মাসুদ রানা ২৮৮ – তুরুপের তাস – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ ২০০০
০১.
অচেনা মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে রানা। মাথায় হাত বুলিয়ে কিংবা ঘুমপাড়ানী গান গেয়ে নয়, মিকি ফিন খাইয়ে।
আজই ভোরে সুইটজারল্যান্ড পৌঁছেছে মাসুদ রানা, ফ্রান্সের থনন থেকে শেষ বোটটা ধরে। ডেকহ্যান্ডের ছদ্মবেশ নিয়েছিল ও, কাজও করেছিল খাঁটি একজন ডেকহ্যান্ডের মতই এবং মনে মনে সন্তুষ্ট ছিল, কারও বাপের সাধ্য নেই চেনে ওকে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কেউ না কেউ ঠিকই চিনে ফেলেছিল–আর তার অর্থ আগুনে ঘৃতাহুতি। মাটিতে পড়ার আগেই দুম করে ফেটে গেছে মিশন লেপার্ড! ভাবছে রানা, বিসিআইয়ের দুর্ধর্ষ এজেন্ট, মেজর জেনারেল রাহাত খানের ডানহাত কি তবে তার অনন্যসাধারণ শৈল্পিক কৌশল হারাচ্ছে?
ঘুমন্ত মেয়েটির দিকে ভ্রূ কুঁচকে চাইল রানা। না, সে তার টাচ হারাচ্ছে না। হারাতে পারে না। যে মুহূর্তে হারাবে তার পরমুহূর্তে মৃত্যু ঘটবে ওর।
অগোছাল ছোট্ট রূমটায় পায়চারি করছে রানা। মলিন, পুরনো ড্রেসটা এখনও পরনে ওর। রানা এজেন্সির বা বিসিআইয়ের কারও পক্ষে, এমনকি রাহাত খানের পক্ষেও সম্ভবত এই বেশে ওকে চেনা দুঃসাধ্য। অবশ্য বড়জোর দশ মিনিট লাগবে ওর নিজেকে পাল্টে নিতে। মেয়েটিকে আরেক ঝলক দেখে নিল রানা-আরও ঘণ্টা দুয়েক নিশ্চিন্তে ঘুমোবে সুন্দরী। ছোট্ট খাঁচাটার ভেতর চিতাবাঘের মত পায়চারি করতে লাগল ও। হাঁটাহাঁটি করছে যদিও, চোখজোড়া সদাসতর্ক, অস্থির।
ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই এঘরে, ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে। রানা। বাগ, টাইম বোম, অথবা কোনও ধরনের লিসনিং ডিভাইস-না, নেই। জেনেভার একটা অপরিচ্ছন্ন, সস্তাদরের হোটেল রূম এটা। কারও পক্ষে আগেভাগে অত প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কেউ জানত না ও আসছে এবং এখানে উঠছে।
নাকি জানত? ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হচ্ছে রানার। কিন্তু তাহলে এই মেয়েটা জুটল কিভাবে?
ছোট করে ছাঁটা চুলে দুহাত বুলিয়ে নিল রানা। ছদ্মবেশের স্বার্থে এতটা ছোট করতে হয়েছে ওকে চুল।
খুব সহজভাবে মিশন লেপার্ড-টাকে নিয়েছে রানা। ওর মূল উদ্দেশ্য ভিন্ন। মিশনটা কিছুই না, নিতান্তই সাধারণ–দুনিয়ার সবচাইতে নিরাপদ ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আনতে হবে দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান এক চিতাবাঘ। এক ফুট উঁচু চিতাবাঘটা, দেড় ফুট লম্বা, চোখে ধারণ করছে পৃথিবীর বিশালতম দুটো রুবি। মূর্তিটা খাঁটি সোনায় তৈরি। টাকা দিয়ে এর বিচার হয় না, জিনিসটা অমূল্য। অনেক কারণেই। চিতাবাঘটাকে হাত করতে চাইছে অনেকে, উদ্দেশ্যও তাদের একেকজনের একেক রকম।
এই কেসে রানা নিজেকে জড়িয়েছে একান্ত ব্যক্তিগত কারণে। ওর মিউনিখ প্রবাসী এক বন্ধু হঠাৎ কমাস আগে মারা যায়, সপরিবারে। মারা যায়। মানে, মেরে ফেলা হয়। স্বামী-স্ত্রী আর পাঁচ বছরের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটা আরও অনেক বিদেশীর মত রুডলফ ব্রিগলের নৃশংস সন্ত্রাসের শিকার হয়। রানার বন্ধু, কায়সার রশীদ, অভিবাসী হিসেবে মিউনিখে থাকত। কিন্তু নিও নাজীরা ইদানীং জার্মানীর নানা জায়গায় বিদেশীদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকলে শঙ্কিত হয়ে পড়ে কায়সার। রানার সঙ্গে ওর কথাও হয়েছিল এ ব্যাপারে। রানা ওকে দেশে ফিরে আসতে বলে। কিন্তু বেচারার কপালে থাকলে তো!
রুডলফ ব্রিগলের সন্ত্রাসবাদী দল একাধিক বার রাতের অন্ধকারে আগুন। জ্বেলে ছারখার করে দিয়েছে অভিবাসীদের অনেকগুলো বাড়ি-ঘর। এমনি এক মর্মান্তিক ঘটনায় জীবন্ত দগ্ধ হয়ে বেঘোরে মারা পড়ে কায়সার, তার স্ত্রী মমতাজ আর একমাত্র মেয়ে, ফুলের মতন নিষ্পাপ শিশু রোজানা।
মেনে নিতে পারেনি মাসুদ রানা, কোনও সুস্থমস্তিষ্কের মানুষই পারবে না। প্রতিজ্ঞা করেছে ও, শেষ দেখে ছাড়বে রুডলফ ব্রিগলের।
রানা ব্যক্তিগত কাজে জেনেভা যাচ্ছে শুনে মেজর জেনারেল ওর ওপর চাপিয়ে দিলেন মিশন লেপার্ডের ভার। রাশেদকে পাঠাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু রানার ব্যক্তিগত আক্রোশকে কাজে লাগানাৈর উদ্দেশে ওকে অনুরোধ করলেন চিতাবাঘটা এনে দেয়ার জন্যে। ব্রিগলও নাকি লেগেছে ওটার পেছনে, হাত করতে চাইছে দুষ্প্রাপ্য মূতিটাকে।
এক কথায় রাজি হয়ে গেছে রানা। দেখে নেবে ও, কতবড় সন্ত্রাসী লোকটা। দলবল লেলিয়ে দিয়ে নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করতে যার বাধে না, নির্মম প্রতিশোধ নেবে ও তার ওপর। দুঃখজনক ঘটনাটা ঘটার পরপরই জার্মানীতে চলে যায় রানা। কিন্তু দেখা পায়নি ব্রিগলের। আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় লোকটা। কিন্তু এখন নাকি সে চিতাবাঘের মূর্তিটার পিছনে লেগেছে। শুনে খুশি হয়েছে-রানা। কপাল গুণে সুযোগ এসে গেছে ওর। সামনে।
আচ্ছা, এই মেয়েটিও কি চাইছে মূর্তিটা?
সোফার কাছে এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যুবতাঁকে দেখল রানা। বাচ্চামানুষের মতন ঘুমাচ্ছে। ফুটফুটে একটা বাচ্চা! কত হবে, আন্দাজ করল রানা, পঁচিশের একটু এদিক বা ওদিক। প্রশান্ত মুখের চেহারায়, আবছা রেখাগুলো যেন অভিজ্ঞতা ও ভোগান্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। দামী ফেইল স্যুটের আড়ালে যুবতীর। দেহবল্লরী দীর্ঘ ও ঢেউ খেলানো। বিশেষজ্ঞের রায় দিল রানা—নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়।
সোফায় শরীর মোচড়াল মেয়েটি, ঘুমের মধ্যে অস্থির। তার খাটো স্কার্টটা কুঁচকে উঠে গেল ওপরদিকে। চিন্তিতভঙ্গিতে, বেইজ স্টকিং পরা ফর্সা, সুগঠিত পা-জোড়া জরিপ করল রানা। এবার নুয়ে পড়ে, স্কার্টটা তুলে দিল। ওপরে। সুডৌল দুই ঊরুতে কালো রঙের চওড়া গার্টার। দুটো গার্টারেই একটা করে খুদে হোলস্টার। এবং হোলস্টার দুটোয়, ধবধবে সাদা সাটিন সিল্কের পটভূমিতে, নিরীহ ভঙ্গিতে সেটে রয়েছে ছোট্ট একটা ছুরি ও খুদে একটা পিস্তল।
খাপ থেকে আলগোছে অস্ত্র দুটো তুলে নিল রানা, সতর্ক রইল মেয়েটির শরীরে যাতে স্পর্শ না লাগে। তারপর স্কার্টটা টেনে নামিয়ে দিয়ে, অস্ত্র দুটো নিয়ে, টিমটিম করে জ্বলা একমাত্র ল্যাম্পটার কাছে চলে এল।
আদৌ ছুরি নয় এটা, ছোট্ট একটা স্টিলেটো। স্পেনে তৈরি পিচ্চি একটা সূচ। খাজ কাটা। পিস্তলটা ওয়েবলির তৈরি ক্ষুদ্রতম অটোমেটিকের সর্বশেষ সংস্করণ। লিলিপুট। ওটা মুঠোয় পুরে দাঁত বের করে হাসল রানা। ট্যাক্সিতে করে এখানে আসার সময় কে ভেবেছিল ওর যুবতী সঙ্গিনীটি সশস্ত্র? পপ-গানের। মতন শব্দ করে পিস্তলটা, এবং জায়গা মত লাগানো গেলে .৪৫ কোল্টের। চেয়ে, অথবা রানার সঙ্গে করে আনা লুগারটার চাইতে কম ভয়ঙ্কর নয়।
ঘরের একপাশে অপ্রশস্ত, স্প্রিং দেবে-যাওয়া খাটটার কাছে এসে দাঁড়াল রানা। গ্ল্যাডস্টোন ধাচের ইয়া বড় এক সুটকেস পড়ে রয়েছে ওটার ওপর। কুমীরের চামড়া দিয়ে তৈরি সুটকেসটার গায়ে ফাটা-ফাটা ট্র্যাভেল স্টিকার সাটা গোপন তল ও পার্শ্বদেশ রয়েছে জিনিসটার। এক গাদা খুদে থলিতে ও কম্পার্টমেন্টে ঠাই পেয়েছে ওষুধ ভর্তি নানা পদের শিশি-বাতল আর সাজ সরঞ্জাম। রানার এবারের মিশনের জন্যে বিশেষভাবে তৈরি করে দিয়েছে এটা, বিসিআই। আনতে চায়নি রানা, জগদ্দল পাথরের মতন মনে হচ্ছিল ওর কাছে জিনিসটাকে। কিন্তু বুড়ো খানের ওপর কথা বলে কার সাধ্য। টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের আশরাফ চৌধুরীর ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। বিভিন্ন ধরনের গ্যাজিট তৈরিতে লোকটার জুড়ি মেলা ভার, মনে মনে স্বীকার করে রানাও। কাজেই আশরাফ চৌধুরী সুটকেসটা গছিয়ে দিতে চাইলে আর কোন ওজর আপত্তি টেকেনি।
সুটকেসে ছুরি ও পিস্তল চালান করে, ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে, থমকে গেল। রানা। সুটকেসটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। কপাল কুঁচকে গেছে ওর। এটাকে সঙ্গে করে আনাটা কি ঠিক হয়েছে? সামান্য একজন ডেকহ্যান্ডের লাগেজ হিসেবে কি মানানসই জিনিসটা? এরই কারণে কি, আক্কেল সেলামী দিতে হবে ওকে নিজের জীবন দিয়ে?
শ্রাগ করে কাজে মন দিল রানা। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর পিছু চেয়ে, লাভ নেই, এখন শুধু আগে বাড়ার পালা। কিন্তু কেউ একজন কিছু একটা ভুল। করেছে। কোনওখানে। কোনওভাবে।
ঘুমন্ত সুন্দরীকে আবার পরখ করে নিল ও। এখনও আউট হয়ে আছে। স্কার্টটা আবারও টেনে নামিয়ে দিয়ে দ্বিতীয়বারের মত যুবতীর পার্সটা ঘেঁটে দেখল, স্রেফ নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। লাগেজ নেই মেয়েটির সঙ্গে।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না এবারও। যুবতীদের পার্সে সচরাচর যা থাকে একটা কম্প্যাক্ট, টিসু, তিনটে লিপস্টিক, চেঞ্জ, আধ-ভর্তি, এক প্যাকেট বেনসন। ফরাসি ও জার্মান মুদ্রা প্রচুর পরিমাণে, কিন্তু সুইস ফ্রাঁ নেই। ব্যাপারটা। বিস্ময়কর নয় মোটেই। রানার সঙ্গে লেক পার হয়েছে ও-সত্যি বলতে কি রানাকে তুলে নিয়েছিল বোটে-এবং তারপর থেকে এখন অবধি কারেন্সি পাল্টে নেয়ার সময় পায়নি।
পাসপোর্টটা পড়ে এবারও আগেরবারের মতই আগ্রহ ও বিস্ময় বোধ করল রানা। জার্মান। নিজের পরিচয় দিচ্ছে ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ হিসেবে। রবার্টা জুলি গ্রাফ। রবাটা? ইংরেজ নাম নয়? ভবিষ্যতে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। রানা-আদতেই যদি ভবিষ্যৎ বলে কিছু থেকে থাকে ওদের।
পাসপোর্ট হাতে সোফার কাছে ফিরে এসে মেয়েটির ঘুমন্ত মুখটা পরীক্ষা করল রানা। কোন সন্দেহ নেই, এই মেয়েই ব্যারোনেস! অন্তত এটুকু বলা যেতে পারে, ব্যারোনেসের পাসপোর্টে ওটা এই মেয়েরই ছবি।
কে জানে, এই মেয়ের ব্যারোনেস হওয়া অসম্ভব নয়, পোশাক-আশাক তো রীতিমত জমকালো আর দামী।
পার্সের মধ্যে পাসপোর্টটা ছুঁড়ে দিয়ে, হতবিহ্বল দৃষ্টিতে নোনা ধরা সিলিঙের দিকে চেয়ে রইল রানা। হোটেল হিলসনে জোরজার করে রানার সঙ্গে আসার পর থেকেই, কেমন জানি খানিকটা ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল যুবতাঁকে। আচ্ছা, এই মেয়ে কাউন্টার-স্পাই নয় তো? হয়তো কাজ করছে স্বাধীনভাবে, ধান্ধা করছে দুতরফ থেকেই ফায়দা লোটার। সন্দেহটা অমূলক নয়। স্টীমারে সেই প্রথম থেকেই, সাধারণ এক ডেকহ্যান্ডের ছদ্মবেশধারী, রানার সঙ্গে ঢলাঢলির কম চেষ্টা তো করেনি মেয়েটি, তারপর তো একরকম জবরদস্তি করেই হোটেল অবধি এসে উঠেছে। যা-ই হোক, খোলসা করে ব্যাপারটা জানতে হবে রানার।
সুটকেস থেকে তাই ওয়াইনের বোতলটা বের করেছিল ও। অবস্থান নিয়েছিল মেয়েটি ও দরজার মাঝখানে, এবং দুজনের জন্যে ঢেলেছিল ছোট্ট দুটো ড্রিঙ্ক। কায়দা করে যুবতীর গেলাসে ফেলে দিয়েছিল ঘুমের ওষুধ।
পরিচয় জেনে নেয়া গেছে মেয়েটির, এখন কি করবে ওকে নিয়ে?
শীঘ্রিই ভোর হয়ে যাবে। দ্রুত এখান থেকে বেরিয়ে মেজর জেনারেলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কি ঘটছে জানাবে তাকে। মিশন লেপার্ড হয়তো এরইমধ্যে চালু হয়ে গেছে। কিংবা এই ব্যারোনেস ভদ্রমহিলা হয়তো ও যা ভাবছে সে সব কিছুই নয়, আজব ধরনের কোন কলগার্ল। বস হয়তো কিছু জানাতে পারবেন এ বিষয়ে। মিকি ফিনের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা আছে রানার, কিন্তু সাবধানের মার নেই। সুটকেস থেকে, বিশেষভাবে তৈরি হাত-পা-মুখ বাধার স্ট্র্যাপগুলো বের করল ও। কাজ সারা হয়ে গেল, এক মিনিটের মধ্যে। এখন নিশ্চিন্ত, নড়াচড়ার।
সুযোগ পাবে না ব্যারোনেস। এক চিলতে একটা বাথরূম, কুমীরের চামড়ার সুটকেসটা নিয়ে ঢুকল ওখানে রানা। অল্প কিছুক্ষণ লাগল জুরিখের কাছে জন্ম। নেয়া, ডেকহ্যান্ড কেনেট ডাহলিনের ছদ্মবেশ পাল্টে ফেলতে।
একটু পরেই ওহাইয়ো, আমেরিকার মিস্টার উইলিয়াম হথর্নকে বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে, ঘুমন্ত মেয়েটিকে পরীক্ষা করতে দেখা গেল। মুখের বাধন শ্বাসরোধ করবে না ওর; এবং রানা আগেই লক্ষ করেছে যুবতী মুখ দিয়ে শ্বাস নেয় না। ঊর্ধ্বমুখী বেয়াড়া খাটো স্কার্টটা আবারও টেনে নামিয়ে দিল রানা, থুড়ি, মিস্টার হথর্ন।
ভুড়িওয়ালা মি. হথর্ন একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক, মাথার চুল ধূসর ও পাতলা হয়ে এসেছে তার। ভুড়িটা বাগাতে ছোটখাট একটা রাবারের পনশ ব্যবহার করতে হয়েছে রানাকে।
রানা বেরোতে যাবে এমনিসময় মাথায় ঘাই মারল চিন্তাটা। আরেহ! ও এত অসতর্ক হলো কবে থেকে? মেয়েদের চিরাচরিত ও বহুল ব্যবহৃত গোপনীয় স্থানটার কথা বেমালুম ভুলেই গেছে!
বুকচেরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মি. হথর্ন। এ ধরনের কাজ তার মতন। ভদ্রলোকের সাজে না। কিন্তু রানার কথা আলাদা।
অগত্যা, যুবতীর পাতলা ব্লাউজটার বোতামগুলো খুলে ফেলতে হলো। হাফ ব্রা মেয়েটির ভরাট বুকের প্রায় সবটুকুই অনাবৃত করে রেখেছে। বুকের উপত্যকা থেকে চেন ধরে টেনে সিলভার লকেটটা তুলে আনল রানা।
জিনিসটা প্রকাণ্ড। আকারে সিলভার ডলারের প্রায় সমান হবে। আঙুলের টোকায় খুলল ওটা রানা। একদৃষ্টে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইল ভেতরের ফটোটার দিকে।
মুখের চেহারা বিকৃত হয়ে গেল মাসুদ রানার মত কঠোর-হৃদয়, বেপরোয়া পুরুষেরও।
.
০২.
লকেটের চেহারাটা-বাকা, কুঁচকানো মৃত মুখটাকে আদৌ যদি চেহারা বলা যায়-একজন প্রৌঢ় জার্মানের।
আবছাভাবে মনে পড়ছে রানার, নিও-নাজীদের বিরোধিতা করার কারণে হত্যা করা হয় এই লোকটিকে। জার্মান এক পত্রিকায় সম্ভবত সচিত্র প্রতিবেদন দেখেছিল সে। বেশ কয়েক বছর আগে।
কিন্তু এ লোকের ছবি কি করছে ব্যারোনেসের বুকের মাঝখানে? এর সাথে কি সম্পর্ক ঘুমন্ত রাজকন্যার?
লকেটটা যেখানে ছিল রেখে দিয়ে এটে দিল রানা ব্লাউজের বোতামগুলো। হাত বুলিয়ে দিল মেয়েটির গালে। কে এই ব্যারোনেস? ছুরি-পিস্তল সঙ্গে রাখে, গলায় পরে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে নিহতের ছরি, ভাবছে রানা।
ঘুমের মধ্যে একবার নড়ে মৃদু গুঙিয়ে উঠল যুবতী। মুখের চেহারা লালচে দেখাচ্ছে ওর, হানি-ব্লন্ড চুল কুঁকড়ে, লতিয়ে পড়ে রয়েছে কপালময়। ঘুমাও, সোনা-মাণিক, বিড়বিড় করে আওড়াল রানা, আমি একটু বেড়িয়ে আসি।
অগোছাল ঘরটার চারধারে, চকিত চাহনি বুলিয়ে নিল রানা শেষবারের। মত। দরজার লকটা খুব একটা মন্দ নয়। বাথরূমে জানালার বালাই নেই। ঝুলকালি-মাখা, ফাটল ধরা, ঘরের সবে ধন নীলমণি জানালাটাও বন্ধ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এক ফোঁটা বাতাস ঢোকারও সুযোগ রাখেনি।
নোংরা একটা প্যাটাইনার মধ্যে দিয়ে জং ধরা ফায়ার এস্কেপটার দিকে, উঁকি মারল রানা। পাক খেয়ে, চার ধাপে পেছনের এলাকায় নেমে গেছে ওটা। ওখানে পড়ে থাকা ব্রক্স, পরিত্যক্ত ক্যান, বেতের ঝুড়ি ইত্যাদির ছায়া লক্ষ করে উপলব্ধি করল রানা, তুরিত হানা দেবে ঊষা।
শীতল সারিয়্যালিস্টিক আলোয়, সামনে বিছিয়ে থাকা দানা বাঁধা ছায়াদের সঙ্গী করে, খোয়া-পাথরের শূন্যগর্ভ শব্দ শুনতে শুনতে, সংকীর্ণ গলিগুলো দিয়ে। এগোচ্ছে রানা। একবার, একটা ইন্টারসেকশনে, ওর দিকে আসতে দেখল দুজন পুলিসকে। একটা দোকানের পাশে চট করে আড়াল নিল রানা। কিন্তু ঘুরে অন্যদিকে চলে গেল দুই পুলিস। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। জেনেভা পুলিসের সঙ্গে কোন হাঙ্গামায় জড়াতে চায় না রানা। কি ব্যাখ্যা দেবে সে, যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বিশিষ্ট বিজনেসম্যান মি. উইলিয়াম হথর্ন অচেনা শহরে রাতবিরেতে ঘুরঘুর করছে কেন?
কুয়াই-দু-মন্ট-ব্লাঁ-তে এসে একটা ট্যাক্সি র্যাঙ্ক খুঁজে পেল রানা, জানত পাবে। সাধের চটকা ভাঙানোতে রক্তচক্ষু মেলে চাইল শোফার। প্রতিবাদ করতে মুখ খুলে, আবার কি ভেবে যেন বন্ধ করে ফেলল। এই হোদলকুতকুত, বুড়ো আমেরিকানটার মাথা খারাপ হলে কি আর করা, যেখানে, নিয়ে যায় যাবে। হাজার হলেও কাস্টোমার-লক্ষ্মী। মেদবহুল কাঁধ কঁকিয়ে, প্রাচীন এঞ্জিনটা স্টার্ট দিল সে। বিদেশী মোটা বুড়োটার চোখজোড়া কেমন জানি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল ওকে। তরবারির মত ঝকঝকে, তীক্ষ্ণ দুচোখের দৃষ্টি সোজা অন্তরে গিয়ে বেঁধে, লোকটার ভুড়ির সঙ্গে ওটা একেবারেই বেমানান।
অ্যালনস! পেছন থেকে বলল ভুড়িঅলা। ভাইট!
মারদে! বলল ড্রাইভার। তবে আত্মগতভাবে।
.
প্রায় চল্লিশ মিনিট পর সুসজ্জিত, খুদে ডিপোটা থেকে বেরিয়ে এল মাসুদ রানা। জরাজীর্ণ, প্রাচীন এক বিল্ডিঙের নিচে, একটা সেলার। ওখানে রানা এজেন্সির। অফিসের, অর্থাৎ ডিপোটার অবস্থান। ছোট অথচ শক্তিশালী রেডিও ট্রান্সমিটার। ঢাকায় বিসিআই ফোন সিস্টেমে সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছে রানার।
রানা যখন ঢুকেছে দুজন লোক ছিল তখন ডিপোতে। ওদের সঙ্গে কথা বলার পর এবং বিশেষ একটি ইশারা করে, কার্ড প্রদর্শনের পর ভারী দরজার বার নামানো হয় ওর জন্যে।
বাইরে মধ্য সেপ্টেম্বরের চোখ ধাঁধানো সকাল। দামী সুইস ওয়াইনের মত স্বচ্ছ, ঝলমলে, তাজা বাতাস; সূর্যের ঠাণ্ডা আলোয়, রোনের নীলগোলা পানিতে সোনালি চুড়ির প্রতিফলন যেন। খোয়া বিছানো সরু একটা ব্রিজ অতিক্রম করছে এ মুহর্তে রানা। হোটেলে হেঁটে ফিরবে ঠিক করেছে ও। হাতে সময় রয়েছে পর্যাপ্ত। মেয়েটি আরও অন্তত এক ঘণ্টা আরামে ঘুমাবে। দীর্ঘ, পেশল পা দুটো স্ট্রেচ করার প্রয়োজন অনুভব করছে রানা, উইলিয়াম হথর্নের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে খিল ধরে গেছে পেশিতে। মাথাটাও একটু-আধটু খাটানো দরকার। মিশনটা যা ভেবেছিল মোটেই তত সহজ নয়, ক্রমেই জটিল। হয়ে উঠছে। বসের সঙ্গে কথোপকথনের পুরো বিষয়টা উল্টেপাল্টে বিবেচনা করছে রানা। অনেক প্রশ্নেরই জবাব জানা হয়েছে ওর, আবার অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে মনে।
ব্রিগল আর নাকাতা রওনা হয়ে গেছে। দুজনেই স্পষ্টত জেনেভার উদ্দেশে মুভ করছে। হয়তো পৌঁছেও গেছে ইতোমধ্যে। ওরা চিতাবাঘটা হাত করার পরপরই ওটা ছিনিয়ে নিতে বলেছেন বস রানাকে।
সম্প্রতি ওকে যে ব্রিফিং দেয়া হয়েছে সেটার কথা ভাবছে রানা। রুডলফ ব্রিগল আর হির্দেতোশি নাকাতা হচ্ছে সেই দুই শৰ্মা, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে যাদেরকে। বিসিআই ও আরও গোটা ছয়েক দেশের এজেন্সি ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় আছে, সোনার চিতাবাঘ তুলে। নিতে কবে মাঠে নামে লোক দুটো। অবশেষে কাজে নেমে গেছে তারা।
দুদিন আগে টোকিও ত্যাগ করেছে নাকাতা। গন্তব্য জেনেভা। কাভার নিয়েছে সে ক্যামেরা বিক্রেতার। আর চারদিন আগে হামবুর্গ ছেড়েছে দ্বিগল। তারও গন্তব্য, বলাইবাহুল্য, সেই একই।
প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছে রানা, ব্যারোনেস রবার্টা জুলি গ্রাফ জার্মান। ইন্টেলিজেন্সের একজন এজেন্ট। তার পরিচয়ে কোন খুঁত নেই। এই মিশনে। তার অন্তর্ভুক্তির কারণ রুডলফ ব্রিগল নিজের চেহারা পাল্টে নিয়েছে, প্লাস্টিক সার্জারি করে। রানার কাছে লোকটার যে ছবি আছে সেটা এখন অর্থহীন। একমাত্র ব্যারোনেস গ্রাফই চেনে রুডলফ ব্রিগলের আসল চেহারা।
বস স্পষ্ট ভাষায় রানাকে সাবধান করে দিয়েছেন কালকেউটের চাইতেও শতগুণ ভয়ঙ্কর এই জার্মান সন্ত্রাসী সম্পর্কে। বলেছেন, তোমাকে আর নতুন করে কি বলব। তবে একটা কথা, রানা, কাভার ফাস হয়ে গেলে ব্রিগল জেনে যাবে তুমি কে। কিংবা জানার সুযোগ পাবে। কিন্তু সে ঠিকই নিশ্চিত থাকবে তুমি ওকে চিনতে পারবে না–পারতেও না, যদি না ওই ব্যারোনেস মেয়েটা আমাদের পক্ষে থাকত। আসলে সমস্ত প্ল্যানই নাকি ব্রিগলের। নাকাতা নাচছে। তার কথায়।
কিন্তু, স্যার, আমতা আমতা করে বলেছে রানা, ব্যারোনেস আমাকে চিনে নিয়ে বোটে তুলল কিভাবে?
তোমার জেনেভায় ঢোকার সম্ভাব্য কয়েকটা রুট জানিয়ে দিয়েছিলাম বন কে। তোমার উদ্ভট সুটকেসটার স্টিকারগুলোর কথাও বলেছিলাম। বিসিআইয়ের পক্ষে টেম্পোরারি এজেন্টের কাজ করছে এখন ব্যারোনেস।
ব্যারোনেসের লুকেটে পোরা ছবিটার কথা বসকে জানিয়েছে রানা।
লোকটা নিশ্চয়ই ওর বাবা, বলেছেন বস। ব্যারোনেস ছবিটা সঙ্গে নিয়ে ঘোরে, ব্রিগলকে খুন করতে হবে সেই প্রতিজ্ঞাটা নিজেকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে। তোমার মত সে-ও লোকটাকে পচা ঘায়ের মত ঘৃণা করে, লোকে অন্তত তাই বলে। ব্রিগলকে বাগে পাওয়ার জন্যে গত কয়েক বছর ধরেই লেগে আছে পিছনে। জুডাসের মত চিনিয়ে দেবে সে ব্রিগলকে। বাকি কাজ তোমার। তুমি হুঁশিয়ার না থাকলে ও নিজেই হয়তো ফাঁক পেয়ে খুন করে বসবে লোকটাকে। লক্ষ রেখো মেয়েটার দিকে, রানা। ও এখন কোথায়? তোমার হোটেলে?
জ্বী, স্যার, জবাব দিয়েছে রানা। গভীর ঘুম দিচ্ছে। ওকে মিকি ফিন খাইয়ে দিয়েছি।
.
ছোট ব্রিজটা পেরিয়ে, মি. হথর্নের হুঁড়ি ও চরিত্রের সঙ্গে মানানসই চলনভঙ্গি রপ্ত করে নিতে, একটুক্ষণের জন্যে বিরতি নিল মাসুদ রানা। ঝট করে চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ভুড়িটা হাতিয়ে যথাস্থানে ফের বসিয়ে নিল।
তিন মাস আগে, মেজর জেনারেল রাহাত খানের অফিসে মনটা চলে গেল ওর। বস্ তখনই আভাস দিয়েছিলেন, শীঘ্রি সুইটজারল্যান্ড যেতে হতে পারে ওকে।
তারপর তো ব্রিফিঙের নামে সোহেলের ওই বকবকানি। সুইস ব্যাঙ্ক ও ফ্রেঞ্চ কী সম্পর্কে কান পচিয়ে ছেড়েছিল ওর।
বিশেষ করে জেনেভা আর বার্নের সুইস ব্যাঙ্কগুলো, ডিপোজিটরদের চেনার জন্যে গোপন কোড ব্যবহার করে থাকে, বলে সোহেল। এই অ্যাকাউন্টগুলো এমনই ক্লোজলি গার্ড দেয়া হয় যে-কী আর বলব-কাগজে কলমে কিছুই পাবি না। কোড নম্বরগুলো মুখস্থ করা হয়।
শুনে হাঁ হয়ে গেছে রানা। বলে কি শালা? ডিপোজিটর তার কোড নম্বর মনে রাখতে পারে, কিন্তু ব্যাঙ্ক ম্যানেজার কিভাবে?
সোজা, কথা কেড়ে নিয়েছে সোহেল। অবশ্য তোর কাছে সবই কঠিন। রানাকে চোখ পাকাতে দেখে মুখ টিপে হেসে ফের বলে চলে, ওদের অনেক ম্যানেজার আর সহকারী থাকে। কাজেই অল্প কয়েকজনের কোড নম্বর মুখস্থ করে রাখা এমন কোন কঠিন কাজ নয়, বোঝা গেছে, বুন্ধু কাহিকে?
মুখ বুজে গালি-গালাজ হজম করতে করতে সোহেলের কথামত পান। করেছে রানা।
এবার আয় ফ্রেঞ্চ কী-র প্রসঙ্গে। এই যে দেখ, একটা পিচ্চি গ্যাজিট। জীবনেও তো দেখিসনি, আদেখিলে কোনখানের, আগে আশ মিটিয়ে দেখে। নে। স্টীলের খুদে রডটা রানার উদ্দেশে ছুঁড়ে দেয় সোহেল।
জিনিসটা লুফে নিয়ে ভাল করে লক্ষ করে রানা।
এই সো কল্ড চাবিগুলো মুখস্থ করা কোড নম্বরের জায়গা নেয়। বড়সড় কোন ভল্ট ভাড়া দেয়া হলে সচরাচর ব্যবহার করা হয় এগুলো। সাধারণ সেফ ডিপোজিট বক্স হলে নয়। এই রড, কিংবা চাবি, ভল্টলকের মাঝখানের বিশেষ একটা গর্তে ঢোকানো হয়। ক্লায়েন্ট আর ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সামনে ভল্ট লক করা হলে, গর্তে গুঁজে দেয়া হয় ফ্রেঞ্চ কী। তারপর বিশেষভাবে তৈরি একটা। করাত দিয়ে কেটে ফেলা হয় ওটাকে, ফলে চাবিটার দুপ্রান্তে স্পেশাল চিহ্ন রয়ে যায়। লকের ভেতর ঢুকে থাকে চাবির একটা অংশ। বাকি অর্ধেকটা দিয়ে দেয়া হয় ক্লায়েন্টকে। চাবির দুটো অংশ ম্যাচ করলে পরই কেবল খোলা যাবে ভল্ট, কাটা অংশ পরস্পর জুড়তে হবে ভল্ট খুলতে হলে। বিশেষভাবে তৈরি। ওই করাতটাকেও এরপর ধ্বংস করে দেয়া হয়। দুটো চাবি কখনোই এক হবে। অর্থাৎ বিশেষ ভল্টটা খুলতে বিশেষ, ওই চাবি লাগবে, এছাড়া হচ্ছে না।
কিন্তু ধর, ক্লায়েন্ট যদি কাউকে টুকরোটা দিয়ে দেয়, কিংবা ওটা চুরি যায়? খেই ধরিয়ে দেয় রানা।
এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক তাই ঘটেছে। শোনা যায়, ইয়ামাগুচি নাকাতা। আর কার্ল ব্রিগল যার যার ছেলেকে দিয়ে গেছে চাবির টুকরো।
আবার বর্তমানে ফিরে এল রানা। হিদেতোশি নাকাতা ও রুডলফ ব্রিগল এখন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া চাবির টুকরো জুড়ে সোনার চিতাবাঘটা হাতাতে চাইছে।
…মি. উইলিয়াম হথর্ন ফিরতি পথ ধরে, থপথপ করে হোটেলের উদ্দেশে হেঁটে চলেছে। মান্যবর ব্যক্তিটি ভুড়ি দুলিয়ে, খোয়া বিছানো গলিটা দিয়ে হাঁটার সময় ভয়ানক লজ্জিত বোধ করছে। তার মতন এতবড় একজন বিজনেস ম্যাগনেট কিনা এই নোংরা গলিপথ ধরে…ছি, আর ভাবতে পারল না সে। জেনেভার বাসিন্দারা যার যার দৈনন্দিন কাজে পথে নামায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সড়কগুলো। হোঁতকা আমেরিকানটির দিকে এখন কারও দৃষ্টিক্ষেপের সময় নেই। খানিকটা অভিমান মত হলো রানার। ছদ্মবেশ ধরতে খাটুনি কি কম? বাইক ও ছোট ছোট মোটর গাড়িগুলো হর্ন বাজিয়ে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। সূর্য এমুহূর্তে আধ ঘণ্টা ওপরে অবস্থান নিয়েছে, নির্মল সোনালী আলো। অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে গলি, তস্যগলিতে। বাতাসে প্রথম শরতের ফিকে গন্ধ।
রিস্টওয়াচ বলছে ঝাড়া পঁচিশ মিনিট ধরে হাঁটছে রানা। আর দুই, বড়জোর তিন মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যাবে ও।
লাগল আসলে পাক্কা দুমিনিট। গোলগাল আমেরিকান ভদ্রলোকটি হেলতে দুলতে বাঁক ঘুরে অ্যালী ডি নেপোলিয়নে ঢুকল। এঁদো গলির আবার গালভরা। নাম, বলল মনে মনে, এবার আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝটিতি– বিস্ময় ও সতর্কতার লেশমাত্র না দেখিয়ে-ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি স্থাপন করল ছোট্ট একটা পুরানো বইয়ের দোকানের জানালায়। মুহূর্তে উবে গেছে নাদুসনুদুস মি. হথর্নের চরিত্র। সে জায়গা দখল করে নিয়েছে এখন মাসুদ রানা। প্রতিটি ইন্দ্রিয় সজাগ তার, সতর্ক দেহের প্রতিটি পেশি। দেখেই চিনেছে রানা। ওই যে, হোটেল হিলসনের সামনে দুজন ওয়াচার।
গাট্টাগোট্টা লোক দুজনের গায়ে কালো রেইনকোট ও মাথায় নরম ফেল্ট হ্যাট। হোটেলের উল্টোদিকে, একটা কাঠের হোর্ডিঙে অলস ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ওরা, সিগারেট টানছে আর একঘেয়ে গোমড়া দৃষ্টিতে চেয়ে। রয়েছে হোটেলটার অন্ধকারময় প্রবেশমুখের দিকে।
দোকানের জানালায় মন দিয়ে মেডিকেলের ধুলো পড়া মোটা বইগুলো। দেখার ভান করছে এখন রানা। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত লয়ে বইছে ওর, অতিপরিচিত রোমাঞ্চের অনুভূতি হচ্ছে, সঙ্গে খানিকটা ভীতিও মিশেছে। অতীতে অসংখ্যবার এই বিশেষ অনুভূতিটা জীবন রক্ষা করেছে ওর।
পুলিস না! সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে রানার মস্তিষ্ক সম্ভাবনাটা যাচাই করে বাদ করে দিল। ওর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চোখ বলছে লোক দুটো পুলিস নয়। পুলিস আসার কোন কারণ নেই, কেনেট ডাহলিনের কাগজপত্রে তো কোন গলদ নেই। আধ মাতাল নাইট পোর্টার, রানার কাছ থেকে অগ্রিম ভাড়া নিয়েছিল যে, ব্যারোনেসের দিকে তাকায়ইনি বলতে গেলে। আরও হাজারো গেস্টের মতন এরাও এসেছে, কঘণ্টা বাদে চলেও যাবে। রানার হাতে চাবি গুঁজে দিয়ে কাউচে আবার নাক ডাকাতে চলে গিয়েছিল লোকটা।
যেখান থেকে এইমাত্র এসেছে সেই কোনাটার দিকে পিছাতে শুরু করল রানা। একপাশে কাত হয়ে পিছাচ্ছে ও, একেকবারে এক ফুট এক ফুট করে, পাহারাদার, দুজনের ওপর ডান চোখ স্থির রেখে। একজনকে ওর দিকে একনজর চাইতে দেখল। মি. হথর্নের মোটা শরীরের ভেতরে কাঠ হয়ে গেল রানা, অপেক্ষমাণ। ওরা যদি স্পট করে থাকে রানাকে, মেয়েটা যদি চিনিয়ে। দিয়ে থাকে, তবে চেনাবে ডাহলিনকে। উইলিয়াম হথর্নকে নয়। তবু সাবধানের মার নেই।
যে লোকটা তাকিয়েছিল ওর দিকে, সে এবার সিগারেটের শেষটুকু ড্রেনে টোকা মেরে ফেলে দিল। থুথু ছিটাল। সঙ্গীকে কিছু একটা বলতে, হেসে উঠল দুজনেই। এবার আবার ক্লান্তিকর নজরদারী আরম্ভ করল।
সাঁত করে কোণ ঘুরে বেরিয়ে এল রানা। মি. হথনের ছদ্মবেশ খসে পড়ছে দ্রুত। দৌড় পায়ে হাঁটছে এখন সে, হোটেলের পেছন দিকের ছোট অ্যালিটার উদ্দেশে এগোচ্ছে। জানালা দিয়ে আগেই দেখে রেখেছিল ওটা।
ব্যারোনেস গ্রাফ এখনও রয়েছে ওই নোংরা হোটেল কামরাটায়। হাত-পা মুখ বাধা অবস্থায়। সম্ভবত এখনও ঘুমের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিরপেক্ষ হলে মহাবিপদের মধ্যে রয়েছে সে। আর তা যদি না হয়-সেটাও জানতে হবে রানাকে! কারণ পাহারাদার দুজন যদি পুলিস না হয় তবে নির্ঘাত ব্রিগলের আর নয়তো নাকাতার অনুচর। কিংবা দুজনেরই। ধরে নেয়া যায়, দুজনেই এখন জেনেভায়, এবং খুব সম্ভব দলবলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
অ্যালির বাঁক ঘুরে দৌড় লাগাল রানা। রবারের পেটটার একটা ভালভ খুলে দিতে হুশ করে বেরিয়ে গেল বাতাস। জিনিসটা চুপসে মিশে গেল চামড়ার পেটের সঙ্গে।
দৌড়নোর ফাঁকে বিশ্বস্ত সঙ্গী তিনটিকে পরখ করে নিল রানা। লুগারটা বেল্টে, প্লাস্টিকের হোলস্টারে নিরাপদে রয়েছে; আস্তিনে তৈরি সাপের মতন বিষাক্ত স্টিলেটো; গ্যাসের খুদে অথচ মারাত্মক বড়িটা পকেটে বসে শুধু। হুকুমের প্রহর গুণছে। দৌড়চ্ছে আর ভাবছে রানা কোটা ব্যবহার করবে, যদি প্রয়োজন পড়ে। মনে প্রাণে চাইছে দরকার পড়বে না। লুগারটা শোরগোল সৃষ্টি করবে, মনোযোগ কাড়তে না চাইলে অস্ত্রটা ব্যবহার না করাই ভাল। আর প্রায় অচেনা হোটেলরূমে পয়জন গ্যাস লোফালুফি করার কোন অর্থ নেই। তারমানে গতি নেই স্টিলেটো ছাড়া। নিঃশব্দ অথচ ভয়ঙ্কর।
হোটেল হিলসনের পেছনের ফেন্সটা এক লাফে উড়ে পেরোল রানা, টাল সামলে নিল ল্যান্ড করে। ভুল হতে পারে.ওর, ব্যাক ইয়ার্ডের আবর্জনার মধ্য দিয়ে পথ করে এগোনোর সময় স্বীকার করল ও মনে মনে। সত্যিকারের বিপদ এখনও হয়তো আসেইনি, নিছক কল্পনা করে নিচ্ছে মগজ। লোক দুটোকে হয়তো এমনি এমনিই পাহারায় লাগানো হয়েছে। ভেতরে হয়তো দলের আর কেউ নেই। কিন্তু রানার মন বলছে ভুল করছে না ও। ওর ইন্দ্রিয় বিপদের সঙ্কেত দিচ্ছে। মেয়েটির এবং ওর দুজনের জন্যেই হুশিয়ারি জানান দিচ্ছে। এবং মাসুদ রানার ওয়ার্নিং সিস্টেম ভুল করে কদাচ।
মরচে ধরা ফায়ার এস্কেপটা দিয়ে সর্পিল গতিতে উঠে যাচ্ছে রানা। নিঃশব্দে। রবারের ভুড়িটা খসানোতে মি. হথর্নের দুসাইজ বড় কাপড়-চোপড় লটপট করছে মাসুদ রানার মেদহীন, ছিপছিপে শরীরে। ওর ঘরের জানালাটার। দিকে অগ্রসর হয়ে গতি সামান্য শ্লথ করল রানা, উবু হয়ে শেষ কয়েক ফুট মাংসের উদ্দেশে এগোনো বাঘের ক্ষিপ্রতায় পেরিয়ে গেল। সাবধানে। ধুলোমলিন জানালাটার কাঁচ ভেদ করে উঁকি দিল। ভেতরের দৃশ্য দেখে দাতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল ও। ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি। ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ বিপদাপন্ন।
মিস্টার হিদেতোশি নাকাতা, সদ্য কারামুক্ত অপরাধী, মোটেই ভদ্রলোক নয়। ছোট্ট রূমটায় দাঁড়িয়ে সে, অচেতন যুবতীর দিকে চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে। ঠোঁট চাটছে লোকটা, মুখটা হাঁ হয়ে রয়েছে তার, লোলুপ দৃষ্টিতে ফুটে বেরোচ্ছে প্রশংসা। বেঁটে জাপানীটার উত্তেজিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে রানা।
নাকাতাকে হঠাৎ করে একটু চিন্তিত মনে হলো। ঘরের দরজাটার কাছে। গিয়ে ওটা বন্ধ করে এল। লকটা যতটা ভেবেছিল ততটা পোক্ত না, ভাবল। রানা। এবং তালা খোলার যন্ত্র ওর একার কাছেই নয়, অন্যদের কাছেও রয়েছে।
সোফার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নাকাতা। জানালার দিকে ক্ৰক্ষেপ করার কথা মাথাতে এলই না তার। লালসায় ধকধক করে জ্বলছে চোখজোড়া। পরিপাটি বিজনেস স্যুট পরিহিত নাকাতাকে রানার চোখে দেখাচ্ছে, একটা লিকলিকে, হলদে মুখো বানরের মত।
ঘুমন্ত যুবতীর গায়ের কাছ বরাবর আরেকটু সরে এল নাকাতা। বাহ্যত মনে হলো জুলি গ্রাফ ঘুমের মধ্যে লাফ-ঝাঁপ করছিল, কারণ তার ফর্সা উরুদ্বয় স্কার্টের আবরণ সরিয়ে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। আশপাশে ও নিচে চকিত চাহনি বুলিয়ে নিল রানা। ব্যাক ইয়ার্ড খা-খা করছে। ফায়ার এস্কেপে ওকে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে দেখার মত কেউ নেই কাছেপিঠে। হোটেলের সামনে অবস্থানরত লোক দুটো, নাকাতাকে নিয়ে এলাকা ছাড়ার জন্যে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবে।
মি. হিদেতোশি নাকাতা এমুহর্তে মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে, গোড়ালির স্ট্র্যাপ খুলে কুতকুতে চোখে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে ফর্সা ধবধবে শরীর। সময় হয়নি, সিদ্ধান্ত নিল রানা। বদমাশটা ব্যারোনেসের জন্যে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ানো মাত্র হস্তক্ষেপ করবে ও।
জাপানীটা নিশ্চয়ই ভেবে মরছে কে বেঁধে রেখে গেল যুবতাঁকে দাঁত বেরিয়ে পড়ল রানার।
কিন্তু না, ভাবাভাবির ধার ধারল না নাকাতা। অত সময় নেই তার হাতে। সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাতে রাজি নয় সে। লোকটা ব্যারোনেসের স্কার্টে হাত রাখতে ঘৃণায় ও রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল রানার।
নিজেকে গুরুতর আহত না করে, কাঁচের জানালা ভাঙার কায়দা বহু আগেই রপ্ত করেছে রানা। পিছনে সরে গেল ও, জানালাটার দিকে পিঠ অর্ধেকখানি ঘুরিয়ে নিল; তারপর প্রচণ্ড বেগে ক্রুদ্ধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ বুলডোজারের মতন কাঁচ ভেঙে, হুড়মুড় করে ঘরের ভেতর গিয়ে পড়ল।
.
০৩.
চোখের পলকে ঘটে গেল সমস্ত ঘটনা!
