মাশুল
০১. ঘণ্টাখানেক আগে হিক্যারি পাস
ঘণ্টাখানেক আগে হিক্যারি পাস পেরিয়েছে বেন স্লেজেল। সূর্য এখন বিস্তীর্ণ উপত্যকার ওপাশে পাহাড়শ্রেণীর আড়ালে ডুব দিচ্ছে, শেষ বিকেলের সোনালী আলোর রেখারা উঁকি-ঝুঁকি মারছে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে। প্রেয়ারিতে পাইনের সুবাসিত ঠাণ্ডা বাতাস।
স্যাডলে বসেই ঘাড় ফিরিয়ে ফেলে আসা নিচু জমির দিকে তাকাল বেন, একটা মেসায় উঠে এসেছে ওর বাকস্কিন। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ঢেউ খেলানো তৃণভূমি জরিপ করল-পিছু নিয়ে আসছে না কেউ, কিংবা এলেও অন্তত ওর চোখে পড়ছে না। মাইল দশেক পেছনে হিক্যারি পাসে থেমে ঘোড়াকে পানি পান করার সুযোগ দিয়েছিল, সেই থেকে অস্বস্তি ভর করেছে মনে-কেবলই মনে হচ্ছে কেউ অনুসরণ করছে ওকে। আরেকটা কারণ সিরেনোর আশপাশে “গাট-হুক” র্যাঞ্চার টম নোলানের কুখ্যাতি-নিজের রেঞ্জে অনাহূত কারও উপস্থিতি সহ্য করে না দাম্ভিক বুড়ো; বেন স্লেজেলের মত মানুষকে তো নয়ই। এ মুহূর্তে গাট-হুক রেঞ্জ পাড়ি দিচ্ছে ও।
মেসার এক পাশে সরে এল বাকস্কিন, প্রায় হেঁটে এগোচ্ছে এখন। চলার মধ্যেই তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল বেন, ডানে-বামে তীক্ষ্ণ নজর চালাল। খোলা প্ৰেয়ারিতে নেমে গেছে মেসার ঢাল, বুনো কিছু ক্যাকটাস আর জুনিপার ঝোঁপ ছাড়া অন্য কোন গাছ নেই; বোল্ডার আর খানাখন্দে ভরা। ছায়া পাওয়া যাবে এমন কোন জায়গা দেখা যাচ্ছে না। তবে এ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় বেন; দুপুরের বিশ্রাম নেবে না ও, বরং রাত কাটাবে।
এবং তারও আগে, পরখ করে দেখবে আসলেই কেউ অনুসরণ করছে কিনা।
পাহাড়ের আড়ালে টুপ করে ডুবে গেল সূর্য, আবছা অন্ধকার নেমে এল, প্ৰেয়ারিতে। হেঁচড়ে স্যাডল ছাড়ল বেন। মেসার ঢাল শেষে অগভীর একটা অ্যারোয়ো চোখে পড়েছে, বাকস্কিনের লাগাম হাতে সেদিকে এগোল। ঘোড়াকে গ্রাউন্ড-হিচ করে স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেল বের করল, লেভার টেনে চেম্বারে একটা ৪৪-৪০ বুলেট পাঠিয়ে দিল। অ্যারোয়োর ঢাল বেয়ে ওঠা শুরু করল এবার; সন্ধের অস্পষ্ট আলোয় ব্যর্থ এক শিকারী মনে হচ্ছে ওকে। দীর্ঘ, ঋজু দেহ কিছুটা ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। জেদ আর প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়ে গেছে চোয়াল-সত্যিই যদি কেউ পিছু নিয়ে থাকে, কপালে খারাবি আছে ব্যাটার!
পড়ে থাকা একটা বোল্ডার এড়িয়ে অ্যারোয়োর চূড়ায় উঠে এল ও। কিনারে এসে শুয়ে পড়ল মাটির ওপর। ব্রিমে টোকা মেরে হ্যাটটা ঠেলে দিল পেছন দিকে, চিবুকের সঙ্গে স্ট্র্যাপ থাকায় পিঠের ওপর ঝুলে থাকল ওটা। জুনিপারের একটা, শাখা ওর মাথাকে আড়াল করেছে সামনের জমি থেকে, এমনকি মেসার ওপর থেকেও চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম। উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন করেছে, সময় আর স্থানও ওর অনুকূলে-সন্তুষ্টির সঙ্গে উপলব্ধি করল বেন। সিগারেটের গোড়া মাটির। সঙ্গে পিষে নেভাল, বাতাসে তামাকের ক্ষীণ গন্ধ ছাড়া আর কোন আভাস নেই যে। পিছু নেওয়া লোকটির জন্যে অপেক্ষায় আছে ও। গন্ধটাও অবশ্য বেশিক্ষণ থাকবে না, শিগগিরই বাতাসে মিলিয়ে যাবে।
সন্দেহটা হত না, যদি সচরাচর কোন ট্রেইল ধরে এগোত ও। তৃণভূমি পাড়ি দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথে গন্তব্যে পৌঁছতে চাইছে, ট্রেইলের কোন বালাই নেই; ঘণ্টা খানেক ধরে যদি পেছনে ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা যায় তাহলে কার না সন্দেহ হবে?
এবার ধৈর্য ধরার পালা। আদপে কাউকে পিছু নিতে দেখেনি বেন, কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিমে বিপদসঙ্কুল ট্রেইলে বহু দিন কেটেছে ওর, সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করার ব্যাপারে সচেতন একটা প্রবৃত্তি তৈরি হয়েছে, যার ওপর বেনের আস্থা ষোলোআনা। এ জিনিসটা না থাকলে এতদিনে হয়তো ট্রেইলের পাশে ফলকহীন কোন কবরে শুয়ে থাকতে হত ওকে।
ধীরে ধীরে কাটছে সময়। ঠাণ্ডা পড়ছে বেশ। কিন্তু অ্যাপাচীদের মত ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা আয়ত্ত করেছে বেন, শারীরিক ব্যথা বা দুর্ভোগ অগ্রাহ্য করতে শিখেছে। দরকার হলে সারা রাত একই ভাবে পড়ে থাকতে পারবে এখানে।
মৃদু হেষা ধ্বনি করল বাকস্কিন, জানিয়ে দিল সন্দেহটা অমূলক ছিল না-আসছে ওর শিকার!
উইনচেস্টারটা দেহের সামনে নিয়ে এল ও, তীক্ষ্ণ নজর চালাল বিস্তৃত তৃণভূমিতে। আবছা অন্ধকারে ক্ষণিকের জন্যে গাঢ় একটা অবয়ব দেখতে পেল, বোল্ডার সারির আড়ালে হারিয়ে গেল অশ্বারোহী। এখনও পঞ্চাশ গজ দূরে আছে, দুলকি চালে ঘোড়া ছোটাচ্ছে। মিনিট খানেকের মধ্যে নুড়িপাথর গড়ানোর ক্ষীণ শব্দ কানে এল, তারপর মেসার ওপর আকাশের পটভূমিতে গাঢ় একটা কাঠামো ফুটে উঠল। এক চুলও নড়েনি বেন, সম্ভবত অবচেতন মন সন্ধিগ্ধ করে তুলেছে লোকটাকে, আচমকা ঘোড়ার গতি কমিয়ে এনেছে। ধীরে ধীরে মেসা পেরিয়ে এল। সে, সতর্ক অনায়াস ভঙ্গি। ঢাল বেয়ে নেমে আসার পর নিচের উপত্যকা ধরে এগোল কয়েক গজ, বাকস্কিনটাকে সামনে দেখে দ্রুত রাশ টানল।
তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ করল লোকটার ঘোড়া, দু’কদম এগিয়ে থেমে গেল বাকস্কিনের পাশে। ইতি-উতি তাকাল লোকটা, কোমরে চলে গেছে ডান হাত। দ্রুত কয়েকটা সেকেন্ড পেরিয়ে গেল, একসময় ধাঁধা কাটিয়ে স্যাডল ছাড়ল সে-অ্যারোয়ের কাছ থেকে বিশ গজ দূরে। জানে না অ্যারোয়োর কিনারে অপেক্ষায় আছে বেন।
বাঁকা হাসিতে ভরে গেল বেনের মুখ। একেবারে সহজ টার্গেট। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল ও, খানিকটা ঝুঁকে সামনে প্রসারিত করল শরীর। কাউকে খুঁজছ নাকি, দোস্ত? মৃদু স্বরে জানতে চাইল এবার।
চরকির মত ঘুরল লোকটা। ঘোরার মধ্যেই ছোবল হেনেছে হোলস্টারে, নিমেষে বেরিয়ে এল পিস্তল। অ্যারোয়োর দিকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই কমলা আগুন। ওগরাল তার হাতের কোল্ট, শব্দ লক্ষ্য করে গুলি করেছে।
সময়মত মাথা সরিয়ে নিয়েছে বেন, ঠিক ওর নাকের সামনে দিয়ে গুঞ্জন তুলে চলে গেল গুলিটা। নিশানা দারুণ লোকটার, ভাবল ও। রাইফেলে নিশানা করেছি তোমাকে, দোস্ত! ফের যদি গুলি করো, তোমার ডান হাতে একটা সীসা ঢুকিয়ে দেব! চাপা, শীতল স্বরে সতর্ক করল বেন।
কিছুই দেখতে পাচ্ছে না লোকটা, স্রেফ ওর কণ্ঠ শুনে অবস্থান আন্দাজ করে নিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার সুযোগ নেওয়ার মত পরিস্থিতি নয়, অচিরেই উপলব্ধি করল সে, বেনের শীতল কণ্ঠ মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।
পিস্তল ফেলে দাও! সশব্দে মাটিতে পড়ল কোল্টটা।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল বেন, সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে লোকটার ওপর। আগন্তুকের দশ হাত দূরে এসে থামল, আবছা অন্ধকারে খুঁটিয়ে দেখল লোকটাকে।
ছ’ফুটের কাছাকাছি হবে সে, সুঠামদেহী। নিচু ব্রিমের হ্যাট মাথায়, ঘাড়ের কাছে তুলে দিয়েছে শীপস্কিন কোটের কলার।
কথার আগে দেখি পিস্তলের গুলি চালাও তুমি, দোস্ত! খুব অবাক হয়েছ আমাকে এখানে দেখে, না? ভেবেছ নিশ্চিন্তে অনুসরণ করতে পারবে, কিছুই টের পাব না?
শীতল দৃষ্টিতে ওকে দেখছে লোকটা। জানতাম ওখানেই আছ তুমি, অ্যারোয়াটা দেখিয়ে নিরুত্তাপ স্বরে বলল সে।
তুমি তো দেখছি একটা মিথ্যুকও! আমার পিছু নিয়েছ কেন?
লেযি-এনের জমিতে আছ তুমি?
গাট-হুক রেঞ্জ? চোখ
ছোট করে তাকাল লোকটা। যার মুখেই কথাটা শুনে থাকো, স্ট্রেঞ্জার, নির্দ্বিধায় বলতে পারি টম নোলান বা ওর রেঞ্জ সম্পর্কে ভাল কিছু বলেনি সে। লেযি-এনের জমিতে পা রেখে কখনও এই শব্দটা উচ্চারণ কোরো না, কারণ মি. নোলান বা আমরা–ওর কুরা–কেউই শব্দটা শুনতে পছন্দ করি না। লোকটা নিশ্চয়ই এও বলেছে নিজের জমিতে অবাঞ্ছিত কারও উপস্থিতি সহ্য করে না টম নোলান?
ওর হামবড়া ভাব কমেনি তাহলে! দাঁত কেলিয়ে হাসল বেন। বসের মতই সামান্য কথায় খেপে যাচ্ছ দেখছি! ঠিক আছে, না হয় লেযি-এনের জমি পাড়ি দিচ্ছি আমি, কিন্তু তাতে দোষের কি হলো? যে কোন রেঞ্জই সবার জন্যে উন্মুক্ত, অন্তত রাইড করতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
ঠিক। কিন্তু তোমার মত নিঃসঙ্গ রাইডাররাও মাঝে মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য কাজটা করে বসে, সুযোগ পেলে কয়েকটা গরু নিয়ে সীমানা পেরিয়ে যায়। ওদের ঠেকানোর জন্যে এই ব্যবস্থা। তোমার রাইড করা যেমন বেআইনী নয়, তেমনি নিজের রেঞ্জ দেখে-শুনে রাখাও বেআইনী নয়।
যুক্তিটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এবার বলো তো, আসলে লেযি-এনের হয়ে কেন কাজ করছ তুমি?
দু’হাত প্রসারিত করল লোকটা, হাতের তালু ওপর দিকে থাকল। পুরো রিও ফ্রিয়ো এলাকা দু’ভাগে বিভক্ত। এখানে হয় মি. নোলানের, নয়তো যাদেরকে সে বেসিন থেকে তাড়াতে চাইছে তাদের কাজ নিতে হবে তোমার। লেযি-এন বেতন ভাল দেয়, বাঙ্ক বা খাবারের মানও ভাল। বরাবরই ভাল খাবারের সমঝদার আমি। তাছাড়া বুড়ো কখনোই আমার কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিতে চায়নি।
ভালই লেকচার দিয়েছ! নিজের সম্পর্কে এমন খোলামেলা মন্তব্য কোন কাউহ্যান্ডের কাছ থেকে কখনও শুনিনি আমি।
বড়বড় কথা তো ভালই বলতে পারো, মিস্টার। কিন্তু লেযি-এন ক্রুদের চেহারা যখন দেখতে পাবে, তখন দেখব কোথায় থাকে এত তেজ! দু’জনকে লেজ তুলে পালাতে দেখলাম সেদিন, আরেকজন তো আরেকটু হলে পৈত্রিক প্রাণটাই হারিয়ে বসেছিল।
কারণ?
বেসিনের নিয়ম বা রীতি মানেনি ওরা, নিস্পৃহ স্বরে ব্যাখ্যা দিল সে।
গাট-হুক রীতি, তাই তো বলতে চাইছ?
নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে একটা হাত নাড়ল লোকটা। আবারও!
উইনচেস্টারটা মাটিতে রাখল বেন। অস্ত্র তুলে নিয়ে কেটে পড়ো, দোস্ত। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল ও, জানে বড় বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে, হয়তো পেছন থেকে ওকে গুলি করার চেষ্টা করবে লোকটা। কিন্তু নিজের সদিচ্ছা বোঝাতে বোধহয় এটাই একমাত্র উপায়।
ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ ওর, লোকটা নড়লেই টের পাবে। অবচেতন মন বলছে ঠকতে হবে না ওকে। প্রলোভনটা নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছে আগন্তুক, নিঃসাড় দাঁড়িয়ে থাকল সে, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বেনের দিকে।
থেমে, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল বেন। নামটা কি তোমার, চাদ?
পিস্তল তুলে লেগে থাকা বালি মুছল, লোকটা। জ্যাক হারলো।
টেক্সাসে এখনও তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে রেঞ্জাররা, জানো?
হাতটা স্থির হয়ে গেল, যেন তপ্ত লোহার ছ্যাকা খেয়েছে। স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল জ্যাক হারলো। পিস্তলের নল নিশানা করে রেখেছে বেনের বুক বরাবর। কি বললে?
বাদ দাও। এবার আমার কথা শোনো: স্রেফ চলার মধ্যে আছি, দোস্ত। দড়ির ব্যবসা করি না আমি। যদি করতামও, টম নোলানের গরুর কাছ থেকে অন্তত দশ মাইল দূরে থাকতাম; কিংবা ঘোড়া চোরও নই। যত দ্রুত সম্ভব রিও ফ্রিয়য়া পেরুতে চাই আমি।
অন্ধকারে জ্যাক হারলোর প্রতিক্রিয়া দেখার সুযোগ হলো না ওর। ধীরে ধীরে হোলস্টারে পিস্তলটা ভরে রাখল সে। রিও ফ্রিয়োর দিকে যাচ্ছ কেন?
ব্যবসা করতে।
নীরবে ওকে নিরীখ করছে জ্যাক হারলো-হিসেব কষছে। বেনের হেঁয়ালিতে বিরক্ত, গ্রাহ্য করতে চাইছে না, কিন্তু ঊরুতে নিচু করে বাঁধা জোড়া পিস্তল অস্বস্তি, ধরিয়ে দিচ্ছে মনে; তাছাড়া একটু আগে নিজের কারিশমা দেখিয়েছে আগন্তুক, তিক্ত মনে ভাবল সে, এর সঙ্গে ঝুঁকি নেয়া উচিত হবে না।
আনাড়ী লোক ভাল করেই চেনে হারলো। বেসিনে দুই ধরনের গানম্যান আছে–একটা পক্ষ টম নোলানের অধীন, গাট-হক করিডায় এদের আবাস; ওদের বিরুদ্ধে লড়ছে অন্যরা, তবে সংখ্যায় বেশি নয়। দুটো পক্ষের মধ্যে সীমানা হিসেবে কাজ করছে রিও ফ্রিয়ো। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া লেযি-এনের জমিতে পা রাখে না কেউ, কারণ এর মাশুল:বড় চড়া। নেহাত বোকা না হলে সবাই এড়িয়ে চলে গাট-হুক রেঞ্জ। এ লোকটি কোন কাতারেই পড়ে না-বোকা নয় সে, কিংবা লেযি-এনের সঙ্গেও কোন ব্যবসা নেই ওর।
এবার বিদেয় হও, হারলো।
প্রায় ঘোষণার মত শোনাল বেন স্লেজেলের কণ্ঠ, গলার স্বরে তাচ্ছিল্য আছে কিনা খুঁজতে গেল না জ্যাক হারলো, বরং নড় করল। আমারও একটা উপদেশ শোনো, দোস্ত, আগন্তুকের মত প্রায় একই সুরে জ্ঞান দান করল ও। এখনই রওনা দাও, সরাসরি উত্তরে গেলে সবচেয়ে কম সময়ে লেযি-এনের সীমানা পেরুতে পারবে, তাও অন্তত দশ মাইল পাড়ি দিতে হবে। রিও ফ্রিয়ো পেরুনোর আগে ভুলেও থেমো না।
নিজের ইচ্ছে মত পথ চলতে অভ্যস্ত আমি।
শ্রাগ করল হারলো, হেঁটে নিজের ঘোড়ার দিকে এগোল। পরিচয় দিতে আপত্তি আছে তোমার? খানিকটা কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল সে।
বেন স্লেজেল।
চরকির মত আধ-পাক ঘুরল হারলো, চোখ ছোট হয়ে এসেছে। সাহস আছে তোমার, স্লেজেল! পুরানো দিনের কথা ভুলে গেছ, নাকি ভেবেছ এতদিন পর ফিরে এসেছ বলে তোমাকে জামাই আদর করবে টম নোলান? মাঝে মধ্যেই তোমার কথা বলে বুড়ো, আর ফ্রেড মোরিস তো প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মুখ ধোয়ার আগে তোমার চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে!
সন্দেহ নেই ওসব শুনতে আমার অন্তত ভাল লাগবে না।
দাঁত কেলিয়ে হাসল সে। ফ্রেড মোরিসের ব্যাপারটা না হয় জানি, কিন্তু টম নোলানের কি ক্ষতি করেছ তুমি? কারও ওপর এত খেপে থাকতে ওকে দেখিনি আমি, স্লেজেল। দুনিয়ায় যদি কাউকে সে ঘৃণা করে থাকে তো সেই লোক হচ্ছে তুমি। আনমনে মাথা নাড়ল লেযি-এন গানহ্যান্ড। নার্ভ আছে তোমার, দোস্ত! লেযি-এনের জমিতে পা রাখার দুঃসাহস এমনিতেই কেউ করে না, আর তোমার তো রীতিমত কুখ্যাতি আছে এখানে।
জানতাম না আগের মত এখনও নিজেদের এলাকায় টহল দিয়ে বেড়ায় ওর লোকেরা।
নড করল হারলো। এই একটা ব্যাপারে কখনও ব্যতিক্রম হয়নি। কার্ল ব্রেনেল খুন হওয়ার পর থেকে আরও বেশি লোক নিয়োগ করেছে বস।
নীরবে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কেউই মুখ খুলছে না। দূরে একটা নিঃসঙ্গ কয়োটের আর্তনাদ শোনা গেল।
হয়তো কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যুর কারণেই ফিরে এসেছ, অনেকক্ষণ পর মন্তব্যের সুরে নীরবতা ভাঙল হারলো। ব্রেনেলের খুনের কিনারা করতে?
হয়তো।
নড করল হারলো। মেসার ঢাল বেয়ে উঠে গেল সে, চূড়ায় উঠে ফিরে তাকাল। মাইল দেড় দূরে আমাদের লাইন ক্যাম্প, ছেলেদের নিয়ে ওখানে আছে ফ্রেড মোরিস। অন্তত ছয়জন আছে ওর সঙ্গে। ইচ্ছে করলে বিশ মিনিটের মধ্যে ক্যাম্পে পৌঁছে যেতে পারব আমি, ফ্রেডকে তোমার কথা জানালে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করবে না ও।
ঠিক তাই করবে তুমি?
হ্যাঁ। যে কোন ট্রেসপাসিঙের ঘটনা রিপোর্ট করতে হয়, এটাই নিয়ম। স্মিত হাসল বেন। দেরি করছ কেন তাহলে?
চোখ তুলে উত্তর দিকে তাকাল হারলো। সরাসরি উত্তরে গেলে সংক্ষিপ্ত পথে লেযি-এনের সীমানা পেরুতে পারবে। জানোই তো স্কিলেট ক্রীকের ওপাড় থেকে ডাবল-বির জমির শুরু। আমার পরামর্শ শোনো: পাহাড়শ্রেণীর কাছাকাছি। পৌঁছা’নো পর্যন্ত থেমো না, দরকার হলে সারা রাত রাইড কোরো।
নড করল বেন। গ্রেসিয়াস, হারলো।
ভুলে যাও। তোমার কথা অনেক শুনেছি, শ্লেজেল। হয়তো তোমাকে সৎ পরামর্শ দেওয়ার মত যথেষ্ট কারণ আছে আমার।
যেমন?
নীরবে ওকে নিরীখ করল লোকটা। মানুষটা তুমি যাই হও, আমার অন্তত খারাপ লাগেনি। তোমাকে খুন করতে চাই না আমি, এটাই হচ্ছে আসল কারণ। অ্যাডিওস, দোস্ত!
লেযি-এন গানম্যান চলে যেতে বাকস্কিনের কাছে ফিরে এল বেন। দাঁড়িয়ে থেকে হারলোর ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনল মনোযোগ দিয়ে, ধীরে ধীরে দক্ষিণে চলে যাচ্ছে-একসময় মিলিয়ে গেল। বাকস্কিনের লাগাম ধরে হেঁটে খোলা জায়গায় সরে এল ও, তারপর স্যাডলে চড়ল।
ট্রেইলে এসে হাঁটুর তোয় বাকস্কিনকে এগোনোর নির্দেশ দিল ও। প্রায় হেঁটে এগোচ্ছে ঘোড়াটা। তাড়া নেই বেনের, কিন্তু মনে দুশ্চিন্তার ঝড় বইছে। ইচ্ছে করলেও জ্যাক হারলোর প্রচ্ছন্ন হুমকিকে উপেক্ষা করতে পারছে না।
দেখা যাচ্ছে ছয় বছরে এতটুকু বদলায়নি টম নোলান-এখনও প্রতিবেশী বা পাসিং-থ্র রাইডারদের রাসলার মনে করে সে। রেঞ্জে প্রবেশ করা যে কোন লোকের দিকে তেড়ে আসত লেযি-এনের ভাড়াটে গানম্যানরা, ছয় বছর আগে। দেখেছে বেন; সামান্য পান থেকে চুন খসলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিত। ওদের সুঁইয়ের খোঁচার মানে হচ্ছে ফর্টি-ফোরের সীসা–এই হচ্ছে গাট-হুক রীতি। নিরীহ অনেক রাইডার মারা গেছে এভাবে, লোকটাকে স্রেফ ট্রেসপাসার বা রাসলার হিসেবে দাবি করে লেযি-এন। ব্যস, আইনের ঝামেলা ওখানেই শেষ। টম নোলানকে প্রশ্ন করার সাহস কারও নেই। ঘাড়ের ওপর দুটো কল্লা আছে কার?
শীতল একটা অনুভূতি হচ্ছে বেনের। নেহাত ব্যক্তিগত কারণে ফিরে এসেছে। ও, কিন্তু শেষে হয়তো ঝামেলায় পড়বে, অবচেতন মন বলছে ওকে। জ্যাক হারলোর কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না, ধারে-কাছে আছে ফ্রেড মোরিস•••খবর পেলে পাগলা কুত্তার মত ছুটে আসবে সে। তার কারণও আছে।
অনর্থক রক্তপাত এড়াতে ছয় বছর আগে রিও ফ্রিয়ো এলাকা ছেড়েছে বেন, কিন্তু অন্য সবাই ভুলে গেলেও অন্তত ফ্রেড মোরিসের ওকে ভুলে যাওয়ার কথা নয়; এমনকি সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না সে।
বেন স্লেজেল যখন স্কিলেট ক্রীক পেরুল, ততক্ষণে মাঝ আকাশ পেরিয়ে গেছে চাদ, ফিকে হয়ে এসেছে আলো। কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত বোধ করছে ও। এখন আর ওকে ট্রেসপাসার বা রাসলার দাবি করতে পারবে না কেউ, কারণ লেযি এনের জমি ছেড়ে ভাবল-বির তৃণভূমিতে পা রেখেছে।
বাকস্কিন থামিয়ে ফেলে আসা ক্রীক আর লেযি-এন জমির দিকে তাকাল বেন। নিউ মেক্সিকোর উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে উর্বর জমি। বহু বছর ধরে এ জমি ভোগ করছে টম নোলান। হিক্যারি পাস থেকে রিও ফ্রিয়ো পর্যন্ত কয়েক হাজার একর নয়ন জুড়ানো তৃণভূমি-সৎ-অসৎ যে কোন উপায়ে হোক, দখল করেছে সে; তবে প্রতিবেশীদের অনেকের সঙ্গেই খুব একটা তফাৎ নেই তার, অন্তত নিজের জমি বাড়ানোর মানসিকতা বিবেচনা করলে। আর দশজনের চেয়ে কঠিন, পোড়-খাওয়া এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ বলেই আজ অন্যদের ঈর্ষার কারণ সে।
শীতল হুমকির মত ঠাণ্ডা বাতাস ধেয়ে এল গাট-হক জমি থেকে, কাপ ধরিয়ে দিল বেনের শরীরে। আজও দীর্ঘ একটা দিন কেটেছে স্যাডলে, কদিন আগে সিমারন ত্যাগ করার পর থেকে বলতে গেলে স্যাডল থেকে নামেইনি।
ঘুরে সামনের জমির দিকে তাকাল ও। মাইলের পর মাইল বিস্তৃত ঢেউ খেলানো তৃণভূমি, এদিক-ওদিক গজিয়ে উঠেছে জুনিপার বা মেস্কিটের ঝোঁপ। মাইল কয়েক দূরে সেন্টিনেল পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা বরফের চাঙড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে চাঁদের আলো-রূপার পাহাড় যেন!
ডাবল-বির জমিতে পা রেখেছে ও এখন। কার্ল ব্রেনেলের রেঞ্জ। বেন সেধে ঝামেলা না করলে নিশ্চয়ই ক্রীকের ওপাড়ে নিজেদের জমিতে থাকতে বাধ্য হবে লেযি-এনের ভ্যাকুয়েরোরা। ভরসা করার উপায় না থাকলেও আপাতত নিশ্চিন্ত বেন। পালক-পিতার আচমকা মৃত্যুর খবর পেয়ে ফিরে এসেছে ও, ঝামেলা করার আদৌ কোন ইচ্ছে নেই।
নিজেই চিঠিটা লিখেছে বিল ব্রেনেল, ওর ভাই-রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একসঙ্গে বড় হয়েছে ওরা। কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যুর পর ডাবল-বির দায়িত্ব বিলের ওপর বর্তেছে। ছয় বছর দূরে সরে থাকলেও ওকে ভুলে যায়নি বুড়ো। উইল অনুযায়ী নগদ কিছু টাকা পাবে বেন, প্রাপ্য অংশ বুঝে নিয়ে এ তল্লাট ছেড়ে চলে যেতে পারবে। ডাবল-বির কোন অংশ চায় না, কিংবা সঙ্গে উপরি হিসেবে লেযি এনের শত্রুতাও চায় না।
শরীর ক্লান্ত, তারপরও ঘণ্টা খানেক ঘোড়া ছোটাল ও। যত দ্রুত সম্ভব ডাবল-বিতে পৌঁছতে চাইছে, লেযি-এনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করার ইচ্ছে আরেকটা কারণ।
ভি-আকারের একটা রীজের কাছে পৌঁছে স্যাডল ছাড়ল বেন। জায়গাটা মোটামুটি নিরাপদ মনে হচ্ছে। ঘোড়ার লাগাম হাতে জুনিপার ঝোঁপের আড়ালে চলে এল ও। ঝড়ে বাঁকা হয়ে বড়সড় পাথরের ওপর ঝুঁকে পড়েছে উইলোর শাখা, অস্থায়ী আশ্রয় হতে পারে ওর জন্যে। স্যাডল ছাড়িয়ে ঘোড়ার যত্ন নিল ও, তারপর ক্যাম্প করল। আগুন জ্বেলে পাশে বেডরোল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল, কিছুটা হলেও উষ্ণতা পাবে।
পুরো ছয় বছর পর রিও ফ্রিয়োয় ফিরেছে বেন। ঈশ্বরের মত ভক্তি করত। এমন একজন মানুষের কথায় বেসিন ছেড়েছে, যে মানুষটা আপন ছেলের মত। লালন-পালন করেছে ওকে, নিজের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে ওর পার্থক্য করেনি কখনও। একুশ বছরের মাথা-গরম এক তরুণ ছিল ও তখন, কিন্তু কার্ল ব্রেনেলকে এতটাই শ্রদ্ধা করত যে তার নির্দেশ অমান্য করতে পারেনি, সমস্ত অসন্তোষ চেপে রেখে নির্দ্বিধায় অজানার উদ্দেশে পা বাড়িয়েছে।
মানুষটা দৃঢ়চেতা ছিল, কিন্তু টম নোলানের মত যথেষ্ট দৃঢ় ছিল না বলেই বোধহয় অপঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে। নিজের বিশ্বাস থেকে সরে আসেনি সে কখনও, গুটিকয়েক কাউহ্যান্ড নিয়েই লেযি-এনের কুখ্যাত ভ্যাকুয়েরোদের ঠেকিয়ে রেখেছিল এতদিন। গানশ্লিংগার ভাড়া করার বিপক্ষে ছিল সে, এবং নিজের সীমিত জমি নিয়েও সন্তুষ্ট ছিল। সারা জীবন লেযি-এনের তোপের মুখে কাটিয়েছে। কার্ল ব্রেনেল, কিন্তু ভেঙে পড়েনি কখনও।
দৃঢ় মনোবল আর যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসের কারণে পুরানো অভিজ্ঞ কিছু কাউহ্যান্ডের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে সে। কাউহ্যান্ডরা তাকে যতটা সমীহ করত, ঠিক ততটাই ঘৃণা করে টম নোলানকে।
ডাবল-বি ছাড়ার মুহূর্তটা স্পষ্ট মনে আছে বেনের। অফিসরূমে বিল আর ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল কার্ল ব্রেনেল। দশ দিন আগে শহরে পাট গাট-হুক ত্রুর মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল ওরা, সিরেনোর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গনফাইট সেটা। গান পাউডারের ধোয়া সরে যাওয়ার পর দেখা গেল দু’জন মারা গেছে, একজন আহত এবং সারা জীবনের জন্যে একটা হাত হারিয়ে বসেছে আরেকজন।
লেযি-এন প্রতিশোধ নিতে না পারলেও সুযোগ খুঁজছিল, বিল বা বেনকে মওকামত পাওয়ার জন্যে বেরিয়ে পড়েছিল বেশিরভাগ গানহ্যান্ড। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজের লোকদের ফিরিয়ে নেয় টম নোলান, হয়তো সিরেনোয় গানাইটের নেপথ্যে কারণটাই তার মত বদলে দিয়ে থাকবে-ঘটনাটা চেপে যায় লেমি-এন; এবং সম্ভাব্য একটা রেঞ্জ অরও এভাবে এড়িয়ে যায় টম নোলান।
কিন্তু তাতে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি বেন, বিল কিংবা ডাবল-বির অন্য কেউ। জানত হুমকিটা খাঁড়ার মত আজীবন ঝুলে থাকবে মাথার ওপর, সুযোগ পেলেই প্রতিশোধ নেবে লেযি-এন।
বিপদ এড়াতে একটা উপায় খুঁজে বের করল কার্ল বেনেল। প্রিয় দুই ছেলের মধ্যে অন্তত একজনকে বেসিন ছাড়তে হবে। আলাদা আলাদা ভাবে ওরা কেউই তেমন ভয়ঙ্কর নয়, কিন্তু একসঙ্গে আগুন আর সলতের মত! পিস্তল বা মুঠি চালাতে দু’জনেই দক্ষ, গড়পড়তার চেয়েও বেশি ক্ষিপ্র। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দু’জনের ওপর ছেড়ে দিল কার্ল ব্রেনেল। স্বেচ্ছায় বেসিন ছাড়তে চাইছিল বিল, কিন্তু তার আগেই নিজের কথা জানিয়ে দেয় কেন। ভিন্ন রক্তের ও, পালক পুত্র। যুক্তি না মেনে উপায় থাকল না কারও, না বিল কিংবা তার বাবার।
সাহসী লোকটা আর নেই এখন। প্রিয় নদীর কিনারে রূপালী এক রাতে মাথার পেছনে একটা বুলেট নিয়ে আজীবনের জন্যে শুয়েছে সে। কিন্তু কিছু পাওনা রয়ে গেছে তার, বেন স্লেজেলের কাছে; এই দেনা শোধ না করে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না বেন।
পাশ ফিরে শুলো ও। ঠাণ্ডা বাতাস কাপ ধরিয়ে দিচ্ছে শরীরে। হয়তো কিছু দিনের জন্যে খোলা জায়গায় এটাই শেষ রাত কাটাচ্ছে, ভাবল বেন। আবারও বিল ব্রেনেলের সঙ্গে একত্রিত হলে-দুই হরিহর আত্মার পক্ষে আলাদা হওয়া সত্যিই কঠিন হবে, জানে ও।
উঠে বসে আগুনে কয়েকটা কাঠ ঠেসে দিল বেন। সিগারেট রোল করল এরপর। দক্ষিণে লেযি-এন তৃণভূমির দিকে তাকাল চিন্তিত দৃষ্টিতে। জ্যাক হারলো যদি লাইন ক্যাম্পে গিয়ে ফ্রেড মোরিসকে ওর কথা জানিয়ে দেয়, নির্ঘাত স্কিলেট ক্রীকের উদ্দেশে ঘোড়া ছোটাবে মোরিস। পৃথিবীতে কাউকে যদি সে ঘৃণা করে তো সেই লোক হচ্ছে বেন। সিরেনোর সেই গানফাইটের পর নিজের লোকদের কঠিন শাসনে বেঁধে রেখেছিল টম নোলান, সেজন্যেই বেন বেসিন ছাড়ার আগে সুযোগ পায়নি মোরিস। তাছাড়া, বেন খবর পেয়েছে শেষ দিকে কিছুটা হলেও কোমল মনোভাব দেখিয়েছে লেযি-এন বস, শক্রর উদ্দেশে রাইডারদের লেলিয়ে দেয়া বন্ধ করেছে; কিন্তু একাধিকবার মেক্সিকো পর্যন্ত খেদিয়ে নিয়ে গেছে রাসলারদের, এমনকি উদ্দিষ্ট লোকটাকে ধরার জন্যে পুরস্কারও ঘোষণা করেছে।
কিন্তু সেসব বহু দিন আগের কথা, যখন রক্ত গরম ছিল টম নোলানের; আর। বসের মত আগ্রাসী, কলহপ্রিয় ছিল সব কাউহ্যান্ড। আপাতত বোধহয় ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা নেই, যতক্ষণ না নিজে আগ বাড়িয়ে ঝামেলা করে ও। কিন্তু তেমন কোন ইচ্ছে নেই ওর, ছয় বছরে যথেষ্ট পরিণত হয়েছে বেন–সতর্ক থাকতে শিখেছে, বিপদ বা ঝামেলা এড়াতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
জুনিপারের শাখার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা গানবেল্টের দিকে তাকাল ও, হাত বাড়ালেই তুলে নিতে পারবে। সিগারেটের গোড়া মাটির সঙ্গে পিষে নেভাল, পলকের জন্যে আগুনের শিখার আড়ালে নাচতে থাকা অবয়বগুলো দেখল শূন্য দৃষ্টিতে–অস্পষ্ট একটা মুখ ফুটে উঠেছে। প্রায় ছয় বছর হতে চলল রক্তমাংসের। অ্যাগনেস নোলানকে দেখেনি ও। কিন্তু ক্যাম্পের আগুনের পটভূমিতে এভাবে বহুবার অপূর্ব সুন্দর মুখটা কল্পনা করেছে, কল্পনা করতে ভাল লেগেছে।
টম নোলানের ঘরে কিভাবে অ্যাগনেসের মত মেয়ে জন্মেছে, ব্যাপারটা বরাবরই বিস্মিত করত ওকে। স্বভাবের মত দেখতেও বদখৎ সে। কিন্তু বেসিনের লোকজন জানে টম নোলানের স্ত্রী ছিল দারুণ সুন্দরী; অ্যাগনেসের জন্মের বছর খানেক পরই স্বামীর ওপর খেপে গিয়ে চিরতরে চলে গিয়েছিল মহিলা-রেখে গিয়েছিল একটা বাচ্চা আর তিক্ত কিছু স্মৃতি।
স্যাডলে মাথা এলিয়ে দিল বেন। শত মাইল দূরে থাকতে অ্যাগনেস নোলানের চিন্তা কুরে কুরে খেত ওকে, আর এখন কয়েক মাইলের মধ্যে পৌঁছে অস্থির করে তুলেছে–এতে বিস্ময়ের, কি আছে। কিন্তু মেয়েটিকে দেখার ইচ্ছে। নেই ওর, কিংবা দেখা করারও ইচ্ছে নেই। পুরানো ক্ষতের মুখ খুলে কি লাভ, যেখানে সিরেনোর রাস্তায় ওই ভয়ঙ্কর গানফাইটের কারণ স্বয়ং অ্যাগনেস নোলান।
সেই ঘটনার জের ধরে দু’জন লোক মারা গেছে, একজন বিকলাঙ্গ হয়েছে। যে কোন লোকের প্রতিহিংসা বা ঘৃণা দমানোর জন্যে যথেষ্ট রক্তপাত।
০২. একাই আছে ও
একাই আছে ও, চাপা স্বরে বলল কেউ। ঠিক খবরই দিয়েছে হারলো।
চোখ মেলে তাকাল বেন, দেখল আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিনটে ছায়া। কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না, কারণ প্রত্যেকের হাটের ব্রিম নিচু করা; তাছাড়া সবে ঘুম ভেঙেছে ওর, তন্দ্রালু ভাবটা উধাও হয়ে গেলেও দৃষ্টি পরিষ্কার হয়নি।
জাগাও ওকে! নির্দেশ দিল শীতল একটা কণ্ঠ।
কণ্ঠটা চেনা চেনা লাগছে, চোখ সরু করে লোকটাকে দেখল বেন। ছোটখাট গড়ন, লম্বায় বড়জোর সাড়ে পাঁচ ফুট হবে; তবে চওড়ায় পুষিয়ে নিয়েছে সে। কষ্ট করতে হবে না, জেগে আছি আমি, নিরুত্তাপ স্বরে বলল ও।
তাহলে উঠে বসো, বলল সবচেয়ে কাছের লোকটা। পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়ে না আবার।
নড করল বেন। কোল্টের দিকে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে নেই ওর। গা থেকে কম্বল সরিয়ে দিল, ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে কামড় বসাতে অজান্তে মৃদু কেঁপে উঠল। দেখল পশ্চিমাকাশে চলে গেছে চাঁদ, গাছপালার ছায়া লম্বা হয়ে গেছে। পায়ে বুট গলিয়ে জ্যাকেটের দিকে হাত বাড়াল ও।
থামো! শীতল একটা কণ্ঠ বাধা দিল।
খানিকটা পাশ ফিরে তাকাল বেন। লুকানো পিস্তল নেই আমার কাছে। জ্যাকেট পরব।
দরকার নেই, স্লেজেল! একটু ঠাণ্ডা লাগলে এমন কিছু হবে না তোমার।
শ্ৰাগ কুরল ও। একে একে সবার দিকে তাকাল, মুখগুলো ছায়ায় ঢাকা। তারপরও অন্তত একজনকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে, কাঠামোটা পরিচিত। সবচেয়ে খাটো লোকটা ছোটখাট একটা গরিলা বলা যাবে তাকে; কি যেন একটা অসঙ্গতি আছে লোকটার মধ্যে, মনে হলো বেনের।
চিবুকে হাত বুলাল দীর্ঘদেহী লোকটা। এখানে কি করছ তুমি, স্লেজেল?
ক্যাম্প করেছি।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু লেযি-এনের জমিতে কেন?
খানিকটা বিস্ময় নিয়ে লোকটার দিকে তাকাল বেন। এটা তো ডাবল-বির জমিঃ স্কিলেট ক্রীক পেরিয়ে এসেছি, নিশ্চিত হওয়ার পর ক্যাম্প করেছি আমি।
তাই নাকি? তুমি কি নিশ্চিত ওটাই স্কিলেট ক্রীক? বিদ্রূপ ঝরে পড়ল লোকটার কণ্ঠে।
তুমিও নিশ্চিত জানো, পার্ড।
পরস্পারের দিকে তাকাল তিনজন। আগুনে কিছু কাঠ ফেলল, নির্দেশ দিল খাটো গরিলা।
আগুন উস্কে দেওয়ার পর আলোকিত হলো জায়গাটা। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল বেন। খাটো লোকটার ডান বাহুর দিকে তাকাল, শীতল শিহরণ বয়ে গেল সারা দেহেলোকটার কনুইয়ের নিচ থেকে কিছুই নেই! কনুইয়ের নিচে শার্টের আস্তিন কাটা। ফ্রেড মোরিস? প্রায় স্বগতোক্তি করল ও।
নড করল সে, একইসঙ্গে পিস্তলও তুলল। তাহলে মনে করতে পেরেছ আমাকে? এখনও মনে রেখেছ দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি।
কাউকে পঙ্গু করে দেওয়া পছন্দ করি না আমি, মোরিস।
তাই? হাসালে, স্লেজেল! কিন্তু উল্টোটাই সত্যি মনে হচ্ছে আমার, ছয় বছর আগে আমাকে বিকলাঙ্গ করে দিতে তো খারাপ লাগেনি তোমার! পঙ্গু হাত নিয়েও দিব্যি কাজ চালিয়ে নিচ্ছি আমি, তাই না, বয়েজ?
নড করল অন্যরা।
লেযি-এনের ছায়াও মাড়াবে না, কয়েক বছর আগে সেই নির্দেশই দেয়া হয়েছিল তোমাকে, তাই না?
সেটার বরখেলাপ করলাম কোথায়? ওই তো স্কিলেট ক্রীক, আর এপাড়ে ডাবল-বির জমি।
পাশের লোকটার দিকে ফিরল ফ্রেড মোরিস। স্লিম, ওটাই কি স্কিলেট ক্রীক?
নাহ।
কার্লি?
আরে নাহ, ফ্রেড।
মিথ্যে বলছে ওরা, মোরিস, এবং তুমিও তাই করছ! শুকনো স্বরে বলল বেন। মনে শঙ্কার দামামা বাজছে, অনায়াসে আঁচ করতে পারছে নিকট ভবিষ্যৎ, নির্ঘাত ওকে রাসলার বা ট্রেসপাসার দাবি করবে এরা।
ঝুঁকে এল খাটো গরিলা, সস্তা হুইস্কির গন্ধ আঘাত করল বেনের নাকে। আমাকে মিথ্যুক বলছ, স্লেজেল? উস্কানির স্বরে জানতে চাইল সে। লোকটার কণ্ঠে হিংস্র সুর টের পেল বেন। পরিষ্কার আক্রোশ। মামলা চুকিয়ে ফেলতে অস্থির হয়ে পড়েছে।
ফ্রেড মোরিসের কাঁধের দিকে তাকাল ও। খাপ থেকে পিস্তল বের করে ফেলেছে কার্লি আর স্লিম। কোন চান্সই নেই ওর। নির্দ্বিধায় ওকে খুন করবে এরা, তারপর লাশটা টেনে নিয়ে যাবে রিও ফ্রিয়ের ওপাড়ে, যাতে দাবি করতে পারে। বেনই ট্রেসপাস করেছে কিংবা ঝামেলা করছিল। রিও ফ্রিয়ো অঞ্চলে এই ঘটনা নতুন কিছু নয়।
তো? শীতল স্বরে তাগাদা দিল মোরিস।
ওটাই স্কিলেট ক্রীক! জেদী স্বরে ঘোষণা করল বেন।
চোখের নিমেষে সক্রিয় হলো ফ্রেড মোরিস। বাম হাতে সজোরে ঘুসি হাকাল বেনের পেটে, এক লহমায় বেরিয়ে গেল ফুসফুসের সব বাতাস। অজান্তে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল বেন, সুযোগটা কাজে লাগাল লোকটা, বিকলাঙ্গ ডান হাত দিয়ে আঘাত করল ওর মুখে। তারপর কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মারল বেনের বুকে। কনুইয়ের নিচে হাতের বাকি অংশ না থাকলে কি হবে, আঘাতের চোটে চোখে অন্ধকার দেখল বেন, মনে হলো একটা গদা দিয়ে আঘাত করছে মোরিস। নিজের বেডরোলে চিৎপটাং হয়ে পড়ল ও।
ওর বুকের ওপর একটা বুট তুলে দিল মোরিস, ধীরে ধীরে চাপ বাড়াচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বেনের। মরিয়া চেষ্টায় দু’হাতে বুটটা চেপে ধরল ও, তারপর গায়ের জোরে মোচড় দিল। অস্ফুট স্বরে কাতরে উঠল মোরিস, বুটের চাপ কমে গেছে।
সুযোগটা লুফে নিল বেন, বুট ধরে ঠেলে দিল মোরিসের শরীর। উড়ে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ল সে ঘাসের ওপর। এদিকে গড়ান দিয়ে সরে গেছে বেন, ছেড়ে দেওয়া ম্প্রিঙের মত ঝটিতি উঠে বসল, দ্রুত হাত বাড়াল জুনিপারের শাখায় ঝুলন্ত কোল্টের দিকে।
কিন্তু ওর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষিপ্র ফ্রেড মোরিস। এতটাই ক্ষিপ্র যে, নিজেকে শুধু সামলেই নেয়নি, বরং সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেছে। কিছু টের পাওয়ার। আগেই মাথার পেছনে আবারও গদার মত আঘাত অনুভব করল বেন-সুযোগ। পেয়ে সরোষে গায়ের ঝাল মেটাচ্ছে মোরিস। মুখ থুবড়ে পড়ল ও, দেখল জুনিপারের শাখাটা তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে ওর দিকে।
কোন রকমে সামলে নিল ও, জুনিপারের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে পারলেও ফ্রেড মোরিসের নির্মম মার এড়াতে পারল না। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল ও, আধ পাক ঘুরে দাঁড়াতে পেটে পরপর দুটো ওজনদার ঘুসি এসে পড়ল। বাতাসের অভাবে খাবি খেল বেন, যন্ত্রণায় কুঁচকে গেছে মুখ। সুযোগ পেয়ে ওর অরক্ষিত মুখে আঘাত করল গরিলা, গদাসদৃশ ডান কনুই ব্যবহার করছে নিপুণ দক্ষতায়। আঘাতের চোটে চোখে সর্ষে ফুল দেখল বেন, মনে হলো নড়বড়ে হয়ে গেছে কয়েকটা দাত, মুখ ভরে গেছে তাজা রক্তে। ঠোঁটের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত চিবুক হয়ে বুকের কাছে ওর শার্টে পড়ল।
টলমল পায়ে পিছিয়ে গেল বেন, নিজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ভারসাম্যহীন শরীরটা গিয়ে পড়ল আগুনের ওপর। লেভাইসের আবরণ ভেদ করে শরীরে আগুনের তপ্ত হ্যাঁকা লাগতে যন্ত্রণায় অস্ফুট শব্দ করে উঠল।
দাড় করাও হারামজাদাকে! চাপা স্বরে নির্দেশ দিল মোরিস।
সঙ্গীর সাহায্যে এগিয়ে এল স্লিম নামের লোকটা, বেনের দুই বাহু চেপে ধরে। আগুন থেকে সরিয়ে আনল, তারপর মোরিসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।
শীতল ক্রোধ আর জিঘাংসা নিয়ে অপেক্ষা করছে ফ্রেড মোরিস। চোখ দুটো জ্বলছে হিংস্র শ্বাপদের মত, গরিলার ন্যায় বিশাল মুখে নগ্ন আক্রোশ ফুটে উঠেছে। এদিকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বেন, তবে এতটা হয়নি যে সুযোগ পেয়েও পাল্টা আঘাত করতে পারবে না-ক্ষণিকের বিরতির সুযোগ নিল ও। একটা হাঁটু তুলে মোরিসের পেটে আঘাত করল, চটপট দুটো ঘুসি হকাল প্রশস্ত মুখটায়।
তীব্র ব্যথায় খিস্তি করল মোরিস, মুখ কুঁচকে গেছে। মাথা নিচু হয়ে গেল তার। বেনের বুটের ঝাড়া লাথিতে পরমুহূর্তে মাটিতে পড়ে গেল সে।
ঘুরে ফ্লিমের দিকে মনোযোগ দিল বেন। ঘুসির তোড়ে উড়ে গিয়ে ছুটে আসা কার্লির ওপর পড়ল স্লিম ফ্লেচার, জোড়া দেহ আছড়ে পড়ল একটা লগের ওপর।
স্খলিত পায়ে দু’পা এগোল বেন। অনুভব করছে তাজা রক্তে ভরে গেছে মুখ। সশব্দে থুথু ফেলল ও, হাতের চেটো দিয়ে মুখের কোণে লেগে থাকা রক্ত মুছল। ফ্রেড মোরিস উঠে বসার চেষ্টা করতে লাথি চালাল তার গলায়। কাত হয়ে ঘাসের গালিচায় ঢলে পড়ল লোকটা।
হাত বাড়িয়ে কোল্ট তুলে নিয়ে কক করল বেন। পিস্তল বাগিয়ে ধরে দেখল উঠে বসার চেষ্টা করছে কার্লি আর স্লিম, সমানে খিস্তি করছে। কোল্টের মাজল দিয়ে তিনজনকে কাভার করল বেন।
খুব কাছেই গর্জে উঠল একটা পিস্তল, সংবিৎ ফিরল ওদের।
যথেষ্ট হয়েছে, স্লেজেল, বলল চেনা একটা কণ্ঠ। পিস্তল ফেলে দাও!
নিশানা করা কোল্টের নল নিচু করল বেন, কিন্তু ফেলল না। পাশ ফিরে দেখল তিনজন দর্শক জুটে গেছে। এদের একজন লেযি-এন ফোরম্যান স্টিভ হারকার। গোল্লায় যাও তুমি, হারকার! ত্যক্ত স্বরে গাল দিল ও।
দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল। স্থির দৃষ্টিতে বেনকে দেখছে স্টিভ হারকার, মুখটা পাথরের মতই কঠিন, নির্বিকার। চোখের কোণ দিয়ে দেখল হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অবাঞ্ছিত তিন অতিথি, দ্রুত শ্বাস ফেলছে এখনও। শীতল উম্মা ঝরে পড়ছে ফ্রেড মোরিসের চাহনিতে। কিন্তু স্লিম আর কার্লির চোখে শঙ্কা। জানে খেপে গিয়ে বেন যদি গুলি করে, তবে ওদের তিনজনই আসল টার্গেট।
আবারও বলছি, পিস্তলটা খাপে ভরে রাখো, স্লেজেল! কোন চান্স নেই তোমার! নিরুত্তাপ স্বরে সতর্ক করল লেযি-এন র্যামরড।
তিনটা ধেড়ে শয়তান পিটিয়ে আমাকে আধমরা করার চেয়ে বরং চান্সটা নেওয়াই ভাল।
দু’পা এগিয়ে এল স্টিভ হারকার। দীর্ঘদেহী মানুষ সে, ছ’ফুটের কাছাকাছি হবে। কালো একটা কোট পরনে, এমনকি হাতের দস্তানাগুলোও কালো। চাঁদের। আলোয় মুখটা মড়ার মত ফ্যাকাসে আর বিবর্ণ দেখাচ্ছে। ফ্রেড, সঙের মত দাঁড়িয়ে না থেকে সরে এসো, শান্ত স্বরে নির্দেশ দিল সে। স্লিম, কার্লি…তোমরাও চলে এসো। ক্রীক পেরিয়ে সরাসরি লাইন ক্যাম্পে চলে যাও।
কিন্তু স্টিভ, প্রতিবাদ করল মোরিস। এই হারামজাদা… ফোরম্যানের চোখের দিকে তাকাতে নিস্তেজ হয়ে এল তার কণ্ঠ। হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছল, তারপর হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল বেনের দিকে। শ্রাগ করে হারকারকে পেরিয়ে গেল সে, অনুসরণ করল স্লিম আর কার্লি।
পিস্তলটা খাপে ভরে রাখো, স্নেজেল, নিস্পৃহ স্বরে বলল হারকার।
মাথা খারাপ!
আপাতত নিরাপদ তুমি।
ফোরম্যানের পেছনে পরিচিত একটা মুখ দেখতে পেল বেন। জ্যাক হারলো। বেনের সঙ্গে চোখাচোখি হলো তার, মৃদু নড করল টেক্সান।
আমার সঙ্গে লাগতে এসো না, স্লেজেল! আলগোছে কোটের ল্যাপেল সরিয়ে দিল হারকার, নিচু করে বাঁধা ভয়াল দর্শন কোল্ট উঁকি দিচ্ছে হোলস্টারে। টান টান বুক আর পা দুটো কিঞ্চিৎ ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে সে, ডান হাতের আঙুলগুলো লেপ্টে আছে হোলস্টারের গায়ে; ভঙ্গিটায় স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে আত্মবিশ্বাসী সে, এতটাই যে বেনের হাতে খোলা পিস্তল থাকার পরও চ্যালেঞ্জ করতে দ্বিধা করেনি।
ঠাণ্ডা বাতাস বইছে প্ৰেয়ারিতে, বাতাসে মৃত্যুর ফিসফিসানি। শীতল অনুভূতি হচ্ছে বেনের। সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে নিরীখ করল-লেযি-এন ফোরম্যানের নির্লিপ্ত মুখ, খানিক বেঁকে থাকা ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল ও, অযথা বেপরোয়া হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারানোর মানে হয় না। তাতে ফ্রেড মোরিসের ইচ্ছের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়াই সার হবে। শুধু রিও ফ্রিয়ো অঞ্চলই নয়, সারা নিউ মেক্সিকোয় বোধহয় স্টিভ হারকারের চেয়ে ফাস্টগান নেই কেউ।
স্লেজেল? মৃদু স্বরে ডাকল সে। দস্তানা পরা হাতের মুঠি খুলে আবারও বন্ধ করল। এটাই তোমার শেষ সুযোগ।
আবারও নড় করল হারলো, চোখের কোণ দিয়ে দেখল বেন, বুকে ক্রস আঁকল।
হ্যামার নামিয়ে পিস্তলটা বেডরোলের ওপর ছুঁড়ে ফেলল ও। এবার নিশ্চিন্তে গুলি করতে পারো তুমি, হারকার, তিক্ত স্বরে বলল বেন। কি চান্স বাকি থাকল আমার?
কয়েক পা এগিয়ে এল স্টিভ হারকার। কফি তৈরি করো তো, জ্যাক, মি. স্লেজেলের সৌজন্যে।
আগুনে আঁরও কাঠ ফেলল তৃতীয় লোকটা, আড়চোখে বেনকে জরিপ করছে সে। মেক্সিকান নাকি দো-আঁশলা, নিশ্চিত হতে পারল না বেন। পরিচিত মনে হচ্ছে লোকটাকে, কিন্তু চিনতে পারল না। রিও ফ্রিয়ো অঞ্চল ছাড়ার আগে এমন বহু লোককেই চিনত। লোকটার উপস্থিতি কিংবা নির্লিপ্ত চাহনি অস্বস্তি ধরিয়ে। দিচ্ছে মনে, শীতল অনুভূতিটা ক্রমশ জোরাল হচ্ছে। স্টিভ হারকার হয়তো কঠিন বিপজ্জনক মানুষ, একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত তাকে বিশ্বাসও করা যায়; কিন্তু এই লোককে কখনোই বিশ্বাস করা যাবে না, অভিজ্ঞতা বলছে বেন স্লেজেলকে, কেউটের মতই দু’মুখো সাপ সে।
শ্রাগ করে ডেনিম জ্যাকেট গায়ে চাপাল বেন।
বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে, আলাপী সুরে বলল হারলো। শীত বোধহয় এবার তাড়াতাড়ি আসবে। রাজহাঁসগুলো দেখেছ, দক্ষিণে যাচ্ছে ওরা?
পাখিদের দক্ষিণে যাওয়ার সময় এখন। তোমার মত অতিথি পাখি, শ্লেজেল, নড করে বলল লেযি-এন ফোরম্যান। রিও ফ্রিয়োয় কি করছ তুমি?
স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, শুকনো স্বরে বলল বেন, আলতো হাতে কেটে যাওয়া ঠোঁট স্পর্শ করল।
কনুইহীন হাতটা ব্যবহার করতে জানে বটে ফ্রেড, মন্তব্যের সুরে বলল হারলো। এমনকি সুস্থ যে কোন লোকের মুঠির চেয়েও ঢের ভাল ব্যবহার করে।
কোন একদিন ওর গলাটাই কেটে ফেলব আমি! বিড়বিড় করে বিষোদার করল বেন।
হয়তো, নিস্পৃহ স্বরে বলল হারকার, বেনের মন্তব্যটাকে স্রেফ উপেক্ষা করল। আগুনের কাছে গিয়ে দস্তানা পরা মুঠি দুটো মালিশ করল উষ্ণতার আশায়। ওকে খেপিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি তোমার, স্লেজেল।
আমি ওর ওপর চড়াও হইনি, হারকার, বরং ওরাই ঘুমের মধ্যে আক্রমণ করেছে আমাকে।
ফ্যাকাসে নীল চোখ জোড়া স্থির হলো বেনের ধূসর চোখে। উঁহু, আজ রাতে ওকে খেপাওনি তুমি, স্লেজেল। ছয় বছর আগে সিরেনোর রাস্তায় ওর ডান হাতের কনুই উড়িয়ে দিয়েছ তুমি।
ওর হাতে তখন একটা পিস্তল ছিল, হারকার। এর মানে নিশ্চয়ই বোঝো? যদূর জানি তুমি নিজেও কয়েকটা খুন করেছ, কিছু লোককে পঙ্গুও করেছ।
ফট করে ফাটল আগুনে ঠেসে দেওয়া জুনিপারের শুকনো শাখা। কফির কেতলি আগুনে চাপিয়ে দিল জ্যাক হারলো, তারপর সাবধানী দৃষ্টিতে তাকাল বেনের দিকে-চাহনিতে ভৎর্সনা।
বিকেলে লেযি-এনের জমি পাড়ি দিয়েছ তুমি, শান্ত স্বরে বলল স্টিভ হারকার, যেন বেনের মন্তব্যটা শুনতেই পায়নি। এর পরিণতি জানো নিশ্চয়ই? অন্য যে কারও চেয়ে তোমার সেটা ভাল জানার কথা।
দ্রুত রিও ফ্রিয়ো পেরুতে চাইলে এটাই…
অন্য পথেও রিও ফ্রিয়ো পেরুনো সম্ভব। হয়তো ঘুরপথ, কিন্তু সেটাই স্বাভাবিক। তুমি ভাল করেই জানো লেযি-এনের জমিতে অবাঞ্ছিত কারও উপস্থিতি সহ্য করে না বস্। ইচ্ছে করলে তোমার শরীরে একাধিক বুলেট ঢুকিয়ে দিতে পারত হারলো।
না হেসে পারল না বেন। সুযোগ আমারও ছিল।
বরফের মত শীতল হয়ে গেল নীল চোখের চাহনি। কোন লেযি-এন ক্রুকে গুলি করেই দেখো, এই মাটিতেই খুন হয়ে যাবে তুমি!
