। আমি হয়তো তোমাকে সবচেয়ে ভালো সম্ভাবনা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করতে পারব। কিন্তু মনে রেখো সব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে।
ইপি, তুমি জানো আমি তোমার উপর নির্ভর করি।
সেই নির্ভরতা শুধুমাত্র তোমাকে সত্য এবং মানবসেবার পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে তোমাকে প্রভাবিত করার জন্য, তোমার উন্মুক্ত চিন্তাধারাকে সুষম করতে সাহায্য করার জন্য, তোমাকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত রাখার জন্য।
ইপি, তুমি খুব কঠিন কথা বলছ।
রিবিট, আমি খুব সহজ কথা বলছি। তুমি বাচ্চাদুটোর জন্য খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছ, এজন্যই আমার কথা তোমার কাছে কঠিন মনে হচ্ছে। তুমি চাচ্ছ বাচ্চাদুটোর এখনই চিকিৎসা হোক, এখনই ওরা সুস্থ হয়ে উঠুক। আমি তোমার এই আবেগ এবং চাওয়ার প্রশংসা করছি। কিন্তু তোমাকে মনে রাখতে হবে মানুষের সমস্যা খুবই জটিল। মানুষের সমস্যা আমাদের প্রোগ্রামের মতো নয় যে ইলেকট্রন প্রবাহের তারতম্য ঘটালেই সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। মানুষের সমস্যাগুলো জটিল হলেও সমাধান খুব সহজ আবার অত্যন্ত কঠিনও বটে। তুমি যে-সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে তার সমাধান খুব সহজ, হত যদি সকল মানুষ তোমার দৃষ্টিভঙ্গিতে সমস্যাটি দেখত। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে মানুষ একই দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছু দেখে না। কিছুক্ষণ আগেও প্রফেসর হক তোমাকে এ-বিষয়ে বলেছেন। তাই তোমাকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হচ্ছে। ভবিষ্যৎ হয়তো আরো কঠিন হবে। তোমাকে খুব শক্ত হতে হবে রিবিট। তুমি অপেক্ষা করো। সময় এবং পরিস্থিতিই বলে দেবে তোমাকে কী করতে হবে।
ইপি তোমাকে ধন্যবাদ। কিছুক্ষণ পূর্বে আমার মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা ছিল। এ মুহূর্তে আমি আবার স্থিরতা ফিরে পেয়েছি।
তোমার অস্থির হওয়াটা ভালো লক্ষণ। মানুষের জন্য তোমার ভালোবাসা গম্ভীর হতে শুরু করেছে। যাইহোক, যেহেতু এ-ধরনের পরিস্থিতির কোনো অভিজ্ঞতা তোমার আমার কারো মেমোরিতেই নেই, সেহেতু তোমাকে এ-বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
কিন্তু কীভাবে জ্ঞান আহরণ করব?
জ্ঞান আহরণের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে মানুষ। মানুষের চেয়ে জ্ঞানী আর কেউ নেই। তোমার আশেপাশের অভিজ্ঞ মানুষদের জিজ্ঞেস করো এ-ধরনের পরিস্থিতিতে তুমি কী করতে পারো? তাহলে তুমি তোমার কর্তব্যজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা করতে পারবে।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ইপি।
রিবিট লক্ষ্য করল নার্স বাচ্চাদুটোকে বসিয়ে পিঠ মুছে দিতে চেষ্টা করছে। দুটো বাচ্চা একসাথে হওয়ায় নার্সের বেশ কষ্ট হচ্ছে। রিবিট এগিয়ে এসে বলল : আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
নার্স কিছু না বললেও রিবিট বাচ্চাদুটোকে ধরল। আর নার্স খুব যত্নের সাথে ওদের পিঠ মুছে দিতে লাগল। তবে তার ভয় এখনো কাটেনি। হাত একটু একটু কাঁপছে।
রিবিট এবার তার অভ্যন্তরীণ মেমোরি থেকে মানুষের সাথে দ্রুত সম্পর্ক স্থাপনের উপায় জেনে নিল। তাতে সে জানতে পারল মানুষের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনই মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম সহজ উপায়। উপরন্তু সত্যিকারের প্রশংসার সাথে মানুষকে যদি গ্রহণযোগ্য কোনো সম্বোধন করা সম্ভব হয় তাহলে সম্পর্কস্থাপনের বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল নার্সকে ‘আপা’ সম্বোধন করবে এবং তার কাজের প্রশংসা করবে। এই সিদ্ধান্ত থেকেই সে বলল : আপা আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি বাচ্চাদুটোকে খুব যত্ন করে মুছে দিচ্ছেন। আমি এর আগে অনেকের কাছে ওদেরকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার মতো কেউ করেনি।
নার্স কিছু বলল না। তবে সে আরো সতর্কতা আর যত্নের সাথে বাচ্চাদুটোকে মুছে দিতে লাগল।
আপনি কি আমাকে একটা বিষয়ে সাহায্য করবেন? প্রশ্ন করল রিবিট।
কী সাহায্য বলুন। এবার যেন কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠল নার্স।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না আমাকে কী করতে হবে।
নার্স একটু সময় নিয়ে বলল : আপনি আর দেরি না করে ওদেরকে এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি করে দিন। তাহলে সকল দায়দায়িত্ব হাসপাতালের ওপর এসে পড়বে। বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকবে এবং তিনিই চিকিৎসা করবেন।
হাসপাতালে ভর্তি করব কীভাবে?
এখন যে ডাক্তার আসছেন উনি যদি লিখে দেন তাহলে আপনি ওদেরকে ভর্তি ইউনিটে নিয়ে যাবেন। সেখানেই ওদেরকে ভর্তি করা হবে।
আপা আপনাকে ধন্যবাদ।
নার্স আর কথা বলল না। তবে এখন আর সে ভয় পাচ্ছে না। বাচ্চাদের শরীর মোছা শেষে সে ওদেরকে নিজের কোলে তুলে নিল। তারপর খুব হালকাভাবে দোল দিয়ে হাঁটতে লাগল। রিবিট নার্সের আচরণে খুব অবাক হল। মুহূর্তেই বাচ্চাদুটোকে কত আপন করে নিয়েছে সে। কী সুন্দর দোল দিয়ে হাঁটছে। অথচ ঘণ্টাখানেক আগে অনেক চেষ্টা করেও সে এত সুন্দরভাবে বাচ্চাদুটোকে দোল দিয়ে হাঁটতে পারেনি। সে মনে-মনে ভাবল : মানুষের ভালোবাসা সত্যিই অদ্ভুত।
১১
মাঝবয়সী একজন ডাক্তার বেশ মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাদুটোকে দেখছেন। রিবিট পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে নতুন একজন নার্স। ডাক্তার শিপন আর সেই মোটা নার্স অন্য একজন রুগীকে দেখতে গেছে।
ডাক্তার সাহেব বাচ্চাদুটোকে পরীক্ষা করে বললেন : রিবিট সাহেব, ওদেরকে আপনি কোথায় পেয়েছেন?
ডাস্টবিনের পাশে একটি কার্টুনের মধ্যে।
ডাক্তার সাহেব ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন : কেন যে এমন হয়! তারপর বললেন : দেখুন রিবিট সাহেব, আমার মনে হচ্ছে দুটো বাচ্চাই অসুস্থ। তবে মেয়েটির অবস্থা সত্যিই খারাপ। এ-ধরনের সংযুক্ত যমজ বাচ্চাদের যে-কোনো একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্যজনও অল্প সময়ের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাচ্চাদুটো পা এবং মাথার মাধ্যমে একে অপরের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত যে দুজনের শরীরের রক্ত একে অপরের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে মেয়েটি যদি কোনো সংক্রামিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে আমি নিশ্চিত অল্পসময়ের মধ্যে ছেলেটিও আক্রান্ত হবে। আর যদি সংক্রামিত রোগ না হয় তাহলে জটিল অন্য কিছু হতে পারে।
জটিল কিছু বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
সত্যি কথা বলতে কী এ-ধরনের যমজ শিশুদের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার উদাহরণ খুব কমই রয়েছে। কেন যে ওরা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে না তার সকল কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানেরও জানা নেই। এই বাচ্চাদুটোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে জটিল বিষয় হল এদের মাথা একে অপরের সাথে সংযুক্ত। যদি এমন হয় যে এদের মাথার অভ্যন্তরের মস্তিস্কও একে অপরের সাথে সংযুক্ত তাহলে বিষয়টি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়বে। যাইহোক, মেয়েবাচ্চাটির অসুস্থতা সম্পর্কে আমি আপনাকে এ-মুহূর্তে কোনো ধারণা দিতে পারছি না। তাই আমি আপনাকে অনুরোধ করব বাচ্চাদুটোকে হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য। সকাল ন’টার সময় যদি মালেক স্যারকে আনা সম্ভব হয় তাহলে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারব।
মালেক স্যার কে?
উনি আমাদের হাসপাতালে শিশুবিভাগের সবচেয়ে অভিজ্ঞ আর প্রবীণ ডাক্তার এবং প্রফেসর। তিনি প্রফেসর মালেক হিসাবেই পরিচিত। আমি বিশ্বাস করছি উনাকে এখন দেখাতে পারলে ভালো হত।
অনুরোধ করলে উনি কি আসবেন না?
সম্ভবত না। কারণ এখন উনার ডিউটি টাইম না। তাছাড়া আজ ছুটির দিন। সম্ভবত আজ হাসপাতালেও আসবেন না।
ও আচ্ছা।
হ্যাঁ রিবিট সাহেব, এখন আপনাকে যে-কাজটা করতে হবে তা হল আমি যে ইনজেকশনটি লিখে দিচ্ছি সেটি বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে।
কেন? আপনারা দেবেন না?
না রিবিট সাহেব। এই ওষুধ আমাদের হাসপাতাল থেকে দেয়া হয় না। ইনজেকশন দেয়ার পর বাচ্চাদুটোকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তারপর কয়েকটি প্যাথলজিক্যাল টেস্ট, এক্সরে আর মাথার সিটি স্ক্যান করাতে হবে। আমরা এখানে কিছু টেস্ট আর এক্সরে করতে পারব। সিটি স্ক্যান করতে আপনাকে সকাল ন’টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর কয়েকটি টেস্ট বাইরে করাতে হবে, কারণ এই টেস্টের ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই।
ডাক্তার সাহেব দ্রুত একটি ইনজেকশনের নাম লিখে রিবিটের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনি এক্ষুণি ওষুধটা নিয়ে আসুন। আমার পাশে যে নার্স রয়েছে ওর নাম সোমা। সোমা নতুন হলেও খুব ভালো নার্স। ও-ই ইনজেকশন দিয়ে দেবে। রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো, আমাকে কয়েকজন রুগী পরীক্ষা করতে হবে। আমি যাচ্ছি। রুগী ভর্তি করার পর আমাকে জানাবেন।
এই বলে ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন।
রিবিট স্থির দাঁড়িয়ে আছে দেখে নার্স সোমা বলল; আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ওষুধটা নিয়ে আসুন, খুব দরকার।
রিবিট একবার বাচ্চাদুটোর দিকে তাকাল। তারপর কী মনে করে ওদের কোলে তুলে নিল।
সোমা বলল : আপনি ওদেরকে আমার কাছে রেখে যান। দ্রুত ওষুধটা নিয়ে আসুন।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে কয়েক মুহূর্ত বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখল। তারপর সোমার কোলে তুলে দিয়ে বলল : দেখবেন ওদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়। কথা বলেই রিবিট দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে এল।
সোমার মনে হল শেষমুহূর্তে সে বুঝি রিবিটের চোখে পানি দেখল। সে খুব অবাক হল ভেবে যে রোবট এভাবে মানুষের মতোই কাঁদতে পারে।
রিবিট বাইরে দুটো দোকান খোলা পেল। প্রথম দোকানে ঢুকতে দোকানদারের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। রিবিটকে দেখে সে যে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। রিটি শুধু বলল : আমাকে দেখে ভয় পাবেন না। আপনার কাছে কি এই ইনজেকশনটি আছে?
দোকানদার প্রেসক্রিপশন দেখে বলল : না নাই।
কেন নেই? অবশ্যই আপনার রাখা উচিত ছিল। কিছুটা জোরগলায় বলল রিবিট।
সাথে সাথে রিবিট ইপির গলা শুনতে পেল, রিবিট তুমি অবান্তর এবং অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করছ যা তোমার কোড অব ইথিকস বা নীতির বাইরে।
আমি দুঃখিত ইপি।
তোমাকে সবসময় তোমার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে তুমি তোমার শারীরিক শক্তির অপব্যবহার করতে পারো।
তোমাকে ধন্যবাদ ইপি।
এদিকে হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠ শুনে দোকানদার আরো ঘাবড়ে গেল। সে এদিক ওদিক উঁকি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল আশেপাশে আদৌ কোনো মেয়ে আছে কিনা। যখন দেখল কেউ নেই তখন সে যেন ভয়ে নড়তেও ভুলে গেল। স্থিরচোখে শুধু রিবিটের দিকে তাকিয়ে থাকল।
রিবিট বলল : আমি দুঃখিত। আপনি কি বলতে পারবেন আমি কোথায় এই ইনজেকশনটি পাব?
স্যা..র, স্যা..র, আ..আপনে পাশের দোকানে পাবেন।
আপনাকে ধন্যবাদ।
রিবিট বেরিয়ে এসে দ্বিতীয় দোকানে ঢুকল। সে লক্ষ্য করল তার পিছন পিছন আগের দোকানদারও এসেছে। তবে সে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছে।
দ্বিতীয় দোকানের দোকানদার আঠারো-উনিশ বছর বয়সী একটা ছেলে। সে ক্যালকুলেটরে কী যেন হিসাব করছিল। রিবিট তার সামনে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিতে সে মাথা উঁচু করে তাকাল। তারপর একেবারে হাঁ হয়ে গেল।
রিবিট এবার বলল : আপনার কাছে কি এই ইনজেকশনটি আছে?
সারারাত জেগে থাকায় ছেলেটির চোখদুটো লাল হয়ে আছে। রিবিটের প্রশ্নে সে লালচোখে কয়েকবার পিটপিট করে তাকাল। তারপর প্রেসক্রিপশন দেখে তোতলাতে তোতলাতে বলল : আ..আ…ছে।
ইনজেকশনটির দাম কত?
ছেলেটি একটু সময় নিয়ে কী যেন ভাবল, তারপর বলল : তিনশো টাকা।
এত দাম কেন?
রাইতে ওষুধের দাম বেশিই থাকে। আ..আপনার কাছে তো কমই বললাম। অ..অন্য কেউ হইলে চারশো টাকা বলতাম।
কেন চারশো টাকা বলতেন?
এগুলো লাইফসেভিং বা জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, সবসময় পাওয়া যায় না। তাছাড়া সারারাত দোকান খোলা রাখি, খরচ উঠানো লাগব না? দিনে হইলে পঁচিশ টাকা কম রাখতাম।
আপনি তো ওষুধের দাম এভাবে বাড়াতে পারেন না। আর লাইফসেভিং ড্রাগের ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই আসে না।
এবার যেন ছেলেটা হঠাৎই সাহসী হয়ে উঠল। কিছুটা উঁচুগলায় বলল : দেখেন ভাই, আপনে কে আমি জানি না, আমার জানারও দরকার নাই। আপনে ইচ্ছা করলে ওষুধ কিনবার পারেন, আবার নাও কিনবার পারেন। তয় অহেতুক বিরক্ত করবেন না।
রিবিট কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল। কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
এবার আগের দোকানদার তার সাহায্যে এগিয়ে এল। সে ভিতরে ঢুকে বলল : এ্যাই, তুই আড়াইশো টাকার ওষুধ তিনশো টাকা কস্ কেন? তুই কি স্যাররে চিনস না?
ছেলেটি আগের মতোই বলল : না চিনি না। তবে আপনে যখন বলছেন আড়াইশো টাকায় দিলাম। এই বলে ছেলেটি একটা ইনজেকশন বের করে প্যাকেটে ভরল।
রিবিট বলল : আমি দুঃখিত, আমার কাছে এত টাকা নেই। দুইশো তেত্রিশ টাকা আছে। আপনি যদি দয়া করে এ টাকায় আমাকে ইনজেকশনটি দেন আমি পরে এসে বাকি টাকা দিয়ে যাব।
না হবে না। বেশ কড়া উত্তর দিল ছেলেটি।
আগের দোকানদার ছেলেটিকে আবার অনুরোধ করে বলল : স্যার চাইতেছে। দিয়া দে, সে-তো আর তোর টাকা মাইরা দিব না। বলছে তো পরে আইসা দিয়া যাব।
আপনের কথায় আমি তিনশো টাকার ওষুধ আড়াইশো টাকায় বিক্রি করতে রাজি হইছি। আবারও কম রাখতে বলেন কেন? আমি পারব না।
এবার রিবিট কথা বলল : ঠিক আছে, আমি আপনাকে একটা চেক দিচ্ছি। এ মুহূর্তে ব্যাংক বন্ধ থাকায় আমার পক্ষে টাকা তোলা সম্ভব নয়। আমি যদি আজ সন্ধ্যার মধ্যে আপনার টাকা পরিশোধ না করি তাহলে একদিন পর আপনি এই চেকের মাধ্যমে আপনার সতেরো টাকা তুলে নেবেন।
ছেলেটি এবার রাজি হল।
রিবিট ছেলেটাকে একটি ব্ল্যাংক চেক আর টাকা দিতে ইপি এবার অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বলল : রিবিট, তুমি ব্ল্যাংক চেক দিও না। তাহলে দোকানদার সকালেই ব্যাংক থেকে প্রফেসর হকের নয় হাজার টাকা তুলে নেবে।
তোমাকে ধন্যবাদ ইপি। ব্যাপারটা আমি পরীক্ষা করতে চাই।
আমার কাজ তোমাকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া। কিন্তু সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়িত্ব তোমার। তারপরও বলছি, তুমি অযথা ঝুঁকি নিচ্ছ।
আমি এই ঝুঁকিটা নিতে চাই।
বাচ্চাদুটোর জীবন বাঁচানোর জন্য এই নয় হাজার টাকা অনেক টাকা।
আমি জানি ইপি। তারপরও আমি বিষয়টি পরীক্ষা করছি। এমনও হতে পারে ছেলেটি হয়তো টাকা তুলবে না।
হতে পারে। কিন্তু তুমি কি সত্যি ঝুঁকি নেবে?
হ্যাঁ নেব।
ইপি আর কথা বলল না।
রিবিট দোকান থেকে বের হয়ে আসার সময় আগের দোকানদারকে ধন্যবাদ দিতে ভুলল না। দোকানদারের ভয় অনেক আগেই কেটেছে। সে এবার বলল : স্যার আমি আপনাকে দেখে ভয় পাইছিলাম। এখন বুঝছি আপনে একজন ভালোমানুষ।
আমি মানুষ নই। অতি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার একটি রোবট।
দোকানদার মাথা চুলকে বলল : রোব..ট, একটু থেমে আবার বলল : আপনে কি কম্পিউটার?
রিবিট এবার মৃদু হেসে বলল : হ্যাঁ ওরকমই কিছু।
ও তাই বলেন। স্যার, আপনের যদি কোনো ওষুধ লাগে আমার দোকান থেকে নিয়েন। টাকাপয়সা কিছু লাগবে না। যখন পারেন তখন দিবেন। যদিও আমার দোকান না, কিন্তু আমি সকালে মালিকরে আপনার কথা বলব।
রিবিট থমকে দাঁড়াল। তারপর বলল : মনে হচ্ছে আপনি একজন ভালোমানুষ।
দোকানদার বলল : না স্যার। আমি ভালোমানুষ না। আমিও রাইতের বেলা ওষুধের দাম বাড়ায় দেই।
আর বাড়াবেন না।
আমি চেষ্টা করব স্যার।
রিবিট হ্যান্ডশেকের জন্য দোকানদারের দিকে হাত বাড়াল। দোকানদার মহাআনন্দে রিবিটের সাথে হ্যান্ডশেক করল।
রিবিট চলে যেতে দোকানদার ভেবে পেল না কম্পিউটার কীভাবে হাঁটতে, চলতে আর কথা বলতে পারে।
১২
ইনজেকশন দেয়ার পর বাচ্চাদুটোকে ভর্তি করার জন্য ভর্তি ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হল। রিবিটের সাথে নার্স সোমাও আছে, বাচ্চাদুটো তারই কোলে। ভর্তি ইউনিটে যাওয়ার পর নতুন বিপত্তি শুরু হল। ভর্তি ইউনিটের বয়স্ক এক কর্মচারী জানাল, শিশুদের ইউনিটে কোনো বেড খালি নেই।
রিবিট বলল; তাই বলে কি আপনি এদের দুজনকে ভর্তি করবেন না? আপনাদের ডাক্তারই তো ভর্তি করতে বলেছেন।
কর্মচারী বলল; আমরা কী করব বলুন, কোনো বেড খালি না থাকলে কীভাবে ভর্তি করব?
শিশু দুটো মরণাপন্ন।
এখানে যারা আসে সবাই মরণাপন্নই থাকে।
রিবিট একটু সময় নিয়ে খুব অনুরোধের সাথে বলল : কোনোভাবেই কি ভর্তি করা সম্ভব নয়?
কিভাবে করব বলুন? বেড না থাকলে তো শিশুদেরকে আমরা আর মেঝেতে রাখতে পারি না?
তাহলে এখন আমি কী করব?
আপনি কী করবেন আমি কীভাবে বলব? অন্য কোনো হাসপাতালে ভর্তি করুন। তা না হলে অপেক্ষা করুন, বেড খালি হলে তারপর ভর্তি করবেন। অবশ্য আপনার আগে আরো আটজন সিরিয়ালে আছে। তাদের পর আপনার কথা বিবেচনা করা হবে।
এতে কতক্ষণ সময় লাগবে?
কতক্ষণ নয়, বলুন কত দিন? দু-দিন থেকে শুরু করে দুসপ্তাহ পর্যন্ত লাগতে পারে।
রিবিট সোমার দিকে ফিরে অসহায়ভাবে বলল : এখন কি করতে পারি আমি?
