মোগলমারির বৌদ্ধমহাবিহার বিবিধ প্রসঙ্গ – সম্পাদনা : সূর্য নন্দী
সহ-সম্পাদনা – বিশ্বজিৎ ঘোষ তরুণ সিংহ মহাপাত্র
পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড
প্রথম সংস্করণ ২০১৬
.
মোগলমারি প্রত্নক্ষেত্রের প্রথম উৎখনন-নির্দেশক
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান
প্রয়াত ড. অশোক দত্তের স্মৃতির উদ্দেশে
ঋণস্বীকার
এবং সায়ক সাহিত্য পত্রিকা
প্রয়াত শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস
মোগলমারি তরুণ সেবা সংঘ ও পাঠাগার
প্রয়াত মন্ত্রী নন্দগোপাল ভট্টাচার্য
দাঁতন ১ পঞ্চায়েত সমিতি
ভট্টর মহাবিদ্যালয়, দাঁতন
দন্ডভুক্তি পুরাতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র
.
প্রাককথন
মোগলমারি গ্রামে সম্প্রতি বৌদ্ধমহাবিহার আবিষ্কৃত হওয়ায় মধ্যযুগের ইতিহাস যেমন আন্দোলিত, তেমনি আলোড়িত আমরা সকলেই। বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন-১নং ব্লকের অন্তর্গত গ্রামটি। খড়্গপুর থেকে ৪৫কিমি দক্ষিণে, উড়িষ্যা যাওয়ার রেলপথ ও সড়কপথ (NH 60)-এর পাশেই এর অবস্থান। কাছেই দাঁতন শহর। পশ্চিমদিক দিয়ে প্রবাহিত সুবর্ণরেখা নদী। কয়েকশো বছর ধরে মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে অতীতের এই বৌদ্ধবিহারটি। লোকে জানত সখিসোনার ঢিবি বা সখিসোনার পাঠশালা। রাজকন্যা সখিসোনা ও মন্ত্রীপুত্র অহিমাণিককে নিয়ে প্রণয় উপাখ্যানও লোকমুখে প্রচলিত।
সখিসোনার ঢিবি ও কিছু প্রত্ননিদর্শন দেখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. অশোক দত্ত চমৎকৃত হয়েছিলেন এবং উৎসাহিত হয়েছিলেন উৎখননে। ২০০৪ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ৬টি পর্যায়ে মোট ৭ বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে উৎখননের কাজ সম্পাদিত হয়, মূলত তাঁরই অধিনায়কত্বে। ধীরে ধীরে জানা গেল, এটি একটি বৌদ্ধমহাবিহার। একাধিক বিহারের স্থাপত্য। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বিহারগুলির অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমিত। গুপ্ত-পরবর্তী যুগ থেকে প্রায় তিনবার নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ হয়েছে বলে তাঁর অনুমান। গুপ্ত-পরবর্তী সময়কালের ইট যেমন পাওয়া গেছে তেমনি পাওয়া গেছে পরবর্তীকালের প্রায় ৬০ রকমের ছাঁচে-ঢালা নকশাযুক্ত ইট। পাওয়া গেছে দেওয়ালের অপূর্ব স্থাপত্য, স্টাকোর অলংকরণ, বুদ্ধমূর্তি, বৌদ্ধ দেবদেবীর অসংখ্য মূর্তি, এমনকী মানব-মানবীর মূর্তিও। বিহারের প্রবেশদ্বার, প্রদক্ষিণ পথ, সন্ন্যাসীদের আবাসকক্ষ, পোড়ামাটির বিভিন্ন সিল ও উৎসর্গফলক (ভোটিভ ট্যাবলেট), অর্ঘ্যপাত্র, কলস, প্রদীপ প্রভৃতি প্রত্ন উপাদান এই প্রত্নক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে। নালন্দার সমসাময়িক এই বৌদ্ধবিহারের আলংকারিক বৈশিষ্ট্যের অভিনবত্ব প্রত্নতত্ত্ববিদদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শুধুমাত্র ঢিবিটি নয়, পুরো গ্রামটিই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্র।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ২০১০ খ্রিস্টাব্দে মোগলমারির প্রত্নক্ষেত্রটিকে ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সৌধ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০১৩-র নভেম্বরে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব অধিকারএটিকে অধিগ্রহণ করে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিনবার রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব অধিকার থেকে খনন ও সংরক্ষণের কাজ হল। পোড়ামাটির একটি নামফলক পাওয়া গেছে যাতে লেখা—‘শ্রীবন্দকমহাবিহারে আর্যভিক্ষু সংঘ’। একটি মিশ্র ধাতুর মুদ্রা, একটি সোনার লকেট প্রভৃতি বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন-উপকরণ এই সময়কালেও পাওয়া গেছে। গত ২৪ জানুয়ারি, ২০১৬ একটি ট্রেঞ্চে পাওয়া গেল ৯১টি অক্ষত ব্রোঞ্জ বা মিশ্রধাতুর বুদ্ধ ও বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি। ৭ মার্চ পাওয়া গেল একটি সোনার প্রলেপ দেওয়া মুকুট (৭সেমি × ৪সেমি) সঙ্গে সঙ্গে সংরক্ষণের কাজও চলছে।