অস্ফুট আর্তনাদ করে চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়েছে নাকাতা, যুগপৎ বিস্মিত ও আতঙ্কিত। খুদে চোখজোড়া ওর যদূর সম্ভব বিস্ফারিত। হাডিড়সার হলদেটে একটা থাবা ক্যাক করে ধরল রানার ঘাড়ের পেছনটা, হঠাৎ চুলকানিতে ধরেছে যেন জায়গাটাকে।
ছুরি! ভাবল রানা। ঘাড়ের খাপে ছুরি রেখেছে। নাকাতাও তারমানে নিঃশব্দে কাজ সারতে চাইছে। বেশ, অন্তত এ বিষয়ে কোন মতবিরোধ নেই ওদের মধ্যে।
আস্তিনে ওর স্টিলেটোটা তৈরি, কিন্তু রানা ঠিক করল ব্যবহার করবে না। ওটা। নাকাতা হতবিহ্বল, চমকিত। লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে ওর ছুরি, রানাকে। আক্রমণের ভান করতে দেখলে।
নাকাতাকে উদ্দেশ্য করে লাফ দিতে গেল রানা, তারপর হঠাৎ ব্রেক কষে। একপাশে পিছলে পড়ে গেল। রানা যখন এসব ছল-চাতুরী করছে ঠিক সে। মুহূর্তে পিটপিট করে চোখ মেলল যুবতী। মুখের বাধনের পরোয়া না করে প্রাণপণ চিৎকারের চেষ্টা করতে দেখল তাকে রানা, কিন্তু স্বর ফুটল না। বেচারীর।
ফাঁদে পা দিয়েছে নাকাতা। থ্রোইং নাইফটা বাতাসে শিস কেটে গেল রানা যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল এই একটু আগে। ছুরিটা নিক্ষেপের পর ভারসাম্য ফিরে পেতে ক্ষণিকের কালবিলম্ব হলো নাকাতার। পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল রানা সুযোগটার। তিন পা এগিয়ে এল ও সাভাতের ভঙ্গিতে, ঈষৎ নুয়ে থাকা জাপানীটার উদ্দেশে। শূন্যে লাফিয়ে উঠে, পিঠ ফিরিয়ে, নাকাতার ঊরুসন্ধি লক্ষ্য করে লাথি চালাল সজোরে।
লোহার হীল লাগানো জুতোটা বেচারা নাকাতার দেহের কোমলতম অংশে আঘাত হানতে পেঁতো হাসল রানা। সো সলি, মিস্তাল হাগামোতা! নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলল।
তীব্রকণ্ঠে আর্তচিৎকার দিল জাপানী। হাঁ করা মুখ থেকে লালা গড়িয়ে। মাটিতে পড়ল। ধীরে ধীরে ভাজ হয়ে যাচ্ছে দেহ ওর, দুহাতে অণ্ডকোষ চেপে ধরে রয়েছে। হলদে নয়, এমুইতে সবুজাভ দেখাচ্ছে ওর মুখের চেহারা, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। দড়াম করে মেঝেতে পড়ে গেল লোকটা, তখনও কুঁকড়ে রয়েছে শরীর, চেঁচাচ্ছে আর থাবা মারছে নিজেকে লক্ষ্য করে, কিলবিল করছে দুআধখানা করে কেটে ফেলা সাপের মতন।
নাকাতার আর্তনাদ ছাপিয়ে ধুপ করে একটা ভোতা শব্দ কানে এল রানার। সোফায় নেই, মুখ ও হাত বাধা থাকলে কি হবে, তাই নিয়েই মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে ব্যারোনেস। তার সুন্দর মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে আতঙ্কে, ঘুম ভেঙেই এসব ভয়ানক কাণ্ড-কারখানা দেখতে হয়েছে বলে চোখ রসগোল্লা। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো, এবং ধপাস শব্দ তুলে চিতপাত হলো আবার, শূন্যে দোল খেল ওর দুধ সাদা মসৃণ পা জোড়া।
ভাগ্যিস মুখ বেঁধে রেখেছিল, ভাবল রানা, নইলে চেঁচামেচিতে নাকাতাকে নির্ঘাত হার মানাত ব্যারোনেস। মাটিতে বুক ঘষটাতে থাকা নাকাতার উদ্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার রানা।
হৈ-হুঁলস্থূল যা করল ওরা, যে-কোন মুহূর্তে পুলিসে গিজগিজ করবে হোটেল। নিচে হাত বাড়িয়ে জাপানীটাকে ময়দার বস্তার মতন থাবা মেরে ধরল রানা। পথের একটা কাটা সরানোর মোক্ষম সুযোগটা যখন পাওয়াই গেছে কপাল গুণে, হাতছাড়া করার বান্দা মাসুদ রানা নয়।
নাকাতার দুর্বল দেহটা ভাঙা জানালার কাছে বয়ে নিয়ে যেতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হলো না রানাকে। ব্যাটা জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক। ব্যথায় কাতরালে কি হবে, রানার বদ মতলব আঁচ করে, হাত-পা ছুঁড়ে, ধারাল নখ। দিয়ে আঁচড়াতে লাগল বিশালদেহী প্রতিদ্বন্দ্বীকে।
শক্ত করে ধরে জাপানীটাকে দুবার সামনে-পিছে দুলিয়ে খোলা জানালা গলিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল রানা।
শুকনো দেহটিকে পলকের জন্যে ফায়ার এস্কেপের রেলিংটার ওপর ঝুলতে দেখল ও। নাকাতা মরচে ধরা লোহা থাবা মেরে ধরতে চেয়ে ব্যর্থ হলো, তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে পেছনের উঠানে উড়ে গিয়ে পড়ল সে।
ঝট করে ব্যারোনেসের দিকে ফিরল রানা। নষ্ট করার মত সময় নেই এ মুহূর্তে।
যুবতী ইতোমধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। রানাকে চাইতে দেখে আঁতকে পিছু হটে গেল। রানা কাছে এসে অভদ্রের মত ধাক্কা মেরে ওকে ফেলে দিল সোফার ওপর, শক্তিশালী দুহাতে চেপে ধরেছে মেয়েটির কাঁধ । রানার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ব্যারোনেস, ধূসর, কালো চোখে তার। হিস্টিরিয়ার আভাস।
আমি রানা। বিসিআইয়ের মাসুদ রানা। তুমি এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ। বুঝতে পেরেছ?
গভীর চোখে মনের ভাব ফুটল না। রানার হাত থেকে ছাড়া পেতে যুঝছে। মেয়েটি। রানার তলপেটে হাঁটু দিয়ে গুতো মারার চেষ্টা করছে।
ওর কাঁধে হাতের চাপ আরও বাড়াল রানা। মুখটা নিয়ে এল মেয়েটির মুখের কাছে। শোনো! এখন গোলমাল করার সময় নয়। যে-কোন মুহূর্তে পুলিস এসে যাবে। আমি বিসিআইয়ের মাসুদ রানা। গত রাতে আমাকে বোটে তুলে নিয়েছিলে তুমি, মনে পড়ে? ছদ্মবেশ না, আমার গলার স্বর লক্ষ করো। আমি মাসুদ রানা আর তুমি ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ। আমাদের দুজনের একসাথে কাজ করার কথা মিশন লেপার্ড-এর ব্যাপারে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ?
ধূসর গভীর চোখে বোধশক্তি ফিরে আসছে বানের পানির মতন দুকূল ছাপিয়ে। সহসা ঢিল পড়ল যুবতীর শরীরে। মাথা ঝাঁকাল সে।
থ্যাঙ্ক গড, বলল রানা। হাতের বাঁধন খুলে দিল সে মেয়েটির, বিজলি খেলা করছে ওর আঙুলে। হাতে সময় বড় কম। চতুর্থ শ্রেণীর হোটেল বলেই রক্ষে, নইলে হৈ-হল্লার শব্দ পেয়ে বহু আগেই চলে আসত হোটেলের লোকজন। রানা ভেবে অবাক হচ্ছে এখনও কেন এসে হাজির হয়নি সুইস পুলিস, দক্ষতার জন্যে তো এদের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ও আচ্ছা, এই হোটেলের বদনাম তারমানে পুলিস মহলেও সর্বজনবিদিত। কিন্তু হাঙ্গামার কারণ আর ব্যাক কোর্টের ওই দেহটা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেবে কে?
চড়চড় করে টেনে তুলল রানা মেয়েটির মুখের বাঁধন, ধার ধারল না ভদ্রতার। হাঁ করে শ্বাস টেনে ওর কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল যুবতী, চোখে আবার তার ভর করেছে. দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সন্দেহ। তুমি-তুমি কি সত্যিই মাসুদ রানা? আমি জানি না! আমি-আমি এখনও কনফিউড।
সুটকেস থেকে কাগজপত্র বের করে দেখিয়ে নিশ্চিন্ত করল ওকে রানা। এখন আল্লার ওয়াস্তে তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও তো। এক্ষুণি পালাতে হবে আমাদেরকে। বাইরে দুটো গুণ্ডাকে পাহারায় বসিয়েছিল নাকাতা। ওদের নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা পুলিসকে নিয়ে। পালাচ্ছি আমরা, বোঝা গেছে?
কথা বলার ফাঁকে ছোট্ট রূমটায় শশব্যস্তে চলাফেরা করছিল রানা, কুমীরের চামড়ার সুটকেসটার মধ্যে ইতোমধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে ব্যবহৃত বাঁধনগুলো। ওর শ্যেনদৃষ্টি ঘরটির আনাচে-কানাচে ঘোরাফেরা করছে, পুলিসকে কোন ক্রু দিতে রাজি নয় ও নাকাতা বা ব্রিগলের লোকদেরও না। ওরা সবাই এখন রানার বিরুদ্ধে। বিসিআইতে যোগ দেয়ার অর্থ সমস্ত ঝুঁকি মাথায় নিয়ে একা কাজ করা, সুটকেসে একটা অ্যাশট্রে খালি করতে করতে ক্ষুণ্ণ মনে ভাবছে রানা।
পেছনে শুনতে পাচ্ছে ও কাপড়-চোপড় ঝাড়া দিয়ে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। ব্যারোনেস। শব্দ হচ্ছে তার ফলে খস-খস, দ্রুতলয়ে বইছে মেয়েটির শ্বাস প্রশ্বাস। হঠাৎ আঁতকে ওঠার অস্ফুট একটা ধ্বনি কানে এল। পাই করে ঘুরতে দেখতে পেল রানা, স্টকিং টেনে সিধে করতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেছে যুবতী–বিস্ফারিত নেত্রে শূন্য গার্টার হোলস্টার দুটো লক্ষ করছে।
ও নিয়ে ভেবো না, মুচকি হেসে বলল রানা। তোমার খুদে বন্ধুরা নিরাপদেই আছে এখানে। সুটকেসটায় মৃদু চাপড় দিল রানা।
স্কার্টটা ছেড়ে দিয়ে রানার দিকে চেয়ে রইল ব্যারোনেস, মুখের চেহারা টকটকে লাল। হ্যাঁ, সহজ কণ্ঠে বলল রানা। তোমার সুন্দর সুন্দর পা দুটো দেখে ফেলেছি। নাও, হাঁটো। দরজার উদ্দেশে ঠেলে দিল ও মেয়েটিকে। তালা মেরে হল-এ অপেক্ষা করবে আমার জন্যে। এখুনি এসে পড়ছি। আর হ্যাঁ, রানিং শু পরে তৈরি থেকো, জীবনের সেরা দৌড়টা হয়তো দৌড়তে হবে। আজকে।
খুট শব্দ করে লেগে গেল দরজার তালা। দৌড়ে গিয়ে ছোট্ট বাথরূমটায় ঢুকল রানা, দেখে নিল ভেতরটা শেষবারের মত। কিছু নেই। ঘরে এক ছুটে ফিরে এসে সুটকেসটা তুলে নেবে, এসময় মেঝের কোণেতে কি একটা জিনিস পড়ে থাকতে দেখল। কি ওটা?
ছোঁ মেরে তুলে নিল রানা জিনিসটা। নকল দাঁত! ওপরের সারির। স্থান কাল ভুলে হেসে উঠল রানা গলা ছেড়ে। নাকাতার বাঁধানো দাঁত। লালার সঙ্গে নিশ্চয়ই খসে পড়েছিল, তখন লক্ষ করেনি।
রানার সুটকেস বাধাহ্যাঁদা সারা। খোলার সময় নেই। নকল দাঁতের পাটিটা কি ভেবে পকেটে ফেলে দিয়ে দরজা লক্ষ্য করে দৌড় দিল রানা।
ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ দরজার ঠিক বাইরেই অপেক্ষা করছিল। একটা আঙুল ঠেকাল ঠোঁটে। কে যেন উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে! শব্দ পাচ্ছ? পুলিস। নাকি?
বয়-বেয়ারা না, কর্কশ কণ্ঠে বলল রানা। যা হাঙ্গামা হলো তাতে পুলিস ছাড়া আর কে? জলদি চলো! দেখি কেমন ছুটতে পারো তুমি।
ভারী সুটকেসটা খেলনার মতন হাতে ঝুলিয়ে, অন্ধকারাচ্ছন্ন, ভাপসা করিডরটা ধরে সিঁড়ির উদ্দেশে দৌড়াল রানা। ল্যান্ডিঙের ঠিক আগে থমকে দাঁড়িয়ে, হাত-ইশারায় মেয়েটিকে থামতে বলল পেছনে। রেলিঙের ওপর দিয়ে। সাবধানে উঁকি মেরে, দেখে নিল সিঁড়ির নিচটা। বেশি দেরি হয়ে গেছে? হোটেলের দারোয়ান দুই-ল্যান্ডিং নিচে। উঠে আসছে হন্তদন্ত হয়ে। হাঁফাচ্ছে। দস্তুর মত আর উচ্চকিত গলায় ফরাসিতে আপত্তি জানাচ্ছে। তার পেছনে চ্যাপ্টা ক্যাপ পরা দুজন এজেন্টস দ্য পোলিস। দারোয়ান ব্যস্তভাবে বোঝাচ্ছে এহেন ভদ্র হোটেলে এসব কি ঘটছে তার ব্যাখ্যা পাচ্ছে না সে।
পেছনের উঠানে লাশটা পেয়ে নিক আগে, দোস্ত! হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে হিড়হিড় করে ল্যান্ডিঙের আড়াআড়ি টেনে নিয়ে চলল রানা।
নিচে যেতে পারছি না, ফিসফিস করে বলল। ওপরে যেতে হবে। প্রার্থনা করো, ছাদে যেন একটা রাস্তা পেয়ে যাই পালানোর জন্যে। জলদি, কোন শব্দ নয়।
মেয়েটিকে সামনে নিয়ে এগোল রানা। ভয় পাচ্ছে, হাই হীলের কারণে হোঁচট খেয়ে না আবার ধরিয়ে দেয় দুজনকেই। অল্প কয়েকটা মিনিট পাবে। ওরা খুব জোর। পুলিস দুটো খালি রূম ও ভাঙা জানালা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে যখন।
তিন ল্যান্ডিং উঠে ফুরিয়ে গেছে সিঁড়ি। কিন্তু রানা একটা স্কাইলাইটের তরছা আলো লক্ষ্য করে দৌড়ে গেল ওটার কাছে, অনেক উঁচুতে উড়াল দিয়েছে ওর আশা-আকাক্ষা। ইঁদুরে বোধ হয় শেষমেষ কাটতে পারছে জালটা।
স্কাইলাইটটা দেখে মনটা দমে গেল আবারও রানার। অবিশ্বাস্যরকমের পুরানো, জং ধরা আর ভয়ানকদর্শন জিনিসটা। আকারে প্রায় চার বাই ছয়, রুক্ষ লেভেলের ওপরে মেলে দিয়েছে কাঁচের ছোটখাট একটা চাদোয়া। আশপাশে কোন মই-টই চোখে পড়ল না। স্কাইলাইটটা মাথার ওপরে অন্তত দশ ফিট। সেটা বড় কোন সমস্যা নয়-রানা নিজেই প্রায় ছয় ফিট-কিন্তু হাত রাখার কোন জায়গা ওখানে নেই। নেই ঝুলন্ত শিকল কিংবা দড়ি। আছে শুধু মেঘাচ্ছন্ন। কাঁচের বিস্তার আর ক্ষয়টে কতগুলো কবজা। খিস্তি ঝাড়ল রানা। এটা কি কানাগলি নাকি? আর একেবারে শেষেরটা?
ফাঁদে পড়লে সুইস পুলিশদের সামলাতে পারবে রানা। এমনকি মেয়েটা সঙ্গে থাকলেও ক্ষতি নেই, খানিকটা কষ্টসাধ্য হবে যদিও। কিন্তু নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে পুলিসের সঙ্গে লাগতে যাবে না ও। মেজর জেনারেলের নির্দেশ। কথাটা ওকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বারবার করে।
তেতো হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। বুড়োকে এখানে পেলে ভাল হত। দাঁড়াতে পারত তার কাঁধে ভর দিয়ে!
এসময় হলদেটে দেয়ালটায়-ওটা লক্ষ করল রানা। রীলের ওপর একটা ফায়ার হোস। হিলসনের মতন হতশ্রী হোটেলেও ফায়ার হোস থাকতে হয়। মান্ধাতা আমলের ভঙ্গুর হোসটা নেতিয়ে পড়ে রয়েছে বহুদিন আগে মরা সাপের মতন। অবশ্য কাজ হয়তো চলে যাবে ঠিকই। ওটার পাশে, একটা গ্লাস ফ্রন্টেড বাক্সে, একটা অ্যালার্ম কী।
ব্যারোনেস মহাশয়া লক্ষ করছে ওকে, হাপরের মত শ্বাস বইছে তার, চোখজোড়া বিস্ফারিত। স্কাইলাইটের মাঝখান বরাবর নিচে বেঢপ সুটকেসটা দাঁড় করাল রানা। ধরে থাকো এটাকে, আদেশ করল। যাতে পড়ে না যাই।
ফায়ার হোসটার উদ্দেশে লাফ দিল ও, রীল থেকে খসিয়ে আনুল ককিয়ে প্রতিবাদ জানানো জিনিসটাকে। ভারী পিতলের নজলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল খাড়া করে রাখা সুটকেসটার ওপর। স্কাইলাইটের সবচাইতে ওপরের কিনারাটা। এখন আর মাত্র তিন ফিট উঁচুতে। নিচে মেয়েটির দিকে তাকাল রানা। সুটকেসের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। রানার দেহের চাপে কাবু জিনিসটাকে ধরে রাখতে প্রাণান্ত লড়ছে।
দেঁতো হাসি উপহার দিল ওকে রানা। এই তো, লক্ষ্মী মেয়ে! খুব শব্দ হবে কিন্তু! জলদি কেটে পড়তে হবে আমাদের, কারণ পুলিশ দুজন যে কোন মুহর্তে এসে পড়বে। গ্লাস ভেঙে, লোহার শার্শির গায়ে হোসটা আটকে নিচে নামিয়ে আনব আবার।.তোমাকে তখন ওটা বেয়ে ছাদে উঠে যেতে হবে। খুব। তাড়াতাড়ি। পারবে তো?
আ-আমি জানি না। আমার গায়ে অত জোর নেই। তবে চেষ্টা করব।
চেষ্টা-ফেষ্টা বাদ দাও পারতে হবে, কঠোর শোনাল রানার কথাগুলো। মেয়েদের নিয়ে কাজ করার এইই ঝকমারি! এমুহূর্তে সময় প্রয়োজন ওদের। হোস রীলের পাশে ফায়ার অ্যালার্ম বেলের ওপর রানার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষেপও অত্যন্ত জরুরী, ভিন্নমুখী করে দিতে হবে প্রতিপক্ষের মনোযোগ। তাহলে হয়তো ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে পার পেয়ে যেতে পারে এ দফা।
সুটকেসের ওপর থেকে লাফ দিয়ে নেমে পরনের কোটটা খুলতে শুরু করল রানা। মেঝেতে শার্টটা ফেলে দিয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করল। মি. উইলিয়াম হথর্নের ধবধবে ফর্সা শার্টটার দফারফা হয়ে গেল।
রানার লোহাপেটা বুক ও কাঁধ লক্ষ করে বলল ব্যারোনেস। এসবের মানে–
দুনিয়ার প্রাচীনতম কৌশল, কথা কেড়ে নিল রানা। নিচের বন্ধুদের জন্যে একটু ডাইভারশনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কসরত করে কোটটা ফের পরে নিয়ে তুলে নিল ছিন্নভিন্ন শার্টটা। এক টানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে ঠেলে দিল ফায়ার অ্যালার্ম বক্সের উদ্দেশে। আমি সিঁড়ির খাদে শার্টটা ফেলে দিলে বোতামটা পুশ করবে তুমি-সেইসঙ্গে প্রার্থনা করতে থাকবে বুদ্ধিটা কাজে লাগে যাতে।
মাথা ঝাঁকাল যুবতী। কিন্তু রানা বারো কদম এগোতে এগোতেই মৃদু স্বরে পিছু ডাকল রানা! আমি-আমি বক্সটা খুলতে পারছি না। জং ধরে আটকে গেছে।
ত্বরিত ফিরে এল রানা। ঠিকই বলেছে ও। ওর কাঁধ চাপড়ে দিল রানা। ভাগ্যিস চেক করেছিলে। একটু পিছনে সরো দেখি।
বলেই ডান হাতের মুঠোয় শার্টটা পেঁচিয়ে দুম করে এক ঘুসি মেরে বসল বক্সটার ওপর। রুনঝুন শব্দ তুলল কাঁচ।
মেয়েটির দিকে চাইল রানা। মনে রেখো। শার্টটা যেই ফেলর সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু মুভ করতে হবে।
পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে, এক ছুটে করিডর পেরিয়ে, সিঁড়িঘরে চলে এল রানা। উঁকি দিল সন্তর্পণে। কানে এল আবছা কণ্ঠস্বর।
ওদেরকে জল্পনা-কল্পনার জন্যে আরেকটা সাবজেক্ট দেয়া দরকার, ভেবে। কোট পকেট থেকে সিগারেট লাইটারটা বের করল রানা।
ছেঁড়া-ফাটা শার্টটা সামনে বাড়িয়ে ধরে লাইটার জ্বেলে ধরল ওটার নিচ দিকে। মুহর্তে দপ করে ধরে গেল আগুন। ওর হাত লক্ষ্য করে লকলক করে এগিয়ে আসছে অগ্নিশিখা, ধোয়ার কটু গন্ধে হলওয়ে ভরাট হতে শুরু করেছে। চট করে পেছনে মেয়েটিকে এক ঝলক দেখে নিল রানা। অ্যালার্ম বক্সে আঙুল ওর। জ্বলন্ত শার্টটা স্টেয়ার ওয়েল দিয়ে এবার ছেড়ে দিল রানা। দাউ দাউ করে জ্বলতে জ্বলতে, প্রচুর ধোয়া ছড়িয়ে দ্রুত নেমে যাচ্ছে ওটা নিচে।
দুদ্দাড় করে করিডর ধরে ফিরে আসার সময় খুশি হয়ে উঠল রানার মনটা। ঘণ্টী বাজতে লেগেছে হোটেলটার অজ্ঞাত কোন স্থানে। ধন্যবাদ, খোদা! কাজ হয়েছে। কপালগুণে খানিকটা সময় হাতে পাওয়া গেল। তবে খুবই সামান্য!
দশ সেকেন্ড পর আবারও সে চড়াও হলো সুটকেসটার ওপর। স্কাইলাইটের উদ্দেশে পিতলের নজলটা গদার মত করে ধরে ধাই করে চালিয়ে দিল। চুরচুর হয়ে গেল কাঁচ প্রথম আঘাতেই। বারে বারে নজলটা দিয়ে মেরে। চলল রানা, কাঁচের ঝর্নার হাত থেকে বাচতে এক হাতে ঢেকে রেখেছে চোখ। বেশ কয়েকবার সামান্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হলো, ওদিকে কানে আসছে ফায়ার অ্যালার্মের অবিরাম ঢং-ঢং শব্দ।
এক মিনিটও লাগেনি, স্কাইলাইটের একপাশের কাঁচ ভেঙে চুরমার করে দিল রানা। এবার মরচে পড়া একটা ফ্রেমের ওপর নজলটা ছুঁড়ে দিল। ওটা ওখানে আটকে যেতে, নেমে পড়ল এক লাফে। হোসটাকে গোটা দুই প্যাঁচ মেরে, নিচের দিকটায় একটা গিঠ দিয়ে দিল।
মেয়েটির দিকে ফিরল এবার ও। জলদি পিঠে চাপো। শক্ত করে ধরে থাকবে। ওটা বেয়ে উঠব এখন আমরা!
মৃণাল দুই বাহু পেছন থেকে গলা সাপটে ধরল রানার। কোমল বুকের চাপ এখন পিঠে, শুনতে পাচ্ছে রানা মেয়েটির মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। কি একটা পারফিউম মেখেছে, নাকে আসছে হালকা সুবাস।
এক হাত এক হাত করে উঠে যাচ্ছে রানা। শার্শির ওপর একটা হাত রেখে এবার অপর হাতে ঠেলা দিয়ে তুলে দিল মেয়েটিকে ছাদে।
ব্যারোনেসের হাই হীল জোড়া সহসা খসে রানার মুখের পাশ দিয়ে নিচে পড়ে গেল। ওপর থেকে শোনা গেল বলছে জুলি গ্রাফ, দুচ্ছাই! রানা। প্রথমটায় ভেবেছিল বিরক্তির কারণ, ওর জুতোজোড়া। কিন্তু পরে লক্ষ করল জং ধরা একটা কবজায় আটকে গেছে মেয়েটির স্কার্ট। টানা-হেঁচড়া করছে যুবতী। পা ছুঁড়ে মুক্ত করতে চাইছে নিজেকে, এবং অভিশাপ দিয়ে চলেছে। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান-সীমাবদ্ধ থাকছে না ওর অসন্তুষ্টি কোন ভাষাতেই।
স্কার্টটাকে নিচে থেকে মুক্তি দিতে হলো রানাকেই। পরক্ষণে ওর শক্তিশালী, প্রকাণ্ড হাতের এক ঠেলা খেয়ে, স্কাইলাইট ফুড়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটি শ্যাম্পেন কর্কের মত। আঁক করে উঠে, আরও একটা গালি ঝাড়ল। ব্যারোনেস ল্যান্ড করার পর, শুনতে পেল রানা।
হোস বেয়ে পিছলে নামার সময় হাসি চাপা দায় হলো রানার পক্ষে। হতে পারে ব্যারোনেস, কিন্তু বস্তিবাসীদের ভাষাও ভালই রপ্ত করেছে জুলি গ্রাফ।
ভাগ্য এখন পর্যন্ত সঙ্গ দিচ্ছে ওদের। অ্যালার্ম বেল বেজে চলেছে খেয়াল করল রানা কুমীরের চামড়ার সুটকেসটা তুলে নিতে নিতে। নিচে, সিঁড়িতে, তুমুল তর্জন-গর্জন। মুচকি হাসল রানা। পুলিশরা নির্ঘাত মনে করবে ভুলক্রমে কোন ইয়ো-ইয়ো অ্যাকাডেমিতে সেঁধিয়ে পড়েছিল ওরা। নাকাতার লাশটা ওরা খুঁজে পেলেই রানা ও ব্যারোনেস হাতে পেয়ে যাবে পর্যাপ্ত সময়।
এক হাতে সুটকেসটা ধরে হোস বেয়ে উঠে যাচ্ছে রানা, পা ব্যবহার করছে এবারে। স্কাইলাইটের কিনারে সুটকেসটা রেখে উঁকি মেরে চাইল। ছাদে দাঁড়িয়ে যুবতী, হানি ব্লন্ড চুল তার এলোমেলো। সুন্দর মুখটা ধুলো মেখে মলিন আর উত্তেজনায় লালচে। পিটপিট করে রানার দিকে চাইল ও।
রানা! এই-এই ছাদ থেকে আমরা নামব কিভাবে?
চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রানা। মৃদু শিস দিল। ছাদের ঢালটা ওপরের অংশের চাইতে দুরারোহ। প্রাচীন উতরাইটা শেল পাথরের মতন পিছল ও বিপজ্জনক চূড়া থেকে পাশ দুটো নেমে গেছে খাড়াখাড়ি। তিমি মাছের পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার মতন অসহায় অবস্থা।
মনে সাহস রাখো, অভয় দিল রানা। ভয়ের কিছু নেই।
ওকে অবাক করে দিয়ে মুচকি হাসিতে উদ্ভাসিত হলো ব্যারোনেসের মুখটা। মৃদু, আবছা কণ্ঠে বলল সত্যি বলতে কি, ভীষণ ভয় লাগছে। এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি তো। যাকগে-কি করতে হবে এখন? পুলিস তো শিগগিরিই উঠে আসবে ছাদে। ওদেরকে অত বোকা পাওনি।
ঠিকই বলেছ, সায় জানাল রানা। রিজের শেষ প্রান্তে চোখ রাখল ও, ব্যারোনেসের পাশ দিয়ে। পেছন দিকে মুভ করো। ধরে নাও, এটা একটা ছেলেমানুষী খেলা। রিজের শেষে কি আছে দেখা দরকার।
জুলিকে অনুসরণ করে রিজের কিনারে চলে এল রানা, শক্ত হাতে ধরে আছে সুটকেস।
ছাদের চূড়ার শেষপ্রান্তে, মেয়েটির পাশ ঘুরে, ওপাশে কি আছে দেখার সুযোগ পেল রানা। চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে ওর মুখে। বলাবাহুল্য, পরিশ্রম সম্পূর্ণ দায়ী নয় এরজন্যে। নিচে কি দেখবে রানা তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। ওদের এখানে আটকা পড়ার অর্থ পুলিসের কাছে সিটিং ডাক হওয়া, স্কাইলাইট থেকে পিস্তল দেখিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করবে তাহলে পুলিস। রানার পক্ষেও এতখানি প্রতিকূলতার বিপক্ষে লড়া অসম্ভব। বিশেষ করে মেয়েটির জীবনের নিরাপত্তা যেখানে জড়িত। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পরোয়া করে না রানা-নিচ্ছেও প্রতিদিন-এবং পঞ্চাশ-পঞ্চাশ চান্স থাকলে ব্যারোনেসেরটাও নিতে পারত। কিন্তু কোন সুযোগ যেখানে নেই সেক্ষেত্রে এটা স্রেফ খুনের পর্যায়ে পড়বে!
বিল্ডিঙটার কিনার দিয়ে উঁকি মারল রানা। লাগোয়া বাড়িটার সমতল ছাদ, মাত্র দশ ফিট নিচে। আটকে রাখা শ্বাস ছেড়ে এবার লাফ দিল রানা।
পায়ের নিচে আরামপ্রদ ঠেকল আলকাতরা মেশানো চ্যাপ্টা ছাদটা। ওপরদিকে চেয়ে দুবাহু প্রসারিত করল এবার ও। ইশারায় ঝাঁপ দিতে বলল জুলিকে। সামান্য তালগোল পাকানো একটা পুতুলের মতন ঝটপটিয়ে নেমে এল ব্যারোনেস। আলতো হাতে, জন্টি রোডসের দক্ষতায় ক্যাচ আউট করল ওকে রানা। মুহূর্তের জন্যে ওকে আঁকড়ে ধরল ব্যারোনেস দুহাতে। পরক্ষণে ঝাড়া মেরে মাটিতে নামিয়ে দিতে বাধ্য করল রানাকে।
ওদিকে একটা ফায়ার এস্কেপ আছে। শিগগির এসো। সুটকেসটা তুলে নিয়ে বলল রানা।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওর পাশাপাশি ছুটছে ব্যারোনেস। আউউ! পা-টা গেছে। ইস, খালি পায়ে-জুতো খসে গেছে আমার, জানোই তো। হঠাৎ এ্যাচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে, রোষ কষায়িত চোখে রানার দিকে চাইল। রানা! জুতো ছাড়া কিভাবে আমি মানে, আমরা কিন্তু লোকের চোখে পড়ে যাব। এভাবে খালি পায়ে…
কোটের দুপকেট থেকে দুপাটী হাই হীল জুতো বের করে, ব্যারোনেসের হাতে ধরিয়ে দিল রানা। তোমার পদসেবাই আমার জীবনের লক্ষ্য। নাও, আল্লার ওয়াস্তে এগুলো পরে নিয়ে উদ্ধার করো আমাকে। একদম সময় নেই।
রানার কাঁধে মসৃণ একটা হাত রেখে তাল সামলাল জুলি, পায়ে গলিয়ে নিল জুতোজোড়া। চলো! ফায়ার এস্কেপের দিকে এবার ওকে ঠেলে দিল। রানা। সরু একটা গলিতে পৌঁছেছে ওটা। আশপাশে জমনিষ্যির চিহ্ন নেই।
আঙুলের ইশারায় ব্যারোনেসকে নামার ইঙ্গিত দিল রানা। লেডিজ ফার্স্ট। আমরা লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছি বটে, কিন্তু এখনও একটা সুযোগ হয়তো আছে আমাদের। নাকাতার দেহ ওদের ব্যস্ত রাখবে বেশ কিছুক্ষণ। আর জাপানীটার চামচা দুটো খুব সম্ভব ব্রিগলের কাছে রিপোর্ট করতে ছুটবে। তারমানে দম নেয়ার একটা চান্স পাচ্ছি আমরা। এখন সবার আগে লুকানোর মত একটা গর্ত দরকার আমাদের, পরিষ্কার হওয়া দরকার কিছু বিষয়। কঠোর হলো রানার দৃষ্টি। অনেক কথা আছে তোমার সাথে।
লোহার মইটা বেয়ে ব্যারোনেসের পিছু পিছু নেমে এল রানা।
.
০৪.
চার মেইন গট, বলে উঠল ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ। মাসুদ রানার সঙ্গে পরিচয়ের পর এই প্রথম তুবড়ি ছোটাল মাতৃভাষায়; হোটেল হিলসনের ছাদে উচ্চারিত খিস্তি-খেউড়গুলো যদি অবশ্য ভুলে যাওয়া হয়। মেইন গট, পুনরাবৃত্তি করল। জন্মেও ভাবিনি এসব পাগলামি কাণ্ড-কারখানা বাস্তবে কোনদিন ঘটতে পারে।
ফ্যান্টাস্টিক! ভয়ঙ্কর সুন্দর! কি যেন বলে না-একেবারে তুলনারহিত!
কর্মজীবীদের খুদে রেস্তোরাঁটার চারধারে নজর বুলিয়ে নিল রানা, এমুহূর্তে যেখানে ওরা চকোলেট ও ব্রিওখে খাচ্ছে। বারের কাছে টেবিলে বসা এক নাবিক, ঢুলুঢুলু চোখে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে মদের গেলাসটার দিকে। শ্রমিক গোছের আরও জনা দুই লোককে দেখা গেল আরেকটা টেবিলে, কিন্তু রানাদের দিকে দৃষ্টি নেই কারও। মনে মনে সেজন্যে কিছুটা স্বস্তি বোধ হচ্ছে রানার। ইতোমধ্যে যদূর সম্ভব পরনের পোশাকের ভাজ-টাজ মেরামত করে নিয়েছে। ব্যারোনেস, মিশে যেতে পারবে লোকের ভিড়ে। কিন্তু মাসুদ রানা, ওরফে উইলিয়াম হথর্নের অবস্থা বড়ই করুণ। সমস্যা নেই ছোট করে ছাটা চুল নিয়ে, কিন্তু মুখের জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে। পরনে শার্ট নেই, বিজনেস স্যুটটা ধুলো-ময়লা লেগে মলিন, আর ফকিরের ঝোলার মত টুটা-ফাটা। রবারের ভুড়ির অভাবে রীতিমত ঢলঢল করছে পোশাকটা রানার শরীরে। অনেক আগেই জিনিসটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ও।
ওদের আগমন এখন অবধি বিশেষ কোন সাড়া জাগাতে পারেনি রেস্তোরাঁর ভেতর। খেটে খাওয়া লোকজনেরই জায়গা এটা, ফলে সকলেই ওদের শ্রেণীর মানুষজন দেখে অভ্যস্ত। ভাল কাপড়-চোপড় পরে ঢুকে পড়লেই বরং বিপদ হত।
রিস্ট ওয়াচে নজর বুলাল রানা। মাত্র সোয়া নটা বাজে দেখে অবাক হয়ে গেল। মধ্য সেপ্টেম্বরের নীলচে-সোনালী সকাল। ওদের সামনে স্বচ্ছ কাঁচের। মতন বিছিয়ে পড়ে রয়েছে ল্যাক লেম্যান, কিংবা কোন জাপানীর বাগানের। কৃত্রিম হ্রদের মত।
ছোট টেবিলটার ওপাশে হাত বাড়িয়ে চাপড়ে দিল রানা মেয়েটির হাত। সত্যিই ভাল খেল দেখিয়েছ তুমি, আবারও বলছি। কিন্তু আমার বস বলেছিলেন তুমি নাকি বনের হয়ে অনেকদিন কাজ করেছ-এত অবাক হচ্ছ কেন তাহলে? তুমি যদি এজেন্টই হয়ে থাকো, মানে—
রানার আঙুলগুলোয় আলতো চাপ দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল জুলি। এরকম কোন অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি আমার। সত্যি বলছি, রানা! হ্যাঁ, বনের। হয়ে কিছুদিন কাজ করেছি বটে, কিন্তু খুব শিগগিরিই বিরক্ত হয়ে পড়ি। ডেস্ক ওঅর্ক করতে করতে হাফ ধরে গেছিল। অনেকবারই ছেড়ে দেব ছেড়ে দেব করতে করতে রয়ে গেছি, মনকে বুঝিয়েছি দেশের কাজ করছি। অন্য কোনভাবে দেশকে যে কিছু দেব তার উপায় ছিল না-কাজেই ছাড়তে পারিনি। কিন্তু এটা একদম-হেসে উঠে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল রানার একটা হাত।
আবার বলছি–এরকম কাণ্ড আগে কোনদিন দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। চাপ বাড়াল রানার হাতের ওপর। তোমার মত তুখোড় লোকও এই প্রথম দেখলাম, রানা! তুমি ম্যাগনিফিক! তোমার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম এখন দেখছি মিথ্যে নয়।
ভ্রূ কুঁচকে গেল রানার। কিংবদন্তী হওয়ার এই এক মুশকিল। বহু লোক জানে তোমাকে।
চকোলেট শেষ করে চারপাশে আরেক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল ও। উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কোন কারণ ঘটেনি। ঝুলে পড়া কোটটা টেনেটুনে ওটার সঙ্গে আন্তরিক হলো রানা। কুৎসিত দেখাচ্ছে ওকে। কোন অত্যুৎসাহী পুলিশ এখন এখানে এসে হাজির হলে, বিব্রতকর নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে।
ব্যারোনেস, বলল রানা, চকোলেট আর বান জলদি শেষ করো। আমাদের সটকে পড়তে হবে এখান থেকে। কোথায় যাব জানি না, তবে একটা কিছু ভেবে বের করতে হবে। আসলে, ভাবল রানা, এজেন্সীর ওই ডিপোটা ছাড়া এখন আর কোন নিরাপদ আশ্রয় নেই। পুলিশ, নাকাতার ও ব্রিগলের লোকদের হাত এড়াতে চাইলে ওটাই মোক্ষম জায়গা। তাছাড়া, বসের সঙ্গে কথা বলাটাও জরুরী। তাকে জানাতে হবে মারা পড়েছে নাকাতা, এবং ক্রমেই আগুনের মত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে খেলাটা।
সময় নষ্ট হচ্ছে খামোকা। রুডলফ ব্রিগল হয়তো এমুহূর্তে ফ্রেঞ্চ কী-টা ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের হাতে দিয়ে, ভল্ট খুলে হাতিয়ে নিচ্ছে দুষ্প্রাপ্য চিতাবাঘ।
রাহাত খান অবশ্য যথারীতি প্রতিটি অ্যাঙ্গেল কাভার করেছেন। পালা করে ব্যাঙ্ক পাহারা দিচ্ছে অন্যান্য এজেন্টরা। কিন্তু সে তো রুডলফ ব্রিগল তার চেহারা প্লাস্টিক সার্জারি করে বদলে ফেলার আগেকার সেট আপ। ও একা। ব্যাঙ্কে গেলে চেনার সাধ্য নেই কারও। ওদের কাছে যে ছবি আছে এখন তার এক কানাকড়ি দামও নেই।
এদেশ থেকে বেরোনোর সম্ভাব্য প্রতিটি পয়েন্টে চোখ রাখা হয়েছে, কিন্তু তাই বলে গোটা একটা দেশকে তো আর সর্বক্ষণ কভার করে রাখা সম্ভব নয়। রুডলফ ব্রিগল যদি সুইটজারল্যান্ড ত্যাগ করার জন্যে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলে, এবং রানার ধারণা বলবে, সেক্ষেত্রে ব্যাপক রক্তপাত ঘটতে চলেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর অনন্যসাধারণ এই দেশটিতে।
মুসলিম বিশ্বের একাধিক দেশ অনুরোধ করেছিল রাহাত খানকে, রুডলফ ব্রিগল ও হিদেতোশি নাকাতার হাত থেকে সোনার চিতাবাঘটা উদ্ধার করতে যেন মাসুদ রানাকে পাঠানো হয়। লোক দুটো মূর্তিটা হাত করতে পারলে নাকি ভয়ানক বিপদ নেমে আসতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর। কি বিপদ জানে না। রানা। মেজর জেনারেল বলেননি, ও-ও জানতে চায়নি। বলা যায় এবার একটা ব্লাইন্ড মিশন নিয়ে কাজে নেমেছে রানা।
গুল্লি মারো! কিছু একটা করতে হবে, নিজেকে মনে মনে কঠোর কণ্ঠে শোনাল রানা। এবং দ্রুত। ব্যারোনেসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বসে থাকতে পাঠানো হয়নি ওকে। ও সেজন্যে আসেওনি।
এই যুবতীটিকেও করার মতন লাখো প্রশ্ন মাথার মধ্যে রয়েছে ওর। এর। একটা না একটা মিথ্যে ধরার জন্যে অস্থির হয়ে রয়েছে রানা। মেজর জেনারেল একে বিশ্বাস করতে পারেন। বন কর্মকর্তারা হয়তো বাইবেল ছুঁয়ে সাফাই গাইবেন এর পক্ষে। কিন্তু মন গলবে না তাতে মাসুদ রানার। অন্তত এখন পর্যন্ত গলার মত কোন কারণ ঘটেনি। গত রাতে যেভাবে ওকে বোটে তুলে নিয়েছিল ব্যারোনেস, সে ব্যাপারে সন্দেহ দূর হয়নি ওর।
কিন্তু সে সব সন্দেহের অবসান পরেও ঘটানো যাবে। এই মুহূর্তে রানাকে
ওর হাতে চাপড় দিল ব্যারোনেস। কি ভাবছ অত? আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না, তাই না?
কথা-বার্তা ওর উচ্চশিক্ষিতা নারীর মত। ছবি আর পাসপোর্ট মিলে গেছে। মেজর জেনারেল আর বন সাক্ষ্য দিয়েছে ওর পক্ষে। সত্যিকারের ব্যারোনেস জুলি গ্রাফই এই মেয়ে। তাহলে এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিসের রানার? এর জবাব পেল না ও।
সেজন্যেই ড্রাগ দিয়েছিলে আমাকে। সার্চ করেছিলে আমার পার্স, নাছোড়বান্দার মতন বলল জুলি।
রুটিন ওঅর্ক, এক কথায় জবাব দিল রানা। তার কারণও আছে। স্টীমারে নিজের পরিচয় দাওনি তুমি, আগেই ঢলাঢলি শুরু করে দিয়েছিলে। ব্যাপারটা তাজ্জব করে আমাকে। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার, ওই পাসপোর্টটা ছাড়া আর কোন আইডেন্টিফিকেশন দেখাওনি আমাকে তুমি, এবং পাসপোর্টটা তোমার না কার বুঝব কি করে আমি?
রহস্যময় হাসি ঠোঁটে ধরে রেখে চকোলেটে চুমুক দিল জুলি। দুটোই খুব সিম্পল, রানা। তোমার দ্বিতীয় সন্দেহটার অবসান আগে ঘটানো যাক। আমাকে কোন আইডেন্টিফিকেশন দেয়া হয়নি। যাতে বন কিংবা বিসিআইয়ের সঙ্গে আমাকে কেউ জড়াতে না পারে। আমার বস ভেবেছিলেন আমি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে স্পাইং করছি রুডলফ ব্রিগলের ওপর, সে-ও হয়তো স্পাই লাগিয়েছে আমার পেছনে। সে হয়তো জানে, এখন একমাত্র আমিই আইডেন্টিফাই করতে পারব তাকে। তার মানেটা বুঝতে পারছ?
পানির মতন, বলল রানা। তোমাকে খতম করার চেষ্টা করবে ও যত শিগগির পারে।
ব্যারোনেসের সুন্দর মুখশ্রীর ওপর একটা চঞ্চল ছায়া খেলে গেল। সসারে কাপ, রেখে মাথা ঝাঁকাল জুলি গ্রাফ। আমার শরীরে কোন চিহ্ন থাকুক চাননি বস, বোঝোই তো কেন।
ব্যাপারটা মেনে নিল রানা। এসপিওনাজ, কাউন্টার এসপিওনাজ সম্পর্কে ওকে আর নতুন করে কি বোঝাবে ব্যারোনেস?
আর ঢলাঢলির কথা বললে, সেটারও কারণ আছে, বলে চলেছে ব্যারোনেস। আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না তুমিই মাসুদ রানা কিনা। বড় জব্বর ভড়ং ধরেছিলে তো। সত্যিকারের মাঝি-মাল্লা মনে হচ্ছিল। আর মদও যা টেনেছিলে, বাপরে!
দাঁত বেরিয়ে পড়ল রানার। সবই অভিনয়ের অংশ। সন্দেহ ক্রমে ক্রমে দূর হতে লেগেছে ওর।
তোমার সঙ্গে ঘেঁষটা-ঘেঁষটি করে সুটকেসের স্টিকারগুলো পড়তে চেষ্টা করছিলাম, বলল জুলি। কিন্তু তুমি তো স্টার্নের ছায়ায় থাকার জন্যে নাছোড়বান্দা। বুঝব কি করে তুমি ব্রিগলের লোক নও? কাজেই শ্রাগ করল ব্যারোনেস, ছেঁড়া, ধুলোমাখা ফেইল জ্যাকেটেও অদ্ভুত সুন্দর দেখাল ভঙ্গিটা। কাজেই ঢলানি সাজতে হলো আমাকে। তাও শিয়োর হতে পারলাম কই?
কথাগুলোয় যুক্তি আছে, মনে মনে স্বীকার করল রানা। আলাপচারিতার মাধ্যমে জেনে নিল এক ফাঁকে, নাকাতাকে চেনে না জুলি। ব্রিগলের সঙ্গে কি সম্পর্ক তার সেটাও জানে না। রানাও ভেঙে বলতে গেল না আর। কথা যত কম ফাস হয় ততই মঙ্গল। নাকাতাকে ব্যারোনেস একজন সুযোগসন্ধানী ধর্ষণকারী হিসেবেই জানুক না, ক্ষতি কি ওর?
কোটের পকেট থেকে একটা বলপয়েন্ট পেন বের করল রানা। এটার কথাও তোমাকে নিশ্চয়ই জানানো হয়েছে? লেখা যায় না এটা দিয়ে, শুধু কালি ছেটায়।
হাসল না জুলি। তাও ভাল, মাথা ধরিয়ে দেয় না। তুমি কিন্তু খুব অন্যায় কাজ করেছ-আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমার জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি…তোমাকে ঘেন্না করা উচিত আমার।
হেসে উঠল রানা। কিন্তু করছ না?
না। আমার কোন ক্ষতি করোনি তুমি। বরঞ্চ হনুমানটার হাত থেকে রক্ষা করেছ। কিন্তু আমার খুদে বন্ধু দুটোকে তোমার এখন ফিরিয়ে দেয়া উচিত।
পাশে রাখা কুমীরের সুটকেসটায় হাত বুলাল রানা। এখানে আছে। সময় হলেই ফেরত পাবে। এবার আমার একটা কথার জবাব দাও তো, ব্যারোনেস।
আর ব্যারোনেস নয়, এখন থেকে জুলি, কেমন? মিষ্টি হেসে বলল ব্যারোনেস।
বেশ, জুলি, সায় জানাল রানা। অবশ্য তোমাকে দেখে কিন্তু মোটেই ব্যারোনেস মনে হয় না—
আমি ব্যারোনেস, খানিকটা উদ্ধত শোনাল জুলির কণ্ঠ। বহু পুরনো টাইটেল। আলমানাক ডি গথা-য় আমার ফ্যামিলির নাম আছে।
হয়েছে, হয়েছে, বলল রানা। খেপো কেন? আমি আসলে জানতে চাইছিলাম, নাকাতা জানল কিভাবে আমরা ওই হোটেলে উঠেছি? জবাবটা আমি জানি, কিন্তু তোমার ধারণাটা জানতে চাইছি।
পার্স হাতড়ে বেনসনের প্যাকেটটা বের করল জুলি, তল্লাশীর সময় রানা। যেটা লক্ষ করেছিল। লাইটার বাড়িয়ে ধরতে ধোয়া ভেদ করে একদৃষ্টে চেয়ে। রইল ওর দিকে মেয়েটি। আমার আইডিয়া আলাদা কিছু হবে কেন, রানা, তোমার মতই। ওরা ফলো করছিল তোমাকে নয়, আমাকে। ওরা আসলে ব্রিগলের চর। গত রাতে বোট থেকে নিশ্চয়ই পিছু নিয়েছে আমাদের।
সরু চোখে মাপল ওকে রানা। একশো মাইল বেগে মাথার মধ্যে দুশো রকম চিন্তা ঘুরছে ওর। দ্বিমত করল না মেয়েটির ধারণার সঙ্গে। খুব একটা কিছু এখন এসে না গেলেও, মিশন লেপার্ডের সফল পরিণতি কিন্তু হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ল। এই অভাবিত মোচড়টার জন্যে তৈরি ছিল না রানা। রাহাত খানই কি ছিলেন? ব্যারোনেস চিহ্নিত করবে ব্রিগলকে রানার জন্যে, ব্যাপারটা ছিল তাই। কিন্তু এখন কি হলো, রানার সঙ্গে ওর উপস্থিতি উল্টে রানাকেই ফাস করে দেবে। ব্যারোনেসের সঙ্গে যে লোক থাকবে তাকে নিশ্চয়ই বন্ধু মনে করতে যাবে না ব্রিগল। আরও মুশকিল হচ্ছে, মেয়েটিকে যে মিশন শেষ। না হওয়া পর্যন্ত কোথাও লুকিয়ে রাখবে তারও উপায় নেই। রুডলফ ব্রিগলকে আইডেন্টিফাই করতে, এ মেয়ে অপরিহার্য।
রানার চিন্তা-ভাবনা বয়ে গেল অন্য খাতে। এ মুহূর্তে রুডলফ ব্রিগল সম্পর্কে নিশ্চিত অনুভূতি হচ্ছে ওর। লোকটা হুট করে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে না। এতদিন ধরে সোনার চিতাবাঘটার জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পর তো নয়ই। না, রুডলফ ব্রিগল অপেক্ষা করবে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে এবং গুটি চালবে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে। ওর প্ল্যান হবে খুঁতহীন ও ক্ষুরধার, এব্যাপারে বাজি ধরতে রাজি মাসুদ রানা। বাবার কাছ থেকে চাবির অর্ধাংশ পাওয়ার পর বহু সময় পেয়েছে সে পরিকল্পনাটাকে নিখুঁত করতে। জাপানে যোগাযোগ করে খুঁজে বের করেছে ইয়ামাগুচি নাকাতার ছেলে হিদেতোশি নাকাতাকে। সন্ত্রাসী হিসেতোশি নাকাতা তেরো বছরের জেল খেটে বেরোনোর পর একত্র হয়েছে দুইজন।
গোটা বিষয়টা উল্টেপাল্টে বিবেচনা করতে, পরিষ্কার হয়ে গেল রানার কাছে, ভয়ের কিছু নেই। রুডলফ ব্রিগল ব্যাঙ্ক থেকে চিতাবাঘ বের করতে পারবে না। চাবির বাকি অর্ধাংশ তো নাকাতার কাছে। দুজনের কেউই কাউকে এক কানাকড়ি দিয়েও বিশ্বাস করবে না! জীবনবাজি রেখে এ-কথা বলতে পারে রানা।
ব্যারোনেসের দিকে চাইল ও। ওকে। আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা। এভাবে সাজানো যায়-ওরা তোমার পেছনে লেগেছে। আমার পরিচয় ফাস হয়নি এখন পর্যন্ত। কেনেট ডাহলিন পালিয়েছে হোটেল হিলসন ছেড়ে। উইলিয়াম হথর্নকে চেনে না ওরা। কারণ সকালে ওয়াচার দুজনের তরফ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাইনি, আমি–এবং মারা গেছে নাকাতা। কোন সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে। তবে যাই হোক, এমুহূর্তে আমার ধারণা, ব্রিগল এবং তার লোকেরাও আমাদের মতই বিভ্রান্ত বোধ করছে। নাকাতার মৃত্যু খানিকটা দুর্গন্ধ ছড়ারে, কাজেই ওই হোটেলের আশপাশে ঘুরঘুর করার সাহস পাবে না ওরা।
এখন প্রবলেম হচ্ছে-তোমাকে সাথে রেখে কিভাবে এগোনো যায়, যাতে প্রয়োজনের সময় রুডলফ ব্রিগলকে তুমি স্পট করতে পারো। তার আগে পর্যন্ত তোমাকে বাঁচিয়ে তো রাখতে হবে, আর আমি আছি তোমার সাথে। সেটাও বোঝানো চলবে না। এই সমস্যার একটা মাত্র সমাধানই মাথায় আসছে, আমার। তোমার সুনাম কেমন, ব্যারোনেস-মানে, জুলি?
