রাধানগর – বাণী বসু
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০০
দিদি (রমা চৌধুরী)-কে
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অর্ঘ্য
এক – মন্দারের কথা
একটা প্রকাণ্ড মাঠ। কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে জানি না। ছমছম করছে জোছনা মাঠময়। পাতলা সরের মতো এই জোছনা যেন মাঠটাকে মুড়ে রেখেছে। সরও নয়। মসলিন কাপড়। একটা রেশমি-রেশমি ভাব। দুরে দুরে গাছের জট। পাকুড়…শিরীষ…তমাল…ওটা কী? শিমুল না ছাতিম? পাহাড়ের মতো উঁচু তেঁতুল দেখা যাচ্ছে একটা। পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে কী একটা রাত-পাখি উড়ে গেল। এই মাঠটা আমাকে পার হতে হবে। একটা ঠিকানা…একটা ঠিকানায় পৌঁছতে হবে আমায়। এ মাঠ আগাগোড়া এই একই রকম। কতটা এলাম বোঝবারও কোনও উপায় নেই।
কোথাও গঙ্ গঙ্ করে গম্ভীর সুরে একটা ঘণ্টা বাজছে না? অনেক দূর থেকে আসছে আওয়াজটা। আমাদের ঠাকুরবাড়ির ঘণ্টাটার মতোই আওয়াজ! উঁচুতে, মন্দিরের আড়ার সঙ্গে বাঁধা ঘণ্টাটা। দড়িতে টান মেরে মেরে বাজাতে হয়।
দূরে, মাটির তলা থেকে যেন ঠেলা খেয়ে উঠে আসছে কী একটা। অন্ধকার রং। দুর্গ। দুর্গ একটা। আশ্চর্য! এই তো সেই দুর্গ যেখানে আমার পৌঁছবার কথা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি দুৰ্গটার বুরুজে বুরুজে কামান। সবগুলো আমার দিকে তাক করা। জানি এই কামানগুলোর পেছনে, কালো পোশাক পরা কালোকাপড়ে মুখ ঢাকা গোলন্দাজরা আছে। যাঃ দুম দাম করে গোলা ছুটে আসছে যে! যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল? আমার সঙ্গে ওদের? আমি কি মধ্যযুগীয় নাইট? একা আমার সঙ্গে কেন এত লোকে যুদ্ধ করে? গোলাগুলো এসে পড়ছে আমার আশেপাশে। পায়ের কাছ এসে পড়ল একটা। আশ্চর্য! এ তো গোলা নয়। কালো কাপড়ে-ঢাকা মুণ্ডু একটা। গোলন্দাজ-সৈনিকের মুণ্ডু। আমি জানতাম না এই ভাবে কামান ছুঁড়তে হয়। গুঁড়ি মেরে কামানের নলের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিজের মুণ্ডুটাকেই গোলার মতন এমনি ছুঁড়ে দিতে হয়? এ ভাবেই যুদ্ধ হয়? তাই তো… এ ভাবেই তো হওয়ার কথা!
হঠাৎ মনে পড়ে বাঃ আমি তো উড়তে জানি! পায়ের পাতায় একটু চাপ দিয়ে শূন্যে উঠে যাই। আরামে উড়ছি। নীচে জোছনার মাঠ, মাঠে মুণ্ডু গড়াগড়ি খাচ্ছে। এসে গেছি…এসে গেলাম… ‘অজামিল! অজামিল!’ কে যেন ডাকছে আমায়। সাড়া দেবার প্রাণপণ চেষ্টায় হাঁকপাঁক করতে করতে জেগে উঠি। ঘোর কাটেনি এখনও। এখনও শরীরে ওড়ার বেগ, চোখে ভাসছে অন্ধকার রঙের দুর্গ। কিন্তু, কেন সাড়া দিতে গেলাম? কাকে? আমি তো অজামিল নই! আমার নাম যে মন্দার! লোকে আমায় ডাকে না। ডাকার দরকার হয় না। তবু যদি কখনও আমাকে শনাক্ত করতে হয়, কেউ মন্দারও বলে না। বলে ছোট সোনা। অর্থাৎ ‘সোনা’ নামটাও আমার ভাগের। ‘সোনা’ বলে আমার পূর্ববর্তী একজন আছে। সে-ই প্রকৃত সোনা। কোনও অসতর্ক মুহূর্তে কেউ হয়তো আমাকেও ‘সোনা’ বলে ডেকে ফেলেছিল। সেই থেকে আমিও একজন ‘সোনা’ হয়ে গেছি। তবে ছোট সোনা, নকল সোনা, আসল নয়।
ভোর হচ্ছে এখন আমার তক্তপোশের বিছানার চারদিক ঘিরে। প্রভাতী গানের সুর ভেসে আসছে দূর থেকে। কোল-হার্মোনিয়াম নিয়ে ছোট চক্কোত্তি বেরিয়ে পড়েছেন। সঙ্গে ওঁর স্যাঙাৎ ভবতারণ, তার গলায় মাদুলির মতো ঝুলছে শ্ৰীখোল। পেছনে ভবতারণের ছেলে, হাতে খঞ্জনি। অর্থাৎ রাধানগরের ভোর
‘রাই জাগো রাই জাগো শুকসারি বলে
কত নিদ্রা যাও কালা মাণিকের কোলে’
এদিক থেকে নাকের সাজা পুব দিকে চলে গেলে ঠাকুরবাড়ি পড়বে। প্রভাতী শুরু হতে না হতেই খুলে যাবে ঠাকুরবাড়ির দরজা। কোল্যাপসিব্ল-এর ভেতর দিয়ে দেখা যাবে ঠাকুরমশাই রাধামাধবের নিদ্রা ভাঙাচ্ছেন। পাতলা মসলিন কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঘষে ঘষে চকচকে করবেন উনি ঠাকুরের অঙ্গ। তারপর মাধবকে পরাবেন চাঁপা রঙের সিল্কের ধুতি, রাধারানির অঙ্গে উঠবে নীল বেনারসী বস্ত্র। তারপর দোলায় এসে বসবেন ঠাকুর। এই রকম সব ভাষাই ব্যবহার করতে হয় ঠাকুরের বেলায়— অঙ্গবস্ত্র, মার্জনা, নিদ্রা, শয়ান, জাগরণ। অনেক দিন আমি মন্দিরের ধাপে বসে বসে এইসব দেখি। খুব আলগা চোখে দেখি। যেন অন্য কিছু করবার নেই বলে দেখছি। অন্য কেউ কোথাও নেই বলে…।
আজ অনেকক্ষণ বিছানাতেই বুঁদ হয়ে থাকি। এই দুৰ্গটা আমি আগেও যেন দেখেছি, আগেও যেন পৌঁছতে পারিনি, আগেও যেন কে ‘অজামিল অজামিল’ বলে ডেকে আমার সব কিছু গুলিয়ে দিয়েছিল, আগেও আমি ঘুম ভেঙে বুঝতে পারি আমি ঠকে গেছি, ভুল নামে সাড়া দিতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেছি। আগে যখন ঘটেছে তখন পরেও নিশ্চয় ঘটবে! তখন, সেই অনাগত ভবিষ্যতে কি এ ভুল শুধরে নিতে পারব?
একদিন না একদিন ওই মুণ্ডুগুলোর কালো কাপড়ের ঘোমটা আমি এক ঝটকায় সরিয়ে দেবই। মুণ্ডুগুলোর পরিচয় আমায় জানতে হবে। ওরা কারা? কেন ওরা এমন মরিয়ার মতো নিজেদের মুণ্ডু আমার দিকে তাক করে? কীসের শত্রুতা আমার সঙ্গে ওদের? একদিন না একদিন ওই দুর্গে আমি ঢুকবই।
শিশিরদা আমার মাস্টারমশাই। উনি আমাকে একটা ডায়েরি উপহার দেন। ডায়েরির ভেতর ভারতের রেলপথ, সড়কপথের মানচিত্র, সারা বছরের ছুটির দিনের হিসেব, প্রধান প্রধান শহরের ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক বিবরণ, জরুরি টেলিফোন নম্বর, প্রধান প্রধান ট্রেনের খবর, আয়করের চার্ট, রাশিফল, আরও কত রকম খুঁটিনাটি তথ্য। পাতাগুলো রুলটানা, ভাল কাগজ, লিখতে বসলে কলম যেন আপনা আপনি চলতে থাকে। এই ডায়েরিতে পৃথিবীর অনেক সুন্দর জায়গার চমৎকার সব ফটোগ্রাফ আছে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, কোপেনহেগেনে সাগরের নীল জলে অ্যান্ডারসেনের জলপরীর মূর্তি, নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ওপর ইন্দ্রধনু, দক্ষিণ মেরুর বরফের ওপর পেঙ্গুইন-পাড়া, ইলোরার কৈলাস মন্দির, চিনের প্রাচীর, লাসার পোতালা প্রাসাদ…। এই ছবিগুলো আমার খুব প্রিয়, এগুলো আমাকে খুব নিষ্পৃহ হতেও সাহায্য করে। যেন আমি আর রাধানগরের রায়বাড়ির পশ্চিম প্রান্তের চারচালা ঘরটায় নেই। ঘুরে বেড়াচ্ছি জেটগতিতে কানাডা থেকে উত্তরমেরু, উত্তরমেরু থেকে তিব্বত, তিব্বত থেকে মালয়েশিয়া। জানি সবটাই একটা মোহ, একটা কল্পমায়া, কিন্তু তারও একটা মূল্য আছে আমার কাছে। এই ছবিগুলো দেখতে দেখতেই নিজের অকিঞ্চিৎকরত্ব আমি ভুলে যাই। ভুলে যাই আমি একটা কেউ-না। ডায়েরির মসৃণ পাতা আমায় হাতছানি দিতে থাকে। আমি লিখি। লেখা তো নয়, আসলে এটা নিজেকে গুছিয়ে তোলা। লোকে যেমন ছুটির দিনে আলমারি গোছায়, তাক গোছায়। গোছাতে গেলেই পরিষ্কার জানা যায় কী আছে আর কী নেই, কোন জিনিসটা হারিয়ে গেছে, কোনটা দরকার…।
আমি প্রাণীটি খুব চাপা প্রকৃতিরও বটে। চট করে কারও কাছে মন খুলি না। কাউকে ডেকে বসিয়ে জোর করে নিজের কথা শোনাবার ইচ্ছে আমার নেই। নিজের জীবনকে বুঝে নিতে চাই বলেই না আমার ডায়েরি লেখা! সত্যি কথা বলতে কী, বড্ড বেশি কুয়াশায় থেকেছি, বড্ড বেশি আবছায়ায়। আবছা কোনও কিছু আমি যেন আর মেনে নিতে পারি না। স্পষ্ট পরিচয়ের আলোয় দাঁড় করিয়ে দিতে চাঁই সব কিছু।
এই আবছায়ার ব্যাপারটা খুলে না বললে আপনারা বুঝতে পারবেন না।
শৈশবে আমাদের প্রথম জ্ঞান হয় একটা কি দুটো মানুষকে ঘিরে। নয়? যেমন এই আমার মা। এ আমাকে খাওয়ায়, নাচায়, ঘুম পাড়ায়। ওই আমার বাবা এল, এই সময়ে আমার বাবা আসে। কতকগুলো কার্যকারণ সম্পর্কও আমরা আবিষ্কার করি, কাঁদি, তা হলেই ঠাকুমা ছুটে আসবেন। ছটফট করি, বিরক্ত করি এদের, তা হলেই এরা আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। কোনও কাকা, মামা-দাদা বা খুব আপন কোনও কাজের লোক নিয়ে যাবে খুশি হয়ে।
আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু এ রকম নয়।
ধরুন আমি কাঁদছি। কেন কাঁদছি আমি জানি না। বুঝতে পারছি না। কাঁদতে কাঁদতে কখন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আবার কখনও কখনও কাঁদতে কাঁদতে আমি চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের বাইরে চলে এসেছি। কাঁদছি একটা জৈবিক তাগিদে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে আমার। বুঝতে পারিনি সেটা।
একজন মহিলা বললেন— কেঁদে পাড়া মাথায় করল যে। কী হয়েছে সোনা! ও সাবির মা একটু দেখো না। এর বোধহয় খিদে পেয়েছে। দেখি তো! একটা আঙুল মহিলা আমার মুখের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। আমি সাগ্রহে সেটা মুখে পুরতে যাই।
—দেখছ তো। ঠিক ধরেছি! ও সাবির মা।
গেলাসে করে দুধ খাওয়ানো হয় আমাকে অতঃপর।
একটা কাঁসার বাটি কেউ বসিয়ে দিয়ে গেছে আমার সামনে। আর একজন মহিলা। বাটিতে মুড়ি। যত না খাচ্ছি, তার চেয়ে বেশি ছড়াচ্ছি চারদিকে। কয়েকটা শালিক এসে ফুটুর ফুটুর করে খেয়ে যাচ্ছে সেগুলো। আমি মজা পাচ্ছি। আরও মুড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছি।
গোঁফওয়ালা একজন লোক আমায় এক রকম টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। পুকুরঘাটে দাঁড় করিয়ে মাথায় দু ঘটি জল ঢেলে দিল। হাঁসফাঁস করে কেঁদে উঠলাম আমি। কাঁধের গামছাটা দিয়ে খপ খপ করে গা মুছিয়ে দিল লোকটা। এবার উল্টো মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল– যা এবার পালা।
আমি এগিয়ে যাচ্ছি, একেবারে নাঙ্গা। একজন ভারী গলার রাশভারী লোক আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন।
—আরে! আরে! তুরতুর করে এ দিগম্বর চলল কোথায়? কে এটা? রঘু! রঘো! বাসু! কে আছিস?
—কী সেজোবাবু!
—আরে বছরকার দিনে কার খোকা এমন ন্যাংটা ঘুরে বেড়াচ্ছে?
—এ হল ছোট সোনা, রাজেন দাদার…
—অ। তা জামা-কাপড় পরিয়ে দে না!
আমাকে টানতে টানতে পশ্চিমের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
—কে আছ গো! কেউ আছ না কি?
—কী বলছ? কে?
—এই তো নন্দদিদি, দাও দিকি এই খোকাকে জামা-প্যান পরিয়ে। চান হয়ে গেছে এর।
আধ ডজন লোকের হাতে ঘুরে-ফিরে আমার স্নান, ভোজন, বেশকরণ, শয়ন হতে থাকে। সকলেই করে দায়ে পড়ে। এই আধ ডজনও আবার পাল্টে পাল্টে যেতে থাকে। তো কী করে আমি চিনব এদের, কী করে বুঝব এদের কার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?
তবে সবচেয়ে আগে এদের ভেতর থেকে স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসে নন্দ পিসি। কোরা-কোরা থান-পরা। গলায় তুলসীর কণ্ঠী। খালি গা। তলার পাটির দুটো দাঁত নেই। কপালে একটা চন্দনের টিপ। চুলগুলো টঙের দিকে তুলে একটা গুটকি খোঁপা বাঁধা। নন্দপিসি আমার ঘরে শোয়। মোটের ওপর আমার জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়া, অসুখবিসুখের খোঁজ রাখে। মোটের ওপর। কেন না, তারও তো কাজ কম নয়!
আর একজন বেরিয়ে আসে— রঘুদা। বেশ শক্তসমর্থ জোয়ান। বুকটা চ্যাটালো। হাঁটুর কাছ অবধি গুটিয়ে তুলে ধুতি পরা। পায়ের পাতাগুলো যেন শাবলের মতো। তেমনই খসকা কালো, তেমনি শিরা ওঠা আঁকাবাঁকা আঙুলঅলা! এদের আমি সারা দিনে একাধিক বার দেখি। রঘুদাকেও আমি চিনে ফেলি। মাঝেসাঝে রঘুদা আমাকে হিজলবাগানে বেড়াতে নিয়ে যায়।
আরেক মহিলা আসেন। স্বর্গ থেকেই নেমে আসেন বোধহয়। কারণ এঁর সান্নিধ্যে সুন্দর গন্ধ। এঁর হাত-পা-চুল চোখমুখ সব ভরা ভরা। সুন্দর রঙিন কাপড় পরে থাকেন। সোনার হাতে সোনার কাঁকন…। এঁকে মা বলি। কিন্তু এই মাকে তো পাই না সর্বক্ষণ। সারা বছর। ক’দিন দেখি আমাদের পশ্চিমের ঘর আলো করে ঘোরাফেরা করেন, খুব আদর করেন আমায়। কাছে নিয়ে শোন। গল্প বলেন, তারপর একদিন দেখি ঘরদোর ভাল করে গুছিয়ে নন্দপিসিকে ডেকে বলেন ‘মন্দারের সব গুছিয়ে দিয়ে গেলাম। একটু দেখো ওকে।’ অনুনয় মিশে থাকে গলায়। আমাকে চুমু খেয়ে ইনি দাওয়া থেকে উঠোনে নামেন, মাথায় ঘোমটা তুলে দেন, ব্যাগ কাঁধে জুতো পায়ে দেখতে দেখতে আবার দৃষ্টির বাইরে চলে যান। ভেতর থেকে কান্না ওঠে আমার, কাতর একটা ডাক উঠে আসতে চায়, সে-সব গিলে নিই আমি। নন্দপিসি বলে মহিলা একবার মায়ের চলে-যাওয়ার পথের দিকে তাকায়, একবার আমার দিকে তাকায়,—‘ধাত বটে একখানা বাবা, পাষাণও হার মেনে যাবে।’ কাকে লক্ষ্য করে বলে পিসি? আমাকে? না আমার মাকে!
মা এলে একজন মানুষকে একটু বেশি বেশি দেখতে পাই। একে বলে ‘বাবা’। লাঠিয়ালদের মতো পাকানো চেহারা এর। পেশির ঢেউ গোটা দেহে। চকচক করছে একেবারে। যেন তবক দেওয়া শরীর। বাবরি চুল। পাকিয়ে তোলা গোঁফ। টানা টানা চোখ। চোখের পাতা এত ঘন যে মনে হয় কাজল পরে আছে। মা থাকলে আমরা এই দাওয়াতে খাই। বাবাকে দেখতে পাই ঘন ঘন। মা চলে যাবার পর তাই এই বাবার কাছেই ঘেঁষতে যাই। বাবার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু যত রাতই হোক বাবা আমাকে তুলে আমার নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় তুলে দিয়ে যায়।
মা চলে যাবার পরে আবার সব গুলিয়ে যায়। সম্পর্ক, সময়, সব। কখন চান করি, সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরি, কখন কোথায় যাই তার কোনওই ঠিক থাকে না। ইচ্ছে হল চান করলাম। মনে পড়ল না, করলাম না। খিদে পেলে আগে ঘরে খুঁজি। যদি মুড়ি, নারকোল নাড়ু, কি মুড়ির চাক ছোলার চাক কিছু পাওয়া গেল, তা-ই চিবিয়ে নিলাম। কিছু না পেলে যেখানে রান্না হতে দেখেছি, বসে পড়ি। তিন চারটে ঘরে রান্না হয় রায়বাড়ির, যেখানে হোক বসে পড়লেই হল।
—কী? খিদে পেয়েছে?
—হ্যাঁ।
থালায় করে ভাত এসে যায়। হাতায় করে ডাল ঢেলে দেওয়া হয়। তরকারি, ভাজা, অম্বল, দই, যেটা ভাল লাগল খেলাম, যেটা না লাগল পড়ে রইল পাতে।
এর চেয়েও যখন ছোট ছিলাম, আমার খাওয়ার সময় ছিল মাঝ রাত্তির। সারাদিন হয়তো খাওয়া হয়নি। কেউ মনে করে দেয়নি। একটা বয়স পর্যন্ত শিশুদের তো দিতেই হয়! আমাকে কারও দিতে মনে থাকত না। ঘুমিয়ে পড়েছি এক সময়ে। মাঝরাত্তিরে খিদের চোটে ঘুম ভেঙে গেছে। তখন পিঁড়ির ওপর পিঁড়ি সাজিয়ে শিকেয় রাখা খাবার পাড়বার চেষ্টা করেছি। কিন্তু হাত পৌঁছচ্ছে না।
—ও কী? সোনা! কী খুটুর খুটুর করছ? খিদে পেয়েছে বুঝি?
নন্দপিসি শিকে থেকে ঠাকুরের রাতের ভোগের মালপো, সুজির পায়েস বার করে দিত।
যেমন উল্টোপাল্টা খাওয়া, তেমন যেখানে সেখানে ঘুম। খেলতে খেলতে যেখানে ঘুম পেল, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম। খেলা মানে তো বেড়ালের পেছনে ছোটা, কাঠবেড়ালির সঙ্গে গাছে ওঠা। এই সব খেলায় তো লোকালয়ের চৌহদ্দিতে আটকে থাকা যায় না! সুতরাং কখনও মাঠে-ঘাটে, কখনও গোয়াল ঘরে, কখনও পুকুরের ঘাটে, আমাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যেত। কারও চোখে পড়লে তুলে দিয়ে যেত, অনেক সময় শুধু ঠেলে তুলে দিত।—যা বাড়ি গিয়ে ঘুমোগে যা। তবে এসব ঘটনা ঘটত দিনের বেলার পরিসরে। একবার হল কী, ঘুম ভেঙে দেখি ভীষণ হাওয়া দিচ্ছে, হাওয়া তো নয়, নদীর স্রোত যেন। এক আকাশ জলজ্বলে তারা হাওয়ার স্রোতে ভেসে চলেছে। তারপর দেখি, আরে আমিও তো ভেসে যাচ্ছি? আমার শরীরের তলায় মাটি, চারিদিকের গাছপালা সবই তো ভেসে যাচ্ছে? ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, কোথায় যাচ্ছি আমি? চারদিকে কেমন ছায়া-ছায়া মূর্তি সব। এরা যেন সব পাহারা দিয়ে আমাকে নিয়ে চলেছে। যাতে আমি কিছুতেই পালাতে না পারি। মনে হল, অনেক দিন থেকে আমাকে নিয়ে একটা চক্রান্ত চলছিল। এই আকাশ, এই তারা, এইসব ছায়ামূর্তি মিলে ভয়ঙ্কর কিছু একটা করার তালে ছিল, হঠাৎ ঘুমটা না ভাঙলে সেই ভয়ঙ্করটা নির্বিঘ্নে হয়ে যেত।
এই সময় দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে উঠল। প্রথমে একটা। তারপর অনেকগুলো। বিশ্রী একটা ‘হ্যা হ্যা হ্যা’ ডাকে চারদিক যেন ভেঙে চৌচির হয়ে যেতে লাগল। আমি প্রাণপণ চেষ্টায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই আওয়াজ হয়তো অনেকদূর ছড়িয়ে গিয়েছিল। মানবশিশুর কান্না বলে বোঝা গিয়েছিল কি না জানি না অবশ্য। কেননা কেউ সাড়াশব্দ করেনি। গাঁয়ের লোকের নানারকম কুসংস্কার তো থাকেই, হয়তো লোকে শুনে থাকলেও ভূতের ছল, কি পেতনির কান্না ভেবে নিয়েছিল। কিন্তু গোরুদের তো কুসংস্কার নেই। কয়েকটা গোরু কাছাকাছি কোথাও হাম্বা হাম্বা করে রীতিমতো শোরগোল শুরু করে। তখন লণ্ঠন নিয়ে দু’জন মানুষ বেরিয়ে আসে।
—কে রে? গোরুগুলো এত ডাকছে কেন? কে যেন কাঁদল? হরি হরি, রাধাকেষ্ট, রাধাকেষ্ট।
আমি তখন ভয়ে নেতিয়ে পড়েছি। এরা নিচু হয়ে আমাকে দেখছে, আমি বুঝতে পারছি কিন্তু গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
—এ যে একটা ছোট ছেলে দেখছি। কাদের ছেলে? একেবারে হিম হয়ে গেছে যে। তোল তোল!
ভজহরি আর শ্রীরাম, দুই ভাই আমাকে বাসা থেকে পড়ে যাওয়া পাখির ছানার মতো তুলে নিয়ে যান। ওঁদের বাড়ির মেয়েরা অনেকক্ষণ ধরে গরম সেঁক দিয়ে দিয়ে, অল্প করে গরম দুধ খাইয়ে খাইয়ে আমায় চাঙ্গা করেন। পরদিন বেলা ৯টা অবধি আমি ঘুমোই। ওঁরাই পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত হন যে আমি ঠাকুরবাড়ির ছেলে। ভাগ্যক্রমে রঘুদাকেই ওরা ডেকে নিয়ে যান আমায় শনাক্ত করতে।
আমি তখন ভজহরি ঘোষের স্ত্রীর কোলের কাছে বসে কাঁঠালের রস দিয়ে মেখে চিড়ের ফলার খাচ্ছি। রঘুদাকে ঢুকতে দেখেই ফলার টলার ফেলে উঠে দাঁড়াই।
—ওঘু, ওঘু…।
রঘুদা বলে ওঠে—আরে এ তো ছোট সোনা, রাজেনকত্তার ছেলে। কী করে এল এখানে?
—মাঠের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বটগাছতলায়, চারদিকে ঝুরি নেমেছে তো৷! আরাম পেয়েছিল বোধহয়!
এই ঝুরিগুলোকেই আমার ছায়ামূর্তি মনে হয়েছিল।
বলরাম ঘোষের স্ত্রী বললেন—সাপেখোপে কাটেনি এই ঢের। বাড়িতে নিশ্চয় এতক্ষণে কান্নাকাটি পড়ে গেছে?
রঘুদা বললে—তুমিও যেমন বউঠাকরুন, ও ঠাকুরবাড়ির কেউ এখনও টেরই পায়নি যে ছেলেটা বাড়িতে নেই!
—আশ্চয্যি। মা নেই, না কি?
—আছে আবার নেই-ও। ও সব বড় ঘরের কারবার, তুমি আমি বুঝব না গো! তখন আমার কত বয়স হবে? বছর চারের বেশি না।
দুই
পাকুড় গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে, আমার বাবা চোখ বুজিয়ে নিম ডাল দিয়ে দাঁতন করছে। জানলা দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে আমি বিছানা থেকে নেমে পড়ি। কেমন মনে হল, আচ্ছা এত কিছু বদলে যায়, বাবার এই চোখ বুজিয়ে দাঁতন করার দৃশ্যটা বদলে যায় না কেন? ধরা যাক উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের বিপ্লবের আগস্ট, ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হল, বাবা কি সেদিনও এমনি করে দাঁতন করছিল? কিম্বা উনিশশো একচল্লিশ সনের ৮ই আগস্ট, বাইশে শ্রাবণ যে দিন রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন? ভুল করছি, বাবা বোধহয় সে সময়ে জন্মায়নি, আচ্ছা ধরা যাক, বাবারই ব্যক্তিগত জীবনের কথা, বাবার তো একজন মা ছিলেন, তিনি তো এইখানে এই রাধানগরেই থাকতেন, তা তিনি যেদিন মারা গেলেন? যদি বাবার জীবৎকালে ভারতবর্ষের কিংবা সমগ্র পৃথিবীরই অন্তিম দিন এসে যায়? সেদিনও বাবা এমনি পাকুড়তলায় দাঁড়িয়ে…। এরপর বাবা ছোলা ভিজে চিবিয়ে বেশ কয়েকটা ডন মারবে। বাবার জলখাবার হল প্রকান্ড এক কাঁসি মুড়ি, জবজব করে তেল দিয়ে মাখা, গোটা সাত আট লাল টকটকে কাঁচা লংকা, আর তারপরে এক ঘটি দুধ। লাল পাড় ধুতি পরে বাবারা। এই ধুতি আর এইরকমই লাল পাড় শাড়ি, ভক্তরা নানান উপলক্ষে পুজো দেয় রাধামাধবকে। অগুন্তি এরকম ধুতি শাড়ি টাল করে রাখা থাকে মন্দিরের ডাইনের ঘরে। সেই কাপড়ই পরে আছে বাবা। কোরা কাপড়। কয়েক কাচের পরে কেমন ময়লাটে হয়ে যায়, সদু ধোপানি অনেক সেদ্ধ করেও আর ধবধবে করতে পারে না।
ভাল করে রোদ না হতেই বাবা হিজলবাগানে চলে যাবে। সারাদিন সেখানেই কাটবে বাবার। মাঝখানে হয়তো খেতে আসতে পারে, না-ও পারে। সূর্য ডুবে গিয়ে সন্ধের অন্ধকার বেশ ভাল করে নেমে না আসা পর্যন্ত বাবা বাড়ি ফিরবে না। অনেক দিন সন্ধেতেও বাবা বাড়ি ফেরে না। কোথায় থাকে এ সময়টা আমি জানি না। হয়তো বন্ধুদের বাড়ি। বুড়ো ভঞ্জ, সেতাব চাচা, মোটা ভটচায্যি, ছোট চক্কোত্তি, ভবতারণ খোলবাজিয়ের দাদা রামতারণ যাকে সবাই বলে গেঁজেল রাম।
যখন ছোট ছিলাম, অনেক সময়ে তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেলে আমি ছুটতে ছুটতে হিজলবাগানে চলে যেতাম।
‘এই আম্রকানন ঁশ্রীশ্রী রাধামাধব জিউর সেবা বিধায় শ্রীযুক্ত উপীন্দ্রনাথ রায়কে দেবত্র অর্পিত হইল, বং ১২৭৩, তাং উনত্রিশে আষাঢ় শ্রীশ্রীরথযাত্রা ইতি’—এইরকম একটা নোটিস হিজলবাগানের ফটকে টাঙানো আছে। নীল টিনের ওপর সাদা দিয়ে লেখা। পুরনো হয়ে গেলে এটা আবার রং করে ঠিকঠাক করা হয়। কত বড় এ বাগানটা আমার কোনও ধারণাই নেই। শয়ে শয়ে আমগাছ ঠিক বড় বড় খোলা ছাতার মতো বাগান জুড়ে আছে। চন্দননগর থেকে একবার কয়েকজন সাহেব বাগান দেখতে এসেছিল। তখন বাবা তাদের বোঝাচ্ছিল ‘ম্যাংগোজ অফ দা বেস্ট কোয়ালিটি হিমসাগর ভ্যারাইটি।’ তবে আম ছাড়াও এ বাগানে আছে আরও বহু রকমের ফল গাছ। জাম, জামরুল, লিচু, বাতাবি লেবু, কাঁঠাল, পেয়ারা, ফলসা, ডালিম..। হিজলপুকুর বলে একটা মস্ত পুকুর আছে এক দিকে। তার পাড় থেকে অনেকটা জুড়ে শীতের সবজির ক্ষেত। এটা বোধহয় আমার বাবার বিশেষ শখের। অনেক সময়েই দেখেছি, বাবা উবু হয়ে বসে টোম্যাটো গাছের পাশে কাঠি পুঁতে দিচ্ছে রঘুদার সঙ্গে, তার ওপর তুলে দিচ্ছে গাছের নরম ডাল। বাবারা বলে বিলিতি বেগুন। তবে বাবার আসল জায়গা হল হিজল পুকুর। প্রকাণ্ড দিঘি। মূলবাগানটার থেকে তারের ঘের দিয়ে আলাদা করা। চোপর দিন এইখানে ছিপ হাতে করে বসে থাকবে বাবা।
আমরা রাধামাধবের সেবাইত। মাছ খাই না। ধরারও কথা নয়। বাবাও খায় না। কিন্তু ধরে। হিজলপুকুরে বোধহয় বাবা প্র্যাকটিস করে। অনেকদিন দেখেছি একটা চ্যাটালো কালচে কাতলা মাছ বাবা ছিপের মুখ থেকে ছাড়িয়ে আবার জলে ফেলে দিল। কিন্তু বাবা বেশ নাম করা মাছ শিকারি। মাঝে মাঝেই বন্ধুদের নিয়ে মাছ ধরতে যায়। সে-সব দিনে বাবার ওই বন্ধুরা—বুড়ো ভঞ্জ আর সেতাব চাচা, মোটা ভটচায্যি আর গেঁজেল রাম আমাদের দাওয়ায় বসে গেলাস গেলাস কড়া চা আর বিড়ি খায়; আর এনতার মাছ ধরার গল্প করে। মাছ ধরার গল্পের সঙ্গে ছিঁচকে চোর আর ডাকাতের দলের গল্পও থাকে, আর থাকে ভূত পেতনির গল্প। গল্পগুলো শুনতে ভাল লাগলেও বাবার এই দোস্তদের আমার ভাল লাগে না।
নস্যি-নেওয়া খোনা গলায় বুড়ো ভঞ্জ বলে—রাজির ব্যাটা পাজি, অ্যাই রাজির ব্যাটা পাজি, ভেতর বাড়ি থেকে এক ঝোড়া তেলে ভাজা ভাজিয়ে নিয়ে এসো তো বাপ।
বাবা আমাকে বাঁচায়—খেতে হয়, কেষ্টর দোকান থেকে আনিয়ে দিচ্ছি। ও সব মতলব ছাড়।
যখন ছোট্ট ছিলাম, সেতাব চাচা দুটো আঙুল সাঁড়াশির মতো করে আমার নরম পেট চিপটে ধরত। কী যে ভীষণ লাগত।
বাবার ঘরে একগাদা ছিপ আর বঁড়শি। খুব সাবধানে সে সব থেকে একটা দুটো বেছে নিত বাবা, বিটকেল সব চার তৈরি করত। রাত থাকতে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে চলে যেত সেজেগুজে। মাছ শিকারেই যাচ্ছে না বাঘ শিকারেই যাচ্ছে।
—কোথায় গিয়েছিলে বাবা?
—সে একটা জায়গায়।
—কোথায়?
—হুগলি বর্ধমানের বর্ডারের দিকে।
—কত বড় মাছ ধরলে?
—হুঁ।
—কত বড়? পাঁচ ছ’ সের?
—হুঁ।
—আর ওরা? চাচারা?
—ভালই।
—কত বড়?
—দেখিনি।
এর চেয়ে বেশি কথা বাবার মুখ দিয়ে বার করা শক্ত ছিল।
কেউ জিজ্ঞেস করলে সে সময়ে আমি বলতাম—‘আমার মা চাকরি করে আর বাবা মাছ ধরে।’
ছোট ছেলের কথায় বোধহয় সবাই মজা পেত। আমার স্কুলের বন্ধু তারক-এর মা বলতেন—আবার বলো! কী, কী করেন তোমার বাবা-মা!
—মা চাকরি করে আর বাবা মাছ ধরে।
মাকে চাকরি করতে হয় বলেই যে মা আমাদের সঙ্গে থাকে না, এ-কথা মা-ই আমাকে বুঝিয়ে ছিল। খুব মস্ত চাকরি। সেখানে মাকে না হলে চলেই না। পরে বুঝেছি, চাকরি হয়তো মা করে। কিন্তু না করলেও মা আমাদের সঙ্গে থাকত না। থাকতে পারত না। মাকে এখানে, এই রাধানগরে কেউ পছন্দ করে না। নন্দপিসি ছাড়া কাউকে তো মায়ের সঙ্গে কথা বলতেই দেখিনি। মা এলে সবাই কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। তবে, মা চলে যাবার পর ফুলকাকিমা কি রাঙাবউদি, নিজেদের ঘরে ডেকে আমাকে এটা-ওটা দিত, হঠাৎ-হঠাৎ জিজ্ঞেস করত মা কী বলল, কী আনল, বাবার সঙ্গে মায়ের কী কথা হল! কৌতূহলটা আমার কান এড়াত না, যদিও খুব স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করত ওরা। অন্য সময়ে আমাদের নিয়ে কারও মাথা-ব্যথা ছিল না।
অনেক দিন পর্যন্ত মা খুব নিয়মিত এসেছে। মাসে একবার কি দুবার। জুটের বাহারি ব্যাগ থেকে তখন বেরোত আমার জামা-কাপড়, জুতো, বই, খেলনা, চকলেট, লজেন্স, প্যাকেট প্যাকেট বিস্কুট, বাবার জন্যে সিগারেট।
মা যে কদিন থাকত, আমাদের দাওয়ার এক পাশে চ্যাটাইয়ের আড়াল দিয়ে কেরোসিন স্টোভে রান্না হত। পোলাও রাঁধত মা। আমাদের ঠাকুর বাড়ির পোলাওয়ের মতো মিষ্টি খেতে নয়। মটরশুঁটি দিয়ে মায়ের সাদা পোলাও, টক ঝাল কপির তরকারি, কড়কড়ে আলুভাজা খুব ভাল লাগত। সারা বছর মিষ্টি মিষ্টি আর মিষ্টি খেয়ে আমাদের মুখ পচে থাকত তো!
ক্রমে ক্রমে মায়ের আসা খুব অনিয়মিত হয়ে গেল। আমি হয়তো জিজ্ঞেস করলাম—সরস্বতী পুজোর সময়ে এলে না তো মা!
মা বলল—কাজ ছিল। —তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—তা ছাড়া তুই তো বড় হয়ে যাচ্ছিস মন্দার!
আমি বড় হয়ে যাচ্ছি বলে মায়ের আর আসার দরকার নেই না কী! সোজাসুজি না বললেও কথাটার অর্থ তো তাই-ই দাঁড়ায়! সত্যিই কমতে কমতে কবে যে মায়ের আসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল! খুব সইয়ে সইয়ে একটু একটু করে ব্যাপারটা হয়েছে বলে আমার নিজেরই খেয়াল হয়নি। সত্যিই তো আমি বড় হয়ে যাচ্ছিলাম! স্কুলে শিশিরদা, বিপিনদা, হেডসার এঁরা আমার বাবার জায়গা নিয়ে নিচ্ছিলেন। ক্রিকেট খেলছি তখন। টিম তৈরি হচ্ছে। তারকের সঙ্গে আমার খুব ভাব। প্রায়ই স্কুল-ফেরত তারকদের বাড়িতে চলে যাই। তারকদের পরিবার একটা স্বাভাবিক পরিবার। ওর বাবা মা ছাড়াও দুজন বোন আছে, ঠাকুমা আছেন, দিদিমা মাঝে মাঝে মামাকে নিয়ে বেড়াতে আসেন। আমি কারও সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হতে পারি না, তবু তারকের সঙ্গে আমার পটে। ও আমায় কথা বলায় না। নিজেই সাতকাহন কথা বলে। আর ওর বাবা আমার সঙ্গে কত গল্প করেন, আমার ইংরেজি অঙ্ক দেখিয়ে দেন, কত রকমের গল্প বলেন, তারকের মা আমাকে কত যত্ন করেন।
তারকের মা-ই একদিন বললেন আমায় কথাটা।
—স্কুলের পাশটা দিয়ে তুমি মায়ের কাছে চলে যেও মন্দার। এভাবে মানুষ বাঁচে? আসলে সেদিন উনি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন,
—সকালে কী দিয়ে ভাত খেয়েছ মন্দার?
—ভাত তো খাইনি আজ মাসিমা! অত সকালে আমাদের ভাত হয় না।
—সে কী? তবে কী খেলে?
—দুধ-মুড়ি।
তখনই উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন কথাটা। —স্কুলের পাশটা দিয়ে তুমি মায়ের কাছে চলে যেও মন্দার। এভাবে মানুষ বাঁচে?
উনি বোঝেননি, মানুষ যেটা কখনও পায়নি, তার জন্য তার অভাববোধও থাকে না। আমি জানতাম না একটা আঁটসাঁট পরিবারের মধ্যে মায়ের স্নেহ, বাবার যত্ন, ভাইবোনেদের সঙ্গে খেলাধুলো ঝগড়াঝাঁটির জীবনটা কীরকম। তাই তার জন্যে আমার কোনও কষ্ট ছিল না। কিন্তু যেই ওঁর কথাটা শুনলাম অমনই কী যেন একটা আমার মধ্যে খুলে গেল। আমি ভাবতে শুরু করলাম।
—এ-ভাবে মানুষ বাঁচে?—কথাটার গুরুত্ব ভীষণ।
কী ভাবে? কী ভাবে বেঁচে আছি?
ওঁর মায়ের মন। শুধু আমার খাওয়া-দাওয়ার অনিয়মের কথা মনে করেই হয়তো করেছিলেন মন্তব্যটা। কিন্তু আমি আমার পুরো জীবনযাত্রাটা সম্পর্কেই জিজ্ঞাসু হয়ে উঠলাম। কী ভাবে? কী ভাবে বেঁচে আছি?
আমরা থাকি পশ্চিম প্রান্তে। আমি আর বাবা। মাটির উঁচু দাওয়ার ওপর খাপরার চালের দুটো ঘর। একটায় বাবা থাকে, শোয়, একা। অগত্যা অন্যটাতে আমি থাকি, শুই একা।
আমরা খাই ন’ জ্যাঠাইমার হেঁশেলে। সকালে স্কুলে যাবার সময়ে ন’ জ্যাঠাইমাদের সবে প্রথম হাঁড়ি চালের ভাত নেমেছে। পঞ্চা, নিতাই, রবি, গায়ত্রী, বিনু, সত্য…এই রকম জনা ছয় সাত স্কুলযাত্রী গরম ভাতে ঘি দিয়ে আলুভাতে মেখে খেয়ে উঠে যায়। আমি বারবার ভাত খেতে পারি না। নন্দপিসি মুড়ির মধ্যে দুধ ঢেলে আমার জন্যে নিয়ে আসে। নারকোল কোরা আর বাতাসা ঢেলে দেয় ওপরে। বিকেল সাড়ে তিনটে চারটের সময়ে স্কুল থেকে ফিরে আমরা ভাত খেতে বসি। শুকতো থেকে অম্বল সব কিছু খেতে হয় আমাদের। তখনও ন জ্যাঠাইমাদের পাত পড়েনি। আমরা উঠব, তবে ওঁরা বসবেন। উনি, ফুলকাকিমা, রাঙাবউদি, লীলাপিসিমা, নন্দপিসি।
ন’ জ্যাঠাইমা হয়তো একদিন বললেন—হ্যাঁরে ছোট সোনা, তোর বাপকে যেন কদিন বসতে দেখিনি!
আমি কী করে জানব? আমি কিছুই জানি না।
নন্দপিসিই বলল—ওর বাপের তো কদিন খুব সর্দি, জ্বরোভাব। আমাকে বললে দুধ-বার্লিক করে দিতে তো তাই দিচ্ছি।
এত মানুষ আর এত বিশৃঙ্খলা যে নিজে উদ্যোগ করে পাতা পেতে না বসলে খাওয়াই জুটবে না এ বাড়িতে। নন্দপিসির যত্ন-আত্তিটুকু ছাড়া ঠাকুর বাড়ির সবই এজমালি, সবই ভাগের—তরিতরকারি, চাল, ডাল, তেল মশলা, কাপড়চোপড় কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু হাত পেতে চেয়ে নিতে হবে। যদি না পারো তো পাবে না।
আমি পারি না, পেতামও না কিছু। হয়তো অযত্নে, অবহেলায়, না খেয়ে মরেই যেতাম। নন্দপিসির দয়ায় বেঁচেছি। ওর দয়াতেই পাই ঠাকুরের প্রসাদ, বছরের জামাকাপড়, রোগের ওষুধ পথ্য। আমার মা থেকেও নেই, বাবা খোঁজ করে না। কিন্তু পঞ্চা, রবি, নিতাই ইত্যাদি আমার জাড়তুত খুড়তুত পিসতুতদের মায়েরা শত কাজেও তাদের ওপর নজর রাখেন। কে তেতো ভালবাসে না, কর মুগের ডাল আর আলুভাজা ছাড়া খাওয়া হয় না, কার প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে, কার জুতো ছোট হয়ে গেছে এ সমস্ত খোঁজ খবরই তাঁরা রাখেন, সেই মতো ব্যবস্থাও নেন। এদের অনেকেরই বাবা চাকরি করেন কোথাও না কোথাও। হয়তো সপ্তাহ শেষে বাড়ি আসেন, সেই সময়ে এস্টেটের হিসেব বহির্ভূত শখের জিনিসও তাঁরা ছেলেমেয়েদের জন্যে আনেন। কিন্তু আমার বাবা হিজল বাগানে জামগাছতলায় বসে মাছ ধরে কিংবা রঘুদার কালো ছাগলছানাটার সঙ্গে কঞ্চি কাড়াকাড়ি খেলে। বাবা নিজেও এস্টেটের কোরা লালপাড় ধুতি ছাড়া পরে না, আমিও বারো মাস তিরিশ দিন পরি এস্টেটের খাকি হাফপ্যান্ট আর ছাই রঙা শার্ট। মা যতদিন আসছিল আমারও কিছু শহুরে শখের জিনিস প্রাপ্তি হচ্ছিল। তখনকার ক্রেয়ন, জলরং, স্কেচবুক, তখনকার গেমস আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু এখন মা আর আসে না, বাবাও যত দিন যাচ্ছে আরও আলগা, আরও ভুলো হয়ে যাচ্ছে।
রাত্তির সাতটা অবধি আমি তারকদের বাড়িতে রয়েছি। সাতটা বেশ রাত। তারকের বাবা জিজ্ঞেস করলেন—বাড়িতে বকুনি খাবে না এতক্ষণ অবধি বাইরে রয়েছ।
—কে বকবেন?—আমার উত্তরে কি দার্শনিকতা মিশে থাকে?
—কেউ ভাববেন না? চিন্তা করবেন না?
