রিবিট ও কালো মানুষ – মোশতাক আহমেদ
প্রথম প্রকাশ : ফাল্গুন ১৪১৪, ফেব্রুয়ারি ২০০৮
.
রিবিট অদ্ভুত একটা ই-মেইল পেল।
প্রিয় রিবিট,
আমার নাম তিশা। আমি তোমার একজন খুব ভালো বন্ধু। আমি ধানমন্ডি লিটল মুন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। বিশেষ কারণে তোমার সাহায্য খুব প্রয়োজন। গতকাল আমার আব্দুর কাছে ‘কালো মানুষ’ নামের কেউ একজন ফোন করে দশ লক্ষ টাকা চেয়েছে। ‘কালো মানুষ’বলেছে সে খুব ভয়ঙ্কর, টাকা না দিলে সে আমাকে মেরে ফেলবে। আর পুলিশকে জানালে বেশি ক্ষতি হবে। আমার আবু-আম্মু খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এত টাকা দেয়ার মতো আর্থিক অবস্থা আমাদের নেই। রিবিট, প্লিজ আমাদের সাহায্য কর। আমি জানি একমাত্র তুমিই আমাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে।
তোমার প্রিয়
তিশা
রিবিট ই-মেইলটা আবার পড়ল। সে বুঝতে পারল তিশা সত্যি বিপদে আছে। ভয়, উত্তেজনা বা যে কোনো কারণেই হোক নিজের ঠিকানা পর্যন্ত লিখতে ভুলে গেছে। রিবিট মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিল সাহায্য করবে তিশাকে।
রিবিট কি শেষ পর্যন্ত পেরেছিল তিশাকে সাহায্য করতে?
.
মোশতাক আহমেদ
জন্ম ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭৫, জেলা ফরিদপুর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ডিপার্টমেন্ট থেকে এম ফার্ম ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ এবং ইংল্যান্ডের লেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ক্রিমিনোলোজিতে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। কর্মজীবনে তিনি একজন চাকুরিজীবী। তাঁর লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবনে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে তিনি অধিক আগ্রহী হলেও গোয়েন্দা এবং ভৌতিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে :
সায়েন্স ফিকশন : রোবটিজম, ক্লিটি ভাইরাস, নিহির ভালোবাসা, লাল শৈবাল, পাইথিন, ক্রিকি, ক্রি, লিলিপুটের গ্রহে, পৃথিবীতে লিলিপুটেরা, রোবো, নিকি, অণুমানব, রোবটের পৃথিবী, সবুজ মানব, প্রজেক্ট ইক্টোপাস, গিগো, লালমানব।
সায়েন্স ফিকশন সিরিজ : রিবিট, কালোমানুষ, রিবিট এবং ওরা, রিবিটের দুঃখ।
ভৌতিক : অতৃপ্ত আত্মা, প্রেতাত্মা, আত্মা, রক্ততৃষ্ণা, অভিশপ্ত আত্মা, রক্ত পিপাসা।
গোয়েন্দা এবং কিশোর অ্যাডভেঞ্চার : ডাইনোসরের ডিম, লাল গ্যাং, নীল মৃত্যু, ববির ভ্রমণ।
প্যারাসাইকোলজি : মায়াবী জোছনার বসন্তে।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস : নক্ষত্রের রাজারবাগ
জকি তার জীবনধর্মী বহুলপ্রশংসিত একটি উপন্যাস।
.
.
উৎসর্গ
হাসিখুশি, প্রাণবন্ত
এবং অতিপ্রিয় ব্যক্তিত্ব
জাকির হোসেনকে
.
ভূমিকা
(যে সকল পাঠক রিবিট সিরিজের প্রথম বইটি পড়েননি শুধুমাত্র তাদের জন্য)
দীর্ঘ ত্রিশ বছর গবেষণাশেষে বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর হক মানুষের কল্যাণের জন্য ঢাকা শহরে একটি অতি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবটকে মুক্ত করে দেয়। এই অতি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবটটির নাম ‘রিবিট’। সকল রোবটের মতো একটি মাইক্রোচিপস রিবিটের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে রিবিটের মূল প্রোগ্রাম সংরক্ষিত আছে এবং এই মূল প্রোগ্রামের নাম ‘প্রোগ্রাম রিবিট’। ‘রিবিট প্রোগ্রাম’-ই রোবট রিবিটের নিয়ন্ত্রক বা প্রাণকেন্দ্র। রিবিটের অভ্যন্তরে ‘ইপি’ নামের অপর একটি বিশেষ প্রোগ্রাম রয়েছে। ইপি মূলত রিবিটের তথ্য বা জ্ঞানকেন্দ্র, পৃথিবীর সকল বিষয় সম্পর্কে সাধারণ তথ্যসমূহ ইপির অভ্যন্তরে সংরক্ষিত আছে। ইপির মূল কাজ হচ্ছে রিবিটকে তথ্য প্রদান করা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে নানাভাবে রিবিটকে সাহায্য করা। এছাড়া রিবিটের নিঃসঙ্গতা দূর করাও ইপির অন্যতম কাজ। উল্লেখ্য, রিবিটের কণ্ঠস্বর পুরুষালি হলেও ইপির কণ্ঠস্বর এক নারীর। রিবিট এবং ইপি যে-কোনো সময়, যে-কোনো প্রয়োজনে, যে-কোনো বিষয়ে, একে অন্যের সাথে কথা বলতে পারে। তবে এটা সত্য, ‘প্রোগ্রাম ইপি’ সবসময় ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং সকল বিষয়ে ‘প্রোগ্রাম রিবিট’-ই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এছাড়াও রিবিটের অভ্যন্তরে হাজার হাজার প্রোগ্রাম রয়েছে যেগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ কিংবা ‘প্রোগ্রাম ইপির’ তুলনায় গৌণ। মাইক্রোচিপস্-এর অভ্যন্তরে এই হাজার হাজার প্রোগ্রামগুলোও ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত।
রিবিটের সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হল ‘অনুভূতি’। মানুষের মতোই রিবিট সুখ দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা উপলব্ধি করতে পারে। আর এ-কারণেই মানুষের সুখে রিবিট সুখী হয়, মানুষের আনন্দে আনন্দিত হয় এবং মানুষের ব্যথায় ব্যথিত হয়। রিবিট মানুষের মতোই আবেগপ্রবণ এবং সে তার নিজস্ব মর্যাদার প্রতি যথেষ্ট সচেতন। তাই যে কোনো কটুক্তি কিংবা আপত্তিজনক আচরণে রিবিট অপমানিত বোধ করে। তবে রিবিটের মধ্যে প্রতিহিংসার কোনো অনুভূতি নেই। রিবিট নিজের প্রয়োজনে কখনো প্রতিহিংসাপরয়ণ হতে পারে না। যে সামান্য রাগের অনুভূতি রিবিটের মধ্যে আছে তা শুধুমাত্র মানুষের মঙ্গলের জন্য অথবা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। রিবিট সর্বদাই সত্যবাদী। তবে মানুষের মঙ্গলের জন্য রিবিট যে-কোনো তথ্য গোপন করতে পারে কিংবা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারে। রিবিটের আচরণ নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর। মানসিকভাবে রিবিট কখনো শিশু, কখনো কিশোর, কখনো তরুণ, আবার কখনো মাঝবয়সী? তবে সাধারণত রিবিট উদ্যমী এবং পরোপকারী এক প্রাণবন্ত হাসিখুশি তরুণ, যে কিনা সবসময় মানুষের কল্যাণ এবং মঙ্গল নিয়েই চিন্তা করে।
রিবিট একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রোবট। সক্রিয় থাকার জন্য রিবিট কখনো মানুষকে বিরক্ত করে না। রিবিটের অভ্যন্তরের ব্যাটারি বা চার্জার ইলেকট্রিক কিংবা সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে চার্জ হয়। এ কারণে সূর্যের আলো থেকে রিবিট নিজেকে প্রয়োজনমতো চার্জ করে নিতে পারে। এমনকি, বিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উপরের যে কোনো তাপমাত্রার পরিবেশ থেকে রিবিট নিজেকে চার্জ করতে পারে। রিবিটের অভ্যন্ত রে আত্মরক্ষার জন্য যে-প্রোগ্রাম রয়েছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ক্ষিপ্র। ‘রাইট অব প্রাইভেট ডিফেন্স’ বা ‘ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ ব্যতীত রিবিট কখনো কোনো মানুষ বা প্রাণীকে আঘাত করে না। তবে শিশু, অন্য কোনো নিরপরাধ মানুষ কিংবা প্রাণীর জীবন রক্ষার্থে রিবিট মানুষের উপর নিয়ন্ত্রিত শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।
মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেই রিবিটকে কিছু অতিমানবীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। রিবিট প্রয়োজনে তার শক্তি পাঁচগুণ বৃদ্ধি করতে পারে, তবে এই শক্তি অবশ্যই একটি পাহাড়কে উল্টে দেয়ার মতো নয়। আধুনিক প্রযুক্তির সবকিছুই রিবিটের অভ্যন্তরে আছে। রিবিটের মূল প্রোগ্রাম সরাসরি মোবাইল, রেডিও, টেলিভিশন এবং টেলিফোন নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত। এ-কারণে রিবিট মুহূর্তেই ইন্টারনেট, ইমেইল এবং টেলিফোনের মাধ্যমে যে-কোনো স্থানে যোগাযোগ করতে পারে এবং রেডিও কিংবা টেলিভিশনের যে-কোনো অনুষ্ঠান শুনতে বা দেখতে পারে। রিবিটের নিজস্ব ই-মেইল নম্বর [email protected]। রিবিটের চোখে অত্যন্ত শক্তিশালী ডিজিটাল এবং অপটিক্যাল জুমের ভিডিওক্যাম রয়েছে। এ-কারণে রিবিট যেমন মুহূর্তেই যে-কোনোকিছুর ছবি তুলতে পারে তেমনি অনেক দূরের জিনিসও দেখতে পারে। রিবিট তার চারপাশে যা-কিছু দেখে বা শুনে তা তার অভ্যন্তরের মেমোরিতে পাঁচবছর পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে। আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো রিবিট তার স্মৃতি থেকে কখনোই মুছে ফেলে না, বছরের-পর-বছর সংরক্ষণ করে। ফলে রিবিট যে কোনো সময় তার পূর্বের যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিকে দেখতে পারে বা সেখান থেকে যে-কোনো স্মৃতির ভিডিও ধারণ করে বা ছবি তুলে তা প্রিন্ট করতে পারে। রিবিটের মূল প্রসেসর এতটাই শক্তিশালী যে মুহূর্তেই রিবিট মানুষের মতো যে-কোনো বিষয় বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতার কারণেই রিবিট অতি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবটের মর্যাদা লাভ করেছে।
রিবিটের মূল কাজ হচ্ছে মানুষের কল্যাণ সাধন করা। আর এই কল্যাণসাধনের জন্যই রিবিট ঘুরে বেড়ায় বাংলাদেশের শহর-গ্রামে, পথে-প্রান্তরে, আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে। কখনো সে অসুস্থ শিশুর পাশে, কখনো হতদরিদ্র কৃষকের সাথে, কখনো দুর্ধর্ষ অপরাধীর পিছনে, কখনো অসহায় শিশু-কিশোরদের মাঝে, কখনো উত্তাল সাগরে বিপদগ্রস্ত জেলেদের সাথে, আবার কখনো সুন্দরবনে আতঙ্কগ্রস্ত পশু পাখির মাঝে। রিবিট তার এই পরোপকারী আর কল্যাণকর কাজের জন্য অল্পদিনেই মন জয় করে নেয় সবার। পথে-প্রান্তরে যে যেখানে রিবিটের সাক্ষাৎ পায় ছুটে আসে রিবিটের সাথে কথা বলতে, তার সাথে হাত মেলাতে, তাকে জড়িয়ে ধরতে, তাকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে। আর শিশু-কিশোর- তাদের কাছে রিবিট যেন এক আদর্শ, এক মহান ব্যক্তিত্ব। রিবিট বলতে তারা পাগল, তারা উন্মাদ। রিবিট যেন তাদের সুখ, শান্তি, আনন্দ, হৃদয়ের ভালোবাসা। তাই তো রিবিটের আহ্বানে তারা বারবার ছুটে আসে রিবিটকে সাহায্য করতে, সবাই মিলে অংশগ্রহণ করে মানবসেবামূলক মহান মহান কাজে।
.
১.
রাত একটা। ফার্মগেটে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিল রিবিট। হঠাৎই কী মনে করে ওভারব্রিজের উপর উঠতে শুরু করল। এই ওভারব্রিজটা রিবিটের খুব প্রিয়। মাঝে মাঝেই সে গভীর রাতে এই ব্রিজের উপর এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে উত্তর দক্ষিণে অনেকদূর পর্যন্ত রাস্তা দেখতে পায় সে। গভীর রাতেও এই রাস্তাতে অনেক গাড়ি চলাচল করে। রাতে অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইটের আলোগুলো দেখতে দারুণ লাগে তার। তাই পত্রিকা-অফিসে কাজ শেষে মাঝে মাঝেই এখানে এসে দাঁড়ায়। তারপর তাকিয়ে থাকে দূরে, অনেকদূরে- যেখান থেকে ছুটে আসছে গাড়িগুলো।
প্রফেসর হকই চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছে রিবিটকে। রিবিটের অনেক ভালো ভালো চাকরি করার সুযোগ থাকলেও শেষপর্যন্ত পত্রিকা-অফিসের চাকরিটাই নেয় সে। কারণ প্রফেসর হক এমনটিই আশা করেছিল। চাকরিটা শুরু করার পর রিবিট অবশ্য বুঝতে পেরেছে প্রফেসর হকের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। কারণ সপ্তাহে তাকে মাত্র একদিন কাজ করতে হয়, আর তাও আবার সন্ধ্যার পরে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। এজন্য পুরো সপ্তাহটাই সে মানবকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। পত্রিকা অফিসে তার কাজ মূলত টাইপ করা। পত্রিকাটি সাপ্তাহিক যে ক্রোড়পত্র বের করে সেটাই তাকে টাইপ করতে হয়। তার জন্য কাজটা মোটেও পরিশ্রমের নয়। তবে বিনিময়ে সে যে-অর্থ পায় তাতে তার ভালোই চলে যায়, কিছু অর্থ হাতেও থেকে যায়। হাতে থেকে যাওয়া এই অর্থ দিয়ে সে সপ্তাহে একদিন রাস্তার কয়েকজন দরিদ্র শিশু কিশোরকে খেতে নিয়ে যায়। ওদের খাওয়া দেখতে রিবিটের খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে সে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তার চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। এদেশের হত দরিদ্র শিশুরা যে কতটা কষ্টে জীবন অতিবাহিত করে তা সে রাতে অন্ধকারে ঢাকার রাস্তায় না হাঁটলে হয়তো কোনোদিনও বুঝতে পারত না।
রিবিট, কী ভাবছ?
অভ্যন্তরীণ প্রোগ্রাম ইপির ডাকে রিবিট বাস্তবে ফিরে এল। সে এতক্ষণ যেন ভিন্ন। এক জগতে ছিল। বলল : হ্যাঁ ইপি বলো।
তুমি কি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ?
কী ব্যাপার?
ঐ যে দ্যাখো, ইটভর্তি একটা ঠেলাগাড়ি আসছে। বৃদ্ধ এক লোক ঠেলাগাড়িটি ঠেলে নিয়ে আসছে।
হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি। বৃদ্ধলোকটির সাথে দুটো ছেলেও আছে।
হ্যাঁ, একজন যুবক, আর অন্যজন কিশোর।
খুবই অমানবিক ব্যাপার। প্রযুক্তির এ-যুগে মানুষকে এখনো এভাবে কাজ করতে হয়।
এদেশের জন্য অবশ্য এ-দৃশ্য নতুন কিছু নয়।
আমরা কি এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারি না ইপি?
রিবিট তুমি পারো এবং করছ। তবে তোমার পক্ষে বৃহৎ কিছু করা কঠিন। কারণ বৃহৎ কিছু করার জন্য তোমাকে সৃষ্টি করা হয়নি। তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে স্বল্প পরিসরে মানুষের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে।
এটা কি আমার বিশাল সীমাবদ্ধতা নয়?
আমার বিশ্লেষণ সেরকম বলছে না। কারণ প্রাফেসর হক তোমাকে অনেক চিন্তা ভাবনা করে সৃষ্টি করেছেন। আমার বিশ্বাস তার চিন্তা-চেতনায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। তোমাকে যদি বৃহত্তর মঙ্গল সাধনের জন্য সৃষ্টি করা হত তাহলে তোমাকে নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে যেত। সেক্ষেত্রে তুমি হয়তো তোমার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারতে না, সত্যিকারের মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারতে না। আর…
ইপি কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই বুম শব্দের পর ধপ ধপ করে শব্দ হতে থাকল। সাথে সাথে ইপি বলল : কী হল? কী হল?
রিবিট বলল; ঠেলাগাড়ির চাকা বিস্ফোরিত হয়েছে। আর ঠেলাগাড়ির উপরের ইটগুলো নিচে গড়িয়ে পড়ছে।
রিবিট কথা শেষ করেই ওভারব্রিজের উপর থেকে দ্রুত নিচে নেমে এল। ব্রিজের ঠিক নিচে এসে থেমেছে ঠেলাগাড়িটা। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধলোকটি। সে ইটগুলোকে নিচে পড়ে যেতে দেখে হায়, হায়..করে চিৎকার করছিল। রিবিটকে দেখামাত্র সে তার চিৎকার বন্ধ করে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। আর অন্য দুজন চেষ্টা করছিল ঠেলাটাকে সোজা করতে, যেন ইটগুলো নিচে পড়ে না যায়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছিল না। ইটগুলো আগের মতোই ধপ ধপ করে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। তারা দুজনও রিবিটকে দেখে বৃদ্ধের মতোই ‘থ’ বনে গেল।
রিবিট অবশ্য প্রথমে কারো সাথেই কোনো কথা বলল না। ইপিকে শুধু বলল : ইপি, তুমি কি প্রস্তুত?
তুমি কী করতে যাচ্ছ রিবিট?
পাওয়ার অ্যাকটিভেট করো। লেভেল মিডিয়াম।
তোমার পাওয়ার অ্যাকটিভেট করা হয়েছে।
টায়ার বিস্ফোরিত হওয়ায় ঠেলাগাড়ির যে-পাশটি নিচু হয়েছিল রিবিট সরাসির সেই পাশে এসে ঠেলাগাড়িটিকে উঁচু করে ভারসাম্য রক্ষা করল। এতে ইট পড়া বন্ধ হলো ঠিকই, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হল না, কারণ ইট যা পড়ার তা আগেই নিচে পড়েছে।
কেউ কিছু করছে না দেখে রিবিট হালকা ধমকের স্বরে বলল : তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? তাড়াতাড়ি ঠেলাটির নিচে ইট দাও। আমি তো অনেকক্ষণ এভাবে ধরে রাখতে পারব না।
এবার যেন বাস্তবে ফিলে এল যুবক ছেলেটি। সে তাড়াতাড়ি কয়েকটি ইট এনে ঠেলাটির নিচে ঠেকনার মতো করে দিল। আর তাতে ঠেলাটিকে ছেড়ে দিতে পারল রিবিট। ঠেলাটি এখন প্রয়োজনীয় ভারসাম্য রক্ষা করে স্থিরভাবে একজায়গায় থাকতে পারছে।
এতক্ষণ চুপ থাকলেও আবারো বিলাপ করতে শুরু করল বৃদ্ধ : এখন আমার কী হবে গো? এই ঠেলা ঠিক কইরা কেমনে ইটগুলা উপরে উঠাব? হেরপর আবার ইট আনবার যাব? রাইতে কাম শেষ করবার পারব না গো, আমাগো না-খাইয়া থাহা লাগৰ গো…
রিবিট বুঝতে পারল এরা সবাই খুব বিপদে পড়েছে। তাই সে বৃদ্ধের দিকে। এগিয়ে এসে বলল : আপনি ভাববেন না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি আপনাদের সাহায্য করব।
বৃদ্ধ বিলাপ থামিয়ে রিবিটের দিকে তাকাল। তারপর আচমকাই বলল : আপনে কিডা?
আমি রিবিট। দশম মাত্রার একটি রোবট।
বৃদ্ধের অভিব্যক্তি দেখে মনে হল সে কিছুই বুঝতে পারেনি।
এবার কিশোর ছেলেটি বলল : বাপজান, এত কতা কইও না। কামে লাগো। আর একটা চাক্কা যেইডা আছে লাগান শুরু করো। নইলে কাম শেষ করবার পারবা না।
যুবকটি অবশ্য ইতিমধ্যে কাজে লেগে গেছে। ঠেলাগাড়ির নিচে একটি অতিরিক্ত টায়ার বিশেষভাবে বাঁধা ছিল। গাড়ি চালানোর সময় এভাবে যে টায়ার বিস্ফোরিত হতে পারে তা তারা আগে থেকেই অনুমান করে রেখেছিল। তাই এভাবে একটি অতিরিক্ত টায়ার রেখে দিয়েছে। রিটি অনুমান করল, সম্ভবত প্রত্যেক ঠেলাগাড়িতেই এরকম অতিরিক্ত টায়ার থাকে।
ঠেলাগাড়িতে চাকা লাগাতে রিবিটও সাহায্য করল। এরই ফাঁকে ফাঁকে রিবিট কথা বলেছে সবার সাথে। এরা তিনজনই একই পরিবারের সদস্য। একজন বাবা আর অন্যদুজন ছেলে। থাকে কমলাপুর বস্তিতে। ঠেলাগাড়ি চালিয়েই তাদের জীবন চলে। এত রাতে ঠেলাগাড়ি চালানোর কারণ জানতে চাইলে তারা জানায় দিনের বেলায় ঠেলা চালানো খুব কষ্ট। এমনিতেই রোদ থাকে, তার ওপর ট্রাফিক জ্যাম। অতিরিক্ত কষ্ট করতে হয়। তাছাড়া দিনের বেলায় অনেক পথ ঘুরে আসতে হয়। কারণ ভিআইপি রাস্তায় ঠেলা চালানো যায় না। এজন্য কষ্ট আরো বাড়ে।
টায়ার লাগানো শেষ হলে সবাই ঠেলাগড়িতে ইট তুলতে শুরু করল। রিবিট একাই এত ইট তুলছে যে অন্য তিনজন মিলে তা পারছে না। রিবিটের এ আচরণে সবাই খুব খুশি। অবশ্য রিবিট একটা বিষয় গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে। আর তা হল তিনজনেরই কথাবলার চেয়ে কাজের প্রতিই মনোযোগ বেশি। কারণটা ঠিকই বুঝতে পারল সে। এরা সবাই ব্যস্ত কাজ শেষ করতে। কাজ শেষ না হলে প্রয়োজনীয় অর্থ আয় করতে পারবে না। আর আয় করতে না পারলে আগামীকাল হয়তো খাওয়াও হবে না।
এরই মধ্যে পুলিশের একটি ডবল কেবিন পিক-আপ এসে হাজির। পিক-আপটি থামার সাথে সাথে সামনের দরজা দিয়ে একজন পুলিশ নেমে এসে অনেকটা ধমকের স্বরে বৃদ্ধকে বলল : এ্যাই, আপনারা এখানে ঠেলাগাড়ি থামিয়েছেন কেন?
বৃদ্ধ উত্তর দেয়ার আগে রিবিটই বলল : ওনাদের ঠেলাগাড়ির টায়ারটি বিস্ফোরিত হয়েছিল।
রিবিটকে দেখে কিছুটা দমে গেল পুলিশ। এরই মধ্যে পিছনের দরজা দিয়ে সাদা পোশাক পরা অল্পবয়সী অন্য একজন পুলিশ-সদস্য নেমে এল। দেখে মনে হল
অফিসারই হবে। সে সরাসরি রিবিটের সামনে এসে বলল; রিবিট, তুমি এখানে?
হ্যাঁ, আমি ওনাদেরকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছি। এতগুলো ইট তুলতে সবার অনেক সময় লেগে যাবে।
চমঙ্কার। মৃদু হেসে বলল অফিসার। তারপর বলল : আমি শাহেদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ডিবি। সবাই আমাকে এসি শাহেদ বলেই চিনে। রাতে অপারেশনে বেরিয়েছিলাম, তোমাকে দেখে থামলাম।
ধন্যবাদ।
আমি আগে সবসময় তোমাকে টেলিভিশনে কিংবা পত্রিকায় দেখেছি। বাস্তবে দেখিনি। আজই প্রথম দেখলাম! তোমার সাথে পরিচিত হয়ে আমি খুব আনন্দিত রিবিট।
আমিও তোমার মতো তরুণ অফিসারের সাথে পরিচিত হয়ে সত্যি আনন্দিত। তোমার মতো তরুণ আর উদ্যমী অফিসারদের আমি খুব পছন্দ করি।
ধন্যবাদ রিবিট। আমরা কি তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারি?
তার বোধহয় প্রয়োজন হবে না। আমরা প্রায় কাজ শেষ করে এনেছি।
রিবিট, আমার অফিসে তোমার আমন্ত্রণ রইল। তুমি এলে আমি খুব খুশি হব।
প্রয়োজন হলে অবশ্যই আসব।
তাহলে আজ বিদায়। যদি কখনো মনে হয় আমার সাহায্য তোমার প্রয়োজন, আমাকে জানিও। তোমার সাথে কাজ করতে পারলে আমি সত্যি খুব খুশি হব।
আমি অবশ্যই তোমাকে জানাব।
আমার মোবাইল নম্বরটা রেখে দিতে পারো। তোমার নম্বর অবশ্য আমার কাছে আছে।
আমার নম্বর তুমি পেলে কোথায়?
পত্রিকা থেকে। পত্রিকার লোকজন তোমার নম্বর ছেপে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস ঢাকা শহরের প্রায় সবার কাছেই তোমার নম্বর আছে।
এই বলে শাহেদ তার নম্বর বলল। তারপর রিবিটের সাথে হ্যান্ডশেক করে চলে গেল।
শাহেদ যে মিথ্যা বলেনি তা রিবিট জানে। ঢাকা শহরে সবার কাছে না-থাকলেও অধিকাংশ শিশু-কিশোরদের কাছে যে তার নম্বর আছে এ-বিষয়ে সে নিশ্চিত। প্রতিনিয়তই তার কাছে একটার-পর-একটা ফোন আসতে থাকে। এই ফোনগুলোর উত্তর দিতেই ইপির সময় কেটে যায়। প্রথম প্রথম এত ফোন আসত যে ইপি সেগুলো রিসিভ করার সময় পর্যন্ত পেত না। ইদানীং ফোন আসা কিছুটা কমেছে। তারপরও দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় ইপিকে ফোনের উত্তর দিতে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে কীভাবে যে নম্বরটা এভাবে ছড়িয়ে পড়ল তা সত্যিই জানা নেই রিবিটের। মিডিয়ার ভূমিকা তো আছেই। কিন্তু তারা যে কীভাবে নম্বরটা পেল আর কেনই বা এভাবে নম্বরটা সবাইকে দিয়ে দিল তার কোনো যুক্তি খুঁজে পায়নি রিবিট। তবে এটা সত্য, ফোন পেয়ে সে বিরক্ত হয় না। এতে বরং আরো ভালোই হয়েছে। সবাই তাকে সহজে খুঁজে পায়।
কথার ফাঁকে ফাঁকে এতক্ষণ কাজ করেছে রিবিট। রিবিটের সাহায্যের কারণেই এত অল্পসময়ে ইটগুলো ভোলা সম্ভব হয়েছে ঠেলাগাড়িতে। ইট ভোলা শেষ হলে বৃদ্ধসহ সবাই কৃতজ্ঞতার চোখে তাকাল রিবিটের দিকে। রিবিটও হাত নেড়ে কৃতজ্ঞতার জবাব দিল। তারা আর অপেক্ষা করল না। ঠেলাগাড়ি নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকল সামনের দিকে। আজ রাতে তাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে, তা না হলে আগামীকাল হয়তো ঠিকমতো খাবার জুটবে না।
.
২.
সকাল নয়টা। রিবিট উদ্দেশ্যহীনভাবে নিউমার্কেটের চারপাশ দিয়ে হাঁটছে আর কথা বলছে ইপির সাথে। নিউমার্কেটের পিছনে রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তূপ দেখে খানিকটা হতাশ হয়েই সে বলল : ঢাকার সবাই রাস্তাঘাট এভাবে নোংরা করে রাখে কেন?