অপূর্ব চোখজোড়া প্রস্ফুটিত হলো মেয়েটির। তুমি কিসের কথা বলছ, রানা?
ওর ভুবনভোলানো হাসিটা উপহার দিল এবার রানা। আমাদেরকে এখন প্রেমিক-প্রেমিকা সাজতে হবে, মাই গার্ল। মানে লোকের চোখে ধুলো দিতে আরকি। তাই জানতে চাইছিলাম প্রেমিকা হিসেবে তোমার সুনাম কেমন। ইমেজ হানি-টানি হবে না তো? রুডলফ ব্রিগল ধূর্ত লোক, আর তুমি ওকে যতখানি চেন, সে-ও তোমাকে ঠিক ততখানিই চেনে। কাজেই কুমারী হিসেবে তোমার সুখ্যাতি থেকে থাকলে ওকে ধোকা দেয়া যাচ্ছে না, বুঝতে পেরেছ?
গোলাপী হয়ে গেল ব্যারোনেসের গাল দুটো। অদ্ভুত সুন্দর এক দুতি ওর চোখে। অপেক্ষা করছে রানা। হঠাৎ হেসে উঠল জুলি। দাতে কাটছে ভেজা। অধর। রানার মনে হলো সহসা অদ্ভুত এক ইঙ্গিত আবিষ্কার করেছে ও মেয়েটির চোখে। সঙ্গে খানিকটা বিদ্বেষও কি?
মাথা ঝাঁকাল জুলি। কোন আপত্তি নেই আমার, কোন সমস্যা ও নেই। তবে মনে থাকে যেন, রানা, এটা স্রেফ অভিনয়। নিছক একটা কাভার, ঠিক আছে?
ফাইন, বলল রানা। ওভাবেই অভিনয় করব আমরা। সাময়িকভাবে পেয়েও যেতে পারি এর সুফল। যত যাই হোক, গতরাতে একটা নোংরা নাবিককে বোটে তুলে নিয়েছ তুমি। ব্রিগলের লোকেরা দেখেছে সেটা। ফলে করেছে আমাদের হোটেল হিলসন পর্যন্ত। চিন্তা-ভাবনা ওদের মাথাতেও চলছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না।
পকেট হাতড়ে গোল্ডলীফের প্যাকেটটা বের করল রানা। কিন্তু খুলে দেখে খালি। ধ্যাত্তেরি! স্বগতোক্তি করল।
বেনসনের প্যাকেটটা এগিয়ে দিল জুলি। এটা নাও। আরেক পকেট হাতড়াচ্ছে তখন রানা। থাকার তো কথা-আরেহ, এটা কি?
জনাব হিদেতোশি নাকাতার বাধানো দাঁতটা টেবিলে ওদের মাঝখানে রাখল। বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল ও কুড়িয়ে পাওয়া অমূল্য রতনটার কথা।
অস্কুট বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে এল ব্যারোনেসের মুখ দিয়ে। বিদ্রুপের হাসি হাসল রানা। মরহুম নাকাতার বিকশিত দন্ত। জিনিসটা পুলিশের হাতে পড়ক চাইনি।
মুখ কুঁচকে গেছে জুলির। ছিঃ! ফেলো, ফেলো, শিগগির ফেলে দাও। মাগোহ
কিন্তু রানা সে কথায় কান না দিয়ে বাঁধানো দাঁতের পাটীটা তুলে নিল। খুব আমোদ পাচ্ছে ও। দেখো, দেখো, বাক টীথ! আগের পাটীগুলোর সাথে মিল রেখে ইচ্ছে করে কোদাল মার্কা করা হয়েছে। কৌশল জানে বটে জাপানীরা, কি বলো?
প্লীজ, রানা! ফেলে দাও ওটা। বমি পাচ্ছে আমার।
ব্যারোনেসকে আরেকটু সহনশীল হতে পরামর্শ দিতে যাবে রানা, এসময় আচমকা ওর চোখ আটকে গেল নকল দাঁতের সারিটার ওপর। কোনাকুনিভাবে চিড় খেয়ে গেছে প্লেটটা। লাল নিয়োপ্রেনের ভেতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে চকচকে ধাতব কিছু। আঙুল দিয়ে টেনে বের করতে চেষ্টা করল রানা। কিন্তু এটে আছে, জিনিসটা, খসবে না।
রানা! আমাদের এখন চলে যাওয়া দরকার। আমার মনে হচ্ছে—
একটা হাত তুলে বাধা দিল রানা। চুপ থাকো!
টেবিলে আলতো করে ঠুকছে ও পাটীটাকে। নিয়োপ্ৰেনের ফাঁদটা বড় হলো আরেকটু। অসহিষ্ণু মাসুদ রানা এবার সহসা জোর খাটিয়ে ফেড়ে ফেলল প্লেটটাকে। টেবিলে পড়ে গড়িয়ে গেল খুদে একটা ঝকঝকে লোহা, থাবা মেরে ধরল ওটাকে রানা। নিমেষে বুঝে গেছে জিনিসটা কি। ফ্রেঞ্চ কী-র একাংশ!
মাসুদ রানার কঠোর মুখটায় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল আনন্দের চওড়া হাসি। বিসিআইয়ের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছেলেগুলোর ধারণা তারমানে অমূলক ছিল না। ওরা অনুমান করেছিল, ফ্রেঞ্চ কী-র অর্ধেকটা ব্রিগলের ও বাকি অর্ধেকটা নাকাতার কাছে রয়েছে। করাত দিয়ে কাটা ফ্রেঞ্চ কী-টাকে সমান দুভাগে ভাগ করে নিয়েছিল ওদের বাবারা। কাজেই পরস্পরকে বিশ্বাস না করে কোন উপায় আছে লোক দুটোর?
নাকাতার অর্ধাংশ এ মুহূর্তে, যেন আকাশ থেকেই, রানার কোলে এসে পড়েছে। মৃদু হাসি ফুটল ওর মুখে। হাফ কী-র হাফ গ্রহণ করবে না কোন সুইস ব্যাঙ্ক। হাসি চাপল রানা। এতবছর নাকাতার জেলমুক্তির জন্যে অপেক্ষা করে গেল ব্রিগল, সোনার চিতাবাঘটা যাতে কজা করতে পারে-কিন্তু পেলটা কি? লবডঙ্কা। মারা পড়েছে নাকাতা এবং তার ভাগের টুকরো চাবিটা এখন মাসুদ রানার হাতে। ব্রিগলকে আসতে হবে ওর কাছে। না চাইতেই দর কষাকষির মস্ত সুযোগ পেয়ে গেছে ও।
ঘামের দুর্গন্ধ নাকে আসতে মুখ তুলে চাইল রানা। ওয়েটার এসে দাঁড়িয়েছে। রানা টেবিলে দাঁত ঠোকাতে সে মনে করেছে ডাক পড়েছে। মাথা নেড়ে এক মুঠো ফ্রা ঢেলে দিল রানা টেবিলে। কলজেটা অ্যা-ও বড় হয়ে গেছে। ওর। ফুর্তি অনুভব করছে মনে। অলৌকিকভাবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এমনই লাগে মানুষের। ফ্রেঞ্চ কীর টুকরোটা পকেটে ছেড়ে দিল ও। এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি ব্যারোনেস, বেশিরভাগ সময় চোখ সরিয়ে রেখেছিল ঘেন্নায়।
সটান উঠে দাঁড়াল এবার রানা, তুলে নিল সুটকেস। ব্যারোনেসের উদ্দেশে চোখ টিপল, নতুন ভূমিকায় মানিয়ে নিচ্ছে স্বচ্ছন্দে। এসো, ডার্লিং। যাওয়া যাক। অনেক দেরি হয়ে গেল।
দেরি মানে দেরি?দরজার দিকে পা বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল ব্যারোনেস। তোমাকে যেটা বলতে চাইছিলাম। পুলিস-রাস্তার ওমাথায়। বায়ে-আরেকটা কাফেতে ঢুকেছে।
তাহলে ডানে টার্ন নেব আমরা, বলল রানা। দৌড় দিয়ো না, আস্তে আস্তে হাঁটো কাছের একব্জিটটার দিকে। প্রেমিক-প্রেমিকার মত হাত ধরাধরি করে হাঁটব আমরা। কোটের কলার তুলে দিয়ে, ঢোলা পোশাকটা টেনেটুনে আটসাট করল দেহের চারপাশে। এবার পা বাড়াল একব্জিটের উদ্দেশে। এটা। খুব সম্ভব রুটিন চেক, কিন্তু এমুহর্তে ওকে থামানো যোক চায় না রানা। শার্টবিহীন লোকের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারে ওরা। আর সুটকেসটা চেক করলে তো কথাই নেই, খেল খতম।
ফ্রেঞ্চ কী ভাগ্যগুণে হাতে পাওয়ার পর কিছুতেই এ সুযোগ দেয়া যায় না। হাতে হাত ধরে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে ওরা। কাজে দিয়েছে বুদ্ধিটা। কারও সন্দেহ জাগেনি। কানে আসেনি কোন তর্জন-গর্জন, কাঁধে পড়েনি পুলিসী থাবা।
পাশ থেকে মৃদু স্বরে বলল এসময় ব্যারোনেস পেয়ে গেছি, রানা। লুকানোর জন্যে একটা চমৎকার জায়গা পেয়ে গেছি। আমার এক পুরানো বন্ধুর বাড়ি, কিন্তু সে এখন ওটা ব্যবহার করছে না। তার অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন পড়বে না। আমাকে পারমিশন দিয়ে রেখেছে, যখন খুশি উঠতে পারি। ওখানে, খুশি হবে সে। কাজের লোকেরও অসুবিধা নেই। যাবে?
চট করে চাইল একবার ওর দিকে রানা। ব্যারোনেসের হানি-ব্লন্ড মাথাটা ওর কাঁধ ছুঁই-ছুঁই করছে। স্বৰ্গটা কোথায়?
লেকটার বিশ মাইল উজানে, সুইস অংশে। আমাদের জন্যে পারফেক্ট হবে জায়গাটা।
যাব কিভাবে ওখানে? সাঁতরে?
লঞ্চ ভাড়া করা যায়। ওই দেখছ না জেটি?
বেশ, চলো। ছোট জেটিটা হ্রদের শান্ত পানিতে কাঠের আঙুলের মত মাথা উঁচিয়ে রয়েছে। ঝট করে পেছনটা এক নজর দেখে নিল রানা। পুলিস বা আর কারও কোন আগ্রহ নেই ওদের প্রতি।
লেকের পারে বাতাস চঞ্চল ও ঈষৎ ঠাণ্ডা। জেটির চারপাশে পতাকা ও বান্টিং সাহসী ভঙ্গিতে পতপত করছে। সাদা রঙের ছোটখাট একটা লঞ্চ নোঙর করা, পুরানো টায়ারে তৈরি ফেন্ডার প্রতিরক্ষা দিচ্ছে ওটাকে।
জেটির তক্তা ও পায়ের নিচে অনুভব করতে ব্যারোনেস বলল বাধানো দাঁতটা পেয়ে অত খুশি হয়ে উঠেছ কেন, রানা? আমাদের কাজের সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে ওটার? চিতাবাঘটার সাথে?
ধীরে বৎস, ধীরে, রহস্য করে বলল রানা।
কি ছিল দাঁতের পাটীটার ভেতরে? নাছোড়বান্দার মত জবাব চাইল জুলি।
জানবে, বলল রানা। তবে এখন নয়, পরে। গুনগুন করে সুর ভাঁজছে ওঃ কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা–
.
০৫.
এইমাত্র পনেরো মিনিটের পরিশ্রমসাধ্য যযাগব্যায়াম শেষ করল মাসুদ রানা শবাসন দিয়ে ইতি টানল ও। না, না, এতে মনের ওপর চাপ পড়ে না ওর। কারণ শবটাকে সব সময়ই সে অন্য কেউ বলে ধরে নেয়। এরপর একটু স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করল রানা। মেডিটেশনের ভঙ্গিতে কাটাল আরও পনেরোটা মিনিট। প্রথম, পদ্মাসনে। তারপর গোমুখাসনে।
ওর বৃদ্ধ গুরুর, যার কাছ থেকে এগুলো শিখেছে রানা, দুটো পরামর্শ মনে মনে ক্ষমা চেয়ে অমান্য করে সে। চোখ বন্ধ করে না রানা। এবং খোলা রাখে। কান। এ দুটো বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আবিষ্কার করেছে রানা, যথেষ্ট কাজে দেয় ওর যোগব্যায়াম। মেডিটেশনে বসলে সম্ভাবনা থাকে অনেক গভীর লেভেলে চলে যাওয়ার, সঙ্গে সম্ভাবনা বেড়ে যায় অপমৃত্যুরও। কে কখন অজান্তে পিঠে ছুরি মারে, মাথা ফুটো করে দেয় গুলি করে, কিংবা গলায় দড়ির ফাস পরায় কেউ বলতে পারে? ব্যারোনেসের সঙ্গে ভিলা রিকোতে আসার পর থেকেই কেমন জানি একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে রানার। কেন জানে না ও। চালকের আসনেই তো এ মুহূর্তে বসে আছে সে। মৃত জাপানীর চাবির ভাগটা ওর কাছে, তারমানে হাত-পা বাঁধা অবস্থা রুডলফ ব্রিগলের। রানার সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করতেই হবে তার। এবং তখনই মওকা পাবে ও প্রতিশোধ নেয়ার।
ও আর ব্যারোনেস-মানে জুলি-কয়েক ঘণ্টা হলো এসে উঠেছে ভিলা রিকোয়, এবং এখন অবধি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, নিরাপদ মনে হচ্ছে রানার জায়গাটাকে। ভবিষ্যতের কথা জানে না ও।
সুইস উপকূলের দুশো গজ ভেতরে, পর্বতসঙ্কুল ছোট্ট এক দ্বীপে ভিলাটার অবস্থান। ফোনের ব্যবস্থা নেই। তীরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে, ডকে নোঙর করা, ছোট্ট একটা বৈঠা চালিত হালকা নৌকা রয়েছে। লঞ্চটা ওদেরকে যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে সেখানে। বৈঠাগুলো রয়েছে নৌকায়, কিন্তু শিকল ও তালা মেরে আটকে রাখা হয়েছে একটা পাইলের সঙ্গে। রানা লক্ষ করেছে ব্যাপারটা। শুধু এটাই নয়, লক্ষ করেছে আরও অনেক কিছুই; খাড়া, ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের মুখ বরাবর ভিলায় উঠে আসার সময়।
তোমার বান্ধবী খুব প্রাইভেসি মানে দেখছি, মন্তব্য করেছে রানা।
জেনেভা থেকে এখানে আসার পথে বান্ধবীর ব্যাপারে মুখ খুলতে অনাগ্রহী মনে হয়েছে ব্যারোনেসকে। তবুও রানা জেনে নিয়েছে যতটা পারে। ওর বান্ধবী কন্টেসা ডি কারেন্থ একজন সম্মানিতা বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা, এককালের বিখ্যাত কনসার্ট পিয়ানিস্ট। কঠিন বাতে আক্রান্ত কন্টেসা এখন প্যারিসে একাকী জীবন যাপন করছেন। কদাচ ভিলা রিকোয় আসেন। অবশ্য সারা বছরই ভোলা রাখেন এটা, কাজের লোকজনও পোষেন, এবং ব্যারোনেসের। জন্যে ভিলায় অবারিত দ্বার। জুলি বলেছে রানাকে, ভিলা রিকো ওর কাছে দ্বিতীয় ঠাই। প্রথমটা অবশ্যই বন। তবে প্রায়ই নাকি ও আসে এখানে। নিজস্ব ব্যবহার্য অনেক জিনিসপত্রও রাখে কাপড়চোপড়, বইপত্র ইত্যাদি।
এটুকু বলে কৌশলে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছে ব্যারোনেস।
দেহের একটি পেশিও না নাড়িয়ে এক পলকে ঘড়িটা দেখে নিল রানা। আর তিন মিনিট বাকি। তারপর ব্যালকনি জানালার পাশে রাখা দামী টেলিভিশনটা খুলবে ও, জেনেভার কোন খবর-টবর যদি পাওয়া যায়। দুএকটা। তথ্যসূত্র পেয়ে যেতে পারে হোটেল হিলসন ও নাকাতা সম্পর্কে।
আড়ষ্ট ভঙ্গিটা ছেড়ে মুচকি হাসল রানা। রুডলফ ব্রিগলও হয়তো ঠিক একই কাজ করবে।
দরজা ভেজানোর খুট শব্দটা এক মিনিট আগেই পেয়েছে রানা। কোন মহিলার উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়েছে, তবে মুখ খোলেনি। নাকে এসেছে ওর উগ্র সেন্টের গন্ধ। কি ব্যাপার, মেরী? কি চাই?
ভিলার কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওর আসার পর। কর্মচারী বলতে দুজন, মেইড মেরী পেটি ও বিশালদেহী এক লোক, ওমর আব্রাহাম-ব্যারোনেসের কাছ থেকে জেনেছে লোকটা সব কাজের কাজী।
ব্যারোনেস পাঠালেন, বলল মেরী। ডিনারের আগে তার সাথে সাঁতার কাটবেন কিনা জানার জন্যে।
খুশি মনে, বলল রানা। কিন্তু কোথায়? লেকের পানি খুব ঠাণ্ডা থাকে না বছরের এসময়টায়?
কনজারভেটরী আছে, মঁসিয়ে। গরম পানির পুল। ব্যারোনেস এখন ওখানে আছেন। আপনি চাইলে আমি পথ দেখিয়ে দেব। ওর গোলগাল, নিষ্পাপ মুখটায় সাহায্য করার ব্যাকুলতা।
দরকার নেই। ব্যারোনেসকে বলে দাও দশ মিনিটের মধ্যে আসছি আমি।
মেরী বেরিয়ে গেলে দরজা লাগিয়ে দিল রানা। এক কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা লম্বা শেভাল গ্লাসটায় নিজের প্রতিবিম্ব লক্ষ করল ও। বোঝা যায়, একসময় কোন মহিলার রূম ছিল এটা। এবার বেরিয়ে গিয়ে ঘোট স্লীপিং পোর্চটায় প্রবেশ করল। এই সুইটের বেডরূম হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটা।
বিছানায় খোলা পড়ে রয়েছে রানার বেটপ সুটকেসটা। ভেতরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল ও। ছোট্ট একটা সমস্যা ওর সামনে। সত্যি বলতে কি, একাধিক ছোটখাট সমস্যা। এক নম্বর, পোশাক। পরিষ্কার কাপড়চোপড় প্রায় নেইই বলতে গেলে। একটা স্পোর্টস শার্ট, গোটা দুই স্ন্যাক, একটা জ্যাকেট, মোজা আর জুতো। আপাতত এই সম্বল, তবে চলে যাবে। পরে, পরে বলে আদৌ থাকে যদি কিছু জেনেভায় রানা এজেন্সির ওই ডিপোটায় ঢুকে নিজেকে সাজিয়ে নেবে রানা।
এই মুহূর্তে মূল সমস্যা ওই চাবির টুকরোটা। পরনের বক্সার ট্রাঙ্কের ইলাস্টিক ওয়েস্ট ব্যান্ড থেকে ওটা বের করে নিয়ে পরখ করে দেখল রানা। সযত্নে লুকিয়ে রাখতে হবে এটাকে।
কিন্তু রাখবেটা কোথায়? ওর সুইমিং ট্রাঙ্কে তো পকেট নেই। আশরাফ চৌধুরী এতকিছু পারে আর সামান্য একটা পকেট বানিয়ে দিতে পারে না? শেম, শেম!
সমস্যাটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার ফাঁকে সুটকেস থেকে বিশ্বস্ত তিন সঙ্গীকে বের করে পরীক্ষা করে দেখল রানা। ফার্স্ট ক্লাস অবস্থায় আছে সব কটা। একটা বিজ্ঞাপন দিলে কেমন হয়? টিপটপ অবস্থায় একটি লুগার অটোমেটিক, একটি স্টিলেটো ও একটি গ্যাস বম বিক্রয় হইবে!
লুগারটা রেখে যেতে হবে। টেরি-ক্লথ রোবে জায়গা করে নেবে গ্যাস বম। কিন্তু স্টিলেটো? তালুর ওপর রাখল ওটাকে রানা। ট্রাঙ্কের ইলাস্টিকে সেঁধিয়ে দিল এবার। ব্যারোনেস হয়তো অবাক হতে পারে। হোকগে। কিন্তু রানা নিরস্ত্র অবস্থায় কখনও কারও হাতে ধরা পড়তে চায় না।
ফ্রেঞ্চ কী-টা সুটকেসে রাখতেই মনস্থ করল রানা। বার্গলার প্রাফ সুটকেসটার গোপন কোন কুঠুরিতে নিরাপদেই থাকবে ওটা। সাঁতার কাটতে গেলে চোখে চোখে থাকবে জুলি; মানুষ বলতে তো আর কেবল ওই মেরী পেটি ও হোদল কুতকুত ওমর। নাহ, ওদের সাধ্য হবে না বিশেষভাবে তৈরি রানার অসাধারণ সুটকেসটাকে বাগে আনা।
সুইট ত্যাগ করে দরজা লক করার সময় ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা টের পেল। রানা। হালকাভাবে শুরু হলেও এখন ভাবাচ্ছে ওকে মিশন লেপার্ড। চাবির অনাকাঙিক্ষত টুকরোটা কয়েক ডিগ্রি চড়িয়ে দিয়েছে ওর টেনশন।
সাদা ও গোলাপী স্টাকৌ ব্যবহার করা হয়েছে ভিলা রিকোয়। এর ফলে প্রাসাদোপম বিশাল বাড়িটা পেয়েছে ভিন্নতর মাত্রা। লাল টালির ছাদ ও নিখুঁত রুট আয়রন ব্যালকনিগুলো আশ্চর্য এক সৌন্দর্য দান করেছে ভিলাটাকে। প্রাচীন কোন রোমান প্রিন্সের বাসস্থান হিসেবেই যেন বেশি মানানসই এটা। বাড়িটাকে খাড়া পার্শ্বদেশসমৃদ্ধ, খুদে দ্বীপটার মাথার মুকুট বললেও অত্যুক্তি হবে না। গাছ-পালা, ঝোপ-ঝাড় ঘন হয়ে জন্মেছে দ্বীপটিতে। অসংখ্য মোচাকৃতি গাছ গাছালি জড়াজড়ি করে রয়েছে লার্চ, বার্চ আর ওকের জটলার সঙ্গে। এবাড়িতে আসার পথে লক্ষ করেছিল রানা, অনেকগুলো পথ এদিক ওদিক চলে গেছে এখান থেকে, বাহ্যত দ্বীপের প্রতিটি কোণে, সাইকেলের শোকের মতন।
প্রশস্ত সিঁড়িটায় লোহার ব্যানিস্টার, ওটা, বেয়ে নেমে আসতে গিয়ে রানার মনে হলো একটু ঘুরেফিরে দেখা উচিত দ্বীপটার চারধার। কাজটা সকালের দিকে সারবে ঠিক করল।
ব্যারোনেসের সঙ্গে ভিলায় ঢোকার সময় কনজারভেটরী, কিংবা গ্রীনহাউজটা লক্ষ করেছিল রানা। সেদিকেই এগোচ্ছে এখন পথ করে নিয়ে। খিড়কি দরজা দিয়ে মেইন হাউজ ত্যাগ করেছে ও। দুপাশে ইউ গাছের সারি নিয়ে বিছিয়ে পড়ে থাকা, চওড়া মেটে রাস্তাটা ধরে রানা হটছে। পথটা আঁকাবাঁকা। রানা যেই শেষ বাকটা ঘুরেছে অমনি দেখা পেল সব কাজের কাজী হোঁতকা ওমরের। আস্ত একটা ফুটবল লোকটা, জায়গামতন নাক-মুখ-চোখ পেয়ে গেছে কেবল।
চর্বির ডিপো ওমর আব্রাহাম, প্রথম দর্শনে ধারণা করেছে রানা, সিরীয় কিংবা তুকী হবে। সুইস পর্বতারোহীর বেশভূষায় বিদঘুটে দেখাচ্ছে। লোকটাকে। অতিকষ্টে হাসি চাপল রানা।
পাথরের বেঞ্চিতে বসে সিগারেট ফুকছিল ওমর, রানামোড় ঘুরতে ওকে দেখতে পেয়ে সটান উঠে দাঁড়াল লোকটা। প্রায় চারশো পাউন্ড ওজন নিয়ে তার ওরকম ক্ষিপ্র রিফ্লেক্স রীতিমত তাজ্জব করে দিল রানাকে। অন্তরে গেঁথে নিল রানা দৃশ্যটা। যতটা ভেবেছিল, ততটা অচল মাল নয় তারমানে।
গুড ইভনিং, স্যার, বলল ওমর। ফাইন ডে, স্যার।অতিভক্তি আবিষ্কার করল রানা লোকটার কণ্ঠস্বরে। চড়া, তীক্ষ্ণ, মধুমাখা স্বরটা কানে লাগল ওর।
গুড আফটারনুন, ভদ্রতা রক্ষা করল রানা। হ্যাট হাতে দাঁড়িয়ে ওমর, স্পষ্টতই নার্ভাস। কাচুমাচু ভঙ্গিতে চেয়ে রয়েছে রানার দিকে। লোকটার মাথা সম্পূর্ণ বেল, চর্বি ভরা কোটর থেকে উঁকি দিয়ে রয়েছে একজোড়া কুতকুতে চোখ। বেচারী মেরী পেটি! আহা রে, এই কিম্ভুত জীবটার সঙ্গে একাকী দ্বীপবাস করতে হচ্ছে তাকে!
সহসা উপলব্ধি করল রানা, খুব কাছ থেকে গভীরভাবে লক্ষ করছে ওকে ওমর। রানাকে সরাসরি চাইতে দেখে চোখ নামিয়ে নিল। খুব কৌতূহলী লোক মনে হচ্ছে, ভাবল ও হবে না-ই বা কেন? এই নির্জন দ্বীপে মানুষ জনের পা তো পড়েই না একরকম। অবশ্য ব্যারোনেসের কথা সত্যি হয়ে থাকে যদি। মনে মনে হাসল রানা, এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না ও জুলি গ্রাফকে।
ব্যারোনেস গ্রীনহাউজে আছে?
ও, হ্যাঁ। আছেন, স্যার। অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে, স্যার। চর্বি বাধা না দিলে হয়তো কুনিশ করত ওমর। হাস্যকর সবুজ হ্যাটটা গ্লাসহাউজের উদ্দেশে ঝটকা মেরে ইঙ্গিত করল। উঁচু তারে চড়ে বসল এবার ওর কণ্ঠস্বর। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন, স্যার।
ওর দিকে চেয়ে মুচকি হাসল রানা। লোকটাকে একেবারেই পছন্দ হয়নি। ওর। কিন্তু ভাবে ভঙ্গিতে যাতে সেটা প্রকাশ পেয়ে না যায়, সতর্ক রইল।
কনজারভেটরীর উদ্দেশে পা বাড়াতে ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিল ওমর লক্ষ করছে ওকে। মরুকগে, মনে মনে বলল রানা।
লম্বা একটা কাঁচের দরজা ঠেলে প্রবেশ করল রানা কুয়াশাচ্ছন্ন জঙ্গলময় এক পরিবেশে। হালকা রোবটা গায়ে ওর, পকেটে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা ছুরিটা হঠাৎ করেই ভারী ঠেকল ওর কাছে। ওটা বের করে নিয়ে গুটিয়ে রেখে দিল আস্তিনের ভাজে। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। ও। কন্টেসা ডি কারেষুর, ভাবল ও, রুচি আছে বলতে হবে। সঙ্গে অবশ্যই আছে পকেটের জোর।
রানা যেখানে পা রেখেছে সে জায়গাটাকে অরণ্য কিংবা রেইন ফরেস্ট হিসেবে কেউ ভুল করলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। চারপাশে সর্বত্র তৃণ সবুজ গাছ-পালা। সবুজের যে ধরনের শেড চাই সবই আছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উজ্জ্বল পুষ্প-পল্লব জায়গাটাকে দান করেছে বিশেষ বৈচিত্র্য। বাদুড়ের সমান একেকটা প্রজাপতি, রঙবেরঙের মোম তুল্য ডানা ঝাপ্টে ভেসে বেড়াচ্ছে, ওড়াওড়ি করছে। রঙিন পাখিরা চকচকে তীরের মতন শো-শো উড়াল দিচ্ছে। গাছ থেকে গাছে, ঝোপে-ঝাড়ে।
চিতাবাঘটাকে গাছের মোটা ডাল থেকে নিষ্ঠুর, বুনো দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে আতকে উঠল রানা। প্রবৃত্তির বশে হাত চলে গেল। ওর স্টিলেটোর ওপর। কিন্তু হেসে উঠল পরক্ষণে। চিতাবাঘটা স্টাফ করা! কিন্তু একেবারে জলজ্যান্ত যেন। বুক এখনও ধড়াস ধড়াস করছে রানার।
দরজা থেকে জঙ্গলে ঢুকেছে বেশ কতগুলো পথ। রানা এক পলকের জন্যে দ্বিধা করতে কানে এল একাধিক মানুষের কণ্ঠস্বর। একটা কণ্ঠস্বর। আরেকটা রেডিও। মৃদু হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। ব্যারোনেস নিশ্চয়ই খবর। শুনছে। মেরী তখন এসে না পড়লে ও-ও শুনত। রাস্তা ধরে এগোল রানা, ঘোষকের ধাতব খ্যানখ্যানে কণ্ঠস্বর অনুসরণ করছে।
ছোট্ট একটুখানি ফাঁকা জায়গায় এনে পৌঁছে দিল পথটা রানাকে। ক্যামোফ্লেজটা এতই বাস্তব, এমনই শিল্পসম্মতভাবে তৈরি, যে জঙ্গলে অবস্থান করছে আবারও এমনি অনুভূতি হলো রানার।
সুইমিং পুলে দাপাদাপি করছে ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ। সোনালী বিকিনি। পরনে ওর। রানা পুলের কিনারায় এসে দাঁড়াতে ওকে লক্ষ্য করে সাঁতরে কাছিয়ে এল যুবতী। মুখের চেহারায় আবছা অভিমানের ছায়া।
কোথায় ছিলে এতক্ষণ, রানা? জবাব চাইল। মেরীকে সেই কখন। পাঠিয়েছি!
কখন মানে পনেরো মিনিট আগে। যাকগে-খুব সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু তোমাকে, বলল রানা।
সত্যি বলছ? হাসিতে উদ্ভাসিত ব্যারোনেসের মুখ।
পুলের কিনারায় অনেকগুলো পুরু রাবার ম্যাট লক্ষ করল রানা। তার একটায় বসে বকবক করে চলেছে মাঝারি সাইজের এক ট্রানজিস্টর। আরেকটার ওপর দেখা গেল লাঞ্চ হ্যাঁম্পার ও একটা সিলভার আইস। বাকেট-একটা বোতল ঠাণ্ডা হচ্ছে ওটার ভেতর। জুলির সাদা রোবটা দখল করেছে অপর একটা রাবার ম্যাট।
পুলের প্রান্ত আঁকড়ে ধরে রয়েছে এমুহর্তে ব্যারোনেস। ভেজা চুলে আঙুল চালিয়ে সিথি করছে। মুগ্ধ সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওকে লক্ষ করছে রানা। সত্যি সত্যিই জলপরী মনে হচ্ছে ব্যারোনেসকে। কিন্তু মুগ্ধতা নয়, জয়ী হলো রানার। পেশাদারী মনোভাব।
জিনিসটা খুলে রেখেছ মনে হচ্ছে, বলল ও।
ঝট করে ওর চোখের দিকে সরাসরি চাইল জুলি। সবুজাভ আলোয় ল্যাভেন্ডার-গ্রে রঙ ধারণ করল মেয়েটির চোখ, সঙ্গে ঝিলিক দিল সোনালী ফুলিঙ্গ। কপালে দুমুহর্ত স্থির হয়ে রইল ওর হাতটা, ভেজা চুল সরাচ্ছিল।
কোন জিনিসটা, রানা?
লকেট।
আধো হাসিটা ধরা ছিল এতক্ষণ ঠোঁটে, মুছে গেল এবার। মুখ ফিরিয়ে নিল ও। আমার-আমার মনে ছিল না তুমি আমাকে সার্চ করেছ। লকেটটার। কথা তো জেনেছই তুমি-ছবিটাও নিশ্চয়ই দেখেছ। কিন্তু ওসব কথা কি এখন না বললেই নয়?
সরি, বলল রানা। এবং মন থেকেই।
হাসি ফিরল যুবতীর মুখে। সাঁতার কাটবে এসো।
ইতস্তত করছে রানা। চারপাশের ছদ্ম-জঙ্গলে তীক্ষ্ণ, সতর্ক দৃষ্টি ঘুরে এল ওর। রঙিন পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে, উড়ছে এদিক সেদিক। একঘেয়ে সুরে বেজে চলেছে রেডিওটা, এই ফরাসিতে এই আবার জার্মানে। রোবট। গুটিয়ে শক্ত একটা বান্ডিল করে পুলের কিনারায় রেখে দিল রানা। আপাতত বহাল তবিয়তেই থাকবে সাপের মতন বিষধর স্টিলেটোটা। ঝুঁকে পড়ে আঙুল ছোঁয়াল ও শীতল, ধাতব অস্ত্রটার গায়ে।
চারপাশে আরেকবার সাবধানী নজর বুলিয়ে নিল রানা। ওর ইন্দ্রিয় বলছে, ভয় নেই। আপাতত নিরাপদ ও।
নিশ্চিত হয়ে তারপর ঝাঁপ দিল রানা।
.
০৬.
হোটেল হিলসনের ঘটনায় পুলিস বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েছে ফরাসিতে ঘোষণা করছে এখন স্থানীয় রেডিওর লোকটা।
তড়াক করে সিধে হয়ে বসল মাসুদ রানা। ব্যারোনেস ক্লান্ত দেহে শুয়ে আছে ওপাশে।
কি হলো, রানা? প্রশ্ন করল যুবতী।
চুপ!
বলে চলেছে ঘোষক পুলিস অনুরোধ জানাচ্ছে জুরিখের অধিবাসী কেনেট ডাহলিন যেন দয়া করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুলিসের ধারণা, কেনেট ডাহলিন, যিনি গভীর রাতে জনৈক ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে হোটেল হিলসনে উঠেছিলেন, অদ্ভুত এই ঘটনার ওপর আলোকপাত করতে পারবেন…
ব্যারোনেসের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল রানা। কেনেট ডাহলিনের ঠেকা পড়েছে তো–কিন্তু নাকাতার লাশটার কথা কিছু বলল না কেন? হয়তো বলেছে, মিস করেছি আমি…
একটা হাত তুলল জুলি। শশ-কি যেন বলছে।
বিজ্ঞাপন গেছে একটা, এবার ঘোষক আরম্ভ করল আবার। হোটেলের দারোয়ান, ইম্যানুয়েল থুরামের মতে, মুখোশধারীরা কোন কিছুর সন্ধানে এসেছিল। কেনেট ডাহলিনের ব্যবহৃত রূম তারা লণ্ডভণ্ড করে দেয় এবং পেছনের উঠানে ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। মঁসিয়ে থুরাম জানিয়েছেন, মুখোশধারীরা তাকে পিস্তলের মুখে আটকে রাখলেও কোন ক্ষতি করেনি। আগন্তুকরা বিদায় হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিসে খবর দেয়া হয়। পুলিস ইতোমধ্যে একবার তল্লাশী চালিয়ে এসেছে হোটেলটিতে। এর ফলে আরও কিছু বিস্ময়কর বিষয় আবিষ্কৃত হয়েছে। শ্রোতাদের আমরা কেসটির অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত রাখব। এখন আমরা ফিরে যাচ্ছি মূল-
নব ঘুরিয়ে দিল রানা। ভ্রূ কুঁচকে উঠেছে ওর। অস্বস্তিকর এক অনুভূতি পেটের মধ্যে। নাকাতার কি হলো? ওর মৃতদেহের কোন উল্লেখ নেই, ব্যাপারটা কি?
তিনটে বিকল্প চিন্তা খেলে গেল ওর মাথায়। নাকাতার মৃতদেহ পুলিস। পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে চেপে গেছে। নাকাতার লাশ সরিয়ে নিয়ে গেছে ওর সাঙ্গপাঙ্গরা। কিংবা নাকাতা মারা পড়েনি আদৌ!
ভুল একটা করেছে রানা এখন বুঝতে পারছে। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই খাড়া। করেছে মনগড়া কল্পনা। কিন্তু তবুও খুঁতখুঁতানিটা যাচ্ছে না-নাকাতার মত একটা পলকা লোক অণ্ডকোষে অমন এক বেয়াড়া লাথি হজম করল, উপরন্ত উড়ে গিয়ে পড়ল কংক্রিটের উঠানে, তারপরও বাঁচে কিভাবে? বাঁচার সম্ভাবনা লাখে এক। নাকাতা কি তবে সেই অতি সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটি? এ যে লটারিতে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পাওয়ার মত ব্যাপার!
রানার মাথায় কি চিন্তা-ভাবনা চলছে জানার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জুলি। আবার কাজের কথা ভাবছ বুঝি? এই স্বর্গে এসেও কাজের চিন্তা! ওহ, মাঝে মাঝে ঘেন্না ধরে যায় দুনিয়ার ওপর। সে যে কী ঘেন্না তুমি কল্পনাও করতে পারো না।
সবুজাভ আলোয় ওকে লক্ষ করল রানা। গ্লাস হাউজের বাইরে দিনটা মরে আসতে ক্রমে জোরাল হচ্ছে আলো। পাখিরাও কেমন ঝিম মেরে যাচ্ছে। জানি, বেবি। কিন্তু দুনিয়াকে দুষে কি হবে বলো? একসময় তো কল্পনার স্বর্গরাজ্য ছেড়ে বাস্তবে ফিরতে হয় মানুষকে-জীবনের মুখোমুখি হতে হয়। কিংবা মৃত্যুর।
কেন?
সধৈর্য হাসল রানা। হাত বুলিয়ে দিল জুলির পিঠে। আপাতত কল্পনাবিলাস ছাড়ো। আমার বসের সোজা কথা, আগে কাজ পরে আর সব।
বস্! কাল সকালে যেভাবে হোক কন্ট্যাক্ট করতে হবে তাকে। রানা এজেন্সির ওই ডিপোটায় গিয়ে আবার ফিরে আসতে সমস্যা হতে পারে। খানিকটা, কিন্তু উপায় বের করে নিতেই হবে রানাকে।
তুমি এখন বিসিআইয়ের হয়ে কাজ করছ, বলল ব্যারোনেসকে। কাজেই ওসব স্বর্গমর্তের চিন্তা ছাড়ো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রানাকে ভেংচি কাটল জুলি। আমি বোধহয় তোমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি রানা, বলে পরক্ষণে জ কুঁচকাল। না, কারও প্রেমে পড়ি না আমি। কাউকে কখনও সত্যিকারের ভালবাসতে পারিনি।
বাবাকেও না?
শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে যেন ব্যারোনেসের, আড়ষ্ট দেখাচ্ছে গোটা দেহ। চোখের পাতা কেঁপে উঠে বন্ধ হয়ে গেল। আবছা, শীতল সুরে প্রশ্ন। করল ও, একথা বললে কেন, রানা?
কেন বলেছে রানা নিজেও জানে না। মনে হলো একটা ঢিল ছুঁড়ে দেখি, দেখেছে। কিন্তু এর ফলে ব্যারোনেসের প্রতিক্রিয়া স্পষ্টতই প্রকাশ পেয়ে গেছে।
এক মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল জুলি। কিছু মনে কোরো না রানা। হঠাৎ বাবার কথা বলায় একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম।
আমারই বরং দুঃখ প্রকাশ করা উচিত, বলল রানা। বাদ দাও, আমরা বরং কাজের কথায় আসি, কেমন?
ওকে। ঢিল পড়ল ব্যারোনেসের শরীরে। মাথার নিচে দুহাত জুড়ে শুয়ে রইল চোখ বুজে।
আমি প্রশ্ন করব তুমি জবাব দেবে, ঠিক আছে?উত্তরের তোয়াক্কা না করে বলে চলল রানা, প্রথমে এই জায়গাটা সম্পর্কে জানতে চাই আমি। এবং তোমার বান্ধবী কন্টেসা ডি কারেম্বু সম্পর্কে। এটা সেফ হাউজ, মেনে নিচ্ছি আমি। কিন্তু আঁধারে থেকে কাজ করতে ভাল লাগে না আমার।
সময় হয়েছে, তন্দ্রাচ্ছন্ন কণ্ঠে আওড়াল জুলি। অনেক কথা খুলে। বলার
মনোযোগী হলো রানা।
কাজের লোক দুটোকে দিয়েই শুরু করি। মেরী নতুন এসেছে। এবারই প্রথম দেখলাম ওকে। কন্টেসার পুরানো মেইড ডেবি তার সাথে প্যারিসে থাকে। কিছু দিন আগে পাওয়া কন্টেসার শেষ চিঠিটায় জানতে পারি, মেরীকে কাজে নেয়া হয়েছে।
আর ওমর? দ্য ফ্যাট ম্যান? অদ্ভুত লোকটা, এখানে ঠিক যেন মানায় না।
অদ্ভুতই বটে। বেশিরভাগ মানুষের কাছে। তবে বহু পুরানো লোক। দেখে বোঝা যায় না, বয়স আসলে অনেক। এখানে-এখানে প্রথমবার যখন আসি তখনও দেখেছি।
ব্যারোনেসের কণ্ঠের দ্বিধাটুকু কানে লাগল রানার। কন্টেসা আর ওমর সম্পর্কে কিছু গোপন করে যাচ্ছ মনে হয়? বলল, তির্যক ভঙ্গিতে।
দীর্ঘ নীরবতার পর জবাবটা এল। সব কথা তোমার শুনতেই হবে, রানা? এর সাথে আমাদের, রুডলফ ব্রিগল কিংবা ওদের কারও কোন সম্পর্ক নেই। বিশ্বাস করো।
সেটা আমি দেখব। তুমি বলো। রানার কণ্ঠে কাঠিন্য।
ব্যারোনেস দীর্ঘ একটা শ্বাস মোচন করল। বেশ। আমি-আমি ষোলো বছর বয়সে পরিচিত হই কন্টেসার সাথে। আমাকে ভাল লাগে তার, এবং তার অস্বাভাবিকতার সাথে একবার মানিয়ে নেয়ার পর আমারও ভাল লাগতে থাকে তাকে। আমার প্রতি আশ্চর্য মমতা ছিল তার। এবং সেটার দরকারও ছিল। আমার তখন। জীবনে ভালবাসা-মমতা কতটুকুই বা জুটেছে।
তার অস্বাভাবিকতা বলতে?
আবারও দীর্ঘ নীরবতা। সে পুরুষমানুষদের পছন্দ করে না, একেবারে। সহ্যই করতে পারে না। মেয়েদের ভালবাসে।
লেসবিয়ান?
হ্যাঁ। আঁধারে নড়ে উঠল ব্যারোনেস। দপ করে জ্বলে উঠল লাইটার। সিগারেট ধরাতে গিয়ে ক্ষণিকের জাফরানী আলোয় স্থিরদৃষ্টিতে রানাকে নিরীখ করে নিল ব্যারোনেস জুলি। এই ভিলায় কিছুদিন ছিলাম আমি। তারপর চলে যাই। ওসব আমার ভাল লাগত না। সত্যি বলছি, রানা।
তোমার নিজেকে জাস্টিফাই করার দরকার নেই, বলল রানা। তোমার। সেক্স-লাইফ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই আমার। আমি শুধু অ্যাঙ্গেলগুলো দেখতে চাইছি।
কোন অ্যাঙ্গেল-ট্যাঙ্গেল নেই, রানা, তেতো সুরে বলল জুলি। সুসম্পর্ক বজায় রেখে বিচ্ছিন্ন হই আমি আর কন্টেসা। তার সত্যতা তো নিজের চোখেই দেখলে। যখন খুশি আসতে পারি, থাকতে পারি যতদিন ইচ্ছে। আজ সকালে সবার আগে তাই এ জায়গাটার কথাই মনে পড়ল। তা নাহলে এতক্ষণে হয় ব্রিগল, নয়তো পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যেতাম।
বেশ, বলল রানা। তোমার গল্পটা মেনে নিলাম। কিন্তু ওই ওমর লোকটা কেমন যেন আজব ধরনের।
ব্যারোনেসকে ব্যঙ্গের হাসি হাসতে শুনে একটু থতমত খেয়ে গেল রানা। ওমর সম্পর্কে অমন প্রতিক্রিয়া আগেও অনেকের হয়েছে। তোমার খটকাটা মিটিয়ে দিচ্ছি-ও আসলে এক হতভাগ্য লোক। বেচারা খোজা।
ও, এইজন্যেই! এবার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল তীক্ষ্ণ, মেয়েলি কণ্ঠস্বরের আর নতজানু আচরণের। সেই সঙ্গে খোলসা হলো কন্টেসার চরিত্রও। কন্টেসা পুরুষ মানুষ সহ্য করতে পারে না, কিন্তু ওমর তো সেই অর্থে পুরুষমানুষ নয়। কাজেই এতবছর ধরে ওকে মেনে নিতে অসুবিধে হয়নি মহিলার।
আবার কন্টেসার কথায় আসি- সিগারেট ধরাল রানা। আচ্ছা, এমন কোনও সম্ভাবনা কি আছে-ক্ষীণতম সম্ভাবনা–যে সে রুডলফ ব্রিগলের সঙ্গে জড়িত? কিংবা নাকাতার সাথে? ব্রিগল এ জায়গাটা সম্বন্ধে জানে এর সম্ভাবনা কতটুকু?
গলার ভেতর হাসল ব্যারোনেস। জিরো–অন্তত প্রথমটার কথা বলা যায়, একেবারেই অসম্ভব। কন্টেসার কোনদিনই রাজনীতি বা ভায়োলেন্সের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না-আর রুডলফ ব্রিগলের মত একটা লোকের মুখে সে থুথুও ফেলবে না। দুনিয়া থেকে আলাদা থাকতে চেয়েছে কন্টেসা সারাজীবন, রানা। জীবনটা সে কাটিয়ে দিয়েছে সঙ্গীতকে আঁকড়ে ধরে। অসাধারণ পিয়ানিস্ট ছিল। এখন বাতের ব্যথায় কাবু, আঙুল চলে না। প্যারিসে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছে। বয়স তাও প্রায় সত্তরের কাছাকাছি তো হবেই। আমার আমার সঙ্গে যখন পরিচয় হয় তখন প্রায় ষাট।
কিন্তু রুডলফ ব্রিগল যদি জায়গাটা স্পট করে থাকে? বলল রানা। ওর তো বড়সড় শক্তিশালী অর্গানাইজেশন। বিকেলে হোটেল হিলসনে যারা হাঙ্গামা। করেছে তারা ব্রিগলের লোক, কোন সন্দেহ নেই। নাকাতার এধরনের সংগঠন থাকবে না–অন্তত জেনেভায় নয়। ওরা ব্রিগলের লোক এবং খুঁজতে এসেছিল নাকাতার বাধানো দাঁত।
শেষ বাক্যটা রানার অন্তরে একটা খচখচে কাঁটা গেঁথে দিল। ব্রিগলের লোকেদের নাকাতার নকল দাঁত খোঁজ করার অর্থ, নাকাতা নিজে ব্রিগলকে জানিয়েছে কোথায় সে তার চাবির টুকরোটা রাখত। কিন্তু এর কোন অর্থ। পাওয়া যাচ্ছে না। নাকাতা ব্রিগলকে বিশ্বাস করবে না, ব্রিগল যেমন করবে না। তাকে। ব্যাঙ্কে যাওয়ার আগেই চাবির খোঁজ দেবে নাকাতা বিশ্বাস হয় না। রানার। গেলেও অবশ্য পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করেই যাবে জাপানী। না, কোথাও কোন একটা গড়বড় আছে; খাজে খাঁজে পুরোটা মেলানো যাচ্ছে না। যাকগে, আপাতত ভাবনাটা একপাশে সরিয়ে রাখল রানা।
রুডলফ ব্রিগল জানতে পারে দ্বীপটার কথা, অসম্ভব নয়, বলল জুলি। অবশ্য কিভাবে জানবে বুঝতে পারছি না আমি। তবে সবই সম্ভব। বিশেষ করে এই লাইনে।
মুচকি হাসি উপহার দিল ওকে রানা। আপাতত ভুলে যাও ওটা। ও যদি জানেও আমরা এখানে, তেমন কিছুই করতে পারবে না। ওর হাত-পা বাঁধা। এবং সেটা জানেও সে। ও দস্তুরমত চাইছে এমন একটা জিনিস আছে আমার কাছে। কাজেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করার আগে আমার কোন ক্ষতি সে করবে না। পরিস্থিতিটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে সে। আমি মারা পড়ার আগেই যাতে হাতে পেয়ে যায় জিনিসটা।
রানাকে ছুঁয়ে দিতে হাত বাড়াল ব্যারোনেস। প্লীজ, রানা! অমন কথা বোলো না!
