যুক্তিবাদীর চোখে রাম ও রামায়ণ – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
.
উৎসর্গ : আমার জীবনসঙ্গী শ্ৰীমতী তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমার সুপুত্র আয়ুধ বন্দ্যোপাধ্যায়কে
.
সূচিমুখ
- গোড়ার কথা : ইতিহাস ও ধর্মকথার দ্বন্দ্ব
- রামায়ণ কি ইতিহাস, নাকি রূপক?
- ‘নরচন্দ্রমা’ শ্রীরামচন্দ্র : ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক? ভগবান? ঐতিহাসিক মানুষ?
- দশরথ : পক্ষপাতদোষে দুষ্ট, বিষয়াসক্ত, কামার্ত, স্ত্রৈণ রাজা
- সীতা : তেজস্বিনী, পতিব্রতা এবং নার্সিসিস
- রাবণ : প্রাজ্ঞ, বেদজ্ঞ, নির্ভীক বীর, কামুক শিরোমণি এবং অপরিমাণদর্শী।
- লক্ষ্মণ : কর্তব্যনিষ্ঠ, ক্রোধী, বলশালী, অকুতোভয় এবং স্পষ্টবক্তা
- বাল্মীকি : মহাকবি, মহাঋষি এবং আর্যায়নের প্রতিনিধি
- রামায়ণে মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণের আধিপত্য
- রামায়ণের পার্শ্বচরিত্র : ইন্দ্রজিৎ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, মন্দোদরী, শত্রু, শান্তা, মন্থরা, লবকুশ, মারীচ, শূর্পণখা, অহল্যা
- বানর এবং হনুমান : মানুষ না ভগবান, নাকি মানবেতর প্রাণীমাত্র?
- রাক্ষস-খোক্ষস : বাস্তবে এবং অবাস্তবে
- যাঁরা রামায়ণেও আছেন, মহাভারতেও আছেন
- রামায়ণে অস্ত্র এবং শস্ত্র
- রামায়ণের খাদ্যতালিকা
- রামায়ণে বিমানের ব্যবহার
- শেষ পাতে, শেষ কথা
.
কথামুখ
রামায়ণের কাহিনি সমগ্র সমগ্র বিশ্বমানবের চিত্তের রসায়নস্বরূপ এমন কয়েকটি কাহিনির মধ্যে অন্যতম প্রথম শ্রেণির কাহিনি। প্রাচীন ভারতে ভারতবিদ্যার আধুনিক রীতির আলোচকদের মতে অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে ভারতে আর্যভাষায় রামায়ণ-কথা তার প্রথম রূপ প্রকাশ করেছে। পরে ভারতের মধ্যেই বিভিন্ন সাহিত্যিক ও মৌখিক রূপভেদকে আশ্রয় করে রামায়ণ কাহিনিটি পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়। ভারতের বিভিন্ন কথ্য ভাষায় প্রচলিত মৌখিক রূপগুলোর বিলোপসাধন না-করে, বরং সেগুলোকে অতিক্রম করে বাল্মীকির নামের সঙ্গে জড়িয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণরূপে এই কাহিনি এমন একটি চিরস্থায়ী মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে, যা কেবল ভারতীয় মানুষের পক্ষে নয়, বিশ্বের সকলের পক্ষেও এক অতি মহৎ সাহিত্যিক আকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সভ্যতার সঙ্গে রামায়ণের নাড়ীর যোগ আছে। ভারতের ভারতত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে রামায়ণ, সেইসঙ্গে মহাভারতের মাধ্যমেই।
সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৩০০ টি রামায়ণের সংস্করণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন ভাষায়। প্রতিটি সংস্করণই একে অপরের থেকে পৃথক। ফলে কোন্ রামায়ণ যথার্থ, কোন্ রামায়ণ নয়–সেটা ভক্তিভাবে বোঝা মুশকিল। যুক্তিভাবে বুঝতে হবে। যদিও সবকটি রামায়ণই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মান্য, তা সত্ত্বেও গোটা দেশে তুলসীদাসের রামায়ণের মাহাত্ম্যই বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। সংস্কৃত ভাষায় বাল্মীকির রামায়ণ ও বাংলা ভাষায় কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ এই দুটি পৃথক গ্রন্থ। তুলসীদাসের কোসলী (হিন্দি) রামায়ণ, যাঁর কবিপ্রদত্ত নাম হল শ্রীরামচরিতমানস’, এটিও আর-একটি পৃথক রামায়ণ। এই রামায়ণে বাল্মীকির রামায়ণকে অনুসরণ করা হয়েছে সামান্যই। তুলসীদাস স্বয়ং লিখছেন–“নানা-পুরাণ-নিগমাগম-সম্মতং যদ্/ রামায়ণে নিগদিতং, কচিদন্যতোহপি-/ স্বান্তঃ সুখায় তুলসী রঘুনাথগাথা-ভাষা-নিবন্ধমতিমঞ্জুলমাতনোতি।” অর্থাৎ, শ্ৰীযুক্ত সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের বঙ্গানুবাদ–“অনেক পুরাণ, বেদ ও শাস্ত্রসম্মত যে কথা রামায়ণে আছে, আরও অন্যত্র হইতে (নিজের অনুভব) একত্র করিয়া, নিজের অন্তরের সুখের জন্য রঘুনাথজীর গাথা, ভাষায় মনোহর ছন্দাদিরূপে বিস্তারপূর্বক তুলসী রচনা করিতেছে।” এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, স্বয়ং তুলসীদাস বলছেন ‘নিজ অনুভব ও কবি-কল্পনার প্রয়োগে তাঁর শ্রীরামচরিতমানস’ রচিত হয়েছে। অতএব এইসব কবিদের রামায়ণ থেকে রাম ও রামায়ণের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ যে ভক্তিরস এইসব কবিদের রচনা প্রবাহিত হয়েছে, তা দিয়ে প্রকৃত রামকে ছোঁয়া যাবে না। এহেন ভক্তি প্রবাহ বাল্মীকির রামায়ণে নেই। সেই কারণেই আমার এই গ্রন্থটি বাল্মীকির রামায়ণ অনুসারেই মূল্যায়ন করা হয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণকে ভিত্তি করেই আমার বিশ্লেষণ।
