মাসুদ রানা ৩২১ – জাত গোক্ষুর – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী
১
এক পলকের জন্যে চোখ মেলে প্রথমেই শকুনটাকে দেখতে পেল মাসুদ রানা, আকাশে ডানা মেলে উড়ছে, লম্বা গলা আরও লম্বা করে লোলুপদৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে সম্ভাব্য খোরাক হিসেবে ওকে বিবেচনা করা যায় কিনা। রোদে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় পাতা বন্ধ করে ফেলেছে, তারপরও শকুনটার কালো আকৃতি দেখতে পাচ্ছে ও। মুখের ভেতর পুরানো কাগজের কটু স্বাদ, কানে অস্পষ্ট ভনভন গুঞ্জন। জিভ অসম্ভব মোটা লাগছে, শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে গেছে ঠোঁট। ভয়-ভয় করছে ওর। বিমূঢ় ও হতভম্ব। এই জায়গাটা কোথায় ও জানে না। কি কারণে এখানে এভাবে পড়ে রয়েছে তাও বুঝতে পারছে না। এ তো দেখছি ভারি মুশকিল, কিছু মনে পড়ছে না কেন!
এবার একটু একটু করে, উজ্জ্বলতা সইয়ে নিয়ে চোখ মেলল ও। মাথার একপাশে সূর্য। মণি ঘোরাচ্ছে রানা। আছে, শকুনটা আছে। এটা একটা জঙ্গল। একটু দূরে প্রচুর গাছ। ও পড়ে রয়েছে ঘন একটা ঝোপের গায়ে। ভোঁতা, ভনভন আওয়াজটা এখনও বাজছে কানে। এবার চোখ নয়, ঘাড় ফেরাল। ওর কাছ থেকে প্রায় ত্রিশ গজ দূরে পড়ে রয়েছে প্রায়-বিধ্বস্ত ছোট একটা প্লেন। জায়গাটা ফাঁকা, তাই শুকনো ঝোপে আগুন লাগেনি। এক পলকে সব মনে পড়ে গেল রানার। টু-সিটার সেসনা নির্মেঘ আকাশ থেকে আহত ঈগলের মত খসে পড়েছিল। মাটির সঙ্গে সংঘর্ষের সময় প্লেনটা থেকে ছিটকে পড়ে ওর শরীর। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায় সেসনায়, হামাগুড়ি দিয়ে লেলিহান শিখাগুলোর নাগাল থেকে দূরে সরে আসে ও। এখনও ওটা থেকে একটু একটু ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
ভঙ্গিটা আড়ষ্ট-দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে—উঠে বসল রানা। ট্রাউজার ছিঁড়ে গেছে, উরুতে শুকনো মাটি লেগে রয়েছে। গায়ের শার্টটা এখন কয়েক ফালি কাপড় মাত্র, বাতাসে উড়ছে। কপালে হাত রেখে রোদ ঠেকাল, চারপাশটা আরেকবার ভাল করে দেখে নিচ্ছে। গভীর জঙ্গল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সবুজ ঘাস মোড়া ফাঁকা জায়গায় রয়েছে ও, একটা ঝোপের গায়ে। না, সভ্যতার কোন চিহ্ন চোখে পড়ছে না।
সামনে দিয়ে স্যাঁৎ করে উড়ন্ত ছায়াটা চলে যেতেই আবার আকাশে তাকাল রানা। শকুনটাকে দেখে এবার বন্ধু জুলিয়াস কাইজার ওরফে জুলহাস কায়সারের কথা মনে পড়ে গেল ওর। ওকে জ্যান্ত দেখার পরও কিসের আশায় এখনও চক্কর দিচ্ছে ওটা? একটা কিছু অমঙ্গল আশঙ্কা করে রানার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।
বিরক্তিকর আওয়াজটা আগের চেয়ে জোরাল লাগছে কানে; এতক্ষণে উপলব্ধি করল, শব্দটা আসলে ওর মাথার ভেতর হচ্ছে না—ভেসে আসছে অকুস্থলের আরও কাছাকাছি কোথাও থেকে। একঝাঁক মাছি ভন-ভন করছে।
বিধ্বস্ত সেসনাকে কোন রকমে চেনা যাচ্ছে। ওই প্লেনে কায়সার ছিল। সে-ই চালাচ্ছিল ওটা। ধ্বংসসতূপের কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।
দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাবার উপক্রম করল রানা। পা টলছে। সারা শরীরে ব্যথা। তবে নেহাতই ভাগ্যের জোরে মানুষ প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে বাঁচে। আর কিছু লোকের ভাগ্য চিরকালই বাকি সবার চেয়ে ভাল। আশ্চর্য, ওর একটা হাড়ও ভাঙেনি। বাম বাহুর লম্বা ক্ষতটা এরইমধ্যে শুকাতে শুরু করেছে। বিধ্বস্ত সেসনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ও। কায়সারকে খুঁজে বের করতে হবে। দেখতে হবে সে বেঁচে আছে কি না।
প্লেনটার কাছে হেঁটে আসায় মাছির ভন-ভন আওয়াজটা বড় বেশি বিরক্ত করছে রানাকে। ঝুঁকে ককপিটের ভেতর তাকাতে চাইছে ও। কি দেখতে হবে জানে না, বুকের ভেতরটা ধক-ধক করছে। কিন্তু না, ককপিটে ওর বন্ধু কায়সার নেই। তলপেটের ভেতরটা খালি-খালি লাগছে। ধীর পায়ে হেঁটে ধ্বংসসতূপের সামনে চলে আসছে ভাঙা ডানা আর তোবড়ানো ফিউজিলাজকে পাশ কাটিয়ে। হঠাৎ স্থির হয়ে গেল রানা।
প্রায় দশ গজ দূরে রক্তাক্ত, থেঁতলানো মাংসের একটা বেঢপ সতূপকে কায়সার বলে চিনতে পেরেছে ও। ওর মত সে-ও ছিটকে দূরে পড়েছিল, তবে প্লেনটা ওর হাড় গুঁড়ো আর মাংস ছিঁড়ে নেয়ার আগে নয়। তার কপাল আর নাক-মুখ উইন্ডশীল্ডের ধাক্কায় খুলির ভেতর সেঁধিয়ে গেছে। ঘাড়টাও ভেঙে গেছে। কাপড়- চোপড় শত ছিনড়ব, সারা গায়ে শুকিয়ে কেক হয়ে গেছে রক্ত। বড় আকারের একদল ব্রাজিলিয়ান মাছি কমলা রঙের ফাটল, ফুটো ইত্যাদি দিয়ে ভেতরে ঢুকছে, বাকিরা লাশটাকে ঘিরে বিরতিহীন উড়ছে। বমি পাওয়ায় ঘুরতে যাবে, ফাঁকা জায়গার কিনারায় ঝোপের ভেতর কিছু একটা নড়ে ওঠায় স্থির হয়ে থাকল। লাশের পিছনের ওই ঝোপ থেকে অত্যন্ত ভীরু ভঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে এলো একটা হায়েনা; চোখাচোখি হতে অন্যদিকে তাকাল, যেন লজ্জা পাচ্ছে, অথচ কাঁচা মাংসের গন্ধ পেয়ে হাঁ করা মুখের বাইরে বেরুনো জিভ থেকে লালা ঝরছে টপ-টপ করে, এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে এগিয়ে আসাটাও থামেনি।
অভিজ্ঞ শিকারী, এসবই আসলে হায়েনাটার অভিনয়। সে জানতে চায় জ্যান্ত লোকটা ওকে বাধা দেবে কি না। দিলে অস্ত্রটা কি হবে?
রানা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, দেখেই হায়েনা বুঝে নিল ও নিরস্ত্র। তারপর যা ঘটল, চোখের পলকে। সামান্য দূরত্ব এক নিমেষে পার হলো হায়েনা, লাশের একটা পাশ কামড়ে ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে ছিঁড়ে নিল।
‘এই ভাগ! যা!’ খালি হাতেই তেড়ে গেল রানা, তবে আগুনটাকে পাশ কাটাবার সময় জ্বলন্ত একটা ডাল দেখতে পেয়ে তুলে নিল, ছুঁড়ে মারল জানোয়ারটার দিকে। ঝোপের এক দিক দিয়ে ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে ছুটে পালাল সেটা, মুখে কায়সারের এক টুকরো মাংস নিয়ে।
বেঢপ সতূপটার দিকে আবার তাকাল রানা। কায়সারকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে কষ্ট হবে ওর। এই অচেনা জঙ্গলে কবর খোঁড়ার জন্যে কোথায় কোদাল পাবে ও। নাহ্, লাশটাকে পোকামাকড় আর শেয়াল-শকুনের খোরাক হিসেবে ফেলে রেখে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তারপরও কিসের আশায় কে বলবে বিধ্বস্ত প্লেনটার আশপাশে ঘুর-ঘুর করছে ও। কিছু হয়তো খুঁজছে।
চিন্তা করছে রানা। শেষ পর্যন্ত কায়সারের ধারণাটাই সত্যি প্রমাণিত হলো। তাকে ওরা ঠিকই সুযোগ তৈরি করে নিয়ে ধরেছে, অর্থাৎ মেরে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, কায়সারের সঙ্গে রানাকেও প্রায় খুন করে ফেলেছিল। বলতে হবে স্রেফ ভাগ্যের জোরে অন্তত এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে ও। তবে ভাগ্যের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা সম্ভবত একটু পর সামনেই। আদিবাসীদের এলাকা থেকে বহাল তবিয়তে সভ্য জগতে ফিরে যাওয়া বড় কঠিন কাজ।
খুঁজলে হয়তো সত্যি সবই পাওয়া যায়। অন্তত এক্ষেত্রে রানার বেলায় সত্যি পাওয়া গেল ইস্পাতের একটা রড, ডগার দিকটা চ্যাপ্টা ও ধারাল। ঘাস মোড়া মাটি খুব নরম। এ-ও ভাগ্যের সহায়তা, তাছাড়া আর কি বলা যায়। পাথুরে মাটি হলে ক্লান্ত রানা কবরটা খুঁড়তে পারত কিনা সন্দেহ।
মাটি খুঁড়ছে রানা, আর ভাবছে। পাঁচ হাজার ফুট ওপরে, স্যাবটাজ-এর শিকার সেসনার এঞ্জিন খক খক কাশতে শুরু করার ঠিক আগে, কথায় কথায় কায়সার বলছিল কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা একটা ছোট্ট গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে যাবে। তার সেই কথা থেকে রানা আন্দাজ করছে, গ্রামটা অন্তত পঁচিশ থেকে ত্রিশ মাইল উত্তরে হবে। পানি ও অস্ত্র ছাড়া ওখানে পৌঁছানোর সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। হয় জংলী আদিবাসী, নয়তো হিংস্র কোন জানোয়ারের পেটে চলে যাবার আশঙ্কাই প্রবল।
দুপুর একটায়, এক নাগাড়ে দেড় ঘণ্টা মাটি খোঁড়ার পর, যথেষ্ট গভীর একটা কবর তৈরি করা সম্ভব হলো। গায়ের ছেঁড়া শার্ট খুলে লাশটাকে কোন রকমে জড়াল ও, তারপর প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরে কবরের নিচে নামাল।
বন্ধুকে মাটি চাপা দেয়ার পর খানিকটা হেঁটে এসে প্রায় ওর সমান উঁচু একটা উইঢিবির গায়ে হেলান দিয়ে বসল রানা। মাত্র তিন দিন আগে ব্রাজিলের ব্রাজিলিয়া শহরে এক চীনা রেস্তোরাঁয় জুলহাস কায়সারের সঙ্গে দেখা হয় ওর। বাইশতলা উঁচু টেরেসে বসে সন্ধে লাগার মুহূর্তে শহরটাকে আলোকমালায় সেজে উঠতে দেখছিল ও, এইসময় ওর টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল কায়সার। ‘রানা! দোস্ত, তুই?’ সুদর্শন গ্রীক চেহারায় একাধারে বিস্ময় ও আনন্দের হাসি ফুটছে। কায়সারের চোখ দুটো শুধু উজ্জ্বল নয়, দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ যেন মাথার ভেতরকার সমস্ত গোপন তথ্য জেনে নিচ্ছে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, না আঁচড়ালেও সুন্দর একটা আকৃতিতে সাজানো থাকে।
‘হ্যাঁ-রে, শালা, আমি,’ বলে চেয়ার ছাড়ল রানা, বন্ধুকে আলিঙ্গন করল। ‘কিন্তু তুই ব্রাজিলে কি করছিস?’ কায়সারের হাসি নিভে গেল। এই প্রথম খেয়াল করল রানা, বন্ধুর চোখের নিচে কালি জমেছে। শেষবার তাকে কবে দেখেছে স্মরণ করল ও। এই তো মাত্র দু’বছর আগের কথা। প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট-এর গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল চুরি করে পালাবার পথে এথেন্সে লুকিয়ে ছিল ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের এক এজেন্ট। ইয়াসির আরাফাতের হেডকোয়ার্টার থেকে সেটা উদ্ধার করার অনুরোধ পেয়ে বিপদেই পড়ে যায় রানা এজেন্সি, কারণ ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের চীফ মিস্টার মারভিন লংফেলো রানাকে যেমন সেড়বহ করেন, ও-ও তেমনি ভদ্রলোককে প্রাপ্য শ্রদ্ধা থেকে কখনও বঞ্চিত করে না। তাছাড়া, আনঅফিশিয়ালি রানা ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের একজন অবৈতনিক উপদেষ্টাও বটে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে বিএসএস-এর কোনও এজেন্টকে কাবু করে ডকুমেন্টটা ছিনিয়ে নেয়া রানা এজেন্সির জন্যে বেশ বিব্রতকর। সমস্যাটার কথা তখন কায়সারকে জানায় রানা। পরদিন কায়সার সেই ডকুমেন্টটা ওর হাতে তুলে দেয়। কিভাবে কি করেছে, জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও কিছু বলেনি; শুধু বলেছিল, ‘তোর দেয়া ট্রেনিং কাজে লাগল, এটুকু জেনেই খুশি থাক, দোস্ত।’ এই ট্রেনিঙের ব্যাপারটা ঘটে এই ঘটনার আরও তিন বছর আগে।
সে-সময় বিসিআই চীফ রাহাত খান তাঁর সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় সকল এজেন্টের জন্যে জার্নালিজমে হাতে-কলমে ট্রেনিং নেয়াটাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। এর পিছনে তাঁর যুক্তি ছিল, একজন স্পাই-এর জন্যে সবচেয়ে আদর্শ কাভার হচ্ছে মিডিয়া রিপোর্টার। যাই হোক, লন্ডনে তিন মাসের একটা কোর্স কমপ্লিট করার পর রানাকে গ্রীসের রাজধানী এথেন্সে পাঠানো হয় সেখানকার ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং স্টার’-এর সাংবাদিক জুলিয়াস কাইজারের সঙ্গে থেকে হাতে-কলমে কাজ শেখার জন্যে। সেই থেকে দু’জনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা।
রানা এজেন্সিতে উপযুক্ত লোক নিয়োগ করার জন্য সারা দুনিয়া চষে বাছাই করা হয় কিছু তরুণকে; এদেরকে উত্তীর্ণ হতে হয় নৈতিকতা, আনুগত্য, বিশ্বস্ততা, মেধা, অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা সহ আরও অনেক কঠিন সব পরীক্ষায়। এই কাজ সারা বছর ধরে চলতেই থাকে, ফলে বাছাই করা তরুণদের তালিকা যে হারে লম্বা হয় ফ্যাসিলিটির অভাবে সে হারে তাদেরকে ট্রেনিং দেয়া সম্ভব হয় না। জুলিয়াস কাইজার ছিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সেই তরুণদের একজন। জার্নালিজমের ওপর হাতে-কলমে তিন মাস কাজ শেখার পর নিউ ইয়র্কে চলে যায় রানা, সঙ্গে করে নিয়ে যায় জুলিয়াস কাইজারকেও। ওখানে রানা নিজে তাকে একটা শর্ট কোর্স ট্রেনিং কমপ্লিট করায়। তবে দু’জনেই ওরা জানত যে এই শর্ট কোর্স রানা এজেন্সিতে নিয়মিত কাজ করার ছাড়পত্র নয়। তবে মূল ট্রেনিং কোর্স করার জন্যে যখন ডাক পড়বে, এই কোর্সটা তখন খুব কাজে লাগবে কায়সারের, এক বছরের ট্রেনিং তিন মাসে শেষ করতে পারবে সে।
জুলিয়াস কাইজার একজন গ্রীক, তবে সে তার খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয় কারও দ্বারা প্ররোচিত না হয়েই, সেই সঙ্গে নিজের নামও খানিকটা পাল্টে নেয়-জুলিয়াস কাইজার হয় জুলহাস কায়সার।
বন্ধুর হাত ধরে খালি একটা চেয়ারে বসাল রানা, চিৎকার করে ডাকল, ‘ওয়েটার!’ এক চীনা তরুণ ছুটে এল। ডিনারের লম্বা অর্ডার দিল রানা, কায়সার কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘অনেকদিন পর দেখা, কাজেই সহজে ছাড়া পাচ্ছিস না।’ হাত দুটো এক করে ঘষল বার কয়েক। ‘তারপর বল। কেমন আছিস?’
‘না-রে, দোস্ত, ভাল নেই,’ ম্লান হেসে বলল কায়সার। ‘আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি।’
‘কেন? কি ঘটেছে?’ জানতে চাইল রানা।
কাঁধ ঝাঁকাল কায়সার। কিছু বলল না।
‘আমি কোন সাহায্যে আসব?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ব্যাপারটা সিরিয়াস,’ বলল কায়সার। ‘তবে আবার এত সিরিয়াস নয় যে তোর বা আর কারও সাহায্য চাইতে হবে। বিপদটা দেখা দেয়ার পর তোর কথা আমার মনে হয়েছে, কিন্তু যোগাযোগ করার প্রয়োজন বোধ করিনি-কারণ নিজের ওপর বিশ্বাস আছে আমার…’
‘একান্ত ব্যক্তিগত না হলে বিপদটা ঠিক কি রকমের, বল্ না আমাকে।’
‘না, মানে, বলতে আপত্তি নেই,’ ইতস্তত করছে কায়সার।
‘ব্যাপারটা ব্যক্তিগত কিছুও নয়। ঠিক আছে, শোন তাহলে-কেউ একজন আমাকে খুন করতে চাইছে।’
কায়সারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল রানা। ‘ঠিক জানিস? পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে বলছিস কথাটা?’
ক্ষীণ হাসি দেখা গেল কায়সারের মুখে। ‘হানড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত হওয়া কি সম্ভব? এথেন্সে রাইফেলের একটা বুলেট আমার অফিসে জানালার কাঁচ ভাঙল, মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্যে আমার মাথায় লাগেনি-সে কামরায় তখন একাই ছিলাম আমি। পত্রিকার একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ব্রাজিলিয়ায় চলে আসতে হলো। কিন্তু এখানেও, মাত্র দু’দিন আগে, সিয়েরা আকাপাকু রোডে একটা মার্সিডিজ চাপা দিতে চেষ্টা করল আমাকে। এবারও একটুর জন্যে বেঁচে গেছি। আশ্চর্য কি জানিস, মার্সিডিজের ড্রাইভারকে আগেও দেখেছি আমি -এথেন্সে।’ ‘লোকটার পরিচয় জানিস?’
‘না,’ মাথা নেড়ে বলল কায়সার। ‘তাকে আমি কোলোসস বিল্ডিং থেকে ইদানীং বেরিয়ে আসতে দেখেছি। বিল্ডিংটার ওপর নজর রাখছিলাম…,’ হঠাৎ থেমে রানাকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘কোলোসস লাইন্স-এর নাম তো শুনেছিস?’
‘একটা অয়েল ট্যাংকার কোম্পানি।’
‘হ্যাঁ। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ট্যাংকার লাইন। আমার দেশের একজন লোক, মানে একজন গ্রীকই ওটার মালিক। ডাফু সালজুনাস।’
‘আরে, ডাফু সালজুনাসের নাম কে না শুনেছে। বড় মাপের মানুষ। সামান্য নাবিক থেকে বিলিওনেয়ার হয়েছেন। চিরকালই প্রচার বিমুখ। এমন নির্জনতাপ্রিয় ও নিভৃতচারী পুরুষ দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। খুব কম লোকই নাকি তাঁকে দেখেছে। তবে রানা এজেন্সির হার্ডডিস্কে তাঁর ফটো দেখেছি আমি।’
‘হ্যাঁ।’ মাথা ঝাঁকাল কায়সার। ‘হঠাৎ বছর দশেক আগে পাবলিক লাইফ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন সালজুনাস, তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশের কাছাকাছি। যাই হোক, কোলোসস বিল্ডিংটা কনস্টিটিউশন প্লাজায়। মনে করা হয় ওই বিল্ডিঙেরই পেন্টহাউসে তাঁর প্রায় সবটুকু সময় কাটে, ব্যবসা-বাণিজ্য যা দেখাশোনা করেন সব ওখান থেকেই। তবে প্রায় কেউই তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে পারে না। যোগাযোগ হয় ঘনিষ্ঠ কর্মচারীদের মাধ্যমে।’
‘খুব বেশি ধনী হবার পর কার কি রকম প্রতিক্রিয়া হবে বলা মুশকিল,’ বলল রানা। ‘কিন্তু ডাফু সালজুনাসের সঙ্গে তোর এই বিপদের কি সম্পর্ক?’
বড় করে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ল কায়সার। ‘এই ধর মাস ছয়েক আগে থেকে সালজুনাসের আচরণ বদলাতে শুরু করে। ব্যাপারটা একা শুধু আমাকে নয়, বহু সাংবাদিককেই কৌতূহলী করে তোলে, কারণ পাঠকদের কাছে ডাফু সালজুনাস অত্যন্ত প্রিয় ও উত্তেজক একটা সাবজেক্ট।’
‘আসল কথায় আয়। আচরণ বদলাতে শুরু করে-মানে?’ ‘রাজনীতি সম্পর্কে সালজুনাস কখনোই কোন রকম আগ্রহ দেখাননি,’ বলল কায়সার। ‘কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল এথেন্সের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে মিডিয়াতে নিয়মিত বিবৃতি পাঠাচ্ছেন তিনি। সে-সব বিবৃতিতে অভিযোগ করা হলো, মন্ত্রীসভার সকল সদস্য, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে আছেন। শুধু তাই নয়, কিছু কর্নেল ও জেনারেলের বিরুদ্ধেও নানান অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তাঁর অভিমত হলো-গ্রীসে একটা বিপ্লব দরকার, তা না হলে শান্তি বা সমৃদ্ধি কোনটাই সাধারণ জনগণের কপালে জুটবে না। ভদ্রলোক আভাসে যেন বলতে চাইছেন, গ্রীসে এখন একটা সামরিক অভ্যুত্থান খুবই দরকার।’
‘রাজনীতি সম্পর্কে যে-কেউ আগ্রহী হতে পারে,’ বলল রানা। ‘এর মধ্যে দোষের কিছু নেই।’
‘কিন্তু আমার চোখে দোষ ধরা পড়ল,’ বলল কায়সার। ‘দেখা গেল কর্নেল আর জেনারেলদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলে কি হবে, সালজুনাসের পেন্টহাউসে অন্য একদল কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। কিন্তু সালজুনাসের সঙ্গে কি বিষয়ে আলাপ হলো, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কেউ তাঁরা রাজি নন। এদিকে রাজধানীতে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল, ঘুষখোর কিছু সামরিক অফিসারের সাহায্য নিয়ে সালজুনাস একটা প্রাইভেট সেনাবাহিনী গড়ে তুলছেন উত্তর গ্রীসে বিশেষভাবে তৈরি একটা ক্যাম্প, আর মাইকোনোস নামে এক দ্বীপে।
‘তারপর, সমপ্রতি, জেনারেল পয়টারাস নিখোঁজ হয়ে গেলেন। সালজুনাস-এর সমর্থক একটা জাতীয় পত্রিকা রিপোর্ট ছাপল, বোট নিয়ে প্রমোদভ্রমণের সময় লেকে ডুবে মারা গেছেন পয়টারাস। কিন্তু তাঁর লাশ কেউ খুঁজে পেল না। এদিকে সালজুনাস ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন, জেনারেল পয়টারাসের জায়গায় তাঁর পছন্দের লোক জেনারেল হ্যারি কাউরিসকে যাতে পদোনড়বতি দেয়া হয়। অথচ সবাই জানে জেনারেল কাউরিস একজন ফ্যাসিস্ট। সরকার জেনারেল কাউরিসকে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা কমিটিতে চায় না, কিন্তু নির্বাচিত শান্তিপ্রিয় নেতারা সালজুনাসকে ভয় পাচ্ছেন, কারণ সেনাবাহিনীতে তাঁর ভক্ত অফিসাররা সংখ্যায় কম নয়।’ ‘জটিল একটা পরিস্থিতি,’ স্বীকার করল রানা। ‘তবে তোর কি মনে হচ্ছে, ব্যবসা ছেড়ে ক্ষমতার লোভে রক্তাক্ত একটা বিপ্লব ঘটাতে চাইছেন সালজুনাস?’
‘হয়তো। তবে অন্য কিছুর সম্ভাবনাও আছে। আমরা, সাংবাদিকরা, কোলোসস বিল্ডিঙের পেন্টহাউসে নতুন কিছু লোককে আসা-যাওয়া করতে দেখতে পাচ্ছি। ডাফু সালজুনাস অবশ্য এখনও আগের মতই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। নতুন লোকজনের মধ্যে একজনকে আমি চিনতে পেরেছি, নাম বললে তুই-ও চিনবি। একজন গ্রীক-আমেরিকান, আকার্ডিয়া মারকাস।’ রানার চোখ সামান্য সরু হলো। ‘মারকাস এথেন্সে?’ বিড়বিড় করল। ‘সালজুনাসকে সঙ্গ দিচ্ছে?’
‘দেখে তো তাই মনে হচ্ছে, যদি না…’
‘যদি না কি?’
কাঁধ ঝাঁকাল কায়সার। ‘সালজুনাসের সামপ্রতিক বিদঘুটে কীর্তিকলাপ তাঁর চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই মিলছে না, তাই ভাবছি ওগুলোর উৎস হয়তো তিনি নাও হতে পারেন।’
‘সালজুনাস সাম্রাজ্য বেদখল হয়ে গেছে বলতে চাস? নতুন সম্রাটের নাম আকার্ডিয়া মারকাস?’
‘অসম্ভব কি? আমি বলতে চাইছি, হয়তো এরইমধ্যে একটা ছোটখাট ক্যু ঘটে গেছে-চুপিসারে। সালজুনাস যে মাত্রায় গোপনীয়তা পছন্দ করেন আর সমস্ত কাজ লোকজনদের দিয়ে করান, তাঁকে বন্দী বা খুন করে কেউ যদি তাঁর নামে সব কিছু অপারেট করে, সেটা জানাজানি হবার সম্ভাবনা খুবই কম, অন্তত বেশ কিছু দিন। এই সুযোগে তাঁর টাকা সরিয়ে ফেলাও সোজা। ঠিক এই কথাগুলোই আমি আমাদের পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলাম। লেখাটা ছাপা হবার দু’দিন পরই গুলি করা হয় আমাকে।’
দু’জনকেই চুপ করে থাকতে হলো, ওয়েটার টেবিলে ডিনার পরিবেশন করছে। বিরতির এই সময়টা আকার্ডিয়া মারকাসের কথা ভাবছে রানা। তার ফাইল ওর পড়া আছে। অনায়াসেই তাকে রাহু বলা যায়, কারণ পরের ধন গ্রাস করাটাই তার পেশা। কলেজ জীবন কেটেছে ইয়েল-এ, তখন ছিল কমিউনিজম ও সর্বহারাদের পক্ষে, হাতে তৈরি বোমা ফাটিয়ে বুর্জোয়াদের ভয় দেখাত। লেখাপড়া শেষ করে একটা সন্ত্রাসী গ্রুপ গঠন করে সে, গ্রীসের গ্রামে গ্রামে ডাকাতি করে বেড়ায় পাঁচ বছর। ধরা পড়ায় মামলা চলে, হাজত থেকে পালিয়ে দেশ ছেড়ে ব্রাজিলে চলে যায়। যেভাবেই হোক, ব্রাজিলের নাগরিকত্ব পায় মারকাস। প্রথম কয়েক বছর কেউ টেরই পায়নি ব্রাজিলের বড় বড় শহরগুলোয় কি কাজে আসা-যাওয়া করে সে। ধীরে ধীরে আন্ডারগ্রাউন্ডে গুজবটা ছড়াল-আকার্ডিয়া মারকাস চুক্তিতে মানুষ খুন করে। কিছুদিন পরপর পেশার ধরন বদলায় মারকাস। ব্রাজিলে তখন রিয়েল এস্টেট ব্যবসা তুঙ্গে। ব্যবসায়ীরা গুণ্ডা পুষছে অন্যের জমি দখল করার জন্যে। এরকম দু’চারজন ব্যবসায়ীকে খুন করে মারকাস প্রথমে আতঙ্ক সৃষ্টি করল, তারপর দলবল নিয়ে মাঠে নামল ব্যবসায়ীদের জমি জবর দখল করার কাজে। ব্রাজিল পুলিস তাকে ছয়বার গ্রেফতার করলেও প্রমাণের অভাবে প্রতিবার কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়ে যায় সে। তবে অনেকেরই সন্দেহ, পুলিস অফিসার, রাজনীতিক, মন্ত্রী ও বিচারকদের কোটি কোটি মার্কিন ডলার ঘুষ দিয়ে নিজেকে মুক্ত রেখেছে মারকাস। সে নাকি তার বন্ধুদের দুঃখ করে বলে, ‘যা কামাই সব তো ঘুষ দিতেই বেরিয়ে যায়, নিজের জন্যে প্রায় কিছুই থাকে না।’
এক এক করে সব রকম অপরাধেই হাত পাকিয়েছে আকার্ডিয়া মারকাস। যুক্তরাষ্ট্রে তার পাঠানো হেরোইনই পরিমাণে সবচেয়ে বেশি। ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় সবগুলো দেশে তার একটা নেটওঅর্ক কাজ করছে-কাজটা হলো, বাচ্চা ছেলেমেয়ে ধরে ধনী আরব রাষ্ট্রগুলোয় পাচার করা।
ডিনারটা প্রায় নিঃশব্দেই সারল ওরা। ওয়েটার টেবিল পরিষ্কার করে কফি দিয়ে গেল।
‘আর ওই লোকটা?’ এক সময় জিজ্ঞেস করল রানা। ‘যে তোকে এখানে, ব্রাজিলিয়ায় গাড়ি চাপা দেয়ার চেষ্টা করল? এথেন্সের কোলোসস পেন্টহাউস থেকে তাকে তুই বেরিয়ে আসতে দেখেছিস?’
‘হ্যাঁ, রানা।’ দু’হাতের ভেতর দেশলাই জ্বেলে একটা সিগারেট ধরাল কায়সার। ‘পত্রিকার কাজ শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকি। তারপর ছোট বোন লায়লার সঙ্গে দেখা করতে যাব সান্তা ফিলোমেনায়। ওর কাছে খুব বেশি হলে দিন দুই থাকব, তারপর এথেন্সে ফিরে আকার্ডিয়া মারকাস আর সালজুনাসের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগব আবার…’
‘একা?’ বাধা দিয়ে জানতে চাইল রানা।
‘আপাতত একাই,’ বলল কায়সার। ‘তবে তুই একটা চিঠি লিখে দিবি, প্রয়োজন হলে যাতে রানা এজেন্সির এথেন্স শাখার সাহায্য চাইলেই পেতে পারি।’
‘গুড ডিসিশন,’ মাথা ঝাঁকিয়ে মন্তব্য করল রানা। ‘ওদের সঙ্গে একা তোর লাগতে যাওয়াটা ঠিক হবে না।’
‘সারাক্ষণ তো নিজের কথাই বললাম, এবার বল তোর কি খবর?’ হাসিমুখে জানতে চাইল কায়সার। ‘ব্রাজিলে কি, বেড়াতে?’
‘ছোট্ট একটা অফিশিয়াল কাজে এসেছি, সেটা সেরে ফেলতে আমারও আর একদিন লাগবে,’ বলল রানা। ‘তারপর বেড়াব।’
‘তাহলে চল, আমার বোনের বাড়ি সান্তা ফিলোমেনা থেকে বেড়িয়ে আসবি। তোর কথা ওকে এত বলেছি, তোর রীতিমত ভক্তই বলতে পারিস…’
একটা হাত তুলল রানা। ‘সরি, দোস্ত। ছোট বোনের সঙ্গে পরে কোন এক সময় দেখা করা যাবে। আসলে, রিসর্ট শহর ফোর্টালেজায় আমার জন্যে একজন অপেক্ষা করছে। আমার পৌঁছতে দেরি হলে চলে যাবে সে, এতই অভিমানী…’
ম্লান একটু হেসে কায়সার বলল, ‘সেক্ষেত্রে আমি লায়লার কাছে স্বীকারই করব না যে তোর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। শোন, অফিস থেকে ওরা ছোট্ট একটা প্লেন দিয়েছে আমাকে। আমার সঙ্গে তুই যদি সান্তা ফিলোমেনা পর্যন্ত যাস, পথটা গল্প করে কাটানো যাবে। তোকে তো ওই পথেই ফোর্টালেজা যেতে হবে।’
প্রস্তাবটায় যুক্তি আছে, বন্ধুর অনুরোধ মেনে নিল রানা। ‘ঠিক হ্যায়, তাই যাব।’
দু’দিন পর টু-সিটার সেসনায় চড়ে রওনা হলো ওরা। খবরের পিছনে প্রায়ই প্লেন নিয়ে ছুটতে হয় কায়সারকে, ফলে ইতিমধ্যে পাইলট হিসেবে রীতিমত দক্ষ হয়ে উঠেছে সে। বন-জঙ্গলের ওপর দিয়ে ছোটার সময় প্লেনটাকে যথেষ্ট নিচে রাখল সে, বন্য প্রাণীগুলোকে যাতে দেখা যায়।
সান্তা ফিলোমেনার পথে অর্ধেক দূরত্বও পেরোয়নি সেসনা, কেশে উঠল এঞ্জিন। প্রথমে গুরুত্ব দিল না কায়সার। কিন্তু কাশিটা আরও কর্কশ ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠল। ছোট কন্ট্রোল প্যানেলের এটা-সেটা নাড়াচাড়া করে কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পেল না কায়সার। অথচ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। সেসনার খসে পড়া ঠেকানো যাচ্ছে না। তারপর চক্কর খেতে শুরু করল প্লেন।
হঠাৎ গ্রীক ভাষায় কাকে যেন গালি দিল কায়সার, মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। কন্ট্রোল প্যানেল কোনভাবে স্থির রাখল সে, ঝট্ করে রানার দিকে তাকাল। বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে হেডসেটের ভেতর কপালে। ‘ফুয়েল গজের কাঁটা “ফুল”-এর ঘরে,’ চিৎকার করে বলল রানাকে। ‘সকালে যেখানে ছিল এখনও সেখানেই রয়েছে, এক চুল নড়েনি কাঁটা।’ গজ ঢাকা কাঁচে ঘুসি মারল সে, কিন্তু কিছুই ঘটল না। F অক্ষরের ওপর স্থির হয়ে থাকল কাঁটা।
‘গ্যাস নেই!’ রানার গলায় অবিশ্বাস। যে-কোন প্লেনের জন্যেই এটা দুঃসংবাদ।
‘না, এখনও খানিকটা আছে, তবে এখুনি শেষ হয়ে যাবে,’ বলল কায়সার, আবার কন্ট্রোল প্যানেলের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে সেসনার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার চেষ্টা করছে। ‘স্যাবটাজ করা হয়েছে, রানা। গজের কাঁটা ওই পজিশনে আটকে দেয়া হয়েছে, কিন্তু আমরা রওনা হবার সময় ট্যাংকগুলো প্রায় খালি ছিল। এটা আমার লাইফের ওপর তৃতীয় হামলা। দুঃখ এই যে আমার সঙ্গে তোকেও…’
‘ওহ্, গড!’ ফিসফিস করল রানা। ‘কোথাও ল্যান্ড করানো যায় না?’
মাথা ঝাঁকাল কায়সার। ‘আশপাশে কোন এয়ারফিল্ড নেই, তবে ফাঁকা মাঠ হয়তো পাওয়া যাবে। প্লেনটাকে গ্লাইড প্যাটার্নে রাখতে পারলে ল্যান্ড করাতে পারব।’
‘কে ল্যান্ড করাবে–তুই না আমি?’
‘আমি,’ বলল কায়সার। ‘তুই প্রার্থনা কর। সত্যি আমি খুব দুঃখিত, দোস্ত।’ ভাব দেখে সন্দেহ হলো কেঁদেই না ফেলে।
‘দুঃখিত পরে হোস,’ প্রায় ধমকে উঠল রানা। ‘আগে প্লেনটাকে ল্যান্ড করা।’ প্যারাশুটের কথা জিজ্ঞেসই করল না। জানে নেই; তাছাড়া সময় কোথায়! ফাঁকা একটা জায়গার দিকে গোত্তা খেয়ে নামতে শুরু করেছে সেসনা।
২
লম্বা উইঢিবির গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে, মাথাটা বার কয়েক নেড়ে প্রিয় বন্ধু জুলহাস কায়সারের ছিনড়বভিনড়ব লাশটার কথা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করল রানা। ধীরে ধীরে দাঁড়াল, রডটা হাতে। বিধ্বস্ত প্লেনটার দিকে একবারও না তাকিয়ে হাঁটা ধরল-জানে না কোনদিকে যাচ্ছে, ওদিকে কোনও পথ পাওয়া যাবে কি না।
ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে এল। ঝোপের কাঁটা ট্রাউজারে আটকাচ্ছে, ছাড়াতে সময় লাগছে, ফলে এগোবার গতি মন্থর। সামনে পড়ল লম্বা ঘাস। এ যেন একটা সবুজ সাগর, অনায়াসে ডুবে যাওয়া যায়। একটুর জন্যে কুণ্ডলী পাকানো একটা বিষাক্ত সাপের গায়ে পা পড়ল না, দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে তিন হাত দূরে সরে এলো।
সারা শরীরে তীব্র ব্যথা, তবে গ্রাহ্য না করে ধীরে ধীরে হাঁটছে। দু’ঘণ্টা পার হয়ে গেল। কোথায় পথ, কোথায় জনবসতি, কোথায় কি। রানা বুঝতে পারল, বিশ্রাম না নিয়ে ওর পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব নয়। এত দুর্বল, পা দুটো কাঁপছে। হাঁপানোর ধরনটা, যেন শ্বাসকষ্টে ভুগছে। মরা একটা গাছের গুঁড়ি দেখতে পেয়ে ধপ করে পাশের মাটিতে বসল ও, হেলান দিল সেটার গায়ে।
চোখ দুটো আপনা থেকে বুজে আসছে। উরুর একটা পেশি বার বার মোচড় খাচ্ছে। মশা-মাছি বসছে চোখে-মুখে। এ-সব গ্রাহ্য না করে অনড় থাকল রানা। জানে বিশ্রাম দরকার, যত বাধাই আসুক বিশ্রাম পেতে হবে।
ঘাসের রাজ্য থেকে একটা শব্দ ভেসে এলো।
কেঁপে কেঁপে খুলে গেল চোখের পাতা। ওর কি শুনতে ভুল হয়েছে? লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে যতদূর দৃষ্টি চলে, কোথাও কিছু নড়ছে না। ব্যাপারটা তাহলে কল্পনাই। আবার চোখ বুজল রানা। কিন্তু ঠিক তখুনি দ্বিতীয়বার শুনতে পেল।
এবার চোখের পাতা ঝট্ করে খুলে গেছে। আর কোন সন্দেহ নেই-পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে ও মানুষের গলা। কান পেতে অপেক্ষায় থাকল। আরও একটা শব্দ হলো। একটা ডাল ভাঙার আওয়াজ।
‘হ্যালো!’ ডাকল রানা। গলা আরও কিছুটা চড়িয়ে বলল, ‘এইদিকে!’
একটু পরই ঘাসের ওপর দু’জন লোকের মাথা দেখা গেল। কালো মাথা। গায়ে বহুরঙা শার্ট। রানাকে দেখে তাদের একজনের গলার আওয়াজ বেড়ে গেল। একটা হাত লম্বা করে সঙ্গীকে দেখাল সে। সঙ্গীটিও উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল।
রানার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না ওকে দেখেই এত উল−সিত হবার কি কারণ থাকতে পারে। স্প্যানিশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যালো। তোমাদের কাছে পানি আছে?’
ওর সামনে এসে দাঁড়াল দুই তরুণ। রোগা, তবে দুর্বল নয় তারা। চেহারা গম্ভীর, ভঙ্গিটাও-দু’জনেই নিজেদের কোমরে হাত রেখে রানাকে খুঁটিয়ে দেখছে। রানার প্রশ্ন শুনে পরস্পরের দিকে তাকাল, তারপর আবার ফিরল ওর দিকে। আরও একটু এগিয়ে এলো তারা। রানা দাঁড়াবার চেষ্টা করছে না। ‘পানি,’ আবার বলল ও।
দু’জনেই প্যান্ট-শার্ট পরে আছে, পায়ের স্যান্ডেলগুলো টায়ার কেটে তৈরি করা। এরা অসভ্য জংলী নয়, সভ্যজগতের বাসিন্দা। দু’জনের মধ্যে একজন বেশ লম্বা, হাত তুলে রানার পা দুটো দেখাল সে, তারপর রানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁটু গেড়ে বসে ওর জুতোর ফিতে খুলতে শুরু করল। কি করছে সে, এ প্রশ্ন তোলার সময় পাওয়া গেল না, এক পাটি জুতো খুলে সঙ্গীর দিকে বাড়িয়ে ধরেছে। দ্বিতীয় তরুণ বেঁটে, মুখে কাটাকুটির শুকনো দাগ। জুতোটা নিয়ে পরীক্ষা করছে সে। তার সঙ্গীর কানে খুদে আয়না লাগানো দুল ঝুলছে। দু’জনের সঙ্গেই একটা করে ছোরা রয়েছে। খাপে মোড়া, কোমরে গোঁজা। সে-ই প্রথম কথা বলল, স্প্যানিশ ভাষায়, সঙ্গীকে উদ্দেশ করে, ‘আজ বোধহয় আমার কপালটাই খুলে যাবে।’
‘আমার কথা শোনো,’ নরম গলায় শুরু করল রানা।
ওকে তারা গ্রাহ্যই করল না। লম্বা লোকটা ঝুঁকে দ্বিতীয় জুতোটাও পা থেকে খুলে নিল। স্যান্ডেল জোড়া ফেলে দিয়ে জুতো দুটো পরে ফেলল সে। ‘ভালই ফিট করেছে, কি বলিস?’
তার সঙ্গী ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসি নিয়ে গোটা ব্যাপারটা উপভোগ করছে। ‘কি করে ধরে নিচ্ছিস ওগুলো তোর? আমরা তো লোকটাকে একই সময়ে দেখতে পেয়েছি, তাই না?’
