যে হীরকখণ্ডে ঘুমিয়ে কুকুরদল – কিশোর পাশা ইমন
যে হীরকখণ্ডে ঘুমিয়ে কুকুরদল – কিশোর পাশা ইমন
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৮
গ্রন্থকারের কথা
লেখালেখির ক্ষেত্রে আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে কোন উপাদান? অবশ্যই মৃত্যু! কাছের কিংবা দূরের কারও মৃত্যু।
আমার সর্বশেষ যে উপন্যাসটি প্রকাশ পেয়েছিলো (বাতিঘর প্রকাশনী থেকেই), তার নাম মৃগতৃষা। আমার এই উপন্যাস লিখার কথা ছিল না। সে সময় পরিচিত, তবে ঘনিষ্ঠতা নেই-এমন কারও পরিবারের একজনকে হত্যা করা হলো। এই হত্যাকাণ্ডটি আমাকে স্তব্ধ করে দেয়।
সেই সময় এক উপন্যাস নিয়ে কাজ করছিলাম; আমার ঘরের দরজার পেছনে, হোয়াইটবোর্ডের সবখানে সেই উপন্যাসের প্লট আর চরিত্ররা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে আমি হোয়াইটবোর্ড আর দরজায় আটকে রাখা কার্ডবোর্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম, মানুষটিকে হত্যা করার পর ওই আমি আমূল পাল্টে যাই। হোয়াইটবোর্ড নয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাতি নিভিয়ে বসে অন্ধকার শুন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকি তখন। আমি চাইছিলাম, খুব করে চাইছিলাম, খুনিরা ধরা পড়ুক। কিন্তু খুনিরা ধরা পড়লো না। গলা পর্যন্ত হতাশায় ডুবে থাকতে থাকতে একদিন ঠিক করলাম, এই বিপর্যয় সামলাতে হলে আমাকে লিখতে হবে। দরজার পেছনটা দ্রুত খালি করে ফেলতে হলো, হোয়াইটবোর্ড মুছে ফেলা হলো। বিশ হাজার শব্দের মতো লিখে ফেলা একটা উপন্যাস চলে গেলো ‘অসমাপ্ত’ নামধারী ফোল্ডারে। তবে কিবোর্ডের সামনে আমি ফিরে গিয়েছিলাম, মৃগতৃষার জন্ম এভাবেই।
মৃগতৃষার পর আমি ঠিক করেছিলাম, স্রেফ সখের বশে উপন্যাস লিখবো না আর। উপন্যাস লিখতে হয় দীর্ঘ একটা সময় ধরে। এর মধ্যে নানা রকম ব্যস্ততা এসে পড়ে, যেহেতু প্রফেশনাল রাইটার নই। বিরতিসহ উপন্যাস লিখতে হলে গল্পের বিষয়টার ওপর তীব্র এক টান থাকতে হবে, নয়তো ভেতরে জ্বলতে হবে আগুন। কোনো উপন্যাস অর্ধেক লিখে যদি ঔপন্যাসিক আগ্রহ হারান-এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।
এরপর আমি সেই খবরটা শুনতে পাই। গত বছর, আরও একজন পরিচিত কিন্তু অচেনা কারও মৃত্যুর খবরটা যখন আমার কানে এলো-মেনে নিতে পারিনি। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি! মেনে নিতে না পারা পরিস্থিতিতে আমার পুরোনো ক্রাইং শোল্ডারস একদল কালো কালো বোতাম। কিবোর্ডে ফিরে এসেছি আরও একবার, বাস্তবতা থেকে আরও একবার লুকিয়ে পড়তে। অথচ এবার আমি লুকাইনি।
আমি চেয়েছি বাস্তবতাকে নিজে লিখতে। প্রকৃত বাস্তব আমার পছন্দ হচ্ছিলো না। পছন্দ না হলেও যে হীরকখণ্ডে ঘুমিয়ে কুকুরদল লিখতে গিয়ে বাস্তবতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। বরং প্রচেষ্টার পুরোটাই ছিল সত্য ঘটনাকেন্দ্রিক একটি উপন্যাস লিখে ফেলার। একশ সত্য ঘটনা যখন চলে আসে এক উপন্যাসে, তখন তা কেমন দাঁড়ায়? এটাই আমি দেখতে চেয়েছি। লোকজনকে বিরক্ত করেছি। এদিক ওদিক ছুটেছি। ব্রিতকর প্রশ্নবাণে কাউকে কাউকে জর্জরিত করেছি। যদি কেউ উপন্যাসের ভেতর কোনো সত্য ঘটনার ছাপ দেখতে পান, তবে ধরে নিতে পারেন ওটা আপনি ঠিকই ধরেছেন। আর যদি মনে হয় সবটাই গাঁজাখুরি, তবে তো পোয়াবারো-কাল্পনিক গপ্পো ভেবেই পড়বেন। এতে করে কিছুর আসবে যাবে না।
ঠিক যেমন মৃগতৃষা লেখার কারণে খুনিদের বিচার হয়নি, তেমনই যে হীরকখণ্ডে ঘুমিয়ে কুকুরদল-এর কারণে প্রচলিত কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। হীরকখণ্ডগুলোয় অবাধ বিচরণ চলবে কুকুরদলের। তাই বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল পাওয়ার দরকার তেমন একটা নেই।
তাছাড়া, কল্পকাহিনী তো কল্পকাহিনীই, তাই নয় কি?
কিশোর পাশা ইমন
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হল,
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,
রাজশাহী।
২৪-০১-২০১৮
.
মিথ্যে আর দুর্নীতি সময়ের সাথে অতি অবশ্যই উন্মোচিত হয়ে যায়, ইতিহাসে এদের কোনো স্থান নেই।
-নরোডম সিহানুক
Leave a Reply