রামায়ণ–কারোর কাছে ইতিহাস, কারোর কাছে নিছকই রূপকথা, আবার কারোর কাছে শুধুই ধর্মগ্রন্থ। রাম কারোর কাছে মনুষ্যমাত্র, কারোর কাছে ভগবান। মহাকবি বাল্মীকির রামায়ণ যতটাই ইতিহাস, অন্যান্য কবিদের রচিত রামায়ণগুলি ততটাই রূপকথায় পর্যবসিত হয়েছে। অন্যান্য কবিগণ তাঁদের কাব্যে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বাল্মীকির রামায়ণকে বিকৃত করেছেন। আর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন রামকে দেবতার বানানোর। শুধু রামই নয়–লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সীতা, বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র, রাবণ, বানর, হনুমান, রাক্ষস প্রমুখ সমস্ত চরিত্রগুলিকেও ভগবান বা দেবতা বানিয়ে ছেড়েছেন অলৌকিক কাহিনির মধ্যে দিয়ে। এই কারণেই রাম ও রামায়ণকে নিয়ে এত বিভ্রান্তি, এত বিতর্ক। বাল্মীকির রামায়ণে কোনো চরিত্রই ভগবান বা দেবতা নন, এমনকি অবতারও নন৷ সকলেই দোষেগুণে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ মানুষ। বাল্মীকি রামায়ণে যে অতিরঞ্জিত নেই, একথাও হলফ করে বলা যায় না। রাজকাহিনি বা রামকাহিনি লিখতে গিয়ে অনেকেই অতিরঞ্জিত করে থাকে নানা কারণে।
এখন প্রশ্ন হল বাল্মীকির রামায়ণ ইতিহাস হতে বাধা কোথায়? আমরা তো অতিরঞ্জিত ইতিহাসই পাঠ করি। চন্দ্রগুপ্তের ইতিহাস, অশোকের ইতিহাস, বাবরের ইতিহাস, আকবরের ইতিহাস, আরঙ্গজেবের ইতিহাসে আমরা যে সূত্র থেকে পাই, সেগুলি তো অনেকটাই অতিরঞ্জিত ইতিহাস। ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিকদের ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস পাই একই ব্যক্তির একই ঘটনার। সেগুলি যদি ধ্রুবসত্যের ইতিহাস হয়, সেই ইতিহাস পাঠ্যবইতে পড়ানো হয়, তবে বাল্মীকির রামায়ণ কেন ইতিহাস হিসাবে পড়ানো সম্ভব নয়?
আমার এ গ্রন্থটি বাল্মীকির রামায়ণের উপর আধারিত। এই গ্রন্থের চরিত্র ও কাহিনি বিশ্লেষণ বাল্মীকিকে অনুসরণ করে। আমার আলোচনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বাল্মীকির রামায়ণটি হাতে তুলে নিতে হবে, অন্য কোনো মহাকবির রামায়ণ নয়। অন্য প্রাদেশিক মহাকবিদের রামায়ণের খুচরো কিছু কাহিনি আমি এনেছি তুলনামূলক আলোচনার সুবিধার্থে। একঘেয়েমি কাটাতে এই কাহিনিগুলি মনোরঞ্জনে সাহায্য করতে পারে। শুধু মনোরঞ্জন নয়, নিজের যুক্তিটাকেও শান দিয়ে নিতে পারবেন। আমার এ গ্রন্থে ভক্তির কোনো জায়গায় নেই, যুক্তির পালে হাওয়া দিয়েই এ গ্রন্থ শেষ লাইন পর্যন্ত পৌঁছেছে।
ইতিহাস যখন কাব্যে তখন তা অতিরঞ্জিত হয়, তা যুক্তি হারায়। আর সেই মিথ যদি ধর্মীয় কাহিনি হয়ে ওঠে তাহলে তা শেষপর্যন্ত বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। আর এখানেই জনমানসে বিভ্রাট ঘটিয়েছে। তার উপর অসংখ্য ভিন্ন ভাষায় রচিত অসংখ্য কবিদের কল্পকথার রং-চড়ানো কীর্তি রামায়ণকে বিতর্কের কেন্দ্রে এনে ফেলেছে। এই বিতর্কের অবসান হওয়ার নয়। তবুও একটা মীমাংসার চেষ্টায় আমার এই বিনম্র প্রয়াস। আদি বাল্মীকির থেকে আধুনিক চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পর্যন্ত–সবই আপামর মানুষ হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। রামায়ণ কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই নয়–মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেরই কাছে আগ্রহের বিষয়। যে যাঁর বিশ্বাসমতো সমাদর করে, পাঠ করে। বস্তুত আমাদের ইতিহাস মূলত রাষ্ট্র পরিবর্তনের ইতিহাস। কোন্ রাজার পর কোন্ রাজার শাসনকাল শুরু ও শেষ হয়েছে, তারই ‘অর্ধসত্য’ বিবরণই আমাদের প্রচলিত ইতিহাস। নানারকম কূট ষড়যন্ত্র, দূরভিসন্ধি, কুটিল, প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক দাবাখেলার মধ্য দিয়েই রাজাদের উত্থান-পতন রচিত হয়। রামায়ণের ঘটনাও এই সূত্রের বহির্ভূত নয়।
