রামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
রামায়ণের উৎস কৃষি
জিতেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় বর্ধমান
প্রথম প্রকাশ : ১৫ জুন, ১৯৫৮
নক্শা ও অলংকরণ : সমর সিংহ
প্রচ্ছদের আলোকচিত্র : বর্ধমান জেলার কালনা সহরের প্রতাপেশ্বর মন্দিরগাত্রের টেরাকোট
মুদ্রক : মৃদুলকান্তি সেন, সহ-অধীক্ষক
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস
প্রকাশক : রথীন্দ্রকুমার পালিত, পাব্লিকেশন্স অফিসার, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসর্গ
জীবন যন্ত্রণার ধুসর দিনগুলিতে
যার আবির্ভাব ও তিরোধান,
দিয়ে গেল বেঁচে থাকার মানসিক শক্তি,
আত্মমগ্ন করল আমাকে ‘রামায়ণ’ রহস্যে,
সেই তাকে যার নাম ছিল
টুম্পা
ভূমিকা
কত শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষ কত নতুন নতুন ভাবে রামায়ণের রসাস্বাদন করে চলেছেন। রামায়ণের কথা বলতে গেলে আমাদের সময়কার প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাঠ্য এস. ওয়াজেদ আলির সেই লেখাটা মনে পড়ে যায়। বৃদ্ধ গ্রাম্যমুদি সন্ধ্যায় প্রদীপের আলোতে তার ভাংগা চশমা লাগিয়ে রামায়ণ পড়ে যায়; তার ছোট নাতি মুগ্ধ হয়ে শোনে। কতদিন কেটে গেল তারপর। লেখক সেই গ্রামে ঘটনাচকে এসে সন্ধ্যায় সেই একই দৃশ্য দেখলেন; তবে এখন নায়ক পরিবতিত হয়েছে। বৃদ্ধের পুত্র আজ পাঠক, আর তার নাতি শ্রোতা।
সেই ট্রাডিশান সমানে চলেছে, কোথাও তার এতটুকু পরিবর্তন হয়নি।
যে মহাকাব্য ট্রাডিশানের অংশীভূত তার সম্বন্ধে নতুন আলোকে বিচার করায় কিছু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে যায়। যে কোনও রচনা বা সৃষ্টি কোনও এক কালে, কোনও এক সমাজে সৃষ্ট হয়েছিল-সে যে ইতিহাসের বাইরে নয়, কালাতীত নয় এ সহজ সত্যটা গতানুগতিকায় আবদ্ধ মন সহজে মেনে নিতে পারে না। না পারলেও কিন্তু ঘটনাট সত্য। মানুষের ইতিহাসের বাইরে, সমাজবদ্ধ মানুষের সমাজের গণ্ডীমুক্ত অবস্থায় মানুষের কোনও সৃষ্টিই হতে পারে না। তাই রামায়ণ বা মহাভারত আমাদের ঐতিহ্যের একান্ত এবং আত্মস্থ হলেও, তাদের কালিক এবং সামাজিক পটভূমিকা আছে। এ সব মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে, তাদের রূপকগুলোর অন্তরালে তৎকালীন সমাজের সমাজবদ্ধ মানুষের সম্বন্ধে যে সব তথ্য লুকিয়ে আছে তাদের ধরতে পারা যায় বিশ্লেষণী মননশীল দৃষ্টি দিয়ে। তাতে মিথ্যা সংস্কারে আঘাত লাগলেও সত্যের হানি হয় না। তবে ট্রাডিশান যে গ্রন্থকে এক বিশেষ কালাতীত আসনে বসিয়ে পুস্তকের অন্তস্থ চরিত্রগুলিকে কালের বাইরে নিয়ে গেছে—তাতে কালিক সত্য নির্ধারণ করতে গেলে দরকার সাহসের দরকার সুস্থ মুক্ত মনের।
জিতেন্দ্ৰ নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মশায়ের ‘রামায়ণের উৎস কৃষি বইটি পড়ে তার সাহসিকতা এবং সত্যসন্ধানী দৃষ্টিতে ইতিহাসকে ধরার বা বোঝার প্রচেষ্টায় মুগ্ধ হয়েছি। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুস্তকটি প্রকাশিত হচ্ছে দেখে অনাবিল আনন্দ পাচ্ছি। আমার আশা পুস্তকটি সুধীজনের মাঝে সমাদৃত হবে। এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হবে, রসপিপাসু, সত্যসন্ধানী পাঠক সমাজে কিছু আলোড়ন জাগবে।