সোমা বলল : আসলে খুব জটিল সমস্যা। আমাদের এখানে রুগীর সংখ্যা অনেক বেশি। অনেকে রুগী ভর্তি করতে না-পেরে বারান্দায়ই অপেক্ষা করে। হাসপাতাল-কর্তপক্ষ তাদের বেড দিতে না-পারলেও চিকিৎসা দিতে চেষ্টা করে।
তার মানে আপনি বলছেন বাচ্চাদুটোকে আমি বারান্দায় শুইয়ে রাখব! বিস্মিত হয়ে বলল রিবিট।
না তা নয়। আমি বলছিলাম আপনি যদি স্যারকে বলেন, স্যার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
কীভাবে?
আমি জানি না। হয়তো স্যার অন্য কোনো রুগীকে কিছুক্ষণের মধ্যে রিলিজ করিয়ে ওদেরকে সেই বেডে ভর্তি করার ব্যবস্থা করবে।
না, তা সম্ভব নয়। এ-কাজ আমি করতে পারব না। এই বাচ্চাদের চিকিৎসার জন্য অন্য কোনো বাচ্চাকে বঞ্চিত করতে পারব না।
তাহলে তো আর কোনো উপায় নেই। আমরা কি অন্য কোনো ইউনিটে ভর্তি করে ওদের চিকিৎসা করতে পারি না?
না পারি না। কারণ শিশুদের চিকিৎসা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাছাড়া শিশুদের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। শিশুদের খাদ্য, পানীয় সবকিছুর জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন। অন্য ইউনিটে এসব সুবিধা পাওয়া যাবে না। তাছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও রাজি হবে না।
তাহলে কী করা যায়?
অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।
উপায় যে আমাদেরকে বের করতেই হবে।
কিন্তু কীভাবে?
চলুন আপনার স্যারের কাছে চলুন।
ঠিক আছে চলুন।
শিশু ইউনিট অতিক্রম করার সময় রিবিট লক্ষ্য করল প্রত্যেকটা বেডেই রুগী রয়েছে। একটা বেড়ও খালি নেই। এককোণায় বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা দেখে বলল : ঐ জায়গাটা ফাঁকা কেন? কোনো বেড নেই কেন ওখানে?
ছিল, কিন্তু বেডটি নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন বেড এলে ওখানে পাতা হবে।
ও আচ্ছা।
তারপর রিবিট হঠাই বলল; আমরা একটা কাজ করতে পারি।
কী কাজ?
আপনি আসুন আমার সাথে।
রিবিট আবার ভর্তি ইউনিটে এল। সেখান থেকে জেনে নিল কোন ইউনিটে। ফাঁকা বেড রয়েছে। যখন জানতে পারল নিউরোলজি ইউনিটে, তখন বলল : সোমা আমি নিউরোলজি ইউনিটে যেতে চাই।
কী করবেন আপনি?
দেখুন আমি কী করি।
এমন সময় ডাক্তার শিপন উপস্থিত হল। সে রিটিকে দেখে বলল : ওদেরকে ভর্তি করতে পেরেছেন?
না পারিনি। কোনো ফাঁকা বেড নেই।
তাহলে তো ভালো সমস্যা।
সমস্যা যেহেতু হয়েছে, সমাধানও রয়েছে। আসুন আমার সাথে। রিবিট আর কোনো কথা না বলে এগিয়ে যেতে শুরু করল। এরই মাঝে সে অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ইপির সাথে কথা বলল : ইপি, আমি যে কাজটি করতে যাচ্ছি তা কি খুব অন্যায়?
না রিবিট। আমি তোমাকে সমর্থন করছি। তুমি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত হাসপাতালের নিয়ম ভঙ্গ করতে যাচ্ছ ঠিকই, কিন্তু তা মানবশিশুর জীবনরক্ষার জন্য। তাছাড়া তুমি কারো কোনো ক্ষতি করছ না।
ধন্যবাদ ইপি।
রিবিট নিউরোলজি ওয়ার্ডে প্রবেশ করে দেখল এখানে বেশ কয়েকটা বেড খালি পড়ে আছে। ভিতরে মাত্র কয়েকজন রুগী। ওয়ার্ডের ভিতরে টেবিলের পাশে বসে-থাকা নার্সকে উদ্দেশ করে বলল : আপনার পাশের ঐ বেডটিতে কি কোনো রুগী আছে?
নার্স বেচারি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল : না…না।
রিবিট আর কোনো কথা বলল না। শুধু বলল; ইপি, অ্যাকটিভেট এক্সট্রা পাওয়ার।
পাওয়ার অ্যাকটিভেট করা হয়েছে, লেভেল মিডিয়াম। সাথে সাথে উত্তর দিল ইপি।
রিবিট বেডের উপর থেকে বালিশটি এনে ডাক্তার শিপনের হাতে দিয়ে বলল : আমাকে অনুসরণ করুন।
তারপর রিবিট যা করল তাতে উপস্থিত সবার চোখ ছানাবড়া। রিবিট বেড়সহ লোহার খাটটি উঁচু করে কাঁধে তুলে ফেলল। তারপর ডাক্তার শিপন আর সোমার সামনে এসে বলল : সরাসরি শিশু ইউনিটে।
শিশু ইউনিটের যে-ওয়ার্ডে রিবিট ফাঁকা জায়গা দেখেছিল সেখানে এনে বেডটি রাখল। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বলল : সোমা, এই বেড়টা বাচ্চাদুটোর জন্য, কারো কোনো অসুবিধা আছে?
কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু ডাক্তার শিপন বলল : অবিশ্বাস্য রিবিট! অসাধারণ! আমি আপনার সাথে আছি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
রিবিটকে বেড় উঁচু করে আনতে দেখে ভর্তি ইউনিটের কর্মচারীও পিছন পিছন এসেছে। রিবিট এবার তার দিকে ফিরে বলল : এখন ভর্তি করতে কোনো অসুবিধা?
না, না..স্যার। আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি।
তারপর সোমার উদ্দেশে বলল : এখন মূল দায়িত্ব আপনাদের। আমাকে আর কী কী করতে হবে বলুন?
আপনি অনেক করেছেন। বলল ডাক্তার শিপন। কী করতে হবে আমি দেখছি।
রিবিটের এ-ঘটনায় আশেপাশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। নার্স ডাক্তার সবাই বাচ্চাদুটোর ওপর বিশেষ নজর দিতে শুরু করল। এই শেষরাতেই রক্তপরীক্ষা, এক্সরেসহ অন্যান্য প্যাথলজিকাল পরীক্ষারও ব্যবস্থা করা হল। অবশ্য এ সবকিছুর পিছনে রিবিটের পরে যার অবদান বেশি সে হল ডাক্তার শিপন আর নার্স সোমা। এ দুজনের অতিরিক্ত তৎপরতায় বেশ দ্রুতগতিতে এগোতে লাগল সবকিছু।
রিবিট বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। এক্সরে-শেষে নার্স সোমা এসে বলল : ভাই আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
সত্যি কথা বলতে কী মেয়েটার অবস্থা ভালো না। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে, হঠাৎ যে কেন এমন হচ্ছে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।
কী বলছেন আপনি!
হ্যাঁ ভাই। আপনি যেভাবে পারেন একবার মালেক স্যারকে খবর দিন। উনি এলে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন।
এমন সময় ডাক্তার শিপন এসে উপস্থিত হয়ে বলল : সোমা অবশ্য ঠিকই বলেছে। আমি নিজে মালেক স্যারের বাসায় ফোন করেছিলাম, কিন্তু স্যার আসতে রাজি হচ্ছেন না। এককথা বলার পরই ফোন রেখে দিয়েছেন।
তাহলে?
রিবিট, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরাওয়ার্ড বয়কে পাঠিয়েছি। আশা করছি এবার স্যার আসবেন।
রিবিট অবাক হয়ে বলল : দুটো শিশু মারা যাচ্ছে, অথচ উনি আসবেন না কেন?
আসলে হাসপাতাল তো অনেক রুগী-প্রতিদিনই এরকম দু-একটা কেস থাকে। ফলে স্যারদের কাছে এই ধরনের কেস খুব-একটা গুরুত্ব পায় না।
কিন্তু তাই বলে…
আপনি চিন্তা করবেন না। মালেক স্যারের বাসা পাশেই কলোনিতে। আশা করছি ওয়ার্ডবয় যখন গেছে তখন স্যার অবশ্যই আসবেন। তাছাড়া বদমেজাজি হলেও স্যারের মন ভালো। একবার যদি রুগীর প্রতি মনোযোগ দেন তাহলে সেই রুগীর রোগ নিরাময় করে ছাড়বেন। দেখা যাক কী হয়!
আমরা কি যেতে পারি না?
মনে হচ্ছে তার প্রয়োজন হবে না।
এমন সময় একজন নার্স এসে ডাক্তার শিপনকে জানাল ইমার্জেন্সিতে একজন রুগী এসেছে। ডাক্তার শিপন বলল : আমি তাহলে রুগী দেখে আসছি।
ঠিক আছে, আমি অপেক্ষা করছি।
ডাক্তার শিপন চলে যেতে রিবিট সোমাকে উদ্দেশ্য করে বলল : এখন কি আর কোনো ওষুধ লাগবে?
আপাতত না। এখন যে-ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে সেগুলো হাসপাতাল থেকেই দেয়া হচ্ছে। তবে পরে হয়তো লাগবে। সেক্ষেত্রে স্যাররাই আপনাকে জানাবেন।
এমন সময় অল্পবয়সী এক ছেলে এসে বলল : শিপন স্যার কই? কেন? তুমি কি মালেক স্যারের বাসায় গিয়েছিলে? প্রশ্ন করল সোমা। হ গেছিলাম। স্যার আমারে এক ধমকে বাইর কইরা দিছে। স্যার কি কোনো কথাই বলল না?
না, খুব বিরক্ত হইছে। মুখের উপর দরজা বন্ধ কইরা দিছে।
সোমা অসহায় ভঙ্গিতে বলল : এখন কী হবে? স্যার আসতে আসতে সেই ন’টা। এখনো অনেক সময় বাকি। কোনোভাবে স্যার যদি এখন আসতেন অন্তত সিদ্ধান্ত পাওয়া যেত। সবাই স্যারের জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে এমনভাবে বলল : আজ তো বন্ধের দিন, স্যার তো হাসপাতালে আসবেন না।
রিবিট এবার ছেলেটির দিকে ফিরে বলল : আপনি তাহলে ওয়ার্ডবয়, মালেক স্যারের বাসায় গিয়েছিলেন?
হুঁ।
আমি যাব চলুন।
আমি আবার যাবার পারব না। স্যার আমার চাকরি নট কইরা দিবে।
আপনাকে যেতে হবে না। আপনি শুধু আমাকে বাসাটা চিনিয়ে দেবেন। তারপর যা করার আমি করব। আপনার নাম আমি আপনার স্যারের কাছে বলব না। কাজেই আপনার কোনো ভয় নেই।
না আমি পারব না।
এবার সোমা কথা বলল : আরে, তোমার তো কোনো ভয় নেই। সবাই বাচ্চাদুটোকে সাহায্য করার জন্য চেষ্টা করছে আর তুমি করবে না? তাছাড়া ভাই তো আর তোমার নাম স্যারকে বলতে যাচ্ছে না। তুমি শুধু বাসাটা দেখিয়ে দিয়ে চলে আসবে।
এবার ছেলেটি রাজি হল। বলল : আমি কিন্তু আপনের সাথে স্যারের বাসায় যাব না।
আমি তো আগেই বলেছি আপনাকে যেতে হবে না। বলল রিবিট।
রিবিট যখন প্রফেসর মালেকের বাসার কলিংবেল বাজাল তখন চারদিক ফর্সা হয়ে উঠেছে। তিনবার কলিংবেল বাজানোর পর প্রফেসর মালেক নিজেই দরজা খুললেন। স্লিপিং ড্রেস পরা প্রফেসর মালেক দরজা খুলে প্রায় ধমকেই উঠেছিলেন, কিন্তু শেষমুহূর্তে রিবিটকে দেখে তিনি থমকে গেলেন।
রিবিট খুব মোলায়েম স্বরে বলল; স্যার আমার নাম রিবিট, অতি উচ্চবৃদ্ধি মাত্রার রোবট। দুটো বাচ্চার অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি যদি দয়া করে একবার আসতেন।
প্রফেসর মালেক বেশ রূঢ়স্বরে বললেন, আ..আপনিই তাহলে সেই রোবট?
জ্বি, আপনি যদি একবার আসতেন স্যার।
আমি বলেছি আমি আসব না। তবে কথা দিচ্ছি নটার সময় আমি আপনার রুগীকে দেখব।
আজ একদিন নাহয় আপনি কয়েকঘন্টা আগে অফিস করলেন স্যার। আপনার এই কয়েক ঘণ্টা আগে অফিসে যাওয়ার জন্য যদি দুটো শিশু বছরের-পর-বছর বেঁচে থাকতে পারে তাহলে কি আপনার জন্য তা আনন্দের হবে না?
দেখুন, আমার জন্য কী আনন্দের আর কী আনন্দের না, তা একান্তই আমার ব্যাপার।
কিন্তু আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন..
আমি কিছু বুঝতে চাই না।
আপনি কি তাহলে সত্যি যাবেন না স্যার? এতগুলো মানুষ যারা শিশুদুটোকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছে তাদেরকে কি আপনি সাহায্য করবেন না?
প্রফেসর মালেক কোনো কথা বললেন না।
রিবিট এবার খুব আকুতি নিয়ে বলল : প্লিজ স্যার আপনি চলুন।
প্রফেসর মালেক একবার রিবিটের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন : আমি বুঝতে পারছি আমার যাওয়া উচিত। ঠিক আছে আমি যাব। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।
১৩
সকাল নটা। রিবিট প্রফেসর মালেকের চেম্বারে বসে আছে। প্রফেসর মালেক গভীর মনোযোগের সাথে এক্সরে আর প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টগুলো পরীক্ষা করছেন। রিবিট নিশ্চিত প্রফেসর মালেক আগেও এই বিপোর্টগুলো পরীক্ষা করেছেন। এখন করছেন আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য। প্রফেসর মালেকের চেহারাই বলে দিচ্ছে সবকিছু স্বাভাবিক নেই, নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট থেকে মুখ তুলে তাকালেন প্রফেসর মালেক। তারপর লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন : রিবিট সাহেব..
স্যার আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আমাকে রিবিট বলে ডাকার জন্য। দয়া করে আমাকে ‘সাহেব’ বলবেন না। ‘সাহেব’ শব্দটি মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি আপনি আমাকে তুমি করে বললে আমার বেশি ভালো লাগবে।
প্রফেসর মালেক মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন : ঠিক আছে, আপনি যেহেতু আপনাকে রিবিট’ বলেই শুনতে বেশি পছন্দ করেন আমি আপনাকে ‘রিবিট’ বলেই ডাকব। পাশাপাশি ‘তুমি’ও বলব।
ধন্যবাদ স্যার।
হ্যাঁ যে-বিষয়ে বলতে চাচ্ছিলাম। রিবিট, তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছে আমি সবগুলো রিপোর্ট পরীক্ষা করেছি। অবশ্য আমাদের আরো কিছু রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাছাড়া সিটিস্ক্যান তো আছেই। আমি অবশ্য বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে বাচ্চাদুটোর সিটিস্ক্যান করার ব্যবস্থা করেছি। আশা করছি দুপুর বারোটার আগে কয়েকটা রিপোর্ট ব্যতীত সকল রিপোর্ট হাতে পেয়ে যাব। আপাতত আমার হাতে যে-রিপোর্টগুলো রয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতে এবং আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলছি বাচ্চাদুটোর জীবন খুব সংকটাপন্ন।
এই বলে প্রফেসর মালেক একটু সময় নিলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন : দুটো বাচ্চার মধ্যে মেয়েবাচ্চাটির অবস্থা বেশি খারাপ। আমি কারণ। সম্পর্কে ধারণা করতে পারলেও এখনো নিশ্চিত নই। তবে আমার বিশ্বাস আমার অনুমান মিথ্যা নয়। তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ বাচ্চা দুটো পা এবং মাথার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। অর্থাৎ ছেলেটির বাম পা এবং মাথার বাম অংশ মেয়েটির ডান পা এবং মাথার ডান অংশের সাথে সংযুক্ত। পায়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। দুজনের সংযুক্ত পা দুটির গঠন আপাতদৃষ্টিতে ঠিকই মনে হচ্ছে। তবে তাদের দুজনের পায়ে দুটো আর্টারি বা ধমনি একই জায়গায় সংযুক্ত হয়েছে। ফলে খুব সহজে একজনের রক্ত অন্যজনের শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এটা তেমন কোনো মারাত্মক সমস্যা নয়। কয়েক ঘণ্টার অপারেশনে আর্টারি দুটোকে আলাদা করা সম্ভব হবে। মূল সমস্যা হচ্ছে মাথায়। ছেলে এবং মেয়ে দুজনের মস্তিষ্ক পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। তবে আশার কথা এই, মস্তিষ্ক খুব সামান্য অংশে একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়েছে, বলতে পারেন মস্তিষ্ক দুটো শুধু। একে অপরকে স্পর্শ করেছে মাত্র। ফলে অপারেশন করে আলাদা করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করছি। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো এই সংযোগস্থলে মেয়েটির মস্তিষ্কে একটা টিউমার হয়েছে। তার থেকেও ভয়ংকর ব্যাপার হল মেয়েটির মস্তিষ্কে ইন্টারন্যাল হেমোরেজ বা রক্তপাত হচ্ছে। মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে এ-ধরনের হেমোরেজ অতি অল্পসময়ে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তার নমুনা আপনি নিজেই দেখেছেন। মেয়েবাচ্চাটি প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
প্রফেসর থামলে রিবিট বলল : তাহলে এখন কী করতে হবে?
আমাদের হাতে অপারেশন ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। বাচ্চাদুটোকে অপারেশনের মাধ্যমে একে অপরের কাছ থেকে আলাদা করতে হবে।
কখন! বিস্ময় নিয়ে বলল রিবিট।
আজই।
আজই!
হ্যাঁ রিবিট, আজই। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমি আজ দুপুর তিনটার সময় অপারেশন শুরু করতে চাই। কারণ আজ অপারেশন করলে দুজনেরই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ছেলেটির বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে আমি নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারলেও মেয়েটির ক্ষেত্রে পারব না। কারণ মেয়েটির বর্তমান অবস্থা মোটেই ভালো নয়। তবে আমি চেষ্টা করব। আমাদের পক্ষে আর দেরি করা উচিত হবে না। কারণ, অপারেশন ছাড়া মেয়েটির মাথার অভ্যন্তরের জমাটবাধা রক্ত বের করা সম্ভব নয়। আজ যদি অপারেশন করা না হয়, তাহলে দু’রকম খারাপ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমত, মেয়েবাচ্চাটির মৃত্যু ঘটতে পারে। আর মেয়েবাচ্চাটির মৃত্যু ঘটলে অল্পসময়ের মধ্যে ছেলেবাচ্চাটিরও মৃত্যু ঘটবে। কারণ মৃত মেয়েটির রক্ত পায়ের সংযুক্ত ধমনির মধ্যে দিয়ে ছেলেটির শরীরে প্রবেশ করে ছেলেটির রক্তকে দূষিত করে ফেলবে। ফলে অল্পসময়ের মধ্যে ছেলেটিরও মৃত্যু ঘটবে। আর দ্বিতীয় খারাপ সম্ভাবনা হল, যদি কোনো কারণে মেয়েটি বেঁচেও যায় তাহলে দুজনের কেউই বেশিদিন বাঁচতে পারবে না। কারণ মেয়েটির মাথায় একটি টিউমার রয়েছে। এমনিতেই টিউমার খুব দ্রুত বড় হয়, উপরন্তু শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধিও বেশি। এ-কারণে অল্পসময়ের মধ্যে টিউমারটি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং বাচ্চাদুটোর মস্তিষ্ক আরো বেশি স্থান নিয়ে একে অপরের সাথে সংযুক্ত হবে। ফলে জটিলতা আরো বাড়বে, এমনকি ছেলেটিও টিউমারে আক্রান্ত হতে পারে। কারণ দুজনেরই শারীরিক গঠন এক এবং দু’জনের শরীরে একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। যদি আমরা দুজনের শরীরকে একটি শরীর কল্পনা করি, তাহলে টিউমার যেমন শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত বিস্তৃত হয় তেমনি মেয়েটি থেকে ছেলেটিতে বিস্তৃত হবে। সুতরাং এখনই অপারেশন ব্যতীত বাচ্চাদুটোর দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।
রিবিট কিছুটা ম্লান গলায় বলল : তাহলে অপারেশনই করতে হবে?
হ্যাঁ রিবিট। তুমি যদি কোনো যুক্তিতর্ক না-মেনে ধরে নাও শিশুদুটো কোনো অলৌকিক কারণে বেঁচে থাকবে তাহলেও আজ হোক কাল হোক ওদেরকে অপারেশন করে আলাদা করতেই হবে। কারণ যমজ শিশু নিত্যনৈমিত্তিক কোনো ব্যাপার নয়। তার উপর একটি ছেলে এবং অন্যটি মেয়ে, যেখানে অধিকাংশ। ক্ষেত্রে দুটো ছেলে কিংবা দুটো মেয়ে একসাথে জন্ম গ্রহণ করে। তার থেকে বড় কথা, ছেলে মেয়ে দুটো একে অন্যের সাথে সংযুক্ত। আমি আমার দীর্ঘজীবনে ছেলে মেয়ে একসাথে সংযুক্ত যমজ হিসাবে পাইনি। এটাই আমার প্রথম কেস। তাই আমি বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সাথে নিচ্ছি। হ্যাঁ যা বলছিলাম, আজ হোক কাল হোক ওদেরকে অপারেশনের মাধ্যমে আলাদা করতেই হবে। কারণ ওদের একজন ছেলে আর অন্যজন মেয়ে। একজন ছেলে আর একজন মেয়ের এভাবে বসবাস করা কতটা অস্বস্তিকর তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ। তাছাড়া বয়োঃসন্ধির পর এরা আর স্বাভাবিক শিশু হিসাবে থাকতে পারবে না। কারণ হরমোনাল ইমব্যালান্স বা ভারসাম্যহীনতা। পুরুষ-বৈশিষ্ট্যের জন্য যে হরমোন দায়ী সেটা হল টেসটেসটেরন আর মেয়েদের জন্য প্রজেস্টেরন এবং ওয়েস্ট্রোজন। সাধারণত বারো থেকে আঠারো বছর বয়সের মধ্যে এই হরমোনগুলো শরীরে উৎপাদন হতে থাকে এবং ছেলেদেরকে পুরুষের বৈশিষ্ট্য এবং মেয়েদেরকে নারীর বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। যেহেতু বাচ্চাদুটোর শরীরের রক্ত একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে, এই হরমোনগুলোও একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে প্রবাহিত হবে এবং ওদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হবে। ফলে ওরা অন্য পুরুষ বা নারীর মতো স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের এবং আচরণের অধিকারী নাও হতে পারে। তাছাড়া এ-ধরনের হরমোনের ভারসাম্যহীনতা জটিল শারীরিক সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ওরা যদি বেঁচেও থাকে ওদের জীবন হবে দুর্বিষহ, ওরা ওদের বেঁচে থাকাকে নিজেদের এবং সমাজের জন্য বোঝা ছাড়া আর কিছু মনে করবে না। হয়তো ওদের একজনের মনে অন্যজনের জন্য ভালোবাসার পরিবর্তে প্রচণ্ড ঘৃণার জন্ম হতে পারে। এমনকি ওরা আত্মহত্যা বা অন্যকে হত্যার চেষ্টাও করতে পারে। রিবিট, তুমি কি চিন্তা করতে পারছ ওদের ভবিষ্যৎ কতটা ভয়াবহ আর দুর্বিষহ হবে?