বৃহৎ ভারতের সমাজজীবনের প্রাণভোমরা রামায়ণ। কৃত্তিবাস, তুলসীদাসের মতো কবিদের দাপটে ভারতের মানুষ বাল্মীকিকে ভুলেই গেছেন। ভারতের অনেক মানুষ আবার রামানন্দ সাগরের দূরদর্শন ধারাবাহিক (সব রামায়ণের বাছাই করা কাহিনি একত্রে) রামায়ণকেই প্রকৃত রামায়ণ মনে করেন। গোটা রাম-কাহিনিটাই যেন কেমন গুলিয়ে গেছে। রামের কথা জানতে হলে, প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে হলে বাল্মীকির বিরচিত রামায়ণ অনুসরণ করা ছাড়া আর কোনো উপায়ান্তর নেই।
বস্তুত রামায়ণ নিয়ে যে-কোনো গবেষণা করা মানে মহাসাগরের জল নিয়ে মহাসাগরের গবেষণা করার সামিল। রামায়ণকে কেন্দ্র করে অসংখ্য গ্রন্থ লেখা হয়েছে। নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ হয়েছে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা হয়েছে। এখনও থেমে নেই। বিনির্মাণের পর বিনির্মাণ, এ তো চলতেই থাকে।
প্রাচীন যুগের সঙ্গে আধুনিক যুগকে মিলিয়ে দেখা। স্মরণে রাখতে হবে, মহাকবি বাল্মীকি কোনো ধর্মাবলম্বীদের জন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ লিখে যাননি৷ রামায়ণ-মহাভারতকে ধর্মগ্রন্থের মান্যতা দিয়েছেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা, প্রোপাগান্ডা করেছেন ব্রাহ্মণবাদীরাই। যেহেতু গ্রন্থটিতে মানবধর্ম অনেকটা অংশ জুড়ে আছে, আছে রাজধর্মও, গার্হস্থ্য ধর্ম। আছে পরমার্থ–ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের কাহিনি-সংবলিত ব্যাখ্যা। পরবর্তীতে সময়াসময়ে হিন্দুজাতিদের (হিন্দুধর্ম?) ধর্মগ্রন্থ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। বাল্মীকি যে সময় বসে গ্রন্থখানি সংকলিত করেছিলেন, সে সময় হিন্দুধর্ম বা হিন্দুজাতির ধারণাই তৈরি হয়নি। রামায়ণে কোথাও হিন্দু বা হিন্দুধর্মের উল্লেখ নেই। কোনো ধর্মাবলম্বীদের জন্য এ গ্রন্থ লেখা হয়েছে, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না রামায়ণে, মহাভারতে। বস্তুত ভারতের সংস্কৃতিই হিন্দুজাতির সংস্কৃতি, সেই বহমান ছবিই উঠে এসেছে রামায়ণে, মহাভারতেও। তাছাড়া রামায়ণ কেবল হিন্দুরাই গ্রহণ করেছেন তা তো নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরাও নিজেদের মতো করে গ্রহণ করেছেন। আমার মনে হয় একেশ্বরবাদী খ্রিস্ট বা ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও নিজেদের মতো করে গ্রহণ করতে পারত, যদি রামায়ণে ঈশ্বরের বহুত্ববাদ না-থাকত। যাই হোক, রামায়ণ সময় থেকে সময়ান্তরে এসে সংযোজিত হয়েছে সংস্কৃতির নতুন নতুন ধারা। সমৃদ্ধ হয়েছে মহাকাব্যিক ইতিহাস।
কৃত্তিবাস, রঙ্গনাথ, তুলসীদাসের মতো গুণি কবিরা মানুষকে স্বনির্মিত গল্প শুনিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন একজনের কাহিনির সঙ্গে অন্য মিল তো দূরের কথা, অমিলই দৃষ্ট হয়। ভাবনাও পৃথক পৃথক। গল্পের থিমও পৃথক পৃথক। কেউ-বা একে অপরের কাহিনি নিজের রচনায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যেমন পূর্বজ রচয়িতা রঙ্গনাথের স্বকল্পিত প্রচুর কাহিনি হুবহু নিজের রচনায় যুক্ত করে নিয়েছেন পরবর্তী রচয়িতা কৃত্তিবাস। আবার বাল্মীকির রামায়ণ আর অধ্যাত্ম রামায়ণের সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে শঙ্কর কবিচন্দ্রের বিষ্ণুপুরী রামায়ণ’।পরবর্তী রচয়িতারা বাল্মীকিকে তো অনুসরণ করেননি, উলটে বিপরীত পথে হেঁটেছেন। প্রকৃত সত্য ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজের মতো করে মনগড়া গল্প গেঁথেছেন।এর ফলে একই কাহিনির হাজারো পরিণতিতে তামাম মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এইসব রচয়িতারা কবি হিসাবে অবিসংবাদিত হলেও রামায়ণকার হিসাবে বিশ্বস্ত নন। এইসব রচয়িতাদের অনেকে অনুবাদক বলেন। আমি অনুবাদক বলতে পারছি না। কারণ এঁরা। কেউই মূল রামায়ণের ভাষান্তর করেননি। এঁরা যাঁর যাঁর ভাষায় নবরূপে লিখেছেন, যেখানে বাল্মীকি কম তিনিই প্রকট। প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল তাঁর তথাকথিত অনুবাদগ্রন্থ ‘না-মানুষের পাঁচালী’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন–“কোনো কাহিনিই অনুবাদ করিনি, কাহিনিগুলি অবলম্বনে বঙ্গভাষাভাষী পাঠকদের উপযুক্ত করে পরিবেশনের চেষ্টা করেছি।” বাল্মীকি-পরবর্তী রচিয়তারা সেই কাজটিই করেছেন।বেশি যেটা করেছেন, তা হল মূল ঘটনাকে যথেচ্ছ বিকৃত করেছেন এবং স্বকল্পিত সুপার ন্যাচারাল গল্প বুনেছেন।একেই বলে খোদার উপর খোদগারি!
