যুধাজিৎ – অভিষেক চট্টোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০২১
প্রচ্ছদ – কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল
ইতিহাসের অনাখ্যায়িত, হারিয়ে যাওয়া সকল নরনারীকে—
.
প্রাক কথন
বাহরাইচ, পৌরাণিক জনপদ, অষ্টবক্র মুনি থেকে শুরু করে, শাক্য সিংহ বুদ্ধদেবের পবিত্র তীর্থভূমি রূপে পরিচিত এক ঐতিহাসিক জনপদ৷ ভারত নেপাল সীমান্তে এক ছোটো জনপদ যেখানে হিংসার প্রতীক কুখ্যাত ডাকু অঙ্গুরিমালকে অহিংসার মন্ত্রে দীক্ষিত করেন তথাগত, সেই বাহরাইচ৷ আর, সহস্রাধিক বৎসরের বেশি সময় ধরে ঐতিহ্য মন্ডিত শ্রাবস্তী পৌরাণিক জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠে রাজা শ্রাবস্তের সময়৷ কোশল জনপদের তৎকালীন রাজধানী হিসেবে গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত শ্রাবস্তী৷ সেই শ্রাবস্তী যেখানে ধনী ব্যবসায়ী সুদত্তর আমন্ত্রণে প্রায় দুই সহস্রাধিক বৎসর পূর্বে উপস্থিত হয়েছিলেন তথাগত এবং সুদত্তর ক্রীত ভূখণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় বিহার, যা আজও দেশ ও বিদেশের বহু বৌদ্ধ মতাবলম্বীর তীর্থ, এই কাহিনির সূত্রপাত সেখানেই৷ না, আজ তথাগত বা কোনো পৌরাণিক কাহিনি নয়, বরং ভুলে যাওয়া এক রাজনের কাহিনি শোনা যাক৷ ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক ভুলে যাওয়া অধ্যায় যা হয়তো বৈদেশিক হানাদারদের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করেছিল বহু বছর, ইতিহাসকে বইয়ে দিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য খাতে তারই একটু তুলে আনার কিঞ্চিৎ প্রচেষ্টা৷ ভারতের ইতিহাসের এমনি বহু না জানা অধ্যায়, যা আমরা গৌরবের সাথে স্মরণ করতে পারতাম কিন্তু কালের অতলে চলে গিয়েছে শুধুমাত্র সঠিক চর্চা অভাবে, জানি না আজ ক-জন নাম জানেন কিন্তু আজ এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তাকে স্মরণ করার…
মহারাজ সুহেলদেব৷ হয়তো ইতিহাসের পাতায় সঠিক বর্ণনারও অভাব কিংবা তথ্যের অপ্রামাণ্যতা আজ রাজার অস্তিত্ব বা তার বীরগাথাকে সঠিক বর্ণনার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধক, তাই কোনো বাদ বিবাদের অবকাশ না রেখে প্রথমেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, যে এটিকে ইতিহাস মনে না করে ইতিহাস-আশ্রিত রচনা হিসেবে পাঠ করুন৷ কারণ, পারিপার্শ্বিক কিছু প্রমাণ থাকলেও কিছু অপ্রমাণিত তথ্যও সন্নিবেশিত হয়েছে, যার উৎস মূলত স্থানীয় মানুষজনের বিশ্বাস৷ সেটিকে ইতিহাস রূপে কতটা স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়… সুতরাং কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে এটিকে পাঠ করাই যুক্তি যুক্ত৷ রচনাকারের এ-বিষয়ে সত্যিই কোনো দায় নেই৷ তবে এ কাহিনি শুধুমাত্র সুহেলদেব বা তাঁর বীরত্বের কাহিনি নয়, সেই সময়ের, যখন হয়তো ভারতবর্ষ সেই হিসেবে ঐক্যবদ্ধ নয়, সেই সময়ের এক দলিল, যেখানে একাধিক রাজনের সম্মিলিত লড়াই প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল বৈদেশিক হানাদারদের৷ ঐতিহাসিক এই পটভূমিকায় কাহিনির চরিত্ররা চলাফেরা করেছে৷ ঐতিহাসিক পটভূমি জানা থাকলে হয়তো পাঠকগণের কিঞ্চিৎ সুবিধা হতে পারে তাই এই অংশের অবতারণা৷
বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সময় আব্দুর রহমান চিস্তী রচিত গ্রন্থ মিরাত-ই-মসুদিতে সর্বপ্রথম শ্রাবস্তীর রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র সুহেলদেবের নাম পাওয়া যায় আর পাওয়া যায় সুলতান মামুদ গাজনাভির নিকট আত্মীয় সৈয়দ সালার মাসুদ বা গাজী মিয়ান৷ চিস্তী এই গ্রন্থটি রচনা করেন৷ ত্বারিখ-ই-মাসুদী অবলম্বনে যা রচনা করেন মোল্লা মুহাম্মদ গাজনাভি৷ তাদের কেন্দ্র করেই রচনা৷ আরো কিছু চরিত্র কাহিনির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়েছে যাঁদের ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজতে যাওয়া অনর্থক হলেও একেবারে আকাশ থেকে পড়া নয়৷ বিখ্যাত ঐতিহাসিক কানিংহামের লেখায় সুহেলদেবের নাম ও তাঁর পূর্বসূরিদের সম্পর্কে জানা যায়, যদিও সেখানে সুহেলদেবের নাম সুহৃয়াল ধ্বজ উল্লিখিত৷ সুতরাং কতটা ইতিহাস আর কতটা কল্পনা তা বুঝে নেওয়া নিতান্তই পাঠকের ব্যক্তিগত রুচি৷
.
তমসাঘন রাত্রি৷ সারাদিনের কর্মনিবৃত্তির পর সূর্যদেব বিদায় নিয়েছেন কিছু পূর্বেই, হয়তো-বা সারাদিনের নিরলস পরিশ্রমের পর ঘরের পথে ফিরে গিয়েছেন সমস্ত মানুষ৷ এই গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলের সমস্ত গৃহে জ্বলে উঠেছে সন্ধ্যাপ্রদীপ৷ কোথাও পর্ণকুটিরের ধারে নিশ্চিন্ত গো-শালায় কর্মময় দিনযাপন উত্তর সামান্য ঝিমুনি আর সন্তানস্নেহে ব্যাপৃত গো-অশ্বেরদল৷ দূর থেকে একটি ছায়ামূর্তি ক্রমশ প্রকটমান৷ দিগন্তবিস্তৃত অমানিশার কারণে সঠিক প্রতীয়মান না হলেও ক্রমশ সুস্পষ্টতর হচ্ছে অশ্বক্ষুরের শব্দ৷ খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় কোনো এক অশ্বারোহী অতি দ্রুত এগিয়ে আসছেন৷ অশ্বের ক্ষুরের শব্দ থেকে কিঞ্চিৎ নিবৃত্তি ঘটিয়ে অশ্বারোহীর দিকে মনোনিবেশ করলে দেখা গেল তার দৃঢ় শারীরিক গঠন, পরনে ধুতি জাতীয় বস্ত্রখণ্ড এবং ঊর্ধ্বাশে আংরাখা৷ কটিদেশে বৃহৎ অসি কোমরবন্ধের মধ্যে থেকে ভূমি স্পর্শ করতে যেন সদা উদ্যত৷ কিন্তু অশ্বের রূপটি দেখে অবশ্য কিছুটা কৌতুক সৃষ্টি হওয়া আশ্চর্যকর নয়৷ অশ্বের আকৃতি অবশ্যই স্বাভাবিক আকৃতি অপেক্ষা কিছুটা খর্বাকৃতি৷ সর্বোপরি তার গতিময়তার ঘাটতি নিঃসন্দেহে তার বংশপরিচয়ে অকৌলীন্যের পরিচায়ক৷
অশ্বারোহী ক্রমে প্রতীয়মান হলেন৷ এ-স্থলে অশ্বারোহীর পরিচয় পর্বটি সেরে ফেলা যাক৷ অশ্বারোহী যুবক, বয়স অনুমান বিংশতিবর্ষীয়, চওড়া কাঁধ এবং উন্নত বক্ষ, উচ্চতা মাঝারি কিন্তু শারীরিক গঠন নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে তিনি সুযোদ্ধা৷
যোদ্ধা আগন্তুকের নাম স্বয়ম্ভূ, অসিযুদ্ধে নিপুণ তার থেকেও বেশি তীব্র জয়লিপ্সা৷ বান্ধব স্থানীয়দের মতে অসিযুদ্ধে তার প্রতিদ্বন্দ্বী পুরো গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে বিরল৷ স্বয়ং দেবসেনাপতি কার্তিকেয় যদি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তাহলে তাঁকেও হয়তো অসতর্ক মুহূর্তের সুযোগ গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হবে, নচেৎ…৷ স্বয়ম্ভূ শ্রাবস্তী অঞ্চলের এক গোষ্ঠীপতির সেনাবাহিনীতে কর্মরত৷ নিজস্ব সামরিক প্রতিভা তাকে অল্প কয়েক বৎসরেই রাজনের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে এনে ফেলেছে৷ আর সেই বিশ্বাসের রক্ষা করার জন্য সে সদা নিবেদিত৷ স্বয়ম্ভূ তাঁর নামের মতোই স্বয়ং যেন উদ্ভূত৷ বংশপরিচয়ের কৌলিন্য বা অকৌলিন্য সবই তাঁর কাছে নিতান্তই অজ্ঞাত৷ সে গোষ্ঠীপতি কংসের এক সাধারণ সেনানীর দ্বারা প্রতিপালিত, শোনা যায় কোনো এক বর্ষামুখর রাত্রে আপন গৃহে ফেরার সময় সদ্যজাত শিশুর অস্তিত্ব জানানের শব্দ পেয়ে, সেই সেনানী শব্দ-উৎস অনুসরণে স্বয়ম্ভূকে লাভ করে৷ বাস্তবিক লাভ করে বলাই যুক্তিযুক্ত, কারণ দীর্ঘদিন সন্তানহীনতার কারণে সমাজের বঙ্কিম নয়নবাণ বক্ষে গ্রহণ করার পর এই শিশু যেন মাতৃত্বের ফল্গুধারা বইয়ে দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাঁর স্ত্রীকে৷ নাম অবশ্য দিয়েছিলেন নিকটবর্তী সূর্য মন্দিরের প্রধান পুরোহিত৷ তবে নামকরণ যে তাঁর নবজন্মের দ্যোতক হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে বলাই যায়৷ পিতার ন্যায় সেও গোষ্ঠীপতি কংসের অধীনে কর্মরত৷ সাম্প্রতিক যুদ্ধে বিশেষ পরাক্রম প্রদর্শন করে সে রাজনের বিশ্বাসভাজন আর তা ছাড়া সে অকুতোভয়, ফলে দুঃসাহসিক ও গোপন কর্মে সেই প্রথম পছন্দ৷
কিন্তু স্বয়ম্ভূ বিশেষ চিন্তান্বিত, তার থেকেও বেশি তার উদ্বিগ্নতা, যে বিশেষ কাজে সে প্রেরিত তা সমাধা করার জন্য৷ ত্রিকালেশ্বর মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের কাছে কাল প্রথম প্রভাতে তাকে পৌঁছে দিতে হবে সেই বিশেষ সংবাদ যা পারাবতের ন্যায় পৌঁছে দিয়ে জবাব পৌঁছে দেওয়ার উত্তর দায়িত্ব তার উপরেই বর্তেছেন গোষ্ঠীপতি রাজন কংস৷ আংরাখার ভিতরে একবার হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হন স্বয়ম্ভূ, না নির্দিষ্ট স্থানেই আছে… স্থানচ্যুতির কোনো সম্ভাবনাই নেই, নিজের প্রাণের থেকেও নিরাপদে রাখা আছে রাজনের বার্তাটি৷ কিন্তু এ-মুহূর্তে ক্ষুধায় তার শরীর রীতিমতো অবসন্ন৷ মনে পড়ে গেল স্বয়ম্ভূর এতটা পথে দুটো কদলী ভিন্ন আর কিছুই যায়নি উদরে৷ সুতরাং এই মুহূর্তে প্রয়োজন কিছু পানাহারের আর তার জন্য দরকার কোনো পান্থশালা৷
দূরে দেখতে পাওয়া আলোক নিশান ধরে অগ্রবর্তী হয়ে স্বয়ম্ভূ
দেখল, না কোনো পান্থশালা নয়, তবে একটি আসবগৃহ, ভিতরে রীতিমতো কোলাহল চলছে কোনো বিষয় নিয়ে৷ আজ বোধ হয় ভাগ্যে এই আছে— খানিকটা স্বগতোক্তির সুরেই ভাগ্যকে দোষারোপ করে প্রবেশ করতে উদ্যত হল স্বয়ম্ভূ৷ অশ্বের বন্ধন
আলগা করে কিছুটা জলের ব্যবস্থা করে, ভিতরে প্রবেশ করল স্বয়ম্ভূ৷ কলকল্লোলতা থেকে খানিকটা তফাতে অন্যদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে খানিকটা আম্ররস হাতে নিয়ে আলোচনায় কান পাতার চেষ্টা করল সে৷ সে মদ্যপান করেনা তা নয়, কিন্তু আজ কোনো ঝুঁকি নিতে সে রাজি নয়, তাকে আবার পথে বেরোতে হবে, সুতরাং নিজেকে বিরত রাখাই যুক্তিযুক্ত৷ তা ছাড়া দীর্ঘ পথ অতিক্রমজনিত শ্রম তার ক্ষুধা ভিন্ন অন্য কোনো বস্তুর প্রতি আকর্ষণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত করেছিল৷ আলোচনার দিকে খানিক মনোযোগ প্রদান করেই স্বয়ম্ভূ বুঝতে পারল প্রবল তর্কের মূল বিষয় হল সাম্প্রতিক শ্রাবস্তী পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যবন সেনার আক্রমণ৷ একদলের মতে সেই আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব কারণ তারা ইতিমধ্যে সাতরিখ দখল করতে সক্ষম হয়েছে, আর অন্যদলের মতে শ্রাবস্তী রাজ থাকতে রাজ্যবাসী নিঃসন্দেহে নিরাপদ৷ কারণ গো এবং হিন্দুদের তিনিই আসল রক্ষাকর্তা৷ কিছুটা অন্যমনস্ক হল স্বয়ম্ভূ৷ সত্যিই বড়ো বিপদের বার্তা, কারণ যবন সৈন্যদল রীতিমতো আগ্রাসী, সে তথ্য তো ভ্রান্ত নয়, তাদের ঝটিকা আক্রমণের প্রমাণ সে নিজেও পেয়েছে৷ তাদের লক্ষ্য যে শুধু সম্পদ তা তো নয় বরং হিন্দু মন্দিরগুলিও তাদের নিশানার বাইরে নয়, সে প্রমাণ তো সোমনাথ মন্দির৷ এ-অবস্থায় কোথাও যবন আক্রমণ হলে তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করা শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষা, কারণ শ্রাবস্তী ও তৎসংলগ্ন বিস্তীর্ণ স্থানে অনেক ক্ষুদ্র রাজ্যের সমাহার এবং সেখানে প্রকৃত নেতৃত্বের বড়োই অভাব৷ কিছু একটা ব্যবস্থা না করলে নিশ্চিত বিপদ৷ এসব চিন্তা করতে করতে স্বয়ম্ভূ কিছুটা হৃতমনস্ক, অকস্মাৎ…
— মহাশয় কি এ-স্থানে নবাগত?
