মেঘলা আকাশ – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ – জুন ২০০০
উৎসর্গ
অফুরন্ত শ্রদ্ধার সহিত আমেনা বেগম-কে
১) “যখন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তিকে ধন দেন, সে যেন প্রথমেই নিজের জন্য ও পরিবারবর্গের জন্য ব্যয় করে।” বর্ণনায় : জাবের বিন সামেরাহ (রাঃ) মুসলিম
২) “দরিদ্রকে দান করিলে এক সওয়াব (পূণ্য) এবং আত্মীয়কে দান করিলে দ্বিগুণ সওয়াব হয়। (দান এবং আত্মীয়তা রক্ষা)। বর্ণনায় : হযরত সোলাইমান বিন আমের (রাঃ)–তিরমিযী, নেসায়ী ও ইবনে মাযাহ
১
আরমান যখন কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামল তখন রাত আটটা। তখনও ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। ট্রেনে থাকতেই প্রায় আধঘণ্টা আগে থেকে শুরু হয়েছে, এখনও থামার নাম নেই। এর আগে কখন সে ঢাকায় আসে নি। প্লাটফর্মের গেটের কাছে এসে দু’জন লোককে পশ্চিম দিকে নামায পড়তে দেখে সেও এশার নামায পড়ল। ট্রেনেই জোহর, আসর ও মাগরিবের নামায পড়েছে। নামায শেষ করে বাইরে এসে দেখল, টিকিট কাউন্টারের সামনে যাত্রীরা গীজ গীজ করছে। নিজের ছোট্ট সুটকেসটা ফ্লোরে রেখে তার উপর বসে ঝড়-বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগল। যাদের গাড়ি এসেছে তাদেরকে চলে যেতে দেখল। অনেককে আবার রিকশা বা স্কুটারে চলে যেতে দেখল। প্রায় আধঘণ্টা পর ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলে আরমান সুটকেসটা হাতে নিয়ে একজন ভদ্রলোককে একটা ঠিকানা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিভাবে যাব, যদি দয়া করে একটু বলে দিতেন?
ভদ্রলোক আরমানের আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বললেন, আপনি কী নতুন ঢাকায় এসেছেন?
আরমান বলল, জ্বি।
আপনি স্কুটারে অথবা বাসে যেতে পারেন। বাসে গেলে ঠিকানামতো পৌঁছাতে অনেক অসুবিধেয় পড়বেন। তার চেয়ে স্কুটারে যান। ড্রাইভারকে ঠিকানা দেখালে বাসার সামনে পৌঁছে দেবে।
স্কুটারে ভাড়া কত নেবে?
তা চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা।
আরমান চিন্তা করল, আসার সময় আম্মা পাঁচশ টাকা দিয়েছে। ট্রেনের টিকিট ও দুপুরের খাওয়াতে দেড়শ খরচ হয়ে গেছে। আছে সাড়ে তিন শ। তা থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা খরচ করে স্কুটারে যাওয়া কি ঠিক হবে?
তাকে ভাবতে দেখে ভদ্রলোক মনে করলেন, স্কুটারের ভাড়া হয়তো তার কাছে। নেই। বললেন, বাসেও যেতে পারেন। ভাড়া মাত্র পাঁচ টাকা।
আরমান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ধন্যবাদ, আমি বাসেই যাব।
ভদ্রলোক বললেন, আসুন তা হলে, আমিও বাসে ঐদিকেই যাব, তবে দু’স্টপেজ আগে নামব।
ঐ ভদ্রলোকের সাথে আরমান যখন আমজাদ সাহেবের বাড়ির গেটে পৌঁছাল তখন রাত সাড়ে নটা। বাস থেকে নামার আগেই আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তবে তত জোরে নয়। তবু লোকজনকে জিজ্ঞেস করে আসতে আসতে ভিজে জাব হয়ে গেছে। গেটটা বড়। গেট থেকে দোতলা বাড়িটা বেশ দূরে। গেট বন্ধ দেখে কি করবে ভাবতে লাগল। এমন সময় একটা গাড়ি আসতে দেখে একপাশে সরে দাঁড়াল।
আমজাদ সাহেব এক বন্ধুর বাসা থেকে ফিরছিলেন। ড্রাইভার হর্ণ বাজাতে গেট খুলে গেল।
ততক্ষণে আমজাদ সাহেব আরমানকে দেখে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি? এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছ কেন?
আরমান ঠিকানাটা তার হাতে দিয়ে বলল, আমি এঁর কাছে এসেছি।
আমজাদ সাহেব ঠিকানা পড়ে বললেন, কেন এসেছ?
আমাকে পলাশপুর হাইস্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টার তমিজউদ্দিন স্যার পাঠিয়েছেন।
আমজাদ সাহেব কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, ভিতরে এস। তারপর দারোয়ানকে বললেন, ছেলেটা একদম ভিজে গেছে। জামা-কাপড় বদলাবার ব্যবস্থা করে ড্রইংরুমে পাঠিয়ে দাও।
দশ মিনিট হল আরমান ড্রইংরুমে কার্পেটের উপর বসে আসবাবপত্র দেখছে। শহরের ধনী লোকদের সব কিছু যে এত দামী, তা ভাবতেই পারছে না।
আরও মিনিট দশেক পর আমজাদ সাহেব পর্দা ঠেলে ঢুকে বললেন, তুমি ওখানে বসে আছ কেন? সোফায় বস। তারপর নিজে একটা সোফায় বসে বললেন, স্যার কেন পাঠিয়েছেন?
আরমান দাঁড়িয়ে বুক পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে তাঁর হাতে দিল।
আমজাদ সাহেব তাকে বসতে বলে চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন —
স্নেহের আমজাদ,
দোয়া নিও। আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালো আছ। তারই কৃপায় আমিও একরকম ভালো আছি। পর সমাচার, তুমি যেমন আমার খুব প্রিয় ছাত্র ছিলে, এই ছেলেটাও আমার খুব প্রিয়। খুব গরিবের ছেলে। আর্থিক অনটনের জন্য বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি। যদি আরো লেখাপড়া করতে চায়, সে ব্যবস্থা করো। আর যদি লেখাপড়া করতে না চায়, তা হলে রুজী-রোজগারের একটা ব্যবস্থা করে দিও। শুনেছি, আল্লাহ তোমাকে ধন-মান সবকিছু দিয়েছেন। একে সাহায্য করলে আল্লাহ তোমাকে সেসব আরো বাড়িয়ে দেবেন। আশা করি, আমাকে নিরাশ করবে না। মহান প্রভু আল্লাহর দরবারে তোমার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তমিজউদ্দিন আহম্মদ
পলাশপুর।
চিঠিটা ভাঁজ করে আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?
আরমান।
কতদূর লেখাপড়া করেছ?
বাংলা, ইংরেজী পড়তে লিখতে পারি।
আমি তা জিজ্ঞেস করি নি। কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ?
এস.এস.সি পাশ করেছি।
মনে হচ্ছে অনেক আগে পাশ করেছ?
জ্বি, পাঁচ বছর হয়ে গেল।
এতদিন কী করতে?
বাবা যখন মারা যান তখন আমি নয়-দশ বছরের। বোন দু’টো ছোট। আম্মা অনেক কষ্ট করে আমাকে পড়িয়েছেন। আম্মার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সংসারের হাল ধরি।
তা এতদিন পর স্যার তোমাকে আমার কাছে পাঠালেন কেন, ঠিক বুঝতে পারছি না ।
সব জিনিসের দাম যা বেড়েছে, তাতে করে লোকের বাড়ি কামলা খেটে সংসার চালাতে পারছিলাম না। স্যারের বাড়ির কাছে আমাদের বাড়ি। তিনি বিপদ
আপদে অনেক সাহায্য করেন। আম্মা অনেকদিন থেকে অসুখে ভুগছেন। খুব স্নেহ করেন। আমাদের দুঃখ কষ্ট দেখে তিনি এই চিঠি লিখে আমাকে পাঠিয়েছেন।
তোমাদের বাড়ি কী পলাশপুর?
জ্বি।
তোমার বাবার নাম কী?
সোলেমান আলি।
ঠিক আছে, আপাতত কয়েকদিন থাক। তারপর একটা কিছু করার ব্যবস্থা করব। সঙ্গে কিছু আন নি?
জ্বি, দারোয়ানের কাছে সুটকেসে আমার জামা-কাপড় আছে।
আমজাদ সাহেব ড্রাইভারকে ডেকে বললেন, তোমার রুমে তো দু’টো চৌকি? ও তোমার রুমে থাকবে। তারপর আরমানকে বললেন, তুমি ওর সঙ্গে যাও।
ড্রাইভার ও আরমান চলে যাওয়ার পর আমজাদ সাহেবের ছাত্র জীবনের কথা মনে পড়ল। ভালো ছাত্র হিসাবে তমিজউদ্দিন স্যার তাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। তারই অক্লান্ত চেষ্টায় এস.এস.সি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম স্থান পেয়েছিলেন। তারপর কলেজে পড়ার সময়ও…..স্ত্রীর গলা পেয়ে বাস্তবে ফিরে এলেন।
চুপচাপ বসে কী এত ভাবছ? বাইরে থেকে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে চা খেয়েই চলে এলে, কে এসেছিল? কাউকে দেখছি না তো?
আমজাদ সাহেব চিঠিটা এগিয়ে দিলেন।
সাজেদা বেগম পড়ে গম্ভীর মুখে বললেন, ছেলেটা কোথায়?
ড্রাইভারের রুমে।
তোমাদের গ্রামের ছেলে?
না, পাশের গ্রামের।
কী বলেছ ওকে?
কিছু বলি নি, কাল সকালে কিছু একটা বলব।
কিছু একটা বলবে মানে?
না মানে….।
স্বামীকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে সাজেদা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, এ বাড়িতে তোমার কোনো আত্মীয়কে আশ্রয় না দেওয়ার বা তাদেরকে সাহায্য ন। করার ওয়াদা করেছিলে, সে কথা ভুলে যাচ্ছ কেন? ওকে কাল সকালে বিদেয় করে দেবে। এটা কোনো এতিমখানা নয়।
আমজাদ সাহেব রেগে গেলেও স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ, ওয়াদা করেছিলাম বলেই তো ফেরেস্তাতুল্য বড় ভাই, যে নাকি না খেয়ে না দেয়ে সম্পত্তি বিক্রি করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করতে ঢাকায় পাঠিয়েছিল, তাকে আজ পর্যন্ত একটা টাকা দিয়ে সাহায্য করি নি। এমন কি তারা মারা গেছে না বেঁচে আছে সে খবরও নিই নি। আমার খোঁজ-খবর না পেয়ে একবার বড় ভাই আমার কাছে এসেছিল, ওয়াদা রক্ষা করার জন্য গেটের বাইরে গাড়ি থামিয়ে তাকে বিদায় করে দিয়েছিলাম। মায়ের মতো যে ভাবি বিয়ের গহনা বিক্রি করে আমার পড়ার খরচ যুগিয়েছে, নিজে উপোষ থেকে আমাকে খাইয়েছে। সেই ভাবির জন্যও আমি কিছু করি নি।
সাজেদা বেগম এতক্ষণ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলেন। এবার গর্জে উঠলেন, চুপ কর। যে দিন বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে বড় লোকের একমাত্র মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেছিলে, সেদিন ভাই-ভাবির কথা মনে ছিল না? গ্রামের ধনী লোকের একমাত্র সন্তানের পরিচয় দিয়ে আমার সঙ্গে প্রেম করার সময়ও তাদের কথা মনে ছিল না? মা-বাবাকে জানিয়ে বিয়ে করলে তারা শহরের মেয়েকে বৌ করতে রাজি হবে না বলে তাড়াতাড়ি করে গোপনে কোর্ট ম্যারেজ করেছিলে। এমন কি আমার বাবাকে পর্যন্ত জানাতে দাও নি। বিয়ের আগে যদি এসব জানতে পারতাম, তাহলে….তাহলে বলে থেমে গেলেন।
আমজাদ সাহেব বললেন, থেমে গেলে কেন? তা হলে কী করতে? আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে? তা কি তুমি পারতে? পারতে না? কারণ তখন আমার প্রেমের অতল সাগরে তুমি তলিয়ে গিয়েছিলে। তা না হলে তিন চার বছর প্রেম করার সময় একটু চোখ-কান খোলা রাখলে আমার আসল পরিচয় ঠিক ধরতে পারতে। গরিবের ছেলে । কষ্টে মানুষ হয়েছি। তাই তোমার বাবার অর্থের দিকে লোভ ছিল ঠিক; কিন্তু তার থেকে তোমার রূপের ও প্রেমের আকর্ষণ ছিল আরো অনেক বেশি। তোমার বাবার ঐশ্বর্য, তোমার রূপ ও প্রেম আকর্ষণ করলেও বিয়ের আগে আমার আসল পরিচয় জানাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি পাগলের মতো এত বেশি আমাকে ভালবেসেছিলে যে, যদি বলতাম, তা হলেও বিয়েতে অমত করতে
অথবা আত্মহত্যা করতে। দেখ সাজেদা, এখন আর পুরোন কথা তোলা উচিত হচ্ছে না। ছেলেমেয়ে শুনে ফেললে কি ভাববে বলতো? সব সময় একটা কথা মনে রাখবে, “এক হাতে তালি বাজে না।”
সাজেদা বেগমের রাগ বারুদের আগুনের মতো। বারুদ যেমন দপ করে জ্বলে উঠে এবং দপ করে নিভে যায়। সাজেদা বেগমও সামান্য কথায় রেগে যান। আবার চট করে রাগ পড়ে যায়। স্বামীর মুখে প্রেমের কথা শুনে তাই হল। স্বামীর মাথায় একটা হাত রেখে মিষ্টিস্বরে বললেন, এগারটা বাজে, সেই কখন থেকে বকবক করছ, চল খাবে চল।
আমজাদ হোসেন বিয়ের আগে থেকে সাজেদা বেগমের এই স্বভাবের কথা জানেন। স্ত্রীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ চল, খুব ক্ষীদে পেয়েছে। যেতে যেতে বললেন, যে স্যার ছেলেটাকে পাঠিয়েছেন, তার কাছে আমি ঋণী। ছেলেটার জন্য কিছু একটা করলে সেই ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে।
সাজেদা বেগম বললেন, একথা আগে বললে, এত কিছু বলতাম না। আমি মনে করেছিলাম, তোমার আত্মীয়। স্যার যখন পাঠিয়েছেন তখন ছেলেটাকে কোনো কাজে লাগিয়ে অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দাও।
রাত দশটায় সবাই ভাত খায়। রুবী ঐ সময় ডাইনিংরুমে গিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বুয়াকে জিজ্ঞেস করল, মা-বাবা আসে নি?
বুয়া বলল, খালাম্মা ও খালুজী ড্রইংরুমে।
খাওয়ার সময় মা-বাবা ড্রইংরুমে কি করছে দেখার জন্য দরজার কাছে। আসতে মা-বাবা তাদের প্রেম ও বিয়ের কথা নিয়ে বলাবলি করছে শুনে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তারপর তাদের আলাপ শুনে মনে মনে হেসে উঠল। ভাবল, তার জীবনেও কী কোনো ভালবাসার পাত্র আসবে? সে কি তাকে মায়ের মতো ভালবাসতে পারবে? এমন সময় মা-বাবাকে ভাত খাওয়ার কথা বলতে শুনে তাড়াতাড়ি ডাইনিংরুমে ফিরে এল।
২
ড্রাইভার আরমানকে রুমে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী?
আরমান নাম বলে বলল, আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমি তো আপনার ছেলের বয়সী। নাম ধরে তুমি করে বলবেন। আর আমি আপনাকে ড্রাইভার চাচা বলে ডাকব।
ড্রাইবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিকই বলেছ। আমারও একটা ছেলে ছিল। বেঁচে থাকলে এতদিনে তোমার মতই হত। তা তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?
আরমান চিন্তা করল, বাবার বয়সী লোকের কাছে মিথ্যা বলা উচিত নয়। বলল, আমার বাবা নেই। আপনি আমার বাবার বয়সী। তাই কোনো কিছু গোপন করব না। ছেলে হয়ে আপনাকে একটা অনুরোধ করব, বলুন রাখবেন?
ড্রাইভার সরল-সোজা মানুষ। বলল, তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
পরে আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। এখন আমার পরিচয় যা বলব, তা কাউকেই বলবেন না বলুন?
ড্রাইভার সরল-সোজা হলেও বয়স্ক মানুষ। বুঝতে পারল, ছেলেটার কোনো উদ্দেশ্য আছে। বলল, তুমি কী সাহেবের কাছে পরিচয় গোপন করেছ?
আরমান মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ চাচা, আপনি ঠিক ধরেছেন।
তুমি এখানে থাকতে এসেছ?
হ্যাঁ।
কিন্তু তোমার যদি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকে? আমি অনেক বছর ধরে সাহেবের গাড়ি চালাচ্ছি। তাদের এতটুকু ক্ষতি হোক, তা আমি চাই না।
আরমান তার দুটো হাত ধরে ছলছল চোখে বলল, আপনাকে বাবার মতো, মনে করে আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি চাচা, আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। তবে পরিচয় গোপন করে থাকার একটা উদ্দেশ্য অবশ্য আছে, সময় মতো আপনাকে বলব।
আরমানের চোখে পানি দেখে ও তার কথা শুনে সন্তানহারা ড্রাইভারেরও চোখে পানি এসে গেল। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ মুছে বলল, ঠিক আছে; তোমার সব কথা গোপন রাখব।
আরমান কিছু বলতে যাচ্ছিল, কাজের বুয়া জমিরনকে রাতের খাবার নিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল।
জমিলা মেঝের একপাশে সব কিছু নামিয়ে রেখে বলল, দু’জনের খাবার আছে। তারপর চলে গেল।
ড্রাইভার বলল, এস খেয়ে নিই। তারপর তোমার কথা শুনব।
খাওয়ার পর আরমান বলল, চাচা, আমি আপনার কাছে ড্রাইভিং শিখব।
আমার শেখাবার সময় কোথায়? আমি তো সব সময় সাহেবের গাড়ি চালাই। তুমি সাহেবকে বলো, তিনিই ব্যবস্থা করে দেবেন। ওসব কথা থাক। তোমাদের গ্রামের নাম বল?
সাহেবদের গ্রামের পাশের গ্রামে।
ও তা হলে তো তুমি সাহেবদের দেশের লোক। তা কী মনে করে এসেছ?
কাজ কামের চেষ্টায় এসেছি।
সাহেব কি বললেন?
বললেন, কয়েকদিন থাক। ব্যবস্থা করে দেবেন। তারপর হাই তুলে বলল, চাচা, খুব ঘুম পাচ্ছে এবার ঘুমাব।
ড্রাইভার চিন্তিত মুখে বলল, বিছানাপত্র ছাড়া ঘুমাবে কী করে? আজ না হয় আমার কাছেই ঘুমাও, কাল নিশ্চয় সাহেব তোমার বিছানাপত্রের ব্যবস্থা করে দেবেন।
.
অভ্যাসমতো ফজরের আজান শুনে আরমানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ড্রাইভারকে। জাগিয়ে বলল, চাচা উঠুন, মসজিদে নামায পড়তে যাবেন না?
ড্রাইভার পাশ ফিরে শুয়ে বলল, আলনায় নামায পাটি আছে, তুমি অযু করে ঘরের মেঝেতে নামায পড়ে নাও। গেট বন্ধ। আটটার আগে খুলবে না।
আরমান বুঝতে পারল, ড্রাইভার চাচা নামায পড়ে না। ভাবল, এ বাসায় হয়তো কেউ-ই পড়ে না।
ফজরের নামায পড়ে আরমান প্রতিদিন দু’পারা কুরআন মুখস্থ পড়ে। ও তফসির পড়ে। তাই নামায শেষ করে দু’পারা কুরআন মুখস্থ ও দোয়া-দরূদ পড়ে আব্বা ও মরহুম-মরহুমা মুরুব্বীদের নামে বশখে দিয়ে নামায পাটি তুলে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে এল। রাতে বৃষ্টির মধ্যে এসেছিল বলে কোনো দিকে তাকিয়ে দেখে নি। বাড়ির চার পাশের পরিবেশ দেখে যেমন অবাক হল তেমনি মনটা আনন্দে ভরে গেল। তখনও তেমন ফরসা হয় নি। আবছা আবছা অন্ধকার। পূর্ব দিকের পাঁচিল থেকে পশ্চিম দিকের পাঁচিল পর্যন্ত পুরোটাই ফাঁকা। ঠিক যেন একটা খেলার মাঠ। আরমানদের গ্রামেও এর চেয়ে বড় একটা খেলার মাঠ আছে। এ সময় সে প্রতিদিন মাঠের এমাথা ওমাথা কয়েকবার দৌড়ায়। শহরে কোনো বাড়ির সামনে এরকম মাঠ থাকে তার তা জানা ছিল না। লুঙ্গীটা হাঁটুর নিচ পর্যন্ত উঠিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। রাতে বৃষ্টি হলেও মাঠটা বেলে মাটির হওয়ায় কাদা হয় নি।
এ বাড়িটা আমজাদ সাহেবের শ্বশুর মকবুল হোসেনের। তার একমাত্র সন্তান সাজেদা বেগমকে আমজাদ সাহেব বিয়ে করেন। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। বিয়ের পর সাজেদা বেগম পাঁচ বছর সন্তান গ্রহণ করতে রাজি হন নি। এর মধ্যে আমজাদ সাহেব অন্তত একটা সন্তান নেওয়ার জন্য অনেক বুঝিয়েছেন, কিন্তু তিনি শরীরের গ্লামার নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে স্বামীর কথা রাখে নি। শেষে তার মা মুনসুরা বেগম ব্যাপারটা জেনে বংশ রক্ষার জন্য মেয়েকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একটা সন্তানের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সে সন্তান এক মাসের মধ্যে মারা যায় । তারপর সাজেদা বেগমের মন সন্তানের জন্য উতলা হয়ে উঠে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে দু’বছর অন্তর দু’টো সন্তান নেন। প্রথম সন্তান ছেলে। তার নাম শাওন। দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে। তার নাম রুবী। শাওন ইকোনিমিক্সে অনার্স করছে। আর রুবী ভিখারুন্নেসা-নুন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। মায়ের মতো অপূর্ব সুন্দরী ও রাগি। তবে দাদার মতো মন পেয়েছে। উঁচু সোসাইটির ছেলেমেয়েদের ছাড়া কারো সঙ্গে মেলামেশা করে না। আগে ফুটবল খেলা দেখা তার হবি ছিল। কলেজে ঢোকার পর ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। শুধু তাই নয়, বাসার সামনে অর্ধেক জায়গা জুড়ে যে ফুলের বাগান ছিল, সেটা উত্তর দিকে ট্রান্সফার করে পুরো জায়গাটা ক্রিকেট খেলার মাঠ করেছে। বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে সেখানে ক্রিকেট খেলে।
সেও ভোর ছটার সময় প্রতিদিন মাঠের এমাথা ওমাথা কয়েকবার দৌড়ায়। আজ ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে যেতে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সাড়ে পাঁচটায় বিছানা ছেড়ে উঠে ট্রাকসুট পরে বেরিয়ে এল। লুঙ্গী ও গেঞ্জী পরা একটা ছেলেকে দৌড়াতে দেখে বারান্দাতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাবল, এই ছেলেটাই কি কাল রাতে এসেছে?
আরমান বেশ কয়েকবার দৌড়ে হাঁফিয়ে পড়েছে। তাই মাঠের একপাশে বসে বিশ্রাম নেওয়ার সময় ভাবতে লাগল, এখানে ক্রিকেট খেলার পীচ রয়েছে, নিশ্চয় ক্রিকেট খেলা হয়। ড্রাইভার চাচাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কারা খেলে?
ততক্ষণে রুবী তার কাছে এসে বলল, কে তুমি?
মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনে আরমান মুখ তুলে তাকিয়ে রুবীর ড্রেস দেখে মুখ নিচু। করে নিয়ে বলল, আমি আরমান।
অনুমানটা ঠিক কিনা জানার জন্য রুবী গম্ভীর স্বরে বলল, তুমি এখানে এলে কি করে? গেট তো বন্ধ?
সে কথা পরে বলছি, আগে বলুন, আপনি কে?
রুবী খুব রেগে গিয়ে বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। আরমান মুখ তুলে একবার তার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, বারে, ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আমি কে জানতে চাইলেন, আপনি কে জানতে চাইতে দোষ হয়ে গেল?
রুবী বুঝতে পারল, ছেলেটা খুব সরল। সংযত হয়ে মৃদু হেসে বলল, আমি এই বাড়ির মালিকের মেয়ে।
আরমান তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, ভুল করে ফেলেছি, মাফ করে দিন।
রুবী সালামের উত্তর না দিয়ে বলল, এখানে এলে কী করে? গেট টপকে এসেছ নিশ্চয়?
গেট টপকে আসব কেন? আমি তো কাল রাতে এসেছি।
তা দৌড়াচ্ছিলে কেন?
ভোরে দৌড়ান আমার অভ্যাস। তাই মাঠ দেখতে পেয়ে দৌড়ালাম। জানেন, ভোরে দৌড়ান স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো। আপনিও মনে হয় দৌড়াতে এসেছেন? আমি এবার যাই, আপনি দৌড়ান বলে আরমান হাঁটতে শুরু করল।
রুবী বলল, চলে যাচ্ছ কেন? দাঁড়াও।
আরমান দাঁড়িয়ে তার দিকে ফিরে মাথা নিচু করে বলল, কিছু বলবেন?
হ্যাঁ, কাছে এস।
আরমান দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে এসে দাঁড়াল।
তুমি মুখ নিচের দিকে করে রয়েছ কেন? আমার মুখের দিকে তাকিয়েও কথা বলছ না?
আপনার পোশাক দেখে লজ্জা পাচ্ছি। তা ছাড়া যারা এরকম পোশাক পরে তাদের দিকে তাকালে গুনাহ হয়।
রুবী আবার রেগে যাচ্ছিল, আরমানের সহজ-সরল মুখের দিকে তাকিয়ে রাগতে পারল না। মৃদু হেসে বলল, তুমি গ্রাম থেকে এসেছ তাই না?
জি, আপনি ঠিক বলেছেন।
তোমাদের গ্রামের নাম কী?
পলাশপুর। এবার যাই, আপনি দৌঁড়ান। রোদ উঠে পড়বে। রোদ উঠার আগে দৌঁড়াতে হয়।
তোমার দৌঁড়ান দেখেছি, আমার দৌঁড়ান দেখবে না?
লজ্জা লাগবে বলে আরমান সেখান থেকে দ্রুত চলে আসতে লাগল।
রুবী খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, গেঁও ভূত। তারপর দৌড়াতে শুরু করল।
বেলা সাড়ে আটটার সময় কাজের বুয়া জমিলা নাস্তা নিয়ে ড্রাইভারের রুমে রেখে যাওয়ার সময় আরমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, নাস্তা খেয়ে ড্রইংরুমে আসবে, সাহেব ডেকেছে।
নাস্তা খাওয়ার পর আরমান ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা কোথায় যেতে বলল?
ড্রাইভার বলল, ড্রইংরুমে। চল দেখিয়ে দিচ্ছি।
আরমান ড্রইংরুমে ঢুকে দেখল, সাহেব, সাহেবের মেয়ে, একটা ছেলে, একজন মহিলা ও একজন বয়স্ক লোক রয়েছেন। সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
আমজাদ সাহেব সকালেই শ্বশুরকে চিঠিটা পড়তে দিয়ে বলেছিলেন, আমি ছেলেটাকে সাহায্য করতে চাই।
মকবুল হোসেন নিজের মেয়ের স্বভাব জানেন। সে যে এই ছেলেকে কিছুতেই বাসাতে রাখতে চাইবে না তা জানেন। তাই বলেছিলেন, তুমি এ ব্যাপারে কিছু করতে যেও না। যা করার আমি করব। এখন আরমানকে দেখে তার খুব ভালো লাগল। কেউ সালামের উত্তর না দিলেও তিনি দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করতে চাও?
আরমান সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, আমি ড্রাইভার হতে চাই।
মকবুল হোসেন ও আমজাদ সাহেব ছাড়া সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
মকবুল হোসেন ধমকের স্বরে বললেন, আহ! এতে হাসির কি হল? তারপর আরমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ড্রাইভার হতে চাচ্ছ কেন?
আমি তো বেশি লেখাপড়া করি নি, কোনো চাকরি পাব না। ড্রাইভার হলে সহজে চাকরি পাওয়া যাবে। চাকরি পাওয়ার পর আরো লেখাপড়া করব।
মকবুল হোসেন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, গ্রামের অল্প শিক্ষিত ছেলে হলেও ওর বুদ্ধি আছে। তারপর আরমানকে বললেন, ড্রাইভারী না করেও তুমি লেখাপড়া করতে পার। আমরা সে ব্যবস্থা করে দেব।
আরমান ভক্তিগদগদ কণ্ঠে বলল, আপনারা খুব ভালোমানুষ। তাই থাকতে দিয়েছেন, খেতে দিয়েছেন। আবার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেবেন বলছেন। কিন্তু আমি তো শুধু লেখাপড়া করার জন্য এখানে আসি নি। আয় করতেও এসেছি। নচেৎ বাড়িতে সবাই খাবে কী? তাই বলছিলাম, আপনারা মেহেরবাণী করে আমাকে ড্রাইভারী শিখিয়ে তাড়াতাড়ি একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন।
এবার সাজেদা বেগম স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওকে একটা মেসে রাখার ব্যবস্থা করে ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি করে দাও।
আমজাদ সাহেব কিছু বলার আগেই মকবুল হোসেন, বললেন, গ্রামের ছেলে কখনও ঢাকা শহরে আসে নি। শহরের মানুষজন, রাস্তাঘাট সম্পর্কে কিছুই জানে না। মেসে থাকলে কখন কি অঘটন ঘটে যাবে তার কোনো ঠিক আছে? তার চেয়ে ও আমাদের এখানেই থেকে ড্রাইভিং স্কুলে যাতায়াত করুক। আর আমাদের ড্রাইভারের রুমে ওর থাকার ব্যবস্থা করা যাবে।
আমজাদ সাহেব বললেন, হ্যাঁ বাবা, সেটাই ভালো হবে।
মকবুল হোসেন আরমানকে বললেন, তুমি এখানে থেকে আগে ড্রাইভিং শেখ, তারপর চাকরির একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
আরমান মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আপনাদের সবাইকে কাকে কি বলে ডাকব বলে দিন।
মকবুল হোসেন বুঝতে পারলেন, ছেলেটা খুব ইন্টেলিজেন্ট। নাতি শাওনকে বললেন, তুমি ভাই বলে দাও তো।
শাওন দাদুর কথা শুনে রুবীকে বলল, তুই বল।
রুবী শাওনের থেকে দু’বছরের ছোট হলেও তার সঙ্গে তুই তোকারি করে। বলল, দাদু তোকে বলতে বললেন, তুই বল। আমি বলতে পারব না।
মকবুল হোসেন বললেন, ঠিক আছে, তোদের কাউকেই বলতে হবে না, আমিই বলছি। তারপর কাকে কি বলবে আরমানকে বলে দিয়ে বললেন, এবার তুমি যাও।
আরমান চলে যাওয়ার পর রুবী বলল, দাদু আজ আপনার কোথাও যাওয়া চলবে না। আমার বন্ধুদের সঙ্গে শাওনের বন্ধুদের ম্যাচ হবে। আপনি আম্পায়ার থাকবেন।
মকবুল হোসেন বললেন, তাই নাকি? তা যে দল জিতবে তারা কী পাবে?