গাট-হুক আইন, তাই না, হারকার?
ফিরে এসেছ কেন?
বলেছি তো, দেখা করতে। কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যু সম্পর্কে আগ্রহ নেই তোমার?
কেতলিতে পানি ফুটতে শুরু করেছে। শীতল অস্বস্তিকর পরিবেশে উষ্ণ আমেজ এনে দিল যেন শব্দটা। একটু পর, কাপে কফি ঢেলে সবাইকে পরিবেশন। করল জ্যাক হারলো।
দীর্ঘদেহী গানফাইটারকে নিরীখ করছে বেন। এক হিসেবে ঠিকই বলেছ।
প্রতিশোধ নিতে চাও?
না, কফিতে চুমুক দিল ও। কার ওপর প্রতিশোধ নেব? কেউই জানে না কে খুন করেছে ওকে।
সেটা ঠিক।
কফির কাপের ওপর দিয়ে চোখাচোখি হলো দু’জনের, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ওরা। বেনের দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ, কিন্তু র্যামরডের চাহনিতে শীতল উষ্মা ঝরে পড়ছে।
কাপ নামিয়ে রেখে সিগারেট ধরাল হারকার। হয়তো বুড়োর কাছে কোন দেনা আছে তোমার?
নড করল বেন। স্মৃতি, হারকার। একজন বিশাল হৃদয়ের মানুষের স্মৃতি, যে কিনা কুড়িয়ে পাওয়া একটা বাচ্চাকে নিজের সন্তানের মত মানুষ করেছে, অথচ মানুষটা নিঃসন্তানও ছিল না। আমাদের মধ্যে কখনোই পার্থক্য করেনি সে, সবাই ওর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম।
কিন্তু তারপরও তোমাকে বেসি ছাড়া করেছে সে।
না, আমি নিজেই চলে গেছি। হয় বিল নয়তো আমাকেই যেতে হত। বিল ওর নিজের রক্তের।
স্মিত হাসি দেখা গেল আরকারের ঠোঁটে। কেউ কেউ বলে বিলকেই বেসিন ছাড়া করা উচিত ছিল তার।
কি বলতে চাও তুমি?
কফি নিঃশেষ করে উঠে দাঁড়াল ফোরম্যান। শিগগিরই জেনে যাবে।
সিগারেটের গোড়া আগুনে ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল বেন। বুঝতে পারছে স্টিভ হারকারকে প্রশ্ন করে লাভ হবে না, নিজে না চাইলে মুখ খুলবে না সে। বরং
আগে যা করেনি কখনও, অনেকক্ষণ কথা বলেছে ওর সঙ্গে।
আয়েশী ভঙ্গিতে দু’হাত মালিশ করছে হারকার। দেখো, স্লেজেল, ব্যক্তিগত ভাবে তোমার ওপর কোন বিদ্বেষ নেই আমার; কিন্তু টম নোলানের হয়ে কাজ করি আমি। সে যা বলে সেটাই হয় এখানে। কার্ল বেনেলের মৃত্যুর পরপরই আমাকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে বস, ঠিকই আঁচ করেছে যে ফিরে আসতে পারো তুমি। আরও একটা আন্দাজ করেছে সে: এসেই ঝামেলা শুরু করবে তুমি। সেজন্যেই। দেখতে এলাম কিছু ঝামেলা যাতে তোমাকেও ফেরত দেয়া যায়। পরিষ্কার?
নিজস্ব কোন ইচ্ছে আছে তোমার, হারকার? টম নোলান কি তোমার জন্যে ভাবে কখনও, বলে দেয় আসলে তোমার কি করা উচিত?
রাগে জ্বলে উঠল ফোরম্যানের চোখ দুটো, চোখের পাশে দপদপ করে লাফাচ্ছে একটা শিরা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে। মন্তব্যটা এড়িয়ে যাচ্ছি, আপাতত, নিস্পৃহ স্বরে বলল। কাল ডাবল-বিতে পৌঁছে যাবে তুমি, যতদিন ইচ্ছে থাকো; কিন্তু ঝামেলা করতে এদিকে এসো না, কারণ বিনিময়ে এর কয়েকগুণ ফেরত পাবে তুমি। এবং আমি না চাইলেও হবে এসব।
নড করল ও।
আজ রাতে আর কোন ঝামেলা হবে না তোমার।
গ্রেসিয়াস, শুকনো স্বরে বলল বেন।
মুহূর্তের জন্যে নীরব হয়ে গেল হারকার। ছয় বছর পর বিল ব্রেনেলের সঙ্গে দেখা হবে তোমার, তাই না?
হ্যাঁ।
শুনেছ তো বিয়ে করেছে ও, স্লেজেল? কিংবা জানো মেয়েটা কে? বাঁকা হাসি ঝুলছে লেযি-এন র্যামরডের ঠোঁটের কোণে, পমেল আঁকড়ে ধরে স্যাডলে চড়ে বসল। মাথায় হ্যাট চাপিয়ে দস্তানা পরা হাত তুলে উইশ করল বেনের উদ্দেশে।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বেন। ওর বিয়ের খবর পাইনি আমি।
মাত্রই তো এলে। যাক না কটা দিন। আরও অনেক খবরই পাবে, বেন স্লেজেল!
০৩. পুব আকাশে ভোরের রঙ
পুব আকাশে ভোরের রঙ ধরতে শুরু করেছে, হিমেল বাতাস বইছে প্ৰেয়ারিতে। নিভু নিভু হয়ে গেছে ক্যাম্পের আগুন, তবে দিনের আলো ফুটতে শুরু করায় দেখতে সমস্যা হচ্ছে না। তিক্ত এবং প্রায় নিঘুম একটা রাত কাটানোর পর ভোরের উন্মেষে ঘুমানোর চেষ্টা করার মানে হয় না, ভাবল বেন স্লেজেল। বেডরোল গুটিয়ে যাত্রার আয়োজন করল ও। সবকিছু গুছিয়ে বাকস্কিনের স্যাডলে চেপে বসল।
সরাসরি উত্তরে পাহাড়শ্রেণীর দিকে এগোল বেন। হিমেল বাতাস সঙ্গী হলো ওর। সামনে কটনউড আর উইলোর ঘন সারি চোখে পড়ছে, কিছুটা নিচুতে ঢেউ খেলানো জমির বুকে সরু ফিতের মত বয়ে যাচ্ছে নদীটারিও ফ্রিয়ো। একটা রীজের চূড়ায় এসে ক্ষণিকের জন্যে থামল ও, সিগারেট রোল করার ফাঁকে রিও ফ্রিয়ো উপত্যকায় নজর চালাল।
চির সবুজ এ উপত্যকায় সোনা ফলতে বহু রক্ত ঝরেছে। রিও ফ্রিয়ো যেন অপূর্ব সুন্দরী এক রমণী-কে পাওয়ার নেশায় বেপরোয়া হয়ে পড়েছে কিছু মানুষ, সংঘাত আর খুনোখুনি করতেও কুণ্ঠা বোধ করছে না কেউ। আসলেই কি এই উপত্যকার ততটা মূল্য আছে? আনমনে ভাবল বেন। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই নিজস্ব সৌন্দর্য আছে উপত্যকাটার, আছে অবারিত সবুজ তৃণভূমি আর। পাইনের গন্ধ মাখা সুবাসিত বাতাস। স্বপ্ন দেখতে পারে যে কেউ-বসতির স্বপ্ন, ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
এই উপত্যকার ইতিহাস রক্তাক্ত সংঘাতে ভরা। স্পেনিয়ার্ডরা আসার আগে এর দখল নিয়ে লড়েছে ইন্ডিয়ানরা, আর মেক্সিকান যুদ্ধের পর লড়েছে আমেরিকানরা। এখনও লড়ছে, মাঝে মধ্যেই তাদের প্রতিহিংসার আগুনে বুলি হয়েছে হতভাগ্য কিছু মানুষ; শত্রুতা আর ঘৃণার দীর্ঘস্থায়ী পথ তৈরি করেছে।
পুব আকাশে গোলাপী আভা ছড়িয়ে দিল সূর্য, উষ্ণ কোমল আলোয় ডুবে গেল প্ৰেয়ারি। রিও ফ্রিয়োর পশ্চিম আর দক্ষিণে ডাবল-বির জমি, বাপের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ডলোরেস ক্যাস্টানের সম্পত্তি ছিল একসময়। টেক্সান কার্ল ব্রেনেলকে বিয়ে করে স্প্যানিশ এই মহিলা। পাঁচ সন্তানের জন্ম দেয় সে, যাদের মাত্র তিনজন বেঁচে আছে এখন সবার বড় বিল ব্রেনেল, বাপের। লালচে চুল আর মা-র কালো চোখ পেয়েছে সে; বাপের নীল চোখ আর মা-র ঘন কালো চুল এবং সৌন্দর্য পেয়েছে মিরিয়াম; সবার ছোট জেফরি ব্রেনেল মা-র কোমল স্বভাব পেলেও শারীরিক ভাবে বাপের হুবহু সংস্করণ।
ডলোরেসের সৎ বোন নূয বিয়ে করেছিল টম নোলানকে। লেযি-এনের যে কোন সম্পত্তি যেমন দৃঢ় হাতে, আগলে রাখে নোলান, তেমন করেই মহিলাকে ভালবেসেছিল সে, কিন্তু তাতে দুজনের কেউই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। প্রথম বাচ্চার জন্মের পরপরই টম নোলানকে ছেড়ে চলে যায় মহিলা, পেছনে রেখে গেছে তিনটা জিনিস: বাচ্চা এক মেয়ে-অ্যাগনেস, স্বামীর প্রতি অপরিসীম ঘৃণা এবং রিও ফ্রিয়ো উপত্যকার অস্পষ্ট, সামঞ্জস্যহীন একটা দলিল।
কার্ল ব্রেনেল আর ডলোরেসের বিয়ের যৌতুক হিসেবে পাওয়া ডাবল-বির সম্পত্তির দলিলের ঠিক উল্টো এটা। দুই ক্যাস্টানে বোন পরস্পারকে যথেষ্ট ভালবাসত, কিন্তু নিজেদের অজান্তে ঘৃণা আর প্রতিহিংসার বীজ বপন করেছে ওরা। কার্ল ব্রেনেল আর টম নোলানকে তারই জের টানতে হচ্ছে, নিজের বা অধীন ক্রুদের রক্তের তেতো স্বাদ নিয়ে। ল্য নোলান এই উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ সাতাশ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সম্পত্তির নিস্পত্তি যেমন হয়নি, তেমনি দুটো বাগানের মধ্যে শক্রতারও শেষ হয়নি।
রীজ ছেড়ে উপত্যকা ধরে এগোল বেন। মিনিট ত্রিশের মধ্যে আরেক রীজে উঠে এল, থেমে নিচের উপত্যকায় ডাবল-বি র্যাঞ্চ হাউসের দিকে তাকাল। এটাই ওর বাড়ি, সত্যিকার বাড়ি। কয়েকদিন বয়সে রাস্তা থেকে তুলে আনার পর নিজের সন্তানের মত ওকে মানুষ করেছে কার্ল ব্রেনেল। বেন সম্পর্কে কেবল একটা কথাই জানত ব্রেনেলরা–ওর নাম স্লেজেল, রিও ফ্রিয়োর কিনারে পড়ে ছিল বাচ্চাটা, গায়ে জড়ানো কাপড়ে সুতো দিয়ে নাম লেখা ছিল। স্লেজেলের সঙ্গে নিজের মৃত ছেলের নাম জুড়ে দেয় কার্ল ব্রেনেলবেন স্লেজেল নাম নিয়ে বড় হয় ও।
বেন স্নেজেল, আনমনে স্বগতোক্তি করল ও, স্যাডল হর্নে একটা হাত রেখে র্যাঞ্চ হাউস জরিপ করছে। ভাবছি আসলে তুমি কে!
আলো আর উষ্ণতা দিয়ে রিও ফ্রিয়ো উপত্যকা ভরিয়ে তুলেছে সূর্য। র্যাঞ্চ হাউসের পেছনে বিশাল উইন্ডমিলটা নড়তে শুরু করেছে। কোথাও ডেকে উঠল একটা মোরগ।
আনমনে হাসল বেন, কিন্তু মুখের পেশীতে টান পড়তে ব্যথায় কুঁচকে গেল, মুখ। ক্যাম্প ত্যাগ করার পর প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে দুই মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে, ব্যথা প্রশমন হয়নি এতটুকু কিংবা গরম কফিও কাজে আসেনি। সান্তুনার ব্যাপার একটাই-ফ্রেড মোরিস বা তার দুই সঙ্গীও নিশ্চয়ই ওর চেয়ে ভাল বোধ করছে না। এখন।
ঢাল ধরে নিচে নামার সময় স্টিভ হারকারকে মনে পড়ল ওর। হ্যামার টানা পিস্তল ছিল বেনের হাতে, আর লেযি-এন র্যামরডের জোড়া কোল্ট ছিল। হোলস্টারে; কিন্তু গ্রাহ্য করেনি সে। হারকার কি সত্যিই ততটা ফাস্ট, ও গুলি করার আগেই ড্র করতে পারত?
বেনকে চেনে সে, জানে ওর সম্পর্কে। সিরেনোর রাস্তায় সেই গানফাইটের। কথা ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। লড়াইটা এত দ্রুত ঘটেছিল যে আসলে কি থেকে কি হয়েছে এই এতদিন পরও পরিষ্কার জানে না বেন। পিস্তলের মুহুর্মুহু গর্জন, গান পাউডারের তীব্র ঝাঁঝ আর প্রবল উত্তেজনায় কিছুই আঁচ করা সম্ভব ছিল না। দুজন মারা গেছে, একজন আহত হয়েছে এবং আজীবনের জন্যে একটা কনুই হারিয়েছে আরেকজন-সবাই লেযি-এন ক্রু। কিন্তু বিপক্ষে ছিল মাত্র দু’জন-বিল আর বেন, উঠতি বয়সের দুই তরুণ; লড়াইয়ের পর দেখা গেল কারও গায়ে। একটা আঁচড়ও লাগেনি।
জনশ্রুতি আছে হীথ পাওয়েলকে আহত করেছিল বিল, আর লাশ দুটো ফেলেছে বেন স্লেজেল এবং ফ্রেড মোরিসকে বিকলাঙ্গ করেছে। সত্যি কথা বলতে কি মদে চুর হয়ে ছিল তখন বিল, ওকে সেলুন থেকে বের করে নিয়ে আসে বেন; সেলুনের সামনের রাস্তায় লেযি-এন ক্রুদের তোপের মুখে পড়ে যায় দুজন। বিলের পক্ষে ঠিকমত নিশানা করাও সম্ভব ছিল না তখন, কিন্তু এমনিতে বেনের চেয়েও ক্ষিপ্র সে। রাইফেলেও অসাধারণ।
এটাই আসল কারণ। এ জন্যেই বেসিন ছেড়েছে বেন। কার্ল ব্রেনেলের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই, এটা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। সিরেনোর ওই গানফাইটের পর ও নিজেও কিছুটা অস্থির হয়ে উঠেছিল, চাইছিল অন্তত কিছু দিনের জন্যে হলেও অন্য কোথাও চলে যাবে। আর যাই হোক, মানুষ খুন করা মোটেও আনন্দের কাজ নয়। তাছাড়া শোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল লেযি-এন ক্রুরা। ভয় পায়নি বেন, বরং অনর্থক রক্তক্ষয় এড়াতেই দূরে সরে গেছে।
স্যাডল থেকে নামল ও, তারপর লাগাম হাতে এগোল বিশাল স্টেবলের দিকে। নিজের জন্যে স্থায়ী বাড়ি তৈরির আগেই স্টেবল তৈরি করেছিল কার্ল ব্রেনেল, জানে ও, বিভিন্ন জাতের শক্তিশালী ঘোড়ায় ভরা থাকত সবকটা স্টল। কার্ল ব্রেনেল আসলে যতটা না ক্যাটলম্যান, তারচেয়ে বরং হর্স-ব্রীডার হিসেবে বেশি পরিচিত ছিল। ছয় বছরে যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে ডাবল-বির, এবং পরিবর্তনের প্রথম নমুনা শূন্য স্টলের সংখ্যা দেখেই জেনে গেল বেন। রিও ফ্রিয়োর চৌহদ্দিতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ স্টেবল ছিল এটা, অথচ এখন যে কটা আছে এত কম ঘোড়া কখনোই দেখেনি ও।
বাকস্কিনের যত্ন করে ওয়ারব্যাগ, উইনচেস্টার আর বেডরোল নিয়ে স্টেবল ছাড়ল ও। অস্বাভাবিক নীরব মনে হচ্ছে বাড়িটাকে, যদিও রান্নাঘরের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। রাতাসে পাক খাচ্ছে ঘোলাটে ধোয়া। পোর্চে এসে একটা খুঁটিতে গিয়ার আর রাইফেল রাখল বেন, তারপর হ্যাট দিয়ে বাড়ি মেরে গায়ের ধুলো ঝাড়ল। রান্নাঘরের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল। হ্যালো, টেকোস, ব্যস্ত কূকের উদ্দেশে শুধাল ও।
ঘুরে তাকাল শীর্ণদেহী কুক। খোদা! এ যে বেন! বেন স্লেজেল! এক হাতে সরু গোঁফে তা দিল সে, চোখ পিটপিট করে দেখছে ওকে। শুনলাম আসছ তুমি, কিন্তু ভাবিনি এত জলদি পৌঁছে যাবে!
বয়স্ক লোকটির সঙ্গে হাত মেলাল বেন। চলার মধ্যে ছিলাম আমি, টেকোস। এই ঠাণ্ডায় খোলা জায়গায় রাত কাটানো সত্যিই কঠিন, তাই রাতেও রাইড করেছি।
বুঝেছি, বাড়ি ফেরার জন্যে তাড়া বোধ করেছ, সেটা প্রকাশ করতে চাইছ না।
এখনও রান্নাই করছ, প্রসঙ্গ পাল্টাল বেন। ক’বছর হলো?
তোমার জন্মের আগ থেকে, সান। এখন কিন্তু এই কিচেনে রান্না করছি না।
তাহলে চলছে কিভাবে?
দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল টেকোস। স্রেফ আগুনটা জ্বালিয়ে দিচ্ছিক্কশ্যাকে রান্না করার দায়িত্বই শুধু আমার।
কুকের দিকে তাকিয়ে থাকল বেন। একসময় কাউহ্যান্ড ছিল সে, কিন্তু ঘোড়া থেকে পড়ে একটা পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে কুক হিসেবে কাজ করছে ডাবল বিতে। তাও অন্তত দশ বছর হবে।
নিতান্ত অবহেলায় একটা হাত নাড়ল টেকোস ফারমিন। সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়, বেন। এখানেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। একজন মহিলা রান্নার কাজ করে এখন। ওর নাম কেষ্ট। চমৎকার রাঁধে। মি. ব্রেনেল নয়, বরং মিসেস ব্রেনেলের আইডিয়া এটা। বিল যদিও আমার রান্না খুব পছন্দ করত, কিন্তু মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি! সত্যি কথা বলতে কি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না ওর।
সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়, স্বগতোক্তি করল বেন। বিয়ে করেছে ও। কিন্তু প্রায়ই বলত ওর গলায় দড়ি ঝোলাবে এমন কোন মেয়ের নাকি জন্ম হয়নি।
চুলোয় আগুন ধরেছে। হাতের চেটো দিয়ে কপালের ঘাম মুছল টেকোস। হ্যাঁ, মৃদু স্বরে বলল সে। কিন্তু ঠিকই সেধে গলায় দড়ি পরেছে ও।
বেসিনের মেয়ে?
স্থির হয়ে গেল কূকের হাত, শূন্য দৃষ্টিতে দেখল বেনকে। হ্যাঁ, বলা যায়…কেন?
স্রেফ কৌতূহল।
হাতে কিছু কাজ আছে, বেন। পরে তোমার সঙ্গে আলাপ করব। তুমি বরং এই ফাঁকে কফিতে চুমুক দাও। ছয় বছর কেমন কাটল তোমার? জবর গল্প করা যাবে! বলেই কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল সে।
শ্রাগ করল বেন। কিচেন থেকে বেরিয়ে হলওয়ে ধরে বাড়ির সামনের দিকে এগোল। পুরো বাড়িই নীরব হয়ে আছে। কার্ল ব্রেনেলের প্রিয় বিশাল লিভিংরূমে ঢুকল ও, মাথা থেকে হ্যাট সরিয়ে হাতে তুলে নিয়েছে।
দরজার উল্টোদিকে বিশাল ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে, কামরায় উষ্ণ আরামদায়ক আমেজ। প্রবল বিস্ময় নিয়ে দেখল বেন, আশাতীত পরিবর্তন হয়েছে। কামরাটার। শিকার করা পশুর মাথা, হরিণের চামড়ার ওপর বসানো রাইফেল আর শটগান ছিল দেয়ালে, বেশিরভাগই উধাও হয়ে গেছে এখন। পুরু চামড়ায়। মোড়া চেয়ারগুলোর একটাও নেই, মেহগনির টেবিল কিংবা সুদৃশ্য নাভাজো কার্পেটও নেই মেঝেয়।
ঐতিহ্যকে সরিয়ে আধুনিকতা তার জায়গা দখল করে নিয়েছে। দেয়ালে চুনকাম করা হয়েছে, ওয়ালপেপার মোড়া। আসবাবপত্র সবই হাল ফ্যাশনের, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা ঘরে। মেঝেয় কার্পেট। বিশাল টেবিলটাকে মাঝখানে রাখা হয়েছে, সুদৃশ্য কাপড় দিয়ে ঢাকা এবং তাতে সুদৃশ্য ঝাড়বাতিদানি; মেক্সিকোর বড়বড় চার্চে এত দামী জিনিস দেখেছে বেন।
দেয়ালে পেইন্টিং আর কিছু স্কেচ শোভা পাচ্ছে এখন। কামরাটা, যেন রিও ফ্রিয়ো উপত্যকার কোন র্যাঞ্চারের নয়, বরং প্রথম শ্রেণীর অভিজাত কোন হোটেলের সীটিংরূম। ফায়ারপ্লেসের সামনে বিশাল উইং চেয়ারে বসে আছে। কেউ। লোকটার বুট জোড়া দেখা যাচ্ছে-দামী সুতী কাপড়ের ট্রাউজার আর মেক্সিকান চামড়ার বুট, এতটাই পালিশ করা যে ম্লান আলোয়ও চকচক করছে। অজান্তে নিজের পায়ের কাছে নেমে গেল বেনের দৃষ্টি, ধুলোমলিন জীর্ণ বুটের দিকে তাকাল; স্বভাবতই কার্পেটের ওপর স্থির হলো ওর দৃষ্টি।
কার্পেটটা নষ্ট হয়ে গেলে কেউ বকবে না তো?
ফায়ারপ্লেসের দিকে এগোল ও, পাশ থেকে দেখল বসে থাকা লোকটাকে। লালচে চুল দেখা যাচ্ছে। চেয়ারের হাতলের পাশে ঝুলে আছে একটা হাত, শূন্য গ্লাস ধরে রেখেছে লোকটা। চেয়ারের পাশেই ছোট্ট টেবিল, টেবিলে রূপালী ট্রে-র ওপর প্রায় শূন্য একটা বোতল।
ঝুঁকে এল বেন। বিল? মৃদু স্বরে ডাকল ও।
নড়ল না বিল ব্রেনেল।
বিলের কাঁধে একটা হাত রাখল ও। বিল? খানিকটা চড়া স্বরে ডাকল আবার।
মাথা তুলল কার্ল ব্রেনেলের বড় ছেলে, আধ-বোজা চোখে তাকাল ওর দিকে। টেকোস? জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইল সে।
আমি বেন।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল বিল, চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করে নেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছে। ওহ, বেন! মাথা নাড়ল সে, দৃষ্টি বিভ্রম কাটাতে নাকি সত্যিই বেনের উপস্থিতি অবিশ্বাস্য লাগছে বোঝা গেল না। তাড়াতাড়িই চলে এসেছ, তাই না? চেয়ারের হাতল ধরে উঠে দাঁড়াল সে। ডিনারের সময় থাক তো, বেন?
বিলকে দেখল ও। কিছু লিকার উপচে পড়েছে কাপড়ে, কার্পেটের একটা জায়গা ভেজা। মিসেস ব্রেনেল, সে যেই হোক, কার্পেটের অযত্ন বা দুর্গতি দেখে নিশ্চয়ই খেপে যাবে।
বিলের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ছোট্ট টেবিলে নামিয়ে রাখল বেন।
স্মিত হাসল বিল। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র একটা ক্যাটল ড্রাইভ শেষ করে এসেছ। যাকগে, আমাদের গড়ন প্রায় একই রকম। কেটকে গিয়ে বলো আমার ওয়ার্ডরোবটা যেন দেখিয়ে দেয়। বিয়ের সুটটা ছাড়া যে কোন কিছু পরতে পারো। ফের হাসল সে। ভাবছি গ্লাসের একটা কেসে ভরে সুটটা সান্তা ফের যাদুঘরে পাঠাব কিনা।
বোতলটা তুলে নিয়ে গন্ধ শুকল বেন। ব্র্যান্ডি, একেবারে খাঁটি জিনিস। কর্ক খুলে তলানিটুকু গলায় ঢালল ও। মুখ মুছে বোতল নামিয়ে রাখল, অনুভব করল গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে উষ্ণ পানীয়। গতরাতে এরকম ড্রিঙ্ক দরকার ছিল ওর।
চারপাশে তাকাল ও। পাশের দেয়ালে লিকার কেবিনেট দেখতে পেল, দরজার পাল্লা খোলা। অসংখ্য বোতল সারি করে রাখা, সবই সেরা জিনিস। কন্যাক ব্র্যান্ডি, লিকার, স্কচ। সগ্রহটা সত্যি অসাধারণ। দক্ষিণ-পশ্চিমের দামী হোটেলেও এত ভাল সংগ্রহ দেখা যায় না। সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়, ভাবল বেন, ডাবল-বির মালিকপক্ষ এখন আর বীয়ার, বুরবন বা রাই পান করে ।
ডিনারের জন্যে ওকে, থেকে যেতে বলেছে বিল, কিন্তু নিজে হয়তো সারা বিকেলই এখানে কাটিয়ে দেবে। কে জানে, রাতটাও বোধহয় এখানে কাটিয়েছে!
জানালার কাছে এল বেন, ভারী মখমলের পর্দা টেনে সরিয়ে দিল। উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল সারা ঘর।
দিনের আলো? সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইল বিল, চোখ কুঁচকে রেখেছে।
কিচেন থেকে বাসন-কোসন ধোয়ার শব্দ আসছে, আচমকা বেনের মনে পড়ল গতকাল দুপুরের পর ভাল করে কিছুই খাওয়া হয়নি। কূকের কাছ থেকে, কিছু একটা মুখে দেওয়ার জন্যে নিয়ে আসছি আমি, বিল, বলল ও।
উঠে দাঁড়াল বিল, চেয়ারের ব্যাকরেস্ট চেপে ধরেছে এক হাতে। ভঙ্গিটা আড়ষ্ট, অথচ বরাবরই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল সে। বয়সের চেয়ে তরুণ মনে হত ওকে–সবাই ওকে “রিও ফ্রিগো কিড” বলে ডাকত এবং ব্যাপারটা পছন্দও করত সে-অথচ এখন দেখে মনে হচ্ছে চল্লিশের ঘরে পা পড়েছে।
তুমি বরং অপেক্ষা করো, মৃদু স্বরে বলল সে। টেবিলে বসার আগে কিছু খাওয়ার নিয়ম নেই এ বাড়িতে। শুনলেই খেপে যাবে আমার বউ। কেটের কাছে অনুরোধ করেও কিছু পাবে না তুমি। এভাবেই চলছে এ বাড়ির সবকিছু।
তুমি কখনও বলোনি যে বিয়ে করেছ, বিল।
রক্তলাল চোখ জোড়া ঝিকিয়ে উঠল। মনে হয় না অতে কিছু আসত-যেত।
নিশ্চয়ই আসত-যেত, তুমি ভাল করেই জানো।
খানিকটা দ্বিধা করল বিল। ঠিক আছে, এক্ষেত্রে খানিকটা ব্যতিক্রম না হয় হয়েছে। কিন্তু মনে করে দেখো পরিস্থিতিটা আমাদের দুজনের জন্যেই সমান ছিল–হয় আমি, নয়তো তুমি। বেসিন ছাড়ার ইচ্ছে আমারও ছিল, কিন্তু তুমিই চলে গেলে। জিতি বা হারি–সব দায়িত্ব আমাকেই নিতে হলো! শুকনো হাসি দেখা গেল বিলের ঠোঁটে।
কি বলতে চাচ্ছ, বিল?
মিষ্টি একটা কণ্ঠ বাধা দিল ওদের। সত্যি বলার জন্যে সাহস সঞ্চয় করছে–বলবে আমাকে বিয়ে করেছে ও, বেন।
হলওয়ের দরজার দিকে ফিরল বেন স্লেজেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অ্যাগনেস নোলান, একটা ফ্রক পরনে; দেখে মনে হচ্ছে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের কোন সুন্দরী মডেল। হালকা বাদামী চুল খোঁপা করে তুলে রেখেছে মাথার পেছনে, অপূর্ব একটা মুখ, গাঢ় নীল চোখে নিরীখ করছে বেনকে।
হৃদয়ের গভীরে একটা আলোড়ন আবিষ্কার করল বেন। খোদা, আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ও পরিণত লাগছে অ্যাগনেসকে। ক্যাম্পের আগুনের পটভূমিতে প্রায়ই এই মেয়ের ছবি কল্পনা করেছে ও, কিন্তু ঠকিয়েছে নোলান কন্যাকে–বাস্তবের ধারে-কাছেও কল্পনা করতে পারেনি!
কি ব্যাপার, বেন, উইশ করবে না আমাকে? ক্ষীণ হেসে জানতে চাইল অ্যাগনেস, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওর দিকে।
হ্যালো, অ্যাগনেস, এগিয়ে গিয়ে অ্যাগনেসের সাথে হাত মেলাল বেন। মেয়েটির উজ্জ্বল স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি, সৌন্দর্য প্রায় মাদকতা সৃষ্টি করছে মনে।
বেশ তাড়াতাড়ি চলে এসেছ, মন্তব্যের সুরে বলল অ্যাগনেস, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেনের মুখের ক্ষতগুলো দেখছে। স্যাডল থেকে পড়ে গেছ নাকি?
হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করল ও। ঠিক তা নয়।
একটা হাত তুলে আলতো ভাবে ফেটে যাওয়া ফোলা ঠোঁট স্পর্শ করল অ্যাগনেস। আমার ওপর ছেড়ে দাও, দেখি কি করা যায়, হালকা সুরে বলল ও।
গ্রেসিয়াস, অ্যাগনেস।
খানিকটা ঝুঁকে বো করল বিল ব্রেনেল। রিও ফ্রিয়োর ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। শুকনো স্বরে বিদ্রূপ করল সে।
ঝটিতি ঘুরে তাকাল বেন, দেখল বিলের চোখের চাহনি কঠিন হয়ে গেছে। এক ট্যাংক ব্র্যান্ডি পেটে পড়েছে তার, সুস্থির ভাবে চিন্তা করতে পারছে না-অনর্থক ঈর্ষা আর সন্দেহের শিকার।
ভুলে যাও, বেন! মৃদু স্বরে বলল অ্যাগনেস।
অচেনা একটা কামরায় ওকে নিয়ে এল মেয়েটি। বহু দিন আগে একটা বাথটাব ছিল এখানে, আর ছিল র্যাঞ্চ হাউসের পরিত্যক্ত সব জিনিস। শীতল অন্ধকার থাকত সবসময়, ব্যবহার করা হত না বললেই চলে। আবর্জনা তো সরানো হয়েছেই, উপরন্তু বাসযোগ্য করা হয়েছে ঘরটাকে-একেবারে সাজানো গোছানো, দামী আসবাবপত্রে ভরা।
পছন্দ হয়েছে? ঘাড়ের ওপর দিয়ে ওর দিকে ফিরে জানতে চাইল অ্যাগনেস।
স্মিত হাসল বেন। ডাবল-বিতে একটা বাথটাবই ব্যবহার করতাম। আমরা-ঘোড়ার ট্রাফ। মাঝে মধ্যে অবশ্য রিও ফ্রিয়োয় চলে যেতাম।
নড করল মেয়েটি। ঘুরে-ফিরে দেখে নাও, বেন, সন্তুষ্টি ওর কণ্ঠে। দেখবে এখানকার সবকিছু কেমন বদলে দিয়েছি আমি।
হ্যাঁ, কেবল জড় পদার্থগুলোই নয়।
ঝটিতি ঘুরে দাঁড়াল অ্যাগনেস। বিলের কথা বলতে চাইছ তুমি?
হয়তো।
এছাড়া উপায় ছিল না আমার।
সত্যি বলছ, অ্যাগনেস? শত্রুর ছেলেকে বিয়ে করতে দিল তোমার বাবা? বেসিনে আর কোন যোগ্য পুরুষ ছিল না?
মর্যাদা, প্রতিপত্তি বা আভিজাত্যের বিচারে নোলানদের সমকক্ষ শুধু ব্রেনেলরাই। হ্যাঁ, ব্রেনেলদেরই বেছে নিয়েছিলাম আমি। বাবা আপত্তি করেছিল বটে, কিন্তু পাত্তা দেইনি।
কিন্তু আমি তো জানতাম লেযি-এনের মত একই পরিবেশ ছিল এখানে-শত্রুর মেয়ে ছেলের বউ হয়ে আসবে, চিন্তাটাই হাস্যকর ছিল ডাবলবিতে। যদূর মনে পড়ে বিলই এ ব্যাপারে বেশি সোচ্চার ছিল, রীতিমত লেকচার দিয়ে বেড়াত সবসময়!
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল মেয়েটি। কখনোই দৃঢ়চেতা ছিল না ও।
কিন্তু দৃঢ়, কঠিন চরিত্রের পুরুষ তোমার পছন্দ, তাই না?
উত্তর দিল না অ্যাগনেস, বেনের ক্ষতের শুশ্রূষায় ব্যস্ত।
তো?
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল অ্যাগনেস, তারপর শ্রাগ করল অসহায় ভঙ্গিতে। ছয়টা বছর, বেন! বড় দীর্ঘ সময়, একবারও ফিরে আসোনি তুমি, কিংবা একটা চিঠিও লেখোনি!
কিন্তু মোটামুটি স্থায়ী একটা ঠিকানা ছিল আমার, বিল সেটা জানত।
কি আশা করেছ আমার কাছে, তোমার খোঁজে চলে যাব?
না। কিন্তু মাত্র একটা শব্দে ফিরে আসতাম আমি।
বাবার কথা ভুলে গেছ বোধহয়?
না হেসে পারল না বেন। তোমার বাবাকে? গাট-হুক নোলান, রিও ফ্রিয়োর। আতঙ্ককে কেউ ভুলতে পারে? তারপরও, তুমি যদি খবর পাঠাতে নির্ঘাত গাট-হক। দুর্গে হানা দিতাম আমি, বুড়োর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটা ছিনিয়ে নিয়ে বলতাম: গোল্লায় যাও তুমি! দৃষ্টি নামিয়ে অ্যাগনেসের দিকে তাকাল ও, দেখল ওর মুখ। থেকে শুকনো রক্ত পরিষ্কার করছে মেয়েটি। তুমিও জানো সেটা, অ্যাগনেস। স্বীকার করো!
বেশি কথা বলছ তুমি!
কিন্তু এটাই সত্যি। মেয়ে হয়ে বাপের নিষেধ মানোনি তুমি, আমি মানতাম? আমার বা বিলের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়-যোগ্যতায়, নাকি আমি ব্রেনেলদের রক্তের নই বলে?
আচমকা আঙুল দিয়ে ওর ক্ষতে চাপ দিল অ্যাগনেস, অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে উঠল বেন। ভুরু কুঁচকে উঠেছে। মুহূর্তের জন্যে মেয়েটির মায়াবী চোখে নিষ্ঠুরতা দেখতে পেল, যেন সুদৃশ্য ফুলের বাগানে ওত পেতে আছে হিংস্র কোন শিকারী পশু। এ ধরনের নীচতা সবসময়ই ছিল মেয়েটির মধ্যে, মনে পড়ল বেনের, হয়তো নিষ্ঠুর বাবার পক্ষ থেকে পেয়েছে।
কাজ শেষে ওর দিকে ফিরে তাকাল অ্যাগনেস, হাত দুটো দেহের পেছনে। কমোডের কিনারা চেপে ধরেছে। মেয়েটির চোখের দৃষ্টি দেখে সবই ভুলে গেল বেন–অ্যাগনেসের প্রতি ক্ষণিকের জন্যে জেগে ওঠা অসন্তোষ কিংবা এ-ও মনে থাকল না যে অ্যাগনেস এখন আর ধনীর দুলালী নয়, বরং ওর ভাইয়ের বউ। ছয় বছরের তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল বুকে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল ও, চোখ ফিরিয়ে নিল।
বেন? ডাকল অ্যাগনেস।
বেন জানে কি চাইছে মেয়েটা। কিন্তু ওর ইচ্ছে অন্যরকম, অবচেতন মন বলছে শিগগিরই এ কামরা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত এবং অ্যাগনেস ব্রেনেলের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা উচিত।
বেন!
ঘুরে দরজার দিকে এগোল বেন, কিন্তু টম নোলানের মেয়েকে চেনে দাবি করলেও আসলে ঠিক ততটা চেনা হয়নি ওর। পেছন থেকে ওর বাম বাহু চেপে ধরল মেয়েটি, জোর করে ফেরাল নিজের দিকে। দ্রুত ওর গলায় উঠে এল মৃণাল দুই বাহু, ঘাড় ধরে টেনে নিচু করল ওর মুখ। ফোলা ক্ষত-বিক্ষত ঠোঁটে পুরুষ্ট পেলব এক জোড়া ঠোঁটের অস্তিত্ব অনুভব করল বেন। কোমল স্পর্শ, তবু ব্যথা পেয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর শরীর; কিন্তু মেনে নিল শেষে। অজান্তে সাড়া দিল ও।
মিনিট খানেক, তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল অ্যাগনেস ব্রেনেল। রক্ত ঝরছে তোমার ঠোঁট থেকে, প্রায় নিরুত্তাপ স্বরে বলল মেয়েটি। ওর ঠোঁটেও রক্ত লেগে আছে। পাতলা এক খণ্ড কাপড় দিয়ে ঠোঁট মুছল, তারপর বেনের ঠোঁটও মুছে দিল। মুহূর্তের জন্যেও বেনের চোখ থেকে দৃষ্টি সরায়নি।
রিও ফ্রিয়োয় ফিরে আসা ঠিক হয়নি, তিক্ত মনে ভাবল বেন স্লেজেল।
০৪. শূন্য কফির মগ ভরে
শূন্য কফির মগ ভরে বেনের দিকে এগিয়ে দিল টেকোস ফারমিন। এবার তো স্বচক্ষে দেখলে সবকিছু কেমন বদলে গেছে এখানে, বাতিলের ভঙ্গিতে একটা হাত নাড়ল কুক। এটা আর র্যাঞ্চ নয় এখন। জমি আছে, কিছু গরু আর ঘোড়াও আছে, কিন্তু কাজ করার মত পরিবেশ বা মেজাজ কোনটাই নেই। একসময় বিশ ত্রিশজন কাজের লোক ছিল। এখন, আমার মত বুড়ো অথর্বকেও যদি গোনায় ধরো, সব মিলিয়ে হয়তো দশজন হবে। স্রেফ নিরীহ পাঞ্চার এরা, পুরানো একজনও নেই।
কূকশ্যাকের জানালায় দাঁড়িয়ে বিশাল র্যাঞ্চ হাউসের দিকে তাকিয়ে আছে বেন স্লেজেল। প্রায় অসময়ে নাস্তা করেছে ও, অতীতের ডাবল-বির সঙ্গে যার কোন সামঞ্জস্যই নেই। ন্যাপারি আর দামী রূপালী কাপড়ে ঢাকা ডিশ দেখে। তাজ্জব বনে গেছে বেন, অ্যাগনেস ব্রেনেলের জন্যে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে পুরো দশটা মিনিট। পুরোটা সময় থালার খাবার নিয়ে খেলেছে অর্ধ-মাতাল বিল। ব্রেনেল। আর এদিকে ডাবল-বিকে নিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ফিরিস্তি শুনিয়ে ওকে ক্লান্ত করে তুলেছে অ্যাগনেস, জানিয়েছে শহরে একটা বাড়ি তৈরির ইচ্ছেও আছে। ইচ্ছে করলে অবশ্য তাই করতে পারে মেয়েটি–স্বামীর টাকায় না হোক, বাপের টাকায় সেটা সম্ভব, কারণ একমাত্র মেয়ের কোন সাধই অপূর্ণ রাখেনি টম নোলান।
স্টোভের পাশে কাঠের বাক্সে থুথু ফেলল টেকোস। কার্লের মৃত্যুর পর থেকে মনে হচ্ছে সবকিছু উচ্ছন্নে যেতে বসেছে! বোতল নিয়ে পড়ে আছে বিল। ওকে নিরস্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে মিরিয়াম, কিন্তু শেষে ঝগড়া করে আলাদা হয়ে গেছে দু’জন। তাতে বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। জেফকে নিয়ে শহরে থাকছে মিরিয়াম, জেফের স্কুলের পাট না চুকা পর্যন্ত ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুকনো হাসি দেখা গেল কূকের মুখে। কিন্তু বেয়াড়া ওই। ছেলেকে স্কুলে আটকে রাখতে পারবে না কেউ, এমনকি মিরিয়ামও পারবে না।
কেমন আছে ও?
চোখ তুলে তাকাল টেকোস। অতীতের ডাবল-বির ঐতিহ্য নিয়ে বোধকরি কেবল ও একাই ভাবে। মেয়েটা হয়েছেও ঠিক ওর মা-র মত সুন্দরী, বনেদী আচরণ আর মিশুক স্বভাবের কারণে বেসিনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত নারী।
আর জেফরি?
ফের সশব্দে থুথু ফেলল টেকোস। ছোট্ট একটা বেয়াড়া আঁচিল ও। তোমার। ধারণা তুমি আর বিল বুনো স্বভাবের? ঈশ্বরের দিব্যি, ওই ছেলে তারচেয়েও কয়েক কাঠি বাড়া। ওর তুলনায় তোমরা কিছুই না! নিজেকে বিলি দ্য কিড বা ওরকম কিছু মনে করে সে। পাগলামি ছাড়া আর কি, এভাবে নিজেকে জাহির করে কোন বাচ্চা ছেলে?
জানালা থেকে ঘুরে দাঁড়াল বেন। কিন্তু বরাবরই শান্ত স্বভাবের ছিল ও।
হ্যাঁ, চুপচাপ ঠিকই। কিন্তু দারুণ বিপজ্জনক! গত ছয়টা বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে ওর।
তাহলে পিস্তল বয়ে বেড়ায় ও?
নড করল টেকোস। দুটো, বেন। একবার ওকে বলেছিলাম কাজ-সারার জন্যে একটা পিস্তলই যথেষ্ট, দুটোর ওজন মানুষের গুরুত্ব বরং: কমিয়ে দেয় অন্তত যে লোক পিস্তলের সঠিক ব্যবহার জানে না। কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে ও।
বিলি দ্য কিড তো মাত্র একটা পিস্তল ঝোলায়, স্মিত হেসে বলল, বেন।
শ্রাগ করল সে। জেফরি ব্রেনেল দুটো ঝোলায়।
পিস্তলে কেমন ওর হাত?
স্থির দৃষ্টিতে তাকাল কুক। বিলের চেয়ে ক্ষিপ্র, হয়তো তোমার চেয়েও। যদিও একটা কথা জানি আমি।
কি?
বিরক্তি দেখা গেল নীল চোখে। স্টিভ হারকারের চেয়ে ক্ষিপ্র নয় ও।
শূন্য কাপ টেকোসের দিকে বাড়িয়ে ধরল বেন। মাঝে মধ্যেই ভাবি
কি?
সিরেনোর ওই লড়াইয়ের পর নিশ্চয়ই অনেক ভেবেছে স্টিভ হারকার। ওর মত বন্দুকবাজ সবার সমীহ কাড়তে পছন্দ করে। নিজের কাছাকাছি সামর্থ্যের কোন লোককেই এরা পছন্দ করে না, ক্ষমতার অহঙ্কার বলতে পারো। পশ্চিমের সব বিখ্যাত বন্দুকবাজই এই ম্যানিয়ার শিকার। সুযোগ পেলে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। আমার তো মনে হয় হরকারের গোপন এই ইচ্ছে কোন ভাবে আঁচ করে ফেলেছিল কার্ল ব্রেনেল, সেজন্যেই বিলের বদলে তোমাকেই বেসি ছাড়া করেছে।
মানে?
গোঁফে তা দিল টেকোস। কোন একদিন শো-ডাউন হবেই, বেন। তোমার সঙ্গে হরকারের। কিন্তু কারও পক্ষে বাজি ধরতে পারছি না আমি।
বিল আমার চেয়েও ক্ষিপ্র, টেকোস, এবং নিশানাও ভাল ওর।
সিরেনোর গানফাইটে কিন্তু তার প্রমাণ হয়নি। বিল প্রায় মাতাল ছিল।
নড করল কুক। মাতাল না হলেও কিছু যেত-আসত না। বিল হয়তো ক্ষিপ্র, নিশানাও দারুণ, কিন্তু শত্রুর সামনে দাঁড়াতে সাহস লাগে, মনের জোর থাকতে হয়। শত্রুকে খুন করার ইচ্ছে নিয়ে গুলি ছুঁড়তে হয়, সেটা নেই ওর, যা তোমার আছে।
ফালতু কথা!
উঁহু, ঠিকই বলেছি আমি।
একটা চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দিল বেন। বাবার ব্যাপারটা কি, টেকোস?
মাথার পেছনে একটা বুলেট আঘাত করেছে। নরম ধাতুয় মোড়া পয়েন্ট ফটি-ফোর। রাইফেল বা পিস্তল, দুটোই হতে পারে। যদিও শেরিফ দাবি করেছে। রাইফেলের বুলেট ওটা। ট্রেইলের পাশে কার্লের জন্যে অপেক্ষায় ছিল লোকটা। নরম মাটিতে কনুই আর হাঁটুর দাগ বসে গিয়েছিল, আর পাওয়া গেছে ডজন খানেক সিগারেটের গোড়া। বোঝা গেছে বহুক্ষণ অপেক্ষায় ছিল লোকটা। কার্ল। বরাবরই ওই পথ ধরে ফিরত বাথানে। খুনী সেটা ভাল করেই জানত।
কে করেছে কাজটা, কোন ধারণা আছে তোমার?
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল টেকোস ফারমিন। এখানে ভাল একটা চাকুরি করি আমি, এবং কাজটা পছন্দও করি।
বিল তোমাকে বরখাস্ত করবে না, টেকোস।
বিল আমাকে বরখাস্ত করল বা না-করল, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই আমার, বেন। আমি যদি মুখ খুলি হয়তো অন্য কেউ অসন্তুষ্ট হবে। সুতরাং মুখ বন্ধ রাখাই ভাল।
লেযি-এনের লোকেরাই করেছে কাজটা?
হতে পারে, কোন কিছুই নিশ্চিত বলা যাবে না।
টম নোলানকে যতটা ঘৃণা করি, ঠিক ততটাই নিশ্চিত জানি কাউকে ড্রাই গালশ করবে না সে।
কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছ তুমি, বেন? কিছুই বলা যায় না। সবই সম্ভব।
দরজার দিকে এগোল বেন, মাঝপথে ফিরে তাকাল। মনে হচ্ছে ফিরে না এলেই ভাল হত।
টাকা আসছে তোমার কাছে, বেন। বুড়ো তোমাকে ভুলে যায়নি। আমার তো ধারণা নিজের যে কোন ছেলের চেয়ে তোমাকেই বেশি পছন্দ করত ও।
হ্যাঁ। জানি আমি। দরজা খুলে আঙিনার দিকে তাকাল ও, বহু দূরে খোলা প্রেয়ারি শেষে নদীর তীরে গাছের সারি চোখে পড়ছে। বাতাসে নড়ছে সবুজ শাখা। পাইন মাখা সুবাসিত বাতাস নাকে দোলা দিচ্ছে। তারপরও মনে হচ্ছে। ফিরে না এলেই ভাল হত, অন্যমনস্ক সুরে বিড়বিড় করল ও।
তোমাকে ফিরে আসতেই হত, বেন। কিছু কিছু কাজ আছে যেটা সবাই করতে পারে না, এবং দেরিতে হলেও সেটা সারতে হয়। প্রীচাররা যেমন বলে: সাধারণ মানুষের চেয়েও বেশি ক্ষমতা আছে, এমন শক্তির পক্ষেই সম্ভব সেসব কাজ করা। তোমাকে ফিরে আসতেই হত, বেন স্লেজেল।
ঘুরে দাঁড়াল ও। ভাল-মন্দ যাই হোক, তার জন্যে, টেকোস?
হ্যাঁ, ভাল বা মন্দের জন্যে। কারণ অদৃষ্টের খণ্ডন এখনও এড়াতে শিখিনি আমরা।
ভাবছি সেটা কি হবে?
কুয়েইন স্যাবে?
বেরিয়ে এসে পেছনে দরজা বন্ধ করে দিল বেন। মূল র্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোল। আচমকা বীজের ওপর দু’জন রাইডারকে দেখতে পেল, ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে। চোখ কুঁচকে তাকাল ও। রাইডারদের একজন মেয়ে-নিঃসন্দেহে মিরিয়াম। ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বেশিরভাগ পুরুষের চেয়ে অনায়াস দক্ষতার সঙ্গে রাইড করে মেয়েটা, এবং অবশ্যই মেয়েলি ঢঙে।
সাইড স্যাডলে রাইড করছে মেয়েটি। কালো চুলের রাশি খোঁপা বেঁধে রেখেছে ঘাড়ের পেছনে, হ্যাটটা চিবুকের সঙ্গে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা। নীল রাইডিং স্কার্ট আর চামড়ার জ্যাকেট মেয়েটির পরনে। কত হলো ওর বয়েস? আঠারো, ঊনিশ? বছর গুনতে শুরু করতে বেনের মনে পড়ল মিরিয়াম ব্রেনেলের বয়স অন্তত বাইশ বছর।
গেটের দিকে এগোল বেন, গেট খুলে দেবে।
বোনের পাশে রাইড করছে ছেলেটা। লম্বা হয়েছে জেফরি ব্রেনেল। স্যাডলে বসার ভঙ্গি অভ্যস্ত, স্বতঃস্ফূর্ত। কালো পোশাক জেফরির পরনে-হ্যাট থেকে বুট পর্যন্ত সবই কালো। সকালের সূর্যের আলোয় চকচক করছে বুট জোড়া।
হ্যালো, বেন! দূর থেকে স্বাগত জানাল মিরিয়াম ব্রেনেল। শেষপর্যন্ত এসেছ তুমি!
হ্যালো, মিরিয়াম! জেফ!
দস্তানা পরা একটা হাত নাড়ল জেফরি।
ভাই-বোন প্রবেশ করার পর পেছনে গেট বন্ধ করে দিল বেন। মেয়েটির দিকে তাকাল ও, খানিকটা বিস্ময় নিয়ে দেখছে কিশোরী থেকে বদলে গিয়ে, পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠা মিরিয়ামকে। অপূর্ব সুন্দর কমনীয় মুখ, দীঘল কালো চুল বরাবরের মতই উজ্জ্বল। মায়াবী নীল চোখ, খানিকটা বেগুনী আভা তাতে; আর আছে যে কোন লোকের ভেতরটা দেখার মত তীক্ষ্ণ চাহনি।
মিরিয়ামের চেয়েও বেশি বদলেছে জেফরি। স্যাডল ছেড়ে বোনকে নামতে সাহায্য করল সে। প্রায় বেনের সমান লম্বা ও, খানিকটা শীর্ণ-অন্তত বেনের চওড়া পেশীবহুল কাঁধের তুলনায়। সুদর্শন ফর্সা মুখ, গোঁফ উঠতে শুরু করেছে। দস্তানা খুলে বেনের উদ্দেশে একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে। জেফরির স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গি অন্য একজনের কথা মনে করিয়ে দিল বেনকে-ব্রেনেল এবং ক্যাস্টানে, দুই রক্তের মিশেল হয়েছে তার মধ্যে, কিন্তু বাড়তি কি যেনও আছে-লুকাছাপা, সহজে চোখে পড়ে না–অশুভ একটা ব্যাপার, যেটা হয়তো একসময় তাড়া করবে ওকে, ক্ষতিই করবে ওর।
তোমাকে দেখে খুশি হয়েছি, বেন, বলল জেফরি-নিরুত্তাপ, চাঁছাছোলা স্বর; চোখের চাহনি নিস্পৃহ, স্থির।
মুহূর্তের মধ্যে কালো পোশাকধারী আরেকজনের কথা মনে পড়ল বেনের। আরেক স্টিভ হারকারের দিকে তাকিয়ে আছে, ও! অনুভূতিটা সুখকর নয়, অন্তত ওর জন্যে। রিও ফ্রিয়ো উপত্যকার সব পিস্তলেরো কি কালো পোশাক পরতে শুরু করেছে নাকি?
তুমি দেখছি বেশ স্লিম হয়ে গেছ, হালকা চালে বলল মিরিয়াম।
টেকোসের রান্না মিস্ করেছি না!
বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করল মিরিয়াম। ভেতরের লোকজনের জন্যে এখন আর রান্না করে না ও।
জানি।
দস্তানা দিয়ে উরুতে নিচু করে বাঁধা হোলস্টারের ওপর চাপড় মারল জেফরি। তাহলে অ্যাগনেসের কথাও জানো তুমি?
নড করল বেন।
স্ত্রী হিসেবে ওকে পেয়ে ভালই হয়েছে বিলের, মৃদু স্বরে মন্তব্য করল ছেলেটা।
জেফরির দিকে তাকাল বেন, শীতল চ্যালেঞ্জ দেখতে পেল ছেলেটার চোখে। হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা, জেফ।
এখানকার সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে ও।
হ্যাঁ।
ব্যাপারটা তোমার পছন্দ হয়নি, তাই না, বেন?
ক্ষীণ হাসল বেন। আমার পছন্দ-অপছন্দে কি যায়-আসে, অন্তত এখন? নড করল ছেলেটা।
কত হবে ওর বয়েস? স্মৃতির পৃষ্ঠা হাতড়ে বেড়াল বেন। খুব বেশি হলে আঠারো বা ঊনিশ! বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে জেফরির-যে ছেলে সারাক্ষণ বাড়ির আশপাশে থাকত; বই, খেলনা আর পোষা জন্তুদের নিয়ে সময় কাটাত; সে-ই এখন জোড়া পিস্তল বয়ে বেড়ায়। প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকত সে, অতি মাত্রায় স্পর্শকাতর বলে খুব বেশি সহানুভূতি দেখাতেও সাহস করত না কেউ, গাঢ় নীল চোখে মুহূর্তে অসন্তোষ ফুটে উঠত তাহলে।
কিন্তু সেই তিক্ত অসন্তোষ এখন পরিপূর্ণ এক যুবকের অহঙ্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাহস দেখাতে গিয়ে ঔদ্ধত্য আর তাচ্ছিল্য প্রকাশ করছে জেফরি। স্পারঅলা বুট পরছে সে, মুক্তো বসানো হাতলের জোড়া কোল্টের ওজন বয়ে বেড়ায় ওর দুই উরু।
ওজনটা কি শেষপর্যন্ত বইতে পারবে সে? কিংবা জেফরি কি আদৌ বোঝে দুটো পিস্তল ঝোলানোর খেসারত হিসেবে কতটা মূল্য দিতে হয়?
ছয় বছরে নিশ্চয়ই অনেক ঘুরেছ তুমি, বেন? জানতে চাইল মিরিয়াম।
হ্যাঁ, বেশিরভাগ সময় দক্ষিণ-পশ্চিমে কাটিয়েছি। কলোরাডো আর ওয়াইওমিংও গেছি। কিন্তু এ জায়গাটাই এখনও সেরা আমার কাছে।
এখানে থাকতে চাইছ তুমি? প্রশ্নটা করেই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল জেফরি ব্রেনেল।
মনে হয় না।
অ, তাহলে টাকা নিয়ে কেটে পড়বে?
জেফ! লালচে হয়ে গেছে মিরিয়ামের মুখ।
ক্ষীণ হাসল বেন। হয়তো ঠিকই বলেছে ও। যাকগে, তোমাদের দুজন আর বিলকেও দেখতে এসেছি আমি, জেফ।
দ্রুত ওর দিকে ফিরল ছেলেটা, আচমকা মুখে ভান করা পর্দাটা সরে গেল যেন। মুহূর্তের জন্যে, তারপর আগের মতই নিস্পৃহ হয়ে গেল। মনে হয় না বাড়ি ফেরার জন্যে অস্থির হয়ে ছিলে তুমি, প্রায় তাচ্ছিল্যের সুরে বলল সে।
মিরিয়ামের জন্যে দরজা মেলে ধরল বেন। হ্যাঁ, জেফ, আমার ধারণা ছিল সত্যিই বাড়ি ফেরার জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে, অবস্থা দেখে ততটা নিশ্চিত নই আর
শহরে একটা গুজব শুনলাম, এরই মধ্যে নাকি গাট-হ্ক ক্রুদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছ তুমি?
কিচেনের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। হলওয়েতে ঢুকে ঘুরে দাঁড়াল মিরিয়াম, বেনের মুখে স্থির হলো দৃষ্টি।
খবর দেখছি দ্রুত ছড়ায়, শুকনো স্বরে বলল বেন। হ্যাঁ, ওদের সঙ্গে কিছুটা ঝামেলা হয়েছে। সন্ধের পর লেযি-এনের সীমানা পেরিয়ে এসেছি আমি, স্কিলেট ক্রীকের এপাড়ে ক্যাম্প করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল ডাবল-বির সীমানা নিয়ে সন্দেহ আছে ওদের, ওদের দাবি অনুযায়ী তখনও গাট-হুক রেঞ্জে ছিলাম আমি।
গোলাগুলি হয়েছিল নাকি? জেফরির প্রশ্ন।
না। তিনজন ছিল ওরা–স্লিম, কার্লি আর ফ্রেড মোরিস।
নড করল ছেলেটা। সাধারণত একসঙ্গেই থাকে ওরা। ত্রিরত্ন!
ওদের সঙ্গে হাতাহাতি হলো। স্টিভ হারকার সময়মত না এলে হয়তো মার। খেয়ে ভর্তা হয়ে যেতাম। জ্যাক হারলো ছাড়াও আরেকজন ছিল ওর সঙ্গে, ব্রীড বা মেক্সিকান হবে।
বোনের দিকে তাকাল জেফরি। বাজি ধরে বলতে পারি, ওই লোকটা কারাঞ্চো।
হ্যাঁ, মৃদু স্বরে একমত হলো মিরিয়াম। কারাঞ্চো কে? জানতে চাইল বেন। একটা শকুন!
