যেতে নাহি দেব – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ ঢাকা বইমেলো ১৯৯৯
স্মরণ রেখ, ইসলাম যে সম্মান দান করেছে, এতে তৃপ্ত না হয়ে যদি অন্য আরও কোনোখান থেকে সম্মান অর্জন করতে চেষ্টা কর, তবে আল্লাহপাক অবশ্যই তোমাদেরকে লাঞ্ছিত করে ছাড়বেন।
–হযরত ওমর (রা)
‘সবক ফের পড়হ সাদাকাত কা, আদালাত কা, শাজায়াত কা,
লে য়ে জায়েগা তুঝসে কাম দুনিয়া কি ইমামত কা।’
‘সত্য, ন্যায় ও বাহাদুরির দীক্ষা তুমি লও আবার,
তোমার শিরে আসছে পুনঃ ভূমণ্ডলের শাসনভার।’
–দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল (র)
উৎসর্গ
ঔপন্যাসিক ও কবি আল মাহমুদ
যার বই পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি
.
এক
মুকুল এই মুকুল, একটু দাঁড়া।
মুকুল পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। রীমার ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর তার দিকে তাকিয়ে সঙ্গের মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ হল। মেয়েটি বেশ কালো, কিন্তু তার ফিগার ও মুখের লাবণ্য দারুন।
রীমা বান্ধবী মুক্তার সঙ্গে লাইব্রেরীতে যাচ্ছিল। মুকুলকে দেখে মায়ের কথা মনে পড়ল। কাছে এসে বলল, তোকে মা আজ যেতে বলেছে। মুকুলকে মুক্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, আমার বান্ধবী মুক্তা। আমার সঙ্গে পড়ে। তারপর মুক্তাকে বলল, মুকুল আমার খালাত ভাই।
মুকুল মুক্তাকে দেখে এত মুগ্ধ হয়েছে যে, রীমার কথা কানে গেল না। সে তখন চিন্তা করছে, কালো মেয়ে আবার এত সুন্দর হয়?
রীমা পরিচয় করিয়ে দিতে মুক্তা মুকুলের দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। তার দৃষ্টির মধ্যে মুক্তা এমন কিছু দেখতে পেল, যা এর আগে কখনো দেখেনি। মনে শিহরণ অনুভব হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
রীমা ব্যাপারটা অত খেয়াল করল না। মুকুলকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিরে যাবি তো?
এবার মুকুল সম্বিত ফিরে পেয়ে রীমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় যাব?
রীমা অবাক হয়ে বলল, সে কীরে? এত কাছ থেকে আমার কথা শুনতে পাসনি?
মুকুল আমতা আমতা করে বলল, একটা কথা চিন্তা করছিলাম, তাই কী বললি, শুনিনি।
মা তোকে আজ যেতে বলেছে।
ঠিক আছে যাব বলে মুকুল এক পলক মুক্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু। করল।
রীমা মুক্তাকে বলল, চল পশ্চিম দিকে পার্কে বসি।
বসার পর মুক্তা বলল, তোর খালাত ভাই কিসে পড়ে?
রীমা বলল, ম্যানেজমেন্টে অনার্স নিয়ে মাষ্টার্স করছে।
তা হলে তো তোর থেকে বড় মনে হচ্ছে, তার সঙ্গে তুই করে কথা বলছিলি কেন?
মুকুল আমার থেকে দেড় বছরের বড়। ও বড় খালার ছেলে। মা বড় খালার কাছে থেকে লেখাপড়া করে বি.এ.পাশ করে। মাকে বাবা প্রাইভেট পড়াত। সেই সময় একে অপরকে ভালবেসে ফেলে। বাবা বড় খালুর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না হলেও বংশ খুব ভালো। তাই খালা খালু তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর বাবা মাকে নিয়ে খালুর বাসাতেই থাকতেন। কারণ বাবা তখন বেকার। খালুই চেষ্টা করে বাবাকে চাকরিতে লাগিয়ে দেন। বেতন কম থাকায় প্রায় পাঁচ ছয় বছর ওখানেই থাকেন। বিয়ের দু’বছর পর আমার জন্ম। তখন মুকুল দেড় বছরের। এক সঙ্গে তিন চার বছর মানুষ হয়েছি। তারপর বাবার প্রমোশন হতে খালার বাসা থেকে আমাদেরকে নিয়ে ভাড়া বাসায় চলে আসে। সেই ছোট বেলা থেকে ওর সঙ্গে তুই তোকারি করে বলি। ছেলে বেলায় আমি আরো রোগা ছিলাম। সে জন্যে মুকুল আমাকে হাড়গীল্লে বলত। আমি খুব রেগে যেতাম। এমন কি এক এক সময় কেঁদে ফেলতাম। আর ও তখন হাসতে হাসতে বারবার হাড়গীল্পে বলত। বড় হওয়ার পর খুব কম বলত। তারপর আমি যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখন একদিন কি একটা কথায় হাড়গীল্পে বলতে বললাম, আমি হাড়গীল্লে হলে তুই মাংশগীল্লে। মুকুল হাসতে হাসতে বলল, মাংসগীলে আবার কী জিনিস রে? বললাম, আগে বল, আমাকে হাড়গীল্পে বলিস কেন? বলল, তোর গায়ে মাংস নেই, শুধু হাড় আর চামড়া। তাই হাড়গীল্পে বলি। বললাম, তোর গায়ে হাড় নেই, শুধু মাংস আর চামড়া তাই তুই মাংসগীলে। মুকুল আবার হাসতে হাসতে বলল, কলেজে পড়ছিস আর এটা জানিস না, হাড় ছাড়া শুধু মাংসের মানুষ হয় না? বললাম, তুই তো আমার চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে পড়ছিস, আর এটা জানিস না, মাংস ছাড়া শুধু হাড়ের মানুষ হয় না? বলল, তা আর জানি না। তোকে রাগাবার জন্য ঐ কথা বলি। বললাম আমিও যদি ঐ একই কারণে তোকে মাংসগীল্লে বলি? বলল, বললেও আমি রাগব না। কারণ সব মানুষই চায় গায়ে মাংস হোক। তাছাড়া হাড়গীল্লে শব্দ বাংলা ভাষায় থাকলেও মাংসগীল্লে শব্দ নেই। এমন কি অভিধানেও নেই। বললাম, তবু তোকে আমি মাংসগীলে বলব, যতদিন না তুই আমাকে হাড়গীল্লে বলা বন্ধ করবি।
মুক্তা জিজ্ঞেস করল, তারপর আর তোকে হাড়গীলে বলে?
রীমা বলল, না আর বলেনি।
মুক্তা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল এবার ফেরা যাক।
রীমা বলল, হ্যাঁ তাই চল।
.
মুকুল বিকালে রীমাদের বাসায় গিয়ে কলিং বেলের সুইচে চাপ দিল।
কিছুক্ষণ আগে রীমার বাবা আসফাক সাহেব অফিস থেকে ফিরেছেন। নাজনীন বেগম স্বামীকে চা নাস্তা খাওয়াচ্ছিলেন। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে এদিক ওদিক চাইতে ছোট মেয়ে শ্রাবণীকে দেখতে পেলেন। একটু উঁচু গলায় বললেন, শ্রাবণী দেখত কে এল।
শ্রাবণী গেট খুলে মুকুলকে দেখে উৎফুল্ল কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলল, ভাইয়া কেমন আছ?
মুকুল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তুই কেমন আছিস?
আমিও ভালো বলে, উচ্চস্বরে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, মা মুকুল ভাই এসেছে।
মুকুল বলল, চেঁচাচ্ছিস কেন? তারপর ভিতরে এসে খালা খালুকে সালাম দিল।
আসফাক সাহেব নাস্তা খেয়ে চা খাচ্ছিলেন। সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললেন।
মুকুল বসার পর নাজনীন বেগম জিজ্ঞেস করলেন, বাসার সবাই ভালো আছে?
জ্বি, সবাই ভালো আছে। আপনি ভালো আছেন?
হ্যাঁ বাবা ভালো আছি।
নাজনীন বেগম স্বামীকে বললেন, তুমি চা খাও, আমি আসছি। তারপর মুকুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই আমার সঙ্গে আয়।
মুকুল তার সঙ্গে যেতে যেতে বলল, কেন ডেকেছ বল, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।
নাজনীন বেগম বললেন, অনেক দিন তুই আসিসনে। আমিও যাওয়ার সময় পাইনি। তোকে দেখার জন্য মন ছটফট করে। মাঝে মাঝে আসতে পারিস না?
মুকুল বলল, ভার্সিটিতে রীমার সাথে দেখা হলে তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করি। তারপর বলল, ওকে দেখছি না কেন?
নাজনীন বেগম বললেন, ওর এক বান্ধবী এসেছিল। একটু আগে তার সঙ্গে বেরিয়ে গেল?
নাজনীন বেগম মুকুলকে নিজের রুমে নিয়ে এসে বসতে বলে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরে প্লেটে করে বেশ কয়েকটা পুলি পিঠা এনে বললেন, তোর জন্যে বানিয়েছি।
ছোটবেলা থেকে মুকুল পুলিপিঠা খেতে খুব ভাল বাসে। ছোট খালা যখন তাদের বাড়িতে থাকত তখন প্রায় বানাত। তারপর এই বাসায় চলে আসার পর যখনই তাদের বাড়িতে যেত তখনই পুলি পিঠা করত। মুকুল খেতে খেতে বলল, মাও মাঝে মধ্যে বানায়, সত্যি বলতে কি, মায়ের চেয়ে তোমার হাতের পিঠা খেতে খুব মজা লাগে।
নাজনীন বেগম বললেন, সেই জন্যেই তো রীমার হাতে তোকে আজ ডেকে পাঠিয়েছি।
এমন সময় শ্রাবণী এসে মায়ের কথা শুনে বলল, জান মুকুল ভাই, মা আমাদের সবাইকে ছ’টা করে খেতে দিয়েছে। আমি আরো চাইতে বলল, “ভাগ, তোর মুকুল ভাইয়ের জন্য বানিয়েছি। সে খেয়ে বাঁচলে খারি।” আমার মনে হয়, মা আমাদের চেয়ে তোমাকে বেশি ভালবাসে।
মুকুল হাসতে হাসতে বলল, আমার প্রতি তোদের খুব হিংসা হয়, তাই না?
শ্রাবণী বলল, হিংসা হবে কেন? আফটার অল তুমি তো আমাদের ভাই।
শ্রাবণী না এলে মুকুল সব পিঠা খেয়ে ফেলত। তার কথা শুনে কয়েকটা রেখে দিয়ে বলল, নে, এগুলো তুই খা।
নাজনীন বেগম মেয়েকে ধমকের সুরে বললেন, তুই আবার এখন এলি কেন? তারপর মুকুলকে বললেন, তুই সব খেয়ে নে, ওদেরকে আর একদিন বানিয়ে দেব।
শ্রাবণী বলল, সেদিনও তো মুকুল ভাইকে ডেকে পাঠাবে।
নাজনীন বেগম রাগের সঙ্গে মেয়েকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগে মুকুল বলল, এবার যেদিন বানাবে সেদিন আমাকে ডেকে পাঠালেও আসব না। তোরা সব খেয়ে ফেলিস। তারপর হাত মুখ দুয়ে খালাকে বলল, পেট ভরে গেছে, আর খেতে পারব না। এক কাপ চা দাও খেয়ে বিদায় হই। বললাম না, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।
নাজনীন বেগম শ্রাবণীকে বললেন, তুই খেয়ে রীমার জন্য কটা রাখিস, তারপর মুকুলকে বললেন, তোর খালুর কাছে চল, সেখানে চা খাবি। তারপর যেতে যেতে বললেন, রীমার হাতে ডেকে না পাঠালে আসবি না বুঝি?
মুকুল জানে খালা তাকে ভীষণ ভালবাসে। বলল, ঠিক আছে আসব।
চা খেয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুকুল চলে এল।
প্রায় মাসখানেক পর নিউমার্কেটে মুক্তাকে দেখে মুকুলের মনে আনন্দের শিহরণ বয়ে গেল। মুক্তা মার্কেটিং করে বারান্দা থেকে নামছিল। মুকুল কাছে গিয়ে বলল, মুক্তা যে, কেমন আছ?
মুক্তা মুকুলকে দেখেনি। তার নাম ধরে কেউ কথা বলছে শুনে তার দিকে তাকিয়ে মুকুলকে চিনতে পারল। একদিনের পরিচয়ে আপনজনের মতো তুমি করে বলতে শুনে বেশ অবাক হয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
মুকুল মৃদু হেসে বলল,কী ব্যাপার? চিনতে পারছ না?
মুক্তা একটু রাগের সঙ্গে বলল, চিনতে পারব না কেন? কিন্তু আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? কালো মেয়েরা বুঝি দ্র ব্যবহার পেতে পারে না?
না-না তা কেন? বিশ্বাস করুন এক বারের আলাপেই আপনাকে খুব আপন মনে হয়েছে। তাই তুমি করে বলে ফেলেছি। যদি মাইও করে থাকেন, তাহলে ক্ষমা চাইছি।
মুক্তার তবু রাগ পড়ল না। বলল, কালো মেয়েদেরকে ছেলেরা মেয়ে বলে গ্রাহ্যই করে না।
আপনার কথা কতটা সত্য জানি না। আমি কিন্তু ওরকম কিছু ভাবিনি। তা ছাড়া আপনি যে কালো, তা আমার মনেই হয়নি। চলুন না, রেস্টুরেন্টে বসে একটু গলা ভেজাই।
ধন্যবাদ, আমার গলা ভেজাই আছে। আপনার শুকিয়ে গেলে ভেজাতে পারেন। কথা শেষ করে মুক্তা গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
মুকুল তার সঙ্গে যেতে যেতে বলল, ক্ষমা পেয়েছি কিনা বললেন না যে?
যদি সত্য বলে থাকেন, তা হলে পেয়েছেন। নচেৎ শুধু শুধু ক্ষমা চেয়ে নিজেকে ছোট করছেন কেন?
আমার কথা তা হলে আপনি বিশ্বাস করেন নি?
কি করে করব বলুন, আজ কাল ভালো ছেলের সংখ্যা খুব কম।
আর মেয়েরা বুঝি সবাই ভালো?
সবাই ভালো না হলেও তাদের সংখ্যা ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি। আর সময় দিতে পারছি না, বাসায় ফিরতে হবে বলে মুক্তা গেটের বাইরে এসে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে যেতে বলল।
মুকুল তার দিকে তাকিয়েছিল। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর মার্কেটের ভিতরে যাওয়ার সময় চিন্তা করল, মুক্তা নিশ্চয় বড় লোকের মেয়ে। নচেৎ কালো মেয়ের এত অহঙ্কার থাকতে পারে না।
মুকুলদের বাসা রামপুরা। তার খালার বাসা মোহম্মদপুর। নিউমার্কেটে মুক্তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মুকুলের জীদ চেপে গেল। ঐ কালো মেয়েটার অহঙ্কার ভাঙতে হবে।
একদিন মুকুল পাবলিক লাইব্রেরীতে যাচ্ছিল। এমন সময় রীমাকে বেরোতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছে এলে বলল, তোকেই মনে মনে খুঁজছিলাম।
রীমা হেসে উঠে বলল, তাই নাকি? কেন খুঁজছিলি বলে ফেল।
কিছুক্ষণ সময় দিতে পারবি?
রীমা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আধ ঘন্টা।
ওতেই হবে, চল, বারান্দায় বসি।
বসার পর মুকুল বলল, সেদিন মুক্তা নামে যে বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয় করালি, সেই মেয়েটা কেমন বলতো?
রীমা বেশ অবাক হয়ে বলল, আগে বল, তার কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
কেন আবার এমনি জানতে ইচ্ছা করল।
এমনি আবার ইচ্ছা করে বুঝি? আমার তো অন্য রকম কিছু মনে হচ্ছে?
কি রকম মনে হচ্ছে?
এই প্রেম-ট্রেম আর কি?
ভার্সিটিতে ঢুকে খুব পেকে গেছিস মনে হচ্ছে?
তাতো একটু আধটু সবাই পাকে, তুইও কী পাকিস নি?
তোর বান্ধবীর কথা জিজ্ঞেস করায় যদি পেকে থাকি, তাহলে তাই। এবার যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দে।
রীমা ভ্রু কুঁচকে বলল তুই কী তার বায়োডাটা জানতে চাস?
তা ঠিক চাইনি। মেয়েটার স্বভাব চরিত্র কেমন জানতে চাই। তবে তোর যদি ওর বায়োডাটা জানা থাকে বলতে পারিস।
রীমা মৃদু হেসে বলল, বুঝেছি।
কী বুঝেছিস?
বলব না।
নাই বলিস, মুক্তার বায়োডাটা বল।
মুক্তা ব্রিগেডিয়ার আমজাদ সাহেবের একমাত্র মেয়ে। ব্রিগেডিয়ারের মেয়েতো, তাই মেজাজ খুব কড়া, আর খুব স্পষ্টবাদী। তবে মনটা খুব সরল। মুক্তার মা ছাড়া ওর নানার আর কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তার বিষয় সম্পত্তি প্রচুর। তিনি মারা যাওয়ার আগে ঐ সব মুক্তার মায়ের নামে উইল করে দিয়েছেন। ওর মাকে ছোট রেখে মুক্তার নানি মারা গেছেন। ওর নানা পরে আর বিয়ে করেননি। বছর দুয়েক হল মুক্তার বাবা আমজাদ সাহেব মারা গেছেন। রিটায়ার্ড করার পর স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে পল্লবীতে শ্বশুরের বাসায় থাকতেন। মুক্তার বাবা মারা যাওয়ার পর ওর মা ঐ বাসা ভাড়া দিয়ে। আগারগাঁওয়ের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে থাকেন। এই পর্যন্ত বলে রীমা হেসে উঠে বলল, এই বায়োডাটায় চলবে, না আরো লাগবে?
না লাগবে না যতটুকু জানতে চেয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি তুই বলেছিস।
এবার আমার একটা কথার উত্তর দেতো, তোর তো গার্লফ্রেণ্ডের অভাব নেই, তবু মুক্তার মতো একটা কালো মেয়ের বায়োডাটা জানতে চাইলি কেন?
মুকুল নিউমার্কেটের ঘটনা বলে বলল, এখন বুঝতে পারলাম তোর বান্ধবী কেন এত অহঙ্কারী।
রীমা বলল, ও অহঙ্কারী মোটেই নয়, তবে কোনো ছেলেকেই বিশ্বাস করে না।
ছ্যাক খেয়েছে বুঝি?
না, তবে অনেক ছেলে ওকে প্রেম নিবেদন করেছে, অনেকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। ও সবার সঙ্গে মেলামেশা করে বুঝেছে, কালো বলে তারা ওকে কেউ পছন্দ করে না। ওর মায়ের সম্পত্তির জন্য বিয়ে করতে চায়। তাই সবাইকেই যেমন ফিরিয়ে দিয়েছে, তেমনি কোনো ছেলেকেই বিশ্বাস করে না। ওর এক ফুফাতো ভাই ওকে বিয়ে করার জন্য পাগল। ওর মায়ের তাকে খুব পছন্দ। কিন্তু মুক্তা তাকে দেখতেই পারে না। বলে আমাদের সম্পত্তি হস্তগত করার জন্য শুধু আমাকে বিয়ে করতে চায়। বিয়ের পর বান্ধবীদের নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াবে। আমি বললাম, কাউকে তো একদিন বিয়ে করতেই হবে। বলল, এমন কাউকে যদি পাই, যে নাকি আমাদের সম্পত্তিকে নয়, আমাকে ভালবাসবে, তাহলে তাকে বিয়ে করবো নচেৎ চিরকুমারী থাকবো। তারপর রীমা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এবার চলি, ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। কথা শেষ করে হাই হীলের খট খট শব্দ তুলে চলে গেল।
মুকুল লাইব্রেরীতে যাওয়ার সময় ভাবল, মুক্তা দেখতে বেশ কালো হলেও সম্পত্তির লোভে আরো অনেকে তাকে বিয়ে করতে চাইবে, কিন্তু তাদেরকে লোভী জেনে রাজি হবে না। তাহলে কী সত্যি সত্যি চিরকুমারী থাকবে? কথাটা চিন্তা করে মনে ব্যথা অনুভব করল। ভাবল, আমি যদি ওকে বিয়ে করতে চাই, আমাকেও কি অন্য পাঁচটা ছেলের মতো মনে করবে? এরপর থেকে মুক্তার কথা আরো বেশি মুকুলের মনে পড়তে লাগল।
দুই
ইবরাহীম সাহেব উঁচু সমাজের মানুষ। ব্যবসা করে রামপুরায় বাড়ি করেছেন। স্ত্রী জাহানারা বেগমও উঁচু ধনী ঘরের মেয়ে। তাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। সবার বড় ইরা, তারপর মুকুল, মুকুলের পরে ইতি। জাহানারা বেগম ইরা ও মুকুল হওয়ার পর আর সন্তান নিতে চাননি। ইবরাহীম সাহেব আরো একটা পুত্র সন্তান চান। তাই সে কথা স্ত্রীকে জানিয়ে বলেছিলেন, তোমাকে আর একটা সন্তান ধারণ করতে হবে। জাহানারা বেগম প্রথমে রাজি না হলেও বারবার স্বামীর অনুরোধে আরো একটা সন্তান জন্ম দেন। কিন্তু ছেলে নয় মেয়ে। মেয়ে হওয়ার পর ইবরাহীম সাহেব অসন্তুষ্ট হয়ে ভাবলেন, ভাগ্যে দু’টো ছেলে নেই, তাই মেয়ে হল। আর একটা সন্তান নেওয়ার কথা স্ত্রীকে বলার ইচ্ছা থাকলেও বলেননি।
ইরা যখন বি.এ. ফাইনাল ইয়ারে পড়ে তখন ইবরাহীম সাহেব তার বিয়ে দিয়ে দেন। ইরা খুব আপত্তি করেছিল; কিন্তু তিনি শোনেন নি। ছেলে মেরিন ইঞ্জিনীয়ার। দেখতে শুনতে খুব ভালো, নাম মোরসেদ। বাড়ি কুষ্টিয়া। খানদানী বংশ। চট্টগ্রাম পোর্টে চাকরী করে। সেখানে সরকারী কোয়াটারে ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। ইতি এ বছর এইচ. এস.সি. সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে। নাজনীন বেগমের স্বামী আসফাক সাহেব সরকারী অফিসে বড় চাকরি করেন। তাদের কোনো পুত্র সন্তান নেই। শুধু দুই মেয়ে। রীমা ও শ্রাবণী। রীমা বড়। ভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স করছে। আর শ্রাবণী নাইনে পড়ে। নাজনীন বেগম ও আসফাক সাহেবের খুব ইচ্ছা মুকুলের সঙ্গে রীমার বিয়ে দেওয়ার। সেকথা অবশ্য রীমা বা মুকুল জানে না। এমন কি মুকুলের মা বাবাও জানেন না।
মুকুলের চেহারা সুন্দর। লম্বা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। দোহারা গড়ন, রং উজ্জ্বল ফর্সা। বিয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতি। সব সময় ঠোঁটে হাসি লেগে থাকে। কারো সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা বলে না। নিজস্ব একটা প্রিন্সিপল আছে। তবে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, কেউ আলাপ করতে এলে ফেরায় না। এরকম ছেলেকেই মেয়েরা বেশি পছন্দ করে। তাই তার ছেলে বন্ধুর চেয়ে মেয়ে বন্ধু বেশি। মুকুল তাদের সঙ্গে মেলামেশা করলেও কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে করেনি। কেউ তার মনে দাগ কাটতে পারেনি। ইদানীং মুক্তার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর বার বার তার কথা মনে পড়ে। চেষ্টা করেও তাকে ভুলতে পারছে না। বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেলে তার মনে হয়, মুক্তা থাকলে যেন বেশি আনন্দ উপভোগ করা যেত।
হঠাৎ একদিন বিকেলে গ্রীন সুপার মার্কেটে মুকুল গাড়ি থেকে নেমেছেএমন সময় অল্প দূরে মুক্তাকে একটা স্কুটারওয়ালাকে আগারগাও যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে শুনে এগিয়ে এসে বলল, কেমন আছেন?
মুক্তা মুকুলের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বলল, ভালো, আপনি?
ভালো না।
মানে।
মানেটা এখানে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না। গাড়িতে চলুন। যেতে যেতে বলব।
মুক্তার মা লায়লা বেগম গাড়ি নিয়ে পল্লবীতে গেছেন। তাই মুক্তা স্কুটার নিয়ে মার্কেটে এসেছে। মুকুলের কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগল, গাড়িতে যাবে কিনা।
মুকুলও তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। চোখে চোখ পড়তে বলল, কী হল? যাবেন না?
আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখলাম, মার্কেটিং না করেই যাবেন?
তেমন জরুরী কিছু নয়, আপনি চলুন তো।
কিন্তু আমার জন্য আপনি…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মুকুল বলল, বললাম তো তেমন জরুরী কিছু নয়।
এতদিন যত ছেলে তার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে তাদের দৃষ্টিতে মুক্তা লোলুপতা দেখেছে। কিন্তু মুকুলের দৃষ্টিতে সে রকম কিছু দেখেনি। বরং যা দেখেছে তা অন্তরে দাগ কেটেছে। তাই আর আপত্তি না করে তার সঙ্গে এসে গাড়িতে উঠল।
মুকুল গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠিকানাটা বলুন।
মুক্তা ঠিকানা বলে বলল, এবার বলুন আপনার ভালো না থাকার কারণ।
বললে মাইণ্ড করবেন, তার চেয়ে না বলাই ভালো।
এতে মাইণ্ড করার কি আছে? আপনি বলুন।
যদি বলি কারণটা আপনিই?
মুক্তা মৃদু হেসে বলল, সেদিন নিউমার্কেটের ব্যাপারটা হজম করতে পারেন নি মনে হচ্ছে?
মুকুলও মৃদু হেসে বলল, আমার জায়গায় আপনি হলে পারতেন?
মুক্তা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ছেলে হলে বলতে পারতাম। তারপর বলল, ছেলেরা কালো মেয়েদের পছন্দ করে না, সবাই ফর্সা সুন্দরী মেয়ে চায়। কিন্তু নিজেরা কতটা সুন্দর একবারও চিন্তা করে দেখে না।
শুধু ছেলেদের কথা বলছেন কেন? মেয়েরাও তো সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলে পছন্দ করে।
তা করে, তবে যে সব মেয়ে সুন্দরী তারা। কালো ও অসুন্দর মেয়েরা অত বাছ বিচার করে না। তা ছাড়া মেয়েরা গার্জেনদের উপর নির্ভরশীল। অবশ্য আজকাল ধনী ঘরের শিক্ষিত মেয়েরা নিজেদের পছন্দমতো বিয়ে করছে।
আপনি ঠিক কথা বলেছেন। তবে ছেলেরা ফর্সা সুন্দরী মেয়ে পছন্দ করলেও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক এমন ছেলেও আছে, যারা সৌন্দর্যের চেয়ে মেয়ের গুনাবলী পছন্দ করে। তারা জানে, “অল দ্যাট গীটার ইজ নট পোন্ড।” জানেন বোধ হয়, ঝিনুক দেখতে খারাপ হলেও তার মধ্যে মুক্তা থাকে?
তা জানি; কিন্তু সবাই তো বাইরেরটা দেখেই পছন্দ করে। ভিতরে কি আছে না আছে ক’জনই বা খোঁজ করে?
একদম যে নেই তা নয়। অল্প সংখ্যক হলেও যে আছে, তা নিশ্চয় অস্বীকার করবেন না?
তা করব না, তবে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়নি।
পরিচয় হয়নি বলে যে নেই, এটা ভাবলে ভুল করবেন।
মুক্তা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কি জানি, হয় তো আপনার কথাই ঠিক।
ততক্ষণে গাড়ি বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগারের কাছে এসে গেছে। মুকুল বলল, এবার কোন দিকে যাব বলুন।
মুক্তা বলে দিতে মুকুল তাদের বাড়ির গেটের সামনে এসে গাড়ি থামাল।
মুক্তা হর্ণ বাজাতে বলল।
মুকুল হর্ণ বাজিয়ে বলল, এবার আসি তাহলে?
মুক্তা বলল মানে?
মানে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে গেলাম।
ভিতরে যাবেন না?
যেদিন আপনি নিয়ে আসবেন, সেদিন যাব।
হর্ণ শুনে দারোয়ান ছোট গেট খুলে গাড়িতে মালিক কন্যাকে দেখে ততক্ষণে বড় গেট খুলে দিয়েছে।
মুক্তা মুকুলকে বলল, গাড়ি ভিতরে নিয়ে চলুন।
মুকুল গাড়ি ভিতরে এনে বারান্দার সিঁড়ির কাছে পার্ক করল।
মুক্তা গাড়ি থেকে নেমে বলল, ভালো ছেলের মতো নেমে আসুন।
মুকুল মৃদু হেসে বলল, এতক্ষণ তাহলে খারাপ ছেলে ছিলাম?
