মোতাহের হোসেন চৌধুরীর নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর নির্বাচিত প্রবন্ধ
সংকলন : আবুল কাসেম ফজলুল হক
ভূমিকা : শফিউল আলম
ভূমিকা
তিনি এক বিরলপ্রজ লেখক লোকচক্ষুর অন্তরালে, লজ্জাতুর; অথচ প্রবল ব্যক্তিত্বশালী, মিতবাক অথচ এক অপার্থিব সুন্দর ও সত্যের সাধনায় নিমগ্ন; খ্যাতির অভিলাষ তাঁর নেই; বিনয়ী, সজ্জন এবং সম্ভ্রান্ত মনের অধিকারসম্পন্ন হৃদয়বান পুরুষ তিনি, তিনি মোতাহের হোসেন চৌধুরী। সাতচল্লিশোত্তর ক্রান্তিকালে আমাদের সাহিত্যের আদর্শ, আঙ্গিক ও কলাগত ভাবনায় যখন আমাদের সংস্কৃতিক্ষেত্র চঞ্চল, বিবিধ বৈরী মতবাদ ও মতভেদের প্রচণ্ড ঝড়ে আন্দোলিত, তখনো এই নেহাত অধ্যাপক মানুষটি নীরবে আপন সাহিত্যকর্মে নিমগ্ন ছিলেন, মতবাদ ও মতভেদের বিভিন্ন ঝাঘাত থেকে বহু দূরে। এবং সেজন্যই সম্ভবত কোনো দলীয় নামাবলি, মতবাদ বা ইজম’ তার লেখাকে আক্রান্ত করে নি, বরং সর্বপ্রকারের মতাদর্শকে অশ্রদ্ধা না করেও তার নিজস্ব ভুবনে, স্বকীয় শিল্পলোকে পরমহংসের মতো সন্তরণ করেছেন, আপন সৌরলোকে ঘুরেছেন, তার বিশ্বাস ও চেতনালোক থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নি। তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়ে ও প্রগাঢ় প্রজ্ঞায় তার বক্তব্যের বুনন দৃঢ় এবং সুসংবদ্ধ ছিল।
বস্তুতপক্ষে মীর মশাররফ হোসেনের গদ্যে যে ঐতিহ্যের প্রথম ও শক্তিশালী উন্মোচন, নজরুল ইসলামের গদ্য তাঁর পরিণত অগ্রগতিরই স্মারকবাহী। মীরের গদ্যের যে ভারী, ঋজু ক্লাসিকধর্মিতা বা নজরুলের গদ্যের যে প্রাণবন্যা–এর কোনোটারই প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি মোতাহের নন। তাঁর গদ্যে তাদের থেকে একটা ভাগত এবং আঙ্গিকগত দূরত্ব সহজেই লক্ষণীয়। মীর মশাররফ যে সমাজগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, নজরুল ইসলামও সে সমাজেরই ছায়ায় লালিত। নজরুল যে-যুগের ধ্বজাবাহী, সে যুগ ক্রান্তি ও পরিবর্তনের এবং এ পরিবর্তনের অন্তরঙ্গ হাওয়ায় তাঁর গদ্য ও পদ্যাবলি উন্মীলিত। কিন্তু, যেহেতু প্রত্যেক সাহিত্যকর্ম ও শিল্পকর্ম যুগেরই প্রতিভাস, যন্ত্রণা আত্মদহনে রঞ্জিত, আনন্দ ও বেদনার স্মারক, সেজন্য নজরুলের রচনা চঞ্চল ও ঊর্মিমুখর না হয়ে পারে নি; যেহেতু সাতচল্লিশ-পূর্ব সময় স্বাভাবিক কারণেই ছিল উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতার যুগ, অস্থিরতার পদধ্বনি দিকে দিকে।