এবং বাজার্ড! ক্ষীণ হেসে বলল বেন। বিশেষণটা লাগসই হয়, সত্যিই যদি স্টিভ হারকারের সঙ্গে চলাফেরা করে ও।
ওর কাছ থেকে দূরে থেকো, বেন, সতর্ক, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল মিরিয়াম। স্টিভ হারকারের সব নোংরা কাজ করে দেয় সে।
মিথ্যে কথা! তপ্ত স্বরে প্রতিবাদ করল জেফরি। এখানে কাউকে ডরায় না স্টিভ হারকার। ওর চেয়ে ফাস্টগান আছে কেউ? অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে বেনের দিকে তাকাল সে। বিলও ওর সমকক্ষ নয়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রাগ করল বেন। মিরিয়ামের দিকে তাকাতে দেখল মাথা নাড়ছে মেয়েটি। বোনের দিকে পেছন ফিরে ওকে নিরীখ করছে জেফরি-মাপা, উস্কানি আর ঔদ্ধত্য ভরা চাহনি।
তো, বেন, নিস্পৃহ স্বরে জানতে চাইল সে। ঠিক বলেছি না?
হয়তো।
কিংবা তুমিও ওর সমকক্ষ নও।
খানিকটা তেতে উঠল বেনের মেজাজ, জেফরির ছেলেমানুষিতে বিরক্ত। কে ফাস্টগান সেই ফালতু তর্ক করার জন্যে বাড়ি ফিরে আসিনি আমি, কিড।
কে জানে, কি জন্যে এসেছ তুমি, সেটা তুমিই ভাল বলতে পারবে, শান্ত স্বরে বলল জেফরি। কিন্তু গাট-হক ক্রুদের সঙ্গে মোলাকাত করতে একটুও দেরি হয়নি তোমার। সেধে লেযি-এন রেঞ্জে গেছ তুমি, যদিও ঠিকই জানতে ট্রেসপাসারদের দেখলেই তেড়ে আসে ওরা।
একটা বাহু চেপে ধরে জেফরিকে সরিয়ে নিয়ে গেল মিরিয়াম, লিভিংরুমের দিকে এগোল। বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল জেফরি, কিন্তু মিরিয়াম চাপা স্বরে ধমকে উঠতে নিরস্ত হলো।
দেহের পাশে দু’হাত ছড়িয়ে অসহায় ভঙ্গি করল বেন। ছেলেটার ওপর প্রায় খেপে উঠেছিল, ইচ্ছে করছিল খানিকটা হলেও শাসন করবে; কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়েছে। জেফরির জোড়া পিস্তল দেখে ভয় পেয়েছে বা দ্বিধা বোধ করেছে তা নয়, বরং নিজেদের মধ্যে তিক্ততা বাড়ানোর অনিচ্ছাই আসল কারণ। শত হলেও এরাই ওর একমাত্র আপনজন, এবং এটাই বড় সত্যি। নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করতে জেফরির অতি উৎসাহ তারুণ্যের খামখেয়ালীপনা বলে নিজেকে প্রবোধ দিলেও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।
দু’জনকে অনুসরণ করে লিভিংরূমে ঢুকল ও। বিশাল উইং চেয়ারে বসে আছে বিল ব্রেনেল, হাঁটুর ওপর পড়ে আছে দুই কনুই, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফায়ারপ্লেসের দিকে। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগার, আর এক হাতে পানীয়ের গ্লাস। ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে সিলিঙের দিকে। উল্টোদিকের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মিরিয়াম, উদাস দৃষ্টিতে রিও ফ্রিয়োর সৌন্দর্য দেখছে। বোধহয়। টেবিলের কাছে একটা চেয়ারে বসেছে জেফরি, বরাবরের মতই নিস্পৃহ চাহনি চোখে।
মাথা ধরেছে অ্যাগনেসের, চোখ না তুলেই বেনের উদ্দেশে বলল বিল। আমার মনে হয়…ওকে ছাড়াই শুরু করতে পারি আমরা। বেন, নিশ্চয়ই কৌতূহল হচ্ছে বাবা ঠিক কতটা দিয়ে গেছে তোমাকে?
তাড়া নেই আমার।
আড়চোখে ওকে দেখল জেফরি, তারপর আপন-ভাইয়ের ওপর ফিরে গেল তার দৃষ্টি।
সিগারে পাফ করল বিল। উইল অনুযায়ী নগদ টাকা পাবে তুমি, বেন। টাকা…অথবা তোমার আগ্রহ থাকলে র্যাঞ্চের অংশও পেতে পারো–চার ভাগের এক অংশ, ক্ষীণ হাসল সে। কিন্তু একটা শর্ত আছে; কখনও আলাদা হতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কি, শর্তটা আমাদের যে কারও জন্যেও প্রয়োজ্য; র্যাঞ্চের কাজে সরাসরি কোন অবদান না থাকলেও লভ্যাংশ পাবে, কিন্তু আলাদা। হতে পারবে না কেউ কিংবা অন্য কারও কাছে এই রেঞ্জের কোন অংশ বিক্রিও করা যাবে না। ক্রেতা-বিক্রেতা, এই চারজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই হচ্ছে অবস্থা, ইচ্ছে থাকলে আমার সঙ্গে পার্টনারশীপে র্যাঞ্চ চালাতে পারবে তুমি। সেজন্যে মাসিক একটা বেতনও ধার্য করে দিয়েছে বাবা।
এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই আমি, বিল, অন্যমনস্ক স্বরে বলল বেন, আনমনে। কার্ল ব্রেনেলের উইলের কথা ভাবছে। বুড়োর ইচ্ছে পরিষ্কার: সে চায়নি চার ছেলে-মেয়ে আলাদা হয়ে যাক; চেয়েছে সম্পত্তি এবং সম্পর্ক, দুটোই অটুট থাকুক।
স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখছে বিল। কিন্তু কোন কিছু বিচার বা নিরীখ করার মত বিচক্ষণতা নেই তার চাহনিতে। তারমানে…আমার সঙ্গে পার্টনারশীপে যেতে চাও?
কারণটা ভাল করে জানো তুমি। সমস্যাটা অন্যখানে, লেযি-এনের সঙ্গে শত্রুতাই আমার দুশ্চিন্তার কারণ।
নিতান্ত অবজ্ঞা ফুটে উঠল জেফরির চাহনিতে।
এটাই শেষ কথা, বেন? মরিয়া হয়ে জানতে চাইল বিল।
বাথানের অবস্থা যা দেখলাম, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে আসলে র্যাঙ্কিং করছ তুমি। বেশিরভাগ ঘোড়া নেই। টেকোসের কাছে শুনলাম আগের তুলনায় গরুর সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। কারণটা জানি না, কিন্তু রাসলিঙের কারণে স্টক ছোট হয়ে গেছে এমন কিছু মানতে রাজি নই আমি, কারণ বরাবরই এ ব্যাপারটা দৃঢ় হাতে সামাল দিত বাবা। রাসলাররাও অদ্ভুত কোন কারণে ডাবল-বি এড়িয়ে চলত।
তো? জেফরির উষ্মা ভরা জিজ্ঞাসা।
পাশ ফিরে তার দিকে তাকাল বেন। সবসময়ই খানিকটা তাচ্ছিল্য আর চ্যালেঞ্জ প্রকাশ পাচ্ছে তরুণের স্বরে। র্যাঞ্চিং করার ইচ্ছে আমার যোলোআনাই। আছে, কিড। ডাবল-বির জমি বেসিনে সেরাগুলোর একটা, ঘোড়া বা গরু চরানোর জন্যে আদর্শ। কিন্তু অযথা ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি! টাকাই নেব আমি, বিল।
দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল কামরায়, ফায়ারপ্লেসে আগুনের মৃদু শব্দই কেবল শোনা যাচ্ছে।
তো? শেষে জানতে চাইল বেন, পুরো ব্যাপারটাই অপছন্দ হচ্ছে ওর, প্রায়। ঘৃণা করছে পরিস্থিতিটা।
ওকে বলল, বিল, শান্ত, মৃদু স্বরে বলল মিরিয়াম।
গ্লাসের সবটুকু তরল গলায় ঢালল বিল ব্রেনেল। কিছু নগদ টাকা ছিল। আমার কাছে। কিন্তু বিয়ের সময়, এবং পরে সবকিছু গুছিয়ে নিতে বেশিরভাগই খরচ হয়ে গেছে, হাত নেড়ে বিলাসবহুল লিভিংরূমটা দেখাল সে। সান্তা ফে থেকে মহিলা কৃক আনতে হয়েছে, অ্যাগনেসের জন্যে কাপড় কিনতে হয়েছে। সান ফ্রান্সিসকোয় হানিমুন করেছি আমরা। প্রায় সব টাকাই খরচ হয়ে গেছে, বেন।
অপেক্ষা করব আমি।
হেসে উঠল বিল। ক’দিন? এত টাকা কামাই হবে না র্যাঞ্চ থেকে, বেন, বহু দিন লাগবে।
কত টাকা?
দশ হাজার ডলার।
মৃদু শিস দিল বেন। জানতামই না বাবার কাছে নগদ এত টাকা ছিল!
গ্লাসটা আবার ভরে নিল বিল। এরচেয়েও বেশি ছিল। বাবা মারা যাওয়ার আগেই কিছু খরচ করেছি আমি, বেশিরভাগই জুয়ার দেনা। মিরিয়াম আর জেফরিরও টাকা দরকার ছিল-মাস খানেক ধরে শহরে থাকছে ওরা।
এটা আমার আইডিয়া নয়, অসন্তুষ্ট স্বরে বলল জেফরি, হেঁটে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। সশব্দে বন্ধ করে দিল দরজাটা।
শহরে থাকাটা অবশ্য জরুরী ছিল না, স্বীকার করল মিরিয়াম। কিন্তু আর কিছু যোগ করল না, ব্যাখ্যা দিতে নারাজ।
ব্যঙ্গ ঝরে পড়ছে বিলের হাসিতে, বিদ্রূপ মাখা আমুদে হাসিটা লেপ্টে থাকল, ঠোঁটের কোণে। বেনের সন্দেহ হলো স্রেফ হুইস্কির জন্যেই বোনের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করছে না সে, কিছুটা হলেও অসন্তোষ রয়েছে এর পেছনে।
বাদ দাও। এভাবেই চলুক না!
বেনের প্রস্তাবে যেন সংবিৎ ফিরল বিলের। ধীরে ধীরে নির্বিকার হয়ে গেল মুখ, দৃষ্টি নামিয়ে হাতের গ্লাসের দিকে তাকাল। পলকহীন দৃষ্টি। কিছুই ভাবছে না। সে, নিশ্চিত বলতে পারবে বেন, এক ধরনের ঘোর তাড়া করছে ওকে। সত্যি কথা হচ্ছে, তোমাকে দেয়ার মত পর্যাপ্ত টাকা নেই আমার কাছে, বেন! শেষে নিচু তিক্ত স্বরে বলল সে।
অপেক্ষা করব আমি।
উঁহু, বাধা দিল মিরিয়াম। বাকিটাও বলল ওকে, বিল।
ব্র্যান্ডিতে চুমুক দিল বিল। আমি সত্যিই জানি না কিভাবে ওই টাকা জোগাড় করতে হবে।
র্যাঞ্চটা আছে। সিরেনোর চৌহদ্দিতে সেরাগুলোর একটা।
কিন্তু এটা চালাতে পারছি না আমি। কখনোই র্যাঞ্চার ছিলাম না, হতেও পারব না, বেন। তুমি চলে যাওয়ার পর বাবা বহুবার কথাটা বলেছে আমাকে। ছয় বছর আগে হয়তো আমারই চলে যাওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু যাওনি তুমি, চাঁছাছোলা স্বরে বলল মিরিয়াম।
অসন্তোষ নিয়ে বোনের দিকে তাকাল বিল, মুখ খুলেছিল কিছু একটা বলতে, কিন্তু নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল শেষে।
বেনের দিকে তাকাল মিরিয়াম। বেন, বিলের সঙ্গে একটা রফা করছ না কেন? এখানেই থাকতে পারো তুমি, র্যাঞ্চটা চালাও। তোমার হাতে পড়লে হয়তো ক্ষতি সামলে নিতে পারবে ডাবল-বি। তারপর না হয় ইচ্ছে হলে থাকবে, কিংবা টাকা নিয়ে চলে যাবে।
চিবুক ঘষছে বেন। এখানে থাকার পরিকল্পনা করিনি আমি।
লেযি-এনের ক্রুরা কি সিদ্ধান্তটা নিতে সাহায্য করেছে তোমাকে? অধৈর্য স্বরে জানতে চাইল মিরিয়াম।
অজান্তে লাল হয়ে গেল বেনের মুখ। সময় দাও আমাকে, ব্ৰিত স্বরে বলল ও। এখানকার পরিস্থিতি পছন্দ হচ্ছে না আমার। কিন্তু এটা ঠিক, এই বাথান কিংবা রিও ফ্রিয়য়া এলাকা…সত্যিই আমার পছন্দের জায়গা। তাই বলে গান পাউডার ভরা একটা বাক্সের ওপর বসতে চাই না আমি, যেখানে সলতেয় আগুন দেয়ার জন্যে মুখিয়ে আছে কিছু লোক!
তাছাড়া, বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটা সুরাহা হয়নি। কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছা’নোর আগে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। আপাতত শুধু এটা নিয়েই ভাবছি আমি। ফিরে যাওয়ার সময় আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই যে বাবার খুনী ধরা পড়েছে কিংবা ডাবল-বিকে নিয়ে কেউ ষড়যন্ত্র করছে না। সেজন্যে যদি ছয় মাসও অপেক্ষা করতে হয়, থাকব আমি, এবং প্রয়োজনে যদি লেযি-এনেও হানা দিতে হয়, তাই করব!
মুখ তুলে তাকাল বিল, স্থির দৃষ্টিতে দেখছে বেনকে। দুর্বোধ্য একটা ইঙ্গিত তার চোখের গভীরে, মিরিয়ামের অগোচরে কি যেন বোঝাতে চাইছে; কিন্তু অর্ধ মাতাল যুবকের দিকে মনোযোগ নেই বেনের, ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছে। পোর্চে বেরিয়ে এল ও।
বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে, তিক্ত মনে ভাবল ও। ঘোড়ার জন্যে স্টেবলের দিকে এগোনোর সময় শুনতে পেল নিচু স্বরে বিলের সঙ্গে তর্ক করছে মিরিয়াম।
কতটা বিপদে আছে ডাবল-বি? তিন ভাই-বোন চাইছে বাথানের দায়িত্ব নিক ও…এখন–অথচ এতদিন চেয়েছে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিলের দায়িত্বহীনতাই কি ডাবল-বির ভরাডুবির কারণ, নাকি সত্যিই লেযি-এনের সঙ্গে কোন ঝামেলায় পড়েছে?
০৫. চওড়ায় অন্তত ত্রিশ গজ
চওড়ায় অন্তত ত্রিশ গজ হবে রিও ফ্রিয়ো। দু’পাড়ে উইলোর শাখা হেলে পড়েছে পানির ওপর, জোরাল বাতাস ঘূর্ণি তুলছে পানিতে। সূর্য এখন ঠিক মাথার ওপর, মেঘের পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে নীল আকাশ! ঘোলাটে মেঘের দল ছুটছে অবিরাম, নিচের জমিনে পড়া ছুটন্ত ছায়াগুলোকে ধরার নিরন্তর চেষ্টায় আছে যেন।
উইলো সারির কাছে এসে ঘোড়া থামাল বেন স্লেজেল, স্যাডল ছেড়ে নদীর বাঁক ধরে এগোল। কার্ল ব্রেনেলকে যে জায়গায় অ্যাম্বুশ করা হয়েছিল, জায়গাটার বর্ণনা দিয়েছে টেকোস ফারমিন বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে পৌঁছতে হবে।
রিও ফ্রিয়োর ওপারে লেযি-এনের জমি, ঢালের আকারে উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর। পাহাড় না বলে বিশাল, মাটির ঢিবিই বলা উচিত। ঘন ঝোঁপ আর বোন্ডার ছাড়াও কিছু গুল্ম জাতীয় গাছ আছে। ওখান থেকেই গুলি করা হয়েছে কার্ল ব্রেনেলকে।
উপত্যকা ধরে ওপরে-নিচে তীক্ষ্ণ নজর চালাল বেন। ডাবল-বি র্যাঞ্চ হাউস থেকে এ জায়গাটা বহু দূরে, রিও ফ্রিয়োর বাঁকের ঠিক মুখে। ডাবল-বির জমি হলেও তিন দিকেই লেযি-এন রেঞ্জ। নদীর এপাড়ের জমি অপেক্ষাকৃত নিচু, আর ওপাশে গাট-হক জমি ঢালের আকারে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে মিশেছে। ন্যাড়া মাথার কিছু পাহাড় আছে পেছনে, তারপরই বেসিনের সবচেয়ে উর্বর তৃণভূমি-অবারিত, সমৃদ্ধ এই জমির মালিক, স্বভাবতই টম নোলান।
জায়গাটার অবস্থান এমনই যে রিও ফ্রিয়োর ওপাড়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে ডাবল-বির তৃণভূমিতে নজর রাখতে পারবে যে কেউ। অন্তত কয়েক মাইল জায়গা দৃষ্টিসীমায় থাকবে তার। জায়গা আর সময় নির্বাচন ঠিক থাকলে এখানে বসেই যে কাউকে খুন করে সরে পড়া সম্ভব। লুকিয়ে থাকার মত যথেষ্ট আড়াল আছে, আছে পালানোর উপযুক্ত পথ।
কে করেছে কাজটা? লেযি-এন? সন্দেহটা প্রথমে ওদের ওপরই গিয়ে পড়ে, কারণ আড়াই দশক ধরে দুটো বাথানের শক্রতার নিষ্পত্তি হয়নি এখনও। অস্বীকার করার উপায় নেই কার্ল ব্রেনেল না থাকলে লেযি-এনই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। পেছন থেকে কিংবা অ্যাম্বুশ করে খুন করার লোক যথেষ্ট আছে লেযি-এন করিডায়, ভাল বেতন দেয়া হয় এদের, এবং লেযি-এনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত লোক বেসিনে কমই আছে।
নিদারুণ কৌতূহল বোধ করছে বেন। বিপদের আশঙ্কা বা সম্ভাবনার চেয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে ওর কৌতূহল, এতটাই যে পরোয়া না করে ফোর্ড ধরে রিও ফ্রিয়োর ওপাড়ে উঠে এল। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালাল বেন, মনে হলো না কেউ দেখছে ওকে।
বিপজ্জনক “গাট-ক” জমিতে আবারও পা রাখল ও। পানিতে নামার আগে বুট জোড়া খুলে নিয়েছিল, পাড়ের নরম মাটি এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত মাটিতে উঠে আসার পর বুট পরে নিল।
ঢিবির মত উঁচু পাহাড়ের দিকে দ্রুত এগোল ও, ছোট্ট একটা চাতাল আছে। বিশ ফুট ওপরে। ওটার কাছে পৌঁছে হাঁটু গেড়ে বসল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করল জায়গাটা। গাছের ফাঁক দিয়ে লেযি-এন তৃণভূমির বড়সড় একটা অংশ চোখে পড়ছে। ডাবল-বির দিকে তাকাতে রীতিমত বিস্মিত হলো। যতটা ভেবেছিল তারচেয়ে অনেক বেশি জায়গা চোখে পড়ে এখান থেকে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওপাড়ের সবকিছু রিও ফ্রিয়ের পাড় বরাবর দক্ষিণে প্রায় এক মাইল এবং উত্তরে আধ-মাইলের মত নদীর দু’ধার, এমনকি বহু দূরে ডাবল-বি র্যাঞ্চ হাউসও চোখে পড়ছে।
একটা সিগারেট রোল করল ও। ভাবছে ঠিক কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল খুনীকে, মাত্র একটা শটে ওর সারা জীবনে দেখা সবচেয়ে ভাল মানুষটাকে খুন করেছে লোকটা।
ফর্টি-ফোর ক্যালিবারের গুলিতে মারা গেছে কার্ল ব্রেনেল। খুব চলতি ক্যালিবার, এবং কার্তুজগুলো পিস্তল বা রাইফেল দুটোতেই ব্যবহার করা যায়। নিবিষ্ট মনে আশপাশের মাটি আর ঘাস পর্যবেক্ষণ করল বেন, ক্ষীণ আশা করছে কোন চিহ্ন খুঁজে পাবে যার মাধ্যমে খুনীর পরিচয় পেতে পারে।
ডজন খানেক সিগারেটের গোড়া পড়ে আছে মাটিতে, কিছু নুয়ে পড়া ঘাস…ব্যস, আর কিছু না। চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় গুলি করতে হয়েছে লোকটাকে, রিও ফ্রিয়ের ওপাড়ে ট্রেইলের ওপর চোখ রেখে আনমনে ভাবল বেন, এবং অন্তত তিনশো ফুট দূর থেকে। মাত্র এক গুলিতে কাজ সেরে ফেলেছে খুনী–নিখুঁত নিশানায়!
বেনের সন্দেহ, যতটা বলেছে তারচেয়ে বেশি জানে টেকোস ফারমিন। কে জানে কি কারণে সত্য চেপে গেছে সে! কিন্তু মুখ না খোলার জন্যে দোষ দেয়া যায় না তাকে, কারণ এখানে বেশিরভাগ লোকই মুখ বুজে থাকতে পছন্দ করে, কিংবা বাধ্য হয়। বেয়াড়া যে কোন মুখ মাত্র একটা গুলিতে চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
আচমকা মেরুদণ্ডে শিরশিরে একটা অনুভূতি হলো ওর। বিপদ! তৎক্ষণাৎ নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হলো-লেযি-এনের জমিতে আছে এখন, বিপদ এলে ওখান থেকেই আসবে। ঝটিতি ঘুরে তাকাল ও, গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখল পাহাড়ী উপত্যকা ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে তিন রাইডার। নির্ঘাত লেযি এন ক্রু। কিন্তু কিভাবে ওর খবর পেল ওরা?
ফিরতি পথে এগোল ও, ঘুরতে যেতে আচমকা কিছু একটায় বেধে গেল ডেনিম জ্যাকেট। বাম হাতে সেটা চেপে ধরে টান দিল ও, দেখল ধুলো মাখা একটা স্পার-জ্যাংলার-সাধারণত টেক্সাস জাতীয় স্পারের সঙ্গে এ ধরনের ধাতব টুকরো ব্যবহার করা হয়। দ্রুত জ্যাকেটের পকেটে জিনিসটা চালান করে দিয়ে ফিরতি পথে ছুটতে শুরু করল ও।
রাইডাররা যখন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এল, ততক্ষণে বাকস্কিনের স্যাডলে চেপে বসেছে বেন। ছুটে আসায় হাঁপাচ্ছে কিছুটা, দম নিচ্ছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ অসঙ্গতিটা চোখে পড়ল ওর, রাইডারদের একজন উধাও হয়ে গেছে, দু’জনকে দেখতে পাচ্ছে এখন। ঢাল বেয়ে নেমে এল তারা, নদীর কাছাকাছি হলো। ঠিক উল্টোদিকে বাকস্কিনের স্যাডলে স্থির হয়ে বসে আছে বেন, নীরবে দেখছে লোকগুলোকে। স্ক্যাবার্ডে রাখা উইনচেস্টারের ওপর ফেলে রেখেছে একটা হাত।
আবারও তুমি, স্লেজেল? পরিচিত একটা কণ্ঠ জানতে চাইল ত্যক্ত কণ্ঠে।
হ্যাঁ, হারলো, স্মিত হেসে বলল ও।
মনে হয় তোমাকে একটু আগে এপাড়ে দেখেছি?
হয়তো, প্রতিবেশী হিসেবে ওপাড়ে যেতেও পারি আমি, তাই না?
নেহাত গুরুত্বহীন জিজ্ঞাসা, অন্তত জ্যাক হারলোর আচরণে তাই প্রমাণ হলো। দস্তানা পরা ডান হাত বাতাসে নাড়ল সে, যেন প্রতিবেশী হিসেবে বেনের অধিকার বাতিল করে দিচ্ছে। নীল চোখ স্থির হলো ওর মুখে, গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল: এখানে এসেছ কেন, স্লেজেল?
হারিয়ে যাওয়া একটা মেয়েকে খুঁজছি, অ্যামিগো!
উরুতে সপাটে চাপড় মারল হারলো, বেনের কৌতুকে আহত হয়েছে বোধহয়। কাজ শুরু করে দিয়েছ তাহলে?
স্যাডলে নিশ্চল বসে আছে অন্য লোকটা, নিচু ব্রিমের হ্যাটের তলা দিয়ে নিরীখ করছে বেনকে। পোড়-খাওয়া দৃঢ় চেহারা, ইস্পাত-ধূসর চোখ জোড়ায় সতর্ক দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায়, বহু পথ চলার আর বহু মানুষের সাথে মেশার অভিজ্ঞতা আছে তার।
রীজের ঢাল ধরে সতর্ক দুষ্টি চালাল বেন। তৃতীয় লোকটা কোথায়? হয়তো ঝোঁপের আড়ালে শুয়ে থেকে রাইফেলে নিশানা করছে ওকে।
ব্যস্ত আছ নাকি, স্লেজেল? জানতে চাইল হারলো।
জরুরী কিছু নয়। কেন?
বুড়ো কথা বলতে চায় তোমার সঙ্গে। কি চায় সে?
শ্ৰাগ, করল টেক্সান, দু’হাত ছড়িয়ে দিল। আমাকে কিছু বলেনি। বস্ নিজেই বলবে তোমাকে।
বাকস্কিন ঘুরিয়ে নিল বেন। প্রায় ছয় বছর হলো টম নোলানকে দেখেনি, এবং বুড়ো কয়োটটাকে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর, স্রেফ খানিকটা কৌতূহল অনুভব করছে।
সত্যিই আসছ? খানিকটা বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল হারলো।
আঙুল চালিয়ে হ্যাটের কিনারা ওপরে তুলে দিল বেন, স্যাডল হর্নে কনুই রেখে ঝুঁকে এল কিছুটা। যেতেও পারি। আগে শোনা যাক তোমাদের সঙ্গে ছিল এতক্ষণ, ওই লোকটা কোথায় গেছে?
সবকটা দাঁত বের করে হাসল হারো। ঘুরে স্যাডল ক্যান্টারে একটা হাত রাখল, মুক্ত হাত আগু-পিছু করল অবহেলার ভঙ্গিতে। মিনিট কয়েকের মধ্যে দেখা গেল তৃতীয় লোকটাকে, রীজের চূড়ায় উঠে এসেছে এখন, হারলোর উদ্দেশে হাত নেড়ে কিনারা ধরে উত্তরে এগোল।
লোকটা দৃষ্টির আড়ালে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল বেন, তারপর রিও ফ্রিয়ো পেরিয়ে লেযি-এনের জমিতে পা রাখল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে হারলোর সঙ্গীর দিকে তাকাল।
ডড কিনলে, সঙ্গীর দিকে খানিকটা মাথা ঝুঁকিয়ে জানাল হারলো।
নড করল বেন।
চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল কিনলে। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মৃদু স্বরে বলল সে; মার্জিত উচ্চারণ, কণ্ঠে বিদ্বেষ বা অতিরিক্ত আগ্রহ কোনটাই নেই। পরিষ্কার কাপড় পরনে, দামী না হলেও ভদ্রস্থ এবং পরিচ্ছন্ন। সাধারণ লেযি-এন রাইডার বা ভ্যাকুয়েরোদের চেয়ে সহজে আলাদা করা যাচ্ছে তাকে–মাসিক একশো ডলারে পোষা ভ্যাকুয়েরো নয়।
নীরবে লেযি-এন ব্ল্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোল ওরা।
র্যাঞ্চ হাউসটা তৈরি করার সময় সৌন্দর্য এবং নিরাপত্তা দুটো দিকই বিবেচনা করা হয়েছে। দোতলা বিল্ডিং–অ্যাডোবি দালান, টালির ছাদ। আঙিনায়, ফ্লাওয়ার বেড আর একটা পুকুর কাটা হয়েছে। পুকুরে কিছু হাঁস সাঁতার কাটছে। অসংখ্য কটনউড এবং উইলোর ঝাড় ছায়া আর প্রশান্তি বিলাচ্ছে র্যাঞ্চ হাউসের চারপাশে। ঠিক পেছনে পাহাড়ের নিরেট শরীর। শিকাগোয় দেখা যায়, এমন একটা উইন্ডমিল রয়েছে এক পাশে, লাগোয়া ট্যাঙ্কে পানি পাম্প করছে।
মূল দালানকে ঘিরে রাখা অ্যাডোবি দেয়ালের প্রশস্ত গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল তিন অশ্বারোহী। র্যাঞ্চ হাউসটা দেখে মাথা নাড়ল বেন স্লেজেল। বহু বছর আগেও যেমন দেখেছে, অপূর্ব সুন্দর একটা বাড়ি। শান্তি, নীরবতা আর আন্তরিকতার এক স্বর্গ। বাস্তবের সঙ্গে ওর কল্পনার অমিল লক্ষ করে ক্ষীণ হাসল বেন, বেসিনের সমস্ত অশান্তি যে এখান থেকে শুরু হয়েছিল তা ক’জন জানে? অথচ এমন একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখবে যে কেউ।
দারুণ, তাই না? প্রসন্ন সুরে জানতে চাইল হারলো।
নড করল ও। অন্য কোথাও এত সুন্দর বাড়ি দেখিনি আমি।
থুথু ফেলল সে। আমি প্রায়ই ভাবি এত সুরক্ষিত করে বাড়ি তৈরি করার কারণটা কি?
টেক্সানের দিকে তাকাল বেন। মানুষটাকে কিছুটা হলেও ভিন্ন রকম মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে। মার্সেনারির মতই কঠিন, দৃঢ়চেতা; কিন্তু একইসঙ্গে একজন, খুনীর সহজাত প্রবৃত্তিও লুকিয়ে আছে জ্যাক হারলোর মধ্যে।
কিছু মানুষ ঘোড়া পছন্দ করে, কেউ কেউ লিকার বা মেয়েদের পছন্দ করে, খানিকটা তিক্ত স্বরে বলল বেন। টম নোলানের ক্ষেত্রে এর কোনটাই খাটে না, শুধু ক্ষমতা আর সমৃদ্ধিই পছন্দ তার।
কোনটারই অভাব নেই ওর।
কিন্তু সবকিছুরই শেষ আছে, দার্শনিক সুরে খেই ধরল বেন। একটা সময় আসে যখন সবাইকেই হাল ছেড়ে দিতে হয়, কিংবা বিদায় নিতে হয়।
ঝট করে বেনের দিকে ফিরল ডড কিনলে। কেন? শান্ত স্বরে জানতে চাইল সে।
এটাই রীতি, এভাবেই চলে আসছে পৃথিবী।
সন্দেহ আছে আমার!
প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য আছে।
তোমার লক্ষ্য কি, স্লেজেল? জানতে চাইল কিনলে। নিশ্চিত নই আমি।
নিশ্চিত হলে কি করবে, নোলানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে আবার?
নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করতে গিয়ে কাউকে খুন করার ইচ্ছে নেই আমার।
স্মিত হাসল কিনলে, প্রায় বিদ্রুপের মত দেখাচ্ছে হাসিটা। কিন্তু যদূর শুনেছি, খুন-খারাবি নতুন কিছু নয় তোমার কাছে।
ছয় বছর আগে সিরেনোর ওই ফাইটের কথা বোঝাতে চাইছ?
হ্যাঁ। তাছাড়া আরও কিছু ঘটনা আছে।
শীতল একটা অনুভূতি হলো বেনের। কিসের কথা বলছ?
ওর চোখে চোখ রাখল ডড কিনলে, স্থির নিষ্কম্প দৃষ্টি। কিভাবে ভাবলে মাঝখানের ছয়টা বছর আড়াল করতে পারবে?
ধীরে ধীরে সিগারেট রোল করল বেন, উত্তর দেয়ার আগে খানিক ভাবল মনে মনে। জানতাম না ইতিহাস তৈরি করেছি আমি, কিনলে, ব্যাখ্যা দেয়ার সুরে। বলল ও, যদিও জানে সেটা মোটেই জরুরী নয়। পশ্চিম বড় অদ্ভুত জায়গা, বাঁচার তাগিদেই বেপরোয়া হয় লোকেরা।
ক্ষীণ হাসি দেখা গেল লোকটার মুখে, বেনের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে আর দরকার নেই তোমার, হারলো, অন্তত আজকে, লেযি-এন রাইডারের উদ্দেশে বলল সে, তারপর বেনের দিকে ফিরল। হাস্টা লা ভিস্টা, স্লেজেল।
নড করল বেন। তামাক আর কাগজ হারলোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সিগারেট ধরাল। লোকটা কে? পিঙ্কারটনের গোয়েন্দা?
স্টক ডিটেকটিভ।
ভাড়াটে খুনী, তাই তো বলতে চাইছ, হারলো?
যীশুর দোহাই, ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নাও, স্লেজেল!
হেসে আলতো স্পার দাবাল বেন, গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল ওর বাকস্কিন। আমি কি একাই যাব? ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছন ফিরে জানতে চাইল ও।
একাই যেতে হবে তোমার। বুড়ো নোলানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার প্রায়ই মনে হয় সঙ্গে এক টুপ সৈন্য না থাকলে ঠিক নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই।
খুব বেশি বাড়িয়ে বলেনি লোকটা, বিশাল বাড়ির সামনের হিচিং রেইলে ঘোড়ার লাগাম বাঁধার সময় ভাবল বেন। হ্যাট দিয়ে কাপড় থেকে ধুলো ঝেড়ে ছায়া ঘেরা বারান্দায় উঠে এল ও, মূল দরজায় পেতলের নকার ধরে নাড়া দিল দু’বার। ভারী মেহগনি কাঠের পাল্লায় খোদাই করে বসানো হয়েছে নকারটা, গরুর মাথার মত হুবহু আকৃতির। শিং দুটো আঙ্কার কাজ করছে, ওগুলো ধরে নাড়া দিতে হয়। মিনিট পূর্ণ হওয়ার আগেই সরে গেল পাল্লা দুটো, বয়স্ক এক মেক্সিকান এসে দাঁড়াল সামনে।
মি. নোলানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমার নাম বেন স্লেজেল।
নড করল লোকটা। এসো, সেনর।
প্রশস্ত সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এল ওরা। দুটো দরজা পেরিয়ে তৃতীয়টার দরজায় মৃদু করাঘাত করল মেক্সিকান।
এসো! ভেতর থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে এল।
দরজা মেলে এক পাশে সরে দাঁড়াল ভূত্য। হেঁটে বিশাল কামরায় ঢুকল বেন। টম নোলানের অফিসরূম এটা। পাখিদের এয়ারি রূমের মত উঁচু জায়গায় নির্মিত, এখান থেকেই নিজের সাম্রাজ্য পরিচালনা করে লেযি-এন বস। বিশাল কামরাটা সাজানো-গোছানো, ছবির মত সুন্দর। সারা ঘরে উষ্ণতা বিতরণ করছে ফায়ারপ্লেস। চুনকাম করা দেয়ালে নাভাজো কম্বল, অ্যাপাচী বর্শা, গদা, পেতলের তৈরি স্প্যানিশ স্পার সমেত জুতো, মাজল-লোডিং বন্দুক, বাফেলো গান, বুলেটের খোলস…এমনি সব অ্যান্টিক, শিল্পকর্ম বা পুরা-নিদর্শনে ভরা। বিশাল রোল-টপ ডেস্কের পেছনে সাদা-চুলো লোকটি বসে আছে, পেছনের জানালায় লেযি-এন তৃণভূমির একটা অংশ দেখা যাচ্ছে।
তোমাকে দেখে টাফ লোক মনে হচ্ছে, বেন, গম্ভীর স্বরে নীরবতা ভাঙল টম নোলান।
ক্ষীণ হাসল বেন। কিন্তু তোমার চেয়ে টাফ নই, মি. নোলান।
হাসতে যাচ্ছিল লেযি-এন মালিক, বেনের মন্তব্যে হাসিটা মিলিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। স্ফটিকের মত স্বচ্ছ নীল চোখে নির্বিকার চাহনি। জীবিত অবস্থায় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে মানুষটা। অহংকার তো থাকবেই, বেন যেন নিজের অজান্তে তাতে খানিকটা চোট দিয়ে ফেলেছে। নিমেষে চেপে বসল টম নোলানের চোয়ালের পেশী, কঠিন মাপা দৃষ্টিতে নিরীখ করল ওকে।
বরাবরের মত, এবারও বিস্ময় বোধ করল বেন–অ্যাগনেসের বাবা টম নোলানের মত নিষ্ঠুর মানুষ, হিসেবটা কোন দিনই মেলাতে পারেনি, এবারও ব্যর্থ হলো।
একটা চেয়ার ইঙ্গিত করল লেযি-এন মালিক। বোসো, বেন। কি দেব তোমাকে?
রাই?
দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালল নোলান, একবারের জন্যেও চোখ তুলে তাকাল না। ভোমার সম্পর্কে ইদানীং অনেক খবর আসছে আমার কানে, খানিকটা হেসে মন্তব্য করল সে।
কোন কিছুই দেখছি তোমার অগোচরে থাকে না, মি. নোলান।
চারপাশে কি হচ্ছে, উপস্থিত না থাকলেও খবর রাখতে হয়, বেন, নইলে এত বড় একটা বাথান চালানো সম্ভব হত না।
মানছি। হয়তো আমার বাবার মৃত্যু সম্পর্কেও কিছু খবর দিতে পারবে তুমি।
তীক্ষ দৃষ্টিতে ওকে দেখল টম নোলান। নীরবে গ্লাসে চুমুক দিল ওরা, কেউই নীরবতা ভাঙছে না। বিশাল দেয়াল-ঘড়ির টিকটিক শব্দ কানে বাজছে। এজন্যেই ফিরে এসেছ?
এক হিসেবে তাই বলা যায়।
উত্তরাধিকার বুঝে নেওয়ার জন্যে আসোনি?
হয়তো। আমার ধারণা সেটা তুমিও ভাল করে জানো।
কিংবা…অ্যাগনেসের কারণেই ফিরে এসেছ তুমি।
না। তবে ও চাইলে অনেক আগেই ফিরে আসতাম।
কিন্তু ও তোমার ভাইয়ের বউ এখন, বেন।
ঘড়িটা টিকটিক করেই যাচ্ছে।
গ্লাসের অর্ধেকটা পান করেছে নোলান। বাকি পানীয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল শূন্য দৃষ্টিতে, নির্বিকার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ঠিক কি ভাবছে। আনমনে হাতের গ্লাস নাড়ল সে, গ্লাসের ভেতরে পানীয়তে ঘূর্ণন উঠল। হয়তো তোমাকে বিশ্বাস করা উচিত, করতে পারলেই ভাল লাগত আমার।
কিন্তু এটাই সত্যি।
তাহলে কার্ল ব্রেনেলের খুনীর পরিচয় জানতে এসেছ তুমি?
হ্যাঁ।
আমিও তাই ভেবেছি।
প্রসঙ্গটা ঠিকই তুলেছে বুড়ো। প্রশংসা না করে উপায় নেই। এক ধরনের নিষ্ঠুরতা বলা যায় এটাকে, কিন্তু একইসঙ্গে স্পষ্টবাদিতার নমুনাও, শল্য চিকিৎসকের কাঁচির মত–নিষ্ঠুর কিন্তু অত্যাবশ্যক এবং দারুণ কার্যকরী, এই হচ্ছে টম নোলান।
খুনটা আমি করিনি, বেন, ঘোষণা করল সে।
তোমার মতই বলতে হয়: বিশ্বাস করতে পারলে খুশি হতাম, মি. নোলান।
সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে জানালার দিকে ফিরল টম নোলান, আয়েশ করে। হেলান দিল চেয়ারে। পেছন থেকে শুধু গ্লাস ধরা হাত আর এক মাথা চুল দেখতে পাচ্ছে বেন।
তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, নিস্পৃহ স্বরে বলল সে। কিন্তু কার্ল ব্রেনেলকে খুন করিনি আমি, আসলে খুন করার যৌক্তিক কোন কারণও ছিল না।
হয়তো ব্যক্তিগত কোন কারণ নেই। নিজের পোশাকে কখনোই রক্ত লাগতে দাওনি তুমি। ঠিক বলিনি?
ঝট করে চেয়ার ঘুরিয়ে ওর মুখোমুখি হলো লেযি-এন মালিক, কঠিন চোখে চাপা অসন্তোষ ফুটে উঠেছে। স্বীকার করছি কার্লের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল আমার, মনে-প্রাণে ঘৃণা করতাম ওকে। জনমের শত্রুতা বোধহয় একেই বলে।সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ওর পেটে বুলেট ঢুকিয়ে দিতে পারলে শান্তি পেতাম আমি। কিন্তু ড্রাই–গালশ করা আমার ধাতে নেই, বেন।
বড়বড় কথা বলছ, তুমি, মি. নোলান। সারা নিউ মেক্সিকোর লোকেরা অন্যদের সম্পর্কে তোমার দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানে, বছরকে বছর নিজের রেঞ্জে নিষ্ঠুর এক আতিথেয়তার নমুনা দেখিয়ে এসেছ তুমি। অপছন্দের লোকটাকে খুন করে গাট-হৃক জমিতে এনে ফেলে রাখো, তারপর দাবি করো ট্রেসপাস নয়তো রাসলিং করছিল সে। ব্যস, ঝামেলা খতম। কেউ তোমাকে জিজ্ঞেস করতে আসে না, সেই সাহসও নেই কারও। আরেকটু হলে গতরাতে এই আতিথেয়তার শিকার হয়ে গেছিলাম আমি।
এক চুমুকে গ্লাসের অবশিষ্ট পানীয় শেষ করে ফেলল টম নোলান। ক্ষীণ বিদ্রুপের হাসি ঝুলছে ঠোঁটের কোণে, চোখে কৌতুক ফুটে উঠল। নিজের পিঠ বাঁচাতে যথেষ্ট করেছ তুমি, বেন। কিন্তু স্টিভের ধারণা, ও সময়মত না পৌঁছালে হয়তো খুনোখুনি হয়ে যেত।
ঠিকই বলেছে ও।
ফ্রেড মোরিস তোমাকে ভুলে যায়নি, বেন, উপযুক্ত কারণও আছে।
ছয় বছর আগে সিরেনো কর্নারে বিল আর আমার মুখোমুখি হয়েছিল ও, ক্ষত-বিক্ষত মুখে হাত বুলাল বেন, র্যাঞ্চারের ভর্ৎসনায় আমল দিল না, বরং পাল্টা বিদ্রুপের স্বরে মনে করিয়ে দিল: খুন করার জন্যেই গুলি ছুঁড়েছিল ওরা। যা পাওয়া উচিত ছিল, তাই পেয়েছে সে।
নড করল টম নোলান। মজার ব্যাপার কি জানো, আসল সত্য কিন্তু চাপা, পড়ে গেছে। লড়াইয়ের সমস্ত কৃতিত্ব নিজের করে নিয়েছে বিল ব্রেনেল আর বেসিন ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছ তুমি।
তো?
এবার চওড়া হাসি দেখা গেল র্যাঞ্চারের মুখে। তুমি নও, বরং বিলই দু’জনকে খুন করেছে এবং আহত করেছে ফ্রেডকে। এটাই হচ্ছে সিরেনোর ওই লড়াই সম্পর্কে অন্যদের ধারণা। কিন্তু সত্যটা তুমি যেমন জানো, আমিও জানি। আর জানে ফ্রেড মোরিস। ও ঠিকই জানে সেদিন কার গুলিতে বিকলাঙ্গ হয়েছে। বিলের পক্ষে দু’জনকে ধরাশায়ী করা কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না, কারণ বেহেড মাতাল না হলেও নেশায় এতটাই বিপর্যস্ত ছিল যে ট্রিগার টানার মত মনের জোরও ছিল না ওর তখন।
বলে যাও।
স্বীকার করছি, তুমি চলে যাওয়ায় আমি কিন্তু খুশিই হয়েছিলাম। কিছু দিন নিশ্চিন্তে চলে গেছে, কারণ কার্ল বা বিল সেধে কখনও ঝামেলা করেনি। আসলে সিরোনোর ওই লড়াইয়ের পর পরস্পারের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকেছে দুই বাথানের ক্রুরা। দু’একটা মারামারির ঘটনা ঘটেছে অবশ্য, কিন্তু কোনটাই গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু তুমি ফিরে আসার পর বোধহয় পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। শোনো, বাছা, বিল ব্রেনেলকে অনায়াসে সামলাতে পারব আমি, ওর মত লোককে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।
গ্লাস খালি করে উঠে দাঁড়াল বেন। ঝামেলা করতে ফিরে আসিনি আমি, মি. নোলান।
সত্যি কথা হচ্ছে: ফিরে এসেছ তুমি, এবং রিও ফ্রিয়োর দখল এখনও চাই আমার। একজন ব্রেনেলকে বিয়ে করেছে আমার মেয়ে। আমার একমাত্র মেয়ে! আমার কষ্টটা বুঝতে পারবে না, বেন। বুঝবে, কখনও যদি সন্তানের বাবা হও।
একটা কথাই বলার আছে তোমাকে: হয় চলে যাও, নইলে ঝামেলা পোহাও। জানি না বিলের কাছে কত পাওনা হয়েছ তুমি, কিন্তু এটা জানি ফুটো পয়সা দেওয়ারও সামর্থ্য নেই ওর। তোমাকে দশ হাজার ডলার দিতে রাজি আছি আমি, স্রেফ একটা শর্তে: বেসিন ছেড়ে চলে যাবে চিরদিনের জন্যে, কখনও ফিরে আসতে পারবে না।
কেন? ধীরে ধীরে প্রশ্নটা করল বেন।
দুটো গ্লাসে আবারও পানীয় ঢালল টম নোলান। তোমার মধ্যে যে জিনিস দেখেছি, স্লেজেল, স্বীকার করছি দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার। বিল ব্রেনেল বা অন্যদের অনায়াসে সামলাতে পারব, কিন্তু তুমি ওদের চেয়ে আলাদা কিসিমের। রিও ফ্রিয়ো ছেড়ে চলে যাও; সান। টাকাটা নিয়ে ছুটতে থাকো। এখানে যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি আমি, ঠিক ততটাই নিশ্চিত জানি তুমি থেকে গেলে কিছু দিনের মধ্যে আমাদের যে কোন একজন খুন হয়ে যাবে।
গ্লাস তুলে পানীয়টা দেখল বেন। অন্তত কিছু দিন থাকছি আমি।
স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখল টম নোলান, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাসটা তুলে ধরল। জানতাম এ কথাই বলবে। ঠিক আছে, হয়তো এটাই হওয়া উচিত ছিল–যেহেতু আমাদের দুজনের পরিণতি একই সূত্রে গাঁথা। নিজের পিঠের দিকে খেয়াল রেখো, স্লেজেল।
গ্রেসিয়াস, মি. নোলান। পরস্পরের গ্লাস ঠোকাঠুকি করল ওরা, তারপর পানীয় ঢেলে দিল গলায়।
০৬. রিও ফ্রিয়োর নিচু জমি
রিও ফ্রিয়োর নিচু জমি পেরিয়ে যখন ডাবল-বি র্যাঞ্চ হাউসের কাছাকাছি পৌঁছল বেন স্নেজেল, ততক্ষণে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে সূর্য। গেটের কাছে আসতে আচমকা গুলির শব্দে চমকে উঠল ও, অজান্তে লাগাম টেনে ধরল। স্ট্যিাপের ওপর ভর দিয়ে শরীর উঁচু করে দেখার প্রয়াস পেল, গুলির উৎস খুঁজে বের করল স্টেবলের পেছনে বিশাল করালের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে তিনজন লোক।
হাঁটুর গুঁতোয় বাকস্কিনকে আগে বাড়াল বেন, দ্রুত র্যাঞ্চ হাউস পেরিয়ে গেল। প্রায় টানা কয়েক ঘণ্টা রাইড করেছে ও, বেসিনের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের পরিকল্পনা আর উপস্থিতি বিবেচনা করেছে–একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেয়েছে। টম নোলান কোন কালেই বোকা ছিল না, বরং ওর চেয়ে বেশিই উপলব্ধি করেছে সে; কিন্তু একটা ব্যাপার ঘোলাটে মনে হয়েছে বেনের কাছে ওর উপস্থিতিতে বেসিনের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর দিকে মোড় নেবে, টম নোলানের এ আশঙ্কা কি অমূলক নয়?
দ্রুত স্যাডল ত্যাগ করল ও, তারপর লাগাম হাতে এগোল করালের দিকে। ঠিক তখনই আবারও গুলির শব্দ হলো। করালের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো তিনজনের দিকে এগোল ও। গান পাউডারের ধোঁয়ায় ভরে গেছে জায়গাটা। বিল ব্রেনেল, টেকোস ফারমিন আর পুরোপুরি কালো কাপড়ে ফিটফাট এক তরুণ-জেফরি ব্রেনেল। সুদৃশ্য পিস্তলটা রিলোড করছে সে। দারুণ সন্তুষ্টি ছেলেটার চোখে মুখে।
ওকে দেখে ঘুরে দাঁড়াল বিল। ঢেকুর তুলল হঠাৎ। তোমাকে ফিরতে দেখে খুশি হলাম, বেন, জড়ানো স্বরে বলল সে। আমাদের এক হাত দেখে নিচ্ছে কিড।
গোল্লায় যাক ও! বিরক্তি প্রকাশ করল টেকোস। গানশ্লিংগার নই আমি, কখনও এমন দাবিও করিনি!
হোলস্টারে লোডেড পিস্তল ভরে রাখল জেফরি, তারপর বেনের দিকে তাকাল পলকের জন্যে। ঘুরে দাঁড়িয়ে করালের বেড়ার দ্বিতীয় রেইলের ওপর সাজানো ক্যানগুলোর মুখোমুখি হলো। একজন মানুষের পেট বা বুকের উচ্চতায়। বসানো সবকটা ক্যান। খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে দাড়াল জেফরি, বন্দুকবাজরা ড্র করার আগে যা করে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল সে, চোখের পলকে হাতে উঠে এল জোড়া কোল্ট, তারপর মুহুর্মুহু গুলি শুরু হলো–একবারে একটা পিস্তল থেকে গুলি পাঠাল জেফরি, শব্দ শুনে মনে হলো মেশিন পিস্তল থেকে গুলি হচ্ছে। সার বেঁধে পড়তে থাকল ক্যানগুলো।
সব ক্যান পড়ে যাওয়ার পর দুই আঙুলে পিস্তল দুটো চরকির মত ঘোরাল জেফরি, তারপর দ্রুত চামড়ার হোলস্টারে ভরে রাখল।
আনমনে মাথা নাড়ল বেন স্লেজেল। চোখ ধাঁধানো ড্র আর নিখুঁত নিশানার প্রদর্শনী দেখল এই মাত্র। জেফরিকে চালু বলতেই হবে।
ক্যানগুলো তুলে সাজাও আবার, টেকোস! গম্ভীর স্বরে, সদম্ভে নির্দেশ দিল জেফরি ব্রেনেল।
নির্দেশ তামিল করল কুক, তারপর বিলের পেছনে এসে দাঁড়াল।
থোক করে মাটিতে থুথু ফেলল বিল। নিচু করে বাঁধা একটা পিস্তল ওর ঊরুতে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্যানের সারি দেখল, মুখটা নির্বিকার রাখার চেষ্টায় প্রায় ক্লান্ত বোধ করছে। আড়চোখে দেখল চাপা হাসি ঝুলে আছে ছোট ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে।
এবার তোমার কারিশমা দেখাও তো, বিল! চ্যালেঞ্জ করল সে।
ক্ষণিকের দ্বিধার পর ড্র করল বিল। কোমরের কাছ থেকে গুলি করল। রেইল থেকে পড়ে গেল তিনটা ক্যান, বাকিগুলো আগের মতই খাড়া থাকল। শূটিংটাও থেমে থেমে, সময় নিয়ে করেছে; জেফরির তুলনায় যথেষ্ট শ্লথ।
মাথা নাড়ল বিল, তারপর ব্যাখ্যা দেয়ার সুরে বলল, সাধারণত এরচেয়ে ভাল করি আমি।
বেড়ার পোস্টের সঙ্গে হেলান দিল জেফরি। নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! টিটকারির সুরে একমত হলো সে।
বিশ্বাস করছ না?
এবার হেসে উঠল জেফরি। সিরেনোর সেই বিখ্যাত গানফাইটের কথা অনেক শুনেছি। দু’জন লোককে খুন করেছ তুমি, বিল, আরেকজনকে নাকি বিকলাঙ্গ করেছ। তোমাদের দুজনই আছে এখানে, সিরেনোর ইতিহাসে সবচেয়ে চালু দুই পিস্তলবাজ!
চোখ ফিরিয়ে নিল বিল। হাতের চেটো দিয়ে মুখের ঘাম মুছল। কিন্তু বরাবর এরচেয়ে ভাল শূটিং করি আমি, জেফ, প্রায় অসন্তোষের সুরে সাফাই গাইল সে। আজকে ঠিক চলছে না হাত দুটো।
ফালতু কথা বলো না তো! চাছাছোলা স্বরে বলল ছেলেটা।
যথেষ্ট হয়েছে, জেফ! দ্রুত বেনের দিকে তাকাল টেকোস, শ্রাগ করল।
বেড়ার গায়ে হেলান দিল বেন। আমার মনে হয় একটু বেশি গিলে ফেলেছ তুমি, বিল।
ওটা আমার ব্যাপার! কিন্তু এ অবস্থায় শূটিং করা সত্যিই বিপজ্জনক, তাই না?
ঠিকই সামাল দিতে পারব আমি।
নিশ্চয়ই।
একটা পিস্তল তুলে সিলিন্ডার খুলল জেফরি। সময় নিয়ে নতুন বুলেট ভরল, কিন্তু দৃষ্টি ভাইয়ের ওপর স্থির হয়ে আছে। সিরেনোয় গাট-হুক রাইডারদের কিভাবে ধরাশায়ী করলে, বলো আমাদের, বিল! তখন ঠিক কেমন লেগেছিল তোমার? কিভাবে করলে কাজটা? দু’জন পটল তুলল আর তোমার গুলিতে ডান কনুই হারিয়ে ফেলল ফ্রেড মোরিস। তোমার তুলনায় ব্রেনের কৃতিত্ব অবশ্য অনেক কম, তবুও বলা যায় অন্য একজনকে আহত করে যোগ্য সহযোগিতা করেছে সে। পেটে এক গ্যালন হুইস্কি পড়ার পরও চোস্ত শূটিং বলা যাবে এটাকে, তাই না?
লাল হয়ে গেছে বিলের ফর্সা মুখ। তৎক্ষণাৎ ভাইয়ের দিকে, দু’পা এগোল সে, একটা মুঠি উঠে গেছে মাথার ওপর। কিন্তু একেবারে নির্বিকার দেখাচ্ছে ছেলেটাকে, সিলিন্ডার বন্ধ করে দু’পা পিছিয়ে গেল সে, তারপর মুহূর্তের মধ্যে পিস্তলে বিলের পেট নিশানা করল। যেখানে ছিলে ওখানেই থাকো, বিল! শীতল সাবধানী সুরে বলল সে। আমার গায়ে হাত দিতে এসো, না। গালিগালাজও কোরো না, তাহলে কিন্তু তোমার পেটে একটা ফুটো তৈরি করে দেব।
থমকে দাঁড়াল বিল ব্রেনেল। বিহ্বল, মুখে ঘাম জমতে শুরু করেছে। পিস্তলটা সরিয়ে রাখো! নেশা ছুটে গেছে তার, ভয় ফুটে উঠল স্বরে।
ঢোক গিলল টেকোস ফারমিন, আড়চোখে বেনের দিকে তাকাল। দেখো, ছেলেরা, কি শুরু করেছ তোমরা!
চুপ করো তুমি! দাবড়ানি দিল জেফরি।
মাতাল কিংবা সুস্থই হোক, ইচ্ছে করলে এক হাতে ছেলেটাকে পিটিয়ে তক্তা বানাতে পারবে বিল, কিন্তু পেট বরাবর ছুটে আসা একটা সীসাকে সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নেই ওর। বহু আগেই সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
দু’পা পিছিয়ে হোলস্টারে কোল্টটা ফেরত পাঠাল জেফরি। ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। বেহেড মাতাল, উস্কানি আর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল সে। সিরেনোর সেই গানফাইটের নায়ক তুমি নও, বিল। বেনই আসল কাজ সেরেছে, এবং তুমিও জানো সেটা। কিন্তু এত মিথ্যে বলেছ, যে কথাটা তুমি নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছ।
খানিকটা পাশ ফিরে বেনের দিকে তাকাল বিল, অনুনয় ফুটে উঠেছে চাহনিতে। ওকে বলো, বেন। ভুলটা ভেঙে দাও!
বেন জানে এতটুকু মিথ্যে বলেনি জেফরি, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ভুল ধারণাটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে বিল ব্রেনেল। সারাক্ষণ নেশার ঘোরে যার বসবাস, সহজে তাকে সচেতন করা যাবে না, বিল সেটা মেনেও নেবে না।
ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতেই মনস্থির করল বেন। ভুলে যাও, জেফ, তরুণের দিকে ফিরে বলল ও। ভেতরে যাও। দেখতেই পাচ্ছ, বিল ঠিক সুস্থির নেই।
পাশ ফিরে থুথু ফেলল তরুণ, ভঙ্গিটায় একইসঙ্গে ঔদ্ধত্য আর বিদ্রূপ প্রকাশ পেল। দুই মহা পিস্তলবাজ! ঠোঁট বাঁকিয়ে টিপ্পনি কাটল সে।
অপমানটা অসহ্য বোধ হলো বিলের, ধৈর্য হারিয়েছে। চরকির মত আধ-পাক ঘুরে দাঁড়াল, একইসঙ্গে ছোবল হেনেছে হোলস্টারে। কিন্তু জেফরি অনেক বেশি ক্ষিপ্র, ভোজবাজির মত লাফিয়ে হাতে উঠে এল জোড়া কোল্ট; ততক্ষণে মাত্র হোলস্টার মুক্ত হয়েছে বিল ব্রেনেলের পিস্তল।
আরেকজন মানুষ তারচেয়েও ক্ষিপ্র বেন স্লেজেল। করালের বেড়ার রেইল ধরে টান দিল ও, আড়াই ফুট দীর্ঘ একটা অংশ ভেঙে চলে এল হাতে। গায়ের জোরে সেটা দিয়ে জেফরির বাহু বরাবর আঘাত করল ও, ছেলেটা ট্রিগার টানার মুহূর্ত খানেক আগে। ভারী কাঠের চেলার আঘাতে ঘুরে গেল জেফরির শরীর। কিন্তু ট্রিগার টেনে দিয়েছে তরুণ, সামান্য নড়ে গেল নিশানা।
গুলির তীক্ষ্ণ শব্দের পরপরই আর্ত চিৎকার করে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল টেকোস ফারমিন। সেকেন্ড কয়েক ওভাবেই স্থির হয়ে থাকল দেহটা, তারপর ধুলো মাখা ইয়ার্ডে মুখ থুবড়ে পড়ল।
দ্রুত সক্রিয় হলো বেন। কঁধ দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল বিল ব্রেনেলকে, দুই ভাইয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আঘাতটা, তখনও সামলে উঠতে পারেনি তরুণ, শরীর কাঁপছে ওর, পিস্তল তুলে নিশানা করার চেষ্টা করছে আবার।
দু’পা এগিয়ে জেফরির কজি চেপে ধরল বেন, চাপ দিয়ে খসাতে চাইল মুঠিতে ধরা, পিস্তল। কিন্তু পাল্টা জোর খাটাচ্ছে ছেলেটা, বাধ্য হয়ে হাতটা ওপরের দিকে ঠেলে দিল বেন। এবারে সময়মত কাজটা করেছে, আরেকবার। গর্জে উঠল জেফরির পিস্তল। আকাশে চলে গেল গুলিটা।
অদম্য ক্রোধে জ্বলে উঠল বেনের সারা শরীর। গায়ের জোরে জেফরির কজি মুচড়ে ধরল ও, টের পেল হাল ছেড়ে দিয়ে শরীর শিথিল করে দিল ছেলেটা। মুঠি থেকে মাটিতে পড়ল কোল্ট। লাথি মেরে করালের ভেতর ওটাকে পাঠিয়ে দিল বেন।
নিকুচি করি তোমার!সরোষে বিষোদ্গার করল তরুণ, বেনকে ধরতে হাত বাড়াল সে। চোখে নগ্ন আক্রোশ আর শীতল চাহনি।
ডান হাতের মুঠি চালাল বেন। জেফরির চিবুকে গিয়ে লাগল ঘুসিটা। উড়ে গিয়ে বালির ওপর পড়ল সে, যন্ত্রণায় কুঁচকে গেছে মুখ। কিন্তু বিদ্বেষ বা আক্রোশ বিদায় নেয়নি চাহনি থেকে। রাগে জ্বলছে চোখ দুটো, বেনের চোখে চোখ রেখে থুথু ফেলল। থুথুর সঙ্গে নিজের রক্ত দেখে খেপা বিড়ালের মত গরগর করে উঠল।
খোদা! ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে! জড়ানো স্বরে বলে উঠল বিল।
ওর সঙ্গে লাগতে যাওয়ার আগেই তোমার বোঝা উচিত ছিল ব্যাপারটা? বিরক্তি প্রকাশ করল বেন। পালাক্রমে দুই ভাইকে নিরীখ করল, বুঝল কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছে জেফরি, আপাতত কারও জন্যেই বিপজ্জনক নয় সে। দ্রুত টেকোস ফারমিনের পাশে এসে দাড়াল ও, ঝুঁকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটা চিৎ করল। শূন্য দৃষ্টি কূকের চোখে, চোখ ভোলা কিন্তু কিছুই দেখছে না। আর কখনও তাকাবে না মানুষটা।
নিশ্চিত হওয়ার জন্যে গলায় ধমনীর স্পন্দন পরখ করল বেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিধে হলো। মাটিতে পড়ে থাকা হ্যাট তুলে নিয়ে ফিরল দুই ভাইয়ের দিকে।
মরে গেছে নাকি? বিমূঢ় স্বরে জানতে চাইল বিল ব্রেনেল।
নড করল ও।
খোদা, নরক নেমে এসেছে এখানে!