মুক্তা ও মৃদু হেসে বলল, না, তা ছিলেন না, আমাকে গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার কথা বলে……থেমে গেল।
মুকুল হাসতে হাসতে গাড়ি থেকে নেমে বলল, ঠিক আছে, চলুন এ দুর্ণামের বোঝা নিয়ে ফিরে যাব না।
মুক্তা যেতে যেতে বলল, আমি কিন্তু কথাটা এমনিই বলেছি, তবু যখন মাইণ্ড করলেন তখন ক্ষমা চাইছি।
মুকুল বলল, না, মাইও করিনি। আমিও কথাটা এমনিই বলেছি। ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
মুক্তা আর কিছু না বলে তাকে নিয়ে ড্রইং রুমে এসে বলল, একটু বসুন, আসছি।
মুক্তা চলে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পর তার মা নায়লা বেগম ফিরলেন। গাড়ি দেখে ভাবলেন, কে আবার এল? ড্রইং রুমে ঢুকে একটা অচেনা ছেলেকে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কে আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
টেবিলের উপর অনেকগুলো ম্যাগাজিন ছিল, মুকুল একটা ম্যাগাজিন। নিয়ে পড়ছিল। তাই নায়লা বেগমের আগমন টের পাইনি। তার কথা শুনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি মুকুল। মুক্তার সঙ্গে এসেছি।
ও, বলে ভিতরে যাওয়ার সময় চিন্তা করলেন, মুক্তাতো কখনো কোনো বয় ফ্রেণ্ডকে বাসায় নিয়ে আসেনি, একে আনল কেন? তা হলে কি ….? অবশ্য ছেলেটা দেখতে দারুন।
মুক্তা ট্রে টেবিল ঠেলে ফিরে এসে বলল, একটু দেরি হয়ে গেল। সে জন্যে ক্ষমা চাইছি। তারপর টেবিলে নাস্তা পরিবেশন করে বলল, নিন খান। আমি চা তৈরি করি।
মুকুল নাস্তার প্লেটে কেক বিস্কুট, চানাচুর, দু’পদের মিস্টি ও কয়েক পদের ফল পিস করা দেখে বলল, আমাকে কি আপনি রাক্ষস মনে করেন? না হলে এক জনের জন্যে এত কিছু কেউ নিয়ে আসে?
মুক্তা লজ্জা পেয়ে বলল, ছি ছি, কি যে বলেন। আপনি কি খেতে পছন্দ করেন, তাতো জানি না। তাই বলে থেমে গেল।
মুকুল একপিস কেক হাতে নিয়ে বলল, আপনিও নিন।
আপনি শুরু করুন, আমি চা বানিয়ে নিচ্ছি। তারপর দুকাপ চা বানিয়ে এককাপ তার সামনে রেখে দু’টো বিস্কুট খেয়ে চায়ে চুমুক দিল।
মুকুল একপিস কেক খেয়ে চায়ের কাপ নিতে গেলে মুক্তা বলল, কিছুই তো খেলেন না।
বাসা থেকে খেয়ে বেরিয়েছি। তারপর খালি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে। দাঁড়িয়ে বলল, এবার আসি।
মুক্তা গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে এসে দেখল, মা ড্রইং রুমে বসে আছে।
মেয়েকে দেখে নায়লা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কে রে ছেলেটা?
রীমার খালাতো ভাই মুকুল। রীমাকে তো তুমি চেনো।
কি করে?
ম্যানেজমেন্টে মাস্টাস করছে।
তোর সাথে কত দিনের পরিচয়?
পরিচয় তেমন হয়নি। কয়েক মাস আগে পাবলিক লাইব্রেরীতে রীমা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। কিছু দিন পর নিউমার্কেটে একদিন দেখা হতে কিছুক্ষণ আলাপ হয়। তারপর আজ গ্রীন সুপার মার্কেটে দেখা হতে গাড়ি নেই জেনে পৌঁছে দিয়ে গেটের কাছ থেকে ফিরে যাচ্ছিল, আমি জোর করে নিয়ে এসেছি।
নায়লা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দেশের সামাজিক পরিবেশ দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে। আমাদের কোনো গার্জেন নেই। তুইতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকিস। প্রতিদিন টেলিফোনে তোকে বিয়ে করার জন্য কত ছেলে। যে প্রস্তাব দিচ্ছে তার হিসেব নেই। তোর দু’মামাই বিদেশে। বিপদের সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। আসিফ তোকে বিয়ে করার জন্য পাগল, তাকে তুই পছন্দ করিস না। তোকে নিয়েই আমার যত চিন্তা। কথা শেষ করে নায়লা বেগম সেখান থেকে চলে গেলেন।
টেলিফোনের ব্যাপারটা মুক্তা যে একদম জানে না তা নয়। একদিন মা। রান্না ঘরে থাকায় সে টেলিফোন রিং হতে রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো, কাকে চান?
উত্তর এল, এটা কি মরহুম ব্রিগেডিয়ার আজাদ সাহেবের বাসা?
জ্বি, কাকে চান বলুন।
আমি ওঁর ওয়াইফকে চাচ্ছি।
কে আপনি?
সে কথা পরে বলছি, আপনি কী ওঁর ওয়াইফ?
মুক্তা চালাকী করে বলল, হ্যাঁ।
ছেলেটা ভক্তিগদগদ কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলল, খালাআম্মা, আমি শামসের। কয়েকদিন আগে আপনার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আপনি ভেবে চিন্তে জানাবেন বলেছিলেন। কিছুক্ষণ আগে আমার বন্ধু রাসেলের কাছে শুনলাম, সেও প্রস্তাব দিয়েছে। খালাআম্মা, রাসেলের বাবার থেকে আমার বাবা অনেক বেশি বড়লোক। তাদের চেয়ে আমার বাবার ব্যবসাও অনেক বড়। আপনাকে আমাদের ঠিকানা দিয়েছি, খোঁজ খবর নিয়ে দেখুন আমার কথা সত্য না মিথ্যা।.
মুক্তা বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল, এই কদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। এবার খোঁজ খবর নেব। এখন রাখি কেমন বলে ফোন রেখে দিয়েছিল। এখন মায়ের কথা শুনে বসে বসে অনেকক্ষণ চিন্তা করল, যাদের কোনো পুরুষ গার্জেন নেই, বিশেষ করে যারা সম্পদশালী ও যাদের বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে থাকে, তারা খুব দুশ্চিন্তায় দিন যাপন করছে। হঠাৎ মুকুলের কথা মনে পড়তে অন্ধকারে যেন আলোর রেখা দেখতে পেল। মুকুল যেন অন্য দশটা ছেলের মতো নয়। যদি তাই হয়, তাহলে তাকে বাজিয়ে দেখতে হবে। তারপর মৃদু হেসে অস্ফুট স্বরে বলল, মুকুলকে বাজিয়ে দেখব কি? তার আগে নিজেইতো বেজে গেছি।
তিন
একদিন ভার্সিটিতে মুক্তা রীমাকে বলল, প্রেম ভালবাসা সম্বন্ধে তোর কী ধারণা।
যে মুক্তা প্রেম ভালবাসার নামে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে, তার মুখে এই কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মুক্তা বলল, কিরে মুখের দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস? আমার প্রশ্নের উত্তর দিবি না?
তোর মুখে প্রেম ভালবাসার কথা শুনব ভাবতেই পারছি না।
তা না হয় নাই পারলি, প্রশ্নের উত্তর দে।
মনে হচ্ছে প্রেমে পড়েছিস?
এখনো পড়িনি, তবে পড়ার পথে।
কেরে ছেলেটা?
বলা যাবে না।
কেন?
ছেলেটাকে আমার পছন্দ হলে কি হবে, সে আমাকে পছন্দ করে কিনা না জেনে বলি কেমন করে?
আমাদের পরিচিত কেউ?
তাও বলা যাবে না। যেদিন তার মনের খবর জানতে পারব, সেদিন জানাব। যা জিজ্ঞেস করেছি এবার বল।
রীমা হেসে উঠে বলল, আমি তো এখনো ঐ পথে পা বাড়াইনি বলব কি করে?
তবু বল। ভালবাসা সম্বন্ধে সবারই কিছু না কিছু ধারণা থাকে। আর তুই এত লেখাপড়া করছিস, তোরও নিশ্চয় আছে।
রীমা হাসতে হাসতেই বলল, আমার তো মনে হয়, প্রেম ভালবাসা আবেগের ব্যাপার। আবেগ শেষ হয়ে গেলে প্রেম ভালবাসাও শেষ হয়ে যায়। আমার এক ফুফাতো বোন প্রেম করে বিয়ে করেছিল। তিন চার বছর পর তাদের যখন ছেলে হল তখন থেকে তাদের রোজ ঝগড়া হতে দেখেছি। তবে ঝগড়াটা কি কারণে হয় তা জানি না। আমার কি মনে হয় জানিস, প্রেমের সার্থকতা মিলনে নয়, বিরহে। বিরহের মধ্যে প্রেম যেমন গম্ভীর হয় তেমনি অমর থাকে।
মুক্তা বলল, বাহ! প্রেম না করে প্রেমের যে ব্যাখ্যা দিলি তার জওয়াব নেই। তোকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। তারপর বলল, ধর তোকে কোনো পরিচিত ছেলে প্রেম নিবেদন করল, তখন কী করবি?
রীমা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ছেলেটা মনের মতো হলে ফেরাব না। তা না হলে এমন কিছু বলে কাটিয়ে দেব, যেন বুঝতে না পারে আমি তাকে সরাসরি ডিনাই করছি।
সেদিন মুক্তাকে লিফট দেওয়ার পর থেকে মুকুলের মনের অস্থিরতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু বেঁচে তার সঙ্গে দেখা করতে বিবেক বাধা দিয়েছে।
.
আজ ক্লাস শেষে বেরিয়ে গেটে যাওয়ার সময় তাকে রীমার সঙ্গে কথা বলতে দেখে মনের মধ্যে আনন্দের স্রোত বইতে লাগল। সেই সঙ্গে মুক্তার সঙ্গে কথা বলার জন্য তার মন অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু রীমা থাকায় সরাসরি কাছে যেতে তার মন চাইল না। তাই বুদ্ধি করে তাদের অল্প দূর থেকে দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে হাঁটতে শুরু করল।
রীমার পিছন দিক থেকে মুকুল যাচ্ছিল, তাই সে তাকে দেখতে পেল না। কিন্তু মুক্তা দেখতে পেয়ে তারও মনের মধ্যে আনন্দের স্রোত বইতে লাগল এবং তার সঙ্গে কথা বলার জন্য তার মনও খুব ছটফট করতে লাগল। সঙ্গে রীমা থাকায় তাকে ডাকতে পারল না। তাই বুদ্ধি করে বলল, এই রীমা তোর খালাত ভাই যাচ্ছে বলে তার পিছন দিকে ইশারা করল।
রীমা ঘুরে মুকুলকে দেখে বলল, এই মুকুল, আমাদেরকে দেখেও চলে যাচ্ছিস যে?
মুকুল এগিয়ে এসে বলল, তোদেরকে দেখেও চলে যাচ্ছি বলছিস কেন? আমি একটা কথা চিন্তা করতে করতে যাচ্ছিলাম, তাই দেখতে পাইনি। তোদের খবর কী? খালা খালু ভালো আছেন?
রীমা বলল, হ্যাঁ। তোদের বাসার খবর বল।
আমরা সবাই ভালো আছি। তারপর মুকুল মুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কেমন আছেন?
মুক্তা বলল, ভালো । আপনি?
এমন সময় নাঈমা এসে রীমাকে বলল, তুই এখানে, আর আমি তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
রীমা বলল, সরি তোর কথা একদম ভুলে গেছি। তারপর ওদের দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোরা কথা বল আমি চললাম। তারপর নাঈমাকে বলল, নে চল।
মুক্তা ও মুকুল এটাই চাচ্ছিল, রীমা চলে যাওয়ার পর মুক্তা কয়েক সেকেণ্ড মুকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি কিন্তু কেমন আছেন বলেন নি।
মুকুল তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। মৃদু হেসে বলল, ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, আর বোধ হয় ক্লাস নেই?
না।
তা হলে চলুন না কোথাও একটু বসি।
ভার্সিটি এলাকায় বসতে আপত্তি আছে, অন্য কোথাও হলে নেই।
বেশ তো চলুন, দেখি কোথায় বসা যায়। তারপর বলল, আপনি গেটে গিয়ে দাঁড়ান আমি গাড়ি নিয়ে আসি।
গাড়ি নিয়ে এসে মুকুল পাশের দরজা খুলে দিল। মুক্তা উঠে বসার পর গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, সে দিন আমাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে আপনি ভিতরে চলে যাওয়ার পর পর এক ভদ্রমহিলা বাইরে থেকে এসে ভিতরে চলে গেলেন। উনি নিশ্চয় আপনার মা?
মুক্তা বলল, হ্যাঁ। তারপর বলল, মা আপনার সঙ্গে কথা বলেনি?
শুধু বললেন, “কে আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না?”
আপনি কী বললেন?
বললাম, “আমি মুকুল, মুক্তার সঙ্গে এসেছি।”
আর কিছু বলেনি?
না।
মা খুব কম কথা বলে। প্রয়োজন ছাড়া আমার সঙ্গেও বলে না।
হ্যাঁ দেখেতো তাই মনে হল।
কোথাও বসবার কথা বললেন, অথচ…..বলে মুক্তা থেমে গেল।
গাড়ি ততক্ষণে সায়েন্স ল্যাবরেটরী পার হয়ে ধানমণ্ডি এসে গেছে। …..একটা চাইনিজ রেষ্টুরেন্টের কাছে গাড়ি পার্ক করে বলল, কোনো পার্কে বসার চেয়ে এখানে বসাই ভালো। তারপর তাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে বসে বলল, প্রথমে কিছু পেটে দিয়ে নিই আসুন। খালি পেটে মনের মতো আলাপ করা যায় না। বলুন কী খাবেন?
আমি বিদেশী খাবার পছন্দ করি না। দেশী যা ইচ্ছা অর্ডার দিতে পারেন।
মুকুল অবাক কণ্ঠে বলল, আমার রুচির সঙ্গে আপনার মিল আছে। দেখছি। আমিও বিদেশী খাবার পছন্দ করি না। তারপর বেয়ারাকে ডেকে দেশী খাবারের অর্ডার দিল।
খেতে খেতে মুক্তা জিজ্ঞেস করল। পড়াশোনা শেষ করে কী করবেন ভেবেছেন?
উচ্চ শিক্ষা নিতে ফরেনে যাবার ইচ্ছা আছে।
রীমার কাছে শুনেছি আপনার কোনো ভাই নেই। এক ছেলেকে আপনার মা বাবা যেতে দেবেন?
যেতে দিলে তো অনার্স পাওয়ার পর পরই চলে যেতাম। এক রকম বাধ্য হয়ে মাষ্টার্স করছি। এর মধ্যে বাবাকে রাজি করিয়েছি। আশা করি, শেষমেস মাকেও রাজি করাতে পারব।
একটা কথা বলব, মাইণ্ড করবেন না তো?
মাইণ্ড করার মতো কথা বলবেন বুঝি?
মুক্তা বুঝতে পারল মুকুল এত লেখাপড়া করলেও খুব সরল। মৃদু হেসে বলল, না, তেমন কিছু বলব না। অনেকে কথার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে মাইণ্ড করে বসে। তাই বললাম আর কি।
ঠিক আছে বলুন, মাইণ্ড করব না।
আমি তো কালো ও অসুন্দর একটা মেয়ে, তবু আমার পিছনে লেগেছেন কেন?
আপনি কালো হলেও অসুন্দর নন। যে আপনাকে অসুন্দর বলে, তার চোখ থাকলেও দেখার মতো দৃষ্টিশক্তি নেই। এমন অনেক মেয়ে বা ছেলে দেখা যায় তারা ফর্সা হলেও দেখতে মোটেই ভালো না। কেউ রোগা, কেউ মোটা, আবার কারো মুখের অবয়ব খারাপ। আসলে কী জানেন, ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে চারিত্রিক সৌন্দর্য হল বিচার্য বিষয়। তা ছাড়া যার মন সুন্দর তার সব কিছুই সুন্দর। মনীষীরা বলেন, “একটা সুন্দর মন একটা হীরার পাহাড়ের চেয়ে মূল্যবান। আপনার মধ্যে সেই রকম সুন্দর মনের খোঁজ পেয়েছি। তাই পিছু লেগেছি।
মুকুলের কথা শুনে মুক্তা এত অভিভূত হল যে, খাওয়া বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবল, এরকম ছেলে তা হলে এখনো সমাজে আছে? আনন্দে এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
মুকুল কথা শেষ করে খাচ্ছিল। হঠাৎ মুক্তার দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ল । তার চোখে পানি দেখে থতমত খেয়ে বলল, আপনার চোখে পানি কেন? অন্যায় কিছু বলেছি কী?
মুক্তা বাম হাতের রূমালে চোখ মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, না, আপনি অন্যায় কিছু বলেন নি। চোখে পানি আসার কারণ অন্য।
বলতে অসুবিধে আছে?
অসুবিধে না থাকলেও এখন বলতে পারব না। আর একটা প্রশ্ন করব?
একটা কেন যত ইচ্ছা করতে পারেন।
মুকুলের কথা বলার ধরণ দেখে মুক্তা হেসে ফেলে বলল, পেছনে লাগার যে কারণ বললেন, তার উদ্দেশ্য কি তাতো বললেন না।
বুঝতে পারেন নি?
বারে আপনার মনের উদ্দেশ্য আমি বুঝব কেমন করে?
অনুমান করে বলুন।
সেটা আমার ব্যাপার। আপনিই বা বলছেন না কেন?
বললে যদি মাইণ্ড করে বসেন।
আমি অত মিন মাইণ্ডেড নই যে, মাইও করব।
ভেবেছি আপনি রাজি থাকলে জীবন সাথি করব। পাবলিক লাইব্রেরীর সিঁড়িতে রীমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে এক সেকেণ্ডের জন্যও। আপনাকে ভুলতে পারিনি। সে কথা জানাবার জন্য সুযোগের প্রতিক্ষায় ছিলাম। আমারটা তো শুনলেন, এবার আপনারটা বলুন।
মুকুলের কথা শুনে মুক্তার আবার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, ছেলেরা তাড়াতাড়ি ডিসিসান নিতে পারলেও মেয়েরা পারে না। আমারটা পরে জানাব।
তবু একটু আধটু কিছু বলুন না, একেবারে শূন্য হৃদয়ে ফিরিয়ে দেবেন?
ততক্ষণে মুক্তার খাওয়া শেষ হয়েছে। এবারেও তার কথা বলার ধরণ দেখে হেসে ফেলল। তারপর বেসিন থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে বসল।
মুকুলেরও খাওয়া শেষ হয়েছে। সেও হাতমুখ ধুয়ে এসে বেয়ারাকে ডেকে দুটো কোক দিতে বলল। বেয়ারা কোক দিয়ে যাওয়ার পর পাইপে দু’তিনটে টান দিয়ে মুকুল বলল, কই কিছু বললেন না যে?
মুকুল যখন হাত মুখ ধুতে গিয়েছিল তখন মুক্তা একটা কাগজে টেলিফোন নাম্বার লিখে রেখেছিল, সেটা তার হাতে দিয়ে বলল, এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
মুকুল ধন্যবাদ জানিয়ে কাগজটা বুক পকেটে রেখে মৃদু হেসে বলল, মেয়েরা সত্যিই বড় রহস্যময়ী।
আর ছেলেরা?
ছেলেরা রহস্যের ধার ধারে না। তাদের মনে যা থাকে, তা প্রকাশ করে দেয়।
মেয়েরাও তাই ছিল। ছেলেরাই তাদেরকে রহস্যময়ী করতে বাধ্য করেছে।
মানে?
মানে সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখুন না? একটা ছেলে কয়টা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে।
একটা মেয়েও কয়েকটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে।
এই রাস্তা প্রথমে ছেলেরাই দেখিয়েছে। ছ্যাক থেতে খেতে মেয়েরা পরে শিখেছে।
সব ছেলেরা একরকম হয় না।
সব মেয়েরাও একরকম হয় না।
মুকুল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, এই যাহ, তিনটের মধ্যে মা বাসায় ফিরতে বলেছিল, কোথায় যেন যাবে। একদম ভুলে গেছি। তাড়াতাড়ি চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরব।
রেষ্টুরেন্টের বাইরে এসে মুক্তা বলল, আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না আপনি যান। এমনিই আধ ঘণ্টা লেট হয়ে গেছে। আমি স্কুটারে চলে যাব।
মুকুল বলল, হোক দেরি, তবু আপনাকে পৌঁছে দিই।
মুক্তা বলল, আপনার কথায় এখানে এসেছি ও খেয়েছি। মানে আপনার দু’টো কথা রেখেছি, এবার আমার একটা কথা আপনি রাখবেন বলুন?
মুকুল মুক্তার চালাকি ধরতে পারল না, বলল, নিশ্চয়।
তা হলে দেরি না করে সোজা বাসায় চলে যান। আপনার গাড়ি অদৃশ্য হওয়ার পর আমি স্কুটারে উঠব।
মুকুল থতমত খেয়ে কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল।
মুক্তা তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। অদৃশ্য হয়ে যেতে একটা খালি স্কুটার থামিয়ে উঠে বসে বাসার ঠিকানা বলল।
বাসায় ফিরতে মুকুলের চারটে বেজে গেল। জাহানারা বেগম বললেন, এই বুঝি তোর তিনটে?
মুকুল আমতা আমতা করে বলল, কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। তা তুমি যেন কোথায় যাবে বলেছিলে, কই এখনও তো রেডি হওনি?
আমি যাব না, তোর বাবা যাবে। এই তো কিছুক্ষণ আগে ফোন করে জানতে চাইল তুই ফিরেছিস কিনা। যা ড্রাইভারকে অফিসে যেতে বলে আয়।
মুকুল ড্রাইভারকে বলে এসে মাকে বলল, বাবা আমার উপর মনে হয় খুব রেগে গেছে?
তোর বাবা কোনোদিন তোর উপর রাগ করেছে?
তা অবশ্য করেনি, তবে কোনো জরুরী দরকার থাকলে আজ অসন্তষ্ট হবে।
না হবে না। কারণ আমাকে চারটের সময় গাড়ি পাঠাতে বলেছিল। এখন চারটে দশ বাজে। তেমন দেরি হয়নি।
তা হলে তুমি তিনটেয় ফিরতে বলেছিলে যে?
তোর যে সময়ের কথা মনে থাকেনা, তা জানি। তাই একঘণ্টা আগের কথা বলেছিলাম।
মুকুল সস্তির নিশ্বাস ফেলে রুমে এসে পকেট থেকে মুক্তার টেলিফোন নাম্বারটা বার করে ডাইরীতে লিখে রাখল। তারপর ভাবল, মুক্তা নিশ্চয় আমাকে পছন্দ করে, নচেৎ টেলিফোন নাম্বার দিত না। তবু ফোন করে কথাটা তার মুখ থেকে শুনতে হবে। ওদের দুটো ফোন। একটা ড্রইংরুমে, অন্যটা বাবার রুমে। ভেবে রাখল, সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ড্রইংরুম থেকে মুক্তাকে ফোন করবে।
ঐদিন রাতেই মুকুলের ফোন করার খুব ইচ্ছা করল, কিন্তু করল না। ভাবল, ওদের ফোনটা কোথায় থাকে জানি না। যদি ওর মায়ের রুমে থাকে? ভদ্রমহিলাকে দেখেতো মনে হল, খুব রাগি। এত রাতে একটা ছেলে তার মেয়েকে ফোন করেছে জেনে মুক্তাকে নিশ্চয় রাগারাগি করবেন। তার চেয়ে আগে জানতে হবে ফোনটা কোথায় থাকে এবং বেশি রাতে ফোন করলে কোনো অসুবিধা হবে কিনা।
তিন চারদিন চেষ্টা করেও মুক্তার দেখা পেল না। একবার মনে করেছিল, রীমাকে তার কথা জিজ্ঞেস করবে। জিজ্ঞেস করলে রীমা যা মেয়ে, একেবারে ছিঁড়ে খাবে। আরো দুতিন দিন মুক্তার খোঁজ করল, কিন্তু তাকে পেল না। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, তুই একদম বুন্ধু। দিনের বেলা যে কোনো সময়ে। তাকে ফোন করতে পারিস। কথাটা চিন্তা করে খুব লজ্জা পেল। ভাবল, প্রেমে পড়লে কি সবারই বুদ্ধি লোপ পায়?
প্রতিদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে কিছুক্ষণ রেষ্ট নেয়। আজ ড্রইং রুমে এসে মুক্তাদের বাসায় ফোন করল।
তিন চার বার রিং হওয়ার পর মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে এল, হ্যালো, কাকে চান?
মুকুল বলল, আপনি কে বলছেন?
আমি এ বাসায় কাজ করি।
এটা কি মুক্তাদের বাসা?
জ্বি।
ওঁকে একটু ডেকে দাও। বলবে মুকুল ফোন করেছে।
মুক্তাদের বাসায় দু’জন কাজের মেয়ে ও দু’জন বয়স্ক কাজের লোক আছে। তাদের প্রতি নায়লা বেগমের কড়া নির্দেশ, “যে কেউ ফোনে মুক্তাকে চাইলে তাকে ডেকে না দিয়ে ওঁকে জানাতে। তাই মুকুলের কথা শুনে কাজের মেয়েটি বলল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। তারপর রিসিভার সেটের পাশে রেখে নায়লা বেগমের কাছে গিয়ে বলল, আপাকে মুকুল নামে একটা ছেলে ফোন করেছে।
নায়লা বেগম এসে রিসিভার তুলে বললেন, হ্যালো কে বলছেন?
নায়লা বেগমের ভারী গলা শুনে মুকুল নার্ভাস ফিল করল। ঢোক গিলে বলল, আমি মুকুল, আপনি?
বিরক্ত কণ্ঠে নায়লা বেগম বললেন, আমি মিসেস আজাদ। আপনার পরিচয় বলুন।
মুকুল বুঝতে পারল নিশ্চয় উনি মুক্তার মা। বলল, খালাম্মা, আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমি মুকুল, মুক্তার বান্ধবী রীমার খালাত ভাই। কিছু দিন আগে আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম।
নায়লা বেগম চিনতে পেরে স্বাভাবিক স্বরে বললেন, তা ফোন করেছ কেন?
মুক্তা প্রায় একসপ্তাহ ভার্সিটি যায় নি। তাই আর কি। ওকে একটু দেন।
ওর শরীর খারাপ, তাই যায়নি। এখন ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে, দেওয়া যাবে না। কথা শেষ করে ক্রাডেলে রিসিভার রেখে নায়লা বেগম সেখান থেকে চলে গেলেন।
ওর কি অসুখ? এখন কেমন আছে মুকুল, জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল; কিন্তু রিসিভার রাখার শব্দ পেয়ে সেও রিসিভার রেখে চিন্তা করল, ভদ্র মহিলা এরকম ব্যবহার করলেন কেন? আবার ফোন করে লাভ হবে না ভেবে দু’একদিনের মধ্যে ওদের বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
পরের দিন শুক্রবার সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় মুকুল বাবাকে বলল, তুমি কী এ বেলা কোথাও যাবে?
ইবরাহীম সাহেব বললেন, কেন বলতো?
গাড়িটা নিয়ে একটু বেরোব।
দূরে কোথাও যাবি না তো?
না।
তা হলে নিতে পারিস। দুপুরের আগে ফিরলেই চলবে।
মুকুল কাপড় চোপড় পরে তৈরি হয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, কিছু টাকা দাওতো?
মুকুল কখনো মুখ ফুটে তার কাছে টাকা চায় নি। বরং বেরোবার আগে তিনি নিজে থেকে টাকা দেন। তাই জাহানারা বেগম বেশ অবাক হলেন। কয়েক সেকেণ্ড ছেলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে মৃদু হেসে বললেন, কিছু মানে কত?
পাঁচশো বা এক হাজার যা হোক দাও না।
জাহানারা বেগম দু’টো পাঁচশ টাকার নোট এনে তার হাতে দিয়ে বললেন, কোথায় যাবিরে?
আগারগাঁও।
তোদের কোনো ফাংসান আছে নাকি?
না, একজনকে দেখতে যাব।
কি হয়েছে তার?
খুব জ্বর হয়েছে।
তোর সাথে পড়ে বুঝি?