কনজারভেটরীর ভেতর-বাইরে এখন ঘনঘোর অন্ধকার। বাইরে শরতের চোরা শীতের পরশ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু কনজারভেটরীর ভেতরে বিরাজ করছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রাতের উষ্ণতা। ব্যারোনেসের শরীর থেকে ভেসে আসছে পারফিউমে মিষ্টি এক হালকা সুবাস।
তোমার সম্পর্কে তো এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই জানি না। ব্রিগলের সম্পর্কে আমাকে জানানোর দায়িত্ব তোমার, বলল রানা। রুডলফ ব্রিগলের চেহারা প্লাস্টিক সার্জারি করার পর কেমন হয়েছে, সেটা একমাত্র তুমিই জানো, এটা কি করে হয়? সে যে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছে, তা-ই বা জানো কিভাবে তুমি?
মনে হচ্ছে, বলল জুলি, প্রথম থেকে শুরু করা উচিত। ভয় নেই, সংক্ষেপেই সারব। বনে শিখেছি কিভাবে রিপোর্ট তৈরি করতে হয়-বাহুল্য বাদ দিয়ে। আমার জন্ম–
ভাড়ামো ছাড়ো! রানার কণ্ঠে চাবুক।
ভাড়ামো নয়, রানা। আর সব কিছুর সঙ্গে নিজের কথাও একটুখানি। জানাব তোমাকে। এতে করে আমাকে বুঝতে সহজ হবে তোমার। পছন্দ করি না, তবু কেন কাজ করলাম বনের হয়ে জানতে পারবে। সমস্তটা বুঝলে পরে। আমার প্রতি বিশ্বাসও খানিকটা বাড়তে পারে তোমার। এখন যেটার ছিটেফোঁটাও নেই।
কে বলল নেই, একটু রূঢ় কণ্ঠেই বলল রানা। যথেষ্টই আছে। হ্যাঁ, বলে যাও।
পশ্চিম জার্মানীর এক অভিজাত পরিবারে জন্ম হয় আমার। বাবার নাম কার্ল হাইঞ্জ গ্রাফ। মা ছিল ইংরেজ-বাবা লন্ডনের পশ্চিম জার্মান দূতাবাসে কাজ করার সময় পরিচয় হয় তাদের…
রবাটা? নামটা ইংরেজ নয়?
হ্যাঁ। আমার নানীর নামও ছিল রবার্টা। আমরা কিন্তু প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি।
সরি। ঈষৎ লজ্জিত হলো রানা।
আমার বাবাকে হত্যা করে ওরালকেটে ছবিটা দেখেছ তুমি, আমাকে বাধ্য করা হয় বাবার হত্যাকাণ্ড সামনে থেকে দেখতে। রীতিমত ঘটা করে হত্যা করা হয় আমার বাবাকে। কি দোষ তার? সে নাজীদের একজন কঠোর সমালোচক ছিল।
তলপেট কেমন যেন গুলিয়ে উঠল রানার। নিও নাজীরা কি জিনিস ভালই জানা আছে আমার।
ওরা মানুষ না, রানা। আমার তখন বারো বছর বয়স। মা মারা গেছে, আমাকে নিয়ে গেল ওরা বাবার মৃত্যুর সাক্ষী হওয়ার জন্যে। শিক্ষা দিতে চাইল। আসলে-রাইখের শত্রুদের কি দশা হয় নিজের চোখে দেখে যাতে শিখি। তোমাকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, কে এসেছিল আমাকে নিয়ে যেতে এবং কে পরে আবার ফিরিয়ে দিয়েছিল ফুফুর কাছে?
রুডলফ ব্রিগল?
হ্যাঁ, সে-ই। নিও নাজীদের নেতা উয়ে সিলারের খুব ঘনিষ্ঠ তখন সে। সারাজীবনেও ভুলতে পারব না গুলি করার পর বাবার সে কী অসহ্য কাতরানি, বেচারা ছটফট করছিল কাটা মুরগির মতন। আমি নিজের হাতে, রানা, যদি সম্ভব হয়, খুন করতে চাই পিশাচটাকে।
ব্যারোনেসের কথা ও গলার সুর শুনে হিমশীতল একটা স্রোত নেমে গেল রানার শিরদাঁড়া বেয়ে। মনে হলো, যুবতীটির অত সুন্দর কোমল ত্বক একটা স্তরমাত্র, তার নিচে রয়েছে ইস্পাত ও জমাট বরফ।
আমি কোন কথা দিতে পারছি না, জুলি, বলল রানা। পরিস্থিতি বলে দেবে কি হতে যাচ্ছে ভবিষ্যতে। আচ্ছা, তারপর?
পরেরটুকু ভাবতেও ঘেন্না লাগে আমার। আমি টীন এজে পৌঁছতে না পৌঁছতে মারা গেল ফুফু। বাবার এক বন্ধু একটা ইনস্টিটিউশনে ঢুকিয়ে দিতে চায় আমাকে, কিন্তু পালালাম আমি। জড়িয়ে পড়লাম অপরাধ জগতের সাথে-কী না করেছি। কালোবাজারী থেকে নিয়ে ক্যাবারে ড্যান্স পর্যন্ত সবই, অবৈধ জিনিসপত্র বেচেছি! এখানে এসে গলাটা ভেঙে গেল ওর। এমনকি নিজেকেও বাধ্য হয়েছি বিক্রি করতে। গড়িয়ে রানার বাহুর মধ্যে এসে ঢুকল জুলি। কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রানা।
কমুহূর্ত পরেই নিজেকে সরিয়ে নিল জুলি। দুগাল থেকে মুছে নিল। অশ্রু। কঠোর সংগ্রাম করে ঠিকই বেঁচে থাকলাম আমি। কিন্তু ভুলতে পারলাম না রুডলফ ব্রিগলকে।
পারার কথাও নয়, সান্ত্বনার সুরে বলল রানা। কুকুরটা সম্পর্কে আমাকে একটু জানিয়ে রাখো। লোকটা তোমার বাবাকে খুন করেও পার পেয়ে গেল কিভাবে?
ভাগ্যের জোরে। বদমাইশ নিজেরটা খুব ভালই বোঝে। আগে থেকেই সব সাজানো ছিল। খুনের দায়ে বিচার হয় ওর–কিন্তু সাজা হয়নি। বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। শুধু এটাই তো না, আরও অনেক অপকর্ম আছে ওর। এই কিছুদিন আগেই তো জার্মানীতে বসবাসরত বিদেশীদের পিছনে লেগেছিল। মারাও পড়েছে বেশ কিছু লোক।
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রানার। রোজানার সরল মুখটা ভেসে উঠল। কল্পনায়।
কিন্তু বারবার যেভাবে বেঁচে যাচ্ছে … বিশ্বাস হতে চায় না।
হ্যাঁ। বাবার ব্যাপারটা আমিও প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু এটাই সত্যি। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন মিথ্যে সাক্ষী দেয়, এবং বেঁচে যায়। ব্রিগল। কিন্তু তারমানে এই নয় যে ওকে ভুলে যাওয়া হয়েছে। আমি তো ভুলিইনি, ভোলেনি ওয়েস্ট জার্মানি, মানে এখনকার জার্মান ইন্টেলিজেন্স পুলিসও। আর বিদেশীদের ওপর হাঙ্গামার পর সমস্ত সন্দেহ ওর ওপর গিয়ে পড়লেও প্রমাণের অভাবে কেউ কিছু করতে পারেনি।
দীর্ঘশ্বাস মোচন করল ব্যারোনেস। ব্রিগল ছাড়া পেলে রাগে অন্ধ হয়ে। যাই আমি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি বড় হয়ে এর উপযুক্ত প্রতিশোধ নেব। পরে সুযোগ পেয়ে জার্মান ইন্টেলিজেন্সে যোগ দিই। পার্ট-টাইম জব। কিন্তু ইন্টেলিজেন্সের সাথে যুক্ত থাকায় রুডলফ ব্রিগলের ওপর চোখ রাখা সহজ হয়ে যায় আমার জন্যে। যদিও সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারিনি। আর সেটা সম্ভবও ছিল না। নিশ্চিত শাস্তির হাত এড়াতে পেরে একদম সাধু বনে যায়। ব্রিগল, সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নেয় নিজেকে।
তারপর? সুতো ধরিয়ে দিল রানা।
হামবুর্গে সেটল করে। ছোট একটা চাকরি নেয়, বাড়ি কেনে শহরতলিতে। কয়েক বছর একদম ঘাপটি মেরে থাকে। মাঝেমাঝেই উধাও হয়ে যেত বাড়ি ছেড়ে। সম্ভবত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেত স্বেচ্ছায়। প্রায়ই হামবুর্গে যেতাম আমি ওর হাল-চাল বোঝার জন্যে, তক্কে তক্কে থাকতাম। আশা ছিল একদিন না একদিন ঠিকই হাতেনাতে ধরে ফেলতে পারব ওকে; কোন না কোন অপকর্ম করার সময়। শাস্তি তো পাবেই, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হয়ে যেতে পারে। এখন হাসি পায় কি ছেলেমানুষ ছিলাম। একটা পাকা শয়তানকে ওভাবে কেউ কোনদিন ধরতে পারে?
আসলে এক সময় না এক সময় নজর বন্দী জানোয়ার টের পেয়ে যায় তাকে নজরবন্দী রাখা হয়েছে, বলল রানা। বিশেষ করে, একই মানুষ একই জায়গার ওপর যদি চোখ রাখে তাহলে তো আরও সহজ।
কাঁচা বুদ্ধি আর কাকে বলে, তিক্ত হেসে বলল ব্যারোনেস। একা একা যতটুকু পেরেছি করেছি। আমার সহকর্মীরা অবশ্য ব্রিগলকে ভুলতে রাজি ছিল না, কিন্তু কি আর করবে তারা, অভিযোগ থাকতে হবে তো লোকটার বিরুদ্ধে। হাজার হলেও ওরা প্রফেশনাল। যুক্তি-তর্ক মেনে চলতে হয় তাদের। কিন্তু আমার তো আর তা না। আমার ব্যাপারটা ব্যক্তিগত-ঘৃণা করি আমি! অন্তর, থেকে ঘৃণা করি শয়তানটাকে।
খুবই স্বাভাবিক, বিড়বিড় করে বলল রানা। লকেটটা তো দেখেছি আমি।
হ্যাঁ, তুমি বুঝবে। যাকগে, শেষমেষ আমার স্পাইং কাজে লাগল। কিছুদিন আগে আমি তখন হামবুর্গে। যথারীতি নজর রাখছি রুডলফ ব্রিগলের। বাড়িতে। কিন্তু পাখি ভাগল। বাড়ি বেচে দিয়ে চলে গেছে কোন্ ফাঁকে। যেমন তাজ্জব হলাম তেমনি রাগ হলো। যতভাবে পারি খোঁজ নিলাম, কিন্তু কোন পাত্তা পেলাম না ওর। স্রেফ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে রুডলফ ব্রিগল। এবং এমন এক সময়ে যখন বিচারে ওকে রক্ষাকারী লোকটা, ক্যান্সারে আক্রান্ত, মৃত্যুর আগে দিয়ে সত্য কথা স্বীকার করে যাবে ঠিক করেছে। খুশিতে মাথা ঠিক ছিল না আমার। এইবার বাগে পেয়েছি বাছাধনকে!
ব্যারোনেসের কাহিনী খাপে খাপে বসিয়ে দিচ্ছে বেশ কিছু বিষয়। রুডলফ ব্রিগলের ওপর চাপ বেড়েই চলেছিল ক্রমাগত। নিঃসন্দেহে জানত লোকটা নজর রাখা হচ্ছে তার ওপর। কিন্তু হিদেতোশি নাকাতা কারামুক্ত না হওয়া। অবধি কিছুই করা সম্ভব ছিল না ওর পক্ষে। নাকাতার কাছে চাবির অর্ধেকটা ছিল যেহেতু। ধীর অথচ অপ্রতিরোধ্য গতিতে চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকায় শেষ পর্যন্ত। ফট করে ভালভ গেছে খুলে। নিকষ অন্ধকারে নিষ্ঠুর এক টুকরো হাসি খেলে গেল রানার ঠোঁটে।
বস ওকে মিশন লেপার্ড সম্পর্কে সমস্তটা খোলসা করে বলেননি, ভাবল রানা। ও-ও বসের ওপর দিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চায়নি। মিশন নয়, রুডলফ ব্রিগল জেনেভায় টেনে এনেছে ওকে। বস পাঠিয়েছেন ব্রিগলের পেছনে, ও এসেছে। কিন্তু অনেক কিছুই জানার বাকি ওর–আরও অনেক কিছু। অবশ্য বুড়োর জন্যে এটা নতুন কিছু নয়। যতটুকু দরকার তারচেয়ে বেশি কখনোই বলেন না তিনি। আর অত কথার দরকারই বা কি? রানা এসেছে। প্রতিশোধ নিতে, বাঘ-সিংহ পরের কথা।
তো ওকে আবার খুঁজে পেলে কিভাবে? জিজ্ঞেস করল রানা। ও চেহারা পাল্টানোর পর
ব্যারোনেস হাসল শীতল, নিষ্ঠুর হাসি। ও আসলে কোথাও যায়নি। বাড়ি টাড়িও বেচেনি। ওকে নজরবন্দী রাখায় সতর্ক হবার সুযোগ যেমন পেয়েছে, তেমনি ধরাও পড়েছে। ও করল কি, বাড়িটা বেচে দিয়ে চলে যাওয়ার ভান দেখাল। কিছুদিনের মধ্যে চেহারা বদলে নিল প্লাস্টিক সার্জারি করে। তারপর ফিরে এল বাড়িটার নতুন মালিক হিসেবে।
বাহ, ভারি বুদ্ধিমান তো, স্বীকার করল রানা। তা ফিরে আসার পর কি নাম নিল খুনীটা?
লিটবারস্কি। পিয়েরে লিটবারস্কি। বেচারা হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী। কারও সঙ্গে মেলামেশা করে না। বাসায় প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র ডেলিভারি দেয়া হয়। কক্ষনো বাসা ছেড়ে কোথাও যায় না সে, শুধু মাঝেমধ্যে মন চাইলে রাতের বেলা একটু হাঁটাহাঁটি করে।
চেহারাটা সারানোর জন্যে।
হা। পরে বুঝতে পারি। কিন্তু কিভাবে ওকে স্পট করলাম শোনো। এক কারণে না, ওকে ধরা পড়তে হয় একাধিক কারণে। ছোট ছোট অনেকগুলো ব্যাপার। দীর্ঘদিন নজর রাখার ফলে ওর কতগুলো অভ্যেস মুখস্থ হয়ে যায়। আমার। ওর সামনে ঝোকা, কান ঘষা কিংবা চিবুক চুলকানো এসব ছোটখাট ভঙ্গি। ওর হাঁটা আর দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও চিনে ফেলি আমি। কথায় আছে না, কয়লার ময়লা না যায় ধুলে, স্বভাব না যায় মলে-তেমনি আরকি। মানুষ এত সহজে তার বহুদিনের অভ্যেস ত্যাগ করতে পারে না। আর এগুলোই ধরিয়ে। দেয় ব্রিগলকে। ছোট্ট একটা বাগান করেছিল ব্রিগল। কাছের ভাড়া করা রূমটা থেকে দূরবীন দিয়ে ওর কাণ্ড-কারখানা দেখতাম আমি। শেষ যেদিন হামবুর্গ গেলাম, এবং আবিষ্কার করলাম ব্রিগল নেই, তখনও হাল ছাড়িনি আমি। ওর বাড়ির ওপর কি ভেবে চোখ রাখতে গেলাম, আমার মন বলছিল ফিরে আসতে পারে সে।
ব্রিগল ফিরে আসেনি। সে আসলে কোথাও যায়ইনি। পিয়েরে লিটবারস্কি নামের লোকটাকে বাগানে কাজ করতে দেখি আমি। হঠাৎই বুঝতে পারি এই লোকই রুডলফ ব্রিগল। পরদিন ও শহরে গেলে ফলো করলাম। অনেক দিন বাদে সম্ভবত সেদিনই প্রথম বাড়ি থেকে বেরোয় সে। বাসে ওর উল্টোদিকে বসি আমি। ভাল করে লক্ষ করি মুখের চেহারা।
এবং সে-ও লক্ষ করে তোমাকে, জুগিয়ে দিল রানা।
ও আমার দিকে একবারও তাকায়নি। চমৎকার কাজ করেছে ডাক্তাররা ওর মুখের ওপর। মুখ দেখে ওর মায়েরও চেনার সাধ্য নেই।
শুধু তুমি চেনো ওকে। কিন্তু পুলিসকে বা ইন্টেলিজেন্সকে চিনিয়ে দাওনি কেন?
সুযোগ পেলে তো, বলল ব্যারোনেস। ও তো জেনেভা চলে এল।
ব্রিগল মনে হয় জানে, বলল রানা। যে আমরা তোমাকে কড়া পাহারায়। রাখব। অন্তত ও মারা না যাওয়া পর্যন্ত। মিশন লেপার্ড ঠিক সময়ে ব্রেক না করলে এতক্ষণে হয়তো পরপারে পাঠানো হত তোমাকে। তুমি খুব লাকি। নাকাতা টোকিওর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জেনেভা পাড়ি দিয়েছে। সব ধরনের চাপ সইতে হচ্ছিল রুডলফ ব্রিগলকে। তোমাকে হত্যা করার মত সময় এখনও করে উঠতে পারেনি ও। সোনার চিতাবাঘটাকে হাতে পেতেই ব্যস্ত ¢ সে। দুপ্রাপ্য চিতাবাঘ আর নয়া চেহারা নিয়ে সম্ভবত দেশত্যাগ করবে ব্রিগল। নাকাতার সঙ্গে নাকি জাপানী কমিউনিস্টদের যোগাযোগ রয়েছে। তাকে কিভাবে, সামলাবে ব্রিগল সে-ই জানে। কারণ চিতাবাঘের একজন ভাগীদার তো সে ও। কিন্তু পালালেও পেছনে আলগা সুতো ফেলে রেখে যেতে রাজি নয় ব্রিগল। তুমি কিন্তু, জুলি, ওর জন্যে সত্যিই একটা হুমকি।
আমি জানি, রানা। বলল জুলি। সেজন্যেই বলছি কি, আমার খুদে বন্ধু দুটোকে ফেরত দাও। আমার নিরাপত্তার জন্যেই ওগুলো দরকার।
সকালে পাবে, কথা দিল রানা। আর তোমার নিরাপত্তার ভার, আমার ওপর ছেড়ে দাও। এসো, ঘরে যাবে। উঠে দাঁড়িয়েছিল রানা, এবার একটানে দাঁড় করিয়ে দিল ব্যারোনেসকে।
খাবে না! ওফ, খিদেয় মরে যাচ্ছি আমি। আর ওয়াইন-ওটা তো ছুঁয়েও দেখিনি আমরা। খুবই চমৎকার ওয়াইন-কন্টেসার দুর্দান্ত একটা সেলার আছে।
ফাইন। লাঞ্চ হ্যাঁম্পার আর কুলার থেকে ওয়াইনের বোতলটা তুলে নিল রানা। তুমি ড্রিঙ্ক কোরো। তবে ভাল মত ঘরের দরজা লক করে, তারপর। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পোড়ো। আমি একটু টহল মারব চারধারে।
ইতোমধ্যে রোবটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে ব্যারোনেস। ওকে ঘরের দরজায় পৌঁছে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলল রানা, রুডলফ ব্রিগলকে দেখলে সত্যিই চিনতে পারবে তো? যদি দেখা পাই আরকি।
ওর লাশপচা মুখও চিনতে ভুল হবে না আমার, দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করল জুলি।
আশা করা যাক, বলল রানা। কবরে ওকে দেখতে পাব আমরা, তোমাকে নয়।
.
০৭.
রাত নটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল ভিলা রিকো। রানা কোন ঝুঁকি নিল না। অভিযান। শুরু করার জন্যে মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিল। এরমধ্যে গুছিয়ে। নেবে বেশ কিছু কাজ।
চাবির টুকরোটা বের করে ভরে নিল টোবাকো পাউচের মত দেখতে, প্লাস্টিকের একটা, খামে। শর্টসের ওয়েস্টব্যান্ডে, গুঁজে দিল ওটা, স্টিলেটোর। সঙ্গে। এরপর সেরে নিল আরও কিছু টুকিটাকি কাজ।
সুটকেস থেকে বের করল ছোট্ট একটা ভাইস, প্যাডেড। খুদে একজোড়া প্লয়ার্স বেরোল এরপর, এটাও প্যাডেড। খাটের পায়ায় জুড়ে দিল ও ভাইসটাকে। এবার ব্যারোনেসের খুদে পিস্তলটা বের করে কাজে লেগে পড়ল, মুচড়ে, চাপ দিয়ে, ঠোকাঠুকি করে নিল জিনিসটাকে। ছোট্ট একটা হাতুড়ি ব্যবহার করে কাজটা সেরে, সমস্ত যন্ত্রপাতি ও লিলিপুট গানটা চালান করে দিল। সুটকেসে।
হাতঘড়িতে চোখ বুলাল রানা। সময় হয়ে এল।
বেডরূমের আলো নিভিয়ে দিল ও। বিছানায় বালিশ ও কম্বল দিয়ে একটা ডামি তৈরি করল। লোহার রেলিং ঘেরা ব্যালকনিটায় এরপর আরও পনেরো। মিনিট অপেক্ষা করল, নিঃশব্দে বইছে শ্বাস-প্রশ্বাস।
মেইনল্যান্ডের সঙ্গে ভিলার দূরত্ব সৃষ্টি করেছে দুশো গজ মত পানি, তার। ওপাশে ইতস্তত আলো চোখে পড়ছে। রাস্তার বাতি, ঘর-বাড়ির আলো, মেলা কিংবা কোন ধরনের কার্নিভলের রঙবেরঙের আলোকমালা। বিক্ষিপ্তভাবে কানে আসছে গান-বাজনার টুকরো-টাকরা আওয়াজ। এই মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল সেটা এবং রঙিন বাতিগুলো একসঙ্গে নিভে গেল দপ করে।
আকাশে আধখানা চাঁদ, ছাইরঙা মেঘের ঘোমটা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে ক্ষণে। ক্ষণে প্রথম শরতের নির্মল বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। প্রাচীন আঙুরগাছটা বেয়ে, ব্যালকনির নিচে করবী ঝোপে অনায়াসে নেমে এল রানা। এক ফালি ঘাস-জমির ওপর দিয়ে, দ্রুত লঘুপায়ে এসে থামল পাইনের অন্ধকার জঙ্গলটার। কাছে। কান পেতে পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করল এখানে, জরিপ করে নিল ভিলাটাকে। চারদিক সুনসান, অন্ধকার। মোটকু ওমর বোধহয় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ব্যারোনেসও জেগে থাকবে না। খোদা জানে, কি স্বপ্ন দেখছে এখন মেয়েটা।
ডকে নেমে যাওয়া কাঠের সিঁড়িটার উদ্দেশে পা বাড়াল রানা। চলাফেরা অশরীরী প্রেতাত্মার মতন, গাছের আশ্রয় থেকে তীরবেগে ছুটে যাচ্ছে ও ঝোপ ঝাড়ের আড়াল নিতে। অপেক্ষা করছে কখন ঝকঝকে চাঁদটাকে গ্রাস করে অস্থির মেঘ।
খা-খা করছে ডকটা। তাই করার কথা। অ্যালুমিনিয়ামের নৌকাটা শিকলে বাঁধা, নড়ছে- চড়ছে-গুতো খাচ্ছে পাইলিঙে।
নিঃশব্দে পানিতে নেমে পড়ল মাসুদ রানা। ডাঙার চাইতে পানিটা। উষ্ণতর। ডুব দিল ও, প্লাস্টিকের খাম ও কর্ড তৈরি রয়েছে ওর হাতে।
পাইলিঙের গোড়ার সঙ্গে খামটা বাঁধতে দুমিনিটও লাগল না। ল্যাক লেম্যানের দশ ফিট পানির নিচে থেকে, এবার খুঁজে বের করুক দেখি রুডলফ। ব্রিগল চবির টুকরোটা!
মাথা তুলে লম্বা করে শ্বাস নিচ্ছে রানা এসময় দেখতে পেল ওটা। ব্লিঙ্কার। লাইট। মেইনল্যান্ড থেকে টিপটিপ করে অথচ ক্রুদ্ধভাবে জ্বলছে। লক্ষ্য ওটার। দ্বীপ ও ভিলা। রাতের আঁধারে সাদা একটা ফুটকির মতন দেখাচ্ছে বাতিটাকে। ডকের পাশে নিঃসাড়ে বসে পড়ল রানা। পানির ওপর কেবলমাত্র নাকটা জাগিয়ে রেখে, পড়ে নিল মোর্স সিগন্যালটা।
প্রেরক রেগুলার ক্লিঙ্কারল্যাম্প ব্যবহার করছে, ফ্ল্যাশলাইট নয়। ফোঁটা ও ড্যাশগুলো আসছে মসৃণ, অনুশীলিত গতিতে।
রানা ওখানে আছে?
হ্যাঁ, মনে মনে আওড়াল রানা। আছিই তো! পরিষ্কার পড়তে পারছি তোমার পাঠানো সঙ্কেত! নিঃশব্দে পানি থেকে উঠে আসছে ও। চোখজোড়া ওঁর অনুসন্ধান চালাচ্ছে মাথার ওপরে, কালো পাহাড়টিতে। যে কোন মুহূর্তে
ওই যে। পাহাড়ের ঠোঁটের কাছে, এক গুচ্ছ ঝোপ-ঝাড়। তার কাছ থেকে, রানার মাথার ঠিক ওপর দিয়ে, উজ্জ্বল একটা আলো পাল্টা পিটপিট করছে দূরবর্তী তীরের উদ্দেশে। সিঁড়ির শেষ ধাপটায় দাঁড়ানো রানা ওটা পড়ার জন্যে বিরতি নিল। মেইনল্যান্ডের প্রেরকের মতন অত অভিজ্ঞ নয় এপারের ব্যক্তিটি। মেসেজটা খুবই সংক্ষিপ্ত অবশ্য। টু দ্য পয়েন্ট।
হ্যাঁ।
ক্ষণিকের বিরতি, তারপর রানার মাথার ওপরের ব্লিঙ্কারটা একটা প্রশ্ন জ্বেলে দিল তীরের উদ্দেশে…
একেকবারে চারটে করে সিঁড়ির ধাপ টপকাচ্ছে রানা, নগ্ন পা ওর শব্দ করছে না কোন। দৌড়নোর ফাঁকে বিজলী খেলছে মস্তিষ্কের ভেতর। তারমানে জানে, ওরা আমি কে এবং কোথায় রয়েছি। কমপক্ষে ওদের একজন জানে-ওপরের ঝোপে ঘাপটি মেরে বসে থাকা প্রেরকটি। কিন্তু কি করবে। রানাকে নিয়ে তা জানে না। নির্দেশ প্রয়োজন তার। বেল্ট থেকে আলগোছে তুলে নিয়েছে রানা স্টিলেটো, ইতোমধ্যে পাহাড় চূড়ার শেষ ল্যান্ডিংটায় পৌঁছে। গেছে। মেইনল্যান্ডের ব্লিঙ্কার কাজ করতে শুরু করেছে আবার।
সাবধান হওয়ার সুযোগ দিয়ো না।
মেসেজ চালাচালি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা। ঝোপে লুকিয়ে বসে থাকা মানুষটার সঙ্গে রানার দূরত্ব এখন আর বড়জোর পঞ্চাশ ফিট। সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকবে ঠিক করল রানা। ভিলায় ফেরার পথে। মানুষটাকে একটু অস্বস্তিকর চমক হজম করতে হবে। নিষ্ঠুর এক চিলতে হাসি ফুটল রানার ঠোঁটের কোণে। বাটন টিপে দিতে ওর ভয়ঙ্কর অস্ত্রটার ফলা সৎ করে বেরিয়ে এল।
মেইনল্যান্ডের লাইটটা আরেকবার দুপ দপ করে জ্বলে উঠল। পরবর্তী আদেশের জন্যে অপেক্ষা করো। ঝোপে আত্মগোপনকারী সঙ্কেত পাঠাল বি…রিসিভড অ্যান্ড আভারড…কে…আউট।
ঝোঁপের মধ্যে নড়াচড়া। গভীরতম ছায়ায় ওত পেতে বসে অপেক্ষমাণ রানা। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে ওর। রাতটা ঠাণ্ডা এবং মাসুদ রানা বিন্দুমাত্র ভীত নয়। এবার উপলব্ধি করল কেন এত ঘাম হচ্ছে ওর-দুর্ধর্ষ এজেন্ট মাসুদ রানার পক্ষেও কোন সুন্দরী নারীর কোমল শরীরে ছুরি গেঁথে দেয়া সহজ কাজ নয়।
মেঘের আড়াল ছাড়ল চাঁদ। পরিষ্কার, স্বচ্ছ আলোয় বেরিয়ে এল এপারের সিগন্যাল প্রেরক। শ্বাস নিল রানা আবার, সর্বাঙ্গে বয়ে যাচ্ছে স্বস্তিকর অনুভূতি। ওমর। কন্টেসার হোল্কা খোঁজা। আজ রাতে অন্তত মেয়েমানুষ হত্যা করতে হচ্ছে না রানাকে।
থলথলে দেহ, হেলে দুলে হেঁটে চলেছে ওমর আব্রাহাম, পরনে সেই সন্ধেবেলার পোশাক। গোদা এক হাতে ধরে রয়েছে ব্লিঙ্কার ল্যাম্পের ভারী বার। ছায়া থেকে বেরিয়ে এল রানা।
ওমর। কথা আছে, বলল মৃদু সুরে।
অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে পাই করে ঘুরে দাঁড়াল খোঁজা। ব্লিঙ্কার ল্যাম্পটা। ছেড়ে দিয়ে, হাত চালাল মাউন্টেনীয়ারের কিভূত জ্যাকেটটার পকেটে। বেরিয়ে এল ওটা একটা ছুরি নিয়ে। চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল দীর্ঘ, সুতীক্ষ্ণ ফলাটা। এ এক ভিন্ন ওমর। ক্রীতদাস সুলভ জ্বী হুজুর ভাব মুহর্তে উধাও হয়ে গেছে। চারপাশে চর্বি নিয়ে ধকধক করে জ্বলছে কুতকুতে চোখজোড়া।
তো আপনি আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করছেন, মি. রানা? হাহ-একটু হয়তো অসাবধানী হয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওই বেশ্যাটার সঙ্গ উপভোগ করে আপনি হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, আরামে ঘুমাচ্ছেন। খুব খারাপ কথা, মি. রানা। আমার জন্যে খুব খারাপ হয়ে গেল!
খনখনে শোনাল নিশুতি রাতে ওমরের কণ্ঠস্বর। সুইচ ব্লেডটা সরু তরবারির মতন সামনে বাগিয়ে ধরে, রানাকে কেন্দ্র করে পাক খাচ্ছে।
রানা চক্কর দিচ্ছে ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে, স্টিলেটো তৈরি। ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা এটে ফেলেছে ওধীরে ধীরে পিছু হটে যাচ্ছে রানা, পাহাড়ের কিনারার উদ্দেশে। ফাঁকা এক চিলতে জমি আছে ওখানে, পাহাড়ের প্রান্তে ও জুয়গাটায় গাছ-পালা, ঝোপ-ঝাড়ের বালাই নেই।
রানার পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে ওমর। চক্কর কাটা বাদ দিয়ে, এপাশে ওপাশে শরীর দুলিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। রানাকে পাহাড়টার কিনারার দিকে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক যা চাইছিল রানা।
ছুরি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর এই প্রথম মুখ খুলল রানা। তুমি ঠিকই বলেছ, ওমর। বিপদেই পড়ে গেছ তুমি। আমাকে খুন করলে বিপদ আরও বাড়বে। ব্রিগল এখনও আমার লাশ দেখতে তৈরি নয়। আমাকে প্রয়োজন আছে তার। ওমরের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করল ও। জ কুঁচকে গেছে। উদ্বিগ্ন। আর যদি খুন না করো, পেঁতো হেসে আরও বলল রানা। তবে নিজেই খুন হবে। তোমার এখন উভয় সঙ্কট, মোটকু!
মুখখিস্তি করল ওমর। থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্তের জন্যে। ভারী শ্বাস প্রশ্বাস বইছে ওর। বিশাল কাঁধ দুটো ঝাঁকাতে দুলে উঠল গা ভর্তি চর্বি। এবার জ্যাকেটটা খুলে ফেলে বাম বাহুতে জড়িয়ে নিল। সুইচ ব্লেডটা ওর ডান হাতে হিসিয়ে উঠল বিষধর কেউটের মতন।
বাহুতে জ্যাকেটের ঢাল নিয়ে, রানার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ওমর। তুমি ভুল বলোনি, রানা। মারব না এখন, আহত করব। তারপর দেখা যাবে কি হয়।
মিস্টার বলতে ভুলে গেছ, মনে করিয়ে দিয়ে, সুইচ ব্লেডটার লকলকে জিভ এড়াতে ঝটকা মেরে পিছে সরে গেল রানা। চকিতে এক ঝলক দেখে নিল পেছনটা। বেশিদূর নয়, পাহাড়ের প্রান্তটা আর বড় জোর বিশ গজ।
এবার একটু পাল্টা আক্রমণ, সিদ্ধান্ত নিল রানা। স্বচ্ছন্দ গতিতে, হরিণের ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে এগিয়ে এল রানা। প্রতিপক্ষের মাংসল দেহে ছোবল মারল ওর স্টিলেটো একবার, দুবার, তিনবার। সতর্ক ছিল ও ভাইটাল স্পট যাতে এড়ানো যায়। ওমরকে জ্যান্ত চায় ও, ওমর যেমন জ্যান্ত চায় ওকে। মুখে কথা ফুটবে ওমরের-শেষ পর্যন্ত।
বাতাসে শিস কাটা ছুরিটার আওতার বাইরে ইতোমধ্যে সরে গেছে রানা। অক্ষম রাগে গর্জে উঠল ওমর। শাটের চেরা অংশ দিয়ে রক্তের একাধিক ধারা বেরিয়ে আসছে। তবুও তাকে বিন্দুমাত্র চিন্তিত দেখাল না। নবায়িত ক্রোধে তেড়ে এল ওমর, নিচের দিকে স্ট্যাব করছে ও, এবং কব্জির মোচড়ে সুইচ ব্লেডটাকে তুলে আনছে ওপরে। ভঙ্গিটা পরিচিত রানার। ভুলে মেরে দিয়েছে। মোটকু মনিবের সমস্ত সতর্কবাণী আর আদেশ-নির্দেশ। রানার ভুড়ি ফাঁসিয়ে দেয়ার অপচিন্তা এখন ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল ওর মোটা মাথার মধ্যে।
নাচের ছন্দে সামনে আবারও এগিয়ে এল রানা। শূন্যে দেহ ভাসিয়ে জোড়া পায়ে লাথি হাকাল আচমকা। কিন্তু বুকে লাথি হজম করেও দানোটাকে পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাজ্জব হয়ে গেল। এবার সুদক্ষ বক্সারের আঘাত হানা লেফট জ্যাবের ভঙ্গিতে স্টিলেটো চালাল, ও দুবার। এবং সরে গেল পাল্টা আঘাত আসার আগেই। মোটা মানুষটার দেহের সামনের দিকটা এখন রক্তে জবজব করছে। আঙুলে উষ্ণ আঠাল ছোঁয়া অনুভব করল রানা। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকের মত একটা ভাবনা খেলে গেল ওর মাথায়। এটা তো ভেবে দেখেনি এতক্ষণ!
ওমর আব্রাহাম চর্বির ডিপো! স্টিলেটোটা রানার স্বাভাবিক অবস্থায় মারাত্মক, কিন্তু জিনিসটা তো লম্বা নয় বেশি। চাইলেও কি খুন করতে পারবে। রানা ওমরকে? সন্দেহ হলো ওর। কিন্তু এখন এটাই সম্বল। লুগার ও গ্যাস। বোমাটা রয়ে গেছে ভিলায়।
পাহাড়ের কোনায় এসে পড়েছে এমুহর্তে রানা। পেছনে আর পাঁচ ফিটও। আছে কিনা সন্দেহ। হাঁসফাস করছে ওমর, অতিকায় দেহটি ওর সপসপ করছে রক্তে ভিজে।
আর এক ফুট, পেছনে এক পলক তাকানোর ঝুঁকিটা নিতেই হলো রানাকে। দেখতে পেল পানি চিকমিক করছে চাঁদের আলোয়। পায়ের কাছ থেকে খাড়া একশো ফিট নেমে গেছে খাদ।
ওমরের হাব-ভাব দেখে যা বোঝার বুঝে নিল রানা। খুন চেপে গেছে। হোঁতকার মাথায়। এখন এসপার, নয় ওসপার।
আর দেরি করাটা সর্বনাশা হতে পারে। সর্বশক্তিতে স্টিলেটোটা নিক্ষেপ করল রানা মোটা লোকটাকে লক্ষ্য করে। বাতাসে উড়ে যেতে ঝিক করে উঠল ছুরিটা। ওমরের প্রকাণ্ড পেটটায় বোর্ডে গাঁথা ডার্টের মতন গেঁথে গেল ওটা। থকথকে চর্বির মাঝে কাঁপছে থরথর করে। রানার দিকে চেয়ে হেসে। উঠল মোটা। হোঃ-এই আলপিন দিয়ে খুন করবে ওমরকে?
ভুড়ি থেকে ছুরিটা বের করারও ধার ধারল না লোকটা। দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে রানার উদ্দেশে, বাতাসে ভীতিকর আকিবুকি কাটছে সুইচ ব্লেডটা। রক্তাক্ত লোকটাকে দেখে রানার মনে হলো, নরকের গহ্বর থেকে উঠে আসা কোন পিশাচ বুঝি। হাতে সময় নেই।
বিরাট এক লাফ মেরে সামনে এসে পড়ল রানা। ছোরার ক্রুদ্ধ কামড়টা এড়িয়ে এক হাতে খপ করে চেপে ধরল প্রতিপক্ষের হাত। ছুরিটাকে যে করে যোক পেটের কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। শত্রুর পেটে বেধা ছুরিটা এবার। চেপে ধরে তার বুক ও পেট বরাবর ওপর-নিচ করল রানা পরপর চারবার।
বিদ্যুদ্বেগে ফোয়ারার মতন বেরিয়ে এল রক্ত। সূচ মেরে নীল তিমি বধ করার চেষ্টা করছে মনে হলো ওর।
মোটা লোকটা সহসা হাত থেকে ছেড়ে দিল ছোরাটা। রক্তমাখা হাত বাড়িয়ে টিপে ধরতে চাইছে রানার কণ্ঠনালী। চাঁদের আলোয় ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ওর চোখজোড়া, খিচানো দাঁতের ফাঁক দিয়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের হলকা এসে ঝাপ্টা মারছে রানার নাকে-মুখে।
হয়তো মারা যাব আমি, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ওমর। দাঁড়িয়ে থাকতে রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছে ওকে। কিন্তু-কিন্তু তোমাকে সঙ্গে নিয়ে। যাব, রানা। ওমর একা যাবে না!
মেদসর্বস্ব হাত দুটোয় যে অত জোর কে জানত? সাড়াশির মতন রানার গলায় চেপে বসেছে ও দুটো, ওকে পেড়ে ফেলেছে মাটিতে। রানার বুকের ওপর এখন ওমর। ও বৃথাই চেষ্টা করছে নিজেকে মুক্ত করতে। এই ফাঁকে স্টিলেটোটা ভুড়ি থেকে বের করে দাবিয়ে দিল হৃৎপিণ্ডের যতটা পারে কাছে, এবং মোচড়াতে শুরু করল পাতলা ব্লেডটাকে। চাপ দিচ্ছে এবং মোচড়াচ্ছে! মোচড়াচ্ছে আর চাপ বাড়াচ্ছে! মত্ত হাতিটাকে ব্যথা দিচ্ছে ও সাধ্য মত। অস্ফুট কাতরধ্বনি বেরিয়ে আসছে ওমরের ফোপানো আর্তনাদের সঙ্গে। কিন্তু প্রকাণ্ড এক বুলডগের মত রানার গলা ঠিকই আকড়ে ধরে রইল ও।
চোখে আঁধার দেখতে আরম্ভ করেছে মাসুদ রানা। পাই-পাই চক্কর খাচ্ছে। চাঁদটা মাথার ওপরে, অন্ধকার আকাশে রূপোল একটা চাকা যেন ক্রমাগত ঘুরছে বনবন করে। শেষ চেষ্টা হিসেবে ওমরের দুহাতের কড়ে আঙুল ধরে উল্টোদিকে হ্যাঁচকা টান দিল। কড়াৎ একাকার হয়ে গেল শব্দ দুটো।
বাপ রে! আর্তনাদ করে উঠল ওমর। ক্ষণিকের জন্যে শিথিল হলো বজ্রমুষ্টি। সুযোগটা নষ্ট করল না রানা। শার্টের কলার চেপে ধরে, শোয়া অবস্থায় পা ঠেকাল ওমরের পেটে। তারপর ছুঁড়ে দিল মোটা লোকটাকে মাথার ওপর দিয়ে নিচে, অতল গহ্বরে।
ঝপাৎ! একটু পরে ভারী বস্তা পতনের শব্দ হলো পানিতে।
বেঁচে থাকা কত যে আনন্দের, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত এড়াতে পেরে, আবারও উপলব্ধি করল মাসুদ রানা। বুক ভরে দম নিতে গিয়ে ফোঁপাচ্ছে ও, দড়ি কেটে এইমাত্র যেন ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে ওকে। গলার চারটাপাশ দাউদাউ করে জ্বলছে ওর, বড় যন্ত্রণা হচ্ছে ঢোক গিলতে।
নিজেকে সামলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল রানা। চোখ বুলিয়ে নিল চারধারে। অপেক্ষা করছে এই বুঝি ওমর মাথা তুলবে পানির ওপর। নিজের কাছেই অসম্ভব, অবিশ্বাস্য মনে হলো ভাবনাটা। মোটা মানুষটার মধ্যে এখনও লড়াইয়ের শক্তি অবশিষ্ট থাকতে পারে না। ও বেচে আছে সে সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ। তবুও-মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো রানা-ভয়ঙ্কর ফাঁইট দিয়েছে লোকটা খোজা হলে কি হয়, ভানুমতির খেল দেখিয়ে দিয়েছে রানাকে।
মেঘের ছোট এক রত্তি চাদরটা সরিয়ে এইমাত্র উঁকি দিল চাঁদ। রানা এসময় লক্ষ করল ওটা, কাছেই ভাসছে, স্রোতের মৃদুমন্দ আলোড়নে দুলছে ওপরে-নিচে। ওমরের লাশ। স্টিলেটোটা তারমানে মোক্ষম জায়গা বেছে নিতে পেরেছিল।
প্রকাণ্ড শরীরে এখনও বিপুল পরিমাণ বাতাস ধরে রেখেছে লাশটা, চিত হয়ে ভাসছে। ওর নিষ্প্রাণ চোখজোড়া একদৃষ্টে চেয়ে আছে বহুবর্ণে চিত্রবিচিত্র আকাশের দিকে। অতিকায় এক তিমি মাছের মত ঢেউয়ের দোলায় দুলছে লাশটা, উঠছে, নামছে। মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল রানার। মোটা লোকটার মাথায়। খুনের নেশা না চাপলে ওকে মারার প্রয়োজন পড়ত না। রানা ওকে বাঁচিয়েই রাখতে চেয়েছিল, কথা আদায়ের জন্যে।
সাঁতরে শবদেহটার কাছে চলে এল রানা। দেহে শক্তি ফিরে পাচ্ছে আবার। ইতিকর্তব্য সাজিয়ে নিল ও মনে মনে।
পুলিস এসে ওমরকে খুঁজে পাক চায় না সে। অন্তত এই মুহূর্তে নয়। ব্যারোনেস এবং ও শীঘ্রিই নিজেদের পথ ধরবে। রুডলফ ব্রিগলকে খুঁজে বের করতে-কিংবা ব্রিগলের হাতে ধরা পড়তে। কিন্তু এখন পুলিসী ঝামেলায় জড়ানো চলবে না কিছুতেই।
হৃৎপিণ্ডের ঠিক ওপরে আমূল বিধে আছে স্টিলেটোটা। রানার শেষবারের মরিয়া আঘাত কোতল করেছে ওমরকে। ছুরিটা বের করে নিল ও, ফলাটা পানিতে ধুয়ে নিয়ে, বন্ধ করে গুঁজে দিল ট্রাঙ্কসের ওয়েস্টব্যান্ডে। এখন কি ব্যবস্থা করা যায় ওমরের লাশটার?
বিকেলে দেখা বোটহাউজটার কথা মনে পড়ল ওর। আপাতদৃষ্টিতে জায়গাটা অব্যবহৃত, খসে পড়ছে বীম, চটে গেছে পেইন্ট-কিন্তু কাজ হবে।
ডকের দূর কিনারে বোটহাউজটার অবস্থান। ওমরের চিবুকের নিচে চর্বির। থাকে আঙুল দাবিয়ে সাঁতরাতে আরম্ভ করল রানা, টাগবোট যেভাবে লাইনার টেনে নিয়ে যায় তেমনিভাবে টেনে নিয়ে চলেছে স্থূলকায় লাশটাকে। কাজটা বিস্ময়করভাবে সহজ ঠেকল। এমুহূর্তে প্রায় ফোলানো থলের মত হালকা ওমর।
ডকটার ওপাশ ঘুরে প্রাচীন বোটহাউজটার দিকে এগোচ্ছে রানা। অকৃপণভাবে আলো বিলিয়ে চলেছে চাঁদ, রূপালী আলো-ছায়া খেলা করছে লেকের পানিতে। যা ভেবেছিল রানা, তারচাইতে খানিকটা বড় বোটহাউজটা। ইটের পাতলা পাইলিঙে তৈরি। যেভাবে বিস্তার পেয়েছে পানিতে তাতে বড়সড় যেকোন বোট সরাসরি এসে ঢুকতে পারবে। একসময় ওয়াটার ডোর ছিল, কিন্তু পচে খসে পড়েছে কবেই। ধ্বংসপ্রাপ্ত, তির্যক দরজাগুলো একটামাত্র মরচে পড়া কজার ওপর লটকাচ্ছে, কাঠামোটার হা করা মুখ-গহ্বর মানুষের কুগঠিত দাঁতের মত। মৃতদেহটা টেনে বোর্টহাউজে প্রবেশ করল রানা। ছাদে একাধিক গর্ত। ক্ষয়ে গেছে কাঠের তক্তা, অবাধ সুযোগ দিচ্ছে চাঁদের আলো। গলার। পরিত্যক্ত ভগ্ন্যুপের, মাকড়সার জালের, ধুলো-ময়লার মাঝে দুটো পুরানো ক্যানু আর একটা স্কিফ আবিষ্কার করল রানা। ভাঙা বৈঠা, তেলচিটে বালিশ, চেইন ও দড়ি-দড়া, নোঙর আর বোটহুক, শক্তকাঠ পেইন্ট ব্রাশ, হাতলঅলা খালি বালতি কি নেই ওখানে। পচা ক্যানভাসের, কাঠের আর প্রাচীন পেইন্টের গন্ধের সঙ্গে মিশেছে বাসি পানি আর মরা মাছের দুর্গন্ধ।
এবং ইঁদুরের!
