মুক্তপুরুষ
১. উত্তর অ্যারিজোনার ট্রেইল ধরে
শীত-অপরাহ্নের ম্লান আলোয় উত্তর অ্যারিজোনার ট্রেইল ধরে এগিয়ে আসছে এক ঘোড়সওয়ার। পরনে মোষের চামড়ার কোট। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা। রং জ্বলা জিনসের প্যান্টের ওপর মোষের চামড়ার লেগিং। মাথায় চওড়া কার্নিসের হ্যাট। অদ্ভুত তার বসার ভঙ্গিটা। বুকের কাছে নুয়ে পড়েছে চিবুক।
তুষার পড়ে চলেছে। হালকাভাবে। তারই মাঝে এগিয়ে চলেছে, ঘোড়া। নিজের ইচ্ছেতেই এগোচ্ছিল এতক্ষণ। এবার একটা উঁচু টিলার ওপর উঠে এল।
মুখ তুলে সোজা হয়ে বসল লোকটি। তাকাল চারদিকে। বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায় এখান থেকে। কোর্টের কলার খানিকটা তুলে দিল আরোহী। আরও খানিকটা সামনে টেনে দিল হ্যাট। কিন্তু তাতে কাজ হল না বিশেষ। ইতিমধ্যেই তীব্র শীতে লাল হয়ে গেছে তার মুখ।
কোটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে মুখ বিকৃত করল সে, তীক্ষ্ণ ব্যথাটা পাঁজরে। দস্তানা পরা হাতটা বার করে আনল, দেখল কিছু লেগে রয়েছে কিনা। বেশ কিছুক্ষণ সামনের দিকে চেয়ে রইল লোকটি। শহর দেখা যাচ্ছে। তবে তুষারের কারণে আবছা তার অস্তিত্ব। বরফ ঢাকা উপত্যকায় কিছু ঘরবাড়ি, গাছপালা। কয়েকটা বাড়ির চিমনি থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ঘোড়র পেটে স্পার দাবাল আরোহী, ক্লান্ত ঘোড়াটা নেমে আসতে লাগল উঁচু টিলা থেকে।
শীতের বিকেল শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। শহরে ঢোকার মুখে ট্রেইলের পাশে একটা কাঠের সাইনবোর্ড দেখে লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল সে। সাইনবোর্ডের লেখাটা পড়া যাচ্ছে না। তুষার জমেছে। সামনে ঝুঁকল আগন্তুক। দস্তানা পরা হাতে সরিয়ে দিল তুষার। সানশাইন, অ্যারিজোনা। কাঠের গায়ে খোদাই করা দুটো শব্দ। এক দষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর কি মনে হতে আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইল। পড়েই চলেছে তুষার। আবার স্পার দাবাল ঘোড়র পেটে।
সোজা হয়ে বসেছে এখন আরোহী। সতর্ক চোখে চাইছে এদিক-ওদিক। বাড়ি-ঘরগুলোর মাঝখান দিয়ে একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে থামল সে। স্যালুন অ্যাণ্ড জেনারেল স্টোর লেখা একটা জীর্ণ সাইনবোর্ড ঝুলছে দরজার মাথায়। গ্রিফিথ পড়ল সে। এক হাতে মুখ মুছে স্যালুনের ডান পাশে চলে এল। সে। ঠাণ্ডা বাতাস এখানে অপেক্ষাকৃত কম। একটা খুঁটির সাথে বাধল ঘোড়াটাকে। জিনের পেটি আলগা করল। তারপর মুখের কাছে ঠেলে দিল ছোলার ডাবা।
এই সামান্য পরিশ্রমেই হাঁফ ধরে গেল তার। পাঁজরের ব্যথাটা মাথাচাড়া দিতে চাইছে। হাঁ করে শ্বাস নিল সে। তারপর স্যাডল বুট থেকে অস্বাভাবিক লম্বা ও ভারি একটা রাইফেল বার করল। নিয়মিত যত্নের ফলে চকচকে মসৃণ ওটার বাট আর ব্যারেল।
ডান হাতে রাইফেল নিয়ে স্যালুনের বারান্দায় উঠে এল লোকটি। হ্যাট দিয়ে বাড়ি মেরে কোট প্যান্টের তুষার ঝাড়ল। আবার পরে নিল হ্যাটটা। কোটের। বোতামগুলো খুলে ফেলল। পেছন দিকে টেনে দিল খানিকটা। যাতে কোমরে ঝোলানো রিভলভারটা যে-কোন মুহূর্তে অনায়াসে বার করে আনা যায়।
স্যালুনে ঢুকে লোকটি সরাসরি বারের দিকে এগোল না। দাঁড়িয়ে রইল এক মুহূর্ত। তাকাল চারদিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভেতরটা। ধোয়াটে। সবার আগে তার চোখ পড়ল গ্রিফিথির ওপর। বারের মালিক। দাঁড়িয়ে আছে সে বারের পেছনে, লোকটা মোটা-সোটা। পরনে সাদা অ্যাপ্রন, তবে ব্যবহারের ফলে নোংরা। আগন্তুকের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল গ্রিফিথ। তারপর কাজে মন দিল।
দুটো টেবিল ঘিরে পাঁচ-ছয়জন মারকুটে চেহারার লোক বসে আছে। তার দিকে চেয়ে রয়েছে সবাই। টেবিলের ওপর পা তুলে বসে থাকা লোকটা থুথু ফেলল। তার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই।
স্যালুনের পেছন দিকে বিশাল ফায়ারপ্লেস। দু’একজন লোক আছে। সেখানেও। তবে ধোয়ার কারণে প্রায় অস্পষ্ট তাদের অবয়ব।
স্যালুনের ডানদিকটা জেনারেল স্টোরের মালপত্রে ঠাসা। তিন চারটে কাঠের র্যাকে নানা আকারের টিনের পট। মেঝেতে গোটা তিনেক ময়দার বস্তা। সিলিং থেকে ঝুলছে শুকনো বেকন এবং কয়েক গোছা দড়ি।
আগন্তক ধীরপদক্ষেপে বারের কাছে এসে দাঁড়াল। হাতে এখনও সেই বিশাল আকৃতির রাইফেল। সতর্কদষ্টিতে ঘরের চারপাশে আরেকবার নজর বোলাল সে। তারপর রাইফেলটা বারের সঙ্গে হেলান দিয়ে রেখে নিচু গলায় ফরমায়েশ দিল, হুইস্কি।
স্পেশাল না দেশী?
বারম্যানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল লোকটি, দুটোর মধ্যে কোনও তফাৎ আছে?
পাঁচ সেন্ট।
তাহলে দেশীটাই দাও।
একটা গেলাসে হুইস্কি ঢেলে আগন্তুকের দিকে ঠেলে দিল বারম্যান। লম্বা এক চুমুকে সবটুকু শেষ করল সে। ইঙ্গিত করতেই গেলাসটা আবার ভরে দিল গ্রিফিথ। এক চুমুকে অর্ধেকটা খালি করল সে। গেলাসটা নামিয়ে রাখল বারের ওপর। উষ্ণ হয়ে উঠছে শরীর। শিথিল হচ্ছে পেশীগুলো। খোলা বোতুল হাতে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল গ্রিফিথ। কিন্তু গেলাসটা শেষ করার লক্ষণ দেখা গেল
লোকটির মধ্যে। ছিপি এঁটে বলল গ্রিফিথ, চল্লিশ সেন্ট, মিস্টার।
ক্লান্ত হাতে পকেট থেকে একটা ডলার বার করল লোকটি। রাখল বারের ওপর।
এসময় ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে এক কালো, রোগাটে ইণ্ডিয়ান তরুণ ওর পাশে এসে দাঁড়াল। পরনে রঙীন পোশাক। আমাকে একটু হুইস্কি খাওয়াবে?
আগন্তুক জবাব দেয়ার আগেই তেড়ে উঠল গ্রিফিথ। ভাগো এখান থেকে!
একপা পিছিয়ে আবার দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটি। কি হল? কথা কানে যায় না? তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল গ্রিফিথ। তারপর বারের ওপর ঝুঁকে পড়ে হ্যাট দিয়ে বাড়ি মারল ছেলেটির মুখে।
উফ শব্দ করে গাল চেপে ধরে পিছিয়ে গেল ছেলেটি।
ফের যদি কাউকে বিরক্ত করতে দেখি তবে তোর হাড় গুঁড়ো করে দেব, হারামজাদা, খিস্তি করল গ্রিফিথ।
ঘটনাটা যেন লক্ষ্যই করেনি নবাগত। ছিপি খুলে পুরো এক গেলাস হুইস্কি ঢালল সে। তারপর মার খেয়ে ফায়ারপ্লেসের পাশে জবুথবু হয়ে বসে থাকা ছেলেটিকে মৃদু গলায় ডাকল, এই, এদিকে এস।
দৌড়ে এল ছোঁকরা। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে বারটেণ্ডারের দিকে। তারপর গেলাসটা চেপে ধরে এক চুমুকে সাবড়ে দিল হুইস্কিটুকু।
গ্রিফিথ লোকটির দিকে তাকিয়ে অপ্রসন্ন মুখে বলল, অযথা পয়সা নষ্ট করলে, মিস্টার। এক গেলাস স্পেশাল হুইস্কি খেতে পারতে ওই পয়সা দিয়ে। যাক, এখন মোট আট সেন্ট দিতে হবে।
গ্রিফিথের কথার জবাব দিল না লোকটি। খানিক বাদে অনেকটা স্বগতোক্তির মত ফিসফিস করে বলল, শীত, বড্ড শীত।
আরও বাড়তে পারে, গ্রিফিথ বলল।
বল কি? অস্ফুটে বলল লোকটি। তলানিটুকু শেষ করে গেলাসটা নামিয়ে রাখল বারের ওপর। অনেকখানি ফিরে পেয়েছে উষ্ণতা। হ্যাটটাও খুলে রাখল। মৃদু গলায় প্রশ্ন করল, আমার ঘোড়াটার জন্যে কোনও আস্তাবল পাওয়া যাবে?
গ্রিফিথ প্রথমে যেন শোনেইনি প্রশ্নটা। তারপর বলল, কিছু বললে? প্রশ্নটা আবার করল লোকটি। টেবিলে বসা লোকগুলোর দিকে একটা চোরা চাহনি হানল গ্রিফিথ। বলল, না, কোনও আস্তাবল খালি নেই।
ভ্রুকুটি করল লোকটি। বোতলের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার কি ভেবে সরিয়ে নিল। তারপর শান্তস্বরে বলল, আমি আসার সময় একটা খালি বার্ন দেখেছি।
গ্রিফিথ বারের তক্তা মুছতে মুছতেই জবাব দিল, দেখতে পার। তবে ওটা খালি নয়। তাছাড়া এ শহরে বাইরের কারও থাকার নিয়ম নেই।
ধীরে ধীরে সোজা হল লোকটি। কড়া চোখে চাইল গ্রিফিথের দিকে। একটা খালি বাঙ্ক হাউসও চোখে পড়েছে আমার। ঘুরে দাঁড়িয়ে টেবিলে বসা লোকগুলোর দিকে চাইল সে। বিছানার দরকার নেই। কোনওমতে শীত কাটলেই হল। কেবল ঘোড়াটার জন্যে আশ্রয় দরকার।
বললাম তো খালি নেই, গ্রিফিথ বলল আবার।
গ্রিফিথের দিকে চাইল নবাগত। ধীরে ধীরে বলল, এই শীতের মধ্যে নিশ্চয় তাড়িয়ে দেবে না আমাকে? হাসল একটু। কাজটা কি ঠিক হবে?
গ্রিফিথ, প্রতিটি কথার ফাঁকে টেবিলে বসা লোকগুলোর দিকে চাইছে। ব্যাপারটা সন্দেহজনক ঠেকল তার কাছে। লোকগুলো নিশ্চয় জড়িত এর সাথে। টানটান হয়ে উঠল তার পেশীগুলো। প্রস্তুত হচ্ছে বিপদের আশঙ্কায়। এবার সবাইকে শুনিয়ে স্পষ্ট গলায় বলতে শুরু করল সে, আমাকে তাড়িয়ে দেয়ার পেছনে কোনও যুক্তি আছে? থাকলে শুনতে চাই আমি।
লোকটির কাঁধের ওপর দিয়ে চাইল গ্রিফিথ, কাছের, টেবিল থেকে বলে উঠল একজন, গ্রিফিথ, আজ রাতটা থাকতে দাও ওকে।
কথাটা কে বলল বোঝার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল লোকটি। একে একে দেখল সবাইকে। অল্পবয়সী এক কাউবয় নড় করল।
ঠিক আছে, বলল গ্রিফিথ। ঘোড়ার জন্যে লাগবে এক ডলার। আর তোমার বিছানার জন্যে পঞ্চাশ সেন্ট।
ক্ষীণ হাসল লোকটি। মৃদু গলায় বলল, ঠিক আছে, পাবে।
দেড় ডলার।
বারের ওপর দুই ডলার রাখল লোকটি। বলল, খুচরো ফেরত দিতে হবে। পরে হুইস্কি খেয়ে নেব।
পিকো! গলা চড়িয়ে ডাকল গ্রিফিথ ইণ্ডিয়ান ছেলেটিকে। এর ঘোড়াটাকে আস্তাবলে রেখে দিয়ে এস।
হুকুম তামিল করতে ছুটল ছোঁকরা।
খালি গেলাসে মদ ঢেলে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে মৃদু গলায় বলল লোকটি, সানশাইন।
কিছু বললে? প্রশ্ন করল গ্রিফিথ।
না, তেমন কিছু না। ভারী অদ্ভুত তোমাদের শহরটার নাম।
টেবিলের ওপর পা তুলে দেয়া বেঁটে লোকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, নামটা মনে হয় পছন্দ হয়নি তোমার!
উত্তর দিল না নবাগত চেয়ে রইল অন্যদিকে।
কথা কানে যায় না? নামটা পছন্দ হয়নি তোমার? জিজ্ঞেস করল বেঁটে লোকটা।
নামে কিছু যায় আসে না আমার, বলল আগন্তুক। বেঁটে লোকটা খটাশ করে পাটা নামিয়ে আনল মেঝেতে। পুরু ঠোঁটে কুৎসিত হেসে বলল, অনেক কিছু যায় আসে। মনে হচ্ছে শহরটা পছন্দ হয়নি তোমার। কাজেই কেটে পড়।
ভূ কুঁচকে তার দিকে খানিক চেয়ে রইল লোকটি। চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে। অল্প বয়সী কাউবয়টি দ্রুত বলে উঠল, আহ, রজার! অযথা গোলমাল বাধাচ্ছ কেন?
তার কথা যেন কানেই যায়নি রজারের। খানিকটা গলা তুলে জিজ্ঞেস করল সে, কোত্থেকে এসেছ তুমি? এমন অভদ্র রসিকতা শিখেছ কোথায়?
রজারের দিকে সোজাসুজি তাকাল লোকটি। শান্ত গলায় বলল, দক্ষিণে।
পরিবেশটাকে হালকা করার জন্যে গ্রিফিথ জিজ্ঞেস করল লোকটিকে, এটা কামান না রাইফেল, মিস্টার? আঙুল দিয়ে দেখাল বারের সাথে হেলান দিয়ে রাখা রাইফেলটা।
রাইফেল। তবে বিশেষ ভাবে তৈরি, বলল লোকটি।
তুমি কি শিকারী?
ছিলাম।
ক্যালিবার কত অস্ত্রটার?
অনেক, সংক্ষেপে বলল লোকটি।
কত?
এবার আর জবাব দিল না লোকটা। গেলাসের পানীয়টুকু শেষ করে জিজ্ঞেস করল, বাঙ্কহাউসটা কোথায়?
গ্রিফিথ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, দাঁড়াও, দেখিয়ে দিচ্ছি…কিন্তু তোমার সাথে বেডরোল আছে তো?
‘আছে।’
বাড়তি পয়সা দিলে কম্বল পাবে।
মৃদু হেসে দরজার দিকে এগোল লোকটি। বেরিয়ে যাওয়ার সময় চেঁচাল রজার, রাইফেলটা কি আসল?
জবাব দিল না লোকটি। জিদ চেপে গেল রজারের। গুলি করা যায় ওটা দিয়ে?
বেরিয়ে গেল লোকটি।
ও বেরিয়ে যেতেই উইলসন নামের তরুণ কাউবয়টি রজারের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল, খামোকা ওকে রাগাচ্ছিলে কেন?
রজার কঠিন মুখে বলল, ওকে পছন্দ হয়নি আমার। তাছাড়া এখানে ওর থাকার কোন অধিকার নেই। গ্রিফিথকে ডেকে বলল সে, ওকে থাকতে দিলে কেন? জান না মিস্টার হিগিন্স গোটা শহরটাই কিনে নিয়েছেন? অপরিচিত লোকজন মোটেও পছন্দ নয় তার।
আমার কি দোষ? ও-ই তো বলল, উইলসনের দিকে আঙুল তাক করল গ্রিফিথ।
কোনও রকম ঝামেলা চান না তিনি। ওকে তাড়িয়ে দিলে বা মারামারি করলে ঝামেলা বাড়ত বই কমত না, বলল উইলসন।
ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না আমার কাছে। জানতে হবে ব্যাটা কি চায়। কেন এসেছে এখানে। খেকিয়ে উঠল রজার।
শ্রাগ করল উইলসন। বলল, ওর রাইফেলটা শার্পশূটারদের। সেজন্যেই ভয় পাচ্ছ তুমি। ওকে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছ।
গেলাসে লম্বা একটা চুমুক দিল রজার। উইলসনের দিকে তাকিয়ে বলল, দরকার হলে ওকে মেরে তাড়াব।
দরকার হবে না। কাল সকালেই চলে যাবে ও, বলল উইলসন।
বাইরে এসে ধীর পদক্ষেপে হাঁটতে লাগল লোকটি তুষারের ওপর দিয়ে। পাজরের ব্যথাটা হঠাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কোটের ভিতর দস্তানাপরা হাতটা ঢোকাল সে। খানিকবাদে বার করে মেলে ধরল চোখের সামনে। যা সন্দেহ করেছিল তাই। রক্ত। কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইল সে। তারপর প্যান্টের লোমশ লেগিং-এ হাতটা মুছল। হাঁটা ধরল আবার।
বাঙ্কহাউসটা বেশ বড়সড়। একসাথে বিশ-পঁচিশজন লোক থাকতে পারবে। ছোট ছোট অনেকগুলো জানালা, মাথার ওপর টালির ছাদ। ভেতরটা ফাঁকা। লোকজন নেই। দু’ধারে সারি সারি খালি বাঙ্ক। ওপরে মাদুর নেই। কাঠের ফ্রেমে ম্প্রিঙের পরিবর্তে দড়ি লাগানো। সবচেয়ে কাছের বাঙ্কটাতে শরীর এলিয়ে দিল সে। অনেকক্ষণ কোনও নড়াচড়া নেই। পড়ে রইল চুপচাপ।
বেশ অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর কাপড় ছাড়ার কথা মনে পড়ল তার। বিছানায় উঠে বসতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ব্যথা উঠল বুকে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা সহ্য করল সে।
ব্যথা কিছুটা কমে আসার পর গা থেকে কোটটা খুলে ফেলল। আরও কিছুক্ষণ চেষ্টার পর শার্টটাও খুলতে পারল। বুকের বাঁ দিকে বেশ বড়সড় একটা ব্যাণ্ডেজ। খানিকটা অংশ লাল হয়ে আছে।
আলতো হাতে ব্যাণ্ডেজটা স্পর্শ করল সে। রক্তে ভেজা জায়গাটা চটচটে আঠাল। মৃদু চাপ দিল সে, প্রচণ্ড ব্যথা। তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিয়ে সুতির গেঞ্জিটা টেনে দিল নিচের দিকে।
খানিকবাদে বেডরোল নিয়ে পিকো এল। তার পায়ের কাছে বেড়োলটা নামিয়ে রেখে বলল, তোমার ঘোড়াটা বেশ ভাল জাতের। মাসট্যাঙ, তাই না?
মাথা ঝাঁকাল সে। বলল, গ্রিফিথের কাছে আমার কিছু পয়সা জমা আছে। ওকে আমার কথা বললেই তোমাকে হুইস্কি দেবে।
পিকোর যেন বিশ্বাসই হয়নি কথাটা। চেয়ে রইল অবাক হয়ে।
কোটের পকেট থেকে একটা ডলার বার করে পিকোর হাতে দিল লোকটি। বলল, এটা দিয়ে হুইস্কি আর তামাক নিয়ে এস।
ছেলেটি ডলার হাতে দাঁড়িয়ে রইল। ওর দিকে চেয়ে বলল, তুমি অসুস্থ?
না, বলল লোকটি। যাও।
পিকো চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে উঠল লোকটি। বেডরোলটা বিছাল খাটের ওপরে। রাইফেলটা রাখল বিছানার এক পাশে। তারপর বুটসহই শুয়ে পড়ল বিছানায়।
শুয়ে থেকে হোলস্টার থেকে রিভলভারটা বার করে আনল সে। লোড করা আছে কিনা দেখে নিয়ে রেখে দিল আবার।
সিলিং-এর দিকে চেয়ে শুয়ে রইল সে। অপেক্ষা করছে পিকোর জন্যে। হুইস্কি আনতে গেছে ও। দু’এক ঢোক পেটে পড়লে ব্যথা হয়ত কমবে কিছুটা।
সকাল। তুষারপাত বন্ধ হয়েছে। বাঙ্ক হাউসের ছোট ছোট জানালাগুলো দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ঘরের ভেতর।
এইমাত্র লোকটির ঘুম ভাঙল। চোখ মেলেই টের পেল তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকজন-তিনজন। স্যালুনে কাল বিকেলে দেখেছে যাদের। অভ্যাসবশেই তার হাতটা চলে গেল হোলস্টারে। তবে সরিয়ে নিল দ্রুত, লোকগুলোর হাতে অস্ত্র নেই। নিজের বুকের দিকে চোখ গেল তার। শাটের বোতামগুলো খোলা। ওপর দিকে ওঠানো গেঞ্জিটা। বেরিয়ে পড়েছে ব্যাণ্ডেজ। কাজটা যে ওদেরই কারও বুঝতে পারল সে।
কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে রজার। বিছানার পায়ের কাছে উইলসন।
সারাদিনই ঘুমাবে নাকি? হেসে বলল উইলসন। জবাব দিল না লোকটি। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে রজারকে। কোমরে গানফাইটারদের কায়দায় পিস্তল ঝুলানো। হঠাই সামনে ঝুঁকে পড়ল রজার। আঙুল দিয়ে খোঁচা মারল বাঁ দিকের পাজরে। এটা কি করে হল? প্রশ্ন করল সে।
কুঁকড়ে গেল লোকটি। তবে শব্দ করল না কোনও। হাতটা আবার চলে গেল রিভলভারের বাটে, আহ! এসব কি হচ্ছে? ব্যথা পাচ্ছে ও! উইলসনের কণ্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ল।
পাক,বলল রজার। ঠোঁট চেটে ভেংচি কাটল সে। ওটা কিসের জখম? জিজ্ঞেস করল সে। জবাব না দিয়ে উঠে বসল লোকটি। কপালের ডান দিকে একটা শিরা লাফাচ্ছে। রিভলভারের বাটে আরও শক্ত হল আঙুলগুলো।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করল উইলসন। শান্ত অথচ কঠিন গলায় বলল, ভুল কোরো না, স্ট্রেঞ্জার, আমরা তোমার সম্বন্ধে জানতে চাই। গোলমাল চাই না।
রিভলভারের বাট থেকে হাত সরে গেল।
আবার ঝুঁকল রজার। খোঁচা দেবার জন্যে হাত বাড়িয়ে বলল, গুলি খেয়েছ, তাই না?
আশ্চর্য ক্ষীপ্রতায়, লোকটি ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল রজারের হাত। তারপর প্রায় অর্ধেকটা বার করে আনল রিভলভার। কিন্তু বোধহয় পরিস্থিতি অনুধাবন করেই থেমে গেল সেখানেই। কাজটুকুর দ্রুততা লক্ষ্য করে স্বগতোক্তি করল উইলসন, গানফাইটার!
প্রায় চেঁচিয়ে বলল রজার, ‘আমি জানতে চাই ও কে এবং এখানে কি চায়।’
রজার, তুমি সর। আমি দেখছি। রজারকে সরিয়ে দিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল উইলসন। নরম গলায় বলল, কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও। তোমার নাম কি?
একে একে ওদের মুখের দিকে চাইল লোকটি। ভাঙা গলায় বলল, টেকন।
কোত্থেকে এসেছ?
দক্ষিণ•••নেভাদা থেকে।
‘জানি,’ উইলসন বলল। আমরা জানতে চাইছি তুমি সানশাইনে এসেছ কেন, কিভাবে?
টেকন ক্লান্ত গলায় বলল, আমার বিশ্রাম দরকার। শহরটা পেয়ে গেলাম..তাই এলাম এখানে।
বাজে কথা রাখ, দাঁত খিচিয়ে বলল রজার। টেকনের ক্ষতটা দেখাল সে। গুলি খেয়ে পালাচ্ছ তুমি। কারা তাড়া করছে?
ম্লান হেসে বলল টেকন, কেউ তাড়া করছে না।
বললেই হল? বিদ্রূপ ঝরে পড়ল রজারের কণ্ঠে। ভাল চাইলে সব খুলে বল।
‘সে অনেক কথা। পরে শুনো।’
‘এখনই শুনব। আমাদের হাতে সময় আছে।’ রজারের কথায় কান দিল না সে। ক্লান্ত ভাবে শুয়ে পড়ল।
রজার জবাবের জন্যে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর মুঠো পাকিয়ে এগিয়ে এল। বিদ্যুৎ বেগে উঠে বসল আহত লোকটা। উইলসন দ্রুত বাধা দিয়ে বলল, ওকে বিশ্রাম নিতে দাও। পরে সব শোনা যাবে। আমরা বরং নাস্তা সেরে আসি।
হাত ধরে টেনে রজারকে নিয়ে বেরিয়ে গেল উইলসন। ওরা চলে যাবার পরও বসে রইল টেকন। গেঞ্জিটা টেনে নামিয়ে শার্টের বোতামগুলো লাগাল। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। তবু শীত করছে। হ্যাট পরে নিয়ে কোটটা গায়ে চাপাল সে।
এ সময় এল পিকো। দু’হাত ভর্তি চেলাকাঠ। ফায়ারপ্লেসের কাছে কাঠগুলো নামিয়ে রাখল সে। কয়েকটা টুকরো ফেলে দিল আগুনে। উসকে দিল আগুনটা। ফিরে এল টেকনের কাছে। এক গ্লাস হুইস্কি খাওয়াবে?
বাঙ্কের তলা থেকে হুইস্কির বোতল বার করে আনল টেকন। বেশ খানিকটা অবশিষ্ট আছে এখনও, ছিপি খুলে গলায় ঢালল খানিকটা, তারপর বোতলটা বাড়িয়ে দিল পিকোর দিকে।
কোটের পকেট থেকে চুরুট বার করে ধরাল টেকন। ওকে দেখছে পিকো।
লোকগুলো কারা? জিজ্ঞেস করল টেকন।
শ্রাগ করল পিকো, কেন?
দরকার আছে। ওরা এ শহরেই থাকে?
হ্যাঁ।
কি করে? শিকার না অন্য কিছু?
কিছু করে না।
কত দিন ধরে আছে? আবার শ্রাগ করল পিকো। অনেকদিন।
এক সপ্তাহ? এক মাস?
জানি না। অনেকদিন হবে।
লোকগুলো সারাদিন বসে থাকে?
হ্যাঁ। ওরা ভাল লোক না। আমাকে হুইস্কি খাওয়ায় না। শুনেছি কয়েকজকে খুন করেছে ওরা।
কেন? ওরা কি লুটপাট করে নাকি?
কে জানে? আমাকে এত কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? তারপর সহসাই উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখমুখ। আমাকে আরও হুইস্কি কিনে দেবে?
মৃদু হেসে বলল টেকন, পরে। এখন যাও।
পিকো চলে যাওয়ার পর কোটের পকেট থেকে একটা হরিণের চামড়ার ব্যাগ বার করল সে। উপুড় করে ঢালল বিছানায়। গুণে আবার রেখে দিল ব্যাগে। মাত্র আট ডলার। এ দিয়ে বেশিদিন চলবে না। ঝেড়ে ফেলল চিন্তাটা। ব্যাগটা ঢুকিয়ে রাখল কোটের পকেটে।
শহরটার কথা ঘুরছে তার মাথায়। এখানকার লোকগুলোর আচরণ বড় অদ্ভুত। কিছু একটা ঘটছে এখানে। তবে যাই ঘটুক নিজেকে এসবের সঙ্গে জড়াবে না সে। ওকে অসুস্থ দেখেও তাড়িয়ে দিতে চাইছে লোকগুলো। কিন্তু কারণটা কি?
