রক্তাক্ত প্রান্তর – মুনীর চৌধুরী
আমার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ
লিলির নামে
উৎসর্গ করলাম
ভূমিকা
১.১ পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ এই নাটকের পটভূমি। এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় ১৭৬১ সালে। মারাঠা বাহিনীর নেতৃত্ব করেন বালাজী রাও পেশোয়া; মুসলিম শক্তির পক্ষে আহমদ শাহ্ আবদালী। এই যুদ্ধের ইতিহাস যেমন শোকাবহ তেমনি ভয়াবহ। হিন্দু ও মুসলিম পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সংকল্প নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধের স্থূল পরিণাম মারাঠাদের পরাজয় ও পতন, মুসলিম শক্তির জয় ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ। জয়পরাজয়ের এই বাহ্য ফলাফলের অপর পিঠে রয়েছে উভয় পক্ষের অপরিমেয় ক্ষয়-ক্ষতির রক্তাক্ত স্বাক্ষর। যত হিন্দু আর যত মুসলমান এই যুদ্ধে প্রাণ দেয় পাক-ভারতের ইতিহাসে তেমন আর কোনোদিন হয়নি। মারাঠারা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলো বটে কিন্তু মুসলিম শক্তিও কম ক্ষতিগ্রস্ত হলো না। অল্পকাল মধ্যেই বিপর্যস্ত ও হৃতবল মুসলিম শাসকবর্গকে পদানত করে ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতে তার শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে উদ্যোগী হয়। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের অব্যবহিত ফলাফল যেমন মানবিক দৃষ্টিতে বিষাদপূর্ণ, তার পরবর্তীকালীন পরিণামও তেমনি জাতীয় জীবনের জন্য গ্লানিময়। এই রক্তরঞ্জিত পানিপথের প্রান্তরেই আমার নাটকের পট উন্মোচিত।
১.২ তবে যুদ্ধের ইতিহাস আমার নাটকের উপকরণ মাত্র, অনুপ্রেরণা নয়। ইতিহাসের এক বিশেষ উপলব্ধি মানব-ভাগ্যকে আমার কল্পনায় যে, বিশিষ্ট তাৎপর্যে উদ্ভাসিত করে তোলে নাটকে আমি তাকেই প্রাণদান করতে চেষ্টা করেছি। আমার নাটকের পাত্র-পাত্রীরা মহাযুদ্ধের এক বিষময় পরিবেশের শিকার। নিজেদের পরিণামের জন্য তারা সকলেই অংশত দায়ী হলেও তাদের বেশির ভাগের জীবনের রূঢ়তম আঘাত যুদ্ধের সূত্রেই প্রাপ্ত। রণক্ষেত্রের সর্বাঙ্গীন উত্তেজনা ও উন্মাদনা, এদের জীবনেও সঞ্চারিত করে এক দুঃসহ অনিশ্চিত অস্থিরতা। রণস্পর্শে অনুভূতি গভীরতা লাভ করে, আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়, হতাশা হৃদয় বিদীর্ণ করে। রক্তাক্ত হয় মানুষের মন। যুদ্ধাবসানে পানিপথের প্রান্তরে অবশিষ্ট যে কয়টি মানব-মানবীর হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করি তাদের সকলের অন্তর রণক্ষেত্রের চেয়ে ভয়াবহরূপে বিধ্বস্ত ও ক্ষতবিক্ষত। প্রান্তরের চেয়ে এই রক্তাক্ত অন্তরই বর্তমান নাটক রচনায় আমাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে।
১.৩ এর সঙ্গে একটা তত্ত্বগত দৃষ্টিও এই নাটকে প্রশ্রয় লাভ করেছে। সে হলো এ যুগের অন্যতম যুদ্ধবিরোধী চেতনা। যুদ্ধবিগ্রহে পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক পটভূমিতে প্রেমের নাটক রচনা করতে গিয়ে আমিও হয়ত, একালের আরও অনেক নাট্যকারের মতোই সংগ্রাম নয় শান্তির বাণী প্রচারে যত্ন নিয়েছি। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ আমি নাটকের বশ, ইতিহাসের দাস নই। নাটকে ইতিহাস উপলক্ষ মাত্র। তাকে আমি নির্বাচন করি এই জন্য যে তার মধ্যে আমার আধুনিক জীবন-চেতনার কোনো রূপক আভাসে হলেও কল্পনীয় বিবেচনা করেছি। এবং যেখানে কল্পনা বিঘ্ন অলঙ্ঘীয় মনে করেনি সেখানে অসংকোচে পুরনো বোতলে নতুন সুরা সরবরাহ করেছি। এই অর্থে রক্তাক্ত-প্রান্তরকে ঐতিহাসিক নাটক না বললেও ক্ষতি নেই।
