মোল্লা ওমর তালিবান ও আমি – সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
নিবেদন
ধর্ম একটা আফিম, সেই আফিংয়ের নেশায় বুঁদ সমগ্র মানবজাতি, রাজনীতিবিদের দাবা খেলায় সাধারণ মানুষগুলো হয়ে যায় দাবার বোড়ের চাল। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে চলছে সেই দাবা খেলা। মরছে জনগণ, তাতে কার কি ক্ষতি হচ্ছে? মরেছে কি কোনও নেতা? ছাগলের মতন মরছে শুধু সাধারণ মানুষ। কথায় বলে, ঠক বাছতে গাঁ উজাড় সেই রকমভাবে লাদেন ও মোল্লা ওমরকে খুঁজতে আফগানিস্তান উজাড় হল। কোথায় সেই লাদেন? কোথায় আলকায়দা? কেন এই প্রহসন, মানুষ দুটো তো হাওয়ায় মিশে যায়নি। মাটির সাথে আলকায়দাও বিলীন হয়ে যায়নি। আসলে সবই ওই চোরে-চোরে মাসতুতে ভাই। মোল্লা ওমর কোনদিনও ধরা পড়বে না। লাদেন থাকবে কায়দার মধ্যে পৃথিবীর সর্বত্র।
কাবুলিওয়ালার বউ হয়ে আফিগানিস্তানের মাটিতে পা দিয়েছিলাম। নিজের চোখে দেখেছি অশান্ত মাটি। একদিকে সংসারের টানাপোড়েন, অন্যদিকে রাজনীতির অশান্ত আর উত্তাপ হাওয়ায় দেশটাকে খুব ভালো করে দেখার সুযোগ হয়েছে। পেয়েছি সেখানে মোল্লা ওমরকে মামা হিসাবে। তাই অনুভব করেছি, তাদের সংস্কৃতিকে। নিজের চোখে দেখেছি অসহ্য যন্ত্রণা আর পাশবিক অত্যাচার।
সেই অভিজ্ঞতা তাই সোজাসুজি ভাষায় তুলে দিলাম পাঠকের জন্য। যাতে পাঠকসমাজ আমার চোখ দিয়ে দেখতে পায় আফগানিস্তানের মোল্লা ওমর, লাদেন আর তাদের সমাজব্যবস্থাকে।
সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মোল্লা ওমরের উত্থান
শেষ হয়ে যাওয়া বিধ্বস্ত, বিপন্ন, অনাহার, অনিদ্রায় ক্লান্ত মানুষগুলোর জীবনে এই যুদ্ধ নতুন করে এনে দিল ধ্বংস এবং মৃত্যু। সমস্ত সম্পদ, জমির উর্বরতা শুষে নিল যুদ্ধ। রুশ ফ্রন্টের যুদ্ধ বিরতি হয়েছিল মাত্র দশ বছর আগে। দেশদ্রোহী এবং বিশ্বাসঘাতক বলে পরিচিত ভাঃ নজিবুল্লার শেষকৃত্য সমাধা হয়েছে সেই ১৯৯৬ সালে। তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত দেশটা তালিবানের হাতে চলে গেল।
১৯৯১ সালের এক গৃহযুদ্ধ স্পর্ধার আগুনকে উসকে দিল। সেই উস্কানিকে সম্বল করে এক গভীর রাতে বিপর্যয় নেমে এল আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে। কান্দাহারের নদহা গ্রামের জাজিরা পাড়ায় এবং মোল্লা ওমরের আর একটা বাড়ি আছে উরগুণে। ওমর কেবল সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে ছিল। কিছুতেই প্রকাশ্যে আসার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সেই রাস্তা করে দিল ইঞ্জিনিয়ার গুলবদীন হেকমতিয়ার। ইসবি ইসলামি অফ আফগানিস্তান পার্টির মাথা। সেই সুযোগকে হেলায় সরিয়ে দিতে চাওয়ার মতন নির্বোধ মোল্লা নন মোল্লা ওমর। বিগত পাঁচ বছর ধরে জীবনের সমস্ত সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে যারা দিনের পর দিন অসহায় জনগণের মধ্যে থেকে শক্তিশালী জোয়ান ছেলেগুলোকে নিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, অনাহারের সুযোগ নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা দান করে তাদের নিজের দলের সমর্থক করে তুলেছে; তাদের আজ কাজে লাগবে না এমন অনর্থ হতে পারে?
একদিন ওমর গ্রামের ভেতর নিজেকে পরিচিত করতে জিপের ওপর দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে প্রচার করতে গেল তালিবানের নাম; কিন্তু সেই সময়কার শক্তিশালী সংগঠন ইসবি ইসলামি অফ আফগানিস্তান, যার সংক্ষেপে নাম হল ইউসুফ পার্টি, সেই পার্টি থেকে প্রচন্ড রকম বাধাপ্রাপ্ত হল। মোল্লা ওমরের পথ পরিবর্তিত হতে বেশি সময় লাগল না। তালিবানের প্রথম ও প্রধান জঙ্গি প্রশিক্ষণের ঘাঁটি তখন ওয়ার্নার খুব নিকটবর্তী একটা পাহাড়ে, সরু পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সেই পাহাড়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দূর থেকে নজরে পড়ে। অতি আশ্চর্য যে ওই পাহাড়ের প্রায় সমস্ত পাথরের গায়েই সাদা চ দিয়ে লেখা পিপলস পার্টি। ওমর বেশি কথা বলে না মুখে। ওমরের বোন ফতেমা বিবি বলে–মা উনোর গুন্দি সারাই, তামাম দুনিয়ারে নাস্তা। অর্থাৎ আমার ভাইয়ের মতন লোক সমস্ত দুনিয়াতেও নেই।
কান্দাহারের জাজিরা পাড়ার মোল্লা ওমর মোজাহিদ থেকে তালিবান সর্দারে পরিণত হল। সেই তালিবান হতে বাধ্য করেছিল বার বার যুদ্ধ, ভাঙ্গন এবং দুর্ভিক্ষ ও লোভ। প্রচুর অর্থের লোভ মোল্লা ওমর সংবরণ করতে পারেনি। শান্ত, একগাল ভর্তি দাড়ি ফর্সা টিকাল নাক, খুদি খুদি দুটো চোখের একটা কানা, মোটা চেহারার সেই লোকটা হয়ে বসল সমস্ত তালিবানের ও জঙ্গিদের নয়ন মণি। গ্রামে গ্রামে প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্ক ধোলাই করে বেড়াত ওমর! দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষগুলোকে অর্থদান করত, তাদের বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দিত। শান্তির বাণীর মাধ্যমে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ইসলামী জেহাদ। সমস্ত তালিবানদের বলেছিল এই কাজগুলো করতে। শান্ত, বিচক্ষণ বুদ্ধিদীপ্ত, সাংসারিক ওমর হঠাৎ একদিন হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর। রক্ত নিয়ে শুরু হল হোলি খেলা। ১৯৯২ সালের গোড়ার দিকে আচমকা সে হুকুম জারি করল–আগামীকাল তোমরা সবাই যাবে গজনীর উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত উরগুণ গ্রামে। গ্রামটা দখল করবে, তারপর জনগণকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দেবে শান্তির বাণীর মাধ্যমে। বিপুল অর্থ ছড়িয়ে দেবে গ্রামে-গ্রামে দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষগুলির ঘরে। ধেয়ে যাবে গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহরে। মনে রাখবে জিততে আমাদের হবেই হবে। তা না হলে পৃথিবী থেকে মুছে যাবে ইসলামের নাম। ইসলামকে প্রসারিত করতে হবে। ইসলামই হবে একদিন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের একমাত্র ধর্ম। আর এই ইসলামকে প্রসারিত করার জন্যে আমাদের নবী তার জীবিতাবস্থায় অন্ততঃ কম করেও তিরিশ অথবা চল্লিশবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তার একমাত্র ইচ্ছা রেখে মারা গেছেন। তোমরা সকলেই জান তার ইচ্ছার কথা?
এক বাক্যে চিৎকার করে উঠে জবাব দিল তালিবানেরা–হ্যাঁ, আমরা জানি, তিনি চেয়েছিলেন তার শেষ কাজ সমাধা করবে তার উত্তরসূরীরা।
কী সেই কাজ? সে কাজটা হল সমগ্র বিশ্বে ইসলাম ধর্মের বীজ রোপণ করা এবং পৃথিবী থেকে কাফের নিমূল করা। অন্য কোন কিতাব পৃথিবীতে থাকবে না, কেবল কোরাণ ছাড়া। বিজ্ঞান বলে কিছু নেই, ইতিহাস সমস্ত মিথ্যে। আল্লা বলেছেন, কোরাণই একমাত্র কিতাব। তাছাড়া সব মিথ্যে। যারা কোরাণ ছাড়া অন্য কিতাব পড়ে তারা সত্য অস্বীকার করে, তাদের বর্জন কর। সদা হাস্য, রসিক, আমুদে মানুষটা হঠাৎই হয়ে গেল ইসলাম ধর্মরক্ষার প্রতীক। কেন এমন হল?
আসলে এই অশিক্ষিত মোল্লা ওমর রাজনীতির দাবার চালের বোড়ে হয়ে উঠল। পিপিলস পার্টির নেত্রী বেনজির ভুট্টো হাত করে নিয়েছিলেন, পাকিস্তানে যারা মাজার (উদ্বাস্তু) হয়ে গিয়েছে আফগানিস্তান থেকে তাদের। ধর্মের নেশায় তাদের কুঁদ করে দেওয়া হয় মাদ্রাসায় নিয়ে গিয়েওয়ার্না এবং দেরার মাদ্রাসার পরিচালনা করতেন মৌলনা ফজল রহমান। অতি ধূর্ত এবং শয়তানি বুদ্ধিসম্পন্ন মৌলানা ছিলেন এই ফজল। কঠোর ও কট্টর মৌলবাদী ক্ষমতাভাবাপন্ন ফল রহমান। পাকিস্তানের চর। এবং এই ফজলের উপর ভার পড়েছিল প্রত্যেক মাজার হয়ে আসা গরীব আফগানবাসীকে ধর্মের নেশায় উদ্বুদ্ধ করা। আফগানিস্তানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করাই ছিল পাক সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য। অতিশয় দরিদ্র পরিবারের ছেলে মোল্লা। ওমর অর্থের লোভ সংবরণ করতে পারেনি। এই দারিদ্র্য অবস্থার স্বীকার হয়েও মোল্লা রাতারাতি বিশাল ধনী হয়ে যায়। যে দীর্ঘদিন রাশিয়ার সঙ্গে লড়ছে, মুজাহিদ হয়ে সুখ বিসর্জন দিয়েছে, দেশকে বহিরাগতের হাত থেকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে সংসার ও বিবিদের অবহেলা করেছে, সেই মোল্লা ওমরকেই ইসলাম ধর্ম বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করল আফিগানিস্তানের নির্বোধেরা। ওমর তালিবানদের মগজধোলাই করার জন্য বলেছিল-মনে রাখবে জিততে আমাদের হবেই হবে, নইলে পৃথিবী থেকে মুছে যাবে ইসলাম ধর্ম। ইসলাম ধর্মকে আরও প্রসারিত করার জন্যেই আমাদের শেষ নবী জীবিতাবস্থায় তিরিশ থেকে চল্লিশ বার যুদ্ধ করেছিলেন। তার একমাত্র শেষ ইচ্ছা রেখে তিনি মারা গেছেন। সেই ইচ্ছা পূর্ণ করাই আমাদের ইচ্ছে। পরে এই ওমর জেহাদের জন্যে গ্রামে-গ্রামে ঘুরে সমস্ত জোয়ান ছেলেদের তালিবান দলে নিযুক্ত করতে লাগল। স্বেচ্ছায় এলে ভালো, শহীদ হয়ে জন্নতে যেতে পারবে, সেখানে শহীদদের জন্যে অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সমস্ত সুখ। আর স্বেচ্ছায় না এলে মরো, যাও জাহান্নামে।
তালিবান কথার অর্থ তালিব মানে ছাত্র। বান মানে গোষ্ঠি ১৯৮৯ সালের পুনরাবৃত্তি। তখন ছিল রাশিয়ার মোজাহিদ ধ্বংসের যুদ্ধে সৈন্য বাহিনীতে নিযুক্ত করার জন্য জোয়ানদের দলে টানা। না এলে গুলি করে মেরে ফেলা। ১৯৯২-তে তালিবানের দলে টানা।
তাই সৃষ্ট হল আজকের এই মহা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ! লক্ষ লক্ষ নিহতের লাল তাজা রক্তে মোল্লা ওমর উৎসাহিত ও উত্তেজিত হয়ে উঠছে। এই অভিশপ্ত যুদ্ধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে কে? সেটা করা সম্ভব কেবল অন্য এক সত্যিকারের দেশপ্রেমী বিপ্লবীর পক্ষে, যারা কেবলই দেশের ভালো চায়, জনগণের মঙ্গল কামনা করে, কোন চেয়ারের লোভ তার কিংবা তাদের অন্য কোন লোভ থাকবে না। তারাই পারে অবিলম্বে এই যুদ্ধকে প্রতিহত করতে। জনগণকে বাঁচান যায় কেবল সত্যিকারের বিপ্লবের পূর্ণতা ঘটিয়ে, আর সে জন্য চাই বুদ্ধি, বিচক্ষণতা এবং অপরিসীম ক্ষমতা। যার কোনটাই নেই আফগান সাধারণ জনগণের মধ্যে। যুদ্ধ যে কি ভয়ঙ্কর তা আমি নিজে দেখেছি ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। আমাদের দেশের শান্ত, স্নিগ্ধতায় অভ্যস্ত মেয়ে আমি। গিয়ে পৌঁছলাম উত্তপ্ত অগ্নিগুহায়। আমার নিজের চোখে দেখা তীব্রতম ঘৃণিত একটা যুদ্ধের বিবরণ আমি তুলে ধরছি আমাদের জনগণের জন্যে।
আফগানিস্তানের যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে সেই ১৯৪২ অথবা ১৯৪৪ সাল থেকেই। সৎ মানুষের পরাজয় হয় দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের হাতে। তারপর থেকে আজ। পর্যন্ত ক্রমাগত যুদ্ধ হয়ে চলেছে আফগানিস্তানে। জাহির শা থেকে শুরু করে রাব্বানী পর্যন্ত সবাই দুর্নীতিবাজ মানুষের হাতে পরাজিত হয়েছে। এদের মধ্যে জাহির শা। এবং রাব্বানীর বরাত ভালো যে এদের দুজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়নি, যা করা হয়েছিল বাবরাক কারমল, নূরমহম্মদ তারাকী এবং ডাঃ নজিবুল্লাকে। যাই হোক যারা অতীত তাদের সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই, কিন্তু নজীবুল্লা?
হ্যাঁ নজীবুল্লার থেকে আমার কাহিনী শুরু। যদিও সে কাহিনী শুরু হয়েছে ১৯৮৪ সাল থেকে, কিন্তু আমি যেখান থেকে দেখেছি তা ১৯৮৯ সাল থেকে এক ভয়ংকর বিভীষিকাময় দিন ও রাত। সারা বিশ্বের মানুষ যখন সর্বাধিক সুখ এবং স্বাধীনতায় জীবন যাপন করছে তখন আফগানিস্তানের মানুষ চরম বিশৃঙ্খলায়, যুদ্ধ বিধ্বস্ততায়। দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। দেশকে স্বাধীন করার এবং শান্তিময়। করার জন্যে যে প্রতি বিপ্লব সৃষ্ট হয়েছিল সেই প্রতি বিপ্লবীরা পরম বিক্রমে লড়ে চলেছে ডাঃ নজিবুল্লা এবং রাশিয়ার বিপক্ষে। একদিকে রাশিয়া চাইছে দেশটাকে করায়ত্ত করতে; অন্য এক দিকে প্রতি বিপ্লবী মুজাহিদরা চাইছে ইসলাম রাষ্ট্র করতে। অন্য আর একদিকে জনগণ চাইছে কেবল শান্তি, শিল্প, নিয়মতান্ত্রিক, শৃঙ্খলাপূর্ণ একটা রাজতন্ত্র। এই তিনের যে তীব্র সংঘাত তৈরী হল তা কোন পক্ষই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হল না। এক স্বৈরাচারীর বদলে অন্য এক স্বৈরাচারীর আবির্ভাব ঘটতে লাগল, আর রক্তে লাল হতে লাগল পথ-ঘাট-খানা-খন্দর। দেশি বিপ্লবীদের হাতেও মুন্ডচ্ছেদ যেমন হতে লাগল তেমনিই বৈদেশিক যুদ্ধের মধ্যেও মরতে লাগল জনগণ। দীর্ঘদিন ধরে দেশটা এক বিক্ষুব্ধ অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে, আফগান জনগণ কোন বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তির সন্ধান পায়নি যার নেতৃত্বে তারা সুখে দিন কাটাতে পারে। কেবল পাশবিক আক্রমণটাই পেয়েছে, পায়নি তাদের বিরুদ্ধে সুন্দর, শিক্ষিত ব্যক্তিদের সংগ্রাম। চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কে?
ক্ষমতা অধিকারের মতো শিক্ষা সাধারণ জনগণের নেই। এবং তেমন কোন চেষ্টা করতে গেলেই অনিবার্য এক প্রতিক্রিয়া যে ঘটবে তা বিলক্ষণ জানা ছিল জনগণের। ফলে ক্ষমতা দখলের ইচ্ছে তাদের বিসর্জন দিতে হয়েছিল। তবে তাদের বিশ্বাস ছিল রাশিয়া কোনদিন তাদের পদানত করতে পারবে না। তাই একটা পথেই তাদের সমর্থন জানানো প্রয়োজন নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে গেলে, সে পথটা অবশ্যই প্রতি বিপ্লবদের দিকে সমর্থন। যখন রাশিয়া আফগানিস্তানকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে লাগল তখন দেখা গেল জনগণ মুজাহিদদের পক্ষ নিয়ে লড়তে লাগল। কোন বিধ্বংসী যুদ্ধ নয়, মুজাহিদরা চেয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে নতুন সরকার গড়ে উঠুক। প্রত্যেক গ্রাম, শহর, মহানগর, প্রদেশ যেন বারুদের আগুনের মতো জ্বলে উঠল। এক নতুন প্রেরণায় প্রেরিত হয়ে উঠল সমস্ত আফগান জনগণ। সেই সময় নতুন সংবিধান তৈরীর প্রচেষ্টায় বিভিন্ন দল ও নানান মত তৈরী হল। প্রায় এগারোটা। দল। গ্রামের ভেতরে আবার আরও বেশি। তাদের সকলের একটাই চাওয়া গদি। কিন্তু এরা কেউ প্রকাশ্যে কোন কাজ করতে পারে না কারণ রাশিয়ানরা মেরে দেবে। গোপনে রাতের অন্ধকারে কাজকর্ম চালাত। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আন্ডারগ্রাউন্ড ঘর তৈরি হয়েছে। যখন খুব যুদ্ধ হয় এবং রাশিয়ানরা বোমা ফেলে তখন সবাই সেই আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমি গিয়ে দেখেছি প্রতিটি জানালা দেওয়াল গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন কারো বাড়িতে উনুন জ্বলে না, একদিন রুটি করে একমাস ধরে খায়। যাদের খাদ্য থাকে তাদের খাদ্য দেওয়া হয়। সেই আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরে যে কেবল মানুষ থাকে তা নয়, এমনকি গরু, ছাগলও নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ঘরেই হয় বিয়ে, হয় দাওয়া (অর্থাৎ পাকা দেখা), হয় বৈবাহিক জীবনের স্বাদ গ্রহণ মায় প্রসবও। হয় মৃত্যু এবং শ্রাদ্ধ। তা বলে এই নয় যে এতদিন ধরে রয়েছে সেই ঘরে। আসলে যখন যুদ্ধ লাগে তখন কারও না কারও এগুলো হওয়ার থাকে, আগে থেকে তা প্রস্তুত থাকে। কারও তো জানা থাকে না যুদ্ধ কখন শুরু হবে? তবুও কোন আপোষ মীমাংসায় আসেনি আফগান বিপ্লবী মুজাহিদরা। অসংখ্য মানুষ মরে যেতে লাগল। রাশিয়া সর্বশক্তি নিয়োগ করল তবুও মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হল না। সরকার তখন দোদুল্যমান হয়ে যেতে লাগল। মুজাহিদরা আত্মগোপন করে থাকে বিভিন্ন পাহাড়ের গুহায়, জঙ্গলে। তাদের শেষ করতে অক্ষম সরকার অন্ধ হয়ে গ্রামের বাড়ি ঘরের ওপর বোমা ফেলতে শুরু করল। ওদিকে আবার শীত আসছে। প্রচন্ড শীত। মুজাহিদদের মতে দুর্নীতিবাজ, পৈশাচিক ভাঃ নজিবুল্লা এবার হেরে যাবে। আর নজিবুল্লার ধারণা এই ভয়ঙ্কর শীতে পাহাড়ের গুহায় থাকা অসম্ভব ব্যাপার। তাই মুজাহিদরা ফিরে আসবে গ্রামে। সুতরাং গ্রামেই বোমা ফেলা হবে।
আমি মনে মনে ভাবতাম এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের সমাপ্তি কবে ঘটবে? কবে বোমা ফেলার অবসান হবে? ভাবতাম বিপদ ঘনিয়ে আসছে কাদের? জনগণের, মুজাহিদদের নাকি নজিবুল্লা ও রাশিয়ানদের? এই নতুন এক যুদ্ধরত দেশে এসে অবিশ্বাস্য রকম ভাবে দ্রুততর এক অসহনীয় জীবনের সঙ্গে কেমন যেন চট করে। খাপ খাইয়ে নিয়েছি আমি। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেও আমি ছিলাম সেই ভারতের মেয়ে যেখানে আছে সবদিক দিয়ে শান্তিপূর্ণ সহবাস। শীতের বেলা ছোটো বেলা। এই ছোটো হয়ে যাওয়া দিনগুলোও আমার কাটে না। শূন্য আকাশ থেকে অনবরত ঝিরঝির করে পড়তেই থাকে বরফ। যেখানেই পা দেবো সব বরফ। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘরের বাইরে বেরোয় কার সাধ্য? সব যেন ঘন কুয়াশায় ঘেরা, নিতান্তই সাদামাটা দিন যাপন আমার। অসহ্য হয়ে উঠি, সেই অসহিষ্ণু মন বিদ্রোহ করতে চায়, ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, ঝগড়া হয় জাজের সঙ্গে। বাতাসে বারুদের গন্ধ ভরা। সমস্ত শিশুরা মেয়েরা উৎকণ্ঠায় দিন রাত কাটায়, এই বুঝি খবর এল আপন কেউ মারা গেছে। এক বাড়ি কান সজাগ করে রাখে অন্য বাড়িতে কান্নার রোল উঠল নাতো? এমনি অসহায় দিন রাত কাটাতে কাটাতে ১৯৯০ সালের শেষে শোনা গেল নজীব সরকার আত্মসমর্পণ করবে। ঘরে ঘরে খুশির আমেজ, আনন্দধারা। নজীব বিদায় নোবে, এবার দেশ স্বাধীন হবে, দিন রাত ভালো কাটবে। হলোও তাই। নজীৰ গদি ছাড়ল কিন্তু নিজে ছাড়া পেল না। রাজবন্দী হয়ে রইল।
আজরাৎ সাহেব মাসের জন্যে রাজ্য ভার নিলেন। তারপর সমস্ত পার্টির মধ্যস্থতায় রাব্বানীর মন্ত্রী হওয়া। দেশ শান্ত। তবুও ইঞ্জিনিয়ার গুলবদীন হেকমতিয়ার শান্ত থাকতে দিল না। আবার শুরু হল যুদ্ধ। সেই ভাঙন এবং মৃত্যু।
১৯৯২ সাল। আর মাত্র কিছুদিন বাকি আছে শীত আসতে। মোল্লা চলে গেল ওয়ার্নার তালিবানের ঘাঁটিতে, যুদ্ধের জন্যে তৈরি কিনা তালিবান তা পর্যবেক্ষণ করে হুকুম দিল উরগুণ দখল করতে। উজবেক জাতির একটা ছোট্ট গ্রাম, যা গজনীর একেবারে গায়ে। ঊরগুণকে অনেকেই উরুজগান বলে।
ভোর চারটে বাজে। গ্রামের মসজিদগুলো থেকে ভোরের প্রথম আজান ভেসে এলো, আস্তে আস্তে গ্রামের সব ঘরের দরজা খুলে পুরুষ নারী সবাই ওজু করার জন্যে বাইরে বেরুল। পুরুষরা মসজিদে চলে গেল নামাজ পড়তে, মেয়েরা বারান্দায়। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে। হঠাৎ রকেটের আগুন ঝলসে উঠল। ঝাঁকে ঝাকে গুলি এসে লাগতে লাগল ঘরের দেওয়ালে। যারা মসজিদে নামাজ পড়ছিল তারা আর কেউ বেঁচে রইল না। বারান্দায় নামাজে দাঁড়ানো মেয়েরাও গুলিবিদ্ধ হল। নৃশংস নরনারীখাদক তালিবান জয়যুক্ত হল। উজবেকদের, তালিবানদের হাতে ধরা দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। অগ্রসর হওয়ার সমস্ত পথ তাদের কাছে বন্ধ। রাজনৈতিক সাফল্য হল তালিবানের, এবার তাদের আত্মপ্রকাশের সময় আগত। তালিবানের উদ্ভব, বিকাশ কোন সন্দেহের দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখা হল না। একটা প্রগতিশীল পদ্ধতির ভড়ং মাখানো আশ্রয় নিয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল দিকে দিকে, গ্রামে গঞ্জে, শহরে, নগরে। সমস্ত পুস্তুন দলনেতারা যোগ দিল তালিবানদের সঙ্গে, কারণ রাব্বানীর মন্ত্রীত্বকালে সমস্ত সুবিধা মিলতে লাগল উজবেক, হাজারা ও ফার্সিদের। পুস্তুনদের ওপর অকারণে জুলুম হত। সুবিধা কিছু ছিল না। তখন আলাদা দল গড়ার তাগিদে তালিবানদের সমর্থন করতে শুরু করল। অভ্যন্তরীণ সমস্যা উদঘাটনের চেষ্টায় রত তালিবানরা, কোথায় কোন বিরোধ আছে, সন্দেহ আছে, তালিবানেরা তা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হল, এবং তার সঙ্গে আছে প্রহার। রাত হলে আগুন জ্বেলে তার চারধারে নাচ, গান উল্লাস এবং মুরগির রোস্ট হতে লাগল। আফগান জনগণ প্রতিবাদে মুখর হতে পারেনি কিংবা সম্ভব হয়নি। বাস্তব দৃষ্টি নিক্ষেপ করার মতো বুদ্ধিমত্তার মানুষ কোথায়? প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে যারা, যারা আজ দীর্ঘ বছর ধরে যুদ্ধ করে চলেছে, দীর্ঘ যুদ্ধের পর সাময়িক শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে সেই তারাই আজ এই বিপদসঙ্কুল সন্ধিক্ষণে এসে আত্মসমর্পণ করল। কিন্তু কেন? কেন? এই আত্মসমর্পণের মূলে কী? নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের দখলদারীর অন্যতম মুখ্য বুনিয়াদটাই কী ধর্ম? নাকি এর পেছনে অন্য আরও কোন কিছু ষড়যন্ত্র কাজ করছে? আসন্ন সমস্যার যে পরিস্থিতি সেদিন তৈরি হল তা কোথায় গিয়ে থামবে? সেই প্রশ্ন তখন। আমার মনে তীব্র হয়ে দেখা দেয়।
যে আধিপত্য তালিবান বিস্তার করল তা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনই সংক্রামক। সর্বপ্রথম যারা তালিবানের হাতে ধরা দেয় বা আত্মসমর্পণ করে তারা হল আরাকাত পাটি। এই পার্টিই তখন সর্বপ্রধান। রাব্বানী সরকারও আরাকাত। তবে গ্রামে কেন আরাকাতের প্রধান মাদালী খান আত্মসমর্পণ করল? আরাকাতের রফিক ফরিদ কেন প্রতিবাদ করল না? সমস্ত গ্রামের মানুষ যাদের বিশ্বাস করে নিজেদের সঁপে দিয়েছে তারা কেন করল বিশ্বাসঘাতকতা? কোন শুভবুদ্ধিতে? কেবল পুস্তুন জাতের সঙ্গে দেশকে বৈরীর হাতে তুলে দেওয়া?
এই প্রশ্ন আমি মাদালীকে করেছি। মাদালীর কাছ থেকে কোন সদুত্তর আমি পাইনি। যে উত্তর পেয়েছি তা ভেক, যেমন–সাহেব কামাল যদি আমরা আত্মসমর্পণ না করতাম তবে ওরা যুদ্ধ করত, অনেক মানুষ মারা যেত, তাই আত্মসমর্পণ।
আশ্চর্য? জলে বাস করে কুমিরের ভয়ে গুটিয়ে থাকা? তা কি বিশ্বাসযোগ্য? যারা দীর্ঘদিন ধরে বিধ্বংসী যুদ্ধ করে আসছে তারা যুদ্ধের ভয়ে আত্মসমর্পণ করল তা কি বিশ্বাসযোগ্য বলব?
এর পর গুলবদিন হেকমতিয়ারের সঙ্গে আমি দেখা করে বলেছিলাম–সমস্ত দিক বিবেচনা করে গুরুত্বপূর্ণ সর্বাঙ্গীন সুগভীর অনুসন্ধান করে তবেই কিন্তু আপনি অগ্রসর হতে দেবেন তালিবানদের। তালিবানরা খবর পেল আমার গতিবিধি ও বক্তব্য সম্পর্কে। আমার বাড়ি থেকে বেরুনো নিষেধ হল। তারই মধ্যে যে প্ররোচনা আমি দিয়েছি তাতেই খানিকটা কাজ হয়েছে। নিপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াবার একটা প্রবণতা ততদিনে আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছে। আমি বিপুল আগ্রহে জনগণের। প্রতি সহানুভূতির বাসনা নিয়ে, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ওপর আমার ক্ষুদ্র। মস্তিষ্কের সুস্থ চিন্তার প্রতিফলন বিস্তার করতে লাগলাম। তালিবান যা বলে যায় আমি ঠিক তার উল্টো বলি। মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করি–ওরা কোনদিন। তোমাদের জন্যে শান্তি আনতে পারবে না, যারা কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে ঘর থেকে টেপ নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে, যারা মসজিদের দীর্ঘদিনের মৌলবীদের চাবুক মারে। ঠিক উচ্চারণ হচ্ছে না কোরাণের সেই কারণে যারা রাতের রোস্ট খাওয়ার জন্যে। দরিদ্র অসহায় মানুষদের বাড়ি থেকে জোর করে মেয়ে মুরগি নিয়ে যায় তারা কোন শান্তির জন্যে আসে না। তালিবানের আসল উদ্দেশ্য অন্য-অন্য। এই দেশের জন্যে বা জনগণের জন্যে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। তালিবানের এই সংগ্রামের মূলে অবস্থান করছে অন্য কোন বৃহৎ স্বার্থ। আমার সামান্য অভিজ্ঞতা যে সত্যিই সামান্য তা তালিবানেরা বিশ্বাস করতে পারল না। ওরা ভাবল সামান্য হলে এমন স্বাবলম্বী দৃঢ় পদক্ষেপ কোন মতেই সম্ভব নয়। তালিবানের ভাবনা আমার মনে প্রেরণা সঞ্চার করল। এবং যা সত্যিই সামান্য ছিল তা অসামান্য হয়ে উঠতে লাগল। তালিবানের দাসত্ববন্ধন অস্বীকার করলাম, শুধু তাই নয় অন্যদের মনেও সেই বীজ বোপণ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি জানি না কোথা থেকে কেমন করে সেই অসম্ভব এক অলৌকিক শক্তিতে রূপান্তরিত হতে লাগল আমার মন, হৃদয়। তালিবান আমাকে দেখলে প্রথম প্রথম বিদ্রূপ করত, পরে তা প্রহারে রূপান্তরিত হল।
আমি একদিন মোল্লা ওমরের বোনের বাড়িতে গিয়ে তার মগজ ধোলাই করে। এলাম সে খবর মোল্লার কানে পৌঁছাল। মোল্লার ঘরে গৃহযুদ্ধ লাগল, তার বিবিকে গিয়ে ফতেমা শাসিয়ে এল, বলে এল দাদা যা করছে তাতে তোমার কিছু হবে না কারণ তুমি তার বৌ। কিন্তু আমি পরের ঘরের বৌ, এবং অনা গ্রামের, সুতরাং যদি এই ভাবে দাদা তার কাজকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে তবে গ্রামবাসীরা আমার শ্বশুরবাড়িকে ছাড়বে না কারণ আমি মোল্লা ওমরের বোন। আজ বুঝতে পারছি মোল্লা ওমরের বোন হয়ে জন্ম নেওয়ার থেকে কাফেরের ঘরে জন্ম হলে সুখী হতাম।
ওমর পরে বোনের সঙ্গে দেখা করে তাকে নিজের যুক্তিতে হারিয়ে দিয়ে আমাকে মিথ্যের প্রতীক হিসাবে গণ্য করল। বলল–ও কাফের, ওই কাফেরের কথা শুনে তুইও কি কাফের হতে চাস? ওত চাইছে কাফের হোক আফগানের সমস্ত মানুষ। তুই কি জানিস না রাশিয়ার সঙ্গে হিন্দুস্থানের দোস্তির কথা?
তবে একটা কথা লিখতেই হয় যে ব্যক্তিমানুষ মোল্লা ওমর আর রাজনৈতিক মোল্লা ওমর এক নয়। একই মানুষ যেন দুই রকম। ব্যক্তি মানুষ হিসাবে সে খারাপ নয়, অন্ততঃ আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে, সে সাংসারিক চেতনা সম্বন্ধে সমঝোতাবান, সংসারের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, নিজের গ্রামের মানুষের প্রতি কর্তব্য সচেতন ও সক্রিয়। কিন্তু রাজনৈতিক বা অন্ধ ধর্মালোচনায় সে কঠোর, কঠিন, গোড়া, একলোখা বাস্তব বুদ্ধিহীন, যন্ত্রণাদায়ক, গভীর মতবিরোধ, নৃশংস, হত্যাকারী পৈশাচিক। ধর্ম ও কোরাণ ছাড়া সে কাউকে চেনে না। তার কোন বন্ধু বান্ধব নেই কেবল মাত্র সমমতাবলম্বীদের পছন্দ করে, নিঃসম্বল অবস্থার মানুষদের অর্থ দান করে স্বার্থ নিয়ে তাদের দলে টেনে আনার উদ্দেশ্যে।
এই তার রূপ। বিচিত্র তার জীবন, আরও বিচিত্র তার কর্মকান্ড। ঐশ্বর্য তার তেমন একটা নেই, তবে কোথা থেকে পায় সে অর্থ? যা নিঃসম্বল মানুষদের বিলিয়ে হাত করে নেয়? শুনেছি বাইরের থেকে তাকে অর্থ সাহায্য করে, কিন্তু কেন? এই কেন্নর উত্তর খুঁজতে আমি তখন ব্যস্ত। কিন্তু কেউ সঠিক উত্তর আমাকে দিতে পারে না। চোখে দেখেনি বা অন্য কোন খবর জানে না। ইতিমধ্যে আমি সবার মুখে শুনতে পেলাম যে খোস্ত শহরে নাকি একজন এমন মৌলানা এসেছে সে নাকি ভূত-ভবিষ্যত সব বলে দিতে পারে। সে নাকি পীরবাবা। তার মতো ধার্মিক লোক নাকি এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই, সে নাকি মুখ দিয়ে যা বলে তাই হয়। জনে-জনে মানুষ তার কাছে যেতে লাগল, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, উদ্দেশ্য নানা রকম, কারও বাচ্চা হচ্ছে না, কারও সংসারে অশান্তি, কারও স্বামী অন্য বউ আনার পরে আগের বউকে ভালোবাসে না, কারও বাচ্চা হয়ে হয়ে মরে যাচ্ছে, কারও কেবল মেয়ে হচ্ছে ছেলে নেই, কেউবা কাউকে বশ করার বাসনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। মির মসজিদে সেই মহামানব এসে তিনদিন করে থাকে আর সব্বাইকার মুশকিল আসান করে। সেই মসজিদের চারিদিকে নাকি আখরোট গাছ, আপেল গাছ, বেদানার গাছ, আঙ্গুর গাছ আছে, এবং সারা বছর নাকি তাতে ফল হয়, যেমন হয় জন্নতে। কই অন্য গাছে তো সারা বছর ফল হয় না? এত বছর তো হয়নি? আজ ওই পীরবাবার পদার্পণে হচ্ছে ফল? নানা রকম যুক্তি মানুষের মনে গেঁথে গেল। আমার মনেও বিস্ময় উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল, সত্যিই তো এই দেশে সারা বছর গাছে ফল? শীতের হাওয়ায় যেখানে গাছের পাতা ঝরে যায়? আমিও মনে মনে ভাবলাম যাবো, একটা মাদুলি নেব, যাতে এই দেশ থেকে বেরিয়ে আমার নিজের দেশে যেতে পারি। তবেই বুঝব সব সত্যি। সে কি হিড়িক? জিপ ভাড়া করে, টয়টো ভাড়া করে, ট্রাক্টর বোঝাই সব মানুষ যেতে লাগল। আমি খবর পাঠালাম আমার ননদ গুনচার কাছে, গুনচা তার স্বামী রম্মাজানকে গাড়ি ভাড়া করতে হুকুম জারি করল। আমি গুনচার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম, গুনচার বাড়ি থেকে তামির খুবই কাছে, প্রায় এক ঘণ্টার পথ।
আমরা পরের দিন ভোরে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেলা হলে রোদের তাপ বাড়বে, ঘণ্টাখানেক পরে সেখানে গিয়ে পৌঁছালাম, ইতিমধ্যেই অনেক ভিড় হয়ে। গেছে। আমি আমার সন্দেহ অমূলক কি সত্যি তাই পরীক্ষা করার জন্যে ঘুরে ঘুরে সূব দেখতে শুরু করলাম। আখলোট গাছ দেখলাম। সবুজ সবুজ আখরোট হয়ে আছে গাছে, এবং আশ্চর্য যে আপেল, আঙ্গুরও হয়েছে, অথচ আমাদের বাড়ির গাছে এখনও ফুলই আসেনি। বিস্ময়ের প্রথম ধাপ বিশ্বাসে পরিণীত হল, বাকি আসল এবং উদ্দেশ্য মূলের ধাপ। প্রায় ঘণ্টা দুই পরে আমাদের ভেতরে যাওয়ার পালা। আমার বুকের ভেতরটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় কেমন অস্থির হয়ে উঠছে মন। ভেতরে গেলাম যেখানে একটা সামান্য লম্বা তোষকের ওপর হাঁটু পর্যন্ত পা মুড়ে সোজা হয়ে বসে আছেন পৃথিবীর বিস্ময়কর এক বিস্ময়। যার কাছে অগণিত মানুষ এসে নতজানু হয়ে বসে পড়ছে। আমিও গিয়ে বসলাম, পাশে গুনচা ও রম্মাজান। গুনচাই প্রথমে কথা বলল-বাবা, মা মোলা খুইজে ডের কাল, লিক দম ওয়াকা, জোড়সে, মা কাক্কালি কাক্কালি আওলাদুনা। অর্থাৎ, বাবা, আমার কোমরে ব্যথা অনেকদিন ধরে, দম করে দাও যেন সেরে যায়, আমার ছোটো ছোটা। বাচ্চা সব।
বাবা অমনি এক শিশি তেল মুখের কাছে নিয়ে বিড়বিড় করে পড়ে দিয়ে দিল গুনচাকে, তারপর আমার দিকে ফিরে দেখে বলল–তা?
গুনচা আমার হয়ে বলল-দে মেরো ইলিয়ে নাস্তা, হিন্দুস্থানকে, দে বুম হিন্দুস্থানি দা, কোরতা জরু না লেগিইছে চিসাই ওয়াকা জরু লেগিয়েদাল আকপার। অর্থাৎ ওর স্বামী এখানে নেই হিন্দুস্থানে, ও নিজেও হিন্দুস্থানি, ঘরে মন বসছে না, কিছু করো যাতে মন বসে।
এবার সেই মহান পুরুষ আমার মুখের দিকে চাইলো, আমিও চেয়ে রইলাম, সেই চোখে কি ছিল জানি না তবে আমার মতো মেয়েকেও কিছুক্ষণের জন্যে। যেন মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। একটু সময় যাওয়ার পর তিনি বলেছিলেন– পরিষ্কার হিন্দী উর্দু মিশিয়ে–ইয়াদ রাখনা বেটি এক বাত, সমঝোতা জীন্দেগিকে নেহি পাকাড়তা, জীন্দেগি সমঝোতাকো পাকাড়কে চলতা। অউর এক বাত, ধরম বহুত বড়া চিজ হায়। তুম অগর এক ইসলামকো সাদি কিয়া ওর উসকা ধরমকো আপনা নেহি মানতা তো পতিভি আপনা নেহি হো সেখতা।
এরপর সেখান থেকে চলে এসেছি। কিন্তু সমস্ত রাস্তায় ভাবতে-ভাবতে এসেছি যে, যে কথাগুলো উনি বললেন তার তাৎপর্য কী? কেন আমার মুখের দিকে অমন করে তাকিয়ে ছিলেন? কি অনুসন্ধান করছিলেন? কি সৌম্য ব্যক্তিত্ব, সুন্দর, রোগা ছিপছিপে চেহারা, সমস্ত মুখ দাড়ি ভর্তি, সাদা ধবধবে কামিজ গায়ের সমস্ত মুখমন্ডলে অসম্ভব ব্যক্তিত্ব যেন বিরাজ করছে। একি সত্যিই কোন মহাপুরুষ? নাকি কোন প্রতিক্রিয়ার প্রতীক। দীর্ঘদিন যাবৎ ঐ মসজিদ ভূতের আড্ডার সুন্দর বাংলো হিসাবে অবস্থান করছিল; সেখানে হঠাৎ কোথা থেকে আবির্ভাব ঘটল ওই মানবপ্রেমীর? সক্রিয় মানবতাবাদের এই ধারা সত্যিই কী ঐতিহাসিক কোন মুক্তির পথ দেখাবে? অবিচ্ছেদ্যভাবে আফগানে পীড়িত মানুষের সঙ্গে জড়াবে? আফগানিস্তানের মানুষের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন আজ বন্ধ্যা। বাস্তব চিন্তায় নিষ্ক্রিয়, উপলব্ধির ক্ষেত্রের জ্ঞানের ক্ষেত্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রসার ঘটবে না। নিজেদের মতবাদকে সম্বল করে আফগান মানবজাতি নতুন কোন পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে না। এই মহাপুরুষ তা ঘটাতে সক্ষম হবে?