আমি বুঝতে পারছি স্যার। উত্তর দিল রিবিট।
আর এ-কারণেই আজ আমি অপারেশন করতে চাচ্ছি। আজকের অপারেশনেও মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। কারণ রুগী দুজনই শিশু, বয়স মাত্র তিন মাস। এত কমবয়সী শিশুদের শরীরে এ-ধরনের অপারেশনের ধকল সইবে কিনা তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। তাছাড়া স্বাভাবিক অপারেশনের সময় রুগীকে অপারেশনের উপযোগী করতে আমরা কিছু সময় নিই। এ সময় কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লাগে। অথচ সেই সময়ও আমাদের হাতে নেই। সুতরাং সবকিছু বিবেচনা করে আমি তোমাকে সম্ভাবনার কথা বলতে পারছি না। হতে পারে ছেলেটির জন্য ফিফটি ফিফটি, আর মেয়েটির জন্য এই সম্ভাবনা আরো কম।
স্যার আপনি কি নিজেই অপারেশন করবেন?
না। মূলত আমি এই অপারেশনের দায়িত্বে থাকব। সাত থেকে নয় সদস্যের একটি টিম করবে। কারা কারা এই অপারেশনে অংশগ্রহণ করবে তা আমি এখনো ঠিক করিনি। তবে অবশ্যই অত্যন্ত অভিজ্ঞ একজন নিউরোসার্জন থাকবেন যিনি মস্তিষ্কের অপারেশন সম্পন্ন করবেন। পায়ের অপারেশনের জন্য একজন সার্জন ইতিমধ্যে ঠিক করা হয়েছে। জেনারেল এ্যানেসথেসিয়ার জন্য এক্সপার্ট থাকবেন। দুপুর বারোটার মধ্যে আমি সবাইকে নিয়ে মিটিং-এ বসব এবং বিকেল তিনটার সময় অপারেশন শুরু করব। আশা করছি ছয় থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে আমি এই অপারেশন সম্পন্ন করতে পারব।
ছয় থেকে সাত ঘণ্টা!
হ্যাঁ, ছয়-সাত ঘণ্টা সময় তো লাগবেই। সময় আরো বেশি লাগতে পারে। তবে মূল সমস্যা হচ্ছে ডাক্তারদের রাজি করানো। কারণ আজ ছুটির দিন। সবাইকে হয়তো পাওয়া যাবে না।
যদি স্যার পাওয়া না যায়? আশঙ্কিত গলায় বলল রিবিট।
তুমি ডাক্তার নিয়ে চিন্তা কোরো না। ওটা আমার দায়িত্ব। তোমাকে অন্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
কী বিষয় স্যার?
তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ এই অপারেশন অত্যন্ত জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আমাদেরকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। তাই খরচও অনেক বেশি, কমপক্ষে তিন লাখ টাকা। তোমাকে এই টাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
তিন লাখ টাকা! বিস্মিত গলায় বলল রিবিট।
হ্যাঁ রিবিট। এই অপারেশনে আমি যে-সকল ডাক্তারের কথা ভাবছি তাদের অপারেশনের ফি অনেক বেশি। তাদের সকলে সরকারি ডাক্তার নয়, এজন্য খরচ একটু বেশিই হবে। তাছাড়া আজ বন্ধের দিন, স্বাভাবিক ফি-তে তারা কাজ করতে চাইবে না। হয়তো আমি অনুরোধ করায় করতে পারে। আর ওষুধের খরচ তো রয়েছেই। একই সাথে মাথা এবং পায়ে দুটো মেজর অপারেশন হতে চলেছে এবং রুগী একজন নয়, দুজন। অপারেশন থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ের জন্য দু-জনের ওষুধের ব্যবস্থা করতে হবে। এই ওষুধগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাছাড়া অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে আমরা কিছু ওষুধ কিনে রাখব যেন জরুরি পরিস্থিতিতে এই ওষুধগুলো ব্যবহার করা যায়। অবশ্য শেষপর্যন্ত এই ওষুধগুলো নাও লাগতে পারে।
কি..কিন্তু স্যার, এত টাকা আমি কোথায় পাব?
আমি তোমার সমস্যা জানি, কিন্তু এ ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। সরকারী হাসপাতালে অপারেশন হওয়ায় আমি এখানকার জন্য কোনো খরচ কিংবা আমার বা অন্য কোনো ডাক্তারের ফি ধরছি না। হাসপাতাল থেকে যতদূর সম্ভব আমি ওষুধ সরবরাহ করতে চেষ্টা করব। তবে তোমাকে তিন লাখ টাকা একসাথে দিতে হবে না। অধিকাংশ টাকা খরচ হবে অপারেশনের পরে ওষুধ কেনার জন্য। আপাতত তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। বাইরের ডাক্তারদের ফি নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না। ওটা দু-চারদিন পরে দিলেও চলবে। কিন্তু আগামীকালের মধ্যে তোমাকে আরো এক লাখ টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। বাকি টাকা এক সপ্তাহের মধ্যে।
রিবিট কী বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। তাকে এত টাকা কে দেবে? কোথা থেকে জোগাড় করবে এত টাকা?
প্রফেসর মালেক আবার বললেন, তুমি বলছিলে বাচ্চাদুটোর নাম তুমি জানো না?
না আমি জানি না।
কিন্তু ওদের নাম তো দরকার। তা না হলে অপারেশনের বন্ড পূরণ করব কীভাবে? তুমি দুজনের নাম রেখে দাও না?
না স্যার, এ-কাজটা করা আমার উচিত হবে না। নিশ্চয় ওর বাবা-মা কোনো নাম রেখেছিল। আমি কোনোভাবেই সেই নাম পরিবর্তন করে অন্য কোনো নাম রাখতে পারব না।
তোমার কথায় অবশ্য যুক্তি আছে। ওদের বাবা-মাকে খুঁজে পেলে ভালো হত। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়। তাছাড়া রক্তেরও ব্যবস্থা করতে হবে। অবশ্য সেটা কোনো সমস্যা হবে না। আমার কাছে ডোনার আছে। একটু থেমে প্রফেসর মালেক আবার বললেন : জানো রিবিট,..
স্যার বলুন।
গত পরশুদিন কেউ একজন আমাকে বলেছিল আউটডোরে সংযুক্ত যমজ শিশু নিয়ে একজন মহিলা এসেছিল। আমি অবশ্য ব্যস্ততার জন্য সেদিন শিশুদুটোকে দেখতে পারিনি। জানি না এই শিশুদুটোই সেই শিশু কিনা!
আমি সঠিক বলতে পারব না স্যার। তোমার না-পারারই কথা। ঠিক আছে তুমি যাও, টাকার জোগাড় করো। আমি ওষুধ লিখে দেব। সেগুলো কিনে আনতে হবে। আমি এখন সবার সাথে যোগাযোগ করব। বারোটার সময় অবশ্যই আমাকে অপারেশন টিমের সকলকে নিয়ে প্রি-অপারেটিভ মিটিং-এ বসতে হবে।
রিবিট কিছু বলল না। সে নীরবে প্রফেসর মালেকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল।
১৪
হাসপাতালে সবার মুখে-মুখে এখন যমজ বাচ্চাদুটোর খবর। সবাই বাচ্চাদুটোকে এক নজর দেখার জন্য শিশু ইউনিটে ভিড় করছে। ভিড় কমাতে কর্তৃপক্ষ ওয়ার্ডের সামনে লোক নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। এতে ভিড় বরং আরো বাড়ছে। সবাই এসে বাচ্চাদুটোকে দেখতে না-পেরে ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকছে এই আশায় যে কখন ওদেরকে একনজর দেখা যায়। তাছাড়া রিবিটকে দেখার ব্যাপার তো রয়েছেই। হাসপাতালের মধ্যে একটা রোবট ঘোরাঘুরি করছে এবং এই রোবটটাই বাচ্চাদুটোর প্রাণ বাঁচাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এ-খবর সেই সকালেই হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই বাচ্চাদুটোকে দেখার পাশাপাশি রিবিটকে দেখার কৌতূহলও কারো কম নয়।
এদিকে মিডিয়ার লোকজন সকাল থেকেই রিবিটকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে। তারা যখন জানতে পেরেছে রিবিট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং দুটো শিশুর জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, তারা তাদের ক্যামেরা নিয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছে। সবারই শত শত প্রশ্ন রিবিটের কাছে, কিন্তু রিবিট নিরুত্তর। সে তার কাজ করে যাচ্ছে। তবে সে স্থির থাকতে পারছে না। সবসময় তার পিছনে আঠার মতো মিডিয়ার লোকজন লেগে আছে।
প্রফেসর মালেকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে রিবিট বারান্দায় এল। এ-জায়গাটা অবশ্য নিরিবিলি। প্রফেসর মালেক বারান্দার এপাশে কাউকেই আসতে দিচ্ছেন না। মিডিয়ার সদস্যরা প্রফেসর মালেকের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্যও উদগ্রীব হয়ে আছে। কিন্তু তিনি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন মিডিয়ার কারো সাথে কোনো কথা বলবেন না।
রিবিট দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। তাকে এখন অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে। বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য তিন লাখ টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কিভাবে করবে সেটাই চিন্তার বিষয়। রিবিট বিস্তারিত আলোচনার জন্য ইপিকে ডেকে বলল : ইপি, কী করি বলো তো? এত টাকা এই অল্পসময়ের মধ্যে আমি কোথায় পাব?
ইপি রিবিটের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে বলল : তোমার একটা মেইল এসেছে রিবিট।
হ্যাঁ আমি পড়েছি। সাংবাদিক সাইফ করেছে। আমি হাসপাতালে আছি কিনা জানতে চেয়েছে।
তুমি তো কোনো উত্তর দিলে না।
আমার ভালো লাগছে না। বাচ্চাদুটোর জন্য খারাপ লাগছে। আদৌ আমি ওদের জন্য কিছু করতে পারব কিনা। তুমি আমার হয়ে মেইলের উত্তর দাও। জানিয়ে দাও আমি হাসপাতালেই আছি।
ঠিক আছে রিবিট।
এখন বলল আমি কী করব?
এ-ধরনের অবস্থায় পড়লে মানুষ কীভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে সে সম্পর্কে আমি ইন্টারনেটে, বইতে এবং পত্রপত্রিকায় বিস্তারিত অনুসন্ধান করেছি। প্রচলিত যে-সকল উপায় রয়েছে সেগুলো হল : নিজের সম্পত্তি বিক্রি করা, আত্মীয় স্বজনের নিকট হতে ধার করা, ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণ করা, অফিস থেকে অগ্রিম উত্তোলন করা, দীর্ঘ দিনের জমান টাকা খরচ করা, আন্তর্জাতিক বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য গ্রহণ করা, সাহায্যের জন্য পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া ইত্যাদি।
তুমি যেগুলো বললে সেগুলো তো আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আমার নিজের কোনো সম্পত্তি নেই, আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিবার-পরিজন বলতে প্রফেসর হক যিনি ব্যাংকের নয় হাজার টাকাই দিয়ে দিয়েছেন, ব্যাংক কোনোভাবেই আমাকে ঋণ দেবে না, অফিস হতে অগ্রিম উত্তোলনের তো প্রশ্নই আসে না, দীর্ঘদিনের জমানো টাকা বা আমার নিজের তিনশত তেত্রিশ টাকা। ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অথবা পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সাহায্যপ্রাপ্তির আশা তো অনিশ্চিত, আর তাছাড়া দুটো উপায়ই দীর্ঘমেয়াদী।
তুমি ঠিকই বলেছ রিবিট।
তাহলে উপায়! যে করেই হোক আমাকে দুপুরের আগে পঞ্চাশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে। হাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় রয়েছে।
তোমার এই টাকা মূলত বাচ্চাদের ওষুধের জন্য প্রয়োজন। তুমি এ-ব্যাপারে কাল রাতে প্রথমে যে-ওষুধের দোকানে গিয়েছিলে সেই দোকানের ওপর নির্ভর করতে পারো। দোকানদার বলেছিল তোমাকে বাকিতে ওষুধ দেবে।
সকালে আমি এগারোশো টাকার ওষুধ বাকিতে এনেছি। ওরা অবশ্য আমার সাথে ভালো আচরণ করেছে, কাল রাতের দ্বিতীয় দোকনদারের মতো নয়। প্রথম দোকানদার প্রফেসর হকের দেয়া দ্বিতীয় চেকটি রাখেনি। কিন্তু ওদের ওপর তো এত টাকার ওষুধের জন্য নির্ভর করা যাবে না। আর সব ওষুধ ঐ একই দোকানে পাওয়া যাবে না। উপরন্তু ওষুধ ছাড়াও নিশ্চয় আরো কিছু খরচ রয়েছে। যেমন বাচ্চাদের খাবার এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনা। আর ওষুধের দোকানের ওপর নির্ভর করা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আগামীকাল আমি টাকা জোগাড় করব কীভাবে?
রিবিট, তাহলে আমাদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব আন্তর্জাতিক বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করা।
কিন্তু কীভাবে?
তুমি তো জানো আমার এবং তোমার মেমোরিতে বাংলাদেশের সকল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার টেলিফোন নম্বর রয়েছে। আমরা এখনই ওদেরকে টেলিফোন করে সাহায্য কামনা করতে পারি। জরুরি প্রয়োজনে এ-সকল সংস্থা অনেক সাহায্য দিয়ে থাকে।
তোমার কি মনে হয় এতে কাজ হবে?
আমাদের চেষ্টা করতে তো দোষের কিছু নেই।
ঠিক আছে তুমি ফোন করো।
ত্রিশ সেকেন্ড পর কথা বলল ইপি। রিবিট, আমি ইউনিসেফসহ আরো আটটি সংস্থাকে একই সাথে ফোন করেছিলাম। কিন্তু প্রত্যেকটি সংস্থা থেকে একই উত্তর আসছে, ছুটির দিন হওয়ায় অফিস বন্ধ।
তার মানে দ্রুত আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আরো কমে গেল।
হ্যাঁ, তাইতো।
ইপি, তুমি আবার ইন্টারনেটে খুঁজে দেখ। উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পেয়েও যেতে পারো। আমিও খুঁজে দেখছি। দেখি কিছু পাই কিনা।
রিবিট ইন্টারনেটে প্রবেশের আগে কী ভেবে দৈনিক পত্রিকাগুলোর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করল। পত্রিকাগুলোর শিরোনাম দেখে সে বিস্মিত হয়ে ইপিকে বলল : ইপি, তুমি কি আজকের পত্রিকাগুলো দেখেছ?
না রিবিট।
তুমি দ্যাখো, প্রত্যেকটি পত্রিকা আমাকে নিয়ে লাল কালিতে শিরোনাম করেছে।
ইপি বলল : হ্যাঁ তাই তো দেখছি। একটি পত্রিকার শিরোনাম, ‘ঢাকায় মানব রোবট’। অন্যটি লিখেছে, ‘রিবিট আমাদের আশীর্বাদ’, অন্যগুলো লিখেছে, ‘ঢাকার সুপারম্যান রিবিট’, ‘রিবিট : আশা নিরাশার রোবট’, ‘রিবিট আমাদের অহংকার’, ‘মানুষের সেবায় রোবট’, ‘রিবিট তোমাকে স্বাগতম’, ‘রিবিট : আশীর্বাদ না অভিশাপ’, ‘মানুষের বন্ধু রিবিট’, ‘রিবিট এক নতুন অধ্যায়, মানুষের জীবনে রোবট’…।
রিবিট বলল : এ তো দেখছি সবগুলো পত্রিকা আমাকে নিয়ে কোনো-না কোনো সংবাদ পরিবেশন করেছে।
হ্যাঁ রিবিট এবং প্রায় সবই তোমার পক্ষে। বলল ইপি।
তাই তো দেখছি।
তুমি কি টিভি-চ্যানেলগুলো দেখেছ? ওরাও তোমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
না দেখিনি। কাল রাতের পরে তো আর টিভি দেখা হয়নি।
তুমি কি লক্ষ্য করেছ কয়েকটি চ্যানেল যমজ বাচ্চাদুটো সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ করছে। যদিও ওরা ওদের কোনো ছবি দেখাচ্ছে না, তবে তোমার নাম উল্লেখ করে সম্পূর্ণ ঘটনা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করছে।
সম্ভবত ভিতরে আসতে না-পারায় বাচ্চাদুটোর ছবি তুলতে পারেনি। অবশ্য নিরাপত্তার কারণে এটা করা হয়েছে। রিবিট একটু থেমে আবার বলল : ইপি, তুমি কি লক্ষ্য করেছ একটি চ্যানেল হাসপাতালের সামনে মানুষের ভিড় দেখাচ্ছে। এখানে তো অনেক মানুষ। কেন?
ঠিক জানি না। তবে কাল রাতের ঘটনা জেনে আর পত্রিকায় তোমার ছবি দেখে নিশ্চয় ওরা তোমাকে দেখতে এসেছে। যেভাবে টিভি-চ্যানেলগুলো প্রতি মুহূর্তে তোমার অবস্থান প্রচার করছে তাতে তুমি কোথায় রয়েছ তা জানতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না। হাসপাতালের সামনে অনেক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সম্ভবত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিশেষ নিরাপত্তার জন্য এই অতিরিক্ত পুলিশ চেয়ে পাঠিয়েছে।
ইপি, এইসব আলোচনা বাদ দাও। আমরা আমাদের মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কীভাবে টাকার ব্যবস্থা করা যাবে?
আমি তোমাকে নতুন কোনো পরামর্শ প্রদান করতে পারছি না বলে দুঃখিত।
এমন সময় রিবিট সাংবাদিক সাইফের মোবাইল থেকে আর-একটি মেইল পেল। সাইফ লিখেছে : রিবিট, নিরাপত্তার কারণে আমি ভিতরে প্রবেশ করতে পারছি না। তুমি কি আমাকে ভিতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?
মোবাইল থেকে সাইফের ই-মেইল পেয়ে রিবিট কিছুটা অবাক হল। সাইফ ছেলেটি যে তার মোবাইলে ইন্টারনেট ব্রাউজিং আর ই-মেইলের ব্যবস্থা রেখেছে এ-বিষয়টি তাকে অবাক করেছে। সাইফ যে যুগোপযোগী ছেলে সে তা বুঝতে পারল।
রিবিট বলল : কী করি ইপি? ওকে আসতে দিলে তো আরো অনেকে আসতে চাইবে।
তা ঠিক। তবে এ-মুহূর্তে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। সাইফ হয়তো কোনোভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। তুমি ওকে ভিতরে আনতে পারো। সাইফ নবীন সাংবাদিক হলেও ওর নিশ্চয় অনেক কিছু জানা থাকবে। তাছাড়া সাইফ ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র। কাজেই ওর নেটওয়ার্কও বড় হবে।
তুমি ঠিকই বলেছে ইপি।
সাইফকে ভিতরে আনতে রিবিটকে তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হল না। ভিতরে এসেই সাইফ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল : রিবিট, তুমি তো চারদিকে তোলপাড় ফেলে দিয়েছ?
কীভাবে?
অনেকভাবে, বলে শেষ করা যাবে না। আপাতত জেনে রাখো এই বাচ্চাদুটোর জন্য তুমি যা করছ তাতে মানুষ তোমাকে মহান ছাড়া আর কিছু
ভাবছে না। যাইহোক, বাচ্চা দুটোর কি অবস্থা?
ভালো না।
কেন?
ওদের অপারেশন করতে হবে এবং তা আজকেই।
তাহলে অপারেশন হবে, কিন্তু অসুবিধা কোথায়?
এটাই তো সমস্যা। অপারেশনের জন্য তিন লাখ টাকার প্রয়োজন। আজকে দুপুরের মধ্যে পঞ্চাশহাজার টাকা জোগাড় করতে হবে। এখন এই টাকা আমি কোথায় পাব?
তিন লাখ টাকা! বড় বড় চোখে বলল সাইফ।
হ্যাঁ তিন লাখ টাকা।
এত টাকা জোগাড় করা তো সত্যি কঠিন ব্যাপার। তা আবার অল্পসময়ের মধ্যে।
এজন্যই তো চিন্তায় আছি। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর সাহায্য পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। আজ সরকারি ছুটি। সব অফিস বন্ধ।
সাইফ হঠাই গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। সাইফের আচরণে রিবিট খুব অবাক হল। বলল : কী ব্যাপার সাইফ, তুমি কি কিছু চিন্তা করছ?
সাইফ এবার বলল : রিবিট তুমি যদি কষ্ট না পাও তাহলে আমি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি।
হ্যাঁ বলো।
সাইফ এবার একটু ইতস্তত করে বলল : তুমি যে-কোনো টিভি-চ্যানেলে তোমার অতিমানবিক ক্ষমতার উপস্থিতির প্রমাণ সাপেক্ষে একটা ইন্টারভিউ বা সাক্ষাৎকার দিতে পারো। আমি আশা করছি তোমার এই ইন্টারভিউর জন্য তারা তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হবে।
কিন্তু আমি তো এভাবে ইন্টারভিউ দিয়ে কমার্শিয়ালাইজড বা বাণিজ্যিক হতে পারব না। এটা আমার নীতির বিরুদ্ধে।
রিবিট তুমি বুঝতে চেষ্টা করো। তুমি তো নিজের জন্য করছ না, দুটো বাচ্চার জীবন বাঁচানোর জন্য করছ।
সাইফ আমি তোমার যুক্তি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি এ-কাজ করতে পারব না। আমি টিভি-চ্যানেলে আমার শক্তি বা ক্ষমতার ব্যবহার করে অতিমানবিক কাজ করব তা হতে পারে না।
তাহলে তো আমাদেরকে অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে।
কী উপায় হতে পারে?
