রক্তাক্ত খামার
০১. অনেক পথ চলেছে জুলিয়াস দত্ত
অনেক পথ চলেছে জুলিয়াস দত্ত। গত তিনটে মাস বলতে গেলে ঘোড়ার পিঠেই কেটেছে ওর। কয়শো মাইল পথ যে চলেছে তার কোন হিসেব রাখেনি সে। অনেক দিন থেকেই তার ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা, তাই বেরিয়ে পড়া একান্ত জরুরী হয়ে উঠেছিল। কিছুদিন নতুন মানুষ, নতুন দৃশ্য, নতুন পরিবেশে। সময় কাটিয়ে এবার সে বাড়ি ফিরছে। স্থির হয়ে আবার নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে পুরোনো রুটিনে।
কিন্তু কথাটা ভেবে মোটেই স্বস্তি পাচ্ছে না সে। মানুষের মনে এমন অস্থিরতা কেন আসে? নিয়মের মধ্যে চলতে চলতে কেন মানুষ সন্দিহান হয়ে। পড়ে? অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে? নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হয়? মন কেন নিয়ম ভেঙে বাইরে বেরিয়ে পড়তে চায়? তার বাড়ি ছাড়ার সাথে অবশ্য একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনাও জড়িত ছিল-কিন্তু আসলে মনের ভিতরেই তার সেই অস্থিরতা। তার বাবা ব্যাপারটা ঠিকই টের পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুই মিছেই এত বেশি। খেটে মরছিস, জু, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আজ বাদে কাল তুই বিয়ে করবি, তখন তোর মাথায় চিন্তার বোঝা আরও বাড়বে। তার আগেই তোর বেরিয়ে পড়ে দুনিয়াটা একবার ভাল করে দেখে আসা উচিত। তাতে তোর মনটা অনেক শান্ত হবে।
মন কতটা শান্ত হয়েছে জানে না সে, তবে অস্থিরতা কিছুটা দূর হয়েছে। বাড়ি ফিরে যাচেছ বলে মনটা বেশ উৎফুল্লই লাগছে ওর। নিজের এলাকা পার্কে ফিরে যাচ্ছে সে। আগামীকালই পৌঁছে যাবে ও। এতদিন পরে আবার বাবার সাথে দেখা হবে ভাবতেই খুশি লাগছে। তার বাবা সেবাস্টিন দত্ত, খুব ভালবাসেন ওকে। জারভিস আর পেপিকেও আবার দেখতে পাবে সে। আর দেখা হবে জিনার সাথে-শেষ সাক্ষাতে রূঢ় ব্যবহার করেছিল মেয়েটা, অবশ্য সেটা প্রত্যাশিত; ভাইয়ের অকস্মাৎ মৃত্যুতে খুব মুষড়ে পড়েছিল সে।
সাধারণ বাঙালীর মতই মাঝারি গড়নের যুবক জুলিয়াস। তীক্ষ্ণ চেহারা, গায়ের চামড়া রোদে পোড়া। গত তিন মাসে তার মুখ কিছুটা শুকালেও দেহটা একেবারে লোহার মতই আছে। দড়ির মত পেশী আর চওড়া কাধ তার। কালো চুল, চোখ দুটোও কালো। চোখে তার কেমন একটা বিষণ্ণতার ছায়া। বেশ কয়েকটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে তার জীবনে। কিন্তু অনুশোচনা করে কোন লাভ নেই, অতীতকে আবার নতুন করে নিজের ইচ্ছা মত লেখা যাবে না, নিজের দুঃখকে সহ্য করে বুকে পুষে বয়ে বেড়াতে হবে তাকে চিরকাল।
পাহাড়ের আরও উপরের দিকে উঠছে জুলিয়াস। সূর্য ডুবে গেছে, আরমান্ডের তেমাথার কাছাকাছি চলে এসেছে সে। দিনের আলো নিভে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে স্টেজ-স্টেশনের উঠানে পৌঁছে গেল। এখন কোন স্টেজ নেই। তাই ভিতরে কাউকে আশা করেনি জুলিয়াস। কিন্তু দেখল স্টেজ এজেন্ট হ্যাঙ্ক ক্লার্কের সাথে আরও দু’জন লোক একটা ছোট টেবিলে বসে ব্ল্যাক জ্যাক খেলছে। ওকে ঢুকতে দেখে সবাই চোখ তুলে চাইল। একমাত্র হ্যাঙ্কই তার পরিচিত। জুলিয়াসের মনে হলো হ্যাঙ্ক যেন তাকে দেখে একটু চমকে উঠল।
মাথা ঝাঁকাল জুলিয়াস। গুড ইভনিং, হ্যাঙ্ক, খাবার কিছু আছে?
আ…আমার মনে হয় আছে, ঢোক গিলে জবাব দিল সে।
টেবিলের আর দুজনের একজন মাঝারি গড়নের, দেখে মনে হয় কোন খামারের কর্মচারী হবে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ইদানীং সে স্নান করছে বলে মনে হয় না। অন্যজন তারই সমবয়সী, তীক্ষ্ণ চোখ আর বাদামী রঙের কোঁকড়া চুল। লোকটার পোশাক বেশ পরিচ্ছন্ন।
উঠে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল হ্যাঙ্ক, শুনছ, কিছু খাবার গরম করো।
রান্নাঘরের দরজায় ছোটখাট একজন মহিলাকে দেখা গেল, হাতে প্লেট মোছার তোয়ালে। সাদামাঠা গলায় সে জানাল, একটু বসো, এখনই খাবার নিয়ে আসছি আমি।
কষ্ট করে বিশেষ কিছু করার দরকার নেই, মিসেস ক্লার্ক, আছে তা-ই দিলেই চলবে। ততক্ষণ একটা ড্রিঙ্ক নিয়ে নিচ্ছি আমি।
পাশেই বার। বারের ওপর রাখা বোতল থেকে নিজেই একটা ড্রিঙ্ক ঢেলে নিয়ে ওদের টেবিলেই বসল জুলিয়াস।
হ্যাঙ্কের তেরো বছরের এলোমেলো চুলের ছেলেটা বাইরে জুলিয়াসের ঘোড়া দেখে টু-পাইস ইনকাম করার আশায় ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, জিন নামিয়ে আপনার ঘোড়াটাকে কিছু খেতে দেব?
না, জিন খোলার দরকার নেই, জবাব দিল জুলিয়াস। আমি খাওয়া সেরেই আবার রওনা হব। তুমি বরং ওকে কিছু ওট (oat) আর পানি খাইয়ে দাও।
এখনি যাচ্ছি আমি, খুশি মনে বেরিয়ে গেল ছেলেটা।
হ্যাঙ্ক এগিয়ে এল, তুমি তো বাইরে কাটালে বেশ কিছুদিন, তাই না?
হ্যাঁ, একটু বেড়িয়ে এলাম।
এবার ঘরে ফিরছ?
হ্যাঁ, পার্কের কি খবর?
ভাল, খুব ভাল, বলল হ্যাঙ্ক। আমি দেখি তোমার খাবার ব্যবস্থা কতদূর হলো।
ঘুরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল হ্যাঙ্ক। গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে অন্য দু’জনের দিকে ফিরল জুলিয়াস। হ্যাঙ্ক উঠে যাওয়ায় ওদের ব্ল্যাক জ্যাক খেলা ভণ্ডুল হয়ে গেছে। কমবয়সী লোকটা তাসগুলো তুলে নিয়ে সলিটেয়ার খেলছে, অন্যজন দেখছে।
অল্পক্ষণ পরেই খাবার নিয়ে এল হ্যাঙ্ক-গিন্নী। রান্না এমন কিছু চমৎকার হয়নি, তবে খাবারটা গরম, তার ওপর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে জুলিয়াসের। খাওয়ায় মন দিল সে। বারের কাছে গিয়ে কি যেন করছে হ্যাঙ্ক। জুলিয়াস শুনেছে লোকটা বিশেষ সুবিধার নয়, কিন্তু এখন আর সেদিকে খেয়াল করার সময় নেই। একটু পরেই সে চলে যাবে নিজের পথে।
জুলিয়াস বেরুবার কিছু আগেই উঠল অপেক্ষাকৃত বয়স্ক লোকটা। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, চলি, হ্যাঙ্ক, আবার দেখা
হ্যাঙ্ক বারের পিছনে ব্যস্ত। অন্য লোকটার নজর তাসের দিকে। নীরবে খাওয়া শেষ করে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস। জিজ্ঞেস করল, কত হয়েছে?
সব মিলিয়ে মোট দেড় ডলার, মনে মনে হিসাব করে নিয়ে জানাল হ্যাঙ্ক।
টেবিলের ওপর টাকা রেখে দরজার দিকে এগোল সে। দরজার কাছে। পৌঁছা’র আগেই টেবিলে বসা লোকটা কথা বলে উঠল।
এই যে ভদ্দর লোক, তোমার কি খুব তাড়া আছে?
কেন? থেমে দাড়িয়ে ওর দিকে ফিরে তাকাল জুলিয়াস।
যে লোকটা একটু আগে বেরিয়ে গেল তাকে তুমি চেনো?
সে চেনে। তোমাকে ঢুকতে দেখেই একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেছিল। খাওয়ার সময়ে দু’বার সে তোমার পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। চলে যাচ্ছে বলে বিদায় নিয়ে গেল, কিন্তু ঘোড়ার খুরের শব্দ পাইনি-মনে হয় সে এখনও বাইরে কোথাও রয়েছে।
জুলিয়াস অবাক হয়ে চেয়ে আছে-কে লোকটা? কি বোঝাতে চাইছে? হ্যাঙ্কের দিকে চাইল সে। একেবারে পাথরের মূর্তির মত দাড়িয়ে আছে হ্যাঙ্ক। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর মুখ।
হ্যাঙ্ক! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ধমকে উঠল জুলিয়াস। এসবের মানে কি? মাথা নেড়ে সে জবাব দিল, তুমি কি বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
যে লোকটা বেরিয়ে গেল সে কে?
সত্যি বলছি, ওকে চিনি না আমি।
টেবিলে বসা লোকটা হেসে উঠে বলল, ডাহা মিথ্যুক তুমি।
আমি কসম… লোকটার দিকে ফিরে চাইল জুলিয়াস। তোমার নাম কি?
এডমন্ড ফিনলে। তোমার?
জুলিয়াস দত্ত।
তাস সরিয়ে রাখল লোকটা। আমিও পার্কে যাচ্ছি। রাতটা এখানেই কাটাব মনে করেছিলাম, কিন্তু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন তা না করাই ভাল মনে হচ্ছে। একসাথে যেতে আপত্তি নেই তো তোমার?
না, আপত্তি কিসের? সাথী পেলে বরং খুশিই হব আমি।
হাসল এড। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পিস্তল পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোন দিক দিয়ে বেরুতে চাও তুমি, সদর দরজা দিয়ে না পিছন দিয়ে?
পিছন দিক দিয়েই বেশি নিরাপদ হবে। হ্যাঙ্ককে নিয়ে কি করা যায়? এমন পাজি লোক…
বারের নিচে হাত বাড়িয়েছিল হাঙ্ক, কিন্তু রাইফেলটা তোলার আগেই এডের পিস্তল বেরিয়ে এসেছে। এত দ্রুত আর কাউকে পিস্তল বের করতে দেখেনি জুলিয়াস। চোখের নিমেষে সে দেখল এডের পিস্তল ধরা হাতটা হ্যাঙ্কের দিকে তাক করা রয়েছে।
রাইফেলটা ফেলে দাও, আদেশ দিল এডমন্ড। এবার দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াও।
তর্ক করতে গেল না হ্যাঙ্ক। সুবোধ বালকের মত রাইফেল ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে পিস্তলের নল দিয়ে ওর মাথায় আঘাত করল এড। হ্যাঙ্কের অজ্ঞান দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
এবার বাইরেটা একটু দেখে নেয়া যাক, বলল এড। বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হয়নি লোকটা। শান্ত স্বাভাবিক ভাবেই হ্যাঙ্ককে সামলাল সে। ঘটনাটা সত্যিই মনে রাখার মত।
রান্নাঘরে ঢুকল ওরা। মিসেস ক্লার্ককে ওখানে দেখা গেল না। বাইরে বেরিয়ে দরজার পাশে অন্ধকারে একটু দাঁড়াল দু’জন।
তুমি এইদিক দিয়ে এগোও, আমি উলটো দিক দিয়ে যাচ্ছি-আমরা বাড়ির সামনের দরজায় আবার একত্র হব, ফিসফিস করে বলল জুলিয়াস
তাড়াহুড়ো কোরো না, সামনে দেখা হবে।
এগিয়ে গেল জুলিয়াস। সব কটা ইন্দ্রিয়ই সজাগ রয়েছে তার। তবু ঘটনার আকস্মিকতায় একটু বিভ্রান্ত বোধ করছে সে। ওই লোকটা আসলে কে? সত্যিই সে চেনে না ওকে। কিন্তু ব্যাপারটা কি? লোকটা বিনা কারণে তার পিছনে লাগতে যাবে কেন? নাকি মিছেই ভাবছে সে?
একটা গুলির শব্দে চমক ভাঙল তার। বিকট গলায় একটা চিকারের সাথে সাথে আরও দুটো গুলির শব্দ শোনা গেল। ছুটতে শুরু করল জুলিয়াস। বাড়ির সামনের বাকটা ঘুরে দেখল ওপাশের বাকে একজন দাড়িয়ে রয়েছে। এডমন্ড! ঠিক ওর পায়ের কাছেই পড়ে আছে একটা নিথর দেহ।
এখানেই উবু হয়ে অপেক্ষা করছিল লোকটা, সাদামাঠা গলায় বর্ণনা দিল এড। ওকে পিস্তল ফেলে দেয়ার সুযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু শোনেনি।
জুলিয়াস ঝুঁকে পড়ে অসাড় দেহটা পরীক্ষা করল। মারা গেছে লোকটা! বিস্মিত কণ্ঠে বলল সে।
তবে? তুমি কি আশা করেছিলে বেঁচে থাকবে? একটা ম্যাচ জ্বেলে ওর মুখটা ভাল করে দেখল জুলিয়াস সম্পূর্ণ অপরিচিত। পকেট হাতড়েও লোকটার কোন পরিচয় জানা গেল না।
আমার ঘোড়াটা নিয়ে আসছি, বলল এড।
জুলিয়াস ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এই পরিস্থিতিতে তার কি করা উচিত। উঠে দাঁড়াল সে। হয়তো ইন্ডিয়ান ব্লাফে শেরিফের কাছে খবর পাঠিয়ে এখানেই তাদের অপেক্ষা করা দরকার, কিন্তু এডের হাবভাবে মনে হচ্ছে না সে রাজি হবে।
আমি যাই, হ্যাঙ্কের সাথে একটু কথা বলে দেখি, ধীরে ধীরে বলল জুলিয়াস, ও-ই শেরিফের কাছে খবর পৌঁছে দেবে।
খুশি তোমার, নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিল এড।
চাঁদের আলোয় ওরা চড়াই পথে এগিয়ে যাচ্ছে পার্কে ঢোকার গিরিপথটার দিকে। জুলিয়াসই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে তার সঙ্গীকে। এদিককার পথঘাট, সবই তার খুব ভাল করে চেনা। একটা বেশ খাড়া চড়াই পেরিয়ে ঘোড়া দুটোকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য থামল ওরা। কথা বলার ভাল সুযোগ। বেশ আগ্রহ নিয়েই এতক্ষণ অপেক্ষা করেছে জুলিয়াস। এডের সম্বন্ধে আরও জানার জন্যে
উৎসুক হয়ে আছে সে।
এই পাহাড়ী এলাকাটা বেশ সুন্দর, একটা সিগারেট ধরানোর ফাঁকে বলল এড। কিন্তু এর মধ্যে র্যাঞ্চ করার মত সমান জায়গাই তো নেই কোথাও।
গিরিপথটা পার হলেই দেখতে পাবে, জবাব দিল জুলিয়াস। ইডেন পার্কটা অনেকটা মালভূমির মত। সুন্দর ঘাস আর প্রচুর পানি আছে।
কিন্তু পশু আনা-নেয়া করো কিভাবে?
ওপাশে ক্যল্ডওয়েল যাওয়ার পথটা অনেকটা সমতল, ওদিকে রেলরাস্তাও আছে।
শহর আছে পার্কে?
হ্যাঁ, ক্রেস্টলাইন।
কয়টা র্যাঞ্চ?
গোটা ছয়েক বড় আর কয়েকটা ছোট র্যাঞ্চ আছে-কেন, চাকরি খুঁজছ তুমি?
হ্যাঁ, একটা কাজ নিয়েই এসেছি।
কোথায়?
আমার এক পুরোনো বন্ধু মেডক লেটনের চিঠি পেয়ে এসেছি। তুমি চেনো ওকে?
হা, চিনি, একটু চিন্তিতভাবে জবাব দিল জুলিয়াস।
মেডক লেটন তার বাবার র্যাঞ্চেই কাজ করে। কিন্তু সে সামান্য একজন কর্মচারী মাত্র। তার পক্ষে কাউকে চাকরি দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। হয়তো চিঠিতে র্যাঞ্চে লোক দরকার হবে এটুকুই জানিয়েছে সে।
এড তার হাতের সিগারেটটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল, সাধারণত আমি অন্যের কোন ব্যাপারে নাক গলাই না, জুলিয়াস।
আমার ভাগ্য তাহলে ভাল বলতে হবে।
তুমি সত্যিই চেনো না ওই মৃত লোকটাকে?
না।
কোন শত্রু আছে তোমার?
দু’একজন নেই এমন বলা যায় না সব মানুষেরই কিছু শত্রু থাকে। কিন্তু এই ব্যাপারটা আদৌ মাথায় ঢুকছে না আমার।
ভাল করে ভেবে দেখো, বলল এড়। লোকটা যেভাবে খোলা পিস্তল হাতে উবু হয়ে বসেছিল তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায় তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল সে। পার্কে কোন র্যাঞ্চে আছ তুমি?
রকিং এইচ র্যাঞ্চ।
তাই নাকি? অবাক হলো এড। তবে তো তুমি মেডকের অধীনেই কাজ করছ।
না। আমার বাবার র্যাঞ্চ ওটা।
এডের মুখের ভাবটা দুর্বোধ্য হয়ে উঠল। প্রাণহীন হাসি হাসল সে। চোখ দুটো কঠিন হলো।
আমরা তাহলে একই জায়গায় যাচ্ছি, মন্তব্য করল জুলিয়াস।
হ্যাঁ, একই জায়গায় যাচ্ছি। মেডক আমাকে লিখেছিল মালিকের এক ছেলে বাইরে আছে।
বাইরেই ছিলাম, তিনমাস পরে আবার ফিরছি।
ঝামেলা হয়ে গেল।
মুখোমুখি বসে আছে ওরা দু’জন। হাসি নেই কারও মুখে। আগামীতে কি ঘটবে জানে না জুলিয়াস। স্টেজ-স্টেশনে এড কিভাবে দ্রুত পিস্তল বের করেছিল মনে পড়ল তার। একটা মানুষকেও খুন করেছে সে-কিন্তু কোন রকম মানসিক বিকার নেই, মনে হয় আগেও অনেক মানুষকে হত্যা করেছে ও।
মেডককে কতটা চেনো তুমি? হঠাৎ প্রশ্ন করল এড়।
সামান্যই জানি, জবাব দিল জুলিয়াস।
পছন্দ করো?
না।
মুচকি হাসি হাসল এড। ঠিকই চিনেছ তুমি ওকে। ওর জনপ্রিয়তা কম। পার্কে ফিরে কি করবে তুমি?
জানি না।
চলো ওঠা যাক।
চলো।
ঘোড়া দুটোর যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে। জুলিয়াসই আবার পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ঘামে ভিজে উঠেছে সে। ভাবছে এড যদি হঠাৎ পিস্তল বের করে বসত কি করত সে? কি যে ঘটত বলা যায় না। তার বাবা তাকে যত্ন করে হাতে ধরে রাইফেল-পিস্তল চালানো শিখিয়েছেন। দ্রুত পিস্তল বের করাতেও তার জুড়ি নেই। কিন্তু ওর আর এডের মধ্যে কে যে বেশি ক্ষিপ্র তা বলা ভার। তবে জানার খুব একটা আগ্রহও তার নেই।
আর একটা ব্যাপারে বিব্রত বোধ করছে জুলিয়াস। এড একজন বাইরের লোক হয়েও এত জোর পাচ্ছে কোত্থেকে? গত তিনমাসে কি ঘটেছে পার্কে? রকিং এইচ র্যাঞ্চেরই বা কি অবস্থা? যতই এগোচ্ছে, সংশয়ে ভরে উঠছে তার মন।
০২. ঠিক মাঝরাতে গিরিপথের মাথায়
ঠিক মাঝরাতে গিরিপথের মাথায় এসে পৌঁছল ওরা। অর্ধ বৃত্তাকারে সামনের দিকে হাত নেড়ে জুলিয়াস বলল, ভাল করে চেয়ে দেখো, এড, পুরো ইডেন পার্কটাই দেখা যাচ্ছে নিচে।
কতটা চওড়া? প্রশ্ন করল এড।
যে-কোন দিকেই ঘোড়ার পিঠে একদিনের পথ। মাঝে মধ্যে জঙ্গল, আছে, কিন্তু ফাঁকা এলাকা সবটাই চমৎকার সবুজ মাঠ।
অন্ধকারে বিশেষ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এখানকার সব কিছুই জুলিয়াসের এত পরিচিত যে সে অন্ধকারেই আঙুল নির্দেশ করে একে একে বলে গেল কোথায় কি আছে। সে ভাল করেই জানে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না এড, তবু কেবল কথা চালিয়ে যাবার খাতিরেই বলে চলল। কথা বলার মোটামুটি একটা নিরাপদ বিষয় এটা। এর আগেও কয়েকবার থেমেছে ওরা, কিন্তু দু’জনেই কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করেছে। এখন আর কেউই নিশ্চিন্তে মন। খুলে কথা বলতে পারছে না।
রকিং এইচে পৌঁছতে কি আমাদের শহর হয়ে যেতে হবে?
না, শহরকে দক্ষিণে রেখে সোজা পথে পশ্চিমে যাব আমরা।
আর কতক্ষণ লাগবে?
এখনও দূর আছে। ভোর হয়ে যাবে। একটা সিগারেট ধরাল এড। ক্রেস্টলাইনের শেরিফ কে?
ডিগবি নোল লোকটা কেমন?
আমার ভাল লাগে না। লোকটাও পছন্দ করে না আমাকে। অবশ্য সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ঘোড়ার ওপর একটু নড়ে চড়ে বসল এড়। তারপর ওর দিকে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, জুলিয়াস, আমার সম্বন্ধে কৌতূহল হচ্ছে না তোমার?
নিশ্চয়ই।
তবে কোন প্রশ্ন করোনি কেন?
তাতে কি কোন ফল হত?
না।
আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম, এড।
মৃদু হাসল লোকটা। বলল, জুলিয়াস, আমরা দুজনে একই পক্ষে থাকলে। খুশি হতাম, কিন্তু দুঃখের বিষয় তা হবার নয়।
শুষ্ক হাসি হাসল জুলিয়াস। যাবার জন্যে তৈরি তুমি?
তোমার বলার অপেক্ষাতেই রয়েছি।
ধীরে ধীরে পার্কে নামতে শুরু করল ওরা। ঘণ্টা দুই পরে কয়েকটা অতি পরিচিত জায়গা পার হলো জুলিয়াস। ছেলেবেলায় জারভিস আর পেপির সাথে অনেক খেলেছে এখানে। তার সৎমা বেঁচে থাকতে কোনদিন সে বুঝতে পারেনি ওরা তার আপন ভাইবোন নয়। সৎমাকেই নিজের মা বলে জানত। তিনি মারা যাবার অনেকদিন পর ধীরে ধীরে টের পেয়েছে সে। তার নিজের মা ছিলেন বাঙালী। খ্রীস্টান ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হননি তাঁর বাপ-মা। চুপিচুপি বিয়ে করে তার মাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন সেবাস্টিন দত্ত। অনেক দেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত আমেরিকায় এসে ঘর বেঁধেছিলেন তাঁরা। কিন্তু জুলিয়াসের জন্মের সময়েই মারা যান তিনি। দুই বছর পর একজন আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেন সেবাস্টিন দত্ত। তাঁরই গর্ভে জন্ম জারভিস আর পেপির।
বড় হবার পরে সে যে ওদের সৎ ভাই হাজারো রকমে তা বুঝিয়ে দিতে ত্রুটি করেনি ওরা।
উনিশ বছর বয়সেই জারভিস লম্বা সুপুরুষ হয়ে উঠেছে। চেহারা সুন্দর হলেও বয়স যতই বাড়ছে ততই সে হয়ে উঠছে মদ্যপায়ী, উচ্ছঙ্খল, অদূরদর্শী আর অস্থির। জুয়া খেলতে খুব ভালবাসে, তবে জেতার চেয়ে হারেই বেশি। পিস্তল একটা কোমরের বেল্টে ঝুলায় বটে তবে ওটার ব্যবহার জানে না সে। ওটা কোমরে থাকলে নিজেকে পরিণত-বয়স্ক পুরুষ মনে হয় বলেই রাখা! বাবা তাকেও পিস্তল চালানো শেখাতে অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কষ্ট করে নিয়মিত অনুশীলন করতে হয় এমন কোন কাজেই সে উৎসাহী নয়।
জারভিসের মাত্র এক বছরের ছোট পেপি। কিন্তু পেপি যে আসলে কেমন তা জুলিয়াস নিজেও বর্ণনা করতে পারবে না। অপূর্ব সুন্দরী, আর জারভিসের মতই অস্থির সে-ও। যে-কোন পুরুষ মানুষের মতই ঘোড়া চালাতে আর ল্যাসো ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু পুরুষদের মোটেও সহ্য করতে পারে না। অনেকেই তার সাথে একটু বন্ধুত্ব করতে পারলে বর্তে যায়, ওদের কাউকেই পাত্তা দেয় না পেপি। এমনকি বাবাও বিচলিত হয়ে ওর ব্যাপারে দু’একবার জুলিয়াসের সাথে আলাপ করেছেন। সে বাবাকে অভয় দিয়েছে সময় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে-কিন্তু নিজেই সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয়।
আমাদের তো এতক্ষণে পৌঁছে যাবার কথা? প্রশ্ন করল এড।
আকাশ ফিকে হয়ে আসছে। সকাল হতে আর বেশি বাকি নেই। রকিং এইচের বাবুর্চি সকালের নাস্তার যোগাড়ে লেগে গেছে। ঠিক সময় মতই ওরা হাজির হবে।
প্রায় এসে গেছি, আর মাত্র দু’মাইল।
নিজের পিস্তল চেক করে নিল এড। তারপর মস্করা করে বলল, এটা আমার একটা পুরোনো অভ্যাস।
আমারও, বলে নিজেরটাও পরীক্ষা করে দেখে আবার খাপে ভরল জুলিয়াস।
তাই নাকি? কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে উঠল এডু।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই, হেসে জবাব দিল ও।
তাদের সামনে চওড়া মাঠটার পরেই দেখা যাচ্ছে র্যাঞ্চের ঘরগুলো। উঁচু ছাদওয়ালা বিরাট গুদাম ঘরটাই সবার আগে নজরে পড়ে। তবে প্রধান বাড়িটাও নেহাত ছোট নয়। ওটার পরেই একটা কেবিন, কয়েকটা টিনের চালা আর আস্তাবল। বাড়ির পিছনে ঢাকা পড়ে আছে আরও কয়েকটা ছোট ছোট ঘর।
বিরাট ব্যাপার, তাই না? এডের স্বরে সন্তোষ প্রকাশ পেল।
আমাদের বেশ চলে যায়, বলল জুলিয়াস।
মাঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। হাসিহাসি মুখ করে রয়েছে জুলিয়াস। বাড়ি ফিরে এসেছে বলে স্বস্তি বোধ করতে চাইছে সে। কিন্তু দেহের সবক’টা পেশী উৎকণ্ঠায় টানটান হয়ে আছে, পেটের ভিতরে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। দূরে নাস্তার আয়োজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
সময় মতই হাজির হয়েছি আমরা, বলল এড।
উঠানে পৌঁছানোর পরেও কাউকে দেখতে পেল না ওরা। কেউ নিশ্চয়ই ওদের দেখেছে, কারণ ওরা নেমে ঘোড়া বাধতে বাঁধতেই মেডক লেটন বেরিয়ে। এল। ওদের দেখেই মুখ বাড়িয়ে ভেতরে কাকে যেন কি বলল সে। ওরা এগিয়ে যেতেই আরও কয়েকজন এসে হাজির হলো মেডকের পাশে। জারভিস আর পুরোনো লোক ব্রায়েন চাইল্ডকে চিনতে পারল জুলিয়াস, অন্যেরা তার অপরিচিত। ওদের মধ্যে দু’জনকে বেশি করে নজরে পড়ল তার। একজনের কেমন একটু পেঁচানো দেহ, একটা কাঁধ অন্যটার চেয়ে কিছুটা নিচু, রোদে পোড়া গায়ের রঙ। দ্বিতীয়জনের বিশাল লম্বা-চওড়া দেহ, লালচে গাল, মোটা
এক জোড়া ঠোঁট আর থ্যাবড়া নাক। দাঁত বের করে হাসছে লোকটা।
কি ব্যাপার, একেবারে পুরো অভ্যর্থনা কমিটি! ঠাট্টা করে বলল এড।
চট করে একবার এডের দিকে চেয়ে দেখল জুলিয়াস। কৌতুকে ভরা ওর চেহারা, চোখ দুটো ঝিকমিক করছে। দুশ্চিন্তার কোন ছাপ নেই ওর মুখে।
ও কিছু না, সব এখানকারই লোক, বলল জুলিয়াস।
তাই নাকি?
মেডক আর জারভিস একটু দূরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খানিক আলাপ সেরে নিয়ে এখন ঘুরে ওদের দিকে চেয়ে রয়েছে। ভারি চওড়া কাঁধ মেডকের। মুখে গভীর বলীরেখা, কঠিন চোখ আর শক্ত উঁচু চোয়াল। লোকটা সব সময়েই রেগে আছে বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে ওর চেহারাটাই ওরকম। জুলিয়াস যেদিন ওকৈ চাকরিতে নিয়েছিল সেদিনও ওর চেহারাটা এই রকমই দেখেছিল। র্যাঞ্চে লোকের খুব প্রয়োজন থাকায় একরকম বাধ্য হয়েই ওকে নিয়েছিল সে। জারভিসের চেহারাও রুষ্ট। কোন কিছু সামান্য একটু এদিক ওদিক হলে বা পছন্দ মত না হলেই সেটা ফুটে ওঠে ওর চেহারায়!
কেমন আছ, জারভিস? সহজ ভাবেই জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস, বাবা কোথায়?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মুখটা একটু বাড়িয়ে অস্বাভাবিক উঁচু স্বরে সে পালটা প্রশ্ন করল, আবার ফিরে এলে কেন তুমি?
এ আবার কেমন প্রশ্ন? বাড়িতে ফিরব না আমি?
সে কথা বলছি না। তোমার গোলমালে জড়িয়ে পড়ার খবর আমরা পেয়েছি।
ঝামেলা যা ছিল মিটে গেছে, বলল জুলিয়াস। বাবা কোথায়?
অস্বস্তিভরে মেডকের দিকে চাইল জারভিস। এগিয়ে এসে মেডক বলল, আমি দুঃখিত, জুলিয়াস, তোমার বাবার শরীর খারাপ-আসলে খুবই দুর্বল আর
অসুস্থ উনি।
অসুখ! উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল জুলিয়াস। কি হয়েছে বাবার?
শরীর অত্যন্ত দুর্বল, বিশ্রাম দরকার।
কোথায়, নিজের ঘরে?
হ্যাঁ, কিন্তু এখন দেখা করতে পারবে না তুমি।
কি বললে? জুলিয়াসের বিস্ময় চরমে পৌচেছে।
ঠিকই বলছি। ডাক্তারের নির্দেশ, কোন রকম উত্তেজনা একেবারে নিষিদ্ধ। তুমি দেখা করতে গেলে স্ট্রোক হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।
একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে জুলিয়াস। নিজের কানকেই আর বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। বুড়ো হননি তার বাবা। সুস্থ, সবল আর কর্মঠ-মাত্র পঞ্চাশের কোঠায় তার বয়স। যে-কোন তিরিশ বছরের যুবকের সাথে পাল্লা দিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোড়া দাবড়েও ক্লান্ত হবার পাত্র নন তিনি। সেই লোক বিছানায় মরণাপন্ন! ভাবতেই অসম্ভব ঠেকছে তার। দেখা করতে পারবে না-কিন্তু সে দেখা করলে বাবার উত্তেজিত হবার কি কারণ থাকতে পারে?
জারভিস কথা বলছে, ব্যাখ্যা দিচ্ছে, কিন্তু সেই সাথে জুলিয়াসকে দোষারোপ করছে। সবই তোমার দোষ, জুলিয়াস। তুমি চলে যাওয়ার সাথে সাথেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তোমার সাথে ঝগড়া করার পরই এই রকম হয়েছে। ডাক্তার বলেছে তোমার জন্যেই আজ তার এই দশা, তুমি যদি আবার তার সামনে যাও…
বাধা দিয়ে জুলিয়াস বলে উঠল, আমাদের কথা কাটাকাটি হয়েছে তা কে বলল তোমাকে?
আমি ছিলাম কাছেই-গুদাম ঘরের ভিতর সেদিন তোমাদের কি কথা হয়েছিল সব শুনেছি আমি।
তাহলে শেষটুকুও নিশ্চয়ই শুনেছ? সমঝোতা হয়েছিল আমাদের।
বাবা তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল।
তুমি ভাল করেই জানেনা, জারভিস, বাবা তেমন কিছুই করেননি।
ঠোঁট কামড়াল জারভিস। যা শোনার ঠিকই শুনেছি আমি। বাবা তোমাকে বের করে দিয়েছে।
এইভাবে গলাবাজি করে কোন মীমাংসা হবে না। বারান্দায় দাড়ানো সবার। দিকে চাইল জুলিয়াস। পুরোনো লোক ব্রায়েন ইশারায় তাকে সাবধান করল। কি বোঝাতে চাইছে সে? কিসের বিরুদ্ধে সাবধান করছে? তার ইচ্ছে করছে সব ভেঙেচুরে দরকার হলে সবার সাথে মারপিট করে ছুটে বাবার ঘরে গিয়ে হাজির হতে। কিন্তু উপায় নেই, বাবা যদি সত্যি অসুস্থ থাকেন তবে কোন মতেই তা ঠিক হবে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে জারভিসের দিকে চেয়ে সে বলল, শোনো জারভিস, বাবা একা তোমার নন; আমারও। আমি তার সাথে দেখা করব, বাধা দেয়ার চেষ্টা কোরো না।
খুবই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। জুলিয়াস জানে না এর পরে কি করবে। তাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ মেডক, বলে উঠল, এত উত্তেজিত হয়ে। ওঠার কিছু নেই, জুলিয়াস। বাবার সাথে দেখা নিশ্চয়ই হবে তোমার। এত ভোরে এখনও ওঠেনি সেবাস্টিন-তোমরা বরং ততক্ষণে নাস্তা সেরে নাও।
এড বলে উঠল, আমার ব্যাপারটা কি হবে?
তুমি আবার কোন নাগর? বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল মেডক।
আমার নাম এডমন্ড ফিনলে। চাকরি খুঁজছি আমি। জুলিয়াসের সাথে পথে দেখা, সে বলল এখানে কাজ পেতে পারি আমি।
তোমার ব্যাপারে পরে ভেবে দেখব। নাস্তার পর কথা হবে।
এবার জুলিয়াসের অবাক হবার পালা। মেডকই চিঠি লিখে খবর দিয়ে আনিয়েছে এডকে, নিশ্চয়ই ওরা দু’জন দু’জনকে চেনে, অথচ ভাব দেখাচ্ছে। যেন কেউ কাউকে দেখেইনি কোনদিন!
যাক, আমাকে অন্তত দূর দূর করে তাড়াচ্ছে না, অস্ফুট কণ্ঠে বলল এড।
সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি, জবাব দিল জুলিয়াস।
সার বেঁধে ভিতরে ঢুকল সবাই। খাওয়ার মাঝে বিশেষ কথা হলো না। সবাইকে অগ্রাহ্য করে জারভিস বসেছে টেবিলের মাথায় বাবার আসনে। মেডক লেটন বসেছে তার ডান দিকে, তিন মাস আগেও ওই আসনটা ছিল জুলিয়াসের মেডকের উল্টোদিকে বসেছে এড়। ব্রায়েন চাইলডের পাশে বসতে পারলে ভাল হত, কিন্তু ওর দু’পাশে আগেই অপরিচিত লোক বসে গেছে। কার কোথায় বসার অধিকার আছে না আছে এ-নিয়ে আর হট্টগোল বাধাল না সে। পরে এক সময়ে সুযোগ বুঝে ব্রায়েনের সাথে কথা বলবে-জারভিস আর মেডকের সাথেও অনেক কথা আছে তার। নানান প্রশ্নের ভিড় জমেছে ওর মাথায়।
খেতে বসে আপন মনেই পরিস্থিতিটা বিচার করে দেখছে জুলিয়াস। বাবা অসুস্থ, হয়তো বা অকর্মণ্য হয়ে পড়েছেন। তাতে সব দায়িত্ব জারভিসের কাঁধে চেপেছে, আর তার কাজে সহযোগিতা করার জন্যে মেডককে বেছে নিয়েছে সে। কিন্তু টেবিলের আর সব লোক কোথা থেকে এল? কেবল ব্রায়েন ছাড়া। বাকি সবাই জুলিয়াসের অপরিচিত। হয়তো নতুন কাজে নেয়া হয়েছে ওদের। কিন্তু এর মধ্যে আরও কথা আছে! এড়কে চিঠি লিখে খবর দিয়ে আনানো হয়েছে। বাকি সবাইকেও কি একইভাবে আনা হয়েছে? তাই যদি হয়, এসবের কারণ কি? মেডকের কি কোন মতলব আছে?
আর এক কাপ কফি খেলো জুলিয়াস। পেপি এখনও অনুপস্থিত। কিন্তু এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। পুরুষ লোকদের সাথে খেতে পছন্দ করে না সে। বাড়ির মধ্যে ওদের নিজস্ব আর একটা খাবার ঘর আছে, সেখানেই খায়
সবার আগে জারভিসের খাওয়া শেষ হলো। মেডকের সাথে একটু আলাপ করে নিয়ে উঠে দাড়াল সে। দেখি বাবা উঠেছে কিনা, বলল জারভিস, তার ঘরে তোমাকে ঢুকতে দেবে কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করব আমি।
ধন্যবাদ, শুকনো গলায় জবাব দিল জুলিয়াস।
বাবার, জবাব সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই তার মনে। যাবার দিন তার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তখনই তা মিটমাট হয়ে গেছে। মাথা গরম করে বেরিয়ে গেলেও বাবা তার সাথে দেখা করতেন। কোন সমস্যাই এড়িয়ে যাওয়া তার নীতি নয়, সমস্যার সামনাসামনি মোকাবিলা করাই তার চিরকালের স্বভাব।
ব্রায়েন বেরিয়ে গেল। বাকি সবাই থাকল ঘরে। মেডক আর এড কাজের ব্যাপারে আলাপ শুরু করল এবার। জুলিয়াস ভাবছে এত ভণিতা কেন? টেবিলের অন্য সবাইকে এত সব কথা কি তার উদ্দেশেই শোনানো হচ্ছে? লোক নেয়ার আগে সাধারণত যেসব প্রশ্ন করা হয় সেসব প্রশ্নই করল মেডক। এডও ঠিক ঠিক জবাব দিল। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়ে নেয়া হলো ওকে। সন্দেহ নেই শিগগিরই ওদের মধ্যে গোপন বৈঠক বসবে।
হঠাৎ পেপিকে দেখা গেল দরজার মাথায়। সম্ভবত, জারভিসই তাকে খবর দিয়েছে। বুট পরেছে সে, স্কার্টটা দুই পাশে ফাড়া, গায়ে বাদামী ব্লাউজ আর গলায় কায়দা করে একটা রুমাল বাঁধা। চুল পিছন থেকে তুলে শক্ত করে মাথার সাথে ক্লিপ দিয়ে আঁটা। ঘোড়ায় চড়ে বেরুবোর সাজে সেজেছে সে। সুন্দর লম্বা গড়ন, ছিপছিপে দেহ। আকর্ষণীয় অথচ নিপ্রাণ। হাসলে চোখ ধাধিয়ে যায়। কিন্তু এ মুহূর্তে আসছে না। ঠোঁট দুটো চেপে বসে আছে-চোখ দুটো কঠিন।
কেমন আছ, পেপি? উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস।
জবাব না দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় পাল্টা প্রশ্ন করল সে, তুমি ফিরে এলে কেন?
না ফেরার তো কোন কারণ দেখি না।
আমরা শুনেছি ডেনভারে তুমি মানুষ খুন করেছ, ফাঁসি হবে তোমার।
হাসল জুলিয়াস। ভুল শুনেছ তোমরা।
খবরটা শুনেই বাবার প্রায় মরার দশা হয়েছিল। এখন আবার নিজেই এসে হাজির হয়েছ-তোমাকে কোন প্রয়োজন নেই আমাদের।
সব লোকজনের সামনেই কথাগুলো বলল পেপি। বাবা যখন বাড়ির প্রধান কর্তা ছিলেন তখন পারিবারিক ঝগড়া বিবাদ অন্যদের কাছ থেকে গোপন রাখাই ছিল তাঁর নীতি। বাবার অনুপস্থিতিতে পুরোনো সব নিয়ম-কানুনও বিসর্জন দেয়া হয়েছে।
টেবিলের লোকজনের দিকে চাইল জুলিয়াস। আসলে ওদের দেখছে না, পেপিকে বোঝার চেষ্টা করছে সে। পেপি কোনদিনই খুব একটা আপন ছিল না, কিন্তু তার আজকের এই রূঢ় ব্যবহার সত্যিই অভাবনীয়। কঠিন সে আগেও ছিল তবে কথায় এই বিষ ছিল না। বরং বছরখানেক ধরে জুলিয়াসের সাথে বেশ বন্ধুসুলভ ব্যবহারই করেছে ও। একবার জারভিসের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে জুলিয়াসের সাথে খোলাখুলি আলাপও করেছিল পেপি। কিন্তু কি হয়েছে ওর? বোঝাই যাচ্ছে জুলিয়াসের ঝামেলার কথা কিছু শুনেছে সে, কিন্তু সেটাই কি কারণ?
পেপির দিকে মুখ তুলে চাইল এড়। ওর চেহারা শান্ত অথচ কঠিন। দেখাচ্ছে। বলো তো ওকে এখান থেকে বের করে দেই। এই কাজে ওস্তাদ আমি।
ওর দিকে চোখ ফিরাল পেপি! তুমি আবার কে?
এইমাত্র কাজে নেয়া হয়েছে আমাকে। হয়তো তোমাদের কথার মাঝে কথা বলা ঠিক হয়নি-কিন্তু ওই আমার দোষ, যেখানে নাক গলানোর কোন দরকার নেই সেখানেই গলিয়ে বসে থাকি।
বড় বেশি কথা বলো তুমি! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল পেপি।
জারভিস ফিরে এসে দাঁড়াল পেপির পাশে। বোনের কাঁধে একটা হাত রেখে জুলিয়াসের দিকে চেয়ে সে বলল, বাবা তোমার সাথে দেখা করতে রাজি। হয়েছেন-কিন্তু মনে রেখো মাত্র এক মিনিট সময় দেয়া হবে তোমাকে। আর তুমি যদি কোনরকম বাদরামি বা চালাকির চেষ্টা করো তবে আমি নিজে তোমার সবকটা হাড় ভেঙে গুড়িয়ে দেব।
হাস্যকর শাসানি, একেবারে খেলো শোনাল। এর কোন জবাব না দিয়ে। টেবিল ছেড়ে উঠে ওদের দিকে এগিয়ে গেল জুলিয়াস।
০৩. জারভিস আগে আগে চলেছে
জারভিস আগে আগে চলেছে, পেপি রয়েছে তার পাশে। জুলিয়াস অনুসরণ করছে ওদের। তার পিছন পিছন আরও যেন কে আসছে, কিন্তু ফিরে দেখার প্রবৃত্তি হলো না জুলিয়াসের। বৈঠকখানা আর রান্নাঘর পার হয়ে পশ্চিমের বারান্দা ধরে এগিয়ে গেল ওরা। তার নিজের ঘরটার পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখল দরজাটা বন্ধ। সম্ভবত ঘরটা এখন ব্যবহৃত হচ্ছে না। উল্টো দিকে মেহমানের আর তার পাশেই পরপর পেপি আর জারভিসের ঘর। বাবার ঘরটা বারান্দার একেবারে শেষ মাথায়।
শোবার ঘরের তুলনায় ঘরটা বেশ বড়। বিছানা ছাড়াও ঘরে একটা বড় টেবিল, বইয়ের শেলফ আর কয়েকটা আরামদায়ক ভারি চেয়ার পাতা রয়েছে। জানালার পর্দা সব ক’টাই টানা, ভিতরটা তাই বেশ অন্ধকার। বিরাট ডবল বিছানায় বাবা শুয়ে আছেন। তার দেহের কাঠামোটা অন্ধকারেও আবছা দেখা যাচ্ছে। বিছানার পাশেই ছোট একটা টেবিলে এক জগ পানি, একটা গ্লাস, বোতলে কিছু ওষুধ আর কয়েকটা বই রাখা রয়েছে।
জারভিস আর পেপিই প্রথম এগিয়ে গেল। নিচু গলায় জারভিস ফিসফিস করে বলল, ও এসেছে, বাবা, মনে রেখো ডাক্তার কি বলেছে!
ওকে এখানে আসতে বলল, বললেন সেবাস্টিন দত্ত।
তার গলাটা ভীষণ দুর্বল আর কাঁপা শোনাল। গলার স্বরটা স্বাভাবিক মনে হলো না। এগিয়ে গেল জুলিয়াস। জারভিস আর পেপি একটু সরে জায়গা করে দিল ওকে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না জুলিয়াস। সে আশাই করতে পারেনি বাবা এতখানি দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন। একেবারে রোগা আর। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখটা, চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। চেনাই যায় না!
বাবা, তুমি যে এরকম অসুস্থ কিছুই জানতাম না আমি, জানলে…
জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিলেন সেবাস্টিন দত্ত। বেরিয়ে যাও!
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে জুলিয়াস। শব্দ দু’টোর অর্থ বুঝেও বুঝতে পারছে না সে। এ হতে পারে না! বাবা কিছুতেই তাকে ও কথা বলতে পারেন না! কিন্তু তাই তো বললেন! তাদের সম্পর্ক তো এমন ছিল না? হঠাৎ কি করে কি ঘটল?
বাবা…, কিছু একটা বলতে শুরু করেছিল জুলিয়াস।
আবার তাকে বাধা দিলেন সেবাস্টিন দত্ত। এবার তার গলা আগের চেয়ে কিছুটা জোরাল শোনাল। বেরিয়ে যাও! তোমার মুখ আর দেখতে চাই না, আমি। আমার ছেলে না তুমি। বেরিয়ে যাও!
কিন্তু কেন, বাবা?
অসহায়ভাবে জারভিসের দিকে চাইলেন সেবাস্টিন দত্ত। যেন তার কাছেই আপীল করছেন। ওকে বের করে দাও। তোমার তো নিজের লোকজন আছে, ওকে আমার চোখের সামনে থেকে দূর করো। সবাইকে বলে দিয়ো ও আমার ছেলে না। বোলো আমার বড় ছেলে মরে গেছে।
নিশ্চল পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল, জুলিয়াস। একটা কথাও বলল না, মুখ দিয়ে কথা সরছে না তার। কিছুই বুঝতে পারছে না সে, অথচ ঠিকই শুনেছে, ওই কথাগুলোই উচ্চারণ করেছেন সেবাস্টিন দত্ত…তার বাবা!