পিছু ডাকে হঠাৎ সম্বিত ফেরে স্বয়ম্ভূর৷ ব্যক্তিটি বোধ হয় অনেকক্ষণ ধরেই তাকে পর্যবেক্ষণ অন্তে প্রশ্নটি ছুঁড়েছে৷ দীর্ঘ, দোহারা চেহারা, বেশ ভূষার বাহুল্যের অভাব ঢাকা পরে গেছে তীক্ষ্ণ, উজ্জ্বল দুটি চোখে, মাথায় উষ্ণীষ৷ চেহারার ঔজ্জল্য যেন প্রাণপনে ঢাকা রয়েছে অনাড়ম্বর বেশে কিন্তু কোথাও যেন সবকিছুর মধ্যে একটা সংহতির স্পষ্ট অভাব৷ নিজের অসাবধানতাকে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে মনের ভাব প্রশমিত করে উত্তর করল স্বয়ম্ভূ৷ এ-পথে সর্বদা তাঁর সতর্ক থাকার কথা, কেননা গূঢ়পুরুষের দল যে রাজ্যের সীমানায় অসংখ্য ছড়িয়ে রয়েছে, সে-তথ্য তাঁর অজানা নয়৷
— আজ্ঞে৷
— তা মহাশয় কী করা হয়?
— আজ্ঞে আমি সামান্য এক ব্যাপারী, ত্রিকালেশ্বর মন্দিরে যাচ্ছি, কাল প্রভাতে পুজো দেওয়ার অভিলাষে৷
— আমার অহেতুক কৌতূহল মার্জনা করবেন, কোনো বিশেষ কারণ?
— আজ্ঞে, কারণটি খুবই সুখকর, সম্প্রতি ত্রিকালেশ্বরের কৃপায় আমি একটি পুত্র সন্তান লাভ করেছি, তাই… পুজো দেওয়াই লক্ষ্য৷ স্বয়ম্ভূ উত্তর দিয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করল৷
— মহাশয় কি স্থানীয়? প্রশ্ন করল স্বয়ম্ভূ৷
— আজ্ঞে, আমি মহারাজ সুহেলদেবের সেনাবাহিনীর এক সামান্য বেতনভুক, ওঁনার কৃপায় সামান্য জমি লাভ করে নির্বাহ করি, কিন্তু আপনার সঙ্গের অস্ত্রটি…
— আজ্ঞে, পথে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টা বলতে পারেন… স্বয়ম্ভূ অপ্রতিভ ভাবে উত্তর করল৷ সে মিথ্যাবচনে বিশেষ পারদর্শী নয়, উত্তর প্রদান করে খানিকটা হাঁফ ছেড়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল৷
— আপনার নাম?
স্বয়ম্ভূর প্রশ্নে হেসে উঠল আগন্তুক৷ আমার নাম কী হবে মহাশয়? আমি সামান্য সৈনিক, এই আমার পরিচয়৷
স্বয়ম্ভূর হাতের পানীয় শেষ হয়ে গিয়েছিল, সে উঠে পড়ল৷ পানশালার কর্মচারীর হাতে একটি মসক মূল্য হিসেবে প্রদান করে গাত্রোত্থান করল৷
—তবে, বিদায়…
— বিদায়, সাবধানে গমন করুন, হয়তো আবার দেখা হবে, বন্ধু…
স্মিতহাস্যে বিদায় জ্ঞাপন করে বেড়িয়ে পড়ল সে৷
অশ্বপৃষ্ঠে গমন কালে সারাক্ষণ আগন্তুকের কথাই ভাবতে লাগল স্বয়ম্ভূ৷ বড়ো বিচিত্র ব্যক্তি, পোশাকের সাধারণতা ঠিক যেন খাপ
খায় না চোখের ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে, যেন ছাইচাপা আগুন৷ কোথাও যেন এক অদ্ভুত আত্মদীপ্তি যা মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে অপরকে৷ স্বয়ম্ভূর অভিজ্ঞতা বলে শত্রু হোক বা বন্ধু এনার সংসর্গ যে বেশ রঙিন হতে পারে তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ ফিরে আসার সময়ের কথাগুলো স্বয়ম্ভূর কানে যেন বেজেই চলল… দেখা হবে… বন্ধু না শত্রু তাই অবশ্য নিয়ামক… কোথায় কী ভাবে দেখা হবে! তবে স্বয়ম্ভূরও মনে নিশ্চিত প্রতীতি দেখা হবে নিশ্চয়ই৷
এবার তাড়ার কথা মনে পড়ল স্বয়ম্ভূর৷ আর বেশি সময় নেই, কাল প্রভাতে সূর্যোদয়ের পূর্বেই পৌঁছাতে হবে আর বার্তা পৌঁছে দিতে হবে, প্রধান পুরোহিতের কাছে, সুতরাং ছুটতে হবে৷ অশ্বের রাশিতে টান দিল স্বয়ম্ভূ৷ অন্ধকার বিদীর্ণ করে পথ চলতে শুরু করল সে৷
এ-অঞ্চলের পথ বেশ মনোরম৷ পার্শ্বস্থ তরুরাজি আর কল্লোলিনী নদী পার করে চলার পথ যদি দিবালোকে পার করতে হত তবে নিঃসন্দেহে প্রাকৃতিক শোভা স্বয়ম্ভূর পথ আটকে অবশ্যই তাকে দু-দণ্ড চোখের প্রশান্তি যোগাত৷ নিদেনপক্ষে শুক্লা অষ্টমীর রাত তাকে মোহাবিষ্ট করার জন্য দু-হাত প্রসারিত করে নিশ্চিত আহ্বান জানাত, কিন্তু গভীর নিকষ আঁধারে সে-উপায় সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ৷ তাতে লাভ অবশ্যই স্বয়ম্ভূর, লক্ষ্যের দিকে সে আরও একাগ্রভাবে এগিয়ে চলল৷ মাঝে মধ্যে দু-একটি শৃগালের বা বাদুড়ের ডানা ঝাপটানির শব্দ ছাড়া কিছুই তার মনোসংযোগ বিঘ্নিত করল না৷
মন্দিরের নিকটবর্তী হয়ে অশ্বটিকে রাখার ব্যবস্থা করে কাছাকাছি পৌঁছে সে অপেক্ষা করাই সঠিক বলে মনস্থ করল৷ রাত্রি প্রায় শেষ হতেই চলেছে, পূর্ব আকাশে আর কিছুক্ষণের মধ্যে লাল আভা দেখা যাবে, আর সেই মুহূর্তেই প্রধান পুরোহিত বেরোবেন তার নৈমিত্তিক স্নানাদি সম্পন্ন করতে৷ সুতরাং ততক্ষণ অপেক্ষা করাই শ্রেয়, শেষ রাত্রে ধর্মাচারী বৃদ্ধের নিদ্রা ভঙ্গ করা অনুচিতই হবে৷ কিন্তু ততক্ষণের জন্য নিতে হবে এক নিরাপদ আশ্রয়৷ কারণ এ-স্থলে ভয়ঙ্কর শ্বাপদ না থাকলেও, শৃগাল বা বুনো কুকুরের আক্রমণ অস্বাভাবিক নয়,আর আছে দস্যুর আক্রমণের ভয়৷ যদিও সে এসব থেকে ভীত নয় তবুও কোনো উটকো ঝামেলায় সে জড়াতে চায় না৷ সুতরাং সব দিক চিন্তা করে সে নিকটবর্তী একটি বৃক্ষের উপর উঠে বাকি রাতটুকু বিশ্রাম নেওয়াই স্থির করল৷ ত্রিকালেশ্বর মন্দির এই অঞ্চলের একটি বহু পুরাতন মন্দির,
আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পুণ্যার্থীদের পূজাভিলাষে নিত্য আগমন স্বাভাবিক ঘটনা৷ প্রভাতকালীন সময় পার হয়ে গেলেই পুণ্যার্থীদের ভিড়ে প্রধান পুরোহিতের সাক্ষাৎ পাওয়া কিংবা গোপনীয়তা রক্ষিত হওয়ার সম্ভবনা নগণ্যই বলা যায়, সুতরাং ওই উষাকালই প্রকৃত সময়৷ প্রধান পুরোহিত বৃদ্ধ ব্যক্তি, তাঁর বয়স সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা করা সম্ভব না হলেও আনুমানিক সত্তর বৎসর হবেই৷ এ-অঞ্চলে কেউই তার বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও মহারাজের রাজসভায় তার প্রতিপত্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য৷ মহারাজ সুহেলদেব তার পরামর্শ ব্যাতিত কোনো কর্ম সম্পাদন করেন না বলেই প্রজাদের বিশ্বাস৷ আর তাই মহামন্ত্রী ও অন্যান্য অমাত্যদের কাছেও তিনি সম্মানীয়৷ সুতরাং তার মাধ্যমে মহারাজের কাছে যে বার্তা পৌঁছোবে তার গুরুত্ব অপরিসীম৷
— হে ধর্মপ্রাণ, আমি মহারাজ কংসের বিশেষ সংবাদবাহক হিসেবে আপনার শরণাগত৷ মহারাজ এ বিশেষ সংবাদ আপনাকে দিয়ে তার জরুরি জবাব প্রার্থনা করেছেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর, এই বলে স্বয়ম্ভূ তার আংরাখার ভিতর থেকে তুলোটপত্রের বিশেষ বার্তাটি প্রদান করল৷
পুরোহিত কিছুক্ষণ স্বয়ম্ভূকে পর্যবেক্ষণ করে জবাব দিলেন
— তুমি যুবক, নিঃসন্দেহে বলশালী, কিন্তু তোমার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট, তুমি আমার কক্ষে বিশ্রাম করো, পুজো সমাপনে প্রসাদ গ্রহণ করে আমার বার্তা নিয়ে রওয়ানা হয়ো৷
— আজ্ঞে, যেমন আপনার আদেশ, বলে স্বয়ম্ভূ তাকে প্রণাম করে তার পশ্চাৎগমন করল৷ কক্ষটি নিতান্তই অনাড়ম্বর৷ একপাশে বৃদ্ধের শয়নের ব্যবস্থা বলতে একটি কম্বলবস্ত্র ও অপরপ্রান্তে একটি মৃৎ নির্মিত কলসি৷ কক্ষের অপরদিকে একটি দীপ সম্ভবত সারারাত প্রজ্জ্বলনের কারণে কালিমা লিপ্ত৷ বৃদ্ধ তাকে কক্ষে পৌঁছিয়ে বাহির হলেন৷ কক্ষে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ বিশ্রামের মনস্থ করল স্বয়ম্ভূ, সব কাজ আজকেই সমাধা করে ফিরে যেতে হবে, সে চোখে মুখে জল স্পর্শ করে নিজের আংরাখা খুলে খানিকটা স্বস্তি বোধ করল৷ অনেকটা পথ, সাত-পাঁচ বিচার-বিবেচনা করতে করতে চক্ষু মুদ্রিত হল তার৷
বাহরাইচ জনপদ, বর্ধিষ্ণু, শান্তিপূর্ণ, নদীতীরে বনানীর মধ্যে এসে যুবকের মন আনন্দে উৎফুল্ল৷ না, জন্মাবধি এত সবুজ-শ্যামল পরিবেশ সে দেখেনি কখনো৷ ঊষর মরুপ্রান্তরে ইতস্তত অশ্বারোহণে পার করেছে একের পর এক জনপদ৷ জনপদ অবশ্য নামেই, এই জনাকীর্ণ শস্যশ্যামলা জনবহুল দেশের ন্যায় নয়৷ এমনকী হিন্দের পশ্চিম উপকূলে সৌরাষ্ট্র জনপদের মতোও নয়, যেখানে উপাসনালয় ধ্বংসের সেও এক মহৎ শরিক, না কোনো অনুতাপ নেই তার, যুদ্ধ তো হয়ই এ-জন্য, আজন্ম সে জেনেও এসেছে তাই৷ শক্তিশালীর মত স্থাপন আর দুর্বলকে লুন্ঠন এই তো যুদ্ধের একমাত্র নীতি৷ যে বলশালী সে তার বাহুবল দ্বারা সব কিছু অধিকার করবে, আর নিজের মত স্থাপন করবে এই তো যুদ্ধের ধর্ম৷ যোদ্ধার ধর্ম যুদ্ধ, এ ব্যতীত আর কিছুই তার মনকে নাড়া দেওয়া অনুচিত৷ কিন্তু তাও কখনো কখনো উচাটন অনুভব করে সে, মনে হয় যেন তার অন্তরাত্মা সুখী নয়, কী যেন হারিয়ে ফেলেছে সে, হয়তো-বা আর ফিরে পাওয়ার কোনো আশা নেই, এক অদৃষ্ট ভবিতব্য তাকে অমোঘ আকর্ষণে টেনে নিয়ে চলেছে, আর সেও তার পিছনে তাড়া করে চলেছে শাপিতের মতো৷
শ্যামল বনানী আর পক্ষীকুলের কূজনে মুখরিত এই জনপদ যেন অতুলনীয়৷ মন চায় এখানেই চিরবসতি গড়ে তুলতে, জীবনের সবকটা দিন এখানেই অতিবাহিত করতে৷ তরবারির ঝনঝনানি আর অস্ত্রের ভীষণ নিনাদের মাঝে একটুকরো শান্তি যদি কোথাও থাকে তো এখানেই৷ অন্যমনস্ক হয়ে পরে মাসুদ৷ এর আগেও সে এসেছে সাতরিখে, কিন্তু কাছেই এই জনপদ তার জানা ছিল না৷ নিজের অজ্ঞতা কে মনে মনে ধিক্কার দিল সে৷ একটা কুলকুল শব্দ আসছে যেন৷ শব্দ অনুসন্ধান করে কিছুদূর যেতেই নজরে এল এক নদী৷ সবুজ বনছায়ার আড়ালে বয়ে চলা এক অনাবিল স্রোতধারা৷ বিস্মিত মাসুদ৷ ঠিক তার মনোগতির অনুরূপ৷ এতক্ষণে সে নিশ্চিত, যদি জয়ী হয় এখানেই হবে তার আবাস, আর যদি মৃত্যু হয় এই যুদ্ধে তবে… তাহলেও এখানেই শায়িত থাকবে, মনের কাছাকাছি, শরীরী কর্তব্যের থেকে দূরে, অনেক অনেক দূরে৷
— জনাব, পিছুডাকে জাগ্রত স্বপ্ন ভঙ্গ হয় মাসুদের৷
— হাসিম!! তুমি কি আমার সঙ্গেই ছিলে? অবাক হয় মাসুদ৷
— জি, জনাব৷ আমি আপনার পশ্চাতেই ছিলাম, আপনি অন্যমনস্ক ছিলেন, তাই খেয়াল করেননি৷
— তুমি তো এখানে অনেক দিন আছ, এ-স্থানের কথা তো আমায় বলোনি কখনো?