এবার সাইফ হঠাৎই উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তারপর বলল : রিবিট আমরা বাচ্চাদুটোর ওপর বিশ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি বা প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করব। তারপর সেটি আমাদের চ্যানেল ফোকাসে প্রচার করব। আমি বিশ্বাস করছি আমাদের চ্যনেল এজন্য তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে রাজি হবে।
আমাকে কি কিছু করতে হবে?
না তেমন কিছু না। সবকিছু আমার উপর ছেড়ে দাও। তোমাকে যে-কাজটা করতে হবে সেটা হল বাচ্চাদুটোর জীবন বাঁচানোর জন্য কিছু বলা। অর্থাৎ তুমি সবার উদ্দেশে এমন কিছু বলবে যেন তারা বাচ্চাদুটোর কষ্ট অনুভব করে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে। এতে নিশ্চয় তোমার কোনো আপত্তি থাকবে না?
রিবিট একটু ভেবে বলল : না আমার কোনো আপত্তি নেই।
চমৎকার, আমি আশা করছি আর কোনো সমস্যা হবে না। আমি দুপুর একটা থেকে এই ডকুমেন্টারি প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। তার আগে আমাকে আমার পরিচালকের সাথে কথা বলতে হবে।
ঠিক আছে তুমি কথা বলো, আমি বাচ্চাদুটোকে দেখে আসি। এই বলে রিবিট হাঁটতে শুরু করল।
ওয়ার্ডের সামনে ভিড় লেগে আছে। আশেপাশের বেডের রুগীদের আত্মীয় স্বজন, এমনকি নার্স এবং হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পর্যন্ত ভিড় করছে। বাচ্চাদুটোকে দেখার পর সহজে কেউ আর সরে যাচ্ছে না। ফলে ওয়ার্ডের সামনে ভিড় লেগেই থাকছে।
রিবিট ভিতরে প্রবেশ করতে চারদিকে হালকা গুঞ্জনের শব্দ হলো। রিবিট সেদিকে খেয়াল না করে সরাসরি বেডের পাশে এসে দাঁড়াল। দুটোবাচ্চাই চোখ বুজে রয়েছে, মেয়েবাচ্চাটির চোখের পাতা সামান্য খোলা। তবে বোঝা যাচ্ছে ওরা ঘুমাচ্ছে, সম্ভবত ওদেরকে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। বাচ্চাদুটোর পাশে নতুন একজন নার্স। সকাল ছয়টায় শিফট পরিবর্তন হলেও ডাক্তার শিপন এবং নার্স সোমা অনেকক্ষণ ছিল। পরে ডাক্তার মালেকের নির্দেশেই তারা বিশ্রাম নিতে গেছে। তবে দুজনেই দুপুর বারোটায় প্রফেসর মালেকের সভায় উপস্থিত থাকবে। কারণ বাচ্চাদুটোর প্রতি দুজনেই যেমন আগ্রহী তেমন সহানুভূতিশীল। দুজনেই প্রফেসর মালেককে অনুরোধ করেছে তাদেরকে অপারেশনের সময় যেন রাখা হয়। প্রফেসর মালেক অবশ্য দুজনকেই আশ্বস্ত করেছেন।
রিবিটের মনে হলো বাচ্চাদুটো রাতের তুলনায় আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই কয়েক ঘণ্টায় কেমন যেন শুকিয়ে গেছে ওরা। এ মুহূর্তে খুব কষ্ট হচ্ছে রিবিটের। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এলো। তারপর বুকভরা কষ্ট নিয়ে অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ডেকে উঠল : ইপি :
বলো রিবিট।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
আমি বুঝতে পারছি। তোমার চিপসে অসম ইলেকট্রন প্রবাহের তীব্রতা প্রকাশ করছে তুমি কতটা কষ্ট পাচ্ছ।
রিবিট একটু থেমে বলল : ইপি তুমি খুব সুখী।
আমি দুঃখিত রিবিট। আমার মধ্যে সুখ বলে কোনো অনুভূতি নেই। আমি অনুভূতিবিহীন একটি প্রোগ্রাম মাত্র।
এজন্যই তুমি সুখী। অনুভূতি থাকার যে কতটা কষ্ট তা তুমি বুঝতে পারবে না।
আমার কাছে অনুভূতি শুধু সুখ কিংবা দুঃখের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অনুভূতি এক বহুরূপী ব্যাপার। অনুভূতি থাকার যেমন সুবিধা রয়েছে তেমনি অসুবিধাও রয়েছে।
তুমি কী বলতে চাচ্ছ ইপি?
রিবিট, তুমি গতকাল রাতে বাচ্চাদুটোকে কোলে নিয়ে যখন আদর করছিলে তখন অনুভূতি তোমার কাছে ছিল আনন্দের। আমার অনুভূতি নেই বলে তুমি দুঃখ প্রকাশ করেছিলে। অথচ এখন এই অনুভূতির উপস্থিতিই তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে এবং আমার অনুভূতি নেই বলে আমাকে সুখী বলছ। এজন্যই বলছি অনুভূতি বহুরূপী। অনুভূতি কখনো আনন্দের, কখনো দুঃখের, কখনো হাসির, কখনো বেদনার, কখনো ভালোবাসার, আবার কখনো ঘৃণার।
তুমি চমৎকার বলেছ ইপি। তোমার কি কখনো এই অনুভূতি পেতে ইচ্ছে করে না?
তুমি তো জানো আমার প্রোগ্রামে অনুভূতি প্রাপ্তি বা উপলব্ধির জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করার কোনো উপায় নেই।
আমার যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে এ মুহূর্তে আমি তোমার মধ্যে অনুভূতির সৃষ্টি করে তোমাকে বোঝাতে চেষ্টা করতাম অনুভূতি কতটা কষ্টের! কতটা যন্ত্রণার!
রিবিট, তুমি তোমার এখনকার অনুভূতি বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখো না। এ ধরনের চিন্তা তোমার জন্য অবাস্তব।
ধন্যবাদ ইপি। আমি সত্যিই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। এখন বলো বাচ্চাদুটোর জন্য আমাদের আর কী করার আছে?
সম্ভবত সাংবাদিক সাইফ কোনো উপায় বের করতে পারবে। তাহলে অন্তত আজকের সমস্যার সমাধান হবে। হয়তো এভাবেই আগামীকালের সমাধানও হয়ে যাবে।
তাই যেন হয় ইপি।
রিবিট এমন সময় সাইফকে দৌড়ে এদিকে আসতে দেখল। সাইফ কাছে আসতে রিবিট বলল : কী খবর সাইফ?
খুবই..ভা…লো খবর রিবিট।
মনে হচ্ছে তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছ।
তুমি ঠিকই বলেছ। আমি আমার পরিচালকের সাথে কথা বলেছি। বিস্ময়ের ব্যাপার হল আমার পরিচালক রাজি হয়েছেন এবং তিনি..
তিনি কী?
তিনি এক লাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছেন। আমি সাহস করে এক লাখ টাকার কথা বললে উনি প্রথমে রাজি হতে চাননি, পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত দিতে রাজি হয়েছিলেন। একটু ভালোমতো বোঝাতেই রাজি হয়ে গেলেন। রিবিট তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমরা অবশ্যই তিন লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পারব।
রিবিট বিস্মিত চোখে বলল : কী বলছ!
হ্যাঁ রিবিট। যা বলছি তাই সত্য। আর এজন্যই আমি এত উত্তেজিত হয়ে আছি।
রিবিট সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে বলল : ইপি আমি খুব আনন্দ পাচ্ছি।
তোমার চিপস্-এর অভ্যন্তরে সুষম ইলেকট্রনপ্রবাহ সেই অর্থই বহন করছে।
আমার চোখ দিয়ে পানি এসে যাচ্ছে ইপি।
আমি বুঝতে পারছি।
ইপি, সত্যি যদি আমার ক্ষমতা থাকত তাহলে এ-মুহূর্তে তোমাকে অনুভূতি প্রদান করে আমি তোমাকে বোঝাতাম অনুভূতি কতটা আনন্দের।
আমি দুঃখিত রিবিট, তুমি তোমার এখনকার অনুভূতি বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখো না।
১৫
দুপুর একটা। প্রফেসর মালেক অপারেশন-সংক্রান্ত সভা শেষে তার কক্ষে রিবিটের সাথে কথা বলছেন। প্রফেসর মালেক চেয়ারে বসতে বসতে বললেন : রিবিট, তুমি কোনো চিন্তা করবে না।
চিন্তা কিছু হচ্ছে স্যার। তবে এখন আর আগের মতো না। বলল রিবিট।
তা অবশ্য হওয়ারই কথা। তবে এটা ঠিক, চমৎকারভাবে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। আমি তোমার জন্য গর্ব অনুভব করছি।
ধন্যবাদ স্যার। আপনার সহায়তার জন্যই এই অপারেশন সম্ভব হচ্ছে।
না রিবিট। আজকের এই অপারেশনের জন্য তোমার সাফল্যই বেশি। অপারেশন সফল হলে হয়তো আমার অবদানের কথা আসতে পারে, কিন্তু আমি সবসময়ই বলব তুমিই বাচ্চাদুটোর জীবন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছ।
ধন্যবাদ স্যার। আপনারা কখন অপারেশন শুরু করবেন?
তিনটার সময়, অর্থাৎ আর মাত্র দু-ঘণ্টা পর। সবাই এখন বিশ্রামে রয়েছে, অপারেশনের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমি যাদেরকে অনুরোধ করেছিলাম তারা সবাই অপারেশনে অংশগ্রহণের জন্য রাজি হয়েছে। সর্বমোট নয়জন। আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না। এখন সবই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তবে আমি আশাবাদী। অবশ্য মেয়েটিকে নিয়ে সংশয় রয়েছে। ওর শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। অপারেশনটা যদি দু-একদিন আগে করা যেত তাহলে এতটা অসুবিধায় পড়তে হত না।
আপনিই সঠিক বলতে পারবেন স্যার।
হ্যাঁ রিবিট, তুমি ঠিকই বলেছ। আমিই সঠিক বলতে পারব। কিন্তু সবকিছু তো আর আমার ওপর নির্ভর করছে না। যদি সবকিছুই আমার ওপর থাকত, তাহলে আমি নিশ্চিত বাচ্চাদুটোকে বাঁচিয়ে ভোলার জন্য যা যা করার সবকিছুই করতাম।
স্যার আপনার সাথে কি সাইফ নামের এক তরুণ সাংবাদিক দেখা করেছিল?
হা হা, কী যেন টিভি-অনুষ্ঠান তৈরি করবে। আমি অবশ্য ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। খুব উদ্যমী ছেলে। ও-ই তো তোমাকে সাহায্য করছে, তাই না?
হ্যাঁ স্যার। ওর জন্যই প্রাথমিকভাবে আমি আর্থিক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি।
রিবিট, আমিও চেষ্টা করছি তোমাকে সাহায্য করার জন্য। আমি সকল ডাক্তারকে অনুরোধ করেছি তারা যেন বিনা-পারিশ্রমিকে আজকের এই অপারেশন করে। যদিও আমি তাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাইনি, তবে আমার বিশ্বাস তারা আমার প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পারবে না।
তাহলে তো স্যার খুবই ভালো হয়। আমাদের খরচ আরো কমে যাবে।
হ্যাঁ সত্য। প্রফেসর মালেক একটু সময় নিয়ে আবার বললেন : আমি আজ একটা বিষয় বিশেষভাবে উপলব্ধি করলাম।
কী বিষয় স্যার?
ভালো কাজের শুরুটা কঠিন। কিন্তু একবার শুরু হয়ে গেলে তখন আর তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানুষের অভাব হয় না।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না স্যার।
আজকের ঘটনাটা বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করো। তুমি গতরাতে বাচ্চাদুটোকে পেয়েছ। প্রথমে তোমাকে কেউ সাহায্য করতে চায়নি। তুমি বাচ্চাটিকে নিয়ে এদিক-ওদিক অস্থিরভাবে ছুটে বেড়িয়েছ। এমনকি আমি নিজেও প্রথমে তোমার ডাকে সাড়া দিতে চাইনি। অথচ দ্যাখো, কীভাবে তুমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে ফেললে। এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে সবাই শুধু বাচ্চাদুটোকে সুস্থই দেখতে চায়, তারা অন্য কিছু ভাবতে পারছে না বা ভাবতে চাচ্ছে না। কাজ করছে মাত্র কয়েকজন মানুষ অথচ শুভকামনা করছে হাজার হাজার মানুষ। আমাকে আমার ওয়ার্ডবয় বলল : প্রতিটি টিভি-চ্যানেলে নাকি এখন এই বাচ্চাদুটোর খবরই প্রচারিত হচ্ছে, অন্য কিছু নয়। এই তুমি, সাংবাদিক সাইফ, ডাক্তার শফিক, নার্স সোমা, আর দু-একজন এই মহান কাজটি শুরু করেছ, আর এখন সবাই চাচ্ছে এই মহান কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হোক। কীভাবে যেন তোমরা ভালোমনের মানুষেরা একজায়গায় জড়ো হয়ে যাও। তারপর সমাজের জন্য ভালো কাজ করতে চেষ্টা করো, আর সমাজ ঠিকই তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। এখন যদি তোমারা সবাই পিছিয়েও যাও, তাহলেও এই অপারেশন হবে, হয়তো বাচ্চাদুটো বেঁচেও থাকবে। অর্থাৎ শুধু দরকার ছিল ভালো কাজটি শুরু করে দেয়া, তারপর কাজটি নিজে থেকেই চলতে থাকে। রিবিট, আমার দুঃখ কোথায় জানো? আমরা আমাদের দেশে এই ভালো কাজগুলো সুন্দরভাবে শুরু করতে পারি না।
রিবিট লক্ষ্য করল প্রফেসর মালেক কথা বলার সময় বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। তাই সে বলল : স্যার আমার এখানে থাকা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। এখন আপনার বিশ্রামের সময়। সেই সকাল থেকে আপনি ব্যস্ত রয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে তা আপনার জন্য ভালো হবে।
রিবিট তুমি ঠিকই বলেছ। আমার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।
তাহলে আমি উঠি স্যার।
হ্যাঁ তুমি যাও, তুমি তোমার কাজ করো। অপারেশনের আগে আমার সাথে তোমার আর দেখা নাও হতে পারে।
তিনটার আগে আমি অপারেশন থিয়েটারের সামনে থাকব। আপনার সাথে আমার সেখানে দেখা হবে।
তার প্রয়োজন হবে না। তুমি বরং মিডিয়ার লোকজনকে ঠেকাতে চেষ্টা করো। আমাকে একেবারে পাগল করে ফেলল। একটু পর প্রফেসর আবার বললেন : তুমি ঠেকাবে কীভাবে? তোমার অবস্থা তো আমার থেকেও খারাপ। মিডিয়ার লোকজন তোমাকে পেলে তো আর ছাড়তে চাইবে না। ঠিক আছে তুমি যাও, আমি অন্য ব্যবস্থা করছি।
এই বলে প্রফেসর মালেক চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝলেন।
রিবিট প্রফেসর মালেকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার সময় নিশ্চিত হল, প্রথমে সে প্রফেসর মালেককে যেমন ভেবেছিল আসলে তিনি সেরকম মানুষ নন। তিনি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল এবং পরোপকারী।
প্রফেসর মালেকের কক্ষ থেকে বের হতেই দেখা হল সাংবাদিক সাইফের সাথে। রিবিট কিছু বলার আগেই সাইফ বলল : কী অবস্থা রিবিট? সবকিছু ঠিক আছে? তোমার খবর কী?
ভালো। তোমার?
মোটামুটি সবকিছু ঠিকই আছে। তবে আমাদের ডকুমেন্টারিটি প্রচারের সময় একটা ত্রিশ মিনিট নির্ধারণ করা হয়েছে। ডকুমেন্টারির সময় কমিয়ে পনেরো মিনিট করা হয়েছে যেন প্রতি ঘণ্টায় এটি অন্তত একবার করে প্রচার করা সম্ভব হয়।
তার মানে তোমরা অনেকবারই ডকুমেন্টারিটি প্রচার করবে?
অবশ্যই। পারলে তো আমার পরিচালক ঘণ্টায় চারবার করত। অবশ্য বাকি সময় তোমার আর বাচ্চাদুটোর সংবাদই প্রচার হচ্ছে। অন্য কোনো অনুষ্ঠান প্রচারের উপায় নেই। দর্শক সবাই তোমাদের সংবাদ জানার জন্য অস্থির হয়ে আছে। অফিসে একটার-পর-একটা ফোন আসছে। জানি না আমাদের এই অনুষ্ঠান প্রচারের পর কী হবে? মিডিয়ার কোনো অফিসেই হয়তো ফোন রাখার সময় পাওয়া যাবে না।
সাইফ, আমার কাছে প্রচার খুব বেশি মনে হচ্ছে।
এটা তো তোমার আমার স্বার্থে করা হচ্ছে না। সত্যিকথা বলতে কী বাচ্চাদুটোর স্বার্থও প্রাধান্য পাচ্ছে না। যা-কিছু করা হচ্ছে বাণিজ্যিক বিষয়কে মাথায় রেখে, দর্শকদের চাহিদার কথা মনে রেখে।
বিষয়টি খুব দুঃখজনক।
হয়তো সত্য, হয়তো নয়। কিন্তু এসব দেখার সময় আমাদের নেই। আমরা সঠিক পথেই রয়েছি। কোনো অন্যায় করছি না। আমাদের মূল লক্ষ্য বাচ্চাদুটোকে বাঁচানো। আর আমরা সেটাই করতে যাচ্ছি এবং ন্যায়ের পথে থেকে।
কিন্তু তাই বলে মিডিয়ার এই প্রচারের উদ্দেশ্যের মধ্যে মানবতা বলে কিছু থাকবে না?
একেবারে যে নেই তা নয়। মানবতার জন্য মিডিয়া অনেক কিছুই করে। তবে বাণিজ্যিক বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিডিয়াকে টিকে থাকার জন্য বাণিজ্যিক বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতেই হবে।
সাইফ তুমি ঠিকই বলেছ।
যাইহোক, রিবিট এখন আমাদেরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কী বিষয়ে?
তুমি তো জানো আমরা বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য সাহায্য প্রদানের অনুরোধ জানাচ্ছি। যেহেতু আজ ছুটির দিন এবং ব্যাংক বন্ধ, অনেকে হাতে হাতে সাহায্য প্রদান করতে চাইবে এবং তা তোমার কাছে। আমাদেরকে সেই সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। হাসপাতালে অবস্থান করে আমাদের পক্ষে সে সাহায্য গ্রহণ করা সম্ভব নয়। অন্য কোনো স্থান নির্ধারণ করতে হবে।
হাসপাতালে সম্ভব হবে না কেন?
রিবিট, তোমার কি মাথাখারাপ! এখন বাইরে যে-অবস্থা তাতে নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। লোকজন তোমার আর বাচ্চাদুটোর সংবাদ জানতে পাগল হয়ে গেছে। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার পর এখন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। জানি না বিকেলে কী হবে। বাইরে রোদ থাকায় খুব বেশি মানুষ এখনো বের হয়নি। তবে আমার বিশ্বাস, রোদ পড়ার সাথে সাথে মানুষের সমাগমও বৃদ্ধি পাবে। আর এ-কারণেই আমি চাচ্ছি আমরা এখানে সাহায্য গ্রহণ না করি।
তাহলে কোথায় করতে পারি?
সবচেয়ে ভালো হত কোনো সম্মেলনকক্ষে করতে পারলে। কিন্তু এই অল্পসময়ে তা সম্ভব নয়।
তাহলে?
আমরা শহীদ মিনার বা টিএসসিতে করতে পারি।
তোমার কাছে কোন স্থানটিকে বেশি উপযুক্ত মনে হয়?
টিএসসি। কারণ সেখানে এমনিতেই প্রচুর ছাত্রছাত্রী আসে। ভার্সিটি থেকে আমরা ভালো সহযোগিতা পাব। উপরন্তু বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কাছে হওয়ায় সহযোগিতা আরো বাড়বে। তাছাড়া টিএসসি সবার কাছে যেমন পরিচিত তেমনি অন্যান্য জায়গার সাথে এখানকার যোগাযোগব্যবস্থাও ভালো। ‘
ঠিক আছে, তাহলে আমরা টিএসসিতেই সাহায্য গ্রহণ করব।
বিকাল চারটার সময় এবং সেভাবেই টিভিতে ঘোষণা দেয়া হবে। বলল সাইফ।
আচ্ছা।
তাহলে তোমার সাথে আমার টিএসসিতেই দেখা হবে। এখন আমাকে অনুষ্ঠানের বাকি কাজটুকু দ্রুত শেষ করতে হবে। আমি তাহলে আসি।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সাইফ।
না রিবিট, ধন্যবাদ যদি কারো পেতে হয় তোমারই পাওয়া উচিত। যাইহোক, আমি আসছি, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের আবার দেখা হবে।
কথা শেষ করেই সাইফ দ্রুতপায়ে করিডোর থেকে বেরিয়ে গেল। রিবিট কিছুক্ষণ স্থিরচোখে সাইফের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর অভ্যন্তরীণ
নেটওয়ার্কে ডেকে উঠল; ইপি!
বলো রিবিট। সাথে সাথে উত্তর দিল ইপি।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি।
রিবিট, এ মুহূর্তে তুমি শুধু অর্থসংগ্রহের কথাই ভাবছ। হয়তো তুমি সেটা সংগ্রহ করতে পারবে। তারপরও অনেক কিন্তু থেকে যায়।
কী রকম?
ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তাহলে তুমি দাবি করতে পারবে তুমি সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছ। যদি এমন হয় যে দুটোবাচ্চার মধ্যে একটি বাচ্চার মৃত্যু হল তাহলে নিশ্চয় তুমি পরিপূর্ণ শান্তি লাভ করতে পারবে না।
ইপি তুমি ঠিকই বলেছ। দুটো বাচ্চার জীবনরক্ষাই আমার মূল উদ্দেশ্য। আচ্ছা এমনকি কোনো উপায় নেই যে আমি ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি?