নজরুল যখন চারণের বেশে দিকে দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন; নতুন কথায়, প্রাণের বন্যায় ভরিয়ে দিচ্ছেন সারাদেশকে; নবীন চেতনার দ্বারা সনাতনপন্থীদের মনে ও হৃদয়ে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি করছেন ঠিক সে সময়ে মুসলমান সমাজের একটি স্থিতধী তরুণ দল, বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনে স্থির-প্রতিজ্ঞ হয়ে, অভীষ্ট পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মুসলমান সমাজের কুসংস্কার, অন্ধতা, বুদ্ধিহীনতা, কূপমণ্ডুকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের উজ্জ্বল সূচিপত্র ছিল তাঁদের হাতে। অন্ধকারকে দূর করবার প্রদীপ্ত শিখা ছিল তাঁদের হাতে। আর তারা তাদের সম্মিলিত সংঘের নামকরণ করেছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজ।
“শিখা ছিল তাঁদেরই অন্তরের বহ্নিশিখার মুখপত্র। তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য “চিন্তাচর্চা ও জ্ঞানের সমন্বয় ও সংযোগসাধন।” সংকীর্ণতা নয়, মূল্যবোধ ও যুক্তির বিচারে সবকিছুকে নিরিখ করাই এঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তরুণ অধ্যাপক আবুল হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহের হোসেন, আবুল ফজল, আনোয়ারুল কাদির এ আন্দোলনের প্রথম পথিকৃৎ হলেও এঁদেরই চিন্তাধারার মূলস্রোত ছিল মোতাহের হোসেন চৌধুরীর শোণিতে। এবং সত্যিকার অর্থে তিনিই ছিলেন “খুব সম্ভব বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের শেষ ফসল।” বুদ্ধির মুক্তি যারা চেয়েছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উঠতি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, এবং অনেকে পেশাগত কারণে বা বৃত্তিগত প্রেরণায় লেখাকে একটা অন্তর্গত দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আধুনিক জীবন ও জগতের পরিবর্তন ও নবমূল্যবোধের চৈতন্য তাদের নতুন করে ভাববার প্রেরণা যুগিয়েছিল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ ও প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র’ মোতাহের হোসেনকে যুগপৎ আকর্ষণ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে বাইরের দিক থেকে শিখায়। সমাজসচেতনতা প্রবলভাবে উচ্চারিত হলেও আন্তরিক ভুবনে তার মধ্যে ছিল ব্যক্তির জড়তা উন্মোচনের আগ্রহ এবং এদেশের তরুণ মুসলমান সম্প্রদায়কে আত্মসম্মানবোধে জাগ্রত ও উদ্দীপিত করে তোলবার ঐকান্তিকতা। অপরপক্ষে সবুজপত্রের আদর্শ ছিল সতেজ ও জাগ্রত মননের উদ্বোধন ঘটানো। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মানসভূমি এ দুটি কেন্দ্র থেকেই সমানভাবে প্রেরণা পেয়েছিল। কোনো প্রকারের ভাবাবেগ বা উচ্ছ্বাসপ্রবণতা, এজন্যেই তাঁর রচনায় দুর্লভ। বরং সবসময় এক বুদ্ধিনিষ্ঠ বিবেচক হৃদয়বান সংযমী শিল্পীর দৃষ্টি দেখা যায় তার প্রতিটি রচনায়। একদিকে কাজী আবদুল ওদুদ অন্যদিকে প্রমথ চৌধুরী দুজনেই তাঁর হৃদয়ের কাছাকাছি। যুক্তি বিচার ও মূল্যবোধ তার সমস্ত চিন্তার স্রোতকে এক সুনির্দিষ্ট গ্রথিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে গেছে; সে কারণেই তার প্রবন্ধে বক্তব্য যেখানে সোচ্চার হয়েছে আপন নিজস্বতায়, যুক্তির