জুলিয়াসের হাত ধরল জারভিস। পিছন থেকে মেডক এসে দাঁড়াল তার অন্যপাশে। বলল, চলো, নিজের কানেই তো শুনলে।
হ্যাঁ, শুনেছি, আড়ষ্ট ভাবে জবাব দিল সে।
আড়চোখে জারভিসের দিকে চাইল জুলিয়াস। ছেলেটার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে বিজয় উল্লাস। এখন থেকে সে-ই সেবাস্টিন দত্তের একমাত্র পুত্র। জুলিয়াস আর তার সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে আসবে না।
চলো, তাড়া দিল মেডক।
মাথা ঝাঁকিয়ে পেপির দিকে চাইল সে। অদ্ভুত একটা ভাব ফুটে উঠেছে ওর মুখে। চমকে গেছে মেয়েটা, ভিতরে ভিতরে ভয়ও পেয়েছে-হয়তো বাবার জন্যেও চিন্তিত সে। জুলিয়াসের দিক থেকে বাবার দিকে মুখ ফেরাল পেপি। ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে রওনা হতেই বাবার বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে নিচু স্বরে কি যেন বলল, শুনতে পেল না জুলিয়াস।
বসার ঘরে ফিরে এল ওরা। এখনও বিহ্বল বোধ করছে জুলিয়াস। মাথাটা ঠিক কাজ করছে না ওর। সব কিছুই নিরর্থক আর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
তুমি তো এখন এখান থেকে চলে যাচ্ছ, তাই না? প্রশ্ন করল মেডক।
জুলিয়াস কোন জবাব দেয়ার আগেই জারভিস বলে উঠল, ওকে অবশ্যই যেতে হবে-এখানে আর জায়গা নেই ওর।
নড়ে উঠল জুলিয়াস। হ্যাঁ, চলেই যাব আমি। তবে বাবা যে কেন আমার ওপর রাগ করেছেন কিছুই বুঝতে পারলাম না। তার শরীর এত অসুস্থ না থাকলে ব্যাপারটা আলাপ করে দেখা যেত।
তাতে কোন লাভ হত না, মেডক বলল। তুমি যেদিন ঘর ছেড়ে গেছ সেদিনই সেবাস্টিন আমাকে বলেছিল তার সঙ্গে তোমার সব সম্পর্ক শেষ।
ডাহা মিথ্যে কথা বলছে লোকটা, জানে জুলিয়াস, কিন্তু ওর সাথে তর্ক করে মিছে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তুমিই তাহলে র্যাঞ্চ চালাচ্ছে, মেডক? অনুমানে ঢিল ছুঁড়ল জুলিয়াস।
না, আমি চালাচ্ছি, তাড়াতাড়ি বলে উঠল জারভিস। বাবা অসুস্থ হবার পর থেকেই র্যাঞ্চ চালাচ্ছি আমি, মেডক আমার ডান হাত।
একে একে ওদের দু’জনকেই ভাল করে দেখল জুলিয়াস। নিজের দাবি তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে জারভিস। মেডকও কোন আপত্তি করল না এতে। জারভিসের নেতৃত্ব দেয়ার কোন ক্ষমতা নেই, মেডকই যে র্যাঞ্চ চালাচ্ছে বুঝে নিতে কষ্ট হলো না জুলিয়াসের। এ কি ধরনের খেলা খেলছে মেডক? এতে ওর কি লাভ? একটু খটকা লাগলেও কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্নটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল সে। তার বাবাই যখন তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন তখন এসব নিয়ে মিছে ভেবে কি লাভ?
কোথায় যাবে বলে ঠিক করেছ? প্রশ্ন করল মেডক।
ঠিক নেই, জবাব দিল সে, কি করব এখনও কিছু ঠিক করিনি।
সবার সামনে একটু অপদস্থ করার জন্যে জারভিস বলে উঠল, কিছু টাকা পয়সা লাগবে তোমার?
না, দরকার নেই, জবাব দিল জুলিয়াস।
দরজা খুলে উঠানে বেরিয়ে এল সে। রাস্তার টেবিলে যারা ছিল তাদেরই দেখতে পেল বাইরে। এতক্ষণে সবার কাজে বেরিয়ে যাবার কথা-নাকি কাজই করছে ওরা? জুলিয়াস যাওয়া পর্যন্ত উঠান পাহারা দিচ্ছে কারও নির্দেশে?
দু’জন রয়েছে আস্তাবলের কাছে, একজন এড, অন্যজন ব্রায়েন। একমাত্র ব্রায়েনকেই কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। একটা ঘোড়া বাগে আনার চেষ্টা করছে সে।
এডের মুখে একটা প্রচ্ছন্ন কৌতুকের হাসি লেগে রয়েছে। তাহলে শেষ পর্যন্ত চলে যাচ্ছ? খুব খারাপ কথা।
দিন আরও আসবে, বলল জুলিয়াস।
তার মানে?
বুঝে নাও।
পার্ক ছেড়ে চলে যাচ্ছ?
পার্ক ছাড়তে যাব কেন?
ছাড়লে আয়ু বাড়বে তোমার।
কাষ্ঠ হাসি হাসল জুলিয়াস। তাহলে আমার শঙ্কিত হওয়া উচিত?
কেন, টের পাও না?
না, আপাতত সবই উল্টোপাল্টা লাগছে, শান্তভাবেই বলল জুলিয়াস। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখব-হয়তো একটা সমাধান পেয়েও যেতে পারি।
একটা ঘোড়ার গলায় রশি পরিয়ে বের করে এনেছে ব্রায়েন। জিন চড়াতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেল। ব্যথা পায়নি, তবু উঠে বসে গালাগালি আরম্ভ করল ও। ওর গালির স্টক শুনে না হেসে পারল না এড। জুলিয়াসও হেসে ওর দিকে এগিয়ে জিনটা তুলে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিল।
আমাকেও উঠতে একটু সাহায্য করো, বলল ব্রায়েন। বুড়ো হয়েছি বলে এখন আর কেউ খেয়ালও করে না।
দূর, তোমার আর এমন কি বয়স হয়েছে?
নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে ব্রায়েনকে টেনে তুলল জুলিয়াস। ওঠার সময়ে সে ফিসফিস করে জুলিয়াসের কানেকানে বলল, শহরে দেখা করো আমার সাথে কথা শেষ করেই ঝাড়া দিয়ে ওর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে আবার ঘোড়াটাকে গালাগালি করতে থাকল ব্রায়েন।
ওর বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। একটু নুয়ে পড়ছে শরীরটা, চামড়া কুঁচকানোর দাগ স্পষ্ট দেখা যায়। অনেকদিন আগেই তার অবসর নেয়া উচিত, ছিল, কিন্তু তাতে সে কোনমতেই রাজি নয়। সে বলে, সারাটা জীবন আমার ঘোড়ার পিঠেই কেটেছে, বাকি যে কটা দিন বাচি ঘোড়ার পিঠেই কাটাতে চাই আমি। আসলেও সে তাই চায়।
বাঁধন খুলে নিজের ঘোড়ায় চড়ে পিছন ফিরে চাইল জুলিয়াস। জারভিস, পেপি আর মেডক বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই ওরা চেয়ে দেখছে তাকে। হয়তো গোপনে তার ঘর থেকে বাবাও চেয়ে দেখছেন। বুকের ভিতরটা কেমন খালি খালি লাগছে, একটা হাত তুলে বিদায় জানাল জুলিয়াস-কিন্তু জবাবে কাউকে হাত নাড়াতে দেখা গেল না।
এডের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে সে বলল, আমার উপদেশ শোনো, ভেগে যাও।
কথাটা ভেবে দেখব, জবাব দিল সে।
ঘোড়া ছুটিয়ে ক্রেস্টলাইনের দিকে এগিয়ে চলল জুলিয়াস। একবারও আর পিছন ফিরে চাইল না।
মেডক লেটনের বয়স ঊনচল্লিশ। জীবনে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছে সে। তার বেশির ভাগই আইন-বিরোধী। এককালে সে কিং ফিশার, বিউড়ি, কারসন বাদার্স আর থ্যাডো টার্নার ব্যান্ডের সাথেও কাজ করেছে। তবে দলের একজন হিসেবেই ছিল-নাম ডাক হয়নি তার, পুলিশের খাতাতেও নাম ওঠেনি। ভাগে যা পেত তাতে তার চলা মুশকিল হয়ে দাঁড়াত বলে মাঝে মধ্যে চাকরি করে। সভাবে খেটে খেতে হত তাকে। তার অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল একদিন সে একটা বিরাট দাও মারবে। কিন্তু সেটা যে কি হবে ইডেন পার্কে চাকরি নেয়ার সময়ও এ সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না তার।
হঠাৎ ওর জন্যে দুটো অনুকূল ঘটনা ঘটল! জুলিয়াস বাড়ি ছেড়ে ঘুরতে বেরুল আর সেবাস্টিন দত্ত অসুখে পড়লেন। জারভিসের ওপর র্যাঞ্চ চালানোর দায়িত্ব পড়ল। জারভিসকে সামলানো কঠিন কিছু নয়, ধাপ্পা দিয়ে কয়েকজনকে ডিঙিয়ে হাল ধরে বসল মেডক।
একটা ভয় ছিল তার, জুলিয়াস যে-কোন সময়ে ফিরে আসতে পারে, কিন্তু তিন মাসের মধ্যে ফিরল না সে। নিজের প্ল্যান অনুযায়ী একে একে পুরোনো সবাইকে বিদায় করে সেই জায়গায় নিজের লোক ভর্তি করল মেডক। শহরে হঠাৎ হিউ হাপার আর হোয়েল কিডের দেখা পেয়ে ওদেরও কাজে বহাল করে নিল সে। একজন বড় কেউ হয়ে উঠেছে মেডক। এক বছর আগেও কিছুতেই ওরা মেডকের আদেশে কাজ করতে রাজি হত না, কিন্তু এখন মেনে নিয়েছে।
প্রথমে তার ইচ্ছা ছিল র্যাঞ্চ আর সেবাস্টিন দত্তের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে যতটা সম্ভব হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়বে। কিন্তু র্যাঞ্চের লোকজন সব তারই। পুরোনো প্ল্যান বাতিল করে সে এখন আরেকটা চমৎকার প্ল্যান এটেছে।
জুলিয়াস অদৃশ্য হতেই মেডক বলে উঠল, দুঃখ হয়, ছেলেটাকে ভালই লাগত আমার। কে জানে, এখন কি আছে ওর কপালে? ওদের বাজিয়ে দেখতে চায় মেডক।
চুলোয় যাক, ব্যাটা, নিজের মতামত প্রকাশ করল জারভিস।
এটা তোমার মনের কথা হতে পারে না, প্রতিবাদ করল পেপি।
মনের কথাই।
আমার কিন্তু দুঃখই হচ্ছে ওর জন্যে।
প্রাণ খুলে হাসতে ইচ্ছে করছে মেডকের। কৃত্রিম বিষণ্ণ মুখে সে বলল, লোকজনকে এবার কাজে যাবার নির্দেশ দাও, জারভিস। কি করতে হবে তা তো তোমার সাথে সকালেই আলাপ হয়েছে। তুমি কাজ শুরু করাও, আমি ওই নতুন লোকটার সাথে বাকি কথা সেরে নিয়েই হাজির হচ্ছি।
ঠিক আছে, এদিকটা আমি নিজেই দেখছি, বলল জারভিস।
ইশারায় এডমন্ডকে ডেকে কেবিনে ঢুকল মেডক। এড যখন কেবিনে ঢুকল মেডক তখন সারা ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। এডকে ঢুকতে দেখে হেসে বলল, এই যে, এড, ভালই হলো তুমি এসে গেছ।
হ্যাঁ, বসেই ছিলাম, তোমার চিঠি পেয়ে ভাবলাম ঘুরে আসি। অনেক লোকজন যোগাড় করেছ দেখছি?
ওদের চেনো নাকি তুমি?
বেশির ভাগই চিনি। তা মতলবটা কি তোমার? যুদ্ধে নামবে?
হাসল মেডক। না, তার দরকার হবে বলে মনে হয় না-তবু সব ব্যবস্থাই রেখেছি। পেপিকে কেমন লাগল তোমার?
সুন্দর।
সুন্দর, ব্যস?
না, বলতে গেলে অনেক কিছুই বলা যায়, বলল এড। মেয়েটাকে নিয়েই কি আমার কাজ?
সেই রকমই প্ল্যান আমার। পছন্দ হয়?
সন্দেহ নেই, কাজটা আকর্ষণীয়।
তাহলে কাজে লেগে যাও। আমিও সাহায্য করতে পারব তোমাকে। কিন্তু সে কথা পরে হবে, আগে বলো জুলিয়াস আর তুমি দু’জনে এখানে একসাথে। কিভাবে পৌঁছলে?
ঘটনাচক্রে তাই ঘটল, সহজভাবেই জবাব দিল এড।
সন্ধানী দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল মেডক। জুলিয়াসকে দেখেই চমকে উঠেছিল সে, তার ওপর সাথে এডকে দেখে একেবারে ভিতর পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে ওর। সে ভাবছে এডের সম্পর্কে ভাল করে না জেনে ওকে এর মধ্যে ডাকা ঠিক হয়নি। ওর সম্বন্ধে বলতে গেলে কিছুই জানে না মেডক। থ্যালন্ডোর দলে দু’জনেই একসাথে কয়েক মাস কাজ করেছে ওরা। দলটা ভেঙে যাবার পরে এড কোথায় যাচ্ছে জানা ছিল ওর-ব্যস ওই পর্যন্তই।
তুমি বুঝছ না, এড, বলে উঠল মেডক। ওই জুলিয়াস লোকটা আমাদের অনেক ঝামেলায় ফেলতে পারে। রাতের বেলাতেই ওকে তুমি শেষ করলে সেই হাঙ্গামা থেকে রেহাই পাওয়া যেত।
তাকে আমার গুলি করা উচিত ছিল বলছ?
নিশ্চয়ই।
কিন্তু আমি কি করে চিনব তাকে?
তোমরা কি গিরিপথ ধরে এসেছ?
হ্যাঁ।
ওখানে একজন লোক বসিয়েছিলাম আমি জুলিয়াসের জন্যে। লোকটার নাম এবেল বেইন।
মারা গেছে সে। বুক ভরে একটা শ্বাস নিল মেডক। কি হয়েছিল?
আমার হাতেই মারা পড়েছে লোকটা। না, চমকে উঠো না, লোকটা কে, আর ওখানেই বা কি করছিল, এসব আমার জানার কথা নয়। পছন্দ না হয় জাহান্নামে যাও তুমি।
দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। দু’জনই নীরব। এড কি ভাবছে ঠিক ধরতে পারছে না মেডক। এটা ঠিক যে চিঠিতে আরমান্ড ফর্কে লোক রাখার কথা কিছু জানায়নি সে। হতে পারে এবেল বেইন যে মেডকেরই লোক তা জানত না সে। কিন্তু ঘটনা যা ঘটেছে তা ওর মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। আর ওদের দুজনের এক সাথে হাজির হওয়াটাও ভাল চোখে দেখছে না ও।
নিজেই ভেবে দেখো, বলল এড। তোমার পছন্দ হয় থাকব, নয়তো চলে যাব, তোমার এখানে চাকরি না করলেও আমার চলবে।
তুমিও মনে কোরো না যে তোমাকে ছাড়া আমাদের চলবে না, রাগতস্বরে জবাব দিল মেডক। তোমাকে ছাড়াও চলবে। থাকলে কাজে লাগাতে পারব, সে জন্যে ভাল টাকাও দেয়া হবে। এখন থাকা না থাকা তোমার ইচ্ছা-কি করতে চাও?
জানালা দিয়ে বাইরে চাইল এড। ওর কাঁধের ওপর দিয়ে মেডকের চোখে পড়ল, পেপিকে দেখা যাচ্ছে উঠানে। এড ঘুরে দাঁড়াবার আগেই সে অনুমান করে নিল ওর জবাব কি হবে।
০৪. কয়েক মাইল চলার পরে
কয়েক মাইল চলার পরে উত্তর দিকে ঘুরল জুলিয়াস। অল্প পরেই ইডেন নদীর ধারে পৌঁছে গেল। এটাই রকিং এইচের উত্তরের সীমানা।
নদীর এই জায়গাটা তার কাছে খুব পরিচিত। ছেলেবেলায় বাবার সাথে প্রায়ই আসত এখানে। সাতার কাটা আর মাছ ধরা বাবার কাছে এখানেই শিখেছে সে। পিস্তল ছোড়ায়ও তার হাতেখড়ি এখানেই। এখনও স্পষ্ট মনে আছে তার বাবার কথাগুলো। বলেছিলেন, আর একজন মানুষের ওপর তুমি পিস্তল চালাও এ আমি চাই না, জু, কিন্তু নিজেকে রক্ষা করার জন্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য এই বিদ্যাটা তোমার রপ্ত করে রাখা উচিত।
এক ঝটকায় খাপ থেকে পিস্তল বের করে তাক করল জুলিয়াস। পরক্ষণেই আবার তা খাপে ভরে রাখল। এড তার এই অ্যাকশন দেখলে কি ভাবত? সে যদি তার সম্পর্কে খোঁজ নেয়, জারভিস তাকে জানাবে পিস্তলে জুলিয়াসের হাত খুব ভাল। কিন্তু জারভিস নিজেও জানে না কত ভাল। আজ পর্যন্ত সবার সামনে এর প্রমাণ দেয়ার কোন দরকার পড়েনি তার।
নদী পার হলো জুলিয়াস। কলিন গেইলের এলাকায় চলে এসেছে সে। কলিনের র্যাঞ্চের উদ্দেশে ঘোড়া চালাল জুলিয়াস। মাত্র আধ ঘণ্টার পথ।
হঠাৎ করে ওই পথে আসেনি সে। বাড়িতে কিছু না ঘটলেও এটাই তার দ্বিতীয় স্টপ হত। আজ কেমন অভ্যর্থনা পাবে জানে না, তবে অতীতে ওই বাড়িতে খুবই সমাদর পেত সে।
সেই ছেলেবেলা থেকে ওই বাড়িতে সে যে কতবার গিয়েছে তার কোন হিসেব নেই। গেইল খামার তার জন্যে ছিল যেন তাদেরই বাড়ির আর একটা কামরা। প্রথম দিকে কলিন গেইলের ছেলে জনই ছিল তার প্রধান আকর্ষণ। জুলিয়াসেরই সমবয়সী সে। দু’জনের ছিল মানিকজোড় বন্ধুত্ব। জনের ছোট বোন জিনা ওর দু’বছরের ছোট। পরের দিকে প্রায়ই ওর সাথে সে জুটে যেত। জিনার সাথেই বেশি সময় কাটাত জুলিয়াস।
কিছুদিন পরেই সে হঠাৎ আবিষ্কার করল জিনার উপস্থিতি তার কাছে দারুণ ভাল লাগে। তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে জিনা। তার এত আসা যাওয়ার মাঝে তিনমাস আগের একটা সন্ধ্যার কথাই বেশি করে মনে পড়ছে। একটা ওয়্যাগনে করে জনের মৃতদেহ পৌঁছে দিতে নিয়ে গেছিল সে। ঘটনা শুনে ভীষণ আঘাত পেয়েছিল কলিন। তার স্ত্রী একেবারে ভেঙে পড়েছিল। জিনা মূৰ্ছা গেছিল। কিন্তু খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে অত্যন্ত রূঢ় ব্যবহার করেছিল তার সাথে। জনের মৃত্যুর জন্যে সরাসরি জুলিয়াসকেই দোষারোপ করেছিল সে।
জুলিয়াসের সামনে দাঁড়িয়ে রক্তশূন্য মুখে, চোখে আগুন ঝরিয়ে সে বলেছিল, নিজে না চলে জনকে কেন ঘোড়ায় চড়তে দিলে?
নিজেই চড়েছিলাম, বোঝানোর চেষ্টা করেছিল জুলিয়াস, ঘোড়াটা আমাকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়ার পরেই জন উঠেছিল।
ওকে উঠতে দিলে কেন? তুমি তো ভাল করেই জানো, যে ঘোড়ার পিঠে তুমি থাকতে পারোনি তার পিঠে থাকা জনের পক্ষে অসম্ভব?
না, জিনা, তুমি ভুল করছ। আমার চেয়েও ভাল ঘোড়া বশ করতে পারত জন। পড়ার সময়ে খুঁটির সাথে বাড়ি না খেলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না।
মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে কোন যুক্তিই মেনে নিতে পারছে না সে। তুমি নিজেই গতকাল জনকে বলেছিলে, ওটা একেবারে পাগলা ঘোড়া। তুমিই জনকে। ডেকে নিয়ে ওকে ক্ষেপিয়ে ওই ঘোড়ায় চড়তে বাধ্য করেছ। ওকে ডেকে নিয়ে ওর বুকে গুলি করাও একই কথা হত। তুমিই খুন করেছ জনকে।
সেদিন বাড়ি ফিরে ঘোড়াটাকে গুলি করে মেরেছিল জুলিয়াস। কাজটা তার বাবা পছন্দ করেননি। এ নিয়েই সেদিন বাবার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল তার। আসলে বাবা ঠিকই বলেছিলেন, জনের মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা, অযথা ঘোড়াটাকে হত্যা করা তার ঠিক হয়নি। ঘোড়াটাকে পরে বশ মানিয়ে কাজে লাগানো যেত।
এরপরে আর কলিনের খামারের কারও সাথে দেখা হয়নি জুলিয়াসের। সেই রাতেই পার্ক ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে। পালিয়েই গিয়েছিল বলা যায়। মানসিক অস্থিরতা, জিনা, তার বাপ-মা, জনের স্মৃতি-সব কিছু থেকেই পালিয়ে দূরে চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আবারও ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। একটা বোঝাপড়া হওয়া দরকার।
খামারটা দেখা যাচ্ছে সামনে। বাড়ির উঠানে ঘোড়া বেঁধে ফিরে দেখল মিসেস গেইল এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। ছোটখাট প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা মহিলা। চুলে পাক ধরেনি এখনও। জুলিয়াস এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ করল তার মুখে সুন্দর একটা হাসি লেগে রয়েছে। মনে কোন ক্ষোভ থেকে থাকলেও মুখ দেখে তা বোঝার উপায় নেই।
তুমি ফিরে এসেছ দেখে খুব খুশি হয়েছি, জুলিয়াস, বলল গেইল-গিন্নী। কলিন আর জিনা বাইরে গেছে, এখনই এসে পড়বে। এসো, ভিতরে এসে বসো।
সেই ভাল, একটু বসি, হিলডা গেইলের পিছন পিছন ঘরে ঢুকল জুলিয়াস।
রান্নাঘরের ছোট টেবিলটার কাছে বসল ওরা প্রথমে। সেবাস্টিন দত্তের কথা তুলল হিলডা। শুনেছি তোমার বাবা খুব অসুস্থ। লোকজনের সাথে দেখা করাও ডাক্তারের বারণ। তোমার সাথে দেখা হয়েছে?
হ্যাঁ, দেখা হয়েছে, জবাব দিল জুলিয়াস। কিন্তু এই আলোচনা করার জন্য আসেনি সে। লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে ধীর গলায় বলল, জনকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে? আমি-আমি আসতে পারিনি। বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম।
জুলিয়াসের মনের অবস্থা হিলডা বুঝতে পারছে বলেই মনে হলো। আমি জানি কেমন লেগেছিল তোমার। তোমরা তিনজন ছেলেবেলায় যেখানে খেলতে, সেই পিছনের বাগানেই কবর দেয়া হয়েছে ওকে। এটা জেনো, আমি জনের মৃত্যুর জন্য তোমাকে মোটেও দোষ দিই না। আমি জানি ওটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। কলিনেরও একই মত।
আর জিনা?
মুখ বিকৃত হলো হিলডার। তোমার নাম মুখেও আনে না। ভিতরে ভিতরে সে-ও নিশ্চয়ই জানে দুর্ঘটনাই এটা, কিন্তু তুমি তো জানো কেমন জেদী, গোয়ার আর ছেলেমানুষ ও? একদিন…
বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ পাওয়া গেল। একটু পরেই কলিন আর জিনা ঢুকল ঘরে। দরজার কাছেই থেমে দাঁড়াল ওরা। একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেছে জিনা। কলিনও অবাক হয়েছে, কিন্তু চট করে সামলে নিয়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল সে। হ্যালো, জুলিয়াস। ফিরে এসেছ দেখে খুব খুশি হলাম। বলেই অনিশ্চিতভাবে মেয়ের দিকে ফিরে চাইল।
ওকে দেখে আমি মোটেও খুশি হইনি, বলে উঠল জিনা। জনকে হয়তো ভুলে গেছ তোমরা। আমি ভুলিনি।
সংযত স্বরে কথা বলল হিলডা গেইল। জন আমাদেরই ছেলে, জিনা। আমরা তাকে ভালবাসতাম।
তাকে যে খুন করেছে সেই লোককেই আপ্যায়ন করছ তোমরা।
না, জিনা, ভুল করছ তুমি, বলল কলিন। যা ঘটেছিল সেটা একটা দুর্ঘটনা।
ওটাকে দুর্ঘটনা বলে মানি না, জ্বলে উঠল জিনা। ঘটনাটার সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানি আমি যা তোমরা জানো না। চলি, আমার ভাইয়ের হত্যাকারী বিদায় হলে পরে ফিরব।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাইরে চলে গেল জিনা।
কলিন-গিন্নী অস্বস্তিকর নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, আমি দুঃখিত, জুলিয়াস। জিনা এরকমই করবে বলে ভয় করছিলাম আমি। তাকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোন কথাই শুনতে চায় না ও। হয়তো সময়ে বদলাবে মেয়েটা।
বদলাতেই হবে ওকে, বলে উঠল কলিন। এই তিক্ততা বিষের মত। ও আর সেই আগের জিনা নেই এখন।
জিনার কথাটাই জুলিয়াসের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল, যা আপনারা জানেন না তা জিনা জানে-একথার মানে কি? কি বোঝাতে চাইছিল ও?
জানি না আমি, বলল কলিন। হতে পারে।
কি হতে পারে?
জারভিসের সাথে ইদানীং বেশ ভাব হয়েছে জিনার। মনে হয় না ওকে ভালবাসে সে। তোমাকে আঘাত দেয়ার জন্যেই হয়তো ওর সাথে মেলামেশা শুরু করেছে। জারভিস ওকে কিছু বলে থাকতে পারে।
কথাটা একটু মনে মনে ভেবে দেখল জুলিয়াস। শেষে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। দুর্ঘটনা সম্পর্কে এমন কোন নতুন কথা থাকতেই পারে না যা জুলিয়াস নিজেই বলেনি।
তাড়াহুড়ো করে উঠছ কেন? বাবার সাথে দেখা হয়েছে তোমার?
হয়েছে, না হওয়ারই মত।
চিন্তিতভাবে নিজের চিবুক চুলকাল কলিন। খুশি হয়েছি ফিরে এসেছ। তুমি। ওদিকে তোমাদের রকিং এইচের চেহারা দেখে ভাল ঠেকছিল না আমার। পুরনো সব কাজের লোককে বিদায় করে নতুন লোক কাজে নিয়েছে মেডক। গুণ্ডার মত চেহারা একেকজনের। যাক, তুমি যখন এসে পড়েছ, নিজেই দেখে শুনে সামলাতে পারবে সব।
খামার চালাবার দায়িত্ব আর আমার নেই।
কিন্তু তা কি করে…
বাবার সাথে দেখা হয়েছে তা তো বলেছি আপনাকে। প্রীতিকর কোন ঘটনা নয়। এখনও বুঝিনি কেন আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো।
তোমার বাবা?
হ্যাঁ, স্বয়ং তিনিই!
বিশ্বাস করি না আমি।
বিশ্বাস আমারও হচ্ছে না-কিন্তু তাই ঘটেছে। আমি কি করব। বাবা ত্যাজ্যপুত্র করেছেন আমাকে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার। বড় হয়েছি, কোনমতে চলে যাবে, সম্পত্তির লোভ আমার নেই। শুধু দুঃখ যে ঘটনাটা এইভাবে ঘটল-বাবাকে শ্রদ্ধা করি আমি।
তোমাকেও যে উনি খুব স্নেহ করেন তাতে কোন সন্দেহ নেই আমার।
কি জানি, কিছুই বুঝতে পারছি না।
কি করবে তুমি এখন?
কিছু ঠিক করিনি এখনও।
এখানেই থাকতে পারো। জিনার সাথে কথা বলব আমি, দরকার হলে ঝটা পেটা করে ওর ভূত ছাড়াব।
হেসে মাথা নাড়ল জুলিয়াস। জিনার বর্তমান মানসিক অবস্থায় তার এখানে থাকাটা মোটেও ঠিক হবে না। মেয়েটাকে ভালবাসে সে, তাই দিনরাত উঠতে বসতে তার ঘৃণাভরা ব্যবহার সহ্য করতে পারবে না ও। না, আমি ক্রেস্টলাইনের দিকে যাচ্ছি এখন, দরজার দিকে এগোল জুলিয়াস। ওখানে দুই একদিন কাটিয়ে একটা কিছু সিদ্ধান্ত নেব।
বাইরে বেরিয়ে দেখল গুদামঘরের পাশে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে জিনা। কটমট করে তারই দিকে উদ্ধত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে সে। আগে খেয়াল করেনি, ওর পরনে রয়েছে তারই পছন্দ করা ঘোড়ায় চড়ার পোশাক। জনের মৃত্যুর মাত্র মাসখানেক আগেই কেনা। আঁটসাট প্যান্টে তার সুঠাম নিতম্ব আরও বেশি করে, ফুটে উঠেছে। পরনে জ্যাকেট নেই বলে ওর ক্ষীণ কটি আরও সরু দেখাচ্ছে। টাইট ব্লাউজে তার উন্নত বক্ষ বাগ মানতে চাইছে না। লম্বা নয় মেয়েটা, কিন্তু সেজন্যে জুলিয়াসের মনে কোন ক্ষোভ নেই।
এত তাড়াহুড়ো করে যাবার কি দরকার ছিল, পিছন থেকে আপত্তি জানাল হিলডা।
আবার একদিন আসব, জবাব দিল জুলিয়াস।
নিজের ঘোড়ার কাছে এগিয়ে গেল সে। জিনাকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বাড়ির পিছন দিককার বাগানে চলে এল জুলিয়াস। গাছের তলায় ক্রস লাগানো কবরটা সহজেই চোখে পড়ে। কাছে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে টুপিটা মাথা থেকে খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়াল সে। নীরবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। থেকে তার মনে পুরোনো দিনের অনেক স্মৃতি ভিড় করে এল। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। গলাটা বুজে এসেছে। দু’চোখ পানিতে ঝাঁপসা হয়ে এল। হয়তো ভবিষ্যতে আরও বন্ধু আসবে তার জীবনে, কিন্তু তাদের কেউই জনের জায়গা কেড়ে নিতে পারবে না।
কতক্ষণ যে ওখানে দাড়িয়েছিল জুলিয়াস, তা সে নিজেও জানে না! শেষ। পর্যন্ত অতীতের স্মৃতির জাল ছিঁড়ে আবার ঘোড়ায় চড়ল সে। চলে যাবার আগে বাড়িটার দিকে ফিরে চেয়ে দেখল দরজায় জিনা দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনেই। ওর বাবা-মাও রয়েছে। জুলিয়াসকে বিদায় জানাতে হাত নাড়ল ওরা। নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল জিনা।
০৫. কলিনের খামার থেকে ক্রেস্টলাইন শহর
কলিনের খামার থেকে ক্রেস্টলাইন শহর বেশ কিছুটা দূরে। বিকেল নাগাদ শহরে পৌঁছল জুলিয়াস। আস্তাবলে ঘোড়া রাখতে গিয়ে ক্লান্ত জুলিয়াস। আড়ষ্টভাবে নেমে দাঁড়াল।
ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ফিলিক্স গ্রেস ওকে চিনতে পেরেই অবাক হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, আরে! জুলিয়াস না? আমরা ভেবেছিলাম…
কি ভেবেছিলে?
হাসল ফিলিক্স। না, ও কিছু না। আমরা শুনেছিলাম ডেনভারে একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়েছ তুমি। নিশ্চয়ই ভুল খবর। যাক, তুমি ফিরে এসেছ দেখে খুশি হয়েছি।
আজ সকালেও জারভিস ডেনভারে গোলমালের কথা কি যেন উল্লেখ করেছিল। পেপিও একই কথা তুলেছিল। এসব গুজব কে ছড়িয়েছে? ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার।
আমার ঘোড়ার ভালমত যত্ন কোরো, ফিলিক্স। দানা খাইয়ে শরীরটা ডলে দিয়ো।
ঘোড়াটা কখন দরকার তোমার?
জানি না, তবে তাড়া নেই। বিশ্রাম দরকার ওর।
সত্যি তুমি ফিরে আসায় খুব খুশি হয়েছি আমি, আবার বলল সে।
ফিলিক্সের বয়স হয়েছে। প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েছে। অত্যধিক মদ খায় বলে কেউ ওর কথায় গুরুত্ব দেয় না। পার্কে তার কোন দাম নেই, তবু ওর আন্তরিকতায় নিজেকে আর অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে না জুলিয়াসের। কেউ ওর কথায় নির্ভর করে না। পার্কে তার কোন দাম নেই, তবু ওর কথায় নিজেকে আর অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে না জুলিয়াসের।
কিন্তু কতক্ষণ সে এইরকম ভাল বোধ করবে কে তা জানে? জনমত খুব সাংঘাতিক জিনিস। যখন তার বাসায় থাকা একান্ত প্রয়োজন, তখনই সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল। সেই সময় কিছু একটা গুজব ছড়িয়েছে এখানে তার নামে। তার ওপর আজই বাবা যে, তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন সেই খবরটাও জানাজানি হয়ে যাবে। অনেকের কাছেই খবরটা খুব রসাল হবে।
এখন থেকে তো রকিং এইচ খামার তুমিই চালাবে, কি বলো?
বিরক্তি বোধ করছে জুলিয়াস। মাত্র ফিরেছি আমি, এখনও কি করব না করব কিছু ঠিক করিনি, জবাব দিল সে।
উঠান পার হয়ে রাস্তায় চলে এল জুলিয়াস। সেলুনের সামনে কয়েকটা ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। বস্টন স্টোরের বারান্দায় দু’জন লোক দাঁড়িয়ে। তিনটে বাচ্চা ছেলে নাপিতের দোকানের সামনে মার্বেল খেলছে। শেরিফের অফিসের সামনে একটা বড় কুকুর বসে আছে-অর্থাৎ শেরিফ অফিস ঘরেই আছে।
ডাক্তারের সাথে দেখা করে তার কাছ থেকেই বাবার সঠিক অবস্থাটা জেনে। নিতে হবে। শেভ সেরে খাওয়া-থাকার একটা জায়গাও খুঁজে নিতে হবে তাকে। থাকার জায়গা নিয়েই বেশি চিন্তা। ক্রেস্টলাইনে কোন আবাসিক হোটেল নেই। মাঝেমধ্যে কেউ বেশি মদ খেয়ে ফেললে তাকে সেলুনেই থাকার জায়গা করে দেয় মালিক অ্যালেন কারভার। ডাক্তার নাথান অ্যাশওয়ার্থের বাসায় অতিরিক্ত কামরা আছে, তবে সেগুলো তার রুগীদের জন্যেই রাখা থাকে। মিসেস ল্যাঙলী দু’এক সময় ঘর ভাড়া দেয়, কিন্তু বুড়ি এত বেশি কথা বলে যে ওখানে থাকলে দু’দিনেই মাথা খারাপ হয়ে যাবে তার।
প্রথমে শেভ করবে বলে এগোল জুলিয়াস। শেরিফের অফিস পার হবার সময় পিছন থেকে ডাক শুনে দাঁড়াল সে। ঘুরে দেখল দরজায় ডিগবি নোবলকে দেখা যাচ্ছে।
জানালা দিয়ে তোমাকে দেখলাম, ডিগবি বলল, তাড়া আছে নাকি তোমার?
না, তাড়া কিসের? জবাব দিল জুলিয়াস।
তাহলে ভিতরে এসো, একটু আলাপ করা যাক। মাথা ঝাঁকিয়ে ওর প্রস্তাবে রাজি হলেও মনে মনে বিরক্তই হলো জুলিয়াস। কেন যেন লোকটাকে মোটেই সহ্য করতে পারে না সে।
ডিগবির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। শক্ত ভারি দেহ-কিন্তু মেদ নেই তার শরীরে। কালো চুল, ঘন ভুরু এবং সরু করে ছাঁটা গোঁফ আছে পাতলা ঠোঁটের ওপরে। সহজে হাসে না সে-অন্তত জুলিয়াসের সামনে তো নয়ই।
অফিস ঘরে ঢুকল ওরা। বোর্ডে কয়েকজন আসামীর ছবি ঝুলানো।
শুনেছি বাইরে ছিলে তুমি, বলল শেরিফ। কোথায়?
আর একটু আলাপ হলে ওখানেই শেষ হয়ে যেত। প্রশ্ন শুনেই রাগে রক্ত চড়ে গেছিল জুলিয়াসের মাথায়-সে কি করে আর কোথায় যায় এসব তার নিজস্ব ব্যাপার! রাগ সামলে সে জবাব দিল, একটু বাইরে বেড়িয়ে এলাম।
তোমার ডেনভারে যাওয়ার ব্যাপারে কি যেন শুনলাম।
এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল জুলিয়াস। মানুষ গুজব নিয়ে কি রকম মাথা ঘামায়! হঠাৎ হেসে উঠে সে বলল, হ্যাঁ, ডেনভারেও গিয়েছিলাম আমি।
শুনলাম তোমাকে নিয়ে কিছু গোলমাল বেধেছিল ওখানে?
হ্যাঁ, ছয়জন মানুষ খুন করেছি, দুটো ব্যাঙ্ক-না, দুটো না, তিনটে ব্যাঙ্ক ডাকাতিও করেছি!
উত্তরটা শেরিফের কাছে মজার কথা বলে মনে হলো না। একটু চড়া সুরেই সে বলল, বাজে কথা রেখে কি ঘটেছিল তাই বলো।
ডেনভারে টেলিগ্রাম করেই জেনে নিয়ো।
তাই হয়তো করব।
খুশি তোমার, আর কিছু?
হ্যাঁ, কোন কারণে দরকার হলে তোমাকে কোথায় পাব? একটু আগে জারভিসের কাছে শুনলাম তুমি আর রকিং এইচে থাকছ না।
অবাক হলো জুলিয়াস। খবরটা ছড়িয়ে দিতে মোটেও দেরি করেনি ওয়া।
এখন তাহলে কি করবে বলে ভাবছ? আবার প্রশ্ন করল ডিগবি। অনিশ্চিতভাবে হাত নেড়ে সে বলল, এখনও ঠিক করিনি কিছু।
জারভিস বলল পার্ক ছেড়ে নাকি চলে যাচ্ছি তুমি?
বললাম তো, ঠিক নেই।
এদিকে কোন চাকরি নেই, থেকে কি করবে?
চাকরি একটা সব সময়েই পাওয়া যাবে।
তুমি পাবে না। যাদের রেকর্ড খারাপ তাদের চাকরি নেই এখানে।
রাগ চাপতে জানালার দিকে ফিরল জুলিয়াস। শেরিফকে ভালমত দু’কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু ঝামেলা করে লাভ নেই। ব্রায়েন চাইল্ডের কথা মনে পড়ল–তার সাথে শহরে দেখা করবে বলছিল লোকটা। এখন হাজতে ঢুকে কাজ নেই। কিছু একটা তাকে বলতে চেয়েছিল ব্রায়েন। হয়তো এমন কিছুই নয়, আবার তা গুরুত্বপূর্ণ কথাও হতে পারে। ব্রায়েনই তাদের বাসার সবচেয়ে পুরোনো আর বিশ্বাসী মানুষ। বাবার খুব কাছের লোক সে। কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ওর সাথে জুলিয়াসের কথা হওয়া দরকার।
আজ পর্যন্ত পার্কে কোনদিন কোন ঝামেলা হয়নি, গম্ভীর স্বরে বলল ডিগবি। এখন হোক, তা আমি চাই না।
তোমার কথার মানে?
সবাই জানে পিতা ইচ্ছা করলে কুসন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে ত্যাজ্য করতে পারে। তোমার যদি ভ্রান্ত ধারণা থাকে যে রকিং এইচ খামারে এখনও তোমার অধিকার আছে তবে তা এই মুহূর্তেই ত্যাগ করো। ঝামেলা বাধাতে যেয়ো না।
চারদিকে একবার চেয়ে দেখে কাষ্ঠ হাসি হাসল জুলিয়াস। আমার তো মনে হচ্ছে তুমি ঝামেলাই চাইছ, শেরিফ?
তোমাকে জানিয়ে দিলাম কোন রকম পাগলামি-ছাগলামি বরদাস্ত করব না আমি, বুঝেছ?
আর কিছু?
না, আপাতত যা বললাম সেটা মনে রাখলেই চলবে।
শুকনো ধন্যবাদ জানিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল জুলিয়াস। একটা প্রিং ওয়্যাগন শহরে এসে ঢুকল। ড্রাইভ করছে বোকো, পাশে তার স্ত্রী হেলেন। শহরের পশ্চিমে ওদের খামার। বোকো দম্পতির সাথে জুলিয়াসের বেশ ভাল খাতির। অনেকবারই তাদের র্যাঞ্চে দাওয়াত খেয়েছে সে। হেলেন দেখতে এখনও সুশ্রী, খুব ভাল রাধুনী বলেও পার্কে নাম আছে তার। ওদের দেখেই হাত নাড়ল জুলিয়াস, উৎফুল্লভাবে উত্তরে বোকোও কি যেন বলল। কিন্তু, হেলেন ওকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। নিচু স্বরে স্বামীকে কিছু বলতেই সে রেগে উঠে বকুনি দিল। কিন্তু হেলেন অটল-জুলিয়াসের দিকে আর মুখ ফিরাল না সে। এসবের মানে কি? হেলেনের কাছে সব কিছুই খুব ভাল, নয়তো খুব খারাপ-মাঝামাঝি বলে কিছু নেই। মনে হচ্ছে জুলিয়াস ডেনভারে কি করেছে সেই সম্বন্ধেই কোন কিছু শুনেছে সে। গুজবটা সত্যিই তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।
এগিয়ে নাপিতের দোকানে ঢুকে পড়ল জুলিয়াস। চুল ছাটা আর দাড়ি শেভ করার ফাঁকে পার্কের যতসব ঘরোয়া খবর শোনাল রকি। বিভিন্ন খদ্দেরের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করে সেগুলো আবার অন্যদের শোনায় সে। বোকোর র্যাঞ্চে কবে আগুন লেগেছিল, নডির লোক দরকার, ওর খামারের দু’জন লোক কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে, ফ্রেডের ছেলেমেয়েদের সবার হাম হয়েছে, এইসব খবর থেকে শুরু করে মিসেস বেলের আবার বাচ্চা হবে, এই খবরও পেয়ে গেল জুলিয়াস।
রকিং এইচের খবর তো তোমাকে দেয়াই হয়নি, জুলিয়াসের মুখে ব্রাশ দিয়ে সাবান ঘষতে ঘষতে বকবক করেই চলল রকি।
বল, যোগান দিল জুলিয়াস।
তোমাকে যে বের করে দেয়া হয়েছে এটা আমাদের কাছে নতুন খবর কিছু নয়। তুমি বাইরে যাওয়ার পর থেকেই জারভিস বুক ফুলিয়ে শহরে ঘুরে বেড়ায় যেন সে-ই সর্বেসর্বা। আসলে পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে মেডক। ওকে সাহায্য করছে হোয়েল কিড় আর হিউ হার্পার-দু’জনেই নামকরা বন্দুকবাজ।
জারভিসের আর কি খবর?
জুয়া খেলায় খুব মত্ত।
হারে?
গত সপ্তাহেই দু’হাজার ডলারের বেশি হেরেছে। সেবাস্টিন দত্তের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স দ্রুত নামিয়ে আনছে সে।
আর আমার কথা? আমার কথা কি শুনেছ তুমি?
আমি ধরেই নিয়েছি ওটা গুজব।
হাসল জুলিয়াস। ভাল কথা, কিন্তু গুজবটা কি?
ওরা বলে ডেনভারে কাকে যেন খুন করেছ তুমি।
ব্যস, এইটুকু?
না, মেয়ে-ঘটিত একটা ব্যাপার আছে। মেয়েটির স্বামী নাকি তোমাকে তার ঘরে হাতেনাতে ধরেছিল।
কথাটা কে ছড়িয়েছে?
ঠিক কোথা থেকে বা কার কাছে থেকে ছড়িয়েছে বলা মুশকিল। যতদূর মনে পড়ে আমি প্রথম শুনি রকিং এইচেরই কর্মচারী চাকের মুখে। অ্যালেন কারভার শুনেছে হোয়েল কিডের কাছে। কে যেন বলছিল ডেনভারের একটা কাগজেও বেরিয়েছে এই খবর।
গুজবটাকে এখনই গলা টিপে মারতে না পারলে জুলিয়াসকে এর জের অনেক বছর পর্যন্ত টানতে হবে। কিছু একটা করা দরকার-রকিকেই ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল সে।
রকি, ওই খবরের কাগজটা বা আমি ডেনভারে কাউকে গুলি করেছি এর কোন প্রমাণ যদি কেউ দেখাতে পারে, তাকে আমি এক হাজার ডলার পুরস্কার দেব-কথাটা একটু ছড়িয়ে দিতে পারবে? হাজার ডলার দেয়ার মত টাকা ব্যাঙ্কে জমা আছে আমার নামে।
বুদ্ধিটা ভাল, এতে কাজ হবে বলেই মনে হয়-ঠিক আছে, কথাটা আমি ছড়িয়ে দেব, প্রতিশ্রুতি দিল রকি।
রকির ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকল জুলিয়াস। আইডা, বেইলি, আর তার মেয়ে লোলা, দু’জনে মিলে রেস্টুরেন্টটা চালায়। রাতের ডিনার খাবার সময় এখনও হয়নি। তাকে দেখেই লোলা জানাল অল্পক্ষণের মধ্যেই খাবার তৈরি হয়ে যাবে। রান্নাঘর থেকে ওকে এক কাপ কফি এনে দিয়ে একটু গল্প করার জন্যে জুলিয়াসের টেবিলেই বসল সে।
ছিমছাম লম্বা গড়ন লোলার। সোনালী চুল, নীল চোখ। ওর ধারণা মুখের তিল দুটো তার সৌন্দর্যহানি ঘটিয়েছে। কিন্তু জুলিয়াসের মনে হয় ওতেই আরও সুন্দর দেখায় তাকে। সবাই খুব পছন্দ করে লোলাকে। পার্কের অনেক যোগ্য পুরুষই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কেন যে মেয়েটা আজও বিয়েতে রাজি হয়নি বুঝতে পারে না জুলিয়াস।
সামনাসামনি বসে টেবিলের ওপর ঝুঁকে নিজের দুই তালুতে মুখ রেখে জুলিয়াসের দিকে কৌতূহলী চোখে চেয়ে দেখছে লোলা।
কি হলো, অমন করে চেয়ে কি দেখছ? জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোলা। কেমন ছিল ডেনভারের সেই মেয়েটা? খুব সুন্দর?
অপরূপ! ডবল সুন্দরী-দুটো মাথা ছিল ওর!
তাই বুঝি পালিয়ে এলে? ওই মেয়েটার জায়গায় আমি হলে কিন্তু কিছুতেই তোমাকে যেতে দিতাম না। ওই গল্পের একটা অক্ষরও বিশ্বাস করিনি আমি। কি করব, কপাল খারাপ, তুমি জিনা গেইলের প্রেমে বিভোর, নইলে কবেই তোমাকে সোনার শিকলে বেঁধে ফেলতাম।
জুলিয়াস হেসে বলল, আমার চেয়ে অনেক ভাল ভাল পাত্র তোমার পথ চেয়ে বসে আছে জানি। কবে মনস্থির করবে বলো তো?
বিয়ে কি করতেই হবে?
সবাই তো করে।
মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসল লোলা। জেরিকে তোমার কেমন মনে হয়?
বোকোর খামারে কাজ করে জেরি। সচ্চরিত্র, কম কথা বলে, কিন্তু কাজের লোক।
ভাল লোককেই বেছে নিয়েছ-ঝুলে পড়ো।
ওকে বিয়ে করব বলিনি আমি-ওর সম্পর্কে তোমার মত জানতে চেয়েছিলাম।
ভাবছ তাহলে?
হয়তো-এমনও হতে পারে ভাবতে ভাবতেই বুড়ি হয়ে যাব। তোমার কি মনে হয় আদর্শ আইবুড়ি হওয়াই লেখা আছে আমার কপালে?
কক্ষনো না!
রান্নাঘর থেকে মায়ের ডাকে লোলাকে উঠতে হলো। আরাম করে গা এলিয়ে বসল জুলিয়াস। লোলার মনের ভাব জেনে খুশি হয়েছে সে। জেরি লোকটার কোন মিথ্যা আড়ম্বর নেই। কাজ করে টাকা জমাচ্ছে সে। সন্দেহ নেই ভবিষ্যতে একদিন জায়গা-জমি কিনে নিজেই খামার করবে ও।
লোলা ওর খাবার নিয়ে এল। জুলিয়াসের খাওয়ার মাঝেই কয়েকজন লোক ঢুকল রেস্টুরেন্টে। ওদের মধ্যে নডি কোলম্যান সোজা এগিয়ে এসে জুলিয়াসের টেবিলেই বসল। সরল লোক। কোন রকম ভণিতা না করেই সে জিজ্ঞেস করল, শুনলাম তুমি নাকি রকিং এইচ ছেড়ে চলে এসেছ?
আত্মসম্মান বাঁচিয়ে বললে ওভাবেও বলা যায়।
কথাটা তাহলে সত্যি?