রুবী বলল, যে দল হারবে তারা বিজেতা দলকে চাইনীজ খাওয়াবে।
আম্পায়ারকে খাওয়াবে না?
অফকোর্স। তারপর শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল, কীরে, তোর বন্ধুরা আসবে তো?
শাওন বলল, আসবে। তোর বন্ধুরা এলেই হয়। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকেও থাকতে হবে। তুমি লেগ আম্পায়ার হবে।
আমজাদ সাহেব বললেন, বিদেশ থেকে একটা পার্টি এসেছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আমি থাকতে পারব না।
মকবুল হোসেন বললেন, হ্যাঁ, আমজাদের থাকা চলবে না।
শাওন বলল, লেগ আম্পায়ার তা হলে কে হবে?
যে দল ব্যাটিং করবে তাদের একজন থাকবে।
দশটার মধ্যে সবাই এসে যাওয়ার পর খেলা শুরু হল। টসে জিতে রুবীদের দল প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিল। প্রতি দলে চারজন মেয়ে ও তিনজন ছেলে মোট সাতজন করে চৌদ্দজন প্লেয়ার। তাই ছয় উইকেটের খেলা। এক ঘণ্টার মধ্যে রুবীর দল সব উইকেট হারিয়ে ষাট রান করল। চা খাওয়ার বিরতির পর শাওনদের দল খেলতে নেমে পাঁচ উইকেট হারিয়ে একষট্টী রান করে জিতে গেল। দু’দলের মেয়েদের মধ্যে রুবী সর্বোচ্চ বিশ ও শাওনের এক বন্ধু বাইশ রান করল।
এক সপ্তাহ হল আরমান ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হয়েছে। একদিন বাংলাদেশ। ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান আসিফ সাহেবের বাসায় গিয়ে একটা চিঠি তাঁকে দিল।
আসিফ সাহেব চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন,
স্নেহের আসিফ,
পত্রে আমার দোয়া নিও। আশা করি, আল্লাহর ফজলে স্বপরিবারে ভালো আছ। তারই কৃপায় আমরা সকলে একরকম আছি। অনেকদিন তুমি চিঠিপত্র দাও নি। দেশেও আস নি। তাই তোমাদের কোনো খবরাখবর পাচ্ছি না। আসতে না পারলেও মাঝে মাঝে পত্র দিয়ে এই বুড়ো চাচাকে সুখী করো। যাই হোক, পত্র বাহক আমার খুব প্রিয় ছাত্র। বি.এ.তে ফার্স্টক্লাস পেয়েছে। গরিবের ছেলে। স্কুল জীবন থেকে ক্রিকেট খেলে। কলেজে পড়ার সময় খুব নাম করেছে। পড়াশোনায় যেমন ভালো, ক্রিকেট খেলায়ও তেমনি ভালো। ক্রিকেটার হিসাবে গ্রামে তার খুব সুনাম। ওর প্রতীভা আছে। তুমি যদি ওকে একটু সাহায্য কর, তা হলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ইনশাআল্লাহ একদিন দেশের একজন নামকরা ক্রিকেটার হবে। ওর ইচ্ছা, ঢাকায় গিয়ে প্রথমে কিছু রোজগারের ব্যবস্থা করে মাষ্টার্স কমপ্লিট করবে। আর সেই সাথে ক্রিকেট খেলা প্র্যাকটিস করবে। আশা করি, ওকে তুমি বিমুখ করবে না। একটা কথা মনে রেখ, কারো সাহায্য ছাড়া কেউ কোনোদিন বড় হতে পারে না। অবশ্য সবকিছু আল্লাহপাকের মর্জি।
অবশেষে আল্লাহপাকের দরবারে তোমাদের সবার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোমার চাচা
তমিজউদ্দিন আহম্মদ
চিঠি পড়া শেষ করে আসিফ সাহেব কয়েক সেকেন্ড আরমানের আপাদমস্তক তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তমিজুদ্দিন চাচা তোমার কে হন?
আরমান বলল, কেউ হন না; কিন্তু আমাদের মধ্যে পিতা-পুত্রের মতো সম্পর্ক।
ঢাকায় কবে এসেছ?
এক সপ্তাহ হয় এসেছি।
উঠেছ কোথায়?
স্যারের এক ছাত্রের বাসায়।
কোনো চাকরির চেষ্টা করছ?
ড্রাইভিং শিখছি। শেখার পর উনি চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন।
প্রতিদিন সকাল আটটায় প্র্যাকটিস করতে আসতে পারবে?
জ্বি পারব।
আসিফ সাহেব একটা কার্ড দিয়ে বললেন, কাল সকাল আটটায় এখানে। আসবে।
জ্বি আসব। এবার আসি হলে?
বস, চা খেয়ে তারপর যাবে।
ড্রাইভিং স্কুলে আরমান বেলা দশটায় যেত। আসিফ সাহেবের বাসা থেকে ফেরার পথে ড্রাইভিং স্কুলে গিয়ে বিকেল তিনটেয় আসার কথা জানিয়ে এল। বাসায় এসে মাকে সবকিছু জানিয়ে একটা চিঠি লিখল এবং উত্তর দিতে নিষেধ করল। পরের চিঠিতে ঠিকানা দিলে যেন উত্তর দেয়, সে কথাও লিখল। তখন তার নাজনীনের কথা মনে পড়ল। ভাবল, নাসরিন যখন টেনে পড়ছে, তা হলে নাজনীন নিশ্চয় এস.এস.সি. পাশ করে কলেজে ঢুকেছে। একটু সামলে উঠলে ঢাকা শহরের সব কলেজের গেটের সামনে কয়েকদিন ধরে অপেক্ষা করবে। নাজনীন ও নাসরিন যখন একই রকম দেখতে তখন এত বছর নাজনীনকে না দেখলেও ঠিক চিনতে পারবে।
পরপর চার-পাঁচ দিন আরমানকে ভোরে দৌঁড়াতে না দেখে একদিন রুবী তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে আর ভোরে দৌড়াতে দেখি না কেন?
আরমান বলল, দৌঁড়াই নি, তাই দেখেন নি।
কেন-দৌঁড়ান নি কেন?
খুব সকালে এক জায়গায় হেঁটে যেতে হয়, তাই দৌঁড়াই নি।
কোথায় যাও?
সত্য কথা বলা যাবে না, মিথ্যাও বলতে পারবে না ভেবে আরমান চুপ করে রইল।
কী হল? কোথায় যাও বলবে তো?
বলা যাবে না।
কেন?
বললাম তো বলা যাবে না, তবু জিজ্ঞেস করছেন কেন?
কেন বলা যাবে না, সেটাই তো জানতে চাই।
কি মুশকিল? আপনি তো দেখছি ভীষণ জেদী?
হ্যাঁ, জেদী। একথা সবাই জানে। তুমিও এখন জানলে। এবার বলে ফেল কোথায় যাও। নচেৎ…..বলে থেমে গেল।
নচেৎ এখান থেকে তাড়িয়ে দেবেন, তাই না?
হ্যাঁ, তাই।
কিন্তু কোথায় যাই বললেও তাড়িয়ে দেবেন।
প্ৰমিশ করছি তাড়াব না। এবার বল।
আরেকটা প্রমিশ করলে বলতে পারি।
রুবী, অল্পক্ষণ চিন্তা করে বলল, কি প্রমিশ করব বল?
যেখানে যাই, তা কাউকে বলবেন না বলুন?
রুবী হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে, প্রমিশ করলাম কাউকে বলব না।
ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতে যাই।
রুবী খুব অবাক হয়ে বলল, হোয়াট?
আরমান কিছু না বলে মুখ নিচু করে রইল।
রুবী আবার প্রশ্ন করল, কোথায় প্র্যাকটিস করতে যাও?
আবাহনীর মাঠে।
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
তুমি কী গ্রামে ক্রিকেট খেলতে?
জ্বি, খেলতাম।
নিশ্চয় ভালো খেলতে?
এই একটু আধটু আর কী।
কোন দলে প্র্যাকটিস কর?
আবাহনীর জুনিয়ার গ্রুপে।
ওখানে চান্স পেলে কী করে?
যে স্যার চিঠি লিখে আপনার বাবার কাছে পাঠিয়েছেন, তিনিই ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছেও আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে আমাকে খেলার ব্যাপারে সাহায্য করতে বলেছিলেন। উনিও ঐ স্যারের প্রিয় ছাত্র ছিলেন।
রুবী আরো বেশি অবাক হয়ে বলল, ও মাই গড! তুমি তো দেখছি খুব জিনিয়াস ছেলে। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, ড্রাইভিং শিখতে যাও নি তা হলে?
বিকেল তিনটের সময় ড্রাইভিং স্কুলে যাই।
কিন্তু তুমি নাস্তা খাও কোথায়? তা ছাড়া আবাহনীর মাঠ তো এখান থেকে
অনেক দূর। যাতায়াত কর কী করে?
আমার কাছে কিছু টাকা-পয়সা ছিল। তাতেই চালাচ্ছি।
ঐ টাকা শেষ হয়ে গেলে কিসে চলবে?
আল্লাহ যখন এতদূর এগিয়ে দিয়েছেন তখন বাকিটা তিনিই ব্যবস্থা করে দেবেন।
আল্লাহর উপর দেখছি তোমার খুব ভক্তি ও বিশ্বাস?
প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর তাই থাকাই তো উচিত। আপনার নেই?
সে কথার উত্তর না দিয়ে রুবী বলল, আল্লাহ কী ন্যায় বিচারক?
অফকোর্স।
তা হলে ধনী-গরিব সৃষ্টি করলেন কেন? মানুষের মধ্যে সাদা-কালো, বেঁটে
লম্বা, ভালো-মন্দ, হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি করলেন কেণ?
আপনি খুব কঠিন প্রশ্ন করেছেন। আমি পাড়াগাঁয়ের অল্পশিক্ষিত ছেলে। আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বলতে পারি, কালো না থাকলে সাদার, বেঁটে না থাকলে লম্বার, মন্দ না থাকলে ভালোর, হিংসা না থাকলে ন্যায়পরায়ণতার এতটুকু মূল্যায়ন কেউ করত না। আর কেন এইসব করেছেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র মালিক আল্লাহ তা জানেন। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যদি হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বছর এ বিষয়ে গবেষণা করে, তবু এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে না।
তুমি তো দেখছি, ধর্মের ব্যাপারে বেশ জান?
ধর্মের ব্যাপারে প্রত্যেক নর-নারীর জানা উচিত।
কিন্তু তুমি তো গরিব ঘরের ছেলে, আর্থিক কারণে বেশি লেখাপড়া করতে পারনি। ধর্মের ব্যাপারে পড়াশোনা করলে কী করে?
পড়াশোনা করার সৌভাগ্য আমার হয় নি। তবে ঐ যে ইংরেজীতে একটা কথা আছে না “হয়ার দেয়ার ইজ এ উইল, দেয়ার ইজ এ ওয়ে (ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়)।” আজকাল বাংলায় অনেক ধর্মীয় বই অনুবাদ হয়েছে। কেনার সামর্থ ন থাকায় যাদের আছে তাদের কাছ থেকে চেয়ে-ছুঁয়ে পড়েছি। আর যারা ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী তাদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি।
ওসব কথা থাক, তুমি যদি আমার কথা রাখ, তা হলে তোমার খরচের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারি।
বলুন কি কথা, অন্যায় কিছু না হলে নিশ্চয রাখব।
প্রতিদিন বিকেলে আমাকে এবং আমার বন্ধুদের ক্রিকেট প্র্যাকটিস করাবে।
তা সম্ভব নয়।
কেন? এটা তো অন্যায় কিছু নয়?
আমি মেয়ে হলে অথবা আপনি ও আপনার বন্ধুরা ছেলে হলে অন্যায় কিছু হত না।
মেয়েদেরকে খেলা শেখালে অন্যায় হবে কেন? বুঝতে পারছি না।
আপনাদের কাছে অন্যায় না হলেও আমার কাছে অন্যায়। কারণ আমি ধর্মের যতটুকু জানি, তা মেনে চলার চেষ্টা করি। সেয়ানা ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে মেলামেশা ও খেলাধূলা ধর্মে নিষেধ। তা ছাড়া আপনারা যে ড্রেসে খেলাধূলা করেন, সে অবস্থায় আপনাদের দিকে তাকানও ধর্মে নিষেধ।
রুবী রেগে উঠে বলল, তুমি একটা পাড়াগাঁয়ের জংলী ভূত। বেশি লেখাপড়া যদি করতে, তা হলে বুঝতে তুমি কত বড় মূখের মতো কথা বলছ।
আপনার কথা হয়তো ঠিক। তবে শুধু পাড়াগাঁয়ের নয়, শহরের বড় বড় জ্ঞানী গুণীজনেরাও কিন্তু ছেলেমেয়েদের ফ্রি মিক্সিং সমর্থন করেন না এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের তা থেকে বিরত রাখেন।
সেইসব জ্ঞানী-গুণীজন মৌলবাদী। তাদের জন্যই এদেশের মানুষ সভ্যতা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
কথাটা কিন্তু আপনি ঠিক বলেন নি। শুধু আমাদের দেশেরই নয়, পৃথিবীর বহু উন্নত ও সভ্য দেশের জ্ঞানী-গুণীজনেরাও ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলতে বলেছেন এবং নর-নারীর ফ্রি মিক্সিং এর বিরোধিতা করেছেন। আমার মনে হয়, আপনি পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো কিছু পড়াশোনা করেন না এবং কোনো জ্ঞানী-গুণীদের লেখা বই পত্রও পড়েন না।
রুবীর কেন জানি মনে হল, আরমান অল্পশিক্ষিত নয়। বলল, তুমি সামান্য এস.এস.সি পাশ; কিন্তু কথায় কথায় ইংরেজী বল, তা ছাড়া তোমার কথাবার্তাও উচ্চশিক্ষিতের মতো।
আরমান হেসে উঠে বলল, ইংলিশ ভাষার উপর আমার বেশ দখল। এস.এস.সিতে ইংলিশে লেটার মার্ক পেয়েছিলাম। আর বললাম না, জ্ঞানী লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করি? তা ছাড়া যেখানে যত পত্র-পত্রিকা ও বইপুস্তক পাই পড়ে ফেলি। তারপর বলল, এবার যাই ড্রাইভিং স্কুলে যেতে হবে।
ওরা দুপুরের খাওয়ার পর থেকে কথা বলছে। এখন আড়াইটা। আরমানের কথা শুনে রুবী বলল, আর পাঁচ মিনিট বস, কথা আছে।
আরমান যাই বলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বসে বলল, কি কথা বলুন।
আমার ভাইয়া শাওন মোহামেডান জুনিয়র দলে খেলে, তা কি তুমি জান?
না।
আচ্ছা, শুধু আমাকে প্র্যাকটিস করাতে পারবে না?
আরমান কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, মেয়েদের এসব খেলা ঠিক নয়।
ঠিক বেঠিক শুনতে চাই না; প্র্যাকটিস করাবে কিনা বল?
তা হলে তো সবাই জেনে যাবে, আমি একজন ক্রিকেটার।
দু’দিন পরে তো সবাই জানবেই। এখন জানলে ক্ষতি কী?
আপনার কথা অবশ্য ঠিক; তবে কি জানেন? এত তাড়াতাড়ি আমি জানাতে চাই না।
আমি কিন্তু ছাড়ছি না, আমাকে প্র্যাকটিস করাতেই হবে। নিজেই তো বললে, আমি খুব জেদী।
এসব খেলা তো দু’একজনে প্র্যাকটিস করা যায় না। প্লীজ, জীদ করবেন না।
রুবী রেগে গিয়ে বলল, আমি যা বলি তা করেই থাকি। আর যা চাই তা পেয়েই থাকি। তোমাকে প্র্যাকটিস করাতে বাধ্য করাব। তারপর সেখান থেকে চলে গেল।
৩
আনিসুর রহমানরা শুধু দু’ভাই। কোনো বোন নেই। উনি বড়। ছোট ভাই আমজাদ হোসেন। তাদের বাবা সামসুর রহমান নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কৃষক ছিলেন। তিনি যখন মারা যান তখন আমজাদ হোসেনের বয়স নয় বছর। আর্থিক কারণে আনিসুর রহমান সেভেন পর্যন্ত পড়ে আর পড়েন নি। নিজেদের ও অন্যের ক্ষেত-খামারে কাজ করে বাবাকে সাহায্য করেছেন। ছোট ভাই আমজাদ হোসেন লেখাপড়ায় খুব ভালো জেনে তাকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। সামসুর রহমান মারা যাওয়ার সময় বড় ছেলে আনিসুর রহমানকে বলেছিলেন, আমজাদকে তোর হাতে দিয়ে গেলাম। একে মানুষের মতো মানুষ করিস। আনিসুর রহমান বাবার কথা পালন করেছিলেন। কষ্ট করে ছোট ভাইকে এম.এ. পর্যন্ত পড়িয়েছেন। সুফিয়া খাতুনও দেওরকে নিজের আপন ভাইয়ের মতো মানুষ করেছেন। বিয়েতে যা দু-একখান সোনা রূপার গহনা পেয়েছিলেন, সেগুলো বিক্রি করে দেওরকে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়েছিলেন। তারপর নিজেরা একবেলা একসন্ধ্যে খেয়ে না খেয়ে ঢাকায় দেওরের খরচ যুগিয়েছিলেন। আনিসুর রহমানও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ও জমি বিক্রি করে ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ যুগিয়েছেন, আর ভেবেছেন, আমজাদ হোসেন পাশ করে অনেক টাকা বেতনের চাকরি করবে, তখন আর তাদের সংসারে অভাব থাকবে না, জমি জায়গা কিনবেন, নতুন বাড়ি ঘর-ঘোর করবেন। কিন্তু সে আশা তাদের পূরণ হয় নি। এম.এ পড়ার সময় আমজাদ হোসেন একজন ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেন।
তখন থেকে ঘরজামাই তিনি হয়ে আছেন। শ্বশুরের ব্যবসা দেখাশুনা করছেন। বড় ভাই ও ভাবি যে তাকে এত কষ্ট করে লেখাপড়া করাল, সে কথা একেবারে ভুলে গেছেন। অনেকদিন খোঁজখবর না পেয়ে আনিসুর রহমান ঢাকায় এলেন। আমজাদ হোসেন মেসে থেকে লেখাপড়া করতেন। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, আমজাদ বড় লোকের মেয়েকে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে থেকে শ্বশুরের অফিসে চাকরি করছে।
কথাটা জেনে আনিসুর রহমান মনে মনে খুব খুশী হলেন। তাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে একটা রিকশায় করে রওয়ানা হলেন। যেতে যেতে ভাবলেন, আমজাদ না জানিয়ে বিয়ে করেছে বলে হয়তো ভয়ে ও লজ্জায় তাদেরকে জানাইনি। তার ভয় ও লজ্জা ভাঙ্গিয়ে বলবেন, বৌকে নিয়ে কয়েকদিন গ্রামের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসতে।
ঠিকানা মতো পৌঁছে দেখল, বিরাট বাড়ি। গেটটাও বেশ বড়। রিকশা বিদায় করে বন্ধ গেটের কাছে এগিয়ে এলেন।
দারোয়ান গ্রীলের ছোট গেটের কাছে ভিতরে একটা টুলে বসেছিল? আনিসুর রহমান এগিয়ে এলে জিজ্ঞাসা করল, এখানে কি চাই?
আনিসুর রহমান ততক্ষণে গেটে নেমপ্লেটে ঠিকানা দেখে নিয়েছেন। দারোয়ানের কথা শুনে বললেন, মকবুল হোসেনের জামাই আমজাদ হোসেন। আমার ছোট ভাই। আমি গ্রাম থেকে এসেছি। গেটটা খুলুন, ভিতরে যাব।
দারোয়ান তার আপাদমস্তক দেখে বলল, উনি তো এখন বাসায় নেই, অফিসে গেছেন।
ঠিক আছে, গেট খুলুন, আমি ভিতরে বসে অপেক্ষা করব।
সাহেবের হুকুম ছাড়া অচেনা লোককে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া নিষেধ।
আমি তো পরিচয় দিলাম, তবু ভিতরে যেতে দেবেন না?
এই পরিচয় দিয়ে দুস্কৃতিকারীরা ভিতরে ঢুকে ডাকাতি করে। শহরের ব্যাপার স্যাপার আপনি বুঝবেন না।
আমজাদ হোসেন কখন ফিরবেন বলতে পারেন?
পাঁচটার সময়।
ঠিক আছে, সেই সময় আসব বলে আনিসুর রহমান সেখান থেকে এসে একটা কমদামি হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করলেন; তারপর এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে পৌঁণে পাঁচটায় ফিরে এলেন।
তাকে দেখে দারোয়ান বলল, ছোট সাহেব আজ সাড়ে চারটেয় ফিরেছেন। তখন এলে দেখা হয়ে যেত।
আনিসুর রহমান বললেন, তা হলে গেট খুলুন, ভিতরে যাই।
হুকুম ছাড়া গেট খোলা যাবে না। তারপর গ্রীলের ফাঁক দিয়ে এক টুকরো কাগজ ও একটা বলবেন বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাম ঠিকানা লিখে দেন।
আনিসুর রহমান নাম ঠিকানা লিখে কাগজ কলম ফেরৎ দিতে যাবে এমন সময় গাড়ির হর্ণ শুনে দারোয়ান বলল, ওটা আর লাগবে না। ছোট সাহেব আসছেন। তারপর বড় গেট খুলে দিল।
আনিসুর রহমান গাড়ির পিছনের সিটে আমজাদকে দেখে এগিয়ে এসে নাম ধরে ডাকলেন।
আজমাদ সাহেব বড় ভাইকে দেখে চমকে উঠে সামলে নিয়ে ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি গেটের বাইরে দাঁড় করাও।
ড্রাইভার গাড়ি থামাবার পর আমজাদ সাহেব গাড়ি থেকে নেমে বড় ভাইয়ের কাছে এসে বললেন, তুমি এখানে এলে কিভাবে?
কিভাবে এসেছেন আনিসুর রহমান বললেন, আমি তোর সব কথা মেসের লোকের কাছে শুনেছি। দোয়া করি, আল্লাহ তোকে আরো বড় করুক। তুই বাড়িতে যাস নি কেন? তোর ভাবি তোর জন্য কাঁদে। কথা শেষ করে চোখ মুছলেন। তারপর বললেন, তোর দু’টো ভাইঝি হয়েছে। নাম রেখেছি নাজনীন ও নাসরিন। অনেক দিন…..।
তাকে থামিয়ে দিয়ে আমজাদ সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ভাইয়া, অত কিছু শোনার আমার সময় নেই। একটা মিটিং-এ যাচ্ছি। এখানকার সবাই জানে দুনিয়াতে আমার কেউ কোথাও নেই। যদি জানতে পারে তুমি আমার বড় ভাই, তা হলে আমি খুব অপমানিত হব। আমার স্ত্রীর সঙ্গেও ভীষণ মনোমালিণ্য হবে, সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলবে। তুমি নিশ্চয় চাইবে না, তোমার কারণে আমি অসুখী হই? আমাদের সংসারে আগুন জ্বলুক? তারপর পকেট থেকে পাঁচশ টাকার কয়েকটা নোট বের করে বললেন, এখানে পাঁচ-ছয় হাজারের মতো আছে। আর কখনো এখানে এস না। আসি সময় সুযোগ মতো তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব, নাও ধর।
আনিসুর রহমান ছোট ভাইয়ের কথা শুনে যতটা না অবাক হলেন, তার থেকে লক্ষগুণ বেশি আঘাত পেলেন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমি তোর বড় ভাই, আমার কথা না হয় বাদ দিলাম; কিন্তু তোর যে ভাবি তোকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য বিয়ের গহনা বিক্রি করে লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছে, যে নাকি তোকে আপন ভাইয়ের মতো মনে করে কতদিন নিজে উপোষ থেকে তোকে খাইয়েছে, তার কথাও ভুলে গেলি?
আমজাদ সাহেব রাগের সঙ্গে বললেন, এটা ধর, আমার আর সময় নেই বলে টাকাটা তার হাতে দিতে গেল।
আনিসুর রহমান কয়েক পা পিছিয়ে এসে বললেন, এক্ষুনি তুই বললি, দুনিয়াতে তোর কেউ নেই, তবে আমাকে টাকা দিচ্ছিস কেন? আমি কি ভিক্ষুক নাকি যে, খয়রাত দিচ্ছিস? কথা শেষ করে চোখের পানি মুছতে মুছতে হাঁটতে শুরু করলেন।
আমজাদ সাহেবের মিটিং-এ জয়েন করার সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তাই টাকাটা পকেটে রেখে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে যেতে বললেন।
ঐদিন রাতের বাসে আনিসুর রহমান বাড়ি ফিরে এলেন।
স্বামীর মুখের অবস্থা দেখে সুফিয়া খাতুন আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমজাদের খোঁজ পাওনি?
আনিসুর রহমান আসার সময় চিন্তা করেছেন সত্য ঘটনা বললে সুফিয়া মনে খুব কষ্ট পাবে, তাই কি বলবেন ভেবে রেখেছিলেন। বললেন, খোঁজ পেয়েছি, সে ভালো আছে।
তুমি তার সঙ্গে দেখা কর নি?
করেছি।
তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে না কেন?
সে এখন চাকরি করে। ছুটি ছাড়া আসবে কি করে?
তুমি চলে এলে কেন? দু’চারদিন থেকে ছুটি নেওয়ার পর সঙ্গে করে নিয়ে আসতে।
আমি সেখানে থাকলে তোমাদের মুখের আহার জোগাবে কে? আমজাদ ছুটি নিয়ে কিছুদিন পরে আসবে বলেছে।
স্বামীর কথায় সুফিয়া খাতুনের মনে সন্দেহ হল। বললেন, তা না হয় আসবে, কিন্তু তোমার মন এত খারাপ কেন?
মন খারাপ তোমাকে কে বলেছে? যাও কিছু খাবার থাকলে নিয়ে এস।
সুফিয়া খাতুনের সন্দেহটা আরো বেড়ে গেলেও কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন।
রাতে বিছানায় স্বামীকে এপাশ ওপাশ করতে দেখে এবং মাঝে মাঝে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে শুনে সুফিয়া খাতুনের ঘুম আসছিল না। একসময় থাকতে না পেরে বললেন, রাত গম্ভীর হয়েছে। তবু তুমি ঘুমাতে পারছ না কেন? এতদিন না হয় আমজাদের চিন্তায় ঘুমাতে পারতে না, এখন তো তার খোঁজ পেয়েছ, কিছুদিন পর আসবে বলেছে, তবু এই রকম করছ কেন? আমার মন বলছে, তুমি কিছু গোপন করছ।
আনিসুর রহমান একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, গোপন কিছুই করি নি, তবে একটা কথা তোমাকে মিথ্যে বলেছি। সে জন্য খুব খারাপ লাগছে।
সত্য কথাটা বলে ফেললে তো আর খারাপ লাগবে না।
আজ বলব না, কয়েকদিন পর বলব।
এখন বলতে অসুবিধা কি? আমি তো বুঝতে পারছি না। কথাটা চেপে রেখে তুমিও যেমন অস্বস্তিতে ভুগছ, আমিও ভুগছি। ভালোমন্দ যাই হোক না কেন তুমি বল।
বললে তুমি মনে খুব কষ্ট পাবে, সহ্য করতে পারবে না।
সুফিয়া খাতুন ধড়ফড় করে উঠে বসে আতঙ্কিত স্বরে বললেন, আল্লাহর কসম লাগে, আমজাদের কিছু হয়েছে কিনা সত্যি করে বল।
তোমার অনুমান ঠিক, তবে কোনো বিপদ হয় নি।
সুফিয়া খাতুন কাতরস্বরে বললেন, তার কি হয়েছে বলছ না কেন?
আমজাদ বড়লোকের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে আছে, শ্বশুরের অফিসে চাকরি করছে।
সুফিয়া খাতুন খুব অবাক হলেও খুশী হলেন। বললেন, তুমি তার সঙ্গে দেখা করেছিলে?
করেছি, মনে হয় সে আর কখনও আসবে না।
দূর, তোমার যেমন কথা, নিশ্চয় আসবে। আমাদেরকে ছেড়ে বেশি দিন। থাকতে পারবে না। তুমিই তো বললে কিছুদিনের মধ্যে আসবে।
ঐ কথাটা মিথ্যা বলেছি। আমজাদ আসবার কথা বলে নি। তারপর কিভাবে তার সঙ্গে দেখা করল ও দেখা হওয়ার পর কি ঘটল সবকিছু বলে বললেন, এই সব। কথা কাউকে বলবে না। বললে আমরা কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না।
যা বললে তা যদি সত্যিও হয়, তবু বলছি কোনো কারণে হয়তো আমজাদ ঐ কথা বলেছে। তাকে আমরা স্নেহ-মমতা দিয়ে মানুষ করেছি, জমি-জায়গা, গহনা বিক্রি করে শিক্ষিত করেছি। আমাদেরকে দেখবে না, এটা হতেই পারে না। তুমি দেখে নিও, তার শরীরে যদি এতটুকু মানুষের চামড়া থাকে, তা হলে সে ফিরে আসবেই। তখন আর আমাদের কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না।
আনিসুর রহমান আবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহ যেন তোমার আশা পূরণ করেন। কথাটা মুখে বললেও মন সায় দিল না। তার দৃঢ়বিশ্বাস আমজাদ আর কখনও আসবে না এবং টাকা-পয়সা দিয়েও সাহায্য করবে না। মনে মনে আল্লাহকে জানালেন, হে রহমানুর রহিম, এখন কি করব বলে দাও। আমি যে আর অভাবের সংসার টানতে পারছি না। তুমি আমজাদকে সুমতি দাও। একসময় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
অনেকক্ষণ স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে সুফিয়া খাতুন বললেন, কী হল? ঘুমিয়ে পড়লে না কি?