না, তবে ভার্সিটিতে পড়ে।
ছেলে না মেয়ে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জাহানারা বেগম সামলে নিলেন। বললেন, ঠিক আছে যা।
মুকুল ফার্মগেট থেকে তিন চার রকমের ফল, বড় এক বোতল হরলিক্স ও ওভালটিন কিনে মুক্তাদের বাসায় এল। গেট বন্ধ দেখে হর্ণ বাজাল।
দারোয়ান ছোট গেট দিয়ে বেরিয়ে বলল, বেগম সাহেব বাসায় নেই। আপনি ফোনে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করে পরে আসবেন।
মুকুল বলল, মুক্তার অসুখ জেনে তাকে দেখতে এসেছি। কিছু দিন আগে ওর সঙ্গে আমি এসেছিলাম, আপনি তো দেখেছেন।
দারোয়ান বলল, হ্যাঁ দেখেছি, কিন্তু তবু ভেতরে যেতে দিতে পারব না। বেগম সাহেবের কড়া নির্দেশ, উনি বাসায় না থাকলে কেউ যেন ভিতরে না। যায়।
মুকুল একটা কাগজে লিখল “আপনার অসুখ জেনে দেখতে এসেছি; কিন্তু দারোয়ান ভিতরে যেতে দিচ্ছে না।”–মুকুল।
লেখা শেষ করে কাগজটা দারোয়ানের দিকে বাড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনি এটা মুক্তাকে দেবেন। উনি যদি ফিরে যেতে বলেন, ফিরে যাব।
দারোয়ান বিরক্তের সঙ্গে কাগজটা নিয়ে ছোট গেট ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল। তারপর বারান্দার কাছে গিয়ে কাজের মেয়ে রসিদাকে ডেকে কাগজটা তাকে দিয়ে বলল, এটা তোমার আপাকে দাও। উনি কী বলেন ফিরে এসে আমাকে বলবে।
মুক্তা সর্দিজুরে চার পাঁচ দিন ভুগে গতকাল গোসল করে খাওয়া দাওয়ার। পর যখন ঘুমাচ্ছিল তখন মুকুল ফোন করেছিল।
নায়লা বেগম চান ননদের ছেলে আসিফের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে। মুক্তা না করে দিলেও হাল ছাড়েন নি। আসিফকে নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে মাঝে মাঝে বাসায় আসতে বলেন। এই কদিন আসিফ প্রায় রোজ একবার করে এসে মুক্তার ভালমন্দ খোঁজ খবর নিয়েছে। মুক্তা বিরক্ত বোধ করলেও ফুফাতো ভাই হিসাবে তা প্রকাশ করেনি। নায়লা বেগম এর আগে মেয়েকে কোনো বয়ফ্রেণ্ডকে বাসায় নিয়ে আসতে না দেখলেও ঐ দিন মুকুলকে নিয়ে এসেছিল বলে মেয়ের উপর যেমন রেগে ছিলেন তেমনি মুকুলের উপরও। তাই গতকাল যখন মুকুল ফোনে মুক্তাকে চেয়েছিল তখন ইচ্ছা করে ডেকে দেনি এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহারও করেন নি।
আজও আসিফ এসেছিল, একটু আগে নায়লা বেগম তাকে নিয়ে পল্লবীর বাড়িতে গেছেন। একটা ফ্লাটের পুরান ভাড়াটিয়া আজ চলে যাবে এবং নূতন ভাড়াটিয়া আসবে।
তারা চলে যাওয়ার পর মুক্তা নিজের রুমে বসে একটা গল্পের বই পড়ছিল। রশিদাকে ঢুকতে দেখে বলল, কিরে, কিছু বলবি?
রশিদা কাগজটা তার হাতে দিয়ে বলল, দারোয়ান এটা দিল।
.
মুক্তা যে দিন মুকুলকে ফোন নাম্বার দিয়েছিল, সেদিন থেকেই ফোনের অপেক্ষায় ছিল। সাত আট দিন ফোন না পেয়ে ভেবেছিল, সেও কী অন্য দশটা ছেলের মতো? এখন রশিদার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়ে আনন্দে তার বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল। বইটা রেখে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা ঠিক করে পরে রশিদাকে কিছু না বলে বেরিয়ে এল।
দারোয়ানকে বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, চাচা, উনি এলেই গেট খুলে দেবে। তবে আমি যখন থাকব না তখন গেট খোলার আগে সে কথা জানিয়ে ভিতরে আসবেন কিনা জিজ্ঞেস করবে। যাও তাড়াতাড়ি গেট খুলে দাও।
দারোয়ান গেট খুলে দেওয়ার পর মুকুল গাড়ি নিয়ে ভিতরে এসে বারান্দার কাছে পার্ক করল।
মুক্তা এগিয়ে এসে বলল, গেটে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইছি। দারোয়ানের কোনো দোষ নেই। সে মায়ের নির্দেশ পালন করেছে?
মুকুল গাড়ি থেকে নেমে বলল, ক্ষমা চাইছেন কেন? দারোয়ান তার কর্তব্য পালন করেছে। কেমন আছেন বলুন।
কয়েক দিন জ্বরে ভুগে কাল থেকে ভালো আছি। ভিতরে চলুন। তারপর যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমন আছেন?
আপনি আর ভালো থাকতে দিলেন কোথায়? ভার্সিটিতে এই কদিন খোঁজ করে না পেয়ে কাল ফোন করেছিলাম। আপনার মা ফোন ধরেছিলেন। বললেন, “আপনার খুব জ্বর, ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছেন। এখন তাকে ডাকা যাবে না।” অসুখের খবর জেনে এসে পড়লাম।
ততক্ষণে তারা ড্রইংরুমে এসে বসল। মুকুলের কথা শুনে মুক্তা বলল, পরিচয় দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কিছু মনে করবেন না। মা একটু ঐ রকম। তার হয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মুখে ঐ কথা বললেও মনে মনে মায়ের উপর রাগ হল।
মুকুল হাতের প্যাকেটটা টেবিলের উপর রেখে বলল, আপনার অসুখের কথা শুনে এগুলো নিয়ে এসেছি, মাইণ্ড করবেন না। করলে ব্যথা পাব।
প্যাকেটে কি আছে?
সামান্য ফলটল।
মুক্তা হেসে ফেলে বলল, মনে ব্যথা পাবেন বললেন, তাই নিলাম। তবে আর কখনো এরকম ছেলেমানুষী করবেন না। তারপর কলিং বেল বাজিয়ে একজন কাজের মেয়েকে ডেকে বলল, এই প্যাকেটটা আমার রুমে রেখে মেহমানের জন্য নাস্তা নিয়ে এস।
কাজের মেয়ে চলে যাওয়ার পর মুকুল বলল, আপনাকে বেশি রাত্রে মানে বারটার পর ফোন করলে পাওয়া যাবে?
মুক্তা আবার হেসে ফেলে বলল, অত রাত্রে কেন?
অন্য সময় করলে যদি আপনার মা রিসিভ করেন?
ফোনটা ড্রইংরুমে থাকে। অত রাত্রে ফোন করলে কাজের মেয়ে ধরবে।
তাহলে দিনে কখন করলে আপনাকে পাব?
বাসায় থাকলে যে কোনো সময়ে পাবেন। আমি মাকে বলে দেব। আপিন ফোন করলে যেন আমাকে দেয়। আর ফিকস্ড ডেটে করলে আমি ফোনের কাছে থাকব।
মুকুল নিজের নাম্বারটা দিয়ে বলল, আপনিও করবেন। আর সোমবার ও শুক্রবার ফিকড ডেট। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনার মা বাসায় নেই।?
না। কিছুক্ষণ আগে পল্লবী গেছে।
কাজের ময়ে রশিদা ট্রে টেবিলে নাস্তা নিয়ে এলে মুক্তা পরিবেশন করে বলল, নিন খান।
মুকুল বলল, মাফ করবেন, নাস্তা খেয়ে এসেছি। শুধু চা বা কফি দিন। মুক্তা দু’কাপ কফি বানিয়ে এককাপ তাকে দিয়ে নিজেও এক কাপ নিল।
কাপে চুমুক দিয়ে মুকুল বলল, কাল নিশ্চয় ভার্সিটি যাবেন।
হ্যাঁ যাব।
ক্লাস শেষ হবে কটায়?
একটায়।
পাবলিক লাইব্রেরীর পশ্চিম দিকের পার্কে অপেক্ষা করব, আসবেন?
আসব।
কাপে শেষ চুকুম দিয়ে কাপটা টেবিলের উপর রেখে এবার আসি বলে মুকুল উঠে দাঁড়াল।
মুক্তাও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন আপনাকে গাড়িতে তুলে দিই।
গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে মুকুল বলল, কালকের কথা মনে থাকবে তো?
মুক্তা মৃদু হেসে বলল, থাকবে।
পরের দিন ক্লাশ শেষ হতে মুক্তা রীমার চোখ এড়িয়ে পাবলিক লাইব্রেরীর পশ্চিম দিকে যখন এল তখন সোয়া একটা। অল্প দূরে দূরে জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়ে বসে গল্প করছে। মুক্তা এদিক ওদিক তাকিয়ে মুকুলকে দেখতে পেল না। ভাবল, এখনো হয়তো আসেনি। এমন সময় তার পিছন থেকে মুকুলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমি কি দেরি করে ফেললাম?
মুক্তা তার দিকে ফিরে মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু মৃদু হাসল। কিছু বলল না।
মুকুল দূরে একটা গাছ দেখিয়ে বলল, চলুন ওখানে বসা যাক।
মুক্তা চুপচাপ গাছের কাছে এসে ছায়া দেখে ঘাসের উপর বসে পড়ল।
মুকুল তার পাশে বসে বলল, আমি ভার্সিটি থেকে আপনার পিছন পিছন এসেছি। পিছনে তাকালেই দেখতে পেতেন। গেটে এসে বাদাম কিনতে একটু দেরি হয়ে গেল। তারপর বাদামের ঠোঙা ও লবনের পুরিয়া দুজনের মাঝখানে রেখে বলল, শুধু মুখে আলাপ জমে না। নিন শুরু করুন।
গতকাল মুকুল তাদের বাসা থেকে চলে আসার পর থেকে মুক্ত চিন্তা করেছে, কাল নিশ্চয় মুকুল তার মতামত জানতে চাইবে। কি বলবে ভেবে রেখেছে। আজ মুকুল আসার পর থেকে কি ভাবে শুরু করবে ভাবছিল। তাই এতক্ষণ চুপ করে ছিল। মুকুল বাদাম খাওয়ার কথা বলার পরও কোনো কথা না বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মুকুল তা লক্ষ করে বেশ অবাক হল। বলল, কী ব্যাপার? একদম চুপ চাপ যে? বাদাম খেতে আপনি কী পছন্দ করেন না?
মুক্তা ঠোঙা থেকে বাদাম নিয়ে খেতে শুরু করে বলল, না-না এইতো খাচ্ছি।
তবু যা হোক, বাদাম খাওয়াকে উপলক্ষ করে কথা বললেন। আসা অব্দি মুখ খোলেন নি। তারপর বলল, শাড়ির চেয়ে শালওয়ার কামিজে আপনাকে বেশি মানায়।
তাই?
হ্যাঁ তাই। তারপর বলল, কেন আজ আসতে বলেছি জানেন?
মুক্তা বুঝতে পেরেও বলল, আপনার মনের খবর আমি জানব কেমন করে?
আমার তো মনে হচ্ছে জেনেও না জানার ভান করছেন।
কী করে বুঝলেন?
আপনার মুখ দেখে। জানেন না, মুখ দেখে মনের কথা জানা যায়?
তা হলে জিজ্ঞেস করলেন কেন?
সেদিনের প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য।
এক্ষুণি তো বললেন, মুখ দেখলেই মনের খবর জানা যায়। উত্তরটা জানতে পারেন নি?
একদম যে পারিনি তা নয়। সিওর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম।
আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
বেশতো বলুন।
সেদিন আপনি বললেন, আমাকে আপনার পছন্দ, এমন কী বিয়েও করতে চান; কিন্তু আপনার মা বাবা তাদের একমাত্র ছেলের জন্য আমার মতো একজন কালো ও অসুন্দর মেয়েকে নিশ্চয় পছন্দ করবেন না। তাদের মতামত না জেনে এরকম কথা বলা কী ঠিক হয়েছে?
তাইতো, এসাইডটা ভেবে দেখিনি। তবে আমার পছন্দকে তারা একেবারে না করতে পারবেন না।
যদি করেন?
যেমন করে হোক আমি তাদের রাজি করাই।
যদি একান্তই রাজি করাতে না পারেন?
এই কথার উত্তর দিতে না পেরে মুকুল কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কী হল, কিছু বলছেন না কেন?
একান্ত রাজি করাতে না পারলে তাদের অমতেই আপনাকে বিয়ে করব।
কিন্তু আমার জন্য মা-বাবা, আত্মীয় স্বজনের অমতে বিয়ে করা কী আপনার উচিৎ হবে? তাছাড়া সকলের কাছে আপনি ছোট হয়ে যাবেন। আর সবাই আমাকে ঘৃণা করবেন। বলবেন, ছেলেকে ঐ পেত্নীটা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। সব থেকে বড় কথা, মা বাবার মনে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো সুখী হয় না। আমাদের মতো শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের এটা করাও কি উচিত হবে?
আপনি খুব যুক্তি সংযত কথা বলেছেন। তবে কী জানেন, আপনাকে বিয়ে করার পর যা কিছু ঘটবে, তা সাময়িক। একমাত্র ছেলে হিসাবে মা বাবার অমতে বিয়ে করলে, কিছুদিন হয়তো আমাদেরকে গ্রহণ করবেনা। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরকম ঘটনা সমাজে প্রায়ই ঘটছে। আশাকরি, আমাদের ব্যাপারে কিছু ঘটলেও তেমন গুরুতর কিছু ঘটবে না। আর যদি কিছু ঘটার সম্ভাবনাও থাকে, তবু আমি আমার সিদ্ধান্ত মতো কাজ করব। আর সে জন্য আপনাকে প্রমিজ করতে হবে, সাবলম্বি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। এবার আপনার মতামত বলুন।
মুক্তা এটাই শুনতে চাচ্ছিল। শেষের দিকের কথা শুনে হেসে ফেলে বলল, প্রমিস করতে যখন বললেন, তখন আবার মতামতের কথা বলছেন। কেন? আপনার জন্য আমি আজীবন অপেক্ষা করব।
মুকুল তার দুটো হাত ধরে বলল, প্রমিস?
সাবালক হওয়ার পর থেকে আজ প্রথম কোনো যুবকের স্পর্শ পেয়ে মুক্তা কেঁপে উঠল। তার সমস্ত শরীরে আনন্দের ঢেউ বইতে শুরু করল। কয়েক সেকেণ্ড মুকুলের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্রমিস।
মুক্তার মতো মুকুলেরও একই অবস্থা। ধরা হাত দুটোতে কয়েকটা কিস দিয়ে বলল, আমি জয়ী হয়েছি, তাই প্রেমের প্রথম পুরস্কার দিলাম।
আনন্দে মুক্তার চোখ চিক চিক করে উঠল, সেও মুকুলের ধরা হাতে কয়েকটা কিস দিয়ে ভিজে গলায় বলল, প্রেমের প্রতিদান দিলাম।
বেশ কিছুক্ষণ দুজন দুজনের হাত ধরে বসে রইল। এক সময় মুকুল বলল, চল, এবার উঠা যাক।
মুক্তা বলল, আর একটু বসুন। আমাদের ফ্যামিলিগত কয়েকটা কথা বলব।
মুকুল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন আর আপনি করে বলছ কেন?
মুক্তা মৃদু হেসে বলল, ঠিক আছে। তারপর বলল, আমাদের ফ্যামিলি সম্পর্কে তোমার জানা দরকার।
মুকুল আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রীমার কাছে তোমাদের সব কিছু জেনেছি।
তাই নাকি? কি জেনেছ বলত।
রীমার কাছে যা কিছু শুনেছিল, মুকুল সব কিছু বলে বলল, আরো কী কিছু জানার বাকি আছে?
মুক্তা বলল, না তেমন আর কিছু নেই। তবে আসিফকে বিয়ে করতে রাজি না বলে মা আমার উপর ক্ষেপে আছে। আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছে। প্রায় প্রতিদিনই আমাদের ও আশে পাশে মহল্লার কেউ না কেউ আমাকে বিয়ে করার জন্য ফোনে মাকে প্রস্তাব দেয়। আসিফরা ছাড়া ঢাকায়। আমাদের কোনো আত্মিয় স্বজন নেই। দুই মামা থাকলেও তারা আমেরিকায়। সেটেল্ড। ফুফা মানে আসিফের বাবা ব্যাংকে চাকরী করেন। পারিবারিক অবস্থা স্বচ্ছল হলেও সমাজে তেমন হোল্ড নেই। আসিকও এবছর ব্যাংকে ঢুকেছে। মোটামুটি ভালো ছেলে। তবে একটু হ্যাংলা, মানে বোকা টাইপের। নিজস্ব কোনো প্রিন্সিপল নেই। যে যা বলে তাতেই সায় দেয়। এক কথায় ভিজে বিড়াল। এই সব কারণে তাকে আমি একদম দেখতে পারি না।
মুকুল বলল, তুমি মাকে এসব কথা বলেছ?
বলিনি আবার, শুনে বলল, এরকম ছেলেকে বিয়ে করলে তুই সুখী হবি। যা বলবি, তাই শুনবে। কোনো প্রতিবাদ করবে না। আমিও মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, বেঁচে থাকতে আসিফকে বিয়ে করব না।
তা হলে তো আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেলে তিনি তোমার উপর আরো ক্ষেপে যাবেন। সেই সাথে আমাকেও সুনজরে দেখবেন না নিশ্চয়?
হ্যাঁ, তুমি অবশ্য ঠিক কথা বলেছ; তবে আমি তার একমাত্র মেয়ে। যতই ক্ষেপে যাক না কেন, আমার মতের বাইরে কিছু করতে পারবে না। মাকে নিয়ে তুমি কিছু ভেব না। কলেজ লাইফ থেকে এখন পর্যন্ত বহু ছেলে। পেছনে লেগেছে। তাদের কাউকেই আমার পছন্দ হয়নি। প্রথম যেদিন তোমাকে দেখলাম, সেদিনই তুমি আমার মন কেড়ে নিয়েছিলে। তাইতো তোমার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারিনি।
এবার চল, বড় ক্ষিদে পেয়েছে। হোটেলে খেয়ে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব।
মুক্তা দাঁড়িয়ে বলল, আজ কিন্তু আমি খাওয়াব।
মুকুলও দাঁড়িয়ে উঠে বলল, সে দিনের ঋণ শোধ করতে চাও?
মুক্তা যেতে যেতে বলল, ঋণ শোধ করার কথা বলছ কেন? তুমি প্রতিদিন খাওয়াবে এটা কেমন কথা?
হোটেলে খেয়ে মুকুল যখন মুক্তাদের বাসার গেটে পৌঁছাল তখন বেলা সাড়ে তিনটে। গাড়িতে মুক্তাকে দেখে দারোয়ান গেট খুলে দিল।
মুকুল ভিতরে না গিয়ে গাড়ির গেট খুলে দিয়ে বলল, আজ আর ভিতরে যাব না।
মুক্তা বলল, কেন?
চারটের মধ্যে বাসায় ফিরতেই হবে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বাবার অফিসে যাবে।
মুক্তা গাড়ি থেকে নেমে বলল, অন্ততঃ এককাপ চা খেয়ে যাও।
অন্য দিন খাব বলে মুকুল গেট বন্ধ করে গাড়ি ছেড়ে দিল।
চার
নায়লা বেগম বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। গেটে মেয়েকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেছেন। কাছে এলে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটা কে?
মুক্তা বলল, মুকুল।
এত দেরি করে ফিরলি যে?
ওর সঙ্গে হোটেলে খেয়ে ফিরতে দেরি হয়ে গেল। কথা শেষ করে মুক্তা রুমের দিকে এগোল।
নায়লা বেগম মেয়ের সঙ্গে রুমে এসে বললেন, মুকুলের সঙ্গে এতটা মেলামেশা করা কী তোর উচিত হচ্ছে? আসিফের সঙ্গে তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে বলে বাইরের ছেলেদের উৎপাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।
বাইরের ছেলেদের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যা বলেছ তা ঠিক করেছ, কিন্তু তাই বলে একথা ভেব না, আমি সত্যি সত্যি আসিফ ভাইকে বিয়ে করব।
তুই কী মুকুলকে পছন্দ করিস?
হ্যাঁ।
নায়লা বেগম রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, মুকুল তোকে পছন্দ করে?
হ্যাঁ করে।
সে যদি অন্য পাঁচটা ছেলের মতো আমাদের সম্পত্তির লোভে তোকে বিয়ে করতে চায়?
মুকুল সে রকম ছেলেই নয়। তার বাবারও সম্পত্তি কম না। তাছাড়া সে মা-বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান।
তার মা বাবা তোকে যদি পছন্দ না করেন?
এসব ব্যাপার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি তার সঙ্গে সব কিছু আলাপ করেছি।
তুইও তো জানিস, আজকাল ধনী ঘরের ছেলেদের চরিত্র বলতে কিছু নেই। মুকুল যদি ঐ ধরনের ছেলে হয়?
এক্ষুনি বললাম না, মুকুল সে রকম ছেলেই নয়? তুমি এখন যাও, আমি একটু রেষ্ট নেব। তারপর বলল, মুকুলের ফোন এলে আমাকে ডেকে দিও।
নায়লা বেগম আর কিছু না বলে বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে ভাবতে লাগলেন, মুক্তা তারই মতো জেদী হয়েছে। তখন তার নিজের পুরনো দিনের কথা মনের পাতায় ভেসে উঠল। মা যখন মারা যায় তখন তার বয়স প্রায় নয় দশ বছর হবে। তাকে দেখাশোনা করার জন্য বাবা একজন শিক্ষিত আধা বয়স্কা মেয়ে রেখেছিলেন। বাবা সরকারী অফিসে চাকরি করতেন। ঐ মেয়ে তাকে স্কুলে নিয়ে যেত এবং ছুটির পর নিয়ে আসত। বাবার অনেক বন্ধু বান্ধব ও তাদের স্ত্রীরা বাসায় আসতেন। তারা বাবাকে আবার বিয়ে করার কথা বললে বাবা মৃদু হেসে বলতেন, নায়লা না থাকলে অবশ্যই করতাম। যাকে বিয়ে করে নিয়ে আসব, সে যদি আমার নায়লাকে কষ্ট দেয়? বন্ধুরা বলতেন, কিন্তু ওকে দেখাশোনা করার জন্য তো একজন মেয়ে মানুষ লাগবে। তা ছাড়া আপনি বাকি জীবন একাকী কাটাবেন কী করে? বাবা বললেন, ওকে দেখাশোনা করার জন্য অবশ্যই একটা ব্যবস্থা করব। আর বাকি জীবন কাটাবার কথা যে বললেন, তা মা নায়লার মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেব। বাবা যে মাকে ভীষণ ভালবাসতেন তা কিশোরী নায়লা জানত। বড় হয়ে বুঝতে পারে মায়ের জন্যই বাবা আর বিয়ে করেনি। তবে তার ভালো মন্দের ব্যাপারটাও সেই সাথে জড়িত। অফিস টাইম ছাড়া বাবা সব সময় তাকে সঙ্গ দিতেন। সকালেও রাত্রে পড়াতেন। বিকেলে মহল্লার ও বাবার বন্ধুর ছেলে মেয়েরা এলে তাদের সাথে খেলতে দিতেন। ছুটির দিন। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন। ভার্সিটিতে পড়ার সময় আজাদ নামে একটা ছেলের প্রেমে পড়ে যাই। আজাদ নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ছাত্র হিসেবে খুব ভালো। পৌনে ছয় ফুট দীর্ঘ সুঠাম দেহ। যা নাকি যে কোন মেয়ের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। কিন্তু গায়ের রং কালো। তবে কালো হলেও দেখতে খারাপ নয়। ভার্সিটির এক ফাংশনে আজাদের সঙ্গে নায়লার পরিচয়। সেই সময় তাকে নায়লার খুব পছন্দ হয়। তারপর বিভিন্ন ছুতোয় তার সঙ্গে আলাপ শুরু করে। আজাদ প্রথম দিকে তেমন খেয়াল করেনি। পরে যখন নায়লার মতিগতি বুঝতে পারল তখন তাকে এড়িয়ে চলতে লাগল। কিন্তু নায়লা তার পিছু ছাড়ল না। একদিন তাকে বলল, তুমি কী আমাকে ঘৃণা কর।
নায়লা যে ধনী বাবার আদরের একমাত্র কন্যা, আজাদ তা জানত। তাই থতমত হয়ে আমতা আমতা করে বলল, হঠাৎ একথা বলছ কেন? বরং গরিব ঘরের ছেলে হিসাবে আমিই তো তোমাদের মতো মেয়েদের কাছে ঘৃণার পাত্র।
দুনিয়ার সমস্ত মেয়ের কাছে ঘৃণার পাত্র হলেও আমার কাছে যে তুমি হীরের টুকরো সে কথা কী জান?
আজাদ কালো বলে মেয়েরা বড় একটা তার সঙ্গে মেলামেশা করেনি। নায়লাকে তার সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখেও তার আচার ব্যবহারে ও কথাবার্তায় কিছুটা তার মনের খবর পেয়ে মনে মনে শিহরিত হলেও নিজের অস্তিত্বের কথা চিন্তা করে তাকে এড়িয়ে চলে। তাই তার কথা শুনে খুব অবাক হল না। বলল, নিশ্চয় কৌতুক করছ?
না, যা সত্য তাই বললাম।
কি কারণে হীরের টুকরো বললে, জানি না। তবে তোমার কথা যদি সত্য হয়, তা হলে আমি সারা দেশের কাছে হীরের টুকরো না হলেও সোনার। টুকরো হওয়ার ইচ্ছা রাখি।
নায়লা কগ্রাচুলেশন জানিয়ে বলল, আজ আমার কাছে হীরের টুকরো হলেও একদিন তুমি সারা দেশের কাছেও তাই হবে। আর সেই বিশ্বাস আছে। বলে তোমাকে নিজের থেকে বেশি ভালবেসে ফেলেছি। বল, আমাকে ফেরাবে না?
জান বোধ হয়, প্রেম-ভালবাসা উন্নতির পথে প্রাচীর স্বরূপ।
জানি, তবে যে প্রেম-ভালবাসা উন্নতির পথে প্রাচীর, তা সত্যিকার প্রেম ভালবাসা নয়। প্রমিস করছি, আমি প্রাচীর না হয়ে জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমার উন্নতির পথ করে দেব।
কিন্তু তুমি তো আমার সম্পূর্ণ পরিচয় জান না। আমার বাড়ির পরিবেশ, আমাদের আর্থিক…….।
তাকে থামিয়ে দিয়ে নায়লা বলল, ওসব জানার আমার দরকার নেই। আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমার পরিচয়কে নয়। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না আজাদ। তুমি শুধু বল, আমাকে নিরাশ করবে না? শেষের দিকের কথাগুলো নায়লার নিজের কাছে কান্নার মতো শোনাল।
একজন সুন্দরী ললনার প্রেম প্রত্যাখ্যান করা আজাদের পক্ষে সম্ভব হল না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, তোমাকে ফেরাব না ঠিক কথা, কিন্তু তোমার বাবা আমাকে নিশ্চয় পছন্দ করবেন না।
অন্য পাঁচজনের মতো আমার বাবা নন। তিনি আমার পছন্দকে নিশ্চয় মূল্যায়ন করবেন। এখন আমাদের বাসায় চল, আলাপ করলেই আমার কথার প্রমাণ পাবে।
ঠিক আছে আজ নয় অন্য একদিন যাব।
কবে যাবে বল, আমি বাবাকে বলে রাখব।
যেদিন যাব সেদিন বলব। তার আগে আমি যে গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সেকথা তাঁকে জানাবে। শোনার পর যদি উনি যেতে বলেন, তাহলে যাব।
নায়লা আহত স্বরে বলল, তুমি তাহলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?
এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয় নায়লা। এটা সারা জীবনের সুখ দুঃখের প্রশ্ন। তোমার প্রতিটি কথা বিশ্বাস করি। তবু বলব, এত লেখাপড়া করলেও আমাদের জ্ঞান এখনো পরিপক্ক হয়নি, যা তোমার বাবার হয়েছে। তাই তাকে বলতে বললাম।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
কর।
তুমি আমাকে ভালবাস?
তোমার কী মনে হয়?
আমার যাই মনে হোক না কেন? তোমার মুখে শুনতে চাই।
ভালবাসা কি মুখের জিনিস? ওটা তো মনের ব্যাপার।
মনের ব্যাপারটা তো মুখ দিয়ে বলতে হয়। আসল কথা না বলে এত ভূমিকা করছ কেন?
বাসি।
কতদিন থেকে?
তুমি যত দিন থেকে বাস।
তা হলে এড়িয়ে চল কেন?
নিজের অস্তিত্বের কথা চিন্তা করে।
কথা দাও, আর এড়িয়ে চলবে না।
বেশি মেলামেশা করা কি ঠিক হবে? পড়াশোনার ক্ষতি হবে না?
তুমি না ভীষণ চালাক আর বাকপটু। বেশি মেলামেশার কথা তো বলিনি, বলেছি এড়িয়ে চলার কথা।
আজাদ মৃদু হেসে বলল, ঠিক আছে, কে চায় প্রেমিকাকে এড়িয়ে চলতে। তারপর বলল, আর নয় অনেক সময় নষ্ট হল। এবার বিদায় বলে হাঁটতে শুরু করল।
নায়লা বলল, এই, আমাকে রেখে চলে যাচ্ছ কেন? তারপর হাঁটতে হাঁটতে বলল, কাল কিন্তু দেখা করবে।
ঐ দিন রাতে নায়লা বাবাকে বলল, একটা ছেলেকে তোমার সঙ্গে পনি করাতে চাই।
ইয়াকুব সাহেব মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে। বললেন, ছেলেটার পরিচয় বল।
গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। নাম আজাদ। আমাদের সঙ্গে ভার্সিটিতে পড়ে। এক বছরের সিনিয়ার। খুব তুখোড় ছাত্র।
ইয়াকুব সাহেব বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে রইলেন।
কিছু বলছ না কেন বাবা?
ইয়াকুব সাহেব গম্ভীর স্বরেই বললেন, তার সঙ্গে তোর কত দিনের পরিচয়?
