যমুনা নদীর মুশায়রা – সেলিনা হোসেন
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ২০১১
প্রচ্ছদ – ধ্রুব এষ
উৎসর্গ
অধ্যাপক আবু সয়ীদ আইয়ুব
লেখক গৌরী আইয়ুব
কবি গুলজার
গবেষক পবনকুমার ভার্মা
কবি শঙ্খ ঘোষ
কবি সৈয়দ শামসুল হক
সকলের সঙ্গে এক হয়ে
কবি গালিবকে বুঝতে চেয়েছি
ভূমিকা
এখন থেকে ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় আগের কথা। গালিব সম্পর্কে খানিকটুকু ধারণা ছিল মাত্র। ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার শিক্ষক আবদুল হাফিজের কাছে গালিবের গজল শুনেছিলাম। সত্তর দশকের শেষের দিকে আমার বড়ভাই প্রয়াত আবু সৈয়দ গোলাম দস্তগীর আমাকে গালিবের বিভিন্ন শের শোনাতেন, যেসব শের তাঁর প্রিয় ছিল। তখন পর্যন্ত গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লিখব, এমন চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয় আবু সয়ীদ আইয়ুবের বিখ্যাত বই ‘গালিবের গজল থেকে : চয়ন ও পরিচিতি।’ বইটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে ২০১১ সালের মধ্যে বইটির সাতটি মুদ্রণ হয়। বইয়ের শেষ অংশে কবিজীবনী রচনা করেন গৌরী আইয়ুব।
১৯৮৩ সালের তৃতীয় মুদ্রণের একটি কপি আমাকে দেন আমার বোন শিরিনার স্বামী প্রয়াত সৈয়দ সিরাজুল কবীর। বলেন, আপা বইটি পড়লে আপনি গালিব সম্পর্কে ধারণা পাবেন। অনেক শের-এর অনুবাদ আছে।
বইটি পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আবু সয়ীদ আইয়ুবের মননধর্মী বিশ্লেষণ আমাকে গালিবকে বুঝতে সাহায্য করে। ‘কবিজীবনী’ অংশে গৌরী আইয়ুব গালিবের বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন। তখন আমার মনে হয়েছিল এই জীবন উপন্যাসের উপাদান। লিখবই তখন পর্যন্ত আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইনি। তবে বিষয়টি মাথায় রেখেছিলাম।
আমি প্রথম দিল্লিতে যাই ১৯৯৬ সালে। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়ার আমন্ত্রণে। উপলক্ষ ছিল দ্বাদশ বিশ্ব বইমেলা। সে বছর মেলার মূল বিষয় ছিল সার্ক দেশসমূহ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বইয়ের তালিকা অবমুক্ত করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল। তখন আগ্রা শহর দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কারণ গালিব ১৮৯৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দিল্লিতে গালিবের কবর দেখারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেবার আর কবর দেখা হয়নি। ট্রাভেল প্যাকেজের সঙ্গে আগ্রা দেখে ফিরে এসেছিলাম।
২০০০ সালের এপ্রিল মাসে আবার দিল্লিতে যাই। ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচার আয়োজিত সার্ক লেখক সম্মেলনে। এবার গালিবের কবর দেখতে যাই। কবর দেখে মন খারাপ হয়। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। পাশে একটি লাইব্রেরি আছে। সেখানে গালিবের উপর রচিত বই পাওয়া যায় কিনা দেখেছিলাম। কিন্তু তেমন ভালো বই পাইনি। দু-চারটে অনুল্লেখযোগ্য বই কিনে ফিরে আসি। এরপর সম্রাট হুমায়ূনের সমাধি দেখতে যাই। সিপাহি বিদ্রোহের সময় মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এখানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করলে বাদশাহকে এখান থেকে গ্রেফতার করা হয়। গালিব উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে এই বিষয়গুলো জরুরি বলে আমি এমন ঐতিহাসিক জায়গাগুলো একাধিকবার দেখেছি। লালকেল্লা, জামা মসজিদ, চাঁদনি চক, কাশ্মিরী গেট—এমন অনেক জায়গায় যতবার দিল্লি গিয়েছি ততবার দেখেছি। এ বছরের মার্চ মাসে শেষবার গিয়েছিলাম চাঁদনি চক, জামা মসজিদ চত্বরে।
সার্ক রাইটার্স কনফারেন্সে দেখা হয়েছে কবি, চলচ্চিত্র পরিচালক গুলজারের সঙ্গে। তিনি গালিবের জীবনভিত্তিক টেলিভিশন সিরিয়ালের চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনা করেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে উপকৃত হয়েছি। তাঁর বই ‘M।rza Ghal।b : A B।ograph।cal Scenar।o’ ২০০৬ সালে কিনে আনি দিল্লি থেকে। দিল্লির সাহিত্য অকাদেমী থেকে আরও কয়েকটি বই কিনি। মনে বেশ জোর পাই। ভাবি যে এবার লেখা শুরু করতে পারবো।
২০০৬ সালে আবার দিল্লি যাওয়ার আমন্ত্রণ পাই। আমন্ত্রণকারী সংস্থা ।nd।an Counc।l For Cultural Relat।ons। তারা আয়োজন করেছে The Afr।ca-As।a L।terary Conference। এই সম্মেলনে পরিচয় হয় প্রাবন্ধিক-গবেষক পবনকুমার ভার্মার সঙ্গে। তিনি তখন ।CCR-এর ডিরেক্টর জেনারেল। কনফারেন্স রুমের সামনে সব দেশের লেখকদের বই প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছিল। চোখ আটকে গেল পবনকুমার ভার্মার বইয়ের ওপর। বইয়ের নাম Ghal।b : The Man, The T।mes। এই গবেষণা গ্রন্থটি আমার খুব কাজে দিয়েছে। গালিব সিপাহী বিদ্রোহের সময় কোন প্রয়োজনে ইংরেজদের সমর্থন দিয়েছিলেন এই বইয়ে তার বিশ্লেষণ আছে। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর তাঁর কত আপন ছিলেন সে ব্যাখ্যা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে কলকাতা থেকে গালিব বিষয়ে কয়েকটি বই কিনি। সব বই পড়া শেষ হলে বুঝতে পারি যে উপন্যাসটি লিখতে পারবো। নিজের ভেতরের ভরসার জায়গাটি তৈরি হয়েছে।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় গালিবের বয়স ছিল প্রায় ষাট বছর। একজন অসাধারণ কবির জীবনবৈচিত্র্য— মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ অবস্থা এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় ইংরেজদের উত্থান ছিল ইতিহাসের ক্রান্তিকাল। এই উপন্যাসে সেটুকু ধরতে চেয়েছি।
পাশাপাশি মনে করি একজন বড় কবি বা সাহিত্যিক একটি বিশেষ সময়ের মানুষ মাত্র নন। তাঁরা সময়কে অতিক্রম করেন। তাঁরা সমকালীন পরিপ্রেক্ষিত লাভ করেন। তাঁদের জীবন ও সময় সাহিত্যেরই বিষয়। সে জন্যই গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লেখা।
উপন্যাসের শেষে যেসব গ্রন্থের উল্লেখ করেছি সেসব গ্রন্থের কয়েকটিতে গালিবের কবিতার অনুবাদ আছে। সেখান থেকে আমি কবিতাগুলো সংগ্রহ করে এই উপন্যাসে ব্যবহার করেছি। অনুবাদ বোঝানোর জন্য প্রতিটি কবিতায় উর্ধ্ব কমা ব্যবহার করেছি। আবু সয়ীদ আইয়ুবসহ সকল অনুবাদকের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
সেলিনা হোসেন
২১ ডিসেম্বর ২০১০
Leave a Reply