রজারের কথা ভাবল সে। দাঙ্গাবাজ লোক। পশ্চিমের বিভিন্ন ক্যাম্পে, রেস্টুরেন্টে এ ধরনের লোক অনেক দেখেছে সে। শেষতক হয়ত খুনই করতে হবে ওকে। তবে রজার তো আর একা নয়, আরও অনেকে আছে তার সঙ্গে। অসুস্থ শরীরে বেশ কঠিন পরিস্থিতিতেই পড়েছে সে। ওরা চাইছে সে চলে যাক। কিন্তু এ মুহূর্তে যে তা সম্ভব নয় সেটা বুঝতে চাইছে না।
বাঙ্কহাউস থেকে বেরিয়ে স্যালুনে গিয়ে ঢুকল টেকন। কাল বিকেলের সবাই আছে আজও। কোণের দিকে একটা টেবিলে বসল সে। সবাই চেয়ে রয়েছে ওর দিকে।
কফি দেব? বারের পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল গ্রিফিথ।
দাও, বলে পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে ধরাল। চুরুট ধরানোর ফাঁকে খেয়াল করল রজার লক্ষ্য করছে তাকে।
গ্রিফিথ কফি নিয়ে এলে টেকন জিজ্ঞেস করল, কি নাস্তা আছে?
শিম আর বেকন, যেটা খুশি খেতে পার, জানাল গ্রিফিথ।
ডিম হবে?
গ্রিফিথ জোরে হেসে উঠে অন্যদের ডেকে বলল, শুনেছ? ও ডিম চাইছে!
ওকে পেড়ে নিতে বল, বলল রজার। চুপ করে রইল টেকন। ব্যথা করছে। পাজর। গোটা দুয়েক হাড় ভেঙেছে। তবে জখমটা আরও মারাত্মক হতে পারত। ইঞ্চি খানেক নিচ দিয়ে গেলেই ফুটো হয়ে যেত ফুসফুস;
গ্রিফিথ খাবার দিয়ে গেল, খানিক বাদে। শিম আর বেকন ভাজা। খেতে শুরু করল সে। এসময় উঠে এল উইলসন। কফির কাপ হাতে দাঁড়াল সামনে, বসতে পারি? জিজ্ঞেস করল সে।
ঘাড় নেড়ে সায় দিল টেকন। দীর্ঘক্ষণ বসে রইল উইলসন। টেকন খেয়েই চলেছে। শেষমেশ জিজ্ঞেস করল, নাস্তা সেরেই চলে যাচ্ছ তো?
না।
সামান্য হাসল উইলসন। তারপর মাথা নেড়ে বলল, এখানে থেকে কি করবে? এখানে আছেটা কি?
টেকন বলল, সে তো তোমাদের জানার কথা। আমার দরকার বিশ্রাম।
ছ, তোমার জখমটা•••, কথা শেষ না করেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল উইলসন। রাইফেলটা দেখিয়ে বলল, দারুণ জিনিস। সবখানে নিয়ে যাও?
মাথা ঝাঁকাল টেকন। তার খাওয়া প্রায় শেষ। প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছে সে, যে কোনও কারণেই হোক উইলসন খুব ভাল ব্যবহার করছে তার সাথে। কারণটা হয়ত জানা যাবে শিগগিরই। আন্দাজ করল সে।
তুমি তো শিকারী। কি ধরনের?
জবাব দিতে একটু সময় নিল টেকন। বলল, কন্ট্রাক্ট। কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে রেল রাস্তার হয়ে শিকার করে দিতাম।
রেল রাস্তা? অবাক মনে হল উইলসনকে। একবার চাইল টেবিলে বসা লোকগুলোর দিকে। মনোযোগ দিয়ে শুনছে ওরা। সে তো অনেক দূরে! বলল সে।
এখন এগিয়ে এসেছে, বলল টেকন। আধপোড়া চুরুটটা ঠোঁটে গুজল সে। ওটা জ্বালানোর আগেই শার্টের পকেট থেকে একটা আনকোরা চুরুট বার করল উইলসন। ছুঁড়ে দিল ওর দিকে।
সময় নিয়ে চুরুটটা ধরাল টেকন। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল, ‘ধন্যবাদ।’
কাজটা ছাড়লে কেন? শুনেছি ও কাজে ভাল পয়সা আছে, বলল উইলসন।
ছাড়িনি। ওরাই ছাড়িয়ে দিয়েছে, শান্ত স্বরে বলল টেকন।
ওর জখমের দিকে দেখিয়ে জানতে চাইল উইলসন। কারও সাথে গোলমাল করেছিলে?
বড় বেশি প্রশ্ন করছে উইলসন, তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাইছে। ভেতর ভেতর অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে সে। কিন্তু প্রকাশ না করে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ওটা ফেয়ার ফাইট ছিল। পুরানো এক শত্রুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওকে খুন না করে উপায় ছিল না।
শব্দ করে হাসল উইলসন। সেই লোকও যে শক্ত চিজ ছিল তা তোমার জখম দেখেই বুঝতে পারছি।
চুরুটটা নিভিয়ে ফেলল টেকন। উইলসনকে বলল, এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও। তোমরা আমাকে তাড়াতে চাইছ কেন?
স্থির চোখে টেকনকে দেখল উইলসন। আমাদের ধারণা কোনও ল অফিসার চলে আসবে এখানে। তোমাকে ফলো করে। তখন বিপদে পড়ে যাব আমরা। এবার বুঝেছ, কেন আমরা তোমাকে চাইছি না?
‘আগেই বলেছি আমাকে কেউ ফলো করছে না। আমি ওয়ানটেড নই।’
ঠোঁটে চুরুট গুঁজে হাসল উইলসন। তোমার অবস্থায় পড়লে একই কথা বলতাম আমিও, কিন্তু আমরা ওয়ানটেড, লোক। আমাদের চিন্তার কারণটা বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই?
টেকন উইলসন এবং অন্যদের দেখে নিয়ে বলল, আইন খুঁজলে তোমাদেরই খুঁজবে। আমাকে নয়। আমার জন্যে তোমাদের ভয় না পেলেও চলবে।
তারপরও কথা থাকে, বলল উইলসন।
টেকন খানিক চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে, এই স্যালুন ছেড়ে দেব আমি। রাস্তার ওপারে যে বাড়িটা আছে সেটায় চলে যাব।
অন্য টেবিল থেকে হেসে উঠল রজার। দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করল উইলসন। বলল, তাতেও লাভ নেই। গোটা শহরটাই আমাদের। বলতে পার এটা আমাদের হেডকোয়ার্টার। বাইরের লোককে চাই না আমরা।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি, ক্লান্ত স্বরে বলল টেকন।
তাহলে যাচ্ছ তুমি?
হ্যাঁ, বলল টেকন। যাচ্ছি। বারের দিকে ধীর পায়ে এগোল সে। একটা বোতল দাও, এক বোতল দেশী হুইস্কি দেখাল সে গ্রিফিথকে।
দেড় ডলার, বোতলটা বারের ওপর নামিয়ে রেখে বলল গ্রিফিথ।
পকেট থেকে চামড়ার ব্যাগটা বার করল টেকন। ছয় ডলার গুনে ধরিয়ে দিল গ্রিফিথের হাতে। মদ এবং নাস্তার জন্যে দেড় ডলার, বাকিটা আমার আর ঘোড়াটার তিনদিনের খরচ। বোতলটা তুলে নিয়ে রাইফেলটা কাঁধে ঝোলাল টেকন। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ও বেরিয়ে যেতেই অন্যলোকগুলোর দিকে চেয়ে অসহায় ভঙ্গিতে ত্যাগ করল উইলসন। ভাবটা এমন যেন ওর আর কিছু করার নেই।
বাইরে এসে চারদিকটা দেখার জন্যে থামল টেকন। বুক ভরে নিল টাটকা বাতাস। আকাশ এখন অনেকখানি নীল। ঝলমল করছে সূর্য।
রাস্তার ওপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকাল সে। একটা বাড়ির চিমনি দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে। বাড়িটার দরজায় চোখ পড়তেই দেখতে পেল দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক তরুণী। সুন্দরী। তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। মাত্র কয়টি মুহূর্ত। তারপরই দ্রুত ভিতরে চলে গেল মেয়েটি। কিন্তু ওই নীরব ক’টি মুহূর্ত দু’জোড়া চোখ পরস্পরকে দেখে নিল প্রাণভরে।
২. বাঙ্কহাউসে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে
বাঙ্কহাউসে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিল টেকন। ক্লান্ত। মাথায় ঘুরছে কেবল একটিই চিন্তা। চলে যেতে হবে এখান থেকে। যত দ্রুত সম্ভব। তবে সেজন্যে চাই বিশ্রাম। রিভলভারের লোডিং পরীক্ষা করে দেখল সে। সেফটি হোলেও কার্তুজ ভরা হয়েছে। ফলে পুরো ছয়টি গুলি রয়েছে এখন ওটায়।
বাঙ্কহাউসের দরজাটা আচমকা খুলে গেল দড়াম করে।
চমকে উঠে দ্রুত পাশ ফিরল টেকন। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল রিভলভারে। গ্রিফিথকে দেখে পেশীতে ঢিল পড়ল। হ্যাণ্ডগান থেকে হাত সরিয়ে বলল, কি ব্যাপার?
টেকনের বাঙ্কের কাছে এল গ্রিফিথ। কোনও রকম ভূমিকা ছাড়াই বলল, ঘোড়ায় স্যাডল চাপিয়ে চলে যাও। এখুনি।
কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল টেকন। ধীরে ধীরে বলল, মিস্টার, তোমাকে তিনদিনের টাকা দিয়েছি আমি। এখন চলে যাবার কথা উঠছে কেন?
এই নাও তোমার টাকা। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে পারবে না তুমি। তোমাকে বার করে দিচ্ছি আমি, টাকাগুলো বাঙ্কের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল গ্রিফিথ।
টেকন মোলায়েম স্বরে বলল, ওদের কথায় তুমি মত বদলাচ্ছ। কই আগে তো কিছু বলনি। টাকাটা তুলে নাও। থাকছি আমি।
তোমাকে যেতেই হবে, গলা চড়িয়ে বলল গ্রিফিথ। ওরা বলে দিয়েছে।
টেকন চাইল ওর দিকে। ওরা কারা, মিস্টার? এখানে কি করছে?
জানি না, ক্রুদ্ধস্বরে বলল গ্রিফিথ। জানতে চাইও না। ওরা আমাকে ভাল পয়সা দিচ্ছে। কাজেই ওরা যা বলবে তাই করব আমি। ওঠো!
টেকন ভাবল খানিকক্ষণ, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, টাকাটা নিয়ে যাও। তিনদিনের আগে নড়ছি না আমি।
হতাশভঙ্গিতে পাশের একটা বাঙ্কে বসে পড়ল গ্রিফিথ। ওর দিকে চেয়ে বলল, বোকামি কোরো না। ওরা যা বলছে শোন।
ক্লান্ত চোখে গ্রিফিথের দিকে চেয়ে বলল টেকন, আমাকে ওরা তাড়াতে চাইছে কেন? ঘটছেটা কি, এখানে?
জানি না, আবার গলা চড়াল গ্রিফিথ, শুধু জানি, ওরা লোক ভাল নয়। বিশেষ করে রজার। ওকে চটিয়ো না। আবার বলছি চলে যাও এখান থেকে। এখুনি।
আমি থাকছি, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল টেকন।
ওর দিকে চেয়ে কাঁধ ঝাঁকাল গ্রিফিথ। কঠিন স্বরে বলল, যেতে তোমাকে হবেই। একভাবে না একভাবে। আমার উপদেশ পছন্দ হল না তোমার। বেশ। টাকাটা নিয়ে যাচ্ছি আমি, ঝুঁকে পড়ে বিছানা থেকে সিলভার ডলারগুলো তুলে নিল সে। আর একটিও কথা না বলে বেরিয়ে গেল। শুয়ে পড়ল টেকন। দীর্ঘশ্বাস, ফেলে চোখ বুজল।
বিকেলের আলো মরে এসেছে। স্যালুনে একটা টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে ওরা পাঁচজন। সামনে হুইস্কির বোতল। গ্রিফিথ ফিরে এসে জানিয়েছে, যাচ্ছে না টেকন।
সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি, হুঙ্কার ছাড়ল রজার।
প্লীজ, মাথা গরম করো না, অনুরোধ করল উইলসন। দেখি আমি ওকে বোঝাতে পারি কি না।
খামোকা সময় নষ্ট করছ, উইলসন। এভাবে হবে না, বলল রজার।
খামোকা নয়। মিস্টার হিগিন্স দু’একদিনের মধ্যেই আসছেন। তিনি কোনও রকম গোলমালে জড়াতে নিষেধ করেছেন আমাদের, জানোই তো, টেকনকে খুন করলে বিপদ হতে পারে। ওর বন্ধু থাকতে পারে। শত্রুও। তারা যদি এসে পড়ে এখানে তখন? পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাবে আমাদের। আমার ধারণা, ওকে বোঝাতে পারব আমি, বলল উইলসন।
বেশ। চেষ্টা করে দেখ। তবে না পারলে যা করার আমিই করব, বারের দিকে এগোতে এগোতে বলল রজার।
বাঙ্কে শুয়ে রয়েছে টেকন। মুখটা ফ্যাকাসে। দরজাটা খুলে গেল একসময়। ঢুকল উইলসন। শেষ বিকেলের ম্লান আলো এসে পড়ল দরজা দিয়ে। টেকনের পাশের বাঙ্কটায় এসে বসে পড়ল উইলসন। কি খবর? জিজ্ঞেস করল সে।
ভাল, বলল টেকন।
চুরুট বার করে ধরাল উইলসন। খাবে একটা? মাথা নাড়ল টেকন।
খানিকক্ষণ ওকে দেখল উইলসন। তারপর বলল, চলে গেলে তোমার ভাল হবে। মাইল দশেকের মধ্যে আরেকটা শহর পেয়ে যাবে। আজ রাতেই পৌঁছা’তে পারবে সেখানে।
সামান্য হাসল টেকন। মিথ্যে কথা। আশেপাশে আর কোনও শহর নেই।
প্রতিবাদ করল না উইলসন। কেবল বলল, চলে যাও, টেকন।
আধশোয়া ভঙ্গিতে উঠে বসল টেকন। সময় হোক, যাব।
বুঝতে চেষ্টা কর, উইলসনের কণ্ঠে অনুনয়। আমার বন্ধুদের বহুকষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত রেখেছি। ওরা অবুঝ। তোমার মতই। বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারব না ওদের। তাই বলছি, চলে যাও।
আর তিনটে দিন অপেক্ষা কর, কর্কশ শোনাল টেকনের কণ্ঠ।
তা হয় না, মাথা নেড়ে বলল উইলসন। দু’একদিনের মধ্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন লোক আসছেন এখানে। তিনি তোমাকে দেখলে বিপদ হবে।
‘কেন?’ প্রশ্ন করল টেকন।
বলা যাবে না। এটাই বলতে পারি তিনি অপরিচিত লোকজন পছন্দ করেন।
আমার পক্ষে এখন কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়, মদ গলায় বলল টেকন।
জানি, কিন্তু কিছু করার নেই। তোমার ঘোড়ায় স্যাডল চাপিয়ে দিচ্ছি। তুমি তৈরি হয়ে নাও, বলল উইলসন।
না, দঢ় স্বরে বলল টেকন।
বিকৃত হাসল উইলসন। চুরুটটা ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। বলল, আর না নয়, টেকন। আমি তোমাকে মাইল খানেক পথ এগিয়ে দিয়ে আসব। তৈরি হয়ে নাও। আর অপেক্ষা করল না উইলসন। বেরিয়ে গেল দ্রুত।
চুপচাপ খানিকক্ষণ বসে রইল টেকন। বুটজোড়া পড়ল কষ্ট করে। হাঁফ ধরে গেল। বাঙ্কের পাশ থেকে হুইস্কির বোতলটা তুলে নিল সে। ছিপি খুলে লম্বা এক ঢোক গিলল। বসে থাকতে ভাল লাগছে কিন্তু উপায় নেই। পরিস্থিতি চলে যাচ্ছে আয়ত্তের বাইরে। সামাল দিতে হবে। এখনই।
এ সময় আবার এসে ঢুকল উইলসন। ঠাণ্ডায় লাল হয়ে গেছে মুখ। অল্প খানিকক্ষণ ছিল বাইরে, তাতেই।
হল তোমার? স্যাডল চাপিয়ে ঘোড়াটা বেঁধে এসেছি। দাও, তোমার জিনিসপত্রগুলো দাও, ঝুঁকে পড়ে টেকনের বেডরোল এবং অন্যান্য জিনিসগুলো বাঁধতে লাগল সে। এখুনি রওনা হতে হবে। নইলে থাকার জায়গা পাওয়া মুশকিল হতে পারে। আঁধার হয়ে আসছে।
ধীরে উঠে দাঁড়াল টেকন। হাত বাড়াল রাইফেলটার দিকে, আমি নিচ্ছি এটা, তার আগেই তুলে নিল রাইফেলটা উইলসন। তারপর হাঁটা ধরল দরজার দিকে। তাকে অনুসরণ করল টেকন।
সীসের বর্ণ এখন আকাশ। তুষার পড়তে শুরু করেছে। ঘোড়ার পিঠে ১১০ বেডরোলটা বেঁধে দিল উইলসন। রাইফেলটা রাখল বুটে। উঠে পড়, বলল সে। হাসল। তারপর কোটের পকেট থেকে একটা হুইস্কির বোতল বার করে বাড়িয়ে দিল টেকনের দিকে। নাও। গ্রিফিথের স্পেশাল মাল।
হঠাৎই স্যালুনের দিকে পা বাড়াল টেকন।
কি হল? কোথায় যাচ্ছ?
স্যালুনে, না থেমেই জবাব দিল টেকন।
পাশে এসে পড়ল উইলসন, হাঁটতে হাঁটতে বলল, কিছু লাগবে? আমি এনে দিচ্ছি। তোমার যেতে হবে না।
না, বলল টেকন। আমিই যাব। দাঁড়িয়ে থাকল উইলসন। বলল, বোকামি করো না, টেকন।
জবাব না দিয়ে এগিয়ে চলল টেকন। দেখে নিল একবার কোটের বোতামগুলো ভোলা আছে কিনা। আছে। রিভলভারটা বার করতে অসুবিধা হবে না।
স্যালুনের বারান্দায় উঠে এল সে। ঠিক তখুনি খুলে গেল রাস্তার ওপারের বাড়িটার দরজা। দাঁড়াল টেকন। সেদিনের সেই মেয়েটি, থমকে গেল ওকে দেখে। তারপর দ্রুত নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। লম্বা একটা পোশাক পরেছে মেয়েটি। কাধ, মাথা ঢেকে রেখেছে শাল দিয়ে। চুলের রঙটা দেখতে পেল না টেকন। তবে কাছ থেকে দেখে বুঝল যথেষ্ট সুন্দরী মেয়েটি। অন্তত ও যা ভেবেছিল তার চেয়ে তো বটেই।
সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে থামল মেয়েটি, দু’জোড়া চোখ স্থির হল পরস্পরের চোখে। সেদিনের মতই। চোখ নামিয়ে নিল মেয়েটি। ঘুরল টেকন, শেষবারের মত দেখে নিল। তারপর ডানহাতে নব চেপে ধরে সজোরে ধাক্কা দিল দরজাটা।
দরজায় দাঁড়ানো টেকনের দিকে তাকাল সবাই। গ্রিফিথ দাড়িয়ে রয়েছে বারের পেছনে। অন্যরা যথারীতি আড্ডা মারছে টেবিল ঘিরে বসে। আলতো হাতে দরজাটা বন্ধ করল টেকন। ধীরপদক্ষেপে বারের সামনে গেল। খুলে ফেলল কোট। চোখ তার রজারের দিকে।
কোটটা বারের ওপর নামিয়ে রাখল টেকন, তারপর রজারকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি আরও কদিন থাকছি। কারও আপত্তি থাকলে এগিয়ে এস।
খানিকক্ষণ ওর দিকে চেয়ে রইল সবাই। হাসি প্রসারিত হল রজারের মুখে। উঠে দাঁড়াল সে। বেড়ালের ক্ষিপ্রতায়। শিকারের গন্ধ পেয়েছে যেন। খেলাটা বিপজ্জনক, সন্দেহ নেই। তবে আমি রাজি।
টেবিল ঘিরে ঘুরতে শুরু করল রজার। সিধে হল টেকন, হাত চলে গেল কোমরে। হ্যাণ্ডগানের বাঁটে। মনে মনে হিসেব কষল। এক গুলিতেই ঘায়েল করতে হবে রজারকে। বুকে করতে হবে গুলিটা। ওর বাঁ পাশের লোক দুটো পালাবে নিশ্চিত। কাজেই ডান দিকের লোকটাই হবে পরবর্তী টার্গেট, তবে উইলসনের অবস্থান সম্বন্ধে জানা নেই। খুব সম্ভব পেছনের দরজায় আছে সে। গ্রিফিথকে নিয়ে চিন্তা নেই। গোলাগুলি শুরু হলে ওর টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঠিক লুকোবে বারের পেছনে।
এগোচ্ছে রজার। সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করল টেকন। ওকে বেশি কাছে আসতে দেয়া চলবে না। কল্পিত একটা সীমারেখা টানল সে। দুজনের মাঝখানে। ওটা পেরোলেই গুলি করবে সে রজারকে। টেকনের হাতটা চেপে ধরল রিভলভারের বাট। ট্রিগার গার্ডের ভেতর চলে গেল আঙুল। রজারের হাতও শক্ত হল বাটে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করল টেকন। যে-কোন মুহূর্তে ড্র করবে রজার।
আর এক পা। তারপরই লাশ ফেলে দেবে সে রজারের। ঠিক সে মুহূর্তে দড়াম করে খুলে গেল স্যালুনের দরজা। ঘুরে তাকাল রজার। টেকনও দেখার জন্যে ফিরল। সেই মেয়েটি। দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজায়। চাপা উত্তেজনার ছোয়া পেয়েছে সে-ও, বুঝতে পারছে না ঘরে ঢুকবে কি না।
হ্যাট ছুঁয়ে নরম গলায় বলল টেকন, মিস, একটা মিনিট বাইরে অপেক্ষা করবে?
কৌতূহল ফুটল মেয়েটির চোখে। কেন?
আছে। একটা মিনিট অপেক্ষা কর।
না।
শ্রাগ করল টেকন। এই লোকগুলোর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া হচ্ছে। আমি চাই না তুমি থাক এখানে।
কিন্তু এখানে আমারও তো কাজ আছে, বলল মেয়েটি। তবে মুখ দেখে বোঝা গেল ব্যাপারটা বুঝেছে সে। নবাগত লোকটির প্রতি সহানুভূতি অনুভব করল সে। তার ধারণা ছিল লোকটি হিগিন্সের নতুন আমদানি। ভুল ধারণাটা ভাঙল তার।
প্লীজ, মিস, টেকন অনুরোধ করল আবার। হাত ছোঁয়াল হ্যাটে।
ঠিক আছে, টেকনের দিকে চেয়ে বলল মেয়েটি। বেরিয়ে যাওয়ার আগে চেঁচিয়ে বলল গ্রিফিথকে, আমাদের জন্যে ময়দা, চিনি আর বেকন পাঠিয়ে দিয়ে। গরুর মাংসও লাগবে।
পিকোকে দিয়ে এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি সব, বলল গ্রিফিথ।
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটি। কুৎসিত হাসি ফুটল আবার ব্লজারের মখে। ছড়িয়ে পড়ল। ওর দিকে চেয়ে টেকনের মনে হল, ব্যাটাকে খুন করলেও বিন্দুমাত্র দুঃখ হবে না তার। মুখোমুখি দাড়িয়ে ওরা। দুজনের হাতই হ্যাণ্ডগানের বটে। পেছনের দরজা দিয়ে এসময় ঘরে এসে ঢুকল উইলসন। আড়চোখে দেখে নিল তাকে টেকন।
মিস্টার গানম্যান, তোমার বাহাদুরী শেষ, একপা সামনে বেড়ে বলল, রজার।
ড্র করল টেকন। কিন্তু পেছন থেকে কে যেন চেপে ধরল তার দুহাত। গ্রিফিথ। মেয়েটা চলে যাওয়ার পরে উইলসন ঢুকেছিল। সেদিকেই লক্ষ্য ছিল। টেকনের। কখন যে বারের আড়ালে ঠিক তার পেছনে অবস্থান নিয়েছে গ্রিফিথ টেরই পায়নি সে। ছুটতে চেষ্টা করল টেকন। পারল না। এখন বুঝল কেন এত আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল রজারকে।
টেকনকে ততক্ষণে ঘিরে ফেলেছে তিনজন। চেপে ধরেছে হাত দুটো। ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়াল রজার। দু’কানে গিয়ে ঠেকেছে হাসি।
শোন, রজার, উইলসন বলল। পেছনে এসে দাড়িয়েছে সে।
তার কথায় কান দিল না রজার। কলার ধরে হ্যাচকা টানে সামনে এনে ফেলল টেকনকে। শক্তিশালী কঁধ দিয়ে সজোরে ধাক্কা মারল ওর বুকের বা দিকে। জখমে। বুক থেকে হঠাই যেন সব বাতাস বেরিয়ে গেল টেকনের। ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখ। একপাশে নুয়ে পড়ল শরীর। ওকে ধরে রইল, তোক তিনটি।
করছ কি? মেরে ফেলবে নাকি? তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল উইলসন।
মারব কেন? তুমিই তো নিষেধ করেছ। আমার হাতে মরবে না ও, তবে মরবে, বলল রজার।
চুলের মুঠি ধরে টেকনের মুখটাকে তুলল রজার। জোরালো চড়-চাপড় পড়ল। কয়েকটা। সোজা হয়ে দাড়ানোর চেষ্টা করল টেকন। অসম্ভব ভারি ঠেকছে পা দুটো। ওকে দাঁড়ানোর সুযোগ দিল রজার। তারপর প্রচণ্ড জোরে দুটো ঘুসি মারল। ক্ষতস্থানে। বসে পড়ল এবার টেকন।
হাসল রজার। ওকে নিয়ে যেতে পার। ঘোড়ায় চড়িয়ে দাও। এবার আর আপত্তি করবে না, উইলসনকে বলল সে।
মেয়েটি জানালায় দাড়িয়ে থেকে দেখল সবই। বাড়ির পথে পা বাড়াল এবার সে। কিন্তু স্যালুনের পেছন দরজা দিয়ে টেকনকে নিয়ে ওদের বেরোতে দেখে দাড়িয়ে পড়ল। দুদিক থেকে ওকে ধরে রেখেছে দুজন। ওদের সামনে উইলসন। পথ দেখাচ্ছে সে। টেকনকে তুলে দেয়া হল ঘোড়ায়। ঘোড়া খুলে দিল একজন। লাগামটা ধরিয়ে দিল টেকনের হাতে।
যাহ্ যাহ্! হ্যাট দিয়ে একজন চাপড়ে দিল ঘোড়ার পাছায়।
সবেগে ছুটল ঘোড়া। লাগাম ধরে কোনমতে বসে রইল টেকন। নুয়ে পড়েছে। একপাশে। দ্রুত দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ঘোড়া। মেয়েটি দেখল সবই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির পথে পা বাড়াল সে।
ব্যাটা গেল শেষ পর্যন্ত, বলল একজন।
হু, মরবে সন্দেহ নেই, উইলসন বলল।
হ্যাঁ, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই জমে বরফ হয়ে যাবে।
শহর থেকে মাইলখানেক বেরিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল ঘোড়াটি। তুষার ছাড়া আর কিছু নজরে এল না তার। বড় ঠাণ্ডা এখানে খুর দাপাল তুষারে। ঘোড়ার গলা ধরে কোনমতে বসে রয়েছে টেকন। অর্ধ সচেতন। অসম্ভব ব্যথা করছে বুকটা।
ফেলে আসা শহরটার দিকে তাকাল টেকনের ঘোড়া। তারপর কি মনে করে ফিরে চলল সেদিকেই। গলার ওপর অনভ্যস্ত ভার। মাথাটা নুয়ে এল। ধীরে ধীরে ফিরে চলল বাড়িগুলোর দিকে।
ওদিকে সানশাইন স্যালুনে যথারীতি তাসের আড্ডা বসেছে। মদ গিলছে লোকগুলো। নেশা ধরে গেছে ওদের। দৃষ্টি ঘোলা, আবোল তাবোল বকছে। জানালায় দাঁড়িয়ে ক্যাথি তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। অন্যমনস্ক। হঠাৎ কিছু একটা দেখে ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ হল তার। নড়ে উঠেছে কি যেন। আঁধারে দেখতে পেল না ভালমত। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এল সে। বাড়ির কাছেই রাস্তার মাঝখানে টেকনের ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে। পিঠে টেকন। স্যালুন থেকে বেশ অনেকটা দূরে।
ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল টেকন। শুয়ে রইল তুষারের ওপরেই। কেবল একটা মুহূর্ত। তীব্র শীত যেন সাড় ফিরিয়ে এনেছে তার। এখনও ধরে রেখেছে। লাগাম। ওঠার চেষ্টা করল সে। কিন্তু হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। মুখ থুবড়ে।
স্যালুনের দিকে চাইল ক্যাথি। আবছা আলো চোখে পড়ল তার। বারান্দায় দেখা গেল না কাউকে। জানালাতেও নেই কেউ।
তাসের আড্ডা জমে উঠেছে স্যালুনে। লম্বা একটা চুমুক দিল রজার হুইস্কির গেলাসে। পরিতৃপ্ত দেখাচ্ছে তাকে। উইলসনকে বলল, বলেছিলাম না, ওকে খুন করব না আমি। কথা রেখেছি?