দুঃখজনকে হলেও সত্যি।
তুমি আমার খামারে চলে এসো না কেন? তোমার কাজের যোগ্য পারিশ্রমিক দেব আমি। কাজের লোক খুব দরকার আমার। চাও তো একটা চুক্তিতে আসতে পারি আমরা।
বেঁটে, স্বাস্থ্যবান আর পরিশ্রমী লোক নডি কোলম্যান। তিন ছেলে-মেয়ের সাপ সে। ওর স্ত্রীর সাথেও জুলিয়াসের আলাপ আছে-মহিলাকে তার বেশ ভালই লাগে। নডির হয়ে কাজ করতে আপত্তি নেই ওর। কিন্তু কথা হচ্ছে পার্কেই থাকবে কিনা সেটা এখনও ঠিক করেনি সে।
নডি, তোমাকে কি জবাব দেব বুঝতে পারছি না, ধীরে ধীরে বলল জুলিয়াস। সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে, ভেবে দেখার জন্য কিছু সময় দরকার আমার।
ঠিক আছে, কাজ করতে করতেই চিন্তা কোরো তুমি-আপাতত দৈনিক হিসেবে নাও? পরে চিন্তা করে দেখো কি করবে।
ঘোড়াটাকে বিশ্রাম দিচ্ছি, তাই আজ রাতে আর যেতে পারছি না।
কেন পারবে না? সহজে ছাড়ার পাত্র নয় নডি। ফিলিক্সের কাছ থেকে। অন্য একটা ঘোড়া নিয়ে নাও, তোমারটা পরে এক সময়ে ফেরত নিয়ে নিয়ো।
বোকো আর হেলেন এসে ঢুকল। জুলিয়াসদের কাছেই একটা টেবিলে বসল ওরা। বোকো জুলিয়াসের সাথে কথা বললেও হেলেন মুখ ঘুরিয়েই থাকল।
নডির খাবার নিয়ে এল লোলা। কয়েক মিনিট পরেই আবার ওদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল সে।
একটা খবর শুনলাম, জুলিয়াস, শান্ত গলায় বলল লোলা। তোমাদের খামার থেকে একজন লোক এসেছিল, সে বলল রকিং এইচে পিস্তল পরিষ্কার করার সময়ে দুর্ঘটনায় ব্রায়েন মারা গেছে।
একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল জুলিয়াসের শিরদাঁড়া বেয়ে। চেয়ার থেকে অর্ধেক উঠে আবার ধপ করে বসে পড়ল সে। ব্রায়েন মারা গেছে? পিস্তল পরিষ্কার করতে গিয়ে দুর্ঘটনা? বিশ্বাস হচ্ছে না তার। শিথিল ভাবে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল সে।
খুবই দুঃখের কথা, বলে উঠল নডি। চমৎকার লোক ছিল ব্রায়েন। খুব সাবধানীও ছিল। কি করে এমন ঘটল?
কোন জবাব দিল না জুলিয়াস। তার বলে উঠতে ইচ্ছে করছে এটা কখনোই দুর্ঘটনা হতে পারে না-এটা খুন! কিন্তু প্রমাণ কই? গোলাগুলি নাড়াচাড়ায় এসব হতেই পারে। ঘটনাকে ওভাবে সাজানোও হয়ে থাকতে পারে। যাই হোক, ব্রায়েন আর তার সাথে শহরে দেখা করতে আসছে না। ওর যাই বলার থেকে থাকুক সেটা না বলাই রয়ে গেল।
তোমার সাথে পরে বাইরে দেখা হবে, নডি, উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস। কিছু বোঝাপড়া আছে তার।
রকিং এইচের কয়েকটা ঘোড়া বাঁধা রয়েছে সেলুনের সামনে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল জুলিয়াস। ব্রায়েন কিভাবে মারা গেছে তা প্রত্যক্ষদশীর কাছ থেকে শুনতে চায় সে।
ডজনখানেক লোক সার বেঁধে বারের সামনে দাড়িয়ে। কয়েকজনকে আজ সকালে নাস্তার টেবিলে দেখেছে সে। জারভিস বা মেডককে ওদের মাঝে দেখা গেল না। ওদের মধ্যে এডমন্ড ফিনলেকে দেখে তাকে ডাকল জুলিয়াস। এড, একমিনিট একটু এদিকে শুনে যাও।
ঘুরে দাঁড়াল এড। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে স্বাভাবিক গলায় সে বলল, আরে, জুলিয়াস যে! এসো, এক গ্লাস মদ নিচ্ছি, খাও।
সে আর এক সময় হবে। চলো, একটু বাইরে এসো-কথা আছে।
ওর কথায় সম্মতি জানিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল এড। বাঁকা-দেহ বন্দুকবাজ হিউ হার্পার আর দৈত্যের মত মাডিও রয়েছে বারে। এডের পিছন পিছন রকিং এইচের লোকজনও সবাই এগোল-দরকার পড়লে এডের কাছাকাছিই থাকতে চায় ওরা।
জুলিয়াসের কাছে এসে মাথা নাড়তে নাড়তে এড বলল, আসলে তুমি একটা মস্ত গোয়ার লোক। খুব বোকামি করছ তুমি।
কি করব, স্বভাব তো আর বদলানো যাবে না?
বাইরে বেরিয়ে রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে বাড়ির কোনা পেরিয়ে দাঁড়াল ওরা। সেলুনের দরজার বাইরে হিউ হার্পার, মাড়ি আর রকিং এইচের অন্যান্য লোকজন এসে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার ওপারে ডিগবি নোবলও তার অফিস থেকে বেরুল।
অন্য কারও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে জুলিয়াস বলল, এড, ব্রায়েনের কি হয়েছিল?
বুড়োটার? দুর্ঘটনা।
কে দেখেছে?
টুপিটা একটু পিছন দিকে ঠেলে দিল এড। একটা কৌতূহলী ভাব প্রকাশ পাচ্ছে ওর মুখে। তুমি কি ভাবছ ওটা দুর্ঘটনা নাও হতে পারে?
ঠিক তা-ই ভাবছি আমি। ঘটনাটা কে দেখেছে?
যতদূর শুনেছি কেউই দেখেনি। ওর জন্য আবার এত দুশ্চিন্তা কে করতে যাবে বলো?
সন্ধানী দষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে জুলিয়াস। রকিং এইচের আস্তাবলে ব্রায়েনকে ধরে ওঠাবার সময়ে ফিসফিস করে আমাকে শহরে দেখা করতে বলেছিল সে। তুমি শুনে থাকলে…
লোক চিনতে ভুল করেছ হে, স্বার্থের খাতিরে খুন করা আমার স্বভাব নয়। জাহান্নামে যাও তুমি?
বেশ রেগেছে এড। মুখটা লালচে দেখাচ্ছে। জুলিয়াসের মনে হলো সত্যি কথাই বলছে ও, হয়তো ব্রায়েনের মৃত্যুর সাথে ওর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাই বলে দুর্ঘটনায় ব্রায়েন মারা গেছে এমন ভাবারও কারণ নেই।
মিছে নিজের ওপর ঝামেলা ডেকে আনছ, বলল এড়। চোখের সামনেই দখতে পাচ্ছি এর ফলাফল কি হবে। মেডক বলেছে ওটা দুর্ঘটনা, মেনে নাও। অন্য কিছু বলতে গেলেই সে তোমাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করে ছাড়বে। তখন কোথায় থাকবে তোমার আত্মসম্মান?
ভাল লোকজনের সাথেই যোগ দিয়েছ। খোঁচা দিল জুলিয়াস।
সে মাথাব্যথা আমার।
লোকটা যে আসলে কেমন বুঝতে পারছে না জুলিয়াস। মেডক, হিউ, মাডি বা অন্যান্য রকিং এইচের লোকজনের সাথে ওর ঠিক খাপ খায় না। নাকি বুঝতে ভুল করছে সে? চলে যাবার জন্যে ঘুরল জুলিয়াস।
কোথায় যাচ্ছ এখন? জিজ্ঞেস করল এড।
একটা কাজ পেয়েছি, জবাব দিল সে। তোমাকে তো বলেছি, এড, পার্ক আমার খুব পছন্দ, আশপাশেই থাকব আমি-দেখা হবে।
কোনাকুনি রাস্তা পার হয়ে ডাক্তারের বাড়িতে গেল জুলিয়াস। নাথান অ্যাশওয়ার্থকে বাসাতেই পাওয়া গেল।
আশা করছিলাম তুমি আসবে, দরজা খুলেই সাদর আমন্ত্রণ জানালেন ডাক্তার। এসো, ভিতরে এসে বসো।
না, বসব না, বাবার সঠিক অবস্থা জানতে এসেছি আমি।
অসুস্থ। খুবই অসুস্থ তিনি।
মানে, বাঁচার আশা নেই?
এতদিন যে কিভাবে টিকে আছে সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। যে-কোনদিন মারা যেতে পারেন। এই অসুখে কখন যে কি হয় বলা কঠিন। সপ্তাহে দু’দিন দেখতে যাই বটে, কিন্তু আসলে আমার করার কিছুই নেই।
হার্টের অসুখ?
হ্যাঁ, হার্টের কাছে একটা শিরায় রক্ত জমে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। কেন এমন হয় জানি না-মানুষ এতে চট করে মারাও যেতে পারে, আবার মাঝেমধ্যে অনেকদিন বিছানায় ভুগেও মরে।
এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল জুলিয়াস। বাবাকে সে চেনে, দীর্ঘদিন বিছানায়। শুয়ে ভোগা সহ্য হবে না তার। তারচেয়ে তার তিনমাস আগেই মরে যাওয়া অনেক ভাল ছিল।
০৬. নডি কোলমানের সাথে
নডি কোলমানের সাথে খোলাখুলিই আলাপ করল জুলিয়াস। বলল কাজটা সে নিচ্ছে বটে কিন্তু কতদিন যে থাকতে পারবে তার কোন ঠিক নেই। মেডকের সাথে গোলমাল বাধলে নডির এখানে কাজ করে বলে নডিও গোলমালে জড়াক এটা সে চায় না।
যে-কোনদিন যে-কোন মানুষের সাথেই মেডকের লাগতে পারে, বলল নডি। শুধু সে-ই নয়, ওর সাথের লোকগুলোও সবাই ঝগড়াটে। গায়ে পড়ে ঝগড়া করাই ওদের স্বভাব।
কিন্তু আমার কারণে ঝগড়া হোক, এটা আমি চাই না।
জুলিয়াস কাজে যোগ দিয়েছে জেনে মারিয়া কোলম্যান খুব খুশি হয়েছে। গুজবের কারণে কোন অস্বস্তি যদি তার থেকেও থাকে তা কারও বোঝার উপায়। নেই। সে কিছুতেই বিশ্বাস করে না সেবাস্টিন দত্ত তাঁর ছেলেকে অমন কথা বলতে পারে। মারিয়া জোর দিয়েই বলেছিল, তোমাকে তোমার বাবা খুব। ভালবাসেন জানি আমি। তুমি দেখে নিয়ো, ওঁর মাথা একটু ঠিক হলেই আবার তিনি তোমাকে ডেকে পাঠাবেন।
এ নিয়ে আর তর্ক করেনি জুলিয়াস। পরদিন সকাল থেকে ইনডির সাথে কাজে লেগে গেল সে। গরু-মহিষের গায়ে মার্কা মারা, খড় কেটে সেগুলো। সংগ্রহ করে পশুর শীতকালের খাবার হিসাবে জড়ো করা, খুঁটি বদল করে বেড়া মেরামত করা, ইত্যাদি প্রচুর কাজ বাকি পড়ে আছে।
চতুর্থ দিনের দিন শহর থেকে জনি এসে হাজির হলো জুলিয়াসের খোঁজে। রান্নাঘরে জুলিয়াস, নুডি আর মারিয়ার সাথে বসল সে। জনিকে খুব বিচলিত দেখাচ্ছে।
কিছু একটা করা দরকার, কে জানে এরপরে আবার কি ঘটবে? চিন্তাগ্রস্ত ভাবে বলল জনি।
কেন, তোমার আবার কি হলো? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
না, আমার কিছু হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ? জেরিকে চিনতে? মারা গেছে। গত সন্ধ্যায় হিউ গুলি করে মেরেছে ওকে।
হিউ! কি হয়েছিল?
এখন ওরা বলছে জেরিই নাকি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে হিউ-এর সাথে ঝগড়া বাধিয়েছিল। হিউকে মারার জন্যে পিস্তল বের করতে দেখেই হিউ ওকে গুলি করে। কিন্তু মদ খেয়ে মাতাল হবার মানুষ জেরি নয়। যাহোক, ওদের কথার ওপর হিউকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মেডককে যদি এখনই থামানো না হয় তবে ওর লোকজনেরা একটার পর একটা এই ধরনের কাজ করেই চলবে।
চট করে লোলার কথা মনে পড়ল জুলিয়াসের। মেয়েটার ভাব ছিল জেরির সাথে। এখন কেমন লাগছে ওর? শূন্য? অবশ? হয়তো কাদছে সে-কিন্তু তাতে আর কি লাভ হবে? জেরি তো আর ফিরবে না!
মারিয়া কোন মন্তব্য করেনি। সে শঙ্কিত মুখে স্বামীর দিকে চেয়ে রয়েছে। নডিকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে। জনি উত্তেজিতভাবে ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।
কি করা যায়, জুলিয়াস? থেমে দাড়িয়ে প্রশ্ন করল জনি। করার আছেই বা কি?
ওদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে আমাদের, জবাব দিল জুলিয়াস। দেখি ওরা কি করে।
চারদিন পর রাতের বেলা আর একজন অতিথি এসে হাজির হলো। দরজায় কড়াঘাতের শব্দে নড়ি পিস্তল হাতে সন্তর্পণে এগোল দরজার দিকে-জুলিয়াস দূর থেকে ওকে কাভার করে রয়েছে।
তোমার একজন গেস্ট এসেছে, জুলিয়াস, চিৎকার করে জানাল নডি।
লোলা বেইলি!
রাইফেল হাতে এগিয়ে এল জুলিয়াস। যেমন অবাক হয়েছে তেমনি দুশ্চিন্তাও হচ্ছে তার এই অসময়ে লোলাকে দেখে। রাত বারোটা ঠিক, বেড়াতে আসার সময় নয়। কিন্তু হয়েছে, লোলা? উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
কিছু হয়নি, কিন্তু তোমার সাথে কথা বলা খুব দরকার।
তোমরা ভিতরে এসো, ডাকল নডি।
আমি বাচ্চাদের বা মারিয়ার ঘুম ভাঙাতে চাই না।
আমি জেগেই আছি, বলতে বলতে মারিয়া বেরিয়ে এল। আর বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তা নেই, ভূমিকম্প হলেও জাগবে না ওরা। বাতি জ্বালাচ্ছি আমি।
ভিতরে ঢুকল ওরা। বুট, জীনস আর ব্লাউজের ওপর সোয়েটার পরেছে লোলা। চুলগুলো ছাড়া। ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে।
আমি কফি চাপিয়ে দিচ্ছি, বেশি দেরি হবে না।
ওসব ঝামেলা করার কোন দরকার নেই, এখনই ফিরতে হবে আমাকে। অনেকদূর পথ-সকালেই আবার রেস্টুরেন্ট খুলতে হবে।
তাহলে আর ঘুমাবে কখন তুমি? বলে উঠল জুলিয়াস। একদিন তোমার মা চালিয়ে নিতে পারবেন না?
মা জানেন না আমি এখানে এসেছি। কেউই জানে না। শনিবারে শহরে যাচ্ছ তুমি?
নডির দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকাল জুলিয়াস। হ্যাঁ, কিছু জিনিস কেনা দরকার, শনিবারেই শহরে যাব ঠিক করেছি।
যেয়ো না! কথা দাও, প্লীজ! বলো যাবে না তুমি?
লোলাকে টলতে দেখে জুলিয়াস এগিয়ে এসে ওকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল। ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে গোলার মুখ-কথা বলতে পারছে না মেয়েটা।
কারও কোন আপত্তি শুনতে চাই না-কফি চাপাচ্ছি আমি, বলল মারিয়া।
কফিতে চুমুক দিয়ে একটু সুস্থির হয়ে ধীরে ধীরে সব খুলে বলল লোলা। রেস্টুরেন্টের কাজে টুকরো টুকরো কথাই কানে আসে। তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা কিছুটা কানে এসেছে আমার।
কার কাছ থেকে শুনলে? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
বিভিন্ন লোকের কাছে। মেড, হিউ, এড, আরও অনেকে।
আমার সম্বন্ধে কিছু বলছিল?
হ্যাঁ, শনিবারের কথা বলছি। ওদের ধারণা শনিবারে তুমি শহরে যাবে। ওদের টেবিলের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে শুনলাম মেডক বলছে, কাজটা ঠিকমত করতে পারলে শেরিফ কিছুই করতে পারবে না। হিউ বলল, আমার হাতে ছেড়ে দাও কাজটা-মিস করি না আমি। এড বলল, লোকে ওকে বেশ পছন্দ করে। আর একটা হত্যা এই মুহূর্তে ঠিক হবে না। মেডক ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল।
বিশ্বাস করছ আমার কথা?
মাথা ঝাঁকাল জুলিয়াস। তোমার কথা মোটেও অবিশ্বাস করছি না আমি।
তাহলে শনিবারে শহরে যাচ্ছ না তো?
হাসল জুলিয়াস। প্রশ্নটার সরাসরি জবাব না দিয়ে বলল, সেটা ভেবে দেখতে হবে। একদিন না একদিন শহরে যেতেই হবে-সারা জীবন তো আর পালিয়ে বেড়ানো যাবে না?
কেন? প্রতিবাদ করল লোলা। পার্কেই তোমাকে থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই-অন্য কোথাও চলে যাও না কেন তুমি?
হয়তো পার্কের মায়া কাটাতে পারি না বলেই যেতে পারি না।
কিন্তু শনিবারে শহরে না গেলেও তোমার চলবে।
তা ঠিক। চিন্তাযুক্ত মুখে জবাব দিয়ে জানালার ধারে সরে গেল জুলিয়াস। লোলার কথাগুলোই মনেমনে উল্টেপাল্টে ভেবে দেখছে সে। আসলে এতে খুব একটা অবাক হয়নি ও। এড তাকে পার্ক ছেড়ে চলে যাবার পরামর্শ দিয়েছিল। জারভিস, মেডক-ওরাও একই কথা বলেছে। জুলিয়াস পার্কে থাকুক এটা সহ্য হচ্ছে না ওদের-কিন্তু কেন? এক সপ্তাহের ওপর হয়ে গেল রকিং এইচের ধারে কাছেও যায়নি সে। বরং ওখান থেকে বহুদূরে ও এই কাজটা নিয়েছে।
কেউ যদি তোমার পিছনে লেগে থাকে সে তো এখানে এসেও তোমাকে মারতে পারে? আলোচনায় যোগ দিল নডি।
পারে, কিন্তু সেটা হবে খুন। শহরে ব্যাপারটা যদি ওরা ঠিক মত সাজাতে পারে তবে ঘটনাটা গান-ফাইটের মত দেখাবে। আমাকে উস্কে দিয়ে ওরাই ঝগড়াটা বাধাবে।
তোমার কোমরে পিস্তল বাধা না থাকলে?
অন্য পথ খুঁজে নেবে ওরা।
শহরে সর্বক্ষণ যদি তোমার সাথে সাথেই থাকি আমি?
তাতে তুমিও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু এতে কাজ হতে পারে।
সেটা ভাল করে ভেবে দেখতে হবে।
রাত অনেক হয়েছে, উঠল লোলা। জুলিয়াস ওকে বিদায় দিতে ওর সাথেই বাইরে এল। বাইরে দাঁড়িয়ে জেরির কথা তুলে লোলার জবাব শুনে খুব অবাক হলো জুলিয়াস।
ওর কথা ভেবে আমার জন্য দুঃখ কোরো না, জুলিয়াসের কনুই-এর ওপর হাত রেখে বলল লোলা। জেরি খুব ভাল লোক ছিল, পছন্দ করতাম, কিন্তু ভালবাসতাম না। ওকে কখনোই বিয়ে করতাম না আমি।
তাহলে তোমার এখনও কোন মনের মানুষ মেলেনি?
দুর্ভাগ্য আমার।
হেসে উঠল জুলিয়াস। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, এখনও অনেক সময় আছে। চলো তোমাকে শহরে পৌঁছে দিয়ে আসি।
সুন্দর পরিষ্কার আকাশ। দুজনে গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। লোলার বাবা বেঁচে থাকতে তার ছেলেবেলাটা নিজেদের খামারেই কেটেছে। সেখানেই সে বন্দুক ছোড়া, ল্যাসো ব্যবহার করা, ঘোড়ায় চড়া, এসব শিখেছে।
জুলিয়াসই বেশির ভাগ কথা চালিয়ে গেল সারাটা পথ। শহরের কাছাকাছি এসে নীরবেই পথ চলছিল ওরা। হঠাৎ লোলা প্রশ্ন করল, ফেরার পরে ওর সাথে তোমার দেখা হয়েছে, জুলিয়াস?
অবাক হয়ে ওর দিকে চাইল জুলিয়াস। সে যে জিনার কথাই ভাবছে কি করে বুঝল মেয়েটা? হ্যাঁ, দেখা হয়েছে, বলল।
অন্ধকারেও লোলার মুখ ভঙ্গি নজরে পড়ল তার। কি হয়েছে বলো তো?
না, কিছু না, থেমে থেমে উচ্চারণ করল জুলিয়াস। তারপর কি ভেবে। আবার বলল, জিনা ওর ভাইয়ের মৃত্যু ভুলতে পারেনি।
কিন্তু সেটা তো আকস্মিক দুর্ঘটনা। সে জন্যে
ভাইকে খুব ভালবাসত সে।
কিন্তু-
কথাটা শেষ করল না লোলা। আবার নীরবে পথ চলল ওরা। এরপরে যখন আবার মুখ খুলল তখন সে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে কথা বলল। শনিবারে ঠিকই শহরে আসবে তুমি-তাই না?
সম্ভবত।
তাহলে তোমাকে সাবধান করতে আসাটা একেবারে বৃথা হলো আমার?
না, তা কেন হবে? সতর্ক হয়ে গেলাম। শহরে যখন ঢুকব চোখ-কান খোলা রাখব আমি।
সোজা জুলিয়াসের দিকে চাইল লোলা। আমি জিনা হলে বলতাম, দূরে কোথাও আমাকে নিয়ে চলো-পৃথিবীর যে-কোন দেশে।
আর জিনা ওকথা বললেও আমি জবাব দিতাম, সেটা সম্ভব নয়।
অন্তত সাবধানে থাকবে তো তুমি?
হ্যাঁ, থাকব।
এগিয়ে চলল ওরা। শনিবারের কথা ভাবছে জুলিয়াস। শহরে সেদিন কি ঘটবে? কতটা সাবধান থাকতে পারবে ও? আসলে মেডকের প্ল্যানটা তার জানা দরকার। হয়তো জারভিস বা পেপির সাথে তার কথা বলা উচিত। পেপির সাথে কথা হলেই ভাল হয়।
০৭. শনিবারে একটু সকাল সকাল
শনিবারে একটু সকাল সকালই ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে তুলে শহরে যাবার জন্যে তৈরি করতে ব্যস্ত হলো মারিয়া। তার ভিতরকার দুশ্চিন্তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু রওনা হবার পরে বারবার অকারণেই নডির হাতে হাত রাখছে সে। ফিলিক্সের থেকে ধার করা ঘোড়াটার পিঠে চেপে গাড়িটার অল্প পিছনে থেকে ওদের অনুসরণ করছে জুলিয়াস। মারিয়া প্রতিবার নডির হাত ছোয়ার সাথে সাথেই সে হাসি মুখে মারিয়ার দিকে চেয়ে তাকে স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা করছে, খেয়াল করল জুলিয়াস। ছেলে দুটো পিছনের সীটে বসেছে, ছোট মেয়েটা মারিয়ার কোলে। ঘণ্টাখানেক পরে বাচ্চাকে কোলে নিল নডি, মারিয়া লাগাম ধরল।
মাঝপথে একবার একটা গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ থেমে ছেলে দুটোকে চলে ফিরে হাত-পাগুলো একটু সোজা করে নেয়ার সুযোগ দিয়ে আবার যাত্রা শুরু করল তারা।
এগারোটা নাগাদ ওরা ক্রেস্টলাইনে পৌঁছল। আরও কয়েকটা ওয়্যাগন দেখা যাচ্ছে ব্যাঙ্কের, পাশে ফাঁকা জায়গায়। গাড়ি থেকে ঘোড়াগুলো খুলতে সাহায্য করল জুলিয়াস। ছেলে দুটো আগেই নেমে দাঁড়িয়েছে। নড়ি ঘোড়াগুলো নিয়ে কাঠের রেইলের সাথে বেঁধে রাখল। বৈশ কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে আশপাশে। ওদের কয়েকজনের সাথে কথাও বলল জুলিয়াস–কিন্তু ওদের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি জুলিয়াসের নজর এড়াল না অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। এতদিনে তাকে ত্যাজ্য করার খবরটা নিশ্চয়ই ছড়িয়ে পড়েছে।
সেলুনের সামনে রকিং এইচের বেশ কয়েকটা ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। দিন শেষ হওয়ার আগেই কিছু একটা গোলমাল ওরা বাধাবে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা যে কোনদিক থেকে আসবে কিছুই আঁচ করতে পারছে না জুলিয়াস।
খাবার জিনিস কি কি লাগবে সব অর্ডার দিতে হবে আমার, বলল নডি। চলো, একসাথেই যাই, অর্ডার দিয়ে একবারেই ওই পথে ফিলিক্সের ঘোড়া ফেরত দিয়ে তোমার ঘোড়াটা নিয়ে আসব। কি বলো?
কাঁধ ঝাঁকাল জুলিয়াস। জনিও জুটে গেল ওদের সাথে। বলল, চলো, একসাথেই যাই-আমিও ওদিকেই যাচ্ছি।
এভাবে যেচে ওদের সাথে যেতে চাওয়া দেখে জুলিয়াসের সন্দেহ হলো হয়তো নডি ওকে কিছু জানিয়েছে। ওর দেহরক্ষীর সংখ্যা এখন দুই-এ দাঁড়াল।
ফিলিক্সের ঘোড়া ফেরত দিয়ে ফেরার পথে শেরিফের সাথে দেখা হলো অফিসের দরজায়। জুলিয়াসকে দেখেই সে বলে উঠল, ভিতরে শুনে যাও, জুলিয়াস, তোমার সাথে কথা আছে।
নডি একবার জনির দিকে চেয়ে বলল, ঠিক আছে, আমরা বাইরেই দাঁড়াই।
দু’জনে অফিস ঘরে ঢুকল। শেরিফই প্রথম কথা বলল। তাহলে চাকরি একটা জুটিয়ে নিয়েছ?
হ্যাঁ, চাকরি পেয়েছি।
টিকবে তো?
হয়তো। কিন্তু তোমার ডেনভার থেকে টেলিগ্রামের জবাবের কি হলো?
মাথা নাড়ল শেরিফ। আমার প্রশ্নের জবাব হলো না ওটা। যাহোক, সে কথা না হয় আপাতত ছেড়েই দিলাম। টেলিগ্রামের জবাব পেয়েছি আমি, তোমার হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণার কথাও শুনেছি-তোমার টাকাটা বেচেই যাবে। কিন্তু তাই বলে মনে কোরো না তুমিও বেঁচে গেলে। ইন্ডিয়ান ব্লাফে নকারের সাথে কি হয়েছিল তোমার?
ওই নামের কাউকে চেনে না জুলিয়াস। ইন্ডিয়ান ব্লাফেও মনে রাখার মত কোন ঘটনা ঘটেনি। তাহলে ব্যাপারটা কি? কৌতূহলী হলো সে।
নকার কে? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
ন্যাকামি কোরো না। তুমি ফেরার একদিন পরেই এখানে এসেছে লোকটা, মেডকের ওখানে কাজ নিয়েছে সে।
ওকে চিনি না আমি।
ইন্ডিয়ান ব্লাফে ঝগড়া করে এসেছ আর এখন বেগতিক দেখে সব ভুলে যেতে চাইছ, না? কি নিয়ে ঝগড়া বেধেছিল?
ওকেই জিজ্ঞেস করো।
লাল হয়ে উঠল ডিগবি। উত্তেজিত গলায় সে বলল, কসম বলছি, এখানে কোন গোলমাল চাই না আমি। তোমার পিস্তল আমার কাছে জমা দাও।
ওর পিস্তল জমা নিয়েছ তুমি?
ওর সাথে দেখা হলেই নিয়ে নেব।
তাহলে তাই করো। ওর সাথে দেখা করে ওর পিস্তল জমা নিয়ে তারপর আমাকে খবর দিয়ো!
ভাল চাও তো যা বলছি তাই শোনো-পিস্তল জমা দাও।
না।
দুজন দুজনের দিকে চেয়ে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। পার্কের নিয়ম হচ্ছে এখানকার লোকজন সবাই পিস্তল নিয়ে চলাফেরা করে, শেরিফ তা কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখে, তবে একমাত্র অ্যারেস্ট করলেই সে সেই ক্ষমতা খাটাতে পারে। ভাওতা দিয়ে কাজ সারতে চেয়েছিল ডিগবি, কিন্তু কাজ হলো না। আত্মসম্মান বাঁচিয়ে নিজের কথা ফিরিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সে বলল, ঠিক আছে, পিস্তল রাখতে চাও রাখো, তবে কোনরকম গোলাগুলি বা ঝামেলা হলেই তোমাকে জেলে ভরব আমি-মনে থাকে যেন।
বাইরে বেরিয়ে এল জুলিয়াস। ভিতরে কি কথা হলো শুনলে?
বেশির ভাগই কানে এসেছে, জবাব দিল নডি।
নকার লোকটা কে?
দু’একবার দেখেছি আমি ওকে, বলল জনি। মাঝারি গড়নের লোক, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। সৌখিন বাবু-কায়দার গেঞ্জিটেঞ্জি পরে। বন্দুকবাজ বলেই মনে হয়।
মেডক যখন কাজ দিয়েছে তখন বন্দুকবাজই হবে ও, মন্তব্য করল নডি।
রাস্তার এদিক ওদিক চেয়ে দেখল জুলিয়াস। মেডকের লোকজন কাউকে এখন দেখা না গেলেও আগামীতে কি ঘটতে যাচ্ছে বেশ বুঝতে পারছে সে। একটা তৈরি ঝগড়া তৈরি করে নিয়েছে ওরা–আর তা-ও ইন্ডিয়ান ব্লাফের ঘটনা বলে প্রচার করায় মেডক বা রকিং এইচের সাথে এটাকে কেউ জড়াবে না।
তাড়াহুড়ো করে গান ফাইটে না যাওয়াই ভাল, বলল নডি।
ঠিক বলেছ, সায় দিল জনি। কিন্তু একটা কিছু করা দরকার।
দেখা যাক ওরা কি করে।
শহরে টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে নিয়ে দুপুরে লাঞ্চ খেতে রেস্টুরেন্টে ঢুকল ওরা। জুলিয়াস বসল নডি আর, তার দুই ছেলের সাথে একই টেবিলে। জনি পাশের টেবিলে মারিয়ার সাথে বসল।
রেস্টুরেন্টে বেশ ভিড়। ব্যস্তভাবে ছুটাছুটি করে কাজ করছে লোলা। শঙ্কিত দেখাচ্ছে ওকে। জুলিয়াসের সামনে খাবার প্লেট নামিয়ে রাখতে রাখতে সে বলল, আজ সকালে মেডক কফি খেতে এসেছিল, ওর সাথে আরও দুজন। ছিল। ওরা বলছিল
দরজার দিকে চেয়ে লোলার কথা হঠাৎ করে থেমে গেল। ওদিকে চাইল জুলিয়াস। পাঁচজন লোক রেস্টুরেন্টে ঢুকছে। ওদের মধ্যে তিনজনকে চেনে জুলিয়াস-মেডক, এড আর তার ভাই জারভিস। বাকি দু’জন অপরিচিত। একজনের পরনে ফ্যাশানের গেঞ্জি-সাদা সিল্কের ওপর কালো সুতোর কাজ করা। শহরের আরও দুই একজন গেঞ্জি পরেছে আজ, কিন্তু ওটার সাথে তুলনা কোনটারই হয় না।
একটা খালি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল ওরা। যাবার পথে মোক কয়েকজনের সাথে বিনীতিভাবে কথা বলল। জারভিসকে আড়ষ্ট আর বিচলিত দেখাচ্ছে। কিন্তু এডের চলাফেরা একেবারে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। চতুর্থ লোকটাকে খেয়ালই করেনি জুলিয়াস, কারণ তার দৃষ্টি পঞ্চম লোক নকারের ওপরই আবদ্ধ। হঠাৎ সে থেমে দাড়িয়ে জুলিয়াসের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ওর মুখটা বেশ লালচে দেখাচ্ছে-হয়তো ড্রিঙ্ক করেছে-কিন্তু তবু চোখ দুটো স্থির আর কঠিন। মেডকের ডাকে এগিয়ে গিয়ে টেবিলে বসল সে।
আর একজন লোক ঢুকল রেস্টুরেন্টে-শেরিফ। কিন্তু টেবিলে না বসে দরজার কাছেই একটা সুবিধা মত জায়গায় দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
এক মিনিট আগেও ঘরটা কথাবার্তা আর হাসিতে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু এখন সে সব থেমে গিয়ে একটা বিশ্রী নীরবতা নেমে এসেছে। যারা উপস্থিত আছে তাদের কেউ কেউ এর কারণটা জানে, আর বাকি লোক আন্দাজ করে নিয়েছে। মারিয়ার দিকে চাইল জুলিয়াস। ওর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে-স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে আছে সে।
আমাদের খাবার আমরা শেষ করি, বলল মারিয়া।
নিশ্চয়ই, মাথা ঝাঁকাল নডি। সেজন্যেই তো রেস্টুরেন্টে আসা।
পরবর্তী আধ ঘণ্টা খুব অস্বস্তির মধ্যে দিয়ে কাটল। কয়েকটা টেবিল থেকে লোকজন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠে পড়ল।
মেডকদের টেবিলে মৃদু কথাবার্তা চলছে। জারভিস মেডকের সাথে আর এড চতুর্থজনের সাথে কথা বলছে-নকার নীরব বসে আছে। জুলিয়াসের দিকে পিঠ দিয়ে বসেছে সে, তবে মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে একবার করে তাকে দেখে। নিচেছ। দরজার পাশে তার জায়গা থেকে একটুও নড়েনি শেরিফ। সে যে কেন ওখানে দাঁড়িয়েছে তা জলের মতই পরিষ্কার-রেস্টুরেন্টের মধ্যে কোন গোলমাল হলে নির্দোষ মানুষজন চোট পেতে পারে, ডিগবি তা চায় না।
খাওয়া শেষ করে প্লেটটা ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল জুলিয়াস। বলল, নডি, আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তোমরা এসো।
না, থামো, বলে উঠল নডি, আমরা সবাই একসাথেই বেরুব, মারিয়া বাচ্চাদের নিয়ে এখানেই থাকুক।
আমারও খাওয়া শেষ, নডির বড় ছেলে বলল।
ভালই হয়েছে, তাহলে তুমিই তোমার মায়ের দেখাশোনা করতে পারবে।
পানির গ্লাস তুলতে গিয়ে মারিয়ার হাত থরথর করে কাঁপছে, তবু তার গলার স্বরে দৃঢ়তা প্রকাশ পেল। তোমার কর্তব্য তুমি করো, নডি, আমরা ঠিকই আছি।
রকিং এইচের টেবিলটার দিকে চাইল জুলিয়াস। নকারও ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর দিকে ফিরে চেয়েছে। মনে হলো এখনই উঠে দাঁড়াবে সে। লোলা একটা ট্রেতে করে এঁটো থালা-বাসন নিয়ে ওদের টেবিলের পাশ দিয়েই ছুটতে ছুটতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ পা পিছলে গেল ওর। ট্রের ওপরকার সব থালা বাসন পড়ল নকারের কোলে। হয়তো প্লেটে গরম কোন কিছু ছিল। এক লাফে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে গেঞ্জি আর প্যান্ট ঝাড়তে লাগল সে। টেবিলের সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। মেডক আর জারভিস হতবুদ্ধি হয়ে গেছে-হি হি করে হাসছে এড।
দেখে চলতে পারো না? চিৎকার করে বলল নকার। আমার জামা কাপড়ের কি অবস্থা হয়েছে, দেখেছ?
তার সাধের গেঞ্জিটার কিম্ভুতকিমাকার চেহারা হয়েছে উচ্ছিষ্ট খাবার, কফি আর ঝোলে। প্যান্টের সামনের দিকটা একেবারে ভিজে গেছে।
আমি সত্যি খুব দুঃখিত, বলে উঠল লোলা।
কটমট করে ওর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে ঘুসি ওঠাল নকার। চট করে ওর হাত ধরে ফেলে হাসতে হাসতেই এড বলল, মাথা ঠাণ্ডা করো, নকার, ও তো আর ইচ্ছে করে এটা করেনি! তাছাড়া কোন চোটও পাওনি তুমি।
রকিং এইচ টেবিল ঘিরে বিশৃঙ্খলা চলার মাঝেই জুলিয়াস বেরিয়ে পড়েছে রেস্টুরেন্ট থেকে। ওর সাথে নডি আর জনিও আছে। কেউ পিছু নেয়নি ওদের। নকার পিছু নিতে চাইলেও লোলার জন্যে পারেনি। ডিশ মোছার কাপড় দিয়ে তার কাপড় মুছে দেয়ার ছলে ওকে দেরি করিয়েছে সে।
রাস্তায় চলতে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে নডির। কি ঘটেছে সবটাই দেখেছি আমি। ইচ্ছে করেই মেয়েটা অপেক্ষা করছিল ওখানে-ঠিক সময় মতই এগিয়ে গিয়ে ট্রে-সদ্ধ সব ফেলেছে নকারের কোলে। ট্রেতে একটা পটে কিছুটা গরম কফিও ছিল!
সত্যি চমৎকার ভেল্কি দেখিয়েছে লোলা। গরম কফি পড়ে নকারের কোল নিশ্চয়ই এখনও জ্বলছে, হাসি মুখে বলল জনি। যেভাবে কফির দাগ লেগেছে তাতে ওই বাহারের গেঞ্জিটা আর পরা হবে না ওর।
হাসছে জুলিয়াসও। সত্যি, একটা মেয়ে বটে লোলা! কেমন সুন্দর নিজেই একটা বুদ্ধি বের করে কঠিন একটা পরিস্থিতি সামলে নিল। স্থায়ী সমাধান হয়নি বটে, তবু এখনকার মত রক্ষা হলো।
রাস্তার অন্য মাথায় রকিং এইচের লোকজনের সাথে শেরিফকেও রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে দেখা গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ওরা। ডিগবিকেই বেশি বলতে দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মেডকের সাথে সেলুনের দিকে এগোল ওরা। সেলুনের সামনে আর একদফা কথাবার্তা চলল। তারপর ঘোড়ায় চেপে নকারকে একাই রকিং এইচের দিকে ফিরে যেতে দেখা গেল।
মনে হয়, বাড়তি পরিষ্কার গেঞ্জি সাথে আনেনি ও, ফোড়ন কাটল নডি। এক বন্দুকবাজের কথা জানি আমি, একটা বিশেষ টুপি ছিল ওর। তোবড়ানো, ময়লা একটা পুরোনো টুপি। অন্য ভাল টুপিও ছিল তার, কিন্তু মারপিটের সম্ভাবনা থাকলেই সে পুরোনো টুপিটাই মাথায় দিত! একদিন অন্য টুপি পরা অবস্থায় গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়েছিল সে। মরার সময়ে তার মৃত্যুর জন্যে সে তার শত্রুকে দায়ী না করে দোষ দিয়েছিল নিজের ভাগ্যকে। তার ধারণা ছিল পুরোনো টুপিটা পরা থাকলে তাকে কেউ মারতে পারত না। হয়তো কারেরও গেঞ্জির ব্যাপারে ওই রকম কিছু কুসংস্কার আছে।
অন্তত এখনকার মত বিদায় হয়েছে লোকটা, বলল জনি।
সে-বিষয়ে সত্যিই কোন সন্দেহ নেই। নকার অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে ডিগবি নোবল এগিয়ে এল ওদের কাছে।
চলে গেল নকার, বিরক্তি নিয়ে জুলিয়াসের দিকে চেয়ে বলল শেরিফ। তোমার জন্যেই যত ঝামেলা।
আমি তো বলেছি লোকটাকে চিনি না আমি, জবাব দিল জুলিয়াস। ঝামেলা হলেও সেটা আমার তরফ থেকে আসত না।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডিগবি বলল, এবারের জন্যে বেঁচে গেলে বটে, কিন্তু পরেরবার আমি মুখ ফিরিয়ে থাকব। আগামীবার ঠিকই মরবে তুমি।
কিংবা নকার।
দু’জনেই মরবে তোমরা-আমাকেও জ্বালাবে। আচ্ছা তোমার আর এখন পার্কে ঘুরঘুর করার কি দরকার বলো তো? বাবা যখন ত্যাজ্য করেছেন, বিদায় হও না কেন তুমি?
এই এলাকাটাই আমার পছন্দ।
নিরাশ ভাবে এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে প্রথমে জনি, পরে নডির দিকে চাইল ডিগবি। তার বিরক্তি ভরা ভেঙচি কাটা মুখের অন্তরালে রাজ্যের অনিশ্চয়তা।
জনি বলে উঠল, তোমার জায়গায় আমি থাকলে জুলিয়াসকে নিয়ে মাথা ঘামাতাম না মোটেও, বরং মেডকের লোকজন নিয়েই, দুশ্চিন্তা হত। জেরিকে হত্যার ব্যাপারটা তো কারোই অজানা নয়। এই ধরনের ঘটনা…
মেডককে সাবধান করে দিয়েছি, বাধা দিয়ে বলে উঠল ডিগবি। এরপর থেকে নিজের লোকজনকে সে সামলে রাখবে বলেছে।
কই, নকারকে ঠেকাবার তো কোন চেষ্টাই করেনি সে? প্রতিবাদ করল জনি।
কেন, তোমাদের সামনেই তো সে নকারকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল, দেয়নি? বলেই দর্পের সাথে হেঁটে গিয়ে তার অফিসে ঢুকল ডিগবি। ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জনি বলল, ডিগবি সুবিচারই করতে চায়, তবে ওর ব্যক্তিগত মনোভাব বাধ সাধে-লোকটা বোধহয় তোমাকে অপছন্দ করে, তাই না, জুলিয়াস?
ঠিকই ধরেছ, জনি।
ওদিকে মেডকের সাথে তো ওর বেশ বন্ধই আছে বলে মনে হয়। বন্ধুর ত্রুটি চোখে পড়লেও মানুষ তা এড়িয়ে যেতে চায়।
মারিয়ার এটা ওটা টুকিটাকি শপিং সেরে রওনা হতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে শুনে জুলিয়াস বলল, ঠিক আছে, তোমরা তোমাদের কাজ সেরে নাও, আমি ততক্ষণে লোলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।
এখন আর ওখানে বিপদের সম্ভাবনা নেই, বলল নডি। তারপর আবার বলল, জিনাও শহরে এসেছে আজ, জানো?
ওর সাথে আজ দেখা হয়নি জিনার। রেস্টুরেন্টে যাবার পথ চারদিকে নজর রাখল জুলিয়াস, কিন্তু জিনাকে কোথাও দেখল না। রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া চুকেছে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল মিসেস আইডা বেইলি তলোলা, দু’জনেই কাপ প্লেট ধোয়ায় ব্যস্ত। জুলিয়াসকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে চেয়ে মিসেস বেইলি বলল, ওরা বলে গেল আমার মেয়ের নাকি কোন কাজের ছিরি নেই।
বিন্দুমাত্র নেই, হাসতে হাসতেই বলল জুলিয়াস।
হোঁচট খেয়েছিলাম, বলল লোলা, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল আমার। মুখে ওকথা বললেও ওর চেহারায় লজ্জার রেশমাত্র দেখা গেল না। চোখ দুটো চকচক করছে। মুখ গম্ভীর রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ও।–
লোলার মা তোয়ালেতে হাত মুছে ওকে বলল, তুমি এখানকার কাজগুলো শেষ করো, আমি ততক্ষণে সামনের ঘরটা পরিষ্কার করছি। দেখো, আগুনটা যেন নিভে না যায়।
আমাকেও কিছু একটা কাজ দাও, আমিও সাহায্য করি? প্রস্তাব দিল জুলিয়াস।
ওর হাতে একটা শুকনো তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে লোলা বলল, প্লেটগুলো মোছো তুমি। এখন থেকেই অভ্যাস করো, বিয়ের পরে তো কাজটা শিখতেই হবে।
কপট রাগে গজর গজর করতে করতে কাজ শুরু করে দিল জুলিয়াস। তার দূরবস্থাটা বেশ উপভোগ করছে লোলা। চুলোয় কিছু কাঠ চাপিয়ে আভেনের, ডালা খুলে পাইগুলো চেক করে দেখে, একটা পাত্রে রাখা জিনিস একটু নাড়াচাড়া করে আরও পিছন দিকে ঠেলে দিল সে।
তোমার কি সব সবসময়ই এরকম কাজ করতে হয়? জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস।
হ্যাঁ, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এখানকার কাজ সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এরপর বিকেলে লোকজন আসা আরম্ভ করবে কফির জন্যে, সেটা শেষ হতে না হতেই আবার রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে-মানে, মোটামুটি ব্যস্তই থাকতে হয় আমাদের।
প্রত্যেক দিন?
আমার বিয়ে পর্যন্ত। বিয়ের পরে মাকে আমার বদলে আর কাউকে রাখতে বলে দেব।
আমি হলে ঝটপট একটা বিয়ে করে ফেলতাম।
সত্যি? আমার তাই করা উচিত?
নিশ্চয়ই, কাউকে পেলেই ঝুলে পড়ো।
সে যে-ই হোক, মনে ধরলেই হলো?
মন চাইলে আর দোমনা কোরো না। ফাঁসিয়ে ফেলো।
চুলোর ধার থেকে ফিরে তাকাল লোলা। হয়তো আগুনের আঁচেই গাল দুটো ঈষৎ লাল হয়ে উঠেছে তার। তাই করব, বলল লোলা, তার মন জয় করার চেষ্টাই করব।
প্লেট মোছা শেষ হয়েছে। তোয়ালেটা ঝুলিয়ে রেখে জুলিয়াস বলল, তুমি আজ যা করেছ সেজন্যে যে কি ভাষায় ধন্যবাদ জানাব জানি না, জানলে…’
তুমি বেঁচে থাকো, ভাল থাকো, এইটুকুই চাই, বাধা দিয়ে বলে উঠল লোলা। আরও হামলা আসবে তোমার ওপর। তুমি কি নডির ওখানেই থাকবে বলে ঠিক করেছ?
আমি জানি মেডকের কিছু একটা প্ল্যান আছে। বাবা মারা গেলে রকিং এইচ খামার জারভিস আর পেপি পাবে। হয়তো জুয়া খেলে জারভিসের শেয়ারটা জিতে নিতে পারবে সে, কিন্তু পেপির ব্যাপারে কি করবে? পেপি যে সোজা মেয়ে নয় একথা সবাই জানে। তাহলে মেডকের মতলবটা কি?
পেপি বিয়ে করলে তখন কি হবে?
পেপি? মেডককে সে কোনদিনও বিয়ে করবে না।
তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আজকে নতুন যে লোকটাকে দেখলাম, তাকে যদি ওর পছন্দ হয়?
এডমন্ড ফিনলে!
আশ্চর্য কি? সুদর্শন যুবক, ওর চলাফেরার মধ্যে একটা স্বাতন্ত্র আছে, আকর্ষণ আছে। তোমার বোনকে কতটা চেনো তুমি?
ছেলেদের দিকে চোখ তুলে তাকায়ও না সে।
অবিশ্বাস ভরা চোখে জুলিয়াসের দিকে চাইল লোলা। মেয়েদের সম্পর্কে কিছুই বোঝো না তুমি। হয়তো পেপি এতদিন ছেলেদের দিকে চায়নি কারণ চোখে পড়ার মত কাউকে এর আগে সে দেখেনি। এডমন্ড নিঃসন্দেহে সাধারণের অনেক ওপরে।
একটু চুপ করে রইল জুলিয়াস। এই লাইনে চিন্তা করে দেখেনি সে। অসম্ভব কি? মেডকের চিঠি পেয়ে এসেছে এড। বন্দুকবাজ যথেষ্ট আছে ওর। হয়তো মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় চরিত্র বলেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছে মেডক? হয়তো এটাই ওর কাজ?
তোমার কি মত, জুলিয়াস?
নতুন চিন্তার খোরাক জোগালে তুমি। কথাটা ভেবে দেখার মত।
যাক, তবু কিছুটা কাজে লাগলাম।
মন্তব্যটা জুলিয়াসের কানেই গেল না। সে এখনও পেপি আর এডমন্ডের কথাই ভাবছে। জারভিসের যদি কিছু হয়, আর পেপি এডকে বিয়ে করে, কে চালাবে রকিং এইচ? পেপির স্বামী এড-বা মেডক-কিংবা দু’জনেই যৌথভাবে চালাবে!
জুলিয়াস? ডাকল লোলা।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে চমকে মুখ তুলে চাইল সে। কিছু বলছ?
নকার শহর ছেড়ে চলে গেছে বলেই মনে কোরো না সব বিপদ কেটে গেছে।
আমি সতর্ক থাকব, হেসে বলল জুলিয়াস। তোমারও সৌভাগ্য কামনা করছি।
কিসের জন্যে?