এখানকার মানুষেরা সচেতন নয় এজন্য। তুমি লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে ডাস্টবিনের মধ্যে যতটা না ময়লা আছে, তার থেকে বাইরে আছে বেশি। উত্তরে বলল ইপি।
হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। সবার মধ্যে শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রবণতা কম। সকলকে এ বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে ভালো হত।
তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু অবাক ব্যাপার হল শিক্ষিত মানুষেরাও অশিক্ষিত মানুষের মতো কাজ করে। তার অন্যতম উদাহরণ হল সিটি কর্পোরেশন। তুমি লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে ডাস্টবিন বা ময়লার কন্টেইনারগুলো সব রাস্তার মাঝে। ফলে রাস্তায় যেমন এদিক-ওদিক ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে তেমনি যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ এই কন্টেইনারগুলো রাস্তার কোণায় বা সুবিধাজনক স্থানে হওয়া উচিত ছিল।
এক্ষেত্রে আমাদের কী করার আছে?
এক্ষেত্রে আমাদের অনেককিছুই করার আছে। তবে সবকিছু আমাদের হাতে নেই। যাইহোক, আমার বিশ্লেষণ বলছে এ-মুহূর্তে তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে একটা ই-মেইল পড়া। তিশা নামের একটি মেয়ে তোমাকে একটি মেইল পাঠিয়েছে।
তুমি আমাকে মেইলটি পড়ে শোনাও।
ইপি মেইলটি পড়তে শুরু করল।
প্রিয় রিবিট,
আমার নাম তিশা। আমি তোমার একজন খুব ভালো বন্ধু। আমি ‘ধানমণ্ডি লিটল মুন’ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। বিশেষ কারণে তোমার সাহায্য আমাদের খুব প্রয়োজন। গতকাল আমার আব্দুর কাছে ‘কালোমানুষ’ নামের কেউ একজন ফোন করে দশ লক্ষ টাকা চেয়েছে। ‘কালোমানুষ’ বলেছে সে খুব ভয়ংকর, টাকা না দিলে সে আমাকে মেরে ফেলবে। আর পুলিশকে জানালে বেশি ক্ষতি হবে। আমার আবু-আম্মু খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এত টাকা দেয়ার মতো আর্থিক ক্ষমতা তাদের নেই। রিবিট, প্লিজ আমাদের সাহায্য করো। আমি জানি একমাত্র তুমিই আমাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে। উল্লেখ্য, কালোমানুষ আরো বলেছে যে ঘটনাটি পুলিশকে জানালে মহাবিপদ ঘটবে। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।
তোমার প্রিয় বন্ধু
তিশা
ইপি মেইলটি পড়া শেষ করলে রিবিট বলল, ইপি, আমার এখন কী করা উচিত?
তোমার অবশ্যই উচিত তিশাকে সহায্য করা।
কিন্তু তিশার ঠিকানা তো নেই।
তা নেই, তবে স্কুলের নাম তো আছে।
হ্যাঁ আছে। কিন্তু আমি আমার প্রোগ্রামের অভ্যন্তরে ঢাকার যে ম্যাপ আছে সেটা পরীক্ষা করে দেখেছি। কোথাও ধানমণ্ডি লিটল মুন স্কুল খুঁজে পেলাম না।
হতে পারে স্কুলটি নতুন। এ কারণে ম্যাপে স্কুলটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
তাহলে আমরা এখন কী করতে পারি?
আমার বিশ্লেষণ বলছে স্কুলটিকে খুঁজে পেতে আমাদের খুব একটা সমস্যা হবে না। ধানমণ্ডি এলাকায় যে-কোনো স্কুলে যেয়ে আমরা যদি লিটল মুন স্কুলের কথা জিজ্ঞেস করি নিশ্চয় আমরা স্কুলের অবস্থান জানতে পারব। তারপর স্কুল খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না।
ধানমণ্ডি এসে লিটল মুন স্কুল খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হল না রিবিটের। ইপির পরামর্শ অনুসারে একটি স্কুলের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই বলে দিল লিটল মুন স্কুলের ঠিকানা। লিটল মুন স্কুলটি মাত্র তিনবছর পূর্বে স্থাপিত হয়েছে। এ-কারণে স্কুলের নাম ঢাকার মূল ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সহজে স্কুল খুঁজে পেলেও বিপত্তি বাধল তিশাকে খুঁজে পেতে। তিশা আজ স্কুলে আসেনি। শেষে রিবিট প্রধানশিক্ষিকার সাথে দেখা করতে তার কক্ষে প্রবেশ করল। রিবিট প্রধানশিক্ষিকার কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি বললেন : তুমিই তাহলে সেই রোবট যে কিনা দিন-রাত ছন্নছাড়ার মতো পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়াও?
রিবিট খানিকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, জি..জি ম্যাডাম। আমার নাম রিবিট।
আমি তো তোমার নাম জিজ্ঞেস করিনি। তোমার নাম রিবিট না ফিবিট তা তো আমার জানার দরকার নেই।
রিবিট সত্যি আহত হল। সে আগে কারো কাছ থেকে এ-ধরনের ব্যবহার পায়নি। আর একটি স্কুলের প্রধানশিক্ষিকার কাছ থেকে এ-ধরনের আচরণ সে কল্পনায়ও আশা করেনি।
প্রধানশিক্ষিকা আবার প্রশ্ন করলেন : তুমি কেন আমার কাছে এসেছ?
রিবিট সরাসরি কথা বলারই সিদ্ধান্ত নিল। সে বলল : আমি তিশা নামের একটি মেয়ের ঠিকানা জানতে এসেছি।
তিশা! জ কুঁচকে বললেন প্রধানশিক্ষিকা।
হ্যাঁ তিশা। আপনার স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী।
তুমি তো জানোই তিশা পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। তাহলে ওর কাছে যাচ্ছ না কেন? আমার কাছে এসেছ কেন?
তিশা তো স্কুলে আসেনি।
তিশা স্কুলে আসেনি?
না আসেনি।
কেন আসেনি? চিৎকার করে উঠে বললেন প্রধানশিক্ষিকা। তার চিৎকারের ধরন শুনে মনে হল তিশার স্কুলে না-আসার জন্য যেন রিবিটই দায়ী।
রিবিট অবশ্য কিছু বলল না। সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। রিটিকে এভাবে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রধানশিক্ষিকা এবার আগের মতোই রুক্ষ গলায় বললেন : তিশার ঠিকানা তোমার কেন প্রয়োজন?
তিশা সমস্যায় আছে। আমি তিশাকে সাহায্য করতে চাই।
তিশার বাবা-মা আছে। তিশার সমস্যা থাকলে তারাই তিশাকে সাহায্য করবে। তুমি কেন তিশাকে সাহায্য করতে যাবে?
আমি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আপনাকে বোঝাতে পারব না ম্যাডাম। আমার তিশার ঠিকানাটা প্রয়োজন। আপনি যদি..
না না। আমি তোমাকে তিশার ঠিকানা দেব না। তুমি একটি রোবট। তোমার মতিগতি ভালো না। আমি শুনেছি তুমি বাঁদরের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াও। তোমার কোনো কাজকর্ম নেই। এরকম এক ভবঘুরে রোবট তিশাকে সাহায্য করবে তা আমার বিশ্বাস হয় না।
রিবিট সত্যি খুব আহত হল। আগে কখনো কেউ তাকে উদ্দেশ্য করে এরকম আপত্তিকর মন্তব্য করেনি। সে ঠিক করল প্রধানশিক্ষিকার সাথে আর কোনো কথা বলবে না। তাই সে বাইরে বেরিয়ে এল।
কিছুটা পথ আসতেই পিছন থেকে কেউ একজন ‘রিবিটা’ ‘রিবিট’ বলে ডেকে উঠল।
রিবিট ফিরে তাকাতে দেখে ছোটখাটো সুন্দর দেখতে একজন ভদ্রমহিলা তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভদ্রমহিলা কাছে এসে খুব মিষ্টি স্বরে বলল : রিবিট, আমি মিস পিয়াল। তিশার শিক্ষক।
আমি আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে সত্যি খুব আনন্দিত। মোলায়েম গলায় বলল রিবিট।
আমি জানতে পেরেছি আপনি তিশাকে খুঁজছিলেন।
হ্যাঁ। আমি এজন্য আপনাদের প্রধানশিক্ষিকার সাথে এ-ব্যাপারে কথা বলেছি। কিন্তু..
রিবিটকে শেষ করতে না দিয়ে মিস পিয়াল বলল : হা হা আমি শুনেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। আমাদের প্রধানশিক্ষিকা খানিকটা ভিন্ন মেজাজের। কিন্তু তার মনটা সুন্দর। এই স্কুলে তার অবদান অবিস্মরণীয়। যাইহোক, যা বলছিলাম- আমি আপনাকে তিশার ঠিকানা দিচ্ছি।
আপনি আমাকে ঠিকানা দেবেন! অবাক হয়ে বলল রিবিট।
হ্যাঁ আমি দেব। আমি জানি আপনি কখনোই তিশার কোনো ক্ষতি করবেন না। তিশা বিপদে আছে জেনে আমি নিজেই উৎকণ্ঠিত। আশা করছি আপনি তিশাকে সাহায্য করতে পারবেন।
এই বলে মিস পিয়াল একটু সময় নিল। তারপর বলল : আমি আসলে কলম আনতে ভুলে গেছি। আমি যে আপনাকে ঠিকানাটা লিখে দেব সেই উপায় নেই। আপনি একটু দাঁড়ান, আমি কলম নিয়ে আসছি।
না না, আপনাকে কলম আনতে হবে না। আপনি বলুন, তাতেই হবে।
আ..আপনি যদি ভুলে যান।
না ভুলব না। আমি আমার মেমোরিতে সেইভ করে রাখব।
ওহ তাই বলুন। আপনার তো বিশেষ ক্ষমতা আছে। আপনি যা একবার শোনেন তা বছরের-পর-বছর মনে রাখতে পারেন। সত্যিই রিবিট, আমি আপনার ক্ষমতায় বিস্মিত।
আমার ক্ষমতায় বিস্মিত হবেন না। সত্যি যদি বিস্মিত হতে হয়, মানুষের ক্ষমতায় বিস্মিত হবেন। মানুষই আমাকে সৃষ্টি করেছে। কাজেই আমার মধ্যে যা-কিছু আছে তা মানুষের অসাধারণ বুদ্ধির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কথাগুলো খুবই বিনয়ের সাথে বলল রিবিট।
মিস্ পিয়াল এবার চোখ বড় বড় করে বলল : আপনি সত্যিই অসাধারণ। আপনি শুধু বিশেষ ক্ষমতার অধিকারীই নন, আপনি অত্যন্ত মার্জিত এবং বিনয়ীও বটে।
আপনাকে ধন্যবাদ। এবার তিশার ঠিকানাটা দেবেন কি?
ও.. হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই বলে মিস পিয়াল রিবিটকে তিশার ঠিকানা বলল।
রিবিট ঠিকানাটা শোনার পর নিজে থেকেই একবার হুবহু বলল। তারপর বলল, ঠিক আছে?
মিস্ পিয়াল মৃদু হেসে বলল : রিবিট ভুল করতে পারে আমার বিশ্বাস হয় না।
আপনি ঠিকই বলেছেন। মেশিন সহজে ভুল করে না।
আমার বিবেচনায় আপনি কখনোই মেশিন নন। আপনি একজন পরিপূর্ণ মানুষ।
যদিও আমি মানুষ নই কিংবা মানুষের সমকক্ষ নই, তথাপি আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ মিস্ পিয়াল।
আমি আশা করছি আপনি তিশার উপকার করতে পারবেন। তিশাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবেন।
আমি চেষ্টা করব। আজ তাহলে আসি।
রিবিট এবং মিস্ পিয়ালের মধ্যে আর কোনো কথা হল না। রিবিট হেঁটে সরাসরি গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আর মিস্ পিয়াল একদৃষ্টিতে রিবিটের পথের দিকে তাকিয়ে থেকে ফিরে গেল নিজের ক্লাসে।
.
৩.
রিবিট যখন তিশাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তখন সকাল দশটা বাজে। বাড়ি খুঁজে পেতে তাকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। তিশাদের বাড়ি ধানমণ্ডিতেই, স্কুল থেকেও কাছে। দূরত্ব এক কিলোমিটার মতো হবে। রিবিট এই পথটুকু হেঁটেই এসেছে।
তিশাদের বাড়িটা ছোট্ট দোতলা। বাড়ির সামনে খানিকটা জায়গা থাকলেও মূল বাড়িটা বেশ ছোট, পুরাতনও বটে। বাইরের দেয়ালে অনেকদিন রঙের ছোঁয়া পড়েনি। বোঝা যাচ্ছে অনেক আগে তৈরি করা হয়েছে বাড়িটা। আর এ-বাড়িতে যে থাকে তার অবস্থা যে খুব ভালো নয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
বাইরের গেটটি লোহার। গেটের সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল রিবিট। অভ্যন্তরীণ প্রোগ্রামে বিশ্লেষণ করল ভিতরে প্রবেশ করে কীভাবে কথা বলবে বাসার সবার সাথে। তবে বেশিক্ষণ সে বিশ্লেষণ করতে পারল না। তার আগেই দেখতে পেল ভিতরের দরজা থেকে বাইরের গেটের দিকে দশ-এগারো বছরের সুন্দর একটি মেয়ে ছুটে আসছে। গেটের সামনে এসে মেয়েটি দ্রুতহাতে গেট খুলে খুপ করে রিবিটের হাত ধরে বলল : রিবিট তুমি আসবে আমি জানতাম।
রিবিট তার বিশ্লেষণী ক্ষমতায় বুঝতে পারল এই মেয়েটিই তিশা। তাই সে বলল। তুমি নিশ্চয় তিশা?
একদম ঠিক। আমি জানি রিবিট তুমি ভুল করতে পারো না।
তাই বুঝি!
হ্যাঁ। আমি এও জানি যে তুমি ছাড়া আর কেউ আমাদের সাহায্য করতে পারবে না। এজন্য আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। আমি জানতাম তুমি আসবে।
রিবিট অবাক হওয়ার ভান করে বলল : আমার উপর দেখছি তোমার অগাধ আস্থা।
শুধু আমারই, সবারই তোমার উপর অগাধ আস্থা। আমার সকল বন্ধুরা তোমাকে দারুণ ভালোবাসে। তোমার কথায় আমরা সবাই পাগল। তুমি আমাদের বাসায় এসেছ, আমি যে কী খুশি হয়েছি তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমি নিশ্চিত তুমি আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
তোমাদের সমস্যাটি কী তিশা?
আগে বাসার মধ্যে এসো, তারপর বলছি।
তোমাদের বাসায় আর কে কে আছে?
বাবা মা, দাদু সবাই। এসো, এসো।
রিবিটের হাত ধরে তিশা রিটিকে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে থাকল। রিবিটকে পেয়ে তিশার যেন উৎসাহের শেষ নেই। তার প্রতিটি আচরণে সেই বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট।
বাসার ভিতরে প্রবেশ করতে বয়স্কমতো একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তিনি রিবিটকে দেখে প্রথমে থমকে গেলেও পরে নিয়ন্ত্রণ করলেন নিজেকে। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বললেন : আ..আ..পনি রিবিট না?
হ্যাঁ আমি রিবিট। খুব স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল রিবিট।
আ..আ..আমি কল্পনা করতে পারছি না আপনি এখানে। বিস্ময়ের ভঙ্গিতে বললেন ভদ্রলোক।
আমিই তো আসতে বলেছি দাদু। আমি নিশ্চিত রিবিট আমাদের সাহায্য করতে পারবে।
বয়স্ক ভদ্রলোক এবার রিৰিটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন : আমি তিশার দাদু। আমার নাম সোবহান আহমেদ।
রিবিট সোবহান সাহেবের সাথে হ্যান্ডশেক করতে ঘরের মধ্যে আরো দুজন এসে প্রবেশ করল। রিবিট দুজনকে দেখে বুঝতে পারল, এনারাই তিশার বাবা-মা। তবে দুজনকেই খুব অল্পবয়সী মনে হল তার কাছে।
তিশার বাবা-মা তিশার দাদুর মতো অবাক হলেও পরিচয়ের পর দুজনই স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল। কিন্তু তারা পারল না। রিবিটের কাছে তাদের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপটা স্পষ্ট ধরা পড়ল। রিবিট বুঝতে পারল এ-বাসায় এমন কিছু ঘটেছে যা স্বাভাবিক নয়।
পরিচয়-পর্ব শেষে রিবিট তিশার বাবা সুমন আহমেদকে বলল : আমি যতদূর জেনেছি আপনারা সম্ভবত কোনো ঝামেলার মধ্যে আছেন। বিষয়টা যদি আমাকে একটু খুলে বলতেন।
কিসের ঝামেলা! অবাক হওয়ার ভান করে বলল সোবহান সাহেব। সোবহান সাহেব অবশ্য ছেলে সুমনকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না।
কেউ বোধহয় আপনাদের কাছে অর্থ দাবি করেছে। অর্থ দাবি?
না না। এমন কিছু ঘটেনি। জোর দিয়ে বললেন সোবহান সাহেব।
এবার তিশা বলল : টেলিফোনে কালোমানুষ….
কী বলছ তিশা! মৃদু ধমকে উঠে বলল তিশার মা মুনা।
রিবিট মুনার দিকে তাকাতে সে আবার বলল : ও ছোট মানুষ, আপনাকে কী সব বলেছে। তারপর তিশার দিকে ফিরে বলল : তুমি যা দুষ্ট হয়েছ না তিশা! রিবিট সাহেবকে এভাবে মিথ্যাকথা বলে বাসায় না-আনলেই পারতে। আমন্ত্রণ করলে রিবিট সাহেব এমনিতেই আমাদের বাসায় আসতেন।
আমি মিথ্যা বলিনি। সত্য বলেছি। জোর দিয়ে বলল তিশা।
আবারো মিথ্যাকথা! রিবিট সাহেব আপনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। আজকাল মেয়েটা যা দুষ্ট হয়েছে না! শুধু মিথ্যাকথা বলে। যাও ভিতরে যাও, আর একমুহূর্তও এদিকে থাকবে না।
তিশা অসহায় দৃষ্টিতে রিবিটের দিকে তাকাল। মুনা আবারো ধমকে উঠে বলল : যাও, ভিতরে যাও বলছি।
তিশা এবারো নড়ল না।
মুনা এবার নিজেই উঠে এসে তিশাকে অনেকটা জোর করে ভিতরে নিয়ে গেল। ব্যাপারটা ভালো লাগল না রিবিটের। সম্পূর্ণ ব্যাপারটার মধ্যে বিশেষ এক রহস্যের গন্ধ পেল সে।
তিশাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল সবাই। অবশেষে রিবিটই প্রথমে কথা বলল : তিশা আজ স্কুলে যায়নি কেন?
ইয়ে..মানে.. ওর শরীরটা ভালো নেই। আমতা-আমতা করে বললেন সোবহান সাহেব।
কিন্তু তিশাকে দেখে তো মনে হল সম্পূর্ণ সুস্থ।
আসলে গতরাতে হালকা জ্বর এসেছিল।
কিন্তু আপনি অফিসে যাননি কেন? আপনি তো কিছুক্ষণ আগে বলেছেন আপনি একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরি করেন। এবার তিশার বাবার দিকে ফিরে বলল রিবিট।
মেয়ে অসুস্থ, এজন্য যায়নি। নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল সুমন।
ও আচ্ছা। রিবিট মুখে বলল ঠিকই কিন্তু সে নিশ্চিত সুমন সত্যকথা বলছে না। কিন্তু কেন বলছে না সেটাই সে বুঝতে পারছে না।
এবার প্রশ্ন করলেন সোবহান সাহেব : আপনি আমাদের বাসায় হঠাৎ কী মনে করে?
তিশা আমাকে একটি ই-মেইল পাঠিয়েছিল। ই-মেইলে লেখা ছিল আপনাদের কাছে ‘কালোমানুষ’ নামে কেউ একজন দশলক্ষ টাকা চাদা দাবি করেছে। চাদা না দিলে কালোমানুষ আপনাদের ক্ষতি করবে। এমনকি তিশাকে পর্যন্ত মেরে ফেলতে পারে। আর এ ব্যাপারে পুলিশকে জানাতে নিষেধ করেছে তারা।
না না, কী যে বলেন! আর এত টাকা আমাদের কাছে কেউ চাইবেই বা কেন? আমাদের কি এত টাকা আছে? কোনোমতে আমি এই বাড়িটা করেছিলাম। এখানেই থাকি। সুমন চাকরি করে যা পায় তাতেই আমাদের সংসার চলে। আমাদের সাথে কারো শত্রুতাও নেই। আমাদের কাছে কেউ টাকা চাইতে যাবে কেন? তাও আবার দশ লক্ষ টাকা। কী যে বলেন আপনি! হো.. হো.. হো..। হেসে প্রায় সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করলেন সোবহান সাহেব।
রিবিট অবশ্য বুঝতে পারল সোবহান সাহেবের হাসিটা কৃত্রিম।
হঠাই টেলিফোন বেজে ওঠায় একই সাথে চমকে উঠল সোবহান সাহেব এবং তার ছেলে সুমন। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না রিবিটের। সোবহান সাহেব এবং তার ছেলের যে চোখাচোখি হল সেটাও বুঝতে পারল সে। টেলিফোন আসলে কখনোই স্বাভাবিক মানুষের এ-ধরনের আচরণ করার কথা নয়।
অবশেষে সোবহান সাহেবই উঠে গেলেন। ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন একনাগাড়ে কিছু কথা বলে গেল। তারপর সোবহান সাহেব যখন আবার ‘হ্যালো’ বললেন, ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দিল কেউ। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পারল রিবিট। আর এই পুরো সময়টা সুমন তার বাবার দিকেই তাকিয়ে ছিল। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। কাউকে বসিয়ে রেখে নিশ্চয় কেউ টেলিফোনে কথা বলতে থাকা অন্য কারো দিকে তাকিয়ে থাকবে না।
রিবিট লক্ষ্য করল টেলিফোনে কথা বলার পর সোবহান সাহেবের মুখটা একেবারে মলিন হয়ে গেছে। তিনি সোফায় এসে বসতে রিবিট জিজ্ঞেস করল : কী ব্যাপার, কিছু হয়েছে?
না না, কিছু হয়নি। সবকিছু ঠিকই আছে। অন্যমনস্কভাবে বললেন সোবহান সাহেব।
কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কিছু নিয়ে চিন্তিত।
চিন্তিত তো হতেই হয়। জিনিসপত্রের যে দাম, আর যে দিনকাল পড়েছে তাতে চিন্তিত না হয়ে উপায় আছে।
রিবিট বুঝতে পারল সোবহান সাহেব ইচ্ছে করেই তাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন না। তাই সেও আর জোরাজুরি করল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল : আমি তাহলে আসি।
ঠিক আছে। এবার কথা বলল সুমন।
যদি কখনো মনে করেন আমাকে আপনাদের প্রয়োজন তাহলে আমাকে ফোন করবেন। আমি আপনাদের টেবিলে আমার ফোন নম্বরটা রেখে যাচ্ছি।
আচ্ছা। নির্লিপ্ত উত্তর সুমনের।
রিবিট আর কোনো কথা বলল না। সে সরাসরি বাইরে বেরিয়ে এল। সে বুঝতে পারছে যে-কোনো কারণেই হোক তার উপস্থিতিকে তিশা ছাড়া বাড়ির অন্য কেউ ভালোভাবে মেনে নিচ্ছে না। তবে সে নিশ্চিত, বাড়ির সবাই কোনো-না-কোনো বিপদে আছে। সে ঠিক করল, যেভাবেই হোক সাহায্য করবে এই পরিবারকে।
.
৪.
রিবিট তিশাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াল। তার মূল প্রোগ্রামে এখন ইলেকট্রনের গতি অনেক বেশি। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এখন সে বিশ্লেষণ করছে। তিশাদের বাড়ির সকলের রহস্যময় আচরণের মূল রহস্য কী এ-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে ডেকে উঠল; ইপি।
সাথে সাথে সাড়া দিল ইপি। বলল : রিবিট, আমি বুঝতে পারছি তুমি কী চিন্তা করছ?
তুমি কি সত্যি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ রিবিট। আমার বিশ্লেষণ এই সিদ্ধান্ত প্রদান করছে যে তুমি তিশাদের বাড়ির সকলের আচরণের মূল রহস্য উন্মোচন করতে চেষ্টা করছ।
চমৎকার ইপি। তোমার বিশ্লেষণ একশত ভাগ সত্য। ইপি, আমার সত্যি তোমাকে হিংসা করতে ইচ্ছে করে।
আমি দুঃখিত রিবিট। তোমার কাউকে হিংসা করার ক্ষমতা নিতান্তই কম। যাইহোক, আমি কি জানতে পারি কেন আমার প্রতি হিংসা হচ্ছে তোমার?
কারণ তুমি আমার সবকিছু জেনে যাচ্ছ।
কিন্তু আমি তোমার নিয়ন্ত্রণাধীন। তুমি যেভাবে খুশি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো।
তা পারি। কিন্তু আমি তো তোমাকে কখনোই নিয়ন্ত্রণ করছি না। তুমি স্বাধীন।
আমি স্বাধীন নই রিবিট। আমি নির্দিষ্ট কিছু প্রোগ্রামের নির্দেশনার মধ্যে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারি মাত্র। সত্যিকারের অর্থে স্বাধীন হচ্ছ তুমি। তুমি মানুষের মতোই চিন্তাভাবনা করতে পারো। সীমাহীন তোমার চিন্তার ক্ষমতা।
হতে পারে। যাইহোক, যা বলছিলাম। তুমি যেমন আমার বিশ্লেষণ বুঝতে পারো তেমনি আমি চাইছিলাম মানুষের চিন্তাচেতনা বুঝতে। আমি যদি মানুষের ভাবনা বুঝতে পারতাম তাহলে তিশাদের বাড়ির কার মনে কী আছে তা আজ সত্যি জানতে পারতাম।
তুমি অলীক এবং অবাস্তব কল্পনা করছ যা তোমার মূল প্রোগ্রামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
হয়তো তাই। কিন্তু তুমি জানো আমার চিন্তার ব্যাপ্তি সীমাহীন। এই কারণেই এই চিন্তা করতে পারছি।
এ-মুহূর্তে তুমি তোমার অলীক কল্পনা থেকে বিরত থাকতে পারো। তোমার এখন উচিত তিশাদের বাড়ির মূল সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা এবং তিশাদের সাহায্য করা।
কীভাবে সাহায্য করব? তিশাদের বাড়ির কেউই তো আমার সাহায্য কামনা করছে।
আমার বিশ্লেষণ বলছে সবাই ভয় পাচ্ছে। যেহেতু কালোমানুষ হুমকি প্রদান করেছে এজন্য কেউ ভয়ে তোমার সাহায্য আশা করছে না।
কিন্তু আমি তো খুব সতর্কতার সাথে এগিয়েছি।
তা এগিয়েছ, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একমাত্র তিশা ছাড়া কেউ তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
আমি তাহলে কী করতে পারি?
যেভাবেই হোক তিশার কাছ থেকে তোমার শুনতে হবে।
কীভাবে ওর কাছে পৌঁছাব? ও ছোট মানুষ, ওর বাবা মা কিছুতেই আমার কাছে ওকে আসতে দেবে না।
তোমার কথায় যুক্তি আছে।
আমরা কি পুলিশকে জানাতে পারি না? পুলিশ নিশ্চয় ওদেরকে সাহায্য করবে। বলল রিবিট।
তা করবে। কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ ব্যাপার সম্পর্কে নিশ্চিত নই।
কিন্তু তিশা কি আমাকে মিথ্যা বলবে? সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করল রিবিট।
আমার বিশ্লেষণ বলছে করবে না। কিন্তু আবার করতেও তো পারে। অনেক ছেলেমেয়েরা তো তোমার সাথে দুষ্টুমি করে।
তা করে। কিন্তু তিশাকে আমার সেরকম মনে হয়নি। তিশা কোনো দুষ্টুমিই করেনি। বরং তিশাকে আমাদের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়া, তিশার স্কুলে না-যাওয়া, তিশার বাবার অফিসে না-যাওয়া– সবই আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।
হ্যাঁ, এগুলো অস্বাভাবিকই বটে। আর এই অস্বাভাবিকতা প্রমাণের জন্য তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। গোয়েন্দাগিরিতে অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন হয়।
আমি তো গোয়েন্দা নই।
তা নও। তবে এ মুহূর্তে তুমি যে কাজটি করছ বা করতে যাচ্ছে তা গোয়েন্দাগিরির থেকে কোনো অংশে কমকিছু নয়। তুমি তাত্ত্বিক দিকে চলে যাচ্ছ ইপি।
আমি দুঃখিত রিবিট। যাইহোক যে কথা বলছিলাম, তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে।
কীভাবে এবং কীজন্য?
আমার বিশ্লেষণ বলছে তিশার দাদা কিংবা বাবা কেউই যেহেতু তোমাকে কিছু বলেনি সেহেতু পুলিশকেও তারা কিছু বলবে না। অর্থাৎ তারা কালো মানুষের সাথে সমঝোতায় আসবে।
এই কালোমানুষ আসলে কারা?