ভারসাম্যেও সেখানে তা হয়েছে ঋদ্ধ। আনন্দ, সুন্দর, প্রেমবোধ, কল্যাণবোধ তাঁর রচনার ও চিন্তার আকর। মোতাহের হোসেন যে যুগ ও পরিবেশের সন্তান তা প্রধানত ছিল নব্যচিন্তায় উদ্দীপ্ত মুসলমান যুবকদের ব্যক্তিত্ব-বিকাশের যুগ। মোতাহেরের রচনায় এ কারণেই নতুন ব্যক্তিবাদ, একক সৌন্দর্যবিশ্বাস ও আনন্দচর্চার ধ্বনি শোনা যায় অবিরামভাবে। তার সাহিত্যচর্চার পটভূমিতে যদিও রয়েছে এক সুসংস্কৃত ব্যক্তিমানস, তথাপি সাহিত্যচর্চাকে তিনি বুদ্ধির মুক্তির অন্য প্রবক্তাদের মতো কোনো মন্ত্র বা হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন নি। সাহিত্যচর্চা তার কাছে ছিল গভীর শ্রদ্ধায় ভরা পবিত্রতায় পূর্ণ নৈবেদ্যের মতো। তিনি বলেন : “লেখা আমার কাছে একপ্রকারের প্রার্থনা আর প্রার্থনার উদ্দেশ্য আত্মার ঔজ্জ্বল্য সাধন, অর্থ উপার্জন নয়। শুধু তাই নয়, এমন এক নির্মল ও পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী তিনি ছিলেন যে, সাহিত্যচর্চায় কোনোপ্রকার প্রতিযোগিতা করাকে তিনি পাপ বলে মনে করতেন। সবকিছুর উর্ধ্বে তিনি চেয়েছেন একজন সংস্কৃতিবান, যুক্তিনিষ্ঠ, প্রেমময় ও সভ্য মানুষ হতে। তার এ চিন্তার জগতে আরো দুজন মনীষী তাঁকে প্রভাবান্বিত করেছেন। এবং প্রকৃতপক্ষে “বহু বিভিন্ন দিগন্ত থেকে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ওপর আলো এসে পড়েছিল; যদিও শেষপর্যন্ত যে-কোনো সৎ লেখকের মতোই তাঁর নিজস্ব কিছু ছিল, যার জন্য তাঁকে চেনা যায়। তার ওপরে যেমন দেশজ কোনো কোনো ব্যক্তির প্রভাব দেখি, তেমনি তিনি কোনো কোনো মহৎ বৈদেশিকের অংশভাগী।” এ বৈদেশিক দুজন হলেন বিংশ শতাব্দীর মানবতাবাদী দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল ও চিন্তাবিদ ক্লাইভ বেল। “ক্লাইভ বেল এবং বার্ট্রান্ড রাসেল মেঘের মতোন ছায়া ফেলে আছেন তাঁর ভাবনার আকাশে।” ক্লাইভ বেল বা রাসেল যে যুগ-সমাজের প্রতিনিধি, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর যুগ ও সমাজ তা থেকে ভিন্ন হলেও চিন্তার জগতে তিনি ছিলেন তাঁদের সঙ্গে একাত্ম। তাঁদের মতোই মানবতার শুভবুদ্ধি ও নিরঞ্জন সুন্দরের সাধনা তারও কাম্য এবং তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মে এর পরিচয় বিস্তৃত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর সামন্ততান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এবং বিংশ শতাব্দীর উদার মানবিকতাবাদের জয়ধ্বনি–এই দুই দিগন্ত সমানভাবে তাঁর রচনার ওপর আলোক ছড়িয়েছে। রাসেল স্বকীয় উদারতায় ও মানবিকতাবাদে যেমন একদিকে মানবসমাজের অন্যতম প্রতিভূ, অন্যদিকে ঠিক তেমনি ব্যক্তিচিন্তার দ্বন্দ্বে প্রায়শ জর্জরিত, দীর্ণ এবং হতাশাগ্রস্ত। একটা বিরাট আত্মদ্বন্দ্বের ছায়া লক্ষ করা যায় তার সমগ্র জীবনে। ক্লাইভ বেলের (যিনি সভ্যতার আলোকে