রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস [বৃহত্তর কুমিল্লার ইতিহাস] – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত
ভূমিকা – ড. তপন বাগচী, ড. আলী হোসেন চৌধুরী
প্ৰথম প্ৰকাশ – আশ্বিন ১৩০৩
গতিধারা প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০০৯, পৌষ ১৪১৫
দ্বিতীয় প্রকাশ – অক্টোবর ২০১৯ কার্তিক ১৪২৬
প্রকাশক – প্রচ্ছদ – সিকদার আবুল বাশার
.
বাংলাদেশ সংস্করণ প্রসঙ্গে
১২৮৩ বঙ্গাব্দে শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ (১৮৫১-১৯১৪) লিখেছিলেন ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত’ নামের একটি ‘ক্ষুদ্র পুস্তক’। লেখকের ভাষায় এটি ছিল তাঁর ‘সাহিত্যজীবনের অপ্রস্ফুটিত প্রথম কুসুম’। এই কুসুমটিই ফুলে ফলে ভরে ওঠে ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ নামে। গ্রন্থাকারে এটি প্রকাশিত হয় ১৩০৩ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে আগরতলা থেকে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের আকর এই গ্রন্থটি শতবর্ষ পরে আগরতলা থেকেই পুনঃপ্রকাশিত হয় অক্ষর পাবলিকেশনস্ থেকে। কৈলাসচন্দ্রের মূল গ্রন্থে ত্রিপুরার রাজাদের কোনো ছবি ছিল না। শতবার্ষিক সংস্করণে রাজাদের ছবি, প্রথম সংস্করণের আখ্যাপত্র, পাণ্ডুলিপির অনুলিপি, কৈলাসচন্দ্রের ছবি, ত্রিপুরার প্রাচীন মুদ্রা, রাজসিংহাসনের ছবি মুদ্রিত হয়। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন ভারতীয় ইতিহাসের গুরুনানক অধ্যাপক ডক্টর অমলেন্দু দে। তিনি জানিয়েছেন, ‘প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ইতিহাসের বিশাল প্রেক্ষাপটে কৈলাসচন্দ্র ত্রিপুরার রাজনৈতিক ইতিহাসের ঘটনাবলী আলোচনা করেন। একই সঙ্গে তিনি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে যেসব তথ্য পরিবেশন করেন তা থেকে ত্রিপুরার ও উত্তরপূর্ব ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা করা যায়।’ ইতিহাসবেত্তা অমলেন্দু দে মনে করেছেন, ‘যাঁরা ত্রিপুরার ও উত্তরপূর্ব ভারতের ইতিহাস গবেষণায়রত আছেন তাঁদের কাছে এই গ্রন্থ মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবেই সমাদৃত হবে।’ কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি যে, ত্রিপুরার ও উত্তরপূর্ব ভারতের গবেষকদের কাছেই নয়, বাংলাদেশের গবেষকদের কাছেও এটি এক মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত হওয়ার যোগ্য। কৈলাসচন্দ্রের বিবরণ থেকেই জানা যায়, ত্রিপুরার রাজ্যের সীমা ছিল ‘পূর্বদিকে কুকি প্রদেশ, উত্তরে শ্রীহট্ট জেলা, শ্রীহট্ট ত্রিপুরা ও নোয়াখালী জেলা, দক্ষিণে চট্টগ্রাম’। অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলা ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত। কৈলাসচন্দ্র সিংহ বর্ণিত ‘ত্রিপুরার ইতিহাস’ তাই বৃহত্তর কুমিল্লা জেলারও ইতিহাস। সেই বিবেচনা থেকে এই গ্রন্থ আমরা বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার স্বপ্ন লালন করেছি। আমরা লক্ষ করেছি যে, কুমিল্লার পাশাপাশি