যেন মনের মানুষের নাগাল পাও।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোলা জানাল, তার মন পাওয়া খুবই শক্ত।
চেষ্টা চালিয়ে যাও, পাবে।
এগিয়ে গিয়ে লোলার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে মৃদু চাপ দিল জুলিয়াস। তারপর ঝুঁকে ওর ঠোঁটে চুমু খেলো। শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু হিসেবেই চুমু খেয়েছিল জুলিয়াস, কিন্তু ঘটনাচক্রে ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াল। দু’পাশ থেকে লোহার হাত দুটো শক্ত করে জুলিয়াসের গলা জড়িয়ে ধরল। লোলার ভেজা উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া লাগল জুলিয়াসের ঠোঁটে। নরম বুকের চাপে রোমাঞ্চিত হলো তার দেহ। জুলিয়াসের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল লোলা। থরথর করে কাঁপছে ওর দেহ। হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়েছে তারও। জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল জুলিয়াস। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে, চিন্তাশক্তি হারিয়ে গেছে, মুখ লাল হয়ে উঠেছে-গরম লাগছে ওর।
সে বলল, লোলা…লোলা আর বলার কিছু ভেবে পেল না জুলিয়াস।
মনে করার কিছু নেই, বলল লোলা। কিন্তু এখন যাও তুমি, মা হঠাৎ এসে পড়তে পারেন।
চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াল জুলিয়াস। পালিয়েই যাচ্ছে সে। মাথার ভিতর সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে তার।
জুলিয়াস? সে দরজার কাছে পৌঁছতেই ডাকল লোলা।
ফিরে তাকাল জুলিয়াস। লোলাকে সম্পূর্ণ শান্ত সংযত দেখাচ্ছে। একটু হাসির আভাসও যেন দেখা যাচ্ছে ওর মুখে।
ঘটনাটা একটু তলিয়ে ভেবে দেখো, বলল লোলা।
কোন জবাব দিল না জুলিয়াস। হঠাৎ এমন ঘটে যাবার জন্যে নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে তার। ভাবার কি আছে এতে? এটা ভুলে যাওয়াই তার উচিত। হ্যাঁ, তাই সে করবে।
০৮. লাঞ্চের পরপরই এক গ্লাস মদ
লাঞ্চের পরপরই এক গ্লাস মদ খুব দ্রুত শেষ করেছে মেডক। এখন দ্বিতীয় গ্লাসটা সামনে নিয়ে বসে ধীরে ধীরে পান করছে সে। নিজের অভ্যাস ভাল করেই জানা আছে তার। দ্বিতীয়টা শেষ করলেই তৃতীয় আয় চতুর্থও শেষ করতে সময় লাগবে না, তারপরই কাউকে না কাউকে ঘুসি মেরে বসবে ও। কিন্তু এবারে অনেক বড় খেলায় নেমেছে মেডক, এখন মাথা গরম করলে চলবে না তার। চিন্তা করে ঠাণ্ডা মাথায় সব কাজ করতে হবে।
হোয়েল কিড় বারে ঢুকল। মেডকের টেবিলে বসতে বসতে নিচু স্বরে বলল, জুলিয়াস এখনও শহরে আছে, আবার রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। বলো তো হিউ আর আমি গিয়ে ওর সাথে একটা ঝগড়া বাঁধিয়ে ওকে শেষ করে আসতে পারি-একাই আছে সে।
ধমকে উঠল মেডক, বোকার মত কথা বোলো না। যত সুন্দর করেই সাজাও এখন আর সেটা ভাল দেখাবে না। জুলিয়াসকে ঘাটাতে যেয়ো না এখন।
গ্লাসে আর একটা চুমুক দিয়ে নীরবে বসে রইল মেডক। একটা প্ল্যান ভেস্তে গেছে তার, কিন্তু তাতে কি? আবার নতুন করে আরেকটা প্ল্যান আটবে সে সব কিছুর সাথে সুন্দর করে খাপ খাইয়ে। অনেকক্ষণ মনে মনে নানান দিক বিবেচনা করে দেখল মেডক, তারপর খুশি মনে শেরিফকে খুঁজতে বেরুল।
অনেক ভেবে দেখলাম, শেরিফ, ধীরে ধীরে বলল মেডক। জুলিয়াসকে খুন করতে চায় এমন লোক রকিং এইচে পোষা ঠিক হবে না। হাজার হোক জুলিয়াস যদি ঠিক পথে চলত তবে আজ সে রকিং এইচেই থাকত।
ওসব তোমার সমস্যা নয়, মিছেই ভাবছ তুমি।
হয়তো তাই, কিন্তু আমি ঠিক করেছি নকারকে আর কাজে রাখব না, বিদায় করে দেব ওকে।
তুমি ভাল মানুষ বলেই এত ভাবছ।
জুলিয়াসকে নিয়ে সত্যিই দুশ্চিন্তায় আছি আমি। জারভিসের ধারণা সে একটা গোলমাল বাধাবেই।
ওকে বের করে দেয়া হয়েছে, এখন আর সে কি ঝামেলা করবে? ওর ভাইয়ের সাথে তোমার মিলমিশ কেমন?
মাথা ঝাঁকাল মেডক ছেলেটা ভালই। তরুণ তো, এখনও অনেক কিছু ওকে শিখতে হবে। মাঝে মধ্যে কঠোরভাবে শাসন করতে হয়-তবে ছেলেটা মানে আমাকে। এবার উঠি, আবার দেখা হবে।
সন্তষ্ট মনে ফিরে এল মেডক। আজকের আলাপে বেশ কাজ হয়েছে, নিখরচায় ডিগবিকে নিজের পক্ষে টানতে পেরেছে সে। রাস্তার ওপাশে এডকে ঘোড়ায় চড়তে দেখে হঠাৎ রেগে উঠে তাকে চিৎকার করে ডাকল।
কোথায় যাওয়া হচ্ছে, শুনি?
সুন্দর একটা হাসি দিল এড। এদিককার খেল খতম। পেপি বাসায় রয়েছে, সেখানেই যাচ্ছি।
কোন নতুন খবর আছে?
না।
অনেকদিন তো হলো, এক ফোঁটা কাজও করোনি, আর কতদিন লাগাবে?
পেপির মত মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যথেষ্ট সময়ের দরকার, জবাব দিল এড। ঠিক মত জাল পেতেছি আমি-সময়ে অবশ্যই কাজ হবে।
কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছি কই?
কোন জবাব না দিয়ে কেবল কাঁধ ঝাঁকাল এড।
অনিশ্চিতভাবে এডের দিকে চাইল মেডক। ওর ব্যাপারে কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারছে না সে প্রথম থেকেই। কেন, তা সে নিজেও জানে না। তার কথা মতই কাজ করতে রাজি হয়েছে এড-তবে কেন স্বস্তি পাচ্ছে না মেডক?
এড, তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে তোমাকে, বলল মেডক।
কেন? মুখ বাঁকাল এড। ধীরে সুস্থে কাজ সারারই কথা ছিল আমার।
তাই বলে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে এমনও কোন কথা ছিল না। আর এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি তোমাকে।
দুই সপ্তাহ।
এক।
ঘোড়ার পিঠে একটু ঝুঁকে সামনে এগিয়ে এল এড। ঠিক আছে। চেষ্টা করব, কিন্তু মনে হয় আরও সময় লাগবে আমার। চটকদার গেঞ্জি পরা নকার বোকা বনেছে বলেই তোমার এতটা আতঙ্কিত হয়ে ওঠার কোন কারণ দেখি না। প্রয়োজন হলে আরও সময় নেব আমি।
উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল এড।
বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই সেলুনের কোণে দাড়ানো হিউ-এর দিকে চোখ পড়ল তার। মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে মিছেই এডকে নিয়ে এত চিন্তা করছে ও। আগে কাজ শেষ করুক এড, তারপর হিউকে ব্যবহার করলেই চলবে। তার জানা মতেই হিউর সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা কারও নেই।
বাকি দিনটা শহরের বিভিন্ন লোকের সাথে সদালাপ করে কাটিয়ে খাওয়া সেরে রাত নটার দিকে কি এইচে পৌঁছল মেডক। মাডি এদিককার চার্জে ছিল। সে জানাল, এড আর পেপি একসাথে কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। আর সব খবরও ভাল। ওকে কর্মচারীদের থাকার ঘরে ফিরে যেতে বলে সোজা সেবাস্টিন দত্তের ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাল মেডক। বিছানায় স্থির হয়ে শুয়ে আছেন সেবাস্টিন।
নিচু স্বরেই কথা বলল মেডক। ওঠো, তোমার সাথে কথা আছে। কোন সাড়া দিলেন না সেবাস্টিন।
জুলিয়াসকে আজই শেষ করার প্ল্যান ছিল কিন্তু ঘটনাক্রমে সেটা সম্ভব হয়নি। তবে নকারকে আবার পাঠাব আমি, এবার আর ব্যর্থ হবে না সে।
সেবাস্টিন দত্তের চোখ খুলল এবার, কিন্তু কোন কথা বললেন না তিনি।
নকারের মত দ্রুত বন্দুকবাজ কমই আছে। জুলিয়াসকে ও-ই কবর দিয়ে আসবে।
লড়তে গেলে জু’র হাতে মারা পড়বে সে, এতক্ষণে কথা বললেন রকিং এইচের মালিক।
ছাই হবে। নকারকে পাঠানো মানেই জুলিয়াসের মৃত্যু। কিন্তু কথা হচ্ছে, তুমি আর কতদিন বেঁচে থেকে জ্বালাবে আমাদের?
চোখ বুজে শুনছিলেন সেবাস্টিন দত্ত। শেষ প্রশ্নটা শুনে তার চোখ দুটো আবার খুলে গেল। এখন মরব না, দুর্বল স্বরে বললেন তিনি, তোমাকে মেরে তবে মরব আমি।
তাঁর হাস্যকর দাম্ভিকতায় মাথা পিছনে হেলিয়ে হা-হা করে প্রাণখোলা হাসি হাসল মেডক। প্রায়ই রাতের বেলা ধারে কাছে কেউ না থাকলে সেবাস্টিন দত্তের ঘরে ঢুকে এই ধরনের কথাবার্তা বলে মেডক। এতদিন যার দাপটে পার্কের সবাই কাপত আজ তাকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে মানসিক কষ্ট দিয়ে পৈশাচিক এক আনন্দ পায় সে।
তোমার মেয়ের সাথে প্রেম করে তাকে পটানোর জন্যে লোক লাগিয়েছি
আমি-তার সাথেই পেপি আজ বাইরে বেড়াতে গেছে। আর জারভিস আছে আমার হাতের মুঠোয়। আমার প্ল্যান মতই এগিয়ে চলেছে সব। তুমি আরও কিছুদিন টিকে থাকলেও অসুবিধা নেই, কিন্তু বেশিদিন বাঁচলে বাধ্য হয়েই সুবিধা মত ব্যবস্থা করব। জানো তো ইচ্ছা কলেই যে-কোন মুহূর্তে তোমাকে শেষ করতে পারি আমি?
কোন জবাব না দিয়ে আবার চোখ বুজলেন সেবাস্টিন। অত্যন্ত ক্ষীণ আর রক্তশূন্য দেখাচ্ছে তাকে।
শুভ রাত্রি, বুড়ামিয়া, বলল মেডক। শুয়ে শুয়ে কত একর জমি আমার জন্যে রেখে যাচ্ছ সেই স্বপ্ন দেখো।
এবারেও কোন জবার দিলেন না সেবাস্টিন দত্ত।
আরও দুইদিন কাজ করার পর জুলিয়াস নডিকে জানাল তার ছুটি দরকার। এড আর পেপির ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছে সে পেপির সাথে দেখা তাকে করতেই হবে একটা কিছু এখনই করা দরকার।
কিন্তু পেপির সাথে দেখা করবে কিভাবে? প্রশ্ন করা নডি। কাজটা মোটেও সোজা হবে না।
পেপির ঘোড়ায় চড়ে একা একা বেড়াতে বেরুনো অনেক দিনের অভ্যাস-দেখা করা কঠিন হবে না।
নকারের সাথে যদি দেখা হয়ে যায়?
শহরে যাচ্ছি না, রকিং এইচের রাস্তার ওপর গোপনে নজর রাখব আমি-নকারকে দেখলে এড়িয়ে যাব।
আর আপত্তি তুলল না নডি। বলল, এই কয়দিন একেবারে হাড়ভাঙ খাটুনি খাটিয়েছি, ছুটি পাওনা হয়ে রয়েছে তোমার-তবে সাবধানে থেকে কোন ঝুঁকি নিয়ো না।
কয়েকদিনের খাবার সাথে নিয়ে পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ল জুলিয়াস হয়তো আজ সন্ধ্যার মধ্যেই দেখা হয়ে যেতে পারে, কিংবা কপাল মন্দ থাকলে কয়েকদিনেও দর্শন না-ও মিলতে পারে। কোন নিশ্চয়তা নেই দেখে তৈরি হয়েই বেরুল সে।
দুপুরের আগেই নদীর ধারে ঝোঁপের আড়ালে আস্তানা গাড়ল জুলিয়াস। রকিং এইচ থেকে শহরে যাবার রাস্তাটা ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। দুপুর বেলা মেডককে দেখল জুলিয়াস। ওর সাথে আরও চারজন লোক রয়েছে। প্রতিদিনই পেপির একবার করে শহরে যাওয়ার অভ্যাস। অভ্যাসটা থাকলে আজই দেখা মিলবে। শেষ পর্যন্ত পেপির দেখা পেল জুলিয়াস-কিন্তু সে একা নয়, ওর সাথে রয়েছে এড।
দু’জনে ঘোড়ায় চড়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। বোঝাই যায় একে অন্যের সঙ্গ দারুণ উপভোগ করছে ওরা। ওদের হাসি শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু হাসি-খুশি ভাবটা দূর থেকেই টের পাচ্ছে। দেখছে আর অস্বস্তি বোধ করছে জুলিয়াস। পেপির একজন পুরুষ বন্ধু দরকার, যে তাকে আনন্দ দেবে, সঙ্গ দেবে, হাসি ফোঁটাবে তার মুখে। কিন্তু এ বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তার বোনকে খেলাচ্ছে সে, শেষ পর্যন্ত ঠকাবে।
ওখানে বসে বসেই ওদের ব্যাপারে কি করা যায় ভাবছে জুলিয়াস পেপি যদি সত্যিই এডের প্রেমে পড়ে থাকে, তাকে বোঝা কঠিন হবে। সহজে। বুঝতে চাইবে না সে। জুলিয়াসের প্রতি তার মনোভাব আরও বিরূপ হবে। পেপিকে ওরা এডের মাধ্যমে হাত করলেও জারভিসকে সামলাবে কিভাবে? চরম বিপদের মধ্যে রয়েছে জারভিস। নাহ্, যে করেই হোক পপির সাথে তাকে কথা বলতেই হবে।
অন্ধকার হয়ে এল। খাবারের পোঁটলা বের করে কিছু খেয়ে নিল জুলিয়াস এখানে বসে থেকে কোন লাভ নেই, বুঝতে পারছে সে। ওরা শহরে গেছে দু’জনে, ফিরবেও একই সাথে। পেপিকে একা পাওয়া যাবে না। শহরে গিয়ে জোর করে দেখা করা যায়। কিন্তু কি লাভ হবে তাতে? এত অল্প সময়ে তাড়াহুড়ো করে কথা বলে কিছুই বোঝাতে পারবে না, তাছাড়া শহরে গেলে নকারের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে অথ ওর সাথে মারপিট করে কোন লাভই নেই।
হঠাৎ তার মনে অন্য একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল। লুকিয়ে রকিং এইচে পেপির ঘরে ঢুকে দেখা করলে কেমন হয়? খামারের প্রতিটি ইঞ্চি তার চেনা। র্যাঞ্চের কুকুর দুটোও জুলিয়াসকে চেনে, ঘেউ ঘেউ করবে না ওরা। অন্ধকারে ছায়ার মতই পেপির ঘরে পৌঁছে যেতে পারবে সে। একবার ওখানে পৌঁছতে পারলে পেপি যে তাকে ধরিয়ে দেবে না, এ বিশ্বাস তার আছে।
অন্ধকার গাঢ় হতেই রকিং এইচের বাড়িতে পৌঁছে গেল জুলিয়াস। বাইরে কর্মচারীদের ঘর থেকে লোকজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে-এখনও ঘুমায়নি ওরা। কিন্তু ওদিকে নজর দেয়ার দরকার বোধ করল না সে, তাকে ওরা কেউ আশা করবে না।
নিঃশব্দে, বারান্দায় উঠে এল জুলিয়াস। কেউ বাধা দিল না ওকে। চাবির গর্ত দিয়ে ভিতরে চেয়েই চমকে উঠল সে। ভাগ্যিস দরজা খুলে সোজা ঢুকে পড়েনি জুলিয়াস। ভিতরে একটা চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে সেই বিশাল-দেহ লোকটা! কি যেন নাম ওর? হ্যাঁ, মাডি। মাডি লরিমার।
পিছিয়ে এল জুলিয়াস। ভিতরে কেউ না কেউ থাকবে এটাই আশা করা উচিত ছিল ওর। একটা কুকুর এর মধ্যেই জুলিয়াসকে খুঁজে বার করে লেজ নাড়তে নাড়তে মহা আনন্দে ওর গা চাটছে। কুকুরটার পিঠ থাবড়ে একটু আদর করে বাইরে দিয়ে ঘুরে পেপির জানালার কাছে সরে এল সে। কায়দা করে জানালা খুলে টপকে ভিতরে ঢুকে পড়ল জুকিয়াস। এখন শুধু পেপির ফেরার অপেক্ষা।
প্রায় রাত বারোটার দিকে পেপি এডের সাথেই ফিরল শহর থেকে। উঠানে ওদের আওয়াজ শুনতে পেল জুলিয়াস। কয়েক মিনিট পরেই বাড়ির ভিতরে পেপির গলা শোনা গেল, তুমি এবার নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও, বাবার কিছু দরকার হলে আমিই দেখব। বাকি সবাই কিছুক্ষণ পরেই ফিরবে-জারভিস ফিরেছে?
এখনও ফেরেনি, জবাব দিল মাড়ি।
তাহলে জিনার সাথেই কাটাচ্ছে সে, খুশি মনেই বলল পেপি। ভিতরের বারান্দা থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এল। কিন্তু সরাসরি নিজের ঘরে না এসে প্রথমে বাবার ঘরে ঢুকল সে। বাবা কেমন আছেন দেখে ঘরে ফিরল পেপি। দরজা বন্ধ করে আপন মনে গান গাইতে গাইতে কাপড় ছাড়ার জন্যে দেয়াল আলমারির কাছে গিয়ে আলো জ্বালাল সে।
নীরবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে জুলিয়াস। মুহূর্তে ঘরটা আলোয় ভরে উঠল। ঘুরেই ওকে দেখতে পেল পেপি। সাথে সাথে চিনলেও চমকে উঠে ওর মুখ থেকে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল। হাত দুটো আপনা আপনি উঠে এল বুকের উপর। চোখ দুটো বিস্ফারিত।
আমি পেপি, ভয়ের কিছু নেই, শান্ত স্বরে বলল জুলিয়াসপ
চট করে বন্ধ দরজাটা একবার দেখে নিয়ে সে বলল, এখানে কি করছ তুমি?
তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।
ওরা যদি জানতে পারে তোমাকে খুন করে ফেলবে, জানো?
কেন? আমাকে কেউ মারতে চাইবে কেন?
নকার নামে একজন লোক কাজ করে এখানে। সে যদি…
আমার মৃত্যু কামনা কি সে একাই করে?
তাই কি যথেষ্ট নয়? আরও দরকার আছে তোমার?
বাবার শরীর কেমন?
পেপির চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। তুমি যদি বাবাকে বিরক্ত করতে এসে থাকো …
না, আমি সেজন্যে আসিনি। বাবা যা বলছেন তার পরে তাঁর সম্পত্তির কানাকড়ি অংশও আমি চাই না। জানি না, মনে হচ্ছে কোন কারণে আমার প্রতি তার মন বিষিয়ে গেছে। মনের ওপর হাত নেই কারও, তবু হাজার হোক নিজের বাবা তো, তাই জানতে ইচ্ছা করে। কেমন আছেন তিনি?
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল পেপি। এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দাটা ভাল করে টেনে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। চেহারাটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে তার-হঠাৎ তাকে অত্যন্ত ক্লান্ত আর চিন্তিত দেখাচ্ছে। বাবা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছেন, জুলিয়াস। খুব কষ্ট হচ্ছে তার, বুকের ব্যথাটা সব সময়ই থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন এর চেয়ে তার মরে যাওয়াই ভাল। এমন মনে হওয়া কি অন্যায়?
না, বোন, তোমার ব্যথাটা আমি বুঝি।
আমি যতটা সম্ভব বাবার কাছে থাকতে চেষ্টা করি, কিন্তু আমার মনে হয় সেটা উনি চান না। কথা মোটেও বলেন না-তার ধারণা কথা না বলে শক্তি সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে ভাল হয়ে উঠবেন। আবার একদিন আগের মত বাইরে ঘুরে বেড়াবেন কিন্তু সে আশা মিছে-একেবারেই অসম্ভব।
এ ব্যাপারে জারভিসের কি মত?
সে দুঃখিত, কিন্তু…ওর কথা আলোচনা করতে চাই না আমি
বস সাজতে ভালই লাগছে ওর, পেপির মনের কথা আন্দাজ করে বলল জুলিয়াস
এখনও ছোট, সব বোঝার বয়স হয়নি ওর।
তা ঠিক, বলে প্রসঙ্গ বদলাল জুলিয়াস। অন্য একটা ব্যাপারে আলাপ করতে এসেছি আমি। কিন্তু কথাটা কিভাবে পাড়ব, মানে
বুঝেছি। এডের ব্যাপারে আলাপ করতে এসেছ, সহজ ভাবেই বলল পেপি।
কি করে বুঝলে?
হয়তো তোমাকে কিছুটা চিনি বলেই বুঝেছি!
বড় ভাইগিরি ফলাতে আমি আসিনি।
সরাসরি জুলিয়াসের চোখে চোখ রাখল পেপি। তুমি আমাকে বলতে এসেছ এড একজন বন্দুকবাজ, একসময় ডাকাতির সাথেও জড়িত ছিল সে। বলবে ওকে ভাড়া করে আনা হয়েছে আমার সাথে প্রেম করে আমাকে বিয়ে করার জন্যে হয়তো এও বলবে আমার মত অনেক মেয়েকেই এর আগে ভোগ করেছে সে।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে জুলিয়াস এই বয়সেই পেপি এত বোঝে তা কল্পনাও করতে পারেনি সে বলল, এত রূঢ়ভাবে কথাটা বলতাম না আমি।
বললেও মিথ্যে বলা হত না।
সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
খাটের ধারে হাত দুটো কোলে রেখে মেঝের দিকে চেয়ে বসে রইল পেপি। একটু পরে স্বগতোক্তির মত বলে চলল, হ্যাঁ, এড সম্বন্ধে যা বললাম সেগুলো সবই সত্যি। বন্দুকবাজ ডাকাত ছিল সে। আমি সুন্দরী বলে নয়, আমি একদিন রকিং এইচের একটা অংশের মালিক হব বলেই আমাকে বিয়ে করতে এসেছিল সে! আমি তার জীবনের প্রথম নারীও নই। কিন্তু সে কি ছিল, কেন এখানে এসেছিল, সেসব কিছুই জানতে চাই না, আমি ওকে বিয়ে করব।
কেন? অস্থিরভাবে নড়ে উঠল জুলিয়াস।
কারণ ওকে ভালবাসি আমি!
চোখ তুলে চাইল পেপি! পানি টলটল করছে ওর দুই চোখে। মুখটা ব্যথায় বিকৃত ওর এই রূপ আগে কোনদিন দেখেনি জুলিয়াস। হাতের আঙুলগুলো পরস্পরের সাথে আবদ্ধ-মুখে ভয় আর বেপরোয়া ভাবের একটা অদ্ভুত মিশ্রণ।
তাহলে তো আমি শত বোঝালেও কোন ফল হবে না।
না, আমি মনস্থির করে ফেলেছি
জারভিস কি বলে?
ওর কথায় কিছু আসে যায় না
মেডক সম্বন্ধে কিছু ভেবেছ?
এর সাথে মেডক লেটনের কি সম্পর্ক?
ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো, ধীরে ধীরে বলল জুলিয়াস! আপাতত সে-ই সবকিছু চালাচ্ছে। খামারের লোকজনও সবাই তার বাছাই করা নিজস্ব লোক। এখন সে জারভিসকে বড় বলে মানছে বটে, কিন্তু বাবা মারা গেলে কি ঘটবে? র্যাঞ্চ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। তুমি বিয়ে করলে তোমার অংশটা মেডক এডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিন্তু জারভিসের অংশ কিভাবে দখলে রাখবে ওরা? একটা উপায় হতে পারে জারভিসকে মেরে ফেলা-তা হলে পুরো সম্পত্তিই তোমার অর্থাৎ মেডকের হাতে চলে যাবে।
উঠে দাঁড়াল পেপি। ওর গাল দুটো রক্তহীন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ওরা জারভিসের কোন ক্ষতি করবে না। সে তো ওদের কথা মতই চলে। কোন বাধাই সৃষ্টি করছে না সে।
এখন করছে না বটে, কিন্তু পরে করতে পারে। ছড়ি ঘুরিয়ে আদেশ দেয়া আর কর্তৃত্ব করা পছন্দ করে নে। এখন মেডক সেটা সহ্য করছে-কিন্তু পরে কি হবে? সূক্ষ্ম একটা সুতোয় ঝুলছে জারভিসের জীবন।
তর্ক করল না পেপি জুলিয়াসের কথাগুলো যে কতটা সত্যি তা সে বেশ বুঝতে পারছে এগিয়ে এসে জুলিয়াসের দুই বাহুমূল খামচে ধরল পেপি জুলিয়াস, কি করব আমরা? কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল সে।
জানি না। জারভিসের সাথে কথা বলে লাভ নেই। কারও কথাই সে শুনবে না।
আমি…আমি যদি বিয়েতে রাজি না হই তাহলে কি সমস্যার সমাধান হবে?
কিছুটা সাহায্য হবে বটে কিন্তু তাতে স্থায়ী সমাধান হবে না। এখনও কোন নির্ভরযোগ্য উপায় খুঁজে পাইনি, কিন্তু সেই চেষ্টাতেই আছি আমি।
কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখল পেপি। মুহূর্তের জন্যে শিউরে উঠল ওর সারা দেহ। ওহ, জুলিয়াস আমি যে কি করব। বুঝি না। মাঝে মাঝে মনে হয় আবার সেই ছেলেবেলার নিশ্চিন্ত জীবনে যদি ফিরে যেতে পারতাম!
না, পেপি, তা হয় না। কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন একদিন আমাদের হতেই হবে। বড় হয়েছি…বড়দের মতই বুদ্ধি-বিবেচনা করে চলতে হবে এখন।
আমরা যদি
কথার মাঝেই থেমে মুখ তুলে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল পেপি। বাইরের উঠানে কয়েকটা ঘোড়া এসে থামার শব্দ শোনা গেল। ওদের অস্পষ্ট কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে জুলিয়াস।
শহর থেকে লোকজন ফিরে এসেছে, বলল পেপি, ওরা আসার আগেই এখান থেকে বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল তোমার।
অসুবিধা হবে না, ঠিক চলে যাব আমি।
ফু দিয়ে বাতি নিভিয়ে জানালার ধারে এসে অন্ধকারে পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিল পেপি। উঠান থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওর ঘর। ঘোড়া থেকে নামছে ওরা। ওদের কারও এদিকে আসার সম্ভাবনা খুব কম।
জুলিয়াস এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। আমরা ভাগ্যচক্রে এই বিপাকে জড়িয়ে না পড়লেই ভাল ছিল, পেপি।
ঘুরে দাঁড়াল পেপি। তোমার আর জিনার মধ্যে সম্পর্ক এখন কেমন? প্রশ্ন করল সে।
ওর সাথে ভাল করে কথা বলারই সুযোগ হয়নি আমার।
জারভিসের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ওর।
শুনেছি।
ওর যে কি হয়েছে জানি না, হয়তো তোমার কারণেই ওখানে যাওয়া আরম্ভ করেছে। তুমি যাবার পর এখানে সে তোমার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে জিনার কাছেও সেই একই ব্যাপার করার চেষ্টা করছে। কেমন যেন বদলে গেছে জারভিস। তোমাকে দেখতে তো পারেই না, আমার সাথেও ইদানীং বিশেষ কথা বলে না।
ছোটকাল থেকেই আমি ওর দু’চোখের বিষ। বাবা আমাদের যত কিছু শেখাতে চাইতেন তার কোনটাতেই ওর আগ্রহ ছিল না। বাবা আমার সাথে বেশি সময় কাটাতেন বলে ও ধারণা তিনি আমাকেই ওর চেয়ে বেশি ভালবাসেন। সেই জন্যেই জারভিসের এত রাগ।
মাথা ঝাঁকাল পেপি। ওরা ভিতরে গেছে রান্নাঘরে ওদের আওয়াজ পাচ্ছি আমি, এই সুযোগে পালাও।
সত্যি আর থাকাটা উচিত হবে না। এমনিতেই অনেক ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে সে। পেপির পাশ দিয়ে এগিয়ে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ল জুলিয়াস। মাটিতে শুয়ে পড়ে চারপাশে চেয়ে দেখল-অন্ধকারে কোন নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল না।
জুলিয়াস? ফিসফিস করে ঘর থেকে ডাকল পেপি।
কিছু বলছ?
আমি এডের সম্বন্ধে কি করব জানি না। ওকে হারাতে চাই না আমি। আমার ভিতর যে কি ঝড় বইছে বোঝাতে পারব না। থাক, এখন কিছু বোলো না, আমি নিজেই ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নেব।
আর একবার চারদিকটা ভাল করে দেখে নিল, জুলিয়াস। জানালা বন্ধ করার আওয়াজ পেল সে। কোথাও কিছু নড়ছে না। মৃদু বাতাস বইছে। দূর থেকে কাঁপানো স্বরে একটা কয়োটির ডাক ভেসে এল।
বিপদের সম্ভাবনা নেই দেখে সেন্টিনেল পাহাড়ের ঢাল ধরে রওনা হলো জুলিয়াস। কয়েক পা এগিয়ে বাড়ির কোনা থেকে একটা খসখস আওয়াজে ঝট করে ঘুরে তাকিয়েই মাটিতে শুয়ে পড়ল। পিস্তলটা বেরিয়ে এসেছে ওর হাতে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে আছে জুলিয়াস। বাড়ির কোনায় কাকে দেখল সে? লোকটা কি তাকে দেখেছে? ওখানে কি করছিল ও?
পরিষ্কার গলায় কেউ বলে উঠল, দুই হাত মাথার ওপরে তুলে দাঁড়াও, জুলিয়াস। চারজন লোক বন্দুক তাক করে রয়েছে–পালাবার পথ নেই তোমার।
তবু নড়ল না জুলিয়াস। মাথাটা সামান্য একটু ফিরিয়ে নিজের দুই পাশ ভাল করে দেখল। যে লোকটা কথা বলেছিল প্রথমে তাকেই কেবল চোখে। পড়ল। পরে খেয়াল করল বাড়ির কোনা থেকে একটা রাইফেলের ব্যারেল সামান্য ঝিলিক দিয়ে উঠল।
উঠে দাঁড়াও, জুলিয়াস, লোকটা আবার আদেশ দিল। কোন আড়াল নেই তোমার, ভাল মতই ফাঁদে পড়েছ। লক্ষ্মী ছেলের মত মাথার ওপরে হাত তুলে দাঁড়াও।
বেশ অন্ধকার, কিন্তু গা ঢাকা দিয়ে পালাবার জন্যে যথেষ্ট নয়। দু’জনকে জুলিয়াস নিজেই দেখতে পেয়েছে-হয়তো আরও লোক তৈরি রয়েছে ওকে গুলি করার জন্যে। সেন্টিনেল পাহাড়ের দিকে দৌড় দিয়েও বিশেষ লাভ নেই-সিকি মাইলের আগে বাচবার মত কোন আড়াল নেই। ভাল মতই ফেঁসেছে সে।
শেষবারের মত বলছি, আবার লোকটার গলা শোনা গেল। হাত তুলে উঠে দাঁড়াও, জুলিয়াস।
আর কোন উপায় নেই। পিস্তলটা খাপে ভরে হাত তুলে উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস। আগের দু’জনসহ দু’পাশ থেকে আরও দু’জন এগিয়ে এল ওর দিকে। ওদের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সে ভাবছে: তার উপস্থিতি ওরা টের পেল কি করে? অবশ্য সে প্রশ্ন এখন অবান্তর, তাকে নিয়ে ওরা কি করবে সেটাই বড় কথা।
কাছে আসতেই ওদের দুজনকে চিনল জুলিয়াস। একজন এড, অন্যজন হিউ হার্পার-বাকি দুজন তার অচেনা। এই ওদের পরিচালনা করছে।
ওর পিস্তলটা নিয়ে নাও, হিউ, আদেশ করল এড।
ওকে গুলি করে মেরে ফেললেই তো ঝামেলা চুকে যায়, হিউ গজর গজর করতে থাকল বটে, কিন্তু আদেশ অনুযায়ী জুলিয়াসের পিস্তল তুলে নিয়ে পিছিয়ে। গেল।
টুপিটা মাথার পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে দাঁত বের করে হাসল এড। বলল, দুঃখিত, জুলিয়াস, মাথা খাটাওনি তুমি। তারপরই ওর গলার স্বর একেবারে বদলে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে সে আদেশ দিল, ওকে গুদাম ঘরে নিয়ে যাও, আমি মেডককে খবর দিচ্ছি।
০৯. জুলিয়াসকে রূঢ়ভাবে ঠেলতে ঠেলতে
জুলিয়াসকে রূঢ়ভাবে ঠেলতে ঠেলতে গুদাম ঘরে নিয়ে গেল ওরা। সেখানে একটা খড় গাদা দেয়ার খুঁটিতে ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা হলো।
একটু পরেই নকার ঢুকল। একটা লাল বর্ডার দেয়া নীল গেঞ্জি পরেছে সে। বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে ওকে। আমি ভাবিনি তোমাকে ওরা এত জলদি ধরতে পারবে, বলল নকার।
ইন্ডিয়ান ব্লাফে তোমার সাথে তো কোন বিবাদ হয়নি আমার!
হয়নিই তো! হাসতে হাসতে বলল সে, ওইসব অজুহাতের কোন দরকার ছিল না আমার, ওটা মেডকের ফন্দি।
উঠানে কয়েকজনের সাড়া পাওয়া গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই মেডককে ঘরে ঢুকতে দেখল জুলিয়াস। ওর সাথে এড, জারভিস আর মাডিও রয়েছে। মেডককে খুব খুশি দেখাচ্ছে। জারভিসের মুখ উত্তেজনায় লাল। ঢোকার সময়ে কি যেন বলছিল সে, কিন্তু মেডকের ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল। এডের মুখ দেখে ওর মনের ভাব বোঝা যাচ্ছে না। চিরাচরিত কৌতুকের হাসিটা এখন মুছে গেছে ওর মুখ থেকে। মাড়ি দাঁত বের করে হাসছে।
তুমি দেখা দেবে এটাই আশা করেছিলাম, বলল মেডক। তোমার বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পরও শিক্ষা হয়নি তোমার, আবার বেহায়ার মত ফিরে এসেছ কিছু হাতানোর আশায়!
বাবার সাথে দেখা করে সম্পত্তির ভাগ চাইতে আসিনি আমি।
গপ ছেড়ো না।
বিশ্বাস না হয় পেপিকে জিজ্ঞেস করে দেখো।
জবাব শুনে একটু থমকাল মেডক। এড, যাও, পেপির কাছ থেকে শুনে এসো ওর কি বক্তব্য আছে। তাড়াতাড়ি করো, সারারাত লাগিয়ো না।
আসছি, বলেই সাঁই করে গোড়ালির ওপর ঘুরে রওনা হয়ে গেল এড।
এই ঘটনা প্রবাহ জারভিসের ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। সে বলে উঠল, এর মধ্যে পেপিকে টেনে আনার কি দরকার? জুলিয়াসের প্রতি দুর্বলতা আছে ওর, সে তো ওকে বাঁচানোর চেষ্টাই করবে।
চুপ করো! ধমকে উঠল মেডক।
ধীর গতিতে ঘুরে মেডকের মুখোমুখি হলো জারভিস। মুখ সামলে কথা বলো, মেডক। মালিকের সাথে কথা বলছ তুমি!
কয়েকটা মুহূর্ত নীরবতার মধ্যে কাটল। সবার চোখ ওদের দু’জনের ওপর। মেডকের হাত তার পিস্তলের দিকে নেমে গেছে, কিন্তু পিস্তল ছুঁলো না সে। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে-মনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া চলছে। শেষ পর্যন্ত তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, জারভিস, খামারের সব ব্যাপারে তুমিই বস, কিন্তু শৃঙ্খলা বজায় রাখা আমার কাজ। এটা আমাকে আমার মত করেই দেখতে দাও। পেপির কি বলার আছে জানতে চাই আমি। তবে সে যা বলবে তাই বিশ্বাস করতে হবে এমন কোন কথা নেই।
অর্ধেক বিজয় হলো জারভিসের। এতেই সন্তুষ্ট সে। জোর করে শব্দ করে হেসে উঠে বলল, ঠিক বলেছ তুমি, মেডক। আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি না। হওয়াই ভাল। দু’জন মিলেমিশে কাজ চালিয়ে যাব আমরা।
জুলিয়াস ভাবছে: জারভিস কি বুঝতে পারল মৃত্যুর দুয়ার থেকেই এইমাত্র ফিরে এল সে?
জলদিই ফিরল এড। বলল, পেপির সাথে কথা হলো, সে বলছে সেবাস্টিন দত্তের সাথে নয়, ওর সাথেই দেখা করতে এসেছিল জুলিয়াস।
কেন? প্রশ্ন করল মেডক।
আমাকে বলেনি তা, বলল ওটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ব্যক্তিগত না ছাই! দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল মেডক। তারপর জুলিয়াসের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কি জন্যে এসেছিলে তুমি?
সত্যি কথা বলতে গেলে এখনই খুন হয়ে যাবে জুলিয়াস। বানিয়ে কিছু বলতে গেলেও ওরা বিশ্বাস করবে না। দৃঢ় কণ্ঠে সে জবাব দিল, আমার বোনের সাথে ব্যক্তিগত আলাপ করেছি আমি-এখানে সেসব কথা বলব না।
সামনে ঝুঁকে উল্টো হাতে চড় কষাল মেডক। জুলিয়াসের মুখের ওপর পড়ল আঘাতটা। চোখ দিয়ে পানি আর নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল।
নকার! হঠাৎ ডেকে উঠল মেডক। জুলিয়াসের সাথে তোমার ঝগড়ার নিস্পত্তি করতে চাও?
অবশ্যই চাই। উৎসাহের সাথে জবাব এল।
তাহলে হাতের বাঁধন খুলে ওকে ওর পিস্তল ফিরিয়ে দাও!
হঠাৎ হেসে উঠল এড। বলল, মেডক, জুলিয়াসকে যদি নকার হারাতে পারে তবে তুমি যা বাজি ধরবে তার দশগুণ টাকা দিতে আমি রাজি।
নিজেকে খুব বাহাদুর মনে করো, না? খেপে উঠল নকার। আমি একশো ডলার বাজি ধরছি।
তোমার সাথে বাজি ধরে লাভ নেই, নির্ঘাত মারা পড়বে তুমি-আমার কথা বিশ্বাস না হয় জারভিসকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো জুলিয়াস কেমন পিস্তল চালায়।
রেগে আগুন হয়ে গেছে নকার। তুমি যা শুনেছ তা শিকেয় তুলে রাখো। নিজেকে খুব বড় ওস্তাদ মনে করছ, তোমার সাথেই না হয় হয়ে যাক এক হাত? এডের দিকে ঘুরে দাঁড়াল নকার।
সরে এসে দু’জনের মাঝখানে দাড়িয়ে কটমট করে এডের দিকে চাইল মেক। তোমার মতলবটা কি? তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে?
না, তোমাদের মত বুদ্ধি হারায়নি আমার, জবাব দিল এড। তোমরা যা করতে যাচ্ছ তা আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। এটা শহরে ঘটলে বিবাদের ফল বলে চালানো যেত, কিন্তু এখানে ঘটলে কি হবে ভেবে দেখেছ? বিভিন্ন রকম কথা উঠবে না?
তাহলে তোমার মতে ওকে ছেড়ে দেয়াই উচিত?
না, তা কেন? মাডিকে ব্যবহার করলেই হয়। ওকে মারপিট করতে দেখেছ কখনও? ওর হাতে মার খাওয়ার পর জুলিয়াসের আর কারও ক্ষতি করার মত অবস্থা থাকবে না।
চোখ দুটো ছোট করে এডের প্রস্তাবটা ভেবে দেখল মেডক। ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। মাড়ির দিকে তাকাতেই সে বক্সিং করার ভঙ্গিতে হাত দুটো তুলে দাঁড়াল। তার বিশাল মুঠি দুটোয় অতীতের মারপিটের চিহ্নগুলো। ফুটে রয়েছে।
আগের ব্যবস্থাটাই তো ভাল, আপত্তি জানাল নকার। বাজিতে কিছু বাড়তি টাকা রোজগার করার সুযোগ পেতাম।
বাড়তি টাকা কামাবার সুযোগ পরেও পাবে তুমি, জবাব দিল মেডক। আজ ওকে আমি মাডির হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি।
জুলিয়াসের হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে, কিন্তু পিস্তলটা তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি-হবেও না। মাডির সাথেই মারপিট করতে হবে ওকে।
মাডির দিকে চেয়ে মনে মনে জরিপ করে নিল জুলিয়াস। বিশাল হলেও ওর দেহের কোথাও মেদ নেই। দড়ির মত পেশীওয়ালা শক্তিশালী হাত দুটো গিয়ে মিশেছে অত্যন্ত বলিষ্ঠ কাঁধের সাথে। হয়তো একটু ধীর হতে পারে ওর গতি। কিন্তু তাই বা কি করে বলা যায়? বিশাল লোককেও অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতি হতে দেখেছে জুলিয়াস।
আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, দু’জনের ঘুসাঘুসি শেষ পর্যন্ত বীভৎস আকার নিতে পারে। এই রকম মারামারিতে একবার একটা লোককে ঘুসি খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়তে দেখেছিল সে, তবু রেহাই পায়নি, মাথায় বুটের লাথি খেয়ে মারা পড়েছিল লোকটা। এইসব মারপিটে ফাউল বলে কিছু থাকে না, সবই চলে। আজ রাতেও কোন বিধি-নিষেধ থাকবে না।
মাডির দিকে চেয়ে স্থির হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবছে জুলিয়াস। দৈত্যের সাথে মানুষ কি করে মারপিট করে? ওর হাতের একটা ঘুসি ঠিকমত পড়লেই ছিটকে মাটিতে পড়বে সে। সাথে সাথে উঠে দাঁড়াতে না পারলেই বুটের লাথি খেয়ে ছাতু হয়ে যাবে ওর মাথা।
ঘরের সবাই ওদের দু’জনকে জায়গা করে দিয়ে পেছনে সরে দাঁড়িয়েছে। পাশ থেকে মেডক বলে উঠল, আমি পঞ্চাশ ডলার বাজি রাখছি, জুলিয়াস পাঁচ মিনিটও টিকবে না।
আমি নিলাম ওই পঞ্চাশ, বলল এড। আর কেউ?
অন্যেরাও কমবেশি বাজি ধরল। কিন্তু সেদিকে খেয়াল করছে না জুলিয়াস, সতর্ক চোখে মাতিকে দেখছে ও। ঝুঁকে পড়ে খেলার ছলে সে একটা হাত ছুঁড়ল জুলিয়াসের মাথা লক্ষ্য করে। ঝটকা দিয়ে তাকে ঘুসি এড়িয়ে মাথা সরিয়ে নিতে দেখে হাসল মাড়ি। আবার এগিয়ে এল সে, আবারও মাথা নিচু করে ঘুসি কাটিয়ে সরে গেল জুলিয়াস। কিন্তু এবারে সরে যাবার সাথে সাথে পা চালাল সে। বুটের শক্ত মাথাটা গিয়ে সজোরে লাগল মাড়ির হাঁটুতে। ব্যথায় আর্তনাদ বেরিয়ে এল ওর গলা থেকে। দারুণ আক্রোশে ঘুসি চালাল মাড়ি। সরে গিয়েই শক্ত একটা ঘুসি বসাল জুলিয়াস ওর বাঁকা নাকের ওপর। রক্তের রেখা নেমে এল ঠোঁট বেয়ে চিবুকে। বুটের লাথি মারল আবার জুলিয়াস ওর হাঁটুর নিচে শিন বোনের ওপর। তীব্র যন্ত্রণায় পিছিয়ে গেল মাড়ি। সাথে সাথেই আর একটা ঘুসি পড়ল ওর মুখে। চট করে ডাইনে বা বামে মাথা সরিয়ে মাড়ির ঘুসিগুলো এড়িয়ে গেল জুলিয়াস। কিন্তু সবগুলো কাটাতে পারল না, একটা জোরাল ঘুসি এসে পড়ল ওর কপালের ওপর।
ছিটকে পিছিয়ে এসে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল জুলিয়াস। তেড়ে ছুটে এল মাডি, ওর চোখে-মুখে বিজয় উল্লাস। জুলিয়াসের মাথা লক্ষ্য। করে বিদ্যুৎ বেগে বুটের লাথি চালাল মাডি। ওটা লাগলে এখানেই মারপিটের, সমাপ্তি ঘটত-গড়িয়ে কোনমতে সরে গিয়েই জোড়া পায়ে লাথি চালাল জুলিয়াস। লাথি খেয়ে পড়ে গেল মাড়ি। সাথে সাথেই আবার দুজনে উঠে দাঁড়াল।
একটু দম নেয়ার ফুরসত পাওয়া যাবে মনে করেছিল জুলিয়াস। কিন্তু মাডি সে সুযোগ দিল না। উঠে দাঁড়িয়েই তেড়ে এল। দু’হাত মুখের সামনে তুলে ঘুসি ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে পিছিয়ে গেল জুলিয়াস। পা ফেলে একপাশে একটু সরে গিয়েই মারপিটের ধারা পাল্টে আক্রমণ করে বসল সে। প্রথম ঘুসিটা চোয়াল, ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল, দ্বিতীয়টা ঠিকমত গিয়ে পড়ল মাড়ির চোয়ালে। জুলিয়াসের মনে হলো যেন পাথরের ওপর পড়ল ওর ঘুসি। হাত কেটে গেছে-ঠিক করল এই রকম ঘুসি আর মারবে না সে। ভীষণ বেগে পেটের ওপর ঘুসি চালাল জুলিয়াস। কেঁপে উঠল মাডি, কিন্তু ক্লান্ত হবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ওর।
সামান্য নিচু হয়ে দু’হাতে জুলিয়াসকে জড়িয়ে ধরল মাডি। পাঁজরের ওপর কঠিন চাপ পড়ছে। হাত দুটো যেন লোহা দিয়ে তৈরি। পিছন দিক থেকে হাত বাড়িয়ে চুলের মুঠি ধরে প্রাণপণে টান দিল জুলিয়াস। বেকায়দা দেখে ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল মাডি। তারপরেই দু’হাতে ঘুসি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে এল।
ঘুসির তোড়ে পড়ে গেল জুলিয়াস। সাথে সাথেই বুটের লাথি মুখের পাশ ছুঁয়ে ওর গালে আগুনের জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। পরবর্তী লাথিটা পড়ল পাজরে। বুকের ওপরই শক্ত করে পা-টা চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস। ভারসাম্য হারিয়ে টলমল করে উঠল মাডি। সামলে ওঠার সুযোগ না দিয়ে কষে লাথি চালাল জুলিয়াস। লাথির আঘাতে পিছিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে একটা গড়ান দিয়েই আবার উঠে ঘুরে দাঁড়াল মাডি।
মুখটা রক্তাক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে, মাডিকে আর চেনা যাচ্ছে না। কিন্তু তার নিজের চেহারাও আর এখন সুদর্শন নেই তা জানে জুলিয়াস। দেহের সব ক’টা পেশী টনটন করছে, মুখের ভিতর ধুলোবালি কিচকিচ করছে। ক্লান্তিতে হাত দুটো আর তুলে রাখতে পারছে না সে। চোখের দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে এসেছে-পায়ের ওপর নিজের ভার রাখাটাই কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছে। সে বুঝতে পারছে না মাডির কেমন অবস্থা, কিন্তু সে আর পারছে না।
দাড়িয়ে মাতালের মত মাড়ির দিকে চেয়ে টলছে জুলিয়াস। লোকজন চিৎকার করে মাডিকে উৎসাহ দিয়ে মারামারির সমাপ্তি ঘটাতে বলছে বারবার। পিছন থেকে কে যেন ধাক্কা দিল ওকে! মাডি এগিয়ে আসছে ঘুসি তুলে। কাটাবার সুযোগ পেল না জুলিয়াস। ঘুসিটা ওর চোয়ালের ওপর পড়ল। সে-ও শেষ চেষ্টায় ঘুসি চালাল মাডির নাক বরাবর। মাথার ভিতর বিস্ফোরণ ঘটেছে মনে হলো জুলিয়াসের। চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে আসছে। মাটিতে পড়ার ব্যথাটা অনুভব করল না জুলিয়াস।
গুণে গুণে এডের পঞ্চাশ ডলার মিটিয়ে দিয়ে মাডি আর জুলিয়াসের দিকে চাইল মেডক। দুজনেই ধরাশায়ী-কেউই নড়ছে না। দেখে মনে হচ্ছে মাডিকে অন্তত এক সপ্তাহ বিছানায় থাকতে হবে-অনেক মার খেয়েছে বেচারা।
এডের পেছন পেছনই বেরিয়ে এল মেডক। বলল, তুমি না বলেছিলে মাডি ঘুসাঘুসিতে ওস্তাদ?