গাঁজলা পানির মাঝে দাঁড়িয়ে রানা, লাশটা নিয়ে কি করবে ভাবছে। এমনিসময় দেখা পেল ওগুলোর। ডুজনে ডজনে, সম্ভবত শয়ে শয়ে। বোটহাউজের মেঝেয় ভাঙাচোরা তক্তাগুলোর চারপাশ থেকে খুটখাট, কিচ কিছু শব্দ তুলে বেরিয়ে আসছে। বিদ্বেষপূর্ণ খুদে খুদে চোখ মেলে অনাহত আগন্তুককে লক্ষ করছে প্রাণীগুলো, আধো অন্ধকারে লাল বাতি জ্বেলেছে যেন।
ভয়-ডর আছে মনে হচ্ছে না ওগুলোকে দেখে।
প্রথমটায় চিন্তা করল রানা ডুবিয়ে দেবে লাশটাকে। শিকল আর ছোটখাট নোঙর ব্যবহার করবে কাজটা সারতে। কিন্তু পরে বাতিল করে দিল ভাবনাটা। ওমরের মাশাল্লা যা একখান বপু, ওকে ডোবাতে প্রচুর ওজন ও সময় প্রয়োজন হবে। একটা দড়ি খুঁজে পেয়ে গলায় পরানোর ফাস তৈরি করল ও। পানি থেকে উঠে যাওয়া একটা ভাঙা সিঁড়িতে দড়ির শেষ প্রান্তটাবাঁধলরানা। লাশটা পড়ে রইল ওখানে, দড়ির ওমাথায় নিশ্চিন্তে ভাসছে। ছাদের ফাঁক-ফোকর ভেদ করে স্থিরদৃষ্টিতে ওপরে চেয়ে উপভোগ করছে চাঁদমামার সৌন্দর্য। শেষপর্যন্ত ডুবতেই হবে লাশটাকে, জানে রানা। বহুদিন, হয়তো বহু সপ্তাহ পর কারও পা পড়বে এই পরিত্যক্ত বোটহাউজটিতে।
দ্রুত সাঁতরে ডকে ফিরে এল রানা, উঠে পড়ল। লুকিয়ে-চুরিয়ে ভিলায় ঢুকতে হবে ওকে। ওমরের সঙ্গে লড়াইয়ের ও লাশ পাচারের সমস্ত ক্লান্তি এমুহর্তে দূর হয়ে গেছে ওর।
একটা বেজে চার মিনিট। এখনও সম্ভব, ভাবল রানা; কঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়ে, ব্যারোনেসকে সঙ্গী করে দ্বীপ ত্যাগ করা। ব্লিঙ্কার সিগন্যাল ওমরকে বলেছিল, রানাকে হুঁশিয়ার হওয়ার সুযোগ না দিতে, অপেক্ষা করতে। এর মানে, এখনও হাতে সময় পাচ্ছে কিছুটা।
সকালে এসে ভিড় করবে বিভিন্ন সমস্যা, তবে সমাধানও করা যাবে সেগুলো। এখুনি নিজের ঘরে যেতে চাইছে না রানা। তার বদলে ভিলাটাকে পাক খেয়ে এসে থামল। ব্যারোনেসের জানালার নিচে। ওরটার মত এটারও লোহার ব্যালকনি রয়েছে। ব্যালকনির কাছে, আস্তর করা দেয়ালে উঠে গেছে একটা লতায় পাতায় মোড়া মাচা।
ওটায় উঠে বেডরূমে উঁকি দিতে এক মিনিটও লাগল না রানার। চাদর গায়ে ওই শুয়ে আছে ব্যারোনেস, তার হানিব্লন্ড চুল বালিশময় ছড়িয়ে। রানা আলতো হাতে চেষ্টা করল জানালাটার ল্যাচ খুলতে-ভেতর থেকে বন্ধ। এতে অবশ্য কিছুই প্রমাণ হয় না। হয়তো বেরিয়েছিল ব্যারোনেস, পরে ফিরে এসে বন্ধ করে দিয়েছে জানালা। তবে স্কাইলাইট খোলা।
মাচাটা পরীক্ষা করতে যুক্তিটা অসার ঠেকল নিজের কাছেই। ওর জন্যে পানির মতন, সহজ হলেও, ব্যারোনেসের পক্ষে রীতিমত কঠিন। হোটেল হিলসনের ফায়ার হোসে উঠতে, হিমশিম খেতে হয়েছিল ওকে। না–ব্যারোনেস যদি আজ রাতে তার কামরা থেকে বেরিয়ে থাকে, যদি সে জড়িতও থাকে ওমরের সঙ্গে, তবে দরজা ব্যবহার করেছে সে, জানালা নয়। শীঘ্রিই জবাবটা জানা যাবে।
কমিনিট বাদে ভিলায় প্রবেশ করল রানা, কিচেনে আলো দেখে উঁকি মারল। দরজা ভেজানো, কিন্তু মেরী নেই। গেল কোথায়? খটকা লাগল। রানার। এত রাতে কোথায় যাবে? বাথরূমে, কে জানে? এবার পরীক্ষা করে। দেখল ব্যারোনেসের বেডরূমের দরজা। ওর লাগানো প্রায় অদৃশ্য, সরু সুতোটা ছেড়েনি। তারমানে এঘর থেকে কেউ বেরোয়নি আজ রাতে, কেউ ঢোকেনি। ভেতরে।
সন্তুষ্ট, রানা স্বস্তির শ্বাস ফেলে নিজের সুইটের দিকে এগোল। ব্যারোনেস। জুলি গ্রাফকে সম্ভবত বিশ্বাস করা যায়। মনটা খুশি খুশি লাগছে ওর।
কিন্তু খুশির আমেজটুকু খুবই স্বল্পস্থায়ী হলো। ঘরে ঢুকতেই ব্যালকনি জানালা দিয়ে আলোর ঝলক চোখে পড়ল ওর। আবার শুরু হয়েছে সঙ্কেত পাঠানো। মেইনল্যান্ডের লোকটা তারমানে এখনও রয়েছে ওখানে। মোর্স সিগন্যালটা পড়ছে রানা।
চাবিটা রানার কাছে আছে?
এপার থেকে কি জবাব গেল জানা হলো না। একটু পর আবার সিগন্যাল।
যেভাবে পার ওটা উদ্ধার করো।
দ্বীপে এখন ব্যারোনেস আর মেরী ছাড়া আর কেউ নেই। রানা ভেবে পেল সঙ্কেত গ্রহণ করছে কোনজন। এবারও এপারের জবাবটা জানতে পারল না। তবে কিছুক্ষণ পরই মেইনল্যান্ডের লাইটটা দপ দপ করে ঝলসাতে দেখল।
শীঘ্রি-সুখবর আশা করছি। পরবর্তী যোগাযোগের জন্যে অপেক্ষা করো।
মুখের ভেতরটা বিস্বাদ ঠেকল রানার। মনস্থির করল, মেরী কিংবা ব্যারোনেস কাউকেই বুঝতে দেবে না সঙ্কেত চালাচালির গোমর ফাস হয়ে। গেছে ওর কাছে। দেখা যাক কে চলছে ডালে ডালে।
.
০৮.
ঘুম ভাঙতে কফির প্রাণকাড়া গন্ধ নাকে এল রানার, নিচে আবছা টুং-টাং শব্দ। হচ্ছে ডিশ নাড়াচাড়ার। সাতটা বেজে তিন। আর আলস্যি নয়, রওনা দেয়ার সময় হয়ে গেছে পালানোর!
কিন্তু পালিয়ে যাবেটা কোথায়, সোজা গিয়ে তো সেঁধোতে হবে বিপদের মধ্যে।
ব্রেকফাস্টের টেবিলে চোখ ধাঁধিয়ে দিল ব্যারোনেসের রূপ। গ্রে স্ন্যাক্স ও ভারী চেইন স্টিচড় সবুজ সোয়েটার চমৎকার মানিয়েছে চুলের রঙের সঙ্গে। সামান্য মেকআপ নিয়েছে। জ্বলজ্বল করছে ধূসর চোখজোড়া। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মনে মনে স্বীকার করল রানা, অত সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটিকে।
তড়িঘড়ি ব্রেকফার্স্ট সারছে রানা। হাসিমুখে সার্ভ করছে মেরী। মহিলাকে ভাল লেগেছে রানার। যদিও কাল রাতের ঘটনায় মনটা খুতখুত করছে। মোর্স সিগন্যাল পাঠানোর সময় কোথায় ছিল মেরী? এমুহূর্তে জুলির সঙ্গে কোন অর্থপূর্ণ আলোচনার সুযোগ নেই। রাতের ঘটনাগুলো সম্পর্কে কিছু জেনেও থাকে যদি, মুখ খুলছে না। ওমরের অনুপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তোলার সময় এখনও হয়নি।
নাস্তার পরে ব্যায়োনেসের পিছু নিয়ে টেরেসে বেরিয়ে এল রানা। আরেকটা ঝকঝকে সকাল। গাঢ় নীল ও সোনালী জেলার মিশ্রণ প্রথম শরতের ইঙ্গিত দেয়। রং পাল্টাতে শুরু করেছে কিছু কিছু পাতা। দেশের কথা মনে। পড়ছে রানার। নীলগোলা আকাশে শরৎকালে ভেসে বেড়ায় ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা। মেঘ। বৃষ্টি এই আসে, এই যায়।
সময় নষ্ট করল না রানা। আমরা মাছ ধরতে যাচ্ছি, বলল জুলিকে। তুমি আর আমি। স্কিফ নিয়ে লেকে যাব, তারপর দেখব কোনও বোট-টোট পাওয়া যায় কিনা। ফিরছি না আমরা, কাজেই যা যা লাগে নিয়ে নাও। ওই লাঞ্চ হ্যাঁম্পারটায় ইচ্ছে করলে তোমার জিনিসপত্র ভরে নিতে পারো-লাঞ্চ নিয়ে ফিশিঙে যাচ্ছি আমরা ভাববে লোকে। বি কেয়ারফুল। স্বাভাবিক থাকতে হবে। আমি শিয়োর মেইনল্যান্ড থেকে ওয়াচ করা হচ্ছে আমাদের। যাও, তৈরি হয়ে নাও-এ জায়গাটা এখন আমাদের জন্যে বিপজ্জনক।
বিস্ময়ে বিস্ফারিত ব্যারোনেসের চোখ। কিন্তু, রানা-বুঝতে পারছি না। আমি। আমার ধারণা ছিল
গুলি মারো, কথা কেড়ে নিয়ে বলল রানা। আমিও ভেবেছিলাম ভিলাটা নিরাপদ, কিন্তু আসলে তা নয়।
নশংস ঘটনাটা রাখঢাক না করে ব্যারোনেসকে জানাবে ঠিক করল রানা, এবং লক্ষ করবে প্রতিক্রিয়া।
ওমর ছিল ব্রিগলের লোক। ব্রিগল জানে আমরা এখানে। কাল রাতে সিগন্যাল পাঠানোর সময় ওমরকে হাতেনাতে ধরে ফেলি এবং খুন করতে বাধ্য হই আমি।
কবুতরের ওপর যেন দৃষ্টি পড়েছে বাজপাখির, এমনিভাবে ব্যারোনেসকে লক্ষ করে রানার মনে হলো-জুলি গ্রাফ হয় সত্যি সত্যিই হতবিহ্বল আর নয়তো অতি পাকা অভিনেত্রী। কোনটা, বুঝতে পারল না রানা।
রানার মুখে রাতের ঘটনা শুনে ফ্যাকাসে হয়ে গেল জুলি, নিচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে। স্পষ্টতই উত্তেজিত। গলা কাঁপছে, অনিশ্চিত সুরে বলল শেষ পর্যন্ত, ওমর? তু-তুমি ওমরকে খুন করেছ?
উপায় ছিল না, বলল রানা। নইলে আমাকে খুন হতে হত। মেরেই ফেলেছিল প্রায়, বেঁচে গেছি অল্পের জন্যে। ব্রিগলের লোক ও। ওকে প্ল্যান্ট করা হয়েছে এখানে।
ব্যায়োনেসের বিস্মিত, হতচকিত মুখভঙ্গি মিথ্যে মনে হলো না রানার চোখে।
আ-আমার মাথায় আসছে না, যুবতী বলল শেষমেষ। এত মানুষ ছেড়ে শেষপর্যন্ত ওমর! ও তো বহু বছর ধরে কন্টেসার চাকরি করছে। উনি অসম্ভব। বিশ্বাস করতেন ওকে।
ও হয়তো ওঁর বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি, কাটখোট্টা সুরে বলল রানা। আমাদের করেছে। রুডলফ ব্রিগল যেভাবেই হোক কুজা করেছে ওকে। ব্যাপারটা আমার কাছেও রহস্যময় ঠেকছে-যাকগে, পনেরো মিনিটের মধ্যে ডকে চলে এসো। মনে রেখো, ওয়াচ করা হচ্ছে আমাদেরকে। ওকে-ঠিক পনেরো মিনিট।
ঘুরে দাঁড়ানোর সময় বলল জুলি, আমার পিস্তল আর ছোরাটা এখন পেতে পারি নিশ্চয়ই? প্লীজ? লাল ঠোঁটে ওর প্রার্থনার বিনীত হাসি। প্রাণ বাঁচাতে দরকার হতে পারে।
এসো, বলল রানা। ব্যারোনেসকে নিজের কামরায় নিয়ে গেল। সুটকেস থেকে অস্ত্র দুটো বের করে তুলে দিল ওর হাতে। রাখো, কিন্তু ইউজ কোরো না–আমার ওপর ভরসা রেখো।
সামনে ঝুঁকে রানার গালে চুমু খেল ব্যারোনেস। ধন্যবাদ, রানা, বলল। তাহলে পনেরো মিনিটের মধ্যে ডকে দেখা হচ্ছে, কেমন?
.
লেকের মাঝামাঝি না পৌঁছনো অবধি একটানা দাঁড় বাইল মাসুদ রানা। ফিশিঙের অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে মেরীর স্টোররূম থেকে গোটা দুয়েক ছিপ-বড়শি ধার নিয়ে এসেছে। বিরাট সুটকেস ও লাঞ্চ হ্যাঁম্পারটা রাখার পর ছোট্ট নৌকাটায় জায়গা আর বাঁচেনি। ফলে নৌকাটা ডুবে না যায়, সাবধান থাকতে হচ্ছে সেজন্যে।হদটা এখানে মাত্র চার মাইল চওড়া, কাজেই অসতর্ক না হলে ওয়াচাররা ঠিকই দেখতে পাবে ওদের। দ্বীপটাকে নিজেদের ও পাহারাদারদের মাঝামাঝি রাখতে পারলে অবশ্য ওদের দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব। কিন্তু এর ওপর ভরসা করতে পারল না রানা। পরে ক্রমান্বয়ে লেকে ব্যস্ততা বাড়তে ওদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেল অনেকখানি।
ওরা আর ফিরছে না। ওমরও নেই, ভাবল রানা। মেরীকে একদম একা ফেলে আসা হলো। অবশ্য কোন উপায়ও ছিল না।
বেলা গড়াতে স্টীমার লেনে পৌঁছল ওরা। সাদা রঙের প্রমোদ তরীগুলো সগর্জনে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঢেউয়ের দোলায় বিপজ্জনকভাবে দুলিয়ে দিয়ে গেল রানাদের ছোট্ট নৌকাটাকে। প্রমোদ রিহারে বেরোনো লোকজন কৌতূহলী চোখে লক্ষ করল নৌকার দুই যাত্রীকে।
সাঁতরাতে না হলেই বাঁচি, ব্যারোনেসকে বলল রানা। ওরকম আরেকটা ঢেউ উঠলে আর নৌকায় বসে থাকতে হবে না।
স্টার্ন সীটে ঠিক মাঝবরাবর বসে ব্যারোনেস, সাবধানে ভারসাম্য বজায় রাখছে। নৌকার নিচে রয়েছে লাঞ্চ হ্যাঁম্পার ও সুটকেস। ছিপ-বড়শি আগেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ওরা।
আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না? প্রস্তাব করল জুলি, আমরা নৌকাডুবির ভান করি। উল্টানো নৌকা, বৈঠা এসব খুঁজে পাক পুলিস-কিন্তু আমাদের লাশ পাবে না! কাগজে বেরোবে খবরটা। ব্রিগল আর তার লোকেরা পর্যন্ত ধোকা খেয়ে যাবে। আমরা কিছুটা সময় অন্তত হাতে পাব।
ব্রিগলকে বোকা বানানো অত সহজ নয়, বলল রানা। আসলে বোকা বানাতে চায় না সে। মুখোমুখি হতে চায় বন্ধুর হত্যাকারীর — তারপর লড়াই হবে সেয়ানে সেয়ানে। তবে বুদ্ধিটা মন্দ নয়। আগে অবশ্য কোথাও গা ঢাকা দিতে হবে আমাদের। নৌকাডুবির ঘটনাটা সত্যিই সত্যি হয়ে যাক সেটা চাইছি– না।
দাঁড় বাওয়ায় বিরাম দিয়ে চারধারে নজর বুলিয়ে নিল রানা। লক্ষ করল দূর। থেকে ওদের দিকে আগুয়ান একটা সাদা লেক স্টীমার। উঁহু, চলবে না। ওরা। সত্যিকারের বিপদে পড়লেই কেবল থামবে ওটা। এখন থামালে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে ছাড়বে ওদের। দরকার একটা প্রাইভেট বোট। এমুহূর্তে ফাঁকা ভাড়াটে লঞ্চ, কিংবা-ওই তো, বেশি দূরে নয়, কাছেই একটা পালতোলা নৌকার লাল রঙা ত্রিভুজ ধরা পড়ল রানার চোখে। অনুকূল আবহাওয়ায়, লাতিন। কায়দায় সাজানো ছোট ছোট বেশ কিছু ক্রাফট ভেসে বেড়ায় লেকের বুকে। অমনই একটা পাওয়া গেছে।
একই সঙ্গে দুজনে লক্ষ করল ওটা। কুয়াশা! ঠাণ্ডা, ভেজা স্যাঁতসেঁতে একটা পর্দা লেকের পানিতে ঝপ করে নেমে এল কাফনের কাপড়ের মত। কে জানে কোত্থেকে হঠাৎই এল ওটা, ঢেকে দিল সূর্যটাকে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধীরে, অথচ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলল বাতাসের বেগ। এই একটু আগের স্বচ্ছ নীল পানি এখন নোংরা ধূসর রঙ ধরেছে, দেখাচ্ছে খুদে খুদে সাদা দাঁত।
একেই বলে মোলান, বলল ব্যারোনেস। ফল স্টর্ম। আগেও দেখেছি কয়েকবার। এখুনি এই নৌকা ছাড়তে হবে, নইলে মারাত্মক বিপদ হয়ে যাবে।
সে আর বলতে। দ্রুত ঘনায়মান কুয়াশা ভেদ করে দৃষ্টিক্ষেপ করছে। রানা। গতিপথ পরিবর্তন করে বাড়িমুখো হচ্ছে একটা ক্রাফট, কাছ ঘেঁষে যাবে। ওদের। বৈঠা তুলে নিয়ে সর্বশক্তিতে বাইতে লাগল রানা। সেইলবোটটার পথরোধ করবে এমনি একটা কোর্স সেট করল। ব্রিগলের ওয়াচারদের কথা এখন না ভাবলেও চলবে। ওটার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে কুয়াশা।
রানার হাক-ডাক শুনে পাল ফেলে কাছিয়ে এল ক্রাফটটা, প্রবলবেগে। দুলছে। ব্যারোনেসকে বোটে তুলে নিল দুই যুবক-যুবতী। দুজনেই হৃষ্টপুষ্ট, রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ। আর কেউ নেই বোটে। ব্যারোনেসের পেছন পেছন নিজের সুটকেস ও লাঞ্চ হ্যাঁম্পারটা ছুঁড়ে দিল রানা। তারপর চটপট লাফিয়ে উঠে পড়ল। এরই ফাঁকে অ্যালুমিনিয়ামের হালকা নৌকাটাকে উল্টে দিয়েছে কায়দা করে। পরিত্যক্ত নৌকাটা ভাসছে উল্টো হয়ে, দাঁড় দুটো ওটার ছিটকে গেছে এদিক-ওদিক। যুবক স্কিপার পাল তুলে দিতে রওনা হয়ে গেল ক্রাফট। আগের চাইতে অনেক জোরাল এখন বাতাস, একপাশে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে কাত হয়ে ছোট্ট ক্রাফটটা ছুটে চলেছে জেনেভার উদ্দেশে।
ওদের যা বলার আমি বলব, ইংরেজিতে ব্যারোনেসকে বলল রানা। তুমি বরং নিচে গিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করো। সুন্দর একটা গপ্পো আর একগাদা ফ্ৰ গছিয়ে দিচ্ছি আমি। লাক মনে হচ্ছে ফেভার করছে আমাদের।
মুচকি হেসে, কম্প্যানিয়নওয়ে দিয়ে, নিচের ছোট্ট কেবিনটার দিকে নেমে গেল ব্যারোনেস। ককপিটে ঘেষাঘেঁষি করে বসে থাকা যুবক-যুবতীর কাছে চলে এল রানা। স্বভাবতই এই বিদেশী ও তার সঙ্গিনী সম্পর্কে কৌতূহলের। অন্ত নেই উদ্ধারকারীদের। ল্যাক লেম্যানের মাঝখানে, ভয়ঙ্কর মোলানের মুখে, কি করছিল ওরা ছোট্ট ওই নৌকাটায় চেপে? স্যাক্রে ব্লিউ! পাগল না পেট খারাপ?
প্রেমে পড়লে লোকের মাথা খারাপ হওয়াই তো স্বাভাবিক, বলল রানা। আসলে হয়েছে কি, আরেকজনের বউকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও। স্বামীটা, যথারীতি, বজ্জাত-অমানুষ, বড্ড অত্যাচার করত নিরীহ বউটার ওপর–আর ওরা দুজন একদম সাচ্চা প্রেমিক-প্রেমিকা! রানা, প্রায় নিশ্চিত, উদ্ধারকারীদের সহানুভূতি পাবে ওরা, নান? এবং ওদেরকে জেনেভার তীরে পৌঁছে দিয়ে। মুখটাও বন্ধ রাখবে দয়া করে আউই?
রানার কাহিনীটার ওপর না রাখলেও, ফ্রার বান্ডিলটার ওপর ঠিকই বিশ্বাস। রাখল ওরা। টিলার নিয়ে ওদের লড়াই করার সুযোগ দিয়ে কেটে পড়ল রানা। খুদে ক্রাফটটা এখন পানি কেটে হিস-হিস শব্দ তুলে ছুটে চলেছে। ইতোমধ্যে জেনে নিয়েছে রানা, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জেনেভা বন্দরে পৌঁছে যাবে ওরা। ভাগ্য যদি সহায় থাকে আরকি। নিচে ছোট কেবিনটায় এসে ঢুকল রানা। সরু এক বাঙ্কে শরীর গুটিয়ে শুয়ে রয়েছে ব্যারোনেস, নিচু ছাদটার দিকে চেয়ে। সিগারেট ফুকছে। উল্টোদিকের বাঙ্কটায় গা এলিয়ে দিল রানা
তোমার বুদ্ধিটা হয়তো কাজে দিতে পারে, সিগারেট ধরিয়ে বলল রানা। ঝড়টা আমাদের একটা ব্রেক দিল বলতে পারো, আমাদেরকে লোকেট করতে আরেকটু সময় ব্যয় করতে হবে এখন রুডলফ ব্রিগলকে। তবে লোকেট সে করবেই।
রানাকে উদ্দেশ্য করে ধোয়া ছাড়ল ব্যারোনেস। তুমি তো এখন ওর সঙ্গে মোকাবিলা করতে চাও, ঠিক না, রানা? চাও ও খোড়ল ছেড়ে বেরিয়ে আসুক? আমি যাতে–কি বলে-ফিঙ্গার করতে পারি ওকে?
মাথা ঝাঁকাল মাসুদ রানা। চাই। কিন্তু আমি চাই মোকাবিলাটা আমার পছন্দসই সময়ে আমার পছন্দসই জায়গায় হোক। ও অবশ্য বাউলি কাটার চেষ্টা করবে-সেটাই স্বাভাবিক। আমি যেটা বুঝতে পারছি না, ও এখন পর্যন্ত কেন গুটি চালছে না। অপেক্ষা করছে ও। কিসের জন্যে? আমাকে সাবধান হওয়ার সুযোগ দিতে নিষেধ করা হয় ওমরকে। কেন? মনে হচ্ছে, সময় নিয়ে খেলা করছে ব্রিগল। বুঝতে পারছি না কারণটা। পারলে ভাল হত। সিগারেটে টান দিয়ে ভ্র কোঁচকাল রানা।
সময় কিন্তু বেশি নেই, রানা। সব কিছু দেখছ না কত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে! রুডলফ ব্রিগলের হয়তো অর্গানাইযড় হতে সময় লাগছে। খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট!
হুঁ। পানির হিসহিসানি আর গলগল শব্দ কান পেতে শুনছে রানা।
কেবিনে মুহূর্তের নীরবতা, তারপর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল ব্যারোনেস। আমি কিন্তু খুব ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি, রানা।
চোখ সরু করে ওর দিকে চাইল রানা। কি রকম?
ঠোঁটে সিগারেট, হাততালি দিল ব্যারোনেস। সব ব্যাপারেই ডার্লিং! অ্যাবাউট এভরি থিং! এই সোনার চিতাবাঘ-বাধানো দাঁতের মধ্যে তুমি কি খুঁজে পেলে-থুঃ-এখন আবার বলছ ওমরকে খুন করতে বাধ্য হয়েছ তুমি। কৌতূহলে মরে যাচ্ছি আমি, রানা। আমাকে বলবে না?
দুমুহূর্ত ভেবে নিল রানা। ব্যারোনেসকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জানাতে নিষেধ করে দিয়েছেন বস। কাজেই সব কথা বলা যাবে না। তবে মিশন লেপার্ডের নেপথ্য ঘটনা মেয়েটিকে জানালে ক্ষতির কোন সম্ভাবনা আছে মনে হলো না ওর। রানার মুখ থেকে ব্যারোনেস যা জানতে পারল সেটা এরকম রুবিচক্ষু সোনার চিতাবাঘটাকে জাপানীরা চুরি করে জাভার একটি মন্দির থেকে। নাটের গুরু ছিল কর্নেল ইয়ামাগুচি নাকাতা, হিদেতোশি নাকাতার। বাবা। এর কিছুদিন পর আরেক কর্নেল গিয়ে উপস্থিত হয় ফার ইস্টে-কর্নেল কার্ল ব্রিগল, রুডলফ ব্রিগলের বাপ। জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গাঢ় করার স্বার্থে হিটলার স্বয়ং পাঠিয়েছিলেন তার এসএস কর্নেলকে।
জাপানীরা নিজেরাও থার্ড রাইখের সঙ্গে জড়িত হতে উদগ্র আগ্রহী ছিল। মোটকথা, দুনিয়াটা ভাগাভাগি করে শাসন করতে চাইলে জার্মানীর সঙ্গে দোস্তী না পাতিয়ে উপায় ছিল না তাদের।
কিছু উচ্চপদস্থ জাপানী কর্তাব্যক্তি হিটলারকে খুশি করতে সোনার চিতাবাঘটা ভেট পাঠায়। কর্নেল কার্ল ব্রিগল বার্লিনে নিয়ে যায় ওটা। আর সঙ্গে যায় কর্নেল ইয়ামাগুচি নাকাতা, জার্মানীর রাজধানীতে স্থায়ী লিয়াজো পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে।
হিটলার, উপহার পেয়ে খুশি হলেও, আর্টের সমঝদার ছিলেন না। চিতাবাঘটা তিনি দেন তার স্থূলদেহী এয়ার মার্শাল হার্মান গোয়েরিংকে। ভদ্রলোক আবার জীবনের সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখতেন।
মোটকু জার্মান, সারা দুনিয়া জানে, লোভী ও ধূর্ত লোক ছিলেন। সাবধানীও বটে। যুদ্ধের শুরুতে সুইসদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাখেন তিনি, ব্যাঙ্ক অভ পল শার্দে এট ফিল-এ একটা ভল্টের জন্যে।
ব্যারোনেস এখানটায় এসে বাধা দিল। কিন্তু গোয়েরিং ও কাজ করল, কিভাবে? সুইসরা যেমন, জেদী তেমনি নিরপেক্ষ! ওরা ভাঙবে তবু মচকাবে না।
আরেকটা সিগারেট জ্বেলে নিল রানা। কিন্তু এটাই ঘটেছিল-ইহুদিদের প্রতি সুইসদের মনোভাব বুঝতে পেরে গোয়েরিং প্রস্তাব দেন, সুইসরা রাজি থাকলে, বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পাঁচ হাজার ইহুদিকে ছেড়ে দেবেন। আর তা না হলে পুরো ব্যাপারটা ফাঁস করে দেবেন। ভালই বিপদে ফেলে দেন তিনি সুইসদের। তো ওরা শেষপর্যন্ত একটা ব্যাঙ্ক ভল্ট ছেড়ে দেয় তার জন্যে। গোপনে হয়ে গেল যা হবার, খুশি থাকল সবাই। লুটের মাল লুকিয়ে রাখার জন্যে একটা জায়গা পেয়ে গেলেন গোয়েরিং, আর পাঁচ হাজার ইহুদির জীবন। বাঁচানোর জন্যে বাহবা পেল সুইসরা।
যুদ্ধ এগিয়ে চলল, সেই সঙ্গে মূল্যবান চোরাই মাল জমতে লাগল গোয়েরিঙের ভল্টে। কার্ল ব্রিগলকে দিয়ে সুইটজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে পাচার করতেন তিনি যাবতীয় রত্নরাজি। ব্রিগল তখন এস এস বাহিনীর জেনারেল। মাঝে মধ্যে, ব্রিগলকে সঙ্গ দিত ইয়ামাগুচি নাকাতা, তখনও কর্নেল রয়ে গেছে সে।
১৯৪৫-এর বসন্তের শুরুতে সুইটজারল্যান্ডে সোনার চিতাবাঘটা পাঠান। গোয়েরিং, যখন আরকি নিশ্চিত হলেন যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য। গোয়েরিঙের দূত হিসেবে কার্ল ব্রিগলের সেটাই ছিল শেষ ট্রিপ, এবং এবারে তার সঙ্গে ছিল ইয়ামাগুচি নাকাতা। জার্মান ও জাপানী লোক দুটো এবারই ঠিক করল। ডাবলঞস করবে গোয়েরিংকে।
ব্রিগল নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল এটাই শেষ সুযোগ, ব্যাখ্যা করল রানা। গোয়েরিং তাকে আদেশ দেন ভল্টটা সীল করে ফ্রেঞ্চ কী-টা নিয়ে আসতে। ব্রিগল মানে নির্দেশটা-একটা পর্যায় পর্যন্ত। খুব সম্ভব সে আর নাকাতা মেরে। দেয় চাবিটা। গোয়েরিংকে ভুয়া একটা চাবি গছিয়ে দিয়ে আসলটা রেখে দেয়। কেউ কাউকে ওরা বিশ্বাস করত না বলে আধখানা চাবিটাকে কেটে আরও আধখানা করে। দুজনেই রাখে একটা করে টুকরো। স্থির করে যুদ্ধের পর মিলিত হয়ে ভাগাভাগি করে নেবে মোটকা গোয়েরিঙের সমস্ত সম্পত্তি। কিন্তু ওরা যা ভেবেছিল ব্যাপারটা ঠিক সেরকম ঘটল না। যুদ্ধাপরাধে বিচার হয়। নাকাতার-জিআইদের কল্লা নিতে ভালবাসত সে, ফলে চল্লিশ বছরের জেল হয়। তার!
কার্ল ব্রিগল তার ছেলের মতই ভাগ্যবান। ছাড়া পেয়ে যায় সে, তিক্তকণ্ঠে বলল জুলি।
কিন্তু নাকাতা পার পায়নি, বলে চলেছে রানা। আর কি আশ্চর্য দেখো, ওর ছেলেকেও বাপের মত জেল খাটতে হয়েছে। যাকগে, ইয়ামাগুচি কিন্তু ফাঁসিয়ে দিল ব্রিগলকে। সে কবে জেলমুক্ত হবে আর কবে ওরা গোয়েরিঙের চোরাই মাল গাপ করবে। ওদের কপালে আসলে ছিল না ওগুলো। ইয়ামাগুচি জেল খাটার সময়ই মারা যায় কার্ল ব্রিগল। চাবির টুকরোটা দিয়ে যায় একমাত্র ছেলে রুডলফ ব্রিগলকে। আর নাকাতা তার অংশটা দিয়ে যায় বড় ছেলে হিদেতোশিকে। পঁয়ত্রিশ বছর জেল খাটার পর মুক্তি দেয়া হয় ওকে। কিন্তু। বাঁচেনি বেশিদিন। এদিকে কাল ব্রিগলের ছেলে রুডলফ ব্রিগল ইয়ামাগুচির। খোঁজ করতে এসে জানতে পারে সে মারা গেছে। চাবির টুকরো এখন তার ছেলে হিদেভোশির কাছে। কিন্তু সে উগ্র বামপন্থী কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে জেলে গেছে। রক্তের দোয়। ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পুনরাবৃত্তি দেখো, ব্রিগলরা আবারও বসে বসে অপেক্ষা করতে বাধ্য হলো নাকাতাদের জন্যে। তো শেষমেষ, তেরো বছর পর নাকাতা জেল খেটে বেরোলে ওদের মধ্যে আবার যোগাযোগ হলো। ওরা ঠিক করল ওদের বাবারা যেটা পারেনি, অর্থাৎ গোয়েরিঙের দুনম্বরী সম্পত্তি মেরে দিতে, ওরা সেটা করবে। কিন্তু আমার ধারণা, এবারও ব্যর্থ হবে ওরা। হাজার হলেও পাপের মাল-এতদিন যখন কেউ ভোগ করতে পারেনি এখনও পারবে না।
শুধু এই কারণেই এখানে এসেছ তুমি? প্রশ্ন করল ব্যারোনেস। ওরা যাতে ভল্ট খুলতে না পারে সেজন্যে?
মাথা নাড়ল রানা। না, বলল। গম্ভীর হয়ে উঠেছে ওর মুখের চেহারা। সপরিবারে কায়সার রশীদের হত্যাকাণ্ডের কথা খোলসা করে জানাল। ব্যারোনেসকে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি তো, বলে উঠল জুলি। বিদেশীদের অনেকেই, বিশেষ করে এশিয়ানরা মারা পড়েছে ওদের হাতে। ও, জানতাম না তো তোমার বন্ধুও ছিল তাদের মধ্যে। আহারে… অকৃত্রিম শোনাল ওর কণ্ঠস্বর।
বাঙ্ক থেকে ঝুঁকে পড়ে সিগারেটটা নেভাল রানা। চারপাশ থেকে এখন কেবল ঝড়ের শোঁ-শোঁ শব্দ আর প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইরত বোটটার অসহায় গোঙানি কানে আসছে।
হাতের ওপর চিবুক রেখে রানাকে লক্ষ করছে ব্যারোনেস। ওর চোখে অদ্ভুত এক জ্যোতি আবিষ্কার করল রানা।
তুমি রুডলফ ব্রিগলকে খুন করবে, তাই না? প্রতিশোধ নেবে বন্ধু হত্যার?
সেজন্যেই জেনেভা আসা আমার। মিশন-ফিশন পরের কথা, বলল রানা। তবে বললে না, খুন করব রুডলফ ব্রিগলকে? আমি একজন এজেন্ট। যতবড় অপরাধীই হোক না কেন, নিতান্ত বাধ্য না হলে মানুষ খুন করি না আমি, আইন তুলে নিই না নিজের হাতে।
রানার কণ্ঠে এমন একটা কিছু ছিল যে আর কথা বাড়াল না ব্যারোনেস।
.
০৯.
দুপুর পার করে তারপর জেনেভা হার্বারে পৌঁছল সেইলবোট। মোলান পরের দিকে প্রশমিত হয়ে এসেছিল অনেকখানি। সূর্যকিরণ ঝিকমিক করছে এখন হ্রদের পানিতে। কুয়াই-ডু-মন্ট-ব্লা-র কাছে বন্দরের ফোয়ারাটা শুন্যে দুশো ফীট ছুঁড়ে দিচ্ছে দুধ-সাদা ফেনা। জলকণাগুলো অগুনতি খুদে খুদে রংধনু হয়ে ঝরে পড়ছে নিচে।
রানা সুটকেস ও লাঞ্চ হ্যাঁম্পারটা বইছে, জুলিকে তাগাদা দিল কুয়াই থেকে শিগগিরি সরে পড়ার জন্যে। ওদেরকে স্পষ্ট করা হয়েছে মনে করে না রানা, কিন্তু কোন ঝুঁকি নিতেও রাজি নয়।
তোমাকে কিছুক্ষণের জন্যে একা থাকতে হবে, বলল ও। তবে ভয়ের। কিছু নেই। রানা এজেন্সীর ডিপোটার কথা উল্লেখ করল না রানা। রু গাস্টনে বাঁক নিয়েছে ওরা এ মুহূর্তে।
সিভিক গার্ডেনসের একটা বেঞ্চিতে ব্যারোনেসকে বসিয়ে, লাঞ্চ হ্যাঁম্পারটা পাশে রাখল রানা। নো চিন্তা ডু ফুর্তি, আশ্বস্ত করল। পিকনিক করতে এসেছ তুমি, অপেক্ষা করছ একজনের জন্যে। অস্থির হয়ে উঠছ তার দেরি দেখে। পুলিশ বা আর কেউ কৌতূহলী হলে একটু অভিনয় দেখিয়ে দিয়ো। তবে তার দরকার পড়বে মনে হয় না। ভদ্রমহিলাদের ওরা ঘটায় না। আর যদি অন্য ধরনের বিপদ আসে, ও দুটো তো আছেই। যুবতীর সুগঠিত পা দুটো গ্রে স্ন্যাক্সে মসৃণ দেখাচ্ছে আরও। কি, আছে তো? পা লক্ষ করে বলল।
রানার বাহুতে চাপ দিল ব্যারোনেস। আছে। আশা করি ওগুলোর দরকার পড়বে না। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো কিন্তু, রানা। পর যত তাড়াতাড়ি পারি। বাদামঅলার কাছ থেকে এক ঠোঙা বাদাম কিনে ব্যারোনেসকে দিল রানা। কবুতরকে খাওয়াতে থাকো। সময় কাটবে।
ব্যারোনেসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকে পড়ল রানা। খদ্দেরদের ভিড়ে মিশে গিয়ে এক সময় সাইড ডোর দিয়ে বেরিয়ে গেল। দুবার ক্যাব পাল্টে, শেষ ছটা ব্লক হেঁটে মেরে দিল। বিল্ডিংটায় প্রবেশ যখন করল তখন নিশ্চিত ও, কেউ নেই পিছনে। অন্ধকার সিঁড়িগুলো টপকানোর সময় মৃদু হাসি ফুটল ওর মুখে। এমুহর্তে ওরা মাসুদ রানার প্রতি আগ্রহী নয়, রানার চিন্তা-ভাবনায় যদি কোন ভুল না হয়ে থাকে।
পাঁচ মিনিট পর ঢাকায় মেজর জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ হলো রানার। সংক্ষেপে যা যা ঘটেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিল ও। একমনে শুনে গেলেন বস, বাধা দিলেন না।
স্যার, সবশেষে বলল রানা, ব্রিগল শিগগিরিই চাল দেবে। তার আগে। আমার কন্টেস ডি কারেন্ধু সম্পর্কে কিছু তথ্য জানার দরকার।…জ্বী, কা-রে সু। উনি প্যারিসে থাকেন। এক সময়কার বিখ্যাত পিয়ানিস্ট।
আর কিছু?
ব্যাঙ্কে ওয়াচ রাখার দরকার নেই, স্যার, বসকে বলল রানা। বর্ডারের পাহারাও তুলে নিতে বলুন। ব্রিগল সতর্ক হয়ে যাক সেটা চাইছি না। ওকে খোলাখুলি মোকাবিলা করতে চাই আমি। আমার সবচেয়ে যেটা অবাক লাগছে, ও বসে বসে অপেক্ষা করছে, নিজেকে ওপেন করছে না। দুনিয়ার সমস্ত সময় যেন হাতে ওর। ব্যাপারটা আমার একদমই পছন্দ হচ্ছে না। লোকটা অসম্ভব ধূর্ত এবং তার সংগঠনটাও শক্তিশালী। সময় যত যাবে ততই শক্তি সঞ্চয়। করবে ও। মুখোমুখি হতে না পারলে আঘাত হানব কিভাবে?
হুমমম বসকে সন্দিহান মনে হলো। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে রানা, ডেস্কের পেছনে বসে আছেন বৃদ্ধ। কাঁচা-পাকা ভুরুজোড়া কুচকানো তার, তুরুপের তাস, ঠোঁটে নিভে যাওয়া চুরুট। কম্পিউটারের গতিতে চলছে মগজ।
কাজটা একা করতে চাইছ? বসের সন্দেহ তখনও কাটেনি।
জ্বী, স্যার। ওর সঙ্গে ব্যক্তিগত বোঝাপড়া আছে আমার, আপনি জানেন। তাছাড়া নাকাতার চাবির টুকরোটা এখন আমার কাছে। ওটা ছাড়া ব্রিগল কানা। খোলস ছেড়ে বেরোতে ওকে হবেই, স্যার। এবং খুব শিগগিরিই ঘটতে যাচ্ছে সেটা। আমি নিজেও অবশ্য একটা টোপ দেব ঠিক করেছি। এইবার বস ওর পরের কথাগুলো পছন্দ না-ও করতে পারেন।
কি টোপ দেবে, রানা? বসের কণ্ঠস্বর শুকনো, প্রশ্নবোধক। কপালে ভাজ, আবারও কুঁচকে উঠেছে কাঁচা-পাকা ভুরু, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রানা মনের আয়নায়।
ব্যারোনেসকে ব্যবহার করব টোপ হিসেবে, বলল রানা। ওকে সিভিক গার্ডেনসে বসিয়ে রেখে এসেছি। আমি শিয়োর ওখানে ফলো করা হয়েছে। আমাদের, যদিও বলিনি সেটা ব্যারোনেসকে। ওরা যদি কিডন্যাপ করে। ব্যারোনেসকে, এবং আমার ধারণ করবে, তাহলেই রাস্তা খুলে যায়।
দীর্ঘ নীরবতা। স্ক্র্যামলারের ও প্রান্ত থেকে বসের গলা খাকরানির শব্দ। শুনতে পেল রানা।
ব্যাপারটা খুবই রিস্কি, রানা। বন্ধুদেশের কাছ থেকে ধার নেয়া হয়েছে। ওকে। ওর সমস্ত দায়-দায়িত্ব আমাদের। আমি এটা অ্যাপ্রুভ করতে পারি না।
যা করার তা তো করেই ফেলেছি, স্যার, খুশিখুশি গলায় বলল রানা। আপনাকে জিজ্ঞেস করার সময় পাওয়া গেল না। তবে আমি শিয়োর বুদ্ধিটা কাজে দেবে, স্যার।
কিন্তু মেয়েটাকে তুলে দিয়ে তুমি তো ওদের আপারহ্যান্ড দিয়ে দিলে।
আমি সেভাবে দেখছি না, স্যার। ও স্রেফ গো-বিটউইনের কাজ করবে। . আমার মনে হয় না ব্রিগল মেয়েটার ক্ষতি করবে-অন্তত এত তাড়াতাড়ি না।
কাশতে শোনা গেল মেজর জেনারেলকে। মেয়েটাই একমাত্র ব্রগলের এখনকার চেহারা চেনে। একথা জানার পরও বলছ বাঁচিয়ে রাখবে ওকে
জী না, স্যার, স্বীকার করল রানা। মেরে ফেলার চেষ্টাই করবে।
তাহলে কিভাবে তুমি- মেজর জেনারেল গর্জে উঠতে যাচ্ছিলেন।
পারবে না, স্যার, কথা দিল রানা। ওকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি . আমি, উদ্ধারও করব আমি।.কোন ক্ষতি হবে না ওর।
অত নিশ্চিত হচ্ছ কি করে? চাবির টুকরোটা?
হ্যাঁ, স্যার, চাবির টুকরো পেতে হলে আমার সাথে সমঝোতায় আসতে হবে ব্রিগলকে। তা নাহলে ওর এতদিনকার অপেক্ষার কোন মূল্য থাকবে না। আর আমার সাথে ডিল করতে হলে, ও জানে, মেয়েটার কোন ক্ষতি করা চলবে না। আরেকটা ব্যাপার হলো ওর সময় ফুরিয়ে আসছে-ব্যারোনেস আমাকে বলেছে আবারও নাকি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। ওকে। এবং সুইস ব্যাঙ্কও চিরদিন ডিপোজিট হোন্ড করবে না। আইনটা জানা নেই আমার, তবে মনে হয় ভল্ট বাজেয়াপ্ত করার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
এসবই জানে ব্রিগল। ফাঁদে পড়ে গেছে সে। আমিই এখন তার একমাত্র আশা-ভরসা! চাবির টুকরোটা উদ্ধার করতেই হবে ওকে-এবং তা করতে হলে সামনাসামনি হতে হবে। ও হয়তো জানে না, কায়সার আমার বন্ধু ছিল। আর জানলেই বা কি, শত্রুর মুখোমুখি ওকে হতেই হচ্ছে।
হ্যাঁ, আর কিছু বলবে?
আমি এখন কাজে নেমে পড়ছি, স্যার, বলল রানা। ভাত ছিটালে কাক আসবে-কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাফ সুতরো করে ফেলব সব কিছু। একটা কথা, স্যার, আমি না চাইলে যাতে সাহায্য করা না হয়। আমি নিজের মত করে সারতে চাই কাজটা।
বুঝেছি। তোমার মনের মধ্যে কি চলছে জানি আমি, রানা, বললেন। মেজর জেনারেল। কিন্তু প্রতিশোধের নেশায় হুট করে কোন বিপদ ডেকে এনো না আবার। বি কেয়ারফুল।
রাখি, স্যার?
ডিপো থেকে বেরিয়ে সিভিক গার্ডেনসে ফেরার পথে মৃদু শিস দিচ্ছে রানা। ব্যারোনেসকে দেখতে পাবে না, আশা করছে। কুয়াই থেকেই পিছু নেয়া হয়েছে ওদের নিশ্চিত ছিল রানা, ব্যারোনেসকে মিথ্যে কথা বললেও ফেউটাকে স্পট করতে পেরেছিল ও। বেটে মোটা এক লোক। পরনে ছিল লেদার উইন্ডব্রেকার আর ট্রিলবি হ্যাট।
এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। রানা আশা করেনি লেকে বৈঠা বাইলেই থোকা খেয়ে যাবে ব্রিগলের লোকেরা। আচমকা ঝড় বোকা বানাবে এদের তেমন। সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ। রানা আর জুলিকে অন্য কোন বোট তুলে নেবে ওরা কি আর বোঝে না? প্রশ্ন থাকতে পারে কেবল ওদের গন্তব্য সম্পর্কে। কিন্তু, রুডলফ ব্রিগলের সংগঠন বেশ বড় প্রতিটি সম্ভাব্য বন্দর কভার করবে তারা।
ব্যারোনেসের যেখানটায় অপেক্ষা করার কথা তার কাছাকাছি পৌঁছে হাঁটার গতি বাজল রানা। উদ্বিগ্ন এক লোক যেন তড়িঘড়ি হেঁটে চলেছে। রুডলফ ব্রিগলের চোখে ধুলো দিতে হলে নিখুঁত হতে হবে অভিনয়টা।
বেঞ্চিটা দূর থেকেই খালি দেখতে পেল রানা। পা চালিয়ে চলে এল ওটার কাছে, ভ্রূ কুঁচকে ইতিউতি চাইছে। ব্যারোনেসই। চমৎকার। সুকৌশলে, পেশাদারী দক্ষতা দেখিয়ে নিশ্চয়ই কাজটা সেরেছে তারা। অস্ত্র ব্যবহার করবে কি, হয়তো লোকের দৃষ্টি আকর্ষণেরও সুযোগ পায়নি ব্যারোনেস। রানাও ঠিক এইই চেয়েছিল। কিন্তু যদি উল্টোটা ঘটে থাকে। ব্যারোনেস ধস্তাধস্তি করতে, বগলের লোকেরা সটকে পড়তে বাধ্য হয় এবং পলিস এসে ব্যারোনেসকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে গিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কেচে যাবে সমস্তটাই। যে তিমিরে সেই তিমিরেই পড়ে থাকবে রানা আর ব্রিগল।
শীঘ্রি অবশ্য জানা যাবে কোনটা ঘটেছে। ব্রিগলের লোকের হাতে। ব্যারোনেস ধরা পড়লে রানার সঙ্গে তারা যোগাযোগ করবে।
রানা বেঞ্চিটার সামনে তার অভিনয় পর্ব চালিয়ে যেতে লাগল। ভ্রূ কুঁচকে চিবুক ঘষে, চিন্তিত ভঙ্গিতে চারধারে নজর বুলাচ্ছে। একটা সিগারেট জ্বলে নার্ভাস ভঙ্গিতে কয়েকবার ফুক দিয়ে ফেলে দিল। ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানাচ্ছে, ওয়াচ করা হচ্ছে ওকে। কে করছে এখনও জানে না, তবে টের ঠিকই পাচ্ছে। পার্কে আসা মানুষ-জনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে।
দশ মিনিট অপেক্ষা করল রানা। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া প্রতিটি মহিলাকে লক্ষ করল উদ্বেগভরা চোখে। ভঙ্গিটা এমন ব্যারোনেস একবার ফিরে আসুক, তারে আমি মজা দেখাব। এমন বকা দেবে রানা, যেখানে খুশি চলে যাওয়ার মজা টের পবে। প্রায়ই সুটকেসটার ওপর লাথি মেরে গায়ের ঝাল ঝাড়ছে ও।
শেষ পর্যন্ত, যখন বুঝল ওয়াচার লোকটার বিশ্বাস জন্মানো গেছে, ঘুরে দাঁড়িয়ে মন্থর গতিতে গার্ডেনস ছেড়ে বেরিয়ে গেল রানা। হতভম্ব, গভীর চিন্তায় মগ্ন এক লোকের মত হেঁটে চলেছে ও।
শহরের প্রাণকেন্দ্রের উদ্দেশে এগোচ্ছে রানা। এক্সেলশিয়র হোটেলে এসে পৌঁছল পনেরো মিনিট বাদে। অ্যাডভান্স পেমেন্ট করে, ছেলেটার হাতে দিয়ে, নিজেই বয়ে তুলল সুটকেসটা।
এলিভেটরটা পুরানো আমলের, কন্টিনেন্টাল ধাঁচের খোলা খাঁচা একটা। ওটা হড়াক করে উধমুখী হতে, জাফরির ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল রানা, ট্রিলবি হ্যাট এইমাত্র হোটেলে প্রবেশ করে ডেস্কের দিকে যাচ্ছে। বেশি দেরি হবে না আর। দাঁত বেরিয়ে পড়ল রানার। রেজিস্টারে গোটা গোটা হরফে নাম লিখেছে। ওঃ মাসুদ রানা। বল এখন রুডলফ ব্রিগলের কোর্টে।
ডিপোতে যখন ছিল রানা, সুটকেসটাকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। নয়া কাপড়-চোপড় সঙ্গে এখন ওর, সেই সঙ্গে দেয়া হয়েছে আরও মারাত্মক ধরনের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। শাওয়ার নিয়ে কাপড় পাল্টাল রানা, অপেক্ষা করছে। কল আসবে যে-কোন মুহূর্তে। শেভ করার সময় গুনগুনকরতে লাগল রানা।
দিনের যোগ ব্যায়াম যেই সেরেছে অমনি ঝনঝন করে উঠল। টেলিফোনটা। রিসিভার তুলে নিল রানা। ইয়েস?