জবাব দিল না উইলসন। উঠে চলে গেল বারের কাছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল ক্যাথি। টেকনের দিকে। হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে সে। ভাল করে শালটা জড়িয়ে নিল ক্যাথি। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার জোগাড়। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে। ওদিকে তুষারে টেকনের শরীর ঢেকে গেছে প্রায়। অসহিষ্ণু ঘোড়াটা খুর দাপাচ্ছে। অস্থির করে ফেলল ক্যাথি। বাঁচাবে লোকটাকে।
ধীর পায়ে নেমে এল সে। দ্রুত পৌঁছে গেল টেকনের কাছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে ওকে চিৎ করতে পারল। কান ঠেকাল বুকে। বেঁচে আছে। চিৎকার করে মেরীকে ডাকতে গেল সে। নামটা অর্ধেক বলেই থেমে গেল। চোখ চলে গেল স্যালুনের দিকে। কেউ নেই। উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে ছুটল সে।
মেরী অর্থাৎ কাজের মেয়েটিকে ডেকে আনতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল সে। মায়ের কাছে। ওর কথা শুনে বরান্দায় বেরিয়ে এলেন মা। বললেন, এর কথাই বলেছিলি? রজার যাকে…’
কথা শেষ করতে দিল না ক্যাথি। হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল মেরীকে।
টেকনের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল ক্যাথি। ঘড়ঘড় করে শব্দ করল টেকন। ভয় পেয়ে গেল মেরী। বলল, একে বাচানো যাবে না। শুধু শুধু বিপদে জড়াচ্ছি আমরা। চল, ফিরে যাই।
যা বলছি কর, নির্দেশ দিল ক্যাথি। হাঁটুতে ভর দিয়ে বসল টেকন। দুদিক থেকে টেনে তুলল ওকে ওরা। দাঁড়াল টেকন। ফিসফিস করে প্রশ্ন করল, আমি কোথায়?
ওর কথার জবাব দিল না ক্যাথি। টেকনের বিশাল দু হাত নিজেদের কাঁধে চাপাল ওরা। ধীরে ধীরে নিয়ে চলল ওকে বাড়ির দিকে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মা, বললেন, বড় বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেললি, ক্যাথি। হিগিন্স আসছে শিগগিরই। জানতে পারলে বিপদ হবে। আর ওর লোকগুলো যদি খুঁজতে আসে?
আসবে না,মাকে বুঝ দিল সে।
তিনজনে মিলে ওকে নিয়ে এল দোতলায়। মেরীর ঘরে। শুইয়ে দিল বিছানায়। মাকে বলল ক্যাথি, এখানেই থাকবে ও। দোতলায় আসবে না ওরা। মেরী শোবে আমার সঙ্গে।
চোখ বুজে খানিকক্ষণ পড়ে রইল টেকন। তারপর অস্ফুটে বলল, আমার ঘোড়া।
ব্যস্ত হয়ো না। আমরা দেখছি, বলল ক্যাথি।
নিচে নেমে এল ওরা তিনজন। মেরীকে বলল ক্যাথি, ওর ঘোড়াটা বার্নে তুলে দাও।
তাকে থামালেন মা। না, তাহলে সবাই ধরা পড়ে যাব। ওর জিনিসপত্রগুলো নিয়ে এস। ঘোড়াটা ছেড়ে দাও। ওরা মনে করবে ঘোড়াটা একা ফিরে এঋেছে।
যুক্তিটা পছন্দ হল ওদের। মা মেয়ে ফিরে চলল টেকনের ঘরে। দোতলায়। মেরী গেল টেকনের রাইফেল এবং অন্যান্য জিনিসগুলো আনতে।
স্যালুনে বসে, ওরা কেউ জানতেও পারল না কোন ফাঁকে এতসব ঘটনা ঘটে গেল।
৩. বাঙ্কহাউসে উইলসন, রজার এবং অন্য লোক
পরদিন সকাল। বাঙ্কহাউসে উইলসন, রজার এবং অন্য লোক তিনটির ঘুম ভাঙল প্রায় কাছাকাছি সময়ে। ফায়ারপ্লেসের সামনে জড়ো হল ওরা। খুব বেশি গিলে ফেলেছে কাল রাতে। রেশ কাটতে চাইছে না।
ইণ্ডিয়ান হারামজাদাটা কফি আনছে না কেন? খিস্তি করল রজার।
খানিক বাদেই খুলে গেল বাঙ্কহাউসের দরজা। বিশাল এক কফিপট হাতে ঘরে ঢুকল পিকো। অন্যহাত ভর্তি টিনের কাপ।
কফিপটটা নামিয়ে রাখল সে। ওটা টেনে নিয়ে নিজের কাপটায় কফি ঢালল রজার। তারপর পটটা বাড়িয়ে দিল অন্যদের দিকে। দাঁড়িয়ে রইল পিকো। কিছু বলতে চায়, সাহসে কুলোচ্ছে না। শেষমেশ বলেই ফেলল, আমাকে একটু হুইস্কি খাওয়াবে?
লাথি ছুঁড়ল রজার। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল পিকো। তারপর ছুটল দরজার দিকে। কফি শেষ করে লোকগুলো কাপড় পরতে লাগল একে একে।
মিস্টার হিগিন্স যদি আজই এসে পড়েন! বলল একজন।
আসতে পারেন, বলল উইলসন। শোনোনি টেকন বলছিল, রেলরোড় খুব কাছে এসে গেছে।
বার্নার্ড নামের লম্বা, হালকা-পাতলা লোকটি বলল, রেলরোড়, দুটো জোড়া দেবে কিভাবে বুঝতে পারছি না আমি। একটা শুরু করেছে ইস্ট কোস্ট হক, আরেকটা ওয়েস্ট কোস্ট। দুটো মেলাতে চায় কাছাকাছি কোথাও।
রেলরোড দুটো ইউট-র কাছে কোথাও মিলবে। এখান থেকে মাইল পঞ্চাশেক উত্তরে, বলল উইলসন।
ওজায়গাটা আমি ঘুরে দেখে এসেছি। ফাঁকা প্রান্তর। আবার কোথাওবা দুর্গম, মেলাবে কি করে? বলল বার্নার্ড।
জরিপ করেছে ওরা। মেলাবেই, ব্যাখ্যা করল উইলসন।
জরিপ করেছে মানে?
আহ্, চুপ করবে? খেকিয়ে উঠল রজার। ফালতু চিন্তা ছেড়ে কাজের কথা ভাব। কাজটা করতে পারলে ভাল পয়সা পাবে।
কারও মুখে কথা নেই। নীরবতা ভাঙল উইলসন। রজারের দিকে চেয়ে বলল, এতবড় একটা ব্যাপারে জড়াব, কোনদিন ভাবতেও পারিনি।
হুঁ, আমিও, সায় দিল রজার। ঠোঁট চাটল সে।
খানিক ইতস্তত করে বলল উইলসন, আমরা…মানে খুব বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলছি। তাই না?
মানে? রজার প্রশ্ন করল তাকে।
মানে••একটু ভয় ভয় করছে না?
ঠাণ্ডা দৃষ্টি বোলাল রজার, উইলসনের চোখে মুখে।
আমার করছে না।
তিতে ঠেকল উইলসনের জিভ। তবু বলল, এটা স্যালুন নয়। গলাবাজি করছি না আমি। বলতে চাইছি ব্যাপারটা খুব সাধারণ নয়। ব্যাঙ্ক ডাকাতি বা ফালতু কাউকে খুন করার মত সহজও নয়।
আমার কাজ টার্গেট সই করা। ব্যস। তাই করব আমি, একগুলিতেই শেষ করব ওকে। রজার বলল ঘৃণাভরে।
আর চুপ করে থাকতে পারল না বার্নার্ড। এতক্ষণ চরম আগ্রহ নিয়ে শুনছিল ওদের কথা। এবার বলল, একটামাত্র লোকের জন্যে এত খরচ? এতসব পরিকল্পনা?
সাধারণ লোক নয় ও, নরম গলায় বলল উইলসন। চাইলেই ওর পেটে পিস্তল ঠেকানো যাবে না।
তারমানে ওর চারপাশে গার্ড থাকবে প্রশ্ন করল বার্নার্ড।
থামবে তুমি? গলা উঁচিয়ে বলল রজার।
মুখ কালো করল বার্নার্ড। মিস্টার হিগিন্স দেশের সেরা পাঁচজন গানম্যানকে জড়ো করেছেন। কিন্তু কেন, সেটা জানতে চাইব না?
সময় হলে সবই জানতে পারবে, উইলসন বলল।
আমি বাইরে থেকে ঘুরে আসছি, কোট পরতে পরতে বলল একজন। বেরিয়ে এল সে। হাই তুলল। ঝলমল করছে রোদ। ওর নজর গেল গ্রিফিথের স্যালুনের দিকে। একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে স্যালুনের সামনে। লাগাম ঝুলে রয়েছে গলার কাছে। দেখে মনে হল পরিত্যক্ত। ওটার দিকে এগিয়ে গেল সে। তারপর ভালমত দেখে নিয়েই ছুটল বাঙ্কহাউসের দিকে। ঝড়ের বেগে। রজার, শিকারী ব্যাটা মনে হয় ফিরে এসেছে, বুড়ো আঙুল ঝাঁকাচ্ছে পেছন দিকে।
বাঙ্কে বসে ছিল রজার। নিরুত্তাপ গলায় প্রশ্ন করল, কি বললে?
ওর ঘোড়াটাকে দেখলাম, স্যালুনের সামনে। আর একটি কথা না বলে। লাফিয়ে নামল রজার। গানবেল্ট পরে নিল। বেরিয়ে এল দ্রুত। পেছনে অন্যরা।
রজার বলল উইলসনকে, সত্যি যদি ফিরে এসে থাকে তবে বেজন্মাটা এবার আর বাঁচবে না। দেখব মিস্টার হিগিন্স কি বলেন।
ঘোড়াটার কাছে গিয়ে থামল ওরা। ঠাণ্ডার ধকলে কাবু হয়ে গেছে। সারারাত বাইরে ছিল। লাগামটা ধরল উইলসন। বলল, ধ্যাৎ, ঘোড়াটা একাই ফিরে এসেছে। এই দেখ। স্যাডলে পুরু হয়ে জমে থাকা তুষার দেখাল সে। ঘোড়াটা সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। একাই ফিরে এসেছে।
আমারও তাই মনে হয়, সায় দিল বার্নার্ড। ঘোড়াটার দিকে তাকাল রজার, ঠোঁট চেটে বলল, আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।
আমি নিশ্চিত, উইলসন বলল। ঘোড়াটার পিঠে স্যাডল আছে। অথচ স্যাডলব্যাগগুলো নেই। রাইফেলটাও। লোকটা হয়ত ক্যাম্প করতে নেমেছিল কোথাও। সেই সুযোগে পালিয়েছে ঘোড়াটা।
কে জানে, রজার বলল। গাল চুলকাল, হতেও পারে।
উইলসন ঠিকই বলেছে, বলল আরেকজন। ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে থাকতে চায়নি ওটা। তাই পরিচিত পরিবেশে ফিরে এসেছে।
হয়ত তাই, উদাস কণ্ঠে বলল রজার।
স্যালুনের দিকে এগোল ওরা। চাইল রাস্তার দিকে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সাদা। তুষার ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না ওদের। লোকটা নিশ্চিত মারা গেছে। আহত অবস্থায়, ঘোড়া ছাড়া কারও পক্ষে টেকা সম্ভব নয়। উইলসন বলল।
তবু খোঁজ করা দরকার, রজার বলল। ফিরে এসে লুকিয়ে থাকাও অসম্ভব নয়।
তা অবশ্য ঠিক, সম্মতি জানাল উইলসন। বাঙ্কহাউস, স্যালুন আর ক্যাথিদের বাড়িতে থাকবেনা ও। তাহলে বাকি রইল বার্ন আর দুটো বাড়ি। বার্নার্ড, ঘোড়াটাকে বার্নে রেখে এস। আমরা বাড়ি দুটো দেখতে যাচ্ছি।
দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্যাথির মা। লোকগুলোকে জটলা করতে দেখলেন তিনি। তারপর ছড়িয়ে পড়ল ওরা। কেন সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না তার। ছুটে এলেন তিনি ক্যাথির ঘরে। ঘুমোচ্ছিল ক্যাথি। ডেকে তুললেন।
রজাররা ঘোড়াটা দেখতে পেয়েছে। খুঁজতে বেরিয়েছে লোকটাকে। ছুটে জানালার কাছে গেল ক্যাথি। লোকগুলোঁকে দেখতে পেল না, ওরা এখানে আসবে না, মাকে সান্ত্বনা দিল সে।
কি করে বুঝলি তুই? বিশ্বাস হল না মায়ের। ওরা ধরে নেবে ঘোড়া থেকে পড়ে মারা গেছে ও। আর খুঁজতে আসেও যদি দোতলায় আর আসবে না। কাজেই চিন্তা কোরো না।
কি জানি বাবা, আমার ভাল ঠেকছে না, চিন্তামুক্ত হতে পারলেন না মা।
স্যালুনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুরুট ফুকছে লোকগুলো। রজার বলল, কারও গিয়ে দেখে আসা দরকার রাস্তাটা। কোনও চিহ্ন পাওয়া যেতে পারে। লোকটা মরেছে কিনা নিশ্চিত হতে পারছি না।
কিছু করার নেই। সারারাত তুষার পড়েছে। তুষার খুঁড়ে চিহ্ন বার করা অসম্ভব, উইলসন বলল।
জানি। তবুও। মিস্টার হিগিন্স আসছেন…’ কথা শেষ করতে পারল না। রজার। বাধা দিল তাকে উইলসন। ব্যাপারটা কি রজার? এত খুঁতখুঁত করছ কেন? এই শীতে কি কেউ আশ্রয় ছাড়া বাঁচে? আসলে ভয় পাচ্ছ তুমি। তাই না? ও বেঁচে থাকলে প্রতিশোধ নেবেই।
জবাব দিতে পারল না রজার। চুপ করে রইল। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে অস্বস্তি।
মেরীর ঘরে শুয়ে রয়েছে টেকন। ওর শার্টটা খুলে ফেলল ক্যাথি। কেটে দিল গেঞ্জি। ফলে বেরিয়ে পড়ল ব্যাণ্ডেজ। শুকনো রক্ত লেগে রয়েছে। কাচি দিয়ে সাবধানে ওটা কাটতে লাগল ক্যাথি। বোকা, আপন মনেই বলল সে। নইলে এ অবস্থা হয়?
পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন ওর মা এবং মেরী। মায়ের মুখ গম্ভীর। মেয়ের কাজ কারবার মোটেও ভাল লাগছে না তার। কোত্থেকে একটা উটকো লোককে ধরে নিয়ে এসেছে। হিগিন্সের লোকেরা জানতে পারলে ভয়ানক বিপদ হবে। এমনিতেই ওরা সানশাইন ছেড়ে যেতে দিচ্ছে না ওদের।
ব্যাণ্ডেজটা কাটা হয়ে গেছে। চামড়ার সাথে শক্ত হয়ে লেগে রয়েছে ব্যাণ্ডেজ। ফলে ওটা খোলার সময় তীব্র ব্যথায় ছটফট করতে লাগল টেকন।
ক্যাথি খুলে ফেলল ব্যাণ্ডেজটা। বেরিয়ে পড়ল ক্ষত। চমকে উঠলেন ক্যাথির মা। দগদগে ঘা। লাল বুলেটের ফুটোটা চোখে পড়ল পরিষ্কার।
মাগো, লোকটা বেঁচে আছে কিভাবে? বলল মেরী। বিকৃত হয়ে গেছে মুখ।
জখমটা ভাল হয়ে যেত আপনিই। বোকা লোকটা রজারের সঙ্গে লাগতে গিয়ে এ অবস্থা করেছে নিজের, ক্যাথি বলল।
ক্ষতস্থানের চারপাশে আঙুল দিয়ে আলতো করে চাপ দিল সে। গুঙিয়ে উঠল টেকন।
পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে। আমাদের করার নেই কিছু। মেরী,খানিকটা গরম পানি আর সাবান নিয়ে এস গে। ক্ষতটা পরিষ্কার করতে হবে, ক্যাথি বলল।
ক্যাথি যখন ক্ষতস্থান ধুয়ে দিচ্ছে তখন নড়ে উঠল টেকন। ব্যথা লাগছে। চোখের পাতা দুটো কাপল তার। তবে খুলল না। অসহ্য যন্ত্রণা, গুলিটা লাগার পর যেমন লেগেছিল ঠিক তেমন।
আচ্ছন্ন টেকনের মনে নানা কথা ভিড় করছে এসে। ফিরে আসতে চাইছে স্মৃতিরা। হ্যাঁ, মনে পড়ে গেছে। হিংস্র একটা মুখ। হুরন, না না, হুরনের ভাই স্যাটান। হুরন তো আগেই মারা গেছে। পুবের একটা পরিবারকে সাহায্য করেছিল টেকন। তখনই বেধেছিল গোলমালটা। হুরনের সঙ্গে গানফাইটে নামতে হয়েছিল তাকে। তার জীবনের ভয়ঙ্করতম প্রতিপক্ষ। কিন্তু যতই ভয়ঙ্কর হোক টেকনের কাছে ঠিকই হার মেনেছিল সে। মারা পড়েছিল।
তারই ভাই স্যাটানের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল টেকনের। একটা স্যালুনে। ওকে খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির হয়েছিল স্যাটান। দুর্ধর্ষ গানফাইটার সে-ও। তবে ফেয়ার ফাইটে টিকতে পারেনি টেকনের সামনে। বিদ্যুৎ গতিতে ড্র করেছিল টেকন। গুলি খেয়ে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল স্যাটানের দেহ। আছড়ে পড়েছিল একটা চেয়ারের ওপর। তবে তার আগে ছোবল দিয়ে গিয়েছিল সে। পাঁজর ফুটো করে দিয়েছিল টেকনের।
আর ভাবতে পারল না টেকন। পড়ে রইল চুপ-করে।
৪. ক্যাথি ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিতেই
ক্যাথি ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিতেই চোখ মেলল টেকন। ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করল। চাইছে এদিক ওদিক। অপরিচিত পরিবেশ।
উঠতে হবে না। শুয়ে থাক, ক্যাথি বলল।
আমি এখানে কেন? বলল টেকন। চিনতে পেরেছে ক্যাথিকে।
পরে শুনো। এখন বিশ্রাম নাও, নরম গলায় বলল ক্যাথি।
এসময় ঘরে ঢুকলেন ক্যাথির মা। হাত ধরে টেনে কিছুটা দূরে নিয়ে গেলেন ওকে। কাজটা কি তুই ভাল করছিস? চাপা গলায় বললেন তিনি।
‘কোন কাজ, মা?’ না বোঝার ভান করল ক্যাথি।
‘এই যে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এলি লোকটাকে। ওরা জানতে পারলে কি অবস্থাটা হবে ভেবে দেখেছিস?’
মা, লোকটা আহত।
জানি। কিন্তু আমাদের কি করার আছে বল, ওরা লোক ভাল নয়। তোর বাবাকে মেরেছে। আমাদের আটকে রেখেছে। হিগিন্স বলেছিল মাস খানেকের মধ্যেই ছেড়ে দেবে। এখন এ ঘটনা জানতে পারলে ছাড়বে মনে করিস? ছাড়বে না। তাই বলছি, লোকটাকে চলে যেতে বল।
মাথা নাড়ল ক্যাথি। বলল, না, মা। সেটা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমরা ওদের পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলেছি। এত সহজে ওরা ছাড়বে না আমাদের।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন ক্যাথির মা। মা বেরিয়ে গেলে ক্যাথি ফিরে এল। টেকনের বিছানার পাশে। বলল, তুমি শিগগিরই সেরে উঠবে। বিশ্রাম নাও, খাও-দাও। কথাটা বলেই সরে যাচ্ছিল সে, শক্ত একটা হাত চেপে ধরল তার কব্জি। দুজোড়া চোখ স্থির হল, টেকন বলল, আমি চাই না, আমার জন্যে তোমাদের কোনও বিপদ হোক ক্যাথি। নামটা উচ্চারণ করতে দ্বিধা করল টেকন।
‘ও নিয়ে ভেব না।’
কব্জি ধরেই রেখেছে টেকন। শেষ পর্যন্ত ঝুঁকে পড়ে ওর কপালে চুমু খেল ক্যাথি। সোজা হয়ে বলল, আমি নিচে যাচ্ছি, তোমার জন্যে সুপ বানিয়ে আনছি। খেয়েই ঘুমোতে চেষ্টা করবে। ক্যাথি চলে যাওয়ার পর ঘরটা ভালভাবে দেখে নিল টেকন। এই প্রথম। ওর রাইফেলটা দাঁড় করানো রয়েছে এক কোণে। রিভলভারটা অন্যান্য জিনিসগুলোর সাথে রয়েছে সেখানেই। নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুজল টেকন।
শীতের বিকেল ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। সুপের বাটি নিয়ে ফিরে এল ক্যাথি। বার্লির সুপ, গরুর মাংসের টুকরোও আছে।
কি অবস্থা? জিজ্ঞেস করল ক্যাথি।
ভাল।
বিছানার পাশে বসল ক্যাথি। বাটিতে চামচ ডুবিয়ে তুলে ধরল টেকনের মুখের কাছে। মুখ সরিয়ে নিল ও। কয়েকটা ব্যাপার জানতে চাই আমি, বলল টেকন।
প্রথমে জবাব দিল না ক্যাথি। তারপর মৃদুস্বরে বলল, কি ব্যাপার?
আমি এখানকার কিছুই বুঝতে পারছি না। এই শহর, স্যালুনের লোকজন, তুমি, সবাই কেমন যেন রহস্যময়।
এখানে রহস্যের কিছু নেই। হিগিন্স একটা বিশেষ কাজের জন্যে জড়ো করেছে এদের।
কাজটা কি?
জানি না।
ক্যাথি, প্লীজ। আমার জানা দরকার…
হঠাৎ রেগে উঠল ক্যাথি। গলা চড়িয়ে বলল, ফালতু কথা ছাড়। আমি কিছু জানি না। জানলেও বলব না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হও। তারপর দুর হয়ে যাও এখান থেকে।
ক্যাথির রেগে ওঠার কারণ বুঝতে পারল না টেকন। এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াল না সে। জেনে নেয়া যাবে পরে এক সময়। মৃদু হেসে বলল, তোমার কথা জানতে চাই। বলতে আপত্তি আছে?
‘আমার কি কথা?’ অবাক হয়ে বলল ক্যাথি, মুখে সামান্য হাসি।
এই কিভাবে এলে এখানে সেসব।
‘ওসব শুনে লাভ নেই,’ গম্ভীর মুখে বলল ক্যাথি। চাইল ওর দিকে। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল, বাবার সাথে পুব থেকে পশ্চিমে এসেছিলাম। পথে ওয়াগনের চাকা ভেঙে যাওয়াতে এ শহরে আসি। সন্ধে হয়ে এসেছিল তখন। কিন্তু ঢুকতে না ঢুকতেই ওরা চলে যেতে বলে আমাদের। বাবা হিগিন্সের হাতে-পায়ে ধরে রাতটা কাটানোর ব্যবস্থা করেন। সেদিন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ছিল। বাবা ওয়াগনের চাকাটা মেরামত করে রাতে স্যালুনে ঢুকেছিলেন গলা ভেজাতে। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ শুনলাম। বাবার খোঁজ করতে গিয়ে দেখি মেঝেতে পরে রয়েছেন তিনি। মারা গেছেন। রজারের হাতে পিস্তল।
তোমার বাবা কি করেছিলেন? প্রশ্ন করল টেকন।
ওদের কথা শুনে ফেলেছিলেন বাবা।
আচ্ছা হিগিন্সটা কে? প্রথম থেকেই ওর নাম শুনছি।
ও হচ্ছে দলটার নেতা। টাকা-পয়সা সব ও-ই দিচ্ছে।
কিন্তু কেন? হাজার প্রশ্ন এসে ভিড় করল টেকনের মনে। এই শহরের আশেপাশে স্বর্ণখনি নেই। বড় কোনও র্যাঞ্চও নেই। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সোনার চালানও আসছে না। আছে কেবল ওই রেল রাস্তা। তা-ও কাজ শেষ হয়নি। তবে কিসের জন্যে এতসব?
কোন উত্তর দিল না ক্যাথি। সুপের বাটিটা টেকনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
৫. চারজন ঘোড়সওয়ারকে আসতে দেখা গেল
পরদিন সকালে চারজন ঘোড়সওয়ারকে আসতে দেখা গেল সানশাইন শহরের দিকে। একজন লোক আর্মি অফিসারের মত নেতৃত্ব দিচ্ছে দলটির। ওর কাপড় চোপড়ের মানও অন্যান্যদের চেয়ে উন্নত। পরনে লম্বা কোট। মাথায় বিবরের চামড়ার হ্যাট। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো জরিপ করছে সবকিছু। তার নিষ্ঠুরতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে মুখে।
বার্নার্ডই প্রথম দেখতে পেল দলটাকে। স্যালুনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট কুঁকছিল সে। বাঁ দিকে চোখ পড়তেই সোজা হল। দলটা কয়েক শ গজ দূরে থাকতেই ও ঘুরে ঢুকে গেল স্যালুনে। দ্রুত। অন্যরা নাস্তা সারতে ব্যস্ত তখন। ওদের টেবিলের কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল সে, হিগিন্স, মিস্টার হিগিন্স আসছেন। অন্যরাও আছে সঙ্গে।
মৃদু হেসে বলল উইলসন, এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? চুপ করে বস।
বার্নার্ড একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, আমাদের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করা উচিত না?
হাসল উইলসন, কোনও দরকার নেই। মাংসের টুকরো চিবোতে চিবোতে বলল রজার, কত দূরে ওরা?
কাছেই, বলল বার্নার্ড, এই এল বলে।
প্লেটে কাঁটা চামচ নামিয়ে রাখল রজার। আমরা কদ্দিন ধরে বসে আছি? উইলসনকে প্রশ্ন করল সে।
চুলে আঙুল চালিয়ে বলল উইলসন, মাসখানেক তো হবেই।
অথচ মনে হচ্ছে বছর পেরিয়ে গেছে, বলল রজার।
উইলসন সায় দিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ।
তবে শিকারী শালাকে প্রত্যেকদিন ধোলাই দিতে পারলে বোধহয় এতটা একঘেয়ে লাগত না, ঠোঁট চেটে বলল রজার।
এখন আর একঘেয়ে লাগবে না। আমাদের কাজ বোধহয় দু’একদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে, বার্নার্ড বলল।
ঘোড়সওয়াররা এসে থামল স্যালুনের সামনে। লোক তিনটি নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। রুক্ষ, মারকুটে চেহারা। এবার স্যাডল থেকে নেমে লাগামটা ফেলে দিল হিগিন্স। কেউ না কেউ ঘোড়াটার দায়িত্ব নেবে, ভাবটা এমন। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে এল সে। কাপড় থেকে তুষার ঝাড়ার প্রয়োজন বোধ করল না। দুজা খুলে ঘরে পা রাখল। ওকে দেখে টেবিলে বসা লোকগুলো উঠে দাঁড়াল। বিড়বিড় করতে লাগল রজার। বিরক্ত।
গা থেকে কোটটা খুলে ফেলল হিগিন্স। ছুঁড়ে ফেলল কাছের একটা চেয়ারে। ভালই আছ দেখছি, সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল সে। চুরুট ধরাল। তারপর গ্রিফিথের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদেরকে ড্রিংক দাও।
ইয়েস, স্যার।
আমার প্রাইভেট স্টক থেকে দিয়ো।
ইয়েস, স্যার।
অন্য লোক তিনটি ঘরে ঢুকল এসময়। হ্যাণ্ডশেক করল ওদের পাঁচজনের সাথে। বোতল এসে গেল।
আমি অনেকদূর থেকে এসেছি। এখন আর কোন কাজের কথা নয়। এস, সাফল্য কামনা করে টোস্ট করি আমরা, গেলাসটা তুলে বলল হিগিন্স।
ক্যাথি তখন টেকনের জন্যে নাস্তার ব্যবস্থা করছে। এসময় ছুটে এল মেরী। হাঁপাতে হাঁপাতে ঝলল, ক্যাথি, হিগিন্স এসেছে।
এখানে?