— আপনি যোদ্ধা, জনাব এ-স্থানে আপনার কৌতূহল থাকবে তা আমি বুঝিনি৷
— শোন, যদি আমি এই যুদ্ধে জয়ী হই তাহলে এখানেই আমি থাকতে চাই, আর ফৌত হলে এখানেই… আমার মাকবারা বানানোর ইন্তেজাম করো৷ আপাতত এখানে এই জীর্ণ মন্দির থাকার কোনো অর্থ হয় না, এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করো৷
— জি, আমি সেজন্যই আপনার কাছে এক খাস সন্দেশ এনেছি জনাব৷ আমি এই কয়েকদিনে এখানকার সব জায়গা চষে ফেলেছি, লেকিন…
— লেকিন কী হাসিম?
— এখানকার রাজারা পরাস্ত হলেও ঘুটনা ঠেকতে রাজি নয়, বরং কোথাও একটা দুসরা বাত ভি চলছে৷ মহারাজ সুহেলদেব… পাসি রাজ৷ উসকো হারানা জরুরি হ্যায়৷
— জরুরি হ্যায়? আমার মঞ্জিলের পথে যে আসবে তাকে শুধু শিকস্ত দেওয়া নয়, কুচালনা জরুরি হ্যায়… ক্যা তুমে ইয়াদ নেহি? নাকি হিন্দের নরম মিট্টি তোমায় নরম করে দিয়েছে হাসিম?
— মাথা নীচু করে থাকে হাসিম৷ এই যুবা কী বলছে? স্বয়ং সুলতান মামুদ কখনো এ-কথা বলেনি তাকে!! ধমনীর ভিতরে ফুটন্ত রক্তকে কোনোক্রমে প্রশমিত করে, উত্তর করল—
— আমি সে-কথা বলিনি জনাব, রাজারা অন্যরকম কিছু ভাবতেই পারে, আমার অন্তত সেরকমই খবর৷
মাসুদও নিজের ভুল বুঝতে পেরে আর কথা বাড়াল না, আপনার ওপর আমার একিন আছে জনাব, আমি জানি আপনি হয়তো ঠিকই বলছেন৷ আপনি কি আব্বাজান কে এ-বিষয়ে এত্তেলা করেছেন?
— জি জনাব, লেকিন উনি একিন করেননি৷
— ঠিক আছে আমি আব্বাজানের সাথে কথা বলব৷
— কিন্তু আমার ইচ্ছের কথাটা মাথায় রেখো… এই মন্দির…
— জি, আমি ইঁয়াদ রাখব৷
বৃদ্ধ পুরোহিতের ডাকে তন্দ্রা কাটল স্বয়ম্ভূর৷ নিজের এই অসময় নিদ্রামগ্ন হওয়াতে কিঞ্চিৎ লজ্জিত হয় সে৷ বৃদ্ধ পূজারি বলেন, তুমি অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলে, তাই তোমাকে নিদ্রাভঙ্গ করিনি, তোমার রাজনের পাঠানো বার্তা আমি যথা সময়ে মহাধিপের কাছে প্রেরণ করেছি৷ মহারাজ স্নানাহারের পর তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন, আজ তুমি রাজঅতিথি৷
— কিন্তু হে মহাপ্রাণ, আমার যে আজ রাজ্যে ফিরে রাজনের কাছে বার্তা পৌঁছোনোর কথা৷
— তুমি নিশ্চিন্ত থাকো যুবক, মহারাজ বার্তা প্রেরণ করে যথাসময় দূত প্রেরণ করেছেন৷ সে ইতিমধ্যে হয়তো রওয়ানা হয়েও গিয়েছে৷
এর পর আর কিছু বলার থাকে না, সুতরাং স্নানাহারে মনোযোগী হওয়াই উচিত৷
নিকটবর্তী নদীতে স্নানের পর পুরোহিতের কক্ষে খাদ্য গ্রহণে বসল স্বয়ম্ভূ৷ দীর্ঘ পথচলনজনিত পরিশ্রমের ফলে তার ক্ষুধা চরম সীমায় পৌঁছেছিল৷ সে আসন গ্রহণ করে দেখল উদরপূর্তির আয়োজন অনাড়ম্বর হলেও নিতান্তই কম নয়৷ পিস্তক, মোদক ও ফলাদি পরিপূর্ণ পাত্র নিমেষেই শেষ করে স্বয়ম্ভূ খানিক স্বস্তি অনুভব করল৷
যথাসময়ে রাজদরবার থেকে ডাক এল৷ প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পরে প্রথমেই বেশ চমকিত হল স্বয়ম্ভূ৷ বেশ ভালো ব্যবস্থা৷ কিন্তু তার মতো সামান্য রাজকর্মচারীর জন্য সুসজ্জিত শকট! চমকের আরও বাকি ছিল তার৷ বিস্মিত স্বয়ম্ভূ দেখল শুধু শকটই নয়, স্বয়ং রাজকর্মচারী একজন তার অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত৷ নিজেকে বেশ লজ্জিতই লাগল তার৷ রাজকর্মচারী এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলেন৷
— মহাশয় আমি, শ্রাবস্তীর মহামন্ত্রী, মহারাজের আদেশে
আপনাকে রাজসভায় নিতে এসেছি৷
— আপনি স্বয়ং?
— হ্যাঁ মহাশয়, মহারাজ আপনার অভ্যর্থনার দায়িত্ব অন্য কারো হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হননি, তাই তিনিই আমাকে প্রেরণ করেছেন, আপনি রাজ অতিথি৷
— আচ্ছা চলুন৷ স্বয়ম্ভূর বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছিলই না, সে মহামন্ত্রীর পশ্চাৎগামী হল মন্ত্রমুগ্ধের মতো৷
রাজপ্রাসাদের সম্মুখে যখন সে পৌঁছোল, ততক্ষণে সূর্যদেব মধ্যগগন থেকে তার পশ্চিমপানে যাত্রা শুরু করেছেন৷ রাজপ্রাসাদ বেশ অনেকটা স্থান দখল করে গঠিত৷ সুদৃশ্য প্রাসাদ, প্রস্তরনির্মিত প্রাকার পরিবেষ্টিত৷ খুব বেশি বড়ো না হলেও সর্বত্র পরিশিলিত রুচির ছাপ বেশ স্পষ্ট৷ মূল রাজসভার পার্শ্বস্থ বেশ কয়েকটি তদপেক্ষা ক্ষুদ্র প্রাসাদের সমাহার৷ সম্ভবত সেগুলি রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দের বাসস্থান৷ স্বয়ম্ভূর শকট দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হতেই মহামন্ত্রীর ইশারায় দ্বারী তোরণদ্বার উন্মুক্ত করল৷
রাজসভায় আসন গ্রহণ করে রাজ সভার জৌলুস নজর এড়াল না৷ কাশমণ্ডির রাজসভায় সে আছে প্রায় কয়েকবছর হল কিন্তু এ-জৌলুস অতুলনীয়৷ রাজনের রাজসভায় প্রবেশে আরও বিস্ময়ের বাকি ছিল৷ কী দেখছে সে, এ চেহারা তো তার পরিচিত! সেই চোখ আর সেই উজ্জ্বল দৃষ্টি… আজ রাজপোশাকে যেন আরও ঝকমক করছে সেই আত্মবিশ্বাস, ইনি কী সেই আসগৃহের অপরিচিত ব্যক্তি!
রাজনের আন্তরিক আহ্বানে চমক কাটল— ‘‘কী বন্ধু বলেছিলাম না দেখা হবে?’’ এবার সমস্ত সংশয় কেটে গেল তার৷ কাল রাত্রে তাহলে মহারাজের সাথেই দেখা হয়েছিল? কিন্তু মহারাজ তাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কিছুতেই ভেবে বের করতে পারল না সে৷ রহস্য উন্মোচন করলেন মহারাজ নিজেই৷ উপস্থিত সভাসদদের কাছে নিজেই পরিচয় করালেন তিনি৷
— আপনারা দেখুন ইনিই হচ্ছেন কাশমণ্ডির মহারাজ কংসের বিশিষ্ট সেনানী স্বয়ম্ভূ সর্দার৷ ওনার বীরত্বেই লক্ষ্মণপুর আজ যবন সেনা আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে৷ শুধু তাই নয় সেনাপতি হাতিম ও তার সহযোগী খাতিম নিহত হয়েছে৷ আপনারা ওঁনাকে অভিবাদন জানান৷ রাজসভায় আনীত হল একটি সুলক্ষণযুক্ত গাই, স্বয়ম্ভূর উপহার…
উপস্থিত সকল সভাসদ উঠে দাঁড়াতে নিতান্তই লজ্জিত হল স্বয়ম্ভূ৷ সে সামান্য সেনানী, যুদ্ধক্ষেত্রের রুক্ষতাই তাকে মানায়, এই কোমল অভিবাদন তার মুখে রক্তিম আভা সৃষ্টি করল৷ সেই সঙ্গে সে এও বুঝতে পারল কেন মহারাজ কংস তাকে শ্রাবস্তীরাজের কাছে পাঠিয়েছেন৷ সত্যিই গুণীর কদর তিনি কতটা করতে পারেন, তা আজ বুঝেছে সে৷ কিন্তু কাল রাত্রে একাকী… প্রশ্নটা আসতেই
আবার সব কেমন জট পাকাতে শুরু করল তার৷ আসব গৃহ, অপিরিচিত ব্যক্তি, মহারাজ, সব কেমন মিলে মিশে স্বয়ম্ভূর মস্তিস্কে ঝঞ্ঝার সৃষ্টি করল, কিন্তু কাজের কথা তো বলতেই হবে আর তা অত্যন্ত গোপনীয়৷
— হে মহাধিপ, আপনার এই সুব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে বললেও কম বলা হয়৷ কিন্তু আপনার সাথে যে আমার গোপন কিছু আলোচনা ছিল৷
— আমি জানি হে বীর, আপনি বিশেষ কোনো সংবাদ এনেছেন যা হয়তো বার্তায় উল্লেখ নেই, আমিও তা জানতে বিশেষ আগ্রহী৷ আজকের রাজসভা এখানেই সমাপ্ত, আমি কাশমণ্ডির রাজ প্রতিনিধির সঙ্গে একান্তে কিছু পরামর্শ করতে চাই৷ মহারাজের
অঙ্গুলি ইশারায় রাজসভা সভাসদ শূন্য হল৷
রাজসভা ভঙ্গ হল৷ স্বয়ম্ভূ মহারাজের নিকটবর্তী হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল…
— মহারাজ কাল রাত্রে আমার পরিচয় গোপনের কারণটা হয়তো আপনি বুঝেছেন, কিন্তু আপনার ছদ্মবেশের বিষয়টা একটু পরিষ্কার করুন৷
— দেখুন, আপনি ঠিক যে কারণে আমার কাছে এসেছেন ঠিক একই কারণে আমারও ছদ্মবেশে রাত্রিভ্রমণ৷ গুপ্তচর মারফত রাজ্যে যবন সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিষয়টি আমারও কানে এসেছে তাই সংবাদ সংগ্রহের জন্যই আমার এই নৈশ অভিসার৷ এখন আপনি বলুন কি সংবাদ আপনি এনেছেন, যা দেওয়ার জন্য এত গোপনীয়তা৷
—আপনি জানেন মহারাজ, লক্ষ্মণপুরে মহারাজ কংসের দ্বারা যবন আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু ফের আক্রমণের সম্ভাবনা থেকেই গিয়েছে৷ আমাদের কাছে সংবাদ, সৈয়দ সালার সাহু এক বড়ো সৈন্যবাহিনী নিয়ে তো এসেইছেন তার উপর তাকে সাহায্য করতে এসেছেন তার পুত্র মাসুদ৷ গজনীর সুলতান মামুদের নির্দেশে মাসুদ বর্তমানে ভারত অভিযানের দায়িত্বে, আর আপনি জানেন…
স্বয়ম্ভূর কথার রেশ ধরেই সুহেলদেব বলতে শুরু করলেন…
— প্রায় দেড় লক্ষ সেনাদল নিয়ে সে মুলতান, দিল্লি, মিরাট
আক্রমণের পর বর্তমানে সাতরিখ পর্যন্ত তার বাহিনী অগ্রসর হয়ে দখল করেছে৷ আর শুধু তাই নয়, তার লক্ষ্য বাহরাইচ এবং অন্যান্য অঞ্চল সে খবর আমার কাছে পৌঁছেছে৷
—হ্যাঁ মহারাজ, আপনি ঠিকই শুনেছেন, তার থেকেও বড়ো বিষয় হল, গুপ্তচর মারফত বিভিন্ন প্রদেশগুলির গোপন তথ্য খুবই সুচারু ভাবে সংগৃহিত হচ্ছে৷ বিভিন্ন রাজনের দুর্বলতাগুলির নিপুন পরিমাপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সালার মাসুদের সেনাবাহিনী৷ দিল্লি ও মিরাট অঞ্চলে ব্যাপক লুট ও ধ্বংসলীলা চালানোর পর এবার নজর বাহরাইচ, গোপামও ও বেনারস৷