ওকে তো দেখেশুনেই কাজে নিয়েছ, জবাব দিল এড। আর তাছাড়া চেষ্টার ত্রুটি করেনি ও। এরচেয়ে ভাল মারপিট আর কি আশা করো?
কিন্তু এতে জুলিয়াসের ব্যাপারটার কোন সুরাহা হলো না।
ওকথা কেন বলছ? আবার ভাল করে দেখে এসো। আধমরা অবস্থা জুলিয়াসের।
কিন্তু ওকে একেবারে শেষ করাটা বাকি রয়ে গেল।
এমন একটা ব্যবস্থা করো যেন সব কূল রক্ষা হয়। ওর মৃত্যুতে দোষটা তোমার কাঁধে পড়লে ফল শুভ হবে না। শুধু তুমি কেন, এখানকার কারও ওপর দোষ চাপানোই ঠিক হবে না।
মেডককে চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে। গুম করে ফেলতে হবে ওকে, শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল সে। জুলিয়াস পার্ক ছেড়ে চলে গেছে, এই কথাটা ছড়িয়ে দিতে হবে। এর চেয়ে সহজ বুদ্ধি আর কিছু মাথায় আসছে ন!।
আমি যাই, পেপিকে ঘটনাটা জানিয়ে আসি।
ওকে এসব জানানোর কি দরকার?
মাথা খাটলও, মেডক। সে জানে তার ভাই এখানেই আছে। কিছু একটা গল্প বানিয়ে ওকে বুঝ দিতে হবে তো?
ধীর পায়ে বাড়ির ভিতরে এগিয়ে গেল এড। পেপির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় করছে ওর পেপি যে ব্যাপারটা কিভাবে নেবে কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না।
পেপিকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি এড। বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ওদের মধ্যে, কিন্তু তবু মাঝে মাঝে মনে হয় যেন ও অনেক দূরের মানুষ। এর আগে যত মেয়েকে সে জেনেছে তাদের কারও সাথেই মিল নেই পেপির ওর প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কিছুটা ভাব হওয়ার পর ওকে নিজের অতীত সম্পর্কে খানিকটা আভাস দিয়েছে এড। পূর্ব অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে এতে ভাল কাজ হয়। বেশির ভাগ মেয়েই এতে একটা অজানা পুলক অনুভব করে! সে দেখেছে অবস্থার ফেরে পড়ে তাকে ওই পথে যেতে হয়েছিল জেনে কিছু মেয়ে ওর জন্যে উদ্বিগ্ন হয়, আর অন্যেরা তাকে নতুন করে গড়ে নেয়ার জন্যে উঠেপড়ে লেগে যায়। কিন্তু পেপি ওদের কোন দলেই পড়ে না। ওর কথা শুনে সে হেসে বলেছিল, তোমার অতীত সম্বন্ধে আগেই শুনেছি আমি। জানি তুমি কেন এসেছ। তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও কারণ বাবার মৃত্যুর পর অনেক সম্পত্তির মালিক হব আমি। সব জেনেও হয়তো তোমার কথায় ভুলতে পারি আমি-কে বলতে পারে? এটা আবার কি ধরনের কথা হলো?
পেপির ঘরের দরজায় টোকা দিল এড। সাথে সাথেই দরজা খুলে দিল পেপি। জামা ছাড়েনি সে-চেহারাটা ভীত-সন্ত্রস্ত আর মলিন দেখাচেছ। এড… আর কিছু বলতে পারল না সে।
এখানে সুস্থির হয়ে একটু বসো তুমি, হাত ধরে টেনে নিয়ে পেপিকে বিছানার ওপর বসাল এড।
ওকে…ওকে কি মেরে ফেলা হয়েছে?
না, পেপি। এখনও মারেনি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত মারবে?
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আবার ফিরে এসে পেপির পাশে বসল এড়। গুদাম ঘরের ঘটনাটা সংক্ষেপে বর্ণনা করল সে। তারপর বলল, আমার মতে এটাই ভাল হয়েছে। এছাড়া অন্য কোন পথ বেছে নিলে এতক্ষণে ওর মৃত্যু ঘটত।
নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল পেপি। জুলিয়াস কি খুব খারাপভাবে আহত হয়েছে?
সেটা ঠিক জানি না, তবে সে যে জখম হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
তাহলে? এরপরে এখন কি ঘটবে?
মাথা নাড়ল এড সে ভাল করেই জানে এরপর কি ঘটবে। উপায়টা জানে না বটে, কিন্তু মেডক যখন চায় তখন জুলিয়াসকে মরতেই হবে
এডের দিকে একটু ঝুঁকে এল পেপি। বলল, ওর পালাবার একটা ব্যবস্থা তোমাকে করে দিতে হবে, এড।
সেটা কি করে সম্ভব, পেপি? আমি আর কি করতে পারি?
তা জানি না, কিছু একটা করতেই হবে।
কিন্তু সেটা যে অসম্ভব!
এডের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে সে বলল, আমার এটাই সান্তনা যে আমাকে মিথ্যে বুঝ দিচ্ছ না তুমি।
তার মানে?
তুমি নিজেই স্বীকার করেছ আমাকে ভালবাসার অভিনয় দিয়ে ভুলিয়ে বিয়ে করার জন্যেই তুমি এসেছিলে। তারপর হেসে বলেছিলে, আমাকে ভোলাতে এসে এখন নিজেই ফাঁদে পড়ে গেছ-অভিনয় করতে করতে সত্যি সত্যিই ভালবেসে ফেলেছ আমাকে। সেটাও কি তোমার অভিনয়?
অব্যক্ত ব্যথায় ম্লান হয়ে গেল এডের মুখ। না, পেপি। ওটা মন ভুলানো কথা নয়। নিজের অজান্তেই ভালবেসে ফেলেছি তোমাকে।
কিন্তু আমার চেয়ে মেডককেই বেশি দাম দিচ্ছ তুমি।
না! কখনোই না! তীব্র প্রতিবাদ করল এড।
কিন্তু ভাব দেখে তো আমার তাই মনে হচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে অস্থিরভাবে ঘরে পায়চারি করতে শুরু করল এড। এর আগে নিজেকে কোনদিন তার এতটা অসহায় আর বিভ্রান্ত মনে হয়নি। আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সে? জানে না। আগামীকাল কি অবস্থা হবে? তা-ও জানা নেই। পায়চারি থামিয়ে পেপির দিকে চাইল এড। সত্যিই কি মেয়েটা তাকে ভালবাসে? আসলে পেপির জন্য উপযুক্ত পাত্র সে নয়। জীবনে ওকে কি দিতে পারবে এড? যে কোন সময় ওকে গা ঢাকা দিয়ে পালাতে হতে পারে।
একটা বিষাদ মাখা হাসি ফুটে উঠল এডের ঠোঁটে। তার পেটের ভিতরে একটা গিট লেগে গেছে-কিন্তু তার চেহারায় এর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে বলল, ঠিক আছে, আমি জুলিয়াসকে পালাতে সাহায্য করব। কিন্তু বিনিময়ে তুমি আমায় একটা কথা দেবে?
তুমি যা চাও তাই দেব, এড, দ্বিধাহীন স্বরে জবাব দিল পেপি।
আগামীকাল যখন মেডক জানতে পারবে পাখি উড়ে গেছে তখন আমি যেন বলতে পারি তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ। জুলিয়াসকে যেতে দেয়ার একটা অজুহাত আমার থাকতেই হবে, নইলে আমার বেঁচে থাকাই দায় হয়ে উঠবে।
উঠে দাঁড়াল পেপি। সত্যিই কি আমাকে বিয়ে করতে চাও তুমি?
তুমি তো জানো আমি কি চাই।
আমিও তাই চাই।
এগিয়ে গিয়ে পেপির দুই কাঁধে হাত রাখল এড। ওর ভিতরটা এক অব্যক্ত জ্বালায় জ্বলছে। না, পেপি ওই ভাবে নয় আমি তোমাকে চাই সত্যি, কিন্তু জুলিয়াসকে বাঁচানোর বিনিময়ে নয়! কেবল মাত্র নিজের বিনিময়েই আমি পেতে চাই তোমাকে আমাদের মাঝে আর কেউ থাকবে না, শুধু তুমি আর আমি
কিন্তু, এড…
না, আর কথা নয়। কথা অনেক হয়েছে, এবারে কাজ করতে হবে আমাকে-অনেক কাজ বাকি।
দরজার দিকে এগিয়ে গেল এড যাবার আগে পেপিকে নরম গলায় শুভরাত্রি জানিয়ে গেল।
গোলাঘরে একটা লণ্ঠন জ্বলছে। ধীরে ধীরে জুলিয়াসের জ্ঞান ফিরে আসছে। একে একে সব মনে পড়ছে তার। মারপিটটা ঠিক কিভাবে শেষ হলো মনে পড়ছে না। গা-হাত-পা সব টনটন করছে ব্যথায়। মুখ ফুলে উঠেছে, হাতের। মুঠি দুটো আড়ষ্ট-মাথার ভিতরে হাতুড়ি পেটা চলেছে।
অন্ধকার থেকে একটা গলা শোনা গেল, কেউ আর একজনকে প্রশ্ন করছে, কি খবর ওর? জ্ঞান ফিরেছে?
দু’একবার সামান্য নড়েছে, জবাব দিল লোকটা। মনে হয় না এখনও জ্ঞান ফিরেছে। বেচারা বেশ জখম হয়েছে।
মার মাডিও কম খায়নি, বলল এড। ওর ভাই ওকে ধাক্কা দিয়ে বেসামাল করে না দিলে ড্র হত না, জুলিয়াসই জিতত। ভাইয়ের সাথে কি কেউ এই ব্যবহার করে?
খুব ভেঁপো ছেলে ওই জারভিস-জানি না মেডক কেমন করে ওকে সহ্য করে।
আর বেশিদিন হয়তো সহ্য করবে না সে যাক, তুমি যাও, সকাল পর্যন্ত আমি নিজেই পাহারা দেব।
কিন্তু মেডক আমাকে এখান থেকে নড়তে মানা করেছে।
মত পালটেছে সে, সকালে তোমাকে কি একটা কাজে পাঠাবে। যাও, একটু ঘুমিয়ে নাও।
উঠে দাঁড়াল লোকটা, সেই ভাল, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে আমার। সকালে দেখা হবে।
চলে গেল, লোকটা। একটু পরে জুলিয়াসের কাছে গিয়ে এড় নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, জুলিয়াস, জেগে আছ?
জেগেই আছি আমি, বিরক্ত স্বরে জবাব দিল জুলিয়াস।
গোলাঘরের পিছনে ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে রেখে এসেছি, তোমাকে ওই পর্যন্ত পৌঁছে দিলে যেতে পারবে?
অবাক হয়ে মুখ তুলে চাইল জুলিয়াস। এডই তাকে বন্দী করেছিল, এখন আবার সে-ই তাকে ছেড়ে দিচ্ছে। ঘোড়ার পিঠে টিকে থাকতে পারব, জবাব দিল জুলিয়াস। কিন্তু আসলে সে নিজেও এ সম্বন্ধে নিশ্চিত নয়।
মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে পার্ক ছেড়ে চলে যাওয়াই এখন তোমার জন্যে ভাল।
তুমি ভাল করেই জান! আমি যাব না।
ওরা পিটিয়ে ছাতু করবে তোমাকে।
মুখ তুলে চাইল জুলিয়াস তুমি আমাকে সাহায্য করছ কেন?
পেপির জন্যে।
উঠে বসল জুলিয়াস। দুর্বল শরীরে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। নিজেকে সামলাতে চোখ বন্ধ করল সে। একটু পরেই সামলে নিয়ে চোখ খুলে এডের দিকে চাইল। আমি জানি কিসের লোভে তুমি পার্কে এসেছ। তোমার সব। মতলব বুঝেছি আমি। একটা নীচ আর লোভী লোক তুমি এড।
ওসব কথা ছাড়ো।
কেন ছাড়ব? আমি চাই না তুমি আমার বোনকে বিয়ে করো।
কে বলেছে আমি তা করব? জানতে চাইল এড।
কেন, তাই কি তুমি চাও না?
হ্যাঁ, চাই, স্বীকার করল সে। জানি না সেটা সম্ভব হবে কিনা, তবে পারলে আমি তাই করব। যাক, সে ব্যাপারে কথা বলার সময় এখনও আসেনি।
আমাকে একটা পিস্তল দাও।
কি লাভ? হাতের মুঠোয় পিস্তল ধরার ক্ষমতা এখন আর নেই তোমার।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জুলিয়াস জিজ্ঞেস করল, আমার চলে যাওয়াটা মেডক কি চোখে দেখবে?
কৌতুকপূর্ণ হাসি হাসল এড। মেডক রাগে ফেটে পড়বে তর্জন গর্জন করবে, চিৎকার করে রাগ দেখাবে আমার ওপর, আর নিজের নখ কামড়াবে। মনে মনে আমাকে খুনও করতে চাইবে ও, কিন্তু ওই পর্যন্তই। পেপির থেকে স্বার্থসিদ্ধি করতে হলে আমাকে ওর দরকার, তাই ইচ্ছা থাকলেও সে মারতে পারবে না আমাকে।
তাহলে ওর কাজটা আমিই শেষ করব, বলে উঠল জুলিয়াস। এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটা পিস্তল যোগাড় করে আবার ফিরে আসব।
তার আগে তোমার বোনের সাথে একটু আলাপ করে নিয়ো।
কেন?
কারণ ঘটনা যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে এতে তিনটে পক্ষ থাকবে। একটা তোমার, একটা মেডকের আর বাকিটা পেপি আর আমার। দেখি, উঠে দাড়াও তো?
প্রথমে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে কোনমতে উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস। চট করে এড ওকে ধরে না ফেললে সে ঠিক পড়েই যেত। একটু পরে ধাতস্থ হয়ে নিজেই দাড়াতে সক্ষম হলো সে। একবার ঘোড়ায় উঠতে পারলে টিকে থাকতে পারবে বলেই মনে হচ্ছে ওর।
শব্দ কোরো না, নিঃশব্দে চলার চেষ্টা করো।
রোষের সাথে এডের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জুলিয়াস বলল, জাহান্নামে যাও তুমি। ভবিষ্যতে সাবধান থেকো।
দরজার দিকে এগিয়ে গেল ওরা।
১০. ঘোড়ার কাছে পৌঁছতেই
ঘোড়ার কাছে পৌঁছতেই যেন অনন্তকাল লেগে গেল ওর। সেখান থেকে যে কোথায় কোথায় ঘুরেছে আবছা ভাবে কিছু কিছু মনে পড়ছে তার। ভোরের বেলা জুলিয়াস দেখল ইডেন নদীর ধারে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলছে সে। রকিং এইচ থেকে জায়গাটা মাত্র দু’ঘণ্টার পথ। এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার। ক্রেস্টলাইনের দিকে রওনা হতে পারে সে, কিন্তু এতটা পথ পেরিয়ে ওখানে পৌঁছতে পারবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া এতক্ষণে হয়তো মেডকের লোকজন তাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। পশ্চিমে গিয়ে, পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তাতেও ঝুঁকি অনেক। শেষ পর্যন্ত কলিন গেইলের খামারেই যাবে বলে ঠিক করল জুলিয়াস।
নদী পার হয়ে কোনাকুনি ভাবে কলিনের র্যাঞ্চের দিকেই রওনা হলো সে। এবারে জিনার কথা মনে পড়ল ওর। জুলিয়াসকে কি চোখে দেখবে জিনা? ওর সাথে দেখা হওয়া দরকার, কয়েকদিন ভেবেছে সে। কিন্তু সুযোগ আসেনি। হয়তো ওর সাথে কথা বলেও লাভ হবে না আর। ওর বিশ্বাসই হতে চায় না-এই কিছুদিন আগেও জিনার সাথে তার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এখন দু’জনার মাঝে গড়ে উঠেছে একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল।
জুলিয়াস যখন কলিনদের উঠানে পৌঁছল তখন সূর্য সবেমাত্র উঠেছে। ঘোড়া থেকে নামার আগেই কলিন বেরিয়ে এল। ওকে চিনতে পেরে সাদর সম্ভাষণ জানাল সে। আর একবার ভাল করে জুলিয়াসের দিকে চেয়েই উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কলিন, কি হয়েছে, জুলিয়াস? তোমার একি…
কথা শেষ না করেই ছুটে এগিয়ে এসে জুলিয়াসকে ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করল সে।
রাতটা দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে কেটেছে, শুকনো মুখে মন্তব্য করল জুলিয়াস।
তোমার এই অবস্থা কে করল?
মাডি লরিমার।
ঝাল লাগার ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে শব্দ করে বাতাস টানল কলিন। মাডি, না? ওতো একাই ছয়জনের সমান ভিতরে চলো, দেখি কি করা যায়।
ওরা আমার পিছনে ধাওয়া করে আসতে পারে।
মেডক?
সাথে আরও লোকজন থাকবে ওর।
মুখ তুলে রকিং এইচে যাবার পথের দিকে চাইল কলিম। ওর ঠোঁট দুটো একটা দৃঢ় সঙ্কল্পে পরস্পরের ওপর চেপে বসেছে। এটা আমার বাড়ি। আর কারও মাতব্বরি চলবে না এখানে ঢুকতে হলে আগে আমার সাথে বোঝাপড়া করতে হবে। মনে হয় না ওরা সে চেষ্টা করবে। চলো, ভিতরে যাই।
হিলডা বারান্দায় বেরিয়ে এল। ওদের একনজর দেখে নিয়েই ভিতরে জিনার উদ্দেশে কি যেন বলে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল। পরমুহূর্তেই জিনাকে দেখা গেল দরজায়। ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব ওর চোখে-মুখে।
ওকে জনের কামরায় নিয়ে যাই, চলো, বলল হিলডা।
কি যেন বলার জন্যে মুখ খুলল জিনা, কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে বলল না সে। সবার আগে আগে গিয়ে জনের কামরার দরজা খুলে বিছানা ঢাকা চাদরটা উঠিয়ে নিল জিনা। জুলিয়াসকে ধরে বিছানার ওপর বসিয়ে দিল কলিন।
আমি পানি গরম করতে যাচ্ছি, বলল হিলডা। কলিন, তুমি ওর মোজা আর কাপড়-জামা খুলে দাও-ধুতে হবে। ড্রয়ারে জনের ধোয়া কাপড় আছে, সেগুলোই আপাতত পরাও ওকে। তোমার জামা ওর গায়ে ছোট হবে।
ড্রয়ার থেকে কাপড় বের করে বিছানার ওপর রাখল জিনা। হাত কাঁপছে ওর। দুর্বল গলায় সে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছিল, জুলিয়াস?
পেপির সাথে দেখা করতে খামারে গেছিলাম-ফেরার পথে ওদের হাতে ধরা পড়ে যাই।
বাবার সাথে দেখা করতে চাওনি তুমি?
না।
জারভিস বলছিল তুমি বাবার সাথে দেখা করে সম্পত্তির ভাগ আদায় করার চেষ্টা করবে।
না, জিনা।
তাহলে পেপির সাথে দেখা করার কি দরকার ছিল তোমার?
এতক্ষণ জুলিয়াসের বুট খোলায় ব্যস্ত ছিল কলিন। সে এবার সোজা হয়ে দাড়াল, আর বকবক কোরো না, জিনা, এবার যাও। জুলিয়াসের কাপড় বদলাব আমি এখন।
ঠোঁট কামড়ে ধরে দরজার দিকে এগোল জিনা। বেরুবার মুখে হঠাৎ ঘুরে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা, রকিং এইচের লোক যদি জুলিয়াসের পিছনে ধাওয়া করে এসে এখানে হাজির হয়, তখন?
ওরা এলে ওদের আবার খালি হাতেই ফিরে যেতে হবে, রুক্ষ গলায় জবাব দিল কলিন। আর কোন কথা নয়, এবার যাও।
শরীরের সবখানেই কমবেশি কেটে-ছিলে গেছে জুলিয়াসের এ নিয়ে দুর্ভাবনা নেই তার, সে জানে সময়ে সবই সেরে যাবে-শুধু পাঁজরের ব্যথাটা নিয়েই চিন্তা। হয়তো পাজরের কোন হাড় ভেঙে থাকতে পারে। তাছাড়া হাতের গাটগুলো কেটে রক্ত জমে আড়ষ্ট হয়ে গেছে, কয়েক সপ্তাহেও তার হাত দুটো ঠিক হবে কিনা সন্দেহ। পশ্চিমের লোকেরা হাত ছাড়া নিতান্তই তাহার
যথাসাধ্য চেষ্টা করছে হিলডা। ক্ষত পরিষ্কার করে মলম লাগানো, পা গরম করে বাইক্লোরাইড ট্যাবলেট মিশিয়ে জুলিয়ানের হাত দুটো ভিজিয়ে রাখা-সবই করছে সে। জিনাও নীরবে সাহায্য করে যাচ্ছে। সব সময় ওর মুখ থাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আর শুকনো। এই জিনা আর জনের মৃত্যুর আগের জিনা যেন ভিন্ন মানুষ। জিনাকে ইদানীং প্রাণখুলে হাসতে দেখেনি জুলিয়াস।
পানিতে হাত দুটো ডুবিয়ে বসে আছে জুলিয়াস। বাইরে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা গেল। জিনা উঠে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে, ওরা এসে গেছে, বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
তুমি নিশ্চিন্ত মনে হাতের যত্ন নাও, বলল হিলডা। চিন্তার কিছু নেই, কলিনই ওদের সামলাবে।
ওরা কয়জন এসেছে? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
উঠে, জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল হিলডা। মেডক আর জারভিস। সাথে এডমন্ড ফিনলে, নকার, হোয়েল কিড আর হিউ হাপার। জানালাটা খুলেই দিচ্ছি। আমি।
খোলা জানালা দিয়ে ওদের কথাবার্তা, শোনা যাচ্ছে। মেডক বলছে, ‘…এই হলো অবস্থা, গেইল। জুলিয়াস রকিং এইচে এসে গোলমাল করুক এটা আমরা চাই না। বিশেষ করে সেবাস্টিন দত্তের যা শারীরিক অবস্থা তাতে এসব ঝামেলা না হওয়াই ভাল। তাই আমরা এসেছি জুলিয়াসকে ধরে নিয়ে জেলে আটকে রাখব।
সেটা আজ হবে না, জবাব দিল কলিন।
কেন হবে না?
জুলিয়াসের কোথাও যাবার মত অবস্থা এখন নেই। তোমার লোকই তো ওর এই দশা করেছে। তোমার আর ওর বিরুদ্ধে কোন নালিশ থাকা উচিত নয়। অনেক চোট পেয়েছে বেচারা।
মিথ্যে কথা! লোক দেখানো ভণিতা করছে ও। ওকে বের করে দাও, গেইল।
না।
নকার, হোয়েল-যাও ওকে ভিতর থেকে বের করে নিয়ে এসো।
হঠাৎ কলিনের স্বর রুক্ষ হয়ে উঠল। খবরদার, মেডক। এখানে মাতব্বরি করতে যেয়ো না। তোমাদের সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছি-কেউ আমার বাসায় ঢোকার চেষ্টা করলেই গুলি করব আমি।
এক মুহূর্ত নীরবে কাটল। জুলিয়াস ওখান থেকে ওদের দেখতে পাচ্ছে না বটে, কিন্তু ঘটনা পরিষ্কার আন্দাজ করতে পারছে। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কলিন। কোন রকম উত্তেজনার প্রকাশ নেই ওর চেহারায়। উত্তেজিত হওয়া ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। শান্ত পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল কলিন। এটা জানা কথা, মেডকের লোকজনের সাথে সে কখনোই পেরে উঠবে না, কিন্তু কেউ তাকে গুলি করলে পার্কের সবাই ক্ষেপে উঠবে। এই সাহসেই সে রুখে দাঁড়িয়েছে। ভেবেছিল এতেই কাজ হবে, কিন্তু তা হলো না।
তাহলৈ আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছ তুমি? রাগত স্বরে প্রশ্ন করল মেডক।
নিশ্চয়ই না, জবাব দিল কলিন। তুমি আবার কবে থেকে আইনের প্রতিনিধি হলে?
যে কোন লোকেরই গ্রেপ্তার করার অধিকার আছে।
আমার এলাকায় নয়। এখানে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তোমরা অনধিকার প্রবেশ করেছ এখানে।
আবার সবাই চুপ হয়ে গেল। মেডকের কয়েকটা অসহ্য মুহূর্ত কাটল। রাগে নিল ভাবে দাঁতে দাঁত ঘষে সে বলল, খোদার কসম, গেইল, তোমার, এই আচরণের কথা আমার মনে থাকবে।
একটু পরেই ঘোড়ায় চড়ে ওদের চলে যাবার শব্দ শুনল জুলিয়াস। জানালার ধার থেকে স্বামীর গরবে গর্বিতা একটা ভাব নিয়ে সরে এল হিলডা।
নিজের হাতের যত্ন নাও তুমি, আমি তোমার খাবার যোগাড় করছি।
কলিন দম্পতি সারাদিন বাসাতেই রইল। কি একটা কাজে কলিন কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে গেছিল। ফিরে এসে জানাল মেডকের দু’জন লোক এই বাড়ির আশপাশেই ঘুরঘুর করছে। ওদের লক্ষ্য করে গুলি করা উচিত ছিল আমার, রাগের সাথে বলল কলিন।
গুলি না করে ভালই করেছেন, মন্তব্য করল জুলিয়াস। এসবের মধ্যে আপনার জড়ানো ঠিক হবে না।
দুপুরের দিকে জিনা ঘোড়ায় চেপে বাইরে কোথাও গেল। দু’ঘণ্টা সে যে কোথায় ছিল জুলিয়াস তা জানে না। হয়তো ফিরে এসে সে তার বাপ-মাকে। বলেছে-কিন্তু জুলিয়াস তখন গভীর ঘুমে অচেতন। জিনার সাথে কথা বলার সুযোগই পাচ্ছে না জুলিয়াস। ইচ্ছা করেই যেন ওকে এড়িয়ে চলছে সে।
রাতে খাবার সময়ে বিছানা ছেড়ে উঠল জুলিয়াস। এতক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার। পর বেশ চাঙ্গা বোধ করছে সে। পাঁজরের ব্যথার জন্যে একটু খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছে তাকে, শরীরটাও একটু আড়ষ্ট। মুখটা এখনও ফুলে রয়েছে, তবু নিজেকে আর আগের মত দুর্বল ঠেকছে না। একটু অসুবিধা হলেও হাত দুটো এখন কিছুটা ব্যবহার করতে পারছে সে।
খেতে বসে প্রকাশ পেল জিনা দুপুরে কোথায় গেছিল। বিকেলের দিকে জারভিসের সাথে দেখা হয়েছে আমার, বলল সে।
কেউ কথা বলল না। অস্বস্তি ভরে নিজের প্লেটের দিকে চেয়ে বসে রইল জুলিয়াস। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে এবারে অপ্রিয় কোন প্রসঙ্গ তুলবে জিনা।
জারভিসের কাছে গতরাতের ঘটনা শুনলাম। বাবার কামরায় যাবার পথে ধরা পড়েছিল জুলিয়াস। ওর এই অবস্থার জন্যে সে নিজেই দায়ী, বাবার সাথে দেখা করার জিদ ধরে মারপিট না করলে মার খেতে না ও।
না, আসল ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন, প্রতিবাদ করল জুলিয়াস। পেপির সাথে দেখা করতে গেছিলাম আমি। ওর ঘর থেকে বেরিয়ে ফিরে আসার পথে আমাকে ধরে গোলাঘরে নিয়ে যায়, সেখানেই মাড়ির সাথে মারপিট করতে বাধ্য করেছিল ওরা।
তাহলে হয় জারভিস মিথ্যে কথা বলেছে, নয় তুমি।
হ্যাঁ, বোঝাই যাচ্ছে আমাদের দু’জনের একজন মিথ্যাবাদী। পেপির সাথে শহরে দেখা হলে ওর কাছেই জেনে নিয়ে আসল ঘটনা।
তাই করব।
একটু সামনে ঝুঁকে কলিন জিজ্ঞেস করল, আমার খামারে ওদের দুজন লোক কি করছে তা কিছু বলেছে জারভিস?
হ্যাঁ, সে বলল ওদের একজন হচ্ছে নকার, জুলিয়াসের সাথে তার পুরোনো বিবাদ আছে। ঝামেলা এড়াবার জন্য মেডক তাকে বরখাস্ত করেছে। এখন সে কি করছে না করছে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার।
আর অন্যজন?
সেটা জারভিসও জানে না।
বিষণ্ন মুখে মাথা নাড়ল কলিন। দুঃখ হয় ভাবতে যে বাইরে থেকে দেখে কেউ বলবে না আমরা একই পরিবারের মানুষ। বিপর্যয়ের মাঝে পরিবারের সদস্যরা একজোট হয়ে একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে-কিন্তু এই বাড়িতে তা হবার নয়। হিলডা আর আমি একজন বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি, কিন্তু জিনার সমর্থন আমরা পাইনি।
জিনার মুখটা লাল হয়ে উঠল। আমার অনুভূতিকে কি করে অস্বীকার করব আমি? প্রশ্ন করল সে।
চেষ্টাই করোনি তুমি!
করেছি। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে আমি যা জানি তা তোমরা জানো না। জারভিস আমাকে বলেছে বিপজ্জনক জেনেও জুলিয়াস ইচ্ছে করেই উস্কে জনকে উত্তেজিত করে ওই ঘোড়ায় চড়তে বাধ্য করেছিল।
কথাটা ঠিক নয়, জিনা। সবাই জানে ঘোড়া বশ করায় জন আমার চেয়েও বেশি দক্ষ ছিল। আমি দু’বার চেষ্টা করেও পারলাম না দেখে সে নিজেই এগিয়ে এসেছি। বন্য ঘোড়া বশ করার আছে একটা নেশা, উত্তেজনা, আনন্দ আর সব শেষে আছে তৃপ্তি। একটা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে জয়ী হবার আনন্দ পেতে চেয়েছিল জন। কিন্তু তাতে যে, এমন মর্মান্তিক একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে তা আমরা কেউই আশা করিনি।
ঘটনা, অন্য রকম ঘটেছিল বলে শুনেছি আমি। জন চায়নি, তুমিই ওকে উস্কে দিয়ে ওই ঘোড়ায় চড়তে রাজি করিয়েছিলে।
হতাশ ভাবে মাথা নাড়ল জুলিয়াস। ওকে চেনো না তুমি? ধরতে গেলে ঘোড়া চরিয়েই বড় হয়েছে জন। ঘোড়া বশে আনতে পার্কের সেরা লোকদের একজন ছিল সে।
আমি জানি আমার ছেলে দুর্ঘটনার শিকার হয়েই মারা গেছে, বলে উঠল কলিন। বুনো ঘোড়া বশ করে সে যে কত আনন্দ পেত তা অজানা নয় আমার। ঠ্যাটা ঘোড়াটাই ওর জিদ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ঘাড় কাত করে বাঁকা চোখে বাবার দিকে চাইল জিনা। জারভিস বলেছে-আচ্ছা ঘাড় বিকৃত করায় ওর কি স্বার্থ?
নিজের ভাই সম্বন্ধে এমন কথা কি ধরনের মানুষ মুখে আনতে পারে বোঝো না? শাসনের সুরে প্রশ্ন করল কলিন।
এ কথার কোন জবাব দিতে পারল না জিনা হঠাৎ একেবারে চুপসে গিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে থরথর করে কাঁপতে লাগল মেয়েটা। অস্বস্তিকর নীরবতা ভঙ্গ করার মত কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে ন জুলিয়াস। হাত বাড়িয়ে জিনাকে ছুঁয়ে সান্ত্বনা দিতে বড় ইচ্ছে করছে, কিন্তু আবার ভয় হচ্ছে হয়তো ঘৃণায় কুঁকড়ে সারে যাবে ও। হিলড়ার দিকে চাইল জুলিয়াস।
গরম পানিতে আবার হাত ভিজানোর সময় হয়েছে, বলে উঠে দাঁড়াল হিলডা। জিনা, তুমি গামলাটা বার করো, আমি টেবিল পরিষ্কার করছি।
রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটল। বাইরের লোক দুটো এখনও আছে। রাতের বেলা আস্তাবলের কাছেই একটা আস্তানা করে কাটিয়েছে ওরা। সম্ভবত ঘোড়ার ওপর নজর রাখার জন্যেই। সকাল হতেই আবার সরে গেছে। দূর থেকেই নজর রেখেছে এই বাড়ির ওপর। সারাটা দিন বাড়ির আশপাশেই কাজ করে কাটাল কলিন। জিনাও সাথে থেকে সাহায্য করল তাকে। গত রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছে, আর আজ সকালেও জুলিয়াসকে কথা বলার কোন সুযোগ দেয়নি মেয়েটা।
দুপুরে নডি এল। কলিনের অনুরোধে ওদের সাথে খাওয়া দাওয়া করল সে। মেডকের লোক ‘দু’জন ওকে আসতে দেখেছে, বাধা দেয়নি। বোঝাই যাচ্ছে, জুলিয়াসের জন্যেই অপেক্ষা করছে ওরা।
খেতে বসে ঠাট্টা করে নডি বলল, আমি দেখতে এসেছি কেউ যেন আমার কাজের মানুষটাকে ভাগিয়ে না নেয়। জুলিয়াসের সাথে মারামারির খবরটা ক্রেস্টলাইনের সবাইকে শোনানো হয়েছে।
কি রকম রং চড়ানো হয়েছে শুনি?
শোনা যাচ্ছে মাডিকে নাকি সেবাস্টিন দত্তের দেখাশোনা করার ভার দেয়া হয়েছিল। তুমি ওঁর সাথে দেখা করার জন্যে জিদ ধরায় তোমাকে মেরে পিস্তল কেড়ে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঘোড়াটা হাটতে হাটতে এখানে এসে হাজির হয়।
শেরিফ তো ঘটনা শুনে তোমাকে হাজতে ভরার জন্যে তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু মেডকই ওকে ঠেকাল। বলল তোমার নাকি যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।
খাওয়ার টেবিলে বসেই জুলিয়াসের কাছ থেকে রকিং এইচের আর কলিনের কাছ থেকে তার পরের সব ঘটনার বিবরণ শুনল নডি। দু’জন লোক এখনও এই খামার বাড়ির বাইরে পাহারায় আছে সেকথাও জানাল কলিন। এখন অবশ্য চিন্তা নেই, কিন্তু জুলিয়াস এখান থেকে যাবার পথে কি ঘটবে বলা মুশকিল।
কিছু একটা উপায় বের করে ফেলব, বলল নডি।
এর মধ্যে জড়াবার কোন দরকার নেই তোমার আপত্তি জানাল জুলিয়াস। মারিয়া আর ছেলেমেয়েদের কাছেই তোমার এখন থাকা উচিত।
ফেরার তাড়া নেই আমার। জিনার দিকে ইচ্ছে করেই চাইছে না জুলিয়াস। গতকাল সে জারভিসের সাথে দেখা করতে গেছিল, হয়তো আজও যাবে। মন চাইলেও ওকে বিশ্বাস করতে পারছে না জুলিয়াস।
তোমার হাত দুটো এক সপ্তাহের আগে ঠিক হবে বলে মনে হয় না। মন্তব্য করল নডি।
বেশিও লাগতে পারে বলে উঠল কলিন। কিন্তু কোন অসুবিধা নেই, জুলিয়াস যতদিন খুশি থাকতে পারে এখানে।
কৃতজ্ঞতা ভরে মাথা আঁকাল জুলিয়াস। এক সপ্তাহের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে আশা করছি।
বিশেষ করে জিনাকে শোনানোর জন্যেই কথাটা বলল সে। কিন্তু খাওয়া শেষ হতেই নডির সাথে গোপনে কিছুক্ষণ আলাপ করল জুলিয়াস। এক সপ্তাহ কিছুতেই বসে, থাকবে না, আজ রাতেই সে বেরিয়ে পড়বে। কতদিন আর কলিন বাড়ি বসে থাকবে ওর জন্যে? খামারের লোকদের বাড়ি বসে থাকলে কাজ চলে না, এটা বোঝে জুলিয়াস।
বিকেলের দিকে নডি বিদায় নিল। অল্প পরেই জিনাও বেরুল। সে যে কোথায় যাচ্ছে তা আন্দাজ করে নিল জুলিয়াস। মনটা ওর বিষাদে ছেয়ে গেল। কেন এমন হয়? নিষ্ফল আক্রোশে ওর দেয়ালে ঘুসি মারতে ইচ্ছে করছে। জিনার কথা আর ভাববে না জুলিয়াস।
রাতে খেতে বসার আগেই এক ফাঁকে কলিনকে তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে রাখল জুলিয়াস। বাকি দুজন এ ব্যাপারে কিছুই জানল না। জিনা ফিরেছে, কিন্তু আজ কোথায় গেছিল এ সম্বন্ধে সে আর কাউকে কিছু বলল না। খাওয়া সেরে বেশ জলদিই ঘুমাতে গেল সবাই।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাড়িটা নিঝুম হয়ে গেল। অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে প্রহর গুনছে জুলিয়াস। নডির সাথে যুক্তি করে একটা সহজ পন্থা বেছে নিয়েছে সে। শহরে গিয়ে অন্ধকার হবার সাথে সাথে একটা বাড়তি ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসবে নড়ি। ঘোড়া নিয়ে কলিনের খামার থেকে মাইল তিনেক দক্ষিণে নদীর ধারে অপেক্ষা করবে। দূরত্ব নিয়ে ভাবছে না জুলিয়াস, তার আসল কঠিন কাজটা হবে পাহারায় যে দু’জন আছে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানো। তবে জুলিয়াস আশা করছে কাজটা তার পক্ষে খুব শক্ত হবে না, কারণ ওরা কলিনের আস্তাবলের ওপরই চোখ রাখবে। জুলিয়াস যে পায়ে হেঁটে পালাতে পারে এটা ওদের মাথায় চট করে খেলবে না।
কলিন একটা পিস্তল দিয়েছে-অন্ধকারে বসেই সেটা একবার পরীক্ষা করে দেখে নিল জুলিয়াস হাতের বর্তমান অবস্থায় সে পিস্তলটা ঠিকমত ব্যবহার করতে পারবে কিনা সন্দেহ, তবু ওটা সাথে থাকলে সাহস অনেকটা বাড়ে। নিঃশব্দে উঠে দরজার কাছে গেল জুলিয়াস। খোলার সময়ে সামান্য শব্দ হলো দরজায়। একটু অপেক্ষা করে আবার এগিয়ে গেল সে। কিন্তু পর মুহূর্তেই একটা খসখস শব্দ শুনে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে দাড়িয়ে পড়ল। কে যেন অন্ধকার থেকে ফিসফিস করে ডাকল, ‘জুলিয়াস?’
জিনার গলা চিনতে পেরে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, কি?
ওর দিকে এগিয়ে এল জিনা। অন্ধকারে আবছা ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে ওকে। তুমি চলে যাচ্ছ? কোথায়? বাইরে ওই দুজন রয়েছে না? একসাথে একগাদা প্রশ্ন করে বসল সে।
ওরা আস্তাবলের দিকে নজর রেখেছে, জবাব দিল জুলিয়াস। আমি হেঁটেই যাচ্ছি, নডি ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।
মুখ দেখা না গেলেও বিরক্তিতে বিকৃত ওর চেহারাটা আঁচ করতে পারছে জুলিয়াস।
আমাকে বলতে পারতে তুমি? বুঝেছি, রিশ্বাস কোরো না। তোমার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম-পাইনি। যাক, এখন কোথায় যাচ্ছ? নাকি তাও বলা যাবে না?
নিজেই জানি না কোথায় যাব!
পার্কেই থাকছ?
হ্যাঁ।
কি দরকার?
দরকার আছে, জিনা।
হঠাৎ রাগ প্রকাশ পেল ওর গলায়। এখানে থেকে ওদের সাথে বোঝাপড়া করতে চাও। তোমার অংশ আদায়ের চেষ্টা করবে তুমি! জারভিস ঠিকই বলেছিল।
না, জিনা। আমাকে ভুল বুঝছ তুমি।
এছাড়া এখানে থাকার আর কি কারণ থাকতে পারে? নাহ্, অনেক বদলে গেছ তুমি।
তুমিও আর সেই আগের মত নেই।
নীরবে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। জুলিয়াসের মনে হচ্ছে যেন এই মাত্র ওদের শেষ কথা বলা হয়ে গেল। কিছুই বাকি রইল না। মুখের ভিতরটা বিস্বাদ ঠেকছে। পেপি বলেছিল ছেলেবেলাটাই ভাল ছিল। কথাটা এখন সমর্থন করতে ইচ্ছে করছে ওর। এখন বুঝতে পারছে পেপি ঠিক কি রোঝাতে চেয়েছিল।
নড়ে উঠে দরজার দিকে ফিরল জুলিয়াস। এবার যাবার সময় হলো, জিনা।
বেশ, যাও।
আবেগহীন একটা উক্তি। সামান্য মমতার আভাস থাকলেও মনে মনে আশা করতে পারত জুলিয়াস। ওর শেষ কথা যেন জানিয়ে দিল জিনা।
বাইরে বেরিয়ে এল জুলিয়াস।
১১. বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে
বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নকার আর তার সঙ্গীর অজান্তেই নদীর ধারে নডির সাথে মিলিত হলো জুলিয়াস। শহরে পৌঁছে নডিকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানিয়ে লোলার খোঁজে রেস্টুরেন্টে ঢুকল সে।
রাত হয়েছে। রেস্টুরেন্টের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার জন্যে তৈরি হচ্ছিল লেলা এত রাতে জুলিয়াসকে দেখে অবাক হয়ে ওকে ভিতরে নিয়ে গেল সে। ভিতরে বসে পেপির সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে ক্রেস্টলাইনে পৌঁছা’ অবধি আদ্যপান্ত সব কথাই জুলিয়াসের মুখে শুনল। বিবরণ শেষ করে সে বলল, আরও বলতে গেলে তুমিই আমার ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি জেনে ফেলবে!
আমি তো তা-ই চাই, হেসে জবাব দিল লোলা। এবারে পেপির কথা কিছু শোনাও।
তাই করল জুলিয়াস। দুজনে মিলে পেপিকে নিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনা করল। জুলিয়াসের ধারণা সব কিছুর মূল চাবিকাঠিই পেপির হাতে। লোলারও একই মত, কিন্তু এখন যে কি করা দরকার তার কোন ভাল বুদ্ধি সে যোগাতে পারল না।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পেপির কতদিন লাগবে?
জানি না। তবে ওরা তাড়াহুড়ো করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। বিয়েটা হয়ে গেলেই মেডকের সবচেয়ে বড় বাধাটা সরে যাবে। তখন বাবার মরার অপেক্ষায়। থাকবে ওরা এরপরে আসবে জারভিসের পালা।
আমার মনে হয় তুমি বাবার সাথে দেখা করতে পারলে ভাল হত।
সুযোগ পাইনি-তবে হয়তো এটাই ভাল হয়েছে। পেপি বলছিল বাবার শরীর খুব দুর্বল। তবে সে এটাও বলেছে যে বাবা আশা ছাড়েননি। একদিন তিনি আবার ভাল হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠবেন বলেই তার দৃঢ় বিশ্বাস।
ডাক্তার কি বলে? তার কি ভাল হবার কোন আশা নেই?
সম্ভাবনা কম। তবে বাবা একটু ওইরকমই-চিরদিনই উনি একটু একগুয়ে। মৃত্যুর ব্যাপারেও তিনি শেষ পর্যন্ত যুঝবেন, সন্দেহ নেই।
হাসল লোলা। ওঁর মত মানুষেরা এইরকমই। একদিন না একদিন মৃত্যু হবেই, কিন্তু মরেও তারা অন্যের মনের সাহস হয়ে বেঁচে থাকেন তবু এসবের মাঝে তোমার স্থান কোথায়, জুলিয়াস? তুমি কিসের জন্যে লড়ছ?
জুলিয়াস তার মনের অনুভূতি কথায় প্রকাশ করার চেষ্টা করল সম্পত্তির অংশের লোভে লড়ছি না আমি। বাবা যদি আমাকে বঞ্চিত করতে চান প্রতিবাদ আমি করব না। কিন্তু তাই বলে অতীতকেও ভুলতে পারব না। বাবা, পেপি, জারভিস ওদের সবাইকে নিয়েই আমাদের পরিবার, ওরাই আমার আপনজন। ওদের বিপদ মানেই আমার বিপদ। মেডক লোকটা সবকিছু গ্রাস করার মতলবে আছে-কিন্তু এত সহজে আমি তা হতে দেব না।
কিন্ত পেপি যদি এডকে বিয়ে করে?
ওর মাথা ঠাণ্ডা থাকলে তা করবে না।
এত নিশ্চিত হয়ো না, জুলিয়াস, প্রেম বড় সাংঘাতিক। কেউ নিজের ইচ্ছা মত চালাতে পারে না মন। অনেক সময়েই যুক্তি বা বুদ্ধি মেনে চলে না প্রেম। এর জন্যে অনেক দুঃখ-কষ্টই হাসি মুখে সহ্য করে মানুষ। না, হেসো না তুমি। আমি জানি বলেই বলছি।
গুরুগম্ভীর আলোচনা অনেকক্ষণ চলেছে। এবারে হাসতে হাসতেই আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে জুলিয়াস বলল, দেখো, মোটেও হাসছি, না আমি।
হেসে ফেলল লোলাও। ঠিক আছে, মুখ যখন আছে যতখুশি হাসো। কিন্তু আজ রাতে কোথায় থাকবে ঠিক করেছ কিছু?
না।
কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে চাও?
পারলে সেটাই সবচেয়ে ভাল হত। পেপি কয়েকদিন একটু ভেবে দেখার সুযোগ পেত। ওর সাথে আবার দেখা করব। সপ্তাহখানেক লুকিয়ে থাকতে পারলে আমার হাত দুটোও সেরে যেত।
আমাদের ওখানে থাকলে কেমন হয়? বাবা মারা যাওয়ার আগে আমরা যে খামারে ছিলাম ওটা তো খালিই পড়ে আছে। যে লোকটা ওটা ভাড়া নিয়েছিল, চালাতে পারেনি বলে ছেড়ে দিয়েছে।
জায়গাটা রকিং এইচ থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের মধ্যে। এক সপ্তাহের মধ্যে জুলিয়াসকে ওখানে খুঁজতে যাবে না কেউ। জুলিয়াসের জন্যে সবদিক দিয়েই জায়গাটা চমৎকার।
খাওয়ার কি ব্যবস্থা হবে?
আগামীকাল রাতে আমি খাবার পৌঁছে দিতে পারি।
আমার জন্যে রাধাৰাড়া করবে কে? দুষ্টুমির হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস। আমার দেখাশোনা?
লোলার চোখ-মুখ, হেসে উঠল। ভেবেছ পারব না? তবে সে-সময় এখনও আসেনি। হেভি ইঞ্জিন আমি, একবার চালু হলে সহজে থামতে পারি না।
চিন্তার বিষয়।
অবশ্যই! সে যাক, আমাদের খামার বাড়িতে থাকতে চাইলে এখনই রওনা হয়ে যাও। তোমার সাথে নেয়ার জন্যে কিছু খাবার বেঁধে দিচ্ছি।
এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে জুলিয়াসের হাতে একটা পোঁটলা ধরিয়ে দিল লোলা। কাল রাতে তোমার জন্যে এক সপ্তাহের বাজার করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসব।
ঠিক আছে-কাল আবার দেখা হবে। বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেল জুলিয়াস।
পার্কের একেবারে পুব সীমানায় লোলাদের র্যাঞ্চ। ঘরগুলো এখনও ভালই আছে। কিছু আসবাবপত্রও রয়েছে ভিতরে। বিছানাগুলো বেশ নরম। ঘোড়াটাকে আস্তাবলে রেখে ঘরে এসে কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ল জুলিয়াস। পরদিন বিকেল পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটল ওর। ঘোড়ার যত্ন সেরে ঘরদোর হাঁড়ি পাতিল ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলল সে। এত কাজ করে খিদে পেয়ে গেছে তার, কিন্তু উপায় নেই, খাবার যা সাথে দিয়েছিল লোলা তা এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। এখন লোলার পথ চেয়ে বসে থাকতে হবে।
একা একা চিন্তা করার প্রচুর অবকাশ আর সুযোগ আজ পেয়েছে জুলিয়াস। বিভিন্ন ধরনের চিন্তা আসছে ওর মাথায়। কিন্তু কেন যেন ঘুরেফিরে বারবার লোলার কথাই মনে আসছে। ওর সঙ্গ পাবার জন্যে জুলিয়াসের মনটা উদ্গ্রীব হয়ে আছে। সে কি নিজের অজান্তেই মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছে? অবশ্য ওদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক সবসময়ই ছিল। যখনই শহরে গেছে, লোলার সাথে অবশ্যই দেখা করেছে। এতদিন লোলাকে নিছক বন্ধু বলেই ভাবত সে। কিন্তু এখন নিঃসন্দেহে বুঝেছে মেয়েটা ভালবাসে তাকে।
সন্ধ্যার দিকে দূর থেকে লোলাকে আসতে দেখে বাইরে এসে দাঁড়াল জুলিয়াস। ঘোড়া থেকে নামতে নামতে হাসি মুখে জুলিয়াসের দিকে চেয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কি, খিদে পেয়েছে?