মিস্টার রানা? মিস্টার মাসুদ রানা? অনুচ্চ অথচ দঢ় ও কর্তৃত্বপূর্ণ একটা কণ্ঠস্বর। গলা শুনে বোঝা যায় এ লোক হুকুম করতে অভ্যস্ত, তামিল করতে নয়।
বাঁকা হেসে এক হাতে একটা সিগারেট বের করল রানা প্যাকেট থেকে। হ্যাঁ, আমি মাসুদ রানা। কে বলছেন, রুডলফ ব্রিগল?
দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ হচ্ছে, কেবলমাত্র তারের গুনগুন শব্দের কারণে। এবার বলল কণ্ঠস্বরটা হ্যাঁ, আমি রুডলফ ব্রিগল। চিনে ফেলেছেন দেখছি।
না চিনে উপায় কি বলুন, দাঁতের ফাঁকে বলল রানা। আপনার ওপর মোটাসোটা একটা ফাইল আছে যে আমাদের কাছে।
তা তো থাকবেই, মি. রানা। আচ্ছা, আমরা বরং কাজের কথায় আসি। কুশল বিনিময়ের জন্যে ফোন করিনি আমি। সংক্ষেপে সারব-ওহ, কলটাকে ট্রেস করার কথা ভেবে থাকলে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। পাবলিক ফোন থেকে কথা বলছি আমি।
জানা ছিল, বলল রানা। তাই মাথা ঘামাইনি। কি ব্যাপারে ফোন করেছেন, তাই বলুন। যেন জানি না আমি! মনে মনে বলল রানা।
এক কথায় সারি, মি. রানা। ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ। এটাও আন্দাজ করেছিলেন বুঝি?
করেছিলাম। ওকে ওভাবে রেখে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। আমি ভেবেছিলাম, আপনার লোকদের খসাতে পেরেছি। ভুল ভেবেছিলাম। গলায় চাতুর্যের সঙ্গে উদ্বেগ ও ক্ষোভ মিশিয়ে দিল রানা। ওকে কষ্ট দেবেন না, মি. ব্রিগল। আমি সহ্য করব না। সাবধান করে দিচ্ছি আপনাকে-ওর কিছু হলে আপনি দায়ী থাকবেন।
ঘোঁৎ করে উঠল ব্রিগল, রুক্ষ স্বরে বলল, আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে, অপেক্ষা করছি আমি, রানা। সত্যিই তর সইছে না আমার। অনেক কথাই, কানে এসেছে আপনার সম্পর্কে। আমি সেগুলো এতদিন নিছক গাল-গল্প ভেবে, উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু আপনার ধৃষ্টতা সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম দেখছি তা মিথ্যে নয়। দর কষাকষির পর্যায়ে আপনি নেই, রানা। ব্যারোনেসের জন্যে এতটুকু কেয়ার করলে সে সুযোগ আপনার থাকতে পারে না।
ব্যারোনেসকে আমি ভীষণ কেয়ার করি, ব্রিগল। সেজন্যেই সাবধান করে দিচ্ছি, ওর কোন ক্ষতি করতে যাবেন না। তার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। কাউকে আহত না করেও আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া হতে পারে।
আবার বিরতি। ফোনে দাঁত বের করে হাসল রানা। রুডলফ ব্রিগলের পূর্বকল্পিত আইডিয়াগুলো উল্টোপাল্টা করে দিচ্ছে ও। তার ফলে ধূর্ত লোকটাকেও এখন মাথা খাটাতে হচ্ছে পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্যে।
আপনি বারগেইনে ইচ্ছুক তারমানে? মেয়েটার বদলে-দেবেন আমি যেটা চাই?
আপনাকে খুন করতে পারলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম, বলল রানা, মন থেকেই। কিন্তু গ্যাড়াকলে পড়ে গেছি যেহেতু, বারগেইন না করে উপায় কি? মেয়েটাকে ফেরত চাই আমি, ব্রিগল।
হেসে উঠল ব্রিগল। আপনি আর যাই হন ভণ্ড নন অন্তত। কিন্তু আমার ওপর কেন এত রাগ আপনার জানতে পারি?
কায়সার রশীদের কথা মনে পড়ে? ওর নিরীহ স্ত্রী, নিষ্পাপ বাচ্চাটার কথা? কঠোর হয়ে উঠেছে রানার কণ্ঠস্বর। ওরা আমার বন্ধু ছিল।
ওপ্রান্তে দুমুহূর্তের নীরবতা। আপনি সে সুযোগ পাবেন না, শেষমেষ বলল ব্রিগল। আর বারগেইনের ব্যাপারে একটা সমঝোতায় আসতে পারি। আমরা। তবে খবরদার, রানা। আবারও সাবধান করে দিচ্ছি-কোন ট্রিকস নয়! কথাটা তোমার ভালর জন্যেই বলা হল।
ক্লান্তির ও পরাজয়ের সুর কণ্ঠে ফুটিয়ে তুলল রানা। আমার ভাল আমিই বুঝব। কিন্তু দর কষাকষির অবস্থায় সত্যিই নেই আমি। তোমার মত একটা বজাতের কথায় নাচতে ঘেন্না, করছে আমার। কিন্তু নাচতে হলে আর কি করব,নাচব। তা তোমার প্রস্তাবটা কি?
আমার বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে হিদেতোশি নাকাতার চাবির টুকরোটা এখন তোমার পকেটে, বলল ব্রিগল। আমার চাই ওটা। বিনিময়ে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেব ব্যারোনেসকে।
এটুকুই যথেষ্ট নয়, বলল রানা। চিতাবাঘ তুমি নিলে নাও, তারপর যেখানে খুশি চলে যেয়ো, বাধা দেব না। কিন্তু গোয়েরিঙের বাদবাকি লুটের মাল আমাকে দিতে হবে। বাংলাদেশ যাদের যাদের জিনিস তাদেরকে ফিরিয়ে দেবে। কি, রাজি?
ব্রিগল এত দীর্ঘক্ষণ নীরব রইল যে ঘাবড়ে গেল রানা, অতিচালাকের না গলায় দড়ি পড়ে-সন্ত্রাসীটার মুখোমুখি হওয়া ওর কাছে এখন সব কিছুর চাইতে বেশি জরুরী। গুবলেট হয়ে গেল না তো সে সম্ভাবনা? এমনিতেই আপোষে ব্যারোনেসকে ওদের হাতে তুলে দিয়ে সন্দেই উদ্রেক করার মত কাজ করেছে
ওপ্রান্তে শেষ অবধি জবান চালু হলো ব্রিগলের। টেলিফোনে অনেক কথা হলো, প্রাঞ্জল সুরে বলল। এখন সামনাসামনি বসে একটা ফয়সালা করা প্রয়োজন। তুমি ভিলা রিকোয় ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করবে, রানা। মাইন্ড ইট, ওয়েট। সময় মত তোমার সাথে যোগাযোগ করব আমি। আর মনে রেখো-কোন চালাকি নয়! চালাকি করতে গেলে ব্যারোনেস জুলি গ্রাফকে জ্যান্ত ফেরত পাবে না।
এবং তোমাকেও, ঠাণ্ডা গলায় কথা যুগিয়ে দিল রানা, ফ্রেঞ্চ কী-র বাকি অর্ধেকটা আর পেতে হবে না। আচ্ছা, তোমার দোসরের কি হলো বলো তোর ওর লাশের ব্যাপারে মুখে তালা মেরে রেখেছে পুলিস।
রুডলফ ব্রিগল আবারও হেসে উঠল, এবারে অকপটে। পুলিস নাকাতার কথা জানে না। এবং শুনে দুঃখ পাবে, সে মারাও যায়নি।
এহ-হে, বলল রানা। হাত খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখি আমার।
সে আমার জিম্মায় আছে, বলে চলেছে ব্রিগল, এবং সময় হলে তার উপযুক্ত ব্যবস্থাও করা হবে। আপাতত ওর কথা বাদ রাখো-ওর এখন কোন গুরুত্ব নেই!
হ্যাঁ, সায় জানাল রানা। চাবি খুইয়েছে, ওর আবার কিসের দাম সলিল সমাধি ঘটতে যাচ্ছে বেচারার, আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি।খোশমেজাজে আরও বলল ও, ওজনে কোন ভুল যেন না হয়, ব্রিগল। প্রচুর ভার চাপিয়ে। আমরা চাই না ও লেকে ভেসে উঠে সবাইকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিক।
নাকাতা একটা নির্বোধ, আক্কেলসেলামী তাকে দিতেই হবে, অসন্তুষ্ট কণ্ঠে জানাল ব্রিগল। অনেক হয়েছে-ভিলায় গিয়ে অপেক্ষা করোগে যাও।
ও, বিটকেল, ব্রিগলের নামটাকে বিকৃত করে উচ্চারণ করল রানা। তোমাকে একটা কথা জানানো দরকার। ওমর আব্রাহামকে খুন করতে বাধ্য। হয়েছি আমি। এ মুহর্তের বিরতির পর খলখল করে হাসল ব্রিগল। নো ম্যাটার। ও-ও একটা অপদার্থ ছিল। হাতের পুতুল-কিন্তু তোমার সম্পর্কে চালু গল্প-গাছাগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করেছি আমি। খুব হুশিয়ার থাকতে হবে বুঝতে পারছি।
আমাকেও, বলল রানা। গুড বাই, ব্রিগল। দেখা হচ্ছে।
আউ রিভয়, মিস্টার রানা। অবশ্যই দেখা হচ্ছে।
.
১০.
এক্সেলশিয়রের পার্কিং লটে, কথামত জাগুয়ারটা অপেক্ষা করছিল রানার জন্যে। ডিপোতে বলে এসেছিল রানা একটা জাগুয়ার পাঠাতে। চাবি ঝুলছে। সুইচ লক থেকে। রঙচটা, তোবড়ানো ছদ্মাবরণের নিচে ঝাঁ-চকচকে একটা গাড়ি-ঘণ্টায় একশো চল্লিশ মাইল স্পীড ওটার।
সুটকেস থেকে যা যা প্রয়োজন সব বের করে নিয়ে হোটেলে রেখে। এসেছে ওটা রানা। এখন থেকে ঝাড়া হাত-পা সে, মুক্তবিহঙ্গ। উদ্দাম গতিতে এখন শুধু সামনে ছুটে চলার পালা।
বিকেলটা পার করতে হবে ওকে। পেছনে ফেউ.লাগাবে রুডলফ ব্রিগল। তেমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। রাতের আঁধারে ভিলায় আসবে সে কিংবা তার লোকজন। রানা অপেক্ষা করবে ওদের জন্যে সেটাই আশা করবে। তাইই। করবে রানা। প্রতি মুহূর্তে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে ও। পরিস্থিতির ওপর আসলে নিয়ন্ত্রণ চাইছে। রুডলফ ব্রিগলকে খুন যদি করতেই হয়, এবং ও নিশ্চিত করতে হবে, সেক্ষেত্রে অনতিবিলম্বে কাজটা সেরে ফেলতে চাইছে রানা। নাকাতাকে থোড়াই পরোয়া করে ও। ব্যক্তিগত শত্রুতার কোন ব্যাপার নেই তার সাথে। এবং ব্রিগলের চাবির টুকরোটাও যদি কোনভাবে হাত করা যায় তবে তো পোয়াবারো। কিন্তু যদি না পায়-রানার মত ব্রিগলও নিশ্চয়ই গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখবে ওটা-তাহলেও ক্ষতি নেই, বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ তাতে ঠেকে থাকবে না। গোয়েরিঙের লুটের মাল না পেলে কি হবে, পরোয়া করে না রানা।
হোটেল ত্যাগের আগে তেল দিয়ে মুছে লগারটা পরীক্ষা করে নিয়েছে। রানা। তৈরি রয়েছে পকেটে গুটিসুটি মেরে গ্যাস বমটা। স্লীভ স্ক্যাবার্ডে রাখা স্টিলেটোটাকে ভাল মতন গোসল করাতে হয়েছে সাবান, পানি ও অ্যালকোহল দিয়ে, তারপর দূর করা গেছে ওমর আব্রাহামের রক্তের চিহ্ন।
ভাবছে রানা, লেকের পাশ দিয়ে মন্ট্রেয়ক্সের উদ্দেশে ড্রাইভ করার সময়, ওমরের দড়ি বাঁধা লাশ কি এখনও ভাসছে বোটহাউজে? সম্ভবত ডুবে গেছে এতক্ষণে। কঙ্কালটা বাদে বাকি দেহ তো ইঁদুরের ভোজে লাগার কথা।
ছোট্ট এক রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে নিল রানা। দীর্ঘ সময় নিয়ে কোক পান করল দুটো। সূর্য পাটে বসার অনেকক্ষণ পরে রওনা দিল ভিলার উদ্দেশে। ব্যারোনেসের কথা খুব মনে পড়ছে ওর। কেমন যেন অদ্ভুত এক সহানুভূতি অনুভব করছে ও মেয়েটির প্রতি। নিজের সুবিধার জন্যে ওকে ব্রিগলের হাতে তুলে দিয়েছে রানা। পরে পস্তাতে না হলেই হয়। জুলিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে আনা ওরই দায়িত্ব।
আঁধার রাত, এলোমেলো বাতাস বইছে। ছাই রঙা মেঘের পুঞ্জ ঢেকে রেখেছে চাঁদটাকে। সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়েছে মনোরম আবহাওয়া। বাতাসের আন্দোলনে নতুন এক ঝড়ের স্যাঁতসেতে উত্তেজনার গন্ধ। ভালই হলো, ভাবল রানা। যেমন কালো রাত তেমনি কালো কাজ।
জেনেভা শহরের উপকণ্ঠে এখন রানা। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের সংখ্যা এখানে নগণ্য। এ অঞ্চল অচেনা ওর। বার দুয়েক পথ হারিয়ে, অবশেষে গত রাতে দেখা স্ট্রীট কার্নিভালের উজ্জ্বল আলোগুলো খুঁজে পেল। ওগুলোকে সঙ্কেত ধরে নিয়ে শেষমেষ ঢুকে পড়ল সরু এক ধুলোটে রাস্তায়। দ্বীপের ও ভিলার উল্টোদিকেহদের কাছে চলে এল গাড়ি নিয়ে। পথ যেখানে ফুরিয়েছে, ওখানে এক ঝড় সিলভার বার্চের আড়ালে জাগুয়ারটা ছেড়ে, পায়ে হেঁটে পৌঁছল এসে লেকের কিনারে। ছোট্ট দ্বীপটা দেখা যায় এখান থেকে, আলো জ্বলছে ভিলার প্রতিটি জানালায়।
এত বাতি জ্বালা হয়েছে কেন? আঁধারে একাকী ভয় পাচ্ছে মেরী? নাকি মেইনল্যান্ড থেকে ওর বন্ধু-বান্ধব এসে আসর জমিয়েছে? ঐ কুঁচকে গেল রানার। জটিলতা বেড়ে যাবে তাহলে।
কার্নিভল থেকে ভেসে আসা হুল্লোড়ের শব্দ এক মুহূর্ত কান পেতে শুনল রানা, তারপর শ্রাগ করে অনুসন্ধান আরম্ভ করল। পেন্সিল-বীম ফ্ল্যাশলাইটটা রয়েসয়ে ব্যবহার করছে। একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেছে রানা। রুডলফ ব্রিগল, অথবা তার লোকেরা, এরমধ্যেই পৌঁছে গেছে দ্বীপে।
লেকের কিনারে, ভাঙাচোরা ছোট্ট ডকটায় বাধা একটা স্কিফ। ওটা খুঁজে পেতে পাঁচ মিনিট ব্যয় হলো রানার। খুশিমনে চুরি করতে যাবে ওটা, লক্ষ করল, আজ রাতে বেশ কিছু বোট রয়েছে লেকে। ওগুলোর সাদা, লাল ও সবুজ বাতি অন্ধকার পানির বুকে মূল্যবান মণিমুক্তোর মতন ইতস্তত ঝিকমিক করছে। দ্বীপের কাছাকাছি কোনটাই নেই অবশ্য। বাতাসের জোর বাড়তে বেশিরভাগই তীরমুখো হয়েছে। তীরের ও-ই দূরপ্রান্তে ঝলমলে বেশ কিছু। আর্কলাইট দৃষ্টি কাড়ল রানার, প্রকাণ্ড কোন বোটহাউজ হবে হয়তো। বোটগুলোর অধিকাংশ ওদিকেই ছুটছে। স্কিফে,জেঁকে বসে, ঠেলা মেরে লেকে নামতে গিয়ে রানার ধারণা হলো, রুডলফ ব্রিগল বা তার লোকেরা ওই বোটহাউজটা থেকেই নৌকায় উঠবে। যদি না ব্রিগলের অর্গানাইজেশন, যেটা ক্রমেই আরও শ্রদ্ধা অর্জন করছে ওর, মোটরবোট ব্যবহার করে। কিন্তু সন্দেহ আছে রানার। ব্রিগল একা ভিলায় আসবে এটাও বিশ্বাস করে না ও। লোকটা অসম্ভব ধুরন্ধর।
ঘুরপথে নৌকা চালিয়ে, লেক সাইড থেকে দ্বীপটার উদ্দেশে অগ্রসর হচ্ছে রানা। ভাগ্য ভাল, নিয়মিত তেল দেয়া হয় ওরলকগুলোতে। ফলে শব্দ হচ্ছে খুব সামান্য। প্রথম পাঁচ মিনিট পাড়ের কাছাকাছি থাকল ও। চোখ-কান খোলা রেখেছে। বাতাসে দোল খেয়ে ধীরেসুস্থে যেটুকু পারে নিজে থেকে এগোচ্ছে নৌকাটা। বাতাস আজকে বড় খেল দেখাচ্ছে। প্রায় প্রতি মিনিটেই পরিবর্তন করছে দিক। দ্বীপের দিক থেকে যখন বইছে মিউজিকের সুর। আবছাভাবে কানে আসছে রানার। মেরী কি রেডিও বাজাচ্ছে, না স্টিরিও?
কাদা-পানিতে নৌকা ঠেকতেই নেমে পড়ল রানা, টেনে ওটাকে তুলে আনল পাড়ে। কূল থেকে পঞ্চাশ ফুট ভেতরে পর্বতমালার শুরু। পেন্সিল লাইট জ্বেলে, শেষমেষ ঊর্ধ্বমুখী একটা বন্ধুর পথ আবিষ্কার করল রানা। পাঁচ মিনিট বাদে দেখা গেল ভিলার পেছনে, গাছ-পালার আড়ালে পৌঁছে গেছে ও। আলোয় উদ্ভাসিত কিচেনের জানালাগুলোর দিকে চেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। রানা।
আলোকসজ্জা যেন গোটা বাড়ি জুড়েই। ওপরে-নিচে সর্বত্র। মেরী, এখনও যদি এখানে থেকে থাকে, ঝড়ো রাত্রির সঙ্গে ধুন্ধুমার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। রাতের বেলা লাইটহাউজের মতন দেখাচ্ছে ভিলাটাকে। মিউজিকের শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে এখন রানা। স্ট্রাউস ওয়ালয বাজছে।
রানা অপেক্ষমাণ, সেটআপটা পছন্দ করতে পারছে না মোটেই। অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান অনুপস্থিত। ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ডের পেছনে ছায়ার কোন। নড়াচড়া নেই। জানালায় এসে একবারও দাঁড়াচ্ছে না মেরী পেটি। নিথর-নিস্তব্ধ ভিলা রিকো। উজ্জ্বল আলো আর মিউজিকের শব্দ ছাড়া যেন আর কিছুর অস্তিত্ব নেই।
রানার গায়ে কাঁটা দিল। সতর্কসঙ্কেত। যেন কোলাহলমুখর.. আলোকসজ্জায় সজ্জিত এক সমাধি স্তম্ভের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক সুনসান, জনমানুষের সাড়া-শব্দ নেই কোথাও।
তবুও গাছের আড়ালে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। ছায়ার আড়াল নিয়ে রায়ে সরে গেল রানা। কুঁজো হয়ে দৌড়ে ভিলাটাকে একবার পাক খাবে। সুন্দরবনের মাওয়ালীর দক্ষতায় মুভ করছে ও, পা ফেলছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত সন্তর্পণে। ভিলা থেকে বেরোনো দুটো রাস্তাই পরীক্ষা করে দেখল রানা, সতর্ক। কিছু নেই। কোন ওয়াচার নেই। অপেক্ষা করছে না। কেউ। ভিলাটা বাজনা বাজাচ্ছে, আলোর সাজে সেজেছে অথচ তারপরও আধার ও নৈঃশব্দের চাইতে অনেক বেশি ভীতিকর মনে হচ্ছে এটাকে রানার কাছে।
চক্করটা শেষ করল রানা। আবার শুরুর জায়গায় ফিরে এসেছে। বেল্টে লুগারটা ঠিকমত আছে কিনা পরখ করার জন্যে এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়াল। দেখে নিল গ্যাস বম ও স্টিলেটোটাও রয়েছে বহাল তবিয়তে। এবার ভিলার কিচেন, ডোরটার উদ্দেশে ছুট দিল। এখন জানা যাবে। শীঘ্রি।
ফক্কা। স্ক্রীন ডোর টেনে খুলে প্রশস্ত কিচেনটায় সেঁধিয়ে পড়ল রানা। থমকে দাঁড়াল ওখানে কাঠ-পুতুলের মতন। মেঝের ঠিক মাঝখানে পড়ে থাকা জিনিসটার ওপর নিবদ্ধ হলো দৃষ্টি। গলার কাছে একটা দলা উঠে এসেছে অনুভব করল। বুকটা টনটন করে উঠল ব্যথায়। বড় হাসিখুশি ছিল মহিলা!
প্রাণপণ লড়ে মৃত্যুবরণ করেছে মেরী পেটি। ঝকঝকে টালির মেঝেতে ছিন্নবাস পুতুলের মতন পড়ে রয়েছে ও। দেখে বোঝা যায় ধর্ষণ করা হয়েছে। বেরিয়ে আছে সুডৌল দুই উরু, হাত দুটোয় এখনও থাবা মারার ভঙ্গি। দৃষ্টি ওর চলে গেছে পেছন দিকে। চোখের চকচকে সাদা অংশ দুটো ছাদের দিকে নিথর একদৃষ্টে চেয়ে।
দরজার কাছ থেকে সরে এল রানা, দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হলো। বাড়ির সামনের দিকে কোথাও রেডিওটা বাজছে। কন্টেসার স্টাডিতে। খুব সম্ভব। ভিলার চারধারে ভাসা-ভাসা পর্যবেক্ষণ চালানোর সময় একটা টেলিফানকেন দেখেছিল ওখানে মনে আছে রানার।
কিচেনটা ত্বরিত পার হয়ে মেয়েটির পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ও। প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই। একটা চরম ক্রোধ ফেনিয়ে উঠছে ভেতরে, টের পাচ্ছে রানা। কেন? এবং কে? ও নিশ্চিত, রুডলফ ব্রিগলের সঙ্গে কোনক্রমেই জড়িত ছিল মেরী। ওমর ছিল ব্রিগলের লোক, এবং এখন সে বোটহাউজে পেট ফুলে ভাসছে।
দ্বীপে তাহলে আর কেউ ছিল? কে? এখনও কি আছে?
শুনতে পেল রানা। তবে অসময়ে। ওর অসাধারণ রিফ্লেক্সও এযাত্রা রক্ষা করতে পারল না ওকে।
স্টোররুমের দরজা খুলতে ক্যাচ করে উঠেছিল কব্জা।
ঘাড়ের পেছনে ঠাণ্ডা, ধাতব কিছুর স্পর্শ অনুভব করল রানা।
দয়া করে মাথার ওপরে হাত দুটো তুলুন, মিটার রানা।
.
১১.
হাত তুলে ঘুরে দাঁড়াল মাসুদ রানা। ধীরে ধীরে।
পেছনে সরে গেল হিদেভোশি নাকাতা। রানার বুক বরাবর স্থির-অকম্প ওর পিস্তল, যদিও জাপানীটাকে ভারসাম্য রক্ষা করতে হেলান দিতে হচ্ছে একটা চেয়ারে। সাগর থেকে উঠে আসা পিশাচের মতন দেখাচ্ছে ছোটখাট লোকটাকে। কোট ও টাই দেখা গেল না ওর। শার্টটা ওর কাদায় মাখামাখি আর শতচ্ছিন্ন। পায়ে জুতো নেই পিস্তলধারীর। সেদিনের ইস্তিরি করা। ধোপদুরস্ত ট্রাউজার এখন ফুটপাথে ঘুমিয়ে থাকা ভবঘুরেদেরও লজ্জা দেবে।
সময়ক্ষেপণ করবে, সিদ্ধান্ত নিল রানা। খুব চুবানি খেয়েছ, বলল ও। নাকাতার দিকে সরল মুখ করে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ব্রিগলের কাজ বুঝি?
খাঁটি ঘৃণা ঝরে পড়ল নাকাতার চোখ থেকে। বাদরমুখো চেহারাটা হলদে পার্চমেন্টের মত সেঁটে রয়েছে খুলির নিচে। লোকটার সামনের পাটির দাঁত গায়েব।
আমি জানি তুমি সঙ্গে অস্ত্র রাখো, মিস্টার রানা, আস্তে আস্তে বলল। নাকাতা, ঢলঢলে ঠোঁটজোড়া যন্ত্রণার সঙ্গে বাঁকিয়ে। এতক্ষণ যে চেয়ারটায় ঠেস দিয়ে ছিল ধীরে ধীরে বসে পড়ল ওটায়। রানার পেটের দিক থেকে লক্ষ্যচ্যুত হলো না পিস্তলটা এক মুহূর্তের জন্যেও। আমি জানি তুমি সশস্ত্র, বলে চলেছে নাকাতা। কাজেই হাত একটুও নিচে নামিয়েছ তো বিচি উড়ে যাবে। পিস্তল দিয়ে রানার তলপেটের নিচটা ইঙ্গিত করল ও। যেখানে মেরেছিলে আমাকে ঠিক সেখানেই গুলিটা করব আমি। ভয়ঙ্কর ব্যথা দিয়েছিলে, রানা-এখনও যায়নি। তোমার সঙ্গে যন্ত্রণাটুকু শেয়ার করতে পারলে আমার খুশির সীমা থাকবে না।
গা জ্বালানো হাসি উপহার দিল ওকে রানা। তুমি কি কাজটা করতে গেছিলে মনে করে দেখো। যেমন কর্ম তেমনি ফল।
রানা অতিরিক্ত জুয়া খেলে ফেলছে নিজেও বুঝতে পারছে নাকাতা ওকে এখনই খুন করবে না কেবলমাত্র এই সাহসে জুয়াটা খেলছে ও। আর এই সুযোগে নাকাতাকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে তোলার চেষ্টা করছে।
মুহূর্তের জন্যে নাকাতার হলদেটে তর্জনীটা চেপে বসেই আবার শিথিল হয়ে গেল পিস্তলের ট্রিগারে। ভয়ানক বেদনা উপেক্ষা করে, দন্তহীন হাসি পর্যন্ত। হাসতে বাধ্য হলো বেচারা। তুমি খুব সাহসী লোক, মিস্টার রানা। নাকি বোকা? এখনও মনে করছ তুমি ডিকটেট করার পজিশনে আছ?
এখনও হাত শূন্যে ভোলা মাসুদ রানার। আর কেউ হলে এতক্ষণে কাপ ধরে যেত শরীরে। কিন্তু রানা জানে, চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে সে।
আমার বিশ্বাস একটা বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত আমিই বস, বলল। আমার কাছে যেটা আছে সেটা ছাড়া তুমি জিরো, নাকাতা। রুডলফ ব্রিগলের কাছে। তোমার এখন এক কানাকড়ি মূল্য নেই। ও তোমাকে খতম করে দেবে জেনে গেছ নিশ্চয়ই? আমাকে তো তাই বলল।
জ্বলে উঠল নাকাতার খুদে চোখজোড়া। জানি। রুডলফ ব্রিগল একজন হঠকারী জার্মান-খানিকটা বোকাও বটে। আমি বোকা বানিয়েছি তাকে তার কারাগার থেকে পালিয়েছি।
মুখের চেহারায় অকৃত্রিম প্রশংসা ফুটিয়ে তুলল রানা। তবে সতর্ক রইল বাংলা নাটকের মত অতি অভিনয় না হয়ে যায়। এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে ও, নাকাতা জানে না ব্রিগলের লোক আজ রাতে ভিলায় আসছে।
কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে খেই ধরল রানা। কিভাবে পালালে বুঝতে পারছি না, বলল ও। তুমি গুণী লোক সন্দেহ নেই। রানা আশা করছে ব্রিগলের লোকেরা এসে নাকাতার হাত থেকে বাঁচাবে ওকে।
খুশিতে মাড়ি বের হয়ে পড়ল নাকাতার। ফলে, রানার পক্ষেও হাসি চাপা দায় হলো। আমাকে যেখানে আটকে রেখেছিল ওখানে একটা এয়ার গ্রেটিং ছিল, পরিখাটা যখন গভীর ছিল এবং পানির উচ্চতা যখন কম ছিল, সেই তখন থেকেই। এখন পরিখায় পানি বেড়ে গেছে আর ঝাঁঝরির শেষপ্রান্ত এখন পানির নিচে। গর্দভগুলোর মাথায় আসেনি.ছোটখাট যে কোন মানুষ সামান্য ফাঁক পেলেই গলে বেরিয়ে যেতে পারে। আর শ্বাস ধরে রেখে সাঁতার কাটা তো কোন ব্যাপারই না। ঠিক তাইই করেছি আমি। তোমাকে এখানে পাব ভাবলাম। কারণ মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখছে ব্রিগলের লোকেরা। এ জায়গাটার কথা জানে ব্রিগল-বহু বছর ধরে জানে মেয়েটা আসে এখানে। এই দ্বীপে ব্রিগল বহু আগেই তার লোক প্ল্যান্ট করেছে।
রানার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক বাছাই করা শব্দগুলো গেঁথে নিল পরিখা জেলখানা-বাতাস চলাচলের ঝাঁঝরি। রুডলফ ব্রিগল নিশ্চয়ই কোন না কোন দুর্গে ঘাঁটি গেড়েছে। কিন্তু রানার তাতে সুবিধে হবে না বড় একটা। এদিকে প্রাচীন দুর্গের ছড়াছড়ি।
আর ব্রিগল খুন করবে মেয়েটাকে তাই না?
মাথা ঝাঁকাল নাকাতা। রেডি হলে পর। মেয়েটা ওর নতুন চেহারা দেখে ফেলেছে। ওকে খুন না করে উপায় নেই ব্রিগলের। শক্রর শেষ রাখে না সে।
রানা বিস্মিত। কিন্তু তুমি-তুমিও তো ওর নতুন মুখ দেখেছ।
ওকে অবাক করে দিয়ে মাথা নাড়ল নাকাতা। দেখিনি। যখনই দেখা হয়, কথা হয়, মুখোশ পরে থাকে ও। সে-ই ভাল। ও দেখতে কেমন জানার দরকার নেই আমার। জেনে ফেললেই তো মেরে ফেলার অজুহাত পেয়ে যাবে।
তোমাকে ও এমনিতেই মারবে, নাকাতা। আমাকে বলেছে। চাবিটা ছাড়া তুমি ফোতো কাপ্তেন।
চাবির অংশটা ছাড়া আমার কোন দাম নেই জানি, বিরস কণ্ঠে বলল নাকাতা। গুঙিয়ে উঠল ব্যথায়। কিন্তু ওটা হাতে চলে এলে আমাকে আবারও প্রয়োজন হবে ওর। লুটের মাল হাত করে, যে যার ভাগ নিয়ে কেটে পড়ব। বাজে কথা অনেক হলো। খুব ক্লান্তি লাগছে আমার। এবার বলে ফেলো তো, বাছা, ফ্রেঞ্চ কী-টা কোথায় রেখেছ?
যেখানে রাখলে কেউ খুঁজে পাবে না, শীতল কণ্ঠে বলল রানা। আর কত চাপাবাজি করবে, নাকাতা? নিজেও ভাল করে জানো আমাকে খুন করার উপায় তোমার নেই। কাজেই আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। পিস্তলটা নামিয়ে রেখে আমার কথা শোনো। আমরা দুজন মিলে হয়তো একটা বুদ্ধি বের করে ফেলতে পারব। তুমি ব্রিগলের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাও, কি, ঠিক না? সোজাসাপ্টা একটা চাল, এতে কাজ হবে আশা করেনি রানা।
কাজ হলোও না।
হলদেটে মুখ কঠোর হলো নাকাতার। কথার গুরুত্ব বাড়াতে রানার দিকে পিস্তলটা ঝাঁকি দিল সে। তুমি সময় নষ্ট করার খেলা খেলছ, রানা। কেন; তা বুঝতে পারছি না। এখানে কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না। আমার ধৈর্যের। বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। এখনও বলে ফেলো চাবিটা কোথায়-নইলে কাতরানি ছাড়া মুখে কথা ফুটবে না। তোমাকে মেরে ফেলার জন্যে আমার হাতে পায়ে ধরবে তখন। কিন্তু অত সহজে তোমাকে মুক্তি দেব না আমি, রানা। তিলে তিলে কষ্ট দেব-তারপর চাবির খোঁজ পেলে চেক করে দেখর মিথ্যে বলেছ কিনা। যদি দেখি সত্যি কথা বলেছ, তখন মুড ভাল থাকলে হয়তো মৃত্য দিতে পারি তোমাকে!
ব্যথা করতে শুরু করেছে রানার হাত। কিন্তু মাথার ওপর অকম্প রাখল সে ও দুটো, জাপানীটাকে গুলি করার কোন অজুহাত দিতে রাজি নয়। নাকাতার, শেষের কথাগুলো রানার মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা এক স্রোত বইয়ে দিয়েছে। লোকটা জেলখাটা দাগী আসামী। কিচেনে, ছয় ফিটও দূরে হবে না, পড়ে রয়েছে মেরী পেটির লাশ। চকিতে মৃতদেহটা একবার দেখে নিল রানা। ব্রিগলের লোকেদের আসতে আর কত দেরি? নাকাতাকে আরও কিছুক্ষণ কথায় ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে দেখবে নাকি?
মৃত মেয়েটির দিকে মাথা ঝাঁকাল রানা। ওই বেচারীকে অযথা মারতে গেলে কেন? ও তো এসবের মধ্যে ছিল না।
রানার দিক থেকে একবারের জন্যেও নড়ল না নাকাতার স্থির দৃষ্টি। লাশটার দিকে ও একবার চাইল না পর্যন্ত। শালীকে একটু আদর করতে গেছি তো ভয় পেয়ে এমন চেঁচামেচি শুরু করে দিল। আর গায়ে শক্তিও রাখত মেয়েলোকটা-গলা টিপে মারতে দম বেরিয়ে গেছে আমার। খুন না করলে ওকে ভোগ করতে পারতাম না। আর ছেড়ে দিলেই আক্রমণ করে বসত। কাজেই না মেরে উপায় কি?
যৌন বিকারগ্রস্ত লোকটার কথা শুনে হাঁ হয়ে গেল রানা।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অস্ফুট গোঙানী বেরিয়ে এল নাকাতার মুখ দিয়ে। কিন্তু ও ভাগ্যবতী, রানা। তাড়াতাড়ি মরেছে। চাবির খোঁজ না; দিলে তোমার কপালে কিন্তু অত সুখ নেই। কই, চলো! আমরা একসঙ্গে যাব, কাজেই মিথ্যে বলে লাভ নেই। ওটা আমার হাতে তুলে দেবে তুমি।
কিন্তু তুমি জানলে কি করে যে ওটা আমার কাছে আছে? রানা প্রশ্ন করল।
ব্রিগলের লোক আছে দ্বীপে। সে মোর্স সিগন্যালে জানিয়েছে। ব্রিগলের মুখ থেকে কথাটা জেনে ভাবলাম একটা চান্স নিয়ে দেখি না। যদি টুকরোটা উদ্ধার করতে পারি তো আমাকে আবার মাথায় তুলে রাখবে ব্রিগল। তাই বলছি ভাল চাও তো চাবিটা মানে মানে দিয়ে দাও।
মুখের চেহারায় ভীতির ও হতাশার ছাপ ফুটতে দিল রানা। তারপর? তারপর আমার কি হবে?
ধীরে ধীরে নিষ্ঠুর এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে পড়ল নাকাতার মুখে। কি আবার হবে, মরবে। তবে কথা দিচ্ছি, কষ্ট দেব না। মগজের মধ্যে একটামাত্র বুলেট।
দরাদরির সুযোগ পাচ্ছি না তারমানে, বলল রানা। আর ধরো, যদি না দিই?
দুর্বল হলেও ভয়ঙ্কর দেখাল নাকাতার হাসিটা। আফসোসের শেষ থাকবে না। মিস্টার রানা-আর একটা কথাও না। টু শব্দ করেছ কি সবচেয়ে নরম জায়গাটায় গুলি করব। রানার ঊরুসন্ধি লক্ষ্য করে পিস্তল তাক করল নাকাতা।
দশ পর্যন্ত গুনব,বলে চলেছে জাপানী। আস্তে আস্তে গুনব দশ পর্যন্ত। এর মধ্যে চাবিটা কোথায় না বললে গুলি করব-ঠিক ওখানটায়। মরবে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাবে, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে। তখন ছোট্ট একটা খেলা খেলব আমি। ছুরি দিয়ে কেচে মোরব্বা বানাব তোমাকে। বেশি না মাত্র এক হাজার বার কাচা হবে তোমাকে।
পৈশাচিক ও ধর্ষকামী প্রতিক্রিয়ার মিশেল এখন নাকাতার মুখের চেহারায়। পিছে সরে গেল ও আলগোছে, চোখ সরাল,না মাসুদ রানার চোখ থেকে। পেছনে হাত ঢুকিয়ে দিল ও ক্যাবিনেটের এক ড্রয়ারে, বের করে আনল চকচকে লম্বা এক বুচার নাইফ। রানাকে উদ্দেশ্য করে দোলাতে আলো লেগে ঝিকিয়ে উঠল ফলাটা। একটু একটু করে কাটা হবে, মিস্টার রানা। নাকের। একটু অংশ। কানের লতিটা। ঠোঁটের একটা পাশ। মুখ খোলার আগে কতটুকুই আর বাকি থাকবে তোমার?
রানার কান নাকাতার চাইতে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ। প্রখর যে-কোন সাধারণ মানুষের চাইতে। শুনতে পেল ও, কে যেন, পা টিপে টিপে পেছন দরজার দিকে এগোচ্ছে। ব্রিগলের লোক। হয়তো ফাড়া কাটবে, হয়তো না। কি হতে যাচ্ছে কে জানে। অবস্থা এরচেয়ে গুরুতর হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। ক্ষণিকের জন্যে হলেও একটা ডাইভার্শন কামনা করছে রানা। সঙ্গে অস্ত্র আছে এখনও ওর। বলা যায় না, ওগুলো ব্যবহার করার সুযোগ হয়তো পেয়েও যেতে পারে।
নাকাতার মনোযোগ বাকি সেকেন্ডগুলোর জন্যে ধরে রাখার জন্যে বলল, ও, তোমাকে খুন না করে মস্ত ভুল করেছি আমি। ভেবেছিলাম মারা পড়েছ তুমি। কিন্তু তোমার যে পাখনা আছে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি।
মুখ বাঁকাল নাকাতা। আমার কপাল ভাল। একগাদা বাক্স ছিল ওখানে। ওগুলোর ওপর পড়ায় বেঁচে গেছি। ব্রিগলের লোকেরা আমাকে খুঁজে পেয়ে দুর্গে নিয়ে যায়। এক…দুই…তি…
দরজার কাছ থেকে এসময় বিস্ফোরিত হলো এক ঝাঁক গুলি। আর্তনাদ ছেড়ে পই করে ঘুরে গেল নাকাতা, পিস্তলটা হাত থেকে উড়ে গিয়ে মেঝেয়। পড়ল। পা হড়কে কিচেনের পিচ্ছিল মেঝেতে পড়ে সমানে লাথি ছুঁড়তে লাগল ও, খাবলা মেরে বুক থেকে খুনে বুলেটগুলো বের করার চেষ্টা করছে।
ট্রিলবি হ্যাট পরপর আরও তিনবার ফায়ার করল। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে। শরীর একবার মোচড় খেল নাকাতার, দাঁতহীন মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত। অব্যক্ত যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠে জড়ানো গলায় কি যেন বলল মাতৃভাষায়। তারপর নিথর হয়ে গেল। পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেছে হিদেতোশি নাকাতা।
.
১২.
থামো! থামো!
গর্জে উঠল মাসুদ রানা। বিদ্যুৎগতিতে লুগার ও গ্যাস বোম এসে গেছে ওর হাতে। ডান হাতে লুগারটা ওর, মাযুল খানিকটা নিচের দিকে নামানো। বা হাতের তালু খুলে মারাত্মক খুদে বোমাটা দেখাল ও।
ব্রিগল আমার লাশ চায় না, আমাকে চায়, তড়িঘড়ি বলল রানা। আমিও তোমাকে খুন করতে চাই না। আমাকে গুলি করলেও এটা ঠিকই ছেড়ে দেব হাত থেকে-এক পা-ও যেতে পারবে না, মরে পড়ে থাকবে। কাজেই কেউ মাথা গরম করছি না! তা
নাকাতার বিকৃত মৃতদেহের ওপাশে লোকগুলোর দিকে চাইল রানা। কিচেনের দরজায় ট্রিলবি ও তার পেছনে আরও দুজন।
ট্রিলবি হ্যাট আস্তে আস্তে মেঝের দিকে নামাল তার পিস্তলের নল। লেদার উইন্ডব্রেকারের পরিবর্তে ট্রেঞ্চ কোট গায়ে তার। জা, জার্মান টানে বলল সে। বার্থোন্ড-রিডলে! শুনতে পেয়েছ?
জা, সঙ্গীরা মৃদু স্বরে জানাল পেয়েছে। পকেট থেকে হাত বের করে কিচেনের ভেতরে পা রাখল ওরা। কিচেন টেবিলের চারধারে রাখা চেয়ারগুলো ইশারায় দেখাল রানা। নাকাতা যে চেয়ারটায় হেলান দিয়েছিল সেটা তুলে নিয়ে দুরে গিয়ে বসল। ধীরে সুস্থে, পরম সতর্কতার সঙ্গে লুগারটা পাশে, মেঝেতে। নামিয়ে রাখল। কিন্তু গ্যাস বমটা এমনভাবে রেখে দিল বা হাতে যাতে লোকগুলো দেখতে পায়।
এসো, সামান্য গল্প-গুজব সেরে নেয়া যাক, বলল রানা। তোমরা আরাম করে বসো। কিছু খাওয়াতে পারছি না বলে দুঃখিত। দেখতেই পাচ্ছ, আমাদের মেইড বেচারী ভয়ঙ্কর এক অ্যাক্সিডেন্টের শিকার হয়েছে। মেরী পেপটির লাশটা ড্র উচিয়ে দেখাল রানা। শান্ত-শিষ্ট ভিলাটায় হঠাৎ করে, ভাবল রানা, লাশের মেলা বসে গেছে যেন।
মৃত মহিলাটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল ট্রিলবি হ্যাট। এবার দৃষ্টি ফেরাল রানার উদ্দেশে। কাজটা কার?
নাকাতার লাশ দেখাল রানা তর্জনী তুলে। তোমাদের দোস্তের।
কিচেনের ঝকঝকে মেঝেতে গুথু ফেলল ট্রিলবি। স্কিউইন।
সায় জানাল রানা মাথা ঝাঁকিয়ে। ভোতা নাক, ফোলা ঠোঁটওয়ালা ট্রিলবি। হ্যাটকেও ওর চোখে যে শুয়োরের মতন দেখাচ্ছে সে কথা আর বলল না। পা আড়াআড়ি করে আয়েশ করে বসল রানা, আশা করল ইঙ্গিতটা বুঝে ওরাও তাই করবে।
একটা সিগারেট খাওয়া দরকার ছিল, বলল রানা ওদেরকে উদ্দেশ্য করে। পকেটে হাত ঢুকালে তোমরা আবার গুলি ফোঁটাতে শুরু করবে না তো?
দুমুহূর্ত স্থির চোখে ওকে জরিপ করে নিল ট্রিলবি হ্যাট। এই অদ্রত লোকটার কোন তল খুঁজে পাচ্ছে না ও। কিন্তু মুখে বলল, বেশ। আমরা সবাই তোক করব। সযত্নে টেবিলে নামিয়ে রাখল লোকটা পিস্তল। নলটা রানার দিকে তাক করে, পকেট থেকে বের করল সিগারেটের প্যাকেট। ওর দুসঙ্গীও একই কাজ করল, পলকের জন্যেও চোখ সরাল না রানার দিক থেকে। রেইনকোট ও নরম ফেল্ট হ্যাট পরা গাঁট্টাগোট্টা দুজন জার্মান। হোটেল হিলসনের বাইরে এ লোক দুটোই পাহারা দিচ্ছিল, এবার চিনতে পারল রানা। নিষ্ঠুর-নির্দয় মুখের চেহারা ওদের।
নীলচে ধোয়ার মেঘ ছুঁড়ে দিল রানা সিলিং লক্ষ্য করে। বুকে এল সামনে। এবার কাজের কথায় আসি, কেমন? ব্রিগল নিজে আসেনি ধরে নিতে পারি নিশ্চয়ই?
কঠোর চাহনি হানল ট্রিলবি রানার উদ্দেশে। বস তোমাকে দুর্গে নিয়ে। যাবার জন্যে আমাদের পাঠিয়েছেন। তুমি স্বেচ্ছায় যাবে আশা করি, এবং বস্ যেটা চাইছেন সেটাও সঙ্গে নেবে। জা?
নেইন, পাল্টা চোখ কটমট করে চাইল রানা। আমি রেডি হলে তারপর দুর্গে যাব, তার আগে নয়। শিগগিরিই যাব, তবে তোমাদের সঙ্গে নয়। আমার কাজ আছে এখানে। মেরীর লাশটা ইশারায় দেখাল ও। ওর একটা হিল্লে করব আগে। আর কিচেনটা সাফ-সুতবোও করতে হবে-পুলিসের হাতে কোন সূত্র তুলে দিতে চাই না আমি।
উদ্ধত চোখে তাকাল রানার দিকে ট্রিলবি। আমাদের ওপর অর্ডার আছে। তোমাকে নিয়ে যাব আমরা আর তুমি সাথে নেবে বসের সম্পত্তি।
ব্যঙ্গের হাসি হাসল রানা। ভালই বলেছ-বসের সম্পত্তি! সরি, আমি যেমন বললাম সেভাবেই হবে। তোমরা রওনা দাও, আমি এখুনি আসছি। আগে একটা কল দেব আমি, যাতে সে রেডি থাকতে পারে। দুর্গে ফোন আছে। নিশ্চয়ই?
আছে, জানাল লোকটা। কিন্তু তুমি আমাদের সঙ্গে গেলে ভাল
যাব না, চাবুক আছড়ে পড়ল রানার কণ্ঠে। গ্যাস বোমাটা শূন্যে এক ফুট ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিল। তিনজোড়া ভয়ার্ত চোখ ড্যাবড্যাব করে লক্ষ করল দুঃসাহসিক কাণ্ডটা। আমি ভাল জাগলার, বলল রানা। কিন্তু তোমরা তর্কাতর্কি করতে থাকলে হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে পারি। আমরা কেউই সেটা চাই না, ঠিক না। কাজেই খেলাটা আমার নিয়ম মেনেই হবে।
শর্তসাপেক্ষ আত্মসমর্পণ করল ট্রিলবি। জা। মেনে নিলাম। কিন্তু ভুলে যেয়ো না মেয়েটা আমাদের হাতে। আর যখন যাবে সঙ্গে যেন কোন অন্ত্রপাতি না থাকে। দুর্গে ঢোকার আগে সার্চ করা হবে তোমাকে। থরো সার্চ–সব কাপড়-চোপড় খুলে। বুঝতে পেরেছ,
বাঁকা হাসল রানা। এখন ফোন নম্বরটা লিখে দিয়ে কেটে পড়ো তো, বাছাধনেরা। আর হ্যাঁ, ওটাকে নিয়ে যেয়ো। নাকাতার লাশটার দিকে ইঙ্গিত করল ও।
সঙ্গীদের উদ্দেশে ঘোঁৎ করে হুকুম জারি করল ট্রিলবি। রানার সামনে থেকে সরে, সতর্কতার সঙ্গে লাইন অভ ফায়ার এড়িয়ে, দুজনেই নাকাতার একটা করে পা চেপে ধরল। এবার পেছনের দরজা দিয়ে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে গেল। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে লোকটার। ফলে কিচেনের মেঝেতে বড়সড় এক রক্তের দাগ রয়ে গেল।
পকেট থেকে নোটবই বের করে, খসখস করে দ্রুত হাতে কি সব লিখল ট্রিলবি। ফড়াৎ করে পাতাটা ছিঁড়ে বাড়িয়ে দিল রানার উদ্দেশে। এই নাও ফোন নম্বর। দুৰ্গটা রোন নদীর ওপর। ব্রিসন অ্যাভেনিউয়ের শেষ মাথায়। চিনতে পারবে।
কোন কারণ নেই না চেনার। জেনেভার ম্যাপ ভেজে খেয়ে তারপর এসেছে রানা। মাথা ঝাঁকাল। চলে যাব। শহরের পুবদিকে তো? মোন যেখান থেকে শহরে ঢুকেছে।
জা। ওস্ট।
.