এই সব সাত পাঁচ ভাবতে-ভাবতে পৌঁছে গেলাম গুনচার বাড়ি। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক একটা রঙ্গমঞ্চে নতুন এক নাট্যকার ও রঙ্গকর্মীর দল আত্মপ্রকাশ করল। ধর্মের, কুসংস্কারের জাল বিস্তার করতে লাগল। জনগণকে নিজেদের অধীনস্থ করার স্বদিচ্ছায় মানুষের স্বাধীন চিন্তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্যে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা জারি করতে লাগল। মোল্লা ওমরের কথার প্রতিবাদ যারাই করেছে তাদেরই কপালে জুটেছে নৃশংস, পৈশাচিক মৃত্যু। অসহায়ের মতন দেশবাসী কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর দৌড়ে যায় দ্রানাই খানের কাছে। বাঁচার ক্ষীণ সূত্র দ্রানাই। দ্রানাই চাচা সব্বাইকে সান্ত্বনা দেন, বলেন-দাঁড়াও সবাই, সবুর কর, আমি দেখছি কি করা যায়। (সব কথা পুস্ততে হয়)।
দ্রানাই চাচা মোল্লা ওমরের সঙ্গে গিয়ে দেখা করেন, বিস্তারিত আলোচনা করেন। বলে এলেন–মোল্লা, মনে রেখ আমি বেঁচে থাকতে তোমার আধিপত্য আমার গ্রামে ফলাতে দেব না। অন্য কোথায় তুমি কি করছ তাতে আমার মাথাব্যথা নেই, কিন্তু আমার গ্রামের চৌহিদ্দির মধ্যে তোমার সর্বনাশা কাজ বন্ধ কর।
মোল্লা ওমর শুনল, কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া যে তার মনে ঘটেছে তা মনে হল। কেবল তার চোয়াল দুটো শক্ত হল। কিন্তু তালিবানের উপদ্রব পরের দিন। থেকে একটু যেন কমেছে বলে মনে হল। যারা বিনাশ সাধনের প্রবক্তা তারা কি থেমে থাকে? তালিবানরা সমস্ত গ্রামের শক্তিশালী পুরুষ বেছে বেছে দলে নিযুক্ত করার জন্যে উঠে পড়ে লেগে গেল। যদি কেউ দলে যোগ না দেওয়ার পরিকল্পনা করে তবে তার মৃত্যু অবধারিত। সন্ত্রস্ত সব জোয়ানরা ঘরের ভেতরে লুকিয়ে থাকত কেউবা গ্রাম ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে লাগল।
আবার হিড়িক পড়ে গেল সেই তামিরের মসজিদে আসা, তেজোদীপ্ত ললাটদেশ, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, সদাহাস্য মহামানবের কাছে যাওয়ার। উদ্দেশ্য যদি এই বিপদ, মহারক্তক্ষয়ী বিপদ থেকে তিনি বাঁচাতে পারেন। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, যখন সবাই সেই মহামানবের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসতে লাগল তখন এই মহারক্তক্ষয়ী বিপদকে আর কোন বিপদ বলে মনে করল না। যাদের এতদিন কঠিন অত্যাচারী বলে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে থেকেছে, মহামানবের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসার পরে সেই অত্যাচারীরাই নিকট বন্ধুর স্থান পেয়েছে। তালিবানদের সঙ্গে মোজাহিদদের। যে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল তা আজ মিত্রতায় রূপান্তরিত হল। তালিবানের ফতোয়া যা এতদিন শৃঙ্খলস্বরূপ হয়ে মোজাহিদদের ভাবিয়ে তুলেছিল তা আজ আর শৃঙ্খল রইল না। প্রতিটি মানুষ এক বাক্যে ঘোষণা করল তালিবান ইসলাম রক্ষার দূত। আমাদের মিত্র, শত্রু নয়। বিদেশীরা কাফেররা চায় ইসলাম ধর্ম পৃথিবী থেকে মুছে যাক, তাই মোল্লা ওমর তালিবানদের তৈরি করেছে যাতে ইসলাম ধর্মে কেউ আঘাত হানতে না পারে। ইসলামকে বাঁচাবে এই মোল্লা ওমর ও তালিবানরা।
আমি স্তম্ভিত, বধির! এই অশিক্ষিত জনগণকে সমূহধ্বংসের পথ থেকে নিবৃত্ত করবে কে? আজ তালিবানের গতিবিধির পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল, স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেল। মোস্লা ওমরের আধিপত্য কায়েম হল। আমার মনে গভীর ক্ষতের সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড রাগ পুঞ্জিভূত হল। জনগণের মুক্তির বাসনা পরিত্যাগ করে নিজের মুক্তির কথা ভাবতে লাগলাম। যারা মূর্খ, চৈতন্যজ্ঞানহীন, তাদের শোষণ থেকে মুক্ত করার বাসনা কেবল বাতুলতা। যে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে কঠোর, কঠিন এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্তে অগ্রসর হব সেই ভিতটাই তো টলমল। মোল্লা ওমরের অভূতপূৰ্ণ জয় হল। আমি ভাবলাম, যাক চুলোয় যাক আফগান জনগণ, পরাধীন হয়েই থাক, কিন্তু আমি পরাধীনতা কোনমতেই স্বীকার করব না। আমাকে মুক্তি পেতেই হবে এই বর্বর তালিবানের হাত থেকে।
তালিবান ও গুলবদিন যুদ্ধ, আমাকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা
যুদ্ধ কোনদিন শান্তি আনতে পারে না। আনে কেবল দুঃখ, দুর্দশা। এক পক্ষের ওপর অন্য পক্ষের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, খুন ও সর্বশেষে মৃত্যু। সেই যুদ্ধই ঘোষণা করল তালিবান। গুলবদিন হেকমতিয়ারের পার্টির বিরুদ্ধে। আরাকাত পার্টি তখন লিড করছে সমস্ত আফগানে। রাব্বানী আরাকাতের কথা আগেই বলেছি, ইসবি ইসলামি অফ আফগানিস্তান দ্বিতীয় স্থানে। সেই ইসবির সঙ্গে তালিবানের যুদ্ধ হবে কারণ তারা মোল্লা ওমর মায় তালিবান, কাউকেই স্বীকৃতি দেয়নি, এবং দেবেও না বলে ঘোষণা করেছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ। যুদ্ধের তোড়জোড় চলতে লাগল জোর কদমে। গ্রামের যারা ইসবি পার্টির সদস্য তারা প্রকাশ্যে আর বেরুতে পারছে না, কারণ তালিবান কোতল করবে। লুকিয়ে লুকিয়ে চলে যেতে লাগল
এবার গ্রামবাসী পড়ল আর এক ঝামেলায়। একদিকে গুলবদিন ঘরে-ঘরে ডাক পাঠাল জোয়ান ছেলেদের যুদ্ধে যোগ দিতে, অন্য দিকে তালিবানও ডাক পাঠাল। উভয় সংকট মাথায় নিয়ে আসন্ন বিপদকে কি করে কাটিয়ে উঠতে পারে তারই জল্পনা-কল্পনা চলতে লাগল। সেই জল্পনা-কল্পনার সিদ্ধান্তে আসতে সময় লেগে গেল প্রায় একমাস। ততদিনে তালিবান তালিকা করে ফেলেছে কার বাড়িতে কতজন পুরুষ আছে। একজন পুরুষ বাড়িতে থাকবে অন্যরা যুদ্ধে যোগ দেবে। আমার সমস্ত শরীর রাগে যন্ত্রণায় ফেটে পড়তে চায়, নিজেকে সম্বরণ করি। মূর্খের দল! একমাস কি কম সময়? কুরুক্ষেত্র এবং পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়! আর এদের সিদ্ধান্ত হয় না? মরুক সব! এবার বোঝ ঠেলা? যাও তালিবানের দলে, বেঘোরে প্রাণটা দিয়ে দাও। তারপর শহীদ হয়ে জন্নৎতো আছেই। যারা ইসবি পার্টিকে সত্যিই সত্যিই সমর্থন করে তারাও বাধ্য হল তালিবান হতে।
এর পর শুরু হল গ্রাম, শহর কাঁপিয়ে ভয়ঙ্কর প্রলয়। আবার ব্যবহৃত হতে লাগল আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরগুলো। একবছর যে ঘর ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি। ঘরে ঘরে আবার নতুন করে কান্নার রোল উঠল। আবার সেই দুর্ভিক্ষ মানুষকে গ্রাস করল, আফগানবাসি আবার নতুন করে সব হারাতে লাগল অসহায়ের মতো। তালিবান এবার যুদ্ধে জয় করল গড়দেশ, তামির এবং কাবুল মাজার-ই-শরীফের দশ কিলোমিটার আগে চারাশিয়া। এই চারাশিয়া পর্যন্ত গুলবদিনের এলাকা ছিল। সে জায়গা দখল করার পর তালিবানের উল্লাস পুরোদমে বেড়ে চলল। ইসবির সমস্ত মানুষ পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল খোস্ত শহরে। গুলবদিন কোথায় গা ঢাকা দিল, তা কেউ বলতে পারল না। অভূতপূর্ব জয় তালিবানের। ওদের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। এবার দুবৃত্ততায় সর্বশক্তি তারা নিয়োগ করল। স্বেচ্ছাচারিতা উত্তরোত্তর বেড়ে চলল। অত্যাচার এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল যে গ্রাম, শহরের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগল। জোর করে ধরে ঘরের খাদ্য কেড়ে নিতেও কুণ্ঠিত বোধ করত না। মুরগি, দুম্বা, ভেড়া যা যেখানে পায় নিয়ে গিয়ে নিজেদের উদর পূরণ করতে লাগল। এমনকি শীতের দিনের লেপ তোষক, পোশাক পর্যন্তু কেড়ে নিয়ে যেতে লাগল। সমস্ত বাড়ি থেকে কালাউনশিকভ, এ. কে. ৪৭ এবং অন্যান্য সব আগেই ছিনিয়ে নিয়েছিল। এবার কারও বাড়িতে জিপ বা টয়টা গাড়ি থাকলে তাও কেড়ে নিতে লাগল। উপরন্তু পাকিস্তান থেকে তালিবানের জন্যে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আসতে লাগল গাড়ি বোঝাই করে। এক নব আন্দোলনের আনন্দে যেন সবাই মেতে উঠল। বেনেজির ভুট্টোর মন্ত্রীত্ব চলে গেল, তাতে তালিবানের কোন ক্ষতি হলো না। নওয়াজ শরীফ আসার পর তালিবানের আরও সুবিধা হয়েছে। নওয়াজ শরীফ একদিন জনসমক্ষে তো বলেই দিল, পাকিস্তানের জন্যে আমি কতটুকু করতে সক্ষম হয়েছি তা জনগণ বিচার করবে। তবে আমি সুখী যে আফগানিস্তানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল বুদ্ধিদীপ্ত কমিউনিস্ট মাইন্ডের মানুষগুলোকে শেষ করতে পেরেছি।
এই আফগানিস্তানে ১৯৯০ সালের আগে বসবাস করত বিভিন্নধর্মী এবং জাতি। উঃ নজিবুল্লা যখন নেতৃত্বে ছিলেন তখন কোন গোঁড়ামি ছিল না কাবুল শহরে। জাতিভেদ ছিল না। মেয়েদের স্বাধীনতা ছিল, ছিল স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি। ছিল শিল্প, সিনেমা, টিভি, রেডিও। সেই শান্তিপূর্ণ সহবাস আজ তালিবানের স্বেচ্ছাচারিতায় খর্ব হল। অন্তঃপুরবাসিনী হতে বাধ্য করল মেয়েদের। শুধু তাই নয় বোরখা দিয়ে তাদের এক জন্তুর মতো খাঁচায় বন্দীর ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। পকেট থেকে ছুরি বের করে মেয়েদের গলার নলি কেটে আবার তা হাত দিয়ে মুছে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে এই বর্বর তালিবান। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, উন্নয়ন সম্পর্কে ভাববার কোন চেষ্টা এই তালিবানের নেই। থাকবেই বা কেন? ওরা তো আর আফগানিস্তানের উন্নতি প্রকল্পে প্রবেশ করেনি ওই দেশটায়? তালিবানরা কেবল ওই দেশটাকে ঘাঁটি করেছে। আজ সারা বিশ্বের মানুষ মোল্লা ওমর সম্পর্কে জানার জন্যে উদগ্রীব। আমার কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ বইতেই তো মোল্লা ওমর সম্পর্কে লেখা আছে। জাজের মামার বাড়ির গ্রামের লোক বলে তাকে জান্বাজরা সবাই মামা বলে ডাকত। ওমর মামা। আমার বইতে লেখাই আছে যে ওমর মামা পাকিস্তানের মাদ্রাসায় কোরাণ শিক্ষা নিয়ে ফিরে এসেছে গ্রামে। এবং আমার সঙ্গে তর্ক হয়েছিল আল্লা, ভগবান সব এক নিয়ে, কিন্তু ওমর মামা মানতে রাজি ছিলেন না। পরে আমি উদাহরণ দিয়েছিলাম আকাশের চাঁদ দিয়ে….. তালিবানের উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা তালিবান আফগান ও আমি বইতে লেখাই আছে তালিবান কত নৃশংস, অত্যাচারী, ভয়ঙ্কর। এবং এক বর্ণ মিথ্যে নয় বইটাতে লাদেনের ইচ্ছে সম্পর্কে লেখা আছে ১০৩ পৃষ্ঠাতে। যাই হোক, সেই ওমর মামা পরবর্তী সময়ে হয়ে গেল মোল্লা ওমর। একাধারে অন্ততঃ কুড়ি থেকে পাঁচিশ বার কোরাণ শেষ করে মৌলবীর পদাধিকারের অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন, অন্য ধারে তার বাবা ছিলেন মৌলবী, সুতরাং মোল্লা নামের আগে জুড়ে দিতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। এবার দেখা যাক তাদের আসল উদ্দেশ্যটা কী? এবং কী তাদের শেষ কথা? এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দ্বারা আফগানিস্তানের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ বিকাশ, উন্নয়ন নির্ধারণ করা? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা? এবং সারা বিশ্বে তার প্রতিক্রিয়ার বীজ রোপণ করে একে বারে হজরত মহম্মদের মধ্যে সেরা হওয়া? আমার ব্যক্তিগত ধারণা ও পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মোল্লা ওমর ও লাদেন হিরো হতে চেয়েছে, এবং যে অসমাপ্ত কাজ মহম্মদ তার উত্তরসূরীর জন্যে রেখে গিয়েছেন, মোল্লা ও লাদেন যৌথভাবে তা সমাপ্ত করবে। এখন সমস্যা হচ্ছে সেই অসমাপ্ত কাজটা কী?
একদিন মোল্লা ওমর দ্রানাই চাচার ঘরে বসে বক্তৃতা দিচ্ছিল, যথারীতি আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ওমর প্রথমেই বলেছিল–দ্রানাই, আমাদের শেষ নবীর অন্তিম ইচ্ছে কি ছিল তা কি তুমি জান না? জানি (সমস্ত কথা পুস্তুতে হয়, আমি বাংলায় লিখছি)। জানোই যদি তবে আমার কাজে বাধা দিচ্ছ কেন? নবীর ইচ্ছে অনুসারেই আমি অগ্রসর হচ্ছি, এবং দ্রানাই তুমি দেখবে এই সারা বিশ্ব একদিন ইসলামধর্মী হবেই হবে। তবে মনে হয় আমাদের মিত্র বেশিদিন আর মিত্র থাকবে না।
–কেন? পাকিস্তান বরাবরই তো আমাদের মিত্র।
–না, না, পাকিস্তান নয়। আরও শক্তিশালী দেশ। তবে এখুনি কেউ আমাদের শত্রু হবে না, যখন ইসলামি কায়েম করতে উদ্যত হব তখনই হবে সমস্ত সমস্যা।
আমি বোকার মতো ওদের কথা শুনছিলাম। ওমর দ্রানাই চাচার সঙ্গে কথা শেষ করার পর বলেছিল আমাকে
–সাহেব কামাল, তুমি এখনও কাফের হয়েই রইলে? দ্রানাই চাচার দিকে তাকিয়ে বলেছিল ওমর–
–দ্রানাই তুমি কেন সাহেব কামালকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দিচ্ছে না? একটা কাফেরের হাতে কিছু খাওয়া গুনহা, এমন গুনহা করো না। দ্রানাই চাচা গভীর স্নেহের সঙ্গে বলেছিলেন–
–ওমর ও কাফের হলেও মূশাফির, আমাদের এখানে ওর আপন বলতে কেউ নেই আমরা ছাড়া। এখন ওকে জোর করে কিছু করলে আরও গুনহা হবে। ওর স্বামী ফিরে এলে তখন যা হয় হবে।
ওমর আমার দিকে চেয়ে বলেছিল– সাহেব কামাল, ইসলাম ধর্ম খুব পবিত্র ধর্ম, শান্ত এবং শান্তির ধর্ম, ক্ষমা ও ত্যাগের ধর্ম, সহনশীলতার ধর্ম। জ্ঞান এবং চৈতন্যের উদয় হয় একমাত্র ইসলাম ধর্মে, যখন বিসমিল্লা রহমানের রহিম উচ্চারণ করবে তখন দেখবে তোমার সমস্ত শরীর মন কেমন শিহরিত হবে। আর তুমি। ডাকলে আল্লা সাড়া না দিয়ে পারবেই না, কারণ তুমি একটা বিধর্মী কাফের থেকে পবিত্র ইসলামে পরিবর্তিত হবে। তোমার ডাক সর্বাগ্রে আল্লার কানে গিয়ে পৌঁছাবে, বল, আমার সঙ্গে বল–লা ইলাহা ইল্লালা, মহাম্মাদুর রসুল্লোলা।
ওমর উচ্চস্বরে সুর করে কথাগুলো বলতে লাগল, আমার সমস্ত শরীর যেন কেঁপে উঠল, হাত পা ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগল। ওমর তার একটা হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শ করল, আমি কেঁপে উঠলাম, কি ছিল ওই স্পর্শে জানি না আমার সমস্ত শরীরের রক্ত যেন হীম শীতল হয়ে গেল। আমার কানে বার বার ধ্বনিত হতে লাগল শান্ত-শান্তির ধর্ম, ক্ষমা-ত্যাগসহনশীল জ্ঞান…….
আমি অবশ হয়ে গেছি। হঠাৎ, হঠাৎ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল ছুরি বের করে কণ্ঠনালি কেটে দিয়ে ছুরি মুছে পকেটে রাখার দৃশ্য। মেয়েটার অপরাধ? ইঞ্জেকশান নিতে গিয়েছিল কবির খান নামে একজন পুরুষ ডাক্তারের কাছে। হঠাৎ আমার পিঠে কে যেন চাবুকের বাড়ি মারল, আমি সমস্ত বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠলাম, আর আমার কোন অলসতা নেই, নেই কোন কাঁপুনি। আমি বাস্তবে ফিরে এলাম এবং ওমরকে বললাম– ওমর মামা, তোমার শান্তির ধর্ম তোমার কাছে থাক, আমার অপবিত্র অশান্তির ধর্ম আমার থাক। আমি না হয় কাফের হয়ে রইলাম?
–তাহলে তুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে না? ওমর মামা কণ্ঠস্বর কঠিন করে বলল।
–না করব না। যে ধর্মে ডাক্তার দেখানোর অপরাধে গলার কন্ঠি কেটে দেওয়া হয় সে ধর্ম আমি মানি না, আর শান্তির কথা বলছ? তা তো আমি নিজের চোখেই সব দেখতে পাচ্ছি। ত্যাগ ও ক্ষমার মানে জানে তোমার ধর্ম? যদি জানত তবে আজ আফগানিস্তানের এমন হাল হতো? তোমার ইসলাম ধর্ম অশান্তির ধর্ম, পৃথিবীর সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীর ধর্ম। যাক, তোমার মতো সর্বজ্ঞানীর কাছে বসে আমি নিজেকে খুব ধন্য বলে মনে করলাম, এবার চলি।
আমি ওমর মামাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে এলাম। আসতে আসতে শুনলাম ওমর বলছে দ্রানাই চাচাকে
–আল্লার কি বিধান আছে জান? অইচ্ছুক একটা কাফেরকে ইসলাম করতে। পারলে অনেক সওয়াব, জন্নতের পথ খুলে যাওয়া।
আমি শুনলাম কথাগুলো, বাড়িতে ফিরে এলাম, নিজের ঘরে ঢুকে আলো আঁধারির নির্জনতায় বসে ভাবতে লাগলাম এই জন্যেই কি জাব্বাজ আমাকে নানা রকম ছলনার আশ্রয় নিয়ে বিয়ে করে এনেছে? কেবল আমার পরিচয় একটা কাফের? এবং আমি বলির পাঁঠার মতো? কেবল ইসলাম করে জন্নতে যাওয়ার রাস্তা করার জন্যে আমাকে বিয়ে? অথচ সেই সেদিন? যেদিন সবে মাত্র জাজের সঙ্গে আমার ভালোবাসার রং ধরতে শুরু করেছে? তারপর বিয়ে করে পালিয়ে জান্বাজের হাত ধরে কাবুলে চলে আসা? এই আফগানিস্তান সম্পর্কে জান্বাজ আমার চোখে এক স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল। বলেছিল–মিতা, তুম সোচ ভি নেহি শাখাত, মেরা দেশ এ্যাতনা খুবসুরৎ হ্যায় যো তুমে কেয়া বাতায়গা?
জান্বাজের প্রথম বিবিকে আবিষ্কার, বন্দি হওয়া
সে স্বপ্ন ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। ঠিক কুড়িদিন পরেই ভেঙেছে সেই স্বপ্ন। যখন প্রথম কাবুলের মাটিতে পা রাখলাম। ঘটনার প্রবাহে ভালোবাসা যেন কেবল নিছক একটা কথা হয়ে ঘুরপাক খেয়েছে মনের মধ্যে। আরও একটা কথা সেদিন আমাকে বিদ্ধ করতে থেকেছে, জান্বাজ আমাকে মিথ্যে বলল? প্রথম প্রথম ওখানকার ভাষাও আমি বুঝতাম না। সব্বাইকে কেমন যেন অন্য পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হত। যেন অনা কোন গ্রহ থেকে ওরা এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে আমার চারপাশে। কেবল পুরুষরাই একটু হিন্দি বলতে পারত। কাবুলে যাওয়ার পরদিন থেকেই জাম্বাজ যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। সদাসর্বদা বাইরেই থাকে। যখন বাড়িতে থাকে তখনও নিজের লোকদের সঙ্গেই বেশি কথা বলে ওদের ভাষায় ও যেন ভুলেই গেছে আমার। অবস্থানের কথা। কেবল রাতের অন্ধকারে চার দেওয়ালের মধ্যে ও আমার হয়। আমি যদি ওর এমন ব্যবহারের জন্যে কোন প্রশ্ন করি তবে হয় ও এড়িয়ে যায় নতুবা কোন না কোন অজুহাত দেখায়। আরও একটা ব্যাপারে মাত্র দুতিন দিনেই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল তা গুলগুটি বলে একটা বৌকে নিয়ে। গুলগুটিকে দেখি, কিন্তু ওর স্বামী কে? জামাজের কোন ভাইয়ের বৌ নয়, আসাম চাচার ছেলেরা ছোট, জ্যাঠা শ্বশুরের তিন ছেলে, দুই ছেলের বৌ আছে এক ছেলের বিয়ে হয়নি। তবে? গুলগুটি কার বৌ? জাম্বাজ ভাববাচ্যে বলে, ওমেরা ভাবি। গুলগুটির গতিবিধি আমার মোটেও ভালো লাগে না, কেমন যেন বেপরোয়া ও নির্লজ্জ বলে। মনে হয়। দরজায় নক্ না করেই যখন তখন ঘরে ঢুকে পরে। যাইহোক শুলগুটির চিন্তার থেকে তখন আমার একাকীত্ব আমাকে খুব বেশি ভাবিয়ে তুলেছিল। রাতারাতি আমি যেন এক বোবা মেয়ে হলাম। বোবার মতো দিন কাটছে তখন আমার এই সময় আরও একটা জিনিস আমাকে ভীষণ বিচলিত করে তুলল। জান্তাজ মাঝে। মধ্যেই বাড়িতে ফেরে না রাতে। জিজ্ঞাসা করলে বলে বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম, নয়তো কোন আত্মীয়ের নাম বলে। সেই সময় সবে মাত্র চার মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। আমি আফগানিস্তানের মাটিতে প্রস্ফুটিত হয়েছি আমার শ্বশুরবাড়িতে। ততদিনে আমি জেনে গেছি যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে একটু একটু করে ওদের ভাষাও বোঝার এবং বলার চেষ্টা করছি। আবু, জাম্বাজের জেঠিমা, আমাকে একটু বেশি স্নেহ করেন। কারণ আমি মুসাফির বলে। অবসর সময় আমার সাথে থাকেন। তবু তার মধ্যেও একটা বিশেষ অবসর সময় কাটাবার জন্যে আমি আপুর ঘরে চলে যাই। বসি গল্প করি, চা খাই। এমনি করেই চলেছে আমার আফগানি দিন।
১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর। দোসরা ডিসেম্বর আমার জন্মদিন। আমার জন্মের পর এই প্রথম আমি আমার বাবা, মা, ঠাকুমা এবং সব্বাইকার থেকে দূরে বহুদূরে আছি। সকাল থেকেই মনটা খুব খারাপ। অন্যান্য বার এই দিনে ভোরে উঠে মা আমার মাথায় ঠাকুরের ফুল ছুঁইয়ে দিত। বাবা পুরো একশ টাকা দিত ঘোরার বা খাওয়ার জন্যে। ঠাকমা এসে কোন না কোন সোনার জিনিস উপহার দিত। যা মেজো কাকা তৈরি করে দিত। আজ। এই ৮৯ সালে সকালে কেউ এসে তার স্নেহের হাত আমার মাথায় রাখেনি। স্নেহের হাত নয় নাই বা রাখল কিন্তু পাশে। তো থাকতে পারত জাম্বাজ। গতকাল রাতে সে বাড়িতে ফেরেনি। একরাশ কষ্ট মনে নিয়ে বসে চা খাচ্ছি। বাইরে ক্রমাগত বরফ পরেই চলেছে। মনটা ভার মুখটা গম্ভীর শরীর অবসন্ন। বেলা প্রায় দশটা বাজে এমন সময় জান্তাজ বাড়ি এল। হাতে একটা খরগোশ ঝুলছে। বাইরে থেকে চিৎকার করতে করতেই এসেছে আমার নাম ধরে, যে নামটা ও রেখেছে–পাগলি। আমি ঘরের ভেতর বাসেই আছি, গুলগুটি দৌড়ে গেল। জাম্বুজের হাত থেকে খরগোশটা নিল। জাম্বাজ ঘরে এল, আমার। পাশে এসে বসল। বলল- ক্যায়সা হ্যায় পাগলি?
আমি চুপ করেই আছি। কিছুক্ষণ পরে ওকে বললাম- তুমে মালুম নেহি আজ মেরা জন্মদিন হ্যায়?
এক গাল হেসে বলল– বাপরে, আজ তুমারা জনমদিন? তুম সাচমুছ পাগলি হ্যায়। তুম বাচ্চা হয়? যো জনমদিনকা বাত শোনা? আমি ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে ও বলল– আচ্ছা যাও তুমে এক কামিজ হাম দেগা! বলে উঠে কোথায় যেন চলে গেল। আমি বসেই আছি। মনটা খুব খারাপ লাগতে শুরু করল। বিয়ের আগে এতো কিছু ভাবিনি। ভাববার তাগিদ তখন অনুভব করিনি। জান্বাজ যা বলেছে তাই সরল বিশ্বাসে বিশ্বাস করেছি। আমি যখন যাকে বিশ্বাস করি তখন ভাবতেই পারিনা যে সে মিথ্যে বলছে। একবার ট্যাটন আমাকে বলেছিল সুমি, বিস্কুটের গাছের তলায় যা দেখবি অনেক বিস্কুট পড়ে আছে, গাছ থেকেও পাড়তে পারিস, পলিও তাই বলেছিল কোথায় সে গাছ তাও দেখিয়ে দিয়েছিল। একটা সবুজ ব্রিটেনিয়া বিস্কুটও দেখিছে। আমি সেই গাছ খুঁজতে গিয়ে অযথা হয়রান হয়ে বাড়ি ফিরে দাদুর বাঁকা লাঠির মার খেয়েছি। বিশ্বাস গেছে হাড়িয়ে। জান্বাজও আজ হয়তো তেমনই কোন শান্তনা দিয়ে কোথাও চলে গেল। নইলে হঠাৎ করে ও জামা পাবে কোথায়? ওতো এখুনি শুনল আমার জন্মদিনের কথা। একটু পরে সত্যিই একটা জামা নিয়ে এসে হাজির হল।
বলল– লো, কামিজ লো। দো তিনদিন পহেলে হম কাপড় লাকে আবুকে দিয়া থা, তুমারে লিয়ে এক কামিজ বানানেকে লিয়ে। খুশতো?
সত্যিই আমার মন খুশিতে ভরে উঠল। তবে ও ভোলেনি আমার জন্মদিনের কথা? আমি আনন্দে মেতে উঠলাম। ভাবতে লাগলাম ওকে নিয়ে কবে নিজের দেশের বাড়িতে যাব। বাবার যত রাগই হোক আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তাড়াতে পারবে না। মা, ঠাকুমার কান্না বাবা নিশ্চয়ই অবহেলা করতে পারবে না। মনে মনে আমি জান্মাজকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াই বাবার সামনে। মনে মনেই ভাবি বাবা প্রথমে বলে বেড়িয়ে যেতে, তারপর আমি যখন বাবার পা জড়িয়ে ধরি তখন বাবা নরম হন। বাড়িতে খুশির হাট বসে। ভাবতে বড় ভালো লাগে আমার। গরম তোযষাকের ওপর শুয়ে ভাবতে-ভাবতে আমি কোলকাতায় সংসার পেতে নিই জান্ধাজকে নিয়ে। ভাবি আমার একটা মেয়ে হয়েছে। তখন আমি ঠিক তিনমাস অন্তঃসত্বা। সেই মেয়ে আধো আধো বলে আমাকে মা বলে গলা জড়িয়ে ধরছে। আমি ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। কখনও বা জাম্বাজ আমি আর মেয়ে বেড়াতে যাচ্ছি, সব কিছুই ভাবনার মধ্যে হতে থাকে। এমনকি মেয়ে বড়ও হয়ে যায়। তখন বিয়ে দেওয়ার প্রশ্নে এসে থমকে দাঁড়ায় ভাবনা। হঠাৎ মেয়ে থেকে পালটে ছেলে হয়ে যায়। কিন্তু না আর ভাবনা, বাড়তে পারে না। ছেলে না মেয়ে? এই প্রশ্নের বিচারে তখন ভাবনা দুলতে-দুলতে বিদায় নেয়। তবু আমি শুয়েই থাকি।
ঘরটাই তখন আমার ও জাজের পৃথিবী। আমার ঘরে আর একজনের অস্তিত্ব আছে। সে হল গুলগুটি। আমার কাছে ও একষ্টা রহস্যময় চরিত্র বলে মনে হয়। ওর স্বামী নাকি লন্ডনে। তা হোক কিন্তু ওর শ্বশুরবাড়ি কোথায়? এ বাড়ির সব ছেলেকেই তো আমি চিনি, তবে? গুলগুটির স্বামী নাকি জাজের খুড়তুতো ভাই। কিন্তু তার তো একটা বাড়ি থাকবে? কি জানি, কি সব হচপচ ব্যাপার, আমার মাথায় ঢোকে না। আর তা ঢোকাবার চিন্তাও করি না। ভালো ভালো সুখের, স্বপ্নের ভাবনা ছেড়ে গুলগুটির ভাবনা ভাববার সময় নেই। তবে যখন তখন ও ঘরে ঢুকে পড়ুক সেটাও আমার ভালো লাগে না। ঘরের গোপনীয়তা বলে একটা ব্যাপার আছে তো? এই তো সেদিন, তখনও ভালো করে ভোর হয়নি, আমি আর জাম্বাজ শুয়ে তখনও। হঠাৎ গুলগুটি দরজা খুলে নির্দ্বিধায় ভেতরে ঢুকল, আমাদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখল, মুখে বিড় বিড় করে কি সব যেন বলল, তারপর নামাজ পড়ার জানো জায়নামাজ নিল, (যার ওপরে বসে নামাজ পড়া হয় তাকে জায়নামাজ বলে। সেটা নিয়ে বাইরে চলে গেল। ব্যাপারটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। অথচ দরজা লক করার কোন সিস্টেম নেই, যা দিয়ে আমি লক করতে পারি। আমি সকালে চা খেতে খেতে ব্যাপারটা জাম্বাজকে বললাম। জান্বাজ কোন গুরুত্বই দিল। যেন ওটা কোন ঘটনাই নয়, এমনটাই সর্বত্রই হয়ে থাকে। আমার ভীষণ রাগ হয়। এই রকম অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি এলটির মাফ হয়ে যায়। আরও একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি গুলটি সবসময় আমাদের সঙ্গেই খেতে বসে। ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে ডিনার পর্যন্ত। আর অন্য ঘরের কারও সঙ্গে বসে না কেন? ওর কাছে আমরা যা অন্য সবাইতো তাই। এই প্রশ্নও আমি জান্বকে করলাম। জান্বাজ বলল ও আমাদের একটু বেশি ভালোবাসে তাই। আমার মন কথাটা মেনে নিতে পারল না। খেতে বসে জান্বাজ ও গুলগুটির মধ্যে অনেক কথা হয়, আমার মনে হয় কথাগুলো ঠিক বৌদি দেওরের মধ্যে কথার মতো কথা নয়। কিছু বললে জান্বাজ আমাকে এক ধমকে থামিয়ে দেওয়ার মতো করে থামিয়ে দেয়। এই ভাবেই চলছে তখন জীবন। আমি যেন পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে সুখী। জাম্বাজ বাইরে কোথাও গেলে, ফিরে এসে বাইরের দরজার কাছ থেকে চিৎকার করে আমাকে ডাকে–পাগলি, তুম কিধার হ্যায়? দেখ হা আ গ্যয়া। একদিন জাম্বাজের সঙ্গে আমার রাগারাগি হল। সেদিনটা ছিল ১৯৮৯ সালের বাইশে অক্টোবর। আমি রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘরে হ্যারিকেনের আলোয় বসে গল্প করছি। ঠিক গল্প নয়, অন্যান্য সবাই গল্পে হাসি ঠাট্টায় মশগুল, আমি কেবল বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার তিন দেওর গুলগুটি ও জান্ধাজ ওদের ভাষায় কথা বলে, যা আমার বোঝা দুঃসাধ্য। নিজের ওপর নিজের রাগ হয় আর রেগে যাই জাজের ওপর। ও তো আমার সঙ্গে একটু গল্প করতে পারে? সারাদিন রাত আমি কথা বলি না। আমি যেন বোবা মেয়ে। জাম্বাজের এটা বোঝা উচিত? মনের মধ্যে একটা জেদ জমে ওঠে, যেমন করেই হোক ওদের ভাষা শিখতে হবে।
সেদিন যখন সবাই বসে গল্প করছিল তখন আমি জান্ধজকে বললাম-জান্বাজ এক বাত বাতায়েঙ্গে? শুনোগে তো খুশিসে ঝুম উঠোগে।
জাম্বাজ বলল-এ্যায়সা কেয়া বাত হ্যায়? ফির শুনাও।
আস্তে করে বলার প্রয়োজন নেই। কারণ আমার ভাষাও কেউ বোঝে না, তাই জোরেই বললাম–জানতে হো? তুম পাপা বননেবালা হো।
হঠাৎ যেন জান্ধাজ চুপ হয়ে গেল। আমি লক্ষ্য করলাম ও মুখ নিচু করে যেন কিছু ভাবছে। আমি যে উৎসাহ নিয়ে বললাম তার কণামাত্র ছোঁয়াও যেন জাজের মনে রেখাপাত করেনি। আমার খুব কষ্ট হল, তবে কি জান্বাজ খুশি নয়? সন্তান কি ও চায়নি? অনেক পুরুষ আছে স্ত্রীর যৌবন নষ্ট হয়ে যাবে সেই চিন্তায় সন্তান না হওয়ার পক্ষে। জান্বাজও কি সেই জাতের পুরুষ? কিন্তু আমি? আমি যে সস্তান চাই। সন্তান স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার বন্ধনের সেতু? যোক আমার শরীরে ক্ষয়। তবু একটা সৃষ্টি তো হবে? আমি জাম্বাজকে বললাম- কেয়া হুয়া তুম খুশ নেহি। হ্যায়?
জরুর খুশ হ্যায়….মগর?
–মগর?
–হাম তুমে বাতানা চাতা যো আভি কিসিকো কুছ মাত বলো?
–কিঁউ? মেরা বাচ্চা হোগা, কিঁউ ইয়ে বাত দুপায়েঙ্গে?
-কিঁউ কি, দেখ গুলগুটিভি হামারা ঘরমে রহেতা, আভিতক উসকা কোই বাচ্চা নেহি হুয়া, উসকা দিলমে দুখ আয়গা! আখির ও তুমসে পড়া হ্যায়।
–জান্বাজ? ইয়ে তুম কেয়া বাত কর রহে? উসকা বাচ্চা নেহি হুয়া তো মেরে তুমারে কেয়া হ্যায়। ও তো দুসরা ঘরকা জানানা হ্যায়? উসকে লিয়ে হাম আপনা খুশি দাবাকে রাখু? ইয়ে মুঝসে নেহি হোগা। হাম বাতায়েঙ্গে।
–ফের বাতাও।
জান্বাজ রেগে বলল কথাটা। আমি হতবাক ও আহত হলাম। ও খানিক চুপ করে থেকে বলল-ইহাকা জানানা বহৎ জাদু জানতা। অগর ও দিলকা দুখসে দম করকে তুমারা বাচ্চাকা লোকসান পৌঁছাদে তো? ইসিলিয়ে আভি বাতানা ঠিক নেহি হ্যায়। মেরা বাত সমঝনেকে কৌসিস কর?
আমি বুঝলাম কেন জান্বাজ বলতে বারণ করছে। সত্যিই যদি হিংসা করে আমার গর্ভস্থ সন্তানকে নষ্ট করে? জাজের কথা মেনে নিলাম। কাউকে এখন কিছু বলব না, বলে ঠিক করলাম। একটু সন্দেহ প্রকাশ করে জান্থজকে বললাম- মগর ও লোগোকোতো মালুম পড়েগা?
–জব মালুম পড়েগা তব বাচ্চা থোড়া বড়া হো জায়গা, অর কুছু নেহি হোগ। জাজের যুক্তি মেনে নিলেও মনের অতলে কোথায় একটা কষ্ট যেন মনটাকে তালগোল পাকিয়ে দিতে থাকে। সেই তালগোল পাকানো মন নিয়ে চলে। যেতাম আবুর ঘরে। আবুর স্নেহ যেন ঠিক আমার মায়ের স্নেহ। মন চায় আবুর কোলে মাথা রেখে একটু কঁদি, আবুকে সবকিছু বলি। আবার ভাবি সত্যিই যদি জাম্বাজের কথা ঠিক হয় তবে……. তবুও পারি না নিজেকে সামলাতে। একদিন সত্যিই আমি আবুর কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললাম। আবু আমার মাথায় হাত। বোলাতে বোলাতে বলল। সে যে হাত পা নেড়ে কি বলল তা আমি বিন্দু বিসর্গও অনুধাবন করতে পারলাম না। বিরক্ত, বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে আবার চলে গেলাম। নিজের ঘরে। একদিকে ভয়, অন্য দিকে এক অপরিসীম আনন্দ। এই সময়টা যদি আমি মায়ের কাছে থাকতে পারতাম? একটা আয়না জাৰাজ আমার জন্যে কিনে এনেছিল বেশ বড় দেখে মুশফেল বাজার থেকে। আমি সেই আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শরীরের কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা তা দেখতে লাগলাম। আমার পেটের ভেতরেও আর একটা অস্তিত্ব দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে। মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক, বেড়েই চলেছে, জাম্বাজের কাছ থেকে এই ব্যাপারে কোন সহানুভূতি পাই না। আমার যে সন্তান আসছে সে যেন ওর অনাকাক্ষিত ও যেন চায় না। এদিকে আমি উপলব্ধি করছি যে আমার শরীর ক্রমাগত যেন একটু-একটু করে ভারি হয়ে উঠছে। পেটের ভেতরটাও কেমন ভারি ভর্তি-ভর্তি বলে মনে হয়। বমি পায়। অথচ আমি কাউকে বলতে পারি না আমার কষ্টের কথা, বা আনন্দের কথা। মনের মধ্যে কি অসম্ভব যন্ত্রণা, যে শিশু পৃথিবীতে আসছে সে কি কোন সহানুভূতি পাবে না কারও থেকে? আমি খুব যত্নে পেটে হাত বুলাই। যেন আমার হৃদয়ের সমস্ত আদর পৌঁছে দিই আমার আগত সন্তানকে। এই পৃথিবীতে এর থেকে সুখ, এর চাইতে বেশি আনন্দ আর আছে কী কোথাও? সেই আনন্দের দোসর কেবল আমি। আমার চারপাশে কেবল হতাশা। দিন দিন আমি অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলাম। কিন্তু আমার অসুস্থতা দেখার মতো কোন মানুষের খোঁজ আমি পেলাম না। একেবারেই বিছানা নিলাম, কিছুই ভালো লাগে না। খাবার খেতে পারি না একদম। মানসিক দিক থেকে আমি যেন একেবারেই ভেঙে পড়লাম। ওকে দেখি কেবল যেন চুপচাপ। আগের মতো করে বসে কারও সঙ্গে কথা বলে না; আমি ভাবলাম আমার কথা ভেবেই ওর মনটা এত বিক্ষিপ্ত। রাত তখন আটটা হবে। সামান্য একটু দই দিয়ে রুটি খেয়ে শুয়ে পড়েছি। মনটা চলে গেছে মায়ের কাছে। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘরের ভেতর ভীষণ অন্ধকার, কাছের মানুষও দেখা যায় না। কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল। জাজের নাম ধরে ডাকলাম, কোন সাড়া না পেয়ে পাশ ফিরে ওর গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গেলাম। চমকে উঠলাম, জাম্বাজ পাশে নেই। ভাবলাম বোধহয় বাইরে বাথরুম করতে গেছে। একটুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, কিন্তু ও ফিরছে না দেখে মনে কেমন একটা সন্দেহ জেগে উঠল। আমি ওদের ভাষা জানি না বলে জান্বাজ ও গুলগুটি আমার সামনে বসে যখন কথা বলে তার মধ্যে একটা কথা মনে রেখে আমি একদিন নাদির চাচার কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম–চাচা সানাজ মানে কি?
চাচা বলেছিল সানাজ মানে পেয়ারা।
সেই কথাটা আমার কানে ধ্বনিত হত, জান্বাজ কেন গুলগুটিকে বলেছে সানাজ? কিন্তু ওকে কোন প্রশ্ন আমি করিনি। কারণ কি লাভ? ওতো স্বীকার করবে না কেবল অশান্তি করবে। শরীরের যে অশান্তিতে আমি দিন কাটাচ্ছি তাতে নতুন করে কোন অশান্তি নিতে চাইনি। সন্দেহ মন নিয়ে হঠাৎ আমি অন্ধকারেই উঠে বসলাম। একটু সময় নিয়ে আস্তে-আস্তে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুললাম। মাথার কাছে রাখা টর্চটাও নিয়েছি হাতে, তবে জ্বালাচ্ছি না। আন্দাজে আন্দাজে পা টিপে টিপে গেলাম পাশের ঘরে যেখানে গুলগুটি শোয়। হঠাৎই আমার কেমন যেন মনে হয় যে গুলশুটির ঘরে ও গেছে নিশ্চয়। এক ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে দিলাম, টর্চ জ্বালালাম। যা দেখলাম তা দেখার আগে আমার মৃত্যু কেন হল না? আমি স্তম্ভিত। প্রায় নির্বাক। গুলগুটি উলঙ্গ, জাম্বাজও উলঙ্গ। পাশে পড়ে আছে ওদের জামা কাপড়। আমি কাঁদব? জান্বাজকে কিছু বলব? বললে কি বলব? কেবল গুলগুটিকে বললাম, বদনকা গরম মিটানেকে লিয়ে কেয়া মেরেহিই পতিকো তুম চুন লিয়া? জাব্বাজ আমার কাছে আসতে যায়, আমি ওকে বললাম-খবরদার, মেরে পাশ মাত আনা, ইয়ে ভুল কভি নেহি করনা। সত্যনাশ হো জায়েগা। ইয়া তুম জিন্দা রহেগা নেহিতো হাম। অর হাঁ মুঝে কালহি ঘঁহাসে লে জানেকা বন্দোবস্ত কর দেনা। উসকা বাদ ও আওরাকো লেকে রহনা। জিসকো পতি ছোড় গিয়া তুমারে লিয়ে।
নেহি, উসকা পতি উসকো মেরে লিয়ে নেহি ছোঁড়া কিঁউ কি….?