‘না, আমি আগে দেখেছি,’ প্রথমজন বলল। ‘তুই ওর ট্রাউজার নিতে পারিস। বিদেশী লোক, মানিব্যাগে প্রচুর ডলার পাব।’
‘কিভাবে ভাগ হবে?’ জানতে চাইল বামন।
‘আধাআধি।’
‘ঠিক আছে,’ রাজি হলো খর্বকায়, তবে অসন্তোষ প্রকাশ করতে ছাড়ল না। ‘কিন্তু জুতো জোড়া তোর নেয়া উচিত হলো না।’
লম্বা লোকটা রানার দিকে ফিরল। ‘ট্রাউজার খোলো।’
‘দূর গাধা!’ বামন ধমক দিল। ‘আগে জিজ্ঞেস কর মানিব্যাগে কত টাকা আছে। ভুল হলো। জিজ্ঞেস করার দরকার কি, পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগটা বের কর। যদি বেশি টাকা পাই, ট্রাউজার নেব না-জবাই করে কেটে পড়ব।’
লোকটার কথায় যুক্তি খুঁজে পেল রানা। বিদেশী একজন ট্যুরিস্টের সব কিছু ছিনিয়ে নেয়ার পর কোন্ বোকা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে?
কিন্তু রানাকে হতভম্ব করে দিয়ে দুই ছিনতাইকারী বুদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল। আয়না লাগানো দুল দুলিয়ে লম্বা লোকটা বলল, ‘আমি যদি গাধা হই তো তুই কি? শুনে বল, আমার এই বুদ্ধিটা কেমন।’ কোমরে আটকানো খাপ থেকে ছোরাটা টেনে নিল সে। ‘আগে জবাই করাটা সব দিক থেকে নিরাপদ নয়?’
‘বেড়ে বলেছিস। নাহ্, সত্যি, তোর বুদ্ধি আছে! তো কর, ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেল, দেরি করছিস কেন?’ ‘না, দেরি কিসের!’ বলেই লম্বা লোকটা রানার বুক লক্ষ্য করে ছুরি চালাল। জবাই যদি করেও, পরে; আগে আহত করে নিতে চাইছে।
খুন হতে হবে শুনে কোথায় পালিয়েছে দুর্বলতা আর ক্লান্তি, শরীরের পাশে লুকানো ইস্পাতের রডটা শক্ত মুঠোয় নিয়ে অপেক্ষা করছিল, যেই দেখল লোকটা ছুরি চালাতে যাচ্ছে অমনি সেটা তুলে লোকটার কব্জিতে আঘাত করল রানা। লোকটা কেঁদে ফেলল, নিশ্চয়ই ছুরি হারাবার শোকে নয়, কারণ তার কব্জির হাড় শুধু ভাঙেনি, গুঁড়ো হয়ে গেছে। তবে তার কানড়বা দেখার জন্যে থেমে নেই রানা, বসে বসেই একটা লাথি মারল লোকটার তলপেটে। ছিটকে ঘাসের ভেতর ডুবে গেল সে, কানড়বা ও নড়াচড়া দুটোই থেমে গেছে।
ইতিহাসের শিক্ষা নিল না দ্বিতীয় লোকটা, ছুটে এসে আক্রমণ করল, ছুরিটা লম্বা করা হাতের বর্ধিত অংশ যেন। একপাশে সরে গিয়ে ল্যাং মারল রানা। ছিটকে পড়ে যাচ্ছে, নিতম্বে ওর একটা লাথি গতিবেগ তিনগুণ বাড়িয়ে দিল।
ঘাসের ওপর পড়ায় আঘাত গুরুতর নয়, সিধে হয়ে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করল লোকটা। কিন্তু ততক্ষণে ওর ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে বাগিয়ে ধরেছে রানা। মারার ভঙ্গি করে ভয় দেখাল। তারপর সংক্ষেপে নির্দেশ দিল কয়েকটা। ওর কথা শেষ হতে মাথা ঝাঁকাল লোকটা নিঃশব্দে।
অজ্ঞান লোকটার পা থেকে জুতো খুলে রানার পায়ে পরাল খর্বকায়। রানার প্রশেড়বর উত্তরে জানাল, দক্ষিণ দিকে গেলে রাস্তা ও গাড়ি দুটোই পাওয়া যাবে। সে নিজে অবশ্য সদ্য জ্ঞান ফিরে পাওয়া সঙ্গীকে নিয়ে পুব দিকে ছুটল, যেদিক থেকে এসেছিল। লোকটা সত্যি কথা বলেছে, এরকম ভাবার কোন কারণ নেই; রানা উল্টো অর্থাৎ উত্তর দিকে রওনা হলো।
মাইলখানেক হাঁটার পর নিজের প্যাঁচালো বুদ্ধির তারিফ করল রানা। চোখের সামনে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হলো চওড়া হাইওয়ে, তীর বেগে গাড়ি চলাচল করছে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাত তুলতে একটা লিফট পেতেও বেশি সময় লাগল না। ট্রাক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল কাছাকাছি এয়ারপোর্ট ডিয়ানোপলিস।
ট্রাক ছুটছে। রানা অন্যমনস্ক ও গম্ভীর। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে জুলহাস কায়সারের ক্ষতবিক্ষত লাশটা। তার এই করুণ পরিণতির জন্যে ডাফু সালজুনাস দায়ী হোক বা আকার্ডিয়া মারকাস, অবশ্যই তাকে চরম মূল্য দিতে হবে।
এথেন্সের কোলোসস বিল্ডিঙে কি ঘটছে জানতে হবে রানাকে। তবে তার আগে জানতে হবে আকার্ডিয়া মারকাস ব্রাজিলে আছে কিনা।
ডিয়ানোপলিস এয়ারপোর্ট থেকে প্রথমে রিসর্ট শহর ফোর্টালেজায়, তারপর লং ডিসট্যান্স কল করল রানা বিসিআই হেডকোয়ার্টার ঢাকায়। ফোর্টালেজায় এক বান্ধবী ওর জন্যে অপেক্ষা করছে, ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করতে হলো হঠাৎ জরুরী একটা কাজ ঘাড়ে এসে চাপায় ব্রাজিল ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে ও।
তারপর বিসিআই-এর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (অপারেশন্স) প্রিয় বন্ধু সোহেল আহমেদকে জানাল কি ঘটেছে। সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেল সোহেল। ‘এখন তুই কি করতে চাস?’ প্রথম প্রশ্ন তার।
‘তুই জানিস কায়সারের সঙ্গে কি রকম সম্পর্ক ছিল আমার,’ বলল রানা। ‘এই হত্যাকাণ্ডের কারণটা আমার জানতে হবে।’
‘প্রতিশোধ নিতে চাস?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি তোকে বাধা দেব না,’ সোহেল শান্ত, ভেবেচিন্তে কথা বলছে, ‘কারণ জানি আমার বাধা তুই পাত্তাও দিবি না। কিন্তু একটা কথা জানিস তো, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারটাকে বস্ কোনদিনই ভাল চোখে দেখেন না…’
‘দ্যাখ, আমাকে জ্ঞান দান করতে আসিস না। কাজটা আমি অফিশিয়াল অনুমোদন না নিয়েও করতে পারি, সোহেল,’ ঠাণ্ডা গলায় বলল রানা, সোহেলের চেয়েও শান্ত। ‘কারণ আমি ছুটিতে।’
‘তাহলে ফোন করেছিস কেন? এই অসময়ে ফোন করে আমাকে ঘাবড়ে দেয়ার কি মানে?’
‘ফোন আমি বিসিআই-এর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরকে করিনি, করেছি আমার বন্ধুকে।’
অপরপ্রান্তে বিশ সেকেন্ড কোন সাড়া নেই। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দেয়ার আওয়াজ। ‘তাহলে সব কথা তোকে খুলেই বলতে হয়।’
‘কি কথা?’ রানা একটু অবাকই।
এরপর দীর্ঘ সময় নিয়ে সোহেল যা বলল, তার সার সংক্ষেপ হলো এরকম:
গত বছরের কথা। গ্রীক বিলিওনেয়ার ডাফু সালজুনাস তাঁর পার্সোন্যাল সেক্রেটারীর নেতৃত্বে একদল কর্মকর্তাকে বাংলাদেশে পাঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়ে। কোলোসস কোম্পানি ফ্লাইওয়ে, পাতালরেল, উপকূল থেকে গ্যাস উত্তোলন ইত্যাদি মোট বারোটা প্রজেক্টে বাংলাদেশে সব মিলিয়ে তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দিয়ে তড়িঘড়ি চুক্তির খসড়া তৈরি করালেন তাঁরা, তারপর সেই চুক্তি ডাফু সালজুনাসকে দিয়ে অনুমোদন করাতে এথেন্সে ফিরে গেলেন। সেই যে গেলেন, তারপর আর কোন খবর নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বারবার যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছে খসড়া চুক্তি মিস্টার সালজুনাস অনুমোদন করেছেন কিনা। উত্তরে প্রথমে বলা হয়েছে, বিষয়টা তিনি এখনও বিবেচনা করে দেখছেন। তারপর বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও কোলোসস কোম্পানি কিছু বলছে না। বাণিজ্য মন্ত্রী নিজে এই ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত, তাঁর কেমন যেন সন্দেহ হয়। বিসিআই চীফ রাহাত খানকে চিঠি লিখে তিনি তাঁর সন্দেহের কথাটা জানান, এবং অনুরোধ করেন সম্ভব হলে বিসিআই যেন একটু খোঁজ নিয়ে দেখে-বাংলাদেশের কোনও শত্রু কি চাইছে না কোলোসস কোম্পানি এ-দেশে এত মোটা টাকা বিনিয়োগ করুক? তারা কি সালজুনাসকে বুঝিয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা তাঁর উচিত হবে না? তা না হলে এরকম উদ্ভট আচরণ কেন করা হলো?
সবশেষে সোহেল জানাল, লোকবলের অভাব থাকায় ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখা হয়নি। তবে এথেন্স এজেন্টদের চোখকান খোলা রাখতে বলা হয়েছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘বন্ধুকে ফোন করেছিস, ভাল কথা। এবার বল, বন্ধুর কাছে কি চাস?’
‘কমপিউটর অন কর্।’
‘করাই।’
‘প্রথমে কয়েকটা তথ্য,’ বলল রানা। ‘এক, গ্রীক-আমেরিকান ক্রিমিন্যাল আকার্ডিয়া মারকাস এখন কোথায়। দুই, ব্রাজিলে তার যে র্যাঞ্চ বা প্ল্যানটেশনটা ছিল, এখনও কি সেটা আছে?’
ত্রিশ সেকেন্ড পর উত্তর দিল সোহেল, ‘মারকাস এখন কোথায় নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। শেষবার, গত হপ্তায়, এথেন্সে দেখা গেছে তাকে। হ্যাঁ, প্ল্যানটেশনটা আছে। ওটাই এখন তার হেডকোয়ার্টার।’
‘আমাদের দৃষ্টিতে আকার্ডিয়া মারকাসের সবচেয়ে বড় অপরাধ কোনটা?’
‘ইয়াসির আরাফাতের উত্তরাধিকারী হিসেবে যাকে বিবেচনা করা হত, সেই আবু ইসহাক ইমাম সালেহকে গত বছর খুন করেছে মারকাস। তখন থেকেই বিসিআই-এর “ওয়ান্টেড” তালিকায় তার নাম আছে।’
উল্লাস বোধ করছে রানা। ‘তাহলে তো বলতে হয় লোকটার ব্যবস্থা করতে পারলে একটা অফিশিয়াল দায়িত্বই পালন করা হবে আমার।’
এ-প্রসঙ্গে কিছু বলল না সোহেল। ‘তুই বরং রিয়ো ডি জেনেরিওতে চলে যা। রানা এজেন্সির চ্যানেল ধরে খোঁজ নিয়ে দেখ মারকাস কোথায় আছে। কি সূত্র পাবি তার ওপর নির্ভর করবে আদৌ তোর এথেন্সে যাবার দরকার আছে কিনা।’
আরও তিন মিনিট আলাপ করার পর পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল ওরা। রিয়ো ডি জেনেরিওতে পরদিন সকালে পৌঁছাল রানা। বিশ্রাম, ওষুধ, আর ভাল পথ্য যেমন ওর শরীরের শক্তি ফিরিয়ে এনেছে তেমনি নতুন এক প্রস্থ পোশাক চেহারায় ফিরিয়ে এনেছে ভদ্র ও মার্জিত ভাব। কোপাকাবানা প্যালেস-এর উত্তরে, ফাইভ স্টার হোটেল হিলটনে উঠল ও। একটু দূরেই সৈকত, ওর বারোতলা ঝুল-বারান্দা থেকে সাগর দেখা যায়। রানা এজেন্সির রিয়ো শাখায় গেল না ও, ফোন করে শাখা প্রধান রিয়াজুল হাসানকে জানাল কি কি দরকার ওর, কোথায় কিভাবে দেখা হবে।
লাঞ্চ খেতে নিচে নামবে, রূম সার্ভিস একটা প্যাকেজ ডেলিভারি দিয়ে গেল। প্যাকেজ থেকে বেরুল একটা ওয়ালথার পিস্তল ও একটা খাপে মোড়া ছুরি, সিপ্রঙ লাগানো স্ট্র্যাপ সহ। রিয়াজুল হাসান একটা চিরকুটও পাঠিয়েছে, তাতে লেখা- ‘পিস্তলের লাইসেন্স আপনার নামে অনেক আগেই করা ছিল’। কথাটা আসলে রানাকে শুধু মনে করিয়ে দেয়ার জন্যেই লেখা। রানা এজেন্সির এরকম অনেক শাখাতেই ওর নামে পিস্তলের লাইসেন্স তৈরি আছে।
নিচে নেমে রেস্তোরাঁয় বসল রানা। মেন্যু দেখে অর্ডার দিচ্ছে, টেবিলের পাশ ঘেঁষে একটা মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখল। মুখটা ভাল করে দেখার সুযোগ হয়নি, তা সত্ত্বেও চোখ ফেরাতে পারছে না। দীর্ঘ কাঠামো, স্বাস্থ্য ভরাট হওয়া সত্ত্বেও ক্ষীণ কটি। আঁটসাঁট জিনস আর ম্যাগাজিন টি-শার্ট পরেছে। কাঁধে লাল চুলের সতূপ। দশ গজ দূরে একটা টেবিলে বসল, এদিকে মুখ করে।
মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে রানার, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না কবে বা কোথায় দেখেছে। আসলে এই পোশাকেও দেখেনি, এই মেকআপেও নয়, চিনতে দেরি হবার সেটাই কারণ। ওয়েটারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হেসে উঠল মেয়েটা, অমনি রানা চিনে ফেলল তাকে। ওর নাম তারানা আজিজ, প্যালেস্টাইন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর একজন অপারেটর। বছর কয়েক আগে ফাতেমা কোডনেম নিয়ে একটা অ্যাসাইনমেন্টে রানার সঙ্গে কাজ করেছিল এই মেয়েটা, সেবার ওরা ইজরায়েলের রাজধানী জেরুজালেমে ঢুকে মোসাদের হেডকোয়ার্টার ধ্বংস করে দিয়ে এসেছিল।
তারানা ব্রাজিলে কেন?-এই প্রশ্নটাই প্রথমে জাগল রানার মনে। চুলের রঙ আর পোশাকের পরিবর্তন বলে দিচ্ছে ছদ্মবেশ নিয়ে রয়েছে মেয়েটা। নামটাও বদলে গিয়ে থাকতে পারে। সরাসরি আলাপ করতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। রানা সিদ্ধান্ত নিল, ওকে চিনতে পারার একটা সুযোগ দেয়া যেতে পারে তারানাকে।
লাঞ্চের অর্ডার বাতিল না করেই টেবিল ছাড়ল রানা, ধীর পায়ে তারানার টেবিলটাকে পাশ কাটাচ্ছে।
‘গ্রেট! জাস্ট গ্রেট!’ চেয়ার ছেড়ে রানার পথ আগলাল বেদুইনকন্যা। ‘এটাই সম্ভবত বছরের সেরা জোক, মাসুদ রানা আমাকে চিনতে পারেনি!’
হেসে ফেলল রানা। ‘চিনতে পেরেছি ঠিকই, তবে দু’সেকেন্ড দেরি হয়েছে, দায়ী তোমার চুল আর ড্রেস।’
‘কাভার অ্যান্ড ক্যামোফ্লেজ,’ চাপা হাসির সঙ্গে ফিসফিস করল তারানা, তারপর রানার একটা হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের টেবিলে বসবে?’ রানা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে দেখে আবার বলল, ‘পরে একজন আসছে। তুমি আবার কিছু মনে করবে নাকি?’
আবার হাসল রানা। ‘উত্তরটা দিতে পারব তাকে দেখার পর।’ দু’জনে মুখোমুখি বসল ওরা। ইঙ্গিতে ওয়েটারকে ডেকে নতুন করে তিনজনের জন্যে লাঞ্চের অর্ডার দিল রানা, তারানার আপত্তি কানে তুলল না। ‘তারপর, তারানা?’ জিজ্ঞেস করল ও। ‘ভাল যে আছ তা তো দেখছিই। ব্রাজিলে কি? বেড়াতে?’
মাথা নাড়ল তারানা। ‘কাজে। তুমি?’
রানা ভাবল, ব্রাজিলে প্যালেস্টাইন ইন্টেলিজেন্সের কি কাজ থাকতে পারে, আবু ইসহাক ইমাম সালেহ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়া ছাড়া? ‘আমিও কাজেই,’ বলল ও।
প্রায় ভোজবাজির মতই অকস্মাৎ ওদের টেবিলের পাশে দেখা গেল তরুণটিকে। বয়স কম, বিশ কি একুশ; তবে দীর্ঘ কাঠামোর ওপর কঠোর শ্রম ও যতেড়ব তৈরি করা পেশিগুলো কাপড়ের বাইরে থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চেহারায় খেপা-খেপা একটা ভাব, যেন সারাক্ষণ রেগে বোম হয়ে আছে। ছোকরার সামার-ওয়েট সুট বাম বগলের তলার ফোলা ভাবটুকু লুকাতে পারেনি।
‘এটা কি হলো, তারানা?’ কর্কশ সুরে জানতে চাইল তরুণ। ‘এ তো আমি জানতাম না যে তোমার সঙ্গে আর কেউ থাকবে।’
তার আচরণ সামান্য অভব্য যদি হয়েও থাকে, রানা ব্যাপারটাকে হালকা দৃষ্টিতেই দেখতে চাইছে। অন্যতম কারণ, অল্প বয়স; দ্বিতীয় কারণ, ছেলেটাকে চেনে ও। চেনে মানে ছবি দেখেছে, ফাইলও কিছুটা পড়া আছে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে পি.আই.বি-তে ঢোকে হাবিব বাকারা-অবিশ্বাস্য শোনালেও, কথাটা সত্যি-একজন খুনী হিসেবে। গত পাঁচ-ছ’বছরে তার হাতে কম করেও ষাটজন ইজরায়েলি এজেন্ট মারা পড়েছে। তারানার সঙ্গে বাকারার উপস্থিতি রানার ধারণা আরও দৃঢ় করল, ওরা নিশ্চয়ই আকার্ডিয়া মারকাসকে ধরতে এসেছে।
‘ইনি আমার পুরানো এক বন্ধু, হাবিব,’ বলল তারানা।
‘আমার, এবং ফিলিস্তিনীদের।’
‘জানি।’ খালি চেয়ারটায় বসল বাকারা। ‘মাসুদ রানা।’ তার আচরণে কোন রকম শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ নেই, তবে তুচ্ছতাচি ছল্যও করছে না। ‘আমাদের হয়ে বেশ কয়েকবারই মোসাদকে আপনি ভাল মার দিয়েছেন।’
‘তোমার সম্পর্কে কিছু তথ্য আমিও জানি,’ বলল রানা। ‘মোসাদ তোমাকে আজরাইলের চেয়েও বেশি ভয় পায়।’ ‘কিছু যদি মনে না করেন তো একটা সত্যি কথা বলি।’ এই প্রথম সরাসরি রানার দিকে তাকাল বাকারা। ‘মোসাদ বলুন, সিআইএ বলুন, এতটা বাড়তে পেরেছে আপনাদের মত নরম প্রকৃতির কিছু এজেন্টের জন্যে। আপনারাও লড়েছেন, তবে সূক্ষ্ম কৌশলে, গা বাঁচিয়ে। আমার পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা।’ হাসিমুখেই জানতে চাইল রানা, ‘সেটা কি?’
‘আঙুল তুলে টার্গেট বা সাবজেক্ট দেখিয়ে দিন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তার লাশ ফেলে দেব।’ হাবিব বাকারা হাসছে না; আসলে হাসতে সে জানেই না।
‘ব্রাজিলে, আমার ধারণা, সাবজেক্ট তো একটাই,’ বলল রানা। ‘দেখি তুমি তাকে ফেলে দিতে পারো কিনা। পারলে সত্যি আমি খুশি হব।’
হাঁ করে তাকিয়ে থাকল বাকারা। তারপর তারানার দিকে তাকাল। ‘কি বলছেন উনি?’
তারানাও অবাক হয়ে দেখছে রানাকে। ‘কি জানি, বুঝতে পারছি না। রানা?’
বাতাসে হাত নেড়ে ব্যাপারটা ভুলে যেতে বলল রানা, তারপর ইঙ্গিতে এগিয়ে ওয়েটারকে দেখিয়ে কথা বলতে নিষেধ করল। ‘তোমরা কি এই হিলটনেই উঠেছ, তারানা?’ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।
‘না,’ বলল তারানা। ‘আমরা উঠেছি ইন্টারকনে। আঠারোতলায়। আমার রূম নাম্বার একশো বারো।’
বাকারা কঠিন চোখে তারানাকে দেখছে।
‘আমি ওখানে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি তো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
বাকারা তাড়াতাড়ি তারানাকে বলল, ‘বন্ধুত্ব ঝালাই করার মত সময় কিন্তু তোমার হাতে নেই, তারানা।’
তার কথায় কান না দিয়ে তারানা প্রথমে একটু লাল হলো, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে রানাকে বলল, ‘অবশ্যই তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারো। বরং দেখা না করলেই দুঃখ পাব আমি। মাত্র একটা অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করেছি, কিন্তু পরস্পরকে আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাইনি? সে-সব স্মৃতি কি কখনও ভোলা যাবে?’
লাঞ্চ খাচ্ছে, পুরানো সেই সব স্মৃতি নিয়ে গল্পও চলছে। বাকারাকে দেখে মনে হলো রাগে বেলুনের মত ফুলছে সে। রানা উৎসাহ দিতেও ওদের আলোচনায় অংশ গ্রহণ করল না। এমন কি নিজের লাঞ্চের বিলটাও রানাকে দিতে বাধা দিল, বলল, ‘আমার বিল আমিই দেব।’
খানিক পর তারানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এলো রানা, পিঠে বাকারার দৃষ্টি গরম আঁচের মত অনুভব করল।
৩
বিকেলে কেব্ল্ কার-এ চড়ে কোরকোভাডো পাহাড়ে উঠল রানা। কোরকোভাডোর চূড়ায় যিশুর বিশাল এক স্ট্যাচু দাঁড়িয়ে আছে। কার থেকে নেমে সরাসরি অবজারভেশন প্যারাপিট-এ চলে এলো ও, দাঁড়াল ঠিক যেখানটায় দাঁড়াবার কথা হয়ে আছে। পাঁচ মিনিট পর আরেকটা কেব্ল কারে চড়ে পৌঁছাল হাসান। ওর পাশে দাঁড়িয়ে নিচের শহর, তারপর সারি সারি পাহাড় ও আরেক দিকে বিস্তৃত সাগরের দিকে হাত তুলল সে। ‘ভারি সুন্দর, তাই না, মাসুদ ভাই?’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘আর সব খবর কি?’
‘বিশেষ সুবিধের নয়, মাসুদ ভাই,’ জবাব দিল হাসান। ‘সোহেল ভাই গত মাসে বললেন, আকার্ডিয়া মারকাসের অ্যাকটিভিটি রেকর্ড করতে হবে। তার প্ল্যানটেশনের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করলাম। খবর পেলাম এখন থেকে ছয় কি সাত হপ্তা আগে শেষবার তাকে প্ল্যানটেশনে দেখা গেছে। তারপর একটা গুজব কানে এলো, মারকাসকে মাদ্রিদে দেখা গেছে। সেই থেকে আমরা আর প্ল্যানটেশনে নজর রাখছি না।’
‘ওটা গুজব না-ও হতে পারে। মাদ্রিদ ফ্লাইট এথেন্স পর্যন্তও যেতে পারে।’
‘তা পারে।’
‘প্ল্যানটেশনে কি ঘটছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ওই প্ল্যানটেশনটাই মারকাসের আসল হেডকোয়ার্টার। এখানে, রিয়োয়, সেরবেরাস ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট লিমিটেড নামে যে কোম্পানিটা আছে, এই কোম্পানির মাধ্যমে ড্রাগ ব্যবসাটা চালায় সে। সবাই জানে সে-ই মালিক, যদিও অফিসে প্রায় আসে না বললেই চলে। তবে পারাকাটুতে নিয়মিতই আসা-যাওয়া করত-অন্তত ছয় কি সাত হপ্তা আগে করত।’
‘প্ল্যানটেশনটা ওখানে- পারাকাটুতে?’
মাথা ঝাঁকাল হাসান। ‘ওদিকে একটা গ্রাম আছে ঠিকই, কিন্তু গোটা এলাকাটা আসলে ফাঁকা, জনবসতি নেই বললেই চলে। পাহারায় আছে সাবেক গেরিলারা, এখন যারা পেশাদার সৈনিক-মার্সেনারি। সেই সাথে মারকাসের ভক্ত কিছু পলিটিক্যাল ফ্যানাটিকও আছে। তবে সব মিলিয়ে সংখ্যায় তারা খুব বেশি হবে না।’
‘বেমানান কিছু চোখে পড়েছে তোমাদের?’
‘যদি জিজ্ঞেস করেন লোক জড়ো হচ্ছে কিনা, বা অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তুলছে কিনা, উত্তরে বলব-না। তবে একজন নতুন লোককে আমরা দেখেছি। ওরকম একটা জায়গায় লোকটাকে বেমানানই বলতে হবে।’
‘কেন?’
‘ওখানে যারা থাকে সবাই কাজের লোক। কেউ বসে বসে খায় না। কিন্তু এই লোকটাকে আমরা কেউ কোনও কাজ করতে দেখিনি।’
‘লোকটাকে কবে থেকে দেখছ ওখানে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘শুনেছি, দেখিনি; তিন মাস আগে মারকাসই নাকি সঙ্গে করে নিয়ে আসে ওকে। গত তিন হপ্তায় মাত্র একবার ঘরের বাইরে বেরিয়েছে সে, সঙ্গে দু’জন গার্ড ছিল। মাসুদ ভাই, আমার ধারণা লোকটা মারকাসের বন্দী।’
‘দেখতে কেমন? বয়স কত?’
‘আমরা তার ফটো তুলেছি, তবে অনেকটা দূর থেকে। বয়স, এই বাহানড়ব থেকে পঞ্চানড়ব, সবেমাত্র কপালের পাশে পাক ধরেছে চুলে। সব সময় সিল্কের শার্ট পরে, গ্রামের কয়েকজন লোক অন্তত তাই বলল।’
রানার মনে হলো, এই ভদ্রলোক গ্রীক শিপিং ম্যাগনেট ডাফু সালজুনাস হতে পারে। উল্টোপাল্টা রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়ে এথেন্সের পরিস্থিতি গরম করার পর ব্রাজিলে এসে বন্ধু আকার্ডিয়া মারকাসের আতিথ্য গ্রহণ করেছে? নাকি বিবৃতিগুলো দেয়ইনি, এবং এখানে মারকাসের হাতে বন্দী হয়ে আছে?
হাসানের সঙ্গে জরুরী কয়েকটা কথা সেরে কোরকোভাডো পাহাড় থেকে নেমে এলো রানা। পাঁচটা বাজতে এখনও দেরি আছে, একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা সেরবেরাস ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট লিমিটেড কোম্পানির অফিসে চলে এলো ও। অফিস বিল্ডিংটা তিনতলা, ওপরতলায় সেরবেরাস। এলিভেটর কাজ করছে না, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলো। রিসেপশন হলে যে মেয়েটা বসে আছে, ওকে দেখেই কেমন যেন সজাগ হয়ে উঠল রানার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।
‘বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি।’ ভাষাটা পর্তুগীজ।
রানা ইংরেজি বলছে। ‘আমি মিস্টার মারকাসের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
মেয়েটার চোখ দুটো আরও সরু হয়ে গেল। ভাঙাভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘আমার বিশ্বাস আপনি ভুল জায়গায় চলে এসেছেন, সিনর।’
‘কি আশ্চর্য, তা কি করে হয়!’ রানাকে হতভম্ব দেখাচ্ছে।
‘মিস্টার মারকাস নিজে আমাকে বলেছেন সেরবেরাস ইমপোর্ট- এক্সপোর্ট অফিসের মাধ্যমে আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।’
‘সিনর, এখানে মিস্টার মারকাসের কোন অফিস নেই…’
হঠাৎ একটা প্রাইভেট অফিসের দরজা খুলে রিসেপশনে বেরিয়ে এলো এক লোক-সুদর্শন, শক্ত-সমর্থ। ‘কোন জটিলতা?’ জানতে চাইল সে; কর্কশ সুর, প্রশেড়বর ভঙ্গিটা অমার্জিত ।
‘আমি মিস্টার মারকাসকে খুঁজছি।’ রানা হাসল।
‘কি জন্যে?’
ধমকের সুরে করা প্রশ্ন, গায়ে না মেখে রানা বলল, ‘মিস্টার মারকাস বলেছিলেন, এখানে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে পাইকারি দরে জাপানি ক্যামেরা কিনতে পারব আমি।’ এখন আবার হতভম্ব দেখাচ্ছে ওকে। ‘আমি কি সত্যি ভুল করে অন্য কোন অফিসে ঢুকে পড়েছি? এটা সেরবেরাস নয়?’
‘মিস্টার মারকাস হলেন বোর্ড চেয়ারম্যান,’ বলল লোকটা। ‘তবে এখানে তাঁর কোন অফিস নেই, কোম্পানির হয়ে তিনি কোন ব্যবসাও করেন না। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হলাম আমি। আপনি ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।’
‘উনি সিনর কার্লোস মোলাডো,’ বলল মেয়েটা, গলার সুরে গর্ব বা দম্ভ কিছু একটা আছে।
‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, সিনর,’ বলে ডান হাতটা বাড়াল রানা। লোকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধরল, ভঙ্গিটা আড়ষ্ট। ‘আমার নাম শেখ মাহাথির মাসুদ। চেরি’স রেস্টুরেন্টে হঠাৎই মিস্টার মারকাসের সঙ্গে দেখা ও পরিচয় হয় আমার বেশ কয়েক হপ্তা আগে। বলেছিলেন, প্রায় এরকম সময়েই ইউরোপ ট্যুর শেষ করে রিয়োতে ফিরবেন, তখন আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।’
‘তিনি এখনও এথেন্সে,’ বলল মেয়েটা।
মেয়েটার দিকে চোখ গরম করে তাকাল কার্লোস মোলাডো, তারপর রানার দিকে ফিরে বলল, ‘আমি যেমন বলেছি, এখান থেকে মিস্টার মারকাসের সঙ্গে যোগাযোগ বা ব্যবসা করা যাবে না। তবে আপনার অর্ডার নিয়ে আমরা আলাপ করতে পারি।’
‘আচ্ছা! মানে, আমি আসলে সরাসরি মিস্টার মারকাসের সঙ্গে ব্যবসা করতে চেয়েছিলাম। আপনি বলতে পারেন, এথেন্স থেকে কবে তিনি ফিরবেন?’
কপালের পাশে মোলাডোর একটা শিরা কেঁপে উঠেই থেমে গেল। ‘আমাদের ধারণা ইউরোপ থেকে ফিরতে আরও অনেক দেরি হবে তাঁর, মিস্টার মাসুদ। ব্যবসা করতে চাইলে আপনাকে আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
এতক্ষণে হাসল রানা। ‘আমি যোগাযোগ করব, মিস্টার মোলাডো। সময় দেয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।’
একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল ওরা, রিসেপশন থেকে বেরিয়ে এলো রানা। একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফেরার পথে ভাবল, মেয়েটার অসতর্কতা অন্তত একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে সাহায্য করেছে ওকে। কায়সার যেমনটি বলেছিল, আকার্ডিয়া মারকাস সত্যি ওই সময়ে এথেন্সে ছিল। এখন দেখতে হবে হাসানের ফটোটা বিলিওনেয়ার ডাফু সালজুনাসের সঙ্গে কিছুটা হলেও মেলে কিনা। যদি মেলে, অ্যাকশনে যেতে বেশি সময় নেবে না ও।
বাস ডিপোটা সেন্ট্রাল এভেনিডা-য়, হাসানের কথামত এগারো নম্বর ডাবল ডেকারে উঠে দোতলার বারো নম্বর সিটে বসল রানা। সিটের তলাটা হাতড়াতেই টেপ দিয়ে আটকানো এনভেলাপটা পাওয়া গেল। দুই স্টপেজ পর বাস থেকে নেমে ছোট একটা কাফেতে ঢুকল ও। কফির অর্ডার দিয়ে এনভেলাপটা খুলল।
অনেকক্ষণ ধরে দেখল রানা ফটোটা। টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করা হলেও, ছবিটা ভাল ওঠেনি। ছবিতে তিনজন লোক দেখা যাচ্ছে, অযতেড়ব তৈরি একটা র্যাঞ্চ হাউস থেকে এই মাত্র বেরিয়ে হেঁটে আসছে ক্যামেরার দিকে। হাসান মাঝখানের লোকটার চেহারার বর্ণনা দিয়েছে রানাকে। দূর থেকে তোলা, মুখটা ছোট দেখাচ্ছে, তাসত্ত্বেও স্মৃতিতে ধারণ করা ডাফু সালজুনাসের চেহারার সঙ্গে এই লোকের হুবহু মিল দেখতে পাচ্ছে ও। বাকি দু’জনকে কখনও দেখেনি।
দুইজনের মাঝে গম্ভীর মুখে হাঁটছে সালজুনাস। তিনজনের কেউই কথা বলছে না, তবে বাঁ দিকের লোকটা এমন ভঙ্গিতে সালজুনাসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন এইমাত্র একটা প্রশ্ন করে উত্তর শোনার জন্যে অপেক্ষায় আছে সে। সালজুনাসের মাথাটা নিচে ঝুঁকে আছে, চেহারা থমথমে।
ফটোটা এনভেলাপে ভরে পকেটে রেখে দিল রানা। বুঝেছে, কায়সারের জার্নালিস্টিক অবজারভেশন নির্ভুল: যেভাবেই হোক ডাফু সালজুনাসের এথেন্স হেড অফিস দখল করে নিয়েছে আকার্ডিয়া মারকাস, এবং তারপর থেকে সালজুনাসের নামে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চক্রান্ত করছে।
কফি শেষ করে ইন্টারকনে ফোন করল রানা, কথা বলল তারানার সঙ্গে। মেয়েটা যেন ওর ফোন পাবার অপেক্ষাতেই ছিল। রানার প্রশেড়বর উত্তরে জানাল, একঘেয়ে সময় কাটছে তার, ওর সঙ্গ দারুণ ভাল লাগবে। তার সঙ্গে সামান্য একটু তর্ক হয়েছে হাবিব বাকারার, তাই একাই সে একটা নাইটক্লাবে চলে গেছে। তারানাকে রানা সময় দিল রাত ন’টা।
ট্যাক্সি নিয়ে মেইন পোস্টঅফিসে চলে এলো ও। একটা বুদে ঢুকে ফোন করল ঢাকায়, সোহেলের নম্বরে।
কয়েকবার রিঙ হতে অপরপ্রান্ত থেকে কর্কশ গলার গালি ভেসে এল, ‘এই অসময়ে কোন্ শালা রে?’
‘আমি না হয়ে কলটা যদি বস্ করতেন?’
‘এই ফোনের নম্বর আমি শুধু আমার শালাদেরকেই দিই,’ ঘুম জড়ানো গলা সোহেলের। ‘বলে ফেল্, খবর কি?’
‘খবর হলো, পারাকাটুর কাছে মারকাসের প্ল্যানটেশনে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন ডাফু সালজুনাস। আমি এ-ও জানতে পেরেছি যে মারকাস এখন এথেন্সে।’
‘ইন্টারেস্টিং,’ মন্তব্য করল সোহেল। ‘তবে এ-সব আমাদের কাছে তেমন উত্তেজক কোন খবর নয়।’
‘আমি বলতে চাইছি কায়সারের ধারণা ঠিকই ছিল।’
‘কাজেই তুই এখন পারাকাটু যাচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ। তবে একটা ঝামেলা দেখা দিয়েছে।’
‘ঝামেলা? তা প্রাণের বন্ধুকে বলতে অসুবিধে কি!’ সোহেলের গলায় বিদ্রূপ। ‘বিশেষ করে বন্ধুটি যখন চিরকাল তোর উপকার করার জন্যেই এই ধরাধামে এসেছে। শালা, ঝামেলার ওস্তাদ!’
হাসল রানা। ‘রিয়োয় পুরানো এক পি.আই.বি এজেন্টের সঙ্গে দেখা। জেরুজালেমে একটা অপারেশনে আমার সঙ্গে ছিল মেয়েটা।’
‘কে? তারানা আজিজ?’
‘হ্যাঁ।’
‘শালার কপাল! যেখানে যত সুন্দরী আছে তারা শুধু তোকেই দেখতে পায়? তারানাও তোর পিছু নিয়েছে?’
‘আমার নয়,’ বলল রানা। ‘সন্দেহ করছি, তারানা মারকাসের পিছু নিয়েছে। আবু ইসহাক ইমাম সালেহকে খুন করার জন্যে আমরা তো মারকাসকেই সন্দেহ করি, তাই না?’
‘হ্যাঁ, করি।’
‘তারানার সঙ্গে একজন এক্সিকিউশনার রয়েছে,’ বলল রানা।
‘আমার ধারণা মারকাসের খবর নিতে এসেছে। এই মুহূর্তে ওরা হয়তো জানে না যে মারকাস এখন এথেন্সে। কিন্তু আমি চাই না আমরা সবাই একই সময়ে প্ল্যানটেশনে গিয়ে ভুল বুঝে পরস্পরকে গুলি করে অপারেশনটার বারোটা বাজাই।’
‘তো আমি কি করতে পারি?’
‘তুই প্যালেস্টাইন ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হতে পারিস তারানা আর বাকারার মিশনটা আসলে কি। তারানার চীফ মোমেনুর রাহমান তোর বন্ধু, সত্যি কথাটা তোকে অন্তত অবশ্যই জানাবে।’
‘তা হয়তো জানাবে,’ কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করার পর জবাব দিল সোহেল।
‘ঘটনা যদি তাই হয়, অর্থাৎ আমার আর তারানার মিশন যদি একই হয়, খোলা মন নিয়ে পরস্পরকে কিভাবে সাহায্য করা যায় তা নিয়ে কথা বলতে পারি আমরা। কিংবা অন্তত একে অন্যের পথে বাধা না হওয়ার চেষ্টা করতে পারি।’
এবার উত্তর দিতে আরও দেরি করল সোহেল। প্রায় চল্লিশ সেকেন্ড পর মুখ খুলল। ‘এ-ব্যাপারে আমি একা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারব না। আমাকে বসের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। তুই একটা নম্বর দে, আমি ফোন করে জানাব কতটুকু কি করতে পারব।’
খোলা লাইন নিরাপদ নয়, তবু বাধ্য হয়ে হিলটনের নম্বরই দিল রানা। ‘কথা বলবি বাংলাতেই, কারও পুরো নাম উচ্চারণ করবি না,’ সাবধান করে দিয়ে বলল ও।
হিলটনে ফিরল রানা। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর প্রত্যাশিত ফোনটা এল। সবই ভাল খবর। সোহেলের মুখে সব কথা শোনার পর বিসিআই চীফ মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান তাঁর অন্যতম দুর্ধর্ষ স্পাই এম.আর.নাইন-এর বর্তমান তৎপরতার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন, এবং ওর ব্যক্তিগত মিশনটাকে বিসিআই-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে অফিশিয়াল অনুমোদন দিয়েছেন। পি.আই.বি চীফের সঙ্গে কথা বলেছে সোহেলও। ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন মোমেনুর রাহমান। রানা এখন আকার্ডিয়া মারকাসের বিষয়ে তারানার সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করতে পারবে। প্রসঙ্গক্রমে জানা গেছে, বাকারা সঙ্গে থাকলেও অ্যাসাইনমেন্টটার নেতৃত্ব দিচ্ছে তারানাই। রানাকে একটা কোড ওয়ার্ড দেয়া হলো, শুনে তারানা বুঝতে পারবে তার বর্তমান কাজ সম্পর্কে ওর সঙ্গে আলাপ করার নির্দেশ দিয়েছেন চীফ মোমেনুর রাহমান।
ইন্টারকনে ন’টার কিছু পরে পৌঁছাল রানা। সেজেগুজে তৈরি হয়েই ছিল তারানা, ওকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। নিচে নেমে এসে একটা ট্যাক্সি নিল ওরা। আগেই কথা হয়েছে, ওরা যদি একসঙ্গে ডিনার খায়, বিলটা তারানা মেটাবে। তাকে নিয়ে কোন ক্যাসিনো বা নাইট ক্লাবে যাবে রানা, ভাল লাগলে কিছুক্ষণ নাচবে দু’জন, কারও যদি ইচ্ছে হয় সে দু’এক ঢোক ড্রিঙ্কও করতে পারবে। সবশেষে, একঘেয়েমি কেটে গেলে, তারানাকে তার হোটেলে পৌঁছে দেবে রানা। পৌঁছে দেবে মানে শুধুই পৌঁছে দেবে।
ড্রাইভার আর প্যাসেঞ্জারদের মাঝখানে কাঁচের সাউন্ডপ্রূফ পার্টিশন আছে, বোতাম টিপে সেটা তুলল রানা, তারপর তারানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাকারার খবর কি?’
তারানার চেহারা দেখে বোঝা গেল না প্রশ্নটা শুনে তার কি পঙতিক্রিয়া হলো। ‘কি খবর জানতে চাইছ?’ পাল্টা প্রশ্ন করল সে।
‘অত্যন্ত জেলাস মনে হলো। তোমরা কি খুব ঘনিষ্ঠ?’ হেসে ফেলল তারানা। ‘তুমি জানো, আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট ও। সেটাও তেমন কোন ব্যাপার নয়। আসলে ওকে বোঝানোই যাচ্ছে না যে আমি একজনকে ভালবাসি।’
‘এখন আমি জেলাস ফিল করছি!’ হাসল রানা।
হেসে ফেলল তারানাও। তারপর বলল, ‘আমি আসলে এই অ্যাসাইনমেন্টে বাকারাকে সঙ্গে নিতে চাইনি, কিন্তু বার বার বলা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ কথাটা কানে তুলল না। পিস্তল আর রাইফেলে ওর হাত খুব ভাল।’
‘তারমানে এই অ্যাসাইনমেন্টে ও থাকছেই।’
তারানা চিন্তিত, রানার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘হ্যাঁ।’
‘তোমাদেরকে দেখেই আমি আন্দাজ করতে পারি ব্রাজিলে কেন এসেছ,’ বলল রানা। ‘বিসিআই হেডকোয়ার্টার থেকে তোমাদের রামাল্লায় যোগাযোগ করা হয়েছিল। আমার অনুমান সত্যি বলে জানা গেছে। কাজেই এখন আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দেখতে পারি এই ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করার আদৌ কোন সুযোগ আছে কিনা।’
তারানার সবুজাভ চোখ দুটো একটু সরু হলো। ‘কিন্তু রানা, পি.আই.বি অফিস থেকে আমাকে বা বাকারাকে কিছুই জানানো হয়নি।’
‘কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটা ফ্যাক্স পাবে তুমি। তবে তার আগে আমাকে একটা কোড ওয়ার্ড ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, ওটা শুনলে তুমি নাকি বুঝতে পারবে বিশ্বাস করে সব কথা বলা যায় আমাকে। শব্দটা হলো-বিসমিল্লাহ।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল তারানা। ‘ওহ্, গড! দ্যাট ইজ দ্য রাইট ওয়ার্ড!’