— আপনি সঠিক তথ্যই সংগ্রহ করেছেন, আমিও গুপ্তচর মাধ্যমে সেই তথ্যই পেয়েছি, সোমনাথ মন্দির লুন্ঠন শুধু কোনো একক ঘটনা নয়, যবনদের লক্ষ্য এ-অঞ্চলের যাবতীয় মন্দির, সুতরাং
আমাদের অনেক বেশি করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে৷ যাই হোক, আমি রাজনের কাছে সংবাদ প্রেরণ করেছি আপনি কয়েকদিন আমার আতিথেয়তা গ্রহণ করুন, রাজ্যের সমস্ত সামরিক ব্যবস্থা পরিদর্শন করুন৷ আপনার অভিজ্ঞতা বিশেষ কার্যকরী হতে পারে৷ আরও একটা বিশেষ কারণ আছে, আপনি জানতে পারবেন৷
বাহরাইচ থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি মাইল, সাতরিখ, সৈন্যশিবির৷ অনেকগুলির তাঁবুর আয়োজন৷ ইতস্তত কিছু সৈন্য ঘোরাঘুরি করছে, কেউ-বা নিজের অশ্ব কিংবা অস্ত্র-পরীক্ষায় ব্যস্ত৷ দূরে কিছু মানুষের ভিড়, তাদের আলোচনার বিষয় সেনাধিপতির আকস্মিক মৃত্যুর পরবর্তী আশু পরিকল্পনা৷ কে নেবেন দায়িত্ব সে নিয়ে কোনো সংশয় তাদের মধ্যে নেই৷ তবে পরবর্তী আক্রমণের রূপরেখা নিয়ে সংশয় অবশ্যই আছে৷ নতুন সেনাধ্যক্ষ নিঃসন্দেহে যোগ্য, স্বয়ং সুলতান মামুদের ভানজা, কিন্তু কাফেরদের উপর কতটা আক্রমক, তা নিয়ে কিন্তু সংশয় থেকেই যায়৷ মাঝে মাঝে কেমন উদাস নজর, যেন প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বালক৷ বালকই বটে ষষ্ঠদশবর্ষীয়, বালক নয় তো কী! যদিও অসিচালনা নিপুণ, যুদ্ধক্ষেত্রে যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ৷ তখন যেন তরবারি রক্তস্নান না করালে তৃপ্ত হয় না প্রাণ৷ এই সব কানাকানির মধ্যেই হঠাৎ ঘোষণা সেনাধিপতি সালার মাসুদ সৈন্যদল পরিদর্শনে আসছেন৷ সচকিত সেনাদল যে যার অবস্থানে স্থির হল, কানাকানি নিশ্চুপ৷ সবাই সাদর আগ্রহে উৎকণ্ঠিত, নিশ্চিত কোনো বড়ো ঘোষণা হতে চলেছে৷ শিবিরে উপস্থিত হলেন সৈয়দ সালার মাসুদ৷ রণসজ্জায় সজ্জিত, অশ্বারোহী পার্শ্বচর হাসিম৷
— হে দুনিয়ার বেহতেরিন সেনাদল, আপনারা মুলতান থেকে মিরাট জয়ের দ্বারা আমাদের ঝান্ডা উঁচুতে তুলে ধরেছেন, আমার আব্বা সৈয়দ সালার সাহু আপনাদের মদদে সাতরিখ পর্যন্ত জয় করেছেন, কিন্তু আমরা কি এখানেই থেমে যাব? আমরা কি হিন্দের বাকি কাজ না করেই ফিরে যাব? নাকি আমাদের মঞ্জিল হবে আরও সামনের দিকে, বাহরাইচ থেকে বেনারস৷
সকল সৈন্যরা একযোগে সমর্থন জানালো, এখান থেকে পিছিয়ে আসার কোনো অর্থই নেই৷ কয়েকটা কথাতেই দু-পক্ষের সংশয়ের মেঘ কেটে গেল… এখন শুধু আক্রমণ আর আক্রমণ৷
সৈন্য দলের সঙ্গে আলোচনার পর শিবির মধ্যস্থ তাঁবুতে আলোচনা চলছে৷
হাসিম উদ্বিগ্নভাবে পায়চারি করতে করতে প্রশ্ন করল সেনাধ্যক্ষ মাসুদের দিকে…
— জনাব, আপনি কি নিশ্চিত আর অগ্রসরের ব্যাপারে? সামনে কিন্তু কঠিন বাধার সম্মুখীন হতে হবে, তা ছাড়া সৈন্যদলের থাকানের বিষয়টা ভি আছে৷
— আমি জানি, কিন্তু এই যুদ্ধে শুধু ফতেহ করাই নয়, আমাদের লক্ষ্য আরও অনেক বেশি৷ সুলতান মামুদ ইসলামের মহান রক্ষক, আর আমরা হর এক বান্দা, তার কাজ সফল করবই৷ আমি জানি জনাব, আপনি সুহেলদেবের কথা বলবেন, তার অন্য ইন্তেজাম করতে হবে৷ আশেপাশের সব প্রদেশে আক্রমণ চালিয়ে গেলে ওহ ভি ধীরে ধীরে ঘুটনা ঠেকবে, আপনি বেফিকার থাকুন৷ মহারাজ সুহেলদেবের কমজোরি ওঁনার ধর্ম আর তাই হতে চলেছে আমাদের অস্ত্র৷
আজ দু-দিন হল স্বয়ম্ভূ রয়েছে শ্রাবস্তী নগরে৷ মহারাজ সুহেলদেব এবং তাঁর অমাত্য-বর্গের আতিথেয়তা তাকে মুগ্ধ করে চলেছে প্রতি মুহূর্তে, যেন বাইরের কেউ নয়, কতদিনের পরিচয়৷ আর মুগ্ধ করেছেন মহারাজের ভ্রাতৃদ্বয় সেনাপতি বাহারদেব ও মল্লদেব৷ যেমনি অসাধারণ শক্তিশালী তেমনই নিপুণ অস্ত্রক্ষেপন ও কৌশলী বুদ্ধিমত্তা৷ রোজ প্রভাতে স্বয়ম্ভূর কাজই হল মল্লদেবের সেনা পরিচালনার মহড়া দেখা, বলা ভালো শুধু দেখা নয় বিলক্ষণ শেখা৷ ব্যূহ রচনা থেকে শুরু করে ঝটিকা আক্রমণ সবই কেমন অনায়াস কৌশলের অন্তর্গত হয়ে যায় ভাবার বিষয় নিঃসন্দেহে৷ এতদিনে তার নিশ্চিত প্রতীতি হয়েছে যে হিন্দুধর্ম ও ভারতবর্ষকে রক্ষা করতে পারেন শ্রাবস্তী রাজ, আর এ বিষয়ে রাজা কংসর অনুমান নির্ভুল৷
— কী সর্দার, হবে নাকি একহাত?
অবাক হয়ে স্বয়ম্ভূ দেখল পেছন থেকে বাহারদেব, মিটিমিটি হাসছেন, সঙ্গে মহারাজ সুহেলদেব৷
— আপত্তি করার কোনো প্রশ্নই নেই মহাশয়, শুধু একটাই বিষয় তরবারি কি রেশম বস্ত্রে আচ্ছাদিত থাকবে?
— আপনি কি ভীত হয়ে পড়লেন সর্দার?
— আজ্ঞে, তা নয় মহাশয়, আমি আপনার সুরক্ষার কথা ভেবেই চিন্তিত হচ্ছিলাম৷
— আপনারা দুজনেই আমার জন্য অতি প্রয়োজনীয়, সুতরাং, লড়াই, প্রতিযোগিতা চলুক, কিন্তু নিয়ম নির্ধারণ করব আমি, স্মিতমুখে হাল ধরলেন মহারাজ সুহেলদেব৷
— আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মহারাজ, আমাদের মধ্যে এসব এখন চলতেই থাকে, সর্দার এখন আমার পরম মিত্র, এ সামান্য রসিকতা৷ কিন্তু প্রতিযোগিতায় আমরা দুজনেই উৎসাহী, কি সর্দার?
— নিশ্চয় মহাশয়
রেশম বস্ত্রে ঢাকা তরবারি আনীত হল, মুহূর্তেই শুরু হল লড়াই, কিন্তু মুখের হাসি মেলাল না দু-পক্ষে কারও৷
লড়াই করতে গিয়ে স্বয়ম্ভূ টের পেল এক ভীম শক্তিশালী পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অসিচালনায় সেও নেহাত কমজোরি নয়, সমগ্র সেনাবাহিনীতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই, কিন্তু এখানে কিছুতেই যেন কিছু করা যাচ্ছে না৷ বাহারদেবের ভীষণ ক্ষিপ্রতার সাথে তাল মেলানো যেন ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে চলেছে৷ তার এক-একটা ভীষণ অসিক্ষেপন নির্দ্বিধায় ডানদিক কিংবা বামদিকে সরে গিয়ে বিফল করে চলেছেন অনায়াস ভঙ্গিতে অথচ তার অসি ছুঁয়ে যাচ্ছে স্বয়ম্ভূর বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ৷ কর্ণপার্শ্বে স্বেদবিন্দু জমা হতে লাগল স্বয়ম্ভূর, হার বোধ হয় আর বেশি দূরে নয়, কিন্তু না,মাঝখানে তৃতীয় অসির আমদানি ঘটেছে৷ দুই প্রতিদ্বন্দীর মাঝে স্বয়ং মহারাজ৷ স্মিত হেসে ঘোষণা করলেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখানেই শেষ, বন্ধুত্বে জয়-পরাজয় থাকে না৷ কী বল ভ্রাতা?
— আপনি ঠিকই বলেছেন মহারাজ৷ সায় দিলেন বাহারদেব, সর্দার আমার পরম মিত্র৷
স্বয়ম্ভূ কিছুটা নিষ্প্রভ, মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল, আপনি অসাধারণ হে সেনাধ্যক্ষ৷
এবার মহারাজ বললেন আমি যে-কারণে এসেছিলাম সর্দার, আজ অপরাহ্নে আপনার সাথে আমার বিশেষ পরামর্শ আছে, মল্ল ও বাহার ও উপস্থিত থাকবেন, মনে রাখবেন অপরাহ্নে আমার গোশালা পার্শ্ববর্তী প্রাঙ্গণে আমি অপেক্ষা করব৷
ইতিমধ্যে সৈয়দ সালার মাসুদের সৈন্যদল একের পর এক প্রদেশের রাজন্যবর্গকে পদানত করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন, সেই সঙ্গে চলছে নির্বিচার লুন্ঠন, ধর্মান্তরকরণ আর ধ্বংসলীলা৷ একের পর এক হিন্দুরাজা হার স্বীকার করলেও, পুরোপুরি বশ্যতা স্বীকার করা তাদের ধাতে নেই৷ সুতরাং প্রত্যাঘাতের জন্য তারা প্রস্তুত পুরোমাত্রায়৷
অপরাহ্নে গোশালা পার্শ্বস্থ প্রাঙ্গণে পৌঁছে স্বয়ম্ভূ দেখল মল্লদেব এবং বাহারদেব ইতিমধ্যে উপস্থিত, আরও দেখল মহামন্ত্রী ও আরও একজন ব্যক্তি, যাকে সে চেনে না, তারাও উপস্থিত৷ মহারাজ সুহেলদেব উপস্থিত হলেন৷ এই প্রথম বোধ হয় মহারাজের মুখে সামান্য উদ্বিগ্নতা৷ অবশ্য তা উদ্বিগ্নতা না ক্রোধ তা ঠিক বোঝার উপায় নেই৷
মহারাজ বলতে শুরু করলেন…
— আপনারা হয়তো বুঝতেই পারছেন যে আজকের এই
আলোচনা আমি রাজসভায় না করে পৃথক স্থানে করছি, সুতরাং এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ৷ আমার কাছে সংবাদ আছে যে সালার মাসুদের বিশেষ প্রশিক্ষিত গুপ্তচরেরা আমাদের প্রদেশেও ছড়িয়ে রয়েছে, আর তারাই রাজ্যের খুঁটিনাটি সব খবর পৌঁছে দিচ্ছে৷ আর তাই এই গোপনীয়তা৷
এতক্ষণে চিন্তিত মল্লদেব মুখ খুললেন, গোপামও থেকে বেনারস বাহরাইচের পাশাপাশি সব প্রদেশগুলো আক্রমণের পর এখন লক্ষ্য বাহরাইচ, সব থেকে বড়ো বিষয়টা হল একের পর এক মন্দির যবন সেনাদের দ্বারা আক্রান্ত৷ গোশালাগুলোও ওদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না৷
স্বয়ম্ভূ এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর প্রথম মুখ খুলল…
— কিন্তু একের পর এক গোশালা লুন্ঠনের এবং গো অপহরণ করার পশ্চাতে নিশ্চিত কোনো অভিসন্ধি আছে, কারণ কোথাও কোনো গোহত্যা কিন্তু হয়নি৷
— আপনি হয়তো ঠিকই বলছেন সর্দার, কিন্তু নির্বিচার গণহত্যা, ধর্মস্থানের ওপর একের পর এক আঘাত, ধর্মান্তরিতকরণ, এরপরেও কি হাত গুটিয়ে বসে থাকার কোনো অর্থ হয়?
