যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০১৯
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: সৌরীশ মিত্র
.
মিটল না সাধ
সুনীলদা চলে গেছেন, ছ’বছরের বেশি হয়ে গেল। থাকলে, এখন তাঁর বয়েস হত চুরাশি। কী এমন বয়েস? আটাত্তরে যে একটুও বুড়ো হয় না, চুরাশিতেই বা তার যাওয়ার সময় হবে কেন?
এই সঙ্কলনের শেষ লেখাটি ২০১২ সালের ১০ অক্টোবর, তাঁর বিদায়ের তেরো দিন আগে প্রকাশিত। সেই লেখার শিরোনাম: ভালবাসার জন্য কাঙালপনা মুছে যায়নি তো? সুনীলদা চলে গেছেন অষ্টমী পুজোর রাতে। হিসেব করে দেখছি, এই লেখা যখন লিখছেন তিনি, তখনও দেবীপক্ষ পড়েনি। বাল্যে কৈশোরে তারুণ্যে শারদোৎসব কেমন ছিল তাঁর, তাঁদের, সেই সব কথা নিয়েই লেখা। আমরা তো জানি, পুজোর দিনগুলোতে সতেরো বছর বয়স কী দুঃসহ! কিন্তু জানলেও, ক’জন আটাত্তরে বসে লিখতে পারে সে কথা? সুনীলদা লেখেন, “তখন মণ্ডপে ঠাকুর দেখা হত এক ঝটকায়। তার পরই দু-চোখ খুঁজত জ্যান্ত সুন্দরী কিশোরীদের।’ এবং স্বভাবসিদ্ধ সহজ স্বীকারোক্তি তাঁর: ‘আমরা মেয়েদের কাছে দয়া চাইতাম। কখনও কখনও তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দু-একটা ব্যাপারে সম্মতি আদায় করতেও আপত্তি ছিল না। আমরা ছিলাম ভালবাসার কাঙাল।’ তার পর পৌঁছে যান তাঁর উপসংহারে, যা হয়ে উঠবে তাঁর এই আশ্চর্য কথামালার শেষ অনুচ্ছেদ: ‘এখন ছেলেমেয়েদের মেলামেশার কত সুযোগ রয়েছে। ও-রকম লুকোচুরির কোনও দরকার নেই। তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই যে ভালবাসা পাওয়ার জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা, তা এ-কালে বরবাদ হয়ে যায়নি নিশ্চয়ই।’ এই লাইনগুলো নির্ভুল জানিয়ে দেয় আমাদের— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শেষ দিন পর্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই তরুণ ছিলেন, শরীরের বয়সকে সহজভাবে স্বীকার করে নিয়েই এবং পালটে যাওয়া সময়কে অনায়াসে মেনে নিয়েই তাঁর মন নিজেকে নবীন রাখতে পেরেছিল। তাই বলছিলাম, আটাত্তর কিংবা চুরাশি হলেই চলে যেতে হবে, তার কী মানে আছে?
আসলে বছর দুয়েক ধরে পক্ষকাল অন্তর প্রকাশিত এই লেখাগুলো অনেক দিন পরে নতুন করে, এবং একসঙ্গে পড়তে পড়তে মানুষটার জন্যে খুব মন কেমন করে উঠল। সুনীলদার সঙ্গে প্রথম আলাপ চাকরির সুবাদেই। সম্ভবত ১৯৮৫ সাল, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ শুরু করেছি। এক দিন তিনি এলেন আমাদের ঘরে, নিখিলদার (নিখিল সরকার, শ্রীপান্থ) কাছে একটা লেখা দিতে, বোধহয় নববর্ষের লেখা। অফিসের পরিবেশ তখনও খুব ঘরোয়া, ছোট্ট ঘরে অনেকে মিলে বসি, কাজ হয়, কাজের সঙ্গে অনর্গল গল্প, চা, সিগারেট। সুনীলদাও একটা চেয়ার টেনে বসে আধ ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে গেলেন, সবে কোন দেশে যেন বেড়িয়ে ফিরেছেন, সেই গল্প। আসা, যাওয়া, কথা বলা, সবটাই খুব সহজ, স্বাভাবিক, ঠিক তাঁর লেখার মতো। মনে আছে, বেশ লেগেছিল।
তার পরে সাতাশ বছরে যখন যেখানে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে— সাধারণত অফিসে, বেশ কয়েক বার তাঁর বাড়িতে, ক্বচিৎ কোনও অনুষ্ঠানে— ওই বেশ লাগা-র অনুভূতিটায় এক দিনের জন্যও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘যা দেখি যা শুনি’-র পাতা ওলটাতে ওলটাতে বেশ লাগল, আর তাই তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করল, এমনিই, উদ্দেশ্যহীন, খুব বেশিক্ষণও নয়— একটু বসলাম তাঁর কাছে, গল্প করলাম, তার পর বললাম, ‘উঠি, সুনীলদা’, অল্প একটু ঘাড় নেড়ে হেসে বললেন, ‘এসো, এসো আবার’। এইটুকুই তো!