না, বলল মেরী। দলবল নিয়ে স্যালুনে ঢুকেছে।
ঠিক আছে, যাও তুমি, শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বললেও ভেতরে ভেতরে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল ক্যাথি।
টেকনের ঘরে গিয়ে বিছানার পাশে বসল সে। ওকে দেখে উঠে বসল টেকন। দেখেই বোঝা গেল অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছে এখন।
তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন? ক্যাথিকে প্রশ্ন করল টেকন।
একটা খারাপ খবর আছে। হিগিন্স এসে পড়েছে। তোমাকে চলে যেতে হবে, মুখ কালো করে বলল ক্যাথি।
ঠিক আছে, যাব, বিছানা থেকে নামতে লাগল টেকন।
এখন নয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
কেন?
কেন? তখন পালাতে সুবিধে। তবে মনে করো না তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি আমি। তোমার ভালর জন্যেই বলছি। হিগিন্স না ফিরলে আরও দিন দুয়েক থাকতে পারতে। এখন আর সেটা সম্ভব নয়।
তোমার এখান থেকে আজই চলে যাব আমি। কিন্তু এশহর ছেড়ে যাচ্ছি না, টেকন বলল।
‘কেন?’
কাজ আছে।
কিসের কাজ? কোনও কাজ নেই। এখান থেকে পালানোই তোমার কাজ। মখের পেশীগুলো শক্ত হল ক্যাথির।
রজারের কথা ভুলে গেছ?
ওহ্ হো! রজার, হতাশ ভঙ্গিতে ওর দিকে চাইল ক্যাথি। কিন্তু নয়জনের বিরুদ্ধে একা কিছুই করতে পারবে না তুমি। রজারের কথা ভুলে যাও।
না।
বোকামি করো না।
উপায় নেই।
খানিকক্ষণ একে অপরকে দেখল ওরা নিঃশব্দে। কি করতে চাও তুমি? নীরবতা ভাঙল ক্যাথি।
‘বার্নে বা অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকব আমি। রজারকে বাগে পাওয়ার জন্যে।’
আসলে মরার সাধ হয়েছে তোমার।
‘আমার মনে হয় মরার নয়, মারার।’
উঠে পড়ল ক্যাথি। পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যাব আমি আজ সন্ধ্যায়, বলল টেকন।
দরকার নেই। কালকের দিনটা থেকে চলে যেয়ো, ক্যাথি বলল। আপত্তি করল না টেকন।
বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দরজায় দাঁড়াল ক্যাথি। তারপর ওর দিকে ফিরে বলল, খুন যদি করতেই হয় কাউকে, তবে হিগিন্সকে নয় কেন?
‘ওর সঙ্গে আমার শক্রতা নেই,’ গম্ভীরমুখে বলল টেকন।
মৃদু হাসল ক্যাথি। আমি মেরীকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। বেরিয়ে গেল সে।
ক্যাথি চলে গেলে বিছানা থেকে নামল টেকন। হাত-পা ছড়িয়ে, ঝুঁকে অল্পক্ষণ হালকা ব্যায়াম করে নিল। প্রথমে কষ্ট হল বটে তবে দাঁত চেপে সহ্য করল সে। আবার বশে আনতে হবে শরীরটাকে। হাত দুটো তুলে মুঠো পাকাল। খুলল। অনেকটা সুস্থ বোধ করছে এখন। পরে নিল বুটজোড়া।
বিছানার কিনারে এসে বসল সে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তুলে নিল বিশাল। রাইফেলটা। প্রায় ছ’ফুট লম্বা অস্ত্রটা। শটগানের মত পেছন দিকটা ভেঙে গুলি ভরতে হয়। ওটা বিছানায় রেখে ঘরের কোণ থেকে চামড়ার তৈরি বেশ বড়সড় একটা থলি নিয়ে এল। ওটা থেকে বার করল প্রমাণ সাইজের একটা গুলি। গুলিটা ভরে রাইফেলটা নামিয়ে রাখল বিছানায়। থলিটা থেকে বার করল কার্তুজ তৈরির বিভিন্ন মাল-মশলা। পিতলের খোসা, বুলেটের চোখা মাথা, গান পাউডার। গুলি বানাতে বসল সে। একটা করে কার্তুজ বানাচ্ছে আর যত্ন করে সাজিয়ে রাখছে বিছানায়।
স্যালুনে হুইস্কির বোতল খালি হয়ে এসেছে প্রায়। গেলাসে লম্বা এক চুমুক দিল হিগিন্স। পরিতৃপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বারের দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রিফিথ, ছেলেটাকে নিয়ে তুমি একটু বাইরে যাও। কিছু লাগলে আমরা নিয়ে নেব।
ইয়েস, স্যার। অ্যাপ্রন খুলে কোট পড়ে নিল গ্রিফিথ। তারপর পিকোকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা বেরিয়ে গেলে বার্নার্ডকে দরজায় পাঠাল হিগিন্স। আড়ি পাতেনি কেউ নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। চলে গেছে, টেবিলে ফিরে এসে বলল বার্নার্ড।
পকেট থেকে একটা ম্যাপ বার করল হিগিন্স। খুলে ছড়িয়ে দিল টেবিলে। রেল লাইন দুটো আর মাইল ত্রিশেক দূরে রয়েছে। প্রতিদিন চার মাইল করে দূরত্ব কমে আসছে। আশা করা যায় সপ্তাখানেকের মধ্যেই মিলে যাবে
ম্যাপের বিশেষ একটা জায়গা দেখাল সে। এখানে।
উইলসন দেখে বলল, প্রোমন্টরি পয়েন্ট, ইউট। শহর নাকি?
না, ওটা রেলরোড কোম্পানির দেয়া নাম। যাই হোক, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কবে হবে এখনও ঠিক হয়নি।
বার্নার্ড জিজ্ঞেস করল, সোনার পেরেক দিয়ে নাকি জোড়া দেয়া হবে লাইন দুটো?
হ্যাঁ, বলল হিগিন্স। আমি যেটা বলছিলাম, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নির্ভর করছে ওয়াশিংটন আর রেলকর্তাদের ওপর। কিন্তু সেজন্যে তো আর বসে থাকা যায় না। দিন কয়েকের মধ্যেই চলে যাব আমরা এখান থেকে। প্রোমন্টরি পয়েন্টের কাছাকাছি ক্যাম্প করব কোথাও।
ইতস্তত করে বলল উইলসন, পালানোর কোন ব্যবস্থা করা হয়েছে, মিস্টার হিগিন্স? আগে থেকে জানা থাকলে ভাল হয়।
মাথা নাড়ল হিগিন্স। ভাল পয়েন্ট। চুরুট ধরাল।
দক্ষিণে প্রতি দশ মাইল অন্তর ঘোড়া বদলানোর সুযোগ থাকবে। প্রত্যেকের জন্যে রেডি থাকবে চারটে করে ঘোড়া। ওরা অনুসরণ করলেও ধরতে যাতে না পারে সেজন্যে। সবার দিকে চেয়ে ধোয়া ছাড়ল সে। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। অত লোকের ভিড়ে কেউ বুঝতে পারবে না। কোত্থেকে গুলি এসেছে। ধাঁধায় পড়ে যাবে গার্ড আর, সৈন্যরা। কোন খুঁত রাখা হয়নি পরিকল্পনায়।
লোকটা গুরুত্বপূর্ণ। মৌমাছির চাকে ঢিল পড়ার অবস্থা হবে, বলল উইলসন।
তা ঠিক। তবে চিন্তার কিছু নেই, দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে তোমাদের। আরও চিন্তা-ভাবনা আছে আমার। সময়মত জানতে পারবে, হিগিন্স বলল।
থ্যাঙ্ক ইউ, উইলসন বলল।
এবার কাজের কথায় আসি, বলল হিগিন্স। আরেকটা মোড়ানো কাগজ মেলে ধরল সে টেবিলের ওপর। গেলাস এবং বোতল দিয়ে চাপা দিল কোনাগুলো। এটা খসড়া যদিও, তবে এর মধ্যেই ডিটেইলস আছে। এখানে আঙুল দিয়ে দুটো লাইন দেখাল সে। পুব-পশ্চিম দুটো রেল পথই দেখানো হয়েছে। আর এখানে
একটা ক্রস চিহ্ন দেখিয়ে বলল, মিলবে ও দুটো। পুরো এলাকাটাই রুক্ষ, পাথুরে। এখানটাতে- তর্জনী রাখল সে বিশেষ একটি জায়গায়, একটা টিলা আছে। টার্গেটে আঘাত করার জন্যে চমৎকার জায়গা। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়। এই টিলার ওপর থেকেই গুলি করবে রজার।
ওদের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল হিগিন্স। হাসিটা সংক্রমিত হল অন্যদের মাঝেও। রজারের দিকে চাইল ওরা। গর্বে বুক ফুলে উঠল রজারের।
আবার শুরু করল হিন্সি, তিনশো বায়ান্ন গজের দূরত্ব। বারবার মাপা হয়েছে। মিস করার প্রশ্নই ওঠে না, কি বল, রজার?
মাথাটা পেছনে হেলিয়ে বলল রজার, আমার ৪০৫ রাইফেল দিয়ে চারশ গজ দূরের যে কাউকে হিট করতে পারব আমি। শরীরের যে-কোনও জায়গায়।
ওর পিঠ চাপড়ে দিল উইলসন।
মাথা ঝাঁকাল হিগিন্স। সন্তুষ্ট। ম্যাপটাতে হাত বুলিয়ে বলল, অনেক সময় নিখুঁত প্ল্যানও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সেজন্যে উইলসন আর চ্যান্সি টিলায় থাকবে, রজারের সাথে। রজারের কিছু হয়ে গেলে রাইফেল তুলে নিয়ে গুলি করবে উইলসন। ওরা গুলি চালালে চ্যান্সি উইলসনকে প্রটেকশন দেবে। তবে এত কিছুর দরকার আসলে পড়বে না। যা জেনেছি, সিকিউরিটি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না ওরা।
সবার দিকে চাইল সে, ধীরে ধীরে বলল, রজার যদি মিস করে…’
বাধা দিল রজার। কর্কশ গলায় বলে উঠল, রজার মিস করবে না। খামোকা সময় নষ্ট করছেন আপনি।
ভাল, মন্তব্য করল হিগিন্স। তবু সাবধানের মার তো নেই। ঘোড়াগুলোর দেখাশোনা করবে বার্নার্ড। স্যাণ্ডার্স আর টাইগার ছদ্মবেশে রেলকর্মীদের সঙ্গে মিশে যাবে। সোনার পেরেক ঠোকার সময় কাছেপিঠেই থাকবে তোমরা। রজারের গুলিতে টার্গেট যদি গুরুতর আহত না হয় তবে গুলি চালাতে থাকবে টাইগার। পিস্তল দিয়ে স্যাণ্ডার্স প্রটেকশন দেবে তোমাকে। আর তোমাদের জন্যে ঘোড়া নিয়ে তৈরি থাকবে বার্নার্ড। কার্টার আর এলভিস ফেডারেল টুপারের পোশাকে থাকবে। তোমাদের কাজও টাইগার আর স্যাণ্ডার্সের মত। তবে বাড়তি সুবিধে পাবে তোমরা। গভর্নমেন্টের ইস্যু করা কারবাইন ব্যবহার করতে পারবে। বুঝেছ সবাই?
টাইগার গলা খাকারি দিয়ে বলল, বুঝেছি। কিন্তু ভিড়ের মধ্য থেকে গুলি করে পালাবে কিভাবে?
একটা কথা বুঝছ না কেন, আমাদের মত প্ল্যান-পরিকল্পনা করেনি ওরা। প্রথম গুলিটা হলেই ওরা হতভম্ব হয়ে যাবে। উল্টো-পাল্টা গুলি ছুঁড়তে থাকবে। ফলে কাজ সেরে পালাতে অসুবিধে হবে না। আর ঘোড়া তো তৈরি থাকবেই। ওদের নাগালের বাইরে চলে যেতে সময় লাগবে না।
সেরকম হলেই ভাল, উইলসন বলল।
এ ব্যাপারে বাকি আলোচনা ক্যাম্পে সেরে নেব, বলল হিগিন্স। মুড়িয়ে রাখল ম্যাপ, খসড়া।
বড় করে শ্বাস টেনে বলল, এবার এদিককার খবর বল। কোনও ঝামেলা হয়নি তো?
তেমন কিছু না। একটা লোক এসেছিল কেবল। ও…বার্নার্ড কথা শেষ করার আগেই গর্জে উঠল রজার। চুপ করে গেল বার্নার্ড।
কে? কে এসেছিল? প্রশ্ন করল হিগিন্স।
এই এক ভবঘুরে শিকারী। চলে গেছে, দ্রুত সামাল দেয়ার চেষ্টা করল উইলসন।
কিছু বুঝতে পারেনি তো? তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে চাইল হিগিন্স।
না, না। কোন প্রশ্নই ওঠে না, মৃদু হেসে রজারকে একবার দেখে নিল উইলসন।
গুড। বাইরে কাউকে বুঝতে দেয়া চলবে না। চেয়ারে নিচু হয়ে বসল সে। ছড়িয়ে দিল পা। মৃদু গলায় প্রশ্ন করল, পুবের পরিবারটা কেমন আছে? পালানোর চেষ্টা টেষ্টা করেনি তো?
সামান্য হেসে বলল উইলসন, না। ঘোড়া পাবে কোথায়? আর এই শীতে যাবেই বা কি করে?
তা ঠিক। বার্নার্ড, আরেকটা বোতল নিয়ে এস গে, খুশি হয়ে বলল হিগিন্স।
শেষ বিকেল। বিছানায় বসে কার্তুজ বানিয়েই চলেছে টেকন। শ’খানেক হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। প্লেটে খাবার নিয়ে এসময় ঘরে ঢুকল ক্যাথি। গরুর মাংস নিয়ে এসেছে। বিছানায় প্লেটটা নামিয়ে রাখল সে।
রজারের জন্যে এতসব আয়োজন? প্রশ্ন করল ও।
না, কাজ করতে করতেই জবাব দিল টেকন। তাহলে এত গুলি তৈরি করছ কেন?
সময় কাটাচ্ছি। কোনও কাজ তো নেই।
জানালায় গিয়ে দাঁড়াল ক্যাথি। বাইরের দিকে চেয়ে বলল, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আঁধার হয়ে যাবে।
টেকন জবাব দিল না। কার্তুজ বানিয়েই চলেছে। ওর কাছে এসে বলল ক্যাথি, মেরীকে বলেছি একটা ব্যাগে খাবার দিয়ে দেবে।
কেন?
কারণ আঁধার হলেই এশহর ছেড়ে চলে যাচ্ছ তুমি। তোমার ঘোড়াসহ।
সেটা সম্ভব নয়, ক্যাথি, শান্তকণ্ঠে, বলল টেকন।
কেন নয়? হিসিয়ে উঠল ক্যাথি। ওদের সঙ্গে পারবে না তুমি। আমি বলছি, তুমি চলে যাবে।
ওরা কারা? ঘটছেটা কি এখানে? আমাকে বলতে চাও না কেন তুমি? নরম গলায় প্রশ্নগুলো করল টেকন।
আগেই বলেছি আমি জানি না কিছু। শুধু এটুকু জানি রজার ওদের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় লোক। ওর কিছু হলে বাঁচবে না তুমি।
আমার কিছু করার নেই, ক্যাথি।
আছে। পালাও! ধরা পড়লে চোখের পলক পড়ার আগেই খুন হয়ে যাবে।
আমার প্রশ্নগুলোর জবাব কিন্তু পাইনি এখনও।
জবাব একটাই। ধরা পড়লে কেউ বাঁচাতে পারবে না তোমাকে। ওরা নয়জন, তুমি একা।
আচ্ছা, হিগিন্স কে? এখানে কি করছে?
আবার একই প্রশ্ন? লোকের কাজ করে দেয় হিগিন্স। প্রচুর টাকার বিনিময়ে। পুরো শহরটাই কিছুদিনের জন্যে কিনে নিয়েছে সে। ভাড়া করেছে সেরা বন্দুকবাজদের। কাজেই বুঝতেই পারছ কি বিশাল কাজের দায়িত্ব নিয়েছে। হিগিন্স।
কাল চলে যাব আমি।
বিছানায় বসল ক্যাথি। টেকনের পাশে। দুহাতে তুলে ধরল ওর মুখ। দেখ, তোমাকে চিনি না আমি। কিন্তু কেন যেন দুর্বল হয়ে পড়েছি তোমার প্রতি। আমি কিছুতেই চাই না ওদের হাতে প্রাণ দাও তুমি। ওর কপালে চুমু খেল ক্যাথি।
কাল চলে যাব আমি, আবার বলল টেকন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল ক্যাথি। মেরী আজ এঘরে শোবে। তুমি খাবারের ব্যাগ নিয়ে চলে যাও।
ক্যাথি চলে গেলে পর খাবারের প্লেট নিয়ে বসল টেকন। খেতে শুরু করল। বিছানার পাশে রাখা হুইস্কির বোতলটার ছিপি খুলল। লম্বা এক টান দিয়ে চেয়ে রইল দেয়ালের দিকে। ভাবছে। যুক্তি দিয়ে বুঝছে ওর চলে যাওয়া উচিৎ এ শহর ছেড়ে। কিন্তু রজারের একটা হিল্লে না করে যাবে না সে। আর অন্য লোকগুলো। কি করছে এখানে। সেটাও জানা দরকার। যদিও এসব নিয়ে তার মাথা না ঘামালেও চলে, তবু। কিন্তু রজারের ব্যাপারটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে। তবে ওকে বাগে পেতে হলে ভাগ্যের সহায়তা লাগবে। আর সুযোগও পাওয়া চাই। এক রকম শিকার আর কি। এতে অভ্যস্ত সে।
রাত হয়ে গেছে অনেক। চুপ করে চেয়ারে বসে রয়েছে টেকন। বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে মেরী। এঘরে ঘুমোতে প্রবল অস্বস্তি বোধ করছিল সে। পরে ক্যাথির ধমকে বাধ্য হয়েছে। টেকনও অবশ্য অভয় দিয়েছে।
টেকনের সব জিনিসপত্র বেঁধে-হেঁদে দিয়ে গেছে ক্যাথি।
রিভলভারটা কোলে নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই এখন টেকনের। রজারকে কিভাবে মুঠোয় পেতে পারে সে ব্যাপারে ভেবেছে অনেক। উপায় মেলেনি।
বাইরের দেয়ালে হঠাৎ থপ করে হালকা একটা শব্দ হল। চমকে উঠল টেকন। পিস্তলটা হাতে নিয়ে দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়াল সে। জানালার কাঁচে দুবার টোকা পড়ল। খানিকবাদে আবার, পাল্লা দুটো খুলে গেল জানালার। ধীরে ধীরে খোলা জানালা দিয়ে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিল টেকনকে। নড়ে উঠল মেরীও। কুঁকড়ে গেল খানিকটা। আগন্তুক তার মাথাটা ঢোকাল ঘরে। তারপর জানালা গলে নামিয়ে দিল পুরো শরীরটাই। পিকো। পিস্তলটা হোলস্টারে রেখেই ওর কাছে পৌঁছে গেল টেকন। কাধ ধরে এক টানে নিয়ে এল ঘরের মাঝখানে। মুখে হাতচাপা দিয়ে শুইয়ে ফেলল মেঝেতে। টু শব্দটি করতে পারল পিকো।
প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে ছোঁকরা। মুখ নামিয়ে জোরাল ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করল টেকন, এখানে কি করছ? ও তোমার প্রেমিকা? ঘুমন্ত মেরীর দিকে মাথা ঝাঁকাল সে।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল পিকো। ভয় কাটেনি।
আমি এখানে আছি জানতে? মাথা নাড়ল সে।
হাত সরিয়ে নিচ্ছি। চিৎকার করবে না।
আবার মাথা কঁকাল পিকো। রাজি। ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল টেকন। খুব ভয় পেয়েছিলাম… স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল পিকো।
কথাটা শেষ করতে পারল না সে। টেকনের হাত আবার চাপা দিল মুখ। আস্তে, ফিসফিস করে বলল সে।
এখানে বসে আছ তুমি! আমি তো ভেবেছিলাম মরেই গেছ, ফিসফিসিয়ে বলল পিকো।
কম কথা বল, ধারালো গলায় বলল টেকন। চেয়ারে ফিরে গেল সে। উঠে। দাঁড়াল পিকো। ওর দিকে চেয়ে টেকন বলল, তুমি তো সমস্যায় ফেলে দিলে। তোমাকে নিয়ে এখন কি করি?
হুইস্কি খাওয়াও, আঁধারে ঝিকিয়ে উঠল ওর দাঁত। হাসছে।
হুইস্কির বোতলটা তুলে নিল টেকন। ছিপি খুলে এগিয়ে দিল পিকোর দিকে। প্রায় ছুটে এসে বোতলটা ছিনিয়ে নিল সে। ঢকঢক করে গিলে ফেলল বেশ খানিকটা।
টেকন ওর হাত থেকে কেড়ে নিল বোতলটা। চুপ করে বসে থাক, একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল সে। ভেবে দেখি তোমার কি ব্যবস্থা করা যায়।
টেকন আর পিকো বসে রইল সারা রাত। মাঝে সাঝে হুইস্কি টানল দুজনে। কথা হল খুব কম। নানা রকম পরিকল্পনা করল টেকন। বাতিল করে দিল সবগুলোই। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করতেই পিকোকে বলল টেকন, তোমাকে ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে, পিকো।
কি কাজ, সিনর?
রজারকে কেমন লাগে তোমার?
রজার! ভয়ের ছায়া ঘনাল পিকোর মুখে। না না, আমি রজারের কোনও ব্যাপারে নেই।
আরে, অত ভয় পাচ্ছ কেন? একটা খবর শুধু পৌঁছে দেবে ওকে, সাহস দেয়ার চেষ্টা করল টেকন।
কি খবর? ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল পিকো।
পরে বলব, টেকন বলল। হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাইরে চল। কোনও শব্দ যাতে না হয়। খুব সাবধান। রাইফেলটা তুলে নিল সে। অন্য জিনিসগুলো দেখিয়ে পিকোকে বলল, নিয়ে চল।
দরজা খুলে বেরিয়ে এল ওরা। সন্তর্পণে। পা টিপে টিপে নেমে গেল নিচে। অন্ধকার লিভিং রূমটায় এল দুজনে। তারপর সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। দুজনে এল বাড়ির পেছন দিককার বার্নটাতে। পায়ের নিচে চূর্ণ হচ্ছে। জমে থাকা শক্ত তুষার। প্রায় নিঃশব্দে। আঁধার কাটতে আরও ঘণ্টা আধেক লাগবে। পিকো অনুসরণ করছে টেকনকে। ভীত, সন্ত্রস্ত।
বার্নে পৌঁছল দুজনে। আঁধারে চোখ সইয়ে নেয়ার জন্যে এক মুহূর্ত দাড়াল। ওরা। বেশ কয়েকটা স্টল রয়েছে ওখানে। গোটা দুয়েক খুঁজতেই নিজের ঘোড়াটা পেয়ে গেল, টেকন। ওকে চিনতে পেরে চারদিকে তাকাল ঘোড়াটা। তারপর মৃদু ডাক ছাড়ল। ঘোড়াটার পাশে গিয়ে ওর গলাটা ঘষে আদর করল টেকন। নরম গলায় পিকোকে, বলল, আমার স্যাডলটা খুঁজে বার কর।
ঘোড়াটা এখানে এল কিভাবে? প্রশ্ন করল পিকো।
স্যাডলটা কোথায়? কর্কশ গলায় পাল্টা জিজ্ঞেস করল টেকন।
আঁধারের মধ্যেই ঘোড়ায় স্যাডল এবং লাগাম পরানো হল। পিকো জিসিনপত্রগুলো বেঁধে দিয়ে রাইফেলটা রাখল বুটে।
চলে যাচ্ছ এখনই? পিকো জিজ্ঞেস করল।
না, টেকন বলল। এখন যাচ্ছি না। এদিকে এস, হুইস্কির বোতল হাতে পিকোকে নিয়ে দরজার কাছে গেল সে। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে একটা বস্তার ওপর বসে পড়ল। উল্টো দিকে বসতে ইশারা করল পিকোকে।
পিকোর দিকে তাকিয়ে বলল টেকন, ভোর হয়ে গেলে রজারকে গিয়ে ডেকে তুলবে তুমি। খবরটা পৌঁছে দেবে।
সবেগে মাথা নাড়ল পিকো। ভীত কণ্ঠে বলল, তা পারব না, সিনর। ঘুম থেকে জাগালে রজার আমাকে মেরে ফেলবে।
চিন্তা কোরো না, টেকন বুঝিয়ে বলল তাকে। মিস্টার হিগিন্স এর মেসেজ পৌঁছে দেবে তুমি। ও চটবে না।
ঢোক গিলল পিকো। স্পষ্ট দেখতে পেল টেকন।
ওরে বাবা, মিস্টার হিগিন্সকে আরও বেশি ভয় পাই আমি।
হিগিন্স জানবে না ব্যাপারটা, বলল টেকন। আর আমার কথামত কাজ করলে রজারকেও আর কোনদিন ভয় পাবে না তুমি।
কিভাবে?
রজারকে খুন করব আমি। এখনই।
খুন? মিস্টার রজারকে?
হ্যাঁ। খবরটা পৌঁছে দিচ্ছ?
জানি না, নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারল না পিকো।
কাজটা করে দিলে যত ইচ্ছে হুইস্কি খেতে পারবে, লোভ দেখাল টেকন। যত ইচেছ?
দু আঙুল তুলল টেকন। দুবোতল, মিস্টার রজারকে ডেকে তুলে বলবে মিস্টার হিগিন্স দেখা করতে চান। পারবে না?
ভয় করছে, ঘোষণা দিল পিকো।
ভয়ের কি আছে? কেউ জানতে পারবে না কিছু, মরা মানুষ কি কথা বলতে পারে? রজার মরবে আমার হাতে, বলেছি না?
আর রজার যদি তোমাকে খুন করে তখন কি হবে?
ফালতু চিন্তা ছাড়, দৃঢ়তার সঙ্গে বলল টেকন।
দিনের আলো ফুটে উঠল। দরজাটা আরও খানিক ফাঁক করল টেকন। এস, পিকোকে বলল সে। উঠে দাঁড়াল পিকো। প্রবল অনিচ্ছায়।
হুইস্কি দেবে তো?
অবশ্যই, বলল টেকন। পকেটে হাত ঢুকিয়ে তিনটে সিলভার ডলার বার করে আনল সে। দু’বোতলের দাম আছে এখানে। সময়মত পেয়ে যাবে তুমি।
কাঁধে হাত দিয়ে পিকোকে বাইরে নিয়ে এল টেকন। রজারকে ডেকে তুলে বলবে মিস্টার হিগিন্স তাকে দেখা করতে বলেছেন। ক্যাথিদের বাসায়। বলবে, তিনি বলেছেন সাথে রাইফেল আনতে। শীঘ্রি। আর কেউ যেন জানতে না পারে। বুঝেছ?
ভয় করছে।
হুইস্কির বোতলটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল টেকন। খানিক বাদে ফিরিয়ে নিল। দেরি করো না, সবাই জেগে যাবে একটু পরেই। জলদি যাও, বলল সে।
রওনা দিল পিকো। খানিকক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে ভেতরে ঢুকে পড়ল টেকন। দেখে নিল ঘোড়াটা রেডি রয়েছে কিনা। তারপর পাশের দরজা দিয়ে বার্ন হাউস থেকে বেরিয়ে এল। চলে গেল ক্যাথিদের বাসার পেছন দিকটাতে। এমন একটা জায়গা বেছে নিল যেখান থেকে দেখা যায় বাঙ্ক-হাউসটা।
রিভলভারে ছ’নম্বর গুলিটা ভরল সে। সাধারণত পাঁচটার বেশি রাখে না। ফ্রী রয়েছে কি না অস্ত্রটা, দেখে নিল বার কয়েক।
রিভলভার হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে টেকন, বাঙ্কহাউস থেকে বেশ অনেকক্ষণ পর বেরিয়ে এল পিকো। বার্নের দিকে চেয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ল স্যালুনে। পেছনের দরজা দিয়ে। মুহূর্ত পরেই বেরোল রজার। হাতে গানবেল্ট। হাঁটা ধরল সে। থামল একবার। বেধে নিল গানবেল্টটা। ওকে লক্ষ্য করছে টেকন।
ক্যাথিদের বাড়ি থেকে রজার যখন গজ বিশেক দূরে তখন আচমকা বেরিয়ে এল টেকন। পিস্তলটা রয়েছে হাতে। নিচু করে ঝুলিয়ে রেখেছে। রজার! তীক্ষ্ণ ডাকটী ভোরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে দিল। চরকির মত ঘুরল রজার।
রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠল মুখে। তুমি…তুমি!