‘তোমাদের চীফ পাঠিয়েছেন।’
এক মুহূর্ত চিন্তা করল তারানা। ‘ঠিক আছে, রানা। তবে তোমার সঙ্গে কতটা ফ্রী হওয়া যাবে, সেটা ফ্যাক্স না দেখে বলতে পারব না।’
রানা ধরেই নিয়েছে তারানা সাবধানে এগোবে। ফিল্ডে তার অভিজ্ঞতা খুব কম নয়। ‘বেশ। আমি তাহলে শুধু কয়েকটা আইডিয়ার কথা বলি তোমাকে। তোমার মুখ খোলার কোন প্রয়োজনই নেই।’
‘দ্যাট’স ফেয়ার।’
‘আমরা দু’জনই আকার্ডিয়া মারকাসকে খুঁজছি, উদ্দেশ্য একই তবে একই কারণে নয়,’ বলল রানা, দেখল তারানার চেহারায় কোন ভাব ফুটছে না। ‘তোমরা তাকে শাস্তি দিতে চাও আবু ইসহাক ইমাম সাহেলকে খুন করার অপরাধে। আমরা তাকে কেন খুঁজছি সেটা ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন। ধরো, গ্রীসে একটা রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে। ধরো, ডাফু সালজুনাসকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।’
‘গ্রীক শিপিং ম্যাগনেট?’
‘হ্যাঁ। তাঁকে হয়তো তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পারাকাটুতে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু মারকাস এথেন্সে, কাজেই সে না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তোমাদের। আর যদি ইউরোপে যেতে চাও, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু আমার ধারণা, পারাকাটুতে গেলে এমন কিছু পেতে পারি, মারকাসকে ধরতে খুব সুবিধে হবে। ওখানে গিয়ে মিস্টার সালজুনাসের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি।
‘যদি আগ্রহ থাকে, আমার সঙ্গে পারাকাটুতে যেতে পারো তোমরা। ভেতরে ঢুকতে হলে, হয়তো গোলাগুলি করতে হতে পারে। ব্যাপারটা নিয়ে বাকারার সঙ্গে আলাপ করো তুমি, তারপর ফ্যাক্স পাবার পর কাল আমাকে জানাও কি করবে।’
‘আমরা যদি সত্যি মারকাসকেই ধরতে এসে থাকি, এখান থেকে সরাসরি এথেন্সে চলে যাওয়াটাই কি আমাদের জন্যে ভাল হয় না?’
‘মারকাস মিস্টার সালজুনাসের কোলোসস পেন্টহাউস দখল করে সেটাকে তার হেডকোয়ার্টার বানিয়েছে। সালজুনাসের ওই পেন্টহাউস নাকি আধুনিক একটা দুর্গ বিশেষ। তুমি আর বাকারা ছোট একটা টীম, ওখানে ঢুকতেই পারবে না। ওখানে ঢোকার গোপন কোন উপায় নিশ্চয়ই আছে। আর সেটা একমাত্র মিস্টার সালজুনাসেরই জানার কথা।’
রানার কথায় যুক্তি আছে, মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা স্বীকারও করল তারানা, তবে বলল, ‘কাল তোমাকে জানাব, কেমন? এ-প্রসঙ্গের এখানেই ইতি। তুমি বরং বিস্তারিত শোনাও, আমাকে নিয়ে আজ রাতে তোমার প্ল্যানটা কি।’
‘প্ল্যানের আর থাকলটা কি! আদ্ধেকটাই তো বাদ করে দিলে। খেয়ে-দেয়ে তোমাকে ইন্টারকনে পৌঁছে দিয়ে বুড়ো আঙুলটা চুষতে চুষতে নিজের হোটেলে ফিরে যাব, এই হচ্ছে প্ল্যান।’
খিলখিল করে হাসল তারানা কিছুক্ষণ। চোখ বাঁকিয়ে চাইল রানার দিকে।
৪
তারানাকে ইন্টারকনের লবিতে পৌঁছে দিয়ে হেঁটেই নিজের হোটেলে ফিরছে রানা। বেশ রাত হয়েছে, আর রাতের বেলাই রিয়ো যেন জেগে ওঠে। চওড়া ফুটপাথ দখল করে নিয়েছে হকাররা, তাদের দোকানের সামনে দেশী-বিদেশী ট্যুরিস্টরা ভিড় জমিয়েছে। বিশ্বাস করা কঠিন, তবে ঘটনা সত্য-এই এভিনেডা রিয়ো ব্রাঙ্কোয় রিকন্ডিশন করা গাড়ি থেকে শুরু করে হীরের আঙটি পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যায়।
বাঁক নিয়ে কয়েকটা রাস্তা পার হয়ে এলো রানা, কোথাও একটা খালি ট্যাক্সি নেই। এদিকের রাস্তা প্রায় নির্জন, দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। সামনের একটা দোকানের দরজায় গাঢ় ছায়া, সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে রানার দিকে মুঠো করা হাত চালাল এক লোক। মুঠোর ভেতর একটা ছুরির হাতল।
দোকানটাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় চলে এসেছে রানা, ঠিক এই সময় হামলাটা হলো। লোকটা আর যদি এক সেকেন্ড দেরি করত, তাকে রানা দেখতেই পেত না; হামলাটা সফল হোত, পিঠে ছুরি খেয়ে ফুটপাথে পড়ে থাকত ও। কিন্তু কাজটা করার ব্যাকুলতা আর উদ্বেগ তাকে এক সেকেন্ড আগে নড়িয়ে দিয়েছে, আর তার সেই নড়াটা ধরা পড়ে গেছে রানার চোখের কোণে।
ছুরির ফলা পিঠে গাঁথতে যাচ্ছে, দ্রুত মোচড় খেয়ে আঘাতটা ঠেকাবার জন্যে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিল রানা। কব্জির সঙ্গে কব্জির শক্তি পরীক্ষা চলল এক কি দুই সেকেন্ড। ছুরির ফলা জ্যাকেট ও শার্ট চিরে দিল ইঞ্চি তিনেক, তারপর লাল রক্তের অগভীর একটা খাল কাটল ওর বাম বাহুতে। লোকটার ভার এড়াবার চেষ্টা না করে নিজের ওপর তাকে আসতে দিল রানা, তারপর তার সঙ্গে নিজেও ঘুরল, দু’হাতে ঠেলে দিল পাশের বিল্ডিঙের নিরেট দেয়ালে।
লোকটা বাকারা। তারানাকে না পাবার আগেই যদি হারাতে হয়, এই ভয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুন করতে চাইছে। অন্তত প্রথমে রানা এটাই ভাবল। তারপর দেখল, না-এ লোকটা বাকারার চেয়ে লম্বা, বয়সও বেশি। ব্রাজিলিয়ান গুণ্ডা।
খালি হাতটা দিয়ে পিস্তল বের করবে রানা, কিন্তু লোকটা ওকে নিজের খালি হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। আবার ছুরি চালাল সে, এবার টার্গেট করল রানার মুখ। মাথাটা ঝট করে সরিয়ে নিতে পারল ও, তবে কানের লতিতে ফলার খোঁচা লাগল। তৃতীয়বার ছুরি তুলল সে, শরীরের সমস্ত ভার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে রানার গায়ে।
গতি তার খুব বেশি হয়ে গেল। রানাকে তো ফেললই, নিজেও দড়াম করে ফুটপাতে আছাড় খেলো। ডান হাতের মোক্ষম একটা ঘুসি মারল রানা তার চোয়ালে। কি আশ্চর্য! যেখানে হাড় ভেঙে যাবার কথা, ভাব দেখে মনে হলো লোকটা কোন ব্যথাই পায়নি। পরস্পরকে ধরে একটা গড়ান খেলো ওরা, রানাকে এখনও প্রতি মুহূর্তে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হচ্ছে শরীরের এখানে সেখানে লক্ষ্য করে চালানো ছুরিটা যেন ওর নাগাল না পায়। ইচ্ছা এবং চেষ্টা দুটোই আছে, হয় পিস্তল নাহয় ছুরিটা বের করবে, কিন্তু কোন সুযোগই পাওয়া যাচ্ছে না।
এক মুহূর্তের জন্যে রানার শরীরে চড়াও হলো প্রকাণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বী। পর্তুগীজ ভাষায় খিস্তির সঙ্গে ছুরির কোপ মারল ওর বুক বরাবর। ফলাটা চওড়া, তবে বেশি লম্বা নয়, ডগাটা ক্ষুরের মত ধারাল। একেবারে শেষ মুহূর্তে ছুরি ধরা হাতের কব্জি ধরল রানা, অন্ধকারেও দেখল চওড়া ফলা চকচক করছে। দু’জনের দুটো হাত থরথর করে কাঁপছে-খুনী ফলাটা গাঁথবে, রানা গাঁথতে দেবে না। ডান হাতটা কোন রকমে মুক্ত করে নিয়ে তার মুখে আঙুল চালাল ও। আঙুলের ডগায় তার চোখ, অনুভব করতে পেরে নখ সহ আঙুলটা ভেতরে সেঁধিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল রানা-হাত ও বাহুর পেশি ফুলে উঠছে। চোখের মণি ফট্ শব্দ করে ফেটে গেল। গর্তটা থেকে বেরিয়ে এলো রানার ভেজা আঙুল।
‘মারে। বাপরে। আল্লারে!’ যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছে লোকটা, খালি হাতে চোখ চেপে ধরেছে, ভুলে গেছে অপর হাতে ধরা ছুরির কথা। কাতর একটা অস্ফুট আওয়াজ করে রানার গা থেকে গড়িয়ে পড়ল সে।
ইতিমধ্যে রানার হাতে নিজের ছুরি বেরিয়ে এসেছে। তবে প্রায় অজ্ঞান একজন লোককে খুন করতে পারবে না ও। তাছাড়া, মারপিট দেখে লোকজন যেহেতু সরে গেছে, আর পুলিসও আসছে না; লোকটাকে কথা বলানো যায় কিনা দেখতে চায় ও। বসতে যাবে, ঘ্যাঁচ করে আবার ছুরি চালাল লোকটা। এবার ব্যর্থ হলো না। অন্ধের মত চালিয়েছিল ছুরিটা, যেখানে লাগার কথা সেখানেই লাগল। গতি মন্থরই ছিল, তারপরও পা সরিয়ে নেয়ার সময় পায়নি রানা। ফলে ওর একটা জুতোর নাক কাটা গেল। খুন করার জন্যে নয়, আত্মরক্ষার তাগিদে নিজের অজান্তে ছুরি চালিয়েছে রানাও; ফলাটা অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটার পাঁজরের ফাঁক দিয়ে ভেতরে। হাতল টেনে ছুরিটা বের করল রানা, লোকটার শার্টে রক্ত মুছল। কয়েক সেকেন্ড ছটফট করে স্থির হয়ে গেল দেহটা।
সার্চ করে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তবে একটা আইডেনটিটি কার্ড ফাঁস করে দিল সব। লোকটা সেরবেরাস ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কোম্পানির একজন কর্মচারী। দেখা যাচ্ছে কার্লোস মোলাডো যতটা ভাবা গিয়েছিল তারচেয়ে অনেক সিরিয়াসলি নিয়েছে ওকে। কিংবা হয়তো এথেন্সে মারকাসকে ফোন করেছিল, আর মারকাস বলেছে শেখ মাসুদ নামে কারও সঙ্গে তার কোন কথা হয়নি। মোলাডো সম্ভবত ওকে ইন্টারপোল বা জাতিসংঘের অ্যান্টি-ড্রাগস স্কোয়াডের কোন লোক বলে ধরে নিয়েছে। যাই ধরে নিয়ে থাকুক, ওর পিছনে লোক লাগিয়েছে সে। কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিয়ো ছেড়ে পারাকাটুতে চলে যাওয়া উচিত ওর। হোটেলে ফেরার পথে আর কিছু ঘটল না। রাতটাও কাটল নির্বিঘ্নে।
সকাল ন’টায় এভেনিডা প্রেসিডেন্টা ভারগাস-এ চলে এলো রানা, বসল ছোট্ট একটা কাফেতে; একটু পর বাকারাকে নিয়ে ওর টেবিলে হাজির হলো তারানা। একসঙ্গে কাজ করতে হবে, এই সুযোগে তারানার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পাবে রানা, সম্ভবত এই কথা ভেবে খুবই উদ্বিগড়ব হয়ে পড়েছে বাকারা। তার আচরণ আগের চেয়েও কর্কশ ও অমার্জিত লাগল রানার।
রামাল্লা থেকে পাঠানো ফ্যাক্স বার্তাটা কাল রাতেই পেয়েছে তারানা, তাতে ওদের দু’জনকে রানার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দু’দলেরই উদ্দেশ্য এক-আকার্ডিয়া মারকাসকে ধরা।
বাকারা প্রস্তাব দিল রানাকে, ‘ডাফু সালজুনাস সম্পর্কে তথ্য দরকার হলে পারাকাটুতে আপনি একা যান না কেন।’ তার কালো চোখে অকারণ জিদ, সামনের কফি ভর্তি কাপ একবার ছোঁয়নি পর্যন্ত। ‘আমাদের মিশন সম্পূর্ণ আলাদা-মারকাসকে খোঁজা, এবং তাকে খতম করা। জানা কথা, পারাকাটুতে তাকে আমরা পাব না।’
তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তারানার দিকে তাকাল রানা। ‘তুমি কি বলো?’ জিজ্ঞেস করল ও।
‘আমি কি চাই তা আগেই হাবিবকে বলে দিয়েছি,’ বলল তারানা, একটু বিব্রত। ‘তোমার অ্যাপ্রোচ শুধু তোমার জন্যে নয়, আমাদের জন্যেও সঠিক।’
‘তারানা!’ চাপা গলায় হিসহিস করে উঠল বাকারা। ‘সেক্স তোমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে! এই মাসুদ রানা নির্ঘাত তোমার লাভার। উনি যা-ই বলুন, সবকিছুতে তুমি যুক্তি খুঁজে পাচ্ছ।’
‘ওহ্, হাবিব, প্লীজ!’ নিচু গলায় বলল তারানা; শুধু বিব্রত নয়, রীতিমত অপমান বোধ করছে সে।
রানা বলল, ‘কাউকে জ্ঞানদান করা আমার স্বভাব নয়। তবে একসঙ্গে কাজ করতে হলে ভাবাবেগের লাগাম সবাইকেই টেনে রাখতে হবে।’
ঝট্ করে চেয়ার ছাড়ল বাকারা, দুই কোমরে হাত রেখে বলল, ‘দেখুন, মিস্টার মাসুদ রানা…’
‘বাকারা, বসো!’ শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কর্তৃত্বের সুরে নির্দেশ দিল তারানা।
ফোঁস-ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে বাকারা, তারানার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকল-মনে হলো নির্দেশটা অমান্যই করতে যাচ্ছে। তবে না, ধীরে ধীরে আবার বসল সে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে কি বলল বোঝা গেল না, তবে রানার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না।
‘এরপর যদি কখনও আবার এরকম ভুল করো, তোমাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে, হাবিব,’ বলল তারানা। ‘আমি কি বলছি বুঝতে পারছ তো?’
বাকারা ইতস্তত করছে। কথা যখন বেরুল, তাতে ঝাঁঝের মাত্রা কম নয়। ‘হ্যাঁ।’
‘তুমি যা ভাবছ তা আসলে সত্যি নয়। রানার সঙ্গে আমার বা আমার সঙ্গে রানার ওরকম কোন সম্পর্ক কোনকালে ছিল না, আজও হয়নি। হবে যে, সে সম্ভাবনাও এখন আর নেই-কারণ এখন আমি অন্য একজনকে ভালবাসি। তবে যেহেতু রানা একজন ভদ্রলোক, আর তাকে অপমান করা হয়েছে, আমাদের উচিত তার কাছে ক্ষমা চাওয়া। তোমার কি মনে হয়?’
বাকারা বুঝতে পারছে, ক্ষমাটা তাকেই চাইতে বলা হচ্ছে। টেবিলে পড়ে থাকা তার হাত দুটো শক্ত মুঠো হয়ে গেল। ‘তুমি যা বলবে তাই হবে,’ অবশেষে বলল সে।
‘আমি বলছি, ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
রানার দিকে তাকাল না বাকারা। কাফে’র ভেতর যথেষ্ট ঠাণ্ডা, তারপরও ঘামছে সে। ‘ঠিক আছে। আমার ভুল হয়েছে-দুঃখিত।’
‘আরেকটা কথা,’ বলল তারানা। ‘তুমি হয়তো ধরে নিয়েছ একই অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করছি বলে আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত কিছু একটা ঘটবে তোমার। কিন্তু আসলে তা ঘটবে না। এই ব্যাপারে তোমার মনে কোন ভুল ধারণা থাকা উচিত নয়।’
‘মানলাম, উচিত নয়।’ মাথা নত করে আছে বাকারা।
‘এখন রানার সঙ্গে পারাকাটুতে যাচ্ছি আমি,’ বলল তারানা।
‘তুমি যদি মনে করো কাজটা বোকামি হচ্ছে, আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব অ্যাসাইনমেন্ট থেকে তোমাকে যেন সরিয়ে নেয়া হয়।’
এতক্ষণে মুখ তুলে তারানার দিকে তাকাল বাকারা। তার চোখ-মুখ বদলে গেছে, অনেক নরম লাগছে দেখতে। ‘তুমি জানো আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারব না।’ রানার দিকে একবার তাকাল সে। ‘তুমি আর মিস্টার রানাই নেতৃত্ব দিচ্ছ, বোঝা গেল। তুমি গেলে আমিও যাব। ’
রানাকে তারানা জিজ্ঞেস করল, ‘কখন যাচ্ছি আমরা?’
চুপচাপ বসে ওদের আলাপ শুনছিল রানা। মনে মনে হাসছিল তারানার নির্জলা মিথ্যা শুনে। আগের অ্যাসাইনমেন্টে অনেক কিছুই ঘটেছিল ওদের মধ্যে, কিন্তু বাকারাকে সেসব জানতে দিতে চাইছে না ও। তবে কি ‘অন্য একজন’কে ভালবাসার কথাটাও মিথ্যা? বাকারার আক্রোশ থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে রানাকে বা নিজেকে?
‘আমি অযথা দেরি করতে চাই না,’ বলল রানা।
‘চলো তাহলে রেন্ট-আ-কার অফিস থেকে একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি,’ বলল তারানা। ‘জানো তো, আমাদেরকে টিজুকা বনভূমির ভেতর দিয়ে যেতে হবে।’
‘আমরা রওনা হব সন্ধ্যায়,’ বলল রানা। ‘যা গরম পড়েছে, রাতে গাড়ি চালাতেই সুবিধে।’
‘আমার তাতে কোন আপত্তি নেই,’ জানাল বাকারা। চেহারায় অস্বাভাবিক শান্ত, ঠাণ্ডা একটা ভাব ফুটে আছে। এটা কিসের লক্ষণ, রানা বুঝতে পারছে না। সরল ছেলেটা কি বিশ্বাস করেছে তারানার সব কথা?
পুরানো একটা টয়োটা ল্যান্ড রোভার নিয়ে সন্ধ্যায় রওনা হলো ওরা। ব্রাজিলিয়া হাইওয়ে ধরে ছুটল গাড়ি, নাম হাইওয়ে হলেও রাস্তার অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। বাংলাদেশের রাজপথের কথা মনে পড়ছে রানার। সারা দুপুর আর বিকেলটা ওরা বিশ্রাম নিয়েছে, তা সত্ত্বেও ঘনঘন প্রবল ঝাঁকি অল্পক্ষণেই ক্লান্ত করে তুলল ওদেরকে। সারারাত গাড়ি চালিয়েও খুব বেশি দূর এগোনো গেল না। পরদিন সবচেয়ে গরমের সময়টা গাড়ি থামিয়ে ছায়ায় শুয়ে-বসে কাটাবার কথা ভাবা হলেও সেটা কাজে পরিণত করা গেল না মশা-মাছির উপদ্রবে। দ্বিতীয়বার থামল ওরা ছোট্ট এক গ্রামের ভেতর, রেস্তোরাঁর সামনে। রেস্তোরাঁর মালিক লোকটা ভাল, রানাকে ডেকে সাবধান করে দিয়ে বলল, ‘আপনারা বিদেশী মানুষ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রাম থেকে বেরিয়ে যান। গ্রামের কেউ নয় তারা, জঙ্গল থেকে আসে। বিদেশী কাউকে দেখলেই হয়, যা পাবে সব কেড়ে নেবে।’
তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল রানা।
আরও একটা রাত গাড়ি চালিয়ে পরদিন সকালে পারাকাটুতে পৌঁছাল ওরা।
হাইওয়ের পাশে পারাকাটু ছোট একটা গ্রাম। গ্রাম হলেও, সাদা চুনকাম করা পাকা ঘরগুলোয় কয়েক হাজার লোক বাস করে। সারি সারি হোটেল-রেস্তোরাঁও দেখা গেল। পালা করে গাড়ি চালাচ্ছে রানা ও বাকারা, রানার নির্দেশে গ্রামে থামল না ওদের ল্যান্ড রোভার। মারকাসের লোকজন গ্রামে খাওয়াদাওয়া বা কেনাকাটা করতে আসতে পারে, ওদেরকে দেখতে পেলে সতর্ক হয়ে যাবে।
পারাকাটু থেকে প্ল্যানটেশনের দিকে রাস্তা পাওয়া যাবে মাইল পাঁচেক। মেটো পথ, পথ না বলে খানা-খন্দের সমষ্টি বললেই হয়। দু’পাশে গভীর জঙ্গল, ভেতরটা দিনের বেলাও প্রায় অন্ধকার। পথ কোথাও এতই সরু যে জানালা গলে গাছপালার ডাল ল্যান্ড রোভারের ভেতরে ঢুকে আরোহীদের চোখে-মুখে ঝাপটা মারতে চাইছে। বাধ্য হয়েই গাড়ি আস্তে আস্তে চালাচ্ছে বাকারা, এই সুযোগে ঝাঁক ঝাঁক মশা ভেতরে ঢুকে ওদের উন্মুক্ত ত্বকে হামলা চালাল। রানা এজেন্সির রিয়ো শাখার প্রধান হাসান রানাকে জানিয়েছে, এই পথ থেকে আরও অন্তত দশ মাইল দূরে মারকাসের প্ল্যানটেশন। ওদের প্ল্যান, পথ যেটুকু পাওয়া যাবে তার অর্ধেকটা ব্যবহার করবে। সেটুকু পার হতেই ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। নেহাতই ভাগ্য বলতে হবে যে উল্টোদিক থেকে কোন গাড়ি আসেনি। এত কাছাকাছি এসে শত্রুদের চোখে ধরা পড়তে চায় না ওরা।
হাইওয়ে থেকে প্রায় ছ’মাইল দূরে ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর ল্যান্ড রোভারটাকে লুকিয়ে রাখল ওরা। পথ নেই, জঙ্গল ভেঙে হাঁটো; প্রত্যেকের হাতে একটা করে রিপেল্যান্ট-এর ক্যান রয়েছে, মশা তাড়াবার জন্যে সেপ্র করে এগোও।
অযত্নে তৈরি করা মারকাসের র্যাঞ্চসদৃশ ভবনটা আকাশ ছোঁয়া একটা ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে আধমাইল দূরে। ফাঁকা জায়গার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে গাছটা, কাছেই উঁচু একটা কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার ওপারের জায়গাটাও একসময় প্ল্যানটেশনের সীমানার ভেতর ছিল, জঙ্গল সেটাকে পুনর্দখল করে নিয়েছে। গাছটাকে রানা এজেন্সির রিয়ো শাখার লোকজন কিছুদিন অবজারভেশন পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ভ্যাপসা গরম আর মশা-মাছির অসহ্য উপদ্রব সহ্য করে তারানা আর বাকারাকে ওই গাছটার দিকেই নিয়ে যাচ্ছে রানা। পৌঁছাতে ঘণ্টা তিনেক লাগল ওদের। গাছটার মাথার কাছাকাছি বাঁশ ও পাম গাছের পাতা দিয়ে তৈরি একটা খুদে প্ল্যাটফর্ম আছে, প্ল্যানটেশন থেকে দেখতে পাওয়া যায় না। গাছের গায়ে বাঁশের ধাপও তৈরি করা আছে, ফলে ওপরে উঠতে কোন সমস্যা হবে না। তবে ওঠার পর দেখা গেল তিনজনই হাঁপাচ্ছে। ‘এত কষ্ট করে কোন লাভ হলো কি?’ তারানার গলায় একটু যেন রাগ।
গলায় ঝোলানো বিনকিউলারটা চোখে তুলে দূরে, প্ল্যানটেশনের দিকে তাকাল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর তারানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি দেখছ?’ তার চোখেও একটা বিনকিউলার রয়েছে।
ডাল ও পাতার ফাঁক দিয়ে গোটা ফার্ম এলাকাটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ওরা। মূল ভবন বা র্যাঞ্চ হাউসের চারপাশে ছোটবড় আরও কিছু দালান দেখা যাচ্ছে, তবে পিছনটায় ওগুলোর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি-দেখতে অনেকটা ব্যারাক-এর মত। সব মিলিয়ে বিশাল আর গুরু-গম্ভীর একটা ভাব আছে। কাঁটাতারের বেড়াটা নতুন, পুরানোটা হারিয়ে গেছে জঙ্গলের আড়ালে। নতুন বেড়াও এগিয়েছে গাছ ও ঝোপের ভেতর দিয়ে। মেটো পথে কাঁকর ছড়ানো, গাড়ি চলাচল করে; পার্কিং এরিয়াটা বেশ বড়। বেড়ার বাইরে এক সময় রাবার বাগান ছিল, পুরানো মালিক বিদায় নেয়ার পর জঙ্গল সে-সব গ্রাস করে নিয়েছে।
‘আমার একটা প্ল্যান আছে,’ চোখ থেকে নিজের বিনকিউলার নামিয়ে বলল বাকারা।
‘শোনা যাক,’ উৎসাহ দিল রানা।
‘গাড়িতে আমার স্কোপ-সাইটেড রাইফেল আছে,’ বলল বাকারা। ‘ওটা হাতে থাকলে এখানে বসে সারাদিন আমি মারকাসের লোকজনকে গুলি করতে পারব। একসময় র্যাঞ্চ খালি হয়ে যাবে, গুলি করার মত কাউকে পাব না। আমি বলতে চাইছি, র্যাঞ্চের ভেতর আমাদের ঢোকারই কোন দরকার নেই।’
‘ঘর থেকে ওদের সবাইকে তুমি বের করবে কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘বের যদি হয়ও, যখন গুলি হবে তখন ওদেরকে তুমি ঘরের বাইরে থাকতে বাধ্যই বা করবে কিভাবে?’
‘তাছাড়া,’ বলল তারানা, ‘আমরা যদি ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকে হামলা চালাই, আমাদের আগে মিস্টার সালজুনাসের কাছে পৌঁছাবে ওরা। সন্দেহ নেই, খুনও করবে।’
‘ঠিক। আর সালজুনাস খুন হয়ে গেলে এখান থেকে কিছুই আমাদের জানা হবে না।’
ওদের যুক্তি মেনে নিয়ে বাকারা বলল, ‘এটা ঠিক যে সালজুনাসের নিরাপত্তা বিঘিড়বত করা যাবে না। তবে সত্যি বলছি, রাইফেল ব্যবহারের জন্যে এই জায়গাটা আদর্শ।’ কাঁধ ঝাঁকাল সে। ‘দুঃখের বিষয়, কপালে সে-সুখ নেই!’
রক্তপাতের জন্যে অস্থির হয়ে আছে ছোকরা, ভাবল রানা। তার কাছে এটা একটা শিকার অভিযান, যত বেশি পারো মারো। বিকেল পর্যন্ত প্ল্যানটেশনের ওপর নজর রাখল ওরা। লোকজন বিভিনড়ব কাজে ঘর থেকে বেরুচ্ছে, এদিক-ওদিক যাচ্ছে, সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা সাত-আটজনের বেশি নয়। হাসানও এরকম একটা হিসাবই দিয়েছে রানাকে।
ডাফু সালজুনাসকেও দেখতে পেল ওরা, প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে নামার ঠিক আগে। ব্যারাকসদৃশ দালানের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, সঙ্গে একজন লোক রয়েছে। অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে র্যাঞ্চ হাউসের সামনে চলে এলেন, তারপর দু’এক মুহূর্ত ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। চোখে বিনকিউলার থাকায় রানার মনে কোন সংশয় থাকল না যে এই ভদ্রলোকই ডাফু সালজুনাস। আর যাই হোক, এখানে ওরা আলেয়া বা মরীচিকার পিছু নিয়ে আসেনি।
প্ল্যাটফর্ম থেকে নামার আগে প্ল্যানটেশনে ঢোকার প্ল্যানটা ব্যাখ্যা করল রানা। ‘নিচে নেমে গাড়ির কাছে ফিরে যাব আমরা। ভেতরে গাড়ি নিয়ে ঢুকব, ভাব দেখাব যেন আকার্ডিয়া মারকাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গেটের লোকের সঙ্গে কথা যা বলার আমি বলব। বলা হবে আমরা আফগানিস্তান থেকে আসছি। ভেতরে ঢোকার পর দেখা করতে চাইব চসেসা গনজালেসের সঙ্গে, মারকাসের অনুপস্থিতিতে সেই এখানকার সব কিছু দেখাশোনা করে।’
‘তোমাকে ওরা চিনে ফেলবে না তো?’ জানতে চাইল তারানা।
‘প্ল্যানটেশনের এরা কেউ আমাকে কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না,’ জবাব দিল রানা। ‘অবশ্য চেহারার বর্ণনা পেলেও পেতে পারে। সামান্য কিছুটা ঝুঁকি, নিতে হবে।’
শোল্ডার পার্স খুলে নাক থ্যাবড়া একটা বেলজিয়ান রিভলভার বের করল তারানা, .২৫ ক্যালিবার। সিলিন্ডার চেক করে আবার সেটা পার্সে রেখে দিল সে। ‘সব ঠিকমতই ঘটবে, ইনশাল্লাহ।’
হেসে উঠে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল বাকারা, ‘এটা কোন ব্যাপারই না। বিপদ দেখলে সব ক’টাকে শুইয়ে দেব।’
৫
গেটের দিকে শেষ পঞ্চাশ গজ ধীরগতিতে গাড়ি চালাল ওরা। গেটে দাঁড়ানো লোকটা কঠিন চোখে ল্যান্ড রোভারের দিকে তাকিয়ে আছে। পরনের খাকি ইউনিফর্ম ঘামে ভেজা, কাঁধ থেকে ঝুলছে একটা অটোমেটিক রাইফেল। ওটা নামাল সে, বাগিয়ে ধরে অ্যাকশনের জন্যে তৈরি করল নিজেকে।
‘এই লোককে বোকা বানিয়ে ভেতরে ঢুকতে না পারলে অসুবিধে আছে,’ তারানা ও বাকারাকে বলল রানা। ‘কাজেই কেউ মাথা গরম কোরো না।’
তারানা মাথা ঝাঁকাল।
‘ঠিক আছে,’ বলল বাকারা। সে-ও অস্ত্র লুকাবার জন্যে বুশ জ্যাকেট পরেছে। রানার কাছে অস্ত্র বলতে ওয়ালথার আর ছুরি। কিন্তু বাকারা রীতিমত আগেড়বয়াস্ত্রের একটা গুদাম। তার কাছে এক জোড়া ল্যুগার ছাড়াও রয়েছে একটা স্টার্লিং পয়েন্ট থ্রী-এইট পিপিএল অটোমেটিক রিভলভার, থ্রোয়িং নাইফ ও গ্যারট। এত কিছুর দরকার ছিল? রানার এই প্রশ্ন শুনে সগর্বে উত্তর দিয়েছে সে, ‘ভাববেন না এ-সব আত্মরক্ষার জন্যে। নিজেকে বাঁচাবার জন্যে খালি হাতই যথেষ্ট মনে করি। এগুলো আসলে কুকুর-বিড়াল মারার যন্ত্র। আবু ইসহাক ইমাম সালেহ আমাদের পরবর্তী নেতা হতেন, ইহুদিরা মারকাসকে দিয়ে তাঁকে হত্যা করেছে। কাজেই মারকাস আর তার সঙ্গী-সাথীদের কুকুর-বিড়ালের মত গুলি করে মারব আমি।’
বাকারার রাগটা কোথায়, রানা বোঝে। তাই আর কথা বাড়ায়নি।
গার্ডের কাছ থেকে দশ ফুট দূরে থামল ল্যান্ড রোভার। হুইলের পিছনে রানা, গলা চড়িয়ে ইংরেজিতে বলল, ‘হ্যালো, দেয়ার!’
অত্যন্ত সাবধানে হেঁটে এসে রানার জানালার পাশে দাঁড়াল গার্ড। চেহারা দেখেই বোঝা যায় নীচ প্রকৃতির লোক, হাত ও মুখে শুকনো ক্ষতর কোন অভাব নেই। রানার হাসির উত্তরে হাসল না। ‘এখানে কি দরকার আপনাদের?’ কর্কশ গলায় প্রশ্ন করল, সন্দেহভরা চোখে গাড়ির ভেতর তাকাচ্ছে। ‘জানেন না, বিনা অনুমতিতে প্রাইভেট প্রপার্টিতে ঢোকা অপরাধ?’
‘দূর ব্যাটা!’ হেসে উঠল রানা। ‘তুই একটা ছাগল। আরে গাধা, আমরা তো আকার্ডিয়া মারকাসের বন্ধু।’
রানার মুখটা খুঁটিয়ে দেখল সে। ‘আমি আগে কখনও আপনাকে দেখিনি। আপনাদের পরিচয় বলেন।’
নিজেদের বানানো নামগুলো গড়গড় করে মুখস্থ বলে গেল রানা। ‘কাবুল থেকে আসছি,’ হাসিমুখে বলল। ‘আমরা “ইউনিকর্ন ক্লাব”-এর সদস্য।’ ইউনিকর্ন ক্লাব একটা আন্তর্জাতিক সংগঠন, মারকাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ড্রাগ ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত। রিয়ো থেকে কাবুল, কোথায় না এদের শিকড় ছড়িয়ে আছে। রানা এজেন্সির রিয়ো শাখার কাছে খবর আছে, কিছু দিন থেকে এই ক্লাবটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে মারকাস।
‘ইউনিকর্ন ক্লাবের সদস্য হলে,’ গার্ড জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কেন এসেছেন আপনারা?’
‘মারকাস আমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছে,’ বলল রানা। ‘তুই ব্যাটা বজ্জাত,’ এখন আর হাসছে না, চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে, ‘আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চাস? মারকাসকে বলে আমি তোর বারোটা বাজাব।’
লোকটা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল রানার দিকে। ‘প্ল্যানটেশনে মিস্টার মারকাস নেই। তিনি ব্যবসার কাজে বিদেশে গেছেন।’
‘বলেও ছিল যে বিদেশে যেতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে চসেসা গনজালেসের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’ রানা মারকাসের বিশ্বস্ত ডান বা বাম হাতের নামও জানে, এই ব্যাপারটা গার্ডকে প্রভাবিত করল। চিবুক চুলকে কি যেন চিন্তা করল সে, তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, এখানে অপেক্ষা করুন।’
গেটের দিকে ফিরে যাচ্ছে গার্ড, তার প্রতিটি নড়াচড়া তীক্ষ্নদৃষ্টিতে পরীক্ষা করছে ওরা তিনজন। ছোট একটা ছাদের নিচে ঢুকল সে, টেবিল থেকে ওয়াকি-টকি তুলল। ছাদ মানে বেড়ার চাল, দেয়াল বলে কিছু নেই, কয়েকটা বাঁশের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ছাদটা। ওয়াকি-টকিতে দু’মিনিট কথা বলল সে। আরও এক মিনিট শুনল। তারপর সেটা টেবিলে রেখে ল্যান্ড রোভারের পাশে ফিরে এল। ‘আপনারা ভেতরে ঢুকতে পারেন। বাড়ির ঠিক সামনের জায়গাটায় গাড়ি থামাবেন। আপনাদের সঙ্গে বাইরে দেখা করা হবে।’
‘বেশ,’ বলল রানা।
তার দিয়ে তৈরি গেট খুলে দিল গার্ড। রাইফেলটা কাঁধে না ঝুলিয়ে এখনও হাতে রেখেছে সে, লক্ষ করল রানা। ইঙ্গিতে গেটের ভেতর ওদেরকে ঢুকতে বলল লোকটা।
গাড়ি ছেড়ে দিয়ে তারানা ও বাকারাকে বলল রানা, ‘শুরু হলো কিন্তু!’
ল্যান্ড রোভার ভেতরে ঢুকতেই ওদের পিছনে গেট বন্ধ হয়ে গেল। গেটে তালা দেয়া হচ্ছে দেখে সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল বাকারা। মেটো পথ, তবে কাঁকর ছড়ানো। ড্রাইভওয়েটা সুন্দর। খানিক পর পর পাতাবাহারে ঢাকা খিলান আকৃতির তোরণ। লনে মর্মর পাথরের দেবদেবীদের নগড়ব মূর্তি, কাঠের বেঞ্চ। দালানটার সামনে ফাঁকা জায়গা, বেশ চওড়া, এখানেই ল্যান্ড রোভার দাঁড় করানো হলো। গাড়ি থেকে নামছে ওরা, দালানের ভেতর থেকে চারজন লোককে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। রানা গাড়ি থামিয়েছে ওদের আর গেটে দাঁড়ানো গার্ডের মাঝখানে।
ওদের সামনে যে-চারজন লোক এসে দাঁড়াল তারা প্রত্যেকে সভ্যজগতের জন্যে অভিশাপ, বুঝতে অসুবিধে হয় না, নিরীহ মানুষ খোদ শয়তানের চেয়েও বেশি ভয় পায় এদেরকে। একজনকে রানা চেনে, বিসিআই কমপিউটরে তার ছবি ও রেকর্ড আছে। তিনজন বয়সে তরুণ, হাবভাব আর চেহারা-সুরত বলে দিচ্ছে এরা একই বৃন্তের ফুল। চারজনের মধ্যে একজন ব্রাজিলিয়ান, বাকি তিনজন গ্রীক। একজন আবার হিপ্পি, হাতে ইস্পাতের বালা, চুল কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে এসেছে প্রায় কোমর পর্যন্ত। এদের পরনে শার্ট ও ট্রাউজার। সুট পরে আছে শুধু একজন; লম্বা-চওড়া কাঠামো, মুখটা প্রকাণ্ড, ছোট করে ছাঁটা মাথার চুলে একটু পাক ধরেছে। একে চিনতে পেরেছে রানা-চসেসা গনজালেস, জেল পলাতক ব্যাংক-ডাকাত; নিরাপত্তার অভাব হেতু এথেন্স থেকে পালিয়ে মারকাসের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। অপর তিনজন গনজালেসের বডিগার্ড। তিনজনই তারা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সম্ভাব্য সব দিক থেকে ওদেরকে কাভার দিচ্ছে। নিজেদের ও গেটের গার্ডের মাঝখানে ল্যান্ড রোভারকে রাখতে পারায় রানা খুশি। গেট থেকে ওদের দূরত্ব প্রায় ত্রিশ গজ।
‘মিস্টার গনজালেস?’ কাঁচাপাকা মাথার দিকে তাকাল রানা।
‘দ্যাট ইজ কারেক্ট,’ পরিষ্কার ইংরেজিতে জবাব দিল গনজালেস। ‘মিস্টার আকার্ডিয়া মারকাসের সঙ্গে দেখা করতে চান, ব্যাপারটা কি?’
বাকারা আর হিপ্পি পরস্পরের ওজন নিচ্ছে। ব্রাজিলিয়ান কোমর থেকে পিস্তল ড্র করার অজুহাত খুঁজছে, আক্ষরিক অর্থেই নিশপিশ করছে তার ডান হাতের মধ্যমাটা। গম্ভীর চেহারার তৃতীয় গার্ড তারানার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না।
‘তিনি আমাদেরকে এখানে দাওয়াত দিয়েছেন,’ স্বাভাবিক, শান্ত ভঙ্গিতে বলল রানা। ‘আমরা তাঁকে আনকাট হেরোইনের একটা চালান অফার করেছিলাম। আমাদের দু’জন ডিলার হঠাৎ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ায় চালানটা নিতে পারছিল না। ব্যাপারটা আপনাকে নিশ্চয় জানিয়েছেন মারকাস।’
রানার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল গনজালেস। ‘না,’ বলল সে। ‘আপনি আফগান। ইউনিকর্ন ক্লাবে কোন আফগান সদস্য আছে, এ আমার জানা নেই।’
‘জানার কোন শেষ নেই, তাই বলে জানার চেষ্টাটাকে বৃ া মনে করবেন না,’ বলল রানা। ‘এখানে আমরা তিনজনই আফগান, তবে একা শুধু আমিই ইউনিকর্ন ক্লাবের সদস্য।’
‘আপনার সঙ্গিনী বোরকা পরেননি কেন?’
‘কারণ এখানে তালেবানরা নেই।’
‘কিন্তু আপনাদের পাগড়ি কোথায়?’
রানার বদলে জবাবটা দিল তারানা, ‘পাগড়ি ফেলে দেয়া হয়েছে, আপনার চুলের মত।’
চোখ সরু করে তারানার দিকে তাকাল গনজালেস। তার হাসিটা ক্ষণস্থায়ী ও কর্কশ। ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং,’ মন্তব্য করল সে, তারানা আর বাকারাকে পালা করে দেখছে। ‘বেশ। মানে, হ্যাঁ, ব্যবসা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমাদের রোদ থেকে সরে যাওয়া উচিত, তাই না?’
‘আইডিয়াটা ভাল,’ বলল রানা। ওর ইচ্ছা ভেতরে ঢোকার পর যেভাবেই হোক গনজালেসকে বাকি লোকগুলোর কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরাতে হবে।
কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে গড়াতে শুরু করল। অকস্মাৎ বাড়ির ভেতর থেকে আরেকজন লোক বেরিয়ে এল। রানা আর তার চোখ এক হলো, মুহূর্তে পরস্পরকে চিনতে পারল ওরা। লোকটা কোলোসস ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কোম্পানির কার্লোস মোলাডো।
‘কি ঘটছে এখানে?’ গনজালেসকে প্রশ্ন করল সে। ‘এই লোকটা তো আমাদের শহরের অফিসেও ঢুকেছিল,’ রানার দিকে একটা হাত তুলে দেখাল। ‘ওর পিছনে একজন লোককে পাঠিয়েছিলাম, ফেরেনি সে।’
রানার দিকে স্থির গনজালেসের চোখ সরু হয়ে যাচ্ছে। হিপ্পি তার কোমর থেকে রিভলভারটা টেনে নিল।
‘অ্যাঁ! তাই নাকি!’ বিড়বিড় করল গনজালেস। রানা, তারানা ও বাকারা, পালা করে তিনজনকেই দেখছে সে। ‘আসলে তোমরা কে?’
মোলাডোর দিকে তাকিয়ে ছিল রানা, চোখ ফেরাল গনজালেসের দিকে। একজন বাদে বাকি কেউ অস্ত্র বের করেনি।
‘নিজের সম্পর্কে যা বলেছি, আমি তাই। আমরা সবাই তাই। এখন বলো, ব্যবসা হবে, নাকি হবে না?’
