শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের রহস্য সমগ্র
প্রথম সংস্করণ – এপ্রিল ২০১৫
“রা-স্বা”
বন্দে শ্রীশ্রীঅনুকূলচন্দ্রম
ইষ্টপ্রাণ শ্রীসজল দাস
করকমলেষু
.
নিবেদন
রহস্যকাহিনি লেখা আমার প্যাশন নয়, তবে প্রথম যখন রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে ধারাবাহিক রহস্যকাহিনি প্রকাশ করার সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত হল তখন প্রথম লেখাটি লেখার জন্য আমাকে তলব করা হয়েছিল। রমাপদবাবুর মুখে সেই প্রস্তাব পেয়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, পারব কি না তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যদিও আমাদের শিলিগুড়ির বাড়িতে আমার বাবার সংগৃহীত গ্রন্থরাজির মধ্যে কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, ব্রিটিশ ও আমেরিকান বিস্তর রহস্যকাহিনি ছিল এবং আমি সেসব গোগ্রাসে পাঠ করেছি, কিন্তু পড়া এক আর লেখা আর-এক জিনিস।
আমার দোনোমোনো ভাব দেখে রমাপদবাবু বললেন, মশাই, আপনার কথাই ভাবা হয়েছে, আপনি না লিখলে রহস্যকাহিনিই প্রকাশিত হবে না ।
অগত্যা রাজি হই এবং সাহস করে লিখি ‘বিকেলের মৃত্যু’, খানিকটা কল্পবিজ্ঞান, মাফিয়া, খানিকটা প্রেম।
এই ভাবেই ‘কালো বেড়াল, সাদা বেড়াল’ লেখা। এটি পুরোটা থ্রিলার। বাংলায় থ্রিলার লেখার বিশেষ চলন নেই, বাংলায় গোয়েন্দাকাহিনির জনপ্রিয়তাই বেশি।
ব্যোমকেশ বা ফেলুদার কাহিনি দীর্ঘকাল বাঙালি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে, তবে প্রাইভেট গোয়েন্দা ব্যাপারটা বাস্তবে প্রায় নেই বলা চলে। অন্তত তারা কোনও খুন বা অপরাধের তদন্ত করার অধিকারী নয়। তারা বন্দুক পিস্তলও যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারে না। তাই আমি যখন আনন্দবাজার সংস্থার শারদীয় পত্রিকাতে লেখার জন্য আহূত হই তখন শবর দাশগুপ্ত নামক একটি গোয়েন্দাকে সৃষ্টি করি। শবর লালবাজারের গোয়েন্দা। খুব লম্বা-চওড়া নয়, কিন্তু প্ৰবল শক্তিমান এবং সম্পূর্ণ ভয়ডরহীন। আমি ইচ্ছে করেই শবরকে সবরকম মানুষী দুর্বলতা থেকে মুক্ত করেছি। সে মদ খায় না, ধূমপান করে না, কোনও প্রেম ভালবাসা বা পরিবারও নেই। কিন্তু সে মোটেই নিষ্ঠুর নয় এবং প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ককেও সে সম্মান করে, উপরন্তু অপরাধীর প্রতিও সে নির্মম নয়। তাকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ঋণ’-এ যখন খুনি তার হাতে ধরা পড়ল তখন সে বলেছিল, তুমি তো পালাতে পারতে। পালালে না কেন?