পিস্তলটা ডান পায়ের আড়ালে নিয়ে গেল টেকন। চিনতে পেরেছ? আমি সেই শিকারী, বলল সে। ভুল করেছিলে; রজার। মস্তবড় ভুল, বরফ শীতল গলায় কথা কটা উচ্চারণ করল সে।
রজারের বিস্ময় যেন কাটেনি এখনও। তবে মুহূর্তের মধ্যেই সামলে নিল নিজেকে। ধীরে ধীরে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল কুৎসিত হাসি। ভাল, খুব ভাল, বলল সে। ঠোঁট চাটল। তীব্র শীতে শুকনো হয়ে গেছে ঠোঁটজোড়া। তোমাকে আবার পাব ভাবিনি কখনও। আমার হাতে দ্বিতীয়বার মরতে যাচ্ছ তুমি। সোজা টেকনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল রজার।
সতর্ক দৃষ্টিতে ওকে লক্ষ্য করছে টেকন। মেপে নিচ্ছে দূরত্বের ব্যবধান। আর কয়েক পা এগোলেই মরবে রজার।
কথা বলতে বলতে এগোচ্ছে রজার। কার সাথে লাগতে এসেছ জান না তুমি, মিস্টার। আজ উইলসন নেই যে বাঁচাবে তোমায়।
গজ দশেক দূরে থাকতে আচমকা থমকে দাঁড়াল রজার। ড্র’ বলেই পিস্তলের জন্যে ছোবল মারল তার হাত। পিস্তল রজারের হাতে আসার আগেই আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায়, বিদ্যুৎ গতিতে হাত উঠে এল টেকনের। রজার পিস্তল বার করল যদিও তবে ততক্ষণে ফুটো হয়ে গেছে তার বুক। গুলি করতে লাগল সে। বৃথাই। ওগুলো আঘাত হানল তুষারে। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে দড়াম করে পড়ে গেল সে। কেঁপে উঠল একবার। তারপর স্থির হয়ে গেল চিরদিনের মত।
টেকন ধীরে ধীরে হেঁটে এল মৃত রজারের কাছে। ইতিমধ্যেই রক্তে লাল হয়ে গেছে সাদা তুষার। রিভলভারের চেম্বার খুলল সে। কার্তুজের খোলটা লাফিয়ে। পড়ল রজারের বুকে। গড়িয়ে পড়ে গেল। আর বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে বার্নের দিকে হাঁটা ধরল টেকন। গুলির শব্দে লোকগুলো নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে, ভাবল সে। তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ওরা তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসার আগেই ঘোড়ায় চেপে নাগালের বাইরে চলে যাবে ও।
বার্নের দিকে ফেরার পথে ক্যাথির কথা মনে হল ওর। ওদেরকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারলে খুশি হত সে। কিন্তু উপায় নেই এ মুহূর্তে। পরে অবশ্যই চেষ্টা করে দেখবে।
ও বার্নহাউস থেকে কদম কয়েক দূরে থাকতেই আচমকা চিৎকার শুনতে পেল, থাম। স্যালুনের পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা লোক। অ্যাকশনে যাওয়ার জন্যে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল টেকন। চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, খবরদার! নড়লেই গুলি করব। মাথার ওপর হাত তুলে দাড়াও। লোকটার হাতে রাইফেল।
লোকটার কথা মতই কাজ করল সে।
মিস্টার হিগিন্স! ওর দিক থেকে চোখ না সরিয়েই চেঁচাল লোকটা। মিস্টার হিগিন্স! টেকনের দিকে চেয়ে বলল, তুমি কে? কি করছ এখানে? আবার ডাকল হিগিন্সকে।
ওর ডাক শুনে বাঙ্কহাউস থেকে বেরিয়ে এল সকলে। কেউ বুট পরছে। কেউ মুক্তপুরুষ, বাঁধছে গানবেল্ট। তুষারের ওপর দিয়ে দৌড়ে আসতে লাগল ওরা। সবার আগে উইলসন। রজারের মৃতদেহের কাছে এসে থমকে দাড়াল সকলে। হাঁটু গেড়ে বসে নাড়ি টিপে পরীক্ষা করল উইলসন। মারা গেছে রজার, জানাল সকলকে।
এসময় স্যালুনের দরজা খুলে বেরিয়ে এল হিগিন্স। পরনে সুট। কিন্তু টাই নেই। টেকনের দিকে এগোল সে। কুঁচকে রয়েছে ভূ। ডাকাডাকি করায় বিরক্ত হয়েছে।
বার্নার্ড সকলের আগে পৌঁছল টেকনের কাছে। মুখ হাঁ হয়ে গেল তার। তুমি..তুমি বেঁচে আছ? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে।
হিগিন্স ঠোঁটে চুরুট গুঁজে কড়া চোখে চাইল টেকনের দিকে। তার দিকে দৌড়ে এল উইলসন। এ কে? তীক্ষ্ণ গলায় জানতে চাইল হিগিন্স।
উইলসন জবাব দেয়ার আগেই বলে উঠল বার্নার্ড, রজার একে মেরে শহর থেকে বের করে দিয়েছিল। ও ফিরে এসে রজারকে মেরে ফেলেছে।
হিগিন্স চাইল ওর দিকে। কি বললে?
ও রজারকে খুন করেছে, মিস্টার হিগিন্স। লাশ পড়ে রয়েছে ওদিকে, শান্ত কণ্ঠে বলল বার্নার্ড।
হিগিন্স অবিশ্বাসের দৃষ্টি বোলাল টেকনের ওপর। এই লোক রজারকে মেরে ফেলেছে? ডেরেক রজারকে?
ততক্ষণে সবাই ঘিরে ফেলেছে টেকনকে। রাইফেলধারী লোকটিও রয়েছে সেখানে। উইলসন বলল, বার্নার্ড ঠিকই বলেছে, মিস্টার হিগিন্স। রজার মারা গেছে। পড়ে রয়েছে ওদিকে। এগিয়ে এসে টেকনের বেল্ট থেকে রিভলভারটা তুলে নিল উইলসন।
ওদের কথা যেন বিশ্বাস হল না হিগিন্সের। নিজের চোখে দেখার জন্যে গেল সে। ফিরে এসে চিৎকার করে বলল, তোমরা বুঝতে পারছ কতবড় সর্বনাশ হয়ে গেছে? এতগুলো লোক থাকতে এটা কি করে সম্ভব হল?
মিস্টার হিগিন্স, ও যে ফিরে এসেছে বুঝতে পারিনি আমরা, ভয়ে ভয়ে বলল বার্নার্ড।
ইতিমধ্যে ক্যাথি, তার মা আর মেরী বেরিয়ে এসেছে বারান্দায়। টেকনকে পাথরের মূর্তির মত দাড়িয়ে থাকতে দেখল ওরা। এখনও হাত দুটো ভোলা রয়েছে মাথার ওপর।
লোকটা কথা শোনেনি। টেকনের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে বুকের মধ্যে ব্যথা অনুভব করল ক্যাথি। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছে। ঠোঁট চেপে ভেতরে চলে এল সে। পেছন পেছন এলেন মা। ওই লোক এখানে ছিল হিগিন্স জানতে পারলে যে কি হবে…’ খুব ধীরে ধীরে বললেন তিনি। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যাথি। কথা বলতে ভাল লাগছে না তার।
হিগিন্স চুরুটটা ছুঁড়ে ফেলল তুষারে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, এ কে? কিভাবে
এল? কি চায় এখানে?
বার্নার্ড বলল, এর কথাই বলতে চাইছিলাম গতকাল। ক’দিন আগে রজার
একে মেরে তাড়িয়েছিল এখান থেকে। আমরা ভেবেছি মারা গেছে ও। আজ ওকে দেখে আশ্চর্য লাগছে।
রাইফেলধারী লোকটি হিগিন্সকে বলল, আপনি চাইলে ওর ব্যবস্থা করতে পারি আমি। টেকনকে উদ্দেশ্য করে বলল সে।
জবাব দিল না হিগিন্স। কড়া চোখে চাইল টেকনের দিকে। আমি জানতে চাই ও এখানে এল কিভাবে? রজারকে মারল কিভাবে? সবার দিকে চাইল এবার সে। উইলসন তোমার কিছু বলার আছে?
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল উইলসন।
বার্নার্ড? তুমি কিছু বলবে?
পুরো ঘটনাটা হিগিন্সকে খুলে বলল বার্নার্ড। কিছুই বাদ দিল না। এ শহরে টেকনের আসা থেকে শুরু করে রজারের হাতে মার খেয়ে অর্ধ সচেতন অবস্থায় চলে যাওয়াতক সবই বলল। শেষে যোগ করল, তবে ও কোথায় লুকিয়ে ছিল একদিন সেটাই ভাবছি। অনেক সুস্থ মনে হচ্ছে ওকে। বিশ্রাম যে পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।
শহরের প্রত্যেকটা বাড়িই খুঁজে দেখেছি আমরা। হারামজাদা ছিল কোথায়? বলল আরেকজন।
সবার কথা চুপ করে শুনল হিগিন্স। নতুন চুরুট ধরাল একটা। তারমানে এই লোক একদিন এখানেই ছিল? আমাদের সব পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলেছে! কপালের একটা শিরা লাফাচ্ছে দপদপ করে। লম্বা করে শ্বাস টানল সে। আমি জানতে চাই এ কদিন ও কোথায় ছিল। গর্দভের দল, ব্যাপারটার সাথে কতগুলো টাকা জড়িত জান তোমরা? সবার দিকে একে একে চাইল সে, সব ক’টা মাথা নিচু। হিগিন্স ঝট করে ঘুরে টেকনের মুখোমুখি হল, এ শহরটা আমার। এখানকার লোকজনও। তুমি কে, এখানে মরতে এসেছ কেন?
টেকন চুপ।
জবাব দাও। হিগিন্সের দিকে চেয়ে দাড়িয়ে রইল টেকন। কোথায় ছিলে তুমি? স্যালুনে? কোন বার্নে?
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল টেকন। চাইল দূরের তুষার ঢাকা পাহাড়গুলোর দিকে। নিশ্চুপ।
দ্রুত এক পা আগে বাড়ল হিগিন্স। চড় কষাল টেকনের গালে। আমার সঙ্গে বেয়াদবি? রাইফেলধারীর দিকে ঘুরল সে। এই, রাইফেল কক কর।
তৎক্ষণাৎ আদেশ পালন করল লোকটি।
মিস্টার, টেকনকে বলল হিগিন্স, শেষবারের মত বলছি, আমার প্রশ্নের জবাব দাও। নইলে রজারের পাশে জায়গা হবে তোমার।
মুখ খুলল টেকন। শান্তকণ্ঠে বলল, সেই ভাল।
এক সেকেণ্ড দ্বিধা করল হিগিন্স। ক্লিনসন, রাইফেলধারীকে বলল সে, গুলি কর। রাইফেল তাক করল ক্লিনসন।
থাম, নীরবকণ্ঠের চিৎকারে চমকে উঠল সবাই। ক্যাথি। কখন যেন ফিরে এসেছিল বারান্দায়। এবার ছুটে এল ওদের দিকে। কাতরস্বরে বলল ও আমাদের বাসায় ছিল। আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম।
আচমকা যেন থমকে গেল সবকিছু। হিগিন্সের হাতটা রাইফেলধারীকে নির্দেশ দেয়ার ভঙ্গিতে শূন্যেই রইল। নামাতে ভুলে গেল সে। কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যাথির দিকে। কেন জানতে পারি?
ও আহত ছিল। ঠাণ্ডায় মারা যাচ্ছিল। ওর জায়গায় একটা বেড়াল ছানা হলেও ঘরে নিয়ে যেতাম আমি। ও আপনাদের পরিকল্পনার কথা কিছুই জানে না, চিন্তা করবেন না।
আস্তে মাথা নাড়ল হিগিন্স। তোমার দয়ার শরীর, ম্যাম। কিন্তু আমার যে ক্ষতি হয়ে গেল তার কি হবে? শ্লেষের সঙ্গে বলল সে।
শুনুন, রাগ চেপে বলল ক্যাথি। ওকে আশ্রয় দেয়ার জন্যে ক্ষতি হয়নি। আপনার রজার ওর ওপর যে অত্যাচার করেছে তারই শাস্তি পেয়েছে সে। দোষ ওর নয়, রজারের।
রজারের দোষ? আমাদের ছেলেমানুষ পেয়েছ? যা হোক, বড় বেশি সাহস তোমার। তোমার ব্যাপারে পরে সিন্ধান্ত নেব আমরা। টেকনের দিকে ঘুরল হিগিন্স, শোন, মিস্টার, বিরাট ক্ষতি করেছ আমার। অপূরণীয় ক্ষতি। কাজেই তোমার বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। রাইফেলধারীর দিকে ফিরে বলল, ক্লিনসন, ওকে বার্নের পেছনে নিয়ে গিয়ে গুলি কর।
ওকে মের না, অনুনয় করল ক্যাথি। চুরুটটা মুখ থেকে বার করে ক্যাথির দিকে চেয়ে রইল হিগিন্স। ভাল। যা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা দেখছি তার চেয়ে গভীর। তুমি ওর প্রাণ ভিক্ষা চাইছ?
ক্যাথি কিছু বলার আগেই মুখ খুলল উইলসন। গলা খাকরে বলল, মিস্টার হিগিন্স…’ মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে নিয়ে সম্মান দেখাল সে। মিস্টার হিগিন্স। আমি বলছিলাম কি…এর সম্পর্কে আপনাকে কিছু জানানো দরকার। হয়ত আগ্রহ বোধ করতে পারেন আপনি।
জানাও, কৌতূহলী হল হিগিনস।
অস্বস্তি বোধ করতে লাগল উইলসন। চাইল এদিক ওদিক। কথাগুলো আড়ালে কোথাও বলা ভাল। এটুকু বলতে পারি লোকটা রেলরোড কোম্পানিতে ছিল।
তো?
লোকটা শিকারী। ওদের মাংস জোগান দিত। শাপশুটারদের রাইফেল আছে ওর।
বলে যাও।
আজকের দুর্ঘটনাটা দেখে মনে হল ওটা ফেয়ার ফাইট ছিল, খানিক ইতস্তত করল উইলসন। তারপর বলল, যে লোক রজারকে ফেয়ার ফাইটে…
কি বলতে চাইছ? জিজ্ঞেস করল হিগিন্স। ত্যাগ করল উইলসন। চলুন না, স্যালুনে গিয়ে বসি। বেলা তো অনেক হল। নাস্তার টেবিলে আমার আইডিয়ার কথাটা বলব আপনাকে। দেখুন, পছন্দ হয় কিনা। লোকটাকে তো ঘণ্টাখানেক পরেও মারা যাবে।
বেশ, চল, খানিক ভেবে বলল হিগিন্স। তারপর ক্লিনসনের দিকে ফিরে বলল, ভালমত সার্চ কর ওকে। অস্ত্র পেলে নিয়ে নেবে।
রুক্ষ হাতে টেকনকে সার্চ করল ক্লিনসন। রওনা দেয়ার মুহূর্তে ক্যাথির দিকে তাকাল হিগিন্স। তুমি আমাকে অবাক করেছ, মিস। এ ব্যাপারে পরে জবাবদিহি। করতে হবে তোমায়। হিগিন্স শান্তকণ্ঠে কথাগুলো বললেও তার গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধে হল না ক্যাথির। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে।
টেকনের দিকে চেয়ে ক্যাথির দিকে আঙুল দেখাল, হিগিন্স। তুমি ওদের বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমরা তোমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে চাইল হিগিন্স। বার্নার্ড! ক্লিনসন! লোকটাকে ক্যাথিদের বাসায় নিয়ে যাও। দুদিকের দরজায় পাহারা দেবে দুজনে। পালাতে যাতে না পারে। যাও।
ইয়েস, স্যার! এগিয়ে এসে বলল বার্নার্ড। উইলসনের দিকে তাকিয়ে বলল হিগিন্স, চল, যাওয়া যাক।
ওরা হাঁটা দিতেই ক্লিনসন আর বার্নার্ড টেকনকে নিয়ে ক্যাথিদের বাড়ির দিকে এগোল। ওকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে বলল ক্লিনসন, ভেতরে বসে থাক, মিস্টার। পালাতে চেষ্টা করো না।
ক্যাথির মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল টেকনের। পুরো ব্যাপারটাই দেখেছেন তিনি জানালায় দাড়িয়ে। কেমন যেন করছে বুকটা। অসম্ভব মায়া লাগছে লোকটার জন্যে। কোন কথা বলতে পারলেন না তিনি। চলে গেলেন ভেতরে।
দোতলায় মেরীর ঘরে এসে টেকন জানালার কাছে দাঁড়াল। ওপরে আসেনি ক্লিনসন আর বার্নার্ড। ক্লিনসনকে সামনের বারান্দায় বসে থাকতে দেখল সে। ধারণা করল বার্নার্ড রয়েছে বাড়ির পেছন দিকে।
মেরীকে বাইরে যেতে বলে ওর কাছে এসে দাঁড়াল ক্যাথি। টেকন চেয়ে রয়েছে রাস্তার ওপাশে, স্যালুনের দিকে। খানিকক্ষণ কথা বলল না কেউই। তারপর নীরবতা ভাঙল ক্যাথি, আমার কথা শুনলে না তুমি।
বাইরের দিকে চেয়েই রইল টেকন। খানিক বাদেই আসবে ওরা। তোমাকে গুলি করে মারবে।
মারুক। তাতে তোমার কি?
কি বললে? বিশ্বাস করতে পারছে না যেন ক্যাথি।
ওর দিকে ফিরল টেকন। মারলে মারবে। তোমার তাতে কি?
ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল ক্যাথি। হাঁ হয়ে গেছে মুখ। লোকটা বলে কি? হঠাৎ কাঁপতে লাগল তার শরীর। প্রচণ্ড ক্ষোভে। চুপ করে অপেক্ষা করল টেকন।
আমার কি! টেকনের দু’গালে দু’হাতে চড় কষাল ক্যাথি। পরপর। আমার কি? আবার বলল সে।
ওর দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল টেকন।
জাহান্নামে যাও তুমি, বলে দূরে চলে গেল ক্যাথি। তারপর ভেঙে পড়ল বাঁধভাঙা কান্নায়।
এবার আর চুপ থাকতে পারল না টেকন। কাথি… চুপ কর তুমি।
টেকন ওর কাছে গিয়ে আলতো করে হাত রাখল কাঁধে। ঝাড়া দিয়ে হাতটা ফেলে দিল ক্যাথি। আমাকে মাফ করে দাও, অনুনয় ঝরে পড়ল টেকনের কণ্ঠে। তুমি আমার জন্যে যা করেছ…’ কথাটা শেষ করল না টেকন। সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আমি।
সারাজীবন? ফুপিয়ে চলেছে ক্যাথি। তোমার জীবন আর কতক্ষণের? বড়জোর আধঘণ্টা। বেড়ে গেল ফোঁপানি।
ক্যাথির কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকি দিল টেকন। চিবুকটা তুলে ধরে বলল, মরার আগে আমি জেনে যেতে চাই কিসের প্ল্যান করেছে হিগিন্স।
টেকনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল ক্যাথি, জেনে কি লাভ তোমার? তুমি কিছু করতে পারবে না।
পারি আর না পারি, জানতে চাই আমি। বল, ক্যাথি, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল টেকন।
চুপ করে রইল ক্যাথি। ওরা প্রেসিডেন্টকে খুন করবে, কথাগুলো বহু কষ্টে উচ্চারণ করল সে।
টেকন যেন বুঝতেই পারল না কথাটা। কি করবে? খুন করবে? প্রেসিডেন্টকে? কোন প্রেসিডেন্টকে?
আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে খুন করবে ওরা।
পুরো ব্যাপারটা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি টেকন। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে? এখানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
এখানে নয়। রেলরাস্তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসবেন প্রেসিডেন্ট। সেখানেই তাকে খুন করবে হিগিন্সের লোকজন।
এখানে কি করছে ওরা?
অপেক্ষা করছে। এটা ওদের ক্যাম্প। সময় হলেই চলে যাবে এখান থেকে।
কিন্তু কেন, ক্যাথি? প্রেসিডেন্টকে মেরে ওদের কি লাভ? শ্রাগ করল ক্যাথি। আমি কি জানি! শুধু জানি পশ্চিমের কয়েকটা রাজ্য আরও কিছুদিন পরে আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট চাইছেন কাজটা এখনই সেরে ফেলতে। সে কারণেই তাকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা হয়েছে। হিগিন্সকে ভাড়া করেছে তারা। টাকা-পয়সা দিচ্ছে পশ্চিমের কিছু বড়লোক। সবকিছু ঠিকমতই চলছিল। মাঝখান থেকে বাগড়া দিলে তুমি, কান্না থামিয়ে বলল ক্যাথি।
আমি? কিভাবে?
রজারকে মেরে ফেলেছ তুমি। ওদের টপগান। প্রেসিডেন্টকে ওরই গুলি করার কথা ছিল।
তুমি এতসব জানলে কিভাবে?
হিগিন্স বলেছে। মদ খেলে মাথার ঠিক থাকে না ওর। মনটা উদার হয়ে যায়।
একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল টেকন। মেঝের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগল ক্যাথির কথাগুলো। ওর কাছে এসে কাঁধে হাত রাখল ক্যাথি। শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবে? মাথা নাড়ল টেকন। অন্যমনস্ক।
দুজনেই নিশ্চুপ খানিকক্ষণ। তারপর মৃদু গলায় প্রশ্ন করল ক্যাথি, তুমি কে, টেকন? শুধুই শিকারী?
হ্যাঁ, শুধুই শিকারী।
তুমি কোথা থেকে এসেছ?
দক্ষিণ থেকে। বেশ অনেক বছর হয়ে গেল। তবে এখন আশেপাশের অঞ্চলেই থাকি।
যুদ্ধে গিয়েছিলে? সবাই গিয়েছিল। দক্ষিণের পক্ষে ছিলে?
হ্যাঁ।
তবে তো প্রেসিডেন্ট মরলে তোমার কিছু এসে যায় না।
টেকন খানিক চেয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ, কিছু এসে যায় না। প্রেসিডেন্টকে রক্ষার দায়িত্ব তার সরকারের।
ওরা যদি তোমাকে রজারের জায়গায় কাজ করতে বলে? হঠাৎ প্রশ্ন করল ক্যাথি।
আমি করব না।
হতাশ কণ্ঠে বলল ক্যাথি, এর অর্থ জান? ওদের কথায় রাজি না হলে গুলি করে মারবে তোমায়।
এত সহজ নয়। আগেও অনেকে চেষ্টা করে দেখেছে, দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো বলল টেকন।
তোমার মত পাগল আর দুটো দেখিনি। ওরা প্রস্তাব নিয়ে এলে ফিরিয়ে দিয়ো না। অন্তত আমার মুখ চেয়ে।
টেকন দ্রুত ক্যাথির মুখের দিকে চেয়ে বলল, হিগিন্সকে ভয় পাচ্ছ?
হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যাথি। না, পাচ্ছি না। কথাগুলো কেন বললাম বুঝবে না তুমি।
ঠিক সে সময় বার্নার্ডের মাথা দেখা গেল দরজায়। মিস্টার হিগিন্স তোমাকে ডাকছেন। নেমে এস। কোনরকম চালাকির চেষ্টা করবে না।
উঠে পড়ল টেকন। দরজার কাছে গিয়ে থামল। ক্যাথির দিকে চেয়ে বলল, আমার জন্যে ভেব না।
কথা বলতে পারল না ক্যাথি। হঠাৎ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল টেকনকে। ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলল আবার।
৬. টেকনকে স্যালুনে আনার আগে
টেকনকে স্যালুনে আনার আগে হিগিন্সের সাথে কথা প্রায় সেরে ফেলল উইলসন। নাস্তা খাওয়া হয়ে গেছে, ওদের। এঁটো প্লেটগুলো সরিয়ে রাখল একপাশে।
মিস্টার হিগিন্স, যা ঘটে গেছে সেজন্যে নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। কিন্তু ও নিয়ে ভেবে তো আর লাভ নেই। আমার মনে হয় ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পারব আমরা, উইলসন বলল।
হিগিন্সের রাগ কমছে না কিছুতেই। ঠাণ্ডা গলায় বলল, এত সোজা নয়, আক্ষেপ ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে। পুরো ব্যাপারটার সাথে বিরাট অঙ্কের টাকা জড়িয়ে আছে। এখন যদি সব ভণ্ডুল হয়ে যায়।
হবে না, স্যার, প্রবোধ দিল উইলসন। আমি হতে দেব না। রজার মারা গেছে সত্যি কিন্তু ওই লোকটা তো আছে। হয়ত রজারের মত অতটা দক্ষ নয়। তবে ওর রাইফেলটা দেখে মনে হয় ওকে দিয়ে হবে।
এই শেষ মুহূর্তে প্ল্যান বদলাতে বলছ? না না, সেটা সম্ভব নয়। নতুন কাউকে দলে নেয়া ঠিক হবে না। তারচেয়ে বরং তুমি তৈরি হও। রজারের বিকল্প তো তুমিই ছিলে। গুলিটা, তুমিই করবে।
আমার আপত্তি নেই, বলল উইলসন। তবে নিশ্চয়তা দিতে পারব না। রজারের নিশানা ছিল অব্যর্থ। আমার তা নয়। আর দুরতুটাও কম নয়। প্রায় সিকি মাইল। রজার নার্ভাস হয়ে পড়লে ওর রাইফেলটা তুলে নিয়ে হয়ত গুলি করে দিতে পারতাম। কিন্তু লাগাতে পারতাম কিনা টার্গেটে, আমি নিজেই জানি না। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আপনার আরও ভেবে দেখা দরকার।
কঠিন হল হিগিন্সের মুখের পেশীগুলো। কাজটা তোমাকেই করতে হবে।
করব। তবে ওটা আমার রেঞ্জের বাইরে। তাছাড়া রজারের রাইফেলে প্র্যাকটিস করিনি আমি। ও করত। প্রতিদিন।
নিজেকে এবার আর সামলাতে পারল না হিগিন্স। চিৎকার করে বলল, এ জন্যেই বলেছিলাম কোনও ঝামেলায় জড়াতে যেয়ো না। কথাটা শুনলে না তোমরা। সব পয়সা পানিতে গেল আমার।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উইলসন বলল, আসলে আমাদের কপালটাই খারাপ। তা না হলে আহত লোকটা এখানে আসবে কেন? ঠাণ্ডার মধ্যে তাকে তাড়িয়ে দিতে মন সরছিল না। আবার মেরে ফেলতেও ভয় হচ্ছিল। পসি বাহিনী এসে পড়তে পারত।
রজারের জায়গায় ওই লোকটাকে নিতে বলছ কেন? হিগিন্স প্রশ্ন করল।
আমার মন বলছে ও পারবে।
মন বলছে!
যুক্তিও আছে। ফেয়ার ফাইটে হারিয়েছে রজারকে। মুখোমুখি। তাছাড়া ওর রাইফেলটা দেখলেই বোঝা যায়, অনেক ব্যবহার হয়েছে।
দেখেছ ওটা?
ইয়েস, স্যার। একদিন সকালে বাঙ্কহাউসে গিয়েছিলাম আমরা। ও ঘুমোচ্ছিল। তখন দেখেছি। বিশেষভাবে তৈরি ওটা। দারুণ জিনিস! কামান বলতে পারেন। ৯০ ক্যালিবারের কম হবে না।
হুম্, চুরুটের গোড়াটা হুইস্কির গেলাসে ফেলে দিল হিগিন্স।
স্যার, আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে। ওকে টেস্ট করে দেখি। টিকে গেলে তো কথাই নেই। আর ফেইল করলে শেষ করে দেব।
বললেই ও রাজি হবে?