র্যাঞ্চ হাউসের দিকে তাকাল বেন। গুলির শব্দ শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে মিরিয়াম। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কেট, এ বাড়ির কুক। পরনের অ্যানে হাত মুছছে মহিলা।
ইদানীং প্রায়ই উসখুস করত ও, ত্যক্ত স্বরে অভিযোগ করল বিল। ঝামেলা খুঁজে বেড়াত। সিরেনোর গানফাইটের কথা তুলে প্রায়ই খোঁচাত আমাকে। আমিই। তো লোকগুলোকে মেরেছিলাম, তাই না, বেন?
ধীরে ধীরে বিলের দিকে ফিরল বেন। চুপ করো, মাতাল বোকার হদ্দ! তোমাদের দুজনের কারণে মারা গেছে নিরীহ মানুষটা!
রেইল দিয়ে তুমিই তো জেফরিকে মেরেছ।
তা না করলে তুমিই খুন হয়ে যেতে, বিল!
উঁহু, অনায়াসে ওকে গুলি করতে পারতাম আমি।
কিছুই করতে পারতে না, সোজাসাপ্টা বলল বেন। সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছ তুমি। …একজন মানুষ মারা গেছে, তোমাদের যে কারও চেয়ে ভাল ছিল মানুষটা।
বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বিল। আপাতত, নেশা ছুটে গেছে, কিন্তু একটু পরই হয়তো এক গ্যালন হুইস্কি গিলে ভুলে যাবে সব। দায়িত্ব আর বাস্তবতা, এভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছে সে।
বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে মিরিয়ামকে, ছুটে আসায় হাঁপাচ্ছে। কৃকের পাশে গিয়ে বসল মেয়েটা, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বিড়বিড় করে কি বলল বোঝা গেল না। উঠে দাঁড়িয়ে যখন বেনের দিকে ফিরল, মেয়েটির চোখে বেদনা আর হতাশা দেখতে পেল বেন।
ওর মতই হতভাগ্য মানুষটার অভাব বোধ করবে মিরিয়াম, ভাবল বেন, এবং কুকের দুঃখজনক মৃত্যুর হতাশা: মেয়েটিকে পোড়াবে বহু দিন।
কি হবে এখন, বেন? শুকনো, ম্লান স্বরে জানতে চাইল মিরিয়াম।
জানি না, তবে শহরে যাচ্ছি আমি।
শহরে!?
শেরিফকে নিয়ে আসতে হবে। সবকিছু আইনের হাতে ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে।
স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল মিরিয়াম, চোখে শঙ্কা ফুটে উঠেছে। বেন ভেবেছিল মেয়েটির চোখে বিদ্রোহ দেখতে পাবে, কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করল সিদ্ধান্তটা বিনা তর্কে মেনে নিয়েছে সে।
বাকস্কিনের দিকে এগোল ও, স্যাডলে বসে ফিরে তাকাল বিল আর মিরিয়ামের দিকে। লাশটা ওখানেই থাকুক, কম্বল বা একটা কিছু দিয়ে ঢেকে রাখো। জেফরিকে আশপাশে থাকতে বোলো, শেরিফ হয়তো প্রশ্ন কররে ওকে। হাঁটুর তোয় এগোল বাকস্কিন। সিরেনোর উদ্দেশে যাত্রা করল বেন স্লেজেল।
সিরেনোয় যখন পৌঁছল ও, ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গেছে।
দূর থেকে শহরের বাতির হলদে আভা চোখে পড়ছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। প্রেয়ারিতে। মালভূমির মত উঁচু জমির ঢাল ভেঙে নিচের দিকে নামতে শুরু করল বেন স্লেজেল। ঢালের নিচে ছোট্ট শহরটাকে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট ছবির মত। উল্টো বাতাসের সঙ্গে কাঠ পোড়ার কটু গন্ধ আর খাবারের সুবাস ভেসে আসছে। জীর্ণ বোর্ডওঅক আর ক্ষত-বিক্ষত রাস্তায় ফ্যাকাসে আলো এসে পড়েছে, দেখল। বেন। সেলুন বা ড্যান্স হল থেকে ভেসে আসা পিয়ানোর ক্ষীণ সুর কানে বাজছে।
গত কয়েক বছরে বেশ বদলে গেছে সিরেনো টাউন। বেশিরভাগ বাড়িই জীর্ণ, চুনকাম করা হয়নি বহু দিন। একসময় ছোট্ট একটা শহর ছিল, স্থানীয় র্যাঞ্চারদের জন্যে কেনা-কাটা এবং গরুর বাজার হয়ে গেছে এখন। আয়তনে বড় হয়েছে বটে, কিন্তু সবকিছুতে যত্নের অভাব।
সরাসরি শেরিফের অফিসের দিকে এগোল ও। কাছাকাছি এসে স্যাডল ছাড়ল, হিচিং রেইলে ঘোড়া বেঁধে পোর্চে উঠে এল। ঠিক তখনই দক্ষিণের প্রেয়ারি থেকে ধেয়ে এল ঠাণ্ডা হিমেল বাতাস, সঙ্গে বৃষ্টির বড়বড় ফোঁটা। ঘুরে দীর্ঘ মূল রাস্তার দিকে তাকাল ও, চল্লিশ গজ দূরে “কটনউড” সেলুন। ছয় বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ল: ওটার সামনেই পাঁচ লেযি-এন ক্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তরুণ বিল ব্রেনেল আর বেন স্লেজেল।
স্মৃতিটা কখনোই মুছে যাওয়ার নয়, একেবারে তাজা মনে হচ্ছে। অথচ সেদিনের পর আর কখনও সিরেনোয় পা রাখেনি ও। আজ, ছয় বছর পর, আবারও এল। মনে মনে দুটো পরিস্থিতির তফাৎ বিবেচনা করল বেন•••বাইশ বছরের টগবগে এক তরুণ ছিল ও সেদিন। জেফরির মত বেপরোয়া স্বভাব বা ঔদ্ধত্য ছিল না; কিন্তু খানিকটা হলেও অস্থিরতা কাজ করত মনে। ঠাণ্ডা মাথায় বিপদ সামলে ওঠার ব্যাপারে একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিল ওরা।
কিভাবে পাচজন লোককে মোকাবিলা করেছে ওরা, হিসেবটা এখনও মেলাতে পারে না বেন। বিলকে নিয়ে মাত্র সেলুন থেকে বেরিয়ে এসেছিল; পোর্চ ছেড়ে রাস্তায় নামতেই পড়ে গেল ফ্রেড মোরিসের তোপের মুখে। একা থাকলে হয়তো উল্টো ঘুরে ঝেড়ে দৌড় দিত, নিদেনপক্ষে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত নিশ্চয়ই; কিন্তু শেষে দেখা গেছে শুধু, রুখেই দাঁড়ায়নি ওরা, বরং নির্মম হয়ে উঠেছিল-পাঁচজনের বিরুদ্ধে পিস্তলবাজিতে খাড়া থাকতে হলে যতটা নিষ্ঠুর হওয়া উচিত, ঠিক ততটাই। বেন জানত বিলের পক্ষে ঠিক ভাবে নিশানা করাও সম্ভব হবে না, কিন্তু পরোয়া করেনি ও, অদম্য জেদ আর বিদ্বেষই শক্তি যুগিয়েছে ওকে। ফ্রেড মোরিসের জন্যে নিশ্চয়ই দারুণ চমকের ছিল পুরো ব্যাপারটা।
পাচজনের বিরুদ্ধে দু’জন–গাণিতিক হিসেবে কোন ভাবেই মেলে না, কিংবা সম্ভাবনা বিচার করলেও একতরফা লড়াই হওয়ার কথা। কিন্তু ডাবল-বির দুই তরুণ মাথা উঁচু করে শহর ছেড়েছে সেদিন। ক্ষণিকের জন্যে খেপা, বুনো ষাঁড়ের মত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল বেন, ফ্রেড মোরিসকে পিস্তলের দিকে হাত বাড়াতে দেখেই নিজের অস্ত্র বের করে একের পর এক গুলি করেছে। ফলাফল দেখার সুযোগ বা সময় কোনটাই ছিল না, এমনকি বিলের কি হলো তা দেখারও ফুরসত ছিল না।
গান পাউডারের ধোঁয়া মিলিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল ওর পাশেই খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিল, নেশার ঘোর কেটে গেছে পুরোপুরি। ভয়ের লেশমাত্র নেই চোখে-মুখে, তবে খানিকটা বিস্ময় ছিল চাহনিতে, বুঝতে পারছিল না সত্যিকারে কি ঘটেছে। উল্টোদিকে ত্রিশ গজ দূরে ধূলিময় রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল ফ্রেড মোরিস, ডান বাহু ধরে কাতরাচ্ছে। আরও একজন পড়ে ছিল, ঠিক নেড়ি কুকুরের মত। মাত্র একটা লোক বহাল তবিয়তে ফিরতে পেরেছে, পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখে উল্টো দৌড় দিয়েছে। লেযি-এনে ফিরে যায়নি সে, বেসিন ছেড়েই চলে গেছে।
ছয় বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। বেন নিজে পরিণত হয়েছে, তারুণ্যের অস্থিরতা বা বেপরোয়া স্বভাব নেই। ইচ্ছে করলেও ছয় বছর আগের মত ওকে খেপিয়ে তুলতে পারবে না কেউ, স্বয়ং টম নোলানও পারবে না। কিছু করার আগে পরিণতি আর নিজের সম্ভাবনা বিচার করতে শিখেছে, পোড়-খাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতার মূল্য এখানেই। সূক্ষ্ম বিচারশক্তি আর বিপদ থেকে দূরে থাকার প্রবৃত্তি তৈরি হয়েছে মনের গভীরে, ওর অজান্তে। ছয় বছর আগের মত ওরকম ভেল্কি দেখানো এখন আর সম্ভব নয়, জানে বেন, একমাত্র কোণঠাসা হলেই সেটা সম্ভব।
ঘুরে শেরিফের অফিসের দিকে এগোল ও। দরজাটা বন্ধ। পাল্লার সঙ্গে একটা কার্ড ঝুলছে, তাতে লেখা:
পাসি নিয়ে বাইরে আছি। রোববার সকালে ফিরব।
-এডলে ভার্ন, শেরিফ
ডাবল-বিতে ফিরে গিয়ে কাজ নেই, তাছাড়া ইচ্ছেও নেই ওর। ক্লান্তি লাগছে, একটা ড্রিঙ্ক হলে ভাল হয়, অনুভব করল বেন। সবচেয়ে কাছের বারের উদ্দেশে এগোল ও, নামটা দেখার চেষ্টাও করল না। ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সরাসরি মেহগনির কিনারে এসে দাঁড়াল।
বাইরে বৃষ্টি বা মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ার পরও বেশ জমে গেছে সেলুন। কয়েকটা টেবিলে পোকার চলছে, খেলোয়াড়ের চেয়ে দর্শকই বেশি। কোণের এক টেবিলে ঢুলতে শুরু করেছে এক মাতাল। মেহগনির সঙ্গে কনুই ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন লোক, হাতে হুইস্কির গ্লাস; নির্বিকার মুখে তাকিয়ে আছে দেয়াল জোড়া আয়নার দিকে, যার যার নিজস্ব ভাবনায় মগ্ন।
কি দেব তোমাকে? জানতে চাইল বারটেন্ডার, একটা ন্যাকড়া দিয়ে মেহগনির মসৃণ পিঠ মুছছে।
রাই।
বোতল আর গ্লাস ওর সামনে ঠেলে দিল লোকটা। গ্লাসে পানীয় ঢেলে মুখের কাছে তুলে ধরল বেন।
তুমি বেন স্লেজেল, তাই না? ওকে নিরীখ করছে বারকীপ।
ক্ষীণ নড় করল বেন, টের পেল আচমকা নীরব হয়ে গেছে পুরো সেলুন, দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির টিকটিক শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। স্থির হয়ে গেছে পোকার খেলোয়াড়দের হাত, বারের মাঝামাঝি দাঁড়ানো তিনজনের দিকে ঘুরে গেল তাদের দৃষ্টি, তারপর বেনের ওপর স্থির হলো।
সেলুনে ঢুকে কারও দিকে তাকায়নি বেন, কিন্তু এবার তাকাতে বাধ্য হলো। তিনজনের দলটাকে দিয়ে শুরু করল ও, পরিস্থিতি সেই দাবি করছে। শীতল একটা অনুভূতি হলো ওর। ফ্রেড মোরিস, স্লিম আর কার্লি।
এখনও মেহগনি মুছছে বারকীপ। বহু দিন বাইরে ছিলে তুমি, তাই না?
হ্যাঁ।
দেশটা ঘুরে দেখেছ? বেশ! আমার মনে হয় সব লোকেরই সংসারের জোয়াল কাধে নেওয়ার আগে দেশটা ঘুরে দেখা উচিত। এবার কিন্তু…
চুপ করো, টড! ধমকে উঠল ফ্রেড মোরিস।
মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল বারটেন্ডার। আড়চোখে মোরিসের দিকে তাকাল, লেযি-এন ক্রুর কনুইহীন গদাকৃতির হাত থেকে চোখ সরাতে পারছে না।
মজার কিছু দেখতে পাচ্ছ নাকি, টড? জানতে চাইল মোরিস।
কে, আমি? মাথা খারাপ, মজার কিছুই দেখতে পাইনি!
তাহলে আমার কনুইয়ে কি দেখছ? শীতল, চাঁছাছোলা স্বরে জানতে চাইল মোরিস, যেন একটা র্যাটল ভাষা খুঁজে পেয়েছে।
ঘাম জমতে শুরু করেছে বারকীপের চর্বিবহুল মুখে। আমি…
এক হাত-অলা লোক এর আগে দেখোনি নাকি? নিশ্চয়ই, ফ্রেড। আমার এক চাচা… চোপরাও!
মুহূর্তের জন্যেও নড়েনি বেন, টডের সঙ্গে ফ্রেড মোরিসের তর্ক শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। বাজি ধরে বলতে পারবে আসলে ঝামেলা খুঁজছে লেযি-এন ক্রু, এবং তার যা স্বভাব সেটা পেয়ে যেতে দেরিও হবে না। বেনের গুলিতে কনুই হারানোর আগে থেকেই ঝগড়াটে ছিল সে, আর এখন বাতাসে কেবলই রক্ত আর মৃত্যুর গন্ধ শুকে বেড়ায়।
সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বারকীপ, ভয়ে জমে গেছে শরীর। সারা সেলুনে পিনপতন নিস্তব্ধতা। ঘড়ির টিকটিক শব্দ, টড ম্যালকমের দ্রুত লয়ের নিঃশ্বাস এবং মাঝে মধ্যে লোকজনের পায়ের ভর বদল করে দাঁড়ানোর ক্ষীণ শব্দ–এই হচ্ছে এ মুহূর্তে একটা জমজমাট সেলুনে একমাত্র কোলাহল। কেউ কেউ চলে যেতে ইচ্ছুক, কিন্তু আচমকা নড়ে উঠলে নরক গুলজার হয়ে উঠবে সেলুনটা, এরকম তটস্থ পরিস্থিতিতে যে কেউ পিস্তলের দিকে হাত বাড়াতে পারে-যেই নড়বে, হয়তো প্রাণের বিনিময়ে সেই ভুলের খেসারত দিতে হবে তাকে।
সেলুনের প্রতিটি লোক জানে গোবেচারা টড ম্যালকমের প্রতি সত্যিকার কোন আগ্রহ নেই ফ্রেড মোরিসের, বরং বেন স্লেজেলকে জড়াতে চাইছে সে। এটাই তার রীতি। কিন্তু সমস্যাটা অন্যখানে, মাঝখানের লোকটা অযথাই বলির পাঁঠা হয়ে যেতে পারে।
হুইস্কির গ্লাস তুলে বারকীপের মুখে ছুঁড়ে মারল ফ্রেড মোরিস।
ক্ষণিকের জন্যে চোখে অন্ধকার দেখল টড ম্যালকম। হাতের চেটো দিয়ে। চোখ-মুখ মুছল সে, তারপর বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল লেযি-এন ক্রুদের দিকে, মোরিসের ওপর স্থির হলো দৃষ্টি। এভাবে আমাকে ত্যক্ত বা অপমান করার অধিকার নেই তোমার, ফ্রেড!
তাই নাকি? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মোরিসের কণ্ঠ। অধিকার নেই আমার? তাহলে কি আশা করো তুমি? কাপুরুষ জারজ! কনুইহীন কোন লোকের হাতের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করতে পারো, অথচ বুক ফুলিয়ে সামনে দাঁড়ানোর সাহস নেই! বারের তলায় একটা ডাবল-বেরেল শটগান আছে না তোমার? যদি আমার ওপর অধিকার ফলাতেই চাও, টড, বের করো ওটা!
রক্তশূন্য হয়ে গেছে বারটেন্ডারের মুখ, মেহগনির কিনারায় চেপে বসল হাত দুটো। ভয় পেয়েছে মানুষটা, কিন্তু মোটেই কাপুরুষ নয় সে, এবং ভীত একজন মানুষ ঠাণ্ডা মাথার যে কোন লোকের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে কখনও কখনও। শটগানটা বের করলে, হয়তো একটা-দুটো গুলি করার সুযোগ পাবে, কিন্তু নিশ্চিত বলা যায় না গুলিটা মোরিস বা ওর সাঙ্গপাঙ্গদের শরীরে লাগবে, বরং নিরীহ কেউ মারা পড়তে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হোলস্টারে ছোবল হানার জন্যে মুখিয়ে আছে মোরিস, টড হয়তো শটগানে হাত রাখার আগেই পড়ে যাবে ওর লাশ।
সহজ ভাবে নাও ব্যাপারটা, ফ্রেড, স্নান কণ্ঠে বলল টড, কিন্তু কণ্ঠে তোষামোদের সুর নেই। তোমার সঙ্গে লাগতে চাই না আমি। কেনই বা চাইব! আড়চোখে বেনের দিকে তাকাল সে। এর আগে কখনও আমার সঙ্গে ঝামেলা হয়নি তোমার, স্লেজেল এখানে আসার পর থেকেই…
স্লেজেল? ওর সঙ্গে এসবের সম্পর্ক কি?
বারের ওপর হুইস্কির গ্লাস নামিয়ে রেখে ধীরে ধীরে পাশ ফিরল বেন, লেযি এন ক্রুদের মুখোমুখি হলো। ওকে একা থাকতে দাও, ফ্রেড, শান্ত নিষ্কম্প সুরে বলল ও।
টড আর আমার ফাইটে নাক গলাচ্ছ তুমি, স্লেজেল?
শুধু শুধু ওকে ত্যক্ত করছ কেন? আমার সঙ্গে ঝামেলা করতে চাইছ, বেশ তো! তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি আমি। এবার অবশ্য ঘুমের মধ্যে আক্রমণ করতে পারবে না, তাই না?
পাশ ফিরে থুথু ফেলল মোরিস। ট্রেসপাস করছিলে তুমি। তাই তো করছিল ও, বয়েজ? সঙ্গীদের উদ্দেশে জানতে চাইল সে।
নীরবে নড় করল স্লিম আর কার্লি।
তাহলে ফয়সালা হয়েই গেছে? স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করল বেন।
হয়নি নাকি? তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পাল্টা জানতে চাইল মোরিস।
স্থির দৃষ্টিতে খাটো ভালুককে নিরীখ করল বেন, ক্রমশ ধৈর্য হারাচ্ছে। দেখো, মোরিস, নিজেকে শান্ত রেখে মৃদু কণ্ঠে বলল, শুধু কথা বলেই কাজ সারতে চাচ্ছ? যদি সাহস থাকে তো সেলুন ছেড়ে বাইরে এসো, রাস্তায় সামনা সামনি লড়ব আমরা, পুরুষ মানুষের মত।
ওর কথা শোনো, পরামর্শ দিল স্লিম।
থুথু ফেলল কার্লি। যাচ্ছ না কেন, ফ্রেড? ঠিকই ওকে সামলাতে পারবে তুমি।
একটু আগের আত্মবিশ্বাস এখন আর ততটা নেই ফ্রেড মোরিসের, ক্ষণিকের জন্যে চিন্তিত চাহনি ফুটে উঠল চোখের তারায়, দ্বিধা করছে। নীল চোখের গভীরে তাকিয়ে লেযি-এন ক্রুর ভাবনা স্পষ্ট পড়তে পারল বেন। হিসেব কষছে সে। বাররূমের উজ্জ্বল আলোয় কাউকে কোণঠাসা করা এক কথা, যখন সাহায্য করার জন্যে দু’জন সঙ্গী থাকে; আর বৃষ্টিস্নাত অন্ধকার রাতে ভোলা রাস্তায় কারও মুখোমুখি হওয়া পুরোপুরি ভিন্ন ব্যাপার, লোকটা যেই হোক। কিন্তু এ লোক যেনতেন কেউ নয়, একবার হিসেব গরমিল করে দিয়েছে সে-নিরন্তর সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে ওর কনুইহীন ডান হাতটা-এরচেয়ে ফেয়ার ফাইট কখনও হতে পারে না!
কৌশলে দাবার খুঁটি উল্টে দিয়েছে বেন স্লেজেল, তিক্ত মনে উপলব্ধি করল ফ্রেড মোরিস। এখনই ড্র করতে হবে, নয়তো বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় মুখোমুখি লড়তে হবে। বিকল্প কোন উপায় নেই। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে, যে কোন একটা পথ বেছে নেওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই ওর; কারণ এভাবে সবকিছু পরিকল্পনা করেনি বা ভাবেনি ও। ব্যাপারটা পরিষ্কার জানে মোরিস, এবং বুঝতে পারছে বেন স্লেজেলও ওর আসল উদ্দেশ্য টের পেয়ে গেছে।
দীর্ঘদেহী যুবক আরেকটা জিনিস জানে–স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে স্লেজেল-মোরিসের মনে হলো ওর চোখের গভীরে তাকিয়ে ভেতরটা অনায়াসে পড়ে নিচ্ছে। হাতটা হারানোর পর থেকে কিছুটা হলেও বদলে গেছে ফ্রেড মোরিস। ঘুমন্ত কোন লোকের অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া এক কথা, যখন সঙ্গে দু’জন গানম্যান থাকে; সমান-সমান সুযোগ পাবে এমন পরিস্থিতিতে সেই একই লোকের মোকাবিলা করা আরেক কথা, যখন লোকটা নিজেই মুখিয়ে থাকে লড়ার জন্যে।
তো, মোরিস? শান্ত, আগের চেয়েও শান্ত স্বরে তাগাদা দিল বেন।
জানালার শার্সি এবং অ্যাডোবি দেয়ালে আক্রোশ ঝাড়ছে দমকা বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁট, চাপা শব্দ হচ্ছে। ঘড়িটা টিকটিক করছে। এছাড়া আরও একটা শব্দ শোনা গেল এবার: কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে ছুটে আসছে কয়েকটা ঘোড়া। বাইরে এসে থামল লোকগুলো, কয়েকটা কণ্ঠ এগিয়ে এল সেলুনের দিকে। পোর্চে বুটের ভারী শব্দ হলো, তারপর ঝট করে খুলে গেল ব্যাটউইং দরজা। অর্ধ-ডজন লোক ঢুকল ভেতরে, সবার সামনে বিশালদেহী চল্লিশোর্ধ্ব এডলে ভার্ন। মাথা থেকে হ্যাট সরিয়ে পানি ঝাড়ল শেরিফ, ধূলিমলিন মেঝেয় ছিটিয়ে পড়ল বৃষ্টির পানি।
বারের সঙ্গে পেট ঠেকিয়ে দাঁড়াও, বয়েজ, সহাস্যে সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল সে, সবকটা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। আজকে ড্রিঙ্কের পয়সা আমি দেব। ব্যাটাদের একেবারে খেদিয়ে দিয়েছি কাউন্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত!
মেক্সিকো পৌঁছা’র আগে বোধহয় থামবে না কেউ, উত্তরে হাসল এক ডেপুটি। এটাই এডলে ভার্নের রীতি, তাই না?
ধীরে ধীরে বারের দিকে ফিরে দাঁড়াল ফ্রেড মোরিস। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কার্লি আর স্লিম। বারের অন্য প্রান্তে এসে জমায়েত হওয়া পাসির সদস্যদের দিকে এগিয়ে গেল টড ম্যালকম, মুখে নিদারুণ স্বস্তি।
হ্যালো, শেরিফ, স্বাগত জানাল বেন।
ঝটিতি ফিরে তাকাল ভার্ন। খোদা! এ যে দেখছি বেন স্লেজেল! প্রায় দৌড়ে এল সে, বিশাল হাতটা বাড়িয়ে ধরেছে। তোমাকে দেখে খুশি হলাম, বেন। ডেপুটির ব্যাজ পরার ইচ্ছে আছে?
মাথা নাড়ল ও। এখনই নয়, এড।
যখনই ইচ্ছে করে বলতে দ্বিধা কোরো না। দক্ষিণে একটা ট্রেন লুঠ করেছে ডরোটিও নাভারেজ, দলবল সহ মেক্সিকোর উদ্দেশে ছুট লাগিয়েছে। অযথা ওর। পেছনে ছোটার কোন কারণ দেখছি না আমি। এরই মধ্যে টেলিগ্রাম করে খবরটা ছড়িয়ে দিয়েছি। আশা করছি ধরা পড়ে যাবে ব্যাটা।
অনেকক্ষণ পর খেলার দিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পেল পোকার খেলোয়াড়রা। মুখ খোলার ইচেছ নেই কারও, অন্তত আজ রাতে আবারও ঘড়ির টিকটিক শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢুলতে শুরু করেছে মাতাল লোকটা। নিজেদের ড্রিঙ্ক গলায় ঢেলে সেলুন ছেড়ে বেরিয়ে গেল ফ্রেড মোরিস আর ওর সঙ্গীরা।
শেরিফকে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে এল বেন, তারপর সিরেনোয় আসার কারণ ব্যাখ্যা করল।
আনমনে মাথা নাড়ল এডলে ভার্ন। বেচারা টেকোস! এই জিনিসটাই আশঙ্কা করছিলাম আমি, বেন, জানতাম যে কোন দিন ওই ছেলের হাতে খুন হয়ে যাবে কেউ।
এটা একটা দুর্ঘটনা, এড।
মানুষ কোরবানি নয়? ক্ষণিকের জন্যে ভাবল বেন। মনে হয় না তেমন কিছু ঘটেছে। নিশ্চয়ই ভাইয়ের বিরুদ্ধে ড্র করেনি ছেলেটা, করেছে কি?
পকেট হাতড়ে তামাক আর কাগজ বের করল বেন। মনে করার চেষ্টা করল মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা। বিল ব্রেনেলই আগে পিস্তলে হাত বাড়িয়েছে, স্পষ্ট জানে বেন, মাতাল না হলে হয়তো জঘন্য কাজটা করত না সে। অপরিণত খামখেয়ালী তরুণের মত নিজের বিপদ ডেকে এনেছে; এবং পরাজিত হয়েছে মুখোমুখি লড়াইয়ে। কিন্তু যে সর্বনাশ বিলের হতে পারত, তাই হয়েছে টেকোস ফারমিনের। বেন রেইল দিয়ে জেফরিকে আঘাত করায় ভিন্ন পথ নিয়েছে বুলেটটা, কিন্তু সেটা করা ছাড়া উপায়ও ছিল না, নইলে নির্ঘাত ছোট ভাইয়ের হাতে খুন হয়ে যেত বিল ব্রেনেল।
তো, তোমার কি ধারণা? শান্ত স্বরে জানতে চাইল ভার্ন।
আগে বরং ডাবল-বিতে যাই, ওখানে গিয়ে সবকিছু খোলসা করা যাবে, নিচু স্বরে প্রস্তাব করল বেন।
নড করল শেরিফ। মুহূর্তের জন্যে শান্ত নীল চোখ জোড়া নিরীখ করল বেনকে, স্পষ্ট টের পাচ্ছে সাধারণ একটা বিবরণের চেয়েও বেশি কিছু আছে বেন–স্লেজেলের গল্পের অন্তরালে। হয়তো সত্যিই স্রেফ দুর্ঘটনাবশত খুন হয়েছে টেকো ফারমিন, কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে ইঙ্গিত করছে, বদ্ধমূল ধারণা এডলে ভার্নের।
০৭. আকাশে ঘন কালো মেঘের আনাগোনা
আকাশে ঘন কালো মেঘের আনাগোনা, বাতাসে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। আবারও বৃষ্টি হবে বোধহয়। প্রায় সারা রাতই ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছে। রিও ফ্রিয়োর পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে দুই কূল ছাপিয়ে উঠেছে এখন।
অস্বাভাবিক নীরব হয়ে আছে ডাবল-বি র্যাঞ্চ হাউস। কুক শ্যাকের পাশে নিজের ছোট্ট রূমে রাখা হয়েছে টেকোস ফারমিনের মৃতদেহ। ডাক্তার ডেভন রাশবী পরীক্ষা করছে লাশটা, এদিকে মূল র্যাঞ্চ হাউসের উষ্ণ, লিভিংরূমে অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে শেরিফ এডলে ভার্ন।
রকিং চেয়ারে বসে আছে বিল ব্রেনেল, দুহাতে মুখ ঢাকা। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে মিরিয়াম, ফুলে-ফেঁপে ওঠা রিও ফ্রিয়ো আর বৃষ্টিস্নাত তৃণভূমি দেখছে বোধহয়।
ফায়ারপ্লেসের পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেন স্নেজেল, মাঝে মধ্যে অজান্তে মিরিয়ামের দিকে চলে যাচ্ছে ওর দৃষ্টি। দীর্ঘ স্লিম দেহ, নারীত্বের লক্ষণগুলো স্পষ্ট জায়গায় জায়গায়। শান্ত কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। মেয়েটির মধ্যে এই পূর্ণতার আভাস আগে কখনও টের পায়নি ও, যেন আচমকাই ঘটে গেছে। অথচ মিরিয়ামকে কখনও নিজের বোন হিসেবে দেখেনি, কিন্তু কার্ল ব্রেনেলকে বাবা আর বিল এবং জেফরিকে আপন ভাইয়ের মত দেখে এসেছে। ব্যাপারটা সত্যিই ধাঁধার মত, এই অদ্ভুত পরস্পারবিরোধিতার ব্যাখ্যা কি?
রান্নাঘর থেকে কফির কাপ হাতে লিভিংরূমে ঢুকল শেরিফ এডলে ভার্ন। বিশাল হাতের তালুয় প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে কাপটা। বগলের তলায় একটা রোল করা কাগজ-কূকের স্বীকারোক্তি। কেট অবশ্য তেমন কিছুই বলতে পারেনি। কাউকে গুলি করতে দেখেনি সে, স্রেফ দূর থেকে ফলাফলটা প্রত্যক্ষ করেছে।
টেবিলে কফির কাপ নামিয়ে রাখল এডলে ভার্ন। এবার তোমার বক্তব্য শুনব আমরা, মিস্ ব্রেনেল। কি দেখেছ তুমি?
ফিরে তাকাল মিরিয়াম, প্রায় লালচে দেখাচ্ছে চোখ জোড়া। টেকোসকে যথেষ্ট পছন্দ করত ও, অস্বাভাবিক মৃত্যুটা তাই বিষণ্ণ করে তুলেছে ওকে। তেমন কিছুই নয়, শেরিফ। রান্নাঘরে কেটের সঙ্গে কথা বলছিলাম আমি, গুলির শব্দ শুনে একবার উঁকি দিয়েছিলাম। রেইলে ক্যান বসিয়ে শূটিং প্র্যাকটিস করছে বিল আর জেফ। কিছুক্ষণ পরপরই গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। শেষবার, গুলির আওয়াজের সঙ্গে চিৎকার শুনে বেরিয়ে এলাম। দেখি করালের কাছে পড়ে আছে টেকোস, ওর ঠিক পাশেই পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে ছিল বিল। আর হ্যাঁ, জেফের হাতেও পিস্তল। ছিল।
চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল শেরিফ, মুখ নির্বিকার। তাহলে গুলিটা কে চালিয়েছে, দেখোনি তুমি?
মিরিয়ামের দিকে তাকাল বেন, বাজি ধরে বলতে পারবে মিথ্যে বলছে মেয়েটা।
নড করল ভার্ন। হুম, ভাল ঝামেলায় পড়লাম দেখছি, বিল আর বেনের দিকে তাকাল সে। জেফরির সাক্ষ্য নিতে হবে। দেখা যাক কি বলার আছে ওর।
ওকে ডেকে আনছি আমি, লিভিংরূম থেকে বেরিয়ে এল বেন। করিডর ধরে এগোল বাড়ির শেষ দিকে, দুটো কামরার পরই জেফরির রূম। দরজায় নক করল ও। কয়েকবারের পরও সাড়া না পেয়ে পাল্লা ধরে ঠেলা দিল।
ফাঁকা কামরা। বিছানার চাদর নির্ভজ, তার মানে রাতেও এখানে শোয়নি কেউ। সারা শরীরে শীতল একটা অনুভূতি নিয়ে লিভিংরূমে ফিরে এল বেন।
রূমে নেই ও।
গতরাতে সাপারের সময়ও আমাদের সঙ্গে ছিল না ও, জানাল বিল।
আর সকালে? জানতে চাইল লম্যান। মাথা নাড়ল ভাই-বোন।
চেয়ার ছেড়ে জানালার দিকে এগোল এডলে ভার্ন, হাতের চেটো দিয়ে আনমনে থুতনি ঘষছে। আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বেনের দিকে ফিরল। রাতে ওকে এখানে থাকার জন্যে বলেছিলে, বেন?
হ্যাঁ।
ওকে চলে যেতে দেখেনি কেউ…কিংবা কাউকে বলেও যায়নি সে?
খানিকটা অপ্রতিভ দেখাল বিলের মুখ। কালকের ওই ঘটনার পর পরস্পারের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমরা।
নির্দিষ্ট কারও দিকে তাকাচ্ছে না মিরিয়াম, আনমনে ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘটনাটার পর জেফের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। শেরিফ এলে এখানে উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ও আমাকে।
শ্রাগ করল শেরিফ। ওকে খুঁজে বের করার জন্যে লোক পাঠাতে হবে। এছাড়া তো উপায় দেখছি না।
তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল বেন। তোমার আপত্তি থাকলে আমি যেতে পারি।
কেন? সেজন্যে আমার ডেপুটিরাই যথেষ্ট। ও এতটা চালাক হয়নি যে আমাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াবে।
জেফরি ভাবছে একজন মানুষ খুন করেছে ও, সেই ভয়েই পালিয়েছে। ওকে ধরতে গেলে…দরকার হলে আরেকজনকে খুন করবে এখন।
আধ-বোজা হয়ে গেল ভার্নের চোখ। বোকা আর-কাকে বলে!
জেফরি এখনও বাচ্চাই রয়ে গেছে, অন্তত চিন্তা-ভাবনায়। ঘটনার আকস্মিকতায় পালিয়ে যাওয়াই ভাল মনে করেছে ও, কারণ এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে হয়তো ঠিকই বুঝতে পারত। কিন্তু ওর বয়সে কোন ছেলেই ঠিকমত চিন্তা করতে পারে না। সেটা সহজও নয়।
শুকনো হাসি ফুটে উঠল বিলের মুখে, কিন্তু তাতে আমোদ নেই। ও কিন্তু তা মনে করে না। ওর শূটিং যদি দেখতে, ভার্ন! আমার বা তোমার চেয়েও ক্ষিপ্র ও। স্টিভ হারকারকে বাদ দিলে, আমার ধারণা যে কারও চেয়ে ফাস্ট।
ফায়ারপ্লেসে কাঠ ফাটার শব্দ হচ্ছে। নীরব উষ্ণ কামরায় ওদের ছন্দময় নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। যার যার নিজস্ব ভাবনায় মগ্ন সবাই। রান্নাঘরের দরজা খুলে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল, একটু পরই লিভিংরুমে প্রবেশ করল ডাক্তার রাশবী। দু’হাতে কি যেন লোফালুফি করছে সে।
কিছু বুঝতে পারলে? জানতে চাইল শেরিফ।
কাউবয়দের একজনের কাছে শুনলাম জেফরি নাকি পালিয়েছে? ওর ধারণা টেকোসকে নাকি ওই মেরেছে? ক্ষীণ হাসি ডাক্তারের ঠোঁটের কোণে।
কিন্তু এতে মজার কি আছে? খেকিয়ে উঠল বিল।
হাতের জিনিসটা শূন্যে ছুঁড়ে মারল ডাক্তার, তারপর লুফে নিল। এই জিনিসটা টেকোসের ওয়ালেটে পেয়েছি, আর ট্রাউজারের বাম পকেটে ছিল ওয়ালেটটা। ওর সারা শরীরে কোথাও ক্ষত নেই, বুঝতেই পারছ বুলেটের কারণে মরেনি সে।
সবকটা চোখ স্থির হলো ডাক্তারের ওপর। তাহলে?
হার্ট অ্যাটাক। আমার ধারণা, টেকোসের জন্যে বুলেটের শক্-ই কাল হয়ে দাড়িয়েছিল, এবং দুর্ভাগ্যক্রমে হলেও, হার্ট অ্যাটাকের কারণে মারা গেছে ও। রিপোর্টে তাই লিখব আমি। তাছাড়া…ছেলেটা হয়তো বিবেকের তাড়নায় ভুগতে শুরু করেছে, অভিযোগ থেকে মুক্তি পেলে খুশি হবে ও।
তাই? এখনও থুতনি ঘষছে এডলে ভার্ন, কোঁচকানো ভুরুর নিচে চঞ্চল দৃষ্টি স্থির হলো বেনের ওপর। তোমার কি মনে হয়, কোণঠাসা হয়ে গেলে আক্রমণ করবে ও?
হ্যাঁ।
এখনও যাওয়ার ইচ্ছে আছে তোমার? নড করল বেন?
তাহলে বেরিয়ে পড়ো। চেয়ার ছেড়ে কাগজপত্র গোছাল শেরিফ, হঠাৎ বিল আর বেনের দিকে ফিরল, জরুরী কি যেন মনে পড়ে গেছে। তোমাদের সাক্ষ্য নেয়া হয়নি।
তৃষিত দৃষ্টিতে লিকার কেবিনেটের দিকে তাকাল বিল ব্রেনেল, সাহস সঞ্চয় করার জন্যে নিশ্চয়ই পানীয়ের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবছে। শেরিফের অলক্ষ্যে বিলের উদ্দেশে ক্ষীণ মাথা নাড়ল বেন।
তাহলে টার্গেট প্র্যাকটিস করছিলে তোমরা, এই তো? নিরুত্তাপ স্বরে জানতে চাইল শেরিফ। ড্র করেই গুলি করল জেফরি। গুলিটা টেকোসের গায়ে লাগে এবং পড়ে যায় সে। ওকে পরীক্ষা করে দেখোনি তোমরা, ভেবেছ লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলির কারণে মারা গেছে সে; করোনারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে টেকোসকে স্পর্শ করার ইচ্ছেও ছিল না তোমাদের। ঠিক এমনই ঘটেছে?
নড করল বিল।
ভাবছি কিভাবে টার্গেট ছেড়ে টেকোসের এত কাছাকাছি গুলি করল ছেলেটা। যদ্র জানি ওর নিশানা তো দারুণ।
টার্গেট হিসেবে ক্যান ব্যবহার করছিলাম আমরা, ক্যানগুলো রেইলের ওপর সাজিয়ে রাখছিল টেকোস। একটা ক্যান বেশ কাপছিল, রেইলের ওপর ঠিকমত বসেনি বোধহয়। ওটা ঠিক করতে এগিয়ে গিয়েছিল টেকোস, লাইন অভ ফায়ারে গিয়ে পড়ে ও।
নড করল এডলে ভার্ন, গম্ভীর দেখাচ্ছে। তাহলে এই হচ্ছে ব্যাপার। করোনারের কাছে সশরীরে সাক্ষ্য দিতে হবে তোমার, বিল। জেফরিকেও দরকার হবে। যত তাড়াতাড়ি ঝামেলা শেষ হয় ততই ভাল।
ফায়ারপ্লেসের আগুনে সিগারেটের গোড়া ছুঁড়ে ফেলল বেন। যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসব আমি।
কোন্ দিকে যাবে তুমি? জানতে চাইল ল-ম্যান।
কোথায় যেতে পারে ও?
সবকটা দাঁত বের করে হাসল শেরিফ। হয়তো মেক্সিকোর দিকে। পথে ডরোটিও নাভারেজের সঙ্গে দেখা না হলেই বাঁচি, তাহলে নির্ঘাত ওকে লুফে নেবে মেক্সিকান লুটেরাটা। নাহ, আরেকটা টেলিগ্রাম করতে হবে দেখছি।
শেরিফ বেরিয়ে যাওয়ার পর রান্নাঘরে ঢুকল বেন। ক’দিন বাইরে থাকতে হবে, কিছু খাবার সঙ্গে না নিলেই নয়। জেফরি কোথায় যেতে পারে এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ওর। এলাকাটা হাতের তালুর মত চেনে জেফরি, তাছাড়া এর আগেও একা দীর্ঘ রাইড করেছে; প্রায়ই নদীর কিনারা ধরে পাহাড়ের দিকে চলে যেত সে।
ওর চাহিদা মত খাবার ভরে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল কেট। তাহলে টেকোসের মৃত্যুর পেছনে জেফরির কোন দোষ ছিল না? জানতে চাইল কূক।
হ্যাঁ।
কিন্তু খুন থেকে মুক্তি পেলেও একজন মানুষের মৃত্যুর দায় থেকে মুক্তি পায়নি ও, তাই না, মি. স্লেজেল?
স্থির দৃষ্টিতে মহিলাকে দেখল বেন? শেরিফের কাছে দেয়া সাক্ষ্যে যা বলেছ, আমার তো মনে হচ্ছে তারচেয়েও বেশি জানো তুমি, কেটি।
ক্ষীণ নড করল মহিলা, তারপর কিছুটা কাছে সরে এল। সবই দেখেছি আমি, নিচু স্বরে বলল সে। রান্নাঘর থেকে করাল আর বাঙ্ক হাউসের পুরোটাই চোখে পড়ে।
কিন্তু তারপরও দুর্ঘটনাই বলতে হবে এটাকে।
কিন্তু এমন নয় যে এড়ানো যেত না।
না, তিক্ত মনে স্বীকার করল বেন।
কোথায় খুঁজবে ওকে?
ভাবছি পাহাড়ে যাব। হয়তো এতক্ষণে কয়েক মাইল দূরে চলে গেছে ও।
নড করল কেট। আমি কিন্তু আগে থেকেই জানতাম এখানে থাকবে না ও।
কিভাবে জানলে? বিস্ময় চেপে জানতে চাইল বেন।
কাঁধের ওপর দিয়ে একটা আঙুল তুলে বাড়ির মূল অংশের দিকে ইঙ্গিত করল মহিলা। ওর কারণে।
মিস ব্রেনেল?
উঁহু, মিসেস ব্রেনেল। গতরাতে জেফরির কামরায় গিয়েছিল সে, অনেকক্ষণ ধরে কি যেন বলেছে ছেলেটাকে।
হৃৎস্পন্দন দ্রুত হলো বেনের। সবকিছু খুলে বলো তো!
মিসেস ব্রেনেলের সঙ্গে কথা বলার পর আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি জেফরি। আমার ধারণা ছেলেটার ওপর যথেষ্ট প্রভাব আছে অ্যাগনেস ব্রেনেলের, হয়তো এ নিয়ে দুই ভাইয়ে ঝগড়া হলো! আর পরোক্ষ ভাবে হলেও চড়া মূল্য দিতে হলো টেকোস ফারমিনকে। একটা কথা না বলে পারছি না, মি. স্লেজেল, ছেলেটা সত্যিই ভয়ঙ্কর এবং ওকে ব্যবহার করছে ওই মহিলা। এ বাড়ির পরিবেশ এখন আর ভাল লাগছে না আমার, অশুভ কি যেন আছে এখানে।
দুজনের কেউই টের পায়নি কামরায় প্রবেশ করেছে অ্যাগনেস ব্রেনেল। নিঃশব্দে, চুপিসারে। ক্ষিপ্র বেড়ালের মত স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারে মেয়েটি। বেনই ওকে দেখতে পেল প্রথম, ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল কুক, মুহূর্তের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে এল স্বর।
কৃকের দিকে এমন ভাবে তাকাল অ্যাগনেস, যেন কুষ্ঠ রোগী দেখছে-নীল চোখে অসন্তোষ, রাগ এবং বিদ্বেষ-একে একে সবই ফুটে উঠল; দৃঢ় চোয়াল দেখে বোঝা গেল চরম সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছে। বেনের আবারও মনে হলো টম নোলানের ছেলে নেই তো কি হয়েছে, অ্যাগনেস সেই অভাব কখনও অনুভব করতে দেয়নি বোধহয়। অ্যাগনেসের মধ্যে এতটা বিদ্বেষ দেখতে পাবে কল্পনা করেনি ও, কিন্তু মেয়েটির নিজেকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা তারচেয়েও বেশি। বিস্মিত করল ওকে। স্বয়ং টম নোলানও কি নিজেকে এভাবে সামলে নিতে পারত?
নোটিশ পেয়ে গেছ তুমি, ক্যাথেরিন! প্রায় নিরুত্তাপ স্বরে বলল অ্যাগনেস ব্রেনেল।
ঝুঁকে বো করল কেট।
দুই সপ্তাহ কি যথেষ্ট হবে তোমার জন্যে? এবার হেসে জিজ্ঞেস করল অ্যাগনেস, চোখে আমোদ দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু এরচেয়ে বেশি সময় যে দিতে পারব না তোমাকে, যেখানে নিয়োগকর্তার প্রতি তোমার আচরণ বা বিশ্বস্ততা দুটোই প্রশ্নের সম্মুখীন!
ক্ষীণ, তিক্ত হাসি দেখা গেল কূকের মুখে। আমিও এক মুহূর্ত বেশি থাকতে চাই না, মিসেস ব্রেনেল। আজই চলে যাব।
প্রশংসা পত্র ছাড়াই?
এটাই হচ্ছে টম নোলানের রীতি, জিনিসটা তার মেয়েও পেয়েছে। বাপ কা বেটি! মন্ট্যানার স্কুলে পড়াশোনা করলেও বাপের কাছ থেকে নোংরা কৌশল আর ধূর্ততা শেখার জন্যে প্রচুর সময় পেয়েছে অ্যাগনেস।
মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল কেটের মুখ, আড়ষ্ট হয়ে গেছে চোয়াল। আপ্রাণ চেষ্টা করল নিজেকে সামলে নিতে। মহিলা কূকের পক্ষে এ দেশে ভাল কাজ পাওয়া কঠিন, জানে সে।
অ্যাগনেসের দিকে ফিরল বেন। একটা প্রশংসা পত্র দিয়ে দাও ওকে।
দেব না!
ক্ষীণ হাসল বেন। দেবে, নিশ্চয়ই দেবে। জেফরিকে এখান থেকে চলে যেতে বলেছ তুমি। কথাটা যদি বিলকে জানিয়ে দেই…শুনেই খেপে যাবে ও।
এখন ওর কাছে যতটা গুরুত্ব পাচ্ছ, তা নিশ্চয়ই থাকবে না, তাই না?
কঠিন হয়ে গেল অ্যাগনেসের চাহনি, কূকের ওপর থেকে সমস্ত আক্রোশ যেন এবার বেনের ওপর গিয়ে পড়েছে।
লিখে ফেলল, অ্যাগি, মৃদু স্বরে তাগাদা দিল বেন। মেয়েটির ডাক নাম ব্যবহার করল এবার, ভাল করেই জানে এ নামটা ঘৃণা করে অ্যাগনেস।
ওর দিকে তাকিয়ে থাকল অ্যাগনেস, শীতল ক্রোধে জ্বলছে নীল চোখ জোড়া। পরস্পারের সঙ্গে চেপে বসেছে ঠোঁট কামড়ে ধরায় ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগল বোধহয়, কিংবা বেনের হুমকির পরিণতি চিন্তা করল। ঠিক আছে, দেব! নিচু কিন্তু তপ্ত স্বরে বলল মেয়েটা, তাকিয়ে আছে বেনের চোখে, সেখানে স্পষ্ট বিদ্বেষ। কিন্তু সেজন্যে তোমাকে মাশুল দিতে হবে, বেন স্লেজেল! দুঃখ প্রকাশ করার সুযোগও পাবে না তুমি! তারপর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না অ্যাগনেস, ঝটিতি ঘুরেই কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
ধন্যবাদ, মি. স্নেজেল, তিক্ত স্বরে বলল কেট।
ভুলে যাও। উল্টো ঘুরে দরজার দিকে এগোল বেন।
এক মিনিট, মি. স্লেজেল।
ঘুরে তাকাল বেন।
খানিকটা দ্বিধা দেখা গেল কৃকের মুখে। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জেফরিকে মিথ্যে বলেছে মিসেস ব্রেনেল, দ্রুত বলে গেল মহিলা। ওকে পরামর্শ দিয়েছে কিছু দিনের জন্যে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারলে টেকোসের খুনের ব্যাপারটা চাপা পড়ে যাবে। ডাবল-বি থেকে দূরে থাকলে নিরাপদ থাকবে ও-বলেছে মিসেস ব্রেনেল-এবং নিজের পিঠের দিকে চোখ রাখার পরামর্শ দিয়েছে ওকে।
একটু আগে কিন্তু কথাগুলো বলোনি আমাকে!
আসলে…ঝামেলা করতে চাইনি আমি।
জেফরি কোথায় যেতে পারে, আসলেই কি কোন ধারণা নেই তোমার?
মাথা নাড়ল কূক, কিন্তু বেন ঠিকই বুঝতে পারল মিথ্যে বলছে মহিলা। ফাঁকিটা যে ও ধরে ফেলেছে তাও জানে ক্যাথেরিন, কিন্তু গ্রাহ্য করছে না।
মিনিট খানেকের মধ্যে ফিরে এল অ্যাগনেস, হাতের কাগজটা নিতান্ত অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলল মেঝেয়। ঝুঁকে ওটা তুলে নিতে উদ্যত হলো কেট, কিন্তু তাকে বাধা দিল বেন। ওটা তুলে নাও, অ্যাগি, মৃদু স্বরে নির্দেশ দিল ও।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল অ্যাগনেস। শীতল ইস্পাতের মত দেখাচ্ছে নীল চোখ জোড়া।
তোলো ওটা, আবারও বলল বেন। আমাদেরকে দেখাও যে একজন সম্মানিত লেডি তুমি, অ্যাগি। টম নোলান তোমাকে কাউন্টির সেরা স্কুলে পড়াশোনা করিয়েছে, তুমি নিশ্চয়ই বাবাকে ছোট করবে না কিংবা নিজের অমর্যাদা করবে না, অ্যাগি?
ঝুঁকে কাগজটা তুলে নিল অ্যাগনেস। কাজটা করতে ঘৃণা বোধ করছে, কিন্তু সমস্ত বিদ্বেষের সঙ্গে অপমানটাও হজম করে ফেলল। কেটের হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না, ঘুরেই ছুটে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। স্কার্টের খসখস শব্দে বুনো রাগ আর অসন্তোষ প্রকাশ পেল।
ধন্যবাদ, মি. স্নেজেল, শ্রাগ করে বলল কূক, কিছুটা বিব্রত দেখাচ্ছে। এখান থেকে চলে যেতে পারছি বলে এক হিসেবে খুশিই আমি। স্বীকার করছি বেতন, খাবার বা থাকার আয়োজনও ভাল ছিল এখানে। তবুও…ডাবল-বির পরিবেশে অশুভ কি যেন আছে, খুব বেশি দিন হয়নি, কিন্তু কয়েক মাস ধরে চারপাশে মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছিলাম।
শ্রাগ করে প্যাকেট তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল বেন। মহিলার শেষ কথাটা প্রায় উপেক্ষা করেছে। মৃত্যুর গন্ধ? হয়তো কার্ল ব্রেনেল আর টেকোস ফারমিনের কথা বোঝাতে চেয়েছে সে। কূকের অতি কল্পনা এসব, আবার দুই মহিলার পারস্পরিক বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশও হতে পারে।
স্টেবলে এসে বাকস্কিনটাকে স্টল থেকে বের করল বেন। জানে যথেষ্ট বিশ্রাম না পেলেও এখনও ছুটতে পারবে ঘোড়াটা। তাছাড়া সঙ্গী হিসেবে অন্য ঘোড়াকে পছন্দ করতে পারছে না ও। স্যাডল সাজিয়ে, স্ক্যাবার্ডে উইনচেস্টার রেখে বেরিয়ে আসতে উদ্যত হলো, দরজার দিকে তাকাতে দেখল স্টেবলের দিকে এগিয়ে আসছে মিরিয়াম।
ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না আমার, বেন, চিন্তিত স্বরে বলল মেয়েটি। জেফরি হয়তো রুখে দাঁড়াতে পারে।
উঁহু, আমার কথা শুনবে ও। ভুলে গেছ ছোট থাকতেও সবচেয়ে বেশি মানত আমাকে? তাছাড়া খুনের অভিযোগ নেই ওর বিরুদ্ধে, এ খবরটাই, ওকে ফিরিয়ে। আনার জন্যে যথেষ্ট।
বাচ্চা ছিল ও তখন, তোমাকে বীর-পূজা করত, নিজের আদর্শ হিসেবে মানত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে তোমাকে বা তোমার মত লোককে এখন স্রেফ চ্যালেঞ্জ মনে করে ও, নিজের দক্ষতার বিরুদ্ধে হুমকি বলে ভাবছে। বুক ফুলিয়ে হাঁটতে চায় ও, চায় সবাই ওকে সমীহ করুক, ভয় পাক।
আমরাও তাই চাই..সবাই।
কিন্তু ওর ব্যাপারটা প্রায় অসুস্থতার পর্যায়ে পড়ে। স্টিভ হারকারের মত লোককে সমীহ করে ও। চায় হারারের মত সবাই সমীহ করুক ওকে, ভয়। পাক।
এটা একটা কারণ বটে!
বেনের মুখ নিরীখ করছে মেয়েটির চঞ্চল দৃষ্টি। সমীহ কিংবা ভয়, কোনটা মানুষের বেশি কাক্ষিত, বেন?
সমীহ।
তোমাকে সমীহ করে সবাই, শ্রদ্ধা করে, তাই না?
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল বেন।বেন? তাগাদা দিল মিরিয়াম।
হয়তো।
সিরেনোই তো সবকিছু নয়। বাইরে ভিন্ন এক দুনিয়া আছে, তাই না? বেনের নির্লিপ্ত উত্তরে মোটেই নিবৃত্ত হয়নি মিরিয়াম।
স্যাডলের পেটি টাইট করল ও। দ্রুত রওনা দিতে পারলে হয়তো সন্ধের আগে পাহাড়ে পৌঁছতে পারব, মিরিয়ামের প্রশ্নটা বাতাসেই জমা থাকল, এড়িয়ে গেল ও।
তোমার ধারণা পাহাড়ে গেছে ও?
যে কোন জায়গায় যেখানে নিরাপত্তা পাবে ও, পিছু নেওয়া যে কোন লোককে ফাঁকি দিতে পারবে।
এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াল মিরিয়াম, ওর শরীরের সুবাস বেনের নাকে দোলা দিচ্ছে। প্রার্থনা করছি যেন কোন গোলাগুলি না হয়! মৃদু, অস্ফুট স্বরে বলল মেয়েটি।
ওকে গুলি করব না আমি, মিরিয়াম, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল বেন। আচমকা নীরব হয়ে গেল মেয়েটি।
উত্তর আশা করেছিল বেন, এল না দেখে ফিরে তাকাল। অদ্ভুত, অচেনা দৃষ্টি মিরিয়ামের মায়াবী চোখের গভীরে-উদ্বেগ, মমতা আর সহানুভূতিতে ভরা। তোমাকে নিয়ে ভাবছি না, বেন, মৃদু স্বরে নীরবতা ভাঙল মিরিয়াম। বরং জেফরিকে নিয়ে আশঙ্কা হচ্ছে। ও হয়তো তোমাকেই গুলি করে বসতে পারে।
উঁহু, তা করবে না সে।
ছয় বছর বেশ দীর্ঘ সময়, তিক্ত হাসি দেখা গেল মেয়েটির ঠোঁটের কোণে। তুমি যতটা উপলব্ধি করছ, তারচেয়ে অনেক দীর্ঘ সময়। সবাই বদলে গেছি। আমরা–বিল, জেফরি…এমনকি আমিও।
কাউকে তো যেতেই হবে, ওকে ফিরিয়ে আনা দরকার। বিল যেতে পারছে।
স্যাডলে উঠে বসল বেন, তাকিয়ে দেখল নড়ার কোন লক্ষণ নেই মেয়েটির মধ্যে। শঙ্কা, একইসঙ্গে উদ্বেগও প্রকাশ পাচ্ছে চাহনিতে। হাত বাড়িয়ে মিরিয়ামের চিবুক তুলে ধরল ও, তারপর ঝুঁকে আলতো চুমো খেল কপালে। অ্যাডিওস,বলে হাঁটুর গুতোয় বাকস্কিনকে সামনে বাড়াল ও, বৃষ্টিস্নাত আঙিনায় বেরিয়ে এল।
র্যাঞ্চ হাউস থেকে একশো গজ দূরে রীজের ওপর উঠে এসে ফিরে তাকাল বেন, নিজের ওপর কিছুটা হলেও বিরক্ত। আচমকা ব্যাপারটা ঘটে গেছে। মিরিয়ামকে কেন চুমো খেল ও? এভাবে নিশ্চয়ই ভরসা আশা করে না কেউ?