তা সম্ভব নয় রিবিট। মানুষ অনেক উপায়ে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, যেমন প্রার্থনার মাধ্যমে, হাতে বিভিন্ন রঙের পাথর ব্যবহার করে, সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে কিছু উৎসর্গ করে ইত্যাদি। তবে কোনো উপায়েরই নিশ্চিত নির্ভরযোগ্যতা নেই। সৃষ্টিকর্তা যে কিসে সন্তুষ্ট হবেন তা কেউ জানে না।
রিবিট হতাশ ভঙ্গিতে বলল : হয়তো তাই।
তবে তোমার হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। যেহেতু ভাগ্যের ওপর কারো। হাত নেই সে-কারণে তোমার কিছু করার নেই।
একটা বিষয়ে আমার খুব আক্ষেপ হচ্ছে।
কী বিষয়?
প্রফেসর হক যদি আমাকে ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করতেন তাহলে আমি দুটো বাচ্চাকেই বাঁচিয়ে দিতাম।
আমি তোমার উদ্দেশ্যকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। পাশাপাশি এটাও বলছি যে তুমি যা আশা করছ তা শুধু অবান্তরই নয়, অসম্ভবও বটে।
রিবিট কিছু বলল না, শুধু উপরে ছাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
১৬
চ্যানেল ফোকাস অনেক আগে থেকেই কিছুক্ষণ পর পর প্রচার করছিল যে তারা দুপুর একটা ত্রিশ মিনিট থেকে রিবিটের বক্তব্যসহ যমজ বাচ্চাদুটোর ওপর একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করবে। এই ঘোষণা শোনার পর থেকে ডকুমেন্টারি দেখার জন্য সকল দর্শক টেলিভিশনের সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের আগ্রহের যেন শেষ নেই। তারা যে যেভাবে পেরেছে তাদের বন্ধুবান্ধবদেরকে অনুষ্ঠান দেখার জন্য উৎসাহিত করেছে। রিবিট যেন তাদের কাছে এক মহাবিস্ময়! অবিশ্বাস্য কৌতূহল! মহাআনন্দ! পাশাপাশি মহিলাদের আগ্রহেও যেন কমতি নেই। রিবিটের পাশাপাশি বাচ্চাদুটো তাদের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা আর আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। প্রতি মুহূর্তে তারা বাচ্চাদুটোর অবস্থা জানার জন্য অস্থির হয়ে আছে।
ঠিক দুপুর একটা ত্রিশ মিনিটের সময় চ্যানেল ফোকাস বাচ্চাদুটোর ওপর ডকুমেন্টারি প্রচার করতে শুরু করল। লক্ষ লক্ষ দর্শক তখন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টিভিসেটের দিকে। প্রথমেই দেখান হল বাচ্চা দুটোকে, ওদের অসহায়ত্ব আর কষ্টকে। বর্ণনা করা হল ওদের জীবনের অস্বাভাবিকতা আর চরম অনিশ্চয়তাকে। সম্পূর্ণ বিষয়টিকে সাইফ তার প্রাণবন্ত আর হৃদয়ছোঁয়া উপস্থাপনায় এমনভাবে উপস্থাপন করল যে দর্শকদের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। শিশু-কিশোররা এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল যে তাদের কেউ কেউ বাচ্চাদুটোর মঙ্গলকামনায় অস্থির হয়ে উঠল।
টেলিভিশনের পর্দায় এরপর দেখা গেল রিবিটকে, যাকে একনজর দেখার জন্য, যার একটু কথা শোনার জন্য সকলে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। টেলিভিশনের পর্দায় রিবিটকে দেখামাত্র সবাই নিজেদের মধ্যে কেমন যেন অজানা উত্তেজনা আর আবেগ অনুভব করল। সবাই নিশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল। এক দৃষ্টিতে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকল টিভিপর্দার দিকে।
রিবিট যা-কিছু দেখে, যা-কিছু করে, শোনে বা বলে, সবকিছুই তার অভ্যন্তরের মেমোরিতে সংরক্ষিত থাকে। রিবিট ডকুমেন্টারি প্রচারের আগেই গতকাল থেকে এ পর্যন্ত বাচ্চাদুটো সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য অংশের ভিডিও একটি সিডিতে রাইট করে তা সাইফকে দিয়েছিল। সেখান থেকেই বিভিন্ন অংশ এডিট করে রিবিটের বক্তব্যের সাথে সাথে সেটা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে দর্শক গতরাতের সকল ঘটনা টেলিভিশনে দেখতে পাবে। তাদের মনে হবে সকল ঘটনা বুঝি তাদের চোখের সামনেই ঘটছে। তবে রিবিট সবসময়ই সতর্ক থেকেছে যেন এই ভিডিও প্রচারে কারো কোনো ক্ষতি না হয়, কেউ যেন অপমানিত না হয় অথবা কারো যেন মানহানি না ঘটে।
রিবিট যখন কথা বলতে শুরু করল তখন তার গলার স্বর খুব ধীর এবং কিছুটা দুঃখ-ভারাক্রান্ত। সে বলতে শুরু করল :
মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ছোট্ট দুটো নিষ্পাপ শিশুর মঙ্গল কামনার মাধ্যমে, আমি রিবিট অতিউচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবট, আপনাদের কাছে শিশুদুটোর জীবনরক্ষার্থে সাহায্যের আশা করছি। প্রিয় দর্শক, মানুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, মানুষ মহাবিশ্বে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, সবচেয়ে হৃদয়বান প্রাণী। আমার গত কয়েকঘণ্টার অভিজ্ঞতায় আমি অনেকবার অনেকভাবে মানুষের এসকল অসাধারণ গুণের প্রমাণ পেয়েছি। তাই আমি নিজেকে মানুষের মধ্যে পেয়ে অত্যন্ত গর্বিত এবং আনন্দিত। তবে এ-মুহূর্তে আমার এই গর্ব এবং আনন্দ অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে। কারণ নিম্ফাপ অসহায় দুটো মানবশিশু আজ জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করে বুঝতে পেরেছি আমার মতো যন্ত্রের পক্ষে এই মানবশিশুকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব নয়, মানবশিশুকে একমাত্র মানুষই বাঁচিয়ে তুলতে পারে। মানুষের স্পর্শ ব্যতীত মানবশিশু বেঁচে থাকতে পারে না, মানবশিশু বিকশিত হতে পারে না, মানবশিশু মানুষ হিসাবে নিজেকে মর্যাদাবান করে গড়ে তুলতে পারে না। তাই এ-মুহূর্তে আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া শিশুদুটোকে বাঁচিয়ে তোলা, তাদের নতুন জীবন দেয়া, তাদের মুখে হাসি ফোঁটানো সম্ভব নয়। তাই তো ওদেরকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য আপনাদের কাছে সাহায্যের জন্য আমার এই আকুল আবেদন।
প্রিয় দর্শক, আপনারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পাচ্ছেন গতকাল কোথায় এবং কীভাবে আমি সংযুক্ত যমজ বাচ্চাদুটোকে পেয়েছিলাম। একটি ডাস্টবিনের পাশ থেকে কুড়িয়ে পাওয়ার পর ওদেরকে পাশের একটি বাসায় নিয়ে যাই। উক্ত বাসার সকল সদস্য আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করে। তারা বাচ্চাদুটোর জন্য দুধের ব্যবস্থাও করে। ছেলেবাচ্চাটি দুধ খেলেও মেয়েবাচ্চাটি তখন থেকেই কিছু খাচ্ছিল না। তাই ওদের অসুস্থতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওদেরকে নিয়ে পাশের একটি ক্লিনিকে যাই। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার বাচ্চাদুটোর অসুস্থতার বিষয় নিশ্চিত করে। যেহেতু উক্ত ক্লিনিকে শিশুদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল তাই ওদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি এবং সেখানে ওদেরকে ভর্তি করা হয়। এখানে প্রফেসর মালেকের তত্ত্বাবধানে এবং ডাক্তার শিপন, নার্স সোমা এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় অতিদ্রুত বাচ্চাদুটোর ডায়াগনোসিস সম্পন্ন করা হয়। অবশেষে জানা যায় যে বাচ্চাদুটোর জীবন সংকটাপন্ন। মেয়েবাচ্চাটির মস্তিষ্কে একটি টিউমার রয়েছে যা অতি অল্পসময়ে ছেলেবাচ্চাটির মাথায় বিস্তৃত হবে। আর এ কারণে মেয়ে বাচ্চাটির শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ এবং তা ছেলেটিকেও প্রভাবিত করছে। আর তাছাড়া কোনোভাবে যদি ওরা এ-যাত্রায় বেঁচেও যায় তাহলে ওদের ভবিষ্যৎ জীবন আরো দুর্বিষহ, যন্ত্রণাময় হয়ে উঠবে এবং ওরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে না। কারণ ওদের একজন ছেলে এবং অন্যজন মেয়ে। কাজেই অপারেশন ছাড়া এখন কোনো বিকল্প নেই। আর এই অপারেশনের জন্য তিন লক্ষ টাকার প্রয়োজন। ইতিমধ্যে যদিও এক লক্ষ টাকার ব্যবস্থা হয়েছে, বাকি দুই লক্ষ টাকা আগামী দু-একদিনের মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। তা না হলে বাচ্চাদুটোকে বাঁচান কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রিয় দর্শক, মানবশিশু মহান সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব এবং বিস্ময়কর সৃষ্টি। সর্বোচ্চ বুদ্ধির অধিকারী মানুষ, শিশু অবস্থায় যে কতটা অসহায় থাকে, এই মানবশিশু দুটো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ওরা কিছু বলতে পারে না, কিছু চাইতে পারে না, কিছু বোঝাতে পারে না, কিছু করতে পারে না। তবে ওরা অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারে, অনুধাবন করতে পারে। মস্তিষ্কের অভ্যন্তরের টিউমারের তীব্র যন্ত্রণা যে ওদের শরীরকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে সেটা ওরা বুঝতে পারে। তাই তো শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিবেকবান মানব জাতির দিকে, যদি কেউ একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে, যদি কেউ ওদের প্রতি এতটুকু সহানুভূতি প্রকাশ করে, যদি কেউ ওদের কষ্টকে এতটুকু হলেও উপলব্ধি করে। প্রিয় দর্শক, আপনাদের বিন্দু পরিমাণ সাহায্য ওদের জীবন রক্ষার জন্য বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। ওরা তো এই সমাজ তথা এই মানুষেরই সন্তান। পরিবেশ পরিস্থিতি এবং ভাগ্যের কারণেই আজ ওদের এই অবস্থা। যে সমাজ ওদেরকে জন্ম দিয়েছে, যে সমাজ ওদেরকে পৃথিবীতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যে সমাজ ওদেরকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই সমাজের কি উচিত হবে না ওদের জীবনকে রক্ষা করা? অবশ্যই হবে। তাই তো সবার প্রতি আমার অনুরোধ এই অসহায় শিশুদুটোর জীবনরক্ষার্থে আমরা সবাই এগিয়ে আসি। আমরা যারা ছোট্ট শিশু কিশোর রয়েছি তারা যেমন এই অসহায় শিশুদুটোকে স্কুলের একদিনের টিফিনের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারি, তেমনি অন্যরা নিজ নিজ ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের একটি অংশ, তা যত সামান্যই হোক না কেন, প্রদানের মাধ্যমে বাচ্চাদুটোকে নতুন জীবন প্রদানের চেষ্টা করতে পারি। আমি বিশ্বাস করি এই সমাজ অবশ্যই এই ছোট্ট বাচ্চাদুটোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। কারণ সমাজ তো মানুষেরই সৃষ্টি। যে মানুষ মহান, যে মানুষ দয়াবান, যে মানুষ মমতাময়ী, যে মানুষ হৃদয়বান, যে মানুষ সহানুভূতিশীল, সেই মানুষের সমাজ কখনো দুটো শিশুকে এতটা অসহায়ভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে না। আমরা সবাই ওদের মুখে হাসি দেখতে চাই, যে হাসিতে তারা বলবে : হে মহান মানুষ, হে সৃষ্টির সেরা জীব; তোমরা আমাদেরকে বাঁচিয়েছ, তোমরা তোমাদের সন্তানকে, তোমাদের ভাই এবং বোনকে বাঁচিয়েছে, তাদের অসহায়ত্বের সময় তোমরা পাশে এসে
দাঁড়িয়েছে; তোমরা সত্যিই মহান, ভালোবাসায় ভরা সত্যিই সৃষ্টির সেরা জীব; মনের গভীর থেকে আমরা তোমাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, তোমাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তোমাদের মহত্ত্বকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
রিবিট যখন শেষ কথাগুলো বলল তখন তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। শুধু রিবিটই নয়, টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা অনেকে রিবিটের বাচনভঙ্গি, স্বরের ওঠানামা আর আবেগভরা আহ্বানে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ল। পারলে তারা অনেকেই এখনই সাহায্য প্রদানের জন্য ছুটে যায়।
রিবিটের পরই টেলিভিশনে অমিকে দেখা গেল। গতকাল রাতে রিবিট অমিদের বাসায়ই গিয়েছিল। সাইফ একথা শোনার পর সে এই অনুষ্ঠানে অমিকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। অমির আহ্বানে ছোট্ট শিশু-কিশোররা সাড়া দেবে এটাই সাইফের উদ্দেশ্য।
টেলিভিশনের পর্দায় অমিকে দুঃখ-ভরাক্রান্ত মনে বলতে শোনা গেল : প্রিয় বন্ধুরা, আমি অমি। গতরাতে রিবিট বাচ্চাদুটোকে নিয়ে আমাদের বাসায়ই এসেছিল। কী অসহায় বাচ্চাদুটো! এমনকি ঠিকমতো খেতেও পারে না। অথচ ওদের চোখে বেঁচে থাকার আশা। ওদেরকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। ওরা আমাদেরই ভাইবোন। প্রিয় বন্ধুরা, তোমরা যারা আমার মতো কিংবা আমার থেকে ছোট বা বড়, আমাদের সবাইকে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আমি টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ভিডিও গেমস্ কেনার জন্য যে দুইশো একাত্তর টাকা জমিয়েছিলাম তা আমি আজ বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য দিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদের সকলকে অনুরোধ করব তোমরাও এগিয়ে আসো। তোমাদের সাহায্য যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তা এই মহান কাজের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আমাদের বন্ধু রিবিট যে-স্বপ্ন আর আশা নিয়ে বাচ্চাদুটোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে আমাদের উচিত আমাদের বন্ধুর এই স্বপ্ন আর আশাকে বাস্তবায়নে সহায়তা করা। তাই আমাদের সকলের সাহায্য শুধু দুটো শিশুর জীবনই বাঁচাবে না, রিবিটের মতো ভালোবন্ধুর কাজকেও উৎসাহিত করবে। প্রিয় বন্ধুরা, এসো আমরা সবাই এক হয়ে একটি ভালো কাজ করি, বাচ্চাদুটোকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য আমরা যে যেভাবে পারি সাহায্য করি, আর সবাই প্রার্থনা করি ওরা যেন খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের মতো সুন্দর জীবন লাভ করতে পারে।
অমির পর প্রফেসর মালেককে কথা বলতে দেখা গেল। প্রফেসর মালেক বললেন : প্রিয় দর্শক, মানুষ হিসাবে আমাদের কর্তব্য মানুষকে সহায়তা করা। আর সাহায্যপ্রার্থী মানুষটি যদি অসহায় শিশু বা কিশোর হয় তাহলে এই কর্তব্যের দায় আরো বেড়ে যায়। আজ আমাদের সময় এসেছে নিজেদের কর্তব্যকে পালন করার। ছোট্ট দুটো শিশু মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে জীবনসায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। আসুন আমরা চেষ্টা করে দেখি ওদেরকে বাঁচানো যায় কিনা? আপনার আমার সামান্য সাহায্য হয়তো ওদের জীবনকে আবারো সুন্দর আর উচ্ছল করে তুলবে। প্রিয় দর্শক, পাশাপাশি ওদের দুজনের জন্য অবশ্যই দোয়া করবেন। কারণ ওদের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচার করতে হবে। আমি জানি এবং বিশ্বাস করি আপনারা আপনাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু সাহায্যের পাশাপাশি মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেটাও অনেক বড় ব্যাপার। তাই তার কাছে আমাদের প্রার্থনা থাকবে তিনি যেন শিশুদুটোকে পৃথিবীতে আবার নতুন এবং সুস্থ-সুখী জীবন দান করেন। আমাদের জন্যও আপনারা প্রার্থনা করবেন, যেন আমাদের টিমের সকল সদস্য যথাযথভাবে কোনোরকম প্রতিকূলতা ছাড়াই ওদের অপারেশন সম্পন্ন করতে পারে।
প্রফেসর মালেকের বক্তব্যের পর সাইফ বাচ্চাদুটোর বর্তমান শারীরিক অবস্থা এবং সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বর্ণনা করল। তারপর সকলের কাছে সে যে আহ্বান জানাল তার সারসংক্ষেপ এরকম :
প্রিয় দর্শক, আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন বাচ্চাদুটো কী জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এ মুহূর্তে ওদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আর্থিক সাহায্য। এই আর্থিক সাহায্য ব্যতীত বাচ্চাদুটোর জন্য ওষুধ পর্যন্ত কেনা সম্ভব হচ্ছে না। এরকম দুটো নিষ্পাপ শিশু চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করবে তা নিশ্চয় আমরা কেউ চাই না। তাই আসুন ওদেরকে সাহায্য করতে, ওদের মুখে হাসি ফোঁটাতে, ওদেরকে নতুন জীবন প্রদান করতে আমরা এগিয়ে আসি। আপনারা যারা সরাসরি রিবিটের নিকট সাহায্য প্রদান করতে চান তারা আজ বিকাল চারটার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আসতে পারেন। আর যাদের পক্ষে আসা সম্ভব নয় তারা ‘লাইফ ব্যাংকে চ্যানেল ফোকাসের ‘মানবকল্যাণ’ হিসাব নম্বর টি-৯৩৭৫২১১-তে সরাসরি আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করতে পারেন। আর এ-বিষয়ে রিবিটের সাথে যোগাযোগ করতে হলে রিবিটের ই-মেইল এ্যাকাউন্টে [email protected] মেইল করতে পারেন অথবা সরাসরি চ্যানেল ফোকাসের গ্রাহকসেবা নম্বরে ফোন করতে পারেন। সবশেষে আমরা আশা করব, আপনারা এই অসহায় শিশুদুটোকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন। হয়তো আপনাদের আর্থিক সাহায্য আর আশীর্বাদের কারণেই ওরা আবার নতুন জীবন লাভ করবে।
এতক্ষণ রিবিট নিজেও অনুষ্ঠানটি দেখছিল। অনুষ্ঠান শেষ হতে সে ইপিকে বলল : ইপি আমার মনে হচ্ছে আমরা সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছি।
রিবিট, আমার লজিক সেরকমই বলছে।
তাহলে আমাদেরকে বিকাল চারটায় টিএসসিতে যেতে হবে।
হ্যাঁ। তার আগে তুমি একবার প্রফেসর মালেকের সাথে দেখা করতে পারো। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করবেন।
তার কি আর প্রয়োজন আছে?
আপাতদৃষ্টিতে নেই। তবে শেষমুহূর্তে তিনি যদি কোনোকিছুর প্রয়োজন মনে করেন সেজন্যই বলছিলাম।
ধন্যবাদ ইপি। আমি যাচ্ছি।
রিবিট এইমাত্র আমি তোমার কাছে লেখা সাতবছরের একটি ছেলের ই-মেইল পেয়েছি। সে বাচ্চাদুটোর জন্য তার জমানো একুশ টাকা সাহায্য হিসাবে প্রদান করতে চায়।
চমৎকার। তুমি ওকে মেইল করে টিএসসিতে আসার বিষয়টি জানিয়ে দাও। তবে অবশ্যই যেন কোনো অভিভাবকের সাথে আসে।
হ্যাঁ জানাচ্ছি।
ধন্যবাদ দিতে ভুলো না কিন্তু।
না না, ভুলব না।
আর হ্যাঁ, তুমি এই ই-মেইলগুলোর উত্তর দিতে থাকো। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে আমাকে জানিও।
আমি সেরকমই করব। সম্ভবত ই-মেইলের সংখ্যা অনেক বেশি হবে। এরই মধ্যে আরো তিনটি ই-মেইল এসেছে। তাছাড়া চারজন তোমার সাথে চ্যাট করার জন্য অনলাইনে অপেক্ষা করছে। তিনজন তোমার সাথে ভয়েস মেইলে কথা বলতে চাচ্ছে। সম্ভবত এরা সবাই শিশু-কিশোর হবে। অধিকাংশই তাদের নাম, বয়স, স্কুলের ঠিকানা লিখে পাঠিয়েছে। তারা তাদের সাহায্য প্রদানের কথাও বলছে। রিবিট, তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ তোমার জনপ্রিয়তা কীভাবে বাড়ছে।
ইপি, তুমি ‘জনপ্রিয়তা’ না বলে ‘গ্রহণযোগ্যতা’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারো। কারণ ‘জনপ্রিয়তা’ শব্দটি স্বার্থ বা রাজনীতিবিষয়ক মনে হয়। আর গ্রহণযোগ্যতা শব্দটির মধ্যে একরকম নিরপেক্ষভাব রয়েছে। যাইহোক, আমরা আর যাই করি এ-মুহূর্তে কোনো শিশু-কিশোরের সাথে অহেতুক চ্যাট করতে চাচ্ছি না। তাহলে ওদের পড়াশোনার মারাত্মক ক্ষতি হবে। ই-মেইলের মাধ্যমে শুধু ছোট ছোট উত্তর প্রদান করব।
রিবিট, তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক। আমি সেভাবেই সবগুলো ই-মেইলের উত্তর দিয়ে দিচ্ছি।
কথা বলতে বলতে রিবিট অপারেশন-থিয়েটারের সামনে চলে এল। সেখানে আগে থেকেই নার্স সোমা দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভিতরে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রিবিট তাকে বলল : কী খবর সোমা?
এখন পর্যন্ত ভালো। বাচ্চাদুটোকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে। মালেক স্যার ছাড়া সবাই ভিতরে আছে। স্যার এক্ষুনি ভিতরে ঢুকবেন।
সোমার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রফেসর মালেক উপস্থিত হলেন। তিনি রিবিটকে দেখে একগাল হেসে বললেন : রিবিট তুমি এখানে এসেছ, ভালোই করেছ। সত্যিকথা বলতে কী তোমাকে দেখলে কেন যেন আমি প্রেরণা পাই।
এই প্রথম রিবিট প্রফেসর মালেককে এভাবে হাসতে দেখল। তার খুব ভালো লাগল। বলল : স্যার আপনাকে ধন্যবাদ। বাচ্চাদুটোর কী অবস্থা স্যার?