রূপক আশ্রিত রামায়ণের মধ্যে বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক যে ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান এবং পরিবেশন করেছেন তা আমাদের ঐতিহাসিক ভাবনা চিন্তাকে নতুন ধারায় বাহিত করবে। পুস্তকটি অনূদিত হয়ে ইংরাজী ভাষার মাধ্যমে প্রচারিত হলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি সেই সুদিনের দিকে তাকিয়ে থাকব। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ইংরাজী তর্জমাটিও প্রকাশ করে নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে অনাগ্রহী হবে না। আমি পুস্তকটির বহুল প্রচার কামনা করি।
শংকরী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
উপাচার্য
প্রস্তাবনা
মহাভারত একাধারে কাব্য ও ধৰ্ম্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্র। সামগ্রিকভাবে এ কাব্য ইতিহাসও। মহাভারতের ঋষি স্বয়ং বলেছেন :
ধৰ্ম্মশাস্ত্রমিদং প্রোক্তং অর্থশাস্ত্রমিদং মহৎ।
মোক্ষশাস্ত্রমিদং প্রোক্তং ব্যাসেনামিতবুদ্ধিনা ৷
মহাভারত সম্বন্ধে এ কথা বলা হলেও রামায়ণকে কিন্তু একক কাব্য বলেই গণনা করা হয়। বহু শতাব্দী ধরে মহাভারত তিলে তিলে তা’র উপাখ্যান এবং কাহিনী সংগ্রহ করলেও আদি এবং সপ্তমকাও বাদ দিয়ে মূল রামায়ণ একই শিল্পীর রচনা। সে শিল্পী কবিশ্রেষ্ঠ বাল্মিকী। যাঁর মধ্যে সত্যদর্শন এবং পরিদৃষ্ট সত্যের চিত্রকল্প নিৰ্মাণ,—এই দুটি শক্তিরই সমন্বয় ঘটেছিল। সত্যদর্শনের সামর্থ থাকলেই মানুষ কবি আখ্যা লাভ করে না। যখন ঐ সত্যের বাকৃপ্রতিমানির্মাণের দক্ষতা তিনি প্রদর্শন করেন, তখন তাকে কবির মৰ্য্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। রামায়ণ মহাকাব্যের রচয়িতা বাল্মিকীকে উত্তরকাল আদিকবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে এই জন্যে যে, বাল্মিকীর মধ্যেই প্রথম তত্ত্বদর্শন ও বাকৃপ্রতিমানিৰ্ম্মাণের সামর্থ্যের সমন্বয় নিজেকে প্রকাশ করেছিল।
রামায়ণ একক কবিসৃষ্টি বলে পরিগণিত হলেও মাঝে মাঝেই প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতেরা এর কাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন সত্যের সন্ধান পেয়েছেন। জার্মান পণ্ডিত ওয়েবার বলেছেন,– রামায়ণের প্রধান উপজীব্য রাম-সীতার কাহিনী, কৃষি-সভ্যতার বিকাশেরই কাহিনী। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,— নবদূৰ্বাদলশ্যাম রামকে মেঘের প্রতীক বলে গ্রহণ করলে এবং সীতার জন্মবৃত্তান্ত বিশ্লেষণ করে তাকে হলকর্ষণজনিত রেখারূপে ব্যাখ্যা করলে রামায়ণের কাহিনীকে কৃষি-সভ্যতা বিকাশের রূপক কাহিনী বলে মানতেই হয়। পণ্ডিতেরা আরও বলেছেন, মহাভারতের সভ্যতা প্রধানতঃ আরণ্যসভ্যতা যেখানে পশুপালন, বনজসম্পদ আহরণ এবং মৃগয়া সভ্যতার একটা অঙ্গ ছিল। এই কারণে মহাভারতের উদ্ভবস্থানকে দক্ষিণ-পশ্চিম-ভারত বলে উল্লেখ করলে ভুল হয় না। রামায়ণের উদ্ভবস্থান হয়ত পূর্ব বা দক্ষিণ ভারত। সেখানকার অধিবাসীদের কাছে বর্ষ আশীৰ্বাদ এবং মেঘের সঞ্চার ধরিত্রীর শস্যশ্যামলবৃপের ইঙ্গিত বহন করে আনে। আর্যের যখন বিভিন্ন সভ্যতার উপকরণ সংগ্রহ করে বেদ এবং মহাভারত রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তখনই হয়ত আর্যেতর জাতির লৌকিক মেঘবন্দনার সূত্র ধরে এবং বর্ষার আবাহনকে অবলম্বন করে এক বিরাট মহাকাব্য রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন। উত্তর-পশ্চিম-ভারতের রূক্ষতা তাই মহাভারতে স্বাভাবিকভাবেই সংক্রামিত হয়েছে, আর রামায়ণে সংক্রামিত হয়েছে পূর্বদক্ষিণ ভারতের কোমল হৃদয়বত্ত ও মাধুর্যমণ্ডিত মানসিকতা। মহাভারতের মত রামায়ণও তাই একাধারে ধৰ্ম্মশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং সর্বোপরি শান্তরস প্রধান কাব্য। রামায়ণকে একক মহাকাব্য বললে তার মর্য্যাদাহানি ঘটানো হয়। পণ্ডিতেরা যখন বলেন কুমারসম্ভব, রঘুবংশ যে অর্থে মহাকাব্য রামায়ণ-মহাভারত সে অর্থে মহাকাব্য নয় এবং রামায়ণমহাভারতকে একই মর্যাদার আসনে সমাসীন করেন, তখন এটাই বোঝাতে চান যে কাবের উপকরণ ছাড়া ইতিহাস, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজদর্শন, জ্যোতিবিদ্যা এবং নৃতত্ত্ববিদ্যার উপকরণের সমাবেশে এ দু’টি মহাকাব্যের কলেবর পুষ্ট।
পণ্ডিতের রামায়ণ কাহিনীকে কৃষিসভ্যতা বিকাশের রূপক কাহিনী বলে উল্লেখ করলেও তাদের আলোচনা বিচ্ছিন্ন এবং অসংলগ্ন। রামায়ণের কাহিনীকে বিশ্লেষণ করে কৃষিসভ্যতার নিগূঢ় অর্থটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবার চেষ্টা এতদিন পর্যন্ত করা হয় নি। ভারতীয় সাহিত্য বিশ্লেষণের এই অপরিপূর্ণতার বৃত্তাংশকে পূর্ণরূপ দেবার দুরূহ কাজে অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করে শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বাঙালী পাঠকের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। রামায়ণের প্রসিদ্ধ শ্লোকগুলিকে বিশ্লেষণ করে শ্রবন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে এই কাব্যের শব্দগুলি দ্ব্যর্থ্যক শব্দের ভূমিকা গ্রহণ করে কখনও মেঘবন্দনায় পৰ্য্যবসিত হয়েছে,—কখনও বা পৰ্য্যবসিত হয়েছে অপ্ৰশ্যাম দিবসের সৌন্দর্য্যবর্ণনায়,—কখনও বা আত্মপ্রকাশ করেছে বর্ষার আগমনে দাবাপৃথিবীর আনন্দোচ্ছ্বাসের চিত্রাঙ্কণরূপে-কখনও বা বিভিন্ন নক্ষত্রের অবস্থানের ইঙ্গিতে। সংস্কৃত ব্যাকরণের সূত্রে প্রবিষ্ট গ্রন্থকার প্রকৃতি-প্রত্যয়-নির্ধারণে এবং শব্দের বুৎপত্তি-বিশ্লেষণে বিশেষ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়ে রামায়ণে প্রযুক্ত শব্দগুলির নতুন ভাবানুসঙ্গ প্রদর্শন করার