হবে না আবার? কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করব আমি। ভুল উত্তর দেবে না ও।
সকালের ব্যাপারটা ভুলে যেয়ো না। আমি গুলির হুকুম দেয়ার পরও নড়েনি ও। মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল।
তা ঠিক। তবে ক্যাথি মেয়েটা জড়িত ছিল সে ঘটনায়। যে তাকে লুকিয়ে রেখে সুস্থ করল, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিল, তার নাম জানতে চাইছিলেন। আপনি। ও বলেনি। ওর জায়গায় হলে আমিও বলতাম না। তাছাড়া রেল রোডের চাকরি করত ও। আমাদের প্ল্যানটা বুঝতে সময় লাগবে না ওর। আমার ধারণা গররাজি হবে না ও। জীবনের মায়া বড় মায়া।
বুঝলাম, কিন্তু…’।
সুযোগ দিয়েই দেখি না। মাথায় পিস্তল ঠেকাব ওর। যেখানে বলব ওকে সেখানেই লাগাতে হবে গুলি। না পারলে…’
মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিল হিগিন্স। ঠিক আছে। ওকে নিয়ে এস এখানে। দৈখি ব্যাটা কি বলে। দিন দুয়েক আছে হাতে। দেখা যাক চেষ্টা করে। কিন্তু উইলসনের দিকে চেয়ে যোগ করল সে, দায়িত্বটা তোমার। যাকে দিয়ে ইচ্ছে গুলি করাও। আমি চাই কাজ।
ঠিক আছে, সায় দিল উইলসন।
টেকনকে নিয়ে আসা হল। হিগিন্সের টেবিলে। একাই বসে আছে সে এখন।
বস, মিস্টার টেকন, নিরুত্তাপ গলায় বলল হিগিন্স।
চেয়ার টেনে বসে পড়ল টেকন। তার পেছনেই বসল বার্নার্ড। রাইফেল হাতে। সতর্ক।
হুইস্কির বোতল আর একটা গেলাস ওর দিকে ঠেলে দিল হিগিন্স। নাও।
না, ধন্যবাদ, কঠিন গলায় বলল টেকন।
খাবে না? বেশ। ওর দিকে চাইল হিগিন্স। তোমার কথা কিছু বল। খানিকটা শুনেছি। আরও শুনতে চাই।
বলার মত কিছু নেই। থাকলেও আপনার জানার দরকার নেই, টেকন বলল।
সীমা ছাড়িও না, মিস্টার। বেশি বাড়াবাড়ি করো না। তোমাকে আমি এই মুহূর্তে গুলি করে মারতে পারি, জান? রাগে লাল হয়ে গেছে হিগিন্সের মুখ।
জানি। এ-ও জানি পারলেও মারবে না।
কি বলতে চাও তুমি?
বলতে চাই তুমি মতলববাজ। আমাকে মারার ইচ্ছে থাকলে এত কথা বলতে না।
মতলবটা কি বল দেখি?
জানি না।
আগ্রহের সঙ্গে সামনে ঝুঁকল হিগিন্স। শুনেছি তোমার দারুণ একটা রাইফেল আছে। ওটায় হাত কেমন তোমার?
মৃদু হেসে চুপ করে রইল টেকন।
চারশ গজের টার্গেট সই করতে পারবে? কারও হ্যাটে গুলি লাগাতে বললে পারবে?
হাসিটা বিস্তৃত হল টেকনের।
তাসের গায়ে?
জানার রাস্তা একটাই, টেকন বলল।
কি সেটা?
তোমার বুক পকেটে তাসটা রেখে চারশ গজ দূরে গিয়ে দাঁড়াও। আমাকে রাইফেলটা দিয়ে যেয়ো। জেনে যাবে।
রসিকতা ভালই জান দেখছি, শুকনো হেসে বলল হিগিন্স।
টেকন কিছু বলল না।
উইলসনের দিকে চেয়ে হিগিন্স বলল, তুমি ঠিকই বলেছিলে। তারপর টেকনের দিকে মুখ ফেরাল, আমাদের দলে যোগ দাও তুমি। তবে তার আগে প্রমাণ করতে হবে লং রেঞ্জের যে-কোন টার্গেট সই করতে পার তুমি। উতরে গেলে ভাল পারিশ্রমিক পাবে।
না, স্পষ্ট গলায় বলল টেকন।
খানিকটা বিস্মিত মনে হল হিগিন্সকে। কাজটা সম্বন্ধে না জেনেই নিষেধ করে দিলে?
তোমাকে পছন্দ করি না আমি, টেকন বলল। তোমার লোকদেরও না। আর কাজটা সম্বন্ধে কিছু জানতেও চাই না আমি।
ওর মুখ দেখে বোঝা গেল না ভেতরে ভেতরে কী পরিমাণ টেনশনে ভুগছে সে। বিপদ ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। বুঝতে পারছে টেকন।
কুৎসিত ভাবে হেসে উঠল হিগিন্স। এমন উদ্ভট কথা বাপের জন্মে শুনিনি। টেকনের চোখের দিকে কড়া চোখে চাইল সে, তোমার পছন্দ-অপছন্দে কিছু এসে যায় না, মিস্টার টেকন। রাজি না হয়ে উপায় নেই তোমার।
আছে, হালকা গলায় বলল টেকন।
বুদ্ধ কোথাকার, হিগিন্স বলল। শেষ কথা বলে দিচ্ছি আমি। যা বলব তাই করতে হবে তোমাকে। নইলে মরবে। বুঝেছ?
টেকন জবাব দিল না।
আর মনে কর না তোমাকে দলে নিচ্ছি। আগে প্রমাণ চাই আমি। রাইফেলে হাত কেমন দেখব। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।
না, সম্ভব নয়, দৃঢ় গলায় বলল টেকন।
বার্নার্ড! ক্লিনসন। নিয়ে যাও একে। বাঙ্কহাউসে নিয়ে যাও। কড়া পাহারা। দেবে। পকেট থেকে সোনার ঘড়িটা বার করল হিগিন্স। সময় দেখে নিয়ে বলল, আধ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি তোমাকে। ভেবে দেখ। ঠিক ত্রিশ মিনিট। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ সে।
ওরা দুজন নিয়ে গেল টেকনকে। রাইফেলের নল দিয়ে খুঁচিয়ে। দৃষ্টির আড়ালে ওরা চলে গেলে পর উইলসন জিজ্ঞেস করল, রাজি হবে মনে করেন, মিস্টার হিগিন্স?
হিগিন্সের রাগ পড়েনি তখনও। হলে হবে না হলে না। কিছু এসে যায় না। শালাকে গুলি করে মারলে আশা মিটবে আমার।
কিন্তু ওকে আমাদের প্রয়োজন…’
ওসব বুঝি না। হয় রাজি হবে নইলে শালাকে কুকুরের মত মারব আমি।
একটা উপায় কিন্তু আছে, ওকে রাজি করানোর, বলল উইলসন।
কি উপায়? ব্যগ্র হল হিগিন্স।
পিস্তল ঠেকাতে হবে।
দূর! পিস্তল কেন, রাইফেলটাই তো ঠেকানো আছে সর্বক্ষণ। কাজ হচ্ছে। কই?
হবে। পিস্তলটা ঠেকাতে হবে ক্যাথির মাথায়।
থমকে গেল হিগিন্স। তাতে কাজ হবে মনে কর? বিশেষ আশাবাদী হতে পারছে না।
হ্যাঁ, আমি এদের ধরনটা ভালই জানি। বহু লোকের সঙ্গে তো মিশলাম। মেয়েদেরকে সম্মান করতে জানে এরা। ক্যাথির মাথায় পিস্তল ঠেকালেই আর ভাবতে হবে না। ব্যাটাকে যা বলব তাই করবে। কিছুতেই ক্ষতি হতে দেবে না ক্যাথির। আজ সকালে দেখেননি?
উজ্জ্বল হয়ে উঠল হিগিন্সের মুখ।
দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল মেরী। টেকনকে বাঙ্কহাউসে নিয়ে যেতে দেখল সে। ছুটে গিয়ে ক্যাথিকে জানাল। সবশুনে ক্যাথি কাবার্ড থেকে একটা হইস্কির বোতল বার করল। গেলাস নিল। তারপর পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে কয়েকটা গলি পেরোল। দ্রুত পৌঁছে গেল বাঙ্কহাউসের পেছন দরজায়। ওর মা জানতে পারলেন না কিছুই।
ভেতরে একটা বাঙ্কে বসে রয়েছে টেকন। মুখোমুখি আরেকটা বাঙ্কে বসে ক্লিনসন আর বার্নার্ড। রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছে ওকে।
পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে ধরাল বার্নার্ড! টেকনকে বলল, খাবে?
ওর কাছ থেকে চুরুট নিয়ে ধরাল টেকন। গলগল ধোয়া ছাড়ল একরাশ। ধোয়ার মাঝ দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুই পাহারাদারকে। সেদিকেই চেয়ে রইল টেকন।
ওর নিষ্পলক দৃষ্টি বার্নার্ডের অস্বস্তির কারণ হল। সে বলল, মিস্টার হিগিন্স খুব কড়া লোক। তুমি তেড়িবেড়ি করে পার পাবে না। আমার মনে হয় তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়া উচিত তোমার।
মুচকি হাসল টেকন। কিছু বলল না। অস্বস্তি আরও বাড়ল বার্নার্ডের।
এসময় পকেট থেকে ঘড়ি বার করল ক্লিনসন। পনেরো মিনিট কেটেছে। আর পনেরো মিনিট পর ওকে নিয়ে যেতে হবে, বলল সে।
এখনই, বলল বার্নার্ড। মনস্থির করে নাও। মিস্টার হিগিন্স তোমাকে এতবড় একটা কাজের দায়িত্ব দিতে চাইছেন; তোমার তো গর্ব বোধ করা উচিত।
কাজটা কি? নরম গলায় প্রশ্ন করল টেকন।
জানি না ঠিক। শুধু জানি কাজটার সঙ্গে রেলরোড আর হোমরা-চোমরা কেউ জড়িত, বার্নার্ড বলল।
ওকে এতসব বলার দরকারটা কি? ক্লিনসন বিরক্ত হয়ে বলল।
কই, কিছুই তো বলিনি।
মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ওদের দিকে তাকাল টেকন। সরু হল চোখ।
এসময় পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল ক্যাথি। হাতে হুইস্কির বোতল, গেলাস। রাইফেল উঠিয়েছিল বার্নার্ড আর ক্লিনসন। চিনতে পেরে নামাল।
তোমার এখানে আসা ঠিক হয়নি, ক্লিনসন বলল।
বেশিক্ষণ থাকব না আমি, ওর দিকে না চেয়েই বলল ক্যাথি। চোখ তার টেকনের দিকে। মিস্টার টেকনের জন্যে খানিকটা হুইস্কি নিয়ে এসেছি। দরকার হতে পারে, কঠিন, তেতো গলায় বলল সে। ঝট করে ওর দিকে তাকাল টেকন। মুখ দেখে বুঝতে পারল না কিছু।
গেলাসটা পূর্ণ করল ক্যাথি। নাও, এগিয়ে দিল ওটা টেকনের দিকে। টেকন গেলাসটা নিতেই দু পা পিছিয়ে গেল ক্যাথি।
গেলাসটা নিয়ে এক মুহূর্ত স্থির বসে রইল টেকন। পরমুহূর্তে ওটা ঠোঁটের কাছে আনতেই দাঁত বার করে হাসল বার্নার্ড। আগে আমি, মিস্টার। রাইফেল সরিয়ে রাখল সে। ওটার নল এখন ছাদের দিকে তাক করা। গেলাসটার দিকে হাত বাড়াল ও। সুযোগটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল টেকন। ক্লিনসনের মুখে ছুঁড়ে মারল গেলাস ভর্তি হুইস্কি। প্রায় অ্যাসিডের মত কাজ করল ওটা সে মুহূর্তে। চোখে অন্ধকার দেখল ক্লিনসন।
টেকন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কেড়ে নিল বার্নার্ডের রাইফেলটা। রাইফেলের নল। দু’হাতে শক্ত করে ধরে বসিয়ে দিল ক্লিনসনের মাথায়। বাঙ্ক থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল সে। পরক্ষণেই রাইফেলটা আঘাত করল বার্নার্ডের মুখে। সে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে প্রচণ্ড লাথি কষাল টেকন ওর মাথায়। বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করল না টেকন। ঘুরে দাঁড়িয়েই চেপে ধরল ক্যাথির হাত। প্রায় হিচড়ে নিয়ে চলল পেছনের দরজার দিকে। বাইরে বেরিয়ে ক্যাথিকে কাছে টেনে নিল টেকন। গালে। চুমু খেয়ে বলল, সোজা বাড়ি চলে যাও। স্যালুনে যাবে না কিছুতেই। যাও। তুমি কোথায় যাচ্ছ? উৎকণ্ঠিত ক্যাথি বলল। কী করতে যাচ্ছ?
ফাইট।
অস্ত্র কোথায় তোমার?
আছে, বলল টেকন। ওকে বাড়ির দিকে ঠেলে দিয়েই দৌড়াল টেকন। বার্নের দিকে। সেদিকে এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বাড়ির পথে, দ্রুত পা চালাল ক্যাথি। ঝড়ের বেগে বার্নে ঢুকল টেকন। লাগাম চেপে ধরে উঠে বসল স্যাডলে। খোলা দরজা দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বেরিয়ে এল ঘোড়া। ডানে মোড় নিয়ে ছুটল শহরের বাইরে। স্ক্যাবার্ড থেকে ততক্ষণে বিশাল রাইফেলটা এসে গেছে টেকনের হাতে।
স্যালুনে বসে টের পেল না ওরা কিছুই। হিগিন্স আর উইলসন টেবিলে বসে গিলেই চলেছে তখনও। ঘড়িটা তুলে নিয়ে দেখল হিগিন্স। আর তিন মিনিট, বলল সে।
ক্যাথিকে এখানে আনা উচিত এবার। কি বলেন, মিস্টার হিগিন্স? উইলসন প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ। স্যাণ্ডার্স, মিস ক্যাথিকে এখানে নিয়ে এস। ভদ্র ব্যবহার করবে, মুখ ফিরিয়ে বলল হিগিন্স।
ইয়েস, স্যার। কোটটা গায়ে চাপিয়ে ঘর থেকে বেরুল স্যাণ্ডার্স। বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখতে পেল ছুটে চলেছে টেকনের ঘোড়া।
স্পার দাবাল টেকন। গন্তব্য পাহাড়। শহরের মাইল আটেক বাইরে সেটা। পিস্তলের জন্যে হাত বাড়াল স্যাণ্ডার্স। কিন্তু বাদ সাধল লম্বা কোট। সে ড্র করার আগেই রেঞ্জের বাইরে চলে গেল টেকন। ছুটে ঘরে ফিরে এল ও। পালিয়েছে, চেঁচাল। টেকন ঘোড়াসহ পালিয়েছে।
কী? লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হিগিন্স। ধর! ধর ওকে! কিছুতেই যাতে পালাতে না পারে।
অন্যদের উদ্দেশ্যে চেঁচাল উইলসন, শিগগির ঘোড়া বের কর। পেছনের দরজা দিয়ে হুড়োহুড়ি করে বেরোল ওরা। স্যালুন থেকে বার্ন প্রায় গজ পঞ্চাশেক দূরে। সেদিকেই ছুটল সবাই।
এ সময় টলতে টলতে বাঙ্কহাউস, থেকে বেরোল ক্লিনসন আর বার্নার্ড। দুজনের মাথা-মুখ রক্তাক্ত। এগোতে গিয়ে হোঁচট খেল বার্নার্ড। পড়ে গিয়েই উঠে পড়ল আবার, বাচাও! বাঁচাও! চিৎকার করতে লাগল সে।
ওদের দুজনকে দেখে থমকে গিয়েছিল সবাই। ঘোড়া বার করার কথা মনে ছিল না কারও। উইলসন ছুটে গেল বাঙ্কহাউসের দিকে। কী হয়েছে?
বার্নার্ডের হাত উঠে এল মুখে। আমি শেষ। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল সে পুরু হয়ে জমে থাকা তুষারে।
ঘোড়া বের কর, উইলসন বলল।
বার্নের দিকে ফের দৌড়াল ওরা। গজ পঁচিশেক দূরে থাকতে বোমা ফাটার মত শব্দ হল, একটা। ওদের একজন পড়ে গেল একপাশে। ভাঙা ওয়াগনের মত। বেশ খানিকটা হেঁচড়ে গিয়ে থামল সে। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে শরীর। থেকে। বিশাল একটা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে পেটের বাঁ দিকে। সাদা তুষার লাল হয়ে গেল।
গুলির উৎসের দিকে চমকে তাকাল ওরা। নিচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় দেখা গেল টেকনকে। আবছা ভাবে। ছায়ামূর্তির মত ঘোড়ায় বসে রয়েছে সে। বোল্ট টেনে রিলোড করল।
শিগগির আড়াল নাও তোমরা। ও সেই রাইফেলটা ব্যবহার করছে, চিৎকার করে সাবধান করল উইলসন।
ছিটকে গেল সবাই। উইলসন, ক্লিনসন আর একজন গানম্যান ছুটল পেছনে, স্যালুনের দিকে। অন্য দুজন দৌড়াল বার্নের নিরাপদ আশ্রয়ে।
উইলসনের কাছাকাছি পড়ল পরবর্তী গুলিটা। বেশ খানিকটা তুষার ছিটকে উঠে লাগল তার পায়ে। তবে নিমেষেই নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে গেল সবাই। কেবল বার্নার্ড ছাড়া। কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন্যে চিৎকার করছে তখন সে। বিকট শব্দ হল আবারও। বার্নার্ডের চিৎকার থেমে গেল চিরদিনের মত।
ওদিকে খালি গুলিটা ফেলে দিল টেকন। পকেট থেকে কার্তুজ বার করে ভরল। নিরুদ্বিগ্ন, উত্তাপহীন সে। গোড়ালি দিয়ে আলতো আঘাত করল ঘোড়াটাকে। চলে গেল অন্য একটা পাহাড়ের চূড়ায়। অনেকগুলো পাহাড় পাশাপাশি রয়েছে এখানে। পরবর্তী আক্রমণ চালানোর জন্যে বেছে নিল পছন্দসই জায়গা।
স্যালুনে ঢুকে হিগিন্সকে সব খুলে বলতে চাইল উইলসন। হাঁপাচ্ছে। ক্লিনসনের মাথা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে তখনও। গ্রিফিথের কাছ থেকে বরফ চেয়ে নিয়ে ঘষল সে।
দেখেছি সবই। জানালায় ছিলাম। কোন্ দুজন মরল? ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল হিগিন্স।
বার্নার্ড আর এলভিস। কার্টার আর স্যাণ্ডার্স রয়েছে বার্নে, দ্রুত বলল উইলসন।
আচমকা ক্লিনসনের কলার চেপে ধরল হিগিন্স। হারামজাদা। ও পালাল কি করে? তোরা কী করছিলি? চিৎকার করে কথাগুলো বলল হিগিন্স। সামনে-পিছে ঝাঁকাল কয়েকবার ক্লিনসনকে।
সব দোষ ক্যাথির, ক্লিনসন বলল। নিজেকে হিগিন্সের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল না সে। পুরো ঘটনাটাই খুলে বলল ও।
প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে লাগল হিগিন্স। কুত্তী, চিৎকার করল সে। কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব ওকে আমি। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল উইলসন।
জানালায় না দাঁড়ানোই ভাল, ও গুলি ছুঁড়তে পারে, বলল সে। ওর কথা কানেই তুলল না হিগিন্স। খানিক বাদেই বিকট শব্দে বিশাল একটা শেল এসে আঘাত হানল মেঝেতে। ছাদের খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ল। সেখানেই শুয়ে পড়ল হিগিন্স। রাগ সরে গেছে মুখ থেকে। সে জায়গায় এসে জমেছে ভয়।
ওপরের দিকে চাইল উইলসন। প্রায় দেড় ফুট মত গর্ত হয়ে গেছে ছাদ। মেঝেয় শুয়ে পড়ল সে-ও।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল গ্রিফিথ। শেলটা এসে পড়তেই ছুটে গিয়ে ডাইভ দিল বারের আড়ালে। মাথাটা সামান্য তুলে চেঁচাল, মিস্টার হিগিন্স, আমি ক্ষতিপূরণ চাই।
চুপ, শালা! ক্রুদ্ধ গর্জন করল হিগিন্স। গুলি চালাল সে গ্রিফিথকে লক্ষ্য করে। অল্পের জন্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল ওটা। আবার হারিয়ে গেল গ্রিফিথ। বারের আড়ালে।
ফায়ারপ্লেসের কাছে জড়সড় হয়ে কাঁপছে পিকো। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরুচ্ছে।
হামাগুড়ি দিয়ে একজন গানম্যান স্যালুনের পেছনের দরজার দিকে এগোল। মাথা বার করে টেকনকে দেখার চেষ্টা করল।
দুড়ুম শব্দে স্যালুনটা কেঁপে উঠল আবার। আরও কয়েকটা টুকরো খসে পড়ল ছাদের।
খানিকক্ষণ নীরবতা। সেই সুযোগে পেছনের দরজার গানম্যান হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে এল জানালার কাছে। মিস্টার হিগিন্স, আমরা কী করব?
জানি না, জানালার নিচে গুটিসুটি মেরে বসল হিগিন্স। তোমাদের জন্যেই এই অবস্থা হয়েছে।
ঘরের মাঝখানে যেয়ো না। দেয়ালের সঙ্গে মিশে থাক, উইলসন বলল।
তা না হয় থাকলাম। কিন্তু আমাদের যে বোতল-বন্দী করে ফেলেছে। গানম্যান বলল। জানালা দিয়ে উঁকি মারল উইলসন। ঐ যে! ক্যাথিদের বাসার পেছনেই পাহাড়ের ওপর রয়েছে ও।
সাহস করে অন্যরাও মাথা জাগাল। ছোট একটা পাহাড়ের চূড়ায় পরিষ্কার দেখা গেল টেকনকে। পাহাড়টা আধ মাইল দূরে। হঠাৎ কালো ধোয়ার মাঝে মিলিয়ে গেল টেকনের শরীর। পরক্ষণেই জানালার খড়খড়ি ভেঙে পড়ল গুলির আঘাতে। জানালার নিচে গড়াগড়ি করতে লাগল ওরা। কাঠ আর প্লাস্টার ঝুরঝুরিয়ে পড়ল ওদের গায়ে।
তারমানে চারশ গজের দূরত্ব ওর কাছে কিছুই নয়, শুকনো গলায় বলল উইলসন।
রিলোড করতে টেকনের কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগবে বুঝে আবার মাথা তুলল ওরা। আগের জায়গাতেই রয়েছে টেকন। রাইফেলটা ভেঙে গুলি ভরল আবার। তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল হিগিন্স। গুলি কর। বাঁচতে চাইলে গুলি কর কেউ!
প্রাণের মায়া বড় একটা করে না হিগিন্স। এখনও করছে না। প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করছে সে। একটামাত্র লোক তার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে। তার এতদিনের পরিশ্রম, এত অর্থব্যয় সব পানিতে যাচ্ছে। কিছুই করতে পারছে না সে। আবার চিৎকার করল ও, গুলি কর।
ও আমাদের রেঞ্জের বাইরে, স্যার।
আমার আর কিছু বলার নেই, চরম হতাশা হিগিন্সের কণ্ঠে, দেশের সেরা গ্যানম্যানেরা সামান্য একজন শিকারীর সঙ্গে পারে না! আমি আর কি বলব!
পরবর্তী গুলিটা উড়িয়ে নিল জানালার ওপরের অংশ। রজারকে আগেই বলেছিলাম, ওর সঙ্গে লাগতে যেয়ো না, বিড়বিড়িয়ে বলল উইলসন।
খেঁকিয়ে উঠল হিগিন্স, ওকে তখন খুন করনি কেন? সামান্য উঁকি মেরে আবার বলল, ওকে ধরতে হবে।
কিভাবে?
ধাওয়া করে। কেঁপে উঠল উইলসন। কী বলছেন আপনি? একশ গজও তো যেতে পারব আমরা। পাখির মত মরব।
সে সময় ক্লিনসন হঠাৎ পিকোকে দেখিয়ে বলল, এটাকে পাঠালে কেমন হয়, স্যার? আমাদের ঘোড়াগুলো নিয়ে আসুক।
তাই কর, নির্দেশ দিল হিগিন্স।
মাথা নিচু করে ফায়ারপ্লেসের কাছে চলে গেল ক্লিনসন। একটানে দাড় করিয়ে ফেলল বসে থাকা পিকোকে। ঠেলে নিয়ে চলল স্যালুনের পেছন দরজার দিকে। বার্নে গিয়ে লোক দুটোকে বলবে ঘোড়াগুলো নিয়ে এখানে আসতে। জলদি যাও।
পা-পারব না।
ওর কপালে পিস্তল ঠেকাল ক্লিনসন। স্যালুনের পেছনে ঘোড়াগুলো নিয়ে আসতে বলবে। দরজা দিয়ে ঠেলে বার করে দিল পিকোকে।
দরজা দিয়ে বেরিয়েই ছুটতে শুরু করল পিকো। তবে বার্নের দিকে নয়। ছুটল সে বাঙ্কহাউসের উদ্দেশে। খিস্তি করল ক্লিনসন। শুয়োরের বাচ্চা! রিভলভার তুলে নিয়ে পরপর দুটো গুলি করল সে। একটা বেরিয়ে গেল দু’ফুট দূর দিয়ে। অন্যটা লাগল পায়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল পিকো! বাঙ্কহাউসটা তখনও গজ পাঁচেক দূরে। উঠে পড়ল ও। খোড়া বেড়ালের মত ছুটতে শুরু করল দরজার দিকে। ঠিক তার মাথার ওপর দরজায় লাগল ক্লিনসনের পরের গুলিটা। তবে নিরাপদেই ঢুকে পড়ল সে বাঙ্কহাউসে।
হিগিন্সের দিকে ফিরে দাঁড়াল ক্লিনসন। স্যার, এখন উপায়?
জবাব দেয়ার সময় পেল না হিগিন্স। তার আগেই প্রচণ্ড শব্দে এল গুলিটা। চিৎকার করে পড়ে গেল ক্লিনসন। তার একটা পা যেন কেটে নিয়েছে কেউ। ডান
পায়ের উরুতে বিশাল গর্ত হয়ে গেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল সে।
ওর দিকে এগোচ্ছিল উইলসন। কিন্তু ছাদ ভেঙে পড়ল আবার। মাথা নিচু করে চেঁচাল সে। গ্রিফিথের উদ্দেশ্যে। ক্লিনসনকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে বলল।
গ্রিফিথের ইচ্ছে ছিল না মোটেই। তবু বেরিয়ে এল সে। কলার চেপে ধরল ক্লিনসনের। হেঁচড়ে নিয়ে গেল বারের পেছনে।
কি করতে বলেন? প্রশ্ন করল উইলসন।
হিগিন্সকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। দিশা হারিয়ে ফেলেছে যেন সে। ক্রল করে দরজার কাছে যাও। চিৎকার করে বার্নের ওদেরকে ডাক।
টেকন ওদিকে অবস্থান পাল্টেছে আবার। পাহাড়গুলোর যেখান থেকে সরু রাস্তাটা শহরের দিকে গিয়েছে সেখানে ঘোড়া সমেত পৌঁছে গেছে সে। সানশাইন শহরের ঘড়বাড়ি ভালমতই চোখে পড়ে এখান থেকে। সামান্য ফাঁক হল বার্নের দরজা। দেখতে পেল টেকন। রাইফেল তুলে নিয়েই গুলি করল সে। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তেই।
ক্যাথিদের বাড়িতে ওরা সবাই জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছে। ওর মা জিজ্ঞেস করলেন, এসব কী হচ্ছেরে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে হবে না, মা। কেবল প্রার্থনা কর ও যেন হেরে না যায়, ক্যাথি বলল। মুখে হাসি ফুটে উঠেছে তার।
স্যালুনের ভেতরে তখন জঞ্জালের স্তূপ। ভেঙে পড়েছে ছাদের অনেকাংশ। ভেঙে ঝুলে রয়েছে জানালাগুলো। দেয়ালের প্লাস্টার খসে গেছে। একটা ভারি টেবিল কাৎ করে ওদের তিনজনের পেছনে রেখেছে উইলসন। ইট-কাঠের টুকরোর আঘাত থেকে বাঁচার জন্যে। সে অবস্থাতেই গ্রিফিথকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল সে; ক্লিনসনের অবস্থা কেমন?
বারের পেছন থেকে জবাব এল, খুব খারাপ, বাঁচবে না বেশিক্ষণ। রক্ত পড়েই চলেছে।
কোনও ভাবে ওটা বন্ধ করা যায় না? আবার জিজ্ঞেস করল উইলসন।
এখন আর সম্ভব নয়। রক্ত সব প্রায় বেরিয়ে গেছে, চিৎকার করে জানান দিল গ্রিফিথ।
হিগিন্সকে বলল উইলসন, কিছু একটা করতেই হবে আমাদের। এখানে থাকলে মরব সবাই।
ফাসফেঁসে গলায় হিগিন্স বলল, ওকে শেষ করতে হবে। এখনই। দেরি করলে আমাদের সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে।
প্ল্যান? অবাক হল উইলসন। প্রাণে বাঁচি কিনা সেটা ভাবুন আগে। আপনি সহ আমরা মাত্র পাঁচজন এখন।
চোখ পিটপিট করে বলল হিগিন্স, অ্যাঁ! পাঁচজন? মাত্র পাঁচজন? ইয়েস, স্যার। চারজন গেছে। ক্লিনসন সহ। তবে সবই গেছে, আর কোনও উপায় নেই! আমার এতগুলো টাকা•••
পাহাড় থেকে সরু রাস্তাটা ধরে নেমে এল টেকন, পৌঁছে গেল শহরে। এবার সামনাসামনি আক্রমণ চালাতে চায় সে। স্যালুনের কাছাকাছি পৌঁছে সে স্যাডলের একদিকে ঝুলিয়ে দিল শরীর। ঘোড়র পেছন দিকটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ডান পা দিয়ে। বাঁ পায়ে পেঁচিয়ে ধরল গলার নিচের অংশ। বাঁ হাতে ধরে রইল স্যাডল হর্ন। স্যাডলের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখল, রাইফেলটা। ধেয়ে এল স্যালুনের দিকে। দরজা লক্ষ্য করে গুলি চালাল। উড়ে গেল দরজার অর্ধেকটা। প্রচণ্ড শব্দে।
ভেতরে বসা লোকগুলো আঁতকে উঠল। বাপরে! চিৎকার করে উঠল গ্রিফিথ।
ওদের বল ঘোড়া নিয়ে আসতে। পালাতে হবে এখান থেকে, কোনও মতে উইলসনকে বলল হিগিনস।
হামাগুড়ি দিয়ে পেছন দরজার দিকে এগোল উইলসন। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল বার্নের লোক দুটোর। পিস্তল দিয়ে গুলি করল বার কয়েক। চেঁচাল। কাজ হল তাতে। একজন সাহস করে দরজা দিয়ে মাথা বার করল।
এক্ষুনি ঘোড়া আন, চিৎকার করে বলল উইলসন।
এক্ষুনি? ভীত মনে হল লোকটাকে।
হ্যাঁ।
স্যালুনের দরজার ওপর আবারও আঘাত হানল শেল। পুরোটাই গায়েব হল এবার। জানালার দিকে ছুটে গেল উইলসন।
ও ঢুকে পড়বে,এক্ষুনি।
ভীত-হতাশ কণ্ঠে বলল হিগিন্স, আড়াই লাখ ডলার! সব গেল!