শ্রীহট্টের প্রাচীন ও আধুনিক বিবরণ, চট্টগ্রামের প্রাচীন ও আধুনিক বিবরণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিবরণ, প্রাচীন ভুলুয়া রাজ্য বা নোয়াখালি প্রভৃতি অঞ্চলের বিবরণ রয়েছে। তাই এই গ্রন্থ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি গ্রন্থ। লেখকের মৃত্যুর ৯৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এই গ্রন্থ বাংলাদেশের কেউ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়নি ভেবে অবাক হয়েছি। এই গ্রন্থের তথ্য বাদ দিয়ে কুমিল্লা অঞ্চলের ইতিহাসচর্চা সম্ভবপর নয়। কুমিল্লা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন বা গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাঁরা এই গ্রন্থের তথ্য ব্যবহার করেন। কিন্তু এই গ্রন্থ পুনমুদ্রণের উদযোগ কেউ গ্রহণ করেননি। অথচ বাংলাদেশের পাঠক ও গবেষকদের বৃহত্তর স্বার্থে এই গ্রন্থটির পুনর্মুদ্রণ হওয়া দরকার ছিল অনেক আগেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘গতিধারা’ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জেনে আমরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। প্যারীমোহন সেনের ‘নোয়াখালীর ইতিহাস’ (ড. আবু হেনা আবদুল আউয়াল-সংগৃহীত), শ্রীকালীনাথ চৌধুরীর ‘রাজসাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ (ড. তসিকুল ইসলাম রাজা সংকলিত), খোসালচন্দ্র রায়, রোহিণীকুমার সেন, বৃন্দাবনচন্দ্র পূততুণ্ড ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের চারটি গ্রন্থ নিয়ে ‘বৃহত্তর বাকেরগঞ্জ জেলার ইতিহাস’ (তপংকর চক্রবর্তী ও সিকদার আবুল বাশার সংকলিত), চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মার ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’, রাধারমণ সাহার ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’, যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’, যোগেশচন্দ্র গুপ্তের ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’, সতীশচন্দ্র মিত্রের ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’, আনন্দনাথ রায়ের ‘ফরিদপুরের ইতিহাস’ (ড. তপন বাগচী সংগৃহীত ও সংকলিত) প্রভৃতি শতবর্ষী ইতিহাসগ্রন্থ এই প্রতিষ্ঠান থেকে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহের ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ সেই ধারাবাহিকতারই অংশ মাত্র।
আমরা কৃতজ্ঞ আগরতলার অক্ষর পাবলিকেশনস্-এর প্রকাশক শুভব্রত দেব-এর কাছে। তাঁর প্রকাশিত সংস্করণ থেকে আমরা আলোকচিত্রগুলো ব্যবহার করেছি। আমরা শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ-রচিত প্রথম সংস্করণের ভূমিকাটিও জুড়ে দিয়েছি। পাঠকদের সুবিধার জন্য সূচিপত্রটিকে পুনর্বিন্যস্ত করেছি। এখন বাংলাদেশের পাঠকদের হাতের নাগালের মধ্যে এই গ্রন্থ এনে দিতে পেরে আমরা আনন্দিত ও গৌরবান্বিত। তবে এটি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার পাঠকদেরও কাজে লাগবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এই সুযোগে প্রকাশক সিকদার আবুল বাশারকে ধন্যবাদ দিই, পুরনো এই আকরগ্রন্থগুলোকে পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা ও কর্মতৎপরতার জন্য। যুৎসই একটি প্রচ্ছদ এঁকে দেয়ার কৃতিত্বও তাঁর। এই গ্রন্থ পাঠকের সংগ্রহকে ঋদ্ধ করবে, এই প্রত্যাশা করছি।