‘বৈধ ইমপোর্টার সেজে কোলোসস-এ কেন গিয়েছিল ও?’ জিজ্ঞেস করল মোলাডো। ‘ও কি এখনও বলছে যে জাপানি ক্যামেরা চায়?’
‘না,’ ধীরে ধীরে বলল গনজালেস। ‘ঠিক তা বলছে না। আপনি ভেতরে আসতে পারেন, মিস্টার…’
‘শেখ মাসুদ,’ বলল রানা।
‘মিস্টার মাসুদ। তবে প্রথমে আমরা চেক করে দেখব আপনাদের কাছে অস্ত্র আছে কিনা।’
চোখের কোণ দিয়ে রানা দেখতে পাচ্ছে কঠিন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল বাকারা। নিরস্ত্র হতে রাজি নয় সে, রানাও তারই পক্ষে। লোকগুলো ওদের অস্ত্র নিয়ে নিলে একজনও ওরা এখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। বাকারার দিকে তাকাল রানা, ধরে নিল ওর দৃষ্টি দেখে যা বোঝার বুঝে নেবে সে। ‘ঠিক আছে, মিস্টার মোলাডো,’ বলল ও, হাত বাড়াল ওয়ালথারটা বের করার জন্যে।
‘উঁহুঁ,’ মোলাডো হাত তুলে বাধা দিল। ‘ওটা আমি বের করে নিচ্ছি, মিস্টার মাসুদ।’
রানা ঠিক এটাই চাইছিল, পিস্তলটা বের করে নেয়ার জন্যে মোলাডো এগিয়ে আসবে। জ্যাকেটের ভেতর হাত গলাচ্ছে সে, ঠিক এমনি সময়ে এক হাতে তার গলাটা পেঁচিয়ে ধরল রানা। হিপ্পিটা রানার মাথায় পিস্তল তাক করল, কিন্তু বাকারা ল্যুগার বের করছে দেখে সেদিকে ঘুরে গেল পিস্তলের মাজল। একটাই গুলি হলো, বসে পড়ায় বাকারাকে লাগল না। পরমুহূর্তে বাকারার হাতেও গর্জে উঠল ল্যুগার। একটা খিলানের গায়ে ছিটকে পড়ল হিপ্পি, মাটিতে পড়ার আগেই মারা গেছে।
পরবর্তী ঘটনাগুলো চোখের পলকে এত দ্রুত ঘটে গেল, মনে হলো সব একসঙ্গে ঘটছে। চিৎকার করে বাকারাকে গুলি করতে নিষেধ করল রানা, কিন্তু ইতিমধ্যে দেরি হয়ে গেছে। একবার শুরু করার পর বাকারা যেন নিজেকে আর সামলাতে সক্ষম নয়। ব্রাজিলিয়ান ও বয়স্ক গ্রীক গার্ড, ওদের সঙ্গে তারানাও, অস্ত্র বের করছে। মোলাডো ঘুরে গিয়ে দালানের দিকে ছুটল, বাকারার বুলেট গুঁড়িয়ে দিল তার শিরদাঁড়া। আহত পশুর মত কাতরে উঠল মোলাডো, দড়াম করে আছাড় খেলো কাঁকর ছড়ানো ড্রাইভওয়েতে।
‘অস্ত্র ফেলো, তা না হলে গনজালেস মারা যাবে,’ বাকি দুই বডিগার্ডকে বলল রানা, একহাতের ছুরি গনজালেসের গলায় ধরা। ওদের পিছনের গেট থেকে গার্ডের উত্তেজিত চিৎকার ভেসে আসতে শুনল ও।
ব্রাজিলিয়ান ছোকরা স্থির হয়ে গেল, কিন্তু বয়স্ক বডিগার্ডের হাতে বেরিয়ে আসা পিস্তল গর্জে উঠল। ল্যান্ড রোভারের পাশে দাঁড়িয়ে পার্স থেকে বেলজিয়ান রিভলভার বের করছে তারানা। বডিগার্ডের বুলেট বাকারার বুকে লাগল। চরকির মত আধ পাক ঘুরে গাড়ির গায়ে ধাক্কা খেলো বাকারা।
লক্ষ্যস্থির করে একটাই গুলি করল তারানা। বয়স্ক বডিগার্ড একহাতে তলপেট খামচে ধরে কুঁজো হয়ে গেল, চিৎকার করছে। কাত হয়ে ঢলে পড়ার আগে তার হাতে আরও দু’বার গর্জে উঠল পিস্তলটা, তবে শুধু ধুলোই উড়ল, কাউকে লাগল না।
এ-সব দেখে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল গনজালেস। রানার মনোযোগ অন্যদিকে, বুঝতে পেরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছুরি ধরা ওর হাতটা নিজের গলা থেকে সরিয়ে দিল, একই সঙ্গে পিছন দিকে পা ছুঁড়ে লাথি মারল রানার হাঁটুর নিচে। ব্যথা পেল রানা, ঢিল পড়ল অপর হাতেও। এই সুযোগে ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে গনজালেস, ওর ছুরি ধরা হাত গায়ের জোরে মোচড়াতে চাইছে। ছুরিটা খসে পড়ল। গাড়ির পাশে আছাড় খেলো গনজালেস রানাকে সঙ্গে নিয়ে।
এ-সব দেখে স্থির ব্রাজিলিয়ান আর স্থির থাকতে পারল না, ডাইভ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় অস্ত্রটা বের করে ফেলল। তারানা গুলি করল, কিন্তু লাগল না। পাল্টা গুলি করে তারানার কাঁধের পাশে ল্যান্ড রোভারে একটা ফুটো তৈরি করল সে। তারানার বিপদ দেখে গনজালেসকে ঠেলে সরিয়ে দিল রানা, পিছনের মাটি হাতড়ে ছুরিটা তুলল, তুলেই কব্জিতে প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খাইয়ে ছুঁড়ে দিল ব্রাজিলিয়ান ছোকরার দিকে। ছোকরা আবার তারানার দিকে লক্ষ্যস্থির করছে, এই সময় তার বুকে আঘাত করল ছুরিটা। চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল, পিস্তল গর্জে উঠে দু’জনের মাঝখানে খানিকটা ধুলো ওড়াল। ছুরির হাতল ধরে ঢলে পড়ল সে।
গনজালেস ক্রল করে এগিয়ে এসে চোখে আঙুল ঢোকাবার চেষ্টা করছে, এই সময় রানা শুনতে পেল ওদের পিছনে গেট খুলে যাচ্ছে। ওর ঘুসি খেয়ে ফুঁপিয়ে উঠল গনজালেস, চোয়ালের হাড় ভেঙে গেছে। রানার অপর হাত তার নাকটাও ভেঙে দিল। হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে আরও মার খাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল সে।
‘সাবধান!’ বাকারার ক্ষীণ কণ্ঠ শুনতে পেল ওরা। ঘুরতেই রানা দেখল, গুলিটা তাকে খুন করেনি। টলমল পায়ে সিধে হচ্ছে সে, তাকিয়ে আছে গেটের দিকে।
‘শুয়ে পড়ো!’ তারানাকে নির্দেশ দিল রানা, ল্যান্ড রোভারের পাশে এবং ওর খুব কাছাকাছি রয়েছে সে।
গার্ড গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে সাবমেশিনগানটা ওদের দিকে তাক করল। দাঁড়াতে পারল বাকারা, হাতের ল্যুগার গার্ডের দিকে তুলছে, কিন্তু গার্ডই তাকে আগে পেয়ে গেল। প্রথম এক ঝাঁক বুলেট বাকারার পায়ের পিছনে ধুলো ওড়াল। পরবর্তী ঝাঁকটা ঝাঁঝরা করে দিল তার বুক।
শরীরটাকে গড়িয়ে দিয়ে ল্যান্ড রোভারের তলায় ঢুকে পড়ল রানা, হাতে বেরিয়ে আসা পিস্তল তুলে অপেক্ষা করছে গার্ড কখন ওর দৃষ্টিপথে বেরিয়ে আসবে।
তারানা ক্রল করে সরে আসছে, ছুটে এসে তার দিকে সাবমেশিনগান তাক করল গার্ড। ল্যান্ড রোভারের তলা থেকে পর পর দুটো গুলি করল রানা তার বুকে। গার্ড পড়ে গেল, সেই সঙ্গে অকস্মাৎ প্রায় ভৌতিক একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো গোটা প্ল্যানটেশনে।
গাড়ির তলা থেকে বেরিয়ে এসে তারানাকে সিধে হতে সাহায্য করল রানা, দু’জনেই ধুলো মেখে প্রায় সাদা হয়ে গেছে। গনজালেস নড়ছে দেখে কয়েকটা চড় কষল রানা, তারপর পিস্তল দিয়ে হালকা একটা বাড়ি মারল দাঁতে। ‘বলো, বাড়ির ভেতর ডাফু সালজুনাসকে ক’জন গার্ড পাহারা দিচ্ছে?’
উত্তর দিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো গনজালেস, ইঙ্গিতে দেখাল তার চোয়াল ভেঙে গেছে। পিস্তল দিয়ে ওই ভাঙা চোয়ালেই বাড়ি মারল রানা। ‘ক’জন?’
দুর্বল একটা হাত তুলে দুটো আঙুল দেখাল গনজালেস। তারানার দিকে ফিরে রানা বলল, ‘এখান থেকে নড়বে না। সাবধান, একে পালাতে দিয়ো না।’
কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল তারানা। সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে।
খিলানের নিচে দিয়ে দালানের ভেতর ঢুকল রানা। সদর দরজা হাঁ-হাঁ করছে। হলরূমে ঢুকতে যাবে, একটুর জন্যে লোকটার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো না। দু’জনেই থমকাল, তারপর পিছাল, গুলিও করল প্রায় একসঙ্গে। রানার পিস্তল সামনের দিকে তাক করাই ছিল, কিন্তু লোকটার পিস্তল ছিল শরীরের পাশে ঝুলে থাকা হাতে, এইটুকু পার্থক্যের কারণে রানার গায়ে তার বুলেট লাগল না, আর রানার বুলেট তার খুলি উড়িয়ে দিল।
লাশ টপকে হলরূম পার হয়ে করিডরে বেরুল রানা। প্রবল একটা তাগাদা অনুভব করছে। পৌঁছাতে দেরি করলে সালজুনাসকে জীবিত অবস্থায় পাবে না। তবে এমনও হতে পারে যে এরইমধ্যে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।
করিডরের দু’পাশে বেডরূম, সবগুলোর দরজা খোলা। শুধু শেষ কামরাটা বন্ধ। সেটার সামনে দাঁড়াতে ছোট্ট, অস্পষ্ট একটা শব্দ বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। কয়েক পা পিছিয়ে এসে ছুটল, লাথি মারল দরজায়। তবে কবাট ভাঙতে আরও তিনটে লাথি মারতে হলো। ভাঙা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা।
হাড্ডিসার, কুৎসিত এক লোক ডাফু সালজুনাসের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিলিওনেয়ার ব্যবসায়ীকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কুৎসিত হাড্ডিসারের হাতের পিস্তল তাঁর কপালে ঠেকে আছে, একটা আঙুল ট্রিগারে পেঁচানো। দরজার কবাট ভেঙে পড়ার মুহূর্তে বন করে ঘুরে রানার দিকে ফিরল সে। গুলি করল চোখের পলকে, কিন্তু লক্ষ্যস্থির না করেই, ফলে রানার পাশে দরজার চৌকাঠে লাগল প্রথম বুলেটটা। রানার পিস্তলও গর্জে উঠেছে। ওর গুলিটা হাড্ডিসারের বুকে লাগল। তারপরও গুলি করতে যাচ্ছে সে। রানার দ্বিতীয় গুলি তার কপালে গর্ত তৈরি করল।
পিস্তলটা কোমরে গুঁজে রাখছে রানা, নেশাগ্রস্ত মাতালের মত ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন গ্রীক শিপিং ম্যাগনেট। ‘ডাফু সালজুনাস?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘হ্যাঁ, আমি ডাফু সালজুনাস,’ মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি।
‘আপনি…?’
‘আমরা আপনাকে মুক্ত করতে এসেছি, মিস্টার সালজুনাস।’
ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন ভদ্রলোক। ‘ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ওই লোকটা আমাকে…’
‘জানি।’ রানা তাঁর বাঁধন খুলে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল। ‘সুস্থ বোধ করছেন তো? একটু হাঁটতে পারবেন?’
মাথা ঝাঁকালেন ভদ্রলোক। ‘আমি ঠিক আছি।’ তারপর গ্রীক ভাষায় বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। রানার দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করলেন। ‘বিশ্বাসই হচ্ছে না যে বিপদটা সত্যিই কেটে গেছে।’
‘বলুন অর্ধেকটা কেটেছে।’
সালজুনাস কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, বাড়ির বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল। রানার মনে পড়ল, বাইরে তারানার সঙ্গে গনজালেসকে রেখে এসেছে। ঘুরে ছুটল ও। হলরূম থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘তারানা!’
একটু পরই তার গলা পাওয়া গেল, ‘আমি ঠিক আছি!’
দালানের ঠিক বাইরে দেখা হলো ওদের, তারানা তার পিস্তল পার্সে ভরে রাখছে।
‘ঘটলটা কি?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘গনজালেসের অকাল মৃত্যু।’
‘তুমি ওকে খুন করেছ?’ জানতে চাইল রানা, গলায় প্রায় অবিশ্বাসের সুর।
‘ভাঙা নাক আর চোয়াল নিয়ে লোকটা ড্রাগস বেচা কোটি কোটি ডলারের লোভ দেখিয়ে বলল, আমাকে বিয়ে করবে। আমি উত্তর না দেয়ায় অকথ্য ভাষায় গাল দিল-আমি বেশ্যা, আরও কত কি। সহ্য করতে পারলাম না, তাই আগেভাগেই নরকে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
তারানাকে নিয়ে ডাফু সালজুনাসের কামরায় ফিরে এলো রানা। তারানার পরিচয় দিয়ে বলল, ‘তারানা আজিজ, প্যালেস্টাইন ইন্টেলিজেন্স।’
চোখ কুঁচকে তারানাকে দেখলেন সালজুনাস। ‘ওদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সবাই সমর্থন করে, কিন্তু প্রায় কেউই সাহায্যের হাত বাড়ায় না-তাদের মধ্যে আমিও একজন। আশা করি ভুলটা সংশোধন করার সুযোগ পাব। কিন্তু আপনি, ইয়ংম্যান?’
‘মাসুদ রানা, একজন বাংলাদেশী,’ এটুকু বলে চুপ করে গেল রানা, দেখতে চাইছে ভদ্রলোক কিছু মনে করতে পারেন কিনা।
ভুরু জোড়া আরও একটু কোঁচকালেন ভদ্রলোক। ‘বাংলাদেশ সরকার আমাকে মুক্ত করার জন্যে লোক পাঠিয়েছে শুধু এই কারণে যে আমি ওখানে কিছু টাকা বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলাম? নাহ্, এ বিশ্বাস করার মত নয়…’
‘আসল কারণ তা নয়ও,’ বলল রানা। ‘জুলহাস কায়সার নামে আমার এক গ্রীক জার্নালিস্ট বন্ধুকে আকার্ডিয়া মারকাস খুন করেছে, আমি তার প্রতিশোধ নিতে মাঠে নেমেছি।’ এরপর সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল কায়সার কেন খুন হলো, পি.আই.বি-র কি উদ্দেশ্য।
দেয়াল ছেড়ে এতক্ষণে সিধে হয়ে দাঁড়ালেন ডাফু সালজুনাস। ‘আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, জানি না এই ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব কিনা। মি. রানা, মুক্ত একজন মানুষ হিসেবে প্রথমেই আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই।’ এরই মধ্যে তিনি তাঁর কর্তৃত্ব ফলাবার স্বভাবটা ফিরে পেয়েছেন, ধনকুবেররা যেমনটি ফলিয়ে থাকেন। ‘তারপর আমি দেখছি মারকাসকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয়।’
‘মিস্টার সালজুনাস,’ ধীরে ধীরে বলল রানা, ‘আপনার বিপদ আসলে কাটেনি এখনও। ব্যাপারটা আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। আপনি কর্তৃপক্ষের সাহায্য নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে গেলে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। যা করার খুব দ্রুত আমরা সরাসরি করতে চাই।’
‘কি করে বুঝব আপনি যা বলছেন সব সত্যি?’ বিলিওনেয়ার ব্যবসায়ী ভদ্রলোক সংশয়ে ভুগছেন।
‘আপনাকে বোধহয় একটা তথ্য এখন দেয়া দরকার,’ বলল রানা। ‘সাউল শিপিং লাইন্সের নাম শুনেছেন কখনও?’
‘রোজই শুনছি। কেন?’
‘ওদের বোর্ড অভ ডিরেক্টরসের চেয়ারম্যানের নামটা আপনার জানা আছে?’
‘কেন থাকবে না। তাঁর নাম মাসুদ রানা। কিন্তু এসব প্রশ্ন…’
‘আমার নামটা কি?’
হাঁ করে চেয়ে রইলেন সালজুনাস কয়েক সেকেন্ড। ‘মাসুদ রানা! আপনিই কি সেই…তাই তো, আরে! কয়েকটা মীটিঙে দেখেছি আপনাকে। হ্যাঁ, আপনাকেই তো!’
মাথা ঝাঁকাল রানা। তারপর বলল, ‘আমার ওই পরিচয়টা বড় কথা নয়। আমি বলতে চাইছি সংশয় প্রকাশ করার চেয়ে ঝটপট আমাদের কথা বিশ্বাস করে নিলেই আপনি নিজের উপকার করবেন। আর যাই হোক, আপনাকে মুক্ত করার জন্যে নিজেদের প্রাণের ওপর ঝুঁকি নিয়েছি আমরা। বাইরে গেলে দেখতে পাবেন আমাদের একজন সঙ্গী মারাও গেছে,’ একটু তিক্ত শোনাল রানার শেষ বাক্যটা।
আকস্মিক ক্লান্তিতে ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের কাঁধ দুটো ঝুলে পড়ল। ‘আপনি ঠিক বলেছেন। প্লীজ, আমাকে মাফ করুন। আসলে আমার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল গেছে…’
‘আর মারকাসকে একা শায়েস্তা করার কথাটাও ভুলে যান,’ বলল রানা। ‘ব্যাপারটা প্র্যাকটিক্যাল নয়। নিজের চারপাশে লোকটা সারাক্ষণ একটা আর্মি মোতায়েন রেখেছে।’
মুখটা বেলুনের মত ফোলালেন সালজুনাস, তারপর সশব্দে বাতাস ছাড়লেন। ‘ঠিক আছে, মিস্টার রানা, ঠিক আছে। আপনারা যা বলবেন তাই হবে। তবে যদি দেখি আপনাদের মেথড কাজ করছে না, তখন কিন্তু কাজটায় আমার মত করে আমিও হাত লাগাব।’
রানা হাসল। ‘ফেয়ার এনাফ। এবার আমার কিছু প্রশেড়বর জবাব দিন। আপনাকে এথেন্স থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল?’
ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় আবার বসলেন গ্রীক শিপিং ম্যাগনেট। ‘আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না আকার্ডিয়া মারকাস কি রকম চালাক লোক। নিজেকে আমি নিরীহ বলে দাবি করি না, তবে ওর মত ভয়ঙ্কর লোক জীবনে আমি দেখিনি। কিভাবে কি ঘটল শুনুন তাহলে…’
কমপিউটর-নিয়ন্ত্রিত আন্ডারওয়াটার অয়েল ট্যাংকারের একটা বহর তৈরি করার আইডিয়া নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন ডাফু সালজুনাস। কিভাবে যেন ব্যাপারটা জানতে পেরে তাঁকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেয় আকার্ডিয়া মারকাস। প্রথমে সালজুনাস দেখা করতে রাজি হননি। কিন্তু কয়েকটা চিঠিতে ইন্টারেস্টিং কিছু আইডিয়া দেখতে পেয়ে এথেন্স পেন্টহাউসে তাকে ডেকে পাঠালেন। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আলাপ করলেন তিনি। মারকাস তাঁকে জানাল, ‘আমার আর আপনার প্ল্যান একই। আপনি শুধু আমাকে অনুমতি দিন, শিপিং ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে আপনার নামটা অমর করে দিই।’ উত্তরে সালজুনাস বললেন, ‘কিন্তু, মিস্টার মারকাস, প্রথমে অত্যন্ত জটিল কিছু এঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার সমাধান দরকার হবে।’
মারকাস জানাল, তার হাতে দু’জন প্রতিভাবান এঞ্জিনিয়ার আছে, তারা এই কাজ করতে পারবে। আলাপের এই পর্যায়ে সালজুনাস সন্দেহ করেন মারকাসের অমায়িক ও মার্জিত আচরণের তলায় কি যেন একটা লুকিয়ে আছে, এমন একটা কিছু যা পছন্দ করতে পারছেন না। মিছে সন্দেহ ভেবে ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করেন তিনি।
রানা জানতে চাইল, ‘এঞ্জিনিয়ার দু’জনকে আপনার সামনে এনেছিল সে?’
‘ও, হ্যাঁ। তাদের ইনভেনটিভ ব্রেন থেকেও ইম্যাজিনেটিভ সব আইডিয়া বেরুতে দেখে আমি তো রীতিমত মুগ্ধ। বিশ্বাস হলো, ওরা পারবে। ঠিক এই পর্যায়ে, মিস্টার রানা, অসতর্ক হয়ে পড়ি আমি। পেন্টহাউসে একটা প্রাইভেট মীটিং-এর জন্যে অনুরোধ জানাল মারকাস। মীটিংটায় শুধু আমার পার্সোন্যাল সেক্রেটারী গিলি ক্ল্যাসিকস আর একজন এইড উপস্থিত ছিল। মারকাস দু’জন লোককে সঙ্গে করে আনল। তাদেরকে আগে আমি দেখিনি।’
‘ব্যাপারটা তাহলে তখনই ঘটল?’ জানতে চাইল তারানা।
হঠাৎ করেই মারকাস পার্সোন্যাল সেক্রেটারী ও এইডকে ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে বলে। তাদের পিছু নিয়ে তার একজন সঙ্গীও কামরা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। একটু পরই দুটো গুলির শব্দ ভেসে এল। পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে এভাবেই খুন করা হয় সালজুনাসের পার্সোন্যাল সেক্রেটারী আর এইডকে। মারকাসের অপর সঙ্গী সালজুনাসকে ঘুসি মেরে প্রায় অজ্ঞান করে ফেলে। টেনে-হিঁচড়ে পাশের কামরায় নিয়ে এসে এইড দু’জনের রক্তাক্ত লাশ দেখতে বাধ্য করে। গিলি ক্ল্যাসিকস-এর মাথার অর্ধেক উড়ে গিয়েছিল। সালজুনাসকে বলা হলো, তাদের কথামত কাজ না করলে তাঁর অবস্থাও এরকম হবে।
‘তারপর কি ঘটল?’ জিজ্ঞেস করল তারানা।
পরদিন ওরা এক লোককে নিয়ে এল-অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি-লোকটা হুবহু গিলি ক্ল্যাসিকসের মত দেখতে। লোকটার আচার-ব্যবহার, হাবভাব, বাচনভঙ্গি, দাঁড়ানো বা বসা, এমন কি হাত নাড়ার বৈশিষ্ট্য-সব গিলি ক্ল্যাসিকসের সঙ্গে মেলে। মারকাস গর্ব করে বলল, লোকটাকে ভাগ্যগুণে খুঁজে পেয়েছে সে। দু’জনের চেহারায় বেশ কিছু অমিলও ছিল, সে-সব প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যে দূর করা হয়েছে। বাকি সব-আচার-আচরণ, বাচনভঙ্গি ইত্যাদি? সাত মাসের কঠোর ট্রেনিং এই অসম্ভবকে সম্ভব করিয়েছে। গিলি ক্ল্যাসিকসের ওপর এক বছর ধরে নজর রাখছিল ওরা। তার প্রতিটি নড়াচড়া, কথাবার্তা, স্বভাব ও অভ্যাস নোট করা হয়েছে। যখনই সুযোগ পাওয়া গেছে ভিডিও ক্যামেরায় বন্দী করা হয়েছে তার মুভমেন্ট।
রানা জানতে চাইল, ‘ওরা আপনার সেক্রেটারীর নকল তৈরি করল, কিন্তু আপনারটা করল না কেন?’
সালজুনাস জানালেন, তাঁর ডুপি−কেট তৈরি করার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ, সমাজে তিনি চলাফেরা করতেন না, মেলামেশা করতেন বাছাই করা অল্প ক’জন ব্যবসায়ী বন্ধুর সঙ্গে। এমনকি তাঁর কর্মচারীরাও অনেকে তাঁকে কখনও দেখেনি।
সালজুনাসকে না জানিয়ে রেকর্ড করা তাঁর কণ্ঠস্বরের কয়েকটা টেপ বাজিয়ে শোনানো হলো। মারকাস মাথায় একটা পিস্তল চেপে ধরে বলল, এখুনি তাঁকে খুন করতে পারে সে, দীর্ঘদিন এই ঘটনা কেউ জানতেও পারবে না। তবে ঝামেলা না করলে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। আরও রেকর্ডিং এবং চিঠি লেখানোর জন্যে তাঁকে ওদের প্রয়োজন। এরপর একটা প্রাইভেট প্লেনে তুলে এই জঙ্গলের ভেতর নিয়ে আসা হয় তাঁকে।
‘মারকাস তার প্ল্যান সম্পর্কে কিছু বলেনি আপনাকে?’
বলেনি মানে! সগর্বে, সদম্ভে ঘোষণা করেছে মারকাস, ডাফু সালজুনাসের নামে গ্রীস সরকারকে উৎখাত করবে সে। সামরিক বাহিনীতে সালজুনাসের যত বন্ধু আছে তাদের সঙ্গে নকল গিলি ক্ল্যাসিকসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সাহায্য ও সমর্থন চাওয়া হবে। সালজুনাস নিভৃতচারী, প্রায় কারও সঙ্গেই সশরীরে দেখা করেন না, এ-কথা সবাই জানে, কাজেই তাঁর সেক্রেটারীর মাধ্যমে সাহায্য ও সমর্থনের প্রস্তাব পেলে কেউ এতটুকু বিস্মিত হবে না। তারপরও কেউ যদি তাঁর সঙ্গে সামনাসামনি বসে কথা বলতে চায়, প্লেনে করে এথেন্সে নিয়ে যাওয়া হবে তাঁকে, লুকানো পিস্তলের সামনে বসে শিখিয়ে দেয়া কথা মুখস্থ বলে যাবেন তিনি।
সালজুনাসকে তাঁর সইও নকল করে দেখানো হয়। কোনটা নকল, কোনটা আসল, সালজুনাস নিজেই ধরতে পারেননি। তাঁকে বলা হয়, জালিয়াত লোকটাকে দিয়ে তাঁর বিভিনড়ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা হবে। এই টাকা খরচ করা হবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বর্তমান সরকারকে উৎখাতের কাজে।
মারকাসের প্ল্যান তিন ভাগে ভাগ করা। প্রথমে সে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় বসাবে সালজুনাসের প্রতি অনুগত সামরিক অফিসারদের। তারা যে শুধু বন্ধু বলে আনুগত্য দান করবে, তা নয়; তাছাড়া বেশিরভাগই তারা সালজুনাসের বন্ধু নয়ও-মারকাস তাদেরকে সালজুনাসের নামে ক্ষমতা, সম্পদ ও গৌরব-এর লোভ দেখিয়ে দলে টানবে।
প্ল্যানের দ্বিতীয় অংশে এই সব জেনারেল ও কর্নেলদের বলা হবে তারা যেন দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। সেই নির্বাচনে সালজুনাস দাঁড়াবেন, এবং সামরিক জান্তার সমর্থন ও দেশবাসীর নিরঙ্কুষ ভোট পেয়ে তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।
প্ল্যানের তৃতীয় পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট সালজুনাস পিস্তলের মুখে আকার্ডিয়া মারকাসকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দান করবেন। তখন সরকারী মিডিয়াতে প্রচার করা হবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ইত্যাদি দেশহিতকর কাজগুলোর পিছনে আসলে আকার্ডিয়া মারকাসেরই সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল-সে-ই বর্তমান গ্রীসের রক্ষাকর্তা। তারপরের অংশটুকু আর বলেনি তাঁকে মারকাস, তিনি নিজেই বুঝে নিয়েছেন-একটা মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হবেন প্রেসিডেন্ট ডাফু সালজুনাস। সংবিধান অনুসারে ভাইস প্রেসিডেন্ট মারকাস হবে প্রেসিডেন্ট।
‘কি ভয়ংকর! সত্যি অবিশ্বাস্য!’ মাথা নেড়ে বলল তারানা।
‘মারকাসের মত লোক যদি গ্রীসে ক্ষমতায় আসে,’ সালজুনাস বললেন, ‘দেশের সমস্ত সম্পদ লুঠ হয়ে যাবে। মাত্র কয়েক বছর পর দেখা যাবে তার অত্যাচারে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ।’
‘আপনি নিশ্চিত থাকুন,’ তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলল রানা, সেরকম কিছু ঘটতে দেয়া হবে না। তারানা ওদের নেতা হত্যার বদলা নেবে, আমি নেব বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ। আপনি শুধু আমাদের সঙ্গে থাকুন।’
‘এই লোককে দমন করার জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করব আমি,’ বললেন সালজুনাস। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, চৌকো চিবুক ঠেলে দিলেন সামনের দিকে। ‘এই লোক এমনকি আমার পরিবারকেও দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। সে গর্ব করে আমাকে বলেছে, আমার ভগড়বীপতি জেনারেল অ্যালেক্সিস ভালটোনা বিশ্বাস করেন এই কুৎসিত ষড়যন্ত্রটা আমিই পাকিয়েছি, এবং আমি চাওয়ায় তিনি আমাকে সমর্থন করতেও রাজি হয়েছেন। লোকটা কত্তো বড় শয়তান, ভাবতে পারেন! হ্যাঁ, অবশ্যই আপনাদের সঙ্গে আছি আমি। বলুন, প্রথমে কি করব আমরা?’
‘প্রথমে আমরা এথেন্সে যাব,’ বলল রানা। ‘ওখানেই আকার্ডিয়া মারকাসের ব্যবস্থা করা হবে।’
৬
আটচল্লিশ ঘণ্টারও কিছু কম সময়ের মধ্যে গ্রীসের রাজধানীতে পৌঁছুল ওরা। রানা এজেন্সির রিয়ো শাখার সাহায্যে নকল পাসপোর্ট, জাল কাগজ-পত্র, ছদ্মবেশ ইত্যাদি সংগ্রহ করতে কোন সমস্যাই হয়নি ওদের। ডাফু সালজুনাসকে আরব আমিরাতের একজন শেখ, আর তারানাকে তাঁর সর্বকনিষ্ঠ বিবি হিসেবে চালিয়ে দেয়া হলো।
ফাইভ স্টার ওডিয়ন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে তিন বেডের একটা ফ্যামিলি স্যুইটে উঠল ওরা।
এথেন্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে, খবরের কাগজগুলোও প্রতিদিন গরম গরম খবর ছাপছে। সাংবাদিক জুলহাস কায়সার খুন হয়েছে, এ-খবর ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে গ্রীসে। শুধু মিডিয়া জগতে নয়, গোটা দেশ জুড়ে ব্যাপারটা নিয়ে হৈ-চৈ শুরু হয়েছে। পত্রিকাগুলো বলছে, এর আগেও কায়সারকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল। তবে একটা পত্রিকা কায়সারের মৃত্যুটাকে দুর্ঘটনা বলে চালাবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। এই পত্রিকার সম্পাদকীয়তে নিয়মিত বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে-বেশ কয়েকজন জেনারেল ও কর্নেলের নাম উলে−খ করে মন্তব্য করা হচ্ছে এদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ এনে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার।
‘বোঝাই যাচ্ছে, আমার টাকা দিয়ে এই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশককে কিনে নিয়েছে মারকাস,’ মন্তব্য করলেন সালজুনাস। সময়টা বিকেল, রানার কামরায় বসে আছেন তিনি। রানা তাঁর মুখোমুখি একটা সোফায় বসেছে, ওই সোফারই হাতলটা দখল করেছে তারানা। ব্রাজিল থেকে আজই ওরা গ্রীসে পৌঁছেছে। ‘কি স্পর্ধা! এখানে আমার নামে যে বিবৃতিটা ছাপা হয়েছে তাতে আমি দেশের জনগণকে ডাক দিয়ে বলছি, সরকারের বিরুদ্ধে সবাইকে রাস্তায় নামতে হবে, কারণ তারা দেশটাকে বিক্রি করে দেয়ার ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে।’
তারানা বলল, ‘মারকাস যদি জানতে পারে আপনি এখন এথেন্সে…’
‘পারাকাটুর সঙ্গে যোগাযোগ করলেই খবর পেয়ে যাবে,’ বললেন সালজুনাস।
‘তা পাবে,’ বলল রানা, ‘তবে সেটা কয়েকদিনের মধ্যে না-ও ঘটতে পারে। ওখানে সবাই মারা যাওয়ায় ঠিক কি ঘটেছে জানার জন্যে কাউকে পাঠাতে হবে। কাজেই সময় লাগবে।’
‘আমাদের প্ল্যানটা কি, রানা?’ জানতে চাইল তারানা।
‘পারাকাটুর প্ল্যানটেশনে ঢোকা আর এথেন্সে কোলোসসের পেন্টহাউসে ঢোকা এক কথা নয়। এখানের সিকিউরিটি অত্যন্ত কড়া হবে।’
‘আমি পেন্টহাউসে ফোন করে জানার চেষ্টা করতে পারি,’ বললেন সালজুনাস, ‘বাইরের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে কি নিয়ম ফলো করছে ওরা। তবে আমার কণ্ঠস্বর শুনলেই চিনে ফেলবে।’
ট্রে থেকে একটা ন্যাপকিন তুলে তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরল রানা। ‘মুখের সামনে এটা রেখে কথা বলুন। আপনি নিজের সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন। ওরা এড়িয়ে গেলে আপনার সেক্রেটারী গিলি ক্ল্যাসিকসকে ডেকে দিতে বলবেন।’
‘নিজের একটা পরিচয় তো দিতে হবে…’
‘বলবেন, সালোনিকা থেকে বলছেন। ওখানকার একটা পত্রিকার সম্পাদক। কি চান? ডাফু সালজুনাসের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ সম্পর্কে একটা বিবৃতি।’
রানার কথা শুনে হাসলেন সালজুনাস। মুখে ন্যাপকিন চেপে ধরে পেন্টহাউসে উপস্থিত আকার্ডিয়া মারকাসের কোন লোকের সঙ্গে কথা বললেন। এক মিনিটের মাথায় অপরপ্রান্তে হাজির হলো নকল গিলি ক্ল্যাসিকস। এই নকল গিলি আসলে একজন এথিনিয়ান অভিনেতা, নাম ইউসুফিস জিয়ানি। নিজের সম্পর্কে প্রশ্ন করে বানানো উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করলেন সালজুনাস, তারপর জানতে চাইলেন মিস্টার সালজুনাসের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে একটা সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব কিনা। প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করা হলো। আলাপেরও ইতি ঘটল এখানে। রিসিভার নামিয়ে রেখে রানা ও তারানার দিকে তাকালেন সালজুনাস। ‘ভৌতিক একটা অভিজ্ঞতা হলো। এই গিলি আমার সেক্রেটারী আসল গিলির কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করতে পারে।’
‘ফোনটা প্রথমে কে ধরল?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘একজন গ্রীক। বয়সে তরুণ মনে হলো। নিশ্চয়ই মারকাসের পোষা কোন গুণ্ডা।’
রানা বলল, ‘মারকাস কাঁচা কাজ করার লোক নয়। আমরা ধরে নিতে পারি পুলিস অফিসারদেরও হাত করেছে সে। তার প্রাইভেট আর্মি ট্রেনিং নিচ্ছে দু’জায়গায়, হয়তো সেই আর্মির লোকেরাই পেন্টহাউস পাহারা দিচ্ছে।’
‘তাহলে মারকাসকে ধরার উপায়?’
‘জেনারেল অ্যালেক্সিস ভালটোনা আপনার ভগড়বীপতি, তাই না?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘হ্যাঁ।’ মাথা ঝাঁকালেন সালজুনাস। ‘তবে এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে সেনাবাহিনীতে উনড়বতি করতে হলে যেসব অতিরিক্ত যোগ্যতা লাগে অ্যালেক্সিসের মধ্যে তা যথেষ্ট পরিমাণে নেই। আমি আমার ভাগ্য ফেরার আগেই তিনি আমাদের ছোট বোনকে বিয়ে করেন। সুন্দর, সুখী দাম্পত্য জীবন ওদের। কিন্তু আমি প্রভাব না খাটালে অ্যালেক্সিস জেনারেল হতে পারতেন না, আরও অনেক নিচে পড়ে থাকতেন। কাজেই তিনি আমার প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন আমি তাঁকে যদি কিছু করতে বলি, তিনি বিনা দ্বিধায় তা করবেন। ঘটেছেও ঠিক তাই, মিস্টার রানা। অ্যালেক্সিস যে আমার কাছে ঋণী, মারকাস এটা যেভাবেই হোক জেনেছে। তারপর আমার নকল করা কণ্ঠস্বর আর নকল করা হাতের লেখা ব্যবহার করে, এবং সশরীরে আমার সেক্রেটারী গিলির ডুপি−কেটকে পাঠিয়ে অ্যালেক্সিসকে বোঝানো হয়েছে যে আমি সরকার উৎখাতের একটা প্ল্যান করেছি, সেই প্ল্যান সফল করতে হলে তাঁর সাহায্য আমার একান্ত দরকার।’
‘আপনার কোনও ধারণা আছে, জেনারেলকে ঠিক কি কাজে ব্যবহার করছে মারকাস?’
‘মারকাস আমাকে আভাসে জানিয়েছিল, অ্যালেক্সিসকে দিয়ে দুটো কাজ করানো হবে। এক, বিশ্বস্ত লোক দিয়ে গোপন একটা বাহিনীকে ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। দুই, তিনি তাঁর সামরিক সহকর্মী ও বন্ধুদের সদলবলে এই ষড়যন্ত্রে অংশ গ্রহণের জন্য প্ররোচিত করবেন।’
‘হুম। জেনারেল ভালটোনা কি এথেন্সে থাকেন?’
মাথা ঝাঁকালেন সালজুনাস। ‘শহরের বাইরে থাকেন, উত্তর দিকটায়।’
‘আপনি তাঁর কাছে নিয়ে যাবেন আমাদের?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। কখন যেতে চান?’
‘এখনই।’
মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচুর শেখ আর আমীর গ্রীসে ছুটি কাটাতে আসে, সাদা ও ঢোলা আলখেল্লা পরে থাকায় সালজুনাসকে তাদের একজনই মনে হচ্ছে। তারানা বোরকা পরা ছোট বউ। আর গ্রীক ভাষার ওপর সমপ্রতি খানিকটা দখল আনতে পারার সুবাদে রানা ওদের গাইড। রেন্ট-আ-কার থেকে একটা মার্সিডিজ নিয়ে সন্ধ্যার খানিক আগে রওনা হলো ওরা।
এথেন্স শহরের ঠিক বাইরে সুন্দর একটা এলাকায় জেনারেল ভালটোনার বিশাল বাড়ি। আঁকাবাঁকা ড্রাইভওয়ে দালানের সামনে, পার্কিং এরিয়ায় এসে শেষ হয়েছে।
একজন সৈনিক ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসে সুসজ্জিত সিটিংরূমে বসিয়ে রেখে চলে গেল। একটু পরই খবর পেয়ে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এলেন জেনারেল ভালটোনা। আলখেল্লা পরা সালজুনাসকে দেখে প্রথমে তিনি চিনতেই পারলেন না। সালজুনাস সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন, মাথা ও মুখের দু’পাশ ঢেকে রাখা সাদা চাদর সরিয়ে ভগড়বীপতিকে জিজ্ঞেস করলেন। ‘এবার চিনতে পারছ, অ্যালেক্সিস?’
প্রায় ছুটে এসে সালজুনাসকে জড়িয়ে ধরলেন জেনারেল ভালটোনা। ‘ভাই, আপনি! এই বেশে! কি ব্যাপার, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
ভগড়বীপতির আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে সালজুনাস জানতে চাইলেন, ‘চেরি কোথায়?’
‘চেরি তার বান্ধবীর বাড়ি বেড়াতে গেছে, কাল ফিরবে…’
‘ভালই হয়েছে। তুমি আমাদেরকে তোমার স্টাডিতে নিয়ে চলো,’ বললেন সালজুনাস। ‘আমরা অত্যন্ত জরুরী কয়েকটা বিষয়ে আলাপ করব।’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে আসুন।’ পথ দেখিয়ে ওদেরকে নিজের স্টাডিতে নিয়ে এলেন জেনারেল ভালটোনা।
সবাই একটা করে চেয়ার দখল করে বসার পর সালজুনাস প্রথমে জেনারেল ভালটোনার সঙ্গে রানা ও তারানার পরিচয় করিয়ে দিলেন, তারপর বললেন, ‘অ্যালেক্সিস, অত্যন্ত গুরুতর একটা বিষয় তোমার কাছে আমার ব্যাখ্যা করতে হবে। আমি চাই তুমি খুব মন দিয়ে শুনবে সব।’
একটু সতর্ক, একটু বিমূঢ়; জেনারেল ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন। সালজুনাস তাঁকে পুরো কাহিনীটা শোনালেন। শোনার সময় মাঝে-মধ্যে জেনারেলের চেহারায় অবিশ্বাসের ভাব ফুটল, তবে কোন মন্তব্য করলেন না। সালজুনাস থামতে বললেন, ‘এ তো দেখছি গল্পকেও হার মানায়!’
‘কিন্তু বাস্তব সত্য।’
‘আপনি এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত নন, এটা জানার পর কি রকম স্বস্তিবোধ করছি সে আমি বলে বোঝাতে পারব না,’ বললেন জেনারেল ভালটোনা। ‘এখন বলুন, শয়তান মারকাসকে শাস্তি দেয়ার জন্যে আমাকে কি করতে হবে।’
‘সেটা মিস্টার রানাই ভাল বলতে পারবেন,’ বললেন সালজুনাস।
‘আমাদের দরকার ভেতরের তথ্য, জেনারেল ভালটোনা,’
বলল রানা। ‘মারকাস ঠিক কিভাবে কি করতে যাচ্ছে তা একমাত্র আপনিই আমাদেরকে জানাতে পারেন।’
‘মাত্র একটা জাতীয় দৈনিকের মাধ্যমে নোংরা প্রচারণা আর মিথ্যে কলংক ছড়ানো হচ্ছে, আর সে-সব বেশিরভাগই জেনারেল ডোনাল্ডিস সেরাফ-এর বিরুদ্ধে,’ বললেন ভালটোনা। ‘এর কারণ, জেনারেল সেরাফ গ্রীসে আর কোন সামরিক অভ্যুত্থান চান না। শুধু তাই নয়, তিনি নির্বাচিত সরকারের পাশে থাকবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। সরকার তাঁকে সেনাপ্রধানের পদে বসাতে চাইছে, কিন্তু তাতেও বাধা দিচ্ছে এই পত্রিকাটি। জেনারেল সেরাফ নাকি একজন ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজ। কিন্তু আমরা জানি এসব অভিযোগ একদমই মিথ্যে। তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কেও নোংরা ও মিথ্যে প্রচারণা ছাপা হচ্ছে। অথচ তাঁর চেষ্টা ও সুপারিশেই সমপ্রতি বেশ কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে হাত দিয়েছে সরকার।’
‘তাঁকে নিয়ে মারকাসের প্ল্যানটা কি?’
