রবিজীবনী / ১ম খণ্ড / ১২৬৮–১২৮৪ – প্রশান্তকুমার পাল
রবিজীবনী / ১ম খণ্ড / ১২৬৮–১২৮৪ – প্রশান্তকুমার পাল
মুখবন্ধ
1972-তে যখন কালানুক্রমিক ভাবে চিঠিপত্র-সহ সমগ্র রবীন্দ্র-রচনা পড়তে শুরু করেছিলাম, তখন লেখালেখির ভাবনা মনের সুদূর প্রান্তেও উপস্থিত ছিল না—পড়ার সুবিধের জন্য শ্রদ্ধেয় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের চার খণ্ডের রবীন্দ্রজীবন ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক এবং অন্যান্য কয়েকটি গ্রন্থ অবলম্বনে শুধু পাঠসূচীর একটি রূপরেখা চিহ্নিত করে নিয়েছিলাম। কিন্তু পাঠ যতই এগোতে লাগল, সেই রূপরেখার অসম্পূর্ণতা ও অন্যান্য সমস্যা ততই প্রকট হয়ে উঠল। ফলে আমার পাঠকক্ষের নিভৃত পরিবেশ থেকে নেমে আসতে হল পাঠাগারের বিস্তৃত প্রাঙ্গণে, বিশেষত তার ধূলি-ধূসরিত প্রান্তগুলিতে। নিজের পথরেখার হদিশ রেখে যাচ্ছিলাম খাতার পাতায়। তার পর 1976-এর শেষ ভাগে যখন রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে’ কবিতায় এসে পৌঁছলাম, তখন দেখা গেল আমার পাঠের পথও বিভিন্ন অপ্রকাশিত ও অব্যবহৃত তথ্যের দ্বারা কণ্টকাকীর্ণ—খাতা জমেছে প্রচুর।
সেই খাতাগুলি নিয়ে আমার বিশেষ শিরঃপীড়া ছিল না, হয়তো একদিন ওজন দরেই তারা বিক্রীত হয়ে যেত—কিন্তু বন্ধুবর অধ্যাপক অরূপরতন ভট্টাচার্য তা হতে দিলেন না, ক্রমাগত তাগিদায় এক দুঃসাধ্য ব্রতে আমায় নিয়োজিত করলেন। তারই পরিণতি এই গ্রন্থ।
১২৬৮ থেকে ১২৮০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত রবীন্দ্রজীবনের প্রথম তেরো বছরের খসড়া বিবরণ যখন লেখা শেষ হয়, তখন অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে কবি-অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের কাছে সেগুলি দিয়ে আসি। কালিদাসের একটি বিখ্যাত প্রবাদপ্রতিম শ্লোক স্মরণ করিয়ে দেবেন—এইটাই যখন প্রত্যাশিত ছিল, তখন আমাকে সম্পূর্ণ বিস্মিত করে তিনি যথেষ্ট উৎসাহ প্রকাশ করলেন। তার পর থেকে এই গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনার প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। গ্রন্থের নামকরণও তিনিই করেছেন। তাঁর কাছে ঋণ আমার জীবনের বড়ো সম্পদ, অবশিষ্ট জীবনের নিষ্ঠা ও পরিশ্রম দিয়েই তা শোধ করতে হবে। সহকর্মী ও বন্ধু অধ্যাপক অচিন্ত্যপ্রিয় ভট্টাচার্যের মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমার যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল, এই উপলক্ষে কৃতজ্ঞ চিত্তে সে-কথা স্মরণ করছি।
রবীন্দ্রজীবন-বর্ণনায় এখানে আমি একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেছি, জানি না আর-কোনো জীবনীকার এই পথ গ্রহণ করেছেন কি না। এখানে ‘পূর্বকথন’ অংশে ঠাকুরবংশের ও দেশ-কালের পরিচয় দেবার পর ‘জীবনকথা’ বর্ণিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রতিটি বৎসরের কালসীমায় এক-একটি অধ্যায়কে বিন্যস্ত করে। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে ‘প্রাসঙ্গিক তথ্য’ অভিধায় একাধিক পরিশিষ্ট যোগ করে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও দেশ-কাল সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ দেবার চেষ্টা করেছি। এই পদ্ধতিতে কোথাও-কোথাও পুনরুক্তি ঘটলেও রবীন্দ্রজীবনের প্রধান ঘটনাগুলিকে মোটামুটি তারিখের দ্বারা চিহ্নিত করার সুযোগ পাওয়া গেছে—যার ফলে তাঁর জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে অনেক বিচার-বিভ্রাট এড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে করি। এক্ষেত্রে আমি সর্বদা সচেতন ভাবে রবীন্দ্রসাহিত্যের রস-বিশ্লেষণকে লক্ষ্যের বহির্ভূত রেখেছি। সে কাজ রসজ্ঞ সমালোচকের জন্য তুলে রাখাই ভালো।