আমি ইন্টারনেটে কালোমানুষ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাইনি। হতে পারে এরা হয়তো নতুন-গড়ে-ওঠা কোনো সন্ত্রাসী দল যাদের মূলকাজই হচ্ছে মানুষকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে চাঁদা আদায় করা। নিরীহ মানুষ ভয়ে পুলিশ কিংবা অন্য কাউকে কিছু না। বলে এই কালোমানুষকে বা মানুষদেরকে চাঁদা দিয়ে দেয় এবং এভাবেই কালো মানুষেরা বেঁচে থাকে।
কিন্তু তাতে লাভ কী? কালো মানুষেরা তো ঐ একই লোকের কাছে আবারো চাদা চাইবে।
তাই তো হচ্ছে। মানুষ আজ সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে। সত্যি যদি এদেশকে সন্ত্রাসী আর চাঁদাবাজ মুক্ত করা যেত তাহলে দেশটির অনেক উপকার হত। অনেক লোক শান্তিতে বসবাস করতে পারত, অনেক..
ইপি কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই রিবিট বলল : তুমি তো দেখি এখন দর্শনের কথার দিকে ধাবিত হচ্ছ।
ঠিক আছে রিবিট। যা বলছিলাম, যদি সত্যি তিশার বাসার সবাই কালো মানুষের সাথে সমঝোতায় আসে তাহলে কী ঘটতে পারে একবার বিশ্লেষণ করে দ্যাখো। তিশার দাদা কিংবা বাবাকে মোটা অঙ্কের টাকা কালোমানুষকে দিতে হবে এবং তা খুব অল্পসময়ের মধ্যেই। নিশ্চয় তিশাদের বাসায় এত টাকা থাকবে না। সেক্ষেত্রে কী ঘটবে? তিশার দাদা কিংবা বাবা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আনবে। আর এই সুযোগের অপেক্ষায়ই থাকতে হবে তোমাকে। যদি সত্যি দেখা যায় তারা টাকা তুলছে তাহলে তুমি বুঝতে পারবে তিশা তোমাকে সত্য বলেছে।
তাহলে আমার এখানে অপেক্ষা করাই সমীচীন হবে।
কিন্তু তোমার নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে।
কেন?
তোমাকে অনেকেই চিনে। তুমি যেখানেই অপেক্ষা করবে সেখানেই মানুষের একটা জটলা হয়ে যাবে। আমার বিশ্লেষণ বলছে আশেপাশে কোথাও কালো মানুষের দলের কেউ থাকবে। সে যদি তোমাকে দেখে ফেলে তাহলে অবশ্যই সে সন্দেহ করবে। তুমি যে তিশাদের বাড়ি থেকে বের হয়েছ এ ব্যাপারটাও দেখে ফেলেছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। যাইহোক, এখন থেকে তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ ইপি। আমি এক কাজ করতে পারি। সামনের ঐ নির্মাণাধীন পরিত্যাক্ত তিনতলা বাড়ির দোতলায় অপেক্ষা করতে পারি।
তা পারো। তবে তোমাকে খুব দ্রুত অবস্থান নিতে হবে। আশেপাশে অনেকেই তোমাকে লক্ষ্য করতে শুরু করেছে।
রিবিট দ্রুত সামনের নির্মাণাধীন পরিত্যক্ত বাড়িটির দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তার দু একজন তাকে লক্ষ্য করলেও কেন যেন অনুসরণ করল না। বাড়িটির তিনতলায় একটা জানালার পাশে যেয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রিবিট বলল : ইপি, এমন যদি হয় যে তিশার দাদা কিংবা বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনো ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে?
সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আমাদের তাদেরকে অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই। তারা নিশ্চয় ফিরে আসবে।
যদি এমন হয় ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কালোমানুষকে দিতে যায়?
ইপি একটু সময় নিল। সেক্ষেত্রে তোমাকে ভাগ্যের উপর নির্ভর করতে হবে। আর..
ইপির কথা শেষ হওয়ার আগেই রিবিটের অভ্যন্তরীণ মোবাইলে একটা ম্যাসেজ এল। মেসেজটি ওপেন করতে রিবিট দেখল তিশা পাঠিয়েছে। তাতে লেখা : রিবিট, আমি তোমাকে যে ই-মেইল পাঠিয়েছিলাম তার সবই সত্য। তুমি আমাদের সাহায্য করো।
মেইলটি পড়ে রিটি একেবারে থমকে গেল। সে বুঝতে পারল যেভাবেই হোক সাহায্য করতে হবে তিশাদের।
.
৫.
রিবিট বেরিয়ে যেতে সোবহান আহমেদ আর সুমন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল সোফায়। তারপর সুমনই প্রথম কথা বলল : বাবা, তিশা বোধহয় রিবিটকে সবকিছু লিখে পাঠিয়েছে।
হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে। তা না হলে রিবিট হঠাৎ করে আমাদের বাসায় আসবে
রিবিট যে আমাদের বাসায় এসেছে এটা কালোমানুষদের কেউ জেনে গেল কিনা?
জেনে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। আমার বিশ্বাস, আশেপাশে কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে।
এখন তাহলে আমরা কী করব? অসহায়ভাবে প্রশ্ন করল সুমন।
সেটা তো আমারও প্রশ্ন।
সুমন ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল : এখন ফোনে কী কথা হল?
ঐ আগের মতোই হুমকি দিয়েছে। যদি আজ রাতের মধ্যে দশ লাখ টাকা দিতে না পারি তাহলে ওরা তিশাকে মেরে ফেলবে।
এত টাকা কোথায় পাব আমরা?
দশ লাখ অনেক টাকা। আমার ব্যাংকে কিছু জমানো টাকা আছে। সর্বমোট লাখ। তিনেক হবে। আমি তোমাকে এই টাকাটা দিয়ে দেব। তবুও তিশার জীবন রক্ষা পাক। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন সোবহান সাহেব।
বাবা, তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে সত্যি আমার খারাপ লাগবে। তারপরও আমাকে নিতে হবে। কিন্তু তারপর কী হবে? আমার সঞ্চয় দুই লাখ টাকা। তোমার আর আমার মিলে হবে পাঁচ লাখ টাকা। আর বাকি পাঁচ লাখ টাকা পাব কোথায়?
আমি জানি না সুমন।
আমরা কি কালোমানুষকে বোঝাতে পারি না?
ওরা তো কোনো কথাই শুনতে চায় না। নিজেরাই কথা বলে। তাও শুধু নির্দেশ। তাছাড়া আলোচনা করার সুযোগ কোথায়? আবার কখন ফোন করবে তাও জানি না। ফোন করলে ল্যান্ডফোনে করবে নাকি মোবাইলে করবে সেটাও অনিশ্চিত।
টাকা কোথায় পৌঁছে দিতে হবে সেটা কি বলেছে?
না, কিছুই বলেনি।
তাহলে?
বলেছে পরে জানাবে। আপতত টাকা জোগাড় করে রাখতে হবে।
এরপর দুজনেই চুপ হয়ে ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। কিছুক্ষণ পর সুমন আবার বলল : বাবা, আমরা যদি পুলিশকে খবর দিই তাহলে কী হবে?
আমি সাহস পাচ্ছি না। আমার বিশ্বাস পুলিশকে জানানো মাত্রই ওরা সম্পূর্ণ। ব্যাপারটা জেনে যাবে। তাতে আমাদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ আমাদের ক্ষতি করতে ওদের সময় লাগবে না। আমাদের প্রতিদিনই বাইরে যেতে হয়। আমি বাইরে যাই, তুমি অফিসে যাও, তিশা স্কুলে যায়। মানুষের ক্ষতি করার নানারকম উপায় আছে। কালোমানুষ যদি আমাদের ক্ষতি করতে চায় তাহলে তা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু তাই বলে এতগুলো টাকা আমরা এভাবে দিয়ে দেব? আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাব।
আমাদের আর কী-ই-বা করার আছে?
বাবা, আমার কী মনে হয় জানো?
কী?
তিশা বোধহয় ঠিকই করেছে। রিবিটকে খবর দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই কারো–কারো সাহায্য গ্রহণ করা উচিত।
নির্ভর করা যায় এমন কারো সাহায্য পেলে আমিও খুশি হতাম। কিন্তু রিবিট কি তা পারবে? মনে হয় না। রিবিটকে সবাই চিনে ফেলবে। কালোমানুষ কিংবা তার সঙ্গীরা যখন দেখবে কিংবা বুঝতে পারবে রিবিট আমাদের সাথে আছে সেক্ষেত্রে উল্টো ফল হতে পারে।
যদি আমরা টাকা না দিই? হঠাৎই প্রশ্ন করল সুমন।
এরকম একটা চিন্তা আমার মাথায়ও ঘুরছে। এমনো হতে পারে যে বা যারা আমাদের কাছে টাকা চাইছে তারা হয়তো আসলেই কুখ্যাত কেউ না। হয়তো কোনো সাধারণ মাদকসেবী, যে কিনা চেষ্টা করছে আমাদের কাছ থেকে টাকাটা বাগিয়ে নিয়ে মাদক সেবন করতে। আর যদি সত্যি কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরনের কেউ হয় তাহলে টাকা না-দেয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কারণ ওরা তখন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে ক্ষোভটা যেয়ে পড়বে তিশার ওপর। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ ঢাকা শহরে তিশার মতো ছোট একটা মেয়ের ক্ষতি করা কঠিন কিছু নয়।
তাহলে এখন সিদ্ধান্ত কী হবে?
আপাতত আমরা টাকা জোগাড় করে রাখি।
কিন্তু দশ লাখ টাকা কোথায় পাব?
আমাদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা আছে। এই পাঁচ লাখ টাকা নিয়েই আমরা প্রস্তুত থাকব। এতে যদি না হয় তাহলে আমাদের কিছু করার থাকবে না।
আমার গহনাগুলো বিক্রি করে দিন বাবা। আমার অনেক গহনা আছে। পিছন থেকে বলল মুনা। সে এতক্ষণ তিশার সাথে ছিল।
না মা, না। এ কাজ করা যাবে না। আমার বিশ্বাস, কালোমানুষ যত খারাপই হোক না কেন, আমাদের কিছু সুবিধা-অসুবিধা বুঝবে।
কিন্তু শেষপর্যন্ত ওরা যদি রাজি না হয়? আবারো প্রশ্ন করল মুনা।
রাজি না হলে তখন দেখা যাবে। আপাতত তোমার গহনা বিক্রির চিন্তা মাথা থেকে বাদ দাও। এখন আমরা দুজন ব্যাংকে যাব। সেখান থেকে টাকা তুলে নিয়ে আবার ফিরে আসব। এর মধ্যে ওরা যদি ফোন করে তাহলে তুমি তেমন কিছু বলবে না। শুধু শুনে রাখবে কখন কোথায় টাকাটা দিতে হবে।
মুনা কোনো কথা বলল না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
সোবহান সাহেব এবার সুমনের দিকে ফিরে বললেন : তুমি বাইরে যেয়ে একটা ট্যাক্সি ঠিক করো। আমরা যে ট্যাক্সিতে যাব, সেই ট্যাক্সিতে ফিরে আসব।
সুমন উঠে দাঁড়াল। এ মুহূর্তে সত্যি তার খুব খারাপ লাগছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। কারো সাহায্যও নিতে পারছে না। অফিস থেকে অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়েছে। কিন্তু এই অসুস্থতা যে কী ভয়ানক অসুস্থতা তা সে ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারছে না।
দশ মিনিটের মাথায় সোবহান সাহেব আর সুমন বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে মুনাকে ভালোমতো দরজা আটকাতে বলতে ভুলল না। এ মুহূর্তে সবার মধ্যেই একরকম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
গাড়িতে বসে সুমনের খারাপলাগাটা আরো বাড়ল। সে বলেই ফেলল : বাবা, আমার মনে হচ্ছে তোমার ধারণাই সত্য। কেউ হয়তো সত্যি আমাদের বোকা বানাতে চাইছে।
সোবহান সাহেব সুমনের চোখের দিকে তাকাতে সুমন আবার বলল : হ্যাঁ বাবা, হয়তো সামান্য কেউ। শুধুই আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।
আমি জানি না সুমন। আমার মনে হয় সবকিছুর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকাই ভালো। এজন্যই এখানে আসা। মনে রেখো, খারাপ মানুষের মতিগতি খুবই খারাপ। নিজের স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করতে পারে না।
সুমন আর কোনো কথা বলল না। এখন আর তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার মনে হচ্ছে সে কোনো ঘোরের মধ্যে আছে। তার চারপাশে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। আর সেই অন্ধকারে খেলা করছে হাজারো রঙ-বেরঙের আলো। প্রত্যেকটি আলোই যেন তার সামনে কুৎসিতভাবে নাচছে আর হি হি করে হাসছে।
.
৬.
তিশার মোবাইলে ম্যাসেজের উত্তর পাঠিয়েও রিবিট আর কোনো কিছু জানতে পারেনি তিশার কাছ থেকে। সে বুঝতে পেরেছে তিশা উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় নেই। তবে সে নিশ্চিত তিশা সুযোগ পেলেই তার সাথে কথা বলবে। আর আশার কথা হল, ইপির বিশ্লেষণ সত্য হয়েছে। সোবহান সাহেব আর তার ছেলে বাসা থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে এসেছে। ফিরে আসার সময় তাদের হাতে একটা কালো ব্রিফকেস ছিল। অথচ যাওয়ার সময় সেটা ছিল না। এই ব্রিফকেসটা কোথা থেকে এল এবং কীভাবে এলো তা বুঝতে অসুবিধা হল না রিবিটের। সে নিশ্চিত এই ব্রিফকেসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় অর্থ রয়েছে।
অনেক বিচার-বিশ্লেষণের পর রিবিট সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে পুলিশের সাহায্য নেবে। কারণ তার একার পক্ষে সম্পূর্ণ কাজটা করা সত্যি কঠিন। তার ধাতব চেহার এমনিতেই চোখে পড়ার মতো, মানুষের মধ্যে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। সহজেই প্রতিপক্ষের চোখে পড়ে যাবে। এ নিয়ে অবশ্য ইপির সাথে কিছুক্ষণ আগেও যথেষ্ট তর্কবিতর্ক হয়েছে। রিবিট দাবি করেছে তার চেহারা মানুষের মতো হলে ভালো হত। কিন্তু ইপি তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে তার চেহারা রোবটের মতো হওয়ায়ই সে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। যাইহোক, শেষপর্যন্ত সে আর ইপি একটা বিষয়ে একমত হতে পেরেছে। আর তা হল সম্পূর্ণ ঘটনাটি পুলিশকে জানানো।
রিবিট পুলিশকে ঘটনাটি জানানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করবে বলে ঠিক করেছে। তাই সে সরাসরি থানাকে না-জানিয়ে ডিবির অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার শাহেদকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিল। ডিবির পক্ষে এ-ধরনের অভিযান পরিচালনা সহজতর হবে। কারণ ডিবি সাদা পোশাকে কাজ করে। তাছাড়া ডিবির তরুণ অফিসার শাহেদ তার পরিচিত। অবশ্য পুলিশের সকল অফিসারই তাকে চেনে। পুলিশের কাছ থেকে সে সবসময়ই যথেষ্ট সম্মান পেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে রিবিট ভাবে : পুলিশ তার সাথে যেরকম ব্যবহার করে, সত্যি যদি তারা সকল মানুষের সাথে একই রকম ব্যবহার করত তাহলে এদেশে পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা অনেক অনেকগুণ বৃদ্ধি পেত। শুধু ব্যবহারের কারণেই আজ তারা সমাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে।
রিবিট প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিবি অফিসে যাবে। কিন্তু পরে পরিবর্তন করেছে সিদ্ধান্তটা। ডিবি অফিসে গেলে তাকে এখান থেকে কিছু সময়ের জন্যও বাইরে থাকতে হবে। এসময়ে যদি সোবহান সাহেব কিংবা সুমন টাকা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় তাহলে তাদেরকে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়ে যাবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানেই অবস্থান করার।
বিকাল চারটার সময় রিবিট ফোন করল এসি শাহেদকে।
শাহেদ ফোন ধরেই বলল : রিবিট তুমি! আমি সত্যি অবাক হয়েছি!
শাহেদ তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। কোনোরকম সময় ক্ষেপণ ছাড়াই বলল রিবিট।
বলো রিবিট বলো। আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
ফোনে সবকিছু বলা সম্ভব নয়।
তাহলে আমার অফিসে চলে এসো অথবা বলো আমি কোথায় আসব।
পারলে আমি তোমার অফিসে আসতাম। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার পক্ষে এখান থেকে নড়া সম্ভব নয়। তুমি যদি ধানমণ্ডিতে চলে আসতে পারে সবচেয়ে ভালো হয়।
আমি এক্ষুনি আসছি।
তোমাকে খুব গোপনে আসতে হবে যেন কেউ টের না পায়।
তোমার কথায় বেশ রহস্য আছে মনে হচ্ছে। আমি রহস্য খুব পছন্দ করি। এজন্যই ডিবিতে চাকরি করি। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো কাক-পক্ষীও টের পাবে না আমি তোমার ওখানে যাচ্ছি।
তাই যেন হয়।
খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তুমি আমাকে তোমার সামনে দেখতে পাবে রিবিট।
শাহেদের কথাই সত্য প্রমাণিত হল। বিশ মিনিটের মাথায় শাহেদ একা এসে উপস্থিত হল রিবিটের অবস্থানে। রিবিট শাহেদকে সবকিছু খুলে বলতে শাহেদ বলল : তুমি আমাকে সংবাদ দিয়ে ঠিকই করেছ রিবিট। এ-ধরনের সমস্যা তোমার একার পক্ষে সমাধান করা সত্যি কঠিন। তাছাড়া আইনগত ব্যাপারও রয়েছে। তুমি অনেক কিছুই করতে পারবে না যা আমরা করতে পারব। যাইহোক এখন আমাদেরকে পরবর্তী পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ।
তোমার কি কোনো পরিকল্পনা আছে?
আমি নিজে গ্রহণযোগ্য কোনো পরিকল্পনা বের করতে পারছি না। মনে হচ্ছে। এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। যখন সোবহান সাহেব কিংবা তার ছেলে বাইরে বের হবে তখন আমি তাকে অনুসরণ করব। কিন্তু পরিকল্পনাটকে ঠিক গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।
কেন গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না? প্রশ্ন করল শাহেদ।
কারণ আমাকে দেখলে সহজেই চিনে ফেলবে। দ্বিতীয়ত এ মুহূর্তে আমার কোনো গাড়ি নেই। আর তৃতীয়ত আমি জানি না টাকাটা কোথায় হস্তান্তর হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ রিবিট। আর এজন্য আমাদের প্রয়োজন তথ্য সংগ্রহ করা।
কিন্তু তিশাদের বাসায় কেউই তো আমাদের সাহায্য কামনা করছে না।
আমরা এক কাজ করতে পারি।
কী কাজ?
আমরা তিশাদের বাসার ফোনের কথা রেকর্ড করতে পারি।
কিন্তু সেজন্য তো আমাদের ফোন নম্বর বা মোবাইল নম্বর জানা থাকতে হবে। আমাদের তো ফোন নম্বরই জানা নেই।
ল্যান্ডফোন নম্বর বের করা কঠিন কিছু হবে না। টিঅ্যান্ডটি অফিস থেকে জানা যাবে। আর কথোপকথন রেকর্ড করাও অসম্ভব কিছু নয়। বাইরে যে এক্সচেঞ্জ আছে সেখান থেকে রেকর্ড করা যাবে। তবে এগুলো অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করবে। আর কালোমানুষ যদি মোবাইলে যোগাযোগ করে থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে।
তিশার দাদু কিংবা বাৰা সাহায্য করলে ভালো হত। আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যেত। বলল রিবিট।
কিন্তু তোমার ভাষ্য অনুযায়ী তারা আমাদের সাহায্য করবে না। এখন যদি আমরা জোরাজুরি করি তাহলে অনেকগুলো সমস্যা হবে। প্রথমত, তারা আমাদের বলতে চাইবে না এবং অতিরিক্ত ভয় পাবে। আর কালো মানুষেরা যদি জেনে যায় তাহলে অধিকতর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে কালোমানুষ কিংবা তার দলবলকে ধরাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা যদি শুধু তিশাদের রক্ষা করতে পারি তাহলে কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। কারণ কালোমানুষ তিশাদের মতো আরো অনেক পরিবারকে ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করবে। কাজেই আমাদের মূল উদ্দেশ্য হবে কালোমানুষ আর তার দলবলকে ধরা।
তুমি এখন কী করতে চাইছ? প্রশ্ন করল রিবিট।
আমি এখনই ডিবি হেডকোয়ার্টার্সে জানিয়ে দিচ্ছি। তিশাদের বাসার ল্যান্ডফোনের কথোপকথন রেকর্ড করার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আর তোমার লোকজন? তারা কি আসবে না।
তারা চলে আসবে। সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
নির্মাণাধীন পুরাতন ভবনটিতে অপেক্ষা করতে লাগল দুজন। সন্ধ্যা নাগাদ টিঅ্যান্ডটির লোকজন তিশাদের বাড়ির ফোনে আড়িপাতা সম্পন্ন করল। মোবাইল কোম্পানির সহায়তায় তিশার মোবাইলটিতেও আড়ি পাতা হল। তিশা তার মোবাইল থেকে রিবিটকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল। এজন্য তিশার নম্বরটি আগে থেকেই রিবিটের কাছে ছিল। কিন্তু অন্য কারো মোবাইল নম্বর সগ্রহ করতে পারল না তারা। আশেপাশে ডিবির অন্য কোনো লোকজনকে না-দেখে রিবিট কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠলেও শাহেদকে কিছু বলল না।
সন্ধ্যার পর রাস্তায় লোকজন কিছুটা কমে এল। তবে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোজন ঠিকই বেরুচ্ছে ঢুকছে। পাশে দুটো বাড়ির পর একটা সুন্দর বাড়িতে একটা সাদা মাইক্রো ঢুকতে দেখল রিবিট। আবার দুজন লোককে ঐ বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে যেতেও দেখল। এদিকে সিটি কর্পোরেশনের একটা ময়লার গাড়ি এসে তিশাদের বাড়ির কোণা থেকে গাড়িতে ময়লা তুলতে শুরু করল। লোকগুলোর কাজ এতটাই ধীর যে রিবিট নিশ্চিত সারারাত কাজ করেও এরা ডাস্টবিনের ময়লাগুলো তুলতে পারবে না। এদিকে আরো খানিক পর এক ঝাড়দার এসে রাস্তা ঝাড় দিতে শুরু করল। এই লোকটা আগের লোকগুলোর থেকে আরো ধীর। রিবিটের ইচ্ছে হল সে নিজে যেয়ে সবাইকে বলে সবাই যেন খানিকটা দ্রুত কাজ করে। কিন্তু সে নড়ল না। তবে তার দৃষ্টি কাড়ল একপাশে এক পিঠাওয়ালা। কিছুক্ষণ হল সে এখানে এসেছে। ভাজা পিঠা বিক্রি করছে। দু-চারজন ভালোই ক্রেতা পাচ্ছে সে।
রিবিটের অবশ্য মূল মনোযোগ তিশাদের বাড়ির দিকে। সে একটু পর পর তাকাচ্ছে আর আশা করছে এই বুঝি বেরিয়ে আসে তিশার দাদা কিংবা বাবা। কিন্তু। সেরকম কিছুই ঘটছে না। তারপরও সে অপেক্ষা করে আছে। সে নিশ্চিত তারা দুজন একসময়-না-একসময় বের হবেই।
.
৭.
দুপুরের পর থেকে তিশাদের বাসার সবাই আশা করছে কালো মানুষের ফোন আবার আসবে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও কালো মানুষের কোনো ফোন এলো না। সন্ধ্যার পর থেকে কেন যেন সুমনের মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কারো দুষ্টুমি হতে পারে। তা না হলে অবশ্যই এতক্ষণ ফোন করে জানতে চাইত কোথায় টাকা দিতে হবে। কিন্তু সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তার ধারণা ছিল বাড়ির বাইরে থেকেও হয়তো কালোমানুষদের কেউ তাদের উপর লক্ষ্য রাখছে। কিন্তু সে-সম্ভাবনাও নেই মনে হচ্ছে। কারণ বাইরে সিটি কর্পোরেশনের কিছু লোক কাজ করছে। এ ছাড়া যারা আছে তার সবাই সাধারণ পথচারী। আর একজন পিঠাবিক্রেতাও আছে। তবে এটা নতুন কিছু নয়। এ এলাকায় অনেকেই এভাবে পিঠা বিক্রি করে। এ ছাড়া অন্য কাউকে তার চোখে পড়েনি যাকে দেখে সন্দেহ হতে পারে সে কালো মানুষের দলের সদস্য।
সন্ধ্যার পর সামনের বারান্দা থেকে সুমন যখন ভিতরে সোফায় এসে বসল তখন সে প্রায় নিশ্চিত ফোনটি ছিল শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির খামখেয়ালিপনা। কিন্তু তার অনুমান সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হল যখন তার মোবাইলটি বেজে উঠল।
মোবাইল বেজে ওঠার সাথে সাথে সোবহান সাহেব, সুমন, মুনা হুমড়ি খেয়ে পড়ল মোবাইলের উপর। স্ক্রিনে ‘আনোন’ বা ‘অপরিচিত নম্বর’ লেখা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল তারা। সুমন তার বাবার দিকে জিজ্ঞাসু-চোখে তাকাতে সোবহান সাহেব উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে ফোন ধরার জন্য সম্মতি দিলেন। সুমন ফোন ধরে হ্যালো বললেও ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না।
সুমন আবার বলল, হ্যালো।
কোনো উত্তর নেই।
সুমন এবার একটু জোর দিয়ে বলল, হ্যালো।
এবার ওপাশ থেকে একটা গল্পীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমার কথা শুনবার পাইতেছেন সুমন সাহেব।
হ্যাঁ হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। কাঁপা গলা সুমনের।
আমারে চিনবার পারছেন?
জি..জি.. না। সুমনের গলাটা আরো কেঁপে উঠল।
আমি কালোমানুষ।
কালোমানুষ!!
হঁ, কালোমানুষ। আপনে কি টাকা জোগাড় করছেন?
জি চেষ্টা করেছি। কিন্তু..
আবার কিন্তু কিসের?
দশ লাখ টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। এত টাকা আমাদের নেই। পাঁচ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছি।
পাঁচ লাখ টাকা! কী বলেন আপনে?
জি, আমাদের কাছে আর টাকা নেই।
পাঁচ লাখ টাকা দিয়া আপনে আপনের মেয়ের জীবন রক্ষা করবার পারবেন না। মনে রাখবেন আমরা খুব ভয়ংকর। আমরা মানুষের জীবন নিয়া খেলা করি। আপনি নিশ্চয় চাইবেন না আর মাত্র পাঁচ লাখ টাকার জন্য আপনের মেয়ে চিরতরে হারায় যাক।
না না চাই না। কিন্তু আমাদের তো করার কিছু নেই। গলা শুকিয়ে এসেছে সুমনের।
আছে, মেলা কিছু করার আছে। টাকা ধার করেন।
এত টাকা আমাদের কেউ ধার দেবে না।
অবশ্যই দিবে। বাড়ি বিক্রি কইরা দেন, নয় বন্ধক রাহেন।
কী বলছেন আপনি! বাড়ি বিক্রি করে দেব! চোখ কপালে তুলে বলল সুমন।
তাইলে আপনের মেয়ের জীবন উৎসর্গ করেন। হো হো.. হো…। কুৎসিতভাবে হেসে উঠল কালোমানুষ।
হাসিটা মোটেই ভালো লাগল না সুমনের। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল : না না, আমরা তিশাকে হারাতে চাই না।
তাইলে যা বললাম তাই করেন। দশ লাখ টাকা জোগাড় করেন।
আমাদের তাহলে এক সপ্তাহ সময় দিন। এত টাকা জোগাড় করতে সময়ের প্রয়োজন।
আর সময় দেওয়া যাবে না। আপাতত যা হাতে আছে তাই আমাগো দিয়া দ্যান। পরের তিন দিন পর।
জি জি। সায় দিয়ে বলল সুমন।
আজ রাইত সাড়ে দশটায় গাবতলীর আমিনবাজারে থাকবেন। টাকাগুলা একটা কালো রঙের ব্রিফকেসে আনবেন।
আমিনবাজারে কোথায়?
মোবাইল খোলা রাখবেন। সময়মতো সবকিছু জানবার পারবেন। কোনোরকম চালাকি করবার চেষ্টা করবেন না।
না না, করব না।
পুলিশকে জানাবেন না। মনে রাখবেন, পুলিশ যদি কিছু জানবার পারে তাইলে আপনের সারাজীবন পস্তান লাগব।
পুলিশ কিছু জানবে না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি।
চমৎকার। আর হঁ, আসার সময় আপনের স্ত্রীর গহনাগুলোও নিয়া আসবেন।
জি নিয়ে আসব।
ঠিক আছে। রাইতে দেখা হবে।
আমার একটা কথা..