প্রায় বছর খানেক।
তা আমার সঙ্গে পরিচয় করাতে চাচ্ছিস কেন?
নায়লা চেয়ারের পিছন থেকে বাবার গলা জড়িয়ে বলল, বোকা ছেলের মতো কথা বলছ, কেৰচাচ্ছি বুঝতে পারছনা?
তুই তো নিজেই আমাকে বোকা ছেলে বললি, বুঝব কি করে?
ঠিক আছে, তুমি খুব চালাক ছেলে হলতো?
ইয়াকুব সাহেব মেয়ের একটা হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসিয়ে বললেন, ছেলেটা নিশ্চয় তোর পরিচয় জানে?
নায়লা বলল, জানে।
ঠিক আছে, নিয়ে আসিস।
পরের দিন ভার্সিটিতে নায়লা আজাদকে খোঁজ করে পেল না। তারপর প্রায় আট দশ দিন পরে আজাদকে দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, এই বুঝি এড়িয়ে না চলার প্রমিস? তারপর তার শুকনো মুখ দেখে বলল, তোমার কী হয়েছে? অসুখ করেছিল নাকি?
আজাদ ম্লান মুখে বলল, ঐদিন বাসায় গিয়ে দেখি দেশ থেকে চাচাতো ভাই চিঠি দিয়েছে। চিঠি পড়ে আম্মার কঠিন অসুখের কথা জেনে পরের দিন বাড়ি গিয়েছিলাম।
তোমার মা কেমন আছেন?
মা নেই। বাড়ি যাওয়ার দুদিন আগে মারা গেছেন। তারপর মুখে দু’হাত : ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
নায়লা তার পিঠে হাত রেখে সমবেদনা জানিয়ে বলল, তোমার মা মারা গেছেন জেনে আমিও খুব দুঃখ পেলাম । তুমি এত ভেঙ্গে পড়ছ কেন? আমারও তো মা নেই। মাকে হারিয়েছি আট দশ বছর বয়সে। ভেবেছিলাম, তোমার মাকে পেয়ে মায়ের অভাব পূরণ করব। কিন্তু তাও ভাগ্যে সইল না। চল, কোথাও গিয়ে বসি।
আজাদ চোখ মুখ মুছে যেতে যেতে ভিজে গলায় বলল, জান। নায়লা,আম্মার বড় ইচ্ছা ছিল, আমাকে অনেক লেখাপড়া করিয়ে বড় পুলিশ অফিসার করবেন। তাই আব্বা মারা যাওয়ার পর আর্থিক কারণে যখন আমি পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চাইলাম তখন আম্মা আমাদের কাছ থেকে পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ নিয়ে বিক্রি করে আমার পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছিলেন।
তোমার নানার অবস্থা বুঝি খুব ভালো ছিল?
হাঁ, নানা প্রচুর বিষয় সম্পত্তি রেখে মারা যান। আমার দুই মামা। আর মায়েরা দুই বোন। সবার অবস্থা খুব ভালো। অবশ্য আগে আমাদেরও ভালো ছিল। আমাদের বজরা ছিল। আব্বা গ্রাম দেশ থেকে ধান-চাল কিনে শহরে চালান দিতেন। একবার বাবা চাল বোঝাই করে ঢাকা যাওয়ার পথে গভীর রাতে স্টীমারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নদীর মাঝখানে বজরা ডুবে যায়। বজরার অন্য সবাই মারা গেলেও আব্বাকে এক মাছধরা নৌকার মাঝি বাঁচায়। তাতে আব্বার কয়েক লক্ষ টাকা নষ্ট হয়। আব্বা খুব ভেঙ্গে পড়েন। আম্মা আব্বাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ধার দেনা করে আবার ব্যবসায় নামান। কিছুদিনের মধ্যে আব্বা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেন। কিন্তু ভাগ্যেকে কে ঠেকাবে। আমি যে বছর এস.এস.সি. পাশ করি, সেই বছর বজরায় ডাকাত পড়ল। আব্বাসহ সবাইকে মেরে ফেলে ডাকাতরা মাল বোঝাই বজরা হাইজ্যাক করল। তাই তো হাইজ্যাকারদের শাসন করার জন্য মা আমাকে বড় পুলিশ অফিসার বানাতে চেয়েছিলেন। তারপর থেকে আমাদের অবস্থার অবনতি। কিভাবে আম্মা আমাকে লেখা পড়া করাচ্ছিলেন, তাতো একটু আগে বললাম।
তোমার আর কোনো ভাইবোন নেই?
ভাই নেই। শুধু দুটো বোন। তারা আমার ছোট। আম্মাই অনেক কষ্ট করে তাদের বিয়ে দিয়েছেন।
নায়লা বলল, তোমার জীবন খুব ট্র্যাজেডি পূর্ণ। তারপর বলল, শুধু হাঁটবে? কোথাও বসলে হত না?
কিছু ভালো লাগছে না। তুমি যাও, আমি বাসায় ফিরব।
তুমি কোথায় থাক?
লালমাটিয়ার একজনের বাসায়। তাদের দু’টো ছেলেমেয়েকে পড়াবার বদলে লজিং পেয়েছি।
আরে আমাদের বাসাও তো লালমাটিয়া মহিলা কলেজের কাছে। এতদিন বলনি কেন?
জানতে চাওনি বলে।
ঠিক আছে, ঠিকানাটা দাও।
দেওয়া যাবে না।
কেন?
বাড়িওয়ালার নিষেধ।
এ আবার কি রকম বাড়িওয়ালা?
বাড়ি ওয়ালার দুটো বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে আছে। আমাকে লজিং দেওয়ার সময় সে কথা জানিয়ে বলেছিলেন, কোনো বন্ধু-বান্ধব বা আত্মিয় স্বজনকে ঠিকানা দেওয়া যাবে না। তাদের কাউকে বাসায় আনাও যাবে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই।
তুমি ঐ দুটো মেয়েকে পড়াও বুঝি?
না। তাদের ছোট দুটো ভাই বোনকে পড়াই।
ওরা ভার্সিটির গেটের বাইরে এসে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। একটা খালি স্কুটার এসে তদের সামনে দাঁড়াতে নায়লা বলল, চল একসঙ্গে যাই।
আজাদ বলল, তুমি যাও, আমি নীলক্ষেত থেকে বাসে যাব।
নায়লা চোখ পাকিয়ে বলল, এমন কথা বলতে পারলে? তারপর তার একটা হাত ধরে স্কুটারে উঠিয়ে নিজেও উঠল।
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?
নায়লা বলল, লালমাটিয়া মহিলা কলেজের সামনে।
ড্রাইভার স্কুটার ছেড়ে দেওয়ার পর নায়লা বলল, আমাদের বাসায় চল, বাবার সঙ্গে পরিচয় হলে ভালো লাগবে।
ওকে আমার কথা বলেছিলে?
হ্যাঁ বলেছি।
উনি যেতে বলেছেন?
হ্যাঁ।
এখন উনি বাসায় আছেন?
না, ঘন্টা খানেকের মধ্যে এসে পড়বেন।
স্কুটার লালমাটিয়ায় আসার পর আজাদ ড্রাইবারকে থামতে বলল। থামার পর নেমে নায়লাকে বলল, তোমাদের বাসার ঠিকানা বল, আমি পাঁচটার দিকে আসব।
নায়লা বলল, কেন? এখন গেলে কী হয়?
লজিং বাড়ির এটাও শর্ত, দুপুরের খাবার বাইরে খেতে হলে আগাম জানাতে হবে। তাই বাসায় যেতেই হবে।
বাড়িওয়ালা খুব বাজে লোক। তোমার স্বাধীনতা বলতে তা হলে কিছু নেই?
বাড়িওয়ালা তোমার কাছে বাজে লোক হতে পারে; কিন্তু আমার কাছে খুব ভালো। তুমি লজিং বাড়িতে কখনো থাকনি, থাকলে বুঝতে। তারপর নায়লা কিছু বলার আগে আজাদ ড্রাইভারকে বলল, যান ভাই, ওকে নিয়ে যান।
আজাদ ঠিক পাঁচটার সময় এসে নায়লার দেওয়া ঠিকানা মতো একটা চারতলা বাড়ির সামনে এসে রিকসা থেকে নামল। বড় গেট বন্ধ ছোট গেট খোলা। ভিতরে একটা টুলে একজন বয়স্ক লোক বসে আছে।
তাকে দেখে লোকটা জিজ্ঞেস করল, কাকে চান?
আজাদ বলল, এটা নায়লাদের বাড়ি না?
লোকটা দারোয়ান। বলল, হ্যাঁ। তারপর দাঁড়িয়ে বলল, আপনার নাম কী আজাদ সাহেব?
হ্যাঁ।
দারোয়ান সালাম ঠুকে বলল, যান ভিতরে যান।
ভিতরে ঢুকে আজাদ দেখল, বারান্দার কাছে মেরুন কালারের একটা ঝকঝকে গাড়ি। কয়েক পা এগিয়েছে, এমন সময় নায়লা এগিয়ে এসে বলল, বাসা পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
আজাদ বলল, না।
নায়লা তাকে সঙ্গে নিয়ে ড্রইং রুমে এসে বলল, একটু বস, আসছি। তারপর চলে গেল।
আজাদ গ্রামের ছেলে। শহরের কোনো উচ্চ ধনী লোকের বাড়িতে যায় নি। ঘরের আসবাবপত্র দেখে বুঝতে পারল, এরা বেশ ধনী। দেওয়ালে টাঙ্গান পাকিস্তান পিরিয়ডের ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সব প্রধান মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টদের বাঁধান বড় বড় ছবি দেখে বেশ অবাক হল।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর নায়লা একজন পঞ্চাশোর্ধ লোককে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসে বলল, বাবা।
আজাদ দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
ইয়াকুব সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন।
আমি তোমাদের জন্য চা নিয়ে আসি বলে নায়লা চলে গেল। ইয়াকুব সাহেব আজাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, তোমার কথা নায়লা বললেও নাম বলেনি।
আজাদ নাম বলল।
গ্রামের বাড়ি কোথায়?
ঝালকাঠি।
কে কে আছে?
আজাদ নায়লাকে যা বলেছিল তাই বলল।
ইয়াকুব সাহেব সমবেদনার সুরে বললেন, হ্যাঁ, মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দী। তা এখন কী করবে ভেবেছ?
অনার্স পরীক্ষা দিয়ে বি.সি.এস.দেব। পরে আর্মিতে যাওয়ার চেষ্টা করব।
এমন সময় নায়লা কাজের মেয়েকে সঙ্গে করে চা নাস্তা নিয়ে ফিরে এল।
ঠিক আছে তোমরা চা খাও, আমি একটু বেরোব বলে ইয়াকুব সাহেব উঠে চলে গেলেন।
নায়লা কাজের মেয়েকে কিছুক্ষণ পরে এসে চা নাস্তার ট্রে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নাস্তা পরিবেশন করে বলল, এগুলো খাও, আমি চা তৈরি করছি।
আজাদ বলল, শুধু চা খাব। কিছুক্ষণ আগে ভাত খেয়েছি। নাস্তা খেতে পারব না। নায়লা দুকাপ চা বানিয়ে আজাদকে এক কাপ দিয়ে নিজেও একটা নিল। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, বাবাকে কেমন লাগল।
আজাদ বলল, ভালো।
কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
বাড়ির সব কিছু খোঁজ খবর নিলেন। এখন কি করব জিজ্ঞেস করলেন।
তুমি কী বললে?
আজাদ ইয়াকুব সাহেবকে যা বলেছিল তাই বলল।
তোমার মায়ের তো ইচ্ছা ছিল তোমাকে বড় পুলিশ অফিসার করার, আর্মিতে যেতে চাচ্ছ কেন?
আজকাল গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে অল্প কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই করাপটেড। তাই সে কথা মাকে জানিয়ে আর্মিতে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলাম। তারপর চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, এবার আসি তা হলে।
নায়লার আগেই চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বলল, চল, তোমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিই।
গেটে আজাদকে রিকসায় তুলে দিয়ে ফিরে এসে নায়লা বাবার রুমে গেল।
ইয়াকুব সাহেব ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে মেয়ের পছন্দের কথা চিন্তা করছিলেন। নায়লা দেখতে খুব সুন্দরী না হলেও সুন্দরী। সে একটা কালো নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেকে পছন্দ করবে এটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। অবশ্য ছেলেটা বেশ কালো হলেও সুন্দর স্বাস্থ্য। দেখতে শুনতেও মোটামুটি ভালো। গ্রামের ছেলে বলে হয়তো সহজ সরল । কিন্তু একটা জিনিস খটকা লাগল, নায়লার পরিচয় জেনেও সে এ পথে পা বাড়াল কেন? তা হলে ছেলেটা কী লোভী। এমন সময় কারো আসার পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ খুলে মেয়েকে দেখে বললেন, আয় বস।
নায়লা ইজি চেয়ারের হাতলে বসে বাবার মাথায় হাত বুলোত বুলোতে বলল, বাইরে যাবে বললে না; শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
ইয়াকুব সাহেব বললেন, না, শরীর ভালো আছে। সন্ধ্যের আগে বেরোব।
নায়লা লাজুক স্বরে বলল, আজাদকে কেমন লাগল?
ভালোকে তো আর খারাপ বলতে পারি না; তবে গায়ের রং বেশ কালো।
তুমি তো একদিন বলেছিলে, শুধু দেখতে সুন্দর হলে হয় না, আর পোষাকে বাবু হলেও হয় না, আচার-আচরণ, জ্ঞান ও নির্মল চরিত্রই হল মনুষত্বের মাপকাঠি। তুমি ওকে কতটুকু বুঝতে পেরেছ জানি না, ঐসব গুনের কারণে কালো হলেও আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি।
আজাদও কী তোকে ভালবাসে।
বাসে, তবে সে কথা কখনো প্রকাশ করেনি। সব সময় আমাকে এড়িয়ে চলত। কিছুদিন আগে জোর করে ওর স্বীকৃতি আদায় করেছি।
ইয়াকুব সাহেবের মনে যে খটকা ছিল, মেয়ের কথা শুনে তা দূর হল। ভাবলেন, নায়লার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে ছেলেটা একটা রত্ন। ভবিষ্যতে উন্নতি করবে। বললেন, আমি শুধু তোর বাবা নই, মাও। বাবার স্নেহের সাথে সাথে মায়ের স্নেহ দিয়েও তোকে মানুষ করেছি। যখন যা আব্দার করেছিস, পূরণ করেছি। এখনো তোর মতের বিরুদ্ধে যাব না। তবে একটা কথা জেনে রাখ। জীবনসাথি নির্বাচন বড় কঠিন জিনিস। যে ভুল নির্বাচন করে, সারা জীবন তাকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে হয়। অনার্স এর পর বি.সি.এস, করে ও আর্মিতে যেতে চায় বলল। এর মধ্যে এমন কিছু করিস নি, যা আমাকে দুঃখ দেবে। এই বয়সটা খুব খারাপ। যারা একবার পিছলে যায়, তারা জীবনে কোনো দিন সুখ-শান্তির মুখ দেখতে পায় না।
নায়লা বলল, বাবা, তুমি আমাকে যেভাবে মানুষ করেছ, তাতে আমি সিওর, জীবন গেলেও এমন কোনো কাজ করব না, যা তোমার মনে কষ্টের কারণ হবে। তুমি একদিন বলেছিলে, মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। আমার ভাগ্যে যা আছে তা হবেই। আমার ব্যাপারটা নিয়ে তুমি বেশি চিন্তা করো না। আমি কখনো তোমাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করিনি। কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতেও করব না।
ইয়াকুব সাহেবের স্ত্রীর কথা মনে পড়ল। সেও কখনো তাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করত না। মেয়ের কথা শুনে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোর প্রতি আমার সে বিশ্বাস আছে। এবার যা, আমি বেরোব।
এরপর আজাদের শত আপত্তি সত্ত্বেও নায়লা আজাদের সব খরচ চালাতে লাগল। অনার্সে ভালো রেজাল্ট করে বি.সি.এস. পাশ করল। তারপর ইয়াকুব সাহেব চেষ্টা চরিত্র করে আর্মিতে ঢুকিয়ে দিলেন। অধ্যাবসায় ও প্রতিভার ফলে দু’তিন বছরের মধ্যে উঁচু পোষ্টে প্রমোশন হল। এই সময় ইয়াকুব সাহেব ওদের বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন। তারপর কর্তব্য নিষ্ঠার কারণে। একের পর এক প্রমোশন পেয়ে আজাদ ব্রিগেডিয়ার হয়েছিল। এমন সময় মা ডাক শুনে নায়লা বেগমের চিন্তা ছিন্ন হয়ে গেল। মেয়েকে দেখে বললেন, কিরে কিছু বলবি?
মুক্তা বলল, তুমি কী এত ভাবছিলে? চা খাওয়ার সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে।
নায়লা বেগম বললেন, কি আর ভাববো, তুই রুমে যা, চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
পাঁচ
পরের দিন ভার্সিটিতে রীমা মুক্তাকে বলল, কিরে ক্লাস শেষে তোকে পেলাম যে?
মুক্তা বলল, একটার সময় একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। ক্লাস শেষই হল একটায়। তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
কে রে সে? যার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে না বলেই চলে গেলি?
মুক্তা কিছু না বলে মিটিমিটি হাসতে লাগল।
কিরে, কিছু না বলে হাসছিস যে? ব্যাপারটা অন্য রকম মনে হচ্ছে?
কি রকম মনে হচ্ছে বলতো শুনি।
এই ধর, যাকে তুই পছন্দ করিস, কাল তার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলি। তার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছিস।
মুক্তা রীমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর অনুমান দারুন। তুই ঠিক কথাই বলেছিস।
আরে ছাড় ছাড়, কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?
তাকে ছেড়ে দিয়ে মুক্তা বলল, কাল তার মনের কথা জানতে পেরেছি। সেও আমাকে পছন্দ করে।
সেদিন তো বলেছিলি ছেলেটার মনের কথা জানার পর তার পরিচয় বলবি, বল তা হলে।
মুকুল।
কি বললি?
কেন বিশ্বাস হচ্ছে না? না জেলাস হচ্ছে?
কোনোটাই হচ্ছে না, বরং খুব খুশি লাগছে। তুই ভাবি হলে যা মজা হবে না? তা হলে এতদিনে মনের মতো ছেলে পেলি। দেখিস, ফসকে না যায়।
সে তো তোর খালাতো ভাই, তাকে আমার থেকে বেশি চিনিস, তবু ফসকাবার কথা বলছিস কেন?
মুকুল খুব ভালো ছেলে, এমনি কথা প্রসঙ্গে মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে। তুই কিছু মনে করিস না। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, চল ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।
রীমা মুক্তাকে ঐসব বললেও মন দিয়ে ক্লাস করতে পারল না। একটা কথা সব সময় মনে হতে লাগল। মুকুল কী করে মুক্তার মতো একটা কালো মেয়েকে পছন্দ করল। বাসায় ফিরে কথাটা অনেক ভাবল। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, তুই মুক্তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। ইচ্ছা করলে তাকে ক্যাপচার করতে পারতিস। মা বাবার একমাত্র ছেলে। সুখে থাকতে পারবি। এখনো সময় আছে, তোর মনের কথা জানালে মুকুল নিশ্চয় তোকে ফেরাবে না। তা ছাড়া তোর খালা খালু নিশ্চয় কালো অসুন্দর মেয়ে বউ করতে চাইবে না। কথাগুলো চিন্তা করে রীমার মন খারাপ হয়ে গেল। রাত্রে পড়তে বসে পড়ায় মন বসাতে পারল না। খোলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ভাবতে লাগল, কি ভাবে মুকুলকে বলবে, “আমি তোকে ভালবাসি”।
রীমা ও তার ছোট বোন শ্রাবণী একই রুমে দুটো আলাদা খাটে ঘুমায়। ওদের রিডিং রুম আলাদা। শ্রাবণী জোরে জোরে পড়ে বলে রীমার ডিষ্টার্ব হয়। তাই সে ঘুমাবার রুমে পড়ে। শ্রাবণী একটা ইংলিশ প্যারাগ্রাফ বোঝার জন্য রীমার কাছে এসে বলল, এটা বুঝিয়ে দাও।
রীমা এত গভীর ভাবে চিন্তা করছিল যে, শ্রাবণীর কথা তার কানে গেল না। তবে বাস্তবে ফিরে এল। তারদিকে তাকিয়ে বলল, কি যেন বললি?
ওমা এত কাছে থেকে তুমি আমার কথা শুনতে পাওনি? মনে হচ্ছে বই এর দিকে তাকিয়ে কিছু চিন্তা করছিলে।
কথাটা পাত্তা না দিয়ে রীমা বলল, কেন এসেছিস বল।
শ্রাবণী বই খুলে প্যারাগ্রাফটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, এটা বুঝিয়ে দাও।
কেন? তোর স্যার আজ আসেন নি?
না। তুমি তো জান, ইংলিশ ম্যাডাম খুব কড়া। হোমটাস্ক না হলে অথবা পড়া না হলে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রাখেন।
ঠিক আছে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
পড়া বোঝানো হয়ে যাওয়ার পর বইটা নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় শ্রাবণী বলল, বইয়ের দিকে তাকিয়ে কী এত ভাবছিলে বলবে আপা?
রীমা ধমকের সুরে বলল, যাই ভাবী, তাতে তোর কী? যা ভাগ।
শ্রাবণী এবছর টেনে উঠেছে। রীমার চেয়ে স্বাস্থ্য ভালো। বাড়ন্ত চেহারা। তরুণী হলেও নভেল নাটক পড়ে বেশ পেকে গেছে। কেউ দু’বোনকে এক সঙ্গে দেখলে শ্রাবণীকেই বড় মনে করবে। তাদের আর কোনো ভাই বোন নেই বলে দু’জনে চার পাঁচ বছরের ছোট বড় হলেও বান্ধবীর মতো ব্যবহার করে। বলল, তুমি ধমক দিচ্ছ কেন? যা ভাবছিলে আমি কিন্তু বুঝতে পেরেছি।
রীমা চোখ বড় বড় করে বলল, খুব পেকে গেছিস না? দেব এক থাপ্পড়।
শ্রাবণী আপার রাগকে গ্রাহ্য করল না। সে জানে আপা তার উপর যতই রেগে থাক না কেন, কখনো গায়ে হাত তোলে না। তাই বলল, তোমার রাগটাই প্রমাণ করছে, আমার অনুমানই ঠিক।
রীমা রাগের সঙ্গেই বলল, কী বলতে শুনি।
তুমি এমন একজনের কথা ভাবছিলে, যাকে তুমি ভালবাস। ছেলেটা কে? মুকুল ভাই, না অন্য কেউ?
তবেরে তোর পাকামী বার করছি বলে রীমা চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়াল।
শ্রাবণী ছুটে পালাবার সময় বলল, সত্য কথা শুনলে সবাই রেগে যায়।
রীমা তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, শ্রাবণী নভেল পড়ে পড়ে পেকে গেছে। ওর নভেল পড়া বন্ধ করতে হবে।
রীমা প্রতিদিন রাতে এগারোটার সময় ঘুমায় এবং সকাল সকাল উঠে পড়া শোনা করে। বিছানায় যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। শ্রাবণী টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বারটা একটা পর্যন্ত পড়ে। তারপর ঘুমায়। রীমা তাকে। এগারটায় ঘুমাতে ও সকাল সকাল উঠে পড়াশোনা করতে বলে। কিন্তু শ্রাবণী তার কথা শোনে না। বলে সকালে আমার পড়তে ইচ্ছা করে না। জোর করে পড়লে পড়ায় মন বসে না। রাত্রে আমার খুব ভালো পড়া হয়।
আজ রীমা সময় মতো ঘুমাতে গেলেও কিছুতেই তার চোখে ঘুম এল না। কেবলই মুকুল ও মুক্তার সম্পর্কের কথা মনে পড়তে লাগল। ঘুম না এলে। কেউ চুপ চাপ শুয়ে থাকতে পারে না। এপাশ ওপাশ করে। রীমা ও তাই করছিল।
শ্রাবণী তা লক্ষ করে বলল, আপা আজ তোমার কি হয়েছে বলতো? এপাশ ওপাশ করছ কেন? রোজতো পাঁচ মিনিটের মধ্যে নাক ডাক।
রীমা জানে কথা বললে ও পাকামী করবে। তাই কিছু না বলে চুপ করে রইল।
শ্রাবণী খুব চালাক। আপার চাতুরি ধরে ফেলল। সেও আর কিছু না বলে পড়তে লাগল।
রীমা অনেকক্ষণ এক কাতে চুপচাপ শুয়ে থাকার চেস্টা করল। শেষে থাকতে না পেরে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে বিছানায় গেল।
শ্রাবণী বলল, আজ কেন তোমার ঘুম আসছে না আমি জানি।
রীমা ওর কথার জওয়াব না দিয়ে চুপ করে রইল। শ্রাবণী আবার বলল, তুমি অভয় দিলে একটা সুখবর শোনাতে পারি।
এবার আর রীমা চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, সুখবর বলার জন্য অভয় দেওয়ার কথা বলছিস কেন?
কারণ খবরটা তোমার চিন্তার সঙ্গে যুক্ত। যে চিন্তার কারণে ঘুমাতে পারছ না।
তার কথা শুনে রীমা রেগে গেলেও বেশ অবাক হল। গম্ভীরস্বরে বলল, সুখবরটা বলতো শুনি।
মা-বাবা আজ বড় খালার বাসায় গিয়েছিল। ফিরে এসে-মা বাবাকে বলল, “তোমাকে বলেছিলাম না, আপা দুলাভাই কেউই আমাদের কথায় অরাজি হবে না। বাবা বলল, ওরা যে এক কথায় রাজি হবেন ধারণা করিনি।”
রীমা ধমকের সুরে বলল, আসল খবরটা বলছিস না কেন?
মা-বাবা মুকুল ভায়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব দিতে গিয়েছিল। বড়খালা ও খালু আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন।
কথাটা শুনে রীমার মনে আনন্দের ঝড় বইতে শুরু করল। পরক্ষণে মুকুল মুক্তাকে পছন্দ করে মনে পড়তে দুশ্চিন্তায় মনটা ভরে গেল। ভাবল, মুকুল কী মুক্তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে তাকে বিয়ে করবে?
রীমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শ্রাবণী বলল, কী হল আপা, এতবড় সুখবর শোনালাম, তবু চুপ করে আছ যে?
রীমা বলল, মুকুল ব্যাপারটা জানে?
তা বলব কি করে? আমি তো যাইনি। তবে মা বলছিল, তোমাদের পরীক্ষার পর বিয়ে হবে।
ঠিক আছে, তুই পড়। আমি এবার ঘুমাব বলে রীমা পাশ ফিরে শুল।
.
মুকুল নাস্তা খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রীমার মা বাবা এসে বিয়ের প্রস্তাব দেন।
জাহানারা বেগম রীমাকে বউ করবে বলে অনেক আগে থেকে ভেবে রেখেছিলেন। তা ছাড়া মুকুলকে সংসারী করে বিদেশে পড়তে যেতে দিতে চান না। বাবার সঙ্গে নিজেদের ব্যবসা দেখা শোনা করুক এটাই তার ইচ্ছা, তাই ছোট বোনের প্রস্তাব শুনে স্বামী কিছু বলার আগে বললেন, আমি অনেক আগেই ভেবে রেখেছি, রীমাকে বউ করব। সময় মতো আমিই প্রস্তাব দিতাম। তোমরা বলে ভালই করলে, আমাকে আর বলতে হল না। ওদের পরীক্ষার পর দিন ঠিক হবে। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কী বল?
ইবরাহীম সাহেবের ইচ্ছা, ছেলে বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে আসুক। তারপর বিয়ে দিয়ে ব্যবসায় লাগাবেন। স্ত্রীর কথা শুনে অসন্তুষ্ট হলেও তা প্রকাশ করলেন না। বললেন, মুকুল রাজি থাকলে আমার কোনো আপত্তি নেই।
স্বামী যে ছেলেকে বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য পাঠাতে চান, তা জাহানারা বেগম জানেন। তাই স্বামী থেমে যেতে বললেন, মুকুল রাজি হবে
কেন? ও আমাদের একমাত্র ছেলে, আমরা যাকে পছন্দ করব তাকে মুকুলও পছন্দ করবে। রীমার মতো ভালো মেয়ে আজকাল কটা আছে শুনি? তারপর ছোট বোন ও তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা কোনো চিন্তা করো না, আমি যা বললাম তাই হবে।
এরপর কেউ আর কোনো কথা বললেন না।
দুপুরে খাওয়ার পর মুকুল বিছানায় শুয়ে রেষ্ট নিচ্ছিল। এমন সময় ছোট বোন ইতি এসে বলল, ভাইয়া, একটা সুখবর আছে, কী দেবে বল।
আগে সুখবরটা বল, তারপর গুরুত্ব বুঝে বলব কি দেব।
তুমি নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর ছোট খালা ও খালু এসেছিল।
মুকুল বিরক্ত কণ্ঠে বলল, এটা আবার কিসের সুখবর? যা ভাগ, আমি একটু ঘুমাব।
ইতি বলল, তুমিতো সুখবরটা বলার আগেই কথা বললে। খালা-খালু তোমার সঙ্গে রীমা আপুর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।
মুকুল চমকে উঠে বলল, কী বললি?