—না।
আদরও নেই, শাসনও নেই আমার। আর সব ছেলেমেয়ে অবশ্য বিকেল হলেই বাড়ি ফিরে যায়, সন্ধে হলেই পড়তে বসে, রাত হলেই খেয়ে নেয়, ঘুমিয়ে পড়ে। আমি যদি একদিন হিজলপুকুরে চলে যাই, কোনও বাহাদুরি দেখাতে দিয়ে ডুবে যাই, আমার লাশ ভেসে না ওঠা পর্যন্ত কারও হয়তো খেয়ালই হবে না আমি নেই।
বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই বা আমার যোগ কতটুকু? একই স্কুলে পড়ি, একই বাড়িতে থাকি, কত সময়ে একই সঙ্গে খাই, কিন্তু অনেক লোভ দেখিয়েও ওদের আমি কখনও আমাদের ঘরে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারিনি। চাইনিজ চেকার, তাস, দাবা, লুডো, কিছু দিয়েই না। কিছুক্ষণ গেলেই বড়রা ওদের ডেকে নেন।
একবার, একবারই মাত্র বাড়ির ছেলেদের একজন হবার সুযোগ এসেছিল। শুনলাম পঞ্চা, ভুতু আর আমি—আমাদের তিনজনের নাকি পাঁচ বছর বয়স হয়েছে, এক সঙ্গে হাতে-খড়ি হবে। নতুন কাপড় পরেছি, নতুন স্লেট-পেনসিল হাতে। ফট করে স্লেটে একখানা ‘অ’ লিখে ফেললাম। বিরাট একটা ‘অ’। ফুলকাকিমা আমাকে নিতে এসে সেই লেখা দেখে মুখ কালো করে ফিরে গেলেন। তারপরে নন্দপিসি এসে ধমকে বলল—‘কে তোমাকে বাহাদুরি করতে বলেছিল? নাও, এখন ওরা কেমন মজা করে হাতে খড়ি করবে, তুমি ন্যাড়া-নুলো হয়ে বসে থাকো। বোকা ছেলে কোথাকার!’ জীবনে প্রথম রায়বাড়ির একজন হয়ে, আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গৃহীত হবার একটা সুযোগ এসেছিল, গেল। যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম।
সাধারণত আমি পেছন দিক দিয়ে ঢুকি বাড়িতে। আমাদের ঘর কাছে হয়। আজ সামনে দিয়ে ঢুকি। বাগান ঘেরা—রাধামাধব জিউর মন্দির। মন্দিরটা পোড়ামাটির। কিন্তু পাশে মন্দিরের গা দিয়েই পাকাঘর তোলা হয়েছে কয়েকটা। ডাইনে দুটো, বাঁয়ে দুটো। সামনে লম্বা চওড়া বারান্দা। ঘরগুলোতে ঠাকুরের সাজ-সরঞ্জাম থাকে।
একেবারে ডাইনের ঘরটায় চেয়ার-টেবিল আর গোটা চার স্টিলের আলমারি আছে। এখানে বড় জ্যাঠামশায়কে কাজ করতে দেখেছি।
মন্দিরের পেছনে আছে ঠাকুরের রান্নাঘর। একটা মাটির ঘর, খড়ের চাল। এখানটা সব সময়ে ঘি-এর গন্ধে ম-ম করে। সামনে মন্দিরটা রেখে রায়বাড়ি ক্রমশ পেছন দিকে বিস্তৃত হয়েছে। বাড়ি বললেও, আসলে তো এটা বাড়ি নয়, একটা পাড়া বিশেষ। থেকে থেকেই দুখানা কি তিনখানা ঘরের এক একটা ইউনিট। সামনে বারান্দা। ঘরগুলো বেশির ভাগই মাটির, কয়েকটা মাত্র পাকা ঘর আছে। কিন্তু চাল সবগুলোরই টালির কিম্বা খাপরার, কোনও ঘরই দোতলা নয়। গাছপালায় ভর্তি রায়বাড়ির চৌহদ্দি। কিছুটা কিছুটা অংশ তো রীতিমতো বাগান। পুকুরও আছে গোটা তিনেক। কারও বিয়েটিয়ে হলেই অমনি নতুন ঘর ওঠে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কয়েকটা উঠোন আছে, তারই চারপাশ ঘিরে ঘরগুলো। উঠোন কিন্তু বাঁধানো নয়। খালি জমি বেশ সমান করে পেটানো, তার ওপর সুরকি চালা। ভেতর দিয়ে পথও গেছে, পথের ওপর নুড়ি বিছোনো। আমি পুব দিকে ঠাকুরবাড়ির বাগানের গেট ঠেলে ঢুকলাম। যখন এখানে অনেক লোকের ভিড় থাকে, তখন আমি এ মুখো হই না। আসি যখন কেউ বিশেষ থাকে না।
এখন আরতি হচ্ছে। ভারী ঘণ্টাটার গং গং আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ঘণ্টার নিরবচ্ছিন্ন পাতলা টুং টুং আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে। বারান্দার ওপর আরতি দেখতে রাধানগরের অনেক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। রায়বাড়ির মহিলারা অনেকেই রয়েছেন। কাকা জ্যাঠাদের মধ্যেও কেউ কেউ জোড় হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। শঙ্খ বাজছে, কাঁসর বাজছে। চক্কোত্তিমশাই পঞ্চপ্রদীপটা নামিয়ে রেখে কর্পূরের দীপটা তুলে নিলেন। পঞ্চপ্রদীপ হাতে নিয়ে সেজ জ্যাঠাইমা এগিয়ে আসছেন ভিড়ের দিকে।
আমি কি একটু তাপ পাব? নাঃ, সেজ জ্যাঠাইমা আমাকে দেখতে পেলেন না। ঠাকুরের পেতলের হাতে মুখে পঞ্চপ্রদীপের ছায়া নাচছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাধামাধবের চোখে চোখ ফেলবার চেষ্টা করি। কিন্তু চারদিকে এত আলো এত শব্দ, এত ভক্তি, কেনই বা ওঁরা আমার অন্ধকার কোণের দিকে তাকাবেন?
চক্কোত্তিমশাই তামার থালা থেকে চামর তুলে নিলেন। আমি আর অপেক্ষা করি না, এ ঘর সে ঘরের পাশ দিয়ে দিয়ে নিজেদের আস্তানার দিকে এগোতে থাকি।
মেজ ঠাকুরদার ঘরের সামনের বারান্দায় কয়েক জন বসে। মেজ ঠাকুরদা আমার চলার আওয়াজ পেলেন বোধহয়। চেঁচিয়ে বললেন —কে যায়?
—আমি সোনা।
—সোনারুপো আবার কেডা?
মেয়ে গলার আওয়াজ পাই— ওই তো ছোট খুড়োমশায়ের ঘরের রাজু গো, ওরির ছেলে।
—রাজু? কোন রাজু?
—আহা বললুম তো! রাজেন যে ম্যাম বিয়ে করেছে।
—তাই বলো।
আমাকে এঁরা ‘আমি’ বলে চেনেনই না আমার পরিচয় আমার বাবার পরিচয়ে রাজুর ছেলে। আবার বাবার পরিচয় আমার মার পরিচয়ে। ‘যে রাজু ম্যাম বিয়ে করেছে।’
মাকে এঁরা মেম বলেন কেন? মা তো শাড়ি-পরা বাঙালি মেয়েই। খুব ফর্সা বলে? না ছোট চুল বলে? ছেলেদের মতো পা-ঢাকা নিউ কাট জুতো পরে আসত মা। চলার ভঙ্গি খুব সোজা। দৃপ্ত ধরনের। তাতে তো বরং মাকে দুর্গা কি জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের মতো লাগত! মেম-মেম নয় মোটেই। আর সুদ্ধু ছোট চুল আর সোজা হাঁটার জন্যেই কি এত ব্যঙ্গ? অদ্ভুত তো!
পারা-চটা গোল আয়নাটায় বাবা খুব মনোযোগ দিয়ে দাড়ি কামাচ্ছে। আমি বিনা ভূমিকায় জিজ্ঞেস করলাম— ‘বাবা, মা আর আসে না কেন?’
থতমত খেয়ে গেল বাবা, কোনওদিন কোনও জরুরি প্রশ্ন তো বাবাকে করিনি। তবে বাবা যা বলল, তাতে আমারও থতমত খাবার কথা। বলল— ‘আমি কী করে জানব?’
যদি বলত— ‘জানি না’, তার একটা মানে হত। কিন্তু ‘আমি কী করে জানব?’ বাবার জানার কথাই নয়? মা তো বাবারই বউ? সেই মা কেন আসে না, বাবা জানে না, জানার কথা বলেও মনে করে না!
—কে জানবে তা হলে? কে জানে? আমি ছাড়ব না আজ।
— কেন আসে না, মা?—আর একটু দৃঢ় গলায় জিজ্ঞেস করি।
—তোমার মা-ই জানে।
এর ওপরে আর কী কথা চলতে পারে! মায়ের আসা-না-আসা নিয়ে বাবার কোনও আগ্রহ উদ্বেগ নেই। কোনও ভূমিকাই নেই। মা নিজের ইচ্ছেয় আসত, নিজের ইচ্ছেয় আসা বন্ধ করেছে— এমনটাই বুঝতে হয়। তা যেন হল। কিন্তু আমি তো মায়ের ছেলে? যতই এরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করুক, যতই বাবা উদাসীন থাকুক, আমার জন্যেও মা আসবে না? আমার কথা মনে করে…। তবে কি মা আর নেই? মারা গেছে? আমাকে লুকিয়ে যাচ্ছে বাবা? লুকোবেই বা কেন? আমার দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বাবার বা আর কারও তো এত মাথাব্যথা দেখিনি? তা ছাড়া মা মারা গেলে শ্রাদ্ধ বলেও তো কিছু আমার করণীয় থাকে! বাচ্চা তো আর নই! হাতে-খড়ি বাদ দিলেও চলে। কিন্তু মাতৃশ্রাদ্ধ? নাঃ, মা মারা যায়নি। বেঁচে আছে কোথাও। আমার মন বলছে ভালই আছে। খারাপ থাকার মানুষ আমার মা নয়। কোনও অজ্ঞাত, রহস্যজনক কারণে এখানে আসা মায়ের বন্ধ হয়ে গেছে। চিঠিপত্র দেওয়ারও উপায় নেই। হয়তো দেয়, আমি পাই না। এ সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ছোট থেকেই আমি আমার ব্যথা-বেদনা না প্রকাশ করে অভ্যস্ত। ব্যথা-বেদনার অনুভূতিই কি আমার আছে? বুঝি না। তবে স্কুলের পরীক্ষাটা পাশ করে আমি মায়ের কাছে চলে যাব। কেন না, এভাবে কি মানুষ বাঁচে?
তিন
চাঁদের আলোয় চারদিক থই থই করছে। আমি রায় বাড়ির চত্বর ছেড়ে মাঠের পথ ধরি।
রাসের মেলা চলছে এখন। শুক্লা একাদশী থেকে শুরু হয় এই মেলা। পূর্ণিমা পার করে তবে শেষ হয়।
‘ভাবিয়াছিলাম এ তিন ভুবনে
আর মোর কেহ আছে।
রাধা বলি কেহ শুধাইতে নাই
দাঁড়াব কাহার কাছে।’
দূর থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসছে। মূল গায়েন একজন মহিলা। তিন-চার জন সঙ্গী, সবাই পুরুষ। খুব সুন্দর গান ইনি। আজ বোধহয় সারা রাত কীর্তন হবে। ইনি ছাড়াও একটা দল এসে বসে আছে।
মন্দির ঘিরে আরও নানান উৎসব হয় সারা বছর। আষাঢ়ে রথযাত্রা দিয়ে শুরু হয়, ফাল্গুনে দোল দিয়ে মোটামুটি শেষ হয়। মাঝে আছে জন্মাষ্টমী, ঝুলন, আর কার্তিকী পূর্ণিমায় এই রাস। বহু দূর থেকে দর্শনার্থীরা আসতে থাকেন কদিন। অন্ধকার হলেই ডায়নামো চলতে থাকে, মন্দিরের সারা অঙ্গে টুনি বালব থাকে। উজ্জ্বল আলোয় ঝকমক করতে থাকে রাধারানির জরি বসানো লাল বেনারসী, মাধবের নীল বসন। পীত উত্তরীয় আজ রাধারানির গলায়। বসন বদলাবদলি হয় এ সময়ে ঠাকুরের। বাগানে ছোট ছোট খোপ করে কৃষ্ণলীলার নানান দৃশ্য পুতুল দিয়ে প্রদর্শনী করা হয়েছে। ছোটবেলায় এই পুতুল সজ্জার আকর্ষণ ছিল খুব। সারা বছর এইসব পুতুল মন্দিরের পাশের ঘরে, জড়ো করা থাকে, সেটা আবিষ্কার করার পর থেকেই আকর্ষণটা কমে যেতে থাকে। কিন্তু কথকতা আর কীর্তন শোনবার আগ্রহ আমার এখনও যায়নি। কতবার তো শুনেছি ধ্রুব, প্রহ্লাদ, বলিরাজা, অজামিল, জড়ভরতের কাহিনী। পুরনো হয় না। আর কীর্তন? কীর্তন শোনবার আমার একটা বিশেষ প্রণালী আছে। আসরে বসে শুনি না আমি। মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াই। ঝলকে ঝলকে গান ভেসে আসে দূর থেকে। ‘রাধে’ বলে টান দিলে, কি ‘কৃষ্ণ’ বলে হাহাকার করে উঠলে চড়াসুরের সেই টান আমার ভেতর থেকে কী সব টেনে বার করে আনে। একমাত্র তখনই আমি বুঝি, ব্যথা-বেদনা আমারও আছে। একটা নি-মানুষের মতো বাঁচলেও, মানুষেরই কষ্ট আমার ভেতরে বাসা বেঁধে রয়েছে।
মাঠের মধ্যে প্রচুর গাছ। জায়গায় জায়গায় জঙ্গল মতো। একটু ছোট্ট টিপি মতন দেখে বসি।
‘বঁধু হে’ বলে একটা চড়া সুরে টান দিয়ে সুরের জাল ছড়িয়ে দেন গায়িকা। হঠাৎ ভেতর থেকে গরম জল উঠে আসে দুই চোখে। আমি হাঁটুর ওপর মুখ রেখে বয়ে যেতে দিই নুনের নদী।
ঘুরে ফিরে গাইতে থাকেন বৈষ্ণবী—
‘এ কূলে ও কূলে দুকূলে গোকুলে
আপনা বলিব কায়।
শীতল বলিয়া শরণ লইনু
ও দুটি কমল পায়।।’
আমি কার পায়ে শরণ নেব? জীবন্ত পা চাই যে আমার। এমন পেতলের রাধামাধবের আমার হবে না, হবে না।
কে যেন আমার মাথায় হাত রাখল। চমকে মুখ তুলে দেখি চেনা-চেনা চেহারা। শিশিরদা না? আমি আর মুখ তুলতেই পারছি না। উনি বোধহয় আমাকে কাঁদতে দেখেই এসে দাঁড়িয়েছেন।
চলো, একটু বেড়ানো যাক— শিশিরদা বললেন।
—তোমাদের এই পুজো কতদিনের, মন্দার! বেড়াতে বেড়াতে উনি জিজ্ঞেস করলেন, অন্য প্রসঙ্গে যেতে পেরে আমি বাঁচি।
—১২৭৩ বঙ্গাব্দে এই সম্পত্তি দেবত্র করা হয়েছিল। ঠাকুরদাদের বাবা পেয়েছিলেন। মন্দির বোধহয় তার আগে থেকেই ছিল।
—উনি কার কাছ থেকে পেয়েছিলেন?
—বোধহয় ওঁর মামার কাছ থেকে।
—আমি কিন্তু অন্য একটা গল্প শুনেছি। শিশিরদা বললেন, মামা নয়, মাতামহ, তোমার প্রপিতামহর মায়ের কাকা না কি নিজের ছেলের ওপর বিরক্ত হয়ে এই নাতিকে সম্পত্তি দেন, কিন্তু মন্দির তৈরি করে সম্পত্তিটা দেবত্র করে দেন। যাতে সম্পত্তিটা নয়ছয় না হয়, আর যাতে ফ্যামিলি একত্র থাকে। তার মানে দেখো মন্দার, সম্পত্তি রক্ষার জন্য নেহাত বৈষয়িক একটা চাল হিসেবে এই মন্দিরের উৎপত্তি। অথচ এখন দেখো জিনিসটা সম্পূর্ণ অন্যরকম দাঁড়িয়েছে।
—অন্যরকম আর কী?
—অন্যরকম নয়? কত লোক আসছে ভক্তি নিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে, কত উৎসব। গ্রামাঞ্চলে একটা এ ধরণের উৎসবের কিন্তু ভীষণ মূল্য। দেখো শহরে কতরকম আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা রয়েছে। ইচ্ছে হলেই সিনেমা, পয়সা খরচ করলেই ভাল হলে গান শুনতে পাবে, এগজিবিশনে যেতে তো বেশির ভাগ সময়েই খরচ লাগে নামমাত্র। কিন্তু এসব জায়গায়? তোমাদের রায়েদের এ বাবদে প্রচুর ধন্যবাদ প্রাপ্য।
আমি বললাম— ওঁরাও তো পাচ্ছেন অনেক।
—ওঁরাও পাচ্ছেন? মানে? —শিশিরদা কেন অবাক হলেন আমি জানি না।
আমি বললাম— প্রণামী পাচ্ছেন, টাকা ছাড়াও কাপড়, গয়না, মেলার দোকানগুলোর সঙ্গে ব্যবস্থার কথা তো সবাই-ই জানে। সম্পত্তি-রক্ষা তো হচ্ছেই। বৃদ্ধিও হচ্ছে নিশ্চয়ই।
শিশিরদা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপরে আস্তে বললেন— তুমি কি এসব নিয়ে ভেবেছ? আলাদা করে?
—না। ভাবলে অন্যায় হবে?
—তা ঠিক নয়। তবে ধরো এতজন মানুষ, তোমাদের ফ্যামিলির কথা বলছি, দেবপূজা নিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন তো? বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে হয়তো কিছু উপার্জন হচ্ছে!
আমার মেজঠাকুরদার সেই মন্তব্য—‘ম্যাম বিয়ে করেছে’ মনে পড়ে গেল চকিতে। এঁদের সবার অনুদারতা, স্বভাবের উদাসীনতা, কাঠিন্য এ সবের কথা মনে পড়ে গেল। আমি চুপ করে রইলাম। কী হবে মন্দির করে, নিত্যপূজা করে যদি একজন মাকে এঁরা পথে ঠেলে দিয়ে থাকেন? একজন শিশুকে যদি আপন করতে না পেরে থাকেন? আরও খানিকটা হাঁটবার পর শিশিরদা বললেন— অনেকটা এসে গেছি কিন্তু মন্দার। চলো এবার ফিরি। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি৷
—আমাকে?—আমি অন্ধকারে হাসি।
—কী হল? তোমাকে পৌঁছনোর কথায় হাসলে কেন?
—আমি তো এখানকারই ছেলে। বড়ও তো হয়ে গেছি। যাই … বরং আপনাকেই আমি এগিয়ে দিই।
শিশিরদা থাকেন স্কুলবাড়ির কাছেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে। শহর থেকে আসা তিনজন মাস্টারমশাই থাকেন—ঘরটায়। ওখানে আমি পড়াশোনা বুঝে নিতে কি খেলা সংক্রান্ত দরকারে বহুবার গেছি। শিশিরদা আমাদের সঙ্গে খুব খোলাখুলি মেশেনও। তবু আজকের মতো কাছাকাছি ওঁকে কখনও পাইনি।
জিজ্ঞেস করলাম—এখানে থাকতে আপনার কেমন লাগে শিশিরদা?
—রাধানগর আমার খুব ভাল লাগে। এত শান্ত। এত পরিষ্কার হাওয়া! দামোদরের তীরটা এত সুন্দর। তবে কলকাতা ছেড়ে থাকতেও খুব কষ্ট হয় মন্দার।
কলকাতায় থাকতে আমার কেমন লাগবে শিশিরদা! ‘আমার’ কথাটার ওপর আমি জোর দিই। শিশিরদা হাসলেন, বললেন—তুমি যে রকম ক্রিটিক্যাল হয়ে উঠছ তাতে করে কলকাতা তোমাকে কাবু করতে পারবে বলে মনে হয় না, তবে ভাল লাগা শক্ত। নোংরা আর আওয়াজ এই দুটো জিনিসই তোমাকে সবচেয়ে পীড়া দেবে।
আমি মনে মনে বলি—নোংরা, আওয়াজ এ সব তো বাইরের ব্যাপার। কিন্তু ওই শহর থেকেই উঠে আসত আমার একমাত্র আপনজন। ওই শহরেই সে হারিয়ে আছে। উপরন্তু শিশিরদা আপনি, অপর হলেও আপনি এত আপন আমার, আপনিও এসেছেন ওই শহর থেকেই, কিছু না কিছু গুণ তো ও শহরের আছেই!
—তোমার কি রাধানগর ভাল লাগে না? অনেকক্ষণ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শিশিরদা বললেন।
আমি বললাম—কী জানি?
—সে কী? ভাল লাগে কি লাগে না জানো না? অবশ্য তোমার বয়সে জন্মভূমি খুব একঘেঁয়ে লাগবারই কথা। নিস্তরঙ্গ জীবন, বৈচিত্র্য নেই…তোমাদের এখন রক্ত টগবগ করে ফুটছে, অ্যাকশন…অ্যাকশনের জন্যে এখন তোমরা ছটফট করছ, তাই না?
—কলকাতায় গিয়ে লেখাপড়া করতে কি আমার খুব অসুবিধে হবে? —আমি জিজ্ঞেস করি।
—না, অসুবিধে কেন? ওখানে প্রতিযোগিতাটা বেশি। সংখ্যাও বেশি। এত মানুষের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার, দিশেহারা হয়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি থাকেই।
—শিশিরদা, আমার পক্ষে কতটা ভাল রেজাল্ট করা সম্ভব? এই ফাইন্যাল পরীক্ষায়?
—আরে, সেটা তো আমিই তোমায় জিজ্ঞেস করব!
—কলকাতায় পড়বার জন্যে আমি আমার পক্ষে যতটা পড়াশোনা করা সম্ভব করছি। আমি একটুও ফাঁকি দেব না। কিন্তু কতটা ভাল করতে পারব সেটা তো আমি জানি না, তাই জিজ্ঞেস করছি।
—তুমি ভাল ছেলে মন্দার, ভাষাগুলো ভাল শিখেছ, অঙ্কের মাথা তোমার পরিষ্কার। বিজ্ঞান আমরা যতটা শেখাতে পেরেছি শিখেছ। ভাল করারই তো কথা।
—শিশিরদা, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?
—কী ব্যাপারে? কলকাতায় যাওয়ার ব্যাপারে?
—হ্যাঁ।
—তোমার বাড়ি থেকে যদি যেতে দিতে না চান…..ওঁরা কী বলবেন…
—ওঁরা কিছু বলবেন না, সেটা কোনও কথা না। আসলে শিশিরদা আমার তো টাকাপয়সা নেই।
—মানে? কী বলছ মন্দার? শিশিরদা অবাক হয়ে গেছেন। রায়বাড়ির ছেলে তুমি…তোমার? নাঃ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
—যতদিন এখানে আছি , ঠিক আছে। কিন্তু দূরে চলে গেলে এঁরা আমার খরচ দেবেন কেন? দেবেন না…। আমার তো কেউ নেই এখানে…।
—কেন? তোমার বাবা? জ্যাঠা-কাকারা, এত আত্মীয়স্বজন অথচ…
আমি কী বলব! চুপ করেই রইলাম।
—কলকাতায় ধরুন, বাচ্চাদের পড়াতে পারি। দিনের বেলায় কলেজ করলাম। সন্ধেবেলায়… এ ভাবে তো অনেকেই চালায়, এরকম কিছু যদি আপনি জোগাড় করে দেন…
শিশিরদা খাপছাড়াভাবে বলে উঠলেন—এই মন্দির, পুজো, এত উৎসব, এত মানুষের সমাগম…এগুলো দেখতে দেখতেই তো তুমি বেড়ে উঠেছ মন্দার, সবাইকেই নিশ্চয় কোনও না কোনওভাবে এ সবের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়, এক জেনারেশন চলে গেলে আরেক জেনারেশনকে এ সব ভার নিতে হয়। তুমি…তুমি…তোমাকেও নিশ্চয় নিতে হবে… সে জন্যেই কি তোমার এ সব ভাল লাগে না, না?
তার মানে উনি ভেবে নিয়েছেন আমি বিদ্রোহী, পারিবারিক পূজা অর্চনা এগুলো আমাকে টানে না, বরং এগুলোর আওতা ছেড়ে আমি বেরোতে চাই।
—ইয়াং ম্যান…তোমার অবশ্য ভাল না লাগতেই পারে…কিন্তু তার জন্য ওঁরা তোমাকে একেবারে ত্যাগ করবেন এ কথা ভাবছ কেন? কোনও নিয়ম আছে না কি এ ব্যাপারে?
কোনও নিয়মের কথা আমি জানি না। এ বাড়ির ছেলেরা বাইরে পড়তে যায়নি এমনও নয়। তবে কম। বাইরে পড়তে গেলেও এঁরা শেষ পর্যন্ত এখানেই ফিরে আসেন। সেটা কোনও নিয়মের জন্যে কি না কী করে জানব? কিন্তু আমি যে এঁদের কেউ না, রায়বাড়ির অবহেলার দানে এত বড়টা হয়েছি তা কী করে শিশিরদাকে বোঝাব। মোটের ওপর আমি এঁদের ওপর নির্ভর করে আর থাকতে চাই না। কারও ওপরেই না।
শিশিরদা বললেন—তোমাকে আমি যতদূর পারি সাহায্য করব মন্দার। কিন্তু বাস্তব তো অত সহজ নয়! ট্যুইশনি করলে আর সেই উপার্জনে পড়লে শহরে থাকলে এতটা সম্ভব না-ও হতে পারে। তোমার অল্পবয়স, চট করে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে কাজ করারই বয়স। কিন্তু একটু ভাবনা-চিন্তা করে না চললে বিপদে পড়ে যাবে মন্দার। যাক গে তুমি এ সব না ভেবে মন দিয়ে পড়াশোনাটা করো।
শিশিরদা কি ভয় পেলেন? বড়লোকের ছেলেকে পড়াশোনা খেলাধুলায় সাহায্য করা এক জিনিস আর আমার মতো হতভাগার দায়িত্ব নেওয়া আরেক। না শিশিরদা, সামান্যতম সাহায্যের চেয়ে বেশি কিছু আপনার কাছ থেকে চাইব না আমি। চাওয়ার মনটাই আমার তৈরি হয়ে ওঠেনি। আপনাকে আমি বোঝাতে পারিনি এ বাড়ির আমি কেউ নয়। কারও সঙ্গে আমার কোনও মিল নেই। আত্মীয়তা নেই, বন্ধুত্ব নেই। কিন্তু বোঝাতে তো আমাকে হবেই, যদি আপনার সাহায্য চাই!
হঠাৎ বললাম—শিশিরদা, আপনি ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলেছেন? হেসে ফেললেন উনি—এখন কি তোমার লুকোচুরি খেলতে ইচ্ছে করছে না কি মন্দার?
—না, আমি একবার ছোটবেলায় এই রায়বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছিলাম, সেটা মনে পড়ল।
—রায়বাড়ির ছেলেমেয়ে মানে? তোমার জাড়তুতো খুড়তুতো ভাইবোনেরা?
—হ্যাঁ
—তো একবার বলছ কেন? মাত্র একবারই খেলেছ?
—খুব বেশি খেলিনি, তবে একবারের চেয়ে বেশি নিশ্চয়ই। শেষবারের কথাটাই খুব ভাল করে মনে আছে। সত্য, নিতাই এদের তো চেনেন? পঞ্চানন, গায়ত্রী…?
—হ্যাঁ, চিনি…
—ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিলাম। খুব জমেছিল খেলাটা। এক এক জন চোর হচ্ছিল, আর তাকে চোখ বন্ধ করে উল্টো মুখে বসিয়ে দিয়ে আমরা অন্যরা লুকোচ্ছিলাম। আমাদের উঠোনের চার পাশে কত গাছপালা দেখেছেন তো? ওইসব ঝোপঝাড় গাছপালাতেই লুকোচ্ছিলাম। তারপর শিশিরদা, একবার আমি চোর হলাম। আমাকেও চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে হল। চোখ বুজিয়ে বসে আছি আর ছড়া কাটছি।
আমপাতা জোড়া জোড়া
মারবো চাবুক চলবে ঘোড়া
ওরে সেপাই সরে দাঁড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া…।
সাধারণত এই ছড়াটা বলতে বলতেই ওদের লুকোনো হয়ে যায়। হয়ে গেলেই ‘কু’ বলে ডাক দেবে একজন। আমার খোঁজা তখন শুরু হবে। তো আমি বসেই আছি, ‘কু’আওয়াজ আর শুনতেই পাইনা। শেষে ধৈর্য হারিয়ে উঠে পড়ি। কী দেখি জানেন?
—কী?
—দেখি ওরা লুকোয়ইনি। গায়ত্রী আর সাবিত্রী রান্নাবাড়ির রোয়াকে বসে বাঘবন্দি খেলছে। সত্য আর নিতাই দুজনে দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে গল্প করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বাকিরা সব বাড়ি চলে গেছে।
—ওইভাবে বসিয়ে? ঠকাচ্ছিল না কি!
—না তো!
—তবে কি সন্ধে হয়ে গিয়েছিল?
—তাও তো না।
—তুমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করনি?
—নাঃ
—তোমাকে উঠে আসতে দেখেও কেউ কিছু বলল না?
—না।
—আশ্চর্য তো। এলেবেলে না কি?
—তা-ই বোধহয়। তবে সে কথাও কেউ তো আমাকে মুখ ফুটে বলেনি।
—আমি এখানে এইচ. জি ওয়েলস-এর সেই ‘ইনভিজিবল ম্যান’-এর মতো, আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি। আমায় কেউ দেখতে পায় না। এক হিসেবে তাই আমি নেই। এক একসময়ে সন্দেহ হয় আমি কারও কল্পনা। সত্যি কোনও অস্তিত্ব নয়।
—কী বললে? তুমি কারও কল্পনা?
—হ্যাঁ ধরুন—কেউ আমাকে ভেবেছে। আমি একটা সত্যি মানুষ নয়। লেখকরা চরিত্র ভাবেন না? ধরুন বেকার স্ট্রিটের যে ঠিকানায় শার্লক হোমস-এর আস্তানা, সেখানে গিয়ে যদি আমরা হোমস-এর খোঁজ করি। পাব? পাব না। কনান ডয়েল বানিয়েছেন ওটা। আমার রাধানগরের ঠিকানাটাও কারও বানানো। আমিও বানানো। অবাস্তব। না হলে এমন হবে কেন?
শিশিরদা আমার কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন—তুমি বড্ড একা মন্দার, তোমার কোনও বন্ধু নেই? তারক? তারক পাল তো তোমার বন্ধু। খেলাধুলো করছ এত। বন্ধু হয় না কেন তোমার? ব্রুড করবে না একদম, ওটা খুব অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস। …আর মন্দার, সে ভাবে দেখতে গেলে তো আমরা সকলেই বানানো …ঈশ্বরের। ফিরে আবার আমরাও ঈশ্বরকে বানাই, এই রাধামাধবের মধ্যে যেমন বানিয়ে তুলেছি।
আমি কিছু বলি না। শিশিরদা বোধহয় ভাবছেন, আমার মাথার গোলমাল হয়েছে। তবে, আমার অবস্থাটা মনে হয় উনি ঠিক না বুঝলেও, খানিকটা অনুভব করতে পেরেছেন।
একটা বাঁকের মুখে এসে উনি নিজের পথে চলে যান। আমিও আমার পথ ধরি।
আগের গানটা শেষ হয়ে গেছে, এখন পুরুষ গায়কের গলা শুনতে পাচ্ছি—
এখন তখন করি দিবস গমাওল,
দিবস দিবস করি মাসা,
মাস মাস করি বরষ গমাওল,
ছোড়লুঁ জীবন আশা॥
আ-হ্! আমি যদি গান গাইতে পারতাম!
একমাত্র গানের মধ্যে দিয়েই, মানে এই কীর্তন গানের মধ্যে দিয়েই আমি স্নেহ-ভালবাসা-আবেগ-অনুভূতির জীবন্ত জগৎটার খোঁজ পাই। আমি নিজেও তখন জীবন্ত হয়ে উঠি। শরীরে, মনে। মাথা টিপটিপ করে, বুক হু হু করে, আমার পেটে, তলপেটে একটা আলাদা জীবনস্পন্দন আছে বুঝতে পারি। আপনজনের জন্য কান্না আমার শিরায় শিরায় চারিয়ে যায়। রাধার গান, কৃষ্ণের গানে ওই যে বিরহ, সে তো নারীপুরুষের প্রেম-বিরহের কথা বলছে! আমার কিন্তু মনে হত একজন বা একাধিক অনির্দিষ্ট প্রিয়জনের কথা। এখন-তখন করে দিবস চলে যাচ্ছে, দিবস দিবস করে মাস, মাস মাস করে বছর … এ যেন আমারই কথা। এতদিন চলে যায় আমার মা আসে না। মা হচ্ছে সমস্ত প্রিয় সম্পর্কের প্রতিনিধি আমার কাছে। একটা স্তর টপকে তো আরেকটা স্তরে যাওয়া কঠিন! তাই হয়তো শৈশবের আকাঙ্ক্ষা টপকে আমি যৌবনের আকাঙক্ষাতেও পৌঁছতে পারি না।
গান ছাড়া অন্য সময়ে আমি যে চেতনায় বাস করি, সেটা প্রায় অনুভূতিহীন। সম্পূর্ণ ব্যবহারিক কিছু কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পাথরের মতো নিরেট একটা অস্তিত্ব। খাচ্ছে, দাচ্ছে, খেলাধুলো করছে, পড়াশোনা করছে একটা যন্ত্র, একটা যন্ত্রমানুষ, দম দিয়ে তাকে চালু করে দিয়েছে কেউ।
চার – মন্দাকিনীর কথা
কেকা বলল— থার্ড বেঞ্চ থেকে একটা ছেলে তোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
ম্যাথসের ক্লাস। বোর্ডের ওপর এ. কে. জি. খসখস করে লিখে যাচ্ছেন। ফলো করতে চেষ্টা করছিলাম। ছেলেটাকে আমি দেখেছি। কিন্তু ভাব দেখালাম যেন আকাশ থেকে পড়ছি।
কেকা বলল—তাকাসনি। সেকেন্ড ফ্রম রাইট। এক্কেবারে গবেট টাইপ।
—কী করে জানলি?— আমি হাসি লুকিয়ে বলি— জাস্ট আমার দিকে চেয়ে আছে বলেই! —শুধু কেকা কেন, সব মেয়েই আমার ওপর জেলাস, প্রচণ্ড।
—আজ্ঞে না—কেকা বলল— খাড়া চুল, ভাঁটা চোখ, প্যাতপেতে কান, ন্যাতনেতে শার্ট… গেট-আপ দেখলেই বোঝা যায়।
—অনেক দেখে ফেলেছিস, আমি বলি, এত দেখছিস বলেই ও এদিকে চেয়ে আছে। আমার দিকে নয়, তোর দিকে। ছেলেটা মোটেই গবেট নয়, দেখবি হয়তো তোকে আমাকে মেরে বেরিয়ে যাবে। গুডি-গুডি টাইপ।
—গাঁইয়া!
ছেলেটা ততক্ষণে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বুঝতে পেরেছে আমরা ওকে নিয়েই আলোচনা করছি।
দেখছে দেখছে। সে নিয়ে এত আলোচনার কী আছে আমি বুঝি না। ছেলেরা মেয়ে দেখে। মেয়েরা ছেলে দেখে। এ তো স্বাভাবিক স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। এমন দিন আমার তো মনে পড়ে না যবে কিছু লোক আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে না দেখেছে। তেমন দিন আসলে যে আমার খুব ভাল লাগবে এমন কথাও আমি বলতে পারছি না। আই ডেফিনিটলি এনজয় অ্যাটেনশন। এতে আমার কনফিডেন্স বাড়ে। সাহস বাড়ে। তবে এ ছেলেটা একেবারে মফঃস্বলী তাতে সন্দেহ নেই। ক্লাস করছি মাস দুয়েক হল ওকে লক্ষ করিনি। সেদিন চার নম্বর রুমে ঢুকছি, আমি একা নয়, অনেকেই ছিল। ও বেরোচ্ছিল। একটা ভিড়ের মাঝখানে ছিল ও। চুলগুলো ভিড়ের মাথায় জেগে ছিল ওর। হঠাৎ চক্ষু ছানাবড়া করে ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। আমাকে দেখছে। —দ্যাখ বাবা দ্যাখ, এরকমটা দেখিসনি কখনও বুঝতেই পারছি। আমার চেয়ে সুন্দর এ কলেজে কি আর নেই? আছে কয়েকটা আর্টস-এ। কিন্তু আমার মতো গ্ল্যামার বোধহয় আর কারওই নেই। অহংকার করছি না। জাস্ট আ স্টেটমেন্ট অফ ফ্যাক্ট।
অনেকেই তো দেখে! প্রোফেসররা দেখেন চুরি করে। সিনিয়ররা দেখে সোজাসুজি, কেউ কেউ কমেন্ট করে যায়। ‘উরি শাবাস— কী মেখেছিস রে?’ এক সিনিয়র সেদিন বলতে বলতে চলে গেল। আর আমার নিজের ব্যাচ-মেটগুলো? ওগুলোর তো এখনও গোঁফে দুধ লেগে রয়েছে। তবু কতকগুলো গায়ে পড়ে ভাব করতে আসে। অন্যগুলো এখনও অত বোঝেসোজে না। তার মধ্যে ইনি কে তালেবর এলেন, এখনও পিঠে মাস্টারমশাইয়ের বেতের দাগ, আমার যাওয়া-আসার পথে চোখ পেতে দাঁড়িয়ে থাকেন? এটা যদি আমাদের পাড়া হত, আমাকে বলতে হত না, রুডি মাইকেল আসলাম আমার বন্ধুরা ওর ঠ্যাং-ফ্যাং ভেঙে দিত।
দিয়া খুব চেষ্টা করেছিল যেন আমি গার্লস কলেজে যাই। কেন তা জানি না। গার্লস কলেজে গেলেই ছেলেদের সঙ্গে হুজ্জোতি করব না, এ গ্যারান্টি দিয়াকে কে যে দিল! স্কুলিং তো হয়েছে রাম-কনজারভেটিভ স্কুলে, তাতে কি আমার ছেলে বন্ধুর সংখ্যা কিছু কম হয়েছে? যতক্ষণ স্কুলে থাকছি লালপাড় সাদা শাড়ি পরে, খালি পায়ে হাত জোড় করে ক্লাস করেছি, যেন সন্ন্যাসিনী এই হলাম বলে। স্কুল বাসে যাতায়াত, একেবারে এয়ার-টাইট। ওয়াটার-টাইট। তাতে কিছু ইতর বিশেষ হয়েছে? মল্লিকদের বইয়ের দোকানে সন্ধে না হতেই আড্ডাও কমেনি, ওদের সঙ্গে দল বেঁধে সিনেমা কি রেস্টুরেন্ট যাওয়াও বন্ধ থাকেনি। দিয়া অবশ্য মুখ ফুটে বলেনি কিছু, কিন্তু দিয়ার মনের কথাই যদি পড়তে না পারব, তো দিয়ার আঁচল আর স্কার্টের ছায়ায় বড় হলাম কেন?
ক’দিনই সেই গাঁইয়াটা বাড়ি আসার সময়ে আমাকে ফলো করছে। আমার ট্রামে উঠেছিল। দু তিনটে সিট পেছনে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল, ভেবেছে আমি দেখতে পাইনি। অগত্যা আমায় ফট করে নেমে যেতে হল। ইচ্ছে হয়ে থাকে সোজাসুজি এসে আলাপ কর না বাবা। লুকিয়ে-চুরিয়ে পেছন-পেছন আসা—এ সব আবার কী? মতলব কী কে জানে? পার্ভার্টেড হতে পারে। সাবধান হওয়া ভাল। আজকাল নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে।
কলেজ স্ট্রিটে নেমে গেলাম। ওমা দেখি, ও-ও নেমেছে। স্টপে দাঁড়িয়ে থাকি। দেখি কী করে। একটু ইতস্তত করল, যেন কিছু বলবে। বল বাবা বলে ফ্যাল, বুকখানা হালকা হয়ে যাবে। নাঃ সরু মতো একটা গলির দিকে পা বাড়াল। কলেজ রো। যাক। ও গলিটাতে ঢুকে যাওয়ার পর আমি হ্যারিসন রোড ক্রস করে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢুকি। বই দেখতে দেখতে চলে যাই ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুট পেরিয়ে কলেজ স্কোয়ারের ওদিকে। ও দিক দিয়ে বেরিয়ে আবার ট্রাম ধরব। লেঃ এবার ঘুরে মর। আলাপ করতিস লক্ষ্মী ছেলের মতো তো তোকে নিয়ে কফি-হাউজে ঢুকতাম। চিকেন ওমলেট খাওয়াতাম। ঘণ্টা দুয়েক তো অন্তত গল্প, আড্ডা হতই। কথা-টথা না বলে একটা ব্লাইন্ড লেনে ঢুকে গেলি। বেরিয়ে দেখবি আমি হাওয়া। যতদিন গাড়লের মতো ফলো করবি এমনি পিছলে পিছলে বেরিয়ে যাব। তুই তো চুনো পুঁটি। কত রাঘব বোয়ালকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছি। বাগবাজার থেকে ওয়েলেসলি পর্যন্ত সমস্ত গলিঘুঁজি আমার হাতের পাতার মতো চেনা। যে কোনও মুখ দিয়ে ঢুকে আবার যে কোনও মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি। প্রত্যেক পুজোর সময়ে নতুন নতুন আউটলেট বার করি। মাইকেলরা আমাকে বলে বান ফিশ। বান মাছ সাপের মতো দেখতে। মোটা সোটা। আমি নাকি ওই স্বাস্থ্যবান দুরন্ত মাছটার মতো সারা উত্তর কলকাতা মধ্য কলকাতা সাঁতরে বেড়াই।
বাড়ি যাওয়ার দুটো রাস্তা আছে আমার। সার্কুলার রোড দিয়ে ট্রামে করে সোজা চলে যাওয়া যায়। এলিয়ট রোডে নেমে পড়লেই হল। হাতে সময় থাকলে আমার এই আনরোম্যান্টিক পথ ভাল লাগে না। সে ক্ষেত্রে দক্ষিণের মেয়েদের সঙ্গে চলে যাব চৌরঙ্গি। লিন্ডসে দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢুকব। এইখানে চৌরঙ্গি লেন, রিপন স্ট্রিট একটু এগিয়ে রয়েড স্ট্রিট এইসব আমার প্রিয় জায়গা। চা কফি আর ভাজা মাংসের গন্ধে বাতাসটা ভারী। হঠাৎ ঢুকলেই গন্ধটা এসে সোজা নাকে ধাক্কা দেয়। জিভে জল এসে যায়। পেটে খিদে থাকলে তো কথাই নেই। আর ক্লান্ত থাকলে? কফির গন্ধে সঙ্গে সঙ্গে চাঙ্গা।
আমাদের বাড়িটা একটু ভেতর দিকে। ঠিক ট্রাম রাস্তার ওপরে নয়। বাড়িটা দিয়ার। তবে দিয়া বা দিদিমা বলে দিয়ার মানেই আমার। দিয়ার যা কিছু সব আমিই পাব। টাকা পয়সা দিয়ার নেহাত মন্দ নয়। চৌরঙ্গি লেনে একটা রিপন স্ট্রিটে দুটো তিনখানা বাড়ি দিয়ার। আগাপাশতলা ঠাসা ভাড়াটে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, আপ-কানট্রি মুসলিম, বাঙালি মুসলিম। অনেক দিনের ভাড়াটে সব। আগেকার রেটে ভাড়া। তাই তিনটে বাড়ি শুনতে যতটা, আয় ততটা নয়। তবে দিয়ার যখন অসুখ করেছিল, স্টিফেনের সঙ্গে গিয়ে আমি ওদের কাছে অ্যাপীল করি, ওরা সকলেই প্রায় ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিল। দোকানগুলো তো বটেই, যারা বসবাস করে তারাও। দেয়নি খালি আকবর আলি, মিসেস ডি-সুজা আর রবিনা পার্কার। আকবর আলি ওখানেই একটা খাবার দোকানে কাজ করে। দুটো বিবি আর সাতটা ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে। ও বেচারা আর কী করে দেবে? বলেছিল— ‘আল্লাহ্ দিলে আমিও বিবিজিকে দেব, ঠকাব না।’ মিসেস ডি-সুজা নিজে থাকেও বটে, একটা মস্ত হলও আছে ওর কাছে। সেই হলে মিসেস ডি-সুজার শাশুড়ির ডান্স-স্কুলে আমার দিয়াও না কি কাজ করেছে একদিন। মিসেস ডি-সুজার আলাদা খাতির দিয়ার কাছে। বন্ধুও তো ছিল দু’জনে। তার ওপরে মিসেস ডি-সুজা এখন পায়ের বাতের জন্য নাচ-স্কুল প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। ওর ছেলে বনি অবশ্য জাহাজে কাজ করে, অনেক মাইনে পায়। কিন্তু সে আছে নিজের তালে। মাকে কিছু দেয় কি না কে জানে! কিন্তু রবিনা পার্কার বেশ শাঁসালো পার্টি। স্টিফেন বলে ওর প্রচুর ইনকাম। স্কুল প্রেমিসেই রিসেসের সময়ে আধঘণ্টা ও বাচ্চাদের হোম টাস্ক করিয়ে দিয়ে রোজগার করে, ছুটির পর এক ঘণ্টা স্কুলের ক্লাসরুমেই পড়ায়। তারপর আবার কাছাকাছি কোনও বাচ্চার বাড়ি মস্ত একখানা ক্লাস করে। তা ও যা ঝগড়াটে! আমাকে তো স্রেফ হাঁকিয়ে দিলে। দিক, এখন দিক। আমি যখন বাড়িগুলোর মালিক হব, তখন দেখব কেমন না দেয়।
তবে এসব বাড়ি মুরগির খাঁচার মতো। আসল বাড়ি হচ্ছে দিয়ার বাড়ি। দাদা যে রুচিশীল মানুষ ছিল সেটা দিয়ার বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়।
লাল ইঁটের দোতলা বাড়ি। থামগুলোর ওপরটা সাদা লতাপাতার কারুকাজ করা। সবুজ দরজার পাল্লাদুটোয় তিনটে তিনটে ছটা পদ্ম। পেতলের কড়াগুলো বালার মতো। ঢুকেই উঠোন। সুন্দর কুচি-কুচি পাথর বসানো উঠোন। দিয়ার শখের গাছগুলো টবে করে মাঝখানে থাকে। অ্যারিকা পাম, নানান জাতের ক্রোটন, রবার, বেশ কয়েকরকমের ফার্ন, প্রকাণ্ড একটা টবে শিউলি গাছ আছে একটা, শিউলি নাকি দাদার প্রিয় ফুল ছিল। দাদার দেশের বাড়ির চত্বরে সারা শরৎকাল জুড়ে শিউলির কার্পেট বিছিয়ে থাকত। কলকাতার বাড়িতে দাদা সেই শিউলির জন্যে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলত, তাই দিয়া টবে শিউলিগাছ করেছিল।
আমাদের সিঁড়িগুলো চওড়া, খুব উঁচু ধাপ নয়। মাঝের চাতালটাতে দুদিকে দুটো বড় বড় ছবি আছে একটা কুইন আলেকজান্দ্রার, আরেকটা হেস্টিংসের সময়কার কলকাতার। ফীটনে চড়ে সাহেব মেমসাহেবরা বেড়াতে বেরিয়েছে। ঘোড়ায় চড়ে সৈনিক যাচ্ছে। নতুন তৈরি সব প্রাসাদ, দূরে দূরে। কত ফাঁকা তখন এদিকটা! কী চওড়া রাস্তা!