বৃষ্টি কুয়াশার মত ঘোলাটে একটা পর্দা সৃষ্টি করেছে দৃষ্টিপথে, কিন্তু তারপরও মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট উপেক্ষা করে এখনও করালের দরজায় দাড়িয়ে আছে মিরিয়াম ব্রেনেল, ওকেই দেখছে। একটা হাত তুলে নাড়ল বেন, দেখল পাল্টা হাত নাড়ছে মিরিয়াম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নিকারের কলার কাঁধ পর্যন্ত তুলে দিল ও, তারপর স্পার দাবাল। বৃষ্টিস্নাত পাহাড় ওর গন্তব্য।
জেফরির জায়গায় নিজে হলে কি করত, ভাবছে বেন। সম্ভবত পাহাড়ে চলে যেত-দক্ষিণ অথবা পশ্চিমে, দুদিকেই পাহাড়শ্রেণী আছে। রেলরোডের কাছাকাছি যেতে হলেও একই পথ ধরতে হবে। রেলরোড পেরিয়ে উত্তর-পুবে যেতে পারবে সে, কিংবা ঠিক দক্ষিণেই যেতে পারবে। এডলে ভার্ন যদি সত্যিই টেলিগ্রাম করে থাকে, তাহলে যেদিকে যাক নিশ্চয়ই ট্রেনেই ধরা পড়বে ছেলেটা।
রীজ পেরিয়ে তৃণভূমি ধরে ঘোড়া ছোটাল বেন স্লেজেল। বৃষ্টি বেড়ে গেছে, হঠাৎ করে যেন খেপে গেছে কারও ওপর। ঠোঁটে একটা সিগারেট ঝুলিয়ে ঘোড়ার গতি কমিয়ে আনল ও, নিচু ব্রিমের হাটের কারণে বৃষ্টিতে ভিজবে না সিগারেট। দেয়াশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল।
নিচু ব্রিমের হ্যাটের কারণে ওর দৃষ্টিসীমাও কমে গেছে, সেজন্যেই পুবের এক রীজের চুড়ায় নিঃসঙ্গ ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেল না, অথচ ডাবল-বি থেকে রওনা দেয়ার পর থেকে সারাক্ষণ ওর ওপর নজর রাখছে লোকটি।
অদৃশ্য কোন লোকের উদ্দেশ্যে নিজের হ্যাট বাতাসে নেড়ে সংকেত দিল লোকটা, সেটাও দেখতে পেল না বেন স্লেজেল। মুহূর্তের মধ্যে রীজের চূড়া থেকে হারিয়ে গেল লোকটার অবয়ব।
০৮. মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে এখন। খুব বেশি দূর দৃষ্টি যায় না। আবছা ভাবে দূরে পাহাড়ের নিরেট অবয়ব দেখতে পাচ্ছে বেন স্লেজেল। ঘোড়ার গতি কমিয়ে প্রায় হাঁটার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। বাকস্কিনের ওপর ভরসা রেখেছে, এছাড়া যেহেতু আর কিছু করার নেই। ঘোড়াটার সহজাত প্রবৃত্তি আর ভাগ্যই ভরসা।
ঘণ্টাখানেক এভাবেই রাইড করল বেন। খুব বেশি হলে মাইল দুয়েক এগিয়েছে। শুরুতে জেফরির ট্রেইল ধরে এগিয়েছে, কিন্তু বৃষ্টির কারণে প্রায় মুছে গেছে ট্র্যাক। আন্দাজের ওপর এগোচ্ছে এখন। বৃষ্টি তো কমেইনি, বরং বেড়েছে; ট্রেইল বা জমিও পিচ্ছিল হয়ে গেছে, যে কোন সময় ঘোড়াটার পা হড়কে যেতে পারে। নিতান্ত অনিচ্ছায় একসময় হেঁচড়ে ভেজা স্যাডল থেকে নামল ও, ঘোড়া আর নিজের জন্যে নিরাপদ আশ্রয় হবে এমন জায়গার খোঁজে চারপাশে চকিত দৃষ্টি চালাল।
সবে একটা ক্যানিয়নের কাছাকাছি পৌঁছেছে ও। ক্যানিয়নের ভেতরে আশ্রয় নেওয়া মৃত্যুর শামিল হবে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা পানির স্রোত চলে যাচ্ছে ক্যানিয়নের ভেতরে, সঙ্গে বিপুল বিক্রমে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভাঙা গাছপালা, উপড়ে যাওয়া ঘাস, নুড়িপাথর••চলার পথে যা পেয়েছে, সবই ভাসিয়ে নিয়ে আসছে, যেন ফুসে ওঠা নিষ্ঠুর সাগর।
ক্যানিয়নের বাইরে আছে বলে যে খুব নিশ্চিন্ত তা-ও নয়। যে কোন সময়ে ভরে যাবে খাদটা, উপচে পড়া পানির স্রোত ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে। তার। আগেই কোথাও নিরাপদ একটা জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার তাড়া অনুভব করছে। বেন।
ঢাল বেয়ে একটা চাতালে উঠে এল ও, সাহস দেয়ার জন্যে ঘোড়াটার সঙ্গে কথা বলছে। পিচ্ছিল ঢাল বেয়ে উঠতে চাইছে না বাকস্কিন, বারবার নাক ঝেড়ে অনীহা প্রকাশ করছে। আচমকা দুই চোখ চরকির মত ঘুরতে শুরু করল ওটার, তীক্ষ্ণ হ্রেষাধ্বনি করে উঠল। নিচের দিকে সমূহ বিপদ দেখতে পেল বেন। বৃষ্টির শব্দ ছাড়িয়ে ভিন্ন একটা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে এখন, উপত্যকা ধরে তেড়ে আসা পানির স্রোতের শব্দ-উন্মত্ত কোন বুনো জানোয়ার ক্ষোভে ফেটে পড়ছে যেন। অভিজ্ঞতা থেকে জানে বেন, যে কোন মুহূর্তে ছুটে আসবে ফুঁসে ওঠা জলরাশি, বিপুল বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়বে চলার পথে পড়া যে কোন কিছুর ওপর।
কোন মতেই উঠবে না বাকস্কিন, আসন্ন বিপদ আতঙ্কিত করে তুলেছে ওটাকে। বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিল বেন। বাড়তি কিছুই করার নেই ওর। স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেল, খাবারের প্যাকেট, বেডরোল আর স্যাডল ব্যাগ তুলে নিল; তারপর স্যাডল-ব্রিডলের বাঁধন ছাড়িয়ে মুক্তি দিল ঘোড়াকে। নেহাত ভাগ্যের জোরে যদি বেঁচে যায় ঘোড়াটা, তিক্ত মনে আশা করল বেন, এছাড়া যেহেতু উন্মত্ত জলরাশির আক্রোশ থেকে বাঁচার কোন উপায় দেখতে পাচ্ছে না।
ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল ও। মিনিট খানেক পরই ঢালের গোড়ায় আঘাত হানল পানির স্রোত। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল শেষ মুহূর্তে বিপদ বুঝতে পেরে উঠতে শুরু করেছিল ঘোড়াটা, কিন্তু পা পিছলে পড়ে গেল কয়েক ফুট। ঘোলাটে পানির স্রোত গ্রাস করল ওটাকে, আতঙ্কে চিৎকার করল বাকস্কিন, মরিয়া চেষ্টায় পানি থেকে উঠে আসার চেষ্টা করল; কিন্তু সমস্ত চেষ্টা বিফলে গেল, পানির তোড়ে একসময় স্রোতের সঙ্গে ভেসে যেতে থাকল ঘোড়াটা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল বেন, স্বজন হারানোর মত তিক্ত অনুভূতি হচ্ছে ওর। কোন কোন সময় ঘোড়াও মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু হতে পারে, অন্তত ওর কাছে বাকস্কিনটার গুরুত্ব সেরকমই ছিল। অথচ অসহায় ভাবে ঘোড়াটাকে মরতে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না ওর।
পিচ্ছিল ঢাল বেয়ে আরও ওপরে উঠে এল ও। ক্যানিয়নের তলা থেকে নিরাপদ উচ্চতায় উঠে আসার পর নিশ্চিন্ত বোধ করল। কাছে ক্যানিয়নের বাঁকে পানির স্রোতের সঙ্গে গ্র্যানিটের সংঘর্ষের গম্ভীর শব্দ কানে আসতে ঘুরে তাকাল। বাকের কাছে ফেনা আর বাষ্প তৈরি হয়েছে, তরল দানবের মত ফুঁসে উঠছে পানির স্রোত।
পানির উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছে।
একসময়, ওর কাছ থেকে পাঁচ হাত নিচে থাকতে রাক্ষুসে খিদে মিটল ক্যানিয়নের, দেয়ালের উচ্চতার সমান সমান হয়ে গেল; নিস্তরঙ্গ জলরাশি নিতান্ত আলসেমির সঙ্গে বইল কিছুক্ষণ, তারপর দ্রুত কমতে শুরু করল। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল বন্ধ হয়ে গেছে এখন, আর ক্যানিয়নের ফাঁক-ফোকর দিয়ে পানি সরতে শুরু করায় যেভাবে ভরে উঠেছিল, ঠিক ততটাই দ্রুত খালি হতে শুরু করল। ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গেছে, বৃষ্টির দাপটও কমে এসেছে।
আবছা অন্ধকারে চড়াই বেয়ে উঠতে শুরু করল বেন। উঠছে তো উঠছেই। পাহাড় বা ক্যানিয়ন, কোনটাই পরিচিত নয় ওর, কিন্তু কি যেন একটা মনে পড়ছে পড়ছে করেও মনে করতে পারছে না। বাকস্কিনটা যেন কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছিল ওকে?
মিনিট ত্রিশ পর একেবারে চূড়ায় উঠে এল বেন। দূরে ক্ষীণ ভাবে ভগ্নপ্রায় কিছু দালানের অবশিষ্ট চোখে পড়ছে, দূরত্ব আর আলোর স্বল্পতার জন্যে প্রায় ভূতুড়ে দেখাচ্ছে কাঠামোগুলো। জায়গাটার কথা শুনেছে ও, বিস্মৃত অতীতের সাক্ষী: ক্যানিয়নের গভীরে নিঃসঙ্গ এই বসতি তৈরি করেছিল হুহোক্যাম নামে পাগলাটে এক লোক, বহু আগে-এমনকি অ্যাপাচী, নাভাজো, পুয়েবলো কিংবা হুপিদের আসারও আগে।
নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল, আনমনে ভাবল বেন। ঠাণ্ডায় শরীর প্রায় অসাড় হয়ে গেছে। টেরেসের দেয়াল টপকে সবচেয়ে কাছের দালানের দিকে এগোল। বাড়িটার ছাদ প্রায় ধসে পড়েছে, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে মেঝে। ওটাকে বাতিল করে দিয়ে পাশেরটার দিকে এগোল।
ভাগ্য এবার প্রসন্ন হলো। বাড়িটার দরজা বা জানালা এমনকি ছাদও আস্ত রয়েছে এতদিন পরও। টি-আকৃতির দরজার ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকল ও। স্লিকার আর ডেনিম জ্যাকেট খুলে ফেলল, শরীরে শীতের কামড় অনুভব করে অজান্তে কেঁপে উঠল।
কত দিন পর মানুষের পা পড়েছে এখানে? আনমনে ভাবল বেন। কিন্তু জানতে চাইছে কে, হারিয়ে যাওয়া একজন মানুষ? মানতেই হচ্ছে আপাতত, অন্তত সূর্য বা তারা দেখার আগ পর্যন্ত ট্রেইল হারিয়ে ফেলেছে ও। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, তারপর হয়তো এই গোলক-ধাঁধা থেকে বেরোতে পারবে। তার আগে প্রাচীন এই আশ্রয়টিই ওর এক রাতের আবাস। এবং স্বস্তির ব্যাপার, খাবার আর পানি আছে সঙ্গে। মন্দের ভাল বলা যায়। অবশ্য সঙ্গে না আনলেও পানির অভাব হত না, পুরো একটা ফ্রিগেটকে উড়িয়ে দেয়ার মত পানি জমা হয়েছে ক্যানিয়নে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ভাগ্যের সহায়তা পেল কেন। দমকা বাতাসে উড়ে আসা কটনউড আর প্রাসের শুকনো ডাল খুঁজে পেল দুটো দালানের ভেতর-গরাদহীন জানালা বা পাল্লাহীন দরজা দিয়ে ভেতরে চলে এসেছে। প্রসন্ন মনে আগুন জ্বালাল ও, প্রচণ্ড শীতের মধ্যে খানিকটা উষ্ণতা পাবে জেনে নিশ্চিন্ত বোধ করছে। কফি আর বেকন তৈরি করে আগুনের আঁচে ভেজা কাপড় শুকিয়ে নিল। আয়েশ করে আগুনের পাশে বেডরোল বিছিয়ে বসে পড়ল ও, তারপর আগুনের উষ্ণতায় পেট পূজা শুরু করল।
কম্বল বিছিয়ে শোয়ার আয়োজন করল, কাপড়গুলো শুকিয়ে নিয়েছে আগুনে। নিচু ছাদের ঘরটা যথেষ্ট উষ্ণ হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। দেয়ালে হেলান দিয়ে দ্বিতীয় কাপ কফি গলাধঃকরণ করল বেন। বহু আগে, তরুণ বয়সে হরিণ শিকার করতে রহুবার পাহাড়ে কাটিয়েছে ও, এলাকাটা সম্পর্কে মোটামুটি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এরকম বিচ্ছিন্ন কেবিন বা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে বহুবার। কিন্তু এ জায়গায় আগে কখনও আসেনি, এমনকি চোখেও পড়েনি। বেনের ধারণা স্কিলেট ক্রীকের দক্ষিণে পাহাড়ের কোথাও জায়গাটা। বৃষ্টি থেমে গেলে, লোকালয়ে ফিরে যেতে হলে আগামীকাল দীর্ঘ পথ আঁটতে হবে ওকে।
চোখ খুলে আবছা অন্ধকারে ছাদের দিকে তাকাল বেন স্লেজেল। আগুনটা প্রায় নিভে গেছে, ছাইয়ের স্তুপের গভীরে কিছু জ্বলন্ত অঙ্গার উঁকি দিচ্ছে এখনও। মাথা তুলে দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল ও, ক্ষীণ আলোর আভা চোখে পড়ছে টি-আকৃতির দরজা পথে। সঁাতাতে কম্বল সরিয়ে উঠে বসল ও, তারপর দরজার দিকে এগোল। বৃষ্টি থেমে গেছে, মেঘ সরে যাওয়ায় ঝকঝকে তারাভরা আকাশ চোখ মেলে তাকিয়েছে; রূপালী স্নিগ্ধ আলোয় ডুবে যাচ্ছে পাহাড়সারি আর ক্যানিয়ন।
বিপদের খাড়া নেই মাথার ওপর, তারপরও অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ক্যানিয়নের আনাচে-কানাচে অস্বস্তিকর নীরবতা, দম বন্ধ করা: নৈঃশব্দে অমঙ্গল আর আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস যেন।
পিছিয়ে এসে উইনচেস্টার তুলে নিল বেন, চেম্বারে একটা বুলেট পাঠিয়ে দিল। আসার পথে নিচে, ক্যানিয়নের ঢালে ফেলে এসেছে স্যাডল ব্যাগ দুটো, তারই একটায় বাড়তি কাজ রয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও, রাইফেলের ম্যাগাজিনটা পূর্ণ-বারো রাউন্ড আছে, দরকার হলে পিস্তলের কার্তুজের সঙ্গে বদল করতে পারবে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাহাড়সারি আর ক্যানিয়নের এবড়োখেবড়ো শরীর জরিপ করল বেন। একটা ঝোঁপ নড়ে উঠতে আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর দেহ, নিঃসন্দেহ যে ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে নড়েনি ঝোঁপটা, তাহলে পাশেরগুলোও নড়ত। ক্যানিয়নের ব্রিমের কাছাকাছি কোন মানুষ, নিদেনপক্ষে কিছু একটা আছে; যে-ই থাকুক ওর অবস্থান যে টের পেয়েছে সেটা একরকম নিশ্চিত।
টেরেসের আড়াআড়ি এগোল ও, ছায়া আর বাড়ির দেয়ালের আড়ালে থাকার চেষ্টা করছে। একটা ভগ্নপ্রায় দালানের পেছনে এসে ভাঙা দেয়াল বেয়ে উঠে এল পাশের বাড়ির ছাদে। গড়ান দিয়ে সামনের দিকে চলে এল বেন, খোলা ছাদের কিনারায় পড়ে থেকে উঁকি দিল। ক্যানিয়নের কিনারে লেগে থাকল ওর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। চাঁদের ম্লান আলো আর বাতাসের কারসাজিতে গাছ আর ঝোঁপগুলোকে হঠাৎ হঠাৎ মানুষ বলে ভুল হচ্ছে, তটস্থ নার্ভে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে প্রতিবার। কিন্তু বেন নিশ্চিন্তও হতে পারছে না যে আসলেই কেউ নেই ওখানে।
ধৈর্য ধরতে হলো ওকে। মিনিট দশ-বিশ, …চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেল। কিন্তু কেউ যে ওর অপেক্ষায় আছে তার বিন্দুমাত্র নমুনা দেখতে পাচ্ছে না। চাঁদের আলো ফিকে হয়ে এসেছে, পুব দিগন্তে সূর্য ওঠার তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
ত্যক্ত হয়ে উঠল বেন, এভাবে অপেক্ষায় থাকতে বিরক্তি লাগছে। সন্দেহ নিরসন করার জন্যে হলেও কিছু একটা করা দরকার। ধীরে ধীরে ক্রল করে পিছিয়ে এল, ছাদের উল্টোদিকে এসে নেমে পড়ল, তারপর টেরেসের দিকে এগোল। আচমকা ক্যানিয়নের কিনারে কমলা রঙের আগুনের ঝলক দেখতে পেল। গম্ভীর শব্দটা এল সেকেন্ড খানেক পর।
টেরেসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ও। ক্যানিয়নের দেয়ালে দেয়ালে আর পাহাড়সারিতে প্রতিধ্বনি তুলল রাইফেলের গম্ভীর শব্দ। একটু আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ও, ঠিক পেছনের দেয়ালে গেঁথেছে গুলিটা। বিধ্বস্ত দেয়াল থেকে চল্টা তুলে ছড়িয়ে দিয়েছে চতুর্দিকে।
বুকে হেঁটে টেরেসের কিনারে চলে এল বেন। জানে পাল্টা গুলি করা সহজ, হবে নাঃ একে তো ওর চেয়ে নিচু জায়গায় আছে টার্গেট, তাছাড়া আলোর স্বল্পতা এবং শক্রর সঠিক অবস্থানও জানা নেই। আসলে কাউকেই দেখতে পায়নি বেন। টেরেসের সমান্তরালে এগোল ও, শেষ প্রান্তে এসে দেয়ালের কিনারা ধরে উঁকি দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকবার আগুনের ঝলক দেখতে পেল।
এবার আরও কাছে লাগল বুলেটটা। টেরেসের দেয়াল থেকে সুরকি আর অ্যাডোবির তুবড়ি ছোটাল, ওর চোখে-মুখে এসে পড়েছে। মাথা নিচু করে পড়ে থাকল বেন। হারামজাদা শূটিং জানে বটে, তিক্ত মনে বিড়বিড় করে গাল দিল।
ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল ও, একটা দালানের পাশে আশ্রয় নিল। দুই হাত আড়াআড়ি ফেলে তার ওপর চিবুক রেখে চোখ রাখল ঢেউ খেলানো জমির শেষ প্রান্তে। প্রায় তিনশো গজ দূরে পাথরের স্তূপ আর বোল্ডারের আড়ালে লুকিয়ে আছে লোকটা।
বাতাসের হা-হুতাশ ছাড়া আর সবই নীরব হয়ে আছে। চাঁদ ডুবে যেতে আচমকা অন্ধকার নেমে এল, কালো পর্দা যেন ঢেকে ফেলেছে টেরেস আর বসতিটাকে। সুযোগটা নিতে দেরি করল না বেন, জানে আবছা অন্ধকারে অনায়াসে সরে যেতে পারবে যে কোন দিকে, শুধু শব্দ না করলেই হলো।
ক্রল করে হাইড-আউট থেকে বেরিয়ে এল ও, টেরেসের দেয়াল টপকে ভেজা শীতল পাহাড়ী ঢালে চলে এল। নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে ও, ওঠার সময় যতটা আয়াস লেগেছিল সেই তুলনায় প্রায় সহজ, সমস্যা কেবল একটাই–আলগা নুড়িপাথরে যাতে পা হড়কে না যায় সেজন্যে সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
মিনিট দশের মধ্যে ক্যানিয়নের দেয়ালের কিনারে পৌঁছে গেল বেনু। পাহাড়ী ঢালে উঠে এল, তারপর বাদামী দেয়ালের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে পড়ে থাকল। উল্টোদিকে বিস্তৃত, ক্ষয়ে যাওয়া দেয়ালের দিকে তাকাল। আবছা অন্ধকারে ওই দেয়াল পাড়ি দেয়া দারুণ বোকামি হবে, গতকাল প্রচুর বৃষ্টিপাতের পর পিচ্ছিল হয়ে আছে দেয়ালটা।
সকাল হওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
নিতান্ত আলসেমির সঙ্গে ভোর হলো, ধীরে ধীরে আলো ফুটল পুব দিগন্তে, তারপর ক্যানিয়নের পশ্চিম প্রান্ত আলোকিত হয়ে উঠল। নিঃসাড় পড়ে রয়েছে বেন, হাতে কক করা উইনচেস্টার। মিনিট দশেকের মধ্যে পুরো উপত্যকাই আলোকিত হয়ে উঠল, অন্তত বোল্ডার আর পাথরের সারি স্পষ্ট দেখতে অসুবিধে হলো না।
আচমকা অস্বাভাবিক একটা শব্দ শুনতে পেল বেন। মনে হলো কেউ যেন, পিছলে ঢাল বেয়ে নেমে আসছে। মুখ তুলে তাকাতে ক্যানিয়নের দেয়ালে দুটো কাঠামো দেখতে পেল, দ্রুত বোল্ডারের আড়ালে হারিয়ে গেল লোকগুলো।
ওকে আগের জায়গায় দেখতে না পেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে লোকগুলো। তবে কোন ভাবে সতর্ক হয়ে গেছে এখন, বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করছে না কিংবা বোল্ডারের। আড়াল থেকে উঁকিও দিচ্ছে না। ক্লিফের ওপাশে ঢাল বেয়ে নেমে আসবে বেন, এই অপেক্ষায় আছে হয়তো।
দূর থেকে চেনার মত পরিষ্কার আলো ফোটেনি এখনও, তাই দুজনের কাউকে চিনতে পারেনি বেন। একজনের পরনে বর্ষাতি দেখেছে, বৃষ্টিতে ভিজে গাঢ় হয়ে ওঠা একটা সির্যাপি দেখেছে অন্যজনের গায়ে। নিচু করে রাখা হ্যাটের ব্রিমের কারণে এতদূর থেকে মুখ দেখা সম্ভব ছিল না।
* সির্যাপি (Serape) : পনচোর মত এক ধরনের বর্ষাতি, সাধারণত মেক্সিকানরা ব্যবহার করে।
আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এল ও, সন্তর্পণে ঢাল বেয়ে ওঠা শুরু করল। যেভাবে হোক লোকগুলোর ওপরে পৌঁছতে হবে, এবং ওদের অলক্ষ্যে; নইলে খেলাটা একতরফা থেকে যাবে-স্রেফ ওকে আটকে রাখবে একজন, অন্যজন ঘুরপথে ওর পেছনে এলে কোণঠাসা করতে পারবে ওকে। এতক্ষণে কেন যে কাজটা করেনি সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। এর ব্যাখ্যা একটাই হতে পারে: লোকগুলো এখনও ওর সঠিক অবস্থান জানে না।
চল্লিশ ফুট উঠে এল ও, এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখান থেকে দু’জনকেই দেখতে পাচ্ছে। অবশ্য পুরো শরীর নয়, ওপর থেকে যতটা দেখা সম্ভব–শুধু দুটো হ্যাট দেখা যাচ্ছে। নিতান্ত না হলেই নয়, প্রয়োজন ছাড়া নড়ছে দুজনের কেউ; কিন্তু হাতের রাইফেল তৈরি, নিজেরাও সতর্ক এবং শিকারকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করার জন্যে উদগ্রীব।
হুহোক্যামের প্রাচীন টেরেস আর ঢালের ওপর লেপ্টে আছে লোকগুলোর দৃষ্টি, জানেই না ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে বেন, এবং ঠিক একশো ফুট ওপরে ক্যানিয়নের ঢালে আশ্রয় নিয়েছে, ইচ্ছে করলেই প্রথম গুলিটা করতে পারে।
আচমকা নড়ে উঠল সির্যাপি পরা লোকটি, বোল্ডার আর বুনো ঝোপে ঘেরা সঙ্কীর্ণ পথ ধরে ক্যানিয়নের দিকে এগোল সে। স্বতঃস্ফুর্ত, অনায়াস ভঙ্গি। অন্য লোকটা আগের মত পড়ে থাকল একই জায়গায়, একটু পর ক্ষীণ নীল ধোয়ার একটা রেখা উঠতে শুরু করল-সিগারেট ধরিয়েছে লোকটা।
সির্যাপি পরা লোকটাকে ক্যানিয়নের গভীরে হারিয়ে যেতে দেখল বেন। যথেষ্ট আড়াল রয়েছে ওদিকে, ইচ্ছে থাকলেও গুলি করার উপায় নেই। তাছাড়া অন্য লোকটা তাহলে সতর্ক হয়ে যাবে।
সন্তর্পণে কিছুটা পাশে সরল বেন, কিন্তু বুটের ঘষায় স্থানচ্যুত হলো একটা আলগা নুড়িপাথর। গড়িয়ে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল ওটা। শব্দটা পিলে। চমকে দিয়েছে ওর। মাথা নিচু করে ছুট লাগাল বেন, লক্ষ্য দশ হাত দূরের একটা ঝোঁপ।
ঝোঁপের পেছনে চলে আসার আগেই দেখল দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠেছে সিগারেটঅলা। সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে গড়ান দিয়ে পাশে সরল সে, ঘোরার মধ্যেই শব্দ লক্ষ্য করে গুলি করেছে। আনাড়ী নয় মানুষটা, কিন্তু এতটা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে যে শব্দের কারণ না জেনেই অ্যাকশনে নেমে গেছে। সেটাই তার কাল হলো।
নিশানা করাই ছিল, নির্দ্বিধায় পুলিটা পাঠিয়ে দিল বেন। গুলির ধাক্কায় থমকে গেল সে, মুহূর্তের জন্যে স্থির হয়ে গেল শরীরটা, তারপর ঢলে পড়ল পাথুরে জমিতে, রাইফেলটা ছুটে গেছে হাত থেকে। রাইফেল আর হতভাগ্য লোকটা, একইসঙ্গে ঢাল বেয়ে গড়াতে শুরু করল।
গুলির শব্দের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঢাল বেয়ে নেমে এল বেন।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্যানিয়নের উল্টোদিক জরিপ করল, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সির্যাপি পরা লোকটার পাত্তাও নেই। নিশ্চয়ই গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে সে, হয় মাথা নিচু করে রেখেছে নয়তো নিজের কাজে ব্যস্ত-ঘুরপথে ওর পেছনে এসে পৌঁছতে চাইছে।
অখণ্ড নীরবতা নেমে এল। অস্বস্তিকর নীরবতা।
জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল বেন, সন্তর্পণে নিচে নেমে এল। একটু আগে লোক দুটো যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল, চাতালে নেমে থামল। বোন্ডারের সারি, ক্যানিয়নের নিরেট দেয়াল আর ঢাল ধরে তাকাল। কিছুই নড়ছে না। কিন্তু অন্য লোকটা পালিয়ে গেছে ভাবতে বাধছে ওর, তবে যাচাই করার জন্যে উঁকি দিতেও নারাজ।
প্রথমে একটা কাশির শব্দ শোনা গেল। অস্ফুট শব্দে ব্যথা বা বিরক্তি প্রকাশ করল কেউ। ক্ষণিকের জন্যে বড়সড় পাথরটার আড়ালে একজনের মাথা দেখতে পেল বেন, তারপর মুহূর্তে মাথা নিচু করে ফেলল লোকটা। নিশ্চয়ই বুকে লেগেছে। গুলিটা, ভাবল ও। লোকটাকে খরচের খাতায় রেখে দিল, আর কখনও গুলি করতে পারবে না সে।
স্লেজেল? কর্কশ একটা কণ্ঠ শোনা গেল।
শব্দ শুনে লোকটার অবস্থান আন্দাজ করল বেন। কণ্ঠটা ওর পরিচিত।
স্লেজেল? খোদার দোহাই!
আনমনে নড করল বেন, এবার পরিষ্কার চিনতে পারছে। জ্যাক হারলো!
স্নেজেল, দয়া করে এদিকে এসো। আমার অবস্থা খারাপ করে দিয়েছ তুমি। গুলি করার মত অবস্থা নেই আমার।
ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল বেন, সামনে বাগিয়ে ধরেছে উইনচেস্টার, সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে ক্যানিয়নের উল্টোদিকে। যে কোন আকস্মিক নড়াচড়া দেখতে পেলেই গুলি করবে। নিরাপদে চাতালের কিনারে পৌঁছে গেল।
তুমিই তো, স্লেজেল? অধীর কণ্ঠে জানতে চাইল হারলো, বেনের নীরবতা অস্থির করে তুলেছে তাকে।
খুব ভাল করেই জানো তুমি কার পিছু নিয়ে এখানে এসেছ।
হ্যাঁ, ফের কাশল জ্যাক হারলো। দারুণ শূটিং তোমার, দোস্ত!
কিন্তু সীসাটা তোমার শরীরেই ঢুকল। বলতে পারছি না তোমার জায়গায় আমি হলে এতটা সন্তুষ্টির সঙ্গে প্রশংসা করতে পারতাম। যাকগে, তোমার হাতের টিপও কিন্তু মন্দ নয়। আরেকটু হলে আমার কপালে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দিয়েছিলে।
আমি নই। কারাঞ্চো গুলি করেছে তোমাকে।
দুদিন আগের একটা ভোরের কথা মনে পড়ল বেনের, স্টিভ হারকারের সঙ্গে আচমকা উপস্থিত হয়েছিল আরও দুই রাইডার। তাদেরই একজন কারাঞ্চো। একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি লোকটা। হাফ-ব্রীড বা যাই হোক, নিজের কাজ সে ভালই বোঝে।
খেলাটা কি, হারলো?
মিনিট খানেক নীরব থাকল টেক্সান। তোমাকে অনুসরণ করে এসেছি আমরা। আমাদের ওপর নির্দেশ ছিল তুমি যাতে এখান থেকে বেরোতে না পারো, কিন্তু আমরা যে জড়িত তাও কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে গেলে তুমি, কর্কশ ভাবে হাসল জ্যাক হারলো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আসলে আমারই গায়েব হওয়ার পালা এসে গেছে!
আরেকটু এগিয়ে বোল্ডারের ফাঁক গলে উঁকি দিল বেন, রুক্ষ এ্যানিটের বুকে পড়ে থাকা ফ্যাকাসে টেক্সানকে দেখতে পেল। ঘামছে লোকটা, মুখের কোণ দিয়ে ফেনিল রক্ত উঠে এসেছে। নিপ্রাণ দৃষ্টি হারলোর চোখে।
দো-আঁশলাটাকে আগে পাকড়াও করে নিই, তারপর তোমাকে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যাব, হারলো।
তুমি তো দেখছি আস্ত বেকুব! ওকে ধরতে পারবে না তুমি, ধারে-কাছেও যেতে পারবে না, কিংবা আমাকে নিয়ে এখান থেকে বেরোতেও পারবে না।
তাহলে তোমাকে ছাড়া চলে যাব। ওই বাজার্ডটাই তোমাকে নিয়ে যাবে।
কারাঞ্চো? আবারও কর্কশ ভাবে হাসল হারলো। খোদা জানে, কি ধরনের লোক তুমি! বুঝতে পারছি না আসলেই কি মিথ্যে বলেছে ওরা, নাকি আমার সঙ্গে তামাশা করছ। উঁহু, আমাকে নিয়ে পাহাড় পাড়ি দেওয়ার ঝামেলায় যাবে না কারাঞ্চো, স্রেফ গলায় ছুরি ঢুকিয়ে ঝামেলা চুকে ফেলবে। যাকগে, ওদের নোংরা খেলায় জড়িয়েছি, মাশুল তো দিতেই হবে। কিন্তু কিছুটা হলেও যদি পুষিয়ে নেওয়া যেত!
ক্যানিয়নের ওপাশে তন্নতন্ন করে একটা কাঠামো খুঁজে বেড়াচ্ছে বেনের দৃষ্টি। মানে?–ব্যক্তিগত ভাবে তোমার সঙ্গে শত্রুতা নেই আমার। অথচ নির্দেশ না মেনে উপায় ছিল না, তোমাকে খুন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমাদের।
টম নোলানের নির্দেশ?
না।
তাহলে স্টিভ হারকারের?
উঁহু, বলব না। মরতে যাচ্ছে এমন লোকের ভয়-ডর বলতে কিছু থাকে না, সুতরাং আমার কাছ থেকে তথ্যটা বের করতে পারবে না।
টেক্সানের দিকে তাকাল বেন। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্বেচ্ছায় কিছু না বললে হারলোর কাছ থেকে কিছু জানা যাবে না।
মাথা খানিকটা তুলল সে। তুমি ফিরে আসার পর সবকিছুই বদলে গেছে, স্লেজেল। কিছু লোককে ভয় পাইয়ে দিয়েছ তুমি, তোমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে ওরা। তোমাকে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমি, ফ্রেড মোরিসও তাই করেছে। আমার ধারণা বুড়ো টম নোলানও চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কিন্তু ভয় পাওনি তুমি। মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে পাবেও না।
আমার পরামর্শ শোনো: বেসিন ছেড়ে চলে যাও। ডাবল-বি বা লেযি-এনের কথা স্রেফ ভুলে যাও, দোস্ত। মেয়েটা তোমার মত লোকের জন্যে স্রেফ উন্মাদিনী, স্লেজেল! টম নোলানের রক্ত বইছে ওর শরীরে; হাজারবার ধুলেও কিংবা হাজার বছর পরেও তা বদলাবে না। আধ-মাইল পশ্চিমে ক্যানিয়নের ব্রিমের কাছে ঘোড়া রেখে এসেছি আমরা, কিছু সিডার আর স আছে ওখানে। জায়গাটা অনায়াসে চিনতে পারবে। ঘোড়া দুটো নিয়ে জঘন্য এই এলাকা ছেড়ে চলে যাও!
আমাকে খুন করার নির্দেশ কে দিয়েছে, হারলো?
মাথা নাড়ল টেক্সান। বলব না। পালাও এখান থেকে! প্রন্তো!
কার্ল ব্রেনেলকে খুন করেছে কে?
চোখ বন্ধ করল জ্যাক হারলো, টানা কথা বলায় হাঁপিয়ে উঠেছে। আচমকা কাশি উঠল, কাশির দমকে কেঁপে উঠল সারা দেহ। মুখ আর চিবুক রক্তে ভরে গেল। তারপর হঠাৎ করেই স্থির হয়ে গেল দেহটা। জেদে দৃঢ় হয়ে গেছে চোয়াল দুটো, চোখে স্থির চাহনি দেখে বোঝা গেল মুখ খুলবে না সে, বেঈমানি করবে না নিজের ব্র্যান্ডের সঙ্গে। দুনিয়ার কোন কিছুর মাধ্যমেই বোধহয় সেটা সম্ভব নয়।
হারলোর রাইফেল তুলে নিয়ে কার্তুজগুলো বের করে ফেলল বেন, তারপর দুটো পাথরের ফাঁকে চাপ দিয়ে মাজলটা বাঁকা করে ফেলল। ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল ও, ক্যানিয়নের উল্টোদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে। জানে ধারে-কাছে কোথাও লুকিয়ে আছে দো-আঁশলা লোকটা। সুযোগ পেলেই তপ্ত সীসা পাঠিয়ে দেবে ওর উদ্দেশে।
চাতালের দিকে ফিরে তাকাল বেন। জ্যাক হারলোকে ফেলে যেতে খারাপ লাগছে। অন্য লেযি-এন ক্রুদের তুলনায় মানুষটা নেহাত খারাপ নয়, অথচ অসহায় ভাবে মৃত্যুর ক্ষণ গুনছে: এখন। উদ্ধার পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। মৃত্যুর জন্যে জ্যাক হারলোকে হয়তো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। নিঃসঙ্গ এবং তিক্ত অপেক্ষা।
এই, স্লেজেল! ক্যানিয়নের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল হারলোর কণ্ঠ। বলতে ভুলে গেছি, আবারও গাট-হকদের জমিতে আছ তুমি, এবার কিন্তু কোন চালাকি করছি না!
উত্তরটা এল দো-আঁশলার কাছ থেকে। শব্দ লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে সে, হয়তো জ্যাক হারলোর মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিতে চাইছে।
গোল্লায় যা তুই, বেজন্মা ব্রীড! রাইফেলের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই গাল দিল হারলো। আশা করছি আমার মত তোরও ব্যবস্থা করবে স্লেজেল!
আবারও গর্জে উঠল রাইফেলটা।
মুহূর্তের জন্যে দুশো গজ দূরে একটা কাঠামো দেখতে পেল বেন। বাদামী দেয়ালের জন্যে ঠিক চোখে পড়ছে না, কিন্তু নিশানা করতে গিয়ে সময় নষ্ট করল ও। আগের গুলির শব্দ শুনে লোকটার সম্ভাব্য অবস্থান আঁচ করে নিয়েছে, ঠিক পাশেই দেখতে পেল লোকটাকে। রাইফেলের নল এক চুল সরাতে হলো কেবল, তারপরই ট্রিগার টেনে দিল।
আশা করেনি লাগবে, কিন্তু হাফ-ব্রীডের অস্ফুট কাতরানি শুনে উল্লসিত হয়ে উঠল বেন। ঢাল বেয়ে আবার নামতে শুরু করল ও, সজাগ দৃষ্টি রেখেছে জায়গাটার পাশে। কারাঞ্চোকে দেখতে পেলেই গুলি করবে।
মিনিট কয়েক পর একটা গুলির শব্দ শুনতে পেল। অসঙ্গতিটা ধরতে অসুবিধে হলো, না ওর, পিস্তলের গুলি এটা। শব্দের উৎসও উল্টোদিকে। অপেক্ষার প্রহর নিজেই সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছে জ্যাক হারলো।
পশ্চিমের ঢাল বেয়ে উঠছে ও, ক্যানিয়নের দেয়ালের বাকের আড়াল পাচ্ছে। জানে ওকে দেখতে পাবে না কারাঞ্চো। সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করলও, দ্রুত উঠে এল চল্লিশ ফুটের মত।
হাঁপাচ্ছে ও, হাপরের মত ওঠা-নামা করছে প্রশস্ত বুক। বিশ্রাম চাইছে পা দুটো। কিন্তু চূড়ায় ওঠার আগে থামল না বেন, এমনকি চূড়ায় উঠে আসার পরও বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেল না। কয়েকটা ঝোঁপ আর ক্যাট এড়িয়ে সঙ্কীর্ণ পথ ধরে এগোল ও, ধারণা করছে সামনে খোলা জায়গা রয়েছে। ঝোঁপের কিনারে পৌঁছতে দেখল খোলা জায়গায় পিকেট করা হয়েছে ঘোড়া দুটো।
ঝোঁপের কিনারে শুয়ে পড়ে অপেক্ষায় থাকল বেন। পুব আকাশে রঙ ধরতে শুরু করেছে, সূর্য উঁকি দেবে কিছুক্ষণের মধ্যে। অপেক্ষায় থাকতে হলো :ওকে, একসময় প্রায় অধৈর্য বোধ করল। কিন্তু নিজেকে বোঝাল কুগারের মত ধূর্ত এক লোকের সঙ্গে ধৈর্যের পাল্লা দিচ্ছে, বেতাল কিছু করলে চড়া মাশুল গুনতে হবে।
বাতাস-তাড়ানো ধোয়ার মত নিঃশব্দে এল কারাঞ্চো, শুকনো নিষ্পত্র ঝোঁপের ওপাশে আবছা একটা ছায়া দেখা গেল প্রথমে; মিনিট দুয়েক স্থির হয়ে থাকল ছায়াটা, তারপর নড়ে উঠল। ঝোঁপ এড়িয়ে সন্তর্পণে খোলা জায়গার কিনারে এসে দাড়াল হাফ-ব্রীড, ঘোড়া আর আশপাশের জমির ওপর শ্যেনদৃষ্টি চালাল।
স্থির পড়ে আছে বেন, এক চুল নড়ছে না। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল, উইনচেস্টারের নলে নিশানা করল লোকটাকে। খানিকটা খোড়াচ্ছে কারাঞ্চো, হাঁটুর নীচে ট্রাউজারে শুকনো রক্তের দাগ লেগে আছে। ধীরে ধীরে ঘোড়র কাছে চলে এল সে, প্রভুকে চিনতে পেরে হেষাধ্বনি করল একটা ঘোড়া। দ্রুত হাতে স্যাডল-ব্রিডল পরখ করল হাফ-ব্রীড, স্ক্যাবার্ডে রাইফেল রেখে পমেল আঁকড়ে ধরল।
উঠতে যাবে, ঠিক এসময় তাকে ডাকল বেন, সন্তর্পণে ঝোঁপের আড়াল থেকে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।
স্থির হয়ে গেল লোটা, ঘাড়ের পেশীগুলো আড়ষ্ট হয়ে যেতে স্পষ্ট দেখল বেন।
কে; জ্যাক নাকি? সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইল কারাঞ্চো।
আনমনে হাসল বেন। হারামজাদা ঠিকই জানে হারলোর পরিণতি, কিন্তু সময় কাটাতে চাইছে, হয়তো আশা করছে কোন ভাবে বেচাল করতে পারবে ওকে।
তোমার বাপ!
দুর্বোধ্য একটা শব্দ করল লোকটা, বিরক্তি নাকি অসন্তোষ প্রকাশ করল কে জানে, কিন্তু কারাঞ্চোকে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াতে দেখে প্রমাদ গুনল বেন: দেখল হোলস্টারে ছোবল: হেনেছে হাফ-ব্রীডের দু’হাত, উরুতে ঝোলানো জোড়া, পিস্তলতুলে আনবে।
ঘূর্ণন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, পিস্তল দুটো যেন ভোজবাজির মত চলে এসেছে হাতে, সরাসরি বেনের চোখে চোখ রাখল কারাঞ্চো। সরীসৃপের মত শীতল চাহনি, চোখের গভীরে খুনের নেশা।
তার চোখে চোখ রেখে স্মিত হাসল,বেন, ট্রিগার টেনে দিল।
মাত্র ত্রিশ গজ দূরত্ব, মিস্ করার কোন সম্ভাবনাই নেই, কিন্তু তারপরও মিস্ হলো। নেহাত ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেল কারাঞ্চো। ঘোরার মধ্যেই মাথা নিচু করেছিল সে, কপালে না ঢুকে মেক্সিকান হ্যাটের ক্রাউন ফুটো করল বুলেট:
অজান্তে কেঁপে উঠল হাফ-ব্রীড, টের পেয়েছে মৃত্যুর কতটা কাছাকাছি চলে, গিয়েছিল। এবার দ্বিতীয় ভুলটা করল সে, বেনকে পুনরায় চেম্বারে বুলেট পাঠাতে দেখে মরিয়া হয়ে উঠল, নিশানা ছাড়াই গুলি করল।
কারাঞ্চোকে তৎপর হতে দেখেই ঝাঁপ দিয়েছে বেন, পড়ন্ত অবস্থায় দ্বিতীয় গুলি করল। স্রেফ ধাক্কা দিয়ে যেন ফেলে দিয়েছে কেউ, ঘোড়ার পিঠের ওপর হেলে পড়ল হাফ-ব্রীডের দেই, তারপর গড়ান খেয়ে, মাটিতে পড়ল। আতঙ্কে। চিৎকার করে উঠল ঘোড়াটা, লাফিয়ে সরে গেল কয়েক হাত
কারাঞ্চোর পাঠানো গুলি বেনের সামনের মাটিতে গেঁথেছে। শিথিল মুঠিতে পিস্তল দুটো ধরে রেখেছে সে এখনও, ডান বুকে একটা গর্ত তৈরি হয়েছে। দ্রুত রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে সেটা। শীতল, নিপ্রাণ দৃষ্টিতে ওকে দেখল কারাঞ্চো, আপ্রাণ চেষ্টায় পিস্তল তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু হাতে শক্তি পাচ্ছে না। ক্রমশ ফ্যাকাসে। হয়ে যাচ্ছে মুখ, ঘাম জমছে কপালে। শীতল জিঘাংসা নিয়ে তাকিয়ে থাকল। বেনের:দিকে।
জ্যাক হারলোর কথা মনে পড়ল বেনের। ঠিকই বলেছে টেক্সান; একটা র্যাটলের মতই বিষাক্ত লাগছে লোকটাকে। ঘৃণায় গা রিরি করে উঠল ওর।
রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে কারাঞ্চোর দিকে এগোল ও… জানে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই একে, প্রায় মুমূর্ষ দেখালেও কাছে গেলেই হয়তো ছোবল হানবে।
বেজন্মা স্লেজেল! হিসহিস করে গাল বকল কারাঞ্চো।
তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল বেনের ঠোঁটে। রাইফেলের মাজল দিয়ে সপাটে লোকটার গালে আঘাত করল, হাফ-ব্রীডকে ককিয়ে উঠতে দেখে বুনো আনন্দ অনুভব করল সারা দেহে। কারাঞ্চো কাত হয়ে পড়ে যেতে লাথি হাঁকাল, দুমড়ে। ছোট হয়ে গেল লোকটার দেহ। রাইফেলের বাঁট দিয়ে এবার তার অরক্ষিত পিঠে আঘাত করল বেন।
কুত্তার বাচ্চা! থুথু ফেলল কারাঞ্চো, থুথুর সঙ্গে রক্ত দেখে জ্বলে উঠল চোখ দুটো, বেনের কাছে মনে হলো বিষধর একটা সাপ ফণা তুলেছে।
গুলি করল ও।
পিস্তল ফেলে দু’হাতে হাঁটু চেপে ধরল সে। যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখ। বিড়বিড় করে খিস্তি করল, শব্দগুলো জোরে উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছে না বোধহয়।
মুখটা বন্ধ রাখো, দো-আঁশলা শয়তান! মৃদু স্বরে সতর্ক করল বেন। এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও।
শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল লোকটা।
এগিয়ে এসে বুট দিয়ে পিস্তল দুটো কারাঞ্চোর নাগালের বাইরে ঠেলে দিল বেন। তোমাদের পাঠিয়েছে কে?
নিকুচি করি তোমার!
ক্ষীণ হাসল বেন। জবাবটা আমার পছন্দ হয়নি, রাইফেলের চেম্বারে আরেকটা বুলেট পাঠাল ও। কিন্তু উত্তরে আরেকটা বুলেট তোমার অন্য হাঁটুতে পাঠিয়ে দিতে কিন্তু ভালই লাগবে।’
দৃষ্টি সরিয়ে নিল লোকটা। দৃঢ় হয়ে গেছে চোয়ালের পেশী। হাঁটু চেপে রাখা হাত দুটো মৃদু মৃদু কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে মুখ খুলবে না।
শ্রাগ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বেন। জ্যাক হারলোর চেয়ে এক কাঠি সরেস এই লোক, প্রশ্নের উত্তরগুলো ওর নিজেরই জেনে নিতে হবে।
কারাঞ্চোর শরীরে তল্লাশি চালিয়ে কোমরের কাছে একটা ছুরি খুঁজে পেল ও। স্ক্যাবার্ড থেকে উইনচেস্টার সরিয়ে হাফ-ব্রীডের সব কাপড় খুলে নিল এবার। সমানে গালাগাল করছে লোকটা, কিন্তু গ্রাহ্য করছে না বেন। ইচ্ছে ছিল পিস্তলের বাট চালিয়ে লোকটাকে অজ্ঞান করে নেবে আগে, কিন্তু হাফ-ব্রীডের ঔদ্ধত্য দেখে জেদ চেপে গেছে মনে।
হালকা দেহটা চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে স্যাডলে আড়াআড়ি করে ফেলল ও। ল্যাসো দিয়ে শক্ত করে বাঁধল কারাঞ্চোর দুই কজি। সিরাপি খুলে কোমরে পেঁচিয়ে দিল, নূ্যনতম এটুকু করুণা বোধহয় পাওনা যে কোন লোকের।
পিছিয়ে এসে হাফ-ব্রীডের উদ্দেশে, দাঁত কেলিয়ে হাসল ও। সন্দেহ নেই লেযি-এন পর্যন্ত যাত্রাটা খুব উপভোগ করবে তুমি, আর যাই হোক এভাবে নিশ্চয়ই কাজ শেষে কখনও র্যাঞ্চে ফিরে যাওনি?
বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কারাঞ্চো, মুখে কথা সরছে না। কিন্তু মুখ ফুটে বলার দরকারও হলো না, সুযোগ পেলে বিনিময়ে কি করবে সেটা চাহনিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
পিছিয়ে এসে অন্য ঘোড়ার স্যাডলে চাপল বেন, তারপর দক্ষিণে ঘোড়া। ছুটিয়ে দিল। কারাঞ্চোর ঘোড়ার লীড-রোপ ওর হাতে।
গন্তব্য লেযি-এন বাথান।
দুপুরের কিছু পর লেযি-এন র্যাঞ্চ হাউসের কাছাকাছি পৌঁছল বেন স্লেজেল। র্যাঞ্চ হাউস থেকে মাইল খানেক দূরের একটা রীজে অবস্থান নিয়েছে। খানিক আগে ঢাল বেয়ে নেমে গেছে কারাঞ্চোর ঘোড়া, হেলে-দুলে দুর্গের ন্যায় বিশাল র্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোচ্ছে। পরিচিত করালে ফিরবে ঘোড়াটা, এটাই স্বাভাবিক।
সময় নিয়ে সিগারেট রোল করল ও। সিগারেট ধরিয়ে ঘোড়া আর সওয়ারীর দিকে তাকাল, দেখল কারাঞ্চোর যন্ত্রণাকাতর মুখে বিতৃষ্ণা আর বিদ্বেষ ঝরে পড়ছে, কুচকুচে কালো চোখে খুনের নেশা।
ঘোড়ার পেটে হাঁটু দিয়ে তো মারল ও, সম্ভষ্ট মনে রিও ফ্রিয়ের দিকে এগোল এবার। দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা রেডরক ক্যানিয়নের দিকে তাকাল, মনে পড়ল পাথুরে এক চাতালে পড়ে আছে জ্যাক হারলোর নিপ্রাণ দেহ। মানুষটা হয়তো বন্ধুও হতে পারত, যদি বেনের মত বেড়ার একই পাশে থাকত দু’জন। একটা হাত তুলে বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে নাড়ল ও, হতভাগ্য টেক্সানের প্রতি করুণা আর সহানুভূতি জানানো ছাড়া কিছুই করার নেই। হারলোর ঘোড়াটাই ব্যবহার করছে ও এখন।
অবস্থাটা এখন আর গতকালের মত নেই। সরাসরি লেযি-এনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ঘোষণা করেছে ও। অথচ যে কাজে বেরিয়েছিল, তার কিছুই করতে পারেনি জেফরি ব্রেনেলের কোন খোঁজ পায়নি, আসলে সুযোগই হয়নি। জানে না কোথায় আছে ছেলেটা, কিংবা কার নির্দেশে দুটো বিষাক্ত নেকড়ে পিছু নিয়েছিল।
রিও ফ্রিয়ো পেরিয়ে ডাবল-বির জমিতে পা রাখল ওর ঘোড়া। সিগারেট রোল করে ধরাল ও। নিজের ওপর কিছুটা বিরক্তি বোধ করছে, জেফরি ব্রেনেলকে নিয়ে র্যাঞ্চে ফিরবে বললেও আসলে দেখাই পায়নি ছেলেটার। এডলে ভার্নের টেলিগ্রাম পেয়ে আইন যদি ছেলেটাকে না আটকে থাকে, তাহলে নিশ্চিত বলা যায় এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে সে; সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ বা আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে জেফরি এখনও জানে একটা খুন করেছে সে।
আপাতত কাজ একটাই, ভাবছে বেন, অ্যাগনেসকে চেপে ধরতে হবে। ডাবল-বি, ছাড়ার আগের রাতে জেফরির সঙ্গে দেখা করেছিল অ্যাগনেস, ছেলেটাকে কি বলেছে: জানা দরকার।
ব্যাপারটা নিশ্চই রোমাঞ্চকর হবে। সিগারেট ধরানোর সময় ক্ষীণ হাসল বেন, ফুঁ দিয়ে দেয়াশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি নিভিয়ে দিল। অভিজ্ঞতাটা অনুমান করতে পারছে, সন্দেহ নেই বুনো একটা ঘোড়াকে পোষ মানানোর মতই যুগপৎ কঠিন এবং আনন্দদায়ক হবে ব্যাপারটা।
০৯. অস্বাভাবিক নীরব
অস্বাভাবিক নীরব হয়ে আছে ডাবল-বি র্যাঞ্চ হাউস, প্রায় ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। একটা বাতিও জ্বলছে না, কেবল দূরে বাঙ্ক-হাউসে ক্ষীণ আলো চোখে পড়ছে। বাতাসে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ রয়ে গেছে এখনও। রীজের ঢাল বেয়ে খোলা উপত্যকায়। নেমে এল বেন, প্রায় হাঁটার গতিতে এগোচ্ছে সোরেল।
করালে এসে স্যাডল ছাড়ল ও, ঘোড়ার যত্ন নিয়ে পোর্চে পা রাখল। এখনও নীরব হয়ে আছে পুরো বাড়ি, সামান্য টু শব্দও হচ্ছে না। শূন্য কোন বসতিতে যেন পা রেখেছে, তাই মনে হলো বেনের, অথচ সিরেনোর চৌহদ্দিতে একসময় এটাই ছিল সবচেয়ে ব্যস্ত, কোলাহলমুখর র্যাঞ্চ।
অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়েছে ডাবল-বির-ঘরে এবং বাইরে। বিয়ের সময় বাপের জমানো টাকার শ্রাদ্ধ করেছে বিল ব্রেনেল, কিন্তু সোনাফলা জমিটা রয়ে। গেছে এখনও, থাকবে আজীবন। লেযি-এনকে বাদ দিলে এরচেয়ে ভাল জমি আর নেই:শত মাইলের মধ্যে। বুড়ো কার্ল ব্রেনেল শুয়ে আছে এই মাটিতে, তার আত্মা হয়তো হা-পিত্যেশ করছে। অদ্ভুত এক উইল করে গেছে মানুষটা। আর কারও জন্যে না হোক, অন্তত বেনের জন্যে একটা দায় রেখে গেছে।
আকারে বড় হলেও একদিনে বা অনায়াসে ডাবল-বির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখানে, সেজন্যে বহু ঘাম ঝরাতে হয়েছে কার্ল ব্রেনেলকে, এবং টম নোলানের মত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকায় কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল। ক্যাটলম্যান হিসেবে নিজের দক্ষতা দেখিয়েছে ডাবল-বি বস্, কিন্তু যোগ্য উত্তরসূরী রেখে যেতে পারেনি। পালক-পুত্র বেসিন-ছাড়া হয়েছে, বড় ছেলে পুরোমাত্রায় অ্যালকোহলিক; ছোট ছেলে কার্যত নিজেকে গানশ্লিংগার ভাবছে, খ্যাতির নেশায় পেয়ে বসেছে ওকে, সামান্য কারণে গুলি ছুঁড়তেও দ্বিধা করছে না। বাকি থাকছে কেবল মিরিয়াম। সন্তানদের মধ্যে শুধু এই মেয়েটির মধ্যেই বাপের রক্ত আর প্রাণপ্রবাহ সঞ্চারিত হয়েছে।
খুনীর পরিচয় প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত কিংবা বিচার না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চয়ই কার্ল ব্রেনেলের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়াবে এই র্যাঞ্চ হাউসের আশপাশে। অস্বীকার করার উপায় নেই বেনের জন্যে একটা দায় রেখে গেছে মানুষটা। আসল কাজ এটাই-কার্ল ব্রেনেলের খুনীকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্তর থেকে জানে বেন, কাজটা শেষ করার আগে বেসিন ছেড়ে যেতে পারবে না।
তথাকথিত গাট-হক আইন ওর ওপর ফলাতে চেয়েছিল কেউ, দুটো নেকড়েকে লেলিয়ে দিয়েছে পেছনে। নির্দেশ ছিল: সুযোগ পেলেই বেন স্লেজেলের। লাশ ফেলে দাও। নীল আকাশের নিচে পড়ে আছে একজন, অন্যজনকে চরম লজ্জা বরণ করতে হয়েছে, এরচেয়ে বেশি লজ্জা পেতে পারে না কোন লোক। নগ্ন এবং অসহায় অবস্থায় কারাঞ্চোকে পাঠিয়ে অলিখিত একটা বার্তা পাঠিয়েছে। বেন-উদ্দেশ্য টম নোলান, কিংবা যে-ই লোকগুলোকে পাঠিয়ে থাকে–সহজে নিজের লক্ষ্য থেকে টলানো যাবে না ওকে। তবে বেন এও জানে, আজকের দিনটায় সত্যিই ভাগ্য পক্ষে ছিল ওর।
সব দিন এমন যাবে না, যেতে পারে না।
রিও ফ্রিয়ের অধিকার এখনও চায় টম নোলান, নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে নিজেই স্বীকার করেছে সে। বেনকে বেসিন-ছাড়া করার জন্যে লোভনীয় অফারও দিয়েছে। বেন যদি চলে না যায়, নিঃসন্দেহে যে কোন দুঃখজনক পরিণতির জন্যে তৈরি থাকতে হবে।
একের পর এক হুমকি এসেছে। কিন্তু খুব একটা পরোয়া করেনি বেন, এখনও নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। নিজের সাহস; দক্ষতা আর পিস্তলের ওপর নির্ভর করছে। অ্যারিজোনার সবচেয়ে বিপজ্জনক করিডার দুর্ধর্ষ কিছু লোকের মোকাবিলা করতে হবে, অবচেতন মন বলছে ওকে, আর তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে এমন লোক যে নিজেই জীবন্ত এক কিংবদন্তী।
রান্নাঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল বেন। গোরস্থানের মতই নীরব ও ঠাণ্ডা হয়ে আছে ঘরটা। করিডর ধরে লিভিংরুমের দিকে এগোল ও, আগুন জ্বালাবে। এক হিসেবে বাড়িটা খালি থাকায় কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করছে। চায় না অ্যাগনেসের সঙ্গে কথা বলার সময় কেউ অযথা ঝামেলা করুক।
বিশাল ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালাল ও। বিলের কেবিনেট থেকে রাই হুইস্কির বোতল নামিয়ে গ্লাসে ঢালল, তারপর দুটো চুমুক দিয়ে সিগারেট রোল করল। ফায়ারপ্লেসের সামনের চেয়ারে এসে বসল ও। মোজা পরা পা মেলে দিয়েছে আগুনের দিকে।
কোথায় গেছে বিল? মিরিয়াম নিশ্চই চলে যায়নি, ওর ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করার স্থা। জেফরির ব্যাপারে কেবল মিরিয়ামই উদ্বিগ্ন, অন্যরা বোধহয় খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে তরুণকে। সত্যিই কি এতটা বিতৃষ্ণা অর্জন করার মত বখে গেছে জেফরি? বেনের অন্তত বিশ্বাস হয় না।
জ্যাক হারলোর কথাগুলো উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। সত্যিই কি অন্যদের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বেন? কারাঞ্চো আর হারলোকে কে লেলিয়ে দিয়েছে ওর পেছনে? টম নোলান, নাকি স্টিভ হারকার? অ্যাগনেসের কথা বলল কেন। হারলো?