কিঁউকি কেয়া? বোলো, রুক কিঁউ গিয়া?
কিঁউ কি ম্যাই উনকো পতি।
জান্বাজ? বলে আমি চিৎকার করে উঠি। তারপর অসহায়ের মত কাঁদতে থাকি। কিঁউ-কিঁউ জান্বাজ? মেরা কেয়া কসুর থা? কিঁউ তুম মুঝে না বড়া ধোকা দিয়া? কেটে কেটে কথাগুলো আমি বললাম। তারপর টলতে টলতে নিজের ঘরে চলে এলাম। শেষ, আমার জীবনে সমস্ত স্বপ্ন আজ বিদায় নিল। প্রাণপণে একটা অসম্ভব যন্ত্রণাকে দমন করার চেষ্টা করতে লাগলাম। ভালোবাসার ছোঁয়াতে পুরুষ ও নারী উভয় উভয়কে চিনতে পারে। সেই চেনা এমন মারাত্মক ভুল হয়ে গেল? চেনার শুরুতেই আমি ওকে চিনতে পারলাম না? আমার হৃদয়ের ভেতরটা ওলট পালট হতে লাগল। বার বার জান্তাজ ও গুলগুটির মিলনের দৃশ্যটা। চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলাম সৌরভের কাছ থেকে। তারপর প্রাণপন দিয়ে ভালোবাসলাম জাম্বাজকে। কোন সংস্কার মনে স্থান দিইনি, জাত ধর্মকে মানিনি। সব কিছু ত্যাগ করে যাকে সম্বল করে চলে এলাম সেও আমাকে এমন নিঃস্ব রিক্ত করে দিল? আঘাতে, যন্ত্রণায় যেন আমার মনের সমস্ত বন্ধ জানালা একটা একটা করে খুলে যেতে থাকে। ঘরের ভেতরকার অন্ধকার যেন আমি ছিঁড়ে তছনছ করে দিতে থাকি। এই আঘাত আমাকে মোহভঙ্গ করল। আমি জেগে উঠলাম। যে ভালোবাসা আমাকে পাগল করেছে, অন্ধ, বিবেকশূন্য করেছে সেই ভালোবাসা আজ আঘাত হেনেছে, দগ্ধ করেছে, কার জন্যে আমি এমন ভাবে সবাইকে, সব কিছু ত্যাগ করে এসেছি? সমস্ত শরীর আমার শিউরে উঠতে লাগল। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কোথায় যাব? সমস্ত মন নিমেষে শূন্য হয়ে গেল; এক লহমায় আমি দেউলে হয়ে গেলাম। আজ আর আমার মনে কোন প্রেম নেই, প্রীতি নেই, নেই কোন মমতা, যা হারালাম তা কোন দুর্লভ সম্পদ নয় যেন। প্রেমের ঘরে কবে থেকে টান ধরেছে তা জানার ইচ্ছে নেই। প্রেমই ছিল না তা আবার টান ধরা। কেবল কতখানি হারিয়েছি তা দুচোখ টান করে দেখতে লাগলাম যেন। মনের মধ্যে জমে উঠতে থাকে একটা প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ, ঘৃণা, রাগ। ধ্বংস করে দেব আমি জান্বাজকেযে যন্ত্রণার শিকার আজ আমি হয়েছি তার অনেকখানি যদি আমি জ্বাৰাজকে ফিরিয়ে দিতে না পারি তবে আমার নারীজনম বৃথা। কথাগুলো ভেবে অনেকখানি শান্তি অনুভব করতে লাগলাম।
আমি বসেই আছি, যেন অনন্তকাল ধরে, হঠাৎ জান্বাজ ঘরে ঢোকে। গুলগুটিও আসে। জান্বাজ আমার সামনে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে। গুলশুটি হ্যারিকেন জালে। জাম্বাজ এবার খুব ধীরে ধীরে বলে-দেখ পাগলি–
আমার কানে কে যেন গরম শিষে ঢেলে দিচ্ছে। আমি দেওয়ালে মাথা রেখে শূন্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, এমনকি কোন প্রতিবাদ। জান্তাজ বলেই চলেছে–আজ সে দশ শাল পহেলে মেরা চাচা বাবা সাদি দিয়া থা উসকা সাথ। উসকো হাম কঁহা ফেক সেকতা বোলোক
আমি চিৎকার করে বলি–
–তুম উসে কাহি ফেকনেকা জরুরৎ নেহি হ্যায়। স্রেফ মুঝে লেকে চল ইঁহাসে।
–নেহি লে জা সেকতা তুমে, তুম ভি মেরা বিবি হো।
–নেহি লে জা সেকতা? মতলব? হাম আপনা দেশ, আপনা ঘর জানা চাহাতা।
–ক্যায়সে জায়গা? মোজাহিদ নেহি ছোড়ে গা।
–জাম্বাজ? কিঁউ এ্যায়সা করতা? কিঁউ মেরী জিন্দেগী চাহেতো হো লুটনেকে লিয়ে। হাম তুমারা কেয়া বিগাড়া? মুঝে ভেজ দো। ভগবানকে লিয়ে মুঝে ছোড়দো।
–হ্যাম বাদমে কৌসিস করেঙ্গে। মগর অভি নেহি জা সেকতা, চারিতরফ লড়াই চুল রহে।
আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম, এই কান্না ছাড়া আর আমার করার কিই বা আছে? মনে মনে ভাবতে লাগলাম কেন এমন হল? আমার একটা ভুলের এত বড় সাজা? আমি কখনও কারও কোনও ক্ষতি তো করিনি? তবে কেন আমার জন্যেই তোলা ছিল এমন যন্ত্রণা? কষ্ট? আঘাত? অনাগত শিশু এখনও আমার পেটের মধ্যে। আমার যন্ত্রণা কি ওকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে? মনে হতে লাগল আমি যেন এক পা এক পা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি, আমার সঙ্গে চলেছে আমার সন্তান। হয়তো ও আমাকে অনুরোধ করছে না, না মা, তুমি দুঃখ করো না, আমি তোমার কোলে যখন শুয়ে থাকবো দেখবে তখন তোমার আর কোন কষ্ট থাকবে না। আমি তোমার জন্যে সমস্ত শান্তি বহন করে আনব। আমাকে নিয়ে তৈরি হবে তোমার আলাদা একটা জগৎ মা, সেই জগতে কেবল থাকবে তোমার সন্তান আমি ও তুমি। আর কেঁদো না, লক্ষ্মী মা। আমার দু-চোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। নিজের মাথার চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। হঠাৎ আমার নজরে পড়ল আমার পরনে যে জামাটা সেটা জান্বাজ কয়েকদিন আগে ছিট কিনে এনে একটা আফগানি জামা আবুকে দিয়ে বানিয়ে আমাকে দিয়েছিল। অনেক ভালোবাসা মাখানো আছে ভেবে এই জামাটা আজ আমার জন্মদিনে আমি গায়ে দিয়েছি। এখন কেমন যেন ঘেন্না-ঘেন্না করতে লাগল। নেই নেই কোথাও কোনখানেই বিন্দুমাত্র ভালোবাসা বেঁচে নেই। আমি উন্মাদের মতো গায়ের জামাটা খুলে টেনে টেনে ছিঁড়তে লাগলাম।
জান্বাজ নীরবেই বসে পর্যবেক্ষণ করছে। আমি ভীষণ অসহায় বোধ করতে লাগলাম। একটু পরে জাব্বাজ আমাকে বলল–শুন পাগলি।
–মত বোল মুঝে পাগলি, অর তুমারা কোই হক নেহি মুঝে পাগলি কহোকে পুকারনেকা। হাম তুমে নফরৎ করতা হ্যায়, সমঝা?
–ঠিক হ্যায় নেহি বুলায়েঙ্গে পাগলি কহেকে। এক বাত শুন, কালসে তুম হাম আর গুলগুটি একহি সাথ একহি ঘরমে শোয়েঙ্গে।
–নেহি, নেহি জান্বাজ এ্যাতনা বড়া সাজা তুম মুঝে মাৎ দো? ইয়ে হাম বরদাস্ত নেহি কর পায়েঙ্গে।
–কিউ নেহি কর সেকতা? সমঝানেক কৌসিস করো। ওভিতো মেরা বিবিই হ্যায়। বাহারকম কোই জানানাতো নেহি হ্যায়? উসে ম্যায় কাহা ফেকে?
–হো সেকতা। মগর মেরে লিয়েতে ও পরেয়া আওরাৎ হ্যায়। সাদি কা পহেলে তো তুম নেহি বাতায় যে তুমারা বিবি হ্যায়। তুম ঝুটে হো মক্কার হে। তুমারা সত: rশ হোগা। তুমারা পুরা খানদান বরবাদ হে জায়গা। হাম খুদ তুমারা পুরা খানদান বরবাদ কর দেঙ্গে। ইয়ে মেরা বরদুয়া হ্যায়।
জাম্বাজ কোন কথা বলল না। চুপ করে বসে রইলো খানিকক্ষণ। তারপর আমার দিকে চাইলো। বেশ কঠিন নির্মম দৃষ্টি যেন তার। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, দরজার দিকে যেতে যেতে বলল–এ্যাতনা দিন গুলগুটি যে ঘরমে শোতথা ওহি ঘর কালা মুশা শাওলি কা শোনেক ঘর হ্যায়। ও লোগ গুলগুটিকা লিয়ে মেহমানকা ঘরমে শোতা হ্যায়। গুলগুটি একহি সাথ শোয়েঙ্গে। ফের ও লোক আপনা ঘরমে শোয়েগা।
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম-ইয়ে কভি নেহি হো সেকতা জাম্বাজ। কভি নেহি হো সেকতা। ম্যায় কভি উসকো মেরে সাথ শোনেকা ইজাজাত নেহি দেঙ্গে!
জান্নাজ আমার কোন কথা শুনল না, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি তখন কি করব ভেবে পাচ্ছি না। এও কি সম্ভব? হায়, হায় ঈশ্বর? কেন, কেন আমি এমন করে নিঃস্ব হয়ে গেলাম? হঠাৎ আমার নজরে পড়ল দেওয়ালে টাঙানো জান্বাজের বিশাল বড় একটা ছবি ফ্রেমে বাঁধান ঝুলছে। আমি সেই ছবিটা একটানে নামিয়ে এক আছাড় মারলাম। ছবির ফ্রেমটা ভেঙে গেল। গুলগুটি বসেছিল। বোধহয় ভয় পেল, ও উঠে বাইরে চলে গেল।
ঘরে আমি একা। নিঃসীম ঘন অন্ধকার আমার সমস্ত সুখ সেই অন্ধকারের। সঙ্গে মিশে গেছে, স্বপ্নও হারিয়ে গেল। কেবল বেঁচে রইলাম আমি নামের মেয়েটা। বিস্ময়, যন্ত্রণা আমাকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিল। এত বড় একটা বিস্ময়, বাস্তব আজ তিনমাস ধরে এরা গোপন করে রেখেছে আমাকে? জীবনের সব চাইতে সুখের মুহূর্তগুলো কেবল মিথ্যে দিয়ে সাজান? জান্বাজ? সে এমন মিথ্যের জাল বুনে চলেছিল? অথচ তাকেই তো আমি বোকার মতো সবচাইতে বেশি বিশ্বাস করেছিলাম? এখন মনে হচ্ছে ওর মধ্যে কোন ভালোবাসা ছিল না। কিছু ছিল না যদি তবে কেন করল এমন প্রহসন? মায়া মমতা শূন্য জীবন দুঃসহ। কোন মতেই সে জীবন কাটান সম্ভব নয়। আজ আর দুজনের একাত্ম ভাবনা কোনখানেই রইল না! ভাগ্যের এতবড় পরিবর্তনে আমি যেন শেষ হয়ে যেতে লাগলাম। এমন বিপর্যয় যে আমার জীবনে আসতে পারে তা কোন অশুভ মুহূর্তেও মনের তলে আভাস দেয়নি। নির্ভরতা হারিয়ে গেল। ভেবেই পাচ্ছি না কি করব আমি? জীবনটাকেই ঠেলে সরিয়ে দেব জীবন থেকে? নাকি মানুষটাকে? নিজেকে, নিজের এই শরীরটাকে ঘেন্না করতে লাগল আমার। গুলগুটি…… আমি। ওহঃ! কি অপরিসীম ঘেন্না সহ্য করিয়েছে মানুষটা। ওই নোংরা ঘেন্না ভরা হাত দিয়ে স্পর্শ করেছে। লেহন করেছে। গ্রাস করেছে। রাতের অধিকার কেবল সে বিস্তার করেছে পরিপূর্ণ হয়েছে। বিভ্রম, বিস্ময় যেন রয়েই যাচ্ছে। রাগ, ঘৃণা বিদ্বেষ মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে যেতে থাকে। আমি যেন কান্না ভুলে যেতে থাকি। এ হৃদয় প্রসন্ন হওয়ার আর কোনই প্রশ্ন নেই। আকাঙ্ক্ষা আগ্রহ বিদায় নিয়েছে। এখন আমার চারিদিকে কেবল রাতের অন্ধকার।
সারারাত কেটেছে এক অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। দূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের মধুর আওয়াজ। আমি একই ভাবে বসে আছি। যেন অনন্তকাল আমাকে এই ভাবেই বসে থাকতে হবে। ভোর কেটে গিয়ে সকাল হল। গুলগুটি চা ও পরোটা নিয়ে এল। আমার কোন ক্ৰক্ষেপ নেই যেন। ভাবলেশ হীন হয়েই বসে আছি। পাশে রাখা চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। গুলগুটিও আমার সামনে মুখ বুজে বসে আছে। আমার মনের ভেতরটা তোলপাড় হতে থাকে। ওর প্রতি একটা রাগ যেন আমাকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। আবার ভাবিওরও তো এমন রাগ হচ্ছে আমার প্রতি আমার আগে ওর স্বামী। ওকেও ঠকিয়েছে জান্বাজ। হঠাৎ জান্বাজ ঘরে ঢোকে। আমার দিকে তাকিয়ে বলে–কেয়া হুয়া? চায়ে নেহি পিয়া?
আমি কোন উত্তর দিইনি, দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে বড় দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। সবাই দেখছে। হঠাৎ আসাম চাচা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এক হুঙ্কার ছাড়ল। পলকের জন্যে আমি দাঁড়ালাম, আবার চলতে শুরু করলাম। আসাম চাচা একেবারে আমার সামনে পথ আগলে দাঁড়াল। আমাকে বলল–কিধার যা রহে?
আমি কোন উত্তর দিলাম না। চাচা অগ্নিমূর্তি হয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন আমার একদম মুখের সামনে। আমি একচুলও নড়লাম না। মুখটাও নামালাম না, লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দিলাম না, দৃষ্টি নিবদ্ধ আসাম চাচার দিকে। আসাম চাচা আবার বলল–কিধার যা রহে?
–মালুম নেহি, মগর জায়েঙ্গে।
–হামারা দেশমে লেড়কি কাহি নেহি জা সেকতা। তুমভি জানে নেহি সেকোগি।
–কৌন রোকেগা? আপ? অত্যন্ত শ্লেষ মাখিয়ে বললাম আমি।
–হাঁ হাম। তুমহে শরম নেহি আতা? ঘরসে নিকাল জাতা? জীবনের সব হারিয়ে আমি তখন মরিয়া; যেন সর্বগ্রাসী একটা হিংস্র অভিলাষে আমার সমস্ত ধমনী যেন ফুলে উঠেছে, মুখের চোয়াল শক্ত হচ্ছে, নিজেকে নিজে আর সামলাতে না পেরে বললাম-সাচ ছুপানেকা জো আদাৎ আপকা ত্যায় উসলিয়ে আপকো সরম নেহি আতা? আপতো ঘরকা বড়া হ্যায়? সব আপকে মানতা ভি হ্যায়, তো উসি টাইম সরমসে আপকা শীর নেহি কুকা? জব আপকা ভাতিজা ঝুটা প্যায়ার দেখাকে এক ইন্ডিয়ান লেড়কিকো সাদি করাকে লেকে আয়া? কাঁহা থা উসি টাইম আপকা সরম? ইজ্জৎ? আজ মেরে পাশ সরম ছুঁড়তে হুয়া আয়ে? চুড! যেৎনা চায়ে চুঁড। অগর মিল জায়ে তো সামালকে রাখো! দুবারা না ছুঁডনেকে লিয়ে দোর দোর ভটকা পরে।
আসাম চাচা যেন বজ্রাহত হল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল আমাকে ভালো করে, তারপর বলল–এ্যাতনা তাকত তুমে মিলতা কাহাসে? জো তুম মুঝে ভি নেহি ডর? তুম জানতা? হাম তুমে মার ডাল সেকতা?
–মারো? মুঝে মার ডালো; তাকি তুমোগোক চেন মিল জায়ে, ওর মুঝে ভি। ওয়সে আভি ওর ম্যায় জিন্দা কাহা? মায়তো জিতে জি মর গিয়া। বাকি ইয়ে শরীর, এভি হাম কাকি খতম কর চুকে হুয়ে হোতা অগর মেরে শরীরকে অন্দর দুসরা কোই শরীর না হোতা?
আসাম চাচা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করে–তুম মা বুননে বালি হো?
–আপকা ভাতিজাকা মেহের বানীসে।
আসাম চাচা বলল–যাও আপনা ঘরমে যাও। সমঝনেক কৌসিস কর, অব তুম হামারা ঘরকা বোহু হত্যায়। একলা যাওগি তো আদমি লোগ খারাপ বাতায়েঙ্গে অর এ্যাসেভি যায়োগি তো কঁহা জাগি? এ দেশসে নিকালনে নেহি শেকোগি, খামাখা হামলোগকো পরেসানি করোগি, আদমি লোগ ভি উল্টাপুল্টা বাত করেঙ্গে।
আমি দিশেহারার মতো চেয়ে রইলাম। চাচা যা বলল তা অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি যে তা আর নতুন করে উপলব্ধি করার প্রয়োজন হল না। এত অসহায় বোধ করতে লাগলাম যে বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেললাম, তখন দ্বিগুণ উত্তেজনায় রাগে চেঁচিয়ে উঠে বললাম–হ্যাম আপনা দেশমে জানে চাহাতা, মুঝে ভেজ দিজিয়ে, নেহিত আচ্ছা নেহি হোগা। ভেজ দিজিয়ে। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
চাচা কোন উত্তর দিল না, উঠোন থেকে চলে গেল ঘরে। অন্য সবাই চলে গেল। আমার ইচ্ছে করল বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে এক থাবায় এনে ফেলে দিই উঠোনের মাঝে। তা না পেরে চিৎকার করে বললাম-পারবো না, কিছুতেই মানবো না তোমার ওই বিবিকে। হঠাৎ বুঝলাম আমি বাংলা বলছি, আবার হিন্দিতে বললাম, সমঝা? ইয়া ওই রহেগা তুমারা বিবি, ইয়া হামআভি সোচলল তুমকো কিসে রাখনা হ্যায়? –জাব্বাজ এবার থমকে দাঁড়াল, আমার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর বলল, রহেগা, তুম দোনোই মেরা বিবি হোকে। অগর জাদা কুছ করোগ তো হাম আপনা জানকে খতম করেগা।
আমি দেখলাম ওর গমন পথের দিকে গনগনে আঁচের মধ্যে কে যেন ঠান্ডা জল ঢেলে দিল। না ও শেষ হয়ে গেলে চলবে না। এ ছাড়া এই দেশ থেকে আমার মুক্তি নেই। অনন্ত কাল ধরে তবে থাকতে হবে এই দেশে। তা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। আমি মুক্তি চাই, এখান থেকে যেতে চাই আমার দেশে, আমার স্বজনদের কাছে। একটা কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে আমি বসে আছি। আমি কখন ঘরে এসেছি নিজের অজান্তে তা টের পাইনি। থমথমে গম্ভীর একটা সকাল। একটুক্ষণ পরে ভ্রানাই চাচা এলেন, আমাকে বোঝতে, যেন সমস্ত দোষ আমার, সব অপরাধ কেবল আমার। দ্রানাই চাচা লোকটা ভালো এবং বিচক্ষণ বলে। মনে হয়। আমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছি। দ্রানাই চাচা অনেক কথা বলে চলে গেলেন। আমার কানে কিছু ঢুকল কিছু ঢুকল না, আবুও এসেছে হাত নেড়ে নেড়ে অনেক কথা বোঝাবার চেষ্টায়, যার বিন্দুবিসর্গ আমার বোঝার বাইরে। আমি কারও দিকে তাকাইনি। তাকাতে ইচ্ছে করেনি। আমি যেন পাথর হয়ে গেছি।
বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। বাড়ির পুরো পরিবেশটাই কেমন গুমোট বলে মনে হল। আমি বসেই আছি, জাজের প্রেমের ভালো ভালো মুহূর্তগুলোও মনে পড়লে সমস্ত শরীরে মনে এক ধরনের জ্বালা অনুভব করছি। এক দুর্বিষহ সময় যেন আমি অতিবাহিত করছি। ভীষণ একটা কষ্ট বুকের মধ্যে আটকে বসে গেছে কাটার মতো তুলতে পারছি না সেই কাটা।
সবাই চলে গেছে ঘর থেকে, আমি একা একা বসে ভাবতে থাকি আমার সুন্দর সুখের কথা। ভাবি সমস্ত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা কি কেবল আমার জন্যেই অপেক্ষা। করছিল? আমার অতিবড় শত্রুও যে হবে তাকেও যেন ছুঁয়ে না যায় এমন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর রাতের অন্ধকার। যা ১৯৮৯ সাল থেকে আমাকে ছুঁয়ে গেল। কি নিষ্ঠুর নির্মম রাত! এই রাতের অন্ধকারেই তো হারাল আমার ভালোবাসা? যা একান্তই আমার তা প্রতিরাতের অন্ধকারেই অন্য ঘরে অন্য শরীরে বিলিয়ে দিয়েছে জাম্বাজ, আমার একান্ত আপন মানুষটা। একমাত্র আমি ছাড়া যে শরীর ও মন কারও থেকে কিছু গ্রহণ করতে পারে না, অন্ততঃ আমাদের বাঙালী হিন্দু মধ্যবিত্ত মনবৃত্তির নারীদের তাই ধারণা বা সেইভাবেই আমাদের মনের গঠন হওয়া। সেই শরীর মিশে গেছে। অন্য শরীরের সঙ্গে, অন্য মনের সঙ্গে ঘটেছে মনের সংযোগ।
সৌরভ ও জাজের কোনই পার্থক্য আমার কাছে রইল না। একজন শিক্ষিত মার্জিত স্বধর্মী, অন্যজন অশিক্ষিত অন্য ধর্মী, তবুও দুজনেই পুরুষ। যাদের কাছে শরীরের প্রাধানা সর্বাগ্রে, মনের নয়। কেবল পার্থক্য একটা তা হল একজন বান্ধবীকে লেহন করেছে নিস্পেষিত করেছে, নিঃশেষ করেছে। অন্যজন দুবার বিয়ে করে, একের কাছে অন্যকে হারিয়ে দিয়েছে। সৌরভকে ভাবতেও ঘেন্নায় গা ঘিন্ ঘি করে উঠেছে! ওকে ভুলে গেছি, জাম্বাজকে? সমস্ত ব্যাপারটা আমার চোখের সামনে আপন মনে যেন খেলে বেড়াচ্ছে। উলঙ্গ, উচ্ছল ওই দৃশ্যের যেন আর কোন যাওয়ার জায়গা নেই আমার মনের মণিকোঠা ছাড়া। সকালের সেই রণিতার ফ্ল্যাটে সৌরভের শুয়ে থাকা, পাশ বালিশ নিয়ে গড়াগড়ি খাওয়া, আর বর্তমানে রাতের অন্ধকারে দুটো শরীর এক সঙ্গে মিশে যাওয়া, যেন আমাকে অস্থির করে তুলছে। আমি সেই ঘরেই বসে আছি, যে ঘর আজ থেকে আর কেবল আমার নয়। হারিয়ে গেছে সেই ঘরের সবকিছু এমনকি ঘরের ৫ আপন মানুষটাও। আবার ভাবি মানুষটা কবে আমার হয়েছে? যে হারাবে। জীবনের প্রথম দিনটাতেও তো জাম্বাজ আমার ছিল না? গুলগুটি তো বহু পূর্বেই ওর জীবনে এসেছে। তবে কেন জাম্বাজ আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এল? কেন করল বিশ্বাসঘাতকতা? গুলগুটি–আমার। লেখা পূর্বের কোন বইতে আমি গুলগুটিকে স্বীকৃতি দিতে পারিনি। ওর পরিচয়। হিসাবে লিখেছিলাম আমার দেওয়রের বিবি যার স্বামী অন্য বিয়ে করে লন্ডনে চলে গেছে। কিন্তু তারপর থেকেই আমি বিবেকের যন্ত্রণায় ছটফট করেছি, একটা মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়ের স্বামীর পরিচয়টা মিথ্যে? গুলগুটিকে স্বীকৃতি না দিলে ওর মেয়েরাও তত অস্বীকৃত হয়ে থাকবে। জান্বাজ দোষ করেছে কিন্তু ওর মেয়েরা তো কোন দোষ করেনি। একটা মেয়ের স্বামীর পরিচয়টা অত্যন্ত জরুরি, সেটাই আমি ক্ষুণ্ণ করতে চেয়েছি? আমার যন্ত্রণাই আমাকে বলে গুলটিকে স্বীকার করে, স্বীকৃতি দাও। নতুবা একটা প্রচণ্ড অন্যায় করা হয়ে যায়। সেই জন্যে আজ আমি গুলটির আসল পরিচয় দিলাম। গুলগুটি জাজের প্রথম বিবি।
যে যন্ত্রণা বারে বারে আমাকে স্পর্শ করেছে দগ্ধ উন্মাদ করে তুলেছে সে যন্ত্রণা গুলগুটিকেও তো ছুঁয়ে গেছে? তবে ওর প্রকাশ ছিল না। কিংবা আমার বোক্সর মন ছিল না। আমি মনে-মনে ওকে কোনদিন স্বীকার করে নিতে পারিনি সেটা ছিল আমার মনের দুর্বলতা ও স্বীকার করে নিয়েছে সেটা ওর মনের উদারতা। আজ উপলব্ধি করি একটা ক্ষেত্রে মেয়েদের যন্ত্রণা এক সূত্রে গাঁথা। হায় হায়রে মোল্লা ওমর! কার কাছে তুমি তোমাদের ধর্মের সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলছ? অবশ্য সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার ধর্মের সৌরভও বিশ্বাসঘাতক। তবে তার জন্যে অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি আমাকে। ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা কেউ করেনি। আমি মনে করি মেয়েদের আলাদা কোনও ধর্ম বা জাত নেই। পৃথিবীর সমস্ত মেয়ের যন্ত্রণা কষ্ট এক। সেক্ষেত্রে ধর্ম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। ধর্ম ও জাতের বিভেদ যারা করেছে তাদের জন্যে অবশিষ্ট থাকে ঘৃণা।
তালিবানের জয়–চারাশিয়ার দমন গুলবদিনের পলায়ন
চারাশিয়া দখল করার পর তালিবান এবার খোস্ত দখল করার জন্যে যুদ্ধ জারি রাখল। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কোন ঋতুতেই যুদ্ধ থেমে থাকে না। ১৯৯৪ সালে খোস্তও দখল করে নিল। এবার কেবল বাকি রইল মাজার-ই-শরীফ ও কান্দাহার দখল করতে। এই সময়তেই আমি পালাই। তালিবানের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে।
একদিকে নিজের বৈবাহিক জীবনের দুর্ভাগ্যজনক দুর্দশা অন্যদিকে তালিবানের অত্যাচার, তার সঙ্গে দেওর ও জায়েদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ, আমার মনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এরমধ্যেই অনবরত তালিবানেরা আসতে থাকে আমাকে বিধর্ম থেকে ধর্মীয় করার বাসনা নিয়ে। এখন আমার ধর্ম বলে কিছু নেই মুসলিম হলে ধর্মীয় হয়ে যাবো।
তালিবানের জয় যেমন হতে লাগল আমার অন্তরাত্মা স্তব্ধতায় পরিণত হতে লাগল। আগে গ্রামের অলিগলি দিয়ে চলত তালিবানেরা এবার প্রকাশ্যে শহরের ওপর দিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে যায়-তালিবান নেতা মোল্লা ওমর জিন্দাবাদ! সমস্ত শহর দাপিয়ে দাবিয়ে চলে এই মিছিল। ক্রমাগত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই মোল্লা ওমরের দল। মাত্র কয়েকদিন আগে যে যুদ্ধ উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় ফুঁসে উঠেছিল, আশা ছিল গুলবদিন জিতবে কিন্তু সে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল, আর প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসল তালিবানের বিজয়ের আনন্দের গর্জন। রাস্তায় রাস্তায় লাল রক্তের দাগ তখনও ভালো করে মুছে যায়নি, হাজার হাজার মানুষের লাশ পচে যাচ্ছে, সেই পচা গন্ধ তখনও বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে। আতঙ্কের ছায়া তখনও মানুষের মন থেকে, চোখ থেকে যায়নি, তখনও পাহাড়ের গায়ে গ্রামের ভেতর আগুন জ্বলছে, অনেক গ্রামের ভস্মস্তূপ থেকে তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে, আফগানিস্তানের একেবারে বুকের ঠিক মাঝখানে ভয়াবহ এই দৃশ্য বর্তমান, তালিবানের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে দিকে। যুদ্ধে জয়ী তালিবানরা এক কথায় দুবৃত্ত, বীভৎস, জঘন্য। ওরা কেবল জানে লুঠ করতে, খুনোখুনি করতে। দুষ্কর্মই ওদের সম্বল। আর ধর্মীয় অনুশাসনে বাঁধার প্রচেষ্টা।
আফগানিস্তানে তীব্র বাতাস বয়ে যায় সারাদিন ধরে, দুপুরের পর থেকে তা আরও বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। গ্রামের ঘরে ঘরে চলে প্রতীক্ষা, তাদের ঘরের পুরুষ গেছে যুদ্ধে, যুদ্ধ শেষ হলে ফিরে আসার পালা। তবে কেন ফিরে আসছে না? বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করার পর সবাই বেরিয়ে পড়ল তাদের নিজের মানুষ খুঁজতে। যেখানে সমস্ত মৃত মানুষের লাশ পড়ে আছে সেখানে যায় দেখতে, যদি অন্ততঃ লাশটাও পাওয়া যায়। কেউ বা লাশ কাঁধে করে বয়ে আনে। রক্তের মতো টকটকে হয়ে যায় তাদের চোখ দুটো। কিন্তু মুখবন্ধ বাড়ির অন্য মানুষগুলোর মুখ বেয়ে নেমে আসে শেষ অশ্রু। তারপর যখন সেই লাশ কবর দেওয়ার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয় তখন মেয়েরা বউরা ফোঁপাতে ফোঁপাতে, গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকে। যখন অনেক দূরে লাশ নিয়ে চলে যায় তখন নিষ্প্রাণ হয়ে বিবর্ণ মুখে একটা যন্ত্রের মতো ফিরে আসে মেয়েরা। ঘরে তখন তার বিবি হয়ত বুক ফাটা আর্তনাদে দিকদিগন্ত বিদীর্ণ করে ফেলছে। শোকের ছায়া নামে সমস্ত বাড়িতে গ্রামে, পাড়ায়। বৃদ্ধা মা এবং বৃদ্ধ বাবা হয়ত কষ্টি কেটে ছেড়ে দেওয়া কোন মুরগির মতো ছটফট করছে, তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা নেই, স্পর্শ করলে তারস্বরে ডুকরে কেঁদে উঠছে তরুণ-তরুণীরা। সমস্ত দিন ধরে চলে অগণিত মানুষের আনাগোনা, সান্ত্বনা দেওয়া। শোকের ছায়া নিয়ে আমি ফিরে আসি নিজের বাড়ি, এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে আমার হৃদয়ের ভেতরটা ওলট পালট হয়ে যেতে থাকে, কি চরম বিশৃঙ্খলা। যা নিয়ন্ত্রণে আনা কোনমতেই সম্ভব নয়। এই অসহায় দেশটার মানুষগুলোর বাঁচার আর কি কোন পথ খোলা নেই? এই সমস্ত মানুষগুলো কি সবাই মরে যাবে? হায়! হায় ঈশ্বর তুমি কেন এমন নির্দয়? সারা বিশ্বের মধ্যে কেউ কি নেই এই নির্ভীক সরল সহজ মানুষগুলোকে বাঁচায়? কথাটা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেই ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসের কথাগুলো, আমি নিজেও কি বাঁচাতে পেরেছি তাকে। সেই অনাবৃত ছোট্ট শিশুকে যে আমার পেটের মধ্যে নিশ্চিন্তে শুয়ে ছিল আমার কোলে ঠাঁই নেওয়ার জন্যে? যাকে রক্ষা করার সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব থাকে কেবলই মায়ের। সেই অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা শিশুকে পেরেছি কি আমি রক্ষা করতে?
জান্বজের দুই বিবির সঙ্গে রাত্রিবাসের প্রচেষ্টা
১৯৮৯ সাল ডিসেম্বর মাস–সাহেব কামাল, সাহেব কামাল পোর্তাস, মাস্পিন দা, চায়ে না সুরায়ে অর্থাৎ সাহেব কামাল ওঠে, বিকেল হয়ে গেছে। খাবে না? আমি চোখ মেলে তাকাই। সামনে দাঁড়িয়ে জ্যাঠ শাশুড়ি আবু। দুটো কোমরে হাত দিয়ে সে দাঁড়িয়ে, তার দাঁড়াবার ধরনটাই ওইরকম। আমি উঠে বসলাম, হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ থেকে গুলগুটিও তো এই ঘরে শোবে বলেছে জাব্বাজ, আমার মনে আবার শোকের ছায়া নামল, সমস্ত রাগ এসে জড়ো হল মাথায়, আবুকে বললাম, না আমি চা খাব না। (ভাঙা ভাঙা পুস্তুতে বললাম)
–দাগা স্যায়কে জোয়? অয়লি ক্ষাপাকিজে? অর্থাৎ, কেন এমন করছ, কেন দুঃখ কর?
আমি মুখে কিছু বললাম না, বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। সেই সকাল থেকে এই একই জায়গায় আমি বসে আছি, বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সারাদিন কিছু খাইনি, খাওয়ার ইচ্ছেও নেই। মনের সমস্ত অবসাদ শরীরকে গ্রাস করেছে, কিছু ভালো লাগছে না কাউকে ভালো লাগছে না। আবু আমার সামনে বসে পড়ল, গুলগুটি একটা ট্রেতে সাজিয়ে চা নিয়ে এল এবং একটা গোল মোটা পরটা। গুলশুটিকে দেখা মাত্র আমার শরীরে এক ধরনের জ্বালা আরম্ভ হল। বার বার সব কিছু মনে পড়ছে ছবির মতো। চোখের সামনে ঘোরাফেরা করছে। অজানা এক রাগ, অভিমান, যন্ত্রণা সব মিলেমিশে আমার মস্তিষ্কটাকে যেন কুরে কুরে খাচ্ছে। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝলসাচ্ছে। আবু কাপে চা ঢেলে দিল, পরোটা আমার সামনে রেখে বলল-দ্রোয়াকা, উখরা। {ধরো, খেয়ে নাও)।
আমি চীৎকার করে বললাম–না, না!
আবু এবার আমার পেটে হাত দিয়ে বলল–মা খাপাকিয়েজা, উখরা, নাসকে আওলাদ দা, বিয়া খারাপিজে? অর্থাৎ রাগ করো না খাও, পেটে বাচ্চা যে, নয়তো খারাপ হবে?
আবু আবার বলল-গুলগুটিতা উগরা, ওয়গি না কিয়েজে বিয়া দা মারুই খুরে, নাস খালাস না প্রিয়েদে। তা ভাগ ম্যাস ঠান্ডে দা আগা দ্রি ম্যাস ঠাল্ডে দা। সাঙ্গ রাি খোশালায় খবর দা, তাস দুয়ারাই জোয় পয়দা কিজে।
অর্থাৎ গুলগুটিকে দেখ, ক্ষিদে না পেলেও রুটি খায়, পেট খালি রাখে না। তোমার দুয় মাস পেটে বাচ্চা, আর ওর তিন মাস। কি খুশির খবর, তোমাদের দুজনেরই ছেলে হবে।
আমি চমকে আবুর দিকে তাকালাম, আবার কথাগুলো আমার কানে প্রধ্বিনিত হতে লাগল, আমার বুকের ভেতর থেকে হৃদপিন্ডটা যেন এখুনি বাইরে বেরিয়ে আসবে। গুলশুটিও…। তার মানে যেদিন থেকে আমি এখানে এসে এই ঘরের মধ্যে রচনা করেছি একটা সুন্দর স্বচ্ছ স্বর্গ, একটা একটা করে স্বপ্ন দিয়ে মালা গেঁথেছি, তা কোনদিন কোন কুৎসিত রূপ ধারণ করে আমাকে কষ্ট দেবে তা যে কল্পনাও করতে পারিনি। এক অসম্ভব যন্ত্রণা হয়ে ফিরে আসবে তা ভাবতেও পারিনি। মানুষটা এমন ঘৃণিত? যেদিন ওই মানুষটা আমার গর্ভে রোপণ করেছে বীজ; পরিপূর্ণতা পেয়েছে তা আর একটা অস্তিত্বে, ঠিক সেই মুহূর্তে আরও একটা গর্ভ সঞ্চার? এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা? হায়রে ঈশ্বর? প্রতি মুহূর্তের প্রতিটি আঘাত কী কেবল আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। প্রত্যেকটা লহমায় আমি যেন রিক্ত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। ঐ কারণেই কী জান্বাজ আমাকে বলতে বারণ করেছিল আমার গর্ভসঞ্চারের কথা? শুনেছি প্রেগনেন্সির অবস্থায় আচমকা কোন খবর ও আঘাত খুব ক্ষতি করে গর্ভের ও গর্ভস্থ বাচ্চার। আমার চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। মনে মনে জান্বাজকে বললাম–কেন তুমি এমন আঘাত দিলে আমাকে? একবারও ভাবলে না আমার কত কষ্ট হতে পারে? তুমি হতে পারলে এমন নিষ্ঠুর? আমার কতটা দুঃখ হতে পারে তা ভেবে তুমি একটু কী দুঃখ অনুভব করলে না? বোবা অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম শূন্যে। সামনে আবু বসে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। গুলগুটি তার মাথা একটা হাঁটুর উপর শুইয়ে রেখে কি যেন আকাশ পাতাল ভেবে চলেছে। বাইরের ঠান্ডা দমকা হাওয়া এসে ঘরের দরজা খুলে দিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ, কারও সেদিকে খেয়াল নেই। ধূসর নির্জীব একটা বিকেল, ঝিরঝির করে বরফ পড়েই চলেছে, উঠোনের এককোণে রাখা বুট (যা দিয়ে উনুন জ্বলে। রাখা আছে, তার ওপর একটা দাঁড় কাক বসে হেঁড়ে গলায় কা, কা করেই চলেছে। নাক্সিরা চাচি হ্যারিকেন নিয়ে পাবুলু চাচির ঘরে রেখে এল। একটু পরেই সন্ধে নেমে আসবে তার পরেই তো রাত? আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল, রাত? সে তত ভয়ঙ্কর নির্মম নিষ্ঠুর? যে রাতের আগমনে এতদিন আমার মন খুশিতে নেচে উঠত, সারাদিন অপেক্ষায় থাকতাম কখন রাত হবে? আজ এক মুহূর্তে সেই রাত আমার কাছে হয়ে উঠল এক ভয়ঙ্কর? কেমন করে তাড়াব এই রাতকে? চোখের জল আর বাধা মানে না। সে গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়তে থাকে, আর মনে মনে আমি বলতেই থাকি রাত তুমি এসো না, রাত তুমি এসো নাকি উদ্ভট আমার ভাবনা, রাত আসবে না তা কি হয়? কিন্তু এই রাতের অন্ধকারেই তো আমি হারিয়েছি আমার সব কিছু আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা, আমার চাওয়া। পাওয়া, আমার কল্পনা, কামনা বাসনা, সর্বোপরি আমার একান্ত আপন মানুষটাকে, এই রাতই তো কেড়ে নিয়েছে আমার বর্তমান ভবিষ্যৎ। সেই রাত আসছে আবার, আবার একটা যন্ত্রণা আমার জন্যে বহন করে নিয়ে আসছে, আবার সহ্যের অসহ্যের সামনে হতে হবে আমাকে, আবার প্রশ্ন আসবে ত্যাগ ও ক্ষমার, শান্তি কিংবা অশান্তির। সেই রাতকে কেমন করে করি আহ্বান? রাত, তুমি আমাকে নিষ্কৃতি দিতে পারো না? আমি কেমন যেন এক অসহায় হয়ে ভাবতে থাকি, চোখের দৃষ্টি ভোলা। আমি যেন সর্বহারার এক মহান নেতা।
রাত নটা প্রায় বাজে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া পাঁজরার ভেতরের হাড়গুলোতেও কাঁপুনি ধরাচ্ছে। ঘরের মধ্যে টিম টিম করে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। আমার সামনে বসে আছে জান্বাজ, একটু দূরে গুলগুটি। আজ থেকে একসঙ্গে শোয়ার পালা আমাদের তিনজনের। একদিকে পড়ে আছে তোক বালিশ, লেপ। গুলগুটি বিছানা করতে গিয়েছিল, আমি করতে দিইনি। আমি ভাবতেও পারছি না এমন একটা ঘটনার কথা। সুসভ্য জগতের সভ্য মেয়ে আমি, কেমন করে মেনে নেব এমন একটা নোংরা জঘন্য ঘৃণিত প্রস্তাবকে যা অতি অসভ্যতা? এও কি কখনও হয়? স্বামী তার দুটো স্ত্রীকে দু পাশে নিয়ে শোবে? এটা কোন সভ্য জগতের রীতিনীতি? এতো চরম দুর্নীতি। এক ধরনের পাশবিক অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার। এমন অত্যাচার কোন মাপকাঠি দিয়ে মাপ করা যায়? আমাদের দেশের পুরুষরা যে অন্য মেয়ের প্রতি আসক্তি হয় না তা নয়। ভুরি ভুরি তেমন প্রমাণ আছে, তবে একই বিছানায় একই সঙ্গে …. এমন ঘটনা বিরল বললে অত্যুক্তি করা হবে না একেবারেই। ঘরের কোণে আলো আঁধারির এক মায়াজাল যেন বিরাজ করছে, সেখানে বসে আছে গুলগুটি, আমি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখলাম। মনে মনে ভাবলাম গুলশুটিও কি আমার মতো করে ভাবছে? আচ্ছা! ওর মনে কষ্ট হচ্ছে ঠিক আমার মতো? আমার ভাবনার মতো করে ওর ভাবনা একই জায়গায় এসে শেষ হচ্ছে? ও নিজেও তো একটা মেয়ে, আমার মতো। নিশ্চয়ই ওর কষ্ট হচ্ছে। তবে ও কেন প্রতিবাদ করছে না? তবে কি ওর চাওয়াটা জান্বজের মতো বিকৃত? ও কেন বিছানা করতে চাইছে? এরা কী মানুষ নাকি জানোয়ার? জান্বাজ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল–শোয়া হবে নাকি বসেই থাকব সবাই? আমার ঘুম পেয়েছে। কথাগুলো হিন্দিতেই বলল, মানে আমাকে বলছে। আমি কোন উত্তর দিলাম না। এবার গুলগুটিকে ঝাঁঝিয়ে বলল–মন্ডে বিস্তারা জোরকা। মানে তাড়াতাড়ি বিছানা বানাও।
গুলগুটি তাড়াতাড়ি উঠে বিছানা বানাল। একটা বেশ চওড়া তোষক পাতা হল, পর পর তিনটে বালিশ রাখা হল, লেপ তিনটে রাখা হল। এবার জান্বাজ গিয়ে মাঝখানে শুয়ে পড়ল। আমি বসে বসে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছি। গুলগুটিও বসে আছে ঠিক বিছানার কাছে। সে ভাবছে শোবে কি শোবে না? ঠিক করে উঠতে পারছে না যে কি করবে? একবার আমার দিকে দেখছে একবার জাজের দিকে দেখছে। একবার হ্যারিকেনের দিকে তাকাচ্ছে। হ্যারিকেন নেভাবে কি নেভাবে না সেটা বোধহয় ভাবছে। এই ভাবে সময় অতিবাহিত হতে লাগল।
আমি ঠায় বসে আছি, আকাশ পাতাল ভেবে চলেছি, ভাগ করে নিতে হবে স্বামীকে, তাও গুলগুটির মতো একটা অশিক্ষিত নোংরা গ্রামের মেয়ের সঙ্গে? আমার দেশে যার অস্তিত্ব কেবল ঘরের পরিচারিকা হিসাবে। রাগে, যন্ত্রণায় সমস্ত ঘেন্না গিয়ে পড়ে গুলগুটির ওপর, রাগের জন্যে সমস্ত কটুক্তি বর্ষাতে থাকি ওকেই। তাছাড়া স্বামীর ভাগ? তা একেবারেই অসম্ভব। তবে তো সৌরভকেই মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু এখানে এই আত্মীয়-স্বজন বিহীন বিদেশে মেনে না নিয়ে আমার উপায় কী? আমি এখান থেকে একা একা যেতেও তো পারব না? সে কথা বেশ জোর দিয়েই তো আসাম চাচা বলেছিল। কি করব আমি এখন? কিন্তু এই ভাবে মেনে নিয়ে কতদিন থাকতে হবে আমাকে এখানে? মনে মনে ভেবেই চললাম, একবার কলকাতায় পৌঁছাই, তারপর সমস্ত হিসাব নিকাশ হবে জান্তাজের সঙ্গে। আজ যেমন নিজের হাতের মুঠোয় পেয়ে আমাকে ও বাধ্য করছে এমন যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি। মেনে নিতে, ঠিক এমনিই যন্ত্রণা ওকে আমি দেব। প্রতিশোধ আমি নেবোই। ওকেও এমনি করে বাধ্য করব যা মানা যায় না তাই মেনে নিতে। যা সহ্য করা যায় না তাই সহ্য করতে, যা পেলাম তার অনেক বেশি হবে ওকে মেনে নিতে। সেদিন সফল হবে আমার নারী জীবন। নারীত্বের এমন অপমান মুখ বুজে সহ্য করব না। আমি গুলগুটিকে শুতে বললাম। গুলগুটি বোধহয় এই অনুমতিরই অপেক্ষা করছিল, সে হ্যারিকেন নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। আমার বুকের ভেতরের একটা যন্ত্রণা উপর দিকে ঠেলে উঠতে চাইছে। আমি বালিশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জানালা দিয়েই। লাফিয়ে নামলাম বারান্দায়, কোথায় যাবো? কি ভাবে যাবো, কার কাছে যাবো? কোথায় গিয়ে আমার মুখটা লুকাব? কার কোলে বা বুকে গিয়ে আমার মাথাটা রাখব? কার কাছে গিয়ে চাইব শান্তি? এই অপরিসীম লজ্জার শেষ কোথায়? কে বাড়িয়ে দেবে তার সহানুভূতির হাত? ঘন অন্ধকারের মতো আমার জীবন অন্ধকার। কে দেবে আলোর দিশা? আমি যেন উন্মাদ হয়ে গেছি তাই, উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠোনের মাঝে চলে গেলাম, আবার ফিরে এলাম বারান্দায়, পারছি না, কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। আবার উঠোনে নেবে সোজা পাতকুয়ার দিকে গেলাম, হঠাৎ পেছন। থেকে জান্ধাজ এসে আমার হাত ধরল। না ধরলেও অন্ততঃ আত্মহত্যা করার মতো মানসিকতা আমার নেই। চোরের মতো জীবন থেকে পালাবার মেয়ে নই আমি। জাম্বুজের হাত থেকে এক ঝটকায় আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আমাদের আওয়াজ পেয়ে বাড়ির অনেকেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আৰু এলো, বলল, স্যায়কে? (কি হয়েছে)। জাব্বাজ তখন বলল সব। শুনে আবু আমাকে বলল-ওয়লি দাগাসাকে জোয়? আজ খোনেকে আজা। (এসো ঘরে এসো)। আমি বললাম-না, হাম। নেহি জায়েঙ্গে ওই ঘরমে হাম কভি নেহি রহে সেকেঙ্গে একসাথ। জান্বাজ তখন আমার হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। আমি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু জান্নাজের শক্তির কাছে আমি হেরে যাই। জান্তাজ একবারে টেনে হিঁচড়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে চলে যায়। আমি তখন রাগে দুঃখে, যন্ত্রণায়, কিছু না করতে পারার জ্বালায় দিশেহারার মতো হয়ে একটান মেরে বিছানাটা উঠিয়ে। ছুঁড়ে দিলাম দরজার দিকে। গুলগুটি তাড়াতাড়ি করে উঠে গিয়ে বসেছে ঘরের এক কোণে। আমি জান্বাজকে বললাম–অগর তুম মেরে না হো সেকা তো অর কিসিকো হোনে নেহি দেঙ্গে। মেরে সব স্বপ্ন টুট গিয়া, হাম কিসিকো স্বপ্ন দেখনে নেহি দেঙ্গে। মেরে দিলসে য্যায়সে চেইন লুট লিয়া, অব তুম লোগোকোভি চেইনসে রহেনে নেহি দেঙ্গে।
জান্বাজ এবার দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে বলল– কেয়া করগে তুম?