কুইন আলেকজান্দ্রার ছবির একটা গল্প আছে। গল্পটা খুব মজার। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এই ছবির গলায় মুক্তোর চোকার দেখে নাকি দিয়া খুব মুগ্ধ হয়ে যায়। দাদা তখন চুপিচুপি ওই রকম চোকার করিয়ে দিয়ার জন্মদিনে উপহার দেয়। তখন দিয়া আবদার করেছিল আলেকজান্দ্রার ওই ছবিটাও তার চাই, দিয়া গলায় চোকার পরে আলেকজান্দ্রার ছবির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখবে। ভিক্টোরিয়া থেকে ওই ছবি দাদা কত টাকা দিয়ে, কীভাবে কিনেছিল তা জানি না। কিন্তু দিয়ার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। ভালই করেছিল দিয়া আবদার করে। ওই চোকার আমি ব্যাংকের লকার থেকে বার করে দেখে এসেছি। দা-রুণ! দিয়ার অন্যান্য গয়না আর টাকা কড়ির মতো ওটাও আমার।
দোতলায় আমাদের চারটে মস্ত বড় বড় শোবার ঘর। দিয়ার পাশের ঘরেই থাকি আমি। আগে আমাদের সব ঘরে ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেট ছিল। সেসব দিয়া তুলে দিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে শহর নোংরা দূষিত হয়ে যাচ্ছে, এখন তাই খোলা মেঝে, প্রতিদিন ঝকঝকে করে পরিষ্কার করা হয়। এতটুকু ধুলো ঘরে থাকলে দিয়ার টান বাড়ে, তখন যা কষ্ট পায় বেচারি, অতি বড় শত্রুও দেখলে আহা আহা করবে। তবে দাদার আমলের আসবাব দিয়া একটাও বদলায়নি। আমাদের প্রত্যেক খাট, চেয়ার টেবিল আলমারির নকশা পুরনো ধরনের। ফুল লতাপাতার কারুকাজ-অলা। প্রত্যেকটি আসবাব মেহগনির। কয়েকটা আছে বার্মা টিকের। আমার পড়ার টেবিল কাম দেরাজটা ওয়ল নাটের। এগুলো সব আমাকে চিনতে, যত্ন করতে শিখিয়েছে দিয়া। পুবের বারান্দা ভর্তি আমাদের ফুল গাছ। সব সিজন ফ্লাওয়ার অবশ্য।
এগুলো প্রতি বছর বর্ষায় পোঁতা হয়। শীতে ফুল দিয়ে সব গাছ নেতিয়ে যায়। হলুদ আর ব্রাউনের ভ্যারাইটি করি আমরা। গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্র মল্লিকা, অ্যাসটার, সূর্যমুখী—সব হলুদ আর ব্রাউন। আমাদের অ্যালসেশিয়ানটারও নাম গোল্ডি। গোল্ডির মায়ের নামও ছিল গোল্ডি, তার আগে যে অ্যালসেশিয়ান ছিল তারও নাম গোল্ডি। গোল্ডি ছাড়া দিয়া থাকতে পারে না। গোল্ডি হওয়া চাই, আর অ্যালসেশিয়ান হওয়া চাই। না হলে দিয়ার মন উঠবে না।
দিয়া অবশ্য বলে এই বাড়ির থেকে মুসৌরিতে আমার বাবা-মার বাড়ি অনেক সুন্দর। তার সব জানলা কাচের, মেঝে ওক কাঠের, কী সুন্দর একটা গন্ধ বেরোয় সেই সব মেঝে দরজা-জানলা দিয়ে। কথাটা সত্যি। কিন্তু ওই বাড়ির চারপাশটাও দেখতে হবে। সেখানে এরকম নোংরাও নেই, ঘিঞ্জিও নেই। উপরন্তু চারদিকে দেওদার পাইনের সারি, চমৎকার হাওয়া, আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নেই কোনও স্কাইস্ক্র্যাপার। এই সব সুবিধেগুলো তো মুসৌরির বাড়ির আছেই।
মুসৌরিতে স্কুলও আছে ভাল। তেমন দরকার হলে দিল্লিতে পড়তে পারতাম। কিন্তু আমি মায়ের কথা শুনিনি। এগারো বারো বছর বয়স অবধি আমি কলকাতার এই গলিতে, দিয়ার কাছেই মানুষ, আমার দিল্লি ভাল লাগে না। মুসৌরি ভাল না লাগার অবশ্য অন্য কারণ আছে। সে যাই হোক, আমার এই এঁদো কলকাতাই ভাল। আমি এঁদো, আমার কলকাতাও এঁদো।
অনেক দিন পর্যন্ত আমার স্কুল ছিল আটটা থেকে একটা। স্কুলের পরে গাড়ি ঘোড়া এড়িয়ে ধর্মতলার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে স্টিফেনের সঙ্গে বাড়ি ফিরেছি। ট্রাম চলার শব্দ, বাস চলার ঘষ্ ঘষ্ আওয়াজ, স্রেফ অনেক মানুষের একসঙ্গে চলাফেরার দরুন একটা চাপা আওয়াজ রাস্তা ভরে রাখত, এই আওয়াজ না থাকলে আমি ঘুমোতেই পারতাম না। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে খালেদা আমার জন্যে লুচি আর চিংড়িমাছ-পেঁয়াজকলি দিয়ে চচ্চড়ি নিয়ে আসত রুপোর রেকাবিতে, এইগুলো আমার প্রিয় জল-খাবার। কিন্তু, এই সময়ে। স্কুল থেকে ফিরে দুপুরবেলায়। সময়টা যদি বিকেল, বা সন্ধে হয়, চায়ের গন্ধ ওঠে বাড়ির বাতাসে, গলি দিয়ে কফি আর কাবাব-এর খদ্দেরদের আনাগোনা বেড়ে যায়! তখন এই খাবার আর চলবে না। তখন চা-এর সঙ্গে মাফিন, কিংবা পেস্ট্রি, দোকান থেকে কিনে-আনা পসিন্দা কি শামি কাবাব এই হবে আমার টিফিন। সে যাই হোক, দুপুরে বাড়ি ফিরে পেঁয়াজ-কলির চচ্চড়ি দিয়ে লুচি চিবোতে চিবোতে আমি পায়রাদের গান শুনতাম।
সিঁড়িতে বসে বসে সাধারণত আমি স্কুলফেরত বেলাটা পুরোই কাটিয়ে দিতাম। পায়রাদের গান শুনে। এই সময়ে গোল্ডি এসে আমার গা ঘেঁষে বসত। গোল্ডির গায়ে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। গোল্ডির গায়ের গন্ধ, পায়রাদের গানের গুব গুব আওয়াজ আর পেঁয়াজকলির চচ্চড়ির স্বাদে ভরা দুপুরবেলা আমি মুসৌরিতে কোথায় পাব?
আমার দিয়া আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। তাকে ছেড়েই বা আমি অতদিন থাকব কী করে?
দিয়া একটা মোমের পুতুলের মতো। কিংবা একটা মোমবাতির মতো। বাতিদানের ওপরে ক্রিম রঙের মোমবাতিটা বসিয়ে চলে গিয়েছিল কেউ। অনেক দিন ধরে জ্বলছে বাতিটা, মোম গলে বাতিটা ছোট হয়ে গেছে বা অসমান হয়ে গেছে বাতির ওপরটা, গলা মোম জমে জমে আছে বাতিটার গায়ে। তবু বাতিটা জ্বলছে, চারদিকে আভা ছড়াচ্ছে। এই রকম মোমবাতি আমার দিয়া। ক্রিম রঙের শিফন কাপড়ের ওপর প্রচুর লেস দেওয়া নাইট-গাউনটা পরে মেহগনির পালংকে বসে যখন দিয়া প্রে করে শোয়ার আগে হাত দুটো জোড়, চোখ বোজানো, লাল লাল চুলের গুছিগুলো কানের পাশ দিয়ে কাঁধের ওপর এসে পড়ে, তখন এইরকম এক ক্ষয়ে-যাওয়া মোমবাতির সঙ্গে দিয়ার এত মিল পাই যে আমি চোখ ফেরাতে পারি না।
সামনের দেয়ালে যিশুর ক্রুসিফিক্স। সেই দিকে চেয়েই প্রার্থনা করে দিয়া। পাশের দেয়ালে আমার দাদার ছবি। অয়েল পেন্টিং। দাদাকে কিন্তু একটুও জমিদারের মতো দেখতে নয়। মাথার চুলগুলো খুব ঘন, কিন্তু ছোট ছোট করে ছাঁটা। নাকটা চওড়া। পুরু লাল ঠোঁট। চোয়ালের হাড়গুলো উঁচু-উঁচু। গোঁফদাড়ি পরিষ্কার কামানো। সুট পরা, স্ট্রাইপ দেওয়া টাই। হিরের টাইপিন জ্বলজ্বল করছে। গোলগাল জমিদারের চেয়ে মিলিটারি অফিসারের মতোই দেখায় দাদাকে ছবিতে। দাদা বেশ কালো, দেখতে ভাল নয়, আমার কিন্তু মনে হয় দাদার একটা ব্যক্তিত্ব ছিল বটে। দিয়া যদি হয় একটা মোমবাতি, দাদা তা হলে একটা বন্দুক, একটা রাইফল্। বারুদের গন্ধ পাওয়া যায় ছবিটার কাছে গেলেই।
আমি জন্মাবার অনেক আগে দাদা মারা গেছে। মা-ই বোধহয় দাদাকে ভাল করে মনে করতে পারে না। এতদিন আগেকার কথা সে সব। আমার দাদার জন্যে খুব মন কেমন করে। যে দাদাকে কোনওদিন দেখিনি সেই দাদার জন্যে। স্টিফেন দেখেছে দাদাকে, খালেদাও দেখেছে। খালেদা গল্প করে তার হাতের রান্না খেতে দাদা কেমন ভালবাসত। পান্তাভাতের মধ্যে কাঁচা সর্ষের তেল, কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচা লংকা দিয়ে সপাসপ মেরে দিত দাদা। খালেদা আর স্টিফেনের কাছে ভাগাভাগি করে দিয়া আর দাদার রোমাঞ্চকর প্রেমের গল্পও আমি শুনে নিয়েছি।
ওই যে রিপন আর চৌরঙ্গির গলির তিনটে বাড়ি, ওরই একটাতে, তেরো নম্বরে নাকি থাকত দিয়া, তার বুড়ি দিদিমার সঙ্গে। খালেদা আমাকে সবকিছু খুলে বলতে পারে না, আমি কিন্তু এখন বুঝে গেছি। দিয়ার দিদিমা খুব ভাল চরিত্রের মহিলা ছিল না। এমন কী দিয়া তার নিজের নাতনি কি না এ নিয়েও সন্দেহ ছিল। তখন দিয়ার পনেরো ষোলো বছর বয়স। স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। স্টেনোগ্রাফি-টাইপিং শিখছে, আর এসপ্লানেড পাড়া মাতিয়ে বেড়াচ্ছে। যত বাজে ছেলের সঙ্গে আড্ডা। যখন-তখন ওরা এসে ডাকে, দিয়া চলে যায় সিনেমা, চলে যায় রেস্তোরাঁয়, বারে। সে সময়ে মিসেস ডি-সুজার শাশুড়ির নাচের স্কুলেও কমপ্যানিয়নের কাজ করেছে দিয়া। ওখানে নাচ শিখতে আসত বড় ঘরের ছেলেরাও। কত জন দিয়াকে ছেলেমানুষ পেয়ে কত রকমের প্রস্তাব দিয়েছে, দিয়া কোনওটাকে পাত্তা দেয়নি। আমি এখনও চোখ বুজলেই দেখতে পাই আইলিন নামে অপূর্ব সুন্দর সেই হাসিখুশি মেয়েটা লাল স্কার্ট আর পোলকাডটেড টপ পরে ওয়ালজ কি ফক্স-ট্রট নাচছে। ওই সময়কার ছবি আছে দিয়ার অ্যালবামে, বিশ্বাস করা যায় না এত সুন্দর সেই আইলিন।
হেসে হেসে ওই সব জমিদার ব্যবসাদারদের ছেলেদের সঙ্গে ফ্লার্ট করছে আইলিন। ওই ছেলেগুলো ক্যাবলা মেরে যাচ্ছে। পাগল হয়ে যাচ্ছে। খালেদা আমাকে ফিসফিস করে বলত—ওই সব বড়লোকের ছেলেরা আইলিনের সঙ্গে ঘুরতে চাইত, হোটেলে ঘর বুক করে একটা রাতও অন্তত কাটাতে চাইত। চাইত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে শহর থেকে দূরে। অনেক আরাম, ঐশ্বর্য, টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটির লোভ দেখাত ওরা। আর লোভ দেখাত ভালবাসার।
—‘আইলিন। আইলিন তোমাকে পেলে আর কিছু চাই না—তুমি আমার হও’—এই রকম গুঞ্জন কানের কাছে করতে থাকলে রক্তে কী রকম দোল লাগে তা তো আমি ভালই জানি। আইলিনেরও নিশ্চয় লাগত। টাকা পয়সা, গয়নাগাঁটির লোভ এড়ানো যায়, ভালবাসার, রোম্যান্সের লোভ এড়ানো খুব শক্ত। তার ওপরে আমরা এই সময়ের মেয়েরা যত প্র্যাকটিক্যাল, যত হিসেবি, আইলিনরা তো তা ছিল না। আইলিন তাই ভেসে যাচ্ছিল। ভাসছিল, আর ভেসে যেতে যেতে বুঝতে পারছিল কত ধানে কত চাল।
বিনয়ভূষণ চৌধুরী এই সময়েই মিসেস ডি-সুজার ডান্স স্কুলে আসে। আইলিনের আর ভেসে যাওয়া হয় না। আমার দাদার অনেক গুণ। আইলিনের জন্যে সে সর্বস্ব পণ করেছিল। কী-ই বা ছিল তখন আইলিন? একটা সতেরো আঠেরো বছরের ফুটফুটে মেয়ে বই তো নয়! বিনয় চৌধুরী তার জন্যে নিজের জমিদারি টাকা পয়সার আশা ছেড়ে দিল। নিজে ব্যবসা করে এখানে এই কলকাতাতেই টাকা পয়সা করল। এই সব বাড়ি ঘর কিনল। আইলিনকে মানুষ করল, ঠিক যেমন মেয়েকে বাবা মানুষ করে। আইলিন বাড়িতে পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত শিখল, বাংলা শিখল। অনেক ভাল ভাল বই পড়ল। গান শিখল, ভজন, কীর্তন, রামপ্রসাদী। শাড়ি-পরা বাংলা মেয়ে, বাংলা বউ হল। মোচার ঘন্ট থোড়ের ছেঁচকি রান্না করতে শিখল, পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে গ্র্যাজুয়েট হল। আমার মা যখন হয়েছে তখন আইলিন পুরোদস্তুর এক মিসেস এলা চৌধুরী।
আমি বলি—দিয়া, দাদা তোমাকে অত চেষ্টা-চরিত্র করে বাঙালি বউ বানাল। তা তুমি এই শেষ বয়সে কেন আবার মেম-সাহেব হয়ে যাচ্ছ?
—মেমসাহেব হচ্ছি? হাউ?—দিয়া অবাক হয়ে তাকায়।
আমি বলি—কেন? তোমার চুলের খোঁপা, বিনুনি কোথায় গেল? চুল কেটে ফেলেছ যে!
—চুল কাটিনি, বুলা—চুল পড়ে গেছে সব। অত যত্ন করে লম্বা চুল করেছিলুম। অ্যাত্ত বড় খোঁপা হত, এখন চুল তো নয়! যেন টিকটিকির ল্যাজ!
—আচ্ছা ঠিক আছে, শাড়ি কেন তাহলে পরো না! পরে থাক তো একটা ম্যাক্সি।
—বুলা, বুড়ো শরীরে আর শাড়ি সামলাতে পারি না রে! কত সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরেছি এক সময়ে। ঢাকাই, জর্জেট, মাইসোর সিল্ক, শিফন, জামদানি, বেনারসী, আবার টাঙ্গাইল বুটিগুলো, ধনেখালির ডুরেগুলো, শান্তিপুরের কলকা পাড় হাতি পাড় এক রঙা শাড়ি এ সবও তো কত পরেছি। তোলা আছে কত আমার আলমারিতে। এখন সে সব যেন হাতেবহরে আমাকে গিলতে আসে।
সত্যি কথাই, এলা চৌধুরীর সেইসব শাড়িপরা চেহারার ফটোও যেন আমাদের অ্যালবামে আছে। এত সুন্দর করে পরত কে বলবে বাঙালি নয়।
—আজকাল তুমি তো আর চচ্চড়ি, ঘণ্ট, মাছের তেলের বড়া, ইলিশের পাতুরি এ সব খাও না,—আসলে এইগুলো আমি নিজে খুব ভালবাসি। মিস্ করি।
—সহ্য হয় না বুলা, তা নয়তো চচ্চড়ি আমারও খুব ফেভারিট।
—তা হলে কেন রাত্তিরে জিসাসের কাছে প্রার্থনা কর?
—এটা চিরকাল করেছি বুলা। ভক্তির জিনিস, দেবতা, কখনও বদলায় না। ভেতর থেকে কোনও আর্জ না এলে আমি কালী কি কৃষ্ণকে ভগবান বলে প্রণাম করতে পারব না। এ নিয়ে তোর দাদা আমাকে দু-একবার জোর করেছিল। আমি কী বলেছিলুম, জানিস?
—কী?
—বলেছিলুম, দেখো পোশাক, খাদ্য, ভাষা এ সবই বাইরের, তাই এগুলো বদলাতে পেরেছি। কিন্তু যিশাস আমার ভেতরের জিনিস। এটা পাল্টানো যাবে না। পাল্টে গেলে আমি আর আমি থাকব না। তুমি আমায় বিয়ে করলে কেন? একজন ফর্সা-দেখে বাঙালি কালীভক্ত মেয়ে বিয়ে করলেই তো পারতে! বাঙালিদের মধ্যে কি ফর্সা নেই? সুন্দরী নেই?
—কী বলল দাদা?
—চুপ করে গেল। একদম চুপ। আর কোনওদিন এ সব নিয়ে কিছু আমায় বলেনি।
এখন শেষ বয়সে দিয়ার ভেতর থেকে, এলা চৌধুরীর ভেতর থেকে কি আইলিন বার হয়ে আসছে? দিয়া হয়তো নিজেও জানে না, কিন্তু ঘটছে ব্যাপারটা।
যখন মুসৌরি থেকে প্রথম চলে এলুম, তখনই দেখি এই পরিবর্তনটা। রেখে গিয়েছিলাম একজন শাড়ি পরা, পান-খাওয়া, দিয়া। এসে দেখি দিয়া পান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। রোগা হয়ে গেছে খুব। পায়ের হাতের গাঁটের ব্যথায় ভোগে। আর কাফতান কিংবা ম্যাক্সি পরে থাকে সারাদিন।
যদি বলি দাদার কষ্ট হবে এলা এরকম বদলে যাচ্ছে দেখে, তখন দিয়া কী বলে জানেন? দিয়া বলে বিনয়ভূষণ এখন শেষ বিচারের দিনের জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন কে এলা কোথায় কী করল দেখবার অবস্থা তার নেই।
আমি বলি–আঃ দিয়া, কী সব পুরনো পুরনো কথা বলছ, বিনয়ভূষণ এখন অন্য কোথাও জন্মে গেছে। শেষ বিচার টিচার তোমাদের শাস্ত্রের পাতাতেই পাওয়া যায়।
এই নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব তর্ক হয়। দিয়া শেষ বিচার আঁকড়ে থাকে, আমি আঁকড়ে থাকি পুনর্জন্ম। দিয়া আঁকড়ে থাকে যিশুকে, আমি বলি যে নিজেকেই বাঁচাতে পারল না সে আবার আমাদের কী বাঁচাবে? নির্ভর করতে হলে কোনও মানুষের ছেলের ওপর করা ভাল? না মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিমান কোনও অপার্থিব, অলৌকিক সত্তার ওপর করা ভাল?
দিয়া বলে—যেটা ট্রুথ, সেটাই আমাদের মেনে নিতে হবে, বিশ্বাস অবিশ্বাসগুলো আমাদের পছন্দ, আমাদের সুবিধে-অসুবিধে মেনে তো হবে না।
আমি বলি—সত্য কোনটা তুমিও জানো না, আমিও জানি না। আমরা দুজনেই আমাদের পছন্দ, আমাদের সুবিধে-অসুবিধেগুলো অনুযায়ী সত্য সৃষ্টি করছি।
—আমরা হয়তো জানি না, কিন্তু মহাজনরা তো জানেন। —দিয়া বলে— তাঁদের কথাই সত্য।
মহাজনদের ওপর অত ভরসা আমার নেই। আর কে প্রকৃত মহাজন এ নিয়েও তো তর্ক হতে পারে। একজন মহাজন হলে আরেকজন আরও বড় মহাজন হতে পারেন। তাঁর চেয়েও বড় হতে পারেন আরেক জন। কার কথা মানব? তাই নিজের বোধ-বুদ্ধিতে যেটুকু বুঝি, সেইটুকুই আমার আসল ভরসা। আর সেই বোধবুদ্ধি বলে মৃত্যুর পরে কে কোথায় যাবে, এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই, মৃত্যুর আগে এই জীবনটাতে কোথায় যাচ্ছ, কী করছ সেটাই আসল।
আমি যাই বলি, দিয়া সেই বিনয়ভূষণেরই আশায় নিজেকে কখনও এলা, কখনও আইলিন বানায় এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে যায়, আবার সেন্ট পলস-এ ক্রিসমাস, গুড ফ্রাইডেতে প্রার্থনা শুনতেও যায় দিয়া, যাকে বলে ‘মাস।’ আর বিনয়ভূষণের লাইব্রেরি? ঠিক সেই একরকম ভাবে রেখে দিয়েছে দিয়া। ঠিক সেই এক জায়গায় ওয়লনাটের ডেস্ক, চেয়ার, রকিং চেয়ার একটা বেতের। একটা জার্মান সিলভারের পানের বাটা ডেস্কটার বাঁ দিকে। ডান দিকে রাইটিং প্যাড, পেন হোল্ডার। আমি যদি লাইব্রেরিতে পড়তে ঢুকি, হয় দিয়া নিজে নয় তো খালেদা, দিয়ার এক নম্বর স্পাই উঁকি মেরে দেখে যাবে আমি কিছু এদিক-ওদিক করছি কিনা। আইভরির পেনহোল্ডারটা কতদিন চেয়েছি। দিয়া খুব আঘাত পাওয়া চোখে চেয়ে বলে—‘ওটা তো তোর দাদার!’ যেন দাদা এখনও বেঁচে আছে, এখনও ব্যবহার করবে এ সব জিনিস!
পাঁচ
—ডেনিমের মিডি-স্কার্টটা খুঁজছিলাম। ডাইং-ক্লিনিং থেকে আনা হয়েছে কি না মনে নেই।
দিয়া বলল—কী খুঁজছিস? কোথাও বেরোবি?
—বাঃ আজ শনিবার না?
শনিবার শনিবার আমি প্রদ্যুম্নদার কাছে পড়তে যাই। এটা ভালই জানে দিয়া, তবু জিজ্ঞেস করবে,—কোথাও বেরোবি?
—আমার ব্লু শিফনটা পর না।
হ্যাঙার সুদ্ধু ব্লু শিফনটা বার করে আনি।
—এটা কবে কিনেছিলে দিয়া? নীল মেঘের মতো শাড়িটাতে হাত বুলোতে বুলোতে আমি জিজ্ঞেস করি।
—বিনু কিনে দিয়েছিল, তোর মাসি হওয়ার পর।—বিনু মানে বিনয়ভূষণ, দাদা।
—বাপ রে কবেকার জিনিস! ছিঁড়ে যাবে না তো।
—মনে তো হয় না।
কিন্তু দিয়ার ব্লাউজ আমার ফিট করল না। দিয়া মানুষটা ছোটখাটো। রোগাও ছিল বেশ। টেনেটুনে যদি বা ব্লাউজটা গলালাম, চার ভাগের তিন ভাগ পিঠ আমার খালি রইল।
আমার নিজের একটা কলার দেওয়া স্কার্টের ব্লাউজ পরে নিই অগত্যা। দিয়ার চেয়ে অনেক লম্বা চওড়া আমি।
—তাড়াতাড়ি আসিস। স্টিফেনকে পাঠাব না কি?
—কী যে বলো! খবর্দার স্টিফেনকে পাঠাবে না—আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি। অন্য দিন এই দূরত্বটা আমি হেঁটে মেরে দিই। আজ দেরি হয়ে গেছে। —এমনিতে হাঁটবার কোনও দরকারই নেই। আমাদের রাস্তা থেকে সার্কুলার রোড ট্রামেই যাওয়া যায়, ঘুরে যাবে ট্রামটা। এন্টালির মোড়ে নেমে পড়তে হবে। এবার কনভেন্ট রোড পর্যন্ত এইটুকু পথ হাঁটতে হবে।
ট্রামেই সুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা। রোজ এটা হবে। ওকে আমি এড়াতে পারি না। আমরা দুজন দুজনকে দেখতে পারি না। দেখা হলেই কথা কাটাকাটি।
—ইসস্ আজ শিফন পরেছিস, তোকে যা লাগছে না!—ও বলল।
আমি কিন্তু ফিরে ওকে কোনও প্রশংসার কথা বললাম না। ও তো সেটাই চায় কিনা। ওকে ওবলাইজ করার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। টুকটুকে করে লিপস্টিক মেখেছে ঠোঁটে, চোখে কাজল, কানে লম্বা দুল। আমার চেয়েও লম্বা-চওড়া চেহারা ওর, কিন্তু কখনও শাড়ি পরে না। সালোয়ার কামিজ পরেছে জর্জেটের।
ওর দিকে চেয়ে আমার ভেতরটায় কেমন জ্বালা ধরে। মনে হয় ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিই। তা তো পারি না, কিন্তু গলায় নিমের রস ঢেলে দিয়ে বলি—যাচ্ছিস তো পড়তে। এত সাজ কীসের রে?
—তুইও তো সেজেছিস। শিফন-টিফন পরে…
—বাস ওইটুকুই। দিয়া বলল ওর এই শাড়িটা পরতে তাই। এটাকে সাজ বলে না।
—তোকে এতেই সাজ-সাজ দেখাচ্ছে। ড্রেসড্-আপ। আমাকে ততটা দেখাতে হলে মেকাপ নিতে হয়।
—তা হলে সেজেছিস স্বীকার করলি।
সুপ্রিয়া শ্রাগ করল। মেকাপ নিতে হয়-টয় কথাগুলো ও একদম ফালতু বলল। ও যথেষ্ট ফর্সা। চোখ-মুখও খুব কাটা-কাটা। সুন্দর যাকে বলে।
স্টপে নেমে দেখি রঙিন, অনিমেষ আর কাকলিও যাচ্ছে। ব্যস এই পাঁচ জনেই আমাদের ব্যাচ।
প্রদ্যুম্নদা আমাদের ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইড। শুধু ফিজিক্স ম্যাথসই বোঝান না, জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান, অনেক রহস্যের উন্মোচন, অনেক দুর্বোধ্য জিনিস হৃদয়ঙ্গম করতেও সাহায্য করেন। ‘সাহায্য’, ওই ‘সাহায্য’ কথাটার বিশেষ গুরুত্ব। কাকলির বাবা ক্যানসারে মারা গেলেন। রোগটা ধরা পড়ার ঠিক এক মাসের মাথায় শেষ। কাকলির এত মন ভেঙে গিয়েছিল সে পড়াশোনা তো করতই না, পরীক্ষায় বসতেও ওর ইচ্ছে ছিল না। খালি বলে—কত রকমের চিকিৎসা আছে, বাবা চিকিৎসার আগেই চলে গেল।
প্রদ্যুম্নদা একদিন বললেন—কাকলি, চিকিৎসা চিকিৎসা তো করছ। চিকিৎসা মানে তো কেমোথেরাপি, আর রেডিয়েশান। তো এই চিকিৎসা যে রোগটার থেকেও কষ্টকর তা কি তুমি জানো? তার পরেও মৃত্যু কেউ আটকাতে পারত না, হয়তো কিছুটা পেছিয়ে দেওয়া যেত। আর সেই অতিরিক্ত আয়ুর প্রতিটি মুহূর্ত তোমার বাবা মৃত্যু-যন্ত্রণা পেতেন, ডাক্তারকে চিকিৎসাশাস্ত্রকে আর তোমাদের সবাইকে অভিশাপ দিতেন। একটা মানুষকে, তার প্রিয় শরীরকে টেনে হিঁচড়ে কুৎসিততম অবমাননার মধ্যে ফেলে তাকে নিঃস্ব করে তবে মারা। তোমার তো সান্ত্বনা পাওয়া উচিত যে তোমার বাবা অন্তত সেই কষ্ট থেকে রেহাই পেয়েছেন।
জীর্ণ বসন, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই ওঁর শরীরটা জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বয়সে নয়, রোগে জীর্ণ। সেই জীর্ণ বাস ত্যাগ করে উনি নতুন বস্ত্র পরেছেন। বুদ্ধ কী বলেছিলেন জানো?—এই দেহ জীর্ণ শকটের মতো হয়ে গেছে। একে দিয়ে আর কিছু করানো যাবে না, এই দেহ এবার আমি ত্যাগ করব। তোমার দিক থেকে আসলে খারাপ লাগছে কেন? মা-বাবা জীবনের সব বিপদ আড়াল করে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে নেই। চিন্তাটা কতটা স্বার্থপর বুঝতে পারছ তো?
কাকলির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও শুনলাম। প্রশ্নটার ভেতরে প্রবেশ করলাম। অন্য কে কতটা করল জানি না। আমি অন্তত করেছি। মাকে আমি আমার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি। দিয়াকে অবশ্য পাশে চাই। একসময়ে চাইতাম অভিভাবক হিসেবে, এখন চাই জাস্ট একটা ফ্রেন্ড হিসেবে।
প্রদ্যুম্নদা বলেছিলেন— প্রত্যেকের জীবনের দায়িত্ব আসলে তার নিজেরই। বাবা-মা ইত্যাদি অভিভাবকরা চারপাশে থাকেন বলে আমরা মনে করি দায়িত্বটা তাঁদের। তাঁরা চালনা করছেন বলে আমরা চালিত হচ্ছি। তাঁরা যেমন গড়বেন আমরা তেমন হব। আসলে কিন্তু আমরা যা হয়ে দাঁড়াই, সেটা আমাদেরই ভেতরকার ‘আমি’র তাগিদের ফল। দায়িত্বটা অন্যদের ওপর ন্যস্ত করে আমরা ভারমুক্ত হতে চাই। এটা এক ধরনের ভুল চিন্তা।
এই ব্যাপারটা আমি খুব ভাল বুঝি। কারণ, সেভাবে অভিভাবকদের চাপ আমার ওপর কখনও ছিল না। আমার মা নিজেকে নিয়ে, নিজের কেরিয়ার, নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত, বাবার কথা তো ছেড়েই দিলাম। একমাত্র দিয়া, দিয়া হচ্ছে এমন একজন মানুষ আমার জীবনে, যাকে সব সময়ে পাশে পেয়েছি। মা কথায় কথায় বলে—একটু বড় হ, বিয়ে দিয়ে দোব। অর্থাৎ কিনা মা আমাকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। আমার মনে আছে, যখন নতুন নতুন বড় হচ্ছি, পাড়ার মাইকেল, রুডি, সলোমন এদের সঙ্গে দৌরাত্ম করে বেড়াই তখন মা বলেছিল—ধুৎ, এগুলোকে দিয়ে কী হবে, বয়সে একটু বড়, আর চাকরি-টাকরি করে এমন ফ্রেন্ড জোগাড় কর। কষে প্রেম কর দিকি, একটা জম্পেশ বিয়ে লাগাই।
আর দিয়া? দিয়া তো সব সময়ে মুখিয়ে আছে, আমি প্রদ্যুম্নর সঙ্গে প্রেম করছি কি না জানতে। এই যে একটা শিফন শাড়ি লড়িয়ে দিল।
দেখো মা, দেখো দিয়া প্রেম হয়তো আমি করব। কিন্তু প্রেমটা আমার কেরিয়ার নয়। সরি, মাফ করতে হল। আমি কিছু একটা করব আমার নিজের জন্যে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যেতে পারি। ব্যবসা করতে পারি—এখনও একেবারে ঠিক করে ফেলিনি সেটা। কিন্তু কবে কোন বিনয়ভূষণ আসবে, এসে আমায় উদ্ধার করবে, আইলিন থেকে নিজের পছন্দের এলা বানাবে আমাকে, —এ ধাত আমার নয়।
আমি কোনও ভাবেই কোনও দায়িত্ব ওদের ওপরে দিই না। যদি ব্যর্থতা আসে, কখনও বলব না, আমার মা আমাকে সে ভাবে দেখেনি তো, তাই আমি পারিনি। আমার দিদিমা তো এরকম, তাই আমিও অন্যরকম হতে পারলাম না। এ সব দোহাই পাড়ার দিকেই আমি যাই না। এইটুকু বুঝে নিয়েছি বাবা, স্বাস্থ্যটা ভাল আছে, ঘটে বুদ্ধিও মন্দ নয়, ব্যাঙ্কে মালকড়ি আছে, শূন্যে দোদুল্যমান অবস্থা আমার কোনওদিনই হবে না। এও বুঝি এই দিদিমা যতদিন বেঁচে থাকবে, এর দায়িত্ব আমার, মায়ের কথা বরং আমায় তত ভাবতে হবে না। ব্যস, এই আমার অ্যাসেট, আর এই আমার লায়েবিলিটি। এইবার চারপাশ থেকে অর্থাৎ বইপত্র স্কুলকলেজের লেকচার, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশার মধ্যে দিয়ে আর কী আহরণ করতে পারি, তার কোনটা নেব, কোনটা ফেলব, সেটা আমারই সিদ্ধান্ত, আমার খুশি।
অনিমেষ যেমন, নিজে হতে চায় পাইলট, বাড়ি থেকে চায় ও ইঞ্জিনিয়ার হোক। সুপ্রিয়া চায় সিনেমার হিরোইন হতে, ওর বাড়ি থেকে ওকে সি-এ কি এম.বি.এ. হবার জন্যে তৈরি করছে। সুপ্রিয়াটার কথা অবশ্য ধর্তব্যের মধ্যে নয়। ও একটা রাম বাজে মেয়ে। কিন্তু অনিমেষ বা রঙিন ওরাই কি ভাল করে জানে ওরা কী হতে চায়, বা হতে পারবে? আমার সন্দেহ আছে।
বেশ কয়েকটা অঙ্ক আমার মেলেনি। কয়েকটা পারিওনি। সুপ্রিয়াটার সুদ্ধু মিলেছে খালি আমার গুলোই…প্রদ্যুম্নদাকে বললাম—রঙিনকে বলুন না, আমাদের বাড়ি গিয়ে একটু দেখিয়ে দিয়ে আসবে একেক দিন। রঙিনের মাথা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার। প্রদ্যুম্নদা বললেন—রঙিনকে সাব-কনট্র্যাক্ট দেব বলছ? ও সব ফাঁকিবাজির কারবার আমি করি না।
রঙিন একটু রেলা নিয়ে নিল এই সুযোগে। বলল—আজকে আর সময় নেই। নইলে আজই তোকে বুঝিয়ে দিতাম। ঠিক আছে যাব একদিন তোর বাড়িতে। ওই এলিয়ট রোডে তো? প্রদ্যুম্নদা মাইন্ড করবেন না তো?
প্রদ্যুম্নদা বললেন—সো লঙ অ্যাজ য়ু ডোন্ট ইনটারফিয়ার উইথ দা বেসিক্স্!
ওদের দলটা চলে গেলে প্রদ্যুম্নদা কয়েকটা বুঝিয়ে দিলেন বললেন—এইগুলো কষে ফেলো, আমি একটু ভেতর থেকে আসছি।
এই ঘরটা আগে বোধহয় বৈঠকখানা ছিল, এখন প্রদ্যুম্নদা কোচিং করবার জন্যে ব্যবহার করেন। এ ছাড়াও এঁদের আর একটা ড্রয়িং রুম আছে, সেটা ওপরে। এই ঘরটা থেকে ভেতরের দিকে বেরোলে একটা চওড়া প্যাসেজ, সেটা গিয়ে পড়েছে একটা গোল দালানে, দালান থেকে ওপরের সিঁড়ি উঠে গেছে। বাবা নেই প্রদ্যুম্নদার, মাকে দেখেছি, খুব ভালমানুষ। এ-ই ঘরটা বাকি বাড়ি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন।
আমার গালের ওপর গরম গাল।
দরজাটা বন্ধ করেছেন তো? —আমি বুঝতে পেরেছিলাম এটা আসছে।
অঙ্কের খাতা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে প্রদ্যুম্নদা আমাকে… আলতো করে বুকে হাত রেখেছেন… আহ এত ভাল যে কেন লাগছে? ঠোঁটের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে আমার ব্লাউজের বোতাম খুলছেন প্রদ্যুম্নদা, আমি ডুবে যাচ্ছি, ভাল লাগায়, ভাল লাগার নেশায়, ভালবাসা? জানি না, জানি না ভালবাসা কি না, এখন এই নেশা, এই সর্বনাশ ভালবাসছি। বিহ্বল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন প্রদ্যুম্নদা, মুখটা লালচে। চোখদুটো কালো, গভীর কালো। আমি দু হাতে ওঁর চুলের মুঠি ধরি, কান কামড়ে ধরি আলতো করে। তার পরে যখন উনি প্রায় পাগল, আমিও মাতাল, বে-হেড হবার আগের অবস্থা, ঠিক তখনই সমস্ত শক্তি সংগ্রহ করে উঠে পড়ি। ব্লাউজের বোতাম আঁটি।
—বুলা-আ—গোঙাতে থাকেন প্রদ্যুম্নদা—বুলা-আ—
কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আমি মৎস্যনারী। আমার কটিতে চেসটিটি বেল্ট বাঁধা আছে, প্রদ্যুম্নদারা যাতে ভেদ করতে না পারেন। সলোমন, সলোমনের সঙ্গে অভিজ্ঞতা আমাকে এ সব শিখিয়েছে। তখন বালিকা ছিলাম, অসাবধান হওয়া মানাত, এখন বড় হয়ে গেছি, এখন এ সব উপেক্ষা করা যায় না। সলোমন যাতে আমাকে আর বাগে না পায়, তার জন্যে আমি মাইকেল আর রুডিকে নিয়ে চলি। এখন, প্রদ্যুম্নদাকে দূরে রাখবার জন্যে আমি কাকে নিয়ে চলব?
আমি ভেসে যেতে পারি, আবেগে আবেগে ভেতরের চোরা মত্ততায়, আবার ভেসে যেতে গিয়েও ফিরে আসতে পারি, এমনই নিয়ন্ত্রণ আমার শরীর যন্ত্রটার ওপরে। আমার ধমনীতে আইলিনদের রক্ত।
নীল শিফনটা কুঁচির কাছে ছিঁড়ে গেছে। মুচকে গেছে আরও কয়েক জায়গায়।
—কী করেছেন দেখুন প্রদ্যুম্নদা…
—কত দাম শাড়িটার? অমন ক’খানা শাড়ি কিনে দিতে হবে বলো!
—অনেক, অনেক প্রদ্যুম্নদা, তার ওপরে আবার মুক্তোর চোকার, তাতে হিরের সেন্টার পীস, সে রকম চোকার কুইন আলেকজান্দ্রার গলায় থাকে। —তেতো তেতো হাসি হাসতে হাসতে বললাম।
কথাগুলো বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে খুব, উজানে ফেরা খুব সহজ কাজ তো নয়, আমার রক্তে এখনও জোয়ার, গলার স্বরে একটা খসখসে হিসহিসে ভাব, নিজেই চিনতে পারছি না নিজের স্বর।
প্রদ্যুম্নদা বুঝতে পেরেছেন, আমি শুধু একটা গহনাই চাইছি না। গহনাটা প্রতীক। কিন্তু কীসের। ওই উল্লেখ কোন পটভূমি থেকে উঠে এল তা উনি বুঝতে পারছেন না। চোখের চশমাটা খুলে কাচগুলো মুছতে লাগলেন উনি। সেই ফাঁকে আমি দরজা খুলে পালিয়ে এলাম। না না চলে এলাম।
আমার ফ্রেন্ড, ফিলসফার, গাইড হতে পারেন প্রদ্যুম্নদা। হতে পারে উনি আমাকে ‘আনা কারেনিনা’ এবং ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ পড়িয়েছেন। হতে পারে উনি জীবন এবং মৃত্যু, মানুষ এবং প্রকৃতি এবং সম্পর্ক বিষয়ে অনেক কিছু শিখিয়েছেন, কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার অংশীদার হতে হলে প্রদ্যুম্নদাকে আরও পরীক্ষা দিতে হবে, নিজের ক্ষমতার পরীক্ষা, জীবনটাকে পৃথিবীটাকে যে হাতের মোয়ার মতো যেদিকে ইচ্ছে ঘোরাতে পারেন, এটা প্রমাণ করতে হবে, কয়েকজন উচ্চ মাধ্যমিক কি বি-এসসি পরীক্ষার্থীকে সপ্তাহে দুদিন অঙ্ক ফিজিক্স পড়ানোর পুঁজি দিয়ে এতটা কি করা যায়? প্রমাণ করুন প্রদ্যুম্নদা, প্রমাণ করতে করতে যদি অনেকদিন পেরিয়ে যায়? যদি আমি নিজেই বদলে যাই? যেতেই পারি। প্রদ্যুম্নদার জন্যে আমি শবরীর প্রতীক্ষা করে থাকব, এ গ্যারান্টিও দিতে পারছি না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কে মহা তালেবর আমি এলাম যে এত মূল্য চাইছি ওঁর কাছে? কীসেরই বা এত অহঙ্কার যে প্রতীক্ষা করার কথা পর্যন্ত দিতে পারছি না! এ-ও তো ঠিক যে এই রোম্যান্স আমার ভাল লাগে। ভাল লাগে বলেই এত দূর আসতে প্রশ্রয় দিয়েছি ওঁকে! সবই ঠিক। কিন্তু এ-ও বোধহয় ঠিক যে উনি আমার সেই স্বপ্নের মানুষ নন। হয়ে উঠতে পারেন কি না সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ঠোঁটের ওপরে ওঁর ঠোঁট, আমার বুকের ওপরে ওঁর হাত উত্তেজনার তুঙ্গে আমাকে নিয়ে গেলেও তার বেশি তো কিছু পারেনি। আমি যেমন, উনিও তো তেমন ওই কয়েকমিনিটের উত্তেজনার কাছেই মাথা বিকিয়ে বসে আছেন! ব্যাস এর পরেই ওঁর পৌরুষ ফুরিয়ে যাবে। কোথায় সেই ঘোড়া যে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে এক দুর্গ থেকে আরেক দুর্গে, কোথায় সেই উষ্ণীষ যা আমার পায়ের তলায় নামিয়ে দেবে কেউ, সেই ভূ-স্বর্গ কোথায় যা আমারই জন্য কেউ রচনা করল? রোম্যান্টিক কল্পনাবিলাস! হতে পারে। কিন্তু এখন, এই বয়সে যদি রোম্যান্টিক কল্পনা করার সাহস না থাকে তো পরে কী হবে! তা ছাড়া, এ তো অসম্ভব নয়? আইলিনের জন্যে বিনয়ভূষণ কি ত্যজ্যপুত্র হওয়ার ঝুঁকি স্বীকার করে নেননি? পরিবার, পিতা, সম্পত্তি এ সব ত্যাগ করে আসা শুনতে যত সহজ, করতে কিন্তু তত সহজ নয়, আমায় যদি আজ কেউ বলে দিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করতে, এই লাল বাড়ির ওপর দাবি ছেড়ে দিতে, দিয়ার গয়নাগুলো সব বিলিয়ে দিতে, আমি পারব? ওই গয়নাগুলো, এই বাড়ির প্রতিটি কোণ আমার জীবনের নানান সময়ের, ভাবনা-চিন্তা, অনুভূতির একেকটা অংশ, এগুলো ছাড়া মানে নিজেরই খানিকটা কেটে বাদ দেওয়া। তো বিনয়ভূষণ তাঁর কিছু অঙ্গ কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন আইলিনের জন্যে। কাজটা বীরপুরুষের। সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। প্রকৃত বীরের মতো আরও অনেক যুদ্ধ জয় করে এসেছিলেন। কোনও দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র্য, সামাজিক অসম্মান সইতে দেননি আইলিনকে। মিসেস এলা চৌধুরী অনায়াসে গেছেন তখনকার সমাজের বাঘা বাঘা লোকেদের বাড়ির অনুষ্ঠানে, পার্টিতে। এই উদাহরণ আজও জীবন্ত হয়ে আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমি কী করে গতানুগতিকে তুষ্ট হব?
ঠিক আছে, যদি বলো আইলিনদের মতো রূপ আমার নেই। রূপ জিনিসটাই এদের সবচেয়ে মজায়, বড় বড় কাজ করতে, বড় বড় আত্মত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করে, মানব না অবশ্য, তবু বলছি, তাই যদি হয়, তো বাস্তব পৃথিবীর বাস্তব জীবনে চলতে গেলে যা আবশ্যক হয় সেই নিরিখেই সাফল্য, নিরাপত্তা, সম্পদ উপহার দিক আমাকে। আমার সঙ্গে একটু আধটু সম্পর্ক হবার পর এক বছরেরও ওপর কেটে গেছে, প্রদ্যুম্ন পালিতকে তো উদ্যোগী হতে দেখিনি! ব্যাচের পর ব্যাচ ছেলে পড়িয়ে তাদের বন্ধুত্ব আর উপদেশ দিতে দিতে ক্রমে তোমার পৃথিবী বাসি, ছোট্ট হয়ে যাবে প্রদ্যুম্নদা, তুমি আমার থেকে যা চাইছ, আর আমাকে যা দিচ্ছ, তা তো কোনও স্বপ্ন নয়, যে কোনও মেয়ে ও পুরুষ পরস্পরের থেকে তা পেতে এবং দিতে পারে, এই আকর্ষণ তো সবচেয়ে সাধারণ সবচেয়ে সহজলভ্য, তাই দিয়ে আর তাই চেয়ে কতদূর পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে? আর এই পড়ানোর ঘরে, কৃত্রিম ভাবে খানিকটা নির্জনতার ব্যবস্থা করে নিয়ে ছাত্রী শরীর খোঁজার এই উন্মাদনা, এ কিন্তু খুব গোলমেলে অভ্যাস প্রদ্যুম্নদা। প্রতি ব্যাচে তোমার কাছে কিছু ছাত্রী তো পড়তে আসেই। আসবেই। এই সোফায় যেখানে আমাকে নিয়ে মত্ত খেলা খেলেছ সেখানে আরও অনেক বুলা এসে বসে, বসবে। তারা, তাদের শরীরও তোমাকে ডাকবে, তোমারও লোভ হবে সে ডাকে সাড়া দিতে। এখনই, এখনই সোফার ওই জায়গায় সুপ্রিয়া যদি বসে, আমার ভেতরটা জ্বলতে থাকে, মনে হয়, তুমি, তুমিও জ্বলছ, বাসনায়। ভাবতে পারো আমি যদি তোমার দাঁড়ে বসা পোষা ময়না হয়ে যাই তা হলে শুধু আমাদের সেই প্রথম উন্মাদনার স্মৃতিই তোমাকে কতবার ওই সোফায় বসা নতুন মুখ, নতুন শরীরের ফাঁদে ফেলবে? সুতরাং, প্রদ্যুম্নদা ওই পর্যন্তই। তোমার আকর্ষণের ফাঁদে পড়ে আমার অমূল্য স্বপ্নের আকাশ আমি হারাতে চাই না। জীববিজ্ঞান আমরা জানি। জেনে গেছি।
সলোমন আমাকে বলত—ইউ আর আ নিম্ফ।
কী ভেবে কথাটা ও বলত জানি না, আমি কিন্তু বুঝি আমার মধ্যে একটা ওয়াটার নিম্ফ, একটা অপ্সরা আছে। আমি স্বেচ্ছাচারী। ইচ্ছে মতো আমার এর ওর তার ধ্যান ভাঙাতে ইচ্ছে করে। ধ্যান ভাঙার খেলায় আমি নিজেও মেতে যাই। কিন্তু তাড়াতাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি, আমার নিজের জলের সাম্রাজ্য আমায় ডাকে। তখন রূঢ়ভাবে খেলা ভেঙে দিয়ে আমি জলে ফিরে যাই।
ছয়
এন্টালির বাস স্টপে এসে দেখি স্টিফেন আসছে। এতবার বারণ করা সত্ত্বেও দিয়া ওকে পাঠাবেই।
রাগ করতে যেতেই, স্টিফেন হাত তুলে বলল—আহা আহা বেবি, শোনোই তো আগে আমার কথা। চিকেন কিনতে এসেছিলাম এন্টালি বাজারে, মনে হল তুমিও তো এদিক দিয়েই যাবে। যদি দেখা হয়ে যায়, আমার ট্রাম ভাড়াটা বেঁচে যাবে।
আমার হাসি পেয়ে যায়।
—কী সুন্দর শাড়ি পরেছ আজ বেবি। —বলতে বলতে স্টিফেনের চোখ দুটো কেমন হয়ে যায়।
—কী হল?
—শাড়িটা যে ছিঁড়ে ফেলেছ বেবি! —ওর চোখ অনুসরণ করে দেখি কাঁধের ওপর, বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে।
—এমা, অপ্রস্তুত হয়ে বলি— এত পুরনো শাড়ি, দিয়াকে বললাম পরব না। দেখো তো কী হল!
স্টিফেন বলল— ইসস্ —এখন কী করবে? এতটা ছেঁড়া পরে কি তুমি ট্রামে উঠতে পারবে?
আমি ততক্ষণে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছি। প্রতিবার পা ফেলছি মনে হচ্ছে, অন্য মচকানো জায়গাগুলোও যদি অমনি ছিঁড়ে যায়!
