ময়ূখ চৌধুরী রচনাসমগ্র – প্রথম খণ্ড
সম্পাদনা – দেবাশিস দেন / তুষার মাজি
প্রথম প্রকাশ – রাখি পূর্ণিমা শ্রাবণ ১৪১৯ / অগাস্ট ২০১২
শুভেচ্ছা
আমি জেনে আনন্দিত হলাম যে ‘লালমাটি’ প্রকাশনার উদ্যোগে ময়ূখ চৌধুরীর রচনা সমগ্র প্রকাশিত হতে চলেছে। উক্ত রচনাসমগ্রটি পাঠক মহলে সমাদর লাভ করুক এই কামনা করে লালমাটি প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সকলকে জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।
ব্রাত্য বসু
ভূমিকা
অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, রোমাঞ্চকর কাহিনি, সব বয়সি পাঠকদের চিরকালই মুগ্ধ করে। একটা সময় বাংলার কিশোর কিশোরীদের মাতিয়ে রেখেছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। যখের ধন, আবার যখের ধন, মেঘদূতের মর্তে আগমন ইত্যাদি কাহিনির নায়ক বিমল কুমারের সঙ্গে বাঙালি পাঠক দেশবিদেশের দুর্গম স্থান মায় ভিনগ্রহেও পাড়ি জমিয়েছে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যোগ্য উত্তরসূরি ময়ূখ চৌধুরীর গল্প উপন্যাসের মূল উপাদানও অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য, রোমাঞ্চ। তাঁর লেখা কাহিনিগুলির ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে আছে শিহরন উদ্রেককারী বর্ণনা। তবে পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে পূর্বসূরির লেখার সঙ্গে। বিমল কুমারদের পথচলায় বাস্তব আর কল্পনার জগৎ মিলে মিশে গেছে। ময়ূখ কিন্তু থেকেছেন পুরোপুরি বাস্তব জগতেই। অবশ্য এর মূল কারণ ময়ুখের লেখাগুলির অধিকাংশই মৌলিক নয়। আরও সঠিকভাবে। বলতে গেলে তিনি তার লেখার উপাদান সংগ্রহ করেছেন দেশবিদেশের রোমাঞ্চকর সত্যি ঘটনার খনি থেকে। কিন্তু তার জন্য ময়ূখের কৃতিত্ব বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় না। শুষ্ক ঘটনাবলি তার কলমের জাদুতে হয়ে উঠেছিল জীবন্ত। ময়ূখ চৌধুরীর ভাষা ছিল তাঁর পুরোপুরি নিজস্ব। সে-ভাষা আদৌ সহজ সরল নয়, কিন্তু কঠিন শব্দ সমষ্টির মেলবন্ধনে রচিত ময়ূখের গদ্যে গতির কোনো অভাব ছিল না, বরং তা-ই হয়ে উঠেছিল তার মূলধন।
এই সংকলনের গল্পগুলিতে সংগৃহীত হয়েছে প্রধানত ময়ূখ চৌধুরী রচিত গল্প হলে গল্প নয়, দুঃসাহসের কাহিনি, নরকের প্রহরী ও কায়না গ্রন্থগুলি থেকে। গল্পগুলির পাতায় পাতায় আমরা বিশ্বভ্রমণের সুযোগ পেয়ে যাব।
আফ্রিকা বার বার এসেছে ময়ূখ চৌধুরীর গল্পে। তার জীবনের প্রথম গল্পের প্রথম শব্দটিই ছিল ‘আফ্রিকা’। ১৩৬৮-র চৈত্র সংখ্যা সন্দেশে প্রকাশিত মরণ খেলার খেলোয়াড় গল্পটির মূল বক্তব্য ছিল মাসাই যোদ্ধাদের বীরত্ব। গল্পটি শুরু করেছেন লেখক এইভাবে :
‘আফ্রিকা!
–বলতেই শিকারীর মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে এক বিশাল অরণ্যভূমি–যেখানে মদগর্বে সর্বত্র পদচারণা করে ঘুরে বেড়ায় বিপুলবপু হস্তীযূথ।
গুরুগম্ভীর ভাষায় গল্পের সূচনা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই ভাষা কিন্তু পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক করে না। বরঞ্চ গল্পের শেষ শব্দ পর্যন্ত পাঠক গল্প থেকে চোখ সরাতে পারে না।
আফ্রিকা দিয়ে শুরু করে ময়ূখ চৌধুরীর গল্প ঘুরে বেড়িয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটিশ চায়না, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের রোমাঞ্চকর ঘটনাও শুনিয়েছেন তিনি। তবে আফ্রিকার পটভূমিতে অজস্র গল্প লিখেছেন তিনি। কারণ জীবজগতের রোমাঞ্চকর কাহিনি ছিল লেখকের প্রিয় বিষয়। আর আফ্রিকা এবং হিংস্র প্রাণী তো প্রায় সমার্থক। অবশ্য হিংস্র প্রাণী শব্দটির ব্যবহারে হয়তো লেখকের প্রতি অবিচার করা হয়। জীবজগতের প্রতি ছিল তার অসীম মমতা (একটি চিত্ৰকাহিনিতে তিনি পৃথিবীর ভয়ংকরতম প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মানুষকে)। ময়ূখের গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে সিংহ, বাঘ, কেপ বাফেলল, ভয়ংকর কুমির, মাংসাশী