যে যেখানে যায় – বাণী বসু
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৮
পাঠকদের
.
লেক গার্ডনস ফ্লাই ওভারটার দু’পাশ জুড়ে কৃষ্ণচূড়া ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। বেগুনি ফুল ঝুপ্পুস দুলছে লেকের বাইরে, ভেতরে। বসন্ত আসতে না আসতেই চিকচিকে সবুজ, ঝকঝকে দুলদুলে পাতা। ফেশিয়াল করে এসেছে যেন। ফাইন! এদিকে চৌকিটার এইসা জোর হয়েছে গায়ে যে, চেনটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। তাকেই বরং দৌড় করাচ্ছে ব্যাটা। উঃ, ক্রিকেট কোচিংয়ের স্কুলটা শেষ অবধি এসে গেল। তিন রাউন্ড হল, এখনও এক রাউন্ড বাকি। মধুবন বলল— উফ একটু জিরোতে দে রে চৌকি! প্লিজ! মুশকিল হচ্ছে, জিরোতে হলেও সেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জিরোতে হবে। একবার চেন আলগা দিলেই গেছ! এই বিদঘুটে কাজটা তার বাবার। কিন্তু মেদ কমানোর জন্য যেহেতু তার প্রাতঃহন্টনের দণ্ড হয়েছে এবং বাবা আপাতত দিল্লি গেছে, বাবার জায়গায় মধুবনকে ফিট করা হয়েছে। প্রাতঃহন্টনের পর বাড়ি গিয়ে সে সামান্য কিছু খেতে পাবে। প্রচুর জল প্রথমেই। তারপর ঝিঁঝির পাতের মতো পাতলা দুটো মাখনহীন টোস্ট, এক কাপ স্কিন্ড মিল্ক, গুটিকতক শসা। পড়াশোনার কাজটা এই ‘শসাফাস্টে’র পরেই করে থাকে সে। দু’খানা হাতেগড়া রুটি, গাজর, বিন, পেঁপেসেদ্ধ টিফিনে ভরে দেয় মা। চোখ পাকিয়ে বলে— ‘ক্যান্টিনে বসে কাটলেট ধ্বংস কোরো না আবার। এত দিনের পরিশ্রম জলে যাবে। মনে রেখো, পঁচাত্তর কেজি ওজন ইকোয়ালস— হার্ট, প্রেশার, বাত, ডায়াবিটিস…। যখন স্কুল চলে তখন এইরকম।
আচ্ছা মা, নিজের মেয়ের জন্যে এতগুলো মারাত্মক মারাত্মক অসুখ প্রেসক্রাইব করতে বাধছে না তোমার?
অসুখ প্রেসক্রাইব করছি? মারব এক চড়। যা, বেরো এবার।
অন্য লোকের মায়েরা যখন মালাই নিয়ে ছেলেমেয়েদের সাধাসাধি করছে, তখন তার মা গরম টোন্ড মিল্কের ওপর পড়া সরটাও শ্যেনদৃষ্টিতে দেখছে এবং চামচ দিয়ে নির্মমভাবে তুলে ফেলে দিচ্ছে। সেই সব বালকবালিকা, কিশোরকিশোরী যারা দুধ এবং দুধের সরের নামে নাক কুঁচকোয়, মধুবন তাদের দলে পড়ে না। সে ভালবাসে বেশ মোটা সর-পড়া গোদুগ্ধ। সম্পূর্ণ দুধ যাকে বলে। সে ভালবাসে তাজা ক্রিম। নানা রকম ফল টুকরো টুকরো করে কেটে একটা বড় কাচের বাটিতে রাখো। তারপর তাতে দরাজ হাতে ক্রিম ঢালো। এক মুঠো বড় দানার সাদা সাদা চিনি। ব্যস।
এবং যেহেতু সে এরকম ভালবাসে তার জানাশোনা মাসি-পিসিরা যাঁরা যাঁরা ছেলেমেয়েদের দুগ্ধজাত খাওয়াতে পেরে ওঠেন না তাঁদের সমস্ত স্নেহরস ঝরে পড়ে মধুবনের ওপর বা ঠিকঠাক বলতে গেলে তার খাদ্যাখাদ্যের ওপর।
মিল্কশেক করেছি মধুবন। খাবি তো?
আইসক্রিম ফ্লোট ভাসিয়েছ কি মাসি?
শিয়োর শিয়োর! আইসক্রিমের বাক্সটা তা হলে আছে কী করতে?
আমাকে যেন স্ট্র দিয়ো না। ওভাবে শেক খাওয়া যায় না। তা হলে তো কোক, থামস আপ খেলেই হয়!
যা বলেছিস! পাবলোটা এমন বোকা স্ট্র দিয়ে খায়। পুরো আইসক্রিমটা যে গলেই গেল সে খেয়ালই নেই।
সব মাসিরাই তাকে ভালবাসেন। কিন্তু পাবলোর মা যশোমাসি একটু স্পেশ্যাল।
স্পেশ্যাল কেননা, তাঁরও ওই একই রোগ। তাঁরও ব্লাউজের তলায় মোটা মেদের বেল্ট, তাঁরও মুখ আর ধড়ের মাঝখানে ঘাড় অদৃশ্য। তাঁকেও হাঁসফাঁস করতে করতে প্রাতঃহন্টন করতে দেখা যায় এবং মধুবনকে মিল্কশেক দিয়ে তিনি নিজেও অন্য একটি মিল্কশেক নিয়ে মুখোমুখি বসবার পক্ষপাতী। কিন্তু দু’জনেই এখন প্রভূত বিপদে পড়ে গেছেন।
সে দিন বাড়ি এসেই মধুবন বলল— ব্যস দু’কেজি কমে গেছি।
একেবারে দু’কেজি? দাদার ফোড়ন।
হ্যাঁ। এক কেজি হাঁটার জন্যে। আর এক কেজি চৌকির জন্যে। যা ছুট করিয়েছে, বাপস!
তা হলে তো তোর এক মাসে তিরিশ দু’গুণে ষাট কমে যাচ্ছে। বাকি রইল বারো কেজি, বাঁচবি কী করে রে?
মা, নিজের মায়ের পাঁচফোড়ন হল— আবার আইসক্রিম, সর, ক্রিম, রেওয়াজি পাঁঠার গরগরে ঝোল। চড়চড় করে উঠে যাবে। যশোমাসি আছে কী করতে?
এক হপ্তা পরে ডাক্তারখানায় গিয়ে সে সত্যি দেখে এল— এক কেজির মতো কমেছে। ডাক্তারকাকু বললেন,— ঘাবড়াচ্ছ কেন? এসব আলগা ফ্যাট শটাশট ঝরে যাবে। কিন্তু ডায়েট মেনটেন করতে হবে স্ট্রিক্টলি।
যশোমাসি আর মধুবনের যখন এইরকম বিপদ তখন আরমান আর সম্পৃক্তার কেস শুনুন। সম্পৃক্তার প্রবলেম হল ও যতই খায় আটচল্লিশ কেজির বেশি ওঠে না।
কোথায় ওয়েট নিস? সিনেমা হলে? শপিংমলে?— মধুবনের স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে।
আজ্ঞে না। রীতিমতো ডাক্তারখানায়। ক্লিনিকে।
অনেক ডাক্তার গড়বড় যন্ত্র কমদামে কিনে এনে চেম্বার সাজায়, তুইও আটচল্লিশ, হাতিও আটচল্লিশ।
আর তুইও আটচল্লিশ। তো চল আজই তোকে নিয়ে যাই।— সম্পৃক্তা সঙ্গে সঙ্গে রেডি।
অগত্যা মধুবন পিছু হটে। অন্য পথ নেয়। আসলে তুই খাস না— উত্তর হল— ওই আনন্দেই থাক।
খাচ্ছেদাচ্ছে ওয়েট বাড়ছে না। সম্পৃক্তার ডেলি রুটিন কী! দাঁড়া ব্যাটা, একটু গোয়েন্দাগিরি না করলে আর চলছে না।
প্রথমেই মধুবন যশোমাসির ইন্টারভিউ নেয়। কারণ যশোমাসি সম্পৃক্তার সাক্ষাৎ মাসি৷ এবং বলতে গেলে এক বাড়িতেই থাকেন। যশোমাসির বাবা বহুত বড়লোক ছিলেন। সেই বিশাল বাড়ি তাঁর দুই মাত্র মেয়ে যশোধরা আর মধুক্ষরাতে বর্তেছে। যশোমাসির ছেলে পাবলো আর মধুমাসির মেয়ে সম্পৃক্তা দু’জনেই মধুবনের ইয়ার। সেকেন্ড কাজিনও বটে। ওদের বাড়ির মাঝখানে একটা দরজা। এ-দিকে যশোমহল। ও-দিকে মধুমহল।
মধুবন জিজ্ঞেস করে— আচ্ছা যশোমাসি, শম্পি কখন জিমে যায় গো!
শম্পি জিমে? যায় না তো! কেন যাবে? এমনিতেই তো ডিগডিগুনি!
না খেয়ে থাকলে আর ডিগডিগে হবে না তো কী?
যশোমাসি বললে,— শম্পি না খেয়ে থাকে? তোকে বলেছে বুঝি? পাউরুটিতে মোটা মাখন লাগিয়ে তার ওপর মুঠো মুঠো চিনি ছড়িয়ে খায়টা তবে কে? ছানার মালাই কোফতা রেসিপি এনে আমাকে দিয়ে তবে কে রাঁধাল? আমাকে চোখ রাঙিয়ে বললে, মাসি, খবরদার কিন্তু টেস্ট পর্যন্ত করবে না। তা হলেই ফেটে যাবে। পাবলোকে একটা-দুটো দিল কি না দিল। সে অবশ্য কেয়ারও করে না। তা সে যাই হোক ন’-দশটা বাকি ছিল। নিজে সব ক’টি সাঁটাল। শম্পি নাকি না খেয়ে আছে! ওর ধাতই ওইরকম।— ওর বাবার মতো কেঠো ধাত। তুই আমি জল খেলেও ফুলছি। আর ওরা খাচ্ছেদাচ্ছে ফুরফুরেটি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একেই বলে ভগবানের বিচার। বলতে বলতে মাসি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললে।
আরমান এদিকে সকালে জিম, বিকেলে ফুটবল, সন্ধেয় যোগাসন বা ইয়োগা, রাত্তিরে খাওয়ার পর এক ঘণ্টা বাদে পাঁচ মাইল হাঁটে। সুদ্ধু নাকি ফিট থাকবে বলে। পাবলো বলে, ফিট থাকবে বলে? বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাসনি। খাবে বলে, স্রেফ গাঁউগাঁউ করে খাবে বলে। এদিকে ওজন বাড়লে ওর কোচ বাঁড়ুদা ওকে ইয়া খিস্তি করবেন না। তাই আরমান যা খায় সব চেষ্টাচরিত্র করে পুড়িয়ে ফেলে। খাওয়ার জন্যে এটুকু কষ্ট নাকি ওর নস্যি। যে-কোনও রকমের মিষ্টি, সে বালুসাই-ই হোক আর কদমাই হোক, রসমুন্ডিই হোক আর শোনপাপড়িই হোক, কেক পেস্ট্রি চকোলেট সব রকমের দিশি-বিদেশি মিষ্টির দারুণ সমঝদার আরমান।
ভোরবেলা বেশ কিছু মেসো পিসে গোছের ভদ্রলোক শর্টস পরে কেডস পায়ে হনহন হাঁটেন, কারও হার্ট, কারও ডায়াবিটিস। এই সময়টাই পছন্দ করে মধুবন। সবাই তখন খুব নিবিষ্ট হন্টক। এর ওর তার দিকে দৃষ্টি দেবার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই। ভুঁড়ি হার্টের ওপর ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে, কোলেস্টেরল হাই, ইউরিক অ্যাসিড বাড়ছে রক্তে, গাঁটে গাঁটে ব্যথা। কে তখন অন্যের মেদ নিয়ে মাথা ঘামায়। বিকেল হলেই ক্রাউডটা হয়ে যাবে মহিলাপ্রধান এবং তার মধ্যে বেশির ভাগই চেনাশোনা। বড়দের থেকে পরামর্শ, সমবয়স্কদের থেকে টিটকিরি ইয়ারকি একেবারে খইবৃষ্টির মতো চার দিক থেকে ছুটে আসতে থাকে এবং বর্ষিত হয়। ‘কী রে মধুবন, কমল? যশোধরাদির বাড়ি যাওয়া বন্ধ কর, বন্ধ কর— এক্ষুনি হাঁটা সেরেই তো তিনটে আইসক্রিম সাঁটাবি, কমবে কী করে?’
ও-দিক থেকে একজন দু’হাত দোলাতে দোলাতে চলতে চলতে বলবে— এই ভাবে হাঁটো ভাই, এইভাবে, হাত পা ছুড়ে ছুড়ে। তবে না তোমার আর্ম আর থাইয়ের মাংস খসবে! কেউ বুঝবে না, তার হাতে রয়েছে চৌকি নামে একটি বিশালকায় অ্যালসেশিয়ানের চেন। হাত সে ছুড়বে কী করে! আর পা? সে তো চৌকিই ছোড়াচ্ছে! সেটা লোকে দেখতে পায় না!
বেল্টটা চমৎকার! আর একজন কেউ মন্তব্য করে গেল। বেল্ট বলতে কী বোঝায় মধুবন এখন ভালই বুঝে গেছে, কিন্তু কাউকে ধরার উপায় নেই।
এই আমাকে বেল্ট বললে কেন?— এটা বলা যায়? বিশদ করে বলতে হবে, —আমার কোমর থেকে পাঁজরের নীচ পর্যন্ত বেড়ি সদৃশ্য যে চর্বির চাকা বিরাজ করছে, তাকে বেল্ট টেল্ট বলে ইয়ারকি মারলে কেন!— এভাবে বললে নিজেকেই নিজে কনডেম করা হয়। আবার কেউ বলতে বলতে যাবে— ভাল বেশ। শীত করবে না।
জিরো ডিগ্রির তলাতেও?
জিরো ডিগ্রির তলাতেও। মাইনাস চার-পাঁচ হেসে খেলে চলে যাবে।
বলতে গেলে বলবে— আমরা নিজেদের মধ্যে আবহাওয়া, সেন্টিগ্রেড, শীতের জামাকাপড় নিয়ে কথা বলছি। তুমি কে হে? গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে এসেছ!
ম্যাক্সিমাম হল একজন বলল— ট্যাঁপারি।
দ্বিতীয়জন বলল—ধ্যার গোলগাপ্পা।
তৃতীয়জন বলল— ট্যাঁপারিটা বেশি জুতসই। গোলগাপ্পা তো কামড় দিলেই ফুট্টুস!
এ ক্ষেত্রেও কিছু করবার নেই।
তাই বিকেলবেলাটা মধুবন জিমে যায়। সে প্রাণপণে ম্যানুয়াল ট্রেডমিল করে যায়। পাশে একটি হিপোপটেমাস ওয়েট নিয়ে কসরত করতে করতে বলে— কবে যে অন্তত তোমার মতো হব!
আহা কী মধুর! মধুর! কেউ অন্তত পৃথিবীতে তার মতো হতে চাইছে। তার পরেই অবশ্য, সনা সেরে স্লিম বিউটি বেরিয়ে আসেন একজন। সিরিয়ালে অভিনয় করেন। কৃপার দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকান, একটু হাসেন, চলে যান। হিপো এবং সে পরশ্রীকাতরতায় বড্ড কষ্ট পায় সে সময়টা।
কিন্তু ভোরবেলাতেও শত্রুপাত হল। আরমানের মূর্তিতে। আরমানের আপাদমস্তক পেটা চেহারা। ফুটবল খেলে। কালীঘাট ক্লাবে। তিনি দৌড়োচ্ছেন। কৃষ্ণচূড়াগুলো মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল মধুবনের চোখে।
কী রে মৌবটিকা? তুই হন্টন ধরেছিস নাকি?
মধুবন ওকে এড়িয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু আরমান ছাড়বে কেন?
হুঁ। এক অক্ষরে উত্তর মধুবনের।
কাল নেমন্তন্ন ছিল, বুঝলি, একেবারে এই পর্যন্ত— গলাটা দেখিয়ে দিল আরমান। জগিং করতে করতে বলল ল্যাম চপ, ঢাকাই পরোটা, বিরিয়ানি, জিলিপি গরমাগরম ভেজে দিচ্ছিল, বুঝলি! আর আজকাল তো আইসক্রিম পার্লার বসাচ্ছেই। কুলফিও ছিল। দুটোই খেলাম। ন্যাচারালি। বহুত হয়ে গেল। সো পোড়াচ্ছি।
যা ক্যালরি পুড়ে
জিলিপি যা উড়ে।
মধুবন আর থাকতে পারল না। বলল—
ক্রিম ক্ষীর যা জমে চর্বিগুলো ক্রমে
গালের ওপর গাল হোক
পেটের ওপর পেট
তোর জন্মদিনে কোক পাঠাব
ক্রেটের ওপর ক্রেট।
বুড়োআঙুল নেড়ে আরমান জানিয়ে দিল তাতেও ওর কিস্যুই হবে না।
বাড়ি এসে এক চক্কর। ক’দিন ধরেই বাড়িতে কুরুক্ষেত্র চলছে। মায়ের ভার্শন সর্বকর্ম সম্পাদক বা আপ্তসহায়ক যা-ই বলো বিদায় নিয়েছে। বিদায় নিয়েছে বলতে সে তার ‘গেরামে’ গেছে। মহা চালু। কিছু দিন অন্তর অন্তরই তাকে ‘গেরামে’ পায়, ইতিমধ্যে মাকে ফুসলে ফাসলে ব্ল্যাকমেল করে করে সে বেশ কিছু হাতিয়ে নিয়েছে বলে বাবার সন্দেহ। এখন হাতানো কমপ্লিট। দেশেঘরে বা গেরামে জমি-জায়গা বাড়িটাড়ি সব হয়ে গেছে তাই পরের চাকরিতে ইস্তফা। ‘ইস্তফা দিবি তো তা-ই দে না বাপু।’ মা ঝম্পক তালে বলে। ‘না বলে এমন ফেরার হবার মানেটা কী?’ ‘মানে আলমারিতে খোঁজো’— বাবার উপদেশ— তোমার আলমারি থেকে তো সদাসর্বদা চাবি ঝুলছে। সবাইকার সামনে ঝনাত করে খুলছ আর টাকা বার করছ, শাড়ি বার করছ, গয়না বার করছ।
দ্যাখো, তুমি গা জ্বালানো কথা বলবে না। ও আমার আটপৌরে আলমারি। ওতে ওসব থাকে না। আর গয়না কোথাওই থাকে না। জানো না যেন সে-কথা!
আর ক্যাশ টাকা?
মা মধুর হাসে— টাকা তো ব্যাঙ্কে ডার্লিং। হাতে একশো টাকায় এসে ঠেকলে তখন রাত বিরেতে ঢং করে এটিএম থেকে তুলে আনো! টিপে টিপে! পিঁপড়ের পেছন টিপলেও এর চেয়ে বেশি মধু বেরোয়।
আচ্ছা মা, আটপৌরে আলমারিটা কী?— মধুবনের দাদা ঋজুরুস্তম জিজ্ঞেস করে।
মা দুই কোমরে হাত রেখে রণং দেহি মূর্তিতে দাঁড়ায়।— আটপৌরে! আটপৌরে? আটপৌরেটা নিয়ে তোমার অসুবিধে না আলমারিটা নিয়ে।
আলমারি ইজ অল রাইট, বাট হোয়াট ইজ আটপৌরে!
মিনস ক্যাজুয়াল— মাই ডিয়ার
মানে তোমার ক্যাজুয়াল ড্রেস রাখো মামণি, না?— মধুবন মাকে সাহায্য করতে চায়।
আজ্ঞে না। শুধু জামাকাপড় না, আর যা কিছু রোজ দরকার হয়, তেমন দামি নয় সে সবই।
ঋজু বলে— বাট আটপৌরে—আলমারি! আই জাস্ট কান্ট টেক মাম্মি।
মা গম্ভীরভাবে বলে— তোমাদের দাসী খাটতে খাটতে ব্যাকরণ-ট্যাকরণ ভুলে গেছি তবু চেষ্টা করছি— আটপৌরে জিনিস রাখার আলমারি। কর্মধারায় সমাস— বাংলা মতে। ইংরেজি মতে— ট্রান্সফার্ড এপিথেট। আলমারির জিনিসগুলো আটপৌরে, জিনিসগুলোর বিশেষণ ট্রান্সফার্ড হয়েছে আলমারিতে— ঢুকল মাথায়?
ওরে বাপ— মাদার এ তো ক্যালকুলাসের চেয়েও শক্ত!
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার কাছে জলের মতো সোজা, তোমাদের মতো বিজ্ঞান-নবিশদের কাছে ইটের মতো শক্ত। আই কিউ সবেতেই লাগে ঋজুরুস্তম। আর তাই যদি বলো তো তোমার নামটির মানেই আমাকে একটু বুঝিয়ে বলল না!
নাথথিং — ঋজুরুস্তম সব উড়িয়ে দেওয়া হাসি হাসে— ঋজু মিনস স্ট্রেট অ্যান্ড রুস্তম মিনস্ আ ব্রেভ ম্যান, হিরো।
তা হলে দাঁড়াল একজন স্ট্রেটফরোয়ার্ড হিরো। যেটা নাকি সোনার পাথর বাটি।
অতশত জানি না। তোমরা ঋজু নাম দিয়েছিলে। আমার পছন্দ ছিল রুস্তম, দুটো জুড়ে নিয়েছি— এই তো আমার অপরাধ!
ঋজুরুস্তম নামটির পেছনের ইতিহাস এই। ঋজু নামটি ঠাকুরদার দেওয়া। কিন্তু স্কুলে বহু ভাষাভাষী বহু প্রদেশীয় বহু ধর্মীয় বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে ঋজুর মনে হয়েছিল তার নামটি যথেষ্ট আন্তর্জাতিক নয়। অন্ততপক্ষে সর্বভারতীয় বা এশীয় হলেও তার এমন জাত যেত না। বেশির ভাগই তার স্কুলে হসন্তান্ত— প্রসন্, অকশয়, সাদিক, রোহান্, কুলদীপ্, তাই সে নিজেকে সময় সুবিধে মতো ঋজুরুস্তম-এ পরিণত করেছে। বাবা ততটা খেয়াল করেনি। কেননা বাবার কাগজ পড়বারও সময় নেই। কিন্তু মাতৃদেবী প্রচুর রাগ করেন।
তোমার জন্ম যেমন দিয়েছি, নামটাও তেমন আমরা গুরুজনরাই দিয়েছি। তুমি যদি নতুন নাম নাও সেটা ছদ্মনাম বা পেননেম হতে পারে। তুমি কি লিখতে শুরু করছ?
পাগল নাকি?
ঠিকই। পাগল না হলে কেউ তোমাকে একজন দায়িত্বশীল কল্পনাপ্রবণ পড়ুয়া লেখক হিসেবে কল্পনা করবে না। মায়ের রাগত প্রস্থান।
যাই হোক, মধুবন মা আর দাদার এইসব দ্বৈরথে থাকে না। পাঁচ-ছ’ রাউন্ড প্রাতঃহন্টন সেরে গলদঘর্ম হয়ে বাড়ি ফিরে সে দেখল— একটি ঝিঁঝির পাতের মতো মেয়ে তার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মা তাকে দু’হাত নেড়ে কী সব সমঝাচ্ছেন। মেয়েকে যে এখন কিছু খেতে দিতে হবে মায়ের এ খেয়ালই নেই। অভিমানে দশখানা হয়ে মধুবন তোয়ালে দিয়ে ভাল করে নিজেকে মুছল তারপর স্রেফ শুয়ে পড়ল এবং শুয়ে পড়লেই যেহেতু তার ঘুম পেয়ে যায় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
বাজখাঁই আওয়াজে ঘুম ভাঙল। কে আর? মাতৃদেবী।
আজ কোচিংয়ে যেতে হবে না না কী?
চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল মধুবন। জঠরে দাবানল। ব্যাপারটা সে এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না। মাতৃদেবী তাকে জানিয়ে দিয়েই সরে পড়েছেন। মধুবন দেখল তার সামনে ঝিঁঝির পাতের মতো দেখতে সকালের সেই মেয়েটা। মধুবন কাতরে উঠল পেটে হাত দিয়ে। ওরে বাবা উঃ, কী আগুন জ্বলছে রে বাবা।
মেয়েটা খুব নিশ্চিন্ত গলায় বলল— ওব্বেস হয়ে যাবে।
মানে? আমার পেট ব্যথা করছে আর তুমি বলছ অভ্যেস হয়ে যাবে।
পেট ব্যথা তো নয়। আগুন জ্বলছে বললে না দিদি! তাই বললুম— খিদে, খিদের আগুন জ্বলে জ্বলে ঠিক একদিন খাক হয়ে যাবে তখন আর তত কষ্ট হবে না।
যা ব্বাবা! মধুবন তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে ধপাস করে খাটের ওপর বসে পড়ে।
প্রথম প্রথম মাথা ঘুরবে অমন— ঝিঁঝির পাত বলে ওঠে।
মা! ও মা!— মধুবন রান্নাঘরের দিকে হাঁউ মাউ খাঁউ করে যেতে থাকে, তখন মেয়েটা বলে— আমি তো তখন থেকে তোমার খাবার টেবিলে ঢাকা দিয়ে দাঁইড়ে আছি। এই নাও।
ওর হাত থেকে প্লেটটা ছিনিয়ে নেয় মধুবন। দু’খানা আটার রুটি। পেঁপে মরিচ, গাজর শসা বিন দিয়ে স্যালাড। মধুবন প্রায় একটা গোটা রুটিই মুখে পুরে দিচ্ছিল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হবে, এবং এই ফুচকা দু’খানা রুটি দু’গরাসে পেটে চালান হয়ে গেলে খাদ্যের সেই অপূর্ব স্বাদ সে আর পাবে না।
ও বাবা। মেয়েটা বাটি খুলে একটা সেদ্ধ ডিম বার করছে।
ওটা কার?
তোমার।
তুই কি জিনপরি!
নির্বিকারে ঘাড় নাড়ল সে, বলল— জিনপরি নই। শুধু পরি।
পরিই বটে। ফুঁ দিলেই তো উড়ে যাবি।
হ্যাঁ গত এক বছরে খুব রোগা হয়ে গেছি।— জবাব হল।
এবার মেয়েটা সেই সরহীন দুধ বার করছে। পরম আরামে আধো গরম সেই দুধে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ একবার চোখ তুলেছিল মধুবন। দেখে মেয়েটা নির্নিমেষে জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। পেছন ফিরে জানলা দিয়ে রোদ খাঁ খাঁ রাস্তা ছাড়া কিছু তো দেখা গেল না।
দুধটা শেষ করে ওর হাতে গ্লাসটা দিয়ে মধুবন বলল— কী দেখছিলি ওখানে?
কিছু তো না। মেয়েটা কেমন জড়সড় হয়ে গেল। তার মনে হল মেয়েটা তার খাওয়াটা দেখতে চাইছিল না। কেন রে বাবা?
আজ থেকে কাজে লাগলি, না কী?
হ্যাঁ দিদিমণি।
আবার মণিফণি নয়। স্রেফ দিদি। কোথায় বাড়ি?
বাড়ি? বাড়ি ঘর নেই— বলে পরি আর দাঁড়াল না।
ঘড়িতে বারোটা বাজছে। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে কোচিংয়ের দিকে রওনা দিল মধুবন। বড্ড সুখী-সুখী লাগছে আজ। অনেক দিন পরে গরম গরম লাঞ্চ খেয়ে বেরোতে পারছে সে। শান্তি আর কাকে বলে। আহা, তাকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে মায়ের মনে ক্ষুধিত মেয়ের জন্যে করুণা জেগেছে। নিজের কঠোর ভাবমূর্তি পাছে গলোগলো হয়ে যায় তাই জিনপরিকে পাঠিয়ে দিয়ে চান করতে ঢুকে গেছে। আর তাই-ই আজকে ডিমটা এক্সট্রা।
আরএনজি-র ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ মধুবন খেয়াল করল সে এখনও ডিমের কথা, নরম গরম রুটির কথা ভেবে যাচ্ছে। শম্পি যখন ক্লাসের শেষে বলল— তুই একখানা দেখালি বটে মৌবটিকা, না হয় একটু দেরিতেই ঢুকেছিস। তাই বলে আরএনজি-কে ওইরকম একস্ট্রা মনোযোগ দিতে হবে?
পাবলো বলল— যাকে বলে অভিনিবেশ! মুখখানা এক্কেবারে গোলগাপ্পা হয়ে গিয়েছিল। স্যারসুদ্ধু হাঁ হয়ে গেছেন।
তো মুখে একটা সেদ্ধ ডিম পুরে দিলে পারতিস। মধুবন রাগ করে ক্লাসরুম থেকে বেরোতে বেরোতে শোনে— শম্পি বলছে— দেখেছিস পাবলো মধুবন সব সময়ে, অলয়েজ টকস ইন টার্মস অব ফুড আইটেমস। সেদিন আমাকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে বলল— কাঁচকলা! ক’দিন আগে কাকে যেন বলছিল কোচিংয়ের কেমিস্ট্রি সারের পেটটা ঠিক তরমুজের মতো।
এ তো ভাল, স্বাভাবিক। কাঁচকলাটলা আমরা বলেই থাকি। কিন্তু পরশু দেখি নীলাঞ্জন আর পিকলু উত্তেজিত হয়ে তর্কাতর্কি করছে, গদগদ করে তোর কাজিন এগিয়ে গেল, বলল— কী রে পাপকর্ন ভাজছিস নাকি?— পাবলো বলল।
আই অবজেক্ট। তোর কাজিন মানে কী? মধুবন কি তোরও কাজিন নয়! নাকি ডিজওন করছিস?
করছি না এখনও তবে অদূর ভবিষ্যতেও ও যদি ওরকম নদগদে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, করতে পারি।
এই পর্যন্ত মধুবনের কানে গিয়েছিল।
পাবলো, সেই পাবলো যার সঙ্গে সে একটা গলদা চিংড়ি ভাগ করে খেয়েছে, যাকে সে তার ফেভারিট নলি হাড় এবং মেটের টুকরো দিয়ে দিয়েছে কত কত বার, কেক কাটতে গিয়ে টুকরো অসমান হয়ে গেলে সানন্দে বড় টুকরোটা যে পাবলোকে দিয়েছে। সে-ই পাবলো তাকে ডিজ … ওন করবে? কা…জিন বলে স্বীকার করবে না!!! গদ্দার! গদ্দার! অসম্ভব সব প্রতিহিংসার দুঃস্বপ্ন মধুবনের মনে ধোঁয়ায়। সে মিলিটারি ভঙ্গিতে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে।
বসন্ত বলে ইদানীং আর কিছু নেই। রোদে ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই লঙ্কার ঝাঁঝ আর ঘাম। সেই সঙ্গে হাঁসফাঁস করো। প্রাণ বেরিয়ে যায় একেবারে। মধুক্ষরা মুখার্জি যশোধরা ব্যানার্জিকে বললেন— কী রে, মার্চ এপ্রিল কি এখানেই পচব আমরা? শহর তো নয় এ যেন সাহারা-কালাহারি। এইবেলা ব্যবস্থা না করলে এপ্রিলের শেষে বেরোনো যাবে?
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম! যশো হাত উলটে বললেন।
মানে? তুই বলতে চাইছিস সুহৃৎদা তোর কথায় ওঠেবসে না!
দ্যাখ মধু, তুই খুব ভাল করেই জানিস আমার কথায় কেউ ওঠেবসে না। শুধু তোর সুহৃৎদা কেন? সুহৃৎদার ছেলে, ছেলের মাসি, মাসির মেয়ে, সেই মেয়ের বাবা কারও ওপর যশোধরা বাঁড়ুজ্যের কোনও ইনফ্লুয়েন্স নেই।
তাই বলে তুই এই স্কোয়াডে আমাকেও ইনক্লুড করবি?
তো কী? তুই-ই বল না, তুই আমার একটা কথা শুনিস, রাখিস? তোকে বলেছিলুম হকি না খেলে নাচ প্র্যাকটিস কর, করেছিলি?
বলিস কী রে? সে যে আমার ১৩/১৪ বছর বয়সের কথা! সেই কথা এখন তুলছিস!
যশোধরা এসব কানেই নিলেন না, বললেন— তোর কাছ থেকে একটা, একটা মাত্র তিলের নাড়ু চেয়েছিলুম আর আমসত্ত্বর ছেঁড়া কোণ, দিয়েছিলি?
মধু হাঁ করে দিদির অভিমানাহত থমথমে মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। কেননা দিদি আরও পিছিয়ে গেছে।
আমার পিচকিরিটা কাজ করছিল না। তোরটা একবার মাত্র চেয়েছিলুম, ব্যাঙাদাকে রং স্প্রে করব বলে, ধার শুধু, কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। ব্যাঙাদা পাস করে গেল, মুখ তুলে আমাদের যথারীতি ভেঙিয়ে গেল— ‘এই যে দুষ্ট সরস্বতী, এইবারে ছিরি খুলেছে। বাঁদুরে রংটা কে মাখালে? তার বেশ রসজ্ঞান আছে দেখছি!’ তোর মনে না থাকতে পারে, আমার মনে দগদগে হয়ে জেগে আছে। শুধু একটি পিচকারি— ব্যাটাকে নাইয়ে দিতুম।— দিলি না।
সে তো ভালই হয়েছে রে! তখন ব্যাঙাদাকে পিচকিরি আবির গুলাল ছোড়ার কী মানে হত বল তো!— এতক্ষণে ভাষা খুঁজে পায় মধুক্ষরা— মানে হত ব্যাঙাদার প্রেমপত্তরের উত্তর দেওয়া। ব্যস লেগে যেত তাক ধুম ধুম, তুই ব্যাঙাদার সঙ্গে গঙ্গার হাওয়া খেতে যাচ্ছিস, ভাবতে পারছিস দিদি?
যশো কোমরে আঁচল গুঁজে নেয়— মানে? মানে? প্রেমপত্তর আবির গুলাল, গঙ্গার ধারে হাওয়া খাওয়া— এ সব কী? মাথায় এল কী করে?
ব্যাঙাদার ওই সব চ্যাটাং চ্যাটাং কথার আসল মানে যে পিরিত সে তো আমি তখনই বুঝতুম। তুইও নিশ্চয় বুঝতিস। তোর নিশ্চয় ব্যাঙাদার সঙ্গে ভিড়ে যাবার মতলব ছিল না! কী রে কিছু বলছিস না যে বড়?
যশোধরা ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন— তুই যে বরাবর আমার শত্রুতা করে যাচ্ছিস তা টের পেয়েও কেন যে পেলুম না এটাই বিস্ময়।
মানে?
দেখ, আমি বুঝতে পারিনি, পারিনি, তুই আমাকে বোঝাতে পারতিস ব্যাঙাদার প্রেমের কথাটা।
বুঝে কী করতিস?
সান্ত্বনা। সান্ত্বনা পুরস্কার। তোর তখন এক বাইরে ঘর ভরতি প্রেমিক। আমারও একটা আছে— চ্যাঙা হোক ব্যাঙা হোক, এই সান্ত্বনা। আর কী! যশো বিয়ের পিঁড়িতে বসছে অথচ পাড়া বেপাড়ায় কারও বুক ফেটে যাচ্ছে না, কেউ সন্ন্যাসী হওয়ার কথা ভাবছে না, এ যে কত বড় কলঙ্ক একটা মেয়ের পক্ষে তা তুই ভাবতে পারছিস! আমার সে জোর কই, কনফিডেন্স কই যে, তোর সুহৃৎদাকে ওঠাব বসাব?
কলঙ্ক কীসের? কার কেচ্ছা হচ্ছে! বলতে বলতে এই সময়ে পাবলো ঢুকল।— কে আমার বাবাকে ওঠবোস করাতে চায়!
তোর মাসি— বলে যশোধরা বন্দ্যোপাধ্যায় সরে পড়লেন।
বছর দশ বয়স থেকে পাবলো বাড়ির ব্যাপারে উদাসীন হয়ে গেছে। বাবা কোথায় গেছে, মা কী করছে, কার মন খারাপ, কেন, কার মন ভাল তাই-ই বা কেন… এ সব পাবলো ভাবে না। বাড়িটাতে সে পরম আরামে বাস করে, চমৎকার খাওয়া-দাওয়া করে। এদিকে বাবা-মা ওদিকে মাসি-মেসো যে সামনে পড়ে তার সঙ্গেই কথাবার্তা বলে। কেউ দেখলে বা দু’দিন বাস করলে বুঝবে না যে পাবলো আলগা হয়ে বাড়ির বোঁটাটিতে ঝুলছে। কিন্তু প্রকৃত সংবাদ হল এই যে, পাবলোর একটি বিশাল বন্ধুকুল আছে। তার মনপ্রাণ সেই বন্ধুদের কাছেই গচ্ছিত আছে। বাড়িতে সে যা বলে তা হল কাজের কথা— পাজামাটা কোথায়? জিনসটা কাচতে দিয়েছে কে? বারবার বলেছি না আমার জিনিসে হাত দেবে না! বাঃ আজ পরোটা মাংস? চমৎকার মেনু করেছ মাম্মি। তোমার হবে। হ্যাঁ বাবা, পড়াশোনা ভাল হচ্ছে। কিন্তু এগুলো ওই কথার পিঠে কথা। আসল গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তার জন্যে আছে রোহন, পঙ্কজ, আমন, উন্নীতা, বল্লী ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মাসতুতো বোন সম্পৃক্তা বা শম্পিও এই বন্ধুকুলের মধ্যে পড়ে। আছে ফুটবলার আরমান, এবং পরিধির কাছে যারা ঘোরাফেরা করছে তাদের মধ্যে রয়েছে মধুবন।
স্কুলের পর পাবলো বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরেছে প্রধানত একটু চান করে নেবার জন্যে। এবং গৌণত নিয়মরক্ষার জন্যে। তার মা যশোধরা ভীষণ রক্ষণশীল, ঘোর নিয়মবাদী। ছেলে বিকেলবেলায় বাড়িতে না ঢুকলে মায়ের ফিটটিট হতে পারে, আর তা যদি না হয় তো পাবলোরই ফিটটা হবে, কেননা মা পাবলোকে খেতে শুতে চান করতে তিষ্ঠোতে দেবে না। বকেই যাবে, বকেই যাবে। পাবলো অশান্তি পছন্দ করে না। সে বিদ্রোহী। কিন্তু নীরব গোত্রের।
মধুমাসি অমনি সাতখানা করে বলতে বসল— দেখ না দিদিকে বলছিলুম ঠান্ডা কোথাও ঘুরে আসি, তা তোরা সবাই, ইনক্লডিং সুহৃৎদা যে দিদির কত অবাধ্য সেই পুঁটলি খুলে বসল। এই গরমে টেকা যায়, তুই-ই বল।
পাবলো হাঁ করে মাসির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল— আচ্ছা মাসি, তোমার ওজন তো বেশি নয়!
আমার ওজন? ওজনের কথা উঠছে কেন?
না, ধরো ঊনষাট-ষাট ওজন এমন কিছু বেশি নয়। তাই না?
অ্যাঁ?
তোমার তার বেশি হবে না। মা অবশ্য উনআশি-টাশি হবে।
মোটেই না। দিদি বড়জোর পঁচাত্তর হবে। বাজে বকিসনি।
কথাটা তা না। কথাটা হচ্ছে চর্বির লেপ যার গায়ে যত বেশি তার গরমও তত বেশি। এখন মাসি, তোমাদের এই পিতৃভবনের কথা ধরো। এটিতে কুড়ি ইঞ্চির দেয়াল। পনেরো ফুটের হাইট। গরম তোমাদের লাগে কী করে? রোদ তো দাঁত ফোটাতে পারছে না তোমাদের বাড়ির ইনসাইডে। সন্ধেবেলা পেল্লাই পেল্লাই জানলাগুলো খুলে দিলে দক্ষিণ সমুদ্দুরের হাওয়া হু হু করে বয়ে যেতে থাকে। যাবে পঙ্কজদের বাড়িতে?
কে পঙ্কজ? তার বাড়ি আমি যেতে যাব কেন? আচ্ছা তো!
উঃ, যেতে বলছি না। কমপেয়ার করছি। ওদের টপ ফ্লোরের ফ্ল্যাটে এসি চলছে গদাম গদাম করে, কিন্তু নো ঠান্ডা, নো রিলিফ। পঙ্কজের মা একখানা মসলিনের না কীসের সি-থ্রু নাইটি পরে ঘোরেন।
পাবলো! অসভ্যতা হচ্ছে!
বা রে, অসভ্যতাটা কি আমি করছি? ভেবে দেখতে গেলে পঙ্কজের মাকেও দোষী করা যায় না। তাঁকেও তো টিকতে হবে রে বাবা! আমাদের মতো তো আর শর্টস পরে, খালি গায়ে বসে থাকতে পারেন না! পারেন? কিন্তু তোমাদের কেস আলাদা। এইরকম ন্যাচার্যালি এয়ার কন্ডিশনড্ আর্কিটেকচার এখন আর বেশি নেই। তা-ও তোমাদের যখন এত গরম হচ্ছে, মনে হচ্ছে প্রবলেমটা অন্য কোথাও। প্রেশার মাপিয়েছ?
চুপ কর।
আহা রাগ করো কেন? মেসোর কি আরও টাকা হয়েছে?
ভাল হবে না বলছি পাবলো।
কী আশ্চর্য। আমি মাওবাদী নই যে, মেসোর টাকায় আপত্তি করব। গরমটা টাকার কি না সেটাই বুঝতে কথাটা তোমায় জিজ্ঞেস করলুম।
পাবলো আর দাঁড়াল না। তিন লাফে দোতলার সিঁড়ি টপকে বাথরুমের দিকে রওনা দিল।
আর্কিটেকচারের সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়ির মেজাজমর্জি সাজসজ্জা সবই জমিদারি। বাথরুমটাই একখানা ঘরের মতো। তাতে পেল্লায় এক বাথটব। অনেক দিনের পুরনো। প্রচুর যত্ন সত্ত্বেও তাতে সামান্য একটু হলদেটে ভাব এসেছে, কিছু কিছু চিড় খাওয়া জায়গার ওপর পট্টি লাগানো হয়েছে। কিন্তু তাতে কী! বাথটবটাতে পাবলো তার পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বাই ছড়িয়ে আরামসে চান করে আর চান করে।
পাবলিক প্রসিকিউটরকে সংক্ষেপে কী বলে? পি পি। কিন্তু পি পি-র প্রচলিত মানে হচ্ছে পাবলো-পঙ্কজ। জুটিটি অবিচ্ছেদ্য বলে বিখ্যাত। কিন্তু ইদানীং এদের মধ্যে একটা ডিফারেন্স দেখা যাচ্ছে। পঙ্কজের ইচ্ছে সে স্টেটস-এ যাবে। পাবলো স্টেটসকে ঘৃণা করে। কেন? বুশ-এর জন্যে? ইরাক-আফগানিস্তানের ওপর বুশী হামলার জন্যে? না। একেবারেই না। কে কোথায় কার ওপর হামলা করছে সে সব নিয়ে ঘেন্না-পিত্তি থাকলে তো আর এ-পৃথিবীতে টেকা যাবে না। গুড বাই জানিয়ে বেহেস্ত্-জাহান্নম যে-দিকে হোক কেটে পড়তে হবে। আসলে বড্ড কমন, ভালগার হয়ে গেছে। তবে কি পাবলো অস্ট্রেলিয়া যেতে চায়? আজকাল লোকে খুব অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। হাজার হাজার ডলার খরচ করে ক্যানবেরা সিডনির ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাচ্ছে। আর ফিরছে না। অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর তৃতীয় মেল্টিং স্পট হতে যাচ্ছে। প্রথমটা রবীন্দ্রনাথ নামে গুরুদেব ভদ্রলোকটি দাগিয়ে গিয়েছিলেন— ‘শক হুন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’ দ্বিতীয়টি অবশ্যই আমেরিকা। বিশ্বসুদ্ধু সায়েন্টিস্ট জড়ো করে অ্যাটম বোমা বানাল, বলল আমেরিকার উদভাবন। ভাল বাবা কর। তৃতীয় মেল্টিং স্পট হতে চলেছে অস্ট্রেলিয়া। একরের পর একর খালি জমি পড়ে রয়েছে সেখানে। ভারত স্বাধীন হবার পর দলে দলে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেন, বিকল্প হোম।
আর এখন অস্ট্রেলিয়া তার খালি জমি, চাষবাস, খামার-টামার, ক্রিকেট-টিকেট, বিশ্ববিদ্যালয়-টয় নিয়ে ডাক পাঠাচ্ছে দিকে দিকে। এসো, এসো আমাকে ধনী করো, যেমন করেছ আমেরিকাকে। লোকে যাচ্ছেও, খুশিতে যাচ্ছে। খুশিতে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু পাবলো অস্ট্রেলিয়াতেও যেতে চায় না। উঃ পাবলো যে কী চায়! সে ম্যানেজমেন্ট পড়বে না। ডাক্তার হবে না। ইঞ্জিনিয়ার হবে না। আর্টিস্ট হবে না। তবে পাবলো কী হতে চায়! পঙ্কজ ধুধুরিয়ার আইকন হচ্ছে বিল গেটস। সে আই টি-তে যাবে, ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোবে। প্রথমে বি পি-ও জয়েন করবে একটা কেননা তার এগ্রিগেট রেজাল্ট তেমন সুবিধের হচ্ছে না। সে যাই হোক সে ক্রমে ক্রমে ঊর্ধ্বে উঠবে, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ের জন্যে যা যা থাকা দরকার পঙ্কজ ধুধুরিয়ার সে সবই আছে। স্মার্টনেস, চটপট চিটিরপিটির কথা বলবার ক্ষমতা, অ্যালার্টনেস যাকে বলে। কম্পিউটারের বেসিকস তো সে কবেই জেনে গেছে। সে বি এস সি-টা করবে, তার পরে বি পি ও, তার পরে সিলিকন ভ্যালি স্ট্রেট। বাড়িতে গোড়ায় গোড়ায় টাকা পাঠাবে। তারপর প্রথমে ভাইকে তারপরে বাবা-মাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। এবং যদি ম্যানেজ করতে পারে তো নিয়ে যাবে বল্লীকে বল্লী ধুধুরিয়া করে। মুশকিল হচ্ছে বল্লী ঠাকুর হচ্ছে অতি ধুরন্ধর মেয়ে। পঙ্কজ যদি চলে ডালে ডালে তো বল্লী চলে পাতায় পাতায়। এবং বল্লী ঠাকুরকে ন্যাশন্যালিস্ট পোকায় কেটেছে। বল্লী মনে করে, সে না থাকলে ভারতবর্ষকে আর দেখবার কেউ থাকবে না। তাই সে স্টেটস অস্ট্রেলিয়া তো কোন ছার, হাতের কাছে মায়ানমার কি চায়না পর্যন্ত যেতে চায় না।
এখন বন্ধু মহলে পি-পি বলতে যেমন পঙ্কজ পাবলো বোঝায় তেমন পি বি এক্স বলতে টেলিফোনের প্রাইভেট বক্স এক্সচেঞ্জ বোঝায় না। বোঝায় বল্লী কমন ফ্যাক্টর কিন্তু পি-টি কোন পি? পাবলো? না পঙ্কজ? সেইজন্যেই শেষে এক্সটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোন পি সেটা পি-রাও জানে না, বল্লীও জানে কি না সন্দেহ আছে। এই নিয়ে একটা সুক্ষ্ম টেনশন যে তাদের মধ্যে নেই তা নয়। কিন্তু কোনও মনোমালিন্য এখনও নেই।
পাবলোর কম্পিউটার-সম্পর্কিত চাকরির ওপর ভীষণ ঘেন্না। প্রচুর মাল ছাড়ে কোম্পানিগুলো তারপর তোমাকে স্রেফ কিনে নেয়। কারও ক্রীতদাস হবার সাধ পাবলোর নেই। তার বাবা সুহৃৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তার খাটুনিটা খেটে দিচ্ছেন, বাবার এক ছেলে সে, আর্থিক দিক থেকে যাকে বলে সাউন্ড। টাকার জন্যে দাসত্ব করার মতো গাঁইয়ামি করবার পাত্র পাবলো নয়। তবে সে কী করবে? ক’দিন পরই আই এস সি পরীক্ষা। তার মধ্যেই ঠিক করে ফেলতে হবে। বাবা জিজ্ঞেস করছে, মা জিজ্ঞেস করছে, মধুবন পর্যন্ত জিজ্ঞেস করছে।
কী রে পাবলো, কী ঠিক করছিস?
কোনও একটা নির্দিষ্ট দিন থেকে পাবলোর মাসতুতো বোন মধুবন কেমন একটু তেতো, তির্যক, বিদ্রূপাত্মক হয়ে উঠেছে। এটা একটা ডেফিনিট চেঞ্জ। কেননা মধুবন চিরকাল পাবলোর খুব বন্ধু। মধুবন পাবলোর মায়েরও খুব বন্ধু। হেন জিনিস নেই পৃথিবীতে যা মধুবন আজ অবদি পাবলোর সঙ্গে ভাগ করে নেয়নি। সে চকলেট-ফুচকাই বলো, আর মধুবনের নিগূঢ় প্রেমাকাঙক্ষা, তার নিদারুণ ডিপ্রেশন সে মোটা বলে কেউ তাকে সিরিয়াসলি নেবে না… ইত্যাদি ইত্যাদি সে পাবলোর সঙ্গে যত সহজে আলোচনা করে, শম্পির সঙ্গেও ততটা নয়। যদিও পাবলো মোটেই তার গোপন কথাবার্তার ভাগ মধুবনকে দেয় না। যাই হোক, যে-মধুবন সব সময়েই তার নিজস্ব বন্ধু হয়ে টিকে ছিল, সেই মধুবন হঠাৎ কেমন খামখেয়ালিনী তিক্তা হয়ে উঠেছে।
কী রে পাবলো, কিছু যে বলছিস না! ভ্যারেন্ডা ভাজবি নাকি?
কেন। তুই জেনে কী করবি? তোর এত কৌতূহল কেন?
বাঃ চিরকাল সব আমাকে বলে এসেছিস, হঠাৎ এখন মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট স্টেপটা বলছিস না।
বেশ তো তুই বল না তুই কী করছিস।
আমি তো ভাই বহুত দিন আগে থেকেই বলে দিয়েছি সায়েন্সই পড়ি আর যাই করি শেষ পর্যন্ত আমি ইংলিশ হন্স্ নিয়ে পড়ব, মাস্টার্স করব, তারপর ড্যাংডেঙিয়ে কলেজে পড়াব। মধুবনদি। মধুবনদি, ম্যাডাম, ম্যাডাম বলে ছাত্র-ছাত্রীগুলো ঘিরে ধরবে। এই আমার অ্যাম্বিশন।— হতে পারে ছোটখাটো। কিন্তু আমি জানি আমি কী চাই। তোদের মতো অন্ধকারে ঢিল ছুড়ি না।
বলে মধুবন বেশ কায়দা মেরে চলে গেল। পাবলো এখন বাথটবে গা ডুবিয়ে ভাবছে, সত্যিই সে কী করবে! ছোট থেকে এত কিছু সে করেছে যে, এখন নিজেকে বাঁশবনে ডোম কানা মনে হচ্ছে।
পাবলোর দারুণ ড্রয়িংয়ের হাত বুঝলেন আনন্দবাবু। আপনি যদি ওকে একটু…। যশোদা-মা গদগদ। পাবলোকে ‘বসে আঁকো’ফাঁকোতে না বসালে চলছে না। ফুল আর্টিস্ট কিন্তু নয়, পার্ট টাইম আর্টিস্ট হতে হবে।
আনন্দ গোস্বামীর কাছে পাবলো আঁকা শিখেছে। ড্রয়িং, স্কেচ, জলরং, তেলরং, ওয়াশ, সবই।
পাবলোর সুরতালজ্ঞান সাংঘাতিক বুঝলে যশো— সুহৃৎবাবুর উক্তি। কেননা পাবলো সব চলতি হিন্দিবাংলা গান গাঁক গাঁক করে গেয়ে দিত। যত ধাঁই ধপাধপ টাইপ হবে তত ফুরতি। সুতরাং, তাকে নাচের ক্লাসে ভরতি হতে হল। ক্রিয়েটিভ ডান্স। সেই সঙ্গে গানও। জ্ঞানদা তালুকদারের কাছে। গোটা দশেক রাগ সে ভক্তিভরে শিখেছে। বাড়ি ঢোকা থেকে শুরু করে ঘুমোতে যাবার আগে পর্যন্ত গান গুনগুন করে থাকে। এক-এক সময় এক-একটা গান তাকে পেয়ে বসে। এক সময়ে ছিল ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’— মধুবন একদিন বলল— আর য়ু অ্যান ওল্ডি?