বাড়ি ফিরতেই দিয়ার ডাক।
বুলা—অ, বুলা—আ।
আচ্ছা জ্বালালে তো বুড়ি?
আত্মরক্ষার সবচেয়ে ভাল উপায় হল আক্রমণ।
আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি।
—দেখেছ তো, পুরনো পচা একটা শাড়ি আমায় জোর করে পরালে, পিঁজে গেছে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে।
—কই দেখি? —বুড়ি ছাড়বে না। আমাকে কাছে ডেকে ছেঁড়াগুলো পরীক্ষা করে দেখল। এবার কি গোল্ডিকে দিয়ে আমায় শোঁকাবে না কি?
—তুই মুসৌরি চলে যা বুলা— কর্কশ গলায় বুড়ি বলল।
আমি খাচ্ছিলাম। টোম্যাটো সুপ করেছে আজ খালেদা। একেবারে টাটকা টোম্যাটো সুপ। টোস্ট খাচ্ছি কামড়ে, পেঁপে-মরিচ আছে। রাত্রে দিয়া এইরকমই খায়। আমিও খাই তাই। জিনিসগুলো তো খারাপ নয়! শেষকালে আমি একটা ফুট সালাড খাব। ক্রিম আর মধু দিয়ে, দিয়া ক্রিমটা বাদ দিয়ে খাবে। খাচ্ছিলাম, খেতে থাকলাম। আমি চুপ করে থাকলেই যাবতীয় বলার কথা বুড়ি বলে ফেলবে।
আমার চেয়ারের পাশে পা মুড়ে বসে আছে গোল্ডি। বাঁ হাত দিয়ে গোল্ডিটাকে একটা আদর করে দিই।
—কিছু বলছিস না যে?
—কী বলব?
—ওই যে বললুম মুসৌরিতে চলে যা।
—তুমি নিজেই জানো সেটা সম্ভব না। ফাইন্যাল পরীক্ষা দেখতে দেখতে এসে যাবে। প্র্যাক্টিকাল ক্লাসগুলো আছে।
—ঠিক আছে। পরীক্ষাটা হয়ে গেলে চলে যাস, আমি তোর ভার নিতে পারব না।
—আরে মেমসাব। একটা হাসির কথা বললে আজ। কে কার ভার নেয় এ বাড়িতে। —আমি হেসে বলি— তাছাড়া একটা ফাইন্যালের পর আর একটা ফাইন্যাল থাকে, তারপর আরেকটা ফাইনাল…।
—মুসৌরিতে মায়ের চোখের সামনে সুবিধে হচ্ছিল না, না?
—মায়েরও অসুবিধে হয়ে থাকতে পারে দিয়া।
—কী বললি?
—ঠিকই বললাম। মা তো এখন একটা কনে বউ। আমার মতো এত বড় একটা মেয়ে সর্বক্ষণ পাহারাদারের মতো ঘুরে বেড়ালে অসুবিধে হবে না?
—একেবারে গোল্লায় গেছিস।
—যাক গোল্লায় যখন চলেই গেছি, মুসৌরিতে আর যেতে হচ্ছে না। দুটো জায়গায় তো আর একসঙ্গে যাওয়া যায় না।
রাগ করে চামচটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিল দিয়া।
—কেন মেজাজ খারাপ করছ? কী বলতে চাও, বলো না। ঝেড়ে কাশো, ওল্ড গার্ল, ঝেড়ে কাশো।
—শাড়িটা ছিঁড়ল কী করে?
—আদ্যিকালের শাড়িটা গেছে বলে রাগ করছ? আরে বাবা আমি জানি শাড়িটার সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু অনেক। কেন দিলে পরতে?
প্রশ্নটা করেই আমার মনে হল, ইচ্ছে করেই দিয়েছিল দিয়া। তারপর বুঝতে পারলুম স্টিফেনকেও ইচ্ছে করেই পাঠায়। যাতে বেশিক্ষণ না থাকি, স্টিফেন গিয়ে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দেয়। সমস্তটাই পরিকল্পিত। তবু দিয়ার পরিকল্পনা আমি ভেস্তে দিয়েছি। তাই রাগ।
—এর পর থেকে তোকে আর ওই টিউটরের কাছে যেতে হবে না।
—বাঃ, না গেলে প্রবলেমগুলো কে সলভ্ করবে! ফেল করে যাব যে দিয়া।
—করো ফেল।
—তা হয় না। তুমি বরং স্টিফেনকে আরও একটু তাড়াতাড়ি পাঠিও। ও বসে থাকবে। ভালই। ওরও ফিজিক্স অঙ্কটা শেখা হয়ে যাবে।
আমার নিশ্চিন্ত ভাব দেখে বোধহয় দিয়া একটু আশ্বস্ত হল। আরেকটা চামচ দিয়ে খাওয়াটা শেষ করল। উঠতে উঠতে বলল —ইয়ার্কি করছ করো বুলা। এভাবে চললে পস্তাবে। ভীষণ বিপদে পড়বে। ভেবো না সব বিপদ-আপদ থেকেই আমি তোমায় বাঁচাতে পারব।
—আশ্চর্য দিয়া, আমি আর থাকতে পারি না, —তুমি চেয়েছিলে না প্রদ্যুম্নর সঙ্গে আমি প্রেম করি!
—কে বললে?—ফোঁস করে উঠল বুড়ি, —তাকে তো আমি চোখেই দেখিনি আজও।
—সেটাই কি তোমার আপত্তির কারণ?
—বাজে কথা বলিস না বুলা, প্রেম এক জিনিস আর… এ লোকটা একদম ভাল নয়।
এবার আমি হাসতে থাকি। হাসতে থাকি। দিয়া ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। শেষকালে বলে— তুই আমার নাতনি… আমার নাতনি একটা সিনিক হয়ে গেছিস। আমি ভাবতেও পারি না।
দিয়া শুতে চলে যায়। আমি উচ্ছৃঙ্খল, আমি অপ্সরা, আমি আবার সিনিক হলাম।
দিয়াকে কষ্ট দিলাম। দিতে চাইনি। কেন দিলাম? আজ দিয়ার কথায় নিজের একটা নতুন দিকই আবিষ্কার করলাম। আমি তা হলে সিনিক? পৃথিবীর কোনও জিনিস, পবিত্র বলে মান পায় না আমার কাছে। সব কিছুর মূল্য সম্পর্কে আমি সন্দিহান। একটা তিক্ত তামাশার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখি জীবনটাকে। অথচ আমি এই আমিই স্বভাবে আবার একজন অপ্সরাও বটে, নিজের মধ্যে প্রচণ্ড সঙ্কল্পের নড়াচড়াও তো টের পাই। ঠিক বিপরীত প্রবৃত্তি না হলেও এগুলো তো একসঙ্গে একজনের মধ্যে পাওয়াও দুষ্কর। কেন এরকম উল্টোপাল্টা চরিত্র আমার?
একজন পুরুষ অভিভাবক আমার খুব দরকার ছিল। একজন বাবা, একজন দাদু। বাড়িটাতে শুধু মেয়ে, মেয়ে আর মেয়ে, নানান বয়সের মেয়ে। আর স্টিফেন? ও এতদিন ধরে মহিলাদের চাকরি করছে যে ও-ও মেয়েই হয়ে গেছে। আমার বন্ধুরা, পাড়ার বন্ধুরা তো ওকে স্টিফেন বুড়ি, হাই ওল্ড উওম্যান বলেই ডাকে।
শোবার সময়ে পা টিপে টিপে দিয়ার ঘরে ঢুকি। হালকা নীল আলোয় আমার নিজেকে একটা অলৌকিক প্রাণী বলে মনে হচ্ছে। মানুষ সমান আয়নায়, আমার প্রেতিনী শরীরের ছায়া পড়েছে। দিয়ার বিছানার কাছে এগিয়ে যাই। ঘুমোয়নি এখনও দিয়া? নিঃশব্দে কাঁদছে। মুখটা চোখের জলে মাখামাখি।
আমি ওর কপালে একটা চুমু খাই, আলতো করে গলা জড়িয়ে ধরে।
—তুই ঠিকই বলেছিস— ধরা ধরা গলায় দিয়া বলে— প্রেমের কথা বলবার অধিকার আমার নেই।
—কী বলছ দিয়া? ও কথা আবার আমি কখন বললাম? তুমি বলবে না তো কে বলবে প্রেমের কথা?
—ঠিক নয়। এ কথা ঠিক নয় বুলা। সে বলতে পারত, সে অনেক স্যাক্রিফাইস করেছিল আমার জন্যে। আমি কী করেছিলাম? বড়জোর সহ্য করেছিলাম। সিঁড়ির মতো ব্যবহার করেছিলাম তাকে। আমি যা যা চাই, —তা পাওয়ার জন্যে… আমার সৌন্দর্য ঠিকঠাক প্রকাশিত হতে পারবে এমন সব জায়গায় যাবার জন্য… দিয়া কাঁদতে লাগল।
আমি বললাম— এ ভাবে কেঁদো না দিয়া। সবাই দিতে পারে না, গ্রহণ করাও এক রকমের দেওয়া কিন্তু দিয়া। তুমি রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ পড়েছ? দাদা তোমাকে পড়িয়েছিল?
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান।
গ্রহণ করেছো যত ঋণী তত করেছ আমায়।
দিয়া কিন্তু সান্ত্বনা পেল না। বলল— তোর দোষ কী? তোর শরীরে আমারই রক্ত বইছে।
—দাদার রক্তও বইছে দিয়া। আমার বাবার রক্তও বইছে।
অনেকক্ষণ কাঁদল দিয়া, তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘুমিয়ে পড়ল।
আজ এতদিন পর হঠাৎ আমার মনে হল বাড়িটা বড্ড বদ্ধ। এটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর—এই বদ্ধতা। এই পুরনো পাড়ায় বাড়ি তৈরি করে ভাল করেনি দাদা। নিশ্চয় দিয়া চেয়েছিল বলেই এখানে বাড়ি করেছিল। ইচ্ছে করলেই তো অন্য কোথাও করতে পারত! আইলিনকে তার পুরনো পরিবেশ থেকে একেবারে তুলে নিয়ে গেল না কেন বিনয়ভূষণ? ভয় পেয়েছিল তুলে নিয়ে যেতে? এখানে রাখতে আরও ভয় পাওয়া উচিত ছিল। যতই এলা চৌধুরী হয়ে থাক, পাশের গলির আইলিনের কথা নিশ্চয় অনেকে ভুলতে পারেনি। ভুলতে দেয়ওনি। বড্ড বেশি মাংসের গন্ধ এ পাড়ায়। রক্ত-মাংস।
স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে অনীতার সঙ্গে আমার খুব ভাব। উত্তর কলকাতার গড়পাড়ে ওর বাড়ি। কয়েকবার আমায় নিয়ে গেছে অনীতা। ওখানে ওর মা, বাবা, ভাই, বোন, বিধবা জেঠিমা, কাকা, কাকিমা এতজন থাকেন। ওদের বাড়ির আবহাওয়া একেবারে অন্যরকম। মনে হয় যেন অন্য দেশ। ওখানে ওরা অনেক মুক্ত, স্বচ্ছন্দভাবে বাস করে। ওদের তেমন কিছু লুকোবার নেই। অন্যদিকে আমি? আমাকে ভেবে-চিন্তে সাবধানে কথা বলতে হয়।
অনীতার বাবা জিজ্ঞেস করলেন—কোথায় থাকো?
রাস্তার নাম শুনে ওর মা বললেন— ওটা তো একেবারে অ্যাংলো পাড়া। অনীতার বাবা অসন্তুষ্ট চোখে ওর মায়ের দিকে তাকালেন।
—আমি তো তখন বলতেই পারতাম আমার দিদিমাই তো একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। কিন্তু বললাম না তো! আমার মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে সংক্ষেপে মুসৌরির কথা বললাম। কিন্তু একবারও বললাম কি মুসৌরি থেকে কেন আমি চলে এসেছি। এই সমস্ত সামাজিক অনিয়ম ওঁরা কীভাবে নেবেন সেটা তো জানি না! ওঁদের উদারতার ওপর আমার ভরসা নেই।
অনীতাদের পরিবারের চেয়েও উদার, স্বাধীনচেতা রঙিনদের বাড়ি। রঙিনের বড়দা ইংল্যান্ডে থাকেন, ওদেশিই বিয়ে করেছেন। রঙিন আর ওর বোন সুবচনী একেবারে নিজেদের নিয়ে থাকে। ওদের মা-বাবা দুজনেই বড় চাকরি করেন। তাঁদের ছেলে-মেয়েদের বন্ধু বান্ধবের ব্যাপারে মাথা গলাবার অত সময়ই নেই। তবু, কল্পনা করতে পারি, যদি ওঁরা জিজ্ঞেস করতেন, সব সব কিছু আমি ওদেরও বলতে পারতাম না।
এখন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দুপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকালে আমার মনে হয় প্রত্যেকটা একটা দুর্গ, একটা আলাদা দুনিয়া। নিয়মকানুন, বোধ-বুদ্ধি-অনুভূতি, আবহাওয়া সব আলাদা। এ সব জায়গা থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে একই সঙ্গে আমার একটা স্বস্তিও হয়। আবার খেদও হয়। স্বস্তির কারণটা বোঝা শক্ত নয়। জলের মাছ জলে ফিরলে স্বস্তি তো হবেই। কিন্তু খেদ কেন? স্বাভাবিক সাধারণ একটা পরিবারে জন্মাইনি বলেই কি খেদ? আপাতদৃষ্টিতে তো আমাদের পরিবারের অস্বাভাবিক কিছু নেই! কত ছেলে-মেয়েই তো মামার বাড়িতে মানুষ হয়। আসল কথা, ওপরের মাটি খুঁড়তে গেলেই, ভেতরকার জলকাদাওলা নরম মাটি বেরিয়ে পড়ে। যেমন আজ। দিয়ার এই কান্না, এই খেদোক্তি যে সে দাদার উপযুক্ত ছিল না, ভালবাসার কথা বলা তার সাজে না, আমার শরীরে তার রক্ত বইছে বলে আক্ষেপ, এ সব কেন? দিয়া আমার কাছ থেকে লুকোতে পারবে না, এর পেছনে কোনও গোপন কারণ আছে।
রহস্যভেদ করার জন্যে যতটা কৌতূহল থাকা দরকার, ততটা যেন আমার আর নেই। যত মাটি খুঁড়ছি জট বেরিয়ে পড়ছে, আরও জট, আরও জট। খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে কী সেই রক্তের অভিশাপ যা আমাকে শুধু শুধুই বহন করতে হবে। কেন মাঝে মাঝেই শুনতে হবে রক্ত তুলে এই তিরস্কার?
আমি চলে যেতে চাই। এই বাড়ি, এই ঘর ছেড়ে। এইসব আসবাব ছবি এখন যেন আমার বিষ মনে হচ্ছে। কী করে লোকে সারা জীবন এক বাড়িতে থাকে? আমি যদি কখনও চাকরি করি, এমন চাকরি করব যাতে আমাকে অনবরত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলি হতে হয়।
সাত
বিকেল হয়ে এসেছে। রোদটা আর নেই। কিন্তু রোদের আভাটা এখনও আছে। ডিসেম্বর মাস, অথচ শীতের কোনও কামড়ই নেই। এই রকম বিকেলের দিকটায় উত্তুরে হাওয়ার কতকগুলো ঝাপটা আসে। তাইতে একটু অস্বস্তি লাগে এই পর্যন্ত। সেটাকে শীত বলা যায় না। স্টিফেনকে দেখলে অবশ্য সেটা বোঝা যাবে না। ওকে দেখলে মনে হবে দেশটা নরওয়ে কি সুইডেন, রীতিমতো বরফ পড়ছে। একটা পাঁশুটে রঙের ফুলপ্যান্ট পরেছে স্টিফেন, গায়ে চাপিয়েছে একটা ওভারকোট। চেহারা দেখলে মনে হয় জিনিসটা কম্বলের। ওর টাক মাথায় একটা মাঙ্কি ক্যাপ। ক্যাপটা ও সারা শীতকাল মাথা থেকে নামায় না। নামালেই নাকি ওর জ্বর এসে যাবে। দেখি খুব অনিচ্ছুক মুখে ও উঠোনের কলের মুখে রবারের পাইপটা লাগাচ্ছে।
আমি বললাম— দাও, দাও আমি জল দিয়ে দিচ্ছি।
—তুমি তো একটু আগেই কলেজ থেকে এলে বেবি, টিফিন খেয়েছ?
—দেখো স্টিফেন— আমি বিরক্ত হয়ে বলি— যতই বলো, আমি কিন্তু আর বেবি নেই। টিফিন-ফিফিন খাই না, বুঝলে? দাও দিকি পাইপটা।
গজগজ করতে করতে পাইপটা আমার হাতে তুলে দিল ও। আসলে কিন্তু, বেশ খুশি হয়েছে। জল দিতে গিয়ে একটু আধটু জল তো হাতে পায়ে লাগেই। সেইটা থেকে বেঁচে গেল!
মনে হল দরজাটা কেউ ধাক্কাচ্ছে।
—কে দেখো তো স্টিফেন।
—কে আবার, কেউ না।
—বলছি, কেউ।
স্টিফেন বলল— বেল আছে তো, কেউ এলে বেল বাজাবে।
কলটা বন্ধ করে দিয়ে পাইপটা নামিয়ে রাখি আমি। দরজাটা খুলে দিতে যাই। বিরাট দরজা। তার ওপরে আবার দুটো খিল। একটা কাঠের, একটা লোহার। স্টিফেনের বোধহয় কষ্ট হয় আজকাল এত ভারী খিল খুলতে, তাই অত টালবাহানা।
দরজা খুলে আমি অবাক। সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে। —রাগে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেছে।
—কী চাও? রুক্ষ, কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করি।
—একটা কথা— ছেলেটা ইতস্তত করে বলল… অনেক দিন ধরে…মানে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবছি…তাই… আচ্ছা তুমি ইরাবতী রায় বলে কাউকে চেনো?
আমি হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। বলে কী? পাগল, না কী?
বেশ কিছুক্ষণ পরে বলতে পারলাম—
—কেন? কেন বলো তো।
—চেনো কি না বলো না, নিশ্চয় চেনো, তাই না?
ছেলেটার মুখটা লালচে হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো…কী বলব… ভীষণ কাতর…।
আমি বললাম— ইরাবতী রায় আমার মা। ওঁকে দিয়ে তোমার কী দরকার?
ছেলেটার মুখটা সাদা হয়ে গেছে, সে কোনওমতে বলল— দরকার? নাঃ। দরকার আর কী? উনি আমারও মা।
আমরা দুজনে দুজনের দিকে গবেটের মতো চেয়ে রইলাম।
শেষকালে আমি জিজ্ঞেস করলাম— তুমি কোথায় থাকো?
—রাধানগর।
—বাবা?
—রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়।
আমি ডাকলাম—স্টিফে—ন! —আমার এখন ভীষণ শীত করছে।
স্টিফেন এলে বললাম— একে দিয়ার কাছে নিয়ে যাও। বলবে রাধানগর থেকে রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের ছেলে দেখা করতে এসেছে। বলতে বলতে আমার ভেতর থেকে কেমন একটা কাঁপুনি আসতে লাগল।
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বলল— দিয়া কে? আমি তাঁকে চিনি না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করিয়ে দেবে? একবার একটু দেখা করেই আমি চলে যাব। মাকে বলবে— মন্দার এসেছে।
—তোমার নাম মন্দার? মন্দার রায়?
—হ্যাঁ, তোমার?
—মন্দাকিনী। মন্দাকিনী রায়। দিয়া আমার দিদিমা। মা এখানে নেই। থাকে না। কেটে কেটে বললাম।
স্টিফেনের পেছন পেছন খুব দ্বিধাগ্রস্তভাবে ও আস্তে আস্তে ওপরে উঠে গেল।
এ আমার ভাই? মন্দার-মন্দাকিনী। বেশ মিলিয়ে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছে তো? অথচ ও খুঁজছে ওর হারানো মা-কে। আর আমি আমার বাবা রাজেন্দ্রনারায়ণকে এখনও পর্যন্ত চোখেই দেখিনি! ওর কথা আমাকে বলা হয়নি কেন? ছোটবেলায় মা মাঝে মাঝে রাধানগর যেত। প্রত্যেকবার আমি বায়না ধরতাম সঙ্গে যাব বলে, বাবাকে দেখবার ভীষণ লোভ ছিল আমার, প্রত্যেকবার মা ভয় দেখাত ওখানে গেলে আমাকে আটকে রেখে দেবে, আর আসতে দেবে না। রাগে আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। আমি নীচের পুরনো ড্রয়িংরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
শুনতে পাচ্ছি— খালেদা ডাকছে বুলা-আ-বুলা-আ! বুলাবাবা!
স্টিফেন বোধহয় দরজায় খটখট করে আওয়াজ করছে। আমি সাড়া দেব না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে আমার অস্তিত্বের কথাও ও জানত না। কেন? কেন? দুই ভাইবোনের কাছে দুজনের অস্তিত্বের কথা গোপন করে কী মোক্ষলাভ হয়েছে এদের? হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা কথা মনে হল। আমরা দুজনে একই ক্লাসে পড়ি, তার মানে খুব সম্ভব আমাদের একই বয়স। এক বয়সের দুই ভাইবোন হয়? হতে পারে, যদি যমজ হয়। তবে কি আমরা যমজ? কিন্তু আমাদের মধ্যে সাধারণ ভাই-বোনেদের ভেতর যে চেহারার মিল থাকে সেটুকুও তো নেই! যদি যমজ হই, বা যদি আমাদের এক বয়স না হয়, তা হলে ঠিক আছে। কিন্তু বয়স যদি এক হয়, তা হলে আমরা ভাইবোন হতে পারি না। একজনকে মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে। কে সে? কেন এত মিথ্যে?
মাকে এখন যদি সামনে পেতাম, আঁচড়ে কামড়ে মেরে ধরে শেষ করে দিতাম একেবারে।
আট – মন্দারের কথা
ময়লাটে সন্ধেটা শেষ হয়ে আসছে এখন। এইবারে কালচে রাত শুরু হবে। আমি তাড়াতাড়ি পা চালাই। চাপা শীত এখন, ধোঁয়া। এটা কি রাধানগর? রাধানগরের রাস্তা দিয়েই তো আমি চলেছি। উজ্জ্বল আকাশে একটা রুপোর চাঁদ ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। উত্তুরে হাওয়া বইছে। মাঠের মধ্যে জায়গায় জায়গায় একটা করে ধোঁয়ার শিষ, হয়তো আগাছা পোড়াচ্ছে চাষিরা, হয়তো গোয়ালে ভিজে খড় জ্বালানো হয়েছে। সেই ধোঁয়াই ছড়িয়ে পড়ছে গোটা রাধানগরে, ঢেকে দিচ্ছে এক রহস্যের গুণ্ঠনে ওখানকার বাড়িঘরদোর গাছপালা, মন্দির, মন্দিরটাও। শাঁখের আওয়াজ খোলা আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর বাড়ি থেকে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ আসছে। ঢঙ্ ঢঙ্ ঢঙ্ ঢঙ্ ঢঙ্ ঢঙ্।
ধাক্কা লেগে গেছে কার সঙ্গে।
—দেখতে পাও না? আচ্ছা তো! বিরক্তি প্রকাশ করে লোকটি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় দেখছে কানা-টানা কি না।
আরে! এ তো কলকাতার রাস্তা! রাধানগরে তো আমার কোনও পরিচয় ছিল না। তবু কেন রাধানগরে ফিরে যাচ্ছি বারবার? এ শহরে আমি আরও অপরিচিত, অজ্ঞাতকুলশীল, এ শহর কাউকে রেয়াত করছে না। কিন্তু তবু এ শহর আমাকে আমার নিজের মতো করে একটা অনুসন্ধানের সুযোগ দিয়েছে। এক ভীষণ জরুরি অনুসন্ধান। কে জানে হয়তো তদন্তও। যে ভাবে আমি মায়ের ঠিকানা পেলাম, তা রূপকথার চেয়েও অদ্ভুত। রোমাঞ্চকর।
জুলাই, অগস্ট, সেপ্টেম্বর তিনটে মাস কাটল আশ্রয়ের সন্ধানে। কোথাও জায়গা পাই না। হস্টেলে শুনলাম এখন যারা পার্ট-টু দেবে তাদের পরীক্ষার পর কিছু সিট খালি হতে পারে। এখন কোনও আশাই নেই। ওয়েটিং লিস্টে নামটা তোলালাম অনেক কষ্টে, তাও শিশিরদা ছিলেন বলে সম্ভব হল। সে সময়টা ছিলাম শিয়ালদার একটা বাসা বাড়িতে, শিশিরদার বন্ধু রাখালবাবুর ঘরে গেস্ট হয়ে। আমার অবস্থা দেখে উনিই বললেন—কদিন তো থাকলে এ ঘরে। যদি খুব অপছন্দ না হয় থেকে যেতে পারো যতদিন প্রয়োজন। আমার যা সিটরেন্ট লাগে তার হাফ দিয়ে দেবে। বাস। আমিও সেমি-অভিভাবক রইলুম। কী বলো শিশির।
আমার তো এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। হাতে চাঁদ পেলাম।
খাওয়া-দাওয়া পড়াশোনার তখন দারুণ অসুবিধা। ওই বাসাবাড়িতে তো আর কোনও রান্না-টান্নার ব্যবস্থা নেই! রাখালবাবুর দুপুরের খাওয়াটা বোধহয় অফিস-ক্যান্টিনে হয়। কিন্তু আমার সকালবেলায় চা পাঁউরুটির পর আর বিশেষ কিছু খাওয়াই হয় না। চা খেতাম না, পাঁউরুটিও কোনওদিন খাইনি, কিন্তু অন্য জিনিসগুলো আরও বিশ্রী। দোকানের ভাতে, মাছ, পেঁয়াজ-রসুনের আঁশটে উগ্র গন্ধ পাই, চারদিকে নোংরা। বেশির ভাগ সময়েই পালিয়ে আসতে পথ পাই না। কলেজ ক্যান্টিনে ঘুগনি কি সিঙ্গাড়া, ছুটির পর দোকানে গিয়ে মিষ্টি খেয়ে কাটিয়ে দিই। ও সবে কি আর পেট ভরে? কিন্তু কী করা যাবে? আমি হন্যে হয়ে নিরামিষ ভাতের হোটেল খুঁজি, কোন দোকানে একটু দুধ পাওয়া যাবে খোঁজ করি, আর ফলটল খেয়ে পেটে কিল মেরে বসে থাকি। তা ছাড়া রয়েছে এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিং-এ ছোটাছুটি করে ক্লাস করা, অজস্র ছেলে-মেয়ের ভিড়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। মায়ের খোঁজ করবার সময়ই পাইনি। সত্যি কথা বলতে কী মনেও ছিল না। অক্টোবরের প্রথমে পুজো, তখন বাড়ি গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা হল না। পরে নভেম্বরে রাসপূর্ণিমার সময়েও গেলাম, সে সময়ে বাবা ছিল বটে, কিন্তু রাত্রে এসে স্রেফ শুয়ে পড়ত। তখন বাবাকে ডেকে মায়ের ঠিকানা জিজ্ঞেস করা আমার সাহসেই কুলোত না। মায়ের কথাবার্তা, গল্প-গাছার পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বার হল কয়েকটা সূত্র— মা কোথা থেকে খেলনা এনেছ? —নিউ মার্কেট। নিউ মার্কেট কোথায়? —আমাদের বাড়ি থেকে কাছেই। এইসব সুন্দর সুন্দর ছবি কোথায় পেলে? —পার্ক স্ট্রিট। সেটা কোথায়? আমাদের বাড়ির কাছেই। এ ছাড়া— এলিট সিনেমায় মা ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ ছবি দেখেছিল, সেই গল্প আমি মুগ্ধ হয়ে শুনেছি, ‘লোটাস’ সিনেমাতে মা ‘কিংকং’ দেখেছিল, সে-ও আর এক রোমাঞ্চকর গল্প। এ হলটাও মায়ের বাড়ির কাছে। মা পড়ত সিস্টার নিবেদিতার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে, সেটা কিন্তু মায়ের বাড়ি থেকে বেশ দূর।
এই সূত্রগুলো থেকে আমি একটা ম্যাপ আঁকতে চেষ্টা করি। এলিট থেকে লোটাস, লিন্ডসে থেকে পার্ক স্ট্রিট, ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম, যদি মাকে হঠাৎ দেখা যায়! মা তো চাকরি করে, বেরোবে নিশ্চয়ই। এই অসম্ভবের অভিযান আমার হয়তো সারা জীবন ধরেই চলত, যদি না একদিন মাকে সত্যিই দেখতে পেয়ে যেতাম। দেখতে পেলাম, পার্ক স্ট্রিট বা লোটাস সিনেমার পাশে নয়, একেবারে আমার কলেজের মাঝ মধ্যিখানে।
সেদিন আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল প্রায় ছুটছিলাম কলেজের করিডর ধরে। হঠাৎ দেখি সামনে খানিক দূরে মা চলেছে কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে। ফুল ফুল ছাপ সিল্কের শাড়ি। পায়ে তেমনি পা-ঢাকা পাম্প শু’ পেছন থেকে দেখছি। বুঝতে পারছি অবশ্য ওটা মা নয়, মায়ের মতন ধরনটা। কিন্তু মেয়েটি যখন সামনে ফিরল আমি অবাক মায়ের সঙ্গে ওর মিল দেখে। মামার বাড়ির কথা আমি কিছুই তো জানি না, কিন্তু এই মেয়েটি কোনও না কোনওভাবে মামার বাড়ির পরিবারের সঙ্গে যুক্ত তো থাকতে পারে! এত মিল যখন! সেই থেকে আমি ক্রমাগত ওর পেছনে পেছনে ঘুরছি। ওর সঙ্গে আলাপ করে জানতে হবে ও আমার মাকে চেনে কি না। কিন্তু সাহসে কুলোয় না, তারকের বোন নমিতা ছাড়া আর কোনও এই বয়সের মেয়ের সঙ্গে কথা বলিনি আগে। রায় বাড়ির অল্প বড় দিদিরা আমাকে কোনওদিনই পাত্তা দেয় না। এমনকী গায়ত্রী বা তার দিদি সাবি বা সাবিত্রী আমার সমান সমান আর আমার থেকে সামান্য বড়, কিন্তু ওদের সঙ্গেও আমার কোনও কথাবার্তা হয় না। মহিলা বলতে ন’ জ্যাঠাইমা আর ফুলকাকিমা বাড়ির মধ্যে, আর বাইরে— মাসিমা, অর্থাৎ তারকের মা। এর বাইরে আমার কোনও মহিলা বা মেয়ের সঙ্গে কোনওরকম কথাবার্তারও সুযোগ হয়নি। এখানে এসে দেখছি রাশি রাশি মেয়ে। পথেঘাটে, ট্রামে-বাসে। কলেজটা তো মেয়েতে ভর্তি। ওদের কাছাকাছি হলেই আমার হাত পা পেটের ভেতর গুটিয়ে যেতে চায়। গলা শুকিয়ে যায়। কথা বলব কি? দূর থেকে আমি মায়ের মতো দেখতে মেয়েটির দিকে নজর রাখি। অন্য মেয়েদেরও দেখি। কোনও ভুল করছি না তো? হয়তো এক রকম দৈর্ঘ্য, দেহের গঠন, চুল ইত্যাদি হলেই মেয়েদের এক রকম লাগে। না, তা কিন্তু নয়, আমার মায়ের ছিল ছোট গোল করে কাটা চুল। মাথার চারপাশে চালচিত্রের মতো হয়ে থাকত। এ মেয়েটা দুটো বিনুনি করে, কখনও একটা বিনুনি। তা সত্ত্বেও ওকে দেখলেই মায়ের কথা মনে পড়বে। ওকে দেখতে দেখতে বুঝতে পারি হ্যাঁ, আমার মায়ের এইরকম একটু লম্বাটে মুখ ছিল বটে। এই রকম চেরা চেরা চোখ, পাতলা সরু নাক, ঠিক এইরকম ফুলো ফুলো ঠোঁট।
কিন্তু এত নজর করি বলে বুঝতেই পারছি মেয়েটা বিরক্ত হচ্ছে। অনেকেই বুঝতে পারছে। দু-চার বার কথা বলতে গিয়েও পিছিয়ে এলাম। এত সঙ্কোচ! কলেজে এত লোকের মাঝখানে জিজ্ঞাসাবাদ করাটাও বোধহয় ঠিক না। কী জিজ্ঞেস করব? আপনি কি আমার মায়ের কেউ হন।’ কিংবা ‘আমার মা ইরাবতী রায়কে চেনেন?’ ‘আমার মা হারিয়ে গেছেন, আপনি মনে হচ্ছে ওঁর কেউ হন, খুঁজে দেবেন, আমার মাকে?’ এই সব কিম্ভুত প্রশ্ন যদি আর কারও কানে যায়। আমাকে কি পাগল ভাববে না? একজন ছেলে তার মায়ের ঠিকানা জানে না। সুদ্ধু মুখের মিল দেখে একজন মেয়েকে ধরেছে মুশকিল আসান বলে। ভূ-ভারতে কেউ কখনও শুনেছে এমন কথা?
কলেজ নয়। অন্য কোনও জায়গায় মেয়েটাকে ধরতে হবে। কিন্তু যতবার ওর সঙ্গে বেরোই, এক ট্রামে বা বাসে উঠি, ও উল্টোপাল্টা জায়গায় নেমে পড়ে। বোধহয় ভয় পেয়েছে। অন্য রকম কিছু ভাবছে।
ইতিমধ্যে রাখালবাবুর ওখানে অবস্থা ঘোরালো হয়ে উঠেছে। উনি শিশিরদার কী রকম বন্ধু কে জানে! আমার ওপর রীতিমতো অত্যাচার শুরু করেছেন। যখন-তখন সিগারেট, পান, আনতে দেবেন। আমাকে দেখলেই ওঁকে ফরমাশে পায়। আমরা দুজনেই সকালে জলখাবার খেতে দোকানে যেতাম। উনি এক দিন বললেন- ‘আমারটা একটু নিয়ে আসবে মন্দার, শরীরটা ভাল লাগছে না।’
আমি যত্ন করে ওঁর জন্যে পাঁউরুটি মাখন, তার ওপর পুরু করে চিনি ছড়িয়ে রুমালে করে স্টিলের গরম গ্লাসের চা কোনও মতে ধরে নিয়ে এলাম। বাস, তারপর থেকে ওঁর সকালের জলখাবার নিয়ে আসাও আমার ডিউটি হয়ে গেছে। একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়মের কেটলি কিনেছেন। তাইতে করে আমি চা এনে দিই। উনি বিছানায় বসে তারিয়ে তারিয়ে খান। রাত্তিরের খাবারটাও আমাকে আনতে হচ্ছে। প্রায়ই উনি রুটি-মাংস খান। মাংসের গন্ধে আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে। তার পরে কালী মার্কা বোতল খুলে বিকট গন্ধঅলা মদ খান উনি। খেয়ে বেসামাল হয়ে যান, যা-তা কথা বলেন। এ সব ভাষা আমি আগে কখনও শুনিনি। এক ঢোঁক খাবেন, শয়তানি ভরা চোখে আমার দিকে পিটপিট করে চাইবেন আর বলবেন—কী ভাবছ ছোকরা? তোমার শিশিরদাকে বলে দেবে? তা শিশিরদা তোমার পদ্মপত্রে এক ফোঁটা শিশির বই তো নয়। কত গুণ জানো না তো আর! আমার মতো চারটে মাতালকে ও একা জব্দ করে দিতে পারে!
এ বাসাবাড়িতে ফেরবার পর সমস্ত সময়টা আমার কাটে বিভীষিকার মতো। পড়াশোনা তো দূরের কথা। একটু নিশ্চিন্তে নিজের মনে থাকতে পর্যন্ত পাই না। অথচ এমন তো হবার কথা নয়!
এইচ. এস. পাস করবার পর মনে হয়েছিল জীবনের একটা পর্ব আমার শেষ হয়ে গেল। অন্ধকার পর্ব। এবার হয়তো অন্যরকম দিনকাল শুরু হবে। তারকের বাবা প্রায়ই বলতেন কথাটা— ‘অ্যায়সা দিন নহি রহেগা। চিরকাল কখনও কারও এক রকম যায় না, খারাপ সময়টা আগে কেটে যাওয়া ভাল।’ পরীক্ষার ফল বেরোল। তারক হুগলিতে পড়তে যাবে। আরও কয়েকজন যাবে হুগলিতে। চন্দননগর, শ্রীরামপুরেও অ্যাপ্লাই করছে ওরা। কোথায় হবে তা তো বলা যায় না। হেড সার আমাকে বললেন— ‘কলকাতা চলে যাও মন্দার। আমি যতদূর জানি তোমার টাকা পয়সার অসুবিধে হবে না। তবে আর কী? বড় শহরে না গেলে চোখ খোলে না।’
শিশিরদা ইশারা করে আমায় ডেকে নিলেন স্কুলের মাঠে।
—তোমার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে মন্দার?
—না শিশিরদা, বাবা তো বাড়িতেই নেই। —আমার মুখ শুকিয়ে গেছে। শিশিরদার বোধ হয় দয়া হল। উনি বললেন— ঠিক আছে আমি আপাতত, যা লাগবে দিয়ে দিচ্ছি। ভর্তিটা তো হয়ে নাও। মার্ক শীট বেরোনো পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করা তো যায়ই।
সেদিন সন্ধেবেলাতেই পঞ্চা এসে বলে গেল— বড় জ্যাঠামশাই নাকি আমাকে ডেকেছেন। আমাকে ডেকেছেন? বড় জ্যাঠামশাই? আশ্চর্য! পঞ্চাও আমার সঙ্গেই পাস করেছিল। ওকে নাকি ইতিমধ্যেই সেরেস্তার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেজো জ্যাঠামশাইয়ের ছেলের কাছে ও কাজ শিখছে। আমাকেও কি তাই দেওয়া হবে, না কী? তেমন কিছু হলে আমাকে কিন্তু অবাধ্যতা করতে হবে। তার পরে? তার পরে নিশ্চয় রাস্তা দেখা ছাড়া আমার সামনে আর কিছু থাকবে না।
বড় জ্যাঠামশাই বসে ছিলেন ঠাকুর বাড়ির সেই ডান দিকের ঘরে। বাতি জ্বেলে কী সব লেখাপড়ার কাজই করছেন। আমি গিয়ে দাঁড়াতে, মুখ তুলে বললেন— কে? সোনা? এসো এসো।
আমি এত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে কথা বলতে পারিনি গোড়ায়। ইনি আমার নাম জানেন? আমাকে নামে চেনেন? আমি তো রাজুর ছেলে, যে রাজু ম্যাম বিয়ে করেছে!
টেবিলটা ঘুরে গিয়ে আমি ওঁকে প্রণাম করলাম। উনি উঠে দাঁড়িয়ে আমার মাথার ওপর হাত রাখলেন, বললেন।
হরের্নাম, হরের্নাম, হরের্নামৈব কেবলং।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।।
উনি এভাবে আশীর্বাদ করেন কেন কে জানে!
—তুমি তো এবার পাশ করলে? কী করবে ঠিক করলে?
—পড়ব, কলকাতায়।।
—‘বেশ’, উনি কথা না বার্তা না একটা সোনার হার আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। তাতে একটা মাদুলি গাঁথা, বললেন— এটা পরে থাকবে, বুঝলে বাবা?—তা কী পড়বে?
—সায়েন্স।
—ভর্তি হতে তো তোমায় কলকাতায় যেতে হয় তা হলে? যে কোনও কলেজে ভর্তি হলেও চলবে না, হস্টেল চাই। তোমাদের কোনও দাদাকে বলি তা হলে। কবে যেতে চাও?
আমি বললাম— মার্ক শীট বেরোলেই যেতে হবে। শিশিরদা নিয়ে যাবেন বলেছেন।
—শিশিরদা কে?
—আমাদের স্কুলের মাস্টার মশায়
—ভাল। দেখো তো এটা পছন্দ হয় কি না!
উনি একটা লম্বাটে বাক্স আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। দেখি স্টিল ব্যান্ডের কালো ডায়ালের একটা চমৎকার ঘড়ি। বেশ দামি মনে হয়।
—পরের পরীক্ষাগুলোতে তোমার কাজে লাগবে।
উনি কী করে জানলেন? পরীক্ষার সময়ে একটা ঘড়ির অভাবে কী কষ্টটাই পেয়েছি আমি। মুখ ফুটে বাবাকে বলেছিলাম, বাবা কোনও জবাবই দেয়নি! আমাদের এ বাড়ির পঞ্চা, সত্য, গায়ত্রী, আমার বন্ধু তারকের পর্যন্ত ঘড়ি আছে। আমি একাই খালি পনেরো মিনিট, আধ ঘণ্টা অন্তর সময়ের জন্য একে ওকে তাকে বিরক্ত করেছি। জ্যাঠামশাই বললেন, এখন তোমায় হাজার পাঁচেক দিচ্ছি। ভর্তি হয়ে এসো। বই পত্র কেনো, জামা কাপড় যা লাগে। এখন গিয়ে তোমার আর শিশির মাস্টারের কোথাও উঠতেও তো হবে! তারপর রেগুলার কলেজ শুরু হয়ে গেলে একটা মাসোহারার বন্দোবস্ত করে দেব। তখন একটা হিসেব দাখিল করতে হবে সেরেস্তায়। মানে এক্সট্রা কিছু লাগলে।
আমি বললাম— তখন না হয় আমি ট্যুইশনি করে… মানে নিজের খরচ নিজে…
জ্যাঠামশাই একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, বললেন তোমার মুখে এ কথা শুনে খুশি হলাম সোনা। এখানে তো সব সেই যাকে বলে— কাঁচা টাকা আর পাকা অন্ন এই দুইয়ে মতিচ্ছন্ন।
কিন্তু এ সব কৃচ্ছ্র শুধু শুধু করবে কেন? তোমার পড়াশোনার খরচ তো সব এস্টেটের! রাধামাধবের সন্তান তুমি। খুব ভাল মানুষ হবার চেষ্টা করো। ভালও আবার কৃতীও। আমরা তো তোমার তেমন দেখাশুনো কিছু করতে পারব না। নিজেই নিজেকে বাঁচিয়ে বর্তে রাখতে হবে তোমায়। গর্তে পড়ে যেও না। আর দেখো, সায়েন্স পড়বে ঠিক করেছ। তেমন বুঝেছ, নিশ্চয় পড়বে। কিন্তু এস্টেটের তোমার কাছে আর্জি সময় মতো আইনটা পড়ে নিও। আইনটা পড়া থাকলে আমরা তোমার কাছ থেকে অনেক সাহায্য পাব।
তা এর পরে বাবাও আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। নিজের ট্রাঙ্ক থেকে বাবা বালি-কাগজের খামে মুড়ে হাজার টাকা বার করেছিল। আমি যখন বললাম— লাগবে না, বড় জ্যাঠামশাই দিয়েছেন, তখন বাবা একেবারে হতভম্ব হয়ে যায়।
বাবাকে ঘড়িটা দেখালাম। বাবার টাকা ছিল অথচ বাবা জিনিসটা আমায় দেয়নি। ঘড়িটা দেখল বাবা। কিছু বলল না। হারটা খালি আমি দেখালাম না। আমার মন বলল— এটা উপহার নয়, এটা কোনও সম্মান, সম্মানটা পেয়েছি আমি বাবাকে টপকে। দেখলে হয়তো বাবা দুঃখ পাবে। বাবা আমার সুখ দুঃখের কথা না ভাবলেও আমি বাবার সুখ দুঃখের কথা ভেবে থাকি।
তা বাবা পরদিন ভোরে সেই যে বেরিয়ে গেল, তিন দিনের মধ্যে আর ফিরল না।
আমার পছন্দমতো কলেজে ভর্তি হতে পারলাম কই? হস্টেল তো দূরস্থান। রেকমেন্ডেশন ছাড়া ও সব না কি হয় না। আমরা কি অতশত জানি? শেষ পর্যন্ত রাখালবাবুর ঘর!
আজ কলেজে যাইনি। রথী আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল এনটালিতে। খাওয়াবে বলে। রথীই একমাত্র ছেলে যার সঙ্গে আমার একটু ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। ও কিন্তু আমার সেকশনে পড়ে না। আমার পিওর সায়েন্স। ও ফিজিওলজি নিয়ে পড়ছে। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় কেমিস্ট্রি ক্লাসে।
একদিন কলেজের কাছাকাছি একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকেছি, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করছি ‘আপনাদের এখানে দুধ পাওয়া যায়?’ দুধের অভাবে আমার এত কষ্ট হচ্ছে যে বলার নয়। দোকানদার জবাবই দেয় না। এখানে এই কলকাতায় এইটা খুব দেখছি। বেশির ভাগ দোকানেই দোকানি ক্রেতার কথার জবাব দেয় না। তা, আমার পাশ থেকে কেউ বলে উঠল—‘যারা দুধ রাখে তারা কিন্তু একটা নোটিসও টাঙিয়ে রাখে।’ দেখি একটি চেনা ছেলে। চিনি কিন্তু নাম জানি না।
ও বলল— আমার নাম রথী, রথী দাশ।
—আমি মন্দার রায়।
—এখনও দুগ্ধ পোষ্য আছ? না না লজ্জা পাবার কিছু নেই। আমিও তোমার দলে। আসলে আমরা নিরামিষাশী তো, দুধ ছাড়া থাকতে পারি না।
ও-ও নিরামিষাশী জেনে ওর সঙ্গে আমার একটু ঘনিষ্ঠতাই হয়ে গেল। কথায় কথায় আমার খাওয়া-দাওয়ার কষ্টের কথা ও জেনে গিয়েছিল। ও-ই আমাকে দু-চারটে দোকান দেখিয়ে দেয় যেখানে দুধ ছানা ইত্যাদি পাওয়া যায়। আজ ও আমাকে খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিল। অনেকবার না-না করলাম ও শুনল না।
অনেক দিন পর রথীদের বাড়ি খুব ভাল করে পেট ভরে খেলাম। ওর মা, ঠাকুমা, এঁরা বসে আমাদের খাওয়ালেন। এগুলো অবশ্য আমার অভ্যাস নেই। কিন্তু ওঁরা তো ছাড়বেন না। তবে সুখের বিষয়, বাবা-মা সম্পর্কে তেমন কোনও কৌতূহল ওঁরা দেখাননি। ধরেই নিয়েছেন সকলেই রাধানগরে থাকেন। ওখানকার ঠাকুরবাড়ির ছেলে শুনে আমার খাতির বেড়ে গেল।
রথীদের বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। রথীও আমার সঙ্গে আছে। হঠাৎ ও বলল— দেখো ট্রামে ওই মেয়েটি বসে আছে, ও আমাদের সঙ্গে পড়ে। ট্রামের দিকে চেয়ে আমি জানলার পাশে মায়ের মতো দেখতে মেয়েটির মুখটা দেখতে পেলাম। ও কারও সঙ্গে কথা বলছিল। সে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
তারপরেই রথী বলল— এ মেয়েটা এলিয়ট রোডে থাকে। একটা দোতলা লাল বাড়ি আছে, বারান্দায় অনেক ফুল, সেই বাড়িটা থেকে ওকে বেরোতে দেখেছি। আলাপ করলে হয়। তবে বড্ড ডেঁটো। ফর্সা-টর্সা হলেই ডেঁটো হয় মেয়েগুলো। আমি তখন ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত। উল্টো দিকের স্টপে গিয়ে দাঁড়াই। বাস ট্রাম সব ভীষণ ভিড়। কিন্তু রথীকে কাটাতে হবে।
তাই ভীষণ ভিড় একটা ট্রামে কোনও রকমে উঠে পড়ি, অন্য যাত্রীদের গালাগাল খেতে খেতে। একটা স্টপ গিয়েই নেমে পড়ি। রাস্তা-ঘাট আমি তেমন কিছু চিনি না। সহজেই সব গুলিয়ে যায়। তবু সামনে যে গলিটা পেলাম ঢুকে পড়লাম। সার্কুলার রোড দিয়ে গেলে যদি রথীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! সরু রাস্তাটা। নাম দেখি রিপণ স্ট্রিট। দোকানে-দোকানে জিজ্ঞেস করতে করতে এ মোড় ও মোড় ঘুরে এলিয়ট রোডে পৌঁছই। এবার বারান্দায় ফুলঅলা লাল বাড়ি। প্রচণ্ড নার্ভাস লাগছে। যদি পাই, আমি হয়তো মায়ের খুব, খুব কাছে এসে যাব, হয়তো। মায়ের কাছে এসে যাওয়া মানে অনেক প্রশ্ন, অনেক অনেক কৈফিয়ত। আর যদি না পাই? যদি সবটাই একটা মরীচিকার পেছনে দৌড়োনো হয়, তা হলে ওই ডাঁটিয়াল মেয়েটিকে কৈফিয়ত দিতে দিতে আমার প্রাণ যাবে। ও বিশ্বাসই করবে না, মায়ের সঙ্গে মিল দেখে ওর পিছু নিয়েছি আমি। কারও মা এরকম ভাবে নি-পাত্তা হয়ে যায় জীবন থেকে সে কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? এ জায়গাগুলো আমার সম্পূর্ণ অজানা, এ পাড়ার ছেলেদের হাতে বেধড়ক পিটুনি খাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এবং তার পরেও আছে আবার অনুসন্ধান, আবার আরেকটা জীবন লেগে যাবে হয়তো তাতে।
এই সময়েই আমার চোখ ঝলসে গেল হলুদ আলোর বন্যায়। কত ফুল? সূর্যমুখী, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, কসমস, কত? সমস্ত হলুদ রং। কী সুন্দর! কী অপূর্ব সুন্দর!