জীবনের মূল্যায়নের প্রয়াসী) রচনায়ও এক প্রচণ্ড আত্ম-অভিঘাত বর্তমান এবং প্রায়শ আত্মদ্বন্দ্বে নিক্ষিপ্ত তিনি। যেহেতু এঁরা দুজনেই ঊনবিংশ শতাব্দীর চেতনার পটভূমিতে এবং বিংশ শতাব্দীর মানবিক মূল্যবোধে লালিত, সুতরাং এদের চৈতন্যে এই সংঘাত স্বাভাবিক। তাছাড়া মহৎ শিল্পীমাত্রেই তো আজীবন এই অবধারিত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শিকার। মোতাহের হোসেন যেহেতু এদের দুজনেরই ভাবশিষ্য, তাঁর রচনায় তাই বেল ও রাসেলের কণ্ঠ অনুচ্চ নয়।
শুধু জীবনধারণ করাটাই বাঁচা নয়। বাঁচাটাও একটা শিল্পিত জীবনধারা। জীবনের সৌন্দর্য, রসপিপাসা ও অর্থময় ভাবজগৎকে স্বকীয় জগতে জারিত করে নেয়ার মধ্যেই জীবনের মহত্তম সার্থকতা ও গভীরতম তাৎপর্য। প্রয়োজন দিয়েই শুধু মানুষ বাঁচাকে পরিপূর্ণতায় উত্তীর্ণ করতে পারে না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক বাচ্যাতিরিক্ত অব্যক্ত আনন্দময়তার সন্ধান মানুষকে করতে হয়। তাঁর মতে : আমরা জীবনে বাঁচার উপায়কেই বড় করে দেখি; জীবন আমাদের কাছে তাই অর্থ উপার্জনের একটা নিমিত্ত মাত্র। জীবনকে আমরা সর্বদা বেড়া-দেয়া শস্যক্ষেতের মতো সযত্নে লালিত করবার ব্যর্থ চেষ্টা করি। আর সেই অতি-যত্ন এবং অতি-সাবধানতার ফলেই আমাদের জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমরা জীবনে কৃতকার্যতা লাভ করি না বলে আমাদের হতাশা ও দুঃখের শেষ নেই। মোতাহের হোসেনের ভাষায়-”জীবনের উদ্দেশ্য জীবন উপভোগ; কৃতকার্যত নয়, কৃতকার্যতা একটা উপায় মাত্র।তিনি আরো বলেন, “বাঁচার উপায়কে যখন বড় করে তুলি জীবন তখনই হয় দরিদ্র, বাঁচার উদ্দেশ্যকে বড় করে তুললেই জীবন ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে।
তাঁর কাছে জীবন যেহেতু এক সুন্দর আনন্দলোকের সঙ্গে মিশ্রিত, তাই তা কখনো অসংস্কৃত ও অপরিচ্ছন্ন নয়। তিনি তাই বারংবার তথাকথিত ধার্মিক হওয়ার চাইতে সংস্কৃতিবান হওয়ার প্রার্থনা করেছেন। এবং যা জীবনপ্রদ, তাকেই সুখের উৎস মনে করেছেন : “যা জীবন-দায়ী তাই সুখ-দায়ী। কালচারের উদ্দেশ্য তাই সুখ সাধনা।” আর কালচার তার দৃষ্টিতে তথাকথিত কোনো সংঘবদ্ধ জীবনাচরণ নয়, বরং “কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা–সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি।” এবং “সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়, উপায়। উদ্দেশ্য নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লা সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সেই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়।”