হাতঘড়িতে চোখ রাখল রানা। সোয়া দশটা। প্রচুর কাজ বাকি, সময়ও খুব। কম। বিদায় নেয়ার আগে শেষবারের মত শাসিয়ে গেছে ট্রিলবি। রানাকে কোন জারিজুরি খাটাতে নিষেধ করে দিয়েছে। খোলাখুলি শুনিয়ে গেছে দুর্গের টর্চার চেম্বারের হুমকি।
তাড়াহুড়ো করে কাজ সারছে রানা, বালতি ও মপ খুঁজে নিয়ে মুছে ফেলল। নাকাতার রক্ত। মেরী, পেটির লাশ ওর সুইটে বয়ে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল বিছানায়। শীটটা টেনে দেয়ার আগে শেষবারের মত একনজর দেখে নিল মুখটা। নিষ্পাপ একটা মানুষকে জীবন দিতে হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শীটটা মুখ পর্যন্ত টেনে দিল রানা। সান্তনা এটুকুই, শান্তি পেয়েছে মেরীর হত্যাকারী। এবার আসল কাজ। সময় উড়ে যাচ্ছে। ওর পাতা গজানো প্ল্যানটাকে পুষ্পশোভিত করতে হলে কাজে নামতে হবে এখুনি।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ তো নয়, রানা ভেবে উঠতে পারেনি এমন কেঁপে বৃষ্টি নামবে। ওমরের কামরায় গিয়ে, কালো রবারের এক তাবু-সমান ওয়াটারপ্রাফ আবিষ্কার করল ও। বাঁচা গেছে। এখন আর বৃষ্টিতে ভেজার ভয় নেই এবং এটা গায়ে দিয়ে আঁধারে চমৎকার মিশেও থাকা যাবে।
পকেট থেকে বড় এক প্লাস্টিসাইন পাউচ বের করল রানা। লুগার, গ্যাস বোমা ও স্টিলেটো স্থান পেল ওটার মধ্যে। পাউচটা বেল্টে গুঁজে রাখল রানা। বাথরুমগুলোর একটা থেকে বেশ কটা তোয়ালে বের করল ও। ওমরের অতিকায় ওয়াটারপ্রাফটা পরে নিল। এবার ভিলার প্রতিটা বাতি নিভিয়ে, ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, সঙ্গে জোর বাতাস। কবরের অন্ধকার চারদিকে। বাতাসের ঝাঁপটায় ঠাণ্ডা পানির ছিটে এসে নাকে-মুখে লাগছে। বাতাসে ফোপানির শব্দ, আঁধারে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রানা। বাতাসের গোঙানি ছাপিয়ে, আবছাভাবে কানে আসছে একটা আউটবোর্ড মটরের একটানা ভটভট শব্দ। ট্রিলবি তার চালাদের নিয়ে দ্বীপ ছেড়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা এক টুকরো হাসি ফুটল মাসুদ রানার কঠোর মুখে। নাকাতাকে ওরা ভালমতন চুবিয়ে দিয়ে গেলেই হয়।
এক ঘণ্টা পর, নির্জন অ্যাভিনিউ ব্রিসন থেকে বাঁক নিয়ে, রানার জাগুয়ার প্রবেশ করল সরু এক লেনে। ব্রানহিল্ড দুর্গের পেছন দিয়ে গেছে রাস্তাটা।
বাতি নিভিয়ে ড্রাইভ করছে এখন রানা। প্যাচপেচে কাদাময় পথটা, টায়ারের চাপে দেবে যাচ্ছে, গাড়িতে বসেই অনুভব করতে পারছে। বাতাসের দোলায় আন্দোলিত এক ঝাড় গাছের কাছে এসে ফুরিয়ে গেল রাস্তাটা। এঞ্জিন বন্ধ করে ক্যানভাসের ছাদে বৃষ্টির বোল শুনছে রানা। প্রতি মুহূর্তে আরও বিশ্রী রূপ নিচ্ছে রাতটা-এবং মনে মনে খুশি হয়ে উঠছে রানা।
জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট্ট একটা টিন বের করে মুখে কালো রঙ মাখতে লাগল রানা। চর্বিহীন রঙটা চাইলেই তুলে ফেলা যাবে। রিয়ার ভিউ। মিররে এক ঝলক চাইবার ঝুঁকিটুকু গ্রহণ করল ও, পেন্সিল-বীম টর্চটা জ্বেলে। ওর চোখজোড়া ধক্ করে জ্বলে উঠল ওরই দিকে চেয়ে। বাপরে, শালার চোখ তো না-আগুন, মনে মনে আওড়াল রানা। ঢোক গিলে নিভিয়ে দিল টর্চ।
দ্রুতহাতে কাপড় ছাড়ল রানা, হোট গাড়িটার মধ্যে কোনমতে শরীর। মোড়ামুড়ি করে। শেষমেষ একজোড়া কালো শর্টস পরনে রইল ওর। পেস্ট মাখল এবার ও বাকি শরীরে।
অস্ত্রসহ ওয়াটারপ্রাফ পাউচটা ট্রাঙ্কসে গুঁজে নিল রানা। কাঁধ ঝাড়া দিয়ে গায়ে গলাল ওমরের অতিকায় রেইনকোট। প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন ওর। ঝাবিক্ষুব্ধ রাতে বেরিয়ে এসে গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিল আলগোছে। গদা পিটাচ্ছে বৃষ্টি এখন ওর গায়ে।
জাগুয়ারের পেছনদিকে চলে এল রানা। ট্রাঙ্ক খুলে বের করল খুদে এক ইনট্রেনশিং টুল। মনেপ্রাণে কামনা করছে প্রয়োজন পড়বে না কিন্তু বলা কি যায়। এবার ব্রানহিল্ড দুর্গের উদ্দেশে রওনা হলো আধারের পটভূমিডে অতিকায় এক দানবের মত দেখাচ্ছে বাড়িটাকে। জরুখুৰু হয়ে অপেক্ষমাণ যেন ঝড়ের মধ্যে।
কষ্টকর হলো পথ চলা। পায়ের নিচে বিপজ্জনক রকমের পিচ্ছিল কাদা। বার কয়েক হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রানী, মৃদু শাপ-শাপান্তু করল। ঘন ঝোপ ঝাড় ভেদ করে পা চালাতে হচ্ছে। কাটাঝোঁপের তীক্ষ্ণ নখর আঁচড় কাটছে ওর ওয়াটারপ্রাফে। শেষপর্যন্ত যার ভয় পাচ্ছিল সেটার কাছে এসে পৌঁছল রানাউ এক তারের বেড়া। ওটার ঠিক ওপাশেই, দুর্গের প্রাচীন অংশটা পড়েছে-মধ্যযুগীয় এক সুউচ্চ ভগ্নস্তূপ। ওটাকে ঘেরাও করে রেখেছে। কালিপোলা এক পরিখা। বিজলীর বিক্ষিপ্ত ঝলকানিতে ওটাকে অশুভ, অমঙ্গলকর দেখাল রানার চোখে।
ফেন্সটার অনেক পেছনে দাঁড়িয়ে ওটাকে বিচার করে নিল রানা। হয়তো ইলেকট্রিফায়েড, যদিও নিজের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না ভাবনাটা। অযথা ঝামেলা ডেকে এনে লোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে চাইবে না রুডলফ ব্রিগল।
ইলেকট্রিফায়েড না হলেও নিশ্চয়ই কোন না কোন ধরনের ওয়ার্নিং সিস্টেম। থাকবে। যেই ছোবে বেড়াটা অমনি দুর্গের ভেতরে কোথাও বেজে উঠবে অ্যালার্ম বেল।
একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে, ইনট্রেনশিং টুলটা নিয়ে সাবধানে কাজে। নামল মাসুদ রানা। দশ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল পর্যাপ্ত একটা ফাঁক, বেড়া স্পর্শ না করে, ওটার নিচ দিয়ে শরীর মুচড়ে ঢুকে পড়া যাবে। বৃষ্টিপাতের কারণে মাটি ভিজে আছে, সেজন্যে কৃতজ্ঞতা বোধ করল রানা।
ফেন্সের কাছে যন্ত্রটা রেখে দিল ও। ফেরার সময় তুলে নেবে। এবার চলে এল ও পরিখার কিনারে। ঠাণ্ডা পানি ছলাৎছলাৎ শব্দে এসে বাড়ি খাচ্ছে। পায়ের পাতায়। ওয়াটারপ্রাফটা মাথার ওপর তুলে ফেলেছে এসময়ে শুনতে পেল ওটা। আঁধারে পিলে চমকানো বুনো গরগর শব্দ।
কোত্থেকে ফুঁড়ে বেরোল ডোবারম্যানটা আল্লা জানে। লালাঝরা, কুচকুচে কালো এক হিংস্র বল্লম যেন। পাঞ্চোটায় জড়ানো ছিল রানা। ওটার পুরু রাবার এযাত্রায় গলাটা বাঁচিয়ে দিল ওর। অতর্কিত আক্রমণে মাটিতে ছিটকে পড়ল ও, খুনে কুকুরটার আশি পাউন্ড ওজনের নিচে ছটফট করছে।
মুহূর্তের জন্যে সর্বাঙ্গ হিম হয়ে গেল রানার। অপ্রস্তুত অবস্থায় বেমক্কা ধরা পড়েছে ও। লুগার, গ্যাস বোমা, স্টিলেটো-সবই রয়ে গেছে বেল্টে গোঁজা। পাউচে। সময় নেই, কুকুরটা এখন তর্জন-গর্জন শুরু করে দিলেই মরেছে।
কিন্তু ডাক ছাড়ল না ডোবারম্যান। গলার গভীর থেকে মৃদু খ্যাক-খ্যাক শব্দ করেই বেজায় সন্তুষ্ট। ওয়াটারপ্রুফ থেকে ঝকঝকে দাঁত ছাড়িয়ে রানার দিকে তেড়ে এল আবার। দীর্ঘ, সাদা দাঁত ওটার ঝিকাচ্ছে। ওয়াটারপ্রুফটা একপাশে ছুঁড়ে দিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল রানা, জানোয়ারটা দ্বিতীয়বার আঘাত হানতে গড়ান দিল ওটাকে নিয়ে।
খালি হাতে খুন করতে হবে কুকুরটাকে। ডোবারম্যানটার চকচকে গলা। এক হাতে জড়িয়ে ধরল রানা, বলিষ্ঠ পেশিতে দাবিয়ে দিল আঙুল। অপর হাতটাকে নিয়ে এসে চাপ দিতে না পারা অবধি, লালাঝরা জানোয়ারটাকে দুরে সরিয়ে রাখতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হলো। অমানুষিক নিষ্পেষণটা এমনকি রানার পক্ষেও প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। শরীর মুচড়ে, জোরাজুরি করে, মুক্তি পেতে চাইছে চকচকে লোমযুক্ত আশি পাউন্ডের ডিনামাইটটা।
সটান উঠে দাঁড়াল রানা, এক হাত দুরত্বে ধরে রাখল, তারপর টুটি টিপে ধীরে ধীরে শ্বাসরোধ করে মারল অপূর্ব সুন্দর কুকুরটাকে। বিষাদে ছেয়ে গেল। মন। নির্দোষ ছিল জানোয়ারটা। মনিবের স্বার্থে দায়িত্ব পালন করছিল শুধু।
বাঁচার জন্যে যারপর নাই চেষ্টা করল ওটা। পাক্কা তিন মিনিট যুঝে শেষবারের মত ঝাঁকি খেল দেহটা। উষ্ণ মৃতদেহটা ফেলে দিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে রানা। যত্তসব! কুকুরের সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখা উচিত ছিল। রুডলফ ব্রিগল পাখোয়াজ লোক, সন্দেহ নেই।
আরেকটা মিনিট কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইল ও। বাতাসের গোঙানি আর বৃষ্টির তেরছা তীর ছাড়া কোথাও কিছু নেই। ডোবারম্যানের লাশটা পাঁজাকোলা করে তুলে পরিখার কালো পানিতে নিয়ে ছেড়ে দিল রানা। পাওয়া এটাকে যাবেই শেষ পর্যন্ত, কিন্তু তখন আর কিছু আসবে-যাবে না।
কুকুরটাকে ভেসে যেতে দিয়ে মনটা স্থির করার চেষ্টা করল রানা। দুৰ্গটার প্রাচীন ভগ্নাবশেষের ঠিক উল্টোদিকে এখন ও। প্রাচীরের গায়ের ফুটোগুলো, যেখান থেকে তীর-গুলি ইত্যাদি ছোঁড়া হত, ওর মাথার ওপর। ভাঙাচোরা আর কয়েক শতাব্দীর শ্যাওলা-উদ্ভিদ গায়ে মেখে স্যাঁতসেঁতে, পিচ্ছিল। পাথরের এই ধ্বংসস্তূপের কোথাও, রানা জানে, বন্দী করে রাখা হয়েছিল নাকাতাকে। সেখান থেকে পালায় জাপানী লোকটা। আর নাকাতা যদি পালাতে পারে, তবে মাসুদ রানাও নিঃসন্দেহে সেঁধোতে পারবে! এবং প্রয়োজনে সটকাতেও!
দুৰ্গটাকে চক্কর দিতে আরম্ভ করল রানা, নিঃশব্দে বুক-সাঁতার কাটছে, নাকটা শুধু জাগিয়ে রেখেছে পানির ওপর।
ধীরে ধীরে, বিনা শব্দে কুচকুচে কালো পানির বুকে সাঁতরে চলেছে ও। মৃত্যুর মত সন্তর্পণে, সাবধানে। প্রাচীন পরিখাঁটির কোথাও কোথাও পাড় ভেঙে যাওয়ায় অন্ধকার হ্রদের মত সৃষ্টি হয়েছে। দুর্গের দেয়ালের নিচের দিক ঘেষে প্রায় খাড়া হয়ে এগোচ্ছে রানা।
পরিখার একটা মোড় ঘুরতে দুর্গের নয়া অংশ দেখতে পেল। সদ্য তৈরি, ভাবল রানা। খুব বেশি হলে একশো বছর হতে পারে। সাদা পাথরে তৈরি হলেও এখন রেইন-ডার্ক। আকৃতিটা মোটা, গোলাকার এক টাওয়ারের। চারতলা উঁচু এক টাওয়ার। ওটার এখানে সেখানে জানালা। উজ্জ্বল আলো। খোশমেজাজে বেরিয়ে আসছে ওগুলো দিয়ে।
এর পরের দৃশ্যটা হজম করতে পারল না রানা। একটা ড্রব্রিজ। তুলে রাখা হয়েছে ওটা, অ্যাভিনিউ ব্রিসন থেকে আধুনিক ড্রাইভওয়েটা এসে মিশেছে। এখানে। দুর্গে যাতায়াতের রাস্তা এমুহূর্তে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সবদিকে খেয়াল রাখে লোকটা, মনে মনে স্বীকার করল রানা।
কাশির শব্দ। আধারে সিগারেটের দ্যুতি লক্ষ করল রানা তুলে রাখা ড্রব্রিজটার পাশে। গার্ড। অবাক হওয়ার কিছু নেই। রানার জন্যে প্রতীক্ষা করছে।
ধৈর্য ধরো, বৎস, আসছি আমি। ফুসফুস ভরে নিয়ে ডুব দিল রানা। পানির নিচে তিন মিনিট ছিল, নিঃশব্দে ও জোর গতিতে সাঁতরেছে। মাথা যখন তুলল। তখন দুর্গের পেছনটায় ও। স্টার্টিং পয়েন্টে ফিরে না আসা অবধি অবিরাম ডুব সাঁতার চালিয়ে গেল রানা। ওয়াটার লাইনের নিচে, শ্যাওলা ধরা পাথরের কোথাও, সেই প্রাচীন গ্রেটিংটা রয়েছে। নাকাতা যেটা গলে পালিয়েছিল।
ডুব দিয়ে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে রানা। মাঝে মধ্যে মাথা তুলে দম নিচ্ছে। চার মিনিট লাগল ওটা খুঁজে বের করতে। পাথরের সাথে গোল এক টিউব, পুরানো লোহার গ্রিলটা যেখান থেকে ক্ষয়ে গেছে মরচে পড়ে। রানার শরীরের যা আকৃতি, সেঁধোতে বেগ পেতে হবে। নাকাতার জন্যে অনেক সহজ ছিল কাজটা।
ভুস করে মাথা তুলে এক মুহূর্ত ভেবে নিল রানা। ঝুঁকিগুলো স্পষ্ট ওর। কাছে। পাইপের ভেতর কি আছে জানা নেই। এটার একাংশ পানির তলায়। দুর্গের ভেতর নিশ্চয়ই উত্থান হয়েছে ওটার, তারপর আবার নেমে গেছে। বন্দীখানায়। কিন্তু ভেতরে ঢুকে যদি আটকে পড়ে রানা! কতক্ষণ সইতে পারবে ওর ফুসফুস? অসহায়-বীভৎস মৃত্যু ঘটবে তাহলে ওর।
দশটা গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে রেডি করল ও। বৃষ্টিভেজা বাতাস টেনে নিল ও ফুসফুঁসের অন্তস্তল পর্যন্ত। একবারও মনে ঠাই দিল না এ বাতাসটুকুই হতে পারে ওর জীবনের শেষ সঞ্চারণ। কাজটা করতে হলে-এটাই একমাত্র রাস্তা। ওর বন্ধুর হত্যাকারী রুডলফ ব্রিগল ভেতরে রয়েছে। আছে ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ। মেজর জেনারেলকে কথা দিয়েছে ও উদ্ধার করবে মেয়েটিকে। এছাড়াও উপরি হিসেবে ওখানে আছে ফ্রেঞ্চ কী-র বাকি অংশটুকু।
শেষবারের মতন লম্বা করে শ্বাস টানল রানা। প্লাস্টিকে অস্ত্র তিনটে নিরাপদে আছে দেখে নিয়ে ডুব দিল।
.
১৩.
মাঝরাতের পর রানার জাগুয়ারটা ঘ্যাচ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল তোলা ড্রব্রিজটার সামনে। ক্রমেই বেড়ে চলেছে ঝড়ের তাণ্ডব। মুষলধারে বর্ষণ সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার। হর্ন বাজাল রানা, ব্রিগলের সঙ্গে ফোনে নির্ধারিত সিগন্যাল দিল। তিনবার খাটো-দুবার লম্বা-আবার তিনবার। খাটো।
পরিখার ওপারে পাথুরে এক গার্ডহাউজে আলো জ্বলে উঠল। গুমগুম, ঠং ঠং শব্দ করে নেমে আসছে ড্রব্রিজ, নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আধুনিক এক উইল্যাসের মাধ্যমে। সব ধরনের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধে রয়েছে, মনে মনে বলল রানা। এমনকি বিল্ট-ইন টর্চার চেম্বার পর্যন্ত!
ব্রিজটার যথাস্থানে নেমে আসার ফাঁকে রিয়ার ভিউ মিররে নিজেকে এক নজর দেখে নিল রানা। পরিপাটি, সুবিন্যস্ত চুল। জেলখানা থেকে বেরোনোর পর বৃষ্টিতে গোসল করেছিল রানা। খুঁতখুঁতে লোক ও। তাছাড়া কারও সাক্ষাপ্রার্থী হলে যদূর সম্ভব ফিটফাট হয়ে যেতেই পছন্দ করে।
শেষবারের মতন ঠং করে উঠে জায়গা মত বসে গেল ড্রব্রিজটা। স্লিকার। ও ভেজা হ্যাট পরা এক লোক ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে সঙ্কেত দিল রানাকে। দুর্গে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করল ও। পেছনে শুনতে পেল গুমগুম করে ড্রব্রিজটা ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে আবারও। ফাঁদে পড়েছে ইঁদুর। মাকড়সার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে। জড়িয়ে গেছে মাছি।
লম্বা করে হাই তুলল রানা। ঘনায়মান টেনশন দূর করতে কার্যকর কৌশল এটা। এমুহর্তে বেহালার তারের মতন টান-টান ওর নার্ভ।
ছোটখাট এক কোর্টইয়ার্ডে থামতে বলা হলো ওকে। এক লোক খুলে ধরল গাড়ির দরজা। রানার পুরনো বন্ধু, ট্রিলবি হ্যাট। বেরিয়ে এসো, আদেশ এল। মাথার ওপর হাত তুলে। নো ট্রিকস।
শ্রাগ করে বেরিয়ে এল রানা। শূন্যে হাত তুলে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। ওর শরীর চাপড়ে চাপড়ে দেখল ট্রিলবি। প্রাথমিক বডি সার্চ, অনুমান করল রানা। ট্রিলবির পেছনে, একপাশে দাঁড়িয়ে সাব-মেশিনগান হাতে রানাকে। কভার করছে আরেকজন লোক।
নিষ্কম্প দাঁড়িয়ে রানা। চোখজোড়া আবছায়া, বৃষ্টিস্নাত কোর্টইয়ার্ডে ঘোরাফেরা করছে। কোন কিছুই দৃষ্টি এড়াল না ওর। ছজন ওরা। দুজন সাব মেশিনগানধারী, আর বাকিদের হাতে হ্যান্ডগান। ট্রিলবিকে নিয়ে সাত। ভেতরে। আরও লোক আছে বলাই বাহুল্য। নিও-নাজীদের নেতা বেশ শক্তিশালী এক সংগঠন চালাচ্ছে। প্রচুর পয়সা খরচ করতে হয় নিশ্চয়। অনেকে অবশ্য আদর্শের কারণেও দলসেবা করে থাকে। ভয়ের কিছু নেই, মনকে প্রবোধ দিল রানা। ওর প্ল্যান সফল হলে তো কথাই নেই-আর ব্যর্থ হলে, রাহাত খান নাহয় ফুল পাঠাবেন ওর কবরে।
.
প্রকাণ্ড রূমটায় এমুহূর্তে রানা। চেয়ে রয়েছে বিশাল ডেস্কের পেছনে বসে থাকা। লোকটার দিকে। উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কের এপাশে রাখা চেয়ারটা ইঙ্গিত করল সে। এসো, মিস্টার রানা। দেখা হলো শেষ পর্যন্ত। বসো।
এর আগে ছোট এক ঘরে নিয়ে গিয়ে কাপড় খুলিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে রানাকে। ট্রিলবি ও তার সঙ্গীরা প্রথমে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে রানা নিরস্ত্র। তারপর টানা এক হলঘর পার করিয়ে, আধো-অন্ধকার এক বারান্দা দিয়ে নিয়ে এসেছে দুপাল্লার অতিকায় দরজাটার সামনে। গার্ড রানাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতে নোংরা হেসে বিদায় নিয়েছে ট্রিলবি। ভারখানা এমন, বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেলাম-পারলে বেরোও দেখি।
গার্ড পেছন থেকে মৃদু ঠেলা দিল রানার পিঠে। কামরার সাইকোলজিকাল সেটআপটার তারিফ করল রানা মনে মনে। ঘরে একটামাত্র উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে এবং এমনভাবে ওটাকে সেট করা হয়েছে যেন রানার মুখের ওপর আলো পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়। ওর চেয়ারটাও ডেস্কের ওপাশের চেয়ারের চাইতে নিচুতে, ফলে প্রতিপক্ষের মুখ ছায়াময় হয়ে থাকবে।
অনেক ভাবনা-চিন্তা করেছে, স্বীকার করল রানা। কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধে হবে না রুডলফ ব্রিগলের।
নির্দেশিত চেয়ারটার পাশে থেমে দাঁড়াল রানা। রুডলফ ব্রিগল, কায়সার ও তার স্ত্রী-সন্তানের হত্যাকারী, তখনও দাঁড়িয়ে তার ডেস্কের পেছনে। এবার ডেস্কটা ঘুরে কপা এগিয়ে এল ও, উজ্জ্বল আলোর কিনারে। রানা এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ওকে।
বসো, মিস্টার রানা, আঙুল ইশারায় চেয়ারটা দেখাল ব্রিগল। হাত মেলালাম না। দুজনেই জানি, ভণ্ডামি হবে সেটা। আমরা দুজনেই প্র্যাকটিকাল- লোক, এখানে মিলিত হয়েছি অত্যন্ত প্র্যাকটিকাল এক উদ্দেশ্য নিয়ে। সুতরাং সেটা নিয়েই ব্যস্ত হওয়া যাক-তবে তার আগে কি নেবে, ড্রিঙ্ক সিগার?
নো, থ্যাঙ্কস,বলল রানা। চেয়ারে গা এলিয়ে দিল, চোখ ব্রিগলের মুখের ওপর নিবদ্ধ। লোকটা সুদর্শন। ঘন আয়রন গ্রে চুলের নিচে বাজপাখির মত মসৃণ চেহারা। সরু অথচ সুন্দর মুখে চমৎকার মানিয়ে গেছে নাকটা। প্লাস্টিক সার্জনকে বাহবা দিল রানা মনে মনে। ব্রিগলের পুরানো, ইঁদুরমুখো ছবির সঙ্গে কোন মিলই খুঁজে পাওয়া গেল না এখনকার চেহারার।
আশপাশে শব্দ হচ্ছে শুনতে পাচ্ছে এখন রানা। সুবিশাল রূমটার আউটার শ্যাডোয় ক্ষীণ নড়াচড়া। ওরা একা নয় এঘরে, নিঃসন্দেহে। আলো-আঁধারি সয়ে আসতে লেগেছে ইতোমধ্যে রানার চোখে। ব্রিগলকে আর এক মুহূর্তের জন্যে ভারসাম্যহীন রাখতে বলে উঠল রানা, তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। ওরা চেহারা একেবারে পাল্টে দিয়েছে তোমার। কিন্তু গালের কাটা দাগটা সারিয়ে নিলে না কেন?
ব্রিগল প্রকাণ্ড ডেস্কটার কোনায় তখনও দাঁড়িয়ে, ক্ষতস্থান স্পর্শ করতে-ওঠা হাতটাকে অতিকষ্টে সামলাল। লম্বালম্বি নেমে এসেছে কুঁচকানো এক দগদগে স্ফীতি, বাঁ চোখের কোনা থেকে মুখ অবধি।
মাথা নামিয়ে ফেলেছে ব্রিগল। জবাব দেয়ার আগে মুহূর্তের জন্যে দৃষ্টি স্থির করল রানার ওপর। এটা ব্যাজ অভ অনার, মিস্টার রানা। সাহসিকতার চিহ্ন। ডুয়েল লড়ে এটা আদায় করেছি আমি। এধরনের সম্মান কেউ ছুঁড়ে ফেলে দেয় না। কিন্তু আমার কথা ছাড়ো-তোমার কথা বলা। ফ্রেঞ্চ কী-টা এনেছ?
মাথা নাড়ল রানা। না, বলল। আনিনি।
আলোর বৃত্তের ঠিক বাইরে কার যেন হাঁ করে শ্বাস নেয়ার শব্দ পাওয়া গেল। শব্দটা লক্ষ্য করে উঁকি দিল রানা। ব্যারোনেস। চেয়ারে বসে ও, বাঁধনমুক্ত আপাতদৃষ্টিতে, ডাগর চোখ মেলে রানাকে দেখছে। পরনে এখনও ওর সেই ধূসর স্ন্যাক্স ও সবুজ সোয়েটার। ম্লান আলোতেও মেয়েটির ফ্যাকাসে। মুখের চেহারা নজর এড়াল না রানার।
ওটা তোমার আনা উচিত ছিল, রানা। আমরা হেরে গেছি। আ-আমার। ভয় করছে, রানা। একনাগাড়ে বলে গেল ব্যারোনেস।
আতঙ্কিত শোনাল ওর কণ্ঠ। ভীত, হতভম্ব ও পরাজিত।
চেয়ারে ঝুঁকে এল রানা। স্মিত হেসে আশ্বাস জোগাতে চাইল। হাল। ছেড়ো না, জুলি। আমাদের চান্স এখনও শেষ হয়ে যায়নি।
মিস্টার রানা! ব্রিগলের তোলা ডান হাতটাকে এখন উদ্যত থাবার মতন। দেখাচ্ছে। সৌজন্যের তেলতেলে ভাবটুকু বিলকুল উধাও গলা থেকে। টেলিফোনে শোনা সেই উদ্ধত, রুক্ষ কণ্ঠস্বর ফের আবিষ্কার করল রানা। কি বলতে চাও তুমি? আশা করি তোমার পজিশন রিয়ালাইয় করতে পারছ!
পা আড়াআড়ি করে রাখল রানা। এখানে ঢোকার জন্যে মিথ্যে বলেছিলাম। তোমার সঙ্গে কথা হওয়া দরকার ছিল। তোমার নিজের পজিশন চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর জন্যে। এবং আমারটাও। কারণ আমার ধারণা। আমার হাতে। চাবিটা তোমার দরকার। ওটা এখন আমার কাছে।
দুমুহূর্ত রানাকে নিরীখ করল রুডলফ ব্রিগল। বরফের মুখোশটা আবার। পরে নিয়েছে সে। চিকন চিকন আঙুলে ছোট্ট এক গম্বুজ তৈরি করেছে। লোকটা। রানা এতক্ষণ পরে এই প্রথম লক্ষ করল, ইভনিং ক্লোদস পরে রয়েছে ব্রিগল। ডিনার জ্যাকেট।
চাবি তোমার কাছে, কথা সত্যি, বলল ব্রিগল। কিন্তু তুমি তো আমার হাতে!র
আমার সম্পর্কে কিছুই জানো না দেখছি, বলল রানা। জানা নেই কে আমি। কিভাবে ভাবতে পারলে জয়েন্টটা ঘেরাও করে নেই আমার বন্ধুরা? মানে এজেন্টরা, এবং সুইস পুলিস?
মাথা নাড়ল ব্রিগল। মনে হয় না। এই দেশে আমার মত তোমারও ক্ষমতা সীমিত। সুইসরা নিজেদের দেশে কোন যুদ্ধ চায় না। তুমি ধরা পড়লে তোমার দেশ তোমাকে অস্বীকার করবে। অফিশিয়ালি অন্ততপক্ষে। উঁহু, মিস্টার রানা, তুমি একদম একা। এবং মোটেই দর কষাকষির অবস্থানে নেই।
শ্রাগ করল রানা। তোমার সব কথা মেনে নিলাম। শুধু শেষেরটা ছাড়া। মাথা ওপরদিকে ঝটকাল ও, রূমটাকে ঘিরে থাকা অন্ধকার গ্যালারিগুলোর উদ্দেশে। ওপরে অস্ত্রধারী লোক আছে তোমার?
ওর প্রশ্নের জবাব দিতেই যেন খকখক করে কেশে শোনাল গ্যালারির একজন, এবং নগ্ন মেঝেতে পা দাপিয়ে শব্দ করল।
বাউ করল ব্রিগল। অবশ্যই সাব-মেশিনগান দিয়ে এমুহর্তে কাভার করা হচ্ছে তোমাকে। যদিও এর তেমন দরকার ছিল না-খুটিয়ে খুঁটিয়ে যেহেতু সার্চ করা হয়েছে,
সেজন্যেই তো বলছিলাম, এরকম নিরস্ত্র অবস্থায় তোমার গুহায় যখন –ঢুকেছি, বলে চলেছে রানা। আপারহ্যান্ড আছে বলেই না। কিভাবে, শুনবে? সামনে ঝুঁকে ডেস্কের পেছনে বসা লোকটির দিকে কঠোর চোখে চাইল ও। ছায়ার আড়ালে শুনতে পেল ব্যারোনেস অস্ফুট আর্তধ্বনি করে উঠল, কিন্তু গ্রাহ্য করল না রানা। এখন এসব খুচরো অনুভূতি নিয়ে ভাবার সময় নয়।
আমাকে খুন করতে তো পারবেই না, টর্চার করতেও দেব না, বলছে। রানা। পিস্তল ছাড়াও তোমার চারটে লোককে সাবড়ে দিতে পারি আমি। আমাকে জ্যান্ত পাবে না তুমি। খুন করে লাশটা পেতে পারো। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে সায়ানাইড পিলটা গিলে নেব আমি, কেউ কিসসু করতে পারবে না। বুড়ো আঙুল নাচাল ও।
মিথ্যে কথা, গর্জে উঠল ব্রিগল। আমার লোকেরা তোমাকে থরোলি সার্চ—
অস্ত্রের জন্যে, কথা কেড়ে নিয়ে বলল রানা। হাসছে দাঁত বের করে। মিথ্যেটাকে দৃঢ় ভিত্তি দেয়ার জন্যে বলে যাচ্ছে, কিন্তু ছোট্ট একটা বড়ি খুঁজে। পাবে কোথায়? এক্সপার্টদের পক্ষেও কাজটা রীতিমত কঠিন। জানো নিশ্চয়ই তোমার বাপের দোস্ত গোয়েরিং ইউজ করেছিল এটা। একই জিনিস আছে। আমার কাছেও। তবে আশা করছি তার প্রয়োজন পড়বে না। এখন তুমি বুঝে দেখো, ব্রিগল। আমি চাই তুমি পরিস্থিতি বিবেচনা করো, ড্রাইভারের আসনে তুমি নও, আমি বসে আছি, সেটা বোঝে।
নির্ভেজাল ভাওতাবাজি। বসে রসে লক্ষ করছে রানা কাজ হয় কিনা।
পরবর্তী কমুহূর্ত মনে হলো কাজে লেগেছে বুঝি। নীরবে ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বসে রইল ব্রিগল, আঙুল বুলাচ্ছে সরু চিবুকে। ধরে নাও-কথার কথা-আমি তোমার সাথে একমত হলাম। প্রস্তাবটা কি হবে তোমার?
মুচকি হাসল রানা। প্রস্তাবটা হবে, এসব নাটুকেপনা বাদ দিয়ে তুমি ব্যারোনেসকে ছেড়ে দেবে। তারপর তুমি আর আমি সকালবেলা হাজির হব। পল শার্দে এট ফিলস ব্যাঙ্কে। তুলে নেব সোনার চিতাবাঘটা। তোমার মস্তানদের সঙ্গে নেয়া চলবে না। তবে তার আগে আমার চাবির অর্ধেকটা, উদ্ধার করতে হবে।
পাতলা এক টুকরো হাসি ফুটতে দিল ব্রিগল তার মুখে। তোমার অর্ধেক, মিস্টার রানাঃ
মাথা ঝাঁকাল রানা। নিশ্চয়ই। নাকাতা নেই। নাকি তোমার লোকেরা বলেনি?
বলেছে। আপদ বিদেয় হয়েছে, নির্দয় শোনাল ব্রিগলের কথাগুলো। ব্যাটা আমাকে বিশ্বাস করত না। করলে আজকে আর এই পাকে পড়তাম না। হোটেল হিলসনে যাওয়ার জন্যে জোরাজুরি শুরু করে দিল আর থেমে গেল ব্রিগল। মরুকগে, ব্যাঙ্কে যাওয়ার পর কি হবে, মিস্টার রানা? যাচ্ছি তো শুধু তুমি আর আমি?
হ্যাঁ। খুব সোজা, বলল রানা। যেমনটা বলেছিলাম। চিতাবাঘটা নিয়ে কেটে পড়বে তুমি। লুটের আর সব মাল পাব আমি। ফোনে বলিনি, ওগুলো ফেরত দিয়ে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে তার ইমেজ বাড়াবে? চিতাবাঘটা কেন উদ্ধার করতে পারলাম না তার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ অবশ্য জানাতে হবে আমাকে। সে ঝেড়ে দেব একটা কিছু। বসের কাছে আমার জীবনের দাম অনেক। তাকে বুঝিয়ে বললেই হবে, ব্যারোনেস আর আমার জান বাঁচাতে হাতছাড়া করতে হয়েছে মূর্তিটাকে। তবে ওরা অবশ্য তোমার পিছু ছাড়বে না। শ্রাগ করল রানা। সে তোমার ব্যাপার।
আঙুল দিয়ে আবারও গম্বুজ বানাল ব্রিগল। কমুহূর্তের গভীর ধ্যানমগ্নতার। পর মুখ খুলল একটা কথা ভুলে যাচ্ছ-জুলি আমার হাতে। তোমার সামনে যদি ওকে টর্চার শুরু করি? তখনও পারবে আমার প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পারবে না। সুড়সুড় করে চাবিটা এনে তুলে দেবে আমার হাতে।
আগেই তো বললাম, ব্যারোনেসকে ছেড়ে দিতে হবে, বলল রানা। তাছাড়া এটাও সত্যি, ব্যারোনেস আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট কেউ নয়। ওর দায়িত্ব ছিল আমার সঙ্গে থেকে তোমাকে চিনিয়ে দেয়া, ব্যস-ওকে এখন আর কারও দরকার নেই। কাজেই ওকে টর্চার করলে না আদর করলে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।
গুঙিয়ে উঠল ব্যারোনেস। এ তুমি কি বলছ, রানা? তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে এই শয়তানটার হাতে তুলে দিয়ো না, প্লীজ
তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, জুলি, আশ্বস্ত করতে চাইল রানা। রুডলফ ব্রিগল অত অভদ্র লোক নয়। এমনি একটু ভয় দেখাতে চাইছে আর কি।
তীক্ষ চোখে রানাকে লক্ষ করছিল ব্রিগল। খেঁকিয়ে উঠল এবার কি? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? ওর ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হলো ভদ্রলোক হওয়া বুঝি মস্তবড় অপরাধ।
হলেও উপায় নেই, ব্রিগল, কঠোর গলায় বলল রানা। আমি প্রফেশনাল লোক। ব্যারোনেসকে টর্চার করলেও চাবিটা পাবে না তুমি। কাজেই অনুরোধ করছি, ওকে বেহুদা কষ্ট দিয়ো না। চিতাবাঘটা পেতে হলে আমার প্রস্তাবে রাজি হতেই হবে তোমাকে। এছাড়া অন্য কোন পথ নেই।
অস্ফুট আর্তনাদ শোনা গেল আঁধারের ওপাশ থেকে। ওকে তুমি চেনো, রানা, কান্না বোজা কণ্ঠে বলে উঠল ব্যারোনেস। ও একটা পিশাচ্য বলছে করে ছাড়বে-ও মানুষ না, রানা।
মেয়েটির দিকে চাইতে পারছে না রানা, চোখ নামিয়ে নিল। আমি দুঃখিত, জুলি। খুবই দুঃখিত। কিন্তু আমার হাত-পা বাঁধা, বিশ্বাস করো।
ব্রিগলের গলা এখন শুষ্ক ও নরম। কণ্ঠস্বরটা শুকনো পাতার মধ্যে দিয়ে সড়সড় করে চলে যাওয়া সাপের কথা মনে করিয়ে দিল রানাকে।
ওর সাদা মসৃণ চামড়ায়, বলল ব্রিগল। গনগনে সাড়াশির ছ্যাকা পড়লে চমৎকার নকশা হবে।
কটমট করে ওর দিকে চেয়ে আছে রানা। ধাপ্পাবাজি ছাড়ো, ব্রিগল। যা বললাম করো।
চেয়ারে পাঁই করে ঘুরে গেল ব্রিগল। ঘেউ করে আদেশ দিল চোস্ত জার্মানে। আধার ছেড়ে বেরিয়ে এসে রানাকে ঘিরে দাঁড়াল ওর লোকেরা এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে ব্যারোনেসকে।
দুর্গের জেলখানায় নিয়ে যাও এদের, গর্জে উঠল ব্রিগল। ধক-ধক করে জ্বলছে দুচোখ। কে ধাপ্পাবাজি করছে শিগগিরিই দেখা যাবে! বলল রানাকে উদ্দেশ্য করে।
.
১৪.
খুদে চেম্বারটা, প্রাচীন দুর্গের নিচে ঠিক যেন একটা কবরস্থান –নির্যাতন ও মৃত্যুর গন্ধে ভারী হয়ে আছে। লোহার কুলুঙ্গিতে সেট করা কম পাওয়ারের ইলেকট্রিক বালবগুলো এতটুকু দূর করতে পারেনি বন্দীশালার ভয়াবহতা।
ভ্রূ কুঁচকে আকাশ-পাতাল ভারছে রানা। টোপ গিলেছে মাছ। টর্চার চেম্বারে নিয়ে আসা হয়েছে ওদেরকে।
আগেই এখান থেকে ঘুরে গেছে মাসুদ রানা।
দরজার কাছে, মরচে ধরা বর্মটার এক লোহার দস্তানার মধ্যে গুঁজে রাখা। আছে ওর গ্যাস বোমাটা। অন্যটার ভেতরে স্টিলেটো। অপেক্ষা করছে রানার বিশ্বস্ত সঙ্গীরা।
কিন্তু নাইন এমএম ভয়ঙ্কর লুগারটা, যেটার ওপর সবচেয়ে বেশি আস্থা। রাখছে রানা, ওই র্যাকটার নিচদিকে টেপ দিয়ে সাঁটা। ব্যারোনেস জুলি গ্রাফকে এখন টান-টান করে বাঁধা হচ্ছে যেটার সঙ্গে।
ত্বরিত নজর বুলিয়ে মাপ-জোখ করে নিয়েছে রানা চেম্বারটা। ছোট্ট, অন্ধকারময় কামরাটার প্রাচীন দেয়ালগুলো ভেজা-স্যাঁতসেতে। পানি চোয়াচ্ছে। জায়গায় জায়গায়। পেছনের দরজাটা কাঠের তৈরি, তবে ভারী আর নিরেট। মস্ত এক লোহার বার দিয়ে বাইরে থেকে আটকানো ছিল।
রানার পাশে দাঁড়িয়ে ব্রিগল। এখনও ধাপ্পাবাজি মনে হচ্ছে?
ঢোক গিলল রানা-অভিনয়ের অংশবিশেষ। মনে প্রাণে আশা করছে ফ্যাকাসে ও অসুস্থ দেখাক ওকে। হ্যাঁ, হচ্ছে। তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারো না। মনে মনে হাসল রানা। শালা খুনী, তোমার সময় ফুরিয়ে এসেছে-সবুর, করো।
ব্রিগল একটা সঙ্কেত দিল। ওর এক চ্যালা টানাটানি করে খুলে নিল। ব্যারোনেসের সোয়েটার। র্যাকে পা বাধা হয়ে গেছে ওর, তবে হাত খোলা। এখনও। লোকটাকে আঁচড়ে-খামচে বাধা দেয়ার সাধ্যমত চেষ্টা করল। ব্যারোনেস। অস্ফুট, অসহায় আর্তধ্বনি বেরিয়ে আসছে তার গলা দিয়ে।
রানা! দোহাই তোমার, রানা! বাঁচাও আমাকে-ওরা যা চাইছে দিয়ে দাও, প্লীজ!
মুখের চেহারায় যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল রানা। পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে ভ্রূ মুছে নিল।
ব্যারোনেসের পরনে এখন সাদা অন্তর্বাস। ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিগলের চামচা দুটো তারিয়ে তারিয়ে ধবধবে সাদা, অর্ধনগ্ন যৌবনপুষ্ট দেহটি উপভোগ করছিল। এ্যাক করে উঠল ব্রিগল। আহাম্মক কোথাকার, লোহা গরম করো। তোমাদের মজা লোটার জন্যে পীপ শো-র আয়োজন করা হয়নি। কয়লার চুলোয় লোহার সাঁড়াশি গরম করা হচ্ছে, একজন হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল সেদিকে। ইতোমধ্যে হাতও বাঁধা পড়েছে মেয়েটির।
নিজের চারধারে শেষবারের মতন নজর বুলিয়ে নিল রানা। মোকাবিলা করতে হবে ওকে ব্রিগলের সঙ্গে। অবশ্য লোকটার সঙ্গে অস্ত্র রয়েছে বলে মনে করে না ও। একা ব্রিগল নয়, লড়তে হবে সেই সঙ্গে আরও চারজনের বিরুদ্ধে। এদের দুজন ব্যস্ত ব্যারোনেসকে নিয়ে এবং দুজন দাঁড়িয়ে রানার পেছনে, দরজা ও তার মাঝখানে। একজনের হাতে সাব-মেশিনগান।
চুলো থেকে লোকটা ইতোমধ্যে তুলে নিয়েছে গনগনে এক সাড়াশি। ধূমায়িত লোহাটার ছড়ানো গন্ধে অসুস্থ বোধ করল রানা। গত কয়েক শতাব্দী ধরে, এ কামরায় নিগৃহীত-নির্যাতিত মানুষজনের বুকফাটা হাহাকার যেন শুনতে পেল ও। চারপাশ থেকে ভেজা দেয়াল চেপে এসে যেন পিষে মারবে ওকে।
রানার পাশ থেকে এসময় বলে উঠল রুডলফ ব্রিগল, এখনও সময় আছে, রানা, ভেবে দেখো। ব্যারোনেসের কান্নাকাটি-আর্তনাদ সইতে পারবে তুমি?
যথেষ্ট হয়েছে, এখনই সময়। রুমালটা দিয়ে জ্ব জোড়া আবারও মুছে নিল। রানা। কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাস পড়ছে ওর। ফিরল ও ব্রিগলের দিকে। দাঁড়াও! আ আমি হার মানছি!
পাতলা হাসল ব্রিগল। এই তো হুঁশ ফিরেছে। র্যাকের কাছে দাঁড়ানো লোক দুটোর উদ্দেশে হাত নাড়ল ও। ওকে ছেড়ে দাও।
সরে যাও, ভুরু কুঁচকে ব্রিগলের পাশ কাটিয়ে তেড়ে গেল রানা। অনেক শাস্তি দিয়েছ তোমরা নিরীহ মেয়েটাকে। ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও।
মহানুভবতার হাসি এখন ব্রিগলের ঠোঁটে। ও যা বলছে করো। শ্লেষ ওর কণ্ঠে। প্রেমিক যুগলকে একটুক্ষণ একা থাকতে দেব আমরা-তারপর কাজের কথা।
ব্যারোনেসের ওপর ঝুঁকে পড়ল রানা। আতঙ্কমাখা, পদ্মফুলের মত চোখজোড়া মেলে ধরল যুবতী। সামনে ঝুঁকে একটা রশির বাধন আলগা করার সময় ফিসফিস করে বলল রানা, সব কটা দোজখ ভেঙে পড়বে এখুনি। আমি চিৎকার করলেই, দৌড় দেবে-কোটইয়ার্ডে পৌঁছতে পারলে আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো। ওখানে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থেকো। আমাকে হেল্প করার কোন চেষ্টা কোরো না! বুঝেছ?
মাথা নাড়ল যুবতী। শেষ দড়িটা শিথিল করল রানা। হাতটা তারপর ঢুকিয়ে দিল র্যাকের কিনারার নিচে। টেপে সাঁটা লুগারটার ঠাণ্ডা বাট অনুভব করল আঙুলে। হাতটা চেপে বসল বাটের ওপর।
মেয়েটাকে ঠেলে র্যাক থেকে সরিয়ে দিল রানা, এতই জোরে যে মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল। লাইন অভ ফায়ারের বাইরে এখন ব্যারোনেস।
পালাও এবার!