নয়
ওর কথায় অবিশ্বাস করবার কিছুই নেই। ও যে মায়ের মেয়ে সেটা ওর চেহারায় সীলমোহর করে দেগে দেওয়া আছে। মন্দাকিনী। আমার বোন। অজানাকে খুঁজতে এসে একটা পুরো রত্নভাণ্ডার যেন কেউ খুলে দিয়েছে আমার সামনে। বোন… দিদিমা… মা… মামার বাড়ি। আমি একটা অচিন্ত্যপূর্ব পারিবারিক উষ্ণতার মধ্যে ঢুকে পড়ছি। কী রকম হবেন আমার দিদিমা? আমার অর্ধেক প্রশ্নের উত্তর তো উনিই দিয়ে দিতে পারবেন।
সামনেই, সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ ইংল্যান্ডের কোনও রানির ছবি। এঁরা কি খুব ইংরেজ-ভক্ত? আমি কিন্তু ভক্তি করি মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ এঁদের, নেতাজির মতো আত্মত্যাগ করতে আমার খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু কার জন্যে করব, এখন তো ভারতবর্ষ আর পরাধীন নেই।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা চওড়া চৌকো মতো জায়গা। একটা গোল শ্বেতপাথরের টেবিল সেখানে, চারদিকে চারটে কাঠের চেয়ার। টেবিলটার ওপর একটা বিরাট খিলির মতো শেডওয়ালা আলো, ওপর থেকে ঝুলছে। বাঁ দিকে সাদা গ্রিল ঢাকা বারান্দা আর ডান দিকে ভারী ভারী পর্দা ঢাকা ঘর। কোথা থেকে গুনগুন স্বরে গান ভেসে আসছে…
আমি মথুরা নগরে প্রতি ঘরে ঘরে
যাইব যোগিনী হয়ে!
রেডিয়োতে হচ্ছে না কি? এখানে এলিয়ট রোডের এই সাহেবি বাড়িতে কীর্তন? বারান্দার শেষ ঘরটার সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে লোকটি পর্দা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে গেল। কী যেন নাম ওর? স্টিফেন।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শীতের বিকেলেও ঘামছি আমি। খুব নার্ভাস লাগছে। উনি কি আমার সঙ্গে দেখা করবেন না?
ওই যে স্টিফেন বেরিয়ে আসছে।
—আসুন।—পর্দা সরিয়ে ধরল লোকটি। ঘরটা বাইরে থেকে এসে অন্ধকার লাগছে। স্টিফেন আলো জ্বালিয়ে দিল। ঢুকে ডান দিকে ঘুরে দেখি একটা আরাম চেয়ারে একজন মেম সাহেব বসে আছেন। একটা ঘিয়ে ঘিয়ে রঙের সিল্কের গাউন পরে, ধবধবে ফর্সা একজন সত্যি মেম সাহেব, মাথায় চুড়ো করে রাখা লাল চুল। মেম সাহেবের নাকে হিরের নাকছাবি, কানেও জ্বলজ্বল করছে হিরে। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মতো কিছুর মালা। হাতে সোনার চুড়ি।
এরকম কোনও মানুষ আমি জীবনে এই প্রথম দেখলাম। মা আমাকে যে সব বই কিনে দিয়েছে— অ্যান্ডারসেন, গ্রীম ব্রাদার্সের রূপকথা, গ্রিস আর রোমের গল্প… সেই সব বইয়ে এইরকম মানুষের ছবি দেখেছি। এই বয়স, চেহারা, এই রকম পোশাক…। তবে তাঁদের নাকে নাকছাবি ছিল না। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
—তুমিই মন্দার? রাধানগর থেকে আসছ?
পরিষ্কার বাংলায় বললেন উনি। তখনই আমি বুঝতে পারলাম উনিই গান করছিলেন। এই একই গলা। আমি শুধু ঘাড় নাড়লাম।
উনি বললেন —আমি ইরাবতীর মা।
ইনি? ইনিই আমার দিদিমা? তা হলে এই জন্যেই রাধানগরে আমার মাকে মেম বলে? মেম সাহেবের মেয়ে বলে?
প্রণাম করবার জন্যে আমি নিচু হলাম। দিদিমা যখন, প্রণাম করাই তো ঠিক? যদিও আমার দিদিমা-ধারণার সঙ্গে এঁর কোনও মিলই নেই।
কালো নরম নরম চটির ওপর আমার হাত পড়ল, উনি মাথায় হাত রাখলেন। একটা মোড়া দেখিয়ে বললেন বসো।
—তোমার বাবা কেমন আছেন?
—ভাল।
—আর সবাই?
—ভাল। —যেন গতানুগতিক কুশল বিনিময়ের সময় এটা।
—এখানকার ঠিকানা কে দিলেন, তোমার বাবার কাছ থেকে পেলে?
হঠাৎ আমার ভেতর থেকে একটা ক্রোধ ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠে আসতে লাগল। সারা জীবন আমি অবহেলার মধ্যে মানুষ হয়েছি। নিজের লোকেরা কেউ কোনওদিন আমাকে পাত্তা দেয়নি। মা আমাকে ফেলে চলে গেছে। বাবা থেকেও নেই। যথেষ্ট ভাল ভাল মার্কস পেয়েও আমি এক নম্বর কলেজগুলোয় ভর্তি হতে পারিনি। এত বড় শহরের কোনও হস্টেলে আমার জায়গা হল না, রয়েছি একটা ইঁদুরের গর্তে, … এতটা পথ পার হয়ে এত খোঁজ খবর করে আমি আমার নিজের মায়ের সন্ধানে এসেছি। আর ইনি এখন… এঁরা তা হলে চাননি আমি এখানে আসি?
আমি উঠে দাঁড়াই। কর্কশ গলায় বলি— মায়ের কাছে এসেছিলাম জানাতে যে আমি কলকাতায় এসেছি। কলেজে ভর্তি হয়েছি। মায়ের ঠিকানাটা যদি পেতাম…। দেবার অসুবিধে থাকলে মাকে বলে দেবেন…।
আমি পেছন ফিরে চলে আসি। উনি চেরা গলায় চিৎকার করেন— কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ মন্দার! স্টিফেন ওকে আটকা। ওকে যেতে দিসনি!
আমি ফিরে বললাম—আর থেকে কী করব? মা তো নেই! আমি এ-ও জানতাম না যে আমার একজন বোন আছে।
—মন্দার বসো আগে বসো উনি কেমন হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন। যতক্ষণ না বসলাম শান্ত হলেন না। আর বসলে দেয়ালের গায়ে একটা অয়েল পেন্টিং-এর দিকে দেখিয়ে বললেন— চিনতে পারো?
ছবিটা স্যুট টাই পরা এক ভদ্রলোকের। বোধ হয় মিলিটারি অফিসার হবেন। আমি ওঁকে চিনি না।
দিদিমা বললেন— চেনো না? হাসলেন উনি, বললেন, —তোমার মায়ের বাবা, ওঁকে তোমার চেনার কথা মন্দার। না-ই বা রইল তোমার মা, তুমি আমার নাতি, ওই ওঁরও নাতি, তোমার অসুবিধে কী?
আমি বলতে পারতাম— আপনাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কই বা কী? কোনওদিন কি খোঁজ নিয়েছেন? কেমন করে বুঝব তা হলে আপনারা আমার কেউ?
—কলেজ থেকে আসছ, না?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। রথীদের বাড়ির কথা বেমালুম ভুলে গেছি।
উনি একটা বেল বাজিয়ে স্টিফেনকে ডাকলেন।
—ওর জন্যে খাবার আনো স্টিফেন। খালেদাকে বলো। মন্দার তুমি চা খাও? আমি যে সবে বাধ্য হয়ে চা খাওয়া ধরেছি সে কথা আর ওঁকে বলে কী করব! সায় দিই।
স্টিফেন চলে গেলে উনি আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে আস্তে আস্তে বললেন, বুলা হল তোমার মাসতুতো বোন, কিন্তু ও জানে যে ইরাই ওর মা।
আমি বললাম—তা হলে এখন?
উনি বললেন—এখন সত্যি কথাটা ও জানবে। জানাতে হবে, কষ্ট হবে। কিন্তু জানুক। আর তাছাড়া ইরাই তো ওকে মানুষ করেছে। আমার ছোট মেয়ে ওকে জন্ম দিয়েই মারা যায়। তোমরা দুজন মাত্র ক’দিনের তফাতে জন্মেছ। তা তুমি এখানে কোথায় উঠেছ? হস্টেলে?
আমি রাখালবাবুর বাসার কথা বললাম।
—তোমার মতো ছেলেমানুষের ও রকম লোকের সঙ্গে থাকতে অসুবিধে হয় না?
—হয়। চেষ্টা করছি মানিয়ে নিতে।
উনি প্রশ্ন করে করে আমার সব অসুবিধের কথাই জেনে নিলেন। তারপর বললেন— আমাদের এখানে, যথেষ্ট জায়গা আছে কিন্তু। তুমি থাকবে? তোমার বাবা বা রাধানগরের ওঁরা যদি আপত্তি না করেন…। তুমি যদি অন্যজাতের ছোঁয়া না খাও… তার ব্যবস্থা করে দেব।
আমি বললাম— জাত টাত আমি মানি না।
—তাহলে থাকো না এখানে। এটা তো তোমারও দাদু-দিদিমার বাড়ি?
ভীষণ লোভ হচ্ছিল তক্ষুণি রাজি হয়ে যেতে। কিন্তু নিজেকে অত সস্তা করে দেব কেন? তাই বললাম— দেখি। রাখালবাবুর সঙ্গে কথা বলে।
আমি যতক্ষণ ছিলাম মন্দাকিনীকে দেখতে পাইনি। দিদিমা আমার সঙ্গে চা খেলেন। কিন্তু মন্দাকিনী একবারও মুখটাও দেখাল না। ও আমার বোন জানবার পর আমার সব কীরকম অন্যরকম লাগছিল। ওকে আমার আর ভয় করছিল না। কোনও মেয়েকেই না। এখন যদি ও বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গে পার্টিকল্স নিয়ে আলোচনা করতে চায়, তো করব! নার্ভাস লাগার কোনও প্রশ্নই নেই!
দশ
কী রকম একটা অহঙ্কার হচ্ছিল। কীসের অহঙ্কার? আমি যেন রাস্তা দিয়ে চলছিলাম রাজার মত। রাজকুমারের মতো। কয়েক মাসের মধ্যে বিপুলা এ পৃথিবীর দুটো, অন্তত দুটো জায়গা —রাধানগর আর কলকাতা যেন চলে এসেছে আমলকীর মতো আমার হাতের মুঠোয়। আমি অনাথ-আতুর নই তো! আমার বাবা আছে, মা আছে, দিদিমা, বোন, এক মাসি … মারা গেছে তবু সে আমার আত্মীয়, ঠিক তেমনই আত্মীয় আমার দাদামশাই, দাদা, —আমার বড় জ্যাঠামশাই আছেন। এমন কী রাধামাধব, রাধামাধবের ওই মন্দির, ওই এস্টেট সে-ও আছে আমার। আর এত সব আপনজন থাকা সত্ত্বেও আমার এই আঠারো বছর বয়সে আমি এক অপরিচিত শহরে এসে নিজের তত্ত্বাবধানে নিজে থাকছি। না-খেয়ে, আধপেটা খেয়ে, প্রতিকূল পরিবেশে একজন প্রকৃত অনাথের মতো লড়াই করে বাঁচছি। এখন এই শহরের রাস্তাঘাট, এখানকার মিছিল ময়দান, এখানকার সমস্যা-সংবাদ সব নিজের উদ্যোগে, নিজের চেষ্টায় জানব, আবিষ্কার করব। বিপুল, বিরাট একটা জীবন, একটা পৃথিবী হাট হয়ে খুলে যাচ্ছে আমার সামনে। আগে যেমন মনে হত, এই পৃথিবীটাকে আমি জানি না। এই যে সব লোকে চারদিকে চলাফেরা করছে এদের আমি চিনি না, এখন সেই দেখাটাই এক মুহূর্তে যেন পাল্টে গেল। বুঝলাম—এদের না চিনলেও কোনও ক্ষতি নেই। পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গা তো আমি চিনবই না, তাতে কী? এদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক-স্থাপন হয়ে গেছে। এরা আমার কিছু-না কিছু হয়।
ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ঠিক লাফ দিয়ে দিয়ে ওঠা যায় না। কিন্তু উঠলাম খুব দ্রুত। দরজাটা আধ-ভেজানো। খুলে দেখি রাখালবাবু বিছানায় শুয়ে আছেন, একটা পায়ের ওপর আরেকটা পা, সিগারেট খাচ্ছেন। ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে গেছে।
আমাকে দেখেই উঠে বসলেন, কর্কশ গলায় বললেন—কটা বেজেছে খেয়াল আছে?
আমি হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি সাড়ে আটটার ঘর ছাড়িয়ে যাচ্ছে কাঁটা।
—দোকান-টোকান তো এবার বন্ধ হয়ে যাবে?
আমি জিজ্ঞাসু চোখে ওঁর দিকে তাকাই, — কী বলতে চায় লোকটা?
—আমার খাবার-টাবারগুলো কখন আনবে?
আমি বললাম —আমি খেয়ে এসেছি। এখন আর বেরোব না। আপনি খেয়ে আসুন না।
—তার মানে? তুই আমার খাবার আনবি না? ছিলি ঢোঁড়া, শহরের জল পড়েই হয়েছিস খরিশ। রোয়াব দেখাচ্ছিস?
রাগ নয়, হঠাৎ কেমন করুণা হল লোকটার ওপর। শিশিরবাবুর কাছে শুনেছি লোকটার কেউ নেই। হাত বাড়িয়ে বললাম —পয়সা দিন। এনে দিচ্ছি।
—যাক, তবু সুবুদ্ধি হয়েছে। পকেট থেকে কয়েকটা টাকা বার করলেন উনি। গালিগালাজটা চালিয়ে যেতে পারলেন না বলে যেন একটু বিমর্ষ।
—রুটি আর পাঁঠা, —কাঁচা পেঁয়াজ বেশি করে দিতে বলবি।
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, আবার সেই মাংস আনতে হবে? তার মানে আজ বোতলও বেরোবে!
যাই হোক, এনে দিলাম। দিয়ে বললাম—দেখুন আমি জীবনে কখনও মাংস খাইনি, ধারে কাছে কখনও রান্না হতে পর্যন্ত দেখিনি, আমার কী বিশ্রী লাগে আপনি বোঝেন না? তখনই ওঁর কয়েক ঢোঁক মদ গেলা হয়ে গেছে। বোতলটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম—এ সব খাওয়ার তো জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে খেয়ে এলেই তো পারেন! আমার মতো একজন ছাত্রের সামনে মদ খেয়ে মাতলামি করেন, লজ্জা নেই আপনার?
রাখালবাবু প্রথমটায় অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে, বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কথাগুলো আমিই বলেছি। তারপর হঠাৎ উনি উঠে এসে এক ধাক্কায় আমায় বিছানায় ফেলে দিলেন, আমার বুকের ওপর চড়ে বসে বললেন, লজ্জা? দেখাচ্ছি লজ্জা! তোর বাপের ঘরে থাকি? তোর বাপের টাকায় খাই? উনি উচ্চারণের অযোগ্য বিশ্রী-বিশ্রী কথা বলতে লাগলেন। তারপরে বললেন মাংস খাসনি কখনও? তো আজ খাবি, বলে ভাঁড় থেকে খানিকটা মাংসের ঝোল আমার মুখ ফাঁক করে ঢেলে দিলেন, বোতল থেকে খানিকটা তরল পদার্থও ঢাললেন।
আমার ডান হাতটা পিঠের তলায় চলে গেছে, প্রচণ্ড লাগছে, বাঁ হাতটা উনি নিজের বাঁ হাত দিয়ে ধরে আছেন। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে উল্টে গেলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ভেসে গেল বমিতে।
লুঙ্গি পরা অশ্লীল চেহারার লোকটা — উল্টে পড়ে আমার বাপান্ত করতে লাগল। আমি মুখটুখ ধুতে আমার গামছা সাবান, পাজামা সব নিয়ে নীচের কলঘরে চলে গেলাম। শীতকাল বলেই বোধহয় চৌবাচ্চায় তলানি জল এখনও খানিকটা আছে, চান করে ওপরে উঠে দেখি, তক্তপোষের বিছানাটা গুটিয়ে পুঁটলি মতো করে এক দিকে সরানো, আমার বিছানাটা পেতে উনি শুয়ে পড়েছেন।
—আমার বিছানায় শুলেন যে বড়? —আমি চেঁচাই।
পুরো বোতলটা খেয়ে শেষ করেছে লোকটা, ভাঁড় থেকে মাংস ফাংস চেটেপুটে খেয়েছে, চারদিকে ছড়িয়েছে। বলল–শোন গেঁয়ো ভূত কোথাকার, এ ঘরে আর তোর জায়গা হবে না। ঠিক তিন দিন সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে যা হয় ব্যবস্থা করবি।
আমার পক্ষেও এখানে এ ভাবে আর থাকা সম্ভব নয়।
সারারাত দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে কোনওমতে কাটিয়ে দিই।
পরের দিন কলেজ থেকে ফিরে এদের লেটার-বক্সে একটা চিঠি পেলাম। শিশিরদা লিখেছেন-
কল্যাণীয়েষু মন্দার,
অনেক দিন তোমার চিঠি পাই না। রাখাল অবশ্য নিয়মিত তোমার খবরাখবর দেয়। আশা করি কলেজের পড়াশোনা, আর শহরের গতিশীল জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছ। তোমার বয়সে একা থাকার অনেক বিপদ, চারদিকে প্রলোভন ছড়িয়ে আছে। অবশ্য মাঝে মাঝে মদ্যপান এমন কিছু দোষের নয়। কৌতূহলের বশে আমরাও ছাত্র-জীবনে একটু-আধটু চেখেছি। তবে, বুঝতেই পারছ জিনিসটা তোমার সহ্য হবে না। মেয়েদের থেকেও সাবধান। আর একটা কথা, রাখাল যেমন তোমাকে গাইড্যান্স দিচ্ছে, তুমিও যদি তেমন ওকে একটু আধটু সেবা করো, আমি সুখী হব। পরস্পরকে দেখাশোনার মধ্যে দিয়েই তো আমরা মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়ায় পৌঁছই। আশীর্বাদ জেনো।
শুভার্থী শিশিরদা।
ব্যাপারখানা কী? মদ্যপান? মেয়েদের থেকে সাবধান, রাখালবাবুকে সেবা … উনি নিয়মিত আমার খবরাখবর দিয়ে থাকেন? কী খবর দিয়েছেন? আমি মদ্যপান করছি? বাঃ।
বিরক্তিতে জ্বলতে জ্বলতে ওপরে উঠে দেখি ঘরটায় একটা নতুন শক্তপোক্ত তালা লাগানো। আমার চাবি তাতে লাগল না। নেমে এলাম, —উদ্দেশ্যহীনভাবে খানিকটা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম। আজ মন্দাকিনী কলেজে আসেনি। আচ্ছা, কী ভাবে ওর সঙ্গে কলেজে কথা বলব? যদি বলি, এ আমার বোন, রথী কী ভাববে? একদিন আগেও আমি বোনকে চিনতাম না? তার ওপর যদি ওদের বাড়িতে থাকতে যাই, সে-ও তো রথী জানতে পারবেই। ব্যাপারটা ওদের কাছে দুর্বোধ্য হবে। এক হিসেবে আমার ওখানে না থাকাই ভাল। মন্দাকিনীকেও আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ও বোধহয় খুব বিরক্ত হয়েছে। তারপরে যদি জানতে পারে আমিই আমার মায়ের আসল ছেলে, ওর বেশ জোরালো একটা ধাক্কা লাগবেই।
কলেজ রো চলে গেলাম। রাধাবল্লভি, ছোলার ডাল, আর সন্দেশ দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে, সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি-ফিরে দেখি তখনও তালা একই ভাবে ঝুলছে। বাইরের ছোট্ট চাতালটুকুতে বসে রইলাম। রাত সাড়ে এগারোটা বাজলে বুঝলাম রাখালবাবু আর আজকে ফিরবেন না। তালাটা উনি ইচ্ছে করেই লাগিয়ে গেছেন আমাকে জব্দ করতে। একবার নীচে গেলাম। দোতলায় তিনটে ঘরে, তিন জন ভদ্রলোক থাকেন, সব-দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর এক তলাটা তো কাপড়ের গো-ডাউন। সারা রাত অতএব চাতালটাতে মশায় আর শীতে উস্তমখুস্তম হই। সকাল হতে আবার নীচে খোঁজ নিই। কেউই কিছু জানে না। ওই ঘরে আমার যথা-সর্বস্ব। টাকা-কড়ি আমি সঙ্গে নিয়ে বেরোই না। বই-পত্র, খাতা টাতা, সব নতুন কেনা, জামাকাপড় তো বটেই, কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান হল বড় জ্যাঠামশাইদের দেওয়া সেই মাদুলিসুদ্ধ সোনার হার। যদিও উনি ওটা আমায় গলায় পরে থাকতে বলেছিলেন, দু বার ওটা চুরি যেতে-যেতে বেঁচে যাওয়ায় এখানে আর পরে থাকতে সাহস পাইনি, কলেজ বেরোবার সময়ে খুলে সুটকেসে রেখে দিতাম, এসে আবার চুপিচুপি পরে নিতাম। সমস্ত কিছু ওই ঘরের মধ্যে রয়ে গেছে। ওয়ালেট খুলে দেখি তার মধ্যে তিন টাকা নব্বই পয়সা পড়ে আছে।
সকাল এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। খালি মনে হচ্ছে আমি চলে গেলে যদি রাখালবাবু সেই ফাঁকে তালা খুলে ঢুকে পড়েন? তারপর যদি আবার তালা দিয়ে বেরিয়ে যান? কার সঙ্গে পরামর্শ করব? রথীদের বাড়ি যাব? তাই যাই। এন্টালির মোড়ে যখন পৌঁছলাম, সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে, বাসে-ট্রামে অজস্র মানুষের ভিড়। এখন তো রথী কলেজে বেরিয়ে গেছে। ও না থাকলে ওদের বাড়ি গিয়ে লাভ? আবার হাঁটছি, হাঁটছি।
—মন্দার। কে পেছন থেকে ডাকল।
মুখ ফিরিয়ে দেখি মন্দাকিনী।
—এদিকে কোথায়? কলেজ যাবে না?
মন্দাকিনী না ডাকলে আমি দিদিমার বাড়ি যেতাম না। যদি সেদিন ওভাবে আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়ে না যেত, তা হলে আমি হাঁটতে হাঁটতে আবার শেয়ালদায় ফিরে আসতাম। সন্ধে হলে আবার হাঁটতে হাঁটতে রথীদের বাড়ি আসতাম। তার পরে? হয়তো রথীর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে রাধানগরে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতাম। কিন্তু কী করে বড় জ্যাঠামশাইকে বলতাম? আর শিশিরদা? কত দিন চেনেন উনি রাখাল সরকারকে? আমাকে তো আজ সাত বছর ধরে চিনছেন খেলার মাঠে, স্কুলের ঘরে, কী করে রাখালবাবুর কথা বিশ্বাস করে নিয়ে ওরকম একটা চিঠি দিলেন আমাকে? এই যাঁর বিচার-বিবেচনা, তাঁর কাছে বিপদে পরামর্শ চাইতে যাওয়ার কী-ই বা মানে?
সব কথা আদ্যোপান্ত যে ওকে খুলে বলতে পেরেছিলাম তা-ও না। মন্দাকিনী কলেজগামী ট্রামে উঠল না, বলল—চলো আমার সঙ্গে।
এন্টালি বাজার থেকে ও একটা তালা কিনল, তারপর ফ্রিস্কুল স্ট্রিটে গেল আমাকে নিয়ে। একটা দোকানের মধ্যে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। একটু পরে একটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেকে নিয়ে কথা বলতে-বলতে বেরিয়ে এল। আমাকে বলল—মীট মাইকেল, মাই ফ্রেন্ড। —মাইকেলকে কিন্তু কিছুই বলল না আমার সম্বন্ধে। আমার হাতটা ঝাঁকিয়ে দিল মাইকেল। তার পর আরেকটা বাড়িতে গেল, রুডি, রুডি—চিৎকার করে ডাকতে লাগল মাইকেল। রুডি বলে ছেলেটি নেমে এল। এ ছেলেটি রীতিমতো ব্যায়ামবীর। ওকে একধারে ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা বলল দুজনে। তারপরে মাইকেল একটা ট্যাক্সি ডাকল।
আমার একটু একটু ভয়-ভয় করছে। মারামারি করবে, না কি? শেয়ালদার বাসা আমি চিনিয়ে নিয়ে গেলাম। সদর দরজা যেমন খোলা থাকে খোলাই। নীচের একটা গুদাম-ঘর খোলা, সেখানে কাজ করছে দুজন লোক। মন্দাকিনী বলল— এদের চেনো?
আমি তো কোনওদিন গো-ডাউন খোলাও দেখিনি। দোতলার ঘরগুলো যথারীতি বন্ধ। তিনতলায় উঠে দেখি, তালাটা একভাবে ঝুলছে। ক্ষীণভাবে আশা করেছিলাম রাখালবাবু থাকবেন। মন্দাকিনী ওর কেনা তালাটা ওই তালার ওপরে লাগিয়ে দিল। আমাকে বলল—বাস, যদি ইতিমধ্যেই তোমার সুটকেস এই ঘরের মধ্যে থেকে হাওয়া হয়ে গিয়ে না থাকে, তা হলে আর যাবে না। — মাইকেল আর রুডি পালা করে পাহারা দেবে এখানে, তা হলেই তোমার ওই রাখাল না বাগালকে ধরে খোলা যাবে।
—আর যদি ইতিমধ্যেই সুটকেসটা গিয়ে থাকে? —এ সম্ভাবনাটার কথা আমার আদৌ মনে হয়নি। এখন মন্দাকিনী বলাতে মনে হল।
—তার ব্যবস্থাও হবে। এখন চলো।
—কোথায়?
—বাঃ, তোমার তো কাল থেকে চান-খাওয়া কিছুই হয়নি! ভাল কথা ওই লোকটা কোথায় কাজ করে যেন বলছিলে?
—ক্যালকাটা কর্পোরেশনে।
—ডিপার্টমেন্ট জানো?
—নাঃ।
—নেভার মাইন্ড।
এগারো – মন্দাকিনীর কথা
দিয়ার নাতিকে দিয়ার কাছে এনে দিয়েছি। কী খুশি বুড়ি! পরদিন সকালে দেখি ভোর-ভোর উঠল। দুখানা শাল মুড়ি দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসেছে। খালেদাটাও বুড়ি হয়েছে। দেখি ঘুমোচ্ছে। নাতি এসেছে মিসেস এলা চৌধুরীর, খালেদা বিবির তো আর নয়! আমিই চা-টা করলাম। …পেছন থেকে কাপটা কোলের কাছে বাড়িয়ে ধরেছি। বুড়ি বলল— খালেদ, ছেলেটাকে ভাল করে দেখেছিস?
আমি বলি— হুঁ।
—কার মতো বল তো!
আমি সামনে দাঁড়িয়ে বললাম— কার মতো?
—ওমা তুই? —মুখটা সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
—কার মতো বলো? —আমি আবার জিজ্ঞেস করি।
—না, জিজ্ঞেস করছিলাম। তুই-ই বল না।
আমি বললাম— ঠিক একটা ছেলের মতো। একটা উজবুক, শহরের চাল-চলন জানে না, এসেই বিপদে পড়েছে এই রকম একটা গাঁইয়া হাঁদা ছেলে।
—আর দু-চার দিন পরে দেখবি এমন চালাক-চতুর হয়ে গেছে, যে তোরই কান কেটে নেবে।
—তা হতেই পারে, তুমি যদি ট্রেইনিং দাও আর তোমার মেয়ের এক কণাও যদি পেয়ে থাকে।
দিয়া চুপ করে রইল। সেদিন থেকে আমি একবারও জিজ্ঞেস করিনি দু’ভাই বোন কী করে একই মাসের মধ্যে পাঁচ দিনের তফাতে জন্মায়। দিয়া বারবার আমাকে বলতে গেছে। আমি হাত তুলে থামিয়ে দিয়েছি। এতদিন একটা আষাঢ়ে গল্প বলে রেখেছিল। আবার আর একটা আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবে। এদের আমি আর বিশ্বাস করি না। এদের রক্তের মধ্যে বইছে ছলনা আর কপটাচার। এত মিথ্যার দরকারটা কী ছিল সেটাই শুধু বুঝতে পারি না। বুঝে অবশ্য আর কাজ নেই আমার। যেটুকু বুঝেছি তাই-ই যথেষ্ট।
মুখটা এমন চুন করে আছে যে মানুষটার ওপর দয়া হল। বললাম— তোমাকে আর তোমার মেয়েকে ছাড়া আর কাউকে তো দেখিনি। কী করে বলব, কার সঙ্গে ওর মিল?
একটু বোধহয় উৎসাহ পেল এলা চৌধুরী, বলল— তুই দেখেছিস, রোজ দেখেছিস, ফটোতে। তোর দাদার মতো। নয়?
—কী জানি!
—ঠিক অল্পবয়সের বিনু।
আমি হেসে বললাম— একেবারে এইটুকু ছেলের মুণ্ডু চিবিয়েছিলে? বাঃ, ব্রাভো দিয়া!
দিয়ার মুখটা একবার লাল, পরক্ষণেই সাদা হয়ে গেল। মুখ নিচু করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে, হাতটা একটু একটু কাঁপছে। ঠিক বুড়োদের মতো। কত বয়স হল দিয়ার? ষাট হল? যাঃ দিয়া, তুমি ঢকঢকে বুড়ো হয়ে গেলে?
সকাল হয়ে গেছে। এক ফালি রোদ এসে ব্রাউন চন্দ্রমল্লিকাটার ওপর পড়েছে। ফুলটা হয়েছে যাকে বলে গর্জাস। একটা ছোটখাটো চুবড়ির মতো। টবগুলোর একটু জায়গা অদল-বদল করে দিই। হলুদগুলোই রাজত্ব করছে, ব্রাউনগুলো যে কত যত্নে ফুটিয়েছি! স্পঞ্জ দিয়ে পাতাগুলো পাপড়িগুলো মুছে দিই। ঝকঝক করতে থাকে ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা। এগজিবিশনে দিলেই হয়।
—পরের বছর, পার্প্ল আর লাল ডালিয়া করব, বুঝলে দিয়া?
মুখ ফিরিয়ে দেখি দিয়া চলে গেছে। বারান্দার দরজার কাছে মন্দার দাঁড়িয়ে আছে।
বলি— গুড মর্নিং।
ও বলে—আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান!
—বাঃ, এ তো আশাতীত উন্নতি! লাফিয়ে লাফিয়ে উন্নতি! সত্যিই ওর চোখগুলো দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। কোনও ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই। অদ্ভুত তো?
—ডবল প্রমোশন? —ও বোকার মতো হেসে বলল। —যাক, হাসিটা এখনও বোকা-বোকা আছে।
—ভেতরে আসব?
—ভেতর কী? বাইরে বলো! এসোনা!
বলল— বড় ফুলগুলো, ওই যে হলদে আর বাদামি ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকাগুলো!
—হ্যাঁ, ওগুলো কী?
—তুমি যখন ওগুলোর পাতা মুছিয়ে দিচ্ছিলে, তখন মনে হচ্ছিল ওগুলোও তোমার বোন।
—বাপ রে! এই রেটে যদি উন্নতি হয় তা হলে তো চাঁদে-টাঁদে পৌঁছে যাবে। শিগগিরই।
খুব লজ্জা পেয়েছে। বলল— খারাপ কিছু বলেছি? কিছু মনে করলে মন্দাকিনী?
আমি বলি— আমার ডাকনাম বুলা। তোমার কোনও ডাকনাম নেই।
—সোনা। ছোটসোনা।
—গুড। মন্দার কি একটা নাম হল না কি? যেমন মন্দাকিনী, তেমনি মন্দার দুটোই বোগাস!
—হ্যাঁ ওগুলো স্বর্গের গাছ, স্বর্গের নদী।
—সোনা তো, ছোট কেন? —
বলল— বড় নয়, তাই। দুজনে খানিকটা হাসি। আমি বললাম— আজকের প্রোগ্রাম জানো?
—না তো!
—আজ একটা এক্সপিডিশন আছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
—এক্সপিডিশন? কোথায়?
—কোথায়, তুমিই বলো না।
ভেবে-চিন্তে বলল— শেয়ালদা থানায়?
মনে মনে বললাম— তোমার মাথা! মুখে বললাম— দেখা যাক।
কালকে ওর জন্যে দু’সেট পায়জামা-পাঞ্জাবি, আর একসেট ট্রাউজার্স-শার্ট কিনে এনেছি। ট্রাউজার্সের কোমরটা ফিট করলে হয়। একটু আলগা হলে বেল্ট দিয়ে ম্যানেজ করে নিতে বলব, কিন্তু ছোট হলে? দোকানে অবশ্য বলল— ছোট হওয়ার কোনও চান্স নেই।
জিনিসগুলো নিয়ে গিয়ে ওর ঘরে বিছানার ওপর রেখে দিই।
বলল— এ সব কিনেছ কেন?
—জাহাজডুবি হয়ে তো এসেছ, পরবেটা কী? আমার স্কার্ট না দিয়ার শাড়ি?
—আমি আমার জামাকাপড়গুলো কাল কেচে শুকোতে দিয়েছি।
—কোথায়?
—ওই বাথরুমেই,
ঢুকে দেখি র্যাকে জামা-টামা শুকোচ্ছে বটে, —আমি ঢুকতে যেতেই হাঁ হাঁ করে ছুটে এসেছিল।
—তোমাকে দেখতে হবে না, তোমাকে হাত দিতে হবে না, আমি ঠিক করে নিচ্ছি।
আমি বললাম— ওগুলো আয়রণ না করলে তো পরা যাবে না। আমি স্টিফেনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওকে দিয়ে দাও আর নতুন ড্রেসটাই পরো। পরে দেখে নাও ঠিক হয়েছে কিনা।
রাখাল সরকারের নাকের ওপর একটা আঁচিল আছে এইটাই ছিল আমাদের ট্রাম্প কার্ড। কর্পোরেশনে বেঁটে, ষণ্ডামার্কা নাকে আঁচিল রাখাল সরকারের খোঁজ পেতে মাইকেলের দেরি হয়নি। লোকটা অ্যাসেসমেন্ট সেকশনের ক্লার্ক।
বিকেলে লোকটা বেরোলে মাইকেল পেছু নিল। সুরেন ব্যানার্জি থেকে একটু পরে ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে ঢুকতে যাবে, পেছন থেকে মাইকেল, সামনে থেকে রুডি গিয়ে ওর কাঁধে থাবড়া মারল।
—মিঃ সরকার, কেমন আছ?
—কে? কে? —ভড়কে রাখাল সরকার বলল, কে আপনারা?
—চিনতে পারছ না? সে কী?—অমায়িক হেসে রুডি বলল।
—না তো!
—এখখুনি চিনবে। একটা শিস দিল মাইকেল।
আমি আর মন্দার তখন এগিয়ে যাই।
—দেখো তো মন্দার এই তোমার লোক?
মন্দার মাথা নাড়ল।
লোকটা হাঁ করে মন্দারের দিকে একবার আমার দিকে একবার চাইছিল। মুখে কথা নেই।
ট্যাক্সির ভেতর ঢোকানো হয় লোকটাকে। ওর দুপাশে রুডি আর মাইকেল। সামনে আমি আর মন্দার। লোকটা কিছু বলছে না। ভয়ে চুপ করে আছে। আমার পাশে মন্দারও খুব শক্ত, ঠাণ্ডা মতো হয়ে রয়েছে। ঘাবড়েছে।
শেয়ালদার বাড়িটাতে পৌঁছে ট্যাকসি থেকে নামবার সময়ে রাখাল সরকারের বাকস্ফুর্তি হল। বলল, আমি কিন্তু এখুনি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারি।
মাইকেল বলল—ইউ ক্যান ট্রাই। তবে লোক জড়ো আমরা আরও ভাল করতে পারি।
রুডি বলল—হেই ম্যান, ভালয় ভালয় এর জিনিসগুলো দিয়ে দাও। বেশি ত্যাণ্ডাই ম্যাণ্ডাই করলে কপালে তোমার দুঃখু আছে।
বন্ধ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাখাল বলল—আমার কাছে চাবি নেই।
—তো চাবিটা কোথায় আছে? রুডি জিজ্ঞেস করল—জুলির কাছে?
এমন চমকে উঠেছে রাখাল, যেন কেউ ওর পেটে কোঁৎকা মেরেছে।
—কী? রুডি বলল, জুলির কাছ থেকে নিয়ে আসব!
জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো গুটিয়ে গিয়ে রাখাল বলল
—দেখি আমার ফোলিওটা, থাকলেও থাকতে পারে।
ব্যাগ থেকে চাবি বার করে দরজা খুলল লোকটা। আমরা সকলে ঢুকলাম। মন্দার তাড়াতাড়ি নিজের সুটকেসটার দিকে ছুটে গেল।
আমি বললাম—খুলে দেখে নাও সব আছে কি না।
মাইকেল বলল—এই মন্দার ছেলেটা তোমার জন্য বড্ড ভাবছিল, বুঝলে রাখালবাবু, কোথায় গেল রাখালবাবু, তার তো তিনকূলে কেউ নেই!
রুডি বলল— চ্ চ্, মন্দারবাবু, সত্যি নাকি?—রাখালবাবুর তিনকূলে কেউ না থাকলে কী হবে। আরেকটা কুল আছে—ফোর্থ কুল। জুলি। রাখাল সরকারের মেয়ে জুলি…
মন্দার অবাক চোখে তাকিয়ে বলল—রাখালবাবুর মেয়ে আছে? বলেন নি তো!—মন্দারের মতো আহাম্মক, ইডিয়ট আমি আগে দেখিনি।
—আহা হা হা। রুডি হেসে বলল—মেয়ে কেন হবে? মেয়েমানুষ, না রাখালবাবু? জুলির কাছে কদিন কাটিয়ে আসাও হল, এদিকে মন্দারকে কাটিয়ে দেওয়াও হল।
রাখালবাবু কম যায় না। শয়তানের মতো চোখ মটকে বলল—এই মন্দারও যেমন এই মেয়েটার কাছে কদিন কাটাচ্ছে। তা ভাল। ভাল জুটিয়েছিস মন্দার!
হঠাৎ আমার পাশ থেকে একটা গুলতির মতো কী একটা ছুটে বেরিয়ে গেল। দেখি মন্দার। লাফিয়ে রাখালবাবুর ঘাড়ে পড়েছে। তারপর ওরে বাবা, কী মার, কী মার! মুখে কথা নেই, লোকটাকে শুইয়ে ফেলে একেবারে চোরের ঠ্যাঙানি!—ওর যে অত রাগ, ওইরকম করে যে কাউকে ঠেঙাতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
মাইকেল, রুডি অনেক কষ্টে ওকে তুলে নিয়ে আসে। ওর বইপত্র, সুটকেস, সব নিয়ে আমরা বেরিয়ে যাই। শুধু বিছানাটা মন্দার নেয় না। মুখের একটা ভয়ঙ্কর ভঙ্গি করে বলে—ও শুয়েছিল। ওটা নোংরা হয়ে গেছে।
—আমি থানায় যাব—কোঁকাতে কোঁকাতে লোকটা বলল—এফ. আই. আর করব।
রুডি বলল—ট্রাই ইট। ইটস অলওয়েজ গুড টু ট্রাই। আমাদের এফ. আই. আর তো করাই আছে।
বাড়িতে ফিরে দেখি দিয়া একটা সাদা খোলের তাঁতের শাড়ি পরেছে। কপালে একটা কালো টিপ। আমাদের দেখে বলল—পেয়েছিস? সব কিছু?
আমি বললাম—হ্যাঁ।
—তোমার হার? মন্দার?
—হ্যাঁ।
—বইগুলো গুছিয়ে রাখো—দিয়া বলল।
বইয়ের থলেটা ও নিয়ে গেল ঘরে।
—বেশি গোলমাল কিছু করিসনি তো?—দিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।
—না। আমরা অত বোকা না।
—ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে তো ওই রুডি।
বেশি কিছু করতে হয়নি। আমি বলি—রাখালবাবুর মার খাওয়াটা দেখবার মতো হয়েছিল। ক্যা সীন?
—সেই মারলে? এত করে যে বললাম ছেলেগুলোকে মারপিট করিস না।
—ওরা করেনি তো! মার দিল তোমার নাতি।
—কে মন্দার? মন্দার মারপিট করল?—দিয়ার গলায় অবিশ্বাস।
—মারপিট নয়। এক তরফা মার, বেধড়ক।
—বলিস কী রে? কেন? তোরা সামলাতে পারলি না?
—সামলাব কী? আমাকে লক্ষ্য করে একটা বেফাঁস কথা বলেছিল লোকটা…বাস—ঠাঁই ঠাঁই শুরু হয়ে গেল।
দিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপরে বলল—আশ্চর্য!
আমি বললাম—কোনটা আশ্চর্য?
দিয়া বলল—ঠিক বিনুর মতো।
সুটকেসটা তখনও দালানে পড়ে। নিয়ে ওর ঘরে ঢুকেছি, দেখি ও টেবিলের ওপরে মাথা রেখে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
বই-টই সব চারদিকে ছড়ানো।—কিচ্ছু গোছানো হয়নি। আমি নিঃশব্দে বইগুলো র্যাকে তুলছি। মুখ তুলে বাথরুমের দিকে চলে গেল।
আমি চেঁচিয়ে বললাম—দিস ইজ ক্যালকাটা, এ মেট্রোপলিটান সিটি। কান্নাকাটি করে কিছু করতে পারবে না এখানে। লাইফ ইস টাফ হিয়ার। রিয়্যাল টাফ।
ও মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসছে। আমার দিকে তাকাতে পারছে না। বললে— বিশ্বাস করো, এই প্রথম, জীবনে এই প্রথম, না বোধহয় দ্বিতীয়বার।
—দ্বিতীয়বার? তা প্রথমবার কী কারণে কাঁদলে?
—বলব কেন তোমাকে? তুমি ঠাট্টা করবে।
—ঠাট্টা নিতে পারো না?
—ভেবে দেখতে হবে।
—ঠিক আছে বলো ঠাট্টা করব না।
ও বলল—গান, গান শুনে।
—গান শুনে? তা হলে তো তোমাকে এখানে দিবারাত্র কাঁদতে হবে।
—কেন?
—এখানে তো সব সময়ে গান বাজছে।
—ওহ্। ওই গান। পানের দোকানে টোকানে যেগুলো বাজে? ওগুলো আবার গান না কি?
পানের দোকানে বাজে বলে হয়তো তেমন মন দিয়ে শোননি। অন্য জায়গায় শুনলে কোনও কোনও গান খুবই ভাল লাগার কথা। বলে আমি একটা গান গেয়ে উঠলাম।—হিন্দি ফিলমি গান।
ও মন দিয়ে শুনল, বলল—তুমি গাইছ বলে ভাল লাগছে। কিন্তু এইসব গান, আর ওইসব গলা আমার … আমার ঠিক…। বলতে বলতে দু বার গলা ঝেড়ে নিয়ে ও-ও গেয়ে উঠল—
মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়
দেই তুলসী তিল এ দেহ সোঁপাল
দয়া জনু ছোড়বি মোয়।
আমি তো অবাক! বললাম—তুমি তো বেশ গাও। ভয়েস তো চমৎকার।
—গানটা ভাল লাগল?—ও একটু লজ্জা পেয়ে গেছে।
আমি বললাম—তুমি গাইলে বলে ভাল লাগল। নইলে কীর্তন আমার ভাল লাগে না।
—আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছ? কিন্তু মন্দাকিনী, কার্তিক মাসের শুক্লা পূর্ণিমায় যখন চারদিক দুধসাদা হয়ে যায়, কোথাও কেউ থাকে না, দূর থেকে এই গান হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসে। তখন তোমার মন হু-হু করবে, মনে হবে কেউ নেই তোমার, হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে কেউ যে তোমার একমাত্র আপনজন। কিন্তু….
আমি বললাম—থামলে কেন, বলো আমি শুনছি।
—নাঃ, —ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকাল ও।
—দিয়া খুব ভাল কীর্তন গাইতে পারে। জানো তো?
—তাই বুঝি?—হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রথম যেদিন এ বাড়িতে আসি উনি গুনগুন করছিলেন। আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
—শিখেছে তো ভাল করে।
এই সময়ে পর্দা সরিয়ে দিয়া ঢুকল।—কে গান করল? মন্দার না কি?
—দুটো লাইন মন্দাকিনীকে শোনাচ্ছিলাম, দিদিমা,—খুব লাজুক মুখ করে ও বলল।
—ও তো আর জানত না, তুমি কীর্তনে এক্সপার্ট! আমি বলি।
—তুমি কীর্তন ভালবাসো?—দিয়া জিজ্ঞেস করল।
মন্দার বলল—আমাদের ওখানে তো যে কোনও উপলক্ষে কীর্তন হয়, বিশেষ করে ব্রজবুলির কীর্তন আমার খুবই ভাল লাগে।
—কী মনে হয় তোমার?
—কী মনে হবে?
—না ওই যে বুলাকে বলছিলে!