মনে হচ্ছে একটা আস্ত খাসি খেয়ে ফেলতে পারব আমি!
ঠিক আছে, আমি ভিতরে গিয়ে তোমার খাবার তৈরি করছি, তুমি আমার ঘোড়া সামলাও। জিন নামিয়ো না, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না আমি।
কেন, এত তাড়া কিসের?
পারলে সারারাতই তোমার সাথে কাটাতাম কিন্তু এখন তোমার খুব সাবধান থাকা উচিত। হয়তো সে সুযোগ একদিন আসবে-নাও, ঘোড়াটা ধরো।
জুলিয়াস এগিয়ে গেল ওর দিকে। লোলা…
হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে পিছিয়ে গেল লোলা। না, জুলিয়াস। আগে খাওয়া তারপরে অন্য চিন্তা।
থলে ভরে বাজার করে এনেছে লোলা। সেগুলো ঘরে পৌঁছে দিয়ে ঘোড়াটাকে আস্তাবলে নিয়ে গেল জুলিয়াস। ফিরে এসে দেখল খাবার তৈরি করতে লেগে গেছে মেয়েটা।
তোমার কোন সাহায্যের দরকার আছে? দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস।
না, এখন আর কিছু করতে হবে না। তুমি বরং ততক্ষণে শেভ সেরে নাও। ক্ষুরটা দেখো টেবিলের ওপরই রেখেছি।
টেবিলের ওপর ওটা দেখতে পেল জুলিয়াস। কোন কোন মেয়ে কিন্তু ছেলেদের দাড়ি-গোঁফ পছন্দ করে।
আমি অন্য দলে।
ঠিক আছে, তাহলে শেভটা করতেই হয়
প্রদীপের আলোয় বসে ওরা রাতের খাবার খেলো। রান্নাটা বড় সুস্বাদু হয়েছে। টুকিটাকি হালকা কথাবার্তার মাঝেই খাওয়া শেষ হলো। বাতি নিভিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। সুন্দর ঝিরঝির হাওয়া বইছে।
এসো, বাইরে কিছুক্ষণ বসা যাক, বলল জুলিয়াস।
বেশিক্ষণ দেরি করতে পারব না আমি। মাকে একা ফেলে এসেছি, তাছাড়া কাল সকালেই আছে রেস্টুরেন্টের কাজ। আমাকে এখনই ফিরতে হবে।
এখনই যেয়ো না, কিছুক্ষণ থাকো।
তা হয় না, জুলিয়াস। সহজ সরল মানুষ আমি-যা ভাবি তাই বলি। তুমি বলেছিলে আমার মনের মানুষকে পেতে হলে আমাকে চেষ্টা করতে হবে-চেষ্টা আমি করেছি। এখন থাকলে নিজেকে সামলাতে পারব না বলেই থাকার সাহস পাচ্ছি না। তবে যাওয়ার আগে একটু স্মৃতি রেখে যাচ্ছি। জুলিয়াসের আলিঙ্গনে ধরা দিল লোলা। সেদিন রেস্টুরেন্টে চমকে উঠেছিল সে, কিন্তু আজ সে মনে মনে প্রস্তুত। ওর নরম ভিজে ঠোঁট জোড়ায় চুমু খেলো জুলিয়াস। ওকে যেতে দিতে আর মন সরছে না।
লোলা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই ফিসফিস করে জুলিয়াস বলে উঠল, প্লীজ, থাকো।
যেতেই হবে, জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিল লোলা।
আস্তাবল থেকে ঘোড়া বের করে আনল জুলিয়াস। নীরবেই ঘোড়ায় উঠে বসল লোলা।
তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে মন চাইছে, কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। আবার আসবে তো তুমি?
না, জুলিয়াস।
কেন?
তুমিও আমাকে চাও কিনা সেটা তোমার নিজের ভাল করে বুঝে দেখার জন্যে কিছু সময় দরকার।
জুলিয়াস হাত বাড়াল, লোলা… কিন্তু আর অপেক্ষা করল না লোলা, ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হলো। মিনিটখানেক পরে ঘোড়ার খুরের শব্দও মিলিয়ে গেল।
১২. জুলিয়াস পালিয়ে গেছে
ওদের চোখে ধুলো দিয়ে জুলিয়াস পালিয়ে গেছে, এই খবর নিয়ে ভগ্নদূত হয়ে মেডকের সামনে এসে দাঁড়াল নকার। জানাল, কেবল দু’জনের পক্ষে জুলিয়াসকে পাহারা দিয়ে আটকে রাখা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না।
তাহলে দোষটা সম্পূর্ণ তোমার, এডের দিকে ফিরে মন্তব্য করল মেউক।
আমি আবার কি করলাম? নিরীহ ভাল মানুষের মত প্রশ্ন করল এড।
জুলিয়াসকে আমরা এখানে হাতের মুঠোয় পেয়েছিলাম। তুমিই ছেড়ে দিয়েছ।
কাঁধ ঝাঁকাল এড। এখনও বলি ঠিকই করেছি আমি। জুলিয়াসকে এখানে হত্যা করলে খুব খারাপ দেখাত। কিন্তু এ নিয়ে তুমি এত চিন্তা করছ কেন বুঝি না। রুখে দাঁড়াবার মত শক্তি এখন আর ওর নেই, তাছাড়া সেবাস্টিন দত্ত তো ত্যাজ্যই করেছেন ওকে।
ঘরের মধ্যে উত্তেজিত ভাবে পায়চারি করছে মেডক। সে জানে এড যা বলছে কথাগুলো খুব সত্যি। কিন্তু জুলিয়াস আপাতত ওর কোন ক্ষতি করতে না। পারলেও পরবর্তীতে অনেক ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। পার্কে জুলিয়াস বেশ জনপ্রিয়-ডেনভারের ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দিয়েও সেটা ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি মেডক।
কাল সকালেই শহরে যাচ্ছ তুমি, নকার, হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে বলে উঠল মেডক। শেরিফকে বলেছি তোমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছি আমি। তুমিও সবাইকে জানাবে এখানে আর কাজ করছ না তুমি।
তারপর?
ওকে খতম করাই হবে তোমার কাজ। সম্ভবত নডি কোলম্যানের ওখানেই আবার ফিরে গেছে জুলিয়াস। কিন্তু সে যাই হোক, শিগগিরই একদিন শহরে আসতেই হবে ওকে।
আমার টাকার কি হবে?
কাজ শেষ হলেই টাকা পাবে তুমি। যাও এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও। তুমি না; এড-তোমার সাথে কথা আছে আমার।
সবাই বেরিয়ে যেতেই দরজায় খিল এটে তাতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল এড। দুশ্চিন্তার বিন্দুমাত্র ছায়া নেই ওর মুখে। অবশ্য কেউই ওকে বিব্রত হতে কোনদিন দেখেনি।
তোমাদের খবর কি? প্রশ্ন করল মেডক।
ভাল।
চোখ ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেডক চেয়ে রইল এডের দিকে। আজ সকালেই পেপিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কবে বিয়ে করছ তোমরা-জবাব না দিয়ে আমতা আমতা করল সে।
দিন এখনও ঠিক করিনি।
তবে ঠিক করে নাও, আদেশ করল মেডক।
এডের গলায় একটু ঝাঁঝ প্রকাশ পেল। আমাকে গরু-ছাগলের মত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবার চেষ্টা কোরো না। সেটা পছন্দ করি না আমি। পেপিকে বিয়ে করব, ওর সম্পত্তিও নেব, কিন্তু কাজটা আমি নিজের মত করেই শেষ করতে চাই।
যাই করো, জলদি করো। যাও, তুমিও দূর হও এবার।
দাঁত বের করে অবজ্ঞার হাসি হেসে এড জবাব দিল, সানন্দেই যাচ্ছি।
এড বেরিয়ে যেতেই আবার পায়চারি শুরু করল মেডক। এডকে নিয়ে চিন্তায় পড়েছে সে। জুলিয়াস আর এড দুজনে একই সাথে রকিং এইচে পৌঁছেছিল-কথাটা ভোলেনি মেডক। সেদিন রাতেও এই ওকে ছেড়ে দিয়েছিল। অবশ্য একটা যুক্তিসঙ্গত কারণই দেখিয়েছে সে, তবু ব্যাপারটা মেডকের পছন্দ হয়নি। নজর রাখতে হবে লোকটার ওপর।
সেবাস্টিন দত্তের কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে বাতি জ্বালাল মেডক।
সেবাস্টিন চোখ বুজে পড়ে আছেন বিছানায়।
এই যে বুড়া মিয়া, ওঠো, কথা আছে, বলল মেডক।
সেবাস্টিন দত্তের কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। চোখ বুজেই শুয়ে রইলেন তিনি।
বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে ঠেলা দিল মেডক। কই শুনছ? ওঠো।
চোখ মেললেন সেবাস্টিন। আবার জ্বালাতে এসেছ তুমি?
কেন, আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে না? মরলেই তো পারো, সবারই হাড় জুড়ায়!
তোমাকে না মেরে মরব না আমি।
খ্যাকখাক করে হেসে উঠল মেডক। সেবাস্টিন দত্তের মৃত্যু ঘটলে এই ধরনের আনন্দটা হারাবে সে। সুখবর আছে, তোমার মেয়ে আমার এক কর্মচারীকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।
আমার ছেলে কোথায়?
মেস ঘরে পোকার খেলে টাকা হারছে।
অন্য ছেলের কথা জিজ্ঞেস করছি।
আর ছেলে কই তোমার? জুলিয়াসের কথা জিজ্ঞেস করছ? বেচারা মারা গেছে।
মাথা নাড়লেন সেবাস্টিন দত্ত। না, সে মারা গেলে ফলাও করে সেই খবরটা তুমি আমাকে আগেই শোনাতে।
একটু চটে উঠল মেডক। তোমার আর বেশিদিন নেই, জিন্দা লাশ তুমি। পেপি আর এডের বিয়েটা হয়ে গেলেই সাজানো দুর্ঘটনায় মারা পড়বে জারভিস। তারপর তোমার পালা।
চোখ বুজলেন সেবাস্টিন দত্ত।
কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল মেডক আরও কয়টা দিন টিকে থাকো, বুড়া মিয়া। তোমার জন্যে এক টুকরো বিয়ের কেক পাঠিয়ে দেব আমি।
হাসতে হাসতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পাষণ্ড মেডক।
পরের পাঁচটা দিন একা একাই লোলাদের র্যাঞ্চে কাটাল জুলিয়াস। খরগোস শিকার করে টাটকা মাংস খেয়েছে, সিমেরন পাহাড়ে ঘুরে ফিরে সময় কাটিয়েছে। সে। বাড়িটার ধারে কাছেই গোটা সাতেক বিষাক্ত র্যাটল স্নেক মেরেছে। এর মধ্যে আর কেউ র্যাঞ্চের ত্রিসীমানাতেও আসেনি। ওর মুখের ফোলা ভাবটা চলে গেছে। পাজরের ব্যথাটাও নেই বললেই চলে, হাতের অবস্থাও অনেক ভাল এখন।
ছয় দিনের দিন দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে বিকেল বেলা নডি কোলম্যানের খামারে পৌঁছল জুলিয়াস। নডি বাড়িতে ছিল না-মারিয়া আর বাচ্চারা জুলিয়াসকে পেয়ে খুব খুশি।
আমরা তোমার জন্যে দুশ্চিন্তায় ছিলাম, বলল মারিয়া। অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য মানুষের কাছে খবর পেয়েছি তুমি নিরাপদেই আছ। এখানে আসার পথে কাউকে দেখলে?
কই, না তো?
তাহলে হয়তো সে চলে গেছে।
কে?
নকার। গত দুইদিন সে আশপাশের এলাকা চষে ফেলেছে। দূর থেকে নডি ওকে কয়েকবার দেখেছে, কিন্তু কাছে ভেড়েনি।
কয়েক মিনিট পরেই নডি ফিরে এল। কি, আবার কাজে লাগার জন্যে তৈরি তো?
না, আরও কয়েকটা দিন যাক, জবাব দিল জুলিয়াস।
আমি জানতাম তুমি ওই কথাই বলবে।
রাতের খাবার তৈরি হতে আরও আধঘণ্টা দেরি আছে জেনে নডি আর জুলিয়াস ঘোড়া দেখাশোনার কাজ সারতে আস্তাবলে ঢুকল।
কাল সকালে আমাকে একটা ঘোড়া ধার দিতে হবে, বলল জুলিয়াস। লোলার ঘোড়ায় চড়ে আমার শহরে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
তোমার যেটা পছন্দ বেছে নিয়ে, কিন্তু আমার মতে তোমার আদৌ শহরে যাওয়া ঠিক হবে না।
কেন?
শুনলাম নকারকে রকিং এইচ থেকে বের করে দিয়েছে মেডক। এখানেও তোমাকে খুঁজতে এসেছিল সে। এখনও শহরেই আছে লোকটা।
চিন্তিত ভাবে মাথা নাড়ল জুলিয়াস। বলল, নডি, ওর সাথে মোকাবিলা করার কোন ইচ্ছা নেই আমার। কিন্তু তাই বলে সারা জীবন ওর ভয়ে আমাকে লুকিয়ে চুরিয়ে চলতে হবে, এরও কোন মানে হয় না। আমার মত আমি চলব, যদি ওর সাথে দেখা হয়ে যায়, হবে।
শুনেছি লোকটা খুব ক্ষিপ্র।
সব বন্দুকবাজই নিজেকে সেরা ওস্তাদ বলে মনে করে। সে যাক, লোলার সাথে দেখা হয়েছে তোমার?
হয়েছে, ভালই আছে সে!
রকিং এইচের খবর কি?
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেবাস্টিন দত্ত এখনও স্রেফ মনের জোরেই টিকে আছেন। পেপি আর এডের বিয়ের একটা খবর শোনা যাচ্ছে-কেউই ব্যাপারটা পছন্দ করছে না।
জারভিসের কি সমাচার?
আগের মতই।
চমকে দেয়ার মত নতুন কিছুই ঘটেনি। বাড়ির ভিতরে যেতে যেতে জুলিয়াস বলল, আগামীকাল খুব ভোরে রওনা হব আমি-সকালে ঝামেলার সম্ভাবনা কম থাকবে।
আগামীকাল আমারও শহরে যাওয়া দরকার, বলল নড়ি।
হেসে মাথা নেড়ে জুলিয়াস জবাব দিল, না, তোমার কালকে শহরে যাবার কোন দরকার নেই। মারিয়াকেও আমি তাই জানার। গতবার আমার জন্যে ফাঁদ পাতা হয়েছিল, কালকে আমি শহরে যাব একথা কেউ জানে না। সত্যিই যদি আমার সাহায্যের দরকার হয় তাহলে আমি নিজেই বলব।
পরদিন ভোর না হতেই রওনা হয়ে সকাল ন’টায় জুলিয়াস পৌঁছে গেল ক্রেস্টলাইনে। সোজা রেস্টুরেন্টের সামনে ঘোড়া বেঁধে রেখে ভিতরে ঢুকল সে। দরজার সাথে লাগানো ছোট্ট ঘণ্টিটা ‘টিং’ করে বেজে উঠল। সকালের নাস্তা এরমধ্যেই সবাই সেরে নিয়েছে-কোন লোক নেই রেস্টুরেন্টে।
ঘণ্টির শব্দে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল লোলা। জুলিয়াসকে দেখেই থমকে দাঁড়াল সে-গাল দুটো সামান্য আরক্ত হলো তার।
সুপ্রভাত, লোলা, হাসিমুখে বলল জুলিয়াস।
মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল লোলা। ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, সুপ্রভাত, জুলিয়াস। কফি না নাস্তা?
ব্যস? বলার আর কিছু খুঁজে পেলে না? কৃত্রিম আহত সুরে বলে উঠল জুলিয়াস। তোমাকে এখন জড়িয়ে ধরে চুমু খেলে কি করবে?
প্রতিবাদ স্পষ্ট হয়ে উঠল লোলার চোখে। কিন্তু হাসতে হাসতেই বলল, ভাল হবে না বলছি! আমি চিৎকার করলে ফুটন্ত পানির প্যান হাতে মা বেরিয়ে আসবেন রান্নাঘর থেকে। একবার ঘটেছিল তাই। যাক, তোমার জন্যে একটা খবর আছে।
কি খবর?
পেপি তোমাকে দেখা করতে বলেছে। অ্যাডালামের গুহা চেনো?
গুহাটা রকিং এইচের উত্তর-পশ্চিমে জঙ্গলের ভিতরে লুকানো একটা জায়গা। ছেলেবেলায় ওখানে অনেক খেলেছে ওরা। গা ঢাকা দিয়ে ওখানে পৌঁছতে কোন অসুবিধা হবে না তার। লোলার দিকে চেয়েই সম্মতি জানাল সে।
আজ থেকে শুরু করে তোমার সাথে দেখা করার জন্যে ওখানে প্রত্যেকদিন একবার করে যাবে পেপি। আমি বলেছিলাম দু’একদিনের মধ্যেই তোমার সাথে আমার দেখা হবে।
ধন্যবাদ, লোলা।
এডের সম্পর্কে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওকে ভালবাসে পেপি।
মুখ বিকৃত করলেও জুলিয়াস জানে লোলার কথাই ঠিক। কিন্তু এতে ওর করার কিছুই নেই।
আরও একটা খবর আছে তোমার। খবরটা তোমাকে দিতে মন না চাইলেও দিচ্ছি, জিনা তোমাকে দেখা করতে বলেছে।
জুলিয়াসের বুকের ভিতরটা লাফিয়ে উঠল। জিনা কি জন্যে দেখা করতে বলেছে? গতবার যা কথা হয়েছে তাতে তো সব শেষ হয়ে যাবার কথা! নাকি মেয়েটা নতুন করে কিছু ভেবেছে?
কফি না নাস্তা? সাদামাঠা গলায় জিজ্ঞেস করল লোলা।
লোলার দিকে মুখ তুলে চাইল জুলিয়াস। আগের সেই অন্তরঙ্গ ভাবটা আর। নেই ওর মুখে। এর কারণটাও জুলিয়াসের, অজানা নয়। জিনার পাঠানো খবরে ওর বিচলিত হয়ে ওঠা লক্ষ করেছে লোলা। নিজের অনুভূতি গোপন রাখতে পারেনি জুলিয়ার্স। হঠাৎ নিজের ওপরই রাগ হলো তার, বলল, লোলা, তুমি…
কফি দেব, না নাস্তা? বাধা দিয়ে উঠল লোলা।
নাস্তা, আর শোনো…
কিন্তু বলার মত আর কিছুই খুঁজে পেল না জুলিয়াস। লোলাদের পাহাড় ঘেরা র্যাঞ্চে একা একা সে কেবল লোলার কথাই ভেবেছে। আবার ওকে দেখার জন্যে তার মনটা উদগ্রীব হয়ে ছিল। ভেবেছিল জিনাকে মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলেছে। কিন্তু তবে এই দোটানা কেন? মন স্বীকার করতে না চাইলেও সে বুঝতে পারছে এখনও তার বুক জুড়ে বসে আছে জিনা।
তোমার নাস্তা নিয়ে আসি, ত্রস্ত পায়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল লোলা। অস্বস্তিভরে একটু নড়েচড়ে বসল জুলিয়াস। কেউ একজন ভিতরে ঢুকল। ঘণ্টির শব্দে মুখ তুলে ডিগবিকে দেখে মুখ বাকাল জুলিয়ান। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে তার-শেরিফের এই অসময়ে আসার কি দরকার ছিল? অনেক কথাই লোলাকে বলার ছিল, কিন্তু এখন আর কিছুই বলা যাবে না।
জুলিয়াসের টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে সে বলল, সুপ্রভাত, জুলিয়াস। কোথায় ছিলে তুমি?
সুপ্রভাত, শেরিফ, বিরক্ত সুরে জবাব দিল জুলিয়াস। বিশ্রাম করছিলাম।
আমার প্রশ্নের জবাব হলো না ওটা। সে যাক, রকিং এ ইচে চড়াও হয়ে হাঙ্গামা বাধিয়েছিলে কেন? তোমার বাবা যে খুব অসুস্থ, এতটুকু বোধও কি তোমার নেই?
শেরিফে সাথে তর্ক করার ইচ্ছা জুলিয়াসের নেই। তাছাড়া ডিগবি ওকে দেখতে পারে না, জুলিয়াস যাই বলুক বিশ্বাস করবে না সে। এড়িয়ে যাবার জন্যে সে বলল, যা ঘটে গেছে সেজন্যে আমি খুব দুঃখিত, এখন ওসব কথা তুলে আর কি লাভ?
তা ঠিক। আমি তো সব শুনে তোমাকে জেলেই ভরব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু মেডকের মন নরম, সে-ই বাধা দিল।
মেডকের মন নরম! ভাবতেই হাসি পাচেছ-তবু কোন মন্তব্য করল না জুলিয়াস। লোলা জুলিয়াসের নাস্তা দিয়ে গেল।
শোনো, জুলিয়াস, তোমার রকিং এইচে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি আমি। ওখানে গিয়ে আর গোলামাল পাকিয়ো না, বুঝেছ?
নিশ্চয়ই, সহজভাবেই জবাব দিল জুলিয়াস।
আর একটা কথা, পার্কে যেন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে এজন্যে মেডক খুব সহযোগিতা করছে। নকার আর তোমার ঝগড়ার পরিণাম খারাপ দাঁড়াতে পারে ভেবে নকারকে বরখাস্ত করেছে। পার্ক থেকেই চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছে ওকে। আশা করছি দু’একদিনের মধ্যে চলে যাবে লোকটা, তবে এখনও শহরেই আছে সে।
নকারের সাথে আমার কোন বিরোধ নেই।
সে অন্যরকম বলে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে হন্যে হয়ে রয়েছে। ওকে সাবধান করে দিয়েছি যে পার্কে কোন বন্দুকবাজি আমি সহ্য করব না। এরপরেও যদি তোমরা গোলাগুলি করো, তবে তোমাদের মধ্যে যে বেঁচে থাকবে তাকেই জেলে পুরব আমি।
আমার তরফ থেকে ঝামেলা হবে না, জবাব দিল জুলিয়াস।
নকার তাহলে শহরেই আছে। সাবধান থাকতে হবে ওকে। শহরে যতক্ষণ থাকবে বিপদের সম্ভাবনাও ততই বাড়বে। আর একটা ব্যাপার সেই সাথে টের পেল জুলিয়াস, যতটা মনে করেছিল তারচেয়েও অনেক বেশি ধূর্ত মেডক। নকারকে বরখাস্ত করায় এখন যাই ঘটুক ওর আর কোন দায়িত্ব থাকছে না। সবাই ওকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ভাববে।
উঠে দাঁড়িয়ে ভারী গলায় ডিগবি বলল, তোমার ওপর নজর রাখব আমি, জুলিয়াস। সুতরাং সাবধান।
আমাকে সাবধান করতে হবে না, নকারের ওপর নজর রেখো, হেসে জবাব দিল জুলিয়াস।
কফি নিয়ে এল লোলা। টেবিলের ওপর জুলিয়াসের কফি নামিয়ে রেখে সে বলল, দেখি তোমার হাত?
হাত দুটো লোলার সামনে তুলে ধরে জুলিয়াস বলল, তুমি ও নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না-আমার হাত প্রায় ভাল হয়ে গেছে।
নকারের সাথে যদি…
কোন চিন্তা কোরো না তুমি।
হঠাৎ উল্টোদিকের আসনে বসে পড়ল লোলা। কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা যাচ্ছে কই? এখনই তুমি বাইরে রাস্তায় পা দেবে-কি ঘটবে কিছু ঠিক আছে? তোমাকে এভাবে বিপদের মধ্যে যেতে দিতে মন সরছে না।
আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার ওপর রাগই করেছ।
মাথা নাড়ল লোলা। রাগ করিনি-একটু দুঃখ পেয়েছিলাম। হয়তো আমিই বেশি আশা করেছি, কিন্তু এখন সে-প্রসঙ্গ থাক।
সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে ওকে। বারবার কেবল দরজার দিকে চাইছে লোলা। টেবিলের ওপর রাখা ওর ছোট ছোট হাত দুটোর ওপর নিজের হাত রেখে আদর করে মৃদু চাপ দিল জুলিয়াস। সুস্থির হও, লোলা। মানুষকে ঝুঁকি নিতেই হয়। গুহায় আমাদের পূর্বপুরুষ যারা বাস করত, তারা ঝুঁকি নিয়ে বাইরে না বেরুলে। এখনও আমাদের আগের মত বর্বরই থাকতে হত।
হাসতে চেষ্টা করল লোলা। আমাদের ওই রকম একটা গুহা থাকলেই ভাল হত। আগে ভাবতাম আমার অনেক সাহস, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আসলে আমি একটা ভীতুর ডিম।
তুমি কোন চিন্তা কেরো না, সান্তনা দিল জুলিয়াস সামনেই আমার ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। ঘোড়ায় চেপে এক মিনিটের মধ্যেই শহর ছেড়ে চলে যাব। তবে, আবারও ফিরব আমি।
তুমি ফিরে আসো, এটাই চাই।
লোলার হাতে মৃদু চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস। দরজার সামনে গিয়ে একটু থেমে খাপে ভরা পিস্তলটা পরীক্ষা করে দেখল ওটা ঠিকমত সহজে বেরোয় কিনা। জুলিয়াস জানে লোলা লক্ষ করছে তাকে, কিন্তু উপায় নেই। যদিও শহর ছেড়ে যাবার আগে নকারের সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই, তবু সাবধান থাকা ভাল।
লোলাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এল জুলিয়াস। রাস্তার অন্য মাথায় তার অফিসের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ডিগবি নোবল। অ্যালেন কারভার বারের বারান্দা পরিষ্কার করছে। ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে তিনজন লোক কথা। বলছে। ঘোড়ার রাশটা খুলে লাগাম ঢিলে করতে করতেই পিছন থেকে নকারের চড়া কর্কশ স্বর শুনতে পেল জুলিয়াস। রেস্টুরেন্টের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে নকার!
ঘুরে দাড়াও, জুলিয়াস দত্ত!
ধীর গতিতে ঘুরে দাঁড়াল জুলিয়াস। ওর হাতটা কোমরে বাঁধা পিস্তলের বাঁটের কাছে নেমে এসেছে। মনেমনে তৈরি থাকলেও এটা ঠিক আশা করেনি। ও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নকারের দিকে চেয়ে আছে জুলিয়াস। একটু ঝুঁকে মুখ কুঁচকে দাড়িয়ে আছে নকার। ওর ডান হাতটা পিস্তলের বাটের কাছাকাছি ঘুরছে।
এবার আর এড়িয়ে যাবার উপায় নেই তোমার, বলল নকার। তৈরি
কেন? শান্ত গলায় প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
কেন তা তুমি ভাল করেই জানো, মরার জন্য তৈরি হও।
এমন কঠিন অবস্থায় মানুষের হাসি বেরুবার কথা নয়, তবু চেষ্টা করে একটু হাসল জুলিয়াস। অপেক্ষা করছে সে-নকারের স্নায়ুর জোর পরীক্ষা করার জন্যে ওকেই প্রথম পিস্তল বের করার সুযোগ দিতে চায় জুলিয়াস। গান-ফাইটে শক্ত নার্ভের দরকার। জুলিয়াস আশা করছে মনের জোর কম থাকলে হয়তো পিছিয়ে যাবে নকার। অহেতুক পিস্তল ব্যবহার করতে চায় না ও।
সতর্ক দৃষ্টিতে নকারকে লক্ষ করছে জুলিয়াস। একটু আগেও নকারের কপালটা শুকনো ছিল, এখন বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে সেখানে। ওর চোখের ভাব পালটে গেছে-আগের আত্মবিশ্বাসের ছাপ আর সেখানে নেই।
জুলিয়াসের গলা দিয়ে একটা শব্দ বেরুল। নকারের কাছে ব্যঙ্গাত্মক হাসির মতই শোনাল শব্দটা। আর সহ্য করতে পারল না সে। বেসুরো গলায় চিৎকার করে বলল, এইবার, জুলিয়াস, গুলি করো!
এক ঝটকায় পিস্তল বের করে আনল নকার। জুলিয়াসের হাতেও বিদ্যুৎ খেলে গেল। নিজের গুলির শব্দের প্রায় সাথে সাথেই প্রতিধ্বনির মত নকারের গুলির আওয়াজ শুনতে পেল জুলিয়াস। ঊরুর উপরটা হঠাৎ চাবুকের আঘাতে যেন জ্বলে উঠল। আবার গুলি করল জুলিয়াস। কিন্তু তার দরকার ছিল না, নকার ততক্ষণে পিছন দিকে উল্টে পড়তে শুরু করেছে। হাত থেকে পিস্তল খসে পড়ল-ওর অসাড় দেহটা মাটিতে পড়ার আগে মাথাটা দালানের কোনায় ঠকে গেল। কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল সে।
এক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে থেকে পিস্তল খাপে ভরল জুলিয়াস। অন্য হাতে মুখটা মুছল। ঘামে ভিজে গেল তালু। ওর হাত-পা দুটোও কেমন যেন। দুর্বল ঠেকছে। রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল লোলা। মুখটা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখ দুটো বিস্ফারিত, উৎকণ্ঠায় তার হাত দুটো বুকের কাছে ভাজ করা।
উপায় ছিল না, লোলা, ভারী গলায় বলে উঠল জুলিয়াস। চেষ্টা করেও…
কথাটা শেষ হলো না। আড়চোখে দূরে ডিগবি নোবলকে ওর দিকে ছুটে আসতে দেখল জুলিয়াস। শেরিফের হুমকির কথা ভোলেনি সে। যা ঘটেছে তাতে দেশের কোন আইনেই জুলিয়াসকে আটকানো অসম্ভব। কোন সন্দেহ নেই আত্মরক্ষার জন্যেই গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে সে-কিন্তু শেরিফ ইচ্ছা করলে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তাকে আটকে রাখতে পারে। হাজতে আটকে থাকার কোন ইচ্ছে নেই ওর।
ঘোড়াটা ছাড়া পেয়ে লাগাম মাটিতে লুটিয়ে রাস্তার ওপর হাঁটছে। একটু এগিয়ে ঘোড়াটাকে ধরেই লাফিয়ে ওর পিঠে উঠে বসল জুলিয়াস। চিৎকার করতে করতে শেরিফ ছুটে এল।
এখন সময় নেই, ঘোড়া ছুটিয়ে দূরে সরে যেতে যেতে চিৎকার করে জানাল জুলিয়াস। পরে দেখা হবে!
দ্রুত বেরিয়ে গেল সে। কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে দেখল এর মধ্যেই লোকজন জড়ো হতে আরম্ভ করেছে। লোলা হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওকে। শেরিফও ওর দিকে চেয়ে হাত নাড়ছে, তবে তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ।
১৩. ক্রেস্টলাইন থেকে ছয়-সাত মাইল
ক্রেস্টলাইন থেকে ছয়-সাত মাইল এসে পশ্চিমে মোড় নিল জুলিয়াস। বিকেলের দিকে কলিন গেইলের বাড়ির উত্তরে পৌঁছল সে। ইচ্ছা করলেই ওখানে গিয়ে রাতের খাওয়াটা সেরে নেয়া যায়। তাছাড়া জিনা নিজেই দেখা করতে বলেছে, সুতরাং তার যাওয়াটা একেবারে অকারণ হবে না।
ভাবতে ভাবতেই একটা সিগারেট ধরাল জুলিয়াস। কি চায় জিনা? কেন সে আবার দেখা করতে বলেছে? যেতে গিয়ে ও ভিতর থেকে কেমন যেন একটা বাধা অনুভব করছে। বুঝতে পারছে ভিতরে ভিতরে জিনা কি বলবে এই ভয়টাই বাধা দিচ্ছে ওকে কিন্তু ভয় পাওয়ারই বা কি আছে? আঙুলে টিপে সিগারেট নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। কলিনের বাড়ির দিকে একবার মুখ তুলে চেয়ে হঠাৎ সোজা পশ্চিম দিকেই আবার ঘোড়া ছুটাল জুলিয়াস। জিনার সাথে পরে দেখা করলেও চলবে-পেপির সাথে দেখা করাই এখন তার প্রথম কাজ। রাত বারোটার দিকে গুহায় পৌঁছল সে। পেপি নেই ওখানে-অবশ্য এই অসময়ে পেপিকে এখানে আশাও করেনি ও। বিশ্রাম নেয়ার একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল জুলিয়াস।
পরদিন সকাল দশটায় পেপিকে দেখা গেল। ঝর্নার পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে সে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পেপিকে কেউ অনুসরণ করেনি দেখে সামনে বেরিয়ে এসে বলল, সুপ্রভাত, পেপি।
ক্লান্ত আর শুকনো দেখাচ্ছে ওকে। তাড়াতাড়ি জুলিয়াসের দিকে ফিরে সে বলল, আমি ভাবিনি…
যে গুহাটার কথা মনে থাকবে আমার? কথার মাঝেই বলে উঠল সে। ছেলেবেলায় পেপিই এই গুহার নামকরণ করেছিল।
না, তুমি খবরটা পাবে কিনা, আর পেলেও আসবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না।
কেন?
গতবার আমার সাথে দেখা করতে এসে অনেক ভোগান্তি হয়েছে তোমার।
সেটা তো আর তোমার দোষ নয়।
ঘোড়া থেকে নামল পেপি। মাডি লোকটা আস্ত একটা জানোয়ার। শুনেছি সে নাকি খালি হাতেই একবার একজন লোককে মেরে ফেলেছিল।
ঘোড়াটা গাছের সাথে বেঁধে রেখে ঝর্নার ধারে গিয়ে বসল ওরা। তোমাকে কেউ অনুসরণ করেনি তো? জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস।
সুন্দর করে হেসে মাথা নাড়ল পেপি। না, আমার পিছন পিছন কেউ আসবে না। লোকজন বেশির ভাগই বাইরে গেছে, তাছাড়া কেউ আমার পিছু নিলে এডের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। নিজস্ব একজন পুরুষ থাকার এটাই সুবিধা।
এখন কোথায় সে?
বাসায়। আমি কোথায় আর কি জন্যে এসেছি, সব জানে ও। তুমি রাজি থাকলে আজ বিকেলে ওকে নিয়ে আসতে পারি।
সেটা দেখা যাবে। হ্যাঁ বা না, কিছুই বলল না জুলিয়াস।
আমার যা বক্তব্য সেটা ঠিক পছন্দ হবে না তোমার!
বলেই দেখো না।
আমি কি চাই তা আমি জানি। এডকে আমার চাই, তোমাকে আর জারভিসকে আমি আবার আগের মত বাড়িতে দেখতে চাই; চাই মেডক আর তার ভাড়া করা লোকজনকে রকিং এইচ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হোক।
হাসল জুলিয়াস। পেপির কথায় অবাক হয়নি সে। বলল, লম্বা অর্ডার।
কিন্তু তা-ই চাই আমি।
এডের কি মত?
ও বলে চেষ্টা করা যায়-তবে ফল কি হবে বলা যায় না।
তুমি কি সত্যিই ওকে ভালবাসো?
হ্যাঁ।
আর সে?
মুখ তুলে জুলিয়াসের দিকে তাকাল পেপি। আমার মনে হয় সে-ও আমাকে ভালবাসে। অন্তত এমন করে আগে আর কেউ আমাকে চায়নি।
তাহলে এখন কি হবে?
জানি না, জুলিয়াস। তবে ওকে বিয়ে করব আমি। বাবার মৃত্যুর পরে খামারের একটা অংশ ভাগে পাব আমি। মেডকের ধারণা এডের মাধ্যমে সেটা হাত করবে সে। তবে এড এত সহজে ছেড়ে দেবে না। ওদের মধ্যে ঠোকাঠুকি লাগতে বাধ্য।
অর্থাৎ তুমি জানতে চাও দরকার পড়লে এডকে আমি সাহায্য করব কিনা?
কেন করবে না? সম্পত্তিতে তোমারও ভাগ আছে।
বাবা তো আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন।
বাবা অসুস্থ অবস্থায় রাগের মাথায় কি না কি বলেছেন-ওটা তার মনের কথা নয়।
কনুই-এ ভর দিয়ে গা এগিয়ে বসল জুলিয়াস। বাবার শরীর কেমন, পেপি?
দুর্বল। গতরাতে তাঁর ঘরে গেছিলাম-সব কথাই খুলে বললাম বাবাকে। কিছুই বাদ দিইনি। এড় আর আমার কথা থেকে শুরু করে তোমার, জারভিনের, মেডকের-সবার কথাই বললাম। মিথ্যে কথাও একটা বললাম-বলেছি নিজেরা আলাপ করে আমরা একটা পন্থা ঠিক করেছি, চিন্তার কিছুই নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা যে কতটুকু শুনেছেন ঠিক বুঝলাম না, অর্ধেক শোনার পর মনে হলো যেন শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
তবে তো বোঝা যাচ্ছে উনি সত্যিই অসুস্থ-তোমার এভাবে সব কথা বলে তাঁকে বিব্ৰত করা ঠিক হয়নি।..হ্যাঁ, জারভিসের কি খবর?
খুব খারাপ। দিন দিন আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে। সেদিন মেডকের সাথে ঝগড়া করেছে ও। নিজেকে বড় কেউ ভাবতে আরম্ভ করেছে সে। এড বলেছিল, ও যদি হিউ হারপারের সাথে মাতব্বরি ফলাতে যায় তবে ওকে করে ফেলবে হিউ।
ওকে বাঁচানো হয়তো আমাদের পরে সম্ভব হবে না, মন্তব্য, জুলিয়াস।
কিন্তু ও যে আমাদেরই ভাই-ওকে বাঁচাতেই হবে।
মাথা নেড়ে আবার উঠে বসে জুলিয়াস বলল, সত্যি কথাটা স্বীকার করতেই হবে, জীবনটা ছেলেখেলা নয়। এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে মেডকের সাথে সংঘর্ষ বাধলে বলা যায় না এডও মারা যেতে পারে। এর সাথে জড়ালে আমারও মৃত্যু ঘটতে পারে–তুমি নিজেও নিরাপদ নও।
এড আর আমি যদি পার্ক ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই, তাহলে কি হয়?
এডমন্ড পালাবার লোক নয়। আর তাতেও জারভিসের কোন সুরাহা হচ্ছে। না। সে তো বোকার মত মাতব্বর সেজে মহা আনন্দেই আছে।
তবে কি এই বিয়েতে আমার রাজি না হওয়াই উচিত?
জানি না তুমি রাজি না হলে ওরা কোন পথ ধরবে-তবে কিছু একটা করবেই। সব চাবিকাঠিই এখন ওদের হাতে।
লম্বা করে একটা শ্বাস নিল পেপি। তাহলে বলতে চাও এর থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ কোন রাস্তা নেই?
ঠিকই ধরেছ।
তোমার সাথে দেখা করার জন্যে এডকে নিয়ে আসব?
নিরুৎসাহিতভাবে ধীরে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল জুলিয়াস। ক্ষতি কি? ওকে ভাল করে জানার কৌতূহল হচ্ছে আমার। জানি না, হয়তো সে মেডকের চেয়েও খারাপ।
কেন যেন ওর কথায় রাগল না পেপি। উল্টো হেসে মাথা নেড়ে বলল, তুমি চেনো না ওকে, জুলিয়াস। জানি ওর সম্পর্কে অনেক কথাই তুমি বলতে পারো, কিন্তু ওর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে, প্রচুর সময় একসাথে কাটিয়ে, ওর বাইরের শক্ত খোলসটার ভিতরে একটা সুন্দর রুচিশীল মানুষ খুঁজে পেয়েছি আমি।
ভালমতই মজেছ দেখছি, দুষ্টুমি ভরা মুখে বলল জুলিয়াস।
হ্যাঁ, পুরোই ডুবেছি।
বিয়ে কবে করছ?
সামনের রোববার। অর্থাৎ আর চারদিন।
মুখ সামান্য তুলে আকাশের দিকে চেয়ে আছে পেপি, গালে গোলাপি আভা। স্বপ্নালু চোখে সুখের স্বপ্ন দেখছে সে। ওর কোমল প্রশান্ত মুখ থেকে দুশ্চিন্তার ছায়া মিলিয়ে গেছে। কল্পরাজ্যে হারিয়ে যাওয়া কনের মতই দেখাচ্ছে ওকে। চট করে ওর হাতের ওপর হাত রেখে সস্নেহে মৃদু চাপ দিল জুলিয়াস। পেপি; তুমি সুখী হও, এ-ই আমি চাই। যাও, ওকে নিয়ে এসো।
হাসতে হাসতেই বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেল পেপি। এতদিন পরে ওকে আবার এমন সুন্দর প্রাণখোলা হাসি হাসতে দেখে জুলিয়াসের মনটা খুশিতে ভরে উঠল। কিন্তু ওর এই হাসি কতদিন থাকবে? এড়ের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না সে-পেপি কি ওকে বিয়ে করে সুখী হবে? বিয়ের পরে গতানুগতিক একাণেয়ে রুটিনে কি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে এড?
সাথে করে আনা খাবার খেয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে জুলিয়াস। বিকেলের শেষ ভাগে ওদের দূর থেকে আসতে দেখল সে। ঘোড়ার পিঠে পেপি এডকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। খোলা জায়গাটায় পৌঁছে পিছন ফিরে হাসতে হাসতে এডকে কি যেন বলল পেপি। হাসি মুখেই জবাব দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পেপিকে দু’হাতে শূন্যে তুলে মাটিতে নামিয়ে দিল সে। নিশ্চিন্ত আত্মহারা এডের চেহারা-কোনরকম দুশ্চিন্তার ছায়া নেই ওর মুখে।
পেপিই প্রথম জুলিয়াসকে দেখতে পেয়ে বলে উঠল, এই যে, জুলিয়াস, ওকে নিয়ে এসেছি।
জুলিয়াস ওদের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল, এসো, পেপি। কি খবর, এড?
এই তো, হাতটা একটু তুলে জবাব দিল এড। তোমার কেমন চলছে?
দু’জনেই দু’জনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দাড়িয়ে আছে। একে অন্যকে মেপে দেখছে। ভিতরে ভিতরে কেমন একটা বিরূপ ভাব কাজ করছে জুলিয়াসের মনে। সে বুঝতে পারছে এড়েরও একই অনুভূতি হচ্ছে।
মাটিতে পা ঠুকে প্রতিবাদ করল পেপি। খুব হয়েছে! মনে হচ্ছে তোমরা কঠিন দৃষ্টিতে চেয়েই পরস্পারকে ভস্ম করে ফেলবে।
কই, আমি কঠিন চোখে চাইনি তো? আপত্তি জানাল জুলিয়াস।
সাথে সাথেই এডও বলে উঠল, আমিও না!
এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল এড। আনন্দের সাথেই ওর হাতটাও গ্রহণ করল জুলিয়াস।
খুশি হলাম। এবার আলোচনা শুরু করা যায়, আশ্বস্ত হয়ে বলল পেপি।
ঘোড়া দুটোকে নিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখল এড়। তারপর ভাল একটা জায়গা বেছে নিয়ে তিনজনে বসল। কোনরকম ভণিতা না করে সরাসরি কাজের কথায় চলে এল এড। জুলিয়াস, আমরা সামনের রোববারে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি।
মাথা ঝাঁকাল জুলিয়াস। হ্যাঁ, শুনেছি। পেপি বলেছে আমাকে।
তোমার কথায় মনে হয় খুশি হওনি তুমি।
মুখ তুলে সোজাসুজি এডের দিকে চাইল জুলিয়াস। পেপি ভুল করছে কিনা সেটাই ভাবছি আমি।
অস্বীকার করে লাভ নেই, পেপির আরও ভাল কোন পাত্র হলেই যোগ্য জুড়ি হত। মিথ্যা বলব না, মেডকের প্ল্যান অনুযায়ী আমি পেপিকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলাম। কথা ছিল আমি পেপিকে রাজি করাতে না পারলে ওরা অন্য পথ ধরবে।
তবে তো তোমার গর্ব বোধ করাই উচিত? ফোড়ন কাটল জুলিয়াস।
আমাকে খেপিয়ো না, রাগের সাথে বলে উঠল এড। এই ভাবেই প্ল্যান করা হয়েছিল। প্ল্যানটা আমার নয়, মেডকের। একঘেয়ে কাজ করতে করতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম-এই কাজটা আকর্ষণীয় মনে হওয়ায় এটা নিয়েছি-এতে আমার দোষটা হলো কোথায়?
পেপিকে বিয়ে করতে যাচ্ছ তুমি।
ওকে ভালবেসে ফেলেছি আমি।
হয়তো।
এডের চোখ দু’টো কঠিন হলো। তোমার ভালর জন্যেই বলছি, অমন কথা দ্বিতীয়বার আর উচ্চারণ কোরো না।
গলার স্বরে জুলিয়াসের মনে হলো যথার্থই খেপেছে লোকটা। পেপির দিকে চাইল সে। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি মেয়েটা। ওর চুপ করে থাকতে যে কত কষ্ট হচ্ছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে জুলিয়াস। হাত দুটো কোলের ওপর মুঠো করে রাখা-মুখটা বেদনায় ক্লিষ্ট।
মেডকের প্ল্যানটাই তাহলে শোনা যাক, সংযত স্বরে বলল জুলিয়াস। তোমাদের বিয়ের পরে কি ঘটবে?
মেডকই আগের মত র্যাঞ্চ চালাবে। পেপি ওর জমি আমার নামে লিখে দেবে, সেটা আমাকে দিয়ে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে আমার পাওনা মিটিয়ে দেবে মেডক।
অর্থাৎ সবকিছুই শেষ পর্যন্ত মেডকের পেটে যাচ্ছে?
সেই রকমই পরিকল্পনা, জুলিয়াস।
জারভিসের কি হবে?
নিজের বোকামির জন্যে কোন দুর্ঘটনায় মারা পড়বে সে।
পেপি বলেছিল মেডকের সাথে তোমার বিরোধ বাধবে।
মৃদু হাসল এড। অবশ্যই বাধবে, কারণ ওর প্ল্যান অনুযায়ী পেপিকে আমার নামে জমি লিখে দিতে বলব না আমি। আমার মাধ্যমে মেডক কোনদিনই পেপির সম্পত্তি পাবে না।
তোমাকে মেরে ফেলবৈ ও।
চেষ্টা সে অবশ্যই করবে। কিং অ্যালেনবির সাথে রেভ রিভার এলাকায় দলগতভাবে কাজ করার সময়ে মেডকের সাথে আমার পরিচয়। লোকটা পিস্তলের যাদুকর। এছাড়া রয়েছে হিউ হার্পার। তিনবার ওকে নিজের চোখে অ্যাকশনে দেখেছি-আজ পর্যন্ত ওর সাথে তুলনা করার মত কাউকে দেখিনি। এই রকম আরও তিনজন উঁচুদরের বন্দুকবাজ রয়েছে ওদের সাথে-হোয়েল কিড, হোরেস আর চাক। ওদের মধ্যে বিশেষ করে হোয়েল কিড খুব সাংঘাতিক লোক। আরও একজন ছিল, কার, কিন্তু তোমার দৌলতে ওর কথা আর ভাবতে হবে না আমাদের।
এতসবের মোকাবিলা করার চেয়ে পালিয়ে যাওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ, কি বলো? জানতে চাইল জুলিয়াস।
আমি শুধু পেপির প্রেমেই পড়িনি, জুলিয়াস, পার্ককেও ভালবেসে ফেলেছি। এখানেই ঘর বেঁধে বসবাস করতে চাই আমি। এখানে এত দূরে হয়তো আমার অতীত আর আমাকে বিব্রত করবে না। নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে পারব। ছেলেবেলায় র্যাঞ্চেই বড় হয়েছি, র্যাঞ্চের সব কাজই জানা আছে আমার। অতীতে যা কিছু অন্যায় করেছি সব ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাই আমি। এর জন্যে দরকার হলে রুখে দাড়াতেও আমি রাজি।
এডের কথাগুলো সত্যি হলে পেপির জন্যে ভালই হয়। কিন্তু জুলিয়াস আর ওর অতীত নিয়ে ঘাটতে চায় না, অন্য কথা পাড়ল সে।
জারভিসের কি হবে? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
ওকে নিয়ে যে কি করা যায় তা নিজেও ভেবে পাই না আমি, নিজের মতামত প্রকাশ করল এড। তোমাদের ভাই হলেও একেবারেই ছেলেমানুষ আর বোকা ও। সেবাস্টিন দত্ত জীবিত আছেন বলেই ওরা এখনও হত্যা করেনি ওকে! ওর মাধ্যমে মেডক এখনও বেশ সুন্দর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।
বাবা আর কতদিন বাচবেন?
কে বলতে পারে? মেডক তাঁকে যে-কোন সময়ে খতম করতে পারে, করছে না, কারণ পেপির সাথে আমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে ওর বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, সেদিন তার ঘরে গিয়ে দেখলাম উনি ঘুমাচ্ছেন। যে বইটা তিনি পড়ছিলেন সেটা মাটিতে পড়ে আছে। ওটা তুলে তাকের ওপর রেখে দিয়ে ফিরে আসি আমি। পরে উনি ওটা চাইতে পারেন মনে করে ওটা তার হাতের কাছে এগিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ঘরে গিয়ে দেখি, ওই বইটাই তিনি পড়ছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম ঘরে আর কেউ আসেনি। তাহলে বইটা কে এগিয়ে দিল তাকে?