আর কোনো কথা নয়। শুধু এটুকু মনে রাখবেন, কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। পরিণতি তাহলে খুবই ভয়ংকর হবে। মনে রাখবেন আমরা খেলোয়াড় মানুষ। মানুষের জীবন নিয়ে খেলতেই আমি বেশি পছন্দ করি। আর সেটা যদি কোনো শিশুর জীবন হয় তাহলে আনন্দটা আরো বেশি।
এরপর লাইনটা কেটে গেল।
এটুকু কথাতেই কপাল ঘেমে উঠেছে সুমনের। সে শূন্যদৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকাতে সোবহান সাহেব বললেন : তুমি ঘাবড়ে যেও না। একটা-না-একটা সমাধান বের হবেই। তারপর মুনার দিকে তাকিয়ে বললেন : তিশা কোথায়?
ওর ঘরে, টিভি দেখছে।
ওর কাছে মোবাইল নেই তো? শেষে দেখা যাবে কালোমানুষ ওকে ফোন করে হুমকি দিয়েছে।
না বাবা, নেই। আমি অনেক আগেই মোবাইল সরিয়ে ফেলেছি। তবে..
তবে কী?
রিবিট ওকে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিল। সম্ভবত তিশা আগেই রিবিটকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
না না, আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। তিশা যেন আর রিবিটের সাথে যোগাযযাগ করতে না পারে। রিবিটকে জানানো আর পুলিশকে জানানো একই কথা। শেষে দেখা যাবে উল্টো ফল হবে।
ঠিক আছে বাবা।
আর এখন থেকেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাতে আমরা কী করব।
কী করব মানে? ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করল সুমন।
মানে আর কিছুই নয়। আমাদের পরিকল্পনা কী হবে। সত্যি আমরা টাকাগুলো কালোমানুষকে দিয়ে দেব কিনা। আর দিয়ে দিলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ওকে আবারও টাকা দিতে হবে। আমার বিশ্বাস দ্বিতীয়বার দেয়ার পর তৃতীয়বারও দিতে হবে এবং এভাবে চলতে থাকবে। আর যদি না দিই….
না না বাবা, আমি আমার মেয়ের উপর কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। আমার বিশ্বাস পাঁচ লাখ টাকা পাওয়ার পর কালোমানুষ আর আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে না। প্রয়োজনে আমি আমার গহনাগুলো দিয়ে দেব। বলল মুনা।
তুমি ব্যাপারটাকে যত সহজ ভাবছ বৌমা, আসলে তত সহজ নয়। এদের চরিত্র খুব খারাপ। যেখানেই এরা সুযোগ পায় সেখানেই হাত বাড়ায়। এদের হাতদুটো কেটে না ফেলা পর্যন্ত এরা হাত বাড়ানো বন্ধ করে না।
হাত বাড়াচ্ছে বাক, তারপরও আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। আবারো বলল মুনা।
ঠিক আছে। টাকা যদি দিতেই হয় কীভাবে দেবে?
আমি নিয়ে যাব। বলল সুমন।
তোমার একা যাওয়া ঠিক হবে না। আমিও যাব তোমার সাথে। দুজনে থাকলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।
কিন্তু যাব কীভাবে?
আমরা এখান থেকে কোনো ট্যাক্সি নিয়ে বের হয়ে যাব। সরাসরি আমিনবাজারে যেয়ে নামব। সেখানে পৌঁছালে কালোমানুষ হয়তো বলে দেবে কী করতে হবে।
ঠিক আছে বাবা। মলিন স্বরে বলল সুমন।
তারপর সে উঠে এল সোফা থেকে। এগিয়ে গেল সামনের বারান্দায়। এখনো বাইরে সিটি কর্পোরেশনের মানুষগুলো কাজ করছে। তার মনে হল মানুষগুলো খুব ধীরগতিতে কাজ করছে। অবশ্য সে জানে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা সমসময়ই ধীর। তবে আজকের লোকগুলো বেশি ধীর। কোথায় যেন সমীকরণে মিলছে না, ঠিক যেমন মিলছে না তাদের সুখের জীবনে কালো মানুষের উপস্থিতির ঘটনা।
.
৮.
রাত সাড়ে নটার সময় বাসা থেকে বের হল সোবহান সাহেব এবং সুমন। সাথে একটা কালো ব্রিফকেস। সেখানে পাঁচ লাখ টাকা আর মুনার সোনার গহনা। কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না তারা। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যদি সম্ভব হয় সামনাসামনি হলে কালোমানুষকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবে।
ট্যাক্সিক্যাবে ওঠার পর একেবারেই চুপ হয়ে গেল দুজন। দুজনের মধ্যেই একধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। তাদের কেউই বুঝতে পারছে না আদৌ তারা সমাধানের দিকে এগোচ্ছে নাকি জটিলতা আরো বাড়াচ্ছে। উপরন্তু পঁচ লাখ টাকা খোয়া যাওয়ার যন্ত্রণা তো আছেই।
সোবহান সাহেব কিংবা সুমন কেউই লক্ষ্য করল না যাত্রা শুরুর পর থেকে তাদেরকে অনুসরণ করছে একটি মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাসের প্রশিক্ষিত ড্রাইভার এমনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে যে সামনের গাড়ির ড্রাইভার বুঝতেই পারছে না তাকে অনুসরণ করছে কেউ। এই মাইক্রোবাসে আছে রিবিট, শাহেদসহ আরো কয়েকজন।
মাইক্রো ধানমণ্ডি থেকে বের হয়ে গাবতলীর পথ ধরলে রিবিটই প্রথম কথা বলল : শাহেদ, তুমি তো আমাকে একেবারে বোকা বানিয়ে ফেলেছিলে।
কেন?
আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি তোমার লোক আশেপাশে এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আমরা এভাবেই থাকি।
তাই বলে একেবারে পরিচ্ছন্ন-কর্মী, পিঠা-বিক্রেতা, ঝাড়দারের বেশ ধরে।
এতে অনেক সুবিধা আছে। কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না।
আমি অবশ্য তোমাদের কাজের গতি দেখে সন্দেহ করেছিলাম।
তা করেছিলে। কিন্তু আমরা যদি দ্রুত কাজ করতাম তাহলে আরো সন্দেহ করতে। কারণ আমাদের কাজ আগেই শেষ হয়ে যেত এবং আমরা সেখানে অতিরিক্ত সময় অবস্থানের জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি খুঁজে পেতাম না। এজন্য আমাদেরকে ধীর গতিতে অত্যন্ত কৌশলে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু হতাশার ব্যাপার হল, আমাদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ভেবেছিলাম আশেপাশে হয়তো কালো মানুষের দলের কেউ থাকবে। কিন্তু আসলে কেউই ছিল না।
কিন্তু এতে হতাশ হওয়ার তো কিছু নেই। তোমাদের কাজের ধরনটাই এরকম।
তা তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-গুণটার প্রয়োজন হয় তা হলো ধৈর্য।
যাইহোক, এখন তোমার কী মনে হচ্ছে?
একটু সময় নিয়ে শাহেদ বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। কালোমানুষ যে কীভাবে তিশাদের বাড়ির সবার সাথে যোগাযোগ করছে তাও বের করতে পারছি না। ল্যান্ডফোনে কথা বলেনি আমি নিশ্চিত। মোবাইলের ব্যাপারটাও নিশ্চিত নয়। যদিও তিশার বাবার অফিস থেকে আমরা সুমন সাহেবের নম্বর জোগাড় করেছি, সেটাও
কোনো কাজে আসেনি। সুমন সাহেবের মোবাইলে কালো মানুষের কেউই কথা। বলেনি।
এমনো হতে পারে সুমন সাহেবের মোবাইল নম্বর জোগাড় করে তা মোবাইল কোম্পানির সাহায্যে আড়ি পাতার আগেই কালো মানুষেরা সুমন সাহেবের সাথে কথা বলেছে। কারণ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা আমরা মাত্র কিছুক্ষণ আগে শেষ করেছি। তাছাড়া এমনো হতে পারে কালোমানুষ বাসার অন্য কারো মোবাইলে কথা বলেছে যেটা আমরা জোগাড় করতে পারিনি। তবে এখন কেন যেন আমার মনে হচ্ছে আমাদের উচিত ছিল বাসার কারো সাথে কথা বলা। অন্তত আমরা তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হতাম যে আমরা তাদেরকে সাহায্য করতে চাই।
কিন্তু তিশাদের বাড়ির কারো আচরণে সেটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়নি।
হতে পারে তোমার কথাই সঠিক। আমাদের এই গোয়েন্দাগিরির কাছে আসলে কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক অনেক সময় আগে থেকে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। যাইহোক, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি। আশা করছি আমরা সফল হব।
এদিকে ট্যাক্সিক্যাব গাবতলী আসতে ফোন এল সোবহান সাহেবের মোবাইলে। আগের মতোই স্ক্রিনে কোনো নম্বর ভেসে উঠল না। সোবহান সাহেব বুঝতে পারলেন ফোনটি কোথা থেকে এসেছে। তিনি একবার সুমনের দিকে তাকিয়ে ফোন ধরে বললেন : হ্যালো।
ওপাশ থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে এল : ফোনডা আপনের ছেলেরে দ্যান।
সোবহান সাহেব কাঁপা হাতে ফোনটি সুমনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
সুমন ফোন কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বর বলল : সুমন সাহেব, আপনে যদি বিপদ এড়াবার চান তাইলে আপনে একা আমিনবাজারে আসবেন, আপনের সাথে যেন আর কেউ না আসে।
জি..জি। তোতলাতে তোতলাতে বলল সুমন।
আমি কী কইছি বুঝবার পারছেন?
জি, বুঝতে পেরেছি।
আপনের সাথে আপনের বাবা ছাড়া কি আর কেউ আছে?
না নেই।
সত্য করে বলুন।
হ্যাঁ সত্য বলছি। আমার সাথে আমার বাবা ছাড়া আর কেউ নেই।
মনে রাখবেন, কথার এদিক-ওদিক হইলে আপনের ভয়ানক পরিণতি বরণ করা লাগব। যাইহোক, আপনে গাবতলী থ্যাইকা একলাই আমিনবাজার আসবেন। আপনের সাথে যেন আর কেউ না থাহে।
ঠিক আছে থাকবে না।
আমিনবাজারে পৌঁছানোর পর আমি আপনেরে পরবর্তী নির্দেশ দিব। আর ই, আপনের বাবার মোবাইলডা সাথে রাখবেন। আপনারড়াও রাখবেন।
জি রাখব। তবে..
সুমন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে দিল ভরাট কণ্ঠস্বরের কালোমানুষ।
সুমন সোবহান সাহেবকে সবকিছু খুলে বলতে সোবহান সাহেব গাবতলীতে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। গাড়ি থেকে নামার সময় সোবহান সাহেবের মুখটা একেবারে চুপসে গেল। তার মধ্যে এখন অতিরিক্ত একটা চিন্তা যোগ হয়েছে। আর তা হল তার সন্তানের সুস্থভাবে ফিরে আসা। কালো মানুষেরা এত খারাপ যে তারা সুমনের ক্ষতি করে কিনা এ-চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠল।
এদিকে সুমন ঘামতে শুরু করেছে। তার খুব ভয়ও করছে। এই প্রথম তার নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। অবশ্য সে সত্যি নিঃসঙ্গ। তাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। কালো মানুষেরা যে একা আসবে না এ-বিষয়ে সে নিশ্চিত। কারণ সে যখন কালোমানুষদের সাথে কথা বলেছে প্রত্যেকবারই ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে। সে নিশ্চিত কালোমানুষদের একটা দল আছে এবং এই দলের সবাই আসবে। নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যে তারা করতে পারে না। এমনকি ইচ্ছে করলে তাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে। খুনের কথা মনে হতেই শিউরে উঠল সুমন।
ড্রাইভারের কথায় বাস্তবে ফিরে এল সুমন। ভাইজান, আপনে আমিনবাজারের কোন্হানে নামবেন?
সুমন দ্বিধায় পড়ল। সে আমিনবাজারের উপর দিয়ে অনেকবার যাওয়া-আসা করেছে ঠিকই কিন্তু কখনো এখানে নামেনি। জায়গাটা তার সম্পূর্ণই অপরিচিত।
সুমন কিছু বলছে না দেখে ড্রাইভার আবার বলল : ভাইজান, কোনহানে নামবেন কইলেন না তো?
এই তো আর একটু সামনে। আপনে এগোতে থাকুন।
ড্রাইভারকে মনে হল সে সুমনের কথায় সন্তুষ্ট হয়নি। তাই খানিকটা সামনে যেয়ে সে আবার বলল : ভাইজান, আপনে কি এইহানে নামবেন?
সুমন দ্বিধায় পড়ল। এতগুলো টাকা নিয়ে নামাও মুশকিল। যদি ছিনতাই হয়। হতেও পারে। সে জানে আমিনবাজার জায়গাটা ভালো না। এখানে অনেক সন্ত্রাসী চাঁদাবাজরা থাকে। ড্রাইভারের প্রশ্নে সে শুধু বলল : না, আরো সামনে।
ভাইজান আপনে কি কোনোকিছু নিয়া চিন্তায় আছেন? প্রশ্ন করল ড্রাইভার।
না না। আমার কোনো চিন্তা নাই। তড়িঘড়ি করে উত্তর দিল সুমন।
কিন্তু আমার মনে হইতেছে আপনি কিছু নিয়া খুব টেনশন করতেছেন।
ড্রাইভার কেন এই প্রশ্ন করছে তা বুঝতে সুমনের অসুবিধা হল না। তার আচরণ ড্রাইভারের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। সে শুধু বলল : না আমি টেনশনে ভুগছি না।
কিন্তু আপনি ঘামতেছেন। আবারো বলল ড্রাইভার।
এবার কিছুটা বিরক্তিই হল সুমন। সে বুঝতে পারছে ড্রাইভারের প্রশ্ন তার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।
সুমন কিছু না-বলায় ড্রাইভার আবার বলল : ভাইজান, আপনে কে এই এলাকায় আইছেন আমি জানি না। তয় এই জায়গাড়া ভালো না। আপনের ব্রিফকেসে যদি টাকা থাহে তাইলে সাবধানে থাকবেন।
সুমন বিস্ময়ে একেবারে থ বনে গেল। আমতা-আমতা করে শুধু বলল : জায়গাটা সত্যি খারাপ?
হুঁ ভাইজান। যা কইছি তাই সত্য। আমার মনে হয় আপনের কারো সাহায্যের প্রয়োজন।
না না, আমার কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
তাইলে ভাইজান এইহানে নাইমা পড়েন। আমিনবাজার ছাইড়া আইছি।
ও আচ্ছা।
ড্রাইভার ভাড়া নেয়ার সময় সুমনের সাথে চোখাচোখি হল। ব্রিফকেসটার দিকেও তাকাল একবার। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না সুমনের। যাওয়ার সময় ড্রাইভার শুধু বলল : ভাইজান এইহানে বেশিক্ষণ থাকবেন না, জায়গাড়া ভালো না।
ড্রাইভার খুব দ্রুত গাড়িটা নিয়ে চলে গেল। ড্রাইভার চলে যেতে ভয় আর আতঙ্ক চারদিক থেকে গ্রাস করল সুমনকে। সে কী করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। এখানে রাস্তার দুপাশে মাল বোঝাই অনেক ট্রাক। লোকজনের চলাচল আছে। অধিকাংশই ট্রাকের হেলপার আর ড্রাইভার। তার দিকে দু-একজন তাকাচ্ছেও। আর এজন্য অস্বস্তিটাও বেড়েছে।
সুমন বুঝতে পারল এখানে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে লোকজন সন্দেহ করবে। তাই সে সাভারের দিকে হাঁটতে শুরু করল। কী ঘটবে ভাবতে চেষ্টা করল সে। হয়তো কোনো গাড়ি কিংবা হোন্ডা এসে ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ব্রিফকেসটা নিয়ে নেবে। অথবা হঠাৎই কেউ ট্র্যাকের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে তাকে ছুরি মেরে বা গুলি করে ব্রিফকেসটা ছিনিয়ে নেবে। নতুবা চার-পাঁচজন এসে তাকে মারধোর করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে নিয়ে নেবে ব্রিফকেসটা।
সুমনের কাছে থাকা সোবহান সাহেবের ফোনটা হঠাৎই বেজে উঠল। সাথে সাথে চমকে উঠল সুমন। সে বুঝতে পারল অল্পতেই ভয় পাচ্ছে সে। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করতে জোরে শ্বাস নিল। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না। ভয়টা আগের মতোই জেঁকে ধরে থাকল তাকে।
সুমন ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতে ওপাশ থেকে ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল : সুমন সাহেব, আপনি কোনহানে?
আমি এখন আমিনবাজার পার হয়ে সাভারের দিকে হাঁটছি।
চমৎকার। আপনে হাঁটতে থাকেন। কখনো থামবেন না।
হ্যাঁ আমি হাঁটছি।
যেভাবে কইছিলাম সব ব্যবস্থা করছেন তো?
হ্যাঁ করেছি। পাঁচ লাখ টাকা এনেছি, সাথে আমার স্ত্রীর গহনা।
সবকিছু কালো ব্রিফকেসে আছে?
হ্যাঁ আছে।
আপনের সাথে কেউ নাই তো?
না নেই।
আপনের বাবা?
বা নেই, তাকে আপনার কথামতো গাবতলী নামিয়ে দিয়েছি। চমৎকার। আপনি হাঁটতে থাকুন। একেবারে সাভারের দিকে হাঁটবেন। কখনো ডাইনে বামে কিংবা পিছনে তাকাবেন না। আপনের পাশে কালো রঙের একটা গাড়ি থামলে শুধু তহনই থামবেন। কোনোরকম কথা ছাড়া ব্রিফকেসটা গাড়ির ভিতরে বসা মানুষের হাতে দিয়া দিবেন। আপনে কি আমার কথা বুঝবার পারছেন?
হ্যাঁ পেরেছি।
কথার কোনোরকম বরখেলাপ করবেন না।
করব না।
আপাতত আপনের সাথে আমার আর কথা হবে না। পরে সময়-সুযোগমতো আমি আমার বাকি পাওনাটা বুইঝা নিব।
জি আচ্ছা।
আর কোনো কথা হল না। ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দিল কালোমানুষ।
সুমন উপলব্ধি করল কালো মানুষের কণ্ঠস্বর এবারো ভিন্ন ছিল। উপরন্তু মনে হচ্ছিল এবার বুঝি কণ্ঠস্বরটা অনেকদূর থেকে ভেসে আসছিল। তার সাথে যে কথা বলেছে সে-যে আগের জন থেকে ভিন্ন এ-বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই।
সুমন হেঁটে চলছে। তার পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে বেরিয়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার বড় বড় বাস আর ট্রাক। সুমন এতটাই ভীত যে একবার ডানে-বামেও তাকাচ্ছে না। মূল রাস্তার পাশে যে ঘাস তার উপর দিয়ে হাঁটছে সে। এখানে রাস্তায় লোকজন একেবারেই নেই। দুইপাশে শূন্য বিল। রাত গম্ভীর হতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডাও পড়েছে। ঠাণ্ডায় ভয়টা যেন আরো জেঁকে বসতে শুরু করেছে।
প্রায় পনেরো মিনিট একটানা হাঁটার পর কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠল সুমন। তাই সে প্রথমবারের মতো পিছনে ফিরে তাকাল। আর তখনই দেখতে পেল কালো রঙের একটা প্রাইভেট কার এগিয়ে আসছে। তার কেন যেন মনে হল এই গাড়িটাই সেই গাড়ি। কিন্তু পরক্ষণেই চমকে উঠল সে। কালো গাড়িটার পিছনেই একটি পুলিশের পিক-আপ।
সুমন ভেবে পেল না পুলিশ কীভাবে খবর পেল। তাই আরো আতঙ্কিত হয়ে উঠল সে। সাংঘাতিক কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে এ-বিষয়ে নিশ্চিত সে। কারণ গতি আরো বাড়ছে কালো গাড়ির। তবে পুলিশের গাড়িটি আগের গতিতেই চলছে। সে অবশ্য স্থির দাঁড়িয়ে আছে। রাতের ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছে সে।
সুমনকে অবাক করে দিয়ে কালো প্রাইভেট কারটি তার সামনে দিয়ে শাঁই করে বেরিয়ে গেল। আর পুলিশের গাড়িটি এসে থামল তার সামনে। গাড়ির মধ্যে দেখে লম্বা মতো একজন পুলিশ অফিসার নেমে এসে সরাসরি তার সামনে দাঁড়াল। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল : এত রাতে এখানে কী করছেন?
না..মানে… ইয়ে,,। সুমন আমতা-আমতা করতে লাগল। কোথা থেকে কী ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
আপনার ব্রিফকেসে কী? আবার প্রশ্ন করল পুলিশ অফিসার।
না.. মানে.. ইয়ে.. কিছু না।
নিশ্চয় কোনো মাদক অথবা অবৈধ কিছু? পাচারের চেষ্টা করছিলেন।
না। তেমন কিছু না।
তাহলে কি কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য?
বিস্ফোরক দ্রব্য থাকবে কেন?
তাহলে এত রাতে এখানে একা একা এই ব্রিফকেস হাতে কী করছেন?
আ.. আ..মি আসলে..।
হুঁ বুঝতে পেরেছি। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে সত্য কথাই বলেছে। আপনার আচরণ সন্দেহজনক। আপনার ব্রিফকেস, মোবাইল আটক করা হল। আপনাকেও থানায় যেতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে আমাদের হেফাজতে থাকতে হবে।
সুমন একেবারে অসহায় হয়ে পড়ল। তার ব্রিফকেস, মোবাইল নিয়ে নেয়া হয়েছে। তাকেও গাড়িতে উঠতে বলা হয়েছে।
সুমন যখন গাড়িতে উঠল তখন নিঃশব্দে একটা মাইক্রো এসে গাড়ির পিছনে থামল। মাইক্রোর ভিতরে কারা বসে আছে সুমন বুঝতে পারল না। কারণ ভিতরের লাইট বন্ধ থাকায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে যখন মাইক্রোর উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে পুলিশের পিক-আপ।
সুমন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সঁপে দিল ভাগ্যের হাতে। সে বুঝতে পারছে মাঝে মাঝে মানুষ ভাগ্যের কাছে সত্যি অসহায় হয়ে পড়ে।
.
৯.
থানায় এসে সবকিছু খুলে বলতে বাধ্য হল সুমন। থানার অফিসারদের সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে কষ্ট হত যদি-না ডিবির এসি শাহেদ সেখানে উপস্থিত থাকত। থানার ডিউটি অফিসার তারপরও অনেক কিছু জানতে চায় সুমনের কাছ থেকে। সবকিছু বিস্তারিত জানার পর একটা জিডি করে অবশেষে সুমনকে ছেড়ে দেয় তারা।
মাইক্রোবাসে করে শাহেদ যখন সুমনকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে তখন প্রথম প্রশ্ন করল সুমন : শাহেদ সাহেব, আপনি কি শুরু থেকেই আমাদের অনুসরণ করছিলেন?
হ্যাঁ শুরু থেকেই।
আপনি জানলেন কীভাবে যে আমরা এমন একটা বিপদের মধ্যে আছি।
আমরা আমাদের সোর্সের মাধ্যমে জেনেছি। ইচ্ছে করেই রিবিটের নাম বলল না শাহেদ।
আমি কি আপনাদের সোর্সের নাম জানতে পারি?
না পারেন না। আমরা কখনোই আমাদের সোর্সের নাম কাউকে বলি না।
ও আচ্ছা। একটু থেমে সুমন আবার বলল : তাহলে থানায় আপনারা কোনো খবর দেননি?
না দিইনি কিংবা থানার কোনো সাহায্য আমরা চাইনি। আপনি আর আপনার বাবা যে-ট্যাক্সিতে করে আমিনবাজার গিয়েছিলেন সেই ট্যাক্সির ড্রাইভার বুঝতে পারে আপনি বিপদে আছেন। তাই ফিরে আসার সময় সে থানাকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা অবহিত করে এবং থানার অফিসাররা আপনাকে খুঁজতে শুরু করে। আপনি স্বীকার করতে পারেন ট্যাক্সিড্রাইভার আপনার অনেক বড় উপকার করেছে।
কিন্তু এতে তো আমার বিপদ বাড়বে।
না বাড়বে না। বরং আপনি যদি আজ পাঁচ লাখ টাকা ওদের দিয়ে দিতেন ওরা আবার আপনার কাছে টাকা চাইত। ওরা আপনাদের বাড়ি বিক্রি করিয়ে পথের ফকির বানিয়ে ছাড়ত।
কিন্তু এখন কি আমরা নিরাপদ? আমার তো মনে হচ্ছে সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। বলল সুমন।
আপনার সেরকম মনে হওয়ার যুক্তিসংগত কারণ আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা এ-মুহূর্তে অনুমান করা সত্যি কঠিন। অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে এরকম বেনামী চাঁদাবাজরা ব্যর্থ হয়ে আর বিরক্ত করে না। আবার দেখা গেছে তারা আগের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে, অবশ্য যদি তারা শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরনের কেউ হয়।
কালোমানুষ কী ধরনের সন্ত্রাসী?
কালোমানুষ সম্পর্কে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আপনাদের ঘটনা থেকেই আমরা কালোমানুষ সম্পর্কে প্রথম জেনেছি। আশা করছি অল্পদিনের মধ্যেই আমরা কালোমানুষ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য পেয়ে যাব এবং ওদেরকে ধরতে পারব।
এই অল্পদিনে আমাদের নিরাপত্তার কী হবে? অসহায়ভাবে প্রশ্ন করল সুমন।
দেখুন, ব্যক্তিনিরাপত্তার উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত হচ্ছে নিজে সতর্ক থাকা। কাজেই প্রথমেই আমি আপনাকে বলব, আপনারা নিজেরা সতর্ক থাকবেন। আর আমরা তো আছিই। যখন প্রয়োজন আমাদের সংবাদ দেবেন। আপনারা যদি সংবাদ না দেন এবং আমরা যদি জানতে না পারি তাহলে আপনাদের মতো শত শত মানুষের কাছ থেকে কালো মানুষেরা টাকা নিতে থাকবে এবং আমরা কোনোদিনও ওদেরকে ধরতে পারব না। কাজেই আপনাদের নিরাপত্তা প্রদান যেমন আমাদের দায়িত্ব তেমনি আমাদের সহায়তা প্রদান করাও আপনাদের দায়িত্ব।
কিন্তু কালোমানুষ তো বলে আপনাদের জানালে ক্ষতি আরো বেশি হবে।
ওদের কাজই হবে আপনাদেরকে ভীত করে তোলা। আপনাদেরকে ওরা যত ভীত করতে পারবে ওরা তত সহজে ওদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে। আর আমাদেরকে যদি আপনারা জানান, অন্তত ওরা ভীত থাকবে এবং আমরা ওদেরকে ধরার সুযোগ পাব।
ধন্যবাদ শাহেদ সাহেব।
আপনি কি একটা বিষয় আমাদেরকে জানাবেন?
কী বিষয়?
আপনি কি একই লোকের সাথে বারবার কথা বলেছেন নাকি ভিন্ন কোনো লোক?
আমি জানি না। তবে কণ্ঠস্বর ভিন্ন ছিল।
টেলিফোনে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করা কঠিন কিছু না। আপনি রিসিভারের উপর ভিন্ন। ঘনত্বের কাপড় বা আবরণ ব্যবহার করলেই কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হবে। তবে কথার ধরন পরিবর্তন করা কঠিন। আপনার কী মনে হয় কথার ধরন পরিবর্তন হয়েছে?
ঠিক বুঝলাম না।
প্রত্যেক মানুষের কথা বলার ধরণ ভিন্ন। এই যেমন ধরুন কারো কথায় আঞ্চলিকতার টান থাকে, কারো কথা সম্পূর্ণ শুদ্ধ, কেউ আবার বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে। আপনার কাছে কি মনে হয়েছে কালোমানুষ সবসময় একইভাবে কথা বলেছে।
আমার কাছে ভাষার কোনো ভিন্নতা ধরা পড়েনি। তবে যে বা যারা কথা বলেছে তাদের কথায় আঞ্চলিকতার টান আছে। আর অবাক ব্যাপার হল প্রত্যেকেই কালো মানুষের কালো’ শব্দটা সবসময় শুদ্ধভাবেই বলে।
হুঁ। ঠিক আছে, আমরা আপনাদের বাসায় চলে এসেছি। আমার ফোন নম্বরটি রেখে দিন। প্রয়োজনে ফোন করুন।
সুমন শাহেদের ফোন নম্বর রেখে মাইক্রো থেকে নেমে গেল। মাইক্রো চলে যেতে সে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বাইরের গেটে দাঁড়িয়ে থাকল। দেখতে পেল এককোণায় একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে কয়েকজন পুলিশ বসে আছে। আর বাইরে দুজন হেঁটে বেড়াচ্ছে। পুলিশ দেখে সুমন সত্যি প্রশান্তি অনুভব করল। এই প্রথম সে অনুভব করল, পুলিশ দেখে আগে কখনো সে এখনকার মতো এতটা প্রশান্তি অনুভব করেনি। সে বুঝতে পারছে, আজ রাতে তার খুব ভালো ঘুম হবে।
.