কথা বললে কান্না চেপে রাখতে পারবেন না ভেবে আনিসুর রহমান কিছু না বলে চুপ করে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করলেন।
স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করে সুফিয়া খাতুন বালিশে মাথা রাখলেন।
আমজাদের কাছ থেকে আসার পর চিন্তায় চিন্তায় আনিসুর রহমানের শরীর ক্রমশঃ ভেঙে পড়তে লাগল। পাড়া-পড়শী ও হাট-বাজারের দোকানে অনেক ধার-দেনা করে সংসার চালিয়েছেন। আমজাদের চাকরি হলেই তাদের সব শোধ করে দেবে, বলেছেন। অনেকদিন তার খোঁজ খবর নেই জেনে তারা আর বাকিতে সদায়পাতি দিতে চায় না। দুশ্চিন্তায় শরীর ভেঙে যাওয়ার ফলে খাটা-খাটনিও করতে পারছেন না। দিনের পর দিন না খেয়ে আনিসুর রহমান বিছানায় পড়ে গেলেন। তারপর মাসখানেকের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় ও অনাহারে একদিন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরকালের পথে পাড়ি জমালেন।
আনিসুর রহমানের এক ছেলে দুই মেয়ে, আরমান, নাজনীন ও নাসরীন।
তিনি যখন মারা যান তখন আরমান ক্লাস টুয়ের ছাত্র, নাজনীনের বয়স চার আর নাসরিনের বয়স তিন। দুইবোন এক বছরের ছোট বড় হলেও দেখতে প্রায় একই রকম। অপরিচিত কেউ তাদেরকে একসঙ্গে দেখলে যমজ বোন মনে করে।
স্বামী মারা যাওয়ার পর সুফিয়া খাতুন অকুল সাগরে পড়লেন। ছোট ভাইকে শিক্ষিত করতে আনিসুর রহমান ভিটে বাড়ি ছাড়া পৈত্রিক যতটুকু ছিল, সব বিক্রি করে দিয়েছিলেন। মারা যাওয়ার আগে যখন বিছানায় পড়েছিলেন তখন ভিটে বাড়িটাও চাচাতো ভাই আকমল হোসেনের কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আকমল হোসেন না কিনে বেশ কিছু টাকা কর্জে হাসানা দিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করার পর সামর্থ দিলে টাকাটা শোধ করে দিও। আর যদি শোধ করতে না পার, তা হলে আমার কোনো দাবি থাকবে না। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। এই সামান্য টাকার বদলা আল্লাহ আমাকে হাসরের মাঠে দেবেন। ভিটেবাড়ি বিক্রি করলে তোমরা থাকবে কোথায়?
আকমল হোসেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। খুব অবস্থাপন্ন ও দ্বীনদার। স্বস্ত্রীক হজ্ব করেছেন। কিন্তু নামের আগে হাজী খেতাব লাগান নি। সময় অসময় আনিসুর রহমানকে অনেক সাহায্য করেছেন। উনিই আনিসুর রহমানের সব জমি-জায়গা ন্যায্য দামে কিনেছেন। তার দাফন-কাফন তিনিই করেছেন। আকমল হোসেনের বাবাও আজীবন চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিও খুব দ্বীনদার ছিলেন। বাবার যোগ্যপুত্র আকমল হোসেন। তাই প্রত্যেকবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাই আজ দশ বছর ধরে চেয়ারম্যান হয়ে আসছেন। ইউনিয়নের সব মানুষ তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে। তিনিও মানুষের বিপদ-আপদে যথাসাধ্য সাহায্য করেন।
আনিসুর রহমান মারা যাওয়ার পর চার পাঁচ মাস ধরে তিনি তাদের সংসারের খরচপত্র চালাচ্ছেন। একদিন স্ত্রীকে বললেন, আনিসুরের বৌ কী তিনটে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে জীবন কাটাতে পারবে? তা ছাড়া তার বয়সও কাঁচা। গ্রামে নানারকমের লোকের বাস। আমি তাদের সংসার চালাচ্ছি বলে এর মধ্যে লোকজনের আজে-বাজে কথা আমার কানে পড়ছে। তাই বলছিলাম, তুমি সঙ্গে আলাপ কর। যদি রাজি থাকে, তা হলে আমি ওর নিকের ব্যবস্থা করব।
জেবুন্নেসা বিবি বললেন, কথাটা বলে ভালই করেছ। আমি তোমাকে বলব ভাবছিলাম। গতকাল ওপাড়ার করিম মেম্বারের বৌ এসেছিল। কথায় কথায় বলল, “শুনলাম চেয়ারম্যান সাহেব নাকি আনিসুরের বৌকে নিকে করবে?”
আমি বললাম, চেয়ারম্যান সাহেব কেমন লোক আপনারা জানেন না? উনি। অসহায় গরিবদের সব সময় সাহায্য করেন। আনিসুরের বৌ তিনটে দুধের বাচ্চাকে নিয়ে না খেয়ে মরতে বসেছিল। তাই উনি তাদের সংসার চালাচ্ছেন। আনিসুর বেঁচে থাকতেও অনেক সাহায্য করেছেন। একথা তো তোমরাও জান। নিশ্চয় কোনো খারাপ লোক এমন নোংরা কথা ছড়াচ্ছে।
মেম্বারের বৌ বলল, চেয়ারম্যান সাহেব কেমন লোক তা আমরা আর জানি? উনার মতো মানুষই হয় না। আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। দুষ্ট লোকেরাই কথাটা ছড়াচ্ছে।
আকমল হোসেন বললেন, আল্লাহর দুনিয়ায় যে কত রকম মানুষ আছে, তা তিনিই জানেন। যাক গে, যে যাই বলুক না কেন? সত্য-মিথ্যা আল্লাহকে মালুম। আমিও চাই আনিসুরের বৌ এর নিকে দিতে। তা না হলে দুষ্টু লোকেরা আরো কুৎসা রটাবে। যদি রাজি না হয়, তুমি বুঝিয়ে রাজি করাবে। নিকে দিলে নিজেও বাঁচবে, আর ছেলেমেয়ে তিনটে মানুষও হবে।
জেবুন্নেসা বিবি বললেন, তুমি চিন্তা করো না, আমি ওকে রাজি করাব।
সুফিয়া খাতুন গরিব ঘরের অল্প শিক্ষিত মেয়ে হলেও ছোটবেলায় মক্তবে পড়েছেন। সে সময় ওস্তাদজী ধর্মের যেসব শিক্ষা দিয়েছেন, সেসব ঐ সময় থেকে মেনে চলেন। কোনো প্রয়োজনে ঘরের বাইরে গেলে চাদর দিয়ে ভালো করে শরীর ঢেকে ঘোমটা দিয়ে যান। ছেলেমেয়েদেরকেও ওস্তাদজীর শিক্ষামতো মানুষ করেছেন। আরমানকে ক্লাস ওয়ান থেকে নামায ধরিয়েছেন। টুয়ে উঠার আগে কুরআন খতম করিয়েছেন। আরমান খুব মেধাবী, তাই ক্লাস টুয়ে উঠার পর তাকে কুরআনে হাফেজ করার জন্য পাশের গ্রামের হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করার কথা স্বামীকে বলেছিলেন।
আনিসুর রহমান বলেছিলেন, আমিও ওকে হাফেজী পড়াতে চাই। কিন্তু ওতো এখন খুব ছোট, এই বছর স্কুলেই পড়ক, সামনের বছর মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেব।
আরমান এ বছরও ফার্স্ট হয়ে থ্রিতে উঠল। যেদিন রেজাল্ট বের হল, সেদিন এসে মাকে রেজাল্টের কথা বলে বলল, এবার আমাকে নতুন জামা-প্যান্ট কিনে দিতে হবে। নতুন ক্লাসে সব ছেলেমেয়ে নতুন জামা-প্যান্ট পরে আসবে। আমি ছেঁড়া পড়ে যেতে পারব না।
ছেলের কথা শুনে সুফিয়া খাতুনের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে বললেন, তোকে এ বছর হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করাব। তোর আব্বারও ইচ্ছা তাই ছিল। মাদ্রাসায় জামা-প্যান্ট কেউ পরে না। পাজামা, লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী পরে, তোকেও তাই কিনে দেব।
আরমান যেমন মেধাবী তেমনি খুব বুদ্ধিমান। বলল, আমি মাদ্রাসায় ভর্তি হলে তোমার ফাইফরমাস কে শুনবে? এটা সেটা কে কিনে আনবে? তুমি নাজনীন নাসরিনকে নিয়ে একা ঘরে থাকতে পারবে? তোমার ভয় করবে না?
এতটুকু ছেলের কথা শুনে সুফিয়া খাতুন খুব অবাক হলেন। বুকে জড়িয়ে বললেন, না বাবা ভয় করবে না। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে, তিনিই আমাদের দেখবেন। যতই অসুবিধে হোক তোকে আমি হাফেজ করবই। ইনশাআল্লাহ।
আনিসুর রহমান মারা যাওয়ার পর আকমল হোসেন তাদেরকে সাপ্তাহিক কিছু চাল-ডালের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাতে চারজনের কোনো রকমে খাওয়া চললেও সংসারের অন্যান্য খরচপত্রের জন্য খুব অসুবিধে হতে লাগল ।
দশ বছরের আরমান তা বুঝতে পেরে একদিন মাকে বলল, আমি হাফেজী পড়তে যাব না, বাজারে গিয়ে কাজ করব।
সুফিয়া খাতুন ছেলের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না, চোখ মুছে বললেন, তোর চেয়ারম্যান চাচার সঙ্গে আলাপ করে দেখি, উনি কি বলেন। আল্লাহ রাজি থাকলে একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।
কিন্তু তুমি বাজার-হাটের পয়সা কোথায় পাবে? একথার উত্তর দিতে সুফিয়া খাতুন পারলেন না। মসলাপাতির অভাবে বেশিরভাগ দিন শুধু নুন দিয়ে ডাল সিদ্ধ করে তা দিয়ে ভাত খান। কোনো কোনো দিন পুকুর পাড় থেকে শাক-পাতা তুলে এনে পাড়া-পড়শীর বৌ-দের কাছ থেকে একটু আধটু মসলা-পাতি চেয়ে এনে রান্না করেন। আবার কখনও কখনও মুরগী হাঁস ডিম দিলে তা বিক্রি করে মসলাপাতি কেনেন।
মাকে চুপ করে থাকতে দেখে আরমান বলল, কিছু বলছ না কেন মা?
সুফিয়া খাতুন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তুই এখন দুধের বাচ্চা, বাজারে কি কাজ করবি?
সে আমি বুঝব বলে ছুটে বেরিয়ে গেল। সুফিয়া খাতুন তাকে ডেকে ফেরাতে পারলেন না। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, আল্লাহ্ গো, তুমি ওকে হেফাজত করো।
সেইদিন থেকে আরমান সারাদিন প্রায় বাজারে থাকে। শুধু দুপুরে খেতে আসে। সেখানে একটা চায়ের দোকানে টুকটাক কাজ করে।
চায়ের দোকানের মালিক আনিসুর রহমানকে চিনতেন। তাই আরমান যখন তার কাছে কাজ করতে চাইল তখন না করতে পারলেন না। ছোট ছেলে বলে তাকে সন্ধ্যের পরপর ছুটি দিয়ে দেন। আর সে সময় প্রতিদিন পাঁচটি করে টাকা ধরিয়ে দেন।
৪
চেয়ারম্যান আকমল হোসেনের ছোট শালী সায়লা বানুর বিয়ে হয়েছে ঢাকার এক ধনী পরিবারের ছেলে আজরাফের সঙ্গে। আজরাফ সুইডেনে চাকরি করতেন। বিয়ে করে সায়রা বানুকে নিয়ে সুইডেনে চলে গিয়েছিলেন।
বিয়ের কয়েক বছর পর যখন সায়রা বানুর পেটে বাচ্চা এল না তখন সায়রা বানু ও আজরাফ সাহেব ডাক্তারী পরীক্ষা করালেন। তাতে দু’জনেরই কোনো দোষত্রুটি পাওয়া গেল না। ডাক্তাররা বললেন, শরীরের কোনো দোষত্রুটি না থাকলেও অনেকের দেরিতে সন্তান আসে। ডাক্তারের কথা মতো অপেক্ষা করতে করতে পনের বছর হয়ে গেল, তবুও সন্তানের মুখ দেখলেন না।
আজরাফ সাহেব সুইডেনে সারাজীবন থেকে যাবেন ভেবে সেখানে অনেক কিছু করেছিলেন, কিন্তু কোনো ছেলেমেয়ে না হওয়ায় সেসব বিক্রি করে স্ত্রীকে নিয়ে বছরখানেক হল দেশে ফিরেছেন। ফিরে এসে ব্যবসা করছেন। স্ত্রীর অনুরোধে একদিন পলাশপুরে তার বড় বোন জেবুন্নেসার বাড়িতে বেড়াতে এলেন।
পরেরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে বারান্দায় সায়রাবানু বড়বোনের সঙ্গে গল্প করছিলেন। এমন সময় সুফিয়া খাতুন নাসরীনকে কোলে ও নাজনীনের হাত ধরে সেখানে এসে সায়রাবানুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
জেবুন্নেসা বিবি তাকে বললেন, আমার ছোট বোন। দু’দিন হল বেড়াতে এসেছে। তারপর একজন কাজের মেয়েকে ডেকে বললেন, ভঁড়ার ঘরে ধামায় চাল-ডাল আছে, এনে আনিসুরের বৌকে দে।
কাজের মেয়ে চাল-ডাল দিয়ে চলে গেলে সুফিয়া খাতুন বললেন, বুজি, তোমরা আর কতদিন আমাদেরকে এইভাবে টানবে? আমি বলছিলাম কি, তোমাদের সংসারে কাজ-কর্ম আমিও করব।
সে কি গো আনিসের বৌ, তোমার ভাসুর কি মনে করবে?
মিয়াভাই ফেরেস্তার মতো মানুষ। উনি কিছু মনে করবেন না। তুমি না করো না বুজি। আরমানকে এ বছর তোমার ভাই হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করবে বলেছিল। আল্লাহ্ তাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছে। আরমান বাজারে চায়ের দোকানে কাজ করছে। তুমি যদি আমাকে তোমাদের সংসারে রাখ, তা হলে মিয়াভাইকে বলব, আরমানকে মাদ্রাসার এতিমখানায় ভর্তি করে দিতে।
আনিসুর রহমান ছোট ভাইকে শিক্ষিত করার জন্য যা কিছু করেছে গ্রামের সমস্ত মানুষজন তা জানে। সেই ছোট ভাই যে বড় ভাইয়ের সঙ্গে বেঈমানী করেছে, এতদিন তাও জেনে গেছে। সুফিয়া খাতুনের কথা শুনে জেবুন্নেসা বিবি ক্ষেদের সঙ্গে বললেন, আমজাদ যে এরকম বেঈমান হবে তা ভাবতেই পারি নি । তোর মিয়াভাই বলছিল সে নাকি বড় লোকের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে আছে। আনিসুর দেখা করতে গেলে……।
সুফিয়া খাতুন তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলেন, থাক বুজি, ঐসব কথা বলো না। আমাকে তোমাদের সংসারে রাখবে কিনা বল?
ঠিক আছে, এখন যা, ছেলেমেয়েদের খাইয়ে তারপরে আসিস তখন বলব ।
সুফিয়া খাতুন চলে যাওয়ার পর সায়রাবানু বললেন, মেয়েটা কে বুবু? খুব দুঃখী মনে হল। সব সময় চোখ দুটো ছলছল করছিল।
জেবুন্নেসা বিবি বললেন, হ্যাঁরে, মেয়েটা খুব দুঃখী। আল্লাহ্র কি কুদরত, মেয়েটা খুব ধার্মিক ও গুণবতী। দেখতেও খুব সুন্দরী ছিল। দুঃখ কষ্টে মলিন হয়ে গেছে।
তাই তো বলি অমন মেয়ের অত সুন্দর ফুটফুটে দু’টো মেয়ে হয় কি করে? মেয়ে দুটো যমজ তাই না বুবু?
রে, যমজ নয়। এক বছরের ছোট বড়। ওদের একসঙ্গে দেখলে অবশ্য যমজ মনে হয়।
ওদের বাবা নেই?
না, ছ’মাস হল মারা গেছে। আনিসুর, মানে ওদের বাবা, ছোট ভাইকে ঢাকায় উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য জমি-জায়গা বিক্রি করে খরচ যুগিয়েছে। আনিসুরের বৌ, মানে ঐ মেয়েটা বিয়ের গহনা বিক্রি করে দেওরের পড়ার খরচ দিয়েছে। তারপর আমজাদের বেঈমানীর কথা বলে বললেন, আনিসুর ঢাকা থেকে ফিরে আসার কয়েকদিন পর সেই যে বিছানায় পড়ল আর উঠল না। তাই বলছিলাম, আল্লাহর কুদরত মানুষের বোঝা অসাধ্য। ভালো লোকদেরকে তিনি দুঃখ কষ্ট বেশি দেন।
সায়রা বানু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ম্লান মুখে বললেন, হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক। আমাদের দু’জনের শারিরীক কোনো দোষ-ত্রুটি নেই, তবুও একটা সন্তানের মুখ দেখালেন না। সন্তানের জন্য কত নামায রোজা মানত করেছি, মসজিদ-মাদ্রাসায় কত দান করেছি, গরিবদের কত সাহায্য করেছি। কিন্তু কিছুই হয় নি। অথচ গরিবদের ঘরে বছরে বছরে কত সন্তান দিছেন। তারপর চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, আল্লাহর কি বিচার বুঝি না বুবু।
জেবুন্নেসা বিবি তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ছিঃ সায়রা, ওকথা বলতে নেই, গুনাহ হবে। আল্লাহ্ বেআয়েব ও ন্যায় বিচারক। সারা মাখলুকর সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তার ইশারায় সারা মাখলুক চলছে। তার ইচ্ছা ব্যতিরেকে গাছের একটা পাতাও নড়ে না। কেউ সামান্য পরিশ্রমে ধনী থেকে আরো ধনী হচ্ছে, আবার কেউ কঠোর পরিশ্রম করে দু’বেলা পেটের অন্ন জোগাড় করতে পারছে না। কেউ শত শত কঠিন গুনাহ করেও সুখে আছে, আবার কেউ এতটুকু গুনাহ না করেও দুঃখ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। কেউ না চেয়েও গন্ডায় গন্ডায় সন্তান পাচ্ছে, আবার কেউ একটা সন্তানের জন্য জীবনভর কেঁদে কাটাচ্ছে। এইসব আল্লাহ্ কেন করেছেন, তা তিনিই জানেন। এসবের কারণ দুনিয়ায় কোনো মানুষের জানার সাধ্য নেই ।
চোখ-মুখ মুছে সায়রা বানু বললেন, এসব কথা আমিও জানি। কারো বাচ্চা দেখলে নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে মনটা তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। তখন সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায়।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর জেবুন্নেসা বিবি দু’খিলি পান সেজে একটা গালে পুরে, অন্যটা সায়রা বানুকে দিলেন।
সায়রা বানু খিলিটা গালে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আমি কখনও পান খাব ঠিক করেছিলাম, তুমি কিন্তু অভ্যাস করিয়ে দিচ্ছ।
প্রথম জীবনে পান না খাওয়াই ভালো। বয়সকালে একটু-আধটু না খেলে চলে? এমন সময় সুফিয়া খাতুনকে আসতে দেখে বললেন, তুই একটু ঘরে গিয়ে বস; আমি ওর সঙ্গে কিছু আলাপ করব।
সায়রা বানু অবাক হয়ে বললেন, কি এমন আলাপ করবে? আমাকে চলে যেতে বলছ? তোমাদের সংসারের কাজে ওকে রাখবে কি না সেই কথা তো?
ততক্ষণে সুফিয়া খাতুন অনেকটা কাছে এসে গেছেন। তাই জেবুন্নেসা বিবি। ফিসফিস করে বললেন, ঘরে যাতো, যা আলাপ করব ঘর থেকে শুনতে পাবি। তুই থাকলে সুফিয়া লজ্জা পাবে।
সায়রা বানু উঠে ঘরে গিয়ে জানালার কাছে খাটে বসে কান পেতে রইলেন।
সুফিয়া খাতুন কাছে এলে, জেবুন্নেসা বসতে বলে বললেন, নিরিবিলিতে তোর সঙ্গে কিছু আলাপ করার জন্য ডেকেছি। শোন, তোর বয়স এখনও কাঁচা, তিনটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে সারাজীবন কাটাবি কি করে? বাপ ভাই নেই যে, তাদের সংসারে থাকবি। ভালো-মন্দ মানুষ আল্লাহর দুনিয়ায় সবখানে আছে। আমাদের গ্রামেও আছে। দুষ্ট লোক যদি গভীর রাতে তোর উপর হামলা করে, তখন কি হবে একবার ভেবে দেখ। গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকবে না। তখন তিন-তিনটে বাচ্চার কি হবে তাও ভেবে দেখ। তারপর চুপ করে গেলেন।
এইসব শুনে সুফিয়া খাতুনের চোখ থেকে পানি পড়ছিল। বললেন, আমিও এসব কথা অনেক ভাবি, কিন্তু ভেবে কিছু ঠিক করতে পারি নি। কি করব বুজি, তুমিই বল?
তোর মিয়াভাইয়ের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি, আমরা তোর নিকে দিতে চাই। তা হলে তুইও বাঁচবি, আর তিনটে ছেলেমেয়েও মানুষ হবে।
সুফিয়া খাতুন আঁতকে উঠে বললেন, না বুজি না, অমন কথা বলো না। যদিও জানি তোমরা আমার ভালই চাও এবং এটা কোনো অন্যায়ও নয়, তবুও আমি কিছুতেই নিকে করতে পারব না। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে সারারাত নফল নামায পড়ি, কুরআন তেলাওয়াত করি। কোনো দুষ্টু লোক আমার ক্ষতি করতে এলে, আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন। বিয়ে করে একজনকে যে ইজ্জত দিয়েছি, নিকে করে অন্যকে সেই ইজ্জত দিতে পারব না। তার চেয়ে আমার মরণ ভালো। তা ছাড়া যার সঙ্গে আমি নিকে বসব, সে যদি আমার এই তিনটে ছেলেমেয়েকে দেখতে না পারে তখন আমি সহ্য করতে পারব না। আমি তোমাদের সংসারে বাঁদীগিরি করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করব। তুমি মিয়াভাইকে বলে তোমাদের সংসারে কাজকর্ম করার ব্যবস্থা করে দাও বুজি। তা না হলে আমি ছেলেমেয়েদেরকে বিষ খাইয়ে নিজেও খাব, এই কথা বলে চোখ মুছতে মুছতে সুফিয়া খাতুন চলে গেলেন।
সায়রা বানু ঘরের ভিতর থেকে সবকিছু শুনছিলেন। এবার বেরিয়ে এসে জেবুন্নেসা বিবির পাশে এসে বসে বললেন, তোমার কথাই ঠিক, মেয়েটা খুব ভালো।
জেবুন্নেসা বিবি বললেন, ওর স্বামীও খুব ভালো ছিল।
আচ্ছা বুবু, আমি যদি অনেক টাকা দিয়ে ওর একটা মেয়েকে কিনে নিই, তা হলে কেমন হয়। ওরাও খেয়ে পরে বাঁচবে, আর আমরাও একটা মেয়ে পেয়ে যাব।
পাগলের মতো কী বলছিস তুই? তা কি করে হয়?
কেন হবে না? ও বেলা মেয়ে দুটোকে দেখেছি। ছোটটা মনে হয় এখনও মায়ের বুকের দুধ ছাড়ে নি। বড় মেয়েটাকে আমি নেব। তুমি দুলাভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে দেখ । যদি রাজি হয়, তা হলে এমন কিছু ব্যবস্থা আমরা করে দেব, যাতে করে ওদের থাকা খাওয়ার কোনো কষ্ট না হয়। দুটো ছেলেমেয়েকেও লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে পারবে। শুধু একটা শর্ত থাকবে, যে মেয়েকে আমরা নেব, তাকে চিরকালের জন্য দিয়ে দিতে হবে। কোনো রকম যোগাযোগ আমাদের সঙ্গে রাখবে না। এমন কি মেয়েকে একবার দেখতে যেতেও পারবে না, সবকিছু কাগজে লেখাপড়ার মাধ্যমে হবে।
আজরাফ রাজি হবে?
রাজি হবে না মানে? ও প্রায়ই আমাকে বলে, যদি তেমন কোনো ভালো গরিব ঘরের ছেলে বা মেয়ে পেতাম, তা হলে কিনে নিতাম। ওরা তো দুলাভাইয়েরই বংশধর। তা ছাড়া তুমিই তো বললে, ওরা খুব ভালো।
আজ রাতে তোদের সামনে তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করব। তারপর সুফিয়াকে কথাটা বলব।
শুধু বললে হবে না, যেমন করে হোক রাজি করাবে।
রাতে সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল, যতদিন ইচ্ছা সুফিয়া খাতুন এই সংসারে কাজকর্ম করতে পারবে, তবে করতেও পারে নাও করতে পারে, সেটা তার ইচ্ছা । আর নগদ টাকা-পয়সা সুফিয়া খাতুনের হাতে দেওয়া হবে না। যা দেওয়ার আকমল হোসেনের হাতে দেবেন। তিনি প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে সুফিয়া খাতুনকে দেবেন, আর ছেলেমেয়েরা যতদূর লেখাপড়া করতে চাইবে, তার সব খরচ তিনিই দেবেন। বাড়িঘর সংস্কার করে দেবেন। সুপাত্রে নাসরীনের বিয়ে দিয়ে দেবেন। তবে ছেলের বয়স পঁচিশ বছর হওয়ার পর আর কোনো টাকা পয়সা দেওয়া হবে না। আকমল হোসেনের অবর্তমানে তার স্ত্রী জেবুন্নেসা বিবির উপর এই দায়িত্ব থাকবে।
পরেরদিন সকালে সুফিয়া খাতুনকে ডেকে জেবুন্নেসা বিবি একাকী বললেন, তোর মিয়াভাইকে তোর মতামত জানিয়েছিলাম। সে বলল, আনিসের বৌ যদি আমাদের সংসারে কাজকর্ম করে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পারবে বলে মনে করে, তা হলে করুক।
সুফিয়া খাতুন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, আমি জানতাম মিয়াভাই না করবেন না।
শোন, আর একটা ভালো সুযোগ আল্লাহ তোকে দিতে চাচ্ছে। সেই সুযোগ যদি হাত ছাড়া না করিস, তা হলে তোর ও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ খুব ভালো হবে। তোর মিয়াভাইও এই সুযোগ তোকে নিতে বলেছে।
বল বুজি, ভালো হলে নিশ্চয় নেব।
আমার ছোট বোনকে কাল তো তুই দেখেছিস, ওর স্বামীও এসেছে। ওরা খুব বড় লোক। ঢাকায় থাকে। আগে বিদেশে ছিল। বছর খানেক হল দেশে ফিরে ব্যবসা করছে। ওদের কোনো ছেলেমেয়ে হয় নি। তাই ওরা তোর বড় মেয়ে নাজনীনকে নিতে চায়।
কিন্তু নাজনীন তো খুব কান্নাকাটি করবে। আর আমিও কি মন ধরে থাকতে পারব?
তোকে পারতেই হবে। আমার সব কথা আগে শোন, নাজনীনকে ওরা নিজের মেয়ে করে নিতে চায়, তারপর কিভাবে নেবে সবকিছু বলল।
সুফিয়া খাতুন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, এ তুমি কী বলছ বুজি? নিজের সুবিধের জন্য মা হয়ে মেয়েকে বেঁচে দেব?
বুঝছিস না কেন? মেয়েকে তো পানিতে ফেলে দিচ্ছিস না, ওদের কাছে রাজকন্যার মতো লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে। খুব বড় ঘরে বিয়ে দেবে। মেয়ে জামাই ওদের সব বিষয়-সম্পত্তির মালিক হবে। মেয়ের জন্য তোর মন কাঁদলেও তোর দুঃখ দূর হবে। বাকি ছেলেমেয়ে দু’টোর ভবিষ্যৎও ভালো হবে। এক্ষুনি তোকে কিছু বলতে হবে না। ওরা কয়েকদিন থাকবে, ভেবে চিন্তে দু’একদিন পরে বলিস। আর শোন, আমার ও তোর মিয়াভাই-এর কথা হল, আল্লাহ্ যখন এমন একটা সুযোগ দিচ্ছেন তখন আর এই সুযোগ হাত ছাড়া করা তোর উচিত হবে না।
দু’তিন দিন অনেক চিন্তা ভাবনা করে সুফিয়া খাতুন রাজি হলেন। তারপর যেদিন লেখাপড়ার মাধ্যমে নাজনীনকে নিয়ে সায়র বানু ও আজরাফ সাহেব ঢাকায় চলে গেলেন, সেদিন কেঁদে কেঁদে বুক ভাসালেন।
আরমান বাজারে ছিল। দুপুরে খেতে এসে মাকে বলল, নাজনীন কই?
সুফিয়া খাতুন বললেন, তোর বড় চাচির বোন বেড়াতে এসেছিল। তাকে পালতে দিয়েছি। তারা তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবে। বড় হলে বিয়ে দেবে।
তারা কোথায় থাকে?