রুদ্ধশ্বাসে উঠে বসল পেপি। একথা আমাকে আগে বলোনি কে তুমি?
এখনও বলা হয়তো ঠিক হলো না, আমি তোমাদের আশা দিয়ে নিরাশ করতে চাই না। কিন্তু আমার ধারণা তাকে আমরা যতখানি দুর্বল আর অসুস্থ মনে করছি আসলে তিনি তা নন।
কিন্তু আমাকেও তো এ ব্যাপারে কোন কথা বাবা বলেননি?
এই কেনর জবাব পেতে হলে তোমার বুঝতে হবে জুলিয়াসের সাথে তিনি কেন দুর্ব্যবহার করলেন।
তার মানে?
আবার হাসল এড। পেপির দিক থেকে জুলিয়াসের দিকে চোখ ফিরাল সে। তুমিও বোঝেনি? তোমার তো বোঝা উচিত ছিল? সেবাস্টিন দও অসুস্থ, সন্দেহ নেই–কিন্তু দেহ অসুস্থ হলেও মাথায় তো আর কোন দোষ হয়নি তার। তিনি জানেন মেডকই সবকিছু চালাচ্ছে, জারভিস বোকা আর পেপি অসহায়। তাই জুলিয়াস যখন ফিরে এল তখন তাকে সাথে সাথেই অমন করে বের করে না দিলে আর একটা দিনও বাঁচার উপায় ছিল না ওর।
জুলিয়াসও পেপির মত সোজা হয়ে বসেছে এখন। ব্যাপারটাকে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আগে কখনও ভেবে দেখেনি। এডের ধারণা সত্যি হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে তা ভাল করেই বুঝতে পারছে ও। তাকে বাঁচাবার জন্যে বাবা সবই করতে পারেন। আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল জুলিয়াসের গলা। দুর্বল আর অসুস্থ অবস্থায় নিজের বাড়িতে বন্দী থেকেও জুলিয়াসের জীবন বিপন্ন হবে ভেবেই কারও কাছে সাহায্য চাননি তিনি।
সত্যি, সেবাস্টিন দত্ত একজন মানুষ বটে! বলে চলল এড। আমার বাবাও ঠিক এমনই ছিলেন। কঠিন, জেদী আর সৎ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মারা পড়েছিলেন তিনি। এক রাতে সারা দেহে অসংখ্য গুলির জখম নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। অন্য যে-কেউ হলে অনেক আগেই নির্ঘাত মারা যেত। কিন্তু আমাদের সাবধান করা আর সেই সাথে নিরাপদে পালিয়ে যাবার কথা বলার উদ্দেশ্যেই যেন জেদ করে বেঁচে ছিলেন তিনি। সেই রাতেই মাকে নিয়ে অন্যখানে চলে যাই আমি। তবে পরে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ আমি নিয়েছি-তারপর থেকেই আমি ফেরারী।
নিজের জন্যে একটা সিগারেট বানিয়ে নীরবে এডের দিকে তামাক আর কাগজ বাড়িয়ে দিল জুলিয়াস।
রোববারেই বিয়ে করে ফেলাটা হয়তো আমাদের ঠিক হচ্ছে না, বলে উঠল পেপি।
সিগারেটের কাগজটা জিভের ডগা দিয়ে ভিজিয়ে মাথা নাড়ল এড। না, পেপি, দেরি করার উপায় নেই আমাদের। হয় রুখে দাঁড়াতে হবে, নয়তো পালাতে হবে।
বিয়ের পরে কি ঘটবে? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
সাথে সাথেই কিছু ঘটবে না হয়তো, কিন্তু বিয়ের পরে সেবাস্টিন দত্ত আর জারভিস দু’জনেই বিপদের মুখে পড়বে।
এর প্রতিকার জানা আছে আমার, মন্তব্য করল জুলিয়াস। আমাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান এতে হবে না বটে কিন্তু মেডক আপাতত ঠাণ্ডা থাকবে।
শুনি কি ফন্দি এঁটেছ?
জারভিসকে ঘিরেই আমার প্ল্যান। ধরো রোববার তোমাদের বিয়ে হলো, তোমরা এক সপ্তাহের জন্যে মধু-চন্দ্রিমা যাপন করতে কোথাও চলে গেলে। বিয়ের রাতেই জারভিসও নিরুদ্দেশ হলো।
কিন্তু জারভিস নিরুদ্দেশ হবে কেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল পেপি।
হাসল জুলিয়াস। ওকে রাজি করানোর ভার আমার। কিন্তু ভেবে দেখো, এমন হলে কিন্তু মেডকের হাত থেকে নিরাপদ থাকছে জারভিস। ওকে হাতে না পেয়ে বাবার বিরুদ্ধে ও কিছু করতে সাহস পাবে না মেডক।
আলাপ আলোচনা আরও কিছুক্ষণ চলল। কিন্তু নতুন কোন প্ল্যান ওদের মাথায় এল না। এড আপত্তি জানাচ্ছিল যে জুলিয়াসের কাঁধেই কাজের গুরুভার পড়ল। কিন্তু সে নিজেও কম ঝুঁকি নিচ্ছে না, তাকে সবসময়ই থাকতে হচ্ছে। মেডক আর তার লোকজনের মাঝে।
জারভিসকে গায়েব করার সময় সাহায্য দরকার হবে না তোমার? প্রশ্ন করল এড।
হ্যাঁ, তবে ভাল লোকের অভাব হবে না আমার।
বিয়ের রাতেই কাজটা সারতে চাইছ?
ওই সময়েই সুবিধা হবে।
মনে রেখো উৎসবের রাতে মদ সবাই বেশি খাবে। নকারের পক্ষ নিয়ে কেউ প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করা বিচিত্র নয়। মদের আসরে একটা ঝগড়া বাধিয়ে নেয়া কঠিন হবে না।
সতর্ক থাকব আমি, শান্তভাবেই জবাব দিল জুলিয়াস।
বিয়ের আগে কোন কারণে দরকার হলে কিভাবে যোগাযোগ করব?
বিন্দুমাত্র না ভেবেই জুলিয়াস জবাব দিল, কোন খবর থাকলে সেটা লোলার কানে পৌঁছলেই আমি জানতে পারব। ওর ওপর পুরো বিশ্বাস আছে আমার।
কথা শেষ করে উঠল ওরা। জুলিয়াসও ওদের সাথে এল। ঘোড়ায় চড়ার আগে এডের হাতে হালকাভাবে পেপির হাতের ছোঁয়া লাগল। চট করে পেপির দিকে ফিরে চাইল এড। নীরবেই দৃষ্টি বিনিময় হলো ওদের। ওই দৃষ্টি দেখেই জুলিয়াস মনে মনে বুঝে নিল ওদের ভালবাসা কত গভীর। ওঁরা একে অন্যকে এমন আপন করে জেনেছে যে দৈহিক সংস্পর্শের দরকার পড়েনি ওদের, চোখের দৃষ্টি দিয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করল ওরা। এগিয়ে এসে পেপির গালে চুমু খেলো জুলিয়াস। সুখী হও। তোমাদের দুজনেরই শুভ কামনা করি।
এডের সাথে হাত মিলিয়ে ওদের বিদায় দিল জুলিয়াস। অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল সে। কয়েক ঘণ্টা আগেও জুলিয়াস বিশ্বাস। করেনি পেপি আর এড বিয়ে করে সত্যিকার সুখ খুঁজে পাবে। কিন্তু ভুল ভেঙেছে ওর। বুঝেছে সুখ এখন ওদের হাতের মুঠোয়-ওদের ভাগ্য প্রসন্ন।
১৪. শুক্রবারে জুলিয়াসের খোঁজে
শুক্রবারে জুলিয়াসের খোঁজে নডির র্যাঞ্চে এসে হাজির হলো শেরিফ ডিগবি। একাই এসেছে সে। মারিয়াকে জিজ্ঞেস করে কোন এলাকায় ওরা কাজ করছে জেনে নিয়ে সেখানে হাজির হলো ডিগবি। খড় কাটছে ওরা-দু’জনেই পরিশ্রমে নেয়ে উঠেছে ঘামে।
ভাল সময়েই এসেছ শেরিফ, একটা ফর্ক তুলে নিয়ে কাজে লেগে যাও, মুচকি হেসে বলে উঠল নডি।
হাতে সময় নেই এখন, জবাব দিল ডিগবি। তারপর একটু ভেবে বলল, ভাগ্যিস সময় নেই, তোমাদের সাথে এই রোদে একঘণ্টা কাজ করতে হলে নির্ঘাত মারা পড়তাম। আমি এসেছি জুলিয়াসের সাথে কিছু আলাপ করতে।
ঝটপট বলে ফেলো কি বলবে, তাড়া দিল জুলিয়াস। সেদিন নকারের মৃত্যুর তদন্ত হলো, তোমার থাকা উচিত ছিল সেখানে। সে যাক, জুরি একচেটিয়াভাবে রায় দিয়েছে তোমার দোষ নেই, আত্মরক্ষার জন্যেই ওটা ঘটেছে। অন্য কোন রায় হলেই বরং অবাক হত জুলিয়াস। ডিগবিকে পছন্দ করে না বটে জুলিয়াস তবে এটা ঠিক যে লোকটা নিরপেক্ষ-কোন পঁাচ নেই ওর মনে। সে বলল, ধন্যবাদ, ডিগবি। ঘটনায় আমি নিজেও দুঃখিত। এড়িয়ে যেতে পারলে…
অন্য একটা ব্যাপারে এসেছি আমি-এই রোববারে তোমার বোনের বিয়ে হচ্ছে ক্রেস্টলাইন চার্চে সানডে সার্ভিসের পর।
এই রকমই একটা কথা কানে এসেছে আমার।
তোমাকে কে বলল?
এসব কথা বাতাসে ছড়ায়।
কার সাথে ওর বিয়ে হচ্ছে তা-ও শুনেছ?
হ্যাঁ, এডমন্ড ফিনলের সাথে।
চোখ ছোট করে জুলিয়াসের দিকে চাইল শেরিফ। আমার ধারণা ছিল এ বিয়েতে আপত্তি থাকবে তোমার।
কাঁধ ঝাঁকাল জুলিয়াস। আপত্তি থাকলেও আমার করার কিছুই নেই, নিজের পছন্দ মতে বিয়ে করছে পেপি। মিয়া-বিবি রাজি তো কেয়া কারেগা কাজী? ও সুখী হলেই আমিও খুশি।
তাহলে বিয়েতে যাচ্ছ না তুমি?
যাব না কেন? বোনের বিয়েতে নিশ্চয়ই যাব।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই এটা গ্রহণ করেছ তুমি, কিন্তু মনে রেখো, বিয়েতে তুমি যদি কোন গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করো তবে আমি নিজে তোমাকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করব। মেডককেও আমি এই কথাই বলেছি।
মেডক কি মনে করে বিয়েতে গোলমাল বাধাব আমি?
বলা কি যায়?
চেষ্টা করে একটু হাসল জুলিয়াস। না, পেপির বিয়েতে কোন ঝামেলা করব না আমি। তুমি দেখে নিয়ো, ভিড়ের মধ্যে আমিও যে আছি টেরই পাবে তুমি।
আরও দু’একটা কথার পরে বিদায় নিল ডিগবি।
রোববার সকালে অন্ধকার থাকতেই রওনা হয়ে গেল ওরা। দেখা গেল বিয়েতে মারিয়ারই উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। এডমন্ড ফিনলে সম্পর্কে প্রশংসা শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেও জুলিয়াসের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন সে। তবে বিয়ে সবসময়ই মারিয়ার কাছে একটা বিশেষ আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। নডি ওর অবস্থা দেখে হেসে ওকে একটা বাড়তি রুমাল সাথে নিতে বলল।
না, কাদব না আমি, বলল মারিয়া, হয়তো একটু ভেজাভেজা হয়ে উঠবে চোখ–কিন্তু সেটা তোমারই দোষ। মেয়েরা বিয়েতে একটু কাঁদে কারণ নিজের বিয়ের স্মৃতি মনে পড়ে যায়।
অনুশোচনা হয় বলে কাদে?
না, নিজের বিয়ের দিনটাই কল্পনায় আবার নতুন করে উপভোগ করে। দোয়া করি যেন পেপি বিয়ে করে আমার মত সুখী হয়। তুমি কবে বিয়ে করছ জুলিয়াস?
হেসে উঠল সে, মেয়েটা রাজি আছে কিনা জিজ্ঞেস করে দেখা হয়নি।
কাকে-
লোলাকে?
চমকে উঠল জুলিয়াস। তার মনের কথা মারিয়া টের পেল কি করে? সে ভাবতেও পারেন তার আর লোলার ব্যাপারটা কেউ আঁচ করতে পারে।
নডিও অবাক হয়েছে। লোলা! ডুবে ডুবে পানি খাওয়া হচ্ছে! আমি কিন্তু মোটেও টের পাইনি।
সন্তুষ্টি ফুটে উঠল মারিয়ার মুখে। একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারতে, বলল সে। লোলার প্রসঙ্গ উঠলেই ওর চেহারা কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, গলার স্বর নরম হয়ে যায়, এসব লক্ষ করোনি? মেয়েটাকে কিন্তু আমার খুব ভাল লাগে। জুলিয়াসের সাথে চমকার মানাবে ওকে।
আপাতত এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমি। বলে উঠল জুলিয়াস। মারিয়ার মন্তব্যে মনে মনে খুশি হয়েছে সে।
দশটার দিকে ক্রেস্টলাইনে পৌঁছে গেল ওরা। চার্চে ভিড় হয়েছে অনেক। কয়েকটা রিজার্ভ করা আসন ছাড়া সব ভর্তি হয়ে গেছে। যারা পরে এসেছে তারা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সার্কিট প্রচারের সার্ভিসে এমনিতেই বেশি লোক হয়, তার ওপর আজ সার্ভিসের পরেই বিয়ে আছে। ক্রেস্টলাইনের সব লোক তো এসেছেই, পুরো পার্কের লোকই আজ এখানে এসে হাজির হয়েছে।
পিছনের দিকে রকিং এইচের পাচজন লোক দেখা যাচ্ছে-হিউ, হোয়েল, ফক্সি, চাক আর হোরেস একসাথেই বসেছে। মাডি ওদের সাথে নেই, সম্ভবত ওকে রকিং এইচের পাহারায় রেখে আসা হয়েছে।
জিনাও এসেছে তার বাপ-মার সাথে। জুলিয়াসকে দেখেও ইচ্ছে করেই মুখ ঘুরিয়ে রইল সে অন্যধারে লোলাকে দেখতে পেল-ওকে দেখে সামান্য মাথা দুলিয়ে হাসল সে।
সার্ভিস শুরু হবার অল্প আগেই পেপি আর এড় ঢুকল। ওদের পিছন পিছন এল জারভিস আর মেডক। মৃদু গুঞ্জন উঠল চার্চের ভিতর। গুঞ্জনের কারণ বুঝে নিতে কারও অসুবিধা হলো না-অপূর্ব সুন্দরী দেখাচ্ছে পেপিকে। ওর সুন্দর মিষ্টি হাসি থেকে যেন একটা স্বর্গীয় আভা ফুটে বেরুচ্ছে। সাদা শার্ট আর ব্রাউন রঙের একটা নতুন সুট পরেছে এড। নির্ভীক, আত্মবিশ্বাসী, আর পেপিকে পাশে পেয়েই যেন একটু গর্বিতও দেখাচ্ছে ওকে।
ওরা চারজন সামনের রিজার্ভ করা সীটে গিয়ে বসল। অনেকক্ষণ ধরে চলল সার্ভিস। এত শ্রোতা পেয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েই সার্কিট প্রচার লম্বা বক্তৃতা দিলেন! সার্ভিসের শেষেই বিয়ের অনুষ্ঠান একপাশে জারভিস আর অন্যপাশে মেডকের মাঝে প্রচারের সামনে দাঁড়িয়ে এড় আর পেপির বিয়ে হলো। দুজনেই স্পষ্ট গলায় জানাল বিয়েতে তারা রাজি। অনুষ্ঠানের শেষে চার্চের অর্ধেক লোকই ঘেঁকে ধরল ওদের। বাইরে রাস্তায় কেউ একজন আনন্দে চিৎকার করে পিস্তল ছুড়ল।
নব-দম্পতিকে অভিনন্দন জানাচ্ছে সবাই-দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে জুলিয়াস। রকিং এইচের ইে পাঁচজন এখন পিছনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। কোন উত্তেজনা নেই চার্চে সবারই হাসি হাসি মুখ, কথাবার্তার গুঞ্জন ছাপিয়ে বারবার হাসির শব্দ ভেসে আসছে, এর মধ্যে থেকে লোলা যে কখন চার্চ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে খেয়াল করেনি জুলিয়াস-নিশ্চয়ই মাকে সাহায্য করতে রেস্টুরেন্টে ফিরে গেছে কলিন আর হিলডার সাথে জিনাও চলে গেছে।
লোকজন চারপাশ থেকে ভিড় করে থাকলেও তারই ফাঁকে জুলিয়ানা ঠিকই লক্ষ করেছে পেপি হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকল সে লোকজনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে ওদের কাছে গিয়ে এডের সাথে হাত মেলাল সে। তারপর পেপির গালে চুমু খেলো। ভাইকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল রেখে আদর নেয়ার সময়ে সে খুব আস্তে ফিসফিসিয়ে বলল, যাওয়ার আগে, লোলার সাথে দেখা কোরো। কথাটা যে আর কারও কানে যায়নি এ সম্বন্ধে জুলিয়াস নিশ্চিত।
চিরাচরিত অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই চার্চ ছেড়ে বেরিয়ে গেল নব-দম্পতি। রাস্তার দুই ধারে ঘোড়ায় চড়া এসকর্টের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেল ওরা দু’জন। ঘনঘন লোকজনের উৎফুল্ল চিৎকার আর পিস্তল ফুটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। পেপি আর এড শহর ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত এইরকমই চলল।
চমৎকারর বিদায় অনুষ্ঠান, বলল নডি। তবে উৎসব মোটে শুরু।
ঠিকই বলেছে নডি। বারের সামনে একটা মারপিট ঠেকাল শেরিফ। বিয়েটা লোকজনের বেশি মদ খাওয়ার একটা উছিলা মাত্র। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই আরও অনেক মারপিট হবে আজ। পাইকারী হারে মদ খাওয়ার এটা অবশ্যম্ভাবী ফল।
গ্রোসার ককসির বাসার বৈঠকখানায় লাঞ্চ সেরে বসে গল্প করছে ওরা তিনজন। ককসি, নড়ি আর জুলিয়াস। ককসির কথায় মনে হয় সে মেডক সম্বন্ধে সন্দিহান। এড সম্পর্কে জুলিয়াসের সামনে কোন মন্তব্য না করলেও বোঝা যায় সে উদ্বিগ্ন।
বৌয়ের ডাকে ককসি একটু ভিতরে যেতেই জুলিয়াস নডিকে বলল, এবার লোলার সাথে দেখা করতে রেস্টুরেন্টে যাওয়া দরকার-পেপি ওর কাছে কিছু খবর দিয়েছে।
তাহলে আমি যাচ্ছি, খবরটা নিয়ে আসি, বলে উঠল নডি। না, আপত্তি কোরো না, আমার দিকে কেউ খেয়াল করবে না, কিন্তু তুমি রাস্তায় নামলেই এখন হোয়েলের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। মগজ খাটাও, সাবধানে চললে সারা জীবন লোলার সাথে দেখা করার অনেক সুযোগ পাবে।
কথাটা সত্যি। হোয়েল যদি জুলিয়াসের পিছনে লেগে থাকে তবে তার পক্ষে রাস্তায় বেরুনো এখন মোটেও ঠিক হবে না।
জনি এসে হাজির হলো। একটা ছুতো দেখিয়ে জনির সাথে বেরিয়ে পড়ল নডি। আধঘণ্টা পরে ফিরে এসে জুলিয়াসকে আড়ালে ডেকে সে বলল, রাস্তায় হোয়েলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ছায়ায় দাঁড়িয়ে সবাইকে লক্ষ করছে। সবাই কম বেশি মদ খেয়েছে আজ, কিন্তু হোয়েল এখনও একফোঁটা মদ ছোয়নি।
জারভিস এখনও শহরে আছে?
হ্যাঁ, বারে বসে পোকার খেলছে। জনি ওর পেছনে একজন লোক লাগিয়েছে, জারভিস বার থেকে একপা নড়লেই আমরা খবর পাব।
আজ রাতেই যে করে হোক জারভিসকে ধরে নিয়ে যাবে জুলিয়াস। তাই এখনও শহর ছেড়ে যায়নি ওরা।
লোলা কি বলল? জিজ্ঞেস করল সে।
চার্চের আগে পেপি, এড, মেডক আর জারভিস কফি খেতে রেস্টুরেন্টে গেছিল। পেপি ওখানে তার পোশাকের কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে এমন ভাব দেখালে লোলা সেটা ঠিক করে দেয়ার জন্যে ওকে রান্নাঘরে নিয়ে যায়। সেখানে আড়ালে একটু কথা বলার সুযোগ পেয়েছে ওরা। পেপি জানিয়েছে এক সপ্তাহের জন্যে হানিমুন করতে ওরা দুজন তোমার বাবার শিকারের কেবিনে কাটাবে। তুমি আর জারভিস ছাড়া রকিং এইচের কেউই জায়গাটা চেনে না। লোলা আরও একটা কথা বলেছে, অবশ্য সেটা তোমার খবরের অংশ নয়।
কি কথা?
বলেছে এই এক সপ্তাহের ভিতর তুমি ওদের বিরক্ত করতে গেলে সে তোমার মাথা ভেঙে দেবে।
বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল জুলিয়াস। আর কিছু বলল সে?
হ্যাঁ, বলেছে তার কাছে জ্যান্ত সাধারণ মানুষও মরা হিরোর চেয়ে অনেক ভাল।
সন্ধ্যার পরে নডিকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জুলিয়াস। মারিয়া শঙ্কিত দৃষ্টিতে চাইল ডির দিকে, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। শহরের উত্তর-পশ্চিমে নদীর ধারে জনির সাথে মিলিত হলো ওরা। দুটো ঘোড়া সাথে এনেছে জনি। সে-ই খবর দিল, জারভিস এখনও বারেই আছে-খেলায় অনেক হেরেছে। এখনও চলছে খেলা। জারভিসের অভ্যাস ভাল করেই জানে জুলিয়াস। অত্যন্ত। সহজ একটা প্ল্যান এঁটেছে সে। তাস খেলার সময়ে বিয়ার খায় জারভিস, তাই প্রতি আধঘণ্টায় তাকে একবার করে বারের পিছনে নিজেকে খালাস করতে যেতে হয়। ওখান থেকেই ওকে অপহরণ করা হবে।
চলো, আর দেরি না করে হাতের কাজটা শেষ করে ফেলা যাক, প্রস্তাব দিল নড়ি।
বারের পিছন দিকে কিছুটা অংশ বেড়া দিয়ে ঘেরা। এর শেষ মাস, টয়লেট। পিছনের উঠানে নানান আকারের কাঠ স্তূপ করে রাখা আছে। জুলিয়াসদের লুকিয়ে থাকার জন্য চমৎকার জায়গা।
গত আধঘণ্টায় বারের পিছন দিককার দরজা দশ-বারোবার খুলেছে। বিভিন্ন লোক তাদের কাজ সেরে আবার ফিরে গেছে। এরপরে জুলিয়াসের প্রত্যাশাই ঠিক প্রমাণ করে জারভিস বেরিয়ে এল। কিন্তু একা নয় সে। ওর সাথে চাকও বেরিয়ে এসেছে-সম্ভবত ওকে সামাল দিতেই।
কাঠের গাদার পাশ দিয়ে টয়লেটের দিকে যেতে যেতে চাককে ওরা বলতে শুনল, জলদি করো, জারভিস, তোমার কপাল মোটে ঘুরতে আরম্ভ করেছিল-আগামী ঘণ্টাটা মনে হয় ভালই যাবে তোমার।
বাজে তাস পাচ্ছিলাম, তিক্ত স্বরে বলে উঠল সে, কিন্তু তুমি দেখে নিয়ে, যা হেরেছি সব সুদে আসলে তুলে নেব আমি।
অন্ধকারের ভিতর থেকে নিচু অথচ তীক্ষ্ণ গলায় আদেশ করল জুলিয়াস, যেখানে আছ সেখানেই চুপ করে দাঁড়াও। পিস্তল বের করার চেষ্টা কোরো না কেউ!
আড়াল থেকে বেরিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল জুলিয়াস। নডিও ওর সাথে সাথেই আছে। জনি পিস্তল হাতে কাভার করছে ওদের দুজনকে।
চাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে একেবারে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত দুটো। সামান্য, উঁচুতে মাঝ পথেই থেমে রয়েছে। জারভিস দাড়িয়ে নেশার ঘোরে দুলছে। হঠাৎ হেঁড়ে গলায় সে চিৎকার করে উঠল, কি চাও তোমরা? আমি কি করেছি? আমি…
ঘুরে দাঁড়াও, কঠিন গলায় নির্দেশ দিল জুলিয়াস।
নির্দেশ মানল না জারভিস, ধীরে ধীরে কয়েক পা পিছিয়ে গেল সে। কিন্তু চাক পিস্তলের মুখে লক্ষ্মী ছেলের মত ঘুরে দাঁড়াল। জনি এগিয়ে এসে ওর কানের পিছনে পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করতেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।
ঘুরেই বারের দিকে হাঁটা ধরেছিল জারভিস! লাফিয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ওকে ধরে ফেলল জুলিয়াস। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর হাল ছেড়ে দিয়ে রাগে ফুঁসতে থাকল জারভিস।
চলো, এখান থেকে জলদি কেটে পড়ি, পরামর্শ দিল নডি, এখনই হয়তো কেউ এসে পড়তে পারে। চাকের কি খবর?
জুলিয়াস আড়চোখে মাটিতে শোয়া চাকের দিকে চাইল। ওরা ভেবেছিল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে চাক-হয়তো কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞান হারিয়েও ছিল সে; কিন্তু এখন পিস্তল তুলে তাক ঠিক করছে ও।
অন্যদের সাবধান করার আর সময় নেই এখন। জারভিকে ছেড়ে দিয়ে পিস্তল বের করেই গুলি করল জুলিয়াস। গুলিটা ওর কাঁধ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠে আবার পিস্তল ওঠাল চাক। জুলিয়াসের দ্বিতীয় গুলিটা ওর হৃদপিণ্ড ছেদা করে দিল। পিস্তলটা ছেড়ে দিয়ে গড়িয়ে পড়ল সে।
মারা গেছে চাক। এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থেকে পিস্তল খাপে ভরল জুলিয়াস।
জারভিসকে আবার ধরে ফেলল জনি। জুলিয়াস, শিগগির চলো, এখনই সবাই এসে পড়বে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে।
ছুটতে ছুটতে পাশের বাড়িটার আড়ালে চলে যাবার আগে একবার পিছন ফিরে দেখল জুলিয়াস। এখনও বারের পিছনের দরজা খুলে কেউ বেরিয়ে আসেনি। দু’জনে দু’পাশ থেকে জারভিসের হাত ধরে দ্রুত এগিয়ে গেল নদীর দিকে।
নদীর ধারে পৌঁছে জারভিসের নেশা কিছুটা পাতলা হয়ে এল। ছাড়া পেলে এই তিনজনের যে কি দুরবস্থা করবে তা সবিস্তারে গালাগাল সহ বর্ণনা করল সে।
কথার কোন জবাব না দিয়ে ওকে ঘোড়ায় তুলে পায়ে রেকাব পরিয়ে ঘোড়ার সাথে ভাল করে বেঁধে দিল ওরা। বারের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে লক্ষ করল পিছনের উঠানে এখন লোক জড়ো হয়েছে। কেউ পিছু নেয়নি দেখেই বোঝা যাচ্ছে পালাবার পথে ওদের দেখেনি কেউ। উঠানে চাকের মৃতদেহ দেখে সবাই মনে করবে জারভিসই ওকে খুন করে পালিয়েছে।
তোমার কি মনে হয় শেরিফ জারভিসকেই খুনী সাব্যস্ত করে লোকজন নিয়ে ওকে খুঁজতে বেরুবে? প্রশ্ন করল নডি।
সেটাই স্বাভাবিক জবাব দিল জুলিয়াস। আকাশের দিকে একবার চেয়ে সে আবার বলল, মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে, বৃষ্টির পরে ওরা আর ঘোড়ার পায়ের। ছাপ দেখে আমাদের খুঁজে বের করতে পারবে না-সব চিহ্ন ধুয়ে মুছে যাবে বৃষ্টিতে।
জনি বলে উঠল, আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়? আগামীকাল আমরা যদি শেরিফকে জানাই আমার একজন কর্মচারী জারভিসকে উধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে গিরিপথের দিকে যেতে দেখেছে, তাহলে নিশ্চয়ই এদিকে খোজা বৃথা মনে করে খোজাখুজি বাদ দেবে ওরা-কি বলো?
বুদ্ধিটা ভালই করেছ, সমর্থন করল জুলিয়াস। জারভিসকে এখন এমন জায়গায় রাখতে হবে যেন কেউ ওকে খুঁজে না পায়। ওর নিরাপত্তাই এখন আমাদের কাছে সবচাইতে বড়। আমরা সবাইকে সত্যি কথা জানাব বিপদ পার। হবার পর। তবে লোলাকে তুমি সব কথা খুলে বলতে পারো, নডি!
ঠিক আছে, সায় দিল সে।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জারভিসকে সাথে করে লোলাদের র্যাঞ্চের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল জুলিয়াস।
বারের পিছনের উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা অল্পক্ষণের জন্যে মিস করল মেডক। মাত্র পনেরো মিনিট আগেই সে রকিং এইচের দিকে রওনা হয়ে গেছে। ওখানে একটা কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে তার।
দিনটা ভালই কেটেছে আজ। এখন মাত্র দুটো ব্যাপারে সে একটু বিব্রত। প্রথমটা অবশ্যই জুলিয়াস, কিন্তু সেটাও আর দু’একদিনের ব্যাপার। নকার কাজটা শেষ করতে পারেনি বটে, কিন্তু হোয়েলকে লাগানো হয়েছে এবার। লোকটা হিউ হাপারের মতই দক্ষ। ওরা একবার সামনাসামনি হলেও জুলিয়াসের আয়ু শেষ।
ওর মাথা ব্যথার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এডমন্ড ফিনলে। ওর ব্যাপারেও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মেডক। লোকটা কাজ করছে বটে; কিন্তু ওর নিজস্ব একটা মতলবও আছে। বোকাটা অভিনয় করতে গিয়ে সত্যি সত্যিই পেপির প্রেমে পড়ে গেছে। পারলে সে নিজেই এখন রকিং এইচ ভোগ করবে।
বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করল। পাতলা বর্ষাতিটা বার করে নিল মেডক। মাথা থেকে সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলল সে। জুলিয়াস মারা পড়বেই-কেবল সময়ের। অপেক্ষা { এডও মরবে, কিন্তু তার আগে কগপত্র হাত করে নেবে মেডক। পিস্তলের মুখে কাগজ সই করে দেয়া ছাড়া কেন এয়ই থাকবে না ওর। এক সপ্তাহ পরে সেই ব্যবস্থাই করবে সে। আপন মনেই হেসে উঠল মেডক-প্ল্যান করেই সে এক সপ্তাহের জন্যে ওদের হানিমুনে যেতে দিয়েছে।
র্যাঞ্চে পৌঁছে আস্তাবলে ঘোড়া রেখে নিজের কেবিনে ঢুকে পোশাক বদলে নিল মেডক। তারপর গ্লাসে খানিকটা হুইস্কি ঢেলে এক চুমুকে শেষ করে বড় বাড়িতে গেল সে। মাডি দরজা খুলে দিল-ওর চোখমুখ এখনও ফোলা।
বিয়ে কেমন হলো? প্রশ্ন করল সে।
অন্যান্য বিয়ের মতই, জবাব দিল মেডক। এবার নিজের ঘরে ফিরে যাও তুমি, বুড়োর সাথে কিছু কথা আছে আমার।
সেবাস্টিন দত্তের ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে বিছানার দিকে চাইল মেডক। প্রতিবারই সে আশা করে ঘরে ঢুকে দেখবে সেবাস্টিন দত্ত তার বিছানায় মরে পড়ে আছেন। এগিয়ে গেল মেডক।
বুড়া কি এখনও বেঁচে আছ? ডাকল সে।
কোন সাড়া সেই-চোখও বন্ধ।
কি হলো, জবাব দাও না কেন, জেগে আছ? অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল মেডক।
জেগেই আছি, বলো, জবাব এল এবার।
তৃপ্তির সাথে হাসল মেডক। আজ শেষ কথা বলবে সে।
এইমাত্র বিয়েটা দেখে ফিরলাম। আমার লোককেই বিয়ে করল তোমার মেয়ে পেপি, বলল মেডক। দাঁত বের করে হাসছে সে। হানিমুনে গেছে ওরা, ফুর্তিতে আছে। দুঃখের বিষয় ওরা ফিরে এসে দেখবে তুমি পটল তুলেছ।
মুখ তুলে চাইলেন সেবাস্টিন দত্ত-কিন্তু কোন কথা বললেন না।
হ্যাঁ, আজ রাতেই মৃত্যু হবে তোমার। দু’দিন পরে তোমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে কবর দেয়া শেষ হলে উকিল তোমার উইলটা খুলে সবার সামনে পড়বে। অর্ধেক পাবে পেপি, বাকি অর্ধেক জারভিস। হঠাৎ দুর্ঘটনায় জারভিস মারা যাওয়ার পর সবই পাবে পেপি-মানে এড। চুক্তি অনুযায়ী সব আমার হাতে তুলে দিয়ে তার পাওনা টাকা চাইবে এড। তার সব পাওনাই মিটিয়ে দিয়ে চিরদিনের জন্যে বিদায় করব আমি। কি বলো, সুন্দর সহজ সরল প্ল্যান করেছি না?
তোমাকে খুন করব আমি, দাঁতে দাঁত চেপে বললেন সেবাস্টিন?
সে সুযোগ আর তোমার হবে না বুড়া মিয়া, মরার আগে যীশুর নাম জপে নাও।
বালিশ থেকে একটু মাথা উঁচু করে কান খাড়া করলেন সেবাস্টিন। উঠানে কয়েকটা ঘোড়া এসে থামার আওয়াজ শোনা গেল। শহর থেকে ফিরেছে ওরা।
তোমাকে মারার জন্যে তোমার বালিশটাই ব্যবহার করব আমি, বলে চলেছে মেডক। এর আগে কোনদিন মানুষ মারতে বালিশ ব্যবহার করিনি, তবে মনে হয় ওতে কাজ হবে। আগামীকাল তোমাকে দেখে সবাই মনে করবে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তোমার। বিদায়, কাঞ্জুস বুড়া, গুড-বাই! বালিশটা নেয়ার জন্যে ঝুঁকল মেডক। বাড়িতে ঢুকেছে কেউ-তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। আবার কি হলো? তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরুতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। হোয়েল বারান্দা দিয়ে এগিয়ে আসছে।
ষাঁড়ের মত চ্যাঁচাচ্ছ কেন, কি হয়েছে? বিরক্ত স্বরে ধমকে উঠল মেডক।
চাক মারা পড়েছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল হোয়েল। জারভিস নিরুদ্দেশ। মনে হচ্ছে সে-ই চাককে গুলি করে পালিয়েছে।
অবিশ্বাস্য! কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না মেডক। প্রকৃতিস্থ অবস্থাতেই জারভিস সোজা গুলি চালাতে পারে না-সেই মানুষ মাতাল অবস্থায় চাকের মত লোককে মারে কি করে?
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিল হোয়েল। খেলায় চাকই একচেটিয়া ভাবে জিতছিল। টয়লেটে যাবার সময়ে জারভিস বেসামাল ভাবে টলছে দেখে জলদি আবার খেলা চালু করার উদ্দেশে চাক নিজেই, ওর সাথে সেলুনের পিছনে গেছিল। অল্প পরে গুলির আওয়াজে সবাই ছুটে পিছনের উঠানে গিয়ে দেখে চাক মরে পড়ে আছে আর জারভিস উধাও হয়েছে।
পার্কের কেউ আসল ঘটনা আঁচ করতে না পারলেও মেডক ঠিকই সন্দেহ করল এটা জুলিয়াসেরই কাজ। জারভিসকে কিডন্যাপ করেছে সে। বাধ্য হয়ে সেবাস্টিন দত্তকে এখন আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে হবে তার নিজের স্বার্থেই।
একটু পরে আমার কামরায় এসো, তোমার সাথে কথা আছে, অনিশ্চিত স্বরে বলল মেউক।
হোয়েল চলে যেতেই আবার বিছানার পাশে ফিরে এল সে। সেবাস্টিন দত্তের দিকে একনজর চেয়ে বাতি নিভিয়ে নিজের ঘরে ফেরার জন্যে পা বাড়াল মেডক।
পিছন থেকে সেবাস্টিন দত্তের গলার স্বর শুনে থমকে দাঁড়াল সে। আবার দেখা হবে, মেডক-বিছানা ছেড়ে ওঠার শক্তি যেদিন হবে সেদিন তোমাকে খুন করব আমি।
চুপ করো! ধমক দিল মেডক। যা কোনদিন পারবে না তা নিয়ে মিছে বড়াই কোরো না।
১৫. পাঁচদিন পর বেশ রাতে
পাঁচদিন পর বেশ রাতে নডির বাসায় হাজির হয়ে ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল জুলিয়াস। মারিয়াও উঠেছে-আগুনটাকে একটু উস্কে কফির জন্যে পানি চাপিয়ে দিল সে।
জারভিস কোথায়? প্রশ্ন করল নডি। ওকে কি বেঁধে রেখে এসেছ?
না, ওর পিস্তল, ঘোড়া আর বুট লুকিয়ে রেখেছি। সাপকে ওর ভীষণ ভয়-জুতো ছাড়া ঘরের বাইরে পা বাড়াতেই সাহস পাবে না ও। ওর সামনেই বাড়ির আশেপাশে পাঁচ-পাচটা র্যাটল স্নেক মেরেছি আমি।
জবাব শুনে হেসে ফেলল নডি। আর যদি আগুন জ্বালায়?
সে ব্যবস্থাও রাখিনি-ম্যাচ নিয়ে এসেছি। ওর কাছে টিনের খাবার খোলার জন্যে একটা ছুরি ছাড়া আর কিছুই নেই। কিন্তু এদিককার কি খবর?
জারভিসের খোঁজে পুরো একটা দিন কাটানোর পর ওকে গিরিপথ দিয়ে পালাতে দেখা গেছে শুনে খোজাখুঁজি বন্ধ করেছে শেরিফ। ওর ধারণা জারভিস ভেগে গেছে।
মেডক কি বলে?
কেমন করে যেন ব্যাটা ঠিকই ব্যাপারটা আঁচ করেছে-শেরিফকেও সে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পাত্তা পায়নি। ডনকে চেনো না?
হ্যাঁ, জনির খামারে কাজ করে।
ওকে রকিং এইচে কাজের খোঁজে পাঠানো হয়েছিল। কাজে যোগ দিয়ে পার্কের উত্তরে একটা গুপ্ত আস্তানায় তোমাদের দেখা গেছে বলে একটা গুজব ছড়িয়েছে সে ওদের মধ্যে। মেডকের লোকজনকে বিপথে চালানোর জন্যে লোক লাগিয়ে ওখানে কিছু পায়ের ছাপের ব্যবস্থাও করেছে সে। কয়েকদিন ওদিকেই বৃথা খোজাখুঁজিতে ব্যস্ত থাকবে মেডক।
নডির থেকে মারিয়ার দিকে মুখ ফেরাল জুলিয়াস। এমন সত্যিকার বন্ধু কয়জনের থাকে? তোমাদের এই উপকারের কথা কোনদিন ভুলব না আমি।
সে কথা থাক-এখন কি করবে তাই বলো। দাবি জানাল নডি।
একটা মতলব এসেছে আমার মাথায়, সকালেই পেপি আর এডের সাথে দেখা করতে যাব।
এক সপ্তাহ তো এখনও শেষ হয়নি-লোলা কি বলেছিল মনে নেই?
মনে আছে, হেসে ফেলল জুলিয়াস। কিন্তু ওদের সাথে দেখা করাটা খুব জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কবে দেখা করবে ভাবছ?
কাল সকালেই রওনা হব-শহরে কবে যাচ্ছ তুমি?
আগামীকালই যাব।
শহরে খবর ছড়িয়ে দিয়ে যে আমিই চাককে মেরে জারভিকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছি, কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা দু’জনে শহরে হাজির হব। কিন্তু সাবধান, কথাটা যে তুমি ছড়িয়েছ এটা যেন কেউ টের না পায়।
চিন্তা নেই, রকিকে কাজটা বুঝিয়ে দিলেই হবে। চুল ছাটার দোকান থেকে আগুনের মতই খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
রাতটা নডির ওখানে কাটিয়ে ভোর বেলাতেই রওনা হয়ে গেল জুলিয়াস। সন্ধ্যার দিকে বাবার শিকারের আস্তানায় পৌঁছুল সে।
পেপি আর এড এখনও এখানেই আছে বোঝা যাচ্ছে। কেবিনের কাছেই ওদের ঘোড়া দুটো বাধা রয়েছে লক্ষ করল জুলিয়াস। হঠাৎ চোখে পড়ল তার বোন হাসতে হাসতে ছুটে পালাচ্ছে, পিছনে খেলার ছলে ওকে তাড়া করেছে এড। পেপি ধরা পড়তেই হেসে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল দু’জনেই। ওরা যে সুখী তা ওদের দেখলেই বোঝা যায়। থমকে দাঁড়াল জুলিয়াস-ইতস্তত করছে, ওদের আনন্দে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে চায় না সে।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। এড দেখে ফেলেছে ওকে। পেপিকে জড়িয়ে থেকেই সে বলে উঠল, দেখো কে এসেছে! এখনও হাসছে সে।
তৃপ্ত আবেশে এডের বুকে মাথা গুঁজে রেখে চোখ বুজেই সে জবাব দিল, ওকে বলে দাও আমরা কেউ বাড়ি নেই।
এড চিৎকার করে বলল, যাও, বিরক্ত কোরো না, দেখছ না আমরা বাড়ি নেই?
হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়িয়ে পেপিকেও টেনে তুলল এড।
পেপির চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে। গাল দুটোয় গোলাপী রঙ ধরেছে। আনন্দে হাসছে ওর সারা অঙ্গ।
অসময়ে এসে পড়ে তোমাদের রস-ভঙ্গ করলাম, বিব্রত ভাবে বলল জুলিয়াস।
না, তুমি আসবে বলেই আশা করছিলাম, জবাব দিল এড। সেইজন্যেই তো আমরা কোথায় থাকব জানিয়ে এসেছিলাম।
একটু দুশ্চিন্তার ছায়া দেখা দিল পেপির মুখে, বাবা কেমন আছেন? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল সে।
আগের মতই-কোন পরিবর্তন নেই।
আর জারভিস?
লোলাদের ব্যাঙ্কে একা রেখে এসেছি ওকে। ভয় নেই, ও যেন কোথাও না যায় সে ব্যবস্থা করে এসেছি। বিয়ের রাতে ওকে আনার সময়ে চাক মারা পড়েছে।
ক্ষতি নেই, দুশমন আর একজন কমল, নির্বিকার গলায় মন্তব্য করল এড।
জুলিয়াসকে কিছুতেই ছাড়ল না ওরা। বাধ্য হয়েই থাকতে হলো ওকে। অনেক রাত অবধি ওরা দু’জন কত আনন্দ উপভোগ করছে সেই বৃত্তান্তই শুনতে হলো ওকে। মাঝে মধ্যে যে ওর, একটু আধটু হিংসে হয়নি এমন নয়-মনে হয়েছে যেন ওরা দু’জনেই পৃথিবীর সব আনন্দ লুটে শেষ করে ফেলেছে, জুলিয়াসের জন্যে আর কিছুই অবশিষ্ট রাখবে না। তবু খুশিতে মনটা ভরে থাকল-কাজের কথাটা সে কিছুতেই পাড়তে পারল না।
শেষ পর্যন্ত এই সুযোগ করে দিল, বলল, বুঝতে পারছি একটা প্ল্যান তোমার মাথায় ঘুরছে-শুনি কি প্ল্যান করেছ?
ঠিকই ধরেছ তুমি, কিন্তু এতে পেপির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
মুখ তুলে জুলিয়াসের দিকে চাইল পেপি। তোমরা যা ভাল মনে করো সেইমতই চলব আমি।
কবে ফিরছ তোমরা?
ফিরতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু কথামত আগামীকালই বিকেলে ফিরতে হবে।
তোমাদের ওই দুশমনদের খপ্পরে ফিরে যেতে দিতে মন সরছে না আমার, কিন্তু অন্য কিছু করতে গেলেই মেডকের লোকজনের সাথে সামনাসামনি মোকাবিলা করতে হবে-অনেক লোক হতাহত হবে। বাড়ি ফিরে তোমরা সবদিক সামলাতে পারবে বলে মনে করো?
জবাব দেয়ার আগে একটু চিন্তা করে নিল এড। মেডক আমাকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে বলেই মনে হয়। কিন্তু আমাকে ছাড়া ওর চলবে না। মনে হয় বাড়ি ফেরার ঝুঁকি নেয়া যায়।
বাড়ি ফিরে একটা দিন অপেক্ষা করবে তোমরা। শুনতে পাবে আমি চাককে মেরে জারভিসকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছি। শুনে পেপির এমন ভাব দেখাতে হবে যেন আমাকে সামনে পেলে খেয়েই ফেলবে।
মাথা ঝাঁকাল পেপি। তারপর?
আরও শুনবে মঙ্গলবার দুপুর বারোটায় শেরিফের কাছে আমি আত্মসমর্পণ করব। এই খবর শুনে মেডক কি করবে বলে মনে হয়, এড?
আরও কিছুটা কফি কাপে ঢেলে নিয়ে এড বলল, স্বভাবতই মেডকও তার লোকজন নিয়ে উপস্থিত থাকবে সেখানে। কিন্তু এতসব করে কি লাভ হবে? হাতের মুঠোয় পেলে শেরিফ সোজা জেলে ভরবে তোমাকে।
না, তা সে চাইলেও পারবে না। কিন্তু সে-কথা থাক, পেপিকে সেদিন ওখানে উপস্থিত দেখতে চাই আমি। বাবা অসুস্থ, জারভিস নিরুদ্দেশ এই অবস্থায় পেপিই রকিং এইচের মালিক। সবার সামনে মেডক আর তার লোকজনকে বরখাস্ত করবে পেপি। পেপির নির্দেশই গ্রাহ্য হবে-এতগুলো সাক্ষীর সামনে মেডকের আর করার কিছুই থাকবে না।
মেডক যদি না মানে, জোর খাটায়?
মাথা নাড়ল জুলিয়াস, এতটা সাহস সে পাবে না। তাহলে আইনের বিরুদ্ধে যেতে হবে তাকে।
ব্যাপারটা এতে মিটবে বলে মনে হয় না, মন্তব্য করল এড। চেষ্টা করতে দোষ নেই, তবে আমি জানি এত সহজে হাল ছাড়বে না মেডক। রাতটা পেপিদের সাথে কাটিয়ে ভোর বেলাতেই বিদায় নিল জুলিয়াস। ওদেরও আজই রকিং এইচে ফিরে যাবার কথা। হানিমুনের সময়টাকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করে বিকেলের দিকে ফিরবে ওরা। নডির র্যাঞ্চে যাবার পথে সমস্যাটা নিয়ে আবার নতুন করে ভাবল জুলিয়াস। প্ল্যানটা ভালই, কিন্তু কিছুই বলা যায় না, হাজারো কারণে বানচাল হয়ে যেতে পারে ওর প্ল্যান। কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছে না সে। সন্ধ্যা নাগাদ নডির ওখানে পৌঁছে গেল ও।
মঙ্গলবার দুপুরে শেরিফের অফিসের সামনে একটা নাটকের ব্যবস্থা করে এসেছি। জুলিয়াস তার প্ল্যানের কথা নডিকে খুলে বলল। সাহায্যের দরকার হতে পারে আমার, তুমি ওইদিন বন্ধুবান্ধবকে ওখানে উপস্থিত থাকতে বলে রেখো। তাছাড়া মেডককে তার লোকজন সহ বিদায় করার পর রকিং এইচে কাজ করার জন্যেও ডজনখানেক লোক দরকার হবে। এসবের ব্যবস্থা আমাদের আগে থেকেই করে রাখতে হবে।
চিন্তা কোরো না, সব ব্যবস্থা আমি করব। তুমি কি এর মধ্যে আর শহরে যাচ্ছ?