১০.
পরিত্যাক্ত একটা চারতলা ভবনের নিচতলার বিশেষ একটা কক্ষ। একপাশে পুরাতন ভাঙা একটা চেয়ারে বসে আছে এক ব্যক্তি, শরীরে কালো আলখেল্লা। চেহারাটা মোটেও আকর্ষণীয় নয়। মুখভরা স্মলপক্সের দাগ, চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। দাঁতগুলোও হলুদ। দেখলে বোঝা যায় লোকটি নিজের শরীরের মোটেও যত্ন নেয় না, কিছুটা নোংরা প্রজাতির।
লোকটির সামনে যুবকবয়সী আরো দুজন বসে আছে। এদের নাম হারুন আর কেরামত। দুজনের অবস্থা তাদের বস্ ইদ্রিস আলীর মতোই। তারা সবাই মিলে কালোমানুষ।
ইদ্রিস আলী সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ডেকে উঠল : হারুন।
বস্।
কী খবর?
ভালো না বস।
ওরা আমাগো সাথে বেইমানী করছে।
জ্বি বস।
কেন বেইমানী করল?
জানি না। তয় মনে হয় ভিতরে কোনো গণ্ডোগোল বাঁধছিল। নইলে এমন হবার কথা না।
কেমনে বুঝলি?
পুলিশ যদি সত্যি আমাগো পিছে লাগত তাইলে এত সহজে আমাগো ছাড়ত না। পুলিশের পিক-আপটা সুমন সাহেবের সামনে আইসাই থাইমা যায়। আর এগোয় নাই। তুমি তো বস্ গাড়িতেই আছিলা।
হুঁ। তার মানে তোরা বলতে চাস্ সুমন কিছু জানত না।
তাই তো মনে হইতেছে। এবার কথা বলল কেরামত।
তাইলে পুলিশ জানল কেমনে?
হেইডা তো জানি না।
তোগা মাথায় আসলে কিছু নাই। মানুষের মাথায় গোবর থাকলেও কোনো কামে লাগে। তোগো মাথায় গোবরও নাই।
বস এমনে কইও না। তুমি কাম দাও, যদি কাম করবার না পারি তাইলে কইও। আমি নিজের হাতে তিনজনরে খুন করছি। তুমি কইলে আরো দুই-চাইরজনরে ফেলায় দিবার পারব। বলল কেরামত।
এবার হারুন বলল : বস, আমিও তো জেল থাইক্যা পালাইছি। জেলতে পালানো সোজা কতা না। ঢাকা শহরের এমন কোনো জায়গা নাই যেইহানে আমি ছিনতাই করি নাই। দিনে-দুপুরে হাজার হাজার মানুষের মইধ্যে আমি কাম সারছি। আর তুমি আমাগো অপবাদ দিতাছ, তা হয় না বস্। তুমি খালি হুকুম দাও, দ্যাখো কী করি।
কী করতে চাস তোরা? শীতল গলায় বলল ইদ্রিস আলী।
তুমি হুকুম দিলেই তিশাগো বাড়ির সবগুলা লাশ ফেলায় দিব।
তাতে লাভ?
আমাগো সাথে বেইমানি করার ঝাল মিটাইলাম।
থাম্। ধমকে উঠে বলল ইদ্রিস আলী। আসলেই তোগো মাথায় কিছু নাই, পচা গোবরও না। খালি আলতু-ফালতু কথা কস্। তিশাদের বাড়ির সবাইরে মাইরা আমাগো লাভ কী? আমাগো দরকার টাকা, মেলা টাকা, যেন এই কাম আর জীবনে করা না লাগে। আগে দুইডা অপারেশন করছি, আর দুই-চাইরড়া করবার পারলে সারাজীবন বইসা বইসা খাবার পারব। বুঝছস?
হ বস্, বুঝছি।
মনে রাখিস, আমাগো টার্গেট ঠিক রাখা লাগব। আমরা টার্গেটগো মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করবার পারছি। এহন যে-কামডা করা লাগব, তা হইল ওগো আরো আতঙ্কিত করা। আমরা যত আতঙ্ক সৃষ্টি করবার পারব আমাগো কাজ করা তত সহজ হবে।
এখন কেমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করবা বস?
প্রথম যে-কামডা করব তা হইল চিঠি লেখা। চিঠি আমি বলব, আর তোরা বাইরে কোনো কম্পিউটারের দোকানতে টাইপ কইরা আনবি। কোনোভাবেই হাতে লেইখা পাঠাবি না। এতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে।
হ বস, বুঝছি। এহন কও কী লিখা লাগব?
তোগো তো বইলা লাভ নাই। পড়ালেখা জানস না। নিজের নামডা পর্যন্ত লিখবার পারস্ না। যাইহোক, শুইনা রাখ আমি কী বলি। এইডাই লেইখা আনবি আর সময় সুযোগমতো তিশাগো বাড়িতে ঢুকায় দিবি। লিখবি–
সুমন সাহেব
কামডা আপনে ঠিক করেন নাই। আপনে কালো মানুষের সাথে বেইমানি করছেন। এর শাস্তি আপনের পাওয়া লাগব। আপনেরে এমন শাস্তি দিব যেন আপনার সারাজীবন মনে থাকব। আপনেরে জানানোর জন্য বলতেছি, আগেরবার যে আমাগো সাথে বেইমানি করছিল তার চোখ দুইডা আমরা তুইলা নিছিলাম। উল্লেখ্য, চোখ দুইডা খেজুরের কাঁটা দিয়া ভোলা হইছিল।
ইতি
কালোমানুষ।
ইদ্রিস তার বলা শেষ করতে কেরামত বলল : বস তো ডাহা মিথ্যা কথা লিখবার বলতেছ।
যা বলি তাই কর। আর হঁ, ফোনডা লাগা। ফোনের উপর এইবার মোটা কাপড় দি।
কোনহানে লাগাব?
সোবহান সাহেবরে।
ঠিক আছে বস্।
ওপাশ থেকে সোবহান সাহেব ফোন ধরতে ইদ্রিস আলী বলল : সোবহান সাহেব, কেমন আছেন?
কে বলছেন?
আমারে চিনলেন না। আমি কালোমানুষ।
জ্বি জ্বি..বলেন। কাঁপা গলায় বললেন সোবহান সাহেব।
আপনেরা কেমন আছেন?
জি…জি…
জ্বি জ্বি করছেন কেন। টাকা খরচ করা লাগে নাই, বাসার সবাই ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। তাই না?
জি..জি..
আমরা কিন্তু ভালো নাই। আর আপনেরা তো বোঝেনই, আমরা ভালো না থাকলে কাউরেই আমরা ভালো রাহি না। আর আমাগো সাথে বেইমানি করার পরিণাম তো আপনাগো জানা নাই। জানবেন জানবেন, অল্পসময়ের মইধ্যেই জানবেন।
আমরা বেইমানি করিনি।
সেটা এহন বিষয় না। টাকাপয়সা প্রস্তুত রাখবেন। মনে রাখবেন, খেলা কেবল শুরু। আর পুলিশ, পুলিশরে বইলা কোনো লাভ নাই। পুলিশ আমাগো টিকিটিও ধরবার পারব না।
আ..আ..আপনি..
হঁ আমি, আমরা, কালো মানুষেরা কহনও পরাজিত হই না। আমাগো সাথে খুব শীঘ্র আপনাগো দেহা হবে, হো.. হো.. হো।
লাইন কেটে দিল ইদ্রিস আলী। তারপর কয়েক মুহূর্ত থমকে বসে থেকে বলল : হারুন, নতুন অপারেশনের জন্য তৈরি থাহি। এইবারের অপারেশন হবে ঝুঁকিপূর্ণ।
কী অপারেশন বস্?
আমি চাই শিকার আমার নিয়ন্ত্রণে থাকুক। বুঝবার পারছস্?
হারুন, কেরামত দুজনেই ফিক করে হেসে দিয়ে বলল : বুঝবার পারছি বস্। কোনো চিন্তা করবেন না। সবকিছু প্রস্তুত থাকব।
ইদ্রিস আলী এবার চিবিয়ে চিবিয়ে বলল : দেহি এইবার কেমনে বেইমানি করে। এইবার আমি কড়ায়-গণ্ডায় সবকিছু বুইঝা নিব।
এই বলে ইদ্রিস আলী একটা বাঁকা হাসি দিল।
.
১১.
এরই মধ্যে সাতদিন পার হয়েছে। তিশাদের ব্যাপারে প্রথম দুইদিন রিবিট খোঁজ রেখেছিল। তারপর ডিবির এসি শাহেদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এই ধারণা থেকেই পরবর্তীতে আর খোঁজ রাখেনি তিশাদের। আজ ধানমণ্ডি এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই ইপি বলল : রিবিট, আজ পাঁচ দিন হল তুমি তিশাদের খোঁজ নিচ্ছ, না?
হ্যাঁ ইপি, তুমি ঠিকই বলেছ।
তোমার কি উচিত ছিল না তিশাদের বাড়ির সবার খোঁজ নেয়া?
তা ছিল। কিন্তু তেমন কিছু ঘটলে অবশ্যই তারা জানাত।
আগের মতো ভয়ে নাও জানাতে পারে।
পুলিশ তো খবর রাখছে।
প্রথমদিকে হয়তো রেখেছিল। এখন রাখছে কিনা সে-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। তোমার উচিত একবার হলেও খোঁজ নেয়া।
তাহলে চলো যাই, তিশাদের বাড়িতে যাই।
তিশাদের বাড়ি যেয়ে খুব একটা লাভ হবে না। ওদের বাড়ির কেউই তোমাকে সত্যকথা বলবে না।
তাহলে কোথায় যাব?
তিশার স্কুলে। ওখানে যেয়ে তুমি তিশার সাথে কথা বলবে। আমার বিশ্লেষণ বলছে, তিশা তোমাকে সত্য তথ্য প্রদান করবে।
তুমি ঠিকই বলেছ ইপি। তাহলে তিশার ওখানেই যাওয়া যাক। আর একটা কাজ অবশ্য করা হয়নি। আর তা হল কালোমানুষের খোঁজ নেয়া। পুলিশ কালো মানুষের খোঁজ পেয়েছে কিনা তাও জানতে চেষ্টা করিনি।
তুমি ডিবির এসি শাহেদের সাথে কথা বলে দেখতে পারো। ডিবি এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে। ওদের কাছে সকল শীর্ষসন্ত্রাসী এবং কুখ্যাত অপরাধীদের জীবন বৃত্তান্ত থাকে।
রিবিটের নিজেকে সত্যি অপরাধী মনে হল। সে বুঝতে পারল তিশার খবর রাখা ছিল তার দায়িত্ব। তিশা মেয়েটা বিপদে পড়েই তার সাহায্য চেয়েছিল। অথচ সে আর খবর রাখেনি। কাজটা যে ভালো হয়নি সে বুঝতে পারল। তাই সে আর অপেক্ষা করল না। ফোন করল এসি শাহেদকে।
শাহেদ ওপাশ থেকে ফোন ধরেই বলল : আরে রিবিট তুমি!
হ্যাঁ আমি, তোমার তো আর খোঁজখবর নেই।
খুব ব্যস্ত ছিলাম। দুটো মার্ডার নিয়ে এত ঝামেলায় পড়েছিলাম যে তোমাকে বোঝাতে পারব না।
আমার খুব ইচ্ছে একদিন তোমাদের অর্থাৎ পুলিশের সাথে ঘুরি। দেখি তোমাদের জীবনটা কেমন।
আমাদের জীবন দেখলে তুমি অনেককিছু জানতে পারবে। তবে একটা কথা বলছি, বেশিদিন এ জীবন ভালো লাগবে না। আমাদের এত সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয় যে তুমি দেখলে আমাদের জন্য সত্যি তোমার সহানুভূতি বেড়ে যাবে।
আমি জানি শাহেদ।
যাইহোক, বাদ দাও এসব কথা। এখন বলো কীজন্য ফোন করেছ?
ফোন করেছি তিশাদের সম্পর্কে জানতে। তুমি কি ওদের আর খোঁজখবর নিয়েছিলে?
হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়েছি। এই তো পরশুদিনও আমি তিশাদের বাসায় গিয়েছিলাম। ওর দাদু, বাবা-মা সবার সাথে কথা বললাম। তারা জানাল সবকিছু ঠিক আছে। সেই রাতের পর থেকে ওদের সাথে কালোমানুষ আর যোগাযোগ করেনি।
আর কালোমানুষ, ওদের কোনো খোঁজ পেয়েছ?
নির্দিষ্টভাবে পাইনি। তবে এটা বুঝতে পারছি কালোমানুষ নামের বিশেষ একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এরা বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোনে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে দুটো জায়গা থেকে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। আর একটা খবর অবশ্য পেয়েছি যেখানে কালোমানুষ একটা পার্টিকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করে ফেলেছে।
কী বলো!
হ্যাঁ রিবিট। ওরাও বোকামি করেছে, আমাদের কিছুই জানায়নি।
তাহলে কালোমানুষ নামে সত্যি একটা চাদাবাজ গ্রুপ তৈরি হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। তবে আমাদের বিশ্বাস, খুব অল্পসময়ের মধ্যেই আমরা ওদেরকে ধরতে পারব। আমরা অবশ্য চেষ্টা শুরু করেছি। সেদিন রাতে যে কালোগাড়িটা সুমন সাহেবের সামনে দিয়ে চলে গিয়েছিল সেটাকে খুঁজতে চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে আমরা কালো রঙের অনেক গাড়ির সত্যিকারের মালিকানা পরীক্ষা করে দেখেছি। অবশ্য এখন বুঝতে পারছি বাস্তবতা অনেক কঠিন। কারণ গাড়ির নম্বর আমাদের জানা নেই। তবে আমি নিশ্চিত, আজ হোক, কাল হোক কালোমানুষকে ধরা পড়তেই হবে।
আমিও আশা করব কালোমানুষ ধরা পড়ুক। যাইহোক, এটা শুনে ভালো লাগল যে কালোমানুষ আর তিশাদের হুমকি প্রদান করেনি।
হ্যাঁ রিবিট। এ-বিষয়ে তুমি নিশ্চত থাকতে পারো। তোমাকে ধন্যবাদ শাহেদ। প্রয়োজনে আবার আমি তোমাকে ফোন করব।
ঠিক আছে রিবিট। ভালো থেকো।
তুমিও ভালো থেকো।
তিশার স্কুলে আসার আগে রিমন দুবার তিশার মোবাইলে ফোন করতে চেষ্টা করল। কিন্তু তিশার মোবাইলে রিং বাজল না। রিবিট খানিকটা অবাক হয়ে বলল : ইপি, তিশার মোবাইলে রিং বাজছে না কেন?
আমরা ঠিক নিশ্চিত নই তিশার কোনো মোবাইল আছে কিনা। সেদিন যেটা থেকে করেছিল সেটা অন্য কারো মোবাইলও হতে পারে। আর ওর মোবাইল থাকলেও সেটা এখন বন্ধ থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ তিশার ক্লাস চলছে।
ইপি, তুমি ঠিকই ধরেছে। আমার বিশ্লেষণ মাঝে মাঝে কী বলে জানো?
কী বলে?
আমার থেকে তোমার বুদ্ধির মাত্রা বেশি।
না রিবিট। তোমার বিশ্লেষণ এক বলতে পারে না। তুমি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করো। অবশ্যই আমার চেয়ে তোমার বুদ্ধির মাত্রা বেশি
তাহলে স্কুলের সময় মোবাইল বন্ধ থাকবে এই সামান্য ব্যাপারটা আমার মাথায় এলো না কেন?
এল না এ-কারণে যে তোমার মধ্যে অনুভূতি আছে। কখনো তুমি সুখী থাকো, কখনো দুঃখী, কখনো আবেগপ্রবণ। তুমি এসব অনুভূতি অনুভব করতে ব্যস্ত থাকো। এজন্য তোমার মূল বিশ্লেষণটা ভিন্নদিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এ-ধরনের ঝামেলা নেই।
বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা ইপি, তোমার কি কখনো অনুভূতিকে অনুভব করতে ইচ্ছে করে না?
আমি দুঃখিত রিবিট। আমার অনুভূতিকে অনুভব করার ইচ্ছে প্রকাশ করার কোনো ক্ষমতা নেই। পাশাপাশি এটাও বলছি, তোমার এই প্রশ্নটি যুক্তিহীন।
ও আচ্ছা।
রিবিট যখন তিশাদের স্কুলে এল তখন স্কুলে টিফিন চলছে। রিবিটকে দেখে চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। ছেলেমেয়েরা সবাই দৌড়ে এল রিবিটকে ঘিরে ধরতে। তাদের সে কী উল্লাস! রিবিটও সবার সাথে কিছুক্ষণ আনন্দ-উল্লাসে সময় কাটাল। বাচ্চাছেলেদের অনুরোধে সে তার দু-একটা অতিমানবীয় ক্ষমতার নমুনাও প্রদর্শন করল। তার এই আচরণে সবাই খুশি হলেও প্রধানশিক্ষিকা খুশি হতে পারল না। টিফিন শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত রাগে গজগজ করতে থাকল সে। আর টিফিন শেষ হলে সবাইকে ধমকে ক্লাসে পাঠিয়ে দিল।
তিশার ক্লাসশিক্ষক মিস পিয়ালের সহায়তায় টিফিনের পর তিশার সাথে কথা বলতে পারল রিবিট। এতক্ষণ তিশাও রিবিটের সাথে মজা করেছে। আর এখন রিবিটকে একা পেয়ে বলল : রিবিট তুমি আসবে আমি জানতাম।
তাই বুঝি!
হ্যাঁ। কারণ আমি জানি তুমি কাউকে বিপদে ফেলে চলে যেতে পারো না।
তোমাদের না বিপদ কেটে গেছে?
না রিবিট। বিপদ কাটেনি। কালোমানুষ আমাদের সবসময়ই হুমকি দিচ্ছে।
তাই নাকি! তোমার দাদু, আব্বা-আম্মা কেউই তো ডিবির শাহেদ সাহেবকে কিছু বলেনি।
ভয়ে বলেনি। কালোমানুষ বলেছে কাউকে বললে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। আব্বকে একটা চিঠিও দিয়েছে। ভয়ংকর চিঠি।
চিঠিটি কখন এসছে? চিঠিতে কী লেখা আছে?
চিঠিটি এসেছে তিনদিন আগে। চিঠিতে কী লেখা আছে আমি জানি না। আমাকে চিঠিটি দেখতে দেয়া হয়নি। তবে দাদু আর আব্দুর কথা থেকে বুঝতে পেরেছি, চিঠিতে মানুষের চোখ তুলে ফেলার কথা লেখা হয়েছে। কী সাংঘাতিক, তাই না!
কী বলছ তুমি! অবাক হয়ে বলল রিবিট।
হ্যাঁ রিটি। কালোমানুষ গতকালও ফোন করেছিল। বাসার সবাই আমরা মোবাইল নম্বর পাল্টে ফেলেছি। তারপরও কালোমানুষ কীভাবে যেন আলুর ফোন নম্বর জেনে গেছে। ওরা খুব ভয়ংকর।
তুমি কীভাবে বুঝলে?
ওরা বলেছে দুই-একদিনের মধ্যে আমাদের সাংঘাতিক বিপদ ঘটবে। ভয়ে তো আবু-আম্মু আমাকে স্কুলেই আসতে দিতে চায় না। অন্যদিন আমি স্কুলভ্যানে স্কুলে আসতাম। চিঠি পাওয়ার পর থেকে দাদু আমাকে সাথে করে নিয়ে আসে আবার নিয়ে যায়।
তুমি কি জানো ওরা এখন কী চাচ্ছে?
ওরা চাচ্ছে দশ লাখ টাকা। এবার কাউকে জানালে নাকি সবাইকে মেরে ফেলবে। এজন্য কাউকে কিছু বলা হয়নি। আমাকেও বলতে নিষেধ করে দিয়েছে।
আবার দশ লাখ টাকা! বিস্মিত কণ্ঠে বলল রিবিট।
হ্যাঁ, দাদুর মন খুব খারাপ। দাদু বাড়িটা বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কী বলছ তুমি তিশা!
হ্যাঁ রিবিট, তুমি আমাদের সাহায্য করো। তা না হলে আমার দাদু খুব কষ্ট পাবে। বাড়িটা দাদুর খুব প্রিয়। বাড়ি বিক্রি ছাড়া দাদু কোনোভাবেই টাকা জোগাড় করতে পারবে না।
রিবিট কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ ঝিম্ মেরে বসে থাকল। তারপর বলল : ঠিক আছে তিশা, তুমি ক্লাসে যাও, দেখি কী করা যায়।
তিশা চলে যাওয়ার সময় বলল, প্লিজ রিবিট আমাদের সাহায্য করো। আর ভুলেও কাউকে বোলো না যে আমি তোমাকে এসব কথা বলেছি। তাহলে কালোমানুষ আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। প্লিজ রিবিট কাউকে কিছু বলবে না।
এ কথা বলে তিশা ক্লাসে চলে গেল।
তিশার কথা শুনে রিবিট একেবারে চুপসে গেল। সে বুঝতে পারল সত্যি তিশাদের খোঁজ না-রেখে সে মস্তবড় ভুল করেছে।
.
১২.
তিশা যখন স্কুল থেকে বের হল তখন দুপুর সাড়ে বারোটা। গেটের বাইরে তার দাদুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে প্রথমে ছুটে গেল তার কাছে। সোবহান সাহেব আদরের নাতিকে সাথে সাথে কাছে টেনে নিলেন। তারপর মিষ্টি গলায় বললেন : কী দাদু, ক্লাস শেষ হল?
হুঁ, তুমি কখন এসেছ?
এই তো কিছুক্ষণ হল।
তোমার তো আসার কোনো দরকার ছিল না দাদু। আমি একাই যেতে পারতাম।
না না, খবরদার।
কেন না? আগে তো আমি স্কুলভ্যানে সবার সাথে এসেছি। এখন তোমার সাথে আসি, সবাই আমাকে খ্যাপায়। আমি নাকি ছোট মানুষ।
কে বলল তুমি ছোট মানুষ? এই তো তুমি কত বড় হয়ে গেছ।
তাহলে কাল থেকে আমাকে অন্যদের সাথে আসতে দেবে।
না দাদু। তুমি তো জানো আমাদের খুব বিপদ। বিপদটা কাটুক, তারপর অন্যদের সাথে আসবে।
আমাদের বিপদ কেটে গেছে দাদু।
কেটে গেছে মানে! অবাক হয়ে বললেন সোবহান সাহেব।
আজ একজন এসেছিল যে সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। সে বলেছে আমাদের সমস্যার সমাধানে সাহায্য করবে। তুমি কোনো চিন্তা করবে না।
সোবহান সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন : কে এসেছিল?
এসেছিল, এসেছিল। তোমাকে বলা যাবে না।
তুমি কি তাকে কিছু বলেছ?
হ্যাঁ বলেছি। না বললে আমাদের সাহায্য করবে কীভাবে?
কী বলেছ?
যা বলার বলেছি। তোমাকে বলা যাবে না। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। এখন দাদু আমাকে আইসক্রিম কিনে দাও, আমি আইসক্রিম খাব।
সোবহান সাহেব খুব অস্বস্তিতে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন না তিশার কাছে কে এসেছিল। তিশাকে হাজারবার জিজ্ঞেস করেও কিছু জানা যাবে না। তিশা খুব জেদি। একবার কিছুতে ‘না’ বলেছে তো আর ‘হ্যাঁ’ বলবে না।
তিশা আবার বলল : দাদু আইসক্রিম খাব।
এমনিতেই ঠাণ্ডা পড়েছে, তার উপর আইসক্রিম খাবে কেন?
আমি অনেকদিন আইসক্রিম খাই না। তোমরাই তো আমাকে স্কুলে আসতে দাও না।
ঠিক আছে আইসক্রিম কিনে দেব। কিন্তু আইসক্রিম খেতে হলে তো আরো খানিকটা হাঁটতে হবে।
বেশিদূর তো না। চলো না হাঁটি।
সোবহান সাহেব তিশাকে নিয়ে আইসক্রিমের দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। এ মুহূর্তে তিনি বেশ অস্বস্তিবোধ করছেন। প্রথম কারণ হল তিশার কাছে কে এসেছিল তা জানতে না-পারা, দ্বিতীয় কারণ হল তিনি অতিরিক্ত সময় বাইরে আছেন। সময়টা খুব খারাপ। যে-কোনো সময় পথে যে-কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর তিনি এখন যে-পথ দিয়ে হাঁটছেন পথটা বেশ নির্জন। এই রাস্তার মাথায়ই আইসক্রিমের দোকান। এই পথটুকু হেঁটে যেতে কম করে হলেও পাঁচ মিনিট সময় লাগবে।
সোবহান সাহেব যখন তিশাকে নিয়ে অর্ধেক পথ এসেছেন ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। একটা কালো রঙের গাড়ি এসে ঘ্যাঁচ করে থামল তার পাশে। সোবহান সাহেব কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি থেকে দ্রুত বেগে নেমে এলো দুজন লোক। একজন কোনোরকম কথা ছাড়াই ভয়ানক এক ঘুসি কষাল সোবহান সাহেবের মুখ বরাবর। তারপরই লম্বা একটা ছুরি বের করে আঘাত হানল পেট বরাবর। কপাল ভালো, সোবহান সাহেব আগেই হাত দিয়ে ছুরিটা ধরে ফেলেছিলেন। এ-কারণে তার হাতের তালু কেটে গেলেও পেটের মধ্যে ছুরিটা ঢুকল না।
এদিকে অন্য একজন দুহাতে তিশাকে উঁচু করে গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে ডেকে উঠল : এই, তাড়াতাড়ি আয়। এহন আর মারিস না। জায়গাড়া ভালো না। আর ঐ বুড়ারে বল, হে যেন কোনোকিছু পুলিশরে না জানায়। জানাইলে তার নাতিরে আর জীবিত ফেরত পাবে না।
অন্য একজন, যে সোবহান সাহেবকে ছুরি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করছিল, সে ক্ষান্ত দিল। দ্রুত এসে ঢুকল গাড়ির মধ্যে। আর তখনই গাড়ি টান দিল সামনের সিটে থাকা একজন। এদিকে পিছনে কিছু লোক হৈ হৈ রৈ রৈ করে উঠতে গাড়ির মধ্যে বসে থাকা তৃতীয় ব্যক্তি খুব ঠাণ্ডামাথায় বাইরের দিকে দুটো ককটেল ছুঁড়ে মারল। ককটেলের বিস্ফোরণের শব্দে চারদিকটা এমনভাবে কেঁপে উঠল যে, যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল। শুধু ছুটতে পারল না রক্তাক্ত সোবহান সাহেব। শেষমুহূর্তে সে শুধু গাড়িটার নম্বর দেখতে চেষ্টা করল।
এভাবেই কালোমানুষ আর তার দলের সদস্যরা অপহরণ করল তিশাকে। বাইরে ককটেল ছোঁড়ার পর ইদ্রিস আলী তিশার চুল ধরে টেনে বলল : তোর নাম কি তিশা?
জি। কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল তিশা।
তোর বাবার নাম কি সুমন?
হুঁ।
কোনোরকম নড়াচড়া করবি না। টু শব্দও করবি না। যদি করস তাহলে তোর চোখ দুইডা খেজুরের কাঁটা দিয়া তুইলা নিব।
জি।
পাশ থেকে হারুন বলল : বস, এই ছোট্টগুলারে বিশ্বাস নাই। ফাঁক পাইলেই ছুট দিব। হাত-পাও বাইন্দা ফেলাই।
ঠিক আছে।
হারুনের কাছে আগে থেকেই দড়ি ছিল। সেগুলো দিয়ে শক্তভাবে সে তিশাকে বেঁধে ফেলল। মুখেও মোটা টেপ মেরে দিল। তারপর শুইয়ে রাখল সিটের উপর।
বড় রাস্তায় উঠতে ইদ্রিস আলী বলল : কিরে কেরামত, গাড়ি ঠিক আছে তো?
হ বস, একেবারে ঠিক।
কেউ পিছে লাগছে নি?