রিও ফ্রিয়োতে আসার পর থেকে উদ্ভট কিছু সমস্যায় পড়েছে ও। অনেক ঘটনারই ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি, প্রায় দুর্বোধ্য এবং অস্পষ্ট মনে হয়েছে। অথচ জানে এসবের তাৎপর্য জানা জরুরী, অন্তত ওর জন্যে, হয়তো ডাবল-বির জন্যেও।
অথচ ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু ভেবে দেখার সুযোগ বা অবসর হয়নি এ পর্যন্ত।
অবচেতন মনে এক ধরনের তাড়া অনুভব করছে ও, স্যাডলে চেপে রিও ফ্রিয়ো ছাড়ার ইচ্ছে ক্রমে তীব্র হয়ে উঠছে–যে কোন দিকে ঘোড়া ছোটালেই হলো; এখানে থাকলে দুই বাথানের চিরশত্রুতার পরিণতি ওকেও টানতে হবে। পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠছে, ঘটনাগুলো জট পাকিয়ে গেছে, দ্রুত পরিণতির দিকে এগোচ্ছে এখন; যেমন আচমকা এসেছিল, তেমনি দ্রুত বেসিন ছাড়তে না পারলে গান পাউডার আর রক্তের তিক্ত স্বাদ নিতে হবে ওকে।
পোড়া কাঠের তিক্ত-মধুর গন্ধ ছাড়িয়েও ক্ষীণ, মিষ্টি একটা সুবাস পেল বেন; যেন পাহাড় থেকে বসন্তের বুনো ফুলের সুবাস টেনে নিয়ে এসেছে শীতল বাতাস। খানিকটা মাথা তুলে দেখল ও, তারপর সিধে হয়ে বসল চেয়ারে। অন্ধকার। কামরায় এখন আর একা নয় ও। পাঁচ ফুটের মধ্যে এসে দাড়িয়েছে অস্পষ্ট একটা মূর্তি।
হ্যালো, বেন! মৃদু স্বরে শুভেচ্ছা জানাল অ্যাগনেস ব্রেনেল।
উঠে দাঁড়াল বেন, হাতের গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখে মেয়েটির দিকে ফিরল। বাড়ি ফিরেছ কখন?
চাপা স্বরে হাসল অ্যাগনেস। সারাক্ষণ এখানেই ছিলাম আমি, বুড়ো খোকা!
অন্যরা কোথায়?
নিস্পৃহ ভঙ্গিতে শ্রাগ করল মেয়েটি। সিরেনোয় গেছে বিল, অল্প বিস্তর জুয়া খেলবে, কিন্তু গিলবে প্রচুর। ডাবল-বির পরিস্থিতি পছন্দ না হলে কিংবা সমস্যায় পড়লে ওখানেই চলে যায় সে। …তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই চলে গেছে মিরিয়াম, জানি না কোথায় গেছে। হয়তো জেফরিকে খুঁজতে বেরিয়েছে।
পাহাড়ে?
বাচ্চা মেয়ের মত মুখটা এক পাশে কাত করল অ্যাগনেস। কেন ভাবছ পাহাড়ে গেছে ও?
অদ্ভুত একটা চিন্তা খেলে গেল বেনের মাথায়, কুৎসিত একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে মনে। অ্যাগনেস বোধহয় নোংরা একটা খেলা খেলছে; মেয়েটি টম নোলানের সন্তান, ব্যাপারটা কোন ভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
জেফরি কোথায়, অ্যাগি? তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইল ও।
জানি না।
জেফরি এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে কথা বলেছ তুমি, হয়তো ওকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছ।
হয়তো তাই করেছি, নির্বিকার মুখে বলল অ্যাগনেস, তবে কণ্ঠে আপসের সুর। আমি চাই না এখানে থাকুক ও। ওকে দেখলেই বিরক্ত হয় বিল।
মন্তব্যটার যথার্থতা মনে মনে যাচাই করল বেন: সম্ভব। জেফরির ঔদ্ধত্য যে কাউকে বিতৃষ্ণ করে তুলতে পারে, ও নিজেও সেদিন অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। বিলকে একটা সুযোগ দিচ্ছ না কেন তুমি? আন্তরিক স্বরে জানতে চাইল ও।
কিসের সুযোগ? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল অ্যাগনেস।
বিলের যোগ্য স্ত্রী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারো, ওর নেশা ছাড়ানোর চেষ্টা করবে, জেফরিকে ঘটাবে না।
সহাস্যে মাথা নাড়ল অ্যাগনেস। কথাটা তোমার কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছি বলে সত্যিই হাস্যকর লাগছে, বেন। এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় আমাকে ভালবাসতে তুমি, আমার ধারণা, এখনও ভালবাস। ওই মাতাল গর্দভটাকে যদি আমি বোকা বানাই তাতে কি যায়-আসে তোমার?
মাতাল গর্দভ? স্বামীকে এভাবে উপহাস করে কোন মেয়ে? এটাও সম্ভব, কারণ অ্যাগনেস টম নোলানের মেয়ে। সীমাহীন ঔদ্ধত্য আর অহংকার মেয়েটিকে প্রায় অন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া বিলের স্বভাব অনেকটাই বদলে গেছে, অন্যদের করুণা আর বিরক্তিই কেবল আশা করতে পারে সে। মানুষটা যতই বদলে যাক, কিংবা খারাপ হোক, স্ত্রীর কাছে এতটা গুরুত্বহীন হওয়ার মত খারাপ হয়নি নিশ্চয়ই?।
ফায়ারপ্লেসের পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল বেন, নিবিষ্ট মনে সিগারেট রোল করছে। ঘুরে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল অ্যাগনেস। কাঠের ছোট্ট একটা বাক্স টেবিলের ওপর রাখা, ঢাকনা খুলে আগেই রোল করে রাখা দুটো সিগারেট বের করল মেয়েটি। দুটোই নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে জ্বালাল, তারপর একটা বেনের ঠোঁটে ঝুলিয়ে দিল। এর আগে কখনও অ্যাগনেসকে ধূমপান করতে দেখেনি বেন, কিন্তু মেয়েটির ভাবভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারল ব্যাপারটা ওর কাছে নতুন কিছু নয়, এবং সম্ভবত উপভোগও করছে।
বিলকে কেন বিয়ে করেছ? মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল বেন।
তুমি তো চলেই গেলে•••এছাড়া আর কি করার ছিল আমার।
বাজে কথা! স্পষ্ট ভাবে আমার সম্পর্কে নিজের আবেগ কখনও প্রকাশ করোনি তুমি, অথচ অসংখ্য সুযোগ পেয়েছ।
খোদা! ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে সশব্দে শ্বাস টানল অ্যাগনেস। লোকটার কথা শোনো!
একটা ট্রাউটের মত আমার সঙ্গে খেলেছ তুমি, তোমার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে এমন যে কোন লোকের সঙ্গে যেমন খেলেছ।
সামনের দিকে ঝুঁকে এল মেয়েটি, সরু চোখে নিরীখ করছে বেনকে। আসলে কি বলতে চাইছ তুমি?
সিগারেটটা ফায়ারপ্লেসে ছুঁড়ে ফেলল বেন। লিপস্টিক লাগার কারণে স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে, ব্যাপারটা প্রায় অসুস্থ করে তুলল ওকে; তলে তলে স্বয়ং অ্যাগনেস ব্রেনেলওঁ যেন অসুস্থ করে তুলছে ওকে!
খানিকটা কাছে সরে এল মেয়েটা। কিছু একটা ত্যক্ত করছে তোমাকে, বেন, কি সেটা?
অনেক কিছু। কার্ল ব্রেনেলের খুন, ডাবল-বির দুরবস্থ…।
এবং আমি?
কিছুটা।
আরও কাছে সরে এল অ্যাগনেস। ভরাট কোমল শরীরের চাপ অনুভব করছে বেন, মিষ্টি একটা সুবাস দোলা দিচ্ছে নাকে, সুস্থির ভাবে চিন্তা করা কঠিন হয়ে উঠল।
কি বলতে চাও, বেন? তাচ্ছিল্যের হাসি অ্যাগনেসের ঠোঁটে, বুঝতে পারছে নিজস্ব আবেদন দিয়ে প্রায় অস্থির করে তুলেছে বেনকে।
অ্যাগনেসের কাঁধ চেপে ধরল বেন। দেখল মুখ তুলে দিয়েছে মেয়েটি, ভাবছে ওকে চুমো খাবে বেন। দৃষ্টি নামিয়ে নোলান-কন্যাকে দেখল ও। সত্যিই সুন্দর মেয়েটা, কিন্তু একইসঙ্গে বিকর্ষী কি যেন আছে ওর চরিত্রে। যেখানেই যায় ঘৃণা আর ধ্বংস ছড়িয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। রাতের পর যেমন দিন আসে, তেমনি ঘৃণার পরপরই সংঘাত আর রক্তপাত হচ্ছে।
কোমল কাঁধে চেপে বসল বেনের আঙুলগুলো। দেখল আয়ত দুই চোখ মেলে তাকিয়ে আছে অ্যাগনেস, সুন্দর মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠছে। বেন, ব্যথা দিচ্ছ আমাকে?
শিথিল হলো না হাত দুটো, বরং আরও চাপ দিল বেন। অনুভব করল ওর হাতের মুঠোয় আড়ষ্ট হয়ে গেছে অ্যাগনেসের দেহ।
বেন! চড়া গলায় প্রতিবাদ করল অ্যাগনেস।
এবার মন খুলে কিছু আলাপ করব আমরা, অ্যাগি, নিরুত্তাপ স্বরে বলল ও। আমার ধারণা জেফরি কোথায় গেছে সেটা জানো তুমি।
ছাড়া আমাকে…গোল্লায় যাও তুমি!
জেফকে তুমি বুঝিয়েছ যে খুনটা ও-ই করেছে, স্রেফ দুর্ঘটনার কারণে মারা যায়নি টেকোস; অথচ তুমি ভাল করেই জানো যে নিতান্ত দুর্ভাগ্যের কারণে মারা গেছে কুক। আসলে তুমি চেয়েছ জেফ যাতে এখানে না থাকে। কেন, অ্যাগি?
ততক্ষণে ধৈর্য হারিয়েছে অ্যাগনেস ব্রেনেল, নীল চোখে ক্রোধ আর জেদ ফুটে উঠছে। সজোরে লাথি হাঁকাল মেয়েটা। আমার হাতে যদি একটা পিস্তল থাকত, খোদার কসম, এতক্ষণে তোমার মাথা উড়িয়ে দিতাম!
অ্যাগনেসকে ছেড়ে দিয়ে ফের দেয়ালে হেলান দিল বেন। বিশ্বাস করছি, স্মিত হেসে বলল ও, মেয়েটির চোখে চোখ রেখেছে। পিস্তল বা রাইফেলে ছেলেদের মত দক্ষ তুমি, তাই না? টম নোলানও খুশি মনে সেটা অনুমোদন করেছে। শুনেছি প্রায়ই লেযি-এন ভ্যাকুয়েরোদের চ্যালেঞ্জ করতে তুমিএবং প্রতিবার তাদের হারিয়ে দিয়েছ। হয়তো বসের মেয়েকে অখুশি করতে চায়নি ওরা, তাই ইচ্ছে করে তোমার সঙ্গে ড্র-য়ে হারত।
প্রবল অসন্তোষের সঙ্গে মাথা নাড়ল অ্যাগনেস, সুন্দর মুখে উড়ে এসে পড়ল সোনালী চুলের রাশি। উই, কারও বদান্যতা দরকার ছিল না আমার। কাউহ্যান্ডদের প্রায় প্রত্যেককে ড্র কিংবা শূটিং-এ হারানোর সামর্থ্য ছিল আমার।
মানলাম, সরাসরি অ্যাগনেসের চোখের দিকে তাকাল বেন। এবার আমার প্রশ্নের জবাব দাও, অ্যাগি।
গোল্লায় যাও তুমি! আমার নাম অ্যাগনেস!
হ্যাঁ, তিক্ত স্বরে স্বীকার করল ও। অ্যাগনেস ব্রেনেল।
ঝুঁকে এল বেন। মিষ্টি ঘ্রাণ আর ভরাট শরীরের অমোঘ আকর্ষণ প্রায় আচ্ছন্ন। করে ফেলছে ওর অনুভূতিকে, বেপরোয়া হয়ে যেতে চাইছে মন; কিন্তু নিজেকে সামলে নিল। সুন্দর এই নারীটির মধ্যে অস্বাভাবিক, অশুভ যে শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করেছে, সেটাই সাহায্য করল ওকে।
বলো আমাকে, অ্যাগি! এক হাতে মেয়েটির বাহু চেপে ধরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে তাগাদা দিল বেন। জেফরি নিজেকে খুনী ভাবছে, নিশ্চয়ই ধারণাটা ওর মাথায়। ঢুকিয়ে দিয়েছ তুমি? সেটা কি উচিত হয়েছে? কোন কারণ ছাড়াই ফেরারী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও, লড়াই ছাড়া ওকে ধরতে পারবে না এডলে ভার্ন, এবং সিক্সগানে জেফরির দক্ষতা অসাধারণ, বেসিনের যে কোন লোকের চেয়ে ভাল। ওকে ধরতে গেলে গুলি করবে জেফরি, এবং খুন করার জন্যেই করবে। আমি যদি ওকে খুঁজে পাই, হয়তো বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফিরে আসতে রাজি করাতে পারব।
উচ্চস্বরে হেসে উঠল অ্যাগনেস, বেনের অসহায়ত্বে মজা পাচেছ।
সজোরে চড় মারল বেন। ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি পরিণতিতে বুনো বেড়ালীর মত খেপে উঠবে অ্যাগনেস। ওর হাতটা চেপে ধরেই কামড় বসিয়ে দিয়েছে মেয়েটা, খামচে ধরল বেনের শার্ট, তারপর টান দিতে হুড়মুড় করে কার্পেটের ওপর পড়ে গেল দুজনেই। অ্যাগনেসের ওপর পড়ল বেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে খুলে গেল দরজাটা। শীতল বাতাসের ঝাঁপটায় উজ্জ্বল হয়ে, গেল ফায়ারপ্লেসের ম্লান আলো। চোখ তুলে দরজায় থমকে দাঁড়ানো বিহ্বল মিরিয়াম ব্রেনেলকে দেখতে পেল বেন।
অ্যাগনেসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ও, খানিকটা হলেও বিব্ৰত বোধ করছে। উঠে দাঁড়িয়ে মিরিয়ামকে নিরীখ করল, চোখের চাহনিই বলে দিচ্ছে প্রিয় এবং আদর্শ একজন মানুষের স্থলন দেখার তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। মেয়েটি।
হাঁচড়ে-পাচড়ে উঠে দাঁড়াল অ্যাগনেস। রাগে কুৎসিত দেখাচ্ছে সুন্দর মুখটা। মিরিয়ামের দিকে ফিরল, সমর্থন আর অনুমোদনের চাহনি ফুটে উঠেছে চোখে। ও-ই যত নষ্টের গোড়া! দ্রুত বলল মেয়েটা। আমাকে একা পেয়ে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ও চলে যাওয়ার পর বিলকে বিয়ে করেছি বলে আমার ওপর খেপে আছে। দেখো ওকে, মিরিয়াম, ওর মুখে পাপের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আমি নই, মিরিয়াম! ও-ই আমাকে জোর করছিল!
নিস্পৃহ ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল, মিরিয়াম, হ্যাটটা টেবিলের ওপর রেখে। আনমনে মাথা ঝাঁকাল। মনে হচ্ছে খুব বেশি প্রতিবাদ করছ তুমি।
খেপে গিয়ে মিরিয়ামের দিকে এগোল অ্যাগনেস। কি বলতে চাও তুমি? শান্ত, মৃদু স্বরে জানতে চাইলেও শীতল সুরটা চাপা থাকল না।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল মিরিয়াম। আমি বরং এ ব্যাপারে মুখ বুজে থাকব, অ্যাগনেস। সত্যিটা যদি প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ে কখনও, মনে হয় না এ ব্যাপারে খুব একটা সাহায্য করতে পারবে বেন।
তোমার অনুগ্রহ বা কটাক্ষ কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না আমার, মিরিয়াম!
তুমি আসার পর শুধু ঝামেলাই বেধেছে এখানে, অ্যাগনেস, এবং মনে হচ্ছে তোমার খায়েশ না মেটা পর্যন্ত আরও ঝামেলা পোহাতে হবে আমাদের।
দু’পা এগিয়ে সজোরে চড় কষল অ্যাগনেস। মিরিয়ামের গালে লাগল চড়টা, আঘাতের চোটে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল ও। কর্কশ হেসে আবারও বাম হাতে চড় মারতে উদ্যত হলো অ্যাগনেস। কিন্তু সরে গেল মিরিয়াম, ঠোঁটের কোণে রক্ত দেখা যাচ্ছে, টেবিল আঁকড়ে ধরে কোন রকমে সামলে নিয়েছে। ঠিক তখনই ওকে লাথি হাঁকাল অ্যাগনেস।
অ্যাগনেসের একটা বাহু চেপে ধরে মেয়েটিকে নিজের দিকে ফেরাল বেন। রাগ আর প্রতিহিংসায় জ্বলছে মেয়েটার চোখ, ভস্ম করে দেবে যেন সবকিছু।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল মিরিয়াম। বেন, হাতের তালু দিয়ে ঠোঁট থেকে রক্ত মুছল মেয়েটা, শীতল নিস্পৃহ স্বরে বলল: ছেড়ে দাও ওকে। কোন একদিন হয়তো উচিত শিক্ষা হত ওর, কিন্তু আজকের দিনটাই উপযুক্ত সময়, তাছাড়া ও ও এটাই চাইছে।
সত্যি সত্যিই অ্যাগনেসকে ছেড়ে দিল বেন, তারপর স্রেফ দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। দেখল মিরিয়ামের দিকে ছুটে যাচ্ছে অ্যাগনেস, এক পা পিছু হটল মিরিয়াম, একটা হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে, বাড়িয়ে দিয়েছে সামনে। অ্যাগনেস পৌঁছে যেতে সজোরে হাঁকাল মুঠি, টলে উঠল নোলান-কন্যা। কিন্তু ওকে সামলে নেয়ার সুযোগ দিল না মিরিয়াম, ডান হাতে জোরাল ঘুসি বসিয়ে দিল অ্যাগনেসের চিবুকে। টলমল পায়ে দরজার দিকে ছুটে গেল মেয়েটি।
এবার নিজেই এগিয়ে গেল মিরিয়াম। জায়গা বেছে বেছে মারছে। একসময় মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল অ্যাগনেস, নাক-মুখ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।
স্মিত হাসল মিরিয়াম। তিন ভাইয়ের সঙ্গে শুধু শুধুই বড় হইনি আমি! ঘুরে বেনের দিকে ফিরল মেয়েটা, ক্ষীণ হাসল।
উঠে দাঁড়িয়েছে অ্যাগনেস, কোত্থেকে ভারী একটা বই তুলে নিয়েছে। ছুটে এসে মিরিয়ামের কাঁধে আঘাত করল। ব্যথায় কুঁচকে গেল মিরিয়ামের মুখ। সুযোগটা নিল অ্যাগনেস, বুনো আক্রোশে একের পর আঘাত করছে মিরিয়ামকে।
কিন্তু ব্রেনেলদের রক্ত বোধহয় এত সহজে পরাজয় বরণ করার নয়। পাল্টা আঘাত করল মিরিয়াম। ঠেলে অ্যাগনেসকে সরিয়ে দিল ও, তারপর চুল চেপে ধরল।
এবার আর দর্শক হয়ে থাকা হলো না বেনের, লড়াইটার সমাপ্তি টানতে বাধ্য হলো। দু’জনকে আলাদা করতে গিয়ে খামচি, চড় বা ঘুসি হজম করতে হলো। ওকে। অ্যাগনেসকে হলঘরের দরজার দিকে ঠেলে সরিয়ে দিল, ঘরের এক কোণে সরে যেতে বাধ্য করেছে মিরিয়ামকে।
আচমকা নীরব হয়ে গেল কামরাটা, মেয়ের্দের দ্রুত লয়ের শ্বাস-প্রশ্বাস আর। ফায়ারপ্লেসে কাঠ-ফাটার মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু।
হাত চালিয়ে মুখের রক্ত মুছল অ্যাগনেস, বিক্ষত মুখে ঘৃণা আর বিদ্বেষ উপচে পড়ছে। চলে যাচ্ছি আমি। যথেষ্ট হয়েছে এখানে, এই গর্তের মধ্যে বাস করা সত্যিই কঠিন! বোকা আর অসভ্য কিছু মানুষের সঙ্গে কোন মতেই থাকতে পারব না আমি!
যাত্রা শুভ হোক তোমার, বিদ্রুপের স্বরে বলল মিরিয়াম। আশা করছি যে। জঞ্জাল ফেলে যাচ্ছ সেসব পরিষ্কার করতে পারব আমরা।
কিছুই করতে পারবে না তোমরা, বরং র্যাঞ্চটাই হারাবে! সবকিছু উচ্ছন্নে। যাবে তোমাদের! সবকিছু, বুঝেছ? আমি দেখব এক কাপড়ে যাতে তোমাকে রিও। ফ্রিয়ো ছেড়ে চলে যেতে হয়, মিরিয়াম! বলেই আর দাড়াল না নোলান-কন্যা, ছুটে বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে যাওয়ার সময় সপাটে বন্ধ করে দিল দরজা।
আনমনে থুতনি ঘষছে বেন। মার তো তুমিও কম খাওনি দেখছি, স্মিত হেসে বলল ও, খানিকটা হলেও সমীহ ফুটল স্বরে। ক্ষতগুলোর পরিচর্যা করো। আমি দেখছি, অ্যাগনেসের জন্যে একটা ঘোড়ায় স্যাডল সাজিয়ে দেই।
তুমি কি সত্যিই মনে করো, চলে যাচ্ছে ও?
নড করল ও। কিন্তু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মাথায় কেন এখানে এসেছে ও, অথচ বিল কখনোই পাত্তা পায়নি ওর কাছে!
বেরিয়ে এসে অ্যাগনেসের ডান-মেয়ারে স্যাডল চাপাল বেন। একটু পর দেখল হনহন করে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অ্যাগনেস। জেদে দৃঢ় হয়ে গেছে। চোয়াল দুটো, বুক টানটান করে হাঁটছে। দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে এল, কোন দিকে তাকাচ্ছে না। স্যাডলে চেপে দৃষ্টি নামিয়ে বেনের দিকে তাকাল। আমার জিনিসপত্র নেওয়ার জন্যে পরে কাউকে পাঠিয়ে দেব, শীতল স্বরে বলল মেয়েটি।
লেযি-এন পর্যন্ত এগিয়ে দেব তোমাকে
কেন? তুমি কি মনে করো টম নোলানের মেয়েকে বিরক্ত করার সাহস হবে কারও?
না।
চলে যাওয়ার জন্যে তাড়া দেখা যাচ্ছে না অ্যাগনেসের মধ্যে। একটা সিগারেট রোল করে দাও আমাকে, বেন।
দুটো রোল করল বেন, জ্বালিয়ে একটা ধরিয়ে দিল অ্যাগনেসের হাতে। পাফ করল মেয়েটা, মুখে খানিকটা হলেও সন্তুষ্টি দেখা যাচ্ছে এখন, কোমল হয়ে এসেছে চাহনি। এখান থেকে চলে যাচ্ছ না কেন, বেন? কি আশায় পড়ে আছ? তুমি কি বুঝতে পারছ না আসলে ডাবল-বির কোন চান্সই নেই?
এখনই যেতে পারছি না আমি।
কর্কশ স্বরে হাসল অ্যাগনেস। বিলের কাছ থেকে ওই টাকা কখনোই পাবে তুমি। দশ হাজার দূরে থাক, এক হাজার দেয়ার সামর্থ্যও নেই ওর।
অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি, অ্যাগি।
র্যাঞ্চ পরিচালনা করার কথা ভাবছ? সন্দিহান সুরে জানতে চাইল মেয়েটি। খানিকটা নিচু হয়ে এল, আবছা অন্ধকারেও বিক্ষত মুখে কালসিটে দাগগুলো স্পষ্ট দেখতে পেল বেন। এখানে থেকে নায়ক হওয়ার চেষ্টা কোরো না, বেন। ব্রেনেলরা শেষ হয়ে গেছে। এই জায়গার কানাকড়িও মূল্য নেই। শিগগিরই পুরো রিও ফ্রিয়োর দখল পেয়ে যাবে বাবা।
ঠিক টম নোলানের মতই কথা বলছ তুমি, অ্যাগি।
ক্ষীণ হাসল মেয়েটা। আমি তো ওরই মেয়ে, তাই না? একটা কথা কি জানো, কেন, আজীবন কিন্তু বেঁচে থাকবে না সে। লেযি-এনের দায়িত্ব তখন অন্য কেউ নেবে।
আমার পরামর্শ শোনো, বেন। সুযোগ পেলেই বেসিন ছেড়ে চলে যাও, নয়তো বাবার রোষের শিকার হতে হবে তোমাকে। বাবা তোমাকে পছন্দ করে না, কিন্তু লড়াকু মানুষ হিসেবে ঠিকই সমীহ করে। তুমি থাকলে হয়তো সামলে নিতে পারবে ডাবল-বি, কিন্তু নিজে কি পাবে ভেবে দেখেছ? দেনার দায়ে প্রায় শেষ হয়ে। যেতে বসেছে র্যাঞ্চটা, এটার জন্যে লড়াই করে কি হবে? অথচ এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকার যোগ্য তুমি…এমন একজন মানুষ টম নোলানের অনুপস্থিতিতে যে দক্ষ হাতে লেযি-এন সামলাতে পারবে।
মানে!? ফের হাসল অ্যাগনেস, রহস্যময় চাহনি চোখের গভীরে। নিজেই বুঝে নাও। তোমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কোন বিদ্বেষ রা ক্ষোভ নেই আমার, বেন। আলতো স্পার দাবাল অ্যাগনেস, মৃদু ঝুনঝুন শব্দ তুলল শারগুলো। একবারও ফিরে না তাকিয়ে ঢাল ধরে ঘোড়া ছোটাল মেয়েটা।
১০. মিরিয়াম আর নিজের জন্যে নাস্তা
মিরিয়াম আর নিজের জন্যে নাস্তা তৈরি করল বেন। ভোর হওয়ার খানিক আগে পুরো মাতাল অবস্থায় র্যাঞ্চে ফিরেছে বিল। নিজের বেডরূমে অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে, বিকেলের আগে ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা নেই।
প্রায়ই আনমনা হয়ে যাচ্ছে বেন। চুলোয় কফির পানি চড়িয়েছে, এখানে আসার পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং সুদূর অতীত বারবার তাড়া করছে ওকে। ওপাশের দেয়ালের লাগোয়া ডাইনিং টেবিলে বসে আছে মিরিয়াম, উৎসুক দৃষ্টিতে ওর কাজ দেখছে মেয়েটা। মাঝে মধ্যেই শান্ত, স্বল্পভাষী মিরিয়ামের দিকে চলে যাচ্ছে বেনের দৃষ্টি। এখন বোধহয় মেয়ে বলা উচিত হবে না ওকে, মহিলা বলা উচিত, ভাবল বেন। রক্তের সম্পর্ক নেই ওদের, কিন্তু ভাই-বোনের মত বড় হয়েছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে ওকেই বেশি পছন্দ করত মেয়েটা, মনে পড়ল বেনের, ছোট থেকে প্রায় ছায়ার মত লেগে থাকত ওর সঙ্গে।
ভাবছি জেগে ওঠার পর বিল যখন দেখবে অ্যাগনেস চলে গেছে কি প্রতিক্রিয়া হবে ওর, মৃদু স্বরে নীরবতা ভাঙল মিরিয়াম।
শ্রাগ করল বেন। হয়তো এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত ওর। কি মনে হয় তোমার, মিরিয়াম, সত্যিই কি বিলকে ভালবাসত অ্যাগনেস?
নিজেকে ছাড়া কখনও কাউকে ভালবাসেনি ও, এমনকি বাপকেও নয়। তবে টম নোলানকে বোধহয় সমীহ করে। আসলে নিজের ইচ্ছেমত যাকে চালানো সম্ভব নয়, তাকেই সমীহ করে অ্যাগনেস।
যেমন তোমাকে?
ক্ষীণ হাসল মেয়েটি। আমার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম। তুমি বোধহয় ওকে সামলে রাখতে সক্ষম, বেন।
বাতিলের ভঙ্গিতে একটা হাত নাড়ল বেন। কিন্তু বেসিন ছাড়ার আগে আমাকে ইচ্ছেমত নাচিয়ে ছেড়েছে ও।
কফির মগের কিনারার ওপর দিয়ে ওকে নিরীখ করছে মিরিয়াম। মনে হচ্ছে শেষপর্যন্ত ওর ভেতরটা ঠিকই দেখতে পেয়েছ তুমি।
ছয় বছর আগে যেমন দেখেছি, অ্যাগনেস যে আগের মত নেই সেটা বোঝার মত যথেষ্ট দেখতে পেয়েছি। অনেক বদলে গেছে ও।
উঁহু, বরাবরই এরকম ছিল ও•••ওর আগের রূপটা সম্পর্কে জানতে না তুমি, যা এখন জানো। ও সত্যিই বিপজ্জনক, তাই না?
নোলানদের রক্ত ওর শরীরে, সংক্ষেপে মন্তব্য করল বেন, ফের মগে কফি ভরে ফিরে এসে টেবিলে বসল। বিলকে কবে বিয়ে করেছে ও?
তুমি চলে যাওয়ার আগে বোধহয় শুধু তোমাকে নিয়ে ভাবত অ্যাগনেস। কিন্তু…তুমি চলে যাওয়ার পর, কিছু দিন কয়েকজনের সঙ্গে মেলামেশা করল। মন্ট্যানার স্কুলে পড়ার সময়ও কিছু-গুজব রটেছে ওর নামে, বাধ্য হয়ে ওকে ফিরিয়ে আনে টম নোলান। কিন্তু বেসিনের স্বার্থে বোধহয় ওকে সেখানেই রেখে আসা উচিত ছিল মি. নোলানের। কথাটার তাৎপর্য অনুধাবন করে নিজেই হেসে উঠল মিরিয়াম।
কিন্তু বিলকে বিয়ে করল কেন?
বাবা যতদিন বেঁচে ছিল, ডাবল-বির কারও পক্ষে কোন নোলানকে বিয়ে করা কোন দিনই সম্ভব ছিল না। বাবাকে তো চিনতে তুমি।
জানি, শুকনো স্বরে বলল বেন। অ্যাগির প্রতি আমার আগ্রহ দেখে বাবা কয়েকবারই কথাটা বলেছে আমাকে।
বাবার কারণেই ব্যাপারটা ঘটেনি, বিলকে পাত্তা দেয়নি অ্যাগনেস। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর, হঠাৎ করেই যেন রিও ফ্রিয়ের ব্যালে আচমকা আগ্রহী হয়ে উঠল বিলের প্রতি। বিল তো আনন্দে আত্মহারা, ঠিক তখনই সিরেনোর ওই ফাইট সম্পর্কে বড়াই করা শুরু করল ও, দাবি করল তুমি নও, বরং সে-ই ফ্রেড মোরিসের চ্যালেঞ্জ উতরে গিয়েছিল।
থেমে বেনের দিকে তাকাল মিরিয়াম। বাবার মৃত্যুর পর বিলের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে অ্যাগনেস, ঘন ঘন ডাবল-বিতে আসত, তিক্ত হাসি ফুটল মেয়েটার ঠোঁটের কোণে। এখানকার কোন্ জিনিসটা আগের মত আছে? সবকিছু বদলে ফেলেছে ও। টাকার বিনিময়ে ঝামেলা এনেছে। বিল আর জেফরির মধ্যে। বিরোধ হলো ওর কারণে, আমার আর বিলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলো। টেকোস ফারমিনকে অন্দর মহল থেকে বের করে দিল, দায়িত্ব দিল পাঞ্চারদের রান্নার; নিজের জন্যে সান্তা ফে থেকে কুক নিয়ে এল। বিল মদের প্রতি আগ্রহী হওয়ার পর থেকে বাথানের ভরাডুবি শুরু হলো। সত্যটা তুমিও বুঝতে পারছ এখন, বেন, শিগগিরই হয়তো চূড়ান্ত ভরাডুবি হবে আমাদের।
জমিটা এখনও আছে, একগুয়ে স্বরে বলল বেন।
মর্টগেজ সহ, যার দেনা কখনোই শোধ করতে পারব না আমরা।
কি বললে?
নড করল মিরিয়াম। র্যাঞ্চ বন্ধক রেখে প্রচুর টাকা ধার করেছে বিল। কিছু দিনের মধ্যে প্রথম কিস্তি শোধ করার কথা। কিন্তু অত টাকা আমাদের হাতে নেই, বেন, জোগাড় হওয়ার কোন সম্ভাবনাও নেই।
সময়টা কি বাড়ানো যায় না?
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মিরিয়াম, জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অন্য কেউ হলে হয়তো সেটা সম্ভব হত।
কিন্তু কোথাও নিশ্চয়ই কেউ একজন আছে যে তোমাদের সাহায্য করতে পারে।
মাথা নাড়ল মেয়েটি। না, কেউ সাহায্য করবে না আমাদের। বন্ধক থেকে বাথানটা ছাড়ানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত হব আমরা।
কথা বলতে তো দোষ নেই, চিন্তিত স্বরে বলল বেন, টেবিল ছেড়ে মিরিয়ামের পাশে এসে দাঁড়াল। কার কাছে বন্ধক রেখেছে বাথান?
ধীরে ধীরে ঘুরে দাড়াল মেয়েটা। টম নোলানের কাছে।
খোদা! আর লোক পেল না বিল? সেই ছোট থেকেই জানি আমি, এই জমিটা আজীবন চেয়ে এসেছে টম নোলান।
হ্যাঁ। বাবা বেঁচে থাকতে ডাবল-বিতে থাবা বসাতে পারেনি সে, কখনও পারতও না। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর ডাবল-বির দুরবস্থার শুরু, টম নোলানের মেয়ে সেটাকে ত্বরান্বিত করল। আমি বিশ্বাস করি স্রেফ আমাদের সর্বনাশ করার জন্যেই বিলকে বিয়ে করেছে অ্যাগনেস, শেষে বাপের হাতে তুলে। দেবে ডাবল-বি। মনে হচ্ছে সফল হয়েছে ও, বেন। গতরাতে ওর ওপর চড়াও না, হলে হয়তো রাজি করানো যেত ওকে, আমাদের হয়ে টম নোলানের সঙ্গে কথা বলে সময়টা বাড়ানো যেত।
হতাশায় মাথা নাড়ল বেন। নিশ্চিত ভরাডুবি হতে যাচ্ছে ডাবল-বির। ভাবাই যায় না মাত্র একজন মানুষের অনুপস্থিতিতে বদলে গেছে পুরো পরিস্থিতি-দেনার দায়ে ডুবতে বসেছে ডাবল-বি, তিন ভাই-বোনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। সবকিছুর জন্যে কি বিল ব্রেনেলের অযোগ্যতা আর খামখেয়ালীপনাই দায়ী, নাকি অ্যাগনেসেরও ভূমিকা আছে এসবে? মিরিয়াম হয়তো ঠিকই বলেছে, অ্যাগনেস নোলান সত্যিই বিপজ্জনক এবং ওর বিলাসী জীবনযাপনের ব্যয় বহন করতে গিয়ে কাঁধে ঋণের পাহাড় জমিয়েছে বিল ব্রেনেল।
জেফকে খুঁজে বের করতে হবে, মিরিয়ামের প্রসঙ্গ বদলে সংবিৎ ফিরে পেল বেন।
ভাবছি আবার বেরোব।
তোমার সঙ্গে যাব আমি।
না।
কেন, বেন? চ্যালেঞ্জ মেয়েটার চোখে।
মিরিয়ামের কাঁধ দুটো চেপে ধরল ও। কারণ বাইরে মৃত্যুর আশঙ্কা আছে, সংক্ষেপে আগের দিনের অভিজ্ঞতা জানাল বেন। হয়তো লেযি-এনের জমি পাড়ি দিতে হবে আবার, তুমি সঙ্গে থাকলে সহজে বেরিয়ে আসতে পারব না।
অজান্তে খানিকটা কেঁপে উঠল মিরিয়াম। ওই লোকটা, কারাঞ্চো…ওকে খুন করা উচিত ছিল তোমার, বেন। এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না বোধহয়, কিন্তু ওকে যা করেছ…আসলে নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেছ।
ফিরে আসার পর থেকেই মার খাচ্ছি আমি, মিরিয়াম। খুন করার জন্যে গুলি ছুঁড়ছে ওরা। পরিস্থিতি এমন হবে আশা করিনি, কিন্তু বিস্মিত বা বেচাল হইনি, কারণ এভাবেই নিজেকে গড়ে নিয়েছি আমি। …এবার যাও,তত, বিলকে জাগাও। ওর সঙ্গে কথা বলব।
বেরিয়ে গেল মেয়েটা।
লিভিংরূমে এসে কোল্ট আর উইনচেস্টার বের করে তেল দিয়ে, যত্ন নিল বেন। পাশের কামরায় মিরিয়াম আর বিলের কথোপকথন অস্পষ্ট ভাবে কানে আসছে। জড়ানো স্বরে প্রতিবাদ করছে বিল।
বেন! উত্তেজিত, চড়া স্বরে ওকে ডাকল মিরিয়াম।
বলো।
এক্ষুণি এদিকে এসো, প্লীজ!
হলঘর হয়ে দ্রুত এগোল ও, বিলের কামরায় ঢুকল। বিছানায় জবুথুবু হয়ে পড়ে আছে বিল ব্রেনেল। দরজার উল্টোদিকে বিশাল জানালার কাছে দাঁড়িয়ে। আছে,মিরিয়াম, দৃষ্টি রিও ফ্রিয়োর দিকে।
দেখো! উত্তেজনার ছোঁয়া মেয়েটার কণ্ঠে।
মিরিয়ামের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল বেন। ডাবল-বি র্যাঞ্চ হাউসের দিকে আসছে তিন ঘোড়সওয়ার। বলা উচিত, দু’জন পূর্ণ বয়স্ক লোক এবং এক তরুণ-জেফরি ব্রেনেল। স্টিভ হারকারের পাশাপাশি ঘোড়া ছোটাচ্ছে সে; পোশাক, আচরণ কিংবা সামর্থ্যের বিচারে যাকে নিজের আদর্শ মনে করে ছেলেটা। একজন খুনীর প্রতি সমীহ বোধ করছে সে, পরোক্ষ ভাবে আসলে খুনী হতে চাইছে, তিক্ত মনে ভাবল বেন।
তৃতীয়জন ডড কিনলে। লোকটার উপস্থিতি ঘোলাটে করে তুলেছে। পরিস্থিতি। একেবারে স্বল্পভাষী মানুষ, সারাক্ষণই নির্বিকার। মনে কি ভাবনা চলছে বোঝা কঠিন। কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে, গত ছয় বছরে বেন স্লেজেলের ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখে সে। জ্যাক হারলো তাকে স্টক ডিটেকটিভ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে বেনের।
শীতল একটা আঙুল যেন মেরুদণ্ডে স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে, টের পেল বেন। তিনজন কঠিন মানুষ। কিন্তু ওকে সাহায্য করার মত নেই কেউ। যে: ক’জন পাঞ্চার ছিল, প্রত্যেকেই বাইরে আছে এখন। কিন্তু এরা থাকলেও এমন কিছু যেত-আসত না, কারণ মানুষগুলো নিতান্তই নিরীহ। বেঁচে থাকতে কিছু কঠিন লোককে ভ্যাকুয়েরোর কাজ দিয়েছিল কার্ল ব্রেনেল, মালিকের বিদায়ের পর এরাও বিদায় নিয়েছে। হয়তো অ্যাগনেস ব্রেনেলের আঙুলের ইশারায় মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছে ডাবল-বি!
কি করবে, বেন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল মিরিয়াম।
ক্ষীণ হাসল ও। কি করব? দেখি, কি বলার আছে ওদের।
নড করে পিছিয়ে গেল মেয়েটা। আরও আগেই ফিরে আসা উচিত ছিল তোমার, বেন, অন্তত আমি তাই মনে করি। প্রায়ই ভাবতাম তুমি যদি থাকতে হয়তো সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে যেত না!
হাসিটা প্রসারিত হলো বেনের ঠোঁটে। তাই? ফিরে আসার পর থেকে কেবলই মনে হচ্ছিল এখানে এসে ভুল করেছি। টম নোলান আর ওর লোকেরা কিংবা অ্যাগনেসও সেটাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমাকে। কিন্তু অন্তত একজন মনে-প্রাণে আমাকে আশা করেছে এখানে…শুনে সত্যিই ভাল লাগছে। যাকগে, নিশ্চয়ই বাথানের কথা চিন্তা করে কথাটা বলেছ?
কাঁপা হাত তুলে আলতো ভাবে বেনের মুখ স্পর্শ করল মিরিয়াম, বেন দৃষ্টি নামিয়ে তাকাতে অনিশ্চয়তা দেখতে পেল মেয়েটির চোখে।
হ্যাঁ, এক অর্থে তাই, নিচু স্বরে স্বীকার করল মেয়েটি।
বেরিয়ে এসে পোর্চে অপেক্ষায় থাকল বেন। সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে আছে ও, সিগারেট রোল করছে সময় নিয়ে। দূর থেকে দেখল স্যাডল ছেড়ে গেট খুলে দিয়ে অন্যদের ঢোকার সুযোগ দিল জেফরি, তারপর গেট বন্ধ করে নিজের ঘোড়ায় চেপে অনুসরণ করল অন্যদের। দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে স্টিভ হারকারের পাশে চলে এল।
ছেলেটার অন্ধ ভক্তি বিতৃষ্ণা ধরিয়ে দিল বেনের মনে। একটা বিষধর কেউটেকে মানুষ ভয় পেতে পারে, কিন্তু সমীহ বোধ করে না কেউ। করলেই সেটা অস্বাভাবিক, আনমনে ভাবল ও।
আমি আর আমার ছায়া, বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল বেন, স্থির দৃষ্টিতে দেখছে জেফরি ব্রেনেলকে।
ঠিক বিশ ফুট দূরে এসে ঘোড়া থামাল ওরা।
হাউডি, সম্ভাষণ জানাল কেন
স্টিভ হারকার আর কিনলে নড় করলেও এক চুল নড়ল না জেফরি। শীতল মাপা চাহনিতে নিরীখ করছে বেনকে।
তোমাদের জন্যে কি করতে পারি? তিনজনকে ছাড়িয়ে রিও ফ্রিয়োর দুই তীরে চলে গেল বেনের দৃষ্টি, নদীর ধারে কটনউড় আর উইলোর সারির ফাঁকে লুকিয়ে থাকা কোন কাঠামো খুঁজছে-লোকটার হাতে হয়তো একটা রাইফেল দেখা যাবে।
পেছনে নেই কেউ, শান্ত স্বরে বলল স্টিভ হারকার।
তোমার কি ধারণা পেছনে কাউকে দরকার আছে আমাদের বিদ্রুপের স্বরে জানতে চাইল জেফরি, কণ্ঠে স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ।
আমাদের? আনমনে হাসল বেন। গাট-হূক ক্রুদের সঙ্গে রাইড করছ তুমি এখন, জেফ?
যেখানে বা যার সঙ্গে খুশি রাইড করি আমি!
বেশ তো, তোমার যেমন ইচ্ছে।
মিস্টার নোলান পাঠিয়েছে আমাদের, বলল হারকার, আর কিছু যোগ করল।
মিসেস ব্রেনেলের জিনিসপত্র নিতে এসেছ?
ক্ষীণ নড করল, লেযি-এন র্যামরড। তারপর কিছুটা সামনে ঝুঁকে এল সে, পমেলে একটা কনুইয়ের ভর চাপিয়েছে। আরও একটা কারণ অবশ্য আছে, স্লেজেল।
বলে যাও।
মেয়ের গায়ে কেউ হাত তুলবে ব্যাপারটা বরদাস্ত করতে রাজি নয় মি. নোলান।
স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল বেন, ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে ছাই ঝাড়ল। উঁহু, ভুল শুনেছ। কোন পুরুষ পেটায়নি ওকে। ননদের সঙ্গে খানিকটা বাতচিৎ করছিল অ্যাগি, কিন্তু আচমকা আবিষ্কার করে বসেছে ভুলে বাঘের লেজ ধরে ফেলেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে হয়তো খানিকটা ঝামেলাই পোহাতে হয়েছে ওর।
বুঝতে পেরেছি, শুকনো স্বরে বলল স্টিভ হারকার, মুখে পাথুরে নির্লিপ্ততা। ‘এবার বিল ব্রেনেলকে নিয়ে এসো এখানে, স্লেজেল!
কেন?
বাতাসে ঘুরতে শুরু করল উইন্ডমিল, গম্ভীর অদ্ভুত শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সবাই। বাড়ির ভেতরে কোথাও সশব্দে বন্ধ হলো একটা দরজা।
স্থির দৃষ্টিতে বেনকে দেখছে লেযি-এন র্যামরড। প্রশ্ন করার ধরন কিংবা খোদ প্রশ্নটাই পছন্দ হয়নি তার, কারণটাও পরিষ্কার-স্টিভ হারকারের মত লোক কাউকে ব্যাখ্যা দিতে পছন্দ করে না, অন্তত বেন স্লেজেলকে তো নয়ই। সম্ভবত একমাত্র টম নোলানকে জমা-খরচ দিয়ে চলে লোকটি। এটাই স্বাভাবিক, আনমনে ভাবল বেন, ব্যক্তিগত বেপরোয়া স্বভাব বাদ দিলেও, অন্যদের ওপর হুকুমদারি করার মত উপযুক্ত একটা পরিবেশে থাকে সে-বেসিনের সবচেয়ে টাফ আউটফিটের ফোরম্যান!
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে একটা কাঁধ উঁচাল স্টিভ হারকার, যেন নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে কারণটা ব্যাখ্যা করছে। ওকে ডেকে আনো, স্লেজেল। কিছু কথা বলব। স্ত্রীর সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করেছে সে, কথাগুলো না বললেই নয়।
বললাম তো, মিরিয়াম আর অ্যাগনেসের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। বিল তখন ছিলই না এখানে।
নিতান্ত আলস্য ভরে থুথু ফেলল লেয়ি-এন র্যামরড, কিন্তু মুখে অধৈর্যের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। জলদি! চাপা স্বরে গর্জে উঠল সে। ব্রেনেলকে নিয়ে এসো এখানে, স্লেজেল। প্ৰন্তো!
এখনও মাতাল হয়ে আছে ও, হারকার।
মাতাল আর পাগল যাই হোক, ওকে সামনে দেখতে চাই আমি!
ধৈর্য হারাল বেন, তলে তলে শীতল বিতৃষ্ণা বোধ করছে। এটা ডাবল-রি, হারকার, নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি? তোমার দুই সাইড-কিককে নিয়ে চলে যাও এখান থেকে। অন্তত যতক্ষণ না কারও সঙ্গে কথা বলার মত সংযত–বিল, কারও সঙ্গে দেখা হবে না ওর। ও সামলে নেয়ার পর, কোন একসময় এসে সত্যটা জেনে নিয়ে ওর কাছ থেকে।
নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল স্টিভ হারকারের ঠোঁটে। ডাবল-বির জমি থেকে আমাদের তাড়াবে কে, স্লেজেল?
নিরুদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে বেনকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আসলে যথেষ্ট বিচলিত। পরিস্থিতিটা পছন্দ হচ্ছে না ওর। জানে যে কোন উসিলায় ওকে উস্কে দিতে চাইছে হারকার, পিস্তলে হাত দিতে বাধ্য করতে চায়; কিন্তু মনে-প্রাণে সেটা চাইছে না বেন, অন্তত এখন। নিশ্চিত জানে অন্তত দু’জন ওর চেয়ে ফাস্ট, তারপরও এদের যে কারও মুখোমুখি হওয়ার সাহস আছে ওর, কিন্তু একসঙ্গে তিনজনের মোকাবিলা করতে যাওয়া চরম বোকামি হরে। ডড় কিনলেকে জানা নেই ওর, হতে পারে অন্য দু’জনের মত সেও ফাস্টগান।
ছেঁচড়ে স্যাডল ছাড়ল জেফরি, তারপর দ্রুত পা ফেলে পোর্চের দিকে এগোল। বিলকে নিয়ে আসছি আমি, স্টিভ, বলল সে।
দাঁড়াও! বাধা দিল বেন। দেখো, বাছা, এদের কারও সঙ্গে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। অ্যাগনেসকে স্পর্শও করেনি তোমার ভাই।
অ্যাগনেস কিন্তু এ কথা বলেনি আমাকে।
মিথ্যে বলেছে ও, জেফ।
কি বললে তুমি, স্লেজেল? উস্কানির স্বরে জানতে চাইল হারকার।
সরাসরি তার চোখে চোখ রাখল বেন। ঠিকই শুনেছ তুমি, হারকার, গতরাতের ঘটনা নিয়ে তোমাদের মিথ্যে বলেছে অ্যাগনেস ব্রেনেল।
আমার সঙ্গে মিথ্যে বলতে পারে না ও! তপ্ত স্বরে দাবি করল জেফরি।
টেকোসের মৃত্যুর কি ব্যাখ্যা দিয়েছে ও তোমাকে, জেফরি-নিশ্চয়ই বলেছে তাকে খুন করেছ তুমি?
উত্তর দিল না জেফরি, পোর্চের সিঁড়ির গোড়ায় চলে এসেছে।
ফিরে যাও, বাছা, কোমল স্বরে বলল বেন।
জেফরি ব্রেনেলের গাঢ় নীল চোখ জোড়া স্থির হলো বেনের মুখে। শুরুটা যেভাবেই হোক, একজনকে খুন করেছি আমি, কাটা কাটা স্বরে বলল সে, দম্ভ ঝরে পড়ছে বলার: সুরে। দ্বিতীয় লোকটাকে খুন করতেও হাত কাঁপবে না। আমার। বিশ্বাস করো, বেন, একটুও কাপবে না!
অযথা বড়াই করছ, বাছা। হার্ট অ্যাটাকের কারণে মারা গেছে টেকোস, তোমার গুলিতে মারা যায়নি। যদি তোমার গুলিতেও মারা যেত, তারপরও বলা যায় স্রেফ দুর্ঘটনা ছিল সেটা।’
মুহূর্তে কুঁচকে গেল জেফরির মুখ, অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে বেনের দিকে। খ্যাতি চায় সে, চায় অন্যরা ফাস্টগান হিসেবে সমীহ করুক ওকে, কিন্তু তাড়াটা বড় বেশি। সেজন্যে যে সময় আর ধৈর্য লাগে, সেটা বেমালুম বিস্মৃত হয়েছে।
স্যাডল ছাড়ল স্টিভ হারকার। তোমার ভাইকে নিয়ে এসো, কিড! প্রায় নির্দেশ দিল সে।
তিনটে সিঁড়ি ভাঙল জেফরি। কিন্তু বেনের চোখের দৃষ্টি দেখে থমকে দাঁড়াল। অনিশ্চয়তা ফুটে উঠেছে চোখে।
যাও, বাছা! পেছন থেকে উৎসাহ দিল লেযি-এন র্যামরড।
আমার পথ থেকে সরে দাঁড়াও, বেন! ত্যক্ত স্বরে বলল জেফরি, স্টিভ হারকারের তাগাদায় আবারও নিজেকে ফিরে পেয়েছে।
না।
বিপজ্জনক নীরবতা নেমে এল। নিজের ঘোড়ার কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে গেছে স্টিভ হারকার, দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, বাম হাতের দস্তানার উল্টো পিঠ ডলছে সে অন্য হাতে। হ্যাটের ব্রিম নিচু হয়ে গেছে, কিন্তু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে-শীতল তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি খুঁড়ে যাচ্ছে বেন স্লেজেলকে।
আবারও বলছি, খেপা সুরে তড়পে উঠল জেফরি। আমার পথ ছাড়ো!
দেখো, বাছা। তোমাকে ব্যবহার করছে ওরা। অ্যাগনেস মিথ্যে বলেছে। তোমাকে! এই যেমন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, ঠিক ততটাই সত্য যে অ্যাগনেস তোমাকে মিথ্যে বলেছে।
কথাটা বোলো না আবার!
মিথ্যে বলেছে ও!
স্থির দৃষ্টিতে পরস্পারের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। নীরব, উদ্বেগ ভরা কিছু মুহূর্ত পেরিয়ে গেল। বেনের আশঙ্কা হচ্ছে হয়তো খেপে গিয়ে সত্যিই ড্র করবে জেফরি। পরিস্থিতিটা মনে-প্রাণে ঘৃণা করছে ও, কারণ তাহলে প্রাণ বাঁচাতে ওকেও ড্র করতে হবে।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল জেফরি, দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
আলগোছে ডান দিকে দু’পা সরে এল বেন, স্টিভ হারকার আর নিজের মধ্যে ফেলল জেফরিকে, একই সঙ্গে মাথা থেকে হাতে তুলে নিয়েছে হ্যাট। চোখের পলকে সক্রিয় হলো ও-এক পা এগিয়ে জেফরির মুখে হ্যাটটা চেপে ধরল, তারপর সপাটে ঘুসি হাঁকাল তরুণের চিবুক লক্ষ্য করে।
টলে উঠল ছেলেটা। যন্ত্রণার চেয়ে বিস্ময় আর হতাশার ছাপ বেশি পড়ল মুখে। মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠল চোখ দুটো, বেন বুঝল এবার পাল্টা আঘাত হানবে জেফরি। একটা ঘুসি শারীরিক ভাবে যতটা না আঘাত করেছে ওকে, প্রতিক্রিয়াটা হলো আরও গভীর এবং তেতে ওঠা কোণঠাসা মানুষের মত-আত্মসম্মান বোধ আর মিথ্যে অহমিকায় লেগেছে যেন ঘুসিটা!
কিন্তু হিসেবে ভুল করেছে ও, পাল্টা আঘাত করল না জেফরি, বরং পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল।
জেফরিকে সামলে নেয়ার বা চড়াও হওয়ার সুযোগ দিল না বেন। বাম হাতে ওর কজি চেপে ধরল, ততক্ষণে কক্ করা পিস্তল হোলস্টার থেকে বের করে। ফেলেছে জেফরি! এক লহমায় ডান হাতে নিজের পিস্তল বের করে ফেলল বেন। সজোরে পিস্তলের বাঁট দিয়ে জেফরির পেটে আঘাত করল। বাতাসের অভাব। অনুভব করতে টলমল পায়ে দু’পা পিছিয়ে গেল জেফরি, মুখ হা হয়ে গেছে।
পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। জেফরির পেটের সঙ্গে কোল্টের নল চেপে ধরেছে বেন। এবার কি করবে, জেফ? তরুণের বিস্ফারিত চোখে চোখ রেখে শীতল স্বরে জানতে চাইল ও।
অক্ষম রাগে ঘুরে দাঁড়িয়েছে স্টিভ হারকার, চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল বেন। দু’পা পিছিয়ে এল ও। কোল্টের নল স্থির হলো নিজেকে সামলে নিতে ব্যস্ত জেফরি আর হারকারের মাঝামাঝি। শীতল দৃষ্টিতে লেযি-এন ফোরম্যানকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল ও। একটু আগেও বলেছি, হারকার, এটা ডাবল-বি, তোমার গাট-হক র্যাঞ্চ হাউস নয়। এবার জলদি বিদায় হও এখান থেকে!
নিস্পৃহ দৃষ্টিতে পিস্তলের নগ্ন নলটা দেখল গানম্যান, তারপর দৃষ্টিটা উঠে গিয়ে বেনের মুখে স্থির হলো। যথেষ্ট কারিশমা দেখিয়েছ তুমি, বেন স্লেজেল! শীতল নিরুত্তাপ স্বরে বলল সে। ফিরে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু শোধ-বোধটা বাকি থাকল। কি বলো?
ভাগো!
র্যাঞ্চ হাউসের দরজা খুলে গেল এসময়। টলমল পায়ে ছুটে এল বিল ব্রেনেল। কোন্ শালা চায় আমাকে? জড়ানো স্বরে জানতে চাইল সে।
ভেতরে যাও, বিল? কোল্ট হোলস্টারে পুরে নির্দেশ দিল বেন।
গোল্লায় যাও তুমি! আমার বউকে নিয়ে গেছে ওরা! অ্যাগনেসকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি আমি!
বাড়ির ভেতরে চলে যাও!
এতক্ষণে যেন নিজেকে সামলে নিয়েছে জেফরি। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম আমরা, বিল। বেনের সঙ্গে কোন ব্যবসা নেই আমাদের।
পেয়ে গেছ আমাকে! ঝামেলা খুঁজছ তুমি? দেখাচ্ছি তোমাকে ঝামেলা কাকে বলে! বলেই আচমকা ড্র করল সে।
লাফিয়ে পিছিয়ে গেল জেফরি, ছোবল মেরেছে হোলস্টারে। খলিত পায়ে তার দিকে এগোল বিল, কাঁপা হাতে নিশানা করার চেষ্টা করছে। বিলের হাতের আঙুল ট্রিগারে চেপে বসতে যাচ্ছে দেখে পিস্তলটা ছিনিয়ে নিতে হাত বাড়াল বেন..
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। বিল ব্রেনেলেরটা নয়, বরং অন্য একটা পিস্তল গর্জে উঠল।
অস্ফুট শব্দ করল বিল, যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখ। দু’চোখে অবিশ্বাস, নিয়ে পেটের দিকে তাকাল। চরকির মত আধ-পাক ঘুরল সে, তারপর ধড়াস করে সিঁড়ির ওপর পড়ে গেল।
ঝটিতি ঘুরে দাঁড়াল কেন। ত্রিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে স্টিভ হারকার, উদ্যত সিক্সগানের মাজল থেকে ধোঁয়া উঠছে। বরফের মত শীতল দেখাচ্ছে নীল চোখ দুটো, এবং আবারও গুলি করার জন্যে তৈরি সে।
প্রায় অসুস্থ বোধ করছে বেন। লেযি-এন র্যামরডের চোখে শীতল বিদ্বেষ দেখতে পেল-খুনের নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে। যে কোন মুহূর্তে গুলি করবে লোকটা! অথচ কিছুই করার নেই, ওর পিস্তল হোলস্টারে আর এদিকে স্রেফ ট্রিগার টেনে দেবে হারকার। জানে জেফরি বা কিনলে কেউই গুলি করবে না, এবং ওর পায়ের কাছে পড়ে থেকে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে বিল ব্রেনেল।
ভারী ক্যালিবারের গুলির গর্জনে ভেঙে গেল নীরবতা। বেন ভেবেছিল শরীরে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা অনুভব করবে, কিন্তু কিছুই হলো না। সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখল স্টিভ হারকার গুলি করেনি এবার। বরং বাড়ির ভেতর থেকে গর্জে উঠেছে একটা রাইফেল।
ঘুরে দাঁড়িয়ে মিরিয়ামকে জানালায় দেখতে পেল ও। একটা উইনচেস্টার মেয়েটার হাতে।
তোমাদের চলে যেতে বলেছে বেন, ঠাণ্ডা নির্লিপ্ত স্বরে অতিথিদের বলল মেয়েটা।
নড়ে উঠল স্টিভ হারকার, পড়ে যাওয়া পিস্তল তুলে নেবে।
উঁহু, ওখানেই থাকুক ওটা, চড়া স্বরে নির্দেশ দিল মিরিয়াম। জেফ, বাড়ির ভেতরে যাও!
নীরবে মাথা নাড়ল তরুণ।
স্যাডলে চাপল স্টিভ হারকার।
তার দিকে তাকাল ডড কিনলে, বরাবরের মত নির্বিকার দেখাচ্ছে স্টক ডিটেকটিভকে। এইমাত্র একজনকে খুন করেছ তুমি, হারকার!