মনে আছে, এক দিন কী একটা দরকারে তাঁর কাছে গিয়েছি, দেশ পত্রিকার অফিসে, কথা সেরে উঠলাম, তিনিও উঠে পড়লেন, বললেন, ‘চলো, আমিও নামব’। একসঙ্গে লিফটের দিকে হাঁটছি, হঠাই একটু যেন আনমনেই বললেন, ‘আচ্ছা শোনো, ভাবছিলাম, যদি তোমাদের পাতায় একটা কিছু লিখি, এই ধরো দু’সপ্তাহে একটা করে, তোমরা কি নেবে?’ শুনে হাসব না কাঁদব, বুঝে উঠতে না পেরে বললাম, ‘কবে থেকে শুরু করবেন বলুন।’ যত দূর মনে পড়ে পরের বুধবারই প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এবং, সুনীলদা সম্পর্কে যে গল্প সবাই সর্বদা করে এসেছে, এই কলামটির সাজঘরের কাহিনিতেও তার কোনও হেরফের নেই— শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক বারও তাঁর লেখা পাওয়া নিয়ে কোনও উদ্বেগে ভুগতে হয়নি। ঠিক জানতাম, সোমবার দুপুরের দিকে একটা ফোন আসবে, ‘কাউকে পাঠিয়ে দেবে?’ গিয়ে কাচের দরজায় টোকা দিলে মুখ তুলে বলতেন, ‘অনির্বাণ, এসো৷’ বাইরে যাওয়ার থাকলে সাধারণত কয়েক দিন আগেই লেখা চলে আসত। কোনও কোনও সোমবার আবার ফোন করতেন, ‘শোনো, এ বারের লেখাটা যদি মঙ্গলবার দিই?’ কথাটা আগেও জানতাম, কিন্তু এই কলামটির অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছিলাম, আপাতদৃষ্টিতে কতটা নির্লিপ্ত থেকে লেখার প্রতি, পাঠকের প্রতি কতটা দায়িত্বশীল থাকা যায়।
যা দেখি যা শুনি একা একা কথা বলি— নিজেই বেছেছিলেন কলামের নামটা। অনেক লেখার শিরোনাম নিজে করে দিতেন, কখনও আবার বলতেন, ‘একটা নাম দিয়ে দিয়ো।’ কখনও বা তাঁর দেওয়া নামটা হয়তো পাতার নকশায় ঠিক আঁটছে না, তাই একটু বদলে নিতাম, সব সময় জানাতামও না, জানালেও বলতেন, ‘ঠিক আছে, করে নাও যেমন দরকার।’ সেই নিশ্চিন্ত অনাসক্তি। তাঁর সারা জীবনের অজস্র লেখার মতোই এই নিবন্ধগুলিতেও তার অমোঘ পরিচয়। দেখছেন, শুনছেন, দেখা এবং শোনার মধ্যে কোথাও কোনও তাড়া নেই, কোনও আতিশয্য নেই, কিন্তু কোনও অন্যমনস্কতাও নেই। কী দেখবেন, কী শুনবেন, তা তিনি নিজে ঠিক করেন, কিন্তু তার প্রতি তাঁর মন যোলো আনা নিবিষ্ট হয়। আবার, সেই মনকে কখন তিনি তুলে নেবেন, সেটাও তাঁরই স্বাধীন সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। একটি এনজিও-র আশ্রয়ে দুটি শিশু, টলটলে চোখ, সুন্দর মুখ, দেখে তাঁর ভারী ভাল লাগে, ভাবেন, একটু আদর করবেন, কোলে নেবেন, কিন্তু ‘নিই না, বরং দূরে সরে যাই। মায়ায় জড়িয়ে পড়তে আমার ভয় করে। ওরা বেঁচে থাক।’
তবু মায়া তো থেকেই যায়, অনেকখানি মায়া। শান্তিনিকেতনের বাড়িতে মা-বুলবুলি বাসা বেঁধেছে। বাসায় তার শিশুরা। সে সারাক্ষণ আশেপাশে ঘোরে, তদারকি করে, সকালে বারান্দায় বসে থাকা সুনীলদার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। সে দিন বিকেলে ঝড় উঠল, তিনি তখন বাড়ির বাইরে, ফিরতে ফিরতে মনে দুশ্চিন্তা, বাসাটা ভেঙে গেল না তো! ভগবানকে ডাকবেন, তার উপায় নেই, ও-সব পাট সেই অমল কৈশোরেই চুকেছে, তাই মনে মনে ওই পাখিদেরই ডেকে বলতে থাকলেন, ‘বেঁচে থাকো, বেঁচে থাকো।’