—কিছু না, পূর্ণিমার রাতে-টাতে খুব ভাল লাগে, তাই বলছিলাম মন্দার বেশ লজ্জা পেয়ে গেছে। কিছুতেই আর বলল না।
দিয়া বলল—তোমার দাদার ইচ্ছেতেই তো আমি কীর্তন শিখি। উনি বলতেন ভক্তি-সংগীত হিসেবে তোমায় কীর্তন গাইতে হবে না। গাও ল্যভ-সঙ হিসেবে। আমরা দুজন কেউই কিছু বললাম না।
দিয়া বলল—লাভ সঙ ঠিকই। কিন্তু পাওয়ার গান নয়, এগুলো না-পাওয়ার গান। একেবারেই না-পাওয়া, আভাসে-পাওয়া, পেয়েও-না-পাওয়া। যাঁর কাছে শিখেছি সেই যুগল কীর্তনিয়া বলতেন, কীর্তন অঙ্গে মিলনের গানও বিরহের গানের মতো করেই গাইতে হবে। মিলনই বলো আর পাওয়াই বলো, সেটা একটা আইল্যান্ড ডুবু-ডুবু জলের মধ্যে জেগে-থাকা দ্বীপ, যে কোনও সময়ে ডুবে যেতে পারে। তোমার মধ্যে যদি সীমাহীন অভিমান থাকে, যদি তোমার জীবনে রিফিউজ্যালের কষ্ট থাকে, বঞ্চনা থাকে, তা হলে কীর্তন হবে, দি মিউজিক ফর ইউ।
—ওহ্, আমি তোদের খুব বিরক্ত করলাম…দিয়া পর্দা ঠেলে চলে গেল। মাঝে মাঝে দিয়া যেন নিজের ভেতরের একটা ঘরের পর্দা সরিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্য।
—সুটকেস থেকে জামাকাপড়গুলো বার করলাম। —আলমারির মধ্যে সাজিয়ে রাখছি, মন্দার বলল—আচ্ছা মন্দাকিনী, দিদিমা অত সুন্দর বাংলা বলেন কী করে?
—দিয়া তো শিখেছে! দাদার কাছে শিখেছে। টিউটর রেখে শিখেছে।
—কিন্তু একটু টান আছে, তাই না?
—হ্যাঁ, যেমন নয় কে বলে নোয়, হয় কে হোয়, ‘যুগোল’ ‘মিলোন’ যুক্তাক্ষরগুলো একটু ভেঙে বলে, কীরতন, বজ্রো…।
—কিন্তু আমার মায়ের বা তোমার তো এ রকম টান নেই?
—বাঃ দিয়ার বাবা-মারা ছিল ইংলিশ-স্পীকিং। কিন্তু আমার বাবা-মা তো দুজনেই বাংলা বলে, বাঙালি। ইরাবতীর মা মানে আমাদের দিয়া তো সে সময়ে ছিলেন পুরোপুরি বাঙালি। আমরা পড়েওছি নিভেদিতার স্কুলে। মা তো বটেই, আমিও।
—এ সব কি দাদামশাইয়ের আইডিয়া?
—হ্যাঁ, দাদা আসলে দিয়া সুদ্ধু পুরো নিজের ফ্যামিলিটাকে বাঙালি সমাজে রিহ্যাবিলিটেট করতে চেয়েছিল!
—রি-হ্যাবিলিটেট?
—হ্যাঁ! দিয়া তো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান! বাঙালি-সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে ছেলেমেয়েদের বাংলা উচ্চারণ, বাঙালি রীতিনীতি, অভ্যাস সব রপ্ত করতে হবে তো!
—তা সেই সমাজ, তোমার দাদার সমাজ কই? তাঁদের কেউ তোমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন?
—এই ব্যাপারগুলো আমি জানি না। তুমি দিয়াকে জিজ্ঞেস করো। তবে আমার জ্ঞানে আমি দাদার কোনও আত্মীয়কে এখানে আসতে দেখিনি।
—মা কোথায় চাকরি করে মন্দাকিনী? —মন্দার হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
—মা কি তোমায় তাই বলে গেছে?
—আর কী বলবে?
আমি বললাম—দেখো। আমাদের ছোটবেলায় মা একটা চাকরি করত। রিসেপশনিস্ট ছিল। কিন্তু সে চাকরি মা অনেকদিনই ছেড়ে দিয়েছে।
—তা হলে?
—তুমি একটা ফার্স্ট ক্লাস ইডিয়ট মন্দার, বুঝতে পারছ না, মা আবার বিয়ে করেছে?
দিয়া কথাটা বলতে আমাকে বারবার বারণ করেছিল, কিন্তু আমি বলে ফেললাম।
বারো – মন্দারের কথা
সত্যি আমি একটা ইডিয়ট, আহাম্মক মূর্খ। কোনও মা যে বিয়ে করতে পারে এ কথা অতি সুদূর কল্পনাতেও কখনও মনে স্থান দিতে পারিনি। মন্দাকিনী আমায় তোমরা বুঝতে পারবে না বোধহয়। কিন্তু, আঠারো বছর আমি রাধানগর নামে একটি জায়গায়, ঠাকুরবাড়ি নামক একরকম ধর্মীয় রীতিনীতির সংস্কৃতির ছকের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। বেড়ে উঠেছি একা একা। কিছুই শেখাবার জন্য কেউ আমার পাশে কোনওদিন ছিল না। যা কিছু শিখেছি তা অনুমানে। অজানা হাতড়ে হাতড়ে বড় হয়ে উঠেছি। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ…জীবনের এই সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, রায়বাড়িতে, রাধানগরে। আমি দেখেছি দূর থেকে। অনুভব করিনি। এগুলো ঘটে গেছে যেন আমার বাইরে।
মেজো জ্যাঠামশাই মারা গেলেন। শুনলাম মাঠে, ভোরবেলায় বেড়াতে গিয়ে। ভোরে উঠে বইপত্র নিয়ে আমি চলে যেতাম, লোকবসতি অঞ্চল থেকে একটু দূরে। একটা বটগাছ ছিল আমার খুব প্রিয়। এই বটগাছটার তলায় ঘুমিয়ে পড়ে রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে আমার একবার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল! বেড়াতে বেড়াতে আমি ওইখানে চলে যেতাম। শিশিরদারা আমাদের বলতেন শরীর তৈরি করতে বেশ কয়েক পাক ছোটা দরকার। বেশির ভাগ দিনই ওইখান থেকে আমি ছুটতে শুরু করতাম, কোনও কোনওদিন তারক এসে যোগ দিত। কিন্তু পরীক্ষা এসে যাওয়ায় ওই সময়টা রোজ পড়াশোনা করছিলাম। ওইখানেই একজন পথ চলতি লোক আমায় খবর দিয়ে গেল রায়বাড়ির বুড়োকর্তা দেহ রেখেছেন। ফিরে গিয়ে দেখি উঠোনে খাটিয়ায় মেজো জ্যাঠামশাইকে নামানো হয়ে গেছে। নতুন একটা কোরা ধুতি পরানো হয়েছে, গায়ে নামাবলী। কেউ কান্নাকাটি করছে না, কিন্তু সকলেই খুব গম্ভীর। ছোটরা সার বেঁধে প্রণাম করছে, পুরো দৃশ্যটা যেন একটা ছবি, আমি দেখছি। মনে হচ্ছিল মেজো জ্যাঠামশাই অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। ওঁর হাত পা কেমন কাঠের মতো, খুব পাতলা কাঠ। তুলসীপাতার তলায় বুঝি চোখদুটো গলে গেছে। মৃত্যু, একে বলে মৃত্যু, আমি নিজেকে বললাম। কিন্তু নিজের মধ্যে কোনও থেমে-যাওয়া উপলব্ধি করলাম না। মৃত্যু একটা দৃশ্য হয়ে রইল। হয়তো খুব নিকটজনের মৃত্যু হলে সেটাকে আমি অনুভব করতে পারব, কিন্তু সে রকম নিকটজনই বা আমার কই? বাবা, মা এরা তো প্রায় অদৃশ্য অবাঙ্মনসোগোচর হয়েই রয়েছে। থাকলে আছে, চলে গেলেও সেটা কোনও আলাদা অভিজ্ঞতা নয়। এই যে মায়ের শেষবার কলকাতা চলে যাওয়া! তার পর থেকে দেখা নেই, চিঠিপত্র নেই, খবর নেই। এটা মৃত্যু ছাড়া কী? এটাকে সম্পূর্ণ করতে কি আবার একটা ফুল-সাজানো খাটিয়া আর তুলসীপাতা লাগবে?
জন্ম সম্পর্কে আমার অনুভূতি তো আরও ধোঁয়াটে। একগাদা ছোট ছেলেমেয়ে দল বেঁধে খেলছে। ওদের তেমন কোনও বিশেষ মুখ নেই। সংখ্যা আছে। সংখ্যায় হয়তো একদিন থেকে একজন বেড়ে গেল। সেই একজন খুব ছোট ছিল, আরেকটু বড় হয়ে গেল, কোনও একজন কাকিমা, কি বউদি, কি কাজের লোক কাঁথা জড়ানো একটা বাচ্চাকে নিয়ে হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুঝতে পারলাম রায়বাড়িতে লোকসংখ্যা বাড়ল। দাওয়া দিয়ে হামা দিচ্ছে একটা বাচ্চা, টলটল করে হাঁটছে, পায়ে রুপোর মল, চোখে কাজল, কোমরে ঘুনশি, আমার কোনওদিন মনে হয়নি—বাঃ বেশ তো বাচ্চাটা, কবে হল, কার বাচ্চা? ওরা কেউ হাত বাড়িয়ে আমার কাছে আসতে চায়নি। আমিও নিতে চাইনি ওদের।
আর বিয়ে? এই আঠারো বছরে কি আর কম বিয়ে হয়েছে রায়বাড়িতে? বেশির ভাগই মেয়েদের বিয়ে। দিদিদের, পিসিদের। এরা সবাই আমার কাছে অতিশয় দূরের মানুষ। এদের হাসি, কথাবার্তা, সবই আমার চিরকাল বিদেশি-বিদেশি লেগেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানটা যেখানে হচ্ছে, যজ্ঞ বা সম্প্রদান, গায়ে-হলুদ বা এ রকম কিছু সে সব জায়গায় কখনও আমার ডাক পড়েনি, যাইওনি কখনও। লোকের মুখে শুনে শুনে অনুষ্ঠানগুলোর নাম আমার শেখা। সবচেয়ে কাছাকাছি থেকে বিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা আমার খুব সম্প্রতি হল। আমার এক দাদার বিয়ে হল, তার ঘর তোলা হল আমাদেরই উঠোনে। আমাদের ঘরের উল্টোদিকে। দিনের পর দিন উঠোনে মাটি মাড়াই হত। মাটির সঙ্গে খড়ের কুচি, আলকাতরা এই সব মিশিয়ে সেই মাটি তৈরি হত। ইঁট এল। ইঁট দিয়ে ভিত তৈরি হল। তারপর চাপ চাপ মাটি দিয়ে দেওয়াল উঠল, তাতে কাঠের জানলা-দরজা বসল, মাথায় বসল টালির চাল। শেষ কালে পুকুরের তলার মাটির সঙ্গে আলকাতরা মিশিয়ে যখন পলেস্তারা পড়ল দেওয়ালের গায়ে মেঝেতে, তখন ভাল শানের মেঝের সঙ্গে তার আর কোনও তফাত রইল না। কী ভাবে চারদিকে চ্যাঁচারির বেড়া দিয়ে বাগানের জন্য জমি আলাদা করা হল, তাতে ফুল গাছ বসল এই সমস্ত পদ্ধতিটা খুব মনোযোগ দিয়ে আমি লক্ষ করেছিলাম, তার পরে একদিন লাল চেলি আর শোলার মুকুট পরে একটি বউ এসে ওই দুটি ঘরে বসবাস করতে লাগল। সেই সময়ে অনেক রাতে কখনও কখনও ঘুম ভেঙে ওদের প্রণয়লীলার টুকরো-টাকরা দেখতে পেয়ে গেছি। ঠিক যেন রাধা-কৃষ্ণের গল্পের অভিনয় হচ্ছে, আমার দেখা বারণ, এক জায়গায় কানাত উড়ে গেছে, সেই ফুটো দিয়ে দেখছি।
মা বিয়ে করেছে? মা তো বাবার বউ? একটা অমোঘ সম্পর্ক। সেই মা! জুটের ব্যাগ থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বার করছে, দুজনে মিলে চাইনিজ চেকার খেলছি, একটা রঙিন ডুরে শাড়ি পরে মা পশ্চিম পুকুর থেকে চান করে আসছে, আমাদের খাবার বেড়ে দিল! ওই মা চলে যাচ্ছে, ফুল-ফুল ছাপ সিল্ক শাড়ি পরে, পা-ঢাকা জুতো পায়ে, মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে একবার পেছন ফিরে আমায় হাত নাড়ল। ব্যস, এবার মাকে আর দেখা যাবে না। আমার চোখ টনটন করছে, গলা ব্যথা করছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমি কাঁদব না তো! আমি কাঁদি না।
আমার বিমূঢ় ভাব দেখে মন্দাকিনী বোধহয় ভয় পেল, বলল—তুমি কি কখনও ডিভোর্স, রিম্যারেজ এ সবের কথা শোননি?
আমি কোনও জবাব দিলাম না।
—তোমার কাছে যখন রাধানগরে যেত মা কোথায় থাকত?
—আমার কাছে, আমার ঘরে।
—ঠিক কবে মা ডিভোর্স নিয়েছিল জানি না, তবে ডিভোর্সে বাবাকে রাজি করাবার জন্যেই বোধহয় মা রাধানগরে যেত।
এ-কথার মানে কী? আমি কেউ না? মা আমাকে দেখতে যেত না? উদ্দেশ্য, বাবাকে ডিভোর্সে রাজি করাবার উদ্দেশ্য নিয়ে যেত? কথাগুলো যেন বরফের কুচি, ঝরে পড়ছে আমার সমস্ত শরীরে, সমস্ত অস্তিত্বে। আমার যেন কেমন শীত করতে লাগল।
—তোমার জন্যে টানও নিশ্চয় ছিল—অপ্রস্তুত মুখে বলল মন্দাকিনী, আমি বললাম—আগে কহো আর।
—মানে?
—মানে, ও কথা থাক।
—মুসৌরিতে হোটেল ওবেরয়-এ রিসেপশনিস্ট হয়ে গেল মা, আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল। বেশ ছিলাম। তারপরে মা বিয়ে করল। আমাদের বাড়ি কেমন বদলে গেল। অন্য লোকটাকে বাবা বলাবার চেষ্টা চলল কিছুদিন। পারিনি। তারপরে একদিন ডিসিশন নিলাম। মায়ের বাড়িতে যতদিন ছিলাম ঠিক ছিল। কিন্তু এখন মায়ের নতুন সংসার হয়েছে, ঠিক আছে মা এনজয় করুক। আমি চলে এলাম।
মায়ের নতুন সংসার, মা এনজয় করবে? নতুন তৈরি সেই মাটির ঘর। দাদা, লাল-চেলি পরা দাদার বউ, বউটির জায়গায় আমার মা, দাদার জায়গায়, একজন অপরিচিত রোমশ লোক, ঠিক রাখালবাবুর মতো মুখ, খালি রাখালবাবুর মতো বেঁটে নয়, পোশাক-পরিচ্ছদ আরও দামি, কেতাদুরস্ত।
আমার চারপাশে তাসের প্রাসাদ ভেঙে ভেঙে পড়ছে। আশে পাশে, মাথার ওপর। ছিল না, কিছুই ছিল না, শুধু জীবনের কেন্দ্রে একটা মূর্তি ছিল, মায়ের মূর্তি। মা, অন্য কেউ না ভালবাসলেও যে আমাকে ভালবাসে, ভাবতাম অনেক দুঃখেই মা আমাকে ছেড়েছে। মায়ের এই দুঃখটুকুই অদৃশ্য মা আর তার ছেলের মধ্যে যোগসূত্র ছিল। কী বোকা! কী আপাদমস্তক আহাম্মক আমি!
যতই ভাবি ততই মায়ের মূর্তি ক্লেদাক্ত হয়ে যায়। শেষে যখন মায়ের সঙ্গে রাখালবাবুর কোনও তফাতই রইল না, রাখতে পারলাম না, তখন শরীরটা এমন জ্বালা করতে লাগল যে সোজা বাথরুমে গিয়ে, বাথটবে জল ধরে, তার মধ্যে ডুবে শুয়ে রইলাম।
অনেকক্ষণ পরে মনে হল কারা ডাকছে। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে,—মন্দার! মন্দার! কী করছ!
উঠে দরজা খুলে দিলাম। সামনে দিদিমা—এলা চৌধুরী, বা আইলিন। খুব ভদ্র ইনি, অমায়িক, সদাশয়। আমি এখানে কোনওদিন আসব ইনি ভাবেননি। মেয়ের ডিভোর্স করা স্বামীর ছেলে তো আমি! এঁর মেয়েও যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে নিজের পায়ের ছাপ মুছে ফেলে চলে এসেছেন। ভাবেননি, কিন্তু এসেই যখন পড়েছি, তখন অসীম ভদ্রতায় ইনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। এই তো, চমৎকার একটি ঘর, একটা বাথরুম দিয়েছেন আমার ব্যবহারের জন্য। এমন ঘরে কি জীবনেও কখনও থেকেছি? আর এই বাথরুম? একটা ঘরের মতো বাথরুম? আমার মতো কাঙাল কি স্বপ্নেও ভেবেছিল এই রকম এক বাথরুমে সাদা ধবধবে বাথটবে শুয়ে শুয়ে সে তার মন-খারাপ ধুয়ে ফেলবার সুযোগ পাবে?
—এত রাতে তুমি চান করলে মন্দার? কী কাণ্ড! ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে!—
আমার কোনও শীতবোধ কিন্তু ছিল না। আমি যে ওঁর সামনে শুধু একটা তোয়ালে পরে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছি, আমার গলায় রাধানগরের সেই মাদুলি সুদ্দু হার পরে, সে খেয়ালও আমার হয়নি।
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও— এবার আমরা খাব— আমি পাঁচ মিনিট পরে আসছি। উনি ঘর থেকে চলে গেলেন।
আমার আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না এখানে। এক মুহূর্তও না। কীসের আত্মীয়তা এঁদের সঙ্গে আমার? যে-মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক চলে গেছে সেই মুহূর্তে তথাকথিত এই মামা-বাড়ি, থুড়ি, দিদিমার বাড়ির সঙ্গেও আমার আর কোনও সম্পর্ক থাকার কথা নয়।
মন্দাকিনীর আনা জামা কাপড়গুলো এখনও বিছানার ওপর পড়ে রয়েছে। আমি আলমারি থেকে আমার নিজস্ব সস্তার বেলবট্ম প্যান্ট আর স্ট্রাইপ দেওয়া শার্ট পরি। জীবনেও কখনও সোয়েটার পরিনি। রাধানগরে সম্বল ছিল একটা চাদর। এখানেও সেটাই নিয়ে এসেছি। রাতে যখন খাবার কিনতে বেরোতাম, এই চাদরই গায়ে জড়িয়ে যেতাম। দিনের বেলায় গরম জামাটামা আমার দরকার হত না। চাদরটা পাট করে কাঁধে ফেললাম। মন্দাকিনী নাক সিঁটকোবে। বলবে গাঁইয়া! আহাম্মক! বলুক। শীত করছে যখন চাদরটা আমায় গায়ে দিয়েই বেরোতে হবে।
সুটকেসটা গুছিয়ে নিতে সময় লাগল না। বইগুলো আরেক দিন এসে নিয়ে যাব এখন। গুনে দেখলাম— তিন হাজার চারশো আট টাকা রয়েছে, আমার ব্রাউন খামে। আজ রাতটা কোনও হোটেলে-টোটেলে কাটিয়ে দেব। কাল আমার প্রথম কাজ হবে— প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে আরেকবার দেখা করা। হস্টেলের ব্যবস্থা যদি না-ও করতে পারেন, কোথাও পেয়িং গেস্ট থাকবার ব্যবস্থা ওঁকে করে দিতেই হবে। একটা কাঙাল অনাথ পড়ুয়া ছেলের জন্য এইটুকু উনি করবেন না? প্রিন্সিপ্যাল হয়েছেন কেন তবে?
মিসেস চৌধুরী আবার ঢুকছেন। —আসব, মন্দার?
—ও কী? এখন সুটকেস গোছাচ্ছো কেন?
সুটকেসটা হাতে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়াই। বলি— আমি যাই।
—কেন? কোথায়?
সত্যি কথাই বলি—কোনও হোটেলে আজকের রাতটা কাটিয়ে দেব।
—সে কী? কেন?
ওঁর ‘কেন’র উত্তর খুব লম্বা হয়ে যাবে। এত কথা ওঁকে শোনাবই বা কেন? মেমসাহেব মানুষ, অনেক ঝামেলা পুইয়েছেন, আমার জন্য। আর কেন?
উনি আমার হাত ধরলেন, কাঁদছেন, অনর্গল জল পড়ছে চোখ দিয়ে—বললেন —বিনু, বিনু! কোথায় যাবে? যেও না।—কাকে ডাকছেন উনি?
আমি কীরকম একটা ঘোলাটে পর্দার মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ওঁকে। মেমসাহেব, কিন্তু শাড়ি পরেছেন। নাকে হিরের নাকছাবি। হাতে তিন-চার গাছা সোনার চুড়ি। কপালে একটা কালো টিপ। লাল চুলগুলো একটা বিনুনি করে পেছনে ফেলে রেখে দিয়েছেন।
হঠাৎ উনি গলা চড়িয়ে ডাকলেন— বুলা! বুলা! স্টিফেন! আমি বললাম, প্লিজ, কাউকে ডাকবেন না। আমি থাকব না।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হল স্টিফেনকে একবার তড়বড় করে আসতে দেখলাম। মন্দাকিনীর মুখটাও যেন একবার দেখা গেল। কিন্তু কোথায়, কখন অতশত বলতে পারব না।
এত নির্ভরশীল আমাদের মন যে এতগুলো দীর্ঘ বছর প্রায় কারও তত্ত্বাবধান বা পরামর্শ ছাড়া বাঁচার পরও আমি পাগলের মতো কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। সোজা একটা হোটেলে চলে যাব, ঘর বুক করব— এই তো কথা! কিন্তু পারলাম না। আমি চলে গেলাম রথীদের বাড়ি। রথীকে নিয়ে কোনও হোটেলে যাব। যথেষ্ট রাত হয়ে গেছে, যদি কোথাও জায়গা না পাই, তো কী হবে! এমন একটা ভাবনা-ও হয়ে থাকবে।
আমাকে দেখে রথী অবাক! স্বাভাবিক! আমি শুধু বললাম— যেখানে ছিলাম সেখানে থাকতে পারছি না। কোনও একটা হোটেলে গিয়ে উঠব।
—হোটেলে? না, না, ও সব রিস্ক নিতে যেও না। দাঁড়াও একটু। রথী আমাকে বসিয়ে ভেতরে চলে গেল।
ওর মা কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বললেন— কী হয়েছে মন্দার? কী হল হঠাৎ?
ওঁর দিকে আমি নির্নিমেষে তাকিয়ে ছিলাম। উনি একটা রঙিন ছাপা পরেছিলেন। লাল শাল গায়ে জড়ানো। এত নিশ্চিন্ত মুখ! আমি ওঁকে কী বলব? শুধু বললাম— যে লোকটির ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, সে কয়েক দিন ধরেই খুব খারাপ ব্যবহার করছে, টিঁকতে পারছি না মাসিমা।
—তাই ক’দিন কলেজে আসছ না? — রথী জিজ্ঞেস করল।
আমি ঘাড় নাড়ি।
রথীর মা চিন্তিত মুখে বললেন হোটেলে-টোটেলে ওঠার মতলব ছেড়ে দাও মন্দার, তুমি গ্রামের ছেলে, কোনও অভিজ্ঞতা নেই, কোথায় কী বিপদে পড়ে যাবে। আজকের দিনটা তুমি রথীর কাছে কাটিয়ে দাও। আমাদের বাড়িতেও তো খুব একটা জায়গা নেই। থাকলে…. আমি বললাম— না মাসিমা আমি কারও বাড়িতেই থাকতে চাই না। হোটেলেই যাব, কিন্তু আমি তো চিনি না কিছু তেমন, তাই রথী যদি….
—রথীও তো খুব চেনে। শোনো মন্দার, আমি রথীর সঙ্গে তোমার বিছানা করে দিচ্ছি। আজ খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল দেখা যাবে।
খেতে আমার ইচ্ছে করছে না। গা-বমি করছে। অদ্ভুত একটা স্থবিরতা সমস্ত শরীরে। এত গ্লানি যে বলার নয়। কেউ আমাকে চায় না, আমি কারও নই, নিজের অবাঞ্ছিত অস্তিত্বটাকে বারবার একজনের পর একজনের ওপর চাপিয়ে যাচ্ছি। কে রথী? কে-ই বা রথীর মা? একটা সুখী পরিবারের একজন ছেলে, একজন গৃহিণী, কী উটকো বিপদে আমি এঁদের ফেললাম! এত রাত্রে আমার মতো একটা ছেলেকে তো সত্যিই হোটেলে পাঠাতে এঁরা পারেন না! একটা দায়িত্ববোধও তো আছে! দয়া-মায়া-মমতা না হোক চক্ষুলজ্জাও তো আছে। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ, তার চেয়েও বেশি ঘৃণা নিয়ে আমি রথীর পেছন-পেছন ওর চিলেকোঠার পড়ার ঘরে গেলাম।
এটা পড়ার ঘর, এখানে ও শোয় না। কিন্তু আজ মাসিমা এ ঘরেই দুজনের বিছানা করে দিয়েছেন। আমি বললাম— রথী, তুমি কেন আবার কষ্ট করবে? তুমি নীচে যেমন থাকো, তেমনিই থাকো না, আমি একা শুতে পারব।
রথী বলল— তুমি এত কিন্তু কিন্তু করছ কেন বলো তো? তুমি শুয়ে পড়ো, আমি খেয়ে তোমার জন্যে দুধ নিয়ে আসছি। শিওর খাবে না? আমি বললাম— একেবারে শিওর।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। এত উদ্বেগ, এত চিন্তার মধ্যেও দিব্যি ঘুমিয়ে গেছি।
ঘুমিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। দেখি কী, আমার ভীষণ জ্বর হয়েছে। তাপমাত্রা ক্রমাগত এমন উঠে যাচ্ছে যে রথী ওর বাবা-মাকে ডেকে এনেছে। সেই সঙ্গে ওদের যৌথ পরিবারের আরও কেউ কেউ, তাঁদের আমি চিনি না, তাঁরাও এসে দাঁড়িয়েছেন। ওঁদের পারিবারিক ডাক্তার এসে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখছেন। মাথায় আইস-ব্যাগ আর পায়ে হটব্যাগ লাগানো হয়েছে। উনি বলছেন জ্বরটা কমিয়ে রাখা ছাড়া এখন আর কিছু করবার নেই। রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। রক্ত পরীক্ষার ফলাফলটা না পাওয়া গেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া সন্দেহ করছেন উনি।
রথীর বাবা বললেন— পরের ছেলেকে নিয়ে কী বিপদে পড়া গেল, দেখো তো! রথী ওর বাড়ির ঠিকানা-টিকানা বার করো। খবর দিতে হবে।
এরপর বোধহয় ঘুমিয়েছি। সেই ঘুমটা পাতলা হয়ে এসেছে দেখি আরেকটা স্বপ্ন। আগেরটার সঙ্গে এ স্বপ্নটা দিব্যি জোড়া লেগে গেল। দেখি কী একটা স্ট্রেচার নিয়ে মাইকেল আর রুডি দাঁড়িয়ে আছে, ওরা আমায় স্ট্রেচারে তুলে নিল। একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ওরা কি আমাকে রাধানগরে নিয়ে যাবে? না রাখালবাবুর কাছে সেই শেয়ালদার বাসা বাড়িতে? না কি কোনও হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ফেলবে!
কখনও দেখি রাধানগরের রাস্তা। চারদিকে শিশু আর শিরীষ গাছের ছায়া, দামোদর নদ সরু ঘোলাটে ধারায় বয়ে যাচ্ছে। ঝুরিঅলা সেই বট গাছটা। তার থেকে জোড়ায় জোড়ায় ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসছে। কিন্তু ওদের আর আমার ভয় করছে না। কোনও এক সময়ে ওদের ভয় পেয়েছিলাম মনে করেও আমার কষ্ট হচ্ছে। কেন না, ওরা যে আমারই মতো। একেবারে একরকম। ওরা নাম পরিচয়হীন পরিত্যক্ত কতগুলো অস্তিত্ব। ওরা আমার বন্ধু। আমার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। রাস্তায় বড্ড গর্ত, তার মধ্যে পড়তেই আমার অ্যাম্বুলেন্স আমার শরীর মন ঝাঁকানি খেয়ে কাতরে উঠছে, দূরে দেখতে পাচ্ছি একটা দুর্গ, দুর্গের প্রাচীর সব নিশ্ছিদ্র, খালি বুরুজে বুরুজে কামান কাঁধে নিয়ে গোলন্দাজ সৈনিকরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। কালো কাপড়ে ওদের মুখ ঢাকা।
স্বপ্নের মধ্যেই আমি স্বপ্নের অর্থ বিশ্লেষণ করি। ওই দুর্গ ওটা মৃত্যু। ওইখানে যাবার জন্যই আমার এত আকুলিবিকুলি। জীবন ভেবে ওই মৃত্যুর দিকেই ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি আমি। কামান হাতে মৃত্যুদূতরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা গোলা ছুড়ছে, ওদের এড়িয়ে উল্লসিত হচ্ছি, কিন্তু মজা হচ্ছে, ওদের এড়িয়ে ওদের ঘাঁটির দিকেই ছুটে চলেছি ক্রমাগত। যাব, ওই দুর্গেই যাব, ঢুকব শেষ পর্যন্ত, কিন্তু এভাবে স্বপ্নের মধ্যে নয়, ঘুমের মধ্যে নয়, ঘুমের মধ্যে আমাদের নিজের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ যে থাকে না, আমি তো ঢুকতে চেয়েছিলাম নিজের সিদ্ধান্তে টগবগে একটা ঘোড়ায় চেপে। তাই প্রাণপণে ঘুমটা ঝেড়ে ফেলে জেগে উঠতে চেষ্টা করি।
আর এই চেষ্টার ফলেই পিছলে চলে যাই আর একটা স্বপ্নে। সেখানে সাদা দেয়াল, সাদা পর্দা, আমার নাকে কী যেন আটকানো থাকে, হাতের মণিবন্ধেও যেন চিনচিনে ব্যথার অনুভূতির মধ্যে দিয়ে কিছু একটা আটকানো থাকতে দেখি, সাদা ক্যাপ-পরা মসৃণ মুখ মেয়েরা আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকে। এত অচেনা মুখ! এত সাদা ক্যাপ! এই স্বপ্ন আমার পছন্দ হয় না। কিন্তু স্বপ্ন যে কিছুতেই ইচ্ছে মতো বদলানো যায় না। তাই আত্মসমর্পণ করে দিই। হে স্বপ্ন, কী দেখাতে চাও আমাকে, কী-ই বা বোঝাতে চাও! রাধামাধবের মন্দিরে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজে। বড় জ্যাঠামশাই কপালে চন্দনের তিলক এঁকে কী করুণ স্বরে গাইতে থাকেন ‘বল বল তোমার কুশল শুনি, তোমার কুশলে কুশল মানি।’
ক্রমে স্বচ্ছ হয়ে যায় ঘুমের অন্ধকার, স্বপ্নের পর্দা সাদা হয়ে যায়, দেখি সামনে মন্দাকিনীর মুখ, তার পাশে রথী, তার পাশে রথীর মা, তার পরে একেবারে পায়ের দিকে উনি দিদিমা। এটা স্বপ্ন নয়।
আমি একেবারে মূক।
—কেমন লাগছে এখন মন্দার! রথীর মা জিজ্ঞেস করলেন। ইনি কোথা থেকে এলেন? তার পরে মনে পড়ল রথীদের বাড়িতেই তো আমি গিয়েছিলাম! তা হলে মন্দাকিনী? দিদিমা? রথী— মন্দাকিনীর সঙ্গে কথা বলছে, ওরা কি পরস্পরকে চিনত?
তেরো
—কী হয়েছিল আমার? — এক ঢোঁক ফলের রস ফীডিং কাপে করে আমার মুখে ঢেলে দিয়েছে মন্দাকিনী। ও কোনও জবাব দিচ্ছে না।
—ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া? আমি প্রশ্ন করি।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে চায় ও। কী করে জানলে?
—স্বপ্নে কেউ আমায় বলল। বলে গেল।
—ও, স্বপ্নে? তবে ওটা তোমার বাইরের রোগ মন্দার, আসল রোগটা অন্য।
—কী?
—আসল রোগটার নাম হল — মান। মান হয়েছিল তোমার। এখনও সেটা সেরেছে কি না জানি না। ওর মুখে মৃদু হাসি।
—মান সারে না, ভাঙে। — আমি বললাম।
—তাও তো বটে। শেয়ালদায় সেই চাতালটাতে বসে বসে সারারাত মশার কামড় খেয়েছিলে, মনে আছে?
আমি মাথা নাড়ি।
—তখনই ওই মশাগুলো তোমাকে কামড়েছিল। রাত দশটার পর ওগুলো বেরোয় তো! যাক ঠাট্টা-টাট্টার মুডে আছ। — ও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
ঘরটার চারদিকে চেয়ে দেখি। এটাই আপাতত আমার ভবিতব্য। নিয়তি আমাকে বারবার এখানে এনে ফেলছে। আমি তো এখানে আসতে চাইনি! এদের কাছে আশ্রয় চাইনি। — বরং পালাতে চেয়েছি। তবু আমার দু’ দুটো মারাত্মক বিপদের সময়ে এই মন্দাকিনী আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরাই আমাকে উদ্ধার করেছে। এই মিসেস এলা আইলিন চৌধুরীই আমায় আশ্রয় দিয়েছেন। ইরাবতীর ওপর আমার রাগ হতে পারে। কিন্তু সে রাগ এঁদের ওপর ফলানো বোধহয় ঠিক হয়নি। আমার কাছে এঁদের কিছু পূর্বজন্মের ঋণ রয়ে গেছে, আর এঁদের কাছে আমার ঋণ এই জন্মেরই। ঋণ অনেক।
খুব ক্ষীণ হয়ে গেছে স্বর আমার, জিজ্ঞেস করলাম — কী করে আমার খোঁজ পেলে? — মন্দাকিনীকে একটু রোগা লাগল। চোখগুলো কেমন ক্লান্ত।
—স্টিফেন তো সারাক্ষণ তোমার পেছন-পেছন ছিল। তুমি টের পাওনি? —ও বলল।
—না তো। কেন?
—কোথায় যাও দেখতে, বাড়িটা চিনে আসতে। আমি মাইকেল রুডি তিনজনে গিয়ে চিনে এলাম আবার। রুডি তো সারারাত পাহারা দিয়েছে।
—কেন?
—তুমি জিজ্ঞেস করছ মন্দার? এ কথা জিজ্ঞেস করছ? কী অবস্থা আমাদের! দিয়া তো পাগলের মতো করছিল, তা জানো? আমাকে শুধু মারতে বাকি রেখেছে। তুমি একটা বোকা ছেলে, কলকাতায় নতুন, রাত্তির দশটার সময়ে হোটেলে থাকবে বলে বেরিয়ে যাচ্ছ। রাখালবাবু তো কিছুই নয়। যদি গুণ্ডা বদমাসদের হাতে পড়তে? ভোরবেলা রথীদের বাড়িতে ডাক্তার ঢুকতে দেখে রুডিরা জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে, তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছো। তখন আমি আর দিয়া গেলাম রথীদের বাড়ি।
—দিদিমা গেলেন?
—যাবেন না? কী যে বলো! গেলেন, ওঁরা তো একেবারে অবাক। তবে সবকিছু ওদের কাছে প্রমাণ করা খুব মুশকিল হল।
—কী প্রমাণ? কীসের?
—এই আমাদের আইডেনটিটি। তোমার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক।
—আমি কি হাসপাতালে ছিলাম?
—এটাও কি তোমাকে কেউ স্বপ্নে বলে গেল?
—ধরো তাই।
—ছিলে। তুমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছ মন্দার।
আমি দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে রইলাম। এত দুর্বল, যে কথা বলা তো দূরের কথা, কিছুক্ষণ অন্যের কথা শুনলেও আমার ক্লান্তিতে ঘুম এসে যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারি দিদিমা, দিয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আহ্, এইভাবেই যদি ভেসে চলে যেতে পারতাম।
ভোরবেলা একবার ঘুম ভাঙে আমার। ঠিক ভোরও নয়। শেষ রাত। ঘরে একটা নীলচে আলো জ্বলে। সেই আলোতে ঘরের আসবাবপত্রগুলো কেমন অলৌকিক মনে হয়। কেমন একটা বিভ্রম হয় আমার। যেন কোনও অন্য জন্মে চলে গেছি। স্মৃতির জলের তলায় ভেসে আছে এই সব দেরাজ, আলমারি, টেবিল। দেয়ালে ঠিক আমার সামনে একটা ফটো। পাশাপাশি বসে আছেন আইলিন আর তাঁর স্বামী, আমার দাদামশাই। কৌচের হাতলের ওপর আইলিন, একটা নীল সিল্কের শাড়ি পরে, চুলটা ফাঁপানো, প্রচুর গয়না পরে আছেন, মাথার চুলগুলো খোঁপা করে বাঁধা, মুখটা সামান্য একদিকে কাত করা, তাই খোঁপা, খোঁপায় রুপোর কাঁটা দেখা যাচ্ছে। মাথায় ঘোমটা নেই আইলিনের। পাতলা মুখ, নীল চোখ, দুধেআলতা রং,—ঠিক যেন আমাদের ঠাকুরবাড়ির রাধারানি। —কৌচে বসে বিনয়ভূষণ। উনি পরেছেন হালকা হলুদ রঙের যোধপুরী, সেই রঙেরই, বোধহয় একটু গাঢ় শেডের শেরওয়ানি, তাতে বোতামপটির পাশে জরির কাজ। দিদিমা যদি রাধারানি হন তো ইনি হলেন কৃষ্ণ কালো, তমাল কালো। যে চিত্রকর এই ফটোতে রং লাগিয়েছেন, তিনি যেন রাধামাধবকে মনে করেই রং ব্যবহার করেছেন। এই শেষরাতে সবই কেমন অর্থময়, মনে হয় রাধানগরেই আছি। একটু ঘুরলেই দেখতে পাব রাধামাধবের মন্দির। ঠাকুরমশাই ঠাকুর সাজাচ্ছেন। প্রভাতী গাইছেন ছোট চক্কোত্তি। ছোটবেলাকার অভ্যস্ত আবহাওয়াটা সম্ভবত মানুষের চেতনার মধ্যে একেবারে ঢুকে থাকে। কোথাও একটা ছোট্ট মিল পেলেই একেবারে অন্যরকম, বিপরীত বা বিদেশি আবহাওয়াতেও টুক করে ঢুকে পড়ে। ক্রমশ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। এই যে ভোরবেলাটায় আমার এলিয়ট রোডের বাড়ির এই দক্ষিণের ঘরখানাকে রাধানগর-রাধানগর লাগে, কী মিল আছে দুটোতে? মিল তো নেই-ই, বরং চূড়ান্ত অমিল। চমৎকার চমৎকার আসবাবপত্রে সাজানো এই ঘরের সঙ্গে আমার সেই পশ্চিমের ঘরের সামান্যতম সম্পর্কও নেই। তবু পুরো রাধানগরীয় আলো-হাওয়া ঢুকে পড়ল এখানে এই ভোরবেলা আর ওই ফটোগ্রাফটাকে কেন্দ্র করে।
দক্ষিণের জানলার পর্দা একটু সরিয়ে দিই। ভোরবেলার ধারহীন রোদের একটা ভোঁতা-ভোঁতা ফলা বেঁকে পড়ে ওই ফটোগ্রাফটার ওপর। মেমসাহেব বলে মনে হয় না ওঁকে, মনে হয় একজন অসামান্য সুন্দরী, এমন সুন্দরী যাঁকে ঠিক আমাদের পরিচিত দেশজ মুখশ্রীতে কখনও দেখা যাবে না। এই সুন্দরী একজন বিস্ময়, সবসময়ে একটা চমক দেন ইনি। সেইজন্য যেন একটু বিদেশি-বিদেশি মুখে রাধার আদল আরও খুলেছে।
‘কাঞ্চন বরণী কে বটে সে ধনী
ধীরে ধীরে চলি যায়
হাসির ঠমকে চপলা চমকে
নীল শাড়ি শোভে গায়,’
‘গোরোচনা-গোরী-নবীন কিশোরী’ নয় এই আইলিন? এঁর রঙে লালচে ভাব। তবু এঁকে দেখলেই মনে হয় ‘যঁহা যঁহা ঝলকত অঙ্গ তঁহি-তঁহি বিজুরী-তরঙ্গ।’ একটু যে মুখ কাত করে তাকিয়ে রয়েছেন বিনয়ভূষণের দিকে তাতেই যেন বিজুরি-তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। আবার যে মুগ্ধতা, সজীবতা আইলিনের হাবে-ভাবে, — বিনয়ভূষণের মধ্যে তার কিছুই নেই। তিনি সত্যিই একটা তমালগাছের মতো, কালো, স্তব্ধ, মগ্ন। কেমন একটা বিষণ্ণতা ওঁর মুখে। আমাদের রাধামাধবের পেতলের মূর্তিতে খুব গতানুগতিক ভঙ্গিতে আয়ত চোখ, টানা ভুরু আর হাসিমুখ আঁকা, মাধবের মূর্তিটা কালো রং করা। হাতে বাঁশি, কিন্তু সে মূর্তিও আমার কেমন বিষণ্ণ-বিষণ্ণ লাগত। পুরো রাধানগরটাকেই উঠিয়ে নিয়ে এল এই ঘরে ওই ফটোগ্রাফ। ছোট্ট ছোট্ট কাশ্মীরি শাল দিয়ে মূর্তি দুটির অঙ্গ ঢেকে দেন ঠাকুরমশাই এমনই শীতে। রাত্তিরবেলায় হালকা নীল সার্টিনের লেপ ঢাকা দিয়ে শোন রাধামাধব। পৌষসংক্রান্তির দিনে কনকনে হাওয়া বইলে ঠাকুরমশাই বলেন ‘আজ আর স্নান দিয়া কাজ নাই।’ তুলসীপাতা বুলিয়ে ঠাকুরের শুদ্ধিকৰ্ম সারেন তিনি।
শুনেছি এ ঘরটা আমার মাসির। মাসি মিলির একটা সাদা কালো ফটোগ্রাফ আছে ঘরে। ঠিক আমার পড়ার টেবিলের পেছনের দেয়ালে। গালে হাত দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে মাসি। চোখগুলোর দৃষ্টি একটু নীচের দিকে, একটু দূরের দিকে। ছায়াময় এই ছবির মানুষটি একেবারেই অল্পবয়সী। হয়তো আমাদের মতোই হবে। এক আধ বছরের ছোটও হতে পারে। গাল গলার গোল-গোল ভাবে —অল্পবয়সটা বোঝা যায়। কিন্তু চোখের দৃষ্টিটা খুব পরিণত। যেন অনেক জেনেছে, অনেক বুঝেছে, তারপরে চুপচাপ শুধু তাকিয়ে আছে। কিছু বলা বৃথা, শুধু দেখে যাও —এই রকমই যেন বাণী ছবিটার। এ হল আরেক রাধিকা। না আমার দিদিমার মতো, না আমার মায়ের মতো। সাদা-কালো ফটোতে তো রং বোঝা যায় না। তবু মনে হয় ইনি শ্যামলী। দিদিমার মতো কমলিনী গোরীও নয়, আর আমার মায়ের মতো জ্বলজ্বলে বিজলী-গোরীও নন। মায়ের মুখটা যেমন ঈষৎ লম্বাটে, এর মুখটা একটু চৌকো ধাঁচের। চিবুকে একটা সুন্দর ভাঁজ, মায়ের চোখ চেরা চেরা, মাসির চোখ বড়বড়, পালক ছাওয়া, যেন আমাদের রাধানগরের পশ্চিমপুকুর, পাড়ে ভর্তি কলাগাছ, বেশি কেউ যায় না। নির্জন, পাখির ডাকে ভরা।
আমি চোখ বুজিয়ে ফেলি। এতক্ষণ চেয়ে থেকে থেকে আমার আবার ঘুম এসে গেছে।
এই ঘুম ভাঙাবে খালেদা-দিদি চমৎকার এক কাপ চা দিয়ে। এই সময়ের ঘুমটা কখনও খুব গভীর হয় না। হঠাৎ নিজেরই খেয়াল হয় আমি আসলে ভাবছি। ভাবছি দুটো মুখ। দেখছি। —মন্দাকিনী আর ইরাবতী। ইরাবতীর ওপর থেকে সেই বিধ্বংসী ক্রোধ বা তিক্ততা এখন আমার চলে গেছে। ওটা যেন একটা ঘুমিয়ে-থাকা ব্যথার জায়গা। — টিপলে বোঝা যায় আছে, কিন্তু সব সময়ে অনুভব করা যায় না। দিদিমা বলেন ‘ডলি’। দিদিমার এই ডলিকে আমি ভাল করে চিনতে পারি না। আমার মা সোজা হয়ে হেঁটে যেত রাধানগরের মেঠো-মেঠো রাস্তা দিয়ে। মাথায় ছোট চুল, সাধারণের চেয়ে একটু বেশি লম্বা, জ্বলজ্বলে চেহারা, জোরালো ধরন ধারণ, আমাদের দুর্গা কিম্বা জগদ্ধাত্রী-ঠাকুরের মতো। মা আমার মুখে চকলেট পুরে দিত, আমরা একসঙ্গে বসে চাইনিজ-চেকার খেলতাম, সাপলুডো খেলতাম, মা আমাকে অ্যাণ্ডারসেনের ফেয়ারি টেইলস-এর বই ধরে ধরে ইংরেজি শেখাত, টুনটুনির বই, ছোটদের রামায়ণ, ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী মা আমাকে কিনে দিয়েছিল। আজ পর্যন্ত আমার সবচেয়ে প্রিয় বই ‘রাজকাহিনী।’ কিন্তু মন্দাকিনী বলেছে মা কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য রাধানগরে যেত। আমার জন্যে নয়। তা হলে ওই ‘ক্ষীরের পুতুল’ ‘রাজকাহিনী’ বা বিস্কুট-চকলেটের প্যাকেটের মানে কী? মানে কী সেই মেরুন সোয়েটারের যার ওপরে মিকি মাউস আর ডোনাল্ড ডাক বোনা ছিল?
মন্দাকিনীকে আমি ভাল বুঝতে পারি না। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় মন্দাকিনীকে আমার কেমন লাগে, তারও কোনও সোজা জবাব আমি দিতে পারব না। ডলি বলে যে মানুষটির উল্লেখ করেন দিদিমা, মন্দাকিনীর মধ্যে তাকেই যেন দেখা যায়। — বেপরোয়া, ডানপিটে, দলের পাণ্ডাগিরিতে পটু, একটু খেয়ালি, একটু কি নিষ্ঠুরও? ওকে বোন বলেও ভাবতে পারি না আমি কিছুতেই। আঠারো বছর বয়সে কি আর নতুন করে কাউকে বোন ভাবা যায়? আর, আমি যেহেতু এতকাল একা একা কাটিয়েছি, ভাই, বোন এ সব সংস্কার আমার ভেতরেই নেই। মন্দাকিনী বড় জোর একজন আত্মীয়, যে অনেকটা বন্ধু হয়ে গেছে। তবে প্রথম প্রথম মন্দাকিনীর রূপ, তার সপ্রতিভতা যেমন আমার চোখ ঝলসে দিত, আমাকে কুঁকড়ে দিত, এখন আর সেটা হয় না। খুব তাড়াতাড়ি আমি সাবালক হয়ে উঠেছি। কেউ আর আমাকে দমাতে পারবে না।
চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শুয়েছিলাম।
—মন্দার! জেগে আছ! খুব সন্তর্পণে নরম গলায় ডাকলেন দিয়া।
চোখ মেলে দেখি ওঁর হাতে চা।
—আপনি?