প্রফেসর মালেক এবার হো হো করে হেসে উঠে বলল : ভালো খুব ভালো। কোনো চিন্তা কোরো না। ইনশাল্লাহ কোনো অসুবিধা হবে না। তবে…
তবে কী স্যার?
বাচ্চাদুটোর নাম রাখা হল না। ওদের যে আসল নাম কী তাও জানা হল না।
ওদের নাম রাখার অধিকার তো আমাদের নেই স্যার। একমাত্র ওদের বাবা মাই ওদের নাম রাখার অধিকার রাখে। যেহেতু ওদের মা কিংবা বাবা কারোরই সন্ধান নেই, সেজন্য ওদের নামও জানা যাচ্ছে না।
আমার মনে হয় সন্ধান আছে রিবিট।
রিবিট অবাক হয়ে বলল : ওদের মা বাবা কোথায় আপনি জানেন স্যার?
না জানি না। তবে অনুমান করতে পারছি।
কী অনুমান?
আমার বিশ্বাস ওদের বাবা কিংবা মা, হয়তো মা-ই হবে, আশেপাশে কোথাও আছে। আমি নিশ্চিত কোনো মা মাঝরাতে তার সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে না। হয় সে আশেপাশে থাকবে, তা না হলে আবার ফিরে আসবে। রিবিট তুমি জানো না মানুষের ভালোবাসা কত গভীর, কত শক্তিশালী..আর, মায়ের ভালোবাসা…এ গভীরতা, এ ভালোবাসার বন্ধন সকল শক্তির ঊর্ধ্বে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আর গভীর ভালোবাসা হলো মা সন্তানের ভালোবাসা। রিবিট, বাচ্চাদুটোর মাকে খুঁজে বের করাও তোমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যে মা তার বাচ্চাকে এভাবে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে যায়, সেই মা এ ঘটনার জন্য দায়ী কিংবা দোষী হতে পারে না। সেই দায় বা দোষ এই সমাজের, যে সমাজ মায়ের কোলেও সন্তানের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে না। রিবিট, তুমি তোমার চোখ-কান খোলা রাখবে, দেখবে হয়তো… আশেপাশেই তুমি বাচ্চাদুটোর মা, কে পেয়ে গেছ।
প্রফেসর মালেক আর দাঁড়ালেন না। তিনি দ্রুতপায়ে অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে চলে গেলেন। তার পিছন পিছন নার্স সোমাও গেল।
রিবিট লক্ষ্য করেছে শেষকথাগুলো বলার সময় প্রফেসর মালেকের গলা কেমন যেন আবেগময় আর দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। তিনি ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিলেন না, কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল।
রিবিট ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কেন প্রফেসর মালেক হঠাৎ এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তবে প্রফেসরের কথাগুলো তার মনের মধ্যে বেশ প্রভাব ফেলেছে। সে বুঝতে পারছে কথাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা শতভাগ। তাই সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল। আশেপাশে অনেকেই আছে। কিন্তু কাউকেই তার বাচ্চাদুটোর মা কিংবা বাবা বলে মনে হল না।
১৭
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে উপচে পড়া ভিড়। সবারই একই প্রশ্ন : বাচ্চাদুটোর কী হল? আদৌ ওরা বাঁচবে কিনা? ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে কিনা? ভিড় সামলাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অতিরিক্তি দশ প্লাটুন পুলিশ নিয়োগে বাধ্য হয়েছে। এ মুহূর্তে রিবিটের চেয়ে বাচ্চাদুটোই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এদিকে চ্যানেল ফোকাস মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছু বিবেচনা করে তাদের ডকুমেন্টারি বিনামূল্যে সবগুলো টিভি চ্যানেলকে প্রচারের অনুমতি দিয়েছে। ফলে প্রত্যেকটি টিভি-চ্যানেলেই এখন এই ডকুমেন্টারি প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাচ্চাদুটোর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও ক্রমাগত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে চ্যানেলগুলো। এক্ষেত্রে রেডিও পিছিয়ে নেই। একটু পর পর বিশেষ ঘোষণার মাধ্যমে তারাও বাচ্চাদুটো সম্পর্কে বিশেষ বুলেটিন প্রচার করছে এবং সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে। ফলে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সংবাদ পৌঁছে যাচ্ছে। এ ছাড়া দুটি জাতীয় পত্রিকা ইতিমধ্যে রিবিট এবং বাচ্চাদুটোর ওপর বিশেষ কড়চা প্রকাশ করেছে। অন্যান্য পত্রিকাও বিশেষ কড়চা বের করার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে। এসব কারণেই বাচ্চাদুটোর সংবাদ এখন সবার মুখে মুখে।
বিকাল চারটার সময় রিবিট এবং সাইফ যখন টিএসসিতে এসে পৌঁছাল তখন টিএসসিতে শুধু টিভি-ক্যামেরা আর টিভি-ক্যামেরা। অবশ্য সাংবাদিকদের পাশাপাশি পুলিশও রয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে দাঙ্গাপুলিশ পর্যন্ত মোতায়েন করা হয়েছে। ইতস্ততভাবে অনেকে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালেও মানুষের ভিড় ততটা নেই। রিবিট খানিকটা আশঙ্কিত গলায় বলল : সাইফ, তোমার কি মনে হচ্ছে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারব?
সাইফ অবাকচোখে বলল : রিবিট কী ঘটতে যাচ্ছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। মানুষ তোমাকে কীভাবে গ্রহণ করেছে তা তুমি ভাবতেও পারছ না।
কিন্তু সাহায্য প্রদানের জন্য আমি আশেপাশে কাউকে দেখছি নাতো।
রিবিট এখন চারটা বাজে। আমার বিশ্বাস সবাই এখন বাসাবাড়ি থেকে রওনা দিয়েছে। হয়তো আর আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টার মধ্যে এখানে এসে পৌঁছাবে।
যদি না পৌঁছায়।
পৌঁছাবেই। মানুষ যখন বুঝতে পারে ভালো কাজের জন্য তাদের প্রদত্ত অর্থের কোনো অপচয় হবে না, অপব্যবহার হবে না, তখন তারা অর্থ প্রদানে কার্পণ্য করে না। আমি বিশ্বাস করছি কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি তার প্রমাণ পাবে। তাছাড়া আরো অনেক ভালো সংবাদ রয়েছে।
কী রকম?
প্রফেসর মালেক অপারেশন-থিয়েটারে প্রবেশের আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আবাসিক হলে যেয়ে আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য প্রদানের জন্য দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছেন। কাজেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের সকল ছাত্রছাত্রী আমাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে। বুয়েটেও ইতিমধ্যে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু তোমাকে বুয়েটের প্রফেসর সৃষ্টি করেছে, বুয়েটের সকল ছাত্রছাত্রী ধরে নিচ্ছে তোমার অর্থ তাদেরই দায়িত্ব। ইতিমধ্যে প্রত্যেক হলেই বাচ্চাদুটোকে সাহায্য প্রদানের জন্য তহবিল গঠন করা হয়েছে। ওরা হয়তো সন্ধ্যার আগেই তোমার কাছে আসবে। আর ঢাকা ভার্সিটির কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের সকল জাতীয় সমস্যার ক্ষেত্রে ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের অবদান অবিস্মরণীয়। আর তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ জাতীয় সমস্যার তুলনায় তোমার আমার এই সমস্যার গুরুত্ব কতটুকু। শুধু ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরাই মুহূর্তের মধ্যে তোমার এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমাদের শুধু দরকার ছিল তাদেরকে উজ্জীবিত করা, তাদেরকে সম্পূর্ণ বিষয়টি বোঝানো। আমরা সেটা করতে পেরেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর নিজেই এক লাখ টাকা সংগ্রহের উদ্যেগ নিয়েছেন।
কী বলছ তুমি!
হ্যাঁ, আমি যা বলছি সবই সত্য। রিবিট সত্যিকথা বলতে কী আমি নিজেও খুব উত্তেজিত, শিহরিত, প্রকম্পিত। তুমি যে-কাজ করছ নিজেকে তার সাথে সম্পৃক্ত করতে পেরে সত্যিই আমি অভিভূতি, মুগ্ধ, আনন্দিত।
আমি একা কোনো কাজ করছি না। আমরা সবাই মিলে করছি।
না না রিবিট। মানুষের ভালোবাসা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা পাওয়া এতটা সহজ নয় যেমন তুমি ভাবছ। অথচ তুমি সেই ভালোবাসা, বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা অর্জন করতে যাচ্ছ।
রিবিট কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় ইপি বলল : রিবিট, এইমাত্র আমি তিন হাজারতম ই-মেইলটির উত্তর প্রদান করলাম। এই তিন হাজার ই-মেইলের মধ্যে দুই হাজার চারশো তেত্রিশটা মেইল শিশু-কিশোরদের, চারশো বারোটি মেইল মহিলাদের এবং বাকি একশো পঞ্চান্নটি মেইল অন্যান্যদের। এ মুহূর্তে যে হারে তোমার কাছে মেইল আসছে তাতে তোমার নেটওয়ার্ক জ্যাম কিংবা স্লো হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে যদি ঘরে ঘরে ই-মেইল থাকত তাহলে কী হত আমার লজিক তার ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারছে না। অনেকে তো একের-পর-এক মেইল করেই চলছে।
ইপি, তুমি ওদেরকে নিষেধ করো যেন বারবার ই-মেইল না পাঠায়।
ওরা তো আমার কথা শুনছে না। বিশেষ করে ছোট ছোট শিশু-কিশোররা নাছোড়বান্দা। আমি যতই ওদেরকে মেইল পাঠাতে নিষেধ করছি ততই ওরা বেশি বেশি মেইল পাঠাচ্ছে। উপরন্তু বন্ধুবান্ধব যা আছে সবাইকে সংবাদ দিয়ে তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেইল করতে বলছে। তুমি চিন্তা করতে পারো এখন প্রায় এক হাজার সাতশো উনত্রিশ জন শিশু-কিশোর তোমার সাথে অনলাইনে কথা বলার জন্য কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। অনেকে তোমার সাথে কথা বলতে না-পেরে তোমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। তারা অনুরোধ করেছে তারা না-আসা পর্যন্ত তুমি যেন এখানে থাকো।
ইপি, তোমার পরিসংখ্যানে আমি সত্যি বিস্মিত হচ্ছি।
আর এজন্যই বলছি সাইফের কথা মিথ্যা নয়। রিবিট তুমি যে মানুষ, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের কাছ থেকে কী পরিমাণ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা অর্জন করতে যাচ্ছ তা কল্পনাতীত।
ইপি তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি নিশ্চয় জানো মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা অর্জন করার চেয়ে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কল্যাণ সাধন করা।
তুমি ঠিক বলেছ রিবিট। আর এজন্যই তোমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে একজন মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে যেয়ে তুমি যেন অন্য কারো ক্ষতি না করো অথবা অন্য কারো কাছে অপ্রিয় হয়ে না যাও।
ইপি, আমি কি এমন কিছু করছি?
না রিবিট না। আমার লজিক বলছে তুমি সঠিক পথেই এগোচ্ছ, ন্যায়ের পথে রয়েছ এবং মানুষের কল্যাণের জন্যই কাজ করছ।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ইপি।
এদিকে সাইফ টিএসসির ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ন্যাক্স বা ডাচের পিছনে ছোট্ট একটা টেবিল বসিয়েছে। সেই টেবিলের পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে তারা। বিষয়টি খুবই অনানুষ্ঠানিক হলেও সাংবাদিক এবং পুলিশের উপস্থিতিতে যেন মহা আনুষ্ঠানিকতার রূপ নিয়েছে। ডানপাশে মানুষের লাইনে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করেছে পুলিশ। সাহায্য প্রদানের জন্য সেখানে সাত-আটজন দাঁড়িয়েও আছে। সবার সামনে অল্পবয়সী একজন দরিদ্র মহিলা। তার পিছনে দশ-বারো বছরের দুই কিশোর। কথায় বোঝা যাচ্ছে ওরা দুজন একে অন্যের বন্ধু, সম্ভবত বেশ দূর থেকে এসেছে। দুজনেই রিবিটকে দেখে বেশ উত্তেজিত, নিজেদের মধ্যে রিবিটকে নিয়েই আলোচনা করছে। ওদের পিছনে দুই তরুণী, সম্ভবত ভার্সিটির ছাত্রী হবে।
তারপর চার-পাঁচ বছরের মেয়ে-কোলে এক ভদ্রলোক, তারপর আরো দুই। কিশোর। সবাই রিবিটের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে একধরনের অজানা কৌতূহল আর উৎফুল্লতার আভাস।
রিবিট আর সাইফ যখন সম্পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে তখন সামনে থেকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করল : রিবিট আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
না, আমি এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না। দয়া করে আমাকে কোনো প্রশ্ন করবেন না। খুব স্বাভাবিকভাবে বলল রিবিট।
আপনি কেন আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন না? এখানে যা-কিছুই ঘটছে সবই তো সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে। দর্শক আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চায়।
আমি এখানে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে আসিনি। আমি এসেছি দুটো শিশুকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। কাজেই আমার অনুরোধ আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমাকে আমার কাজ করতে দিন। যারা অনেকদূর থেকে এখানে সাহায্য প্রদানের জন্য এসেছে তাদের সাথে কথা বলাকে আমি বেশি জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি।
এদিকে সাইফ ইশারা করতেই সামনের কমবয়সী দরিদ্র মহিলা সাহায্য প্রদানের জন্য এগিয়ে এল। সে রিবিটের সামনে এসে ছলছল চোখে রিবিটের দিকে তাকাল। তারপর হাতের মধ্যে গুঁজে রাখা দুই টাকার একটা নোট রিবিটের দিকে বড়িয়ে দিল। সাথে সাথে চারপাশের প্রায় একশত ক্যামেরা ফ্লাশসহ ক্লিক করে উঠল। তীব্র আলোর ঝলকানিতে মহিলা বোধহয় খুব অস্বস্তিবোধ করল। তাই সে দ্রুত টাকাটা রিবিটের হাতে দিয়ে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় শুধু অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল : ভাইজান, কিয়ামত পর্যন্ত আল্লায় আপনেরে হায়াত দেউক।
দরিদ্র মহিলাটি চলে যেতে এগিয়ে এল দুই কিশোর। রিবিট তাদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল : কী নাম তোমাদের?
একজন বলল : আমার নাম সুমন, আর ও রিপন। আমরা দুই বন্ধু, মিরপুর থেকে এসেছি।
তোমরা তো অনেক দূর থেকে এসেছ।
হ্যাঁ। এই যে আমরা দুইজন আপনাকে বিশ টাকা দিলাম, আর এই যে আরো দুই টাকা।
তোমরা তো সব টাকাই দিয়ে দিলে, ফিরে যাবে কিভাবে?
এবার রিপন বলল : আমাদের কাছে আরো দশ টাকা আছে। শাহবাগ থেকে মীরপুর পর্যন্ত বাস ভাড়া হয়ে যাবে। আমরা যেতে পারব।
ঠিক আছে, তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।
সুমন আর রিপন অবশ্য চলে গেল না। তারা এককোণায় যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
এরপর দুই তরুণী প্রত্যেকে বিশ টাকা করে চল্লিশ টাকা দিল। তারপর এল চার-পাঁচ বছরের মেয়ে-কোলে ভদ্রলোক। ভদ্রলোক রিবিটের হাতে একটা একশো টাকার নোট দিয়ে বলল : রিবিট, আপনাকে দেখার জন্য আমার এই মেয়ে অস্থির হয়ে আছে। তাই আর না-এসে পারলাম না। আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্যের চেষ্টা করলাম।
আপনি যে আমাদের সাথে আছেন এটাই আমদের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের। এই বলে রিবিট হাত দিয়ে মেয়েটির মুখ স্পর্শ করল। আর তাতে মেয়েটি ভয় পেয়ে দুহাতে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরল। ভদ্রলোক মৃদু হেসে বলল : তুমি ভয় পাচ্ছ কেন মা? এইতো রিবিট, তুমি না দেখতে চেয়েছিলে!
বাচ্চাটি কোনো কথা বলল না। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে একদৃষ্টিতে রিবিটের দিকে তাকিয়ে থাকল।
এরপর আরো দুজন কিশোর এলো। দুজনে মিলে তারা দশ টাকা দিল।
ৱিবিট তাদের দুজনকে ধন্যবাদ দিতে তারা রিবিটের সাথে হ্যান্ডশেক করল। তারপর চলে না যেয়ে আগের দুজনের মতো এককোণায় দাঁড়িয়ে থেকে রিবিটকে লক্ষ্য করতে লাগল।
এভাবেই বাড়তে লাগল রিবিটের সংগ্রহ। এরই মধ্যে লাইনও ধীরে ধীরে লম্বা হতে শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে মানুষ আসতে শুরু করেছে। কেউ গাড়িতে, কেউ রিকশায়, আবার কেউ পায়ে হেঁটে এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। তারপর উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করছে রিবিটকে। লাইন ছাড়াও কেউ কেউ আশেপাশে দাঁড়িয়ে। রিবিটকে লক্ষ্য করছে। অবশেষে ভিড় এড়াতে পুলিশ সম্পূর্ণ এলাকাটা কর্ডন করে ঘিরে ফেলতে বাধ্য হল।
রিটি লক্ষ্য করেনি কখন অমি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এখন আর লক্ষ্য করার সময় সে পাচ্ছে না। শুধু হ্যান্ডশেক করে টাকাটা রেখে দিচ্ছে। কথাবলার সুযোগও পাচ্ছে না সে। অপেক্ষারত মানুষের লাইন খুব দ্রুত লম্বা হচ্ছে।
অমি তার বাবা শওকত সাহেবের সাথে এসেছে। সে তার জমানো দুইশো একাত্তর টাকা রিবিটকে দিয়ে বলল; রিবিট আমি কি তোমার সাথে থাকতে পারি?
আমার সাথে থেকে তুমি কী করবে? তোমার তত কষ্ট হবে।
না না কষ্ট হবে না। আমি তোমার সাথে থেকে তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
ঠিক আছে, থাকো আমার সাথে।
অমি তার বাবাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। টেবিলের নিচ দিয়ে এসে রিবিট আর সাইফের মাঝে এসে দাঁড়াল। তারপর সাহায্য করতে লাগল রিবিটকে। অমি তার মতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হাতের মধ্যে রাখতে লাগল। যখন হাতে টাকা আর ধরছে না তখন রিবিট কিংবা সাইফের হাতে তুলে দিচ্ছে।
এদিকে হঠাই ডানদিকে পুলিশের কর্ডনের মধ্যে হইচই শুনে রিবিট সেদিকে ফিরে তাকাল। দেখল একজন লোক লাইনে না-দাঁড়িয়েই ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করছে। পুলিশ বাধা দেয়ায় সে জোরে ‘ভাইজান ভাইজান’ বলে চিৎকার করছে। রিবিট ভালোমতো লক্ষ্য করতে বুঝল লোকটি আর কেউ নয়, ড্রাইভার সালাম।
রিবিট ইশারা করতে পুলিশ সালামকে ছেড়ে দিল। সালাম কটমট চোখে একবার পুলিশের দিকে তাকিয়ে তারপর ছুটে এল রিবিটের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল : ভাইজান, আপনে এতবড় কাম করতেছেন আর আমারে জানাইলেন না? আমার কিনা জানতে হইল অন্য মানুষের কাছ থাইকা?
আসলে অনেক টাকার ব্যাপার তো! তুমি বুঝতেই পারছ। শুধু তোমাকে জানিয়ে কতটা লাভ হত?
আরে থামেন তো! মাত্র তো তিন লাখ টাকা! এইডা কোনো ব্যাপার হইল? আপনে হইলেন মহান, আপনার জন্য তিন লাখ টাকা কেন, তিন কোটি টাকা আমি জোগাড় কইরা দিব।
সে কি!
সে কী মানে! আমি ঢাকা শহরের সব ট্যাক্সিড্রাইভার, সিনজি ড্রাইভার, বাস ড্রাইভার, সবাইরে কইছি এইহানে আইসা একশো টাকা কইরা দেয়ার জন্য।
তুমি কীভাবে সবাইকে বললে?
এইডা আর কঠিন কি! আমি দশ জনরে কইছি। এই দশ জন প্রত্যেকে আবার দশ জনরে কবে। তাইলে কত হইল? একশো জন। এই একশো জন আবার দশ জনরে কবে, তাইলে হাজার জন। তারপর,
হ্যাঁ বুঝলাম। কিন্তু সবাই কি টাকা দেবে? দিবে না মানে। হালাগো ঘাড়ে দিবে। আমি তো কতগুলারে সাথে কইরা ধইরা নিয়া আইছি। এহনই দেখবার পাবেন। আপনের টাকা দরকার আর দিব না! না দিলে হালাগো…।
তুমি আবার অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করছ?
ভাইজান কী যে কন! হালা’ কোনো অশ্লীল শব্দ হইল? আপনি যদি শুনবার চান তাইলে কয়ডা অশ্লীল শব্দ আপনেরে শুনাই। এই যেমন ধরেন…
না না থাক। তোমাকে আর অশ্লীল শব্দ শোনাতে হবে না। তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে। এই টাকাগুলো রাখা। এখন আর এগুলো হাতে রাখা যাচ্ছে না।
ভাইজান কোনো চিন্তা করবেন না। আমি যহন আইছি ব্যবস্থা হবেই। ইশ আপনে যদি আমারে খালি আগে জানাইতেন! তয় এহনও চিন্তা করবেন না। আমার গাড়িতে কয়দিন আগে এক প্যাসেঞ্জার মেলা কাপড়ের ব্যাগ ফেলায় গেছে। ফেরত দেয়ার জন্য হালারে মেলা খুঁজছি, কিন্তু পাই নাই। এহন ওইগুলারেই কামে লাগাব। আপনি কাম চালায় যান, আমি ব্যাগ নিয়া আসি।
ড্রাইভার সালাম তার গাড়িটা একেবারে কাছে নিয়ে এল। এখান থেকে গাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তারপর ভিতর থেকে একটা কাপড়ের ব্যাগের বান্ডিল বের করে এনে বলল : ভাইজান এই যে ব্যাংক নিয়া আইছি। এহন এইহানে টাকা রাহেন। এই বলে সে রিবিট, অমি আর সাইফের হাতে তিনটা ব্যাগ ধরিয়ে দিল। নিজেও একটা নিয়ে রিবিটের পাশে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটু পর ড্রাইভার সালাম বলল : ভাইজান কোনো চিন্তা করবেন না। যদি টাকাপয়সার শর্ট পড়ে হেইডা পূরণ করার দায়িত্ব আমার। কারণ আপনে এক মহান কাম করতেছেন। মনে রাখবেন কেউ না-থাকলেও আমি আপনের পাশে আছি। ভালো কামে ড্রাইভার সালামের কোনো ক্লান্তি নাই।
তুমি কীভাবে ঘাটতি টাকা পূরণ করবে?