উত্তর দিতেই যাচ্ছিল স্বয়ম্ভূ, কিন্তু মহারাজ বলে উঠলেন, হাত গুটিয়ে বসে থাকার কথা হচ্ছে না ভ্রাতা, কিন্তু এখন কোনো তাড়াহুড়ো করে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তার ফল হবে আরও মারাত্মক৷ আর তা ছাড়া সর্দারের কথাটিও ভাবার মতো, হয়তো এটাও কোনো পরিকল্পনার অংশ৷
ক্ষণিক নিস্তব্ধতা, হয়তো প্রত্যেককেই পরের পরিকল্পনা ভাবার প্রচেষ্টায় আত্মমগ্ন, এমন সময় ফের বললেন মহারাজ, এবার লক্ষ্য অপরজন, যে স্বয়ম্ভূর নিতান্তই অপিরিচিত…
— সুলোচন তোমার কর্তব্য তুমি জানো, আমি এতদিন পর্যন্ত তোমার কাজে অত্যন্ত খুশি, কিন্তু আমার সালার মাসুদের পরিকল্পনার বিষয়ে পরিষ্কার জানা চাই৷ আর তার জন্য তোমার থেকে উপযুক্ত আর কেউ নেই, সুতরাং…
— আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মহাধিপ,আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব৷
সুলোচন মহারাজকে প্রণাম করে বিদায় নিল৷
— মল্ল, তুমি সমস্ত প্রাদেশিক রাজন্যবর্গের সাথে আলোচনার চেষ্টা করো, তাদের একসাথে আনাটা অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ এ-লড়াই কারো একার নয়, আমাদের মিলিতভাবে এর প্রতিরোধ করতে হবে, মহামন্ত্রী আপনি একটি পত্র লিখুন আমি আগামীকাল সেটি অনুমোদন করলে, তাতে আমার মোহর লাগিয়ে প্রেরণ করার ব্যবস্থা করুন৷
মহামন্ত্রী যে-পত্রটি লিখলেন তা পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণই ছিল না৷ এক অত্যন্ত সুমধুর অথচ দৃঢ় ভাষায় রচিত পত্র৷ পত্রে সবাইকে একজোট হওয়ার আহ্বান জানানো হলেও কোথাও রাজনের দুর্বলতার বিন্দুমাত্র প্রকাশ নেই, এমনকী গোপন সূত্রে মহারাজের দ্বারা সংগৃহিত তথ্যের কোনো প্রকাশও নেই৷ সম্ভবত পথমধ্যে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েই অভিজ্ঞ মহামন্ত্রী কিছুটা সাবধানী৷ শুধু সম্মতি বা অসম্মতি প্রকাশের কিছু চিহ্ন দূত মারফত প্রেরণের কথা উল্লিখিত৷ এক্ষেত্রেও সেই পথে আক্রমণ সংক্রান্ত সতর্কতা৷ পত্রটি পড়ে সুহেলদেব প্রসন্ন হয়ে তাতে মোহর লাগিয়ে মল্লদেবের হাতে প্রদান করতে নির্দেশ দিলেন৷
পরদিন, যথা সময়ে মল্লদেব রওয়ানা হবার জন্য প্রস্তুত, সঙ্গী স্বয়ম্ভূ সর্দার৷ ঠিক হল দুজনে একত্রে যাত্রা শুরু করলেও স্বয়ম্ভূ যাবেন আগে আর তার পশ্চাতে খানিক দূরত্বে তাকে অনুসরণ করবেন মল্ল৷ যদি স্বয়ম্ভূ আক্রান্ত হন, তবে মল্ল দাঁড়াবেন না, এগিয়ে যাবেন ঘুরপথে, রাত্রে পূর্বনির্ধারিত স্থানে মিলিত হবেন দুজনে৷ আর যদি না মিলিত হন তবে উত্তর দায়িত্ব থাকবে শুধু মল্লরই ওপরে৷ প্রথমে রাজি না থাকলেও স্বয়ম্ভূর পীড়াপীড়িতে মল্ল শেষ অবধি রাজিই হলেন৷
কখনো কখনো মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বোধ হয় তাকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কেই জানানই দেয় না, তাকে তার প্রয়োজনীয় সাবধানতাও অবলম্বন করতে নির্দেশ দেয়৷ স্বয়ম্ভূর মনের আশঙ্কাজনিত সাবধানতা যে এতটা কাজে আসবে তা বোধ হয় সে নিজেও চিন্তা করেনি৷ প্রথম থেকেই নিয়মমতো দূরত্ব বজায় রেখেই চলছিল দুজনে কিন্তু সম্ভবত যে-বিষয়টা তার আগেও গোচরে এসেছিল যে-কারণে আসধগৃহে মহারাজের সাথে প্রথম সাক্ষাতে তার পরিচয় গোপন, তা সে আবার অনুভব করতে পারল৷ অর্থাৎ অনুসরণ, বেশ কয়েক ক্রোশ অশ্ব চালনার পরেই সে অনুভব করতে শুরু করল যেন কোনো অদৃশ্য অনুচরের উপস্থিতি৷ স্বয়ম্ভূ পথ চলার বেগ বাড়িয়ে দিয়ে চিন্তা করতে লাগল, হয়তো মল্লদেব কিছুক্ষণের মধ্যে কাছে চলে আসবেন আর সেক্ষেত্রে নিশ্চিত সংঘর্ষ৷ কিন্তু মল্লদেবের গমনপথে কোনো বাধা থাকলে তা নিঃসন্দেহে সমস্যা, কারণ, তারা দুজনে মিলে সেই বাধা অতিক্রম করলেও সে-সংবাদ ঠিকই বিপক্ষ শিবিরে পৌঁছতে সময় লাগবে না৷ ফলে সমস্ত পরিকল্পনা মুহূর্তে বিনষ্ট হবে৷ তার থেকে তাকেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে আর সেই সুযোগে পরিকল্পনামাফিক মল্লদেব বিকল্প পথে চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবেন৷
যেমন চিন্তা তেমন কাজ৷ অশ্বের রশিতে টান দিল স্বয়ম্ভূ৷ প্রবল হ্রেষাধ্বনিতে মুখরিত হল দিগন্ত৷ অশ্বক্ষুরের আকস্মিক স্থবিরতায় চতুর্দিক ধূলিধূসরিত হয়ে উঠল৷ পশ্চাতে ঘুরেই সে দেখল একজন নয়, তিন-তিনজন অশ্বারোহী তাকে অনুসরণ করছে৷
— মহাশয়রা কি আমাকে অনুসন্ধান করছেন? প্রশ্ন করলেও
উত্তরের অপেক্ষা করল না স্বয়ম্ভূ৷ উন্মুক্ত তরবারি ঝাঁপিয়ে পড়ল অনুসরণকারীদের ওপর৷ তিনজনকে পরাস্ত করতে স্বয়ম্ভূর বেশি সময় লাগার কথা ছিল না, লাগলও না, কিন্তু নিকেশ করার আগেই মস্তকে এক তীব্র আঘাত অনুভব করল সে৷ চোখের সামনে দৃশ্যপট হেলে উঠল, জ্ঞান হারাল সে৷ স্বয়ম্ভূকে লড়তে দেখে মল্ল এগিয়ে যেতে গিয়েও তার মনে পড়ে গেল পূর্ব পরিকল্পনার কথা, সুতরাং সে বিকল্প পথ ধরল৷ সে নিশ্চিতই ছিল স্বয়ম্ভূ তিনজনকে অনায়াসে পরাস্ত করতে পারবে, কিন্তু পরবর্তী দুর্ঘটনার সে কিছুই টের পেল না৷
অনেকটা পথ পেরিয়ে গ্রামের সীমানা দেখতে পেল মল্লদেব,
এখানেই নদীতীরে বালার্ক ঋষির আশ্রমে তার অপেক্ষা করার কথা, অন্তত আজকের রাতটুকু, ততক্ষণে স্বয়ম্ভূর চলে আসার কথা৷ ধীরে ধীরে জঙ্গলে প্রবেশ করলেন মল্লদেব৷ আশ্রমের বেশ ভগ্ন দশা৷ অশ্বটিকে কোথাও স্থানান্তরে রেখে মন্দির পার্শ্বস্থ নদীতে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম নেওয়ার মনস্থ করলেন তিনি৷ সেই অনুযায়ী কিছুদূর যেতেই অনুভব করলেন তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি৷ নিজেকে আড়াল করলেন মল্লদেব, না শুধু একজন নয় বোধ হয় একাধিক ব্যক্তি, নিজেদের মধ্যে কোনো আলাপচারিতায় ব্যস্ত, বরং বলা ভালো কোনো একজন অপরদের ধমকের সুরে শাসন করছেন৷ নিজের গোপনীয়তা আরেকটু নিশ্চিত করে কান পাতলেন মল্লদেব৷
সব কথা ঠিক মত শোনা না গেলেও, মল্ল পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে আলোচনার মুখ্যবিষয় বাহরাইচ আক্রমণ, এবং চারজনের একজন বাকি তিনজনকে রীতিমতো ধমকাচ্ছে, সুহেলদেবের প্রতিনিধির কাছে ধরা পড়ার জন্য, ব্যাপারটা বেশ
কৌতূহল-উদ্দীপক হওয়ায় মল্ল আরেকটু পরিষ্কারভাবে শোনার চেষ্টা করতেই হিমশীতল শিহরন চলে গেল তাঁর শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে৷
— না, জনাব, আমরা ধরা পড়িনি, তবে আরেকটু হলেই তিনি আমাদের বন্দি করতেন৷ অপরজন পাশ থেকে বললেন ঠিক যথাসময়ে আমরা তাকে মস্তকে আঘাত করে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছি, সে সম্ভবত মৃত৷
চমকে উঠলেন মল্ল, তাহলে স্বয়ম্ভূ শেষ পর্যন্ত গুপ্তঘাতকের হাতে মৃত, হাত নিশপিশ করে উঠল তার৷ ইচ্ছে হল এখনই ভীরু, কাপুরুষগুলোকে নিকেশ করে দিতে৷ হাত চলে গেল কটিদেশে আবদ্ধ তরবারির মুঠের দিকে৷ নাসিকা নিঃসৃত উষ্ণ বাষ্পে যেন পার্শ্ববর্তী বৃক্ষের পাতা কেঁপে উঠল৷ কিন্তু না, এ যুদ্ধের সময় নয়, তার থেকে অনেক জরুরি এদের পরবর্তী পরিকল্পনা জানা… নিজেকে সংবরণ করলেন মল্লদেব৷ আর তা ছাড়া স্বয়ম্ভূ বীর, সে অত সহজে মৃত… মানতে মন চাইছে না তার৷
— জনাব, আমাদের এখন কী কর্তব্য?
— তোমরা এখন সাতরিখ যাও, সেখানেই সৈন্য শিবিরে সেনাধ্যক্ষ আসন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনায় ব্যস্ত, আমি এখন কয়েকদিন এখানেই থাকব, কিছু বন্দোবস্ত করতে হবে৷ তোমরা এখন যাও৷ চার অশ্বারোহী ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হল৷
মল্লদেব চিন্তামগ্ন হলেন, নিঃসন্দেহে এদের অনুসরণ করলে অনেকে কিছু জানা যেত, কিন্তু তাতে বিপদ ছিল অনেক, আর তাকে মহারাজ যে-কাজ দিয়েছেন সেটিই এখন তার দায়িত্ব কারণ স্বয়ম্ভূ নিজেকে বিপদে ফেলে সেই কাজেই তাকে এগিয়ে আসতে সাহায্য করেছে, সুতরাং সেটাই এখন তার একমাত্র দায়িত্ব৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পূব আকাশে রঙের আভা খেলবে, আর তাকে বেড়িয়ে পড়তে হবে ভূপতি অর্জুনের প্রদেশের উদ্দেশ্যে, ততক্ষণ একটু জিরিয়ে নেওয়া সমীচীন৷ এই ভেবে সামান্য খাদ্য যা সঙ্গে ছিল তা গ্রহণ করে বিশ্রাম নেওয়া শুরু করলেন মল্লদেব৷ কিন্তু বিশ্রাম নিরববিচ্ছিন্ন হল না, কিছুক্ষণ পরেই শুকনো পাতায় পদচালনার শব্দ শুনে তিনি নিশ্চিত হলেন, যবনদের দলপতি ফিরে এসেছে৷ তবে নিশ্চিত তার উপস্থিতি টের পেয়েছে তারা… হ্যাঁ শব্দটা তার দিকেই আসছে এগিয়ে৷ আর অপেক্ষার মানে হয় না, দৃঢ়হস্তে অসি ধারণ করে মনে মনে খুশিই হল সে, যাক আজ অন্তত একটাকে নিকেশ করব, কাকপক্ষিতেও টের পাবে না৷ শব্দ নিকটবর্তী হচ্ছে, হ্যাঁ এবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, উদ্যত মল্লদেব অসি উত্থিত করে ঝাঁপিয়ে পড়তেই… আহা কি করছেন… আমি স্বয়ম্ভূ… আপনার মিত্র৷
স্বয়ম্ভূ!! সে তাহলে মৃত নয়… তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সে ফিরে
আসবে… উফফ মনের ওপর থেকে পাথর নেমে গেল৷ এতক্ষণ মনে মনে যে আত্মগ্লানি সে অনুভব করছিল, তার থেকে মুক্তি৷
— সর্দার তুমি যে আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলে?
— হ্যাঁ মহাশয় আক্রান্ত হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু বাকিটা অভিনয়! আমি ভেবে দেখলাম এই চুনোপুটিগুলোকে নিকেশ করার থেকে এদের অনুসরণ করাই যুক্তিযুক্ত হবে৷ তাই ওদের অনুসরণ করে গিয়ে যা দেখলাম তা রীতিমতো আশ্চর্যজনক৷ আমি ভাবতেও পারিনি এ-দৃশ্য দেখব!
মল্লদেব অবাক হয়ে স্বয়ম্ভূর দিকে তাকিয়ে রইলেন, শক্তি, সাহস ও বুদ্ধির এই সংমিশ্রণ, এত অভূতপূর্ব, প্রশ্ন করতে মন চায় না, এখন শুধু বিস্মিত হওয়ার পালা, তবুও প্রশ্ন করলেন,
— কি দেখলে সর্দার?