নারে বস্ না। এইরকম কাঁচা কাম কেরামত করে না।
তাইলে চল, দুইটা চল।
না বস্। ঢাকা শহরের মইধ্যে ছুঁইটা গাড়ি চালান যাবে না। তাইলে পুলিশ সন্দেহ করব। এমনিতেই বিপদের মইধ্যে আছি। তুমি খালি মাইয়াডার মাথাডারে ঠাইসা রাইখো যেন বাইরে থাইকা দেখা না যায়। কেউ দেইখা ফেলাইলে বিপদ।
না না, দেখব না। এই বলে ইদ্রিস আলীর তিশার মাথাটা সিটের সাথে চেপে ধরে রাখল।
তিশা বুঝতে পারল নড়াচড়া করার চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না। এরা সবাই খুব ভয়ংকর। সে নিজের চোখে এদের একজনকে তার দাদুকে ছুরি মারতে দেখেছে। তাই ভয়ে সে নড়তেও ভুলে গেল। ইদ্রিস আলী তাকে ঠিক যেভাবে চেপে ধরে রেখেছে সে ঠিক সেভাবে পড়ে রইল।
.
১৩.
বিকাল তিনটার সময় রিবিটের ফোন এল। ফোন রিসিভ করতে ওপাশ থেকে বয়স্ক এক ভদ্রলোক বলল : আপনি কি রিটি বলছেন?
হ্যাঁ, কে বলছেন?
আমি তিশার দাদা, আমার নাম সোবহান আহমেদ।
হ্যাঁ, আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। সেদিন আপনাদের বাসায় আপনার সাথে আমার কথা হয়েছিল।
রিবিট আপনি, ঠিকই ধরেছেন। খুব বিপদে পড়ে আপনাকে ফোন করেছি। আমাদের খুব বিপদ। কিছুক্ষণ আগে তিশাকে অপহরণ করা হয়েছে।
কী বলছেন আপনি! আঁতকে উঠে বলল রিবিট।
হ্যাঁ রিবিট। কে বা কারা আমার কাছ থেকে তিশাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। আর বলে দিয়েছে পুলিশকে জানালে তিশাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু পুলিশ সব জেনে গেছে। সন্ত্রাসীগুলো যাওয়ার সময় এমন জোরে ককটেল ফোঁটাল যে পুলিশ সবই জেনে গেছে। এখন তুমি ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
আপনি অধৈর্য হবেন না। এখন দেখা যাক কী করা যায়। সান্ত্বনার স্বরে বলল রিবিট।
আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার হাতের মধ্যে থেকে আমার তিশাকে ছিনিয়ে নিল, আমি কিছুই করতে পারলাম না।
আপনি কি এখন বাসায় আছেন?
হ্যাঁ বাসায় আছি। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।
হ্যাঁ আমি আসছি।
রিবিট কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ডেকে উঠল : ইপি!
হ্যাঁ রিবিট বলো। সাথে সাথে উত্তর দিল ইপি।
অঘটনটা যে এত দ্রুত ঘটবে তা কিন্তু আমি অনুমান করতে পারিনি। আজ সকালেই তিশার সাথে কথা বললাম। অথচ এর মধ্যেই ও অপহরণ হয়ে গেল। কারা করল?
কালোমানুষই হবে। আমার বিশ্লেষণ বলছে কালোমানুষ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে।
তাই যদি হয় তাহলে সত্যিই ভয়ংকর হবে ব্যাপারটা। এখন আমরা কী করতে পারি?
যেহেতু পুলিশ সবকিছু জেনে গেছে সেহেতু পুলিশের মাধ্যমে এগোনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। পুলিশ যত সহজে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবে তুমি পারবে না। অপহরণের ক্ষেত্রে কীভাবে কী করতে হয় নিশ্চয় পুলিশের জানা। তুমি ইচ্ছে করলে পুলিশকে সহায়তা করতে পারো। আমার বিশ্লেষণ বলছে তোমার সাহায্য পুলিশের ভালোই কাজে লাগবে।
আমি চাচ্ছিলাম আগে এসি শাহেদের সাথে কথা বলতে। যেহেতু শাহেদ আগে থেকেই বিষয়টা সম্পর্কে অবগত আছে সেহেতু তাকে বিষয়টা জানানো দরকার।
তুমি ঠিকই বলেছ। টেলিফোন করব?
করতে পারো।
ইপি দশ সেকেন্ড পরে বলল : টেলিফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে না।
সম্ভবত ব্যস্ত আছে। আমি সরাসরি ডিবি অফিসে যেতে চাচ্ছি।
তুমি তো আগে কখনো ডিবি অফিসে যাওনি।
না, আজই প্রথম।
ঢাকার ম্যাপ থেকে আমি ইতিমধ্যে লোকেশন বের করে ফেলেছি। এখান থেকে হেঁটে যেতে সর্বোচ্চ দশ মিনিট লাগবে।
ধন্যবাদ ইপি। এজন্যই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে। আমি যা করতে চাই তুমি কীভাবে যেন তা আগে থেকেই বুঝে ফ্যালো এবং সেটা করেও ফ্যালো।
ধন্যবাদ রিবিট।
আমার বিশ্লেষণ কী বলে জানো ইপি? তুমি যদি কারো পার্সোনাল সেক্রেটারি হতে তাহলে তুমি হতে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো পার্সোনাল সেক্রেটারি।
তুমি যেভাবে চিন্তা করছ সেটা সম্ভব নয় রিবিট। আমি নিতান্তই একটি প্রোগ্রাম। এরকম প্রোগ্রাম বড় বড় অফিসগুলোতে সবসময়ই ব্যবহার হচ্ছে।
কিন্তু তোমার মতো এমন চটপটে এবং দ্রুত-বিশ্লেষণ-ক্ষমতাসম্পন্ন প্রোগ্রাম খুব কমই আছে।
তোমার বিশ্লেষণ…তুমি…তু..
আমি.. কোনো…
এভাবেই চলতে থাকল রিবিট আর ইপির কথোপকথন। এটা নতুন কিছু নয়। রিবিট আর ইপির মধ্যে সবসময়ই এরকম যুক্তিতর্ক লেগে থাকে।
ডিবি অফিসে শাহেদকে সহজেই পেয়ে গেল রিবিট। ভিন্ন একটা কাজে ব্যস্ত থাকায় এতক্ষণ ফোন ধরতে পারেনি সে। শাহেদ রিবিটকে অফিসে আসার আমন্ত্রণ
জানালেও রিবিট রাজি হল না। সে সরাসরি বলল : তিশা অপহৃত হয়েছে।
কী বলছ! কখন?
দুপুরে।
হ্যাঁ বুঝতে পারছি। তাহলে যার কথা শুনেছি সেই মেয়েটাই তিশা। আমাদের কন্ট্রোলরুম থেকে বারবার বলছিল একটি মেয়ে অপহৃত হয়েছে। সেখানে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ শাহেদ, তুমি ঠিকই ধরেছ।
আমাদের তাহলে আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। এখনই তিশাদের বাসায় যেতে
চলো তাহলে।
রিবিট আর শাহেদ সাথে সাথে রওনা হয়ে গেল। গাড়িতে বসে শাহেদ বলল : এখন আমরা কী করতে পারি রিবিট?
কালো গাড়িটা খুঁজে বের করতে হবে।
আমরা ইতিমধ্যে খোঁজা শুরু করেছি। আমাদের কন্ট্রোলরুমে একটা নম্বর এসে পৌঁছেছে। সম্ভবত তিশার দাদুই পুলিশকে জানিয়েছিল। সেই গাড়িটিকেই খোঁজা হচ্ছে। আশা করি অল্পসময়ের মধ্যেই আমরা গাড়িটা বের করতে পারব। আর গাড়ি বের করতে পারলে তিশাকে উদ্ধার করা খুব কঠিন হবে না।
ইতিমধ্যে তোমরা কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করোনি?
করেছি। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হবে না। ঢাকা শহর থেকে বের হওয়ার জন্য যে-রাস্তাগুলো আছে সেখানে গাড়িগুলো তল্লাশি করা হচ্ছে। অবশ্য এটা একটা রুটিন-ওয়ার্ক। তারপরও উদ্ধারকাজ বা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে মন্দ নয়।
সময়মতো তল্লাশি শুরু করলে অবশ্যই তিশাকে উদ্ধার করা সম্ভব।
কিছুটা দেরি হত হয়েছেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আদৌ তিশাকে ঢাকার বাইরে নেয়া হয়েছে কিনা সেটা জানতে পারা। এমনো হতে পারে তাকে ঢাকার ভিতরে কোথাও লুকিয়ে রাখা হবে। সেক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন হবে।
এ-ধরনের কেইস সমাধান করার জন্য ডিবিতে কোনো বিশেষ অফিসার নেই?
আছে। তিশাদের বাসায় গেলেই দেখতে পাবে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টিমের সদস্যরা পৌঁছে গেছে। পাশাপাশি এ-বিষয়ে অভিজ্ঞ অফিসাররাও পৌঁছে যাবে। সেখানে গেলে পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা আরো বিস্তারিত জানতে পারব।
রিবিট কোনো কথা বলল না। এ-মুহূর্তে তার মূল প্রোগ্রামে ইলেকট্রনপ্রবাহ স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। সে বিশ্লেষণ করে বের করতে চেষ্টা করছে কী করলে তিশাকে উদ্ধার করা সম্ভব।
.
১৪.
তিশাদের বাসার পরিবেশটা থমথমে। তিশার আম্মা বিছানায়। পাশের বাসার দুজন মহিলা এসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না তাকে। কিছুক্ষণ পরপরই “তিশা তিশা বলে চিৎকার করে উঠছে। তিশার বাবাও কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আর তিশার দাদু সেই-যে এসে সোফায় বসেছে আর ওঠেনি। তার হাত অবশ্য ব্যান্ডেজ-করা। উপরের অংশটা লাল হয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে ভিতরে এখনো রক্ত ঝরছে।
সুমন অবশ্য ইতিমধ্যে পুলিশের সাথে দুবার কথা বলেছে। সুমন বলতে চায়নি। পুলিশই এসেছে। কথা বলতে বাধ্য হয়েছে সুমন। সবকিছু শোনার পর বাসার সামনে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। ব্যাপারটা এখন পুলিশকে না-জানানোর কিছু নেই। পুলিশ সবই জেনেছে। আর এই জানাটা যে তিশার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে সুমন।
সুমন ম্লানমুখে তার বাবা সোবহান সাহেবের পাশে সোফায় এসে বসল। ছেলেকে বসতে দেখে সোবহান সাহেব মুখ উঁচু করে বললেন : বৌমা খুব ভেঙে পড়েছে নারে।
হুঁ বাবা।
পড়ারই কথা। কীভাবে যে কী হলো। আগে যদি জানতাম তাহলে কি আর ওকে আইসক্রিম কিনে দিতে ঐ রাস্তায় যেতাম। আমার জন্যই আজ এমন হল।
তোমার জন্য হবে কেন বাবা। সবই আমাদের কপাল। কপালে দুর্ভাগ্য থাকলে কিছু করার থাকে না। আমাদের উচিত ছিল তিশাকে কিছুদিন স্কুলে যেতে না-দেয়া।
হ্যাঁ। কালোমানুষ যে তিশাকেই টার্গেট করবে সেটা আমাদের আগে থেকেই বোঝা উচিত ছিল। অবশ্য একেবারে যে বুঝতে পারিনি তা তো নয়। ওরাই তো বারবার ফোন করেছিল। চিঠি পর্যন্ত দিয়েছিল। চিঠিতে কী সব ভয়ংকর কথাও লেখা ছিল। আর আমরা কিনা..
সোবহান সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না। তার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
সুমন নিজেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল : বাবা তুমি ভেঙে পড়বে না। তুমি ভেঙে পড়লে আমি একেবারে অসহায় হয়ে পড়ব। এ-মুহূর্তে তোমার সাহায্য আমার খুব প্রয়োজন।
আমি বুঝতে পারছি বাবা। কিন্তু মন যে মানে না।
শান্ত হও বাবা। শান্ত হও..
সুমন কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠল। আগের মতোই সেই অপরিচিত নম্বর। তবে এবার আর মোবাইল ধরতে সুমন দেরি করল না। দ্রুত কানে লাগিয়েই বলল : হ্যালো।
ওপাশ থেকে গম্ভীর এবং টানা একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল : সু..ম.ন সা..হে..ব।
কে কে বলছেন? উৎকণ্ঠিত গলায় বলল সুমন।
আমি সেই কালো মনুষ। হো..হো..হো।
কালো মানুষের হাসিতে সুমনের অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।
কালোমানুষ এবার বলল : কেমন আছেন সুমন সাহেব?
দয়া করে আপনি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন।
হো.. হো.. হো… আবারো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল কালোমানুষ। হাসি থামলে বলল : দিব, সব দিব, আপনের মেয়েরে ফেরত দিব। তার চোখদুটোও ফেরত দিব।
কী বলছেন আপনি!
ঐ যে বলছিলাম, আমাগো সাথে বেইমানী করার শাস্তি ভয়ংকর। আপনে এহন তা হাড়ে হাড়ে টের পাইবেন।
কি..কিন্তু আমি তো আপনার সব কথা শুনেছি।
আপনে কিছুই শোনেন নাই। আমাগো সাথে বেইমানি করছেন।
না, বিশ্বাস করুন, আমি দশ লাখ টাকা জোগাড় করেছি। আমার বাবা বাড়িটা অর্ধেক টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে।
দশ লাখ টাকায় তো হবে না সুমন সাহেব। আমাগো দরকার বিশ লাখ টাকা।
কী বলছেন আপনি!
আমি যা বলছি সবই সত্য। আপনে চিন্তা কইরা দেহেন, মেয়ে বড় না টাকা বড়।
আ..আপনি একটু বুঝতে চেষ্টা করুন। ব্যাকুল হয়ে বলল সুমন।
আমি বুঝছি এবং ভালোই বুঝছি। এহন আপনের বোঝার পালা। বুঝলে বুঝবেন,–বুঝলে বুঝবেন না। আমাগো বিশ লাখ টাকা দরকার। এইডাই আসল কথা। আপনে যদি রাজি থাকেন তাইলে আগামীকাল সকাল এগারোটায় গাজীপুরের ন্যাশনাল পার্কের উত্তরে জোড়া তালগাছের গোড়ায় বিশ লাখ টাকা নিয়া হাজির হবেন। টাকা আগের মতোই কালো ব্রিফকেসে আনবেন। আমরা আপনের উপর নজর রাখব, যদি এদিক-ওদিক করেন তাইলে আপনের মেয়েরে আর ফেরত পাবেন না।
আমি তিশাকে ফেরত পাব কখন?
তিশারে নিয়া আপনের চিন্তা করা লাগব না। আমাগো হেফাজতে ও ভালোই আছে। আগে টাকা দেন, পরে সময়মতো আপনে খবর পাবেন
না না। আমি একই সাথে তিশারে চাই।
আরে মিঞা, বেশি বাড়াবাড়ি কইরেন না। তাইলে সবই হারাইবেন। যা কই, তাই হুনেন। আগে যদি আমার কথামতো চলতেন তাইলে আপনের এহন এতবড় বিপদে পড়তে হইত না। মনে রাখবেন, আমি আর আপনেরে ফোন করব না। কাইল সকাল এগারো পর্যন্ত আপনের মেয়েরে বাঁচায় রাখব। তারপর সবকিছু নির্ভর করব আপনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর।
আপনি তিশার সাথে আমাকে একবার কথা বলতে দিন। ও ছোট মানুষ।
না, আপনে কোনো কথা বলবার পারবেন না। আর ছোট বড় আমাগো কাছে কিছু। টাকাই আসল। টাকা ছাড়বেন তো সব ঠিক, নইলে কিছুই ঠিক না। আর আপনের সাথে আমার কথা হবে না। বিদায় সুমন সাহেব। শেষবারের মতো অনুরোধ করি, মেয়ের ভালো চান তো আমার কথামতো চইলেন।
একথা বলে ওপাশ থেকে কালোমানুষ ফোন কেটে দিল।
সুমন মাথায় হাত দিয়ে সোফার উপর বসে পড়ল। সোবহান সাহেবের বুঝতে কিছু বাকি রইল না। সে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল; ওরা কত টাকা চাইল?
বিশ লাখ বাবা।
ঠিক আছে তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তো বাড়িটা বিক্রি করেই দিচ্ছি। সম্পূর্ণ টাকাটাই নাহয় আমি দিয়ে দেব।
তুমি এত অল্পসময়ে বাড়ি বিক্রি করবে কীভাবে?
ঐ যে যার কথা বলেছিলাম। অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হবে, এই যা!
না বাবা, তা হয় না। ব্যাংকে মর্টগেজ রাখো।
ব্যাংক অনেক সময় নেবে। তাছাড়া কোনোদিনও আমাদের পক্ষে ব্যাংকের পোন শোধ করা সম্ভব হবে না। শেষে সম্পূর্ণ বাড়িটাও যাবে, টাকাও পাব না।
তুমি বাবা..
হ্যাঁ সুমন। তোমরা ছাড়া আমার আর কী আছে। তিশা যদি সুস্থমতো আমাদের কাছে ফিরে আসে সেটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
কিন্তু সত্যি কি আসতে পারবে?
অবশ্যই পারবে। আমি রিবিটকেও খবর দিয়েছি। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে রিবিট তিশাকে উদ্ধার করতে পারবে। রিবিট অনেক কিছুই পারে যা অন্যরা পারে না।
আমি কিছু শুনতে চাই না বাবা। আমি তিশাকে ফিরে পেতে চাই। হঠাৎই বাচ্চা মানুষের মতো ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বলল সুমন।
সেবাহান সাহেব কিছু বললেন না। তিনি শুধু সুমনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
.
১৫.
তিশা একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে পড়ে আছে। তার হাত-পা-মুখ শক্ত করে বাঁধা। চাইলেই ইচ্ছেমতো নড়তে পরছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। অনেকক্ষণ একইভাবে থাকাটা যে কী কষ্টের তা সে এরকম পরিস্থিতিতে না পড়লে কখনো জানতে পারত না। তাদের বাসার সবাই যে খুব বিপদে আছে এটাও সে বুঝতে পারছে। তিশা কালোমানুষের দলের সবার নাম জানতে পেরেছে কথোপকথনের মাধ্যমে। তার সামনেই সবাই একে অন্যের নাম ধরে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। ইদ্রিস আলী, যে কিনা কালোমানুষ দলের নেতা, তার নামটা জানতে অবশ্য তাকে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। অন্য দুজন তাকে বস বলে ডাকায় তার নাম জানার কোনো উপায় ছিল না। ইদ্রিস আলী অবশ্য অন্য একজনের সাথে কথা বলার সময় নিজের নাম বলে। সেখান থেকেই তিশা জানতে পারে কালো মানুষের নেতা এই ইদ্রিস আলী।
তিশাকে যখন নিয়ে আসা হয় গাড়ির মধ্যে তখন তাকে একটুও নড়তে দেয়া হয়নি। প্রায় এক ঘণ্টা গাড়িতে থাকার পর গাড়ি একটা সরু রাস্তায় প্রবেশ করে। তখন কিছুটা হলেও তাকে নড়তে-চড়তে দেয়া হয়। এ সময়ে কয়েকবার সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছে। তার মনে হচ্ছিল তাকে কোনো ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছিল। অবশেষে যেখানে গাড়ি এসে থামে সেখানে আবারো মাথা উঁচু করে বাইরের দিকে তাকায় সে। আর তখনই লেখা দেখে সাইনবোর্ডটি। সেখানে লেখা ছিল : ‘ওয়েভ গার্মেন্টস, গাজীপুর’। তিশা অনুমান করতে পারে তাকে গাজীপুরের ওয়েভ গার্মেন্টেসে নিয়ে আসা হয়েছে।
সেই থেকে সুযোগ খুঁজছে তিশা, কীভাবে নিজের অবস্থান কাউকে জানানো যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে-ধরনের কোনো সুযোগ আসেনি। মোবাইলটা প্রথমেই তার কাছ থেকে নিয়ে নেয় ইদ্রিস আলী। তারপর আর দেয়নি। এখানে আশেপাশে অন্য কোনো মানুষও নেই। তিশা অনুমান করতে পারে এটা একটা পরিত্যক্ত গার্মেন্টস্। পুরাতন ভবন ছাড়া আর কিছু নেই। এখানে কারো সাহায্য আশা করা বৃথা। তাই যা করার তা তার নিজেকেই করতে হবে।
সময় অনুমান করতে চেষ্টা করল তিশা। সে অপহৃত হয়েছে ছয়-সাত ঘণ্টা তো হবেই। এই লম্বা সময়ে তার কিছুই খাওয়া হয়নি। ক্ষুধায় চিনচিন করছে পেট। পানি পিপাসাও পেয়েছে। অথচ এতক্ষণে তাকে একফোঁটা পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি কালোমানুষদের কেউ। কয়েকবার ঘুম এলেও তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙে গেছে তার। এ মুহূর্তে সত্যি কষ্ট হচ্ছে! পিপাসায় ফেটে যেতে যাচ্ছে বুকটা।
দরজা খোলার শব্দে সামনের দিকে তাকাল তিশা। হ্যাঁ, যা ভেবেছিল তাই। ইদ্রিস আলী ভিতরে ঢুকছে। ইদ্রিস আলী ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর এগিয়ে আসতে থাকল তিশার দিকে। তিশা ভেবেছিল এবার বোধহয় এরা কেউ তার জন্য কিছু খাবার এবং পানি নিয়ে আসবে। কিন্তু ইদ্রিস আলীর হাত খালি দেখে সত্যি খুব হতাশ হল সে।
ইদ্রিস আলী সরাসরি তিশার সামনে এসে বসল। তারপর তিশার মুখের উপর হাতের টর্চলাইটটি ধরে বলল : কিরে বাইচা আছস, নাকি মরছস?
ওম্ ওহ্…। কথা বলতে চেষ্টা করল তিশা।
ইদ্রিস আলী রুক্ষকণ্ঠে বলল : তোরে বাঁচাইয়া রাইখা আমার কোনো লাভ নাই। তারপরও তোরে বাঁচাইয়া রাখছি। ছোট মানুষ। তোর তো আর কোনো দোষ নাই। তোর বাপটাই যত ঝামেলা করল। ভালোয় ভাসোয় টাকা দিয়া দিলেই পারত। কিন্তু তা করল না। পুলিশরে জানাইল। আমাগো বিপদে ফেলাবার যাইয়া হে-ই বিপদে পড়ল, তোরেও বিপদে ফেলাইল।
ইদ্রিস আলী কথা শুনে তিশা অসহায় দৃষ্টিতে ইদ্রিস আলীর দিকে তাকাল।
ইদ্রিস আলী মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করে বলল : কী আর করবি বল। কপালে কষ্ট থাকলে তা কি আর এড়ানোর উপায় আছে। কাইল সকাল পর্যন্ত আমরা তোরে বাঁচায় রাখব। এর মইধ্যে যদি তোর বাপ টাকা দিয়া দেয়, তাইলে বাঁচবার পারবি। নইলে ঘঁাচ কইরা কল্লাড়া নামাইয়া ফেলাব।
তিশা কিছুই বলল না। ঢোঁক গিলতে চেষ্টা করেও পারল না। গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছে। ভয়ও পেয়েছে খুব।
ইদ্রিস আলী এবার তিশার আরো কাছে এগিয়ে এলো। তারপর হঠাৎই তিশার মুখের টেপটা একটানে খুলে ফেলল। তীব্র ব্যথায় তিশার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে
লো। তার মনে হল কেউ বুঝি ছুরি দিয়ে তার মুখের চামড়াটা তুলে নিল। দীর্ঘক্ষণ টেপটা মুখের সাথে লেগে থাকায় তা শক্তভাবে চামড়ার সাথে আটকে গিয়েছিল। সেটা ভোলার সময় সত্যি খুব ব্যথা পেল তিশা। তবে এখন ভালো লাগছে। কারণ দীর্ঘক্ষণ একভাবে থাকতে থাকতে তার দাঁত আর মাড়ি প্রায় লেগে এসেছিল।
এরইমধ্যে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেছে হারুন। সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল : বস, ওরে খাবার না দিলেই পারতাম। খালি পয়সা খরচ।
কথাটা শুনেই তিশা চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাল। দেখল হারুনের হাতে পানির বোতল আর একটা প্যাকেট। সে বুঝতে পারল প্যাকেটে কোনো-না-কোনো খাবার আছে। পানি আর খাবারের উপস্থিতি উপলব্ধি করে তার পিপাসা আর ক্ষুধা দুটোই যেন বেড়ে গেল।
হারুনের কথায় ইদ্রিস আলী বলল : একেবারে অমানুষ হইয়া গেলে কেমনে হয়।
কিন্তু ঝামেলা বাড়ায় লাভ কী? তুমি হুকুম দিলে এহনই এইডারে পরজগতে পাঠায় দেই।
অহেতুক খুন-খারাবির মইধ্যে না-জড়ানোই ভালো। আমাগো দরকার টাকা। টাকা পাইলেই হয়। কেরামত কোন্হানে?
বাইরা আছে।
কোনো কি দরকার আছে? আমরা যে এইহানে আছি কেউ জানবারও পারব না।
আছে থাউক সতর্ক থাকলে দোষ নাই। একটু থেমে হারুন তিশাকে দেখিয়ে বলল : ওরে কি খাবার দিব না দিব, না?
আনছস যহন দে। হাতটা খুইলা দে। খাওয়া শেষ হইলে আবার বাইন্দা রাহিল।
হারুন তিশার হাত খুলে দিয়ে বলল : কোনোরকম তেড়িবেড়ি করবি তত শরীর থাইক্যা কল্লা নামায় ফেলাব। যা দিলাম, খাইয়া চুপচাপ বইসা থাকবি।
তিশা কিছু বলল না। পানির বোতলটা হাতে পাওয়া মাত্র একবারেই অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে ফেলল। তারপর খেতে শুরু করল কেক আর কলা। সে বুঝতে পারছে বেঁচে থাকতে হলে খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তার ক্ষুধাটা এতটাই প্রকট যে এ-মুহূর্তে যে সে চরম সংকটের মধ্যে আছে সেটা সে ভুলে গেল।
খাবার দেখে খানিকটা বিরক্তই হল ইদ্রিস আলী। সে হালকা ধমকের সাথে বলল: খুঁইজা খুঁইজা খালি কেক আর কলা নিয়া আইলি? আর কিছু পাইলি না?
বস, এইহানে কিছু পাওয়া যায় না। তুমি ভালোমতোই জানো। এই কলা আর কেক জোগাড় করতে আমার দুই কিলো যাওয়া লাগছে।
কেকটাও তো ভালো না।
ইচ্ছা হইলে খাও, না হইলে না-খাও। আগেই তো কইছিলাম টঙ্গী থাইক্যা খাবার নিয়া যাই। তুমি রাজি হও নাই।
তোর মাথায় আসলেই কিছু নাই। এই বিচ্ছুডারে সাথে নিয়া টঙ্গীতে খাবার কিনি? আর দুপুরে খাবার কিনলে কি এহন খাবার পারতি?
তাইলে আর এত কথা কও কেন? খাইয়া নাও। আমি যাই কেরামতরে খাবার দিয়া আসি।
একথা বলে হারুন বাইরে বের হয়ে গেল।
তিশা এবার নিশ্চিত হল সে গাজীপুর আছে। কারণ সে জানে টঙ্গী গাজীপুরের মধ্যে। পাশাপাশি এটাও বুঝতে পারল তাকে এত সহজে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। কারণ সবাই তাকে ঢাকায়ই খুঁজবে। এতদূর কেউ খুঁজতে আসবে না যদি-না সে কাউকে তার অবস্থান জানাতে পারে। কিন্তু তার যে-অবস্থা তাতে তার পক্ষে কাউকে তার অবস্থান জানানো অসম্ভব ব্যাপার।
তিশা লক্ষ্য করল ইদ্রিস আলীর দুটো মোবাইল। সম্ভবত সে এই মোবাইলগুলো দিয়েই ফোন করে। এ মুহূর্তে ইদ্রিস আলী খাবার না-খেয়ে মোবাইল দুটোর বাটনে টিপাটিপি করছে। কিছুটা অন্যমনস্ক সে। মনে হচ্ছে খাবার দেখে খুব বিরক্তও হয়েছে। তাই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে।
হঠাৎই ফোন এল ইদ্রিস আলীর। স্ক্রিনে নম্বর দেখে লাফ দিয়ে উঠল সে। সাথে সাথে কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো হ্যালো বলতে বলতে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। এ মুহূর্তে পিছন ফিরে কথা বলছে সে। তার অন্য মোবাইলটা তিশার ঠিক সামনে চেয়ারের উপর পড়ে আছে।
সুযোগটা যে এভাবে চলে আসবে তিশা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। সে বুঝতে পারছে ঝুঁকি না নিলে কিছুতেই সে বাঁচতে পারবে না। তাই দ্রুত মোবাইলটা তুলে নিল। পরমুহূর্তে মনে পড়ল তার বাসার সবাই মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করেছে। নতুন নম্বর তার মুখস্থ নেই। কিছুটা হলেও দ্বিধায় পড়ল সে। তারপরই মনে পড়ল রিবিটের কথা। রিবিটের মোবাইল নম্বরটা তার আগে থেকেই মুখস্থ ছিল। তাই আর দেরি করল না, মাত্র কয়েকটা শব্দ লিখে ম্যাসেজ পাঠাল রিবিটের নম্বরে। তারপর মোবাইলটা রেখে দিল আগের জায়গায়।
তিশা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ইদ্রিস আলী তখনো কথা বলে চলছে। কিছুটা হলেও নিশ্চিন্তমনে এবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করল তিশা। সে নিশ্চিত যেভাবেই হোক তাকে উদ্ধার করবে রিবিট।
.