আমি বললাম- দেখ লেনা, হাম কেয়া কর সেকতা।
ও বলল–তুম কুছ নেহি কর পাওগি।
আমি যেন তখন হিংস্র এক বাঘিনী, এত কিছুর পরেও লোকটা এমন জোরের কথা বলতে পারে? লজ্জা করছে না ওর? আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম জাজের ওপর। মনে হলো ওকেও দেব যন্ত্রণা, যা আমি ভোগ করছি। জাজের ওপর যাওয়ার আগে ও সজোরে মারল একটা ধাক্কা, আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম জানালার ওপর। সেখানে রাখা ছিল আমার ওয়াটার কুলারটা, ঠিক তার ওপর পড়লাম গিয়ে। পেটে লাগল অসম্ভব জোরে, আমি মাগো বলে চিৎকার করে উঠলাম। হঠাৎ আমি অনুভব। করলাম জলের স্রোতের মতো কি যেন বেরিয়ে আসছে আমার পেটের থেকে। আমি দেওয়াল, ধরে উঠে দাঁড়াতে গেলাম দেখলাম পা বেয়ে নেবে যাচ্ছে রক্তের ধারা। আমি যন্ত্রণায়, ভয়ে ঝাঁকিয়ে উঠলাম। গুলগুটি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, জাম্বাজ আমাকে ধরতে এল, আমি কেঁদে ফেললাম, বললাম– মেরা আখেরি স্বপ্নভি টুট গিয়া জান্বাজ? আর কোন কথা বলতে পারলাম না, মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। তারপর কি হয়েছে জানি না, যখন জ্ঞান ফিরে এল দেখলাম আমার সামনে বসে আবু, জাম্বাজ, দ্রানাই চাচা, আরও অনেকে। সবার মুখ নিচু। যাকে ঘিরে এই দুমাস ধরে নানা রকম স্বপ্নের জাল বোনা শুরু করেছিলাম। মনে মনে। কতবার ভেবেছি তার ছোট্টো দুখানা হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আধো আধো বোলে অনর্গল কথা বলে চলেছে। আমি তাকে শাসন করছি আদর করছি, সেই আকাঙ্ক্ষিত সন্তান আজ আর কোনখানেই নেই। সে আমাকে একা করে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। আমি হারিয়ে ফেলেছি তারে, সে আমার সন্তান। আমার আত্মজ, আমার আমি, সে আর নেই।
শেষ সম্বলটাকে হারিয়ে আমি কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেলাম। মনে হতে লাগল আর কী হবে বেঁচে থেকে? জাজের দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করেছি যে ও একটুও সমব্যখি কিনা, কিন্তু ওই মুখে কোন পরিবর্তন আমি লক্ষ্য। করিনি। আর ও, আর–ও ভেঙে পড়েছি। মনে হয়েছে আমার সন্তান নষ্ট হয়েছে। তাতে জাজের তো কোন ক্ষতি হওয়ার কথা নয়? ওর তো সন্তান হবে? সে। আমার গর্ভে হোক আর গুলগুটির গর্তে হোক। সুতরাং ও কি করে বুঝবে? ও যে কেবল একটা পুরুষ? পুরুষের আবার ছলের অভাব হয়? পুরুষের কি হৃদয় থাকে? পুরুষ কী কোন নারীর হৃদয়ের খবর রাখে? পুরুষের মন কী আনচান করে কোন নারীর জন্যে? পুরুষ যখন যা কিছু পেতে চায় তা সে নিজস্ব মালিকানায় পেতে চায়, কিন্তু মেয়ে নিজস্ব মালিকানায় কেন পায় না? পাবে না? কোন নারী তা পায়নি। পুরুষ কি করে বুঝবে মায়ের হৃদয়ের যন্ত্রণা? সন্তান হারানোর দুঃখ পুরুষ কি বোঝে? পুরুষ যে কেবল পুরুষ! মা তো নয়?
সকাল থেকে দুপুর হয়। দুপুর গড়িয়ে গিয়ে নামে সন্ধে। আমার কোন পরিবর্তন হয় না। সেই যে আমি বিছানা নিয়েছি, তা আজও এই পাঁচদিনে সেরে উঠতে পারিনি। শারীরিক যন্ত্রণা, দুর্বলতা, মানসিক দিক দিয়ে একেবারে বিকল হয়ে পড়েছি। বাড়ির সবাই বোঝে, জাম্বাজও বোঝে কিনা আমি বুঝি না। মনে মনে ভাবি আমি যেন আর সেরে না উঠি। আমার অসুস্থতার সময় লক্ষ্য করলাম গুলগুটি খুব একটা বেশি আমার এই ঘরে আসে না। জাম্বাজ আমার ঘরেই একটু দূরত্ব রেখে শোয়। ভাবলাম, যাক, বাঁচা গেছে। অন্ততঃ ওদের এক সঙ্গে শোয়াটা আমি বন্ধ করতে পেরেছি। এক ধরনের আত্মতৃপ্তি অনুভব করতে লাগলাম। কি এক অপরিসীম শান্তি মনে ঘুরে বেড়ায়। এ যেন সব হারিয়ে একটু পাওয়া, সামান্য তৃপ্তি। সারাটা দিন অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে দিনান্তে বাড়ি ফিরে ভিজে কাপড় জামা ছেড়ে ফেলে হাত মুখ ধুয়ে শুকনো জামা কাপড় পরে শোফার ওপর বসে এক পেয়ালা গরম চা যেমন তৃপ্তি আনে মনে? ঠিক তেমনই এক ধরনের তৃপ্তি আমাকে যেন আচ্ছন্ন করে তোলে। কিন্তু আমার সব ভাবনা কেন এমন করে ভুল হয়ে যায়? কেন সব তৃপ্তির পরে থাকে এক যন্ত্রণা? জুলা? ভাবনা এই কারণে ভুল যে প্রায় বারোদিন পরে দ্রানাই চাচার মা মুসোকি আদি এলো আমার ঘরে। তিনি ছিলেন না, গিয়েছিলেন শেলগর, তার বাপের বাড়ি। সেই গজনির কাছে। আজই সকালে ফিরে এসেছে, এসেই সব শুনে আমার কাছে এসে বসে দুঃখ করছে। গুলগুটি একটু মুখরা বলে তাকে মুসোকি আদি পছন্দ করে না। আমাকে বলল- রেনে! আওলাদও লোকসান কাড়া দ্যা? অর্থাৎ, বাচ্চাও নষ্ট হয়ে গেল? রেনে মানে এতিম। এখন আমার পরিচয় আমি এতিম। মুসোকি আদি বলে কিছু বললাম না, অন্য কেউ হলে ঘুসি মেরে দাঁত কটা ফেলে দিতাম রেনে বলার আগে। যাই হোক, একটু পরে আমি দরজার দিকে মুখ করে শুলগুটির উদ্দেশ্যে বললাম-মুসোকি আদিতা চায় রাওরা। মানে মুসোকি আদির জন্যে চা আনো!
বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে দেখলাম একটা ট্রেতে করে গুলগুটি এক টি পট চা ও একটা পেয়ালাতে কিছু লজেন্স দিয়ে আমার ঘরের চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে মুসোকি আদিকে চা নিতে বলছে। আমার এবার মনে একটু কষ্ট হল। খুব লজ্জা করতে লাগল, ভাবলাম কেন বলেছিলাম ঘরে না ঢোকার জন্যে? তাই ও ঘরে ঢুকছে না। আ হা রে, ওর কি দোষ? ওকেও তো ঠকিয়েছে ওর। স্বামী? দোষ তো তার? যে একটা বৌ থাকা সত্ত্বেও অন্যের সঙ্গে মেশে তেমন পুরুষ তো সমাজের জঞ্জাল। নারীতো নয়। আমি সমস্ত রাগ, ঘৃণা, দুঃখ ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম ও আমার সতীন, আমার ভালোবাসার আর একটা দোসর। সব ভুলে ওকে ডাকলাম, বললাম-স্যায়কে? খানেকে অয়লি না রাজি? অর্থাৎ, কি হল? ঘরে কেন আসছো না? গাম মা কা গুলগুটি। (দুঃখ করো না গুলগুটি)। জে গুসসাকে গায়ে দেলাম।
আমি রাগের মাথায় বলেছি। মা ক্ষাপা কিয়াজা। রাগ করো না।
হাঁ। ম্যায় পাগল হো জায়ুঙ্গি, অগর মুঝে জানে নেহি দোগে রাজা, কিয়ানা।
এসো বসো। গুলগুটি বলল– সেয়িদা। (ঠিক আছে)। মগর ওসম লশস্পিয়ে জে বিয়া না রাজাম। অর্থাৎ, কিন্তু এখনও দশ দিন না যাওয়া পর্যন্ত ঘরে যাবো না।
আমি খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন?
তা আওলাদ বুয়ানসো, অস খোনকে যাম বিয়া মা আওলাবুম বুয়ানিজে যাকে। তা বোনেকে না জাম।
অর্থাৎ–তোমার বাচ্চা খারাপ হয়ে গেছে, এখন ঘরে গেলে আমার বাচ্চাও খারাপ হয়ে যাবে, তাই তোমার ঘরে যাবো না।
আমি বধির হয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম। ভাবলাম, ও এই কারণে তবে এখনকার বিচ্ছেদ? এই ব্যবধান? কোন কষ্ট স্পর্শ করে না? কোন মানবিকতা কিংবা মমত্ববোধ কাজ করেনি? আর একটু আগে যে মায়া, দয়া, করুণার উদ্রেক হয়েছে আমার মনে তা কেবল আমার হয়? গুলগুটির বা জান্বজের নয়? মনের মধ্যে আমার জমে উঠল ক্ষোভ, বিদ্বেষ, ঘৃণা। চাই না আমার কোন করুণা ওই মানুষটার থেকে। ও কেন শোয় আমার ঘরে? খুব স্বাচ্ছন্দে গুলশুটি কথাগুলো বলল ওর একটুও কষ্ট হল না? ভাবল না, এমন কথা বললে সাহেব কামালের কষ্ট হবে? আমার বাচ্চা…..। আমার ঠিক গলার কাছে একটা অব্যক্ত কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠছে। না! গুলগুটির জন্যে আমার ভাবনার প্রয়োজন নেই। আমি আর কোন কথা না বলে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লাম। মুসোকি আদি কখন চলে গেছে কে জানে! ফিসফিস আওয়াজে স্তম্ভিত হয়ে ফিরে মুখ থেকে চাদর সরিয়ে দেখতে গেলাম কে কথা বলছে? দেখলাম জাম্বাজ ও একজন অচেনা লোক। লোকটা মুখে কি সব বিড়বিড় করছে, হাতে একটা বড় পুঁতির মালা, সেটা একটা একটা করে গুনে চলেছে। লোকটার সামনে রাখা এক গ্লাস জল। একবার করে বিড় বিড় করে আর ফুঁ দেয় গ্লাসে। বুঝলাম এটা জলপড়া হচ্ছে। আমাদের দেশে বেলগাছিয়ার মসজিদে এমন করে জলপড়া দিতে দেখেছি। আমি রেগে মেগে উঠে বসলাম, বললাম–এটা কি হচ্ছে?
জাম্বাজ বলল, তুমে নজর লাগা, ইসিলিয়ে মৌলবিকে লেকে আয়ে পানি দম কর দেঙ্গে। তুম ঠিক হো জায়োগি।
আমি চীৎকার করে বললাম–মুঝে নজর লাগা? বেইমান, শয়তান কাহেকা, ধোঁকাবাজ। ভাগো, জলদি ভাগো ইহাসে, নেহিত আচ্ছা নেহি হোগা। মৌলানা লেকে আয়া, ঠিক করেগা।
মৌলানা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল, জাম্বাজও উঠে গেল। আমি চিৎকার করতেই থাকি, মৌলানা লেকে আয়া? দেখাতা হ্যায় কিতনা প্যায়ার হ্যায়? প্যায়ার দেখানে আয়া? মৌলানা লেকে? বিড় বিড় করে বলতেই থাকি, তারপর চোখে জল এসে
তারপর জান্বাজকে ডাকি, জান্বাজ ইধার আও, তুমারা সাথ মেরা ফয়সালা হ্যায়। অগর নেহি আগে তো বন্দুক সে হাম আপনা জান খতম কর দেঙ্গে। গুলগুটিকে ভি মারেঙ্গে। বলে দেওয়াল থেকে কালাউশনিকোভ নাবালাম। হঠাৎ জাম্বাজ এসে আমার হাত থেকে ওটা কেড়ে নিল। তারপর বলল–তুম কেয়া সাচছ পাগল হো গিয়া?
হাঁ। ম্যায় পাগল হো জায়ঙ্গি। অগার মুঝে জানে নেহি দোগে।
তুম বল তো কেয়া করনা চাহাতা?
–হ্যাম আপনা দেশ যানে মাংতা।
–ওতো আভি নেহি হোগা।
–ফের পুছতা কিউ? দুসরা বাত ইয়ে হ্যায় হাম জো কহেঙ্গে তুম কর সেকোগে?
–বাতাওতো সেহি?
–হ্যাম চাতে হ্যায় তুম গুলগুটিকো পাস কভি জানে নেহি সেকোগে।
–ইয়ে ক্যায়সে হোগা?
–ইয়ে নেহি হোগা, ওহ নেহি হোগা, তো কেয়া হোগা?
জান্বাজ চুপ করে বসে রইল, বেশ খানিকক্ষণ পরে বলল–অগর হাম উসকা, পাস নেহি জায়গাতে তুম খুশিসে রহগি?
আমি বললাম-খুশিসে রহেঙ্গে ইয়া না রহেঙ্গে ইয়ে বাত হাম বাতানে নেহি। শেকতা মগর কৌসিস করেঙ্গে।
জান্বাজ বলল, ঠিক হ্যায়, আজসে হাম গুলগুটিকা পাস নেহি জায়েঙ্গে।
আমিও এমনি ছাড়ার মেয়ে নই, বললাম- ফের কোরাণকা উপর হাত রাখকে কসম খাও।
জাম্বাজ কোরাণের ওপর হাত রেখে বলল গুলগুটির কাছে আর যাবে না, এমন কি ওকে ছোঁবে না।
আমার মনে আর কোন দ্বিধা রইলো না। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমিও সব যেন ভুলে যেতে থাকি। জান্বাজ ও আমার মধ্যে আর কোন বাধা যেন রইল না। তবুও আমি স্বাভাবিক হতে পারলাম না, যখনই জাম্বাজ আমাকে কাছে টানতে যায় আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জান্বাজ ও গুলগুটির মিলনের দৃশ্য, আমার এ্যাবোরশান, জাজের বলা–ও মেরা বিবি। আমি পারি না জান্বাজকে মন থেকে কাছে টেনে নিতে। ওকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকি। আর নিজেকে ভাঙতে থাকি, নিজেই নিজের কাছে হেরে যেতে থাকি। ভাবি এই কি আমি সেই মেয়ে? একটু বকলেই বালিশে মুখ গুঁজে যে মেয়ে অভিমানে কেঁদে ভাসাত, সেই মেয়ের এত সহা? ধৈর্য? এরমধ্যে আমার আরও একটা ভীষণ রকম কাজ এসে পড়ল মাথায়, তা হল চব্বিশ ঘণ্টা জাব্বাজকে পাহারা দেওয়া, যতক্ষণ বাড়িতে থাকে আমি ছায়ার মতো ওর সঙ্গে সঙ্গে থাকি, যাতে ভুলেও গুলগুটির ধারে কাছে না যায়। যখন জাম্বাজ বাইরে থাকে তখন গুলগুটির ওপর নজর রাখি যেন কোন বাগান বা ঘুপচিতে না যায়। আমি একটা সুস্থ মেয়ে, আস্তে আস্তে অসুস্থ হতে থাকি। আমার স্ট্যাটাস, শিক্ষা, সব যেন এক দুর্বিষহ অসভ্যতার সঙ্গে মিলেমিশে যেতে থাকে। কথায় কথায় রেগে যাই চিৎকার করি। ভাবি আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? তা না হলে আমার এমন কেন হয়? কেন আমি কিছু বুঝতে চাই না? আবুর ঘরে আর যাই না, দ্রানাই চাচার ঘরে যাই না, কোথাও গিয়ে শান্তি পাই না, মনে হয় যদি জান্বাজ এসে যায়? গুলগুটিকে যদি জড়িয়ে ধরে? এত ভাবনার পরে পাশাপাশি আমরা শুয়েও যেন একে অপরের থেকে অনেক দূরে আছি। এক এক সময় মনে হয় জান্বাজও কি মনে মনে গুলগুটির কথা ভাবে? ওকে পেতে চায়? আমি কি জোর করে ওকে ধরে রেখেছি? এক একবার ভেবেছি রোজ জান্বাজকে আমার এই শরীরটা ভোগ করতে দেব, যাতে ওর ইচ্ছে না হয় গুলগুটির কাছে যাওয়ার সময়ে অসময়ে আমি জান্বাজকে আহ্বান করেছি। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে শরীরটা দান করেছি। রাতের অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে যখন নিজের মুখোমুখি হয়েছি, একে একে আমার স্ট্যাটাস, আভিজাত্য কি সব বিদায় নিয়েছে? তখন প্রশ্ন করেছি নিজেকে, সুমি, এমনি করে ধরে রাখতে পারবে তুমি জান্বাজকে? সুমি সত্যি করে বলতো? তুমি কি আজও জাম্বাজকে ভালোবাসো?
মন উত্তর দিয়েছে না এমনি করে ধরে রাখা যায় না, কেবল একটা উন্মত্ততা আমার এবং জাম্বাজকে গুলগুটির কাছে যেতে না দেওয়ায়। যে সুখের আশায় ও আমাকে বিয়ে করেছে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে, সেই সুখ কি ও কেবল আমার শরীরের মধ্যে পেতে চেয়েছে? সেই শরীর ও পাচ্ছে। আর ভালোবাসা? তাও কি আর সম্ভব? যেখানে প্রতিশোধ স্পৃহায় কেউ মত্ত সেখানে ভালোবাসার স্থান কোথায়?
জান্বজের প্রথম বিবির প্রথম সন্তান প্রসবে ডাক্তারি বিভ্রাট
পুরো একবছর পূর্ণ হল আজ। ১৯৯০ সালের ২০ শে আগস্ট। ১৯৮৯ সালের এই আগস্টেই আমি এসেছিলাম জাম্বাজের হাত ধরে শ্বশুর বাড়ির মানুষজনকে দেখতে, চিনতে। সে দেখা আমার শেষ হয়েছে। এমন করে দেখা বোধহয় কোন মেয়েই দেখেনি। আমার মেজ দেওর কালখানের বিয়ে হয়েছে মাত্র তিনমাস হল। এদিকে গুলগুটির বাচ্চা হবে। গুলগুটির দেখাশোনা করার জন্যে ওর বৌদি সাবু এসেছে। এবং গুলগুটির এক বোন জোরগোলও এসেছে। ওরা আমার ঘরে এসে বসে। জান্বাজ ওদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা তামাসায় মশগুল হয়ে পড়ে। আমার মাথার। ভেতরকার পোকাগুলো কিলবিল করে ওঠে। জাব্বাজ অন্য কারও সঙ্গে গল্প করলে। আমার কিছু হয় না, অথচ ওদের সঙ্গে বললেই যত রাগ। অথচ সাবু জোরগোল কিন্তু আমার সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করে না। নিজেকে নিজে ধিক্কার জানাই, তবুও সহজ সুন্দর হতে পারি না। মাঝে গুলগুটির জন্যেও কষ্ট হয়। যখন ও একা উদাস মনে বাগানে অথবা রান্না ঘরে বসে থাকে তখন যন্ত্রণায় আমার বুকটাও ফেটে যায়। বিবেক আমাকে দংশায়। মনে হয় এটা আমি অনায় করছি। জান্বাজ ওরও স্বামী। তবে কেন আমি ওকে ওর স্বামীর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি? আমার থেকে ওর অধিকার তো কোন অংশে কম নয়? নারী হয়ে নারীকে দিচ্ছি কষ্ট? না, আর এমন করব না। সমস্ত বন্ধন থেকে জান্বাজকে মুক্তি দেব। জান্বাজ ওর কাছে যাচ্ছে ভেবে আবার আমি সহজ, অতি সহজ হয়ে যাই। পারি না। তখন আমি নিজেকে সঁদার করতে। হেরে যাই। আমি হেরে যাই। আমি আমার ঘরেই। বসেছিলাম। হঠাৎ গুলগুটির গর্ভযন্ত্রণা উঠে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাতেই। অথচ একটা চিনচিনে ব্যথা ছিল। আমাকে এসে বলল সাবু। আবার আমার মনে একটা করুণার উদ্রেক হতে লাগল। হাজার হলেও ওতো একটা মেয়ে? আমি আর ঘরে বসে। থাকতে পারলাম না। দৌড়ে গেলাম, গুলগুটির পেটে হাত বুলিয়ে দিতে। বুঝলাম, এখুনি ডেলিভারি হওয়া দরকার, সঙ্গে সঙ্গে একটা কাগজে ইঞ্জেকশানের নাম লিখলাম সিনটোসিয়ান। আমার ছোটো দেওর ইঞ্জেকশান এনে দিল, সাবু, জোরগোল। এমনকি জান্বাজ পর্যন্ত ইতস্ততঃ করতে লাগল, ইঞ্জেকশান দিতে বারণ করল। ওরা ভাবল যদি আমি গুলগুটিকে মেরে ফেলি? ভাবনাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার ব্যবহারই ওদের এমন ভাবনা ভাবতে বাধ্য করেছে। কেবল গুলগুটি সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল-তাস কারারসা। (তোমরা চুপ কর।) জে ইঞ্জেকশান নিসাম। (আমি ইঞ্জেকশান নেব)। ইস পোয়া নাস্তা, জে আকপল বন্দ লাশকে মরকিয়েজাম, তাস চি সাই দ্যা? অর্থাৎ একটুও পরোয়া নেই, আমি নিজের সতীনের হাতে মরব, তোদের কী তাতে?
আমি স্তম্ভিত! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। গুলগুটি? একটা অশিক্ষিত মেয়ের মুখ দিয়ে বেরুল এই কথা? যাকে এই একবছরে আমি কেবল দূরে সরিয়ে রেখেছি এক মুহূর্তের জন্যে যাকে আপন বলে আমি ভাবতে পারিনি? সে আমাকে এমন করে আপন করে রেখেছিল? আমি হেরে গেলাম। আমার শিক্ষা, দীক্ষা, শৌর্য, ধৈর্য সব যেন নিমেষের মধ্যে কোথায় ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। চোখে আমার জল টলটল করতে লাগল। আমি গুলগুটিকে ইঞ্জেকশান দিলাম। দিয়ে বসে বইলাম। অল্পক্ষণ পরে দেখলাম গুলগুটি দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে। ও কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। আমি ওর পালস দেখতে লাগলাম, সর্বনাশ ওর পালস পাওয়া যাচ্ছে না, ও শুয়ে পড়ল। আমি নিজে তখন ঘামতে শুরু। করেছি। এই ইঞ্জেকশান প্রেসার চেক না করে দেওয়া খুব বিপদজনক, তবে কি…? আমি আর ভাবতে পারছি না। এদিকে জাম্বাজ বলছে–হ্যাম পহেলেই তুমে মানা কিয়া, অগর উসকা কুছ হোগা না? তো তুমেভি হ্যাম দেখ লেঙ্গে। আমি কথাটা ঠিক শুনলাম তো? জাব্বাজ বলল কথাটা? কিন্তু তখন আমার আর ভাববার সময় নেই, ঠান্ডা জল দিলাম গুলগুটিকে। চোখে মুখেও ঠান্ডা জল দিলাম। সাৰু জোরগোল সমানে কেঁদে চলেছে। আবু আমাকে বলল–ওয়লি? ওয়লি দাগাসে কাওয়াল? তু ইনসান দা কি চিসাই?
অর্থাৎ কেন কেন এমন করলে? তুমি কি মানুষ? নাকি অন্য কিছু? সবাইকার সমস্ত অভিযোগের আঙ্গুল আমার দিকে। আমি নির্বাক। ভগবানের ওপর ভরসা হারিয়েছি অনেক দিন আগে। আজ আমার এই দুঃসময়ে পাশে কোন বন্ধুকে পেলাম না। সত্যিই তো, গুলগুটি এদের নিজেদের মেয়ে। জান্বজের ফুফুর মেয়ে। আবার বিবি। ওর দাবি অধিকার প্রকাশ্যে না থাকলেও আমার থেকে অনেক গুণে তা বেশি আজ তা প্রমাণিত হল। আমি একা, স্রেফ একা।
হঠাৎ গুলগুটি ঝাঁকিয়ে উঠল জোরে, এবং তখনই একটা মেয়ে ভূমিষ্ঠ হল। আস্তে আত্তে গুলগুটিও সুস্থ হতে লাগল।
আমি আর কোন কথা বললাম না। সোজা নিজের ঘরে চলে এলাম। জাজের বলা কথাগুলো কানে বাজতে লাগল। এক বছর কেবল শারীরিক ভাবে দূরে সরাতে সক্ষম হয়েছি আমি। কিন্তু মানসিক? এক চুলওতো সরাতে পারিনি। আবার দগ্ধ হলাম, কিন্তু কিছু আর বলতে ইচ্ছে করল না। আগে কেবল মানসিক ভাবে আমি দূরে সরে গেলেও শরীরটাকে ওকে দিয়েছিলাম। এবার তাও আর দিতে মন চাইল না। এক বছর ধরে যাকে আগলে রেখেছিলাম, পাহারা দিতাম, এবার সে বাঁধন আলগা হল। পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন আর রইল না। কি হবে? ওই মনটা তো গুলগুটির কাছে আছে। শরীরটা দিয়ে কি হবে? কেবল বুকের ভেতর একটু মোচড় দিয়ে উঠল। আমার দিশেহারা অবস্থার উন্নতি কিছু হয়নি। শুকনো চোখের পাতা। কান্নায় ভিজে উঠতে দেরি করল না। মনে হচ্ছে সবটুকু কেমন একটা কুৎসিত, সমস্ত দৃশ্য যেন জ্বালা ধরায় মনে। অথচ একটা মিষ্টি অনুভূতি নেচে বেড়াচ্ছে মনে, তা একটা আগন্তুকের আবির্ভাব। একটা ছোট্ট শিশু।
এই মাত্র সকাল হল। এই সকালেই একটা গুরুগম্ভীর রোদ ছড়িয়ে পড়েছে সারা আফগানিস্তানে, আমার খুব আপন জায়গা আঙ্গুরের বাগান। বাগানে ঢোকার দরজা দিয়ে ঢুকেই ডান দিকে একটা চাতাল মতে আছে। আবু এই চাতালে এসে নামাজ পড়ে। আমি এসে বসে থাকি এই চাতালে। খোলা আকাশের তলায় বসে মনটাকে পাঠিয়ে দিই কলকাতায়, মনে মনে ভাবি আর আপন মনে গান গাই। আদ্রামান ভাইয়ার মেয়ে আটলাসা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। ও আমার অনেক কথা বোঝে না, তাও ওকে হাত পা নেড়ে আমার দেশের গল্প শোনাই। ও চোখ বড় করে কেবল তাকিয়ে থাকে আর মাঝে মাঝে বলে–খা, তাস ওতন ডের খুরসুরৎ দ্যা। অর্থাৎ, ই তোমাদের দেশ খুব সুন্দর। আমাদের কথার মাঝেই আবু একটা গরুর দড়ি ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে বাঁধল আলুবোখরার গাছের। সঙ্গে। আমাকে বলল-স্যায়কে সাহেব কামাল? গোয়া সিধে দোয়াবালায়সে? মানে কি সাহেব কামাল? গরুর দুধ দুইতে পার?
আমি না বললাম, আবু বলল রাজা, ইয়াজদা কা? মানে এস শিখে নাও। এই আবু পারে না এমন কোন কাজ নেই। আমি সমস্ত বাড়ির মধ্যে এই আবুকেই যেন একটু বিশ্বাস করি। আবুর সঙ্গে বেড়াতে যাই, গরুর খাবার শাওতালা কাটতে। যাই খেতের মধ্যে। আবু একদিন আমাকে বলল-রাজা জেসুজে গারুকে। অর্থাৎ চলো যাই পাহাড়ে। আমি না বললাম না। আসলে আমার ইচ্ছে করছিল কোথাও যেতে। আবুও আমি চলেছি পাহাড়ের কোলে নাদির চাচার শ্বশুরবাড়ি। বেশ খানিকটা চলে গেছি, হঠাৎ মনে হল গুলগুটির বাচ্চা হয়েছে প্রায় দুমাস হয়ে গেছে। এখনতো ওর কাছে যাওয়ার কোন বাধা নেই জাম্বাজের? হঠাৎ মাথাটা কেমন গরম হয়ে উঠল। বিছানার দৃশ্য যেন আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, আবার সেই যন্ত্রণা আমার মাথাটা ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে বলে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। একটা রাগ পা থেকে যেন মাথায় উঠতে থাকে। মুখ বিকৃত হতে থাকে। জান্বাজ কেবল আমার। তাকে। আমি কোন মতেই ভাগ করে নিতে পারব না। যা হয়ে গেছে তা আর হতে দেব না। একটা অসহায় বোধ মনের মধ্যে দ্বিগুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করতে লাগল। আমি আবুকে বললাম–আবু জে না জাম। রাজা কোরতা জে। অর্থাৎ আমি যাবো না, এসো বাড়িতে যাই।
আবু বলল–স্যায়কে? অইলি? মানে কেন? কি হয়েছে?
আমি আবুর প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে বাড়ির দিকে হনহন্ করে হেঁটে আসতে শুরু কলাম। একেবারে বাড়িতে এসে নিজের ঘরের চৌকাঠের কাছে এসে দাঁড়ালাম। হঠাৎ দেখলাম গুলগুটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। ওকে দেখা মাত্র রাগে, যন্ত্রণায়, আক্রোশে থমকে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছি, কোথাও কোন সুখের ছোঁয়া লেগেছে কি না। আমার দুটো চোখের আগুনের একটা ঝাঁপটা গিয়ে লাগল গুলগুটির চোখেমুখে। চরম পরিতৃপ্তির কোন অনুভূতির প্রতিক্রিয়া ওর সমস্ত মুখে আমি খুঁজতে লাগলাম। গুলগুটি নির্লিপ্ত একটা আহ্বান জানাল, বলল–অইলি ওলাদা? রাজা? দাঁড়িয়ে কেন? এসো?
আমি কেবল কষ্ট দিচ্ছি কষ্ট পাচ্ছি। নিজের অসহিষ্ণুতা নিজের কাছেই খুব বিচিত্র বলে মনে হতে লাগল। ওর কোন প্রতিক্রিয়া না দেখতে পেয়ে শান্তি অনুভূত হল মনে। কিন্তু ওর অমন নির্লিপ্ত সুরে আহ্বান আমার অসহ্য বলে মনে হল। ওর স্থির হাবভাব এবং নিরুত্তাপ উক্তি যেন প্রমাণ করে ওর ঔদ্ধত্যতা। আসলে গুলগুটিকে আমি একটুও সহ্য করতে পারি না। ওকে দেখলে কেবলই মনে হয়, ওর জন্যেই তো আমার এত কষ্ট, যন্ত্রণা। কিন্তু যখন কোন যন্ত্রণা থাকে না, জান্বজের বাহুবন্ধনে থাকি তখন ওর কথা ভেবে মনে মনে কষ্ট পাই। যখন গুলগুটি মন মরা হয়ে একা-একা বসে থাকে, তখন ওর জন্যে আমার খুব কষ্ট হয়। নিজেকে নিজেই শাসন করি ধিক্কার জানাই। শুলগুটির পাশে গিয়ে বসি গল্প করি, ওর বাবা। মা সবার কথা জিজ্ঞাসা করি, নানা রকম গল্পে ওকে ভরিয়ে তুলি, সঙ্গ দিতে চাই। কিন্তু আমার সমস্ত দয়া, মায়া, ভালোবাসা, ভাবনা, শাসন, সব সব যেন কোথায় কর্পূরের মতো উবে যায়, যখন পৃথিবীতে নেমে আসে রাতের অন্ধকার। রাতের বেলা আমি যেন কোন নারী থাকি না। তখন আমি নিজেকেই নিজে চিনতে পারি না। এক পাশবিক অত্যাচারের ভূমিকায় আমি অবতীর্ণ হই। হারিয়ে যায় আমার সভ্যতা, ভব্যতা আমার শিক্ষা, স্ট্যাটাস, সমবোধ। অসভ্য উচ্ছল উন্মত্ততায় আমি মেতে উঠি। গুলগুটিকে জাজের ধারে কাছে যেতে না দেওয়ার প্রবণতায় আমি উন্মাদ হয়ে যাই যেন। আমি যেন অন্ধ হয়ে যাই। যেন মহামূল্যবান কোন সম্পত্তি চোরের হাত থেকে রক্ষার্থে বুক দিয়ে আগলে রাখা। দিন দিন আমি যেন কেমন অসুস্থ হয়ে যেতে থাকি। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছি? রাতের অন্ধকারে ঘরের বিছানা সবাইকে শান্তি দেয়। আমার কাছে তা কেন। যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠল? রাত বিছানা কি আমার ফোবিয়া হয়ে দাঁড়াল?
বাড়ির সবার কাছে আমি এক আতঙ্ককারী হয়ে উঠতে থাকি। আমার সঙ্গে কথা বলতে সবাই ভয় পায়। রাতে শুয়ে জাম্বাজের ওপর হাত দিয়ে রাখি যাতে দুরে শোয়া গুলগুটির কাছে যেতে না পারে। রাতে জল পর্যন্ত খাই না, যাতে বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন না হয়। এমনি করে কাটতে থাকে আমার দিন ও রাত। দিনে আমি শান্ত। রাতে হয়ে উঠি উগ্রচন্ডী। আমার মধ্যে থেকে স্নিগ্ধতা হারিয়ে যেতে থাকে। এক কঠোর কঠিন আবরণের মধ্যে ঢুকে যেতে থাকি আস্তে আস্তে। ১৯৯০ সালের জুলাই মাস। আমার ওষুধের দোকান সবে উদ্বোধন করেছি। একটা দুটো করে রুগিও আসে। মেহমান ঘরের পাশে একটা ছোটো ঘর আবর্জনায় ভর্তি ছিল, সেগুলো সরিয়ে পরিষ্কার করে, সেটাকেই কারেছি ওষুধের দোকান। একদিন দোকানে বসে আছি, হঠাৎ আবু এসে বলল-সাহেব কামাল গুলগুটি প্লর কোরতা জে, জে বুম জাম, আগা প্লার মরস। অর্থাৎ, সাহেব কামাল গুলগুটি বাপের বাড়ি যাবে আমিও যাব, ওর বাবা মারা গেছে।
আমি মুখে দুঃখ প্রকাশ করলাম। কিন্তু মনে মনে কোথায় যেন একটা শান্তি অনুভব করতে লাগলাম। ভাবলাম, যাক বাবা। এবার ঘরের ভাগ দিতে হবে না। বেশ কিছু দিন। কেবল আমার ঘর থাকবে। জাম্বাজ ও আমার ঘর। হঠাৎ নিজেকে খুব জঘন্য মনোবৃত্তির বলে মনে হল। ছিঃ, ছিঃ সুমি, তুমি এতো নিচ হয়ে গেছ? ওর বাবা মারা গেছে, তাতে তোমার দুঃখ নেই? তোমার ঘরের কথা ভাবছ? তুমি। এত নিচ হতে পারলে? এমন নিম্নমানের তুমি তো ছিলে না? একটা মানুষের। পৃথিবী থেকে চলে যাওয়াকে নিয়ে তোমার মনে কেবল পাওয়ার চিন্তাটাই বড় হয়ে দেখা দিল? গুলগুটির পিতৃবিয়োেগ তোমাকে একটুও কি বিচলিত করেনি? তোমারও তো বাবা আছে। ছিঃ! ধিক্ সুমি। মনকে উদার করো। এদের জন্যে। একটু ভাববার চেষ্টা কর, এরা–এই আফগানবাসি কি এতই খারাপ যে তাদের মৃত্যুতেও তোমার মনে কষ্টের প্রতিফলন হয় না? এই অসহায় মানুষগুলোর সুখ, দুঃখ, কষ্ট এদের যন্ত্রণা, অনাহার অনিদ্রায়, তুমি কি একটুও উপলব্ধি করো না? জীবনের শুরু থেকে যারা মৃত্যুর করাল থাবা থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করে চলেছে তাদের এই মৃত্যুতে তোমার কষ্ট হয় না?