— দেখলাম এক প্রকাণ্ড বাথান শুধু তাই নয়, সেখানে প্রহরী থেকে শুরু করে গোপালক সবই রয়েছে৷ গাইগুলির রীতিমতো পরিচর্যা চলছে৷
— তার মানে তোমার ভাবনা সঠিক দিকেই ছিল সর্দার, ওদের অন্য পরিকল্পনা আছে৷
— আমি বোধ হয় তার খানিকটা আন্দাজ করতে সক্ষম হয়েছি প্রধান সেনাপতি মহাশয়৷ সে-ব্যাপারে মহারাজের সম্মুখে বলা যাবে, এখন কিছু আহার্য থাকলে বের করুন তো, আমার প্রাণবায়ু বোধ হয় এবার ক্ষুধাতেই বেড়িয়ে যাবে৷ স্বয়ম্ভূর এ-কথা শুনে হেসে ফেললেন মল্লদেব, বললেন সর্দার পাশের জলাশয়ে হাত ধুয়ে আসুন, আমি দেখি কী অবশিষ্ট আছে৷
রাজসভায় পৌঁছে ভূপতি অর্জুনের হাতে রাজনের পত্রটি তুলে দিলেন মল্লদেব৷
— আপনারা আসন গ্রহণ করুন, বললেন রাজা অর্জুন৷
মল্লদেব ও স্বয়ম্ভূ আসন গ্রহণ করার পর পত্রটি হস্তে গ্রহণ করে পড়া শুরু করলেন নৃপতি৷ মুখচ্ছবিতে উদ্বিগ্নতার স্পষ্ট রূপ ধরা পড়ল, যা ধীরে ধীরে দৃঢ়তায় পর্যবসিত হল৷ পত্রটি পড়া শেষ করে মল্লদেবের দিকে ফিরলেন অর্জুন, বললেন…
— মহারাজ সুহেলদেবের পত্রটি পড়ে তাতে রাজি না হওয়ার কোনো কারণই থাকতে পারে না, আমি তো অনেকদিন ধরেই প্রতিশোধের বহ্নিতে দগ্ধ হচ্ছি হে সেনাধ্যক্ষ, যদি একটিবার সুযোগ পাই তো ওই যবন সেনাপতির বক্ষ বিদীর্ণ করতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না৷ আপনি এই পত্রের নির্দেশ অনুযায়ী এই বস্ত্রখণ্ড মহারাজকে প্রদান করুন৷ এই বলে মহামন্ত্রীর দিকে ফিরলেন রাজা অর্জুন, আপনি রাজঅতিথিদের যথাযথ সেবার ব্যবস্থা করুন৷ আর রাজ্যের চিহ্নঅঙ্কিত একটি বস্ত্রখণ্ড ওঁনাদের প্রদান করুন৷
— কিন্তু রাজন, স্বয়ম্ভূ বলল, মহারাজ আপনাকে আরও একটি কাজের দায়িত্ব প্রদান করেছেন৷
— আমি দেখেছি, মহাশয়, আপনি রাজনকে জানাবেন আমি সর্বদা সবরকম ভাবে তার সঙ্গে আছি৷ আমি নিজে বাকি রাজ্যগুলিকে মহারাজের ইচ্ছার কথা জানাব, আর আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এই প্রস্তাব সবাই সানন্দে মেনে নেবেন৷ এরপর আর সংশয় থাকার কোনো প্রশ্ন নেই৷ সুতরাং রাজসভার অমাত্যের সঙ্গে বিশ্রামাগারের দিকে গমন করলেন উভয়ে৷
বিশ্রামাগারে উপস্থিত হয়ে স্বয়ম্ভূ খানিক বিশ্রামের সুযোগ পেল৷ সেইসঙ্গে পেয়ে গেল কিছুটা আত্মসমীক্ষার অবসর৷ পাশের শয্যায় মল্ল নিদ্রামগ্ন হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল৷ তার নাসিকা-নির্গত শব্দনির্ঘোষ তার নিদ্রার গভীরতা জানান দিচ্ছে৷ স্বয়ম্ভূ ভাবতে শুরু করল৷ কয়েকদিনে তার জীবনের কী আমূল পরিবর্তন৷ জীবনের কত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে আজ সে শ্রাবস্তী রাজার হয়ে কর্মরত৷ তার সম্মানও কত বৃদ্ধি করেছেন স্বয়ং মহাধিপ৷ দেশের স্বাধীনতা রক্ষার এই লড়াইয়ে তাকে গুরুত্বপূর্ণ সেনানী হিসেবে ব্যবহার করে তার মর্যাদা কত কত বৃদ্ধি করেছেন তিনি৷ এই সম্মানের উপযুক্ত মর্যাদা দিতে না পারলে তার কোনো মার্জনা হয় না৷ যে করেই হোক মহাধিপের প্রদত্ত সম্মানের মর্যাদা প্রদান করতে হবেই৷ যুদ্ধে সর্বতভাবে বীরত্ব প্রদর্শন করে যবনবাহিনীকে প্রতিহত করাই তার একমাত্র লক্ষ্য৷
যথাসময়ে পত্র এসে উপস্থিত হল ভূপতি অর্জুনের দূত মারফত৷ পত্রের বয়ান খুব সাধারণ হলেও রীতিমতো আশাব্যঞ্জক৷ অর্জুন নিজেই সমস্ত নিকটবর্তী প্রদেশের রাজনদের সাথে যোগাযোগ করে মহারাজ সুহেলদেবের পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেছেন৷ বলাবাহুল্য তার মতো বাকি প্রদেশের ভূপতিরাও যবন আক্রমণের বিরুদ্ধে একটা সংঘবদ্ধ লড়াইয়ের মঞ্চ সন্ধান করছিলেন৷ কিন্তু অভাব ছিল নেতৃত্বের৷ তারা নিজেদের মধ্যে কারো নেতৃত্ব মেনে নিতে না পারলেও সুহেলদেবের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে তাদের কোনো অসুবিধা হবে না৷ তা ছাড়া সুহেলদেবের বীরত্ব এবং ধার্মিক মনোভাব তাকে সেই মুহূর্তে সবার থেকে উচ্চ আসনে আসীন করেছিল অনেক আগেই৷ সুতরাং একুশটি প্রদেশের রাজন্যবর্গ মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দিলেন নির্দ্বিধায়৷ এই সমর্থনের পর একটি পত্রপ্রেরণ আবশ্যক, তাই সুহেলদেব মহামন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন একটি পত্র লেখার জন্য৷ যে-পত্র অবশ্যই ধন্যবাদ জ্ঞাপক এবং বেশ কিছু নির্দেশ সম্বলিত, যাতে যুদ্ধের সময় প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী সাহায্যলাভ করা যায়৷ এই পত্রের একুশটি প্রতিলিপি নিয়ে রওয়ানা করে দেওয়া হল রাজদূতেদের৷ পরের পত্রটি কিন্ত ঠিক এর বিপরীত৷ হয়তো এরকম পত্র মহামন্ত্রী কখনো লেখেননি বা হয়তো কখনো লেখার দরকারও পড়বে না৷ কিন্তু রাজ্যের সম্মান রক্ষা এবং আসন্ন যুদ্ধের পূর্বে শত্রু শিবিরে কিঞ্চিৎ কাঁপুনি ধরাবার জন্য এই পত্রের গুরুত্ব অসীম৷ তার থেকেও বড়ো ব্যাপার যদি এতে কাজ হয় তবে হয়তো যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়ানো সম্ভব হতে পারে৷ মহামন্ত্রী তার সমস্ত অভিজ্ঞতার দ্বারা যে-পত্রটি লিখলেন, তাতে যথারীতি মহারাজের সম্মতির মোহর অঙ্কিত হল, এবং অনুমোদিত হল প্রেরণের জন্য৷ কিন্তু সবথেকে বড়ো সমস্যা হল কে হবেন সেই পত্রবাহক, যিনি সাতরিখে গিয়ে সেই পত্র যবন সেনাধ্যক্ষের হাতে তুলে দেবেন? কারণ এ বড়ো দুঃসাহসিক কাজ, কারণ পত্রপাঠ পরবর্তী অভিব্যক্তি সহজেই অনুমেয়৷
দুঃসাহসিক এই কাজের জন্য নির্বাচিত হল স্বয়ম্ভূ৷ কারণ মল্লদেব বা বাহারদেবের এই মুহূর্তে রাজধানীর থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়, আর তার থেকেও বড়ো ব্যাপার, আগের বারের ঘটনাপ্রবাহের পর মহারাজের স্বয়ম্ভূর উপর আস্থা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে৷
যথারীতি স্বয়ম্ভূ নির্দিষ্ট দিনে যাত্রার জন্য প্রস্তুত৷ যাত্রায় যথেষ্ট বিপদের সম্ভাবনা, কারণ একেবারে শত্রুর সম্মুখীন হয়ে, চোখে চোখ রাখা, যা তা বিষয় নয়, অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ৷ বাহারদেব এলেন, মনে সংশয়, আসন্ন বিপদের মুখে প্রিয় মিত্রকে প্রেরণ করতে মন সায় দেয় না, কিন্তু রাজ্যের প্রয়োজন সর্বদা সবার ও পরে৷ কিন্তু মন মানতে চায় না, জড়িয়ে ধরেন তাকে৷ আলিঙ্গনের দৃঢ়তায় আশ্চর্য স্বয়ম্ভূ৷ অবাক দৃষ্টিতে তাকান বাহারদেবের দিকে৷ যে-ভালোবাসা সে এই কয়েকদিনে পেয়েছে তাতে সে ধন্য৷ ঈশ্বরের অসীম কৃপা, এক প্রাদেশিক কর্তার সামান্য সেনানী হয়ে আজ সে যা লাভ করেছে তাই বা ক-জনের ভাগ্যে ঘটে? সে বলে…
— আমি কিন্তু ফিরে আসব মিত্র, আর সেদিনের হিসেবটাও বাকি রয়ে গিয়েছে৷ আর পরের বার জয় আমার হবে এটা কিন্তু ভুলবেন না৷
বাহারদেবের চোখের কোণে অশ্রু, দৃষ্টিকে ঝাপসা করে তোলে, অশ্রু লুকিয়ে বলেন, কিন্তু আপনি তো জিতে গিয়েছেন সর্দার! জয় শুধু অস্ত্রের দ্বারা হয় না, তার থেকেও বড়ো জয় হৃদয়ের, আর
সেখানে আপনাকে হারায় কার সাধ্য৷
স্বয়ম্ভূ আর দাঁড়ায় না, সুসজ্জিত অশ্ব যা মহারাজের থেকে সে উপহার পেয়েছে তাতে আরোহণ করে, এগিয়ে চলে লক্ষ্যের দিকে৷ অনেকটা পথ পেরিয়ে পৌঁছোতে রাত হয়ে যাবে, সুতরাং আর দেরি করা চলে না৷ লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে চলে স্বয়ম্ভূ, আজ অনেক কিছুই মনের কোণে ভিড় করতে থাকে, নিজের সেই মাতৃভূমি, সেই সবুজ বনানীর মাঝে ছোট্ট গৃহ, আজ সব কিছু ফেলে রেখে সে চলেছে এক দুঃসাধ্য কর্ম সম্পাদন করতে, বাহারদেবের চোখের কোণের অশ্রু, আর মহারাজের আশান্বিত মুখাবয়ব, সবই দৃশ্যপটে ভিড় জমায় তার৷ কিন্তু এ এক ধর্মযুদ্ধ, এখানে নিজের কথা ভাবা নিতান্তই কাপুরুষতা, আর স্বয়ম্ভূ বীরের মতো প্রাণ দিতে পারে কিন্তু সে কাপুরুষ, এই বিষ পান করে জীবনধারণ অসম্ভব৷ তার মাতৃভূমি তাকে কীভাবে মনে রাখবে তা নির্ভর করছে তারই ওপর, কারণ মানুষের জন্ম তার হাতে নয়, কিন্তু কর্মই পারে তাকে ভবিষ্যতের বিস্মৃতির বালুময়তা থেকে রক্ষা করতে, আর সেই অমরত্বের পথে কোনো আবেগ, কোনো পিছুটান থাকতে পারে না৷ বেশ কিছুটা পথ যেন মন্ত্রাবিষ্টের মতো চলার পর বোধ হয় নিজের যোদ্ধা সুলভ মেজাজ ফিরে পেল স্বয়ম্ভূ, আবেগের আতিশয্য তার হৃদয়কে সম্পূর্ণ ছেয়ে ফেলেছিল৷ কিন্তু তার চোখের সামনে ভেসে উঠল লক্ষণপুরের যুদ্ধের সেই নৃশংসতা, আর তখনই বাস্তবের জমিতে অবতরণ ঘটল বেশ রুক্ষতার সঙ্গে৷ কোনোভাবেই নিজেকে দুর্বল করলে চলবে না, মরতে যদি হয়ই, তবে বীরের সদগতি তার প্রাপ্য, আর সে-প্রাপ্য সে বুঝে নেবে কড়ায় গন্ডায়৷
রাত বেশ হলেও জ্যোৎস্নাআলোকে চরাচর বিস্তৃত দৃশ্যমানতা বজায় রয়েছে৷ অকস্মাৎ স্বয়ম্ভূর নজরে এল দূরে কিছু মানুষ ও অশ্বের চলমানতা৷ তবে নিশ্চয় সামনে কোনো সৈন্যঘাঁটি রয়েছে আর সেখানেই মানুষজনের ব্যস্ততা৷ সুতরাং সাবধানতা অবলম্বনের সময় সমাগত৷ সন্তর্পণে কিছুটা পথ অতিক্রম করে সে বুঝতে পারল যে তার অনুমান একেবারেই সঠিক৷ সামনে কিছু তাঁবু রয়েছে, আর সৈন্য সমাবেশ দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু এ তো সাতরিখ নয়, তার মানে বিপক্ষ সেনাদল বাহরাইচের একেবারে সীমান্তবর্তী এলাকা অবধি অগ্রসর হয়েছে৷ কিন্তু সামনে যাকে দেখছে তাকে দেখে তো পরিচিত বলে মনে হচ্ছে৷ যেন কোথাও দেখা হয়েছে৷ কিন্তু… না, কিছুতেই স্মরণ করতে পারল না সে৷
আপাত পরিচিত সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কৌতূহল নিবৃত্তি করার জন্য তাঁবুর দিকে নজর রাখা শুরু করল স্বয়ম্ভূ৷ তাঁবুর ভিতরে কথাবার্তা চলছে দেখে সে দিকে মনোযোগ দিল সে, কেন জানি না তার মনে হতে লাগল এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷
— কী খবর এনেছো সুলেমান, ওহো ভুল হয়ে গেল সুলোচন!
— না, আর সন্দেহের অবকাশ নেই, রাত্রের আলো-আঁধারিতে পরিষ্কার চিনতে না পারলেও এবার সব পরিষ্কার৷ বিশ্বাসঘাতক!! এবার একে একে সব গিটগুলো খুলতে শুরু করল স্বয়ম্ভূর৷ তার ওপর আক্রমণ, গোশালা থেকে গাই অপহরণ সব কিছু… তার হাত নিজে থেকেই কোমরবন্ধে রাখা তরবারি আঁকড়ে ধরল দৃঢ়-ভাবে৷
— জনাব, এই কয়েকদিনে আমি মহারাজ সুহেলদেবের বিশ্বাস অর্জন করেছি৷ তিনি আমাকেই আপনার থেকে খবর সংগ্রহে নিযুক্ত করেছেন৷ আর আমাদের সেনা যে তার সীমানার এত কাছে আছে সে সংবাদ তার কাছেও নেই৷ তবে…
— লেকিন? প্রশ্ন করলেন অপরজন৷
— আমাদের গরু অপহরণের ব্যাপারটা হয়তো ওদের কিছু সংশয় জাগিয়েছে৷ বিশেষ করে রাজা কংসের সহযোগী স্বয়ম্ভূর মনে৷ কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না জনাব, আমরা ওকে নিকেশ করতে পেরেছি৷
— আর কোনো বিশেষ সন্দেশ?
— মহারাজ সুহেলদেব হয়তো অন্য রাজাদের কাছে সাহায্য চাইতে পারেন৷
— তাতে কোনো অসুবিধা নেই, আমরা পেহেলেই ওদের শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছি, ওরা আর লড়াই করতে পারবে না৷
— তাই যদি হয় জনাব, তাহলে আমাদের জয় নিশ্চিত, কারণ, সুহেলদেবের নিজের সেনা বেশি নেই, যুদ্ধের সময় এই রাজাদের ওপর নির্ভর করতেই হবে৷ এই বলে সেলাম ঠুকে বেরিয়ে আসে সুলোচন বা সুলেমান৷
স্বয়ম্ভূর উত্তেজনা আর বশ মানছিল না৷ সে মনে মনে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি বিধান করেই ফেলেছিল৷ সে সুলেমানকে অনুসরণ করতে শুরু করল৷ সুযোগও চলে এল কিছুক্ষণের মধ্যেই৷ ক্লান্ত অবস্থায় সুলেমানের অশ্বটি হঠাৎ যেন প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানিয়ে স্তব্ধ হল, আর অবতরণে বাধ্য হল সে৷ অশ্বের জন্য জলের ব্যবস্থা করতে সুলেমান সামনের দিকে অগ্রসর হতেই অন্ধকার ফুড়ে বেড়িয়ে এল স্বয়ম্ভূ৷ দ্রুত লক্ষ্যনির্দিষ্ট পদচালনার মাঝে হঠাৎ কালবৈশাখীর সম্মুখীন হওয়া পথচারীর মতো বিস্ময়াবিষ্ট সুলেমান একেবারে চিত্রার্পিতের ন্যায় স্থবির হয়ে গেল৷
— কী ভাবছেন মহাশয়? যাকে পিছন থেকে কাপুরুষের ন্যায়
আঘাত করে পলায়ন করেছিলেন, সে কীভাবে জীবিত হয়ে উঠল? নাকি ভাবছেন পুনরায় কোনো বাক্যজালে আমাকে ভুলিয়ে যবন সেনাধিপতিকে আমার মস্তকটি উপহার দিয়ে পুরস্কার লাভ করবেন?