ড. তপন বাগচী
[প্রাক্তন গবেষক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, ঢাকা]
ড. আলী হোসেন চৌধুরী
[অধ্যাপক, লালমাই ডিগ্রি কলেজ, কুমিল্লা]
.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
ত্রিপুরা ভারতবর্ষ মধ্যে একটি অতি প্রাচীন রাজ্য। সুবিখ্যাত গুপ্ত সম্রাটদিগের শিলালিপি পর্যালোচনা দ্বারা অনুমিত হইতেছে যে, মিবারও ইহার ন্যায় প্রাচীন নহে। ত্রিপুরার রাজভাষা বাঙ্গালা, ইহার অধিকাংশ তাম্রশাসন বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা অক্ষরে লিখিত। এই রাজ্যের প্রাচীন ইতিহাস “রাজমালা” প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যের রত্নমালা স্বরূপ। সুতরাং ত্রিপুরার গৌরবে বাঙ্গালি ও বাঙ্গালা ভাষা গৌরবান্বিত।
ত্রিপুরারাজ্য ও রাজপরিবারের সহিত পুরুষানুক্রমে আমাদের সংশ্রব রহিয়াছে, সুতরাং ইহা ত্রিপুরার ইতিহাস রচনার পক্ষে বিশেষ অনুকূল। খ্রিস্টাব্দের অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে মদীয় খুল্লপিতামহ ঁরায় রামপ্রসাদ সিংহ মহাশয় প্রথমত ত্রিপুরার রাজকার্য্যে প্রবেশ করেন। তিনি আজীবন মহারাজ রাজধর মাণিক্যের প্রতিনিধি (আম- মুক্তার) স্বরূপ জাহাগীর নগরে (ঢাকায়) অবস্থান করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরে মদীয় জনক রায় গোলকচন্দ্র সিংহ মহাশয় ১২৪০ বঙ্গাব্দে ত্রিপুরার রাজকার্য্যে নিযুক্ত হন। তিনি যদিচ অধিকাংশ সময় রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারী (সেরাস্ত (১) দার) ছিলেন, কিন্তু তৎকালে, কি সামরিক কি রাজনৈতিক বিভাগ, যখন যে কোন বিভাগে যে কোন গুরুতর কার্য্য উপস্থিত হইয়াছে, তখনই সেই কার্য্যভার তাঁহার হস্তে বিন্যস্ত হইয়াছে। ১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দের সিপাহিবিদ্রোহের সময় মহারাজ ঈশানচন্দ্ৰ মাণিক্য বাহাদুর তৎসংক্রান্ত অতি গুরুতর কার্যভার তাঁহার হস্তে বিন্যস্ত করিয়াছিলেন।[১] কিঞ্চিদধিক ৩২ বৎসরকাল বিশেষ দক্ষতা ও গৌরবের সহিত ত্রিপুরার রাজকার্য্য নির্বাহ করত পিতৃদেব ১২৭৩ বঙ্গাব্দে স্বর্গারোহণ করেন। পিতৃবিয়োগের অল্পকাল পরেই আমি (১৫ বৎসর বয়ক্রমে) ত্রিপুরার রাজকার্য্যে প্রবেশ করি। প্রায় ৪ বৎসরকাল সেই কাৰ্য্য সম্পাদন করত কোন কারণ বশত স্বীয় পদ পরিত্যাগ করিয়াছিলাম।
এই সময়ে ত্রিপুর সিংহাসনের অধিকারিত্ব লইয়া মৃত মহারাজ ঈশানচন্দ্ৰ মাণিক্য বাহাদুরের এক মাত্র জীবিত পুত্র কুমার নবদ্বীপচন্দ্র বাহাদুরের সহিত বর্ত্তমান মহারাজের কলহ উপস্থিত হয়। আমি কুমার বাহাদুরের পক্ষ অবলম্বন করি, তাঁহার সর্বপ্রকার কাৰ্য্য সম্পাদন ভার আমার হস্তে বিন্যস্ত হইয়াছিল।