‘জেনারেল ডোনাল্ডিস সেরাফের সঙ্গী ও সমর্থক হলেন আরও দু’জন জেনারেল-ভিক্টর পাপাভিক্স ও গেইব্রিয়াল সেনটো। এঁদের অপরাধ, এঁরা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে যাবেন না। আপনার সেক্রেটারী গিলি, মানে নকল গিলি, ক’দিন আগে আমার কাছে এসে জানিয়ে গেছে ওঁদের তিনজনকে খুন করা হবে।’
তারানার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল রানা। মারকাস এবার তার কাজে হাত দেবে।
‘কিভাবে কি ঘটতে যাচ্ছে আপনি জানেন?’ জেনারেল ভালটোনাকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ভাসা-ভাসা জানি, সামান্যই। প্রথমে বলা হয়েছিল, এই তিনজনের সঙ্গে আপনার একটা মীটিঙের আয়োজন করতে হবে আমাকে, সালজুনাস ভাই। কিন্তু তারপর গিলি, নকল গিলি, আমাকে ফোন করে জানাল, মীটিংটার আয়োজন তারাই করতে যাচ্ছে-পেন্টহাউসে। আমার যতদূর ধারণা, এই মীটিঙেই তিন জেনারেলকে খুন করা হবে।’
‘মীটিঙের সময়টা জানতে হবে,’ বলল রানা। ‘আপনি এক কাজ করুন, জেনারেল। জেনারেল ডোনাল্ডিস সেরাফকে ফোন করে জিজ্ঞেস করুন সালজুনাসের লোকজন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কিনা। খুন হবার সম্ভাবনার কথাটা এখুনি তাঁকে জানাবার দরকার নেই।’
‘ঠিক আছে,’ বললেন ভালটোনা। ‘আশা করি জেনারেল সেরাফ আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হবেন।’
কিন্তু ফোন করে জেনারেল সেরাফকে তাঁর বাড়ি বা অফিসে কোথাও পাওয়া গেল না। এইডরা কেউ বলল না বা বলতে পারল না কোথায় কি কাজে গেছেন তিনি। ঠিক হলো, জেনারেল ভালটোনা রাতে আরেকবার ফোন করবেন তাঁকে।
সালজুনাসকেও একটা কাজ দিল রানা। ‘মারকাসের প্রাইভেট বাহিনী যে দু’জায়গায় ট্রেনিং নিচ্ছে সেখানকার লীডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাঁদেরকে বলে রাখুন, সরাসরি আপনার মুখ থেকে নির্দেশ না পেলে তারা যেন তাদের বাহিনীকে মুভ না করায়।’
‘কেন, কি লাভ তাতে?’
‘মারকাস সরকার উৎখাত করার সময় এথেন্সের সাধারণ মানুষ খেপে উঠতে পারে,’ বলল রানা। ‘তখন ওই প্রাইভেট আর্মিকে দিয়ে তাদের আন্দোলন থামাবার চেষ্টা করবে সে।’
‘ও, ইয়েস!’ সালজুনাসের যেন চোখ খুলে গেল।
‘একটা কিছু অজুহাত না দেখিয়ে জেনারেল তিনজনকে মারকাস খুন করতে যাবে না,’ বলল রানা। ‘কিংবা হয়তো গোটা ব্যাপারটাকে অ্যাক্সিডেন্ট হিসেবে সাজানো হবে। আপনার কি মনে হয়?’
ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলেন জেনারেল ভালটোনা। ‘একগাদা নতুন অভিযোগ অবশ্যই প্রচার করা হবে। অ্যাক্সিডেন্ট? মনে হয় না। সম্ভবত বলা হবে, পরস্পরের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল, তারই করুণ পরিণতিতে তিনজনই খুন হয়ে গেছে।’
৭
ডাফু সালজুনাস তাঁর ভগড়বীপতি জেনারেল ভালটোনার বাড়িতে থেকে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিতে পারে ভেবে নিষেধ করল রানা। কোনও কারণে জেনারেলের ওপর বিশ্বাসের অভাব দেখা দিলে মারকাস বিনা নোটিশে তাঁর বাড়িতে হানা দিতে পারে।
হোটেলে ফিরে নিজেদের স্যুইটেই ডিনার খেলো ওরা। সালজুনাস তাঁর কামরায় বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। রানাও নিজের রূমে ঢুকল, পিছু পিছু এলো তারানা।
‘সরকার সমর্থক জেনারেলদের নিয়ে মারকাস কি করবে, তার অপেক্ষায় বসে থাকব আমরা,’ বলল রানা, ‘এটা স্রেফ বোকামি হচ্ছে।’ একটা সোফায় বসল ও, ইঙ্গিতে সামনের একটা সোফা দেখাল তারানাকে।
‘তাছাড়া করারও তো কিছু নেই,’ বলল তারানা; হয় রানার ইঙ্গিত দেখতে পায়নি, নয়তো ওখানে বসতে চায় না। ‘তুমি তো আর পেন্টহাউসে হানা দিতে পারো না।’ সোজা এগিয়ে এলো সে, রানাকে একটু আড়ষ্ট করে দিয়ে ওর সোফার হাতলে বসল।
‘হানা দিতে না পারি, এমনি ঘুরেফিরে দেখে আসতে তো পারি,’ বলল রানা। ‘ভেতরে একবার ঢুকতে পারলে ওদের ডিফেন্স সেট-আপ দেখার একটা সুযোগ পেতাম।’
রানার ঘাড়ে হাত রাখল তারানা, তারপর মাথার চুলে আঙুল ঢোকাল। ‘কিন্তু ভেতরে আমরা ঢুকব কিভাবে!’
‘আমরা না,’ একটা ঢোক গিলে বলল রানা, তারানার আচরণ ওর বোধগম্য হচ্ছে না। মেয়েটা কি ওকে আরও কিছু বলার চেষ্টা করছে? কিন্তু ও না নিজের মুখেই বলেছে, একজনকে ভালবাসে? ‘কোন একটা ছুতো দেখিয়ে ঢুকব আমি একা।’
‘এই অ্যাসাইনমেন্টে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি, মনে আছে?’ হালকা সুরে জিজ্ঞেস করল তারানা। ‘তুমি পেন্টহাউসে গেলে তোমার সঙ্গে আমিও যেতে চাই।’ রানার মাথাটা নিজের দিকে টানল সে, তারপর ওর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে কানে গরম নিঃশ্বাস ফেলল। ‘কি ব্যাপার, তুমি এমন জড়োসড়ো হয়ে আছ কেন?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল।
‘সব জায়গায় দু’জন যাওয়া যায় না,’ বলল রানা। তারপর আবার ঢোক গিলল। ‘জড়োসড়ো হয়ে আছি…তুমি নিশ্চয়ই জানো কেন জড়োসড়ো হয়ে আছি।’
‘আমি একজনকে ভালবাসি, এইজন্যে?’
‘বোলো না যে সেই একজন আসলে আমি,’ হাসল রানা।
‘না, সে তুমি না,’ বলল তারানা, দু’হাতে ধরে রানার মুখ নিজের দিকে ফেরাল। ‘তার আসলে কোন অস্তিত্ব ছিল না, রানা, এখনও নেই।’ রানাকে চুমো খেলো সে। ‘তখন কথাটা বিশেষ এক কারণে বলতে হয়েছিল।’ রানার আরও কাছে সরে এল।
‘এখন সে কারণটা আর নেই।’
‘ছেলেটা কিন্তু সত্যিই প্রেমে পড়েছিল তোমার,’ বলল রানা।
‘পি−জ, অতীত বাদ দাও; এসো আমরা বর্তমানে বাঁচি।’
‘ঠিক আছে, অতীত বাদ,’ বলল রানা। ‘কিন্তু দরজা খোলা যে!’ তারানার কোমর জড়িয়ে ধরে সোফা ছেড়ে উঠল রানা।
‘হঠাৎ বেরিয়ে সালজুনাস যদি দেখে তার পেয়ারের ছোট বিবি কিস মারছে আমাকে…’
‘দেখলেও তেড়ে মারতে আসবে না,’ বলে রানার গলা ধরে প্রায় ঝুলে পড়ল তারানা। ‘বরং লজ্জা পেয়ে চট্ করে ভিড়িয়ে দেবে দরজা!’
বলতে না বলতে খুলে গেল সালজুনাসের কামরার দরজা। ওদেরকে ওই অবস্থায় দেখে রসগোল্লা হয়ে গেল শিপিং ম্যাগনেটের চোখ। আধহাত জিভ বের করে দাঁতে কাটল সে। তারপর সত্যিই চট্ করে ভিড়িয়ে দিল দরজাটা।
‘নারে, দরজাটা লাগিয়েই দিই!’ বলে রানার গলা ছেড়ে মেঝেতে নামল তারানা, বন্ধ করে দিল দরজাটা।
পরদিন সকালে ডাফু সালজুনাস ও তারানাকে হোটেলে রেখে কোলোসস বিল্ডিঙে চলে এলো রানা। একদল স্থানীয় উইন্ডো ওয়াশার পাস দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে নিয়মিত বিল্ডিংটার জানালা ধোয়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের একজনের একটা ইউনিফর্ম সংগ্রহ করেছে ও। পাসটা জাল করতে সালজুনাস ওকে সাহায্য করেছেন। আর নকল একজোড়া গোঁফ লাগিয়ে দিয়ে ওর চেহারায় যতটা সম্ভব গ্রীক ভাব বা বৈশিষ্ট্য এনে দেয়ার চেষ্টা করেছে তারানা। বাইরে দাঁড়ানো ইউনিফর্ম পরা গার্ডকে মিথ্যেকথা বলল রানা-গিলি ক্ল্যাসিকস হুকুম দিয়েছেন পেন্টহাউসের জানালা পরিষ্কার করতে হবে।
স্পেশাল এলিভেটরে চড়ে ওপরে উঠতে হবে, তবে তাতে চড়ার পরও নিজের পরিচয়-পত্র দেখাতে হলো রানাকে। বোঝাই গেল যে এলিভেটর অপারেটর মারকাসের লোক। নীল ইউনিফর্মের বাইরে আগেড়বয়াস্ত্রের আকৃতি ফুটে আছে। রানা আর ওর হাতের বালতিটাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখছে সে। এলিভেটর পেন্টহাউসে উঠল। এই একটাই, অন্য কোন এলিভেটর পেন্টহাউস পর্যন্ত উঠতে পারে না-জানিয়েছেন সালজুনাস। টপ ফ্লোর থেকে নিচে পর্যন্ত এক প্রস্থ সিঁড়ি অবশ্য ছিল, তবে সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তারপরও গার্ড দেয়া হয়।
এলিভেটর থেকে একটা করিডরে বেরিয়ে এলো রানা, সেটা বিল্ডিঙের সামনের অংশ থেকে পিছন দিকে চলে গেছে। মেঝেতে পুরু কার্পেট, দেয়াল ঘেঁষে ফুলের টব, উঁচু সিলিঙে ক্রি€াল ঝাড়বাতি। পেন্টহাউসে ঢোকার মুখে একটা ডেস্ক সামনে নিয়ে বসে রয়েছে দু’জন গার্ড। এরাও মারকাসের ভাড়াটে গুণ্ডা, তার প্রাইভেট আর্মির সদস্য। সালজুনাসের নিজের গার্ডরা সংখ্যায় কম ছিল, পেন্টহাউস বেদখল হয়ে যাবার দু’একদিন পরই তাদের চাকরি চলে গেছে।
দু’জনের একজন, সে-ই বেশি লম্বা, করিডর ধরে এগিয়ে এলো রানার দিকে। এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, যেন জন্মশত্রু। ‘এখানে তোমার কি কাজ?’ ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
ওদের ভাষাতেই জবাব দিল রানা, ‘দেখে বোঝা যায় না কি কাজ?’ হাসল ও। ‘জানালা ধুতে এলাম।’
‘এলাম বললেই হলো? কার হুকুমে এলে?’
ইউনিফর্মে সেলাই করা একটুকরো সিল্ক-এর দিকে তর্জনী তাক করল রানা, যে-কোম্পানি জানালা ধোয়ার কাজটা করে তার নাম লেখা রয়েছে তাতে ।
‘তোমার মালিক পেন্টহাউস থেকে কোন অর্ডার পেয়েছে?’
‘অর্ডার না পেলে কি আমাকে পাঠাত?’ প্রশ্নটা করার পর বেশ বড় একটা ঝুঁকি নিল রানা। ‘গিলি ক্ল্যাসিকসের নামই বোধহয় শুনলাম…’
ডেস্কে বসা অপর লোকটা ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কি বলল বোঝা গেল না। তার চুল কালো, চেহারায় উগ্র ভাব। ব্রাজিল থেকে মারকাস যাদেরকে নিয়ে এসেছে, এ লোকটা সম্ভবত তাদের একজন। রানা অনুভব করল, লোকটার দৃষ্টি ওর ছদ্মবেশ ভেদ করে আসল চেহারা দেখে ফেলছে।
‘হুম্-ম্!’ রানার পাশের লোকটা কটমট করে তাকাল। ‘ঘোরো। হাত রাখো দেয়ালে।’
রানা জানত সার্চ করা হতে পারে। পিস্তল আনেনি, তবে ছুরিটা ডান গোড়ালির ঠিক ওপরে টেপ দিয়ে আটকে রেখেছে। ঘুরে দেয়ালে হাত রাখল, দম আটকে অপেক্ষা করছে। বগল, পাঁজর, পিঠ আর বাহুতে হাত চাপড়াবার পর ওর পায়ের ওপর ধীরে ধীরে হাত বোলাচ্ছে লোকটা। হাঁটুর নিচে নেমে এলো আঙুলগুলো। এটা ওর ডান পা। লোকটার হাত ছুরির নাগাল পেয়ে যাচ্ছে। রানার তলপেটে টান পড়ল। ছুরির হাতল থেকে এক, খুব বেশি হলে দেড় ইঞ্চি দূরে থাকতে স্থির হলো আঙুলগুলো। ‘ঠিক আছে,’ দম ছেড়ে বলল সে। ‘ঘুরে আমাকে তোমার আইডেনটিফিকেশন দেখাও।’
নকল কার্ড বের করল রানা। সাবধানে, খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল লোকটা। কথা না বলে দ্বিতীয় লোকটার কাছে এসে কার্ডটা তাকে দেখাল। সে-ও পরীক্ষা করল। তারপর মাথা ঝাঁকাল। প্রথম লোকটা ফিরে এসে রানার হাতে ধরিয়ে দিল সেটা, বালতির ভেতর চোখ রেখে বলল, ‘ঠিক আছে। ও তোমাকে ভেতরে নিয়ে যাবে।’
‘ধন্যবাদ,’ প্রকাশ্যেই স্বস্তির হাঁপ ছেড়ে বলল রানা।
এগোচ্ছে ও, দ্বিতীয় লোকটা ডেস্ক ছেড়ে ওঠার সময় চোখের পলক ফেলছে না। দরজা খোলার সময়ও তাকিয়ে থাকল। তার পিছু নিয়ে পেন্টহাউসের ভেতর ঢুকল রানা।
এ অনুপ্রবেশ যেন দুর্ভেদ্য দুর্গে। শিরশিরে একটা অনুভূতি হচ্ছে, কারণ জানে আসল পরিচয় জেনে ফেললে কি করা হবে ওকে নিয়ে। মারকাস কোন স্পাইকে অবশ্যই জীবিত ফেরত যেতে দেবে না।
প্রশস্ত একটা লিভিংরূমে ঢুকেছে ওরা। আসবাবপত্রের বিলাসবহুল আয়োজন। দুই স্তরে ভাগ করা মেঝেতে দামী কার্পেট, সিলিঙে প্রাচীন গ্রীসের বিচিত্র সব রঙিন দৃশ্য আঁকা। কামরার দূরপ্রান্তের পুরোটা দেয়াল কাঁচের, বাইরে দেখা যাচ্ছে গোটা শহর। একপাশে ছোট্ট একটা স−াইডিং ডোর, ঝুল-বারান্দায় বেরুনো যায়। ওখানেই নিজের কাজ শুরু করবে রানা। ঘাড় ঘুরিয়ে কামরাটার মূল্যবান ফার্নিচারগুলো দেখল ও, বেশিরভাগই অ্যান্টিকস। পালিশ করা টেবিলে প্রাচীন মৃৎশিল্প শোভা পাচ্ছে।
ডান দিকে আংশিক খোলা দরজা দিয়ে আরেকটা কামরায় ফেলা কয়েকটা ডেস্ক ও ক্যাবিনেট দেখতে পাচ্ছে রানা, ধরে নেয়া যায় মারকাস ওটাকে অফিস বানিয়েছে। ওর বাঁ দিকে করিডর, দু’পাশে দরজা-বেডরূম আর লিভিং কোয়ার্টার। ‘প্রথমে বড় জানালাগুলো ধরি,’ বলল ও।
‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকো,’ আদেশের সুরে বলল লোকটা।
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘থাকলাম।’
অফিসে ঢুকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে আড়ালে চলে গেল লোকটা। রানা খানিকটা ডান দিকে সরল, অফিসের ভেতরটা যাতে আরও ভালভাবে দেখতে পায়। গাঢ় রঙের সুট পরা কয়েকজন লোক চলাফেরা করছে ভেতরে, কেউ একজন কথা বলছে টেলিফোনে। অফিস কামরাটা বোধহয় কমিউনিকেশন সেন্টার। রানা যে কামরায় অপেক্ষা করছে, করিডর থেকে সেখানে দু’জন লোক ঢুকল। রানাকে ভাল করে দেখল তারা, তারপর অফিসের দিকে পা বাড়াল। মারকাসের লোকজন এখানে কম নয়। শুধু অফিসেই তো আট-দশজনকে দেখতে পাচ্ছে রানা। সন্দেহ নেই, প্রায় সবাই তারা সশস্ত্র।
রানার গাইড লোকটা ফিরে এল, তারপর বেরিয়ে গেল করিডরে। অফিস থেকে এক লোক তার পিছু নিয়ে এসেছে। লোকটার সব কিছু লম্বাটে-চুল, হাতের নখ, শার্ট। হিপ- হোলস্টারে ভরা পিস্তলটা প্রকাশ্যেই বহন করছে সে। ‘কতক্ষণ লাগবে তোমার?’ রানাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল। সোনালি চুল আর বাচনভঙ্গি বলে দিল লোকটা আমেরিকান।
ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জবাব দিল রানা, ‘কতক্ষণ লাগবে? হয়তো আধঘণ্টা। হয়তো একঘণ্টা। নির্ভর করে জানালায় কি পরিমাণ ময়লা জমেছে তার ওপর।’ লোকটাকে রানার চেনা-চেনা লাগছে। রানা এজেন্সির কমপিউটরে এর ছবি আছে, কিন্তু নামটা মনে পড়ছে না।
‘মিস্টার গিলি ক্ল্যাসিকস মনে করতে পারছেন না তোমাদেরকে ডেকেছেন কিনা,’ পিরিচ আকৃতির নীল লেন্সের ভেতর দিয়ে রানাকে দেখছে মার্কিন তরুণ।
হঠাৎ নামটা মনে পড়ল রানার, মাঙ্কি। আকার্ডিয়া মারকাসের পুরানো শিস্য মাঙ্কি। নিউ ইয়র্ক পুলিস তার নামে প্রথম অভিযোগ এনেছিল-দুই তরুণীর কোমরে টেপ দিয়ে বিস্ফোরক আটকে দেয় সে, তারপর রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটায়।
‘না? ডাকেনি?’ পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে চোখ বুলাল রানা। ‘কিন্তু আমাকে তো ওরা বলল মিস্টার সালজুনাসের ওখানে।’
এই সময় আরেক লোক কামরায় ঢুকে মাঙ্কির পাশে দাঁড়াল। লোকটা সামান্য খাটো, নিঃসন্দেহে গ্রীক। সালজুনাসের মুখ থেকে চেহারার যে বর্ণনা পেয়েছে রানা, সন্দেহ নেই এই লোকটাই গিলি ক্ল্যাসিকসের ডুপি−কেট।
‘আমি কোন উইন্ডো ওয়াশারকে ডেকেছি বলে মনে করতে পারছি না,’ ইংরেজিতে বলল সে, মাঙ্কির যাতে বুঝতে সুবিধে হয়। ‘শেষবার তুমি কবে এখানে এসেছ?’
‘রেকর্ড না দেখে বলা মুশকিল,’ বলল রানা, ইচ্ছা করেই চেহারায় নার্ভাস ভাব ফোটাল। ‘সব কি আর মনে থাকে?’ মাঙ্কি রানার দিকে এক পা এগোল। ‘তবে আগে তুমি এখানে এসেছ?’
ইতস্তত করল রানা। ‘হ্যাঁ, আগে।’
পিস্তলটা বের করে রানার মুখে তাক করল মাঙ্কি। ‘তাহলে বলো কিচেনটা দেখতে কেমন?’
রানার বাম বাহুর ভেতর দিকে ঘামের একটা ধারা গড়াতে শুরু করল। পেন্টহাউসের কোথায় কি আছে, কেমন দেখতে, সব কিছুরই বিস্তারিত বিবরণ সালজুনাসের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে ও, কিন্তু কাজের সময় মনে পড়ছে না। ‘সিঙ্ক আর কাবার্ড আছে, আকারে বেশ বড়। কিন্তু এ আপনারা কি শুরু করলেন বলুন তো?’
‘দূর, বাদ দাও তো!’ নকল ক্ল্যাসিকস বিরক্ত বোধ করছে।
‘ওর কাজ করে ওকে ফিরে যেতে দাও।’
মাঙ্কি তার কথা কানে তুলল না। ‘কিচেনে ক’টা জানালা?’ রানাকে জিজ্ঞেস করল সে।
রানা ভাবছে, এখন যদি মাঙ্কির পায়ের কাছে মেঝেতে ঢলে পড়ে ও, ছুরিটা কত দ্রুত বের করতে পারবে। তবে হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল পেন্টহাউসের কিচেন ভেতর দিকের একটা কামরা, করিডর সংলগড়ব-বাইরের দিকের দেয়াল সংলগড়ব নয়। ‘কি বলেন, কিচেনে আবার জানালা কোথায়!’ গলায় একটু ঝাঁঝ ফুটিয়ে বলল ও।
মাঙ্কির আঙুল ট্রিগারে চেপে বসেছিল। ধীরে ধীরে আঙুলের গিঁট থেকে সাদা ভাবটুকু মিলিয়ে গেল, পিস্তল ধরা হাতটা শরীরের পাশে নামিয়ে নিল সে। আস্তিন গুটানো এক লোক এলো অফিস থেকে।
‘প্রাগমাটোস সার্ভিস থেকে বলছে তারা একজন লোককে পাঠিয়েছে,’ মাঙ্কিকে রিপোর্ট করল সে।
নিজের চেহারায় স্বস্তির ভাবটুকু রানা ফুটতে দিল না। প্রয়োজনে ওকে সাহায্য করবে, এই শর্তে বেশ কিছু ড্র্যাকমা দিয়েছে ও প্রাগমাটোস কোম্পানির মেয়েটাকে, তবে কথা রাখবে কিনা ভেবে উদ্বিগড়ব ছিল।
মাঙ্কি তার অস্ত্র হোলস্টারে ভরে রাখল। ‘বেশ। ধোও শালার জানালা। তবে যত তাড়াতাড়ি পারো।’
‘জ্বী,’ বলল রানা। ‘দয়া করে মিস্টার সালজুনাসকে আমার সালাম দেবেন। কত বড় মানুষ, অথচ আমাকে দেখলেই উনি চিনতে পারেন। ভাগ্য ভাল হলে আজও নিশ্চয় দেখা হবে।’
মাঙ্কি ওর দিকে আগুনে চোখে তাকাল। ‘এই ব্যাটা, বকবক না করে কাজে হাত দে। কারও সঙ্গে দেখা-টেখা হবে না।’
‘জ্বী, ধন্যবাদ।’
বালতিতে পানি ভরে আনার জন্যে করিডর ধরে এগোবার অনুমতি পাওয়া গেল, এই সুযোগে দ্রুত একবার সু্্যইটটার লে- আউটে চোখ বুলিয়ে নিল রানা। বড় জানালায় কাজ শুরু করার পর ওকে একা রেখে যে যার কাজে চলে গেল সবাই। যা দেখতে এসেছিল তা ওর দেখা হয়ে গেছে, এবার চিন্তা করছে কিভাবে কাজে ফাঁকি দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাবে। এই সময় অফিস থেকে একদল লোক বেরিয়ে এল, রানার দিকে খেয়াল না দিয়ে মারকাসের কাজকর্ম নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করছে। রানা রয়েছে ঝুল-বারান্দায়, দরজাটা খোলা।
‘দুটো ক্যাম্পই এখন তৈরি,’ এক লোক বলল। ‘আমি আবার বলছি, মিস্টার মারকাসকে আমাদের জানানো উচিত যে মুভ করার এখনই সময়। তিন জেনারেলকে খতম করে এথেন্সে নিজেদের আর্মি আনতে পারলে প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী পালাতে দিশে পাবে না…’
আরেক লোক তাকে থামিয়ে দিয়ে ইঙ্গিতে রানাকে দেখাল। প্রথম লোকটা ঘুরে গিয়ে গলার স্বর নামিয়ে আবার তার কথা শুরু করল। এই সময় করিডর হয়ে আরও তিনজন লোক ঢুকল হলরূমে, সেই সঙ্গে রানার কপালে জুটল বিরাট একটা বোনাস। বাকি দু’জনকে দু’পাশে নিয়ে মাঝখানে খাড়া পিলার, ওই লোকটাই আকার্ডিয়া মারকাস। ছ’ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা, চওড়ায় প্রায় একটা দেয়াল। ফটোর সঙ্গে কাঠামো ও চেহারা পুরোটাই মেলাতে পারছে রানা-বুনো একটা ভাব চোখে-মুখে, বয়স ত্রিশ-বত্রিশ। বেশ ক্লান্ত লাগছে ওকে, হাতে একগাদা কাগজ-পত্র।
‘ঠিক আছে, মীটিংটা তোমরা সংক্ষেপ করো,’ হলরূমের বাকি লোকদের উদ্দেশে বলল সে। রানা লক্ষ করল, তাদের মধ্যে ইউসুফিস জিয়ানি অনুপস্থিত। এদের এই প্রতিষ্ঠানে তার সম্ভবত অত বেশি গুরুত্ব নেই। ‘সিডাক, মাইকোনোস-এর লেটেস্ট রিপোর্ট কি?’
ওখানে দাঁড়িয়ে জটলাটার দিকে তাকিয়ে আছে রানা, অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপারকে বাস্তবে ঘটতে দেখে বিস্ময় না মেনে পারছে না। আকার্ডিয়া মারকাসের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। অসম্ভবকে সম্ভব করতে চায় সে, গোটা ব্যাপারটা পরিচালনাও করছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।
‘…কমান্ডার এ-ও জানিয়েছেন যে গ্রাউন্ডওঅর্ক কমপ্লিট হয়ে গেছে, আর ট্রূপস…’
অকস্মাৎ মুখ তুলল মারকাস, এই প্রথম রানাকে দেখতে পেল। একজন কর্মচারীকে ইঙ্গিত করল সে, তারপর রানার দিকে কয়েক পা হেঁটে এল। থামল হঠাৎ, রাগে লাল হয়ে উঠল মুখ। ‘ওটা ওখানে কে?’ প্রায় হুংকার বেরিয়ে এলো গলা থেকে। ইঙ্গিত পেয়ে কর্মচারী লোকটা দ্রুত মারকাসের পাশে চলে এল। ‘কাকে যেন বলতে শুনলাম ওকে এখানে জানালা পরিষ্কার করতে পাঠানো হয়েছে।’
‘তুমি শুনলে? বিশ্বাস করার আগে যাচাই করলে না?’ দাঁতে দাঁত চাপল মারকাস। ঝুল-বারান্দায় রানার পাশে রাখা বালতিটা দেখল, দেখল ওর হাতে বুরুশ আর ভেজা ন্যাকড়া রয়েছে। ‘এই! এদিকে এসো!’
মারকাস যদি অতিমাত্রায় খুঁতখুঁতানির কারণে রানাকে বিদায় করে দিতে চায়, তার কথার ওপর কথা বলার কেউ নেই এখানে। শান্ত ভঙ্গিতে ঝুল-বারান্দা থেকে কামরায় চলে এলো রানা। ‘বলুন।’
রানার ওপর থেকে চোখ সরাল মারকাস। ‘কে ওকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে?’
মাঙ্কি এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, ত্রস্ত পায়ে কামরার মাঝখানে চলে এল। ‘ওর ব্যাপারটা ঠিক আছে। আমরা চেক করে দেখেছি।’
ঘাড় ফিরিয়ে অস্ত্রধারী মাঙ্কির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে ঝাড়া দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল মারকাস। নিস্তব্ধতা হয়ে উঠল বিস্ফোরণোন্মুখ। মারকাস যখন কথা বলল, এত নিচু গলা, কোনরকমে শুনতে পেল রানা, ‘আমার চারপাশে এরা কি সবাই গর্দভ?’
তার দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকাল মাঙ্কি, তারপর রানার দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিক আছে, আজকের মত জানালা সাফ করার কাজ শেষ হয়েছে।’
‘কিন্তু আমি তো শুরুই করলাম এইমাত্র!’ প্রতিবাদ করল রানা। ‘মিস্টার সালজুনাস সব সময় চান…’
‘এই ব্যাটা, গেলি!’ চেঁচিয়ে উঠল মাঙ্কি।
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘আমার বালতি…’
‘ওটার কথা ভুলে যা।’
শান্তভাবে মারকাসকে পাশ কাটাল রানা, যতক্ষণ দেখা গেল ওর দিকে তাকিয়ে থাকল সে। এলিভেটরে চড়ে নিচে নামার সময় খাঁচাটা সাউন্ডপ্রূফ কিনা, কমিউনিকেশন লাইন কোন দিক দিয়ে গেছে, তালার ধরন ইত্যাদি খুঁটিয়ে লক্ষ করল রানা। ভাবল, ও কি মারকাসের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে? সে যাই হোক, পেন্টহাউসে ঢোকার পরে অনেক দিক থেকে লাভ হয়েছে ওর। যাকে খুন করতে হবে, আগে থেকে তাকে দেখে রাখা হলো। দুর্ভেদ্য দুর্গটার নকশাও স্বচক্ষে দেখা হলো।
হোটেলের স্যুইটে ফিরে রানা দেখল সালজুনাস নিজের কামরায় পায়চারি করছেন-খুব উত্তেজিত, অস্থির। তারানা এক কোণে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। রানা ভেতরে ঢুকতেই কাগজটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল সে। হেডিংটা পড়ল রানা।
কর্মকর্তার অভিযোগ: জেনারেল সেরাফ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশ বিক্রির ষড়যন্ত্র করছেন।
সালজুনাস বললেন, ‘ক্যাবিনেট সচিব অ্যাকিলিস কারডিক্সকে খুব কম লোকই চেনে। সে বলছে, তার কাছে নাকি প্রমাণ আছে গ্রীসের সমস্ত খনি বিনা টেন্ডারে দশটা বিদেশী কোম্পানিকে নিরানব্বুই বছরের জন্যে লীজ দেয়ার সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে সরকার, ঘুষ দিয়ে কর্নেল ডোনাল্ডিস সেরাফের সমর্থনও আদায় করা হয়েছে। আরও বলছে, বাধা দেয়ার কারণে মন্ত্রীসভা ও সামরিক বাহিনীর অন্যান্য অফিসারদের প্রাণ নাকি বিপনড়ব হয়ে পড়েছে।’
খবরটায় দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে রানা বলল, ‘তাহলে দেখা যাচ্ছে জেনারেল ভালটোনার অনুমান সত্যি। জেনারেল সেরাফের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে মারকাস, মীটিঙে তিনি আর তাঁর দুই সঙ্গী খুন হলে লোকে যাতে হিসাব মিলিয়ে ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়।’
‘এবং লক্ষ করুন,’ ভারী গলায় বললেন সালজুনাস, ‘কেমন সতর্কতার সঙ্গে আমার নামটা ওরা এর সঙ্গে জড়ায়নি।’
‘অভিযোগটা তদন্ত করে দেখছে পুলিস,’ বলল তারানা। ‘কিন্তু যখন জানা যাবে যে অভিযোগের পিছনে কোন ভিত্তি ছিল না, তিন জেনারেলের একজনও তখন বেঁচে থাকবেন না।’
‘থাকবেন, জেনারেল ভালটোনা যদি তাঁর কাজে সফল হন,’ বলল রানা। ‘তিনি কি ফোন করেছেন?’
‘এখনও করেননি,’ জবাব দিলেন সালজুনাস। ‘ভাল কথা, উত্তেজনার মধ্যে আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। আপনি কি আমার ওখানে ঢুকতে পেরেছেন?’
মাথা ঝাঁকাল রানা, তারপর সংক্ষেপে জানাল কি কি দেখেছে ও শুনেছে।
‘তোমার কাছে যদি একটা পিস্তল থাকত, আর সেই পিস্তলের সব ক’টা গুলি যদি মারকাসের বুকে ঢুকিয়ে দিয়ে আসতে পারতে, আমার চেয়ে সুখী কেউ হত না।’ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল তারানা।
হেসে ফেলল রানা। ‘সঙ্গে পিস্তল থাকলে ভেতরে আমি ঢুকতেই পারতাম না। তাকে মারার জন্যে আবার আমাদেরকে ওখানে ঢুকতে হবে। বাকারা বেঁচে থাকলে খুশি হতাম।’
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস চাপল তারানা। ‘সত্যিই ছেলেটার হাত খুব ভাল ছিল।’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘তবে এথেন্সে আমার এজেন্সির শাখা আছে, চাইলেই প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়া যাবে।’ জাহাজব ্যবসায়ী ভদ্রলোকের দিকে ফিরল ও। ‘ক্যাম্প কমান্ডারদের সঙ্গে কি আপনি যোগাযোগ করতে পেরেছেন?’
‘দু’জনের সঙ্গেই কথা হয়েছে,’ বললেন সালজুনাস। ‘আপনি যা বলতে বলেছিলেন তাই বলেছি। তাঁরা কথা দিয়েছেন, সরাসরি আমার মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত আর কিছু করবেন না। আমি তাঁদেরকে পেন্টহাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করে দিয়েছি। বলেছি, আমার সেক্রেটারী খুন হয়ে গেছে, তার জায়গায় একই রকম দেখতে অন্য এক লোককে বসানো হয়েছে।’
‘দারুণ,’ বলল রানা, তবে বাধা পেল টেলিফোনটা বেজে ওঠায়।
রিসিভার তুলল তারানা, অপরপ্রান্তে কে শোনার পর সালজুনাসের হাতে ধরিয়ে দিল সেটা।
সালজুনাস এদিক থেকে ছোট-ছোট অল্প কয়েকটা বাক্য উচ্চারণ করলেন। ‘হ্যাঁ, অ্যালেক্সিস। হ্যাঁ। ও, হ্যাঁ। বলে যাও। আচ্ছা। বেশ, বেশ। ভাল।’ কথা শেষ হতে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন তিনি। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন।
‘কিছু বলুন!’ তারানা ধৈর্য ধরতে পারছে না।
‘আমার ভগড়বীপতি জেনারেল ভালটোনা পেন্টহাউসে ফোন করেছিলেন, কিন্তু ইউসুফিস জিয়ানি ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে আজ বা কাল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে, কিন্তু জিয়ানি গোঁ ছাড়েনি। জেনারেলদের প্রসঙ্গ নিয়ে টেলিফোনে আলাপ করতেও রাজি হয়নি সে।’
‘কিন্তু আপনি হাসছিলেন তাঁর কোন্ কথায়?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘জেনারেল কাউরিসের কথা মনে আছে? প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা কমিটিতে জেনারেল পয়টারাসের জায়গায় যাকে বসানো হয়? মারকাসের নিজের লোক?’
‘আছে।’ মাথা ঝাঁকাল তারানা।
‘জেনারেল ভালটোনা তার কাছে গিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা হয়, মীটিংটার আয়োজন এই কাউরিসই করবে। ধারণাটা পুরোপুরি ঠিক। জেনারেল কাউরিস সব জানে, প্ল্যানটা তার মুখস্থ। তিন সরকার সমর্থক জেনারেলের নিন্দা করে লোকটার বিশ্বাস অর্জন করেন ভানটোনা। মীটিঙের জায়গা ও সময় বলে দিয়েছে কাউরিস। সেরাফ, ভিক্টর পাপাভক্সি ও গেইব্রিয়াল সেনটো এরইমধ্যে আমার সঙ্গে মীটিঙে বসতে রাজি হয়েছেন সেরাফের বাড়িতে। শহরের উত্তর শহরতলিতে তার একটা জমিদারি আছে। বলাই বাহুল্য যে হ্যারি কাউরিসও ওই মীটিঙে থাকবে।’
‘কখন?’ জানতে চাইল রানা।
‘আজ বিকেলে,’ জবাব দিলেন সালজুনাস। ‘আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।’
‘জেনারেলদের কিভাবে মারা হবে?’ রানার চোয়ালের হাড় উঁচু হলো।
ভারী কাঁধ দুটো ঝাঁকালেন শিপিং ম্যাগনেট। ‘জেনারেল অ্যালেক্সিস তা জানেন না শুনে তথ্যটা দিতে রাজি হয়নি কাউরিস। উপায় নেই, আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে…’
‘এরকম পরিস্থিতিতে অপেক্ষা করাটা সাংঘাতিক বিপজ্জনক,’ বলল রানা, কব্জির রোলেক্সে চোখ বুলাল। ‘তারানা, একটা ট্যাক্সি ডাকো। আমরা জেনারেল সেরাফের ওখানে যাচ্ছি। মিস্টার সালজুনাস, আপনাকে আপাতত নেপথ্যেই থাকতে হবে। কেউ চিনে ফেললেই আপনার বিপদ।’
‘আপনি যা বলেন, মিস্টার রানা।’
তারানা ফোনে ট্যাক্সি ডাকছে, এই ফাঁকে পিস্তলটা লোড করার আগে মেকানিজম চেক করল রানা। চেহারায় উদ্বেগ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সালজুনাস।
রিসিভার নামিয়ে রেখে তারানা জানাল, ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সি আসছে।’
৮
‘আমি কিন্তু ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না,’ বিশাল বাড়ির সুসজ্জিত হলরূমে ওদেরকে নিয়ে বসার পর বললেন জেনারেল ডোনাল্ডিস সেরাফ। ‘কাউরিস জানিয়েছে এটা একটা প্রাইভেট মীটিং হতে যাচ্ছে, জেনারেল ভালটোনা।’
আসার পথে জেনারেল ভালটোনাকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়েছে রানা, জানে তা না হলে জেনারেল সেরাফকে ষড়যন্ত্রটা বিশ্বাস করানো যাবে না। বিদেশী ও অচেনা দুই তরুণ-তরুণীর কথা তিনি শুনতেই বা রাজি হবেন কেন?
জেনারেল সেরাফ অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষ, পঞ্চাশ বছর বয়সেও তরতাজা তরুণ। পরনে ইউনিফর্ম, রানার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছেন।
‘বাকি সবাই কি ইতিমধ্যে পৌঁছেছে, জেনারেল সেরাফ?’ জেনারেল ভালটোনা জিজ্ঞেস করলেন।
‘আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বেন তাঁরা।’
‘গুড। আপনি শুধু খানিকটা সময় দিন আমাদেরকে,’ বললেন ভালটোনা।
উত্তরে কিছু না বলে নিঃশব্দে ওদের তিনজনকে খুঁটিয়ে দেখছেন জেনারেল সেরাফ। ‘ঠিক আছে,’ অবশেষে নিস্তব্ধতা ভেঙে বললেন তিনি। ‘চলুন স্টাডিতে গিয়ে বসা যাক, প্লীজ।’
এক মিনিট পর প্রায় অন্ধকার একটা কামরায় ঢুকল ওরা। একজন আরদালি একদিকের পর্দা সরিয়ে দিতে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল স্টাডি। জেনারেল সেরাফ ভালটোনাকে ব্র্যান্ডি অফার করলেন, রানা ও তারানার জন্যে কফি এল।
‘জেনারেল,’ ভালটোনা বললেন, ‘আমি চাই মিস্টার রানা ও মিস তারানা আপনার বাড়িটা এখুনি একবার সার্চ করে দেখবেন। এখুনি মানে মীটিং শুরুর আগে…’
‘কি অদ্ভুত অনুরোধ,’ বাধা দিলেন সেরাফ। ‘কেন?’
‘যা বলছি, প্লীজ, বিশ্বাস করুন। এই মীটিং একটা ফাঁদ। সময়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যাবে, এখন শুধু এটুকু জেনে রাখুন যে ইদানীং আপনার বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে তার উৎস ডাফু সালজুনাস নন। আকার্ডিয়া মারকাস নামে এক গ্রীকআে মরিকান ড্রাগ-সম্রাট সালজুনাসের নাম ব্যবহার করে সরকার ও সরকার সমর্থক সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। আপনি, ভিক্টর পাপাভক্সি ও গেইব্রিয়াল সেনটো আজ বিকেলে এই বাড়িতে খুন হবেন।’
শীতল ও কঠিন হয়ে উঠল অবয়ব, ভারী গলায় জেনারেল সেরাফ শুধু বললেন, ‘আই সী।’
‘আমার ধারণা, হ্যারি কাউরিসের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগবে না,’ বললেন ভালটোনা। ‘আর সালজুনাস এখানে উপস্থিতই থাকবেন না, কারণ এ-সব কিছুর সঙ্গে কোনভাবেই তিনি জড়িত নন।’
দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন জেনারেল সেরাফ। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা দু’জন?’
‘ওরা সাহায্য করতে এসেছেন,’ এর বেশি কিছু বললেন না ভালটোনা।
‘কি করে বুঝব আপনারাই আমাকে ফাঁদে ফেলতে আসেননি?’ জানতে চাইলেন সেরাফ।
ভালটোনা এই প্রথম গম্ভীর একটু হাসলেন। ‘জেনারেল সেরাফ,’ বললেন তিনি, ‘আপনাকে ফাঁদে ফেলে লাভ কি? লাভ খুন করলে। আর আমি যদি আপনাকে খুন করতে এসে থাকি, এখনও আপনি বেঁচে আছেন কি করে বা কেন?’
জেনারেল সেরাফ রানার চোখে তাকিয়ে যেন মাথার ভেতরটা দেখে নিচ্ছেন। ‘ঠিক আছে। আপনারা বাড়িটা সার্চ করতে পারেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, যে এমন কেউ ভেতরে ঢোকেনি যে আমার বা আমার বন্ধুদের কোন রকম ক্ষতি করতে চাইতে পারে।’
‘এ বাড়িতে কি বেইযমেন্ট আছে, জেনারেল?’ জানতে চাইল রানা।
‘আছে।’
‘আমরা ওখান থেকে শুরু করব,’ তারানাকে বলল রানা।
‘আপনি মিস্টার ভালটোনার সঙ্গে আলাপ করুন, জেনারেল। ওরা সবাই এসে পৌঁছানোর আগে কতটা সময় পাচ্ছি আমরা?’