শম্পি বলল— যা বলেছিস! তারপরে সে ধরল ‘ডম ডম ডিগা ডিগা’। মা তাকে শুধু মারতে বাকি রাখত তখন। ‘উফফ পাবলো আমার মাইগ্রেন শুরু হয়ে গেল।’
তুই একটু থামবি?
ইদানীং সে গাইছে ‘আশিক বানায়া’।
ফোটোগ্রাফিতেও দারুণ শখ পাবলোর। পোট্রেট বিশেষ করে। রীতিমতো কালেকশন তার। গোটা তিনেক ক্যামেরা কোডাক, ক্যানন, নাইকন, আলাদা আলাদা লেন্স। ফিল্টার। ডার্করুমের কাজও সে জানে। যেখানে যায়, ক্যামেরাবাবু সঙ্গে যান। ডিজিটাল ক্যামেরায় তার শখ নেই। সে আর্টিস্টিক ছবি তুলতে চায়। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট পছন্দ করে।
এত গুণ, এত শখ নিয়েও পাবলো বাথটবের মধ্যে স্রেফ লক্ষ্যহীন ভাবে শুয়ে থাকছে। বেশ কিছু দিন। মায়েরটা তবু পাশ কাটানো যায়।— উফ আগে আই এস সি-র ধাক্কাটা সামলাতে দাও! মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে আছে বুঝলে মাদার?
ব্যস মা গলে জল। মাদার ডাকলেই কি মায়ের নিজেকে মাদার টেরিজা মনে হয়, না গোর্কির মাদার, কে জানে কিন্তু মাদার ডাকে মা খুশি হয়ে যায়— এক্কেবারে পাবলোর পরীক্ষিত সত্য।
বাবাকে পাশ কাটানো অত সোজা নয়। রোববারের মধ্যাহ্নভোজন পর্যন্ত মোটামুটি এড়িয়ে থাকা গেল, তারপর চটি চটাস চটাস করতে করতে সুহৃৎ ব্যনার্জি ঘরের ভেতর ঢুকে আসবেন— পাবলো খাবি না! চল!
ভাত ভেঙেই প্রথম প্রশ্ন— শরীর স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখছ তো? ওজন বাড়িয়ে যাওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়।
মাতৃদেবীর ঝংকার সঙ্গে সঙ্গে— কেন ওজন বেশি বলে কোন কাজটা আমি হালকা করে করছি? তোমাদের অসুবিধে হচ্ছে কোনও?
আমাদের নয়। তোমার, অসুবিধেটা তোমার, এই সিম্পল কথাটা না বুঝলে তাকে বলে সিম্পলটন।
থাইরয়েড টেস্ট করাও। বারবার তো বলছি আমার হাইপোথাইরয়েড হয়েছে। চোখের পাতা পড়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত লাগে সব সময়ে তা জানো?
ফোন রয়েছে, তুলে দিয়ে জাস্ট একটা কল দাও না অরূপ ল্যাবরেটারিতে।
কেন? আমার অসুখে আমি করব কেন? তোমাদের অসুখের বেলা তো তখন আমাকেই সব করতে হয়। ডাক্তার ডাকা, ওষুধ খাওয়ানো, পথ্য করা— আমার বেলা কেন আলাদা হবে! আমি কাউকে ফোন করব না। চুপচাপ মোটা হতে হতে একদিন ফটাস করে পটল তুলব। তখন দু’হাত তুলে নেচো।
মা হাঁসফাঁস করতে করতে চলে গেল।
ব্যস সুহৃৎ ব্যানার্জির মনোযোগ ছেলে থেকে স্ত্রীর দিকে ঘুরে গেল।— এ হে হে, এটা তো আমার মনে হয়নি। ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাওয়া হয়নি। থাইরয়েডটা— এহে হে… বাবার প্রবল বিবেক দংশন হচ্ছে দেখে পাবলো বলে, ডাক্তার না হলেও হাফ-ডাক্তার দেখেছেন।
হাফ ডাক্তার? বাবার চোখ গোল হয়ে যায়— হাফ ডক্টরস আর ভেরি ভেরি ডেঞ্জারাস পাবুল।
না বাবা। ওই মধুবনের জিম মাস্টার। তাঁর সঙ্গে তো মায়ের খুব ভাব। বিকেলবেলা হাঁটতে তো উনিই মাকে পাঠিয়েছেন। উনিই বলেছেন ডায়েট মানতে হবে।
তা তোর মা কি মানছে না?
পাবলো কাঁধ নাচাল— আমি কী করে বলব। সারাদিন থাকি? একা বাড়ি। কোথাও কেউ নেই। মা কী করছে না করছে, আইসক্রিম খাচ্ছে না রসগোল্লা খাচ্ছে কে দেখতে যাচ্ছে!
তা তুই থাকিস না-ই বা কেন? বাবা মাছভাজা খেতে খেতে নিস্পাপ চোখে জিজ্ঞেস করে।
বোঝো। একটা আঠারো বছরের ছেলে। সে নাকি মা আইসক্রিম খাচ্ছে কি নজরদারি করবার জন্যে বাড়ি বসে থাকবে। পারেও বটে এরা।
তুমি থাকো না কেন?
আমি? সুহৃৎবাবুর মাছভাজা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।— আমি? হো হো হো! না ভাল বলেছিস পাবুল। আমি, অ্যাঁ?
কতক্ষণ বাবার এই ‘আমি আমি’ বিস্ময় চলবে কে জানে তাই পাবলো বলল— আমার কলেজ নেই? কোচিং নেই? খেলা নেই?
বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডার কথাটা কেয়ারফুলি বাদ দিয়ে গেলি, কেমন?— বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকাল।
ওটা হল অকুপেশন্যাল হ্যাজার্ড। থাকবেই বাবা।
কী বললি? কী হ্যাজার্ড? অকুপেশন্যাল? বলি তোর অকুপেশনটা কী?
স্টুডেন্ট। পড়াশোনা, কলেজ করা— ছবি আঁকা, গান-নাচ, তালিম, সব জায়গায় গোছা গোছা বন্ধু। ও তুমি আটকাতে পারবে না, আমিও পারব না। উঠি বাবা, অনেক কাজ হ্যাঁ?
না না, উঠিস না। হাত ধুয়ে এসে টেলিফোন বুকটা দে, আমার সেলফোনটা টেবিলে আছে এনে দে। এইখানে আমার পাশটিতে দাঁড়িয়ে অরূপ ল্যাবে ফোন কর।
অগত্যা পাবলোকে তাই করতে হয়।
ফোন করে নিয়ে পাবলো বলে— বাবা, জিজ্ঞেস করছে কী টেস্ট?
থাইরয়েড।
থাইরয়েডের কী জিজ্ঞেস করছে।
ওই সব টি এইট এস, টি এইচ ওয়ান টু থ্রি যা আছে সব।
বাবা, ডক্টরের নামটা চাইছে ওরা।
বাবা বললেন, —ডক্টর সুহৃৎ ব্যানার্জি বল।
নির্বিকার মুখে নামটা বলে ফোন অফ করে দিয়ে পাবলো বললে, বাবা, তোমার বিরুদ্ধে এবার কিন্তু কেস হবে।
কেন? আমি কি ডক্টর নই!
তুমি ডক্টর অফ সায়েন্স, ওরা মেডিক্যাল ডক্টর চাইছে।
সে তো বটেই। কিন্তু আমার হল কাজটা চটপট হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা, এবং মিথ্যে না বলা নিয়ে কথা— বলে বাবা ‘যশো যশো ইটস ডান, তোমার স্বামী তোমার থাইরয়েড টেস্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, আর রাগঝাল করে থেকো না। একটু খাওয়া-দাওয়া করো’— বলতে বলতে চলে গেল।
এই বলছে খায় কি না নজর রাখিস। আবার এই বলছে একটু খাওয়া-দাওয়া করো— এই মা-বাবা জাতীয় লোকগুলোকে পাবলো আজও বুঝে উঠতে পারল না।
মাঝে মাঝে ক’দিন খুব ঝড় দিচ্ছে। দু’-চারটে গাছ পড়ছে। ছিটকিনি না লাগানো জানলার কাচ মুড়মুড় করে ভেঙে যাচ্ছে, শুকোতে দেওয়া কাপড়-চোপড় ক্লিপসুদ্ধ ছিটকে উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঝড় পরবর্তী বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টির এখনও দেখা নেই। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে যশোধরা তৃতীয় বার চান করে, সারা গায়ে ট্যালকম পাউডারের বৃষ্টি ঝরিয়ে স্লিভলেস একখানা ব্লাউজ গলিয়েছেন, দরজায় বেল বাজল। বেলের আওয়াজটা বিশ্রী। একেবারে চ্যাঁ ভ্যাঁ মতন। শুরু করলে থামতে চায় না। কিন্তু যশোধরা এই বেল বদলাতে দেন না। এটা বাবা লাগিয়েছিলেন। বাবার জীবনের শেষ বেল। সুহৃৎ যদি বলেন— ওফ এটা তো দেখছি মরা মানুষকেও দাঁড় করিয়ে দেবে।
পাবলো ফোড়ন কাটবে— মারকুটেও করে দিতে পারে। বেলটা শুনলেই মনে হয় দরজাটা খুলেই বেলঅলাকে দিই এক থাপ্পড়।
না না এতটা রি-অ্যাক্ট করিস না। তোর রি-অ্যাকশনগুলো আজকাল বড্ড স্ট্রং হয়ে যাচ্ছে রে পাবুল। সামলে। সামলে।
যশোধরা বলেন— যার বাড়িতে আরামসে থাকতে পারছ, প্রেমসে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, মজা মারতে পারছ, তার বাড়ির বেল-কে একটু সহ্য করতে হবে।
‘হবে’টা অতিরিক্ত জোর দিয়ে বলে যশোধরা পাউডার মাখতে থাকেন। আজ কেউ নেই। যশো নিজের মনেই বলেন— বাবা রে বাবা বেল বটে একখানা। পিলে চমকে যাবে। তাড়াতাড়ি করে শাড়িখানা কাঁধে ফেলতে না ফেলতেই আবার চ্যাঁ!
উঃ লোকে বোঝে না প্রথম বেলে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না মানে গৃহকর্ত্রী ব্লাউজ পরছেন, শাড়িটা এখনও দুরস্ত হয়ে ওঠেনি। এই সামান্য কথাটা না বুঝলে… উফ্ফ্।
তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে যশোধরা দেখেন একটি যথেষ্ট সরু মেয়ে সিড়িঙ্গে মতন প্যান্ট পরা, ওপর দিকে একটা বেঁটে মতো টপ, পাশে একটি গাবদা গোবদা ছেলে। তার পরনে বারমুডা, পাতলা আদ্দির মতো কোনও কাপড়ের একটা ফতুয়া, এত পাতলা যে, ভেতরে পইতে দেখা যাচ্ছে।
মেয়েটি বললে— স্যরি ফর দা বেল।
আমার বেলের জন্যে তুমি কেন স্যরি হতে যাবে ভাই?— যশোধরা মোলায়েম করে বলেন।
মেয়েটি বলল— আপনারা স্যরি না হলে আমাদেরই হতে হয়। একটু হাসল— কিছু মনে করবেন না আমি একটু ট্যাঁক ট্যাঁক করে কথা বলি। বেলটা পালটে নিলেই পারেন। না পাবলোবাবুর সেটুকু উদ্যোগও নেই!
বেলটা পাবলোবাবুর নয় ভাই, বেলটা আমার, আরও ভাল করে বলতে গেলে আমার বাবার। বাবার লাগানো শেষ বেল। পালটাবার উপায় নেই।
ফ্যামিলি এয়ারলুম? ছাওয়ালটি এতক্ষণে বলল।
রাইট।
পাবলো কি বাই এনি চান্স বাড়িতে আছে?
নো চান্স— যশোধরা বলেন, তা তিনি আবার কোথায় উধাও হলেন? তাঁর ক’টি ঠেক! —মোটের ওপর?
জানলে তো বলব! ভেতরে আসতে বলবেন না?
কে জানে, ভেতরে আসতে বললে আবার স্যরি-টরি বলবে কি না!
দুই মক্কেল ভেতরে ঢুকে এল।
আ-হ। কু-ল— ছেলেটি বলল।
মেয়েটি বলল— আর্কিটেকচার।
ছেলেটি বলল— ওল্ড ইজ গোল্ড।
মেয়েটি বলল— প্ল্যাটিনাম।
এতক্ষণে ধৈর্যচ্যুতি হল যশোধরার। এসে সোফার ওপর গদিয়ান হয়ে বসেছে ছোকরা-ছুকরি, বসে নিজেদের মধ্যে একাক্ষরে প্রায় কথা বলছে। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল মধুকে ডেকে আনেন। এদের বেয়াদপি দেখান। তারপর দুই বোন মিলে একেবারে দূর করে দেন। একা একা অতটা সাহস হয় না। আজকালকার ছেলে! কখন তেরিয়া কখন মরিয়া!
তোমরা কে বলো তো!
পাবলোর বন্ধু অবভিয়াসলি। আপনি কি পাবলোর মা না মাসি না পিসি না দিদি!
এত কথার উত্তর আমি দিই না। পাবলোকে খুঁজতে ভর সন্ধেবেলা এখানে কেন?
ও যে বলে বাড়িটা ওর সন্ধেবেলার চান করার জায়গা।
কী বলে? বিস্ময়ের আর কূল পান না পাবলোর মা।
বলে বাড়িটার প্রধান ইউটিলিটি হল বাথটব একটা। ছেলেটি হাত ছড়িয়ে দেখায়— এত বড়। খুব মোটা লোকও ধরে যাবে। গড়িয়ে গড়িয়ে চান করতে পারবে।
রাগে গরগর করতে করতে যশোধরা বললেন— গেট আউট। জাস্ট গেট আউট। এক্ষুনি। ওঠো ওঠো। তিনি আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে লাগলেন।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হতভম্ব ছেলেটি বলল— কী আশ্চর্য রেগে যাচ্ছেন কেন? অত রেগে যাচ্ছেন কেন? রাগ তো আমাদের করবার কথা! পাবলো ইজ দা কালপ্রিট। চুরিটুরি করে এখন লুকিয়ে পড়েছে।
সে তার সঙ্গে বুঝে নাও। এ-বাড়িতে আর এক দণ্ড নয়। যাও, যা-ও।
এই সময়ে মধুমহলের দিকের দরজা খুলে মধুক্ষরা ও তার মেয়ে সম্পৃক্তা ঢোকে।
আরে কার্জন, উন্নি তোরা? ও কী? মাসি? ওরকম ফুঁসছ কেন? দাপাচ্ছ কেন? ওরা আমাদের বন্ধু যে!
কী রকম বন্ধু করেছ যে, সে আমার বাড়ি বয়ে এসে গাল টিপলে দুধ বেরোয় আমাকে মোটা বলে যায়! এত বড় সাহস? বলতে বলতে দেখা গেল যশোধরা ভীষণ টলছেন। শম্পি দৌড়ে এসে মাসিকে ধরে। তার মা আসে। ছেলেমেয়ে দুটিও হাত লাগায়। এবং সবাইকেই প্রায় সঙ্গে নিয়ে যশোধরা ব্যানার্জি নিজের বাইরের ঘরের সোফার ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
মধু দৌড়োতে দৌড়োতে বরফ নিয়ে আসেন। শম্পি ডাক্তারকে কল দেয়, মধু জামাইবাবুকে কল দেন, উন্নি মোবাইলে একটার পর একটা কল করে যায়।— তোরা কেউ পাবলোর নম্বর জানিস? জানলে খবর দিয়ে দে। ওর মা সেন্সলেস হয়ে গেছেন। খুব সিরিয়াস কেস!
এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, ডাক্তারের আসার আগেই রোগীর জ্ঞান ফিরে আসে। সুবল ডাক্তারবাবু ঢুকে প্রথমেই হৃষ্ট হয়ে হাতে হাত ঘষে বললেন— এই তো চোখ চেয়েছেন।
মধুক্ষরা কণ্ঠে বিষ ঢেলে বললেন— সে তো আপনি সেন্সে আসার সময়টুকু ইচ্ছে করে পার করেই ঢুকলেন সুবুলদা! মোড়ের মাথায় আপনার ডাক্তারখানা, এইটুকু আসতে আধঘণ্টা লাগে? এতক্ষণ অজ্ঞান থাকা মানে তো সিভিয়ার হার্টঅ্যাটাক!
ম্যা-সিভ— যশোধরা ক্লান্ত গলায় বললেন।— যাক মধু, তুই সুবুলদার সঙ্গে ঝগড়া করিসনি। এখন আর ঝগড়া করা মানায় না।
তুই চুপ কর।
ডা. সুবল মিত্রও স্টেথোস্কোপ বার করতে করতে বললেন— আপনি চুপ করুন, পেশেন্টের অত কথা বলা ঠিক নয়। হ্যাঁ জোরে জোরে শ্বাস নিন। জোর পাচ্ছেন না? একটু চেষ্টা করুন, ডাক্তারের সঙ্গে কো-অপারেট করতে হয় ম্যাডাম।
ইতিমধ্যে শম্পি তার দুই বন্ধুকে নিয়ে ঘরের এক কোণে সরে গেছে। খুব উত্তেজিত ভাবে নিচু গলায় কথা বলছে। খুব সম্ভব পেশেন্টকে নিয়ে নয়।
মধুক্ষরা বললেন— ওহে মাসির আদরের বোনঝি, একবার এদিকে এসো। দিদি নেয়ে গেছে, তার জামাকাপড় পালটাতে হবে, নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারে।
ডাক্তার মিহি গলায় বললেন— এরকম কি আগেও হয়েছে।
মধু বললেন— আপনি জানতে পারতেন না, হলে? হাউস ফিজিশিয়ান বলে যে-কোনও এমার্জেন্সিতে আমরা তো আপনাকেই কল দিই।
ব্ল্যাকআউট জিনিসটা ভাল না— ডাক্তার তাড়াতাড়ি বললেন— ইমিডিয়েটলি একটা ই সি জি আর ব্লাড সুগার করানো দরকার।
খসখস করে প্রেসক্রিপশন লেখার কথা। কিন্তু সুবুল ডাক্তার লিখলেন কাঁপা কাঁপা হাতে। মধুক্ষরা মুখার্জির ধমকে বিলক্ষণ ভড়কে গেছেন।
উন্নি নামে মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছিল, কোমরে হাত দিয়ে বেঁকে দাঁড়িয়ে বলল— এরকম ট্রেমেলো কেন? কেসটা কী?
একজন মাসি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন আর তুমি আলতু-ফালতু বকছ? মধুক্ষরা ধমকে উঠলেন।
উন্নি পাত্তা দিল না। শম্পির দিকে তাকিয়ে বলল— গলায় ট্রেমেলো হাতে ট্রেমেলো। কেসটা কী রে শম্পি?
শম্পি অবাক হয়ে বলল— কী বকছিস বল দিকি?
এই সময়ে ভিজে জবজবে পেশেন্ট ক্লান্ত গলায় বললেন— ধরেছ ঠিকই, গুড! কেস প্রতাপ— শৈবলিনী।
মিনস?
ওহ তোমরা আবার বঙ্কিমচন্দ্র-টন্দ্র পড়ো না। প্রতাপ শৈবলিনী একটি বাল্যপ্রেমের কেস যা সারাজীবন টানা হয়েছিল। বুঝলে কিছু!
আই সি!— উন্নি চকচকে মুখে বলল।— কেসটা আপনার না ওঁর। সে অপাঙ্গে মধুক্ষরার দিকে চাইল।
আমার কোনও কেস নেই, ফাইল নেই। আমি খোলা পাতা। জীবনের ঝরাপাতা এখন।
ওহ মাসি, মাত্র এক বার দু’সেকেন্ডের জন্যে অজ্ঞান হয়েছ বলে অমনি ঝরাপাতা হয়ে গেলে। তোমরা অ্যাত্ত সেন্টিমেন্টাল না!— শম্পি বকে উঠল।
ডাক্তারবাবু কাঁপা কাঁপা হাতে প্রেসক্রিপশনটা শম্পির দিকে এগিয়ে দিয়ে একরকম পালিয়ে গেলেন।
উন্নি বলল— হাউ সুইট! আমরা এবার চলি!
মানে? বাড়িতে একটা ব্যাটাছেলে নেই, আমার দিদি অজ্ঞান আর তোমরা তোমরা— চলে যেতে চাইছ?— মধুক্ষরা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।
আমি কিন্তু ব্যাটাছেলে নই আন্টি। ব্যাটাছেলে ওই কোণে বসে দাঁতে নখ কেটে যাচ্ছে তখন থেকে, আরেকজন একটু আগেই ভোঁ-কাট্টা হয়ে গেলেন।
তা যদি বলো তুমি ব্যাটাছেলের বাড়া— শুয়ে শুয়ে ‘অজ্ঞান’ দিদিটি বললেন।
চমৎকার। আই টেক ইট অ্যাজ আ কমপ্লিমেন্ট। কিন্তু আমার মনে হয় আপনারা দুই আন্টি নির্ঘাত আঙ্কলদের থেকে বেশি স্মার্ট! কোনও ক্রাইসিসের মোকাবিলা করাটা আপনাদের কাছে কোনও ব্যাপার না। তাই আমি বেশ নিশ্চিন্ত হয়েই যাচ্ছি। পাবলোর কাছে খবরও চলে গেছে। তার মায়ের ফিট সে এসে সামলাক। এটুকু কর্তব্যও যদি না করে তো তার ত্যাজ্যপুত্র হওয়া উচিত। আমার সোজা কথা।
পেশেন্ট এবার জোর গলায় বলে উঠলেন— ফিটটা যে তোমাদের জন্যে হল! সে দায় কে নেবে? মারল একজন, গলায় গামছা দিয়ে টেনে আনা হচ্ছে আরেকজনকে। ভেবেছ যা খুশি বুঝিয়ে যাবে, না?
উন্নি বলল— আই সি, এইভাবেই আপনারা পাবলো ব্যানার্জিকে স্পয়েল করে আসছেন। তাই আজ সে একটা ইরেসপন্সিবল, গুড-ফর-নাথিং— বাঃ। বুঝলাম, তবে আন্টি একটা কথা— আমরা আপনাকে মোটা বলিনি। কিন্তু— সে একটু অর্থপূর্ণ বিরতি দিয়ে বলল— কিন্তু মোটা বললেই যদি আপনার ফিট হয় তা হলে আপনার ও রোগ ভগবানের বাবা এলেও সারাতে পারবে না। পাবলো তো কোন ছার! চলি! উন্নি পত্রপাঠ টকাটক টকাটক করে সদর দরজা খুলে চলে গেল। কোণে বসে থাকা ব্যাটাছেলেটিকে নিয়ে গেল না। তাকে অবশ্য কেউ লক্ষই করছিল না।
ইতিমধ্যে জামাকাপড় পালটাতে যশো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ওরে মধু— আলমারি থেকে নীল-ছাপ কোটাটা নিয়ে আয়। ম্যাচিং ব্লাউজ ওখানেই ঝুলছে। শম্পি, পেটিকোট একটা দেখেশুনে আন বাবা। আলনায় আছে। বলে যশো ফটাশ করে শাড়িটা খুলে ফেললেন। তখন কোণের দিক থেকে একটা ভীত গলা শোনা গেল— আমি আছি, আমি আছি।
তিনটে মাথাই একসঙ্গে কোণের দিকে ঘুরে গেল।
মধুক্ষরা বললেন— এই যে ক্যানিং, ইয়ারকি পেয়েছ! হাইলি সাসপিশাস! কোণে বসে বসে কী করছ? ভয়ারিজম? তোমায় পুলিশে দেব।
ক্যানিং নয় মা কার্জন— শম্পি মাকে শুধরে দেয়।
যশো বলেন— ওকে পালাতে দিসনি। আটক কর। আটক কর। শম্পি, ওকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দে।
তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে কার্জন বলল— এই শম্পি। খবরদার বলছি। খবরদার আমার গায়ে হাত দিবি না। বন্ধ করে রাখবি মানে! আমি কি ইচ্ছে করে এখানে বসে আছি!
তবে কোন কর্মে বসে আছ শুনি একঘর লেডিজদের মধ্যে! মধুক্ষরা গর্জন করলেন।
কার্জন বলল আমি পাবলোর জন্যে ওয়েট করছিলুম। সে আমার কিছু দরকারি জিনিস নিয়ে হাপিস করে দিয়েছে। আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে সে বলল, এখন যাচ্ছি, কিন্তু আমি আবার আসব। পাবলোকে বলে দেবেন।
কার্জন নামে ছেলেটি চলে গেলে যশো শম্পিকে চা করতে পাঠিয়ে দিলেন। শম্পি চলে যাওয়ামাত্র ফিসফিস করে বললেন— এখনও, বুঝলি মধু, সুবুলদা এখনও তোর চক্করে পড়ে আছে।
হ্যাঁ তোমাকে বলেছে! দিব্যি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখে ঘর করছে।
তা করুক না। তাতে প্রেম আটকায় না। এ হল বাল্যপ্রেম। অভিশপ্ত। চিরকাল কাঁপাবে।
হ্যাঁ যখন মাসের শেষে মোটকা বিলটা পাঠাবে?
তুই একেবারেই কচিখুকি রয়ে গেলি। বিলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক কী! ডাক্তার ডাক্তারি করেছে ফি নেওয়া তার কর্তব্য। জীবিকা। জীবিকার জন্যে যা করার করে যাচ্ছে। সবাই কি আর মরতে পারে রে?
তাই বলে শুধু শুধু একগাদা টেস্ট লিখে দেবে।
শুধু শুধু! বলিস কী রে! আটচল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেছে, ব্ল্যাকআউট। ভীষণ খারাপ জিনিস!
দিদি, আমাকে ন্যাকা পাওনি, তোমার চালাকি আমি জানি না। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে না আরও কিছু। কী মতলবে চোখ বুজে মটকা মেরে ছিলে বলো তো এবার!
ইসস, তুই চিরদিনের ছোট্ট স্নেহের বোনটি হয়ে আমার মধ্যে মতলব দেখছিস! সত্যি বলছি মাথাটা কেমন বাঁই করে ঘুরে গেল। পড়ে যেতে যেতে মনে হল চোখ দুটো প্যাঁট প্যাঁট করে খোলা রাখাটা ঠিক হবে না। দ্যাখ মোটা মানুষ পড়ে গেলে লোকে হাসবেই, কিন্তু যদি অজ্ঞান হয়ে যায়! তখন তো তার হাসতে হচ্ছে না!
এত কথা তুমি ওই ক’সেকেন্ডে ভেবে নিলে! নাঃ, তোমার মাথা বটে একখানা!
শুধু মাথা নয়। চোখ কান সবই আমার খুব দুরস্ত। ওই ক্যানিং না কার্জন নির্ঘাত শম্পির ক্যান্ডিডেট, বিওয়্যার অব হিম। আর পাবলোটা কী হাপিস করেছে বল তো! প্রেমপত্র? ক্যানিংহামের কাছে শম্পির প্রেমপত্র। দু’জনে কীরকম গুজগুজ করছিল দেখেছিলি? শম্পি আর ওই ক্যানিংহাম!
ওহ দিদি, তোমার মাথাটা প্রেম প্রেম করে এক্কেবারে গেছে। ওরা কি পত্র-টত্র লেখে নাকি আর? ওরা চ্যাট করে, ই-মেল পাঠায়, মোবাইলে এস এম এস রাখে।
তা-ও তো বটে!— উদাস হয়ে গেলেন যশো। প্রেমপত্র? আহা সে যে কী জিনিস তা যদি এরা জানত!
এইরকম উদাস-উদাস ভাবেই যশো জামাকাপড় বদলালেন, চা খেলেন, ছাড়া জামাকাপড়গুলো জড়ো করে ধোবি-বক্সে দিয়ে দিলেন। শম্পি যখন বিদায় চাইল, সস্নেহে তাকে বিদায় দিলেন। এমনকী মধুক্ষরা পর্যন্ত যখন টেলিফোন এসেছে বলে অপসৃত হলেন, যশোধরা তখনও একই রকম ঘোরে। কালীঘাটের অতিপরিচিত পটের মতো। খালি, হাতে তালপাখার বদলে পেল্লাই এক চায়ের মগ। একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছেন আর ডুব দিচ্ছেন। কোথায়? কোন পুকুরে? অতীত পুকুরে, যৌবন পুকুরে। ডুব গালছেন কিন্তু কান চোখ সব খোলা রেখে। ওদিক থেকে ঘাই মেরে উঠল একটা ধাড়ি কাতলা। একমাথা বাবরি চুল, মাথাটা বেশ বড়সড়, ফুল-গ্রোন ডাবের মতো। বিজয়মুকুলদা না?
কী চাও বিজয়মুকুলদা?
ইয়ে মানে তুই আজকাল কী করছিস যশো?
কী আবার করব? বি এ পাশ করে বসে আছি।
নাচ ছেড়ে দিয়েছিস?
মা ছাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে এত বড় মেয়েকে আর ধেইধেই করে নাচতে হবে না। কেন তুমি কি ট্রুপ খুলছ?
বিজয়মুকুলদা তার বংশীবাদনের জন্য বিখ্যাত। সামান্য একটু বেসুর হয়ে যায় মাঝে মাঝে। কিন্তু বাঁশের বাঁশির মেঠো সুরটি বার করে চমৎকার।
তুই-ই যদি না থাকিস তো ট্রুপের বক্স-আর্টিস্ট হবে কে?
কাতলা পুকুর তোলপাড় করে ডুবে গেল। যৌবন পুকুরের ঘাটে বসে যশো ভাবেন— ওটা কীসের তাগিদ? ট্রুপ খুলে ব্যাবসার তাগিদ সংস্কৃতির তাগিদ, না… না… বিজয়মুকুলদা আরও কয়েক বার কারণে অকারণে ঘাই মেরেছে। কেন? কেন? কীসের তাগিদে?
আবার ডুব দেন যশোধরা। একেবারে পাতাল রাজ্যে পৌঁছে যান। এখন তিনি আবার ইউনিভার্সিটিতে ভরতি হয়েছেন। আর কী-ই বা করতে পারেন। মা নাচ বন্ধ করে দিয়েছেন, বাবা হকি বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁদের মনোমতো পাত্রও জোটেনি। সুতরাং এম এ পলসায়েন্স। সরু সরু লম্বা লম্বা ওগুলো কী মাছ রে বাবা। ম্যাকারেল নাকি? পুকুরে তো হয় না? তবে এ-পুকুর তোমার সে-পুকুর নয়। যৌবন পুকুর। এখানে সামুদ্রিক মাছের সঙ্গে, ভেড়ির মাছ, পুকুরের মাছ, নদীর মাছ, এমনকী বাহারি লালনীল মাছ পর্যন্ত একই সঙ্গে বিহার করে।
অ্যাই যশো, কাল এসেছিলি?
হুঁ।
তোর খাতাখানা দে তো মাইরি। একটা বিশাল কাজ ছিল, বেজায় খাটুনি আসতে পারিনি।— হালকা দাড়ি গোঁফওয়ালা মুখখানা খরচোখে তাকিয়ে বলে উঠল।
কালকের খাতা আজকে আনিনি।
ইয়ারকি হচ্ছে? বিনুনি সুদ্ধু মুন্ডু ঘুরিয়ে দেব কিন্তু।
যাও খাতা পাবে না।
দে না, মিনতি করছি দ্যাখ, কমলেশ সিনহা মিনতি করছে তোকে। ভাবতে পারছিস!
না খাতাটা সে দেয়নি। সত্যিই খাতাটা ছিল না। আরেক বার কমলেশ তার খাতা নিয়ে হাপিস করে দিয়েছিল। এখন সন্দেহ হয়, নোটস নয়, খাতাটা, জাস্ট যশোর খাতাটার জন্যেই কমলেশের আকিঞ্চন ছিল। হাপিস খাতাটাও আসলে হাপিস হয়নি। কমলেশের নিজ ডেস্কে রক্ষিত আছে সযত্নে। দ্বিতীয় না-দেওয়া খাতাটা যশো মনে মনে ফেরত পায়। মনে মনে খুলে দেখে পলসায়েন্সের অকিঞ্চিৎকর ক্লাস নোটসের পাশে পাশে মার্জিনে লেখা। কী লেখা? যশো, যশোধরা, আমি তোকে মানে ইয়ে, বুঝিস না কেন? কে এসব খাস্তাগজা নোটস চায় রে? কমলেশ চায় তোর হাতের লেখা, তোর হাতের ছোঁয়া, তোকে, মানে তোকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন যশো। এটাও মিস। কে এমন নাছোড়বান্দা প্রেমিক আছে জগতে যে, তুমি না বুঝলেও তোমাকে বোঝানোর জন্যে অনন্তকাল অপেক্ষা করবে! হে প্রেমের ভগবান রতিকান্ত, যশোকে এত বোকা করলে কেন?
একমাত্র রামলাখন অপেক্ষা করেছিল। রামলাখন তাদের স্কুলের দারোয়ানের ছেলে। সে-ও পড়াশোনা করত বিস্তর, কিন্তু জিভের আড় ভাঙেনি।
এ যশোধরা, এ খোঁখি।
উঃ, কী বলছ? আমি কি এখনও খুকি আছি।
না রে যশোধ্রা, তোকে দেখলেই আমাদের ধউলি গাইটার কথা মনে পড়ে যায়। মুলুকে ফেলে এসেছি।
যশো সঙ্গে সঙ্গে অ্যাবাউট-টার্ন। রামলাখন পেছন পেছন আসতে থাকে। সবে বকনাবাছুর থেকে জওয়ান হয়ে উঠেছে। কী চিকন গা, দুধসফেদ, আঁখ কী! মালুম হয় কি তোদের মতো কাজল দিয়েছে আঁখে। লেজের বালগুলো ঠিক তোর এই বিনুনির শেষে ছাড়া বালগুলোর মতো যশো। যশো, তোকে হামি বহুত পেয়ার করি। তুই আমার ধউলি, আমি তোর মার্তণ্ড। ধউলি, আরে যশো শোন শোন।
একটা কথাও শুনব না। তুমি আমাকে গোরুর সঙ্গে তুলনা করছ? সাহস তো কম নয়।
আরে!— একটা অবাক বাজখাঁই আওয়াজ দিল রামলাখন।
আরে ভঁইস নয়, লেকেন গাই তো দুনিয়া কি সবসে আচ্ছি চিজ হ্যায় রে। তার ওপর ধউলি সবসে খুবসুরত।
এরপরে তার বিরক্তি বুঝে রামলাখন ধউলির তুলনা ত্যাগ করেছিল। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল সে যশোর প্রেমে পড়েছে। তার বাবা স্কুলের দারোয়ান হতে পারে। কিন্তু ভাগলপুরে তাদের মস্ত বড় ফার্ম। দুধের ব্যবসায় তারা সেখানকার তিন নম্বর। সে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে। ফার্ম মডার্নাইজ করবে, ভাগলপুরে গঙ্গার ধারে বেস্ট জায়গায় মকান বানাবে। তত দিনে বাংলা জবান শিখে যাবে জরুর। যশোধরার সঙ্গে তার বাংলাতেই প্যার কি বাত হবে।
দ্য ওনলি ওয়ান। যশোর মরুভূমিতুল্য প্রেমহীন জীবনে রামলাখনই একমাত্র জেনুইন প্রেমিক। সে জাত, শ্রেণি, প্রদেশ, সব বাধা ত্যাগ করেছিল। পরিষ্কার মনের কথা জানিয়েছিল যশোকে। দেখতেও রামলাখনকে খুব ভাল ছিল। ফরসা, ব্যায়াম করা— লম্বা চওড়া অথচ অতি সুকুমার চেহারা। মুখখানা নিষ্পাপ। দেখলেই চুমু খেতে ইচ্ছে করে। যদিও খোকন হিসেবে।
এবার অতীতের কল্পনাপুকুর থেকে অতীতেরই বাস্তব ঘাটে ওঠেন যশোধরা। হেঁটে হেঁটে ঢোকেন বাস্তবের ড্রয়িংরুমে। চার দিকে ঢাউস সোফাকৌচ। কোন কালের একখানা কার্পেট ডাঙায় কুমিরের মতো ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। দেয়ালে দেয়ালে ঠাকুমা-ঠাকুরদাদের অয়েল পেন্টিং। মহারানি ভিক্টোরিয়ার একখানা আর বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের একখানা ছবিও আছে। যখনই কোনও অতিথি আসে যশোধরা, মধুক্ষরা, তাদের বাবা, মা সবাই কৈফিয়ত গাইতে থাকেন জাস্ট শিল্পমূল্য, ছবিমূল্যের জন্যেই ছবিগুলো আছে। এর মধ্যে কোনও কলোনি-মনোবৃত্তি কেউ যেন না খোঁজে। যাই হোক, সেই বৈঠকখানার কোণের দিকে তেপায়ায় একটি মার্বলের বাচ্চা ছেলের মূর্তি, বল হাতে চমৎকার ভঙ্গিতে আধা পেছন ফিরেছে। আরেক কোণে চোঙঅলা গ্রামোফোন।
এই ঘরে ঢুকেই মুখোমুখি তিনটি তরুণের সামনে পড়ে গেল যশো। একটি ধলো একটি কালো আরেকটি বাদামি। তার দিকে পেছন ফিরে দুটি বিনুনি। মাঝে ঘাড়, তার তলায় ছিটের কামিজের পেছন। মধু বসে বসে হাসছে, কথা বলছে, দৌড়ে ভেতরে চলে যাচ্ছে, ট্রে-তে করে চা নিয়ে এল।
এই তোরা চা খাবি তো?
খাবে না মানে? যশো মনে মনে বলে— ওদের ঘাড় খাবে। মধুক্ষরা চাটুজ্যের হাতে করে আনা চা বলে কথা!
এই আমার দিদি। দিদি, দ্যাখ এটা তরুণ।
যশো মনে মনে বলে— সে তো দেখতেই পাচ্ছি। মুখে বলে ও, তরুণ বুঝি? আমি তো ভেবেছিলুম বৃদ্ধ।— তার এই রসিকতায় ফরসা ছেলেটির মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। প্রেম মানুষকে বড্ড রসকষহীন করে দেয়। বোকা, ভ্যাদভেদে মার্কা।
কীসে আমাকে বৃদ্ধ দেখলেন? রোজ ব্যায়াম করি তা জানেন?
যশো হেসে বলে— মাসকুল আছে? গুলি?
পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ছেলেটি প্রাণপণে মাসল ফোলাবার চেষ্টা করে।
যশো বিচ্ছুর মতো হাসে— লুচি ফুলল না তো! বুঁচি, তোর অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে।
এ হল কৃষ্ণেন্দু।
সেটিও মালুম হচ্ছে— ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে যশো— এ যেন বেড়াল এঁকে দাগিয়ে দেওয়া।
এ-ছেলেটির একটু রসবোধ আছে, বললে— আরে সত্যি বেড়াল হবে তবে তো দাগাবে দিদিভাই। কৃষ্ণ আবার ইন্দু কী?
কেন অমাবস্যার চাঁদ?
উঁহু যে-জিনিস দেখাই যাচ্ছে না তাকে কোনওভাবে ডিফাইন করা চলবে না। বাড়িতে ভরতি ইন্দু, পুষ্পেন্দু, কমলেন্দু, অমলেন্দু, শরদিন্দু,… তাই অবশেষে কৃষ্ণেন্দু।
শুধু কৃষ্ণ রাখলেই হত, দিব্যি কদমগাছের তলায় তিনবেঁকা হয়ে দাঁড়ানো যেত।
ততক্ষণে মধু দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে।— আহ্ দিদি, কী হচ্ছে?
না না বলতে দাও না। বেশ জমেছে। আজকাল আর তিনবেঁকা হয়ে দাঁড়ালে হয় না দিদি। ডেজ হ্যাভ চেঞ্জড। এখন সটান বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হয়। বাঁশির বদলে হাতে স্টেনগান, নেহাত না জুটলে চপার।
আচ্ছা আচ্ছা, অনেক হয়েছে মধু বলল— ওর সঙ্গে পরিচয় করবি না, ওর নাম মিহিরকিরণ।
আন্দাজ করতে পারেননি তো!— দাঁত বার করে বাদামি ক্যান্ডিডেট বলল—
যশো বলল— যেই কথা বললে অমনি ধরা পড়ে গেলে ভাই। মিহি মিহি গলা। ওইটুকু তো অন্তত মিলল। মিহি-র কিরণ!
বলে যশো অন্দরের দিকে পা বাড়ায়। পরে মধু এসে দিদিকে এই মারে তো সেই মারে। তুই ওদের সামনে আমার ডাকনাম ধরলি কেন, কে তোকে বুঁচি বলে ডাকতে বলেছিল! ঠাকুমা ছাড়া কেউ তো ও নামে ডাকেই না। তুই নিজে ডাকিস! তোর চালাকি আমি বুঝি না?
দিদি বলে— আরে বাবা বুঁচি বললেই কি আর তুই বুঁচি হয়ে গেলি? তোর এমন বাঁশির মতো নাক!
বিচ্ছিরি নাম। কেউ লোকের সামনে বলে? মান রইল না।
কী যে বলিস মধু, মধু বললেই কি তোর মান থাকত? মধু কাদের নাম হয় বল তো? অনেক দিনের পুরনো কাজের লোকেদের। ম্যয়নে চাকর রাখো জি! মধো, মেধো বাবুরা ডাকত।
ভাল হবে না দিদি, আমিও তোকে যশো বলে পরিচয় করিয়ে দেব। যশোও কাজের লোকেদের নাম হয়। বাসন মাজার যশো।
অম্লান বদনে সে বলে— তো বল না। আই ডোন্ট মাইন্ড।
আসল কথা কাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে! তার এমন বাইরে ঘরভরতি ক্যান্ডিডেটই নেই। দ্বিতীয় কথা— বিশ্বসুদ্ধু লোক তাকে ইতিমধ্যেই যশো বলে ডাকে। এক রামলাখনই সমীহ করে যশোধ্রা বলেছিল।
মা-আ-আ— ওদিক থেকে ভাঙা গলায় একটা ডাক উঠল এই সময়ে।
অতীতমোক্ষণ এমনই অভিভূত, ডুবন্ত ছিলেন যশোধরা, হঠাৎ মা ডাকে মনে হল— ধ্যাত্তেরিকার মা, এখানে কারুর মা-ফা থাকে না। যতই আকাশ ফাটিয়ে চ্যাঁচাও।— কথাটা বলেই ফেললেন!
সামনে পাবলোসুন্দর দাঁড়িয়ে, দু’কোমরে হাত।
কী মা মা করে চ্যাঁচাচ্ছ হে ছোকরা পাশের বাড়ি দ্যাখো, এখানে সুবিধে হবে না— বলে যশো গালে হাত দিয়ে বিছানায় ডুবে গেলেন। পাবলো কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর বলল— অ্যাক্সিডেন্ট কি জানান দিয়ে আসে যে, মজুত থাকব! খবর পেয়ে তো সঙ্গে সঙ্গে গিটার ফেলে চলে এসেছি। এমন রাগারাগির কোনও মানে হয়?
যশো আশ্চর্য হয়ে বললেন— অ্যাক্সিডেন্ট? কার অ্যাক্সিডেন্ট? কখন? গিটারই বা কার? জিনিসটা কী? কে হে তুমি পরের বাড়ি ঢুকে আলটুফালটু বকছ! ইয়ারকি পেয়েছ নাকি?— ও রামলাখন, রামলাখন দ্যাখো না তোমার দেশোয়ালি এক এঁড়ে বাছুর এসে আমায় গুঁতিয়ে দিচ্ছে।
এবার পাবলোর মুখখানা দেখবার মতো হল। সে তিরবেগে পাশের মধুমহলে পগারপার হল।— মাসি ও মাসি, মায়ের হঠাৎ পা পিছলে গেছে, স্ট্রোক এইসব বলে উন্নি আমাকে ডেকে পাঠাল, এসে তো দেখছি মা’র পাগলামির লক্ষণ! তোমরা সবাই কি সত্যি কথাটা চেপে গিয়েছিলে?
মধুক্ষরা একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিলেন— বললেন কে পাগল? তুই না তোদের বন্ধু উন্নি, না ক্যানিং। না তোর মা! বদসঙ্গ, বিশেষ করে পাগলসঙ্গ ছাড় পাবলো, নইলে…
আহ। মা আমাকে চিনতে পারছে না। আর তুমি…
কে চিনতে পারছে না? মা, তোকে? তুই কি চেনার মতো আছিস? ক্রমশই অচেনা হয়ে যাচ্ছিস। কোথায় আমাদের সেই পাবলোসুন্দর, যে কথায় কথায় ঠোঁট গোল করে মাসিকে হামি খেত, কোলে চড়ে জাহাজের আলো দেখে বলতো চাঁদের রাস্তা, কোথায় সেই ছেলে যে নারকোল নাড়ু দিলেই হাত ঘোরাত…
আহ মাসি, তুমিও তা হলে পাগল হয়ে গেছ। শিগগির চলো ও-বাড়ি, মা যেন কেমন করছে। শম্পি কোথায়?
শম্পি তো বেরিয়ে গেল!
আশ্চর্য। বাড়ির মেয়েরা যদি এইভাবে যখন-তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়!
উত্তরে মধুক্ষরা বললেন— আশ্চর্য! বাড়ির ছেলেরা যদি এইভাবে যখন-তখন বাড়িতে ফিরে আসে!
মানে কী? মানে কী এর?
মানে তুই বুঝলে আর দুঃখ থাকত না রে।
যাই হোক, চৌকাঠ পার হয়ে যশোমহলে পা টিপে টিপে চলল দু’জনে। একটু হেঁড়ে গলার গান ভেসে আসছে। বঁধু গো— এই মধু মাস বুঝি বা বিফলে গেল — শচীনদেব বর্মনের গান।
মধুক্ষরা বললেন— দিদি নাচটা ভাল শিখেছিল, গানটায় সুবিধে করতে পারেনি। কিন্তু মিড়গুলো দিব্যি আসছে তো! ও দিদি। কী হল তোমার?
শোবার ঘরে ঢুকে দেখা গেল যশোধরা চিতপাত হয়ে শুয়ে একটা গোলাপি উলের জামা বুনছেন এবং গান গাইছেন।
ও দিদি! কী করছ!
ভ্রুক্ষেপই করলেন না যশো।
ও দিদি, কার জামা বুনছ!
একটি শিশুর।
কে শিশু!
পৃথিবীতে ওই একটি জিনিসের এখনও অভাব হয়নি। যদিও তাদের মেরেধরে, কেটে ছিঁড়ে খেয়ে শেষ করে দিচ্ছ। তবু… কণ্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল।
ও দিদি, তোমার নিজের শিশুটি যে কাঁদোকাঁদো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গো, তাকে একটু কাছে ডাকো!
কাচের মতো চোখে পাবলোর দিকে তাকালেন যশো— এই ধেড়ে কার্তিকটিকে শিশু বলছ! কে তুমি পাগলিনী?
যাঃ মাসি, তোমাকেও মা চিনতে পারছে না।
যশো গাইলেন— ভুঁলে গেছ তুমি সেই মধু নামে ডাঁকা। বঁধু গো… উপায় না দেখে মধুক্ষরাও সঠিক সুর ধরিয়ে দিলেন— এই মধুমাস বুঝি বা বিফলে গেঁল অঁ।
এই দ্বৈতসংগীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাবলো ঘামতে লাগল। হঠাৎ মনে হল সরু মোটা দুই গলায় গানটা তো দিব্যি জমাটি! সে-ও হঠাৎ খসখস করে নোটবুক বার করে কী সব লিখে নিল। তারপর গাইতে লাগল—
এই কলকাতা বুঁঝি বা ঝঁলসে গেল, বঁধু গো,
ভুলে গেছ তুঁমি বালিগঞ্জের বাঁসা
মোড়ে মোড়ে কত চাঁদামুখ খাঁসাখাঁসা
এই বালিগঞ্জ, এই কালীঘাট বুঁঝি বা ঝঁলসে গেঁল ও ও…
দি আইডিয়া! দি আইডিয়া, তিন তুড়ি দিয়ে পাবলো একটা ঘুরপাক খেয়ে নিল। মা, শেষ পর্যন্ত মা-ই তাকে পথ দেখিয়ে দিলে। সে বলল— জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। বলে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করল।
দৃশ্যটি যখন এইরকম— যশো শুয়ে শুয়ে উল বুনতে বুনতে হেঁড়ে গলায়, মধুক্ষরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু হাতে প্রাণ দিয়ে প্যাশন দিয়ে মধুমাস বিফলে যাওয়ার গান গাইছেন, পাবলো মেঝেতে সাষ্টাঙ্গ—ঠিক এই মুহূর্তে দুটি মানুষ ঢুকল, সুহৃৎ ব্যানার্জি আর মধুবন।
কী ব্যাপার? দরজা খোলা। কোথাও কেউ নেই। নীচেটা একেবারে, এ কী! আমি শুনলাম যশো জ্ঞান হারিয়েছে! খোকা এভাবে মাটিতে পড়ে আছে কেন? পাবুল ও পাবুল! সুহৃৎবাবু কাতরে উঠলেন। দেখা গেল তিনি স্ত্রীর চেয়ে ছেলের জন্যেই বেশি কাতর! হবে নাই বা কেন? স্ত্রী বহাল তবিয়তে গান গাইছেন, কিন্তু ছেলে মাটির ওপর সটান উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
মধুবনও খুবই উচাটন, পাবলোর জন্যে— আমি শুনলুম মাসি পড়ে গিয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছে। পাবলো সেন্সলেস এ-কথা তো কেউ বলেনি।— সেও খুব উতলা দেখা গেল। পাবলো, এই পাবলো!
মধুবনকে দেখেই যশো জ্ঞানে ফিরলেন।
এসেছিস মধুবন, আয় কাছে আয়।
মধুবন কাছে যেতে গোলাপি উলের বোনাটা তার গায়ের ওপর, ফেললেন।— নাঃ একটু যেন ছোট হয়ে গেছে।
বলে পড়পড় করে বোনাটা খুলতে লাগলেন।
পাবলো ততক্ষণে উঠে পড়েছে।
তোর কী হয়েছে রে পাবুল! তার বাবা জিজ্ঞেস করেন।
আমি মাতৃদেবীকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছিলাম বাবা। আমার সারা জীবনের কৃতজ্ঞতা। মা আমাকে জীবনের পথ দেখিয়ে দিয়েছে।
তা যেন হল— সুহৃৎবাবু বোকার মতো বললেন— আমি ফোন পেলুম শম্পির। কার অসুখ, কী অসুখ এখনও পর্যন্ত তো কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা না একটা রোগী তো থাকবে!
যশো বললেন— এ-ও তো হতে পারে যে, তুমিই আসল রুগি। বুঝতে পারছ না। কিছুতেই রুগিকে কায়দা করতে না পারলে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে ওষুধ খাওয়াতে হয়, না হয় না?
চতুর্দিকে চোখটা ঘুরিয়ে এনে সুহৃৎ বললেন— তা তোমাদেরও কি তাই-ই মত!