তাঁর জীবনচেতনা বরাবরই এককেন্দ্রিক এবং নিজস্ব বলয়ে ঘূর্ণিত এবং সে বলয়ে শুধু সুন্দর আর আনন্দের, কল্যাণ আর প্রেমেরই ধ্বনি। তাই সংস্কৃতি বলতে তিনি মনে করেন- “সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহত্তাবে বাঁচা, প্রকৃতি-সংসার ও মানব সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা …. নদীর হাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা আকাশের নীলিমায় তৃণগুলোর শ্যামলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে মহতের জীবনদানে বাঁচা…। বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা। প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।” মনে হয় মোতাহের হোসেনই বাংলা সাহিত্যের প্রথম কণ্ঠ যিনি জীবনকে, বাঁচাকে এবং শিল্পিতভাবে বাঁচাকে সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করেছেন।
মোতাহের হোসেনের চেতনায় সংস্কৃতি চিন্তা ছাড়া অন্য যেসব বিষয় আলোড়ন ও আন্দোলন এনেছে তা হল তার সভ্যতা সম্পর্কিত চিন্তা এবং জীবনের চত্বরে মূল্যবোধ ও যুক্তি-বিচারের প্রতিষ্ঠা। সভ্যতা তার দৃষ্টিতে “আলোক ও মাধুর্যের সাধনা।” তাঁর সভ্যতাবিষয়ক চিন্তায় ক্লাইভ বেল প্রধান অনুপ্রেরণা। তার সভ্যতা’ গ্রন্থটি তিনি অনুবাদও করেছেন। তবে সেটাকে শুধুমাত্র অনুবাদকর্ম বললে ভুল হবে। মূল সৃষ্টির মতোই এই রচনাটি তার আপন বক্তব্যে পূর্ণতর। বইটির রচনা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘অহং আশ্রিত মোহ থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ সহজভাবে সংস্কৃতি ও সভ্যতার পানে তাকাতে সক্ষম হবে, এই ভরসাতেই আমি বেল সাহেবের অনুসরণে এই বইখানি লেখার প্রেরণা অনুভব করি।” তিনি তাই সর্বদা ইতর সুখের চেয়ে সূক্ষ্ম সুখকে বড় করে দেখেছেন এবং সূক্ষ্ম রসানুভূতি ও প্রেমবোধকেই সভ্যতার মাপকাঠি বলে গ্রহণ করেছেন।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী আজীবন জন-কোলাহলের বাইরে নিয়োজিত ছিলেন, আপন হৃদয়লোকের সৌন্দর্যে সৃষ্টির এক কল্পিত সুখলোকের স্বপ্নসাধনায়। এর ফলে যথেষ্ট প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও জীবদ্দশায় তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধরাজি স্বকীয় ঐশ্বর্য নিয়ে অলক্ষ্যেই প্রায় ঝরে গেছে, কখনো কখনো সৌন্দর্যসন্ধানী প্রেমিকদের হাতে এলেও এবং তার সুবাস বিভিন্নজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও তা নিয়ে পাঠকসমাজে ব্যাপক কৌতূহল কখনো দেখা যায় নি। তার সংস্কৃতি কথা” গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে, অনেকটা আকস্মিকভাবেই আমাদের সাহিত্যের পদপাতবিরল অঙ্গনে এক নতুন ও অনাবিষ্কৃত ঐশ্বর্যের সন্ধান পেয়ে যান সুধীসমাজ। সনিষ্ঠ, পরিচ্ছন্ন ও সংস্কৃতিবান একজন লেখক যেন আবিষ্কৃত হন আমাদের সাহিত্যে। তার চিন্তার বহুমুখী ধারা এ গ্রন্থেও লক্ষ্যযোগ্য সংস্কৃতি, জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িকতা, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব, রিনেসাঁস, দুঃখবাদ এবংবিধ বহুবিষয় আলোচ্য হয়েছে এই গ্রন্থে। তবে তার সমস্ত লেখা ও চিন্তার বিশ্লেষণ করে মোটামুটি এ উপসংহারে আসা যায়–’কোনো গোঁড়ামি নয়, একদেশদর্শিতা নয়, তীব্রতা ও প্রচণ্ডতা নয়, এক সুচারু ও ভারসাম্যময় মধ্যপথ তার অবলম্বন—এটা অবশ্য ভীরুর গন্তব্য নয়, বরং শক্তি ও সুন্দরের, সাহস ও রুচির সই অবস্থান।” তাঁর সম্পর্কে এ মন্তব্য যথার্থ : “তিনি অমিতাচারের বিরোধী, আবেগবান তিনি, কিন্তু আবেগ উত্তাল নন; যুক্তি বিশ্বাসী কিন্তু হৃদয়কে উপেক্ষা করে নয়; তিনি বক্তব্যে দৃঢ় কিন্তু গোঁড়া নন, কৌতুক ভালোবাসেন কিন্তু ব্যঙ্গপ্রবণ নন। এই ব্যক্তিত্ব বিরল।”
মোতাহের হোসেন চৌধুরী সভ্যতা’ গ্রন্থটির অনুবাদ ছাড়াও বাট্রান্ড রাসেলের ‘দি কংকোয়েস্ট অফ হ্যাপিনেস’ গ্রন্থটির মূলানুসরণে ‘সুখ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। বহুলাংশে এই গ্রন্থ মূল বইটির অনুবাদ হলেও বেলের অনুসরণে সভ্যতার’ রচনার মতো এখানেও তিনি নিজের মতামত সুন্দরভাবে গ্রথিত করেছেন। অনুবাদগ্রন্থ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তার অনিন্দ্য রুচি ও জীবনবোধের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিনি বেছে বেছে সেসব বইকেই অনুবাদের জন্য গ্রহণ করেছেন যেগুলো তাঁর চিন্তা ও রচনায় উজ্জ্বল রশ্মি ফেলেছে বিভিন্ন সময়ে।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী শুধু একজন বুদ্ধিনিষ্ঠ প্রবন্ধের রচয়িতা নন, মূলত তিনি একজন কবিও। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে যে-কোনো মহৎ শিল্পীই প্রকৃত প্রস্তাবে কবি। কিন্তু প্রবন্ধরাজ্যে তিনি যেমন অনন্য ও একক–কারো সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যান না, বক্তব্যের ব্যাপারে স্থির ও পৃথক বিশ্বাসে বলীয়ান এবং সত্যনিষ্ঠ, কবিতার ক্ষেত্রেও তিনি তেমনি অনন্য ও উদার। সেখানেও তাঁর পরিচ্ছন্ন হৃদয় ও সুন্দর অন্বেষার পরিচয় ফুট। তাই তিনি তাঁর প্রার্থনায় যাচনা করেন :
হে আল্লাহ!
বুদ্ধি দাও, শান্তি দাও, অনুভূতি দাও, কল্পনা দাও।
সৃষ্টিপথের মর্মকোষের মধুপানের ক্ষমতা দাও।
জীবনকে আনন্দিত করো, সার্থক করো, উজ্জ্বল করো;
উদ্যোগী করো, প্রাণবান করো, নিষ্ঠাবান করো।
অন্তরে নিয়ত শিখার মতো আলো–
বিবেকরূপে, বিচারবুদ্ধিরূপে।
আমার প্রার্থনা খাঁটি করো, খাঁটি করো, খাঁটি করো।
{ প্রার্থনা : প্রভাতির্ক।}
মোতাহের হোসেনের মানসলোকে প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব সুস্পষ্ট এবং এ কারণেই হয়তো তাঁর মতোই রোমান্টিক কাব্য রচনার চাইতে সনেট রচনাতেই তিনি মুক্তি খুঁজেছেন বেশি।
দীন আমি, দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া বেড়াই।
আনন্দ-কণিকা মাগি। কোথা নাহি পাই।
সে পরম ধনটুকু; তাই নিশিদিন
প্রাণ মোর বহে শুষ্ক মধু ছন্দোহীন!