১৬.
রিবিট আর শাহেদ তিশাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শাহেদ মোবাইলে কারো সাথে কথা বলছে। আর রিবিট তার মূল প্রোগ্রামে একটার-পর-একটা যুক্তি বিশ্লেষণ করে চলছে। কিন্তু কিছুতেই কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। তাই তার অভ্যন্তরে ইলেকট্রনপ্রবাহ কিছুটা হলেও অসম হয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ইপি অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে শব্দহীনভাবে রিবিটকে জানাল : রিবিট, তোমার অভ্যন্তরে ইলেকট্রনপ্রবাহ ভারসাম্য হারাচ্ছে। এটা প্রমাণ করে যে মানুষের মতোই তুমি অস্থির হয়ে উঠছ।
আমি অস্থির না হয়ে পারছি না। কিছুতেই আমি তিশাকে উদ্ধারের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।
এটা তোমার একার দায়িত্ব নয়। মূল দায়িত্বটা পুলিশের। তুমি পুলিশকে সাহায্য করতে পারো মাত্র।
কিন্তু আমি তো আমার দায়িত্ব এড়াতে পারি না। আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণসাধনের জন্য, তিশাকে উদ্ধারের জন্য।
তুমি তো তোমার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছ। সাহায্য করে যাচ্ছ সবাইকে।
কিন্তু আমি নিজে তো সন্তুষ্ট হতে পারছি না।
তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং শান্তভাবে কাজ করতে হবে। তোমার মধ্যে ইলেকট্রনপ্রবাহের ভারসাম্য যতটা বিনষ্ট হবে তোমার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ততটা হ্রাস পাবে। কাজেই তুমি ধীরস্থিরভাবে যুক্তিগুলোকে বিশ্লেষণ করো। আমি আশা করছি তুমি সমাধান পেয়ে যাবে। অন্তত কোনো-না-কোনো সূত্র পাবে।
রিটি বুঝতে পারল ইপি তাকে সঠিক পরামর্শই দিয়েছে। ইপির অন্যতম একটা কাজ হল তাকে দিকনির্দেশনা প্রদান করা, তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা। ইপি এ-মুহূর্তে সেই কাজটিই করেছে। অবশ্য তার স্বাধীনতা কিংবা ক্ষমতা রয়েছে ইপির পরামর্শ গ্রহণ করার বা না-করার। তবে এ-মুহূর্তে সে ইপির পরামর্শ গ্রহণ করার সিদ্ধান্তই নিল। তাই ইলেকট্রনপ্রবাহকে সুষম করতে সে তিশাকে নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করবে না বলে ঠিক করল। কিন্তু তার চিন্তায় বাধ সাধল শাহেদ। ফোনে কথা বলা শেষ হলে শাহেদ বলল :
রিবিট, আমরা বোধহয় আরো দূরে সরে গেলাম।
তুমি কী বলতে চাচ্ছ শাহেদ?
ভেবেছিলাম গাড়ির নম্বর থেকে কোনো সূত্র পাব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অপহরণকারীরা গাড়িতে যে-নম্বর ব্যবহার করেছিল সেই নম্বরের কোনো গাড়িই নেই। এইমাত্র বিআরটিএ থেকে এ-বিষয়ে আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছে।
কী বলছ তুমি! অবাক হয়ে বলল রিবিট।
হ্যাঁ রিবিট। অপহরণকারীরা পরিকল্পিতভাবে গাড়ির নম্বর পাল্টে নিয়েছিল অথবা তিশার দাদু ভুল নম্বর দেখেছিল।
তাহলে তো সম্ভাবনা আরো কমে এল।
হ্যাঁ। তাছাড়া শহরে যে-সকল স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে সেখান থেকেও আশাপ্রদ কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।
এতে আমরা ধারণা করতে পারি তিশা শহরের মধ্যেই আছে।
যদি-না চেকপোস্টের কার্যক্রম শুরুর আগেই তিশাকে শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে।
রিবিট খানিকটা হতাশ ভঙ্গিতে বলল : এখন আমাদের করণীয় কী?
সেটা নিয়ে আমিও ভাবছি। আমাদের লোকজন অবশ্য তিশার বাবার সাথে কয়েকবার কথাও বলেছে। তার কোনো শক্র কিংবা ক্ষতি করতে পারে এমন কেউ আছে কিনা জানতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সেরকম কারো তথ্য পাওয়া যায়নি।
আর মোবাইল ফোনের সন্ধান?
আমরা মোবাইল কোম্পানিকে বলেছি। যে মোবাইল থেকে সুমন সাহেবকে ফোন করে বিশ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে সেটা একটি আনোন নম্বর। ফলে কোন্ কোম্পানির মোবাইল নম্বর থেকে কলটি এসেছে তা বের করা কঠিন। তারপরও আমার সবগুলো মোবাইল কোম্পানির কাছে সাহায্য চেয়েছি। ঐ সময়ে সুমন সাহেবের কাছে যে কল এসেছে, কললিস্ট থেকে সেই কলারের মোবাইল নম্বরটি বের করা সম্ভব কিনা সেটাই চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কাজটি খুব কঠিন। আর যদি মোবাইল নম্বর পাওয়াও যায়, সংশ্লিষ্ট মালিককে নিশ্চয় এত সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই সম্পূর্ণ ব্যাপারটি ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করছে।
তাহলে আমাদের হাতে আর কোনো উপায় থাকল না। হতাশকণ্ঠে বলল রিবিট।
এখনো একটা সূত্র আছে। আর তা হল আগামীকালকের ঘটনার জন্য অপেক্ষা করা। অর্থাৎ জোড়া তালগাছের নিচে সুমন সাহেবের টাকা রেখে আসার ব্যাপারটা।
কিন্তু কালোমানুষ যখন জানবে চারপাশে পুলিশ আছে, নিশ্চয় ওরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে।
হয়তো উঠবে। কিন্তু এ ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো উপায় নেই। অবশ্য আমরা খুব সতর্কতার সাথে অপারেশন পরিচালনা করব। ইতিমধ্যে আমরা একটা টিম পাঠিয়েছি জোড়া তালগাছ এলাকাটা দেখে আসার জন্য। আশা করছি তারা কোনো ইতিবাচক তথ্য আমাদের দিতে পারবে।
অর্থাৎ আমাদের ‘যদির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
আমাদের অর্থাৎ পুলিশের কাজটা যদির উপরই নির্ভর করে বেশি। এভাবেই আমাদের কাজ করতে হয়। কখনো আমরা সফল হই, আবার কখনো হই না।
রিবিট কিছু বলল না। তার মধ্যেকার ইলেকট্রনপ্রবাহ আবার অসম হতে শুরু করেছে। অর্থাৎ মানুষের মতো অস্থিরতা বাড়ছে। সে বুঝতে পারছে সে যতই চেষ্টা করুক না কেন, এই অসম ইলেকট্রনপ্রবাহকে সে সুষম করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে তিশাকে উদ্ধার করতে পারবে। আর তার মধ্যে এই অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ তার অনুভূতি। ইপির অনুভূতি নেই বলেই ইপির কোনো অস্থিরতা নেই। ইপিকে মাঝে মাঝে তার সত্যি হিংসা হয়, কারণ অনুভূতি না-থাকার কারণে ইপির দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা অনুভব করার ক্ষমতা নেই।
রিবিট যখন এসব নিয়ে ভাবছে তখন হঠাই ইপি বলল : রিবিট, তোমার একটা ম্যাসেজ এসেছে।
কে পাঠিয়েছে?
অপরিচিত নম্বর থেকে।
কী লিখেছে?
লেখাটা অদ্ভুত।
তুমি পড়ো। আমার পড়তে ইচ্ছে করছে না।
ইপি পড়তে শুরু করল :
Wave Garments, Gazipur
Kalo Manus- Idris Ali, Harun and Keramot.
Ribit help me.
Tisa.
এ মুহূর্তে রিবিটের ইলেকট্রনপ্রবাহ পূর্বের তুলনায় আরো বেড়েছে। সে বুঝতে পারছে তার অভ্যন্তরের মূল প্রোগ্রাম তিশাকে উদ্ধারের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র খুঁজে পেয়েছে।
.
১৭.
গাজীপুরে একটি ওয়েভ গার্মেন্টস্-এর খোঁজ পাওয়া গেল। তবে গার্মেন্টসটির পুরো নাম ‘নিউ ওয়েভ গার্মেন্টস’ যেটা কিনা গাজীপুরে প্রবেশের মেইন রাস্তার পাশে। রাত এগারোটার সময় সাদা পোশাকে পুলিশ সম্পূর্ণ গার্মেন্টটিকে ঘিরে ফেলল। কিন্তু গার্মেন্টস্ দেখে রিবিটের নিজেরই সন্দেহ হল। গার্মেন্টটি সম্পূর্ণ সচল অবস্থায় আছে। রাত এগারোটার সময়ও কাজ করছে সকল কর্মীরা। কর্মীর সংখ্যা এক হাজারের কম হবে না। বোঝা যাচ্ছে খুব ব্যস্ত গার্মেন্টস। এখানে কাউকে অপহরণ করে রাখা হবে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
সাদা পোশাকের পুলিশ সম্পূর্ণ গার্মেন্টসৃটিকে ঘিরে ফেললেও ভিতরের কেউ টের পেল না। গার্মেন্টসের মালিকের সাথে প্রথম কথা বলল শাহেদ এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। মালিক তো কথা শুনে অবাক। সে নিজেই সাহায্য করতে এগিয়ে এল। ইদ্রিস, হারুন আর কেরামত নামের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হাজির করা হল।
এদের কাউকেই সন্দেহজনক বলে মনে হল না পুলিশের কাছে। অবশ্য হারুন নামের একজনকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সে আজ অফিসে আসেনি। সকালে অসুস্থতার কথা জানিয়েছে। পুলিশ আর অপেক্ষা করল না। উঠেপড়ে লাগল হারুনকে খুঁজে বের করতে।
রিবিট অবশ্য গার্মেন্টসের মধ্যে প্রবেশ করেনি। সে বাইরে দাঁড়িয়েছিল। কেন যেন তার বিশ্লেষণ বলছিল এখানে তিশাকে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই ইপির সাথে এ-বিষয়ে আলোচনা করছিল সে। ইপিও তার বিশ্লেষণী মন্তব্য করছিল।
রিবিট বলল : ইপি, তুমি কি মনে করো তিশা আমাদেরকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে?
কোনোভাবেই সেটা হতে পারে না।
তাহলে কি তিশার নাম দিয়ে অন্য কেউ এই ম্যাসেজ পাঠাল যেন আমরা ভুলপথে পরিচালিত হই?
সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
ঐ নম্বরটায় ফোন করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু অপরিচিত নম্বর হওয়ায় যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। তবে আমি নিশ্চিত তিশা এখানে নেই। এত মানুষের মধ্যে কাউকে কিডন্যাপ করে লুকিয়ে রাখা কঠিন।
তাহলে তিশা কোথায়?
তিশা যে-ঠিকানা লিখেছে সেখানেই। ওয়েভ গার্মেন্টস্, গাজীপুর।
আমরা তো ওয়েভ গার্মেন্টস গাজীপুরেই আছি।
না আমরা নিউ ওয়েভ গার্মেন্টস-এ আছি। আমার বিশ্লেষণ বলছে কোথাও ভুল হয়েছে। এমনো হতে পারে গাজীপুরে একাধিক ওয়ে গার্মেন্টস্ আছে।
কিন্তু সে-ধরনের কোনো তথ্য তো পাওয়া যায়নি।
রিবিট কিছু বলল না।
এরই মধ্যে শাহেদ নিচে নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে সেও দ্বিধান্বিত। এতক্ষণ তার মধ্যে যে উৎসাহ ছিল এখন আর নেই। কাছে এসে বলল : রিবিট, আমাদের মনে হচ্ছে নতুন করে ভাবতে হবে।
কী রকম?
আগামীকাল সকাল এগারোটার পরিকল্পনা নিয়ে। জোড়া তালগাছের নিচে টাকাগুলো রেখে আসার সময়ই আমাদের আসল ফাঁদ পাততে হবে।
কিন্তু ওরা তো বুঝে যাবে।
এ ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের নিরীক্ষণ শুরু করেছি। ব্যাপারটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
যদি কালোমানুষ সত্যি নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয় তাহলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর এসবক্ষেত্রে ঝুঁকি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই। একটু থেমে শাহেদ আবার বলল : তোমার কথার সূত্র ধরে বলছি, আমরা আমাদের ক্রিমিনাল ডেটাবেজ পরীক্ষা করে দেখেছি। ইদ্রিস আলী নামে কুখ্যাত কোনো সন্ত্রাসী নেই। তবে কেরামত নামে একজন আছে যে কিনা ভাড়াটে খুনী। তিশা যদি সত্যি কেরামত কর্তৃক অপহৃত হয়ে থাকে তাহলে বিপদের আশঙ্কাই বেশি।
আর হারুন?
হারুন নামে কয়েকজনই আছে। তবে সেরকম কুখ্যাত কেউ নেই। অবশ্য সন্ত্রাসীরা কে কখন কুখ্যাত হয়ে ওঠে তা বলা মুশকিল। এই দ্যাখো ওদের ছবি।
একথা বলে শাহেদ রিবিটকে কেরামত আর হারুনের ছবি দেখাল। তারপর পিছনের দিকে চলে গেল। রিবিট স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তার মধ্যে বিশ্লেষণের ঝড় বইছে। কিছুতেই মিলাতে পারছে না যুক্তিগুলো। তিশার ম্যাসেজটা যে মিথ্যা, কিছুতেই মানতে পারছে না সে।
রিবিটের সামনে দিয়ে গার্মেন্টেসের বড় বড় কার্টুনগুলো ট্রাকে ওঠানো হচ্ছে। তার একবার মনে হল এই কার্টুনগুলো পরীক্ষা করা হয়নি। পরবর্তীতে সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিল সে। আর যাইহোক, তিশাকে কার্টুনে ভরে গাড়িতে তোলার কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ থাকতে পারে না।
কার্টুনগুলো দেখতে যেয়ে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না সে। সে বুঝতে পারল না কেন ওয়েভ গার্মেন্টসের নাম নিউ ওয়েভ গার্মেন্টস্ হল। অবশ্য আজকাল নামের আগে নিউ জুড়ে দেয়াটা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই হল কিনা কিছুক্ষণ ভাবল রিবিট। কিন্তু সন্তোষজনক কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। এই গার্মেন্টসটা অনেক পুরোনো, প্রায় পনেরো বছর পূর্বের। কাজেই ‘নিউ লাগানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এই বিশ্লেষণ থেকে রিবিট নতুন করে আবার সকল যুক্তি মেলাতে শুরু করল।
রিবিট এবার নিজেই মালিকের অনুসন্ধানে বের হল। মালিককে অবশ্য সে পেল না। মালিক পুলিশকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। তবে রিবিট বয়স্ক একজন কর্মচারীর সাক্ষাৎ পেল। তাকে পেয়ে রিবিট জিজ্ঞেস করল : আপনি এখানে কতদিন কর্মরত আছেন?
পনেরো বছর। এই গার্মেন্টসের শুরু থেকেই।
আপনিই হয়তো তাহলে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। একটু থেমে রিবিট আবার বলল, এই গার্মেন্টসের নাম নিউ ওয়েভ গার্মেন্টস’ হল কেন?
আমি তো বলতে পারব না। মালিক বলতে পারবে।
ইয়ে..মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম নামের আগে ‘নিউ’ অর্থাৎ নতুন শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কেন?
ও তাই বলুন। এই ফ্যাক্টরিটি যখন তৈরি করা হয় তখন এখানে ‘ওয়েভ গার্মেন্টস্ নামে আর একটি ফ্যাক্টরি ছিল।
আর একটি ফ্যাক্টরি ছিল! উৎসাহ নিয়ে বলল রিবিট।
হ্যাঁ। সেটা অবশ্য এখান থেকে অনেক দূরে। বনের মধ্যে। তবে বছর-তিনেক হল ঐ গার্মেন্টসৃটি বন্ধ হয়ে গেছে। দুটো গার্মেন্টস্-এর নাম যেন এক না হয় সেজন্য আমাদের এই গার্মেন্টসের আগে ‘নিউ’ যোগ করা হয়েছে।
রিবিট সাথে সাথে বলল : অন্য গার্মেন্টস্ ফ্যাক্টরিতে কি এখন কেউ থাকে না?
না। সেটা পরিত্যক্ত। এখানে আসার আগে আমি সেখানে কাজ করতাম। তাও পনেরো বছর আগের ঘটনা।
রিবিট নিজের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করল। সে বয়স্ক ভদ্রলোককে আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করল না। শুধু ওয়েভ গার্মেন্টসের ঠিকানাটা নিয়ে রওনা হয়ে গেল তার উদ্দেশে।
.
১৮.
রিবিট যখন ওয়েভ গার্মেন্টসের সামনে এসে দাঁড়াল তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। বিশাল এলাকা নিয়ে ওয়েভ গার্মেন্টস্। চারদিকটা তারকাটার বেড়া দিয়ে ঘেরা। তবে মূল গেটটা লোহার। গার্মেন্টসের চারপাশে ঘন শালবন। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এখানে এতবড় একটা গার্মেন্টসের ফ্যাক্টরি আছে। মূল রাস্তা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে।
রিবিট যখন বাইরের গেটে এসে দাঁড়াল ইপি তখন রিবিটকে সতর্ক করে দিয়ে বলল : রিবিট তুমি কি কাজটা ঠিক করছ?
কেন?
তোমার অবশ্যই পুলিশকে জানানো উচিত ছিল। তুমি ভয়াবহ ঝুঁকি নিচ্ছ। তিশাকে উদ্ধার করতে যেয়ে যদি সত্যি তিশার কোনো ক্ষতি হয় তুমি তার দায়
এড়াতে পারবে না।
আমি জানি ইপি। কিন্তু এ ছাড়া যে অন্য কোনো উপায় নেই। আমি পুলিশকে জানালে পুলিশ চারদিকটা ঘিরে ফেলবে এটা ঠিক। কিন্তু কালোমানুষ যদি পুলিশের অস্তিত্ব জেনে যায় তাহলে তারা তিশাকে হত্যা করতে পারে।
তোমার অবস্থান জেনে গেলেও কালোমানুষ তিশার ক্ষতি করতে পারে।
আমার যুক্তি বলছে আমি অধিকতর সতর্কতার সাথে কাজ করতে পারব।
আমি তোমাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করতে পারছি না। তুমি অহেতুক ঝুঁকি নিচ্ছ।
আমি চেষ্টা করছি ইপি। আমাকে চেষ্টা করতে দাও।
আমি শুধু তোমাকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করতে পারি রিবিট। কিন্তু আমার পরামর্শ গ্রহণ করা বা না-করা একান্তই তোমার। তবে এ-মুহূর্তে তোমাকে অনুরোধ করছি তুমি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এসি শাহেদকে জানাও।
রিবিট কয়েক মুহূর্ত সময় নিল। তারপর বলল : ঠিক আছে ইপি। আমি জানাচ্ছি। তবে আমার বিশ্লেষণ বলছিল এ-মুহূর্তে না-জানালেও পারতাম।
রিবিট কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু একইসাথে ফোনের মাধ্যমে সে তার অবস্থান সম্পর্কে শাহেদকে জানিয়ে দিল। পাশাপাশি এটাও জানাল যে তিশার এখানে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
ওয়েভ গার্মেন্টসের কোথাও ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে না। তবে আকাশে চাঁদ থাকায় চারদিকটা কিছুটা হলেও আলোকিত। বিবিটের অবশ্য অসুবিধা হচ্ছে না। অন্ধকারে তার দেখার ক্ষমতা আছে। আর এই দৃষ্টিক্ষমতাবলেই সে দেখতে পারছে এখানে বড় বড় তিনটি চারতলা ভবন আছে। আশেপাশে আরো কিছু ছোট ভবনও রয়েছে। তিশাকে যে এই ভবনগুলোর কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে এ-বিষয়ে রিবিটের কোনো সন্দেহ নেই। কারণ জায়গাটা কাউকে লুকিয়ে রাখার জন্য উত্তম।
মূল গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশের সময় ওয়েভ গার্মেন্টসের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল রিবিটের। সাইনবোর্ডটি অনেক পুরাতন। অর্ধেক প্রায় ভেঙে পড়েছে। তবে লেখাটা স্পষ্টভাবে এখনও পড়া যায়। একসময় যে এই গার্মেন্টটা ভালো অবস্থানে ছিল তা নিচের পিচের রাস্তা দেখেই বুঝতে পারল রিবিট। মূল রাস্তা থেকে এত দূ্রে শক্ত পিচের রাস্তা করা যথেষ্ট খরচের ব্যাপার। মালিক পর্যাপ্ত লাভ করতে না পারলে কখনোই এত টাকা ব্যয়ে এতদূরে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি করত না।
রিবিষ্ট যখন ভাবছে কীভাবে তিশাকে খোঁজা শুরু করবে তখনই সূক্ষ্ম একটা বিষয় নজরে এল তার। নিচের রাস্তাটা ধুলো-বালি জমে থাকলেও তাতে গাড়ির চাকার দাগ স্পষ্ট; গাড়ির চাকার দাগ দেখে রিবিট বুঝতে পারল গাড়িটা দু-একদিনের মধ্যেই এখান দিয়ে চলাচল করেছে। এতে তার সন্দেহ আরো ঘনীভূত হল। আরো একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত হল, এখানে কেউ-না-কেউ আছে। সম্পূর্ণ ফ্যাক্টরির কোথাও আলো না-জুলার ব্যাপারটা আরে রহস্যজনক মনে হল তার কাছে। মালিক নিশ্চয় এখানে পাহারায় কাউকে-না-কাউকে রাখবে। সে যদি এখানে সত্যি থেকে থাকে তাহলে কেন রাতে আলো জ্বালাবে না!
রিবিট রাস্তা ধরে এগোতে শুরু করল। খুব বেশিদূর এগোতে হল না তাকে। চারতলা একটা ভবনের নিচে এসে শেষ হয়েছে রাস্তাটা। রাস্তার একেবারে শেষ মাথায় ভবনটির নিচেই সে দেখতে পেল কালো গাড়িটাকে। পুরাতন মডেলের একটি টয়োটা প্রিন্টার। রিবিট বুঝতে পারল এই গাড়িটিই ব্যবহার করেছিল কালো মানুষেরা। সে আরো নিশ্চিত হল যখন গাড়ির মধ্যে একটা স্কুলব্যাগ দেখতে পেল। স্কুলব্যাগটিও যে তিশার সে-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকল না রিবিটের। আর যখন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি দেখল তখন নিশ্চিত হল সে সঠিক জায়গায়ই এসেছে। তিশার দাদু যে-নম্বর বলেছিল সেই নম্বরের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে গাড়ির নম্বরটি।
বাইরে মূল দরজার সামনে এসে দেখল দরজাটি ভিতর থেকে বন্ধ। রিবিট বুঝতে পারল ভিতরে কেউ-না-কেউ আছে। তবে সে দরজায় ধাক্কা দিল না কিংবা অন্য কোনো শব্দ করল না। সে ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিল। সে উপলব্ধি করতে পারছে তার সামান্য ভুল তিশার ভয়ানক পরিণতির কারণ হতে পারে।
রিবিট মূল ভবনটির চারপাশে খুব সতর্কতার সাথে ঘুরে এল একবার। পিছনে একটা ভাঙা জানালা দেখে ঠিক করে রাখল যদি ঢুকতেই হয় তাহলে এই জানালা দিয়েই ভিতরে ঢুকবে। রিবিট এবার সময় নিয়ে অন্য ভবনগুলো ঘুরে দেখল। প্রত্যেকটি ছোট বড় ভবনই বাইরে থেকে তালা দেয়া। কোনোটিতেই আলো জ্বলছে না। প্রত্যেকটি ভবনের মূল দরজার সামনে ধুলোর আস্তরণ জমেছে। এমনকি তালাগুলোর উপরও একই অবস্থা।
সবগুলো ভবন দেখার পর রিবিট নিশ্চিত হল এখানে কেউ যদি থেকে থাকে সে ঐ গাড়ি-সংলগ্ন ভবনে আছে। তিশা যদি এখানে থাকে তাহলে ঐ ভবনেই থাকবে। রিবিট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল। সে ভবনের মধ্যে প্রবেশ করবে। তাই সে হেঁটে হেঁটে একেবারে পিছনে চলে এল। তারপর এল ভাঙা জানালটার কাছে। এই জানালার পাল্লা ভাঙা হলেও লোহার গারদগুলো ঠিকই আছে। কারো পক্ষে এই গারদের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
রিবিট জানালা দিয়ে ভিতরে তাকাল; ভিতরটা অন্ধকার হলেও দেখতে পেল সে। নাইটভিশন ক্ষমতা থাকায় অন্ধকারেও দেখতে পায় সে। তবে কিছু দেখতে অনেকটা সবুজাভ মনে হয়। রিবিট ভালোমতো তাকাতে বুঝতে পারল ভিতরের কক্ষটা অনেক বড়। এখানে-ওখানে কিছু ভাঙা চেয়ার-টেবিল ছাড়া আর কিছু নেই।
রিবিট দুহাতে লোহার দুটো গারদ টান নিতে বুঝতে পারল সাধারণ শক্তিতে এটা বাঁকানো সম্ভব নয়। সে অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ডেকে উঠল : ইপি।
ইতি সাথে সাথে উত্তর দিল : বলো রিবিট।
আমার শক্তি বৃদ্ধি প্রয়োজন।
ইপি একমুহূর্ত সময় নিল। তারপর বলল : বৃদ্ধি করা হয়েছে, লেভেল মিডিয়াম।
রিবিট এবার দুহাতে টান দিতেই খুলে এল জানালার গারদ দুটো। ও দুটোকে মাটিতে ফেলে একলাফে সে উঠে বসল জানালার উপর। তারপর শব্দহীন এক লাফে নেমে পড়ল কক্ষের ভিতরে। ভিতরে এতটাই ধূলো যে রিবিটের পা প্রায় এক সেন্টিমিটার ধূলোর মধ্যে ডেবে গেল।
রিবিট এখন যা-কিছু দেখছে সবই সবুজাভ। কিন্তু তার হাঁটতে কিংবা চলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। সে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দরজার কাছে চলে এল। দরজাটা ভেজানো ছিল। পাল্লা ধরে টান দিতেই খুলে এল দরজাটা। এই দরজাটা লম্বা একটা করিডোরের সাথে সংযুক্ত। করিডোরটা এমাথা থেকে অন্যমাথা পর্যন্ত চলে গেছে। করিডোরের দুপাশে সারি সারি দরজা। রিবিট বুঝতে পারল এই ভবনটা মূলত গোডাউন হিসাবে ব্যবহার হত। চূড়ান্তভাবে তৈরি পোশাকসমূহ এখানে রাখা হত। এজন্য এখানকার কক্ষগুলো বেশ বড় বড়।
সম্পূর্ণ ভবনটিতে কীভাবে তিশাকে খুঁজবে সে-বিষয়ে বিশ্লেষণ করতে শুরু করল রিবিট। তিশাকে খুঁজে পেতে হলে প্রতিটি কক্ষ তাকে খুব সতর্কতার সাথে খুঁজতে হবে। তাছাড়া ভবনটি তার অপরিচিত। হাঁটার সময় টুকটাক শব্দও হতে পারে। সেরকম কিছু হলে নিজেকে লুকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। কোনোভাবে যদি কালোমানুষ জেনে যায় যে সে এখানে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
রিবিট যখন একটা কক্ষ পরীক্ষা করে অন্য একটা কক্ষ পরীক্ষা করছে তখনই সে জানালা দিয়ে বাইরে টর্চের আলো দেখতে পেল। সে খুব সতর্কতার সাথে জানালার কাছে এসে বাইরে উঁকি দিতে বুঝল পুলিশ ঘিরে ফেলতে শুরু করেছে চারপাশটা। টর্চের আলো পুলিশেরই ছিল। পুলিশ যে এত দ্রুত এখানে এসে পৌঁছাবে সে তা ভাবতে পারেনি।
রিবিট আরো দুটো কক্ষ পরীক্ষা করতে এসি শাহেদের ফোন এল। অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শব্দহীনভাবে উত্তর দিল রিবিট। এটা বিশেষ এক পদ্ধতি। রোবট যে-কথাগুলো বলতে চাইবে তা সরাসরি টেলিফোন-নেটওয়ার্কে চলে যাবে। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে রিবিট বুঝি চুপচাপ আছে। ঠিক এইভাবে রিবিট আর ইপি নিজেদের মধ্যেও কথা বলে।
এসি শাহেদ বলল : রিবিট তুমি কোথায়?