কী যে কন ভাইজান! আমার গাড়ি আছে না। প্রয়োজনে আমার গাড়ি বেইচা দিব। গাড়ির বডি ভাঙাচোরা হইলেও ইঞ্জিন ভালো। দাম একেবারে খারাপ পাব না।
কী বলছ তুমি! তুমি তোমার গাড়ি বিক্রি করে দিবে! তুমি না বলেছিলে গাড়িটাই তোমার জীবন।
হঁ ভাইজান কইছিলাম। তয় আপনের জন্য আমি সব করবার পারি। আর গাড়ি তো সামান্য ব্যাপার।
তাহলে থাকবে কোথায়? খাবে কী?
কেন? আপনের সাথে থাকব, আপনের সাথে ঘুরব, মানুষের উপকার করব। আর পারলে খাইলাম, না পারলে নাই।
রিবিট যে কী বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। সালামের মতো মানুষের মহত্তে সে সত্যি মুগ্ধ, বিস্মিত, অভিভূত। সে শুধু বলল : সালাম, আমি চাই না তুমি তোমার গাড়ি বিক্রি করো।
ভাইজান আপনে না চাইলে কী হবে? আমি তো চাই। আপনের জন্য আমি সবই চাই।
ড্রাইভার সালামের কথার মাঝেই যুবকবয়সী এক ড্রাইভার এসে হাজির হল। সে রিবিটের হাতে একশো টাকা তুলে দিতেই সালাম ধমকে উঠে বলল : এই হালা বাবুল, হারামজাদা, তুই একশো টাকা দেস কেন? দুইশো টাকা দে।
সাথে সাথে রিবিট বলল : সালাম, তুমি জোর করছ কেন? এখানে স্বেচ্ছায় যে যা সাহায্য করবে তাতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
ভাইজান আপনে থামেন তো। আমারে আমার কাম করবার দেন। এই হালার নাম সিনামা বাবুল। হালায় টাকা কামায় আর সিনামা দেইহা টাকা উড়ায়। এক সপ্তাহে একই সিনামা আটবার দেখছে।
আটবার না, আটবার না, নয়বার। সিনামা বাবুল নিজেই হাসতে হাসতে সংশোধন করে দিল।
শুনেন ভাইজান, শুনেন। নিজের কানে শুনেন, হালার কথা শুনেন। ওর কাছ থাইকা যদি টাকা না রাখি তাইলে কার কাছ থাইকা রাখব। দে আর একশো টাকা দে। ভালো কামে তো আর টাকা দিবি না, পচা কামে দিবি। তোগো কাছ থাইকা জোর কইরা টাকা রাখলে কোনো পাপ নাই।
ড্রাইভার বাবুল চলে যেতে মাঝবয়সী আর এক ড্রাইভার একশো টাকা হাতে এগিয়ে এল। সে টাকা এগিয়ে দিতে সালাম বলল : খবরদার ভাইজান, ওর টাকা নিয়েন না। ও এমনিতেই অভাবে আছে। তারপর মাঝবয়সী ড্রাইভার লোকটিকে বলল : কি আবুল ভাই, তোমার না মেয়ের অসুখ? তোমার টাকা দেওয়া লাগব না, যাও।
ড্রাইভার আবুল আমতা আমতা করে বলল : আমার মেয়ে ভালো হইছে। আমি মানত করছিলাম মেয়ে ভালো হইলে একশো টাকা ভালো কামে খরচ করব। তাই টাকা দিবার আইছি।
লাগব না, লাগব না। নিজের মেয়েরে ভালো-মন্দ খাওয়াও, এইডাও মেলা বড় আর ভালো কাম। যাও এহন যাও, বিরক্ত কইরো না। আমরা মেলা ব্যস্ত। আর হ, সবাইরে যাইয়া কও যেন তাড়াতাড়ি টাকা দিয়া যায়। এইডাও মেলা বড় কাম।
ড্রাইভার আবুল খানিকটা ইতস্তত করে ধীরপায়ে চলে গেল।
এরই মধ্যে সবার টাকা একসাথে করে ড্রাইভার সালাম একটা ব্যাগ ভরে ফেলেছে। সে বলল : ভাইজান এইভাবে তো টাকা রাখা যাব না। আমি গাড়িতে রাইখা আসি। গাড়ির দরজা তালা দেওয়া যায়। চুরি হওয়ার কোনো ভয় নাই।
রিবিট বলল : ঠিক আছে যাও।
ড্রাইভার সালাম গাড়িতে টাকার ব্যাগ রেখে দ্রুত ফিরে এল। তারপর অন্য সবার সাথে যোগ দিল টাকা-সংগ্রহে। অবশ্য একটু পরপরই সে গাড়ির দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। টাকার নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয় সে বিষয়ে সে-সচেষ্ট।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মানুষের ভীড় প্রচণ্ড আকার ধারণ করল। পাঁচটা লাইন করেও ভিড় এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। দুটো লাইন টিএসসি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত, একটি দোয়েল চত্বর পর্যন্ত, একটি জগন্নাথ হল পর্যন্ত, আর একটি নীলক্ষেত পর্যন্ত লম্বা হয়ে গেছে। টিএসসির আশেপাশে মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রিবিটের সাথে সাক্ষাতের পর কেউ আর টিএসসি থেকে চলে যাচ্ছে না। ফলে ভিড় আরো বাড়ছে। অধিকাংশই শিশু-কিশোর, তারা তাদের অভিভাবকের সাথে এসেছে। অনেক মহিলাও আছে। ঢাকা শহরে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে কোটিপতি কেউ বাদ যাচ্ছে না। সবাই কমবেশি সাহায্য করছে। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে এসেছে। রিবিট এখন আর টাকা গ্রহণ করতে পারছে না। সে শুধু হাত মিলাচ্ছে। সাইফ, অমি, ড্রাইভার সালামের পাশাপাশি সুমন, রিপনসহ আরো বেশ কয়েকজন কিশোর রিবিটের সাথে যোগ দিয়েছে। তারা সবাই রিবিটকে অর্থ সংগ্রহ করতে সাহায্য করছে।
সন্ধ্যা সাতটার সময় হঠাত্র একটা খবর শোনা গেল। দুটো শিশুই মারা গেছে। সাথে সাথে চারদিকে হৈ-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। সবাই খেপে উঠল। ডাক্তারের উপর। ভাবখানা এমন যেন তারা এক্ষুনি ডাক্তারদের চামড়া তুলে নেয়, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভাংচুর শুরু করে। রিবিট অবশ্য নিশ্চিত হয়েছে খবরটি মিথ্যা। কারণ অপারেশন এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু কে শোনে কার কথা, যে-যার মতো চিৎকার-চেঁচামেচি করে সবকিছু পণ্ড করার অবস্থা। এ যাত্রায় অবশ্য বিশেষ সংবাদ পরিবেশন করে চ্যানেল ফোকাসই রক্ষা করল সবাইকে। রিবিটের সংবাদ প্রচারের জন্য চ্যানেল ফোকাস টিএসসিতে একটা বিশাল মোবাইল স্ক্রিন বা টেলিভিশন মনিটর বসিয়েছিল। সেখানে যখন ঘোষণা দেয়া হল। যে এখনো অপারেশন শেষ হয়নি, তখন শান্ত হল জনতা।
পরিস্থিতি শান্ত হলে ইপি বলল : রিবিট, তুমি কি ফোকাস টিভি চ্যানেলের সংবাদ শুনেছ?
না শুনিনি।
আমার লজিক বলছে বাচ্চাদুটোর জন্য তোমাকে আর চিন্তা করতে হবে না। ইতিমধ্যে অনেকে অনেকরকম প্রস্তাব দিয়েছে। একটি এনজিও বাচচাদুটোর চিকিৎসার সকল খরচ বহন করতে রাজি হয়েছে। একটি বেসরকারি ব্যাংক ফোকাস চ্যানেলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ওদের চিকিৎসার জন্য ইতিমধ্যে এক লক্ষ টাকা প্রদান করেছে। এ ছাড়াও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনেক টাকা জমা হয়েছে। সবাই ইলেকট্রনিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে টাকা প্রদান করছে। তবে সর্বমোট অর্থের পরিমাণ ঘোষণা করা হয়নি। একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে বাচ্চাদুটোর শিক্ষার খরচ বহন করতে সম্মত হয়েছে। অপর একটি প্রতিষ্ঠান তোমাকে চাকুরি প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। তাছাড়া..
রিবিট ইপিকে থামিয়ে দিয়ে বলল; আমার সত্যি মনে হচ্ছে বাচ্চাদুটোর জন্য আমরা কিছু করতে পারছি।
হ্যাঁ তাই। এখন ওরা বেঁচে থাকলে হয়। তুমি তো জান না, বিভিন্ন স্থানে বাচ্চাদুটোর জন্য দোয়া করা হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখলাম নামাজের পর সবাই ওদের জন্য প্রার্থনা করছে। সমগ্র দেশ এখন উদগ্রীব হয়ে আছে ওদের খবর জানার জন্য। প্রত্যেকটি চ্যানেলে মানুষ যে-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে তাতে বোঝা যাচ্ছে সবাই মনেপ্রাণে চাচ্ছে ওরা যেন বেচে থাকে এবং সুস্থ সুন্দর জীবন লাভ করে।
আমার বিশ্বাস এত লোকের প্রার্থনা বৃথা যাবে না।
হয়তো তাই। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
আমাদের হয়তো আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। আমি শুনেছি ওদের পায়ের অপারেশন শেষ হয়েছে। এখন মাথার অপারেশন শেষ হলেই হয়।
কিন্তু মাথার অপারেশনটাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এজন্যই আমি চিন্তার মধ্যে আছি। তাছাড়া হাসপাতালে কথা বলে জেনেছি মস্তিষ্কের অপারেশনে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তাহলে বিষয়টা সত্যি খুব দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ রিবিট। বলল ইপি।
আমাদের আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। বিড়বিড় করে বলল রিবিট।
সবাইকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। রাত সাড়ে আটটার সময় সংবাদ এল অপারেশন সফল হয়েছে। দুটো বাচ্চাই সুস্থ আছে, এ মুহূর্তে ওদের তেমন কোনো জটিলতা নেই।
সংবাদটা শোনার পর রিবিট নিজের মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করল। শেষপর্যন্ত বাচ্চাদুটোর জন্য সে কিছু করতে পেরেছে।
এদিকে অপারেশনের সফলতার সংবাদ শুনে আশেপাশে মানুষের মধ্যেও যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। উফুল্লতার এক বিশেষ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠল চারদিকটা। ভিড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে কয়েক জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা জড়ো হয়ে রিবিট আর বাচ্চাদুটোকে নিয়ে গান ধরেছে। সবাই তাদেরকে ঘিরে হাততালি দিচ্ছে। কয়েকজন নাচতেও শুরু করেছে। ব্যাপারটা রিবিটকে দারুণভাবে অভিভূত করল। সে কখনো ভাবতে পারেনি ভালো কাজে মানুষ এতটা উৎসাহী হতে পারে।
রাত দশটার পর ধীরে ধীরে ভিড় কমতে শুরু করল। কিন্তু লাইন এখনো অনেক লম্বা। লোকজন এখনো আসছে এবং লাইনে দাঁড়াচ্ছে। রিবিট কারো সাথে কথা বলার সময় পাচ্ছে না, আগের মতোই শুধু হাত মেলাতে পারছে মাত্র। তবে রিবিট কথা বলতে না-পারলেও যে-ই রিবিটের সামনে আসছে রিবিটকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। কেউ কেউ অতি উচ্ছ্বাসে কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। গতকাল রাতের মতো অনেকে পাশ থেকে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে নিচ্ছে। তবে সবই ঘটছে মহূর্তের মধ্যে।
রাত এগারোটা থেকে লাইন ছোট হতে শুরু করল। লাইনের সংখ্যাও কমে পাঁচটি থেকে তিনটি হল। এতক্ষণ যে-সকল কিশোর-কিশোরী আর শিশুরা রিবিটের সাথে ছিল তারাও চলে গেছে। রিবিট বুঝতে পারছে সাইফ আর ড্রাইভার সালাম দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। লাইন ঠিক রাখতে আর ভিড় সামলাতে চিৎকার করতে করতে সাইফের গলা বসে গেছে।
এদিকে টাকা গুনতে যেয়ে সালামের অবস্থাও খারাপ। অধিকাংশই দশ আর পাঁচ টাকার নোট হওয়ায় সালামকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে।
সাইফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিবিট যখন সালামের গাড়িতে উঠল তখন রাত বারোটা। গাড়ি চালু করেই সালাম বলল : কইছিলাম না ভাইজান, চিন্তার কোনো কারণ নাই। আপনে আছেন তো সব ঠিক। মানুষ আপনেরে জান পরান দিয়া ভালোবাসে। তা না হইলে মাত্র কয়ঘণ্টায় কি তিন লাখ আঠারো হাজার তিনশো ষোলো টাকা উঠত?
তুমি ঠিকই বলেছ সালাম। তবে আমাদের এই সাফল্য সকলের প্রচেষ্টার ফল।
আরে না ভাইজান। সবই আপনের কেরামতি। আপনের জায়গায় আমি হইলে কি কিছু হইত? হইত না। লোকজন আমারে প্রতারক, ভণ্ড, ধান্দাবাজ, চান্দাবাজ কইয়া, পারলে দুই-চাইরড়া চড়থাপ্পড় মাইরা কিংবা পাছায় দুইডা লাথি দিয়া হয় ভাগায় দিত, নয় পুলিশে দিত। যাইহোক বাদ দেন, এহন কী করবেন কন? ঢাকা মেডিকেলে যাইতে এক মিনিটও লাগব না।
আগে ওষুধের দোকানে যাব। একটা দোকানে রাতে চেক দিয়েছিলাম। চেকটা ফেরত আনতে হবে।
আপনে চেক দিছিলেন কেন? বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল সালাম।
আমার কাছে টাকা ছিল না।
আপনের কাছে টাকা আছিল না, তাই ঐ ব্যাটা আপনের কাছ থাইকা চেক রাখব? ওর এতবড় সাহস!
আহা, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
রাগব না মানে! কী কন আপনে! আপনের অপমান তো আমার অপমান! দেহেন ভাইজান, আপনের মনডা বেশি নরম, এত নরম মন নিয়া এই কঠিন। দুনিয়ায় চলবার পারবেন না। আপনের উচিত আছিল ঐ হালারে ধইরা একটা আছাড় মারা যেন হাগা-মুতা বাইরায় যায়। তা না হইলে হালায় ঠিক হব না।
আহা সালাম! তুমি আবার অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করছ।
এইডা কোনো অশ্লীল ভাষা হইল? এইডা তো ভদ্রলোকেরই ভাষা।
ঠিক আছে ঠিক আছে। তুমি গাড়ি থামাও, আমরা চলে এসেছি।
রিবিট গাড়ি থেকে নেমে প্রথম ওষুধের দোকানে বাকিতে কেনা ওষুধের মূল্য। পরিশোধ করে দ্বিতীয় ওষুধের দোকানে ঢুকল। এই দোকানে গতকাল রাতের অল্পবয়সী দোকানদারই আছে। রিবিটকে দেখামাত্রই সে ভয়ে চেক বের করে রিবিটের দিকে এগিয়ে দিল। রিবিট অবশ্য কিছু বলতে পারল না। তার আগেই সালাম বলল : এই হালা, তুই ভাইজানরে চিনস্। তুই ভাইজানের কাছ থাইকা চেক রাখছস কেন? দিমু নাকি পেটটা গালাইয়া?
দোকানদার বেচারা কাঁদো-কঁদো গলায় বলল : আমি ওনারে চিনতে পারি নাই।
তা চিনবা কেন? প্যাদানি না দিলে তো চিনবা না। এমন প্যাদানি দিমু যে..
এবার কথা বলল রিবিট : আহা সালাম, থামো তো। তারপর দোকানদারের দিকে টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল : এই নিন আপনার বাকি টাকা।
স্যার আমার টাকা লাগব না। আমি আপনের কাছ থেকে বেশি দাম রাখছিলাম।
দোকানদারের কথা শুনে সালাম এবার লাফ দিয়ে উঠে বলল : হারামজাদা কয় কি! ভাইজানের কাছ থাইকা বলে বেশি দাম রাখছে। তারপর হঠাই রিবিটের দিকে তাকিয়ে বলল : ভাইজান আপনে খালি আমারে একবার অনুমতি দেন, হালার দুই পাছায় এমন দুইডা লাথি মারব যে হালার পাছা দুইডা খুইলা পইড়া যাব।
সালাম তুমি আবার অশ্লীল কথা বলছ! হালকা ধমকের স্বরে বলল রিবিট।
ভাইজান অশ্লীল কথার আপনে দেখছেন কী? আমি এমন অশ্লীল কথা কব যে এই ইবলিসটা মাটির চল্লিশ হাত নিচে যাইয়াও মুক্তি পাব না। আমার কথা ওর শরীরে আগুন ধরায় দিব। ভাইজান আপনে খালি অনুমতি দেন।
রিবিট আর কোনো কথা বলল না, বাইরে বেরিয়ে এল। সালাম দোকানদারকে ছাড়ল না। খপ করে কলার চেপে ধরে হাতের আঙুলে মাথায় একটা গাট্টা বসিয়ে দিল। তারপর বিড়বিড় করে বলল : তোগো তো আর সবসময় মারবার পারব না, ভাইজান যেহেতু সাথে আছে, তার সম্মানে ছোট্ট একটা গাট্টা দিলাম। মনে রাখিস, এই ভাইজানের জন্যই আইজ বাইচা গেলি, নইলে…নইলে.. তোর প্যান্ট খুইলা নিতাম, ন্যাংটা হইয়া বাড়ি যাওয়া লাগত। বুঝছস?
সালাম বাইরে আসতে রিবিট বলল : সালাম, আজকের মতো আমাদের দায়িত্ব শেষ। তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে।
বলেন ভাইজান। আপনের জন্য আমি জাহান্নামেও যাবার পারি।
জাহান্নামে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই টাকাগুলো তোমার হেফাজতে রাখবে। বাচ্চাদুটোর উপযুক্ত অভিভাবক পাওয়া গেলে তাদেরকে বুঝিয়ে দেব।
ভাইজান আপনে কোনো চিন্তা করবেন না। আমার কাছে আমার জানের থাইকা এই টাকার হেফাজতই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাইলে আইজ আসি ভাইজান।
হ্যাঁ যাও। তোমার মোবাইল নম্বর আমার কাছে আছে। আমি প্রয়োজনে তোমাকে ফোন করব। আর আমার ফোন নম্বরও রেখে দাও। প্রয়োজনে ফোন করো। আশা করছি আগামীকাল আমাদের দেখা হবে।
ঠিক আছে ভাইজান।
রিবিট এই প্রথম কাউকে তার ফোন নম্বর দিল।
১৮
ইনটেনসিভ কেয়ারে রিবিট যখন বাচ্চাদুটোকে দেখল তখনো ওদের জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছে ওদের জ্ঞান ফিরতে আরো একঘণ্টা সময় লাগবে। দুজনেই সুস্থ। যদিও মেয়েটির শরীর দুর্বল কিন্তু ভয়ের কোনো কারণ নেই। রিবিট খুব অবাক হয়েছে সাইফকে হাসপাতালে দেখে। সে স্বীকার করতে বাধ্য হল ছেলেটি সত্যি কর্মঠ। বাচ্চাদুটোর জ্ঞান না-ফেরা পর্যন্ত সাইফ নাকি হাসপাতাল ছেড়ে যাবে না।
রিবিট এবারো সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিল না। তার বিশেষ অনুরোধে সাংবাদিকরাও তাকে আর বিরক্ত করল না। সে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এল তখন চারদিকে একেবারে ফাঁকা।
রিবিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর টিএসসির দিকে হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যেয়ে সে ইপিকে বলল : ইপি আমার খুব ভালো লাগছে, বাচ্চাদুটো শেষপর্যন্ত বেঁচে আছে।
রিবিট। আমি তোমার ভালোলাগা বুঝতে পারছি।
এখন আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে মানুষ আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছে।
হ্যাঁ রিবিট, তোমার কথা সত্য। মানুষ তোমার আহ্বানে যেভাবে সাড়া দিয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। যদিও বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, তবে মানুষের সহযোগিতার প্রবণতা বিশ্লেষণ করে আমি তা বুঝতে পারছি। তুমি তো গত কয়েক ঘণ্টা ব্যস্ত থাকায় কিছুই জানতে পারোনি। চ্যানেল ফোকাসের তহবিলে ইতিমধ্যে আট লক্ষ সতেরো হাজার দুইশত তেইশ টাকা জমা হয়েছে। তোমার কাছে প্রেরিত মেইল পড়ে এবং চ্যানেল ফোকাসের সংবাদ থেকে জানা গেছে, একুশটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত এগারো লক্ষ আশি হাজার নব্বই টাক প্রদানের মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ছুটির দিন শেষ হলেই তারা এই অর্থ প্রদান করবে। তিনটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে রাজি হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান বাচ্চাদুটো স্বাবলম্বী না-হওয়া পর্যন্ত তাদের সকল ব্যয় বহন করার প্রস্তাব দিয়েছে। দুটো প্রতিষ্ঠান ওদের বিদেশে চিকিৎসার খরচ বহন করতে রাজি হয়েছে। এ ছাড়া ছয়টি প্রতিষ্ঠান তোমাকে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে যেখানে সম্মানী বিশ হাজার থেকে চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। চারটি প্রতিষ্ঠান তোমাকে ফ্রি গাড়ি প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে অত্যাধুনিক রেসিং কারও রয়েছে যেগুলোর মডেল এখনো বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়নি। চব্বিশটি প্রতিষ্ঠান তোমাকে কোনোরকম শর্ত ছাড়াই মাসিক কিছু অনুদান প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে যা তুমি মানবকল্যাণে ব্যয় করতে পারবে। সতেরোটি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান কোনোরকম শর্ত ছাড়াই তোমাকে তাদের প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। এক হাজার দুইশো বারোটি পরিবার কোনোরকম শর্ত ছাড়াই তোমাকে তাদের বাড়িতে আজীবনের জন্য থাকতে দিতে রাজি হয়েছে। দুই হাজার চারশো আঠারো জন শিশু-কিশোর আজীবনের জন্য তারা তাদের বেডরুমে তোমাকে থাকতে দিতে চেয়েছে। তিন হাজার তিনশো তিরানব্বই জন শিশু-কিশোর তোমার সাথে নিয়মিত মানবকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে রাজি হয়েছে। পাঁচ হাজার আটশো তেরো জন বিভিন্ন বয়সী মানুষ তোমাকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দুই হাজার তিনশ একুশ জন….