সবাই জানে কোথায় পাওয়া যাবে আমাকে, দম্ভ ভরা কণ্ঠে বলল গানম্যান। ঘোড়া ঘুরিয়ে গেটের দিকে এগোল সে, অনুসরণ করল জেফরি।
ওকে যেতে দাও, তিক্ত স্বরে বলল বেন, ঝুঁকে বসে পড়ল বিলের পাশে। ঠিকই বলেছে ও, আমরা জানি কোথায় পাওয়া যাবে ওকে।
সীমাহীন যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে বিল ব্রেনেলের চোখে-মুখে, এক হাতে পেটের ক্ষতটা চেপে ধরেছে সে। আমার সময় শেষ, বেন!
কিছুই হবে না তোমার, বিল।
উঁহু, জায়গামত লেগেছে গুলিটা। সবকিছু লেজে-গোবরে করে ফেলেছি। আমি নাক গলানো পর্যন্ত ঠিকই ওদের সামলে নিয়েছিলে। মাথার ঠিক ছিল না, বেন।
ডড কিনলের দিকে ফিরল বেন, দেখল নীরবে মাথা নাড়ছে সে। এদিকে কাঁদতে শুরু করেছে মিরিয়াম।
আচমকা নিঃশ্বাস আটকে গেল বিলের, রক্ত উঠে এসেছে মুখে। দুঃখ নেই আমার, বেন, খুশি মনেই যাচ্ছি, যন্ত্রণায় দুমড়ানো কাগজের মত কুঁকড়ে গেল মুখটা, কোত্থেকে কথা বলার শক্তি পাচ্ছে কে জানে। অ্যাগনেস আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, আর জেফরি তো ঘৃণাই করে আমাকে! ডাবল-বিকেও হারিয়েছি আমি, তোমাদের জন্যে কিছুই বাকি থাকল না, ক্ষীণ তিক্ত হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটের কোণে। আমি এমনকি কয়েকটা বছর ধরে মিথ্যে বড়াই করেছি, সিরেনোর ওই গানফাইটের নায়ক দাবি করেছি নিজেকে, ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এল কণ্ঠ, একটা হাত নাড়ল সে। দুঃখ একটাই, বাবার খুনীর পরিচয় জানতে পারিনি। লোকটাকে খুঁজে বের করবে, বেন? প্রতিশ্রুতি দাও আমাকে!
তাই করব আমি, বিল।
বেনের দিকে ফিরল ডড কিনলে, তারপর বিলের মুখে স্থির হলো স্টক ডিটেকটিভের কৌতূহলী দৃষ্টি।
যেই খুনটা করেছে, বাবার অভ্যাস সম্পর্কে ধারণা ছিল লোকটার, সেজন্যেই সহজে ড্রাই গালশ করতে পেরেছে। লোকটাকে খুঁজে বের করবে, বেন?
নিশ্চয়ই, বিল!
আচমকা থরথর করে কেঁপে উঠল বিল ব্রেনেলের শরীর, খিচুনি দিয়েই স্থির হয়ে গেল। নিপ্রাণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে খোলা আকাশের দিকে, কিন্তু কিছুই দেখছে না। মারা গেছে বিল ব্রেনেল।
উঠে দাড়িয়ে নদীর দিকে তাকাল বেন। রিও ফ্রিয়োর ওপাড়ে উইলোর কিনারে দেখা যাচ্ছে দুটো ঘোড়া, নদী পেরিয়ে লেযি-এনের জমিতে পা রেখেছে স্টিভ হারকার আর জেফরি ব্রেনেল।
ওদের পিছু নেবে নাকি, স্লেজেল? জানতে চাইল ডড কিনলে।
হ্যাঁ।
ওরা তোমাকে খুন করবে।
হয়তো।
তাই করবে, মাথায় হ্যাট চাপিয়ে ঘোড়ার দিকে এগোল সে, তারপর পমেল আঁকড়ে ধরেও ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরল বেনের দিকে। এক কাজ করা যাক। কিছুটা সময় দাও আমাকে। টম নোলানের সঙ্গে কথা বলব আমি। সে হয়তো হারকারকে আইনের হাতে তুলে দেবে।
সন্দেহ আছে আমার।
শ্রাগ করল ডিটেকটিভ। চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
তোমার ভূমিকাটা কি, কিনলে? এসবের সঙ্গে…
টম নোলানের হয়ে কাজ করছি আমি, স্মিত হেসে ওকে থামিয়ে দিল সে। কিন্তু ওর ভাড়াটে খুনী নই। নিশ্চিত থাকতে পারো, দুই বাথানের ঝামেলার মধ্যে পাবে না আমাকে। দুটো কারণে আমাকে ভাড়া করেছে র্যাঞ্চার, তার একটা হচ্ছে কার্ল ব্রেনেলৈর খুনীর পরিচয় জানা।
বিস্ময় নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকল বেন। অন্য কারণ?
তোমাকে বলতে বাধ্য নই আমি, অন্তত এখন, নিস্পৃহ স্বরে বলল সে, স্যাডলে চেপে আবারও ফিরল বেনের দিকে। পকেট থেকে দুমড়ানো একটা সিগার বের করে সময় নিয়ে ধরাল। স্বীকার করতেই হবে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেছে। আমার পরামর্শ শোনো, শ্লেজেল, বাথান ছেড়ে যেখানেই যাও, দয়া করে লেযি-এনের ধারে-কাছেও যেয়ো না। ভাবছি টম নোলানের সঙ্গে কথা বলব, দেখি বুড়োকে রাজি করাতে পারি কিনা, দরকার হলে আমি নিজেই স্টিভ হারকারকে শেরিফের কাছে নিয়ে যাব।
কিন্তু সে যদি রাজি না হয়?
গাঢ় নীল চোখে বেনকে নিরীখ করল ডড কিনলে। তাহলে ব্যাপারটা শেরিফের ওপর নির্ভর করবে, তাই না? হুট করে কোন কিছু করার আগে তাকেই। সামলাতে দাও।
গাট-হুক করিডায় কোন খুনীকে গ্রেফতার করতে যাবে না এডলে ভার্ন।
হয়তো, স্যাডলে নড়েচড়ে বসল বিশালদেহী মানুষটা। এসবের জন্যে দুঃখিত আমি, স্লেজেল।
দু’জনকে মৃত ভাইয়ের কাছে রেখে রিও ফ্রিয়োর দিকে এগোল সে।
১১. বাইরে হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি
বাইরে হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। র্যাঞ্চ হাউসের ছাদে ছন্দ তুলছে বৃষ্টির ফেটা। লিভিংরুমে বসে আছে বেন, ফায়ারপ্লেসে আগুনের শিখার নাচন দেখছে পলকহীন দৃষ্টিতে, মনের গভীরে কাঁটার মত বিঁধতে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে।
কার্ল ব্রেনেলের খুনী কে? কি উদ্দেশে তাকে খুন করা হয়েছে?
হারলো আর কারাঞ্চোকে ওর পিছনে লাগিয়েছে কে? বছরকে বছর ধরে দুটো বাথানের শক্রতা, অথচ হঠাৎ করে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে লেযি-এন? কি এমন ঘটল যে ডাবল-বি করায়ত্ত করার জন্যে খেপে উঠেছে টম নোলান? কার্ল ব্রেনেলকে খুন করার মাধ্যমে এর শুরু?
আর যে-ই করুক, বেন অন্তত বিশ্বাস করে না কার্ল ব্রেনেলের খুনের পেছনে কোন ভূমিকা আছে লেযি-এন মালিকের। মানুষটা নিষ্ঠুর বা চরমপন্থী হতে পারে, কিন্তু মোটেই কাপুরুষ নয়; বুক ফুলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে শত্রুর শেষ দেখবে, এটাই মানায় টম নোলানকে। অথচ নির্মম, নীচ একজন খুনীর অসাধারণ দক্ষতায় মারা গেছে মানুষটা, যে ছিল ডাবল-বি বাথানের প্রাণ! তার মৃত্যুর পর সাজানো একটা সংসার তছনছ হয়ে গেছে, প্রতিটি মানুষের ভবিষ্যৎ হয়ে গেছে সুনিশ্চিত। খোদ ডাবল-বির অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের সম্মুখীন।
পদশব্দে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকাল বেন। দীর্ঘদেহী ডেপুটি শেরিফ পল লিন্ডলেকে কামরায় ঢুকতে দেখে খানিকটা অবাক হলো।
দৃঢ় পায়ে ভেতরে এসে একটা চেয়ার দখল করল সে, নির্বিকার মুখে দেখল বেনকে। পকেট থেকে তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল। আমি দুঃখিত, বেন, আন্তরিক স্বরে বলল সে। বিলের জন্যে দুঃখই হচ্ছে। আর যাই হোক, এভাবে ওর মত লোকের মৃত্যু কাম্য হতে পারে না।
নীরবে নড করল বেন। কার কাছ থেকে খবর পেলে?
শহরে গিয়েছিল ডড কিনলে।
সিগার ধরিয়ে অপেক্ষায় থাকল ও।
মি. কিনলের কাছ থেকে যা শুনেছি, তাতে অনায়াসে দোষী সাব্যস্ত করা যায় স্টিভ হারকারকে। খুনের অভিযোগে ওর নামে একটা ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছি আমি।
ভার্ন কোথায়?
ডরোটিও, নাভারেজের খবর পেয়ে বেরিয়ে গেছে ও। দক্ষিণে রেলরোডের কাছে নাকি দেখা গেছে নাভারেজকে। ভার্ন বেশ আত্মবিশ্বাসী যে খুনীটাকে ধরতে পারবে, এবার। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে গেছে।
কিন্তু তার আগে নিশ্চয়ই বিলের খুন হওয়ার খবর শুনেছে? শুকনো স্বরে জানতে চাইল বেন।
অযথাই ওর ওপর নাখোশ হচ্ছ, বেন, ঠিক হচ্ছে সেটা?
কিন্তু এটাই সত্যি। এডলে ভার্নকে ভাল করে চিনি আমি, বহু বছর ধরে দেখছি। স্টিভ হারকার দূরে থাক, লেযি-এনের অন্য যে কোন কুকেও পাকড়াও করতে গাট-হুক র্যাঞ্চে যাবে না সে।
একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় খুন, মন্তব্যের সুরে বলল পল লিন্ডলে।
ধীরে ধীরে ডেপুটির দিকে ফিরল বেন। তোমার কাছ থেকে রায় শুনতে চাইনি আমি। লেযি-এনে যাচ্ছ তুমি, স্টিভ হারকারকে পাকড়াও করতে?
খানিকটা ব্ৰিত দেখাল ডেপুটিকে, তবে মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিল সে। উঁহু, তা কিন্তু বলিনি আমি। এডলে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে সারাক্ষণ যেন সিরেনো কর্নারের ধারে-কাছে থাকি, প্রয়োজনের সময় আমাকে যাতে পায় ও। সুতরাং…বুঝতেই পারছ, স্টিভ হারকারের পিছু নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আপাতত সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সরল ব্যাখ্যা দিলেও অজান্তে লালচে হয়ে গেল ডেপুটির মুখ। যাকগে, এডলে কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার বলে দিয়েছে, দরকার হলে যেন ডেপুটি হিসেবে তোমাকে শপথ করিয়ে নিই… শ্রাগ করল সে, তারপর বেনের চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠতে দেখে দ্রুত যোগ করল: যদি স্টিভ হারকারের পিছু নিতে চাও তুমি।
মুহূর্ত খানেক ভাবল বেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাত তুলল। মত বদলে ফেলার আগেই শপথ করাও আমাকে, পল!
মিনিট কয়েকের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলল পল, লিন্ডলে। বেনের জ্যাকেটে একটা টিনের তারা আটকে দিয়েছে সে, হাতে একটা ওয়ারেন্ট ধরিয়ে দিয়েছে। পকেটে সেটা রেখেছে বেন। ডেপুটির তাড়াহুড়োর কারণ স্পষ্ট বুঝতে পারছে, পালাতে পারলেই যেন বাঁচে সে। সিরেনোর চৌহদ্দিতে টম নোলানের অবস্থান এতটাই উঁচুতে যে তাকে ঘটানোর সাহস করতে পারছে না এডলে ভার্ন, কিন্তু বেনকে ব্যবহার করে নিজের অক্ষমতা পুষিয়ে নিতে চাইছে।
ডেপুটি বিদায় নেওয়ার পর লিভিংরুমে একা হয়ে গেল বেন। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল, দেখল বাইরে আন্ডারটেকার সহ বিলের মৃতদেহ ওয়্যাগনে তুলে নিল ডেপুটি, তারপর নিজের ঘোড়ায় চেপে বসল। বৃষ্টির ছাঁট উপেক্ষা করে এগোল রিও ফ্রিয়োর দিকে, নদীর মুখে বাঁক ঘুরে শহরের ট্রেইল ধরবে। সযত্নে লেযি-এনের জমি এড়িয়ে যাচ্ছে ওরা, ওয়াগন আর নিঃসঙ্গ রাইডারের অস্পষ্ট অবয়বের দিকে তাকিয়ে ভাবল বেন, ঘুরপথে অতিরিক্ত ছয় মাইল পাড়ি দিতেও কুণ্ঠা বোধ করছে না।
মিরিয়াম ঢুকল কামরায়। এখনও শোক সামলে উঠতে পারেনি, মুখটা থমথমে দেখাচ্ছে। বেনের শার্টে আঁটা তারাটা দেখে মুহূর্তের মধ্যে নিপ্রাণ দৃষ্টি বদলে গিয়ে সচকিত হয়ে উঠল। ঠোঁট কামড়ে ধরে বোধহয় ওটার গুরুত্ব আর প্রয়োজনীয়তা বিচার করল মনে মনে। তারপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। এ তো স্রেফ পাগলামি, বেন! শেষে অসন্তোষের সুরে মন্তব্য করল মেয়েটি। তোমাকে দেখেই গুলি করবে ওরা!
হয়তো এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। এডলে বা ওর ডেপুটি, কেউই লেযি-এনে গিয়ে হারকারকে গ্রেফতার করার সাহস করতে পারছে না।
সেই দায়িত্ব তাহলে তোমাকে দিয়েছে ওরা? এডলে ভার্ন বোধহয় সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছে, নইলে কিভাবে নিজে সরে থেকে তোমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয় কিংবা দায়িত্ব অস্বীকার করে? রিও ফ্রিয়ের লোকজনকে দেখছি এখনও চেনা বাকি রয়ে গেছে আমার, বেন! বিতৃষ্ণা ফুটে উঠল মেয়েটির কণ্ঠে, হতাশায় কাঁধ নুয়ে পড়ল। কিন্তু বেন…লেযি-এন র্যাঞ্চ হাউসের ধারে-কাছেও যেতে পারবে না। তুমি। নিজেদের জমিতে রাসলার বা ড্রিফটারদের খোঁজে পাহারা দেয় ওরা, এখন তো জানেই যে বিলের খুনের প্রতিশোধ নিতে ওখানে যাবে তুমি। পথে যদি খুন–ও হও, নির্ঘাত র্যাঞ্চ হাউসে ঢোকার আগেই তোমার লাশ ফেলে দেবে ওরা।
স্টিভ হারকারকে চাই আমি, মিরিয়াম।
একটা তারা পরেছ তুমি, বেন। নিজের ইচ্ছেমত এখন আর কিছু করতে পারবে না, যেহেতু আইনের প্রতিনিধিত্ব করছ। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা ক্ষোভ…আসলে আমার চেয়ে তুমিই ভাল বোঝো এসব। আমি যা বলতে চাই…স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করবে না সে। হয়তো অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু
তুমি খুন হয়ে গেলে? কোন কিছুরই সুরাহা হবে না, বেন!
ঝুঁকিটা নেওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না।
হারকারকে না হয় বাদ দিলাম! অন্যরাও কি ছেড়ে দেবে তোমাকে? যেমন ফ্রেড মোরিস, কারাঞ্চো…স্বয়ং জেফরিও তোমার বিরুদ্ধে পিস্তল তুলতে পারে!
ক্ষীণ, তিক্ত হাসি ফুটে উঠল বেনের ঠোঁটে। জেফরি কিন্তু আগের মত অতটা আত্মবিশ্বাসী নেই আর, থেমে আগুনের দিকে তাকাল ও। তাছাড়া, অন্য একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়, ডড কিনলের একটা কথা শোনার পর থেকে ভাবছি…
কি? উদ্বেগে বড় বড় হয়ে গেছে মিরিয়ামের চোখ।
শুনেছ তো কি বলেছে ও। কার্ল ব্রেনেলের খুনের কিনারা করার জন্যে ওকে ভাড়া করেছে টম নোলান, এটা একটা কারণ।
কিন্তু তাতে কি?
কেন করবে সে কাজটা?
জানি না। তুমি জানো?
বোতল থেকে গ্লাসে ড্রিঙ্ক ঢালল বেন। টম নোলানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আলাপের প্রসঙ্গগুলো মনে পড়ছে। টম নোলান নিজেই বলেছে কাল ব্রেনেলকে। খুন করার কোন সঙ্গত কারণ নেই ওর। সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে, চোখের দিকে তাকিয়ে বাবার শরীরে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেয়ার সাহস বা ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ড্রাই-গালশ করার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র ছিল না তার।
হেসে উঠল মিরিয়াম, কিন্তু আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই তাতে। তুমি ওর কথা বিশ্বাস করেছ?
নড করল বেন। টম নোলান কঠিন মানুষ, সন্দেহ নেই অন্যায় সুযোগ নিতেও দ্বিধা করে না সে, কিন্তু খুনী নয় লোকটা। এটা সত্যি যে লেযি-এন রেঞ্জে অনেক লোক খুন হয়েছে, এর কারণ রেঞ্জটাকে নিজের সাম্রাজ্য মনে করে সে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাসলিং ঠেকানোর জন্যে এ কাজ করেছে ওর ভ্যাকুয়েরোরা। এভাবে হয়তো বেসিনের কিছুটা উপকারই করেছে সে, সীমান্তের কাছাকাছি হলেও সিরেনোর আশপাশে রাসলিং কিন্তু কখনোই বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মিরিয়াম, নিরীখ করছে ওকে। তুমি বোধহয় বদলে গেছ, বেন।
হয়তো।
স্টিভ হরকারকে তখন হাতে গুলি না করে বুকে বা মাথায় গুলি করলেই বোধহয় ভাল হত, অনুশোচনা মিরিয়ামের কণ্ঠে। তখন যদি জানতাম বিল ওর গুলিতে মারা যাবে…নিশ্চয়ই বুকেই করতাম গুলিটা!
একজন খুনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের পার্থক্য এখানেই, ক্ষীণ হেসে শ্রাগ করল বেন, ড্রিঙ্ক গলায় ঢেলে ফের গ্লাস ভরে নিল, জানে নীতি-কথা বা এমনকি হুইস্কিতেও হতাশা ঘুচবে না ওর। মিরিয়ামের ক্ষেত্রেও তাই সত্যি। দেরি করে লাভ কি, কাজটা যখন করতেই হবে! বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল ও।
রিও ফ্রিয়োর ওপাশে যাবে না তুমি, বেন! আচমকা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল মিরিয়াম।
কে বলল লেযি-এন র্যাঞ্চ হাউসে যাচ্ছি আমি, কিংবা ভদ্রলোকের মত স্টিভ হারকারকে আইনের হাতে আত্মসমর্পণ করতে বলব?
তাহলে কি করবে?
দাঁত বের করে হাসল বেন, নীরব চোখের চাহনিতে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল মেয়েটাকে। লেযি-এনের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হবে। কাউকে না কাউকে তো কাজটা করতে হবে, তাই না? হারি বা জিতি, নিজস্ব রীতিতে কাজটা করার চেষ্টা করব আমি।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার!
কিন্তু এছাড়া উপায় দেখছি না। তুমি কি বুঝতে পারছ না?
পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিরিয়াম, শক্ত হয়ে চেপে বসা ঠোঁট জোড়ায় রহস্যময় কাঁপন দেখা গেল, কিন্তু দৃষ্টিতে অদম্য অভিমান নিয়ে তাকিয়ে থাকল বেনের দিকে। শঙ্কা আর আশাহতের যন্ত্রণার ঝড় বইছে ওর মনে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল শেষে, দুলে উঠল কাঁধ জোড়া। প্রায় অস্ফুট স্বরে বলা প্রশ্নটা কামরার নীরবতাকে ছাপিয়ে উঠল: কিন্তু আমার কি হবে, বেন?
নিজের শঙ্কা বা নিরাপত্তার কথা বোঝাতে চায়নি মিরিয়াম, বরং হঠাৎ করেই মনের গভীর আবেগের কথা বলে ফেলেছে। পালক-ভাই হিসেবে একসঙ্গে বড় হয়েছে বেন স্লেজেল, কিন্তু মিরিয়ামের কাছে সে ওর মনের মানুষ, প্রিয় মানুষ–এই মুহূর্তে একমাত্র অবলম্বন। এই লোকটিকে হারানোর ইচ্ছে নেই ওর।
মিরিয়াম!
তুমি নিশ্চয়ই আমাকে করুণা করবে এখন! মাথা নিচু হয়ে গেল মেয়েটার, তারপর আচমকা চোখ তুলে তাকাল, গভীর দৃষ্টি চোখে; বেনের চোখে চোখ রাখল মেয়েটি। হ্যাঁ, তুমি যাই ভাবো না কেন, আমি তোমাকে ভালবাসি। নীরবে ভালবেসেছি এতদিন, এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে দেখেছি অ্যাগনেসকে নিয়ে ভাবতে তুমি। ছোট ছিলাম আমি, বুঝিনি কতটা তোমাকে চাই, কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর বুঝেছি…
এগিয়ে গেল বেন। লজ্জায় নিচু হয়ে গেছে মিরিয়ামের মুখ, বেন ওর কাঁধে হাত রাখতে কেঁপে উঠল মেয়েটা। মিরিয়ামের চিবুক তুলে চোখে দৃষ্টি রাখল বেন। এটাই কি সকালের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর? স্মিত হেসে জানতে চাইল ও।
আরক্ত হয়ে গেল মিরিয়ামের মুখ, আয়ত চোখ জোড়ায় খুশির ঝিলিক; জানে ওর প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং সানন্দে, কৃতজ্ঞ চিত্তে সেটা মেনে নিয়েছে পুরুষটি।
কোমর চেপে ধরে মেয়েটিকে কাছে টানল রেন। ওর বুকের সঙ্গে সেঁটে এল মিরিয়াম-আশ্রয় আর ভরসা চাইছে যেন।
পাইনের সুবাস মাখা মৃদু হাওয়া ভেসে আসছে পাহাড়শ্রেণী থেকে, সঙ্গে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। পোর্চে দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ জমিতে বিছিয়ে থাকা গোধূলির আবছা অন্ধকারের দিকে তাকাল বেন স্লেজেল। বাইরে ব্র্যান্ডিং পেনে ডাকছে একটা বাছুর। ফেন্স করালের ওপাশে বিরাট পন্ডেরেসোর গায়ে ঠোকর মারছে একটা কাঠঠোকরা।
দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে আকাশের ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে তাকাল ও রিও ফ্রিয়োর উচ্ছল প্রবাহকে ঘোলাটে একটা ক্ৰীকের মত দেখাচ্ছে এখান থেকে, উইললা আর কটনউডের সারিতে শীতল বাতাস বইছে, পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ঘাপটি মেরে আছে রহস্যময় অন্ধকার।
জায়গাটা সত্যি সুন্দর, বিষণ্ণ মনে ভাবল ও। ডাবল-বির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ রীতিমত পীড়া দিচ্ছে ওকে। বেপরোয়া হয়ে উঠতে চাইছে মন, কিন্তু একইসঙ্গে অনিবার্য এক পিছুটানও অনুভব করছে-মিরিয়াম ব্রেনেল। স্বল্পভাষী মেয়েটি হঠাৎ করে নিজের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে ওকে। বেনকে মনে করিয়ে দিয়েছে হৃদয়ের গভীরে কোথাও স্থায়ী একটা অংশ জুড়ে ছিল মেয়েটি, কিন্তু জানা হয়নি। এতদিন।
ভাবনা বাদ দিয়ে স্টেবলের দিকে এগোল কেন। ধীরে সুস্থে একটা সোরেলের পিঠে স্যাডল চাপাল, আচমকা বাইরে মৃদু পদশব্দ শুনতে পেল। পিছিয়ে এসে একটা স্টলে ঢুকে পড়ল ও, হাতে কোল্ট চলে এসেছে।
দরজায় গাঢ় একটা ছায়া দেখা গেল। স্লেজেল?
কণ্ঠটা চেনা মনে হলেও উত্তর দিল না বেন। অতিমাত্রায় সতর্ক ও, বহুবার দেখেছে সামান্য শব্দ শুনেই নিখুঁত নিশানায় গুলি করতে সক্ষম কিছু মানুষ। পশ্চিমে টিকে থাকতে হলে এই যোগ্যতা অর্জন করতেই হয়।
কাঁধের ওপর হাত তুলল ডড কিনলে, বোঝাতে চাইছে হাতে অস্ত্র নেই। স্লেজেল? ফের ডাকল সে।
ভেতরে এসো।
ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল ডিটেকটিভ। তুমি দেখছি দারুণ সতর্ক, আমাকেও বিশ্বাস করছ না! খানিকটা বিস্ময়ের সুরে বলল সে।
ওই জিনিসটার কারণেই এখনও বেঁচে আছি।
সমঝদারের ভঙ্গিতে নড় করল সে। সিগার চলবে? উত্তরের অপেক্ষায় থাকল না কিনলে, একটা কেস এগিয়ে ধরল বেনের দিকে। স্নান আলোয় বেনের বুকের তারাটা চোখে পড়ল তার, খানিকটা উজ্জ্বল হলো চোখের চাহনি। তাহলে ঠিকই শুনেছি?
নীরবে মাথা ঝাঁকাল বেন।
খবরটা কিন্তু লেযি-এন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, ওখান থেকেই জেনেছি আমি।
জানতাম এমন কিছুই হবে।
সিগারের প্রান্তে লেপ্টে আছে ডড কিনলের দৃষ্টি, আসলে কি যেন ভাবছে সে। লোকটা তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, এবং মাথা গুলিয়ে যায়নি বলেই আমার বিশ্বাস। নিশ্চয়ই মাথা গরম করে লেযি-এনে হানা দিতে যাচ্ছ না? দারুণ বোকামি হবে সেটা। তবে হারকারকে ধরার অন্য কোন উপায়ও বোধহয়, নেই, একটা পোস্টের সঙ্গে হেলান দিয়ে এবার বেনের দিকে ফিরল সে। কিন্তু তোমার। প্রতিপক্ষ শক্তপাল্লা, শ্লেজেল। হারকার একাই একশো, তাছাড়া কারাঞ্চো, ফ্রেড মোরিস, স্লিম, কার্লি তো আছেই। এমনকি তোমার ভাইও তোমার বিপক্ষে অস্ত্র ধরবে।
রক্তের সম্পর্কের ভাই নয়, শুধরে দিল বেন।
কিছু যায়-আসে না তাতে। ছেলেটাকে পছন্দ করো তুমি। ওকে হয়তো হারিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু অন্যদের…একটা কথা না বলে পারছি না, এত নিঃশব্দে চলাফেরা করো কিভাবে? কাউকে এত ক্ষিপ্র হতে দেখিনি আমি!
হয়তো সেজন্যেই বেঁচে আছি।
হ্যাঁ, লিয়ন সিটিতে অন্তত সেটা প্রমাণ করেছ তুমি, চিন্তিত স্বরে বলল ডিটেকটিভ। হর্সহেড ক্রসিঙের ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে কতটা ক্ষিপ্র তুমি।
আবছা অন্ধকারে লোকটিকে নিরীখ করছে বেন, কিন্তু ভাবলেশহীন দেখাচ্ছে ডড কিনলের মুখ। হর্সহেড ক্রসিঙে এ লোক উপস্থিত ছিল না, নিশ্চিত জানে ও, হয়তো কারও কাছে ওখানকার ঘটনা শুনেছে।
টাসকোসার বাররূমের ঘটনাটাকে কি বলবে? সে-রাতে ক’জন লোক মারা গেছে, স্লেজেল?
মনে হচ্ছে সংখ্যাটা তুমিও জানো, কিনলে।
পাঁচজন, আমার ধারণা। এদের দু’জন তোমার গুলিতে মারা গিয়েছিল।
এ নিয়ে দুঃখ বা অনুশোচনা নেই আমার।
থাকাও উচিত নয়। কিন্তু তোমার সম্পর্কে আরও কিছু খবর জানি আমি।
কে তোমাকে এসবে জড়িয়েছে, কিনলে? টম নোলান?
এক হিসেবে তাই বলা যায়। যদিও এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানে না সে।
তাহলে আমার ওপর নজর রাখতে চাইছে সে, তাই না?
অযথা নিজেকে প্রলুব্ধ কোরো না! এতদিন তোমাকে মনে রাখার কোন কারণ ছিল না ওর, কিন্তু ফিরে এসে লেযি-এন রেঞ্জে যখন পা রেখেছ, সঙ্গে সঙ্গেই তোমার ব্যাপারে সচেতন হয়েছে সে, কারণ বেন স্লেজেলের মত লোককে। কখনোই উপেক্ষা করা যায় না। বাধ্য হয়েই তোমার ওপর নজর রাখছে টম। নোলান।
জানি।
সিগারে পাফ করল কিনলে, ফু দিয়ে ধোয়া ছেড়ে একটা চাকতি তৈরি করল বাতাসে। বুড়ো ভাল মজুরি দেয়, স্লেজেল, দার্শনিক সুরে খেই ধরল সে। আমাকে ভাড়া করার একটা কারণ বলেছি তোমাকে, আরেকটা কারণ কিন্তু বলিনি। অন্যদের সামনে বলার ইচ্ছে ছিল না, এবার বোধহয় বলা যেতে পারে।
আমাকে বলতে চাইছ কেন?
খুব একটা নিশ্চিত নই আমি। তুমি কি জানতে চাও না?
কিন্তু বলার জন্যে তোমাকেই বেশি আগ্রহী মনে হচ্ছে।
নড করল ডিটেকটিভ। মিসেস নোলান সম্পর্কে কতটা জানো?
ক্যাস্টানে পরিবারের বড় মেয়ে ছিল মহিলা, ল্য, ডলোরেস ক্যাস্টানের বড় বোন। কখনও মহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়নি আমার। মহিলা যখন এখান থেকে চলে যায় একেবারে বাচ্চা ছিলাম আমি। সত্যি কথা বলতে কি, মিসেস ব্রেনেলকেও ঠিকমত মনে নেই। জেফরিকে জন্ম দেয়ার সময় মারা যায় ডলোরেস ব্রেনেল। সবাই তো বলে দারুণ সুন্দরী ছিল মহিলা, কার্ল ব্রেনেল ওর কথা কখনোই ভুলতে পারেনি।
নিভে যাওয়া সিগার আবার ধরাল কিনলে, আগুনের শিখার ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছে বেনকে। লয় নোলান কখনও ফিরে আসেনি বেসিনে, তাই না?
হ্যাঁ। লোকজনের কাছে শুনেছি দক্ষিণের কোন এক শহরে মাসক্ত হয়ে শেষে মারা গেছে মহিলা। তুমি কি মনে করো, কিনলে, টম নোলানের সঙ্গে বাস করা কি খুব স্বাস্থ্যকর ব্যাপার? ক্ষীণ হাসল বেন। আমার তো মনে হয় গাট-হুক বুড়োর সঙ্গে থাকতে গেলে মদ বা কোন একটা অবলম্বন আঁকড়ে ধরা ছাড়া উপায় নেই।
বেনের সূক্ষ্ম বিদ্রূপ গ্রাহ্য করল না ডিটেকটিভ। মজার ব্যাপার কি জানো, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টম নোলান আর কার্ল ব্রেনেলের মধ্যে সদ্ভাব ছিল। দুটো র্যাঞ্চের শত্রুতার শুরু কিন্তু ডলোরেসের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে দেওয়া জমি নিয়ে।
নড করল বেন–শোনা কথা সব। টেরিটরি সরকারের অনুমোদিত হলেও ক্যাস্টানেডাদের দলিল কিন্তু পুরোপুরি নির্ভেজাল নয়, অন্তত আইনের দিক থেকে। দুই বোনই একমত ছিল এ ব্যাপারে। বড় বোন হিসেবে রিও ফ্রিয়োর পুব অংশটা দাবি করে ল্য ক্যাস্টানেড়া, আর ডলোরেস পায় পশ্চিম অংশ। সূর্য সেরা জমি পেলেও পাহাড়ী এলাকাটা জোটে ডলোরেসের ভাগ্যে। টম, নোলানের তাতেই সন্তুষ্ট হওয়া উচিত ছিল।
মাথা নাড়ল ডড কিনলে। কিন্তু কখনোই সন্তুষ্ট ছিল না সে, কিংবা দুই বোনও ছিল না। ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর, ব্যক্তিগত অসন্তোষ আর ঈর্ষা। রোগের মত সংক্রমিত হচ্ছিল ওদের মধ্যে অন্তত টম নোলানের ক্ষেত্রে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অথচ সেরা জমিটা পেয়েছে সে, সমৃদ্ধিও জীবনে কম আসেনি তার। তারপরও কি এক অতৃপ্তিতে যেন পেয়ে বসেছে মানুষটাকে। এখনও প্রায়। সাধারণ জীবন যাপন করে সে, প্রায়ই জাকাল র্যাঞ্চ হাউস ছেড়ে খোলা প্রান্তরে গিয়ে ঘুমায়। সাধারণ মাংস আর বীনই পছন্দ করে।
আসলে কি চায় সে, এতদিন পর হিসেব মেলানোর দরকার পড়ল কেন?
চোখ তুলে তাকাল ডিটেকটিভ। স্ত্রীর সঙ্গে কখনোই সদাচারণ করেনি নোলান, নিজেই স্বীকার করেছে। অপরাধবোধ তাড়া করছে ওকে। মিসেস নোলানের শেষ জীবনের দিনগুলি কেমন কেটেছে, কোথায় কেটেছে জানতে চাইছে লেযি-এন কস্। আমাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছে। ঠিকই বলেছ তুমি। অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ে মিসেস নোলান, এখান থেকে এল পাসোতে চলে যায় মহিলা।
শুনে সত্যিই খারাপ লাগছে।
মৃত্যুর আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ল্য নোলান। যে নার্স ওর সেবা করেছিল, মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেছি আমি। মরার আগে অদ্ভুত এক গল্প বলেছে ওকে মিসেস নোলান, শেষ মুহূর্তের স্বীকারোক্তি বলতে পারো। মেয়ে নয়, সন্তান হিসেবে একটা ছেলে প্রত্যাশা করেছিল টম নোলান, যাতে ওর সাম্রাজ্যের হাল
ধরে রাখতে পারে সে-আরেকজন নোলান হতে পারে!
টম নোলানের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু সন্তান জন্ম নেয়ার সময় র্যাঞ্চের কাজে বাইরে ছিল সে। ওখানেই খবরটা পায়-একটা মেয়ের জন্ম হয়েছে।
শ্রাগ করল বেন। ওর প্রত্যাশা অ্যাগনেস যে একেবারে পূরণ করেনি তা বলা যাবে না।
টম নোলান কিন্তু মোটেই খুশি হয়নি তখন। সন্তানকে মেনে নিয়েছিল সে, কিন্তু সূর্য নোলানকে মেনে নেয়নি। বছর ঘোরার আগেই তাকে ছেড়ে চলে যায় মহিলা, অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে।
একটু আগে বলেছি, মহিলার নার্সটির সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। শেষ দিকে বিকারগ্রস্ত ছিল মিসেস নোলান, পাগলের মত হাসত। বলত উচিত শিক্ষা দিয়েছে। টম নোলানকে, প্রতিশোধ নিয়েছে। মহিলা দাবি করত একটা অভিশাপ রেখে গেছে টম নোলানের জন্যে। সব শুনে সত্যিই আগ্রহী হয়ে উঠি আমি, ভুলেই গিয়েছিলাম টম নোলানের হয়ে কাজ করছি।
কয়েকটা সূত্র বাকি রয়ে গেছে এখনও। কিছু রেকর্ড যাচাই করার জন্যে কাউন্টি অফিসে যাচ্ছি আমি। কিন্তু তোমাকে একটা কাজ দিয়ে যাব, দয়া করে কাজটা করে দেবে?
বলো।
আমার ফিরে আসা পর্যন্ত লেযি-এন থেকে দূরে থেকো।
তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ল বেন।
কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জেনেই ফিরে আসব আমি।
ঠাণ্ডা মাথায় আমার ভাইকে খুন করেছে হারকার। ওকে চাই আমার, এবং অন্য ভাইটাকেও নিয়ে আসতে চাই, কারণ, এখানেই থাকার কথা ওর।
যৌক্তিক দাবি, কিন্তু দুটো দিন দেরি করলে এমন কিছু যাবে-আসবে না।
দেখো, কিনলে, তুমি নিজেই বলেছ দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে টম নোলানের হয়ে কাজ করছ। একটা হচ্ছে কার্ল ব্রেনেলের খুনীর পরিচয় জানা, আরেকটা কাজ মিসেস নোলানকে ট্রেস করা। দ্বিতীয় কাজটা সাফল্যের সঙ্গে করেছ, কিন্তু প্রথমটার ব্যাপারে, সত্যি কথা বলতে কি, তোমাকে খুব একটা আগ্রহী মনে হচ্ছে না। সুতরাং দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হচ্ছে, কারণ মাথা যার, ব্যথাও তার!
হয়ত দুটো কারণই পরস্পারের সঙ্গে সম্পর্কিত, কখনও কি ভেবেছ তুমি?
না।
আমার ধারণা কিন্তু সেরকমই, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেনকে দেখছে কিনলে, নীল চোখে প্রত্যাশা ফুটে উঠল। এবার দয়া করে আমি ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। করবে?
না।
শ্রাগ করল ডিটেকটিভ। যত দ্রুত সম্ভব কাউন্টিতে পৌঁছা’র চেষ্টা করব, খোদার কাছে প্রার্থনা করছি আমার সন্দেহই যেন সত্যি হয়। আশা করছি রক্তপাত শুরু হওয়ার আগেই ফিরে আসতে পারব।
তাতে কি হবে? তাচ্ছিল্যের হাসি বেনের ঠোঁটে। টম নোলান ভাল মানুষ হয়ে যাবে? আজীবন ডাবল-বি কিংবা অন্যান্য বাথানের ওপর যেসব অন্যায় করেছে, সেজন্যে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবে?
গম্ভীর হয়ে গেল ডড কিনলে, সরু চোখে দেখল বেনকে। অতীতের কথা জানি না, কিন্তু টম নোলান এখন ভিন্ন একজন মানুষ। কে জানে, কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যুও একটা কারণ হতে পারে। এটা তো ঠিক, একসময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল দু’জন। নিজের হাত পরিষ্কার রাখতে চাইছে নোলান, ওর ধারণা ব্রেনেলের মৃত্যু রহস্যের কিনারা না হওয়া পর্যন্ত বেসিনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, রক্তারক্তি বেধে যেতে পারে। সেটাই এড়াতে চাইছে কেউ।
মা-র চেয়ে মাসীর দরদ বেশি দেখছি!
কারণও আছে। টম নোলানের ধারণা তৃতীয় একটা পক্ষ আছে এসবে-দুই বাথানের শত্রুতার ফায়দা লুটতে চাইছে সে।
আনমনে মাথা নাড়ল বেন, নিজের মনে উল্টে-পাল্টে দেখল ধারণাটা, তারপর বাতিল করে দিল। হতে পারে, এ নিয়ে ভাবার বিলাসিতা নেই আমার। সারা জীবন যা দেখেছি, সেটাই বিশ্বাস করব আমি। অন্যরাও তাই করবে।
তুমি কি বিশ্বাস করো কার্ল ব্রেনেলকে খুন করিয়েছে নোলান?
এবার ভাবতে হলো বেনকে। নিজে সে করেনি কাজটা, কে জানে হয়তো ওর কোন ক্রু করেছে–ভাড়াটে লোকের অভাব নেই এ দেশে।
উঁহু, টম নোলান এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র জানে না। ক্রুদের কাউকে নির্দেশ দেয়নি সে, এবং কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যুর পর সব ক্রুকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল-কেউ স্বীকার করেনি। প্রত্যেকের অ্যালিবাই যাচাই করেছি আমি। সেদিন রিও ফ্রিয়োর ধারে-কাছেও ছিল না এদের কেউ।
তাতে কি প্রমাণ হলো?
আরও একটা পক্ষ আছে বেসিনে, খুবই ধুরন্ধর কোন লোক আছে এসবের পেছনে। কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যুর কারণে অশান্ত হয়ে ওঠা পরিস্থিতিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে সে। বিল ব্রেনেলের মৃত্যু স্রেফ এর জের মাত্র।
একটু পর হয়তো বলবে স্টিভ হারকারও নির্দোষ! বিদ্রুপের সুরে অসন্তোষ প্রকাশ করল বেন।
ডাবল-বি বা লেযি-এন স্রেফ দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে দুই আউটফিটের মধ্যে তেমন কোন রক্তপাতের ঘটনা ঘটেনি; পরিস্থিতি মোটামুটি শান্তই ছিল। কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যু দিয়ে শুরু, প্রায় নখ দন্তহীন হয়ে পড়ল ডাবল-বি। তুমি আসায় আবারও শুরু হলো সংঘর্ষ…
সেজন্যে শুধু লেযি-এনকেই দায়ী করা যায়, ডিটেকটিভের মুখের কথা কেড়ে নিল বেন।
হয়তো, কিন্তু এসবের পেছনে টম নোলানের কোন মদদ নেই। নিজের মুখে স্বীকার করেছে সে, কিছু কিছু ঘটনা ওর নির্দেশ ছাড়াই ঘটছে।
তার মানে ঘরেও শক্ত আছে তার, তাই তো বলতে চাইছ?
ব্যাপারটা ওরকমই দাড়াচ্ছে।
নীরব হয়ে গেল দু’জনেই। আনমনে সম্ভাবনাটা বিচার করছে বেন, প্রায় অসম্ভব হলেও ধারণাটা একেবারে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। জ্যাক হারলোর কথায়ও এরকম একটা ইঙ্গিত ছিল। তাহলে লেযি-এন বস্ এখন আর ক্রুদের সামলে রাখতে পারছে না? কে এদের নিয়ন্ত্রণ করছে, স্টিভ হারকার?
সম্ভব। কিন্তু নিশ্চিত বলা যাবে না। টম নোলান চরমপন্থী বা নিষ্ঠুর বটে, কিন্তু চাতুরি বা হীন কৌশল প্রয়োগ করা ধাতে নেই তার, আজীবন তাই দেখে এসেছে বেন। বুড়ো বয়সে এসে মানুষটার অধঃপতন হয়েছে, ভাবতে বাধছে ওর। কিন্তু ডাবল-বি বন্ধকী রাখল কেন? এ ব্যাপারটাই খটকা জাগায়।
রাজি আছ আমার প্রস্তাবে? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল কিনলে।
মাথা নাড়ল বেন। স্টিভ হারকারকে ধরে আনব আমি, কিনলে, এটাই হচ্ছে আসল কথা। তবে আরও একটা কাজ করব, সরাসরি কথা বলব টম নোলানের সঙ্গে। হারকারকে যদি বিনা শর্তে আইনের কাছে সোপর্দ করে, তাহলে বুঝব সত্যিই আন্তরিক সে–বেসিনে অশান্তি চায় না, কিংবা কার্ল ব্রেনেলের খুনের কিনারা হোক দেখতে চায়। যাই ঘটুক, শিগগিরই লেযি-এনে বাথানে যাচ্ছি আমি!
শ্রাগ করল ডড কিনলে, কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিবৃত্ত করে নিল নিজেকে। বেন স্লেজেলের মুখের দৃঢ় পেশী আর চোয়াল দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যাবে না জেদী, একগুয়ে লোকটিকে।
একটা হাত বাড়িয়ে দিল বেন। এখানে আসার জন্যে ধন্যবাদ।
ভুলে যাও। আশা করছি তোমাকে সাহায্য করতে পারব। হয়তো ফিরে এসে দেখব দেরি হয়ে যায়নি তখনও।
হতে পারে, অ্যামিগো।
ভ্যায়া কন ডিওস (ঈশ্বর তোমার সহায় হোন), স্লেজেল।
ভ্যায়া কন ডিওস।
ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল বেন, একটু পর দক্ষিণের প্ৰেয়ারিতে হারিয়ে গেল ওর ঘোড়া।
নতুন একটা সিগার ধরাল ডড কিনলে। কুঁচকে উঠেছে জোড়া ভুরু। চিন্তিত মনে স্টেবল থেকে বেরিয়ে এসে ঘোড়ায় চড়ল। স্পার দাবাল সে, তারপর উত্তরের পাহাড়সারির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। জানে ঘোড়াটার ওপর দিয়ে ধকল যাবে, কিন্তু উপায় নেই। বেসিনের অশান্তি চিরতরে মিটিয়ে দেয়ার জন্যে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরী হয়ে পড়েছে, এবং ষাট মাইল দূরের কাউন্টি অফিসের রেকর্ড ঘেঁটে গোপন তথ্য জানতে হবে ওকে। যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসতে হবে, বেন স্লেজেল বেপরোয়া হয়ে লেযি-এনের ওপর চড়াও হওয়ার আগেই।
টম নোলানের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সুযোগ কি পাবে বেন স্লেজেল? আনমনে ভাবল কিনলে, মনে হয় না। সম্ভবত তার আগেই খুন হয়ে যাবে স্টিভ হারকারের হাতে, কিংবা কারাঞ্চো বা মোরিসের হাতে।
প্রথমে দক্ষিণে এগোলেও মাঝরাতের পর দিক বদলে ঠিক উল্টোদিকে এগোল বেন স্নেজেল, পাহাড়সারির সমান্তরালে এগিয়ে ব্রাভো ক্রীকের ফোর্ড পেরিয়ে লেযি-এন জমিতে পা রাখল। ক্রীকের বাকের মুখে একটা লাইন ক্যাম্প এড়িয়ে গেল ও, তারপর নিচু পাহাড়ী এলাকা ধরে দক্ষিণ-পুবে এগোল। পাহাড় বা ট্রেইলে আড়াল পাওয়ার মত পরিবেশ নেই, খানিকটা হলেও উদ্বিগ্ন মনে এগোতে হচ্ছে ওকে। অনায়াসে যে কারও চোখে পড়ে যেতে পারে, কারণ নিজের সীমানায় কয়েকটা লাইন ক্যাম্পে পাহারা বসিয়েছে টম নোলান। এভাবেই রাসলার আর অনাকাঙ্ক্ষিত রাইডারদের অনুপ্রবেশ ঠেকিয়েছে সে।
ঘণ্টা দুই টানা চলার পর নিরাপদে মালপেই ভ্যালিতে পৌঁছল ও। সবে ডোর হচ্ছে তখন, পুব আকাশের কোলে গোলাপী বিছানায় আড়মোড়া ভাঙছে সূর্য। পর্যাপ্ত পানি আর ঘাস আছে এমন একটা অগভীর ড্র-তে ঘোড়া রেখে রীমের ওপর উঠে এল বেন। কিনারে এসে মাটির ওপর শুয়ে পড়ল, হাতে কার্ল ব্রেনেলের জার্মান ফিল্ড গ্লাস। লেযি-এন হেডকোয়ার্টারের ওপর নজর রাখছে।
জায়গাটাকে ক্যাটক্ল, অ্যাকাসিয়া আর বুনো ঝোঁপের নরক বলা চলে। তীক্ষ্ণ সুচাল শরীরের পাথর, বোন্ডার আর বুনো কাটা ঝোঁপ জাতীয় গাছ তো রয়েছেই। বেশিরভাগ গাছ শুকিয়ে মরে গেছে, কিন্তু খোঁচা খোঁচা দাড়ির মত মাটির ওপর বেরিয়ে আছে ওগুলোর মূল। অবস্থা এমন যে জায়গাটা পার হওয়া প্রায় অসম্ভব, নেহাত প্রয়োজন ছাড়া এখানে আসে না কেউ। কিন্তু এত অসুবিধের পাশাপাশি বিরাট একটা সুবিধাও আছে। ম্যালপেই ভ্যালির কিনারা থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত লেযি-এন হেডকোয়ার্টারের পুরোটাই স্পষ্ট চোখে পড়ে।
কাজটা সত্যিই কঠিন হবে। ঝুঁকি নিতে হবে। হারকার, মোরিস, স্লিম, কার্লি, কারাঞ্চো, এবং সম্ভবত জেফরির মুখোমুখি হতে হবে। চোখ বন্ধ করে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করল বেন, শীতল অনুভূতি হচ্ছে, অস্বীকার করার উপায় নেই এতগুলো বিপজ্জনক লোকের মুখোমুখি হওয়ার চিন্তাটাই অস্বস্তিকর।
ক্ষৌরিহীন চিবুকে হাত ঘষল বেন। ধারণাটা মন্দ নয়, কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে, সমস্যাটা এখানেই। হয়তো দেখা যাবে কাজের কাজ কিছু হবে না, স্রেফ ধরা পড়ে যাবে ও। নিজের সাম্রাজ্যে টম নোলন, সত্যিই বেপরোয়া, হিংসুটে ইন্ডিয়ানদের মত সবকিছু আগলে রাখে সে। যে কোন কিছু। গাট-হক রেঞ্জ থেকে এ পর্যন্ত কেউ কিছু ছিনিয়ে আনতে পারেনি, যদি না নোলান নিজে সুযোগ দিয়ে থাকে। একাধিক লোক সেই চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মাথা হারিয়ে সেই ভুলের মাশুল দিয়েছে। চড়া বেতনের বিনিময়ে ক্রুদের কাছ থেকে দুটো জিনিস আদায় করেছে টম নোলান: মারকুটে স্বভাব আর বিশ্বস্ততা।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। সূর্য একসময় মাথার ওপর উঠে এল, পিঠ তাতাচ্ছে এখন। কিন্তু অনড় পড়ে আছে বেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে লেযি-এন। হেডকোয়ার্টার।
দিনের বেলায় কিছু করতে যাওয়া বোকামি হবে, সামান্য সম্ভাবনাও নেই ওর। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেন, তারপর নিজের খেলা খেলবে। গাট-হুক ক্রুরা জানে বুকে একটা টিনের তারা ঝুলিয়েছে ও, এবং ওকে আশা করছে লোকগুলো। কি ধরনের অভ্যর্থনার আয়োজন করেছে কে জানে, কিন্তু সেটা যে ওর জন্যে সুখকর কিছু হবে না সেটা নিশ্চিত।
পরিণতিতে হারুক বা জিতুক, খেলাটা খেলতেই হবে ওকে।
১২. ধীরে ধীরে অন্ধকার নামল প্ৰেয়ারিতে
ধীরে ধীরে অন্ধকার নামল প্ৰেয়ারিতে। ম্যালপেই রীজের ঢাল বেয়ে নেমে এল গাঢ় একটা ছায়া। দীর্ঘ আঁচড়ের মত আড়াআড়ি চলে যাওয়া অগভীর অ্যারোয়ো ধরে এগোল, নরম মাটিতে স্বতঃস্ফুর্ত পা ফেলছে। ব্রাভো ক্রীকের দক্ষিণ শাখার। কাছে শেষ হয়েছে অ্যারোমোটা, আর ব্রাভো ক্রীকের মূল শাখা ঘুরপথে লেযি-এন র্যাঞ্চ হাউসের পেছন দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
টম নোলানের পরিকল্পনায় কোন খুঁত নেই। আশপাশের জমি থেকে বেশ উঁচুতে হেডকোয়ার্টার তৈরি করেছে। বেন প্রায়ই ভাবত বাড়িটা তৈরি করার সময়। বুড়োর মনে কি ছিল, কারণ বাড়িটার অবস্থান এমন যে ইচ্ছে করলে যে কেউ হামলা করতে পারবে; এবং এও সত্যি সেই হামলা ঠেকানোর উপযুক্ত ব্যবস্থাও রেখেছে লেযি-এন বস্। প্রচুর খাবার-পানি, লোকবল, পর্যাপ্ত অ্যামুনিশূন…কিসের অভাব আছে এখানে? বিশাল অ্যাডোবি দালানে হানা দিয়ে সফল হতে বোধহয়। দানবীয় শক্তি দরকার, একমাত্র কোন আর্টিলারির পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু এখন মাত্র একজন তোক সেই কাজটা করতে যাচ্ছে।
ব্রাভো ক্রীকের কাছে এসে অ্যারোয়ো ছেড়ে উঠে এল ও, পশ্চিম পাড় ধরে এগোল এবার। কিছুক্ষণের মধ্যে বাঙ্ক হাউসের কাছাকাছি পৌঁছে গেল, সেটাকে। পাশ কাটিয়ে মূল দালানের দিকে এগোল। জানালায় হলুদ আলো চোখে পড়ছে। কাছে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেল, তারপর সন্তর্পণে সরে এল একটা জানালার কাছে, উঁকি দিল ভেতরে।
স্টোভের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে তিনজন লোক। স্লিম, কার্লি আর অপরিচিত এক লোক। পোশাক আর ভাবভঙ্গি দেখে অনায়াসে পরিচয় বোঝ যাচ্ছে: লেযি-এন ভ্যাকুয়েরো।
জানালাটা আধ-খোলা। তিনজনের কথাবার্তা শোনার জন্যে কিছুটা ঝুঁকতে হলো ওকে।
চাঁদ ওঠার পর কারাঞ্চোকে সঙ্গে নিয়ে মালপেই ভ্যালিতে চক্কর দিতে বলেছে স্টিভ, বলছে অপরিচিত লোকটা। ওর সন্দেহ…
সশব্দে স্টোভে থুথু ফেলল কার্লি। ও ভাবছে ওখানেই আছে স্নেজেল, তাই, রেড?
শ্রাগ করল লোকটা। তাই তো মনে হচ্ছে। বোঝো অবস্থা, এমনিতে দিনের বেলায় জায়গাটা পছন্দ হয় না আমার, তারওপর সঙ্গে একটা র্যাটলকে নিয়ে যেতে হবে! ওর সঙ্গে চলতে গেলে যে কারও পেটে শিরশিরে অনুভূতি হবে।
সমঝদারের ভঙ্গিতে নড় করল স্লিম। স্লেজেলের জন্যে করুণাই হচ্ছে আমার। কঠিন, এক শত্রু তৈরি করেছে ও, আর যেই হোক কারাঞ্চো অন্তত সেদিনের কথা ভুলবে না। হারলোর মত কারাঞ্চোকেও খুন করা উচিত ছিল ওর। একে তো ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তারওপর ন্যাংটা করে ফেরত পাঠিয়েছে এখানে। একজন ইন্ডিয়ানের জন্যে এটাই সবচেয়ে বড় অপমান। তাছাড়া কারাঞ্চো পুরো ইন্ডিয়ানও নয়, দো-আঁশলা হওয়ায় ওর রক্তে তেজও বেশি।
রাইফেল তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল রেড। বাড়িতে আছে কে?
মুখ তুলে তাকাল কার্লি। বুড়ো, স্টিভ, ফ্রেড আর ওই ছেলেটা।
জানালা থেকে সরে গেল বেন, কিছুটা দূরে এসে দরজার ওপর চোখ রাখল। বেরিয়ে এসে পেছনে দরজা ভিড়িয়ে দিল রেড। পোর্চে দাঁড়িয়ে দূরে ম্যালপেই। ভ্যালির দিকে তাকাল সে, ঘুণাক্ষরেও টের পেল না দু’হাত দূরে চলে এসেছে বেন। জ্ঞান হারানোর আগেও তার মগজে রুক্ষ কঠিন জায়গাটার স্মৃতিই জমা থাকল, বাম কানের পেছনে রাইফেলের বাটের আঘাতে মুহূর্তের মধ্যে চেতনা হারাল সে।
দুই কজি চেপে ধরে টেনে রেডের অজ্ঞান দেহ বার্নে নিয়ে এল বেন। মুখে ব্যান্ডানা গুঁজে দিয়ে বাঁধল তাকে, তারপর খড়ের গাদায় ফেলে রেখে বেরিয়ে এল। তবে তার আগে লোকটার হোলস্টার থেকে কোল্ট বের করে নিজের বেল্টে খুঁজে নিয়েছে। দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ও, দেখল অস্পষ্ট একটা ছায়া। নড়ছে দরজার কাছে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না ওকে। ছুটে এল গাঢ় ছায়াটা, প্রায় নিঃশব্দে। খানিকটা নিচু হয়ে গেল বেন, কাঁধ দিয়ে আঘাত করল ছুটে আসা শরীরটাকে। বেমক্কা আঘাত পেয়ে হুঁক করে পেটের সব বাতাস ছেড়ে দিল লোকটা, ককিয়ে উঠল যন্ত্রণায়। লোকটা কারাঞ্চো, হাতে ভয়াল দর্শন একটা চুচিলো, এক পোচে বেনের গলা কেটে ফেলার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সজোরে কারাঞ্চোকে ঠেলে দিল বেন, একটা পোস্টের সঙ্গে সংঘর্ষ হলো হাফ-ব্রীডের। কিন্তু এরই মধ্যে ছুরি চালিয়েছে সে, বেনের জ্যাকেটে আদুরে স্পর্শ বুলিয়ে চলে গেল ধারাল ফলা। অজান্তে কিছুটা পিছিয়ে এল বেন, দেখল এবার বুনো আক্রোশে এগিয়ে আসছে লোকটা। বাতাসে কয়েকবার ছুরি চালাল, যেন বুঝিয়ে দিল একটু পর এভাবেই কচুকাটা করবে ওকে।
পিছাচ্ছে বেন, দ্রুত লয়ে শ্বাস ফেলায় কর্কশ শব্দ হচ্ছে। এদিকে একেবারেই নিরুদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কারাঞ্চোকে। শিকার কোণঠাসা হয়ে গেছে বুঝতে পেরে রীতিমত উল্লাস বোধ করছে।
গুলি করে কাজটা শেষ করে ফেলার ইচ্ছে অদম্য হয়ে উঠছে বেনের মনে, কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রাখল। গুলির শব্দে সমস্ত পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে। সুতরাং খালি হাতে হাফ-ব্রীকে মোকাবিলা করতে হবে।
দেয়ালে ঠেকে গেল ওর পিঠ, ঠিক সেসময় ছুটে এল কারাঞ্চো। এড়ানোর উপায় নেই দেখে আগেই হামলা করা মনস্থ করল বেন, এক পা এগিয়ে লাথি হাঁকাল হাফ-ব্রীডের শরীরের ডান পাশে, একইসঙ্গে হাত বাড়িয়ে কারাঞ্চোর ডান কজি চেপে ধরল। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এবার ওপর-নিচে টান দিল। অস্ফুট শব্দে ককিয়ে উঠল দো-আঁশলা, এই প্রথম কোন শব্দ বেরোল মুখ দিয়ে। সপাটে লোকটার মুখে ঘুসি হাঁকাল বেন, থ্যাচ করে শব্দ হলো হাতের গাঁটের সঙ্গে ঘর্মাক্ত মুখের সংঘর্ষে। দু’পা পিছিয়ে গেল কারাঞ্চো, টলমল করছে। তাকে সুযোগ দিল বেন, চটজলদি একটা হুক কষাল হাফ-ব্রীডের, চিবুকে। উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল সে, কিন্তু ওঠার সুযোগ পেল না। ততক্ষণে তার পিঠের ওপর চেপে বসেছে বেন, হাতে কারাঞ্চোর ছুরি। নিষ্ঠুর আক্রোশে ছুরি চালাল ও, অনুভব করল আড়ষ্ট হয়ে গেছে লোকটার দেহ, কয়েকটা খিচুনি দিয়েই স্থির হয়ে গেল।
উঠে দাঁড়াল বেন। ঘাম জমেছে মুখে, হাতের চেটো দিয়ে ঘাম মুছল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। ইশশ, আরেকটু হলে গেছিল আজ!