‘আমার হিসাবে মিনিট পনেরো।’
‘যথেষ্ট সময়।’ তারানার দিকে ফিরল রানা। ‘চলো শুরু করা যাক।’
বড়সড় বেইযমেন্টটা দ্রুত সার্চ করে বোমা বা বিস্ফোরক কিছুই পেল না ওরা। বাড়ির বাকি অংশ চেক করেও কিছু পাওয়া গেল না। মীটিংটা বসবে স্টাডিতে, সেটায় তল্লাশী চালানো হলো সবশেষে। কোন বিস্ফোরক নেই, তবে একজোড়া ইলেকট্রনিক ছারপোকা পাওয়া গেল।
‘অবিশ্বাস্য,’ ডিভাইস দুটো দেখাতে রানাকে বললেন সেরাফ। ‘জানি না কখন এ কাজ করা হলো।’
‘ওরা প্রফেশন্যাল, জেনারেল,’ মন্তব্য করল রানা।
‘আর কিন্তু সময় নেই,’ তাগাদার সুরে বলল তারানা। ‘ওঁরা কি একসঙ্গে আসবেন?’
‘আজ সকালে ওরা যেহেতু উপদেষ্টা কমিটির হেডকোয়ার্টারে ছিলেন, একসঙ্গেও বেরুতে পারেন,’ বললেন জেনারেল সেরাফ। ‘এমনকি সঙ্গে কাউরিসও থাকতে পারে, যদিও ওঁরা কেউ তাকে একেবারেই পছন্দ করে না। আসলে এটা এক ধরনের সালিসি বৈঠক তো।’
দেখা গেল সেরাফের অনুমানই ঠিক। দশ মিনিট পর কালো একটা লিমাজিন পৌঁছাল জমিদারবাড়িতে, তিন জেনারেলই তাতে আছেন। ভিক্টর পাপাভক্সি ও গেইব্রিয়াল সেনটোর বয়স হয়েছে, পাক ধরেছে চুলে। কাউরিসের বয়স হবে চল্লিশ। তার চোখ-মুখ যেন কথা বলছে। অসম্ভব আঁটসাঁট ইউনিফর্ম পরেছে, অন্তত তিন সাইজ ছোট। সবার উদ্দেশে হাত নাড়ল সে, গলা চড়িয়ে অকারণে হাসল, যেচে পড়ে আশ্বাস দিয়ে বলছে সমস্যার একটা সুরাহা অবশ্যই করা হবে, এবং রানা তার ডান হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিতে বিস্ময়ে একেবারে বোবা বনে গেল।
তবে তা মাত্র দুই কি তিন সেকেন্ডের জন্যে। হাসিটা ফিরল না, তার বদলে ক্রোধ ফুটল মুখে। চোখে দেখা গেল বরফ শীতল কাঠিন্য। ‘কি করছ তুমি?’ চেঁচিয়ে উঠল সে।
জেনারেল ভালটোনা আর জেনারেল সেরাফ মৌনব্রত অবলম্বন করলেন। কাউরিসকে ধরে গায়ের জোরে ঘোরাল, তারপর হাত দুটো পিছনে এনে এক করল রানা।
‘এর মানে কি?’ গর্জে উঠল কাউরিস, রানা ও জেনারেলদের দিকে পালা করে তাকাচ্ছে। মৌনব্রত ভেঙে সেরাফ ঠাণ্ডা সুরে বললেন, ‘মিস্টার রানা বলছেন, এ-বাড়িতে আপনি আমাদেরকে খুন করতে এসেছেন।’
বাকি দুই নবাগত জেনারেল বিস্মিত ও শঙ্কিত দৃষ্টি বিনিময় করলেন। ‘কথাটা কি সত্যি, ডোনাল্ডিস?’ জানতে চাইলেন সেনটো।
‘এ সত্যি নয়! এ বানানো!’ কাউরিস চিৎকার করছে। ‘আমি জানতে চাই, কে এই লোক?’ জেনারেল সেরাফের দিকে ফিরল সে, সাংকেতিক ভাষায় হড়বড় করে কি সব বলছে আর বারবার তাকাচ্ছে রানার দিকে।
সে থামতে জেনারেল সেরাফ অবশেষে বললেন, ‘আমরা দেখব, কাউরিস।’
কাউরিসের বাহু ধরে জোরে টান দিল রানা, বলল, ‘বেশ কিছুটা সময় স্টাডিতে থাকতে হবে তোমাকে। ওখানে হয়তো সত্যি কোন সারপ্রাইজ আছে, আমাদের চোখে ধরা পড়েনি।’ মাথা তুলে জেনারেল সেরাফের দিকে তাকাল ও। ‘তারানা বাদে আপনারা সবাই হলরূমের পাশের কামরায় চলে যান, পি−জ। আমি না বলা পর্যন্ত ওখান থেকে কেউ বেরুবেন না।’
‘বেশ,’ বললেন সেরাফ।
জেনারেলরা পাশের রূমে ঢুকে পড়লেন। রানা ও তারানা স্টাডিতে নিয়ে এসে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধল কাউরিসকে, তারপর মুখে টেপ লাগিয়ে দিল। তার কোমর থেকে পিস্তলটা টেনে নিয়ে বেল্টে গুঁজল রানা, তারানাকে নিয়ে আবার হলরূম হয়ে অ্যান্টিরূমে বেরিয়ে এল।
‘এখন অপেক্ষা?’ জিজ্ঞেস করল তারানা।
তার দিকে তাকাল রানা। চুল খোঁপা করা হয়েছে, বেল-বটম প্যান্টস সুটে মানিয়েওছে ভাল। পার্স থেকে বেলজিয়ান অস্ত্রটা বের করে অ্যামুনিশন চেক করছে সে। ‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘আমরা অপেক্ষা করব।’ হেঁটে এসে সদর দরজাটা খুলে বাইরে তাকাল ও। দীর্ঘ ড্রাইভওয়ের দু’পাশের লম্বা পপলার গাছের সারি আকাশ ছুঁয়েছে। পথটা প্রায় এক মাইল এগিয়ে প্রধান রাস্তায় মিশেছে, জমিদারবাড়ির কাছাকাছি ওই একটাই রাস্তা। একসঙ্গে কয়েকজনকে হত্যা করার জন্যে আদর্শ একটা জায়গা। প্রশ্ন হলো, মারকাসের বিকৃত মস্তিষ্ক ঠিক কি পদ্ধতির কথা ভেবেছে? কাউরিসকে ইন্টারোগেট করা যায়, কিন্তু সময় নেই। তাছাড়া লোকটার চেহারা দেখে বোঝা যায়, মারকাসকে সাংঘাতিক ভয় পায় সে।
পিছনে এসে রানার পিঠে শরীরটা ঠেকাল তারানা।
‘নিজেদেরকে আমরা খুব কমই সময় দিতে পারলাম, রানা,’ নিচু গলায় বলল সে।
‘জানি,’ বলল রানা। ‘তুমি চাইলে আর আমি ছুটি পেলে মেক্সিকোয় কিংবা মালদ্বীপে বেড়াতে যেতে পারি।’
‘আমি এখনই তোমাকে বুক করে রাখলাম…’
‘চুপ!’ সাবধান করল রানা। এঞ্জিনের আওয়াজ পাচ্ছে ও। দূরের বাঁকে বেরিয়ে এলো কালো একটা সেডান, তীরেবেগে ছুটে আসছে। গাড়িটার মাথায় আলোর আয়োজন দেখা যাচ্ছে।
‘পুলিস!’ বলল তারানা।
‘হ্যাঁ,’ ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ল রানা। ‘তোমার কি ধারণা, মারকাস একজন পুলিস কর্মকর্তাকে কিনে নিয়েছে?’
‘অসম্ভব কি।’
‘তবে পুলিসের সঙ্গে নিজের দু’একজন লোককেও নিশ্চয় পাঠিয়েছে মারকাস।’
এক ছুটে জেনারেলদের কাছে ফিরে এলো ওরা। ‘পুলিসের একটা গাড়ি আসছে,’ দ্রুত তাঁদেরকে জানাল রানা। ‘এটা মারকাসের একটা চাল হতে পারে। আপনারা সবাই সশস্ত্র তো?’
জেনারেল ভালটোনা বাদে সবাই মাথা ঝাঁকালেন। কাউরিসের পিস্তলটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিল রানা। ‘যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকুন, ভাব দেখান এখানে বসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছেন। তবে চোখের আড়ালে অস্ত্র তৈরি রাখবেন। তারানা, তুমি ওই দেয়াল-আলমিরার ভেতর ঢুকে পড়ো।’ সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে পা বাড়াল তারানা।
‘আমি এই ফ্রেঞ্চ ডোর-এর ঠিক বাইরে থাকছি,’ আবার বলল রানা। ‘ওরা সবাই কামরায় ঢোকার পর আমরা অস্ত্র বের করে সারেন্ডার করতে বলব।’ এক মুহূর্ত বিরতি নিল ও। ‘এখন যদি কেউ আপনারা এখানে থাকতে না চান, পিছনের দরজা দিয়ে চলে যেতে পারেন।’
অফিসারদের চেহারা থমথম করছে। কেউ তাঁর চেয়ার ছেড়ে লড়লেন না।
‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘আমরা চেষ্টা করব যাতে গোলাগুলি না হয়। তবে আমার ইঙ্গিত পেলে গুলি করতে ইতস্তত করবেন না।’
ফ্রেঞ্চ ডোর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রানা, দড়াম করে সদর দরজা খোলার আওয়াজ ভেসে এল। একজন আরদালি পুলিসকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল, কড়া ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়া হলো তাকে। তালাবদ্ধ স্টাডি রূমের দরজায় ঘুসি ও লাথি মারার আওয়াজ পেল রানা, ওখানে মুখে টেপ লাগিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে হ্যারি কাউরিসকে। তারপর আবার আরদালির গলা ভেসে এল। তার সঙ্গে কথা বলছে কয়েকজন লোক। এক মুহূর্ত পরই তাদেরকে পরিষ্কার দেখতে পেল রানা। ঝড়ের বেগে কামরাটায় ঢুকল তারা। সব মিলিয়ে ছ’জন-পাঁচজনের পরনে ইউনিফর্ম, একজন সিভিল ড্রেসে। উর্দি পরা সবার বেল্টে পিস্তল আছে।
‘এ-সবের মানে কি?’ জেনারেল ডোনাল্ডিস সেরাফ প্রশ্ন করলেন; দাঁড়াচ্ছেন ঠিকই, তবে হাতের অস্ত্র পিছনে লুকিয়ে রেখেছেন।
সাদা পোশাক সামনে বাড়ল, ইউনিফর্ম পরা একজন লেফটেন্যান্ট তার পাশে থাকল। সাদা পোশাক মারকাসের পোষা লোক, তাকে রানা পেন্টহাউসে দেখেছে। লেফটেন্যান্ট সম্ভবত মারকাসের কোন পুলিস সদস্য। ব্যাপারটায় বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে হলে আসল পুলিস দরকার। সাজানো ঘটনা, বিশেষ করে সেজন্যেই কোনও খুঁত রাখা যাবে না-অন্তত প্রেসকে ঠিকমত গেলাতে হবে।
‘আমরা আপনাকে এখানে আশা করিনি, জেনারেল ভালটোনা,’ লেফটেন্যান্ট বলল। কামরার চারদিকে তাকাল সে, সম্ভবত জেনারেল কাউরিসের খোঁজে। ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে এখানে আপনারা কয়েকটা বিদেশী কোম্পানির পাঠানো একজন প্রতিনিধির সঙ্গে দেশের সমস্ত খনিজ সম্পদ বিক্রি করার ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত করতে বসেছেন।’ মুখে যাই বলুক, অত্যন্ত নার্ভাস দেখাচ্ছে তাকে। ‘সংক্ষেপে, কি পরিমাণ ঘুষ পেলে সরকারকে সমর্থন করবেন, তারই আলোচনা চলছে এখানে।’
‘এ সম্ভব নয়,’ বললেন জেনারেল সেরাফ।
‘আপনারা সবাই বেঈমান,’ চিৎকার করে বলল লেফটেন্যান্ট।
‘আর বেঈমানদের একটাই শাস্তি-মৃত্যুদণ্ড।’ দরজার আড়াল থেকে তাকে পিস্তল বের করতে দেখছে রানা।
মারকাসের পোষা লোকটার ঠোঁটে টান টান হাসি, যেন আর টেনেও রাবার বড় করা যাচ্ছে না। ‘এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা হবে এখানেই,’ ইংরেজিতে বলল সে, ‘যখন আপনারা গ্রেফতার হতে বাধা দেবেন।’
‘কই, না! আমরা তো কেউ গ্রেফতার হতে বাধা দিচ্ছি না,’ তরুণ লেফটেন্যান্টকে বললেন জেনারেল সেরাফ।
‘বাধা দিচ্ছেন না?’ মারকাসের গুণ্ডা হাসল। ‘তাতে কি? বাধা না দিলেও পুলিসের রিপোর্টে লেখা হবে বাধা দিয়েছেন। রেডিওটিভিে ত দেশের লোক শুনবেও তাই, গ্রেফতার এড়াতে বাধা দেয়ায় পুলিসের গুলি খেয়ে মারা গেছেন আপনারা।’
লেফটেন্যান্ট তার পিস্তল জেনারেল সেরাফের দিকে তাক করল। রানা ধারণা করল, আর এক মুহূর্তের মধ্যে তার সংকেত পেয়ে বাকি পুলিস অস্ত্র বের করবে। মারকাসের প্রতিনিধি জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে লেফটেন্যান্টের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল। নিজের লোকদের দিকে ঘুরল লেফটেন্যান্ট। দ্রুত চওড়া দরজার মাঝখানে এসে দাঁড়াল রানা, হাতের ওয়ালথারটা সোজা লেফটেন্যান্টের বুকে তাক করা।
‘ফ্রিজ!’ কঠিন নিরেট নিস্তব্ধতা যেন ফাটিয়ে দিল একটি মাত্র তীক্ষ্ন শব্দ। তারপরই গুরুগম্ভীর আদেশ, ‘কেউ নড়বে না!’ রানাকে দেখে হতচকিত, বিহ্বল হয়ে পড়েছে লেফটেন্যান্ট।
মারকাসের লোকটা তার অস্ত্র এখনও ঠিকমত ধরতে পারেনি, আর পুলিসদের মধ্যে মাত্র দু’জন হোলস্টারের কাছাকাছি হাত নিয়ে যেতে পেরেছে। সবাই স্থির হয়ে আছে। সবগুলো চোখ রানার ওপর।
‘পিস্তল ফেলে দাও,’ লেফটেন্যান্টকে নির্দেশ দিল রানা। ‘আর তুমি, জ্যাকেটের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে হাতটা বের করো।’ রানার নির্দেশ কেউ মানল না। তারা হিসাব কষছে ওকে গুলি করলে কতটা মাসুল গুনতে হবে। তাদের বাঁ দিক থেকে দেয়াল- আলমারির দরজা খুলে গেল, হাতে বেলজিয়ান রিভলভার নিয়ে বাইরে বেরুল তারানা-সাদা পোশাকের মাথার দিকে তাক করা।
‘বোকামি কোরো না,’ কঠিন সুরে বলল সে। ‘ও যা বলছে শোনো।’
মারকাসের গুণ্ডা আর পুলিস লেফটেন্যান্ট তারানার দিকে তাকিয়ে আছে, রাগ ও হতাশা প্রায় পাল্লা দিয়ে দখল করে নিচ্ছে দু’জনের চেহারা। তাদের দিকে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রানা, বোঝার চেষ্টা করছে কি করতে চায় তারা। এই সময় ঘরের ভেতর যেন নরক ভেঙে পড়ল।
হাতের অস্ত্র ফেলল না, তার বদলে রানার বুকে তাক করল, লেফটেন্যান্টের ট্রিগারে জড়ানো আঙুলটা টান-টান শক্ত হয়ে উঠছে। অকস্মাৎ ট্রিগার টেনে দিতে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে মেঝেতে ঢলে পড়তে শুরু করল রানা। তার হাতে কামানের মত গর্জে উঠল পিস্তলটা, সেই সঙ্গে তীব্র জ্বালা ও প্রচণ্ড গরম ছ্যাঁকা খাওয়ার অনুভূতি হলো রানার বাম বাহুতে। ওকে ছুঁয়ে ফ্রেঞ্চ ডোর-এর কাঁচ চুরমার করে দিল বুলেটটা। মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে একটা চেয়ারের পিছনে চলে এলো রানা, লেফটেন্যান্টের দ্বিতীয় বুলেট চেয়ারটার একটা পায়ায় লাগল।
‘কিল হিম!’ চিৎকার করছে লেফটেন্যান্ট। ‘কিল দেম অল!’ লেফটেন্যান্ট যখন রানাকে গুলি করছে, মারকাসের লোকটার হাতে কালো চকচকে একটা পিস্তল বেরিয়ে এল; সে লক্ষ্যস্থির করল সরাসরি তারানার মাথায়। তারানাই আগে গুলি করল, কিন্তু লোকটা মেঝেতে একটা হাঁটু ঠেকিয়ে নিচু হওয়ায় বুলেটটা তাকে লাগল না, লাগল তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিসের উরুতে। উরুর হাড় গুঁড়িয়ে গেছে, অন্তত চিৎকার শুনে তাই মনে হলো। মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে সে।
বাকি দুই পুলিস কুঁজো হয়ে আছে, অস্ত্র পুরোপুরি বের করতে পারেনি। আহত লোকটার সঙ্গে একজন পুলিসও শরীরটাকে গড়িয়ে দিয়ে হালকা কিছু ফার্নিচারের আড়ালে চলে গেল। জেনারেল ভালটোনা আর আমন্ত্রিত দুই জেনারেল এখনও স্থির মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন, তবে জেনারেল সেরাফ এখন লুকানো পিস্তল সামনে এনে লেফটেন্যান্টকে গুলি করলেন। পায়ে যেন চাকা গজিয়েছে, পাক খেয়ে পড়ে গেল লেফটেন্যান্ট সঙ্গে একটা টেবিলকে নিয়ে।
একসঙ্গে কয়েকটা অস্ত্র গর্জে উঠল। জেনারেল সেরাফ পুলিসদের একজনকে ফেলে দিলেন। মারকাসের প্রতিনিধি তারানাকে গুলি করতে যাচ্ছে দেখে মেঝেতে বসতে চেষ্টা করছে রানা; পর পর দুটো গুলি করে লোকটার কপাল আর গলা ফুটো করে দিল তারানা। রানার ওয়ালথার ঘুরে গিয়ে দু’বার গর্জে উঠল। দু’জন পুলিস বিদায় নিল দুনিয়া থেকে।
আহত লেফটেন্যান্ট হাঁটুর ওপর সিধে হয়ে জেনারেল সেরাফকে গুলি করতে যাচ্ছে দেখে লাফ দিয়ে সিধে হলো রানা, বলল, ‘খবরদার!’
লেফটেন্যান্টের দেখাদেখি বাকি পুলিস অস্ত্র ফেলে দিয়ে মাথার ওপর হাত তুলল। পড়ে থাকা লাশগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে রানার দিকে তাকাল লেফটেন্যান্ট। ‘এ একটা বীভৎস হত্যাযজ্ঞ!’ কর্কশ, বেসুরো গলায় চিৎকার করছে সে। ‘পুলিসকে বৈধ আইন প্রয়োগের কাজে বাধা দিয়েছ তুমি, কর্তব্য পালনরত অবস্থায় পুলিস সদস্যদের খুন করেছ। ভেবো না তুমি এর শাস্তি এড়াতে পারবে…’
উত্তরে তার মাথায় পিস্তলের প্রচণ্ড এক বাড়ি মারল রানা। লোকটা পড়ে যেতে একটা লাথি কষল পাঁজরে। ‘শালা, আইন শেখাও, না?’
বাকি দুই পুলিসের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলেন আমন্ত্রিত দুই জেনারেল। লেফটেন্যান্টের হাতে ওটা পরালেন জেনারেল সেরাফ। তারানা দেয়ালে হেলান দিয়ে একটু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। ‘তারানা?’ ডাকল রানা।
একটা হাত তুলে আশ্বস্ত করল তারানা। ‘আমি ঠিক আছি, রানা।’
‘আপনাকে বিশ্বাস করায় আমি খুশি, মিস্টার রানা,’ এগিয়ে এসে বললেন জেনারেল সেরাফ, হাতটা বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডশেক করার জন্যে। ‘আমরা সবাই আপনার প্রতি চিরঋণী হয়ে থাকলাম।’
‘প্রাণে তো বাঁচলামই,’ বললেন জেনারেল পাপাভক্সি, ‘কে কি ষড়যন্ত্র করেছিল তাও পরিষ্কার জানতে পারলাম।’
‘পুলিস কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি আমি,’ বললেন জেনারেল সেরাফ। ‘দেখা যাক সব শুনে তাঁর কি পঙতিক্রিয়া হয়।’
‘আপনাদের কাছে আমি চব্বিশ ঘণ্টা সময় চাই, জেনারেল সেরাফ,’ বলল রানা। ‘তারপর যার সঙ্গে খুশি যোগাযোগ করবেন। অক্টোপাসের মাথাটা এখনও জ্যান্ত, ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে আমরা কাবু না করা পর্যন্ত আপনারা পুরোপুরি নিরাপদ নন। আর আপনাদের নিরাপত্তা না থাকলে সরকারেরও কোন নিরাপত্তা নেই।’
জেনারেল ভালটোনার দিকে তাকালেন জেনারেল সেরাফ। ভালটোনা ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন। রানার দিকে ফিরে সেরাফ বললেন, ‘ঠিক আছে। চব্বিশ ঘণ্টা, তার বেশি নয়, কেমন? তারপর আমাদের যা করার আমরা তা করব।’
‘ফেয়ার এনাফ,’ বলল রানা। ‘কাল এই সময়ের মধ্যে আমরা যদি মারকাসকে না পাই, নিজস্ব পদ্ধতিতে এগোবেন আপনারা।’
‘গুড লাক।’ আরও একবার হ্যান্ডশেক করলেন জেনারেল সেরাফ।
৯
ফিরে এসে ওরা দেখল হোটেল স্যুইটের সিটিংরূমে পায়চারি করছেন ডাফু সালজুনাস। পরিষ্কারই বোঝা গেল, দেরি হচ্ছে দেখে তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে ওরা আর ফিরছে না। ‘জেনারেলরা সবাই ভাল আছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন, চেহারায় স্বস্তির ছাপ।
‘হ্যাঁ, সবাই ভাল,’ বলল রানা।
‘আর অ্যালেক্সিস?’
‘তিনিও বহাল তবিয়তে আছেন,’ তারানা বলল। ‘আমাদেরকে আসলে ভাগ্য সাহায্য করেছে। কেউ খুন হইনি, এটাই আশ্চর্য।’ ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ,’ বললেন সালজুনাস।
‘জেনারেল ভালটোনা সাহায্য করায় কাজটা আমাদের জন্যে অনেক সহজ হয়ে যায়,’ বলল রানা।
‘অ্যালেক্সিস ভাল একটা কাজে অংশগ্রহণ করায় আমি খুশি। আতাতায়ী যারা বেঁচে গেছে, তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তো?’
‘তাদেরকে আটক করা হয়েছে, তবে অফিশিয়ালি গ্রেফতার করা হয়নি,’ বলল রানা। ‘জেনারেলদের কাছে চব্বিশ ঘণ্টা সময় চেয়েছি আমি। এই সময়ের মধ্যে আমরা যদি মারকাসকে ধরতে না পারি, ওঁরা নিজেরা যা করার করবেন।’
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সালজুনাস বললেন, ‘আমি ঠিক এধরে নর গোপনীয়তা পছন্দ করি না। তবে আপনার ওপর পূর্ণ আস্থা আছে আমার, তাই আপত্তিও করছি না। ঠিক আছে, আমিও আগামী চব্বিশ ঘণ্টা মুখে কুলুপ এঁটে রাখব।’
‘ধন্যবাদ, মিস্টার সালজুনাস।’
‘কিন্তু মারকাসকে আপনি ধরবেন কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। ‘পেন্টহাউসে যাওয়া মানে তো আত্মহত্যা করা।’
‘হয়তো তাই,’ বলল রানা। ‘কিংবা হয়তো তা নয়-বিশেষ করে আমি আর আপনি যখন জায়গাটা সম্পর্কে প্রায় সবকিছুই জানি।’
‘কখন যেতে চান?’
‘আজ সন্ধ্যায়।’ তারানার দিকে একবার তাকাল রানা। ‘কি, রাজি তো?’
‘তুমি যা বলো, রানা।’
‘ইতিমধ্যে মারকাস ভাবতে শুরু করেছে তার পাঠানো লোকটা কোন খবর দিচ্ছে না কেন। এক সময় সে নিশ্চিত হবে, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বা ব্যাপারটা কেঁচে গেছে। এই নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পেন্টহাউসে থাকবে সে। কাজেই সন্ধ্যায় ওকে ওখানেই পাব আমরা।’
রানা থামতে বিলিওনেয়ার ব্যবসায়ী বললেন, ‘আপনি নিজেই আর্মি গার্ড দেখে এসেছেন। আমার সন্দেহ হচ্ছে করিডর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন কিনা।’
রানা হাসল। ‘অত চিন্তা করবেন না। আমরা পেন্টহাউসে ঢুকব ঠিকই, তবে অবশ্যই আত্মহত্যা করতে নয়।’
একটু যেন কৌতুক বোধ করলেন সালজুনাস। ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে গুটানো আস্তিনে কিছু লুকানো আছে!’
হেসে ফেলল রানা। ‘আছেই তো। তৃতীয় একজন আমাদেরকে সাহায্য করবে। জেনারেল সেরাফের ওখানে যাবার আগে আমি আমার ইনভেস্টিগেটিভ ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। একজন অপারেটরের সাহায্য নিচ্ছি।’
‘কিন্তু তারপরও আপনারা মাত্র তিনজন,’ বললেন সালজুনাস। ‘ওদের তুলনায় তিনগুণ ছোট একটা ফোর্স।’
হেসে উঠে তারানা বলল, ‘তিনজন তো রীতিমত ভিড়! মিস্টার সালজুনাস, আপনি জানেন না-রানা সব সময় একা কাজ করতে পছন্দ করে। এবার কি ভাগ্যি আমাদের…’
রানাও হেসে উঠে বলল, ‘আমার একটা প্ল্যান আছে, তাতে সংখ্যায় আমরা চারজনও হতে পারি।’
‘চার?’ সালজুনাসকে বিব্রত দেখাল। ‘আপানি যদি আমার কথা ভেবে থাকেন, ভুলে যান। আমি এমনকি পিস্তল পর্যন্ত ছুঁড়তে জানি না।’
‘আপনি নন,’ বলল রানা। ‘এথেন্সে আসার পথে প্লেনে আপনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, আমার মনে সেটা গেঁথে আছে।’
‘কি বলেছিলাম?’ সালজুনাস জিজ্ঞেস করলেন।
‘বলেছিলেন আপনার নিহত সেক্রেটারি গিলি ক্ল্যাসিকসের যমজ এক ভাই আছে, দুই ভাই হুবহু প্রায় একই রকম দেখতে।’
‘হ্যাঁ,’ বললেন সালজুনাস। ‘বেচারা ভোলি এখনও জানে না যে তার ভাই খুন হয়ে গেছে। দেখা-সাক্ষাৎ খুব কম হত, তবে যমজ বলেই বোধহয় পরস্পরের প্রতি খুব টান ছিল।’
‘দু’জনের চেহারা কতটুকু মেলে?’ জানতে চাইল রানা।
‘প্রায় সবটুকুই। গিলি মাত্র পাঁচ মিনিটের ছোট ছিল ভোলির চেয়ে। পার্থক্য? গিলি ছিল ভোলির চেয়ে এক ইঞ্চি বেশি লম্বা, সামান্য একটু মোটাও।’
‘ও-সব ঠিক করে নেব,’ আপনমনে বিড়বিড় করল রানা।
‘ভোলি ক্ল্যাসিকস কি এথেন্সে থাকে? ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব?’
‘শহরের বাইরে, ছোট্ট এক গ্রামে।’ রানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ভদ্রলোক। ‘তার পাশের বাড়িতে ফোন করে দেখতে পারি।’
‘যোগাযোগ করা সম্ভব হলে তাকে আপনি জানান যে গিলি ক্ল্যাসিকস খুন হয়েছে,’ বলল রানা। ‘তারপর জিজ্ঞেস করুন, সে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চায় কিনা।’
তারানা বলল, ‘রানা, তুমি কি…’
তাকে থামিয়ে দিল রানা। ‘মারকাস যদি নকল বা জাল লোক ব্যবহার করতে পারে, আমরা পারব না কেন? মরা মানুষের প্রতিনিধিত্ব একা শুধু ইউসুফিস জিয়ানিই করতে পারে?’
‘তারমানে তিন নম্বর গিলি ক্ল্যাসিকস?’ জিজ্ঞেস করল তারানা।
‘হ্যাঁ, তিন নম্বর। বলা যায় না, সত্যি বলা যায় না, সে হয়তো আমাদেরকে পেন্টহাউসে নিয়ে যেতে পারবে।’ সালজুনাসের দিকে ফিরল রানা, ‘চেষ্টা করে দেখবেন ফোনে তাকে পাওয়া যায় কিনা?’
এক মুহূর্ত ইতস্তত করে সালজুনাস মাথা ঝাঁকালেন। ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। তাকে আমি সরাসরি এখানে চলে আসতে বলছি।’
দু’ঘণ্টা পর সন্ধ্যার ঠিক আগে, ভোলি ক্ল্যাসিকস ওদের হোটেল স্যুইটে এসে হাজির হলো। নিরীহ, আত্মভোলা টাইপের মানুষ সে; তবে সালজুনাসের মুখে সব কথা শোনার পর ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে বলে দৃঢ় শপথ গ্রহণ করেছে। তাকে একজোড়া এলিভেটর শূ পরতে দিল রানা, শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় সাঁটার জন্যে কিছু স্পঞ্জের প্যাডও দিল, সবশেষে মেকআপ নিতে সাহায্য করল। যা-ও বা একটু পার্থক্য ছিল, এ-সবের পর তা-ও আর থাকল না-ভোলি অবশ্য হুবহু তার নিহত ভাই গিলির মত দেখতে হয়নি, হয়েছে পেন্টহাউসে রানার দেখা গিলির নকলটার মত। ভোলিকে ওই জাল লোকটার ভূমিকা নিতে হবে, ভাই গিলির ভূমিকা নয়। রানা চাইছে পেন্টহাউসের লোকেরা ভোলিকে যেন ইউসুফিস জিয়ানি হিসেবে গ্রহণ করে।
পিছিয়ে এসে সালজুনাসকে প্রশ্ন করল রানা, ‘কি মনে হচ্ছে?’
‘গিলির সঙ্গে খুবই মিল দেখছি, ফলে জিয়ানির সঙ্গেও,’ মন্ত ব্য করলেন সালজুনাস।
ওদের নিজস্ব নকল লোক চোখে-মুখে অনিশ্চিত একটা ভাব নিয়ে রানার দিকে তাকাল, একটু হেসে নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি তো ভালই করেছেন, এখন আমি কেমন করি সেটাই হলো কথা।’ তার আর জিয়ানির কণ্ঠস্বর ও ইংরেজি উচ্চারণ প্রায় একই মানের।
‘শুধু মনোবলটা ধরে রাখবেন,’ পরামর্শ ও আশ্বাস দিয়ে বলল তারানা, ‘দেখবেন বাকি সব পানির মত সহজ হয়ে গেছে।’
এক ঘণ্টা পর কোলোসস বিল্ডিঙের কাছে গাড়ি থামাল ওরা। এথেন্সে এখন ডিনার খাওয়ার সময়, রাস্তায় যানবাহন খুবই কম। বিল্ডিংটা প্রায় অন্ধকার হয়ে আছে, শুধু লবি আর আকাশের কাছাকাছি পেন্টহাউসে কয়েকটা উৎস থেকে আলোর আভা ছড়াচ্ছে। রেন্ট-আ-কারের কালো মার্সিডিজে বসে অপেক্ষা করছে ওরা। দশ মিনিট পর বিল্ডিঙের কোণ ঘুরে এক দীর্ঘদেহী তরুণকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। সরাসরি গাড়ির দিকে এলো সে, দরজা খুলে ফ্রন্ট সিটে রানার পাশে উঠে বসল। তারানা ও ভোলি ব্যাক সিটে বসেছে। সালজুনাসকে হোটেলে রেখে এসেছে ওরা।
‘ভাল আছেন, মাসুদ ভাই?’ সবিনয়ে প্রশ্ন করল দীর্ঘদেহী তরুণ, ঘাড় ফিরিয়ে তারানা আর ভোলিকে একবার দেখে নিল। রানা এজেন্সির এথেন্স শাখার প্রধান সে।
‘হ্যাঁ, ভাল। তুমি, বাবুল?’
‘ভাল, মাসুদ ভাই।’
‘কিছু ঘটছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘না। আমি আসার পর থেকে কেউ ঢোকেওনি, কেউ বেরোয়ওনি।’ রানার নির্দেশে গত প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে বাবুল চৌধুরী বিল্ডিংটার ওপর নজর রাখছিল-ঠিক বিল্ডিংটার ওপর নয়, কাঁচের ভেতর দিয়ে স্পেশাল এলিভেটরটার ওপর।
তারানা ও ভোলির সঙ্গে বাবুলের পরিচয় করিয়ে দিল রানা। তারপর বলল, ‘সার্ভিস ডোর দিয়ে লবিতে ঢুকব আমরা।’ মুঠো খুলে একটা চাবি দেখাল। ‘প্রথমে ঢুকবেন ভোলি। হাবভাব দেখে মনে হবে আমরাই যেন এই বিল্ডিঙের মালিক। ওপরে পৌঁছাতে পারলে কি করতে হবে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছি। কারও কোন প্রশ্ন আছে?’
অন্ধকার গাড়ির ভেতর কেউ কোন শব্দ করল না।
কালো মার্সিডিজ থেকে নেমে বিল্ডিংটার দিকে এগোল চারজন। মেইন গেটের বাম দিকে তালা দেয়া একটা গ−াস সার্ভিস ডোর রয়েছে, সেটার সামনে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়াল ওরা। সালজুনাসের কাছ থেকে পাওয়া চাবিটা রানার কাছ থেকে নিয়ে তালায় ঢোকাল ভোলি ক্ল্যাসিকস, তারপর ঘোরাল। লবিতে, এলিভেটরের পাশে, একটা টুলে বসা গার্ড ওদের দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেল।
প্রথমে ভোলি ঢুকল, তার পিছু নিয়ে বাকি সবাই। রানা ভাবছে, সত্যি কি ওরা মারকাসকে বিস্ময়ের একটা ধাক্কা দিতে পারবে? এই মুহূর্তে মেঝেতে পায়চারি করার কথা তার, কর্নেল সেরাফের বাড়িতে কি ঘটেছে শোনার অপেক্ষায়। রানা আশা করছে নিজের একদল লোককে এত তাড়াতাড়ি ওখানে ইনভেস্টিগেট করতে পাঠাবে না সে। তবে গত দু’দিনে পারাকাটুতে যোগাযোগ করে থাকতে পারে। কেউ সাড়া না দেয়ায় মারকাস ধরে নেবে ওখানে খারাপ কিছু ঘটেছে।
এলিভেটরের কাছে গার্ডের সামনে পৌঁছাল ওরা। এখনও ভোলির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সে।
‘কোথায় ছিলেন আপনি?’ অবশেষে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল গার্ড।
‘এঁরা জার্নালিস্ট,’ বলল ভোলি, শুরু হলো তার নতুন ভূমিকায় অভিনয়। ‘মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ভয়ঙ্কর এক ঘটনা ঘটে গেছে বলে শুনেছেন। উপদেষ্টা জেনারেলরা নাকি খুন হয়ে গেছেন। এই খবর পুলিসই ওঁদেরকে জানিয়েছে। এ-ব্যাপারে মিস্টার ডাফু সালজুনাসের পঙতিক্রিয়া জানার জন্যে এসেছেন এঁরা। ওপরে নিয়ে গিয়ে কথা যা বলার আমিই বলব…’
ডান বগলের নিচে ছুরিটার অস্তিত্ব অনুভব করছে রানা, ভাবছে এখুনি ওটা ব্যবহার করতে হবে কিনা। গার্ড যদি বেশ খানিক আগে এখানে ডিউটি দিতে এসে থাকে, তার জানার কথা ইউসুফিস জিয়ানি বিল্ডিং ছেড়ে বেরোয়নি।
‘ঠিক আছে,’ বলল গার্ড। ‘এলিভেটর নামাচ্ছি।’
দেয়ালে আটকানো বোর্ডের দিকে হাত তুলল সে, একটা বোতামে চাপ দিতে পেন্টহাউস থেকে ধীরগতিতে নিচে নামতে শুরু করল এলিভেটর। গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছাতে যেন প্রায় এক যুগ লেগে গেল। তবে একসময় দরজা খুলল। এর আগে যে অপারেটরকে পেয়েছিল রানা, আজও সে-ই ডিউটি দিচ্ছে। এলিভেটরে চড়ল ওরা। অপারেটর এমনভাবে ভোলির দিকে তাকিয়ে আছে যেন ভূত দেখছে। ওদের পিছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু অপারেটর বোতাম টিপে ওদেরকে ওপরে নিয়ে যাচ্ছে না।
‘আমি জানতাম না যে আপনি বিল্ডিঙের বাইরে ছিলেন,’ বলল অপারেটর, গভীর মনোযোগের সঙ্গে খুঁটিয়ে দেখছে ভোলিকে।
‘এখন জানলে,’ গলায় বিরক্তি ফুটিয়ে বলল ভোলি। ‘এই জার্নালিস্টদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে নিচে নামতে হয়েছিল। তাড়াতাড়ি ওপরে নিয়ে চলো। ওঁদেরকে একটা সাক্ষাৎকার দিচ্ছি আমি।’
অপারেটর এখনও ভোলির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, চোখে সন্দেহ। ‘তার আগে ওপরতলার সঙ্গে একটু কথা বলে নিই আমি।’
‘মানে? কি বলতে চাও তুমি?’ রেগে উঠল ভোলি।
কিন্তু তার রাগ গ্রাহ্য না করে কার-এর পাশে বসানো কমিউনিকেশন প্যানেল-এর দিকে ঘুরে গেল অপারেটর। বাবুলের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকাল রানা। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে একটা ল্যুগার বেরিয়ে এল। অপারেটর তার নড়াচড়া দেখে ফেলে ঘুরতে যাচ্ছে, কপালে ল্যুগারের শক্ত বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল।
কন্ট্রোল-এর দিকে পা বাড়াল তারানা।
‘তাড়াতাড়ি!’ তাগাদা দিল রানা।
পেন্টহাউসে ওঠার সময় অপারেটরের অসাড় দেহটা এলিভেটরের এক কোণে সরিয়ে রাখল ওরা, দরজা খুলে চারজন বেরিয়ে যাবার সময় কেউ তাকালে লোকটাকে যাতে তখুনি দেখতে না পায়। কয়েক সেকেন্ড পর পেন্টহাউস করিডরে পৌঁছে এলিভেটরের দরজা খুলে গেল।
রানা যেমন সন্দেহ করেছে, আজও দু’জন লোক ডিউটি দিচ্ছে। একজনের চুল সোনালি, তাকে রানা আগে দেখেছে। এরা পেশাদার অস্ত্রবাজ, বেশি ঝুঁকি নিতে রাজি নয় রানা। ডেস্কটা পেন্টহাউসে ঢোকার মুখে, চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াচ্ছে সোনালি চুল। তার সঙ্গী বসে থাকল, দু’জনেই ভোলির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
‘ব্যাপারটা কি…’ সোনালি চুল অবাক গলায় বলল। ‘এখানে কি ঘটছে?’