চরকির মতন ঘুরে দাঁড়াল রানা। লুগারটা ইতোমধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, সাব-মেশিনগানধারীর উদ্দেশে মৃত্যু বর্ষণ করছে। টাস-টাস-টাস বুকে তিনটে ফুটো তৈরি হলো। ভাজ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা, পাথরের মেঝেতে ঝনাৎ করে খসে পড়ল অস্ত্রটা। অপর লোকটা ফায়ার করতে উদ্যত হয়েছিল, গুলি করল রানা। ওর জ্যাকেটের একটা পাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। প্রতিপক্ষের বুলেট। কিন্তু রানার অব্যর্থ হাতের গুলি লোকটার দুচোখের মাঝখানে একটা কালো গর্ত সৃষ্টি করল। টলতে টলতে পেছনে চিতপাত হয়ে পড়ে গেল সে।
অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় ঘটে চলেছে ঘটনাগুলো-ভিসিআর ফার্স্ট ফরওয়ার্ড করলে ছবির যে গতি দেখা যায়, তেমনি। রুডলফ ব্রিগল, মুখের চেহারা রক্তশূন্য তার, ঘুরে দৌড় দিল দরজা লক্ষ্য করে। ওর পেছন পেছন ছুট দিল। রানা। লোহার বার! দৌড়নোর ফাঁকে বাকি লোক দুটোকে গুলি করল রানা। চামচা দুটো এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে, হাত শূন্যে তুলে। যুদ্ধের সাধ মিটে গেছে ওদের। এখন জান বাঁচানো ফরয।
দরজার কাছে ইতস্তত করছে ব্রিগল। ভীতিমাখা চোখে চেয়ে আছে পেছনে। এবার ভারী দরজাটা ঝটকা মেরে বন্ধ হতে শুরু করল। ব্রিগলের দুহাতের ইঞ্চিখানেকের মধ্যে বুলেটটা রাখল রানা। ব্রিগলকে এমুহর্তে খুন করতে চায় না ও। লোকটাকে জিম্মি হিসেবে কাজে লাগতে পারে দুর্গ ত্যাগের সময়।
আতঙ্কিত চিৎকার ছেড়ে দৌড়নোর জন্যে ঘুরে দাঁড়াল ব্রিগল। একই সঙ্গে দরজার কাছে পৌঁছানোর ফলে সংঘর্ষ হয়ে গেল রানার ও ব্যারোনেসের। পলায়নপর ব্রিগলকে লক্ষ্য করে আরেকটা গুলি করল রানা। বন্দীশালার অন্ধকার করিডর ধরে ছুটে পালাচ্ছে সে। ব্যাটার ঠ্যাঙে লাগাতে পারলে হত, মনে মনে বলল রানা। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো, ভেজা, দেয়ালে লেগে বিকট আওয়াজ তুলল বুলেটটা। মুখ খিস্তি করল রানা। কিছুতেই পালাতে দেয়া যাবে না খুনীটাকে। বর্মের মধ্যে লুকিয়ে রাখা অস্ত্র দুটো তুলে নিল রানা এস্ত হাতে।
ব্যারোনেসকে ধাক্কা মেরে সামনে থেকে সরাল। ভারী দরজাটা দড়াম করে যেই লাগিয়েছে, অমনি ভেতরদিক থেকে কাঠে খটাখট গুলি গেথে যেতে শুরু করল। সাহস ফিরে পাচ্ছে ব্রিগলের চ্যালারা। বারটা জায়গামত নামিয়ে দিল রানা। এবার আর বেরোতে হচ্ছে না বাবাজীদের। তাই
প্যাসেজে ব্যারোনেসকে ঠেলা-গুতো দিয়ে সামনে রাখল রানা। ব্রিগলও স্বমূর্তি ধারণ করতে পারে যে কোন মুহূর্তে।
কুলুঙ্গিটার কাছে এসে কম পাওয়ারের হলদেটে এক বাতি জ্বলতে দেখল ওরা। ফাঁকা জায়গায় টেনে নিল রানা ব্যারোনেসকে। ওর গায়ে প্রায় ঢলে পড়ে কাঁপতে লাগল মেয়েটি। মেইন গট-মেইন গট! বারবার আওড়াচ্ছে শব্দ দুটো।
কাঁধ ধরে ওকে প্রবল ঝাঁকুনি দিল রানা। মনে সাহস রাখো। এখন কাতর হওয়ার সময় নয়। ব্রিগলকে বাগে পেতে হবে আমার। ইতিমধ্যে হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে হবে। এই নাও
গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে ব্যারোনেসকে দিল রানা। ট্রাউজারের পকেটে স্থান পেল গ্যাস বোমা ও স্টিলেটো। এটা পরে নিয়ে সবার অগোচরে কোর্টইয়ার্ডে চলে যেতে চেষ্টা করো। যদি না পারো বাইচান্স, ফিরে এসো। এখানটায়। বুঝতে পেরেছ? এখানে। বেরনোর রাস্তা জানা আছে আমার। মাঝরাতে ঢুকেছিলাম ওখান দিয়ে।
কুলুঙ্গিটা থেকে বাইরে পা রেখে দেয়ালে মিশে দাঁড়াল রানা। জমাট বাঁধা অন্ধকার। টানা করিডরটা থেকে কোন গুলি-গালাজ এল না। ব্যারোনেসকে এক টানে কুলুঙ্গি থেকে বের করে বলল রানা, যাও, দৌড় দাও। ব্রিগলের ব্যবস্থা করে তারপর মীট করব।
দুমুহূর্ত দ্বিধা করে করিডর ধরে শশব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটল যুবতী।
ওকে একটা বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হতে দিয়ে, পা টিপে টিপে অনুসরণ করল রানা। একশো মাইল স্পীড়ে মাথা কাজ করছে ওর। পরিস্থিতির তুল্যমূল্য বিচার করছে, চেষ্টা করছে লড়াইয়ের অর্ডার সেট করতে। দুর্গের নয়া এলাকায় হয়তো চলে যাবে ইতোমধ্যে ব্রিগল, দরজা বন্ধ করে দেবে পুরানো ও নতুন অংশের মধ্যে যাতায়াতের। কিন্তু সত্যিই তাই করবে কি? কারণ প্ল্যান্ট করা অস্ত্রগুলোর কল্যাণে জেনে গেছে সে, রানা দুর্গের প্রাচীন অংশে গোপনে ঢুকেছিল। জায়গাটা পরিচিত তার কাছে। জানে ইচ্ছে করলেই বেরোতে ও ঢুকতে পারবে রানা। কাজেই ব্রিগলকে হয় বাইরে থেকে পাহারা বসিয়ে রানাদের পালানোর রাস্তা রুদ্ধ করতে হবে; আর নয়তো তেড়েফুডে এসে লড়াইয়ে সামিল হতে হবে রানার বিরুদ্ধে।
আবছায়া এক ইন্টারসেকশন তীরবেগে ছুটে পার হলো রানা। কোনখান থেকে, যেন অপসৃয়মাণ পায়ের আওয়াজের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি কানে আসছে। ব্যারোনেস ছুটছে এখনও! শব্দটা মিলিয়ে গেল এবং প্রাচীন কারাগারটিতে নেমে এল মুহূর্তের অটুট নিস্তব্ধতা। কোথায় যেন ছড়-ছড় করে পানি পড়ছে। এছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। হঠাৎ
ঘুপচি অন্ধকারে শোনা গেল নতুন এক শব্দ। কাঠ হয়ে গেছে রানা। ইন্টারসেকশনটার কফিট দূরে, আরেকটা কুলুঙ্গির উদ্দেশে সাত করে সরে গেল ছায়ার মত। আওয়াজটা-অবিশ্বাস্য হলেও সত্য-ভয়ানক রকমের ভীতিগ্রস্ত এক পুরুষ মানুষের ফোঁপানি। নিদারুণ দুর্দশায় পড়লেই কেবল এভাবে কাঁদতে পারে মানুষ।
ইঞ্চি-ইঞ্চি করে ওই কুলুঙ্গিটার দিকে পা বাড়াল রানা। ফোঁপানির শব্দটা থামছে না। তাজ্জব বনে গেল রানা। ফাঁদ হতে পারে এটা, বলাবাহুল্য, কিন্তু তাই বলে এহেন অদ্ভুত কৌশলের আশ্রয় নেবে? রুডলফ ব্রিগল ছাড়া আর কে হবে এই কাদুনে লোকটা? এতবড় নিষ্ঠুর সন্ত্রাসীর এই দশা? তারমানে ওপর। দিয়ে ফিটফাট ভিতর দিয়ে সদরঘাট?,
কুলুঙ্গিটার উদ্দেশে আরেকটু কাছিয়ে এল রানা। গন্ধটা ধক করে নাকে এসে লাগল ওর। ভীতির, আতঙ্কের গন্ধ। আসল রূপ বেরিয়ে পড়েছে রুডলফ ব্রিগলের। এক মুহূর্ত পরেই রানার পায়ে ধরবে জানে না মারার জন্যে!
উঁহু, নিজেকে বোঝাল রানা, এত সোজা নয়। কোথাও কোন গড়বড় আছে বড় ধরনের।
এমুহূর্তে কুলুঙ্গিটার ঠিক পাশে ও। তখনও তরাসমাখা কণ্ঠে ফুঁপিয়ে চলেছে লোকটা। লুগারটা হাতবদল করে ডান হাতে নিয়ে এল রানা। চারধার পরখ করে নিল শেষবারের মত। শুধু ছায়া আর ছায়া। কুলুঙ্গিটার ভেতর। সেঁধিয়ে পড়ল রানা। তারপর ইস্পাতকঠিন মুঠোয় চেপে ধরল এক লোকের কোট-কলার। হাতে মসৃণ ও চকচকে ঠেকল কাপড়টা। ডিনার জ্যাকেট! হায় খোদা, ব্রিগল স্বয়ং।
কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে জড়সড় লোকটাকে বের করে আনল রানা। তলপেটে ঠেকাল লুগারটা। না-না- আর্তনাদ করে উঠল লোকটা। দোহাই তোমার, আমাকে মেরো না! আমি ব্রিগল না, বিশ্বাস করো-আমি একজন বুড়ো মানুষ! তোমার সাথে কোন শত্রুতা নেই আমার! ভাই ভাই, ছেড়ে দাও আমাকে?
চোপ! ধমকে উঠল রানা। একদম নড়বে না। হিপ পকেট থেকে পেন্সিল ফ্লাশলাইট বের করে জ্বলল। টের পাচ্ছে কেমন বন্ধু বানানো হয়েছে ওকে।
ম্যালেরিয়ার রোগীর মত কম্পমান লোকটিকে সোজা করে ধরে রেখে। পরীক্ষা করে দেখল রানা। এ লোক রুডলফ ব্রিগল-আবার নয়ও। এই লোকই নিঃসন্দেহে ডেস্কের পেছনে বসে ছিল-এই একটু আগে টর্চার চেম্বারে।
সন্ত্রস্ত লোকটার একদম কাছে দাঁড়ানো বলে আরেক ধরনের গন্ধ নাকে এল রানার। কসমেটিক স্মেল! লোকটার গালের কাটা দাগে একটা আঙুল ঘষল ও। উঠে আসছে মেক আপ!
বিরক্তিতে মনটা ছেয়ে গেল রানার। ও ধোকা খেল কিভাবে? লোকটা সুঅভিনেতা সন্দেহ নেই, কিন্তু তারপরও বলতে হবে আশ্চর্য দক্ষতায় সে তার দায়িত্ব পালন করেছে।
আলুর বস্তার মতন ছেড়ে দিল রানা লোকটাকে। ওকে-তুমি যে-ই হও না কেন, আসল রুডলফ ব্রিগল কোথায়?
আমি জানি না। কসম খেয়ে বলছি, জানি না!মেঝেতে আধশোয়া নকল। বিগলি। দুর্গের কোথাও আছে সে, এটুকু বলতে পারি। আমরা যখন-আমরা যখন কথা বলছিলাম ও তখন গ্যালারিতে ছিল। লোকটা এবার নাকি কান্না জুড়ে দিল। তুমি আমাকে খুন করবে না তো? কোরো না-দোহাই লাগে। আমি কিছুই জানি না। আমাকে যা যা করতে বলেছে তাই শুধু করে গেছি
লোকটাকে কষে এক লাথি লাগাল রানা। আসলে নিজেকেই মারল। ধুলো দেয়া হয়েছে ওর চোখে, ভাল কথা! কিন্তু কেন? আসল রুডলফ ব্রিগল এ। থেকে কি ফায়দা লুটবে?
রানার কান ঘেঁষে পাথরে আঘাত হানল একটা বুলেট। ক্রন্দনরত লোকটাকে এক লাফে ডিঙিয়ে কুলুঙ্গির ভেতর গা ঢাকা দিল রানা করিডরে। তখনও বজ্রপাত ঘটাচ্ছে পিস্তলের শব্দ। জবাব জানা হয়ে গেল ওর। কোথায়। সত্যিকারের রুডলফ ব্রিগল জানে এখন রানা।
প্যানপ্যান করে কাঁদছে তখনও লোকটা। গেলি এখান থেকে, ভাগ! চাপা গলায় দাবড়ানি দিল রানা।
আদেশ পালন করল লোকটা, কেঁচোর মত কিলবিল করে চলে গেল। দৃষ্টিসীমার আড়ালে। ছোট্ট আশ্রয়স্থলটায় অপেক্ষা করছে রানা। একটু পরে। ব্রিগলের গলা–আসল কণ্ঠস্বর-ছায়াময় করিডরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো।
রানা? প্রাচীন দেয়ালগুলো শব্দটা ধারণ করে বারে বারে প্রতিধ্বনি করল রানা! রানা! রানা!
রানা নিরুত্তর। রাজ্যের চিন্তা পাক খাচ্ছে ওর মাথার ভেতর। কালক্ষেপণের চেষ্টা করবে ব্রিগল। রানাকে কুলুঙ্গিতে আটকে রেখে লোকেদের সুযোগ দেবে ঘেরাও দেয়ার। কিন্তু ওকে সময় দেবে না রানা! দেয়ালে, ওদের দুজনের মাঝখানে একটা ডিম লাইট। ওটাকে জ্বলতে দেয়া চলবে না।
তুমি এখানেই আছ জানি আমি, রানা, বলে চলল ব্রিগল। আমার ধোকাবাজি ধরে ফেলেছ তাও জানি। অ্যালফস ঝানু অ্যাক্টর, কি বলো? কিন্তু। বেচারা বুড়োমানুষ আর ভীরু। ওকে দোষ দেয়া যায় না। ওকে অভিনয় করতে হায়ার করেছি আমি। আমার হয়ে লড়ে দেবার জন্যে নয়, লড়াই আমি ভালই পারি।
আসলের সঙ্গে নকলের কণ্ঠস্বরের পার্থক্য প্রায় নেইই বলতে গেলে। সত্যিই চমৎকার অনুকরণ করেছিল লোকটা। কিন্তু এখন অন্য এক অনুভূতির। স্পর্শ মিশেছে আসলজনের গলায় নিজেকে সর্বশক্তিমান ভাবা। হিটলারের যে রোগ ছিল। ছিল নমরুদের।
ঠাণ্ডা হাসিতে বাঁকা হলো রানার ঠোঁট। এ লোক সত্যিকারের রুডলফ ব্রিগল, যাকে খুঁজতে সে এসেছে। যার সন্ধানে ও গিয়েছিল জার্মানীতে।
স্পেয়ার ক্লিপটার জন্যে পকেটে চাপড় দিল রানা। এই একটাই সম্বল। কটা গুলি করেছে দ্রুত ভেবে নিল-লুগারে একটা গুলি বাকি থাকার কথা, কারণ চেম্বারে সব সময় ও একটা বুলেট ভরে রাখে।
চোখের পলক পড়ার আগেই, কুলুঙ্গি থেকে বেরিয়ে, করিডরের সবেধন নীলমণি বাতিটা গুঁড়িয়ে দিল রানা। ঘনঘোর অন্ধকার এখন চারদিকে। এক লাফে দূরের দেয়ালটার কাছে চলে গেল, শরীর নিচু। গুলি করতে দেরি হয়ে গেল ব্রিগলের। আঁধারে লাল আগুন বর্ষণ করল ওর পিস্তল। পাথুরে টুকরো টাকরা- ছিটকে এসে মুখে লাগল রানার। করিডর ধরে, পায়ের আঙুলে ভরা করে, ব্রিগলের উদ্দেশে দৌড়ে গেল ও। দৌড়নোর ফাঁকে বাড়তি ক্লিপটা ভরে নিল লুগারে। এ
পালিয়ো না, ব্রিগল, চেঁচাচ্ছে রানা। আঁধারে শুটআউট করব আমরা। বিপজ্জনক খেলা। যার কপাল ভাল সে বেঁচে যাবে।
রুডলফ ব্রিগল, এইমাত্র রানার শূটিং চাক্ষুষ করেছে, রাজি হতে পারল না। অন্ধ শিকারীর প্রস্তাবে। ব্রিগল এতক্ষণ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে পৌঁছে। ওর ছুটন্ত পদশব্দ পেল রানা। পায়ের আওয়াজ বয়ে, আরেকটা অন্ধকার। সুড়ঙ্গের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে। বেড়ালের মত নিঃশব্দে ধাওয়া করল রানা, শব্দটাকে। ক্ষণিকের জন্যে ব্যারোনেসের কথা মনে উদয় হলো ওর। কি। করছে মেয়েটা? পারল কি কোর্টইয়ার্ডে পৌঁছতে?
করিডরের একটা মোড় ঘুরল এবার রানা। এখন আর মনে ঠাই পাচ্ছে না। ওর অন্য কোন ভাবনা–একমাত্র প্রাণ বাঁচাবে কিভাবে সেটা ছাড়া। রুডলফ, ব্রিগল মস্ত ভুল করে ফেলেছে। এক কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে সে।
রানা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে রূমটায় প্রবেশ করতে চারধারে তপ্ত সীসা আছড়ে পড়ল ওর। কি ঘটেছে উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হলো না এবার। এটা এক অস্ত্রাগার বিশেষ। ইচ্ছে করেই এখানে আত্মগোপন করেছে ব্রিগল। দেয়ালের উঁচুতে ঘরের একমাত্র জানালাটা। দমকা বাতাস ও বৃষ্টির ছিটে এসে পড়ছে ঘরে। ছাদ থেকে তারের খাঁচায় জ্বলছে ছোট্ট এক বাতি। ভারী টেবিলটার আড়াল নিতে ডাইভ দিল রানা। যুগপৎভাবে কামরার ওদিক থেকে বুলেট ওগরাল ব্রিগলের পিস্তল। রানার মাথার ওপর, দেয়ালে বাড়ি খেয়ে টুপটাপ খসে পড়ল গুলি।
টেবিলের পেছনে নিঃসাড় শুয়ে থেকে কান খাড়া রেখেছে রানা। ব্রিগলের। ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পরিষ্কার কানে আসছে। বাতিটাকে গুলি করার সিদ্ধান্ত বাতিল করল রানা। ব্রিগল ব্যাটাই খরচ করুক না বুলেটটা।
ব্রিগলও সম্ভবত একই কথা ভাবছিল, কারণ বাতিটা নেভানোর ধার ধারল। ও। তামাটে, স্বল্প আলোয় দুই শিকারী পড়ে রইল ওত পেতে। অপেক্ষা করছে প্রতিপক্ষ এই বুঝি কোনও ভুলের ফাঁদে পা দিল।
কামরার চারপাশে দৃষ্টি বুলাল রানা। প্রাচীন এক অস্ত্রশালা। দেয়ালে ঝুলছে। মান্ধাতা আমলের ঢাল-তরোয়াল ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র। সবগুলোই মরচে ধরা, ঝুল-কালিমাখা। কুঠারের ডাই, বিরাট বিরাট তরোয়াল ইতস্তত ছড়ানো। আরও আছে জং পড়া হাপর আর কাত হওয়া গ্রাইন্ডস্টোন।
দীর্ঘ নীরবতা অসহ্য হয়ে দাঁড়াল ব্রিগলের জন্যে। ইঁদুর-রক্ত ওর নেচে উঠল। ঘরের ওপ্রান্ত থেকে কথা যখন বলল, সামান্য কাঁপছে কণ্ঠস্বর। তারতম্যটুকু ধরা পড়ল রানার কানে। বিশ্রী অচলাবস্থায় পড়া গেল, রানা। একটা সমঝোতায় এলে কেমন হয়?
তাতে আমার বন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে না, ব্রিগল। অভিশাপ দেবে ওর বউ-বাচ্চা।
কিন্তু তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা করো। গোলাগুলি করে কোন লাভ নেই। মারা পড়ব দুজনেই। কেউ জিততে পারব না এভাবে! রানা নিশ্চপ। আবার, বলে চলল ব্রিগল, আমার লোকেরা এখুনি এসে পড়বে। তখন আর কোন চান্স থাকবে না তোমার! তারচেয়ে এসো আলোচনা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলি।
হা-হা করে হাসল রানা প্রাণহীন হাসি। নেইন! ওরা এখানে আসছে না। তুমি নিজেও জানো সেটা। নিজেদের গায়ের চামড়া বাঁচাতেই এখন ব্যস্ত ওরা। তোমার মস্তানরা জান নিয়ে পালাচ্ছে। এর ওপর কত টাকা বাজি ধরতে চাও?
অবিরাম জার্মান গালি-গালাজ ছুটল ব্রিগলের মুখে। হঠাৎই নার্ভ খুইয়ে। বসল ও, দৌড় দিল দরজার দিকে। ধেয়ে আসার সময় রানাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল। রানার শাটের হাতা ফুড়ে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। অল্পের জন্যে গায়ে লাগেনি। আরেকটা গেল ডান উরুতে ছ্যাকা দিয়ে।
ক্লোজ রেঞ্জ থেকে ব্রিগলের বুকে পরপর চারবার আগুন বর্ষাল রানা। চিত হয়ে পড়ে গেল লোকটা। মুহূর্তে উড়ে গেছে প্রাণপাখি।
মৃত লোকটার দেহের দুপাশে পা রেখে দাঁড়াল ও, লক্ষ করল জ্বলজ্বলে চোখজোড়া। লোকটার অসাড় হাতে লাথি মেরে পিস্তলটা দূর করে দিল রানা। নুয়ে পড়ে এবার চুল মুঠো করে মাথাটা তুলে ধরল। মুখটা পরখ করল। সযত্নে। বাঁ চোখের কোনা থেকে নিয়ে মুখ পর্যন্ত গোলাপী রঙের, কাঁচা এক কাটা দাগ। অভিনেতাটির সঙ্গে কি অদ্ভুত মিল-যদিও এর চেহারায় যে। শকুনতুল্য বিশেষত্ব রয়েছে, দুনিয়ার কোন সার্জনের ছুরিতেই তা ঢাকা পড়ার। কথা নয়।
মড়ার মুখটায় আঙুল বুলাচ্ছে রানা, অনুভব করছে গালের স্ফীতিটা। এটা। অকৃত্রিম। চামড়ার নিচে ছোট্ট এক পিণ্ড। মুচকে হাসল রানা। হু, পকেট থেকে স্টিলেটো বের করে চিরে দিল ক্ষতটা। জখমের ভেতরটা হাতড়ে বের করে। আনল চকচকে এক খুদে ধাতব, নাকাতার চাবির অংশটার সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য যার। দুআধখানা মিলে আস্ত একখানা। এখন শুধু গটগট করে ব্যাঙ্কে গিয়ে ঢোকা, আর ভল্ট হাতিয়ে সোনার চিতাবাঘ সহ সমস্ত লুটের মাল তুলে আনা। মুচকি হাসল রানা। অত সোজা নয়। অন্ততপক্ষে এখনও।
মিশন সফল আমার, পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেলে ভাবল রানা। নিজ হাতে শাস্তি দেয়া গেল বন্ধুর হত্যাকারীকে। আর চাবি? ওটা বাড়তি পাওনা। বোনাস। চিতাবাঘ নিয়ে যা খুশি করুকগে বুড়ো, থোড়াই পরোয়া করে ও।
রানা সিধে হতে পাথুরে মেঝেতে কার যেন জুতোর মস-মস্ শব্দ শুনতে পেল। পরিচিত পায়ের আওয়াজটা। ব্যারোনেসের।
ঝট করে চারদিকে নজর বুলাল রানা। কাটাঅলা, মরচে ধরা এক গদা। দেখতে পেয়ে তিন-চারবার ওটাকে পাই পাই ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। ব্রিগলের বিধ্বস্ত চেহারাটা মেঝেতে চোখ রেখে দেখছে রানা এমনিসময় কামরায় প্রবেশ করল ব্যারোনেস। হাতে লিলিপুট পিস্তল ওর।
ওর দিকে চেয়ো না, সাবধান করল রানা। মুখে গুলি করতে হয়েছে। দেখলে ভয় পাবে।
কেয়ার করল না ব্যারোনেস। রানাকে ঠেলে সরিয়ে, দুমুহর্ত স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ করল দোমড়ানো মোচড়ানো মৃতদেহটা। অবশেষে, মৃদু কণ্ঠে বলল, শুয়োরটা মারা পড়ল। মনে হচ্ছে যেন ট্রাক চাপা পড়েছিল। বেশ হয়েছে, উচিত সাজা পেয়েছে বদমাশটা- ওর দিকে চেয়ে ছিল রানা, যুবতী কঠোর হাসি হাসল। আগেই বলেছিলাম না–ওর আপন মা-ও চিনতে পারবে না।
ঠিক, বলল রানা, চোখ ওর লিলিপুট পিস্তলটার ওপর। ব্যারোনেস সরে গেল মৃতদেহের সামনে থেকে। রানার দিকে পিঠ ফিরিয়ে এক পায়ের স্ন্যাক। তুলল। খুদে অস্ত্রটা চালান করে দিল তার ভেতর।
মুখের চেহারা নির্লিপ্ত রানার। এখানে কি করতে এসেছ? পালাতে পারোনি?
না। ওরা নতুন অংশে যাওয়ার দরজাটা আটকে দিয়েছে। তাই ফিরে আসতে হলো। একা একা দাঁড়িয়ে থাকব নাকি, আমার ভয় করে না? রানার উদ্দেশে নিজেকে ছুঁড়ে দিল যুবতী। ওহ, গড়, রানা- আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও! আমি আর সইতে পারছি না!
ওর পিঠে মৃদু চাপড় দিল রানা। নিয়ে যাব, ভেবো না। তবে তোমাকে একটু ভিজতে হবে। তার আগে রানা এজেন্সীর লোককে ফোন করা দরকার। আমাদের পিক করে হোটেলে পৌঁছে দেবে। সুইস পুলিস এখানকার ঝামেলা সামলাকগে, কি বলো।…এসো।
.
১৫.
এক্সেলশিয়র হোটেলের চটকদার জানালার বাইরে তখনও সগর্জনে তড়পাচ্ছে ঝড়।
নাকাতার ব্যবহৃত পথটা দিয়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। ঘরের ভেতর জমাট শীতলতা। ক্লান্ত দেহে সোজা বিছানায় গিয়েছে ব্যারোনেস। রানা বাথরূম থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে এইমাত্র সিলিং লাইট জ্বেলেছে। ড্রেসার আয়নায় যুবতাঁকে দেখল ও। বড় বড় চোখ মেলে অবাক নয়নে রানাকে দেখছে সে।
চেকরূম থেকে সুটকেসটা ছাড়িয়েছে রানা। পরিষ্কার শার্ট ও টাই পরনে ওর। জ্যাকেট গায়ে চাপাল এবার।
রানা, ডার্লিং! এত তাড়াতাড়ি কোথায় চললে?
লুগার, স্টিলেটো ও গ্যাস বোমাটা চেক করে নিল রানা। সহি-সালামতে আছে সব কটা জিনিস। নিজের পথে, বলল রানা। এবং তোমাকেও উপদেশ দেব তাই করতে। রাস্তা দেখো, জুলি। তোমাকে একটা সুযোগ দেব আমি–তুমি ডিজার্ভ করো বলে নয়, তোমার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল বলে। বাঁকা হাসি ওর ঠোঁটে। বন্ধুত্ব-হাঃ! বন্ধুত্বের সঙ্গে সঙ্গে তুমি আরও অনেক কাজেই এক্সপার্ট। বিশেষ করে মিথ্যে বলাতে।
তড়াক করে বিছানায় সিধে হয়ে বসল ব্যারোনেস। ওর মুখের চেহারা কঁদো কাঁদো, বিস্ময়ের ও আঘাতের ধাক্কায়।
তুমি এসব কি বলছ? তোমার কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
গেছিল, বেবি, অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েছি! ভালই ঘোল খাইয়েছিলে আমাকে! কিন্তু এখন আর অভিনয় না করলেও চলবে-তোমার খেল খতম জুলি।
মৃণাল দুই বাহু বাড়িয়ে ধরল ব্যারোনেস। এসো, রানা, আমার কাছে। এসো। কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো।
নিষ্ঠুর হাসল রানা। হ্যাঁ, আসব বৈকি। বিদ্রূপ ঝরল ওর কণ্ঠে। প্রথম। থেকেই রুডলফ ব্রিগলের সঙ্গে কাজ করছ তুমি, বলে চলল রানা। হয়তো অনেক বছর ধরেই। সঠিক জানা নেই আমার। কোনভাবে তুমি ঢুকে পড়ো জার্মান ইন্টেলিজেন্সে। ভান ধরো ঘৃণা করো তুমি ব্রিগলকে। ওই লকেটটা পরে থাকার একটাই কারণ, মিথ্যেটাকে ভিত্তি দেয়া।
প্রতিবাদ করবে বলে মুখ খুলেছিল ব্যারোনেস, কিন্তু হাত তুলে ওকে অফ করে দিল রানা। আমাকে শেষ করতে দাও। তারপর বোলো কোথায় কোথায়। ভুল করেছি। তো ব্রিগল আর তুমি পুরানো দোস্ত। কেন এবং কিভাবে, জানি না। আমি। হাল নাগাদ সব খবর ওকে জানাতে তুমি। তাই সে বুঝে যায় কড়াইতে তেল ঢালা হচ্ছে। আবারও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে ওকে! এবং এভাবেই জানতে পারে বিসিআইয়ের এক এজেন্ট জেনেভা আসছে সোনার চিতাবাঘটা। ওর কাছ থেকে উদ্ধার করতে। ব্রিগল প্লাস্টিক সার্জারি করাতে যাচ্ছে জানতে তুমি, কিন্তু ইন্টেলিজেন্সকে জানাওনি, যদ্দিন পর্যন্ত না ভেবে বের করলে নিজেদের স্বার্থে কিভাবে এটাকে কাজে লাগানো যায়।
ঘরে পায়চারি করছে এখন রানা, ব্যারোনেসের দিকে ক্ষণে ক্ষণে চাইছে। হয় তুমি আর নয়তো ব্রিগল বুদ্ধি বের করো নকল ব্রিগল পয়দা করবে। ওই অ্যাক্টর, কি যেন নাম অ্যালফস না কি, হবে বলির পাঠা। ওকে চিনিয়ে দেবে তুমি আমাকে। বলবে ও-ই রুডলফ ব্রিগল। ওদিকে ব্রিগল, আর নাকাতা আরামে গিয়ে ব্যাঙ্কের ভল্ট সাফ করে দেবে, আমি যেহেতু ধাওয়া করছি বুনো হাঁসের পেছনে। তবে অভিনেতাটি বড় জব্বর বাছাই করেছিলে কিন্তু। পুরো নামটা কি ওর?
অ্যালফস। ক্লাউস অ্যালফস। পুরানো দিনের অভিনেতা। না খেয়ে মরছিল বুড়ো। ভুলক্রমে নয়, স্বেচ্ছায় ধরা দিল জুলি গ্রাফ। মুখের চেহারা। গোমড়া ওর।
এই তো, গুড গার্ল, হেসে বলল রানা। পুরোটা খুলে বলো দেখি এবার।
ঠোঁট কামড়াচ্ছে ব্যারোনেস। কি করবে তুমি আমাকে নিয়ে?
শ্রাগ করল রানা। আমি? কিছুই করব না। বলেছিই তো, তোমাকে একটা হেড স্টার্ট দেব। পালাতে পারবে কিনা, কোথায় পালাবে সে তুমি জানো, তবে চেষ্টা করে দেখতে দেয়ায় ক্ষতি কি?
ব্যারোনেসের চোখ ছলছল করছে। ওহ, রানা, বিশ্বাস করো আমার সব কিছু মিছে নয়। তোমাকে আমি সত্যি সত্যি ভালবেসে ফেলেছি। তুমিও কি আমাকে ভালবাসনি? একটুও না?
আমার প্রফেশনে, বলল রানা, এসব কথার কোন অর্থ বা মূল্য নেই। এবার নিজেই মিথ্যে বলল রানা। জীবনে কতবারই তো প্রেম এসেছে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায়নি ও। হাতঘড়িতে চোখ রাখল। নাও, শুরু করো। অনেক কাজ পড়ে আছে আমার।
বেডসাইড টেবিল থেকে সিগারেট নিয়ে জ্বালল ব্যারোনেস। ধোয়া ভেদ করে চেয়ে আছে রানার দিকে। হ্যাঁ, মিথ্যুক আমি। হতেই হয়েছে। টিকে থাকার জন্যে।
আমি বিশেষ পছন্দ করতাম না আমার বাবাকে। ছোটবেলা থেকেই ছিলাম হিটলারের উগ্র সমর্থক। কিন্তু বাবা দুচোখে দেখতে পারত না। নাজীদের। কাজেই ওরা বাবাকে খুন করায় তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি আমার। ব্রিগল আমাকে নিয়ে গেছিল বাবার হত্যাকাণ্ড দেখাতে। হ্যাঁ, আমি নিও-নাজীদের সঙ্গে পরে জড়িত হয়েছি। আরেকটু বড় হয়ে বুঝলাম, আসলে বাবা ছিল বেঈমান। নিও-নাজীদের মহান নেতা উয়ে সিলারকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল সে! কাজেই তাকে খুন না করে কোন উপায় ছিল না এদের।
দুঃখের ও ক্রোধের দ্বৈত অনুভূতি হলো রানার। একভাবে দেখলে, এ মেয়ের দোষ নেই। হিটলার বলেছিল-গিভ মি দ্য চিলড্রেন! এই মেয়ের ব্রেন ওরা ভালই ওয়াশ করেছে বলতে হবে।
বিছানার স্ট্যান্ডের কাছে এসে দাঁড়াল রানা। তারপর?
আমাকে ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করতে বলা হলো। ওরা বলল সময় হলেই সংগঠন আমাকে কাজে লাগাবে। বড় হয়ে কাজে আর কি লাগলাম, তার বদলে হলাম বুড়ো রুডলফ ব্রিগলের মিসট্রেস। ওকে ভালবাসিনি। আমি-কোনদিনও না। ওকে সহ্য হত না আমার-শারীরিকভাবে। কিন্তু কি আর করা, ওটাই আমার ডিউটি যে! লোকটা নিও-নাজীদের একজন বড় মাপের নেতা হাজার হলেও।
কন্টেসা? জবাব চাইল রানা। সে-ও কি জড়িত তোমাদের সাথে?
দুপাশে প্রবল ভাবে মাথা নাড়ল ব্যারোনেস। না, না, সে বেচারী এসবের। মধ্যে নেই।
বস এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করে দেখেছেন কন্টেসার ব্যাপারটা। মাথা ঝাঁকাল রানা। বেশ, ব্রিগলকে ফাঁকা মাঠ করে দেয়ার জন্যে আমাকে ভুল। পথে চালনা করতে তুমি। কিন্তু থনন থেকে স্টীমারে করে আসার সময় গুবলেট হয়ে যায় সব। তুমি শিয়োর ছিলে না, আমি বিসিআইয়ের লোক কিনা। কিন্তু ব্রিগলের লোকেরা তারপরও হোটেল হিলসনে ফলো করে যায় আমাদের। যখন তুমি নিশ্চিত হলে আমার ব্যাপারে, অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন, নাকাতা তার বাধানো দাঁত খুইয়ে বসেছে। আমার কাছে তখন ওটা, খুব কনফিউযড হয়ে পড়েছিলে, তাই না?
অনেকখানি স্বচ্ছন্দ বোধ করছে এখন জুলি। রানার দিকে চেয়ে দু। হাসল। ওটা আমার কোন ব্যাপার ছিল না। আমার কাজ ছিল তোমাকে ভুল লোক চেনানো–ক্লাউস অ্যালফসের পেছনে তোমাকে লেলিয়ে দেয়া।
আর ফ্রেঞ্চ কী-র ব্যাপারটা? জবাব চাইল রানা। ব্রিগল বলেনি তোমাকে ওটা হাত করতে?
না তো, অবাক হয়ে গেল জুলি। আমি তো ওটার কথা কিছুই জানি।
করুণার হাসি হাসল রানা। তাহলে ভিলা থেকে সে রাতে সিগন্যাল পাঠিয়েছিল কে, ব্যারোনেস?
আমি কি জানি? জীবনেও যেন এমন অদ্ভুত কথা শোনেনি ব্যারোনেস এমনি মুখভঙ্গি করল।
জানবে তো তুমিই, বলল রানা। ফ্রেঞ্চ কী আমার কাছে আছে সেটা তো একমাত্র তুমিই জানতে। কি, জানতে না? ব্রিগলের লোককে মোর্স সিগন্যালে জবাব দাওনি তুমি? তবে তোমার দুর্ভাগ্য, সতর্ক ছিলাম আমি। ওটা হাতানোর সুযোগ দিইনি তোমাকে।
চোয়াল ঝুলে পড়ল ব্যারোনেসের। পরাজয় স্বীকারের ছাপ ওর মুখের চেহারায়।
ফেঞ্চ কী আমার হাতে আসতে দেখে কন্টেসার ভিলায় আমাকে নিয়ে যাও তুমি, বলছে রানা। ব্রিগলের লোকজন যাতে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে ওটা। কি, ঠিক না?
ব্যারোনেস লা জবাব। বলার আছেটাই বাকি? রানা যা বলছে সবই তো সত্যি।
আচ্ছা, ওমর যে ব্রিগলের লোক তা তো তুমি জানতে?
ভ্রূ কোঁচকাল জুলি। না। ও যে ওখানে লোক প্ল্যান্ট করেছে জানা ছিল।
ও আসলে তোমাকেও বিশ্বাস করত না। ওমরকে প্ল্যান্ট করে ও তোমার ওপর চোখ রাখার জন্যে। চিতাবাঘের ঘটনার অনেক আগে থেকেই। তোমার কপাল ভাল, ব্যারোনেস। ব্রিগল মূর্তিটা হাত করতে পারলে, আমার ধারণা, তোমার দশাও হত নাকাতার মত।
শিউরে উঠল যেন যুবতী। চিন্তাটা আমার মাথাতেও এসেছিল। ওকে শেষদিকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সংগঠনের প্রতি আনুগত্য কমে এসেছিল ওর। লোভী হয়ে উঠেছিল ভীষণ রকম!
তারপরও তাল মিলিয়েছ তুমি ওর সাথে। যেই চান্স দিয়েছি অমনি চলে গেছ ওর কাছে-কালকে সিভিক গার্ডেনসে। ভান করেছ অ্যালফাই ব্রিগল, ভঙ্গি নিয়েছ ভয়ানক বিপদে পড়ে গেছ-ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে যেন। দারুণ অভিনয়, স্বীকার করতেই হবে। টর্চার চেম্বারে কী খেলাটাই না দেখালে! আমাকেও প্রায় কিনে ফেলেছিলে। খুব সহানুভূতি বোধ করছিলাম। তোমার প্রতি। কিন্তু চেম্বারে না গিয়ে উপায় ছিল না আমার, কারণ অস্ত্রপাতিগুলো সব ওখানেই রেখে এসেছিলাম যে।
ধূসর চোখে অদ্ভুত এক চাহনি নিয়ে রানাকে লক্ষ করছে যুবতী। তাহলে কখন-কখন আমার মিথ্যে ধরে ফেললে?
কর্কশ হাসল রানা। তুমি যখন ব্রিগলরূপী অ্যালফসকে বাগে পেয়েও খুন করলে না। লোকটা তোমার জানের দুশমন অথচ দিব্যি বাঁচিয়ে রাখলে তাকে। আর তুমি যদি ব্রিগলের শত্রুই হবে তাহলে তোমার সঙ্গে পিস্তল থাকে কি করে? আমাকে তো ওরা তন্ন তন্ন করে তল্লাশী করে তারপর দুর্গে ঢুকতে দিয়েছে। কিন্তু তার আগে অভিনেতাটিকে বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কাঁদতে দেখি। অনেকটা শিয়োর হয়ে যাই তখনই। তোমাকে আসলে প্রথম থেকেই বিশ্বাস করতে পারিনি আমি। তুমি আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছ। অ্যালফসই ব্রিগল। তখনই আসলে ফাঁদে পড়েছ তুমি। নিজেও জানতে সেটা, তাই পিস্তল হাতে এসেছিলে আমার পেছন পেছন। তুমি বুঝতে চাইছিলে সত্যিটা আমি জানি কিনা। ব্রিগল মনে করে অ্যাক্টরটাকে খুন করেছি কিনা। যদি করতাম, এবং সত্যটা জেনে ফেলতাম, তাহলে আমাকে খুন করতে তুমি। কিন্তু তোমাকে বোকা বানাই আমি। ব্রিগলের মুখের চেহারা থেঁতলে। দিই যার ফলে ওকে চিনতে পারোনি তুমি-প্রথম দেখায় বুঝতে পারোনি কাকে খুন করেছি আমি। ব্রিগলকে নাকি অ্যালফসকে। আর সত্যিই যদি ওর মুখে গুলি করতাম, তোমাকে যেমনটা বলেছিলাম, তাহলে আমি নিজেও বুঝতে পারতাম না। তাই তুমি ভাবলে তোমার চালবাজি ধরতে পারিনি আমি।
খেলে চললে তুমি আর তাই এখন বসে আছ আমার ঘরে।
সুটকেসটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল রানা। এখনও সময় আছে-পালাও। আমি চাই না বাকি জীবন জেলে পচে মরো তুমি।
রানা! মিষ্টি, অনুচ্চ কণ্ঠে ডাকল যুবতী। ঘুরে দাঁড়াল রানা। ব্যারোনেসের মুখে মৃদু হাসি, হাতে পিস্তল।
বসো, রানা, প্লীজ। তোমাকে খুন করতে চাই না। কিন্তু এখন তোমাকে যেতেও দিতে পারি না আমি। একটা বোঝাপড়া করা যায় না?
কটমট করে চাইল রানা। না।
তাহলে তোমাকে খুন না করে উপায় নেই আমার, রানা। আমার খুদে বন্ধু খুব অল্প আওয়াজ করে। কিন্তু কাজ করে মোক্ষম। আমি দুঃখিত, ডার্লিং, কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দেব আর তুমি হাটে হাঁড়ি ভাঙবে সেটি হয় কি করে? তোমার মৃত্যুর একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে আবার বনের কাজে জয়েন করব আমি।
তুমি একটা গাধা, রুক্ষ স্বরে বলল রানা। আমার ধৈর্যের বাধ কিন্তু ভেঙে যাচ্ছে।
রানার বুক লক্ষ্য করে ধরেছে ব্যারোনেস পিস্তলটা। ট্রিগারে চেপে বসেছে আঙুল। আমি দুঃখিত, রানা।
ট্রিগার টিপল ব্যারোনেস। মুচকি হাসল রানা।
কাজ হবে না, ব্যারোনেস। ভিলায় সেই প্রথম রাতেই পিস্তলটা অকেজো করে রেখেছিলাম আমি।
অবিশ্বাস আর ক্ষোভে বিকৃত জুলির মুখের চেহারা। রানাকে উদ্দেশ্য করে কয়েকবার ট্রিগার টিপল ও। ভোতা টিক শব্দ ছাড়া আর কোন কাজ হলো না।
গট ভেরড্যামপট। খুদে পিস্তলটা রানার দিকে ছুঁড়ে মারল ব্যারোনেস। কনুইয়ের গুতো মেরে সরিয়ে দিল ওটাকে রানা। ব্যারোনেস ফ্যাকাসে মুখে রানার দিকে একবার চাইল। তারপর গলার ভেতর কান্নাবোজা এক শব্দ করে মুখ গুজল বালিশে।
এখনও সময় আছে, ব্যারোনেস, পালাও। নইলে তোমার লোকেরাও তোমাকে ছাড়বে না, খুঁজে বের করে শাস্তি দেবে। আমি তোমাকে কিছুই বলছি না। মেয়েদের ওপর ক্ষোভ পুষে রাখি না আমি। পালাও। বেরিয়ে গেল রানা।
.
১৬.
মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। ঢাকা। বিসিআই হেডকোয়ার্টার।
মেজর জেনারেলের ডেস্ক ল্যাম্পের আলোয় নিষ্প্রভ দ্যুতি ছড়াচ্ছে সোনার চিতাবাঘটা। জ্বলজ্বলে রুবির চোখজোড়া রানাকে, জমাট রক্তের কথা মনে হয়তো আরও ঝরবে ভবিষ্যতে। রানার অবশ্য ও নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।
সিগারের ধোঁয়ার ওপাশ থেকে কথা বললেন বস। শেষবারের মত ভাল করে দেখে নাও, রানা। বিশেষ পাহারায় আজ রাতেই ইন্দোনেশিয়া চলে যাচ্ছে এটা।
সোনার মূর্তিটার গায়ে হাত বুলাল রানা। ওটাকে তুলে নিয়ে তলপেটের কাছটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে, বুক থেকে নিয়ে লেজ পর্যন্ত সরু এক চেরা দাগ আবিষ্কার করল।
মূর্তিটা ডেস্কে নামিয়ে রাখল ও। পেটের ভেতরের জিনিসটাই চাইছিলেন তারমানে, স্যার? কিছু একটা ছিল ওটার পেটে।
মাথা ঝাঁকালেন মেজর জেনারেল। গতকাল জেনেভা উড়ে গেছিলেন বস। ল্যাক লেম্যানের পানি থেকে নাকাতার চাবির অংশটা রানা উদ্ধার করার পর তিনি, রানা ও জার্মান সরকারের এক প্রতিনিধি গোয়েরিঙের ব্যাঙ্ক ভল্ট খোলন। তারপর চার্টার করা প্লেনে, বিশেষ প্রহরাধীনে ঢাকা নিয়ে আসেন বাক্সে ভরা চিতাবাঘের মূর্তি।
হারম্যান গোয়েরিঙের ভল্টে পাওয়া লুটের বাকি মাল দাবি করে জার্মান সরকারের প্রতিনিধি। কিন্তু অটল থাকেন রাহাত খান। তাঁর বক্তব্য, চাবি যার ভল্ট তার। শাসিয়ে দেন প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাবেন। ফলে জার্মান প্রতিনিধি আর বাড়াবাড়ি করতে সাহস পায়নি। সমস্ত সম্পত্তি ঢাকা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন রাহাত খান। তবে নিশ্চয়তা দেন, বাংলাদেশ ফিরিয়ে দেবে যার যা প্রাপ্য জার্মানীর দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
উড়ো টেলিফোন পেয়ে ব্রানহিল্ড দুর্গে ছুটে যায় সুইস পুলিস, কিন্তু গোটা কয়েক লাশ ছাড়া আর কিছুই পায়নি তারা। ভিলা রিকোর ক্ষেত্রেও তাই। সুইস প্রচার মাধ্যমে চরম ব্যঙ্গ করা হয়েছে সে দেশের পুলিস বিভাগকে। তাদের নাকের ডগা দিয়ে সুইস ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক খেলা সাঙ্গ করে, কারা যেন এক গাদা মৃতদেহ রেখে চলে গেছে। কিন্তু কিছুই টের পায়নি তারা।
আমি খুশি হয়েছি, রানা, বললেন বস্।
বুকের ভিতর পুলক অনুভব করল রানা। মাথা নিচু করে সবিনয়ে বলল, আমিও, স্যার। নিজ হাতে শাস্তি দিয়েছি বন্ধুর হত্যাকারীকে। চিতাবাঘ আর। অন্যান্য সব উপরি পাওনা। তবে, স্যার, একটা কথা অজানা রয়ে গেল।
চোখে প্রশ্ন নিয়ে চাইলেন বস। চাহনিতে প্রশ্রয়।
জানার ইচ্ছে ছিল, ওটার পেটে কি পেলেন।
আধো হাসি রাহাত খানের মুখে। অপারেশন ফোর্থ রাইখের মাস্টার প্ল্যান বলতে পারো। মোটা হলেও গোয়েরিং ছিল আর সবার চাইতে বুদ্ধিমান। অন্যদের অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য। কাজেই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা শুরু করে দেয় সে। বাঘটার পেট চিরে মাস্টার পেপার ভরে দেয়। ভয়ঙ্কর এক প্লেগ ব্যাসিলির ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিল এক জার্মান বৈজ্ঞানিক। তিন ধরনের প্লের্গের সংমিশ্রণ ছিল ওটা-বিউবোনিক, নিউমোনিক আর সেপ্টিকামিক। এই ভাইরাস পানিতে আর মাটিতে টিকে থাকবে বহু বছর পর্যন্ত-অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলাসের মত। সংক্রমণশীল অবস্থায় একশো বছরের বেশি সারভাইভ করতে পারবে ভাইরাসটা। এবং এ ধরনের প্লেগ ডায়াগনোস। করা প্রায় অসম্ভব। এ জিনিস হাতে থাকলে যুদ্ধ করতে হবে না, কোটি কোটি মানুষকে ভাইরাস ছড়িয়ে সাফ করে দেয়া যাবে। রুডলফ ব্রিগল জানত এটার কথা। আরও জানত জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স। ওদের কাছে ব্রিগল ফর্মুলা বিক্রি করে দিচ্ছে জানতে পেরে আঁতকে ওঠে গোটা আরব বিশ্ব আমাদেরকে ও.আই.সি অনুরোধ করে ফর্মুলাটা কিছুতেই যাতে ইসরাইলের হাতে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে। আর সেই ব্যবস্থাই করেছ তুমি।
উঠে দাঁড়াল রানা, বিনীত কণ্ঠে বলল, এবার আসি, স্যার? অনুমতি পেয়ে পা বাড়াল দরজার উদ্দেশে।
রানা!
দরজার কাছে থমকে দাঁড়াল রানা। ঘুরল। স্যার?
ডেস্কে রাখা তারের বাস্কেট থেকে একটা ফ্লিমজি তুলে নিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন মেজর জেনারেল। সংক্ষিপ্ত ফ্রিমজিটায় এক ঝলক নজর বুলাল রানা। প্যারিসের এক হোটেল রূমে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ব্যারোনেস জুলি গ্রাফকে। খুদে এক ছুরি ওর বুকে সেঁধিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্যারিস পুলিসের ধারণা আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা? আপনার কি ধারণা, স্যার? জার্মান ইন্টেলিজেন্সকে ঘোলা পানি খাইয়ে ছেড়েছিল ও। বদলা নেয়নি তো ওরা?
আমারও তাই ধারণা, রানা।
মাথা ঝাঁকাল রানা। পুরানো বান্ধবী কন্টেসার কাছে কি সাহায্যের জন্যে গিয়েছিল ব্যারোনেস? হয়তো গিয়েছিল, কিন্তু সাহায্য পায়নি। তারপর আর কি, জার্মান ইন্টেলিজেন্সকে এড়াতে পারেনি কিছুতেই।
বসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লিফটে চড়ল রানা। রাস্তায় বেরিয়ে এল একটু পর। শরতের চনমনে দুপুর। ট্রাফিক গিজগিজ করছে মতিঝিল এলাকায়। হর্নের উৎকট শব্দ। সিগারেট ধরাল রানা, ফুটপাথে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জনতার ঢল দেখল। কারা যেন স্লোগান দিতে দিতে চলে যাচ্ছে। মুচকি হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে।
ওর গাড়িটা পৌঁছে দেয়া হলো ফুটপাথের ধারে। ওতে উঠে চেনাজানা রাস্তা ধরে এগোল রানা অজানা-অচেনা ভবিষ্যতের পথে।
Leave a Reply