১.৪ কাহিনীর সারাংশ আমি কায়কোবাদের মহাশ্মশান কাব্য থেকে সংগ্রহ করি। মহাশ্মশান কাব্য বিপুলায়তন মহাকাব্য। তাতে অনেক ঘটনা, অনেক চরিত্র। আমি তা থেকে কয়েকটি মাত্র বেছে নিয়েছি। তবে নাটকে স্বভাব ও অন্তরের, আচরণ ও উক্তির বিশিষ্ট রূপায়ণে আমি অন্যের নিকট ঋণী নই। আমার নাটকের চরিত্র-চিত্রণ, ঘটনা-সংস্থাপন ও সংলাপ নির্মাণের কৌশল আমার নিজস্ব। যে জীবনোপলব্ধিকে যে প্রক্রিয়ায় রক্তাক্ত-প্রান্তরে উজ্জ্বলতা দান করা হয়েছে তার রূপ ও প্রকৃতিও সর্বাংশে আধুনিক।
১.৫ এই নাটক রচনার জন্য আমি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার লাভ করি।
২.১ রক্তাক্ত-প্রান্তরে নায়ক নয় নায়িকাই প্রধান। জোহরা বেগমের হৃদয়ের রক্তক্ষরণেই নাটকের ট্রাজিক আবেদন সর্বাধিক গাঢ়তা লাভ করে। এই রমণীর দুই রূপ। এক রূপে সে রূপবতী ও প্রেমময়ী; অন্যরূপে সে বীরাঙ্গনা ও স্বজাতিসেবিকা। প্রতিকূল পরিবেশের নিপীড়নে এই দুই প্রবণতা তার হৃদয়ে কোনো শান্তিময় সামঞ্জস্য বিধানে সমর্থ হয়নি। জোহরা বেগম একবার প্রণয়াবেগে দিশাহারা হয়ে শত্রু শিবিরে ছুটে যায় দয়িতের সান্নিধ্য লাভের জন্য কিন্তু নিকটে এসে প্রণয়াবেগ অবদমিত রেখে ক্ষমাহীন আদর্শের বাণীকেই ব্যক্ত করে বেশি। স্বীয় শিবিরে প্রত্যাবর্তন করে ক্ষতাক্ত হৃদয়ে পরম প্রিয়তমের বিরুদ্ধেই উত্তোলিত অসি হস্তে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে সম্ভবত জোহরা বেগমের বীরাঙ্গনা মূর্তির অনেকখানিই তার ছদ্মবেশ, তার বিবেক বুদ্ধি শাসিত সিদ্ধান্তের প্রতিফল। কিন্তু এই রূপসজ্জা অন্তরের রমণী প্রাণকে প্রস্তরে পরিণত করতে পারেনি। পরিণামে হৃদয় বিদীর্ণ হয়, এবং তা থেকে সহস্র ধারায় রক্ত উৎসারিত হয়ে পরিবেশ প্লাবিত করে।
২.২ ইব্রাহিম কার্দির হৃদয়ের আত্মক্ষয়ী দ্বন্দ্বের স্বরূপও একই প্রকৃতির। কৃতজ্ঞতাবোধের বিবেক তাঁকে তার প্রগাঢ় প্রেমানুভূতির বিপরীত পথে পরিচালিত করে। প্রথম থেকেই সে অনুভব করে যে এক মহাযুদ্ধের ভয়াবহ পরিণামের সঙ্গে তার ভাগ্য অবিচ্ছেদ্য সূত্রে বিজড়িত। তবে এও সত্য যে যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের কোনো ফলাফলই তার বিধিলিপি পরিবর্তিত করতে পারত না। তার নিজের বুদ্ধি-বিবেক ও হৃদয়বৃত্তিই পরিবেশের বিরুদ্ধ শক্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে আত্মবিনাশের সংঘটন অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। প্রতিকূল নিয়তির নির্মম নির্দেশে সে নিপীড়িত হয়, অনিবার্যভাবে মর্মান্তিক পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়, মৃত্যুবরণ করে
২.৩ ইব্রাহিম কার্দির চেয়ে নাটকে হয়ত নবাব নজীবদ্দৌলার চরিত্র অধিকতর উজ্জ্বল ও প্রদীপ্ত। প্রবল আবেগ সম্পন্ন এই আদর্শবাদী বীর জোহরা বেগমের রূপ ও শৌর্যে মুগ্ধ হয়। যদি জরিনা বেগমের পতি-সান্নিধ্য লাভের কামনা এত উদ্রগ্র না হতো, সংকটের দিনেও যদি স্বামীকে তার কর্মময় জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল নিজের বাহুপাশে আবদ্ধ রাখার জন্য জরিনা ব্যাকুলতা প্রকাশ না করত, যদি জরিনার নারীসুলভ সন্দেহপরায়ণতা বিষময় তীব্রতা ধারণ না করত, তা’হলে নবাব নিজের অন্তরের প্রচ্ছন্ন বাসনার আগুনে আরও দীর্ঘকাল পুড়ে মরলেও হয়ত যা অনুচিত তা প্রকাশ করত না।