মধুবন বলে উঠল— কাকু, এই সামান্য জিনিসটা বুঝলে না? এখানে দু’জন শুয়ে আছে। এক যশোমাসি, আরেক পাবলো। পাবলো শুয়ে শুয়ে কী সব মন্ত্র-তন্ত্র বলছিল। আমার মনে হয় মধুমাসি ওঝা ট্রাই করেছিল। তারই নির্দেশে পাবলো অমন… যশোমাসি এই গরমে উল বুনছে, আমার ছোটবেলার সাইজ। কিছু একটা গোলমাল তো হয়েছেই। সিরিয়াস গোলমাল।
মধুক্ষরা বললেন— ওঝা? ওঝা ট্রাই করেছি আমি, সায়েন্সের মেয়ে? তোর কি মগজেও ফ্যাট ঢুকে গেছে!
মগজে তো ফ্যাট থাকেই মাসি৷ ঘিলু বলে না? আমি একটা ভীষণ ঘনীভূত রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। যতই কথা ঘোরাও!
কী হয়েছে কেউ আমাকে বলবে?— এবার সুহৃতের গলা বেশ কড়া। ‘আমার সঙ্গে চালাকি হচ্ছে’ গোছের ভাব।
তখন যশো বালিশের তলা থেকে ডক্টর সুবল মিত্রর প্রেসক্রিপশনখানা বার করে দেন। ই সি জি, প্রেশার, ব্লাড কোলেস্টেরল…। সব ইনভেস্টিগেট করতে হবে।
তোমার হার্টের ট্রাবল, আর তুমি গান গাইছ? অবাক হয়ে সুহৃৎ বললেন।
যেরকম হাঁসফাঁস হাঁসফাঁস করো, তাতে করে এ সন্দেহটা আমার আগেই হয়েছে। এখন তুমি চুপটি করে শুয়ে থাকবে আর পাবুল আমাদের চা-টা দেবে। পাবুল যা—ও। চা করো। মধুবন তুই দ্যাখ তো ‘টা’ বলতে কী আছে? প্রচণ্ড টেনশন নিয়ে এসেছি। এখন আমার খিদে পেয়ে গেছে। বলে— সুহৃৎবাবু কোণ থেকে একটা চেয়ার হড়হড় করে টেনে এনে যশোমাসির বিছানার কাছে বসলেন— এই আমি নজরদার বসলুম। দেখি কে কী অনিয়ম করতে পারে।— তিনি হাত বাড়িয়ে যশোর হাতটা টেনে নিলেন, তারপর কবজি টিপে ধরে ঘড়ির দিকে চেয়ে রইলেন।
মধুবন বলল— চ পাবলো চ। রাত প্রায় আটটা বাজছে। তোমরা কে কে চা খাবে?
সব্বাই— মধুক্ষরা বললেন।
রান্নাঘরে ঢুকে পাবলো হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। মধুবন বলল— নে, জল চাপা!
কোথায় চাপাব, আমার মাথায়? মায়ের রান্নাঘর এত ডিজরগ্যানাইজড!
বাজে কথা বলিসনি। ওই তো হুক থেকে সসপ্যান ঝুলছে। ওই দেখ সারি সারি কাপ৷ মেপে মেপে জল নিবি। পাঁচ কাপ।
তো তুই কী করতে আছিস?
আমি চলে যাব? বেশ তাই যাই। বলে মধুবন পেছন ফিরল।
আরে শোন শোন। আমি চা করতে জানি না।
সহজ কাজ। শিখে নে। কাজে দেবে। আমি শুধু সুপারভাইজ করতে আছি। তোর বিদ্যের দৌড় তো জানা আছে।
যা যা বাজে বকিসনি। ভারী একটা কাজ, চা করা।
এই এই তোর চায়ের জল ফুটে উঠেছে। ওই যে চা-পাতার কৌটো। গুনে গুনে চার চামচ দে। আরে অত ভরতি ভরতি নয়। তুই একটা হোপলেস!
সুবিধে পেয়ে খুব ডিং নিচ্ছিস, না?
বাজে কথা না বলে, ঘড়ি দ্যাখ, পাক্কা দেড় মিনিট রাখবি। কাপগুলোয় চিনি দে। যশোমাসির আর আমার সুগার-ফ্রি। বাকি তিনটে এক চামচ করে চিনি দিবি। যাঃ সুগার-ফ্রিটা আবার কোথায় গেল!
কিছুক্ষণ খুঁজে পেতে বড়িগুলো পেয়ে গেল মধুবন। বললে, নিজের রান্নাঘরের কোথায় কী আছে জানিস না, অ্যাঁ? লজ্জায় মুখ লুকো।
পাবলো নিবিষ্ট মনে ঘড়ি দেখছিস। এবার পটে ঢালতে গিয়ে মেলাই ফেলে দিল।
যাঃ। একজনের কম পড়ে গেল। ঠিক আছে আমি খাব না। পাবলো বলল— অ্যামি খ্যাব না! তোর ঘাড় খাবে। এই সময় নাগাদ চা-টা খেলে রাতে তোর খিদে কম হবে। আপসে ডায়েটিং হয়ে যাবে।
আমার ডিনার হয়ে গেছে।— গম্ভীরভাবে মধুবন বলল।
এর মধ্যে কী খেলি?
বাঁধাকপির সুপ, গাজর পেঁপে, বিন সেদ্ধ। একবাটি মুশুর ডাল, একখানা রুটি।
ওহ মধুবন কী কৃচ্ছ্রসাধনটাই না করছিস! অনেক করেছিস। ফ্রিজে বোধহয় আইসক্রিম আছে, একটু খেয়ে যা প্লিজ, এক স্কুপ।
একবার বলছিস চা খা, আরেক বার বলছিস আইসক্রিম খা, মাথাটাথা গন্ডগোল হয়ে গেল, না কী?
মধুবন পরম অবজ্ঞার সঙ্গে ট্রে-তে কাপগুলো সাজাল, বলল— যা নিয়ে যা এগুলো। আর শোন— আমি আরও চার কেজি কমেছি। এখন আমায় ব্রতচ্যুত করবি না।
মধুবনকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে পাবলো বলল— তুই কি ডিটারমিনড?
আজ্ঞে হ্যা। এবং যখন আমি কোনও সংকল্প করি তখন সেটা করেই ছাড়ি।
চায়ে চুমুক দিয়ে সুহৃৎ বললেন— বা, বা, বা, বেশ চা করেছিস তো পাবুল! গুণ আছে ছেলেটার।
মধুবন বলল— আজ্ঞে না কাকু। উনি শুধু নেড়েছেন আমি বলে দিয়েছি। মানে হাতে-কলমে কাজ শেখানো আর কী!
পাবলো বেরিয়ে আসতে আসতে বলল— উঃ, আমার রিহার্স্যালটা মাঠে মারা গেল। এই বাবাগুলো এত স্ত্রৈণ হয় না!
মধুবন বলল— তাই বুঝি! যশোমাসির অসুখ শুনে কাকুর আসা উচিত হয়নি বলছিস! ভাল ভাল। চমৎকার এক ছেলে!
আসতে কে বারণ করেছে। সেই থেকে হাতটা ধরে পালস রেট দেখে যাচ্ছে। যাই বলিস এইরকম ডোর-ম্যাট টাইপের লোকগুলোকে আমার সহ্য হয় না।
মধুবন ঘেন্নার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল— বটে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মধুবন ভাবল তার আর পাবলোর জীবনদর্শন একেবারে আলাদা। পাবলো বাড়ির এক ছেলে। তাকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছেন যশোমাসি৷ আর কাকুর তো কথাই নেই। পাবুল আর পাবুল। আর এই এত ভালবাসা প্রশ্রয় পেয়ে পাবলো ভাবছে তার আর কারুর জন্যে কিছু করার নেই। সে-ই সূর্য। বাকি সব গ্রহতারা তার চার দিকে ঘুরছে। বাঃ চমৎকার ফিলসফি, আর সে মধুবন! স্ট্রিক্ট শাসন তোমার জন্যে। মা’র শাসন, বাবার শাসন এমনকী পাঁচ বছরের বড় দাদা ঋজুরুস্তম পর্যন্ত তার গার্জেনি করবার সুযোগ পেলে ছাড়ে না। কিন্তু তাইতে কি মধুবনের মা-বাবার প্রতি ভালবাসা একটুও কমেছে? তার বাবা কি মা যদি এমন অজ্ঞান হয়ে যান। তারপর প্রাণপণে শচীনদেব বর্মন গাইতে থাকেন মধুবন কি এক মিনিটও অপেক্ষা করবে? ডাক্তার সাইকায়াট্রিস্ট, যে যেখানে আছে মধুবনের বিনতি শুনে তাদের বাড়িতে ডাক্তারি বক্স নিয়ে উপস্থিত হবেন না?
ছোটবেলায় যখন কাড়াকাড়ি করে যশোমাসির বাগান থেকে কুল পাড়া হত, ফুলের জন্যে ডাক্তার বিশ্বাসের বাগানে হানা দেওয়া হত তখন তারা বালক-বালিকা ছিল। অমিলগুলো বোঝা যায়নি। এখন যত বড় হচ্ছে ততই তাদের তফাতটা— অর্থাৎ পাবলোর স্বার্থপরতা আর তার নিজের পরোপকারিতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে মধুবন। জীবন জীবন, তুমি আর কত অমিল পরিস্ফুট করবে? লাইফ ইজ আ চেন অব ডিস্যাপয়েন্টমেন্টস। চেন না হিষ্ট্রি। ভাবতে ভাবতে নিঝুম হয়ে সে বাড়ি ফিরল। মা কোথায়? রান্নাঘরে খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে। রান্নাঘরে বোধহয়। তা মাকে খুঁজতে গিয়ে রান্নাঘরে জিনপরিকে পেয়ে গেল মধুবন। পাউরুটিতে মোটা করে মাখন লাগিয়ে, তার ওপর জ্যাম ঢেলে খাচ্ছে বসে বসে। তাকে দেখে গলায় আটকে দম বন্ধ হয় আর কী! মধুবন আস্তে আস্তে তার ঘাড়ে থাবড়া মারে। এক গ্লাস দুধ বার করে বলে— পরি রে, সলিড জিনিস খাচ্ছিস, একটু লিকুইড কিছু রাখিসনি পাশে? নে একটু করে দুধ খা, আর একটু করে পাউরুটি।
পরির খাওয়া শেষ হওয়া অবধি মধুবন ঠায় রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রইল।— আর কিছু নিবি?
সলজ্জ গলায় পরি বলল— এখন এই-ই যথেষ্ট। এর পর তো আবার রাত্তিরে খেতে হবে। যাকে তোমরা বলো ডিনার?
এটা তা হলে তোর কী? টিফিন?
বলতে পারো। দিদি, মাকে বলে দেবে না তো!
পাগল! বাড়িতে দুধ মাখন চিনি যত কমে যায় ততই তো ভাল, আমার জন্যে কোনও প্রলোভন থাকবে না।
অন্যায় করেছি দিদি। আমায় মাপ করো।
যা বাব্বা খিদে পেয়েছিল, খেয়েছিস। মাকে বলে খেলে আর কিছুই ঝামেলা ছিল না। তো তুই চার বেলা ভাল করে খেতে পাস তো? মা কী কী দেয় রে তোকে?
মা খুব ভাল— পরি অনুতপ্ত গলায় বলল— সকালে তো প্রথমেই আমার রুটি হয়। ফ্রিজে কিছু না কিছু থাকে। তাই দিয়ে চারখানা রুটি খাই। চা-খাই এক গেলাস।
তার পর?
তার পর— দুপুরে ভাত। অনেকটা ভাত খাই দিদি। লজ্জা লাগে। ডালও অনেকটা দেন মা। তারপরে সেদিন যা তরকারিপাতি হয়, খাই।
মাছ মাংস?
হ্যাঁ… রাত্তিরে নয়। সকালে যা হোক একটা থাকে। মা কী ভাল মাংস রাঁধে গো! ইচ্ছে করে বাতাসি, পাঁচু, ইতু সব্বাইকে ডেকে ডেকে খাওয়াই।
এরা কারা? কুকুর!
ওমা কুকুর কেন হতে যাবে? আমার ভাইবোন ওরা।
মা এখন কোথায়?
মা’র কোন বন্ধু অজ্ঞান হয়ে গেছে, মা দেখতে গেছে।
আবার কে অজ্ঞান হল? মা’র অঢেল বন্ধু তা যদি বলো। কিন্তু সে তো যশোমাসির বাড়িতে মাকে দেখেনি! আসবার সময়ে পথেও তো দেখতে পেতে পারত! যশোমাসিও যোধপুর পার্ক। তারাও যোধপুর পার্ক। আবার কে জ্ঞান হারাল রে বাবা!
এমন সময় পেছন থেকে খুব ভাঙা গলায় কে বলে উঠল— পাবলো কি কোনও বান্ডিল-বুন্ডিল তোর কাছে রাখতে দিয়েছে? সত্যি কথা বলবি।
ফিরে সে দেখে কার্জন। একটা পাতলা ফতুয়া পরেছে। ভেতরে পইতে দেখা যাচ্ছে। বছর খানেক আগে কার্জনের পইতে হয়েছে। একটা রংচটা জিনস্, থ্রি-কোয়ার্টার, সুতো ঝুলছে।
কী রে? কিছু বল! পাবলোর বেস্ট ফ্রেন্ড! বান্ডিলটা দিয়ে দে। ভাল যদি চাস।
আর না চাইলে?— অকুতোভয় মধুবন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল রণং দেহি ভঙ্গিতে।
না চাইলে নক আউট করে দেব— এইভাবে— বলে ঘুসি বাগিয়ে কার্জন যে-ই এগিয়ে এসেছে, হঠাৎ দেখা গেল সে কুপোকাত। পেছন থেকে পরি ল্যাং মেরে তাকে শুইয়ে দিয়েছে।
উঃ আঃ করতে করতে কার্জন এঁকেবেঁকে উঠে দাঁড়াল। মধুবন বলল— পরি, যা বরফ নিয়ে আয়।
আমি পারব না। গুন্ডো বদমাইশ, তোমাকে বাড়ি বয়ে মারতে আসে। আমি বরং পুলিশে ফোন করছি।— পরি খরখর করতে করতে চলে যাবার উদ্যোগ করে।
এই পরি। এ-ই পরি। থানা পুলিশ করিসনি। এটা আমার বন্ধু।
কার্জন বলল— আমি কি সত্যি-সত্যি মারতুম নাকি! মধুবন, তুই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলি, না রে?
আমি একটুও ভয় পাইনি। চোর ডাকাত ফেরেববাজদের আমি ভয় পাই না।
তা হলে তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে ল্যাং মারল কেন!
সেটা ওকেই জিজ্ঞেস কর।
আচ্ছা মাফ করে দিলুম, পাবলো যে-বান্ডিলটা তোকে দিয়েছে—!
পাবলো আমাকে কোনও বান্ডিল দেয়নি। আমি পাবলোর মতো অকম্মা ছেলের বেস্ট ফ্রেন্ডও হতে পারি না। এবার যা-ও।
তবে যে বললি। স্বীকার গেলি যে নিয়েছিস!
স্বীকার করিনি তো! তুই ভাল চাসটাস বলে আমায় ভয় দেখালি, তাই বললুম— না দিলে?— তার মানে কি দাঁড়ায় জিনিসটা আমার কাছে আছে! কী ছিল বান্ডিলটাতে?
সেটা তোকে বলতে আমি বাধ্য নই।— দু’হাত বুকে আড়াআড়ি রেখে কার্জন বলল।
তা নোস। কিন্তু এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে তুই বাধ্য। এক্ষুনি আমার দাদা রুস্তম এসে পড়বে। সে হামলাকারীদের প্রশ্রয় দেয় না।
তা হলে কতক চাট্টি বরফ অন্তত দে। ওঃ খুব লেগেছে রে!
পরি বেশ গুছিয়ে-গাছিয়ে বরফ আইসব্যাগে ভরে এনে দিল। প্রাণপণে আইসব্যাগ হাঁটুতে, পায়ের গোড়ালিতে চেপে ধরতে লাগল কার্জন নামে আহত ছেলেটি।
একটু পরে বলল— প্রত্যেক বন্ধুর বাড়িই দেখছি একই রকম ডেঞ্জারাস। একজনের বাড়ি থেকে তার মা মাসি বার করে দেয়, বিতিকিচ্ছিরি অ্যালিগেশন আনে, আরেকজনের বাড়ি থেকে স্বয়ং বন্ধুই বার করে দিতে চায়। আগে চ্যালাচামুণ্ডা দিয়ে মার খাইয়ে। সত্যি ইয়ারদোস্ত ব্যাপারটা আর টিকে থাকছে না।
তুই আইসব্যাগসুদ্ধু এবার ফুটে যা কার্জন। দাদা ফিরে এসে যদি সব শোনে তোর আর রক্ষে নেই।
আইসব্যাগটা নিয়ে যাব? তারপরে বলবি ঝেড়ে দিয়েছি।
দে ঝেড়ে। আমাদের বাড়ি অমন ডজনে ডজনে আইসব্যাগ আছে। প্রত্যেক বার দরকারের সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রত্যেক বার নতুন আসে। আজই প্রথম খুঁজে পাওয়া গেল।
কার্জন খুব বিমর্ষভাবে চলে যায়। আজকে দিনটাই বেচারার খারাপ যাচ্ছে। উন্নি, ওই উন্নির জন্যে। উন্নিটা থাকলেই যত ঝামেলা। চ্যাটাং চ্যাটাং চলবে, কটাং কটাং বলবে। ফলটা ভুগতে হবে তাকে। এখন বান্ডিলটা কোথায় পায় সে? পাবলোকে দেখলে বোঝা যায় না, কিন্তু সে অতি ধড়িবাজ ছেলে। তার কার্যকলাপ, তার হোয়্যারঅ্যাবাউটস সবই খুব কষ্টকর খুঁজে বার করা।
মীনাক্ষী, অর্থাৎ মধুবনের মা যশোধরার মূর্ছা ও পতনের খবর পেয়েছিলেন পাবলোর থেকেই। মনে হয় পাবলো মায়ের যতজন আত্মীয়-বন্ধু জড়ো করা যায় তার একটা চেষ্টা চালাচ্ছিল। ওই যে উন্নির ফোনটা! সিরিয়াস কেস! সেই শুনেই সে সম্ভবত খুব দায়িত্বশীল পুত্রের কাজ করে। উন্নির ফোনটা এসেছিল আরমান মারফত। পাবলো তখন পঙ্কজের সঙ্গে প্র্যাকটিস করছিল। তার হাতে গিটার। সঙ্গে সঙ্গে পঙ্কজের চিলেকোঠা থেকে লাফ দিয়ে সে বার হয়। সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে রাস্তা ভাঙতে ভাঙতে সে ক্রমাগত যার ফোন নম্বর মনে আছে বা স্টোর করা আছে সবগুলিতেই তার শোকসংবাদটি রাখছিল। মীনাক্ষীমাসি— মায়ের খুব শরীর খারাপ। সিরিয়াস কেস!
আলোমাসি— মায়ের হঠাৎ শরীরটা কেমন খারাপ হয়ে পড়েছে। না না ঘাবড়িও না। তবে সিরিয়াস কেস।
বিজয়মামা— শোনো একটা খারাপ খবর আছে। আমার মা মানে তোমার ট্রুপের যশোধরা ব্যানার্জির স্ট্রোক হয়েছে। হ্যাঁ, না আজকাল মেলাই ওষুধ বেরিয়ে গেছে, ভয় কী!
মীনাক্ষী যশোধরার বাড়ির গেট থেকেই একটা কোলাহল মতন শুনতে পেলেন। অনেকে কথা বললে যেমন হয় আর কী! দরজাটা আধ খোলা। ঠ্যালা মারতেই খুলে গেল। সেই বিকট বেলটা আর বাজাতে হল না। রাত প্রায় সাড়ে আটটা। এ সময়ে সদর খোলা! এমনই ক্রাইসিস, না কী? মীনাক্ষীর বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। যশোর সঙ্গে তাঁর প্রায়ই ঝগড়া লাগত। কত তুচ্ছ কারণে তিনি যশোকে কত যাচ্ছেতাই করেছেন। মীনাক্ষী লেখাপড়ায় তুখোড় হওয়া সত্ত্বেও টিচাররা কেন কে জানে যশোকেই বেশি ভালবাসতেন। বাপ রে। সেই নিয়ে কম হিংসেহিংসি। তিনি একেবারে মুখের ওপর বলে দেন এক বার— আহ্লাদিগিরি করিস তো দিদিদের সঙ্গে! তোদের শাড়ির দোকানে থার্টিফর্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দিস। সব দিদিকে কিনে রেখেছিস। নইলে আর যশোধরা চ্যাটার্জি ক্লাস ক্যাপ্টেন হয়? রাতদিন তো নিজেই গুজগুজ ফুসফুস করছিস। দারোয়ানের ছেলের সঙ্গে পর্যন্ত প্রেম করছিস।
ইস ছি ছি, এইটা যশোর খুব লেগেছিল। সবাই জানে রামলাখন স্কুল-দারোয়ান ভগৎরামের ছেলে। কিন্তু ছেলেটা কেমন তা তো দেখতে হবে! অত হ্যান্ডসাম ওদের ধারেকাছে কেউ ছিল না। আর অত ক্লাস কনশাস হবেই বা কেন তারা? রামলাখন তো পাঁড়ে, বিহারি ব্রাহ্মণ! মুচি, ছুতোর, জেলে, মিস্ত্রি এদেরও যদি লেখাপড়া জানা হ্যান্ডসাম ছেলে থাকে, তা হলে কি মীনাক্ষী বা যশোধরাদের মতো আধুনিক মনের মেয়েদের আপত্তি থাকা উচিত? সমস্তটাই একটা কেলো। যশো অবশ্য জানে না রামলাখনের কথা সে-ই যশোর মা মিনতিমাসিকে বলে দেওয়ায় যশোর হুস করে বিয়ে হয়ে গেল। অবিশ্যি খারাপ কিছু হয়নি। ভাগলপুরে থাকার চেয়ে কলকাতার দক্ষিণে নিজ গৃহে থাকা হাজার গুণে ভাল। সুহৃৎদাও রামলাখনের চেয়ে লক্ষ গুণ ভাল। যশোকে কত ভালবাসেন, মানেন। মীনাক্ষীর ফোঁস করে দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। সেই সুখী গৃহকোণ আঁধার করে, গৃহকর্তাকে অনাথ করে এত অল্প বয়সেই যশো চলল!
সদর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভাঙতে থাকেন মীনাক্ষী। এত আস্তে চলা আস্তে বলা তাঁর অভ্যাস নেই। রীতিমতো একটি নারীসমিতি চালাতে হয় তাঁকে। আজ গ্রান্টের জন্য সরকারি আপিসে ছোটো। কাল ছোটো ব্যাঙ্কে লোনের জন্য। সমিতির মেয়েদের হাতের কাজের এগজিবিশন করতে তাঁর ঘাম ছুটে যায়। যশোর মতো থপথপে হলে তাঁর চলে না। বলতে কি তাঁর খুব সন্দেহ তাঁর কন্যা মধুবনকে যশো ইচ্ছে করে, ইনটেনশন্যালি খাইয়ে-দাইয়ে ভাগলপুরী গাইটি বানিয়েছে খুব সূক্ষ্মভাবে তাঁর ওপর শোধ নিতে। ছোটবেলাকার রেষারেষি এইভাবেই সারাজীবন জিইয়ে থাকে। যাই হোক মধুবনকে নিজের ফ্রেমে এনে ফেলে যশোকে তিনি একহাত নেবেনই। এই রে! মীনাক্ষীর চট করে মনে পড়ে যায়। কীভাবে একহাত নেবেন তিনি যশোর ওপরে? সে তো চলল! যদি নাও যায় সে তো আর আগেকার যশোটি হয়ে থাকবে না! ছি ছি বাল্যসখীর দুঃসময়েও এসব ছেঁদো কথা তাঁর মনে এল কী করে? মীনাক্ষীর লজ্জায় দুঃখে নিজের দু’গালে চড় মারতে ইচ্ছে করল। স্বভাব সত্যিই মরার আগে যায় না। ছ্যাঃ।
মীনাক্ষী দোতলায় পা দিয়েছেন। চার দিকে একটা ব্যস্তসমস্ত ভাব দেখতে পেলেন। পাবলো রয়েছে। পাবলোর বন্ধুবান্ধব ক’জন। ও দিকে সুহৃৎদার জ্যাঠামশাইয়ের ছেলে যার সঙ্গে মীনাক্ষীর বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল। ভেতর থেকে সরু মোটা নানান গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। মীনাক্ষী পাবলোকে পাকড়ালেন— আমি কি কোনও হেলপ করতে পারি?
শিয়োর— পাবলো বলল— তুমি যদি আইস বার করে দাও, আমি স্প্রাইটের সঙ্গে আমপানা মিশিয়ে একটা ফার্স্টক্লাস পাঞ্চ করে দিতে পারি।
মানে?— মীনাক্ষীর হাঁ বুজতে চায় না— ডাক্তার শরবত খেতে বলছে? গরমে ভিরমি লেগেছে। না কী?
ভিরমিই বটে মাসি। এতগুলো ছেলেবুড়ো মেয়ে-মদ্দর ভিরমি সামলানো আমার একার কম্মো! তুমি প্লিজ একবারটি ফ্রিজে যাও!
কে এয়েচে রে? ঘরের ভেতর থেকে যে-কণ্ঠস্বরটি বেরিয়ে এল সেটি যশোর বলেই তো মনে হল।
পাবলো ফিসফিস করে বলল— দারুণ ক্রাইসিস মাসি। তুমি ওদিকে যেয়ো না। আমি শম্পিকে এক্সট্রা গ্লাস আনতে পাঠিয়েছি— তুমি ফ্রিজে যাও। আমি আসছি। উঃ প্রথমে চা, তার পরে শরবত, তার পরে যে কী!
পাবলোর চক্করে পড়িসনি। কে এলি?— যশোর কি তবে মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দিল? পাবলো ওদিকে যেতে বারণ করছে। যশো আবার পাবলোর দিকে আসতে বারণ করছে। কিন্তু মীনাক্ষী অত সহজে ঘাবড়াবার পাত্র কিনা! তিনি সুহৃৎদার জ্যাঠতুতো দাদার সঙ্গে নিজের বিয়েটা ঠেকাতে পেরেছেন। আরও কতজনকে সারাজীবন ধরে ঠেকিয়ে আসছেন। তাঁর বীরত্ব চ্যালেঞ্জে পড়লে আরও বেড়ে যায়। তিনি পাবলো একটু মুখ ফেরাতেই সো-জা যশোর ঘর।
বাপ রে! এই নাকি সিকরুম! সমস্ত ঘরটা গমগম ঝনঝন করছে লোকে। এদের পুরো গুষ্টিই বোধহয় যশোকে দেখতে চলে এসেছে।
যশো বলল— লে মধু, মিনিও এসে গেছে, তুই এবার ওর সঙ্গে মিলে মেনুটা ঠিক করে ফ্যাল। মিনি, তুই আর গল্পো করতে বসিস না। আমি দ্যাখ জেরবার হয়ে গেলুম।
মীনাক্ষী হাঁ করে দাঁড়িয়েই আছেন। মধু রয়েছে। তার বর মিহিরকিরণও উপস্থিত। সুহৃৎদা যশোর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বসে রয়েছেন। সুহৃৎদার সেই জ্যাঠতুতো দাদা পরিমল সার এক জোড়া কাঁচা-পাকা গোঁফ নিয়ে হাজির। তাঁর স্ত্রী ছোট্টখাট্টো কলিবউদিও মজুত। সোমা নামে তাঁদের আরেক বন্ধু এবং তার মেয়ে এসে গেছে। অল্প বয়স্ক কয়েকটি ছেলেমেয়েও ঘোরাফেরা করছে— তাদের মধ্যে আরমানকেই একমাত্র চিনতে পারলেন মীনাক্ষী। বিজয়মুকুলদাও রয়েছে আসর আলো করে। মাথার বাবরি চুল ফুলিয়ে।
কী রে মিনি— তোর যে বাক্য হরে গেল? বল ঐক্য, বাক্য, মানিক্য!—
মীনাক্ষী অনেক চেষ্টায় নিজেকে দুরস্ত করে বললেন— তুই আছিস কেমন? হয়েছেটা কী? সেই আউপাতালিগিরি? আর কত অ্যাটেনশন দেবে তোর বর?
যশো হেঁকে বললেন— তুই চিরকালের শত্রু আমার। আমি মলে বাঁচিস। গেছি কি না দেখতে এসেছিলি। খুব ডিস্যাপয়েন্টেড। না রে? তোর বর যদি তোকে অ্যাটেনশন না দেয় তো আমার বর তুলে খোঁটা দিবি? যার ভাগ্য তার তার বুঝলি মিনি?— গলা উত্তরোত্তর চড়ছে দেখে যশোর জ্যাঠতুতো দাদা পরিমল বলে ওঠেন— আহাহা। এত উত্তেজিত হবার কী আছে যশো, বন্ধু বই তো নয়। দুটো ঠাট্টা তামাশা করতেই পারে। ওটা হল গিয়ে রিলিফ, বন্ধুকে ভাল দেখে ফুর্তি হয়েছে তো। তাই ঠাট্টা।
তোমার কুড-হ্যাভ-বিন পত্নীকে বুঝিয়ে বলো বড়দা। আমি নাটক করিনি। নাটক আমার আসে না।— লো সুগার, লো প্রেশার। সিচুয়েশন খুব খারাপ না হলে— ব্ল্যাক-আউট ভাল জিনিস না সুবুল ডাক্তার বলে গেছে। —বলে যশো বিশাল শরীর উলটে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুলেন।
মধুক্ষরা বলল— মিনিদি, একবার বাইরে এসো।
দালানে বেরিয়ে এসে বলল এই সব্বাইকার রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এখন। প্রথম দফায় শরবত, সেটা ছোটদের দায়িত্ব। এখন আমায় নাকি ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে। দিদির হুকুম। কী বে-আক্কেলে দেখো।
মীনাক্ষী বললেন— স্রেফ না করে দে। কে কবে শুনেছে অসুখের বাড়ি রাত ন’টায় ফিস্ট হয়। এটাও যশোর একটা অ্যাটেনশন সিকিং প্লয় বুঝলি?
বুঝি না আবার!— মধুক্ষরা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। মিনিদির সঙ্গে মধুক্ষরার খুব ভাল বোঝাপড়া। ওই যে একটা ফর্মুলা আছে না তোমার শত্রুর শত্রু হল তোমার বন্ধু। সেই আর কী!
কিন্তু এখন কি আর না করা যায়! সব বসে আছে। খেয়েদেয়ে যাবে। সবাইকারই তো একটা রিলিফ হয়েছে!
না করা যাবে না বলছিস! তা হলে, ‘এসো বোসো।’
মানে?
জানিস না। ‘এসো বোসো’ বলে একটা সার্ভিস চালু হয়েছে। টেক-অ্যাওয়ে রেস্তোরাঁ। ফোন করে দিচ্ছি। ক’জন গুনে আয়। যেমন বলবি দিয়ে যাবে।
একটু পরেই সেলফোন বার করে মীনাক্ষী অর্ডার দিয়ে দিলেন— হ্যাঁ হ্যাঁ। সিম্পল মাছের ঝোল আর ভাত, একটু আলুসেদ্ধ দেবেন। হ্যাঁ। এই গরমে আবার কী! আটত্রিশ ডিগ্রি আজ নির্ঘাত।
এই সময়ে পাবলো আর শম্পি— শরবতের গেলাস ভরতি ট্রে নিয়ে দেখা দেয়। মধুক্ষরা আর মীনাক্ষী পটাপট দুটো গ্লাস তুলে নেন। ব্যাজার মুখে দু’জনে সিকরুমের দিকে এগোতে থাকেন। দুটো গ্লাস কমে গেল!
কার্জন খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছে। মাঝে মাঝে নিচু হয়ে আইসব্যাগটা চেপে ধরছে। বড্ড লেগেছে। একটা একফোঁটা মেয়ে সে কিনা পেছন থেকে লেঙ্গি মেরে তাকে ধরাশায়ী করল? মধ্যপ্রদেশে মেয়ে ডাকাত-ফাকাত আছে সবাই জানে। থেকে থেকেই শোষণের বিরুদ্ধে সেখানকার লোকেরা বাগী হয়ে যায়। চম্বলের বেহড়ে ঘোরে। ডাকাতদল গঠন করে। কিন্তু এই মেয়েটাকে তো এম পি-র বলে মনে হল না। তবে কি আজকাল মেদিনীপুর-টুরেও মেয়েরা বাগী হয়ে যাচ্ছে! চম্বল উপত্যকার বদলে কলকাতা শহর, এবং ঠাকুরদের বদলে কলকাতার সাধারণ নাগরিকদের তাক করছে! রীতিমতো অর্গ্যানাইজড বলে মনে হল। এবং এর মধ্যে মধুবনও আছে। জেনে বা না জেনে। আজ যে-মেয়ে তার বন্ধুকে লেঙ্গি মারল, কাল যে সে মধুবনকেও মারবে— এই সামান্য সত্যটা মধুবন বুঝছে না। উঃ হাঁটুটা খচখচ করে উঠল।
প্রায় সাড়ে আটটা বাজছে। কিন্তু বান্ডিলটার একটা হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত কার্জন বাড়ি ফিরতে চায় না। সে পঙ্কজদের বাড়ি চলল। সামনে যে-অটোটা পেল, উঠে পড়ল। পাবলোর বেস্ট ফ্রেন্ড হল পঙ্কজ ধুধুরিয়া। এবং ধুধুরিয়া বেশ ঘুঘুমাল। ঘুঘুরিয়া পদবি হলে ভাল মানাত। ওই ঘুঘুই চোরাই মালটি রেখেছে নিজের ভল্টে। নিশ্চয়ই!
পঙ্কজদের বাড়ির সদর অনেকক্ষণ অবধি খোলা থাকে। একজন খেঁকুরে মতো কেয়ারটেকার টুলে বসে ঢোলে। সে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে লিফটে উঠে পড়ল।
কে? কে? কে?— তালপাতার সেপাইয়ের ঘুম ভেঙেছে। তাকে দেখে বলল— ও পঙ্কজখোকার বন্ধু! কী যেন নাম ক্যানিং না ম্যানিং। ইংরেজি নামের ছেলেদের হেভি রেলা। যাও যাও ওপরে যাও।
লিফট থেকে বেরোতেই লোডশেডিং। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। পঙ্কজদের দরজায় বিশাল ঘুসি মেরে কার্জন চেঁচাল— পঙ্কজ, দরজা খোল!
নিশ্চয় আই হোল থেকে কেউ তাকে জরিপ করছিল। কিন্তু জরিপের রেজাল্ট শূন্য। কেননা অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। এই সামান্য সেন্সটুকু পঙ্কজের বাড়ির লোকেদের নেই।
সে হেঁকে বলল— অন্ধকারে কী দেখছেন? শুনুন, কান পেতে শুনুন। দিস ইজ কার্জন ফ্রম একডালিয়া। সার্চ ওয়ারেন্ট ইন হ্যান্ড!
দরজাটা একটু খুলল— পঙ্কজ মুখ বাড়িয়ে বলল, আবার এসেছিস? কী মনে করে? বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে নাকি?
নিজের বডিটা দরজার ওপর ফেলে দিল কার্জন। ঢুকে পড়ল। বলল— বার কর, বার কর।
যা ব্বাবা এ যে দেখি ডাকাত।
আর তুমি যে বাটপাড়? তোমার বন্ধু পাবলো যদি চোর হয়, চোরাই মাল যদি তোমার কাছে থাকে হে বাটপাড়। তা হলে তো আমাকে হয় ডাকাত নয় পুলিশ হতেই হয়!
ডেলিরিয়াস! পঙ্কজ মন্তব্য করল। অন্ধকারের অন্তর থেকে একটা মোটা গলা বলে উঠল টেম্পারেচার কিতনা? দেখ না! আরে প্যারাসিটামল দো দো খিলা দে ইয়ার। সব ঠিক হো জায়েগা।
এবার একটা অপেক্ষাকৃত সরু-কিন্তু যথেষ্ট জোরালো গলা বলে উঠল— ঠাকুরজি সব ঠিক কর দেগা।
সিরিয়্যাল— পঙ্কজ বলল।
যতই আনশান বকিস আমি আজ খানাতল্লাসি করব। করবই।
কার্জন মেঝেতে পা ঠুকল, এবং সঙ্গে সঙ্গে উ-হু-হু করে উঠল।
দেখলি তো! খানাতল্লাশি-টাশির মতো বাজে কথা বলতে বাড়ির ফ্লোরটাই তোকে শাস্তি দিয়ে দিল। পানিশমেন্ট।
ফ্লোর না আরও কিছু। পা, হাঁটু। ব্যাপক লেগে গেছে।
ওষুধ দরকার? তা সে-কথা বললেই পারতিস! যখন-তখন যেখানে-সেখানে লোডশেডিং হচ্ছে। লোকে ধাক্কা খাবে কি কুপোকাত হবে এ আর বেশি কথা কী! আয়, আমার কাছে একটা স্প্রে আছে। সঙ্গে সঙ্গে আরাম পাবি।
পঙ্কজ আদর করে কার্জনকে নিয়ে যায় হাত ধরে ধরে কেননা তাদের বাড়ি ফার্নিচারে ঠাসা। তাতে ঠোক্কর খেলে কার্জনের সাড়ে সর্বনাশ।
অন্ধকারেই ড্রয়ার হাতড়ে স্প্রে-টা বার করল পঙ্কজ। কার্জনকে একটা চেয়ারে বসিয়ে ছ’ইঞ্চি দূর মাপল। তারপর স্প্রে-টা করল।
আহ! কী আরাম!
আরাম তো? দ্যাখ ইয়ার, এবার চুপচাপ দশ-পনেরো মিনিট বসে থাক এমনি। অ্যাকশনটা না হলে হবে না।
গুনে গুনে দশ মিনিট। তার পরই সব আলো ঝলমলে হয়ে উঠল। একটা হো মতো শব্দ উঠল চার দিক থেকে!
ওই তো আমার বান্ডিল— কার্জন ঝাঁপিয়ে পড়ল পঙ্কজের টেবিলের ওপর। — সে একটা মোটা মতো কাগজের বান্ডিল তুলে নিয়ে নিজের পকেটে ঢোকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল। মুখে শুধু বলছে, মাফ করে দিলুম। পেয়ে তো গেছি। আর কোনও শত্রুতা মনে রাখব না। বন্ধু ইজ বন্ধু। হাতটা বাড়া পঙ্কজ, লেটস সে স্যরি।
পঙ্কজ হাত বাড়াল না। বলল— আমার কেমিস্ট্রির নোটস নিয়ে যাচ্ছিস কেন? শালা তুই না কমার্স পড়িস!
ঢপ কাকে দিচ্ছিস! কার্জন মৈত্র অত সহজে ঢপ খায় না। সদরের দিকে পা বাড়াল কার্জন।
আরে! একবার দেখ তো সহি৷ কিসকা নোটস। কেয়া লিখ্খা হ্যায়।
বাড়ি যাব আগে। চান করব ফার্স্টক্লাস। খাওয়া-দাওয়া করব, তার পরে খুলব, দেখব আমার বান্ডিল।
তবে রে! ভাল কথার কেউ নয়। এ পিতাজি দেখিয়ে তো এক বদমাশ মেরা কেমিস্ট্রি নোটস লেকে ভাগতা হ্যায়।
বলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় পঙ্কজের বাবা এসে উপস্থিত হন।
আরে ক্যা হুয়া! এ বাচ্চালোগ বহোত বদমাশ! ভদ্রলোক আড়ে-দিঘে বিরাট।
মিনমিন করে কার্জন বলল দেখুন না আঙ্কল, আমার বান্ডিল, ও বলছে ওর নোটস।
ক্যায়া থা, তুমারা বান্ডিল মে!
নেই বলুঙ্গা— দু’হাত বুকে আড়াআড়ি রেখে কার্জন বলল। ভদ্রলোক বললেন— স্ট্রেঞ্জ! তো জরা দেখনে তো দো! কার্জন আর কী করবে বান্ডিলটি ধুধুরিয়াজির হাতে সমর্পণ করল। তিনি খুলে বললেন— আরে, ইয়ে তো কেমিস্ট্রিকিই হ্যায়, বহোত ফর্মুলা—উলা, গ্রাফ, দেখো ভাই, খুদ দেখ লো।
দেখে কার্জনের প্রায় কান্না পেয়ে গেল। না তার বান্ডিল নয়, অথচ তারই বান্ডিল। কাগজগুলো স্টেপল করে একটা সাদা বড় খামে ভরেছিল। তারপর পুরো জিনিসটা রোল করে বড় বড় দুটো রবার-ব্যান্ড দিয়ে আটকানো ছিল। একটা নীল, একটা হলদে। এ রবার-ব্যান্ড এখানের নয়, আমেরিকার। কার্জনের মামা কী সব পাঠিয়েছিলেন, তাতেই ছিল। সাদা খামটা একটু ময়লা হয়ে গেছে।
তার কঁদোকাঁদো মুখ দেখে পঙ্কজের বোধহয় দয়া হল, সে বলল আরে ইয়ার, রোও মত্। বান্ডল জরুর মিল জায়েগা।
হ্যাঁ মিল জায়েগা। তুমিই হাপিস করেছ। এই খাম কোথায় পেলে?
হ্যাপি স্টোর্স থেকে।
এই রবার-ব্যান্ড?
আমার মেটারন্যাল আঙ্কল আমেরিকা থেকে কী সব পাঠিয়েছিল, তাতেই ছিল।
কার্জন একেবারে হাঁ হয়ে গেল। হ্যাপি স্টোর্স না হয় বোঝা গেল। কিন্তু রবার-ব্যান্ড ঠিক এই রঙের পাঠানোর জন্যে সেই আমেরিকাতেই বসে রয়েছেন পঙ্কজের মামা! এরকম কাণ্ডে আনহ্যাপি ছাড়া আর কী হতে পারে সে!
খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে লিফটের দিকে চলল। পঙ্কজ খুব ভালমানুষের মতো বলল— ক্যা থে উস বান্ডল মে? লভ-লেটার?
যা খুশি ভাবতে পারিস, বলতে পারিস, আমি বলব না।
কার্জন ব্যর্থ খানাতল্লাশি শেষে নিজের বাড়ির দিকে যাত্রা করল, মুখ কাঁদোকাঁদো, কাঁচুমাচু, ঠিক যেন এক ফেলটুস ছেলে।
পাবলো নয়, পঙ্কজ নয়, উন্নি নয়, একমাত্র বল্লীকেই তার গোপন প্রজেক্টের কথা সামান্য বলতে চেয়েছিল কার্জন। কাউকে না কাউকে বলতে তো হবে! চার পাশে এতগুলো ইয়ার দোস্ত। পেট ফুলবে যে না বললে! ইয়ারকিতে সব এক। সিরিয়াস কিছু করো। একজনের সঙ্গে আর একজনের থোড়ি মিলবে! পাবলো যেমন তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা একমাত্র পঙ্কজকেই বলে থাকে। পঙ্কজ অবশ্য তা নয়। সে সোজাসুজিই বলে তার টাকা চাই। প্রচুর টাকা। কোনও না কোনও এক দিন সে অন্ততপক্ষে ভারতীয় ধনকুবেরদের মেরিট লিস্টে নাম লেখাবেই। পঙ্কজ বলে, দ্যাখ, যাবতীয় কোয়ালিফিকেশন আমার আছে ধনকুবের হবার। দ্যাখ, ফার্স্ট থিং, আমি লেখাপড়ায় ভাল নই, অমনোযোগী, মিলে গেল কি না? দ্যাখ আমি প্রচণ্ড স্মার্ট। কখনও কোনও অবস্থাতেই তোরা আমাকে অপদস্থ করতে পারবি না। হাতেনাতে চুরি করছি এমন অবস্থাতেও যদি ধরিস ঠিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাব। —ঠিকই বলে। আজই তো হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। কার্জনের চুরি করা বান্ডিল ফুসমন্তরে হয়ে গেল কেমিস্ট্রির নোটস! আরও গুণ আছে পঙ্কজের। আলাদা আলাদা নামে অর্থাৎ বেনামে প্রপার্টি কেনবার মতো প্রচুর বিশ্বস্ত আত্মীয়স্বজন। পঙ্কজ উপরন্তু খুব খাটিয়েও। এবং তার বাবা সামান্য স্টেশনারির অর্ডার ধরার ব্যাবসা থেকে এখন হিন্দুস্তান পার্কের মতো জায়গায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। ঘরে ঘরে এসি। মারুতি ৮০০ বিক্রি করে এখন হোন্ডা সিটি কিনেছেন। এমন এলেমদার বাবার উদাহরণ সব সময়ে চোখের ওপর থাকতে পঙ্কজ পথ হারাবে— এ কথা ভাবা শক্ত।— ডোভার লেনে পড়ে, বালিগঞ্জ নিউ মার্কেটের পাশ দিয়ে সে গড়েহাটা রোডে পড়ল।
আরমান তো এখনই কেরিয়ারে ঢুকে গেছে। ফুটবল ওর নেশা, ভলিবল, বাস্কেটবল সব রকমের বল গেমই ওর আসে। খেলতে খেলতেই ও একটা ঘ্যাম চাকরি পেয়ে যাবে। তারপর যত দিন পারে খেলবে আর খেলবে। খেলতে খেলতে কোচ হয়ে যাবে। কোচিংয়ে বহুত ঝামেলা বলে ও কমেন্টেটরও হয়ে যেতে পারে। সেটা অবশ্য ক্রিকেটের। আরমান হল গিয়ে স্পোর্টসম্যান। রাস্তা পার হয়ে একডালিয়ার দিকে ঘুরল কার্জন।
মধুবন বলে থাকে সে— পড়াবে। কিন্তু কার্জনের ধারণা মধুবন নিজেকে বিয়ের জন্যে তৈরি করছে। হঠাৎ এত হাঁটা, এত জিম, ডায়েট। ফিগারের পেছনে এত খরচ, পরিশ্রম, সময়! এর ওই একটাই মানে হয়। বেশ নিরাপদ একটি ম্যারেজ কেরিয়ারই হল তার লক্ষ্য।
শম্পি মানে সম্পৃক্তা ল পড়বে, ফর দা সিম্পল রিজন যে ওর বাবা অ্যাডভোকেট, উন্নি আর বল্লী হল দুই মিস্ট্রি ওদের মধ্যে। এরা যে কী চায়, কী করতে চায় কেউই বুঝতে পারে না। নিজেরা কিছু করবে টরবে না কারুর ঘাড়ে বসে খাওয়ার মতলব আঁটছে—ঘুণাক্ষরেও কেউ বুঝতে পারে না। তবে কার্জন নিশ্চিত যে, উন্নি জয়েন্টে আই আই টি এনট্রান্সে বসছেই। অল্প কথার মেয়ে। প্রচণ্ড তুখোড়। লেখাপড়াতে কোনওদিন এ প্লাসের কম পায়নি। হাঃ উন্নি। লেখাপড়াতে এমন তুখোড় হয়েও তুই কার্জন মৈত্তিরের কাছে হেরে যেতে চলেছিস। জানিস না, মানবি কি না তা-ও জানি না। কিন্তু কার্জন তার মনে মনে পুরো ছকটা কষে তো নিয়েছে। বল্লীও কম কথা বলে, ধারালো মেয়ে। বন্ধুর জন্যে উন্নি-বল্লী জান লড়িয়ে দেবে। কিন্তু বল্লী একটু বেশি সহানুভূতিসম্পন্ন, একটু বেশি বুঝদার। মানুষের আশা-আকাঙক্ষা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে না।
সেদিন বান্ডিলটি নিয়ে সে বল্লীর কাছেই গিয়েছিল। বান্ডিলটা তার পকেট থেকে বেরিয়ে ছিল।
ও মিসাইলটা কীসের রে?— বল্লীই জিজ্ঞেস করে। কী করে বলবে সে? পাবলো, পঙ্কজ দুই মূর্তিমানই মজুত। পাবলো বললে— অগ্নি থ্রি। পঙ্কজ বললে শেয়ার, শেয়ার। সব পকেটমানি তা ছাড়াও যেখান থেকে যা ঝাড়তে পারছে সব শালা সার্টিফিকেট কিনে রাখছে। মাল্টিপ্লাই করতে করতে ওর চব্বিশ বছর বয়সে, পাঁচ লাখপতি। অ্যানাদার সিক্স ইয়ার্স— বারো লাখপতি… ওদের উপস্থিতিতে কার্জন কী বলবে? তবে হ্যাঁ ওটা পকেটে নিয়ে বসতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে সে বান্ডিলটা টেবিলের ওপর রাখে। এবং আড্ডা দিতে দিতে একেবারে ভুলে যায়, ক্ষমার অযোগ্য এই ভুল। ঝোঁকের মাথায় গল্পসল্প করে বেরিয়ে পড়েছিল। মোড় ঘুরতেই মনে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে রিটার্ন টিকিট। বল্লী আছে। বাট নো পঙ্কজ, নো পাবলো, নো বান্ডিল।
কী রে বল্লী, আমার বান্ডিলটা!
কীসের বান্ডিল! যেন আকাশ থেকে পড়ল।
ওই যেটাকে মিসাইল বলছিলি।
বল্লী গম্ভীরভাবে বললে— মিসাইল তো মিস হবেই।
বাজে ইয়ারকি করিসনি। দিয়ে দে বান্ডিলটা।
আমি সত্যিই জানি না ওটা কোথায়?
এখানেই তো রেখেছিলুম।
তখনই বল্লী বলেছিল— দ্যাখ পাবলোরা হয়তো তোকে নাচাবে বলে সরিয়েছে ওটা।
বল্লী আর যাই হোক মিথ্যে কথা বলবার লোক নয়। বিকেল থেকে ঘুরছে সে। অথচ এখন সন্ধের ঝোঁকে একটু লেখাপড়া করে নেবার মতলব ছিল তার। যতই যাই হোক, পরীক্ষাটা যে কাছে চলে এসেছে এটা তো মিথ্যে নয়! কার্জন অগত্যা বাড়ি চলল। সংক্ষুব্ধ সমুদ্রের মতো ভেতরটা। পুরো দিনটাই জলে গেল আজ।— বাড়ি এসে গেল।
সদর দরজার সামনে জেঠু দাঁড়িয়ে, কী হে, বিশ্ব ভ্রমণ করে ফিরলে?
উত্তরে হাঁটু ধরে ধরে কার্জন জেঠুর পাশ দিয়ে বাড়ি ঢুকে যায়।
ন্যাংচাচ্ছ কেন? কে মেরেছে? তুমি তো আগে মারামারির মাল ছিলে না, গুণ বাড়ছে দেখছি।
উঃ জেঠু, পড়ে গিয়ে আমার ভীষণ লেগেছে, একটু চুপ করবে?
তবে যাও, গিয়ে মা-জেঠিমার কাছে আদর খাও। তবে জেনে রেখো তোমার বাবা আগতং। তার কাছে আজ তোমার হচ্ছে!
বন্ধুদের বাড়ি যেমন ডেঞ্জারাস, ওর নিজের বাড়িও তেমনই। সেখানে যদি বন্ধুর মা, মাসি কিংবা অ্যাসিস্ট্যান্ট, এখানে তেমনই জেঠু, বাবা, মা, দাদা। জেঠিমাই একমাত্র বন্ধুভাবাপন্ন। বোঝেন। তার বিপন্নতা তার আশা-আকাঙ্ক্ষা। সে যে শুধুই ভ্যারেন্ডা ভাজার ছেলে নয়। আই এস সি পরীক্ষার আগেটায় কোনও বিকেলে বেরিয়ে সে যদি রাত ন’টা পনেরোয় বাড়ি ফেরে তো তার সংগত কারণ আছে। এটা একমাত্র জেঠিমাই বিশ্বাস করে। অন্যদের রি-অ্যাকশন একদম সুবিধের না।
যাই হোক কার্জন ভয় পায় না। যা ফেস করার তা ফেস করতে হবেই। এই জানুয়ারিতেই তার আঠারো বছর পূর্ণ হয়েছে। এর পরের ভোটে সে অংশগ্রহণ করবে। এখন কথায় কথায় ভয় পাওয়া শোভা পায় না।
সে নিজের ঘরে মানে দাদা ও তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। দাদা যথারীতি নেই। তিনি দিনে চাকরি করে রাতে ম্যানেজমেন্ট পড়ছেন। সবার মাথা কিনে নিয়েছেন সুতরাং। তাঁকে নিয়ে বাড়িতে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। সে সত্যিই ক্লাসে যাচ্ছে না বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা মারছে কেউ খোঁজ নেয় না। জানতেও চায় না। অথচ একদিন লেক রোডের কাফে কফি ডে’তে দুটি বান্ধবীর সঙ্গে দাদাকে আড্ডা দিতে সে স্বচক্ষে দেখে এসেছে। লাগানি-ভাঙানি স্বভাব তার নয়। তবু যখন তার দিকে অভিযোগের তির ধেয়ে আসে সে তো না বলে পারে না!