চেষ্টা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়েছেন ব্যঞ্জনার মূৰ্ছিন এ কাব্যে কতট৷ সাফল্যলাভ করে কত বিচিত্র অর্থের প্রকাশ ঘটাতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্বে তাঁর গভীর প্রবেশ তাকে এই রূপক কাহিনীর একটি সুসংলগ্ন এবং পরিপূর্ণ চিত্র-অঙ্কণে সাহায্য করেছে। সংস্কৃত ব্যাকরণ, সমাজবিজ্ঞান, জ্যোতিবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এবং কৃষিবিজ্ঞান, এই সমস্ত শাস্ত্রে গভীর অনুপ্রবেশের ফলেই শ্রবন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে রামায়ণ কাহিনীর কৃষিসভ্যতাবিষয়ক পরিপূর্ণ আলেখ্য নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। শ্রবন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিভার মৌলিকতা স্বীকৃতির দাবী রাখে। গভীর মননশীলতা, প্রগাঢ় বিশ্লেষণ নৈপুণ্য, অসংলগ্ন চিন্তাধারার মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপনের দক্ষতা, শব্দের বিভিন্ন ভাবানুসঙ্গ এবং দ্যোতনসামথাসম্বন্ধে সচেতনতা,—এ সবের সমন্বয়ে শ্রবন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচকমন একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।।
“রামায়ণের উৎস কৃষি” গ্রন্থে শ্ৰীবন্দ্যোপাধ্যায় যে তথ্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা চিরপরিচিত এবং পুরাতন নয় বলে কারে কারো কাছে নিছক কল্পনাবিলাস বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হয় যে, রামায়ণের স্বরূপ বিষয়ে শ্রবন্দ্যোপাধ্যায় একটি নতুন চিন্তাধারা সংযোজিত করে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। সত্যের উপলব্ধিতে যিনি পদক্ষেপ করেন তাকেই অভিনন্দন জানাতে হয়। কারণ সত্যের প্রকাশ তো সহসা ঘটে না। বিভিন্ন চিন্তার ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়েই তো তাকে বরণ করে নিতে হয়। সত্যের জ্যোতির প্রকাশ ঘটানোর জন্যে শ্রবন্দ্যোপাধ্যায় যে মহতী প্রচেষ্টা করেছেন তাকে যথাযোগ্য মৰ্য্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্যই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এই গ্রন্থ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলা সাহিত্যের আসরে আমি শ্ৰীজিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “রামায়ণের উৎস কৃষি” গ্রন্থটিকে স্বাগত জানাই এবং এর বহুল প্রচার কামনা করি। এই গ্রন্থ যে সত্যানুসন্ধিৎসু গবেষক এবং কৌতুহলী পাঠক উভয়কেই পরিতৃপ্ত করবে এবং সঙ্গে সঙ্গে রামায়ণ সম্পর্কে নতুন চিন্তা প্রসারে সাহায্য করবে,—তাতে সন্দেহ নেই।
আমি সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরথীন্দ্রকুমার পালিতের নেতৃত্বে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশন বিভাগের সমস্ত কৰ্ম্মবন্ধুকে এবং শ্ৰীমৃদুলকান্তি সেনের নেতৃত্বে মুদ্রণ বিভাগের সমস্ত কৰ্ম্মবন্ধুকে এই গ্রন্থ প্রকাশের জন্য অভিনন্দন জানাই।