সাম্প্রতিককালে অমীশ ত্রিপাঠি নামে একজন ‘বেস্ট সেলার’ লেখক ‘সীতা : মিথিলার যোদ্ধা’, মেহুলার মৃত্যুঞ্জয়ীগণ’, ‘বায়ুপুত্রদের শপথ’, ‘নাগরহস্য’, ‘ইক্ষ্বাকু কুলতিলক’ প্রভৃতি কয়েকখানি গ্রন্থ লিখেছেন পৌরাণিক তথা এপিক কাহিনির আধারে। লেখক সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক বলে ঘোষণা দিলেও বিশ্বাসী ভক্তরা যে বর্ণিত ঘটনাগুলি সত্যি বলে মেনে নেবেন না, এমন গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না।
বর্তমান ভারতে প্রায় সর্বত্রই ‘রাম রাম’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কে এই রাম? এই রাম বাল্মীকির মানুষ রাম নয়, এ রাম গোস্বামী তুলসীদাসের ‘ভগবান রাম। ব্রাহ্মণ্যধর্মের চেনা সমাজব্যবস্থার ছাঁচটা আদি শঙ্করাচার্যের সময় থেকে প্রয় ৩০০/৪০০ বছর ধরে নিষ্প্রাণতার শিকার হয়েছিল। এই নিষ্প্রাণতা থেকে উদ্ধারের জন্য যে প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল অনেকের মধ্যে তুলসীদাসই অগ্রগণ্য। তাই তুলসীদাসে রাম ব্রাহ্মণ্যবাদের চাহিদা পূরণ করেছেন। বাল্মীকির রাম ঈশ্বরপ্রতিম কোনো অধিনায়ক নন। মহৎ, কিন্তু রজোগুণসম্পন্ন একজন মানুষের যা কিছু দোষগুণ থাকে, বাল্মীকির রামের সবই আছে। কিন্তু তুলসীদাসের রাম ‘পুরুষোত্তম’, যিনি মানুষরূপে বিষ্ণুর অবতার। তাঁর সবকিছুই উত্তম, শ্রেষ্ঠ। তাঁর কোনো দোষই থাকতে পারে না। খণ্ডিত রাজপুরুষ রামের চরিত্রটির প্রেক্ষিতই পালটে দিলেন। হিন্দি আগ্রাসনের ফলে আজকের ভারতীয় সমাজব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছে তুলসীদাস সৃষ্ট রামভাবনার উপর। আজ ভারত যে রামকে চেনেন তিনি তুলসীদাসে রাম, বাল্মীকির রাম নয়–বিশেষ করে গোবলয়ে।
রামচরিতমানসও কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণের অবিকল ‘অনুবাদ’ নয়। কাহিনিসূত্র অনুসরণ করা হয়েছে, কিন্তু নানা ভিন্ন মাত্রা আছে। রামায়ণ নিয়ে তুলসীদাসের নিজস্ব উদ্দেশ্য ছিল, তা হল ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি সেগুলিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন একেবারে ভূমিগত মানুষের ভাষা ও মানসিকতার নিরিখে। ব্রাহ্মণ্যবাদ, ভক্তিবাদ, দারিদ্র্য, অবমাননা ইত্যাদি নানা আপাতভাবে পরস্পর বিরোধী উপাদান দিয়ে তিনি বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটা নতুন মূল্যবোধ, যার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। কৃত্তিবাসেরও ব্রাহ্মণ্যবাদের চাপ ছিল, তবে তা ন্যূনতম। কিন্তু তুলসীদাসের ভক্তিযুদ্ধটা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। একেশ্বরবাদী শাসকের আর্থ-নীতিগত বলপ্রয়োগের প্রতিষেধক হিসাবে রাম চরিত্রটির স্বভাবে শক্তি সঞ্চার করার দায় ছিল তাঁর। তবে তা ছিল ভক্তিবাদী মানসিকতার আধারে। কৃত্তিবাসকে এই দায়টির বোঝা বইতে হয়নি।
আমার রাম বাল্মীকির রাম। অন্য কোনো রাম নয়। না কৃত্তিবাসের রাম, না তুলসীদাসের রাম। এ গ্রন্থটি আমি বিশেষজ্ঞ গবেষকদের জন্য লিখিনি। যাঁরা ভাবছেন এই গ্রন্থ পাঠ করলে প্রভূত পুণ্যার্জন হবে, এ গ্রন্থ তাঁদের জন্যেও লিখিনি এ গ্রন্থ কেবলমাত্র যুক্তিনির্ভর সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখার চেষ্টা করেছি।এ গ্রন্থ কেবল তাদেরই জন্য লিখেছি, যাঁরা মহর্ষি বাল্মীকি এবং বাল্মীকির রামকে বুঝতে চান, মান্য করেন।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ৩১ জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত প্যাসাডেনায় ‘শেক্সপিয়র সভায়’ প্রদত্ত বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন–“রামায়ণের কবির নাম মহর্ষি বাল্মীকি। পরবর্তীকালে অপরের রচিত অনেক আখ্যানমূলক কবিতা, ওই প্রাচীন কবি বাল্মিকির পরিচিত নামের সহিত জড়িত হইয়াছে। শেষে এমন দেখা যায় যে, অনেক শ্লোক বা কবিতা তাঁহার রচিত না হইলেও সেগুলি তাঁহারই বলিয়া মনে করা একটা প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই সকল প্রক্ষিপ্ত অংশ থাকিলেও আমার এখন উহা যে আকারে পাইতেছি, তাহাও অতি সুন্দরভাবে গ্রথিত, জগতের সাহিত্যে উহার তুলনা নাই।”