ভোলি সোনালি চুলের মনোযোগ ধরে রেখেছে, ওদিকে ডেস্কে বসা কালো চুল লোকটার দিকে এগোল বাবুল। লোকটা ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে বাবুলের মুখোমুখি হলো।
‘এঁদেরকে একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার অনুমতি দিয়েছি আমি,’ বলল ভোলি।
‘কিন্তু পেন্টহাউস থেকে আপনি বেরুলেন কখন?’ সোনালি চুল ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল প্রথম লোকটা।
ভোলি যখন জবাব দিচ্ছে, রানা তখন লোকটার পাশে চলে আসছে। ওদিকে বাবুলও ডেস্কে বসা লোকটার খুব কাছে রয়েছে। ওদের দু’জনকে কাভার দিচ্ছে তারানা, পার্সের পিছনে লুকানো বেলজিয়ান রিভলভার নিয়ে।
‘তুমি আমাকে বেরিয়ে যেতে দেখলে না!’ ভোলি বিস্ময় ও বিরক্তিতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ‘এই তো মাত্র এক ঘণ্টা আগের কথা। আমি না তোমাকে বললাম…’
ব্যাখ্যা করার আর কোন প্রয়োজন নেই। রানার তালুতে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো ছুরিটা। লম্বা সোনালি চুল বাম মুঠোয় ধরে নিজের দিকে টান দিল লোকটাকে, তারপর ছুরি ধরা হাতটা দ্রুত তার গলার ওপর দিয়ে টেনে আনল। ভোলির সাদা শার্ট আর বাদামী জ্যাকেট লাল হয়ে গেল চোখের পলকে।
অপর লোকটা পিস্তল ছুঁতে গেল, কিন্তু তার জন্যে আগে থেকেই তৈরি ছিল বাবুল। কুৎসিতদর্শন একটা গ্যারট বেরুল ওর পকেট থেকে, লূপ বানিয়ে ঝট করে লোকটার গলায় পরাল, তারপর তারের দুই প্রান্তের দুটো হাতল ধরে টান দিল দু’দিকে। লোকটার হাত পিস্তল ছুঁতে পারল না। চোখ বিস্ফারিত হলো, মুখ বিশাল গহ্বর। মাংস, চর্বি, শিরা-উপশিরা ইত্যাদির ভেতর ডেবে গিয়ে হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেল তার। ওদের পায়ের সামনে কার্পেটে আরও খানিকটা রক্ত ছিটাল-বাবুল ধরে রাখা সত্ত্বেও লোকটা লাফ দিচ্ছে ও মোচড় খাচ্ছে। তারপর মেঝেতে তার সঙ্গীর পাশে ঢলে পড়ল।
আগেড়বয়াস্ত্রের ট্রিগারে পেঁচিয়ে থাকা তারানার আঙুলে ঢিল পড়ল এতক্ষণে। লাশ দুটোর দিকে ঘৃণাভরে তাকাল সে, তারপর দেখল একটা লাশের শার্টে ছুরির ফলা মুছছে রানা।
রানার দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকাল বাবুল, দ্বিতীয় লাশের গলা থেকে গ্যারটটা উদ্ধার না করেই পেন্টহাউসের দরজার দিকে এগোল। তার হাতে স্পেশাল একটা পিস্তল বেরিয়ে এল-এয়ার গান, বর্শা ছোঁড়ে। বর্শার ডগায় কিউরারি বিষ মেশানো আছে, দ্রুত কাজ করে; এই বিষ বিসিআই সংগ্রহ করেছে, কলাম্বিয়ান ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে।
ভোলি ক্ল্যাসিকসকে এখনও শক্ত ও আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে, সালজুনাসের কাছ থেকে পাওয়া আরেকটা চাবি বের করে পেন্টহাউসের তালায় ঢোকাল সে। চাবি ঘোরাতেই তালা খুলে গেল। ধাক্কা দিতে নিঃশব্দে ফাঁক হলো ভারী কবাট। একপাশে সরে দাঁড়াল ভোলি, কারণ পেন্টহাউসের ভেতরে তাকে ঢুকতে হবে না। হানা দেয়ার এই পর্যায়ে তার কোন ভূমিকা নেই।
ভেতরে ঢুকে ওরা তিনজন ছড়িয়ে পড়ল। তারানার অস্ত্র ধরা হাত লম্বা হয়ে আছে, গুলি করার জন্যে তৈরি।
মারকাসকে বড়সড় লিভিংরূমটায় পেলে সবচেয়ে ভাল হত, প্রতিশোধের আগুন নেভাতে বেশি সময় লাগত না। কিন্তু মারকাসকে নয়, তার বদলে লম্বা একটা সোফায় ওদের দিকে পিছন ফিরে মাঙ্কিকে বসে থাকতে দেখল ওরা, হাতের গ−াসে ব্র্যান্ডি। দূর থেকেও তার হোলস্টারের স্ট্র্যাপ দেখতে পেল রানা। বিপজ্জনক লোক, সব সময় সশস্ত্র থাকে।
ভেতরের হলওয়েতে কারও সাড়া-শব্দ নেই, ওই পথ বেডরূমগুলোর দিকে চলে গেছে। তবে আলোকিত অফিস কামরা থেকে কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। রানা মাঙ্কির পিঠ লক্ষ্য করে এগোতে যাবে, এই সময় অফিস কামরা থেকে দু’জন লোক লিভিংরূমে বেরিয়ে এল। একজন বডিবিল্ডার, শোল্ডার হোলস্টারে পিস্তল; দ্বিতীয় লোকটা ইউসুফিস জিলানি, নকল গিলি ক্ল্যাসিকস।
ওদেরকে দেখে নয়, দরজায় দাঁড়ানো ভোলিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। দু’জোড়া চোখ পিরিচের মত বড় হয়ে উঠছে, তাকিয়ে আছে ভোলির দিকে। দুই জাল লোক পরস্পরের দিকে মাত্র দুই কি তিন সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল, এই সময় সোফা থেকে ঘাড় ফেরাতে নিজের লোক দু’জনের হতবিহ্বল চেহারা দেখতে পেল মাঙ্কি। এবার জিয়ানির সঙ্গী গুণ্ডার হাতে অস্ত্র বেরিয়ে আসবে।
এয়ারগান তাক করে ট্রিগার টেনে দিল বাবুল। পপ্ করে ভোঁতা একটা শব্দ হলো। কালো ধাতব খুদে বর্শাটা গলায় বিঁধল, কণ্ঠার ঠিক পাশে। সঙ্গীর গলায় বেঁধা কালো জিনিসটার দিকে আতংকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জিয়ানি। গুণ্ডার চোয়াল অদ্ভুত সব ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে, অথচ মুখ থেকে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। বিড়ালের ক্ষিপ্রতা দেখা গেল মাঙ্কির নড়ে ওঠায়; একই সঙ্গে ঘুরছে সে, পিস্তলও বের করছে।
প্রথমে রানাকে দেখতে পেল সে, আর রানা দেখল তার হাত হোলস্টারে গোঁজা পিস্তলে পৌঁছে গেছে। এক হাঁটু মেঝেতে গাড়ল, কব্জি ঝাঁকিয়ে ছুরিটা তালুতে আনল রানা; কব্জিরই আরেক ঝাঁকি খেয়ে ছুটল ছুরি, আলো লেগে ঝিক করে উঠল ফলা, সাপের মত নিঃশব্দে ছোবল মারল মাঙ্কির বুকে, হৃৎপিণ্ডের ঠিক পাশে। থ্যাচ্ শব্দ তুলে ভেতরে ঢুকেছে ফলা, গেঁথেছে হাতলের কিনারা পর্যন্ত।
মাঙ্কির চোখে বিস্ময় ও অবিশ্বাস, যেন ভাবছে এত দ্রুত এটা কিভাবে সম্ভব হলো। চোখ নামিয়ে ছুরিটা দেখল সে, রক্তের ধারা শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। ছুরির হাতলটা ধরল, যেন টেনে বের করতে যাচ্ছে। তারপর অপর হাতটা তুলে রানার দিকে পিস্তল তাক করল। কিন্তু ট্রিগার টিপতে পারল না, মারা গেল তখনি। মুখ থুবড়ে সোফার ওপর পড়ে গেল।
গলায় বর্শা নিয়ে গুণ্ডা স্থির হয়ে গেছে মেঝেতে। জিয়ানি ঘুরে অফিসের দিকে ছুটল। বাবুলের আরেকটা বর্শা টার্গেট করল তাকে। পিঠের ওপর দিকে হাত তুলে সদ্য গাঁথা বর্শাটা টেনে বের করতে চাইছে সে। পারল না, মেঝেতে ঢলে পড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।
‘ওকে জ্যান্ত ধরতে পারলে ভাল হত,’ শান্ত সুরে বাবুলকে বলল রানা। অফিসের দরজায় পৌঁছে উঁকি দিল ও। ভেতরে কেউ নেই। ইঙ্গিতে করিডরটা দেখাল। বেডরূমগুলো ওদিকেই। গোটা পেন্টহাউস সার্চ করল ওরা। কিচেনে একজন অস্ত্রবাজকে পাওয়া গেল, স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। বাবুলকে দেখেই পিস্তল ধরতে গেল সে, কিন্তু বাবুলের তৃতীয় বর্শাটা লোকটার কাঁধে বিঁধল।
লোকটা চেয়ার থেকে পড়ে গেলেও, চোখ খোলা রয়েছে, মারা যাবার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এ লোক একটা দুর্লভ কেস, নির্দিষ্ট কিছু টক্সিক কেমিকেল এর শরীরের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, বা করলেও ধীরে ধীরে করবে। এ লোকটা মারা যাচ্ছে, তবে প্রচুর সময় নিয়ে।
কিচেনে ঢুকল তারানা। ‘মারকাস এখানে নেই।’
লোকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল রানা, শার্টের কলার ধরে ঝাঁকাল। ‘মারকাস কোথায়?’
‘বলব, যদি আমাকে বাঁচতে দেন,’ বিড়বিড় করল লোকটা।
‘একজন ডাক্তারকে ডাকব,’ কথা দিল রানা। ‘কোথায় সে?’
‘আমি কি সত্যি বাঁচব?’ বিষক্রিয়ায় তার জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসছে, জড়িয়ে যাচ্ছে কথাগুলো।
‘সেটা ডাক্তারই শুধু বলতে পারবে।’ পিস্তল বের করল রানা।
‘হয় বলো, নয়তো গুলি খেয়ে মরো।’
‘তিনি মাইকোনোসে গেছেন।’
তারানার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল রানা। দু’জায়গায় ট্রেনিং দিয়ে নিজস্ব একটা বাহিনী গড়ে তুলছে মারকাস, তার মধ্যে মাইকোনোস দ্বীপ একটা। ‘আরেকটা প্রশ্ন।’ পিস্তলের মাজল লোকটার পাঁজরে চেপে ধরল ও। ‘মারকাস কি জেনারেলদের খবর পেয়েছে?’
লোকটা জড়ানো গলায় বলল, ‘জিয়ানি জেনারেল সেরাফের বাড়িতে ফোন করেছিল। রিসিভার তোলে একজন পুলিস। সে জানিয়েছে, লেফটেন্যান্ট সহ তারা সবাই ভাল আছে। আর জেনারেলরা কেউ বেঁচে নেই।’
‘হোয়াট! এ আবার কি শুনছি!’ বাবুল অবাক।
কিন্তু রানা বিস্মিত নয়। কি ঘটেছে কল্পনায় ধরতে পারছে ও। ফোন বেজে ওঠার পর জেনারেল সেরাফ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে একজন পুলিসকে রিসিভার তুলতে বলেন। তিনি বুঝতে পারেন, পেন্টহাউসে মিথ্যে খবর না পাঠালে মারকাস দলবল নিয়ে নিজেই চলে আসবে তাঁর বাড়িতে। রানার সঙ্গে পরামর্শ করার সময় ছিল না, ফলে নিজের বিবেচনায় যা ভাল মনে হয়েছে তাই করেছেন। এতে বুদ্ধিমত্তারই প্রকাশ ঘটেছে, কিন্তু জেনারেলের জানার কোন উপায় ছিল না যে পিস্তলের মুখে পুলিসকে দিয়ে তিনি যা বলাচ্ছেন তা শুনে রানা ওর দলবল নিয়ে হাজির হবার আগেই মারকাস পেন্টহাউস ত্যাগ করার তাগাদা অনুভব করবে। ‘মারসাক মাইকোনোসে গেছে কেন?’ মৃত্যুপথযাত্রী অস্ত্রবাজকে তিক্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘ট্রূপস্ পরিদর্শনের জন্যে?’
লোকটার খিঁচুনি শুরু হয়েছে। ‘আমার জন্যে ডাক্তার ডাকবেন বলেছেন…’
‘আগে উত্তর দাও।’
তার গলা থেকে এখন অস্পষ্ট আওয়াজ বেরুচ্ছে। ‘দুই ক্যাম্পেই ফোন করেন তিনি। নির্দেশ দিলেন, এথেন্সে ট্রূপস্ পাঠাও। সালজুনাস না বললে ট্রূপস মুভ করানো যাবে না, মাইকোনোসের কমান্ডার এ-ধরনের কিছু একটা বলতে চাইলেন। বস্, মানে মিস্টার মারকাস খেপে আগুন। ওখানে তিনি গেছেন নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে।’ লোকটা হাঁ করে বাতাস টানতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। মুখটা ইতিমধ্যেই নীল হয়ে গেছে। এখুনি মারা যাবে সে।
বাবুল চৌধুরীকে পেন্টহাউসে রেখে তারানাকে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে এলো রানা। ভোলি ক্ল্যাসিকসকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল ও। তারপর আরেকটা ট্যাক্সির জন্যে হাত তুলল, নিচু গলায় বলল, ‘চলো, তারানা, শকুন মেরে আসি।’
১০
সকালবেলার কচি রোদে মাইকোনোস হারবার যেন প্রকাণ্ড একটা নীলা। প্রায় বন্ধ একটা হারবার, পাহাড়-প্রাচীরের ভেতর পানিতে ভাসছে অসংখ্য মাছ ধরার ছোট ছোট নৌকা আর লঞ্চ, বাইরে নোঙর ফেলে আছে দুটো প্রকাণ্ড ক্রুজ শিপ। মাইকোনোসে জাহাজ ভেড়ে না। নড়বড়ে গ্যাঙপ্ল্যাঙ্ক বেয়ে নামতে হয় আরোহীদের, হাতে থাকে লটবহর, ডুবু-ডুবু লঞ্চ প্রতিবার অল্প কিছু লোককে তীরে পৌঁছে দেয়। অভিজ্ঞতাটা কেমন তা অবশ্য রানা ও তারানার জানার সুযোগ হয়নি, কারণ প্রায় এক ঘণ্টা আগে দ্বীপের আরেক প্রান্তে নির্মিত নতুন এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে ওরা, তারপর বাসে চড়ে ঝাঁকি খেতে খেতে জেলে পাড়ায় পৌঁচেছে। এই মুহূর্তে পানির কিনারা ঘেঁষা একটা কাফেতে বসে রয়েছে রানা, মাথার ওপর বহুরঙা কাপড়ের চাঁদোয়া। ওর কাছ থেকে পনেরো গজ দূরে দর্শনীয় গোঁফ বিশিষ্ট ছ’জন গ্রীক নাবিক নতুন রঙ করা একটা ফিশিং বোটকে ঠেলে পানিতে নামাচ্ছে। রানার দু’দিকে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ওয়াটারফ্রন্ট বা পানির কিনারা; আরেক দিকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে সাদা চুনকাম করা দালান, সামনের অংশে কফি হাউস, রেস্তোরাঁ, হোটেল, দোকান-পাট ইতাদি। চেয়ারে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে রানা, স্ট্রহ্যাট পরা বুড়ো এক লোককে আঙুর আর ফুল বিক্রি করতে দেখছে। এরকম একটা পরিবেশে মনে রাখা কঠিন যে একজন লোককে খুন করতে এখানে এসেছে ও।
ওর সঙ্গে তারানা নেই। আঁকাবাঁকা পাকা রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ আগে অদৃশ্য হয়ে গেছে সে। মাইকোনোসে বেশ কিছু মুসলমান পরিবার বাস করে, বছর দুই আগে বেড়াতে এসে এরকম এক মুসলিম পরিবারের বুড়ি কর্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তারানার, সেই বুড়ির সঙ্গে দেখা করতে গেছে সে। মাইকোনোসের কোথায় কি ঘটছে জানতে হলে এখানকার যে-কোন বুড়িকে প্রশ্ন করলেই চলে, কারণ তারা নাকি সমস্ত খবর জানে এবং বহিরাগত প্রশ্নকর্তাকে জানাতে পছন্দ করে, বিশেষ করে প্রশ্নকর্তা যদি সংশি−ষ্ট বুড়ির একটা কামরা ভাড়া নেয়। তারানা তার পরিচিতা বৃদ্ধার কাছে মিলিটারি ক্যাম্প সম্পর্কে জানতে গেছে। ক্যাম্পের কমান্ডার কোথায় থাকে তা-ও জানার চেষ্টা করবে সে, কারণ ধরে নেয়া চলে ওই কমান্ডারের ওখানেই পাওয়া যাবে আকার্ডিয়া মারকাসকে।
দ্বিতীয় কাপটা শেষ হয়ে আসছে, এই সময় ফিরে এলো তারানা। ‘তোমাকে কিন্তু একদমই ট্যুরিস্টের মত লাগছে না, জ্যাকেট আর টাই না পরলে গ্রীক ভাবটা আরও বোধহয় খানিক বাড়ত।’
‘আরও একটু সময় দাও আমাকে,’ বলল রানা। ‘কিছু জানা গেল?’
ওয়েটারকে ডেকে এক কাপ চা চাইল তারানা। ওয়েটার চলে যেতে বলল, ‘আমি একা গিয়ে ভালই করেছি। সুফিয়া প্রথমে মুখ খুলতে রাজি হয়নি। যখন অভয় দিয়ে বললাম যে তার কোন ক্ষতি হবে…’
‘সংক্ষেপ করো।’
ওয়েটার চা দিয়ে যাবার পর শুরু করল তারানা। ‘ওরনস সৈকতের কাছে একটা ক্যাম্প আছে। দ্বীপের মাত্র দু’জন লোক ওই ক্যাম্পের ভেতর ঢুকতে পেরেছে। ক্যাম্পের কাছাকাছি একটা ভাড়া করা ভিলায় থাকেন কমান্ডার। তাঁর নাম কর্নেল গেনাডি গাম্বুস।’
‘গুড। আর কিছু জানা যায়নি?’
‘একজন স্থানীয় ট্যাক্সি ড্রাইভার দু’জন আমেরিকানকে রাহমানিয়া হোটেলে পৌঁছে দিয়েছে। হোটেলটা এই গ্রামেরই শেষ মাথায়। পরে ওই ট্যাক্সি ড্রাইভারই আমেরিকান দু’জনকে কমান্ডার গাম্বুসের ভিলায় পৌঁছে দেয়।’
‘সত্যি, দারুণ ইন্টেলিজেন্স ওঅর্ক,’ বলল রানা, দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘চলো, রাহমানিয়া হোটেলটা দেখে আসি।’
‘এই তো সবে বসলাম,’ প্রতিবাদের সুরে বলল তারানা। ‘চায়ে মাত্র একটা চুমুক দিয়েছি…’
‘পরে তোমাকে দশ কাপ খাওয়াব, লক্ষ্মীটি,’ বলে টেবিলের ওপর কিছু ড্র্যাকমা কয়েন রাখল রানা।
‘উফ্! কেমন মানুষ রে বাবা!’ দ্রুত চুমুক দিতে গিয়ে জিভ পোড়াল তারানা, তারপর রানার সঙ্গে থাকার জন্যে প্রায় ছুটতে শুরু করল।
সাগরের কিনারা ঘেঁষে হাঁটছে ওরা; আরেক পাশে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, কাফে আর হোটেল। খোলা একটা চৌরাস্তায় চলে এল, এখানে বাস থেকে স্থানীয় লোকজন আর ট্যুরিস্টরা লটবহর নিয়ে নামছে। চৌরাস্তার এক মাথায় পোস্ট অফিস আর হারবার পুলিসের হেডকোয়ার্টার। রাস্তার মাঝখানে একটা আইল্যান্ড, সেখানে ব্রোঞ্জের তৈরি প্রাচীন কোন গ্রীক বীরের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চৌরাস্তাকে পিছনে ফেলে ছোট একটা আবাসিক এলাকায় ঢুকল ওরা, এরপর পঞ্চাশ গজ হাঁটতেই আকাশের গায়ে দেখতে পেল রাহমানিয়া হোটেল।
হোটেলটা বহুতল, এবং পাহাড়ের মাথায়। পেঁচানো রাস্তা আছে, সরাসরি গাড়ি নিয়ে ওঠা যায়; আবার ধাপও কাটা আছে, হেঁটে উঠতে পারো।
রিসেপশন ডেস্কে বসা লোকটা ভদ্র ও অমায়িক। ‘হ্যাঁ, গতকাল দু’জন আমেরিকান উঠেছেন। তাঁরা কি আপনাদের বন্ধু?’ ‘তাদের নাম কি?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘এক সেকেন্ড, প্লীজ।’ কাউন্টারের নিচে থেকে একটা খাতা নিল সে, পাতা ওল্টাল। ‘এই তো। মিস্টার ব্রায়ান আর মিস্টার জক।’
হেসে উঠল রানা। ‘হ্যাঁ, এরা আমাদের বন্ধু। কত নম্বর রূমে আছে? ওদেরকে আমরা এমন একটা সারপ্রাইজ দেব না!’
‘স্যুইট নম্বর তিনশো বারো। কিন্তু তাঁরা তো বাইরে বেরিয়েছেন। বলে গেছেন দুপুরের দিকে লাঞ্চ খেতে ফিরে আসবেন।’
দ্বীপে ক্রাইম রেট প্রায় শূন্যের কোঠায়, তাই সিকিউরিটির ব্যবস্থা না থাকারই মত। রানার কাছে জাদুর কাঠি অর্থাৎ মাস্টার কী আছে, মিস্টার ব্রায়ান ও মিস্টার জকের স্যুইটে ঢুকতে কোন সমস্যা হলো না। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তল্লাশী চালাল ওরা। দুটো বেডরূমেই বিছানা এখনও তৈরি করা হয়নি। সিটিংরূমে স্কচ হুইস্কির একটা বোতল পাওয়া গেল-অর্ধেক খালি। রেকর্ড বলে, মারকাস খুব একটা খেতে পারে না, বমি করে ফেলে; কাজেই রানা ধরে নিল হুইস্কিটুকু খেয়েছে মারকাসের সঙ্গে আসা গানম্যান।
হুইস্কি আর কয়েকটা সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ছাড়া তারা কিছু ফেলে রেখে যায়নি। মারকাস সম্ভবত সঙ্গে করে কোন লাগেজ নিয়ে আসেনি। সে যে কাজের জন্যে এসেছে তাতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। নিজেকে ডাফু সালজুনাস বলে পরিচয় দিয়ে কে ফোন করেছিল তা তদন্ত করে দেখা আর ক্যাম্প কমান্ডার গেনাডি গাম্বুসের আনুগত্য যাচাই করা। কমান্ডার গাম্বুসের জীবন বিপজ্জনক ঝঁুি কর মধ্যে পড়ে গেছে, সত্যি যদি তিনি সালজুনাসের অনুরোধ মেনে নিয়ে মুভ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে থাকেন। মারকাস যেহেতু এখানে গতকাল পৌঁছেছে, গাম্বুস হয়তো এরইমধ্যে নিহত হয়েছেন।
পাহাড় থেকে নেমে আধঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর একজন প্রৌঢ় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে পাওয়া গেল, প্রচুর খেয়েও দাবি করছে সে মদ খায়নি, মাতালও হয়নি। তার কালো বুইক গাড়িটার বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে তো কম নয়। পুরানো এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার সময় যে হাঁচিটা দিল, রানার সন্দেহ হলো গোটা দ্বীপ কেঁপে উঠেছে।
পাহাড়ের কার্নিসই রাস্তা, আরেক পাশে অনেক নিচে সাগর। ওরনস সৈকতের কাছাকাছি চলে এসেছে বুইক, এই সময় বাঁক ঘুরে ক্যাম্প আর ভিলার পথ ধরল ড্রাইভার।
দূর থেকে ক্যাম্পটার শুধু আভাস পাওয়া গেল, ভাল করে কিছু দেখার সুযোগ মিলল না। সারি সারি সবুজ দালান যেন গুঁড়ি মেরে আছে, গাড়ির পাশের দীর্ঘ কাঁটাতারের বেড়া থেকে বহুদূরে। বেড়ার দিকে পিছন ফিরল ট্যাক্সি। এখান থেকে ভিলাটা বেশ অনেকটা দূরে।
বাড়িটার ছাদে টালি বসানো হয়েছে। কাছাকাছি পৌঁছে ড্রাইভারকে থামতে বলল রানা। মদ খেলেও, লোকটা ঠিকমতই গাড়ি চালাচ্ছে।
কারুকাজ করা সদর দরজার কড়া নাড়ল রানা। যে-কোন ঘটনার জন্যে তৈরি ওরা। তারানা তার পার্সের পিছনে বেলজিয়ান আগেড়বয়াস্ত্রটা আবার লুকিয়ে রেখেছে। তার আশা, এবার ওটা ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। রানা ওর পিস্তল জ্যাকেটের সাইড পকেটে রেখেছে, একটা হাতও ওর সেখানেই। বুড়ো এক গ্রীক চাকর দরজা খুলল।
‘শুভেচ্ছা স্বাগতম, হুজুর,’ গ্রীক ভাষায় অভ্যর্থনা জানাল সে। ‘আপনারা কি কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?’ ‘এক্সকিউজ মি,’ বিড়বিড় করে বলল রানা, নরম হাতে তাকে একপাশে সরিয়ে তারানাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। এটা বড় একটা লিভিংরূম। একদিকের পুরোটা দেয়াল কাঁচ দিয়ে তৈরি, পাহাড় আর বনভূমি দেখা যাচ্ছে।
‘প্লীজ!’ বুড়ো চাকর ইংরেজিতে প্রতিবাদ করল।
এক কামরা থেকে আরেক কামরায় ঢুকে সার্চ করছে ওরা। সবশেষে আবার হলরূমে ফিরে এল। ভিলায় আর কেউ নেই।
‘কমান্ডার কোথায়?’ বুড়োকে জিজ্ঞেস করল তারানা।
প্রবলবেগে মাথা নাড়ল লোকটা। ‘নেই। চলে গেছেন।’
‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘গেছেন আমেরিকানদের সঙ্গে। গেছেন ক্যাম্পে।’
ভিলা থেকে বেরিয়ে এসে ট্যাক্সিতে চড়ল ওরা। ‘মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে চলো,’ ড্রাইভারকে বলল রানা।
‘একবার তো বলেছি আমি মাতাল নই, তারপরও এভাবে আমাকে পরীক্ষা করার মানেটা কি?’ চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করল ড্রাইভার।
‘তোমাকে পরীক্ষা করা হচ্ছে না,’ বলল রানা। ‘আমরা সত্যি সত্যি মিলিটারি ক্যাম্পে যেতে চাইছি।’
‘এই কথা! তাহলে আমিও ওখানে আপনাদেরকে নিয়ে গিয়ে প্রমাণ করব যে সত্যি আমি মাতাল হইনি।’
‘ওখানে গিয়ে কি করব আমরা?’ রানাকে জিজ্ঞেস করল তারানা।
কাঁকর ছড়ানো পথ ধরে আবার ছুটল বুইক। ‘কি করব তা এখনও ঠিক করিনি,’ স্বীকার করল রানা। ‘তবে কেন যেন মনে হচ্ছে অন্তত বাইরে থেকে হলেও ক্যাম্পটা একবার দেখা দরকার।’
তবে অত দূর ওরা গেল না। বাঁক নিয়ে যে রাস্তায় উঠল সেটা কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে, কিছুদূর যাবার পর কিছু ঝোপ আর গাছপালা দেখতে পেয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল রানা, ‘স্টপ!’ রাস্তা ছেড়ে ওই ঝোপ আর গাছগুলোর দিকে এগিয়েছে কোন গাড়ির চাকার দাগ।
সঙ্গে সঙ্গে বুইক থামিয়ে ড্রাইভার অভিমানী সুরে জানতে চাইল, ‘এখনও আপনারা অভিযোগ করবেন যে আমি মাতাল?’
তার কথায় কান না দিয়ে তারানা জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার, রানা?’
‘ঠিক বুঝতে পারছি না। তুমি বসো।’ গাড়ি থেকে নেমে পিস্তলটা বের করল রানা। ঝোপগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে টায়ারের দাগ থেমে গেছে। পাশেই কয়েক জোড়া জুতোর ছাপ, এখানে সম্ভবত ধস্তাধস্তি হয়েছে। দাগগুলোকে পিছনে ফেলে ঝোপের দিকে এগোল রানা। আরেকটু এগোতে যা ভয় করছিল, দেখল সেটাই সত্যি। দীর্ঘদেহী একজন মানুষ ঘন একটা ঝোপের আড়ালে পড়ে আছে, এক কান থেকে অপর কান পর্যন্ত গলাটা কাটা। ধরে নেয়া যায় কমান্ডার গেনাডি গাম্বুসকে রানা খুঁজে পেয়েছে।
ট্যাক্সিতে ফিরে এসে কি দেখেছে তারানাকে বলল রানা। দু’জনেই ওরা চুপচাপ বসে থাকল কিছুক্ষণ। ওদেরকে গম্ভীর ও চিন্তিত দেখে ড্রাইভারও নিজেকে সামলে রাখল।
‘কমান্ডার গাম্বুসের সহকারী কাউকে এরইমধ্যে পাশে পেয়ে গেছে মারকাস,’ একসময় নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল রানা। ‘আমরা যদি মারকাসকে ধরতে না পারি, এখানকার ট্রূপসকে কাল সে এথেন্সে নিয়ে যাবে।’
‘কিন্তু আমরা তো আর তাকে ধরার জন্যে ক্যাম্পে ঢুকতে পারি না,’ বলল তারানা। ‘ছোটখাট হলেও, ওখানে একটা আর্মি তাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে।’
‘চলো তাহলে হোটেলে ফিরি,’ বলল রানা। ‘দুপুরে লাঞ্চ খেতে ফিরবে বলেছে মারকাস, সত্যি সত্যি ফিরতেও পারে। আমরা তার জন্যে অপেক্ষা করব।’
রাহমানিয়ায় পৌঁছে ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছে রানা, ড্রাইভার আবার প্রসঙ্গটা তুলল, ‘আল্লাহর কিরে লাগে, সত্যি কথা বলবেন, আমি কি একবারও এতটুকু মাতলামি করেছি, স্যার?’
তারানার দিকে তাকাল রানা। ‘তুমি কি বলো, ও মাতাল?’ তারানা মাথা নাড়ল।
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা প্রশ্ন করল। ‘আমি যদি মাতাল না হই, তাহলে কেন বলা হবে আমি মদ খেয়েছি?’
রানা ও তারানা দৃষ্টি বিনিময় করল। তারানা বলল, ‘কে বলে তুমি মদ খেয়েছ?’
‘আপনারা না, আপনারা না! বলে ওই শালী, আমার বউটা। আমি নাকি সারাক্ষণ মদ খাচ্ছি, আর তাই দোজখের আগুনে পুড়তে হবে আমাকে।’
ভুরু কুঁচকে রানা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নামটা কি বলো তো।’
‘ইমানুল জাকারিয়াস।’
‘তুমি মুসলমান!’
‘জ্বী। আপনারাও বুঝি?’ ড্রাইভারকে বিব্রত দেখাচ্ছে। মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘দোয়া করবেন, স্যার-আমি যেন মদটা ছাড়তে পারি।’
লোকটার প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
রানা ভাবল চিৎকার করে বলে…কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টে চুপ করে থাকল ও।
রাহমানিয়া ইন্টারন্যাশনালে পৌঁছে আবারও কারও চোখে ধরা না পড়ে মারকাসের স্যুইটে ঢুকল ওরা। দরজায় তালা লাগিয়ে অপেক্ষা করছে। বেলা প্রায় বারোটা এখন, ইতিমধ্যে বেডগুলো তৈরি করা হয়েছে; মেইড বা রূম-সার্ভিসকে নিয়ে উদ্বিগড়ব হবার কিছু নেই।
স−্যাকস সুট-এর সঙ্গে ছোট একটা ভেস্টও পরেছে তারানা, সেটা খুলে ফেলায় স−্যাকসে গোঁজা রইল ছোট্ট একটা ব−াউজ। বিছানায় শুয়ে পড়ল সে, পা দুটো এখনও মেঝেতে, লাল চুল নীল চাদরে ছড়িয়ে পড়েছে। সিলিঙের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘এই যে ছাড়াছাড়ি হবে, আবার কবে দেখা হবে কে জানে। আর যদি দু’জনের একজন মারা যাই, কোনদিনই আর দেখা হবে না।’ ‘হ্যাঁ, আমাদের পেশায় এটা একটা খারাপ দিক…’
‘কাজেই ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না,’ বলল তারানা। ‘ভাল লাগে, কাজেই সুযোগ থাকতে থাকতে যতটা পারা যায় তোমাকে পেতে হবে আমার।’ খোলা জানালা দিয়ে নরম, ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে মারকাসের বেডরূমে। তারানা তার ব−াউজের বোতাম খুলতে শুরু করল।
‘এই, কি করছ, এখন না!’ দ্রুত বলল রানা। ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? জানো না মারকাস যে-কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে।’
চাপা স্বরে হেসে উঠল তারানা। ‘দেখতে চাইছিলাম তোমার পঙতিক্রিয়া কি হয়। ঠিক আছে, এখন না।’
প্রতিটি মিনিট পার হতে যেন এক ঘণ্টা লাগছে। সাড়ে বারোটার সময় নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না তারানা। ‘আমি ডেস্কে যাচ্ছি।’
‘কেন?’
‘মারকাস হয়তো ফোন করে কিছু জানিয়েছে। কিংবা হোটেলের কর্মচারীরা লোকমুখেও তার সম্পর্কে কিছু শুনে থাকতে পারে।’
‘ঠিক আছে, যাও,’ অনুমতি দিল রানা। ‘তবে মারকাসকে দেখতে পেলে একা কিছু করতে যেয়ো না। এখানে আসতে দিয়ো তাকে।’
এক সেকেন্ড ইতস্তত করল তারানা। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, রানা। কথা দিলাম।’
তারানা চলে যাবার পর মেঝেতে পায়চারি শুরু করল রানা। উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছেই। মারকাসকে এই স্যুইটের ভেতর পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে তার পিছনে কম দৌড়ানো হয়নি। হোটেলের রিসেপশন এরিয়ার দিকে তারানা গেছে পাঁচ মিনিটও হয়নি, এই সময় করিডরে পায়ের শব্দ পেল রানা। পিস্তল বের করে দরজার সামনে চলে এলো ও। কান পেতে আছে, আরেকটা শব্দ হলো। অপেক্ষা করছে, কিন্তু কিছুই ঘটছে না। অত্যন্ত সাবধানে ও নিঃশব্দে দরজার তালা খুলল। একটু একটু করে এক ইঞ্চি ফাঁক করল কবাট, সেই ফাঁকে চোখ রেখে করিডরে তাকাল। কেউ নেই। আরও একটু ফাঁক করল কবাট। করিডরের আরও বড় অংশ দেখতে পাচ্ছে এখন। নেই কেউ। স্যুইট থেকে বেরিয়ে এলো এবার। কই, কিছু না। করিডরের একদিকে খিলান আকৃতির দরজা, দরজার ওপাশে বাগান। খিলানের তলা দিয়ে বাগানে বেরিয়ে এসে চারদিক সার্চ করল। এখানেও নেই কেউ। বাগান থেকে বেরিয়ে যাবার আরেকটা দরজা আছে, পঞ্চাশ ফুট দূরে, সেদিকটাও একবার দেখে এল। একটা বিড়াল পর্যন্ত নেই। অবশেষে হাল ছেড়ে দিল রানা। উত্তেজিত সড়বায়ুকে দায়ী করল ও, হয়তো কিছু শোনেইনি। করিডরে ফিরে এসে আধ খোলা দরজা দিয়ে স্যুইটে ঢুকল।
কবাট ধরে ওর পিছনে দরজা বন্ধ করতে যাবে, এই সময় চোখের কোণ দিয়ে কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখল রানা। তবে রিয়্যাক্ট করার সময় পাওয়া গেল না। খুলিতে লাগা আঘাতটা সারা শরীরে তীব্র ব্যথার ঢেউ তুলল।
হাত থেকে পড়ে গেল ওয়ালথার। চৌকাঠ আঁকড়ে ধরল রানা, ওটার ওপরই বাড়ি খেলো শরীরটা। এক পলকের জন্যে একটা মুখ দেখতে পেল, মনে পড়ল এথেন্সের পেন্টহাউসে দেখেছে। নিরেট দেয়াল, ওরফে আকার্ডিয়া মারকাস। হিংস্র পশুর মত দুর্বোধ্য একটা শব্দ বেরিয়ে এলো রানার গলার ভেতর থেকে-চোখে ভাসছে হায়েনাটার পলায়ন, মুখে কায়সারের খানিকটা মাংস-হাত বাড়িয়ে মারকাসের চোখ দুটোর নাগাল পেতে চাইল ও। কিন্তু তখনই আরেকটা আঘাত লাগল মাথার পাশে, ভেতরে বিস্ফোরিত হলো উজ্জ্বল আলো। তারপর অকস্মাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল।
১১
‘ওর জ্ঞান ফিরছে।’
আওয়াজটা অস্পষ্ট, যেন পাশের কামরা থেকে ভেসে এলো রানার কানে। মিট-মিট করে চোখ খুলল, তবে দৃষ্টি পরিষ্কার হলো না। আবছা মত তিনটে মূর্তি দেখতে পেল নিজের চারপাশে।
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে, চোখ খোলো।’
গলাটা চেনা। মারকাস কথা বলছে। শব্দের উৎসের দিকে ফিরে দেখার চেষ্টা করল রানা। ওর দৃষ্টিতে পরিষ্কার ফুটল চেহারাটা। খাড়া একটা পিলার। তার দু’পাশে দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। একজনের বাম চোখে কালো পট্টি, চোখের জায়গায় হয়তো কুৎসিত গর্ত আছে। এই লোকটাকে মারকাসের ব্রাজিলিয়ান বডিগার্ড বলে ধরে নিল রানা। অপর লোকটার বয়স হবে ত্রিশ-বত্রিশ, পরনে সামরিক ইউনিফর্ম। রানা আন্দাজ করল, নিহত কমান্ডার গাম্বুসের পদটা সম্ভবত একেই দেয়া হয়েছে।
‘তো,’ তিক্তকণ্ঠে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল মারকাস, ‘তোমার কাজ তাহলে উইন্ডো ওয়াশ করা?’ গলার ভেতর হাসির মত অদ্ভুত একটা শব্দ তৈরি করল সে, ভেতরে যেন টগবগ করে পানি ফুটছে। ‘আসলে কে তুমি?’
‘ওটাই আমার আসল পরিচয়। ওয়াশার। আমি ধুই। ধোয়াই আমার কাজ।’ এত কথা বলে আসলে মাথাটাকে ঠিকমত চালু হবার প্রয়োজনীয় সময় দিতে চাইছে রানা। তারানার কথা মনে পড়ল ওর। সে-ও কি ওদের হাতে ধরা পড়েছে?
মারকাস পিছিয়ে গিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে রানার গালে মারল। এই প্রথম বুঝতে পারল রানা, ওকে একটা খাড়া চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তারা ওকে বাঁধেনি, তবে পিস্তলটা নেই। জ্যাকেটের বোতাম খোলা, বগলের নিচে ছুরিটার অস্তিত্ব অনুভব করা যাচ্ছে। মারকাসের মার খেয়ে চেয়ার থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল ও।
ওর দিকে ঝুঁকল মারকাস, বাঘের মত গরগর আওয়াজ বেরুল গলা থেকে, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি, আমাকে তুমি চেনোনি।’ রানা লক্ষ করল, আর্মি অফিসার মারকাসের দিকে দ্রুত একবার তাকাল। ‘তবে এখন তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাবে আমি কে এবং কি।’
‘তুমি একটা সাইকো,’ তার মুখের ওপর বলে দিল রানা। ‘তুমি একটা শকুন।’
আরেকটা আঘাত আসছে ভেবে নিজেকে শক্ত করল রানা। মারকাস সিধে হলো, নিজের শার্টের সামনের দিকটা দু’হাতে খামচে ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল। গোটা বুক ও পেট জুড়ে শুকনো ক্ষত, সম্ভবত আগুনে পোড়ার দাগ। ঘুরে নিজের পিঠটাও দেখাল মারকাস, তারপর আবার রানার দিকে ফিরল।
‘দেখলে?’ খেঁকিয়ে উঠল, চোখ দুটোর উজ্জ্বলতা মোটেও স্বাভাবিক নয়। ‘খুব ছোটবেলায় আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে আগুন ধরে যাওয়ায় এই অবস্থা হয় আমার। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে বিছানায় উঠেছিল আমার বাবা। পরিবারের প্রতি অবহেলার এটা ছিল তার সর্বশেষ নমুনা। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ, আমি মারা যাইনি। ভেবো না সারা জীবন ধরে যা করছি তার জন্যে নরকে যাব আমি, কারণ সেখানে আমার আগেই থাকা হয়েছে।’
রানা ভাবছে। আগুনটা মারকাসের ভেতর কিছু একটা পুড়িয়ে দেয়। হয়তো তার আত্মাটাই পুড়ে গেছে, আদৌ আত্মা বলে যদি কিছু থেকে থাকে। সুস্থ একটা মানুষের মাথায় ও মনে যা যা থাকে-স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ, মানুষের প্রতি ভালবাসা, সৎ চিন্তা ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি-মারকাসের মাথায় ও মনে তার বোধহয় কণামাত্রও নেই, সব ওই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে যখন বোতামগুলো লাগাবার চেষ্টা করছে, রানা উপলব্ধি করল কেন লোকটাকে খাড়া পিলারের মত দেখায়। ক্ষতের কারণে চামড়ায় টান পড়ায় বুকটাকে চিতিয়ে রাখতে হয় তাকে।
‘এখন তুমি চিনলে আমাকে,’ হিসহিস করে উঠল মারকাস।
‘এবার বলো কে তুমি। আমার পিছু নিয়ে কেন এসেছ মাইকোনোসে?’
রানা নিরুত্তর।
‘তুমি কি সিআইএ?’ মারকাসের প্রকাণ্ড মুখ রানার চোখের সামনে চলে এল। গরম নিঃশ্বাস ফেলছে রানার গলায়। ‘তুমিই কি ডাফু সালজুনাসের নামে কমান্ডার গাম্বুসকে টেলিফোন করেছিলে?’
তারানার ওপর আস্থা আছে রানার, সে মুক্ত থাকলে ব্যাক আপ হিসেবে সাহায্য করতে আসবেই। কিন্তু সে কি জানে এখানে কি ঘটছে? না জানলে বোকার মত স্যুইটে ঢুকে পড়বে। তবে না, একজন ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট অত বোকা হয় না। ‘আমি সিআই-এ নই, বিসিআই,’ মারকাসকে বলল রানা।
‘বিসিআই? মানে?’ মারকাস যেন আকাশ থেকে পড়ল।
‘বিসিআই মানে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স,’ বলল রানা।
‘বাংলাদেশ? এই নামে কোন দেশ আছে, এটাই তো আমি জানি না!’ মারকাস হতভম্ব। ‘যে দেশকে আমি চিনি না সেই দেশের সঙ্গে আমার শত্রুতা থাকে কি করে? সে দেশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স আমার পিছনে লাগে কেন?’
রানা হাসল। ‘তুমি তোমার হোমওঅর্ক করোনি, মারকাস। এমন কি বড় অপরাধী হতে হলেও এটার প্রয়োজন আছে।’ আসলে কথা বাড়িয়ে তারানার সুবিধে করে দিতে চাইছে ও।
‘হোমওঅর্ক করিনি তো কি হয়েছে, বাংলাদেশ বা বিসিআই আমার কি ছিঁড়তে পারছে?’
‘কি ছিঁড়েছি বা ছিঁড়ব নিজেই টের পাবে, আমার মুখ থেকে শুনতে হবে না।’
‘আমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র পাকিয়েছ তোমরা? তোমার সঙ্গে আর কে কে আছে?’ উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে মারকাস।
কথা না বলে রানা শুধু মাথা নাড়ল। পিস্তলটা উল্টো করে ধরে রানার দিকে এগিয়ে আসছে মারকাসের বডিগার্ড।
‘থামো,’ ভারী গলায় বলল মারকাসের নতুন কমান্ডার। ‘গ্রীসে বন্দীদের কথা বলাবার সম্পূর্ণ নতুন কিছু কৌশল আবিষ্কার করেছি আমরা। কিন্তু এই ইন্টারোগেশন পদ্ধতির খারাপ দিক হলো, সাবজেক্ট ভীষণ চিৎকার আর পায়খানা-প্রস্রাব করে ফেলে। আমাদেরকে তো ক্যাম্পে ফিরতেই হবে, চলুন ওকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাই।’
প্রস্তাবটা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল মারকাস, তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভাল।’
রানাকে ধরে চেয়ার থেকে তোলা হলো। ও ভাবছে, তারানাটা গেল কোথায়! রিসেপশন ডেস্ক থেকে ফিরতে এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়। নাকি তাকেও ধরেছে ওরা? কিন্তু জিজ্ঞেস করার তো উপায় নেই।
রাহমানিয়ার পার্কিং এরিয়াটা প্রবেশপথ থেকে অনেকটা দূরে, নির্জন একটা জায়গায়। ওখানে পৌঁছে ছুরির সাহায্য নিয়ে পালাবার চেষ্টা করবে রানা। তারা যদি ওকে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে পারে, জ্যান্ত আর ফিরতে হবে না।
কিন্তু ছুরি ব্যবহারের কোনও সুযোগই পাওয়া গেল না। মারকাসের বডিগার্ড সারাক্ষণ ওর পাঁজরে পিস্তলের মাজল ঠেকিয়ে রাখল, এমনকি গাড়িতে ওঠার পরও। রানার অপর দিকে বসেছে মারকাস নিজে। ড্রাইভ করছে আর্মি অফিসার।
শহর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ী রাস্তা ধরে ছুটল কার, রানা তারানার কথা ভুলতে পারছে না। মেয়েটার কি হলো বোঝা যাচ্ছে না। তার তো জানার কথা যে মারকাস ফিরছে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে রানার পাশে চলে আসতে হবে।
শহর থেকে বেরিয়ে মাইলখানেক এগিয়েছে ওরা, অর্ধবৃত্তাকার একটা বাঁক ঘুরছে, হঠাৎ বিশ গজ দূরে একটা অচল গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল সরু রাস্তার মাঝখানে। রানার মনে পড়ল, গাড়িটাকে হোটেলের সামনের দিকে কোথাও দেখেছে ও, হোটেল কর্তৃপক্ষই সম্ভবত ওটার মালিক। আর্মি অফিসার ব্রেকে চাপ দিল, মিলিটারি কার হড়কে এসে অচল গাড়িটার কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে ঝাঁকি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘কি ঘটনা?’ জিজ্ঞেস করল মারকাস।
‘অচল একটা গাড়ি, নিশ্চয়ই যান্ত্রিক গোলযোগ,’ অফিসার বলল। ‘ড্রাইভার সম্ভবত মেকানিক আনতে গেছে।’
‘বুঝলাম তো,’ ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে মারকাসকে। ‘এবার পথ থেকে ওটাকে সরাবার ব্যবস্থা করুন।’
ওদের গাড়ির ডান দিকে গভীর খাদ, উল্টোদিকে প্রায় খাড়া পাথুরে ঢাল। অফিসার গাড়ি থেকে বাম দিকে নামল; সাবধানে পা ফেলে, ধীরে ধীরে দ্বিতীয় গাড়িটার দিকে এগোচ্ছে।
মারকাস বসে আছে রানার ডান দিকে। দরজা খুলে খাদের দিকে নামল সে, পেভমেন্টে দাঁড়িয়ে অফিসার কি করে দেখছে। গাড়ির ভেতর এখন রানা আর মারকাসের বডিগার্ড, বডিগার্ডের পিস্তল রানার পাঁজরে ঠেকে আছে।
ওদের গাড়ির পাশ থেকে মারকাস গলা চড়িয়ে নির্দেশ দিল, ‘ঠেলে খাদে ফেলে দিন ওটাকে!’