প্রারম্ভ–কথা
সকল কাজের পিছনে কার্যকারণ থাকে। সুদীর্ঘ আট বছরের নিরলস পরিশ্রমের ফসল এই গ্রন্থেরও একটি পটভূমিকা আছে। জীবনের একটি অধ্যায়ে যখন বিপর্যন্ত, সকল কিছুর উপর বীতশ্রদ্ধ, সহায় সম্বলহীন, আত্মীয়বন্ধু পরিত্যক্ত; সেই অন্ধকার দিনগুলিতে অবলম্বন খুজেছিলাম দোহালিয়া কালীবাড়ীর মাতৃমূর্তির মধ্যে। নিরাবয়ব সেই মূর্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে হঠাৎ যেন মনের জোর পেলাম। আর তখনই চিন্তা এলে মাতৃস্বরূপার এই অপরূপ মূর্তির কারণ কি? উত্তর খুজেছি নানা গ্রন্থে, নানা জনের কাছে; কিন্তু তুষ্টি আসেনি।
সেই চরম অস্থিরতার মাঝে আঘাতের পর আঘাত এসেছে। কখনও মাতৃসম্মুখে, কখনও গ্রন্থের অন্তরে প্রবেশ করে ভুলতে চেয়েছি সেই যন্ত্রণাকে। একদিন কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়ছিলাম। পড়ার চেয়ে পাতা ওলটানোর পাল ছিল বেশী। হঠাৎ চোখে পড়ল রামসীতার বিবাহ আসরে বসিষ্ঠ ইক্ষ্বাকু বংশের পরিচয় জ্ঞাপন করছেন। ব্রহ্ম হতে সৃষ্ট সূর্য। এই সূর্য-বংশর ইক্ষ্বাকু, কুক্ষি, বিকুক্ষি, বাণ প্রভৃতি নামগুলি মনকে আকর্ষণ করল। এই সব নাম ত কেউ ব্যবহার করে না; নামগুলির অর্থই বা কি? খুললাম অভিধান। সেই যে ডুব দিলাম, মনে হয় এ জীবনে এই অবগাহন হয়ত সাঙ্গ করতে পারব না। নান৷ নামের অর্থভেদের ভিত্তিতে ধীরে ধীরে ইক্ষ্বাকু বংশের সূত্রে চোখের সামনে বিশ্ব-ব্রহ্মাও ফুটে উঠল। আজকের বিজ্ঞানীরা গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি এবং পৃথিবী নামক গ্রহে প্রাণের বিকাশের একাধিক মতবাদ পোষণ করেন। ইক্ষ্বাকু বংশেও সেই ধ্যানধারণার প্রাচীন ইংগিত পেলাম।
মনে পড়ল বাল্যকালের পড়া স্যর জগদীশ চন্দ্র বসুর লেখা,—গঙ্গ৷ তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? উত্তর হইল,—শিবের জট হইতে। স্যর জগদীশ ত পুরাণ কাহিনী লিখতে বসেননি, লিখছেন বিজ্ঞান-প্রবন্ধ। সেই আমার চিন্তার শুরু; রামায়ণের বিভিন্ন উপাখ্যানে, সগে, শ্লোকে, শব্দের ভিতরে অনুসন্ধান।
মাসমাইনের বাধ্যবাধকতা কড়ায় গণ্ডায় আদায় দিয়ে পড়াশুনার জন্য সময় করে নিয়েছি রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে, শরীরের বিশ্রামকে বঞ্চিত করে। সংসার হতে দূরে সরে থেকেছি, সেখানে সকল দায়-দায়িত্ব সহধর্মিণী কল্যাণীয়া অণিমা বহন করেছে একা। পুরো একটি বছর পরে রামায়ণ কাহিনীর অস্পষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক স্বরূপ ফুটে উঠল। মফস্বল সহরে বাস। চাহিদামত বই অমিল, পরামর্শ করার মত ব্যক্তি খুজে পাওয়া দায়। এরই মধ্যে পরম সুহৃদের ভূমিকা নিয়েছিলেন পাঁচখুপী টি. এন. ইন্সটিটু’শনের তদানীন্তন প্রধান শিক্ষক শ্ৰীবলরাম ঘোষ রায় এবং কান্দি রাজ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ডঃ শুচিব্ৰত সেন। মূলত শ্ৰীমান শুচিব্ৰত একাধিকবার আমাকে হতাশার অন্ধকার হতে উদ্ধার করেছে, শিক্ষাজগতের বৃহত্তর গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসতে প্রেরণা জুগিয়েছে। এই সময় বাল্যবন্ধু শ্ৰীসত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায় সাগ্রহে তার সাপ্তাহিক ‘কান্দী বান্ধব’ পত্রিকায় তৎকালিন রচিত পাণ্ডুলিপি “রামায়ণ–পুরাণে ও বিজ্ঞানে” প্রকাশ করে বিষয়টির প্রতি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঐ রচনাটি সম্পর্কে প্রথম উৎসাহ প্রদর্শন করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ পঞ্চানন মণ্ডল। তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
আরও কিছুকাল পরে মূল বক্তব্যের একটি সারাংশ বিভিন্ন পত্র-পত্রিক ও মনীষীজনের নিকট পাঠাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জোগানোর মত কোন সাড়া কেউ দেননি। তবে সাংবাদিক শ্ৰীকনকেন্দু মজুমদার এবং সুসাহিত্যিক শ্ৰীবিমল করের সঙ্গে সুদীর্ঘ আলোচনা করে উৎসাহিত হয়েছিলাম। ঐ সংক্ষিপ্তসারটি দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকার ২৯.৮.৪৩ তারিখের রবিবাসরীয়তে ছাপা হয় এবং ‘দেশ’ পত্রিকার ৯.১০.৫০ তারিখের ৪৩ বর্ষ ৫০ সংখ্যায় ‘সাহিত্য প্রসঙ্গ’ অধ্যায়ে ‘রামায়ণ বিতর্ক নিবন্ধে ‘অভিনন্দ মন্তব্য করেন,—‘প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, কিছুদিন আগে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে কোনো গবেষকের একটি রচনা কোনো পত্রিকায় যেন পড়েছিলাম—তাতে তিনি পুরে রামায়ণটিকে কৃষি সভ্যতার প্রতীকী বলেই যেন প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং রামকে মৌসুমী বায়ু অর্থে, সীতাকে হলকর্ষণ দরুণ সৃষ্ট গর্তকে এবং অন্যান্য সব কিছুরই এই ধরণের ব্যাখ্যা করেছেন। রামায়ণের সঙ্গে কৃষি সভ্যতার যোগাযোগ পূর্ব পণ্ডিতদের অনেকেও অনুমান করেছিল বলে জানি। উৎসাহী মারে এসব লেখা পড়তে পারেন। উপকৃত হবেন। কিন্তু তার আগে আবার বলি রামায়ণ মহাভারত পাঠ সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
যেহেতু আমার গবেষণার বস্তু রামায়ণের বিভিন্ন কাহিনীর রহস্য ভেদ করে মহাকাব্যর কৃষিসত্তার উন্মোচন, সেকারণে কল্যাণী বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ শুধাংশু ভূষণ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি ২২.৭.৪৩ তারিখের পত্রাঙ্ক ভি সি/ বি সি কে ভি ভি/৩৩।৩৮০ পত্রে লিখেছিলেন,–I have g০ne with interest thr০ugh y০ur article in which y০u have tried t০ draw anal০gy with with agricultural science and Ramayana. I have been very much impressed by the way in which y০u have been able t০ sh০w the agricultural base ০f Ramayana and I have tried t০ c০rr০b০rate y০ur view p০int with suitable ann০tati০ns. Y০ur attempt is really creditable and I c০ngratulate y০u s০r y০ur eff০rt. I h০pe y০ur eff০rt will receive appreciati০n at appr০priate quarters.