হয়। হয়। ভীষণ রকম প্রতিক্রিয়া হয় আমার অন্তরে যদি কারও মৃত্যুর খবর। আমার কানে আসে। আমিও তো মানুষ! এই আফগানিস্তানের করুণ দুর্দশায় আমার অন্তরাত্মা গর্জে উঠতে চায়। এই সমস্ত রকম বন্ধ্যা দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ অনাহারে দিন যাপন করে। খেত মজুরের কাজ এখানে নেই, বাড়ির পরিচারিকার কাজ এদেশে নেই, কোন কারখানা বা শিল্প এদেশে নেই, আছে কেবলই যন্ত্রণা। সে যন্ত্রণা আমাকে স্পর্শ করে, আনে যন্ত্রণা, দেয় কষ্ট। এখানে কারও মন আবেগে ভাসে না, কারও মুখে হাসি নেই, কেউ রাতের বেলা স্বপ্ন দেখে ভোরে জাগে না, এখনকার মানুষের কথা বলতে মানা, কোন আনন্দ উৎসব করতে নেই প্রচলিত বিধান এখন মানা নিষেধ। কারণ তালিবান এদেশের ভাগ্য বিধাতার আসন গ্রহণ করেছে।
বেচারা গুলবদিন হেকমতিয়ার রাব্বানী সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে জোর করে অন্যান্য দেশের মধ্যস্থতায় যে পদটা কেড়ে নিয়েছিল তা হল রাষ্ট্রপতির পদ। প্রধানমন্ত্রী রাব্বানীই ছিলেন, মাসুদ আহমেদ শা ছিলেন সেনাধ্যক্ষ, আর হাজি রুস্তম তাজিক জাতির যারা গ্লামান নামে পরিচিত। কিন্তু রাব্বানী যে কি জাতির তা আমার জানা নেই। রাষ্ট্রপতি হয়েও গুলবদীন খুশি হল না, পদ গ্রহণ না করে যুদ্ধের আয়োজন করে চারাশিয়াতে গিয়ে দখল করে বসে রইল রাব্বানী সরকারের সঙ্গে শত্রুতা করে। তবে এই দুই দলের দুই শক্তি যদি এক হত বা থাকত তবে বোধহয় মোল্লা ওমর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার সাহস পেত না। যদিও উঠত তবুও একনায়কত্বের শ্লোগান গাওয়ার পথ পরিষ্কার হত কিনা সন্দেহ আছে। মধ্যযুগীয় একটা জঞ্জাল গোষ্ঠিকে গুলবদীন ও রাব্বানী জোট ঝেটিয়ে বিদায় করতে সক্ষম হতো। ভাঙনটাইতো ধরল শাসনক্ষমতার মধ্যে, শত্রুর হাত থেকে কি করে আর রক্ষা করবে দেশকে? তার মধ্যে আবার জাতিতত্ত্ব দ্বিমত এসে হাজির হল। নিজেদের ভুলভ্রান্তির ফল স্বরূপ আজ এই দুর্দশার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সমস্ত আফগানবাসিদের। তখনও ডাঃ নজিবুল্লা বন্দী দিন যাপন করছে কাবুলের মাজার-ই-শরীফে। রাশিয়া সরে গেছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মতে মনে হয় যদি কমিউনিজমকে আফাগনবাসিরা প্রাধান্য দিত হবে তালিবানের বর্বরতায় প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার কোন প্রশ্ন উঠত না। তা ছাড়াও যদি বিভিন্ন মত না হয়ে প্রতিবিপ্লব এক হত তাও দেশটার অস্তিত্ব সম্পর্কে এত চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন হত না। এবং যদি পুস্তুন সম্প্রদায়কে দূরে সরিয়ে না দিত, তবে ভালো হত। কারণ দেশের মধ্যে একশো-ভাগের মধ্যে পঁচাত্তর ভাগ মানুষ হচ্ছে পুস্তুন আর পঁচিশ ভাগ মানুষ বিভিন্ন জাতের মধ্যে ভাগ করা। অথচ রাব্বানী সরকারের মধ্যে কোন পুস্তন জাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। এর ফলে পুস্তুনদের মধ্যে মত বিরোধ হয়, জাতীয়তাবাদের হিড়িক ওঠে। সেই হিড়িক দাঙ্গার দানা বাঁধতে থাকে মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তখন রাব্বানী সরকারকে ফেলার। চেষ্টায় রত পুস্তুনরা। মোল্লা ওমর পুস্তুন সেই প্রথমে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, আহ্বান করে জঙ্গিদের পাকিস্তান থেকে এবং সেই জঙ্গি গোষ্ঠির নাম দেওয়া হল তালিবান। এই তালিবানরা জাতীয়তাবাদকে বিনিষ্ট করার উদ্দেশ্যে এসে বর্বরতার প্রতীক হল। ঘর যত বেড়েছে উঠোন ততই ছোটো হতে থেকেছে। সমস্ত আফগানিস্তানে অসাধারণ পণ্ডিত খুঁজে একটাও পাওয়া যাবে না, কিন্তু অসাধারণ যোদ্ধা একাধিক পাওয়া যাবে তা খোঁজার প্রয়োজন হবে না।
যুদ্ধে রাব্বানী সরকারের পতন
১৯৯৪ সালের শেষে অথবা ১৯৯৫ সালের প্রথমে আবার এক প্রস্থ যুদ্ধ শুরু হল। এবার গ্রামের দিকে নয় শহরে। খোদ প্রধানমন্ত্রী রাব্বানী ও মাসুদ আহমেদ শা এবং হাজি রুস্তমের সঙ্গে সরাসরি তালিবানের যুদ্ধ। শহরের অধিকাংশ মানুষ চলে গেল কাবুল ছেড়ে, কেউ পাকিস্তানে কেউ বা দিল্লি আবার কেউ বা গ্রামে। চার মাস পরে আবার এক বিধ্বস্ত যুদ্ধ। আচমকাই শুরু হয় এই কর্মকান্ড। শহরেই হোক আর গ্রামেই হোক যুদ্ধ-যুদ্ধই হয়। সেই দুর্বিষহ পরিস্থিতির প্রতিফলন আমাদের গ্রামে পড়ল। আমার জীবনে এমন দুঃখ, কষ্ট, বিপর্যয় দিয়ে ঘেরা হবে তা-কি আঁচ করতে পেরেছি কোনদিন অতীতের সুন্দর স্বপ্ন মাখান দিনগুলিতে? বর্তমানের যুদ্ধ বাধাতে আমি একেবারেই যেন ভেঙে পড়তে লাগলাম। আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম যে এ যুদ্ধ কোন ভালো কিছু করার সংগ্রাম নয়। এ কেবল ক্ষমতা দখল ও ভয়ঙ্কর এক ধর্মের মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের আবর্তের মধ্যে সারা পৃথিবীর মানুষকে ধাঁধার চেষ্টা মাত্র। এ যুদ্ধ কোন দারিদ্রতার বিরুদ্ধে কিংবা দেশের শান্তি প্রকল্পের বাসনা নয়। ১৯৯৫ সালে আফগানিস্তানে চরম দুর্ভিক্ষ এবং আর্থিক অনটন দেখা দিল। টাকার বৈদেশিক মুদ্রার দাম চড়চড় করে এ দেশে বাড়তে থাকে। হিন্দুস্থানের এক হাজার টাকায় এদেশে এক লাখ টাকা পাওয়া যায়। সেই অনুপাতে জিনিসের দাম। মৃত্যুমুখে যেন সবাই পতিত হতে শুরু করল। সকলে দেশান্তরিত হওয়ার পরিকল্পনা করতে লাগল। কিন্তু যাবে কি করে? তালিবানেরা কড়া ফতোয়া জারি করেছে, দেশের বাইরে কেউ যাবে না, তাহলে তাদের মরতে হবে।
এই দ্বিমুখী সংকটে মানুষ সব দিশেহারা হয়ে চিন্তায় ভাবনায় অনাহারে উদ্বিগ্নতায় ভাষাজ্ঞানহীন অবস্থায় সব ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে রইল। যুদ্ধ উত্তোরোত্তর বেড়েই চলল, সঙ্গে চলল লুটপাট, গোপন হত্যা, প্রকাশ্যে হত্যা, খৃস্টান বা হিন্দুদের ধর্মান্তকরণ, নইলে হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি। আগে রাশিয়ানদের ভয়ে ঘরে আলো জ্বালতে পারত না। আলো দেখে যদি বোমা ফেলে? এখন তালিবানের ভয়ে সবসময় দরজা বন্ধ করে রাখে যাতে উঠতি বয়সের মেয়ে বৌদের দেখতে না পায়। এই সঙ্কটময় পরিস্থিতি যখন চলছে সেই সময়তেই আমি আমার বুদ্ধি বিচক্ষণতা কাজে লাগিয়ে ওই বর্বর তালিবানের নজর থেকে পালিয়ে গিয়ে পৌঁছেছিলাম পাকিস্তানে। তার পরেও অনেক সাধ্য সাধনা করে ফিরে এসেছি আমার দেশে। দেশের সুন্দর মানুষদের সাধ্যি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আমি তখন অন্ধ। ফিরে আসার পরে আমার স্বামীর সঙ্গে আমার মিল হয়ে গেল। এরপর তালিবান কাবুল দখল করল, রাব্বানী, মাসুদ আত্মগোপন করল। বর্বরতার চরম পর্যায়ে গিয়ে ডাঃ নজিবুল্লাকে ফাঁসি দেওয়া ইল। তারপরেও মোল্লা ওমর ওসামা তালিবান কেন শান্তিতে আফগানে বাস করতে পারল না? কেন স্বৈরাচারী এক বর্বর জঘন্য সন্ত্রাসবাদী হয়ে পৃথিবীর কাছে পরিচিত হল?
যুদ্ধের পর্যালোচনা
যে শান্তির বাণী দিয়ে মানুষের মনে এক আনন্দ সঞ্চার করেছিল কেন তার থেকে বিচ্যুতি ঘটল? কারণ একটাই তা হল কেবল আফগানিস্তান দখল করে তারা নিরস্ত্র হতে চায় না। তারা চায় সমগ্র বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করতে। তার প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হিসাবে আমেরিকা ও ভারতকে বেছে নিল। সর্বাগ্রে এই দুটো দেশকে যদি ধর্মের বেড়াজালে জড়াতে পারে তবে অন্যান্য দেশ আর কোন আপত্তি করবে না। তালিবান সমস্ত সন্ত্রাসের শীর্ষে অবস্থান করল, তাদের ভয়ে সমস্ত মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠতে লাগল। তালিবানের হাতে পরাভূত হয়ে রাব্বানী-মাসুদ-দোস্তম (রুস্তম) অন্দরমহলে প্রবেশ করল। ১৯৯৫ সালের রাব্বানী-তালিবানদ্ধে পাকিস্তান সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে তালিবানদের, আমেরিকাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছে তালিবানকেই। সেই সময় যদি আমেরিকা রাব্বানী সরকারকে সামান্য সাহায্য করত তবে তালিবানের ইতি হত নাকি? আজ তারা যে সংখ্যক জনসমর্থন পাচ্ছে সেই সময় সেই জনসমর্থন ছিল কী? পেত কী? ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত লাদেন নামের কোন লোক আফগানিস্তানের মাটিতে নিজের অবস্থান কায়েমি করে বসতে পারেনি। ১৯৯৫এর পর পাকিস্তান ও আমেরিকার মদতেই তালিবান। নামক সংগঠন ও লাদেন সারা বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করল। লোকবল, অর্থ ও অস্ত্রবলে তালিবান ফুলে ফেঁপে উঠল। ডাঃ নাজিবুল্লাকে হত্যা করল কারা? তালিবান? নাকি তালিবানের নামের পেছনে পাকিস্তান? সমস্ত রকম সন্ত্রাসের সৃষ্টিকারি পাকিস্তানকে এখনও সন্দেহের বাইরে কেন রাখা হচ্ছে? বার বার প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান কেন পার পেয়ে যায়? পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি সে কথা সারা বিশ্ব আজ এক বাক্যে স্বীকার করবে বলে আমার ধারণা। আজ নিজেদের ঘরে আঘাত লেগেছে বলে আমেরিকার টনক নড়ে উঠেছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের ভারতের কাশ্মীরে হাজার হাজার মানুষকে আমরা হারিয়েছি। সেই হারানোর মূল্য কি আমেরিকার কাছে কিছু নয়? যখন আমেরিকায় আঘাত হানল তখন আমেরিকা চিৎকার করতে আরম্ভ করল। এখানেই শেষ নয়। আফগানিস্থানে সন্ত্রাসের নায়কদের ধরতে যুদ্ধ শুরু করল। সাধারণ মানুষ প্রাণহারাল। গৃহ হারা হল।
ভৌগোলিক সুবিধার জন্যে আজ পাকিস্তান আমেরিকার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে নিয়ে সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকেও প্রতিহত করতে সক্ষম হল। তা হলে কি ভেবে নিতে দ্বিধা আছে যে পাকিস্তানের তৈরি জঙ্গিরা এই নৃশংস পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পাকিস্তানেরই সুবিধা ও ভালো করতে চাইছে? সাধারণভাবেই। একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হল আমেরিকার পেন্টাগন ধ্বংসের নায়করা কি সত্যি সত্যিই লাদেনের প্রেরিত? যাই হোক লাদেন কিন্তু আজ অনেক মানুষের কাছে হিরো। তবে পাকিস্তানের ওপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াটা খুবই আশ্চর্য বলে মনে হয়। সন্ত্রাস তৈরি যখন করেছো শেষ করবে। তবে কেন সাহায্য? নিষেধাজ্ঞা ভোলা? সারা বিশ্ব একমাত্র লাদেন ও মোল্লা ওমরকে সর্ব প্রধান সন্ত্রাসবাদীর আড়ালে সর্বাধিক প্রধান সন্ত্রাস সৃষ্টিকারিকে দেখতে পাচ্ছে না, কিংবা চোখ, কান বন্ধ করে আছেন। কে বেশি সন্ত্রাসবাদী? যে তৈরি করে সে নাকি যে সন্ত্রাস করে সে?
মৌলবাদী সব সময়তেই ভয়ঙ্কর হয় তবে ইসলাম মৌলবাদীর কাছে অন্যরা নরম পন্থী এবং লিবারেল। মুশারফ নিজেও কী সেই মৌলবাদীতার বাইরে যেতে সক্ষম হয়েছেন? যদি হয়েই থাকেন তবে অত্যন্ত সংকটজনক মুহূর্তেও ইসলাম তার সবশেষ উক্তি হতে পারত কী? দেশের জঙ্গি মৌলবাদীদের বিক্ষোভ প্রশমিত করতে মুশারফ একই সঙ্গে ইসলামের ইতিহাসের নজির তুলে ধরেন এবং সেই সঙ্গে বলেন, মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানের বিপর্যয় হলে ইসলামেরও ক্ষতি হবে।
–আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে সেপ্টেম্বর।
পাকিস্তান আজ আবার একবার পার পেয়ে গেল ওসামা বিন লাদেনের আড়ালে। তালিবান প্রচার চালাতে একটুও সময় নেয়নি যে লাদেন অজুহাত মাত্র, লক্ষ্য আসলে ইসলাম। তাহলে এখানে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিক কারণেই হতে পারে যে আমেরিকার পেন্টাগনে আঘাত কী তবে কাফেরদের প্রতি? মোল্লা ওমর আরও বলেছিল (২০ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার) আমরা সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে চাই, ওসামা হোন আর যে-ই হোন আফগানিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে কেউইও এমন কোনও কাজ করতে পারবেন না যাতে অন্য কারও কোন ক্ষতি হয়। অথচ সেই প্রমাণ কিন্তু পাওয়া গেল।
প্রমাণ পাওয়ার পর মোল্লা ওমরের কথার সত্যতা কোথায় দাঁড়াল? মোল্লা ওমর আরও বলেছিল-আমাদের দেশই বিশ্বে একমাত্র প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র, আর সে জন্যেই আমরা ইসলামের শত্রুদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছি। তারা যে কোনও অজুহাতে আমাদের ধ্বংস করতে চায়। ওসামা বিন লাদেন আসলে এই ধরনের একটা অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়। (২০ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার আফগানিস্তান ছাড়া যে সব ইসলামি দেশ আছে, মোল্লা ওমর এককথায় সেই সমস্ত দেশকে ইসলামি বলে অস্বীকার করল। বুঝিয়ে দিল তারা ছাড়া অন্য কেউ প্রকৃত ইসলাম নয়। পাকিস্তানও তার মধ্যে পড়ে। পাকিস্তান কিন্তু আফগানিস্তানের মধ্যে নয়। সুতরাং পাকিস্তানেও কেউ নেই প্রকৃত ইসলাম, মোল্লা ওমরের কথায়। অথচ পাকিস্তানের ইসলামি মৌলবাদীরা তালিবানের সঙ্গে আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়ে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত মূখের মতো। তালিবানরা তো তাদের ইসলাম বলেই স্বীকার করে না, তবে কেন প্রাণ দান? ২৯ অক্টো, আনন্দবাজার পত্রিকা।
২৮ অক্টো : কেউ যুবক, কেউ বৃদ্ধ, কারও শরীর সুঠাম, কেউ খঞ্জ। কারও হাতে তরবারি বা মাস্কেটের মতো উনবিংশ শতাব্দীর অস্ত্র, কারও হাতে বেশ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। কিছু অবসরপ্রাপ্ত ফৌজিও রয়েছে। দু-এক জনের কাছে হাল্কা মেশিনগানও দেখা যাচ্ছে। সংখ্যায় তারা কত হবে? কোনও হিসেব নেই। হাজার হাজার। এর বেশি বলা বোধহয় সম্ভব নয়। কারণ কে গুনবে? এরা বেশির ভাগই পাকিস্তানি এবং উপজাতি। কিছু আফগানও রয়েছে। এরা ভিন্ন ভিন্ন কারণে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে এসেছিল। এখন সবাই আবার আফগানিস্তানে ঢুকতে চায়। তালিবানদের পাশে দাঁড়িয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়তে চায়।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের শহর বাজায়ুরে এরা জড়ো হয়েছে। কাছেই আফগানিস্তান সীমান্ত। এরা সীমান্ত পেরিয়ে রণাঙ্গণে যেতে মরিয়া। তেহরিক নিফাজ ই-শরিয়ত-মহম্মদি (টি এন এস এম) এই জনতাকে জড়ো করেছে। সংগঠনের এক মুখপাত্র বলেছেন, সীমান্তে বাধা দেওয়া হলে ধর্মযুদ্ধ সেখান থেকেই শুরু হবে।–রয়টার, পি টি আই।
আরও একটা প্রশ্ন হচ্ছে–তালিবানের কর্মকান্ড হত্যা, রাহাজানি, লুটপাট, নারী ধর্ষণ, মেয়েদের থুতু ফেলতে গেলেও বোরখার সামনের পর্দা তোলা নিষেধ, ভুলবশত তুললেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে ময়দানে বসিয়ে গুলি করে মারা, বর্বরতা, এই সমস্ত কী প্রকৃত ইসলামের প্রবৃত্তি? যদি তাই হয় তবে এক কথায় বলতে আমারও কোন দ্বিধা নেই যে সেই ইসলাম তবে ভয়ঙ্কর বর্বরজনিত এক ভাইরাস। যে ভাইরাস নিমূল করা একমাত্র কর্তব্য।
তাই যদি না হবে তবে সমস্তু প্রকৃত সুন্দর ইসলামরা ওই বর্বর ইসলামের বেশধারি তালিবানদের সহায়তা করার প্রয়াস থেকে বিরত হতেন। লাদেনকে অন্য কোন ইসলামি রাষ্ট্রে তুলে দেবে তালিবানরা তবে আমেরিকার হাতে দেবে না, কারণ লাদেন আফগানে আশ্রয় নিয়েছে বলে এবং লাদেনের বিচার যখন হবে তখন অন্ততঃ একজন মুসলমান আইনজ্ঞ থাকতে হবে। আরও তালিবানের দাবি যে তালিবানদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
লাদেনকে যারা ইসলামি রাষ্ট্রে তুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে, আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে, একদিন তারাই আর একজন আশ্রয়প্রার্থীকে ফাঁসিতে ঝোলাতে কিন্তু বোধ করেনি। ডাঃ নজিবুল্লা কি আশ্রয়প্রার্থী হয়ে বাস করছিলেন না? যারা আশ্রয় দেয় তারা। আশ্রয়দাতা, যারা নেয় তারাই প্রার্থী। ডাঃ নজিবুল্লাকে হত্যা করে আশ্রয়প্রার্থীকে হত্যা করেনি কী? তখন কেন ডাঃ নজিবুল্লাকে কোন ইসলাম রাষ্ট্রে তুলে দেয়নি তালিবান? সে কি ইসলামকে অবমাননা করা নয়? তারাই আবার প্রকৃত ইসলাম বলে নিজের দাবি করে?
কোন অভিপ্রায়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে চায় মোল্লা ওমর? সারা বিশ্বকে কী আফগানিস্তান বানাতে চায়? লাদেন? লাদেন যেভাবে মোল্লা ওমর ও সমস্ত দেশের মানুষকে কোরাণের নেশায় মত্ত করে তুলে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিল, সমস্ত বিশ্বের মানুষকেও কি তাই করতে চাইছে?
লাদেনের যদি বিচার হত, আর কোন মুসলমান আইনজ্ঞ যদি আইনের ফাঁক দিয়ে লাদেনকে ছেড়ে দেওয়ার বাসনা প্রকাশ করত তবে আর একটা পেন্টাগন হয়ে যেত সেই আদালত এবং সেক্ষেত্রে হয়ত, মূতা সুস্মিতার নামটাই শিরোনামে স্থান করে। নিত। অদ্ভুত সমস্তু বিশ্বের নারীরা ওই বর্বর গাষ্ঠির ইসলামিক ফতেয়া থেকে রেহাই পেত। তবে এখনও জানি না, ভবিষ্যৎ কি বলছে বা হবে। কারণ সর্বত্রই মেয়েরাই শিকার হয়।
বার বার লাদেন ও মোল্লা ওমর এই যুদ্ধটাকে ধর্মযুদ্ধ বলে কি কারণে আখ্যা দিয়ে চাইছে তা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বিচার করে দেখা উচিত।
একদিকে তালিবান ও লাদেন বার বার জনসমক্ষে বলছে, আফগানিস্তানের ওপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার করে চলেছে আমেরিকা, আসলে আমেরিকাই অপরাধীর কারখানা। আফগানের সাধারণ মানুষগুলো মারা যাচ্ছে।
কত দরদ লাদেনের আফগানিস্তানের জনসাধারণের জন্যে। আমেরিকাকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলছে, কিন্তু নিজেরা আফগান ছাড়বে না। ওখানে আস্তানা গেড়ে বসে থেকেই লাদেন তার বিধ্বংসী কর্মকান্ড চালাবে। আফগান জনগণ ছাড়া এমন নেশায় কে মত্ত হবে? এমন সহজ সরল মানুষ পাবে কোথায়? যদি লাদেন তালিবান মোল্লা ওমর এবং সমস্ত বিশ্বের সবাই মনে করে এই সন্ত্রাস দমনের যুদ্ধ ইসলাম বিরোধী যুদ্ধ, তবে তাদের স্পষ্ট করে আমি বলছি এই যুদ্ধ কখনই ইসলামী বিরোধী হবে
কারণ ইসলামরা যে যুদ্ধ করে এবং সন্ত্রাসবাদী কর্ম করে স্বর্গে যাওয়ার পথ তৈরি করে, এবং বলে শহীদ হলো, তা যদি কাফের বিরোধী যুদ্ধের নাম না হয় তবে এই যুদ্ধ কেন হবে ইসলাম বিরোধী? স্বর্গে যাওয়ার লোভ কি কেবল ইসলামের? কাফেরের নেই? এই যুদ্ধ সাম্প্রদায়িকতার এবং প্রতিক্রিয়াশীল সন্ত্রাসবাদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আমার ব্যক্তিগত ধারণায় বলতে পারি, এই যুদ্ধ কোন মতেই থামান উচিত নয়। সবাই যে মন্তব্য করছেন যে তালিবানদের হঠানো যাবে না, লাদেনকে ধরা যাবে না। তারা কি তবে বলতে চান যে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে একমাত্র শক্তিশালি ওই লাদেন? আরও একটা বিষয়ে আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন যে সকলের ধারণা রমজান মাস শান্তির মাস, সুতরাং যুদ্ধ বন্ধ রাখা প্রয়োজন বলে সবাই মনে করছেন। কিন্তু তালিবানরা দ্বিতীয়বার যুদ্ধ করে শবেবরাতের দিন ১৯৯৩ সালে। এটা খুব ভালো করেই আমার মনে আছে কারণ এই শবেবরাতের দিন নিজের বাড়িতেই নাকি থাকতে হয়, ওই দিন হজরত মহম্মদ নাকি ছদ্মবেশে প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান এবং বর দান করেন। একটা আগুনের ফুলকি হয়েও ঘরে প্রবেশ করে যদি কেউ সেই আগুনের ফুলকি থেকে ভয় পায়, তবে তার ঘরে আগুন লেগে যায়। আমি ১৯৯৩ সালের শবেবরাতের পাঁচ ছ দিন আগে গিয়েছিলাম আমার ননদ গুনচার বাড়িতে। ফেরার কথা হয়েছিল শবেবরাতের দিন সকালবেলা। কিন্তু ঠিক তার আগের দিন আমার নন্দাই এসে জানাল, গড়দেশের উত্তরের দিকে প্রচণ্ড যুদ্ধ হচ্ছে তালিবানের সঙ্গে গুলবদীন হেকমতিয়ারের। গুনচা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল–লা ইলাহা ইল্লালা মোহাম্মাদুর রসুল-আল্লা, অয়লি? অয়লি দা কাফেরান দাগাসা কে?
অর্থাৎ, কেন ওই কাফেরগুলো এমন করল?
নান শরকদর দা, দে রোজাকে বুম খালাক খোশালায় নে প্রিয়দে?
মানে–আজ শবেবরাতের, আজকের দিনেও মানুষদের খুশিতে থাকতে দেবেনা? ইসবি ইসলামি অফ আফগানিস্তু পার্টির বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করল তালিবান। কারণ গুলবদীন ওই তালিবানদের মেনে নিতে চায়নি এবং মোল্লা ওমরের সঙ্গে কোন সন্ধি করতে রাজি হয়নি বলেই বিদ্রোহ। যুদ্ধ। গুলবদীনকে গ্রেফতারির পরোয়ানা জারি করা হল। আবার শুরু হল নির্যাতন, শাসন, শোষণ, হত্যা। ফতোয়া জারি হল–অবিলম্বে সমস্ত অস্ত্র সমেত যেন গুলবদীন আত্মসমর্পণ করে, নতুবা এই যুদ্ধ চলতেই থাকবে। গুলবদীন আত্মসমর্পণ করতে কোনমতেই রাজি নয়। দীর্ঘ বছর ধরে সে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছে আর উড়ো লোকের কাছে সমর্পণ। হোক যুদ্ধ। যুদ্ধের কৌশলও তার অজানা নয়। এরপর ক্রমাগত যুদ্ধ চলতে লাগল। সর্বত্র রকেটের আগুন ঝলসে উঠতে লাগল। আমি আটকা পড়ে গেলাম গুনচার বাড়িতে। রাতের বেলার আকাশ আগুনের ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে উঠতে লাগল। গুনচার বাড়ির দেওয়াল গুলি থেকে অব্যাহতি পেল না। সমস্ত রাত আমরা জড়োসড়ো হয়ে চারিদিকে গোল করে আটার বস্তা রেখে তার মাঝখানে শুয়ে থাকি। এমনকি বাথরুমে যাওয়া হয় না। আমার মেজো জা সাদাগর দিদির বাড়ি গড়দেশ অঞ্চলে, সেই দিদির বড় ছেলের গায়ে এসে লেগেছিল গুলি। বুকের মাঝখান দিয়ে গুলি চলে গেছে। ব্যাপকভাবে যুদ্ধরত মানুষ যেমন মরতে লাগল তেমনিই জনগণ। দুই পক্ষের লোকই তো এই আফগানিস্তানের মানুষ? দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ। যাদের জোর করে মোল্লা ওমর ও তালিবান যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছে। যুদ্ধে না গেলেও মেরে ফেলবে আর যুদ্ধে গেলেও আছে একটাই পাওনা– মৃত্যু!
নরপিশাচ, হত্যাকারী তালিবান একের পর এক মানুষকে জ্যান্ত মাটির তলায় পুঁতে দিয়ে মারতে লাগল, নারী ও শিশুরাও বাদ গেল না। যারা শিশুদের মাটিতে পুঁতে বা আছাড় মেরে মেরে থেঁতলে মারে তাদের যে কি বলব ভেবে পাই না-নরখাদক? ন্যাক্কারজনক হত্যাকারী? বর্বর? নাকি জংলি জানোয়ার? গুলবদীন অনুকূল মুহূর্তের অপেক্ষায় সময় অতিবাহিত করতে লাগল।ইতিমধ্যে এসে গেল রোজা। শবেবরাতের পনের থেকে কুড়ি দিনের মধ্যেই শুরু হয় রোজা। এই রোজাতেও তালিবান বর্বরদের যে কোন অনুশোচনা বা মানুষের জন্যে কোন দরদ হলো বলে মনে ছিল না–যুদ্ধ। বিরতির কোন লক্ষণ প্রকাশ পেল না। বরং পরম বিক্রমে রোজার সময়ে চলতে লাগল যুদ্ধ। একদিকে যুদ্ধ, অপরদিকে রোজা অন্যদিকে শীত, খাদ্য অমিল। আজকের কঠিন অবস্থা যেমন সারা বিশ্বকে জাগিয়ে তুলেছে, ভাবিয়ে তুলেছে, তার থেকে কোন অংশে কি কম ছিল সেই সেদিনের জনসাধারণের দুঃখ, দুর্দশা, দুর্ভিক্ষ, অসহায়তা? এবং ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ? যে কোন প্রকারে তালিবান, ওমর, লাদেন ওই কাবুলের মসনদটাকে দখল করতে চেয়েছিল। মসনদ দখল করতে না পারলে সমগ্র বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী কর্ম করবে কী করে? ইসলামধর্মী পৃথিবী করতে হলে চাই একটা মসনদ।
তালিবানরা যদি নিজেরা রমজান মাসে, রোজা রেখে যুদ্ধ করতে পারে তবে অন্য কেউ কেন করতে পারবে না? রোজা চলছে বলে তারা তো অব্যাহতি দেয়নি? তবে কেন আজ সবরকম শিথিলতার প্রশ্ন উঠছে? আমার মনে হয়, যারা এই রমজান মাসের অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধ থামাবার জন্যে বলছে তারা পরোক্ষে চাইছে তালিবানদের সমর্থন করতে। কারণ এই যুদ্ধ একবার যদি কোনক্রমে বন্ধ রাখা যায় কিছুদিনের জন্যে তবে ওই প্রতিক্রিয়াশীল তালিবানের পালিয়ে যাওয়া এবং লাদেন ও মোল্লা ওমরকে অন্যত্র সরাবার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে। হজরত মহম্মদ কী লোজা বলে কোন কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ রেখেছিলেন? তবে কাফেররা কেন যুদ্ধ বন্ধ রাখবে? ইসলামরা যদি কাফেরদের জন্যে না ভাবে তবে কাফেররা কেন ভাববে? যারা ওই সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষ নিয়ে বলছেন তাদের সবাইকে ওই তালিবানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। যদি ভারতেও তালিবান সমর্থক থেকে থাকে তবে তাদেরও একটা মাস অন্ততঃ তালিবানের সঙ্গে কাটিয়ে আসতে বলা হোক। তবেই বুঝতে পারবেন যে এই সন্ত্রাস দমনে যুদ্ধ কত প্রয়োজন। ওদের হাতে তিল তিল করে মরার চাইতে এই যুদ্ধে মরা ভালো। কথায় বলে যার বিয়ে তার সাড়া নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই। আফগানিস্তানের দুর্দশায় কবলিত মানুষগুলো কিন্তু কোন কিছু উচ্চবাচ্য করছে না। বরং তারা চাইছে একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক, তালিবানদের সরিয়ে দিক। মাজার হয়ে যাওয়া বে-ঘর মানুষগুলো যেন শান্তি নিয়ে ঘরে ফেরে। এই যুদ্ধ যদি বন্ধ থাকে তাবে ঘরছাড়া মানুষগুলোকে তো বাইরেই থাকতে হবে। তালিবানরা তো সুখেই থাকবে। যদিও আমেরিকা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে যুদ্ধবিরতির কোন প্রশ্নই ওঠে না। লাদেনের ইচ্ছাকে কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। এবার লাদেনের এই ধর্মযুদ্ধ প্রচারের পরিপ্রেক্ষিতেও কোন ইসলামি দেশ কিন্তু সাহায্য করতে উদ্যত হয়নি। কারণ কেউ নিশ্চয়ই এমন বোকার মতন কাজ করবে না যাতে করে এমন বর্বর সন্ত্রাসবাদীরা জীবিত থাকতে পারে। কারণ এরা জীবিত থাকলে পৃথিবীর কোন মানুষ। সুস্থ ও সামাজিক জীবন যাপন করতে সক্ষম হবে না। এরা জীবিত থাকলে সমস্ত বিশ্বের মানুষদের দূষিত করে তুলবে এবং যারা আজও মনে করে তালিবান ও লাদেন কিংবা মোল্লা ওমর হয়তো বা ঠিক করছে ইসলামকে রক্ষা করার জন্যে, আমি বলব তারা নিজেরা ওদের মতো সন্ত্রাসবাদী। আফগানিস্তানের মাটিতে যে সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি হয়েছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আজও গায়ের সমস্ত লোমকূপের গোড়ায় শিহরণ জাগে। নিজের দেশের কিংবা ঘরের সমস্ত জোয়ান ছেলেগুলোকে যদি আফগান মানুষগুলোর মতো করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিত ওই তালিবান, তখন বুঝবেন যে দরদ ও কষ্ট কাকে বলে? আমি প্রত্যক্ষ করেছি সেই দরদ। মায়ের হাহাকার, স্ত্রীর বুকফাটা আর্তনাদ। তাই আবার বলছি যে এমন করে রোজ রোজ মরার থেকে একবারে। মরাই ভালো। যখন মোল্লা ওমর সমস্ত বাড়ির জোয়ান ছেলেগুলোকে কখনও টাকার লোভ দেখিয়ে, কখনও ধর্মের দোহাই দিয়ে, আবার কখনও বা জোর করে তার দলে টেনে নিতে লাগল, তখন তার মধ্যে লাদেন কিন্তু ছিল না। মোল্লা ওমর যে সংগঠন তৈরি করেছিল সেই সংগঠনের আসল উদ্দেশ্য ছিল দেশকে শত্রুর কবল থেকে বাঁচাবার উদ্দেশ্য। রাব্বানী এবং মাসুদ ও দোস্তমদের নিয়ে যে সরকার গঠন হয়েছিল সেই সরকারকে মোল্লা স্বীকার করত না।
মোল্লা ওমরের হাসিমুখ ইস্পাতের মতো কঠিন হলো
১৯৯১ সাল পর্যন্ত যেখানে কোন মানুষ মানুষকে ভয় করত না, মতের অমিল হলেই গুলি করে হত্যা করা হত, সেই মানুষগুলোও ওমরের নামে ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। আগে যেখানে একটা মেয়েকে এমনকি শ্বশুরের শয্যাসঙ্গী হতে হত, সেই মেয়েরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে লাগল। কিন্তু ১৯৯৩ সালে হঠাৎ সব উল্টো হতে লাগল। যে ওমর দেশের মধ্যে কোকেন, আফিম ও তামাকের ব্যবসা বন্ধ করে দিল সেই ওমর ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে নিজেই ট্রাক ভর্তি করে সমস্ত রকম নেশার বস্তু বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে লাগল। যে ওমর অবসর সময় পেলেই বারান্দায়। বসে চা খেতে ও রেডিওর গান শুনত, সেই ওমর ৯৩-তে সমস্ত গ্রামে-গ্রামে রেডিও নিষেধ করে দিল। মোল্লা ওমরের ভয়ে সমস্ত গ্রামে চুরি, ডাকাতি, চোরাচালান বন্ধ হয়েছিল ১৯৯২-তে, ১৯৯৪-তে সেই কাজই আবার চালু করল মোল্লা ওমরের নিজের দলেরই ছেলেরা। আমাদের গ্রামে যারা মসজিদ ঝাঁট দিয়ে বাড়ি থেকে রুটি নিয়ে উদর পূরণ করত তারাও টয়টো গাড়ি, মোটর সাইকেল, জিপের মালিক হয়ে বসল। সে কি হিড়িক পড়ে গেল গ্রামের সব ছেলে, বুড়োদের চারশিয়াতে যাওয়ার। ওখানেই হয় সব লুটপাট। সারারাত ধরে চলে লুটপাট।
১৯৯৩ সালে কেউ কোথাও যেতে সাহস পেত না। কোন রকম যদি সন্দেহ হয় তো গুলি করে মেরে ফেলারই হুকুম দিয়ে রেখেছিল মোল্লা। সারানা, পাতানা, শ্ৰেকালা, চারদা, মদখেল, খোজোখেল, শালো, আরও উত্তর পুবে আছে আন্দার ও সমস্ত পাহাড়ি এলাকা এই সমস্ত গ্রামের ভার পড়েছিল মোল্লা আবদুলের ও মোল্লামোত্তাকির হাতে। এদের ওপরেও ছড়ি ঘোরাতো রহমান ও আবদুল মালিকের হাত। কারও যদি কোয়াজদা কারে, অর্থাৎ বিয়ের ঠিক হয়ে গেলে এই সব তালিবান নেতাদের টাকা দিতে হত। কারও যদি ছেলে হত তবে তালিবানদের দুম্বা ভেট দিতে হত। পাতালানা মক্তাব বাজারে আরবের লোকের সাহায্যে একটা হাসপাতাল গড়ে উঠল, যেখানে সমস্ত আরবের ডাক্তাররাই থাকত এবং এক্সপেরিমেন্ট চালাত দুর্দশায় কবলিত মানুষগুলোর ওপর। যে সব আফগানরা অল্পবিস্তর বই পড়ে ট্রিটমেন্ট করত কেবল ওষুধের দ্বারা, তাদের বহিষ্কৃত করা হল। তালিবানের অধীনে চলে গেল সমস্ত আফগান জনগণের আশি ভাগ মানুষ। এ যাবৎকাল যে দুর্দশার মধ্যে তারা সময় অতিবাহিত করেছে সেই দুর্দিনের সময়গুলোকে কেটে হেঁটে আফগানরা বাদ দিতে চায়।
নিজেদের দেশ স্বাধীন করার অভিপ্রায়ে যারা নিজেদের প্রাণের মায়া না করে তালিবানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আজ তারা কেবল সন্ত্রাসবাদীর মর্যাদায় ভূষিত হল। সমগ্র পৃথিবীতে তাদের পদবী হল তারা আতঙ্কবাদী। তারা বাধ্য হয়ে সন্ত্রাসবাদীর চরম পর্যায়ে চলে গেল। একদা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামী হয়ে এগিয়েছে তারাই পরবর্তী সময়ে বীভৎস জঘণ্য সন্ত্রাসবাদী হয়ে গেল। তারা নিজেদের অজান্তেই কখন কিভাবে তা হয়ে গেল নিজেরাই বুঝতে পারেনি। আর যখন বুঝতে পারল তখন বেরিয়ে আসার আর কোন পথ খোলা নেই। যারা সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সেই সব মানুষরা যারা তালিবানে যোগ দিয়েছিল। নানা রকম জাতের মধ্যে বিভক্ত সমস্ত পার্টিরা নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করল। পুস্করা পুস্তুন নেতাকে চায়, পার্সিয়ানরা চায় তাদের লোক, উজবেকরা চায় তাদের লোক। গজনীর পূর্ব উত্তর ঘেঁষে শেলগড় তখন আজরাং মোল্লার অধীনে। সে তালিবানের একচেটিয়া নায়কত্ব মেনে নিতে চায়নি, তখন তালিবান দুদিনের যুদ্ধ চালিয়ে শেলগড় দখল করে। তালিবানের যত জয় হতে লাগল, ততই সমস্তরকম ফতোয়া জারি করতে লাগল। দলে দলে সমস্ত তালিবান ঘুরে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে, তাদের বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য কেউ করছে কিনা তা দেখার জন্যে আলাদা একটা বাহিনী তৈরি করা হল। বাবো চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলেদের টেনে নিয়ে গিয়ে জঙ্গি শিক্ষা দিতে লাগল তালিবানরা। বৃদ্ধরা দলে দলে তালিবানসর্দার মোল্লা ওমরের কাছে গিয়ে অনুনয় করল, জুলুম করতে নিষেধ করল–মেয়েদের গুলি করে মেরে কি লাভ? যে দেশে মেয়েদের প্রচণ্ড ইজ্জত দেওয়া হয় সেই দেশে কেন হচ্ছে নারী ধর্ষণ? তোমরা এসব বন্ধ কর।তালিবানের অত্যাচার যেমন চলতে লাগল গ্রামে গঞ্জে আর শহরে উত্তরের জোটের জুলুম।
গ্রামের কোন মানুষ যেতে পারে না শহরে, বিশেষ করে যাদের দাড়ি আছে। তেমন লোক দেখলেই রাব্বানী সরকারের লোক কোন প্রশ্ন ছাড়াই গুলি করে মেরে দেবে। দাড়ি না রাখলে আবার তালিবানরা মেরে দেবে। সেই ১৯৮৯ সালেও এমনই ছিল। এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে যারা এল তারা বেশি করে বন্ধন করল। যারা ওমরের কাছে নালিশ জানাতে এল তাদের মোল্লা ওমর বলল–তালিবানদের আমি তৈরি করেছি ঠিক কিন্তু এখন ওরা আমার কথা শোনে না। বেশি বলতে গেলে। ওরা এখন আমাকেই মেরে দেবে।
কঠোর, কঠিন, নরপিশাচ, নৃশংস মোল্লা ওমর বাড়িতে এবং নিজের মানুষদের কাছে একদম ছিল অনারকম। বিবিকে ভীষণ ভালোবাসত, মেয়েরা ছিল তার প্রাণ। ছেলেদের কেবল কোরাণ শিক্ষা দিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানে। জাজিরা গ্রামে তার অনেক জমিজমা থাকলেও নগদ পয়সার জোর তার ছিল না। তার এক দাদা সওদাগর ছিল। বাড়ির সবার অবস্থা মোটেও সুবিধাজনক ছিল না। জাজিরা গ্রামের সবাই কিন্তু মোল্লা ওমরকে খুবমানত এবং বিশ্বাস করত। অর্থাৎ সেখানেও ১৯৯৫তে যখন গোলাবর্ষণ শুরু হল তালিবানের সহায়তায় তখন মরিয়া হয়ে আত্মরক্ষা করতে ছোটাছুটি করতে লাগল মেয়েরা বৌ-রা, বাচ্চারা, নিরীহ মানুষরা দোস্তমের গ্রুপের লোক, মাসুদের গ্রুপের নোক, গুলবদিনের লোক ঘর বাড়ি ছেড়ে সব নিরাপদ জায়গায় পালাতে লাগল। দুর্ভিক্ষ, দুর্দশায় ঠেলে দিতে পারে মোল্লা ও তার নব সংগঠক ছাত্র তালিবানরা, কিন্তু ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দায়ভার গ্রহণ করতে তারা রাজি নয়। আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে তালিবানরা, তালিবানের দলে এসেছে সমস্ত নতুন নতুন পনেরো থেকে তিরিশ বছর বয়সি ছেলেরা। কঠিন জঙ্গি শিক্ষা নিতে গিয়েও অনেক ছেলেরা মরে যেতে লাগল। তারা তাদের অজান্তে ডুবে যেতে লাগল ভয়ঙ্কর এক
এই সমস্ত কিছু দেখতে দেখতে আমার শরীর অবসন্ন, আমার সমস্ত মন জুড়ে এক অসম্ভব ক্লান্তি, তবুও আমি থেমে থাকার মতো মেয়ে নই। তালিবানরা আমার ওপর অত্যাচার করে যাওয়ার পরে আমার জেদ আরও বেড়ে যেতে থাকে। আমার বাড়িতে পরম উৎসাহের সঙ্গে যারা আগে আসত তারা মরার ভয়ে আর আসে না। আমিও দমে যাওয়ার মেয়ে নই, চলে যেতাম সবার বাড়িতেই। তাদের বাড়ির লোক আমার কথা শুনতে চাইতো না। আমিও নাছোড়বান্দা, জোর করে সব কথা শুনতে বাধ্য করতাম। তালিবান যে আফগানিস্তানের হিতাকাঙ্ক্ষী নয় তাও বোঝাতে চাইলাম এবং বোঝালাম। মোল্লা ওমর চাইত, আফগানের সমস্ত মানুষ যেন কেবল কোরাণ নিয়ে পড়ে থাকে, এবং কোরাণকে অনুসরণ করে। আমি ভাবতাম মোল্লা ওমর বার বার কেন এমন করে কোরাণের লেখাপড়ায় জোর দিতে চাইছে? কেন এত জোর করা? তালিবানেরা বলে বেড়াচ্ছে কোরাণের প্রতিটি বাণী অনুসারে চলতে হবে, অন্যথায় মরতে হবে। এই কথাটা কেবল যে তালিবানের কথা তা নয়, এই কথাটা কোরাণের কথা। যেমন–সুরা-৮ আয়াত-১২১৫ আল্লাহ ও তাঁর রসুল মহম্মদকে যারা অবিশ্বাস করে, তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব। এদের স্কন্ধে ও সর্বাঙ্গে আঘাত কর। এদের জন্যে রয়েছে নরক যন্ত্রণা।
সুরা-২, আয়াত-১৯৩, মূর্তিপূজক কাফেরদের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে–যতদিন না কাফের ধ্বংস করে, সারা পৃথিবীতে খোদাহী ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়।
সুরা-৯, আয়াত-৫, নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে অবিশ্বাসীদের জন্যে প্রত্যেক ঘাটিতে ওৎ পেতে থাকবে। যেখানে পাবে তাদের অবরোধ করবে। বধ করবে। বন্দী করবে। অবিশ্বাসী মানে যারা আল্লা ও রসুলকে মানে না, অর্থাৎ কাফের।
সুরা-৪৮, আয়াত-২৮-২৯, আল্লাহ সত্যধর্মসহ মহম্মদকে প্রেরণ করেছেন অন্য সকল ধর্মের উপর এসে জয়যুক্ত করার জন্যে। মহম্মদের সহচরগণ সত্য প্রত্যাখ্যান কারীদের প্রতি কঠোর।
সুরা-৮, আয়াত-৬৫,হে নবী! বিশ্বাসীদের সংগ্রামের জন্যে উদ্বুদ্ধ কর তোমাদের মধ্যে ১০০ জন ধৈর্যশীল থাকলে ১০০০ অবিশ্বাসীর উপর বিজয়ী হবে।
এই সমস্ত কথা ওমর ও তালিবানেরা মসজিদে বসে সমস্ত মানুষকে ডেকে নিয়ে। কোরাণ থেকে পড়ে পড়ে শোনায়। এই সমস্ত কথা দিনের পর দিন শুনতে শুনতে আফগানের নিরীহ মানুষগুলি কেমন যেন কঠোর ও কঠিন হয়ে উঠতে থাকে। যারা আমাকে মেহমান হিসাবে পেতে উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকত, তারাই পরে আমি গেলে সেভাবে আনন্দিত হত না। কারণ আমি ছিলাম কাফের ও পুতুল পূজারি এবং অবিশ্বাসী।
মৃত মানুষ নিয়ে রাজনীতি
একদিন সকালে, সেদিন দ্রানাই চাচার মা মুশাকি আদি মারা গেছেন। এবার তার লাশ নিয়ে যেতে হবে শীলগর তার বাপের বাড়িতে। সেখানেই তাকে কবর দিতে হবে।এটাই রেওয়াজ আফগানিস্তানের। টাকার বিনিময়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার পর বাবা মায়ের মেয়ের প্রতি আর কোন অধিকার থাকে না, শ্বশুরবাড়ির লোক যদি মনে করে বাপের বাড়ির লোকের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবে না তাও স্বীকৃত। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার তা হল, মেয়ে জীবিতাবস্থায় তার প্রতি কোন অধিকার বাপের বাড়ির লোকের না থাকলেও মারা যাওয়ার পর সেই মৃত লাশের প্রতি সম্পূর্ণ অধিকার বাপের বাড়ির লোকেরা এবং বাপের বাড়ির কবর খানায় তার কবর হবে। মেয়ের বিয়ের পর যদি একটু দূরে বিয়ে হয় তবে বাপের বাড়ির লোক বলে-মা লোর মুশাফার দা অর্থাৎ-আমার মেয়ে পরদেশে। আর মেয়েটার মরে যাওয়ার পর যখন তাকে বাপের বাড়ির কবরে কবর দেওয়া হয় তখন শ্বশুরবাড়ির লোক বলে-মুগ গোর মুশাফার দা অর্থাৎ আমাদের বৌ পরদেশে। ওখানে মেয়েদের আলাদা কোন সত্তা নেই। কেবল এ বাড়ি এবং ওবাড়ির বলা ও কওয়ার মধ্যে তার সমস্ত রকম সত্তা। যাই হোক, সেই মুশোকি আদিকে নিয়ে যাবে বাপের বাড়ি।
হঠাৎ ওমর তালিবানদের সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির, বলল–না, সারানার বৌকে সারানাতেই কবর দেবে। জীবিতাবস্থায় সে মুশাফার হয়ে কাটিয়েছে, মারা যাওয়ার পর তাকে কেন মুশাফার করবে? এটাই তার আসল বাড়ি। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িটাই বাড়ি হয়ে যায়। মোল্লা ওমরের যুক্তিকে কেউ উপেক্ষা করতে পারল না। তখন সবাই চলে গেল মুশোকি আদিকে পাতানায় কবর দিতে। পাতানার যে কবরস্থান আছে তাতেই দ্রানাই চাচা ও আমার শ্বশুরবাড়ির লোকের জন্যেও কবর করার জায়গা কেনা আছে। ওখানে কবরের জন্যে জায়গা কিনে রাখতে হয়। এবার ওমর ও তালিবানেরা গিয়ে। বসল দ্রানাই চাচার মেহমান খানায়। ওমরের কথা সবাই বিশ্বাস করে নিলেও আমার ঠিক যেন বিশ্বাস হল না। মনে মনে ভাবতে লাগলাম শীলগরে মুশোকি আদিকে নিয়ে যেতে না দেওয়ার কারণটা কি হতে পারে? কারণটা খুঁজতে খুঁজতে সময় চলে যেতে লাগল। সেদিন পাঁচটা দুম্বা কাটা হয়েছে। এবার বিশাল বিশাল পিতলের হাঁড়ি নিয়ে এসে হাজির হল কায়িম। একাধারে সে নাপিত কাম রাঁধুনি। উঠোনের মাঝখানে পাথর দিয়ে একটা উনোন বানানো হল। কায়িম তাতে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বেলে সুরুয়া রান্নার জন্যে হাঁড়ি চড়াল। অনেক মেয়েরা বসে পেঁয়াজ ছাড়িয়ে কাটতে লাগল। আমি বারান্দার একটা কোণে বসে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টায় রত।
শীলগর গজনীর উত্তর পূর্ব ঘেঁষা শহর। একেবারে উরগুণের গায়ে। উরগুণ, মে শহর দখল পাওয়ার পর তালিবানরা তাদের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে সমস্ত শহরে, মাদালি তাদের কোন বাধা দেয়নি। শীলগরও নিশ্চয়ই দখল করেছে? না আর ভাবতে পারছি না। আবার ভাবি, ভেবে আমার দরকারটাই বা কি। কোন ফয়সালা তো করতে পারব না। হঠাৎ মনে পড়ল ওমর মামারতো মেহমান ঘরে বসে আছে, একবার গেলে কেমন হয়? আমার গতিবিধির ওপর তালিবানেরা অনেক বাধা নিষেধ আনার চেষ্টা করেছে কিন্তু পেরে ওঠেনি, আমি ওদের কোন কথাকে তোয়াক্কা না করে ওদেরই নাকের ডগার ওপর চলাফেরা করি। অহেতুকও ঘুরে বেড়াই, অন্যের বাগানেগিয়ে আপেল, শোও চুরি করে এনে সব বাচ্চাদের দিই। তালিবানরা দেখে। প্রতিবাদ করে, আমি তা নস্যাৎ করে দিই।
আমি গেলাম মেহমান ঘরে। সেখানে বসেছিল অনেকেই আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন। মাদালাম চাচা বলল–সায়কে সাহেব কামাল? স্তারামাইসে, খাইয়ে? জোড়াইয়ে?