শবরকে নিয়ে আমার বেশ কয়েকটি রহস্যকাহিনি আছে। কয়েকটি উপন্যাস এবং কয়েকটি বড় গল্প। সিরিয়াস লেখার ফাঁকে ফাঁকে আরও কয়েকটি শবর উপাখ্যান লেখার একটা ইচ্ছে আমার আছে।
‘সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে’ পড়ে এক শ্রদ্ধেয় মানুষ বলেছিলেন, এটার মধ্যে তিনি আগাথা ক্রিস্টির টুওয়ার্ডস জিরো উপন্যাসটির ছায়া দেখেছেন। টুওয়ার্ডস জিরো আমার প্রিয় উপন্যাস। কিন্তু বস্তুতপক্ষে লিফট অচল করে দিয়ে একজন হৃদরোগীকে হত্যার পরিকল্পনাটি হয়তো সদৃশ, কিন্তু ছায়াপাত যে নেই তা নিশ্চিত। ‘সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে’ ঠিক হত্যাকাহিনিও নয়। এ মানুষের বিভ্রান্তি, মায়া, লালসা এসব কিছুর মন্থনজাত কিছু। শবর হত্যাকারীকে চিহ্নিত করেও তাই কিছুই করে না। কারণ করার কিছু ছিলও না।
‘প্রজাপতির মৃত্যু ও পুনর্জন্ম’ আসলে বোধহয় একটি প্রেমেরই উপন্যাস। রহস্যকাহিনির আবরণে মোড়া। এখানে শবর গোয়েন্দা বটে, সেই সঙ্গে একজন সংবেদনশীল মানুষও। বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রীর মিলন ঘটানোর জন্য সেও কিন্তু কলকাঠি নেড়েছে।
শবরের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক হয়তো পুলিশের মতো নয়। অপরাধীকে সে শুধু অপরাধের নিরিখেই বিচার করতে চায় না কখনও। তার পাথুরে চরিত্র, নির্বিকার হাবভাব এবং আবেগহীন আচরণ দেখে বোঝা যায় না যে, আসলে লোকটা কতখানি সংবেদনশীল।
‘আলোয় ছায়ায়’ উপন্যাসে বিপন্ন শিল্পীর সঙ্গে তার দীর্ঘ সংলাপ রূঢ়তাহীন বটে, কিন্তু তাতে ধার বড় কম নেই।
‘রূপ’ উপন্যাসটি বা বড় গল্পটি সম্পূর্ণ সংলাপ-নির্ভর। একজন সুন্দরী মেয়ে যে একটি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে একটি বিউটি কনটেস্টে জয়ী হতে পারেনি, তার সঙ্গে শবরের সংলাপ। শবর যখন জেরা করে তখন সেটাকে জেরা বলে মনে হয় না। খুব বন্ধুর মতোই কথা বলে সে, সহানুভূতির সঙ্গে, কিন্তু আলাপচারিতার ভিতর দিয়েই একটু একটু সত্যের প্রকাশ ঘটে।
‘ঋণ” নিয়ে ইদানীং একটি চলচ্চিত্রও হয়েছে এবং সেটি প্রভূত জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। পরিচালক অরিন্দম শীল যখন চিত্রনাট্য তৈরির জন্য প্রস্তুত তখন সে আমার কাছে পরামর্শের জন্য আসে। তখনই আমি তাকে শবরের চরিত্রটি সম্পর্কে বলি যে, এটি অন্য সব গোয়েন্দাদের মতো নয়। বাইরের মোড়কে সে খানিকটা রোবট, খানিকটা পাথর, বাহ্যত তার কোনও ঘটনাতেই কোনও লক্ষ্যণীয় প্রতিক্রিয়া হয় না। ভয় নেই, চমকানো নেই, বিস্ময়ও নেই, সে যেন সর্বদাই সব ঘটনার জন্য প্রস্তুত।
এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আমার ‘কাপুরুষ’ উপন্যাসটিও। এটি ঠিক গোয়েন্দাকাহিনি বা রহস্যকাহিনি নয়। তবে হ্যাঁ, এই উপন্যাসের নায়ক বিশ্বরূপ স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার। দিল্লিতে, খালিস্থান আন্দোলনের ফলে যে বিশাল অশান্তি দেখা দিয়েছিল তারই একটি আংশিক ছবি এই উপন্যাসে আছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক উগ্রবাদের মধ্যেই নিহিত তাদের ধ্বংসের বীজটিও। আর বেশির ভাগ খুন-খারাপির রাজনীতি শেষ অবধি নানা ভ্রষ্টাচার ব্যভিচারে গিয়েও নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
এই সংকলনে ‘কাপুরুষ’ অন্তর্ভুক্তির কথা আমাকে বলেন সম্ভবত আনন্দ পাবলিশার্সেরই কেউ, প্রস্তাবটি শুনে প্রথম দ্বিধায় পড়ি, তারপর মনে হল, ‘কাপুরুষ’ এই সংকলনে বেমানান হবে না। কাহিনির টান ও গতি রহস্যকাহিনির মতোই।
সংকলনটি শেষ পর্যন্ত বেশ বড়সড়ই হল। ভয় একটাই, স্থূলাকার বই পড়তে কারও অসুবিধে না হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতাবলে জানি, পাঠক-পাঠিকারা একটু মোটাসোটা বই পছন্দ করেন।
যাই হোক, আমার রহস্যকাহিনিগুলিকে যে এক করা গেল সে একটা মস্ত স্বস্তি। অনেকেই অনেক শবর কাহিনি খুঁজে পান না। আমার শরণ নিলে আমিও বিপন্ন বোধ করি। পাঠক- পাঠিকাদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন এই গ্রন্থখানি তাঁরা কতটা গ্রহণ করবেন তা তো জানি না, তবে নিবেদিত তো রইল।
বিনীত
গ্রন্থকার
Leave a Reply