তার মানে?
হিংস্র দৃষ্টিতে উইলসনের দিকে চাইল সে, কাজটা করে দিতে পারলে আড়াই লাখ ডলার জুটত। এই ব্যাটার জন্যে সব গেল আমার। ওকে মারতে হবে এই মুহূর্তে। চারদিকে বন্য দৃষ্টি বোলাল হিগিন্স। ওই লোক দুটো আসছে না। কেন? উইলসন, দেখ তো গিয়ে কি হল ওদের। উইলসনকে পেছন দরজার দিকে যেতে নির্দেশ দিল সে।
উইলসন আবার হামাগুড়ি দিল দরজার দিকে। পরের গুলিতে বারের পেছনে রাখা বোতলগুলো ভাঙল। মেঝেতে লেপ্টে গেল সে।
মরে গেলাম, বাঁচাও! গ্রিফিথের চিৎকার শোনা গেল। দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। বোতলের ভাঙা টুকরো লেগে কেটে গেছে গাল। হিগিন্সকে উদ্দেশ্য করে চেঁচাল সে, বেরিয়ে যাও তুমি। এই মুহূর্তে।
গ্রিফিথকে লক্ষ্য করে আবার গুলি চালাল হিগিন্স। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল এবারও। বারের আড়ালে উধাও হল গ্রিফিথ।
ওরা আসছে। বার্নের দরজা খুলেছে ওরা, উইলসন বলল,।
বার্নের দরজা দড়াম করে খুলে যেতে দেখল টেকন। বুঝতে অসুবিধে হল না ওদের মতলব। রাইফেল রিলোড করল সে দ্রুত। সে সময় দেখতে পেল স্যালুনের পেছন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একজন। ইশারা করছে বার্নের লোক দুটোকে। রাইফেল তুলল সে। গুলি করবে। কিন্তু পরিচিত মনে হল লোকটির অবয়ব। উইলসনকে চিনতে পারল টেকন। নামিয়ে নিল রাইফেল।
ঋণ শোধ করলাম, আপন মনেই বলল ও।
বার্নের দিকে নজর দিল টেকন। রাইফেল তুলে দেখতে পেল দরজা দিয়ে। বেরিয়ে আসছে দুজন গানম্যান। ঘোড়ায় চেপে। বাড়তি আরও দুটো ঘোড়া নিয়ে আসছে ওরা। বার্ন থেকে স্যালুনের দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ গজ। কিন্তু প্রচণ্ড বেগে ঘোড়া ছোটাল ওরা। স্যাডলের সঙ্গে প্রায় মিশিয়ে দিয়েছে শরীর। পূর্ববর্তী লোকটিকে লক্ষ্য করে গুলি করল টেকন। লাগল না। আহত হল ঘোড়াটা। গুলি খেয়ে আরোহী সুদ্ধ পড়ে গেল। অন্য অশ্বারোহী স্যালুনের পেছন দিকে সবেগে দুটল। রিলোড করল টেকন। এর ফাঁকে লোকটি পেীছে গেল দরজার কাছে। ঘোড়া থেকে নেমেই ছুটল সে। ওকে দৌড়ানোর সুযোগ দিল টেকন। লোকটি ঘরে ঢুকে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে গুলি করল সে। পিঠ দিয়ে ঢুকল শেলটা। বেরিয়ে গেল বুক দিয়ে। গুলির প্রচণ্ডতায় ঘরের ভেতর বেশ খানিকদূর হেঁচড়ে গেল মৃতদেহ।
ভেতরের লোকগুলো চেয়ে দেখল। আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে ওদের।
প্রথমজন এসময় দৌড়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। ঝাপিয়ে শুয়ে পড়ল হিগিন্সের পাশে।
উইলসন দরজা থেকে ছুটে এল ওদের কাছে। জানালার নিচে। দুটো ঘোড়া পালিয়েছে। ঠিকমত বাঁধনি তুমি, বার্নের জীবিত লোকটিকে বলল সে।
তুমি গিয়ে বরং নিয়ে এস ঘোড়া দুটো। তারপর শক্ত করে তোমার দুপায়ের সাথে বাঁধ, প্রায় পেঁকিয়ে উঠল লোকটি।
ঘোড়া মাত্র দুটো এখন। দুটো পালিয়েছে আর একটা গুলি খেয়েছে, বলল উইলসন। কেউ চাইলে আমার ঘোড়াটা নিতে পার। তবে পালাতে পারবে এমন নিশ্চয়তা নেই। মেঝেতে পড়ে থাকা মৃত লোকটির দিকে চেয়ে আবার বলল, মিস্টার হিগিন্স, বড় বিপদ।
দেখতেই তো পাচ্ছি, কাটখোট্টা জবাব এল হিগিন্সের কাছ থেকে। সবার ওপর থেকে কর্তৃত্ব হারিয়েছে সে এখন। তার প্রতিটি কথাতেই ভয়ের ছোঁয়া। মেজাজ দেখিয়ে চাপা দিতে চাইছে ভয়।
আমরা মাত্র চারজন এখন। অবশ্য তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের প্ল্যান সফলও হতে পারে। টেকন যদি সারেণ্ডার করে। বিনাশর্তে। হিগিন্সকে ব্যঙ্গ করে বলল উইলসন।
চুপ করবে তুমি? গর্জে উঠল হিগিন্স।
ভাঙা জানালা দিয়ে ইতিউতি চাইল হিগিন্স। ভুলেই গেল গুলিগুলো এখন আসছে পেছন দিক থেকে। পেছনের দরজাটা আলগা হয়ে ঝুলছিল এতক্ষণ। এবার গুলি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। সশব্দে।
হিগিন্স, ডাকল উইলসন। এই প্রথম নামের আগে মিস্টার বলল না সে। এখান থেকে যে করেই হোক আমাদের পালাতে হবে। ও পুরো স্যালুনটাই উড়িয়ে দেবে।
ইতিমধ্যে সেলুনের ভাঙা দরজা-জানালা আর ফুটো ছাদ দিয়ে তুষার এসে জমছে ঘরে। সঙ্গে বিকেলের ঠাণ্ডা বাতাস। তুষারের পাতলা আস্তরণ পড়েছে মেঝেতে। চেলা কাঠের অভাবে, নিভে গেছে ফায়ারপ্লেসের আগুন। ফলে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে শীত।
মনে হয় আঁধার হলে পালানো যাবে। আর কতক্ষণ বাকি? যে লোকটি ঘোড়া নিয়ে এসেছে জিজ্ঞেস করল সে।
কমপক্ষে দু’ঘণ্টা, উইলসন বলল।
স্যালুনের সামনের দিকটাতে রয়েছে এখন টেকন, ঘোড়ার পিঠে বসে চাইল আকাশের পানে। হিসেব করল, আঁধার ঘনাতে আর কতক্ষণ লাগরে। যথেষ্ট ক্ষতি করা গেছে ওদের, ভাবল সে। ছাদ আর দেয়ালের ভাঙা টুকরো পড়েও ওরা আহত হয়েছে নিশ্চিত।
ক্লান্তিতে ছেয়ে গেছে তার শরীর-মন। চিনচিনে ব্যথাটাও টের পাচ্ছে। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এই রাইফেল দিয়ে এত বেশি গুলি আর কখনও করেনি ও। প্রচুর শক্তিক্ষয় হয়েছে। ট্রিগার টানলেই ব্যথা করছে বুকের এক পাশটা। এভাবে আর কতক্ষণ সম্ভব বুঝতে পারল না সে। ব্যথাটা সেরে এসেছিল প্রায়। কিন্তু আজকের পরিশ্রমের ফলে পাজরে ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা অনুভব করছে টেকন।
রাত নামলে বড় অসুবিধেয় পড়বে সে। আলো থাকতে থাকতেই শেষ করে দিতে হবে ওদের। কিছুতেই বেরুতে দেয়া চলবে না ওদেরকে। এ ব্যাপারে সামান্য ভুলচুক হলে বাচবে না সে। রাতটা কাটাতে হবে ক্যাথিদের বাড়িতে। ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু স্যালুনের লোকগুলোকে খুন না করে ক্যাথিদের বাসায় যাওয়া যাবে না। গেলে সকালবেলাতেই ঘেরাও হয়ে যাবে সে। মারা পড়বে ক্যাথিসুদ্ধ। ওর মা আর মেরীকে ছাড়বে না ওরা। অবশ্য ঘোড়াসহ পালিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু অসম্ভব সেটা। ক্যাথিদের রেখে কিছুতেই যাবে না সে।
স্যালুনে ওদিকে সাবধানে মাথা তুলল উইলসন। টেকনকে দেখতে পেল সে। শুয়ে পড়! গুলি ছুঁড়ছে। সতর্ক করে দিল সবাইকে।
ওদের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। বার্ন থেকে ঘোড়া নিয়ে আসা গানম্যান উফ্! বলে শুয়ে পড়ল। মাথার পেছন দিকটা থেঁতলে গেছে তার। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। সেদিকে চেয়ে ভয়ে ছিটকে সরে গেল হিগিন্স।
তিনজন বাকি রইলাম, নিপ্রাণ গলায় বলল উইলসন। আমি, টাইগার আর তুমি। তবে গানম্যান আমরা দুজন। আমি আর টাইগার। হিগিন্সের দিকে চেয়ে বলল সে। গ্রিফিথ, মোটকাটাকে দু’বার গুলি করেও লাগাতে পারনি তুমি। তোমার থাকা না থাকা সমান।
চুপ কর, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে খেকিয়ে উঠল হিগিন্স।
করব, উইলসন বলল। আগে তুমি দায়িত্ব পালন কর। বুদ্ধি বাতলাও। পালের গোদা তো তুমিই।
সারেণ্ডার করব আমরা, বলল হিগিন্স।
পাগল, টাইগার বলল।
উইলসন বলল, ভাল।
উইলসন! হিগিন্সের গলায় উত্তেজনা।
স্যার!
এটা নাও, সাদা বড়সড় একটা রুমাল টেনে বার করল হিগিন্স পকেট থেকে। উইলসনের হাতে ওটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা নাড়াও। জানিয়ে দাও আমরা সারেণ্ডার করছি।
কাজ হবে না, বলল উইলসন। যা বলছি কর!
না, ও রাজি হবে না।
আরে গাধা, আমরা কি সত্যি সত্যি সারেণ্ডার করছি নাকি? ওকে কোনভাবে এদিকে নিয়ে আসবে। তারপর গুলি করে শুইয়ে দেবে।
মাথা নাড়ল উইলসন। তার আগেই জানে মরব আমি।
মরবে না, বলল হিগিন্স। রুমাল দেখাবে তো। ও ছোটলোক নয়।
ও বোকাও নয়। ওসব চালাকিতে কাজ হবে না, মিস্টার।
ওকে বলবে তুমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। সারেণ্ডার করতে চাইবে। রেঞ্জের মধ্যে নিয়ে আসতে পারলেই হল।
বললাম তো, হিগিন্স, ওসবে কাজ হবে না। আবার উঁকি দিল উইলসন। টেকনের অবস্থান দেখার জন্যে। আগের জায়গাতেই রয়েছে এখনও। প্রায় ছয়শ গজ দূরে। ঘোড়ায় বসে। উইলসন উঁকি দিতেই ট্রিগার টিপল টেকন। লক্ষ্য সেই একই। ছাদ। খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ল এবারও।
আমাদের ঠাণ্ডায় জমিয়ে মারতে চায় ও, বলল টাইগার। কি ভেবে মৃত গানম্যানের কাছে পৌঁছল হিগিন্স। হামাগুড়ি দিয়ে। তারপর ছিড়ে ফেলল লোকটির রক্ত ভেজা সাদা শার্ট। এবার উইলসনের দিকে হামা দিল সে। পৌঁছে ওর প্যান্টের পায়ে ঘষতে লাগল রক্ত।
ছিটকে সরে গেল উইলসন। কর কি, কর কি?
দাড়িয়ে থাক, নির্দেশ দিল হিগিন্স। রক্ত মাখানো হয়ে গেলে বলল, খোড়াতে খোড়াতে বাইরে যাও। ও মনে করবে তুমি আহত।
পাগলামি ছাড়, উইলসন রেগে বলল।
খানিক খুঁড়িয়ে হেঁটে পড়ে যাবে তুমি। ভান করবে যেন হাঁটতে পারছ না। ও আসবেই। একশ গজের মধ্যে ওকে পেলেই হল।
পারব না, উইলসন মাথা নেড়ে বলল। আমাকে দেখামাত্রই গুলি করবে। তোমাকে দুশ ডলার দেব।
না, উইলসন বলল।
স্থির দৃষ্টিতে চাইল হিগিন্স ওর চোখে। পাচশ পাবে।
দ্বিধায় পড়ে গেল উইলসন, পাঁচশ?
আমি রাজি, মিস্টার হিগিন্স, টাইগার বলল।
উইলসন গেলে ভাল হয়। কেননা ঐ লোকের হয়ে কথা বলেছিল সে। জীবন বাঁচিয়েছিল। তাই না, উইলসন? তার দিকে তাকিয়ে সকৌতুকে প্রশ্ন করল হিগিন্স।
হ্যাঁ, বলল উইলসন। তবে মাথা নিচের দিকে তার।
পাঁচশ পাবে।
নগদ?
হ্যাঁ
দাও।
পকেট থেকে গুনে গুনে পাঁচশ ডলার বার করে দিল হিগিন্স। টাকাটা পকেটে পুরল উইলসন।
এক হাতে রুমাল আর অন্য হাতে রাইফেল নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে ক্রল করতে শুরু করল উইলসন। দরজার দিকে সাবধানে একটা হাত বার করে দিল বাইরে। জোরে জোরে নাড়তে লাগল রুমাল।
রুমাল দেখে স্যাডলে সোজা হয়ে বসল টেকন। রাইফেল ওঠাল।
ভয়ে ভয়ে বাইরে বেরিয়ে এল উইলসন। প্রাণপণে নাড়ছে রুমালটা। চিৎকার করে বলছে, আমাকে মেরো না। আমাকে মেরো না!
উইলসনের হাতের রাইফেলটা টেকনের দৃষ্টি এড়াল না। স্যালুনের বারান্দায়। এখন উইলসন। দুটো হাতই ওপরে ওঠানে। এক হাতে রুমাল, অন্যহাতে রাইফেল। দু-এক কদম এগিয়েই পড়ে গেল উইলসন। রাইফেলটা ফেলে দিল তুষারে। কর্কশভাবে ফিসফিস করে বলল সে, নিশ্চিত হয়ে গুলি করবে। কিছুতেই যেন মিস না হয়। হিগিন্সর্দের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলল সে।
টেকনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, আমি সারেণ্ডার করছি, টেকন। সবাই মরেছে। আমিও আহত। পা গেছে আমার।
কিছু বলল না টেকন। চেয়ে রইল ওর দিকে। বহু কষ্টে উঠে সিঁড়ির দিকে আসতে লাগল উইলসন। খোঁড়াতে খোড়াতে।
দোতলার জানালা দিয়ে ক্যাথি উইলসনের এই নাটক দেখছিল। সে পাশে দাঁড়ানো মাকে বলল, জানালার নিচে একটা মাথা দেখতে পাচ্ছ, মা?
হ্যাঁ, পাচ্ছি, ফাঁদ পেতেছে ওরা, মা বললেন। ওদিকে চমৎকারভাবে খুঁড়িয়ে চলেছে উইলসন। বারান্দা থেকে নেমে গেল ধাপে ধাপে। দু’কদম এগিয়ে আবারও রুমাল নাড়তে লাগল সে। টেকন! আমাকে বাঁচাও! আমি মারা যাচ্ছি, বন্ধু! আরও কয়েক পা এগিয়ে টলতে শুরু করল উইলসন। রক্তমাখানো পাটা চেপে ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। রাইফেল নামিয়ে নিল টেকন। পা চেপে ধরে গড়াতে শুরু করল উইলসন। তবে রুমাল নাড়তে ভুলল না। বাঁচাও, টেকন! চিৎকার করল আবার। ভান করল উঠতে চাইছে সে। কিন্তু ভাঙা পায়ের কারণে চিৎ হয়ে পড়ে গেল তুষারে। এতক্ষণ অভিনয়ের পরে উইলসন নিশ্চিত হল, গুলি করবে না টেকন।
জানালার কোণ দিয়ে উইলসনের নাটক উপভোগ করল হিগিন্স।
টাইগার তাকে জিজ্ঞেস করল, ও আসছে?
উঁহু, তবে মনে হচ্ছে আসবে, হিগিন্স বলল। তারমানে পটিয়ে ফেলেছে। ওর কথামতই কাজ করা উচিত আমাদের, বলল টাইগার।
তুমি তৈরি থাক। যে-কোন মুহূর্তে আসবে ও, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ দিল হিগিন্স।
আমি তৈরিই আছি। একটামাত্র গুলি খরচ করব, গর্ব প্রকাশ করল টাইগার।
আমি না বলা পর্যন্ত গুলি করবে না, নির্দেশ দিল হিগিন্স। বাইরে চোখ রেখেছে এখনও।
চিন্তিত ভঙ্গিতে তুষারে পড়ে থাকা দেহটার দিকে চেয়ে রয়েছে টেকন। কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে। একে গুলি করে মেরে অপেক্ষা করতে পারলেই ভাল হত। ভেতরে কেউ থেকে থাকলে তাকে বেরিয়ে আসতেই হবে। এখন না হোক পরে। উইলসনকে গুলি করতে মন চাইছে না টেকনের। যথেষ্ট ভাল ব্যবহার করেছে সে তার সঙ্গে। আর সত্যিকারেরই আহত মনে হচ্ছে উইলসনকে। ওর প্যান্টে লেগে থাকা রক্ত দেখতে পাচ্ছে সে। অনেকক্ষণ যাবৎ স্যালুনের ভেতরে কোন সাড়াশব্দও নেই। মিথ্যে কথা বলেনি বোধহয় উইলসন।
সূর্যের দিকে তাকাল টেকন। ঢলে পড়েছে অনেকখানি। আঁধার হতে দেরি নেই বিশেষ। আকাশের রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছে তুষারপাত বাড়বে। মনস্থির করে ফেলল টেকন। যাবে উইলসনের কাছে। ওর কথা সত্যি হলে বাঁচোয়া।
বড় ক্লান্ত সে। ঠাণ্ডায় আর ব্যথায় কাবুও বটে।
আলতো করে স্পার দাবাল টেকন। ঘোড়াটা আগে বাড়ল। ধীরে।
দাঁতে দাঁত পিষে ফিসফিসিয়ে বলল হিগিন্স, আসছে!
একটা বুলেটই যথেষ্ট, বিড়বিড় করল টাইগার।
আরও কাছে আসুক, হিগিন্স আদেশ দিল। তাড়াহুড়ো করতে যেয়ো না। শত্রুকে বাগে পাওয়ায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে তার সারা মুখে। শিকারের আনন্দ অনুভব করছে যেন সে।
এগিয়ে আসতে লাগল টেকন। আর শ’খানেক গজ এগোলেই রাইফেলের রেঞ্জে এসে যাবে সে।
রাইফেল হাতে জানালার কোণে তৈরি রয়েছে টাইগার। হাঁটুতে ভর দিয়ে নিজের রাইফেলটা কক করল হিগিন্স। অন্য কোণে অবস্থান নিল সে।
তুষারে পড়ে থেকে সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েই চলেছে উইলসন। শীতে দাঁত কপাটি লাগার দশা তার। বাঁচাও, টেকন। মারা যাচ্ছি আমি, বাঁচাও।
স্যালুন থেকে সাড়ে তিনশ গজ দূরে থাকতে লাগাম টানল টেকন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলাল স্যালুনের ডানে-বাঁয়ে সর্বত্র। নাহ! উইলসন আর তার রুমাল ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।
শালা থেমে দাঁড়িয়েছে, দাঁত কিড়মিড় করল হিগিন্স।
গুলি করব? টাইগার প্রশ্ন করল। লেগেও যেতে পারে।
দরকার নেই। এখন জানালা দিয়ে রাইফেল বার করলেই দেখে ফেলবে ও। পালাবে।
টেকন এখন দুশ গজের মধ্যে এসে গেছে। দোতলার জানালায় কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাথি, ওকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে চেঁচাল সে, পালাও, টেকন।
পেছন দরজার দিকে ছুটল ক্যাথি। বাইরে বেরিয়ে এসে পা ঠুকল তুষারে। এদিকে এস না, টেকন। দোহাই তোমার। ওরা তোমাকে ফাঁদে ফেলতে চায়। টেকনের দিকে দৌড়াতে শুরু করল সে। প্রাণপণে। পুরু তুষারে দেবে যাচ্ছে পা, শ্লথ হয়ে আসছে গতি।
স্যাডলে বসা টেকন অবাক হয়ে দেখল ছুটে আসছে ক্যাথি। ওর হাত নাড়া দেখে বুঝতে পারল কিছু বলছে ক্যাথি। কিন্তু মেয়েটি বাতাসের বিপরীতে থাকায় কথাগুলো কানে গেল না তার। এসময় ক্যাথিকে দেখে ফেলল হিগিন্স। গুলি চালাও, টাইগারকে নির্দেশ দিল সে।
দুজনেই গুলি করতে শুরু করল। স্যালুন থেকে। রাইফেল নিয়ে লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামল টেকন। শুয়ে পড়ল মাটিতে। পরপর কয়েকটা গুলি এসে বিধল ঘোড়ার গায়ে। লুটিয়ে পড়ল ওটা। মাটিতে শুয়ে পড়েই রাইফেল সহ অবস্থান নিল টেকন। ক্যাথি ইতিমধ্যে উপুড় হয়েছে তুষারে। ওভাবেই থাক। নড়ো না, চিৎকার করে বলে দিল টেকন।
টেকনের গলার স্বরে বুঝতে পারল উইলসন, মরেনি ও। হিগিন্সরা মিস করেছে। লাফিয়ে উঠেই ঝেড়ে দৌড়াল সে স্যালুনের দিকে। কিন্তু বারান্দায়। ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে গেল তুষারে। হাঁকুপাঁকু করে উঠে দাঁড়াতেই গুলি করল টেকন। তার বাঁ হাত উড়িয়ে নিল গুলিটা। বাহু থেকে। তারপর ঢুকে গেল শরীরের বাঁ দিকে। গভীর ক্ষত সৃষ্টি হল, জীবনীশক্তি যেন হঠাত্র শেষ হয়ে গেছে তার। পড়ে রইল সেখানেই। এক্ষুনি ব্যাণ্ডেজ করতে না পারলে বাঁচার আশা নেই বুঝল সে। ডান হাত দিয়ে উইলসন রুমালটা পেঁচাল বা বাহুতে।
স্যালুন থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করছে ওরা দুজন। খামোকাই। মৃত ঘোড়াটার পাশে ততক্ষণে আড়াল নিয়েছে টেকন। ক্যাথির দিকে তাকাল সে। ওর শরীর ডুবে যাচ্ছে তুষারে। রাইফেল রিলোড করে তৈরি হল টেকন। শোন, আমি গুলি করামাত্রই বাড়ির দিকে দৌড়াবে তুমি। ভেতরে ঢুকে বসে থাকবে। আর বেরোবে না। বুঝেছ? ক্যাথিকে বলল সে।
মাথা নাড়ল ক্যাথি।
জানালার ফ্রেম লক্ষ্য করে টেকন গুলি ছুঁড়তেই লাফিয়ে উঠে দৌড়াল ক্যাথি। সে বাড়ির পেছনে হারিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে দেখে ফেলল হিগিন্স। গুলি চালাল সে। বহুদূর দিয়ে গেল ওটা।
আবার সেই হারামজাদী। ওকে দেখে নেব আমি, ক্রুদ্ধ হিগিন্স স্বগতোক্তি করল।
খানিকক্ষণ চুপচাপ, উভয়পক্ষই অপেক্ষা করছে প্রতিপক্ষের পরবর্তী অ্যাকশনের জন্যে। টেকনের চোখ গেল উইলসনের দিকে। এখনও পড়ে রয়েছে। সে। মারা গেছে উইলসন, ভাবল টেকন। রাইফেল তাক করে শুয়ে রইল সে। উইলসন বাচল কি মরল তাতে কিছু এসে যায় না তার। আর ফাঁদে পড়বে না। সে।
স্যালুনে বিড়বিড় করে চলেছে টাইগার। কি বলছ তুমি তখন থেকে? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল হিগিন্স।
গুনছি, গোমড়ামুখে বলল টাইগার। উইলসনকে নিয়ে সাতজন গেল। চলুন পালাই। এছাড়া রক্ষা নেই।
চুপ কর, হিগিন্স ধমকাল, সময় হোক আগে।
শুনুন, ঘোড়াগুলো বাইরে রয়েছে। এখনও চাইলে পালাতে পারি আমরা। ও ঘোড়াছাড়া পিছু নিতে পারবে না আমাদের।
আগে ও মরুক, খেকিয়ে উঠল হিগিন্স। ওই শালা আর হামরাজাদটাকে মেরে তারপর যাব এখান থেকে। তার আগে নয়।
বিড়বিড় করেই চলল টাইগার। অসন্তুষ্ট। হিগিন্সের কথা পছন্দ হয়নি তার।
দেখ, ভাঙা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বলল হিগিন্স, এই-ই সুযোগ। ওর ঘোড়া নেই। ইচ্ছেমত ঘুরতে পারছে না ও। দুদিক থেকে এগিয়ে যাব আমরা। ও ঘোড়ার আড়ালে থাকলেও লাভ নেই। একদিকে আড়াল পাবে। অন্যদিক খালি। আর ওর রাইফেলটাও সিঙ্গল শট।
কিন্তু একটা গুলিতেই যে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়!
ঘোড়া নিয়ে ওর পেছন দিকে চলে যাবে তুমি। গোল হয়ে ঘুরবে। আর এদিক থেকে বেরিয়ে আসব আমি। গুলি করতে থাকব, ওকে কোণঠাসা করতে অসুবিধে হবে না।
খানিক চিন্তা করল টাইগার। বুদ্ধিটা মন্দ নয়। কাজ হতেও পারে, বলল সে।
হবেই। আমার নির্দেশ পেলেই ওকে ধাওয়া করবে তুমি। ঘোড়াটার আড়াল থেকে ওকে বার করতে পারলেই হল। আর চিন্তা নেই। খুব কাছ থেকে গুলি করা যাবে।
টাকা পাব তো কাজটার জন্যে? প্রশ্ন করল টাইগার।
নিশ্চয়। লোকটাকে মারতে পারলে অন্যদের পাওনাটাও তোমাকে দেব আমি, নরম সুরে বলল হিগিন্স।
মনে থাকে যেন, বলল গানম্যান। দ্রুত ছুটে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
টাইগারকে ঘোড়া দাবড়ে বেরিয়ে যেতে দেখল টেকন। পেছন দিকে চক্কর দিতে শুরু করল লোকটা। ওর রেঞ্জের বাইরে।
স্যালুনের দরজায় ক্ষণিকের জন্যে দেখা দিল হিগিন্স। টেকন আর টাইগারের অবস্থান বুঝে নিয়ে চিৎকার করল সে টাইগারের উদ্দেশে, ধাওয়া কর। কথাটা বলেই গুলি ছুঁড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল টাইগার, পিস্তল হাতে ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে লাগল টেকনের দিকে। পেছনে এক ঝলক তাকাল টেকন। দেখতে পেল হিগিন্সকে। দ্রুত থলি থেকে দুটো শেল বার করল সে। মুখে পুরে রাইফেল তাক করল। ওদের মতলবটা বুঝতে সময় লাগল না ওর। বুদ্ধিটা খারাপ নয়। তবে খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না ওরা। ও গুলি আরম্ভ করলেই ঘোড়ার রাশ টানবে লোকটা। এগোতে সাহস করবে না। আর হিগিন্স যে কাজের নয় বোঝাই গেছে।
ওকে লক্ষ্য করে কয়েকটা উল্টো-পাল্টা গুলি করল হিগিন্স। টেকন ফের মনোযোগ দিল ঘোড়সওয়ারের দিকে। ধেয়ে আসছে লোকটা। গুলি করল কয়েকটা, তুষার ছিটাল সবগুলো গুলিই। লোকটার সঙ্গে তার দূরত্ব অনুমান করে নিল টেকন।
টাইগার উপলব্ধি করল দূরত্ব অনেকখানি কমে এসেছে দুজনের মধ্যে। তার মানে সামনে সমূহ বিপদ। ওদিকে হিগিন্স ঘাপটি মেরে রয়েছে। গুলি ছোঁড়ার নাম নেই। সে প্রাণপণে চেঁচাল, হিগিন্স! হিগিন্স!