মোট কথা, রামায়ণ লোকমুখে গীত হওয়ার জন্যই রচিত হয়েছিল, যা কুশীলব তথা গায়কগণ কর্তৃক গীত হিসাবে প্রচারিত হয়েছিল, তাই এটা গীতিকাব্যও। বাল্মীকি এই গ্রন্থের কোনো নামকরণ করেননি। রামায়ণ’ বাল্মীকি কর্তৃক দেয় শিরোনাম নয়। তবে কে বা কারা এই গ্রন্থের নাম ‘রামায়ণ’ রেখেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বাল্মীকির রামকথার নাম ‘পৌলস্ত্যবধ কাব্য’–“কাব্যং রামায়ণং কৃৎস্নং সীতায়াশ্চরিতং মহৎ।/পৌলস্তবধ ইত্যেবং চকার চরিত ব্ৰতঃ”–অর্থাৎ রামায়ণ গীতিকাব্যের রচয়িতা মহামুনি বাল্মীকি। পুরাণ মতে পুলস্ত মুনির বংশধর বলে রাবণের পর নাম পৌলস্ত্য। তিনি পৌলস্ত বধ নামে রাম ও সীতার চরিত সংবলিত কাব্য রচনা করেছিলেন এবং সেটি রামায়ণ নামে পরিচিত হয়েছিল। একথা রামায়ণের প্রথম সংগ্রহকারকের লিখিত মুখবন্ধ থেকেই জানা যায়। রামায়ণের রচয়িতা হিসাবে মহাকবি বাল্মীকির পরিচয় তাঁর রচিত এই কাব্যে কোথাও পাওয়া যায়নি। ভাগবতকার বাল্মীকিকে আদি কবি বলে স্বীকার করেননি। তিনি ব্রহ্মাকে আদি কবি বলে অভিহিত করেছেন–“তেনে ব্ৰহ্মহৃদায় আদি কবয়ে”। তবে আদি কবি হিসাবে ব্রহ্মা কোনো গ্রন্থ বা কাব্য লিখেছিলেন কি না তার কোনো উল্লেখ কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বেদ ও উপনিষদ ছাড়া রামায়ণের আগে রচিত হয়েছে এমন কোনো গ্রন্থ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অবশ্য পাওয়া যায়নি বলে রামায়ণই আদি কাব্য, তাও হলফ করে বলা যায় না। তবে একেবারে প্রথম খ্রিস্টাব্দের কৰি অশ্বঘোষ তাঁর ‘বুদ্ধচরিত’ লিখেছেন, চ্যবনমুনিই রামায়ণ রচনা আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু রামায়ণটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। বাল্মীকির পৌলস্ত্যবধ কাব্যের নায়ক-নায়িকা-খলনায়ক-শত্রু-মিত্র সকলেই ছিলেন রক্তমাংসের নিখাদ মানুষ। কালে কালে বহু কবি হাত ধরে রাম যতই অবতারের দিকে উন্নীত হন ততই তাঁর মিত্ররা নখ-লেজ-লোমওয়ালা জন্তুজানোয়ার হতে থাকে। অপরদিকে শত্রুরা রাক্ষস-খোক্ষস-ভূতভূতুমের রূপকথায় পরিণত হয়ে যায়। রামায়ণে সকল চরিত্রই কোনো-না-কোনোভাবে দেবতা, বিপুল অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী–তাঁরা হয়কে নয়, নয়কে হয় করতে দক্ষ। একজন বাদে, তিনি হলেন সীতা–জন্মের ঠিক নেই এমন এক কন্যার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই, এক অসহায় মানবী। মূলত এগারো/বারো শতক নাগাদ তামিল কবি কম্বনের (কম্বন রামায়ণ’ নামে পরিচিত) কল্পনায় রামচন্দ্র অর্ধদেবত্ব লাভ করেছেন। এরপর মোলো শতকে এসে তুলসীদাসের (‘রামচরিতমানস’ নামে পরিচিত) কল্পনায় রামচন্দ্র পূর্ণদেবত্ব তথা ভগবানত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। এতটাই ভগবানত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন যে, গো-বলয়ে একে-অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে ‘রাম রাম’ বলে সম্ভাষণ করে থাকেন। এতটাই ভগবানত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্বাধ্বী নিরাঞ্জন অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন–“আপনারা দিল্লিতে রামজাদের সরকার চান, নাকি হারামজাদের সরকার চান?” স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তাঁকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। অবশেষে তুমূল চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে তিনি সংসদে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছেন–“ভারতে ‘রামজাদে’ বলতে সব ভারতবাসীকেই বোঝায়। কারণ এদেশে হিন্দুরা তো বটেই, খ্রিস্টান মুসলিমরাও রামেরই সন্তান।”
তর্কের শেষ নেই। এক পণ্ডিত যা বলেন, অন্য পণ্ডিত তা প্রত্যাখ্যান করেন। মূল রামায়ণের থেকেও প্রাদেশিক রামায়ণ এবং তার কবিই হয়ে উঠেছে প্রিয়তম। মূল সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণের খোঁজ কেই-বা রেখেছেন। বাঙালিজীবনে যেমন রামায়ণ বলতে কৃত্তিবাসের প্রভাব, তেমনই হিন্দিবলয়ে তুলসীদাস। অনুরূপ কাশ্মীরে দিবাকর ভট্টের রামায়ণ বা দাক্ষিণাত্যের প্রদেশগুলিতে কম্বনের রামায়ণ অথবা রঙ্গনাথনের রামায়ণ। আছে ভিল রামায়ণ, মোল্লা রামায়ণ এবং দুরন্ত রামায়ণও। ওডিশা, নেপাল, তিব্বত, থাইল্যান্ড, আসাম–প্রত্যেকের একটি করে নিজস্ব রামায়ণ আছে। সেসব রামায়ণ কখনো চমৎকার, কখনো অদ্ভুত, কখনো-বা অর্থহীন–তবুও মান্য।
বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, কোরান, বাইবেল ইত্যাদি সারা পৃথিবীর শাস্ত্র তথা কিংবদন্তীগুলি নতুন নতুন ব্যাখ্যায় আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে, জানতে পাচ্ছি নবতম তথ্য। চোখের ঠুলি আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে খোলা চোখের বিশ্লেষণে। কেউ বলেন রামায়ণ ধর্মগ্রন্থ, কেউ বলেন মহাকাব্য, কেউ বলেন ইতিহাস।