— না মানে, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন৷ আমি তো মহারাজের কর্ম সম্পাদনের জন্যই শত্রু শিবিরে গিয়েছিলাম৷
— কিন্ত শত্রুরা যে সীমান্তের এত কাছে শিবির বসিয়েছে সে কথা তো আপনি বলেননি সুলোচন… ওহো জনাব সুলেমান৷ যাই হোক আপনার সাথে আমার কিছু পার্থক্য আছে মহাশয়, আপনাকে একটা সুযোগ আমি দেব, নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করব না, তরবারি কোষমুক্ত করুন, ত্রিকালেশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করে বলছি আপনার বেহেস্ত লাভ বিলম্বিত করব না৷
সত্যিই বেশি সময় নিল না স্বয়ম্ভূ৷ সুলেমান একটা মরিয়া চেষ্টা করেছিল ঠিকই কিন্তু সে বোধ হয় নিজেও জানত তার পরিণতি৷ আর তা ছাড়া বিশ্বাসঘাতকদের শারীরিক বল যাই হোক না কেন মনের বল তাদের অনেক কমই হয়৷ আগের বারের লড়াই থেকে তার এটুকু সম্যক ধারণা বিলক্ষণ জন্মেছিল যে স্বয়ম্ভূকে পরাস্ত করা তার পক্ষে নেহাতই অসম্ভব৷ ফলে অস্ত্র হস্তচ্যুত হতে সে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল ঠিকই কিন্তু স্বয়ম্ভূর অস্ত্র তার সে-আশা পূর্ণ করেনি৷
পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা লেগেছে কিছুক্ষণ আগেই, অর্ধমুদিত চোখে শিবিরের দ্বাররক্ষীদের নজরে পড়ল একটি অশ্ব ধীরে ধীরে শিবিরের দিকে এগিয়ে আসছে৷ সতর্ক হতেই তাদের নজরে পড়ল অশ্বপৃষ্ঠে শায়িত দেহের দিকে৷ চমকিত দ্বারীগণ ছুটে নিকটবর্তী হতেই বুঝতে পারল এ আর কেউ নয় হাসিম, ঘনিষ্ঠ সুলেমানের শব৷ কিন্তু অশ্বের গলায় কী যেন একটা বাঁধা… কোনো বার্তা৷ সংবাদ পৌঁছোল শিবিরের ভেতরে, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন হাসিম ও অন্যান্যরা৷ বার্তাটি অশ্বের গ্রীবামুক্ত করে পাঠানো হল সেনাধ্যক্ষ মাসুদের কাছে৷
পত্র পেয়ে হাসিমের কাছে হস্তান্তর করলেন মাসুদ, এই কয়েকটা দিনে হিন্দুস্তানী ভাষা হাসিম খানিকটা পড়তে সক্ষম হলেও, তার দ্বারা আর সেটা হয়ে ওঠেনি৷ কিন্তু ভাষা বুঝতে তার খুব একটা অসুবিধা হয় না৷ কিন্তু যে-পত্র হাসিম পড়তে শুরু করল তা তার কাছে যে খুব একটা সুখদায়ক হল না, তা অনুমান করতে কোনো অসুবিধা হল না কারোই৷ তার মুখমণ্ডলের গৌরবর্ণ শীঘ্রই গোধূলির আকাশের ন্যায় রক্তিম আভা গ্রহণ করল, এতো লাঞ্ছনা বোধ হয় সে কোনোদিন ভোগ করতে পারে তা বোধ হয় তার চিন্তারও অতীত ছিল৷
মহাশয়, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি৷ অবশ্য সৌভাগ্য হয়তো আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ আমিও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আপনি আমার সম্মুখীন না হন৷ কারণ সেক্ষেত্রে আমার শান্ত, ধর্মপরায়ণ মন আপনার রক্তের জন্য পিপাসু হয়ে উঠতে পারে৷ আমি জানি আপনি আমার সীমান্ত লাগোয়া বহু প্রদেশে নির্বিচারে লুঠ, গণহত্যা আর ধর্মনাশ ঘটিয়েছেন তাতে আপনাকে মৃত্যু-দণ্ড না দিলে আমাকেও আমার ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহি করতে হবে৷ কিন্তু আমাদের ধর্ম আমাদের অপর ধর্মকে মান্যতা দেওয়ার যে-শিক্ষা দেয়, তাই এক্ষেত্রে আপনার ঢাল৷ আর তা ছাড়া আপনি রাজা নন, আমার চোখে আপনার অবস্থান লুন্ঠনকারীর৷ লড়াই সমানে সমানে হয়৷ কিন্তু শাস্তি বিধানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই৷ সুতরাং আপনি যদি আপনার গুপ্তচরদের তথ্যের উপর নির্ভর করে আমার রাজ্যের দিকে হস্ত প্রদানের বিষয়ে
ন্যূনতম চিন্তাও স্থান দিয়ে থাকেন, তবে তা ত্যাগ করুন৷ আপনাকে পুনরায় চিন্তনের সুযোগ দিচ্ছি৷ শুনেছি আপনি নিতান্তই বালক, বালকের ভুলে তাকে শাস্তিপ্রদানের পূর্বে তাকে বোঝানো আমার কর্তব্য৷ কিন্তু বাকি আপনার ভাগ্য আপনার হাতে৷
পুনশ্চ— আমার ধর্মবোধকে আমার দুর্বলতা ভাবার ভুল করবেন, সে-বিশ্বাস আমি করি না, তবুও বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে মনে করিয়ে দেওয়া কর্তব্য বোধ করলাম৷
পত্র পাঠের পর মাসুদের মনে হতে লাগল তার হিন্দে যাবতীয় সাফল্য, সমরকুশলতা, প্রাপ্তির ভাড়ার যেন এক লহমায় শূন্যে পরিণত হয়েছে৷ একাধিক সমরনায়ক, যারা নির্দ্বিধায় তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে, তাদের সকলে যেন তারই দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন, শুধুমাত্র একটি উত্তরের অপেক্ষায়৷ অবাক মাসুদ ভাবতে থাকেন মুলতান থেকে দিল্লি কত কত রাজা, প্রাদেশিক শাসক তার কাছে পদানত, আর এক সামান্য রাজন তার কাছে এ-ভাষায় পত্র প্রেরণ করছে৷ বীর সে নিঃসন্দেহে৷ মানুষ মাসুদ তাকে মনে মনে সেলাম জানায়৷ কিন্তু গজনীর সুলতানের প্রতিনিধি, যার এক ও একমাত্র লক্ষ্য বিধর্মী রক্তরঞ্জিত তরবারির ছটায় দিগন্ত আলোকিত করা, আর এ-দেশের মাটি রক্ত সেচিত করা, সেই সালার মাসুদ কি পারে তাকে সেলাম জানাতে? না কখনোই না৷ এর যথার্থ বিহিত হল আক্রমণ, যাতে এ-দেশের মানুষ কখনো মনে করতে ভীত হয় যে কোনো সময় সেখানে সুহেলদেব নামে কোনো রাজা ছিলেন৷ মাসুদ হাসিমকে বললেন প্রস্তুতি শুরু করুন… আর নয়৷
ইতিমধ্যে স্বয়ম্ভূ রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেছে৷ তাকে জীবিত দেখে সবথেকে আনন্দিত বাহারদেব৷ অসাধ্য সাধনের আশা সে যে মনে মনে করেনি তা নয়, কিন্তু বাস্তব বোধ তার সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছে বারে বারে৷ রাজসভায় রীতিমতো বীরের সম্মান পেল স্বয়ম্ভূ৷ কিন্তু তার অভিজ্ঞতা যখন সে রাজ সভায় সকলের সামনে জানাল, বিস্ময়ের শেষ রইল না৷ রাজা সুহেলদেব বুঝতে পারলেন তার সুলোচনের উপর অতিনির্ভরতা কতটা মারাত্মক হতে পারত, কারণ যুদ্ধে সে ভিতর থেকে অন্তর্ঘাত করার সম্ভাবনা ছিল পুরোমাত্রায়৷ আর সে জন্য স্বয়ম্ভূকে ধন্যবাদ জানালেন মনে মনে৷ স্বয়ম্ভূ বলল, মহারাজ আপনার সাথে আমার বিশেষ কিছু কথা রয়েছে৷ মহারাজের সাথে গোপন আলাপচারিতায় সে আগের সমস্ত কথা বিশেষ করে তার আক্রান্ত হওয়ার পরে, গুপ্তচরেদের অনুসরণ করা এবং জঙ্গলের মধ্যে গোশালার কথা সব জানাল৷ সমস্ত আলোচনায় মল্লদেব ও বাহারদেব উপস্থিত রইল এবং মল্ল তাকে পুরোমাত্রায় সমর্থন জোগাল৷
— মহারাজ আমি তিনজনকে অনুসরণ করে জঙ্গলে প্রবেশ করে দেখলাম একটি গোশালা এবং সমস্ত অপহৃত গাই সেখানে সুপালিত৷ নিয়মিত যত্নআত্তির মধ্যেই রাখা রয়েছে সেগুলিকে৷
বাহারদেব রীতিমতো চমকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু এর কী অর্থ সর্দার? বিধর্মীরা গাইগুলিকে অপহরণই বা করল কেন, আর লালন-পালনেরই বা কী কারণ?
— আমার মনে হয় ওগুলি যুদ্ধে আমার সৈন্যদলের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হবে৷ সুহেলদেব বললেন৷ ওরা আমার সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজখবর করে বুঝেছে যুদ্ধে সামনে গো বাহিনী থাকলে তাদের উপরে আমরা আক্রমণ করতে পারব না আর আমার সেই দ্বিধার সুযোগে ঝটিকা আক্রমণে আমাদের ছিন্নভিন্ন করে দেওয়াই ওদের লক্ষ্য৷
— আমারও ঠিক তাই ধারণা, মহাধিপ৷ সেই সুযোগে যবন সেনারা কার্য উদ্ধার করবে৷
— দেখা যাক, তবে মল্ল ও বাহার, তোমরা প্রস্তুত হও, আর সমস্ত প্রদেশে সংবাদ প্রেরণ করো বাহরাইচ অভিমুখে অগ্রসর হতে৷
আমার ধারণা আর বেশি সময় শত্রুপক্ষ দেবে না৷ অন্য রাজনদেরও প্রস্তুত হতে অনুরোধ করো, কিন্তু সাবধান কেউ যেন এখনই
আক্রমণের পথে না যায়৷
— আমরা সদা প্রস্তুত মহারাজ৷ মল্লদেব উত্তর দিলেন৷ আসন্ন যুদ্ধের কথা ভেবেই আমি সেনাবাহিনী প্রস্তুত রেখেছি, তবে
আমাদের সেনা সংখ্যা যবনবাহিনীর তুলনায় নিতান্তই নগণ্য, সুতরাং আমাদের কৌশলী হওয়া আবশ্যক৷
— যে কোনো যুদ্ধে কৌশলই মুখ্য মল্ল, তুমি দুশ্চিন্তা কোরো না৷ আমার এ-বিষয়ে তোমার সঙ্গে কিছু পরামর্শ আছে, কিন্তু তার আগে আমার স্বয়ম্ভূকে একটা বিশেষ দায়িত্ব প্রদান করতে হবে৷
অতঃপর দু-পক্ষের যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু হল পুরোমাত্রায়৷ সুহেলদেবের অনুমান সঠিক প্রমাণিত হল৷ শত্রুপক্ষ এই পত্র পাওয়ার পরে অতি দ্রুত আক্রমণ চালাতে শুরু করল রাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে৷ সালার মাসুদ যুদ্ধক্ষেত্রে তার নিজস্বতা বজায় রাখলেন নির্বিশেষে গণহত্যা এবং লুন্ঠনের মাধ্যমে৷ এ-অবস্থায় এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, লক্ষ সৈন্যের বিশাল বহর নিয়ে সালার মাসুদ বাহরাইচ প্রবেশ করে গেল কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই৷ কোথাও সুহেলদেবের সৈন্য-বাহিনী তাদের বাধা দেয়নি বিলকুল৷ সুহেলদেবের প্রত্যাশামতোই মাসুদের সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগে রইল বিরাট গোবহর, অবশ্যই ঢাল হিসেবে৷ যবন শিবিরে তখন রীতিমতো উৎসবের মেজাজ৷ আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরেই হিন্দের ফেলে রাখা কাজের পরিসমাপ্তি৷ কিন্তু সব কিছু যেন বড়ো অনায়াসে হয়ে যাচ্ছে, গ্রাম আক্রমণ হচ্ছে কিন্তু সব যেন ফাঁকা ফাঁকা, কোথাও অল্প কিছু গ্রামবাসী, কোথাও-বা তাও নেই৷ যারা আছে তারা কোনোভাবে বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টা করছে না, কেমন যেন আগে থেকেই হার মেনে নেওয়া মনোভাব৷ এমন তো এতদিন হয়নি, সব জায়গাতেই সে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হয়েছে৷ কেমন যেন একটা খটকা মাসুদের মনে, তবে কি চালে কোথাও ভুল হল? সুহেলদেব কি অন্য কোনো পরিকল্পনা ছকে রেখেছেন? যাই হোক একটু অন্য কথা ভাবা যাক, তাতে মনের প্রশান্তি আসবে, যুদ্ধে যথেষ্ট ক্লান্ত সে৷ বরং শিবিরের চারিদিকে সৈন্যরা বসে নিজেদের মধ্যে গল্প-তামাশা করছে, কেউ-বা বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে অবসর বিনোদন করছে, সেদিকেই যাওয়া যাক এই মনে করে অগ্রসর হলেন সালার মাসুদ৷ কিছু সেনা নিজেদের মধ্যে শাতরঞ্জ খেলছে, নিজেদের মধ্যে হই-হট্টগোল দেখে সেদিকেই গেলেন মাসুদ৷ সেনাধ্যক্ষকে আসতে দেখে সবাই একটু সংযত হল৷
— কী ব্যাপার এত হল্লা কিসের? প্রশ্ন করলেন মাসুদ৷
— রাজা ফাঁদে পড়েছে! যেদিকেই যাবে সেদিকেই মাত৷ উত্তর দিল এক উৎসাহী সেনা
হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলক৷ কাছেই কোথাও যেন একটা বাজ পড়ল৷ অশনি সংকেত৷ তাহলে কি সে আসলে রুদ্ধ! ঢুকে পড়েছে ঘেরাটোপে, এগোনো-পিছনোর পথ অবরুদ্ধ৷ কিন্তু হাসিম! তার অভিজ্ঞতাও কি বিফল হল? ধীর পদে তাঁবুতে ফিরে এলেন মাসুদ৷
— ইব্রাহিম… ডাক পারলেন, আজ কি গলাটা একটু কেঁপে গেল! কী জানি! নিজের উপর সন্দিহান মাসুদ৷
— জি জনাব, সেলাম ঠুকে এসে দাঁড়ায় ইব্রাহিম৷
— জলদি হাসিমকে বুলাও৷
— জি, সে তো কুছ পেহেলেই ঘোড়া নিয়ে বেড়িয়ে গেল৷ বহুত জলদি ছিল মনে হল৷
লেকিন, এত রাতে কোথায় গেলো হাসিম? স্বগতোক্তি করলেন সালার মাসুদ, এখন একটু পরামর্শ করা ভীষণ জরুরি ছিল, তার মনে যে কু গাইছে, তা একবার মিলিয়ে নেওয়ার জন্য হাসিমকে খুব দরকার ছিল তার৷ কিন্তু হাসিম বেরিয়েছে মানে নিশ্চিত কোনো জরুরি সংবাদ এসেছে৷ কিন্তু কী? আজ যেন কিছুই ভালো ঠেকছে না, একটা অদ্ভুত উচাটন অনুভব করছে সে৷ যাই হোক সে সেনাপ্রধান, কোনোভাবেই দুর্বলতা প্রকাশ করা চলে না৷ নিজেকে সংযত করে, যথাসম্ভব সহজভাবে উত্তর দেয়—
— ঠিক হ্যাঁয়, তুমি তাকে এলেই দেখা করতে বলো৷
— জি, অউর কুছ?