ঢাকায়।
অত দূরে পালতে দিলে কেন? আমরা তো নাজনীনকে দেখতে পাব না।
সুফিয়া খাতুনের চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সামলে নিয়ে বললেন, কি করব বাবা? তোর বড় চাচা চাচিও দিতে বলল। আরো বলল, তারা আমাদের সংসারের। সব খরচা দেবে। তোদের দু’ভাই বোনকে লেখাপড়া করার খরচও দেবে। তোকে আর চায়ের দোকানে কাজ করতে হবে না। দু’একদিনের মধ্যে তোর বড় চাচা তোকে হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেবে।
আরমান বলল, তা হলে ভালই করেছ। তবে নাজনীনের জন্য মনটা খুব ছটফট করবে।
সুফিয়া খাতুন এতক্ষণ সামলাতে পারলেও এখন আর পারলেন না। নাসরিন ও আরমানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোদেরকে মানুষ করার জন্য নাজনীনকে ওদের হাতে তুলে দিয়েছি বাবা।
৫
সায়রা বানু ও আজরাফ সাহেব তাদের কথা রেখেছেন। আজ পনের বছর পলাশপুরে না এলেও বড় ভাইরা ভাই আকমল হোসেন মারফত সুফিয়া খাতুনকে মাসে এক হাজার টাকা দিচ্ছেন। আরমান ও নাসরীনের লেখাপড়ার খরচ দিচ্ছেন। প্রয়োজনে ঘর-বাড়ির সংস্কার করে দিচ্ছেন।
আরমান তিন-চার বছরের মধ্যে কুরআনের হাফেজ হয়ে আলিয়া সিস্টেম মাদ্রাসায় পড়তে চেয়েছিল, কিন্তু কাছাকাছি সে রকম মাদ্রাসা না থাকায় মা-বোনকে একা ফেলে দূরে কোথাও পড়তে যাই নি। স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়। থ্রিতে খুব ভালো রেজাল্ট করে ফাইভে প্রমোশন নেয় এবং ফাইভে বৃত্তি পেয়ে পাশ করে হাইস্কুলে ভর্তি হয়। মেধাবী ও সৎ স্বভাবের জন্য প্রথম বছরেই হাইস্কুলের সব শিক্ষকদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠে। সিক্স থেকে ডবল প্রমোশন নিয়ে এইটে এবং এইট থেকে ডবল প্রমোশন নিয়ে টেনে উঠে। তারপর পাঁচ বিষয়ে লেটার মার্ক নিয়ে এস.এস.সি. পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়। তারপর যখন ফাস্ট ক্লাস নিয়ে বি.এ. পাশ করল তখন তার বয়স চব্বিশ বছর ।
আরমান নাজনীনকে পালতে দেওয়ার কথা ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছিল। বড় হওয়ার পর বিক্রি করে দেওয়ার কথা শুনেছে। তাই বি.এ. পাশ করার পর মাকে একদিন বলল, এখন আমার বয়স চব্বিশ। শর্ত মোতাবেক আর একবছর বড় চাচার ভাইরা ভাই আমাদেরকে টাকা দেবেন। তাই আমি ঢাকায় গিয়ে রুজী রোজগারের চেষ্টা করতে চাই।
নাজনীনের কথা মনে পড়লে সুফিয়া খাতুনের চোখে পানি আসে। এখনও তাই হল। চোখ মুছে বললেন, আমি আর কি বলব বাবা, তুই বড় হয়েছিস; লেখাপড়া করেছিস, যা ভালো বুঝিস কর।
যে বছর আরমান এস.এস.সি পাশ করে, সেই বছর হাইস্কুলের প্রবীণ প্রধান শিক্ষক তমিজউদ্দিন রিটায়ার্ড করেন। তিনি আরমানের বাপ-চাচাঁদের সব খবর জানেন। তাই অন্যান্য শিক্ষকদের থেকে আরমানকে বেশি স্নেহ করেন, পারিশ্রমিক না নিয়ে সাহায্য করেছেন। স্কুল ও কলেজে ভালো রেজাল্ট করার পিছনে তাঁর অবদান অনেক। সুফিয়া খাতুন ভাগ্যের নির্মম শিকার হয়ে যে নাজনীনকে বিক্রি করে নাসরীন ও আরমানকে মানুষ করেছেন তাও জানেন। তাই বি.এ.তে ফাস্ট ক্লাস নিয়ে পাশ করার পর যখন আরমান তার ইচ্ছার কথা জানাল তখন তিনি আরমানের কথামতো আমজাদ সাহেব ও আসিফ সাহেবকে দুটো চিঠি লিখে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন।
তমিজউদ্দিন স্যারের চিঠি নিয়ে আরমান মা ও ছোট বোন নাসরিনকে রেখে ঢাকা রওয়ানা দেয়।
হাইস্কুলে পড়ার সময় আরমান নাজনীনকে বিক্রি করার কথা জানতে পারে । এস.এস.সি পাশ করার পর একদিন মাকে বলল, তুমি নাজনীনকে যাদের কাছে বিক্রি করেছ, তাদের ঠিকানা জান?
সুফিয়া খাতুন বললেন, যে কাগজে লেখাপড়া হয়েছে, তাতে ঠিকানা আছে।
আমাকে কাগজটা দেবে আম্মা? ঠিকানাটা লিখে নেব। কোনো রকমে একবার নাজনীনকে দেখে আসতাম।
না।
কেন আম্মা? ওকে দেখার জন্য মন খুব ছটফট করে। তোমারও কী করে না?
সুফিয়া খাতুন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, মায়ের কাছে ছেলেমেয়ে যে কি, তা শুধু মায়েরা জানে আর জানে আল্লাহ। যতই তার জন্য মন কাঁদুক না কেন, তাকে দেখতে যাওয়ার আমাদের কোনো অধিকার নেই।
কেন আম্মা?
তারা তাদের ওয়াদা ঠিক রেখেছে, আমরাও রাখব। ওয়াদা ভঙ্গ করা কবীরা। গুনাহ।
তা আমি জানি। “আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গকারীকে পছন্দ করেন না।” এটা কুরআন পাকের কথা।
তা হলে দেখতে যেতে চাচ্ছিস কেন?
ভুল হয়ে গেছে, আর চাইব না ।
তারপর বি.এ পাশ করে ঢাকা রওয়ানা হওয়ার আগে আরমান মাকে বলল, তুমি নাজনীনদের ঠিকানাটা দাও। আমি ওদের বাসায় যাব না। বাসার কাছাকাছি কোনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব। নাজনীন যখন বাসা থেকে কোথাও যাবে অথবা বাইরে থেকে বাসায় আসবে তখন তাকে দেখব।
সুফিয়া খাতুন নাজনীনের কথা মনে পড়লে গুমরে গুমরে কাঁদেন। রাতে ঘুমের মধ্যে তাকে স্বপ্নে দেখে কেঁদে উঠেন। প্রত্যেক নামাযের পর মুনাজাত করার সময় তার সহি সালামতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, আর কেঁদে কেঁদে বলেন, মরণের আগে যেন একবারের জন্য হলেও তার সঙ্গে দেখা হয়। এখন আরমানের কথা শুনে চোখ উপছে পানি গড়িয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে তবু বললেন, আমি বুকে পাথর চাপা দিয়ে যন্ত্রণা সহ্য করে আছি, আজীবন করেও যাব। আর তোকেও বলছি, কোনোদিন তার সঙ্গে দেখা করবি না। আল্লাহর মর্জি হলে তিনি যেমন করে হোক আমাদেরকে দেখাবেন। তোর আব্বার মুখে শুনেছি, “আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নেক বাসনা পূরণ করে থাকেন।”
এরপর আরমান আর কোনো কথা বলতে পারেনি।
৬
যেদিন রুবী ক্রিকেট প্র্যাকটিস করানোর কথা বলল, তার চার-পাঁচদিন পর আরমানের রুমে এসে তাকে কিছু লিখতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মাগরিবের নামায পড়ে এসে আরমান একটা ইংরেজী পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত লিখছিল। রুবীর আগমন টের পেল না।
রুবী পা টিপে টিপে এসে তার পিছন থেকে দরখাস্ত পড়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা জানতে পারল। খুব অবাক হয়ে ভাবল, ও আমাদেরকে শুধু এস.এস.সি পাশ বলল কেন? তা হলে ওর কি কোনো উদ্দেশ্য আছে? যদি তাই হয়, তা হলে যেমন করে হোক তা জানতে হবে। এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না ভেবে পা টিপে টিপে দরজার কাছে ফিরে এসে বলল, আরমান কী করছ?
আরমান তাড়াতাড়ি পেপারটা দরখাস্তের উপর চাপা দিয়ে বলল, আসুন আপা। তারপর ঢিলে সালোয়ার কামিজ ও উড়না গায়ে দিয়েছে দেখে খুশী হয়ে বলল, কিছু বলবেন?
রুবী কাছে এসে বলল, কিছু বললে তো তুমি শুনবে না। তারপর একটা খাম তার হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখ।
এতে কি আছে?
খুলে দেখ।
না বললে খুলব না।
এটা কি রকম ভদ্রতা? কেউ কিছু দিলে প্রথমে খুলে দেখাই তো উচিত। না দেখে দাতাকে প্রশ্ন করা চরম অভদ্রতা।
আমি পল্লী গ্রামের অল্পশিক্ষিত ছেলে। মাত্র কয়েক দিন হল শহরে এসেছি। শহরের মানুষের মতো ভদ্রতা জ্ঞান রপ্ত করতে পারি নি।
এই কথায় রুবী খুব রেগে গেল। মনে মনে বলল, তোমার এই ভণিতার কারণ না জেনে ছাড়ছি না। রাগটাকে হজম করে বলল, শহরে যখন থাকতে এসেছ তখন তাদের সবকিছু শিখতে হবে। খুলে দেখ কি আছে।
আরমান খামের মুখ ফাঁক করে কয়েকটা পাঁচশ টাকার নোট দেখে বলল, কী ব্যাপার? টাকা দিচ্ছেন কেন?
যদি বলি, আমি দিচ্ছি না; আল্লাহ দেওয়াচ্ছেন।
আরমান বুঝতে পারল, রুবী খুব টেলেন্ট। তাই সেদিনের আলাপের রেফারেন্স টেনে কথাটা বলেছে। বলল, বসুন দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
রুবী বসে বলল, প্রয়োজন হলে বলবেন, আরো দেব।
আরমান টাকার খামটা ফেরত দিয়ে বলল, আল্লাহ আমাকে আগে যা দিয়েছেন, তা এখনও আছে। যখন প্রয়োজন হবে তখন চাচার কাছ থেকে নেব।
চাচার কাছ থেকে নেবে অথচ আমার কাছ থেকে নেবে না কেন? বাবার টাকা আর আমার টাকা বুঝি ভিন্ন?
নিশ্চয় ভিন্ন। আপনার প্রয়োজনের জন্য চাচা এই টাকা দিয়েছেন। সেই টাকা আমাকে দিচ্ছেন। আমি নিতে পারব না।
যদি বলি আমার প্রয়োজন নেই, তোমাকে দেব বলে বাবার কাছ থেকে এই টাকা চেয়ে নিয়েছি। তাহলেও কী নেবে না?
নেব, তবে এখন তো আমার প্রয়োজন নেই। আপনার কাছেই রাখুন। যখন প্রয়োজন হবে চেয়ে নেব।
ঠিক আছে, রাখলাম। এবার আমার একটা কথা তোমাকে রাখতেই হবে।
বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।
আগে প্রমিশ কর রাখবে।
না শুনে প্রমিশ করা উচিত নয়।
কেন?
যদি কঠিন কিছু বলেন?
রুবী হেসে উঠে বলল, কঠিন নয়, সহজই বলব।
তা হলে প্রমিশ করছি।
আমি তোমার কাছে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতে চাই।
সেদিন প্র্যাকটিস করাতে না পারার কারণ বলার পর যে নাকি তাকে পাড়াগাঁয়ের জংলী ভূত ও মূর্খ বলে অপমান করেছিল,সে যে আবার তাকে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করাবার কথা বলবে আরমান ভাবতেই পারে নি। তাই প্রমিশ করেছিল। এখন তার কথা শুনে কি বলবে অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগল।
কী হল? কিছু বলছ না কেন? এরকম ঢিলে পোশাক পরেই প্র্যাকটিস করব।
আপনি শাওন ভাইয়ের কাছে তো প্র্যাকটিস করতে পারেন।
তাকে বলেছিলাম। বলল, “মেয়েদের এসব খেলা ঠিক না। তা ছাড়া তারা এ খেলায় পারদর্শী হতে পারে না।” আমি ওকে দেখাতে চাই, পারদর্শী হতে পারি কিনা।
শাওন ভাই ঠিক কথা বলেছেন।
রুবী রেগে উঠে বলল, চুপ কর। তুমিও তো ছেলে, তাই শাওনের মতো বলছ। ছেলেরা বড় সার্থপর।
ছেলেরা সার্থপর কিনা জানি না, তবে একথা জানি, “ইসলাম মেয়েদের ও পুরুষদের দৈহিক ও মানসিক কাঠামো ভিন্নভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাই মেয়েদেরও পুরুষদের কর্ম ও কর্মস্থল ভিন্ন করেছেন। এটা কুরআন হাদিসের কথা।
তুমি তো মৌলবাদীদের মতো কথা বলছ।
কুরআন-হাদিসের কথা বললেই আজকাল নব্য শিক্ষিত মানুষ তাদেরকে মৌলবাদী বলে। এটা বড়ই পরিতাপের বিষয়। তারা যদি কুরআন-হাদিস পড়ত, তা হলে কিন্তু একথা বলতে পারত না। আমার কথা সত্য না মিথ্যা কুরআন-হাদিস পড়লেই বুঝতে পারবেন।
আমি অতশত বুঝি না, কথা রাখবে বলে তুমি প্রমিশ করেছ, এখন রক্ষা করবে কিনা বল?
আরমান কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, দাদু ও চাচা চাচি যদি কিছু মনে করেন? অথবা আমার উপর অসন্তুষ্ট হন।
ওরা কিছু মনে করবেন না। সে দায়িত্ব আমার।
আপনাকে একাকী প্র্যাকটিস করাতে পারি। তবে শাওন ভাই থাকলে ভালো হয়। দু’জনে এ খেলা প্র্যাকটিস করা যায় না, নিদেন পক্ষে তিনজন হলেও চলে।
রুবী আনন্দে টগবগিয়ে উঠে বলল, কয়েকদিন একাকী প্র্যাকটিস করাও, তারপর দাদুকে দিয়ে শাওনকে রাজি করাব।
আরমান বলল, ভালো কথা বলছেন, দাদুকেও নেবেন। তা হলে আরো ভালো হবে।
দাদু কিন্তু ক্রিকেটের খুব ভালো সমঝদার এবং তিনি এই খেলার উপর খুব ইন্টারেস্টেড। তুমি যেদিন এলে তার দু’দিন পর দেখলে না, আমার ও শাওনের বন্ধুদের দলের ম্যাচ খেলার সময় দাদু-আম্পায়ার ছিলেন?
হ্যাঁ দেখেছি, তাই তো তার কথা বললাম, এবার আপনি আসুন, আমার একটু কাজ আছে।
রুবী বুঝতে পারল, দরখাস্তটা কমপ্লিট করবে। তাই আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে আসার সময় বলল, কাল বিকেল থেকে প্র্যাকটিস করব মনে থাকে যেন।
এমন সময় ড্রাইভারকে আসতে দেখে রুবী জিজ্ঞেস করল, বাবা ফিরেছেন?
ড্রাইভার বললেন, হ্যাঁ মা ফিরেছেন।
ড্রাইভার রুমে ঢুকতেই আরমান সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে ড্রাইভার বলল, রুবী মা এসেছিলেন কেন?
কাল থেকে ক্রিকেট খেলা শেখাতে হবে। সে কথা বলতে।
ড্রাইভারকে আরমান ক্রিকেট প্র্যাকটিস করার কথা আগেই বলেছিল। বলল, তুমি যে ক্রিকেট খেলা যান, ওরা তা হলে জেনে ফেলেছে।
সবাই জানে না, শুধু রুবী আপা জানেন।
তা, তুমি তাকে কী বললে?
প্রথমে না করেছিলাম। আপনি তো জানেন, রুবী আপা খুব জেদী। শেষ মেস আশ্রয়দাতার মেয়ে ভেবে রাজি হয়েছি।
তা হলে তো সবাই জেনে যাবে ।
কী আর করব চাচা, যা রাগী আর জেদী মেয়ে, রাজি করিয়েই ছাড়ল। তারপর দরখাস্ত লেখায় মন দিল।
ড্রাইভার এতদিনে আরমানের অনেক কিছু জেনেছে। তাই আর কিছু বলল না।
রুবীর বয়স যখন বার বছর তখন তার দাদী মনসুরা বেগম মারা যান। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর মকবুল হোসেন আর অফিসে যান না। জামাই-এর উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। সব সময় বাসাতেই থাকেন। বই পড়েন, টিভিতে দেশ বিদেশের ক্রিকেট খেলা দেখেন। বাকি সময় নাতনি রুবীকে নিয়ে মেতে থাকেন।
কিশোরী রুবী দাদুর সব দিক লক্ষ্য রাখত। দাদুর অসুখ করলে ঠিকমতো ওষুধ খাওয়াবে। সেবা শুশ্রূষা করবে। দাদু বলতে রুবী অজ্ঞান। এখন সেসব আরো বেশি করে।
আরমানের রুম থেকে বেরিয়ে রুবী দাদুর রুমে গেল। মকবুল হোসেন একটা বই পড়ছিলেন। তাকে দেখে বইটা বন্ধ করে বললেন, কী ভাই, পড়াশোনার সময় আমার ঘরে?
কেন? আসতে নেই বুঝি?
তা আসবি না কেন? একশবার আসবি। পড়ার সময় তো তাই বললাম।
আচ্ছা দাদু, ধর্মের বিধি বিধান মেনে চলা কী খারাপ?
খারাপ হবে কেন? বরং ভালো।
তা হলে আপনি মেনে চলেন না কেন?
ধর্ম যে যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওসব কথা রেখে কেন এসেছিস বল।
ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার? কথাটা কী ঠিক?
তোর কি মনে হয়?
আমার তো মনে হয় ঠিক নয়। আপনিও তো বললেন, ধর্মের বিধি বিধান। মেনে চলা ভালো। যা ভালো, তা প্রত্যেকের মেনে চলা উচিত। তা না হলে সারা পৃথিবীতে তো খারাপের বন্যা বয়ে যাবে। আর তা যে হচ্ছে, আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
অন্য সময় এইসব আলোচনা করা যাবে। পড়ার সময় আসা ঠিক হয় নি। যদি কোনো প্রয়োজনে এসে থাকিস বল ।
কোনো কিছু মাথায় থাকলে পড়াশোনা হয় না। সেই কিছুটা মাথা থেকে দূর করার জন্য এসেছি।
বল তা হলে।
দু’টো কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমটা হল যারা কুরআন হাদিসের কথা বলে, তাদেরকে আমরা মৌলবাদী বলি কেন? এটার উত্তর জানার পর দ্বিতীয়টা বলব।
মকবুল হোসেন ভ্রু কুঁচকে বললেন, এ তোর নিজের কথা? না কারো কাছে শুনে এসেছিস?
একটু আগে আরমানের কাছে একটা দরকারে গিয়েছিলাম। দরকারের কথাটা বলতে কুরআন-হাদিসের কথা বলায় আমি তাকে মৌলবাদী বলি। তখন আরমান বলল, কুরআন হাদিসের কথা বললেই যারা মৌলবাদী বলে বিদ্রূপ করে : তারা প্রকৃত মুসলমান নয়। আল্লাহ ও রাসুল (দঃ)-এর বাণী যারা মানে না, স্বীকার করে না, তারা কোনোদিনও মুসলমান বলে দাবি করতে পারবে না। আরো বলল, প্রত্যেক মুসলমান তথা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কুরআন হাদিসের বিধি-বিধান মেনে চলা উচিত। কারণ এগুলো শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য সুখ-শান্তির গ্যারান্টি। আমার মনে হয়, বিশ্ব জগতের সবকিছু যখন ধর্ম মেনে চলছে, আর্থাৎ একটা নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলছে, তখন বিশ্ব জগতের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের ও ধর্ম মেনে চলা উচিত।
মকবুল হোসেন অবাক হয়ে বললেন, তুই সাইন্সের ছাত্রী, এসব জিনিস নিয়ে তোর চিন্তা করা ঠিক নয়। সাইন্স ধর্মকে মানে না, বিশ্বাসও করে না।
রুবী বলল, আপনি জানেন কিনা জানি না, সাইন্সের কোনো থিওরীই কিন্তু সঠিক ও চিরসত্য নয়। আজ যে থিওরী সঠিক বলে মনে হয়, কয়েক বছর পর সেই থিওরী ভুল বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু ধর্মে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের গ্রন্থ কুরআনে আকাশ, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ও সাগর-মহাসাগর সম্পর্কে যা কিছু বর্ণনা আছে, সে সব কিন্তু পরিবর্তন হয় নি। বরং বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিকরা কুরআন রিসার্চ করে বলতে বাধ্য হচ্ছেন, সেগুলোই সঠিক ও চিরসত্য।
আরো বেশি অবাক হয়ে মকবুল হোসেন বললেন, সত্যি করে বলতো, এসব কথা কে তোকে বলেছে?
আরমান বলেছে। তা ছাড়া দু’দিন আগে আমি এক বান্ধবীর বাসায় মুহাম্মদ নূরুল ইসলামের বিজ্ঞান ও কুরআন” বইটি দেখে ভাবলাম, কুরআনের সঙ্গে বিজ্ঞানের সাপে নেউলের সম্পর্ক? বইটাতে কি আছে পড়ে দেখতে হয় তো । ফেরার সময় বান্ধবীর কাছ থেকে বইটা নিয়ে এসে পড়লাম। সেটা পড়ে বুঝতে পারলাম, কুরআনে শুধু ধর্মের বিধি-নিষেধের বর্ণনা নেই, সৃষ্টি রহস্যেরও অনেক কিছু আছে।
বইটা এখন তোর কাছে আছে?
হ্যাঁ আছে। পড়বেন?
দিস তো পড়ব। তারপর বললেন, এখানে আসার দ্বিতীয় কারণটা বল।
কাল থেকে আরমান আমাকে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করাবে, আপনিও থাকবেন।
কী বললি? আরমান তোকে…..।
দাদুকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রুবী মৃদু হেসে বলল, খুব অবাক হচ্ছেন না? আরমান একজন ভালো ক্রিকেটার।
তাই না কী? ওকে দেখে কিন্তু ক্রিকেটার বলে মনে হয় না। তা তুই জানলি কেমন করে?
কি করে জানল তা বলে রুবী বলল, ও কিছুতেই আমাকে প্র্যাকটিস করাতে চাই নি। আমিও নাছোড় বান্দা। এমন কৌশল খাটালাম, রাজি না হয়ে পারল না। তবে আপনাকে ও শাওনকে আমার সঙ্গে থাকতে বলেছে। আমি বললে শাওন শুনবে না। আপনি ওকে বলে রাজি করাবেন। আরমান বলল, এসব খেলা একা একা কাউকে প্র্যাকটিস করানো যায় না। কমপক্ষে তিনজন তো চাই-ই।
কেন তোর বন্ধুরা তো রোজ আসে? ওদের সঙ্গে নিবি।
আমি সেকথা আরমানকে বলেছিলাম। না করে দিয়েছে।
কিন্তু তোর বন্ধুরা কি মনে করবে?
বন্ধুদের আসতে নিষেধ করে দেব।
ঠিক আছে, শাওনকে ডাক।
রুবী শাওনের রুমে এসে বলল, তোকে দাদু ডাকছেন।
শাওন পড়ছিল। বলল, কেন ডাকছেন জানিস?
দু’ভাই-বোন দু’বছরের ছোট বড়। ছোটবেলায় একদম পড়ত না। সামান্য কিছু নিয়ে দু’জনের ঝগড়া লেগেই থাকত। বড় হয়ে ঝগড়া না করলেও কেউ কারো কথা মানতে চায় না। তাই শাওনের কথার উত্তরে বলল, না। তারপর রুবী দাদুর কাছে ফিরে এল।
শাওন দাদুর কাছে এসে বলল, কেন ডেকেছেন বলুন।
মকবুল হোসেন বললেন, আরমানকে তোর কেমন মনে হয়?
খারাপ তো কিছু দেখি নি।
ও যে একজন ক্রিকেটার তা কি জানিস?
হ্যাঁ জানি।
কেমন খেলে জানিস?
জানি। খুব শিঘ্রী ম্যাচে চান্স পাবে।
কী করে জানলি?
এসব কথা বলার এখন সময় আমার নেই। পড়ার তাড়া রয়েছে। কি জন্যে ডেকেছেন, বলুন।
তুই তো রুবীকে প্র্যাকটিস করাতে রাজি হলি না। ও আরমানের কাছে প্র্যাকটিস করবে বলছে।
করলে করবে, তাতে আমার কি? কেন ডেকেছেন বলবেন তো? বললাম না, পড়ার তাড়া আছে?
প্র্যাকটিস করানোর সময় আমাকে ও তোকে আরমান থাকতে বলেছে।
একদিন শাওন বন্ধু রফিকের সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাসায় গিয়েছিল। তার, ছোট ভাই বলল, ভাইয়া প্র্যাকটিস করতে গেছে। শাওন জানে রফিক আবাহনীর মাঠে জুনিয়র গ্রুপে খেলে। সেখানে গিয়ে আরমানের ব্যাটিং ও বোলিং কৌশল দেখে খুব অবাক হল।
প্র্যাকটিস শেষে শাওন আরমানকে বলল, তুমি একজন ভালো ক্রিকেটার, কই, সে কথা তো আমাদেরক বল নি?
আরমান কাচুমাচু হয়ে বলল, বলার দরকার হলে নিশ্চয় বলতাম। তা ছাড়া আমাকে বড় ক্রিকেটার বলছেন কেন? আমি তো এখন প্র্যাকটিস করছি, কোনো ম্যাচে তো খেলি নি।
আমার তো মনে হচ্ছে, তুমি খুব শিঘ্রী জুনিয়র গ্রুপের ম্যাচে চান্স পাবে।
শাওন ভাই, একটা অনুরোধ করব রাখবেন?
বল।
ক্রিকেট খেলার ব্যাপারটা বাসার কাউকে বলবেন না।
কেন?
মাফ করবেন, কেনর উত্তর এখন দিতে পারব না। প্লীজ কথা দিন, বাসার কাউকে বলবেন না।
শাওন মৃদু হেসে বলল, ঠিক আছে বলব না।
এখন দাদুর কথা শুনে ভাবল, এতদিন প্র্যাকটিস করেও কোনো অগ্রগতি হয় নি। কেন হয় নি আরমানের কাছে প্র্যাকটিস করলে নিশ্চয় জানা যাবে এবং নিশ্চয় সে আমাকে সাহায্য করবে। মনে মনে খুশী হলেও গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আমাকে থাকতে হবে কেন? রুবীর বন্ধুরা থাকবে।
মকবুল হোসেন বললেন, ওর বন্ধুরা থাকলে আরমান রুবীকে প্র্যাকটিস করাবেনা। তাই তোকে ও আমাকে থাকতে বলেছে।
‘রুবীর দিকে তাকিয়ে শাওন বলল, তোকে হঠাৎ আরমান প্র্যাকটিস করাতে রাজি হল কেন বুঝতে পারছি না?
রুবী রেগে উঠে বলল, সে কথা তোর জানার দরকার নেই। তুই থাকবি কি না বল?
শাওন রেগে গেলেও স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, দু’একদিন থাকতে পারি। তারপর সেখান থেকে চলে গেল।
রুবী দাদুকে বলল, আপনার ইভিনিং ওয়ার্ক বন্ধ। আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
মকবুল হোসেন বললেন, থাকতে পারি। তবে শর্ত হল, আমাকেও ব্যাটিং বোলিং করার সুযোগ দিতে হবে।
রুবী হেসে উঠে বলল, অফকোর্স।
৭
কয়েকদিন প্র্যাকটিস করার পর সবাই জানতে পারল, আরমান খুব ভালো ক্রিকেটার। সবারই ধারণা, অচিরেই সে ম্যাচে সুযোগ পাবে এবং ভবিষ্যতে একজন নামকরা ক্রিকেটার হবে।
সাজেদা বেগম ব্যাপারটা জানতে পেরে প্রথম দিন স্বামীর সামনে বাবাকে বলেছিলেন, আরমান ভালা ক্রিকেটার হলেও পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের অল্প শিক্ষিত ছেলে। তার কাছে শাওন রুবী প্র্যাকটিস করবে, এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমাদের প্রেসটিজ আছে না? কোনো হাই ফ্যামিলীর একজন ভালো ক্রিকেটারের কাছে প্র্যাকটিস করুক। যত টাকা চায় দেওয়া যাবে।
মকবুল হোসেন বললেন, কোনো হাই সোসাইটির ছেলে টাকার বিনিময়ে বাসায় প্র্যাকটিস করাতে আসবে না। তারও প্রেসটিজে লাগবে। তা ছাড়া আরমান পাড়াগাঁয়ের গরিবের ছেলে হলেও একদম অশিক্ষিত নয়। আমার কি মনে হয় জানিস মা, ছেলেটার মধ্যে অনেক প্রতিভা আছে। দেখে নিস, এক সময় ওর নাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। সেদিন বলল না, একটা কিছু উপার্জনের উপায় করতে পারলে আরো পড়াশোনা করবে? ওকে আমাদের ঘৃণা করা উচিত নয়। গরিবের ছেলে বলে হেয় জ্ঞান করাও উচিত নয়। কার ভিতর কি আছে, কে কখন কি হবে, তা কেউ বলতে পারে না।
আমজাদ সাহেব ব্যাপারটা জানতে পেরে আনন্দিত হয়েছেন। শ্বশুর থেমে যেতে বললেন, হ্যাঁ বাবা, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমিও আপনার সাথে একমত। ছেলেটা খুব সহজ সরল; কিন্তু ওর মধ্যে প্রতিভা আছে।
মাস দুয়েক আরমানের কাছে প্র্যাকটিস করে শাওনের অনেক উন্নতি হয়েছে। রুবীরও তাই। খেলার ব্যাপারে দু’জনেই আরমানের উপর খুব ইন্টারেস্টেড। শাওন তো তার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতে শুরু করেছে। আর রুবী তার প্রতি ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ছে। তবে তা প্রকাশ করে নি।
একদিন দু’জনে পরামর্শ করে মা বাবার সামনে শাওন দাদুকে বলল, আরমানের থাকার জন্য একটা সেপারেট রুমের ব্যবস্থা করা উচিত।
মকবুল হোসেন কিছু বলার আগে সাজেদা বেগম রেগে উঠে বললেন, কেন?