হৃদয় মরুভূ মাঝে ফোটেনাকো ফুল।
হাসে না মধুর হাসি, করে না আকুল
নীরস জীবন মম। রহি ম্রিয়মাণ।
পরাণে বাজিয়া উঠে বিষাদের গান।
কাঙাল পরাণ মোর সকলের কাছে।
প্রাণ দাও, প্রেম দাও–এই ভিক্ষা যাচে।
{ চতুর্দশপদী। }
শুধু সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন স্ত্র, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, নিরহঙ্কার ও রসজ্ঞ। তিনি ছিলেন অজাতশত্রু। আবুল ফজল লিখেছেন : “তার কথা ও ব্যবহারে রুক্ষতা, কঠোরতা ছিল না, তাকে কোনোদিন ধৈর্য হারাতে দেখা যায় নি। তাঁর স্বভাব ও ব্যবহারে বিনম্র মাধুর্য ও আলাপ আলোচনায় সরস পরিহাসপ্রিয়তা শেষদিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। ছাত্রদের সঙ্গেও ব্যবহারের ব্যতিক্রম ঘটে নি কোনোদিন।” মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে আবুল ফজল যৌবনে পেয়েছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের বুদ্ধির মুক্তির দলে এবং পরে পেয়েছিলেন অধ্যাপনা জীবনে চট্টগ্রাম কলেজে সহকর্মী হিসেবে। সুতরাং তার চোখে মোতাহেরের ব্যক্তিগত জীবনের এই পরিচয় নিঃসন্দেহে নির্ভরযোগ্য।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী আমাদের সাহিত্যে সেইসব অল্পসংখ্যক ব্যক্তিদের অন্যতম যারা আপন চিন্তা ও আদর্শকে স্বার্থ বা নিজের প্রয়োজনের জন্যে বিসর্জন দেননি। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা হয়তো অতি-প্রগতিশীল নয় এবং হয়তো এটা স্বাভাবিকও; কেননা তার সমস্ত চিন্তা বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যক্তি। সমষ্টিগত কল্যাণ চেতনা বা শ্রেণীহীন সমাজগঠন তার লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। হয়তো এ কারণেই তিনি অতি-প্রগতিবাদী নন বা কোনো বিশেষ আদর্শকেই একমাত্র আদর্শ হিসাবে ধরে নেন নি। তার প্রধান আদর্শ মানবিকতাবাদ। এসব কারণে সমকালীন রাজনৈতিক উত্থান-পতন বা আলোড়নসমূহ তাঁর রচনায় অনুপস্থিত। এমনকি আঁদ্রে মারোয়ার মতো সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদকে ব্যক্তি বিকাশের অন্তরায় বলেও সমালোচনা করেছেন তিনি। অন্যদিকে, একই সঙ্গে এবং প্রায় একই কারণে, তিনি ধর্মান্ধতা ও শাস্ত্রানুগত্যকে সমালোচনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন : “শাস্ত্রানুগত্য নয়, আত্মপ্রত্যয় ও আত্মোপলব্ধিই পৃথিবীকে সাম্য-মৈত্রীর পুণমন্দিরে পরিণত করতে পারে সুন্দর পৃথিবীকে সুন্দরতম করবার এ-ই সহজতম পন্থা। বিংশ শতকের মানবতাবাদী শিল্পী রমা রোলার কণ্ঠে একদা শোনা গিয়েছিল–
“Broaden yourself or perish. Embrace all new and free forces of the world you are suffocating in your old shells, which are glorious but fossilised. Break them down. Breathe and let us breath”.
মোতাহের চৌধুরীর কণ্ঠেও এ ধ্বনিটিই সুকুমার ভাষায় ধ্বনিত হয়েছে।
—-শফিউল আলম
Leave a Reply