দাদা কী করছে খোঁজ রাখো না? ক্লাস না করে সে কাফেতে বসে আড্ডা মারছিল গত মঙ্গলবার!
মা অম্লান বদনে বলে দিলে— একটু রিল্যাক্সেশনও তো দরকার। ছেলেটা নিশিদিন খাটে।
নাও কী বলবে বলো।
সে গা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এই পা ব্যথা নিয়ে সে এতটা পথ হেঁটে হেঁটে এসেছে। আলোটা টুক করে নিবিয়ে দিল। বান্ডিলটা কার কাছে থাকতে পারে! পঙ্কজের কাছে নেই, বল্লীর কাছে নেই, পাবলোর সঙ্গে এখনও মোলাকাত হয়নি। ওর কাছেও যদি পাওয়া না যায় কার্জন কী করবে? ভাবতে ভাবতে যা অবশ্যম্ভাবী তাই হল— সে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল।
ওদিকে হচ্ছে এক নাটক। বোকা একচোখোদের বাড়িতে যা হয় আর কী। ল্যাপটপ নিয়ে মগ্ন ছিলেন কার্জনের বাবা ঋতম্ভরবাবু। কার্জনের জেঠিমা রত্নমালাদেবী তাঁকে ক’বারই তাড়া দিয়েছেন।— ও ঋৎ খেতে এসো না। আমরা কতক্ষণ হাত-পা কোলে করে বসে থাকব!
কোল থেকে নামিয়ে বোসো।
উঃ আর পারি না।
রাত দশটার সময় টেবিল পড়ল। ঋতম্ভরবাবু তাঁর স্ত্রী সঙ্ঘমিত্রা, রত্নমালাদেবী তাঁর স্বামী বিশ্বম্ভরবাবু সবাই হাজির। গরহাজির শুধু দুই ছেলে।
বিশ্বম্ভর বললেন— লাটসাহেব তো ন’টা নাগাদ ঢুকেছিলেন একবার, তোমাদের কারও সঙ্গে দেখা হয়নি?
রত্না বললেন— ওমা! কই না তো! আমার সঙ্গে দেখা না করে সে যাবে কোথায়! আহা রে!
বিশ্বম্ভর ঋতম্ভর কোরাসে বলে উঠলেন— বাহা রে! এমনি করেই ছেলেটার মুন্ডু চিবোচ্ছ।
সঙ্ঘমিত্রা বেশি কথার মানুষ নন, কাজের মানুষ। তিনি স্রেফ ফোনটা তুলে— পর পর কয়েকটি ফোন করে গেলেন।
এসেছিল? সন্ধের ঝোঁকে? কী হয়েছে যশোধরার? ও, যাক। পরের ফোন— হ্যাঁ মধুবন, কার্জন এখনও বাড়ি ফেরেনি। এসেছিল? বলিস কী? আচ্ছা ঠিক আছে।
হ্যাঁ বল্লী আছে? বলছিস? কার্জন তো এখনও বাড়ি আসেনি। শেষ দুপুরে? বলিস কী!
সঙ্ঘমিত্রা এবার ফোনের দিকে পেছন ফিরে বললেন লালবাজারে করব কি! ও মোটের ওপর সব বন্ধুবান্ধবের বাড়িই গিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে চলেও এসেছে। ওকে নাকি উদ্বিগ্ন, টেনসড দেখাচ্ছিল। কোনও শত্রু-টত্রু?
বিশ্বম্ভর বললেন— অসম্ভব নয়। লেখাপড়ায় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সম্ভাবনা নেই। আমাদের ছেলে বেশি মার্কস পেয়ে কারও ঈর্ষার উদ্রেক করবে না। নিশ্চিত। কিন্তু আরও একটা ক্ষেত্র রয়েছে।
কী ক্ষেত্র?— রত্না ভীষণ চিন্তিত স্বরে বললেন।
প্রেম! প্রেমে রাইভ্যালরি সাংঘাতিক জিনিস।
প্রেম! কার্জন! রত্নমালা হেসে ফেললেন— ওইটুকু বাচ্চা নাড়ুগোপাল ছেলের সঙ্গে কার প্রেম হবে গো!
আহা হা, একেবারে নাড়ুগোপাল, সঙ্ঘমিত্রা ঠিকরে উঠলেন। তোমার কেষ্টঠাকুরও নাড়ুগোপালই ছিলেন দিদি।
কিন্তু নাড়ুগোপাল অবস্থায় কি তিনি প্রেম করেছিলেন? রত্নার জিজ্ঞাসা।
খুব বেশি দিন দেরিও লাগেনি। ষোলো বছর বয়সে তো মথুরাতেই চলে গেলেন। গোপীপর্ব তার আগে। সেকালে আমাদের ছেলের তো আরও দু’বছর বয়স পেকেছে।
এই সময়ে বেল বাজল। বিশ্বম্ভর দরজা খুলে দিলেন তাড়াহুড়ো করে। না কার্জন না, তার দাদা অজিন। ওরফে পল্টন।
ওফফ কী গরম! আমি চান করে এসে বসছি বাবা। অজিন-পল্টন চলে যায়। সে মিনিট পনেরো পরে ঠান্ডা হয়ে যখন ফিরে আসে তখনও কৃষ্ণপর্ব চলছে।
ঋতম্ভর বলছেন— ও-সব গপ্পোকথা গপ্পোকথা। উঠতি বয়সে ছোকরাদের একটু ছোঁকছোঁক হয়। কৃষ্ণ গোয়ালার ঘরে মানুষ কিন্তু আসলে প্রিন্স। ধারেকাছে ব্রজবালা ছাড়া আর কাউকে পায়নি।
অমনি ফোঁস করে উঠলেন সঙ্ঘমিত্রা— ব্রজবালা বলে কি তারা ফ্যালনা নাকি! আজকের দিনে এই ধরনের ক্লাস-কনশাসনেস, জাতপাত ছিঃ। ধিক তোমাকে।
পল্টন বলল কী নিয়ে লাগ ধুম ধুম লেগে গেল এই ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার?
জেঠু বললেন— কথা হচ্ছিল কার্জন কেন এখনও ফেরেনি তাই নিয়ে তো তার থেকে তার প্রেম। তার নাড়ুগোপাল স্টেজ। এই পর্যন্ত আমি আর তোর জেঠি যোগ দিয়েছি। এবারে তোর বাবা-মা’র মধ্যে জাতপাত, সংরক্ষণ, ক্লাস-ট্লাস সবসুদ্ধু এসে গেছে।
পল্টন রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল— কে বলল কার্জন ফেরেনি।
অ্যাঁ?
নাহ্। তোমরা সত্যিই হোপলেস ওল্ড ফুলস। ঘরটা একবার দেখোনি? সে তো ঘর অন্ধকার করে পাখা চালিয়ে ঘুম মারছে।
যা ব্বাবা। একটা ইনটারেস্টিং সম্ভাবনা জলে গেল।— জেঠু বললেন, জেঠিমা বললেন— তা তুই ওকে তুলে আনলি না? খাবে না ও!
আচ্ছা জেঠিমা, কার্জন খেয়েছে কি না খেয়েছে আমি জানব কী করে? সত্যিই তো! সত্যিই তো! চার দিক থেকে একটা রব উঠল। তারই মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে রত্নমালা বেরিয়ে গেলেন। এ-বাড়িতে তাঁরই একমাত্র মেয়ে। মেয়ের যত দিন বিয়ে হয়নি সঙ্ঘমিত্রা সেই সংহিতা-অন্ত প্রাণ ছিলেন। রত্নমালা আবার কার্জন-ভক্ত। যশোদা-মা টাইপ। সংহিতা সুদূর বিদেশে মন্ট্রিয়ল না কোথায় বসে আছে। এখন কার্জনই এঁদের একমাত্র স্নেহের ধন। পল্টন হাত থেকে বেরিয়ে গেছে।
রত্নমালা আলো জ্বেলে দেখলেন— একটা নোংরা বারমুডা পরে, গায়ে পাতলা ফতুয়া, ধূলিধূসর পদদ্বয়, যশোদাদুলাল নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন।
এই কার্জন, কার্জন। রাগ করিস না বাবা, খাবি চল।
কয়েকবার এই পদাবলি আউড়ে যাবার পর, কার্জন অস্ফুটে বলল— কী বিরক্ত করছিস মাঝরাত্তিরে, হাটা তোর অ্যাসিস্ট্যান্টকে নইলে একদিন ও-ই তোকে স্টান্ট দেবে। বুঝবি মজা!
কী বকছিস। এই কার্জন! আমি জেঠিমা রে।
কার্জন অর্ধেক চোখ খুলল।
মাঝ রাত্তিরে ডাকাডাকি করছ কেন?
তুই যে খাসনি বাবা, রাত-উপুসি থাকলে হাতিসুদ্ধু পড়ে যায়। আমার ঠাকুমা বলতেন।
কার্জন তড়াক করে উঠে বসল।— আমি খাইনি?— নিজের শরীরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল আমি চানও করিনি?
হ্যাঁ পা-ও ধুসনি। নোংরা ঘেমো জামা পরে শুয়েছিস।
নামতে গিয়ে— কার্জন গর্জে উঠল— উহ্হ্।
ও কী রে? লেগেছে?
লেগেছে। লেগেছে। লেগেছে। না-ও কী করবে করো। তোমারও লাগেনি তোমাদের পেয়ারের পল্টনচন্দ্রেরও লাগেনি। লেগেছে এই বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানোর। হল তো।
রত্নমালার চোখ ছলছল করে উঠল।— এমন কথা তুই বলতে পারলি? পেছন থেকে বাবার গম্ভীর গলা ভেসে এল— বাজে না বকে চানফান করে এসে খেয়ে নাও।
রাত এগারোটার সময়ে বল্লীর ফোন এল। কার্জন ফিরেছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ ফিরেছে। হাঁটুতে খুব লেগেছে।
পাঁচ মিনিট পরে মধুবনের ফোন। ঘুমঘুম গলায় —জেঠিমা, কার্জন ফিরেছে?
হ্যাঁ ফিরেছে। হাঁটুতে খুব লেগেছে কী করে কে জানে?
আইস প্যাক দিয়েছিলুম তো!
তোর সামনেই পড়ল! কী করে?
একদম শুকনো ডাঙায় আছাড় খেল জেঠিমা, আর বলবেন না।
তা যদি বলো মধুবন, শুকনো ডাঙায় এই বয়সের ছেলে আছাড় খায় না। তোমরা অত্যন্ত কেয়ারলেস। জলটল ফেলে রেখেছিলে আর কী। আজ কার্জনের হাঁটুর ওপর দিয়ে গেছে। কাল তোমার হাঁটুর ওপর দিয়ে যাবে। গুরুজন কথাটা বলছি। কান পেতে শোনো। জল-ফলগুলো পড়ে থাকলে মুছে নিয়ো। নিজে নিচু হতে না পারো, তোমাদের কাজের লোককে বলো।
নিচু হতে না পারার কথাটা মধুবনের খুব লেগেছিল। মাসিমা পর্যন্ত! টেলিফোন রেখে সে নিঝুম হয়ে বসে রইল।
আর পাঁচ মিনিট পরে উন্নির ফোন।
মাসি, কার্জন ফিরেছে? ওর জিনিস পেয়েছে?
ফিরেছে। কী জিনিস?
তা তো জানি না, সারা বন্ধুমহল চষে ফেলেছে। আচ্ছা রাখি।
রত্নমালা সঙ্ঘমিত্রাকে বললেন —একটা জিনিস লক্ষ করেছিস। উতলা হয়ে কার্জনের খোঁজ যারা করল তারা সকলেই নারী।
দ্যাখো দিদি— এইসব উন্নি, মধবন, বল্লীদের নারী বলে নারীদের অপমান কোরো না। ওরা জাস্ট মেয়ে, এখনও টিন। পেছন থেকে ছেলে কি মেয়ে বোঝা যায় না। সামনে থেকেও তোমার কার্জনের যা আছে উন্নির তা নেই। হুঁঃ নারী!
আমি যেটা বলতে চাইনি সেটা হল— প্রেমের সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রেমে রাইভ্যালরির ব্যাপার একটা হয়ে থাকতেই পারে। ছেলেটা খুব ডিপ্রেসড!
তুমি তো সব সময়েই ওকে ডিপ্রেসড কি রিপ্রেসড দেখছ। ইমপ্রেস করতেই খালি দেখা যাচ্ছে না।
আচ্ছা আচ্ছা— রত্না রণে ভঙ্গ দিলেন। কিন্তু মনের ভেতর খটকাটা তাঁর থেকেই গেল।
আই এস সি পরীক্ষার শেষ দিন আজ। এদের সব আজ মুক্তির দিন। প্রহর গোনা শেষ হল। গনগন করছে রোদ। সে সব উপেক্ষা করে দলে দলে মা ইতি-উতি বসে রয়েছেন। লনের ধারে। গাছের তলায় গুচ্ছ গুচ্ছ মা। সকলেই খুব টেনশনে। কিন্তু সাজ দিতে কারও ভুল হয়নি। টিপ, কাজল, লিপস্টিক।
মীনাক্ষী বললেন,— যশো, তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না।
এই তো দিব্যি চিনতে পেরেছিস?
ক’ কেজি নামালি?
যশোধরা দু’হাতের আঙুল মেলে দেখালেন ছ’কেজি। তাঁর বোন মধুক্ষরা বলল— শুধু শুধু হয়েছে নাকি? সুবুলদা ভয় দেখিয়ে গেল।
কে সুবুল? সেই তোর ক্যান্ডিডেট? এখনও লেগে আছে!
ধ্যাত। কী যে বলো মিনিদি। ডাক্তার তো বাড়ির।
মিহির জানে?
উফ। মিহিরের প্রেশার কে রেগুলার মাপে?
উদাস চোখে তাকিয়ে মীনাক্ষী বললেন— দ্যাখ প্রেশারের কারণ হয়তো ওটাই। প্রেশার মাপতে তো কম্পাউন্ডারই যথেষ্ট। ডাক্তার কী করবে!
সাইড-ট্র্যাক করে যাচ্ছিস কেন? যশোধরা আপত্তি করে উঠলেন।
জানিস দু’মাস নো ভাত। নো আলু, সিরিয়্যাল বলতে পাউরুটি-টোস্ট উইদাউট মাখন, পেঁপে সেদ্ধ, গাজর সেদ্ধ, বিনস সেদ্ধ, শসা, নুন দিয়ে ছানা।
আর? এসব তো জানি?
হন্টন। সকালবেলায় চার রাউন্ড, বিকেলবেলায় চার রাউন্ড। প্লাস যোগাসন। তা ছাড়া ওপর নীচে। তিনতলা একতলা ছ’বার এ-বেলা, ছ’বার ও-বেলা। মিথ্যে বলব না, এ দু’মাস আমার সংসার মধুই দেখেছে।
মধুক্ষরা বললে— মাসাজও নিয়েছে দিদি। বেশ হয়েছে না? দেখো ওপর হাতের থলথলে ভাবটা চলে গেছে। গাল গলা দিব্যি ট্রিম।
আচ্ছা আচ্ছা তোকে এই পাবলিকে এখন আমার ফিগার ব্যাখ্যা করতে হবে না।
মধুবন কদ্দূর?
মীনাক্ষী হতাশায় হাত উলটে বললেন একটু কমেছিল। যেই পরীক্ষা ঘাড়ে এসে গেল, জিম, হাঁটা সব বন্ধ হয়ে গেল, খাওয়া-দাওয়াও তেমন রেস্ট্রিক্ট করতে খারাপ লাগল বুঝলি? খালি পেটে কি আর পড়া হয়। দেখা যাক এরপর!
এরপর জয়েন্ট আছে। না যদি দেয় তো এ-কলেজ সে-কলেজে অ্যাডমিশন টেস্ট আছে। তখনও তোর মায়ের প্রাণ খুঁতখুঁত করবে। ও আর হতে হচ্ছে না। ধাতই ওইরকম। বাপের ধাত পেয়েছে। ঠাকুমাও অমনি নোদলগোদল ছিলেন।
রত্নমালা, সঙ্ঘমিত্রা দু’জনেই এসেছেন। এঁরা বেশ একটু সিনিয়র। তার ওপরে রত্নমালা পটনার মেয়ে।
সঙ্ঘমিত্রা সাদা চিকনের শাড়ি পরে এসেছেন। গলায় শাঁখের মালা, কপালে চন্দনের টিপ।
মধুক্ষরা বললেন— হ্যাঁগো সঙ্ঘমিত্রাদি, এমন ‘যোগিনী হইয়া যাব সেই দেশে’ কেন গো?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সঙ্ঘমিত্রা বললেন— বলেছিস ভাল। আমার রত্নটিকে তো আর জানেন না। তাঁর রেজাল্টও বেরোবে আমিও গৃহত্যাগ করব।
তারপর এখন কোথায় কী ফিল্ম চলছে, কোনটা কোনটা দেখা হল না। নিজেদের পরীক্ষায়ও স্যাক্রিফাইস। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায়ও স্যাক্রিফাইস! সকলেই খুব ক্ষুব্ধ। মেয়েদের জীবনে স্যাক্রিফাইসের আর শেষ নেই।
হ্যাঁ কার্জন ছেলেটির মনমেজাজ উড়ুউড়ু —যশো বললেন।
রত্নমালাকে এঁরা চেনেন না। তিনি এক পা এগিয়ে এসে বলে উঠলেন কার মন উড়ুউড়ু নয় ভাই, আপনি কার মা? উন্নির! সে তো ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। মানে উড়েই আছে।
ইনি কে হলেন? যশো একটু যেন অসন্তুষ্ট।
সঙ্ঘমিত্রা বললেন— ইনি হলেন বিন্দুবাসিনী। আমার বড় জা।
বিন্দুবাসিনী নাম?— স্লিভলেস ব্লাউজ পরা টাঙাইল মোড়া ভদ্রমহিলাকে দেখতে দেখতে আশ্চর্য হয়ে যশো বলে।
তোর চিরকালই সেনস অব হিউমারটা কম— সঙ্ঘমিত্রা বললেন।
আমার ছেলে কার্জনকে দিদিই নিয়ে নিয়েছে। কার্জনের ভালমন্দ সব ওর ভাবনা।
তুমি ঝাড়া হাত-পা সঙঘদি! মধুক্ষরা বললেন।
ঝাড়া হাত-পা কি আজকাল আর হওয়া যায় ভাই! এক একটা ছেলের নানান ফ্যাঁকড়া।
কার্জন না ক্যানিং সে যদি তোমার ছেলে হয় সঙঘদি আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, ও একটু ইনকনসিডারেট। একটু মানে গোলমেলে।
গোলমেলে কে নয়? ওদের পুরো জেনারেশনটাই প্রচণ্ড গোলমেলে।— রত্না বললেন— সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভাই কিছু মনে কোরো না, তোমার উন্নি অনেক বেশি গোলমেলে।
কে বলেছে উনি আমার?— যশো হেঁকে উঠলেন— আমার কোনও মেয়েফেয়ে নেই।
তার মানে তুমি নিজে মেয়ে হয়ে অ্যান্টি-মেয়ে? রত্নার যেহেতু একটি কন্যা, তাঁরই গায়ে লেগেছে সবচেয়ে। তিনি হেঁকে বললেন।
অ্যান্টি-মেয়ে হতে যাব কেন? মেয়ে নেই এটা ফ্যাক্ট। আমার বোনেরই তো একটি মেয়ে। তাকে কি আমি নিজের মেয়ের মতো ভালবাসি না? বিন্দুবাসিনী হয়তো হতে পারিনি আপনার মতো! তবে হ্যাঁ অ্যান্টি-মেয়ে না হলেও আমি কিন্তু অ্যান্টি-উন্নি— তা বলে দিচ্ছি। ওরকম কাঠখোট্টা তেরিয়া মতো মেয়ে আমাদের পোষায় না। আমার মেয়ে হলে আমি ওর মলাট পালটে দিতুম।
মধুক্ষরা ভীষণ আহত হয়ে বললেন— দিদি, এবার ইনকনসিডারেট হচ্ছে কে? সেদিন উন্নি খবর না দিলে তোমার পাবলো অত তাড়াতাড়ি আসত। সঙ্গে করে কতক চাট্টি বন্ধুবান্ধবও এনেছিল। তারা কত কাজ করে দিল। অকৃতজ্ঞ হয়ো না।
ইতিমধ্যে ঘণ্টা পড়ে গেছে দলে দলে ছেলেমেয়ে বেরিয়ে আসছে।
কী রে উন্নি? কী রকম হল?
এ প্লাস। তোর?
পাবলো বলল বি ফর বেঙ্গল। বল্লী, তোর?
বল্লী ঠোঁট উলটে বলল লেখার কথা লিখে দিয়েছি এখন কেমন হল, কী মার্কস হবে এসব ভাবতে যায় কোন হাঁদা। ছাড়।
পঙ্কজ বলল— বলবি না তাই বল। এই বান্ডল তোর কেমন হল?
মনমরা গলায় কার্জন দু’দিকে ঘাড় নাড়ল। তারপর সোজা জেঠিমার কাছে গিয়ে চোঁচা করে একটা পেল্লাই ডাবের জল খেয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে চলে গেল। ডাইনে তাকাল না। বাঁয়ে তাকাল না।
আসলে এদের মধ্যে দু’জন পরীক্ষাটা দিতে হয় দিয়েছে। আনমনে। কী এমন হাতি-ঘোড়া আছে পরীক্ষায়? বসে গেলেই তো হল! তাদের মন পড়ে রয়েছে অন্য কোথা অন্য কোনওখানে। সকলেই জয়েন্টে বসছে। পাবলো বসছে না। কার্জন বসছে না। যদি বাই চান্স র্যাঙ্ক এসে যায় বাড়ি থেকে চাপাচাপি করবে সবাই। ও সিনেই তাই নেই ওরা। দু’জনের বাড়ির অন্তঃপুরে খুব গুমোট তাই। সঙ্ঘমিত্রার ধারণা রত্নমালার প্রশ্রয়েই এতটা বেড়েছে কার্জন। ভেতরে ভেতরে তাঁর একটা গোঁসা তৈরি হচ্ছে। নিজের মেয়েটিকে তো বেশ ইলেকট্রনিক্স পড়িয়ে কানাডা পাঠিয়ে দিয়েছ সেখানে সে সাহেব বিয়ে করেছে প্লাস করে খাচ্ছে। আমার ছেলেটির বেলায়— তাতে কী হয়েছে? সবাইকেই কি ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার হতে হবে!
কথাটা মনের মধ্যে গুলোচ্ছে, সঙ্ঘমিত্রা বলেই ফেললেন। রত্না শুনে অবাক এবং আহত।
দ্যাখ সঙ্ঘ, সংহিতা তোরই বেশি ন্যাওটা ছিল। তুইও জানিস, আমিও জানি কারও আদর তাকে তার সংকল্প থেকে টলাতে পারেনি। সেই যে ক্লাস এইটে পড়তে ভবিষ্যৎ ঠিক করে ফেলল, অর্জুনের মতো পাখির চোখটা ছাড়া আর কিছু দেখল না। কোনও দিন সেকেন্ড হয়েছে মেয়েটা?
ও, তার মানে বলতে চাইছ আমার ছেলেটা এলেবেলে। মাথা নেই। তাই তার কিস্যু হবে না—এটাই অবধারিত।
ডিফারেন্স! ডিফারেন্স!— ঠিকরে উঠলেন রত্নমালা, হাতের পাঁচটা আঙুল এক রকম হয় না কিন্তু প্রত্যেকটা ইমপর্ট্যান্ট। এক একটাকে দিয়ে এক এক রকম কাজ হয়। বুড়ো আঙুল লবডঙ্কা দেখায়। আজকাল অবশ্য ভিক্টরি দেখাচ্ছে। তর্জনী দিয়ে শাসানো হয়। মধ্যমা না থাকলে কিছু টিপে ধরে তোলা, অসাধ্য। অনামিকা আংটি পরে। আর ছোটটা? ধর কান সুড়সুড় করছে, কোন আঙুল ঢোকাস? কড়েটাকেই তো! সরু গর্ত, কেউ ঢুকবে না। কড়ে ঠিক ঢুকে যাবে। মানুষ এইরকম আলাদা আলাদা।
তা তোমার কার্জনসুন্দর কোন কম্মে লাগবেন? তোমায় কিছু গুপ্ত কথা বলেছেন?
তা হয়তো বলেনি। কিন্তু আমি যদি প্রকৃত মা-জেঠিমা হই তা হলে ওর গুপ্ত হোক সুপ্ত হোক বাসনাটি ক্রমশ আমার কাছে প্রকাশ পাবেই।
ভাল। ওই আনন্দেই থাকো। সঙ্ঘমিত্রা কখনওই তাঁর এই পটনাই জায়ের সঙ্গে কথায় পেরে ওঠেন না। তিনি রণে ভঙ্গ দিলেন।
জয়েন্ট এন্ট্রান্স শেষ হয়েছে। ঘোর গ্রীষ্ম। বল্লী মায়ের এসি রুমে গল্পের বই নিয়ে শুয়ে। পড়বার চেষ্টা করছে, ঘুম এসে অধিকার করছে তাকে, চুলে পড়ছে, আবার পড়ছে। এমন সময়ে সেলফোনটা বাজল। বল্লী সব সময়ে ফোন ধরে না। বাজছে বাজুক, বেজে যাক। তার এখন মুড নেই, কিন্তু ফোনটা চুপ করেই আবার বেজে উঠল। তুলে দেখে পাবলো।
পড়েছিস!
শনৈঃ শনৈঃ।
মানে?
মানে আস্তে আস্তে। হাতের লেখা খুব খারাপ তো!
ধর অত ধরে ধরে লিখলুম! শচীনদেবের প্যারডি, কেমন?
হঠাৎ বল্লী সতর্ক হয়ে গেল। বলল হ্যাঁ যতদূর সাধ্য চেষ্টা করেছিস।
তোর কী মনে হচ্ছে, হবে?
সেটা নির্ভর করছে টোট্যাল এফেক্টটার ওপর। তুই কি সিরিয়াস?
তবে? আরে ইয়ার! এই জন্যেই তো তৈরি পাবলো।
পিকাসো না নেরুদা?
কিছুটা এ কিছুটা ও। সুরটা এক্সট্রা। —সুররিয়্যালিজম্। বুঝতেই তো পারছিস?
হুঁ।
ঝেড়ে কাশ না। ঢোঁক গিলছিস কেন?
বলছি তো টোট্যাল এফেক্টটার ওপর নির্ভর করছে। এখন বিরক্ত করিস না। ঘুম আসছে। ছাড়ি।
পাবলো দেখল মিসড্ কল তার ফোনে। পরে করবে ভাবছে আবার ফোনটা বেজে উঠল। ভারী ভাঙা গলা ওধার থেকে— পাবলো আমার বান্ডিলটা দিয়ে দে প্লিজ। সারাজীবন তোর ক্রীতদাস হয়ে থাকব। যা বলবি তাই করব। পাবলো! পাবলো!
কত বার তোকে বলব তোর বান্ডল্ আমি নিইনি। নিইনি নিইনি।
বললেই তো হবে না পাবলো কনভিন্সিং হতে হবে। তুই সবচেয়ে বিচ্ছু। পাহাড়ি বিচ্ছু একেবারে। দ্যাখ তোর সুযোগ ছিল। ইচ্ছে ছিল, মোডাস অপারেন্ডাই … পাবলো-পাবলো। প্লিজ আমি তোকে কিচ্ছু বলব না। হ্যাভ পিটি অন মি।
আরে, আরে থাম তো জরা। বকেই যাচ্ছিস, বকেই যাচ্ছিস। কীসের সুযোগ?
আরে ভাই, বান্ডিলটা বল্লীর টেবিলে রেখেছিলুম, ক্লোজেস্ট বসেছিলি তুই। একটু দূরে পঙ্কজ। সারাক্ষণ তোর নজর ছিল বান্ডিলটার দিকে। ওটাকে মিসাইল বললি, আরও কত কী বললি!
ইচ্ছেটা হবে কেন? মোটিভটা কীসের?
জাস্ট একটা প্র্যাঙ্ক।
প্র্যাঙ্কের পক্ষে সময়টা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? তুই আজ দু’মাস ধরে বান্ডুল বান্ডুল করে যাচ্ছিস। এতদিন ধরে তোকে ল্যাজে খেলানোর কী মানে? মোডাস অপারেন্ডাটাই বা কীরকম?
কেন? তোর কার্যকলাপ সব কেমন চুপিসাড়ে, তুই সিক্রেটিভ আছিস। তোর ডান হাত একটা কাজ করলে বাঁ হাত জানবে না।
বা বা বা? চমৎকার অ্যাসেসমেন্ট তোর। সব্বাইকে জিজ্ঞেস কর কার্জন, আমার মতো ফ্র্যাঙ্ক, খোলামেলা ছেলে আর একটাও ধারেকাছে নেই। তুই-ই কি কম সিক্রেটিভ না কি? কী ছিল তোর ওই রোল করা পেপার্সটাতে। সেটা তো বলছিস না। এটা বুঝি সিক্রেটিভনেস হল না?
তুই তো জানিসই।
জানি? বা বা বা। গেস করতে পারি। কারও কাছ থেকে লভ-লেটার পেয়েছিস—
ধুর। কে আমাকে লভ-লেটার দেবে তোরা থাকতে?
তবে কোনও দুষ্প্রাপ্য বইয়ের চ্যাপটারের জেরক্স!
সে তো পরীক্ষা ওভার। চুকেই গেছে তা হলে। এখনও খোঁজ করে আমার লাভ?
তা হলে … তা হলে…
বল কী তা হলে? তুই নিশ্চয় জানিস, বলছিস না। পাছে আমি ধরে ফেলি। চালাক কম না কি?
অনেস্টলি কার্জন, আমি তোর বান্ডল্ নিইনি।
তা হলে কে নিয়েছে? বার কর, তোর ব্রেন আছে গোয়েন্দাগিরি কর, বন্ধুর একটা উপকার।
ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি ভাবব। তুই শিয়োর যে ওটা পকেটে করে নিয়ে যাসনি? রাস্তায় পড়ে গিয়ে থাকতে পারে!
না। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছি। দেখি দুই পি হাওয়া, বল্লী একা বসে সুডোকু খেলছে।
ঠিক হ্যায় কার্জন, জাসুসি করুঙ্গা তেরে বান্ডুলকে লিয়ে! খুশ?
আর খুশ!
যশোধরা আর মধুক্ষরা কারও কথা শোনেনি। সোজা দার্জিলিং চলে এসেছে। স্বামীদের নিরুৎসাহ দেখে, স্রেফ ছেলেমেয়েদের বলল— ভোটাধিকার হয়ে গেল, সংসার সামলাতে শেখো। কবে যে তারা হোটেল বুক করেছে, কাকে দিয়ে যে কাঞ্চনজঙ্ঘার টিকিট কাটাল কেউ বোঝেনি। তবে দীর্ঘ দিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকেরই ফল এসব বোঝাই যাচ্ছে। পাবলো এবং শম্পি আকাশ থেকে পড়েছিল।
সংসার সামলানো মানে? দু’জনেই চলে যাচ্ছ? বাঃ চমৎকার। হলিডের দরকার তো আমাদের। আমরাই পরীক্ষা দিয়ে উঠলুম, শম্পি বলে।
হ্যাঁ, সব দরকারই তো তোমাদের। গিন্নিদের মায়েদের আর কোনও দরকার অধিকার থাকতে নেই। ও-সব আমরা জানি।
কিন্তু মানছ না— এই তো! পাবলো বলে— ঠিক আছে। কিন্তু আমরা আমাদের মতো চালাব। সেখানে কোনও রিমোট কন্ট্রোল চলবে না।
হুঁঃ, রিমোট কন্ট্রোল। যশো হাসে, দড়িদড়া ছিঁড়ে চলে যাচ্ছি। কোনও পিছটান রাখছি না। তবে সার কথাটি শুনে রেখো, সুহৃৎবরণ আর মিহিরকিরণ খেটেখুটে এসে যেন শোবার বিছানা, চানের জল, খাবার-দাবার পায়। এই খবরটি রাখব।
দুঃখের বিষয় কাঞ্চনজঙ্ঘার এসি টু-তে বহু পরিচিতর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মিনি, তাঁর স্বামী বিজেনদা প্রথমেই।
এ কী মিনি? তোরা যাচ্ছিস জানতুম না তো!
নেমে যাবি ভাবছিস নাকি!
কী যে বলিস! তা মধুবন কই?
সে-ও বেড়াতে গেছে।
বন্ধুদের সঙ্গে?
উঁহুঁ। তারা দু’ভাইবোন গেছে পরিদের গাঁয়ে। ঋজু কী সব পেপার করছে। পরিদের গ্রাম টার্গেট। ঝুলোঝুলি করে মধুবনও গেছে। আমরা ফ্রি।
পরি কে? জলপরি না স্থলপরি।
ও আমাদের কাজের মেয়ে। মুড়কিশোলা বলে একটা গ্রামে থাকে।
বলো কী! অমনি পাঠিয়ে দিলে! যদি অ্যাবডাক্ট হয়ে যায়! মধু বলল।
দেব না কেন? বড় হয়েছে, নিজেরা ঘুরুক ফিরুক দেখুক শুনুক।
বিজেন বললেন— আরে ভাবছেন কেন! আমাদের রুস্তম রয়েছে সঙ্গে। পরি মেয়েটাও খুব রেসপন্সিবল্।
আর আপনাদের চৌকি?
তাকে কেনেলে দিয়েছি। সে-ও হলিডে কাটাচ্ছে।
ট্রেন ছাড়তেই ওদিক থেকে একটি উল্লসিত পুরুষকণ্ঠ বলে উঠল —আরে যশো না! মধুও তো রয়েচিস!
সামনে এগিয়ে আসছে ব্যাঙাদা। মাথা-ভরতি পাকা চুল। দাড়িফাড়ি কামায়নি, আজকাল এই এক ফ্যাশন হয়েছে।
ওগো এদিকে শুনে যাও একবার— গলা ছেড়ে ডাকলেন ব্যাঙাদা। ওদিক থেকে একটি পুতুল-পুতুল সুন্দরী মহিলা উঠে এলেন।
আলাপ করো। এই হল যশোধরা ব্যানার্জি— একসময় দারুণ নাচত। আমাদের হার্টথ্রব ছিল। আর এই ওর বোন মধুক্ষরা— মধুর মতোই গলা ছিল, আহা। সিরিয়াস হলে আজ অনেকের ভাত মারতে পারত। যশো দেখ— এই হল তোদের শান্টুবউদি। ফিগার দেখছিস তো! শ্যামা সাজে। চিত্তপ্রসাদের ট্রুপে।
আহ্ তোমার যত্ত— শান্টুবউদি বলে উঠলেন।
ভালই হল। তোরাও দার্জিলিং আমরাও।
হেঁ হেঁ— যশোর মুখে এর চেয়ে বেশি কথা জোগাল না।
চলে যেতে নিচু গলায় মধু বলল— তুমি যাও দুর্জয়লিঙ্গে ব্যাঙা যায় সঙ্গে।
তুই চুপ কর। ব্যাঙার বেঙিটিকে দেখলি!
হুঁ, চালু মাল। কত তফাত হবে বল তো বয়সের?
বছর কুড়ি বলে মনে হচ্ছে, তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। চুলটা পরচুলো।
সে কী রে? কী করে বুঝলি?
নাট্যশালা, বুঝলি না! দ্যাখ না কত রকম চুলের কায়দা বেরোবে। অন্তত তিন-চারখানা উইগ নিয়ে এসেছে।
তার মানে কি ন্যাড়া? না টাক?
ভগবান জানেন, ক্রমশ প্রকাশ্য।
যাই বল দিদি। তুই একটু বেশি ক্রিটিক্যাল, রাইভ্যাল তো! হিংসে হয়েছে!
হুঁঃ হিংসে। হিংসে! হিংসে করার আর লোক পেল না যশো।
জলপাইগুড়িতে নামতে দেখা গেল স-শাশুড়ি পঙ্কজের বাবা বিনোদ ও মা সন্তোষ হাজির। এঁদের যশোরা চিনত না। কিন্তু ওঁরা কোন ছবিতে এঁদের দেখেছিলেন। তাতেই চিনে গেলেন। কী ছবি? না ‘রোজগেরে গিন্নি’। তাতে যশো, মধু, তাদের ছেলেমেয়ে (প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও) উপস্থিত ছিল। খুবই উৎসাহ নিয়ে যশোর নাচ দেখেছিলেন ওঁরা। যশোর নাচ, মধুর গান।
সঙ্ঘমিত্রাও নামলেন স-স্বামী।
তুমিও?
অসুবিধে হল? সঙ্ঘামিত্রা হেসে জিজ্ঞেস করলেন।
ছেলে?
বাড়িতে আছে। জ্যাঠাইমার তত্ত্বাবধানে। আমরা কেটে পড়েছি।
পরে যশো তার বোনকে বলে— সঙ্ঘদির হাসিটা কীরকম গা-জ্বালানি দেখলি?
মধু আবারও বলে— আমি তো তেমন কিছু দেখলুম না। তুমি একটু বেশি ক্রিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছ দিদি।
যাক ভাল ওদের হোটেলে অন্তত কেউ ওঠেনি। কোনও চেনা মুখ না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দু’জনে দুটো চেয়ারে কাত হল।
যশো বলে— কী মজা হাঃ হাঃ হাঃ।
মধু বলে— শেষ পর্যন্ত ফিরি। যা হালকা লাগছে। যেন দু’মনি বোঝা চেপেছিল ঘাড়ে। অমন জানলে কে বিয়ে-থা করত?
যশো বলল— বাবার যা ছিল দু’বোনের হেসেখেলে চলে যেত, বল। আজ দার্জিলিং, কাল গোয়া…
মধু বলল— পরশু সিঙ্গাপুর তরশু ইউরোপ। সত্যি এই সংসারের ঝক্কি ঝামেলা…
এই রে! হঠাৎ যশো তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।
কী হল?
চাবিটা আলমারিতে ঝুলিয়ে এসেছি।
তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। লোকজন আসার আগে পাবলো দেখে ফেলবে এখন।
ওইখানেই তো ভয়! ও ছেলে যে কী হাপিস করবে আর কী করবে না— বন্ধুবান্ধব মিলে…
মধু বলল— ইসস্ আমিও তো একটা মহা ভুল করে ফেলেছি!
কী?
মিহিরের ব্লাড সুগার এসেছে। খাওয়া-দাওয়ার রেসট্রিকশন করতে বলেছে। আমি তো শম্পিকে কিছু বলে আসিনি! এমনকী মিহির নিজেও জানে না।
তা হলে তো ফোন করতে হয়।
দু’জনেই ফোনে অনেকক্ষণ টেপাটেপি করেও কোনও কল পেল না। সমানে বলে যাচ্ছে— সুইচড্ অফ্, সুইচড্ অফ্।
আসলে কী জানিস তো। ওই যে বলল রিমোট কন্ট্রোল চলবে না, তাই বোধহয় বন্ধ করে রেখেছে।
তাই বলে একটা পৌঁছোনোর সংবাদ দেব সে প্রভিশন রাখবে না! তা ছাড়া মোবাইল অফ করে রাখলে ওদের চলবে? হাজার গন্ডা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গুলতানিটা হবে কী করে?
ল্যান্ডফোনও দেখা গেল পিঁ পিঁ করছে। রাত্তিরে অবশেষে ডক্টর সুবল মিত্রর বাড়ি ফোন গেল—
মিসেস সুবল ধরেছেন।— বউদি আমি যশোধরা বলছি, আমাদের বাড়ির কোনও ফোন কাজ করছে না। একটা মেসেজ দিয়ে দেবেন? কিছু না পাবলো বা শম্পি যাকে হোক। ওদের বাবাদের হলেও কোনও ক্ষতি নেই। জাস্ট বলে দেবেন, পাবলো যেন আলমারি বিষয়ে সাবধান হয় আর শম্পি যেন বাবাকে সুগার-ফ্রি ডায়েট দেয়।
এতক্ষণে ডাক্তার-গিন্নি কথা বললেন— কিন্তু মেসেজটা দেবে কে? গম্ভীর গলা।
কেন? মানে…
মানে আমাদের তো সন্তানাদি নেই। আমি নিজেও ব্যস্ত। মেট্রন হয়ে গেছি। ডিউটি নিয়ে জেরবার।
কেন? মানে ডাক্তারবাবু!
উনি তো দার্জিলিং-এ বেড়াতে গেছেন।
অ্যাঁ?
আপনি কোত্থেকে বলছেন?
যশো ততক্ষণে ফ্যাকাশে হয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। —সব্বোনাশ!
কী হল? মধুক্ষরা বলল।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। সুবলদা তোর পেছন পেছন এখানে ধাওয়া করেছে।
সুবলদা? এখানে? তাতে আশ্চর্যের কী আছে! আসতেই পারে।
বেছে বেছে এখানেই আসতে হবে! দিঘা ছিল, পুরী ছিল, মিরিক, কালিম্পং, কার্শিয়ং সবই তো ছিল। লাভা লোলেগাঁও যেতে পারত। সিকিম, ভুটান সব তো হাতের কাছে আয় আয় করে ডাকছে। আসলে তুই, মধু যেখানে সুবল ভ্রমর সেখানেই তো আসবে!
দ্যাখ দিদি, বাড়াবাড়ি করছিস। মধুক্ষরা ভারী বিরক্ত হয়ে বলে— দার্জিলিংটাই গরমে লোকের আগে মনে পড়ে। আমরাও যে কারণে এসেছি সুবলদাও…
না রে মধু, ভোলাটাকে টিকিট করতে দিয়েছিলুম। ও ব্যাটা বোধহয় সুবলদারও এজেন্ট। এজেন্ট মারফত জেনে গেছে। ওখানে তো বউ বাঘিনির মতো বসে আছে।
তো কী? কী করবে? কী করবেটা কী শুনি!— মধুক্ষরা একেবারে রণং দেহি মূর্তিতে ধেয়ে এল।
যশো তার মূর্তি দেখে আপস করতে বাধ্য হয়। ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। সুবলদা এমনি এমনি এসেছে। একেবারে এমনি এমনি। আমরা যেমন এমনি এমনি হরলিক্স খাই।
এরপর দুই বোন আরও কয়েক বারের চেষ্টায় ল্যান্ডফোনটা পেয়ে যায়। ধরেছেন মিহিরকিরণ।
কী হল! ল্যান্ডফোনটা তো খারাপ ছিল, এত তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেল?
কে বললে খারাপ হয়েছিল। রিসিভারটা ঠিক করে ক্রেডলে রাখেনি সব। এমন একেকখানি উদোমাদা ছেলেমেয়ে তৈরি করেছ! ভালভাবে পৌঁছেছ তো?
সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ফার্স্ট থিং তোমার জন্যে বড্ড চিন্তায় আছি! আমার জন্যে? মধু ডিয়ার, সে তো বিয়ের আগে আগে থাকতে। এখন… বাজে কথা বোলো না। আজ কী খেয়েছ?
তা ভালই ব্যবস্থা তোমার মেয়ের। ময়রার দোকান উঠিয়ে এনেছে। অফিস থেকে ফিরে মিষ্টিযোগ— রসগোল্লা, বালুসাই, ক্ষীরমোহন যা যা ভালবাসি।
অ্যাঁ?
তারপরে শোনো না। রাতে আজ এত গরমে প্রাণটা ভাতের জন্যে আইঢাই করছিল। বেশ করে ভাত দিয়ে চিংড়িমাছের মালাইকারি, শেষ পাতে রাবড়ি।
উ হু হু, চুপ করো চুপ করো।
কেন?
তোমার ব্লাড সুগার। বলা হয়নি। সে দিন ব্লাড টেস্ট হল না?
তাতে কী হল?
তাতে সুগার এসেছে। দুশোর কাছাকাছি। এক বেলা এক কাপের বেশি ভাত খাবে না। মিষ্টি নো। চায়ে স্যাকারিন। শম্পিকে দাও।
শম্পিকে দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে মধুক্ষরা টেলিফোনটি রেখে দিলেন।
প্ল্যাটফর্মহীন এক শূন্য মাঠে একটা নড়বড়ে প্যাসেঞ্জার ট্রেন এসে দাঁড়াল। ব্যাকপ্যাক নিয়ে নামল তিন মক্কেল। মধুবন তার দাদা ঋজুরুস্তম এবং জিনপরি বা শুধু পরি। পরিরও ব্যাকপ্যাক, মধুবন গুছিয়ে দিয়েছে— নতুন জামা, জাঙিয়া, প্যান্ট, টি-শার্ট, পুরনো সালোয়ার কামিজ, ধারের দিকে ছোট করা। মধুবন ক্রমশই আড়ে বেড়েছে, তার সালোয়ার কামিজগুলো নানান স্টেজে পরিত্যক্ত হয়েছে। সেই বিভিন্ন স্টেজের সালোয়ার কামিজ প্রায় নতুন। এই প্রায়-নতুন সালোয়ার কামিজের এবং শাড়ির একটি অতিকায় বান্ডিল ঝুলছে পরির হাত থেকে। আরও কী কী আছে এদের হাতেনাতে সে সব ক্রমশ প্রকাশ্য বলে মনে হয়।
কিন্তু আপাতত টাকপড়া এক এবড়ো খেবড়ো মাঠ। এক দিকে এক চিলতে স্টেশন ঘর-টিকিট কাউন্টার, একখানা টিনের বেঞ্চ, তার ওপরে ছায়া করে রেখেছে বিরাট এক শিরীষ গাছ। টিনের বেঞ্চিটি পক্ষীবিষ্ঠায় ভরতি। অদূরে একটি টিউবওয়েল। আশ্চর্যের বিষয় ওরা তিনজন ছাড়া আর কেউ এখানে নামল না। বিকেল প্রায় শেষ। ঘষা কাচের মতো আকাশ, যেন ঘষা কাচের দেয়াল। বোঝাই যাচ্ছে গ্রিন হাউস গ্যাসদের না বেরোতে দেবার মতলবে আকাশ এই ব্যবস্থা করেছে।
ঋজুরুস্তম পাঁচ এগারো লম্বা। রং ফরসা। মুখচোখ কেমন, তার চেয়ে আগে চোখে পড়ে তার ক্ষুরধার বুদ্ধি। চার দিকে চোখ। কোনও কিছু দেখলেই যেন সেটা তিরের মতো বিঁধে ফেলবে চোখ দিয়ে। তার পরনে খাকি রঙের ডেনিম, ছাপা কুর্তা গায়ে। চোখে গাঁধীচশমা, বাঁ হাতে মোটা রুপোলি ধাতুর ব্যান্ডসুদ্ধু গাবদা ঘড়ি। তার নাম ঋজু, মাথার চুলও ঋজু, অর্থাৎ খাড়া খাড়া। আজকাল চুল শজারুর কাঁটা করবার একটা ফ্যাশন এসেছে। তা কোনও লোশন, স্প্রে, কোনও কায়দা ছাড়াই ঋজুর চুল এমনই। বর্তমান ফ্যাশনের সঙ্গে মানিয়ে যাওয়ায় প্রথম দর্শনেই ঋজুরুস্তম খুব সমীহ পায়। অনেকে মনে করে ঋজু শিগগিরই মডেলিংয়ে নামবে। তার চলাফেরা, টুক করে লাফিয়ে খানা-খন্দ পার হওয়া, হেলান দিয়ে দাঁড়ানো দুটো পা ক্রস করে, অপাঙ্গে তাকানো, কখনও হেলেদুলে কখনও সোজা হেঁটে আসা— সবই মডেলোপম। তাকে পারতপক্ষে কিছুই শিখতে হবে না। নামটিও অনুকূল। শুধু পদবিটা বর্জন করলেই ঋজুরুস্তম একটা দারুণ শো ম্যান শো ম্যান নাম।
কিন্তু হায়!
এ জগতে হায় সে-ই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি। ঋজু আরও চায়। সে কেন আরও চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হল না, এর জন্যে সে মনে মনে তার বেঁটে বাবাকে দোষ দেয়। কেন তার গায়ের রং আর একটু কালো হল না। এর জন্যে সে সোজাসুজি তার মাকে দোষ দেয়। কেন তার আরও বুদ্ধি হল না, এর জন্যে সে কলঘরে তার চোদ্দোপুরুষকেই গালাগালি করে। সে খুব খু-উ-ব একজন বিশেষ মানুষ হতে চায়। এইচ এস-এর পর সে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বলে একটা বিষয় পড়তে ক্যানবেরা ইউনিভার্সিটিতে চলে যায়। সেখানে পি এইচ ডি করবার আহ্বান নিয়ে সে বিষয় বেছেছে ভারত/প ব। ফিরে এসেছে এবং কাজ করছে। কখন সে যে কোথায় থাকে, কোথায় থাকে না, বলা মুশকিল। তবে এবারে পরির সঙ্গে তার খুব ভাব হয়েছে এবং পরিদের ‘গেরাম’ যে তার গবেষণাপত্রের জন্য ‘স্বপ্নস্থান’ সেটা বুঝতে পেরে সে তুরন্ত এদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে।
মধুবন ৫′২″ এবং একটি গোল মাখনের ডেলা। তার ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস্ ৪২-৪২-৪৮। সে অনেক কষ্টে অধ্যবসায়ে একটু নেমেছিল। কিন্তু আই এস সি পরীক্ষা দিতে গিয়ে মায়ের আদরে একটু বেশি খেয়ে ফেলে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে। মধুবনের রং খুবই ফরসা। তাতে একটু হলুদ আভা আছে— তাইতে মাখনের ডেলার সঙ্গে তার তুলনাটা আরও যথাযথ মনে হয়। তার চুল বব-ছাঁট। মুখশ্রী খুব কাটাকাটা, সুন্দর কিন্তু সবই মাখনে ডোবানো। মধুবন একটা পাতলা কাপড়ের গোলাপি ঢোলা প্যান্ট বা পাতলুন আর সাদার ওপর গোলাপি ছাপা টপ পরেছে। তার পায়ে ড. শূলজ্-এর ডিজাইনের জুতো। পরি, যাকে এরা ভাইবোনে মাঝে মাঝেই জিনপরি বলে ডেকে থাকে সে একটি এ কাটের ম্যাগিয়া হাতা ফ্রক পরেছে। ৫′২″ লম্বা। ভীষণ রোগা ছিল। কিন্তু মাস তিনেক খাওয়া-দাওয়া করেই তার চেহারা ফিরে গেছে। সে যে নেহাত খুকিটি নয়, মধুবনের চেয়ে ছোট মোটেই নয়, সেটা বোঝা যাচ্ছে। তার চুল সে বিনুনি করে সযত্নে কাঁটা দিয়ে খোঁপা করে রেখেছে। রং ময়লা কিন্তু তাতে এখন নগুরে চাকচিক্য। মুখচোখগুলো ফুটে বেরিয়েছে। দেখা যাচ্ছে সে বেশ চটপটে চালাকচতুর চটকদার একটি কিশোরী যার বাস্তব অভিজ্ঞতা বাকি দু’জনের থেকে অনেক বেশি। জায়গাটা তার নিজের। কাজেই তার স্মার্টনেসও এখন বেশ বেড়ে গেছে।
শিরীষগাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মধুবন, গরম মতো কী তার মাথায় পড়ল।
এ মা দিদি গো। তোমার মাথায় যে কাগে হেগে দিল। গাছের তলায় দাঁড়াতে আছে?