এবার শাওন কিছু বলার আগে মকবুল হোসেন বললেন, হ্যাঁ মা, শাওন ঠিক কথা বলেছে। একটা প্রতিভাবান ছেলেকে ড্রাইভারের সঙ্গে থাকতে দেওয়া উচিত নয়। ওর নিজস্ব একটা রুম থাকা দরকার। তা ছাড়া যখন পড়াশোনা শুরু করবে তখন তো একটা আলাদা রুম ওর দরকার হবে। কিছুদিন আগেই না হয় সে ব্যবস্থা করা গেল। তাই কালকেই জমিলাকে দিয়ে নিচতলার ড্রইংরুমের পাশের দুটো গেস্ট রুমের একটাতে ওর থাকার ব্যবস্থা কর।
সাজেদা বেগম বেশ একটু অহঙ্কারী ধরনের মেয়ে। গরিবদের মোটেই তিনি পছন্দ করেন না। না জেনে ধুম করে গরিবের ছেলে আমজাদ সাহেবকে বিয়ে করে যদিও দাম্পত্য জীবনে অসুখী হন নি, তবুও হাই সোসাইটিতে স্বামীর বংশ পরিচয় প্রকাশ করতে না পেরে আজও অনুতপ্ত। তাই গরিবদের উপর তার ক্ষোভ। সেইজন্য আরমান গরিবের ছেলে জেনে তাকে আশ্রয় দিতে চান নি। স্বামী ও বাবা তাকে বাসায় রাখাতে আগেই অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এখন তাদের কথা শুনে আরো অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, একটা গরিবের ছেলেকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি আমি পছন্দ করি না।
সাজেদা বেগমের কথা শেষ হতে রুবী বলল, তুমি বোধহয় জান না মা, পৃথিবীর বেশিরভাগ বিখ্যাত ব্যক্তিরা গরিব ঘরের সন্তান।
সাজেদা বেগম রাগের সঙ্গে কটমট করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে তুই জমিলাকে দিয়ে ওর জন্য একটা রুমের ব্যবস্থা কর। কথা শেষ করে সেখান থেকে চলে গেলেন।
রুবী দাদুকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার মেয়ে গরিবদের পছন্দ করে না কেন বলতে পারেন?
ছিঃ দাদু, মায়ের সম্পর্কে এরকম প্রশ্ন করতে নেই।
সরি, ভুল হয়ে গেছে, আর কখন এরকম ভুল করব না। তারপর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি কিছু মনে করনি তো বাবা?
স্ত্রী যে কেন গরিবদের পছন্দ করে না, তা আমজাদ সাহেব জানেন। তাই দীর্ঘনিশ্বাস চেপে রেখে বললেন, নারে কিছু মনে করি নি। তোর মায়ের কথা বাদ দে, কালকেই জমিলাকে দিয়ে তুই আরমানের জন্য রুমটা রেডি করে রাখিস।আর কি কি ফার্নিচার লাগবে একটা লিস্ট করে দিস।
এর মধ্যে রুবী ও শাওন তাদের বন্ধুদের সঙ্গে আরমানের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। একদিন তাদের মেয়ে বন্ধুরা শাওনের সঙ্গে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করার কথা আরমানকে জানাল।
আরমান রাজি হল না। বলল, মাফ করবেন, আমি পারব না।
দীবা নামে রুবীর এক বান্ধবী বলল, কেন পারবেন না?
আরমান বলল, আমি নিজেই এখন শিক্ষার্থী, আপনাদেরকে শেখাব কী। তা ছাড়া কয়েকদিন পর হয়তো একটা চাকরি পেয়ে যাব। তখন আর ওদেরকেও সময় দিতে পারব না।
এরপর আর কেউ কিছু বলতে পারল না।
পরের দিন রুবী কলেজে গেল না। জমিলাকে সঙ্গে নিয়ে একটা গেস্টরুম আরমানের জন্য রেডি করল। সকালে কয়েকটা ফার্নিচারের নাম লিখে বাবাকে দিয়েছিল। দুপুরের মধ্যে সেগুলো কিনে আমজাদ সাহেব পাঠিয়ে দিয়েছেন। রুবী সেগুলো জায়গামতো রাখল।
বেলা তখন দু’টো। আরমান খেয়ে উঠেছে, এমন সময় শাওন এসে বলল, তোমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে আমার সঙ্গে এস।
আরমান অবাক হয়ে বলল, জিনিসপত্র নিয়ে যাব মানে?
মানে, দাদু ও বাবা তোমার জন্য একটা রুমের ব্যবস্থা করেছেন। আজ থেকে সেখানে থাকবে।
হঠাৎ এ ব্যবস্থা কেন?
সে কথা ওঁরা জানেন, আমি বলব কি করে?
আমার তো মনে হচ্ছে, আপনিই ওঁদেরকে দিয়ে ব্যবস্থাটা করিয়েছেন।
শাওন অবাক কণ্ঠে বলল, তোমার অনুমান দারুণ। হ্যাঁ, আমি ও রুবী পরামর্শ করে করিয়েছি। কারণ বন্ধুকে বন্ধুর মতো রাখাই তো উচিত।
কিন্তু আমার মতো পাড়াগাঁয়ের গরিবের ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে উঁচু সোসাইটির বন্ধুদের কাছে আপনাদের প্রেসটিজ থাকবে?
সেটা আমাদের ব্যাপার, তোমাকে ভাবতে হবে না।
কিন্তু আমি তো আপনাদের বন্ধু হওয়ার যোগ্য নই।
বন্ধু হওয়ার যে যোগ্যতা তোমার আছে, হাই সোসাইটির অনেকের তা নেই। ওসব কথা বাদ দিয়ে যা বললাম তাই কর।
আরমান মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে সবকিছু নিয়ে শাওনের পিছু নিল।
রুমে ঢুকে আরমান আর একবার অবাক হল। রুমের সবকিছু সুন্দর পরিপার্টি করে গুছান। নতুন চেয়ার টেবিল। টেবিলের উপর ফুলদানিতে টাটকা একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। তার সুবাস ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে।
শাওন তাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। আরমান সবকিছু গুছিয়ে রেখে ড্রাইভিং স্কুলে চলে গেল।
রাতে ড্রাইভার বাসায় ফিরে আরমানকে দেখতে না পেয়ে রুমের চারপাশে তাকিয়ে তার কোনো জিনিসপত্র নেই দেখে খুব অবাক হল। ভাবল, ছেলেটা নিজের থেকে চলে গেছে? না তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে?
গাড়ির শব্দ শুনে আরমান রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়েছিল। সাহেব উপরে চলে যাওয়ার পর ড্রাইভারের রুমে এসে সালাম দিল।
ড্রাইভার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কী ব্যাপার আরমান? রুমে তোমার জিনিসপত্র নেই দেখে ভাবছিলাম, তুমি এখান থেকে চলে গেছ।
আরমান হাসিমুখে বলল, আপনাকে না বলে চলে যাব ভাবলেন কী করে? তারপর অন্যরুমে থাকার কথা বলল।
শুনে খুব খুশী হলাম বাবা। তোমার মতো শিক্ষিত ছেলে এখানে ছিলে, আমার কাছে খুব খারাপ লাগত। আল্লাহ তোমার মনের নেক বাসনা পূরণ করুক।
ড্রাইভার আগে নামায পড়ত না। আরমান তাকে কুরআন-হাদিসের কথা শুনিয়ে নামায ধরিয়েছে।
আরমান বলল, আমি সময় পেলেই আপনার কাছে এসে আলাপ করব। এখন যাই, আপনি নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করুন। তারপর নিজের রুমে ফিরে এল।
তিন মাসের কোর্স হলেও আরমান দু’মাসের মধ্যে শেষ করে ফেলেছে। এখন সে ট্রেনিংকার নিয়ে একা একা রাস্তায় চালায়। আর বিভিন্ন কলেজের অনতিদূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে নাজনীনের দেখা পাওয়ার জন্য। যে দিন প্র্যাকটিস থাকে না সেদিনও তাই করে।
মাস ছয়েকের মধ্যে আরমান সিনিয়র গ্রুপে চান্স পেল। প্রথম কয়েকটা ম্যাচে ব্যাটিং ও বোলিং এ খুব নাম করে অল রাউন্ডার খেতাব পেল। টিম থেকে মাসিক ভাতা বেশ ভালো পায়। তাই চাকরির চেষ্টা ত্যাগ করে মাস্টার্স করার জন্য ভার্সিটিতে এ্যাডমিশন নিল। এখানে তার যানবাহন খরচ ছাড়া অন্য কোনো খরচ নেই। তাই সে প্রয়োজনের টাকা রেখে বাকি টাকা প্রতি মাসে মানি অর্ডার করে মাকে পাঠিয়ে দেয়।
ছেলেমেয়ে একটু বড় হওয়ার পর সুফিয়া খাতুন বড় ভাসুরের সংসারে আর কাজ-কাম করেন না। আরমানের পঁচিশ বছর পূর্ণ হওয়ার পর। একদিন বড় জা জেবুন্নেসা বিবিকে সে কথা জানালেন,
জেবুন্নেসা বিবি বললেন, তা হলে সামনের মাস থেকে তুমি আর কোনো টাকা পাবে না। তবে নাসরিনের বিয়ের খরচ দেওয়া হবে। এটাই কিন্তু শর্ত ছিল।
সুফিয়া খাতুন বললেন, সেই জন্যই তো কথাটা বলতে এলাম। বুজি, তুমি মিয়াভাইকে কথাটা জানিয়ে দিও। তারপর নিজের ঘরে ফিরে এলেন।
.
দিনে খেলা ও নাজনীনকে খোঁজা নিয়ে আরমান ব্যস্ত থাকে। আর রাত জেগে পড়াশোনা করে। একদিন পড়তে পড়তে কখন রাত একটা বেজে গেছে খেয়াল করে নি। হঠাৎ দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে শুনে ঘড়ির দিকে তাকাল । ভাবল, এত রাতে কে হতে পারে? মনের ভুল নয় তো? আবার টোকা দিতে শুনে উঠে এসে দরজা খুলে রুবীকে দেখে অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার? আপনি?
তাতো দেখতেই পাচ্ছেন বলে রুবী তাকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, ভেল্টিলেটার থেকে রুমে আলো জ্বলছে দেখে জানতে এলাম, এত রাত পর্যন্ত জেগে কী করছেন? তারপর টেবিলের উপর একটা বই খোলা দেখে এগিয়ে গিয়ে বইটা হাতে নিয়ে বলল, পড়ছিলেন নিশ্চয়?
এত রাতে রুবীকে দেখে আরমান ঘাবড়ে গিয়েছিল। আপনি করে কথা বলতে ও বইটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করাতে আরো ঘাবড়ে গেল। কোনো রকমে বলল, প্লীজ আপা, আপনি চলে যান। যা কিছু বলার কাল সকালে বলবেন।
রুবী চোখ পাকিয়ে বলল, সাটআপ। বড় হয়ে ছোটকে আপা বলতে লজ্জা করছে না আপনার?
আরমান খেদের সঙ্গে বলল, গরিবদের আবার ছোট-বড়।
রুবী রাগের সঙ্গে আবার বলল, সাটআপ। তারপর এগিয়ে এসে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনি যে বি.এ.তে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছেন, তা এখানে আসার কয়েকদিন পরেই জানতে পেরেছি। এখন মাস্টার্স করছেন, তাও জানি। কেন আমাদেরকে সমান্য এস.এস.সি পাশ বলেছিলেন। তা এতদিন জানার চেষ্টা করেও সফল হতে পারি নি। এখন বলুন তো শুনি।
আরমান কাচুমাচু হয়ে বলল, একথা দিনে যে কোনো সময়ে জিজ্ঞেস করতে পারতেন। দয়া করে এখন চলে যান। এত রাতে আসা আপনার উচিত হয় নি। কেউ জানতে পারলে কি হবে ভেবে দেখুন।
কি আর হবে? আপনাকে তাড়িয়ে দেবে। অবশ্য তাতে তো আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। মাসে মাসে মোটা টাকা পাচ্ছেন। বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবেন। ক্ষতি তো আমার হবে। সবাই আমাকে বকাবকি করবে।
সেই জন্যেই তো বলছি, চলে যান।
আমার ব্যাপারটা আমি বুঝব । আপনি নামায পড়েন, হাদিস কালাম জানেন, তবু কেন মিথ্যে বললেন, বলতে হবে।
আরমান হাত জোড় করে বলল, প্লীজ, আপনি চলে যান।
রুবী দৃঢ়স্বরে বলল, না যাব না। আমার প্রশ্নের উত্তর না শুনে যাব না।
মিথ্যে বলার কারণ নিশ্চয় আছে। তবে এখন তা বলতে পারব না।
আমিও না শুনে যাচ্ছি না।
প্লীজ চলে যান।
অত প্লীজ প্লীজ করছেন কেন? বললাম তো না শুনে যাব না।
তা হলে আমিই চলে যাচ্ছি বলে আরমান জামাকাপড় ব্যাগে গোছাতে লাগল।
রুবী ব্যাগটা টেনে নিয়ে বলল, ভেবেছেন, উত্তর না দিয়ে চলে যাবেন? তা হচ্ছে না। উত্তর না দিয়ে যেতে পারবেন না। জোরাজুরি করলে চীৎকার করে বাসার সবাইকে জড়ো করব। তখন ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়াবে ভেবে দেখুন।
আরমান কিংকর্তব্য নিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আবার হাত জোড় করে বলল, সময় মতো একদিন বলব। আপনি এখন চলে যান। প্রমিশ করছি, আপনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এখান থেকে যাব না।
রুবী কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিক আছে; চলে যাচ্ছি। তবে প্রমিশ ভঙ্গ করলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। কথা শেষ করে? চলে গেল।
সায়রা বানু ও আজরাফ সাহেব চার বছরের নাজনীনকে নিয়ে এসে নিজেদের মেয়ের মতো মানুষ করেছেন। আর নাম পাল্টে রেখেছেন সামিহা। সামিহা তাদেরকে নিজের মা-বাবা বলেই জানে। সে এখন এইচ.এস.সি সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে। সায়রাবানু সামিহাকে এত ভালোবাসেন যে, প্লে গ্রুপ থেকে এস.এস.সি পর্যন্ত তাকে গাড়ি করে স্কুলে নিয়ে গেছেন, নিয়ে এসেছেন। কলেজে ঢোকার পর আর যান না। ড্রাইভার নিয়ে যায় নিয়ে আসে।
একদিন কলেজের গেট থেকে বেরিয়ে সামিহা গাড়ির দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করল, রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে একটা সুদর্শন যুবক তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে দ্রুত হেঁটে এসে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে যেতে বলল। তারপর আড় চোখে তাকিয়ে দেখল, যুবকটা তখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবল, আজকাল ছেলেরা মেয়ে দেখলেই এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, যেন পারলে গিলে খেয়ে ফেলে। তখন তার শাওনের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার কথা মনে পড়ল। সেদিন মায়ের সঙ্গে কিছু কেনাকাটা করার জন্য মৌচাক মার্কেটে গিয়েছিল। সায়রা বানু মডার্ণ স্বামীর মডার্ণ স্ত্রী হলেও নামায রোজা করেন। বাইরে বেরোবার সময় বোরখা পরেন। মেয়ে সামিহাও মাকে অনুসরণ করে। বোরখা পরে বাইরে যাতায়াত করে, কলেজেও যায়। তবে মুখে নেকাব দেয় না। মার্কেট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক তখনই নজরে পড়ল, শাওন তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে এতটুকু লোলুপতা ছিল না। তবে এমন কিছু ছিল, যা দেখে সামিহা দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারে নি। শাওন মৃদু হেসে বলেছিল, কিছু বলবেন? সামিহা লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে না সূচক মাথা নেড়ে গাড়িতে উঠে পড়েছিল। সায়রাবানু ব্যাপারটা লক্ষ্য করেন নি।
এর কিছুদিন পর কক্সবাজারে শাওন বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল । সীসোরে বেড়িয়ে ফেরার সময় দেখতে পেল, মৌচাক মার্কেটে দেখা সেই মেয়েটা তারই বয়সী একটা মেয়ের সঙ্গে দোকানের ভিতর ঝিনুকের মালা দাম করছে। বন্ধুদের একটু অপেক্ষা করতে বলে শাওন দোকানে মেয়েটির কাছে গিয়ে। বলল, আপনি এখানে?
সামিহা তাকে চিনতে পেরে মৃদু হেসে বলল, ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। তা আপনি এখানে কেন?
বন্ধুদের সঙ্গে আমিও বেড়াতে এসেছি। আমি শাওন। ইকোনোমিক্সে অনার্স করছি।
আমি সামিহা, এইচ.এস.সি সেকেণ্ড ইয়ার।
শাওন বাবার একটা কার্ড দিয়ে বলল, ফোন করলে খুব খুশী হব। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে, আসি। তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে এল।
বন্ধুরা গাড়িতে অপেক্ষা করছিল। শাওন এসে উঠতে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।
রাজিব নামে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা তোর কাজিন না কী?
শাওন বলল, না। মৌচাক মার্কেটে একদিন দেখেছিলাম। এখানে দেখে আলাপ করলাম।
অন্য বন্ধু সুমন বলল, তা আলাপটা ইতিবাচক, না নেতিবাচক?
ইতিবাচক।
তোর ভাগ্য খুব ভালো। অত সুন্দরী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না।
শাওন বলল, ওকে নিয়ে আলোচনা না করলে খুশী হব।
রাজিব বলল, কেন রে? আমরা তো আর তোর ভিলেন হতে যাচ্ছি না।
আমি কিন্তু ঐ সেন্সে কথাটা বলি নি। মেয়েটার নাম ছাড়া আর কিছুই জানি না। আব্বর কার্ড দিয়েছি সে নিয়েছে; তাই ইতিবাচক বলেছি।
রাজিব বলল, আমিও কিন্তু কথাটা ইয়ার্কিচ্ছলে বলেছি। তুই মাইন্ড করবি জানলে বলতাম না।
আর এক বন্ধু জামাল বলল, তোরা একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে কি শুরু করলি বলতো? ভবিষ্যতে মেয়েটার সঙ্গে শাওনের কিছু হলে, ও নিজেই বলবে। এখন এ ব্যাপারে আর কেউ কিছু বলবি না।
জামালের কথা শুনে সবাই চুপ করে গেল।
রাশেদা কক্সবাজার মহিলা কলেজের ডিগ্রী ক্লাসের ছাত্রী। সে সামিহার ফুফাতো বোন। সামিহা রাশেদার সঙ্গে সীসোরে বেড়াতে এসেছিল। ফেরার সময় ঝিনুকের মালা কিনতে দোকানে ঢুকেছিল। শাওন চলে যাওয়ার পর রাশেদা রুবীকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। ফেরার সময় রিকশায় বসে বলল, শাওনের সঙ্গে তোর আগে পরিচয় ছিল?
সামিহা বলল, না। তারপর মৌচাক মার্কেটের ঘটনা বলল ।
রাশেদা বলল, কার্ডটা দেখি।
সামিহা কার্ডটা দিল।
রাশেদা কার্ডের উপর চোখ বুলিয়ে বলল, ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে। ভালোমন্দ দুটোই হতে পারে। আজকাল এইসব ছেলেরাই সন্ত্রাসী, রাহাজানি, ছিনতাই, হাইজ্যাক, চাঁদাবাজি ও মাকদসেবন করে। অনেকে আবার কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে লাইন করে। অবশ্য শাওনকে দেখে তেমন কিছু মনে হয় নি। তবু সাবধান করে দিচ্ছি, তুই ফোন করবি না। ছেলেটা যদি সত্যিই ভালো হয়, তা হলে সেই-ই তোকে খুঁজে বের করবে।
সামিহা বলল, তুই এত কিছু জানলি কি করে? মনে হয় ছ্যাক খেয়েছিস।
রাশেদা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁরে, তোর অনুমান ঠিক। আরশাদ নামে একটা ছেলেকে ভীষণ ভালবেসেছিলাম। সেও আমার জন্য পাগল ছিল। কিন্তু এক বছর হল প্রবাসী এক বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে সেখানে চলে গেছে। তাই তোকে সাবধান করে দিলাম।
শাওনকে প্রথম দিন দেখে সামিহার মনে যে আলোড়ন জেগেছিল। আজ তার পরিচয় পেয়ে সেই আলোড়ন আরো বেড়ে গেছে। তাই রাশেদার সাবধান বাণী শুনে বিরক্তবোধ করলেও বলল, ঠিক আছে; তোর সাবধান বাণী মনে রাখব।
ফুফুর বাড়িতে এক সপ্তাহ থেকে সামিহা ঢাকায় ফিরল। শাওনকে ফোন করার জন্য ইচ্ছা হলেও রাশেদার কথা ভেবে কয়েকদিন অপেক্ষা করল। তারপর থাকতে না পেরে একদিন ফোন করল।
রুবী ফোনের কাছে ছিল। রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো, কাকে চান?
এটা কি শাওনদের বাসা?
জ্বি, আপনি কে বলছেন?
আমি সামিহা। ওকে একটু দিন তো।
ধরুন দিচ্ছি বলে রুবী শাওনের রুমে গিয়ে বলল, তোর ফোন।
শাওন দুপুরে খেয়ে বিছানায় কাত হয়ে চিন্তা করছিল, এতদিন হয়ে গেল সামিহা ফোন করল না কেন? তা হলে কি আমাকে খারাপ ছেলে ভেবে কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে? কিন্তু তাকে তো সেরকম মেয়ে মনে হয় নি। রুবী ফোনের কথা বলতে ভাবল, কে আবার ফোন করল? বিরক্ত হলেও উঠে এসে রিসিভার তুলে বলল, শাওন বলছি।
সামিহা কি বলবে ভেবে না পেয়ে লজ্জায় কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
শাওন বিরক্ত কণ্ঠে বলল, কে আপনি? চুপ করে আছেন কেন?
সামিহা সালাম দিয়ে কোনো রকমে বলল, আমি সামিহা।
আনন্দে শাওনের কলজেটা লাফিয়ে উঠল। সালামের উত্তর দিতে ভুলে গেল। কি বলবে ভেবে পেল না। তাই চুপ করে রইল।
কি হল? কথা বলছেন না যে? ফোন করতে বিরক্ত হলেন? না আমাকে। চিনতে পারছেন না?
কোনোটাই নয়। এই ক’দিন আপনার ফোনের আশায় প্রহর গুনেছি। তবু । বিশ্বাস হচ্ছে না, আপনি ফোন করেছেন। ভেবেছি, আমাকে খারাপ ছেলে ভেবে……কথাটা শেষ না করে শাওন থেমে গেল।
থেমে গেলেন কেন? বাক্যটা পূরণ করুন।
কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।
এখন কী মনে হচ্ছে?
ভুল ভেবেছিলাম। কেমন আছেন?
ভালো। আপনি?
ভালো আর থাকতে দিলেন কই! আপনার হরিনীর মতো পটলচেরা চোখ, দুধে আলতা রং এর আপেলের মতো গোলগাল মুখ ও গোলাপী চিকন ঠোঁটের হাসি আমাকে পাগল করে রেখেছে।
সামিহা অনুচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল, আপনি কী সাহিত্যিক?
না।
তা হলে সাহিত্যিকের মতো মেয়েদের রূপের বর্ণনা করলেন যে?
মেয়েদের করি নি, করেছি আপনার। আপনাকে যেমন দেখেছি, তেমনি বর্ণনা করেছি। একটা অনুরোধ করব?
করুন।
আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছে।
চলে আসুন।
কোথায়?
বাসায়।
কখন?
ভীষণ ইচ্ছা করছে যখন, এক্ষুনি আসতে পারেন।
যেদিন আমি কার্ড দিয়েছিলাম, আপনি তো কিছু দেন নি। যাব কী করে?
দেওয়ার সময় তো আপনি দিলেন না। কার্ড দিয়েই চলে গেলেন। হাতের কাছে কাগজ-কলম আছে?
আছে।
ঠিকানা ও ফোন নাম্বার বলে সামিহা বলল, এবার রাখি তা হলে?
রাখুন।
সামিহা সালাম দিয়ে লাইন না কেটে রিসিভার ধরে রইল সালামের উত্তর শোনার জন্য।
অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, প্রথমেই সালাম দিয়েছিলাম, এখন আবার দিলাম। প্রতি উত্তর দেন নি। জানেন না? সালামের প্রতি উত্তর না দিলে গুনাহ হয়? তারপর রিসিভার ক্র্যান্ডেলে রেখে দিল।
রিসিভার রেখে শাওন ড্রেস চেঞ্জ করে গাড়ি নিয়ে রওয়ানা দিল। ট্রাফিক জ্যামে পড়ে সামিহাদের বাসায় আসতে পৌণে একঘন্টা লাগল।
সামিহা সিওর ছিল, শাওন এক্ষুনি আসবে। তাই দারোয়ানকে ডেকে বলে রেখেছিল, শাওন নামে কোনো ছেলে এলে যেন গেট খুলে দেয়।
শাওন গেট বন্ধ দেখে হর্ণ বাজাল।
দারোয়ান নাম জানার পর গেট খুলে দিল।
শাওন গাড়ি ভিতরে নিয়ে এসে বারান্দার কাছে পার্ক করল।
সামিহা এতক্ষণ দোতলার বারান্দার চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল। গাড়ির হর্ণ শুনে গেটের দিকে তাকিয়ে নিচে নেমে এল।
শাওন গাড়ি থেকে নেমে সামিহাকে দেখে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
শাওন নীল রং একদম পছন্দ করে না। কিন্তু নীল রং এর উপর সাদা সুতোর নক্সা করা সালোয়ার, কামিজ ও ওড়না গায়ে রূপসী সামিহাকে অতুলনীয় রূপসী দেখাচ্ছে।
তাকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সামিহা লজ্জা মিশ্রিত গলায় সালাম দিয়ে আসুন আমার সঙ্গে বলে হাঁটতে শুরু করল।
শাওন সালামের উত্তর দিয়ে তার পিছু নিল।
দোতলায় ড্রইংরুমে এসে সামিহা তাকে বসতে বলে নিজেও বসল।
শাওন বসে বলল, এতদিন ফোন করেন নি কেন?
সে কথা পরে, আগে বলুন, আপনি বন্ধু হতে চান, না প্রেমিক?
তার কথা শুনে শাওন খুব অবাক হল, অপলক নয়নে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো পর্দানশীন ঘরের মেয়ে যে প্রথম আলাপেই এরকম প্রশ্ন করতে পারে, তা ভাবতেই পারছে না।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সামিহা মৃদু হেসে বলল, আমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছেন না? তা হলে শুনুন।
ইসলামে সেয়ানা ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও মেলামেশা নিষিদ্ধ। প্রেমও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তবে দৈবক্রমে যদি কোনো ছেলেমেয়ে একে অপরকে দেখে বা অন্য কোনো কারণে পছন্দ করেই ফেলে অথবা একে অপরের মনে প্রেমের অঙ্কুর জন্মায়। তা হলে তারা তাদের মা-বাবাকে সেকথা জানাবে। মা-বাবা যা কিছু ভালো বুঝবেন করবেন। প্রেমের বেলায় ইসলাম এতটুকু কনসিডার করেছে। মা-বাবা যা সিদ্ধান্ত নেবেন, ছেলেমেয়েকে তা মেনে নিতে হবে। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কেন আপনাকে আসতে বলেছি।
শাওন বুঝতে পারল, সামিহা খুব বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী। বলল, ইসলামের বিধি নিষেধ যেমন আমি জানি না, তেমনি প্রেম সম্পর্কেও কিছুই জানি না। তবে একথা ঠিক, আপনাকে আমার এত পছন্দ হয়েছে যে, আপনাকে না পেলে হয়তো সারাজীবন অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাতেও পারব না।
আমারও তাই মনে হয়েছে বলে আপনার কার্ডটা মাকে দিয়ে খোঁজ নিতে বলেছিলাম। মা বাবার দ্বারা খোঁজ নিয়েছেন। ইতিবাচক সাড়া পেয়ে আপনাকে ফোন করে আসতে বলেছি। তবে আরো একটা কারণ আছে, তারপর সামিহা বাবার একটা কার্ড দিয়ে বলল, এটা আপনার মা-বাবাকে দিয়ে আমাদের খোঁজ খবর নিতে বলবেন। ওদের মতামত ইতিবাচক হলে এমন কিছু ব্যবস্থা আছে, যাতে আমরা মেলামেশা করতে পারব এবং পড়াশুনাও চালিয়ে যেতে পারব। আর শুনুন, মুসলমান হয়ে ইসলামের বিধি-নিষেধ জানেন না, তা কি করে হয়। ইসলামকে যারা জানে এবং সেইসব মেনে চলে তাকেই প্রকৃত মুসলমান বলে। “আল্লাহ সারাবিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র মালিক ও খালিক। তার কোনো অংশী নাই, তিনি সর্বশক্তিমান, তাঁর সমকক্ষ কেউ নাই। হজরত মুহাম্মদ (দঃ) তাঁর বান্দা ও রাসুল”, এগুলো বিশ্বাস করেন তো?
শাওন বলল, হ্যাঁ করি।
কুরআন যে আল্লাহর বাণী, তা বিশ্বাস করেন?
হ্যাঁ করি।
তা হলে এবার অবসর সময়ে কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ুন, আর বিধি-নিষেধ যা জানবেন, তা মেনে চলার চেষ্টা করবেন। কুরআনকে বিশ্বাস করেন, মানেন। অথচ তাতে যা বিধি-নিষেধ আছে, তা জানবেন না, মানবেন না, তা হলে কী কুরআনকে মানা হল? তাই বলছি, কুরআনকে জানতে হবে এবং যা জানবেন তা মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। নচেৎ আমার মন-মানসিকতার সঙ্গে আপনার মনমানসিকতা মিলবে না। ফলে বিয়ের পর আমাদের দাম্পত্য জীবনে অশান্তির আগুন জ্বলবে। আজ আর নয়, অনেকক্ষণ বকবক করে আপনাকে বিরক্ত করলাম, সেজন্য ক্ষমা চাইছি। তারপর আয়াকে ডেকে চা-নাস্তা দিতে বলল।
চা-নাস্তা খেয়ে বিদায় নেওয়ার সময় শাওন বলল, আমার আসার ব্যাপারটা আপনার মা-বাবা জানেন?
সামিহা বলল, না। চলুন এগিয়ে দিই।
শাওন গাড়িতে উঠার পর সামিহা সালাম বিনিময় করে বলল, ফোন করবেন, আমিও করব।
.
তারপর তিন মাসের মধ্যে তাদের গার্জেনরা কাবিন করে ফেলেন। কথা হয়েছে, সামিহার ডিগ্রী পরীক্ষার পর শাওনের বাবা বৌ ঘরে তুলবেন। কাবিন হলেও তারা বেশি মেলামেশা করে না। যে যার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে প্রতিদিন রাতে ঘুমোবার আগে আধঘণ্টা ফোনে আলাপ করে। আর মাঝে মাঝে শাওন সামিহাদের বাসায় গিয়ে তাকে নিয়ে বেড়াতে যায়।
এইসব ভাবতে ভাবতে গাড়ি কখন বাসায় পৌঁছে গেছে সামিহা জানতে পারে নি। ড্রাইভার নামার কথা বললে বাস্তবে ফিরে এসে গাড়ি থেকে নামল।
.