হ্যাঁ ভাইয়া, মা সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। বাবা অবশ্য তোমার মতামতের কথা বলেছে। মা পাকা কথা দিয়েছে। তোমাদের পরীক্ষার পর বিয়ের দিন ঠিক হবে। আমার কিন্তু রীমা আপার চেয়ে শ্রাবণী আপাকে বেশি পছন্দ।
মুকুল সামলে নিয়ে বলল, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে মা পাকা কথা দিয়ে ফেলল?
একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাইয়া?
রীমা আপাকে তুমি কী পছন্দ কর না?
নারে তা নয়, রীমা অপছন্দ করার মতো মেয়ে নয়।
তা হলে তুমি চমকে উঠলে কেন?
চমকে উঠার অন্য কারণ আছে।
তুমি কী কোনো মেয়েকে পছন্দ কর? অথবা ভালবাস?
তুই যে দেখছি নানি দাদির মতো জেরা শুরু করলি? যা-ভাগ।
বল না ভাইয়া, কাউকে ভালবাস কিনা।
ছোট বোন হয়ে বড় ভাইকে-ভালবাসার কথা জিজ্ঞেস করছিস, তোর সাহস তো কম না?
বারে, এতে সাহসের কি আছে? কাউকে ভালবাসলে বা পছন্দ করলে বলে ফেল। কথা দিচ্ছি, মা-বাবাকে বলব না।
মুকুল ও ইতি কোলে পিঠে। তাই আগে তুই তোকারী করত। ছোট বেলায় দুজনের মধ্যে বন্মবনি হত না। চান্স পেলেই খুনসুটি করত। ইতি কথা না শুনলে মুকুল মারত। বড় হওয়ার পর সে সব না করলেও ইতি তুই তোকারী ছাড়েনি। বছর খানেক আগে দুজনে কথা কাটাকাটি করার সময় মুকুলকে ইতি তুই তোকারী করতে শুনে বড় বোন ইরা ছোট বোনকে খুব রাগারাগি করে বলল, তুই কলেজে পড়ছিস, এখনো বড় ভাইকে তুই তোকারী করছিস? লোকে শুনলে বলবে কী? তারপর থেকে তুমি করে বললেও মুকুলের সঙ্গে সমবয়সির মতো ব্যবহার করে।
ছোট বোনের কথা শুনে মুকুল হেসে ফেলে বলল, হ্যাঁ বাসি।
ওমা তাই নাকি? তা ব্যাপারটা কত দিনের?
প্রায় বছর খানেক।
এতদিন জানাওনি কেন? জানালে এরকম পরিস্থিতি হত না।
এতদিন শুধু দুজন দুজনকে জেনেছি। গতকাল আমরা ফাইন্যাল ডিসিসান নিয়েছি। আজকালের মধ্যে তাকে বাসায় এনে সবার সঙ্গে পরিচয় করাব ভেবেছিলাম। কিন্তু……
তাকে থামিয়ে দিয়ে ইতি বলল, কিন্তু এখন তা কী করে সম্ভব? মা হয়তো বিকেলে বা সন্ধ্যায় তোমাকে ছোট খালার প্রস্তাবের কথা বলবে।
মুকুল বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে কিছু ঠিক করতে না পেরে বলল, একদিকে মা, অন্যদিকে আমার প্রেম, কি করব মাথায় কিছু আসছে না। তোর মাথায় তো খুব বুদ্ধি; আমার জন্য বুদ্ধিটা একটু খাটানা।
রীমা ভাবী হোক, ইতির তা মোটেই পছন্দ নয়। তাই হেসে উঠে বলল, এখন তা হলে স্বীকার করছ, তোমার চেয়ে আমি বেশি বুদ্ধিমান?
ঠিক আছে; করলাম। এবার বল, কি করব?
ইতি হাসতে হাসতে বলল, প্রেমে পড়লে সবাই সাহসী হয়। তুমিও হও।
মানে?
তাও বুঝলে না? ঠিক আছে, যা বলছি শোন, মা তোমাকে কিছু বলার আগেই মানে এক্ষুনি গিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে এসে মাকে তোমাদের সম্পর্কের কথা বল।
সত্যিই তুই দারুন বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছিস। এত সহজ প্ল্যানটা আমার মাথায় কেন এল না বলতে পারিস?
পারি। প্রেমে পড়লে অল্প কিছু সংখ্যক ছাড়া প্রায় সবারই বুদ্ধি লোপ পায়।
ঠিক কথাই বলেছিস। তুই প্রেমে পড়িসনি বলে তোর বুদ্ধি প্রখর। তারপর খাট থেকে নেমে রুমের বাইরে বেরোতে গেল।
ইতি হেসে উঠে বলল, তোমার বুদ্ধি সত্যিই লোপ পেয়েছে। লুংগী গেঞ্জী পরে প্রেমিকাকে আনতে যাবে নাকি?
মুকুলও হেসে উঠে বলল, যতটা লোপ পাওয়ার কথা ভাবছিস, অতটা পায়নি। ওকে তৈরি হওয়ার জন্য ফোন করতে যাচ্ছি। কথা শেষ করে ড্রইংরুমে এসে মুক্তাকে ফোন করল।
নায়লা বেগম ফোন ধরে বললেন, হ্যালো, কে বলছেন?
মুকুল গলা চিনতে পেরে সালাম দিয়ে বলল, খালাআম্মা, আমি মুকুল। একটু মুক্তাকে দিন তো।
নায়লা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ধর, ডেকে দিচ্ছি। তারপর রিসিবার পাশে রেখে রুমে যাওয়ার সময় কাজের মেয়ে রশিদাকে বললেন, তোর আপাকে গিয়ে বল, মুকুল ফোন করেছেন।
মুক্তা শুয়ে শুয়ে মুকুলের কথা ভাবছিল। রশিদার মুখে সে ফোন করেছে শুনে তাড়াতাড়ি এসে ফোন ধরে বলল, কী খবর? কেমন আছে?
মুকুল বলল, ভালো। তারপর বলল, তুমি তৈরি হয়ে নাও, আমি এক্ষুনি আসছি।
কোথাও যাবে না কী?
হ্যাঁ।
কোথায়?
গিয়ে বলব।
এখন বল না।
বললাম না, গিয়ে বলব। তুমি কিন্তু তৈরি থাকবে। আমি বেরোচ্ছি। তারপর মুক্তা কিছু বলার আগে রিসিভার ক্রাডেলে রেখে রুমে ফিরে এল।
ফোনে মুকুলের গলায় উত্তেজনা অনুভব করে মুক্তা চিন্তিত হলেও পোষাক পাল্টে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
ঠিক পঁচিশ মিনিটের মাথায় গাড়ির হর্ণ শুনে মুক্তা বুঝতে পারল, মুকুল এসেছে। মায়ের কাছে এসে বলল, মুকুল এসেছে, আমি ওর সঙ্গে একটু বেরোচ্ছি।
মুকুল ফোনে মুক্তাকে চাইতে মেয়ের উপর নায়লা বেগম রেগে ছিলেন। এখন তার সঙ্গে যাবে শুনে আরো রেগে গেলেন। কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
মা যে রেগে আছে, তা বুঝতে পেরে মুক্তা আর কিছু না বলে বেরিয়ে এল।
মুকুল গাড়ীর সামনের দরজা খুলে বলল, এস।
মুক্তা বলল, এক কাপ চা খেয়ে গেলে হত না?
যেখানে যাচ্ছি সেখানে খাব; তুমি উঠে এস তো।
মুক্তা উঠে বসার পর মুকুল গাড়ি ছেড়ে দিল।
রাস্তায় গাড়ি আসার পর মুক্তা বলল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বলবে না?
মুকুল বলল, আমাদের বাসায়।
হঠাৎ এত তাড়াহুড়ো করে নিয়ে যাওয়ার কি দরকার ছিল। পরে যে কোনো একদিন গেলেই তো হত?
মুকুল চিন্তা করতে লাগল, ছোট খালার প্রস্তাবের কথা বলবে কিনা।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মুক্তা বলল, কিছু বললে না যে?
জানান উচিত ভেবে মুকুল ছোট খালার প্রস্তাবের কথা বলে বলল, মা আমাকে কিছু না বলেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। অবশ্য বাবা আমার মতামতের কথা বলেছে। আজ সকালের দিকে যখন ছোট খালা ও খালু আমাদের বাসায় এসে প্রস্তাব দেয় তখন আমি ছিলাম না। কিছুক্ষণ আগে আমার ছোট বোন ইতির মুখে শুনে তোমাকে ফোন করি। শোন, আমি যে ব্যাপারটা জেনেছি তা ইতি ছাড়া বাসার আর কেউ জানে না। ইতি আমার ছোট বোন হলেও খুব বুদ্ধিমতী। ছোট খালার প্রস্তাব শুনে আমি খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যাই। ইতি তা বুঝতে পেরে কারণ জিজ্ঞেস করে। আমি তাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলি। সেও চায় না রীমার সঙ্গে আমার বিয়ে হোক। তাই আমাদের সম্পর্কের কথা শুনে মা আমাকে জানাবার আগেই তোমাকে নিয়ে গিয়ে বাসার সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে বলে। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছ, কেন তাড়াহুড়ো করে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি?
মুকুলের কথা শুনে মুক্তা চিন্তিত হয়ে পড়ল। ভাবল, রীমা সুন্দরী, তার উপর আপনার বোনের মেয়ে তাকে বাদ দিয়ে আমার মতো কালো অসুন্দর মেয়েকে কী ওর মা পছন্দ করবেন?
তার মুখে চিন্তার ছাপ দেখে মুকুল বলল, কী ভাবছ?
ভাবছি ব্যাপারটা বেশ জটিল। আচ্ছা রীমা কি ব্যাপারটা জানে।
তা বলব কি করে? জানতে পারে, আবার নাও পারে।
পরশু আমি রীমাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছি।
তাই?
হ্যাঁ।
শুনে রীমার কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলে?
ওকে তো খুব খুশী হতে দেখলাম।
তা হলে বোধ হয় আমার মায়ের মতো ছোট খালাও তার মতামত না। নিয়েই প্রস্তাব দিয়েছে।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। তারপর বলল, আমাকে যদি দেখে। তোমাদের সবাই অপছন্দ করেন?
ও কথা আবার বলছ কেন? এ ব্যাপারে যা বলার তোমাকে তো আগেই বলেছি।
আমার বলার উদ্দেশ্য হল, আজ থেকেই সবার সঙ্গে তোমার। মনোমালিন্য হুরু হয়ে যাবে। তোমার খালা খালুও কষ্ট পাবেন।
ওসব নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করো না।
এর পর আর কেউ কোনো কথা বলল না।
বাসায় পৌঁছে মুকুল ড্রাইবারকে গাড়ি নিয়ে বাবার অফিসে যেতে বলে মুক্তাকে নিয়ে ভিতরে গেল।
ইতি ভাইয়ার প্রেমিকার অপেক্ষায় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুক্তাকে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারল না। ভাবল, ভাইয়ার কত সুন্দরী সুন্দরী বান্ধবী, আর সে কিনা একটা কালো মেয়ের প্রেমে পড়ল। মা । তো এই মেয়েকে একদম পছন্দ করবে না। মন ভার করে বারান্দায় বেরিয়ে এল।
মুকুল মুক্তাকে নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, একে নিয়ে তোর রুমে যা। বাবা আসার পর সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।
ইতি মনের ভাব গোপন করে মুক্তার একটা হাত ধরে বলল, আসুন আমার সঙ্গে। রুমে এসে তাকে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর বলল, আমি ইতি। ভাইয়ার চেয়ে আড়াই বছরের ছোট। আজই ভাইয়ার কাছে। আপনাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলাম। কিন্তু ভাইয়া আপনার নাম বুলেনি।
মুক্তা নাম বলে বলল, আসার সময় আপনার ভাইয়া আপনার কথা। বলেছে। আপনি নিশ্চয় পড়াশোনা করছেন?
আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? বললাম না, আমি ভাইয়ার চেয়ে আড়াই বছরের ছোট? তুমি করে বলুন। তারপর বলল, এবছর ডিগ্রী ক্লাসের শেষবর্ষে।
আমি কিন্তু তোমাকে একবার রীমাদের বাসায় একদিন দেখেছিলাম। সেদিন অল্পক্ষণ আলাপও হয়েছিল। অবশ্য সে সব বছর দুই আগের কথা। তোমাকে দেখে ও তোমার কথা শুনে মনে পড়ল। রীমা যে আমার বান্ধবী সে কথা নিশ্চয় মনে আছে?
মুক্তার কথা শুনে ইতিরও সেদিনের কথা মনে পড়ল। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার কথা শুনে মনে পড়ল। তারপর রীমা আপা তাদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানে কিনা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। এমন সময় গাড়ির শব্দ পেয়ে বলল, বাবা এসে গেছেন। আপনি একটু বসুন বলে ইতি উঠে চলে গেল। প্রায় পাঁচ ছয় মিনিট পর দুগ্লাস লাচ্ছি নিয়ে ফিরে এসে বলল, খুব গরম পড়েছে। তাই ঠাণ্ডা দিলাম। পরে অবশ্য সবার সঙ্গে গরম খেতে হবে। তারপর একটা গ্লাস তার হাতে ধরিয়ে দিল।
গরমের জন্যও কিছুক্ষণের মধ্যে সবার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর কি ঘটবে না ঘটবে ভেবে ফ্যানের নিচে বসেও মুক্তা ঘামছিল। সেই সঙ্গে খুব পিয়াস অনুভব করছিল। লাচ্ছি খেয়ে গ্লাস টেবিলের উপর রেখে রুমালে মুখ মোছার সময় বলল, তুমি খুব বুদ্ধিমতী।
ইতি মৃদু হেসে বলল, ওকথা সবার কাছে শুনে শুনে কান ভোতা হয়ে গেছে। নূতন কিছু বললে না হয় অন্য কথা।
মুক্তাও মৃদু হেসে বলল, যদি বলি তুমি খুব সুন্দরী?
ইতি দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল, হল না। আপা আমার থেকে হাজার গুন সুন্দরী।
তাই না কি?
হ্যাঁ, তার মতো সুন্দরী মেয়ে কখনো দেখিনি।
এমন সময় জাহানারা বেগমের গলা শোনা গেল। ইতি, নাস্তার টেবিলে আয়।
আসছি মা বলে ইতি দাঁড়িয়ে উঠে মুক্তাকে বলল, চলুন।
জাহানারা বেগমের কথাগুলো মুক্তার কানেও গেছে। বলল, কিন্তু তোমার ভাইয়া কোথায়?
ইতি তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভাইয়া নিশ্চয় ওখানেই আছে। চলুন বলে তার একটা হাত ধরে যেতে উদ্যত হল।
এমন সময় মুকুল ঘরে ঢুকে ইতিকে বলল, তুই যা, আমি ওকে নিয়ে আসছি।
ইতি তার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।
মুকুল বলল, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব টেনসন ফিল করছ?
মুক্তা খুব শক্ত মেয়ে, তবু পরিস্থিতির কথা ভেবে একটু টেনসান ফিল করছিল। বলল, তুমি ফিল করছ না?
তা একট করছি বইকি। তারপর বলল এস আমার সঙ্গে।
ইতি এসে বাবার পাশে বসল।
জাহানারা বেগম তাকে বললেন, দেখতো, তোর ভাইয়া আসছে না কেন?
ইতি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে ভাইয়া ও মুক্তাকে আসতে দেখে বলল, ঐতো ভাইয়া আসছে।
জাহানারা বেগম ঘাড় ঘুরিয়ে মুকুলের সঙ্গে অচেনা একটা মেয়েকে দেখে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
ইবরাহীম সাহেবও মুক্তাকে দেখে অবাক হলেন।
মুকুল মুক্তাকে নিয়ে কাছে এসে মা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, পরিচয় করিয়ে দিই, এ হল মুক্তা। আমার গার্লফ্রেণ্ড। তারপর তাদেরকে দেখিয়ে মুক্তাকে বলল, মা ও বাবা। আর ইতির সঙ্গে তো তোমার আগেই পরিচয় হয়েছে।
মুক্তা সালাম দিল।
জাহানারা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, বস মা, আমাদের সঙ্গে নাস্তা খাও।
মুকুল ও মুক্তা বসার পর কাজের মেয়ে নাস্তা পরিবেশন করল।
খেতে খেতে ইতি বলল, জান মা, ইনি রীমা আপার বান্ধবী।
জাহানারা বেগম বললেন, ওমা তাই নাকি? তারপর মুক্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি রীমার সঙ্গে পড় বুঝি?
জ্বি।
তোমার বাবার নাম কী? উনি কী করেন?
আবুল কালাম আজাদ। উনি ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।
কিছু মনে করো না মা, না জেনে তোমাকে দুঃখ দিলাম। তা তোমরা কয় ভাই বোন?
আমার কোনো ভাই বোন নেই, আমি একা।
তোমার আর কে কে আছে?
মা ছাড়া কেউ নেই।
বাসা কোথায়?
আগে পল্লবীর বাসায় থাকতাম। বাবা মারা যাওয়ার পর আগারগাঁও এর বাসায় মায়ের সঙ্গে থাকি। দু’জন কাজের মেয়ে ও দু’জন কাজের লোক আছে।
তা হলে তোমাদের কোনো পুরুষ গার্জেন নেই?
জ্বি না। পুরান ঢাকায় এক ফুফা ফুপি আছেন। ফুফা ব্যাংকে চাকরি করেন।
নাস্তা শেষে চা খাওয়ার পর মুকুল মাকে বলল, আমি ওকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
জাহানারা বেগম বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরবি। গাড়ি নিয়ে যা।
গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মুকুল মুক্তার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ভাবছ?
ভাবছি, রীমা তোমার খালাত বোন। আমার থেকে দেখতে সুন্দর। তা ছাড়া সে আমার বান্ধবী। বান্ধবী হয়ে তার পথে বাধা সৃষ্টি করা কী উচিত হবে? নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।
মুকুল বলল, রীমা আমার যেই হোক, আর যতই সুন্দরী হোক, তাকে আমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না। আমি তাকে নিজের বোনের মতো মনে করি। আমার মনে হয়, সে ও আমাকে তাই মনে করে। যাকগে, তুমি রীমার চিন্তা মাথা তেকে সরিয়ে দাও। আমরা যা প্রমিস করেছি তা আমি জীবন গেলেও ভাঙব না। আশা করি, তুমিও ভাঙবে না।
তা অবশ্য ভাঙব না; কিন্তু তবু যেন ভয় হচ্ছে তোমাকে হয় তো আমি পাব না। রীমা আমার প্রিয় বান্ধবী। সে যদি আমাকে তার রাস্তা থেকে সরে যেতে বলে, তা হলে তাকে ফেরাতে আমার খুব কষ্ট হবে। নিজের স্বার্থের জন্য ওর মনে কষ্ট দিতে বিবেক বাধা দিচ্ছে।
মুক্তার কথাগুলো মুকুলের কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। তবু বলব, তুমি ঐ ব্যাপারে একদম চিন্তা করবে না। আমি মা-বাবা, রীমাকে ও খালা খালুকে ম্যানেজ করব। তারপর তার চোখে পানি দেখে বলল, প্লীজ মুক্তা, এত অধৈর্য হয়ো না। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখ।
মুক্তা সামলে নিয়ে চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, তোমার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আমার জন্য তোমাকে অনেক ঝড় ঝাঁপটা সহ্য করতে হবে, ভেবে সামলাতে পারছি না।
মুকুল বলল, প্রেমের পথে ঝড়-ঝাঁপটা থাকবেই। তোমার জন্য আমি শুধু ঝড়-ঝাঁপটা নয়, আরো বড় কিছু বিপদে পড়লেও তোমাকে ত্যাগ করতে পারব না। মুকুলের কথা শুনে মুক্তা আশ্বস্ত হল। বলল, আমিও তোমার জন্য সব কিছু করতে পারব।
তা আমি জানি, তোমার প্রতি সে রকম বিশ্বাস আছে বলেই তো আমার মনে এত জোর। বাসায় ফিরে মা-বাবাকে তোমার কথা বলে আমার ইচ্ছার কথা বলব। ফলাফল কাল তোমাকে জানাব।
ততক্ষণে তারা মুক্তাদের বাসার গেটে পৌঁছে গেল। গাড়ি থেকে নেমে মুক্তা বলল, এখান থেকেই ফিরে যাবে?
হ্যাঁ, মা বলল, শুনলে না, তাড়াতাড়ি ফিরতে? তারপর গাড়ি ছেড়ে দিল।
মুক্তা গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। অদৃশ্য হয়ে যেতে বাসায় ঢুকল।
মুকুল ফিরে এসে জামা কাপড় পাল্টাচ্ছিল। মাকে রুমে ঢুকতে দেখে। বুঝতে পারল, রীমার ব্যপারে কথা বলতে এসেছে। তাই মা কিছু বলার আগেই বলল, মুক্তাকে কেমন লাগল বল।
জাহানারা বেগম বললেন, ভালো, তবে গায়ের রং বেশ কালো।
কালো হলেও মুক্তা খুব ভালো মেয়ে। ওকে আমার খুব পছন্দ। প্রায় বছর খানেক ধরে ওর সঙ্গে মেলামেশা করছি। ভাবছি, ওকেই বিয়ে করব। তাই তো আজ নিয়ে এসে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
জাহানারা বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন। অবাক কণ্ঠে বললেন, সে । কীরে? ঐ কালো মেয়েটাকে তুই বিয়ে করতে চাস? ছি, ছি, সমাজে মুখ দেখাব কি করে?
মুকুল হেসে উঠে বলল, কেন? কালো মেয়েরা বুঝি মেয়ে নয়? তাদেরকে বুঝি কেউ বিয়ে করে না?
তা করবে না কেন? কিন্তু তুই করতে যাবি কেন? অমন বাজে খেয়াল বাদ দে বাবা। আজ সকালে তোর খালা-খালু এসেছিল। তারা তোর সঙ্গে রীমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি ও তোর বাবা প্রস্তাব গ্রহণ করেছি। রীমার সঙ্গে মুক্তার কোনো দিক দিয়েই তুলনা হয় না।
তোমরা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই প্রস্তাব গ্রহণ করলে কেন? আমার কি নিজস্ব কোনো মতামত নেই? না তোমাদের কাছে আমার মতামতের কোনো মূল্য নেই। আমি কি এখনো কচি খোকা যা বলবে তাই। শুনব? শোন মা, নিঃসন্দেহে রীমা মুক্তার চেয়ে অনেক সুন্দরী; কিন্তু তাকে আমি আপন বোনের মতো মনে করি। কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না। প্রায় এক বছর ধরে মুক্তাকে আমি ভালবাসি। সেও আমাকে ভালবাসে। আমরা বিয়ে করব বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তুমি খালাকে সে কথা জানিয়ে প্রস্তাব ফিরিয়ে দাও।
জাহানারা বেগম রেগে উঠে বললেন, তুই বা মুক্তাকে আমাদেরকে না দেখিয়ে মতামত না নিয়ে একেবারে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলি কেন? এতে আমাদেরকে অপমান করা হয় না বুঝি? ছেলে হয়ে মা-বাবাকে অপমান করতে পারলি?
মুকুল মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাদের না জানিয়ে অন্যায় করেছি, মাফ করে দাও মা। তোমাদেরকে অপমান করা হবে, এটা তখন মাথায় আসেনি।
জাহানারা বেগম গম্ভীরস্বরে বললেন, তখনই মাফ পাবি যখন মুক্তাকে ত্যাগ করে রীমাকে বিয়ে করবি। তার আগে নয়, বলে হন হন করে চলে গেলেন।
মুকুল হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চেয়ারে বসে চিন্তা করল, বাবা নিশ্চয় তাকে সাহায্য করবে।
জাহানারা বেগম স্বামীর কাছে এসে রাগের সঙ্গে বললেন, কতবার বলেছি, ছেলেকে অত আস্কারা দিও না। আমার কথা যদি শুনতে, তা হলে তার এত অধঃপতন হত না।
জাহানারা বেগম খুব কড়া মেজাজের হলেও ইবরাহীম সাহেব খুব ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। স্ত্রীর অনেক রাগ তিনি গায়ে মাখেন না। এখনো মাখলেন না। বললেন, ছেলের কি এমন অধঃপতন দেখলে যে, এত রেগে গেছ?
জাহানারা বেগম গরম মেজাজেই বললেন, বিকেলে মুক্তা নামে যে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিল, তাকে মুকুল ভালবাসে। শুধু তাই নয়। তাকে বিয়ে করবে বলে কথাও দিয়েছে।
মুকুল যখন মুক্তাকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করায় তখন ইবরাহীম সাহেব ছেলের চোখ মুখ দেখে এই রকম কিছু অনুমান করেছিলেন। তাই মুক্তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ভালই লেগেছিল। গায়ের রং কালো না হলে তাকে পুত্রবধু করার কথা চিন্তাও করেছিলেন। এখন তার অনুমান ঠিক শুনে মনে মনে আনন্দিত হলেন। কিন্তু তা প্রকাশ না করে স্ত্রীকে খুশী করার জন্য রাগত স্বরে বললেন, তাই নাকি? তাহলে তো সত্যিই ওর অধঃপতন হয়েছে। তারপর বললেন, তুমি ওর খালা-খালুর প্রস্তাবের কথা বলেছ?
বলিনি আবার। শুনে বলল, “রীমাকে আপন বোনের মতো মনে করি। কিছুতেই তাকে বিয়ে করতে পারব না। তোমরা প্রস্তাব ফিরিয়ে দাও।”
তারপর মতামত না নিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেছি বলে মুকুল যে সব কথা বলেছে। বললেন।
ইবরাহীম সাহেব রাগের সঙ্গেই বললেন, ও আমাদেরকে না জানিয়েই মেয়েটাকে কথা দিল, তাতে যে আমাদেরকে অপমান করা হল, সে কথা বলনি?
তাও বলেছি। আমার পা জড়িয়ে মাফ চেয়েছে। আমি বলেছি; ঐ মেয়েকে ত্যাগ করে রীমাকে বিয়ে করলে মাফ করব।
উত্তরে কি বলল?
কথাটা বলেই আমি চলে এসেছি।
ঠিক কথাই বলেছ। কয়েক দিন অপেক্ষা করে দেখা যাক কি করে?
তুমি তো ছেলের প্রতি দুর্বল। মনে রেখ, বেঁচে থাকতে আমি ঐ কালো পেত্নীকে বউ করব না। আর মুকুল যদি আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে, তবে ঐ বউকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেব না।
ইবরাহীম সাহেব স্ত্রীর রাগ থামাবার জন্য সচেষ্ট হলেন। বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি যা চাইবে তাই হবে। এক ছেলে বলে কিছু বলিনি। তবে এরকম অন্যায়ের পথে পা বাড়াবে আর আমি কিছু বলব না এটা ভাবলে কী করে? তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমি ওর সঙ্গে কথা বলে যা করার করব।
স্বামী যে ছেলেকে কিছুই বলতে পারবে না, তা জাহানারা বেগম জানেন। তাই তার কথা শুনে বললেন, তুমি কী করবে তা আমার জানা আছে। যা। করার আমাকেই করতে হবে। কথা শেষ করে সেখান থেকে চলে গেলেন।
ছয়
মুকুল চলে যাওয়ার পর মুক্তা রুমে এসে চিন্তা করতে লাগল, রীমা শোনার পর ব্যাপারটা কি ভাবে নেবে? আমাকে কী সরে যেতে বলবে, আমার জন্য সে নিজেই সরে দাঁড়াবে?
রীমা ও মুক্তা প্রতিদিন ক্লাসে পাশাপাশি বসে। পরের দিন ক্লাসে ঢুকে দেখল, রীমা একটা মেয়ের পাশে বসেছে। সে তখন বাধ্য হয়ে অন্য বেঞ্চে একটা মেয়ের পাশে বসে পড়ল। মুক্তা রীমার মুখ ভার দেখে অনুমান করল, নিশ্চয় বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনেছে। সারা পিরিয়ডে সে একবারও তার দিকে তাকায়নি তাও মুক্তা লক্ষ করল। ক্লাস শেষে তাকে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে যেতে দেখে মুক্তার অনুমানটা দৃঢ় হল। ভাবল, ভালই হল, সে নিজেই এড়িয়ে চলছে।
আজ তিনটে ক্লাস ছিল। লাষ্ট ক্লাস শেষ হওয়ার পর মুক্তা রীমাকে মাথা নিচু করে চলে যেতে দেখে কিছু বলল না। সবার শেষে সে ক্লাস থেকে বেরোল। গেটের দিকে যেতে যেতে মুকুলকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মুকুল কাছে এসে বলল, দাঁড়ালে কেন? এস আমার সঙ্গে।
মুক্তা কিছু না বলে তার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল।
গেটের বাইরে এসে মুকুল তাকে নিয়ে একটা রিকশায় উঠে বসল। রিকশা চলতে শুরু করলে মুকুল জিজ্ঞেস করল, মা বাবাকে কেমন লাগল?
মুক্তা বলল, ভালো, তবে তোমার মাকে আমার মায়ের মতো রাশভারী মহিলা মনে হল।
আর বাবাকে বুঝি তোমার বাবার মতো গোবেচারা মনে হল?