আগামীকাল জারভিস নিরাপদ আছে কিনা দেখে রাতের বেলা শহরে পৌঁছব আমি। একটা থাকার জায়গা খুঁজে নিতে হবে আমাকে।
লোলাদের ওখানেই তো থাকতে পারো তুমি? মুচকি হেসে প্রস্তাব দিল নডি। দরকার হলে ওখানে থাকার কথা লোলাই বলছিল।
১৬. রাতে শহরের রাস্তা দিয়ে না গিয়ে
রাতে শহরের রাস্তা দিয়ে না গিয়ে মাঠের ভিতর দিয়ে ঘোরা পথে লোলাদের বাড়ির পিছনে পৌঁছল–জুলিয়াস। আস্তাবলে ঘোড়া রেখে এসে বাড়ির সদর। দরজায় টোকা দিল ও।
আইডা বেইলি নিজেই দরজা খুলল। ভিতরে এসো, জুলিয়াস। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। নড়ি খবর পাঠিয়েছে আগামীকাল সকালে সে দেখা করবে তোমার সাথে।
ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক চাইল জুলিয়াস। লোলাকে আশেপাশে কোথাও দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কই, লোলাকে দেখছি না?
অ্যালেন কারভারের স্ত্রী অসুস্থ, ব্যাখ্যা করল আইডা। অ্যালেন বাড়ি না। ফেরা পর্যন্ত তার বউ-এর দেখাশোনা করতে গেছে লোলা। ওর ফিরতে রাত হবে। চলো, তোমাকে তোমার কামরা দেখিয়ে দিই।
অনেক আশা নিয়ে এসেছিল জুলিয়াস, হতাশ হলো। উপায় নেই। ধন্যবাদ জানিয়ে আইডাকে অনুসরণ করল সে।
লোলার ঘরটাই তাকে দেয়া হয়েছে। লোলার মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই খুঁটিয়ে চারদিক লক্ষ করল সে। সবটাই সুন্দর পরিপাটি করে গুছানো।
বাতি নিভিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে লোলার পদ শব্দের প্রতীক্ষায় রইল জুলিয়াস। বিছানার চাদর বদলানো হলেও লোলার উপস্থিতির একটা মৃদু গন্ধ এখনও হালকাভাবে লেগে আছে ঘরটাতে। তার মনে হলো সারারাত বুঝি একটুও ঘুমোতে পারবে না ও। কিন্তু লোলা ফেরার অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়ল। ক্লান্ত জুলিয়াস।
সকালে দরজায় টোকা দিয়ে কফির কাপ হাতে ঘরে ঢুকল লোলা।
না, না, বিছানা ছেড়ে ওঠার দরকার নেই, হাসতে হাসতে বলল লোলা। কফি খেয়ে নাও। সকালে বিছানা ছাড়ার আগে এককাপ কফি না হলে তো তোমাদের পুরুষ জাতের মেজাজের চোটে মেয়েদের টেকাই দায় হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশের একটা প্রচলিত প্রবাদ, স্বামীর পায়ের তলাতেই মেয়েদের বেহেস্ত। সুতরাং চোখ কান বুজে পুরুষ জাতের সেবা করে যাও-স্বর্গ মিলবে! হাসি মুখে জবাব দিল জুলিয়াস।
কফির কাপটা সাইড টেবিলে নামিয়ে দিয়ে দু’হাত কোমরে রেখে কপট রোষে জুলিয়াসের দিকে চাইল লোলা। রাতে ভাল করে বিশ্রাম নেয়ার সময় না পেলেও লোলার চেহারায় ক্লান্তির কোন ছাপই নেই।
কাছে এসো, ডাকল জুলিয়াস।
উঁহু, এখন না। রাতে ঘুম হলো?
তোমার বিছানার মাঝখানটা বেকায়দা রকম উঁচু।
তাতে তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে বলে তো মনে হলো না। রাতে উঁকি দিয়ে দেখলাম ছোট বাচ্চার মত অঘোরে ঘুমোচ্ছ তুমি!
বিছানার ওপর উঠে বসল জুলিয়াস। কালরাতে তুমি এসেছিলে এই ঘরে? কখন?
অনেক রাত হয়েছিল-মায়ের কাছে দেরি করে ফেরার জন্যে বকুনিও শুনেছি। তবে তোমার নাক ডাকছে না দেখে আশ্বস্ত হলাম।
সোজা হয়ে বসল জুলিয়াস। কাছে এসো, লোলা।
হাসতে হাসতেই সে মাথা নেড়ে বলল, না।
কেন আসবে না?
লৌলার মুখের ভাব ধীরে ধীরে বদলে গম্ভীর হয়ে গেল। আজ সকালে তোমার কাজ রয়েছে, কাজটা কি তা না জানলেও বুঝতে পারছি সেটা বিপজ্জনক। তোমার মন এখন বিক্ষিপ্ত না হওয়াই ভাল।
জুলিয়াস উপলব্ধি করল ভুল বলেনি মেয়েটা। জোর করে একটু হাসল সে। আজ দুপুরে শেরিফের সাথে দেখা করব আমি। মেডক, পেপি, আর এড সহ অনেকেই থাকবে ওখানে। আশা করি আজই ব্যাপারটা মিটে যাবে। তারপর কি করব আমি?
সে তোমার খুশি। আমি তো আর চলে যাচ্ছি না।-এখানেই থাকব।
ঠিক আছে, তবে কাজ সেরেই আমি আসব।
ত্রস্ত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পথে দরজার কাছ থেকে ফিরে তাকিয়ে সে বলল, অনেক কথাই বলার ছিল আমার, কিন্তু এখন বলব না। আজ সকালে খুব নার্ভাস থাকব। কাজ করতে কত কাপ আর প্লেট যে আমার হাতে আজ ভাঙবে তার ঠিক নেই। দয়া করে তাড়াতাড়ি ফিরে রেহাই দিয়ে আমাকে।
সারা সকাল আর লোলার দেখা পেল না জুলিয়াস। বিছানা ছেড়ে কাপড়-জামা পরে তৈরি হবার আগেই জুলিয়াসকে একা রেখে মায়ের সাথে কাজে চলে গেল লোলা।
ধীর গতিতে কাটল সকাল। অস্থিরভাবে পায়চারি করেই কেটেছে সময়টা। আজ শেরিফের অফিসে কি ঘটবে জানে না জুলিয়াস। গুছিয়ে কত শক্তভাবে পেপি কথাগুলো বলে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এডের ওপরও খানিকটা নির্ভর করবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা মেডক কিভাবে কথাটা নেয়। শহরে আজ একটা বিরাট গোলমাল বেধে যেতে পারে। কি হবে তা আগে থেকে কিছুই বলা যায় না-তবে এটা ঠিক যে মেডক তার এতদিনের প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে যাওয়াটা কিছুতেই মুখ বুজে সহ্য করবে না।
দুপুরের কিছু আগে জনিকে সাথে করে উপস্থিত হলো নডি।
আমাদের প্রস্তুতি শেষ, বলল সে। রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের বারোজন লোক। ঘটনা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ওদের। ওরা নিজের থেকে কিছু করবে না, কিন্তু গোলাগুলির জন্যে তৈরি থাকবে। শেরিফের অফিসে আমাদের লোকজন হাজির হয়ে গেছে শেরিফের ধারণা তোমার দেখা পাওয়া যাবে না আজ।
মেডকের কি খবর?
আধঘণ্টা আগেই এসেছে সে। ওর সাথে রয়েছে হিউ, হোয়েল, ফক্সি আর হোরেস।
এড আর পেপি? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
ওদের দেখিনি আমি। হয়তো এতক্ষণে এসে গেছে।
হয়তো দিয়ে কাজ হবে না, নিশ্চিত হতে হবে আমাদের। আজকে ওদের দু’জনের উপস্থিতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে হবে।
আমি চট করে দেখে আসছি, বলেই জবাবের অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নডি।
দুপুর বারোটা বেজে গেছে। জানালার ধারে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। জুলিয়াস। নডি এসে খবর দিল পেপি আর এডের কোন দেখা নেই। কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। পৌঁছতে এত দেরি করছে কেন ওরা?
আরও অপেক্ষা করতে হবে আমাদের, চিন্তিত মুখে মন্তব্য করল জুলিয়াস। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষাও করা যাবে না।
আবার পায়চারি আরম্ভ করল জুলিয়াস। বারোটা পঁয়ত্রিশে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল তার।
আর অপেক্ষা করা যায় না, বলে উঠল জুলিয়াস। এড আর পেপি হয়তো দেরিতে এসে হাজির হতে পারে, তবে ওদের ওপর আর ভরসা করা চলে না।
ইচ্ছা করেই ওরা ডুবিয়েছে তোমাকে, তিক্তভাবে বলল নডি।
মাথা নাড়ল জুলিয়াস। ও ভাল করেই জানে এড বা পেপি তা করতেই পারে না-নিশ্চয়ই ওদের কোন বিপদ ঘটেছে। মেডক লোকটা বড় বেশি ধুরন্ধর। তার ভয় হচ্ছে মেডকই ব্যাপারটা আঁচ করে রকিং এইচে ওদের বন্দী করে রেখেছে।
এখন শেরিফের ওখানে গিয়ে কি করবে তুমি? প্রশ্ন করল নডি।
জানি না এখন কি ঘটবে। তবে কথা মত আমাকে হাজির হতেই হবে। মেডক থাকবে ওখানে-সবার সামনে আমাকেই মুখ খুলতে হবে আজ।
আমরা তোমার সাথে আছি জুলিয়াস, উৎসাহ জোগাল নডি।
হ্যাঁ, আজই একটা হেস্তনেস্ত করে ফেললো, আমরা শেষ পর্যন্ত তোমার পাশে লড়ব, জনিও সাহস দিল।
ওদের দুজনের আশ্বাসে জুলিয়াসের বুকের বল অনেক বেড়ে গেছে। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা। সূর্যটা ঠিক মাথার ওপর। একটুও হাওয়া নেই। কিন্তু এসব কিছুই খেয়াল করল না জুলিয়াস। পেপি আর এডকে ছাড়াও অন্তত অর্ধেক কাজ তার নিজেরই করতে হবে।
মোড় ঘুরতেই শেরিফের অফিসের সামনে জটলাটা চোখে পড়ল। মেডককে দেখা যাচ্ছে, ওর দু’পাশে রয়েছে হিউ আর হোয়েল। ককসি, বোকো, কলিন আর সেলুনের মালিক অ্যালেন কারভারকেও ওখানে দেখতে পেল জুলিয়াস।
এগিয়ে যেতে যেতে নিচু গলায় জনি বলল, খেয়াল করেছ মেডক তার লোকজনকে কেমন জায়গা মত দাঁড় করিয়েছে? দু’জন ওর সাথে, দু’জন জটলার বাইরে। কিছু ঘটালেই মাটিতে শুয়ে পড়তে হবে।
জুলিয়াসও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। কাঁধ ঝাঁকাল সে-সব সময়ে প্ল্যানমাফিক কাজ হয় না।
শেরিফই কথা শুরু করল। ওরা জটলার কাছাকাছি পৌঁছতেই ডিগবি দুই কদম এগিয়ে এসে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, জুলিয়াস, তোমাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে-লক্ষ্মী ছেলের মত পিস্তলটা দিয়ে দাও।
এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? জবাব দিল জুলিয়াস। আমাকে কি অপরাধে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলবে তো?
তোমার বিরুদ্ধে দুটো চার্জ আছে, খুন আর কিডন্যাপিং। কিংবা জোড়া খুনও হতে পারে-জারভিস কি বেচে আছে?
আমার সাথে শেষ যখন ওর দেখা হয় তখন সে বেঁচেই ছিল।
প্রমাণ কি?
প্রমাণ করা আমার দায়িত্ব না। জারভিসকে যে কিডন্যাপ করা হয়েছে। একথা কে বলল? হতে পারে সে নিজের খুশিমত কোথাও বেড়াতে গেছে?
মেডক আর চুপ করে থাতে পারল না। ভিড় ঠেলে শেরিফের পাশে পৌঁছে রাগের সাথে বলল, সময় নষ্ট করে লাভ নেই-সবাই জানে জুলিয়াসই কিডন্যাপ করেছে ওর ভাইকে।
সোজাসুজি মেডকের চোখে চোখ রাখল জুলিয়াস। ঘটনাটা তুমি নিজের চোখে দেখেছ? শোনা কথায় কাজ হবে না, প্রমাণ চাই আমি।
সামনাসামনি আক্রমণে মুহূর্তের জন্যে হতবাক হয়ে গেল মেডক। এদিক ওদিক চেয়ে হঠাৎ হোরেসকে দেখতে পেয়ে সে বলে উঠল, হোরেস, তুমিই তো শুনে এসেছিলে জারভিসকে কিডন্যাপ করা হয়েছে-কার কাছে শুনেছ?
বারে অ্যালেন কারভারের কাছে, জবাব দিল হোরেস।
তুমি কার কাছে জেনেছ? অ্যালেনকে প্রশ্ন করল মেডক।
রকির কাছে।
তোমাকে কে বলেছে, রকি?
দাঁত বের করে হাসল নাপিত রকি। কেন, হোরেসই তো আমার সেলুনে দাড়ি শেভ করার সময়ে ওকথা বলল।
ঘুরে ফিরে আবার সেইখানে। কয়েকজন মজা দেখে শব্দ করে হেসে উঠল। কিন্তু মেডকের চেহারা রাগে কুৎসিত হয়ে উঠেছে। সে বলল, মিছে সময় নষ্ট করা হচেছ। আমি জানি জারভিসকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। নইলে সে এমন হঠাৎ করে উধাও হবে কেন?
সে যে কেন নিরুদ্দেশ হয়েছে তা আমি জানি, চড়া গলায় বলল জুলিয়াস।
কথা আরম্ভ করে একটু থেমে রাস্তার দিকে চোখ ফেরাল সে। এখনও পেপি বা এডের কোন পাত্তা নেই। ওরা যে আসবে না তা বুঝে নিয়েছে জুলিয়াস।
বলো জারভিস কোথায়-সবাই আমরা শোনার অপেক্ষায় আছি, তাড়া দিল শেরিফ।
আসল কথা হচ্ছে, ধীরে ধীরে আরম্ভ করল জুলিয়াস। ও যা বলতে যাচ্ছে তাতে সাময়িকভাবে কথাটা পেপি আর এডের বিপক্ষে যাবে। রোববার আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল জারভিস। বোনের সদ্য বিয়েতে মানসিকভাবে খুবই বিব্রত ছিল সে। তাছাড়া এড আবার মেডকের লোক-সে…
চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাল মেডক। বিয়ের সাথে কোন সম্পর্ক নেই এর। তুমি…
চুপ করো, ধমকে উঠল জুলিয়াস। কখনও না!
মেডকের হাত তার পিস্তলের বাঁটের খুব কাছে নেমে এসেছে। সে বুঝে নিয়েছে জুলিয়াস এরপরে কি বলবে। মারপিট করে হলেও তাকে থামাবেই মেডক।
কিন্তু শেরিফ বাধ সেধে ওদের দুজনের মাঝে এসে দাঁড়াল। পদমর্যাদার উপুক্ত গাম্ভীর্য নিয়ে সে দৃঢ় গলায় বলল, বাড়াবাড়ি কোরো না, মেডক। জুলিয়াস কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না-ওর কি বলার আছে শুনতে চাই আমি।
সবার মুখের দিকে একবার চাইল জুলিয়াস। সবক’টা চোখ ওর দিকেই চেয়ে আছে। জুলিয়াস যা বলবে তা সে প্রমাণ করতে পারবে না বটে, কিন্তু তার বক্তব্যটা ভুলে যাবে না কেউ। এতেই ওর অর্ধেক উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে।
খুব সহজ কথা, এতে কারও না বোঝার কিছুই নেই, আবার আরম্ভ করল জুলিয়াস। বাবা মারা যাবার পর রকিং এইচ দুই ভাগে ভাগ হয়ে এক অংশ পেপি আর অন্য অংশ জারভিস পাবে। মেডকের লোকের সাথে পেপির বিয়ের ফলে মেডক এখন সহজেই পেপির অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। আর জারভিস যদি কোন দুর্ঘটনায় মারা যায় তবে পুরোটাই মেডকের আয়ত্তে এসে যাবে। এই কারণেই জারভিস ভয়ে পালিয়ে গেছে।
জুলিয়াসের কথা শেষ হবার আগেই মেঙ্ক চিৎকার শুরু করল তার নামে মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে। তারপর হঠাৎ শেরিফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পিস্তল বের করার জন্যে হাত বাড়াল সে। কিন্তু পিস্তল বের করার আগেই ওর দু’পাশ থেকে দু’জন লোক মেকের হাত চেপে ধরল। হিউ আর হোয়েলকেও পাশে থেকে একইভাবে ধরে রাখল নডি আর জুলিয়াসের বন্ধুরা। একটু দূরে ফক্সি আর হোরেস আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের দুজনেরই পিঠে ছুঁয়ে রয়েছে দুটো পিস্তলের নল। অত্যন্ত তৎপরতার সাথে কাজ সেরেছে ওদের বন্ধু-বান্ধব।
মুহূর্তেই ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে ডিগবি নোব। কোন গোলাগুলি চলবে এখানে, কঠিন স্বরে ঘোষণা করল সে। যে-ই প্রথম পিস্তল ছোঁবে তাকেই গুলি করব আমি।
নির্জলা মিথ্যে কথা বলছে ও, চিৎকার করল মেডক।
সত্যি মিথ্যের প্রমাণ অবশ্যই নেব আমি, উত্তর দিল ডিগবি।
সেটা কি করে সম্ভব?
জারভিসকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।
দু’দিন পরেই আমি এখানে হাজির করব ওকে, শেরিফকে জানাল জুলিয়াস। কিন্তু ওর নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে।
ইচ্ছা করেই মেডকের দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসল জুলিয়াস। মেডক তার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়েছে বটে কিন্তু কিছু করতে গেলেই ওকে আবার ধরে ফেলবে জেনেই সে আর নতুন কোন চাল খাটাতে গেল না। ক্রেস্টলাইনে যে জুলিয়াসের পক্ষের অনেক লোক আছে তা ভাল করেই টের পেয়ে গেছে সে। শেরিফের দিকে চেয়ে সে জুলিয়াসের অভিযোগেরই প্রতিবাদ করল আবার। বলল, এখানে সবাই জানে জারভিসের সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভাল। সে এলে ওর মুখ থেকেই সবাই জানতে পারবে আসল কথা। জুলিয়াসের দিকে একবার রোষের সাথে চেয়ে সে আবার বলল, তবে আমার মনে হয় না তাকে জীবিত দেখতে পাবে কেউ-আমার ধারণা জুলিয়াসই তাকে শেষ করে রকিং এইচে একটা ভাগ বসাবার মতলবে আছে।আর এডমন্ড সম্বন্ধে আমার এইটুকুই বলার। আছে যে লোকটাকে চেনা দূরের কথা, পার্কে আসার আগে ওকে আমি দেখিইনি কোনদিন। সে আমার লোক কখনোই ছিল না।
কথা শেষ করেই রাস্তা পার হয়ে বারের দিকে রওনা হলো মেডক। ওর পিছু পিছু চলল হিউ আর হোয়েল। ওদের পিছনে ফক্সি আর হোরেস।
জুলিয়াস, দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ডিগবি; জারভিস কোথায় আছে?
সেটা বলব না এখন, তবে দু’দিনের মধ্যেই এখানে ওকে হাজির করব আমি।
ঠিক তো?
ঠিক।
আমাকে বলতে তোমার কি অসুবিধা? যাক গে, তুমি মেডক সম্পর্কে আজ একটা অবিশ্বাস্য আর কঠিন অভিযোগ এনেছ। তোমার কথাই যদি সত্যি হয় তবে ওর জেলে থাকা উচিত।
বিশ্বাস করো শেরিফ, ওটাই ওর জন্যে যোগ্য স্থান।
হঠাৎ দূরে রাস্তার ওপর একজন ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেল জুলিয়াস। লোকটা রাশ টেনে ঘোড়া থামিয়েছে। মনে হয় সে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। নিজের ভাইকে চিনতে দেরি হলো না জুলিয়াসের। আর কেউ এখনও চিনতে পারেনি ওকে।
দ্রুত চিন্তা করছে জুলিয়াস। এক মিনিটের মধ্যেই জানাজানি হয়ে যাবে জারভিসের উপস্থিতি! ওর সাথে সামান্য কথা বলার সুযোগ পেলেই ডিগবি তাকে জেলে ভরবে।
চট করে নড়ি আর জনিকে এক পাশে টেনে সরিয়ে নিয়ে উৎকণ্ঠিত স্বরে জুলিয়াস বলল, আমাদের লোকজনকে বিপদ এড়িয়ে থাকতে বলো-ওই ঘোড়াটা কার?
ওটা বোকোর কর্মচারীর-কেন?
ওকে জানিয়ে দিয়ে আমি ওর ঘোড়াটা ধার নিচ্ছি।
কোথায় যাচ্ছ তুমি?
এখন বলার সময় নেই। শেরিফের দিকে ফিরে সে আবার বলল, ডিগবি, আমি এখনই জারভিসকে আনতে যাচ্ছি।
সময় নষ্ট কোরো না, জলদি যাও, জবাব দিল শেরিফ।
ঘোড়া ছুটিয়ে মুহূর্তে দূরে চলে গেল জুলিয়াস। একেবারে দৃষ্টির আড়ালে যাবার আগে জুলিয়াস পিছন ফিরে দেখল শেরিফের অফিসের সামনে আবার লোকজনের জটলা বাড়ছে।
১৭. প্রথম কয়েক মাইল রকিং
প্রথম কয়েক মাইল রকিং এইচের পথ ধরেই গেল জুলিয়াস। তারপর সবার। অলক্ষ্যে র্যাঞ্চে পৌঁছবার জন্যে রাস্তা ছেড়ে অন্য পথ ধরল। যে কেউ ওর। ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখে দেখে সহজেই ওকে অনুসরণ করতে পারবে। কিন্তু সে বিষয়ে চিন্তিত নয় জুলিয়াস। ওর এখন একমাত্র চিন্তা মেডকের আগে তাকে র্যাঞ্চে পৌঁছতে হবে। লোকটা বুদ্ধিমান, জুলিয়াস কোথায় যাচ্ছে তা আন্দাজ করা ওর পক্ষে কঠিন হবে না।
বেয়ার ট্র্যাপ ক্রীক ঘুরে খামার বাড়ির পিছন দিকে উপস্থিত হলো জুলিয়াস। র্যাঞ্চটা খালি খালি দেখাচ্ছে-মাড়ি ছাড়া মেডকের বাকি সব লোকজনকে শহরে দেখে এসেছে সে। নিশ্চয়ই বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্যেই রেখে যাওয়া হয়েছে ওকে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে কারণ যে কোন সময়ে শেরিফ সহ কিংবা তাকে ছাড়াই মেডক এসে হাজির হবে এখন।
লঘু পায়ে দৌড়ে এক ছুটে বাড়ির কাছে চলে এল জুলিয়াস। বাড়িটার সামনের দিকের কোনায় এসে উঁকি দিল সে। কেউ নেই। তার মনে পড়ল, গতবার মাডি বাড়ির ভিতরেই ছিল। সম্ভবত এখনও তাই আছে। পিছনের দরজায় গিয়ে দেখল ওটা ভিতর থেকে বন্ধ। আবারও জানালা দিয়েই ঢুকতে হবে তাকে। কপাল ভাল ওর, পেপির ঘরের জানালাটা খোলা রয়েছে। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকল জুলিয়াস। বিছানার ওপর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে পেপি, দেয়ালের দিকে ফিরানো ওর মুখ।
চট করে দরজাটা বন্ধ করে এল জুলিয়াস। বিছানার কাছে ফিরে এসে ঝুঁকে পেপির কানে-কানে ফিসফিস করে বলল, কোন শব্দ কোরো না, পেপি, এখনি তোমার বাঁধন কেটে দিচ্ছি আমি।
মুখ ফিরিয়ে জুলিয়াসের দিকে চাইল পেপি। করুণ দেখাচ্ছে ওর চেহারা। গালে চোখের পানি শুকিয়ে দাগ পড়ে গেছে। উদ্ভ্রান্ত শূন্য চাহনি। ভয় আর বিষাদ যেন গ্রাস করেছে ওকে।
ছুরি বের করে পেপির বাঁধন কেটে দিল জুলিয়াস। ওরা মেরে ফেলেছে ওকে, হঠাৎ বলে উঠল পেপি।
কাকে? এডকে?
কাঁপা গলায় সে বলল, এডকে ওরা জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। ওকে নিয়ে যাবার একটু পরেই গুলির আওয়াজ শুনলাম। ফিরে এসে বলল এড ওদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এই নিয়ে হাসাহাসি করছিল ওরা। ফুপিয়ে কেঁদে উঠল পেপি!
যুক্তির সাথে মিলছে না কথাগুলো। এই অবস্থায় এডকে মেরে ফেললে ওরা পেপির সম্পত্তি কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবে? মেডকের পুরো প্ল্যানের চাবিকাঠিই তো এড?
চুপ করে এখানেই অপেক্ষা করো তুমি, মাডির একটা ব্যবস্থা করে তোমাকে নিতে ফিরে আসব আমি।
দরজায় কান পেতে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনে বারান্দায় বেরিয়ে এল জুলিয়াস। ঘরে খুব নিচু স্বরে কথা বলেছে ওরা, মাডি নিশ্চয়ই শুনতে পায়নি। পিছন ফিরে বাবার ঘরের খোলা দরজাটা দেখল জুলিয়াস। বাবার সাথে দেখা করা দরকার ওর-কিন্তু এখন সময় নেই। মাড়িকে কাবু করাই এখন তার প্রধান কাজ। পিস্তল বের করে পা টিপে টিপে বৈঠকখানার দিকে এগোল সে।
হাতের বামপাশের দরজাটা পার হয়ে এগোবার সময়ে পিছন থেকে পায়ের। শব্দ কানে এল ওর। পেপি ওকে অনুসরণ করছে মনে করে ফিরে চাইল জুলিয়াস। ভুল! মাডি আসছিল তার পিছনে পিস্তল ওঠারার সময় পেল না জুলিয়াস; তার আগেই মাডি পিস্তলের ব্যারেল দিয়ে আঘাত করল ওর মাথায়। চারদিক আঁধার হয়ে এল-জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল জুলিয়াস। বিফল হয়েছে সে।
জ্ঞান ফিরে জুলিয়াস দেখল গোলাঘরে শুয়ে আছে সে। তার হাত-পা শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। এখনও দিনের আলো রয়েছে-তারমানে বেশিক্ষণ অজ্ঞান ছিল না সে। কিন্তু তাতে কোন লাভ নেই, এখান থেকে ছাড়া পার্বার আর কোন সম্ভাবনাই তার নেই।
যন্ত্রণায় মাথাটা দপদপ করছে। পেটের ভিতরটা গুলাচ্ছে-গা বমি-বমি লাগছে। নিজের বোকামির জন্যে নিজের ওপরই ভীষণ রাগ হচ্ছে। সে মনে করেছিল তার পিছন দিক থেকে পেপিই আসছে। কিন্তু এমন কঠিন অবস্থায় মানুষের একটা ভুলই যথেষ্ট। এখন তাকে অসহায়ভাবে মেডক ফিরে আসা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। তারপর মেডক যে কি করবে তা ভাবতেই জুলিয়াসের গা শিউরে উঠছে। একটু কাত হয়ে পাশ ফিরে অন্যদিকে চাইল সে। গোলাঘরে সে একা নয়, এডও রয়েছে! মরেনি সে। ঘরের একটা খুঁটির সাথে বাধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এড।
জুলিয়াস ডাকল ওকে, এড…কতক্ষণে তোমার জ্ঞান ফিরবে তাই ভাবছিলাম, জবাব দিল সে। তুমি ধরা পড়লে কিভাবে?
তোমাকে আর পেপিকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিতে এসেছিলাম…কিন্তু পারলাম না। মাডির হাতে ধরা পড়ে গেলাম।
আমাদেরও শহরে যাওয়া আর হয়নি। আমারই আগে থেকে সাবধান হওয়া উচিত ছিল-মেডক ব্যাপারটা আঁচ করে আমাদের বন্দী করেছে।
পেপিকে সে জানিয়েছে তোমাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
স্বাভাবিক। ওর মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছে মেডক। আজ রাতে আমাকে আবার পুনর্জীবিত করা হবে-মেডক আশা করছে ততক্ষণে পেপি আমাদের জীবন বাঁচাবার জন্যে যে-কোন কিছু সই করতে রাজি হবে।
কি সই করবে ও?
আগামী দিনের তারিখে একটা চুক্তি সই করিয়ে আমাদের মেরে ফেলা হবে। পরে সেই চুক্তিপত্র মেডকের নামে পোস্ট করে পাঠানো হবে দূরের কোন শহর থেকে সবাইকে বলা হবে আমরা বেড়াতে গেছি-চিঠি পাওয়ার পরে জানানো হবে যে আমরা আর ফিরব না, তাই সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে চাই। তারপরে বিক্রির চুক্তিপত্র দেখানো হবে সবাইকে।
এখন তুমি কি করবে বলে ঠিক করেছ?
কি আর করতে পারি আমি? লড়ার চেষ্টা করতে পারি-কিন্তু কি লাভ হবে তাতে? হাত বাঁধা অবস্থায় থাকতে থাকতে এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, কেউ বাঁধন কেটে হাতে পিস্তল ধরিয়ে দিলেও অসাড় হাতে গুলি ছুঁড়তে পারব না আমি। হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠেছে এডের চেহারায়।
দেখি কি করা যায়, অনিশ্চিতভাবে বলল জুলিয়াস।
পেপির কি অবস্থা?
হাল ছেড়ে দিয়েছে-ওর কাছ থেকে এর বেশি কিছু আশাও করা যায় না।
ওরা কোন রকম নির্যাতন করেনি?
না।
যাক, তবু কিছুটা বক্ষা। ওরা যদি…’ কথা শেষ না করেই কান খাড়া করে মনোযোগ দিয়ে কি যেন শুনল সে। তারপর আবার বলল, আর সময় নেই, ওরা এসে গেছে।
শব্দ জুলিয়াসের কানেও গেছে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। কয়জন এল তা ঠিক বোঝা গেল না। উঠানে কথা বলার শব্দ হওয়ার অল্প পরেই গোলাঘরে ঢুকল মেডক। ওর পিছনে একে একে হিউ, হোয়েল, ফক্সি, হোরেস আর মাডি ঘরে ঢুকল। জারভিসও রয়েছে ওদের সাথে।
খুশিতে পেঁতো হাসি হেসে মাডি বলল, ওকে আমি শেষ করতে পারতাম, কিন্তু তোমার জন্যে জিইয়ে রেখেছি-ভাল বকশিশ পাব তো?
সে দেখা যাবে, বলে এগিয়ে এল মেডক। ওর চোখ দুটো খুশিতে চকচক করছে। শহরে শেরিফের অফিসের সামনে ওর ভিত্তিতে নাড়া পড়েছিল। কিন্তু এখন ওর চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। জারভিসের দেখা পাওয়ার পর থেকেই পরিবর্তন এসেছে ওর মধ্যে।
নিজেই এসে ধরা দিয়েছ? মুখের ভাবে খুশি চাপতে পারছে না মেডক। ভালই হয়েছে, আমাদের ঝামেলা অনেক কমিয়ে দিয়েছ।
আমাকে দিয়ে কিছু করাতে পারবে না তুমি, জবাব দিল জুলিয়াস।
কিন্তু আমাদের সাহায্য তুমি ঠিকই করবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারব আমি। বুড়োটা মর-মর অবস্থায় টিকে রয়েছে অনেকদিন-লোকজন জানবে তুমি তার ঘরে ঢুকে হট্টগোল বাধিয়েছিলে। ওই ঘরেই বুড়োর লাশের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা যাবে তোমার মৃতদেহ।
আড়ষ্ট হয়ে গেল জারভিস। হতবুদ্ধি দেখাচ্ছে ওকে। এতদিন সে এটাকে একটা খেলা হিসাবেই নিয়েছিল। কচি বয়সে বড় কর্তা সেজে ওর ভালই লাগছিল। কিন্তু তার পরিণতি যে এইরকম দাঁড়াবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সে। বিস্মিত কণ্ঠে আপত্তি জানাল জারভিস, আবোল-তাবোল এসব কি বকছ, মেডক? আমার মনে হয়…
ওকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে ধমকে উঠল মেডক। চুপ করো! তোমার কি মনে হয় তা কেউ জানতে চায়নি। বড়দের কথার মধ্যে কথা বোলো না। তুমি-যাও, বাইরে গিয়ে একটু হাওয়া খেয়ে এসো।
রূঢ় আঘাতে কল্পনার রাজ্য থেকে মাটিতে নেমে এল জারভিস। এখন সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যে তার ভাই ভালর জন্যেই তাকে সাবধান করেছিল, বোঝাতে চেয়েছিল-কিন্তু সে-ই জুলিয়াসকে ভুল বুঝে ওর কোন কথাই শোনেনি। এখন আর সময় নেই। মেডকের এতজন লোকের বিরুদ্ধে সে একা কি করতে পারবে? নাহ, সব শেষ হয়ে গেল তার বোঝার ভুলে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে-জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল জারভিস। গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না ওর। স্পষ্ট বুঝতে পারছে বিরোধিতা করতে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু।
তোমাকে যা বলা হচ্ছে তাই করো, জারভিস, জুলিয়াসই ওর একটা সুরাহা করে দিল।
কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল জারভিস। অস্পষ্ট কণ্ঠে সে বলল, আমাকে তাহলে বাড়িতে ঢুকতে হবে-এই ধার করা বুট নিয়ে কোথাও যাওয়া যায় না।
ওর কথা শুনে হেসে উঠল মেডক। জারভিসকে নিয়ে আসলে কোন ভয়ই নেই তার। মেডকের কথা মতই সে উঠবে বসবে। লঘু কণ্ঠেই সে বলল, ঠিক আছে, তুমি জামাকাপড় ছেড়ে বাবু সেজেই না হয় বাইরে যেয়ো। হোয়েল, ওই দু’জনের পায়ের বাঁধন কেটে ওদের বাড়িতে নিয়ে এসো-পেপির সাথে কথা বলার সময় হয়েছে।
জুলিয়াসের পায়ের বাঁধন কেটে দিয়ে ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল হোরেস। এডের বাধন কাটছে হোয়েল। জারভিস অন্যদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল।
শেষটা সুখের হলো না, তিক্তভাবে মন্তব্য করল এড।
ঠিক মত দাঁড়াতেও পারছে না সে। হোয়েল ওকে ধরে সাহায্য করল। সেই সাথে সাবধান করল, কোন রকম চালাকির চেষ্টা কোরো না, এড। দরকার হলে পিস্তল ব্যবহার করব আমি।
গোলাঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো ওরা। উঠানের মাঝখানে পৌঁছে দেখল সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় হঠাৎ থমকে দাড়িয়েছে জারভিস।
অবিশ্বাস ভরা চোখে দরজার দিকে চেয়ে রয়েছে সে।
ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল জুলিয়াস। অন্যেরাও দাঁড়িয়ে গেছে। দরজায় একজনের আবির্ভাব ঘটল-সেবাস্টিন দত্ত! তার দু’হাতে দুটো পিস্তল দেখা যাচ্ছে। ক্ষীণকায় আর দুর্বল দেখাচ্ছে তাকে, কিন্তু পিস্তল দিয়ে উঠানের সবাইকে কাভার করে আছেন তিনি। গমগমে গলায় কথা বলে উঠলেন সেবাস্টিন, গলার স্বরে দুর্বলতার চিহ্নমাত্র নেই। কি হচ্ছে এখানে? আমার ছেলেকে কে বেঁধেছে?
কথাকয়টা জুলিয়াসের কানে অমৃতের মত শোনাল। বাবা তাহলে সত্যি সত্যি রাগ করেননি তার ওপর। এডের কথাই ঠিক, তার জীবন রক্ষা করার জন্যেই বাধ্য হয়ে তাকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
সেবাস্টিন দত্তের পিছন পিছন পেপি বেরিয়ে এল। ওর হাতেও পিস্তল। হঠাৎ এডের দিকে চোখ পড়তেই তার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সব ভুলে এডের দিকে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই সেবাস্টিন দত্ত নিচু গলায় তাকে কি যেন বললেন। থেমে দাড়িয়ে সে আবার সতর্কভাবে উঠানের লোকগুলোর ওপর নজর রাখল।
আশপাশের সবাইকে একবার আড়চোখে দেখে নিল জুলিয়াস। আড়ষ্ট হয়ে আছে সবাই। প্রায় সবারই হাত রয়েছে নিজের পিস্তলের ব্যাটের ওপর-কিন্তু কেউ সাহস করে পিস্তল বের করছে না। সবাই চাইছে আর কেউ ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করুক।
মেডক তার লোকজনকে নিচু গলায় নির্দেশ দিল, সতর্ক থাকো। বুড়োর শরীর দুর্বল, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।
সেবাস্টিন দুর্বল হলেও তাকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। আড়চোখে জারভিসের দিকে চেয়ে ধমকে উঠলেন তিনি, হাঁ করে চেয়ে কি দেখছ। জলদি তোমার ভাই আর এডের বাঁধন কেটে দাও। তাড়াতাড়ি করো।
দিচ্ছি, বাবা, উৎসাহের সাথে জবাব দিল জারভিস। ওর গলা শুনে মনে হচ্ছে এই আদেশে খুশিই হয়েছে সে। জুলিয়াসের দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে ছুরি দিয়ে হাতের দড়িটা কাটতে শুরু করল জারভিস। ছুরিটা ভোঁতা, কাটতে সময় লাগছে অনেক।
মেডক! কঠিন গলায় আদেশ করলেন সেবাস্টিন দত্ত। সামনে এগিয়ে এসো।
গভীর একটা শ্বাস নিয়ে এক পা এগিয়েই আবার থেমে দাঁড়াল মেডক।
আরও কাছে! গর্জে উঠলেন সেবাস্টিন। নাকি ওখানে দাড়িয়েই মরতে চাও তুমি?
আর এক পা এগিয়ে এসেই কথা শুরু করল মেডক। বোঝাই যাচ্ছে, ইচ্ছা করে দেরি করিয়ে সেবাস্টিনের দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায় সে। আপনি ভুল করছেন, সেবাস্টিন। ধৈর্য ধরে এক মিনিট
অনেক শুনেছি আমি। আমার কামরায় এসে তুমি যা যা বলেছ সবই মনে আছে আমার। তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি, মনে আছে?
সবার থেকে কয়েক পা আগে নিশ্চল অবস্থায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে মেডক। ওর হাত এখনও পিস্তলের বাটের ওপরই রয়েছে। জুলিয়াস বুঝতে পারছে মুহূর্তে পিস্তল বের করে গুলি করবে মেডক। এখনও জারভিস তার হাতে বাধা দড়িটা কাটছে।
কেউ বাধা দিতে এসো না, চিৎকার করে বললেন সেবাস্টিন। মেডক, এটা শুধু তোমার আর আমার ব্যাপার-তৈরি হও।
নিমেষে পিস্তল বের করে আনল মেডক, কিন্তু সে গুলি করার আগেই সেবাস্টিনের গুলি তার ডান হাতের কজি ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে গেল। আবার গুলি করলেন সেবাস্টিন। এবারের গুলিটা মেডকের বাম হাতে লাগল। পরের গুলি দু’টো লাগল তার দুই পায়ে। মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাটা মুরগীর মত ছটফট করছে মেডক।
কেমন লাগছে এখন? সেবাস্টিনের কথায় এতদিনের জমানো আক্রোশ ফুটে উঠেছে। বুড়ো মিয়া-না? আমার র্যাঞ্চ নেবে? আরও লোকজন নিয়ে এসো-তবু পারবে না।
আবার গুলি করলেন সেবাস্টিন। মেডকের কাতরানি থেমে গেল। ওর দেহটাও জন্মের মত স্থির হয়ে গেল।
বাঁধন মুক্ত হয়েছে জুলিয়াস, কিন্তু হাত দুটো এখনও পিছন দিকেই ধরে রেখেছে ও। জারভিস এডের বাঁধন কাটার কথা ভুলে গিয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে মেডকের মৃতদেহের দিকে। আড়চোখে কে কোথায় আছে দেখে নিল জুলিয়াস। মেডক মারা পড়লেও ওরা বিপদমুক্ত হয়নি এখনও। মেডকের লোকেরা সৰাই ভয়ঙ্কর আর সশস্ত্র।
হিউ, হোয়েল আর এড রয়েছে জুলিয়াসের, বামে। ডানদিকে ফক্সি, হোরেস আর মাডি। জারভিস এখনও তার পিছনেই দাড়িয়ে। অল্প-অল্প করে সরে ডানদিকে ফক্সির কাছে পৌঁছা’নোর চেষ্টা করল জুলিয়াস। ফক্সির পিস্তলটা ওর বাম দিকে ঝুলছে-বাঁ-হাতি লোক সে। কিন্তু ওর পিস্তলটা ছিনিয়ে নিয়েও হিউ আর হোয়েল, দু’জনকে একসাথে ঘায়েল করা জুলিয়াসের পক্ষে অসম্ভব।
তাছাড়া ডানদিকের তিন জন তো থাকছেই।
এডের সাথে জুলিয়াসের চোখাচোখি হলো। সামান্য মাথা ঝাঁকাল এড। জুলিয়াস বুঝে নিল এডও একই কথা ভাবছে। দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেবাস্টিন। হাতে পিস্তল দু’টো দৃঢ়ভাবে ধরা থাকলেও কঠিন অসুখের পর এত উত্তেজনায় কাহিল হয়ে পড়েছেন। পেপিকে তিনি কি যেন বললেন। পেপি একটু এগিয়ে এসে বলল, সবাই পিস্তল ফেলে দাও। এক্ষুণি! ওর গলাটা খুব চড়া শোনাল।
এক মুহূর্ত সবাই চুপ। হঠাৎ নিচু গলায় হোয়েল বলে উঠল, হিউ, তুমি বুড়োটাকে সামলাও। আমি…
কথা শেষ করার সুযোগ পেল না সে। হাত বাঁধা অবস্থাতেই ওর ওপর ডাইভ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল এড। এক লাফে সামনে এগিয়ে ফক্সির পিস্তলটা তুলে নিল জুলিয়াস। পিস্তল হাতে ঘুরে দাঁড়াতেই একটা গুলির শব্দ হলো। এড ঠিক সময় মত ঝাপিয়ে পড়ায় গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে জুলিয়াসের গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। পিছনে কেউ আর্তনাদ করে উঠল।
এড আর হোয়েল দু’জনেই ধরাশায়ী হয়েছে। হিউ চট করে একটু ঘুরে জুলিয়াসের দিকে ফিরল। গুলি করল জুলিয়াস-একটা, পরক্ষণেই আবার। গুলির ধাক্কায় প্রথমে একপা পিছিয়ে গেল হিউ, তারপরেই আধপাক ঘুরে মাটিতে পড়ল। ফক্সি দু’হাত শূন্যে তুলে চিৎকার করে বারবার জানাচ্ছে সে। আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু হোরেস হাল ছাড়েনি, সে বারান্দার ওপর সেবাস্টিন আর পেপিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। জুলিয়াসের অব্যর্থ গুলিতে হুমড়ি খেয়ে। পড়ে গেল সে। মাডিকে পেট ধরে দু’ভাঁজ হয়ে বসে পড়তে দেখল জুলিয়াস। মুহূর্তে এক হাঁটুর ওপর চট করে ঘুরেই সে দেখল গড়িয়ে এডের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে পিস্তল তুলেছে হোয়েল। আর মাত্র দুটো গুলি আছে জুলিয়াসের পিস্তলে। হোয়েলকে লক্ষ্য করেই পিস্তলটা খালি করল সে। নিজের গুলি শেষ হতেই হোয়েলের পিস্তলটা ছিনিয়ে নিতে ওর দিকে ছুটে গেল জুলিয়াস। কিন্তু তার আর দরকার ছিল না-হঠাৎ করেই থেমে গেল যুদ্ধ।
মেডক আগেই মরেছে। হিউ, হোয়েল, হোরেস আর মাড়ি ধরাশায়ী। কেবল ফক্সি আত্মসমর্পণ করেছে। জারভিস পিস্তল হাতে সবাইকে কাভার করে দাঁড়িয়ে আছে। সে-ই গুলি করেছে মাডিকে।
বারান্দার দিকে চাইল জুলিয়াস। তার বাবা এখনও নিজের পায়েই খাদ্যে আছেন। দেয়ালের সাহায্য নিচ্ছেন না তিনি। এডের দিকে ছুটে যাচ্ছে পেপি।
উঠে বসতে বসতে এড বলল, দেখা যাচ্ছে পিস্তল চালানো ভালই শিখেছ তুমি।
জবাব দেয়ার দরকার বোধ করল না জুলিয়াস। সে জানে পিস্তলে তার হাত যত ভালই হোক না কেন, এড ওভাবে হোয়েলের ওপর ঝাপিয়ে না পড়লে আজ আর তার রক্ষা ছিল না।
এডের কাছে পৌঁছে হাটু গেড়ে বসে বাঁধন খুলতে খুলতে ওকে হাজারো প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল পেপি। বারান্দা থেকে বজ্রগম্ভীর স্বরে সেবাস্টিন দত্ত, হাঁকলেন, বসে থেকো না, জুলিয়াস, জলদি উঠে এসব আবর্জনা সরাও উঠান থেকে।
চটপট উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস। আমি সব ব্যবস্থা করছি, বাবা, তুমি ভিতরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। অনেক ভাল বোধ করছে সে এখন। আবার সব যেন আগের মত হয়ে গেছে। বাবা যে এতদিন অসুস্থ ছিলেন তা মনেই হচ্ছে না।
অনেক বিশ্রাম নিয়েছি আমি, জবাব দিলেন সেবাস্টিন। এই খামার ঠিকমত চালাতে হলে একজন শক্ত লোকের দরকার।
একঘণ্টা পর শেরিফের সাথে নডি, জনি আর বোকো সহ আরও দশ-বারোজন লোক ঘোড়ায় চেপে রকিং এইচে এসে হাজির হলো। মেডক, হিউ আর হোয়েল মারা গেছে, হোরেস আর মাড়ি আহত, কিন্তু প্রাণে বাঁচবে। ফক্সিকে হাতকড়া পরিয়ে দিল ডিগবি।
আমি ভাবতেও পারিনি তলে তলে এইরকম একটা কাণ্ড ঘটতে পারে, বিস্ময় প্রকাশ করল ডিগবি। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি আমি জুলিয়াসের বাবাকে সুস্থ দেখে। আমরা তো ভেবেছিলাম…
হ্যাঁ, বাবাই ডাক্তারকে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন যেন তিনি সত্যিকথা কাউকে না জানান, জবাব দিল পেপি। ডাক্তার নাথান অ্যাশওয়ার্থই প্রথম টের পান যে বাবা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন, আর রাতে তিনি রোজ একটু একটু করে ব্যায়ামও করছেন শক্তি বাড়াবার জন্যে।
কিন্তু কাউকে দিয়ে আমাদের খবর দিলেই তো হত? প্রশ্ন করল নডি।
তাতে তথা অনেক নির্দোষ লোক মারা যেত, জবাব দিলেন স্বয়ং সেবাস্টিন দত্ত। তোমরা খবর পেলেই লোকজন নিয়ে সাহায্য করতে ছুটে আসতে-মেডক ছাড়ত না। তার চেয়ে এই ভাল হয়েছে। বিছানার তলায় পিস্তল আমি অনেকদিন থেকেই লুকিয়ে রেখেছিলাম। মেডককে যে-কোন সময়ই মারতে পারতাম-কিন্তু ওদের সবার সঙ্গে এক সাথে যুঝতে পারার মত শক্তি সঞ্চয় করার জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করেছি আমি।
পেপির ওপর সবাইকে আপ্যায়ন করার ভার দিয়ে ঘোড়া নিয়ে শহরের পথে বেরিয়ে পড়ল জুলিয়াস। অনেকটা পথ যেতে হবে তাকে তার জন্য একজন অপেক্ষা করে আছে।
দরজায় টোকা দিতেই খুলে দিল লোলা। বেশ রাত হয়েছে, এতক্ষণ লোলা জেগে বসে থাকবে আশা করেনি সে। ওকে দেখে জুলিয়াসের মনটা খুশি হয়ে উঠল। একটু পাশে সরে দাঁড়িয়ে জুলিয়াসকে ভিতরে ঢোকার জায়গা করে দিল লোলা। উৎকণ্ঠায় আড়ষ্ট হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
যত জলদি সম্ভব চলে এলাম, বলল জুলিয়াস।
অপেক্ষায় থেকে থেকে আমার মনে হচ্ছিল যেন কত যুগ পার হয়ে গেল, নিচু অস্ফুট গলায় বলল: লোলা।
যাক, এখন আর চিন্তা মেই-এসে পড়েছি আমি। ওদিককার সব ঝামেলা চুকে গেল। কি হয়েছে শুনতে চাও?
এখন না, কেন এসেছ তুমি?
জুলিয়াসের মুখে দুষ্টুমির হাসি। জানো না? তোমার জন্যেই তো এলাম।
তাহলে আর অপেক্ষা কিসের?
এগিয়ে গেল জুলিয়াস। লোলাও এগিয়ে এসে মিলিত হলো ওর সাথে। নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো ওরা।
শোবার ঘরের দরজা খুলে দৃশ্যটা কিছুক্ষণ সস্নেহ চোখে উপভোগ করল আইডা বেইলি। তারপর ওদের অজান্তেই একটু মুচকি হেসে আবার নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
Leave a Reply