টাইগারের মুখে নামটা শুনে চরকির মত ঘুরল টেকন। হিগিন্স এখন বেরিয়ে আসছে দরজা দিয়ে। চৌকাঠে বিধল টেকনের পরবর্তী গুলিটা। ঘরের ভেতরে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হল হিগিন্স, খালি খোলসটা ফেলে দিয়ে দ্রুত রিলোড করল টেকন। কাঁধে ঠেকানো রাইফেল, টাইগার তখন পঞ্চাশ গজের মধ্যে এসে গেছে। বিপদ বুঝে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল সে। উল্টোদিকে ছোটাতে পারল যখন ঘোড়াটাকে তখন টেকনের সঙ্গে দূরত্বের ব্যবধান মাত্র ত্রিশ গজ। দেখে শুনে, সময় নিয়ে গুলিটা করল টেকন। টাইগার এখন ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় বাজিমাৎ করতে চাইছে। এত কাছ থেকে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল সে ঘোড়া থেকে। প্রতিযোগিতায় হার মানল টাইগার।
রিলোড করে স্যালুনের দিকে ঘুরল টেকন। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। হিগিন্স দৌড়ে প্রায় উঠে পড়ল ক্যাথিদের বারান্দায়। টেকন গুলি করল ঠিকই কিন্তু ছুটন্ত হিগিন্সের গায়ে লাগাতে পারল না।
টাইগারকে সাহায্য করার কোনও ইচ্ছেই ছিল না হিগিন্সের। সে আসলে চাইছিল টেকন টাইগারকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। সেই সুযোগে সে পৌঁছে যাবে। ক্যাথিদের বাড়িতে। ক্যাথির ওপর প্রচণ্ড রাগে জ্বলছে তার শরীর। টেকনের চেয়ে কম শত্রুতা করেনি মেয়েটি। হিগিন্স এ-ও জানে কান টানলে মাথা আসে। ক্যাথিকে একবার বাগে পেয়ে গেলে টেকনও ধরা দেবে।
গুলির থলিটা তুলে নিয়েই ছুটতে শুরু করল টেকন। ক্যাথিদের বাড়ির দিক থেকে দ্রুত সরে যেতে লাগল। স্যালুনের এক পাশে জায়গা নিল এখন সে।
ক্যাথিদের বারান্দায় উঠে দরজায় দুটো গুলি করল হিগিন্স, পরপর। তারপর লাথি মেরে খুলে ফেলল দরজাটা। এক ছুটে উঠে এল দোতলায়। দেখা হয়ে গেল ক্যাথিদের সঙ্গে। এবার দেখা যাবে, মিস ক্যাথি, টেকন না এসে পারে কি না, বলল সে।
ক্রোধে জ্বলছে হিগিন্স। ওর রণমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেল ওরা তিনজন।
দ্রুত জানালার কাছে গেল সে। রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করল কাঁচে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাচ। তাকিয়েই দেখতে পেল ঘোড়ার পেছনে এখন। আর কেউ নেই। খিস্তি করল সে।
কিন্তু পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়াল সে। মুখে ব্যঙ্গের হাসি। সকলের উদ্দেশে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ক্যাথিকে উদ্ধার করতে আসবেই ও। সুযোগ আমি পাবই।
পেছনের দরজা দিয়ে স্যালুনে ঢুকল টেকন। সতর্ক। স্যালুনের ভেতরটা আঁধার। তবে চোখ সয়ে এল দ্রুত। ঘরের ভেতর লাশের ছড়াছড়ি। হঠাৎ একটা। আওয়াজ হল তার ডান দিক থেকে। মুহূর্তে ঘুরল সে। গ্রিফিথ বারের আড়াল থেকে মাথা তুলেছে। হাত দুটো মাথার ওপর তোলা। মেরো না তোমার পায়ে পড়ি, আমায় মেরো না। প্রায় কেঁদে ফেলল সে।
ওর দিকে রাইফেল তাক করল টেকন। বেরোও, যেন বিশ্বাসই হল না গ্রিফিথের। দাঁড়িয়েই রইল সে। কথা কানে যায় না? ধমক দিল টেকন।
যাচ্ছি, স্যার। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে গ্রিফিথ। মুক্তির আনন্দে ছুটল দরজার দিকে। ও বেরিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে পিছু ডাকল টেকন। পিকো কোথায়?
মনে হয় মারা গেছে। ক্লিনসনের মৃতদেহের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ও মেরেছে।
ঠিক আছে, যাও।
টেকন দরজায় দাঁড়াল গিয়ে। দেখল গ্রিফিথ পড়িমরি করে ছুটছে বাঙ্কহাউসের দিকে। তুষার মাড়িয়ে।
বেরিয়ে এল টেকন। সতর্ক দৃষ্টিতে জরিপ করল চারপাশটা। পেছন দিকে গেল। বাধা রয়েছে ঘোড়াগুলো এখনও। ঘোড়াগুলো পরখ করে দেখল সে। বেছে নিল পছন্দসই একটা। খানিক দূরে বাঁধল ওটা।
টেকন ফিরে এল স্যালুনে। বার থেকে তুলে নিল হুইস্কির একটা বোতল। ছিপি খুলে জানালার কাছে গিয়ে বসল হাঁটু গেড়ে। লম্বা এক টান দিয়ে চাইল ক্যাথিদের বাড়িটার দিকে।
শান্ত চারদিক। বোতলটা রেখে দিয়ে জানালায় অবস্থান নিল সে। রাইফেল তাক করল। হিগিন্সের একমাত্র তাস ক্যাথি। এছাড়া ওর হাতে আর কোনও খেলা নেই। ওর সব লোক মরেছে। ঘোড়াগুলো এখন টেকনের জিম্মায়। পুরো ব্যাপারটাই আসলে নিয়ন্ত্রণ করছে টেকন। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। ক্যাথি হিগিন্সের হাতে। কাজেই টেকনের আপাতত করার কিছুই নেই। হিগিন্সের মতলব বুঝে এগোতে হবে তাকে। খানিক আগেই ক্যাথিদের বাসা থেকে চিৎকার ভেসে এল, টেকন! টেকন! মৃতপুরীর নিস্তব্ধতা যেন ভেঙে পড়ল হিগিন্সের ডাকে।
বল, শুনছি, পাল্টা চিৎকার করল টেকন। মাথার ওপর হাত তুলে বেরিয়ে এস, এক্ষুনি, হিগিন্স আদেশ করল।
ওর আদেশ পালন করার প্রয়োজন অনুভব করল না টেকন।
শুনতে পাচ্ছ? এবারও চুপ করে রইল টেকন।
ক্যাথিকে বাঁচাতে চাইলে আসতেই হবে তোমাকে।
তোমাকে শেষ সুযোগ দিচ্ছি, হিগিন্স। ওদের ছেড়ে দাও। এ শহর থেকে চলে যাও তুমি। ঘোড়া আমি দেব। তুমি নিশ্চিন্তে বেরিয়ে আসতে পার। গুলি করব না আমি, চিৎকার করে বলল আবার টেকন।
আমি মশকরা করছি না, টেকন। আমার কথা না শুনলে তোমার প্রেমিকা বাঁচবে না।
ওকে তুমি ছুঁয়ে দেখ শুধু!
এক মিনিট সময় দিচ্ছি, টেকন। ভেবে দেখ।
ক্যাথিদের বাড়িতে হিগিন্স তখন চুলের মুঠো ধরে কাৎ করে ফেলেছে ক্যাথিকে। ওর মাথায় ঠেকিয়ে ধরেছে পিস্তল। জানালায় পর্দা থাকায় টেকন দেখতে পেল না এসব। তবে দেখলেও গুলি করতে পারত না সে। কেননা তাতে ক্যাথির আহত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যেত।
হারামজাদী, তুই ওকে বল ও না এলে মরতে হবে তোকে। ওকে শিগগিরই বেরিয়ে আসতে বল, ক্যাথির চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল হিগিন্স।
ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল ক্যাথি। চিৎকার করে বলল, ওর কথা শুনো না তুমি, টেকন। প্রচণ্ড চড় কষাল হিগিন্স। ক্যাথির আর্তচিৎকার কানে এল টেকনের।
জোরালো গলায় হাঁক ছাড়ল সে, খবরদার, হিগিন্স! ওর গায়ে আর একটা টোকাও যেন না পড়ে। বাচতে চাইলে বেরিয়ে এস। কথা রাখব আমি। সন্ধের। আগেই ঘোড়া নিয়ে চলে যেতে পারবে তুমি।
হিগিন্সকে দেখার চেষ্টা করল টেকন। কিন্তু পর্দার কারণে দেখতে পেল না।
তাস সব আমার হাতে, টেকন। তুমি কিছুই করতে পারবে না। মাঝখান থেকে জান যাবে তোমার প্রেয়সীর।
উদ্বিগ্ন চোখে সূর্যের দিকে চাইল টেকন। ঢলে পড়েছে। সন্ধে নামতে বেশি দেরি নেই। তবে কিছুক্ষণ সময় হাতে আছে এখনও।
হঠাৎ ভেসে এল ক্যাথির গলা। আমার জন্যে ভেব না, টেকন। আমাকে ও মারবেই। আমাকে বাঁচাতে চাইলে ওকে খুন-।
কথা শেষ করতে পারল না ক্যাথি। মুখ চেপে ধরেছে তার হিগিন্স।
টেকন, আসছ? হিগিন্স চেঁচাল।
গোধূলি ছায়া ফেলেছে তুষারে। দেখে নিল টেকন। দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে সময়। চাইলে ওকে মেরে ফেলতে পার। আমার কিছু যায় আসে না তাতে। চলে যাচ্ছি আমি।
মিথ্যে কথা!
সত্যি যাচ্ছি। দক্ষিণ দিকে।
ক্যাথিকে ফেলেই?
অবশ্যই। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গেল সে। ঘোড়াগুলো নিয়ে যাচ্ছি আমি। ঠাণ্ডায় জমে মরবে তুমি।
ভাওতা দিচ্ছ।
চেয়ে দেখ।
ক্যাথিকে আমি কুচিকুচি করে কাটব।
আমি চললাম, টেকন চেঁচাল আবার। স্যালুনের পেছনে চলে এল সে। বেছে রাখা ঘোড়াটায় লাগাম পরাল। ওটায় চেপে অন্য ঘোড়াগুলো নিয়ে রওনা। দিল। হিগিন্সের রাইফেলের রেঞ্জের বাইরে রইল সে। ফাঁকা গুলি করল একটা। কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে দক্ষিণ দিকে এগোল টেকন। খানিক বাদেই সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ও।
জানালা দিয় মুখ বাড়াল হিগিন্স। ক্যাথির চুলের মুঠি ধরেই রেখেছে হাতে। টেকনকে চলে যেতে দেখল সে। ও দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই দেয়ালে মাথা ঠুকে দিল ক্যাথির। সজোরে। যন্ত্রণায় কেঁদে ফেলল ক্যাথি। ফুলে উঠল জায়গাটা।
এসময় কাঠের বড়সড় একটা টুকরো নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ক্যাথির মা। সন্তর্পণে। তবে হিগিন্সের মাথায় বাড়িটা দেয়ার আগেই দেখে ফেলল সে। সজোরে চড় কষাল সে তার গালে। ভদ্রমহিলাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দিল ঘর থেকে। ভেতর থেকে আটকে দিল দরজাটা। দরজায় দুমাদম কিল মারতে লাগলেন ক্যাথির মা। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে গিয়ে বসল হিগিন্স। খানিক বাদে হতাশ হয়ে চলে যেতে, হল তাকে।
ঘোড়াগুলো নিয়ে আধ মাইলটাক এল টেকন। শহরটা ভালমত দেখা যায় না এখান থেকে। নিশ্চিন্ত হয়ে সে ঘোড়া থেকে নামল। সবগুলো ঘোড়া একসঙ্গে বেঁধে রাইফেলের নলটা পুতল তুষারে। খুঁটির মত। তারপর ঘোড়াগুলো বাধল তার সাথে। বেল্ট থেকে রিভলভার বার করে লোড পরীক্ষা করল। স্যালুনের একজন মৃত গানম্যানের বেল্ট থেকে নিয়ে এসেছে জিনিসটা। ঢুকিয়ে রাখল আবার। হ্যাটটা খানিক টেনে নামাল টেকন। কোটটা টেনে-টুনে জড়িয়ে নিল ভালমত। আবছাভাবে নজরে এল ঘোড়াগুলো। ঠাণ্ডার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে গাদাগাদি করে রয়েছে।
ক্যাথিদের ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়েছে হিগিন্স। বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছে সে এখন। ঘরের ভেতর রয়েছে ও। তাছাড়া জিম্মি করে রেখেছে ক্যাথিকে। ওদিকে বাইরে ঠাণ্ডায় ঘুরে মরছে টেকন। ক্যাথির দিকে চেয়ে কুৎসিত হাসল সে।
ক্যাথিদের বাসা থেকে গজ ত্রিশেক দূরে থামল টেকন। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার চারদিকে। ফলে পিকোর মইটা খুঁজে পাওয়ার জন্যে অনেকখানি কাছে চলে আসতে হল ওকে। মইটা সেভাবেই হেলান দেয়া অবস্থায় রয়েছে। মেরীর ঘরের সাথে।
চারপাশে তাকাল টেকন। কেউ নেই। কেবল টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে বাঙ্কহাউসে। অস্পষ্ট। হয়ত গ্রিফিথ জ্বালিয়েছে।
মইটার ভার সইবার ক্ষমতা হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল টেকন। বাড়ির ভেতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই।
নিঃশব্দে উঠে আসতে লাগল টেকন মই বেয়ে। শেষ ধাপে পৌঁছে দেখতে পেল জানালাটা বন্ধ। অবশ্য খোলা পাবে এমন আশাও করেনি সে। জানালার নিচের দিকে হাত দিয়ে আস্তে করে টানল সে। খুলল না। তবে কয়েকটা আঙুল ঢোকানোর মত জায়গা পেয়ে গেল সে। আবার টানল জানালাটা। এবার আগের চেয়ে জোরে। কাঁচের ভেতর দিয়ে উঁকি দিল টেকন। ছিটকিনি লাগানো রয়েছে। কাঁচ ভাঙা ছাড়া উপায় নেই। রিভলভারের বাঁট দিয়ে আলতো করে বাড়ি দিল কাঁচে। নিঝুম রাতে খুব বেশি কানে বাজল শব্দটা। তবে কাঁচ ভাঙল না। আরও জোরে আঘাত করতে হবে। তাতে আওয়াজ হবে অনেক বেশি। উপায় নেই। ধরা হয়ত পড়তেই হবে।
ওদিকে হিগিন্স পকেট থেকে লম্বা ছুরিটা বার করে ক্যাথিকে ভয় দেখাল। তারপর টেনে নিল ওর ডান হাতটা। আলতো করে হাত বুলিয়ে চুমু খেল সেটায়। ছুরির ডগা দিয়ে চিরে দিল ইঞ্চি চারেক। বেরিয়ে আসতে লাগল রক্ত। ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ল মাটিতে। দাঁত বের করে হাসল হিগিন্স, চেঁচাও। প্রাণ খুলে চেঁচাও। টেকনকে বল, তোমাকে এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।
ক্যাথিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কাঁচ ভাঙার শব্দ কানে গেল না হিগিন্সের। ক্যাথি ঠিকই শুনতে পেল। তারস্বরে চেঁচাতে লাগল সে। যাতে শব্দটা হিগিন্সের কানে না। যায়। ক্যাথির চিৎকার শুনে ওর মা আবার দুমদুম কিল বসাতে লাগলেন দরজায়। চিৎকার করে অনুনয় করলেন, হিগিন্স, আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও। তোমার পায়ে পড়ি। তাঁর কথায় কর্ণপাত করল না হিগিন্স।
কাচ ভেঙে ততক্ষণে ছিটকিনি খুলে ফেলেছে টেকন। বহু কষ্টে জানালা দিয়ে শরীর গলিয়ে দিল। ঘরে ঢুকে কোটটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল বাইরে। হাতে রিভলভার।
হঠাৎ দরজায় বাড়ি দেয়ার শব্দ শুনতে পেল। ক্যাথির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে গ্রিফিথ। দরজায় কিল দিচ্ছে সে। গ্রিফিথকে দেখে দরজার সঙ্গে মিশে দাঁড়াল টেকন।
হিগিন্স! দরজা খোল। আমি গ্রিফিথ।
দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দরজাটা খুলে দিল হিগিন্স। পিস্তল তাক করল ওর বুকে। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল গ্রিফিথ। ওকে দেখে পিস্তলটা কোটের পকেটে রেখে দিল হিগিন্স।
ওই লোকটাকে দেখলাম! বাইরে! হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলল সে।
বিজয়ীর হাসি হাসল হিগিন্স। ক্যাথির দিকে চেয়ে। বলেছিলাম না ওকে আসতেই হবে?
জানালা দিয়ে বাইরে চাইল হিগিন্স। খুঁজল টেকনকে। গাঢ় অন্ধকারে কাউকেই দেখা গেল না।
এই সুযোগে নিঃশব্দে দৌড়ে দরজার পাশে পৌঁছে গেল টেকন। পরবর্তী পদক্ষেপে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। রিভলভার সোজা তাক করা হিগিন্সের বুকে। ওকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল হিগিন্স। হাত থেকে পড়ে গেল পিস্তলটা।
এসে গেছে! বলে দোতলার জানালা দিয়ে শরীর গলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল গ্রিফিথ। কষ্টে-সৃষ্টে গলাতে পারল স্থূল শরীরটা। লাফিয়ে পড়ল তুষারে। তারপর খোড়াতে খোঁড়াতে উধাও হল আঁধারে।
টেকনকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল ক্যাথি। দুগালে অবিরাম চুমো খেতে লাগল। ওকে একপাশে সরিয়ে দিল টেকন। চলে যেতে বলল বাইরে। নির্দেশ অমান্য করল না ক্যাথি। মাকে খুঁজতে চলে গেল সে।
আতঙ্কে হিগিন্সের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে। আমাকে মাফ করে দাও, টেকন। আমার সঙ্গে অনেক টাকা আছে। সব তুমি নাও, টেকন। আমাকে প্রাণে মেরো না, প্লীজ। প্রায় কেঁদে ফেলল হিগিন্স।
হিগিন্সের ডান হাঁটুতে প্রথম গুলিটা করল টেকন। বাপরে! বলে বসে পড়ল সে।
দোহাই তোমার, আমাকে মেরো না, প্রাণ ভিক্ষা চাইল হিগিন্স।
উঠে দাঁড়াও, আদেশ করল টেকন।
পারছি না, ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে হিগিন্সের মুখ। দরজার দিকে হেঁচড়ে এগোল সে।
ওর উরুতে গুলি করল টেকন। চিৎকার করে দুহাতে ঊরু চেপে ধরল হিগিন্স। শুয়ে পড়ল।
ওঠ, টেকন শান্তস্বরে বলল। এবারে গুলি করল কাঁধে।
ওঠ, আবার আদেশ করল সে। ধীরে ধীরে তীব্র ব্যথা সহ্য করে উঠে বসল হিগিন্স। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত তুলল সে।
বুকে গুলি খেয়ে একবার মাত্র কাঁপল তার শরীর। তারপর স্থির হয়ে গেল।
মৃতদেহের কাছে পৌঁছাল টেকন। কোটের কলার চেপে ধরল এক হাতে। টেনে নিয়ে এল জানালার কাছে। সাহায্য নিল ক্যাথির মা, ক্যাথি আর মেরীর। ওরা হিগিন্সের দুরবস্থা উপভোগ করার জন্যে ক্যাথির ঘরে এসে গেছে ততক্ষণে। সকলে মিলে টেনে তুলে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিল হিগিন্সের নিপ্রাণ দেহটা। নিচে তুষারে সশব্দে পড়ল মৃত হিগিন্স।
৭. টেকনের যখন ঘুম ভাঙল
পরদিন টেকনের যখন ঘুম ভাঙল তখন চারদিক আলোয় ঝলমল করছে। ক্যাথি ওকে ঘর ছেড়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে শুয়েছিল।
কফির গন্ধ পেল টেকন। নিশ্চয় মেরী রয়েছে রান্নাঘরে। একটা চুরুট ধরাল সে। পরিতৃপ্তি লাগছে। ফুরফুরে একটা অনুভূতি। বিরাট একটা দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেলে যেমন লাগে ঠিক তেমনি।
নিচে বারান্দায় নেমে এল সে। ক্যাথি ঘুম থেকে ওঠেনি এখনও। ওর মা-ও নয়।
হিগিন্সের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে কালকের জায়গাতেই। তবে একা নয় ওটা, সাথে আরেকজনকে দেখতে পেল টেকন? গ্রিফিথ। হাতড়াচ্ছে হিগিন্সের পকেটগুলো। হঠাৎ মুখ তুলেই দেখতে পেল টেকনকে। ছাই হয়ে গেল মুখ। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। টেকন চুপ করে চুরুট টানতে লাগল। গ্রিফিথের এক হাতে অনেকগুলো নোট। অন্য হাতে হিগিন্সের সোনার ঘড়িটা। আমতা আমতা করে বলল, আমার পাওনাটা মিটিয়ে নিচ্ছি।
নাও, টেকন বলল। চুরুটটা বার করে আবার বলল, দেখে মনে হচ্ছে পাওনার চেয়ে বেশিই নিচ্ছ। ঠিক আছে, লাশগুলো কবর দেয়ার দায়িত্বও তোমার।
আঁ?
এদের সবার জন্যে কবর খোড়। জলদি। আমি চাই না ক্যাথিরা এসব দেখুক, মৃদু কণ্ঠে আদেশ দিল সে।
একার পক্ষে কি করে সম্ভব, স্যার? আরেকজন লাগবে। তুষার জমে শক্ত হয়ে গেছে, কৈফিয়ত দিল গ্রিফিথ।
যা বলছি কর, কড়া গলায় বলল টেকন।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল গ্রিফিথ, বারান্দা থেকে নেমে টেকন বাইরে বেরিয়ে এলে সে বলল, উইলসন এখনও বেঁচে আছে, স্যালুনের বারান্দার সামনে পড়ে রয়েছে।
অবাক হয়ে গেল টেকন, বেঁচে আছে? এই ঠাণ্ডার মধ্যে ওকে বাইরে ফেলে রেখেছ? পিকোর কি খবর?
বাঙ্কহাউসে আছে। সামান্য আহত। সেরে যাবে। চুরুটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্যালুনের দিকে দ্রুত পা চালাল টেকন।
উইলসন গুলি খেয়ে পড়ে ছিল সে জায়গাতেই। সারা রাত। তাতে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে তার জন্যে। ঠাণ্ডায় জমে গেছে রক্ত। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে রক্তপাত। বিশাল কোটটা এখনও চাপানো রয়েছে গায়ে। টেকনকে দেখে হাসার চেষ্টা করল সে। ফুটল না হাসিটা। ওকে কাঁধে তুলে নিল টেকন। হাঁটতে শুরু করল ক্যাথিদের বাড়ির দিকে।
আমাকে ক্ষমা করে দিও, ফিসফিস করে বলল উইলসন।
কেন? প্রশ্ন করল টেকন।
তোমাকে ধোকা দিয়েছি আমি। মিথ্যে বলেছি। প্রায় বুজে এল উইলসনের গলা। টাকার লোভে…
ওসব কথা বাদ দাও, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তোমার জন্যেই এখনও বেঁচে আছি আমি, ওকে সান্তনা দিল টেকন।
তোমার তুলনা নেই, বন্ধু, নিজেকে সামলাতে পারল না উইলসন। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
ক্যাথিদের বাড়িতে পৌঁছে দোতলায় উইলসনকে নিয়ে গেল টেকন। শুইয়ে দিল, বিছানায়। ক্যাথিকে ডেকে এনে বলল, ওকে শিগগির ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দাও,
উইলসনের পা থেকে বুটজোড়া খুলে দিল টেকন।
এসময় এলেন ক্যাথির মা। উইলসনকে দেখে বিশেষ অবাক হলেন না তিনি। সব ঘটনাই জানা আছে তার। টেকনকে বাঁচিয়েছিল উইলসন।
টেকন এসময় ক্যাথিকে বলল, আমি পিকোকে নিয়ে আসছি। ওকেও কিন্তু সেবা করতে হবে তোমার।
কোনও অসুবিধে নেই। নিয়ে এস তুমি। তাছাড়া পিকোর জন্যে মেরী তো রয়েছেই। ক্যাথি বলল-মজা করে।
হেসে ফেলল টেকন। তোমার হাতের কি অবস্থা?
ভাল। সামান্য ব্যথা আছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে।
ক্যাথির হাতটা টেনে নিয়ে দেখল টেকন।
আরও তিনদিন রইল টেকন। ক্যাথিদের সাহায্য করল অসুস্থদের সেবা করার ব্যাপারে।
চতুর্থ দিন আঁধার থাকতেই ক্যাথিকে জাগাল, টেকন। আকাশে তখন তারাদের রূপালী মেলা। চাঁদ আর তারার জ্যোতি ছাড়া আর কোনও আলো নেই।
শোন, আমি আর খানিক বাদেই চলে যাব, টেকন বলল।
ক্যাথি, অবাক হল না মোটেও। টেকনকে যে বাঁধনে জড়ানো যাবে না, এ ক’দিনে বুঝে গেছে সে।
আজই যাবে?
হ্যাঁ।
আমার কথা কিছু ভেবেছ?
ভেবেছি, উইলসনের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। ও সুস্থ হয়ে উঠলে তোমাদের পৌঁছে দেবে। উইলসন ভদ্রলোক। ওর ওপর বিশ্বাস রাখতে পার। ক্যাথির প্রশ্নটা বুঝেও না বোঝার ভান করল টেকন।
কোনদিকে যাবে ঠিক করেছ? হতাশ হয়ে প্রশ্ন করল ক্যাথি।
দক্ষিণে। তুষার আর ভাল লাগছে না।
সারাজীবন কি এভাবেই কাটাবে? খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল ক্যাথি।
ভাবিনি কিছু।
ভাববে না কখনও?
ভাবলে সবার আগে তোমাকে জানাব।
জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল টেকন। তাকে সাহায্য করল ক্যাথি। স্যাডলব্যাগটা নিয়ে নিচে বারান্দায় নেমে এল টেকন। সঙ্গে ক্যাথি। ওরা দুজন ছাড়া জেগে নেই আর কেউ। স্যাডল ব্যাগটা নামিয়ে রেখে দু’হাত বাড়িয়ে দিল টেকন। ক্যাথির দিকে। ধরা দিল ক্যাথি। পেরিয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ। কতক্ষণ জানল না ওরা।
টেকন জানে,আর কোনদিন তার দেখা হবে না ক্যাথির সঙ্গে। সে-ই দেখা করবে না। বিদায় মুহূর্তে ক্যাথি বলে দিল তার শহরের নাম, ঠিকানা। শুনল টেকন মনোযোগ দিয়ে।
আসবে তো? ক্যাথির কণ্ঠে ব্যাকুলতা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেকন। মিথ্যে বলতে ইচ্ছে করল না তার। শুধু বলল, জানি না।
তখনও ভালমত ফোটেনি ভোরের আলো। তবে কেটে আসছে আঁধার। বার্নের দিকে হাঁটল টেকন। একাই। তাগড়া দেখে বেছে নিল একটা ঘোড়া। হিগিন্সের লোকেরা সবগুলো নিয়ে যেতে পারেনি। স্যাডল চাপাল। বেরিয়ে এল বাইরে। বারান্দায় এখনও দাঁড়িয়ে ক্যাথি। ওর দিকে চেয়ে হাত নাড়ল টেকন। ক্যাথিও নাড়ল। তবে দেখতে পেল না সে। কারণ তার ঘোড়া তখন ছুটে চলেছে আধো অন্ধকারের বুক চিরে। অন্য কোথাও। অন্য কোনখানে।
Leave a Reply