অর্থাৎ, কি সাহেবকামাল, হ্যালো, ভালো আছো, সুস্থ?
আমিও তার প্রতি উত্তর দিলাম। তারপর লপুচাচা বলল–ঈলিয়ে চিসতে বাগালাই? ইলিয়ে প্রদিই খালাক কিয়ানাস্তাল।
অর্থাৎ, এখানে কেন এসেছো? এখানে বাইরের লোক বসে আছে।
মাদালাম ও দ্রানাই চাচা বলল,–মা কাওয়া, দা মুশাফার দা।
মানে–-থাক, কিছু বোলো না, পরদেশি যে।
আমি ভেতরে গিয়ে বসলাম। তারপর এ কথা সেকথা চলছে, হঠাৎ আমি ওমর মামাকে বললাম,–মামা, শ্রেফ সারানায় বসে কোরাণ পড়লে হবে? অন্য জায়গাতেও মসজিদে গিয়ে তাদের শেখাও? মমদখৈল, শলো, বন, শেলগর।
যাই তো, শীলগরে এখনও যাইনি, ওখানে ওই শয়তান আজরাত বলে যে মৌলবীটা আছে বেটা মহা বজ্জাত। মসজিদের ঘর ছাড়বে না বলেছে, দেখি কদিন। তারপর একটা ব্যবস্থা করব। মোল্লা ওমর একটু রাগতঃস্বরেই বলল কথাগুলো।
মনে মনে আমি উল্লসিত হয়ে উঠলাম। কারণ আমি উদঘাটন করতে পেরেছি। এবার রাগ হল এই সস্তা রাজনীতির খেলা দেখে।মৃত মানুষকে নিয়েও চলে রাজনীতি? আমি ওমর মামার উদ্দেশ্যে বললাম-মামা, তুমি যে সমস্ত আল্লার বাণী শুনিয়ে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলছ তা ঠিক নয়। তোমার ইসলাম ধর্মের বদনাম হবে।
যুদ্ধ কোনোদিন কি শান্তি আনতে পারে? ইসলাম যদি শাস্তিরই ধর্ম হয় তবে কেন তা জোর করে, আঘাত করে, যুদ্ধ করে, প্রসার ঘটাবার বিবরণ দেওয়া আছে কোরাণে? কেন অন্য ধর্মের মানুষকে মারার কথা তোমরা প্রচার করছ?
আমার কথা শুনে ওমর মামা রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল- দ্রানাই এই কাফেরকে বলে দেবে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আর একটিও যদি কথা বলে তবে ওকে মেরে ফেলব। আমি অবাক হয়ে গেলাম, সেই মূর্তি দেখে ভয়ও পেলাম। ইসলাম ধর্মকে প্রসার ঘটানো এবং রক্ষা করার জন্যেই নাকি মোল্লা ওমর তার জীবনের সমস্ত কিছু উৎসর্গ করতে রাজি। পাড়ায় পাড়ায় ওমর বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছে যে- আমাদের নবী হজরত মহম্মদ যে কাজ অসম্পূর্ণ করে জন্নাতে চলে গেছেন সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করা সমস্ত ইসলাম ধর্মের মানুষের একমাত্র কর্তব্য। আর সেই কর্তব্য করতে গিয়ে শহীদ হলে যেন তার পরিবারের লোক কোন দুঃখ না করে, কারণ এই নকল দুনিয়া ইসলামের জন্যে নয়, এই দুনিয়া কেবল কাফেরদের জন্যে, শহীদ হয়ে জন্নাতে গেলে পাবে সুখ, শান্তি। আমরা খুব শীঘ্র একজন পীরের দেখা পাব। সে বার্তা আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। আমরা সবাই সেই পীরের কথা মতোই চলব। এবং সেই হবে আগামীদিনের ইসলাম ধর্মের উদ্ধারকর্তা।
আফগানিস্তানের রাজনীতি কোন নীতির ধার ধারে না। কেবলই দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠিদ্বন্দ্ব, জাতীয়তাবাদ। রাব্বানীর মন্ত্রী কিংবা এই সরকার কোনমতেই পুস্তুন গোষ্ঠি ও উজবেক গোষ্ঠি মেনে নিতে রাজি নয় কারণ রাব্বানী সরকার পুস্তুনদের ও উজবেকদেরও জুলুম করে। গুলবদীন হেকমতিয়ার পুস্তন তাই সবাই গুলবদীনকে সমর্থন করতে লাগল। যখন তালিবান ও মোল্লা ওমরের স্বরূপ প্রকাশ পেল তখন তাদের বিনাশের চেষ্টায় রত হয়ে পড়ল। তবে বেশির ভাগ পুস্তুন সমর্থন করতে শুরু করল তালিবানদের। অন্যান্য জাতের থেকে পুস্তুন জাত গোঁড়া, এক কথায় অর্থডক্স। সংস্কারাবদ্ধ শান্তশিষ্ট গ্রামের মানুষগুলো তাদের অজান্তে এগিয়ে যেতে লাগল অনেক অনেক এক অন্ধকারময় গুহার মধ্যে। যেখানে আলোর রেখাও পৌঁছায় না। কে দেবে তাদের মুক্তি? কোথায় আছে তাদের জন্যে চির শান্তি?কে দেখাবে আলোর দিশারি? এই লঙ্কায় যে আসে সেই হয়ে যায় রাবণ। কিন্তু সেই রাবণকে বধ করার জন্য রামকে তারা কোথায় পাবে? খাল কেটে যে কুমিরকে এনে রেখেছিল তা আজ আর একা নয়। অসংখ্য কুমির হয়ে গেছে। ক্ষুদাতুর শিশু চায় না স্বরাজ চায় দুটো ভাত একটু নুন।–নজরুল ইসলাম
রামায়ণে সীতার আবির্ভাব ঘটেছিল রাক্ষস রাজা রাবণের ও রাক্ষস কুলের বিনাশ ঘটানোর জন্যে। কথিত আছে স্বর্গলোকে নারায়ণ ও লক্ষ্মীর দ্বাররক্ষী ছিলেন পরম ভক্ত রাবণ, একদিন দ্বারে বসে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, সেই সময় নারায়ণ ও লক্ষ্মী প্রেমলীলায় মগ্ন ছিলেন আর তখনই নারদ এসে দ্বাররক্ষীকে ঘুমন্ত দেখে অনুমতির জন্যে অপেক্ষা না করে ভেতরে প্রবেশ করে। বিবস্ত্র লক্ষ্মী যারপরনাই লজ্জিত হয়ে পড়েন। খুব রেগে গিয়ে রাবণকে অভিশাপ দেন নারায়ণ–তোমার এই অবহেলার জন্যে তুমি মর্ত্যলোকে যাও।
রাবণ পরমভক্ত নারায়ণের। প্রভুর অগ্নিমূর্তি দেখে সেই সময় আর কোন কথা। বলতে সাহস করেননি রাবণ। পরে সময় ও প্রভুর মতি গতি দেখে প্রশ্ন করেন রাবণ– আবার আমি কেমন করে স্বর্গে এসে আপনার সেবায় নিয়োজিত হতে পারব? প্রভু, আপনার অদর্শনে আমি কেমন করে থাকব? আমার অন্যায়ের কোন ক্ষমা হতে পারে
তা আমি জানি, কিন্তু প্রভু, আমাকে মর্ত্য থেকে মুক্তির পথ বলে দিন। তখন নারায়ণ বললেন–মর্তে তোমার জন্ম হবে রাক্ষসকুলে, পরে আমিই যাবো মর্ত্যে তোমার উদ্ধারের জন্যে। কিন্তু আমার সঙ্গে মিত্ৰতা করলে তুমি সাত জন্ম পরে মুক্তি পাবে, আর শত্রুতায় এক জন্মেই মুক্তি পাবে, এবার বল তুমি কোন পথে যেতে চাও?
রাবণ একটু ভেবে বললেন–প্রভু, আপনাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই মর্তে আমি আপনার সঙ্গে শত্রুতার পথেই যাবো।
পরম ভক্ত রাবণকে মর্তো পাঠিয়ে নারায়ণ ও লক্ষ্মীর দুঃখের সীমা নেই, তাই ভক্তকে উদ্ধার করার জন্যে মর্তে জন্ম নিয়েছিলেন নারায়ণ ও লক্ষ্মী। তারপরে তৈরি। হয়েছিল রামায়ণ। রাবণকে মারার ক্ষমতা কার ছিল? যদি না রাবণ তার স্ত্রীর হাত দুটো পা দিয়ে সরিয়ে না দিত? তুলসীর স্বামী কী মরত যদি না তার স্বামী তুলসীর চুলের মুঠি ধরে সরিয়ে দিয়ে চলে না যেত? আমি ঘরের কোণে বিপন্ন বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে কেবলই এই সব কথা ভাবতাম এবং কল্পনা করতাম তালিবান ধ্বংস হচ্ছে আর ধ্বংসের কারণটা আমিই তাদের বলছি। আফগানিস্তানের মেয়েদের ওপর যে ভাবে নির্বিচারে অত্যাচার চালিয়েছে, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট করেছে, সেই তালিবানের শেষ একদিন না একদিন হবেই হবে। সেদিন বেশি দেরি নেই। অত্যধিক বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে।
সাহেব কামাল? সাহেব কামাল? আমার নকলি নাম ধরে ডাকাডাকিতে ভাবনার জাল ছিন্ন হয়। শাওয়ালি ডাকছে, আমি উত্তর দিলাম, মনে মনে ভাবলাম এতো ভালো ভাবে ঢাকা কেন? নিশ্চয়ই কোন স্বার্থ আছে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের বারান্দায় এলাম, শাওয়ালিকে বললাম–কি ব্যাপার? ডাকছিস কেন? (পুস্তুতে কথা হয়) শাওয়ালি বলল–চারদাকে এও মুশাফার রাগালাই দ্যা আগা জান্বাজ হাল রাওরি, ফিতা বুম রাগালাই, তা রুপি রাওয়াবিরেগাল।
অর্থাৎ, চারদাতে এক মুশাফির এসেছে, সে জাজের খবর এনেছে, ক্যাসেটও এনেছে এবং তোমার জন্যে টাকাও পাঠিয়েছে। আমি বুঝলাম শাওয়ালি কেন এত খুশি। জাম্বাজ মুশাফিরের হাতে আমার জন্যে প্রায়ই টাকা পাঠায়, সে টাকা অবশ্য আমার হাত পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। সম্ভব অসম্ভব অনেক কল্পনা করতে-করতে আমি একেবারেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ১৯৯০ সালে জীবনের সমস্ত স্বপ্ন বিদায় নিয়েছে। যেদিন আমি গুলগুটির আসল পরিচয় জানতে পারলাম, জান্বাজই তার স্বামী, সেদিন সেই বিস্ময়ের ধাক্কায় আমার ভেতর একটা অজ্ঞাত রাগ ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কেবল রাগটাই ছিল আর ঘৃণাটাকেই ভুল করে ভালোবাসা ভাবতে শুরু করেছি। সেই মায়া মমতাশূন্য জীবন যেন একটাই গন্ডির মধ্যে বিচরণ করত। ভবিষ্যতের চিন্তায় আমি কখনও উতলা হয়ে উঠিনি। বর্তমানটাই যার ভাঙাচোরা, তার ভবিষ্যৎ চিন্তা বাতুলতা। মনে মনে ভেবেছি দুজনের একান্ত চিন্তায় যখন এই সংসার গঠন হয়নি তখন কি দরকার সং সেজে এই সংসারকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার? আবার পরক্ষণেই ভেবেছি, তা বলে মরে যাওয়া? জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া? সে তো ভীরুতার প্রকাশ। না আমি ভীরু নই, যুদ্ধ করে আমি বেঁচে থাকব। হারতে আমি শিখিনি, সুতরাং আমি হারব না। ১৯৮৯ সালের পর ভাগ্যের অসম্ভব এক বিপর্যয় পূর্ণ পরিবর্তনে আমি কেমন যেন দুর্বল চিত্তের হয়ে পড়ছিলাম। যে মানুষটাকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল আমার বিশ্বাসপূর্ণ এক ভালোবাসা, বৈবাহিক জীবন, তা হারাতে বেশি সময় আমাকে অতিবাহিত করতে হয়নি। নির্ভরতা সরে গেছে মন থেকে। সব কিছুর ঊর্ধ্বে এখন কেবল অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা। জান্বাজকে আঘাত করার মধ্যেই অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা।
তারই মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা আমাকে ছুঁয়ে যেত, সে আশা ছিল নিজের দেশে, নিজের আত্মীয়দের সান্নিধ্যে ফিরে আসার। কিন্তু সে আশাও দুলে দুলে বিদায় নিয়েছে মন থেকে, হৃদয় থেকে। কিন্তু হৃদয়ের যন্ত্রণা একচুলও নড়েনি, আরও বেশি করে যেন আঁকড়ে ধরেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার মনের পরিবর্তন হয়। কখনও মন শান্ত, কখনও বা উগ্র। কখনও সে সবকিছু ত্যাগ করে তো কখনও সবকিছু গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়ে ওঠে। চাপা উত্তেজনা সমস্ত হৃদয়কে ঘিরে রাখে। দেশের অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে, সেই সঙ্গে বদলেছে আমার ধরন ধারণ। অবশেষে একদিন মোল্লা ওমরের তর্জন গর্জন, চোখ রাঙানি, তালিবানের শাসন শোষণ খবরদারিকে নস্যাৎ করে পালাতে সক্ষম হলাম। আঃ! কি সেই মুক্তির স্বাদ, কয়েক রাত যে এলোমেলো চিন্তা মনের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে আজ তা জীবনের সন্ধান দিল যেন।
মুক্তির স্বাদ গ্রহণ
আমি মুক্ত, খোস্ত থেকে মিরামসাতে যাওয়ার জন্যে যে টয়টোতে আমি চেপেছি সেই টয়টো গাড়ির বাঁদিকে জানালার ধারে বসেছি। সেই জানালা দিয়েই যেন সমস্ত বিশ্বকে আমি দেখতে পাচ্ছি। মনের এক কোণে অসম্ভব একটা ভয়, অন্য এক কোণে আছে অপরিসীম আনন্দ, মুক্তির স্বাদ, জয়ের গৌরব। সে কী আনন্দ! গাড়ি ছুটে চলেছে পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে, কখনও সেই রাস্তা ধরে ওপরে উঠছে, কখনওবা তা নিচের দিকে নামছে, আবার কখনওবা কোন এক অচেনা গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। শীতের হিমেল হাওয়া তখনও আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয়নি। সবে রোদের তাপ লেগে বরফ গলতে শুরু করেছে। যেখানে রোদ পৌঁছায় না সেখানে এখনও বরফ জমাট বেঁধে অবস্থান প্রমাণ করছে। সামনের সিটে তিনজন পাঠান। বসেছে, তাদের মাথা টপকে বাইরের দিকে নজর দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমি দ্রুত নিজের মনে মনে চিন্তা করে নিতে থাকি পাকিস্তানে পৌঁছে কোন কোন জরুরি কাজ আমার সেরে ফেলা দরকার। সেই সঙ্গে একটা অনিশ্চিত চিন্তাও মনে আসছে, কোথায় গিয়ে উঠব? তবুও একটা ভয়–পাকিস্তানও তো ইসলামি দেশ। তাছাড়া সব তালিবানতো পাকিস্তানের লোক। সেখানে আমি কি করে নিরাপদে থাকব। যা করার তা তাড়াতাড়িই করে ফেলতে হবে। যেখানে ষোলো বছর বয়সের ছেলের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় কেবল মৌলবীর উদ্দেশ্যে মুখ ফসকে কোন খারাপ কথা বলার অপরাধে।
হয় খুব ভালো কিছু হবে, নয়তো খুব খারাপ কিছু হবে, সেই সঙ্কল্পে মন বেঁধে তবেই না ঘর ছেড়েছি! এক এক বার পিছুটান অনুভূত হয়েছে যা খুব স্পষ্ট নয়, আবার একেবারে অস্পষ্ট নয়। অসম্ভব একটা উদ্দীপনা মনের মধ্যে প্রেরণার সঞ্চার ঘটায়। সেই প্রেরণা মন থেকে সরিয়ে দেয় ভয় ও আতঙ্ককে। প্রতিকূলতার সঙ্গে যোঝার ক্ষমতা দেয়, প্রতিবাদের শক্তিকে দ্বিগুণ করে, রাগ, দুঃখ, যন্ত্রণা, ব্রাস এবং হতাশার মধ্যে ডুবে যাওয়া আমার মনে নতুন করে যেন আনন্দের ঢেউ উঠেছে, সেই ঢেউ উত্তাল তরঙ্গ হয়ে ফেটে পড়তে চাইছে চারধারে, যেখানে আত্মরক্ষা করার সময় কেউ পাবে না। সেই নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তারা চিৎকার করে বলবে– ওগো মানুষরূপী অসুরশক্তি দমনকারি, ওগো ভয়ঙ্করি, আমরা তোমার শক্তিকে হেয় করেছি, তোমাকে চিনতে পারিনি, আমাদের তুমি ক্ষমা কর, আমাদের অসুরশক্তিকে বিনষ্ট করে, কেবল বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দাও।
আর আমি তখন এক তৃপ্তির হাসি হাসবো। আমার মনের ওপর শরীরের ওপর যে ভাবে অনাবিল ধর্ষণ চালিয়েছে ওই বর্বর তালিবানেরা, তাদের সর্বনাশ ও ধ্বংস আমাকে দেখাতেই হবে। আমাকে দেখতেই হবে এবং প্রকৃত জয় হবে আমার সেদিন। আমার চুল ধরে ওরা টেনেছে, ওদের ধ্বংস অনিবার্য। এক আত্মতৃপ্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল।
চিৎকার করে আবার বলতে ইচ্ছে করছে জীবনে প্রেম ভালোবাসা, বিশ্বাস, সব মিথ্যে নির্ভেজাল মিথ্যে। পৃথিবীর কোথাও কোনখানে বিশ্বাস, ভালোবাসা নেই। ভালোবাসা দিয়ে তৈরি দুর্গ অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছিল, এখন তা যেন টুকরা টুকরো হয়ে গেল। অসুরক্ষিত একটা দুর্গকে আমি সুরক্ষিত করতে চেয়েছি? যে মানসিক একাত্মতা গড়ে উঠেছিল তা যেন হাওয়ায় দুলতে দুলতে বিদায় নিল। আমি কোন রকমে নিজেকে সংযত করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমার নন্দাই বসেছিল। সেখানে একটা চেয়ারে। জান্বাজ আমাদের সঙ্গে আসেনি ডাক্তারের কাছে, নন্দাইকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার ননদের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তখন পাকিস্তানে রাওলপিন্ডির আলিপুরে থাকে, সেই রাশিয়াকে নিয়ে নজিবুল্লার যুদ্ধের সময় চলে এসেছে আলিপুরের মাজারে।
নন্দাই ভালোবেসে আমাকে বাঙালি বলে ডাকে। তার প্রশ্নের কোন উত্তর আমি দিইনি। আমার চোখে জল দেখে নন্দাই বোধহয় আঁচ করতে পেরেছে তাই একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল-কোই বাত নেহি, রো মাত, গুলগুটিকো তো হো রাহে, ওতো তুমারাই হয়?
আমি নীরব হয়ে তাকিয়েই রইলাম কেবল। আশ্চর্য! এরা কি? এদের এমন নগ্ন রূপে দেখে আমার নিজেকে নিজের শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারি না, পারি না আমি। আমার চরিত্রটাই একটা বিস্ময়জনক, শেষ না দেখে শেষ করার মতো চরিত্রের মেয়ে আমি নই। শেষ আমি দেখতে চাই। আমার এই জীবনের শেষ কোথায়?
আমরা যখন ননদের বাড়ি এলাম ডাক্তারখানা থেকে তখন বেলা দুপুর। বাড়ির সবাই খাওয়া সেরে সবে বসেছে, আমরা তখনই ঘরে ঢুকলাম। আমাদের জন্যে খাবার আনতে গেল ননদ গুনচা। আমি গুনচাকে বললাম–যে মারুই নে খুরম। অর্থাৎ, আমি রুটি খাব না। গুনটা আমাকে কিছু বলতে গেল কিন্তু হঠাৎ থেমে গিয়ে তোষকের ওপর বসে পড়ল। আমি বুঝলাম নন্দাই ইশারা করে যেন কিছু বলল। বেশ কিছু সময় সব নিস্তব্ধ, ঘরে উঁচ পড়লেও আওয়াজ শোনা যাবে। হঠাৎ গুনচাই নিস্তব্ধতা। ভেঙে বলল–শুকুরকে, ক্ষাপাকিয়েজা মা লালাই, জাম্বাজ জোয়ান্দি দ্যা!
অর্থাৎ, ভালো, দুঃখ করো না সোনা, জাম্বাজ তো বেঁচে আছে।
গুনচার কথা শুনে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না, যে যন্ত্রণার স্রোত এতক্ষণ ধেয়ে আসতে চাইছিল, সেই স্রোত আর বাঁধ মানতে চাইল না। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে ভাবতে লাগলাম আমার জীবনের কথা। কি ভেবেছিলাম, কত স্বপ্ন দেখেছিলাম, জাম্বাজের সঙ্গে বিয়ের পরে পরেই সেই স্বপ্নে রামধনুর রং লেগেছিল। সেই রং কেমন করে ফিকে হয়ে গেল? কেন এমন হল? ভাবতে-ভাবতে কখন সন্ধে হয়ে গেছে কে জানে। সমস্ত ঘরটা অন্ধকার, বাইরের আলোর রেখা এসে খানিকটা জায়গার অন্ধকারকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। গুনচা রান্না ঘরে গিয়ে রুটি তৈরি করছে, রসিদা, গুনচার ছোটো জা সে তার বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে বসে আছে, আজই তার। রুটি করার পালা বদল হয়েছে। বড় জা জোরোর আজ আট দিন হল বাচ্চা হয়েছে, সে আঁতুর ঘরে বাচ্চা পাশে রেখে শুয়ে আছে। গুনচার শাশুড়ি, তার বড় ছেলে হাজি সাহেব আমার নন্দাই রম্মাজান এবং অন্যান্য বাচ্চাদের নিয়ে বসে আছে মেহমান ঘরে। আমি গুনচার ঘরে একই ভাবে শুয়ে আছি, হঠাৎ জাম্বাজের আগমনের খবর নিয়ে গুনচার মেজ মেয়ে জোরগোল এল ঘরে। গুনচার বড় মেয়ে, কিন্তু স্বাভাবিক নয়। তাকে সারাদিন বারান্দায় শুইয়ে রাখে কেবল রাতে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে ঘরে শুইয়ে দেয় এক কোণে। তাকে খাইয়ে দেয় রম্মাজান অথবা গুনচার শাশুড়ি।
জান্বাজ যখন ঘরে এল তখন ঘড়ির কাটা রাত নটার ঘরে। প্রায় দুঘণ্টা মেহমান ঘরে বসেছিল। এতক্ষণ কোন তাগিদ অনুভব করেনি সে, আমার কাছে এসে প্রশ্ন করে এবং একটু বসে সে ইচ্ছেও বোধহয় মনের কোণে তার জাগেনি। এখন শোয়র প্রয়োজনে তাকে তো ঘরে আসতেই হবে তাই এসেছে। জান্তাজ আমার সামনের পাতা তোষকের ওপর বসল, তারপর একগাল হেসে প্রশ্ন করল–কেয়া হুয়া পাগলি? আজ তুম এতনা চুপচাপ কিউ? কেয়া হুয়া?
–তুমে জাননেক জরুরৎ কেয়া?
–বাতাও না? মেয়ভি থোরা শুনে?
–কোই জরুরৎ নেহি শুননেকা, কেয়া বিগড়েগা? কিঁউ কি তুমারা তো দুসরা বিবি হ্যায়।
–ঝগড়া মাত করো, বোলো, ডাক্তার কেয়া বাতায়া?
–মুঝে আর কভি বাচ্চা নেহি হোগা। মিসক্যারেজ হোনেকা সাথ সাথ অগর ডাক্তার কা পাস যাতা তত আজ কুছ নেহি হোতা।
–নেহি, ইহাকা ডাক্তারকো কুছ মালুম নেহি হ্যায়, তুমে হিন্দুস্তানা সবসে বড়া ডাক্তারকে পাস লে জায়েঙ্গে।
মনের একটা কোণে আনন্দ নাচানাচি করতে লাগল, অন্য আরেকটা কোণে সংশয় দুলতে লাগল, ঠিক মাঝখানটায় অনেক দুঃখ সত্ত্বেও বিশ্বাসের দানা বাঁধতে শুরু করল। নিয়ে যাবে জান্বাজ আমাকে নিয়ে যাবে আমার দেশে, ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাবে। বাড়ির সবার বলা কথা এই যে আমাকে নাকি এখানেই থাকতে হবে, সে। কথা জান্ধাজ সত্যি হতে দেবে না। যাই হোক একটু কপট রাগ নিয়ে মুখে বললাম জরুরৎ কেয়া? তুমারা দুসরা বিবিকো তোতা বাচ্চা হোতাই হ্যায়; মেরে হোনা নেহি হোনেসে কিসকো শীরমে কোন আসমান টুট পরেগা?
–মুঝে তুমারা বাচ্চা চাইয়ে। কিঁউ কি তুম মেরা পেয়ার হ্যায়, মেরা জিনেকা সাহারা তুম হে, তুম।
জান্বাজকে নতুন করে আবিষ্কার
আজ অবেলায় বসে জান্বজের বলা কথাগুলো মনে মনে ভাবি, হয়ত সে তাদের দেশের সংস্কার অনুযায়ী আমাকে ওখানেই ফেলে রেখে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু ভালো সে আমাকেই বাসে। আর তা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। ওখানে অলিবানদের অত্যাচারের নীরব সাক্ষী হয়ে আমি যখন ফিরে এলাম আমার দেশে, তখন থেকে আমি জান্নাজকে বুঝতে ও চিনতে পেরেছি। আবার নতুন করে ওকে উপলব্ধি করতে চেয়েছি অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে যে ভালোবাসা ও বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছিল তাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে নিজেকে দগ্ধ করেছি, নিজের মনের সঙ্গে ক্রমাগত মনে মনে যুদ্ধ করেছি। আফগানিস্তানে দেখেছি মৃত্যুর তাণ্ডব, সেখান থেকে জীবনকে উদ্ধার করে নিয়ে চলে এসেছি হিন্দুস্তানে। চরম বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বার বার যে মুখটা আমার চোখের সামনে নেচে নেচে বেড়িয়েছে, শত চেষ্টা করেও সে মুখটাকে আমি সরাতে পারিনি। সেই মুখের মানুষটা আবার নতুন করে আমাকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। কোন তঞ্চকতা দিয়ে নয়। আবার তৈরি হয়েছে বিশ্বাসের বুনিয়াদ। শক্তপোক্ত। সে বুনিয়াদ হারাবার নয়!
তালিবানের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়েছি তা টেরই পাইনি। যতটা অবিশ্বাস ঘৃণা করা একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব তার সমস্তটুকুই প্রাপ্য তালিবানের। কারণ এই তালিবান ও তাদের সর্দার মোল্লা ওমর আধুনিকতার চরম শত্রু। সমস্ত আধুনিকতা থেকে বঞ্চিত করছে একটা দেশকে। আমি নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যে কিভাবে অসহায় মানুষগুলো তালিবান নামক হিংস্র জন্তুর শিকার হচ্ছে। কিভাবে সব কিছু বিনষ্ট করছে।
এবার একটু আমাদের দেশের তালিবানদের দিকে ফিরে তাকানো যাক। যারা হিংস্রতা সৃষ্টি করে তারাও তো উগ্রপন্থী। কারণ তারা ধ্বংস করে, মেরে ফেলে, আধুনিকতাকে ভাঙ্গছে।এবং ১১ই সেপ্টেম্বর আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশের পুরনো ইতিহাস, বিখ্যাত ঐতিহ্যকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। ইতিহাস বিখ্যাত বামিয়ানের বৌদ্ধমূর্লি ধ্বংসাবশেষে দাঁড়িয়ে শয়তান হায়নার হাসি হেসে উল্লাসে মেতে উঠেছে। এই আধুনিকতার এবং ঐতিহ্যের ধ্বংসকারির ধ্বংস দেখার জন্যে আমি উদগ্রীব হয়ে দীর্ঘ বছর অপেক্ষা করে আছি। ওই তালিবানের রক্ত যদি আমি পান করি তাও খুব কম বলে মনে হয়।
কেবল আমি নই, আফগানিস্তানের সমস্ত নারীজাতিই সেই ধ্বংসের কামনায় আল্লার দরবারে দোয়া ভিক্ষা চাইছে। তারা ভোলেনি তাদের প্রতি তালিবানের অত্যাচার, ফতোয়া। এই মোল্লা ওমর ও লাদেনের একটা একটা করে হাত, পা ছিঁড়ে ফেলতে হবে যেমন ফেলেছিল তোপ দেগে বৌদ্ধমূর্তির। আলজিভ কেটে নিতে হবে যাতে সন্ত্রাসবাদী কথা বলে সন্ত্রাস তৈরি করতে না পারে। এই শাস্তিই হবে লাদেনের ও। ওমরের প্রকৃত শাস্তি। এদের সঙ্গে আর একজনকে ওই শাস্তি দেওয়া উচিত, যার নাম এখনও শিরোনামে উঠে আসেনি। সে হল আবদুল মালিক ও আবদুল মোত্তালিক। মহিলা সংগঠনের সদস্যা জারগুনার ঠিকানা না পেয়ে তার বাবাকে বলে ছেলের বুক চিরে কলিজা বের করে তাকে টাঙাতে। বাবার আর্তনাদ ও চোখের জল তালিবান গ্রাহ্য করেনি। পরে বাবা পাগল হয়ে সত্যি সত্যিই ছেলের বুক চিরে কলিজাটা টেনে বের করে মুত্তালিক ও আবদুল মালিককে উপহার দিয়েছিল। তারপর সে পাগল। হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এই ঘটনার পরেই আমি পালিয়েছি, মুক্তি চেয়েছি। সেই মুক্তি আবার হারিয়ে গেল আবার দুঃখ যন্ত্রণা আমার নিত্যসঙ্গী হল। আমি নজরবন্দী হলাম। পালিয়ে যাওয়ার আগে যে স্বাধীনতা ছিল আমার, তাও হারালাম। যে দেশটা দুঃখেই ভরা সেখানেই আমি সুখের খোঁজ পেতে চেয়েছি। তেল ও জল যেমন এক হতে পারে না কোন ভাবেই কোন অবস্থাতেই। আফগানের মানুষ আনন্দ ও খুশি বলে কোন বস্তুকে চেনে না।
না, একেবারেই যে আনন্দমুখর ছিল না তা নয়। আমার আজও মনে পড়ে সেই ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে রোশেনদারের বিয়ের কথা। কিছুদিন আগেই জান্বাজ আমাকে এই আফগানের মাটিতে একা রেখে চলে গেছে হিন্দুস্তানে। সারারাত বাড়িতে না ফেরার জন্যে যখন আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন, সকালে যখন মুজাহিদদের ফেলে যাওয়া লাশের মধ্যে জান্নাজকে খুঁজতে গেলাম, ভাবলাম ভুল করে হয়তো মুজাহিদ জাজের ওপরেও গুলি চালিয়ে দিয়েছে অন্ধকারে, তারপর যখন জাম্বাজকে সেই লাশের মধ্যে না পেয়ে শাস্তি মনে ফিরলাম তখন আবুই আমাকে বলল–অয়লি দেত বিনায় কে? তা মোয়ো আকপল উড়াল হিন্দুস্তান।
অর্থাৎ–কেন ওকে মারছো? তোমার স্বামী নিজেই চলে গেছে হিন্দুস্তানে। আসলে রাগলে আমি দ্বিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে খুঁষি চালিয়েছিলাম আদ্রামানের বৌকে উদ্দেশ্য করে, সেই ঘঁষি গিয়ে লেগেছিল পাবলুচাচির মুখে ঠোঁটের ওপর। পাবলু চাচি আমার খুড়শ্বশুর আসাম চাচার বড় বৌ। এরপর ঘরে ফিরে এসে চুপ করে একটা কোণে গিয়ে আমি বসলাম। একটু পরে গুলগুটি চা নিয়ে এল, আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম।
–তুমি জানতে জান্বাজ চলে যাবে? (পুস্তুতে কথা হয় সব)
–হ্যাঁ।
–তুমি জানতে? ওঃ! তুমিও জানতে ও যাবে? কেবল আমিই অজানার মধ্যে? ওঃ! কি নির্মম এখানকার মানুষ? স্বামী চলে গেল অন্য দেশে কিন্তু তার স্ত্রী জানতেও পারল না। জাম্বাজ পারল? এমন করে চলে যেতে? আমার রাগ হতে লাগল গুলগুটির
আমি যেন চোখের আগুনে গুলগুটিকে পুড়িয়ে দিতে লাগলাম। গুলগুটি বলল– ও যেতো না, মগর মজবুর হয়ে গেছে।
–কেন?কি মজবুরি ছিল ওর? যার জন্যে আমাকে রেখে গেল? এমনকি বলেও গেল না?
–তুমি ওকে আমার কাছে আসতে দিতে না, আমার ঘরে যাওয়া তো দূর, আমার সঙ্গে কথাও বলতে দিতে না। কিন্তু একদিন, গত মাসে যখন তুমি পাশের গ্রামে গিয়েছিলে তখন ও আমার ঘরে এসেছিল।
আমি শুনছি, গুলগুটির সব কথা শুনছি। আজ আর আগের মতন করে যন্ত্রণা হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে আমার হৃদয়ে। কেবল মানুষের বেশধারি অমানুষগুলোকে খুব ভালো করে চেনার চেষ্টা করি। গুলগুটি বলেই চলেছে–আমি আবার মা হতে
আমি যেন অনেক দূরে কোথাও চলে গেছি, যেন কোন অতল গহ্বরে। খুব আস্তে একটা আওয়াজ যেন আমার কানে এসে পৌঁছাল। বিড় বিড় করে কথাটা উচ্চারণ করলাম। গুলগুটি আরও বলল–এই কথাটা তোমাকে ও বলতে পারবে না বলে চুরি করে চলে গেছে।
শূন্যে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ। গুলগুটি দোপাট্টার খুঁট দিয়ে চোখ মুছল।
আমি ভাবতে লাগলাম, আমার বন্ধন তো বহুদিন আগেই শিথিল হয়ে গিয়েছিল? আগের মতো করে আর তো আগলে রাখিনি? পাহারা দেওয়াও তো বন্ধ করেছি? তবে? তবে কেন এমন করে পালিয়ে যাওয়া? গুলগুটির প্রথম সন্তান মেয়ে, আমিই তার ডেলিভারি করেছি। নাম রেখেছি কিসমতা আমার সন্তানকে হারিয়ে যখন আমার মাতৃহৃদয় সন্তানের জন্যে উন্মুখ তখনই এই পৃথিবীতে এসেছে কিসমত। তার ওপর। গিয়ে পড়ল আমার হৃদয়ের স্নেহ। সমস্ত সময় আমি কিসমতকে আমার বুকে করে রেখেছি। তার সমস্ত দেখাশোনা আমিই করি। গুলগুটি আমার কাছে তার মেয়েকে দিতে চায় না। ও জানে আমি কিসমতকে ছেড়ে থাকতে পারি না, তাও ও কিসমতকে নিয়ে প্রায় বাপের বাড়ি চলে যায়।
একদিন–সে দিন আমার নিমন্ত্রণ পারি চাচির বাড়ি। আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি আগে পারি চাচির বাড়ি পারির ছেলে দৌলত খান যখন হিন্দুস্তানে ছিল তখন জাহাজের সঙ্গে অনেকবার এসেছে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমরা যখন আফগানিস্তানে এলাম তখন দৌলত খান ওর বিবির জন্যে আমার হাতে পাঁচশো টাকা দিয়েছিল। প্রকাশ্যে সে টাকা দৌলতের বিবিকে দেওয়া যাবে না। তাহলে আর রক্ষে নেই। কী? বৌয়ের জন্যে টাকা পাঠিয়েছে? পারি বোধ হয় জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে সেরিনাকে। দৌলতের বিবির নাম সেরিনা। সেই দৌলত খান দেশে ফিরেছে গত পাঁচ দিন হল। এবার এক মাস ধরে চলবে গ্রামের ও গ্রামের বাইরে সব চেনা বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাওয়ার পালা। কারণ মুশাফরাই বাড়িতে ফিরেছে। মুশাফির মানে যে অন্য দেশের বা অন্য জায়গায় থেকে আসে, আর মুশাফরাই মানে যে এই দেশেরই কিন্তু দীর্ঘ দিন বাইরে কাটিয়ে এসেছে। তাই একমাস ধরে মুশাফরাই মারুই ওয়ারকে অর্থাৎ মুশাফরাইকে রুটি দেবে। সেদিন পারি ইয়ানা রান্না করেছে বলে আমাকেও নিমন্ত্রণ করেছে। ইয়ানা মানে মেটে। আমি দুপুরে চলে গেছি পারি চাচির বাড়ি, প্রায় বিকেল হয় হয়, এমন সময়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরেই দৌড়ে গেলাম ঘরে, কিসমতকে দেখতে, কিন্তু যেখানে আমি ওকে শুইয়ে রেখে গেছি সেখানে কিসমতকে দেখতে না পেয়ে আমার মেজ জা কালাখানের বিবিকে জিজ্ঞাসা করলাম–হ্যাঁরে? কিসমত কই? গুলগুটিই বা কোথায়?