ত্রিপুরেশ্বরদিগের বিস্তৃত জমিদারি, চাকলে রোসনাবাদে স্বীয় স্বত্ত্ব সংস্থাপন জন্য কুমার বাহাদুর ব্রিটিস বিচারালয়ের আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেই মোকদ্দমা আমার দ্বারা (২) পরিচালিত হইয়াছিল। তৎকালে ত্রিপুরার ইতিহাসের যে সামান্য উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছিলাম, তদ্বারা ১২৮৩ বঙ্গাব্দে রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত নামক ক্ষুদ্র পুস্তক প্রকাশ করি। ইহাই আমার সাহিত্য জীবনের অপ্রস্ফুটিত প্রথম কুসুম। এই পুস্তকখানা যতই ক্ষুদ্র হউক না কেন, বঙ্গীয় সমালোকগণ ইহার অনুকূল সমালোচনা দ্বারা আমাকে বিশেষরূপে উৎসাহিত করিয়াছিলেন।
উক্ত গ্রন্থ প্রকাশের পর ২০ বৎসর গত হইয়াছে, ইহার অধিকাংশ সময় আমি ভারত পুরাতত্বানুসন্ধানে অতিবাহিত করিয়াছি। এই সময়ে ত্রিপুরার ইতিহাস সংশ্লিষ্ট যে সকল বিবরণ প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহার কোন কোন অংশ মল্লিখিত বিবিধ প্রবন্ধে, সাময়িক পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত হইয়াছে। বহুদিন গত হইল ত্রিপুরার ইতিবৃত্তের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হইয়াছে। বিস্তৃতভাবে ত্রিপুরার ইতিহাস প্রচার করিব বলিয়া সেই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করিতে বিরত ছিলাম, কিন্তু সেই ক্ষুদ্র পুস্তক বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের অংশ বিশেষের কঙ্কাল স্বরূপ গৃহীত হইয়াছে।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ আইনের বিধান অনুসারে “চাকলে রোসনাবাদের” সারবে সেটেলমেণ্ট কার্য্য আরম্ভ হইয়াছে। ইহার দ্বারা লাখেরাজদার ও তালুকদারগণের হৃদয়ে বিভীষিকা উৎপাদিত হইয়াছে। সারবে সেটেলমেন্টের পরিণাম যাহাই (৩) হউক না কেন, ইহার দ্বারা ইতিহাসের একটি প্রধান উপকরণ, – প্রাচীন সনন্দ সংগ্রহের বিশেষ সুবিধা হইয়াছে। উক্ত সারবে সেটেলমেন্ট দ্বারা নুরনগরের তালুকদারবর্গ ও মহারাজের মধ্যে অনন্ত কলহের বীজ উপ্ত হইয়াছে, অঙ্কুরে সেই বীজকে বিনষ্ট করিবার অভিপ্রায়ে ভূতপূর্ব সেটেলমেন্ট অফিসার শ্রীযুক্ত বরদাচরণ মিত্র এম; এ; সি, এস মহাশয় মহারাজ বাহাদুরের প্রধান কর্মচারী এবং তালুকদারবর্গকে লইয়া ১৩০০ বঙ্গাব্দের ১৮ই চৈত্র কসবা (কৈলারগড়) নগরে একটি সভা করিয়াছিলেন। ত্রিপুরার তদানীন্তন মেজেস্ট্রেট কালেক্টর শ্রীযুক্ত মে. আর, ডব্লিউ কার্লাইল সাহেব সি, এস; সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সেই সভায় আমি নুরনগরের ইতিবৃত্তমূলক একটি বক্তৃতা করিয়াছিলাম। তৎকালে মিত্র মহাশয় আমার সেই বক্তৃতা লিখিত আকারে প্রাপ্ত হওয়ার অভিলাষ প্রকাশ করেন। সেই বক্তৃতা নিবন্ধাকারে প্রস্তুত হইলে নুরনগরের তালুকদারগণ তাহা মুদ্রিত করিবার জন্য অনুরোধ করেন। সেই অকিঞ্চিতকর নিবন্ধ সাধারণ পাঠকবৃন্দের প্রীতিপ্রদ হইবে না বিবেচনায় আমার পূর্ব সংকল্পিত ইতিহাসের সহিত তাহা সংযুক্ত করিয়া প্রকাশ করা কর্ত্তব্য বিবেচনা করিলাম। এই গ্রন্থের চতুর্থ ভাগের ষষ্ট ও সপ্তম অধ্যায়ে তাহা পরিবর্দ্ধিত আকারে মুদ্রিত হইয়াছে।