— না, তুমি যাও৷
মহারাজের সাথে গোপন পরামর্শের পর, স্বয়ম্ভূ আবার বড়ো কাজের দায়িত্ব পেয়েছে, মহারাজ সুহেলদেব কাল আক্রমণ করবেন মাসুদকে, চতুর্দিক থেকে আক্রমণে উদ্যত প্রাদেশিক রাজারা, অর্জুন, বীরবল, ভল্লার, নারায়ণ, কর্ণ প্রমুখ মোট একুশ-জন রাজা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে মাসুদের সেনাবাহিনীকে৷ প্রতিশোধের
আগুনে জ্বলছে তারা৷ কিন্তু সুহেলদেবের নির্দেশে কোনোভাবেই আগে থাকতে আক্রমণ করা যাবে না৷ আক্রমণ হবে একত্রে কাল প্রভাতে৷ যাতে মাসুদ কোনদিক থেকে আক্রমণ প্রতিহত করবে ভেবে ওঠার আগেই ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া সম্ভব হয় তার সেনাবাহিনীকে৷ কিন্তু তার আগে ঢালটাও সরিয়ে ফেলতে হবে, আর সে কাজের দায়িত্ব স্বয়ম্ভূর উপর৷
স্বয়ম্ভূ ধীরে ধীরে জঙ্গল পথে অগ্রসর হল৷ গোশালার নিকটবর্তী হয়ে সে দেখল আজ অনেকটাই অসুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে গোশালাটি৷ স্বয়ম্ভূর সঙ্গে রয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষিত দশজনের ছোট্ট একটি দল৷ যে অল্প কয়েকজন রয়েছে গোশালার সুরক্ষায় তারাও বেশ নিশ্চিন্ত রয়েছে৷ কিন্তু তাদের ভীষণ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, সামান্য ভুলে সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে পারে, কালকের লড়াইয়ের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করছে এই রাত্রিকালীন লড়াইয়ের ওপর৷ অনেক চিন্তা করে স্বয়ম্ভূ ঠিক করল একটা এমন কিছু করা আবশ্যক যাতে দ্বাররক্ষার দায়িত্বে থাকা সৈন্যরা অন্যদিকে সরে যায়, আর সেই সুযোগে কার্য হাসিল করা যায়৷
রাত্রির প্রায় তৃতীয় প্রহর, বাথানের দ্বারীরা মৃদু নিদ্রাচ্ছন্ন, কিন্তু দণ্ডায়মান৷ এ বিষয়ে তারা বিশেষ পারদর্শীই হয়৷ কোনো উপদ্রবের কোনো আশঙ্কা নেই, আর উপস্থিত হলেও মুহূর্তে তারা সজাগ হয়ে উঠবে, তারা তা জানে৷ দায়িত্বে থাকা সৈন্যরা হঠাৎ শুনতে পেল
দূর থেকে ফেউয়ের শব্দ, নিকটবর্তী বৃক্ষের উপরে ডালপালায় যেন তীব্র আন্দোলন, আর সেই সঙ্গে কিছু বাঁদরের মিলিত ডাক৷ এখানে বৃক্ষের উপর অনেক বাঁদরের উপস্থিতি তারা আগেও লক্ষ্য করেছে, কিন্তু এই অসময়ে চিৎকার… যেন ভয়ঙ্কর কিছু আঁচ করেছে এই প্রাণীগুলো৷ মনুষ্যেতর প্রাণীরা অনেক আগেই দুর্ঘটনার আভাস পায়, আর তা ছাড়া ফেউয়ের ডাক৷ প্রহরীরা নিশ্চিত হয় বাঘ গোশালার সন্ধান পেয়েছে৷ দুজনকে প্রহরায় রেখে বাকিরা এগিয়ে যায় কিছুটা৷ এই সুযোগ গাছের উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনানীর দল৷ হঠাৎ যেন অশরীরীদের আক্রমণ৷ দ্বারীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজনকে কব্জা করে অল্প কিছুক্ষণের বিরতি… সমস্ত গাই একসাথে মুক্ত… বাঘের সন্ধানে অগ্রসর হওয়া প্রহরীরা হতবম্ব, কিছু ভেবে ওঠার আগেই স্বয়ম্ভূ আর তার দলবল মিলিয়ে গেল কর্পূরের মতো৷
মাসুদকে দুর্ঘটনার সংবাদ দিল হাসিম৷ ঘটনার আকস্মিকতায় সে নিজেও হতবাক৷ অকস্মাৎ আসা এই সংবাদে বিহ্বল হাসিম ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়েছিল অকুস্থলে, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি৷ সুহেলদেবের বিরুদ্ধে ঢাল আর রইল না, এখন বাকি শুধু সম্মুখ সমর৷ মাসুদ মনে মনে ঠিক এই আশঙ্কাই করেছিলেন৷ কিন্তু এখন আর পিছিয়ে
আসার কোনো উপায় নেই৷ আর তা ছাড়া সে ভীরু, কাপুরুষ নয় যে সম্মুখ সমরে পিছু হটবে৷ তবে তার এই বিষয়টাতে আরও নিশ্ছিদ্র হওয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু যা হওয়ার তা কেই-বা খণ্ডাতে পারে৷
পরদিন প্রভাতে সূর্যদেব যথারীতি নির্দিষ্ট সময়েই উপস্থিত হলেন, দু-পক্ষে দুই সমরনায়ক বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন, এই বিষয়ে অনুমানের কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই৷ সুহেলদেব প্রস্তুত
মাতৃভূমির স্বাধীনতা তার পবিত্রতা বজায় রাখতে৷ আর অন্য দিকে মাসুদ তার জয়রথ সচল ও বাধাহীন রাখতে বদ্ধপরিকর৷ মল্ল ও বাহারদেব তাদের সেনাবহর নিয়ে, প্রস্তুত স্বয়ম্ভূ পুনরায় যবন সেনার বিরুদ্ধে তার সমর কুশলতা প্রদর্শন করতে৷ প্রস্তুত অশ্ব, মাতঙ্গর দল, আর এক দল স্বদেশপ্রেমে নিবেদিত সৈন্য৷ যারা যেকোনো মুহূর্তে স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে নিজেদের প্রাণ দিতে বা রণভূমি রক্ত সিক্ত করতে পারে নির্দ্বিধায়৷ মল্লদেব জানে এই সেনারা শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়তে জানে, আর পরিকল্পনা যদি সঠিক হয় তাহলে লক্ষ যবন সেনার উপর ভারী হতে পারে তারা৷
অগ্রসর হতে হতে সেনা দল পৌঁছোল বাহরাইচ জনপদের চিওত্তরা অঞ্চলে৷ দূরে আবছা মরীচিকার ন্যায় দোদুল্যমান ছায়া দৃশ্যমান৷ অজস্র অশ্বের পদ আন্দোলনে ধূসর দিগন্ত৷ সৈন্য সংখ্যা অন্তত পাঁচ গুণ৷ নিশ্বাস বন্ধ করে গণনা শুরু৷ এক, দুই, তিন… আক্রমণ… নির্দেশ দিলেন মহারাজ সুহেলদেব৷ শুরু হল প্রচণ্ড সংঘর্ষ৷ যে সংঘর্ষে রাজার সেনাদল ছিল নগণ্য৷ কিন্তু অমিত বিক্রমে তারা ছাড়িয়ে গেল মাসুদের সেনাদলকে৷ বাহারদেব ও মল্লদেবের দক্ষ রণকৌশলে পর্যুদস্ত যবন সেনারা পশ্চাদ্ধাবন করতেই চারিদিক থেকে আহত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল অন্য রাজাদের সৈন্যদল৷ অস্ত্রনিনাদ আর অশ্বের হ্রেষা ধ্বনিতে দিগন্ত কম্পিত হল৷
কিন্তু স্বয়ম্ভূ, লড়ছিল সে, তাকে ঘিরে ধরেছে অন্তত দশজন যবন সৈন্য৷ প্রত্যেকে উন্মুক্ত অসি৷ তরুণের তরবারি ঘুরছে অবিরত৷ একের পর এক শত্রু নিকেশ করে সে ঢুকে পড়েছে শত্রুব্যূহের অন্দরে৷ কিন্তু একাকী সে, আশেপাশে নেই একজন সহায়ক৷ বাহারদেব ব্যস্ত অপর দিকে, সে জানে কোনোভাবেই সাহায্য পাওয়া যাবেনা কোনোদিক থেকেই৷ কিন্তু সে অকুতোভয়৷ শহীদ হওয়ার দুর্বার আকর্ষণ যেন তাকে টেনে নিয়ে চলেছে আরও ভিতরে৷ আশেপাশে অসংখ্য নিস্পন্দ মৃতদেহের মাঝে লড়ে চলেছে স্বয়ম্ভূ, হঠাৎ পশ্চাৎ থেকে আক্রমণ৷ তীক্ষ্ণ তরবারির
আঘাত তাঁর লৌহজালিক এফোঁড়-ওফোঁড় করে বিদীর্ণ করল তার বক্ষদেশ৷ পিছনে ফিরে অনুমানেই অসিচালনা করল স্বয়ম্ভূ৷ মৃত্যু হল হাসিমের৷ দু-চোখে অন্ধকার দেখল স্বয়ম্ভূ৷ সময় শেষ হয়ে এসেছে তার… হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সে৷ দু-হাত দিয়ে
স্বদেশভূমিকে শেষবারের মতো স্পর্শ করল… অপরাহ্নের সূর্যকিরণ এসে পড়েছে তার ললাটে৷ যেন কোমল স্নেহস্পর্শে পবিত্র করে তুলেছে তার শরীর৷ যে অজ্ঞাতকুলশীল শিশু একদিন নতুন নাম পেয়েছিল, আজ যেন নিজের কর্মের দ্বারা সেই নাম উজ্জ্বল করে যেতে পেরেছে সে৷ না আর কোনো আক্ষেপ নেই তার দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় শহীদ সে৷ তার রক্তসিঞ্চিত জমিন আরও আরও স্বয়ম্ভূর জন্ম দেবে যুগে যুগে… বিদায়৷
সুহেলদেব তাড়া করেছেন মাসুদকে৷ তার সেই ভয়ঙ্কর রূপ ভাবতেও পারেনি সে৷ শুরু হল সম্মুখ সমর৷ একের পর এক তরবারির আঘাতে অশ্বচ্যুত হলেন মাসুদ৷ অতিমাত্রায় আহত৷ পুরো শরীর রক্তরঞ্জিত৷ রায় মহিপাল ও রায় হরগোপালের গদার আঘাতে আগেই চক্ষু ক্ষতিগ্রস্ত ও দুটি দাঁত ভেঙে গিয়েছিল তার, এবার ভূমি নিলেন মাসুদ৷ সহচরেরা উদ্ধার করল তাকে৷ আহত শত্রুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বীরোচিত নয়, তাকে নিস্তার দিলেন সুহেলদেব৷
ভারতবর্ষ বিদেশি হানাদারদের হাতে মুক্ত, পশ্চাদপসরণ ঘটেছে তাদের৷ শিবিরে মুমূর্ষু সালার মাসুদ তার শেষ ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন, এই মাটিতেই শায়িত থাকার৷ ধার্মিক সুহেলদেব মান্যতা দিলেন মুমূর্ষু শত্রুপ্রধানের শেষ ইচ্ছেকে৷ মাটির উপরে যতই কাড়াকাড়ি থাক, কিন্তু ঈশ্বর একজনই, সকল সন্তানের প্রতি তার সমান কৃপাদৃষ্টি, এ-বিশ্বাস তাঁর আছে, সুতরাং মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছে অবশ্যই পালনীয়৷
ভারতবর্ষ রক্ষা পেল বিদেশি হানাদারদের আক্রমণ আর লুন্ঠন থেকে৷ ইতিহাস মনে রেখেছে সালার মাসুদকে৷ তার মারা আজও রয়েছে বাহরাইচে৷ শোনা যায় যেখানে আজ এই সমাধি সেখানেই আগে ছিল পবিত্র সূর্যমন্দির৷ সে-বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় পরবর্তীতে দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ এই সমাধিস্থানটি পুনরায় নির্মাণ করেন৷ আমির খুসরুর লেখা কিংবা জিয়াউদ্দিন বরনীর ত্বারিখ-ই-ফিরোজশাহীতেও এই দরগার উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে মাসুদ গাজী রূপে চিহ্নিত৷ শুধু তাই নয় সে সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের নায়ক রূপে পরিগণিত৷ কিন্তু সুহেলদেবের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে হয় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থেকে৷ আজও গাজী সালার মাসুদের দরগার মেলায় লক্ষাধিক মানুষের ভিড় হয়, কিন্তু সুহেলদেবকে জানি আমরা ক-জন? আর স্বয়ম্ভূ? এরকমই কত স্বয়ম্ভূ মাতৃভূমির জন্য নিবেদিত হয়েছে, তার হিসেব ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না, আর তাই তারা ঐতিহাসিক চরিত্রও নয়৷ এ নিছকই রচনাকারের কল্পনা৷ লেখার শুরুতেই সতর্কীকরণ ছিল… তবুও স্বয়ম্ভূর মতো যোদ্ধারাই দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রাণ নেয়, আবার দেয়ও হাসি মুখে, ইতিহাসে তাঁদের নাম উল্লিখিত থাক আর নাই থাক তারা মৃত্যুর সামনেও অমলিন, অধৃষ্য৷
.
সহায়ক গ্রন্থ পঞ্জি
1. Fascinating Hindutva Saffron Politics and Dalit Mobilisation– Badri Narayan
2. Sleeman in Oudh An Abridgement of W. H. Sleemanós A Journey Through the kingdom of Oude– P. D. Reeves
3. Muslim Saints of South Asia The Eleventh to Fifteenth Centuries– Anna Suvorova
4. Conquest and Community The Afterlife of Warrior Saint Ghazi Miyan– Shahid Amin.
Leave a Reply