সাদগি বলল দা প্লার কোরতা উড়াল। (সে বাপের বাড়িতে গেছে)।
আমি আঘাত পেলাম। তবে আঘাতে আর আমি ভেঙে পড়ি না। আমি জেনে গেছি আঘাত আমার ভীষণ অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাকে সরাতে চাইলেও সে আমাকে ছাড়ে না। তাই আর ছাড়াতে চাই না। জাব্বাজ রাতে বাড়িতে ফিরল। আমি কোন কথাই তাকে বলিনি, আমার কেমন যেন মনে হল জান্বাজ সব জানে। জানে যে গুলগুটি বাপের বাড়িতে যাবে কিন্তু আমাকে জানায়নি। এই সময় আমরা আমাদের নতুন বাড়িতে। মাত্র একমাস হয়েছে বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। তারপর গৃহপ্রবেশ হয়েছে। গৃহপ্রবেশ মানে এখানে আমাদের মত হয় না। এখানে ওই দিন সব আপনজনেরা এবং গ্রামবাসী দরিয়াব হাতে করে আসে, নাচ করে গান গেয়ে, খুশি করে অভিনন্দন জানাবে। মাউথ অরগান বাজাবে। না ভালো করে বাজাতে জানে না। কেবল নিঃশ্বাস টেনে নেয় তাতে বাজে আবার নিঃশ্বাস ছাড়ে তাতে বাজে। সেটা মুখে নিয়েই নাচে। বুড়ি থেকে চুড়ি পর্যন্ত সবাই। দুম্বা কাটা হয়। কাইম এসে রান্না করে, তারপর খাওয়া। আর নাচ, সঙ্গে ঢোল বাজে। আমাদের নতুন বাড়িতেও তাই হল। আসাম চাচা হিন্দু বিয়ে করার অপরাধে জাম্বাজকে আলাদা করে দিয়েছিল। পুরোন বাড়ির ভাগ পায়নি। তার বদলে যে জমি পেয়েছি আমরা, সেই জমির ওপর বানিয়েছি কালা। কালা মানে। বাড়ি। সাদগি তখনও নতুন বৌ সবে তিন মাস হয়েছে ও বৌ হয়ে এসেছে আমাদের বাড়িতে। ওকে কেউ ঠিক দেখতে পারে না। কারণ ও বাপের বাড়ি থাকাকালীন অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে বলে। নিকার আগে মেয়ে বাপের বাড়িতেই থাকবে। স্বামীও যাবে, তবে অন্তঃসত্ত্বা হলে হবে মহা বিপর্যয়। সেই বিপর্যয় ঘটল সাদগির ক্ষেত্রেও। সাদগি বৌ হয়ে আসার পর আমাদের বাড়িতে একটার পর একটা বিপর্যয় ঘটতে লাগল। মুশা, আমার সেজ দেওর তখন হিন্দুস্তানে। একটাও টাকা পাঠায় না বাড়িতে। টাকার অকুলান পড়ে গেল। গম নেই, চাল নেই, চিনি নেই, সবই নেই। এই নেইয়ের হাটে আমাকে রেখে জান্বাজও চলে গেল। এবার বাড়ির সবাই যেন আমার মুখ চেয়ে থাকে, সবাই আমার কাছে ছুটে আসে ক্ষিদের জ্বালায়। আমার ব্যক্তিগত সমস্ত দুঃখের কথা ভুলে পয়সা বোজগারে মন দিলাম। আমার ডাক্তারখানায় রুগী বাড়তে থাকে। আগে আমি খুব কম যেতাম ডেলিভারি করাতে। অভাব আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ডেলিভারিতে। যে গুলগুটি আমাকে না জানিয়ে কিসমতকে নিয়ে চলে গিয়েছিল বাপের বাড়ি, সেই গুলগুটিই তখন কিসমতকে আমার কাছে দিতে চায়। কিন্তু ততদিনে আমি সাদগির আরামুনাই (অনাকাঙ্ক্ষিত) সন্তানকে নিজের সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেছি। তার নাম রেখেছি শেহেনাজ।
আমাদের এই অভাবের মধ্যে গুনচা (ননদ) তার তিন ছেলেমেয়ে স্বামীকে নিয়ে পাকিস্তান থেকে এসে হাজির। গুনচার কোমরের পেছনের হাড়ে আঘাত লেগে চিড় ধরেছিল অনেক দিন। এখন ধরা পড়েছে বোন টিবি। ডাক্তার কেবলই শুয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। সুতরাং বাপের বাড়ি ছাড়া আর কোথায় বা যেতে পারে? আমার ঘরে অভাব। কিন্তু মনে খানিকটা শান্তি। অন্ততঃ খানিক সময় গল্পতো করতে পারব? সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত রুগী দেখি ওষুধ বেচি। মাঝ রাতে ডেলিভারি কেল এলেও ফেরাই না। দুই দেওর তখন বাড়িতে, ছোট দেওর শাওয়ালি, মেজো। দেওর কালাখান। যা রোজগার করি তা গম, চিনি, চাল কিনতেই শেষ হয়ে গেল। ওদিকে গুনচাকে ডাক্তার দুবেলা দুধ খেতে বলেছে। কিন্তু কোথায় পাব? আমাদের গরু নেই। তাই টাকা কিছু কিছু করে সরিয়ে রাখতে লাগলাম। এখানে দুধ ঘি মাখুন। কিনতে পাওয়া যায় না। গরু সব বাড়িতেই আছে। আর না থাকলেও বিক্রি হবে না। আমার দেওররা কোন রোজগার করে না। কেবল শুয়ে বসে গল্প করে সময় কাটায়। অবশ্য এই দেশে করবারও কিছু নেই। করবেটাই বা কি? কলকারখানা, শিল্প থেকে শুরু করে মায় জীবনধারণের জন্যে যে সব সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়, একটা দেশে যে সব থাকা অত্যাবশ্যক তার কোন কিছুই এই দেশে নেই। কেবল যাদের। প্রচুর চাষের জমি আছে তারা গম, আলু এবং তামাক পাতা ও চরসের চাষ করে। হাঁ, একটা কাজে এখানে অরদক জাতেরা রোজগার করে জীবনধারণ করে, তা হল বাড়ি তৈরি করা। এই কাজের জন্যে লোকের চাহিদা আছে। একটা কেল্লার মতো কালা বানাতে প্রায় তিনমাস লেগে যায়। এখানে কালা (বাড়ি বানাতে বলদ লাগে মানুষের সঙ্গে। এ দেশে বলদের সংখ্যা খুব কম। নিচু জাতের মধ্যে গরু খাওয়ার চল আছে, আর তা ওই বলদ জবাই করে।
আমাদের কালা বানানোর সময় গুলগুটির বাবাকে দিয়ে জাম্বাজ উরগুন থেকে বলদ এনেছিল দুটো। বাড়ি তৈরি করতে যে মাটি লাগবে তা নিজেদের জমি থেকেই নিতে হবে। সেই মাটি কেটে তুলে এনে এক জায়গায় টাই করে রাখবে, একদিনে কালা বানাতে যতটুক মাটি লাগবে সেইটুকু আলাদা করে রেখে ঠিক মাঝখানটায় গর্তের মতো করে সেখানে জল দেবে আন্দাজ মত। এবার সারা রাত সেই মাটি ভিজবে, সকালে উঠে সেই মাটির ওপর বলদ দিয়ে মাড়াবে। এবং মানুষও পা দিয়ে মাখবে। যখন দেখবে মাটি মাখা হয়েছে তখন তার মধ্যে পোরা দিয়ে আবার মাখবে। পোরা হচ্ছে গমের যে গাছ তা শুকনো হয়ে হয় খড়, সেই খড়কে শুকনো করা হয় মেশিনে, তবে ধুলোর মতন নয়। আমাদের দেশে হাত দিয়ে সিমুই ভাঙলে যেমন হয় তেমনি হবে। সেই বোরা মেশাবার পরে লাইন করে পনেরো জন দাঁড়িয়ে পড়বে। যেখানে মাটি মাখা হয়েছে সেখান থেকে যেখানে বানাচ্ছে সে পর্যন্ত। একজন হচ্ছে। রাজমিস্ত্রি। সে তখন বসে আছে যতটা কালা বানানো হয়েছে তার ওপর। সে আরও বানাচ্ছে, তার হাতে মাটির যোগান দিচ্ছে সবাই। একটা করে রাউন্ড হবে চওড়ায় মাটি থেকে লম্বা তিন হাত ও এক একটা দিক তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট এবং পুরো এক বিঘে জমির ওপর চতুর্ভুজের মতো রাউন্ড হবে। এমনি করে প্রায় তিন তলার সমান উঁচু করতে যত বার রাউন্ড দিতে হয়। কারও দশ রাউন্ড কারও বা মাটি কম হলে ছসাত রাউন্ড দেওয়া হয়। ঘরের মেঝেতে দেওয়ার জন্যে লাগে দুহাত চওড়া ও তিন হাত লম্বা করে পাতলা ধরনের পাথর। পৃথিবীতে আদি মানুষরা যেমন ছিল, তেমনই না হলেও অনেকটা তেমন। আমাদের এই নতুন বাড়িতে চারখানা ঘর তৈরি করা হানছে। একটা মেহমান ঘর। আমার জন্যে আলাদা একটা ঘর বানাতে বলেছিলাম জান্বাজকে। সেই ঘরে দেওয়াল আলমারি ও আরো অনেক ফিরিস্তি দিয়েছিলাম সভ্য জগতের বাড়ির মতো। কিন্তু জাম্বাজ বলেছেএখন টাকা কম। পরে মুশা টাকা পাঠালে বানিয়ে দেব। আর আমার জন্যে ঘর বানাতে হল না। সে চলে গেছে। এখন গুলগুটি ও আমি একই ঘরে থাকি। আর আমাদের সঙ্গে থাকে অভাব-অনটন। সংসারের সবরকম দায়-দায়িত্ব এমন করে যে আমার মাথায় এসে বর্তাবে সে ভাবনা। ভুলেও আমি ভাবিনি। সেই দায়ভার মাথায় নিয়ে আমি যেন রাতারাতি কেমন বড় হয়ে গেলাম। বাড়িতে সেই সময় কেবল রুটি ও আলুর তরকারি ছাড়া অন্য কিছু জোগাড় করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। সময় কারও জন্যে অপেক্ষা করে না, আমার জন্যে করেনি। রোজগার করেছি, সংসার চালিয়েছি। যেন আমি একজন পুরুষ।
রোশেনদারের বিয়ের ঠিক হয়ে আছে প্রায় এক বছর হয়ে গেল। আজ তার বিয়ে। দ্রানাই চাচা এসে গতকাল বলে গেছেন আমি যেন সকালেই চলে যাই চাচার বাড়িতে। ___ আলাদা করে নিমন্ত্রণ করেছে। আমি যাবো, কিন্তু সকালেই যাওয়া অসম্ভব। কারণ রুগী এসে ফিরে যাক, তা আমি চাই না। ঢোলের আওয়াজ কানে আসছে। মেয়েদের গান হাওয়া বহন করে আনছে। বেলা তখন একটা হবে, আমি কোন পাই চাচার বাড়িতে। একটু পরেই সবাই রওনা দেবে মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কাঠ, দুম্বা, আটা, ঘিয়ের টিন সব দিয়ে এসেছে আগের দিন। এখানে নিয়মই তাই। কনের বাড়িতে বিয়ের আগের দিন সব পাঠাতে হবে। নিমন্ত্রিতদের খাওয়াতে যা। যা লাগবে তা ছেলের বাড়ি থেকেই দিতে হবে। সকালে মেয়ের বাড়িতে সবাই খাওয়া দাওয়া করেছে। ছেলের বাড়িতেও সকালে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে। কনের বাড়ি আমাদের গ্রামেই। একই পাড়ার মধ্যে। দ্রানাই চাচার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকে গিয়ে বেশ খানিকটা রাস্তা যেতে হবে, তারপর আবার ডানদিকে গিয়ে বাঁয়ে ঘুরলেই ডান হাতের বাড়িটা সর্দার চাচার বাড়ি। সর্দার চাচার বড় মেয়ে সাবু হল গুলশুটির বড় ভাই রহিম খানের বিবি। আমরা সবাই তৈরি, এবার যাবো। বাড়ির সব বৌরা চিকন কামিজ পরেছে, বেনারসি ঠেকরাই মাথায় দিয়েছে। চিকন মানে লক্ষ্মেী চিকন নয়। এই চিকন হচ্ছে এখানে এক ধরনের কাপড় পাওয়া যায় যা আমাদের দেশে দক্ষিণ ভারতের কাপড়ের মতো তার ওপর রেশম সুতো দিয়ে ভরাট চেন সেলাই দিয়ে সুন্দর কাজ করা হয়। তাকে চিকন বলে। সেই চিকন দোপাট্টাও আছে, দোপাট্টাটা পাতলা পিওর সিল্কের কাপড়ের মতো। এগুলো পাকিস্তানে তৈরী হয়। আমরা চলেছি কনের বাড়ি। দ্রানাই চাচার বাড়ি থেকে সব মেয়েরা নাচ আরম্ভ করেছে, সমস্ত রাস্তা নাচতে নাচতে ১লেছে। সেরিনা চাচি সবার আগে দুহাতে দুটো রুমাল নিয়ে নাচতে নাচতে চলেছে। সে আজ সব চাইতে বেশি খুশি। সেই খুশির প্রকাশ হচ্ছে নাচের। মধ্যে দিয়ে, গানের মধ্যে দিয়ে। কারণ রোশেনদার তার প্রথম সন্তান। আজ সেরিনা চাচি তার ছেলের বৌকে ঘরে আনার জন্যে নেচে নেচে চলেছে ছেলের শ্বশুর বাড়িতে। আমি সব্বাইকার পেছনে চলেছি। এই ভাবে আনন্দ প্রকাশ করা এই আফগানিস্তানের। প্রচলিত একটা ধারা। আফগানিস্তানের মেয়েদের এই নাচ ও গান গাওয়াটাই একমাত্র প্রচলিত এবং একমাত্ৰ খুশি ও আনন্দের প্রকাশ। এ ছাড়া মেয়েদের আর কোন কিছুই করার নেই ঘরের কাজ ছাড়া। সমস্ত মেয়েদের দেখলেই মনে হবে যেন তারা অবসাদে ভুগছে। কিন্তু না, ওটাই তাদের জীবন।
এই আনন্দও একদিন শেষ হয়ে গেল। সত্যি সত্যিই মেয়েরা অবসাদপূর্ণ হয়ে উঠল। যে সামান্য স্বাধীনতাটুকু ছিল মেয়েদের তাও খর্ব করে দিল তালিবানরা।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস, আটার বেহেস্তে যাত্রা
১৯৯১ সাল। রাব্বানী সরকারের মধ্যে যারা আছে তারা শহরটুকুর মধ্যেই খুব ভালো করে দেখাশোনা করতে লাগল। গ্রামেগঞ্জে, প্রত্যন্ত গ্রামে চলছে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, দুর্ভিক্ষ। রাব্বানী সরকার ঘৃণাক্ষরেও টের পেল না তাদের অজান্তে তাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে এক বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়াশীল বিরুদ্ধ গোষ্ঠি। গোটা গ্রাম তখন নতুন আন্দোলনের প্রস্তুতিতে তুমুল ঝড় তুলতে শুরু করল।
পুস্তুন জাতের মানুষের কোন অধিকার ফলাতে দিতে নারাজ রাব্বানী সরকার। জাত হিসাবে না, কিন্তু গ্রামের মানুষ হিসাবে মাসুদ আহমেদ শা গজনীর মানুষদের একটু প্রাধান্য দিয়েছিল। এই অনধিকারের আঘাত থেকে তৈরি হতে লাগল প্রতিকারের চেষ্টা। পাঠান জাত। আঘাত বুকে নিয়ে বসে কেবল সহ্য করে যাবে তেমন জাত এরা নয়। এদের কাছে বদলাই শেষ ভাবনা। সেই বদলা নেওয়ার জন্যে আহ্বান করল তালিবানদের। সমস্ত মানুষের বেঁচে থাকতে গেলে যা অপরিহার্যতা হল উন্নতি, বিকাশ, উৎপাদন, শক্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামো এবং এটাই মানুষের বেঁচে থাকার আসল বুনিয়াদ! এই বুনিয়াদের ওপরই গড়ে ওঠে সামাজিক জীবনধারা ও চেতনার উন্নতি। এখানেই হচ্ছে সমস্ত সমস্যার সমাধান। এই সমস্যাই তৈরী করেছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন। এই সমস্যাই জীবনধারাকে ধর্মের গন্ডির মধ্যে বাঁধে। সেই মূল সমস্যার কথা। ভাবেনি কেউ কোনদিন। পাকিস্তান নিজেদের স্বার্থে আফগানিস্তানকে নিজের মতো। করে বাঁচতে দেয়নি। কারণ আফগানিস্তানের জনগণের মধ্যে থেকে মোজাহিদ ছেলেদের বিভিন্ন বিধ্বংসী কর্মে নিয়োগ করে সারা বিশ্বের কাছে পাকিস্তান ভালো থাকতে চেয়েছে। আর আফগানিস্তানের মোজাহিদরা সর্বত্র বদনামের মধ্যে ডুবে গেছে। সেই কারণেই রাব্বানীর সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে নারাজ। পরের জন্যে গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়।(আজ সমস্ত আফগান জনগণের মধ্যে অধিকাংশ মানুষের বক্তব্য–যখন আমেরিকা আফগানের ওপর বোমা বর্ষণ করছে, তখন ভাবা উচিত ছিল আসল দোষী কে? সর্বাগ্রে পাকিস্তানের ওপর বোমা বর্ষণ করা উচিত।)
আমার ব্যক্তিগত ধারণাতে মনে হয় এমন সন্ত্রাস সৃষ্টিকারিদের সমূলে ধ্বংস করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে আটা সহ আরও তিনজন আমেরিকার ঐতিহ্যকে ধ্বংস করেছে এবং সমস্ত বিশ্বে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। এবং যে কিতাবের বাণী আটাকে মৃত্যুভয় জয় করতে শিখিয়েছে সেই বাণীর কি মাহাত্ম। আজ আটাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে যে সে সত্যিই কী কোনও জন্নতে পৌঁছেছে? আছে কি হুরি? পাকিস্তানে এবং সর্বত্র এমন ধর্মীয় উৎকট শিক্ষা যেখানে হয় তা অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। পৃথিবীর সমস্ত দেশ আজ আতঙ্কবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু আতঙ্কবাদী তৈরির কারখানা বন্ধ হচ্ছেনা, আতঙ্কবাদী কোন সমস্যা মাথায় নিয়ে ওই ভয়ঙ্কর নিশ্চিত মৃত্যুর জীবন বেছে নিচ্ছে? সেই মূলে কেউ পৌঁছাবার চেষ্টা করছে না। এই দুটো জিনিস যদি নিশ্চিহ্ন করা যায় তবেই আতঙ্কবাদীরা শেষ হবে। এক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হবে, দুই মাদ্রাসা বন্ধ করতে হবে এবং সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী মন্ত্র নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে এক লাদেনের জায়গায় অন্য লাদেন তৈরি হবে।
আজ আমরা সত্যিই খুব দুঃখিত আমেরিকার নিষ্পাপ জনগণের প্রতি, যারা শিকার হয়েছেন সন্ত্রাসবাদীদের বিধ্বংসী ক্রিয়ায়। এই বর্বর পৈশাচিক কাজের কঠিন বিচার হওয়া আজ প্রয়োজন। তা বলে হাজার হাজর মৃত মানুষ নিশ্চয়ই আমাদের কাম্য নয়। আজ আমরা যেমন দুঃখিত, ঠিক ততোধিক দুঃখিত ছিলাম যখন কাশ্মীরে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন। মহা মূল্যবান প্রাণ আমরা হারিয়েছি কাশ্মীরের বিধ্বংসিকতায়, বিচলিতও দুঃখিত হয়ে পড়েছিল সমস্ত দেশবাসী। তেমন কোন নতুন দুঃখ আমাদের যেন বিচলিত করতে সক্ষম না হয় সে দিকে নজর রাখা প্রত্যেক মানুষের একমাত্র কর্তব্য। আজ পাকিস্তান সরকার উভয়-সংকটের মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করে চলেছে। এমন একটা পরিস্থিতি যে আসতে পারে তা বোধহয় পাকিস্তান পূর্বে উপলব্ধি করতে পারেনি। তবে জানা উচিত ছিল যখন সন্ত্রাসবাদীদের তৈরি করছে। মদত যুগিয়েছে। ১৯৯২ সালে পাকিস্তান সরকার তালিবানদের পাঠিয়েছে আফগানিস্তানে। সেই ক্ষমতাচ্যুত সরকার আজ কেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে? নিরীহ আফগানবাসি কী পাকিস্তানের কাছে এমন একটা বর্বর দল পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল? যখন সমগ্র বিশ্বের কেউ তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, তখন কেন পাকিস্তান স্বীকৃতি দিল?
তালিবানের শর্তগুলো আজ যখন সমস্ত কাগজে পড়ি তখন আমার খুব হাসি পায়। তালিবান শর্ত রেখেছে যে লাদেনকে তারা কোন নিরপেক্ষ ইসলামি দেশের হাতে তুলে দিয়ে বিচার চাইছে। কারণ লাদেন তালিবানের আশ্রিত। খুবই মানবিকতার পরিচয় এটা। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন থেকেই যায় তা হল আমি একজন বিদেশী হয়ে ওই দেশে আশ্রিতা ছিলাম না কী? তবে কেন তালিবান একটা নিরপরাধ আশ্রিতা নারীর ওপর চালিয়েছে যথেচ্ছ অত্যাচার? তবে কী ধরে নিতে পারি যে আমি কাফের বলে ধর্মের ধ্বজাধারী ওই তালিবানেরা আমার জন্যে কোন সুবিচার করার ইচ্ছা মনে পোষণ করেনি? বেশ তাই না হয় হল। তালিবানেরা লাদেনের ক্ষেত্রে শিথিল, কারণ লাদেন মুসলমান তাই লাদেনকে রক্ষা করতে মৃত্যুবরণ করতেও রাজি আছে তবুও আশ্রিতকে সমর্পণ করবে না। এর থেকে মানবধর্মের প্রমাণ আর কি হতে পারে? কিন্তু সমগ্র মানব জাতি একবার ভেবে দেখবেন কি? ডাঃ নজিবুল্লা কিন্তু মুসলমান ছিলেন, সঙ্গে আশ্রিত ছিলেন। ১৯৯০ সালে গদি ছাড়ার পর আফগান সরকারের কাছে আশ্রিত হয়ে মাজার-ই-শরীফে বাস করছিলেন। নজীবুল্লা দোষী কি নির্দোষ সেই বিচারের জন্যে তাকে কেন কোন নিরপেক্ষ ইসলামি দেশের হাতে বিচারের জন্যে তুলে দেওয়া হল না? সেই আশ্রিতকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়াটা কোন মানবধর্মের আওতায় পড়ে? নজিবুল্লাকে হত্যা করাটা কি ইসলামের অবমাননা নয়? এটাই কী শান্তির ধর্ম? নজিবুল্লাকে হত্যা করে আশ্রিতের ওপর অবিচার করা হয়নি কী? তবে আজ কেন এমন শর্তের উদ্ভাবন করা হয়েছে? আসলে তালিবানের জঙ্গী কাজকর্মকে যে বা যারা সমর্থন করবে তারাই ওদের প্রিয়। এমন ধ্বংসকারীর সমাপ্তি হওয়া সত্যিই প্রয়োজন নতুবা আমাদের পরের জেনারেশান এই সুন্দর পৃথিবীর নাগরিক হতে পারবে না। আমেরিকায় যারা আজ জন্মাবে তারা কী আর কোনদিন দেখতে পাবে তাদের দেশের ঐতিহ্য পেন্টাগণকে? যারা বামিয়ান প্রদেশে জন্মাবে। তারা কী আর দেখতে পাবে বামিয়ানের পুরোন ঐতিহাসিক বুদ্ধমূর্তি? যে নারীরা তালিবানের কাছে হারাল তাদের ইজ্জত, তারা কি ফিরে পাবে ইজ্জত? যে মায়েরা হারাল তাদের সন্তান, যুদ্ধের বাতাবরণে তাদের কি করে ফিরে পাবে? এই সমস্ত কিছুর জন্যে দায়ী পাকিস্তান। সুতরাং আফগানিস্তানের জনগণের মৃত্যুর বদলা হিসাবে এবং কাশ্মীরের মানুষের মৃত্যুর বদলে পাকিস্তানকে খেসারত দিতে হবে। মৃত্যুর বদলে মৃত্যু। আমেরিকা আজ যাকে বন্ধু বলে মনে করছে সেখানেই তৈরি হয়েছে ওই জঙ্গীরা, যারা পেন্টাগণ ধ্বংস করেছে। সেই পাকিস্তান হল বন্ধু। আর ধ্বংস হল নিরীহ দেশ।
জান্বজের প্রথম বিবির মানসিকতায় আমার পরাজয়
আসুন আমার সঙ্গে! একবার আফগানিস্তানের মানুষগুলোকে দেখে উপলব্ধি করুন। আশ্চর্য হয়ে গেলেন তো? না, না, অবাক হওয়ার দরকার নেই–আপনাদের সেখানে যেতে হবে না। আমার চোখ দিয়ে দেখুন। ও-ও-ই-যে! দূরে দাঁড়িয়ে দশ বছরের ছেলেটা? যার একটা চোখ নেই? সে সবাই খানের বড় ছেলে। শুধু চোখ নয়? ওর দুটো হাতও নুলো। বেচারা জন্ম থেকেই ওই রকম। আর হবে নাই বা কেন? ও যখন পেটে ছিল ওর মায়ের তখন খুব জ্বর হত রোজ, জ্বর কেন হচ্ছে তা তো দেখার মতো ডাক্তার এই আফগানিস্তানে পাওয়া যাবে না? মুশখেলের কোন এক ডাক্তার রোজ জ্বর হচ্ছে বলে, ভেবে নিল মালেরিয়া হয়েছে, সেই অনুপাতে তাকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ দেয়। তবুও জ্বর যেন ছাড়তে চায় না, তখন ডাক্তার বলে দিল টি.বি. হয়েছে। তখন টি.বি-র ওষুধ দিতে লাগল। এর কিছুদিন পরে সেই মহিলার একটা ছেলে জন্ম নিল। তারও দুমাস পরে সেই মহিলা মারা গেলেন। নিজের মা ছাড়া সন্তানের যা অবস্থা হয় তার থেকে কম কিছু অবস্থা ওই দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার নয়। সে প্রতিবন্ধী। তাও তাকে দেখার কেউ নেই। আর দেখে কি হবে? এমন ঘটনা। এদেশে নতুন কিছু নেই। বরং গুলগুটির কাছে যাই, ওর মনটা খুবই খারাপ, কারণ
মাত্র একমাস হল গুলগুটির মা মারা গিয়েছে। খবরটা প্রথমে আদম এসে দিল আমাকে। সবে সকাল হয়েছে, বারান্দায় বসে আমরা চা খাচ্ছি। হঠাৎ আদম এল হাতে একটা তসবি ঝুলিয়ে। আমাদের সামনে বসল, জিজ্ঞাসা করল–চায় খতম দ্যা? চা শেষ হয়েছে?
সাদগি বলল-অয়লি? তু সুরাইয়ে? রাওরাম?
অর্থাৎ–কেন? তুমি খাবে? আনব?
আদম বলল–নে সুয়ারাম, যাম কোরতা, সাহেব কামাল সারা লিক কারদা।
অর্থাৎ-না খাব না, বাড়ি যাব, সাহেব কামালের সঙ্গে একটু দরকার।
আমাকে নিয়ে আদম ঘরে এল, বলল-গুলগুটি মোর মরসয়াই। ওস মা ওয়াই, বিয়া জারে, তু দে সারা ওরজা।
অর্থাৎ–গুলগুটির মা মারা গেছে, এখন বোল না, তবে কাঁদবে, ওর সঙ্গে তুমি যাও।
আদম চলে গেল, আমি চুপি চুপি বাড়ির অন্য সবাইকে ডেকে বললাম। তারপর গুলগুটিকে বললাম–গুলগুটি, নান কোরতা জরু না লেগিইজে, রাজা, জেসুজে তা প্লার কোরতা। ঢের শিয়ে নাদা উৎলালাই।
অর্থাৎ-গুলগুটি, আজ বাড়িতে মন বসছে না,এস, চলো যাই তোমার বাবার বাড়ি অনেকদিন যাইনি।
গুলগুটি বলল–নান নে জাম, কোরতা ঢের কার দা, সাবায়র জাম।
অর্থাৎ–আজ যাব না, বাড়িতে কাজ আছে, কাল যাবো।
আমি নাছোড়বান্দার মতো করে বললাম আজই যাবো। গুলগুটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলল আমার সঙ্গে। বাড়ির ছেলেরা আগেই চলে গেছে। আবুও চলে গেছে। এক সঙ্গে যেতে গেলে গুলগুটি বুঝে ফেলবে সেই কারণে। আমি ও গুলগুটি চলেছি। এক হাঁটু বরফ টপকে। যে দিকে তাকাও শ্বেতশুভ্র বরফ আর বরফ। গুলগুটির বাপের বাড়ি কানাওখেল গ্রামে। আমাদের বাড়ির উত্তরে যেতে হবে সোজা প্রায় মাইল দশেক। সোজা রাস্তায় যেতে গেলে প্রায় মাইল পনেরো হবে। তাই আমরা গ্রামের মধ্যেকার রাস্তা ধরে যাই। গমের ক্ষেতের ওপর দিয়ে যাওয়া, কম করেও প্রথম দিকটাই ছটা গমের ক্ষেত পেরিয়ে পরে ড্যাডিই মামার বাড়ি। ভ্রানাই চাচার শালা ড্যাড়িই মামা। এই মামার বাড়ির বাঁ হাতের রাস্তা দিয়ে গিয়ে খানিকটা তারপর আবার ডান দিকে গিয়ে প্রায় সাতটা কি আটটা গমের ক্ষেত পেরিয়ে বাঁদিকে গুলগুটির বাবার বিশাল কালা। গুলগুটির মা আমার শ্বশুরের বোন। একটিই বোন। আমাদের বাড়ির সবাই যাবে, আবুতো যাবেই। আবু ও গুলগুটির মা খুড়তুতে জ্যাঠতুতো বোন? আবু হচ্ছে ভ্রানাই চাচার নিজের বোন, বিয়ে হয়েছে আমার জ্যাঠ শ্বশুরের সঙ্গে। এদের এই সম্পর্ক বিষয়ে আমি কেমন যেন অবাক হয়ে যাই। কেবল অবাক নই, কেমন যেন লজ্জা করে। মামার ছেলের সঙ্গে ছোটো বেলায় খেলাধুলো, ভাই বলে পরিচয় দেওয়া, পরে তাকে বিয়ে। আবার কাকার ছেলের সঙ্গে একই সংসারে থেকে ভাই ও বোনের মতো বড় হয়ে ওঠে পরে বিয়ে। এক ধরনের অস্বস্তি আমাকে বিব্রত করে। আমরা প্রায় গুলগুটির বাবার বাড়ির কাছে এসে গেছি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। বাড়ির বাইরে জুমাতে (মসজিদ) অনেক লোক বসে আছে, সবাই সাদা পোশাকে ও কালো চাদর গায়ে দেওয়া। গুলগুটি দূর থেকে দেখে সন্দেহ প্রকাশ করে। তার মা আজ দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ ছিল। সুতরাং তার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মা আর এই দুনিয়ার মেহমান নেই। হঠাৎ গুলগুটি বিকট স্বরে আদি বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। গুলগুটির এই পৃথিবীতে কষ্টের ভাগিদার ছিল একমাত্র আদি। মাকে এখানে মোর, আদি, আরও অনেক নামেই সম্বোধন করে। গুলগুটি রাস্তার মধ্যেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে–আজ থেকে আমি এতিম হয়ে গেলাম। সাহেব কামাল আমার দুঃখের আর কোন ভাগিদার রইলো না। (পুস্তুতে কথা হয়)।
আমার চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। না, লাগি মারা গেছে বলে নয়। গুলগুটির মাকে আমাদের বাড়ির সবাই লাগি বলে ডাকে বলে আমিও লাগি বলি।
মানুষ কেউ চিরস্থায়ী নয়। জন্মালে মরতে তাকে হবেই। আজ অথবা কাল। কিন্তু গুলগুটির বলা কথাগুলো আমাকে বিদ্ধ করল। দুঃখের ভাগিদার?
তবে কি গুলগুটি আমাদের বাড়ির সব কথা লাগিকে বলত?
আশ্চর্য! এই ভাবনা এতদিন তো আসেনি মনে? মায়ের কাছে মেয়ে তো বলবেই সব কথা। সেটাই তো স্বাভাবিক? কিন্তু কই? লাগি তো কোনদিন আমার সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করেনি? বরং গুলগুটির প্রতি তার যেমন ভালোবাসা ছিল তার থেকে কোন অংশেই তো আমার প্রতি কম ছিল না? যখনই এই বাড়িতে এসেছি আমার জন্যে মুরগি জবাই করেছে। আমার বাড়িতে ঘি নেই বলে ঘটি ভর্তি করে আমার জন্যে ঘি পাঠিয়েছে। অথচ তার মেয়েকেই তো আমি স্বামী সুখ থেকে বঞ্চিত করেছি। কেবল বাড়ির দাসীর মতো করে রেখেছি গুলগুটিকে। এমনকি স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে নিষেধও করেছিলাম। তার মা আমাকে সব কিছু জানার পরেও বুকে জড়িয়ে ধরে দুগালে আদরের চুমা খেয়েছে! জানি না, আমার বাঙ্গালি মা এতটা উদার হতে। পারত কিনা। আমার ঠাকমাতে কখনই পারত না। মাস্টারমশাই আমার কান মুলে দিয়েছিলেন ইতিহাস লিখতে গিয়ে উল্টোপাল্টা লিখেছিলাম বলে। ঠাকমা আমার অন্যায়টা কোন অন্যায় বলে মানতে নারাজ, বাবাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল–আমি কোন কথা শুনতি চাইনে, কেষ্ট তুমি এখুনি ওই উনোমুখো মাস্টারকে বিদায় দাও।
বাবার তো মায়ের ওপর কথা বলার কোন সাহসই নাকি নেই। মাকে প্রথমে বোঝালেন পরে বাধ্য হয়ে সেই মাস্টারকে বিদায় দিলেন। কিন্তু মায়ের ওপর একটু অভিমান করে বসে রইলেন। ঠাকমা বুঝল সেটা, তাই একদিন সন্ধের সময় ঠাকমা বাবাকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, বলল-শোন কেষ্ট ওই সব কম বয়সি মাস্টারদের মায়াদয়া থাকে না, কারণ ওদের বে-থা হয়নি, ছেলে-পুলে নেই, ওদের মায়া হবে। কেমন করে? ছেলে-পুলে না হলি কি মায়া হয়?
বাবা তার মায়ের যুক্তির কৈফিয়ৎ শুনে হেসে ফেলেন। আমার তো মহা আনন্দ, বেশ কয়দিন সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসতে হবে না। পচা মামাকে ডেকে এনে গল্প শোনা যাবে। কেবল ঠাকমা যে মারার অপরাধে মাস্টার বদল করতেন তা নয়, আমার মেজো কাকাও ওই ঠাকমার পথের পথিক ছিলেন। মেজো কাকা মাস্টার মশাইয়ের মুখের ওপর বলে দিতেন-ওকি? তুমি ওকে মারলে? না না এতো ভালো কথা নয়? মেয়ে মারা মাস্টার যে তুমি? না বাপু তুমি আর কাল থেকে এসো না, তোমার ভাগ্য ভালো যে আমার মা দেখেননি, নইলি তোমারে যে কি করত তা তুমি দেখতে।
হয়তো সেদিন ঠাকমা সামনে ছিল না, তাই ঠাকমার হয়ে কাকাই শাসনটা সেরে নিল। পরে যখন আমাকে পড়াবার জন্যে মাস্টার খুঁজতে ব্যস্ত কাকা, ঠাকমা তখন কোন মাস্টারমশাই আর আমাকে পড়াতে রাজি হলেন না। মাস্টারমশাই একবার আমাদের পাশের বাড়ির ভবেশ জেঠুকে বলেছিলেন–ওরে বাবা, সুমিকে পড়াতে যাবো? না বাবা, ওর ঠাকমা, মেজো কাকা, আমার হাড়-মাস পর্যন্ত গিলে খাবে।
পরে ঠাকমা খুঁজে খুঁজে একজন দিদিমণির ব্যবস্থা করেছিলেন। দিদিমণিরা মেয়ে, তাদের শরীরে মায়া-দয়ার ভাগ নাকি বেশি। অবশ্য সেই দিদিমণিই টিকে গিয়েছিলেন। গীতা দি। একদম ক্লাস সেভেন পর্যন্ত গীতাদির কাছে পড়েছি, তারপরে দিদিমণি আর পড়াতে পারলেন না। অঙ্কটাতেই তিনি আটকে গেলেন। আমার ঠাকমাতো দিদিমণিকে ভীষণ ভালোবাসততা। এমন কি যদি জাতে কুলাতো তবে হয়তো দিদিমণির পরে আমার ছোটো কাকিমা হওয়াটাও কোন বিচিত্র ছিল না। আমার বাবা তো হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন যে আর মেয়ের পড়ার জন্যে অন্ততঃ মাস্টারমশায়ের খোঁজে বেরুতে হবে না। আমার ছোটো কাকা ইছাপুরে একটা মেয়েকে ভালোবাসত বলে শুনেছি। কিন্তু দাদু ও ঠাকমার ভয়ে কোনদিন মুখ ফুটে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি। কারণ ঘোষেদের মেয়ে ছিল বলে আমার দ্বিতীয় ছোটোকাকিমার বাবার খাটো পৈতে বলে
তিনি কোনদিন উপযুক্ত মর্যাদা পাননি। অথচ সেই বাড়ির মেয়ে আমি। আমিই প্রথম এই জাত ব্যবস্থার থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এই জাতীয়তাবাদের প্রতিকার হিসাবে ধর্মের বিভেদের প্রতিকার করলাম। সেই বাড়িতে মুসলমান জামাই উপহার দিলাম।
গুলগুটির মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটু অতীতে চলে গিয়েছিলাম। আমরা পৌঁছে গেছি গুলশুটির বাপের বাড়িতে। বারান্দায় শোয়ানো আছে লাগির অসাড় শরীরটা। একদিন আগেও এই শরীরটার মধ্যে ছিল প্রাণ। তখন এই শরীরটার কত কিছু প্রয়োজন ছিল, কত চাহিদা ছিল, কত অধিকার স্থাপনের অহংকার ছিল, কত যন্ত্রণা ছিল, ছিল মন হৃদয়, ব্যথা, বেদনা, দুঃখ-কষ্ট। আর একদিন পরেই আজ কেবল পড়ে আছে একটা মাংসের ডেলা। যার মধ্যে রক্তের ধমনিগুলো আর কোনো ভাবেই উজ্জীবিত হয়ে উঠবে না। যে শরীরটার আর কোন কিছুর প্রয়োজন পড়বে না। কোন যন্ত্রণা, কষ্ট তাকে বিচলতি করবে না। মস্তিষ্কের রন্ধ্রে আর রাগ অথবা শান্তি পুঞ্জিভূত হবে না। কোন মূল্য আর রইল না এই শরীরটার। একটু পরেই এই মহামূল্যবান শরীরটা চলে যাবে মাটির কবরের নামে একটা লম্বা ও খানিকটা চওড়া গর্তে। আচ্ছা! প্রাণটা কোথায়? সে-ও কি শরীরের মতোই অসাড় হয়ে গেছে? আৰু বলেছিল–মানুষ মরে গেলে সে জন্নতে যাবে যদি সে মুসলমান হয়।
আমি আবুকে প্রশ্ন করেছিলাম, যদি মানুষ পাপ করে তাও জন্নতে যাবে কেবল মুসলমান বলে?
-না, পাপ করলে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। তবে যদি খুব ছোট্ট বাচ্চা মরে যায় সে তার বাবা-মাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে জন্নতে।
–কেমন করে হয় তা আৰু পাপ করেও কি করে যাবে জন্নতে।
-ওই যে ছোট্ট বাচ্চাটা মরে যায়, সে তো কোন পাপ করেনি, সে তত শিশু। শিশুদের কোন পাপ থাকে না। তখন সে কোন সওয়াল জবাব ছাড়াই জন্নতে যায়। এবং ঘুরে বেড়ায় জন্নতে, খোঁজে তার বাবা-মাকে। তারপর যখন বাবা-মা মারা যায় তখন যদি তারা জাহান্নামেও যায় তো সেখান থেকে সেই শিশুটি তাদের উদ্ধার করে জুন্নতে নিয়ে যায়। আল্লার কিছুই বলার থাকে না। সন্তানের থেকে বাবা মাকে তো আর আলাদা করতে পারে না!