মধুবন ভ্যাটকা মুখে উবু হয়ে বসে এবং পরি গাছের পাতা, তার নিজের রুমাল (তার অনেক রুমাল, বেশির ভাগই নিজের হাতে এমব্রয়ডারি করা) দিয়ে— টিউকলের জল ব্যবহার করে মধুবনের মাথা পরিষ্কার করে দেয়।
তুই আবার হ-য়ে একার গ-এ একার বললি? মধুবন বিরক্ত মুখে বলল।
কাগের ইয়েকেও কি পটি বলতে হবে নাকি? হিহি।
ওহ্ তোকে নিয়ে আর পারা যায় না।
ইতিমধ্যে ঋজুরুস্তম বেশ খানিকটা তত্ত্বতালাশ করে এসেছে। টিকিট কাউন্টার থেকে জেনেছে, একটা ভ্যান গাড়ি খারাপ। আর একটা এক্ষুনি মাল নিয়ে গেছে। গো-গাড়ি আগে থেকে বলা না থাকলে পাওয়া যাবে না। অতএব আজ মুড়কিশোলা পৌঁছোতে হলে হন্টন। তিন-চার ক্রোশ হবে। টিকিটের ঘর থেকে বলেছে।
তিন ক্রোশ মানে তিন হাজার হাত গুনে নিয়ে রুস্তম হাঁটা দিল। তার সামনে-পেছনে পরি আর মধুবন। হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে…। হাঁটছে তো হাঁটছেই।
মধুবন বলল একেই কি বলে তেপান্তরের মাঠ?
কেউ জবাব দিল না। সবাইকারই ভেতরটা গরম হয়ে উঠেছে। মাঠের মধ্যে যদি ঘাস থাকত, গাছপালা থাকত তা হলে হাঁটার একটা মানে হত। কিন্তু এ-মাঠে ঘাসটাস নেই। গাছ আছে ছোট বড় বেশ দূর দূর। কিছুক্ষণ পর মধুবন বলল একেই বোধহয় ডেজার্ট বলে। মরুভূমি।
কেউ জবাব দিল না। পরি আগে আগে হাঁটছে। এই দিক-দিশাহীন মাঠে সে-ই একমাত্র ঠিকানা-অলা লোক, সে-ই সেথো, দিশারি। একটা আলাদা দায়িত্ববোধ এসেছে তার চলাফেরায়। একটা বেশ কর্তৃত্বের ভঙ্গি হাঁটাচলায়। শহুরে দাদা-দিদিকে সে নিজের গেরাম দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। সোজা কথা! সোজা দায়িত্ব?
কিছুক্ষণ পর মধুবন বলল— এরই নাম কি কান্তার? দুর্গমগিরি কান্তার মরু…। কেউ কোনও জবাব দিল না।
জবাব দিচ্ছিস না যে বড়? এবার সে রেগে গেছে।
কিছু বললি?— রুস্তম বলল।
ভালই শুনতে পাচ্ছিস।
তুই আগে ঠিক কর তেপান্তর না মরুভূমি না কান্তার। অতগুলো জবাব একসঙ্গে দেওয়া যায়? যাই হোক তুই যে কথা বলার অবস্থায় আছিস এই-ই যথেষ্ট। ক্রোশ বলতে এরা কী বোঝায় সেটা আমায় জানতে হবে।
সামনে থেকে পরি মুখ ফিরিয়ে বলল— পা চালিয়ে দাদা-দিদি, সন্ধে হয়ে গেলে মহা মুশকিল হবে— এখানে তো আর রাস্তায় আলো নেই।
আমার কাছে পাঁচ সেলের টর্চ আছে— সংক্ষেপে বলল রুস্তম। এবং বলা নেই কওয়া নেই মধুবন হঠাৎ নদগদ করতে করতে ছুটতে লাগল।
এ কী রে বাবা, মাথা খারাপ হয়ে গেল, নাকি? রুস্তম আপন মনেই বলে।
পরি বলল— সন্ধে নামার কথায় দিদি ঘাবড়ে গেছে। কিন্তু একটু ছোটাই বোধহয় এখন ভাল।
হঠাৎ ঘষা কাচের মতো আকাশটা ঘষা বেগুনি হয়ে গেল এবং অদূরে সূর্যটি টুপ করে ডুবে গেল। শুকনো মাঠে এখনও এ-দিক ও-দিক আলো ছড়িয়ে রয়েছে। তার প্রকৃতি অদ্ভুত, ভৌতিক।
পরি বলল— একে আমরা বলি সুযযি-ডোবা-আলো। পা চালিয়ে দাদা।
রুস্তমকে টর্চ বার করতে হল। মধুবনও একটা টর্চ বার করল। একজন রাস্তার দিকে আলো ফেলছে আর একজন চোখের সোজা। কিন্তু অন্ধকারকে কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা গেল না। হুড়ুম করে লাফিয়ে পড়ল মাঠভরতি অন্ধকার। এমনই নিকষ যেন নিরেট দেয়াল। একমাত্র ভরসা আকাশে একটি-দুটি তারা ফুটিফুটি করছে।
উই যে গেরাম।— মধুবন তিন বার ঠোক্কর খাবার পর পরির গলায় উল্লাস শোনা গেল।
অনেক দূরে টিমটিম করে কিছু চলন্ত আলো। শুধু আলোই, জোনাকির মতো। সে আলোয় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চার পাশে কী আছে, কারা আলোকধারী। কিছুই না।
রুস্তম বলল— এদের ফর্ম আছে তো রে!
মধুবন বলল— খবরদার ভয় দেখাবি না দাদা।
মাঠের মধ্যে দিয়ে পরি এবার ছুটতে লাগল— ও বাবা! ও মা! আমি পরি এইচি গো! আলো দেখাও শিগগিরই।
মুখের দু’পাশে হাত জড়ো করে পরি চেঁচাচ্ছে, কিন্তু তেপান্তরের মাঠ সর্বস্ব গিলে নিচ্ছে। অন্তত অন্য দু’জনের তাই মনে হল।
মধুবন এবার বসে পড়ল— আমি আর পারছি না। কেউ আলো নিয়ে আসুক তবে উঠব।
পরি চেঁচিয়েই যাচ্ছে। সে প্রস্তাব দিয়েছিল এগিয়ে গিয়ে লোক ডেকে আনবে। কিন্তু মধুবন তাকে যেতে দেয়নি— চালাকি পেয়েছিস না? তারপর নিজের লোকেদের কাছে যাবি আর আমাদের কথা বেমালুম ভুলে যাবি। ও সব চলবে না। কবে তোকে কখন বকাঝকা করেছি এমনি করে তার শোধ নিচ্ছিস? গদ্দার কোথাকার!
পরি আর দ্বিতীয়বার ও প্রস্তাব করেনি। তবে দু’-দুটো টর্চ জ্বেলে নিবিয়ে জ্বেলে নিবিয়ে ওরা বারবার জানান দিয়েছে যে, এখানে মনুষ্য আছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে গোটা দুই কঙ্কালসার লোক অন্ধকারের মধ্যে আরও এক পোঁচ অন্ধকারের কাঠি হয়ে এগিয়ে এল। রুস্তম বলল— আনন্দমঠ।
কে?
আমি গো! পরি! সঙ্গে আমার দাদা দিদি। যেনাদের বাড়ি আমি কাজ করি।
আবার দাদা দিদি! একজন লোক ব্যাজার হয়ে বলল।
অন্য জন বলল— আপনি পায় না খেতে শংকরাকে ডাকে।
রুস্তম বলল— যা ব্বাবা!
পরি বলল— কী বাজে কথা বলছ! দাদা দিদির বাড়ি ফ্রিজ-ভরতি খাবার। ওরা কি তোমাদের এখানে খেতে এয়েচে নাকি! সনাতন কাকা, আমার মান রেকে কথা বোলো। এখন আমি রোজগেরে মনিষ্যি, যে সে নেই আর।
হাতমুখ নেড়ে নেড়ে পরি ইত্যাকারে সব বলবার পর লোক দুটি বলল— তা আসেন।
মধুবন গোমড়া মুখে বলল— রাতটা কোনওমতে কাটিয়ে কালই আমরা ফিরে যাব দাদা।
সে দেখা যাবে— দাদার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
গেরামে যখন ওরা পা দিল যে যেখানে আছে সব একধার থেকে এসে দাঁড়াল। অন্ধকারে সারে সারে কঙ্কাল।
পরির বাবা জনার্দন মাজি এগিয়ে এসে বলল— একটা পোস্টোকার্ড তো লিকে দিবি!
দিয়েচি তো! পাওনি!
কোতায়!
পরি বলল— দাঁড়াও আমি ব্যবস্থা করছি। আগে একটু জল দাও ওদের। কতটা পথ হেঁটে এসেচে জানো তো!
রুস্তমের ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের মগ বেরিয়ে এল। সে বলল— টিউবওয়েল কোথায়? আমি ভরে নিচ্ছি।
টিউকল ঢনঢন করচে— জনার্দন জবাব দিল— কুয়োর ঠেঙে জল দিচ্চি— আসেন।
এদিকে পাবলোদের বাড়িতে জোর জলসা জমেছে। উলটোনা হাঁড়ি বাজাচ্ছে পঙ্কজ ধুধুরিয়া। স্প্যানিশ গিটার হাতে ট্যাং ট্যাং আওয়াজ তুলে গাইছে পাবলো।
গরমেতে হাঁসফাস করবি?
না জলে ডুবে মরবি?
তার চেয়ে শীতে জমে শিলালিপি-ই-ই
নর্থ পোল গলে আসা হিজিবিজি হিবিজিপি-ই
সুনামির জল রোজ বাড়ছে
কোল থেকে কালো জমি কাড়ছে
তার চেয়ে এই বেলা জমি-জমা নদী-টদি নালা-টালা ছেলেপুলে
বেচে-বুচে টাকাকড়ি বুঝে নিয়ে চলো কাকা
আমেরিকা আমেরিকা আমেরিকা
হাঁড়ি বাজাতে বাজাতে সমঝদারি মাথা নাড়ছে পঙ্কজ। মাঝে মাঝে পাবলো হাঁক দিচ্ছে— শম্পি-ই কিছুমিছু এনে দে না বিন্দাস। এটা গানেরই অঙ্গ না শম্পিকে অনুরোধ বা অর্ডার বলা যাচ্ছে না। শম্পি দু’বার এসে ফিরে গেল। দ্বিতীয় বার এসে বলল মাংসের পুরটা তৈরি হয়ে গেছে। একটু দাঁড়া। শিঙাড়াগুলো গড়ছে।
উঁহুঃ ডাকিনি তো কোনও ডাক ডাকিনীকে
একই ভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে পাবলো গেয়ে উঠল।
আমায় ডাকিনী বললি? খাওয়াচ্ছি মাংসের শিঙাড়া, শম্পি তেড়ে আসে।
গিটারটা রেখে পাবলো বলে— শোন, জীবনের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে যেখানে যা কিছু খেলা করে স-ব সম-স্ত গানের বিষয়। কাউকে ডাকছি কাউকে বকছি, চুকলি কাটা হচ্ছে, কেচ্ছা, সেলফ-পিটি, হেভি খাওয়া, জমল না খাওয়া— এভরিথিং পসিবল্ আন্ডার দা স্কাই।
শম্পি গালে হাত দিয়ে বসল। বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে পাবলো বোতলটা পঙ্কজকে এগিয়ে দিল। বলল মুখ লাগিয়ে খাবি না। ছোত ছেলে দুদু খায়।
পরের গান এইখান থেকেই শুরু হল।
ছোতো ছেলে পঙ্কজ দুদু খায়
এত্তুখানি বড় হয়ে মদু খায়।
আর এত্তু বড় হলে উকারটা বাদ দেবে— ব্যাটা ছেলে কে দিচ্ছো উঁকিঝুঁকি? দিয়ো নাকো
বলো খোকা ঢুকু খায়
ঢুকু ঢুকু ঢুলু ঢুলু চুল্লু খায় (খাওয়াচ্ছি)
এইরকম সময়ে সেই চ্যাঁ বেল বাজিয়ে আদি অকৃত্রিম কার্জন ঢুকে এল। এই ক’দিনে বেচারির চেহারায় একটা বড় রকম বদল হয়ে গেছে। সে খুব ম্লান হয়ে গেছে। বিষণ্ণ। চুপচাপ এসে একটা টুল টেনে নিয়ে বসল।
শম্পি রান্নাঘরের দিক থেকে হেঁকে বলল, কেউ এসে শিঙাড়ার ঝুড়িটা নিয়ে যা।
যাবি নাকি কার্জন?
যদি তোরা দয়া করিস!— কার্জন এলোমেলো হেঁটে চলে গেল।
কী ব্যাপার বল তো? কার্জনটা কি মদ খেয়েছে নাকি? পাবলো জিজ্ঞেস করল পঙ্কজকে।
পঙ্কজ কাঁধ নাচাল, বলল— দ্যাখ সব লোকের বাড়িতেই বড়রা নেই। আমার বাড়ি ফাঁকা, তোর বাড়ি ফাঁকা। কিন্তু আমরা কি এই স্বাধীনতা মিসইউজ করছি? আমরা সিগারেট বিড়ি খইনি পানপরাগ পর্যন্ত খাইনি। মদ কফ সিরাপ-গাঁজা— এসবের কথা ছেড়েই দে। মাঝখান থেকে কার্জনটা বয়ে গেল। স্যাড!
আর কোনও কারণ নেই বলছিস? পাবলো চোখ সরু করে বলল।
আবার কী কারণ থাকতে পারে?
আরে ইয়ার, ও পুয়োর ফেলো কা বান্ডুল ছোড় দো না ভাই। উসমে বহোত সারে লভ-লেটার্স হ্যায়।
তার মানে? আমার দিকে অমন গোয়েন্দা-গোয়েন্দা চোখে তাকাবার মানে? অ্যাকিউজ করছিস?
আরে ভাই দে দো না। উসকো নেই বাতাউঙ্গা। কী করছিস পঙ্কজ, ব্ল্যাকমেল-ফেল করে ব্যবসার ক্যাপিটাল জোগাড় করার তালে আছিস, না কী? মেয়েটা কে? মালদার নাকি?
পঙ্কজ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল— আই অবজেক্ট। আমার নিজের বন্ধু আমাকে সন্দেহ করছে! আবার যাচ্ছেতাই সব অ্যালিগেশন!
ইতিমধ্যে একটা ছোট ঝুড়িতে গরম গরম মাংসের শিঙাড়া নিয়ে কার্জন প্রবেশ করে। বেচারা বেচারা মুখ করে পঙ্কজের কাছে যায়, করুণ কণ্ঠে বলে— শিঙাড়া নে, বান্ডিল দে ভাই।
তারপর সে পাবলোর কাছে যায়, করুণতর কণ্ঠে বলে— বান্ডিল দে, শিঙাড়া নে ভাই।
আরে! তুই কি খেপে গেলি নাকি? আমাকে ডিটেকটিভ এমপ্লয় করে আমাকেই আসামি ঠাউরাচ্ছিস?
ভাঙা গলায় কার্জন বলল— সবচেয়ে মারাত্মক সেই গোয়েন্দা গল্পই যেখানে গোয়েন্দাই খুনি। আজও লেখা হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতে লেখা হবে।
শম্পি পেল্লাই একটা চায়ের পট নিয়ে এসে গেল। বাঁ হাতে প্লাস্টিকের কাপ। নে নে চটপট করে নে চা-টা। আমাকে উদ্ধার কর খেয়ে। ভবিষ্যতে কী লেখা হবে রে কার্জন?
পাবলো বলল— গোয়েন্দাই খুনি।
কে লিখবে? তুই না কার্জন?
ওরা কেউই লক্ষ করেনি কার্জন ক্রমাগত পা বদল করছে যেন ভীষণ নার্ভাস। সে বলল— শম্পি, কেন দিক করছিস ভাই। ইউ আর লাইক মাই সিস্টার। দিয়ে দে না।
অ্যাঁ? —শম্পির বিষম খাবার জোগাড় হয়। —আমি কী দেব?
তুই জানিস তুই কী দিবি। আমিও জানি। আমি শিয়োর এখন যে তুই-ই নিয়েছিস বান্ডিলটা। এমন কতকগুলো ইন্ডিকেশন দিলি!
আশ্চর্য তো! শম্পি ঝাঁঝিয়ে উঠল, সে দিন মাসির হঠাৎ অসুখ করল সেই দিন উন্নিকে নিয়ে আমাদের বাড়ি বান্ডিল খুঁজতে এসেছিল, তখন ওর সন্দেহ ছিল পাবলোকে। এখন আমাকে সন্দেহ করছে। মাথাফাতা দেখা রে কার্জন। কেমন অবসেসিভ টাইপ হয়ে যাচ্ছিস!
মাংসের শিঙাড়া ভেঙে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করতে করতে পাবলো বলল— শম্পি এর মধ্যে আসছে কোত্থেকে? তোর ডিডাকশনে মেলাই ভুল। বান্ডিল নিয়ে তুই গিয়েছিলি বল্লীর বাড়ি সেখানে বল্লী ছাড়া ছিলুম আমি আর পঙ্কজ। শম্পি তো ছিল না!
এবার ধূর্ত চোখে তাকাল কার্জন— ফ্রম পাবলো টু শম্পি— খুব কি ঘুরপথ হয়ে গেল! পাবলো, অত গাধা আমি নই।
কী করলে তই বিশ্বাস করবি আমরা নিইনি।
অন্য কোনও জায়গা থেকে ওটাকে প্রোডিউস করলে।
দ্যাখ হয়তো ডাস্টবিনে চলে গেছে।
শিউরে উঠল কার্জন।— পাবলো!!! হোয়াই ডাস্টবিন!
ফর দা সিম্পল রিজন যে ওটা নিশ্চয় তোর পকেট ফকেট থেকে পড়ে গিয়ে রাস্তায় লুটোচ্ছিল, ন্যাচারাল কোর্সে ডাস্টবিনে চলে গেছে। তুই লভ-লেটারগুলোর আশা ছেড়ে দে কার্জন। ভাল কথা বলছি শোন, মাথাটা ঠিক থাকলে লভ-লেটার অনেক পাবি। এই তো সবে কলির সন্ধে।
কার্জন একটা শিঙাড়া নিয়ে পাবলোর লম্বা নাক লক্ষ্য করে ছুড়ল। তারপর রেগেমেগে ঝড়ের বেগে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
এ তো মহা সিরিয়াস ব্যাপার হয়ে গেল দেখছি— পাবলো বলল— ছেলেটা তো একেবারে ডিসট্র্যাক্টেড হয়ে রয়েছে। তোর কী মনে হয় পঙ্কজ!
পঙ্কজ বলল— ফার্স্ট থিং জিনিসটা কী তা আমাদের বলছে না। ও কি নতুন কোনও বোমার ফর্মুলা বার করেছে? এত সিক্রেটিভ কেন?
পাবলো একটু ভাবল— তুই চিন্তাটাকে একটা নতুন খাতে বইয়ে দিলি। বোমার ফর্মুলা হয়তো নয়। কিন্তু এমন কিছু যা ও ডিসক্লোজ করতে চায় না। তার মানে পেটেন্ট নিতে চায়। পেটেন্ট নিয়ে শাঁই শাঁই করে বড়লোক হয়ে যাবে মণি ভৌমিকের মতো।
শম্পি হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল— কার্জনকে হঠাৎ তোরা সায়েন্টিস্ট বানাতে লাগলি কেন? ও তো কমার্সের ছাত্র!
পঙ্কজ বলল— ঠিক আছে। কমার্সেও তো কিছু না কিছু আছে বেসিক প্রবলেম, প্রিন্সিপল্। কম্পুটার হতে পারে। হ্যাকিং ট্যাকিং করার কিছু মেথড বার করেছে, কি নতুন কোনও সফটওয়্যার।
তো সেটা তো কম্পুটারেই থাকতে পারে! শম্পি বলল।
দুই বন্ধুই নখ খাচ্ছে প্রবল বেগে।
শম্পি বলল— নখ খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেললে শিঙাড়াগুলো ঢুকবে কোথায়? নে খেয়েদেয়ে ভাব।
আবহাওয়াটা ভিজে ভিজে। সমানে মেঘ ভেসে আসছে। জামাকাপড় ভিজিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। বেশির ভাগ লোকেই অবশ্য চামড়ার জ্যাকেট বা উইন্ডচিটার পরেছে। মধুক্ষরাও প্যান্টের ওপর জ্যাকেট পরেছে। খালি যশোরই হয়েছে মুশকিল। তবে তার গায়ে একটা মোটাসোটা টুইডের কোট। মাথায় স্কার্ফ, ভিজলেও জলটা ভেতরে ঢুকছে না এই যা রক্ষা। পাইন আর ফার গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে শনশন করে হাড় কাঁপানো হাওয়া দিচ্ছে। সূর্য ডুবলেই আর বাইরে থাকা যাচ্ছে না।
মীনাক্ষী আর তার স্বামীর সঙ্গে সঙ্ঘমিত্রাদের খুব পটে গেছে। চারজনে একসঙ্গে হ্যাপি ভ্যালি ঘুরে এলেন। যশোধরাদের বলা হয়েছিল মধুক্ষরা রাজিও হয়েছিল। কিন্তু যশো বললে— আমি স্রেফ ঠান্ডাটা উপভোগ করতে এসেছি। পাঁচটা লোকের মুখ দেখতে দেখতে পচে গেছে। গোটা চেনা কলকাতাটা দার্জিলিঙে উঠে এল গো! মল দিয়ে হাঁটতে বেরোলেই এখানে বিজয়মুকুলদা ওত পেতে, ওখানে ব্যাঙা-বেঙি হাত ধরাধরি করে বেড়াচ্ছে। সেখানে সন্তোষ তাঁর বিশাল শরীর নিয়ে পনিতে চড়েছেন। পনিটা হাঁপাচ্ছে। হিলকার্ট রোড না গড়িয়াহাট রোড বোঝা দায়।
তুই সামাজিকতা কর যত খুশি— বোনকে ঢালাও অনুমতি দিয়ে যশো নিরালা নিভৃত খোঁজে।
চুপচাপ রুম হিটারের কাছাকাছি বসে একটু করে চায়ে চুমুক আর আত্মসমীক্ষা। যশোর এমনটাই চলছে।
তুই যা না। তোকে কে বারণ করেছে। তুই আর কত আমার মুখ দেখবি! ছোট বোনকে সকাল হলেই ঠেলে বার করে দেয় যশো।
নানান কথা মনে ওঠে। এই যে দড়িদড়া ছিঁড়ে নিজের উদ্যোগে পাহাড়ে চলে এল, কেন? গরমের জন্যে? সংসার করতে করতে অতিষ্ঠ লাগছিল বলে? একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল জীবনে? সব প্রশ্নের উত্তরই বেরোয় হ্যাঁ, খানিকটা, কিন্তু সবটা নয়। নিজের মনোবীক্ষণ করতে করতে অবশেষে যশো আবিষ্কার করল তার বৈরাগ্য এসেছে। এই যে জীবনে পাওয়া আর না পাওয়ার মধ্যে অহর্নিশ দ্বন্দ্ব চলছিল সেই লড়াইয়ে সে ক্লান্ত। সুহৃৎবরণ খুবই ভাল স্বামী। কিন্তু কেমন যেন আনমনা। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বেশ অভিনিবেশ সহকারে যশোর সঙ্গে প্রেম বা দাম্পত্য তিনি করেননি। কিছু বলবার নেই। কিন্তু একটা অভাববোধ থেকে গেছে যশোর লভ-লাইফে। বড্ড ইচ্ছে ছিল প্রেমের বিয়ে করে। মধু তো তার উমেদারদের মধ্যে থেকে মিহিরকিরণকে বেছে নেবার সুযোগ পেল। বাইরে থেকে দুই দম্পতিকে দেখলে অবশ্য কেউই বুঝবে না বড়রটি অ্যারেঞ্জড্ ম্যারেজ, ছোটরটি লভ-ম্যারেজ। দুটোই একই রকমের একঘেয়ে। আসল কথা যশোর রোম্যান্টিক মন। চির-রোম্যান্টিক। সেই রোম্যান্টিক মনটুকু বড্ড উপোসি থেকে গেছে।
লোকে যা চায় সেই টাকাপয়সার অভাব নেই। নিজেরই অঢেল। একটি ছেলে। ছোটতে ছেলেকে নিয়ে যশো অবশ্যই খুব মেতে ছিল। কিন্তু যত বড় হল— পাবলো দূর থেকে দূরে সরে গেল। সে বুঝতে পারে পাবলোর মনের মধ্যে আর মাতৃমূর্তি সদা-জাগরূক নেই। এখন থেকেই। তবে? কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ শাস্ত্রে কি সাধে বলেছে! এই আটচল্লিশ-ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সেই যশোর সব সাংসারিক কর্তব্য সারা হয়ে গেছে। এরপর বাবার মতো পাবলোও আপিস-কাছারি করবে, খুব ধুমধাম দেখনাই করে ছেলের বিয়ে দেবে নিশ্চয়ই সুহৃৎ-যশো। কিন্তু সবই যেন কেমন গতানুগতিক। জীবনে কি আর নতুন কিছু নেই? কোনও চমক? কোনও আচমকা আনন্দ?
ভাবতে ভাবতে যশোর নাক ডাকতে লাগল। এই গুণটা তার আছে। খুব চট করে সে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে ভাবনাচিন্তা করতে গেলেই দুম করে ঘুম এসে যায়। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে। কে যেন কানের কাছে বলল— কীসের ক্লান্তি মা। কীসের অবসাদ! ওঠো, জাগো, তোমার জন্যে নির্দিষ্ট কাজ আছে। জগৎ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
ঘুমের মধ্যেই যশো জড়িয়ে জড়িয়ে বলল— আমার জন্যে কারও অপেক্ষা নেই গুরুদেব। আমি একা, বাতিল। দিনগত পাপক্ষয় করছি।
ঝট করে ঘুমটা ভেঙে গেল। সেই ঘর। জানলার কাচ দিয়ে ঝকঝকে রুপোর মুকুটের মতো কাঞ্চনজঙ্ঘার আধখানা দেখা যাচ্ছে। বাকি অর্ধেক মেঘে ঢাকা। ঘরে কেউ নেই। সোফায় নেতিয়ে রয়েছে সে। সামনে নিচু টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম। ড্রেসিং টেবিলে ফুলদানে গোলাপি বেগুনি অর্কিড সাজানো, ঘরের দেয়ালে শেরপার ছবি। মাউন্ট এভারেস্টের ছবি। সে কি স্বপ্ন দেখল? কিছু তো দেখেওনি! খালি শুনেছে! নাঃ মাথাটা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ল যশো। বড্ড বেশি একা একা থাকা হয়ে যাচ্ছে। তাকে কি ভূতে পাচ্ছে নাকি! বেশ ভাল রোদ উঠেছে আজ। বাইরেটা এতক্ষণে তার কাছে ডাক পাঠাচ্ছে। ক্লজেট থেকে মোটা অ্যাঙ্গোরার কার্ডিগানটা গলিয়ে নিয়ে মাথায় স্কার্ফ, ঘরে চাবি লাগাল যশো। তারপর নীচে নেমে গেল। কাউন্টারে চাবি রাখতে গিয়ে দেখে সেখানে মেলাই লোক। সাহেব, মেম, বাঙালি, মাড়োয়ারি সব নিজেদের মধ্যে কথা বলছে এবং তার পরই দরজা দিয়ে ঢুকলেন গৈরিক পরনে এক সাধু। আহা কী রূপ! কালো ভ্রমরকৃষ্ণ দাড়িগোঁফ। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত। এই শীতে গেরুয়া আলখাল্লা আর গেরুয়া চাদর তার ওপরে। ব্যস। মাথায় কানাঢাকা বিরিঞ্চিবাবা টুপিটা পর্যন্ত নেই।
সবাই সসম্ভ্রমে জায়গা করে দিল। একটি মেমসাহেবের সঙ্গে তিনি তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরের দিকে চলে গেলেন। যাবার সময়ে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে যশোর চোখে চোখ রাখলেন। যশো স্থাণু হয়ে রইল। লাউঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এঁরা সব বসে নানা আলোচনা করছিলেন। বোধহয় ভ্রমণসূচি নিয়ে। যশো মন্ত্রমুগ্ধের মতো একজনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল— উনি কে?
উনি? ওঁকে চেনেন না? চিনবেন কী করে? প্রচার ভালবাসেন না। হৃষীকেশে থাকেন। আর মাঝে মাঝে বিদেশ যান। উনি অভীপ্সানন্দ মহারাজ।
আপনারা?
আমরা ভাগ্যবান। ওঁর মন্ত্রশিষ্য।
কেমন একটা ঘোরের মাথায় যশো লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে কাউন্টারে যায়।— মহারাজজি কওন রুম পে হ্যাঁয়।
দোসো সাত।
যশো রোদ ঝলমলে দার্জিলিং প্রকৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে স্বপ্নচালিতের মতো দোতলার সাত নম্বর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজায় সামান্য শব্দ। দরজা খুলে গেল। সামনে মেমসাহেব। বেশ বুড়ি তবে চটপটে। অদূরে অভীপ্সানন্দ একটি আরামচেয়ারে বসে স্ট্রেট যশোর দিকে তাকিয়ে আছেন। যশো হরিণশিশুর মতো এগিয়ে যায়। কার্পেটের ওপর বসে পড়ে। মহারাজ বলেন—মা, বড় ক্লান্ত না?
হ্যাঁ বাবা। বড্ড।
মধুক্ষরা মুখার্জি অভ্যাস মতো আগে ক্যাভেন্টার্স-এ ঢুকেছিলেন। সেখানে স্বভাবতই আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সবাইকে হাই হ্যালো করে মধুক্ষরা মাঝখানের একটি টেবিলে একলা বসে চা আর চকোলেট পেস্ট্রি অর্ডার করল।
তোর দিদি কি হারিয়ে গেল?— মীনাক্ষী রসিকতা করলেন।
সঙ্ঘমিত্রা বললেন— ঝগড়া হয়েছে দু’বোনে।
মিটিমিটি হেসে মধুক্ষরা চায়ে চুমুক দিল। দিয়েই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল! ডক্টর সুবল মিত্র ঢুকছেন। আড়চোখে দেখেছিল। প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে এখন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে মধুক্ষরা।
মিহিরকিরণের গলা মিহি ছিল। ছিল কেন এখনও আছে। কিন্তু সুবলদার গলায় বল নেই। কেমন উইক উইক। তা নয়তো বেশ স্লিম চেহারা, সুবলদা যোগশিক্ষা দিয়ে থাকেন, অর্থাৎ নিজেও করেন। নিয়মিত। চেহারায় সেই ব্যায়াম আর সংযমের ছাপ আছে। কত ছোট থেকে সুবুলদাদের সঙ্গে চেনাশোনা তাদের। আসা যাওয়া তেমন ছিল না। ওই দূর থেকে। তাই আপনি-আজ্ঞেটা আর ঘুচল না।
যাঃ, মধুক্ষরার সামনের খালি চেয়ারটাতেই সুবুলদা এসে বসলেন।
বসতে পারি?— বসেটসে বললেন।
আপনি বসুন। তবে আমি এখুনি উঠব।
ম্যাডাম কোথায়?
দিদি?— হোটেলে।
কেন? আবার শরীর খারাপ?
উঁহু, মন খারাপ।— বলেই মনে মনে জিব কাটলেন মধুক্ষরা। সুবুলদার চোখ হাসিতে চিকচিক করছে। বললেন,— আর তোমার?
আমার শরীর-মন বেশ তরতাজা ঝরঝরে আছে।
সেটাই তো তোমার চার্ম মধু। ডাক্তারেরা সবচেয়ে কী অপছন্দ করে বলো তো!
মধুক্ষরা অবলীলায় বলে দিলেন— পছন্দ করে নার্স। কিন্তু অপছন্দ কী করে তা তো জানি না!
হাঃ হাঃ হাঃ। বলতে পারলে না?— অসুখ, অসুখ, ডিজিজ। রোগ দেখলেই ডাক্তারদের রাগ হয়ে যায়, মেজাজ খিঁচড়ে যায়, মনে হয় সব ব্যাটাকে খুব কষে কান মুলে দিই।
রোগীকেও?
দ্যাট ডিপেন্ডস। রোগীর আশেপাশে যারা থাকে তাদেরও হতে পারে।
আপনি অনুপযুক্ত সুবুলদা। ডাক্তার হওয়াটা আপনার আদৌ উচিত হয়নি।
হয়নি-ই তো। কিন্তু তুমি তো জানো ক্ষরা আমাদের যুগে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। এবং কর্তা তখন দুটি ইচ্ছে করতেন। হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার। অঙ্কটায় তেমন সুবিধে করতে পারতুম না। এদিকে বায়ো-ক্লাসে অবলীলায় আরশোলা থেকে কেঁচো, কেঁচো থেকে ব্যাং কেটে যাচ্ছি। অতএব…
ইঁঃ! নিন, আপনি আরশোলা কেঁচোর কথা ভাবুন আমি চলি।
যাবে?— মিটিমিটি হেসে সুবুলদা বলল— যাও। তবে যাবে আর কোথায়?
মধু ট্রাউজার্স পরা স্মার্ট পা ফেলে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গটগট করে বেরিয়ে এল। বলে কিনা যাও, তবে যাবে আর কোথায়! সাহস তো কম নয়!
আজ আর হিলকার্ট রোড ধরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে না। আবহাওয়া ভাল বলে কাঁড়ি কাঁড়ি লোক জমেছে। সব বাঙালি। দেখলেই পিত্তি জ্বলে যায়। সোজা পার্কে উঠে গেল মধুক্ষরা। এখানেও ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খেলা করছে। তাদের বাবা-মা’রাও চার দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু মধু একটি নীরব নির্জন বেঞ্চ পেয়ে গেল।
সুবুলদা যে এরকম স্মার্ট কথাবার্তা বলতে পারে, এমন গটগট করে হাঁটে, এমন মিটিমিটি হাসতে পারে কস্মিনকালেও কেউ ভেবেছিল! দার্জিলিঙে এসে সুবুলদার মলাটখানাই পালটে গেছে। সাতসকালে সুবুলদা নিশ্চয়ই পান করে আসেনি। কোনও গন্ধও তো পায়নি মধু কথা বলবার সময়ে। আশ্চর্য, আশ্চর্য এবং আশ্চর্য!
কলকাতায় যে-লোক কথা বলতে গেলেই তো-তো করে, কাঁপা গলায় ওষুধের নাম বলে, কাঁপা হাতে প্রেসক্রিপশান লেখে, ঈষৎ কুঁজো হয়ে চলে, সোজাসুজি চোখের দিকে তাকায় না, দার্জিলিঙে সেই লোক এমনি? তাজ্জব কি বাত! এ সবই কি সুবুল বউদির সৌজন্যে! বউদি মেট্রন, নার্স মানুষ, রাশভারী হবে তাতে আর বিচিত্র কী! কিন্তু তাই বলে পুরো অন্য রকম হয়ে যাবে! কলকাতার সুবুল, দার্জিলিঙে সু-বল। আহা, সুবুলদা আমি খুব খু-উব পাকা মেয়ে ছিলুম। তোমার মনোভাব কি আর আমি টের পাইনি? কিন্তু মিনমিনে টাইপের মানুষ আমার কোনওদিন মনে ধরে না। কত ক্যান্ডিডেট এল গেল জীবনে। খুব ভাব সবার সঙ্গেই। কিন্তু— সিনেমা যাবি?— ধুত, রেস্তোরাঁয় যদি ঢোকো তো পরদা-ফরদার মধ্যে নয়, একেবারে হট্টমেলার মধ্যিখানে চাটুজ্জেবাড়ির রূপসি মেয়েকে নিয়ে বসবার সাহস হয় তো বসো বাবা। নইলে এসো। ছোঁকছোঁকেদের কোনওদিন পাত্তা দেয়নি মধুক্ষরা মুখার্জি। ছিনে জোঁকদেরও না। ঠগ বাছতে বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে গেল, কেউ মধুর মন পেল না। শেষ পর্যন্ত মন্দর ভাল মিহিরকিরণ মুখুজ্জে। সেন্স অব হিউমার, ব্রঞ্জের মতো রং, খয়েরি রঙের একমাথা চুল আর অফুরন্ত বাক্যি। বাক্যবাগীশ একেবারে। বাক্য দিয়েই বাবাকে মাকে বাগিয়ে নিল। মধুক্ষরা প্র্যাকটিক্যাল মানুষ, দেখলে বাছতে গেলে সর্বত্র খুঁত বেরোবে। তার চেয়ে হাসিখুশি যুবকটিতেই সম্মতি দেওয়া যাক।
সুবুলদাকে কোনওদিন ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি মধুক্ষরা। শুধু মিনমিনে ব্যক্তিত্বই না। সুবুলদারা ইয়ে মানে বড্ড মিডল মিডল ক্লাস। সুবুলদার বাবা লুঙ্গি পরেন বাড়িতে, চেক-চেক বিচ্ছিরি লুঙ্গি। সুবুলদার মা বাইরে বেরোলেই মাথায় একটু ঘোমটা, সিঁদুরের টিপ, শাঁখা লোহা তাবিজ নানানখানা। বাড়িটা অবশ্য নিজেদের। কিন্তু কী-ই বা বাড়ির ছিরি। যখন যে যেটুকু পেরেছে যোগ করে দিয়েছে— প্ল্যান না কিছু না। রাস্তার লেভেল থেকে নিচু একতলা। ঠ্যাঙা ঠ্যাঙা সিমেন্টের চৌকাঠ। ঘরে আলো-হাওয়া ঢোকে না। দোতলাটায় যদি বা ঢোকে সেটাকে বোকার মতো ভাড়া দিয়েছে। তার ওপর সুবুলদার তিন তিনটে বোন। এক দিদি, দুই বোন। দিদির বিয়েতে মাংস কম পড়ে গিয়েছিল। সে এক কেলো। বরযাত্রীরা বলে মাংস না খেয়ে আমরা নড়ছি না। লোকে বাজার গেল, মাংসের দোকানের ঝাঁপ খুলিয়ে কাকুতি মিনতি করে পাঁঠা কাটিয়ে আনলে, সেই পাঁঠা রান্না হল। ততক্ষণ বরযাত্রীরা এঁটো হাতে খোশগল্প করেই যাচ্ছে, যেন কিছুই হয়নি। কোনও ব্যাচ বসতে পাচ্ছে না। বেশির ভাগ লোক— দুচ্ছাতার নেমন্তন্ন বলে বাড়ি চলে গিয়েছিল। খালি যশো আর মধু কিছুতেই আসেনি। মাটন রান্না হলে ওই বরযাত্রীরা কতক্ষণে খাবে দেখতে বসে ছিল। মাংস মুখে দিতেই টাকরা পর্যন্ত জ্বলে গেল। উস আস হুস হাস করে বরযাত্রীরা সব লন্ডভন্ড করে আর কী! সুবুলদার বাবা হাতজোড় করে মাফ চান— আর ভাই তাড়াতাড়িতে একটু ঝাল বেশি পড়ে গেছে তো রসগোল্লা খান, পানতুয়া খান। বোকা বরযাত্রীগুলো তাইতে ভুলে গেল। আসল কথা সুবুলদার বাবা আর রান্নার ঠাকুর দু’জনে মিলে এই কীর্তিটা করেছিলেন। বরযাত্রীরা উঠে গেলে জ্যাঠামশাই নিজে এসে যশো-মধু এবং অন্যদের চুপিচুপি বলে গেলেন কিনা— বোসো বোসো আঝালা মাংস আছে। খেয়ে যাবে। সেই সময় সুবুলদাকে বলতে শুনেছিল— যেমন কুকুর তেমনি মুগুর।— ওদের দেখতে পায়নি সুবুলদা। সে তখন মেডিক্যাল থার্ড ইয়ারের ছাত্র। ভাল বেশ। আপন মনেই মিচকে মতন হাসতে হাসতে বলেছিল। এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে মধুর। তার একটু আশ্চর্য লেগেছিল। কেননা সুবুলদা নিরীহ মতো ছেলে কারুর সাতেপাঁচে থাকে না। তার এমন কথা! মিচকে হাসি!
এখন মধুক্ষরা বুঝতে পারছে, সুবুলদা ইচ্ছে করে নিজের অমন একটা ইমেজ বানিয়ে রেখেছিল। বোধহয় বাবা-মাকে ভড়কি দিতে। এখন বউদিকে ভড়কি দিচ্ছে।
তার দিদির কিন্তু এ বিষয়ে কতকগুলো স্বাভাবিক জ্ঞান আছে। সে বলে থাকে যে-লোক চোখে চোখ রেখে কথা বলে না, যারা হাত কচলায় আর যারা স্পন্ডিলাইটিস না থাকলেও কুঁজো হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে গন্ডগোল আছে। খবরদার তাদের বিশ্বাস করবি না। তারা দু’মুখো। জেকিল-হাইডের মধ্যে হাইড অ্যান্ড সিক চলছে।
এক হিসেবে তাকেও তো ভড়কিই দিয়েছে সুবুলদা। জানতে দেয়নি আসলে সে কত চালাক-চতুর, কত কৃতী। দেখেশুনে শাঁসালো কর্মীমেয়ে বিয়ে করেছে। শোনা যায় পৈতৃক বাড়ি ভেঙে এখন সুবুলদার জয়পুরী পিঙ্ক মার্বলের মেঝেঅলা চমৎকার দোতলা বাড়ি। তাতে নাকি জাকুজি আছে। লেকগার্ডেন্সের চেম্বারটিও খুব মনোরম করে সাজিয়েছে সুবুলদা। কখনও গিয়ে দেখে দেয়ালের ছবি সব যামিনী রায়, কখনও সব চিনে জাপানি, ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল। ওয়েটিং রুমটাতে যথেষ্ট গদিআঁটা সোফা, প্রচুর পত্রিকা, ওয়াটার কুলার, চমৎকার বাথরুম। জি-পি তো ইদানীং খুব কমে গেছে। সুবুলদা ইলেত-বিলেত যায়নি। এম ডি করে এখানেই জেনারেল প্র্যাকটিস করছে। কার্ডিওলজিতেও ডিগ্রি আছে। সুবুলদার একমাত্র ছেলে কানাডায় ডাক্তারি করছে। একমাত্র মেয়ে জাপানে ডাক্তারি করছে। ভাবা যায়? আর মধুর একমাত্র বর দিনরাত মক্কেলের সঙ্গে ঘ্যানর ঘ্যানর। চেম্বারটা একটা গুদাম বিশেষ। মধুর একমাত্র মেয়েও সেই পথেই যাবে বলছে। কোম্পানি ল’ পড়বে নাকি! দিগদিগন্তে কোথাও, কোনও কৃতিত্বর ছোঁয়া নেই।
তবে কি সে ভুল করল? অত কাঁটা বাছাবাছি করতে গিয়ে ইলিশ মাছটাই খাওয়া হল না! মধুর দীর্ঘশ্বাস পড়ল। কিন্তু সুবুলদা যে-ধরনের তুখোড় লোক আসলে বলে মনে হচ্ছে, সে ইচ্ছে করলে মধুকে হাসিল করতই। তার মানে ইচ্ছে করেনি। অথচ খুব ইচ্ছে এরকম ভাব দেখিয়েছে। সবটাই চালাকি! যাতে মধু তার দিকে না ঝোঁকে। দারুণ সাইকলজি বোঝে তো লোকটা!
বেশ রেগেমেগে মধুক্ষরা নেমে এল। খটখট গটগট করে এক চক্কর দিয়ে হোটেলে ফিরে এল। ঘরে গিয়ে দেখে চাবি। দিদি বেরিয়েছে। কাউন্টার থেকে চাবি নিয়ে সে ঘরে যায়। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। একটু ঘুমিয়েও নেয়। বেলা দুটোয় ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখে নো দিদি। সন্ধেবেলাও দিদি এল না। দিদি কি ভ্যানিশ হয়ে গেল? মুড়কিশোলা গ্রামে মোট একশো ঘর লোকও নেই। কিন্তু যে ক’ঘর আছে তারা ঝেঁটিয়ে এসেছে শহরের দাদা-দিদিদের দেখতে। পরি ক্রমাগত বলে যাচ্ছে— আহ, ভিড় জমাচ্ছ কেন? পালিয়ে তো আর যাচ্ছে না।
ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল দু’জনের। গায়ে, হাতে, পায়ে খুব করে মশার ওষুধ লাগিয়ে মশারিবিহীন শুয়েছিল। অন্যরা সব দাওয়ায় মশারি টাঙিয়ে শুয়েছে। ওদের একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছিল। হাতপাখা ছিল, কিন্তু বড্ড গরম। বরং বাইরে হুহু করে হাওয়া দিচ্ছে। ভোরে উঠে পড়ে আগে মধুবন।— দাদা, এই দাদা, এদের তো টয়লেট-ফেট আছে বলে মনে হচ্ছে না। ওঠ, আমাকে নিয়ে চল। ঋজুরুস্তম জেগেই ছিল, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ঠিক তো! সে তড়াক করে উঠে বসল। অন্তত পাঁচ মাইল যাওয়া পাঁচ মাইল আসা, তবে প্রাতঃকৃত্য হয়। ফিরে আসতে দেখল পরি আর পরির বাবা উদ্বিগ্ন মুখে খোঁজাখুঁজি করছে।
বেড়াতে গিয়েছিলুম— মধুবন বলল।
পরি বলল— সাপ-খোপ বিছেটিছে কত কী আছে, কে তোমাদের বলেছিল অত দূরে যেতে! মনোহরদাদুর বাড়ি কলঘর আচে সেখানেই ব্যবস্থা করেছিলুম।
বাধিত করেছ— রুস্তম বলল।
এবার রুস্তমের ব্যাগ থেকে চা বেরোল। হাঁড়িতে জল বসল, খড়কুটোর আঁচে। রুস্তম চটপট গোটা দুই পাউরুটি বার করে ফেলল। বাড়ির সবাই ভিড় করে এসেছে। পরির চার ভাইবোন, মা বাবা ঠাকুমা। কৌটো থেকে মাখন বেরোল। মোটা মোটা রুটিতে মাখন মাখিয়ে সবাইকে বিতরণ করল রুস্তম।
ঠাকুমা মন্তব্য করল— নাঃ ছাওয়ালটা ভাল।
পরির বোন বাতাসি ওরা এসে থেকেই মধুবনকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে। সে মধুবনের গা ঘেঁষে বসে। খুব সন্তর্পণে আঙুল দিয়ে মধুবনের হাত-ফাত টিপেটুপে দেখে। এখন সে মন্তব্য করল— এই দিদিটা মাখন-পাউরুটি দিয়েই তৈরি। দেখলেই ইচ্ছে করে খেয়ে নি।
রুস্তম এবার তার নোটবই-টই নিয়ে ডেটা কালেকশনে বেরিয়ে পড়ল। পরির ঝুলি থেকে এইবার সমবেত পরিবারের সামনে বার হতে লাগল— মায়ের জন্যে চারখানা শাড়ি। দুই বোনের জন্যে চারটে সালোয়ার কামিজ। ভাইয়ের জন্যে শার্ট প্যান্ট দু’সেট। বাবার জন্যে শার্ট প্যান্ট— দেখে বাবা মহা লজ্জা পেয়ে বলল— এই বুড়া বয়সে ছোকরা সাজতে পারবনি। ঠাকুমার জন্যে তিনখানা ধুতি বেরোল। সব নতুন। সবই মধুবনের বাবার। ঠাকুমা একগাল হেসে বললে— জেবনের বাকি তিন বছর চলে যাবে। তা আমার জন্যে সালোয়ারকামিজ আনতে পারতিস। বলে বুড়ি ফিক ফিক করে হেসে উঠল।
কত বয়স আপনার ঠাকুমা?—
সে কি আর খ্যাল আছে রে ভাই। গাছ পাতর নাই। তা ধরো দু’কুড়ি দশ হবে। আমার পনেরো বছরে পরির বাপ হয়েছিল, পরির বাপের বিশ বছরে পরি হল। তা সে এখন ষোলো বছুরে তো হয়ে উঠল। তবে হিসেব করো।
মধুবন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই মহিলার একান্ন বছর বয়স? তার বাবার চেয়েও দু’বছরের ছোট তার মানে? চুল যেটুকুই আছে কালচেই আছে। কিন্তু শুধু মুখ নয় সমস্ত শরীরটাই তাল তোবড়ানো। দাঁত পড়ে গেছে বেশ কিছু। চোখ কোটরে, ভুরু নেই। গায়ের চামড়া খসখসে মোটা অদ্ভুত। কিছুতেই এঁকে তার বাবার সঙ্গে মেলানো যায় না। বাবাকে এঁর ছেলে মনে হবে।
একটু পরেই হঠাৎ দেখা গেল আশেপাশের কুঁড়ে থেকে ছোট ছেলেমেয়ে এবং মহিলারা ছুটে আসছে।
এখানে নাকি কাপড় দিচ্ছে?
তখনও এদের কোলেপিঠে শাড়ি-ধুতি ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। এক মহিলা ছোঁ মেরে একটা শাড়ি তুলে নিল। আরেকটি ছোট মেয়ে বাতাসির সঙ্গে সালোয়ারকামিজ নিতে গিয়ে হাতাহাতি লাগিয়ে দিল।
কোমরে হাত দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ওরা বলতে লাগল— হ্যাঁ, সব একজনা নেবে, না? আমরা আর মানুষ না। আমাদের সব ন্যাংটো পোঁদে থাকলেই চলবে। বাঁদর কিনা।
উঃ, মধুবন কানে আঙুল দিল।
কতা ভাল লেগতেছে না, না গো শহুরে বিবি! গেঁয়ো ঘেয়ো মনিষ্যি আমরা।— দু’-তিনজন মহিলা তেড়ে এল।
পরির মা উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল— খবরদার বলছি যমুনামাসি, পরির মুনিব আমাদের অতিথি। দু’দিনের জন্যে এয়েছে। যা-তা বলবি না। বলি তোদের জন্যে কাপড় আনবে কেন? তোরা খেতে দিবি? দু’বেলার খোরাকি এখন কোত্থেকে জোগাড় করি তার নেই ঠিক। উনি এলেন কাপড় মাঙতে।
মহিলাটি একটু মিইয়ে যায়। যুক্তি বোঝে। বলল— তা বটে, তা বটে। তো অ শহরের মেয়ে আমাদের জন্যে কিচু হবে না?
মধুবন ক্ষীণ গলায় বলল— এতজনের কাপড় কি বয়ে আনা সম্ভব? আপনিই বলুন। আমরা বাড়ি ফিরে দফায় দফায় কিছু পাঠিয়ে দেবোখন।
আর দিয়েচ মা!
সত্যি বলছি। কেউ আমাদের সঙ্গে গেলে তার হাতে কিছু পাঠিয়ে দিতে পারি। কিন্তু পুরো গ্রামের কাপড় জোগানো কি আমার পক্ষে সম্ভব, আপনারাই বলুন।
খুব বুঝদারের মতো ভিড়টি মাথা নাড়ল। তখন মধুবন তার ঝোলা-ঝুলি হাতড়ে মুঠো মুঠো চকলেট আর চিকলেট বার করে আনল। বলল, বাচ্চাদের জন্যে লজেন্স এনেছি।
হরির নুট দাও গো মা। হরিবোল বলে ছুড়ে দাও। কুড়িয়ে কাড়িয়ে সব নেবেখনি।
না, তা হবে না। আমি হাতে হাতে দেব। বাচ্চারা কিউ করো। লাইন করো। পরি, ওদের লাইন করে দাঁড় করা।— দেখতে দেখতে গ্রামের যত ছোট ছেলেপিলে কোত্থেকে খবর পেয়ে হরির নুটের জন্যে ভিড় করে এল। ভাগ্য ভাল। প্রত্যেকে কিছু না কিছু পেল।
দুপুর একটা নাগাদ রুস্তম ফিরল। এদিকে রান্নাও হয়ে গেছে গরম গরম ফ্যানাভাত কলমি শাক সেদ্ধ আর তেঁতুলের টক।
ঠাকুমা বললেন— কেমন রান্না হয়েচে গো? ও শহরের ছেলে-মেয়ে?