উনি হাসলেন— নাও, চা নাও। আজকে আমার পূজা হয়ে গেছে।
দেখি উনি একটা ঈষৎ হলুদ আভার শাড়ি পরেছেন। চুলগুলো পিঠের ওপর মেলা। কপালে একটা চন্দনের টিপ।
কী পুজো ইনি করেন রোজ রোজ জিজ্ঞেস করতে সঙ্কোচ হয়। মন্দাকিনীর কাছে আমি যতটা স্বচ্ছন্দ, এঁর কাছে ঠিক ততটাই আড়ষ্ট।
—কেমন বোধ করছ আজ?
—ভাল। আর কয়েকদিনের মধ্যেই কলেজ যেতে পারব।
উনি একেক সময়ে কেমন নির্নিমেষে চেয়ে থাকেন আমার দিকে। আমার ভীষণ অস্বস্তি হয়।
বললেন— তা বোধ হয় পারবে না। বাসের ভিড় আছে। সে সব কাটিয়ে যাওয়া তো! যদি একটা গাড়ি থাকত। অবশ্য খুব দরকার হলে তুমি ট্যাক্সি করে যেতে পারো। তা সে-ও এখনও দেরি আছে।
এটা অবশ্য আমি মনে মনে জানিই। আমি পারব না। উঠে যখনই বাথরুমে যাই, আমার মাথা ঘুরতে থাকে। এই দুর্বলতা কাটানোর জন্যে আমাকে রোজ ডিম খেতে হচ্ছে। ডাক্তার বলছিলেন মুরগির জুস খেলে তাড়াতাড়ি বল পাব, কিন্তু সে আমি খেতে পারব না। একদিন মন্দাকিনী খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল। তাতে আমার এমন বিধ্বংসী বমি হয় যে দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করা হয় নি।
—কী ভাবছিলে শুয়ে শুয়ে? কী ভাবো? —উনি জিজ্ঞাসা করলেন।
—ভাবিনি, দেখছিলাম।
—কী?
—আমি ফটোগ্রাফটা আঙুল দিয়ে দেখাই।
উনি কি একটু লাল হলেন? ওঁর মতো প্রৌঢ়া আমি দেখিনি। ওঁর হাবভাব এখনও কিশোরীর মতো। চলাফেরা করেন নিঃশব্দে, হালকা পায়ে। যখন চলে যান, মুখ তুলে না দেখলে মনে হবে কোনও অল্পবয়স্ক মেয়ে চলে গেল বুঝি বা। হাত দুটো, বিশেষ করে হাতের পাতায় একটা শুকনো ভাব। মুখে কয়েকটা খয়েরি খয়েরি তিলের মতো। কিন্তু চোখ মুখের একটা ক্লান্ত ভাব, লাল চুলের মধ্যে একটা বিবর্ণতা, কপালের ওপরে কয়েকটা হালকা দাগ আর কয়েকটা রুপোলি চুল এ ছাড়া ওঁকে ঠিক প্রৌঢ়াও যেন বলা যায় না। দুঃখের আঁচে উনি যেন শুকিয়ে গেছেন, এমনটা মনে হয়। ওই ফটোগ্রাফের ফুটন্ত ফুলের মতো আইলিন আর নেই। ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে উঠেছে। কিন্তু ফুলই। হঠাৎ আমার মনে হল ‘বিরতি আহারে। রাঙা বাস পরে। যেমতি যোগিনী পারা।’
এই সব পদ আমাদের ঠাকুরবাড়ির হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়, ঝুলন, রাস, দোল, জন্মাষ্টমী উপলক্ষে যে সমস্ত কীর্তনিয়া, কথকঠাকুর, নানা দেশের বৈষ্ণব জড়ো হন তাঁদের কথাবার্তায় গানে এই সমস্ত পদ ঘুরে ফিরে আসে, আমার স্মৃতিতে এগুলো গেঁথে আছে। আমি জানি না এ সব কার পদ, কিন্তু ওই বুলি ওই গান আমার হাত পা যেমন নিজস্ব তেমনই নিজস্ব হয়ে গেছে। কলকাতায় এসে যেটা আমার সবচেয়ে অসুবিধের ব্যাপার হয়ে গেছে সেটা হল ভাষা। এরা, কলকাতার ছেলেরা কেমন ভাঙা-ভাঙা ভাষায় কথা বলে। শব্দগুলো উচ্চারণ করে খুব অবহেলার সঙ্গে। যেন উচ্চারণের যোগ্যই নয় সেগুলো। আমি গোটা গোটা করে কথা বলতে অভ্যস্ত। আমি যদি এই সব পদ উদ্ধৃত করি ওরা আমার পেছনে লাগবে। এমনিতেই ওরা বলে ‘এই যে মন্দার মহারাজ কেমন আছেন?’ আমি অবশ্য বলি, ‘কেমন আছেন’-টা চলবে না—বলতে হবে ‘কুশল তো?’ তখন ওরা খুব হাসে। কিন্তু আমি কী করে আঠারো বছর ধরে শেখা আমার ভাষা, আমার চিন্তাধারা সব পাল্টে ফেলি?
আজ সকালবেলা দিদিমাকে দেখে ওই চরণগুলো মনে এল—
বিরতি আহারে/ রাঙা বাস পরে/ যেমতি যোগিনী পারা।
উনি বললেন— কবেকার ফটো! তখন সবে মাস ছয়েক আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম উনি, দাদামশাই অত বিষণ্ণ কেন?
দিদিমা চমকে উঠলেন, বললেন— বিষণ্ণ, না? আমি তখন বুঝতে পারিনি, পরে মনে হয়েছিল। তোমারও মনে হচ্ছে?
আমি মাথা নাড়ি।
উনি বললেন— তোমার দাদাকে তাঁর বাবা তো আর বাড়ি ঢুকতেই দিলেন না। হি ওয়জ ডিজওন্ড্। তাই-ই হয়তো! ফটোটা দেখে তোমার আর কী মনে হচ্ছে?
আমি বললাম— রাধাকৃষ্ণ।
উনি আবারও চমকে উঠলেন। আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছেন। মন্দাকিনী ঢুকল। রাত পোশাকের ওপর একটা আলগা লাল কার্ডিগ্যান পরেছে ও। চুলগুলো রুক্ষ এলোমেলো হয়ে বেরিয়েছে। মুখে চোখে খুব কষে জল দিয়েছে বোধহয়, লাল হয়ে আছে মুখটা। সামনের চুলে কয়েক ফোঁটা জলও লেগে রয়েছে। হেসে বলল—
‘আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর?’
আমি বললাম— গুড মর্নিং।
চোদ্দো
মন্দাকিনী কলেজ গেছে। আমার এখনও বেরোবার অনুমতি মেলেনি। পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। মন্দাকিনী অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে ওর টিউটর প্রদ্যুম্নদার কাছে আমাকে নিয়ে যাবে। উনি নাকি সব মুশকিলের আসান। দিয়া বিশ্রাম করছেন নিজের ঘরে। স্টিফেন আর খালেদাও তাই। আমার আর শুয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। বারান্দাটা যেখানে ঘুরে গেছে সেখানে দাদামশাইয়ের লাইব্রেরি। দিয়া নিজে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে এ সব ঘর দেখিয়েছেন। লাইব্রেরিতে গিয়ে সারি সারি আলমারিতে বইগুলো দেখি। রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎচন্দ্রের বা বিভূতিভূষণের রচনাবলী নেই, আলাদা আলাদা করে সব বই রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র, বৈষ্ণব পদাবলী, কালিদাসের মেঘদূত/ কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুবাদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতাসংগ্রহ, নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ ‘বিষের বাঁশি’ … পুরো দুটো আলমারি ভর্তি বাংলা বই। ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহ আরও ভাল। এগুলো পাওয়াও যেত তখন ভাল প্রকাশনার ভাল বাঁধাই-এ। শেকসপীয়র তো রয়েছেই। ডিকেন্স, এইচ. জি. ওয়েলস, স্টিভেনসন, বার্নার্ড শ এ সব পুরো সেট রয়েছে। বাংলা পড়া থাকলেও, ইংরেজি ক্লাসিক তো আমার তেমন কিছুই পড়া নেই। এখান থেকে নিয়ে পড়ব। আলমারি খুলতে গিয়ে দেখি চাবি দেওয়া। মন্দাকিনী বলেছিল বটে, দাদার জিনিসপত্র সম্পর্কে দিয়া খুব সাবধান। রকিং চেয়ারটাতে বসে দোল খেতে খেতে কাগজ পড়ি অগত্যা।
হঠাৎ দেখি সামনে একজন স্যুট টাই পরা ব্যক্তিত্ববান ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। এত কাছে দাঁড়িয়ে যে প্রথমটা আমি ভাবতেই পারিনি এটা আমার দাদামশাই। দাদামশাই আর কী! শিশিরদাদের থেকেও বয়সে ছোট। উনি আমাকে ডাকলেন। ওঁর পেছন পেছন যাচ্ছি। উনি একটার পর একটা আলমারির চাবি খুলে দিচ্ছেন। ‘তোমার’ বলছেন মুখে শব্দটা ফুটছে না। কিন্তু বুঝতে পারছি। টেবিল থেকে হাতির দাঁতের কলমদানিটা তুলে উনি আমার হাতে গুঁজে দিলেন। তার পরে বেরিয়ে গেলেন। ঠিক দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে একবার আমার দিকে ফিরে চাইলেন— কী যেন একটা বললেন— অমনই অস্ফুটে, ভাল বুঝতে পারলাম না। কী যেন একটা দেখতে বললেন, ‘দেখো’টা বুঝতে পারলাম। তারপরেই চটকা ভেঙে গেল। আলমারিগুলো যেমন বন্ধ ছিল তেমনই আছে। হাতির দাঁতের কলমদানিটা টেবিলের ওপর যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে।
উঠে পড়লাম চেয়ারটা থেকে। ঠিক ভয় নয়, কেমন একটা অস্বস্তি। যেন অনেকদিন আগে, একটা অতীত ইতিহাসের সময়ে ফিরে গেছি। সেই সময়টা আমার চেতনার ওপর থাবা বসাচ্ছে। ক্রমাগত বসিয়ে যাচ্ছে। সেই থাবাটা আমি হাজার চেষ্টা করেও নামিয়ে দিতে পারছি না।
ঘরটা ছাড়িয়ে কিছুটা এসেছি নীচে সদর দরজার বেলটা বেজে উঠল। আমি নীচে যাই। এদিকে ওদিকে কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না। খিল দুটো আস্তে আস্তে নামাই। মনে হচ্ছে দরজা খুললে সেই ভদ্রলোককে দেখতে পাব, যিনি লাইব্রেরির বইগুলো আমাকে দাতব্য করে গেলেন। খিল নামিয়ে দরজার একটা পাল্লা ধরে আমি পেছনে সরে যাই। বাইরে সালোয়ার কামিজ পরা এক ভদ্রমহিলা, হাতে একটা পাতলা সুটকেস তুলে নিতে নিতে তিনি বলেন, ও স্টিফেন, ট্রেনটা যা লেট না! দীজ রেলওয়ে পীপ্ল… একটা শক খেয়ে উনি থেমে গেলেন। আমার দিকে চোখ বড় বড়, বিস্ফারিত করে তাকিয়ে আছেন। এগারো কি দশ বছর বয়সে আমায় উনি শেষ দেখেছেন। তখন বালক ছিলাম। ছোটখাটো, রোগা রোগা, খাকি হাফপ্যান্ট পরে থাকতাম, ছাই রঙের হাফশার্ট, দুটোই গ্রামগঞ্জের হাট থেকে কেনা, তখনও আমার শিশুর ত্বক, শিশুর মুখ। এখন সাত-আটটা বছর চলে গেছে। হু হু করে লম্বা হয়ে গেছি। গোঁফ দাড়ি গজিয়ে গেছে। কে জানে গত ছ-সাত মাস শহরের জল গায়ে লাগায়, আর গত একমাসের রোগভোগ রোগমুক্তি আর বিশেষ সেবাযত্নের ফলে আর কী পরিবর্তন হয়েছে আমার।
শক কি আমিই খাইনি? ছিলাম ঘোরের মধ্যে। ঘুম-ঘুম চোখে নেমে আসছিলাম, মাথার মধ্যে ছিলেন বিনয়ভূষণ চৌধুরী। ভেবেছিলাম মন্দাকিনী ফিরে এল বোধহয়; কী করে জানব যাঁকে আজ প্রায় ছ’ বছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজছি, যাঁর কাছে আশ্রয় নেবার জন্য আমার এই শহরে আসা, যাঁর জন্য আমার মাঝরাতে গৃহত্যাগ, সেই তাঁকেই আমি দরজা খুলে দেব? অবশ্য এ বাড়ি ওঁরই। উনি এখানে আসতেই পারেন। আমার চাওয়া-না-চাওয়ার ওপর ওঁর আসা নির্ভর করে না। আমিই বরং এখানে বহিরাগত। এখানে আমার উপস্থিতির কোনও সদুত্তর নেই। ইনি তো চাননি আমি এখানে আসি। কিন্তু দেখতে দেখতে এতগুলো দিন কেটে গেল মিসেস এলা চৌধুরী কি মন্দাকিনী কেউই কি চিঠি লিখেও ওঁকে জানায় নি আমি এখানে আছি?
স্টিফেন এসে দাঁড়িয়েছে। কী যেন বলছে হড়বড় করে। খোলা দরজা-পথে ওদের দুজনকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি চলে গেলাম। উঠোনটা পার হচ্ছি, সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম, বারান্দা পেরিয়ে যাচ্ছি, এঁরা যে ঘরটায় আমায় থাকতে দিয়েছেন সে ঘরে ঢুকলাম। দরজাটা কি বন্ধ করে দেব? নাঃ, নাটকীয় হয়ে যাবে ব্যাপারটা। তা ছাড়া এ ঘরে ওঁর অধিকার তো আমার চেয়ে অনেক বেশি। ওঁর অনুমতি ছাড়া এ ঘরে থেকে আমিই বরং আইন লঙ্ঘন করেছি। পর্দাটা টেনে দিলে কি খুব দোষ হবে?
মাথার মধ্যেটা কী ভীষণ ভোঁ ভোঁ করছে। এই অসুখটা যে আমাকে কী করে ফেলল! কত হেলাফেলায়, কত অযত্নে বড় হয়েছি কই দু-এক দিনের জ্বর-টর ছাড়া বড় কিছু কখনও হয়েছে বলেও তো মনে পড়ে না। শরীর স্বাস্থ্যও ছিল খুব ভাল। কলকাতায় প্রথম আসার পর শেয়ালদায় কয়েক মাস যখন-তখন খেয়ে, না খেয়ে, যা তা খেয়ে, বাজে পরিবেশে অতগুলো দিন কাটালাম, তখনও কোনওদিন এমন মাথা ভোঁ ভোঁ করেনি, যেমনটা এই বাড়ির আরামে আয়েসে রাশি রাশি ফল, ভিটামিন, ডিম ইত্যাদি খেয়েও হচ্ছে। এদের এই বাড়ির এই পরিবারের জীবনযাত্রাতেই কোনও ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া আছে যা আমার সহ্য হয় না, আমি কাবু হয়ে যাই, এরা অবশ্য বেশ ভালই থাকে, হয়তো একটু বেশিই ভাল। মন্দাকিনীর কী স্বাস্থ্য। ও পাশ দিয়ে চলে গেলে মনে হয়, ওর গায়ের বাতাসেই আর্ধেক লোক পড়ে যাবে। যেন একটা জোরালো বাস্কেটবল খেলোয়াড়। পুঞ্জীভূত শক্তি সামর্থ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ইনি? এই মহিলা? আজ তাঁকে সম্পূর্ণ বাইরের একজন তৃতীয় ব্যক্তির চোখ দিয়ে দেখলাম। কারও মা বলে ওঁকে মোটেই মনে হয় না। উনিও একজন খেলোয়াড়। কাউকে কোথাও ত্যাগ করে আসার কোনও গ্লানি ওঁর চেহারায়, হাবে ভাবে নেই। হবে না-ই বা কেন। উনি তো লাইফ এনজয় করছেন। মন্দাকিনী বলছিল না?
ক’টা বাজে? খালেদাদিদি আমার বৈকালিক ফলাহারের আয়োজন হাতে করে উপস্থিত। যেন আমি ঠাকুর। টেবিলের ওপর টাইম-পীসটার ওপর রোদ পড়ে চোখ ঝলসে দিচ্ছে, সময়টা দেখতে পাচ্ছি না। চারটে হবে আর কী! খাচ্ছি, দাচ্ছি আর ঘুমোচ্ছি। সময় কাটছে না। আজই সন্ধে থেকে ওই লাইব্রেরির বই ধার করতে হবে। পৃথিবীর যেখানে যা-ই-ই ঘটুক, আমাকে স্থির থাকতে হবে নিজের লক্ষ্যে। আমাকে মনে রাখতে হবে আমি বাবা-মার পরিত্যক্ত সন্তান। সোজা সিধে ভাষায় বলতে গেলে বাপে-তাড়ানো, মায়ে-খেদানো। জীবনে যা পাচ্ছি সবই দয়ার দান, বিন্দুমাত্র অধিকার নেই আমার বড়জ্যাঠামশাইয়ের দেওয়া টাকা-পয়সার ওপর। দিয়ার এই আদর-যত্ন, মন্দাকিনীর সাহায্য এ সবই আমার অধিকার-বহির্ভূত পাওয়া, যার দাম ভবিষ্যতে আমায় চুকিয়ে দিতে হবে যেমন করে হোক। কী ভাবে দেব? যদি টাকা-পয়সা ভাল উপার্জন করতে পারি দিয়াকে আমি তীর্থ-ভ্রমণ করাব। ওঁকে কেদার-বদরি, অমরনাথ, সোমনাথ, সব দেখাব, দক্ষিণে তিরুপতি, মীনাক্ষী, কন্যাকুমারী সব ঘুরিয়ে নিয়ে আসব। আর মন্দাকিনী? মন্দাকিনীর বিয়েতে একটা খুব চমৎকার খুব দামি গয়না উপহার দেব। ওই ছবির আইলিন গলায় যেমন পরে রয়েছেন ওই রকম কিছু।
—সন্ধেবেলায় ঘুমোচ্ছ কেন? মন্দাকিনী আমায় অল্প অল্প ঝাঁকাচ্ছে। সত্যি তো! আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
উঠে বসে বললাম— দূর, কাল থেকে আমি কলেজ যাব।
—একদিন গিয়ে দেখো। তোমাদের ক্লাসের দু-একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তেমন কিছু এগোয়নি। আসল তো প্র্যাকটিক্যাল? ধরো আড়াইটে থেকে চারটে। ওই সময়টায় যদি যাও তো…, অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে? বললাম জাক সুপটা খাও, তিন চার দিনে খাড়া হয়ে যাবে। তা মাছ খাবে না, চিকেন খাবে না সারবে কী করে? এখন চলো, চা খাবে।
দোতলার সিঁড়ির মুখেই আমাদের চা খাওয়ার জায়গা। একটা গোল মাৰ্বল-টপ টেবিল আছে। এটাকে ঘিরে চারটে চেয়ার। আজকে চারটে চেয়ার ভরে যাবে।
কিন্তু বারান্দা দিয়ে যাবার সময়ে দেখলাম—ডলির ঘরের দরজা বন্ধ। যতক্ষণ এঁরা কিছু না বলছেন, আমিও কোনও কথা তুলব না। অনেক প্রশ্ন আসছে মনে, আগেও এসেছিল। আগে প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে ছিল, আজ সেগুলো আবার সব বাধা ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। কিন্তু এঁদের কোনও রকম সুবিধে করে আমি দেব না। আমার দিক থেকে নীরবতা-ই হবে এখন একমাত্র প্রশ্ন। আমি এসেছি এ খবর কি ওঁরা ডলিকে দেননি? না দিয়ে থাকলে—কেন? আমার যে এত বড় একটা অসুখ করেছিল সেটাও ওঁকে জানাবার প্রয়োজন ছিল না? হোক অবাঞ্ছিত সন্তান, তার কঠিন অসুখ বা মৃত্যুর সময়েও মা কি উদাসীন থাকতে পারে? এ সব প্রশ্ন আমি করব না, প্রশ্নগুলো ওঁরা যদি অনুভব করে থেকে থাকেন, তা হলে উত্তর দেবার তাগিদও ওঁদের ভেতর থেকেই আসবে। আর, যদি তা না আসে, তা হলে বুঝতে হবে এঁরা এতকাল যেমন এ সব এড়িয়ে ছিলেন, আজও তাই করতে চাইছেন। যে জেগে জেগে ঘুমোয়, কে তাকে জাগাতে পারে? সুতরাং কথাবার্তা এই রকম নিরীহ সব বিষয়ে হল:
আমি—আজ দুপুরে আমি লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। বইয়ের আলমারিগুলো দেখলাম বন্ধ।
দিয়া—তোমার কিছু দরকার?
আমি—বইয়ের কালেকশন দেখলাম খুবই ভাল। আমি কি বইগুলো পড়তে পারি?
দিয়া—বাঃ বই তো পড়বার জন্যেই।
আমি—মন্দাকিনী পড়নি ওখান থেকে কিছু?
মন্দাকিনী—পড়েছি। তবে দিয়া লাইব্রেরির বই নিয়ে এত ফাস্ করে…। ওইখানেই বসে পড়তে হবে। অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া চলবে না। বইয়ের পাতা-টাতা মোড়া চলবে না। দাগ দেওয়া চলবে না। এত বিধিনিষেধ মেনে কি আর পড়া যায়? শেকসপীয়র টিয়র আমি যেটুকু পড়েছি, নিজে কিনে পড়েছি।
আমি—আছে বাড়িতে, তবুও কিনেছ?
মন্দকিনী—হ্যাঁ! খুঁটিয়ে পড়তে গেলে তো একটু দাগ দিতে হয়ই, হয় না?
আমি—শেকসপীয়র ছাড়া?
মন্দকিনী—ক্ল্যাসিকগুলো কী রকম মোটা মোটা হয় তো দেখেছই! সারাক্ষণ বসে বসে পড়া যায়? আমি শুয়ে শুয়ে পড়তে ভালবাসি। নিজের ঘরে, বারান্দায়, স্কুলের লাস্ট বেঞ্চে পড়তে ভাল লাগে। তাই স্কুল কলেজের লাইব্রেরি থেকে ধার নিতে হয়েছে। —হঠাৎ মন্দাকিনী হেসে উঠল।
—প্রদ্যুম্নদা যদি শোনেন আমাদের বাড়ি ‘আনা কারেনিনা আছে, তারাশংকরের ‘ধাত্রীদেবতা’-টেবতাও আছে, তো ওঁর ফিট হয়ে যাবে।
আমি—কেন?
—ওই বইগুলো আমাকে পড়াবার জন্যে উনি লাইব্রেরিগুলো চষে ফেলেছেন তো! এক বই রিনিউ করতে কতবার যেতে হয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিল, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ….
দিয়া এতক্ষণ চুপই করেছিলেন, বললেন—বইয়ের যত্ন করা কি খুব দোষের? বলো মন্দার?
মন্দাকিনী বলল—যত্ন করা দোষের নয়, তুমি যেটা করো সেটা হল আগলানো ‘যক্ষের’ মতো।
—মন্দার সব বই পড়তে পারে, যেখানে খুশি—দিয়া বললেন।
—‘আনা কারেনিনা?’ ওটা কার? আমি জিজ্ঞেস করি।
—টলস্টয়ের নাম শুনেছ?
টলস্টয়ের ‘শর্ট স্টোরিজ’ হল শেষ গল্পের বই যা আমাকে মা দিয়েছিল। জানি বই কী, টলস্টয়ের নাম ভাল করেই জানি।
—মন্দাকিনী আমাকে একটু ভাল ভাল বই বেছে দেবে?
—তুমি দিয়াকে বলো, দিয়া আমার চেয়ে অনেক বেশি পড়েছে।
দিমিত্রি, আইভান, আলিওসার গল্প পড়ছি আমি। এরা সকলেই এক পিতার সন্তান। কিন্তু দিমিত্রি এক মায়ের, আইভান আর আলিওশা আর এক মায়ের। কেউই এরা মাকে পায়নি। আত্মীয় বন্ধুদের দয়ায় মানুষ হয়েছে। এদের বাবা একটা আস্ত শয়তান। দিমিত্রি ছেলেটা ভীষণ রাগী জেদি, উচ্ছৃংখল। আইভান হল স্থিরবুদ্ধি, ভীষণ বুদ্ধি ধরে। আর আলিওশা সরল, নরম মনের ক্ষমাশীল…।
পৃথিবীতে দুটো পরিস্থিতি, দুটো সঙ্কট, দুটো মানুষ বোধহয় কখনও পুরোপুরি একরকম হয় না। আমার অবস্থাও এদের মতো। মা বাবা থেকেও নেই। অনাথ… আত্মীয়দের বদান্যতায় এত বড়টা হয়েছি। তবু আমার অবস্থা আর ওদের অবস্থা ঠিক এক নয়। কত বিভিন্ন রকমের অনাথ হয়, পড়তে পড়তে আমি ভাবলাম। দিমিত্রির মতো হতে পারতাম তো আমি! ওইরকম বন্য, উদ্দাম! বাবার উদাসীনতা দিনের পর দিন সহ্য করেছি কেন? দাবি করতে পারতাম তো! একদিন একটা কথা কাটাকাটিও তো হল না?
মা নিঃশব্দে ডিভোর্স করে চলে এল, না করল বাবা সে নিয়ে কোনও বিষোদগার, না করলাম আমি। জানলামই না। যে ভাবে লেখাপড়াটা চালিয়ে গেছি, মোটামুটি ভালই করছি। তাতে বলা যায় আইভানের পথে চলেছি আমি। কিন্তু অত চাতুর্য, অত বুঝে সুজে গুনে গেঁথে চলা আমার বুদ্ধিতে কুলোবে না। আর, আলিওশার মতো অমন দয়ালু, পরার্থপর, সাধু-সন্ত প্রকৃতির মানুষ আমি নই, হবার ইচ্ছেও নেই।
—মন্দার! আমার মাথায় একটা নরম হাতের ছোঁয়া।
—এত রাত পর্যন্ত পড়ছ? শরীরটা তো ঠিক নেই। শরীর খারাপ হবে যে!
—তাতে তোমার কী?
—তুমি কদিনেই কত বড় হয়ে গেছো!
ইনি কি ভেবেছিলেন আমি ক্রমশ ছোট হয়ে যাব? ছোট হতে হতে হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যাব? সেটা হলে অবশ্য ভালই হত এঁর। মুখোমুখি হতে হত না।
আমি বইটা রেখে পাশ ফিরে চোখ বুজলাম। মাথার কাছে বেড ল্যাম্পটা নিভে গেল। যখন উনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তখনই আমি বুঝতে পারলাম—মা নয়, দিয়াই এসেছিলেন। এত তীব্র ছিল আমার মাকে প্রত্যাশা যে দিয়াকেই আমি মা ভেবে নিয়েছি। আর উনি, উনিও সেটা বুঝতে পেরেছেন।
পনেরো – মন্দাকিনীর কথা
আমাদের ব্রেকফাস্ট টাইম কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাড়ে আটটা। বহুদিন থেকে এ নিয়ম চলে আসছে! সম্ভবত দাদার টাইম থেকে। এই সময়টা যাদের সুট করবে না, যেমন আমার, তারা পুরো ব্রেকফাস্ট না করে অল্পস্বল্প খেতে পারে, আমি যেমন একটি বিস্কিট, একটু দুধ বা চা খেয়ে থাকি, কিন্তু এই সময়টা আমাদের এই গোল টেবিল কনফারেন্সে যোগ দিতেই হবে।
ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি দিয়া আর মা ইতিমধ্যেই এসে গেছে। কথা বলছে। খাবার-দাবার এখনও এসে পৌঁছয়নি। ওরা দুজনে কথা বলবে বলেই বোধহয় একটু আগে এসে গেছে। আলাদা কথা বলার দরকার ছিল তো সেটা ঘরেই সারলে পারত! আমাকে আসতে দেখেই এই থেমে যাওয়া এটা তো এড়ানো যেত! এটা কি অভদ্রতা নয়? এর পর মন্দার বেচারি আসবে, তো তাকে দেখে তো এরা হাত বাড়িয়ে মুখোশ তুলে মুখে আঁটবে মনে হচ্ছে।
আমার মুখোমুখি বসেছে দিয়া। দিয়া রোজই আজকাল বেশ সকাল-সকাল গোসল করে নিচ্ছে দেখছি। সাদা শাড়ি পরেছে। খুব ফাইন মিলের শাড়ি, ব্লু পাড়, দিয়া কি হিন্দু বিধবা সাজতে চায় না কি? কপালে আবার একটা চন্দনের ফোঁটা। এই ফোঁটাটা কাটলেই দিয়ার পুরো গেট-আপটা পাল্টে যায়। কৃষ্ণভক্ত-কৃষ্ণভক্ত দেখায়। দিয়া বোধহয় সেটা ভালই জানে। নাতিকে ইমপ্রেস করতে দিয়া এটা করছে। যদিও নাতি কৃষ্ণভক্ত কি না দিয়া এখনও জানে না।
মা-ও দেখছি আজ শাড়ি পরেছে। মুসৌরিতে মা একেবারেই শাড়ি পরে না। ওবেরয়ে যখন যেত, তখন তো দারুণ সুন্দর সুন্দর ড্রেস পরে যেত, কোনও কোনও দিন বাঙালি সীজনে, অর্থাৎ পুজোর সময়ে ভাল ভাল সিল্কগুলো মার বেরোত, সে-ও ক্রেতা মজাতে। অন্য সময়ে মায়ের পোশাক হল প্যান্ট, কিংবা সালোয়ার কামিজ। আজকে এই পীচরঙের সুতির শাড়িটা মা কোথা থেকে আমদানি করল? এখানকার আলমারি থেকেই বার করেছে নির্ঘাত। ভাল। বাড়িতে একটা পুরুষ মানুষ এসেছে, এদের পোশাক-পরিচ্ছদ হাবভাব থেকেই বোঝা যাচ্ছে। আঠারো হোক উনিশ হোক আ ম্যান ইজ আ ম্যান।
কাল রাতে, মা এসেছে শুনে একবার জাস্ট ঘরে গিয়ে দেখা করে এসেছিলাম। মাতৃদেবী তখন মন্দার নামক বৈদ্যুতিক শকে অপ্রকৃতিস্থ। শয্যা আশ্রয় করে উপুড় হয়ে শুয়েছিলেন। আমার সঙ্গেও বিশেষ কথা বলার মুডে ছিলেন না। কারও মুড-টুড খারাপ থাকলে আমি আবার তাকে বিরক্ত করবার পক্ষপাতী নই। মুড খারাপের ঝামেলা তো আমারও আছে কি না! সে সব সময়ে আমিও বিরক্ত হতে পছন্দ করি না।
—হাই মিসেস রডরিগস।
মা ফিরে তাকাল। পীচ রঙের শাড়ির আভা সত্ত্বেও মাকে খুবই শুকনো দেখাচ্ছে। চোখ দুটো বেড়ালের মতো সতর্ক হয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকাশে। মেরুন কুমকুমের টিপটা কোনও কাজেই আসেনি। অন্য সময় হলে আমার সম্বোধনে মা নির্ঘাত তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠত। আজ কিন্তু খেয়ালই করল না।
—তুমি কি ওকে বলেছো?—মা জিজ্ঞেস করল সন্তর্পণে।
—কী? কী বলব? আমিও জিজ্ঞেস করলাম যেন কিছুই বুঝছি না।
দিয়া তাড়াতাড়ি বলল—হ্যাঁ বলেছে। তাইতেই তো সেদিন রাত্তির দশটায়।… বললাম না তোমায় গতকাল!
মা বলল—ও ব্রেকফাস্ট করতে এখানে আসবে না? ওকে ডেকে নিয়ে এসো না বুলা।
—সো য়ু আর রেডি নাও? আমি হেসে বলি।
—নো। নট ফর ইয়োর সারকাজমস। ইয়েট। —মা ঝাঁঝিয়ে উঠল। অর্থাৎ এতক্ষণে নিজের স্থৈর্য ফিরে পেয়েছে।
দিয়া বলল—বুলা প্লিজ আর কথা বাড়াসনি, যা।
সুতরাং পুরুষমানুষটির ঘরে গিয়ে নক করি।
—কে?
—আমি বুলা—ভেতরে গিয়ে দেখি। চান হয়ে গেছে। ভাল করে দাড়ি কামিয়েছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বেশ ফিটফাট হয়ে বসে আছে টেবিলের সামনে চেয়ারে।
—চলো, ওয়েট করছ কীসের জন্য?
—যাব?
—বাঃ, যাবে বই কী!
কী একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। বলল—তুমি যাও, আমি আসছি। আবার কী রাজকার্য আছে কে জানে?
ফিরে দেখি খাবার-দাবার এসে গেছে। বাঃ। আজ রুটি-মাখন-ডিম প্রতিদিনের এই একঘেয়ে ব্রেকফাস্টোও নয়। ডলি বেবি এসেছে কি না, খালেদা তাই দু-তিন রকমের পরোটা করে এনেছে। জিভে-জল আনা আচার, গাজরের হালুয়া, আলু কপি কড়াইশুঁটি-বীন এ সব দিয়ে একটা শুকনো শুকনো বস্তু। তার মানে আজ আমি ব্রাঞ্চ খাব। এই সব মুখরোচক জিনিস তো আর রিফিউজ করতে পারি না। এইগুলো খেয়েই আজ কলেজ যাব।
মন্দার আসছে। দাড়ি গোঁফ কামিয়ে কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওকে। পাতলা পাতলা গজিয়ে ছিল, না কামালেই পারত। মায়ের সঙ্গে লড়াইটার কারণে শক্তি সংগ্রহ করবার জন্যেই হঠাৎ ক্ষুর ধরে ফেলল, না কী?
মা পাশ ফিরে বসে আছে। মায়ের চেয়ার পর্যন্ত এগিয়েই, অদ্ভুত কাণ্ড, মন্দার নিচু হয়ে মাকে প্রমাণ করল।
এমন অদ্ভুত, অত্যাশ্চর্য, সমস্ত প্রত্যাশার বাইরে জিনিসটা যে কেউ আমরা কথা বলতে পারলাম না। প্রণাম আমাদের অভ্যাসের মধ্যে পড়ে না। দিয়া বা মাকে গলা জড়িয়ে ধরে চুমো খাওয়াই আমাদের রীতি। তাই বলে কি আর প্রণাম জিনিসটা জানব না? স্কুলে কত করেছি। কিন্তু এখন, এই প্রণামটা এমন একটা শ্রদ্ধানিবেদনের মতো দেখালো যে চুপ, একেবারে চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। মায়ের চোখ দিয়ে দেখি ধারা নেমেছে। এখন তো আর হাতের কাছে রুমাল নেই। নিজের আঁচলটাই মা চেপে ধরেছে চোখে, অবিকল বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো। মন্দারও না এবার ওর জীবনের তৃতীয় কান্নাটা কাঁদে।
ডান হাতটা পুরো আশীর্বাদের ভঙ্গিতে মা ওর মাথায় রেখেছে। কিছু বলতে পারছে না। কিছু না বলেই ওকে নিজের দিকে টানল। পাশের চেয়ারটায় বসতে ইশারা করল। দিয়া মুখ নিচু করে প্লেটে প্লেটে খাবার তুলছিল। একটা প্লেট নিঃশব্দে আমার দিকে এগিয়ে দিল, সেটা আমি মন্দারের দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।
—এই যে বিগ বেবি, খান। আপনার মা কি আপনাকে খাইয়ে দেবেন?
সকলেই একটু-একটু হাসছে। যাক, যে কোনও মুহূর্তে মেঘ ভেঙে তুমুল বর্ষণ হবার সম্ভাবনাটা রুখে গেছে, রুখে দিয়েছি।
—আমি এগুলো খাব?—মন্দার জিজ্ঞেস করল।
—খাবে না কেন? তোমার তো হয়েছিল ম্যালেরিয়া, হেপাইটাইটিস তো আর হয়নি।
দিয়া বলল—খেতে কি ইচ্ছে করছে না?
—না, না, খুব ইচ্ছে করছে।
তাড়াতাড়ি পরোটা ছিঁড়ল ও। যাক বাবা। হালকা হয়ে যাচ্ছে হাওয়াটা। সবাই খালেদাকে বাহবা জানাতে জানাতে খাচ্ছে। মেথি পরোটার রেসিপি বলছে খালেদা মাকে। আমি দিয়ার কাছ থেকে আরও একটা নিই।
—শাক দিয়ে এমন পরোটা হয় আমি জানতাম না—মন্দার বেশ সহজ ভাবে বলল।
দিয়া বলল— তোমাদের ওখানে তবে কী হয়? আলু পরোটা?
—পরোটা জিনিসটারই চল নেই তেমন। লুচিই হয় বেশির ভাগ। তবে কোনও কোনও পূর্ণিমার দিন শখ করে কেউ হয়তো ঢাকাই পরোটা ভোগ দিলেন ঠাকুরকে। সেই ঢাকাই পরোটার অংশবিশেষ প্রসাদ খেয়ে আমার অবস্থা কাহিল।
—কেন? আমি জিজ্ঞেস করি।
—ওইটুকু খেয়ে কি আর সাধ মেটে? — বাঃ মন্দার দেখছি সত্যিই সহজ হয়ে গেছে।
মা এবার মন্দারের মুখের দিকে অসংকোচে তাকাল। এতক্ষণ তাকাতেই পারছিল না। দিয়ার দিকে চেয়ে বলল—মা, মন্দারকে একেবারে অবিকল বাবার মতো দেখতে হয়েছে দেখেছ!
দিয়া এতক্ষণে হাসি হাসি মুখ করে বলল— তুই-ই বললি, আর আমার খালেদ বিবি, আর তো কেউ…..
—কালকেই দেখেছি। স্ট্রাইকিং রিজেমব্ল্যান্স! দেখে একেবারে থ হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক যেন বাবা, বাবাই অ্যালবামের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে আমায় দরজাটা খুলে দিল। তারপর দেখি মন্দার!
—সেটাতেও থ হয়েছ কম না— আমি বললাম— ডাব্ল থ, এখন গলে জল। বাটি-টাটি দেব?
—সবকিছুতেই এমন ইয়ার্কি করিস! মা বিরক্ত। মা জানে না এই ইয়ার্কিই মাকে বাঁচাচ্ছে।
মন্দার বলল—আমার আসার খবর কি তোমরা মাকে দাওনি? মন্দাকিনী?
দিয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল—আমরা ওকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম মন্দার। আসতে লিখেছিলাম, কিন্তু কেন সেটা লিখিনি।
ও বলল, সারপ্রাইজই হয়ে গেল। তবে ভেরি ভেরি আনপ্লেজেন্ট। তাই না মা?
মা অভিমানের দৃষ্টিতে তাকাল একবার মন্দারের দিকে তারপর দিয়াকে বলল—খবরটা না দিয়ে ভাল করনি মা। বুলার কথা ছেড়ে দাও, তুমি যে এরকম ছেলেমানুষি করবে…।
—জানলে কী করতে মা?—মন্দারের চোখে এবার হাসি চকচক করছে, যদিও হাসিটা ঠিক হাসির মতো নয়।
—চলে আসতাম, তোমার ভর্তি-টর্তির ব্যবস্থা করতাম।
—সে সব কি আর তোমার করার জন্যে বসেছিল? তুমি জানো না, এখন অ্যাডমিশন কী রকম ঝামেলার ব্যাপার হয়ে গেছে! বড় জ্যাঠামশাই, খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে সাহায্য করলেন, শিশিরদা স্কুলের একজন মাস্টারমশাই সঙ্গে এলেন … তুমি হঠাৎ দৈবাৎ আমার আসার খবর পেয়ে এত সব করতে পারতে? তুমি তো রেডিও ছিলে না।
—তুই কি আমায় জেরা করছিস?
—যদি করি মা। এতগুলো বছর। তুমি কি জানতে আমি বেঁচে আছি, না মরে গেছি!
এবার মিসেস রডরিগস কী উত্তর দেন শোনবার জন্য কান খাড়া করে রয়েছি। এ তো তাঁর উদ্ধত, সভ্যতা-ভব্যতার-ধার-না-ধারা মেয়ে নয়, এ হল তাঁর মাথা নিচু করে প্রণাম করা বৈষ্ণব বিনয় আর ক্ষমার অবতার, পুত্র।
—মন্দার, তোকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। সব কথা বলা না হলে, তোর পক্ষেও কিছু বোঝা সম্ভব নয়। বিশ্বাস কর…
আমার হঠাৎ ভীষণ রাগ হয়ে গেল, বললাম—ও তো একটা সিম্পল কোয়েশ্চন রেখেছে তোমার কাছে। ও বেঁচে আছে না মরে গেছে সে খবরটা তুমি রাখতে কি না। সেইটুকুর উত্তর দিলেই তো হয়। বাকি আর সব গল্প তুমি না হয় পরে কোরো। কৈফিয়তগুলো পরে দিয়ো।
মায়ের মুখে রাগ ঝলসে উঠল। আমি গ্রাহ্যও করলাম না। বললাম —মন্দার তো তোমার কোনও রকম পাত্তাই জানত না। বেচারি থাকত শেয়ালদার একটা এঁদো ঘরে একটা বাজে লোকের সঙ্গে। লোকটা মাতলামি করত, ওকে ফরমাশ খাটাত আর যাচ্ছেতাই গালমন্দ করত। দিনের পর দিন এই শহরে না-খেয়ে ও ঘুরেছে। তুমি কি জানো আমার চেহারায় তোমার সঙ্গে মিল দেখে কপাল ঠুকে ও আমার পেছু নিয়েছিল! আমি যদি বাই চান্স ওর কলেজে ভর্তি না হতাম তা হলে ও কোনওদিনও তোমায় খুঁজে বার করতে পারত না, আর এই চেহারার মিল দেখে পেছু নেওয়ায় যদি ওর কোনও ভুল হয়ে যেত? তা হলে কী হত বুঝতে পারছ, স্রেফ গণপিটুনি খেয়ে ও মরে যেতে পারত, মা! ইউ ও হিম সাম এক্সপ্লানেশন!
মার মুখটা থমথম করছে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মুখটা তুলতে পর্যন্ত পারছে না। দু’ একবার কিছু বলতে গেল। বলতে পারল না।
হঠাৎ মন্দার ভেজা-ভেজা গলায় বলল— বুলা, মাকে কষ্ট দিস না। আমি চলে যাচ্ছি। কোনও প্রশ্নের জবাব আর আমার চাই না।
ও উঠে চলে গেল। আজ প্রথম ও আমাকে ‘বুলা’ বলল, ‘তুই’ বলল।
আমার দশটা পঁয়তাল্লিশে কেমিষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল। আমাকেও উঠে পড়তে হল। সারাদিন ওদের কেমন কাটবে জানি না। ভাবুক ওরা ভাবুক। দিয়া। মা। নিজেদের জীবনে ওরা নানান জট পাকিয়েছে। সে জটিলতার ভুক্তভোগী তো দেখছি আমরাই। ওরা কি মনে করে কতগুলো গল্প বলে দিলেই সব আবার যেমন কে তেমন হয়ে যাবে? সারাদিন প্রচুর ক্লাস। প্র্যাকটিক্যালের পর কয়েকটা ক্লাস লাস্ট বেঞ্চে বসে কাটিয়ে দিলাম। তারপর আর ভাল লাগল না। প্রথমে গেলাম কনভেন্ট রোড। নেক্সট্ মাস থেকেই মন্দার আসবে প্রদ্যুম্নদার কাছে পড়তে। সেটা ওঁকে বলা দরকার। আমারও বেশ কয়েকদিন বাদ গেছে। একটা ব্যাচ পড়াচ্ছে প্রদ্যুম্নদা। আমাকে অবশ্য বলল—ওয়েট করতে। দূর, বেশি কথা বলতেও আমার আজ ভাল লাগছে না। মা এসেছে—বসতে পারছি না বলে দিই। হাঁটতে হাঁটতে যাই।
এন্টালি বাজারের বাইরে একটা লোক দেখি গ্ল্যাডিওলাস বিক্রি করছে, সাদা আর কমলা রঙের। আঠেরোটা স্টিক কিনলাম। গোলাপও নিলাম অনেকগুলো, দিয়ার জন্য হলুদ গোলাপ, মায়ের জন্য লাল। কেন গোলাপগুলো নিলাম কে জানে? গোলাপ হল ভালবাসার ফুল। এই ফুল দিয়ে কি আমি আসলে মা আর দিয়ার কাছে ক্ষমা চাইছি? না কি শুধুই এদের আশ্বস্ত করতে চাইছি—আমার ব্যবহারে দুঃখ পেও না মা, দুঃখ পেও না দিয়া, এই দেখো তোমাদের জন্য ভালবাসাও এনেছি।— কে জানে?
লাইব্রেরির রকিংচেয়ারটায় হেলান দিয়ে মন্দার ‘ব্রাদার্স কারামাজোভ’ পড়ছে। আমি চুপিচুপি মায়ের ঘরে ঢুকে দেখি মা নেই,— লাল গোলাপগুলো টেবিলের ওপরে রেখে দিই। মা নিজের ইচ্ছে মতো সাজাবে এখন। মন্দারের ঘরে গ্ল্যাডিওলাসগুলো টেবিলের ওপর ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখি। দিয়ার ফুলগুলো নিয়ে ঘরে ঢুকতে যাব, শুনি মায়ের গলা। মা এখানে? কয়েকটা কথা কানে আসতেই আর আমার ঘরে ঢোকা হয় না। চট করে থেমে যাই। পরের কথা আড়ি পেতে শোনা উচিত নয়? পর তো নয়! আমারই মা, আমারই দিদিমাকে আমার কথা বলছে। শুনব না?
মা বলছে—এ সব কি ছেলেমেয়েদের বলা যায়? কী যে বলো মা।
দিয়া—ওরা বড় হয়ে গেছে ডলি। একটু সাহস করে বলেই দেখ না।
মা—কী বলব? রাজেনকে নিয়ে আমার আর মিলির মধ্যে রাইভ্যালরি ছিল? জেলাসি ছিল? এই কথা ওদের বলব? বলা যায়? আমি পারব না। তোমার আর কী? এখন তো আর কারও কাছে ইমেজ নষ্ট হবার ভয় নেই।
দিয়া—ঠিক আছে, আমার না হয় ভয় নেই। কিন্তু তোমারই বা ভয় কীসের ডলি? তুমি তো ওদের নাগালের বাইরেই চলে গেছ।
—না, নাগালের বাইরে যাওয়া যায় না মা। দে আর মাই চিলড্রেন, আই ডু কেয়ার ফর দেম। আমার আর সন্তান হবে না মা। ওরাই আমার প্রথম, ওরাই আমার শেষ। মে বি, এর পরে আমি হয়তো ঘন ঘন আসব এখানে। ওদের কেরিয়ারের ব্যাপারে ইন্ট্রেস্ট নেব। হতে পারে মুসৌরি ছেড়ে পাকাপাকি এখানেই চলে এলাম।
—সে কী?—দিয়ার গলায় উদ্বেগ—আবার কিছু গোলমাল হয়েছে না কি স্যামুয়েলের সঙ্গে?
—গোলমাল ঠিক নয়। হি ইজ ভেরি ভেরি ন্যাস্টি অ্যাট টাইম্স্। ন্যাস্টি অ্যান্ড মীন। ওর ওই স্বভাবের জন্যেই তো বুলা টিঁকতে পারল না ওখানে। আমাকে চাকরিটা ছাড়াল জোর করে। অতদিনের চাকরি। কিন্তু এখন টাকা পয়সা দেবার বেলায় হাত মুঠো। ভাবছি আবার চাকরি ধরব। ওখানে না পাই তো এখানে।
—একজনকে ছাড়লে ডলি। তার জন্যে বোনের সঙ্গে কত কামড়া-কামড়ি। এখন আবার…
—জানতাম এই কথাই বলবে। আচ্ছা সত্যি কথা বলো তো মা রাজেনকে দেখে যে তোমার মনে হয়েছিল আরেক বিনয়ভূষণ ফ্যামিলিতে এল, সেটা কেন? ওকে পেয়িং গেস্ট নেবার আগে কি তোমার দুবার ভাবা উচিত ছিল না? বাড়িতে আমরা উঠতি বয়সের দুটো মেয়ে।
আমরা মানে আমি হলে তো ভাবতাম তুমি ভাবনি কেন না ওই মোহ, ও-ও বিনয়ভূষণের মতো! তুমি আমাদের এনকারেজ করোনি? আমরা ভুল করতেই পারি, ভুল করারই বয়স। কিন্তু ওর যে চেহারা, স্বাস্থ্য অর্থাৎ বডিটা ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না। একটা টোট্যালি অকর্মণ্য পুরুষ, এটা তোমার বোঝা উচিত ছিল।
— বুঝিনি ডলি, এখনও বুঝি না। মিলি হয়তো ওর সঙ্গে সুখী হতে পারত। তোমার পথ পরিষ্কার করার জন্য তো মিলিকে চলেই যেতে হল।
—মা এই দোষটা তুমি আমার ঘাড়ে কিছুতেই চাপাতে পারো না। মিলি ওর সঙ্গে ইনভল্ভ্ড্ হয়েছিল সমস্ত জেনে বুঝে। আমি কি ওকে বলেছিলাম—তুই মরে যা। আমি তোমাকে আবারও বলছি মা— মিলি নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে ছিল। তখন আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। ও যদি আমার ওপর টেক্কা দিতে গিয়ে নিজেকে বিপদে ফেলে তার দায় কি আমার? ডু য়ু ওয়ান্ট মি টু আনডু দা পাস্ট অ্যান্ড বি ইন মিলিজ প্লেস। এ কথা তখন বলনি কেন মা? বিষ হয়তো খেতে পারতাম না। কিন্তু তোমাদের চোখের সামনে থেকে সরে যেতে তো পারতাম!
—মা কি কান্নাকাটি করেছে না কি? বাইরে থেকে একটু আওয়াজ করে দিয়ার ঘরে ঢুকলাম। গোলাপগুলো দিয়ার হাতে দিলাম।—বাঃ— দিয়া বলল যন্ত্রের মতো। মাকে বললাম—তোমারও আছে। তোমার টেবিলে রেখে এসেছি।
—আমি কি ফুল পাবার যোগ্য বুলা! আই ডোন্ট ডিজার্ভ এনিথিং ফ্রম য়ু।
আমি মায়ের হাঁটু জড়িয়ে ধরে কোলের ওপর মাথা রাখলাম। রডরিগস্-এর সঙ্গে মায়ের বনছে না। বনবে না অনেক আগেই জানতাম। লোকটা যেমন হামবাগ, তেমনই মীন। মা আবার এখানে আসবে, এই এলিয়ট রোডে, আমরা সকলে আবার একসঙ্গে থাকব, প্লাস মন্দার। আমাদের পুরো পরিবার। আমার ভীষণ খুশি লাগছিল।
পুরো পরিবার! পুরো পরিবার! ব্যাপারটা কেমন তাই-ই আমি জানি না। হয় থেকেছি দিয়ার কাছে, দিয়া আর আমি। নয় তো মায়ের কাছে—মা আর আমি। বাবা—নেই, দাদা—নেই। মাসি—নেই। আর কোনও ভাইবোনের কোনও প্রশ্নই ছিল না। আজ কোথা থেকে একটা সত্যিকারের ভাই তো জুটে গেছেই। মা-ও চলে আসছে। আর—বিনয়ভূষণ, মিলি, রাজেন্দ্রনারায়ণ—এদের নাম, এদের প্রসঙ্গ ঘুরে ঘিরে বারবার উঠছে, যেন এরা জীবিত।
বিনয়ভূষণ অবশ্য এ বাড়ির সাজ-সজ্জায়, নিয়মকানুনে, গল্পগাছায় বেঁচে আছেন। দিয়া ক্রমশই তাঁকে পূজনীয় পুরুষ থেকে মহাপুরুষ বানিয়ে তুলছে। কিন্তু মাসি? মাসিকে নিয়ে যে দিয়ার মনে একটা কষ্ট আছে এ কথাটা আমি জানতাম। অত অল্প বয়সে মেয়ে মারা গেছে। কষ্ট থাকতেই পারে। কিন্তু তার পিছনে যে একটা ত্রিকোণ প্রেমের গল্প আছে। আত্মহত্যা আছে এতসব তো কোনওদিন শুনিনি। রাজেন্দ্রনারায়ণ তা হলে এ বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে এসেছিল? এ বাড়ির দুই নন্দিনীকে একসঙ্গে জয় করে কেটে পড়ে? দিয়া তাকে অ্যাপ্রুভ করেছিল? দেখতে হয় লোকটাকে!
—একটা কথা বলবে মা? —এখন আমি মাকে আদর করেছি, মার মনটা নরম আছে। মা আমার দিকে ছলছলে চোখে চেয়ে বলল—বলো, বলে ফেলো।
—আমাদের দুজনের জন্মের তারিখে তফাত ঠিক পাঁচ দিনের। আমি আর মন্দার। দুজনেই তো তোমার বাচ্চা হতে পারি না। দিয়া মন্দারকে বলেছে আমি ওর মাসির মেয়ে, আর আমাকে বলেছে মন্দার আমার মাসির ছেলে। কোনটা সত্যি?
মা গম্ভীর মুখে বলল— বলব, কিন্তু তোমাকে একটা কথা দিতে হবে তার আগে। ওয়ার্ড অফ অনর।
—বলো কী কথা? না শুনে কিন্তু কিছু বলতে পারবে না।
—এই সব নিয়ে কোনও প্রশ্ন এর পরে যেন আর তোমার মুখে না শুনি।
—ফেয়ার এনাফ। তুমি ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে দিলে, আর কেন জিজ্ঞেস করব?
মা বলল—হতে পারে তোমাদের মধ্যে পাঁচদিনের তফাত। কিন্তু তোমরা দুজনেই আমার সন্তান। দিস ইজ গডস ট্রুথ। আমি তোমাদের দুজনেরই মা। না না। মায়ের কাছে ক্রস চেক করার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। মা নিজেই তখন চোখের অপারেশনের জন্য ম্যাড্রাসে, নেত্রালয়ে। মা কিছু জানে না।—হয়েছে?
—তুমি বেবি সুইচ করেছিলে?
—আবার কথা?
—বলো না!
—আমার দুটো বেবি বুলা। একটাকে তার বাবার কাছে দিয়েছি। আর একটা আমার কাছে রেখেছি। একটা মেয়ের মা-ছাড়া বড় হয়ে উঠতে খুব অসুবিধে তাই গার্ল-চাইল্ডটাকে কাছে রেখেছিলাম। বাস। তুমি কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করছ বুলা। …মন্দার কী করছে? এখনও লাইব্রেরিতে? নাঃ আমি ওর কাছে যাই। মা তুমি বিশ্রাম করো।
আমি ঘরে গেলাম হাত-মুখ ধুতে। জামাকাপড় বদলালাম। কিছুক্ষণ গান শুনলাম। গান মানে মিউজিক। আলি আকবর। আমার ঘরের দরজাটা খুলে রাখলাম। সরোদের আওয়াজটা বাইরে যাক। ওই ছেলেটা কীর্তন ছাড়া আর কিছু শোনেনি, আমরা যে সব গান শুনি, সেগুলো শুনে বলে—ওগুলো আবার গান না কি? ওকে ওর এই রোগশয্যায় বেশ কিছু গানবাজনা শোনালাম। সরোদ ওর খুব ভাল লেগেছে।
শুনতে শুনতে ঘুম এসে গিয়েছিল, দালানের বড় ঘড়িটার আওয়াজে চোখ মেলে দেখি সাড়ে আটটা বাজল। আশা করি, এবার ওরা খাওয়া-দাওয়ার জোগাড় করবে।
মা এখনও মন্দারের সঙ্গে কথা বলছে। রকিং চেয়ারটায় এখন মা। মন্দার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসেছে। বইটা টেবিলের ওপর ফেস-ডাউন করে রাখা।
—সর্বনাশ! এমন করে রেখেছ কেন? বইটা সোজা করে, পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখে নিয়ে বন্ধ করে দিই।
মন্দার বলল—ইস খুব ভুল হয়ে গেছে? আর কখনও হবে না। বুলা প্লিজ দিয়াকে বোলো না।
ওরা নাকি সন্ধে থেকেই গল্প করছে। জিজ্ঞেস করলাম—কীসের গল্প?
মন্দার বলল—রাধানগরের।
ষোলো
সেই গল্প দেখি আর থামতে চায় না। খেতে খেতেও গল্প চলে। প্রধান বক্তা মন্দার। প্রশ্নকর্তা দিয়া আর মা। আমি শুধু মাঝে মাঝে ফোড়ন দিচ্ছি। রাধামাধবের মন্দিরের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছে দিয়া। কত বড় মূর্তি, মাধবের হাতে বাঁশি আছে কি না। কী ভাবে ঠাকুর সাজানো হয়। রাসের মেলা। দিয়া দেখলাম অনেক খবর রাখে। বলল—রাস হল একটা কমিউনিটি ডান্স। যেমন গরবা, যেমন সাঁওতালদের নাচ। বৃন্দাবনের গোপসমাজে এই নাচটা— চলতি ছিল। সব দেশেই পুরুষ-নারীর সমবেত নৃত্যের একটা প্রবণতা দেখা যায় লোকসংস্কৃতিতে। রাস-নৃত্যকে আধ্যাত্মিক অর্থ দিয়েছে বৈষ্ণব শাস্ত্র। আমরা তো এ সব জানি না। মন্দারও জানে না। বলল— আমি অত সুন্দর সুন্দর গানগুলোর রচয়িতা কারা তা পর্যন্ত জানি না সব। ‘চন্ডিদাস কয়’ কি ‘বিদ্যাপতি ভনে’ এই রকম ভনিতা থেকে কয়েকজন পদকর্তার নাম উদ্ধার করেছি এই পর্যন্ত।
কথকতা, যাত্রা, কীর্তনের আসর, প্রদর্শনী…। ওর বাবার মাছ ধরার গল্প বলছিল। মাছ ধরে ধরে না কি ছেড়ে দিতেন, বৈষ্ণব বলে। শেষ বেলায় মাটির দাওয়ায় বসে উচ্ছে-বেগুন থেকে কুমড়ো-বেগুনের অম্বল পর্যন্ত পঞ্চ ব্যঞ্জন দিয়ে ভাত খাবার গল্প, মাঠের মাঝখানে এক বটগাছ তলায় কাঠবেড়ালিদের সঙ্গে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ার গল্প, ‘অ’ লিখে ফেলবার অপরাধে ওর হাতে-খড়িতে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যাবার গল্প আরও কত কী! পূর্ণিমায় ও রকম জ্যোৎস্না না কি কোথাও হয় না।
আমি হাসতে ও বলল—সত্যি বলছি বুলা, ওরকম জোছনার কোয়ালিটি তুমি আর কোথাও পাবে না!
মা হেসে বলল ও রকম মালপোও কিন্তু সত্যিই আর কোথাও খাইনি। তিন রকমের হয়, না মন্দার?
—সুজির, ক্ষীরের আর প্লেইন ময়দার— মন্দার বলল।
—আর সেই থালার মতো লুচি? হয় এখনও?
—হবে না? ওটাই তো রীতি।
—একটা লুচি খেলেই পেট ভরে খায়, বুঝলি বুলা! ওদের ওখানে মোচ্ছবের সময়ে হয়।
দিয়া বলল—‘লুচি মালপোয়া দিয়ে তো রোজই বিগ্রহের সন্ধ্যাবেলার ভোগ দেওয়া হয়। শীতল বলে না! আর রসমুণ্ডি?
—আপনি তো অনেক কিছু জানেন।—মন্দার অবাক হয়ে বলল।
—এ সব রীতি-নীতির কথা শুনেছি তোমার দাদার কাছ থেকে। রসমুণ্ডির কথাও তিনিই বলতেন।
—রসমুণ্ডি খুব শৌখিন জিনিস, সুদ্ধু জন্মাষ্টমীতে হয় আমাদের ওখানে। দিয়া বলল—এত সুন্দর সুন্দর গল্প … ডলিও কোনওদিন বলেনি আমাকে।
মা বলল—স্মৃতি হিসেবেই মা সব অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে বেশি সুন্দর লাগে। জানো তো! তখন যেতাম কোন পরিবেশ থেকে কোন পরিবেশে বলো! এখানে এত হই-চই, ফ্রিডম; যা-খুশি খেতে পারি, যেখানে খুশি যেতে পারি, কত রকমের গান চারিদিকে। আর ওখানে? মাটির ঘর, বোষ্টম বোষ্টম গন্ধ, মেয়েরা খালি গায়ে জাস্ট শাড়ি জড়িয়ে থাকে। ওদের জীবনযাত্রাটাই আমার কাছে খুব প্রাচীন, অবসোলিট মনে হত। সব এক ধার থেকে লাল পাড় ধুতি আর লাল পাড় শাড়ি। আমি ওদের ছোঁয়াচ বাঁচাতে চাইতাম। যদি ওরা আমাকে দাবি করে, যদি গিলে ফেলে! তা ছাড়া দেখো, তখন রাজেনকে… মন্দার কিছু মনে করবি না তো!
—উঁহু।
—তখন রাজেনকে কোনওমতে শহরমুখী, কাজ-কর্মে উৎসাহী করে তুলতে আমি আমার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করছি। ওই পরিবেশ থেকে ওকে সরিয়ে আনাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। আমিও যেমন ওঁদের পছন্দ করতাম না, ওঁরাও তেমনি আমাকে পছন্দ করতেন না।
—তোমাকে ওঁরা ‘মেম’ বলতেন। ‘মেম’ ও না, ‘ম্যাম’।—মন্দার হাসল।
—বলতেন বুঝি? হবে।—মাও হাসল—তবে এখন মা—মনে করলে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ হয়। যেন একটা জায়গায় একটা আলাদা সভ্যতা বেঁচে আছে। ওদের জীবনযাত্রা, জীবনদর্শন একেবারে আলাদা। উত্তর আমেরিকার অ্যামিসদের মতো একটা চার্ম আছে, তাই না মন্দার? আসলে সব কিছু বোঝবার জন্যেই একটা পার্সপেকটিভ লাগে।
—তুমি মন্দারকেও নিয়ে এলে না কেন মা—আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
—ওরে বাবা, সে তো ওর বাবা-জ্যাঠামশায়রা ছাড়তেনই না। ওঁদের কনডিশনই ওই, ছ মাস বয়স হল কি না হল ওঁদের ওখানে নিয়ে যেতে হবে, রাধামাধবের প্রসাদ মুখে দিয়ে অন্নপ্রাশন হবে। সে হবে রাধামাধবের সন্তান। তারপর…
মন্দার বলল— তারপর আর কী? স্ট্রাগল ফর সারভাইভ্যাল… একটু চুপ করে থেকে মা প্রায় ফিসফিস করে বলল— বয়স অল্প ছিল, বুঝিনি অনেক কিছুই… মাদার ইনস্টিংক্টের থেকেও তখন অন্য ইচ্ছে, অন্যরকম তাগিদ জোরালো ছিল অনেক। এখানে এলেই এখানকার হুল্লোড়ে সব ভুলে যেতাম… ক্ষমা নেই সে সব অপরাধের, তবু মন্দার, পারিস যদি… ভুলে যাস… যদি পারিস…।
ওরা সবাই একে একে উঠে গেল। আমরা প্রত্যেকটা সভা আমাদের আরম্ভ করছি খুশি দিয়ে, শেষ করছি অবধারিত প্রশ্নে, বিষাদে। খালেদাকে টেবিল পরিষ্কার করতে সাহায্য করি। তারপর মন্দারের ঘরে ঢুকি। ফুলগুলোর সামনে ও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা আর কমলা গ্ল্যাডিওলাস। এরই মধ্যে জল পেয়ে ফুলগুলো কত তাজা হয়ে গেছে।
—এগুলো কে আনল? তুমি?
—আর কে? ওগুলো তোমার পুরস্কার।
—পুরস্কার? কোন কৃতিত্বের জন্য? কী এমন করলাম?
—কৃতিত্ব দুটো। তাই দু’রঙের ফুল। কৃতিত্ব নাম্বার ওয়ান ‘বুলা’ আর কৃতিত্ব নাম্বার টু ‘তুই’। তবে এটা চালিয়ে যেতে হবে। গোঁত্তা খেয়ে যাচ্ছ।
প্রথমটায় ও বুঝতে পারেনি। বোধোদয় হতে হাসল। তারপরে একেবারে সিরিয়াস মুখ করে বলল— কিন্তু তোমার প্রশ্নের উত্তরটা পেলে?
—কী প্রশ্ন?
—ওই যে, ছেলে কার?
আমি বললাম— এ তো জলের মতো স্পষ্ট। ছেলে মায়ের আর মেয়ে মাসির।
—মা বলেছে?
—উঁহু। মা বলেছে আমরা দুজনেই মায়ের— এই না কি গডস ট্রুথ। এটাকে কোয়েশ্চন করা চলবে না।
—তবু প্রশ্ন থাকে। তাই না?
—রাইট।
—তা তুমি তোমার মতো করে একটা সমাধানে পৌঁছেছ। তোমার উত্তর শুনলাম। তোমার যুক্তি? আছে নিশ্চয় কিছু!
—রাধানগর চেয়েছিল তাদের সন্তানকে তাদের কাছেই জমা দিতে হবে। সুতরাং রাধানগরে যে জমা পড়ল সে-ই রাধানগরের…
যুক্তির ব্যাখ্যানে আমি যে একটা চালাকি করলাম মন্দার সেটা ধরতে পারল না। ওর সরলতার বর্মে আঘাত খেয়ে আমার যুক্তিটা ফেরত এল। ও বলল, মন্দারকে রাধানগরে রেখে আসা সত্ত্বেও যখন প্রশ্নটা আমরা একবার তুলেছি, তখন এ যুক্তি তো গ্রাহ্য হতে পারে না। বুলা, আগে কহো আর।
—আজকের অনুশোচনা, ভালবাসা, চোখের জল— এগুলোও প্রমাণ।
—মানুষ কি বোন, বোনের ছেলেকে ভালবাসে না?
—মা বাসত না, মন্দার, টেক ইট ফ্রম মি, বোনের সঙ্গে মার ভীষণ রেষারেষি ছিল। দুজনে এত ঝগড়া হত যে দিয়া ওদের দুজনকে দুজনের সঙ্গে কথা বলতেও বারণ করে দিয়েছিল। কথা বললেই না কি ঝগড়া হত। আর মন্দার, রাধানগরের রাজেন্দ্রনারায়ণকে নিয়েও ওদের দুজনের মধ্যে রেষারেষি ছিল।
—ওগুলো কিছু না। ওতে কিছু প্রমাণ হয় না। ঠিক আছে তোমার সমাধানের কথা বললে। এবার আমার কথা শোনো।
আমার শেষ কথাটা মন্দার গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলে না।
—বলো। আমি বললাম।
—আমার সিদ্ধান্ত মন্দার মাসির ছেলে, মন্দাকিনী মায়ের মেয়ে।
—প্রমাণ?
—এক নম্বর প্রমাণ মন্দাকিনীর সঙ্গে মায়ের চেহারার মিল। এমনই নির্ভুল যে সেই মিলের ওপর নির্ভর করেই মন্দার তার মায়ের ঠিকানায় পৌঁছোয়।
—মাসির সঙ্গেও মানুষের মিল থাকে মন্দার। আগে কহো আর, আমিও মজা করে বললাম। খুব একসাইটেড হয়ে গেছি, আসলে, এটা যেন একটা মজার ধাঁধা সমাধানের খেলা, আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা নয়।
—দু’নম্বর প্রমাণ ওই মাদার ইনস্টিংকট্ যেটা মা অস্বীকার করতে চাইল।— মন্দার বলল। আমার যুক্তি মাদার ইনস্টিংকটের অভাব নয়, প্রবল তাগিদেই ডলিকে ত্বরিত কিছু ডিসিশন নিতে বাধ্য করে। তার বাচ্চাকে রাধানগরে দিয়ে আসতে হবে, এটাই পূর্বশর্ত, কিন্তু বাচ্চাকে ছাড়া অত সোজা নয়, তাই বোনের ছেলেকেই সে নিজের ছেলে বলে চালায়। আর নিজের মেয়েকে বোনের মেয়ে বলে কাছে রেখে দেয়। তুমি যে বললে বোনের ওপর তার রাগ ছিল, —তো এটাতে সেই বোনের ওপর বিরাগটাও হয়তো কাজ করছিল।
আমি ভাবতাম ও সরল, অনভিজ্ঞ তাই ওর অনেক বোঝাই বোধহয় অসম্পূর্ণ। এ ধরনের বিশ্লেষণ ওর কাছ থেকে আমি একেবারেই আশা করিনি।
বললাম— আর কিছু?
—সবচেয়ে বড় প্রমাণ ওই চেহারাই। তবে এবার, তোমার নয়, মন্দাকিনী, আমার চেহারা।—বলতে বলতে মন্দার গ্ল্যাডিওলাসগুলোকে একধারে সরিয়ে দিল, মাসির ফটোগ্রাফটা পুরো আলোয় বেরিয়ে এল।
—যবে থেকে এখানে এসেছি বুলা কখনও দিয়া, কখনও খালেদা, আমার সঙ্গে দাদার চেহারার মিল নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। শেষবার অবাক হল মা। কিন্তু এঁদের কেউই ভেবে দেখেননি, বিনয়ভূষণের সঙ্গে কারও চেহারার মিল এই প্রথম দেখা গেল না। এর আগেও দেখা গেছে, তাঁর ছোট মেয়ের মধ্যে। মেয়ে বলে হয়তো মিলটা তত প্রকট বলে মনে হয়নি, ছেলে বলে আমার ক্ষেত্রে সেটা চট করে স্ট্রাইক করে। কিন্তু আসলে সত্য হল এই মিল আমি সরাসরি পাইনি। পেয়েছি ঘুরপথে, আরেকজনের মধ্য দিয়ে। সোজা কথায় বলতে গেলে আমি মাসির ছেলে। দেখো বুলা, ওই আমার মা।
ও সবগুলো আলো জ্বেলে দিয়েছে। স্পষ্ট লাইট পড়েছে মিলির ছবির ওপরে, তার দিক থেকে সন্ধানী আলো ঘুরিয়ে দিচ্ছে সব অস্পষ্টতা মিলির ছবি থেকে। মিলিই এই রাধা-কাহিনীর চন্দ্রাবলী। ডলির কাছে শেষ পর্যন্ত হেরেই গেছে মিলি। রাজেনকে ভালবাসল দুই বোনই। কিন্তু ডলিই পেল রাজেনকে। সেই বিষাদ মিলির কালো চোখে, কালো-চুলে, গালের ওপর চোখের পাতার কালো ছায়ায়। দিয়া বলেছিল মিলি হয়তো রাজেনের সঙ্গে সুখে ঘর করতে পারত। হয়তো বুঝেছিল বলেই বলেছিল। নিশ্চয় তার চাওয়া ছিল আরও তীব্র, আরও গভীর, নইলে সে জেনেশুনে কেন দিদির প্রণয়ীকে আত্মদান করল? কেন জন্ম দিল সেই সন্তানের? কেনই বা আত্মহত্যা করল তার পরে?
আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম রাজেন তার বিয়ের পরই উদাস, অলস, কর্মবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পেরেছে সে ভুল করে ফেলেছে। মনে মনে সে-ও মিলিকেই চেয়েছিল। নিজের দুর্বল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ডলির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারেনি। অতএব সে চলে যাচ্ছে রাধানগরে, সেখানে তাকে আর কোনও সংগ্রাম করতে হবে না। তার চেয়েও বড় কথা সেখানে চলে গেলে ডলি শেষ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেবে।
আমরা দুজনেই মিলিকে দেখতে লাগলাম। মিলির সঙ্গে আমার মায়েরও মিল নেই। দিয়ারও মিল নেই। মিলি খুব বাঙালি-বাঙালি দেখতে। কেমন ছায়াময়ী। কিন্তু দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। দাদার সঙ্গে খুব মিল, মন্দারের দেখায় কোনও ভুল নেই। চৌকো ধরনের মুখ, যাকে বলে গ্রিসিয়ন কাট, চোখ বড় বড়। গভীর, বিষাদময়। ঠোঁটদুটো ভারী, ঢেউওলা, একেবারে বিনয়ভূষণের মতো। শুনেছি, আমার মা সব বিষয়ে চৌখস ছিল, পড়াশোনা, খেলাধুলো, ডিবেট…। মিলি ছিল ঘরকুনো, লাজুক অথচ জেদি। সিন্ডারেলা। রাজেন্দ্রনারায়ণকে জয় করাটাই বোধহয় ছিল দিদির ওপর ওর প্রথম জিত। তা-ও বিষ হয়ে গেল। সম্পূর্ণ হল কী? দিদির ঘরও তো শেষ পর্যন্ত রইল না! আর তারই সন্তান গিয়ে দিদির শ্বশুরবাড়িতে রাজেনের ছেলে বলে প্রতিষ্ঠা পেল। এর ভেতরে একটা আয়রনি তো দেখাই যায়।
মন্দার বলল—আর, এই সব সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াও আর একটা প্রমাণ আছে বুলা, সেটা নির্ভর করে হৃদয়ের সাক্ষ্যের ওপর। মাসি যদি আমার মা হয় তা হলে আমার সেই হৃদয়ের সাক্ষ্যটাও মিলে যায়। সারা ছোটবেলা জুড়ে আমি খালি অন্য শিশুদের অন্য বালকদের দেখেছি আর আশ্চর্য হয়েছি। দেখেছি আর আশ্চর্য হয়েছি। আমার আশেপাশের লোকেরাও কম আশ্চর্য হয়নি। মা না থাকে তো সে অভাগা শিশুর হাড়ির হাল হয়, সবাই জানে। কিন্তু যার মা বর্তমান সে খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল, আবার খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে উঠে পড়ল, তখন দৈবাৎ কারও মনে হল হয়তো এর খিদে পেয়েছে, তখন কেউ এক বাটি দুধ নিয়ে বসল, এটা তুমি ভাবতে পারো? আমার বন্ধু তারকের মা বলতেন স্কুলের পরীক্ষাটা হয়ে গেলে তুমি মায়ের কাছে চলে যেও মন্দার, এভাবে কি মানুষ বাঁচে? মা ছিল না আমার, জন্ম দিয়েই মারা গিয়েছিল তাই, তাই মাতৃহীন শিশুর যা দুরবস্থা হয় তাই আমার হয়েছিল।
ওর যুক্তি একেবারে নির্ভুল। মা বুঝতে পারেনি, কথার ফাঁদে পড়ে মা আমার সত্যি কথাটা বলেই ফেলেছিল। মা-ছাড়া গার্ল-চাইল্ডের বড় হতে অসুবিধে হয় তাই নাকি মা মেয়েটাকে রেখে ছেলেটাকে দিয়ে দিয়েছিল। মায়ের কন্যা-সন্তান হয়েছিল বলেই তো এ প্রশ্ন উঠল। মেয়েটা যদি মাসির হত, তা হলে তো তাকে রাধানগরে পাঠানোর প্রশ্নই উঠত না। মা আমার কাছে ধরা পড়ে গেছে। তবে তা ছাড়াও আমি মোটামুটি মন্দারের মতো করেই যুক্তি সাজিয়েছিলাম। মাসির সঙ্গে ওর চেহারার মিলটা বাদে। এটা আমি সেভাবে খেয়াল করিনি। পাছে ওর আঘাত লাগে বলে অন্যরকম বলেছিলাম। ওর একজন মা দরকার। এত করে অসাধ্যসাধন করে খুঁজে বার করে যদি বোঝে এই মা ওর মা নয় তা হলে ওর কেমন লাগবে? তাই মাকে দিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। আমার দরকার একজন বাবার। একটা ফাদার ফিগার। কিন্তু আমার সেই আসল বাবা যিনি মিলিকে ভালবেসে ডলিকে বিয়ে করলেন, আবার ডলিকে বিয়ে করে মিলির সন্তানের পিতা হলেন, সেই চূড়ান্ত বিভ্রান্ত মানুষটিকেও তাই বলে বাবা হতে ডাকব না কোনওদিন। সুতরাং সেই পুরনো পিতৃকল্প মানুষটি ছাড়া আর আমার গতি নেই। আমি দাদার কথা বলছি। বিনয়ভূষণ।
এইবার মন্দার তার চূড়ান্ত বোকামিটা করল। বলল— মানলি তো আমার যুক্তি? বুলা দেখ, এখন বড় জ্যাঠামশাইয়ের দেওয়া এই হার নিয়ে আমি কী করব? আমি তো রাধানগরের কেউ নই?
কিছুক্ষণ আহাম্মকটার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। ও তা হলে মিলির ছেলের পিতৃত্ব বিষয়ে কিছুই অনুমান করতে পারেনি। তখন রাজেনকে নিয়ে দুই বোনের রেষারেষির কথা বললাম, তাতেও না। ও তো এইবার আরেকবার গৃহত্যাগ করল বলে, এ দফায় সোজা রাধানগরে গিয়ে বলবে— ‘আজ্ঞে রাধানগরের দেবত্রে আমার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই, আমি কি না মাসির ছেলে!’
কড়া গলায় সুতরাং বলতে বাধ্য হলাম— অনেক বকবক করেছিস। আমাদের কলেজে খুব ভাল নাটক হয়। নাম দিস এখন। ডায়ালোগ-টোগ ভালই দিতে পারবি। এখন ‘জয় রাধে’ বলে শুয়ে পড় দিকি। আর শোন, আমরা কিন্তু কাজিন নয়, ভাইবোনই রইলাম, সহোদর নয়, সহবীর্য বলতে পারিস।
—গুড নাইট।
একটা আলোর বল যেন ফেটে গেল ভেতরে। শেষ বলটা ছুড়ে দিয়ে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মন্দাকিনী বিদ্যুতের মতো চলে গেল। চলে গেল সমস্ত দুঃখ, দ্বিধা, অন্ধকার সঙ্গে নিয়ে। ক্রমশ রাতটা নিখাদ নিশুতি রাত হয়ে গেল, তখনও আমি জেগে। সামনে আমার প্রমাণ সাইজ তৈলচিত্রে আইলিন আর বিনয়ভূষণ। যেন রাধামাধবের মন্দিরের ভেতর দুয়ার খুলে গেছে। শুধু আমার জন্যেই নয়, বিনয়ভূষণের জন্যেও। কবে তিনি প্রেমের জন্য ত্যজ্য হয়েছিলেন, নির্বাসিত হয়েছিলেন এই রকমই কোনও রাধানগর থেকে। কে বলতে পারে হয়তো তিনিই সেই মানুষটি যাঁর আচরণে বিরক্ত হয়ে তাঁর বাবা তাঁকে বঞ্চিত করে ভাগনেদের তাঁর সম্পত্তির অছি করে যান। আজ তাঁর নাতি আমার মধ্যে দিয়ে উনি আবার ওই দেবত্রে ফিরে যাচ্ছেন। আমি যেমন জানতাম না রাধানগর এভাবে আমার রক্তের ভেতরে ঢুকে বসে আছে, তিনিও তেমনি জানতেন না ব্যাপারটা। যখন হারাতে হল, তখনই একমাত্র বুঝতে পেরেছিলেন। মুঠোয় করে সোনার কবচটা দেখতে লাগলাম আমি। এই কবচ আমাকে কেন দিয়েছিলেন বড় জ্যাঠামশাই? কেন? যাতে আমি তাঁদের কাছে বাঁধা থাকি? যত দূরেই যাই আমার বাঁধন, আমার টান যাতে না ঘোচে? এটা তো তা হলে শুধু একটা প্রাপ্তি, একটা স্বীকৃতিই নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। কে জানে একটা মন্ত্রশক্তি কিনা।
না, না। রাধানগরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মন্ত্রের নয়, রক্তের। ঘণ্টার সেই গম্ভীর নিনাদ, সেই উৎসব আর গান, আর সেই পেতলের মূর্তিদুটো! মানুষের মতো যাদের স্নান, আভরণ, আহার, বিহার, শয়ান, জাগরণ! তারাই আমাকে টেনে রেখেছে।
গ্ল্যাডিওলাসগুলো চমৎকার ফুটে উঠেছে। তাদের রঙিন আঙুলগুলো ক্রমাগত ইশারা করছে মিলির সাদা-কালো পৃথিবীটার দিকে। এত বাচ্চা যে ওকে মা বলে ভাবতে পারা যায় না। ও যেন মন্দাকিনীরই জুড়ি, আর একটা বোন আমার। বে-আক্কিলের মতো অসময়ে মরে গিয়ে ও তিরস্কারের যোগ্য হয়ে আছে। যদি ও ভাবে ও নিজেকে শেষ করে না দিত! আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই আমার এক মা ফিরে আসছে আর এক মা যাচ্ছে। দেখতে পাই মিলি পুবপাড়া থেকে পশ্চিমপাড়ায় হেঁটে যাচ্ছে। আঁচল দিয়ে রোদ আড়াল করল। মিলি চলে যাচ্ছে হিজলবাগানে, মন্দিরতলায়, জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে ফর্দ তৈরি করছে রাসের কি জন্মাষ্টমীর মেলার। দামোদরের তীরে জোছনারাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে মিলি, তার মুখ থেকে অন্ধকার সরে যাচ্ছে। মিলির সঙ্গে জোছনা মাখছে একটা ছোট্ট ছেলেও।
—কী দিয়ে আজ ভাত খেলে মন্দার?
—শুকতো, ডাল, ভাজা, অম্বল…
—বাব্বা, অত সকাল সকাল এত সব কে করল মন্দার?
—কেন? মা, আমার মা!
—ও কী! এখনই উঠছ কেন মন্দার। এই তো এলে।
—না, যাই, দেরি হলে মা খুব বকবে আমায় মাসিমা। পড়তে হবে আবার।
বাবা মানুষটাকে কোনওদিন তেমন ভাল লাগেনি আমার। ভালবাসতে পারিনি। অত আলগা-আলগা থাকলে কোনও মানুষকে ভালবাসা যায়? মানুষটা কি সব সময়ে বিবেকের দংশনে ভুগত? মিলির জন্যে? আহা, বাবা জানলও না, তার শুধু একটা ছেলেই নয়, মেয়েও আছে। আমার বদলে ও যদি রাধানগরে যেত তা হলে রাধানগরের রাজেন্দ্রনারায়ণের ইতিহাসটাই অন্যরকম হত।
শরতের ভোরবেলা এখন। মাঠে-ঘাটে কাশ ফুটে আলো করে রেখেছে সব। আর আমার আশেপাশে। এই কোয়ার্টার্সের বাগানে হলুদ, ব্রাউন ডালিয়া-চন্দ্রমল্লিকা। শুধু শীতের মরশুমি ফুলই নয়, সারা গ্রীষ্ম, সারা বর্ষা এখানে ফুল ফোটে। ফোটে সারা বছরের ফুলেরা। চা খেতে খেতে দেখছি অশীতিপর আইলিনকে নিয়ে ইরাবতী শিউলি কুড়িয়ে আনছেন। দুজনের হাতেই বেতের ঝাঁপি ভর্তি শিউলি ফুল। শিউলির গোড়ে মালা গাঁথবেন দুজনে, সেই মালা দিয়ে সাজানো হবে প্রয়াতদের ছবি—বিনয়ভূষণ আর মিলি। আইলিন এখন একটি টুকটুকে বুড়ি। কিন্তু তাঁর রাধা-রাধা ভাবটা বোধহয় কোনওদিন যাবার নয়। হাসলে এখনও মনে হয় ‘গোরোচনা গোরী নবীনা কিশোরী’। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস আমি দাদামশাই বিনয়ভূষণেরই ‘অবতার’। জন্মান্তর থেকে তাঁর রক্তের স্রোত বেয়ে বেয়ে বিনয়ভূষণ আবার দৌহিত্র বংশে ফিরে এসেছেন। এই বিশ্বাস যে তাঁর ক্রিশ্চান সংস্কারের বহির্ভূত, তাতেও আইলিনের কিছু যায় আসে না। বেশি কথা কী, বৃদ্ধা আজকাল বেশির ভাগ সময়েই আমাকে ‘বিনু’ বলেই ডাকেন। দাদামশায়ের ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমারও একেক সময়ে মনে হয় ওটা আমারই ছবি। আমার জীবনে যে সমস্ত নাটকীয়, অবিশ্বাস্য, রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে গেছে, তাতে করে বিনয়ভূষণের মন্দার হয়ে আইলিনের কাছে ফিরে আসাটা এমন কী আর অবাস্তব?
মায়ের অর্ধেক চুল পেকে গেছে। মুখে অভিজ্ঞতার আঁচড়। ষাট-টাটের কাছাকাছি হল বোধহয় মার। কিন্তু মা এখনও খেলোয়াড়। গটগট করে চলে, চটপট করে কাজ করে, কথায় চিন্তায় কোনও জড়তা নেই। এবং একটা কর্মহীন জীবন কাটিয়ে আমার বাবা যখন বাহান্ন-তিপ্পান্ন বছর বয়সে ফট করে মারা গেল, বাবা অনেক বুড়ো হয়ে পড়েছিল। আমি ওষুধ-ইনজেকশন নিয়ে পশ্চিম পাড়ায় যেতে যেতেই শেষ। বড় জ্যাঠামশাই তো আশি পার করেও দিব্যি খটখটে আছেন।
রাধানগরের দেওয়ানি হিসেবে আমারই অভিষেক হবার কথা। বড় জ্যাঠামশাইয়ের অভিজ্ঞ চোখ না কি কত কতদিন আগে থেকেই আমাকে বেছে রেখেছিল। কিন্তু আমি আমার ডাক্তারি কর্তব্যের দোহাই দিয়ে ব্যাপারটাকে ঠেকিয়ে রেখেছি। ইতিমধ্যে বড় হচ্ছে আমার চেয়ে ছোট যারা। এখন রাসের মেলা, হয় আরও অনেক বড়। দোলে, জন্মাষ্টমীতে শামিয়ানা খাটিয়ে বসে কীর্তনের আসর, কথকতার আসর। রায় বাড়ির অল্পবয়সীরা এই সব উৎসবে আগের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ব পায়। যাত্রা হয়, প্রদর্শনী হয়। তবে এই সব উৎসবে গীত—ওস্তাদ কীর্তনিয়াদের গানের থেকেও প্রিয় আমার কাছে আমার দিদিমার গান। জ্যোৎস্নারাত্রে আকাশে যখন গোল চাঁদ ঠিক মাথার ওপর থেকে আলো ছড়ায় তখন উনি রাধামাধবের মন্দিরের বারান্দায় কখনও কখনও গান করেন। ‘কে বা শুনাইল শ্যাম নাম।’ কপালে চন্দনের টিপ, গলায় তুলসী বীজের মালা, চন্দনবসনা আইলিন যখন গান করেন, কে বলবে ইনি চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতি-জ্ঞানদাস-গোবিন্দদাসের সেই বিরহিণী শ্রীরাধা নন! তবে সে সবও তো এখন অতীতের গর্ভে।
অনেকদিনই এখানে বিজলি এসে গেছে। পথগুলোতে সন্ধে হলেই আলো জ্বলে। দু-চারটে ছাড়া খড়ের চালের ঘরও আর নেই। সব পাকা হয়ে গেছে। রায় পাড়া এখন অনেক সুবিন্যস্ত। গাছপালা, ফলবাগান, ফুলবাগান, পুকুর, নলকূপ সবই একটা পরিকল্পিত ছক মেনে তৈরি। আমার ছোটবেলার সেই দু-তিনটে ঘরের ইউনিট এখনও আছে। কিন্তু পাকা সব। তাতে বিজলি-বাতি জ্বলে, পাখা চলে, রেডিয়োর আওয়াজ শোনা যায়। পূর্ণিমা রাতগুলোতে কিন্তু সব বিজলি-আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। চারদিক রিমঝিম করে জোছনায়। বৃষ্টির মতো জোছনা ঝরছে শব্দ পাওয়া যায় যেন। মুগ্ধ বিস্ময়ে সেই জোছনার দিকে তাকিয়ে থাকেন আইলিন, ইরাবতী, মন্দাকিনী যখন আসে, সে-ও।
—তুই ঠিকই বলেছিলি মন্দার। সারা পৃথিবীতে কোথাও তোর রাধানগরের জ্যোৎস্নার তুলনা নেই।।
—রাধানগর আমারও যতটা তোরও ততটা—আমি ওকে মনে করিয়ে দিই। মন্দাকিনীও ডাক্তার, তবে তার কাজ প্রধানত গবেষণা, থাকে তার স্বামীর সঙ্গে নরওয়ের শহর অসলোয়। অরোরার দেশে থাকে, জোছনার ভাল-মন্দের বিচার তার মতো আর কে পারবে?
কুড়ি কুড়ি বছরের পার। দুই দশক, মানে তো দুই যুগই! এখন মন্দার ডাক্তারের মনে হয় এতগুলো বছরের মধ্যে সবচেয়ে অকিঞ্চিৎকর ছিল তার ছোটবেলাটা। ইনকিউবেটরে থাকার মতো। শুধু টিঁকে থাকা, শুধু টিঁকে থাকা। তারপর কত শেখা হল, জানা হল, দেখা হল—মন, স্বাস্থ্য, শরীর, পরিস্থিতি। একটা সোঁদা শরীর, সোঁদা মন নিয়ে সে জীবনের বহুমুখী জটিলতার মুখোমুখি হয়েছিল, প্রত্যেকটি ঘটনা, প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতা তাই তার কাছে অমন বিশেষ, অমন অসামান্য চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে। পৃথিবীর কত দেশ সে দেখল, কত মানুষ! বিচিত্র তাদের দুঃখ, বিচিত্র তাদের বিপন্নতা। সে সবের পাশে তার সেই অল্প বয়সের দুঃখ এখন মনে হয় যেন কিছুই না। সত্যিকারের অপ্রাপ্তি তার কিছুই ছিল না, ছিল না বিপদ কিংবা প্রতিকূলতাও। ভেবে দেখতে গেলে সবটাই তার মনে হওয়া। কোনও কামানের গোলা তার দিকে ছুটে আসেনি, যতই সে বারবার স্বপ্নে ভয় পাক, কোনও দুর্গ জয় করার বীরত্বও তার দরকার হয়নি। যখন সে ভাবছিল সে একটা ছন্নছাড়া ছোট ছেলে, তখন আড়ালে বড় জ্যাঠামশাই তার ওপরে লক্ষ রেখেছিলেন, অপেক্ষা করছিলেন সোনার কবচ নিয়ে, রাধানগরের দেওয়ানের সোনার কবচ। সে ভাবছিল কেউ তাকে দেখে না, দেখছিল কিন্তু ঠিকই কেউ না কেউ, হয়তো মায়ের মতো অতন্দ্র পাহারায় নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতার নিরুদ্বিগ্নতা দিয়ে। সে দুঃখ পাচ্ছিল সে মাতৃপরিত্যক্ত অথচ সত্যি-সত্যি মাতৃহীন হওয়া সত্ত্বেও সে কিন্তু মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হয়নি, আর এতগুলো বছর কেটে গেছে তবু ইরাবতী একদিনের জন্যেও তাঁর সেই ঘোষণা থেকে নড়লেন না— মন্দার মন্দাকিনী দুজনেই তাঁর সন্তান, এই-ই না কি গডস ট্রুথ। এটা কোয়েশ্চন করা চলবে না। এখন তো সে এই নিয়ে মাকে খেপায়। মোটা মালা পরিয়ে দেয় মিলির ছবির গলায়। বলে—‘দেখো মা, তোমার আবার হিংসে হচ্ছে না তো!’ —‘হিংসে কীসের? আমি মরে গেলে আমাকেও দিবি।’
তার মানে সে, মন্দার যখন নেই-নেই করে অভিমান করছিল, তার ভাগ্য তখন লুকিয়ে লুকিয়ে তার জন্য ঐশ্বর্য জমাচ্ছিল—আইলিন অপেক্ষা করছিলেন তাঁর অনন্যসাধারণ শিক্ষা, স্মৃতি ও স্বপ্ন নিয়ে, মন্দাকিনী অপেক্ষা করছিল তার সহৃদয় সৌহার্দ্য নিয়ে, ইরাবতী অপেক্ষা করছিলেন তাঁর অল্প বয়সের ভুল শোধরাবার ইচ্ছা নিয়ে, আর এঁদের সবার আড়ালে অপেক্ষা করছিলেন রাধামাধব।
কখনও কখনও তার মনে হয় রাধামাধব তাকে ফিরে পেতে চেয়েছিলেন কেন? সে তো যাকে বলে ভক্ত নয়! বৈষ্ণব ধর্মের বাণীগুলোই যে তাকে টানে তা তো নয়। কেবল হরিনাম করে যে কৈবল্য লাভ তার দিকেও তার কোনও আকর্ষণ নেই। তা ছাড়া রাধামাধব তো ঈশ্বর। সারা পৃথিবীই তো ঈশ্বরের ভূমি! মানুষ যেখানেই যাক না কেন তাঁর নাগালের মধ্যেই তো রয়ে যায়! তিনি কেন তফাত করবেন রাধানগরে আর কলকাতায়, কলকাতায় আর ভারতবর্ষে, ভারতবর্ষে আর বহির্পৃথিবীতে? অথচ চার হাত বাড়িয়ে রাধামাধব খালি তাকে টেনেছেন। চলে গেল মধ্য কলকাতার অ্যাংলো পাড়ায়, সেখানে মেমসাহেব সুদ্ধু গেয়ে উঠলেন— ‘মথুরানগরে প্রতি ঘরে ঘরে যাইব যোগিনী হয়ে।’ যে চুলোতেই সে যাক তিনি নাকি তাকে ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াবেন। পড়াশোনা করতে তো গিয়েছিল ইংল্যান্ড, জার্মানি, যোগ দিয়েছিল আমেরিকার হাসপাতালে। বড় জ্যাঠামশাই তাকে এখানে হাসপাতাল গড়ার প্রস্তাব দিয়ে পাঠালেন, অমনি সে চলে এল। ‘মাধব বহুত মিনতি করি তোয়’…এমন করে আর কোনও গানও তো তার মর্মে গিয়ে বাজল না।
অনেক ভেবে-চিন্তে তার মনে হয়েছে রাধামাধব ঈশ্বর নন, ঈশ্বরপদবাচ্য নন। তিনি এক রকমের দেবতা, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলতেন নিভৃত প্রাণের দেবতা। কারও কারও। সমস্ত পৃথিবী নয়, যে ভূমিতে তাঁদের কল্পনাকে প্রতিদিনের স্মরণে মননে প্রাণ দেওয়া হচ্ছে, সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেখানেই তাঁদের অধিষ্ঠান, তাঁদের ঘিরে চৌম্বক ক্ষেত্র। আর দেবতা জাগলেই তাঁর আকাঙক্ষাও জাগে, কল্পনাও জাগে, মন্দার এবং তার জীবন হয়তো সেই জাগ্রত দেবতার নতুন কল্পনা। সে হিসেবে শেষ পর্যন্ত সে মিলিরও না, রাজেনেরও না, রাধামাধবেরই সন্তান। পুরো অস্তিত্বটাই তার দেবত্র।
Leave a Reply