চার পাশের জগৎ ও জীবনের কত রকমের দৃশ্য, ঘটনা, মানুষ, অভিজ্ঞতা তাঁর খোলা চোখের সামনে নিজেদের মেলে ধরেছে, পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের খুব কম বয়সের সেই ছোট্ট লেখাটির কথা মনে পড়ে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, একটা মানুষ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা গোটা পৃথিবীও চলে যায়। সুনীলদার মতো মানুষরা যত দিন থাকেন, একটা অনন্ত ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিতে থাকেন কাছের এবং দূরের পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি আনন্দ বেদনা, আর তাই এমন আজীবন-হাঁ-করা মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে যে পৃথিবীটা চলে যায় সেটা খুব বড়, খুব ঐশ্বর্যময়।
বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবল উপস্থিতি নিয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু এটা অবশ্যই বলার মতো কথা যে, নিছক উপস্থিতি নয়, সুনীলদা ছিলেন সেই জগতের তন্নিষ্ঠ রসগ্রাহী। এই কলামে নাটক নিয়ে অনেকগুলো লেখা লিখেছিলেন তিনি। নিজের মতো করে সেই সব নাটক আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন। প্রশংসাই করেছেন সচরাচর, নিন্দে করার ধাত তো বিশেষ ছিল না তাঁর। কিন্তু তারই মধ্যে কোনও কোনও অতিপ্রসিদ্ধ অভিনেতা সম্পর্কে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন নিজের সমালোচনা, সে মত অনেককে ক্ষুণ্ণ করবে জেনেও। আবার একই সঙ্গে এটাও খেয়াল করার যে, সেই কঠোর সমালোচনাতেও কোনও অসৌজন্য নেই, নেই বঙ্কিম বাচনের কুচুটেপনা, অধুনা যা বঙ্গীয় সমাজে বহুলপ্রচলিত। কিছু কিছু বিষয়ে তাঁর তীব্র বিরাগ, আপত্তি এবং ক্ষোভের কথা আমরা সবাই জানতাম, এই সঙ্কলনেও তার অনাবিল প্রকাশ আছে। বিশেষ করে বাংলা ভাষার প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের অবহেলা তাঁকে শেষ দিন অবধি পীড়া দিয়েছে, আর সেই ক্ষতে শুশ্রূষা দিয়েছে বাংলাদেশ।
হঠাই মনে হল, শুশ্রূষা শব্দটা সুনীলদার স্বভাবের সঙ্গে বেশ মেলে। অন্যের কথা মন দিয়ে, যত্ন নিয়ে শুনতেন তিনি। এবং, জীবনের শেষ দুটি বছরে দৈনন্দিন সংবাদপত্রের জন্য লেখা তাঁর কথাগুলি পড়তে পড়তে তখন অনেক বার মনে হয়েছে, তিনি যেন তাঁর সহনাগরিকদের একটা দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন— সহমর্মিতার দায়িত্ব। যেন বলছেন তিনি, ভাল থাকো তোমরা, সবাই সবাইকে ভাল রাখো, ভাল থাকতে শেখো, ভাল রাখতে শেখো। ২০১২-র মে মাসের গোড়ায়, চলে যাওয়ার মাস পাঁচেক আগে যে লেখাটি দিলেন তিনি, মনে আছে, পড়েই বুকটা ছাঁৎ করে উঠেছিল। কেন, তার ব্যাখ্যায় যাব না, লেখাটি পড়লেই তা বোঝা যাবে, না-বোঝা অসম্ভব। নার্সিং হোমে থাকা এক শিল্পীর জবানিতে উচ্চারিত সেই লেখার শেষ বাক্যটি স্মরণ করেই থামা যাক: ‘আমি কিছু মানুষের ভালবাসা পেয়েছি ঠিকই, তবু যেন এখন এক সময় বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করে। একা থাকলেই মনে মনে বলতে থাকি, ভালবেসে মিটল না সাধ, ভালবেসে মিটল না সাধ, মিটল না সাধ…’
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
Leave a Reply