ভাল, খুব ভাল— রুস্তম হাত চাটতে চাটতে বলল। মধুবন করুণ কণ্ঠে বলল— ভাল।
বাকি দুপুর রুস্তম বাড়ির বাইরে গাছের ছায়ায় বসে কাজ করতে লাগল।
পুরুষ—১০০, এর মধ্যে ৩০ জন বৃদ্ধ।
নারী— ৯৭।
শিশু— ২০১।
জীবিকা— চাষবাস, খেতমজুরি, দু’ঘর ছুতোর আছে।
ধর্ম— ১৩ ঘর মুসলমান।
মাথাপিছু গড় আয়— সাড়ে সতেরো পয়সা।
প্রধান খাদ্য— কলমি ইত্যাদি শাক, সবজি নিজেদের জমিতে যেটুকু ফলে। ভাত রোজ নয়। গম জাতীয় শস্যের চল নেই।
চাষ— ধান ও সবজি।
মধুবন লজেন্স দিয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের খুব প্রিয় হয়ে গেছে। সে দল বেঁধে পাড়া বেড়াতে লাগল। বিকেলবেলার দিকে খুব চু-কিতকিত খেলা হল। প্রচণ্ড খিদে পেয়ে গেছে। সে পরিকে বলল, তোদের বাড়িতে গোরু নেই?
চাষের বলদ আছে, গোরু নেই।
কারুরই নেই?
হ্যাঁ আছে কারও কারও।
দুধ দোয় না!
পরি বললে— তোমার খিদে লেগেছে না গো! যারা গরু পোষে দুধ তো সব বিককিরি করে দেয়। আচ্ছা চলো তো দেখি।
এদের গাঁয়ে সবগুলোই মাটির ঘর। খড়ের চাল। কারও কারও টিনের, অ্যাসবেস্টসের চালও আছে। মাটিটা বড্ড রুক্ষ।
রুক্ষ, কাঁকুরে। গাছগুলোও যেন কেমন গিঁট গিঁট, হাড় সার। সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রাম মোটেই নয়। সকালে সব খেত খাটতে বেরিয়ে গেছে। বিকেল ঘুরে গেলে ফিরছে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে পরি বলল— উইদিকে সব ধানখেত, বোরো হয় না, আমাদের হচ্ছে আউশ। যেটুক জমি আছে সব খেটেখুটে দোফসালি করেচে। শীতে কিছু ধান, কিছু সবজি হয়। গোরু-বাছুর পোষা খুব একটা পোষায় না। কেন বলো তো! খাবার নেই ওদের। মুড়িয়ে একবার ঘাস পাতা খেয়ে নিলে আবার গজাবে তবে খাবে। খড়-বিচালি সব আমরা বিককিরি করি। নিজেরা খেতে পাই না, গোরুকে কী দেব!
গ্রামে কোনও স্কুল নেই। কোনও ডাক্তার-বদ্যি নেই। বাড়ি এসে একধামা মুড়ি নিয়ে বসল সবাই। মুড়ি খেয়ে পেট ভরে জল খেয়ে নাও— পরি মধুবনকে নির্দেশ দেয়।
রাত্তিরবেলা আবার মুড়ি, রাঙালুসেদ্ধ, গাঁঠি কচু পোড়া।
মাঝরাত্তিরে ঘুমের মধ্যে মধুবন স্বপ্ন দেখল যশোমাসি তাকে বলছে— খা খা। কচুপোড়া খা।
দু’বেলা এখানে কেউ রান্না করে না।— অত জ্বালানি কোথায়? একবেলা যা হল হল। রাত্তিরে ওই মুড়ি চিঁড়ে খেয়ে থাকা।
গভীর রাত্তিরে রুস্তম চুপিচুপি বোনকে বিস্কুট দেয়, বলে— খেয়ে নে।
খাব? উচিত হবে?
কী করা যাবে! কাল এদের হাট বসে। একটু হাটে যাব, তুই যাবি? আর শোন, জিওলিন ছাড়া জল খাবি না।
হ্যাঁ। হাটে যাব। ওরা তো জিওলিন দেয় না।
ওরা অভ্যস্ত। ইমিউন। আধপেটা খেয়ে কীভাবে বেঁচে আছে আবার উদয়াস্ত খাটছে, ভাবতে পারিস?
ট্যাঙস ট্যাঙস করতে করতে রোদের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। মাইল পাঁচ তো হবেই।
মধুবন বলল— দাদা, জিলিপি ভাজছে। তেলেভাজা।
ধারেকাছে কোনও ডাক্তার হাসপাতাল নেই মধুবন, উলটোপালটা খেয়ে অসুখ করলে কে দেখবে?
তোর রিসার্চের কদ্দূর?
হচ্ছে, আরেকটু বাকি আছে। মৌজাটাই পুরো এইরকম, চাষবাস তেমন হয় না। ক্যাশ ক্রপ বলতে কিছু নেই। ইল্ড খুব সুবিধের নয়। একটা খাল আছে। বর্ষায় ছাড়া তেমন জল নেই। কুয়ো ইঁদারা আছে। কিন্তু টিউবওয়েল তেমন নেই। তোকে কি কলকাতায় রেখে আসব?
না, কেমন গোঁয়ারের মতো মধুবন বলল— তুই যদি পারিস তো আমিও পারব।
হাট থেকে টাটকা কুচো মাছ আর ডিম কিনল রুস্তম। মুশুর ডাল দশ কেজি। বেশ কিছু সবজি। সবই অবশ্য শুকনো শুকনো। আলু কিনল, তা-ও কুড়ি কেজি। দু’জনে ভাগাভাগি করে মালগুলো নিল। মুড়ি তেলেভাজা খাওয়া হল।
আহ্লাদে আটখানা ঠাকুমা। বললেন— ছাওয়ালটার মন ভাল। দেকেই আমি বুজেচি।
মাছ কিছু পাশের বাড়ি দেওয়া হল। ঠাকুমা বললেন— দ্যাকো মেয়ে আমি কেমন বাটি চচ্চড়ি রাঁধি। মাছ বেছেধুয়ে নুন হলুদ তেল প্যাঁজ দিয়ে চড়িয়ে দোব, দ্যাখ না দ্যাখ হয়ে যাবে।
অনেক দিন পর আলু, অনেক দিন পর মাছের আঁশ গন্ধ। রাত্তিরের জন্য পাতলা করে ডাল রান্না করে রাখা হচ্ছে। মুড়ির সঙ্গে খেয়ে রাত্তিরে পেটটা একটু ভরে।
রুস্তম তার টেপরেকর্ডার নিয়ে আরও দূরে দূরে যেতে শুরু করেছে। মধুবন বাচ্চাগুলোকে জড়ো করে পড়াচ্ছে। মহিলারাও এসে বসছে।
হঠাৎ একদিন ভারী বৃষ্টি নামল। সে কী তুমুল বৃষ্টি রে বাবা। চার দিক ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার আওয়াজে কান পাতা যায় না। যার যেখানে যা হাঁড়িকুড়ি বালতি কলসি আছে সব জল ভরে। বৃষ্টির জল একটু থামে বৃষ্টি আবার নামে। কারও দেয়ালই ধসে গেল। কারও চাল উড়ে গেল। চাল দিয়ে জল তো পড়ছেই। বাইরে আর শোয়া যাচ্ছে না। ঘরের মধ্যেই সব গুঁতোগুঁতি। তবু কী আনন্দ! কী আনন্দ!
শহর কলকাতায় তখনও হা বৃষ্টি যো বৃষ্টি। একেক দিন আকাশ মেঘলা হয়। আরও ভ্যাপসা গরম। তার ওপর থেকে থেকে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। নিয়ম মেনে নয়, যখন তখন। দুপুর দুটোয় চলে গেল। রাত্তির একটায় চলে গেল। পঙ্কজদের কমপ্লেক্সে লোকে এইসান এ সি চালিয়েছে যে ওভারলোড হয়ে একদিন গদাম গদাম করে একটার পর একটা মিটার বোমার মতো ফেটে আগুন ধরে গেল। বাপ রে সে কী আগুন! সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামা যাচ্ছে না। মিটারগুলো সিঁড়ির নীচেই। পঙ্কজ আজকাল নানান কিসিমের তালবাদ্য সিনথেসাইজার নিয়ে পড়েছে। একমনে বাজাচ্ছিল। ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে। এমন সময়ে গদাম গদাম গদাম। সঙ্গে সঙ্গে পঙ্কজ খাটের তলা খুঁজছে। যাচ্চলে এসব খাটের তো তলা নেই। সব বক্স। কী করে পঙ্কজ! টেবিলের তলায় ঢুকে পড়ল। ঠকঠক করে কাঁপছে। টেবিলের ওপর থেকে সব বইখাতা কলমদানি খাটের ওপর সরিয়ে সিনথেসাইজারখানা সেখানে রেখেছিল। তা ছাড়া দুটো ড্রাম। চেয়ারটাকে ধাক্কা মেরে সেই টেবিলেরই তলায় সেঁধিয়ে গেছে পঙ্কজ। কাঁপুনি একটু থামলে ভাবছে— মাওবাদী না কে এল ও না আলফা, না কি আলকায়দাই ঢুকে এল? পকেট থেকে সেলফোনটা বেরিয়ে আছে। পঙ্কজ এস এম এস পাঠাল পাবলোকে— পাবলো, হেল্প! পুলিশে খবর দে, আমাদের বাড়িতে জঙ্গি হামলা।
কী বলছিস!
আর কী বলছে! পঙ্কজ তখন আরেকটা হেল্প লাইন ধরেছে— কার্জন পুলিশ ডাক, আমাদের বাড়িতে আলকায়দা…
কার্জন ঠান্ডা গলায় বলল— বন্ধুলোকের সঙ্গে কায়দা করলে আলকায়দা আসবেই।
পঙ্কজ শুনল, কিন্তু তার মাথার মধ্যে কিছু ঢুকছে না। এমন সময়ে জানলা দিয়ে ঘন কালো ধোঁয়া ঢুকতে লাগল। চার দিকে আওয়াজ— আগুন আগুন।
বল্লীর ফোন বাজল— বল্লী, আগুনে পুড়ে মারা গেলাম। বাই।
উন্নির ফোন বাজল— উন্নি। তোদের পঙ্কজ শেষ। বাই।
পঙ্কজের বন্ধুদল যখন ওদের বাড়ি পৌঁছোল, তখন পুলিশ থিকথিক করছে। দমকলের পাইপের মুখ থেকে গ্যাস বেরোচ্ছে আগুন নিভে গেছে, কিন্তু তখনও ধোঁয়া প্রচুর।
কার্জন একজন কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করল— আলকায়দার জঙ্গিটাকে ধরতে পেরেছেন?
অ্যাঁ? কনস্টেবল চমকে উঠে লাঠি উঁচিয়ে কার্জনকে তাড়া করল।
পাবলো এগিয়ে গিয়ে বলল— নিরীহ গোবেচারা মানুষ দেখলেই আপনাদের লাঠি ওঠে, না? লন্ডনের টিউব স্টেশনে এইভাবেই একজন ইনোসেন্ট মানুষকে খুন করেছিলেন।
অ্যাঁ? আমি আবার কাকে খুন করলুম! আচ্ছা ফ্যাসাদের চাকরি হয়েছে! একজন বলছে আলকায়দা, একজন বলছে লন্ডনে গিয়ে খুন করে এসেছি। মহা পাগলা পাবলিক তো!
পঙ্কজদের ব্লকের সবাই ছাদে উঠে গিয়েছিল। ধোঁয়ায় তাই অতটা কাবু হয়নি। কিন্তু পঙ্কজ যেহেতু টেবিলের তলায় মুখে খবরের কাগজ চাপা দিয়ে গোঁয়ারের মতো বসে ছিল, সে প্রচুর ধোঁয়া খেয়েছে এবং অজ্ঞান মতো হয়ে গেছে।
পুলিশ দরজা ভাঙে, দমকল নির্বিচারে চতুর্দিকে জল ছিটিয়ে যায় এবং বন্ধুরা টেবিলের তলায় পঙ্কজকে আবিষ্কার করে। সে নার্সিংহোমে যায়। সুবুল ডাক্তারের নার্সিংহোম— পাবলোই ব্যবস্থা করে দিল। সেখানে দু’দিন ডাক্তার-নার্সদের আদর খেয়ে পঙ্কজ খোকা বাড়ি ফিরলেন। তবে নিজের বাড়িতে নয়। এক নম্বরের বন্ধু পাবলোর বাড়ি।
পঙ্কজের হল একটু মুশকিল কেননা পাবলোর বাবা সুহৃৎবাবু ও মিহিরকিরণ সুযোগ পেলেই তাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করেন। পেছনে পড়ে আছেন যাকে বলে। পঙ্কজ দিব্যি চায়ের সঙ্গে মুচমুচে পকোড়া খাচ্ছিল, সামনে পাবলো আর তার বোন শম্পি সকরুণ মমতাময় দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছে, তারাও পকোড়া খাচ্ছে, কিন্তু পঙ্কজের নার্সিং সম্পর্কে তারা খুব যত্নশীল।
সুহৃৎবাবু কাগজ পড়তে পড়তে বললেন— স্ট্রেঞ্জ, তুমি টেবিলের তলায় গেলে কেন? বাড়িতে ডাকাত-টাকাত পড়লে বেগতিক দেখে মানুষ লুকোয় বটে। আগুন ঢুকলে কি তোমাকে টেবিলের তলা বলে ছেড়ে দিত?
শম্পির সাততাড়াতাড়ি কথা বলা চাই— না মেসো, ও ভেবেছিল আলকায়দার আক্রমণ!
তখন মিহিরকিরণ বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলেন—অ্যাঁ, তুমি কি তলে তলে জঙ্গি-টঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখো! সেক্রেটারিয়েট গেল, অ্যাসেমব্লি গেল, হাইকোর্ট গেল, আলকায়দা একেবারে বেছে বেছে পঙ্কজ ধুধুরিয়ার বাড়ি, কী যেন কমপ্লেক্সটার নাম ‘সংকেত’। হ্যাঁ ‘সংকেত’ আক্রমণ করে বসবে? তোমার ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখতে হচ্ছে তো!
সুহৃৎবাবু সমানে মাথা নাড়ছেন— না হে, কাজটা তুমি ভাল করোনি। তোমার উচিত ছিল…
আচ্ছা বাবা, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আবার এত সময় নষ্ট করা কেন? পাবলো বাবাকে ধমকায়।
নেক্সট-টাইম যখন আগুন লাগবে একটা কম্বল গায়ে দিয়ে ছাদে উঠে যাবে। ওপেন জায়গায়। এবং পাবলোরও আগে দমকলকে ফোন করবে। জিরো ডায়াল করে লালবাজারেও করতে পারো ফোনটা। দে উইল টেক কেয়ার অব দমকল। আসল কথা পঙ্কজরাম, বুঝলে— তুমি একটু মানে বেশিই ভিতু। না না এটা ঠিক নয়। এতটা ভয়! তোমার বয়সের একটা ছেলে হবে ডাকাবুকো, নওজওয়ান তোমরা। তুমি টেবিলের তলা! নাঃ এটা ঠিক….
আচ্ছা বাবা, একে ও শেকি হয়ে রয়েছে, ওকে আবার নেক্সট টাইম আগুন লাগার ভয় দেখাচ্ছ?
মিহিরকিরণ বললেন— এ তো দেখছি ভয়ে জুজুবুড়ি টাইপ! নাঃ এই বয়সের ছেলে! তোরা ওর একটা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা কর। সত্যিকারের বিপদ হলে ও কী করবে?
দুই ভায়রাভাই মিলে নিজেরা এদের বয়সে কত ডাকাবুকো ছিলেন সেই সব গল্প মারতে লাগলেন। পঙ্কজ প্লেটে পকোড়াগুলো নাড়াচাড়াই করছে কাঁচুমাচু মুখে। লজ্জায় মুখে তুলতে পারছে না।
কী রে খা!— লজ্জা পাচ্ছিস কেন?
মিহিরকিরণ চলে যাচ্ছিলেন নিজের বীরত্বকাহিনি পেশ করার পর, থেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন— আবার লাজুকও? নাঃ পাবলো, তোদের জেনারেশনে লাজুক-টাজুক আমি এই ফার্স্ট দেখলুম। টেবিলের তলা— লাজুক—নাঃ।
এরপরে পঙ্কজ জেদ ধরে সে বাড়ি চলে যাবে। তাদের বাড়ির ইলেকট্রিক কানেকশন যে সি ই এস সি কেটে দিয়েছে, ধোঁয়ার কালিতে, সব কালো হয়ে আছে— সে সব সে মানতে চায় না।
দার্জিলিঙে খবর গেল। পঙ্কজের বাবা বিনোদ ধুধুরিয়া বললেন— ফায়ার? তো অব্ তো সব ঠিকঠাকই হ্যায়! ক্যা বোলা? পঙ্কজকো নার্সিংহোম ভেজনা পড়া? উও উল্লু একদম ফাস্টক্লাস ডরপোক হ্যায়।
পাবলো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল— সব বাবাই একই রকম সেলফিশ অ্যান্ড ইনসেনসিটিভ।
শম্পি বলল— এর মধ্যে সেলফিশনেসের কী দেখলি? তুই যা-ই বল, আমাদের বাড়িতে ওরকম কিছু হলে আমি অন্তত টেবিলের তলায় লুকোতুম না।
পঙ্কজ দু’কানে আঙুল দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল— ওফ টু মাচ, ইটস টু মাচ।
পাবলো বলল— রিয়্যালি শম্পি, আফটার অল আমরা হলুম শিল্পী। একটু ভয়, একটু লজ্জা, একটু হেজিটেশন, একটু প্যানিক আবার হঠাৎ অ্যাগ্রেশন… এরকম একটু ক্রমশই গ্রো করতে থাকবে আমাদের ভেতর। তুই খেয়াল কর। এই চেঞ্জটা উচ্চৈঃস্বরে বলে দিচ্ছে আমরা ঠিকঠাক পথেই এগোচ্ছি! চল পঙ্কজ, আমরা রিহার্স্যালে যাই। তুই লজ্জা ঘৃণা ভয় সব ঝেড়ে ফ্যাল। দু’জনে প্রেমসে লেগে পড়ি। পঙ্কজকে প্রায় বগলদাবা করে পাবলো লম্বা দিল।
শম্পি বলল— যা ব্বাবা! এটাও তো দেখছি খেপে গেল!
সুহৃৎবাবু কাগজটা তুলে নিয়ে যেতে এসেছিলেন, বললেন— আমি তো বরাবর জানি পাবুলটার মাথার স্ক্রু ঢিলে। তুই আজ জানলি!
বাজার-হাট, যানবাহন, দোকানপত্তর, হাজার হাজার মানুষজন, তাদের চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, হই-হল্লা এইসব দু’পা গেলেই, অথচ তোমার বাড়িটা নির্জন নিভৃত, শান্তির নীড়। সেখানে ওই আওয়াজ ওই হট্টমেলা পৌঁছোয় না। এরকম জায়গা কলকাতার দক্ষিণে একটাই আছে। সে হল ফার্ন রোড। এ দিকে গোলপার্ক ও দিকে গড়েহাটা। কোলে বালিগঞ্জ গার্ডেন্স ঝমঝম করছে— সব সময়ে সার দিয়ে সব খাবার দোকান, রাস্তায় ঠ্যালাগাড়িতে চাওমিন রোল। তার পাশেই ভাঁড়ের চা। ফুল চাও? ফুটপাত জুড়ে ফুলঅলারা বসে গেছে। বিয়ে কি শ্রাদ্ধ কি জন্মদিনের বাড়ি চাও? আছে, ভাড়া দেয়। টাঙাইল শাড়ির সেল— বিশুদ্ধ ফুলিয়া। পুরাতন নয়। টোয়েন্টি পার্সেন্ট রিডাকশন। ভেজিটেবল ডাইয়ে নিজ শিল্পীদ্বারা ছাপা শাড়ির এগজিবিশন— ওই বালিগঞ্জ গার্ডেনেই। সোজা চলে গেলে তুমি খিড়কি দিয়ে গড়িয়াহাট মার্কেটের মধ্যে ঢুকে যেতে পারছ। দু’পা হেঁটে রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরিতে সারাদুপুর পড়াশোনা করে হেলে দুলে বাড়ি ফিরে এলে। ট্যাক্সি চাও? চলতিই পেয়ে যাবে, মোড়ে গেলে তো ভাবনাই নেই। ফার্ন গাছের যেমন একটা একটা ডাঁটি থেকে সরু সরু পাতা বেরোয় সবটা মিলিয়ে তবে একটা পাতা, ফার্ন রোডও তেমন বালিগঞ্জ গার্ডেন্স থেকে সরু সরু করে বেরিয়েছে। তিন চারটি সরু-লম্বা গলি। দু’ধারে সব তালঢ্যাঙা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গলিতে ঢুকলে, আর শব্দবিজ্ঞানের কী আজব নিয়মে কে জানে টুপ করে ডুবে গেল হট্টরোল। এই গলিদের দ্বিতীয়টায় ঢুকে এগোও। এ-গলিটা বাঁ দিকে বেঁকে গেছে, এইখানে কর্নার প্লটে তিনতলা বাড়ি। একতলায় রেশন দোকান, ব্লাউজের দোকানের কারখানা। নিশিদিন সেখানে সেলাই চলছে, মেশিন তো চলছেই সেই সঙ্গে হেম সেলাই, বোতাম ঘর, বোতাম বসানো। চুপচাপ সব কাজ করে চলেছে। সামনের দিকে অবশ্য গ্যারাজ। একটি গাড়ি আর একটি মোটরবাইক রাখা আছে। দোতলায় দক্ষিণমুখো ঘর। জানলা দিয়ে রোদ আর হাওয়া লুটোপুটি খাচ্ছে। কোলে ছোট্ট বারান্দা। চেয়ারে বসে টেবিলে কিছু রেখে মেয়েটি নিবিষ্টচিত্তে পড়ছে। রং ময়লা। চকচকে চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা-আঁটা। চুলগুলো খুব কোঁকড়া, মাথার ওপর ঝুড়ির মতন হয়ে আছে। হাফ প্যান্ট আর ঝোল্লাঝাল্লা টপ পরে আছে। ইনি হলেন বল্লী ঠাকুর। হঠাৎ দেখলে কম বয়সের ছেলে বলেই মনে হবে। ইনি আরও অনেকের মতো দুই পি অর্থাৎ পাবলো ও পঙ্কজের হার্ট থ্রব।
কী পড়ছে বল্লী?— স্টেপল করা একতাড়া কাগজ পড়ছে। ‘একটি অজ্ঞাত পরিচয় মনুষ্যের আত্মজীবনী।’
“আমি একটি বাপে-তাড়ানো, মায়ে-খেদানো, ভাইয়ে ঠোকরানো, পিয়ার— পীড়িত, অশান্ত, সান্ত্বনাহীন, প্রান্তিক মানুষ বিশেষ। বাবা-মা বড্ড আদর করে নাম দিয়েছেন ক্যাবলা। তাকেই নানা ভাবে বেঁকিয়ে চুরিয়ে নানান ভ্যারাইটি (বৈচিত্র্য) বার করে নেয় লোকে যেমন— ক্যাবলরাম, ক্যাবলাকান্ত, কেবল, ক্যাবলাচরণ, ক্যাবলাপদ, এমনকী বললে বিশ্বাস যাবেন না ক্যাবলাকুসুম, কেবলসুন্দর পর্যন্ত। নামের অষ্টোত্তর শতনাম যতই হোক, ক্যাবলটি থাকেই।— উচ্চারণ করার সময়ে প্রত্যেকে নিজের নিজের মৌলিক প্রতিভাজাত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ উচ্চহাস্য মিশিয়ে নিজস্ব কায়দায় ক্যাবলটি উচ্চারণ করে থাকেন, যাতে করে আমি ক্যাবলা হই বা না হই, একেবারেই ক্যাবলা প্রতিপন্ন হই। “হোয়াটস ইন আ নেম” কোন মহামতি যেন বলেছিলেন— শেক্সপিয়র কিংবা মোক্ষমুলর— তিনি মানবচরিত্রের কিছুই জানতেন না। প্রকৃতপক্ষে নামই সব। কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা— অন্য কিছু মহাজন বলেছেন। ঠিক বলেছেন। একটি মানুষকে কী করে শুধু নাম দিয়ে ছোট, অধম, মূল্যহীন, এলেবেলে করে দেওয়া যায় আমার নামটি তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আবার উলটোটাও সত্যি। নামের দাপে গগন ফাটে, শুধু নাম দিয়ে একটি অকিঞ্চিৎকর মানুষকে অনেক অনেক ওপরে তুলে দেওয়া যায়। নাম একটি মই বিশেষ। উদাহরণ: আমার দাদার নাম—আলোকসুন্দর। আলোক বলেই তাকে ডাকা হয়ে থাকে। তার বেলা অন্য কোনও ডাকনাম নেই। সে ভ্যাবলা বা ন্যাপলা বলে যে আমার ক্যাবলা নাম তা কিন্তু নয়। খুব আদুরে মুহূর্তে আমাদের মাতৃদেবী তাকে ‘বাবু বাবু’ করে ডেকে থাকেন। যদিও বাবু ডাকবার বয়স তার চলে গেছে বলেই আমি মনে করি। মধু ঝরে ঝরে পড়ে তা থেকে। প্রসঙ্গত আলোকসুন্দরের সঙ্গে মিলিয়েই বোধহয় আমার পরম পূজনীয় গুরুজনরা আমাকে ক্যাবলাসুন্দর বলে ডেকে থাকেন মর্জি-মেজাজ অনুযায়ী। আমার একটি পোশাকি বা ভাল নাম অবশ্য তাঁরা কৃপা করে দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও কিছু শব্দজব্দ রসিকতা আছে— অচ্যুতনন্দন। তাঁরা কি জানতেন না এ-নামে কেউ কখনও কাউকে ডাকতে পারে না! নিজের নামের বানান শিখতে গিয়ে কি আমার কম পেনসিল ভেঙেছে শৈশবে! তার পরে নামের মানে! তাই নিয়েই কি কম হেনস্থা নাকি? বলা বাহুল্য পূজ্যপাদ মাস্টারমশাইরা অক্লেশে আমাকে অচ্ছুৎ অচ্ছুৎ করেন, হরিজনদের জন্য মন্দির খুলে দেওয়ার এই যুগে তাঁরা যে নিজেদের কত দুর্গতিশীল প্রমাণ করছেন না বুঝেই। সহপাঠীরা অবিলম্বে ডাকনামের খোঁজ পেয়ে যায়। কেননা অচ্ছুৎ শব্দটা এই প্রজন্মের কাছে র্যাগিংয়ের জন্য যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ নয়। তারা সহর্ষে ‘ক্যাবলা এই ক্যাবলা’ করে আমার কান ঝালাপালা করে দেয়। দরকারে যত না অদরকারে ডাকে তার চেয়ে ঢের বেশি এবং বড়ই আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। ক্লাসের ক্যাবলাতম ছেলেও আমাকে ক্যাবলা ডাকতে ডাকতে কলার তোলে।
তুলনা ও প্রতিতুলনায় অর্থাৎ কমপেয়ার ও কনট্রাস্টে আলোকসুন্দরের ও অচ্যুতনন্দনের সম্বন্ধে কী কী তথ্য বেরিয়ে আসে দেখুন।
১। আলোকসুন্দরের চুল খাড়া খাড়া, সে সবেতেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে খ্যাঁকশেয়ালের মতো হাসে। অপর পক্ষে অচ্যুতনন্দনের চুল মাথায় সহজেই পাট করা যায়, সে অত্যন্ত ভদ্র। তার হাসিতে সাধারণত আওয়াজ হয় না। হলেও তা স্বাভাবিক কিশোরসুলভ। আলোকসুন্দরের নাম— বিদ্রূপসুন্দর দিলে কি অনেক মানানসই হত না?— পাঠকের কী অভিমত?
২। আলোকসুন্দর মোটেই আলোকপ্রাপ্ত নয়। তার ন্যাবা হয়েছিল, জনৈক হাতুড়ের পরামর্শে তাকে আমাদের মাতৃদেবী একটি মালা পরান। তাতে সে আপত্তি করেনি। মালা পরে হলুদ চোখে যখন সে ইতি-উতি তাকাত তাকে অনেক বেশি ক্যাবলা এবং অন্ধকারসুন্দর দেখাত। অপর পক্ষে অচ্যুতের জলবসন্ত হওয়ায়, তাকে মৎস্য মাংস বঞ্চিত করার চেষ্টা হয়েছিল। যদিও ডাক্তারের পরামর্শ ছিল প্রোটিন আহারের পক্ষে। সে সময়ে অচ্যুত মৎস্য-মাংস ব্যতীত হাঙ্গার স্ট্রাইক করবার সিদ্ধান্ত নেয়। মৎস্যাদির লোভে নয়, বিজ্ঞানের স্বার্থে, লোকশিক্ষার স্বার্থে। সে প্রমাণ করেই ছাড়ে যে জৈব প্রোটিন আহারে সে অনেক শীঘ্ৰ দেহবল ফিরে পেয়েছে। তার পর থেকে বাড়িতে কারও জলবসন্ত হলে আর নিরামিষ ও বার্লি-পথ্যের অবতারণা হয়নি। কুসংস্কার দূরীকরণে এটি কি একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নয়?
৩। আকৃতি-প্রকৃতিতেও আলোকসুন্দর আদৌ সুন্দর নয়। দৈহিক রূপ ঈশ্বরদত্ত বা বলা যায় জিনদত্ত। তা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি সভ্য মানুষের লক্ষণ নয়, আমি সভ্য উদার সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষ। এ নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাই না। কিন্তু যখন আলোকসুন্দর, যথেষ্ট কৃষ্ণবর্ণ, গুলি চক্ষু, উদ্ধতকর্ণ ও ব্যোমকেশ হওয়া সত্ত্বেও ‘হ্যান্ডসম’ ও পুরুষোচিত খ্যাতি পায় এবং আঠারোতেই কর্কশ দাড়ি-গোঁফাক্রান্ত তাকে বালসুলভ ‘বাবু, বাবু’ ডেকে আদিখ্যেতা করা হয় এবং অচ্যুত গৌরবর্ণ ও চোদ্দোয় দাড়ি-গোঁফহীন সুকুমার থাকে বলে তাকে মেয়েলি, মাকুন্দ বলা হয়ে থাকে তখন বাইরের আকৃতির প্রসঙ্গ না এসে কি পারে?
প্রকৃতিতেও আলোক স্বার্থপর। প্রমাণ সে নিজের টি-শার্ট একই সাইজ হওয়া সত্ত্বেও কখনও ভাইকে ধার দেয় না এমনকী পিতৃদেব একদিন একটি পরে ফেলেছিলেন বলে সে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে। অচ্যুত পরার্থপর— সে অকাতরে দান করে। দরিদ্রকে অন্নদান করার সামর্থ্য তার এখনও হয়নি, কিন্তু দরিদ্রের ছেলেকে সে নিজের, দাদার এবং বাবার জামাকাপড় দিয়ে থাকে। কেউ টের পায় না। বাড়িতে তুলকালাম হয়, সে নীরব থাকে। দাদার টিউটোরিয়ালের বিশেষ নোটের খাতা জেরক্স করে সে দাদারই টিউটোরিয়ালহীন বন্ধুদের সাপ্লাই দেয়। নিজের অঙ্কের খাতা, ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর লেখা খাতা সে নির্বিচারে ক্যাবলা বন্ধুদের ধার দেয়, ঠিক এবং ভুল অঙ্ক, ঠিক এবং ভুল তারিখসমেত। আকবরের দীন-ইলাহির মর্মকথায় সে বাহাই-ধর্মের উল্লেখ করায় কালাতিক্রমণ দোষ ঘটেছে বলে তিরস্কৃত হয়। সেই উত্তরপত্রটিও সে অকাতরে পরখাতা-পিপাসু সতীর্থদের দিয়ে থাকে।— তিন দফা প্রমাণাদি দাখিল করলাম পাঠক ভেবে দেখুন। অভিমত দিন। আপনাদের অভিমত পাঠাবেন ৭৫৭৫ নম্বরে এস এম এস করে…’
এত মন দিয়ে বল্লী পড়ছিল যে এর মধ্যে যে দরজার ঘণ্টি বেজেছে, তাদের কাজের লোক খুলে দিয়েছে সে কিছুই টের পায়নি। ঘরের মধ্যে যে মার্জার চরণে দুই মূর্তি ঢুকেছে তা-ও সে বুঝতে পারেনি। পেছন থেকে একটি হাত এসে খপ করে কাগজগুলো তুলে নিল। বল্লী চমকে মুখ তুলে দেখে ফরসা গোলগাল একটি মুখ সরে যাচ্ছে— কার্জন। পেছনে দাঁড়িয়ে পাবলো বলল— নিজেই দ্যাখ রে কার্জন, গদ্দার কে, মিথ্যুক কে! ঠিক বলেছিলুম কি না!
দু’জনে দুটো মোড়া টেনে বসল। বল্লী হেসে বলল— কী করে ধরলি?— সে একটুও অপ্রস্তুত হয়নি।
সিম্পল ডিডাকশন, ওয়াটসন। সার্কামস্ট্যানশ্যাল এভিডেন্স— পাবলো বলল। পঙ্কজ বল্লী পাবলো তিনজনের উপস্থিতিতে কাগজের রোলটা কার্জন বল্লীর টেবিলে রাখে। ভুলে চলে যায়। দু’মিনিটের মধ্যে ফিরে আসে— নো পঙ্কজ, নো পাবলো, কাগজ ভ্যানিশ। পাবলো জানে সে নেয়নি। পঙ্কজ হ্যাজ বিন ক্লোজলি এগজামিন্ড। সে নেয়নি। পড়ে রইল বল্লী। সোজা হিসেব সে-ই নিয়েছে, ব্যস। প্রথমে, বল্লী নিয়েছে অথচ স্বীকার করছে না— এটা বল্লীর চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না। তাই টিকটিকি একটু মিসলেড হয়। তারপর দেখা গেল লজিক বলছে— বল্লী ইজ দা কালপ্রিট। তখন টিকটিকি চরিত্রের ব্যাপারটা ন্যাচার্যালি ইগনোর করে।— এখন দ্যাখ ধরার কাজটা চ্যালেঞ্জ ছিল ধরে দিয়েছি। কেন নিয়েছিস, কী মতলবে, সে কৈফিয়ত তুই কার্জনকে দিবি। আমার কথা আমি রেখেছি। এবার তোরা বোঝ— বলে-টলে দু’লাফে পাবলো ঘরের বাইরে চলে গেল।
মুচকি হেসে বল্লী বলল— খাসা লিখেছিস কিন্তু প্রান্তিক, সহর্ষে, কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব… র্যাগিংয়ের ইঙ্গিতবহ… গুলি-চক্ষু উদ্ধতকর্ণ… এত সব ভাল ভাল বাংলা সংস্কৃত কোত্থেকে শিখলি রে?
তোরা যখন ঘাড় গুঁজে সিলেবাস পড়িস আমি তখন হরেক কিসিমের বই পড়ি। বই পড়া ছোট থেকে আমার ভীষণ নেশা। বঙ্কিম টু বুদ্ধদেব বসু সব পড়ে ফেলেছি।
তার পরের?
সব সব। আগেকারটা কত পড়েছি বোঝাবার জন্যে বললুম কথাটা। তোর কেমন লাগল?
বললুম তো খাসা। শেষ কর। মজাদার একটা উপন্যাস।
আমি তো তোকে পড়াব বলেই এসেছিলুম। কী ছাইভস্ম হচ্ছে, সেকেন্ড ওপিনিয়ন চাই তো একটা!— তোর চুরি করার কী দরকার ছিল?
জাস্ট কিউরিয়সিটি। বিশ্বাস কর। আনহোলি কিউরিসিটি মানছি। যেভাবে আগলে আগলে আনছিলি আমি ভেবেছি লভ-লেটার। কে দিল, না তুই কাউকে দিচ্ছিস, খুব কৌতূহল হল বুঝলি? খুলে পড়তে গিয়ে দেখি আরে এ যে একটা স্টোরি! তোর লেখা বলে মনেই হয় না। সত্যি তুই লিখেছিস?
সত্যি না তো কি মিথ্যে?
আমি ভেবেছিলুম কোথাও থেকে টুকলিফাই করেছিস। তারপর দেখলুম, বেশ কিছু ক্যারেক্টার চিনতে পারছি। তুই তা হলে রাইটার হচ্ছিস?
ইচ্ছে তো তাই— কার্জন লাজুক মুখে বলল— পরিস্থিতি প্রতিকূল। আমাকে সি এ ফি এ পড়তে হবে। নইলে কম্পুটার লাইনে কি ম্যানেজমেন্ট ঢুকিয়ে দেবে। কী করি বল তো! লাইফ হেল হয়ে যাবে ওসব লাইনে গেলে। তা ছাড়া আমার সময় চাই। অনেক অনেক সময়। তা তুই কি আজই সবে ওটা নিয়ে বসেছিলি?
বল্লী বলল— একরকম তাই ধর। উলটেপালটে একটু দেখে নিয়েছি যে শেষ হয়নি। তারপর তুই এমন ধরপাকড় শুরু করলি! আমি দিয়ে দিতে পারতুম। কিন্তু তখন একটা জেদ চেপে গেছে। মজাও আছে। একটু পড়ে ইন্টরেস্ট পেয়ে গেছি। তারপর তো পরীক্ষা এগিয়ে এল। শেলফের পেছনে রেখে ভুলে মেরে দিয়েছি। মামার বাড়ি গিয়েছিলুম ক’দিনের জন্যে। এসেই হঠাৎ মনে পড়ল দেখি তো! আচ্ছা কার্জন, তোদের বাড়িতে কেউ লেখক আছেন? ছিলেন?
আরে আমার বড়মামাই তো লেখক ছিলেন। মানে হতে চেয়েছিলেন। তা কেউ হতে দিলে তো! দিদিমা কান্নাকাটি শুরু করলেন— ছেলেটা না খেতে পেয়ে মরবে। দাদু হুংকার ছাড়লেন একখানা, মামা সুড়সুড় করে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেলেন। ডি ভি সি-র এঞ্জিনিয়ার। বাড়ি ভরতি বই। তাকের পেছনে তাড়া তাড়া খাতায় পদ্য। মামা আমাকে খুব উৎসাহ দিচ্ছে বুঝলি! বলছে আমার প্রতিভা শেষ করে দিয়েছে সবাই মিলে। তুই লেগে থাক। আদা-জল খেয়ে লাগ। তবে একদম স্পিকটি নট। আমি দুটো পদ্য লিখেই ধরা পড়ে গিয়েছিলুম। তুই স্ট্রিক্ট সিক্রেসি মেনটেন করবি। কাকপক্ষী যেন টের না পায়। খবরদার ঝোলা ব্যাগ নিবি না, প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি পরবি না। চোখের দৃষ্টিটা তোর আনমনা আনমনা হয়ে থাকে, ওটা পালটা। চতুর্দিকে নজর রেখে যাবি। ট্রেনে বাসে বাজারহাটে রাস্তা ঘাটে বাড়িতে। মানুষ কীভাবে কথা বলে, কীভাবে চলে ফেরে।
কার্জন বলল— মামার পদ্য আমার গদ্য। লাইন একটু আলাদা। মামার লাইব্রেরি থেকে মেলা বই পড়েছি রে। এই সিক্রেসি মেনটেন করতে গিয়েই যত্ত ঝামেলা। জানিস বল্লী, আমি একটা ছোট, ব্যাটারি সেট টেপ রেকর্ডার কিনেছি। হাতে করে নিয়ে বাজারে, দোকানে ঘুরি। কথাবার্তা টেপ করি।
লড়ে যা। আমি আছি— বল্লী বলল।
এটা জাস্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট বুঝলি?
তা বুঝেছি। কিন্তু আত্মজীবনী এভাবে লিখতে গেলি কেন?
অসুবিধে কী!
আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সব নিজেদের ভূত দেখবে যে!
কার্জন হাসল। বল্লীও হাসি হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
তোর ভূত দেখেছিস?
না।
তবে কার দেখলি?
অবভিয়াসলি তোর নিজের, তোর দাদার, বাবা-মা’রও বোধহয়!
কার্জন একটা বেশ বোদ্ধার হাসি দিল, —সিবলিং কনফ্লিক্ট বা সিবলিং জেলাসি একটা খুব কমন থিম, বুঝলি? এটা সিরিয়াসলিও নেওয়া যায়, আবার এটা নিয়ে বেশ মজাও করা যায়। মজাটা করেছি। পড়ে তুই যদি বুঝে থাকিস সত্যিই আমি একটা অ্যাগ্রিভড পার্টি, দাদা বেশি অ্যাটেনশন পাচ্ছে বলে খেপে আছি, বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মজা করে, মাস্টারমশাইরাও, তবে বুঝতেই পারছিস খুব ভুল করবি। আমি প্র্যাক্টিক্যালি আমার মা-জ্যাঠাইমার গোপাল। দাদাও আমাকে প্রচণ্ড বোঝে, বন্ধুদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন তা তো তুই জানিসই। আমার জেঠু বীভৎস মজাদার মানুষ। বাবা গম্ভীর। কিন্তু ঝুনো নারকোল, ফাটালেই ফোয়ারা। আমার দিদি মানে জ্যাঠতুতো দিদি একটা এক নম্বর ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। চিরকাল। দাদা বা আমি কেউই ওর ধারেকাছে নেই। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের বাড়িতে কোনও টেনশন, কোনও প্রেশার কিচ্ছু নেই। দিদি নিজেও প্রচণ্ড মজা করতে ভালবাসে। যা এক একখানা মেল পাঠায় না। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে।
এখন কথা হল ফিকশন বলে কেন? তুই দেখবি ফ্যাক্ট যতই অদ্ভুত হোক তা নিয়ে লেখা, মানে বিশুদ্ধ তথ্য নিয়ে লেখা চট করে সার্থক হয় না। কল্পনা। কল্পনা হচ্ছে সেই জিনিস যা ঠিক পরিমাণে মেশালে তবে জীবন থেকে সাহিত্য পাওয়া যায়। কী রে বোর করছি?
বল্লী বলল প্লিজ, ডোন্ট স্টপ, গো অন।
‘আমি’টা কেন নিয়েছি বল তো? ওতে ক্যারেক্টারটার সঙ্গে আইডেন্টিফাই করতে সুবিধে হয়। ওই ক্যাবলা নামে চরিত্রটার মধ্যে ঢুকে গেলুম। মোটামুটি আমাদের বাড়ির যা সেট-আপ সেই রকম একটা সেট-আপ কল্পনা করে নিলুম। সুবিধে হল।
বল্লী বলল— দাদাকে না নিয়ে দিদি বা বোনও তো নিতে পারতিস!
বোন বা দিদি? একটু মিন হয়ে যায় না একটা টিন-এজ ছেলের দিদি বোনের সঙ্গে হিংসেহিংসিটা? বোনে বোনে যতটা হয় ভাইয়ে ভাইয়ে যতটা হয় ভাই-বোনে অতটা হয় না। সিরিয়াস হয়ে যেতে পারে। এনিওয়ে, দাদার সঙ্গে খুনসুটির ধরনটা আমার জানা ছকের মধ্যে পড়ে। ওটাই সহজে এসে গেল। কিন্তু এটাই আমার একমাত্র নয়। পোয়েটিক জিনিস লিখেছি, ক্রিটিক্যাল জিনিস লিখেছি, কবিতাও লিখেছি।
তো সেগুলো কবে পড়াবি?
তুই সত্যি ইন্টরেস্টেড?
তবে? আমিও তো একটু আধটু… মানে ওই আর কী!
লিখিস! তুই! বলবি তো।
ধ্যাত বলবার মতো কিছু নয়। তোর মতো এত ভালই নয়। বল্লীর মুখে লজ্জার আভা।
কালই আসছি। তোরগুলো রেডি রাখিস। ঠিক আছে?
ঠিক। —কার্জন উদ্ভাসিত মুখে বেরিয়ে গেল— সি ইউ!
সুহৃৎবরণ শ্যালিকার ফোন পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। একই বাড়িতে ওরা থাকে ওধারে। চব্বিশ ঘণ্টা না হলেও গড়ে তিন-চার ঘণ্টা করে তো দেখছেন রোজ, তবু শালি— তৃষ্ণা যায় না। শালি চিরসবুজ, চিরনতুন, চিরকালের অপ্রাপ্য পরকীয়া। তার সঙ্গে ফস্টিনস্টি জামাইবাবুদের জীবনের মহত্তম সুখ।
কী হে কী খবর! আর কত দিন আমাদের বিরহজ্বালায় জ্বালাবে?
আপনার বোধহয় চিরবিরহ শুরু হতে যাচ্ছে সুহৃৎদা।
কেন? ফ্ল্যাট কিনেছ? মধুমহল ছেড়ে চললে?
ধুত। মধু মধুমহলেই আছে কিন্তু যশো যশোমহলে ফিরছে না।
অ্যাঁ?
দিদি সন্ন্যাস নিচ্ছে।
বলো কী! দার্জিলিঙে গিয়ে সন্ন্যাস? কী, হিমালয়টয় দেখে, না কী?
না হিমালয়ের চেয়েও জ্যান্ত কিছু। জনৈক সন্ন্যাসী বাবা মহারাজকে দেখে।
বুড়ো?
উঁহুহু। মধুক্ষরা খুব সময় নিয়ে অর্থপূর্ণ ভাবে বলল— আপনার বোধহয় একবার আসা দরকার। পাবলোরও।
সুহৃৎবরণ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এই সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী আধ্যাত্মিক-আধ্যাত্মিক বাই এই বয়সটাতেই মেয়েদের চেপে ধরে। স্বামী চাকরিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। লড়াই শেষ। ছেলে বড় হয়ে গেছে। মাকে আর তেমন দরকার নেই। খাঁ খাঁ শূন্যতা চতুর্দিকে। অমনি ভগবান হাতছানি দ্যান—কোনও সুদর্শন বা যুবক বা দুইই মহারাজের মাধ্যমে। আয় আয়, সংসারের পঙ্কে আর কত ডুবে থাকবি! হল তো সব! দেখলি তো! এবার আমায় দ্যাখ। সুহৃতের নিজের মা-ই গুরুঅন্ত প্রাণ ছিলেন। সংসার টংসার ছেড়ে দেওঘরের আশ্রমে গিয়ে বসে থাকতেন। বাবা মারা যাবার সময়েও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তিনি কি সাধে ঘরজামাই হয়েছেন? মায়ের ষড়যন্ত্র। ছেলে অন্যত্র চলে যাবে, আর দেখাশোনা করতে হবে না। ড্যাংডেঙিয়ে রাজি হয়ে গেলেন। তাঁর দিদি অবশ্য মাকে ও তাঁর গুরুদেবকে খুব ভক্তি করত। তার আর কী! তাকে পড়ালেখা শেষ করিয়েই বিয়ে-থা দিয়ে তবে মা ভক্তিমতী হয়েছেন। শাশুড়ির সঙ্গে তো জেনেটিক মিল থাকার কথা নয়। সাংসারিক মিলমিশও হয়নি। শাশুড়ি নিয়ে ঘর করতেই হয়নি যশোকে। তা হলে? দুটো ফেসের মধ্যে কমন ফ্যাক্টর তিনিই একমাত্র। তবে তাঁরই মধ্যে কি এমন কিছু আছে যা মাদের স্ত্রীদের সংসার ত্যাগ করতে প্ররোচিত করে!
পাবলো সেদিন রাত সাড়ে এগারোটায় বাড়ি ফিরে একেবারে বাঘের মুখে পড়ে গেল। গর্জন করছে বাবা— ইয়ারকি পেয়েছ? এটা হোটেলখানা? যখন খুশি আসছ যাচ্ছ, কোনও দায়িত্বজ্ঞান নেই, বাবা-মা কেউ কিছু নয়। খালি বন্ধু, বন্ধু, বন্ধু এদিকে তো বাপের হোটেলেই খাও। এখনও মা কোলে বসিয়ে পাবুল পাবুল করে ডুডু খাইয়ে দেয়। সেই মা-বাপের কী হল না হল কোনও খেয়ালই নেই। ছিঃ ছিঃ ছিঃ— রাগে গনগনে মুখে সুহৃৎ অপসৃত হলেন।
পাবলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, একেবারে বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জীবনে কোনওদিন সে বাবার কাছে বকুনি খায়নি। মা বকেছে, দু’ঘা দিয়েছে, কিন্তু বাবা কখনও না। পাবুল বলে সত্যি কথা বলতে কী, মা কোনওদিন ডাকেনি, ডেকেছে বাবাই। বেশি আদরের মুড থাকলে আবার শুধু পাবুল নয় পাবুল বাবুল, যার জন্যে ছোটবেলায় তার বন্ধুরা তাকে বাবলগাম বলে খেপাত। তার ওপর আবার ‘বাপের হোটেল?’ ওরে ব্বাপ— এমনতর অশ্লীল কথা পাবলো জীবনে শোনেনি। তবে কি ভেতরে থেকে তার রেজাল্ট জেনেছে বাবা? খুব খারাপ? সি গ্রেড? নাকি বাবার হঠাৎ প্রেশার চড়ে গেছে!
শম্পি উঁকি মারছে।— কী হল রে, চেঁচামেচি শুনলুম যেন?
পাবলো ফ্যাকাশে মুখে বসে আছে, মুখে কথা নেই।
শম্পি তাকে ঝাঁকিয়ে দিল— কী রে, বল।
বলব আর কী! জীবনযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল— বুঝলি! কুলি খেটে কি রিকশা চালিয়ে কোনওরকমে যা হোক কিছু…।
তুই-ই বা এত দেরি করলি কেন? মাসি নেই, মেসোর একা-একা লাগছে এগুলো তো একটু ভাবতে হয়!
আরে রিহার্স্যালে মেতে গেছি। খেয়াল নেই।
মেসোর ঘরে উঁকি মেরে এসে শম্পি বলল— মেসো বাগডোগরার দুটো টিকিট বুক করল রে। কালই। ঠিক বলেছি। মাসির জন্যে মেসোর মন কেমন করছে বুঝলি!
তাই বলে অমন অগ্ন্যুৎপাত! এ তো পুরো ভলক্যানো রে! তা দুটো টিকিট কার? বাবার আর মেসোর?
কী জানি! বাবাকে তো কিছু বলতে শুনিনি। বাবা বরং খুশিতে আছে, মায়ের খবরদারি নেই তো! আমি বকেঝকে যা হোক করে ম্যানেজ করছি। মিষ্টির তো পোকা— বাবাটা। এদিকে সুগার এসেছে ব্লাড-টেস্টে।
পাবলো কড়িকাঠের দিকে মুখ করে চিতপাত হয়ে শুয়ে আছে। মাথার তলায় দুটো হাত। ডান পা-টা বাঁ পায়ের উঁচু করা হাঁটুর ওপর তোলা। তার চোখ সাদা। ঘুম নেই। সে খায়নি। মানে খেয়েছে। কিন্তু বাবার সঙ্গে বা সামনে নয়। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল রাঁধুনি চিকেন স্টু আর রুটি করে রেখে গেছে। তুলে নিয়ে তার যা ভাগের মোটামুটি খেয়ে নিয়েছে।
সুহৃৎ খেতে যানইনি। মিহির এসে বললেন— তোমার খাওয়া-দাওয়া হয়েছে দাদা?
খাওয়া? সুহৃৎ অবাক হয়ে তাকালেন। খাওয়া কথাটা যেন জীবনে এই প্রথম শুনলেন।
শম্পি, শম্পি-ই— মিহির ডাক পাড়লেন। শম্পিই অবশ্য বেগতিক দেখে বাবাকে পাঠিয়েছে। সে কাছেপিঠেই ছিল।— কী বাবা! বলে এসে দাঁড়াল যেন কিচ্ছুটি জানে না।
আরে সুহৃৎদাকে পাবলোকে খেতে দে!