২.৪ সুজাউদ্দৌলা এই নাটকের পথনির্দেশকারী দার্শনিক। ধীর, স্থির ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। সুজাউদ্দৌলা সব সময়ে প্রকাশ না করলেও চারপাশের মানুষের মর্মস্থল পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পায়, তাদের মনের ক্ষোভ ও ক্ষতের জন্য গভীর সহানুভূতি অনুভব করে এবং নিজের বাণীকে সরস দরদে ভরে তুলতে জানে। সুজাউদ্দৌলা যুদ্ধে যোগদান করে নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য। অন্তরে সে জানে যে যুদ্ধ কোনো সমস্যারই সমাধান করে না; জানে যে সংগ্রামের চেয়ে শান্তি, বন্দিত্বের চেয়ে মুক্তি অনেক বড়।
২.৫ আতা খাঁ, দিলীপ, বশীর খাঁ এবং রহিম শেখ এই নাটকের কয়েকটি সাধারণ চরিত্র। এদের মধ্যে আতা খাঁ প্রধানত, বশীর অংশত রক্তাক্ত-প্রান্তরের বিষাদভারাক্রান্ত পরিবেশের মধ্যে মৃদু কৌতুক ও হাস্যরসের খোরাক যোগায়। দিলীপ দুর্বৃত্ত হলেও রঙ্গরসের আধার। তবে এদের কৌতুকের মাত্রা কখনও সীমা অতিক্রম করে নাটকের মূল সুরের সঙ্গে অসঙ্গতি সৃষ্টি করবে না। আতা খাঁর আচরণ স্থল বিশেষে কমিক মনে হলেও তার গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে এমন একটা জাজ্বল্যমান বেদনা বিজড়িত যে তা সহজেই জোহরা বেগমের ছদ্মবেশ ধারণের প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রহরীর কৌতুকজনক আচরণও ভয়াবহতামুক্ত নয়।
৩.০ রক্তাক্ত-প্রান্তরের শেষ দৃশ্য সম্বন্ধে একটি কথা। নাটকে এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই যে রক্ষী রহিম শেখই আহত কার্দিকে হত্যা করে। কার্দির মৃত্যুর কারণ ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। একজন সাধারণ সৈনিকের প্রতিহিংসার কবলে পড়ে কার্দির মৃত্যু হয়, একথা ধরে নেয়ার চেয়ে, আহত বীর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুবরণ করে—কল্পনা করা শ্রেয়।
৪.০ নাট্যকারের পরিচালনাধীনে ১৯৬২ সালের ১৯শে ও ২০শে এপ্রিল, ঢাকার ইন্জিনিয়ারিং ইন্স্টটিউটে রক্তাক্ত প্রান্তর প্রথম মঞ্চস্থ হয়। প্রথম রজনীর শিল্পীদের নাম ও ভূমিকার পরিচয় নিচে দেওয়া হলো।
জোহরা বেগম : ফিরদৌস আরা বেগম
জরিনা বেগম : লিলি চৌধুরী
হিরণ বালা : নূরুন্নাহার বেগম
ইব্রাহিম কার্দি : রামেন্দু মজুমদার
নবাব নজীবদ্দৌলা : নূর মোহাম্মদ মিঞা
নবাব সুজাউদ্দৌলা : কাওসর
আহমদ শাহ্ আব্দালী : মুনীর চৌধুরী
আতা খাঁ : রফিকুল ইসলাম
দিলীপ : আসকার ইবনে শাইখ
রহীম শেখ : এনায়েত পীর
বশীর খাঁ : দীন মোহাম্মদ
মুনীর চৌধুরী
চরিত্র লিপি
ইব্রাহিম কার্দি – বর্তমানে পেশবার সৈন্যাধ্যক্ষ
নবাজ নজীবদ্দৌল্লা – রোহিলার নবাব
নবাব সুজাউদ্দৌলা – অযোধ্যার নবাব
আহমদ শাহ আবদালী – কাবুলের অধিপতি
আতা খাঁ – গুপ্তচর, ছদ্মনাম অমর
দিলীপ – মারাঠা যুবক
বশির খাঁ – আবদালীর দেহরক্ষা ও প্রহরী
রহিম শেখ – ঐ
জোহরা বেগম – কার্দি-পত্মী, ছদ্মনাম মন্নু বেগ
জরিনা বেগম – নজীবদ্দৌলার বেগম
হিরণবালা – মারাঠা যুবতী
কতিপয় সৈনিক ও প্রহরী
Leave a Reply