–শিশুটি কি করে বোঝে তার বাবা মা মারা গেছে বা জাহান্নামে গেছে? সে তো জন্নতে থাকে, জন্নত থেকে জাহান্নাম তো অনেক দূরে।
–বাবা মায়ের গায়ের গন্ধে বুঝতে পারে যে তারা এসে গেছে।
–তাই বল! তা হতে পারে। জন্নতের আগুনের লেলিহান শিখার হাওয়া বোধ হয় সেই গন্ধ বহন করে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেয় শিশুটির নাকে। বাবা মায়ের আগমন বার্তা পেয়ে শিশুটি হোটে জাহান্নামে।
বাঃ! বাঃ! কি চমৎকার! আর কি তার ঘ্রাণশক্তি? দীর্ঘ বছর পরেও বাবা মায়ের গায়ের গন্ধ খোঁজা কি চাট্টি খানি কাজ?(সমস্ত কথাই পুস্তুতে হয়েছে)।আবু অনেকক্ষণ পরে অনুধাবন করেছে যে আমি আবুর সঙ্গে মস্করা করছি, তখন আমাকে তাড়া করে বলে–ওদাড়িয়েজা, বাঙালি। (দাঁড়াও বাঙালি)।
আমি তখন উধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাই।
এই রকম একবার দৌড় লাগাতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলাম, ব্যাপারটা অন্য কিছুনয়, ডাংগুলি খেলতে গিয়ে। আফগানিস্তানে ভাংগুলি খেলাকে লকড়ি খেলা বলে। একদিন দেখি উঠোনের মাঝখানে দিনার (আসাম চাচার ছেলে) আমার ছোটো দেওর শাওয়ালি, আবুর ছোটো ছেলে যারখান, দ্রানাই চাচার ছেলে রোশেনদার, মিরাওজাল লকড়ি খেল (ডাংগুলি) খেলছে। আমি ঘরের কোণে বসে ছিলাম। জান্বজের সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে আমার। সবে মাত্র দুমাস হয়েছে আমার, আমি এই বাড়িতে এসেছি। ওদের খেলতে দেখে আমি জাজের সঙ্গে রাগারাগির কথা ভুলে গিয়ে দৌড়ে গেলাম ডাংগুলি খেলতে। আমি তখন ওদের ভাষা বুঝিও না, বলতেও পারি না। কেবল ইশারায় চলে আমার কাজ। আমি গিয়ে প্রথমে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমি খেলব। কিন্তু ওরা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তখন বাধ্য হয়ে শাওয়ালির হাত থেকে ডাং ও গুলি কেড়ে নিলাম।ওরা হকচকিয়ে গেল, তারপর আমি বললাম অসভ্য বাঁদরগুলো ইশারাও বোঝ না? আমি বাংলায় বললাম। ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সব যেন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম এস আমি খেলব, বলে আমি পিলের কাছে গিয়ে গুলি রেখে খেলতে গেলাম, এবার ওরা বুঝল এবং পরম উৎসাহে খেলতে এল।
সে কি আনন্দ আমার। সারা উঠোন দাপিয়ে খেলতে লাগলাম। বাড়ির সব মেয়ে বৌরা লাইন করে দাঁড়িয়ে দেখছে আর খুব আনন্দের হাসি হাসছে। এমন সময় নাদির চাচা এল তার দু বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে। নাদির চাচা দ্রানাই চাচার বড় দাদা। নাদির চাচা সিঁড়ির ওপর বসে হাসছে আর বলছে-সাবাস; সাবাস বেটি, সবকো হারা দো। অন্যান্য বৌদের দিকে তাকিয়ে কিসব যেন বলল,আমি বুঝলাম আমার কথাই বলছে। আমার তিনশ পয়েন্ট হয়ে গেছে, এমন সময় গুলিতে এমন মারলাম তা ছুটে গিয়ে লাগল সোজা নাদির চাচার চোখে। নাদির চাচা চিৎকার করে উঠল, আমি চেয়ে দেখি গলগল করে রক্ত পড়ছে। আমি আর সেখানে দাঁড়াই? এক দৌড়ে চলে যেতে গেলাম, মুখ থুবড়ে পড়ে তাড়াতাড়ি উঠে আবার দৌড়ে চলে গেলাম একেবারে ভ্রানাই চাচার কাছে, গিয়ে সব বললাম। দ্রানাই চাচা শুনে বলল-যাও, জলদি চুপ যাও সেরিনা চাচির ঘরে, নইলে তোমায় দেবেখন (হিন্দিতে কথা হল)। তারপর প্রায় ঘণ্টা দুই পরে বাড়িতে ফিরে এসেছি। আসাম চাচা আমাকে ডেকে বলল-কিউ এয়সা করতা বেটি? তুম বাচ্চা হ্যায়, যো লকড়ি খেল খেলনে গিয়া? আভি তুম ঘরকা বোহ হ্যায়, আদমি লোক শুনেগা তো কেয়া বাতায়গা?
আমি কিছু না বলে ঘরে চলে এলাম। মনে খুবই কষ্ট নাদির চাচার জন্যে। সবাই বলছে বাঁ চোখে লেগেছে। কি জানি চোখটা বোধহয় কানা হয়ে যাবে।
সত্যিই নাদির চাচার চোখটা কানা হয়ে গেছে, সেই চোখে আর কিছু দেখতে পায় না। আমাকে অবশ্য কিছু বলেনি, বলে মুশাফর, ওকে কিছু বোলো না। ও আমার বেটি।
কি আশ্চর্য!লাগির শরীরের কাছে দাঁড়িয়ে আমি অন্য কথা ভাবছি? আচ্ছা লাগির প্রাণটা কী জন্নতে গেল? নিশ্চয়ই যাবে, লাগির অনেকগুলো ছোটো বাচ্চা মরে গেছে। অদ্ভুত! আমি একবার আকাশের দিকে তাকালাম, জন্নত কোথায়? আকাশে, পাতালে না কি এই মর্ত্যে? আর ভাববার সময় পেলাম না, রহিম খান তার মায়ের কাছে এল। আরও অনেকে এল। তারপর কফিনের মধ্যে লাগিকে শুইয়ে দিয়ে অনেকে মিলে নিয়ে চলল। বাড়িতে সবাই কান্নায় লুটোপুটি খেতে লাগল। ওই প্রাণহীন শরীরটা যে এদের মা একটা প্রাণ নামের বস্তু ওই শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে যে মাংসপিণ্ডকে এতদিন পরিচালনা করল তার হদিস কেউ পেল না, সেই অদেখা বস্তুটার খোঁজে কেউ মাথা ঘামাল না। ওই শরীরটা চলে গেল অনেকক্ষণ। সকলের কান্নার রেশ একটু কমেছে। বার তিনেক ফিট হওয়ার পরে গুলগুটি এখন একটু সুস্থ হয়ে বসে শবেরাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। সামনের উঠোনে পাথর দিয়ে উনোন বানিয়ে কায়িম তাতে দুম্বার মাংসের সুরুয়া রান্না করতে ব্যস্ত। লম্বা বারান্দায় লাইন করে বসে সব মেয়ে-বৌরা গল্প করতে ব্যস্ত, আজ বাড়ির মেয়ে বৌদের কোনও কাজ নেই। সবই করবে ছেলেরা। আর রান্না করবে কাইম। বাইরে মসজিদে বহু মেহমান এসেছে, মুহূর্মুহূ চা যাচ্ছে সেখানে।এবার গল্পের বিষয় ও বস্তু হচ্ছে আদি কি খেতে ভালোবাসত, কি ভাবে ছেলের বৌদের শিক্ষা দিত, কতটা কোন বোকে ভালোবাসত, ছেলেদের জন্যে তার কত চিন্তা ছিল, কোন মেয়েকে কতটা ভালোবাসত, কোন মেয়ের জন্য কতটা চিন্তা ছিল ইত্যাদি। আমি চুপ করে বসে সব দেখছি শুনছি। কি অদ্ভুত সমস্ত মনের মানুষ। সে বেঁচে থাকতে তার কোন কদর ছিল না, সে কার জন্যে ভাবে সে সম্পর্কে কেউ ভাবল না। আর আজ সে নেই, তাকে কে কি বলল, সুনাম, নাকি দুর্নাম করছে তাও আজ তার আর কিছু আসে যায় না। কোথায় সেই শরীর আর কোথায় বা তার প্রাণ? তবুও সবাই বলছে আর একবার করে কাঁদছে। বেলা প্রায় দুটো বাজতে যায়। এবার বাড়ির সবাই এবং আগত মেহমানরা সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল খাওয়ার জন্য! লাগি যখন সকালে মারা গেছে, তখনই সৈয়েদ খানকে দুম্বা কিনতে পাঠিয়ে দিয়েছিল রহিম খান। লাগির তিন ছেলে, বড় রহিম, মেজো লাল, ছোট সৈয়েদ। লাল খান এখন হিন্দুস্তানে। তার মা চলে গেল এই দুনিয়া থেকে ওই দুনিয়ায়। এদের কথায় এই দুনিয়া হচ্ছে খেলার দুনিয়া, আল্লা এই দুনিয়াতে খেলতে পাঠিয়েছেন। ওই দুনিয়া অর্থাৎ মরে যাওয়ার পরে যে দুনিয়াতে যেতে হবে সেটা হচ্ছে আসল দুনিয়া। এই দুনিয়াটা একটা নাট্যমঞ্চ, আল্লা নাট্যকার ও পরিচালক আর আমরা হচ্ছি তার তৈরি অভিনেতা-অভিনেত্রী। অভিনয় শেষে সবাইকে ফিরে যেতে হবে নিজের ঘরে। এই রঙ্গমঞ্চে এসে সবার সঙ্গে তৈরি হয় এক আত্মিক সম্পর্ক হয় বিয়ে, সন্তান থাকে মায়া, মমতা এ সব কিছুই একটা নাটক। মৃত্যু এই নাটকের যবনিকা। আমি ভাবি। এই যাদের জীবন দর্শন তারা কেমন করে হয় মূর্খ? এদের সরলতাকে অন্য সবাই করছে হাতিয়ার। যাই হোক, লাগির মৃত শরীরটা তখনও বারান্দায় শোয়ানো আছে, ওদিকে উঠোনে জবাই হচ্ছে খয়রাতের জন্যে মুগান অর্থাৎ দুম্বা। এখানে মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হয় এই খয়রাত অর্থাৎ শ্রাদ্ধ। সেই শ্রাদ্ধে কোন পুরুত এসে মন্ত্র পড়ে না আত্মার সন্তুষ্টির জন্যে। কেবল মসজিদের ভেতর মৌলবী বসে কোরাণ। পাঠ করে, আর গ্রামের সমস্ত মানুষ, গরিব বড়লোক নির্বিশেষে তাদের খাওয়ানো হয়। এখানে গরিব বলে সে আলাদা বসে ভিক্ষা পাওয়ার মত খাবার পাবে তা নয়, গরিবরাও বড়লোকের সঙ্গে বসে সম্মানের সঙ্গে খাবে। দুপুরে মুরুয়া মাংস খেয়ে আবুর সঙ্গে বাড়িতে চললাম। গুলগুটি এখন কদিন এখানে থাকবে, কারণ তার মা মারা গেছে। বাড়ির একজন সদস্য এই দুঃখের দিনের সাক্ষী হতে পারল না। সে জানতেই পারল না কত বড় আপনজনকে আজ সে হারাল। দু-ফোঁটা চোখের জলও মায়ের জন্যে সে ব্যয় করতে সক্ষম হল না, কারণ গরিবী দেশের অশান্তি তাকে হিন্দুস্তানের মাটিতে রোজগারের জন্যে বসিয়ে রেখেছে। আপনজনের থেকে ভালোমন্দে বঞ্চিত করেছে।
বিকেল হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। হয়তো একটু পরেই বরফ পড়তে শুরু করবে। আবু ও আমি চলেছি সেই বরফের ওপর দিয়ে। এখানে সমস্ত জায়গাতে হেঁটেই যাতায়াত করতে হয়। পা দুটোই গাড়ি আবু খুব তাড়াতাড়ি হাঁটে, আমি অত তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারি না। আবু বলে–স্যায়কে বাঙালি? অয়লি সাতে? মকা। (কি হল বাঙালি পেছনে কেন? তাড়াতাড়ি কর)।
এখানে বাড়িতে ফিরে কাপড় ছাড়ে না কেউ, আর নিমপাতাও খায় না, আগুনেও হাত দেয় না। এরা নিজেদের নিয়ে নিজেরা থাকে। বাইরের জগতের খবর এরা জানে না, পায় না, পাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। কেবল দুবেলা পেটপুরে খাবার চায়, মাথার ওপর ছাদ চায়। চাহিদা একেবারেই নেই, সুতরাং বিলাসিতার প্রশ্নও নেই।
আমার ঘরে আজ আমাকে একা শুতে হবে। গুলগুটি ও আমি একই ঘরে থাকি। কিন্তু যতদিন জান্বাজ ছিল এখানে ততদিন গুলগুটিকে আমার প্রয়োজন পড়েনি। আজ ও আমার কাছে অপরিহার্য। এমন করে ও যে আমার জীবনে একদিন ভয়ঙ্কর ভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।বিছানায় শুয়ে ভাবছি, আমার এই বন্দী জীবনের কথা। আজ প্রায় দুবছর হয়ে গেছে জান্বাজ চলে গেছে হিন্দুস্তানে। রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় তার কথা মনে করতে আমার ইচ্ছে করে না। তবুও গুলগুটি যখন বলে–সাহেব কামাল, ও যেমন তোমার আমারও তো বটে? ও যখন দেশে ফিরবে তখন কখনও কখনও আমার ঘরেও তাকে আসতে দিও। আমি তো কোন দোষ করিনি?
গুলগুটির কথা শুনে হৃদয়ের কোথায় যেন একটা চিন চিন করে যন্ত্রণা হতে থাকে। অনেক ভেবে চিন্তা করেও সে যন্ত্রণা আমি বন্ধ করতে পারি না। একদিন আমরা সবাই বসে চা খাচ্ছি, গুলগুটি সাদগি, সুলতান বিবি ও আমি। সেদিন আলোচনায় আমি রেগে সুলতান বিবিকে বলেছি–দাঁড়া, জাম্বাজ এলে আমি আলাদা হয়ে থাকব, তোদের সঙ্গে আর থাকব না।
তখন গুলগুটি বলেছে–তুমি সব্বাইকার সঙ্গে আলাদা হতে পারবে। কিন্তু আমার সঙ্গে তুমি আলাদা হতে পারবে না কারণ আমার স্বামীও যে জাম্বাজ। সুতরাং তোমার ও আমার বিচ্ছেদ কোনোদিন হবে না। এবং আমার সন্তানও তোমার। আমাদের স্বামী একজন তাই আমরাও এক ও অভিন্ন। হেরে যাচ্ছি, প্রতিপদে প্রতি মুহূর্তে আমি হেরে যাচ্ছি একমাত্র গুলগুটির কাছে। ও যেন আমাকে হারিয়ে দেওয়ার জন্যেই তৈরি হয়ে থাকে। বার বার গুলগুটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে জাম্বাজ কেবল আমার নয়। জাব্বাজকে ভাগ করে নিতে হবে আর একজনের সঙ্গে। এক অকল্পনীয় বাস্তব। যে বাস্তব আমি ইচ্ছে করলেও জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারব না।
বাইরে বরফ পড়ছে। জানালায় দেওয়া প্লাস্টিকের ওপর বরফ পড়ছে, তার শব্দ একটা মায়াজাল সৃষ্টি করছে। মনে পড়ে এমনি শব্দ হলে যাতে আমি ভয় না পাই তাই জান্বাজ হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে একেবারে কোলের মধ্যে টেনে নিত। আজ সে আমার কাছে নেই কিন্তু স্মৃতি আমাকে তার যেন অনেক কাছে নিয়ে গেল। তবুও যেন অনেক দূর। যেমন শরীরে এবং তেমনি হচ্ছে মনের। গুলগুটির নির্ভেজাল সত্যি কথাগুলো আমাকে ভীষণভাবে ক্লান্ত করে দেয়। তবে কি সারাজীবন স্বামীর ভাগ বাটোয়ারা করে একটা সমঝোতায় এসে জীবন অতিবাহিত করতে হবে? এদিকে গুলগুটি ছাড়া জীবনটাও তো ভাবতে পারছি না? কিসম, শবেরাকেও তো আমার জীবন থেকে আলাদা করতে পারছি না? মা হয়ে সাদগি যেদিন সন্তানের মৃত্যু কামনায় খোদার কাছে দোয়া চাইছিল? বাবা হয়ে কালাখান সন্তানের মুখ দেখতে চায়নি, ঘৃণা ভরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে একটা সদ্যজাত ফুলের মতো শিশুকে? সেদিন আমার মাতৃহৃদয়ে ব্যথা লেগেছে। সবে মাত্র হারিয়েছি আমি আমার গর্ভের সন্তানকে। বার বার আমার মনে হয়েছে ওই সাদগির আরামুনাই (নিকার আগে বাপের বাড়িতে প্রেগন্যান্ট হলে সেই সন্তানকে কেউ গ্রহণ করে না এবং তাকে আরামুনাই বলে) মেয়েটাই হয়ত আমার হারিয়ে যাওয়া সন্তান। মায়ের অক্ষমতাকে অনুধাবন করে আবার আমার কাছেই ফিরে আসতে চাইছে। সেই অবহেলিত, ঘৃণিত আরামুনাইকে আমি স্নেহ ভরে, আদরে ভালোবাসায়, মায়া মমতায় নিজের বুকে আশ্রয় দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছি। সে আমার আপন নয়? তার প্রতি আমার কোন অধিকার নেই? কারণ। তাকে আমি গর্ভে ধরিনি বলে? সে জাজের ঔরসে গুলগুটির গর্ভে হয়নি বলে? না।
খুব ঠাণ্ডা লাগছে। বাইরে বরফ বোধহয় হাঁটু সমান হয়ে উঠেছে। রাত এখন কত হবে কে জানে? গুলগুটি বাড়িতে থাকলে অনেকক্ষণ বসে গল্প করি চা খাই। রেডিওতে নাটক শুনি, বি. বি. সির বাংলা অনুষ্ঠান শুনি। তালিবানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে টেপটা কুয়োর সামনে মাটির গর্তে রেখে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিলাম যখন ওরা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে সিজ করছিল সমস্ত টেপ, রেডিও, এ, কে ৪৭, কালাউশনিকভ ইত্যাদি। আমার টেপটা টু-ইন-ওয়ান। আজ গুলগুটি নেই বলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছি। তাই রাত যেন শেষ হচ্ছে না। কাল আবার সব মেয়েদের বন্দুক চালানো শেখাবার কথা। নাদির চাচার পাখি মারার বন্দুকটা এনে রেখেছি। পাঁচশো টাকার একটা গুলির প্যাকেট কিনেছি। স্টিলের ছোট্ট ছোট্ট গুলি। টিপ ঠিক হচ্ছে কিনা বোঝার জন্যে দেওয়ালে খানিকটা জায়গায় মোটা করে মাটি লেপে রেখেছি, গুলিবিদ্ধ হওয়ার মতো। মেয়েগুলোর উৎসাহ দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। আমার মনে হয় মেয়েগুলো বাঁচতে চায়, কেবল বেঁচে থাকার জন্যে বাঁচা নয়। নারীরা প্রকৃত অর্থে বাঁচতে চায়। সেই কারণে ওরা ছুটে আসে আমার কাছে, শিখতে চায় প্রতিবাদের ভাষা, শিখতে চায় কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। জানতে চায় কেমন করে স্বামীকে রুখবে আর একটা বিয়ের থেকে। যদি তা রোখা না যায় কোন মতে, তবে এক সঙ্গে দুই বিবি নিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা কোনক্রমেই যেন মেনে না নেয়। তাতে হয়তো সাময়িক স্বামীর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হতে হবে কিন্তু বেশ কিছুদিন পরে যখন স্বামী দেখবে বিবি তত মেনে নিচ্ছে না তখন বাধ্য হয়ে রাজী হবে। মেয়েদের আমি শিখিয়েছি যে নিজের লজ্জা কেন অন্য মেয়ের সামনে তুলে ধরবে? স্বামীর কাছে দুটো বৌ এক হতে পারে, কিন্তু কোন মেয়ের কাছে তো স্বামীর আর একটা বৌ এক নয়? পুরোন বৌয়ের প্রতি আকর্ষণ না থাকলেও নতুন বৌয়ের প্রতি আকর্ষণ তীব্র থাকে। সুতরাং স্বামীর মানার সম্ভাবনাই বেশি। এই ভাবে একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে নারীদের মনে রাখতে হবে নারীরা কেউ আলাদা নয়। সমস্ত নারী এক ও অভিন্ন। সমস্ত নারীর কষ্ট যন্ত্রণা, ব্যথা-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া সবই এক। জাত, ধর্ম আলাদা হতে পারে, তবে মন-হৃদয়, ভালোবাসা তো আলাদা নয়? তাই যদি হত তবে সমস্ত পৃথিবীর মেয়েদের ভাষা জাত, ধর্ম অনুযায়ী হত কষ্ট, যন্ত্রণা, ব্যথা। সন্তানের জন্যে মায়েদের চোখের জলের রং হত আলাদা আলাদা, স্বামীর জন্যে ভাবনা হত ভিন্ন। মনের যন্ত্রণা হত নানা রকম। কষ্ট হত এলোমেলো পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন মত ও ভাবনা পোষণ করে। নানা চিন্তা নিয়ে কিন্তু নারী নয়।
তালিবান সত্যিই কি শেষ?
যুদ্ধ! তালিবানের সঙ্গে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে যুদ্ধ ঘোষণা করল আমেরিকা। সেপ্টেম্বরেই ১৯৯২ সালে তালিবান উরগুণ দখল করেছিল। সেপ্টেম্বরের, ১৯৯৩ সালে সমস্ত গ্রাম দখল করেছিল গজনী, গড়দেশ, তামির খোস্ত ইত্যাদি প্রদেশ। সেপ্টেম্বরের ১৯৯৪ সালে ইঞ্জিনিয়ার গুলবদীন হেকমতিয়ারের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে ১৯৯৫ সালে মাজার-ই-শরীফ দখল করার উদ্দেশ্যে রাব্বানী সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তালিবানের জন্যে সেপ্টেম্বরে বহুবার খুশি বহন করে এনেছে বলে সেপ্টেম্বরেই লাদেন তার বিধ্বংসী কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু ভাবতে পারেনি সেপ্টেম্বরে বারবার সফলতা দিলেও কখনও উল্টো হয়ে যেতে পারে। সেটাই হল। যুদ্ধ। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এটাই যে এত তাড়াতাড়ি কি করে সমস্ত তালিবান পিছু হটে গেল? আমার ধারণা কি করে বদলে যেতে পারে? আমি কোনমতেই বিশ্বাস করি না যে তালিবান কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই আত্মসমর্পণ করেছে। সেই আফগানিস্তানেই যুদ্ধ হচ্ছে, যে দেশে দীর্ঘ দশবছর ধরে মোজাহিদদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেছে রাশিয়া। সেই দেশে তালিবান শক্তির পতন হল? এটা স্বাভাবিক? সন্দেহ জাগছে মনে।
তাহলে এবার বিশ্লেষণ করে দেখতে হয় যে কেন? তবে কি তালিবানের শক্তির কাছে মোঞ্জাহিদের শক্তি অনেক গুণ বেশি ছিল? আমার মনে হয়, তা নয়। প্রশ্নটা অন্যত্র তা হল একত্রিত শক্তি। দেশের অভ্যন্তরে সমস্ত পাঠান শক্তি এক ছিল। আর রাশিয়া ছিল একা। কোন মোজাহিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি জনগণ। কেবল কাবুল শহরের লোক ছাড়া। আর যারা ছিল তারা যুদ্ধে পারদর্শী ছিল না। পার্টি আলাদা-আলাদা হলেও রাশিয়াকে দেশ ছাড়া করতে দ্বন্দ্ব ভুলে তারা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছিল। এবং একদিকে ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম বুদ্ধিদীপ্ত গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষম পুরুষ গুলবদীন হেকমতিয়ার, আর একদিকে ছিল অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন গেরিলা যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার মতো এবং দক্ষ পরিচালনায় অদম্য পুরুষ মাসুদ আহমেদ শা। অন্য আর একজন ছিলেন হাজি দোস্তম, অত্যন্ত সাহসী, যুদ্ধ পরিচালনা করার মত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন। এরা প্রত্যেকের জাত আলাদা আলাদা। গুলবদীন পুস্তন সম্প্রদায়, মাসুদ তাজিক জাত এবং দোস্তুম (রুস্তম গ্রামের নাম) ছিলেন উজবেক। এরা সমস্ত শক্তি এক করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিজেদের দেশকে রক্ষা করতে। তাছাড়া সাহায্য পেয়েছিল, পাকিস্তান সৈন্যের পর্যবেক্ষণ সমেত দক্ষ যুদ্ধ পরিচালক। তাই রাশিয়া এই শক্তিকে পরাস্ত করতে পারেনি। আর তা ছাড়া তালিবানের মতো কোন ফতেয়া জারি করে দেশের অভ্যন্তরে কোন জনগণকে উত্তপ্ত করে তুলতে পারেনি মোজাহিদ। মেয়েদের অবাধ স্বাধীন ছিল, ছিল সম্মান। সেই কারণে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মোজাহিদদের সমর্থনে। কিন্তু যখন তালিবান প্রবেশ করল, তখন প্রথম দফাতে তারা পুস্তুনদের সমর্থন পেল। কারণ উত্তরের জোট অত্যাচার করত পুস্তুনদের ওপর। পুস্তুনদের কোন স্বাধীনতা ছিল না। খানিকটা স্বাধীনতা খর্ব হয়েছিল মেয়েদের। চলত চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি। সেই কারণে পুস্তুন সমর্থনে বিভেদ দেখা দিল। কিন্তু যখন গুলবদীনকে দেশ ছাড়া করল তালিবানরা তখন থেকে একাংশ পুস্তুন কমিউনিটি তালিবানের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। মোল্লা ওমরের মারের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সক্ষম হতে পারল না। প্রকাশ্যে এমন ভাব করল যে তারা সবাই তালিবানের সমর্থক। ভেতরে ভেতরে ক্রোধ বাড়তে লাগল। সমস্ত একত্রিত শক্তি যারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা তালিবানের সঙ্গে একত্রিত হয়নি। তালিবান পাকিস্তানের মাদ্রাসায় থেকে যে জঙ্গি শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছে তা আফগানিস্তানের মধ্যে থেকে গেরিলা যুদ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছে বিপক্ষ গোষ্ঠী। যারা গুলবদীনের দলের, তারা সাময়িকভাবে তালিবানের পক্ষ নিলেও তাদের নেতাকে ভুলতে পারেনি, তাই প্রকারান্তে দেখিয়েছে নিজেদের প্রাণ দিয়েছে যুদ্ধ করেনি। সেই কারণেই দাঁড়িয়ে থেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ভেবেছে নিজের প্রাণ গেলেও অন্য সমস্ত অমুল্য প্রাণ তত বাঁচবে? এবং বাড়ির অন্য ছেলেরা তো বাঁচবে! প্রাণ দিয়ে অন্য সবার প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছে। অন্য সমস্ত জাতি একত্রিত হয়ে তৈরি হল উত্তরের জোট। এই জোটের মধ্যে সেই ক্ষিপ্তগতিসম্পন্ন সুদক্ষ যুদ্ধ পরিচালক মাসুদ আহমেদ শা আজ আর নেই। তবে হাজি সদস্তম তত আছে। এবং এই উত্তরের জোটকে সবরকম সাহায্য করছে আমেরিকা। বোমা ফেলেছে সামনের দিকে, তালিবান পিছু হটেছে। তখন উত্তরের জোট এগিয়ে গিয়ে দখল নিয়েছে। তাছাড়া আগে পাকিস্তান থেকে যুদ্ধের জন্য সামরিক সাহায্য যে হারে পেয়েছে ও আমেরিকার সাহায্য যেভাবে পেয়েছে বর্তমানে দুটোর কোনটাই তালিবানরা পায়নি। তালিবানরা গোড়াতেই ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। আফগানিস্তানে এসে কেবল ফতোয়ার দিকেই ব্যস্ত হয়েছে। মেয়েদের ঘরবন্দী করার দিকে নজর দিয়ে সময় অতিবাহিত করেছে, কিন্তু যা করলে আজ প্রতিকূলতাকে জয় করতে সক্ষম হত সেই গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ তারা নিতে পারত, নেয়নি। কিন্তু মোল্লা ওমর নিজেকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও যুদ্ধ পারদর্শী বলে মনে করে ফেলেছিল। আরও একটা চরম ভুল করেছে তা হল দেশের মানুষকে ক্ষেপিয়ে ভোলা। বাইরের শত্রুকে পরাস্ত করা যায় কিভাবে করেছিল মোজাহিদ, কিন্তু ঘরের শত্রুকে কোন মতেই পরাস্ত করতে পারেনি তালিবানরা। ধর্মের কুসংস্কার দিয়ে মানুষকে ঘরে বন্দী করে রাখা যায় কিন্তু যুদ্ধে জেতা যায় না। আফগানিস্তানের মাটিতে পাকিস্তান যেমন করে তার সৈন্য পাঠিয়ে দেশের ভেতরে একটা সমস্যা টিকিয়ে রাখতে চাইছে তেমনটা যদি কোনদিন আফগানবাসীরা পাকিস্তানে পাল্টা সন্ত্রাস চালায় ও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তেমন ভাবনা পোষণ করে? তবে পাকিস্তান ঠেকাবে কি করে? তাদের বক্তব্য, পাকিস্তান আমাদের দেশে তালিবান পাঠিয়ে দেশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে যার পরিণাম তো সবাই দেখতে পাচ্ছে। ঠিক এই রকম ভাবেই যদি কোনদিন পাকিস্তানের মাটিতে আফগানবাসিরা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আফগান জনগণ এই ভাবনা মনে ভাবে। পাকিস্তানের কোন প্রভাব থাকুক আফগান সরকার গড়ার ক্ষেত্রে তা আফগানবাসী চায় না। তবে উত্তরের জোট সরকার হলে মেয়েদের কোন উপকার হবে বলে আমার মনে হয় না। এক শাসকের পরিবর্তে আসবে আর এক শাসক মুদ্রার এ পিঠের পরিবর্তে ও পিঠ। সুতরাং শতকরা চল্লিশ জন পুস্তন আর শতকরা চল্লিশ জন উত্তরের জোট এবং শতকরা কুড়ি মহিলা সংরক্ষণ হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। তা না হলে মেয়েদের ওপর চলবে আবার অত্যাচার, পুস্তুনদের করবে অবহেলা এবং চলবে লুটপাট, খুন খারাপি।
আজ যেমন টি. ভি-তে দেখা যাচ্ছে সমস্ত রাস্তা ময়দান জুড়ে পড়ে আছে মৃত দেহ। মানুষের লাশ ট্রাকটারে করে নিয়ে যাচ্ছে, নাকে কাপড় গুঁজে গন্ধকে তাড়াবার চেষ্টা চলছে। এসব আমি নিজের চোখে দেখেছি, ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠেছি। ক্ষত বিক্ষত লাশ দেখে মুখ ঢেকেছি দুহাতে, গন্ধে নাক চাপা দিয়েছি। আজ আবার তার পূনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। কোন গন্ধ আর আমার নাকে এসে পৌঁছাচ্ছে না। রক্ত পায়ে লাগছে না। কিন্তু মৃত বাড়ির মানুষের হাহাকার হৃদয় বিদীর্ণ করা চিৎকার যেন আমার মনকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে।
আবার কত মা তার বুকের ধনকে হারাল। কত বোন তার ভাইকে খোয়াল, কত স্ত্রীর বুক ফাটাকান্না, আর্তনাদ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে তার প্রাণাধিক প্রিয় মানুষটার জন্য। কত নারী পুরুষ শিশু জলাতঙ্কের মত যুদ্ধাতঙ্ক নিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারাল। এর মাঝে উত্তরের জোট একের পর এক গ্রাম শহর দখল করে নিল। তবুও কী আফগানিস্থানের মাটিতে শান্তি ফিরে আসবে? নজিবুল্লার শাসনকালে যে স্বাধীনতা ছিল মেয়েদের, সেই স্বাধীনতা কী আবার ফিরে পাবে? না। পাবে না।
উঃ! কি ভয়ঙ্কর সেই সেদিনের ছবি। মেয়েরা অসহায়ের মত মার খেতেখেতে দৌড়ে পালাচ্ছে। আজও সে দৃশ্য চোখের সামনে আমার ভেসে ওঠে। তখন মনে হয় ওই নির্মম নৃশংস অমানুষগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। মনে হয় ওদের রক্তে স্নান করি। সেই স্নান করার মত শক্তি আমি সেইদিনই পাব যেদিন সমগ্র আফগান মেয়েদের সমস্ত রকম ফতেয়ার বাইরে এনে আমার মত করে একটা বিদ্রোহ আমি করতে পারব। ১৯৯৩ সালে যে সংগঠন আমি শুরু করে এগিয়ে গিয়েছিলাম তা
অচিরেই ধ্বংস করে দিয়েছিল তালিবানরা। আজ আমাকে রুখবে কে? আমি আবার যাবো কাবুলে। মেয়েদের সমস্ত রকম অধিকারের দাবি নিয়ে। মেয়েদের শিক্ষা চাই, সমান অধিকার চাই খাদ্য, স্বাস্থ্য শিক্ষা সব চাই। প্রতিবাদ করার সাহস সঞ্চার করব ওদের মনে। এবং চাই আফগানিস্থানে গণতন্ত্র, চাই শিল্প, সংস্কৃতি। একটা সুসভ্য দেশ। হতে গেলে যা-যতটুকু প্রয়োজন তা সবই ফিরিয়ে আনতে হবে। চাই ভারত-আফগান বন্ধুত্ব। চাই বিশ্বাস ও সততার মুখ্য বুনিয়াদ। চাই বাণিজ্য। সমস্ত কিছুতে পুরুষের সঙ্গে নারীর সমান অধিকার, সেই দাবি নিয়ে আমি যাব। নতুন করে শুরু হবে এক ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট। যার নাম হবে New Feminist-Movement এবং আমি তখন পৃথিবীর সমস্ত মেয়েদের এই মুভমেন্টে সামিল হওয়ার জন্যে আহ্বান জানাবো। এখন আর ঘরে বসে ভাববার সময় নেই যে কি হবে, কেন হবে কোথায় হবে।
উত্তরের জোট সে স্বাধীনতা দিতে পারবে না। তালিবানের শাসনের থেকে কিছু কম শাসন ছিল না উত্তরের জোটের। ১৯৯০ সালে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া প্রথম বন্ধ করেছিল এই উত্তরের জোট। জানি না ভবিষ্যতেও কোন স্বাধীনতা মেয়েদের ওরা দেবে কি না। সেই মিষ্টি মধুর দিনগুলো আজ প্রত্যেকের কাছে যেন একটা স্বপ্ন। সেই সেদিন? যে দিন বছরের প্রথম বরফ পড়ে? সেই দিনটা আফগানবাসির কাছে একটা উৎসবের দিন। কারণ কোন না কোন বাড়িতে পর্চি ফেলার আনন্দ থাকে সবার মনে। ব্যাপারটা খুবই মজার। প্রথম যেদিন বরফ পড়বে সেদিন কেউ না কেউ কোন একটা বাড়িতে গিয়ে একটা কাগজের মোড়ক ফেলে আসবে। তারপর সেই বাড়ির লোক সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবে। কিন্তু যদি বাড়ির লোক দেখে ফেলে পর্চি ফেলার সময় তখন তাকে ধরে খানিকটা ভালোবাসার মার মারবে। পরে যে পর্চি ফেলেছিল সে তখন সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবে। সে এক মজার ব্যাপার। আমিও একবার মজা করে পর্চি ফেলেছিলাম আসাম চাচার বাড়ি। তখন তো জানতাম না যে ওই পর্চি ফেলেই দৌড়ে পালাতে হয়। নইলে মার এবং দাওয়াত দেওয়া সব নিজের ঘাড়ে এসে পড়বে। আসাম চাচার বড় মেয়ে চেঁজি আমাকে দেখে ফেলেছিল। তারপর নিয়ম অনুযায়ি ফৌজি আমাকে পাঁচটা কিল মেরেছিল আমার পিঠে। এবং রাতে সবাইকে খাওয়াতে হয়েছিল আমাদের।
আজ অবেলায় বসে মনে পড়ে সেই সেদিনের ফেলে আসা সুন্দর মুহূর্তগুলি। যাদের সঙ্গে আমার আত্মার মিলন ঘটেছিল আজ তারা বড় অসহায়ের মত দিন কাটাচ্ছে। ফৌজি তার শ্বশুরবাড়ির লোকের সঙ্গে পাকিস্তানে চলে এসেছে। সেখান থেকে ফোনে সে জানিয়েছে কত কষ্ট করে গ্রামের সমস্ত লোক পাকিস্তানে গিয়ে পৌঁছেছে। ফৌজি ফোনে কেবল আমার নামটা ধরে ডেকেই হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। প্রথম দিন সে কোন কথাই ভাল করে বলতে পারেনি। কেবল বলেছিল গ্রামের মানুষ প্রথম দিকে বুঝতেই পারেনি যে আমেরিকা যুদ্ধ শুরু করছে। পরে পাতানায় যখন বোমা পড়ল এবং প্রায় নটা বাড়ি ধ্বংস হয় তখন বুঝতে পারে যুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু তখনও ভাবতে পারেনি যে আমেরিকা যুদ্ধ করছে। ভেবেছে আগে যেমন রাশিয়ানরা যুদ্ধ করে বোম ফেলেছে তেমনই হবে। পরে গ্রামের মানুষের মধ্যে কয়েকজন ও দ্রানাই চাচা গজনীতে যায় এবং সেখান থেকে সব খবর নিয়ে ফিরে এসেই দেশ ছেড়ে পাকিস্তান যাওয়ার জন্যে সমস্ত গ্রামবাসীকে বলে। কিন্তু তালিবানেরা বাদ সাধে। তালিবান সর্তক করে দেয় যে কোন বাড়ির কেউ গ্রাম ছেড়ে যেতে পারবে না। তখন দ্রানাই চাচা গ্রামের সব্বাইকার বাড়িতে গিয়ে বলে আসে রাতের অন্ধকারে সবাই গ্রাম ছেড়ে যাবে। একদিকে আমেরিকার বোমা, অন্যদিকে তালিবানের হুমকি। অসহায় গ্রামবাসি অন্য মৃত্যুর হাতছানিকে পরোয়া না করে সবাই রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়ল। পাহাড়ের দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে তারা চলতে লাগল অজানা পথে জীবনের সন্ধানে। যেমন শীত তেমনই ক্ষুধার্ত। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শীতমৃত্যু ভয় তাদের বন্ধুরূপে সঙ্গে চলল। একটা মৃত্যুকে ঠেকাতে অন্য মৃত্যুকে সঙ্গে নিল। দিনের বেলায় জঙ্গলে আত্মগোপন করে রাতে পথ চলো। সামান্য অসাবধান হলেই দুর্গম পাহাড় থেকে একেবারে নিচে খাদে। পায়ে চটি নেই গায়ে শীতের বস্তু নেই, পেটে খাবার নেই, তবুও কারও খেয়াল নেই। শত কষ্ট সহ্য করে চলেছে তো চলেছেই। কেবল একটু বাঁচার ইচ্ছে তাদের সব কষ্টকে সইবার মত ধৈর্য দিয়েছে। এমনি করে প্রায় পাঁচ দিন পথ চলার পরে তারা এসে পৌঁছায় কোয়েটায়। এই দুর্গম পথচলতে গিয়ে আমাদের গ্রামের ক্ষুধার জ্বালায় শীতের কামড়ে এগারোজন বাচ্চা প্রাণ হারায়। নৃশংস মোল্লা ওমরের জন্যে সমস্ত আফগানিস্থান বিপদগ্রস্ত। প্রথমদিন ফৌজি কেবল এইটুকু কথা বলতে পেরেছে। পরে আবার একদিন ফোন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে ফোন রেখে দিয়েছিল। আজ পঁচিশ বছর ধরে আফগানবাসি কেবলই রাতের অন্ধকারে দেশ পরদেশ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবুও তারা বেঁচে আছে, যদি এই ভাবে বেঁচে থাকাকে-বেঁচে থাকা বলে তবে সেই অর্থে তারা জীবিত।
এরপর আমি রোজ প্রতীক্ষা করে আছি কবে ফৌজি ফোন করবে। লাহোরে ফৌজির শশুরের একটা ওষুধের দোকান আছে এবং একটা বাড়িও আছে। সুতরাং ফৌজির কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয় পাকিস্তানে। কিন্তু বাকি গ্রামবাসিরা কোথায় আছে? কোথায় আছে গুলগুটি এবং ছোটো বাচ্চারা? তিন্নি? আমার আদরের অনেক স্নেহের তিনি কেমন আছে? মনটা হঠাৎ যেন আনচান করে উঠল। মনে হতে লাগল যদি আমি এক্ষুনি একবার যেতে পারতাম! তিন্নিকে দেখার ইচ্ছেয় আমার মনে ঝড় উঠল। ওখান থেকে চলে আসার পরে তিন্নির কথা আমি ইচ্ছে করে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছি। কারণ মনে ভীষণ একটা যন্ত্রণা হয় ওর কথা মনে পড়লে। তবুও পারিনি। আমার ঘরে সর্বত্র তিন্নির ছবি। শোওার ঘরে বসার ঘরে সবখানে। জাম্বাজ বহুবার বলেছে ছবিগুলো আলমারিতে তুলে রাখতে।
কিন্তু আমার মন চাইনি কারণ হতভাগী মায়ের সমস্ত ক্ষমতা চুর্ণ হয়েছে ওই তালিবানের কাছে, তিন্নিকে নিয়ে আসার প্রস্তাবে। পালিত হলেও তাকে আমি আমার সন্তানের স্বীকৃতি দিয়েছি। সুতরাং সন্তান হিসাবে আমার সমস্ত হৃদয়ের একমাত্র অধিকারপ্রাপ্তা তিনিই। এখন সে কেমন আছে? রাতের পরিষ্কার, টান টান বিছানায়। আরামে শুয়ে আছি আমি। তিন্নির হতভাগী মায়ের যে ক্ষমতা সীমিত? সেই ছোট্ট অসহায় মেয়েটা? যে আমাকেই জেনেছে তার রক্ষাকী? রাতের অন্ধকারে বাইরের দিক থেকে শেয়াল ডাকার শব্দ শুনলেই যে তিনি মায়ের কোলের মধ্যে নিজেকে সঁপে দিত? আজ তিন্নির মতো শিশুরা গভীর রাতে শীতের মধ্যে পাহাড়ী রাস্তা ধরে চলেছে জীবনকে পাওয়ার আশায়।
তিন্নি সবেরা, কিসমতের জন্যে আমার মন কেঁদে উঠল। এই জায়গায় আমিও যেন কেমন স্বার্থপরের মত ভাবতে লাগলাম। পকতিকার, সারানার সমস্ত শিশুরাই তে চলেছে অমনি করে। তবুও কেবল জাম্বাজের দুই মেয়ে কিসমত ও সবেরার এবং আমার প্রিয় তিন্নির কথাই বারবার মনে পড়তে লাগল।
তিন্নির জন্যে আমি তালিবানের সমস্ত শর্ত কেন মেনে নিতে পারিনি? কেন চিৎকার করে মোল্লা ওমরকে বলিনি যে হ্যাঁ, গ্রহণ করব আমি তোমাদের ধর্ম? হোক সে কঠোর, কঠিন থাক ওই ধর্মে মৃত্যুর ফাঁদ, তবুও তাকে আমি মানতে পারব, যদি তিন্নিকে তারা দেয়। কিন্তু তা আমি বলতে পারিনি তালিবানদের। কারণ? কারণ আমি ঘেন্না করি তালিবানদের। না মানুষগুলোকে ঘেন্না করি না। ঘেন্না করি তাদের ব্যবহারকে তাদের সিস্টেমকে এবং সেই রাজনীতিকে, যে রাজনীতি তুরুপের তাস তৈরি করেছে নবীন ছাত্রদের। যারা ভবিষ্যতে কোন উদিয়মান সূর্যের মতো হতে পারত। এদের যদি জঙ্গি তৈরি না করে কোন ভালো শিক্ষা দেওয়া হত, তবে কে বলতে পারে যে তাদেরই মধ্যে থেকে কোন বৈজ্ঞানিক কবি কিংবা অন্য কিছু হতো না?
Leave a Reply