ইপি তোমাকে আর বলতে হবে না। আমি সত্যি অভিভূত। আমি কখনো ভাবতে পারিনি মানুষ এভাবে আমার আহবানে সাড়া দেবে। মানুষ সত্যিই মহান।
রিবিট, তুমি নিশ্চয় জানো প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মহত্ব রয়েছে। তুমি মানুষের সেই মহত্ত্বকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছ। আর এ-কারণেই মানুষ এভাবে বাচ্চাদুটোর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ টিভি চ্যানেলই বলছে এই সাহায্যের পরিমাণ এক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তোমাকে শুধু ছুটির দিন শেষ না-হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এক কোটি টাকা!
যা রিবিট। কারণ ছুটির দিন থাকায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সাহায্য পাওয়া যায়নি। প্রত্যেকটি টিভি-চ্যানেল, স্কুল-কলেজ, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সবাইকে আহবান জানাচ্ছে সাহায্য প্রদান করার জন্য। ধারণা করা হচ্ছে এটাই বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত স্বল্পসময়ে প্রদত্ত সর্বোচ্চ সহযোগিতা।
ইপি, তাহলে বাচ্চাদুটোর ভবিষ্যত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
হ্যাঁ তাই।
তবে সবচেয়ে ভালো হত যদি বাচ্চাদুটোর বাবা-মাকে খুঁজে পাওয়া যেত।
হ্যাঁ তাই। কিন্তু খুঁজে পাওয়ার উপায় কী?
প্রফেসর মালেক বলেছিলেন বাচ্চাদুটোর মা আমাদের আশেপাশেই কোথাও থাকবে এবং সে আমাদের আশেপাশেই আছে।
তুমি কি নিশ্চিত?
হ্যাঁ ইপি, এবং এখন আমি নিশ্চিত সে কে?
কী বলছ রিবিট! এতক্ষণ বলোনি কেন? তুমি বাচ্চাদুটোর মায়ের সাথে কথা বলোনি কেন?
আমি নিশ্চিত ছিলাম না। তবে এখন আমি নিশ্চিত হয়েছি।
কীভাবে?
প্রফেসর মালেক যে-মুহূর্ত থেকে আমাকে বলেছিলেন বাচ্চাদুটোর মা আশেপাশে থাকতে পারে, সেই মুহূর্ত থেকেই আমি আশেপাশে লক্ষ্য রাখতে শুরু করি। আশেপাশে যাকেই আমার সন্দেহ হয়েছে তার ছবিই আমি বিশেষ একটি ফাইলে সংরক্ষণ করেছি।
হ্যাঁ আমি লক্ষ্য করেছি। তুমি তোমার মেমোরিতে ‘মা’ নামক নতুন একটা ফাইল খুলেছ এবং তাতে অনেকের ছবি রয়েছে।
এই ফাইলে যে, মহিলার ছবি সবচেয়ে বেশি রয়েছে সে-ই বাচ্চাদুটোর মা। তুমি নিশ্চয় ছবিগুলো লক্ষ্য করেছ?
এ তো দেখছি সেই মহিলা যে কিনা টিএসসিতে সবার প্রথমে সাহায্য প্রদান করার জন্য দুই টাকা দিয়েছিল।
হ্যাঁ ইপি। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। কারণ একজন হতদরিদ্র মহিলা নিশ্চয় দুই টাকা সাহায্য প্রদানের জন্য এমনি এমনি লাইনে সবার আগে এসে দাঁড়াবে না। এই মহিলাকে আমি হাসপাতালের পাশেও দুবার দেখেছি। তাছাড়া সে এখন আমার পিছন পিছন আসছে। সম্ভবত আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল হাসপাতালে আমি বাচ্চাদুটোর পাশে থাকি। কিন্তু যখন বুঝলাম আমার পরিবর্তে এই মহিলা অর্থাৎ বাচ্চাদুটোর মা যদি ওদের পাশে থাকে তাহলে সেটা হবে বেশি আনন্দদায়ক, তখন আমি বাইরে কিছুটা নির্জনে আসার সিদ্ধান্ত নেই যেন ঐ মহিলা আমার সাথে কথা বলতে পারে। কারণ আমি লক্ষ্য করেছি অনেক লোকের মধ্যে মহিলা সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখছিল।
রিবিট তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছ।
রিবিট জাতীয় শহীদ মিনারের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। মহিলা তার থেকে প্রায় ত্রিশ গজ দূরে হাঁটছে। রিবিট ঘুরে দাঁড়াতে মহিলাও থমকে দাঁড়াল। রিবিট এবার তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। মহিলা প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে ধীরে পায়ে রিবিটের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল।
মহিলা রিবিটের থেকে দুই গজ দূরে এসে থামল। কেন যেন সে মাথা নিচু করে রেখেছে। রিবিট তাকে অভয় দিয়ে বলল : আমাকে ভয় পাবেন না। আমি লক্ষ্য করেছি আপনি আমাকে অনুসরণ করছিলেন। আমি কি জানতে পারি কেন?
মহিলা কিছু বলল না। মাথা নিচু করে আগের মতোই স্থির দাঁড়িয়ে থাকল।
আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?
এবার মহিলা ডুকরে কেঁদে উঠল।
রিবিট খুব অস্বস্তিতে পড়ল। মহিলা যে এভাবে কেঁদে উঠবে সে ভাবতে পারেনি। তাই বলল : আপনি কাঁদবেন না। কাঁদলে তো কোনো লাভ হবে না। আমাকে সবকিছু খুলে বলুন।
ইপি এবার অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে বলল : রিবিট তুমি দেরি করছ কেন? দেখতে পাচ্ছ না মহিলার কষ্ট হচ্ছে।
হ্যাঁ ইপি আমি দেখতে পাচ্ছি। যদিও আমি নিশ্চিত তারপরও আমি চাচ্ছি মহিলা নিজের মুখে বলুক সে বাচ্চাদুটোর মা। এতে আমি আরো নিশ্চিত হতে পারব। বাচ্চাদুটোর ভবিষ্যৎ এখন অনেক উজ্জ্বল। এ মুহূর্তে অনেকেই প্রতারণার মাধ্যমে বাচ্চাদুটোর জন্য যে-সাহায্যের অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে তা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করতে পারে।
ঠিক আছে। তুমি তোমার মতো কাজ করে যাও।
এর মধ্যে মহিলা নিজেকে সামলে নিয়েছে। জীর্ণ শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলল : ভাইজান, আমার নাম মমতা। আপনে যে বাইচ্চা দুইডার জন্য জান দিয়া দিছেন আমি ওগো মা।
আপনি কি সত্য বলছেন?
হ ভাইজান। আপনের বিশ্বাস না হইলে আমাগো বাড়িতে খবর নিবার পারেন। আমাগো বাড়ি রাজবাড়ি। আমার স্বামী পঙ্গু। আমার আরো দুইডা মেয়ে আছে। তিনমাস আগে সদর হাসপাতালে সিজার কইরা আমার এই বাইচ্চা দুইডা হয়। ছেলের আশা করছিলাম। ছেলে হইছে, কিন্তু এমন কপাল যে আর একটা মেয়ের সাথে হইল, তাও আবার যমজ। ডাক্তার কইল ঢাকা আইনা মেডিকেলে অপারেশন করলে বাইচ্চা দুইডা বাইচা থাকব। সিজার করায় খুব অসুস্থ আছিলাম। তাই আগে ঢাকা আসবার পারি নাই। তিনদিন আগে দুইশো টাকা নিয়া একলাই ঢাকা আইছিলাম। মেডিকেলেও গেছিলাম। কিন্তু ডাক্তার কইল মেলা টাকা লাগব। কী করব ভাইজান? স্বামী পঙ্গু, নিজেরাই খাবার পাই না, আর এহন এত টাকা পাব কোনহানে? এইদিকে ঢাকা আইসা টাকাও শেষ। শেষে মানুষের কাছে হাত পাতলাম। কেউ বিশ্বাস করে না, কোনো সাহায্য দেয় না। কী করব কিছুই ভাইবা পাই না। বাইচ্চা দুইডারে দেশে নিলেও বাঁচান যাব না। মেয়েডা তো খাওয়া প্রায় ছাইড়াই দিছিল। শেষে উপায় না-পাইয়া বাইচ্চা দুইডারে ফেলায় যাবার সিদ্ধান্ত নেই। কষ্টে বুকটা ফাইটা যাবার চাইছিল। ফিরা আইসা দেহি আপনে বাইচ্চা দুইডারে কোলে নিছেন। সেই থেইকা আপনের পিছন পিছন আছি। তারপর কাইল রাইতে আপনে যহন গাড়িতে উঠেন তহন আপনেরে হারায় ফেলি। ভাবি আপনে মেডিকেলেই আসবেন। সকালে আপনেরে আবার মেডিকেলে খুইজা পাই। আমার কাছে কোনো টাকাপয়সা আছিল না। দুই টাকা আছিল। হেইডাই আপনেরে বিকালে দিছিলাম। এর চাইতে বেশিকিছু করার ক্ষমতা আমার আছিল না ভাইজান।
এই বলে মমতা হু হু করে কাঁদতে শুরু করল।
রিবিট বলল : আপনি কাঁদবেন না। আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনার বাচ্চারা সুস্থ আছে। আমি আপনাকে ওদের কাছে নিয়ে যাব। আর আপনাদের দুঃখ থাকবে না।
মমতা তখনো কাঁদছে।
রিবিট বলল : আমি আগেই অনুমান করেছিলাম আপনি ওদের মা। আমি নিশ্চিত হয়েছি। আপনি চিন্তা করবেন না। আগে চলুন আপনি খাওয়াদাওয়া করবেন। নিশ্চয় গত কয়েকদিন কিছু খাননি।
না ভাইজান, আমি কিছু খাব না। আমার কিছু খাবার ইচ্ছা করে না।
ঠিক আছে, আপনি আসুন আমার সাথে। আপনাকে আপনার বাচ্চাদের কাছে নিয়ে যাই। কিন্তু আর কখনো এভাবে নিজের বাচ্চাকে ফেলে যাবেন না।
ভাইজান, আমি আর কোনোদিনও এমন কাম করব না। আমার ভুল হইছে, আমারে মাফ কইরা দেন।
এতে ভুলের কিছু নেই, এটা অন্যায়। যে সন্তানকে আপনি জন্ম দেবেন, সে বিকলাঙ্গ হোক আর প্রতিবন্ধী হোক তাকে লালনপালন করার দায়িত্ব আপনার, আমার এবং এ সমাজের। সমাজ কোনো-না-কোনোভাবে তাদেরকে রক্ষা করে। তবে সেক্ষেত্রে যদি আমাদের সকলের সহযোগিতা থাকে তাহলে তা আরো সুন্দরভাবে সম্ভব হয়।
ভাইজান, আপনি মহান।
আমি মহান নই। মহান হল মানুষ, সৃষ্টিকর্তার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর হৃদয়বান জীব।
রিবিট মমতাকে নিয়ে হাসপাতালে ফিরে আসার সময় বুঝিয়ে দিল আগামীকাল কীভাবে সে মমতাকে সকল অর্থ বুঝিয়ে দেবে, তার দায়িত্ব কী হবে এবং হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার পর কীভাবে তারা সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।
হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারের সামনে দায়িত্বরত নার্সের কাছ থেকে সে জানতে পারল দুটো বাচ্চারই জ্ঞান ফিরেছে। কথাটা শোনার পর মমতা যেভাবে ই হু করে কেঁদে উঠল তাতে রিবিট আবারো বিস্মিত হল। মানুষের ভালোবাসা আর আনন্দ যে এভাবে কান্নার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, এ-ব্যাপারটা তাকে সবসময়ই বিস্মিত করে।
রিবিট মমতাকে শান্ত করতে বলল : আপনি কাঁদবেন না। যান আপনি আপনার বাচ্চাদেরকে দেখে আসুন। আমার বিশ্বাস ওরা আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবে। প্রায় এক দিন হয়েছে ওরা আপনাকে দেখে না।
পাশাপাশি দুটি বেডে বাচ্চাদুটোকে রাখা হয়েছে। মমতা দুই বেডের উপর যেয়ে বাচ্চাদুটোকে উপুড় হয়ে দেখল। তার চোখ দিয়ে এখনো টপটপ করে পানি পড়ছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে সে সেই পানি ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। তার বাচ্চারা যে বেঁচে আছে এ ব্যাপারটা সে যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
একটু পরেই মমতা ফিরে এসে বলল : ভাইজান ওরা আপনেরে দেখবার চায়।
রিবিট অবাক হয়ে বলল; আপনি কীভাবে বুঝলেন?
আমি বুঝি। আমি ওদের ইশারা বুঝবার পারি।
রিবিট ধীরে ধীরে মেয়েবাচ্চাটির বেডের পাশে এসে দাঁড়াল। দেখল, মেয়েটি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে শুধুই কৃতজ্ঞতা। রিবিট মেয়েটির উপর ঝুঁকে আসতে মেয়েটি অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল। ছোট্ট ডান হাতটিকে সে উঁচু করে রিবিটের কপালে ছোঁয়াল। তারপর হাতটি ধীরে ধীরে মুখের নিচ পর্যন্ত নিয়ে এসে নামিয়ে নিল।
এত দুর্বল শরীরে মেয়েটি যে কীভাবে এমন করতে পারল তা রিবিটের মাথায় ঢুকল না। আনন্দে তার চোখ দিয়ে প্রায় পানি এসে গেল।
পাশ থেকে মমতা বলল : ভাইজান ও আপনেরে চিনবার পারছে।
রিবিট কোনো কথা বলল না। তার খুব কান্না পাচ্ছে এবং তার সত্যি সত্যি কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে কাঁদল না। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ছেলেটির বেডের পাশে এসে দাঁড়াল।
রিবিট ছেলেটির উপর ঝুঁকে আসতে মেয়েটির মতো ছেলেটিও তার মুখে হাত বুলিয়ে একইভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। রিবিট ভেবে পেল না কীভাবে ওরা দুজন একইভাবে তার মুখ ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। যমজ বলে ওরা কি কোনোভাবে একে অন্যের মনোভাব বুঝতে পেরেছে? নাকি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল যদি ওরা বেঁচে থাকে তাহলে এভাবেই ওরা নিজেদের কৃতজ্ঞতা। প্রকাশ করবে?
রিবিট কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। সে বুঝতে পারল মানুষ সত্যি রহস্যময়। তার মতো অতি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার রোবটের পক্ষে মানুষের চরিত্রের এই বিচিত্র রহস্য কখনোই ভেদ করা সম্ভব নয়।
.
রিবিট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে চানখারপুলের রাস্তা ধরে পুরোনো ঢাকার দিকে এগোতে শুরু করল। খানিকটা এগোতে ইপি বলল : রিবিট, তোমার প্রতি মানুষের ভালোবাসার এক অদ্ভুত নমুনা তোমাকে দেখাব।
কী নমুনা?
টিভি চ্যানেলটি দেখো।
রিবিট টিভি চ্যানেলে মমতাকে দেখতে পেল। দেখল, প্রায় বিশ-পঁচিশ জন সাংবাদিক মমতাকে ঘিরে ধরেছে। মমতার ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। সম্ভবত সাংবাদিকরা তাকে কিছু-একটা জিজ্ঞেস করেছে। সে তার উত্তর দিতে চেষ্টা করছে।
এমন সময় তরুণ এক সাংবাদিক বলল : কই আপনি আপনার ছেলে আর মেয়ের নাম বলুন!
মমতা এবার কাঁপা কণ্ঠে বলল : ওগো কোনো নাম নাই, আমি ওগো কোনো নাম রাহি নাই। তয় আইজ আমি ওগো নাম রাখব।
কী নাম? আবারো প্রশ্ন করল তরুণ সাংবাদিক।
মমতা কম্পিত ঠোঁটে বলল : আমার ছেলের নাম হবে আমার ভাইজানের নামে। ওর নাম ‘রিবিট’। আর মেয়ের নাম..
মমতাকে আর কিছু বলতে হল না। তার আগেই সকল সাংবাদিক একসাথে চিৎকার করে উঠে বলল : ইপি, ইপি।
রিবিট সাথে সাথে বলল : ইপি, মানুষের ভালোবাসার কি কোনো সীমা আছে?
না রিবিট। মানুষের ভালোবাসার কোনো সীমা নেই।
মানুষের মহত্ত্বের কি কোনো সীমা আছে?
না রিবিট। মানুষের মহত্ত্বের কোনো সীমা নেই। মা
নুষের বুদ্ধির কি কোনো সীমা আছে?
না রিবিট নেই।
মানুষ সত্যি এক রহস্যময় জীব।
সত্যি রহস্যময়।
আমার খুব গর্ব হচ্ছে এই ভেবে যে ভালোবাসায় ভরা এরকম মহান, অতি বুদ্ধিমান এবং রহস্যময় জীব মানুষের সাথে আমি বসবাস করতে পারছি।
তুমি সত্যি সৌভাগ্যবান রিবিট।
এমন সময় রিবিটের ফোন এল। রিবিট ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে প্রফেসর হক বললেন : রিবিট, আমি সত্যি খুব খুশি হয়েছি। তুমি আমার গবেষণা, আমার সাধনাকে সার্থক করেছ। আমি তোমার জন্য সত্যি গর্বিত। আর হ্যাঁ, তোমার জন্য পত্রিকা অফিসে আমি একটা চাকুরি ঠিক করেছি। সপ্তাহে একদিন কাজ করতে হবে। এতে তোমার খরচ চলে যাবে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানাব।
এই বলে প্রফেসর হক খুক খুক করে দুবার কাশি দিলেন। তারপর আবার বললেন : আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে কোনো চিন্তা করবে না, আর অহেতুক বিরক্ত করবে না। মনে রেখো, তুমি মানুষের কল্যানণসাধন করতে পারলেই আমার কল্যাণ হবে।
প্রফেসর হক রিবিটকে কোনো কথা বলার সুযোগ না-দিয়েই লাইন কেটে দিলেন।
রিবিট খানিকটা স্লান গলায় বলল : প্রফেসর হক সত্যি মহান।
হ্যাঁ রিবিট, তিনি শুধু মহানই নন, রহস্যময়ও বটে। উত্তরে বলল ইপি।
ইপির সাথে কথা বলতে বলতে রিবিট ছোট্ট একটা মাঠের পাশে এসে দাঁড়াল। চারপাশটা একেবারেই নীরব। আশেপাশে কেউ নেই। হঠাৎই একটা অদ্ভুত শব্দে সতর্ক হয়ে উঠল সে। বলল : ইপি এটা কিসের শব্দ?
মনে হচ্ছে কিছু একটা নড়াচড়া করছে।
কী?
আমি বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে মাঠের অপর প্রান্ত থেকে শব্দটা আসছে।
আমি কি এগিয়ে যাব?
হ্যাঁ যাও। তবে সতর্ক থেকো।
রিবিটকে সতর্ক হতে হল না। দু-কদম এগোতেই সে ওয়া..ওয়া.. কান্নার শব্দ শুনতে পেল। সে নিশ্চিত শব্দটা মাঠের অন্যপাশ থেকে আসছে। অনেকটা অবাক হয়ে বলল : ইপি, মনে হচ্ছে মানুষেরই বাচ্চা!
আমার লজিক সেরকমই বলছে।
আবারো মানুষের বাচ্চা! এভাবে পড়ে আছে।
রিবিট, তুমি না বলেছিলে মানুষ খুব রহস্যময়। এটা হয়তো মানুষের চরিত্রেরই অন্য এক রহস্য। হয়তো এদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই রহস্যের মাত্রা কিছুটা বেশি।
তাহলে এখন আমি কী করব?
তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে। এটাই তোমার কাজ। তুমি তো মানুষেরই জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য।
রিবিট কোনো কথা বলল না। সে দ্রুতপায়ে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে এগোতে লাগল। তাকে যে মানুষের অনেক অনেক কল্যাণ সাধন করতে হবে।
(০১.০৮.২০০৬– ০৭.০৯.০৬)
.
রিবিট ০০২
কালো মানুষ
রিবিট অদ্ভুত একটা ই-মেইল পেল।
প্রিয় রিবিট,
আমার নাম তিশা। আমি তোমার একজন খুব ভালো বন্ধু। আমি ধানমণ্ডি লিটল মুন’ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। বিশেষ কারণে তোমার সাহায্য খুব প্রয়োজন। গতকাল আমার আব্দুর কছে কালো মানুষ নামের কেউ একজন ফোন করে দশ লক্ষ টাকা চেয়েছে। কালো মানুষ বলেছে সে খুব ভয়ংকর, টাকা না দিলে সে আমাকে মেরে ফেলবে। আর পুলিশকে জানালে বেশি ক্ষতি হবে। আমার আবু-আম্মু খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এত টাকা দেয়ার মতো আর্থিক অবস্থা তাদের নেই। রিবিট, প্লিজ আমাদের সাহায্য করো। আমি জানি একমাত্র তুমিই আমাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে।
তোমার প্রিয়
তিশা
রিবিট ই-মেইলটা আবার পড়ল। সে বঝতে পারল তিশা সত্যি বিপদে আছে। ভয়, উত্তেজনা বা যে-কোনো কারণেই হোক নিজের ঠিকানা পর্যন্ত লিখতে ভুলে গেছে। রিবিট মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিল, সাহায্য করবে তিশাকে।
রিবিট কি শেষপর্যন্ত পেরেছিল তিশাকে সাহায্য করতে?
Leave a Reply