ঐদিন আরমান নাজনীনের খোঁজে কলেজের গেটের অল্প দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দিকে লক্ষ্য করছিল, হঠাৎ একটা মেয়ের দিকে নজর পড়তে চমকে উঠে ভাবল, মেয়েটা হুবহু নাসরীনের মতো। ও নিশ্চয়ই নাজনীন। তাই একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়েছিল।
পরের দিন বাসা চেনার জন্য ঐ সময়ে একটা স্কুটারে করে এসে ড্রাইভারকে সামিহাদের গাড়ির পাশে রাখতে বলল।
সামিহা আজ গেট থেকে বেরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে গতকালের ছেলেটাকে দেখতে পেল না। গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় তাকে স্কুটারে বসে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে যেমন অবাক হল, তেমনি রেগেও গেল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করলে, চিন্তা করতে লাগল, ছেলেটার উদ্দেশ্য কি? আমার রূপে মুগ্ধ? না অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য? তারপর মনে মনে হেসে ফেলে ভাবল, রূপে মুগ্ধ হলে যখন জানবে আমি বিবাহিত তখন বেচারা পস্তাবে। আর যদি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, তা হলে কপালে দুর্ভোগ আছে।
কিছুদূর আসার পর ড্রাইভার বলল, মামণি, একটা স্কুটার আমাদের গাড়িকে ফলো করে আসছে।
সামিহা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে একটা প্ল্যান ঠিক করে বলল, আসতে দিন, দেখা যাক কতদূর আসে। গাড়ি যখন বাসার গেটে এল তখন সামিহা পেছন ফিরে দেখল, বেশ কিছুটা দূরে স্কুটারটা দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে আরোহীকে চিনতে না পারলেও অনুমান করল, নিশ্চয় ঐ ছেলেটা।
ভিতরে গাড়ি পার্ক করার পর ড্রাইভার বলল, স্কুটারটা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে দেখলাম।
সামিহা বলল, ঠিক আছে, আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু ভাবতে হবে না। আর কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, যা করার আমি করব।
রাতে ফোন করে শাওনকে ঘটনাটা জানাল।
শাওন বলল, তাই না কি?
হ্যাঁ তাই, এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি?
আপাতত কোনো মতামত নেই। এই দু’দিন ছেলেটা যা করেছে, তাতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তোমার যা রূপ, তোমাকে দেখলে যে কোনো ছেলে মুগ্ধ হবেই। ঐ ছেলেটা হয়তো তোমার রূপে মুগ্ধ হয়েছে এবং তোমাদের বাসার ঠিকানা জানতে গিয়েছিল মা-বাবাকে ঠিকানা জানিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে বলে।
সামিহা অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, তুমি সবটাতে রসিকতা কর। একটু সিরিয়াসলি চিন্তা কর, যদি ছেলেটার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকে? যদি আমাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে চায়, অথবা অন্য কিছু…….কথাটা শেষ না । করে থেমে গেল।
আরে না, যারা হাইজ্যাক করে তারা ওভাবে কোনো মেয়েকে ফলো করে না। শোন, এবার থেকে মুখ খোলা রাখবে না? নেকাব দিয়ে ঢেকে রাখবে। এরপরও যদি ছেলেটা তোমাকে ফলো করে, তা হলে যা করার করব। এবার তোমাকে একটা কবিতা শোনাই, একটু আগে লিখেছি।
বেশ তো শোনাও।
ওগো মোর রূপসী প্রিয়তমা,
যদি জানতাম প্রেমে এত জ্বালা,
তা হলে কভু কি ঐ পথ পাড়াতাম?
একেবারে বিয়ে করে ঘরে তুলতাম।
ইচ্ছা হয় সব বাধা-বিপত্তি ঠেলে,
এক্ষুনি মিলিত হই তোমার সনে।
তারপর দু’জনে মেলে দিয়ে ডানা,
উড়ে যাব আকাশে নেই ঠিকানা।
যখন ক্লান্ত হব ডানা নেড়ে নেড়ে,
তখন ফিরিয়া আসিব ধরণীর বুকে।
সামিহা মারহাবা মারহাবা বলে বলল, কবিতাটা অদ্ভুত হয়েছে। আমারও ইচ্ছা করছে, এরকম একটা কবিতা লিখে তোমাকে শোনাতে।
তা হলে রাখি। কবিতাটা লেখ, কাল শোনাবে।
সামিহা হেসে উঠে বলল, আমি কি আর তোমার মতো ছন্দ করে লিখতে পারব? না অত সুন্দর করে?
সুন্দর হবে কিনা সে বিচার আমি করব। আর ছন্দ করে যে লিখতে হবে, তাও ঠিক বল নি। আজকালের কবিরা তো ছন্দ, মানে গদ্য কবিতা লিখছেন এবং পাঠকদের কাছে সমাদরও পাচ্ছেন।
আমি গদ্য কবিতা একদম পছন্দ করি না। কবিতায় যদি ছন্দ না থাকল, তা হলে কবিতা বলে মনেই হয় না।
তুমি যে দেখছি আমারই মতো। আমিও গদ্য কবিতা একদম পছন্দ করি না। ঠিক আছে, তোমার যা মনে আসে তাই লেখ, ছন্দ না মিললেও আমার ভালো লাগবে। এবার রাখি কেমন?
সামিহা সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
.
আরমান সামিহাদের গাড়ি ফলো করে বাসা চিনে আসার পরের দিন তাকে নেকাবে মুখ ঢেকে গাড়ির দিকে যেতে দেখে ভাবল, নাজনীন তাকে অন্যরকম কিছু ভেবেছে। ভুল ভাঙাবার জন্য তার সামনে এগিয়ে এসে সালাম দিল।
ছেলেটার সাহস দেখে সামিহা খুব রেগে গেল। বলল, বেগানা কারো সালামের উত্তর আমি দিই না। কে আপনি? কয়েকদিন আমাকে ফলো করেছেন। কেন?
নাজনীন ও নাসরিন যে শুধু দেখতে একই রকম তাই না, তাদের গলার আওয়াজও একই রকম। তাই সামিহার কথা শুনে অনেকটা সিওর হল, এই-ই। নাজনীন। বলল, প্লীজ, মুখের নেকাবটা একটু সরাবেন?
সামিহা রাগ সামলাতে পারল না, ঠাস করে তার গালে একটা চড় মেরে কর্কশ কণ্ঠে বলল, যতসব ছোটলোকের ছেলেদের কারণে মেয়েদের কোথাও একটু নিরাপত্তা নেই।
আশেপাশে অনেক ছেলে মেয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে তিন-চারজন ছেলে মেয়েদের কাছে বাহবা পাওয়ার জন্য এগিয়ে এল। তারা সামিহাকে চেনে। ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে জিজ্ঞেস করল। কী ব্যাপার চাচা?
ড্রাইভার আরমানকে দেখিয়ে বলল, ঐ ছেলেটা তিন-চারদিন মামণিকে ফলো করছে। আজ আবার কাছে এসে মুখের নেকাব সরাতে বলছে।
তাই না কি? বলে ছেলে তিনটে আরমানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কীল, চড়, ঘুষি মারতে লাগল। তাদের সঙ্গে আরো অনেকে যোগ দিল।
আরমান তাদেরকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করল; কিন্তু তারা তার কথায় কান দিল না। মারতে মারতে যখন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল, তখন সবাই কেটে পড়ল।
জিয়াদ নামে একটা ছাত্র আরমানকে একজন ভালো ক্রিকেটার হিসাবে চেনে। আবাহনী দলে তাকে খেলতে দেখেছে। সেই কথা বলে সাথীদের থামাবার অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারে নি। সবাই চলে যাওয়ার পর আরমানকে একটা রিকশায় তুলে মেডিকেলে নিয়ে গেল।
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আরমান বুঝতে পারল, সে মেডিকেলের বেডে। বই খাতা হাতে একটা ছেলেকে দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
জিয়াদ বলল, আমি ঐ কলেজের ছাত্র। আপনাকে চিনি। সবাই যখন মারছিল তখন অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারি নি। আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আমি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি।
আল্লাহ্ আপনাকে এর জন্য পুরস্কার দেবেন। আপনি এবার বাসায় যান।
আপনাদের বাসায় ফোন নাম্বার থাকলে দিন। খবরটা জানাব। না থাকলে টিকান দিন আমি যাব।
আরমান তাকে ফোন নাম্বার লিখে নিতে বলে বলল, ফোন করে শাওনকে চাইবেন। ধরলে তাকে আসতে বলবেন।
জিয়াদ মেডিকেল থেকে ফোন করতে চাইল। ফোন খারাপ জেনে বাসায় এসে ফোন করল।
ফোন ধরল রুবী?
জিয়াদ বলল, এটা শাওনদের বাসা?
হ্যাঁ, আপনি কে?
আমাকে চিনবেন না, শাওনকে দিন।
ওতো বাসায় নেই। কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। আমি ওর বোন।
আরমান এক দুর্ঘটনায় পড়ে মেডিকেলে আছেন। উনি শাওনকে আসতে বলেছেন।
রুবী চমকে উঠে আতঙ্কিত স্বরে বলল, উনি এখন কেমন আছেন?
জ্ঞান ফিরেছে, তবে বাসায় ফিরতে কয়েকদিন সময় লাগবে।
ঠিক আছে, শাওন ফিরলেই জানাব। তারপর লাইন কেটে দিল।
লাইন কেটে দেওয়ার সাথে সাথে আবার রিং বেজে উঠতে রুবী রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো।
সামিহা সালাম দিয়ে বলল, কে? রুবী?
রুবী সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, তারপর বলল, ভাবি কেমন আছ?
আল্লাহর রহমতে ভালো। তোমার ভাইয়া কোথায়? তাকে দাও।
এ সময় তাকে চাচ্ছ কেন? তোমাদের অভিসার তো গভীর রাতে ফোনে হয়।
দেখ, দুষ্টুমী করবে না, ওকে দাও। খুব দরকারী কথা আছে।
দরকারী কথাটা আমাকে বলা যায় না?
প্লীজ রুবী, দুষ্টুমী করো না। কথাটা তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে জেনে নিও। সে যদি না বলে, আমি তোমাকে বলব।
ভাইয়া তো এখনো বাসায় ফিরে নি।
ফিরলেই আমার কাছে ফোন করতে বলবে।
ঠিক আছে বলব।
শাওন ঘণ্টাখানেক পরে ফিরলে রুবী বলল, ভাবি ফোন করেছিল। কি যেন একটা খুব দরকারী কথা আছে। তাই ফিরলেই ফোন করতে বলেছে।
সামিহাকে দিনে ফোন করতে নিষেধ করে দিয়েছে শাওন। রুবীর কথা শুনে ভাবল, দুষ্টুমী করছে। তাই বলল, তোকে বলেছি না, সামিহার ব্যাপারে কখনও গুল মারবি না?
কথাটা মনে আছে এবং তা মেনেও চলি। বললাম না, খুব দরকারী কী কথা বলবে বলে ফোন করেছিল? আমি জানতে চাইলে, তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে বলেছে। ও হ্যাঁ ভাবি ফোন করার আগে একটা ছেলে ফোন করেছিল, বলল, আরমান দুর্ঘটনায় পড়ে মেডিকেলে আছে। তোমাকে যেতে বলেছে।
কথাটা শুনে শাওনও আতঙ্কিত হয়ে বলল, আমি মেডিকেলে যাচ্ছি, মাকে বলিস ফিরতে দেরি হতে পারে।
রুবী বলল, না, আগে ভাবিকে ফোন কর। ততক্ষণে তৈরি হয়ে নিই, আমিও তোর সাথে যাব।
শাওন বলল, যা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়, আমি তোর ভাবিকে ফোন করে “ আসছি।
শাওন ফোন করতে সামিহা কলেজের ঘটনাটা বলে বলল, একজনকে বলতে শুনলাম, ছেলেটার নাম আরমান, আবাহনী ক্রিকেট দলে খেলে।
আরমানের নাম শুনে চমকে উঠে শাওন ভাবল, ওর মতো ছেলে সামিহার পেছনে লেগেছে? কথাটা শাওন বিশ্বাস করতে পারল না। বলল, তুমি ঠিক শুনেছ, ছেলেটার নাম আরমান?
একটা ছেলে তো তাই বলল, সেই ছেলেটাই তাকে রিকশায় তুলে মনে হয় মেডিকেলে নিয়ে গেছে। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি ওকে চেন?
শাওন তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, এখন আর সময় দিতে পারছি না। রাতে কথা হবে, একটা জরুরী কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে। তারপর তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রিসিভার ক্র্যাণ্ডেলে রেখে বেরিয়ে এল।
রুবী তৈরি হয়ে ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল, তাকে চিন্তিত দেখে বলল, কোনো দুঃসংবাদ?
শাওন বলল, তেমন কিছু নয়, পরে শুনিস, এখন মেডিকেলে যাই চল।
ভাইয়ার গম্ভীর মুখ দেখে রুবী তখন কিছু বলল না। গাড়িতে উঠে বলল, ভাবি কি এমন কথা বলল, যা শুনে তোকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে?
শাওন আরমানের দুর্ঘটনায় পড়ার কারণ বলে বলল, আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, ওর মতো ছেলে সামিহার পিছনে লাগবে।
রুবী অবাক হয়ে বলল, এ তুই কি বলছিস? আমিও তো বিশ্বাস করতে পারছি না।
কিন্তু সামিহা তো আর মিথ্যে বলবে না?
হ্যাঁ, তাতো বটেই।
কি জানিস, দুনিয়াতে মানুষ চেনা খুব কঠিন। ওর গুণ দেখে ওকে বন্ধু করেছিলাম, কিন্তু ও যে এত বড় লম্পট তা চিন্তাই করি নি। আমাদেরকে কি বলে দেখা যাক, তারপর যা করার করব।
দু’ভাইবোনকে দেখে আরমান খুব খুশী হল। বলল, জানেন শাওন ভাই, যে। ছেলেটা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে ও আপনাদের ফোন করে জানিয়েছে, সে যদি ঐ সময় ওখানে না থাকত, তা হলে হয়তো মারাই যেতাম।
শাওন কিভাবে কথাটা শুরু করবে ভাবতে লাগল।
ভাইয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে রুবী গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, দুর্ঘটনাটা ঘটল কিভাবে?
দু’জনের মুখ দেখে আরমান মনে করল, ওরা খুব আতঙ্কিত। বলল, আপনারা ভয় পাচ্ছেন কেন? ইনশাআল্লাহ্ দু’তিনদিনের মধ্যে আমি বাসায় ফিরতে পারব।
শাওনও গম্ভীর কণ্ঠে বলল, রুবী যা জিজ্ঞেস করল তার উত্তর দাও।
আরমান বলল, বাসায় ফিরে বলব, এখন খুব টায়ার্ড লাগছে।
শাওন রেগে উঠে বলল, না। আমাদের বাসায় তুমি আর ফিরে যাবে না। এখনই শুনতে চাই।
আরমান আহত স্বরে বলল, বাসায় ফিরে যাব না মানে?
তোমার মতো লম্পট ছেলের স্থান আমাদের বাসায় নেই।
এ আপনি কি বলছেন শাওন ভাই? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
তা বুঝবে কেন? কলেজ গেটে মেয়েদের টীজ করতে তোমার লজ্জা করে না? মনে করেছ আমরা কিছুই জানি না?
প্লীজ শাওন ভাই, এ রকম কথা আর বলবেন না। কি জেনেছেন সেটাই বলুন।
যা শুনেছি সেইটা তো বললাম, সামিহাকে চেনেন?
আরমান এবার বুঝতে পারল, যাকে সে নাজনীন মনে করেছে, তার নাম সামিহা ।
কী হল? কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?
না চিনি না।
তা হলে শোন, যে মেয়েটার পিছনে লাগতে গিয়ে তোমার এই অবস্থা, তার নাম সামিহা। তার পরিচয় শুনলে তোমার পীলে চমকে উঠবে। সামিহার সঙ্গে এক বছর আগে আমার কাবিন হয়ে আছে। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি ভেবে নিজেকে ঘৃণা হচ্ছে। তোমার মতো ছেলে মেয়েদের পিছনে লাগবে, ভাবতেই পারছি না। তোমার প্রতি আমার যে উচ্চ ধারণা ছিল, তা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছ। ছিঃ ছিঃ আরমান, তুমি একজন ধার্মিক ছেলে হয়ে এরকম কাজ করতে পারলে? তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে, এতক্ষণে তুমি লাশ হয়ে যেতে। তোমার কত প্রশংসা দাদু ও বাবা করেন, ওঁরা তোমাকে খুব ভালো ছেলে বলে জানেন। রুবীও তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর তুমি কিনা……তারপর কথাটা শেষ না করে রুবীর হাত ধরে বলল, চল, আর একমুহূর্ত এইখানে নয় বলে চলে যেতে লাগল।
আরমান চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, প্লীজ শাওন ভাই, আমাকে ভুল বুঝে চলে যাবেন না, আমার কথা শুনুন।
রুবী তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে বলল, তুমি এত নীচ, তা কল্পনাও করি নি। ছিঃ আরমান, ছিঃ, তারপর চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে শাওনকে অনুসরণ করল।
তাদেরকে রুমের বাইরে চলে যেতে দেখে আরমান ফুঁপিয়ে উঠল।
ফেরার সময় রুবী গাড়িতে চিন্তা করতে লাগল, গরিবের ছেলে মাত্রই কি বড়লোকের ঐশ্বর্যের প্রতি লোভী হয়? বাবার মতো আরমানও কি ভাবিকে বড়লোকের একমাত্র মেয়ে জেনে তার পিছনে লেগেছিল? ছিঃ ছিঃ, না জেনে আরমানকে মনে প্রাণে ভালবেসে কি অন্যায় না করেছি। ভাগ্যিস কথাটা তাকে জানাই নি। জানালে লজ্জায় আত্মহত্যা করতে হত।
বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মন খারাপ দেখে শাওন বলল, আরমানকে আমরা পাড়াগাঁয়ের খুব সহজ-সরল ছেলে ভেবে আপন করে নিয়েছিলাম, তাই না?
রুবী দীর্ঘনিশ্বাস গোপন করে বলল, হ্যাঁ তাই। তারপর বলল, ও যদি বাসায় আসে, তা হলে বাবাকে ঘটনাটা বলে। অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে বলব.।
শাওন বলল, তাতো বটেই। তবে ওর যদি সামান্যতম মানুষের চামড়া গায়ে থাকে, তা হলে আমাদের কিছু বলার আগে নিজেই চলে যাবে।
রুবী তখন ভাবছে ঐশ্বর্যের লোভে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে বক ধার্মিক সেজে আমাদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল। আমাদের ভাই আছে জেনে বড়লোকের একমাত্র মেয়ে সামিহার পিছনে লেগেছিল। তাই আমি ওর সঙ্গে মিশতে চাইলে, আমাকে ও এড়িয়ে চলে। সেদিন রাতে অত করে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে এখানে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলেও তা বলে নি।
শাওন বলল, কী রে রুবী? কী ভাবছিস?
ভাবছি, আরমানের ব্যাপারটা জানার পর মা সবাইকে একচোট নেবে, সে তো আরমানকে রাখার ব্যাপারে প্রথম থেকে চটা। বাবাকেই সব থেকে বেশি মায়ের বকুনি খেতে হবে। আর দাদু জানার পর খুব দুঃখ পাবেন।
হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস, আমরাই তাকে ড্রাইভারের রুম থেকে ট্রান্সফার করে গেস্টরুমে এনেছিলাম। মা তো আমাদেরকেই প্রথম বকুনি দেবে। শোন, এখন বাসায় কাউকেই কিছু জানান যাবে না। শুধু দাদুকে বলে গোপনে ওর বাসা থেকে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
নিজের অজান্তে রুবীর দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসছিল, সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ তাই করতে হবে।
আচ্ছা, তুই কি সঠিক জানিস, ও ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বি.এ. পাশ করেছে?
হ্যাঁ জানি। তারপর কিভাবে জেনেছে রুবী বলল।
শাওন বলল, মনে হয় কোনো বিশেষ কারণে সে কথা বাসায় সবার কাছে গোপন করেছে।
কারণটা তোকে বলে নি?
না, তবে সময় মতো বলবে বলেছিল। তাই তো তাকে বন্ধু করেছিলাম।
আমি জানতে চাইলে আমাকেও তাই বলেছিল।
তারপর আর কেউ কোনো কথা বলল না।
৮
তিনদিন পর আরমান মেডিকেল থেকে ছাড়া পেল। এই ক’দিন ভেবে ঠিক করে রেখেছে, কি করবে না করবে। তাই মেডিকেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে একটা মেসে থাকার ব্যবস্থা করল, তারপর শাওনকে ফোন করল।
ফোন ধরলেন শাওনের দাদা মকবুল হোসেন।
আরমান সালাম বিনিময় করে বলল, দাদু, এক দুর্ঘটনায় পড়ে এই ক’দিন মেডিকেলে ছিলাম। ছাড়া পেয়ে ফোন করছি। শাওন ভাইকে একটু দিন তো?
তা দিচ্ছি, কিন্তু তুমি দুর্ঘটনার কথা আমাদেরকে জানাওনি কেন? তোমার জন্য। আমরা উৎকণ্ঠায় ছিলাম।
সামান্য আঘাত পেয়েছিলাম। তাই আপনাদেরকে ঝামেলায় ফেলতে চাই নি।
শাওনকে চাচ্ছ কেন? বাসায় চলে এস।
বিশেষ কারণে এখন যেতে পারছি না। আপনি শাওন ভাইকে দিন?
ধর দিচ্ছি বলে মকবুল হোসেন রিসিভার রেখে বেরিয়ে গেলেন। বারান্দায় এসে রুবীকে দেখতে পেয়ে বললেন, আরমান এ্যাকসিডেন্ট করে এই ক’দিন মেডিকেলে ছিল, শাওনকে চাচ্ছে। ডেকে দে।
একটু পরে শাওন ফোন ধরে রাগের সঙ্গে বলল, ফোন করেছ কেন?
শাওন ভাই, সেদিন আমাকে ভুল বুঝে আমার কোনো কথা না শুনেই আপনারা চলে গেলেন। আমি কাকরাইল মসজিদের উত্তর দিকে রমনা পার্কের গেটে অপেক্ষা করব। আপনি যদি একটু আসতেন, তা হলে…….।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে শাওন বলল, আমরা তোমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। তুমি এক সময় এসে তোমার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যেও। এখানে তোমার আর জায়গা হবে না।
তা আমিও জানি। তবে আমি যে কোনো অন্যায় করি নি, তা প্রমাণ করে দেখাতে চাই।
তার আর কোনো প্রয়োজন নেই বলে শাওন লাইন কেটে দিল।
আরমান কি বলে শোনার জন্য শাওনের সঙ্গে রুবীও এসেছিল। লাইন কেটে দিতে জিজ্ঞেস করল, আরমান কি বলল?
আরমান যা বলেছে শাওন বলল। এমন সময় আবার ফোন বেজে উঠতে রুবী ফোন ধরতে আরমানের কথা শুনতে পেল। প্লীজ আরমান ভাই, আমাকে যদি সত্যিই একদিনও বন্ধু বলে স্বীকার করে থাকেন, তা হলে সেই বন্ধুত্বের দাবিতে শুধু একটা কথা বলব, আল্লাহর কসম, আমি এতটুকু অন্যায় করি নি। আমার কোনো কুমতলবও ছিল না। সে কথা জানাবার জন্য আপনাকে আসতে বলেছি। শোনার পরও যদি আমার কথা বিশ্বাস না করেন, তবু আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।
রুবী প্রচণ্ড ভালবেসে ফেলেছিল আরমানকে। কিন্তু সামিহাকে নিয়ে এই ঘটনার পর তাঁকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। জীবনে কখনও তার মুখ দেখবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। এখন তার কথা শুনে ভাবল, সত্য-মিথ্যা যাই বলুক না কেন, গিয়ে তাকে জুতো মেরে অপমান করবে।
কোনো সাড়া না পেয়ে আরমান মিনতি স্বরে বলল, শাওন ভাই, প্লীজ, আসুন।
রুবী বলল, আমি রুবী। ঠিক আছে, শাওন ও আমি আসছি। কোথায় যেতে হবে বলো।
আরমান জায়গাটার নাম বলল।
রুবী রিসিভার রেখে বলল, এই শাওন, চল যাই।
ঐ মিথুকের কাছে যেতে আমার ঘৃণা করে। ও যে আমাদের বাসায় থাকে সামিহা জানে না। জানার পর আমাদেরকে কি ভাববে বলতো?
আমি সহজে ছাড়ব না, ওর কথা শোনার পর ভাবির কাছে নিয়ে গিয়ে পায়ে ধরিয়ে মাফ চাওয়াব।
প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে গাড়ি নিয়ে দু’ভাই বোন রমনা পার্কের গেটে এল।
আরমানের তখনও কপালে ও বাম হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। তাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, পার্কের ভিতরে চলুন।
ভিতরে ঢুকে তিনজনে একটা গাছের তলায় ঘাসের উপর বসবার পর শাওন বলল, কি বলবে বল?
আরমান বলল, আমরা তিন ভাই বোন। আমি সবার বড়। বোন দুটো ছোট। তারা এক বছরের ছোট বড় হলেও দেখতে প্রায় একই রকম। শুধু তাই নয়, দু’জনের গলার আওয়াজও হুবহু এক। ছোটবেলায় বড় বোনটা হারিয়ে যায়। তারপর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। আমার বয়স তখন দশ। বড় হওয়ার পর আমার কেবলই মনে হয়, ঢাকায় কোনো লোক তাকে চুরি করে নিয়ে এসেছে। অথবা কোনো দুষ্টলোক চুরি করে ঢাকায় কারো কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
একদিন কলেজের সামনে দিয়ে আসার সময় ওঁকে দেখে চমকে উঠি। মনে হল, ঠিক যেন আমার হারানো বোন নাজনীন।
রুবী বলল, আপনি তো বললেন, নাজনীন যখন হারিয়ে যায় তখন আপনার বয়স দশ । তা হলে তো নাজনীন আরো ছোট ছিল। তার ছবি আপনার মনে থাকার কথা নয়?
আপনার কথাটা ঠিক। কিন্তু একটু আগে বললাম না, ছোট বোন নাসরীনের মতো দেখতে নাজনীন? তার গলার আওয়াজও একই রকম।
শাওন বলল, যদি বলি নিজের দোষ এড়াবার জন্য এসব কথা বলছ?
আরমান পকেট থেকে একটা ফটো বের করে বলল, এটা নাসরীনের।
ফটোটার দিকে তারা দু’জনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল।
আরমান বলল, এটা বছর খানেক আগে তোলা।
দু’ভাই বোনই নাসরিনের ফটো দেখে খুব অবাক হল। তারা সামিহার সঙ্গে কোনো তফাৎ দেখতে পেল না।
তাদেরকে চুপ করে থাকতে দেখে আরমান আবার বলল, যদি আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করতে না পারেন, তা হলে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলুন, সত্য মিথ্যা প্রমাণ পাবেন।
শাওন রুবীকে বলল, আল্লাহর কি মহিমা, সামিহার সঙ্গে পাড়াগাঁয়ের নাসরিনের কি অদ্ভুত মিল।
রুবী বলল, আরমানের কথা সত্য হলে ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভূত।
শাওন কিছুক্ষণ চিন্তা করে আরমানকে বলল, ঠিক আছে, আমি একদিন তোমাদের গ্রামের বাড়িতে যাব। এখন তুমি আমাদের বাসায় চল।
আরমান বলল, তা আর সম্ভব নয় শাওন ভাই।
কেন?
আপনারা আমাকে যা সাহায্য সহযোগিতা করেছেন, সেজন্য আমি আপনাদের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকব। সেই ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না। তবু এখন যেতে পারব না। তবে আমি কোনোদিন যদি আমার নির্দোষিতা প্রমাণ করতে পারি, তখন গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসব। আর একটা কথা বলব, আপনারা ভুলেও ভাববেন না, আমাকে অপমান করেছেন বলে আপনাদের বাসায় যেতে চাচ্ছি না। কেন চাচ্ছি না। সেকথা বলতে পারব না। পাড়াগাঁয়ের গরিবের ছেলে, শহরের বড়লোকদের সামাজিক আচার-আচরণ কিছুই জানি না। যদি কোনো ভুলত্রুটি করে থাকি দয়া করে মাফ করে দেবেন।
ছবি দেখেও আরমানের কথা শুনে রুবীর মনের কয়লা ধূয়ে সাফ হয়ে গেছে। আরমানের প্রতিটা কথা বিশ্বাস করেছে। শাওন তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে খুশী হয়েছিল। আরমান না করে দিতে খুশীর জায়গায় বিষাদে ছেয়ে গেল। বলল, আমরা আপনার গ্রামের বাড়িতে যাব কার সঙ্গে?
আরমান বলল, কেন? আমার সঙ্গে যাবেন, তারপর একটা কাগজে ঠিকানা লিখে শাওনের হাতে দিয়ে বলল, এখানে আমাকে পাবেন। আপনারা এবার আসুন, আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে বলে আরমান দাঁড়িয়ে পড়ল।
শাওনও দাঁড়িয়ে রুবীকে বলল, চল, আমরা যাই।
রুবী দাঁড়িয়ে একবার করুণ দৃষ্টিতে আরমানের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ চল।
ফেরার পথে গাড়িতে শাওন রুবীকে বলল,তুই আরমানের সঙ্গে আপনি করে কথা বলছিলি কেন?
রুবী বলল, উনি একজন কুরআনের হাফেজ ও গ্র্যাজুয়েট। তা ছাড়া বয়সে বড় ও তোমার বন্ধু, আপনি করে বলাই তো উচিত।
শাওন বলল, তোর যুক্তি ঠিক। আচ্ছা, আরমান যা বলল, তা কি সত্য বলে মনে হয়?
তোর কি মনে হয়?
সত্য মিথ্যা কোনোটাই সিওর হতে পারছি না। এবার তোরটা বল।
আমারও তোর মতো। একদিন বাসায় কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে ওঁর গ্রামের বাড়িতে যাই চল। তা হলে সত্য মিথ্যা জানা যাবে।
তুই আবার যাবি কেন? আমি একা যাব।
আমি গেলে তোর অসুবিধা কিসের? যাব বলেছি যখন যাবই।
শাওন ছোটবোনের জিদ জানে। তাই বলল, ঠিক আছে, তাই যাস।
.