মুক্তা হেসে ফেলে বলল, কথাটা ঠিকই বলেছ। কিন্তু অবাক হচ্ছি, আমার বাবার সম্বন্ধে জানলে কী করে?
মুকুলও হেসে ফেলে বলল, যাদের মায়েরা রাশভারী হয়, সচরাচর তাদের বাবারা গোবেচারা হয়। অবশ্য কথাটা রসিকতা করে আন্দাজে ঢিল মেরেছি। ঢিলটা যে ঠিক জায়গামতো লাগবে তা জানতাম না।
ওসব কথা রেখে আসল কথা বল, কাল যে জন্যে আমাকে হঠাৎ করে তড়িঘড়ি তোমাদের বাসায় নিয়ে গেলে তার কী, হল?
মায়ের সঙ্গে যে সব কথা হয়েছিল মুকুল সব বলল।
তা হলে এখন কী করবে?
এখন কিছুই করব না। যখন সময় হবে তখন করব।
বুঝলাম না।
না বোঝার কী আছে? এখন চুপ করে থেকে পরীক্ষা দেব। তারপর যা করার করব। অবশ্য এর মধ্যে রীমার সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেব। ভালল কথা, আজ রীমার সঙ্গে তোমার কোনো কথা হয় নি।
না, সে আজ অন্য একটা মেয়ের পাশে বসেছিল। আমাকে দেখেও না, দেখার ভান করেছিল।
তা হলে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা জেনে গেছে।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
ও তোমাকে নিশ্চয় শত্রু ভাবছে?
ওর আর কি দোষ? এটাই তো স্বাভাবিক।
তা অবশ্য ঠিক।
রিকশাওয়ালা তো এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরছে। কোথায় যাবে বল নি?
মুকুল আজ গাড়ি নিয়ে আসেনি। ক্লাস শেষ হওয়ার পর এক রিকশা ওয়ালাকে পঁচিশ টাকা ঘণ্টা হিসাবে ঠিক করে বলেছিল, আমি থামাতে না বলা পর্যন্ত চালাতে থাকবে। মুক্তার কথা শুনে বলল, না বলি নি। তারপর রিকশাওয়ালাকে বলল। একটা ভালো হোটেলের সামনে রাখবে খাওয়া: দাওয়া করব।
রিকশাওয়ালা এরকম প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে পরিচিত। জে আচ্ছা বলে কিছু দুর এসে একটা হোটেলের সামনে রাখল।
মুকুল মুক্তাকে নিয়ে নেমে ভিতরে যাওয়ার সময় রিকশাওয়ালাকে বলল, আপনিও খেয়ে নিন চাচা, টাকা আমি দেব।
খাওয়া দাওয়া করে হোটেল থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠে মুকুল বলল, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরব। তারপর বলল, কাল আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর তোমার মা কিছু জিজ্ঞেস করেন নি?
মুক্তা বলল, কোথায় গিয়েছিলাম জিজ্ঞেস করেছিল। বললাম, মুকুল তার মা বাবার সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্য বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। মা বলল, তোর ফুফা এসেছিল বিয়ের কথা পাকা করার জন্য। আমি তোর মতামত নিয়ে জানাব বলেছি। বললাম, আমি তো আমার মতামত জানিয়েছি, ফুফাঁকে সে কথা বলে দিলেই পারতে। মা বলল, এটাই কি তোর শেষ সিদ্ধান্ত? বললাম হ্যাঁ। আমি মুকুলকে ভালবাসি, তাকেই বিয়ে করব। শুনে মা অনেকক্ষণ চুপ করেছিল। তারপর ভিজে গলায় বলল, আমি তোর ভালো মন্দ চিন্তা করে আসিফের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তুই যখন তা চাস না তখন যা ভালো বুঝিস কর। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবি, জীবনসাথি নির্বাচন যদি ভুল হয়, তা হলে সারা জীবন দুঃখের সাগরে ভাসবি। তড়িঘড়ি করে কিছু করবি না। আর বিয়ের আগে এমন কিছু করবি না, যা নাকি অন্যায়। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুমি আমাকে যে ভাবে মানুষ করেছ, তাতে অন্যায়কে আমি যে কোনদিন প্রশ্রয় দেইনি, তা তুমি জান। আশা করি, ভবিষ্যতেও কোনোরকম অন্যায় করব না।
মা বলল, ঠিক আছে এবার ছাড়। আমি তোর ফুফাঁকে যা বলার বলব। আসিফ খুব দুঃখ পাবে। তার খুব ইচ্ছা ছিল তোকে বিয়ে করার। আমিও তাকে আশা দিয়েছিলাম। ওদের কাছে ছোট হয়ে যাব। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললে তোকে সুখী করার জন্য সবকিছু করব। তারপর তোর ভাগ্য।
মুকুল বলল, তোমার দিকটা ক্লীয়ার হয়েছে জেনে দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা পেলাম।
মুক্তা বলল, আমি তো বলেই ছিলাম, মা আমার অমতে কিছু করতে পারবে না। আমার দুশ্চিন্তা শুধু তোমার মা বাবাকে নিয়ে।
আমার মা বাবাকে নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমাকে তো বলেছি, বাবাকে সহজে ম্যানেজ করতে পারব। আশাকরি, বাবাকে দিয়েই মাকেও পারব। তবে হয়তো একটু সময় লাগবে।
ততক্ষণে তারা মুক্তাদের বাসার গেটে পৌঁছে গেল। মুক্তা রিকশা থেকে নেমে মুকুলকেও নামতে বলল।
মুকুল বলল, আজ নয় অন্য দিন।
বারে রোজ রোজ বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে যাবে, এটা তোমার পক্ষে সম্ভব হলেও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো অজুহাত শুনব না, এস বলছি।
মুকুল রিকসাওয়ালাকে অপেক্ষা করতে বলে মুক্তার সঙ্গে এগোল।
ড্রইংরুমে এসে মুক্তা বলল, একটু বস, এক্ষুনি আসছি। তারপর ভিতরে চলে গেল। রুমে এসে কাপড় পাল্টাচ্ছিল; এমন সময় নায়লা বেগম এসে বললেন, এত দেরিতে ফিরলি যে? চিন্তা হয়নি বুঝি?
মুক্তা মৃদু হেসে বলল, মুকুল দেরি করিয়ে দিল। শেষে হোটেলে খাইয়ে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। আমি নিয়ে এসেছি। ও ড্রইং রুমে আছে। তুমি । বুয়াকে দিয়ে চা পাঠাবার ব্যবস্থা কর।
নায়লা বেগম বললেন, তুই ব্যবস্থা কর, আমি ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলব।
মুক্তা বলল, ঠিক আছে, তুমি যাও, আমি চা নিয়ে আসছি।
নায়লা বেগম প্রায় বছর খানেক আগে মাত্র একবার মুকুলকে দেখেছিলেন। গতকাল মেয়ের সিদ্ধান্তের কথা শুনে ভেবেছিলেন, বলবেন মুকুলকে একদিন বাসায় নিয়ে আসতে। আজ এসেছে শুনে তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
মুকুল ক্লান্তি বোধ করে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছিল, বিয়ের কথা শুনে রীমা যখন মুক্তাকে এড়িয়ে চলছে তখন নিশ্চয় ও আমাকে ভালবাসে। কিন্তু ওতো জানে আমি ও মুক্তা একে অপরকে ভালবাসি। তবু কেন মুক্তার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করল?
নায়লা বেগম ড্রইং রুমে ঢুকে মুকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, ক্লান্তিতে হয় তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সামনের সোফায় বসে কয়েক সেকেণ্ড তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর টেবিলের উপর রাখা এ্যাসট্রে হাতে নিয়ে শব্দ করে রাখলেন।
মুকুল চোখ খুলে নায়লা বেগমকে দেখে তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসল। তারপর সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন খালাআম্মা?
নায়লা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ভালো। তারপর বললেন, তোমার সঙ্গে কিছু আলাপ করতে চাই।
বেশতো করুন।
পুরো বায়োডাটা জানার পর নায়লা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যে মুক্তাকে পছন্দ কর, সে কথা তোমার মা-বাবাকে জানিয়েছ?
জ্বি জানিয়েছি।
তারা কী মুক্তাকে পছন্দ করেন?
সত্য বলবে কিনা মুকুল চিন্তা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নায়লা বেগম বললেন, আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? তা হলে কি বুঝব তারা মুক্তাকে পছন্দ করেন না?
হ্যাঁ, আপনার অনুমান ঠিক। তবে আমি আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছি।
তুমি তাদের এক ছেলে। তারা চাইবেন একমাত্র ছেলের বউ যেন সুন্দর হয়। মুক্তা দেখতে তেমন ভাল না। তাই তারা মুক্তাকে পছন্দ করেন নি। একমাত্র ছেলে হয়ে মা-বাবার মনে কষ্ট দেওয়া কী উচিত হবে? তাদেরকে অসন্তষ্ট করে মুক্তাকে বিয়ে করলে তোমরা কী সুখী হতে পারবে?
দেখুন খালাআম্মা, আপনি খুব ন্যায় সঙ্গত কথা বলেছেন। এসব ব্যাপার নিয়ে আমি ও মুক্তা বিষদ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা নিশ্চিত, তারা প্রথম দিকে আমাদের উপর অসন্তুষ্ট থাকলেও কিছুদিনের মধ্যে তাদের মন জয় করতে পারব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
কিন্তু তুমিতো এখনও ছাত্র।
আমরা এখনই কিছু করতে যাচ্ছি না। মাস্টার্স কমপ্লিষ্ট করে আমি ফরেনে পড়াশোনা করতে যাব। সেখানে থেকে ফিরে যা করার করব।
মুক্তা কাজের মেয়ে রশিদাকে চা-নাস্তার কথা বলে এতক্ষণ ড্রইং রুমের। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল। রসিদা চা-নাস্তার ট্রে নিয়ে এলে তার সাথে ভিতরে এল।
নায়লা বেগম মুকুলের কথা শুনে কিছুটা নিশ্চিত হলেন। তোমরা চা-খাও বলে তিনি চলে গেলেন।
রশিদা ট্রে রেখে চলে যাওয়ার পর মুকুল বলল, এখন কিছুই খেতে পারব না। চা দাও।
চা খেয়ে মুকুল বলল, এবার আসি। তারপর বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠল।
মুক্তা সাথে এসেছিল। বলল, সী এগেন।
.
মুক্তাদের বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশায় যেতে যেতে মুকুল চিন্তা করল আজই রীমার সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়া উচিত। রিকশাওয়ালাকে বলল, মোহম্মদপুর চল। বাসায় ঢুকেই শ্রাবণীর সঙ্গে দেখা। বলল, কীরে কেমন আছিস?
শ্রাবণী আপাকে সকাল থেকে মুখ ভার করে থাকতে দেখেছে। তাই বলল, আমি ভালো আছি; কিন্তু আপা ভালো নেই।
কেন কি হয়েছে?
তা জানি না, কাল থেকে মুখ গোমড়া করে রয়েছে।
মুকুল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও বলল, তা হলে তো নিশ্চয় কিছু হয়েছে। ডাক তো ওকে জিজ্ঞেস করে দেখি।
আপা রুমে আছে তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস কর। আমি মাকে বলি তুমি এসেছ। কথা শেষ করে শ্রাবণী সেখান থেকে চলে গেল।
মুকুল রীমার রুমের দরজার কাছে গিয়ে তার নাম ধরে ডাকল।
রীমা শুয়ে শুয়ে তার কথাই চিন্তা করছিল। উঠে বসে বলল, চেঁচাচ্ছিস কেন? ভিতরে আয়।
মুকুল ভিতরে ঢুকে খাটে তার পাশে বসে বলল, তোর কী হয়েছে? শ্রাবণী বলল, কাল থেকে তুই মুখ গোমড়া করে রয়েছিস?
রীমা কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইল।
কিরে কিছু বলছিস না কেন? না বললে জানব কি করে?
তুই কী কিছুই জানিস না?
মুকুল ভনিতা করে বলল, জানলে জিজ্ঞেস করছি কেন?
মা-বাবা কাল গিয়ে যে তোর সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, সে কথা শুনিস নি?
মুকুল হো হো করে হেসে উঠে বলল, তা শুনব না কেন? তা হলে সেই জন্যে তোর মন খারাপ। দূর পাগলী, এতে মন খারাপের কী হল? শোন, তুই তো আমার ও মুক্তার সম্পর্কের কথা জানিস। মায়ের কাছে যখন খালার প্রস্তাবের কথা শুনলাম তখনই মুক্তার সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলে নাকচ করে দিয়েছি। আরো বলেছি তোকে আমি আপন বোনের চোখে দেখি, বিয়ে করা একবারেই সম্ভব নয়। শুনলি তো, আর মন খারাপ করে থাকবি না। আর শোন, তোর যদি কেউ লাভার থাকে, নির্ভয়ে বলতে পারিস। আমি খালা খালুকে ম্যানেজ করে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
মুকুলের কথা শুনে মনের কষ্টে রীমার চোখে পানি এসে গেল। তাই মাথা নিচু করে চিন্তা করতে লাগল, মুকুল মুক্তাকে ভীষণ ভালবাসে এবং তাকে বিয়ে করবে। আর সেই জন্যেই আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারেনি। মনকে শক্ত করে সামলাবার চেষ্টা করল।
তাকে মাথা নিচু করে চুপ করে থাকতে দেখে মুকুল তার চিবুক ধরে তুলে কান্নাভেজা মুখ দেখে বলল, কিরে কাঁদছিস কেন? আমার কথায় কী তুই দুঃখ পেলি?
চোখ মুখ মুছে কান্নামুখে করুন হাসি ফুটিয়ে রীমা বলল, দুঃখ পাব কেন? বরং খুশি হয়েছি।
তা হলে কাঁদছিলি কেন?
কাঁদার কারণ অন্য।
কি কারণ বল না।
কারণ শোনার তোর দরকার নেই তুই মার কাছে যা।
তোর লাভার আছে কিনা বললি না যে?
থাকলে বলতাম। তুই এবার যাতো।
রীমার কান্নার কারণ মুকুল বুঝতে পেরেছে। তাই আর কিছু না বলে তার কাছ থেকে বাইরে এসে খালা খালা করে তার রুমের দিকে যেতে লাগল।
শ্রাবণীর মখে মুকুল এসে রীমার কাছে গেছে শুনে নাজনীন বেগম খুশী হয়ে নাস্তা বানাচ্ছিলেন। মুকুলের গলা পেয়ে বললেন, রুমে গিয়ে বস, আসছি।
একটু পরে নাজনীন বেগম নাস্তা নিয়ে এসে বললেন, নে খা। তারপর। বললেন, অনেক দিন পরে এলি, একটু ঘন ঘন আসতে পারিস না?
মুকুল খালার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল, খালুকে দেখছি না কেন?
নাজনীন বেগম বললেন, কিছুক্ষণ আগে কোথায় যেন গেল। তা হারে, আপা, দুলাভাই, ইতি ভালো আছে?
মুকুল বলল, হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। তারপর নাস্তা খেয়ে খালার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল।
মুকুল রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রীমা চিন্তা করতে লাগল, মুকুলকে পাওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। বড় খালা খালু চাইলেও মুকুল কিছুতেই তাকে বিয়ে করবে না। শুধু শুধু তার জন্য চিন্তা করে মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না। সে যখন মা-বাবাকে নিজের মতামত জানিয়েছে। আমারও উচিত আমার মা-বাবাকে জানিয়ে দেওয়া, আমি কেন ওর কাছে। এবং মুক্তার কাছে ছোট হতে যাব?
মুকুল নাস্তা খেয়ে চলে যাওয়ার পর পর নাজনীন বেগম মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাবের কথা জানাবার জন্য তার রুমে এলেন। থম থমে মুখে তাকে বসে থাকতে দেখে বললেন, কিরে চুপ করে বসে কী ভাবছিস? মুকুলের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস বুঝি?
মাকে দেখেও তার কথা শুনে রীমা রেগে গেল। রাগের সঙ্গে বলল, ঝগড়া করতে আমার বয়েই গেছে। তারপর একই স্বরে বলল, তোমরা নাকি বড় খালা খালুকে মুকুলের সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছ?
মেয়ের রাগ ও তার কথা শুনে নাজনীন বেগম বেশ অবাক হলেন। বললেন, কার কাছে শুনেছিস?
যার কাছেই শুনি কথাটা তো সত্য?
হ্যাঁ সত্য। কেন কি হয়েছে? তোর খালা খালু খুশী মনে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।
আমার মতামত না নিয়ে প্রস্তাব দিতে গেলে কেন? আমারও তো একটা নিজস্ব মতামত আছে।
তা আছে, তোর প্রতি আমাদের বিশ্বাসও আছে, তুই অমত করবি না।
সব বিষয়ে ছেলেমেয়ের প্রতি মা-বাবার বিশ্বাস থাকলেও তাদের বিয়ের ব্যাপারে থাকা ঠিক নয়। কোথাও প্রস্তাব দেওয়ার আগে অবশ্যই তাদেরকে জানাতে হবে। যাক গে, যা হওয়ার হয়েছে। তুমি বড় খালাকে জানিয়ে দিও, আমি এ বিয়েতে রাজি না।
নাজনীন বেগম খুব রেগে গেলেন। বললেন, লেখাপড়া করে মা-বাবার অবাধ্য হতে শিখেছিস না? মৌলবীরা ঠিক কথাই বলে, “মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করালে মা বাবার অবাধ্য হয়, লজ্জা-শরমও থাকে না।”
মৌলবীরা কি বলে আমার জানার দরকার নেই, আমার যা জানাবার জানিয়ে দিলাম।
নানজীন বেগম গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কী কোনো ছেলেকে পছন্দ করিস?
এখনো কাউকে করিনি, করলে তোমাদেরকে জানাব।
নাজনীন বেগম বলেন, মুকুল নিশ্চয় এমন কিছু বলে গেছে, যা শুনে রীমা মনে কষ্ট পেয়ে কেঁদেছে। আর সেই জন্যেই অমত করছে। বললেন, তোর বাবা শুনলে খুব দুঃখ পাবে। আর তোর খালা খালুও কম দুঃখ পাবে না।
পেলেও আমার কিছু করার নেই। তুমি এখন যাও, আমার মাথা ব্যথা করছে।
নাজনীন বেগম চিন্তিত মনে সেখান থেকে চলে এলেন।
রাতে ঘুমাবার আগে নাজনীন বেগম স্বামীকে মুকুলের আসার কথা ও মুকুলের চলে যাওয়ার পর রীমার সঙ্গে যে সব কথা হয়েছে বললেন।
আসফাক সাহেবও খুব অবাক হলেন। বললেন, এখন তাহলে কী করা যায় বলতো?
নাজনীন বেগম বললেন, এখন কিছু করার দরকার নেই। ওদের পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিকেলে মুকুল এসেছিল বললে, সে হয়তো এমন কিছু বলেছে, যা শুনে রীমা অমত করছে।
আমারও তাই মনে হয়েছে। তারপর চোখ মুছে ভিজে গলায় বললেন, আমি রীমা ও শ্রাবণীর চেয়ে মুকুলকে বেশি ভালবাসি। ও যে রীমাকে পছন্দ করবে না ভাবতেই পারছি না।
আমার কি মনে হয় জান? মুকুল হয় তো কোনো মেয়েকে ভালবাসে।
নাজনীন বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার কথা হয়তো ঠিক।
মুকুলের উপর স্ত্রী যে খুব দুঃখ পেয়েছে, তা বুঝতে পেরে আসফাক সাহেব বললেন, কি আর করবে রীমার মা, সবই তকূদীর। ভাগ্যে যার যেখানে জোড়া আছে, তার সঙ্গেই বিয়ে হয়। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এমনওতো হতে পারে রীমা মুকুলকে পছন্দ করে না?
তা হতে পারে, তবে সে রকম কিছু হলে মুকুল রীমার কাছ থেকে এসে হেসে হেসে আমার সঙ্গে কথা বলত না। আর নাস্তাও খেত না।
এখন ওসব চিন্তা করে লাভ নেই। তুমিই তো বললে, পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখা থাক। এবার ঘুমিয়ে পড়, রাত অনেক হয়েছে, বলে আসফাক সাহেব বালিশে মাখা রাখলেন। নাজনীন বেগমও স্বামীকে অনুসরণ করলেন।
.
রাত দশটা। মুকুল পড়ছিল। বুয়া এসে বলল, ভাইজান, আপনারে সাহেব ডাকছেন।
মুকুল বই বন্ধ করে বাবার রুমে এসে বলল, আমাকে ডেকেছ?
ইবরাহীম সাহেব বললেন, হ্যাঁ, বস। বসার পর বললেন, তোর মায়ের কাছে শুনলাম, তুই নাকি রীমাকে বিয়ে করতে রাজি না? সে দিন যে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিলি, তাকে বিয়ে করতে চাস?
মুকুল বলল, তুমি ঠিকই শুনেছ?
কিন্তু তোর খালা খালু তোকে জামাই করতে চায়। তোর মায়েরও অনেক দিনের আশা রীমাকে বউ করার। তাই তাদের প্রস্তাব আমরা গ্রহণ করেছি। রীমাকে বিয়ে না করলে তোর খালা খালু যেমন দুঃখ পাবে তেমনি আমরাও পাব। তা ছাড়া রীমা খুব ভালো মেয়ে।
বাবা, আমি তো বলিনি রীমা খারাপ মেয়ে। ওর মতো মেয়ে আজকাল খুব কম দেখা যায়। কিন্তু আমি ওকে ইতির মতো মনে করি। কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না।
কাউকে নিজের বোনের মতো মনে করলেও তাকে বিয়ে করা দোষের নয়। ইসলামে আছে, আপন ও দুধ ভাই বোন ছাড়া সব রকমের ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে জায়েজ।
তা হোক, তবু আমি রীমাকে বিয়ে করতে পারব না। তোমরা খালা খালুকে জানিয়ে দিও।
কিন্তু নিজেদের মধ্যে একবার প্রস্তাব গ্রহণ করে ফিরিয়ে দিই কি করে?
তা আমি জানি না। তোমরা যদি প্রস্তাব গ্রহণ করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করতে, তা হলে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে না। মা নাহয় তার ভাগ্নীকে বউ করতে চায়, তাই আমাকে জিজ্ঞেস না করে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। কিন্তু তুমি সেই ভুল করলে কেন?
ভুল ঠিক আমি করি নি। সে সময় তোর মতামত নেওয়ার কথা বলেছিলাম। তোর মা আমার কথার গুরুত্ব দিল না। অবশ্য আমি এখনও তোর মতের বাইরে কিছু করতে চাই না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তোর মাকে নিয়ে। সে তোর উপর খুব রেগে আছে। আর যে মেয়েকে তুই সেদিন নিয়ে এসেছিলি, তাকে তার একদম পছন্দ নয়।
তোমারও কী পছন্দ নয়?
মেয়েটির সবকিছু ভালো শুধু রংটা ময়লা।
আমি ওকে বিয়ে করলে তুমি কী রাগ করবে?
আমাকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না, তোর মাকে নিয়ে ভাব।
মুকুল বুঝতে পারল, বাবা তার ফরে। বলল, মা খুব রেগে আছে। আমার কোনো কথাই শুনবে না। তুমি তাকে ম্যানেজ করবে।
ঠিক আছে, ভালো ভাবে পরীক্ষাটা দে। এরমধ্যে তার সঙ্গে এই ব্যাপারে : কোনো আলাপ করবি না।
সাত
কয়েক মাস পরে দু’মাসের ব্যবধানে মুকুল ও মুক্তার পরীক্ষা শেষ হল। একদিন মুকুল রাত বারটার সময় মুক্তাকে ফোন করল।
ক্লাস সাসপেন্ড হওয়ার পর মুকুলের পরামর্শে মুক্তা ড্রইংরুম থেকে নিজের রুমে একটা প্যারালাল ফোন নিয়েছে। ব্যাপারটা জেনেও নায়লা বেগম মেয়েকে কিছু বলেন নি।
মুকুল প্রায় প্রতিদিন রাত বারটার পর মুক্তাকে ফোন করে। মুক্তাও তার ফোনের প্রতীক্ষায় থাকে। ফোন রিসিভ করার পর ঘুমায়। আজ সন্ধ্যার পর এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। আশ্বিনের শেষ। তাই আবহাওয়া ঠাণ্ডা।
মুক্তা দশটার দিকে খেয়ে এসে সেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েট পড়ছিল। ঠাণ্ডা আবহাওয়ার দরুণ ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, এগারটা। আরো কমপক্ষে এক ঘণ্টা মুকুলের ফোনের অপেক্ষায় জেগে থাকা সম্ভব নয় ভেবে সেটটা বালিশের পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। চার পাঁচবার রিং হতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে বলল, মুক্তা বলছি।
মুকুল বলল, তাতো বুঝতে পারছি; কিন্তু এত দেরিতে ফোন ধরলে কেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলে মনে হচ্ছে?
মুক্তা বলল, হ্যাঁ। তারপর ঘুমিয়ে পড়ার কারণ বলে বলল, দুদিন ফোন করনি কেন? আমার চিন্তা হয়নি বুঝি?
না করে দেখলাম, তুমি কর কিনা। তা তুমিই বা করলে না কেন? আমি তো ফোনের অপেক্ষায় দু’দিন ফোনের কাছে একটা পর্যন্ত বসেছিলাম।
ওমা, তাই নাকি? আমি তো করতে চেয়েছিলাম। তোমার রুমে ফোন নেই। অতরাতে অন্য কেউ ধরতে পারে ভেবে করিনি।
ঠিক আছে শোন, কাল আমরা চিটাগাং যাচ্ছি। আপার বাসায় কয়েকদিন থেকে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবন বেড়াতে যাব।
তোমাদের বাসার আর কে কে যাবে?
বাসার কেউ যাবে না।
তা হলে আমরা বললে কেন?
বোকার ডিম।
কী বললে?
কানে কালি।
কী বলছ মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
মাথায় ছিট।
মুক্তা অধৈর্য গলায় বলল, মুকুল, প্লীজ।
মুকুল হেসে উঠে বলল, সত্যিই তুমি বোকার ডিম।
বোকার ডিম বোকার ডিম করছ কেন? বোকারা বুঝি ডিম পাড়ে?
তা জানি না, তবে তুমি কিন্তু বোকার ডিমই।
আমি বোকার ডিম হলে তুমি কী তা হলে চালাকের ডিম?
মুকুল আবার হেসে উঠে বলল, চালাকের ডিম বাংলা ভাষায় নেই। এমন কি বাংলা অভিধানেও নেই।
মুক্তা অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, আর বোকার ডিম আছে বুঝি?
মুকুল হাসি চেপে রেখে বলল, অভিধানে না থাকলেও বাংলা ভাষায় ব্যবহার হয়।
ঠিক আছে, আমি না হয় বোকার ডিম; কিন্তু কানে কালি বললে কেন?
বোকার ডিম শব্দটা শুনতে পাওনি বলে।
আর মাথায় ছিট?
তোমাকে রাগাবার জন্য।
এবার বল বোকার ডিম বললে কেন?
আমরা চিটাগাং যাব শুনে বাসার কে কে যাবে জিজ্ঞেস করতে বলেছি। আমি আর তুমি যাব। এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
মুকুল তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে শুনে মুক্তা খুব আনন্দিত হল। সেই সাথে ব্যাপারটা বুঝতে না পারার জন্য লজ্জায় চুপ করে রইল।
কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে মুকুল বলল। কি, যাবে না? না গেলে মনে ব্যথা পাব।
মুক্তা আর চুপ করে থাকতে পারল না। উফুল্ল কণ্ঠে বলল, নিশ্চয় যাব।
তা হলে চুপ করে ছিলে কেন?
বোকার ডিম বলে।
মুকুল হেসে উঠে বলল, বোকার ডিম হওয়া চলবে না।
কী হতে হবে তা হলে?
চালাকের ডিম।
তুমি তো এক্ষুনি বললে, ঐ শব্দ বাংলা ভাষায় বা অভিধানে নেই, তবু বলছ কেন?
বলেছি তো কী হয়েছে? আজ থেকে আমরা না হয় শব্দটা চালু করলাম।
তোমার সঙ্গে কথায় পারব না, হার মানছি।
হার যখন মানছ তখন এসব প্যাচাল বাদ দিয়ে যা বলছি শোন, বাবার কাছে গাড়ি চেয়েছিলাম। বললেন, “দু’একদিনের জন্য হলে নিতে পারতিস। তুই তো বেশ কয়েকদিন পরে ফিরবি। বাসে অথবা ট্রেনে যা।” এবার বল কিসে যাবে?
তোমার যা ইচ্ছা, আমার কোনোটাতেই আপত্তি নেই।
খালাআম্মাকে কী বলবে?
কেন? সত্য কথাই বলব। আমি মিথ্যাকে ঘৃণা করি।
শুনে খুশী হলাম। কিন্তু উনি যেতে দেবেন?
সেটা আমার ব্যাপার, তোমাকে ভাবতে হবে না।
ঠিক আছে, কাল সকাল সাড়ে আটটার প্রভাতী ট্রেনে যাব। তুমি একেবারে স্টেশনে আসবে, না আমি তোমাদের বাসায় যাব?
তুমি আবার এতদূর আসবে কেন? আমিই আসব।
আমি টিকিট কেটে গেটের কাছে অপেক্ষা করব। এবার রাখি তা হলে?