এর আগে পশ্চিমবাংলায় দু-টি বৌদ্ধমহাবিহারের সন্ধান আমরা পেয়েছি। একটি মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণে ‘রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার’, আর একটি মালদহের জগজীবনপুরে ‘নন্দদীর্ঘিকা মহাবিহার’। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (সুয়ান জাং) তাঁর বিবরণে তাম্রলিপ্ত-সংলগ্ন অঞ্চলে ১০টি বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত তারই একটি মোগলমারির এই বৌদ্ধবিহার। এখনও পর্যন্ত আর কোনো বৌদ্ধবিহার এতদ অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়নি। সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে বিহারের নালন্দা থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত গুপ্ত-পরবর্তী কাল থেকে যতগুলি বৌদ্ধ মঠ ও বিহার গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল মোগলমারির সদ্য আবিষ্কৃত এই বৌদ্ধমহাবিহার।
এই বৌদ্ধমহাবিহার ধীরে ধীরে উন্মোচিত হওয়ায় দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বৌদ্ধসংগঠন, পর্যটক-গবেষক-শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ আলোড়িত ও আন্দোলিত। অথচ ইতিহাস ও উৎখনন সংক্রান্ত কোনো সাহিত্য হাতের কাছে ছিল না। এটা অনুভব করে আমরা এবং সায়ক সাহিত্য পত্রিকার মোগলমারি বিষয়ক একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করি অক্টোবর ২০১২-তে। চারমাসের মাথায় ১০০০ কপি নি:শেষ হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয়বার মার্চ ২০১৩-তে পুনর্মুদ্রণ করে প্রকাশ করা হয়। দ্বিতীয়বারের সেই সংস্করণের কপিও আর পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছেন ওই বিশেষ সংখ্যাটিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার। সেই থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশ করার আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যোগ।
ইতিমধ্যে আরও তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে। উৎখননে আরও নতুন নতুন তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। কেবল স্থানীয় ভিত্তিতে নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরেও এই বৌদ্ধবিহার নিয়ে কৌতূহল আরও বেড়েছে। উৎখনন সংক্রান্ত ইতিহাস ও সাহিত্য হাতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। তাই আমরা গ্রন্থটি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিলাম। পুরোনো কিছু লেখা পুনর্লিখন করতে হয়েছে। নতুন বিষয়ে আরও পাঁচটি লেখা সংযুক্ত করা হল। অনেকগুলি স্থিরচিত্র, মানচিত্র সংযোজন করা হল—মোগলমারি বৌদ্ধমহাবিহারকে বুঝতে এগুলি সাহায্য করবে। ড. অশোক দত্ত মৃত্যুর পূর্বে এই শেষ লেখাটি লিখেছিলেন ইংরেজিতে। মূল সেই লেখাটিই রাখা হল। অবাংলাভাষী পর্যটক ও গবেষকদের সুবিধার জন্যে আর একটি লেখা ইংরেজিতে থাকল। আশা করি, পাঠকবর্গ বিষয়টি যথাযথ অনুধাবন করবেন। মোগলমারির প্রত্নকথা, উৎখননের ইতিবৃত্ত, ইতিহাস, পর্যটন ও বৌদ্ধপ্রভাব প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করে মোট ১৯টি প্রবন্ধ লিখেছেন মান্য লেখকগণ। এই সুযোগে লেখক শিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানাই। পারুল প্রকাশনীর কর্ণধার সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুসন্ধিৎসু শ্রীগৌরদাস সাহা মহাশয়ের সানন্দ-সম্মতি এই গ্রন্থের প্রকাশনাকে সুগম করেছে। তাঁকেও শ্রদ্ধাসহ ধন্যবাদ জানাই।
মোগলমারি প্রত্নক্ষেত্রের মাত্র তিরিশ শতাংশ খনন হয়েছে, আরও বাকি আছে সত্তর শতাংশ। আরও অনেক কিছু প্রাপ্তির আশা আছে, অনেক তথ্য পাওয়ার অবকাশ থাকছে। ভবিষ্যতে হয়তো ইতিহাস আবর্তিত হবে, আমরাও আলোকিত হব। সুতরাং, এই পর্যন্ত প্রাপ্তির নিরিখে এ গ্রন্থের সংরচন ও সংকলন। অনুধ্যানী পাঠকদের অসীম কৌতূহল সামান্য নিবৃত্ত হলে আমাদের উদ্যোগ চরিতার্থ মনে করব। ধন্যবাদ।
সূর্য নন্দী
Leave a Reply