মকবুল হোসেন বারান্দায় বসেছিলেন, দু’ভাই বোনকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলি?
শাওন বলল, এক বন্ধুর বাসায়।
আরমান ফোনে কি বলল?
ও আর এখানে থাকবে না। কোথায় যেন থাকার ব্যবস্থা করেছে। একদিন এসে দেখা করে যাবে বলেছে।
মকবুল হোসেনের কেমন যেন সন্দেহ হল, বললেন, এ্যাকসিডেন্ট করে তিন দিন হাসপাতালে ছিল অথচ আমাদেরকে জানাল না। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এখানে এল না। অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করেছে। এ্যাকসিডেন্টের আগে তোরা দু’জনে ওকে চলে যেতে বলিস নি তো?
শাওন বলল, দাদু কি যে বলেন, আমরা ওকে চলে যেতে বলব কেন? আপনি শুধু শুধু আমাদেরকে সন্দেহ করছেন?
হয়তো সন্দেহটা আমার অমূলক। যাও, তোমরা ভেতরে যাও।
মকবুল হোসেনের মন থেকে সন্দেহটা গেল না। নাতনি যে আরমানের প্রতি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে, তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করে সন্দেহটা দূর করার জন্য এক সময় রুবীকে ডেকে বললেন, তখন শাওন যা বলল, তা বিশ্বাস করতে পারি নি। সত্যি করে বল তো, তোরা তাকে কিছু বলেছিস কিনা?
রুবী বলল আরমান এমন একটা কাজ করেছে, যে জন্য আমরা তাকে যা তা বলে অপমান করেছি।
কি করেছে, বলতো শুনি।
বলবে কিনা রুবী চিন্তা করতে লাগল।
চিন্তা করছিস কেন? নিশ্চিন্তে বল, আমি তোদেরকে কিছু বলব না।
রুবী সবকিছু খুলে বলল।
মকবুল হোসেনের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ করে থেকে বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আরমান সত্য কথা বলেছে। সামিহার সঙ্গে আরমানের বোনের হুবহু মিলের কথা যা বললি, তা হতে পারে। এটা একটা দৈব ব্যাপার। এরকম একটা ঘটনা অনেক বছর আগে পেপারে পড়েছিলাম। পেপারে মেয়ে দুটোর ফটোও ছাপা হয়েছিল। তোর কথা শুনে আমার কিন্তু আর একটা ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে?
বলুন কি সন্দেহ হচ্ছে।
সামিহা সত্যি সত্যি আরমানের হারানো বোনও হতে পারে।
হঠাৎ এরকম সন্দেহ হল কেন?
পেপারে যে দুটো মেয়ের খবর পড়েছিলাম, তারা কিন্তু আসলে যমজ বোন। ছিল। তাদের একজনকে খুব ছোটবেলায় এক দুস্কৃতকারী চুরি করে শহরের এক নিঃসন্তান দম্পত্তির কাছে স্ত্রী মারা গেছে বলে নিজের মেয়ের পরিচয় দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল।
কিন্তু ভাবিতো তালই মাওই এর একমাত্র সন্তান। আপনার সন্দেহ অমূলক নয় কি?
হ্যাঁ, তা হতে পারে। তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে মকবুল হোসেন বললেন, আরমানের ব্যাপারে শাওনের ভুল করা স্বাভাবিক, কিন্তু তুই ভুল করলি কেন?
আমি আবার কি ভুল করলাম?
আরমানকে সন্দেহ করে ও অপমান করে।
রুবী চুপ করে রইল।
ভুলটা এখন ধরতে না পারলেও পরে ঠিক পারবি। যাক গে, আমার মনে হয়, আরমানের গ্রামের বাড়িতে শাওনের যাওয়াই উচিত।
শাওন তো যাবেই বলেছে, ভেবেছি আমিও ওর সঙ্গে যাব।
মকবুল হোসেনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বললেন, আমারও যেতে ইচ্ছা করছে।
রুবী হেসে উঠে বলল, ধেৎ, ইচ্ছা হচ্ছে না হাতি। তারপর সেখান থেকে চলে গেল।
৯
শাওন রাতে সামিহার সঙ্গে ফোনে আলাপ করার সময় বলল, তোমার কাছে। কলেজের গেটে ঘটে যাওয়ার ঘটনা শুনে আমি ও রুবী মেডিকেলে ছেলেটার সঙ্গে দেখা করি। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই শুনেছ। ছেলেটার নাম আরমান। বাবার গ্রামের বাড়ির পাশের গ্রামের ছেলে। আবাহনী ক্রিকেট দলে খেলে। তার একবোন ছোটবেলায় হারিয়ে গেছে। তুমি না কি ঠিক তার হারিয়ে যাওয়া বোনের মতো। তাই তোমাকে ফলো করত এবং ঐদিন তোমাকে মুখের নেকাব সরাতে বলেছিল।
সামিহা অবাক কণ্ঠে বলল, ওমা, তাই নাকি? খুব আশ্চর্যের ব্যাপার তো?
হ্যাঁ, খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। তবে আমি তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি নি। তাই প্রমাণ দেখাতে বলেছি। আরমান প্রমাণ দেখাতে রাজি হয়ে বলল, হারানো বোনের এক বছরের ছোট একটা বোন আছে। দু’জনে নাকি হুবহু একই রকম দেখতে এবং দু’জনের গলার আওয়াজও একই রকম। সত্য মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য আমাকে তাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাবে।
তা হলে তো ওর কথা সত্য বলেই মনে হচ্ছে। আমারও যেতে খুব ইচ্ছা করছে। নিয়ে যাবে আমাকে?
নিয়ে যাবে কিনা শাওন চিন্তা করতে লাগল।
কী হল? চুপ করে আছ কেন? আমি কখনও পাড়াগাঁয়ে যাই নি। পাড়াগাঁ সম্বন্ধে বই পুস্তক ও পত্র পত্রিকায় যা পড়েছি। জেনেছি, পাড়াগাঁয়ের গরীব মানুষেরা খুব সহজ-সরল। বল না নিয়ে যাবে কিনা?
আমার কোনো আপত্তি নেই, বরং খুব খুশী হব। আমিও কখনো পাড়াগাঁয়ে যাই নি। ওখানের পরিবেশও নাকি খুব সুন্দর। যা আমরা নভেল নাটকে পড়ে থাকি, আর সিনেমা ও টিভিতে দেখে থাকি। কিন্তু তোমার মা বাবা যা কড়া মানুষ, আমার সঙ্গে যেতে দেবেন কি?
তুমি কি তোমার মা বাবাকে সত্য কথা বলে যাবে?
না বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে যাব।
আমিও ঐ কথা বলে মা বাবাকে রাজি করাব। ও নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। নিয়ে যাবে কিনা বল।
তোমাকে কিন্তু আর একটা কথা বলা হয়নি, রুবীও আমার সঙ্গে যাবে।
সামিহা হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, তা হলে তো দারুণ জমবে। তা কবে যাওয়ার মনস্থ করেছ?
মাস খানেকের মধ্যে রুবীর পরীক্ষা শেষ হবে। তারপর যাব। তোমারও তো পরীক্ষা চলছে?
আমার খুব খারাপ লাগছে।
কী ব্যাপার? হঠাৎ খারাপ লাগছে কেন? এনিথিং রং?
না তা নয়, সেদিন আরমানকে অপমান করার ও মারার দৃশ্যটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তার কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে খুব দুঃখের বিষয় নয় কি?
সত্য হলে অবশ্যই দুঃখের বিষয়। আমরা তো ওর গ্রামের বাড়ীতে যাচ্ছি, সত্য হলে মাফ চেয়ে নেব।
তুমি মাফ চাইবে কেন?
দেখা করতে গিয়ে তাকে আমি ও রুবী যা তা বলে অপমান করেছি। অনেক রাত হয়েছে, এবার রাখি কেমন?
আমি কিন্তু ঐ কথা বলে মা-বাবাকে রাজি করিয়ে রাখব। তারপর সালাম বিনিময় করে সামিহা লাইন কেটে দিল।
রুবী রাত দুটো পর্যন্ত পরীক্ষার পড়া তৈরি করে ঘুমাতে গেল, কিন্তু চোখে ঘুম এল না। চোখ বন্ধ করতেই আরমানের মলিন মুখটা মনে পড়ছে। তাকে। ভালোবেসে ও তার সঙ্গে কুরআন হাদিসের আলোচনা করে রুবীর চলার পথে পরিবর্তন এসেছে। ইসলামকে জানার যেমন প্রেরণা পেয়েছে, তেমনি সবটা না, পারলেও কিছু কিছু মেনেও চলছে। সামিহা ভাবিকে নিয়ে ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর থেকে তার মনে যে অশান্তির আগুন জ্বলছিল। আজ আরমানের কথাগুলো সে আগুনে পানি ঢেলে নিভিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অনুশোচনার আগুন জ্বলছে। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, তুমি যে আরমানকে এত ভালাবাস সে তো তা জানে না। কোনোদিন তো জানাবার চেষ্টাও কর নি। আর সেও তোমাকে ভালবাসে কিনা তাও জান না এবং জানার চেষ্টাও কর নি। তা ছাড়া তোমার মা না জেনে গরিবের ছেলেকে ভালবেসে বিয়ে করে আজও অনুতপ্ত। সে তো আরমানকে কিছুতেই জামাই করতে রাজি হবে না। তবুও তুমি আরমানকে ভালবাসলে কেন?
রুবী মনকে বোঝাল, বাবা বেকার ছিল। বিয়ের পর দাদু তাকে ব্যবসায় লাগিয়ে ঘরজামাই করে রেখেছেন। আরমান নাম করা একজন ক্রিকেটার। তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। সে তো আর ঘরজামাই হয়ে থাকবে না। তা ছাড়া সে যে রকম সেন্টিমেন্টাল ছেলে, শ্বশুর বাড়ির কারো সাহায্য নেবে না।
মন বলল, সব কিছুর আগে আরমান তোমাকে ভালবাসে কিনা জানা উচিত। সে যদি বড় লোকের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি না হয়? এমন ও তো হতে পারে, গ্রামের কোনো গরিব ঘরের মেয়েকে ভালবাসে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিল পরীক্ষাটা হয়ে যাক, তারপর ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে যদি আরমানের কথা সত্য প্রমাণিত হয়, তা হলে ক্ষমা চেয়ে তার মনের খবর নিয়ে নিজের মনের কথা জানাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল নিজেই জানতে পারল না।
.
আমজাদ সাহেব সংসারের কোনো ব্যাপারে লক্ষ্য রাখেন না, ব্যবসা নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকেন। আরমান যে বাসায় নেই,তাও জানেন না।
মকবুল হোসেন একদিন জামাইকে বললেন, আরমান যে মাসখানেক হল এখান থেকে চলে গেছে, সে খবর জান?
আমজাদ সাহেব বেশ অবাক হয়ে বললেন, তাই না কি? আমি তো কিছুই জানি না। ছেলেটা তো খুব অকৃতজ্ঞ? আমাদের সঙ্গে দেখা না করে চলে গেল।
মকবুল হোসেন বললেন, ছেলেটা কিন্তু অকৃতজ্ঞ নয়। তার সব কিছু এখানেই আছে। আমার মনে হয়, কোনো কারণে সে এখানে আসছে না। কারণটা দূর হয়ে গেলে নিশ্চয় ফিরে আসবে।
আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না বাবা।
বুঝতে হলে তোমাকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
আমজাদ সাহেব অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মনে হয় ঢাকার বাইরে। কোথাও ভালো চাকরি পেয়েছে।
তাও হতে পারে।
আমি একটু বাহিরে যাব বাবা।
ঠিক আছে যাও, আমিও সন্ধ্যা ভ্রমণে বেরোব।
.
রুবীর পরীক্ষা শেষ হতে আরো এক মাস লাগল। আরমানের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে পারল না রুবী। আরমান যখন ঠিকানা লিখে শাওনকে দেয় তখন সে দেখেছিল। বাসায় এসে লিখে রেখেছিল। একদিন বেলা তিনটের সময় ঠিকানা মতো এসে বুঝতে পারল, এটা একটা মেস। সব রুমের দরজায় তালা। শুধু একটা রুমের দরজা খোলা, সেটাতে পর্দা ঝুলছে। একজন কাজের মেয়েকে কলতলায় থালা-বাসন মাজতে দেখে জিজ্ঞেস করল, এখানে আরমান নামে একটা ছেলে কোন রুমে থাকে বলতে পার?
মেয়েটা বলল, ঐ যে দরজায় পর্দা ঝুলছে, এ রুমে থাকেন। উনি রুমেই আছেন, যান।
রুবী দরজার কাছে এসে ভাবল, আওয়াজ না দিয়ে ঢোকা কি উচিত হবে? তখন কিছুদিন আগে পড়া একটা হাদিসের কথা তার মনে পড়ল, “জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (দঃ) কে জিজ্ঞাসা করিল, আমি আমার মাতার কাছে যাওয়ার সময়ও কি অনুমতি চাইব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অনুমতি চাও। সে বলিল, ইয়া রাসুলুল্লাহ (দঃ) আমি তো আমার মাতার গৃহে বসবাস করি। তিনি বলিলেন, তবুও অনুমতি না নিয়ে গৃহে প্রবেশ করিও না। লোকটি আবার বলিল, ইয়া রাসুলুল্লাহ (দঃ) আমি তো সর্বদা তার কাছেই থাকি। তিনি বলিলেন, তবুও অনুমতি না নিয়ে গৃহে প্রবেশ করিও না। তুমি কি তোমার মাতাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখা পছন্দ কর? সে বলিল না। তিনি বলিলেন, তাই অনুমতি চাওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। কেননা গৃহে কোনো প্রয়োজনে তার অপ্রকাশযোগ্য কোনো অঙ্গ খোলা থাকিতে পারে। [বর্ণনায় : ইবনে ইয়াসার (রাঃ) মুয়াত্তা] হাদিসটা মনে পড়তে রুবী বলল, আসতে পারি?
আরমান পড়ছিল, হঠাৎ মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনে খুব অবাক হল। উঠে এসে পর্দা সরিয়ে সালাম দিয়ে বলল, আপনি?
রুবী সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ আমি। তারপর বলল, এখন তো রাত দুপুর না, ভিতরে আসতে পারি?
আরমান মৃদু হেসে বলল, আসুন। রুবী ভিতরে ঢুকে চৌকির উপর পা ঝুলিয়ে বসে বলল, কেমন আছেন?
আমার কথা বাদ দিন, আপনি কেমন আছেন? বাসায় সবাই ভালো আছেন?
হ্যাঁ, আমাদের সব খবর ভালো।
আশা করি, পরীক্ষা ভালোভাবে দিয়েছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কেমন আছেন বললেন না যে?
কথাটা এড়িয়ে গিয়ে আরমান বলল, আপনার পরীক্ষা তো শেষ হল। আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা নিশ্চয় জানতে এসেছেন?
সে কথা শাওন জানাবে। আমি এসেছি অন্য কারণে।
কারণটা বলুন।
তার আগে বলুন, কেন আপনার কথা বাদ দিতে বললেন?
একটা নগণ্য ছেলের ভালোমন্দ জেনে আপনার কী লাভ?
লাভ ক্ষতির হিসাব আমি করব, আপনি বলবেন না কেন?
কেন? উত্তরটা কী জানেন না?
জানি বলেই তো ক্ষমা চাইতে এলাম। তারপর কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে থেকে আরমানের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল, না জেনে, না বুঝে আপনার প্রতি আমি যে খুব খারাপ আচরণ করে ফেলেছি, তা ঐদিন রমনা পার্কে আপনার কথা শোনার পর বুঝতে পেরেছি। আমি আপনার সব কথা বিশ্বাস করেছি। তখনই ক্ষমা চাইতাম, কিন্তু শাওন ছিল বলে পারি নি। তারপর পরীক্ষার কারণে আসতে পারি নি। বলুন ক্ষমা করেছেন? কথা শেষ করে রুবী ফুঁপিয়ে উঠে ওড়নায় মুখ ঢাকল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আরমান বলল, হাদিসে পড়েছি, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে নিজের পাপের (অন্যায়ের) জন্য অনুতপ্ত, সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে, সে পাপ করে নাই।” [বর্ণনায় : হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) ইবনে মাযাহ] হাদিসটা বলার পর আরমান বলল, এবার নিশ্চয় ক্ষমা পেয়েছেন কিনা বুঝতে পেরেছেন?
রুবী চোখ মুছে ওড়না সরিয়ে বলল, আপনার কাছ থেকে এটাই আশা। করেছিলাম। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই, তিনি আমার আশা পূরণ করেছেন।
আরমান বলল, কী খাবেন বলুন, গরম না ঠাণ্ডা?
রুবী আদুরে গলায় বলল, আগে তুমি করে বলুন, তারপর বলব।
আরমান বড় হয়ে মায়ের কাছে চাচার অমানবিকতার কথা শুনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেমন করে হোক চাচাকে শিক্ষা দেবে। তাই বি.এ. পাশ করার পর একটা পরিকল্পনা করে তমিজউদ্দিন স্যারকে সেকথা জানিয়ে ঐভাবে চিঠি লিখিয়ে চাচার কাছে এসে উঠেছিল। তারপর রুবীকে তার প্রতি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়তে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাকে বিয়ে করে চাচার অমানবিকতার প্রতিশোধ নেবে। এখন তার আচরণ ও কথাবার্তায় বুঝতে পারল, রুবী তাকে ভীষণ ভালবেসে। ফেলেছে। তবু তাকে পরীক্ষা করার জন্য বলল, বলাটা কী উচিত হবে?
কেন হবে না? আমি তো বলতে বলছি?
আপনি বললে তো হবে না, আপনার গার্জেনদের অনুমতি থাকতে হবে।
রুবী বুঝতে পারল, আরমান তার মনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে এবং সেও তাকে ভালবাসে। বলল, ঐ সব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
নিশ্চয় ভাবতে হবে। আপনার বাবা অনুমতি দিলেও আপনার মা অনুমতি দেবেন না। তিনি যে গরিবদের খুব ঘৃণা করেন, তা আমি জানি।
রুবী খুব অবাক হয়ে বলল, মা বাবার ব্যাপারে তুমি জানলে কী করে?
আপনাদের সবাই-এর সবকিছু……।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রুবী করুণ স্বরে বলে উঠল, প্লীজ আরমান ভাই, আমি তোমাকে তুমি করে বলছি, তুমিও আমাকে তুমি করে বল। নচেৎ বলার পর কান্নায় তার গলা বুজে এল।
আপনি কি আমাকে সত্যিকার ভালবাসেন?
ভালোবাসার আবার মিথ্যে আছে না কি?
আরমান যা বোঝার বুঝে নিল। বলল, যা বলছি শুনুন, আমি আপনাদের সবার এমন অনেক কিছু জানি, যা আপনি জানেন না। আপনার মা কখনই আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবেন না। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি সবকিছু ত্যাগ করে আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারেন, তা হলে অন্য কথা।
রুবী বলল, তোমার কথাটা ঠিক। মা কিছুতেই আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবেন না। তাই আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি, আমি সবকিছু ত্যাগ করে তোমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকব।
আরমান মৃদু হেসে বলল, এটা আপনার আবেগ। আবেগের বশে কিছুদিন হয়তো গ্রামে থাকতে ভালো লাগবে। তারপর বাস্তব রূঢ়তায় আপনার মন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। তখন মনে হবে মস্তবড় ভুল করে ফেলেছেন। ঢাকায় ফিরে আসার জন্য ছটফট করবেন। আমার সঙ্গে আপনার দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরবে।
রুবী বলল, তোমার কথা অস্বীকার করতাম না, যদি না তোমাকে উপলক্ষ্য করে আল্লাহ্ আমাকে দ্বিনী শিক্ষা দিতেন। তোমাকে ভালবেসে আমি নিজেকে ও দ্বীনকে চিনেছি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না আরমান ভাই। যদি দাও, তা হলে কাল পেপারে আমার মৃত্যু সংবাদ পাবে।
আরমান তার কাছ থেকে এই কথাই শোনার আশা করছিল। খুশী হয়ে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, ছিঃ রুবী, ওরকম কথা মুখে উচ্চারণ করাও পাপ। বল, আর কখনও বলবে না?
আগে বল, তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না?
ফেরাবার কথা কী বলছে, তুমি চাইলে আজ এক্ষুনি কাজী অফিসে গিয়ে কাবিন করে ফেলতে পারি।
এই কথায় রুবী এত আনন্দিত হল যে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। কান্নাজড়িত স্বরে বলল, ইনশাআল্লাহ আমি রাজি।
তা হলে শোন, অনেকদিন আগে এক গভীর রাতে তুমি যে প্রশ্ন করেছিলে, তখন বলেছিলাম, পরে সময় মতো উত্তর দেব। এখন উত্তর দেওয়ার সময় হয়েছে। আমার কথা শোনার পরও যদি তোমার ভালবাসা অটুট থাকে, তা হলে ইনশাআল্লাহ এক্ষুনি তোমাকে কাজী অফিসে নিয়ে যাব।
রুবী বলল, বেশ তো উত্তরটা বলেই দেখ না।
আরমান বলল, তোমার বাবা আমার আপন ছোট চাচা।
রুবী চমকে উঠে বলল, কী বললে?
আরমান বলল, এতটুকু শুনেই চমকে উঠলে? সবটা শুনলে কী করবে?
রুবী বলল, যা করব তা দেখতে পাবে। বল, আমি সবটা শুনতে চাই।
চাচাকে কিভাবে মা বাবা উচ্চ শিক্ষা দিয়েছে ও চাচার অমানবিকতার আচরণ, বাবার মৃত্যুর কারণ ও কিভাবে মা চার বছরের নাজনীনকে বিক্রি করে ছেলে মেয়েদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে এবং তার ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য বলে, রুবীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তার চেহারার পরিবর্তন দেখার জন্য।
আরমানের কথা শুনতে শুনতে রুবীর চোখ থেকে পানি পড়ছিল। চোখ মুছে দাঁড়িয়ে তার একটা হাত ধরে বলল, এক্ষুনি কাজী অফিসে চল কাবিন করব।
তোমার ভালবাসার কাছে আমি হেরে গেলাম রুবী? এতদিন তোমাকে যতটুকু জেনেছিলাম, আজ তার থেকে আরো অনেক বেশি জানলাম। কাজী অফিসে যাওয়ার আগে ঠাণ্ডা গরম কিছু খেলে হত না?
রুবী হাসিমুখে বলল, এবার বিষ দিলেও খাব।
আরমান বলল, ছিঃ রুবী, আবার? একটু আগে এরকম বলতে নিষেধ করলাম ভুল হয়ে গেছে, আল্লাহ্ মাফ করুক, আর বলব না।
ঠিক আছে চল, আগে কাজী অফিসের কাজ সেরে ফেলি, তারপর খাওয়াব। শুনেছি, বিয়ের আগে বর কনেকে খেতে নেই, বিয়ের পর মিষ্টি মুখ করতে হয়।
কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে আরমান তাকে মিষ্টি মুখ করিয়ে বিদায় দিল।
বাসায় ফিরে রুবী শাওনকে বলল, আমার তো পরীক্ষা ক’দিন হল শেষ হয়েছে। এবার চল না আরমানদের গ্রামে যাই।
শাওন বলল, সামিহার আর দুটো পরীক্ষা বাকী আছে, ঐ দুটো হয়ে গেলে যাব।
ভাবির পরীক্ষার সাথে আমাদের যাওয়ার কী সম্পর্ক? তা ছাড়া আমরা তো থাকতে যাচ্ছি না। যে দিন যাব সেইদিনই ফিরব। যদি ফিরতে না পারি, পরের দিন ফিরব।
তাতো ফিরবই, কিন্তু তোর ভাবিও যে আমাদের সঙ্গে যেতে চাচ্ছে, এক সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা শেষ হবে, তারপর যাব।
ওমা, তুই তা হলে ভাবিকে কথাটা বলেছিস?
হ্যাঁ বলেছি, শুনে বলল, সেও আরমানদের গ্রামে যাবে এবং ঘটনা সত্য হলে তার কাছে ক্ষমা চাইবে।
রুবী উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, ভাবি গেলে দারুণ জমবে, তাই না?
জমবে তো বটেই, কিন্তু যদি দুই ফ্যামিলীতে জানাজানি হয়ে যায়, তা হলে কী ঘটবে চিন্তা করেছিস?
আমি দাদুকে সব কথা বলেছি, তিনিও ঘটনাটা যাচাই করার জন্য যেতে বললেন। যাওয়ার আগে তার সঙ্গে পরামর্শ করে যাব।
হ্যাঁ, তুই খুব ভালো কথা বলেছিস। ব্যাপারটা সবাই জেনে গেলে, দাদু যেন ম্যানেজ করেন, সে কথাও বলে রাখতে হবে।
১০
মকবুল হোসেন খুব উদার মনের মানুষ। কিন্তু তার স্ত্রী মুনসুরা বেগমের মন আত্মকেন্দ্রিক ও অহংকারী। মনসুরা বেগম উচ্চ ফ্যামিলীর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা। তাই বিয়ের পর স্বামীর উদারতার সুযোগে বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াতেন। তবে চরিত্রহীনতার মতো কোনো কাজ করতেন না। একমাত্র সন্তান সাজেদা বেগমকে নিজের মতো করে মানুষ করেছেন। সাজেদা বেগমও মায়ের মতো আত্মকেন্দ্রিক ও অহংকারী। ভাগ্যের ফেরে পাড়াগাঁয়ের গরিবের ছেলে আমজাদ সাহেবের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করে সারাজীবন আত্মতৃপ্তি পাননি। সাজেদা বেগম মেয়ে রুবীকে নিজের মতো করে মানুষ করলেও রুবী দাদা মকবুল হোসেনের মতো উদার মন পেয়েছে। তবে জীদটা পুরোপুরি মায়ের মতো। আর শাওন দাদার মতো সবকিছু পেয়েছে।
.
আজরাফ সাহেবের বাবার নামও মকবুল হোসেন। তিনিও ব্যবসায়ী ছিলেন। কোনো এক পার্টিতে পরিচয় হয়। দু’জনের একই নাম জেনে মিতা অর্থাৎ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আজরাফ সাহেবের বাবা হঠাৎ হার্ট এ্যাটার্ক হয়ে মারা যান। তখন আজরাফ সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে সুইডেনে ছিল। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে দেশে ফিরে আসেন।
একদিন তিনি মকবুল হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সে সময় মকবুল হোসেন জানতে পারেন তারা নিঃসন্তান। তারপর প্রায় পনের ষোল বছর পর যখন আজরাফ সাহেব এসে শাওন ও সামিহার সম্পর্কের কথা বলে কাবিন করার কথা বলেন তখন মকবুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের তো কোনো সন্তান হয়নি জানতাম, তা হলে কি পরে এই মেয়ে হয়েছে?
আজরাফ সাহেব বাবার বন্ধুকে মিথ্যে বলতে পারলেন না। সামিহাকে কিভাবে মেয়ে হিসাবে পেল, তা সব খুলে বললেন এবং মকবুল হোসেন সামিহার পৈত্রিক পরিচয় জানতে চাইলে তাও বললেন।
আমজাদ সাহেব জামাই হওয়ার পর মকবুল হোসেন তার পৈত্রিক পরিচয় নিয়েছিলেন। আজরাফ সাহেবের কাছে সামিহার পৈত্রিক পরিচয় শুনে জামাই এর উপর খুব অসন্তুষ্ট হলেন। মেয়ে জামাইকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য মনে মনে একটা প্ল্যান ঠিক করে আজরাফের প্রস্তাব গ্রহণ করে বললেন, সামিহার আসল পরিচয় আর কাউকেই বলবেন না। তারপর সামিহাকে বন্ধুর নাতনির পরিচয় দিয়ে মেয়ে জামাইকে শাওনের সঙ্গে কাবিন করে রাখার কথা বলেন।
আমজাদ সাহেব ও সাজেদা বেগম সানন্দে মকবুল হোসেনের কথা মতো কিছুদিনের মধ্যে কাবিন করে ফেলেন।
তারপর আরমান যখন জামাইয়ের গ্রামের বাড়ির পাশের গ্রাম পলাশপুর থেকে এসেছে শুনলেন তখন একদিন মকবুল হোসেন কৌশলে আরমানের পৈত্রিক পরিচয় জেনে নিয়ে আগের প্ল্যানের সঙ্গে আরো একটা প্ল্যান ঠিক করে কাজ শুরু করার মনস্থ করলেন এবং রুবী যাতে আরমানের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, সে জন্য তার সঙ্গে মেলামেশা করতে দেন। তাতেও তিনি সাকসেসফুল হন।
কিছুদিন আগে আরমান ও সামিহার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যা কিছু ঘটেছে, সেটাকে তিনি আল্লাহর ইশারা ভেবেছেন এবং রুবীকে পেপারে যমজ বোনের ঘটনাটা বানিয়ে বলেছেন।
কয়েকদিন আগে রুবী ও শাওন আরমানের গ্রামের বাড়ি যাবে শুনে, সামিহাকে তা জানিয়ে তাকেও তাদের সঙ্গে যেতে বলেছিলেন।
পরে সামিহা জানিয়েছে, শাওন তাকে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে এবং কিভাবে তারা যাবে তাও জানিয়েছে।
আজ মর্নিং ওয়াক করে এসে মকবুল হোসেন যখন ড্রইংরুমে পেপার পড়ছিলেন তখন শাওন ও রুবী এসে তার দু’পাশে বসল।
মকবুল হোসেন তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে পেপার পড়তেই থাকলেন।
শাওন দাদু বলে ডাকল।
বল কী বলতে এসেছিস।
রুবী বলল, আপনি পেপার পড়লে শুনবেন কেমন করে?
মকবুল হোসেন পেপার টেবিলের উপর রেখে বললেন, এবার বল।
শাওন বলল, রুবী তো আপনাকে আরমানদের গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারে বলেছে। আমরা মা বাবাকে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাব বলেছি। কিন্তু…..।
তাকে থামিয়ে দিয়ে মকবুল হোসেন বললেন, আর কোনো কিন্তু নয়, কালই তোমরা যাবে।
কিন্তু সামিহাও যেতে চাচ্ছে।
যেতে চাইলে যাবে, সে যদি তার মা বাবাকে ম্যানেজ করতে পারে, তা হলে তো কোনো অসুবিধে দেখছি না।
এবার রুবী বলল, পলাশপুরে যাওয়ার কথাটা যদি লিক আউট হয়ে যায়, তা হলে আপনাকে কিন্তু দুই ফ্যামিলীকে ম্যানেজ করতে হবে।
দাদু হেসে উঠে বললেন, সে ব্যাপারে তোদের কোনো ভয় নেই।
শাওন বলল, আমরা কখন ট্রেনে চাপিনি তো, তাই ট্রেনে যাওয়ার মনস্থ করেছি।
যাওয়া নিয়ে দরকার, সেটা ট্রেন, কার, বাস, অথবা প্লেনে হোক না কেন? তা এ ব্যাপারে আরমানের সঙ্গে কথা হয়েছে তো?