ত্রিপুরার ইতিহাস রচনাকালে আমি যে সমস্ত গ্রন্থ হইতে (৪) সাহায্য প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহার একটি সুদীর্ঘ তালিকা প্রদান করা নিষ্প্রয়োজন। কোন কোন স্থলে টীকায় মূল গ্রন্থের নামোল্লেখ করা হইয়াছে। এই গ্রন্থ রচনা জন্য আমি তিন খণ্ড রাজমালা পুথি সংগ্রহ করিয়াছিলাম; −১ প্রাচীন রাজমালা, ২— সংস্কৃত রাজমালা, ৩— সংক্ষিপ্ত রাজমালা[২] রাজমালা সংগ্রহে যাঁহারা আমাকে সাহায্য করিয়াছেন, তাঁহারাই আমার প্রথম ধন্যবাদের পাত্ৰ।
বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে সমসের গাজি নামক একব্যক্তি ত্রিপুরার অধিকাংশ অধিকার করিয়াছিলেন। প্রাচীন মুসলমানী বাঙ্গালায় তাহার একখণ্ড জীবনচরিত (হস্ত লিখিত) পুঁথি প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।
বর্তমান খ্রিষ্ট শতাব্দীর আরম্ভ হইতে ত্রিপুরারাজত্বের উত্তরাধিকারীত্বের মীমাংসা বারংবার ব্রিটিশ বিচার আদালত কর্তৃক হইয়াছে। এই সকল মোকদ্দমার নথীস্ত কাগজ পত্রগুলি ইতিহাস সংগ্রহ পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয়। (৫)
ব্রিটিশ শাসনারম্ভ হইতে কর্তৃপক্ষগণের লিখিত চিঠিপত্র রিপোর্ট ও গ্রন্থাদি হইতে প্রচুর পরিমাণে সাহায্য প্রাপ্ত হইযাছি। ধারাবাহিকরূপে তাহার তালিকা প্ৰদান নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু বিশেষ কৃতজ্ঞতার সহিত উল্লেখ করিতেছি যে, আমাদের বর্ত্তমান লেপ্টেনেন্ট গবর্ণর মাননীয় শ্রীযুক্ত সার আলেকজেন্ডার মেকেঞ্জি মহোদয়ের প্রণীত History of relations of the Government with the Hill Tribes of the North East Forntier of Bengal নামক উপাদেয় গ্রন্থ হইতে বিশেষ সাহায্য প্রাপ্ত হইয়াছি। ত্রিপুরার ভূতপূর্ব মন্ত্রীদ্বয়ের (নাজির দীনবন্ধু ও ঠাকুর ধনঞ্জয় দেবের) পরিদর্শন রিপোর্ট আলোচনা করিয়াছি। পিতৃদেব মহাশয় রাজকার্য্য উপলক্ষে ত্রিপুরারাজ্যের অধিকাংশ স্থান ভ্রমণ করিয়াছেন। বাল্যকালে তাঁহার নিকট যাহা শ্রুত হইয়াছি, তাহার অধিকাংশ ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণের রিপোর্টে প্রাপ্ত হইয়াছি। কেবল বিখ্যাত কুকি সরদার লালছোকলাকে ধৃত করা সম্বন্ধে তাঁহার বাক্য কাপ্তান ব্লাকউডের বর্ণনার সহিত অনৈক্য হইয়াছে। (৩৫৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য মূল গ্রন্থ)
আদি রত্নমাণিক্যের পূর্ববর্তী ত্রিপুরার ইতিহাস নিবিড় তমসাচ্ছন্ন। তদনন্তর মুসলমানদিগের সংস্রবে ত্রিপুরার ইতিহাস উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। মহারাজ (প্রথম) ধর্মমাণিক্য স্বীয় সভাসদ পণ্ডিত দ্বারা রাজমালা প্রণয়ন করত (৬) একটি উজ্জ্বল অবিনশ্বর কীৰ্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন। আমরা সেই মহাপুরুষের প্রদত্ত নামটি বিলুপ্ত করা নিতান্ত গর্হিত কাৰ্য্য বলিয়া বিবেচনা করি। স্পেন দেশীয় প্রাচীন ইতিহাসগুলির ন্যায় রাজমালা অসম্পূর্ণ কিম্বা অতিবর্ণে রঞ্জিত হইলেও ইহাই প্রাচীন ত্রিপুরেতিহাসের মূল ভিত্তি। যদিচ ত্রিপুরার চতুদিকস্থ রাজ্যসমূহের ইতিহাস, ভ্রমণকারীদিগের ভ্রমণ বৃত্তান্ত, অন্যান্য হস্ত লিখিত পুঁথি, শাসনপত্র ও মুদ্রা প্রভৃতি হইতে সাহায্য গ্রহণ করিয়াছি, তত্রাচ সেই প্রাচীন গ্রন্থের গৌরব রক্ষার জন্য আমরা ত্রিপুরার ইতিহাসকে রাজমালা আখ্যায় আখ্যাত করিয়াছি।