শম্পি বলল ও মেসো, তুমি বাবার সঙ্গে কথা বলো আমি তোমার খাবার এনে দিচ্ছি।
সে মাইক্রোওয়েভ চালু করে দিল। রুটি মাংস সব সুচারুরূপে সাজিয়ে ট্রেতে করে এনে বলল— খাও মেসো, অনেক রাত হয়ে গেছে।
যশো! পাবুল!— বোকার মতো সুহৃৎ বলে উঠলেন।
পাবলো খেয়েছে। মাসিও নিশ্চয় খেয়েছে। তুমি এখন খাও বাবার সঙ্গে গল্প করতে করতে। বাবা, তোমার ওভালটিনটা এখানে দেব নাকি?
ওভালটিন? হ্যাঁ হ্যাঁ দিবি বই কী! তা সুহৃৎদা, কাল তোমার কী প্রোগ্রাম?
মিহিরকিরণ উকিল মানুষ, তিনি জানেন ভালমানুষ সেজে কীভাবে লোকের পেটের কথা টেনে বার করতে হয়।
কাল? কাল তো দার্জিলিং যাচ্ছি। আমি আর পাবুল।
তাই নাকি? হঠাৎ?
যশোর হঠাৎ খুব অসুখ করে গেছে। বুঝলে হে! না গেলেই নয়। জানো তো তোমার শালিটি কেমন আউপাতালি, আর অসুখ-বিসুখ করলেই… জানোই তো— একটু যেন লজ্জা-লজ্জা হাসি ফুটল তাঁর মুখে।
দিদির অসুখ! কই মধু তো বলল না কিছু?
কিচ্ছু-উ বলেনি?— ঘোর সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন সুহৃৎ। কতটা জানে এই ঘোড়েল ভায়রাভাইটি! মধু কি আর ওকে বলতে বাকি রেখেছে? এই বয়সে যশো গৃহত্যাগী হতে চাচ্ছে সেটা কার ডিসক্রেডিট! অবশ্যই তাঁর! এই নিয়ে চতুর্দিকে কত জল্পনা-কল্পনা হবে এখন! তার চেয়েও বড় কথা যশো, সেই বাচ্চা হাতির মতো সাদা ধবধবে নরম-নরম যশো আর তাঁর নেই। কোন যেন মহারাজের হয়ে গেছে।
পাবলো জানে, সে যাবে?— মিহিরের কথায় চটকা ভাঙল তাঁর।
ও হ্যাঁ না। মানে সকালে বলব, গুছোতে আর ক’মিনিট লাগবে।
কিন্তু তার আগেই যদি পাবলো গৃহত্যাগ করে?
গৃহত্যাগ? পাবলো? কেন? সে কী? পাবুল পাবুল— সুহৃৎবাবু চটাস, চটাস করতে করতে ঊর্ধ্বে চললেন। —পাবুল— কাল আমরা, মানে তুমি আর আমি দার্জিলিং যাচ্ছি। বুঝলে? গৃহত্যাগ-ফ্যাগের মতলব ছাড়ো।
পাবলো উঠে বসল আমি? দার্জিলিং? কেন?
তোমার মা’র অসুখ করেছে। তাকে ফিরিয়ে আনতে।
কী আবার হল মায়ের? তো আমি কেন?
তুমি কেন? মানে? মানে কী কথাটার? জবাব দাও। মানে কী? মায়ের বিদেশবিভুঁইয়ে অসুখ করেছে শুনেও তোমার হেলদোল নেই? আমি কেন! আচ্ছা! এই পুরস্কার। এই রিটার্ন। ছ্যা ছ্যা যশো এই ছেলে তৈরি করেছে!
পেছন থেকে মিহির বললেন— পাবলো, ভাল চাস যদি তো তোর বাক্স গুছিয়ে নে। সত্যিই তো— আমি কেন— মানেটা কী! তোর মা-বাপের অসুখ করলে তোর দায়িত্ব থাকে না?
পাবলো মাথা চুলকে বলল— আসলে আমরা তো আর কাঁধে করে মাকে নিয়ে আসব না যে দু’জন লোক লাগবে! একজন গেলেই তো হল! তা ছাড়া তেমন কিছু হলে সোজা অ্যাম্বুল্যান্সে।
বা বা বা বা!— সুহৃতের গলায় এত জোর, এত রাগ ছিল তিনি নিজেই জানতেন না— শি ইজ রাইট। যা’র একমাত্র ছেলে এই রকমের ক্যালাস তার, তাদের গৃহত্যাগ করাই উচিত। আই আন্ডারস্ট্যান্ড য়ু যশো।—ফুললি ফুললি— বলতে বলতে সুহৃৎ বেগে নিজের ঘরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
সত্যি দিস ইজ টু মাচ পাবলো— শম্পি বলল।
কাঁধে করার কথাটাই বা তুই উচ্চারণ করলি কী বলে? মিহির খুবই বিরক্ত।
দ্যাখো মেসো, আমি মাকে খুব জানি। মা খুব ঘোড়েল। এর আগে একদিন খবর পেলুম মা’র নাকি স্ট্রোক হয়েছে— অজ্ঞান। দৌড়োতে দৌড়োতে সব কাজকর্ম ফেলে বাড়ি এসে দেখি— ফিস্টি হচ্ছে। মেলা লোক। সবাইকার জন্যে শরবত সাপ্লাই দাও। রাখাল বালক যেমন বাঘ বাঘ বলে মিছিমিছি চেঁচাত!
কিন্তু তার পালে সত্যিই তো একদিন বাঘ পড়ল। বাবা-মা তো পাড়ার লোক নয় যে, মিথ্যে অ্যালার্ম বলে তোমরা উড়িয়ে দেবে। এসব কথা ভাল নয় পাবলো। আমি অ্যাপ্রুভ করছি না। হাইলি অবজেকশনেবল।
মেসো, পরশু আমাদের প্রথম শো যে—কাতর কণ্ঠে পাবলো বলল, হল বুক হয়ে গেছে, ইনভিটেশন লেটার চলে গেছে। এখন আমিই মূল আমিই পরিচালক—
কীসের শো? কী নাটক পরিচালনা করছিস?
নাটক নয় ব্যান্ড, মেসো— নিচু গলায় পাবলো বলল।
কীসের ব্যান্ড পার্টি? তুই শেষ পর্যন্ত ভ্যাঁপপপোর ভ্যাঁপোর করতে করতে ব্যাগ পাইপ টাইপ বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে প্রসেশন করবি?
উঃ তোমরা যে কোন যুগে আছ! বিটলস শোনোনি? রোলিং স্টোন? স্পাইস গার্লস শোনোনি? বাংলা ব্যান্ড শোনোনি?
তোরা ব্যান্ড বেঁধে গাইবি?
গাইব, বাজাব, র্যাপ করব, নাচবও।
বলিস কী রে, তুই তা হলে শিগগির বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছিস? সেলেব? বাববাঃ। হাতে হাত মিলাও ইয়ার। নাম কী ব্যান্ডের?
ভ্যাগাবন্ড।
বাঃ দারুণ। অ্যাপ্রোপ্রিয়েট। একদম ঠিক।
সত্যি বলছ মেসো!
সত্যি না তো কি মিথ্যে? তোদের জেনারেশনের ছেলেগুলোদের দেখে একদম ঠিক এই কথাটাই এই শব্দটাই মনে আসে। ভ্যাগাবন্ড। সারাদিন কানে মোবাইল, ইয়ার-প্লাগ, জনবহুল রাস্তা দিয়ে লক্ষ্যহীন চলছে। জিনসের পকেট ফেটে ঝুলে গেছে। ফতুয়া ফ্যাতফেতে। চুলে পনিটেল। এক কানে মাকড়ি, এক হাতে বালা। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিছু বোঝা যায় না। এমনকী— জেন্ডার পর্যন্ত বোঝার বাইরে। ভ্যা-গা-ব-ন্ড। ঠিক! তোমার কেস বুঝলুম। কিন্তু তুমি কাল দার্জিলিং যাচ্ছ। মায়ের অসুখের ওপর আর কোনও ব্যান্ড নেই।
পরে শম্পি বাবাকে বলে— মাসির কখনও অসুখ করেনি। করলে মা আমাদের বলত না? আমাকেও ফোন করেছিল তো। কিছু বলেনি। অন্য কিছু।
মিহির বললেন তুই শিয়োর? ডেঞ্জার টেঞ্জার কিছু?
তা হলেও বলত। অন্য কিছু। মায়ের নানারকম দুষ্টুবুদ্ধি খেলে তো?
তা খেলে। আমাকে কম নাকাল করেছে!
কোনও একটি রহস্যময় কারণে মা মেসোকে দার্জিলিঙে নিয়ে ফেলতে চায়। কিছু একটা মজা!
কিন্তু পাবলো! পাবলো কেন!
পাবলোটা হয়তো মেসোর নিজের আইডিয়া।
একটি বড় ঘর। মেঝেতে কার্পেট পাতা। এক প্রান্তে একটি প্রশস্ত হাতলঅলা আরাম চেয়ারে বসে আছেন অভীপ্সানন্দ মহারাজ। ভ্রমরকৃষ্ণ চুল ও দাড়ির মধ্যে থেকে ফুটে আছে তাঁর গোলাপফুল রং হাসিমাখা মুখখানি। সামনে হাঁটু মুড়ে সমবেত শিষ্যকুল। একেবারে সামনে যশোধরা। স্বামীজি মহারাজের মুখের দিকে তাকিয়ে তদগত। তন্ময়।
তার বোনের হয়েছে বিপদ। এখন দার্জিলিঙে নানা মজা। পরিচিত মানুষকুলকে এখানে দেখে দিদির ভাল না লাগতে পারে, মধুক্ষরার কিন্তু মোটেই খারাপ লাগছে না। তা ছাড়া মধুক্ষরা এখানে নিত্য নতুন অবতারে। বেশির ভাগ দিনই ফুল প্যান্ট, জ্যাকেট। কোনও কোনও দিন সালোয়ার কামিজের ওপর কার্ডিগান। লং স্কার্ট পরেও সে অবতীর্ণ হয়েছে। তার চলন পালটে গেছে। পকেটে হাত দিয়ে সামনের দিকে ঝোঁক দিয়ে দিয়ে পাহাড়ি চলা সে রপ্ত করেছে। অচেনারা তো মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেই, চেনারা, যেমন মিনিদি সঙঘদি এরাও বলে— তোর যে দশ বছর বয়স কমে গেছে রে মধু! ওদিকে রয়েছে ব্যাঙা-বেঙি। বেঙি যতই বয়সে ছোট হোক, মধু তাকে টেক্কা দিয়েছেই দিয়েছে। বিজয়মুকুলদা চিরকুমার সুতরাং চিরহরিৎ। সুবুলদা আর বিজয়মুকুলদার সঙ্গেই তার আড্ডা জমে সবচেয়ে ভাল। অথচ দিদি এইসব বাধিয়েছে। দিদিকে চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে। দিদি রোজ মহারাজের ওখানেই প্রসাদ গ্রহণ করছে। রাত্তিরে শুতে আসে যখন, চোখের তারা শিবনেত্র। শুয়ে শুয়ে জপ করে। ভোরে উঠে প্রাণায়াম। বলে— মধু, নশ্বর জীবন, একটা কি লক্ষটা কে জানে, নষ্ট করিস না। নষ্ট করিস না। কথামৃত শুনবি আয়।
কথামৃত আমি পড়েছি দিদি।
আরে এ যে নতুন যুগের নতুন কথামৃত রে! যুগে যুগে যেমন পৃথিবী পালটায়, সমাজ সংসার মানুষ পালটায় তেমন কথাও পালটায়। না শুনলে বুঝবি না।
এই তো অবস্থা! আসল কথাটা অবশ্য মধু একটু একটু বুঝতে পারে। দিদির চিরকেলে রোম্যান্টিক মন।— নতুন, অ্যাডভেঞ্চার, অজানার দিকে তার চিরকালীন টান। দিদি বড্ড চেয়েছিল একটি জম্পেশ লভ ম্যারেজ। তো বাবা-মা অবিলম্বে তাকে সুহৃদ্দার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। সুহৃদ্দা আদৌ খারাপ নয়। গুণী কৃতী মানুষ, দিদির যত্ন নেয়। অসুখ-বিসুখ করলে তো বিছানার পাশ থেকে নড়ে না। কিন্তু দিদির তাতে মন ওঠে না। একখানা উত্তমকুমার কি বিনোদ খান্না দিদির সঙ্গে দুর্ধর্ষ প্রেম করবে, দিদি তার সঙ্গে ইলোপ করবে। মা-বাবা কাঁদবে, পুলিশে খবর দেবে, অভিশাপ দেবে— কিন্তু দিদি ফিরবে না। দিদি তার উত্তমকুমারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। প্রেমের এই আটলান্টিক উদ্দামতা আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় গভীরতা দেখে শেষ পর্যন্ত বাবা-মা মেনে নেবেন। প্রবল ঘটা করে বিয়ে হয়ে যাবে। তারপরে দিদি চিরকাল অমিত রায় লাবণ্যর দীপক-মানসী গোছের একটা জীবন যাপন করবে। দিদির ইচ্ছের খুঁটিনাটি অবশ্য সে জানে না।
কিন্তু সে অনেক সময়েই ঠারে ঠোরে দিদিকে বোঝাতে চেয়েছে প্রেমের বিয়েও ক্রমে ক্রমে একই রকম ম্যাদামারা হয়ে যায়। তাকে আর মিহিরকে দেখেও কি দিদি বোঝে না? সর্বক্ষণ মোটা মোটা আইনের বই নিয়ে বসে আছে চেম্বারে, আর বক বক বক। কোথায় গেল সেই সপ্রেম চাউনি, সেই কাতরতা! সেই কামনাতুরতা! তার চেয়ে বরং সুহৃদ্দা অনেক অনেক বেশি মনোযোগী স্ত্রীর প্রতি। তার তো সুহৃদ্দাকে বেশ লাগে। বেশ মজাদার মানুষ। দিদিটা চিরকালের গোঁয়ার এবং ভোঁদা। কী যে মাথায় প্রেম সেঁধিয়ে বসেছে। এখন অভীপ্সানন্দকে নিয়ে গদগদ। ভক্তি না আরও কিছু! ভগবান না ঘণ্টা! আবার ফোঁস ফোঁস করে প্রাণায়াম করা হয়। দু’মিনিট পরেই অবশ্য ফোঁস ফোঁসটা ভোঁস ভোঁস হয়ে যায়। ভোঁসলে একটা।
তিন-চারদিন হল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। উত্তর প্রদেশীয়, যুগেশকুমার। খুব জমে গেছে। কে কুইন অব হিল স্টেশনস—শিমলা না মুসৌরি না দার্জিলিং এই নিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা উড়ে যায়। সুবুলদা ঘুরঘুর করতে থাকে। সুবুলদা যদি ভেবে থাকে সে-ই একমাত্র মধুর গপ্পো করার লোক, তো ভুল ভেবেছে। আবার যুগেশকুমার যদি ভেবে থাকে সেই একমাত্র, যদি কোনওরকম আপারহ্যান্ড নেবার সম্ভাবনা দেখা যায় অমনি সে সুবুলদার সঙ্গে জমে যাবে। অত সস্তা না। যুগেশকুমার, সুবুলদা, ব্যাঙা-বেঙি এদের সঙ্গে সে টাইগার হিল ঘুরে এসেছে। দিদি কিছুতেই গেল না— আমি শান্তির জন্যে এসেছি মধু, বোঝবার চেষ্টা কর। টাইগার হিল-এ সুর্যোদয় অনেক দেখেছি। এখন জীবনে নতুন সূর্যোদয় হচ্ছে। তুই যা না, ঘুরে আয়।
সূর্যোদয় অবশ্য দেখা হল না। মেঘ সরল না। তবু ঠান্ডায় জমে দই হয়ে ভোর চারটের সময়ে টাইগার হিল যাওয়া তো হল! মধুর এই পথ-চলাতেও আনন্দ।
এইরকম এক কনকনে ঠান্ডা, কনকনে হাওয়া, আর ঝুপঝুপ বৃষ্টির মধ্যে সুহৃৎবরণের ডাকোটা মানে ল্যান্ডরোভারটি দার্জিলিং মল-এ পৌঁছোল। হোটেল সানশাইন-এ আর ঘর নেই। সব ভরতি।
আমার ওয়াইফ রয়েছেন—যশোধরা ব্যানার্জি। আমি সেই ঘরেই থাকব। তিনি গোঁয়ারের মতো বললেন—
কিন্তু সেখানে তো মিসেস মুখার্জিও রয়েছেন। কী করে যেতে পারেন আপনি!
তিনিও আমার আপনজন, স্ত্রীর মতোই।
অ্যাঁ? তিনিও আপনার স্ত্রী?
উফফ, স্ত্রী যেমন আপনজন তিনিও তাই। আমার সিস্টার-ইন-ল।
আপনি দেখা করে আসতে পারেন। কিন্তু ডবল বেডরুমে, চারজনকে আমরা জায়গা দিতে পারি না। দু’-দু’জন জেন্টলম্যান।
রেগে-মেগে সুহৃৎ —আয় রে পাবুল— বলে হোটেল ত্যাগ করলেন।
পাশের হোটেলে একটি ডিলাক্স সুইট পেলেন। নিয়ে নিলেন। পাবলো গোমড়া মুখে সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমে চলে গেল। দার্জিলিং-ই হোক আর যা-ই হোক সে এখন চান করবে।
বৃষ্টি থেমেছে। রোদ হেসেছে। আকাশ ক্লিয়ার। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে সামান্য জানলা ফাঁক করে সুহৃৎ দেখতে পেলেন— একটি সুন্দরী মড যুবতি হোটেল সানশাইন থেকে বেরিয়ে এল। দু’পা যেতেই এক পুলোভার পরা পুঙ্গব এগিয়ে গেল, দু’জনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে। আরে সুবুল ডাক্তার না? খুব জমিয়েছে মনে হচ্ছে! এ কী! এ তো মধু! তাঁদেরই মধু! মধু সার্টেনলি সুবুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল। ওদিক থেকে আর একটি পুঙ্গব এসে যোগ দিল। বাইনোকুলারটা ঠিকঠাক ফোকাস করেও লোকটাকে ঠিক ধরতে পারলেন না সুহৃৎ। কদম কদম এগিয়ে চলেছে মধুক্ষরা, তাঁর শ্যালিকা, দুই পুরুষের মধ্যবর্তিনী হয়ে।— ক্যামেরা, ক্যামেরাটা পাবুল! তিনি চিৎকার করলেন।
পাবলো পোশাক পরছিল, বলল— কী? কাঞ্চনজঙ্ঘা বেরিয়েছে নাকি?
আজ্ঞে না। বেরিয়েছে তোমার মাসিমণি, দু’পাশে দুই কলাগাছ মধ্যিখানে মহারাজ।
এইটুকু বলে সুহৃৎ নিজেকে সামলে নিলেন।
ক্যামেরা তো আনা হয়নি বাবা!
বলিস কী! ক্যামেরা তো তোর ব্যাগে সব সময়ে মজুত থাকে!
অন্য ব্যাগ এনেছি যে!
তোর এক বারও মনে হল না দার্জিলিঙের মতো সুন্দর জায়গায় বেড়াতে এসেছিস ক্যামেরাটা অবশ্যই আনিতব্য?
কিন্তু বাবা তুমি ভুলে যাচ্ছ আমরা দার্জিলিং বেড়াতে আসিনি, অসুস্থ মাকে নিয়ে যেতে এসেছি। এখনও পর্যন্ত মাকে দেখতেই পেলুম না! কী অসুখ কী বৃত্তান্ত জানলুমই না! স্ট্রেঞ্জ! আমার তো মনে হয় না মায়ের কোনও অসুখ করেছে।
অসুখ গুরুতর। সংক্ষেপে বললেন সুহৃৎ। চল, লাঞ্চটা খেয়ে নিই। তারপর তোর মাকে গিয়ে পাকড়াব।
পাবলো হাঁ করে তাকিয়ে রইল। মিস্টিরিয়াস! এ ভদ্রলোক কখনও রেগে ফায়ার হয়ে যাচ্ছেন। কখনও বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে মাসিকে বেরোতে দেখছেন, আবার মাসিমণি! মায়ের অসুখ গুরুতর অথচ নিশ্চিন্তে মুরগির ঠ্যাং চুষছেন। তার পিতৃদেবকে এত এলোমেলো এত রহস্যময়, তাঁর কথাবার্তায় এমন দ্বিমুখী তাৎপর্য পাবলো কখনও দেখেনি শোনেনি। ইন্টরেস্টিং!
গুরুদেবের ঘরটা কোথায়?— হোটেল ‘সানশাইন’-এর কাউন্টারে গিয়ে পাবলোর কান বাঁচিয়ে বললেন সুহৃৎ। পাবলো অবশ্য তখন হোটেলের লাউঞ্জে তন্ময় হয়ে বব ডিলানের পোস্টার দেখছে। তার অন্যতম আইকন। রোল মডেল। মাইনাস বিদ্রোহ। এখন বিদ্রোহের দিন নয়, সমারোহের দিন, সামঞ্জস্য ও সংহতির দিন। সাধু ভাষা, চলিত ভাষা, পরিশীলিত শব্দ, স্ল্যাং, কৃষক মজদুর মেট্রোবাসী সবাইকে গানের মাধ্যমে এক করার দিন। লিরিকের সীমাবদ্ধতা ভেঙে দেবে ভ্যাগাবন্ড। গানের সীমাবদ্ধতাও। কবিতা আসবে, গদ্য আনবে। ব্যাপক ভাবনা-চিন্তার ব্যাপার। আর এই সময়ে বাবাটা তাকে ফালতু দার্জিলিঙে টেনে নিয়ে এল। শো’টা ক্যানসেল করতে হল। খুব, খু-ব ক্ষতি হয়ে গেল। পঙ্কজটা গেঁতো বলে তারা খানিকটা বেঁচে গেছে। খবরের কাগজে অনুষ্ঠানের খবরটা পাঠায়নি। চেনাশোনার মধ্যেই আমন্ত্রণগুলো গেছে।
অভীপ্সানন্দ মহারাজ এখন তো কনফারেন্স রুমে। লেকচার দিচ্ছেন।
কোথায় সেটা?
লাউঞ্জের ও-দিকের দরজাটা খুলে চলে যান।
আয় রে পাবুল!
মঞ্চের ওপর অভীপ্সানন্দ মঞ্চ আলো করে বসে ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে বক্তৃতা করছেন। থেকে থেকেই বলছেন— ভাইয়োঁ ঔর বহেনো।…
একজন বললেন— কোনও গুরুদেবকে কখনও শিষ্যদের ভাইবোন বলে অ্যাড্রেস করতে শুনেছ! হি ইজ আ গ্রেট ম্যান।
হ্যাঁ। বিবেকানন্দ একেবারে, সাক্ষাৎ। —সুহৃৎ মন্তব্য করলেন।
ভিভেকানন্দজিকে ফির আনেকা টাইম হো গিয়া ভাইয়া, কওন জানে মহারাজজি ভিভেকানন্দজিকেই অবতার হ্যাঁয় ইয়া নহি৷
পাবলো বলল— ও বাবা, ওই তো মা ফার্স্ট রো-এ বসে বসে দুলছে।
দেখতে পেয়েছিস? কই কই? দোলা তোর মায়ের রোগ। ঠিক ঠিক ওই তো দুলছে। যেন নামতা মুখস্থ করছে।
আরে সিট ডাউন। বইঠ জাইয়ে। —চতুর্দিক থেকে চাপা গর্জন ভেসে এল। সুহৃৎ ভাল করে যশোকে দেখতে পেলেন না।
অসুখ করেছে বলে তো মনে হল না!— পাবলো ফিসফিস করে বলল।
অসুখ গুরুতর, গুরুত্ব দে, তা হলেই বুঝতে পারবি— চাপা গলায় বললেন সুহৃৎ। পাশের ভদ্রমহিলার ভ্রূকুটিতে বললেন— আর বলব না, স্পিকটি নট। এই চুপ করলুম।
তা-ও তো মন্দ বলছেন না। বলব না-টাও একরকম বলা। আওয়াজ সৃষ্টি করা, অমৃতবাণী শুনতে বাধার সৃষ্টি করছে।
বাইরে যান, বাহার যাইয়ে। বাহার যাকে গপসপ কিজিয়ে—চার দিক থেকে আওয়াজ উঠল।
অভীপ্সানন্দ বললেন, দিস ইজ লাইফ। অবাঞ্ছিত আওয়াজ। চতুর্দিক থেকে আসছে, আমাদের অন্তরাত্মার ধ্যান ভাঙিয়ে দিচ্ছে। নিজেতে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। ছোট্ট মেয়েটি ভিড়ে হারিয়ে গেছে। বলছে ‘হারিয়ে গেছি আমি’। বিশ্ব নিখিল চেয়ে আছে, কিন্তু দেখছে না। এখন বালিকাটি কী করবে? দিস ইজ আ কোয়েশ্চেন!
রোয়েগি, কাঁদবে, শি উইল ক্রাই। চার দিক থেকে জবাব এল।
রাইট। তখন কার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এই কান্না! দিস টু ইজ আ কোয়েশ্চেন।
কেউ কেউ বলল— স্নেহশীল মানুষজন।
রাইট। কিন্তু আরও দুই ধরনের মানুষ। এক নম্বর প্রতারক, শিশু পাচারকারী, ভুলিয়েভালিয়ে তাকে নিয়ে যাবে। আর দ্বিতীয় হল— পুলিশ। তার কর্তব্যই হল আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। একটি ছোট মেয়ে হারিয়ে গেছে এটাও একমাত্র সে-ই কর্তব্য বোধে দেখবে। সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নেবে। ঠিক কি না?
সবাই মাথা নাড়তে লাগল।
এমন সময়ে এক মহিলা উঠে দাঁড়ালেন— মহারাজজি, হোয়াই ছোট মেয়ে? ছোট ছেলে নয় কেন? হারানো অন্তরাত্মার প্যারাডাইম কী করে মেয়ে হয়! অন্য সময়ে তো আপনারা বয়, ম্যান, হি ব্যবহার করেন। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড গুরুজি। আপনিও? আপনিও হয়তো আপনার অজ্ঞাতসারেই পেট্রিয়ার্কির জালে ধরা পড়ে গেছেন। দিস উই রিজেক্ট।
অনেকে হইচই করে উঠল। কিন্তু স্বামীজি দু’হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। বললেন— প্রশ্ন। প্রশ্ন হল সাধনার পথে উত্তরণের প্রথম সিঁড়ি। অজস্র প্রশ্ন মাথা তুলবে। তার জবাব খুঁজবে প্রাণ। এক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল তো আবারও এক প্রশ্ন। এইভাবে একদিন আপসে প্রশ্ন শেষ হয়ে যাবে। তখন সংসারময় শান্তি, সংগতি দেখবে প্রাণ। আমি জবাব দিচ্ছি মা আপনাকে। আমাদের এই সমাজ-সভ্যতার ইনফ্রাস্ট্রাকচারে একটি ছোট ছেলের চেয়েও একটি ছোট মেয়ে অনেক অসহায়, ভালনারেবল, সে স্বভাবতই অনেক ভিতুও।
সকলেই সায় দিল। ভদ্রমহিলা তবু বললেন— এই জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশনটা ঠিক কী বলব, আপনার মুখ থেকে মহারাজ… না ঠিক…
স্মিতমুখে মহারাজ বললেন— বাস্তবকে তো স্বীকার করতেই হবে। আমি আদর্শ সমাজের কথা বলিনি। এখন সমাজ যেরকম তার কথাই বলেছি। যাই হোক— গুরু হলেন— এই সস্নেহ কর্তব্যশীল পুলিশ। হারিয়ে যাওয়া অন্তরাত্মাগুলিকে তিনি প্রথমে তাঁর মিসিং স্কোয়াডে জড়ো করেন। তারপর শুরু হয় কাউন্সেলিং। প্রশ্নোত্তর। এইভাবে কার কী ঠিকানা জেনে সেখানেই তাকে পাঠান। প্রত্যেকের ঠিকানা, চাহিদা, প্রয়োজন আলাদা ভাইবোনেরা। সবাই মহামায়ার অনন্ত আঙুলের একটি মাত্র। দুটো আঙুল কি কখনও এক হয়?
ক্রাইস্ট দা শেফার্ড— এক লালমুখো গুর্খা ভদ্রলোক বললেন। তিনি ঘনঘন মাথা নাড়ছেন। পছন্দ হয়েছে তুলনাটি।
এই সময়ে পাবলোকে অবাক করে দিয়ে তার বাবা উঠে দাঁড়ালেন। আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?
চার দিক থেকে অস্বস্তির রব উঠল। কিন্তু মহারাজজি সব হাতের ঈঙ্গিতে থামিয়ে দিয়ে বললেন— কোয়েশ্চনস আর অলওয়েজ ওয়েলকাম। বাতাইয়ে জি।
সুহৃৎ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন— একটি ছোট মেয়ে হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একজন অ্যাডাল্ট, বিবাহিত, সন্তানের জননী যদি বলে ‘হারিয়ে গেছি আমি’, সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তিনি গেলে বলব না কি ইচ্ছে করে গেছেন? কর্তব্য থেকে পালিয়েছেন? তাঁর মতলব মোটেই ভাল নয়।
যশো মুখ ফেরাল। পাবলোর সঙ্গে মায়ের চোখাচোখি হয়ে গেল। চোখ দুটো আস্তে আস্তে বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। সুহৃৎ কিন্তু সেদিকে তাকাচ্ছেনই না।
চার পাশে সব আপত্তি করে উঠল।— আহা, ছোট মেয়ের কথা বলা হচ্ছে নাকি? সে তো পথ হারানো মানবাত্মার উদাহরণ প্রতীক। য়ু সিলি ফুল!
ব্যস এইটুকুই আমার বলার ছিল। ওঠ রে পাবুল আমরা চলে যাই। বেলা হল। যাবার। বলে পাবুলের হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলেন সুহৃৎ। চেয়ার-ফেয়ার ঠেলেঠুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। কনফারেন্স রুমে একটা হইচই উঠল। যশোও ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলেন। সুহৃৎ তখন হোটেলের দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং মধুক্ষরা, জিনস ও উইন্ডচিটার পরা মাথায় স্কার্ফ বাঁধা, ঢুকছে!
এ কী জামাইবাবু! পাবলো! কখন এলি! কিছু বলিসনি তো!
পেছন থেকে যশো এই অবসরে তড়িঘড়ি গিয়ে সুহৃতের সামনেটা অবরোধ করে দাঁড়ায়।
তু তুমি… তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
এই বয়সে কোনও মহিলা যদি মহারাজের মিসিং স্কোয়াডে যেতে চায়, তার আপনজনের হক আছে তাকে ওয়ার্নিং দেবার, তার মহারাজকে ওয়ার্নিং দেবার।
চলুন চলুন সুহৃদ্দা। ওপরে আমাদের ঘরে চলুন। মাথা ঠান্ডা করুন।
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী। চল রে পাবুল।— সুহৃৎ হনহন করে নিজ হোটেলের দিকে যাত্রা করলেন। দুই বোনও পেছন পেছন এসে পড়ল।
কেউ কোনও কথা বলছে না।— বাঃ ভারী সুন্দর সুইটটা পেয়েছেন তো সুহৃদ্দা! মধুই শেষে বলে।
যশো এতক্ষণে বললে— তুমি শুধু শুধু আমাকে পাবলিকলি অপমান করলে, আমার এত দিনের স্বামী হয়ে?
এত দিনের স্ত্রী যদি হঠাৎ একটা উটকো মহারাজের সঙ্গে গৃহত্যাগ করতে চায়, স্বামী হ্যাজ এভরি রাইট টু ইন্টারফিয়ার।
কে বলেছে গৃহত্যাগ করেছি? আবার মহারাজের সঙ্গে? ছি ছি! ছেলে শুনছে!
কেউ নিশ্চয়ই বলেছে— মধুর চোখের দিকে চেয়ে সুহৃৎ বললেন। কেননা সে প্রাণপণে চোখ টিপছে।
রং ইনফর্মেশন। আমি দুটো স্পিরিচুআল কথা শুনতে পাব না তাই বলে?
হ্যাঁ স্পিরিচুআল কথা না আরও কিছু। হাঁ করে দেখছিলে তো ওই মহারাজটার দিকে। দিব্যি চেহারাটি বাগিয়েছে, টিপিক্যাল গিন্নি-ভোলানো চেহারা।
পাবলো আর পারল না। তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। সে মাসির হাত ঠেলে ঘরের বাইরে টেনে আনল।
আচ্ছা মাসি, তুমি বুঝি বাবাকে এইসব বলেছ? মায়ের অসুখ বলে বাবা আমাকে নিয়ে এল। নাঃ, বাবার রাগ আর জেলাসি এই প্রথম দেখলুম। ফ্যান্টাস্টিক! ব্রেভো মাসি!
না রে, সিরিয়াসলি। আমি দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। দিদি দিবারাত্র ওই মহারাজের কাছে পড়ে আছে। বেরোয় না, আমার সঙ্গে খায় না। খালি প্রসাদ ভক্ষণ হচ্ছে। সে একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড। দেখি ঝগড়া কদ্দূর এগোল?
মধুক্ষরা মুখটা বাড়িয়েই চট করে বের করে আনল।
পাবল বলল ঝগড়া কদ্দূর?
মাসি বলল— অনেক দূর। চল, আমরা দু’পাক ঘুরে আসি। খেয়েছিস?
বৃষ্টি। বৃষ্টি! বৃষ্টি— দারুণ চাঁদিফাটা গরমে যখন চড়চড় করে প্রথম বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়েছিল— মুড়কিশোলা গ্রামে মহোৎসব পড়ে গিয়েছিল। সবাই বাইরে বেরিয়ে এসেছে দৌড়ে। বৃষ্টিতে সব সপাটে ভিজছে। গাছপালা দুলছে। পাখিরা সুদ্ধু গাছের ডালে বসে নিশ্চুপ ভিজছে। কোত্থেকে চাট্টি গঙ্গাফড়িং অবধি এসে গেল। এদের সর্বক্ষণের সঙ্গী।
পরি বলল, ঠাকমা, খিচুড়ি চাপাও।
পরির মা বলল— না, না। খিচুড়িতে তুক আছে। বিষ্টি থেমে যাবে। প্রথম দফায় বৃষ্টি তো মাটি শুষে নিল।
তা দ্বিতীয় দফার বৃষ্টিটা নামল একদিন মাঝ রাত্তিরে। মুষলধারে বৃষ্টি সঙ্গে উথালপাথাল ঝড়।
সকালেও অন্ধকার, তুমুল হাওয়া। তুমুল বৃষ্টি। রুস্তম বলল, সাইক্লোনিক বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু বৃষ্টি থামল না। একটু থামছে কি আবার দ্বিগুণ জোরে নামছে। দু’দিন এই রকমই চলল নাগাড়ে।
‘এক ছেলের মা কে আছ গো?’— বিষ্টি মাথায় করে দল বেঁধে একদল মেয়ে এল। এক ছেলের মা কেউ নেই। সবাইকার কোলে কাঁখে। অবশেষে পরির ঠাকুমা বললেন— ওমা, আমিই তো এক ছেলের মা।
কিন্তুক তুমি বেওয়া বটে!
এটাও ঠিক। কী ব্যাপার? না সধবা এক ছেলের মা ভোরে উঠে বাসি মুখে বাসি কাপড়ে একটি বাটি নিয়ে গাছতলায় পুঁতে দেবে। তা হলেই বৃষ্টি থেমে যাবে। কিন্তু এক ছেলের মা পাওয়াই তো দুষ্কর।— মধুবন বিড়বিড় করে বলল— ইসস যশোমাসি যদি থাকত! কে জানত মুড়কিশোলায় যশোমাসির দরকার পড়বে।
তার তিন দিন পরে আর কারও বাড়ি রান্না হচ্ছে না। কাঠকুটো সব ভিজে গেছে। আগুন জ্বলবে না। দুর্যোগে কেউ বেরোতে পারছে না। জামডুবির মাঠে একজন বজ্রাঘাতে মারা গেল। মুড়ি-চিঁড়ে মুড়কি ফুরিয়ে এল।
রুস্তম বলল— যার বাড়িতে যত কাঠকুটো আছে জড়ো করুন। এক জায়গায় রান্না হবে। সবাই চাল দেবে। যা হবে সবাই খাবে।
তিন-চারটে উনুন জ্বলল। ভাত বসল। প্রথম প্রথম তাতে একটু আধটু আলু-টালু পড়ল, তারপর স্রেফ ফ্যানভাত।
সাত দিন প্রায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টির পর দেখা গেল ফণা তুলে জল আসছে। বান বান— চতুর্দিকে রব উঠল। নদী অনেক দূর। চুটকি নদী গন্ধেশ্বরী। কিন্তু নদী তো! তার সঙ্গে কংসাবতীর যোগও বোধহয় আছে। সেই নদী দিয়েই বান ঢুকে পড়েছে খেজুরপটির খালে। খাল উপচে এখন সব ভাসাচ্ছে। এই খালকে একটা আধ-শুকনো নালা ছাড়া কিছু মনে হত না। সে এখন ফুলে ফেঁপে সব ভাসাচ্ছে।
মধুবন ক্ষীণস্বরে বলল, কোথাও থেকে হেলপ আসবে না, দাদা!
কী জানি, বুঝতে পারছি না। স্টেশনে যাব ভাবছি।
না না আমায় ফেলে তুই যাবি না।
ইসস মধুবন, তোকে অনেক আগে বাড়িতে রেখে আসা উচিত ছিল আমার।
তোর বিপদটাও তো বিপদই, নাকি।
রুস্তম বলল— এদের বিপদটাও বিপদ। খরা-বন্যার কথা, আমলাশোল, চা-বাগান, উত্তরবঙ্গের কথা শুনি, পড়ি। দিস ইজ দা ফার্স্ট টাইম উই নো হোয়াট ইট ইজ।
বেশ কিছু পুরুষ এসে রুস্তমকে বলল— চলুন দল বেঁধে যাই কিছু যদি খবরাখবর দেওয়া যায়।
তুই গেলে আমিও যাব— মধুবন গোঁ ধরল।
তুই এমনিই খুব উইক হয়ে গেছিস। চিঁ চিঁ করছিস, পারবি না, তোকে নিয়ে বিপদে পড়ব।
অনেক বুঝিয়েসুজিয়ে তাকে পরির জিম্মা করে জিওলিনের স্টক ধরিয়ে দিয়ে দশ-বারো জনের দলের সঙ্গে রুস্তম বেরিয়ে পড়ল। ভোর-ভোর। জামডুবির মাঠের ওপর দিয়ে জল বইছে। তবে বেশি নয়। বেশির ভাগ জায়গাতেই গোছ-ডোবা জল। রুস্তমের হাতে টর্চ। ভাগ্যিস সে বেশি ব্যাটারি সঙ্গে এনেছিল। অন্যদের হাতে টিমটিমে একটি লণ্ঠন। যখন দরকার হবে জ্বেলে নেবে।
বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে সমানে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, হঠাৎ দমকাবৃষ্টি। শনশন হাওয়া। তিন ঘণ্টা জল ঠেলে হেঁটে স্টেশনে পড়ল ওরা। যত দূর দেখা যায় জল শুধু জল। লাইন জলের তলায়। স্টেশন মাস্টারের ঘর ফাঁকা। কোয়ার্টার্স ফাঁকা। তালা দেওয়া। চলো পরের স্টেশন পর্যন্ত। রাস্তায় বড় বড় গর্ত। পা পড়লে আর দেখতে হচ্ছে না। জনার্দন বলল, চলো আমরা হাইরোডে উঠি গিয়ে। বাঁকড়ো ঘুর হবে। কিন্তু পথে ট্রাক পাওয়া যেতে পারে।
বিকেল নাগাদ কী ভাগ্য একটা ট্রাক আসছে দেখা গেল। সবাই মিলে জলভরা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ট্রাক থামায়।
আপনারা ফিরে যান, আমি এই ট্রাকে গিয়ে দেখি কত দূরে যাওয়া যায়। খবর দিতে হবে। কিছু খাবারদাবার চাই। গ্লুকোজ চাই।
জনার্দন বলল— তা হবে না শহুরেবাবু, আমাদের বিপদে ফেলে তুমি পালাবে।
কী আশ্চর্য! পালাব কেন? আমার বোন রয়েছে না আপনাদের কাছে!
পেটের খিদের কাছে ভাইবোন কেউ নয়— একজন হিংস্রভাবে বলল।
ঠিক আছে আর একজন আমার সঙ্গে আসুক। তা হলে হবে তো! —সুতরাং মাধব সামন্ত চলল।
সকাল থেকেই সন্ধে, সন্ধে থেকেই রাত এখন। অন্ধকার কুপকুপ করছে। ঝিঁঝি আর ব্যাঙের চিৎকারে কান পাতা যায় না। পরিদের ঘর একটু উঁচুর দিকে, তাতেও সব তক্তপোশে উঠে বসেছে।
হঠাৎ একটা হল্লা মতো শোনা গেল। অনেক লোক যেন চিৎকার করতে করতে আসছে। দেখতে দেখতে পরিদের ঘরের সামনে একদল মারমুখো মেয়েপুরুষ এসে দাঁড়াল। চেঁচাচ্ছে —আমাদের বাচ্চাগুলো পটাপট মরে যাচ্ছে। আজ সিকন্দরকে মাটি দিয়ে এলুম। গত কাল যুগলো গেল। তোদের ঘরের ওই কটা ডাইনিটাকে বার করে দে। কালবিষ্টি আর বান নিয়ে এয়েচে। দে ওকে বার করে। ডাইনি নিকেশ করে তবে শান্তি স্বস্ত্যেন করব— অনেক গলা। এ একটা বলছে তো ও আর একটা বলছে। সব ছাপিয়ে খ্যানখ্যান করে উঠল ঠাকমাবুড়ির শান দেওয়া গলা। হাঁটু জল ভেঙে উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে বুড়ি।— কার এত বড় বুকের পাটা? এগিয়ে আয় সামনে। ওদের আনা লজেন, বিস্কুট, চাল, চিনি খেতে মনে ছিল না? ওই যে ছাওয়ালটা দুয্যুগ মাতায় করে খপর দিতে গেল? ওষুদ দিয়েছে সমানে। উপোস করচে আমাদের সঙ্গে— ডান! থুঃ, ডান হলি তোরা! এক কড়ার মুরোদ নেই। ছেলেগুলোকে যে গুড়-নুনের জল খাওয়াতে বলে গেল। খাইয়েছিলি! সমানে গেরাম সুদ্ধু ওষুধের গুলি বিলোচ্চে কে? লজ্জা করে না!
পরি ঘরে এসে হাতড়ে হাতড়ে মধুবনকে ছুঁল। দিদি ও দিদি। —মধুবন কাঁপছিল, কাঁদছিল নিঃশব্দে।
অন্ধকারে পরি তার মুখটা আন্দাজে খুঁজে কিছু একটা গুঁজে দিল— একটু খাও। —বেশ নরম নরম, গরম গরম, পোড়া-পোড়া গন্ধ।
কী দিলি এটা? তোরা খেয়েছিস? এটা কি মাশরুম? ব্যাঙের ছাতা?
খেয়েছ খাও। আমরা কত রকম খাই, সব কি তুমি জানো? না জানার দরকার! আমরা সবাই খেয়েচি। …জনাকাকারা তো এই ফিরল। হাইরোডে টেরাক পেয়েচে। দাদা আর মাধবকা চলে গেছে খবর দেবে। কাঁদচ কেন? শোকেতাপে মানষের মাতা এমনি খারাপ হয়ে যায় গো! দেকো না দাদা গেছে, এইবার একটা উপায় হবেই।
মীনাক্ষী বিজেনকে বললেন— ছেলেমেয়ে দুটো গিয়ে অবদি একটা খবর দিল না! একটা ফোনটোন তো করবে!
ওখানে টাওয়ার কোথায়? কী যে বলো!
তা হলে চিঠি! চিঠি তো দিতে পারে!
তুমিও যেমন! রুস্তম লিখবে চিঠি! চিঠি কাকে বলে জানে?
দিনটা যশো-সুহৃতের বিবাহবার্ষিকী। হোটেল সানশাইন-এ পার্টি। কলকাতার পরিচিতরা সবাই এসেছে। এখানকার পরিচিতও কেউ কেউ। মীনাক্ষীরা সঙ্ঘমিত্রাদের সঙ্গে গ্যাংটক ঘুরে এসেছেন। বহু দিন পর এমন বেরোনো! কালই বেশির ভাগ ফেরত যাবেন? একমাত্র যশো মধু আর সুবুল ডাক্তার ছাড়া সব্বাই দার্জিলিংকে কেন্দ্র করে প্রচুর ঘুরে নিয়েছে। ব্যাঙাদারা গিয়েছিল ফালুট। বিজয়মুকুলদা ট্রেকিং করে এল সন্দকফু। যুগেশকুমার লাভা লোলেগাঁও। সব রং কালো, ফাটাফোটা রুখু মুখ সব। ব্যাঙাদার মিসেস পরচুলা বদল করেছে।
ড্রিঙ্কসের ব্যবস্থাও আছে। পাবলো সব তদারক করছে— দেখো আবার ছেলের সামনে ঢলাঢলি কোরো না, যশো বলল সুহৃৎকে। মধু বললে— সুহৃৎদা এমনিই যা করছে বটে হুইস্কি পড়লে আর দেখতে হবে না!
সুহৃৎ বললেন— ছোঁবই না হুইস্কি। বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসেছি বাবা!
বাঘ? বাঘ কোথায় পেলেন এখানে?— সুবল ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন।
বাঘ? বাঘ বললুম বুঝি। সিঙ্গিও বলতে পারো। যা কেশর।
কী ব্যাপার?— সুবল একবার এর দিকে একবার ওর দিকে তাকান।
মধু বলল— ও একটা ফ্যামিলি জোক আমাদের আপনি বুঝবেন না সুবুলদা।
মিহির এবার চিতার হাত থেকে ফিরে এলে হয়—শালির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে সুহৃৎ বললেন।
মধু বললে— ভাল হবে না সুহৃৎদা! কোনও চিতা, নেকড়ে, হায়না সিনেই নেই।
সুবল বললেন— এটাও কি ফ্যামিলি জোক?
মধু জোর গলায় বলল— আজ্ঞে হ্যাঁ। এসব আমাদের নিজেদের ব্যাপার। নাক গলাতে আসবেন না।
ওদিকে মীনাক্ষী পার্টি মাটি করেন আর কী! চিকেন তন্দুরি মুখে দিয়ে বলেন— কী রকম ইঁদুর-ইঁদুর গন্ধ ছাড়ছে যেন!
ব্যস আর যায় কোথায়! মেয়েরা সব হাত গুটিয়ে বসল। বিজেন শুঁকেটুকে বলেন— ইঁদুর পোড়া, ব্যাং পোড়া কিন্তু খেতে ভাল, সাঁওতাল টাওতাল আদিবাসীরা তো খায়ই। চিকেনের সঙ্গে এইটুকুই তফাত যে ওগুলো আরও তুলতুলে।
আপনি খেয়েছেন নাকি দাদা? সুহৃৎ সোৎসাহে জিজ্ঞেস করলেন।
মহামাংস ছাড়া সব রকমের মাংস আমার টেস্ট করা আছে ভাই। অক্টোপাস ভাজা, ডলফিনের মাংস, সাপ, সব।
যশো ওয়াক তুলে বললেন— আমি ওয়াক আউট করব বিজেনদা। ছি ছি কী ঘেন্না। মীনাক্ষী বললেন— নাঃ তোমার একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই।
বাঃ তুমিই তো শুরু করলে!
সুহৃৎ আর সুবল তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে হোটেলের রান্নাঘরে কমপ্লেন জানিয়ে এলেন। তারা কিচেন খুলে দিল, দেখে নিন সার।
কোথাও কিছু নেই। তবু মীনাক্ষী চার দিকে ইঁদুর-ইঁদুর গন্ধ পেতে থাকেন।— আমার শরীরটা কেমন করছে ভাই। আমি উঠি।
জলটা ফুটোনো খাচ্ছেন তো?— সুবল ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।
ফুটোনো বলেই তো জানি!
শোবার আগে মীনাক্ষী বেশ খানিকটা বমি করে এলেন। ভাগ্যিস পরের দিনই টিকিট কাটা আছে। সোজা বাগডোগরা। সেখান থেকে ঘণ্টা দেড়েক কলকাতা।
পনেরো দিনের দীর্ঘ ট্যুর সেরে দু’জনে বাড়ি ফিরলেন। এত ছুটি আগে কখনও ম্যানেজ করতে পারেননি বিজেন। বাড়িতে তালা। মানে তারা ফেরেনি। টেলিফোনে কি কোনও মেসেজ আছে?— না। লেটার বক্সে কোনও চিঠি? —নাঃ।
বিজেন তেড়ে-ফুঁড়ে অফিস করতে লেগেছেন। কিন্তু মীনাক্ষী না পারছেন নারীকল্যাণ, না পারছেন সংসার। ছেলেমেয়ে দুটো তো আশ্চর্য! একটা চিঠি তো অন্তত…! একদিন স্বপ্ন দেখলেন সমুদ্রের মধ্যে একটা বেলুনে বসে তিনি ভাসছেন। কোথা থেকে পাবলো এল। পাবলো তবু সে পাবলো নয়। তিনি বললেন, একটু ঠেলে দে না রে বাবা, নইলে চলছে না! এক দিনে পাবলোকে খুব পছন্দ করে ফেলেছেন মীনাক্ষী। ঋজুর মতোই খানিকটা তবে ঋজু অনেক সিরিয়াস ধরনের। কখন কী করছে বা করতে চায় সে সম্পর্কে বাবা-মা’র সঙ্গে কোনও আলোচনা করে না। পাবলো কী সুন্দর শরবত ড্রিঙ্ক পরিবেশন করে। বাবার সঙ্গে দার্জিলিং যায়। বাবা-মা’র বিবাহবার্ষিকীতে কী সুন্দর মজা করল। গান করল। ভাবতে ভাবতে তাঁর ঋজু-মধুবন-তৃষ্ণা এমনই জোরালো হয়ে উঠল যে তিনি যশোকে একখানা ফোনই করে ফেললেন?
কী রে যশো? ফিরলি? বেশ হোল ফ্যামিলি মজা করে, বল!
আর বলিস না মিনি। টিকিট কি পাওয়া যায়! শেষে বিজয়মুকুলদা আর সুবুলদা স্যাক্রিফাইস করল। ওদের টিকিটে এঁরা এলেন। ধরলে কী হত জানি না। নট ট্রান্সফারেবল লেখা থাকে তো! পাবলো কী করে ৫৪/৫৫-র সুবুল ডাক্তার হয় তাই ভাব।
কী আবার হত। পাত্তি দিলেই সব মাফ। এ দেশে সবই চলে। তোকে এমন ভাব করতে হবে যেন হাতে মাথা কাটতে পারিস, আর চাই পাত্তি। যা খুশি কর, সার্টিফিকেট বেরিয়ে যাবে।
যা বলেছিস— যশোর কথাবার্তায় কেমন একটা নতুন নতুন ছলকানি। সামহাউ যশো খুব খুশিতে আছে।— তা মধুবনরা ফিরল?
না রে খুব ভাবনা হচ্ছে, ফিরলও না কোনও খবরও নেই। পাবলো কিছু জানে?
পাবলো? পাবলো কী জানবে? জানলেও বলবে নাকি? সে বান্দাই নয়। বন্ধুদের সিক্রেট তার প্রাণভোমরা।
কেন তোর ছেলেটা তো খুব নেটিপেটি। কী সুন্দর ফ্রাঙ্ক, মা-বাবার বন্ধুদের জেনারেশানের সঙ্গে কী চমৎকার মেশে।
যশো হো হো করে হাসল— পাবলোকে তুই এই বুঝেছিস? ও শালা বহুরূপী। এই দ্যাখ হলদে, দ্যাখ না দ্যাখ সবুজ হয়ে গেছে। মহা সেয়ানা।
তুইও কম সেয়ানা নোস। তোর ছেলে সেয়ানা হবে এ আর বেশি কথা কী?