আমি ভবনের মধ্যে।
কোন্ ভবনে?
যে-ভবনের সামনে গাড়িটা আছে সেটার মধ্যে।
ওটার ভিতর থেকে তো বন্ধ। তুমি নিশ্চয় পিছনের জানালা দিয়ে ঢুকেছ। ওখানে দুটো লোহা ভাঙা দেখলাম।
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ।
তুমিই কি ভিতরে আলো জ্বালিয়েছিলে?
শাহেদের প্রশ্ন শুনে অবাক হল রিবিট। বলল : কই নাতো! আমি তো এই ভবনের মধ্যে কোনো আলো জ্বালাইনি।
তুমি কি একটু পরীক্ষা করে দেখবে কে আলো জ্বালিয়েছে?
এটা কোন্ জায়গায়?
একতলায়, একেবারে উত্তরপাশে।
আমি মাঝামাঝি আছি। ধীরে ধীরে ওদিকে অগ্রসর হচ্ছি।
ঠিক আছে তুমি এগোতে থাকো, আমরাও এগোচ্ছি।
শাহেদের সাথে কথা শেষ হতেই খুট একটা শব্দ কানে এল রিবিটের। সাথে সাথে সতর্ক হয়ে উঠল রিবিট। বুঝতে পারল আশেপাশে কেউ আছে। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে বাইরে করিডোরে তাকাতে দেখল উত্তরপাশের একটা দরজা দিয়ে করিডোরে বেরিয়ে এল একজন। লোকটা অল্পবয়সী। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এর স্বভাব ভালো হতে পারে না।
রিবিট যে-কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে সেই পর্যন্ত এল না লোকটা। তার আগেই ডানে ঘুরে চলে গেল বাইরে বেরোনোর মূল দরজার কাছে। এরই মধ্যে মোবাইলে কারো সাথে কথা বলতে শুরু করেছে সে। চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট।
রিবিট অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ইপিকে বলল : ইপি, লোকটিকে চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ রিবিট। আমি তোমার মেমোরিতে সংরক্ষিত ছবিগুলোর সাথে লোকটির চেহারা মিলিয়ে দেখেছি। এ হচ্ছে কেরামত, পেশাদার খুনী। ডিবি অফিসে এর ছবি সংরক্ষিত আছে। এসি শাহেদ তোমাকে কেরামত আর হারুনের যে-ছবি দেখিয়েছিল এ হচ্ছে সেই কেরামত।
কী সাংঘাতিক! তাহলে তিশা সত্যি এদের হাতে পড়েছে।
হ্যাঁ রিবিট, খুব সতর্ক থাকতে হবে।
রিবিট আর অপেক্ষা করল না। দ্রুত করিডোরের মাঝে এসে অপেক্ষা করতে লাগল দরজার পিছনে। এই দরজা খুলেই কেরামত বাইরে বেরিয়েছে। কেরামত দরজার ঠিক ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইলে এখনো কারো সাথে কথা বলছে সে। রিবিট স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কথা। কেরামত বলছে : বস, মনে হয় সমস্যাই হইল। বাইরে সম্ভবত পুলিশ আছে… হালার বাপটা পুলিশরে এইবারও খবর দিছে…. মাইয়াভারে বাঁচায় রাইখা লাভ নাই… হ দেখতাছি… তুমি সতর্ক হও… আমি আসতাছি…।
মোবাইলের ওপাশে কেরামত কার সাথে কথা বলছিল রিবিট তা বুঝতে পারল না। ওপাশের লোকের কথাও শুনতে পাচ্ছিল না সে। তবে সে নিশ্চিত, এরা সবাই কালো মানুষের দলেরই সদস্য।
রিবিট দরজার পিছনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে ইলেকট্রনপ্রবাহ এখন খুব সুষম। খুব ধীরস্থিরভাবে কাজ করবে সে। কিছুই বুঝতে দেবে না কেরামতকে।
কেরামত ভিতরে প্রবেশের জন্য যেই না পা বাড়ল তখনই রিবিট খপ করে কেরামতের গলা চেপে ধরল। তারপর ভূমি থেকে প্রায় ছয় ইঞ্চি উপরে তুলে চাপা স্বরে বলল : তিশা কোথায়?
এমন কিছু যে ঘটবে কেরামত ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। সে চোখ বড় করে রিবিটের দিকে তাকাতে রিবিট আবার বলল : তিশা কোথায়?
জানি না।
তিশা কোথায়? এবার ধমকে উঠে বলল রিবিট।
জানি না। বলে কুৎসিত একটা হাসি দিতে চেষ্টা করল কেরামত।
রিবিট এবার হাতের চাপ আরো বাড়াল। তাতে কেরামতের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল। কিন্তু তারপরও সে বলল না তিশা কোথায়। এরই মধ্যে রিং বাজতে শুরু করল কেরামতের মোবাইলে। রিবিট কিছু করার আগেই ফোনের রিসিভ বাটনে চাপ দিল কেরামত। তারপর চিৎকার করে উঠে বলল : বস, বিপদ।
রিবিট আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না কেরামতকে। মাথার পিছনে স্পর্শকাতর স্থানে এমনভাবে আঘাত করল যে সাথে সাথে জ্ঞান হারাল কেরামত। কেরামতের মূল উদ্দেশ্যটা বুঝতে পেরেছে রিবিট। কেরামত ফোন কানে না-লাগিয়েই কথা বলেছে। তার মানে সে চেষ্টা করেছে তার বসকে বুঝিয়ে দিতে যে সে বিপদে আছে এবং সেক্ষেত্রে সে সফল হয়েছে।
রিবিট মোবাইলে শাহেদকে কেরামতের দায়িত্ব নিতে বলে নিজে বেরিয়ে এল করিডোরে। তার লক্ষ্য উত্তরে শেষমাথার করিডোরটা। রিবিটকে অবশ্য কষ্ট করতে হল না। সে পৌঁছানোর আগেই ঐ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল একজন। অন্ধকার থাকায় রিবিটকে দেখতে পেল না আগত ব্যক্তি। অনেকটা ছুটে আসছে সে। অথচ রিবিট ঠিকই দেখতে পাচ্ছে লোকটাকে চিনতেও পারল। এ আর কেউ নয়, হারুন। এর ছবিটাও তাকে আগে দেখিয়েছে শাহেদ। ছবিটা তার মেমোরিতে সংরক্ষিত আছে।
হারুনের হাতে টর্চ থাকলেও সে জ্বালাচ্ছে না। তার মূল লক্ষ্য বাইরের দরজা। দ্রুত সেখানে এসে কেরামতকে সাহায্য করা এবং দরজাটি বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি মূল করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে রিবিট। তাই সে রিবিটকে অতিক্রম করার সময় ভয়ানক এক ঘুসি খেল তলপেটে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দ্বিতীয় ঘুসি এসে লাগল চোয়ালে। ঘুসির তীব্রতায় হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল টর্চলাইটটা।
রিবিট দুহাতে হারুনের কলার ধরে তাকে শূন্যে তুলে ফেলল। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল : তিশা কোথায়?
চোখের সামনে কিম্ভুতকিমাকার ধাতব এক চেহারা দেখে হারুন একেবারে হতচকিত হয়ে গেল। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল : ঐ..ঐ..ঘরে।
করিডোরের শেষমাথার ঘরটা দেখিয়ে দিল হারুন।
রিবিট হারুনকে আরো ছয় ইঞ্চি উপরে তুলল। তারপর ছুঁড়ে ফেলল পিছনের দেয়ালে দেয়ালের সাথে ভয়ানক আঘাতে কো করে বিশ্রী শব্দ করে উঠল হারুন। দ্বিতীয়বার অবশ্য সে আর শব্দ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই রিবিটের ভয়ানক ঘুসিতে জ্ঞান হারাল সে।
আগের মতোই রিটি ফোন করে শাহেদকে হারুনের দায়িত্ব দিয়ে দিল। অবশ্য শাহেদও ততক্ষণে কাছাকাছি চলে এসেছে।
উত্তরের কক্ষটিতে প্রবেশ করে রিবিট থমকে গেল। না, ভিতরে কেউ নেই। অবাক হল সে, তাহলে কি তাকে ভুল তথ্য দিয়েছে হারুন। ভাবতেই রিবিট আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সত্যি যদি তিশার কোনো ক্ষতি হয় তাহলে সে নিজেকে সান্ত্বনা দেবে কীভাবে?
রিবিট করিডোরে ফিরে আসতে দেখে শাহেদ এসে গেছে। শাহেদ তাকে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল : তিশার কোনো খোঁজ পেলে রিবিট?
না।
ওদের দলে কতজন আছে?
আমি এখনো জানি না। তুমি ওদের দুজনকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করো। দ্যাখো তো কিছু জানা যায় নাকি।
এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। দুজনই অজ্ঞান। অবশ্য আমার লোকেরা ওদের জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করছে।
রিবিট কিছু বলল না। তার মধ্যে বিশ্লেষণের ঝড় বইছে। ইলেকট্রন এখন তীব্রগতিতে ছুটে চলছে একটা সার্কিট থেকে অন্য সার্কিটে।
এখন আমরা কী করতে পারি রিবিট?
সেটাই তো ভাবছি। আমি নিশ্চিত তিশা আকৌপাশেই কোথাও আছে।
কিন্তু তিশাকে খুঁজে পাব কীভাবে?
হঠাৎই যেন বুদ্ধিটা এসেছে এমনভাবে কেরামতের মোবাইলটার দিকে তাকাল রিবিট। কেরামত অজ্ঞান হওয়ার পর মোবাইলটা তুলে নিয়েছিল সে। রিবিট শুনেছে কেরামত ‘বস’ বলে কাউকে সম্বোধন করেছে। এই বস্-ই যে কালোমানুষ সে-ব্যাপারে নিশ্চিত সে।
মোবাইলে স্কুল করে সে ‘বস’ নামে সত্যি একটা নম্বর সেইভ-করা দেখতে পেল। কল করার আগে শুধু বলল : শাহেদ কান খাড়া রেখো। কোনো রিংটোন শুনলে সাথে সাথে জানাবে।
ঠিক আছে।
রিবিট কল করার সাথে সাথে কান খাড়া করল শাহেদ। ওপাশে রিং হলেও শাহেদ কোনো রিংটোন শুনতে পেল না। দ্বিতীয়বার কল করতে আবারো রিং হতে লাগল। শাহেদ আগের মতো কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। রিবিট এবার খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কিছুক্ষণ আগে যে কক্ষটা থেকে সে বেরিয়ে এসেছে সেই কক্ষটায়। তবে এবার আর সবগুলো রিং হল না। তার আগেই কেউ কেটে দিল লাইনটা।
রিবিট কক্ষটাতে প্রবেশ করতে শাহেদ বলল : কিছু বুঝলে?
হ্যাঁ শাহেদ। মূল নেতা আশেপাশেই কোথাও আছে। আমি রিং শুনেছি।
কিন্তু আমি তো কিছুই শুনতে পেলাম না।
তুমি শোনোনি, কারণ আমার মতো প্রখর শ্রবণশক্তি তোমার নেই। আমি অনেক শব্দ শুনতে পাই যা সাধারণ মানুষের শোনার ক্ষমতা নেই। আর ইলেকট্রনিক শব্দ হলে আমার জন্য ব্যাপারটা আরো সহজ হয়ে পড়ে। মোবাইলের রিংটোনের শব্দ ইলেকট্রনিক শব্দ।
তাহলে কোথায় আছে তিশা?
রিবিট এবার খুব ভালোভাবে মেঝেটা পরীক্ষা করল। তারপর বলল : ঐ দ্যাখো, কোণায় একটা ধাতব ঢাকনা। সম্ভবত এই কক্ষ থেকে কোনো সুড়ঙ্গ নিচের দিকে নেমে গেছে। কিছুক্ষণ আগে আমি এই ঢাকানাটা দেখতে পাইনি, কারণ আমি মেঝের দিকে নজর দিইনি। এখানে যে কোনো সুড়ঙ্গ বা চোরাকুঠুরি থাকতে পারে সেটা আমার ধারণায় ছিল না। তাছাড়া ঢাকনাটার রঙ সবুজ। অন্ধকারে আমি যা-কিছু দেখছিলাম তার সবই নীলচে-সবুজাভ। এ-কারণে ঢাকানাটার উপস্থিতি টের পাইনি। সবুজের মধ্যে সবুজ হারিয়ে গিয়েছিল। আর এখন তোমার হাতের টর্চের আলোতে সবকিছু কী সুন্দর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এখন কী করবে?
যা করার দ্রুত করতে হবে। অতিরিক্ত সময় নেয়া যাবে না। তোমার হাতের টর্চটি জ্বালিয়ে রাখো। আর হ্যাঁ, হারুনকে আমাদের দরকার।
কিন্তু ও তো অজ্ঞান হয়ে আছে।
তাতে সমস্যা নেই। ঢাকনা সরিয়ে প্রথমে ওর পাদুটোই নিচে নামিয়ে দিতে হবে। তাহলে ভিতরের মানুষ ভাববে হারুনই নামছে। আমার যুক্তি বলছে ভিতরে যে-মানুষটি আছে সে আর কেউ নয়, ইদ্রিস আলী। তবে একের অধিক ব্যক্তিও থাকতে পারে।
রিবিটের পরিকল্পনা অনুসারে হারুনকে নিয়ে আসা হল। হারুনকে আনতে যেয়ে দেখা গেল হারুনের জ্ঞান ফিরে এসেছে। এই কক্ষে এসে হারুন ছুটে যাওয়ার জন্য খানিকটা চেষ্টা করলেও রিবিটকে দেখে একেবারে থমকে গেল। রিবিট কিছু বলল না। সে শুধু ইশারায় হারুনকে নিচে যাওয়ার ইঙ্গিত করল।
হারুন দ্বিতীয়বার আর রিবিটের হাতে ঘুসি খেতে ইচ্ছুক নয়। তাই সে সুবোধ বালকের মতো ঢাকনাটা উঁচু করল। এ মুহূর্তে অবশ্য ঘরটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। রিবিটের কথামত শাহেদ তার টর্চলাইটটা বন্ধ করে দিয়েছে। ভিতরে অবশ্য কয়েকজন সশস্ত্র গোয়েন্দা সদস্য আছে।
হারুন ঢাকনা উঁচু করে ভিতরে পা রাখতেই নিচ থেকে সাংকেতিক শব্দ ভেসে এল : হিস্…।
সাথে সাথে হারুনও ওস্..ওস্..শব্দ করে উত্তর দিল।
রিবিট বুঝতে পারল এটা কালোমানুষদের নিজেদের মধ্যেকার কথাবার্তার সাংকেতিক ভাষা যার অর্থ তারা বুঝতে পারবে না। হঠাৎই তার সন্দেহ হল হারুন তাদের পক্ষে কাজ নাও করতে পারে। সে সংকেত দিয়ে হয়তো পুলিশের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দিয়েছে। তাই আর সে অপেক্ষা করল না। হারুনকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিয়ে নিজেও লাফিয়ে পড়ল নিচে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পর পর দুটো গুলির শব্দ হল। চমকে উঠল রিবিট।
একটা গুলি এসে সরাসরি তার কাঁধে লাগল। দ্বিতীয়টা অবশ্য উপরে ছাদে যেয়ে লাগল।
ভিতরটা অন্ধকার হলেও রিবিট স্পষ্ট দেখতে পেল তার থেকে মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে কুৎসিত চেহারার এক লোক। পিস্তলটা এখনো উপরের দিকে তাক করা। অন্ধকার থাকায় কোথায় কী ঘটছে সে তা দেখতে পাচ্ছে না। আর লোকটির ঠিক পিছনে গুটিশুটি মেরে আছে তিশা। খুব ধীরে ধীরে সে সরে যাচ্ছে ডান দিকে।
হঠাৎ হারুন চিৎকার করে উঠে বলল : বস্, গুলি করো, গুলি করো। মাইয়াডারে মাইরা ফ্যালো। এইহানে পুলিশ আইছে।
ইদ্রিস আলী আর দেরি করল না। ঘুরেই তিশা যেখানে ছিল সেই জায়গাটা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। কপাল ভালো তিশা আগেই সরে গিয়েছিল। মাত্র দু-ফুট দূরে যেয়ে লাগল গুলিগুলো। এরই মধ্যে টর্চ জ্বালিয়েছে ইদ্রিস আলী। তিশাকে সরে যেতে দেখে সে রাগে ফুঁসছে। পিস্তল ঘুরিয়ে সে আবারো তিশার দিকে তাক করলেও রিবিট এবার তাকে আর কোনো সুযোগ দিল না। পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইদ্রিস আলীর উপর।
রিবিটের ধাক্কায় এবারেও ইদ্রিস আলীর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। তবে আর কোনো সুযোগ সে পেল না। রিবিটের ভয়ানক ঘুসিতে মুখ থুবড়ে নিচে পড়ল সে। অবশ্য রিবিটকে আর কিছু করতে হলো না। ততক্ষণে শাহেদ আর তার দল নেমে এসেছে নিচে। বাকি দায়িত্বটুকু বুঝে নিল তারা।
এদিকে তিশা অবাকচোখে তাকিয়ে আছে রিবিটের দিকে। রিবিট কাছে এসে তিশার হাত-পা-মুখের বাঁধন খুলে দিতে তিশা রিবিটের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
রিবিটও তিশাকে বুকে টেনে নিল।
হঠাৎই তিশা মাথা উঁচু করে রিবিটের কাঁধে যেখানে গুলি লেগেছে সেখানে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল : রিবিট, নিশ্চয় তোমার খুব ব্যথা লেগেছে?
রিবিট মিষ্টি হেসে বলল : না তিশা, আমার শরীরে ব্যথার কোনো অনুভূতি নেই। ব্যথার যে অনুভূতি আমার মধ্যে আছে তা শুধুই হৃদয়ে এবং শুধুমাত্র মানুষের জন্য। আমার নিজের জন্য নয়।
.
১৯.
একদিন পর।
মাঝরাতের কিছু আগে প্রফেসর হকের বাসা থেকে বেরিয়ে এল রিবিট। প্রফেসর হক রিবিটের কাঁধে গুলির যে আঁচড় লেগেছিল সেটা ঠিক করে দিয়েছে। এখন আর সেখানে কোনো দাগ নেই। একদম আগের মতো হয়ে গেছে।
পলাশীর মোড়ে আসতে রিবিট বলল : হ্যাঁ ইপি, তুমি যেন আমাকে কী বলতে চেয়েছিলে?
পুলিশ কমিশনার তোমাকে ফোন করেছিল। তুমি অবশ্য তখন সার্ভিসিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। তাই কথা বলতে পারনি।
কী বললেন পুলিশ কমিশনার?
হারুন আর কেরামতের মতো দুজন সাজাপ্রাপ্ত এবং কুখ্যাত আসামিকে ধরে দেয়ার জন্য তিনি তোমাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
দুজনেই সাজাপ্রাপ্ত আসামি, এটা তো জানা ছিল না।
ডিবির ডেটাবেজেও সেটা ছিল না। রেকর্ড নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে যেয়ে বের হয়েছে।
ও আচ্ছা। আর ইদ্রিস আলীর কী হল?
ইদ্রিস আলীই কালো মানুষের নেতা। সে আসলে ওয়েভ গার্মেন্টসে চাকুরি করত। ফ্যাক্টরি বন্ধ করে মালিক আমেরিকায় চলে যাওয়ার সময় তাকেই কেয়ারটেকার করে যায়। কেয়ারটেকার থাকার সুবাদে সে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ওয়েভ গার্মেন্টসের ভিতরের জিনিসপত্র বিক্রি করতে থাকে। ব্যাপারটা জানতে পেরে মাঝখানে মালিক নিজে এসে ফ্যাক্টরির মালামাল বিক্রি করে দেয় এবং ইদ্রিস আলীকে কেয়ারটেকারের পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করে। মালিক চলে গেলে ইদ্রিস আলী নিজের আস্তানা গড়ে তোলে ওয়েভ গার্মেন্টসে। মাঝখানে মালামাল চুরি করে বিক্রি করায় তার খরচের হাত বেড়ে যায়। উপার্জনের অন্য কোনো উপায় না-পেয়ে শেষে স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে। ঘটনাক্রমে পরিচয় হয় হারুন আর কেরামতের সাথে। হারুন আর কেরামতও ইদ্রিস আলীকে পেয়ে খুব খুশি। কারণ তারা আর কিছু পাক বা না পাক, অন্তত নিরাপদ আশ্রয় তো পেয়েছে। সেই থেকে তারা নানা অপকর্ম শুরু করে। নিজেদেরকে পরিচয় দিতে শুরু করে কালোমানুষ হিসাবে। সম্প্রতি তারা ভয় ভীতি প্রদর্শন করে চাঁদা আদায় শুরু করে। তিশাদের ঘটনা এমনই একটি ঘটনা। অবশ্য এর আগে আরো দুটো জায়গা থেকে এভাবেই অর্থ আদায় করে, তবে তা ছিল খুব সামান্য। তবে একটা জিনিস সত্য, তিনজনই ভয়ংকর। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এমন কোনো হীন কাজ নেই যা তারা করতে পারে না।
ইপি তোমাকে ধন্যবাদ তোমার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য।
ইপি একটু থেমে বলল : এখন কোন দিকে যাবে?
গুলিস্তানের দিকে।
এই বলে রিবিট হাঁটতে শুরু করল। একটু যেয়ে বলল : আজ খুব ঠাণ্ডা, তাই না?
হ্যাঁ, তাপমাত্রা পনেরো ডিগ্রির নিচে।
এবার বোধহয় শীতের তীব্রতা আরো বাড়বে।
সেরকমই পূর্বাভাস পাওয়া গেছে।
মানুষের খুব কষ্ট হবে, তাই না ইপি?
হ্যাঁ। দরিদ্র মানুষের কষ্ট হবে বেশি।
আমাদের…
তুমি….
এভাবেই ইপির সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে চলছে রিবিট। বুয়েট পার হয়ে চানখারপুলের কাছে আসতেই সে দেখতে পেল একটা দোকানের পাশে ফুটপাতে গরিব কয়েকটি ছেলে একসাথে জড়ো হয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। ওদের মধ্যে এক বয়স্ক বুড়িও আছে। সবাই আগুনের উপর হাত দিয়ে আগুন পোহাচ্ছে। মাঝে মাঝে বুড়ি আশেপাশের কাগজগুলো আগুনের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। আর তাতে দাউদাউ করে উঠছে আগুন। তখন সবাই হাতদুটো দ্রুত বাড়িয়ে দিচ্ছে আগুনের কাছাকাছি, যেন কেউ উত্তাপ থেকে বঞ্চিত না হয়।
রিবিট কাছাকাছি পৌঁছাতে কয়েকজন ভয়ে আগেই উঠে দাঁড়াল। যারা উঠে দাঁড়াল তারা কেউই আগে রিবিটকে দেখেনি। তবে অন্যরা আশ্বস্ত করল তাদেরকে।
রিবিট কাছে এসে বসতেই সবাই ঘিরে ধরল রিবিটকে। বুড়ি আরো কয়েকটা কাগজ ঠেলে দিল আগুনের কুণ্ডলীতে। সাথে সাথে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। সবাই আগুনের আরো কাছে চলে এল। একজন বলল : রিবিট, আগুন যা আরামের!
অন্য একজন বলল : মেলা ঠাণ্ডা! আগুন তো আরামের হইবই।
রিবিট ছেলেগুলোর অভিব্যক্তি লক্ষ্য করছিল। এবার সে অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিল : তোমরা চা খাবে? চায়ের সাথে বড় বড় টোস্ট বিস্কিট?
ছেলেদের কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু বুড়ি বলল : হ খামু।
রিবিট দোকানদারকে চা আর মোটা টোস্ট বিস্কিট দিতে বলল।
দোকানদার খুবই চটপটে। সে দ্রুত সবাইকে চা আর বিস্কিট দিল। রিবিট বিস্মিত হয়ে দেখল সবাই কী তৃপ্তির সাথেই না চা খাচ্ছে! সবার প্রতিটা চুমুকেই যেন স্বর্গীয় তৃপ্তি।
সবচেয়ে ছোট্ট ছেলেটি, যে আজ রিবিটকে প্রথম দেখছে সাহস করে জিজ্ঞেস করল : রিবিট, তুমি চা খাইবা না?
রিবিট মৃদু হেসে ছেলেটিকে কোলের মধ্যে টেনে নিল। অবশ্য উত্তরটা রিবিটকে দিতে হল না। পাশ থেকে অন্য একটি ছেলে বলল : রিবিট কিছু খায় না।
ছোট্ট ছেলেটি এবার বলল : তোমার জন্যি মেলা আনন্দ পাইলাম। তুমি আমাগো আরো আনন্দ দিবার পারবা? আমাগো কাগইজ শ্যাষ, আর আগুন জ্বলব না। আমাগো কয়ড়া কাগইজ কিনা দিবার পারবা? পুরান পিপার হইলে চলব। নইলে আইজ রাইতে মেলা কষ্ট করা লাগব।
রিবিট কোনো কথা বলল না, ছেলেটাকে আরো কাছে টেনে নিল। এ মুহূর্তে কথা বলার মতো ভাষা তার নেই। এদের কষ্টে সে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তার মধ্যে কেন যে এত কষ্ট, সে মাঝে মাঝে তা বুঝে উঠতে পারে না।
অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে রিবিট ডেকে উঠল : ইপি।
বলল রিবিট।
আমি কী চাচ্ছি তুমি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ রিবিট বুঝতে পারছি। তুমি আজ রাতের জন্য হলেও ওদের সবাইকে শীত থেকে বাঁচাতে যাচ্ছ।
তুমি কি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে?
এতে প্রচুর শক্তি খরচ হবে।
হোক না। আমার সমস্ত শক্তিই তো মানুষের জন্য। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এই ছেলেগুলোও তো মানুষ। আমার সৃষ্টি তো ওদের জন্যই। আমি আমার সবকিছু উজাড় করে দিয়ে ওদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই।
তাই হবে রিবিট। আমি এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। দ্রুত উত্তর দিল ইপি।
.
২০.
শেষ রাত। চানখারপুলে একটা বন্ধ দোকানের পাশে কয়েকটা ছেলে আর এক বুড়ি ঘুমাচ্ছে। কোনো শীতের রাতেই তারা আজকের মতো এত আরামে ঘুমায়নি। তাদের মাঝে যে বসে আছে রিবিট। রিবিট তার শরীরের তাপমাত্রাকে এমনভাবে বৃদ্ধি করেছে যে আশেপাশের কয়েক বর্গমিটার জায়গায় একটা সুষম, সহনীয় আর আরামদায়ক তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই তাপমাত্রায় গভীর ঘুমে হারিয়ে আছে আশ্রয়হীন কয়েকটি শিশু আর এক বৃদ্ধা। আর রিবিট, মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
রিবিট জানে না তার মতো এমন মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে সমাজের ক’জন তাকায় আশ্রয়হীন এই মানুষগুলোর দিকে!
(রমনা, ঢাকা-১১.০১.২০০৮ – ২৫.০১.২০০৮)
.
রিবিট ০০৩
অদৃশ্য ফাঁদ
শিশু-কিশোরদের সাথে সময় কাটাতেই রিবিট বেশি পছন্দ করে। তাই তো একদিন সে আসে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে অসহায়, হতদরিদ্র, খেটে-খাওয়া শিশু কিশোরদের মাঝে। সবাই হঠাই রিবিটকে তাদের মাঝে পেয়ে মহাখুশি। আনন্দ ফুর্তিতে রিবিটও সময় কাটাতে থাকে সবার মাঝে। পিতৃমাতৃহীন, গরিব-দুঃখী এই শিশু-কিশোররা যে কত অল্পতেই সুখী তা দেখে বিস্মিত হয় রিবিট। সে আরো বিস্মিত হয় যখন দেখে এদেরই কেউ কেউ হঠাই হারিয়ে যাচ্ছে অজানা কোথাও। যে একবার হারিয়ে যাচ্ছে সে আর কখনোই ফিরে আসছে না। কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে এই নিষ্পাপ, এতিম আর অসহায় শিশু-কিশোররা? সেই রহস্যের বেড়াজাল ভেদ করতে যেয়ে ভয়ংকর আর লোমহর্ষক এক অন্ধকার জগতের সন্ধান পায় রিবিট।
শেষ পর্যন্ত রিবিট কি পেরেছিল অসহায় হতদরিদ্র শিশু-কিশোরদের সাহায্য করতে?
Leave a Reply