হয়েছে, এ্যাডভান্স টিকিটও কাটা হয়েছে।
ভেরী গুড। তা ফিরছ কবে?
আরমানের কথা যদি সত্য হয়, তা হলে গ্রাম দেখার জন্য দু’চারদিন থেকে যেতেও পারি।
তোমার জন্য ডবল ভালো, রুবী দাদুর জন্য ট্রিবল ভালো, আর সামিহা দাদুর জন্য ফোর টাইমস ভালো।
রুবী বলল, আপনার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
এখন বুঝতে না পারলেও পলাশপুরে গিয়ে ঠিকই বুঝতে পারবে। এবার তোমরা যাও, আমি হাত মুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট করব। ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।
দাদুর কথা বলার আর্ট দেখে দু’ভাই-বোন হাসতে হাসতে চলে গেল।
টিকিট কাটার দিন শাওন সামিহার অনুরোধে তাকে আরমানের মেসে নিয়ে এসে বলল, সামিহাও আমাদের সঙ্গে তোমার গ্রামের বাড়িতে যাবে।
সামিহা যাবে শুনে আরমান আনন্দে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। দীলে দীলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ভাবল, মা সামিহাকে দেখে খুশীতে কি করবে কি জানি।
তাকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে সামিহা বলল, আমি যাওয়ার কথা বলতে চুপ করে গেলেন যে!
আরমান বলল, মা আপনাকে দেখে খুশীতে কী করবে না করবে ভাবছিলাম। তারপর আপ্যায়ন করিয়া বিদায় দিল।
.
ষ্টেশনে নেমে তিন মাইল রিকশায় ও এক মাইল হেঁটে আরমানদের বাড়িতে পৌঁছাতে সে ছাড়া সবাইএর খুব খষ্ট হল।
সুফিয়া খাতুন আরমানের সঙ্গে তাদেরকে দেখে অবাক হলেন। সামিহা বোরখা পরে মুখে নেকাব দিয়ে রয়েছে। আর রুবী বড় চাদর দিয়ে মাথাসহ সারা শরীর ঢেকে রেখেছে।
আরমান সবার সঙ্গে মাও ছোট বোন নাসরিনের পরিচয় করিয়ে দিল।
সামিহা, রুবী ও শাওন নাসরিনকে দেখে এত অবাক হল যে, তার দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।
সুফিয়া খাতুন নাসরিনকে বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঘর থেকে পাটি এনে বারান্দায় বিছিয়ে দে, সবাই বসুক।
নাসরিন এক হাতে পাটি ও অন্য হাতে একটা চেয়ার এনে শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি চেয়ারে বসুন। তারপর পাটি বিছিয়ে দিয়ে সামিহা ও রুবীকে বলল, আপনারা এখানে বসুন।
তাকে দেখে ও তার গলার আওয়াজ হুবহু সামিহার মতো জেনে আরমানের সতোর প্রমাণ পেয়ে সামিহা ও শাওন খুব লজ্জা পেল।
তাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আরমান বলল, শাওন ভাই, আপনারা রেষ্ট নিন, নাস্তা পানি করুন, আমি এখন বাজারে যাব। তারপর শাওন ও রুবীকে দেখিয়ে মা ও বোনকে বলল, ঢাকার বিখ্যাত ব্যবসায়ী আমজাদ সাহেব, যিনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, ইনারা তার একমাত্র ছেলে ও মেয়ে। তারপর সামিহাকে দেখিয়ে বলল, ইনি হলেন আমজাদ সাহেবের ছেলের বৌ।
আমজাদ নাম শুনে সুফিয়া খাতুন চমকে উঠলেন, তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে নাসরিনকে বললেন, হ্যাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? লেবু দিয়ে সরবত করে নিয়ে আয়। আমি রান্নাঘরে নাস্তার জোগাড়ে যাচ্ছি। তারপর আরমানকে আসতে বলে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
আরমান মায়ের পিছনে ঘরে এসে ফিসফিস করে বলল, তুমি ঠিকানা না দিলেও আমি নাজনীনকে খুঁজে বের করেছি।
সুফিয়া খাতুন আনন্দে উফুল্ল হয়ে বললেন, নাজনীন কেমন আছে?
আল্লাহর রহমতে খুব ভালো আছে।
নাজনীন বা অন্য কেউ তোকে চিনতে পারে নি তো?
তুমি কি যে বল আম্মা, নাজনীনকে যখন ওঁদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলে তখন চার বছরের। আমাকে ও চিনবে কি করে? আর ওদের বাড়িতে তো আমি যাই নি। আল্লাহর কি মহিমা, নাজনীনের সঙ্গে আমজাদ চাচার ছেলে শাওর্নের কাবিন হয়েছে। দুজনেই এখন পড়াশুনা করছে। পরীক্ষার পর বৌ ঘরে তুলবে।
সুফিয়া খাতুন আবার উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, তবে যে তুই বললি, বোরখা পরা মেয়েটা আমজাদের ছেলের বৌ? তা হলে বোরখা পরা মেয়েটাই নাজনীন?
হ্যাঁ মা, ওরা নাজনীনের নাম পাল্টে সামিহা রেখেছেন। আর শাওন ও রুবী আমজাদ চাচার ছেলে মেয়ে তা তো বলেছি। ওদের কেউ কিন্তু আমার আসল পরিচয় জানে না। শোন মা, খুব সাবধানে ওদের সঙ্গে কথা বলবে। ভুলেও সামিহাকে নাজনীন বলে ডাকবে না। তারপর ওরা কেন এসেছে সংক্ষেপে সব বলে বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তুমি ওদের নাস্তার ব্যবস্থা কর। আমি বাজার করে আনি। কথা শেষ করে বাজারে চলে গেল।
সুফিয়া খাতুন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সামিহার একটা হাত ধরে বললেন, ঘরে এস মা, বোরখা খুলে এসে বসবে।
সামিহা ঘরে এসে বোরখা খুলতেই একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একসময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, আল্লাহ্ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুক, সুখী করুক। চুমো খাওয়ার সময় খুব চালাকির সাথে ডান হাতের কনুই এর লম্বা দাগটা দেখে নিশ্চিত হলেন, এ নাজনীন। নাজনীন যখন পা পা করে হাঁটে, সেই সময় একদিন সুফিয়া খাতুন বঁটিতে আনাজ কুটছিলেন। হঠাৎ নাজনীন হাঁটতে হাঁটতে এসে টাল সামলাতে না পেরে বটির উপর পড়ে যেতে ডান হাতের কনুইয়ের নিচে অনেকটা কেটে গিয়েছিল। ডাক্তার এনে সেলাই করাতে হয়েছিল। সেই দাগ আজ পর্যন্ত রয়েছে।
সুফিয়া খাতুনের চোখ দিয়ে পানি পড়ার কারণ বুঝতে পেরেও সামিহা জিজ্ঞেস করল, আপনি কাঁদছেন কেন?
সামিহার গলার আওয়াজ শুনে সুফিয়া খাতুনের চোখে আবার পানি এসে গেল। চোখ মুছে বললেন, ভাগ্যদোষে আমার বড়মেয়ে নাজনীনকে চার বছর বয়সে হারিয়ে ফেলেছি। তুমি অবিকল তার মতো। তোমাকে দেখে তার কথা মনে পড়ছে। এবার যাও মা, ওদের সঙ্গে বসে সরবত নাও।
সামিহা বেরিয়ে যেতে সুফিয়া খাতুন রান্নাঘরে গেলেন। নাসরিন একটা বড় প্লেটে তিন গ্লাস সরবত নিয়ে এসে সামিহাকে দেখে খুব অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সরবতের প্লেট রাখার কথা ভুলে গেল। সেও বড় হয়ে জেনেছে, অবিকল তারই মতো দেখতে এক বছরের বড় বোন নাজনীনকে মা বিক্রি করে তাদেরকে মানুষ করেছে।
তার অবস্থা দেখে রুবী দাঁড়িয়ে তার হাত থেকে সরবতের প্লেট নিয়ে বলল, ঠিক তোমার মতো তাই না? ও আমার ভাবি।
নাসরীন সম্বিত ফিরে পেয়ে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে বলল, তাই বুঝি এসেই আমাকে দেখে আপনারা অবাক হয়েছিলেন?
বাহ, তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতী। কোন ক্লাসে পড়?
এ বছর এস.এস.সি পরীক্ষা দেব। আপনারা সরবত খান। আমি নাস্তা নিয়ে আসি বলে নাসরিন চলে গেল।
সরবত খাওয়ার পর শাওন বলল, আরমানকে সন্দেহ করে আমরা খুব ভুল করেছি।
রুবী বলল, শুধু ভুল বলছিস কেন? আমরা খুব অন্যায় করেছি বল।
সামিহা বলল, আমি তোমাদের থেকে বেশি অন্যায় করেছি। সবাই এর ক্ষমা চাওয়া উচিত।
শাওন কিছু বলতে যাচ্ছিল, নাসরীনকে নাস্তা নিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল।
.
আরমানদের দু’টো রুম। আরমান একটায় থাকত। সেই রুমে আরমান ও শাওনের এবং অন্যরুমে সুফিয়া খাতুন ও নাসরীনের সঙ্গে সামিহা ও রুবীর রাতে থাকার ব্যবস্থা হল। এই এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। হারিকেন ও ল্যাম্প সবাই ব্যবহার করে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আরমানের রুমে সবাই গল্প করছিল। এক সময় শাওন আরমানকে বলল, আমরা তোমাকে অবিশ্বাস করে খুব ভুল করেছি। তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও।
শাওন থেমে যেতে রুবী ও সামিহা একসাথে বলে উঠল, হ্যাঁ আরমান ভাই, আমরা সবাই ভুল করেছি, আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।
আরমান বলল, ক্ষমা চেয়ে আমাকে লজ্জা দেবেন না। মানুষ মাত্রই ভুল করে। যারা ভুল বুঝতে পেরে সংশোধন হওয়ার চেষ্টা করে, তারা মহৎ। এই ব্যাপারটা না
তুললে খুশী হব। এখন রাত বারোটা বাজে; আপনারা ক্লান্ত, এবার ঘুমানো উচিত। তারপর সামিহা ও রুবীকে বলল, আপনারা ঐ রুমে যান,ওখানে ঘুমাবার ব্যবস্থা হয়েছে।
পরের দিন আরমান শাওনকে নিয়ে মসজিদ থেকে ফজরের নামায পড়ে এসে বলল, শাওন ভাই, আপনি বসুন। আমি ভাবীকে ও রুবীকে ডেকে নিয়ে আসি। গ্রামের মুক্ত বাতাসে হাঁটতে যাব। সেই সঙ্গে গ্রামটাও দেখবেন। তারপর বাইরে এসে নাসরীনের নাম ধরে ডাকল।
সুফিয়া খাতুন নামায পড়ে নাসরীনকে নিয়ে রান্নাঘরে চা-নাস্তা বানানোর জোগাড় করছিলেন। আরমানের গলা পেয়ে মেয়েকে বললেন, তোর ভাইয়াকে এখানে আসতে বল।
নাসরীন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বলল, ভাইয়া, এখানে এস, মা ডাকছে।
আরমান রান্নাঘরে এসে মাকে বলল, শাওনের বৌ সামিহাই যে নাজনীন, তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
সুফিয়া বেগম বললেন, ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছি; তারপর ওর মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করার সময় ছোটবেলায় বঁটিতে কেটে যাওয়া কনুইয়ের দাগটা দেখে নিশ্চিত হয়েছি।
আমি কিন্তু তোমাকে না জানিয়ে একটা অন্যায় করে ফেলেছি। বল, মাফ করে দিয়েছ?
আরমান যে এতটুকু অন্যায় করতে পারে না, তা সুফিয়া খাতুন ভালো করেই জানেন। তাই বললেন, ঠিক আছে, বল কী অন্যায় করেছিস?
আরমান মাথা নিচু করে বলল, এখানে আমার দু’দিন আগে কাজী অফিসে রুবীর সঙ্গে গোপনে কাবিন করেছি। এমন কি শাওন বা সামিহাও জানে না।
সুফিয়া খাতুন চমকে উঠে বললেন, এ তুই কী বলছিস? তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, যে চাচার কারণে তোর আব্বা সব জমি-জায়গা বিক্রি করল, বিনা চিকিৎসায় মারা গেল, চার বছরের নাজনীনকে আমি বিক্রি করে দিলাম, সেই চাচার মেয়েকে তুই বিয়ে করতে পারলি?
আরমান বলল, জানি, তুমি খুব দুঃখ পাবে, তবে কেন করেছি শুনলে তুমি আমাকে দোষী……।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে সুফিয়া খাতুন বললেন, তোর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না, তুই এখান থেকে চলে যা। তারপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
আরমান মাথা নিচু করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।
ভাইয়া বেরিয়ে যাওয়ার পর নাসরিন বলল, মা তুমি ভাইয়াকে মাফ করে দাও। এখন তাকে কিছু বলো না। সে অন্যায় করলেও আমার মনে হয়, এর পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। যা বলার মেহমান চলে যাওয়ার পরে বল। তারপর ভাইয়া কেন ডাকছিল দেখি বলে নাসরীন বাইরে এসে দেখল, ভাইয়া উঠোনের উত্তর পাশের আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এসে বলল, ভাইয়া মায়ের কথায় মন খারাপ কর না। দেখো, দু’দিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। মেহমান চলে যাওয়া পর্যন্ত তোমাকে কিছু বলতে মাকে নিষেধ করেছি। আমাকে ডাকছিলে কেন বল?
আরমান বলল, তুইও আমার উপর খুব রাগ করেছিস, তাই না?
না ভাইয়া, আমার মনে হয়েছে, রুবী আপাকে বিয়ে করার পেছনে নিশ্চয় ‘ কোনো কারণ আছে।
হ্যাঁ, তোর অনুমান ঠিক। পরে মাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলব, এখন যা, সামিহা ও রুবীকে গিয়ে বল, গ্রাম দেখতে যাওয়ার জন্য আমি ও শাওন ভাই তাদের জন্য অপেক্ষা করছি। আর শোন, রুবীকে মায়ের কথা কিছু বলবি না।
সারাদিন মেহমানদের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় করে বেড়ালেও আরমানের মনে শান্তি নেই। কারণ মা তার সঙ্গে কথা বলেনি। তবে মেহমানদের আপ্যায়নের কোন ত্রুটি করেন নি সুফিয়া খাতুন।
সুফিয়া খাতুন সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও রুবীকে পারল না। এক ফাঁকে আরমানকে জিজ্ঞেস করল, চাচিমাকে কি আমাদের ব্যাপার কিছু বলেছ?
হ্যাঁ, কাবিনের কথা বলেছি। তারপর বলল, একথা জিজ্ঞেস করলে কেন? মা এ ব্যাপারে তোমাকে কী কিছু বলেছে?
না বলেন নি। সবার অলক্ষ্যে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন। কাবিনের কথা শুনে চাচিমা কি বললেন?
মনে কষ্ট পেয়েছে। যখন বলি তখন নাসরিন ও ছিল। সে মাকে অনেক বুঝিয়েছে। ওসব নিয়ে তুমি মন খারাপ কর না, মাকে তো আমি চিনি, দু’দিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এমন সময় নাসরিন এসে ভাইয়ার শেষের কথা শুনে বুঝতে পেরে রুবীর একটা হাত ধরে বলল, আপনি একটুও মন খারাপ করবেন না ভাবি। ভাইয়াকে মা যা ভালবাসে দেখবেন, কালকেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
রুবী কিছু বলার আগে আরমান তাকে বলল, সবার সামনে রুবীকে ভাবি বলে। ডাকবি না।
সে কথা বলে দিতে হবে না বলে নাসরিন তাদের কাছ থেকে চলে গেল।
পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে সবাই গল্প করছিল, এমন সময় আরমান জানালা দিয়ে আট দশজন মেয়ে পুরুষ তাদের বাড়ির দিকে আসছে দেখে বলল, আপনারা বসুন, দেখি কারা যেন আসছে। তারপর উঠোন পেরিয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। সামনে বা পিছনে কোনো দিকেই যেতে পারল না।
ততক্ষণে মকবুল হোসেন, আমজাদ সাহেব, সাজেদা বেগম, আজরাফ সাহেব, সায়রা বানু, চেয়ারম্যান আকমল হোসেন, জেবুন্নেসা বিবি ও তমিজউদ্দীন স্যার। কাছে এসে গেলেন।
মকবুল হোসেন সবার সামনে ছিলেন। তিনি আরমানকে দেখতে পেয়ে বললেন, এই হল প্রথম আসামী। একে এ্যারেস্ট করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব খবর পাওয়া যাবে।
আরমান সবাইকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল, দাদুর কথা শুনে আরো ঘাবড়ে গিয়ে কোনো রকমে তোতলাতে তোতলাতে সালাম দিয়ে বলল, কী ব্যাপার দাদু?
সালামের উত্তর দিয়ে মকবুল হোসেন বললেন, রাখ তোমার দাদু, অন্যরা সব কোথায় আগে বল।
আকমল হোসেন বললেন, ফজরের নামায পড়তে আরমানের সঙ্গে আপনার নাতিকে দেখেছি। নাতিন ও নাতবৌ নিশ্চয় ঘরেই আছে। তারপর আরমানকে বললেন, হ্যাঁ করে দেখছ কি? আমাদের বসার ব্যবস্থা কর। ওঁরা ঢাকা থেকে এসেছেন, বুঝতে পারছ না?
ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও তাড়াতাড়ি ফিরে এসে সবাইকে বলল, আপনারা ঐ ঘরে যান। আপনাদের মা বাবা, দাদু ও আমার বড় চাচা-চাচি এসেছেন। আরমানের কথা শুনে ওরা সবাই চমকে উঠল। শাওন বলল, সর্বনাশ এখন উপায়?
আরমান বলল, কোনো উপায় নেই। ব্যাপারটা খুব গোলমাল মনে হচ্ছে। আপনারা ও ঘরে যান।
ততক্ষণে ওঁরা উঠোনের মাঝখানে চলে এসেছেন।
সুফিয়া খাতুন ও নাসরীন লোকজনের আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এসে তাদেরকে দেখে খুব অবাক হলেন।
আকমল হোসেন উচ্চস্বরে বললেন, কই গো আরমানের মা, তোমার আরমান কোথায় গেল, আমাদের বসার ব্যবস্থা করবে না?
সুফিয়া খাতুন, বড় ভাসুর, জেবুন্নেসা বিবি, তমিজউদ্দীন স্যারকে ছাড়া কাউকে চিনতে পারলেন না। ঘোমটা টেনে বললেন, এক্ষুনি করছি।
আরমান এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখে সুফিয়া খাতুন বললেন, পুরুষদের তোর ঘরে বসা। তারপর নাসরিনকে বললেন, তুই মেয়েদেরকে আমার ঘরে নিয়ে এসে বসা।
সুফিয়া খাতুনের কথা শুনতে পেয়ে আকমল হোসেন বললেন, ঘরে বসার দরকার নেই। দুতিনটে পাটি এই উঠোনেই বিছিয়ে দাও, আমরা এখানে বসব।
আরমান পাটি বিছিয়ে দেওয়ার পর সবাই বসল।
বসার পর আকমল হোসেন আরমানকে বললেন, তোমার মাকে এখানে আসতে বল।
সুফিয়া খাতুন ঘোমটা টেনে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
আকমল হোসেন তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই, আমরা মেহমানী করতে আসি নি। ইনারা ঢাকা থেকে গতকাল সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে, এসে উঠেছেন। ওঁরা আরমানের বিরুদ্ধে দু’টো নালিশ করেছেন। এখানকার চেয়ারম্যান হিসাবে বিচার করা আমার দায়িত্ব। তাই ওঁদের নিয়ে এসেছি। প্রথম নালিশ হল, আরমান তোমার দেওর আমজাদের একমাত্র মেয়ে রুবীকে ফুসলে কাজী অফিসে বিয়ে করে তাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। দ্বিতীয় নালিশ হল, চার বছরের যে নাজনীনকে আমার শালী ও ভাইরা ভাই-এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলে, তাকেও তার স্বামী, তোমার দেওরের ছেলে শাওনকেও কৌশল খাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে। তারপর সবার পরিচয় দিয়ে বললেন, তোমার বা তোমার ছেলের কিছু বলার থাকলে বলতে পার।
সুফিয়া খাতুন ছেলের উপর আগে থেকে রেগে ছিলেন। বড় ভাসুরের নালিশ শুনে আরো বেশি রেগে গিয়ে ছেলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, কি বলবি বল।
আরমান মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে। রইল।
সুফিয়া খাতুন অনুচ্চস্বরে গর্জে উঠলেন, চুপ করে আছিস কেন?
আরমান কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে মকবুল হোসেন বললেন, আরমানের বিচার পরে করবেন চেয়ারম্যান সাহেব, আরমানের চাচা আমজাদ যে, অমানবিক আচরণ তার বড় ভাই ও ভাবির সঙ্গে করেছে, তা তো আপনি ভালোই জানেন। সে আপনার সম্পর্কে ভাই হয়, তার বিচারটা আগে করুন। আর আমজাদের স্ত্রী সাজেদাও কম অন্যায় করে নি। ভালবাসা করে বিয়ে করার পর স্বামী গরিবের ঘরে ছেলে জেনে কেন স্বামীকে তার আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছিল? সে বিচারও আপনাকে করতে হবে!
মকবুল হোসেনের কথা শুনে সবাই এত অবাক হল যে, কিছুক্ষণ পিন-পতন নীরবতা বিরাজ করতে লাগল।
রুবী, সামিহা ও শাওন বারান্দার একপাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। শাওন কিছু বলার জন্য তাদের কাছে যাওয়ার উপক্রম করলে, রুবী তার একটা হাত ধরে বাধা দিয়ে অনুচ্চস্বরে বলল, এখন কিছু বলার দরকার নেই, অপেক্ষা কর।
আমজাদ সাহেব স্ত্রী সাজেদা বেগমের একটা হাত ধরে সুফিয়া খাতুনের কাছে এলেন। তারপর তার পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে ভিজে গলায় বললেন, ভাবি, এতদিন তোমার আমজাদ নারী ও অর্থ-সম্পদের মোহে পড়ে বিবেক হারিয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রুবী ও আরমান আমার সেই বিবেক ফিরিয়ে দিয়ে অন্ধত্ব দূর করে দিয়েছে। তুমি আমাকে ছেলের মতো মানুষ করেছ, ছেলে হয়ে মায়ের কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি ক্ষমা না করলে আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করবেন না। তুমি আমাকে য। শাস্তি দিতে চাও আমি মাথা পেতে নেব।
স্বামী থেমে যেতে সাজেদা বেগম ও বড় জায়ের পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে কান্নাজড়িত স্বরে বললেন, আমাকেও ক্ষমা করে দাও। শাওনের বাবার থেকে আমি বেশি অন্যায় করেছি। আমিই তাকে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করেছিলাম। দু’দিন আগে বাবার মুখে তোমাদের সবকিছু শুনে আমি যে কতবড় অন্যায় করেছি, তা বুঝতে পারি। আমি গরিবদের ঘৃণা করতাম, আজ মনে হচ্ছে, ধনীদের থেকে গরিবরাই মানবতার দিক থেকে অনেক বড়। তোমার রূপ ও গুণের কথা মিয়াভাই ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে অনেক শুনেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দাও আপা।
সুফিয়া খাতুন একইভাবে দাঁড়িয়ে চোখের পানিতে বুকের কাপড় ভেজাতে লাগলেন। তিনি যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভাবলেন, দিনে দুপুরে স্বপ্ন দেখছেন না তো? কোনো কথা বলতে না পেরে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
আর শাওন, রুবী ও সামিহা অবাক হয়ে বাস্তবতা ভুলে স্থানুবত দাঁড়িয়ে রইল।
মকবুল হোসেন সুফিয়া খাতুনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, আমিও কম অপরাধী নই। আমজাদ যে তোমাদের সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগ রাখে নি, তা না জানাটাই আমার অপরাধ। আরমান বি.এ. পাশ করেও কম শিক্ষিত বলে পরিচয় দেওয়ার কিছু উদ্দেশ্য আছে, ড্রাইভারের কাছে শুনে কৌশলে আরমানেরই কাছ থেকে তোমাদের সবকিছু জেনে নিই। তখন আমজাদ ও সাজেদার উপর প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। ওদের বিবেক জাগিয়ে তোলার জন্য আরমানকে আমি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছি। তারপর যা কিছু আরমান করেছে, আমার ইশারাতেই করেছে। সামিহা যে তোমার বড় মেয়ে নাজনীন, তা আজরাফের কাছে জেনে তাকে শাওনের সঙ্গে কাবিন করে রেখেছি। সামিহা যে নাজনীন আমজাদ ও সাজেদার কাছে গোপন রাখি। আজরাফ ও সায়রা নাজনীনকে কিনে তোমাদের উপকার করলেও তাদেরও অপরাধ কম নয়। নাজনীনকে জীবনে একবারের জন্যও তার মা দেখতে পাবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি করিয়েছিল, তাও অমানবিক। তারপর উঠে এসে সুফিয়া খাতুনের মাথায় একটা হাত রেখে বললেন, আজ থেকে তুমিও সাজেদার মতো আমার আর একটা মেয়ে। আর কেঁদ না মা। আল্লাহরই ইচ্ছায়, তোমার হারানো মেয়েকে ফিরে পেয়েছ। দেওরের ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। দেওরের মেয়েকে নিজের বৌ হিসাবে পেয়েছ। দেওর ও জাকে পেয়েছ। আজ তো তোমার সব থেকে আনন্দের দিন। যা কিছু ঘটেছে, আল্লাহর ইশারাতেই ঘটেছে। চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রীর মুখে শুনেছি, তুমি খুব ধার্মিক মেয়ে। আমাদের সবাইকে মাফ করে দাও মা।
সুফিয়া খাতুন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না, মকবুল হোসেনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললেন, বাবা হয়ে মেয়ের কাছে মাফ চেয়ে আমাকে গুনাহগার করবেন না। হ্যাঁ বাবা, আজ আমার জীবনের সব থেকে আনন্দের দিন।
আকমল হোসেন আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, আমারও কম আনন্দের দিন নয়? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে এইদিনটার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম। তিনি আমার মতো এক নাদান বান্দার দোয়া কবুল করে আমাকে ধন্য করেছেন। সেই জন্য তাঁর পাক দরবারে জানাই হাজার হাজার শুকরিয়া।
তমিজউদ্দীন স্যার এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার বললেন, বি.এ. পাশ করার পর আরমান যখন বলল, আমি চাচার বিবেকের দরজা খোলার জন্য কিছু করতে চাই তখন তার কথামতো দু’টো চিঠি লিখে,একটা আমজাদকে আর একটা আমার ভাইপো আসিফকে দিই। তারপর থেকে আমিও পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর এই দিনটার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি। সেজন্যে আমিও আল্লাহর দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করছি। তারপর বললেন, ইমাম সাহেবকে ডেকে ওদের শুভ কাজটা সেরে ফেললে হত না?
আকমল হোসেন বললেন, নিশ্চয় শুভ কাজটা সেরে ফেলতে হবে, তবে এখন নয়, রাতে। গ্রামের লোকজনদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে, সারাদিন খাওয়া দাওয়া হবে। আর সারারাত আমজাদের ও আনিসের ছেলের বিয়ের উৎসব চলবে।
স্বামী থেমে যেতে জেবুন্নেসা বিবি বললেন, এখানে বসে বসে শুধু বয়ান করবে? না এদের সবাইকে নিয়ে আমাদের ঘরে যাবে। কত বেলা হয়েছে খেয়াল করেছ?
আকমল হোসেন বললেন, ও হ্যাঁ তাইতো। চল সবাই উঠা যাক।
জেবুন্নেসা বিবি বললেন, তোমরা যাও, আমি এদের সবাইকে নিয়ে আসছি।
পুরুষরা সবাই চলে যাওয়ার পর জেবুন্নেসা কিছুক্ষণ সামিহার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন। তারপর জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, যা তোর মায়ের বুকে যা। সামিহা এগিয়ে এসে মা বলে সুফিয়া খাতুনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
সুফিয়া খাতুন কিছুক্ষণ তাকে বুকে চেপে রেখে চোখের পানি ফেললেন। তারপর সারামুখে চুমো খেয়ে বললেন, তুই আমাকে মাফ করে দে মা।
সামিহা মাকে সালাম করে চোখ মুছতে মুছতে বলল, মা হয়ে মাফ চেয়ে মেয়েকে গুনাহগার করছ কেন? তুমি মনে দুঃখ রেখ না মা। একটু আগে দাদু বললেন না? সব কিছু আল্লাহর ইশারায়ই হয়েছে।
সায়রাবানু এগিয়ে এসে সুফিয়া খাতুনের দুটো হাত ধরে বললেন, সামিহাকে দেখতে না দেওয়ার ওয়াদা করিয়ে আমি খুব অন্যায় করেছি। আমাকেও মাফ করে দিন।
সুফিয়া খাতুন বললেন, আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে মাফ করুক। তারপর রুবীকে জড়িয়ে ধরে দু’গালে চুমো খেয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তোমাকে ও আরমানকে সুখে রাখুক, শান্তিতে রাখুক।”
সামিহা গাল ভার করে বলল, মা, তুমি শুধু ভাইয়া ও ভাবিকে দোয়া করলে, আমাকে ও তোমার জামাইকে দোয়া করলে না যে?
সুফিয়া খাতুন তাকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বললেন, তুই হলি আমার পেটের মেয়ে, তোর সুখ-শান্তির জন্য সব সময় দোয়া করি। এখন আবার করছি, “আল্লাহ তোকে ও শাওনকে সুখে রাখুক, শান্তিতে রাখুক।”
জেবুন্নেসা বিবি বললেন, এখন আর অত দোয়া করতে হবে না। বিয়ের পর ছেলে, বৌ, মেয়ে ও জামাইকে একসঙ্গে যত ইচ্ছা দোয়া করবে। এবার সবাইকে নিয়ে চল, দু’দুটো বিয়ের আয়োজন করতে হবে।
Leave a Reply