জলহস্তী ইত্যাদি। শুধু ভয়ংকর জীবজন্তু নয়, ভয়ংকর কিছু মানুষের গল্পও শুনিয়েছেন তিনি। আবার বিভিন্ন উপজাতির কিছু নারী পুরুষও তাঁর গল্পের চরিত্র হিসেবে আমাদের প্রিয় পাত্রপাত্রী হয়ে ওঠেন। আফ্রিকার জুলু উপজাতির এক ডাকসাইটে রমণী নজমবাজী, যাকে লেখক বাঘিনীর সম্মান দিয়েছেন, খলনায়িকা হওয়া সত্ত্বেও তার বীরত্বে আমরা মুগ্ধ হই। ইতিহাসের পটভূমিতেও গল্প উপন্যাস লিখেছেন ময়ূখ। কিছু কাল্পনিক চরিত্র, আবার কখনো-বা ঐতিহাসিক চরিত্রের কাল্পনিক গল্প। কিন্তু সব ধরনের গল্পেই রয়েছে রহস্য, রোমাঞ্চ এবং অসম্ভব গতি।
এই সংকলনের অধিকাংশ গল্পই বিদেশের পটভূমিতে। ভারতের মাটিতেও রয়েছে কয়েকটি কাহিনি। নায়কের জন্ম কোঙ্কণি বীর কহ্নোজী আংরের উত্থানের রোমাঞ্চকর কাহিনি, ইতিহাসের পটভূমিতে। আর দেবীদর্শন উপন্যাসটি তো আমাদের বাংলার একান্ত নিজস্ব। প্রথম জীবনে একটি অসাধারণ চিত্ৰকাহিনি তৈরি করেছিলেন ময়ূখ খাপে ঢাকা তরোবার। ওই একই গল্প নিয়ে তৈরি দেবীদর্শন। তবে বিশে ডাকাতের স্থান নিয়েছে ডাকাত রানি দেবী চৌধুরাণী। কাহিনির বিভিন্ন চরিত্র আমাদের মুগ্ধ করে। সেই প্রাচীন যুগের বাংলার ডাকাতরা কিন্তু ঘৃণার পাত্র ছিল না। তারা ছিল দুঃখীর বন্ধু, দুষ্টের যম। ময়ূখের কলমেও ফুটে উঠেছে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা।
এই সংকলনে আমরা ময়ূখের সব ধরনের লেখারই স্বাদ পাব। এই সংকলনের বড়ো আকর্ষণ আত্তিলিও গত্তির অভিযানের কাহিনিগুলি। প্রথম মহাযুদ্ধের মিত্রপক্ষের এক সৈনিক কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি। বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর কমান্ডার গত্তি তাঁর দুই সঙ্গী, প্রফেসর ও বিলকে সঙ্গে নিয়ে আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বেশ কিছু অভিযানে বেরিয়েছিলেন। তাঁদের সেসব ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছিলেন আত্তিলিও। সেসব কাহিনি সংগ্রহ করে ময়ূখ তার একান্ত নিজস্ব ভাষায় বাঙালি পাঠকদের কাছে পরিবেশন করেছেন। তিনমূর্তির প্রথম অভিযান কায়না। পরবর্তীকালে অভিযানগুলিতে কখনো আত্তিলিও একা, আবার কখনো তার সঙ্গী বিল। শয়তানের ফাঁদ, শত্রু, নরখাদক দেবতা, প্রতিহিংসা–প্রতিটি গল্পই আফ্রিকার পটভূমিতে বিচিত্র রোমাঞ্চকর কাহিনি। রোডেশিয়ার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চল, সুদান, বেলজিয়ান কঙ্গো, মধ্য আফ্রিকার বাকাভা অঞ্চল ইত্যাদি স্থানে ভয়ংকর সব বিপদের সম্মুখীন হয়েও প্রাণ নিয়ে ফিরে আসার রুদ্ধশ্বাস কাহিনিগুলি আত্তিলিওকে আমাদের কাছের মানুষ করে তোলে। জীবজগতের কিছু বিচিত্র বৈশিষ্ট্য দু-দুবার মহিষ এবং হাতির হাত থেকে (নাকি শিং শুড়, পা থেকে?) আত্তিলিওকে রক্ষা করে তা জানানোর কৃতিত্ব অবশ্যই ময়ূখের। ময়ূখের অতুলনীয় ভাষায় আমরা জানতে পারি–খাদটা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অমিত বলশালী হস্তীযুথের সামনে! হাতি লাফাতে পারে না এবং সাড়ে ছ-ফুটের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে পা ফেলার ক্ষমতাও তার নেই এবং মহিষ চরম আঘাত হানার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মাথা তুলে শত্রুকে লক্ষ্য করে… মহিষের চক্ষু বিবর্ধক শক্তিসম্পন্ন। … সামান্য গতিবিধি তাদের চোখে ধরা পড়বে অসামান্য দ্রুতবেগে বর্ধিত আকারে।
এ ছাড়াও আত্তিলিওর কাহিনিগুলিতে আছে অনেক না-জানা জাতি-উপজাতির কথা, তাদের আচারব্যবহার, রীতিনীতি। জুলু, মামুটি পিগমি, ওয়াকাঁপাগা জাতিদের ছোটো বড়ো নানা কাহিনি।
এক কথায় বলা যায় সার্থক ময়ূখ চৌধুরীর প্রয়াস। বিভিন্ন দেশের নানান রোমাঞ্চকর সত্যি ঘটনা সংগ্রহ করে অতুলনীয় ভাষায় পরিবেশন করার জন্যই তিনি আমাদের সকলের প্রিয়। ধন্যবাদ প্রাপ্য লালমাটিরও। আজকের দিনে প্রায় ভুলতে বসা (আধুনিক প্রজন্ম তো তাঁর লেখা হাতে পায় না) ময়ূখ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার জন্য।
দেবাশিস সেন
Leave a Reply