তাঁর এই অকুণ্ঠ সমর্থন আমাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিল। আজ এই গ্রন্থ প্রকাশের প্রাক-লগ্নে তাঁকে আমার গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
বছরের পর বছর ঘুরেছে। বারংবার নিবন্ধগুলি সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্তন করেছি। নিত্য নতুন চিন্তার সংযোজন ঘটেছে। একদিন ‘আদিশ্লোক—মা নিষাদ’ নিবন্ধটি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য এবং বর্তমানে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে পাঠিয়ে তার অভিমত চেয়েছিলাম। অপ্রত্যাশিতভাবে স্বল্পকালের মধ্যে পরোত্তর শুধু নয়, সমগ্র পাণ্ডুলিপিটি পাঠ করার আগ্রহ তিনি প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে তিনিই পরম শ্রদ্ধাস্পদ শ্ৰী শ্রীজীব ন্যায়তীৰ্থ মহাশয়ের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে ‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকার রবিবাসরীয়তে এবং মুশিদাবাদ হতে প্রকাশিত শ্রীঅতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘চেতনিক’ পত্রিকায় এ বিষয়ে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই সময়ে ঐ সূত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাংবাদিক শ্রীপ্রণবেশ চক্রবতী মহাশয়ের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটে। বিষয়বস্তুটির প্রতি তাঁর আগ্রহ আমাকে প্রেরণা জোগায়।
রামায়ণের কাহিনীর কৃষিসত্তা সম্পর্কে স্থির নিশ্চয় হওয়ার পরই জ্যোতিবিজ্ঞানের প্রতি দৃষ্টি পড়ে। এবিষয়ে আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয়ের পুরাণ কাহিনী ব্যাখ্যার চিন্তাধারার নিকট আমি চিরঋণী। তার প্রদশিত পথের সন্ধান না পেলে আমার গবেষণা হয়ত সম্পূর্ণ হত না।
আমার এই গবেষণা কাজে খুব অল্প সংখ্যক গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছি। ফলে গবেষণা গ্রন্থের চাহিদামত টিকাটিপ্পনীর বাহুল্যে গ্রন্থটি কণ্টকিত করার সুযোগ ছিল না। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন হয়েছে, সেগুলি প্রতি প্রকরণের শেষে পাদটীকায় উল্লেখ করেছি। এই গ্রন্থে সকল ক্ষেত্রে বঙ্গবাসী প্রেস হতে প্রকাশিত পণ্ডিতপ্রবর ভট্টপল্লী নিবাসী yপঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয়ের বাল্মীকি রামায়ণ এর অনুবাদ অনুসরণ করেছি। ব্যক্তিগতভাবে বহু সাধারণ মানুষের নিকট এই গবেষণার বহু সূত্র পেয়েছি, তাদের সঙ্গে অনেক আলোচনাও করেছি। উদ্দেশ্য রামায়ণ সম্পর্কে এই চিন্তাধারা যেন কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞজনের মধ্যে সীমায়িত না থেকে সাধারণের পাঠোপযোগী করে তুলতে পারি।
শ্ৰীযুক্ত রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আগ্রহাতিশয্যে গ্রন্থটি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশনের জন্য অনুমোদন লাভ করায় নিজেকে পরম সম্মানিত বোধ করছি। তিনি এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পড়ে প্রস্তাবনাটি লিখে দিয়ে আমাকে অপরিশোধ্য ঋণের দায়ে আবদ্ধ করেছেন। কৃতজ্ঞ চিত্তে তাকে এবং ন্যায়তীথ মহাশয়কে প্রণাম জানাই।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্রীশংকরী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় সাগ্রহে ভূমিকা লিখে দিতে সম্মতিদান করে আমাকে গৌরবান্বিত করেছেন; তাকে আমার সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা জানাই।
শ্ৰীমান শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় ও অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্ৰীঅসিত বরণ মণ্ডল একাধিকবার পাণ্ডুলিপিটি টাইপ করে দিয়েছে। শ্ৰীশ্যামল কৃফ বন্দোপাধ্যায় জ্যোতিবিজ্ঞান তথ্য সংকলণের ক্ষেত্রে নানাভাবে সহায়তা করেছে। শ্রীসুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীপ্রতীপ কুমার মিত্র, শ্ৰীসমর সিংহ ও শ্রীপ্রশান্ত কুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগিতাও স্মরণ করি। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন জনের নিকট বিভিন্ন রকমের সাহায্য পাওয়ায় এই গ্রন্থ প্রকাশ সম্ভব হয়েছে। এদের সকলের নামোল্লেখ করতে ভয় পাচ্ছি, কারণ অনবধাবনবশতঃ কারও নাম বাদ পড়লে আমার অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাবে। এজন্য বধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সকল কর্মী এবং এই গ্রন্থ রচনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্য যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তাদের সকলের নিকট আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।
জিতেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
Leave a Reply