বাল্মীকির রাম কোনো দেবতা নন, দৈত্যদানবও নন৷ বাল্মীকির রামায়ণের রাম সুখে-দুঃখে কাতর মর্তমানব। তিনি মানৰশ্রেষ্ঠ, নরচন্দ্রমা। বাল্মীকির তাঁর কাহিনি বর্ণনার মধ্য দিয়ে মানবজীবনের ও মানবগৃহধর্মের বিজয়বার্তা ঘোষণা করেছেন। রামায়ণ গৃহাশ্রমের কাব্য। যাঁরা কথায় কথায় কারও ভাবাবেগে বা বিশ্বাসে আঘাত করা ঠিক নয় বলেন, তাদেরকে বলি–কোপারনিকাস, ব্রুনো, গ্যলিলিও প্রমুখরা খ্রিস্টান ভাবাবেগকে আঘাত দিয়েছিলেন, বলেছিলেন পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে না, সূর্যের চারদিকেই পৃথিবী ঘোরে। বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রামমোহন প্রমুখ পূজনীয় ব্যক্তিগণ বহু লোকের ভাবাবেগকে আঘাত দিয়ে সমুদ্রপার করেছিলেন। বিদ্যাসাগর ও রামমোহন প্রমুখ তো বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ, বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে অসংখ্য মানুষের শতাব্দী প্রাচীন বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছিলেন। এক শ্রেণির দুষ্কৃতিরা বাবর-ই-মসজিদ ভেঙে, বামিয়ানে বুদ্ধমূর্তি ভেঙে আর-এক শ্রেণির মানুষের বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করেছেন। যাঁরা বাইবেল পোড়ায়, যাঁরা বেদ পোড়ায়, যাঁরা কোরান পোড়ায়–তাঁরা কারা? তাঁরা অন্যের ভাবাবেগে বা বিশ্বাসে আঘাত করেন না? লেখকরা কাতোর বিশ্বাসে আঘাত করে না, আঘাত করার জন্যেও লেখেন না–এটা একটা চাপিয়ে দেওয়া অভিযোগ, মূলত ব্যক্তিগত আক্রোশকেই চরিতার্থ করেন। যাঁরা করেন তাঁরা লেখক পদবাচ্যই নয়। লেখক কেবল প্রচলিত মিথ ভাঙে, মিথ ভেঙে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই লেখক সাধারণ পাঠকদের চিনিয়ে দেয় মিথ্যাসংস্কৃতির ধারক ও বাহকদের। সত্যটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে কারো-না-কারো বিশ্বাসে আঘাত লাগে। লেখক সত্যসন্ধানী। আমি যাকে জন্ম থেকে বিশ্বাস করে এসেছি যে ব্যক্তিটি আমার বাবা, পরে জানতে পারলাম তিনি আমার বাবা নন, আমি তাঁর ঔরসজাত নই, তিনি কেবলই আমার মায়ের স্বামী–এটাও কি বিশ্বাসে বা ভাবাবেগে আঘাত নয়? আঘাত হলেও, এ সত্য সন্তানকে জানাতেই হবে। সত্য উন্মোচনের মাধ্যমে এই আঘাত না-দিলে সমাজ বর্বর তথা অন্ধকার যুগেই স্থির হয়ে থাকত, প্রগতি বলে কিছু থাকত না। তাই প্রগতির স্বার্থে এ বিশ্বাসে আঘাত দেওয়াও আবশ্যক হয়ে পড়ে। কী বিশ্বাস করবেন, কী বিশ্বাস করবেন না–তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শিক্ষার উপর। যেমন ধরুন–নারদ বাল্মীকিকে যে রাম-কথা শুনিয়েছিলেন (বালকাণ্ড, প্রথম সর্গ), সেই রামকথা রামের রাজ্যলাভেই ইতি হয়েছে। এরপর ১১,০০০ বছর রাজত্ব করার পর রাম ব্রহ্মলোকে গমন করবেন এবং রাজত্বকালে রাম শত সংখ্যক অশ্বমেধ যজ্ঞ, বর্ণাশ্রম প্রতিষ্ঠা ও ব্রাহ্মণদিগকে প্রচুর সংখ্যক গো ও পর্যাপ্ত ধনাদি দান করবেন–নারদ ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন মাত্র। কিন্তু নারদের ভবিষ্যৎবাণীতে সীতার বনবাস, শক্রম্নর যৌবরাজ্যে অভিষেক, লবকুশের জন্ম, রামের অশ্বমেধ যজ্ঞে পিতাপুরে মিলন, সীতার পাতাল প্রবেশ, কুশকে কোশলের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা, রামের পরিশেষে লক্ষ্মণকে বর্জন এবং ভরত ও শত্রুঘ্ন সহ সরযূ নদীতে আত্মবিসর্জন–এইসব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলির কোনো উল্লেখ নাই। ভেবে দেখতে বলি।
‘গঙ্গার মতো তীর্থ নেই, মায়ের মতো গুরু নেই, বিষ্ণুর মতো দেবতা নেই আর রামায়ণের মতো শ্রেষ্ঠ কিছু নেই”–পুরাণের আপ্তবাক্যটির ততদিন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, যতদিন ভারত থাকবে, যতদিন ভারতের নদনদী প্রবাহিত হবে, যতদিন ভারতের পর্বতমালা উত্তুঙ্গ মহিমায় বিরাজ, যতদিন সুপ্রাচীন আরণ্যক সভ্যতার মূল মর্মকথাটি অনুপ্রাণিতহতে থাকবে মানুষের হৃদয়ে। জাতিধর্মনির্বিশেষ রামায়ণ থাকবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবেই। আদি বাল্মীকির রামায়ণ থেকে আধুনিক চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পর্যন্ত–সবই আপামর মানুষ বুকে করে রেখেছে। রামায়ণ কেবলমাত্র হিন্দুদেরই সম্পদ নয়–সব ধর্মাবলম্বীদের কাছেই আগ্রহের বিষয়। বস্তুত আমাদের প্রধানত রাষ্ট্র-পরিবর্তনের ইতিহাস। কোন রাজার কোন্ রাজার শাসনকাল শুরু এবং শেষ হল তারই ‘অধসত্য’ বিবরণের পুনর্মূল্যায়ণই আমাদের ইতিহাস রচনার কাজ, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ববিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে হবে। রাজার ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। নানারকম কূট ষড়যন্ত্র, দুরভিসন্ধি, প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক দাবাখেলার ভিতর দিয়েই রাজাদের উত্থান-পতন রচিত হয়। রামায়ণের কাহিনিও তার ব্যতিক্রম নয়।