‘সে চেষ্টাই করব,’ অফিসারের জবাব ভেসে এল।
ওটাই তার শেষ কথা। দ্বিতীয় গাড়িটার পাশে যেই সে থেমেছে অমনি রানা দেখতে পেল খাদের কিনারা থেকে তারানার মাথা রাস্তার লেভেলে উঠে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে যে হোটেল কামরার বাইরে থেকে ওদের কথা শুনছিল সে, রানাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে শুনে হোটেলের গাড়ি চুরি করে ওদের আগে এই রাস্তায় পৌঁছেছে। এ-ও বোঝা যাচ্ছে যে খাদের কিনারা থেকে কয়েক ফুট নিচে কার্নিস বা ওই রকম কিছু একটা আছে, যেখানে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে তারানার কোন অসুবিধেই হচ্ছে না। ‘সাবধান!’ অফিসারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল মারকাস, দেখল তারানা লক্ষ্যস্থির করছে।
গ্রীক অফিসার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে যাবে, এই সময় গর্জে উঠল তারানার অস্ত্র। অফিসারের কপালে ছোট্ট লাল একটা বেমানান টিপ দেখা গেল। পিছনদিকে ছিটকে অচল গাড়ির ওপর পড়ল সে, সেখান থেকে রাস্তায়। ইতিমধ্যে তারানার পিস্তল মারকাসের দিকে ঘুরে গেছে। মারকাসও নিজের পিস্তল বের করছে। অফিসারকে আগে টার্গেট করায় মনে মনে তারানার প্রশংসা করল রানা, কারণ জানে মারকাসকে মারার জন্যে কেমন অস্থির হয়ে আছে সে।
মারকাসকে হারিয়ে দিল তারানা; আবার গর্জে উঠল তার ছোট্ট আগেড়বয়াস্ত্র, মারকাসকে লাগাতেও পেরেছে।
গাড়ির ভেতর মারকাসের বডিগার্ড রানার দিকে পিস্তল ধরে আছে, জানে না এই চরম সংকটে প্রথমেই তার কি করা উচিত। মারকাসকে গুলি খেতে দেখে তার দ্বিধা কেটে গেল, সিদ্ধান্ত নিল প্রথমে রানাকে গুলি করবে, তারপর গাড়ি থেকে বেরিয়ে তারানার ব্যবস্থা। পিস্তলে পেঁচানো তার আঙুলের গিঁট সাদা হয়ে যাচ্ছে। ভাঁজ করা কনুই দিয়ে তার অস্ত্র ধরা হাতে গুঁতো মারল রানা। গুলি হলো, রানার পাশের জানালার কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে গেল বুলেট। ওর অপর হাতে বেরিয়ে আসা ছুরি ঘ্যাঁচ করে সেঁধিয়ে গেল লোকটার পাঁজরের ভেতর। তার খেলার এখানেই সমাপ্তি।
গুলিটা মারকাসের কাঁধে লেগেছে, তবে হাড় ভাঙতে পারেনি; শুধু সামান্য চামড়া আর মাংস খামচে তুলে নিয়ে গেছে। পেভমেন্টে শুয়ে তারানার গুলির জবাবে সে-ও গুলি করছে। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো রানা, মাথা নিচু করে আছে, গাড়িটাকে ব্যবহার করছে কাভার হিসেবে। হাতে পিস্তল নিয়ে দ্বিতীয় গাড়িটার দিকে যাচ্ছে ও। মারকাস ইতিমধ্যে তারানাকে খাদের নিচে লুকাতে বাধ্য করেছে।
দ্বিতীয় গাড়িটার কাছে পৌঁছাল রানা, এই সময় মারকাস দেখে ফেলল ওকে। পরপর দু’বার গর্জে উঠল তার পিস্তল, রানার পাশে রাস্তার ছাল গুঁড়ো হয়ে ছিটকাল। ডাইভ দিয়ে গাড়িটার আড়ালে চলে এলো রানা। ছুটে এসে মিলিটারি কারে উঠে পড়ল মারকাস। খাদের কিনারা থেকে আবার মাথা তুলল তারানা, গুলিও করল, কিন্তু মারকাসকে লাগাতে পারল না। মারকাস ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছে। এঞ্জিন গর্জে উঠল।
সিধে হয়ে মারকাসকে একটা গুলি করল রানা। হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে সামনে বাড়ল কার, সরাসরি রানার দিকে আসছে। আরেকটা গুলি করে ছুটে আসা কার-এর পথ থেকে ডাইভ দিয়ে সরে গেল। বিকট শব্দে দ্বিতীয় গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেলো সেটা। সংঘর্ষের একেবারে কাছাকাছি শুয়ে আছে রানা, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে প্রার্থনা করছে ছিনড়বভিনড়ব লোহা যেন ওর মাংস চিরে না দেয়। হুইল ঘুরিয়ে, রিভার্স গিয়ার দিয়ে, নিজের গাড়িটাকে আলাদা করল মারকাস, বাঁক নিয়ে শহরের দিকে ফিরে যাচ্ছে। আর এক সেকেন্ডের মধ্যে পালাবে সে; এটাই শেষ সুযোগ ধরে নিয়ে সাবধানে লক্ষ্যস্থির করল রানা, একটা চাকা ফাটিয়ে দিল। তারপরও গাড়ি নিয়ে ছুটছে মারকাস। তারানা পর পর দুটো গুলি করল। গাড়ির গায়ে শব্দ করল বুলেটগুলো, মারকাসকে লাগেনি।
সিধে হয়ে সদ্য তোবড়ানো গাড়িটার দরজা খুলল রানা। ওর হাত থেকে খসে পেভমেন্টে পড়ে গেল সেটা। ভেতরে ঢুকে স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করল ও। তিনবারের পর সাড়া দিল এঞ্জিন।
ছুটন্ত গাড়িতে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল তারানা। শুরু হলো ধাওয়া। শহর পর্যন্ত ওদের দৃষ্টিসীমার ভেতরই থাকল মিলিটারি কার। তারপর হারিয়ে ফেললেও একটু খোঁজাখুঁজি করতেই আবার দেখতে পেল ওয়াটারফ্রন্টে। খালি গাড়ি, ভেতরে মারকাস নেই।
‘খুব বেশি দূর যেতে পারেনি,’ বলল তারানা। ‘আমি এদিকের কাফেগুলোয় দেখে আসি।’
‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘আমি দেখি বোটগুলো। সাবধানে, হ্যাঁ?’
‘তুমিও কিন্তু,’ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল তারানা, হন হন করে কাফেগুলোর দিকে এগোল। ওদিকে লুকিয়ে থাকার মত জায়গার কোন অভাব নেই।
লম্বা একটা জেটি ধরে এগোল রানা। ট্যুরিস্টদের ছোটখাট একটা ভিড় রয়েছে এদিকে, বোট আসবে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা। মারকাস সম্পর্কে প্রশ্ন করতে যাবে, এই সময় একটা মোটর লঞ্চের গর্জন শুনতে পেল ও। জেটির মাথায় ওই লঞ্চে মারকাসকে দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে রওনা হয়ে গেছে সে। ছুটল রানা। যখন বুঝতে পারল লাফ দিয়েও লঞ্চে ওঠা যাবে না, পিস্তল তুলে লক্ষ্যস্থির করল। গুলি করতে গিয়েও করল না ও, কারণ দেখতে পেল ওর পাশেই পানিতে ছোট একটা বোট ভাসছে। লাফ দিয়ে বোটটায় নামল ও, হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা মালিককে বলল, ‘স্টার্ট দাও!’
ওর হাতে পিস্তল রয়েছে, লোকটা প্রতিবাদ না করে স্টার্ট দিল বোট।
‘এবার নেমে যাও।’
‘কিন্তু…’
‘নামো বলছি!’ প্রায় খেপে উঠল রানা।
লোকটা বোট ছেড়ে নেমে যেতেই মারকাসের পিছু নিল রানা। পিছন ফিরে তাকাতে তারানাকে দেখতে পেল, ডকের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু এখন আর ফিরে গিয়ে তাকে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। হাত তুলে নাড়ল রানা। ‘সাবধানে!’ এঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে ওঠা তার চিৎকার শুনতে পেল রানা।
মারকাস যখন মারা যাবে, ওর সঙ্গে তারানা থাকবে না, ভাবতে খারাপই লাগছে রানার। বাকারাকে নিয়ে সে-ও তো প্রতিশোধ নিতেই এসেছে। কিন্তু নিয়তির বিধান হয়তো অন্যরকম। মারকাসকে প্রবেশমুখের ভেতর দিয়ে ইনার হারবারে ঢুকতে দেখল রানা, পিছনে মসৃণ জলপথ রেখে যাচ্ছে। এই সুরক্ষিত জলসীমার বাইরে ছোট অথচ চঞ্চল ঢেউ রয়েছে। রানার ছোট বোট ওখানে পৌঁছাতে লাগাম টানা ঘোড়ার মত উঁচু হলো বারবার, চোখে-মুখে লোনা পানির ছিটা লাগছে। ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার, ডেলোস আইল্যান্ডের কাছাকাছি জনবসতিহীন একটা দ্বীপে পৌঁছাতে চাইছে মারকাস।
মারকাসের চুরি করা লঞ্চের চেয়ে রানার বোটের স্পীড বেশি। ছোট বোটের কিনারা ধরে প্রায় ঝুলে বা শুয়ে আছে রানা, ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছে দূরত্ব। এই সময় আবার তারানার কথা মনে পড়ল ওর। মাইকোনোসে বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে বেচারিকে। যতই ব্যাখ্যা দিক, পুলিস হয়তো তা সত্যি বলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। তবে জেনারেল সেরাফকে ফোন করলে কর্তৃপক্ষ তাদের সব প্রশেড়বরই উত্তর পেয়ে যাবেন। রানা মাইকোনোসে ফিরে হয়তো দেখতে পাবে তারানাকে মেডেল পরানো হচ্ছে। কপালে যদি ফেরা থাকে আর কি।
হঠাৎ করেই মারকাসকে শূটিং রেঞ্জের মধ্যে পেয়ে গেল রানা, তবে ওকে হারিয়ে দিয়ে মারকাসই আগে গুলি করল। পরপর দুটো, দুটোই উইন্ডশীল্ডে লেগে ফাইবার গ−াস ফাটিয়ে দিল। রানার ছোট বোট সারাক্ষণ লাফাচ্ছে, কাজেই কিছু একটায় লাগাতে পারাও দক্ষতার পরিচয় বহন করে। পিস্তল বের করে মারকাসের কাঠামোয় লক্ষ্যস্থির করল রানা। গুলিটা লাগল না। পিস্তলে আর মাত্র দুটো বুলেট আছে।
দ্বীপের ছোট্ট ও পরিত্যক্ত একটা এলাকার দিকে ছুটছে ওরা। এদিকের পানি শান্ত। উত্তপ্ত, রোদে ফাটা, ভগড়বপ্রায় একটা ডকের দিকে যাচ্ছে মারকাস। তাকে পিস্তলটা রিলোড করতে দেখল রানা। বাড়তি অ্যামুনিশনের সুবিধেটা সেই পাবে। ডকে লঞ্চ থামাবার ঠিক আগে রানার দিকে দুটো গুলি করল সে, উদ্দেশ্য দূরে সরিয়ে রাখা। বড় একটা বৃত্ত তৈরি করে এগোল রানা, মারকাসকে সহজে দ্বীপে উঠতে দিতে রাজি নয়। তবে গুলি করছে না ও। এখন বুলেট অপচয় করা যাবে না।
লঞ্চে ঝুঁকে রয়েছে মারকাস, কি যেন করছে। লঞ্চ এরই মধ্যে ডকে ভিড়েছে। রানা ভাবল, এটাই বোধহয় ওর সুযোগ। বোট একটু ঘুরিয়ে ডকে ঢুকতে যাচ্ছে। যেই পিস্তলের রেঞ্জে চলে এলো লঞ্চ, সিধে হয়ে দৃষ্টিপথে বেরুল মারকাস, কি যেন একটা ছুঁড়ে দিল রানার বোট লক্ষ্য করে।
জিনিসটা বোটের ককপিটে পড়ল। ফিউজ পুড়তে দেখে রানা বুঝল, লঞ্চ থেকে ডিনামাইট পেয়েছে মারকাস। মাইকোনোস দ্বীপের অন্য এক মাথায় পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করার কাজে এই ডিনামাইট ব্যবহার করা হচ্ছে। তুলে বোটের বাইরে ফেলে দেবে, অত সময় নেই হাতে, ফিউজটা ছোট। পিস্তল বেল্টে গুঁজে বোট থেকে ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ল ও, তারপর দ্রুত সাঁতরাতে শুরু করল।
বিস্ফোরণের আওয়াজ কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়ার উপক্রম করল, ঝড় উঠল গরম বাতাসে, পানিতে তৈরি হলো বড় আকারের ঢেউ। রানার চারদিকে আবর্জনা ঝরে পড়ছে, তবে সাঁতরে বেরিয়ে আসতে পারল ও। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখল সারফেসে আগুন জ্বলছে, কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া উঠছে আকাশে।
ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছে রানা। সাঁতরে ডকের পাশের সৈকতে পৌঁছাতে চাইছে ও। ওকে দেখতে পেয়ে আবার দুটো গুলি করল মারকাস। দু’হাত সামনের পানিতে ডাইভ দিল বুলেটগুলো। আরেকটা গুলি করল মারকাস। এবার লাগল।
বাম বাহুর ওপর দিকে চামড়া ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে বুলেটটা। মনে মনে ‘দাঁড়া শালা’ বলে গালি দিলেও একটা কথা ভেবে শঙ্কিত বোধ করল-তীরে যদি পৌঁছাতে পারেও, ওর কাছে হয়তো কোন অস্ত্র থাকবে না, কারণ পানিতে ভেজা পিস্তলের কার্তুজ কাজ নাও করতে পারে।
রানা এখনও তীরের দিকে আসছে দেখে ঘুরে আগাছা ভর্তি ডক থেকে ছুটল মারকাস। দ্বীপটার নিচু ও সমতল একটা এলাকার দিকে যাচ্ছে সে, ওদিকে বহুকাল আগে পরিত্যক্ত কিছু কুঁড়েঘর আছে জেলেদের। রানার জন্যে সম্ভবত ওখানেই ওত পেতে থাকবে সে।
ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে উঠল রানা। সামনের খোলা জায়গার কোথাও মারকাসকে দেখতে পাচ্ছে না। গরম রোদে গায়ের লোনা পানি শুকাতে শুরু করেছে। এখান থেকে প্রায় তিনশো গজ সামনে জমিন এদিকের চেয়ে নিচু, প্রায় সমতলই, তবে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে ছোটবড় পাথর। আলগা বোল্ডারও অসংখ্য। একসময় পাথর দিয়ে কিছু দালানও বানানো হয়েছিল, অনেক আগে ধসে পড়লেও নমুনা হিসেবে কিছু পিলার ও পাঁচিল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলোর পিছনে পাহাড়, ঢালগুলো খাড়াই বলা যায়, উঠে গেছে দ্বীপটার মধ্যবিন্দুর দিকে। ওই চূড়ায়, আকাশে, আরেকটা দালান দেখা যাচ্ছে। বাড়িটা দোতলা, ছাদ ও একদিকের দেয়ালের কোন অস্তিত্ব নেই।
রোদে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে মারকাসকে খুঁজছে রানা।
যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, উঁকি-ঝুঁকি মারছে না। পিস্তল থেকে কার্তুজ বের করে একটা বোল্ডারের ওপর রাখল ও। সিলিন্ডার খুলে ব্যারেলের ভেতর তাকাল। মেটাল টিউবের গায়ে পানির ফোঁটা লেগে রয়েছে, প্রতিফলিত রোদের আভায় চকচক করছে। মুখের ভেতর মাজল পুরে পানি বের করার জন্যে ফুঁ দিল। এত সতর্কতার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখা কার্তুজ কাজের সময় মিসফায়ার করতে পারে। ওয়ালথারটা রয়ে গেছে হোটেলে আর মিলিটারি ক্যাম্পে যাবার পথে অস্ত্রবাজের পাঁজরে গাঁথা আছে ছুরিটা, কাজেই কুড়িয়ে পাওয়া এই পিস্তলটা ছাড়া ওর কাছে আর কোন অস্ত্র নেই। ওগুলো হয়তো উদ্ধার করবে তারানা, কিন্তু এখন তো কাজে লাগছে না।
তবে মারকাসের ভয় ছিল যে রানা গুলি করবে, তা না হলে ওভাবে পড়িমরি করে দৌড়াত না সে। কার্তুজ শুকিয়ে গেল। বুলেট দুটো পিস্তলে ভরে রওনা হলো রানা, ভেঙে পড়া দালানগুলোর দিকে যাচ্ছে।
চারদিকে লম্বা ঘাস। উঠান ও ভেঙে পড়া দেয়ালের ভেতর কামরাগুলোতেও আগাছা ভর্তি। উঁচু ঘাস বাতাসে দুলছে। দুনিয়ার যে-কোন জায়গার চেয়ে এখানকার রোদ কি বেশি গরম? হাসি পেল রানার, তবে জানে হাসির সময় এটা নয়। ঘাসের ভেতর দিয়ে সাবধানে এগোচ্ছে ও। দুটো গিরগিটি ডায়নোসরের মত দেখতে, ওর পথ ছেড়ে সরে গেল-দূরে থেমে ঘাড় বাঁকা করে দেখছে ওকে। গরম বাতাসে ভ্যাপসা একটা গন্ধ রয়েছে। আশপাশে কোথাও মাছি ভন ভন করছে। জুলহাস কায়সারের ক্ষতবিক্ষত লাশটা ফিরে এলো চোখের সামনে। এই সময় সামনের একটা দালানের কাছে কি যেন একটা নড়ল।
হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ রগড়ে আবার তাকাল রানা। এখন আর কিছু নড়তে দেখা যাচ্ছে না। তবে অনুভব করল, ওদিকেই ঘাপটি মেরে আছে মারকাস।
দালানটার দিকে ছুটল রানা, ওকে আড়াল দিচ্ছে একটা বোল্ডার। ওটা বুক সমান উঁচু, পিছনে দাঁড়িয়ে কান পাতল। মাছি আর ঝিঁঝি পোকার ডাক সড়বায়ুতে যেন হাতুড়ির বাড়ি মারছে। বোল্ডারে হাত রাখল রানা, হাতটা পড়ল একটা গিরগিটির গায়ে। ওটা লাফিয়ে উঠে চমকে দিল রানাকে। আর ঠিক এই সময় দ্বিতীয় দালানের পিছন থেকে মাথা বের করে গুলি করল মারকাস।
রানার ডান হাতের কাছাকাছি বোল্ডারের পাথর গুঁড়ো করল বুলেটটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা বুলেট ছুটে এসে ওই বোল্ডারেই লাগল, ছিটকে এসে গুঁড়ো পাথর লাগল রানার চোখে মুখে। চোখ পরিষ্কার করে আবার যখন তাকাল, মারকাস ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে ওর আরও কাছাকাছি লম্বা ঘাসগুলোকে নড়তে দেখল ও, প্রথম ও দ্বিতীয় দালানের মাঝখানে।
মারকাস ধরে নিয়েছে, রানা গুলি করতে চাইছে না। ফলে শিকার নয়, শিকারী হয়ে উঠেছে সে। সেই এখন রানাকে ধরতে আসছে।
স্থির হয়ে গেছে রানা। ঘাসের নড়াটাকে সন্দেহজনক মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু মারকাস ওখানে এখনও আছে বলে মনে হচ্ছে না ওর।
‘হাতে ওটা শো পীস, তাই না?’ প্রথম দালানের একটা ঘর থেকে মারকাসের হাসির শব্দ ভেসে এল। ‘গুলি নেই? নাকি ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে?’
বোল্ডারের আড়াল ছেড়ে আগেই বেরিয়ে পড়েছে রানা, প্রথম দালানের তৃতীয় ঘরটাকে পাশ কাটিয়ে এল। শুকনো পাতায় পা ফেলছে না, ঘাস এড়িয়ে ভাঙা পাঁচিল আর দেয়ালের আড়ালে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোথায় মারকাস। পাঁচ নম্বর ঘরেও সে নেই।
‘এবার?’
বন করে ঘুরতেই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রানা মারকাসকে। কিভাবে ওদিকে গেল, একমাত্র সেই জানে। লোকটা শকুন হোক বা উন্মাদ, মাথার হলুদ ঘিলু এখনও তাকে বুদ্ধির যোগান দিয়ে যাচ্ছে। হাতের আগেড়বয়াস্ত্র তুলেই গুলি করল সে।
মারকাস যখন গুলি করতে যাচ্ছে, ডাইভ দিয়ে পড়ল রানা পাথরের একটা সতূপের পাশে। ওদের মাঝখানে এখন কোন বোল্ডার নেই। বুলেটটা রানার শার্টের আস্তিন ছিঁড়ে নিয়ে গেল, বেশ গভীর একটা আঁচড় কাটল বাম বাহুতে। মারকাস আবার গুলি করতে যাচ্ছে দেখে একটা গড়ান দিল ও। ওর পাশে বিস্ফোরিত হলো ধুলো। মরিয়া হয়ে পিস্তল ধরা হাতটা তার দিকে তুলল রানা, এই সময় তৃতীয়বার ট্রিগারে টান দিল মারকাস। খালি চেম্বারে বাড়ি মারল হ্যামার। রানা নিজের পিস্তলের ট্রিগার টানছে, ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মারকাস। ক্লিক করল রানার পিস্তল, কোন বুলেট ছুটল না।
মারকাসের চেহারা বদলে গেল। ধীরে ধীরে উচ্চকিত হলো তার অট্টহাসির শব্দ। তারপর, হাসির দমকে প্রকাণ্ড ও আড়ষ্ট শরীরটা তখনও কাঁপছে, পিস্তলে একটা কার্তুজ ভরতে শুরু করল। হাতের অস্ত্র ফেলে দিল রানা, ধুলোয় পায়ের আঙুল ডোবাল, তারপর লাফ দিল শূন্যে।
পিস্তলটা ওর দিকে তুলছে, এই সময় তার গায়ে দু’পা দিয়ে নামল রানা। শূন্য থেকে সবেগে আসা জোড়া পায়ের লাথি বুকে লাগলে অন্য কোন লোক মারা যেতে বেশি সময় নিত না, কিন্তু ছিটকে মাটিতে পড়েই মারকাস সিপ্রঙের মত লাফ দিয়ে আবার সিধে হতে কোন সময় নিল না। পড়ে গিয়েছিল রানাও, তবে মারকাসের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে-দেখল, শত্রুর হাতে অস্ত্রটা নেই।
পরস্পরকে ঘিরে ঘুরছে ওরা। অকস্মাৎ ঝুঁকে মাটি থেকে কি যেন কুড়াল মারকাস। তারপর হিংস্র একটা হুঙ্কার ছেড়ে রানার দিকে ছুটে এল। এতক্ষণে তার হাতে উল্টো করে ধরা খালি পিস্তলটা দেখতে পেল রানা।
এক পাশে সরে তাকে ল্যাং মারার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। রানা কোন দিকে সরবে বুঝতে পেরে সেদিকেই পিস্তলের বাড়িটা মারল সে, লাগল রানার মাথার একপাশে। ব্যথায় কাতরে উঠল রানা, ঢলে পড়ল ঘাসের ওপর। এখনই দাঁড়াও, রানার ভেতর থেকে কে যেন বলল, নয়তো এখনই মরো। মাথা ঘুরছে, বসতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে, তারপরও দাঁড়াতে চেষ্টা করল ও। চোখে দৃষ্টি ছিল না, ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। মারকাস ঝাপসা একটা মূর্তি, ঢাল বেয়ে পাহাড় চূড়ায় উঠে যাচ্ছে। পিছু নিয়ে ওপরে তাকাল রানা। দু’তলা ধ্বংসাবশেষ এখান থেকে আরও বড় দেখাচ্ছে। পুরানো একটা কাঠের দরজা কব্জার সঙ্গে তির্যক ভঙ্গিতে ঝুলছে, বাতাসের ধাক্কায় ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করছে সেটা। চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা। এই দরজা দিয়ে মারকাসকেও ঢুকতে দেখেছে ও।
ভাঙা ছাদ আর দেয়াল, আগাছা আর ঝোপ এড়িয়ে সাবধানে এগোচ্ছে রানা। বাইরের মত ভেতরেও প্রচুর ঘাস। কিছু ঘাস এখনও সিধে হতে পারেনি মারকাস মাড়িয়ে যাবার পর। রানার মনে পড়ল, কিশোর বয়স থেকে ধাওয়া খেয়ে আসছে এই লোক, এবং আজও বেঁচে আছে। ভাঙা একটা দেয়ালকে ঘুরে পা ফেলতেই বন্যপ্রাণীর হিংস্র চোখ সহ তার মুখটা পলকের জন্যে দেখতে পেল ও, পরমুহূর্তে অনুভব করল মরচে ধরা লোহার একটা রড ওর মাথার ওপর নেমে আসছে। ঝট করে নিচু হলো রানা, ওর চুলে বাতাস দিয়ে রডটা পাশের পাথুরে দেয়ালে লাগল। হাত বাড়িয়ে ওটা ধরার চেষ্টা করল ও, কিন্তু ভারসামা্য আগেই হারিয়ে ফেলেছে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে রডটা ওর মুঠো থেকে বের করে নিল মারকাস। এক মুহূর্ত পর আবার সেটা তুলল সে মারার জন্যে।
রডটা সরাসরি রানার কপালে নেমে আসছে, লাগলে মাথার খুলি চুরমার হয়ে যাবে। গড়াল রানা। ডান কান ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল রড, শক্ত মাটিতে আঘাত করল।
আবার সেটা ধরল রানা, টেনে ও মুচড়ে মারকাসের মুঠো থেকে বের করে আনছে। বঞ্চিত হলো দু’জনেই, দু’জোড়া হাত থেকে ছুটে গেল সেটা, লম্বা ঘাসের ভেতর কোথায় পড়ল কে জানে। ঘুরে পড়ো পড়ো এক প্রস্থ প্রাচীন পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে মারকাস। দোতলার প্রায় কিছুই নেই, অন্তত নিচে থেকে শুধু দোতলার মেঝের ভাঙা খানিকটা কিনারা দেখা যাচ্ছে। সিধে হবার পর রানা দেখল সরাসরি ওর মাথার ওপর, দোতলার মেঝের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মারকাস। ফুটবল আকৃতির একটা আলগা পাথর তুলে নিচে ফেলল সে। সরে গেল রানা, তারপরও পাথরটা ঘষা খেলো কাঁধে। ব্যথায় অবশ হয়ে এলো কাঁধ আর হাত।
সাবধানে, ধীরে ধীরে, সিঁড়ি বেয়ে উঠছে রানা। ভাবছে: ক্লান্ত, হ্যাঁ। কিন্তু যতই ক্লান্ত হই, আমি মাসুদ রানা আকার্ডিয়া মারকাসকে খালি হাতে খুন করে জুলহাস কায়সার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবই।
দোতলায় ওঠার পর তুলনায় ছোট আরও একটা পাথর ছুটে এলো রানার দিকে। মাথাটা নিচু করে নিতে সিঁড়ির ধাপে পড়ে গড়াতে শুরু করল সেটা। সরু মেঝের শেষ দিকের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মারকাস। কাঠামোর খোলা দিকটা তার পিছনে। হিংস্র দৃষ্টিতে রানার দিকে তাকিয়ে আছে সে, চোখেমুখে মরিয়া ভাব। দালানটার পিছনে ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া ঢালটার দিকে তাকাল সে-পাথুরে সারফেস, চারদিকে বোল্ডারের ছড়াছড়ি। এক পলকের জন্যে ইতস্তত ভাব দেখা গেল, তারপর লাফ দিল সে। তাকে পাথরের ওপর পড়তে দেখল রানা, শরীরটাকে সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে দিয়েছে। থেমে একটা গোড়ালি আঁকড়ে ধরল, ব্যথা আর রাগে মোচড় খাচ্ছে মুখ। হামাগুড়ি দিয়ে গোল একটা বোল্ডারের কাছে চলে এলো সে। একটা পাথরের কার্নিসের ওপর কেউ বলতে পারবে না কিভাবে বসে আছে ওটা। ডায়ামিটারে তিন ফুট হবে বোল্ডারটা, ওটার সামনের তলায় ছোট কিছু পাথর আটকে আছে, কার্নিস থেকে ওটার পড়ে না যাবার সেটাই বোধহয় একমাত্র কারণ। বোল্ডারটাকে আগাছা আর ঘাস প্রায় ঘিরে রেখেছে। ছোট পাথরগুলোর দিকে হাত বাড়াল মারকাস রানার দিকে ছুঁড়বে বলে।
লাফ দিয়ে তার পাশের মেঝেতে পড়ল রানা। পড়েই আছাড় খেলো, তবে দাঁড়াতে পারল সঙ্গে সঙ্গে, কোথাও তেমন ব্যথা পায়নি। বোল্ডারটার তলা থেকে এখনও একটা পাথর বের করার চেষ্টা করছে মারকাস; ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে খিস্তি করছে পাথরটাকে। তার দিকে ঘুরছে রানা, ছোট পাথরটা বোল্ডারের তলা থেকে বের করে আনল সে। তারপর সিধে হলো, চোখেমুখে বিজয়ীর হাসি; ওখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, রানা নাগালের মধ্যে এলে পাথরটা ওর মাথায় ভাঙবে। ‘আয় শালা, তোর মগজ বের করি,’ হিসহিস করে বলল সে। ‘অনেক জ্বালিয়েছিস…’
নড়ে ওঠাটা দু’জন একই সময়ে দেখল। ওর কাছের বোল্ডার, ঠেকো হিসেবে তলার পাথরটা সরিয়ে নেয়ায়, পাথুরে কার্নিসের ঢালু মেঝে থেকে গড়িয়ে নামতে শুরু করেছে। মারকাসের মাথা থেকে ঠিক এক ফুট ওপরে কার্নিসটা। বোল্ডারটা নড়ছে দেখে তাকাল মারকাস। তাকিয়েই থাকল। ওটা যেন ওকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। মাত্র সিকি সেকেন্ড সময় পেতে পারত মারকাস। ওইটুকু সময় ইতস্তত করল ওটা, তারপর কার্নিসের কিনারা থেকে গড়িয়ে মারকাসের দিকে পড়তে শুরু করল।
একে তো হাতে ভারী পাথর, তার ওপর গোড়ালি ভাঙা, মারকাস যথেষ্ট দ্রুত সরে যেতে পারল না। এগোতে গিয়েও প্রযোজন নেই বুঝতে পেরে থেমে গেল রানা। বোল্ডারটা তার নাগাল পেতে যাচ্ছে দেখে আতঙ্কে মারকাসের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেল।
বোল্ডারটা যখন নাগালের মধ্যে পেল, দু’হাত বাড়িয়ে দিল মারকাস-যেন ওটার নেমে আসা ঠেকাতে চাইছে সে। কিন্তু ইতিমধ্যে কার্নিসের কিনারা থেকে এত বেশি নেমে এসেছে, ওটার অধোগতি ঠেকাবার সাধ্য এখন কারও নেই। প্রকাণ্ড পাথরটা ধীর গতিতে গড়িয়ে মারকাসের বুকে চড়ল, এক মুহূর্ত টলমল করল, তারপর থেকে গেল ওখানেই। ওটা যখন প্রথম ছুঁলো তাকে-তীক্ষ্ন, কর্কশ, রোমহর্ষক চিৎকার বেরিয়ে এলো মারকাসের গলা চিরে। তারপর হঠাৎ থেমে গেল আওয়াজটা, যেন কেউ নব ঘুরিয়ে একটা রেডিও বন্ধ করে দিল।
রানা গম্ভীর; ঘুরে আরেক দিকে চলে এল, বোল্ডারটার এদিকের তলা থেকে মারকাসের মাথা আর কাঁধ বেরিয়ে আছে। তার চোখ খোলা, তবে দৃষ্টি নেই; তাকিয়ে আছে সাদা, উত্তপ্ত আকাশের দিকে। একটা হাত ঝাঁকি খেলো, তারপর স্থির হয়ে গেল গোটা শরীর। তাকে রানার খুন করতে হয়নি, প্রতিশোধ প্রকৃতিই নিল।
ডাফু সালজুনাসকে নিয়ে বহুরঙা চাঁদোয়ার নিচে, একটা ওয়াটারফ্রন্ট কাফেতে বসে, নীল সাগরে ভেসে যেতে দেখছে রানা জেলে নৌকার বহরগুলোকে। শান্ত ও সিড়বগ্ধ সকাল, সময়টা উপভোগ করছে ওরা।
‘আমি ও জেনারেল সেরাফ গোটা ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষকে ব্যাখ্যা করেছি, এবং আপনার ও মিস তারানার প্রতি তারা সত্যি খুব কৃতজ্ঞ। এখানে কর্তৃপক্ষ বলতে বোঝাতে চাইছি প্রেসিডেন্ট কন্সটানডিনস স্টেফানোপাউলস ও প্রধানমন্ত্রী কন্সটানটাইন সিমিটিসকে।’
কয়েক মিনিটের জন্যে ওদেরকে ছেড়ে গেছে তারানা। দূরে কোথাও যাবে না, একটা ইংরেজি কাগজ নিয়ে ফিরে আসবে।
‘গেনাডি গাম্বুসের জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত,’ বলল রানা।
‘মারকাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ান তিনি বৈরি একটা সময়ে।’
‘সব যুদ্ধেই, ছোট হোক আর বড়, কিছু হতাহত হবেই,’ বললেন সালজুনাস, কফির কাপে চুমুক দিয়ে একটা হাভানা চুরুট ধরালেন। রানাকে সাধলেন না, কারণ আগেই জেনেছেন যে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে ও। ‘মারকাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে-সব সামরিক অফিসার ক্যু ঘটাতে যাচ্ছিল, জেনারেল কাউরিসের কাছ থেকে তাদের একটা তালিকা পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে সবাইকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ‘মারকাস হাজার হাজার, এমনকি সম্ভবত লাখ লাখ মানুষকে নরক যন্ত্রণায় ভোগাত আপনি যদি তাকে না থামাতেন। সেজন্যে মাইকোনোসে উড়ে এসেছি আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাতে। জেনারেলরাও আপনাকে ধন্যবাদ জানাবেন, তবে সেটা এথেন্সে-জনগণের তরফ থেকে সংবর্ধনা আর সরকারের তরফ থেকে আপনাদের দু’জনকে গ্রীসের সবচেয়ে বড় সম্মানিত পদক দিয়ে…’
মাথা নাড়ল রানা। ‘আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ দেবেন তাঁকে,’ বলল ও। ‘তবে আমাদের পেশায় পদক-টদক গ্রহণ করার কোন উপায় নেই।’
‘ঠিক আছে, সংবর্ধনা বাদ,’ বললেন সালজুনাস, ‘কিন্তু পদক নিতে অসুবিধে কি, ওগুলো তো শুধুই রিবন! আপনাদেরকে কোথাও যেতেও হবে না, সরকারই পাঠিয়ে দেবে…’
হেসে ফেলল রানা। ‘ঠিক আছে, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।’ তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইল, ‘আপনি কি এখন পেন্টহাউসে ফিরে যাবেন?’
‘ওই জায়গা থেকে সরে যাচ্ছি আমি,’ বিলিওনেয়ার শিপিং ম্যাগনেট বললেন। ‘যা ঘটে গেল তা থেকে আমি এই শিক্ষাই পেয়েছি যে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখাটা কোন মানুষেরই উচিত নয়। দেশকে এখনও বোধহয় অনেক কিছু দেয়ার আছে আমার।’ গাঢ় চোখে রানাকে কয়েক মুহূর্ত দেখলেন, তারপর অনুনয়ের সুরে বললেন, আপনার কাছে আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে, মিস্টার রানা।’
‘অনুরোধ? বলুন?’
‘এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। আপনি ‘না’ বলতে পারবেন না।’
‘না শুনে হ্যাঁ-ই বা বলি কি করে!’
‘না, ঠাট্টা নয়, অনুরোধটা আমি সিরিয়াসলি করছি।’
‘বলুন।’
‘আমি যে এখনও বেঁচে আছি, কৃতিত্বটা আপনার,’ বললেন সালজুনাস। ‘আমি আপনার এই ঋণ কোনদিনই শোধ করতে পারব না। তাই আপনাকে ছোট্ট একটা উপহার দিতে চাই। ইজিয়ান সাগরে আমার কেনা একটা দ্বীপ আছে। এয়ারস্ট্রিপ, ফাইভস্টার হোটেল, সীবীচ রিসর্ট, পাঁচটা জেটি ইত্যাদি সব একেবারে তৈরি অবস্থায় আছে। ওটা আপনাকে আমি প্রেজেন্ট করতে চাই। সমস্ত কাগজ-পত্র তৈরি করে আমি পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেব…’
‘কিন্তু…’
‘আপনি এই উপহার প্রত্যাখ্যান করলে সত্যি কষ্ট পাব আমি,’ রানাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন সালজুনাস।
‘আমি প্রত্যাখ্যান করছি না, মিস্টার সালজুনাস। আপনার উপহার আমি কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করে আপনার হাতেই ফেরত দিচ্ছি। আমি এমন একটা পেশায় আছি, যাতে কারও কোনও উপহার গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আজ আমি হয়তো আমার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনার কিছুটা উপকার করে ফেলেছি, কিন্তু আগামীকাল, কে জানে, কর্তব্য পালন করতে গিয়ে ক্ষতিও তো করতে পারি।’
মুখটা কালো হয়ে গেল শিপিং ম্যাগনেটের। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনি বিশাল সাউল শিপিং লাইনসের অধিপতি…’
‘হয়তো দেখায় সেরকম, কিন্তু সাউল থেকে একটি পয়সা আমি গ্রহণ করি না। আমার নামে চলছে রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি, কোটি কোটি টাকা রোজগার করছে এ প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এর একটি পয়সাও আসে না আমার পকেটে।’
‘তাই নাকি?’ অবাক চোখে রানাকে দেখলেন সালজুনাস। ‘তাহলে আপনার চলে কি করে?’
‘বেতনের টাকায়। আমি সামান্য একজন বেতনভুক সরকারী কর্মচারী।’
‘তাহলে…?’ হতাশ ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন সালজুনাস, ‘আমি কি আমার কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনও…’
‘আছে,’ মিষ্টি হাসি ফুটল রানার মুখে। ‘আমার দেশ গড়ার কাজে আপনি কোন অবদান রাখলে আমি কৃতার্থ বোধ করব।’
মাথা ঝাঁকালেন শিপিং ম্যাগনেট, শ্রদ্ধা ফুটল তাঁর দৃষ্টিতে। ‘বুঝলাম। ঠিক আছে, নতুন একটা অফিসে গুছিয়ে বসে নিই, আগামী মাসেই ঢাকায় একটা প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছি আমি বিনিয়োগ চুক্তিটা চূড়ান্ত করার জন্যে।’
‘তাহলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না,’ বলল রানা মৃদুকণ্ঠে।
‘আর একটা কথা, প্লীজ! মিস তারানার জন্যে এই হীরের নেকলেসটা…’ ব্রিফকেস থেকে বের করে একটা গহনার বাক্স খুললেন তিনি। ‘উনিও কি আমাকে প্রত্যাখ্যান করবেন?’ রানা দেখেই আন্দাজ করতে পারল, অসম্ভব দামী একটা উপহার, রাজকীয় ঐশ্বর্যই বলা যায়।
‘সেটা ও-ই বলতে পারবে। তবে ওরা সৌন্দর্যের পূজারি, আমার মনে হয় গহনা জিনিসটা মেয়েদের পক্ষে ফিরিয়ে দেয়া কঠিন। দিয়ে দেখতে পারেন।’
‘ধন্যবাদ, মিস্টার রানা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ নেকলেসটা বাক্সে ভরে ব্রিফকেসে রেখে দিলেন সালজুনাস। ‘এটা একটা সারপ্রাইজ গিফট হতে যাচ্ছে, চার-পাঁচ দিন পর কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠাব।’ হঠাৎ ভুরু কোঁচকালেন ভদ্রলোক। ‘আচ্ছা, বলতে পারেন, মিস তারানা তখন ঠিক কোথায় থাকবেন?’
‘আমার ধারণা রাহমানিয়া ইন্টারন্যাশনালে,’ বলল রানা। ‘তবে, ওই তো আসছে ও, ওকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিন।’ কয়েক সেকেন্ড পর ওদের টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল তারানা, হাতে লন্ডনের একটা খবরের কাগজ। ‘প্রতিদিন এই পেপার প্লেনে করে এখানে পাঠানো হয়, তারপরও মাত্র কয়েক ড্র্যাকমার কিভাবে বিক্রি করে বুঝলাম না,’ বলল সে।
‘মারকাসের কথা কিছু লিখেছে?’
কাগজটা টেবিলে মেলে ধরল তারানা, ওরা যাতে পড়তে পারে। বড় হরফে হেডলাইন করা হয়েছে খবরটা: গ্রীসে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ। খবরের পাশে মিস্টার সালজুনাসের একটা ছবিও ছাপা হয়েছে।
‘এই খবর হয়তো আপনার কোম্পানির শেয়ার দর বাড়িয়ে দেবে,’ বলল রানা, হাসছে। চেয়ার ছেড়ে তারানার কোমরে একটা হাত রাখল ও। ‘মিস্টার সালজুনাস জানতে চাইছিলেন আগামী পাঁচ-সাতদিন কোথায় পাওয়া যাবে তোমাকে।’
‘কেন, এই দ্বীপে। রাহমানিয়ায়। এত দৌড় ঝাঁপের পর কম পক্ষে একটা হপ্তা ছুটি তো পেতেই পারি আমরা, তাই না?’
‘আমরা হোটেলের দিকে যাচ্ছি,’ সালজুনাসকে বলল রানা। ‘আপনিও কি আমাদের সঙ্গে হাঁটবেন?’
মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। ‘আমি জানি দু’জন মানুষ কখন একা হতে চায়। ফ্লাইটের সময় না হওয়া পর্যন্ত এখানে বসে ঠাণ্ডা বিয়ার খাব-ধন্যবাদ-আর তাকিয়ে দেখব ওই বিশাল ক্রুজ শিপটা কিভাবে হারবারে ঢোকে। সুন্দর একটা জাহাজের হারবারে ঢোকা দেখতে সত্যি দারুণ ভাল লাগে আমার।’
‘সেক্ষেত্রে গুডবাই, মিস্টার সালজুনাস,’ বলল রানা। ‘আবার হয়তো ভাল কোন পরিবেশে দেখা হবে আমাদের।’
‘হ্যাঁ, হতেই পারে,’ বলে হাসলেন তিনি। হাত নেড়ে বিদায় জানালেন ওদের।
***
Leave a Reply