সেই সময়ে বাঁকুড়া দুর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে এক গণ্ডগ্রামের দিকে এগোচ্ছিল চার-পাঁচটি ট্রাক। বাঁকুড়ার ডি এম এ-র সঙ্গে যোগাযোগ করেছে রুস্তম।
অঞ্চলের খবর পৌঁছেছে সরকারি দফতরে। ত্রাণ যাচ্ছে। চিঁড়ে গুড়, চিনি, চাল, কেরোসিন, তেরপল, ওষুধ, গুঁড়ো দুধ, লবণ। বাঁকুড়া শহরের গেরস্তদের থেকেও তোলা হয়েছে পুরনো জামা-কাপড়ের বোঝা। চাল-ডাল। রুস্তম নিজে কিনেছে পাউরুটি, বিস্কুট। শুকনো মিষ্টি, গ্লুকোজ প্রচুর। জলের গাড়ি আসছে পেছন পেছন।
জামডুবির মাঠ থেকে জল সরে গেছে। কাদা থকথক করছে সেখানে।
ডি এম গ্রামের নামই শোনেননি মনে হল। বৃষ্টিতে হাল সব জায়গাতেই খারাপ। কিন্তু গন্ধেশ্বরী নদীর দরুন এমন একটা বান হয়ে যেতে পারে, কেউ ভাবেনি। এখন বাঁকুড়া শহরে শুকনো খটখট করছে। আর একটু বৃষ্টি হলে ভাল হত যেন।
লোক্যালাইজড রেন সব, অদ্ভুত। ডি এম বললেন— তা ভাই তুমি ওখানে মানে কী করে গেলে?
বাংলার একটা গ্রাম স্টাডি করার দরকার পড়েছিল।
তা এত গ্রাম থাকতে অমন ধাপধাড়া গোবিন্দপুর! মুড়কিশোলা?
ভাগ্যে গিয়েছিলুম। তা নয়তো চেহারাটা দেখতে পেতুম না। আপনার ঠিকেদারের মধ্যে দিয়েই আমার গোটা ভারতের ঠিকেদারদেরও চেনা হয়ে গেল।
সে আবার কী করল?
কী করল না সেটাই বলুন। চালটা পচা। গুঁড়ো দুধে ময়দা মেশানো, চিঁড়েতে গন্ধ বেরোচ্ছে। পুরনো তেরপল আর প্লাস্টিক শিট দিয়ে নতুনের দাম নিচ্ছে। এত ভেজাল সত্ত্বেও আবার প্রত্যেকটি জিনিসের ওজন কম। আর বলবেন না।
আমার পক্ষে কি আর ওজন দেখা সম্ভব, কাজ কি একটা? তুমিই বলো ভাই।
ওজন হয়তো পার্সন্যালি দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু কারচুপি করলে সাজা হবে এ ভয়টাও তো ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।
সমস্ত ওজন করাতে, গোনাগাঁথা করাতে, বাজে জিনিস ফেলে দিয়ে জেনুইন জিনিস তোলাতে, প্যাক করাতে পুরো আড়াইটে দিন শুধু শুধু নষ্ট হয়ে গেল আমার। কে জানে কতগুলো মানুষ মারা গেল। পরের ট্রাকগুলো দয়া করে পাঠাবেন ঠিক।
তাই ঠিকাদার তোমার ওপর অত খাপ্পা! —মানুষ মরার কথাটা কানেই তুললেন না ভদ্রলোক।
আমি কমপ্লেন লিখে দিয়ে যাচ্ছি ওর ঠিকেদারির বারোটা যদি না বাজাই তো আমার নাম ঋজুরুস্তম নয়।
কী নাম? কী নাম? ঋজুরুস্তম? নিউ জেনারেশনের অদ্ভুত সব নাম হচ্ছে। কে দিল ভাই?
বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোক আবহাওয়াটাকে হালকা করতে চাইছেন।
রুস্তম কোনও জবাব দিল না। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বোনটা কী অবস্থায় আছে কে জানে!
জামডুবির মাঠ অর্ধেকটা যেতে না যেতেই প্রচুর লোক গাড়ি ঘিরে ধরল। তেঁতূলতলা, মুড়কিশোলা, আমড়াতালি … তাদের তক্ষুনি ত্রাণ চাই। এ ওকে মাড়িয়ে, ভেদ করে ছুটে আসছে।
ঠিকেদারের লোক বলল— আমরা এইখানে সব ডাম্প করে দিয়ে চলে যাচ্ছি। এই হাড়-হাবাতের দল এক্ষুনি লুটপাট মারধর করবে।
ইয়ারকি নাকি! —রুস্তম তার কাউন্টি ক্যাপটা উলটো করে ঘুরিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলল— ভাল চাও তো ট্রাক চালিয়ে চলো।
গাঁয়ের রাস্তায় ট্রাক চলবে না।
আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন তো চলো।
লোকগুলো সরে না যে— মানুষ মারবে নাকি? আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি!
আমি কেমন লোক দেখাচ্ছি। —রুস্তম লরির ওপর থেকে দু’হাত মুখের দু’পাশে ধরে চিৎকার করে বলল— আপনারা ক’জন এখান থেকে চলে যান। গ্রামে ফিরে গিয়ে এক্ষুনি সব সার বাঁধিয়ে দাঁড় করান। সব্বাই যা বরাদ্দ তাই পাবে। নইলে ট্রাক ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকজন এখানে আসুন, লরিতে চড়ুন।
অনেক কষ্টে এই দাদা জিনিসপত্তর জোগাড় করেছে— মাধব চেঁচিয়ে বলল। সবাই সব পাবি— একদম বেইমানি করবি না। গাঁয়ের নাম খারাপ করবি না।
খুট খুট করতে করতে জামডুবির মাঠ শেষ পর্যন্ত পার হল ট্রাক।
গাঁয়ের সব লোক সার বেঁধে বেঁধে দাঁড়িয়েছে। জনা প্রতি বস্তা আলাদা বাঁধিয়েছে রুস্তম। পরপর সব বিতরণ করতে করতে এক জায়গায় এসে থেমে গেল রুস্তম। মধুবন দাঁড়িয়ে আছে।
নে হাত পাত, ত্রাণ নে— রুস্তম হেঁকে বলল।
মধুবন করুণ স্বরে বলল— দে।
শহরে যে গেলি বাড়িতে একটা খবর দিয়েছিস? বোন বলল।
দাদা বলল— আমার মাথার ঘায়ে তখন কুকুর পাগল, বাড়িতে খবর! কী খবরটা দেব?
জল সরে গেছে। ঠাকমা বলল— সেই আমার ন্যাংটো কালে একবার এরকম বান দেখেছিলুম। বাব্বাঃ।
মীনাক্ষী জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দুটো ট্যাক্সি এসে থামল। ভেতর থেকে কারা নামছে ওরা? একদল ভিখিরি মতন! একজন আবার জিনস পরা, একটা রোগা মতন আধ-ফরসা মেয়ে ওপর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল— মা! ও মা!
ও কী? ও যে মধুবন? নিজের মেয়েকে চিনতে পারছেন না মীনাক্ষী। আরে ওই তো জিনস-এর এক হাতে বালা, এক কানে মাকড়ি। ও তো ঋজু!
এ কী দশা! পেছনে পিলপিল করে ক’টা মেয়ে নামল। পরি … তাই তো! কী চেহারা হয়েছে! ব্যাক টু স্কোয়্যার-এ। তার চেয়েও খারাপ।
মধুবন লিড করছে, প্রসেশন বাড়ি ঢুকল। রুস্তম নীচ থেকে চেঁচিয়ে বলল— মা আড়াইশো টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দাও শিগগিরই।
বিস্ময়ে, ভয়ে, মীনাক্ষীর মুখ দিয়ে কথা সরছে না।
পরি প্রণাম করে বলল মা, এ আমার বোন বাতাসি। এ পাশের বাড়ির তুলসী, এই যমুনা, এদিকে আয়, গঙ্গা, দাঁড়িয়ে রইলি কেন? লক্ষ্মী! শোভা! মাকে সব পেন্নাম কর।
মধুবন কোনওমতে বলল— ওরা সব আমাদের বাড়ি কাজ করবে মা। বলে-টলে সে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
সুবুল ডাক্তারের কাছেই কল গেল। সব্বাইকে একধার থেকে পরীক্ষা করে তিনি ভিটামিন লিখে দিলেন, বললেন— সব ম্যালনিউট্রিশনের কেস। স্রেফ ভাতমাছ খাওয়ান, দু’দিনে চাঙ্গা হয়ে যাবে। সব প্রেশার লো। সুগারও খুব লো মনে হচ্ছে।
চানটান করে ধোপদুরস্ত পাজামা-পাঞ্জাবি পরে রুস্তম বাইরে এসেছে। বলল— তোমার নারীকল্যাণ সমিতির ভরসাতেই এদের আনলুম মা। তুমি যে কত বড়, কত বেসিক একটা কাজ করছ সত্যি আমি আগে বুঝিনি মাম্মি। শুধু শুধু ঠাট্টা-তামাশা করেছি।
ওরা সব চান করেছে। ভাতমাছ খেয়েছে। নীচের খাবার ঘরে ঢালাও কার্পেট পেতে, পাখা চালিয়ে এখন মড়ার মতন ঘুমোচ্ছে। ঋজুরুস্তম আর মধুবনেরও সাড় নেই কোনও। মীনাক্ষী একবার এর কপালে একবার ওর কপালে হাত রাখলেন। ইসস, মধুবনের কি সত্যিই বারো না হোক বত্রিশ কেজি ওয়েট হয়ে গেল? ঋজুটা খাড়া আছে। অসম্ভব মনের জোর। তবে টসকেছে ঠিকই। জামাকাপড়গুলো ঢলঢল করছে। মুখটা পুড়ে ঝামা হয়ে গেছে। সরু হয়ে গেছে মুখটা। পা টিপে টিপে ফোনের কাছে যান মীনাক্ষী।
যশো, যশো আছিস!
হ্যাঁ রে মিনি, আছি, কী খবর?
ভাল খবর। কাজের লোক খুঁজছিলি না?
কখন আবার খুঁজলুম! আমার তো রান্নার, বাসন মাজার সব লোক রয়েছে।
তা জানি না বাবা, দেশ থেকে আনিয়েছি। খুব ভাল মেয়ে। তোদের অত বড় বাড়ি। ঝাড়াপোঁছা করতে, হাতেনাতে কাজ এগিয়ে দিতে একটা ফরমাশের লোক লাগবে না! কী করেই যে দিনরাতের লোক ছাড়া থাকিস! কিছু মনে করিসনি যশো, জ্যাঠামশাই বড্ড কঞ্জুষ ছিলেন। তোর অবশ্য দিল খুব দরাজ। তোদের দু’বোনেরই। দু’জনে দুটো রাখ। ভাল দেশের মেয়ে সব। যদি বলিস তো আমি নয় হপ্তাখানেক ট্রেনিং দিয়ে পাঠাব। মধুকে ডাক। তার দিল তোর চেয়েও দরাজ। সে একটা রাতদিনের লোকের মর্ম আরও ভাল বুঝবে। শোন বাজারদর অনুযায়ী মাইনে দিবি নইলে আমার ছেলেমেয়ে আমাকে আস্ত রাখবে না। ছাড়লুম।
আর একটা নম্বর ডায়াল করলেন মীনাক্ষী।
কে সঙঘদি?
না আমি রত্নাদি।
আমি মীনাক্ষী বলছি, সঙঘকে একটু দাও না।
সঙ্ঘদি রে, কপাল জোরে ভাল কাজের লোক পেয়েছি। দেশ থেকে এসেছে। ফাইফরমাশের লোকের কথা বলছিলি না?
ফাইফরমাশের লোক আমার বড্ডই দরকার রে মিনি। ছেলেগুলো আর তাদের বাবাগুলোর পেছনে বড্ড খাটতে হয়।
বেশ, তোকে দু’দিনের মধ্যে লোক পাঠাচ্ছি। আমি নিজে যাব।
ডায়াল আবার ঘুরল—
সন্তোষজি! ইয়ে আপ কি বহেন মীনাক্ষী হ্যায়, কাম কাজকে লিয়ে একঠো লোক মাঙা না আপনে! খুশি কি বাত কি উও মিল গয়ি। বহোত আচ্ছি লড়কি!
আরে ইয়ার, আমাদের তো ফুলচাঁদ একাই একশোখানা। সব করে। খানা পাকানা আমি খুদ করি।— বাংলাতেই বললেন সন্তোষজি।
কী কঞ্জুষি করছেন সন্তোষজি? এত খাটেন, আপনার হাত-পা টিপে দিতেও তো একটা লোকের দরকার।
ও ভি তো ফুলচাঁদ হি করতা!
ফুলচাঁদ? ওই দামড়া লোকটা আপনার গা-হাত-পা সব টিপে দেয়! বহোত শরম কি বাত, সন্তোষজি খবরদার ও কাজ করবেন না। লোকটা খুব সন্দেহজনক। আপনার মতো ইয়াং লেডির হাত-পা টিপে দিচ্ছে— এ কখনও ভাল কথা হতে পারে না। সে দিনই তো কাগজে দেখলুম— প্রেমচাঁদ নামে একটা লোক বাড়ির গিন্নিকে খুন করে আলমারি ভেঙে পাঁচ লাখ নগদ, পাঁচ লাখের গয়না নিয়ে পালিয়েছে।
আরে বাপ রে! বলছেন কী মীনাক্ষী বহেন। লেকেন ইয়ে তো হাম লোগোকাঁ আদত হ্যায়। জওয়ান নোকর সব আচ্ছা সে সাফা রাখে গা।
বেশ তো নোকর থাক না। পার্সন্যাল কাজকর্মের জন্যে একটা ছোট মেয়ে রাখুন না। আপনার হাসব্যান্ড অত বড় বিজনেস ম্যাগনেট, আপনাদের বাড়ি একটা চটপটে ফাইফরমাশের মেয়ে না থাকলে স্টেটাস থাকে!
উও বাত তো ঠিকই হ্যায় লেকিন উও ছোটি লড়কি, ঔর উও জওয়ান ফুলচাঁদ … এ ভি তো আচ্ছি বাত নেই হ্যায় মীনাক্ষীজি! রিসকি হোচ্ছে না?
ছাড়ুন তো! আপনি বাড়িতে সব সময়ে মজুত থাকতে সাহস পাবে? মেয়েটা খুব ভাল।
উনকো পুছনা হোগা।
পুছিয়ে, লেকেন জলদি কিজিয়ে। হামারি সোসাইটি কি প্রেসিডেন্ট ভি ঢুঁড় রহি। আপকি মাফিকই স্টেটাস, বিজনেসম্যান…
ব্যস বাড়ি সাফ। শেষ মেয়েটি সোসাইটির ঘরদোর সাফ করবে, গুছিয়ে গাছিয়ে রাখবে। মিটিংয়ের দিন চা-টা করবে। রাত্তিরে এ-বাড়ি এসে পরির কাছে শুয়ে থাকবে।
ঋজুরুস্তম চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গম্ভীর ভাবে বলল— মা তোমার নারীকল্যাণ সমিতির নামটা পালটে দাও।
কেন নামটা আবার কী দোষ করল?
ডোমেস্টিক হেলপ সার্ভিস! কমিশন নেবে পার পার্সন। ভাল রোজগার।
মীনাক্ষী ছেলের গঞ্জনা হজম করলেন। কিন্তু আর কী তিনি করতে পারেন। তাঁর সমিতিতে দুঃস্থ মেয়েরা সেলাই করে, আচার, জেলি, জ্যাম বড়ি তৈরি করে। তাঁরা সেগুলো মার্কেটিং করেন। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত তো সেখানে নেই। কী করবেন তিনি এই শহরে অনভ্যস্ত আনাড়ি, প্রায় নিরক্ষর মেয়েগুলোকে নিয়ে। ক’মাস পরেই এই মেয়েগুলোই চোখালো মুখোলো হয়ে যাবে। গায়ে গত্তি লাগবে। বাড়িতে টাকা পাঠাবে। সেই টাকায় বাপ-জ্যাঠারা সার, বীজ কিনবে, কেরোসিন। জামাকাপড় কিনবে, এক পয়সা খরচ নেই, মাস মাস পুরো টাকাটা। খারাপ হল? এরা সব আকাশে পা দিয়ে হাঁটে। কোনও প্র্যাকটিক্যাল সেন্সই নেই।
বোনকে রুস্তম বলল— যে-সময়টা জিমে আর হন্টনে দিতিস সে সময়টা এদের পড়ানোর কাজটা চালিয়ে যা। একটা সময় ঠিক করে দে। ওরা সব এসে তোর কাছে পড়ে যাবে।
আই এস সি-র রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। মেয়েগুলো সব্বাই একধার থেকে ভাল করেছে। ছেলেগুলোর হয়েছে একরকম মোটামুটি। পঙ্কজের বাবা বললেন— ব্যস, কারবারে লাগো। কী ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে ভোঁ ভোঁ করছ!
পঙ্কজ চুপচাপ গিয়ে পাবলোর সঙ্গে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভরতি হয়ে এল। কেমিস্ট্রি হনস। কার্জন ঢুকে গেল গোয়েঙ্কায়। উন্নী চলে গেল কানপুর আই আই টি। এবং সব্বাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে বল্লী প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাস নিয়ে ভরতি হয়ে গেল। মধুবন কাছাকাছি জে-ইউতে ঢুকল ইংরেজি নিয়ে।
বল্লী জয়েন্টে চান্স পেয়েছিল, উন্নী তাকে অনেক বোঝাল। হিস্ট্রি নিয়ে করবিটা কী?
হিস্ট্রি ইজ ওয়ান অব দা বেসিক সায়েন্সেজ অব সিভিলাইজেশন। আমি চেষ্টা করলে সবই পারব। কিন্তু ইচ্ছেটা আসল। আমি হিস্ট্রি পড়তে চাই। কীভাবে সভ্যতার গ্রাফ চলেছে। আপ অ্যান্ড ডাউন আপ অ্যান্ড ডাউন। আজকের জেনারেশনের কোনও হিস্টরিক্যাল এক্সপ্লানেশন আছে কি না আমায় জানতে হবে।
মধুবনের মা মীনাক্ষীর আজকাল খুব রেলা। একমাত্র মেয়ে ইংরেজি নিয়ে জে ইউ-তে। মেয়ে স্লিম। তবে তিনি সাবধান আছেন। তাঁর চেয়েও সাবধান আছে মধুবন নিজে। তবে কেউ জানে না— আসলে মধুবনের খাদ্যের ওপর সেই প্রচণ্ড আকর্ষণটাই চলে গেছে। সে চায় কিন্তু পারে না। মাটন মুখে তুলতে গিয়ে ইঁদুর মনে পড়ে যায়। চিকেনে ব্যাং ব্যাং গন্ধ। আইসক্রিম মুখে তুলতে গেলে সারি সারি কালো কালো ভুখা মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে। নিজেকে কী রকম হৃদয়হীন, অপদার্থ, হ্যাংলা মনে হয়।
এখনও সলিড খাবার খেতে পারছিস না? কত দিন চলবে তোর এই রোগ?
প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট তো বলছে সব ঠিকঠাক আছে।
মা আমাকে দুধভাত দাও।
খাবি? খাবি? দুধভাত খাবি— তিন লাফে মীনাক্ষী রান্নাঘরে চলে যান। গেলাস-ভরতি গো দুগ্ধ, ওপরে মোটা সর। থালায় বাসমতীর ভাত। মেয়ে খাবে বলেছে।
মধুবন দুধের ওপর থেকে সরটা তুলে একটা বাটিতে রাখে, বলে মা সর খেয়ে খেয়ে আবার যদি পঁচাত্তর হই আবার একটা মুড়কিশোলার দরকার হবে। তুমি দুধের সর পরিকে দিয়ো। খাটেখোটে ওর কিছু হবে না।
সুতরাং মধুবন দুধ খায়, পরি সর খায়। পরির চেহারায় চেকনাই আসে। মধুবন আগের থেকে কালো, রোগা থাকে। মেদের থাকের ভেতর থেকে তার আসল মুখখানি বেরিয়েছে।
যশোমাসির বাড়িতে ঢুকছে সে, পাবলোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দরজা খুলে পাবলো বলল— কে তুমি খুকু!
বাজে বকিস না। যেতে দে।
কী করে ঝরালি? সত্যি আমি তোকে চিনতে পারিনি। একদম চিনতে পারিনি। অন গড বলছি। আমার ঘরে একটা ছোটবেলাকার গ্রুপ ছবি আছে। সেইটার জন্যেই তোকে মেলাতে পারলুম। হ্যাঁরে তুই নাচতিস না?
তা নাচতুম! তো কী!
আমাদের ব্যান্ডে জয়েন কর।
তুই ব্যান্ড করছিস।
আরে সব রেডি। ব্যাপক বন্দোবস্ত। সবাই আছে গুরু। লেগে পড়।
ব্যান্ডে ক্ল্যাসিক্যাল ডান্স চলে না।
চলবে চলবে আমার ব্যান্ডে চলবে।
কেন? আমাকে কাজিন বলে স্বীকার করতিস না যে!
যা ব্বাবা কবে? পাবলো আবার কবে এই সব সম্পক্ক টম্পক্ক নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে! মধুবন ইজ মধুবন। কাজিন না ফ্রেন্ড তাতে কী এল গেল?
রোগা মধুবন কাজিন সে তোর ব্যান্ডে নাচবে, মোটা হলেই মধুবন আর মধুবন থাকে না, তখন তাকে হ্যাক থু করিস! শেম শেম! বলে মধুবন ভেতরে ঢুকে গেল।
পাবলোর মনে দৃঢ় সংকল্প জন্মাল মধুবনকে ব্যান্ডে আনতেই হবে। অত ভাল কত্থক আর ভরতনাট্যম আর কেউ জানে না। কবে যে সে মধুবনকে কাজিন বলতে অস্বীকার করেছিল তা তার মনেই নেই। যাচ্চলে!
মীনাক্ষীর রেলা শিগগিরই আরও বেড়ে গেল। তাঁর ছেলে ঋজুরুস্তম একটা দশ লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলারের প্রজেক্ট আপাতত পেয়েছে, তার মুড়কিশোলা গ্রাম পর্যবেক্ষণের পুরস্কার হিসেবে। প্রথম কিস্তি। ক্যানবেরা ইউনিভার্সিটি ভীষণ ইমপ্রেসড্। এই প্রজেক্টের ফলে মুড়কিশোলা এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং তার হাতে, খোদ অস্ট্রেলিয়া থেকে দু’জন আসছে তার সঙ্গে কাজ করতে। শিগগিরই ঋজু ফিরছে। কথাবার্তা সেরে। মীনাক্ষীর সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না! ছেলে ডলারে রোজগারও করবে, আবার দেশেও থাকবে। আপাতত বাঁকুড়ার ডি এম তাকে তাঁর বিশাল বাংলোর একটি বিশাল ঘর অফিস করবার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। ঋজু এক্সপার্টদের পরামর্শ নেবার জন্য নানান জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া। জমির পার্থক্য পশুপালনের খুঁটিনাটি, মৌ চাষ, জল সংরক্ষণ।
রত্নমালা-সঙ্ঘমিত্রা খুব দমে গেছেন। সঙ্ঘমিত্রার মুখে আর চটপট মজাদার ফাজলামি শোনা যায় না। ছেলে পল্টন মাকে সাবধান করে দিয়েছে কার্জনকে কিছু বোলো না যেন, ও ভীষণ সেন্টিমেন্টাল। কী থেকে কী হয়!
রত্নমালা শিউরে উঠেছেন— কী বলিস তুই? যা করেছে ভাল করেছে। আমি তো ওকে খারাপ কিছু দেখছি না— দুঃখী- টুঃখি! একটু যেন উদাস উদাস, অন্য কোথাও চলে গেছে মনে মনে— তো এটা ওর বরাবরই আছে। কী বল সঙঘ?
সঙ্ঘমিত্রা ঠোঁট উলটে বলেন— তুমিই ভাল জানো বিন্দুবাসিনী তোমার অমূল্যধনের মন-মেজাজ। আমি কে? আমি কেউ না।
মধুবনকে দেখে যশো মূৰ্ছা যান আর কী! তুই? তুই কী করে এমনটা হলি!
মধুবন হেসে বলল— স্রেফ না খেয়ে মাসি। দিনের পর দিন না খেয়ে আধপেটা খেয়ে।
ধ্যাঃ। কোথায় যে বেড়াতে গেছিস শুনলাম!
ওই তো গঙ্গা যমুনা তোমাদের বাড়ি কাজ করে ওদের ‘গেরামে।’
বলিস কী রে! সেখানে গোয়ালে গোরু, দিঘিতে মাছ, গাছে ফল, ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা চলে। তোকে না খেয়ে থাকতে দিলে?
কে বলেছে তোমায়? মাছ, ফল, ধান… এসব!
কে আবার বলবে। গঙ্গাই বলছিল। যমুনাও সায় দিল।
কী বলছিল গঙ্গা?
ওই বলছিল— ওদের তো সবই বাড়ির খাঁটি জিনিস। খাঁটি দুধ, খাঁটি ডিম, খাঁটি মাছ, খাঁটি সবজি। একটু দুধ নইলে বেচারিরা ভাত খেতে পারে না। তা না হয় খেল। এ বাড়িতে দুধ দুধের সর যত কম হয় ততই ভাল। কী বল।
তা তো বটেই।
একটা কী সুবিধে জানিস! সরু চাল খেতে পারে না। চালের খরচটা আমার কম পড়ে। ভাবছি শঙ্করীটাকে ছাড়িয়ে দেব। গঙ্গাই সব করবে।
না না অমন কাজও কোরো না মাসি৷ শঙ্করীকে কী দোষে ছাড়িয়ে দেবে গো! তা ছাড়া গঙ্গা যমুনা লেখাপড়া করছে। সব করতে হলে…
লেখাপড়া করছে? গঙ্গা যমুনা? কোথায়? কখন?
ওই করে আর কী!
সর্বনাশ!
কেন মাসি!
অমন কাজের লোকটা আমার! লেখাপড়া শিখলেই ডানা গজাবে রে! মিনিটার এলেম আছে। কেমন ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়েছে।
মধুবন বলল— মাসি, গঙ্গা লেখাপড়া শিখে চলে গেলে তোমাকে আর একটা গঙ্গা এনে দেব গো। গঙ্গাদের শেষ নেই।
তা ভাল— তবে মেয়েটার ওপর মায়াও পড়ে যাচ্ছে। মেয়ে নেই তো? মেয়ে সন্তান দেখলেই বুকটা হু-হু করে বুঝলি!
তুমি যে বলতে আমিই তোমার মেয়ে!
সে তো বটেই। তুই হলি মেয়ে। আর গঙ্গা-টঙ্গা হল মেয়ে মেয়ে। তা এক গ্লাস মিল্কশেক খাবি? করি? এখন নিশ্চয় তোর রেসট্রিকশন উঠে গেছে।
মধুবন বলল— কী জানি! মিল্কশেক খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি মাসি।
তবে কী খাবি। এত দিন পরে এলি।
এক গ্লাস জল আর দুটো বাতাসা।
বাতাসা? বাতাসা কোথায় পাব? আচ্ছা মেয়ে তো তুই! ঠাট্টা করছিস।
মধুবন বলল,— জল-বাতাসা খুব ভাল জিনিস মাসি৷ জল আর গ্লুকোজ। সবচেয়ে সস্তা। ও কী মাসি! ওটা কার ছবি!
ছবিটার দিকে চেয়ে যশো নমস্কার করলেন।— ওটি আমাদের গুরুদেবের ছবি। অভীপ্সানন্দ মহারাজ।
তুমি গুরু করেছ!
তবে! বেলা যে পড়ে এল জলকে চল কবি বলেছেন কেন? একা আমি নই তোর মেসোও আছে।
বলো কী! মেসো যে একের নম্বরের নাস্তিক ছিল!
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তো মানুষের পরিবর্তনও হয়। তা ছাড়া আমাকে চোখে চোখে রাখতে হবে না?
তোমাকে? কেন?
তোর মেসোর ধারণা আমি সংসার ত্যাগ করতে পারি। ওর মা করেছিলেন তো। ঘর পোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়।
তাই বুঝি? তা তোমার কি সত্যি সত্যি সংসার ত্যাগ করার বাসনা হয়?
হয়েছিল, তোকে চুপিচুপি বলি, ইদানীং মনে হত কে বা কার কে তোমার! আমার বলতে কেউ নেই এ বিশ্ব সংসারে। একজন সারাদিন আপিস করছে আর একজন সারাদিন আড্ডা দিচ্ছে। বন্ধুই জ্ঞান বন্ধুই ধ্যান। তাই আমি গুরুতে মন দিলুম। অমনি গুরুই তাড়াহুড়ো করে সব ফিরিয়ে দিলেন। দেখলুম সব কিছুর সেন্টারে বসে আছি— এই আমি যশোধরা মুখুজ্জে। বুঝলি? ভগবানের সঙ্গে টাচটাও রইল। সংসারও বজায় রইল। গুরুদেব যখন হৃষীকেশ থেকে আসবেন তোদের ডাকব— অমৃতবাণী শোনাব এখন। তোর হবে। বুঝলি! তুই খুব ম্যাচিওর হয়ে গেছিস। আই এস সি-তে এ প্লাস করে তোর মলাট পালটে গেছে। তোর চোখের চাউনি দেখেই বুঝতে পারছি আমাদের সেই আহ্লাদি মধুবন আর নেই।
আশ্চর্য! এত লোকের মধ্যে যশোমাসিই একমাত্র এ-কথা বলল। তার পরিবর্তনটা ধরতে পেরেছে অনেকেই। কিন্তু সেটা ওপর ওপর। যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সেই বলছে,— কী রোগা হয়ে গেছিস! চেনা যাচ্ছে না তোকে। বল্লী সুদ্ধু, আজ পাবলোও সেই প্রসঙ্গই তুলল। মা খুব ব্যস্ত হচ্ছে যে তার খাবার রুচি চলে গেছে, মুড়কিশোলায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেয়ে। হাজার রকমের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, ডাক্তার, পথ্য। মা এই নিয়ে ব্যস্ত।
তার গোটা মনটাই যে পালটে গেছে, এটা কেউই ধরতে পারেনি। সবচেয়ে তরল, সবচেয়ে আহ্লাদি, বোকাসোকা যাকে ভাবা যেত সেই যশোমাসিই অবলীলায় ধরে ফেলল তাকে। কারণটা ধরতে পারেনি। কিন্তু আসল জিনিসটা ধরেছে। এমনকী সে নিজেও ঠিক এভাবে বোঝেনি নিজেকে। যশোমাসিই বুঝিয়ে দিল। সেই আহ্লাদি মধুবন আর নেই। তার মলাট ললাট সবই পালটে গেছে। সে বড় হয়ে গেছে মুড়কিশোলার ভয়াবহ, বিভীষিকাময় ঘটনায়।
ভেতরটা কি তার দমে গেছে? একটা খুব হালকা মজাদার সহজ সচ্ছল জীবনের মধ্যে বেঁচে ছিল। জীবনটা তো আদৌ এরকম নয়। এত রকম আলাদা আলাদা জীবন আছে! থাকে! রাত্রে ক্রিম মাখবে না— এটাই তো সে ভাবতে পারত না। দেখল রান্নার তেলই নেই। শাকভাত ছাড়া খাবার নেই, তা-ও যথেষ্ট নয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাবার জোগাড় করা, খাওয়ার জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা! শুনেছে খুব গরিব মানুষ আছে। বি পি এল বিলো পভার্টি লাইন শুনছে তো! কিন্তু বোঝেনি। আদৌ বোঝেনি। দুর্যোগে জলবন্দি। কোনও দিকে যাওয়ার উপায় নেই। কোথাও থেকে কেউ আসছে না। সন্ধে থেকেই কুপকুপ করছে অন্ধকার। মশার ঝাঁক। ব্যাং ডাকছে, কেমন ভৌতিক ডাক। অন্ধকারে যাতায়াত চলছে কঙ্কালসার মানুষগুলোর। ছেলেটার খুব পেট কামড়াচ্ছে, ছটফট করছে, দাদা ওষুধ আছে? ও শহুরে দাদা! দাদা ওষুধ নিয়ে বেরিয়ে গেল। এমনকী কিছু লোক মেয়ে ও ব্যাটাছেলে দুই-ই তাদের অপয়া ডাইনি-টাইনি বলতে শুরু করেছিল। কী ভয় করছিল তার। দাদা পর্যন্ত নেই। তারপর ভয়টা কেমন চলে গেল, মনে হল এই-ই তা হলে হবার ছিল। এইভাবে অপয়া ডাইনি-টাইনি বলে তাকে এরা মেরে ফেলবে। ফেলুক। তখন পরির পরিবার দশ হাতে তাকে আগলেছে। অপয়া! অপয়া! দিদি দাদার জন্যে যে মাছ ভেজে খেলে, শহুরে বিস্কুট লজেঞ্চুস খেলে মনে নেই, না? কে ওষুধ দিয়ে বাঁচাল চুনিকে, অঘোরদাদুকে, কে এখন ত্রাণ আনতে গেছে! থুঃ মড়ার দল। অপয়া!
খিদেয় নিঝুম হয়ে পড়েছিল সে। তখন ইঁদুরের মাংস, ব্যাঙের মাংস খাইয়ে টিকিয়ে রেখেছে তাকে পরিরা। কে জানে হয়তো সাপও খাইয়েছে। সে তখন জানতেও পারেনি। বুঝতেও পারেনি। কিন্তু প্রাণে বেঁচেছে। নাঃ এ অভিজ্ঞতা তার বন্ধুদের কারও নেই। বললেও বুঝতে পারবে না।
হঠাৎ তার মনে হল যশোমাসিরও একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। সংসারে কেউ কারও নয়। তা হলে গুরুতে মন দেওয়া যাক। যশোমাসির মতো উচ্ছ্বল, হাসিখুশি, ইয়ারকিপ্রিয় মানুষের পক্ষে একেবারে আশ্চর্য। এবং যশোমাসিও বদলেছে। না হলে তাকে আর কেউ বুঝল না, যশোমাসি বুঝল কী করে?
মধুবন বাড়ি এসে মাকে জানান দিল। মায়েরা ভাবে। মায়েরা অনুভব করে। মায়েদের জানাতে হয়। সে ছাদে চলে গেল। জুলাই মাসের আকাশ। আজকে অল্প অল্প মেঘ, তারাগুলো ফিকে ফিকে। মুড়কিশোলা গ্রামে বৃষ্টির আগে গ্রীষ্মের আকাশে সে দুর্দান্ত কালো রং আর তারাদের ঝকমকানি দেখেছিল। চাঁদের আলোয় জামডুবির মাঠে গিয়ে ছোটাছুটি করেছিল। মধুবন পাঁচিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েই আছে, দাঁড়িয়েই আছে। এই বিশাল আকাশের তলায় কলকাতাও আছে মুড়কিশোলাও আছে, আছে আরও কত জনপদ! কত বিচিত্র মানুষ কী অদ্ভুত নিঃস্ব তাদের জীবন যাপন। তার বুকের মধ্যেটা খাঁ খাঁ করতে লাগল। তা হলে কী লাভ! কিছু মানুষ যদি এমন নিদারুণ অভাবে সংকটে থাকে তা হলে বেঁচেই বা শেষ পর্যন্ত কী লাভ! পাবলোরা জানে না, বল্লীরা জানে না। তাই ওদের চলনবলনে কী আত্মবিশ্বাস যেন যা করছে ঠিক করছে। কোথাও কোনও ভুল নেই। সবটাই সত্যি। অথচ এই পুরো শহরটা জীবনটা তার কাছে কী ভীষণ অলীক হয়ে গেছে। পাঁচিল দিয়ে ঝুঁকে সে নীচটা দেখতে লাগল। অন্ধকার রাস্তা। আলো জ্বলছে। একটা দুটো লোক আসা যাওয়া করছে। বাড়িগুলো সব চুপচাপ। ‘ঊর্ধ্ব আকাশে তারাগুলি মেলি অঙ্গুলি ইঙ্গিত করি তোমা পানে আছে চাহিয়া।’ যদি সে এখন এখান থেকে ঝাঁপ দেয় নীচে, ভীষণ টানছে তাকে নীচের রাস্তাটা। পড়ে মরে যাবে। ব্যস এই সমাধানহীন অন্তহীন সমস্যার শেষ হয়ে যাবে। অন্তত তার নিজের জীবনে। তার এখন কারও কথাই মনে হচ্ছে না। মা, বাবা, দাদা— কারও কথা নয়। শুধু মনে হচ্ছে এভাবে চলবে না, চলতে পারে না। এ জীবনের কোনও মানে নেই। ‘নিম্নে গভীর অধীর মরণ উচ্ছলি শত তরঙ্গে তোমা পানে উঠে ধাইয়া।’
হেই হেই। এই মধুবন!
চমকে উঠেছে সে। অদূরে দাদা। এগিয়ে এল।
কী করছিস! মৌবটিকা!
হঠাৎ মধুবন দাদার বুকের ওপর মুখ রেখে কেঁদে উঠল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। দাদা কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। দাদাটাও যেন কেমন বদলে গেছে। মধুবনকে খ্যাপানো তার একমাত্র কাজ ছিল। দাদার মুখটা এখন অভিভাবকের হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ভরসার মুখ। দাদা অনেক অনেক কাছের মানুষ হয়ে গেছে তার।
বেরিয়ে আয়। এই মুডটা থেকে বেরিয়ে আয়। চল নীচে চল তো!
আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না।
ভাল লাগাতে হবে। মুখ হাঁড়ি করে থাকলে চলবে? তুইও তো করছিস। প্রথম কথা নিজেকে তৈরি করছিস। দ্বিতীয় কথা এই মেয়েগুলোকে তৈরি করবার চেষ্টা করছিস। কাজ কর। করে যা। বাস।
আর ঠিক পাঁচ বছর পরে মধুবন যখন স্কলারশিপ জোগাড় করে আইওয়ায় পড়তে যাবে, ছুটিতে ছুটিতে হিচ-হাইক করে দু’-একটি বন্ধুর সঙ্গে ঘুরবে, ক্যানিয়ন ভিলেজে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মহান প্রাকৃতিক স্থাপত্য ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আলোছায়া ও রঙের খেলা দেখবে, প্রকৃতি-সৃষ্ট ব্রহ্মামন্দির, শিবমন্দির দেখবে, বৌদ্ধ স্তূপের ওপর, তখন তার সঙ্গে আলাপ হবে তার চেয়েও ছোট, কিন্তু দেখতে বিরাট এক রেড ইন্ডিয়ান কিশোরের সঙ্গে। অত বড় শরীর কিন্তু কী বিনীত, এমনকী যেন একটু বা সন্ত্রস্তও। সামারে খাটতে এসেছে। রোজগার করবে। আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। একেবারেই আমেরিকানদের মতো নয়। অথচ সে-ই প্রকৃত আমেরিকান।
বল্লী— সে তার বন্ধুকে ই-মেল করবে। তুই ঠিক বিষয় বেছেছিস। ইতিহাস। মানুষ, মানুষের সমাজ কীভাবে ভাঙছে গড়ছে, কীভাবে সভ্যতার কোপ কার ওপর গিয়ে পড়ছে। কেন— এইসব জানা খুব, খুব জরুরি। আমি বুঝতে পারি। না জানলে আমি কেন, কোথায় দাঁড়িয়ে, এইরকম কেন মানুষের জীবনের, মনের গড়ন— একটুও বুঝতে পারব না। আমি সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে বুঝছি, বোঝবার চেষ্টা করছি— আলেক্স হেইলি, টোনি মরিসন, নাদিন গার্ডিনার পড়ছি। এই অজানা বিশ্বের মনুষ্যযূথকে আমি জানতে চাই। পড়ছি হার্ডির ওয়েসেক্স টেলস, ডিকেন্স আবার। খালি মগজের খেলা আমার ভাল লাগে না। খুঁজে খুঁজে বার করতে হয় আশ্চর্য সব জনগোষ্ঠীর কথা। এক হিসেবে আমিও তাই ইতিহাসই পড়ছি। — মধুবন।
মেলটা পাঠিয়ে সে চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে থাকবে। তখন তার মনে পড়বে সেই ফিকে তারার রাত। জুলাইয়ের আকাশ। নীচের রাস্তার তাকে টেনে ধরা চুম্বক টানে। মনে পড়বে— হেই মধুবন! কী করছিস! … বেরিয়ে আয় এই মুডটা থেকে। দাদার সেই ভরসা— তুইও তো কাজ করছিস!
তার মনে পড়বে দাদা বিপদ বুঝে তাকে কাউন্সেলিং করেছিল অনেক দিন। তার মনে পড়ে কীভাবে দাদা পাবলোর ‘ভ্যাগাবন্ড’-এর সঙ্গে মিশে তাকে দিয়ে নাচিয়ে গাইয়ে, হইচই করিয়ে, পরিদের দিয়ে ওদের টুসু গান গাইয়ে ভ্যাগাবন্ড-এর আসর জমিয়ে দিয়েছিল। তবু তার ভেতরের ডিপ্রেশন ঘোচেনি। দাদা তার প্রজেক্ট ওয়র্ক দেখাতে মুড়কিশোলা নিয়ে গেল জিপে। সেই জনাকাকা, সনাকাকারা ছুটে এল। ঠাকমা বলল— কী গো সাদা-ডাইনি, এলে আবার? অস্ট্রেলিয়ান নীল আর শন তাকে বুঝিয়ে ছিল ফার্মিংয়ের খুঁটিনাটি। দেখিয়েছিল মুরগির খামার। তার বিশাল ব্যবস্থাপনা। বান হয়ে নাকি ওদের জমি অনেক ভাল হয়ে গেছে।
রবি-চাষ হচ্ছে তখন। চিনে বাদাম, তিসি তিল, নানা রকম সবজি।
মাঠঘাটের চেহারা পালটে গেছে। শীত বইছে শনশন করে। গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঠাকুমারা রোদে বসে।
তবু কি তার ডিপ্রেশন ঠিকঠাক ঘুচল!
দ্বিতীয় মেলটা সে দাদাকে পাঠাবে, ক্যানবেরায়—
দাদা, কেমন আছিস? তোর নিশ্চয় নিজের কথা ভাববার সময় নেই। তুই সব সময়েই কিছু না কিছু হিউম্যান প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। কত জরুরি মেল আসে তোর। বেশি পড়বারও সময় নেই। দাদা, তুই এই বিশাল পৃথিবীতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিস। আমি বোধহয় হারিয়ে গেছি। যে কাজটা নিয়েছিলুম, পারলুম কই। ওদের কাউকেই তো পুরোপুরি শেখাতে পারলুম না। গঙ্গা যমুনা বিয়ে করে পালিয়ে গেল। বরেদের মার খেয়ে, লোকের বাড়ি কাজ করে দিন চলছে। তুলসীটা অবশ্য মায়ের সমিতিতে বেশ সেলাই শিখেছে। রোজগার ভালই। মা দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছে। শোভার খবর ভাল না। বুঝতেই পারছিস! লক্ষ্মী এখনও পঙ্কজ ধুধুরিয়াদের বাড়িতে কাজ করছে। দেখ, পরিটারই মাত্র পড়াশোনার মাথা ছিল। কী চটপট সব শিখে নিত। পাটিগণিত একেবারে হাতের মুঠোয়। বাংলা হাতের লেখা কী চমৎকার! ম্যানার্স কী শিখেছিল! কে বলবে মুড়কিশোলার মেয়ে! টিভি দেখে দেখে কী যে মাথা ঘুরে গেল! সিরিয়ালে অ্যাক্টো করতে চলে গেল। নগণ্য সব রোল, তার জন্যে যে ওকে কী করতে হয় আর না হয়! ভগবান জানেন। মা তো বলছে বাড়িতে আর থাকতে দেবে না। অনেক কষ্টে মাকে আটকেছি। কাউকেই শিখিয়ে পড়িয়ে মুড়কিশোলায় ফিরিয়ে দিতে পারলুম না। কী আর পারলুম তবে!
রুস্তমের জবাবটা আসবে সঙ্গে সঙ্গে।— এখন অনেক রাত। তোর মেলটা পড়লুম। কে বলল তুই হারিয়ে গেছিস! হারিয়ে যাওয়াও একরকম খুঁজে পাওয়া। প্রত্যেকটা কাজে সেন্ট পারসেন্ট সাফল্য আশা করিস না, হয় না। যা করেছিস খুব করেছিস। আমাদের কাজ হিউম্যান ফ্যাক্টর নিয়ে। আনপ্রেডিক্টেবল। আমরা তো কোনও সিস্টেমের সাহায্যও পাইনি! ওরাও পায়নি। একেবারেই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা। এখন মুড়কিশোলার চেহারা পালটে গেছে। দ্যাখ কার ভেতরে কী আছে, কে ঠিক কী চায় শেষ পর্যন্ত সে নিজেই ঠিক করে। ওরা তোর কাছ থেকে কিছুটা রসদ সংগ্রহ করেছে। যে যার নিজের মতো বাঁচছে। ওদের ব্যাপারে তোর কাজ, তোর দায়িত্ব শেষ। সবাই কি আর যে যার মুড়কিশোলায় ফিরে যেতে পারে? আমি পারব কি না জানি না, তুইও পারবি কি না জানিস না। এই এক্সোডাস যদি রুটি-রুজির জন্যে বাধ্যতামূলক না হয়, যদি এর সঙ্গে আবিষ্কারের চৈতন্য থাকে তা হলে যেখানেই যাস তোর মূল ঠিক বেঁচে থাকবে। ভাবিস না। উঁহুঁ, ভুল বললুম— ভাবিস। —দাদা।
আপাতত সে জানে না তার এই অনাগত ভবিষ্যৎ। আপাতত সে নাচছে। পাবলোর কোরিওগ্রাফি। যশোমাসি হেলপ করেছে। ওদের হাত-পা ছুড়ে কত রকমের ক্রিয়েটিভ ডান্স। তারই মধ্যে সে আপন মনে তিল্লানা নেচে যাচ্ছে। কোনও কস্টিউম নেই। সাধারণ একটা ছাপা শাড়ি, কুঁচি তুলে পরেছে। মাথায় তার কাঁধ পর্যন্ত গোছা গোছা চুল ক্লিপ দিয়ে বাঁধা। নিরাসক্ত হয়ে শুনছে কার্জন কী সুন্দর খানিকটা গদ্য পড়ল। ক্রিটিক্যাল লেখা। তাদের জেনারেশন পৃথিবীকে কী ভাবে দেখে, কী চায়, কী পায়। পুরো গ্রন্থনাংশটাই ওর আর বল্লীর। কার্জন কবিতা লিখবে, এত সুন্দর গদ্য লিখবে কেউ কি কখনও ভেবেছিল? কিন্তু সামহাউ তার আশ্চর্য লাগে না। আনপ্রেডিক্টেবল। হিউম্যান ফ্যাক্টর ইজ অলওয়েজ আনপ্রেডিক্টেবল। এ সব যেন হবারই ছিল। হতেই পারে। পাবলোর নিজের হাতে আঁকা ‘ভ্যাগাবন্ড’-এর পোস্টার চার দিকে। তারাও রং বুলিয়েছে। ‘ভ্যাগাবন্ড’ দা ব্যান্ড অব দা জেনারেশন ওয়াই। আ টোট্যাল এন্টারটেনমেন্ট অ্যান্ড আ স্টেটমেন্ট।’ দৃঢ় রেখায় আঁকা স্কেচ, কালিতে, রঙে, চারকোলে। কার হাতে স্প্যানিশ গিটার, কার হাতে একতারা, কে আবার ডুগডুগি নিয়ে পোজ দিয়েছে। পাবলো কী স্বতঃস্ফূর্ত গাইছে! ও চিরকালই খুব ঘ্যাম গায়। তাই বলে নিজে এমন দুর্দান্ত ক্যাচি আবার মন গলানো কান্না নিংড়োনো মজাদার সব সুর দিয়ে গাইবে? এমন সব লিরিক? দাদা ছবি তুলছে। পাবলিসিটিতেও লাগবে। হল-ভরতি গমগম করছে। বল্লীও গাইছে, আরমান আর দাদা হেঁড়ে গলায় হাঁকার দিচ্ছে মাঝে মাঝে— ধ্যাত্তেরিকা! যাচ্ছেতাই। ব্যাটাচ্ছেলে! খাওয়াচ্ছি! সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পঙ্কজ সিনথিসাইজারে। তুলসী-পরি-শোভা-গঙ্গার গলায় পল্লিগীতি। একদম আলাদা গলা। আলাদা সুর। উচ্চারণ।
“আমার টুসু য্যামন অ্যামন, তোমার টুসু ভালা
উদের টুসু ফাস্টো কেলাস ঘর করেছে আলা – উদের ঘর করেছে আলা!
টুহুসু রে! ও টুহুসু রে! …”
পার্কাশনে একজন এক্সপার্ট ছেলে পাওয়া গেছে স্কটিশের স্যন্দন। স্পেশ্যাল এফেক্ট বিজয়মুকুলদার ছেলে বিনয়মুকুলদা। ওদের সবাই দাদা! বাবাও ছেলেও।
আমরা সবাই দাদা, আমাদের এই দাদার রাজত্বে।
মিটিং দাদা, মিছিল দাদা, তোলা দাদা ভোলা দাদা গ্যালো গ্যালো দাদার রাজত্বে আমরা সবাই ভ্যাদা।
দাদা যা বলে তাই শুনি
আমরা লেজকাটা টুনটুনি
এক টুনিতে টুনটুনাল লক্ষ টুনির ন্যাজ কাটাল
নাক কাটাল, কান কাটাল,
দাদার বড্ড গ্যাদা।
দাদাদের এই গ্যাদার রাজত্বে
আমাদের সবার গ্যাদা!
পেট উঁচু করে করে কাঠের পুতুলের মতো হেঁটে হেঁটে পাবলোরা তুমুল হাসির রোল তুলে সব জম্পঝম্প এক্কেবারে থামিয়ে দিল। এখন শব্দহীন প্রেক্ষাগৃহে গর্ভগৃহে কার্জনের বয়ঃভাঙা গলা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আলো অন্ধকারে যাই, ঘুমে বা নির্ঘুমে,
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে, যা যা কাজ করে
ভাবনা, বাস্তব, ঘটনা, কল্পনা
আশা হতাশা আত্মঘাত, অন্তর্ঘাত, অপঘাত
ধনাত্মক, ঋণাত্মক যা যা খেলা করে
লাল নীল হলদে কালো মাছেদের মতো
শ্যাওলার প্রবালের জলজের মতো
শূন্যের ওপর দিয়ে
যত রং, যত মেঘ, বায়ুকণা, পাখি পোকা চামচিকে উড়ে যায়
মরুঝড়ে যত বালুকণা
নদীবুকে যত জলকণা
আমাদের এই সব শহরের নির্গত নিশ্বাসে বিশ্বাসে
যত ধূম, বিষকণা
যত টক্সিন, যত ইনটক্সিক্যান্ট
সমস্ত কিছু মুঠোয় করে মুঠোয় করে মুঠোয় করে … ছড়িয়ে দিলাম।
এবার পাবলোর গিমিক। প্রেক্ষাগৃহ থেকে গাইয়েরা গাইতে গাইতে উঠে যাচ্ছে, গ্রুপে, একে, ভাগ করে গাইছে :
যে যেখানে আছ পেরেন্টস টিচার্স শোনো শোনো
যে যেখানে করে খাচ্ছ লিডার্স শোনো শোনো
আঠারো বছরে ভোটই হয় না বিবেকও হয়
ছড়িয়ে যাচ্ছে দংশন, শুধু দংশন সারা বিবেকময়।
মদের পাউচ, সেক্সি আউচ! ড্রাগের কাউচ ভোটের বাক্স রক্তমাংস
সমস্ত ছুঁয়ে সমস্ত ছেয়ে বিবেক বইছে বিবেকময়! বিবেকময়!
(সমবেত গর্জন) কী করবে করো। কী করবে করো।
তারপর সব চুপ। দর্শক শ্রোতাদের বুঝতে সময় লাগল যে অনুষ্ঠান শেষ। তবু শেষ নয়।।
Leave a Reply