আগেই বলেছি আমার রাম বাল্মীকির রাম। কৃত্তিবাস বা তুলসীদাসের রাম নয়। তাই যাঁরা ভাবছেন এই গ্রন্থ পাঠ করলে পুণ্যার্জন হবে, পরিষ্কার বলে রাখি তাঁরা হতাশ হবেন। এ গ্রন্থ শুধুমাত্র যুক্তিবাদী পাঠকদের জন্য যুক্তিবাদীর উপস্থাপনা। এই গ্রন্থ শুধুমাত্র যাঁরা মহর্ষি বাল্মীকি ও তাঁর রামকে বুঝতে আগ্রহী তাঁদের জন্য। আর-একটা কথা যেটা বলা উচিত, সেটা হল আমি গ্রন্থটি বাল্মীকির রামায়ণের ভাষাগত ও কাঠামোগত বিশ্লেষণ করিনি। তা করতেও এই গ্রন্থের অবতারণা নয়। এই গ্রন্থটি পাঠ করে কোনো পাঠকের যদি মনে হয় এটি বামপন্থী ও বিজেপি-বিরোধী মানসিকতার ফসল, সেটা ভেবে নিলে ভুল হবে বলব। কারণ আমি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী নই। আমি নিজস্ব মতাদর্শেই আস্থা রাখি। সেই আস্থার ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়েই প্রতিষ্ঠা করেছি আমার মত। একজন প্রাবন্ধিক হিসাবে প্রাবন্ধিকের মতই যে প্রকাশ হবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই মতে কেউ সহমত হবেন, কেউ হবেন না। সকলেই লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হবেন, এমন প্রত্যাশা কোনো লেখক করেন বলে আমার জানা নেই। অনেক পাঠক বলতে পারেন, রামায়ণের তো বহু সংস্করণ আছে। সেই প্রতিটি সংস্করণে প্রতিফলিত হয়েছে স্থানীয় ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, ধর্মীয় আচার, জীবনযাত্রা ইত্যাদির ভিত্তিতে। সেগুলো যদি বিশ্লেষণ করে রামায়ণী কথার মাধ্যমে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার জাতিগত ইতিহাসের উপর আলোকপাত করতেন, তাহলে ভালো হত। হ্যাঁ, অবশ্যই ভালো হত। কিন্তু এই গ্রন্থে সেই পরিসর নেই। পৃথক একটি গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।
পরিশেষে জানাই, আমি পণ্ডিত নই। বরং পণ্ডিতগণের আলোয় আমি আলোকিত–এভাবেই নির্ণায়ক। আমার এ লেখা পাঠ করে যদি কোনো পাঠকের মনে হয় তাঁর অনেকদিনের আজন্ম লালিত বিশ্বাসে নাড়া লেগে গেছে, তাহলে তাঁর কাছে আমার বিনম্র নিবেদন রাখি–এ রচনায় সম্পূর্ণভাবে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান এবং হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত রামায়ণ থেকেই আমার রসদ আহরিত হয়েছে। এই গ্রন্থে কোথাও এমন অক্ষর এমন শব্দ এমন বাক্য উল্লেখ হয়নি, যার ফলে ভক্ত-পাঠকগণের বিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে। এমন কোনো বর্ণনা করা হয়নি, যা কোনো বাল্মীকির রামায়ণে উল্লেখ নেই। তা সত্ত্বেও যদি কোনো পাঠকের হৃদয়ে ন্যূনতম রক্তক্ষরণ হয়, তা আমার অনিচ্ছাকৃত–উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। কোনো বিশ্বাস ও কল্পনার আশ্রয়ে এ গ্রন্থ গড়ে ওঠেনি। প্রতিটি চরিত্র আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছি। এতে চরিত্রগুলিকে অনুধাবন করতে সুবিধা হবে বলে আমার বিশ্বাস। যতটা পেরেছি যুক্তি দিয়ে আলোচনা করেছি। যুক্তির সুরে তার বেঁধেছি, ভক্তির সুরে নয়। আমি অলৌকিকত্ব, ভগবত্তার ভক্তিরসে কলম ডোবাতে পারিনি–এটা যদি আমার ব্যর্থতা বলেন, তাহলে এ ব্যর্থতা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই।
সেইসব গ্রন্থ, যেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছি, সেইসব গ্রন্থ, লেখক ও প্রকাশকদের কাছে আমি চিরঋণী। সবসময় সেইসব সূত্র উল্লেখ করা সম্ভব না-হলেও যতটুকু পেরেছি উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। অভিনন্দন জানানোর ভাষা নেই তাঁকে, যিনি এই গ্রন্থের প্রকাশক সেই Exceller Books-এর অঞ্জিতা গাঙ্গুলিকে। অঞ্জিতা আগ্রহী না-হলে আমার এই গ্রন্থখানি আপনাদের মতো বিদগ্ধ পাঠকদের কাছে পৌঁছোত কি না, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল। এছাড়া যে শুভানুধ্যায়ীরা আমাকে অন্তরাল থেকে এ গ্রন্থ রচনায় সাহস জুগিয়েছেন, প্ররোচিত করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করার ধৃষ্টতা আমার আছে বলে মনে করি। শেষ কথা, আমার এ লেখা যদি বিদগ্ধ পাঠকমহলে সমাদৃত হয়, বিন্দুমাত্র চিন্তার খোরাক সরবরাহ করতে সক্ষম হয়, তাহলেই আমার দীর্ঘদিনের ঘাম ঝরানো সার্থক হবে।
–অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা : (১) মনুসংহিতা–সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, (২) বাল্মীকি রামায়ণ–পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত (৩) কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ, (৪) চন্দ্রাবতীর রামায়ণ (৫) বিষ্ণুপুরী রামায়ণ–শঙ্কর কবিচন্দ্র (৬) বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ–নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, (৭) রামায়ণ ও মহাভারত : নব সমীক্ষা–শ্ৰীমনোনীত সেন, (৮) বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা–সুকুমারী ভট্টাচার্য, (৯) প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য–সুকুমারী ভট্টাচার্য, (১০) তুলনামূলক আলোচনায় রামায়ণ ও মহাভারত–ড. বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, (১১) বাংলা সাহিত্য ও বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে রামায়ণ–লেখক অজ্ঞাত (১২) বাল্মীকি রামায়ণে রাম আদিবাসী রামায়ণে রাম–বিপ্লব মাজী, (১৩) রামায়ণের উৎস কৃষি–জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, (১৪) রামায়ণের প্রকৃত কথা–শ্রীসতীশচন্দ্র দে, (১৫) রামায়ণের সমাজ–কেদারনাথ মজুমদার, (১৬) রামায়ণ ভোলা চোখে–হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৭) বাল্মীকির জয়–হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮) ভারতবর্ষের ইতিহাস–রোমিলা থাপার (১৯) ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়–অতুল সুর (২১) রামায়ণ : মিথ অর রিয়ালিটি–হাসমুখ ধীরাজলাল সানকালিয়া (২২) সহজিয়া রামায়ণ–মাহবুব লীলেন (২৩) বর্তমান (শারদ সংখ্যা ১৪১৫), পৃষ্ঠা ৬৪ (২৪) খাসতদন্ত (দ্বিতীয় বর্ষ/দ্বিতীয় সংখ্যা) (২৫) সাপ্তাহিক বর্তমান (১২ মার্চ, ২০১৬) (২৬) রামায়ণী কথা–দীনেশচন্দ্র সেন (২৭) বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (অষ্টম ও নবম খণ্ড)(২৮) রামায়ণে রাক্ষস সভ্যতা–স্বামী বিবেকানন্দ (২৯) অশোকবনে সীতা–জনৈকা দুঃখিনী স্ত্রীলোক (৩০) রামলক্ষ্মণ–গোবিন্দচন্দ্র রায় (৩১) রামবিলাপ–নগেন্দ্রনারায়ণ অধিকারী (৩২) সীতাচরিত্র–কৃষ্ণেন্দ্র রায় (৩৩) ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়–অক্ষয়কুমার দত্ত (৩৪) প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)–সুনীল চট্টোপাধ্যায় (৩৫) হেলেন সীতা দ্রৌপদী–শেখর সেনগুপ্ত (৩৬) স্বর্গলোক ও দেবসভ্যতা–শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্র (৩৭) পৌরাণিক অভিধান–সুধীরচন্দ্র সরকার (৩৮) রামায়ণ-মহাভারতের দেব-গন্ধর্বরা কি ভিনগ্রহবাসী?–নিরঞ্জন সিংহ (৩৯) চরিত্রে রামায়ণ মহাভারত–শিপ্রা দত্ত (৪০) মেগাস্থিনিসের ভারতবিবরণ–সম্পাদনায় বারিদবরণ ঘোষ (৪১) হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ–হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য (৪২) রামায়ণ প্রসঙ্গে–লেখক অজ্ঞাত (৪৩) রামায়ণ সারসংগ্রহ–শ্রীকুশদেব পাল (৪৪) রামায়ণে দেবশিবির–বীরেন্দ্র মিত্র (৪৫) রামচরিতমানস–তুলসীদাস (৪৬) হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত (৪৭) আলবেরুনীর দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত (৪৮) ইবন বতুতার দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত (৪৯) তিব্বতী পরিব্রাজকদের দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত। (৫০) দ্বীপময় ভারত–সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। (৫১) ভারতবর্ষ (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা) (৫২) অনালোকিত অতীত ইতিহাসে ভারতীয় মূলনিবাসীরা ও তাদের ধর্ম ভাবনা (যুদ্ধঃ আর্য বনাম আর্য, দাস ও দস্যু)–মণিমোহন বৈরাগী। (৫৩) দানিকেন প্রমাণ–অজিত দত্ত অনূদিত, (৫৪) রামায়ণ–মহেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত।
Rajkumar roy
ভালো কথা।।।।।
Sakib
ভালো লাগলো