ঠিক আছে রাখ।
মুকুলের রিসিভার রাখার শব্দ পেয়ে মুক্তাও রিসিভার রেখে দিল। তারপর চিন্তা করল, সকালে যদি ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায়, কাপড়-চোপড় গোছাব কখন? এখনই সবকিছু করে রাখাই ভালো। এই কথা চিন্তা করে খাট থেকে নেমে লেদারে প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় ও প্রসাধনী ভরে রাখল। তারপর ছোট বাথরুমের কাজ সেরে এসে যখন ঘুমাতে গেল তখন রাত তিনটে।
মুক্তা প্রতিদিন ভোরে উঠে কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে বারান্দায় বসে বিশ্রাম নেয়। সেই সময় হকার পেপার দিলে পড়ে। তারপর বাথরুমের কাজ সেরে চা-বিস্কুট খেয়ে পড়তে বসে। ঠিক আটটায় নাস্তার টেবিলে যায়। এটাই তার নিত্যদিনের অভ্যাস। আজ তিনটের সময় ঘুমিয়েছে বলে ভোরে তার ঘুম ভাঙল না।
সাতটা বেজে যাওয়ার পরও নায়লা বেগম যখন মেয়ের সাড়া পেলেন না তখন তার রুমের জানালার কাছে এসে পর্দা সরিয়ে দেখলেন ঘুমাচ্ছে। ভাবলেন, অসুখ-বিসুখ করেনি তো? কয়েকবার নাম ধরে ডেকে বললেন, সাতটা বেজে গেছে, এখনও ঘুমাচ্ছিস কেন?
মায়ের ডাকে মুক্তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সাতটা বেজে গেছে দেখে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে দরজা খুলে মাকে বলল, বুয়াকে তাড়াতাড়ি টেবিলে নাস্তা দিতে বল। আর ড্রাইবারকে গাড়ি বার করতে বল। আমি সাড়ে আটটার ট্রেনে চিটাগাং যাব।
নায়লা বেগম অবাক হয়ে বললেন, কই, আগে তো কিছু বলিস নি? তা কার সাথে যাবি?
মুকুলের সাথে।
মুকুলের সাথে ওদের কেউ যাবে?
না, আমি আর মুকুল যাব। চিটাগাং-এ ওর আপা দুলাভাই থাকেন। প্রথমে সেখানে উঠব। তারপর কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবন বেড়াতে যাব।
এখন তোদের বিয়ে হয়নি, যাওয়াটা কী ঠিক হবে? বিয়ের পর না হয় যাবি।
ওসব নিয়ে তুমি ভেব না। হাতে একদম সময় নেই বলে মুক্তা ব্রাসে পেষ্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকল।
তারপর রেডি হয়ে মাকে বলে যখন গাড়িতে উঠল তখন আটটা পাঁচ। গাড়িতে উঠে মুক্তা ড্রাইভারকে বলল, সাড়ে আটটায় ট্রেন ছাড়বে, তার আগে ষ্টেশনে পৌঁছাতে হবে। সেইভাবে গাড়ি চালাবেন।
মুকুলের ধারণা ছিল মুক্তা আটটায় এসে পৌঁছাবে। তাই পৌনে আটটায় এসে টিকিট কেটে টুরিষ্ট ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে প্লাটপর্মের গেটে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আটটা বাজার পর মিনিটের কাঁটা যত নিচের দিকে নামতে লাগল তত মনের মধ্যে অস্থিরতা অনুভব করল। ভাবল, ওর মা কি রাজি হয়নি? আটটা বিশ বেজে যাওয়ার পরও যখন মুক্তা এল না তখন কার্ডে তাদের বাসায় ফোন করল। দু’শো ইউনিটের কার্ড আগেই কিনে রেখেছিল।
রিং বাজতে শুনে নায়লা বেগম ফোন ধরলেন।
মুকুল বুঝতে পেরে সালাম বিনিময় করে বলল, খালাআম্মা, কমলাপুর স্টেশন থেকে মুকুল বলছি। আমার সঙ্গে মুক্তার চিটাগাং যাওয়ার কথা। ওতো এখনও এসে পৌঁছাল না। এদিকে ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। ও কি ….।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই নায়লা বেগম বললেন, ড্রাইবার গাড়ি নিয়ে মুক্তাকে পৌঁছে দিতে আটটায় রওয়ানা হয়েছে। এক্ষুনি পৌঁছে যাবে। তারপর বললেন, ওর কাছে তোমাদের বেড়ানোর কথা শুনেছি। দিনকাল ভালো নয়। সাবধানে থাকবে। সন্ধ্যার পর রাস্তায় বেরোবে না।
ঠিক আছে খালাআম্মা, আপনি কোনো চিন্তা করেবেন না। এবার রাখি, ও এল কিনা দেখি। কথা শেষ করে রিসিভার রেখে গেটের কাছে আসার সময় দেখল, মুক্তা দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পাশে লেদার হাতে ড্রাইভার। কাছে এসে বলল, হাতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময়। তাড়াতাড়ি চল। তারপর প্লাটফর্মের ভিতরে ঢুকে যেতে যেতে বলল, আটটা থেকে অপেক্ষা করতে করতে আটটা বিশে তোমাকে ফোন করতে গিয়েছিলাম। খালাআম্মা বললেন, আটটায় রওয়ানা দিয়েছ। যা চিন্তা হচ্ছিল না। তুমি রওয়ানা দিয়েছ শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি।
মুক্তা বলল, তুমি ফোন করার পর ভাগ্যিস লেদারে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে রেখেছিলাম নচেৎ কি যে হত? ভোরে ঘুম ভাঙ্গার অভ্যাস থাকলেও কাল সবকিছু গেছে-গাছ করে তিনটের সময় ঘুমাবার ফলে ঘুম ভাঙ্গেনি। মা সাতটার সময় ডেকে জাগায়। তাকে তোমার সঙ্গে বেড়াবার প্রোগ্রামের কথা বলে এক ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে রওয়ানা দিই।
গাড়িতে উঠার দু’মিনিট পর গাড়ি ছেড়ে দিল। মুকুল বলল, আমার সঙ্গে বেড়ানোর প্রোগ্রাম শুনে খালাআত্মা কিছু বলেন নি?
বলেছে; তবে তেমন কিছু নয়।
তুমি আগে কখন চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার গিয়েছিলে?
না। শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কম্পানিয়নের অভাবে সম্ভব হয়নি।
আমি দুতিনবার গেলেও রাঙ্গামাটি, বান্দরবন যাইনি। দুলাভাইয়ের গাড়ি নিয়ে আমরা বেরোব।
উনি ওখানে কি করেন।
নেভীতে চাকরি করেন। উনি মেরীন ইঞ্জিনীয়ার। প্রায় এক বছর হতে চলল আপা বা দুলাভাই ঢাকায় আসেননি। মা-বাবা ফোনে আসার কথা। বললে বলেন, কাজের খুব চাপ, ছুটি পাওয়া যাচ্ছে না। ছুটি পেলেই আসবেন। দুলাভাইয়ের যে কাজের চাপ, তা আমরা জানি। আপা অবশ্য ছয়। সাত মাস অন্তর ছেলে মেয়ে গিয়ে দু’চার দিন ঢাকা থেকে ঘুরে আসত। সেও এই এক বছর আসেনি। তাই মা কাল রাতে খাওয়ার টেবিলে আমাকে বলল, তুই গিয়ে ওদেরকে দেখে আয়। আর পারলে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। শুনে তোমাকে নিয়ে বেড়াবার প্রোগ্রাম মাথায় এল। বললাম, ঠিক আছে, কালকেই যাব।
ওঁদের ছেলেমেয়ে কয়টা?
দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটা সবার ছোট।
আমাকে দেখে কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবে?
যা সত্য তাই বলব।
ওঁরা যদি কিছু মনে করেন?
আপা ও দুলাভাই খুব উঁচু মনের মানুষ। তাছাড়া দু’জনেই নারী স্বাধীনতা সংগ্রাম সংস্থার সঙ্গে জড়িত। কিছু মনে করার প্রশ্নই উঠতে পারে না।
মুক্তা কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুকুলের দিকে তাকিয়ে বলল, পরীক্ষা তো শেষ হল, এবার কী করবে?
মুকুল বলল, সে ব্যাপারে তো আগেই তোমার সঙ্গে আলাপ করেছি, এখন আবার জিজ্ঞেস করছ কেন?
আমি সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করিনি। আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে কী করবে জানতে চাচ্ছি।
বিয়ের কাজ সেরে রেখে যাব ভেবেছি। যদি একান্ত সম্ভব না হয় এঙ্গেজমেন্ট হলে ও করে যাব। আপা দুলাভাইকে হাত করার জন্য তোমাকে নিয়ে এলাম। বেড়ানও হল আর আসল উদ্দেশ্যও সফল হল। মানে যাকে বলে “এক ঢিলে দুই পাখী শিকার।”
ফরেনে গেলে ছেলেদের মন-মানসিকতা পাল্টে যায়। অনেকে মেম সাহেবকে বিয়ে করে ফিরে। আবার অনেকে গ্রীন কার্ড পাওয়ার জন্য সে দেশের মেয়েকে বিয়ে করে থেকে যায়। যারা প্রেমিকাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়, তারাও প্রেমিকাকে ভুলে মেম সাহেবদের সঙ্গে প্রেম করে বেড়ায়। এসব কথা মুক্তা জানে। তাই বিয়ে করে যাওয়ার কথা শুনে প্রথমে আনন্দিত হলেও এঙ্গেজমেন্টের কথা শুনে চিন্তিত হল। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
মুকুল বলল, এতক্ষণ চুপ করে আছ কেন? মনে হচ্ছে কিছু যেন ভাবছ?
হ্যাঁ ভাবছি।
কী ভাবছ?
ভাবছি, তোমাকে ছেড়ে অতদিন থাকব কি করে?
সেকথা মনে হলে আমারও খুব খারাপ লাগে। তারপর কয়েক সেকেণ্ড। চুপ করে থেকে বলল, এখন ওসব ভাবলে বেড়ানোর আনন্দ নষ্ট হয়ে যাবে। ভবিষ্যতের চিন্তা করে বর্তমানের আনন্দ উপভোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া কী উচিত হচ্ছে?
না তা উচিত হচ্ছে না। তুমি ঠিকই বলেছ, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মন খারাপ করার কোনো মানেই হয় না। তারপর তারা নানারকম কথাবার্তা বলে সময় কাটাতে লাগল।
রাতে খাওয়ার পর মুকুল ইরা আপাকে ফোনে আসার কথা জানিয়ে স্টেশনে গাড়ি পাঠাতে বলেছিল। ট্রেন দুপুর একটায় পৌঁছাবার কথা থাকলেও দু’টোয় পৌঁছাল। মুকুল মুক্তাকে নিয়ে প্লাটফর্মের বাইরে ট্যাক্সী স্ট্যারে কাছে এসে দুলাভাইকে খুঁজতে লাগল।
এমন সময় পাজামা-পাঞ্জাবী পরা দাড়ি-টুপিওয়ালা একজন লোক এসে সালাম দিয়ে বলল, মুকুল, কেমন আছ?
মুকুল লোকটাকে তাদের দিকে আসতে দেখেছে। চিনতে না পেরে অন্য দিকে তাকিয়ে দুলাভাইকে খুঁজছিল। গলার আওয়াজে চিনতে পেরে খুব অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মোরশেদ মৃদু হেসে বলল, কি হে, চিনতে পারনি? সালামের উত্তরও তো দিলে না?
মুকুল যেন অবাস্তব কিছু দেখছিল। মোরশেদের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলল। সরি দুলাভাই। যে লোক না কি দাড়ি টুপিকে ঘৃণা করত, তাকেই দাড়ি-টুপি অবস্থায় চিনব কি করে?
এখানে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলা ঠিক নয়। বাসায় গিয়ে তোমার কথার উত্তর দেব। তারপর মুক্তার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, ইনি তোমার সঙ্গে এসেছেন নাকি?
হ্যাঁ, আমার গালফ্রেণ্ড।
কই, তোমার আপা তো ইনার কথা বলেনি?
আমিই তাকে জানাইনি।
ঠিক আছে এস বলে মোরশেদ গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, কেমন আছ বললে না যে?
ভালো না থাকলে বেড়াতে এলাম কি করে?
আব্বা, আম্মা ও জাকিয়া কেমন আছে?
ইতির ভালো নাম জাকিয়া সুলতানা। ঐ নাম শুধু স্কুল কলেজের খাতায়। সবাই ইতি বলেই জানে। দুলাভাইকে ইতিকে ইতি না বলে আসল নামে ডাকতে ও মা-বাবাকে আম্মা-আব্বা সম্বোধন করতে শুনে আরো বেশি অবাক হল। বলল, সবাই ভালো আছে। তা আপনি, আপা ও ছেলেমেয়েরা কেমন। আছেন?
আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই ভালো আছি।
দুলা ভাইয়ের পরিবর্তন দেখে মুকুল ক্রমশঃ বেশি অবাক হতে লাগল। ভাবল, যে দুলাভাই মোল্লাদের দু’চক্ষে দেখতে পারত না, সে কি করে তাদেরইে মতো হয়ে গেল?
মোরশেদ তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, আমাকে দেখে ও আমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছ তাই না? বাসায় পৌঁছে আরো বেশি অবাক হবে।
এরপর আর কেউ কোনো কথা বলল না।
বাংলো প্যাটার্নের একটা সরকারী কোয়াটারে মোরশেদ ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। বাড়িটায় দুটো বেড রুম একটা ড্রইং রুম, এটা গেষ্টরুম, দু’টো বাথ ও একটা কিচেন রুম। বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তার একপাশে গাড়ির গ্যারেজ। বাকি জায়গাটায় ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা করে। পুরো বাড়িটা পাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের মাঝখানে গেট। গেট থেকে বেরোলেই রাস্তা।
গেটের কাছে এসে মোরশেদ তিন বার হর্ণ বাজাল। একটু পরে গেট খুলে যেতে গাড়ি ভিতরে ঢুকিয়ে বারান্দার কাছে এসে পার্ক করল।
মুকুলের বড় বোন ইরার আসল নাম জাহেদা।
জাহেদা জানে স্বামী অফিস থেকে ছুটি নিয়ে মুকুলকে নিয়ে আসতে স্টেশনে যাবে। তাই ছেলে মেয়েসহ না খেয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। পরপর তিনটে গাড়ির হর্ণ শুনে বুয়াকে গেট খুলে দিতে বলে সবাইকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ি থেকে সবাই নামার পর সালাম দিল। সেই সাথে ছেলেমেয়েরাও দিল।
মুকুল সালামের উত্তর দিয়ে আপা ও ভাগ্না-ভাগ্নীর পোষাক দেখে অবাক হল। আপার ও ভাগ্নী দু’জনের সালওয়ার কামিজের সঙ্গে বড় ওড়না দিয়ে মাথা ও সারা শরীর ঢাকা। চার বছরে ভাগ্নার পোষাক তার বাবার মতো।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জাহেদা বলল, কিরে, দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? ভিতরে আয়। তারপর মুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে তো চিনতে পারছি না।
মুকুল বলল, ও মুক্তা। আমার বান্ধবী। আমার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে।
আসার সময় ট্রেনে মুকুলের কাছে এদের সম্পর্কে মুক্তা যা শুনেছিল, এখন তার বিপরীত দেখে সেও খুব অবাক হয়েছে। মুকুল বান্ধবী বলে পরিচয় দিতে তার আপাকে সালাম দিল।
জাহেদা সালামের উত্তর দিয়ে এগিয়ে এসে তার একটা হাত ধরে বলল, এস ভাই। তারপর যেতে যেতে বলল, ছোট ভাইয়ের বান্ধবী, তাই তুমি করে বলছি। মনে কিছু করনি তো?
মুক্তা বলল, না-না, মনে করার কি আছে? এটাই তো স্বাভাবিক।
জাহেদা পিছন ফিরে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি মুকুলকে নিয়ে ড্রইংরুমে বস। আমি একে গেষ্ট রুমে নিয়ে যাচ্ছি।
ড্রইংরুমে ঢুকে মুকুল আর একবার অবাক হল। দামী দামী সোফা সেট, বিশ ইঞ্চি রঙিন টিভি ও সি.ডি. সেটের বদলে সাধারণ কয়েকটা চেয়ার টেবিল, আর তিন দিকের দেওয়ালের গা ঘেঁসে আলমারী গুলোতে বই ঠাসা। বইগুলো যে ধর্মিয়, তা বুঝতে বাকি রইল না।
মুকুল আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, দুলাভাই, আপনাদের এত পরিবর্তন হল কী করে?
মোরশেদ বলল, সেকথা পরে শোন। তার আগে খাওয়া-দাওয়া করে নিই এস, বেলা অনেক হয়েছে।
মুকুল ভাগ্না-ভাগ্নীদের জন্য মিমি ও চকলেট এনেছিল। সেগুলো ব্যাগ থেকে বার করে তাদের হাতে দিয়ে বড় ভাগ্নিকে বলল তোর মাকে গিয়ে বল আমি গোসল করব।
মুক্তাকে গেষ্ট রুমে এনে জাহেদা বলল, তোমাকে একটা কথা বলব, মাইণ্ড করবে না তো?
না-না, মাইন্ড করব কেন? আপনি মুকুলের আপা হিসাবে আমারও আপা। বলুন কী বলবেন?
যে কয়েকদিন তুমি এখানে থাকবে, আমি যে ওড়নাটা দেব সেটা আমার মতো করে পরবে। এটা ইসলামের রীতি। আমরা মুসলমান, ইসলামের রীতি মেনে চলা আমাদের একান্ত কর্তব্য।
এদেরকে দেখে মুক্তা প্রথম থেকেই বিরক্ত হয়েছিল। এখন আপার কথা শুনে রেগে গেল। ভাবল, এরা খুব গোঁড়া। কিছু না বলে মুখ নিচু করে রইল।
কি হল ভাই, মুখ নিচু করে রয়েছ কেন? মাইণ্ড করেছ নিশ্চয়?
সৌজন্য রক্ষার জন্য মুক্ত তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, না করিনি।
জাহেদা আলনা থেকে একটা ওড়না নিয়ে তার হাতে দিয়ে বলল, কাপড় পাল্টে বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে এটা গায়ে ও মাথায় দাও। আমি খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
মুকুল গোসল করে ফিরে এলে মোরশেদ ড্রইংরুমের চেয়ার টেবিল একপাশে সরিয়ে রেখে প্রথমে পাটি বিছাল। তারপর দস্তরখানা বিছিয়ে মুকুলকে বলল, এভাবে খাওয়া সুন্নত। এস বসা যাক বলে বসে পড়ল।
মুকুল কিছু না বলে তার পাশে বসল। একটু পরে ভাগ্না-ভাগ্নীদের সঙ্গে মুক্তাকে গায়ে মাথায় ওড়না পরে আসতে দেখে মুকুল খুব অবাক হলেও কিছু বলল না।
খাওয়া-দাওয়ার পর যখন সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করছিল তখন মুকুল দুলাভাইকে বলল, এবার বলুন আপনাদের এত পরিবর্তন হল কি ভাবে?
তার কথা শুনে জাহেদা মৃদু হেসে স্বামীর দিকে তাকাল।
মোরশেদ ও মৃদু হেসে স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, আমাদের পরিবর্তনের কারণ জানার জন্য তুমি যে খুব অস্থির হয়ে পড়েছ, তা বুঝতে পারছি। অবশ্য হওয়ারই কথা। একটা কথা জেনে রাখ, আল্লাহপাক যাকে হেদায়েৎ করার ইচ্ছা করেন, অতি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা করে থাকেন। আমাদের ঘটনাটাই তার প্রমাণ। বলছি শোন, আমাদের অফিসে জলিল নামে একজন মোল্লা টাইপের লোক কাজ করে। লোকটা সুযোগ পেলেই ক্কুরআন হাদিস আওড়ায়। দু’চার জন ছাড়া সবাই তাকে দেখতে পারে না। আমি যে ধর্মের কথা শুনলে রেগে যাই তা জানে। তাই আমার সামনে কিছু বলত না। একদিন টিফিনের সময় ক্যান্টিনে চা খাচ্ছিলাম, এমন সময় তাকে একটা দৈনিক পত্রিকা হাতে নিয়ে ঢোকার সময় বলতে শুনলাম, আল্লাহ কাকে কখন কিভাবে হেদায়েৎ দেন, তা কেউ বলতে পারে না। তখন টিফিনের সময়। অফিসের অনেকেই ক্যান্টিনে টিফিন করছিল। তাদের মধ্যে ক্যাসিয়ার আজিজ ছিল। সেও মোল্লা টাইপের লোক। সে বলল, পেপারে। তেমন কিছু ঘটনা দিয়েছে নাকি জলিল ভাই?
জলিল বলল, তবে আর বলছি কি? বি.বি.সির মহাপরিচালকের ছেলে জোনাথন ইসলাম কবুল করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এখন রীতিমতো ইসলামী পোষাক পরে ইসলামের সবকিছু মেনে চলছেন এবং ইসলামের খিদমতের কাজও করছেন।
জলিলের কথা শুনে আমি রেগে গিয়ে বললাম, যতসব আজগুবী কথা মোল্লাদের পেপারে ছাপা হয়।
জলিল বলল, স্যার, পেপার যাদেরই হোক, ঘটনা সত্য না হলে এরকম একজন বিখ্যাত লোকের ছেলের ছবিসহ ইসলাম কবুল করার ঘটনা ছাপাতে পারত না।
বললাম, পড়ে শোনাও তো দেখি, তারপর না হয় ছবি দেখব। পেপারের এক পৃষ্ঠার অর্ধেক জুড়ে জোনাথন ও তার বাবা জন বার্টের বায়োডাটা এবং জোনাথন কেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন সেই ঘটনা ছাপা হয়েছে। জলিল পড়ে শোনাবার পর তার হাত থেকে পেপারটা নিয়ে জন বার্টের ও। জোনাথনের ছবি দেখলাম। দেখার সাথে সাথে আমার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, তুমি মুসলমান হয়ে ইসলামকে ঘৃণা কর। আর একজন উচ্চ শিক্ষিত ইংরেজ খৃষ্টান, যার মা-বাবা ইসলামকে মৌলবাদ বলে গালা-গালি করে, তাদের একমাত্র ছেলে জোনাথন ইসলামের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। চিন্তাটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। ঐদিন বাসায় ফেরার সময় পেপারটা কিনে নিয়ে এসে নিজে পড়ে তোমার আপাকেও পড়তে দিলাম। পড়ে সেও খুব অবাক হল। তারপর থেকে ইসলামকে জানার আগ্রহ বেড়ে গেল। একদিন ক্কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা, সিরাতুন্নবী (দঃ) সাহাবাদের ও মুসলিম মনীষীদের জীবনী কিনে বাসায় ফিরলাম। তারপর আমিও তোমার আপা সেসব পড়ে অল্প দিনের মধ্যে আমাদের ভুল বুঝতে পারলাম। আল্লাহপাক মেহেরবাণী করে আমাদের জ্ঞানের চোখ খুলে দিলেন। বুঝতে পারলাম, একমাত্র ইসলামই মানুষকে ইহকাল ও পরকালে মুক্তি দিতে পারে। আল্লাহর কাছে আমরা কান্নাকাটি করে তওবা করে বিগত জীবনের ধ্যান ধারণা ও কাজের জন্য ক্ষমা চেয়ে ইসলামী জীবন-যাপন শুরু করলাম এবং ছেলে-মেয়েদেরকেও সেইভাবে পরিচালিত করতে শুরু করলাম। তারপর বড় মেয়ে খাদিজাকে বলল, আলমারীর ড্রয়ার থেকে সেই পেপারটা নিয়ে এস তো মা।
খাদিজা পেপারটা নিয়ে ফিরে এলে তাকেই পড়তে বললাম।
খাদিজা ক্লাস সিক্সে পড়ে। আব্বার কথা শুনে পড়তে শুরু করল বি.বি.সি’র ডি.জি’র একমাত্র পূত্রের ইসলাম গ্রহণ। পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সমাজ ব্যবস্থা ত্যাগ করে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় ইসলাম ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে চলেছে। যে মুহূর্তে বি.বি.সি ও ভয়েস অফ আমেরিকা ইসলামকে মৌলবাদ বলে গালি দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বি.বি.সি’র মহাপরিচালক জন বার্টের একমাত্র ছেলে জোনাথন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। জোনাথন পিতার পাঁচ লাখ পাউণ্ডের বাড়িতেই বসবাস করছেন। তবে তাদের বিশ্বাস ও জীবনধারা সম্পূর্ণ বিপরীত। উভয়ে নাস্তা খান একই টেবিলে। এরপর জন বার্ট লিমোজিনে চড়ে পোর্টল্যাণ্ড প্যালেসে বি.বি.সি’র সদর দপ্তরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। এ সময় জোনাথন সেলওয়ার পরে হাতে পবিত্র ক্কুরআন নিয়ে দক্ষিণ লণ্ডনের পথে বের হয়ে যান। সেখানে তিনি একটি মুসলিম বুকসপ পরিচালনা করেন। এ বুকশপে ইসলাম সম্পর্কে দুর্লভ বই-পত্র পাওয়া যায়। উনত্রিশ বছরের জোনাথন যখন মাথায় টুপি পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান তখন জাত্যাভিমানী ইংরেজদের চোখ কপালে উঠে যায়। তাঁর সাথে কারো মিল নেই। জনসমুদ্রেও তিনি যেন একা। মুখে দাড়ি, ঠোঁটে বি হাসি যেন ইংরেজ সমাজে বিসদৃশ্য। তবে কেউ তাকে সরাসরি কিছু বলার সাহস করে না। হাজার হলেও তো বি.বি.সি’র মহাপরিচালকের ছেলে। জন বার্ট বছরে তিন লাখ চুয়ান্ন হাজার পাউণ্ড বেতন পান। বি.বি.সি’র হাজার হাজার কর্মচারীর তিনি বস। বি.বি.সি. প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষের কাছে। পাশ্চাত্যের ভাবধারা প্রচার করেন। পক্ষান্তরে নও মুসলিম জোনাথন পবিত্র ক্কুরআনের অমিয়বাণী প্রচার করেন মুষ্টিমেয় লোকের কাছে। পিতা ও পূত্র উভয়েই প্রচারের সঙ্গে জড়িত। একজন বেতনভূক্ত কর্মচারী হিসাবে প্রচারনা চালান। আর একজন প্রচারণা চালান সর্বশক্তিমান আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জনের জন্য। পিতা-পুত্র হিসাবে জনবার্ট ও জোনাথনের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক থাকলেও উভয়ের পথ ও লক্ষ্য ভিন্ন। পিতা লিমোজিনে চড়ে অফিসে যান। ছেলে জোনাথন ধরেন ট্রেন। একই পরিমণ্ডলে দুটি জীবন। একটি ভোগবাদী এবং অন্যটি ভোগ বিবর্জিত। জোনাথন নরবেরিতে ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কাজ করেন। ঐ কেন্দ্রে তিনিই একমাত্র ককেশীয়। ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কোর্সে আরবি ভাষা ও ইসলামী রীতিনীতি শিক্ষা দেওয়া হয়। জোনাথন এই কেন্দ্রে আট বছর ধরে কাজ করছেন। তিনি গ্রীষ্মকালে এই কাজে নিয়োজিত থাকেন। বাকি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি শীতের শুরুতেই ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাজে সাময়িক বিরতি দেন। ছাত্র হয়েও অবকাশকালীন উপার্জন করেন শুধু মাত্র ইসলামের স্বার্থে। জোনাথন বড় হয়েছেন পাশ্চাত্য সমাজে। কিন্তু তিনি এখন পাশ্চাত্যে থেকেও যেন সেখানকার কেউ নন। ইসলামী নাম গ্রহণ করেছেন। তার বর্তমান নাম ইয়াহিয়া। তিনি মুসলিম সমাবেশে এবং তবলীগে ওয়াজ করেন। তিনি তাঁর ওয়াজে প্রতিটি কথা বলেন ক্কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে। তাঁর তেজদীপ্ত ওয়াজে শ্রোতারা মুগ্ধ হন।
গত জুলাইয়ে ইয়াহিয়া একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত তরুণীকে বিয়ে করেছেন। এই তরুণীর নাম ফাওজিয়া বোরা। নব দম্পতি সিরিয়া, জর্দান ও পূর্ব জেরুজালেম সফর করেন। ইয়াহিয়ার মায়ের নাম জেনি লেক। তিনি একজন মার্কিন বংশোদ্ভুত শিল্পী। ছোট বোনের নাম এলিজা। ইয়াহিয়া মা ও ছোট বোনের সঙ্গে এই গৃহে কাটিয়েছেন। কিন্তু তিনি পৈত্রিক ধর্মে কখনো উৎসাহী ছিলেন না। ইয়াহিয়ার পিতা জন বার্টের বয়স বাহান্ন বছর। তিনি একজন ক্যাথলিক। বিশ বছর বয়স থেকে তিনি ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা নেন। জন বার্ট বলেছেন, আমার ছেলে কখনো আমার ধর্মে আস্থাশীল ছিল না। সে গীর্জায় যেত না। নিজেকে খৃষ্টান বলে পরিচয় দিত না। তবে সে অশ্রদ্ধাও করত না। বলতো, আমি খৃষ্টান নই। তবে ধর্মকে আমি ঘৃণা করি না।
ইয়াহিয়া মানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ও আধুনিক ইতিহাস নিয়ে অধ্যায়ন করত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন মুসলিমের সঙ্গে ইয়াহিয়ার পরিচয় ঘটে। এই মুসলিম যুবকটিই ইয়াহিয়ার জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আনে। থাকতেন দুজন একই ফ্লাটে। মুসলিম যুবকটির আচার-আচরণ দেখে ইয়াহিয়া মুগ্ধ হয়ে যান। ইয়াহিয়া ভাবতে থাকেন। যে মানুষ এত সুন্দর তার ধর্মও নিশ্চয় সর্বোত্তম। মুসলিম যুবকটির চারিত্রিক মাধুর্য ইয়াহিয়ার মন পরিবর্তন করে দিতে থাকে। ইয়াহিয়া মুসলিম যুবকটির কাছে-পিঠে যেতেন না। তবে তিনি অনুভব করতে থাকেন যে, দূরে থেকেও লোকটি তাকে প্রভাবিত করছে। শেষ বর্ষের মাঝ পথে ইয়াহিয়া পড়াশোনা বাদ দেন। তিনি লণ্ডনে প্রাচ্য ও আফ্রিকা বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ. (অনার্স)-তে ভর্তি হন। মানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আধুনিক ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ফ্রাংক গোরম্যান বলেন, জোনাথন সবকিছু ছেড়ে চলে গেছে। তার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা রয়েছে। সে এ বিষয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী নয়। তার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় পরিবর্তন করায় জোনাথন পড়াশোনায় ভালো করতে থাকেন। তিনি বি.এ. (অনার্স)-তে প্রথম শ্ৰেণী লাভ করেন। গত বছর তিনি ওরউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষক প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেট কোর্সে ভর্তি হন। এর কয়েক সপ্তাহ পর জোনাথনের মনে নুতন চিন্তা আসে। তিনি মনে করেন যে, ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কাজ নিলে ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন।যে চিন্তা সেই কাজ। তিনি ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নিয়মিত কাজ করেন। সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত তিনি ওয়াডসওয়ার্থে তাঁর পরিবারের সঙ্গে কাটান এবং স্ত্রী ফাওজিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সপ্তাহান্তে অক্সফোর্ডে যান।
১৯৯৬ সালে এক বক্তৃতা দেওয়ার অনুষ্ঠানে ফওজিয়ার সঙ্গে জোনাথনের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। প্রথম সাক্ষাতেই তাদের প্রেম হয়ে যায়। ফাওজিয়া ছিলেন একজন সাংবাদিক। জোনাথন তাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেন। ফাওজিয়ার ডাক নাম বোরা। বয়স চব্বিশ বছর। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মিসরের মধ্যযুগীয় ইতিহাস নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীতে পড়াশোনা করছেন। তিনি ইতিপূর্বে অক্সফোর্ডের সেগুহিলডা কলেজ থেকে ইংরেজীতে প্রথম শ্রেণীতে অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জোনাথন ও ফাওজিয়া মধুচন্দ্রিমা উদযাপনের জন্য ইসলামের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জেরুজালেমে আসেন। জেরুজালেমের মুসলিম অংশে তারা ব্যাপকভাবে সফর করেন। স্থানীয় ফিলিস্তিনীরা তাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শহর দেখান। ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে তাদের বেশ ভাব হয়ে যায়। এ সফরকালে তারা বিভিন্ন আলোচনায় ফিলিস্তিনী সার্থের পক্ষে কথা বলেন।
ইয়াহিয়া দম্পতি নিয়মিত নামায পড়েন। লণ্ডনের অক্সফোডের সংলগ্ন একটি মসজিদে তারা হাত ধরাধরি করে নামায পড়তে যান। নামায পড়ে। উভয়ে নিজেদের ভিলায় ফিরে যান। ফাওজিয়া খুব ভালো ছাত্রী। তিনি পড়াশোনা ও ইয়হিয়া ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। একজনকে আর একজনের সঙ্গে চমৎকার মানিয়েছে। যেন সোনায় সোহাগা। ইয়াহিয়া অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তের যুবক। তিনি যা করেন বুঝে শুনেই করেন। সেখান থেকে তাকে কেউ ফেরাতে পারে না। তার পিতা জন বার্ট খুব প্রভাবশালী। তিনি হয়তো তার ছেলেকে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তার চেষ্টা বিফলে যাবে। এ ধরনের চেষ্টা চালান হলে ইয়াহিয়া আরো বেশি করে ইসলামের খিদমতে নিয়োজিত হবেন। ইয়াহিয়া বলেছেন, আমি আমার পিতার মতো বিখ্যাত নই। হতেও চাই না। যা পেয়েছি তা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। ইসলাম আমাকে মুক্তির সন্ধান দিয়েছে। আমি মহত্তম জীবনের অধিকারী হতে চাই। আমাকে এই আকাক্ষা থেকে কেউ বিরত রাখতে পারবে না।
খাদিজার পড়া শেষ হলে মোরশেদ তাকে বলল, পেপারটা তোমার মামার হাতে দাও। জোনাথন ও তার বাবা জন বার্টের ছবি দেখুক।
খাদিজা পেপারটা মামাকে দিল।
ছবি দেখে জন বার্টকে খৃষ্টান মনে হলেও জোনাথনকে মনে হল না। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে মুক্তাকে দেখার জন্য দিল।
ছবি দেখে মুক্তাও অবাক হল। দাড়ি, টুপি ও ইসলামী পোষাকে জোনাথনকে একজন খাঁটি মুসলমান যুবক বলে তার মনে হল। তিনি যে একজন ইংরেজ খৃষ্টান যুবক ছিলেন, এখন তাকে দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না। [৩১শে আগস্ট ১৯৯৭ তারিখে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত “দি মেইল” থেকে।]
মুকুল দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, পেপারে দেখা যায়, দেশ বিদেশের অনেকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। জোনাথনও করেছেন; কিন্তু তার সঙ্গে আপনাদের এই পরিবর্তনের কী সম্পর্ক, তা তো বুঝতে পারছি না।
মোরশেদ বলল, তাই যদি দেখে থাক, তা হলে তারা স্বধর্ম ত্যাগ করে কেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে ভেবে দেখেছ কখনও?
এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি ভাবতে যাব কেন?
তা ঠিক; তবে তুমিওতো ইসলাম ধর্মাবলম্বী, ইসলাম সম্বন্ধে কতটুকু জান বলতে পার?
আমি ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশোনা করিনি।
তা হলে ধর্ম সম্বন্ধে কেউ কিছু বললে বা পালন করলে তাদেরকে মৌলবাদী বল কেন?
এই কথার উত্তর দিতে না পেরে মুকুল চুপ করে রইল।
মোরশেদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, মুকুল তো কিছু বলতে পারছে না, আপনি পারলে বলুন।
মুক্তাও কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
মোরশেদ মৃদু হেসে বলল, তোমরা যখন পারলে না তখন আমিই বলি?
মুক্তা বলল, বলুন।
আমরা অনেকে ছোটবেলায় আম্মা-আব্বা, দাদা-দাদির কাছে অথবা মক্তবে ক্কুরআন ও নামায পড়তে শিখি। বাড়ির সবাইয়ের দেখাদেখি রোযাও রেখেছি। বড় হয়ে ধর্মের অন্যান্য বিষয় না জানলেও স্কুল-জীবনে সেসব কিছুটা মেনেও চলেছি। তারপর কলেজ ও ভার্সিটিতে ঢুকে অথবা কর্মময় জীবনে পরিবেশের কারণে ধর্ম থেকে ক্রমশঃ দুরে সরে গেছি। কারণ সেখানে পাশ্চাত্যের ভাবধারা ছড়িয়ে পড়েছে। ধর্ম সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান অর্জন না করার ফলে পাশ্চাত্যের সবকিছু ভালো মনে করে আমরা গা ভাসিয়ে দিয়েছি। তাই ধার্মিক লোকেরা যখন সে সবের প্রতিবাদ করে ইসলামের সবকিছু মেনে চলতে বলেন তখন তাদেরকে আমরা মৌলবাদী বলে গালাগালি করি।
মুক্তা বলল, একটা প্রশ্ন আমার মনে প্রায় জাগে, পৃথিবীতে তো অনেক ধর্ম রয়েছে, তার মধ্যে কোনটা সত্য? যদি ইসলাম ধর্ম সত্য হয়, তা হলে অন্যান্য ধর্মগুলো কি অসত্য? তাও বা কি করে হয়? অন্যান্য ধর্মও তো কোনো না কোনো পয়গম্বর প্রচার করেছেন?
মোরশেদ বলল, হ্যাঁ, অন্যান্য ধর্মও কোনো না কোনো পয়গম্বর প্রচার করেছেন এবং তাদের সবার ধগ্রস্থ না থাকলেও অল্প কিছু সংখ্যকের আছে। তবে সেসব যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এক শ্রেণীর মানুষ নিজেদের সার্থের জন্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন।
মুকুল বলল, তাই যদি হয়, ক্কুরআন তো দেড় হাজার বছরের পূরান, তাতেও নিশ্চয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে?
মোরশেদ বলল, সারা পৃথিবীতে যত ধর্মগ্রন্থ আছে, তার মধ্যে একমাত্র ক্কুরআনেরই কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয়নি।
মুক্তা বলল, হয়নি যে তার নিশ্চয়তা কি?
মোরশেদ বলল, নিশ্চয়তা ক্কুরআন নিজেই।
মুকুল ও মুক্তা একসঙ্গে বলে উঠল, বুঝলাম না।
মোরশেদ বলল, ক্কুরআন যে অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে তার প্রমাণ ক্কুরআনেই ভুরি ভুরি রয়েছে। যেমন ক্কুরআনে আছে, আল্লাহ বলিয়াছেন, আমিই ক্কুরআন নাযিল করিয়াছি, আমিই ইহার রক্ষক।” [সূরা হিজর, ৯নং-আয়াত, পারা-১৪] ক্কুরআনে আরো আছে, আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (দঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলিয়াছেন, “আপনি বলিয়া দিন, যদি মানুষ ও জ্বিন সকলে এই উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয় যে, এইরূপ ক্কুরআন রচনা করিয়া আনিবে, তথাপিও উহার অনুরূপ আনয়ন করিতে পারিবে না, যদিও তাহারা একে অন্যের সাহায্যকারী হয়।” [সূরা-বনি ইসরাইল, আয়াত নং-৮৮, পারা-১৫]
.
বর্তমানে জ্ঞান বিজ্ঞানের অভিনব আবিস্কার কম্পিউটার। এই কম্পিউটার প্রমাণ করেছে, “ক্কুরআন আল্লাহর বাণী এবং এর এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। তাছাড়া সারা পৃথিবীতে লক্ষ কোটি ক্কুরআনের হাফেজ রয়েছেন। কেউ যদি এতটুকু পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করার চেষ্টা করেন, তা হলে ধরা পড়ে যাবেন। এরকম বহু প্রমাণ রয়েছে, যা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে।
এবার বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে বলছি। মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) থেকে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর আগে পর্যন্ত যত নবী ও পয়গম্বর আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, তাঁরাও ইসলামের সারমর্ম তওহীদের বাণী প্রচার করেছেন। আল্লাহ তাদেরকে পাঠিয়েছেলিন কোনো দেশ বা জাতির জন্য। আর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)কে পাঠিয়েছেন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য। তাই তার ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে পৃথিবীর সব ধর্ম বাতিল বলে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন। ক্কুরআনে আল্লাহ বলিয়াছেন, আর যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম অন্বেষণ করবে, তবে উহা তাহা হইতে গৃহিত হইবে না। আর সে ক্ষগ্রিস্থদের অন্তর্ভূক্ত হইবে।”
ক্কুরআনে অন্যত্র আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (দঃ) সম্পর্কে বর্ণনা করিয়াছেন, “আর আমি আপনাকে সমগ্র মানব সমাজের জন্য পয়গম্বর করিয়া পাঠাইয়াছি, শুভ সংবাদ প্রদানকারী এবং ভয় প্রদর্শনকারী রূপে; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বুঝে না!” [সূরা-আল ইমরান, আয়াত নং-৮৫, পারা-৮]
আসলে কী জান, মুসলমানরা নিজেদের ধর্ম সম্বন্ধে এক রকম কিছুই। জানে না। তাই দুনিয়ার চাকচিক্যে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। দুনিয়ার আয়েশ আরাম ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছে। আর সেই সুযোগ গ্রহণ করেছে। ইসলামের চির দূষমন ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও পৌত্তলিকরা। তারা মুসলীম কাষ্ট্ৰীগুলোতে পরিকল্পিতভাবে আয়েশ-আরাম ও ভোগবিলাসের উপকরণ সাপ্লাই করে ও একদেশকে অন্য দেশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে এবং তাদেরকেই আবার সাহায্য দিয়ে বুকের উপর পাথরের মতো চেপে বসছে। আল্লাহর কি অপার মহিমা, যারা দুনিয়া থেকে ইসলামকে ডুবিয়ে দিতে চাচ্ছে, তাদের ছেলে মেয়েও তাদেরই জাতের বড় বড় মনীষীরা ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করছেন। আর মুসলমানরা সেই দুষমনদের অনুসরণ ও অনুকরণ করে ইসলামকে মৌলবাদী বলছে। আবার তাদেরই দ্বারা পদদলিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। তবু মুসলমানদের বিবেকের চোখ খুলছে না। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল, কেউ যখন ঈমানী দায়িত্ব পালন করার জন্য তাদেরকে আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) এর বাণী শুনিয়ে খৃষ্টান, ইয়াহুদী ও পৌত্তলিকদের অনুকরণ ও অনুসরণের পথ থেকে ফিরে আসার কথা বলেন তখন তাকে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক বলে গালি দেয়। এমন কি ইসলামকে ঘৃণাও করে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জ্ঞানী-গুণী মনীষীরা ক্কুরআন-হাদিস পড়ে ইসলামকে জানছে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। আর মুসলমানরা ক্কুরআন হাদিস না পড়ে ইসলামকে ঘৃণা করছে। অন্যকে আর দোষ দেব কি? আমরাও ঐ দোষে দোষী ছিলাম। আল্লাহপাক মেহেরবাণী করে জোনাথনকে উপলক্ষ করে আমাদেরকে হেদায়েৎ দিয়েছেন। সেজন্য তাঁর পাক দরবারে জানাই লাখো কোটি শুকরিয়া।
জোনাথনের ব্যাপারটা আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলেছিল। এরমধ্যে একদিন খাদিজার বই কিনতে কর্ণফুলি মার্কেটে ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরীতে যাই। বই কেনার সময় বুক সেল্ফে Why we Embrace Islam? বইটা দেখে কেনার তাগিদ অনুভব করলাম। খাদিজার বইয়ের সঙ্গে বইটি কিনে ফেললাম। দু’খণ্ডে বইটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উচ্চশিক্ষিত ও প্রভাবশালী দুইশ জন মনীষী কেন ইসলাম গ্রহণ করেছেন তার বিবরণ রয়েছে। ঐ দিনই বইটি। পড়ার পর তোমার আপাকেও পড়তে বললাম। তারপর থেকে আমরা যে। ইসলামী জিন্দেগীতে চলার চেষ্টা করছি, তা তো একটু আগে বললাম। যে কয়েকদিন আছ, তোমরাও সেসব পড়তে পার। পড়লেই ইসলাম সম্পর্কে তোমাদেরও ভুল ধারণা দূর হয়ে যাবে। আল্লাহর মর্জি হলে হেদায়েৎ নসীব হয়েও যেতে পারে। তখন আর ইসলাম পন্থীদের মৌলবাদী বলে মনে হবে না।
এমন সময় আসরের আজান শুনে মোরশেদ স্ত্রীকে বলল, তুমি নামায পড়ে চা-পানির ব্যবস্থা কর, আমি মসজিদে যাচ্ছি। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল।
জাহেদা মুকুলকে বলল, তোরা গল্প কর। তারপর ছেলে মেয়েদেরকে বলল, তোমরাও এস নামায পড়বে।
তারা চলে যাওয়ার পর মুকুল মুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, যদি জানতাম, আপা ও দুলাভাই মোল্লা হয়ে গেছে, তা হলে এখানে না উঠে হোটেলে উঠতাম। বেড়ানোর পর ঢাকা ফেরার সময় এখানে আসতাম।
মুক্তা হেসে ফেলে বলল, কেন? মোল্লা হয়েছে তো কি হয়েছে? আমাদের তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
আমার কথা বাদ দাও, তোমার তো হচ্ছে। এই যে আসতে না আসতেই তোমাকে মোল্লাদের মেয়েদের মতো গায়ে মাথায় ওড়না দিতে হচ্ছে, এটা বুঝি কিছু নয়?
মুক্তা আবার হেসে ফেলে বলল, আপা ভিতরে নিয়ে গিয়ে যখন এভাবে ওড়না দেওয়ার কথা বললেন তখন খুব খারাপ লাগলেও এখন ভালই লাগছে।
তাই না কী?
হ্যাঁ তাই।
কারণটা শুনি।
দুলাভাইয়ের মতো ধার্মিক লোকের কাছে গায়ে মাথায় ওড়না না দেওয়াটাই অশোভন হত বলে মনে হচ্ছে। আর কি ইচ্ছা হচ্ছে শুনবে?
বল?
জোনাথনের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা জেনে, দুলাভাইয়ের পরিবর্তন দেখে ও তার কথাশুনে আমারও ইসলামকে জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে।
আরে, আমারও তো তাই হচ্ছে।
তাহলে হোটেলে উঠার কথা বললে কেন?
তোমার অসুবিধার কথা ভেবে বলেছি।
আমার মনে হয় দুলাভাইয়ের কথা ঠিক। আমাদের প্রত্যেকের উচিত, ক্কুরআন-হাদিসে কি আছে জানা। জানলে নিশ্চয় আমরা ইসলামের বিধি নিষেধকে খারাপ দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখতাম না এবং মোল্লা-মৌলবীদেরকে গোড়া বা মৌলবাদী বলে সমালোচনা ও করতামনা।
মুকুল বেশ অবাক হয়ে বলল, তুমি যে দেখছি এখন থেকেই ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছ?
ঝুঁকে পড়া বলতে কী বলতে চাচ্ছ জানি না। তবে আমার যা মনে হয়েছে তাই বললাম।
মুক্তার কথা শুনে মুকুল খুশী হয়ে বলল, তোমার মতো আমারও তাই। মনে হয়েছে। এখন ওসব কথা রেখে ভিতরে গিয়ে তৈরি হয়ে এস, চা খেয়ে তোমাকে ফয়েজ লেক দেখাতে নিয়ে যাব।
ফয়েজ লেকের কথা অনেক শুনেছি। ওখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য নাকি খুব সুন্দর?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। তাইতো নিয়ে যেতে চাচ্ছি।
.
ফয়েজ লেক থেকে ফিরে সন্ধ্যার পর এক ফাঁকে মুকুল আপাকে বলেছিল, দুলাভাই ও তোমার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলাপ করতে চাই। তাই রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর মুকুল ও মোরশেদ যখন গল্প করছিল তখন জাহেদা মুক্তার শোবার ব্যবস্থা করে তাদের কাছে এসে বসল। কিছুক্ষণ তাদের গল্প শোনার পর জাহেদা মুকুলকে বলল, তখন কী যেন আলাপ করবি বলেছিলি?
মুকুল বলল, মা-বাবা তোমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। আমি বলে এসেছি, কয়েকদিন কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবন বেড়িয়ে তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ফিরব। বেড়াবার কথা শুনে মুক্তা সঙ্গে এসেছে। তারপর মুক্তার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলে বলল, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই; কিন্তু মা ওকে পছন্দ করে না। তারপর খালা-খালুর প্রস্তাব ও মায়ের মতামত জানিয়ে বলল, তুমি ও দুলাভাই মাকে রাজি করাবে।
জাহেদা বলল, কিন্তু আম্মা, খালাআম্মা ও খালুজান তো মনে ভীষণ ব্যথা পাবেন। তারপর জিজ্ঞেস করল, রীমার মতামত জানিস?
রীমা মুক্তার অনেক দিনের বন্ধু। সে আমাদের সম্পর্কের কথা জানে। তবু খালা-খালুর প্রস্তাব দেওয়ার পর রীমাকে বলেছি, তোকে আমি নিজের বোনের মতো মনে করি, কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না। মা-বাবাকেও তাই বলেছি। রেজাল্ট বেরোবার পর আমি আমেরিকায় পড়াশোনা করতে চলে যাব। তার আগে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাই।
আব্বার মতামত তো বললি না।
বাবা আমার ফরে।
জাহেদা কিছুক্ষণ চিন্তা করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বল?
মোরশেদ বলল, মায়ের মনে কষ্ট দেওয়া কবিরা গুনাহ। তবে এতটুকু বলতে পারি, আমরা আম্মাকে বোঝাবার চেষ্টা করব। বাকি আল্লাহর মর্জি।
জাহেদা বলল, মুকুল তো বলল, আম্মা মুক্তাকে পছন্দ করে না। রীমার সঙ্গে বিয়ে না হলেও মুক্তাকে বউ করতে কি রাজি হবে?
মোরশেদ কিছু বলার আগে মুকুল বলল, তোমরা রাজি করাবে।
জাহেদা বলল, তোর দুলাভাই তো বলল, চেষ্টা করবে।
তোমাদেরকে একটা কথা বলা হয়নি। আমরা একে অপরকে অনেক দিন থেকে ভালবাসি এবং বিয়ের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতীবদ্ধ।
ঠিক আছে, আমরা তো যাচ্ছি। দেখি কতটা কি করতে পারি।
স্ত্রী থেমে যেতে মোরশেদ মুকুলকে বলল, মুক্তার বায়োডাটা বল। বায়োডাটা জানা থাকলে আম্মার সঙ্গে আলাপ করতে সুবিধা হবে।
মুকুল মুক্তার বায়োডাটা বলল।
মোরশেদ মৃদু হেসে বলল, এ যে দেখছি, রাজকন্যার সাথে রাজ্যও পেয়ে যাবে।
মুকুল বলল, রাজ্য পাওয়ার লোভে ওকে ভালবাসিনি।
জাহেদা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, আব্বারও কি কম আছে? ও কেন রাজ্যের লোভ করতে যাবে?
আমিতো লোভের কথা বলিনি। যা বাস্তব তাই বলেছি। তারপর মুকুলকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কবে বেড়াতে যেতে চাও?
পরশু, আপনার গাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
তোমার ড্রাইভিং লাইসেন্স এনেছ?
হ্যাঁ এনেছি।
তা হলে নিতে পার। তবে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে কয়েকটা কথা বলব। যা বলব, তা শুনে হয়তো তোমরা অসন্তষ্ট হবে। তবু দ্বীনি কর্তব্যের খাতিরে বলতে হবে।
বেশতো বলুন।
মোরশেদ স্ত্রীকে বলল, মুক্তাকে ডেকে নিয়ে এস। কথাগুলো তারও শোনা উচিত।
জাহেদা মুক্তাকে ডেকে নিয়ে এসে দু’জনে পাশাপাশি বসল।
মোরশেদ মুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, মুকুল আপনাদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছে। আরো জানিয়েছে, আপনারা বিয়ে করবেন বলে প্রতিশ্রুতীবদ্ধ। মুকল যে সত্য বলেছে তা জানি। তবু আপনার কাছে জানতে চাই।
মুক্তা লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলল, জ্বি সত্য।
মোরশেদ মুকুলের দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়ের আগে তোমরা যেভাবে বেড়াতে এসেছ, তা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ। জেনে শুনে আমি তা করতে দিতে পারি না। তোমরা হয়তো আমাকে গোঁড়া বা মৌলবাদী ভাবতে পার। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ইসলামের রীতি বিরুদ্ধ কাউকে কোনো কাজ করতে দেখলে সাধ্যমত বাধা দেওয়া প্রত্যেক ঈমানদারের অবশ্য কর্তব্য। তাই বললাম, মানা না মানা তোমাদের ইচ্ছা।
মোরশেদের কথা শুনে মুকুল খুব রেগে গেলেও কিছু বলল না। আর মুক্তা রাগল না বটে, তবে অসন্তুষ্ট হল। তাই সেও চুপ করে রইল।
মোরশেদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, আমার কথা শুনে তোমরা যে অসন্তুষ্ট হয়েছ, তা বুঝতে পারছি। এখন এর সমাধানের একটামাত্র পথ আছে, যদি তোমরা রাজি থাক।
সমাধানের কথা শুনে মুকুলের রাগ পড়ে গেল। বলল, সমাধানের পথটা বলুন, তারপর রাজি হই বা না হই পরের কথা।
তোমরা যখন বিয়ের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতীবদ্ধ এবং আমেরিকা যাওয়ার আগেই কাজটা সারতে চাও তখন কালকেই বিয়ে করে ফেল।
কেউ কিছু বলার আগে জাহেদা বলল, এ তুমি কী বলছ? আম্মা যদি মুক্তাকে মেনে না নেয় তখন কি হবে?
একমাত্র ছেলে যত বড়ই অন্যায় করুক না কেন, ক্ষমা না করে পারবেন না। তা ছাড়া আব্বা যখন মুকুলের ফরে তখন এক সময় না এক সময় মেনে নেবেন। তবে তা সময়ের ব্যাপার হতে পারে। আমার মনে হয়, আম্মা যতই রেগে যান না কেন, অথবা মনে কষ্ট পান না কেন, দুদিন আগে আর দুদিন পরে তোক মুক্তাকে মেনে নেবেন। তারপর ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, এখন তোমরা বিয়ে করতে রাজি আছ কিনা বল।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে মুকুল বলল, আমি রাজি।
মোরশেদ মুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি?
বিয়ের কথা শুনে মুক্তার হার্টবিট বেড়ে গেছে। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেমে সামলে নিয়ে মুখ নিচু করে বলল আমিও রাজি।
আলহামদুলিল্লাহ বলে মোরশেদ বলল, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তারপর ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, কাল বিয়ে হলে পরশু তোমাদের বেড়াতে যাওয়া চলবে না। বিয়ের তিন দিন পর না হয় একেবারে মধুচন্দ্রিমা করতে যাবে।
তাদের ছোট মেয়ে আয়শা ফোরে পড়ে। সে বলে উঠল, কাল মামা মামির বিয়ে, কি মজা? তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মধুচন্দ্রিমা কি আম্মু? আমিও মামা-মামীর সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা করতে যাব।
আয়শা তিন বছরের ছোট আব্দুল্লাহ ওয়ানে পড়ে। আয়শার কথা শুনে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমিও মধুচন্দ্রিমা করতে যাব।
ভাই-বোনের কথা শুনে সবাই হেসে উঠল।
আব্দুল্লাহ আবার বলল, আমাকে মামা-মামীর সাথে মধুচন্দ্রিমা করতে। যেতে দেবে কিনা বল না আম্মু?
জাহেদা ছেলেকে আদর করে বলল, মধুচন্দ্রিমায় কাউকে সাথে নিতে নেই। তোমার মামা-মামী মধুচন্দ্রিমা করে ফিরে এলে আমরা সবাই ঢাকায় তোমাদের নানু বাড়ি বেড়াতে যাব কেমন?
আব্দুল্লাহ নানুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে খুশী হল। বলল, কি মজা, কি মজা, নানুর বাড়ি বেড়াতে যাব। তারপর আয়শার কাছে এসে তার একটা হাত ধরে বলল, ছোট আপু, শুনলে তো আম্মুর কথা? তোমারও মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া হবে না। চল আমরা খেলতে যাই।
আয়শা গালভার করে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এখন আমার খেলতে ভালো লাগছে না। তুই যা বলে সেখান থেকে চলে গেল।
.
পরের দিন বাসর রাতে স্বামীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ অবস্থায় মুক্তা আদুরে গলায় বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তাই তোমার আমেরিকা যাওয়া চলবে না।
মুকুল বলল, এখন আমারও মনে হচ্ছে, তোমাকে ছেড়ে আমিও থাকতে পারব না। কিন্তু পড়াশোনা করার জন্য যাওয়া উচিত কিনা তুমিই বল?
মুক্তা বলল, পড়াশোনা যথেষ্ট করেছ। আর না করলেও চলবে। মানুষ বিদেশে যায় উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বেশি উপার্জন করার জন্য। কিন্তু তোমাদের ও আমাদের যা আছে, তা কম নয়। দেখ, তুমি যেমন মা-বাবার এক ছেলে, আমিও তেমনি মা-বাবার এক মেয়ে। তুমি আমেরিকা চলে গেলে বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা কে করবে? আমাকে বিয়ে করেছ জেনে তোমার মা খুব দুঃখ পাবেন। তিনি তোমাকে বিদেশে পাঠাতে চান না। তবুও যদি যাও, তিনি আরো বেশি দুঃখ পাবেন।
মুকুল তার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, তোমার কথা অবশ্য ঠিক; কিন্তু আমার ইচ্ছা……..।
মুক্তা তাকে বুকের সঙ্গে আরো জোরে চেপে ধরে বলল, তোমার কোনো কিন্তু শুনব না। আমার সাফ কথা। আমি কিছুতেই তোমাকে যেতে নাহি দেব।
তা হলে আমিও তোমাকে আজ ছেড়ে নাহি দেব বলে মুকুল আনন্দ সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
Leave a Reply