গ্রাম্য গীতিকবিতা ও প্রাচীন প্রবাদ বাক্যগুলি ইতিহাস সংগ্রহে বিশেষ সাহায্যকারী। কোন কোন গীতি কবিতার সত্যতা কর্তৃপক্ষগণের রিপোর্ট দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে।
আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত হইলাম বর্ত্তমান মহারাজ “রাজরত্নাকর” নামক রাজবংশের একখানি সংস্কৃত ইতিহাস প্রচার করিতে মনস্থ করিয়াছেন। ইহা অবশ্যই আহ্লাদের বিষয়। কিন্তু ইহা দ্বারা তাঁহার পিতৃপুরুষের সেই অমর কীর্ত্তির (রাজমালার) বিকৃতি সাধিত হইলে সর্বসাধারণের মর্মপীড়ার কারণ হইবে।
ত্রিপুরা রাজ্যে যে অব্দ প্রচলিত আছে, তাহার চতুর্দ্দশ শতাব্দী আরম্ভ হইয়াছে। প্রাচীন শাসনপত্র কিম্বা ক্ষোদিত (৭) লিপিতে ইহার উল্লেখ নাই। মূল গ্রন্থের নবম পৃষ্ঠায় তৎসম্বন্ধে যে প্রবাদের উল্লেখ করা হইয়াছে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাহা সত্য বলিয়া বোধ হয় না। বোধ হয় মুসলমান সংশ্রবের পর হিজরী সন গ্রহণ করা হয়, পশ্চাৎ সৌর বৎসর গণনা দ্বারা ইহা কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া অধুনা ত্রিপুরাব্দ আখ্যা ধারণ করিয়াছে। দুই তিন শতাব্দীর প্রাচীন সনন্দ সমূহে শকাব্দের সহিত “সন” আখ্যা দ্বারা ইহা উল্লেখ হইয়াছে।
নরপতিগণের সময়াবধারণে আমরা বিশেষ কষ্ট প্রাপ্ত হইয়াছি। ত্রিপুরেশ্বরদিগের অভিষেক ও মৃত্যুকাল যাহা লেখা হইয়াছে, কোন কোন স্থলে তাহার দুই এক বৎসর অগ্র পশ্চাৎ হওয়া বিচিত্র নহে। সনন্দ সংগ্রহে চাকলে রোসনাবাদের লাখেরাজদার ও নুরনগরের তালুকদারগণ আমাকে বিশেষ সাহায্য করিয়াছেন। কতকগুলি ভদ্রলোকের বংশাবলী হইতে সাহায্য প্রাপ্ত হইয়াছি, তন্মধ্যে ঘোষ বিশ্বাস ও ধর চৌধুরীদিগের বংশাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুদ্রাসমূহের যে সকল ক্ষোদিত চিত্র প্রদান করা হইয়াছে, মূলের সহিত তুলনা করিলে তাহার সহিত সামান্য প্রভেদ পরিলক্ষিত হইবে, এইরূপ প্রভেদ ক্ষোদাই কার্য্যে অপরিহার্য্য।
এই গ্রন্থ রচনা সম্বন্ধে যাঁহারা আমাকে সাহায্য করিয়াছেন আমি কৃতজ্ঞতার সহিত তাঁহাদিগকে ধন্যবাদ প্রদান করিতেছি। (৮)
.
টীকা
১. ১২৬৭ ত্রিপুরাব্দের ২৫ অগ্রহায়ণের ৩০২ নং চিঠি।
২. রেবারেন্ড জেইমস লং সাহেব যে রাজমালার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ প্রকাশ করিয়াছেন (J. A. S. B. Vol. XIX P 533 to 537) তাহার অন্য নাম কৃষ্ণমালা। মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের শাসনকালে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছিল বলিয়া তাহা কৃষ্ণমালা আখ্যাপ্রাপ্ত হয়। উল্লেখিত কৃষ্ণমালা পুঁথি আমরা পর্যালোচনা করিয়াছি।
কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ
Mrinal Karmakar
আপনারা রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ ও শরৎচন্দ্রের সব লেখা আপলোড করেছেন??
জানতে ইচ্ছা করছে
বাংলা লাইব্রেরি
দু’একটা বাদ থাকতে পারে।