এই কাজে শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড ভবতোষ দত্ত আমাকে প্রার্থিত সর্বপ্রকার সুবিধা দিয়েছেন। প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে তাঁর কাছে আমার দাবি ছিল সীমাহীন, আশাতিরিক্ত ভাবে তিনি তা পূরণও করেছেন। সেখানকার সমস্ত কর্মীও অকৃপণভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন। তাঁদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অপ্রকাশিত তথ্য প্রকাশের অনুমতি দান করে রবীন্দ্রভবন-কর্তৃপক্ষও আমাকে বাধিত করেছেন।
বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ, জাতীয় গ্রন্থাগারের সংবাদপত্র-শাখা, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি ও স্টেট আর্কাইভ্স্, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, চাংড়িপোতা বিদ্যাভূষণ পাঠাগার প্রভৃতি স্থানে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। এই প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষ ও কর্মীদের সাহায্য কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি।
ড নরেন্দ্রনাথ কানুনগো, ড সরোজ দত্ত ও শ্ৰীচিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় উনিশ শতকে বাংলা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার রূপটি বোঝার ক্ষেত্রে কয়েকটি মূল্যবান সূত্রের সন্ধান দিয়েছিলেন। এর জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
মুদ্রণের প্রতিটি পর্যায়ে আমার সহায়ক ছিলেন শ্রীসুবিমল লাহিড়ী, দু-একটি তথ্যের ভ্রান্তি-নিরসনেও তিনি সাহায্য করেছেন। এঁর কাছে আমি সবিশেষ কৃতজ্ঞ। পরিশেষে ধন্যবাদ জানাই মুদ্রাকর শ্রীনিশিকান্ত হাটই ও তুষার প্রিন্টিং ওয়ার্কসের কর্মীদের, তাঁদের সহায়তা ছাড়া এত অল্প সময়ের মধ্যে মুদ্রণকার্য সমাপ্ত করা সুকঠিন হত।
ড ভূদেব চৌধুরীর কাছে প্রায় চার বছর কলেজের পাঠ গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু শুধু পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেই তিনি তাঁর দায়িত্ব সমাপ্ত করেন নি, সাহিত্যবোধে দীক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হৃদয়ও দান করেছিলেন। এই গ্রন্থ তাঁকে উৎসর্গ করে আমার গুরুদক্ষিণা নিবেদন করলাম।
প্রশান্তকুমার পাল
১০২/১ রামমোহন সরণি, কলকাতা ৭০০ ০০৯
আনন্দমোহন কলেজ
১ বৈশাখ ১৩৮৯
দ্বিতীয় সংস্করণের নিবেদন
রবিজীবনী প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হল। পরবর্তী গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে এর অনেক অংশই পুনর্লিখিত হওয়ায় একে পুনর্মুদ্রণ না বলে সংস্করণ নামে অভিহিত করাই যুক্তিযুক্ত। শ্রদ্ধেয় গোপালচন্দ্র রায় এই বইয়ের অনেক তথ্য ও মতের প্রতিবাদ করে ‘রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন’ [১৩৯৩] নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। বইটি পড়ে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি। তাঁর যুক্তি সর্বত্র গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, তবু তাঁর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক অংশ পুনর্লিখিত হয়েছে। ‘ভারতভূমি’ কবিতা রবীন্দ্রনাথের লেখা নয়, তাঁর এই সিদ্ধান্ত আমি গ্রহণ করেছি। অনাথনাথ দাস ব্যক্তিগত পত্রে অনেক সংশোধন ও সংযোজনের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ইরাবতী দেবীর জন্মসাল সম্পর্কে আমার পূর্বপ্রকাশিত মন্তব্য সম্পর্কে অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী প্রশ্ন তুলেছিলেন—বিষয়টি সংশোধিত হয়েছে। ড প্রতাপ মুখোপাধ্যায় ও মঞ্জুলা ভট্টাচার্যের লেখা কয়েকটি তথ্য সংশোধনে সাহায্য করেছে। এঁদের সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
খণ্ডটির পূর্বতন প্রকাশক ভূর্জপত্র-এর স্বত্বাধিকারিণী শর্মিলা পাল এবং শিবনাথ পাল, অরিজিৎ কুমার ও অধ্যাপক স্বপন মজুমদারকে তাঁদের আনুকূল্যের জন্য ধন্যবাদ জানাই।
প্রশান্তকুমার পাল
১ কার্তিক ১৪০০
পাঠ-নির্দেশ
এই গ্রন্থ-রচনায় রবীন্দ্রনাথ-লিখিত পুস্তকের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর বিভিন্ন খণ্ড ব্যবহৃত হয়েছে। বিভিন্ন সংস্করণে পৃষ্ঠাঙ্কের সামান্য ব্যতিক্রম হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও পাঠকের পক্ষে উদ্ধৃতি বা উল্লেখের মূল খুঁজে পেতে খুব বেশি অসুবিধা হবে না ভেবে সংস্করণ বা মুদ্রণ-তারিখ নির্দেশিত হয়নি। অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে উল্লেখপঞ্জি-তে প্রথম উল্লেখের স্থানে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে প্রকাশ-সন দেওয়া হয়েছে। দণ্ড চিহ্নের পরের সংখ্যাটি পৃষ্ঠাঙ্ক-সূচক।
গ্রন্থের মূল পাঠে তৃতীয় বন্ধনীর অন্তর্গত তারিখগুলি সাধারণত পুরোনো পঞ্জিকা বা Ephimeris অবলম্বনে নির্ধারণ করা হয়েছে। উদ্ধৃতির মধ্যে এইরূপ বন্ধনী-মধ্যস্থ শব্দ বা শব্দগুলি আমরা যোগ করেছি। মূলের বানান সাধারণত অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। লেখা বা ছাপা ভুল বানানের প্রতি ‘[য]’ অক্ষর-যোগে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, ইংরেজির ক্ষেত্রে যথারীতি ‘[sic]’ শব্দটি ব্যবহৃত। [?]-চিহ্ন সংশয়-সূচক। উদ্ধৃতি ছাড়া অন্যত্র খ্রিস্টাব্দ সর্বদাই ইন্দো-আরবীয় [1, 2, 3… ইত্যাদি] হরফে লিখিত, ‘শক’ শব্দটির ব্যবহার না থাকলে বাংলা হরফে লেখা অব্দগুলিকে বঙ্গাব্দ বুঝতে হবে।
শব্দ-সংক্ষেপণ
জীবনস্মৃতি ১৭। ২৭৩ : রবীন্দ্র-রচনাবলী ১৭শ খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থ, পৃ ২৭৩।
‘পিতৃস্মৃতি’, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ [১৩৭৫]। ১৫২ : ১৩৭৫-এ প্রকাশিত ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘পিতৃস্মৃতি’ প্রবন্ধ, পৃ ১৫২।
কবি-কাহিনী অ-১। ১৩-২৮ : রবীন্দ্র-রচনাবলী অচলিত সংগ্রহ ১ম খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ‘কবি কাহিনী’ গ্রন্থ, পৃ ১৩ থেকে ২৮।
র°র° ১৫ [শতবার্ষিক সং]। ১৩৮-৪৫ : পশ্চিমবঙ্গ সরকার-প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ ১৫শ খণ্ডের পৃ ১৩৮ থেকে ১৪৫।
বি.ভা.প. ১৮।৪। ৩৮৯ : বিশ্বভারতী পত্রিকা, ১৮শ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, পৃ ৩৮৯।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সা-সা-চ ৩। ৪৫।১০: সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা ৩য় খণ্ড ৪৫ সংখ্যক ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর’ গ্রন্থের পৃ ১০।
অগ্র : অগ্রহায়ণ।
তত্ত্ব : তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা।
Leave a Reply