কয়েকটা বস্তার পেছনে টেনে নিয়ে এল কারাঞ্চোর লাশ, তারপর ফিরে এসে মেঝে থেকে রক্তের দাগ মুছে ফেলল। বস্তার ফাঁকে ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলল। কারাঞ্চোকে নিয়ে ম্যালপেই রীজে যাওয়ার কথা রেডের, মনে হয় না আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওদের খোঁজ করবে কেউ। মানুষ শিকার করতে গিয়ে নিজেই শিকার হয়ে গেছে কারাঞ্চো, আর আরেকজন জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে সবচেয়ে ঘৃণ্য লোকটির পাশে!
বাঙ্ক হাউসের কাছে ফিরে এল বেন, জানালা দিয়ে চোখ রাখল আবার। এখনও স্টোভের পাশেই রয়েছে স্লিম আর কার্লি। দেয়ালের লাগোয়া মই বেয়ে ছাদে উঠে এল ও, চিমনির দিকে এগোচ্ছে। ব্যান্ডানা আর বার্ন থেকে আনা চটের বস্তা দিয়ে চিমনির মুখ মুড়ে দিল। দেখল ছাদে শুকাতে দেয়া হয়েছে বেশ কিছু কাঠের চেলা। ওগুলোর পেছনে এসে অবস্থান নিল ও। বাঙ্ক হাউসের ভেতরে খিস্তি করল কেউ, অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেল বেন। চিমনির মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নগদ ফলাফল শুরু হয়েছে।
মিনিট খানেক পর মই বেয়ে উঠে এল এক লোক। পরিষ্কার আকাশের বিপরীতে স্লিমের দেহ স্পষ্ট ফুটে উঠল। চিমনির দিকে এগোচ্ছে লোকটা। বন্ধ চিমনির ওপর ঝুঁকে পড়ল সে, ঠিক তখনই কানের পাশে কোল্টের শীতল নলের অস্তিত্ব অনুভব করল। অজান্তে কেঁপে উঠল লোকটার দেহ।
অজ্ঞান করে তাকেও বাঁধল বেন, মুখে কাপড় ঢুকিয়ে দিয়েছে। হেঁটে ছাদের অন্য কিনারে চলে এল ও, তারপর কিনারা ধরে শরীর ঝুলিয়ে দিল। ছোট্ট লাফে নেমে এল নরম মাটির ওপর। বাঙ্ক হাউসের চারপাশে এক চক্কর দিয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। খোলা দরজা দিয়ে ধোয়ার মেঘ বেরিয়ে আসছে।
নিকুচি করি তোমার, স্লিম! খেপা স্বরে চিৎকার করল কার্লি। করছটা কি? এখনও চিমনির মুখ পরিষ্কার করতে পারোনি?
উত্তর এল না।
কিছুক্ষণ পর রেগেমেগে বেরিয়ে এল কার্লি।
আঘাত করল বেন। কিন্তু যুৎসই হয়নি মারটা। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল কার্লি। আরে! হচ্ছেটা কি…! সবিস্ময়ে বলে উঠল সে, কিন্তু বেনের বুটের লাথি চিবুকে এসে পড়তে প্রশ্নটা আর করা হলো না।
অন্যদের মত কার্লিরও গতি করল বেন, বাঙ্ক হাউস থেকে দূরে সরিয়ে নিল তাকে। তারপর ছাদে উঠে ব্যান্ডানা আর চটের বস্তা সরিয়ে দিল চিমনি থেকে, মই বেয়ে নেমে এল মাটিতে। মই সরিয়ে বাঙ্ক-হাউসের দরজা বন্ধ করে দিল।
চাঁদের আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে ওঠার আগেই মূল বাড়িতে ঢুকতে হবে। সময় কম কিন্তু বেন এখনও নিশ্চিত জানে না ভেতরে স্টিভ হারকার। আছে কিনা। নিচু হয়ে খিচে দৌড় দিল ও, গেট পেরিয়ে বাগানে ঢুকে পড়ল। বাড়ির দক্ষিণ অংশে ফুলের বাগান। এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে বাগানটা, কিন্তু একটু পরেই চাঁদের আলোয় ভেসে যাবে সবকিছু। প্রশস্ত ব্যালকনি থেকে অনায়াসে যে কারও চোখে পড়ে যাবে ও।
গেটের হুড়কো খুলতে যেতে আচমকা পদশব্দ শুনতে পেল বেন? ঝটিতি ঘুরে দাঁড়াল। পাঁচ ফুট দূরে ক্ষীণ একটা কাঠামো দেখা যাচ্ছে। স্রেফ রিফ্লেক্সের বশে পিস্তল বের করে ফেলেছিল, কিন্তু লোকটাকে চিনতে পেরে নিজেকে সামলে নিল। জেফরি ব্রেনেল।
বেন!
কষে যেন চড় মেরেছে ওকে কেউ, নিখাদ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল বেন। জেফরি যেন মেয়েলি কণ্ঠে কথা বলছে, কারণ স্বরটা ওর নিজের বোনের মিরিয়ামের।
আমি, বেন!
হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে নিজের দিকে টেনে আনল বেন, গেটের আড়ালে দাঁড়াল। আরেকটু হলে তোমাকে গুলি করে ফেলেছিলাম! অস্ফুট স্বরে বলল ও।
জেফরির পোশাক পরেছি আমি, দূর থেকে দেখলে হয়তো…
এখানে কি করছ?
ওর চোখে চোখ রাখল মেয়েটা। একা এসেছ তুমি, কারও না কারও সাহায্য তো তোমার দরকার হতেই পারে।
ঈশ্বরের কৃপা দরকার, আর কিছু নয়! বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল বেন।
জ্যাকেট খামচে ধরে নিজের দিকে বেনকে ফেরাল মিরিয়াম। না, বেন! এভাবে বিপদের মধ্যে তোমাকে যেতে দেব না আমি!
একটা শব্দও উচ্চারণ করল না বেন, ঝুঁকে মিরিয়ামের কপালে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েই ঘুরে দাঁড়াল। নিঃশব্দে হুড়কো সরিয়ে গেটের পাল্লা সরিয়ে দিল। ভেতরে ঢুকে পড়ল ও, পেছনে তাকাল না। জানে অনুসরণ করছে মেয়েটা। ছায়াঘেরা গাছের আড়ালে পৌঁছে ফিরে তাকাল ও, পাশে এসে দাঁড়ানো মিরিয়ামের দিকে ফিরল এবার। এখানেই থাকো, চাপা স্বরে নির্দেশ দিয়ে বাড়ির দিকে এগোল ও। দেয়াল টপকে বাগানের নরম মাটিতে পা রাখল। চোখ তুলে দেখল দোতলায় টম নোলানের স্টাডিতে বাতি জ্বলছে।
বাগানের দেয়াল থেকে দোতলার ব্যালকনিতে উঠতে সমস্যা হওয়ার কথা। নয়। নিচু রেলিং-এ উঠে এসে থেমে কান পাতল বেন। ওর বামে আলোকিত একটা জানালা দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত অ্যাগনেসের কামরা। নিচে বাগানের দিকে তাকাল, অস্পষ্ট ভাবে স্ট্রবেরির শাখা দেখা যাচ্ছে। মিরিয়ামকে দেখা যাবে না। মেয়েটির সঙ্গে যে চালাকি করেছে, সেটা মনে পড়তে আনমনে হাসল বেন। স্টিভ হারকারকে ধরা পর্যন্ত মেয়েটা ওখানে থাকলেই স্বস্তি বোধ করবে।
ব্যালকনি ধরে এগোল ও, অ্যাগনেসের কামরার জানালার নিচে এসে দাঁড়াল। চৌকাঠ ধরে জানালা গলে ভেতরে ঢুকল। দেখল নরম কার্পেটে পায়চারি করছে মেয়েটা, লো-কাট গলার একটা ড্রেস পরনে, রেশমী চুলের গোছা তুলে রেখেছে মাথার ওপর। মুখে কালসিটে দাগ থাকার পরও, সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছে। অ্যাগনেসকে, যে কোন লোকের কাছেই কাক্ষিত মনে হবে, যদি না বেন স্লেজেলের মত একে চেনে সে।
জানালার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল মেয়েটা, একটা সিগারেট ধরাল। তারপর ঘুরে আবার পায়চারি শুরু করল। পেছনে নীল ধোয়ার মেঘ ছুটছে। অন্য কেউ হলে হয়তো ভাবত অনুশোচনায় পুড়ছে মেয়েটা, কিন্তু অ্যাগনেস ব্রেনেলের। মধ্যে জিনিসটা নেই, জানে বেন। কোন একটা পরিকল্পনা করছে নোলান-কন্যা, এবং সেটা নিশ্চয়ই ভাল কিছু নয়।
দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা ওয়ার্ডরোবের পাশে এসে দাঁড়াল বেন। দ্রুত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু উদ্দিষ্ট লোকটাকে এখনও খুঁজে পায়নি। জানালা পথে চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত প্ৰেয়ারি চোখে পড়ছে। ওর পাশেই দরজা খুলে গেল, ব্যালকনিতে বেরিয়ে এল অ্যাগনেস ব্রেনেল। রেলিং-এ হাতের ভর রেখে বাগানের দিকে তাকাল সে। গভীর চিন্তায় কুঁচকে আছে ভুরু দুটো। আচমকা কি যেন দেখতে পেল মেয়েটা, চিৎকার করার জন্যে মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
অ্যাগি? বাধ্য হয়েই ডাকল বেন, বাগান থেকে অ্যাগনেসের মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে।
চরকির মত ঘুরে দাড়াল অ্যাগনেস, চোখ সরু হয়ে গেছে। বেন! কি করছ এখানে?
ক্ষীণ হাসল ও। সেদিন জানতে চেয়েছিলে কেন ডাবল-বি ছাড়ছি না, মনে আছে? একটা প্রস্তাবও দিয়েছিলে, তোমার বাপের সঙ্গে যাতে হাত মেলাই।
ওকে নিরীখ করছে মেয়েটা। মিথ্যে বলছ, রেন? যদি তাই করে থাকো, খোদার কসম, কিছুক্ষণের মধ্যে ধরে ফেলব আমি এবং চিৎকার করব। স্টিভ হারকার, ফ্রেড মোরিস আর জেফরি ব্রেনেল মুহূর্তের মধ্যে নিচ থেকে চলে আসবে।
গ্লেসিয়াস, ভাবল বেন, ওদেরঅবস্থান আমাকে জানিয়ে দিয়েছ তুমি। কিন্তু নিচে যাওয়ার আগে সামনের মূর্তিমান আপদ টপকে যেতে হবে। এক হিসেবে মেয়েটা সত্যিই ভয়ঙ্কর, হয়তো স্টিভ হারকারের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
দেখো, অ্যাগি, দ্রুত বলল ও। জানি ডাবল-বি শেষ হয়ে গেছে। ফুটো পয়সাও ওদের কাছ থেকে পাব না। বিল মারা গেছে, তোমাদের পক্ষে যোগ দিয়েছে জেফরি। কিছু দিনের মধ্যে ডাবল-বির দখল নিয়ে নেবে তোমার বাবা, দুটো বাথান মিলে নিউ মেক্সিকোর সেরা বাথান হয়ে যাবে এটা। যে কোন লোক এখানে রাজার মতই বাস করবে, অ্যাগি।
সিগারেটের ছাই ঝাড়ল অ্যাগনেস, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভেতরে এসো, শেষে নিস্পৃহ স্বরে আমন্ত্রণ জানাল ওকে।
ভেতরে ঢোকার আগে আড়চোখে বাগানের দিকে তাকাল বেন। মিরিয়ামের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না।
দরজা আটকে পর্দা নামিয়ে দিল অ্যাগনেস। দুটো সিগারেট জ্বালিয়ে একটা বেনের ঠোঁটে তুলে দিল, তারপর বেন যে-চেয়ারে বসেছে তার হাতলে বসল। আরও কিছু বলল, এত সহজে সন্দেহ যাবে না আমার, মৃদু স্বরে বলল মেয়েটা, এক আঙুলে আলতো টোকা দিল বেনের বুকের তারায়। এটা কি ধরনের বোকামি?
হারকার বিলকে খুন করেছে, শুনেছ নিশ্চয়ই?
অ্যাগনেসের সুন্দর মুখে বিষাদ বা বেদনার কোন চিহ্ন নেই। বিল বরাবরই মাথামোটা ছিল, সহজ জিনিসটাও ধরতে সময় লাগত ওর। খারাপ লাগলেও বলতে হচ্ছে, এমন কিছুই পাওনা ছিল ওর। সবকিছু আমাকে খুলে বলেছে জেফরি, ক্ষীণ হাসল নোলান-কন্যা। তুমি সত্যিই ভাগ্যবান, বেন, নইলে বেঁচে গেলে কিভাবে! হারকার অনায়াসে তোমাকে ফেলে দিতে পারত!
পুরো রিও ফ্রিয়ো উপত্যকার মালিক হতে যাচ্ছে টম নোলান, তুমিই বলেছ। তখন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল ব্যাপারটা, কিন্তু কালই জানতে পারলাম কার কাছে ডাবল-বি বন্ধক রেখেছে বিল। কোনভাবেই দেনার টাকা শোধ দিতে পারবে না ওরা।
ওর দিকে ফিরে তাকাল অ্যাগনেস, চোখে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। বন্ধকের কথা কার কাছ থেকে শুনেছ?
মিরিয়াম বলেছে।
বাতাসে একটা রিং তৈরি করল মেয়েটা। ব্যাপারটা এমন ভাবে ঘটেছে যে বাবাকে জানানোর সুযোগ হয়নি…এখনও জানে না।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বেন। কি বলতে চাইছ?
আরেকটা রিং তৈরি করল অ্যাগনেস। আমি নিজেই রফা করেছি। মদ্যপ স্বামীকে ধার দিয়েছি এবং বন্ধক হিসেবে ডাবল-বিকে রেখেছি। বিল যেহেতু বেঁচে নেই এবং ওর উত্তরাধিকারীদের যথেষ্ট টাকা নেই, ডাবল-বি এখন আমার।
এমনিতেও ডাবল-বির একটা অংশ তোমার, অ্যাগি, তুমি যেহেতু বিলের স্ত্রী।
তীক্ষ্ণ হয়ে গেল চাহনি। তখন কিন্তু এভাবে ভাবিনি! যাকগে, আসল কথা হচ্ছে, এখন পুরো বাথানটাই আমার।
কাজটা নোংরা হয়ে গেল না?
বিতৃষ্ণায় নাক সিটকাল অ্যাগনেস, শেষে স্মিত হাসল। বিলের মদ কেনার টাকা জোগান দেয়ার বিনিময়ে কিছু একটা তো পাওনা ছিল আমার, তাই না?
সবকিছু কখন তোমার বাবাকে জানাবে?
ফের হাসল মেয়েটি। যখন সময় আর ইচ্ছে হবে আমার। এবার কিন্তু বাবাকে একহাত দেখিয়ে দিয়েছি আমি! বহু বছর ধরে ডাবল-বিকে হাতের মুঠোয় পেতে চাইছে সে, চেষ্টাও কম করেনি। শেষপর্যন্ত কি হলো? তার মেয়ে ছোট্ট অ্যাগিই কিন্তু সফল হলো।
টম নোলানের চেষ্টায় গাফিলতি ছিল না, জানে বেন, কিন্তু মেয়ের মত নোংরা কোন কৌশল খাটায়নি সে; হয়তো সেজন্যেই সফল হতে পারেনি। নিজের মুখে ফুটে ওঠা বিতৃষ্ণা আর অসন্তোষ ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হলো বেন, অ্যাগনেস যাতে দেখতে না পায় দৃষ্টি সরিয়ে জানালার দিকে তাকাল।
এক পাশে মাথা কাত করল অ্যাগনেস। স্টিভ হারকারকে সত্যিই চাও, তাই?
হ্যাঁ।
ধরো, ওকে তোমার হাতে তুলে দিলাম আমি। এমনিতে সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে কখনোই ওকে হারাতে পারবে না তুমি, বেন। তুমি নিজেও সেটা ভাল করে জানো।
কিন্তু চান্সটা নেব বলেই এসেছি আমি।
হেসে উঠল নোলান-কন্যা। নিচের লিভিংরূমে আছে ওরা। যাও, পারলে ধরো তোমার পছন্দের লোকটাকে, বেন…যদি সত্যিই বোকা হও, চেষ্টা করতে পারো।
তুমি বোধহয় অন্য আয়োজন করে রেখেছ ওখানে, অ্যাগি।
পুরুষ্টু ঠোঁটে তামাকের কণা দেখা যাচ্ছে, সেদিকেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা। তুমি চাইলে ওকে এখানে নিয়ে আসতে পারি আমি, তোমার হাতে তুলে দেব।
কিভাবে কাজটা করবে মেয়েটা, জিজ্ঞেস করার দরকার হলো না বেনের। একেবারে সহজ উপায়।
বরাবরই আমার ওপর আগ্রহ ছিল ওর, বেন, এখনও আছে। কিন্তু বাবার কারণে আমার কাছাকাছি হওয়ার দুঃসাহস করেনি।
বিশ্বস্ততা নাকি ভয়, অ্যাগি?
স্মিত হাসল অ্যাগনেস। নিজেই বুঝে নাও।
বিনিময়ে কি দিতে হবে তোমাকে?
চেয়ারের হাতলে বসল মেয়েটা। আগেও বলেছি তোমার বিরুদ্ধে ক্ষোভ নেই আমার। আমি যখন লেযি-এনের কর্তৃত্ব পাব, পাশে যোগ্য এবং সত্যিকার অফ একজন লোকের দরকার হবে আমার। তুমিই সেই লোক।
গ্রেসিয়াস, শুকনো স্বরে বলল বেন।
তাহলে রাজি তুমি?
নড করল বেন।
উঠে দাঁড়াল অ্যাগনেস, গাউনের ভঁজ ঠিক করে দরজার দিকে এগোল। ব্যালকনিতে অপেক্ষা করো, বাঁকা স্বরে বলল ও। পাঁচ মিনিট সময় দাও আমাকে, ওকে এমন অবস্থানে নিয়ে যাব যে ড্র করতে পারবে না। বাজি ধরতে পারো তুমি। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল মেয়েটা, পেছনে পাল্লা দুটো ভিড়িয়ে দিল।
এমনিতেই পারব আমি, বাজি ধরছি, নিচু স্বরে স্বগতোক্তি করল বেন। ব্যালকনির দিকে এগোতে গিয়ে বুটের তলায় কিছু একটা পড়তে হোঁচট খেল ও। সামলে নিয়ে জিনিসটা দেখল। এক জোড়া ছোট্ট বুট। নিপুণ ভাবে তৈরি, কারুকাজ করা। টেক্সাসের রূপালী স্পার লাগানো। অ্যাগনেসের বুট, বলে দিতে হলো না কাউকে। ডাবল-বি ছেড়ে আসার রাতে মেয়েটির পায়ে বুট জোড়া দেখেছে বেন।
পা বাড়িয়েও থমকে দাঁড়াল ও। কি যেন নেই একটা বুটে। বাম পায়ের বুটের দিকে তাকাল। রূপার একটা জ্যাংলার আছে ওটায়, কিন্তু অন্য বুটে নেই।
তৎক্ষণাৎ জ্যাকেটের পকেট হাতড়ে জিনিসটা বের করল বেন। ধুলো-মাখা এই জ্যাংলারটা খুঁজে পেয়েছিল রিও ফ্রিয়োর পাড়ে, কার্ল ব্রেনেলের খুনী যেখানে অপেক্ষা করেছে বহুক্ষণ, অন্তত ডজন খানেক সিগারেট ফুকেছে সে।
হুবহু একই জিনিস। হাঁটু মুড়ে কার্পেটের ওপর বসে পড়ল বেন, অজান্তে জিভ চালিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। দুটো জিনিস পাশাপাশি রেখে তুলনা করল। দারুণ ম্যাচ করছে। শীতল একটা শিহরণ বয়ে গেল ওর মেরুদণ্ডে। মার্কসম্যান লোকটার হাত সত্যিই অসাধারণ ছিল, তিনশো গজ দূরে নিচু জমিতে নিখুঁত নিশানায় গুলি করেছে, তাও চাঁদের আলোয়; কার্ল ব্রেনেলের ঠিক মাথার পেছনে লেগেছে বুলেটটা।
উঠে দাঁড়াল বেন। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি মনের পর্দায় দোলা দিচ্ছে, ডাবল-বি র্যাঞ্চ হাউসের লিভিংরূমে অ্যাগনেসের সঙ্গে একাকী কাটানো কিছু মুহূর্ত মনে পড়ছে। ও নিজেই অস্ত্রে অ্যাগনেসের দক্ষতার কথা বলছিল, রাইফেল বা পিস্তলে লেযি-এন ভ্যাকুয়েরোদের অনায়াসে হারিয়ে দিত অ্যাগনেস। কিছুটা তাচ্ছিল্য করতেও দ্বিধা করেনি তখন, কিন্তু সত্যিই কি অ্যাগনেসের কৃতিত্বকে ছোট করা যায়, নাকি ভ্যাকুয়েরোদের বদান্যতাই সব?
খোদার দয়া! বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল ও। অসম্ভব মনে হচ্ছে, কিন্তু প্রমাণ দেখেও কিভাবে অস্বীকার করবে? এবার সিরেনোয় ফিরে এসে আগ্রাসী, হিংসুটে এবং স্বেচ্ছাচারী অ্যাগনেস ব্রেনেলকে আবিষ্কার করেছে ও। দরকার হলে সবচেয়ে জঘন্য কাজটাও করতে পারবে এই মেয়ে।
প্রশস্ত হলওয়েতে কয়েকজনের কণ্ঠ শুনতে পেল বেন। দরজা গলে দ্রুত ব্যালকনিতে সরে এল ও, দেখল পেছনে স্টিভ হারকারের উদ্দেশে হাসছে। অ্যাগনেস। কামরার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গানম্যান, হাতে হ্যাট।
কথা রেখেছে মেয়েটা।
এক পা পিছিয়ে এল বেন, কোল্টের দিকে হাত বাড়াল। স্টিভ হারকার যাই করুক কিংবা যে-কাজেই ব্যস্ত থাকুক না কেন খোলা পিস্তল হাতে কামরায় ঢুকতে হবে ওকে। দুজনকেই চাই ওর। একজন খুনের আসামী, আরেকজন খুনের সম্ভাব্য আসামী; দু’জনকেই ধরতে হবে। কাজটা হয়তো নোংরা হবে, কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন নোংরা জিনিস নিয়ে খেলে, জিনিসটা হাতে না লাগালে কাজ উদ্ধার হয় কিভাবে?
পিস্তলটা সবে হোলস্টার মুক্ত করেছে বেন, ঠিক তখনই পেছনে শীতল হুমকি শুনতে পেয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল শরীর।
হ্যাঁ, বের করো ওটা, স্নেজেল, তারপর পোর্চে ফেলে দাও, শীতল স্বরের হুমকি এল পেছন থেকে। জিনিসটার দরকার হবে না তোমার। শক্ত গোলাকার কিছু একটা দিয়ে ওর পিঠে গুতো মারল লোকটা।
হাতের কোল্ট ফেলে দিল বেন। জানে যে কোন ছুতোয় ওর লাশ ফেলে দেবে ফ্রেড মোরিস।
দরজায় লাথি হাঁকাল সে। মুহূর্ত পরই দরজা খুলল লেযি-এন র্যামরড। বুয়েনস নচেস, স্নেজেল, শীতল স্বরে সম্ভাষণ জানাল সে। ভাবছিলাম কখন তোমার চাঁদমুখ দেখতে পাব।
গানম্যানের কাঁধের ওপর দিয়ে অ্যাগনেস ব্রেনেলের শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকাল বেন। বিশ্বাসঘাতিনী!
কোল্টের ব্যারেল নির্দয় ভাবে ওর মাথায় নামিয়ে আনল ফ্রেড মোরিস। টলে উঠল বেন, স্খলিত পায়ে দু’পা এগিয়ে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করল। অনুভব করল চাদি বেয়ে নেমে আসছে উষ্ণ রক্তের ধারা, স্থির দৃষ্টিতে অ্যাগনেসের দিকে তাকিয়ে থাকল ও। মেয়েটির সুন্দর মুখে ক্ষীণ তাচ্ছিল্যের। হাসি, কিন্তু আয়ত চোখে নিষ্ঠুরতা।
বুড়োর কাছে নিয়ে যাব ওকে? জানতে চাইল মোরিস।
অ্যাগনেসের দিকে ফিরল হারকার। কিন্তু মাথা নাড়ল নোলান-কন্যা। এখন নয়। আগে বাবার সঙ্গে কথা বলব। পছন্দ না করলেও বেনকে সমীহ করে সে, হয়তো ওর মাথায় অন্য কোন চিন্তা খেলে যেতে পারে। বুঝতে পেরেছ, স্টিভ? লিভিংরুমে নিয়ে যাও ওকে। ওখানে বসে পালক-ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প। করতে দাও ওকে।
১৩. বিশাল লিভিংরুমের টেবিলে বসে
বিশাল লিভিংরুমের টেবিলে বসে আছে ছেলেটা, বাম হাতে একটা ছোট গ্লাস। টেবিলের ওপর রাখা হুইস্কির বোতল দেখছে শূন্য দৃষ্টিতে। বেন স্লেজেলকে ঠেলে কামরায় ঢুকিয়ে দিতে চোখ তুলে তাকাল সে।
এখান থেকে দূরে থাকার বুদ্ধিটুকুও কি হারিয়ে ফেলেছ, বেন? উত্মা ভরে জানতে চাইল জেফরি।
একই প্রশ্ন তো আমারও, জেফ।
হাসল সে, যেন ভেঙচি কাটল। শূন্য গ্লাস ভরে নিল মুখ খোলার আগে। বিল আমাকে খুনই করে ফেলত, তুমিও জানো সেটা।
আসলেই কি কোন চান্স ছিল ওর? মাতাল বা পুরো সুস্থির থাকুক, কখনোই তোমার সঙ্গে পারত না ও। ওর চেয়ে অনেক ফাস্ট তুমি, জেফ, নিশানাও দারুণ। তোমার ধারে-কাছেও যেতে পারত না বিল।
গাঢ় চোখে বেনকে নিরীখ করছে ছেলেটা। তাহলে ওটা একটা দুর্ঘটনা, তাই না?
আড়চোখে স্টিভ হারকারকে দেখল বেন। ছেলেটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে গানম্যান। অ্যাগনেস আর র্যামরডের উপস্থিতিতে অসহায় হয়ে আছে জেফরি, ওকে কোন সাহায্যই করতে পারবে না। তাছাড়া ফ্রেড মোরিস তো আছেই। এদের মতই নোংরা হয়ে গেছে জেফরির হাত, হয়তো তারচেয়েও বেশি, কারণ নিজের রক্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সে।
ঠিক বলেছি না, বেন? তাগাদা দিল ছেলেটা।
বলো ওকে, স্লেজেল, শীতল স্বরে নির্দেশ দিল হারকার।
জেফরির দিকে ফিরল বেন। বিলের শরীরে যেখানে ইচ্ছে বুলেট লাগাতে পারত স্টিভ হারকার। বিলের হাতে বুলেটটা লাগিয়ে নিরস্ত্র করতে পারত ওকে, কিন্তু বদলে ওকে খুন করেছে সে।
বরফের ন্যায় শীতল নীল চোখ জোড়া বিদ্ধ করল বেনকে, তাচ্ছিল্য আর উম্মা ঝরে পড়ছে র্যামরডের চাহনিতে। দৃষ্টি সরে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে বেনের বুকের তারায় স্থির হলো। সেদিন স্রেফ ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছ, বেন। আজ কিন্তু তোমার মরণ ঠেকাতে পারবে না কেউ, ওই তারাটাও পারবে না!
দেরি করছ কেন? পাল্টা উন্মা প্রকাশ করল বেন।
এত তাড়ার কি আছে? ধীরে ধীরে, সবই হবে, কুৎসিত হাসি ফুটে উঠল হারকারের ঠোঁটে। ওপরে বাপের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেছে, অ্যাগনেস। রিও ফ্রিয়ো উপত্যকার ইতিহাঁসে আজ অন্য একটা দিন-এখন থেকে লেযি-এন কিংবা উপত্যকায় কর্তৃত্ব করবে অ্যাগনেস নোলান!
টম নোলান সেটা মেনে নেবে?
আলবৎ! না মেনে উপায় থাকবে না। বয়সের একটা ধর্ম আছে, সেটা মেনে নিতে হয় সবাইকে–একসময় নতুনদের জায়গা ছেড়ে দিতে হয়!
জোর করে বাপের কাছ থেকে কর্তৃত্ব কেড়ে নেবে অ্যাগনেস?
সেটা পাওনা হয়েছে ওর।
আড়চোখে জেফরিকে দেখল বেন, খানিকটা বিস্ময় লেগে আছে তরুণের চোখে। টম নোলানকে যতটা চিনি, র্যামরডের দিকে ফিরে খেই ধরল বেন। মনে হয় না মেনে নেবে সে।
নিতান্ত অবজ্ঞার সঙ্গে বাতাসে একটা হাত নাড়ল হারকার, যেন এভাবেই বসের সমস্ত আপত্তি বা অসন্তোষ নিমেষে বাতিল হয়ে যাবে। নেবে। অ্যাগনেসকে এখনও ঠিক চিনতে পারোনি তুমি, স্লেজেল। প্রত্যাশিত জিনিসটা পেয়ে অভ্যস্ত ও, প্রয়োজনে আদায় করে নেয়; আর এভাবেই ওকে বড় করেছে নোলান। আর টম নোলানের ক্ষেত্রে বলতে হয়বয়স হয়েছে, এবং বেসিনে কর্তৃত্ব করার মত দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলেছে মানুষটা। এমন বোঝা দরকার নেই লেযি-এনের।
লেযি-এন মালিক এখানে উপস্থিত থাকলে বোধহয় খাবি খেত, বিস্ময় বা চমকের চেয়ে বোধহয় হতাশাই বেশি আহত করত, তাকে। শুধু অধীন লোকেরাই নয়, সম্ভবত নিজের মেয়েও বিশ্বাসঘাতকতা করছে তার সঙ্গে। উড কিনলের ধারণা অনুযায়ী, এরাই কি তৃতীয় পক্ষ?
সিঁড়িতে অ্যাগনেস ব্রেনেলের পায়ের শব্দ শোনা গেল, কিছুক্ষণ পর দরজায় এসে দাঁড়াল মেয়েটি। নির্লিপ্ততার একটা মুখোশ পরেছে যেন, বিন্দুমাত্র ভাবান্তর নেই। জলদি ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে হবে, দ্রুত বলল নোলান-কন্যা।
বুড়ো? জানতে চাইল মোরিস।
নিকুচি করি তোমার! বেনের কথা বলছি আমি! বিরক্তি প্রকাশ করল অ্যাগনেস। বুড়োকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাদের! ঝামেলা চুকিয়ে ফেলেছি।
কি করেছ? উৎসুক স্বরে জানতে চাইল হারকার, স্রেফ কৌতূহল প্রকাশ করছে সে, উদ্বেগ বা সহানুভূতির ছোঁয়াও নেই কণ্ঠে।
অফিস-কামরায় আটকে রেখেছি ওকে। কিছুক্ষণ ওখানে কাটাক, এদিকে সবকিছু গুছিয়ে নেব আমরা।
দাঁত বের করে হাসল ফ্রেড মোরিস। একে একে সবার পালা আসবে, এক ভাইকে দিয়ে শুরু করি…
চুপ করো! দাবড়ানি দিল হারকার।
এক চুমুকে গ্লাসের পানীয় শেষ করে ফেলল জেফরি ব্রেনেল। কি বলছে ও, অ্যাগনেস?
এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার কাঁধে একটা হাত রাখল অ্যাগনেস। তুমি কি বুঝতে পারছ না, ডিয়ার? এখানে থাকলেই ঝামেলা করবে বেন, লেযি-এনের ধারে কাছেও ওকে চাই না আমরা। চাই?
না।
তাহলে কি চাও তুমি, জেফরি? কর্কশ স্বরে জানতে চাইল বেন।
ওর দিকে ফিরল জেফরি, কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে গেল। অসহায় দৃষ্টি ফুটে উঠল চোখে, পরিস্থিতির পরিবর্তন পুরোপুরি উপলব্ধি করতে না পারলেও সন্দেহ আর বিপদের আশঙ্কা ঠিকই তটস্থ করে তুলেছে ওকে। ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে, সরাসরি তাকাল অ্যাগনেসের দিকে। এসব পছন্দ হচ্ছে না আমার! হয়তো খুব বেশি তাড়াহুড়ো করছ তুমি। তাছাড়া…
এতে জড়িয়ে গেছ তুমি, কিড, কর্তৃত্বের স্বরে মনে করিয়ে দিল হারকার। যা বলা হয়েছে তাই করবে তুমি!
পিঠে পিস্তলের নলের খোঁচা অনুভব করল বেন, মূল দরজার দিকে ওকে এগোতে বাধ্য করল ফ্রেড মোরিস।
ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ তোমরা? বয়স্ক, দৃঢ় একটা কণ্ঠ শোনা গেল।
চরকির মত ঘুরল মোরিস। সিঁড়ি ভেঙে ধীর গতিতে নেমে আসছে টম। নোলান। মাথায় হ্যাট নেই, নিরস্ত্র সে, এবং ঠিক পেছনে মিরিয়াম ব্রেনেল। সবাই যখন ব্যস্ত, দেয়াল টপকে বেনের মতই ব্যালকনিতে উঠে টম নোলানের অফিসে চলে যায় মিরিয়াম; দরজায় তালা ছিল না, স্রেফ হুড়কো তুলে দেয়া হয়েছিল, তাই খুলতে কোন সমস্যাই হয়নি ওর।
নিষ্ঠুর অহঙ্কারী বলে কুখ্যাতি আছে টম নোলানের, কিন্তু ভদ্রলোক বলেও সুখ্যাতি আছে তার, অন্তত কোন মহিলার সঙ্গে কখনও অসৎ আচরণ করেনি সে। মিরিয়ামের সঙ্গে তেমন কোন কথাই বলেনি, স্রেফ হাতের ইশারায় সঙ্গে আসতে বলেছে। মেয়ের ওপর দারুণ নাখোশ হয়ে আছে সে।
বুড়োর দিকে ফিরে তাকাল সবাই। কঠোর দেখাচ্ছে টম নোলানের মুখ, মানুষটা যে দৃঢ়চেতা তাতে কোন সন্দেহ নেই; এই বয়সেও অধীন লোকদের সমীহ আর শ্রদ্ধার পাত্রলেযি-এন ক্রুদের চোখে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি দেখে বোঝা যাচ্ছে। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল ফ্রেড মোরিস, এমনকি স্টিভ হারকারও খানিকটা ভড়কে গেছে। স্বভাবসুলভ আত্মবিশ্বাস আর ঔদ্ধত্যের ঘাটতি দেখা গেল গানম্যানের মধ্যে, নিচু স্বরে সাফাই গাইল সে, লেযি-এন বস্ প্রশ্ন করার আগেই আমাকে ধরতে এসেছিল ও, মি. নোলান।
কারণ ডাবল-বিতে বিল ব্রেনেলকে গুলি করে হত্যা করেছ তুমি?
হ্যাঁ।
তাহলে বরং ওর সঙ্গে যাওয়াই উচিত হবে তোমার, হারকার।
নীরবতা নেমে এল কামরায়, মিনিট খানেক কেউই কিছু বলল না।
না, মৃদু স্বরে শেষে বলল র্যামরড।
এখানে নির্দেশ আমি দেই! তীক্ষ্ণ স্বরে বলল লেযি-এন মালিক, তারপর কিছুটা কোমল হয়ে এল কণ্ঠ। চিন্তা কোরো না, তোমার জন্যে কাউন্টির সেরা ল ইয়ার ভাড়া করব আমি।
না, মি. নোলান, সসমে বলল হারকার।
আরও কয়েকটা ধাপ নেমে এল টম নোলান। স্লেজেলের সঙ্গে যাবে তুমি! নিকুচি করি! কোথাও যাব না আমি!
রাগে লাল হয়ে গেল বুড়োর মুখ। তাহলে তো দেখছি অন্য ছেলেদের ডাকতে হয়, দেখি ওরা তোমাকে সিরেনোয় পৌঁছে দেয় কিনা।
টম নোলানের প্রভাব অস্বীকার বা অতিক্রম করার স্পর্ধা বোধহয় একমাত্র তার মেয়েরই আছে। তাই প্রমাণ হলো আবারও! হেসে উঠল অ্যাগনেস। কোন ছেলেরা? বিদ্রুপের স্বরে জানতে চাইল ও। এরা তোমার ক্রু, বাবা?
কঠিন দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখল নোলান, রমরড আর মোরিসকে দেখল একনজর, তারপর অ্যাগনেসের দিকে ফিরল। একেবারে নির্বিকার দেখাচ্ছে তার মুখ। আমার কু? মনে হচ্ছে, তা আর নেই এখন, তোমার অনুগত হয়ে গেছে ওরা।
বেন স্লেজেলের সঙ্গে কোথাও যাচ্ছে না স্টিভ।
এক হাতে সিঁড়ির রেলিং চেপে ধরল টম নোলান। এখানে আমি নির্দেশ দেই, অ্যাগনেস!
হেসে উঠল মেয়েটা। তুমি অবসর নিচ্ছ না কেন, বাবা? অনেক তো হলো, এবার বিশ্রাম নাও। এখন থেকে লেযি-এন আর ডাবল-বি আমিই চালাব।
নড করল বুড়ো, দু’একটা কথায় বুঝে নিয়েছে আসল পরিস্থিতি। ডাবল-বির সঙ্গে তোমার ব্যবসা বা রফা যাই বলো, কানে এসেছে আমার। নিজের চেয়েও বেশি শিক্ষিত করেছি আমি তোমাকে, অথচ মেয়ে হয়েও পুরুষদের নোংরা খেলায় যোগ দিয়েছ তুমি। আমার জাতশত্রুও বলতে পারবে না সারা জীবনে এমন কোন নোংরা খেলা খেলেছে টম নোলান। ছি! তোমাকে মেয়ে বলতেও বাধছে আমার! ক্ষণিকের জন্যে থামল নোলান, অন্যদের কিছু বলার সুযোগ দিল না, বেনের দিকে ফিরে সহানুভূতি আর দুঃখ প্রকাশ করল নিচু কণ্ঠে: এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না আমি, বেন।
নড করল বেন। জানি আমি।
বাপের কথায় বিকার নেই অ্যাগনেসের, মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি ওর মুখে। নিজের ক্ষমতা উপভোগ করতে শুরু করেছে। রিও ফ্রিয়ো উপত্যকার সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষটিও এখন ওর করুণার পাত্র!
স্লেজেলকে যেতে দাও, হারকার, নির্দেশ নয়, বরং অনুরোধের মত শোনাল টম নোলানের কণ্ঠ। ঠিক আছে, এখন থেকে তোমাদের কথায় চলবে এই বাথান, কিন্তু স্লেজেলকে যেতে দাও। নিজের চোখের সামনে ছেলেটাকে মরতে দেখার। ইচ্ছে নেই আমার। ইতোমধ্যে যথেষ্ট রক্তপাত হয়েছে।
শোনো বুড়োর কথা! বিদ্রূপ করল ফ্রেড মোরিস।
ফ্রেড? ডাকল হারকার। যাও তো, অন্য ছেলেদের ডেকে নিয়ে এসো। দলে হালকা হয়ে গেছি আমরা, শক্তি বাড়ানো দরকার।
সপাটে খুলে গেল সামনের দরজা, প্রত্যেকটা চোখ ঘুরে গেল সেদিকে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ডড কিনলে। ফ্রেড মোরিসের হাতের নগ্ন পিস্তল দেখল সে নির্বিকার মুখে, তারপর বেনের দিকে তাকাল। জানতাম এই হবে, হেসে বলল সে। কিন্তু খোদার দয়া যে সময়মত পৌঁছতে পেরেছি।
এগিয়ে আসছে ডিটেকটিভ, দেখতে পেল পিস্তল বের করছে স্টিভ হারকার, কিন্তু গ্রাহ্য করল না সে। সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়াল। কাউন্টি থেকে এইমাত্র ফিরেছি আমি, মি. নোলান। অবিশ্বাস্য একটা তথ্য জানতে পেরেছি, কিন্তু সেটাই সত্যি। মিসেস নোলানের খোঁজ নিতে গিয়ে এতটাই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম যে আমার প্রথম কাজ, কার্ল ব্রেনেলের খুনীর পরিচয় যে বের করতে হবে, বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।
বলে যাও।
ঘুরে দাঁড়াল ডিটেকটিভ। অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে এল পাসোয় মারা গেছে ল্য নোলান, কিন্তু মরার আগে এমন এক সত্যের স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছে, প্রায় পঁচিশ বছর চাপা পড়ে ছিল তথ্যটা। স্বামীকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত মহিলা, জানত যে সন্তান হিসেবে ছেলেই কামনা করত মি. নোলান, কিন্তু বদলে একটা মেয়ে উপহার দেয় সে।
অ্যাগনেসের দিকে ফিরল টম নোলান, কিন্তু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল মেয়েটা।
আঙুল চালিয়ে হ্যাট পেছনে ঠেলে দিল কিনলে। যা বলছিলাম, টম নোলানকে লেযি-এনের সম্পত্তির দলিল দিয়ে যায় সে, কিন্তু কিছুটা কারসাজি করেছে তাতে। রিও ফ্রিয়োর মূল অংশ নিয়ে দুটো বাথানের মধ্যে বিবাদ, এই দলিল তাতে আরও ইন্ধন জোগাল। কারণ দুটো বাথানই রিও মাকে নিজের বলে দাবি করে আসছে। অথচ রিও ফ্রিয়ের মূল অংশের মালিকানা আসলে ডাবল-বির। ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে ল্য নোলান, টম নোলানকে চিরস্থায়ী এক সংঘর্ষের পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
মানে? কর্কশ স্বরে জানতে চাইল অ্যাগনেস।
টম নোলানের দিকে ফিরল ডিটেকটিভ। সূর্য নোলান সত্যিই এক হাত দেখিয়েছে তোমাকে, মি. নোলান, দুটো বাথানের মধ্যে চিরশত্রুতার পথ তৈরি করে দিয়ে গেছে বেসিন ছাড়ার আগে। জানত দলিল অনুযায়ী রিও ফ্রিয়োর ওই অংশ দাবি করবে তুমি, কার্ল ব্রেনেলও সেটা মেনে নেবে না কারণ আদপে আসল। মালিক তো সে-ই। ফলাফল: দুই বাথানের শত্রুতা। তাই হলো দুই যুগ ধরে!
তাহলে অযথাই ডাবল-বির সঙ্গে এতদিন.. ক্ষীণ হয়ে গেল বুড়োর স্বর, অনুশোচনা আর হতাশা প্রকাশ পেল কণ্ঠে।
দুঃখজনক হলেও, এভাবেই তোমার ওপর শোধ নিতে চেয়েছিল মিসেস নোলান, বলল কিনলে। শেষ দিকে বোধহয় অনুশোচনায় পুড়ছিল সে, তাই মারা যাওয়ার আগে নার্স মহিলার কাছে স্বীকার করে গেছে সব।
মুহূর্তের মধ্যে যেন টম নোলানের বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে। শূন্য দৃষ্টিতে ডিটেকটিভের দিকে তাকাল সে, তারপর বেনের ওপর স্থির হলো দৃষ্টি। খোদা, ম্লান স্বরে বিড়বিড় করল। সত্যিই আমাকে ঘৃণা করত ও!
কেন নয়? মুখিয়ে উঠল অ্যাগনেস। এবার আমার কথা শোনো! সবকিছু শুনতে মন্দ লাগেনি আমাদের। ভুয়া দলিলে কিছুই যাবে-আসবে না আমার। লেয়ি-এনের কর্তৃত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে তুমি, এবং ডাবল-বির মালিকানা শিগগিরই পেয়ে যাব। বন্ধকের টাকা কোন ভাবেই জোগাড় করতে পারবে না ওরা। এই বেসিনে কর্তৃত্ব করবে অ্যাগনেস নোলান।
তোমাকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করতে বাধছে আমার!
তাই নাকি? ঠিক আছে, স্বীকার কোরো না! চাঁছাছোলা স্বরে জবাব দিল নোলান-কন্যা। কিন্তু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করা পর্যন্ত না হয় স্বীকার করো, তারপর। যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারো তুমি, কিংবা থাকতেও পারো, আপত্তি নেই আমার, কিন্তু মনে রেখো, আমার কথায় চলবে লেযি-এন।
এখনও কোন বাথানেরই মালিকানা পাওনি তুমি! নিখাদ বিতৃষ্ণা প্রকাশ করল লেযি-এন মালিক। পাবেও না। অন্তত আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি…
সরু চোখে বাপের দিকে তাকাল অ্যাগনেস, কুৎসিত দেখাচ্ছে মুখটা। ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার? বাবা, হাসাচ্ছ আমাদের! যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। স্রেফ খানিকটা নাটক করার জন্যে এতকিছু করিনি আমি। ঘাম ঝরাতে হয়েছে এই দিনটির জন্যে। এবার আমার সবকিছু বুঝে নেওয়ার পালা। স্টিভ হারকারের দিকে ফিরল মেয়েটা।-এবার তোমার খেল দেখানোর সময়, স্টিভ। সবকিছু হারানোর ঝুঁকি নিতে পারি না আমরা, কিংবা তীরে এসে তরীও ডোবাতে পারি না!
নড করল গানম্যান। একে একে বেন, কিনলে, মিরিয়াম এবং সবশেষে টম নোলানের ওপর স্থির: হলো তার দৃষ্টি। মরা মানুষ কথা বলতে পারে না, মৃদু, দার্শনিক সুরে বলল সে।
মিরিয়ামের সঙ্গে চোখাচোখি হলো বেনের।
বেন! চাপা স্বরে বেনের মনোযোগ আকর্ষণ করল মেয়েটা, একটা কোল্ট দেখা যাচ্ছে হাতে। কোল্টটা ছুঁড়ে দিল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেটা লুফে নিল বেন।
ওর দিকে চোখ রাখো! চিৎকার করল ফ্রেড মোরিস।
ঘুরেই স্টিভ হারকারের চাঁদিতে কোল্টের ব্যারেল নামিয়ে আনল বেন। টলমল পায়ে পিছিয়ে গেল লেযি-এন র্যামরড, দু’হাতে মাথা চেপে ধরেছে; অস্ফুট স্বরে কাতরে উঠল, চোখে বিস্ময়।
সবার আগে তৎপর হয়ে উঠল মোরিস। খোলা পিস্তল ছিল তার হাতে, চোখের নিমেষে গুলি করল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করলে যা হয়, ফস্কে গেল গুলি। মাথা নিচু করে ফেলল বেন, একইসঙ্গে কমলা আগুন ওগরাল ওর পিস্তল। বুলেটের ধাক্কায় পেছনে উড়ে গেল মোরিসের দেহ, রিফ্লেক্সের বশে আঙুলের চাপ পড়ে গেল ট্রিগারে। একের পর এক গুলি বিদ্ধ হলো ছাদে।
চরকির মত আধ-পাক ঘুরে দাঁড়িয়েছে ডড কিনলে। ঘূর্ণনের মধ্যে স্টিভ হারকারের পিস্তল থেকে আসা গুলিটা লাগল তার কাঁধে। হুড়মুড় করে মেঝেয় আছড়ে পড়ল বিশালদেহ।
ধরো ওকে, জেফরি! চিৎকার করে নির্দেশ দিল অ্যাগনেস।
স্টিভ হারকার আর বেনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ, কি করবে বুঝতে পারছে না। বেনের দিকে ফিরল সে।
ফেলে দাও ওকে!
সামনে থেকে সরে দাঁড়াও, কিড! দাবড়ানি দিল স্টিভ হারকার।
ঘুরে দাঁড়াল ছেলেটা। করো গুলি, নিকুচি করি তোমার!
স্টিভ হারকার ভাল মতই বুঝতে পারছে পাশার দান উল্টে গেছে। পিস্তল তুলল সে, কিন্তু ছেলেটা আরও…অনেক বেশি ক্ষিপ্র। নিমেষে হাতে উঠেছে। জোড়া পিস্তল, কেশে উঠল ভয়াল দর্শন কোল্ট। পরপর কয়েকবার ট্রিগার টানল জেফরি ব্রেনেল, শব্দ শুনে মনে হলো মাত্র দুটো গুলি করেছে। কিন্তু ফলাফলটা তৎক্ষণাৎ দেখতে পেল অন্যরা। স্টিভ হারকারের বুকে অন্তত তিনটা গুলি বিধেছে। মেঝেতে পড়ে আছে গানম্যানের নিষ্প্রাণ দেহ।
জেফরির দিকে ফিরল বেন। ছেলেটার অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় বিহ্বল হয়ে পড়েছে। খোলা পিস্তল ছিল স্টিভ হারকারের হাতে, কিন্তু সুযোগই পায়নি বেচারা। একটা গুলিও করতে পারেনি র্যামরড, তার আগেই পিস্তল ড্র করে তিনটা গুলি করেছে জেফরি।
পাক খেয়ে সিলিংয়ের দিকে উঠে যাচ্ছে গান পাউডারের ধোয়া। কটু গন্ধে কেশে উঠল মিরিয়াম আর টম নোলান। রক্তের পুকুরের মধ্যে পড়ে আছে দুটো লাশ। যন্ত্রণায় ককাচ্ছেডড কিনলে। তাকে সাহায্য করতে ছুটে গেল মিরিয়াম।
বেনের দিকে ফিরল জেফরি। এই প্রথম, শান্ত নিরুদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ছেলেটাকে, দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য বা চ্যালেঞ্জ নেই। আমি দুঃখিত, বেন, মৃদু আন্তরিক স্বরে বলল
কেন দুঃখ হবে তোমার? এই মাত্র আমার জীবন বাঁচিয়েছ তুমি!
হারকারের দিকে তাকাল জেফরি, ঘৃণায় কুঁচকে গেছে মুখটা। আমার ভাইকে খুন করেছে ও, নিস্পৃহ স্বরে বলল সে। ধীরে ধীরে গানবেল্ট খুলে মেঝেয় ফেলে দিল। আর কখনও পিস্তল ছোঁব না আমি, বেন, কক্ষনো না!
অ্যাগনেসের দিকে ফিরল টম নোলান। তো?
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা, পরিস্থিতির পরিবর্তনে বিল, হতচকিত। বাঙ্ক হাউসে আছে ওরা… ভাষা খুঁজে পেল অ্যাগনেস। কারাঞ্চো, স্লিম…গুলির শব্দ শুনে চলে আসবে ওরা এখনই…
আসবে না, বাধা দিল বেন। এখানে যাতে না আসতে পারে সেটা নিশ্চিত করেই বাড়িতে ঢুকেছি আমি।
শূন্য দৃষ্টি দেখা গেল মেয়েটির চোখে, কাঁধ ঝুলে পড়েছে। কিন্তু এখনও পিঠ টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে, পরাজয় মেনে নেয়নি। ঠিক আছে, তোমরাই জিতলে! কিন্তু ডাবল-বির মালিকানা আমার হাতে আসছে। এখানে থাকব না আমি, ডাবল-বিতে গিয়ে উঠব!
বাঁকা হাসি খেলে গেল টম নোলানের মুখে। মেয়ে জাতটাকে চিনতে পারি বলে গর্ব করতাম আমি। কিন্তু এখন দেখছি ওদের সম্পর্কে আমার অনেক ধারণাই ভুল। হয়তো অন্যায়, কুরেছি আমি তোমার মা-র ওপর, আর তোমার সঙ্গে ভাল আচরণ করে তারচেয়েও বড় অন্যায় করেছি। দুধ দিয়ে আসলে একটা জাতসাপ পুষেছি এতদিন! বাপকে চোখ রাঙাবে এমন কোন মেয়ে দরকার নেই আমার, অ্যাগনেস! আর কোন ভুল করতে চাই না। এক্ষুণি বেরিয়ে যাবে তুমি!
কিছু বলতে যাচ্ছিল অ্যাগনেস, কিন্তু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল বুড়ো। উঁহু, কোন কথাই শুনব না তোমার। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বলে ফেলেছ। আমার অজান্তে কূটকৌশল খাটিয়েছ, নাছোড়বান্দা কিছু শত্রু তৈরি করেছ তুমি। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়! আর…ডাবল-বিও পাবে না তুমি। ব্রেনেলদের হয়ে আমিই তোমার দেনা শোধ করে দেব। অযথা রিও ফ্রিয়োর দখল নিয়ে ওদের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করেছি আমি, তার খেসারত না হয় এভাবেই দেব! যাকগে, কত পাওনা তোমার? বিলের স্ত্রী হিসেবে একটা অংশ পাওনা তুমি, ওটার জন্যে কত চাও? সব মিলিয়ে…
অবিশ্বাসের সঙ্গে বাপকে দেখছে অ্যাগনেস। বাবা, আমাকে এভাবে তাড়িয়ে দেবে তুমি?
একটু আগে কিন্তু আমাকে তাড়াতে একটুও বাধেনি তোমার!
ঠিক আছে। ঠিকই নিজের পথ খুঁজে নেব আমি। ডাবল-বির বন্ধক বাবদ বিশ হাজার…
কিন্তু ডাবল-বির কাছে তোমার একটা দেনা রয়ে গেছে যে? মৃদু স্বরে জানতে চাইল বেন।
ঝট করে ওর দিকে ফিরল অ্যাগনেস। কিসের দেনা?
অ্যাগনেসের দিকে এগোল ও। কাউন্টির ডেপুটি শেরিফ হিসেবে খুনের সম্ভাব্য আসামী সন্দেহে তোমাকে গ্রেফতার করছি আমি।
আঁতকে ওঠে দু’পা পিছিয়ে গেল মেয়েটা। কি বলতে চাও?
নির্বিকার সুন্দর মুখটা নিরীখ করল বেন। কার্ল ব্রেনেল যে রাতে খুন হয়, রিও ফ্রিয়োর ধারে ওর অপেক্ষায় ছিলে তুমি। ফর্টি-ফোর রাইফেল দিয়ে ওকে গুলি করেছ তুমি। কেবল এভাবেই তাকে সরাতে পারতে। নিজে কাজটা করা ছাড়া উপায় ছিল না তোমার, অ্যাগি, কারণ কাউকে বিশ্বাস করোনি তুমি ব্ল্যাকমেলিংয়ের ভয়ে।
দ্রুত মূল দরজার দিকে পিছিয়ে গেল মেয়েটা। প্রমাণ করতে পারবে না।
পারব, অ্যাগি। তোমার সব খেলাই শেষ হয়ে গেছে।
ঝটিতি হাত বাড়িয়ে দরজার হাতল চেপে ধরল অ্যাগনেস, এক টানে কবাট মেলে ধরল। বিশাল দরজা খুলেই বেরিয়ে গেল। এক পশলা বৃষ্টি ছুটে এসে পড়ল সুন্দর সোনালী চুলের রাশিতে, ভিজিয়ে দিল ছিপছিপে শরীরটা; তারপরই হারিয়ে গেল মেয়েটা। বৃষ্টির ধোঁয়াটে পর্দার জন্যে আর দেখা গেল, না, কেবল দৌড়ানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ধরো ওকে! চিৎকার করল ডড কিনলে।
মাথা নাড়ল বেন। কোথায় পালাবে, কি মনে হয় তোমার, কতদূর যেতে পারবে?
ধীর পায়ে এগিয়ে এল টম নোলান। বেনের একটা হাত চেপে ধরল। ধন্যবাদ, বেন, গম্ভীর স্বরে বলল সে। আর এতদিনের সমস্ত অসন্তোষ আর বিদ্বেষের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করছি, যদিও জানি তাতে কিছুই হবে না। মিরিয়াম, আমি সত্যিই দুঃখিত! দু’পা পিছিয়ে গেল মানুষটা, তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল সিঁড়ির দিকে। কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই আমি, বেন। আর…আজ থেকে লেযি-এনের দুয়ার তোমাদের জন্যে সবসময়ই ভোলা থাকল, যে কোন সময়, আসবে তোমরা, সাদর অভ্যর্থনা পাবে!
সিঁড়ি টপকে ওঠা শুরু করল সে, পেছন থেকে দেখল ওরা। দৃঢ় ভঙ্গি, অহঙ্কার বিসর্জন দেয়নি মানুষটা, কিংবা পরাজয়ের ক্লান্তি চেপে বসেনি। মেয়েকে হারানোর শোকও কাবু করতে পারেনি তাকে। নিঃসঙ্গ কিন্তু অহঙ্কারী আত্মমর্যাদা সচেতন একজন মানুষ।
উঠে দাঁড়িয়েছে ডড কিনলে, যন্ত্রণায় মৃদু গোঙাচ্ছে, কিন্তু মুখে স্বস্তি। ওহ্, ঝানু গোয়েন্দাকেও দেখছি হার মানিয়েছ তুমি, বেন! সপ্রশংস দৃষ্টি ঝরে পড়ল তার চোখে। কোত্থেকে জানলে যে অ্যাগনেস নোলানই খুন করেছে কার্ল ব্রেনেলকে?
ডিটেকটিভকে দোতলায় নিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাখ্যা করল বেন। কাঁধে লেগেছে গুলিটা, তেমন মারাত্মক জখম নয়। কটা দিন হয়তো বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। কিনলেকে গেস্টরুমে নিয়ে এল ওরা। ক্ষতের শুশ্রূষায় তখনই ব্যস্ত হয়ে পড়ল মিরিয়াম।
বাথানে যাচ্ছি আমি, বলল জেফরি, পেছন পেছন চলে এসেছে।
ঘাড় ফিরিয়ে ভাইকে দেখল মিরিয়াম। নিচ থেকে লাশ দুটো সরিয়ে নিয়ে যাবে, জেফ? ওগুলো দেখলেই অস্বস্তি লাগছে আমার!
মাথা ঝাঁকাল সে, তারপর বেরিয়ে গেল।
নিচে নেমে এল বেন, জেফরিকে সঙ্গে নিয়ে লাশ দুটো সরিয়ে রাখল বারান্দায়। আমার মনে হয় শহরেই যাওয়া উচিত, বলল জেফরি। আন্ডারটেকার আর শেরিফকে খবর দিতে হবে। তাছাড়া ডাক্তারও নিয়ে আসতে হবে। মি. কিনলের চিকিৎসা দরকার।
মাথা ঝাঁকাল বেন। বৃষ্টির মধ্যে যেতে পারবে তো?
নিশ্চয়ই।
ওপরে চলে এল বেন। কার্লি, স্লিম আর অন্যান্য ক্রুদের কথা মনে পড়ল। শেরিফ আসার পরই না হয় এদের মুক্তি দেয়া যাবে, ভাবল ও। গেস্টরুমের দিকে এগোল। পুরো বাড়িটাই শূন্য লাগছে, দোতলার অফিসরূমে আছে টম নোলান, সম্ভবত বোতলের মধ্যে ডুবে থাকবে সে আগামী কয়েকটা দিন। বাড়ির অন্দরমহলে ভৃত্যরা আছে বটে, কিন্তু কেউই দরকার না পড়লে এদিকে আসছে না।
শূন্য একটা প্রাসাদ। নিরানন্দ, নিঃসঙ্গ পরিবেশ।
করিডরে মিরিয়ামের দেখা পেল ও।
ঘুমাচ্ছে ও, জানাল মিরিয়াম।
বারান্দায় দাঁড়াল ওরা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বহু রক্তপাত ধুয়ে-মুছে নিঃশেষ করে দিতে বোধহয় এমন বৃষ্টিই দরকার। শুধু বিদ্বেষ আর শক্রতার স্মৃতিই মুছে দেবে না, বরং সতেজ উর্বর করে তুলবে এখানকার মাটি; তাজা ঘাস গজিয়ে উঠবে, মনোরম হয়ে উঠবে তৃণভূমি।
এবার কি, বেন?
পাশ ফিরে মিরিয়ামকে দেখল বেন, তারপর কাছে টেনে নিল মেয়েটিকে। ডাবল-বির বর্তমান মালিক কি ভাবছে, সেটা তো জানা হলো না আমার।
রহস্যময় হাসি দেখা গেল মিরিয়ামের ঠোঁটে। প্রথম দিনই তো বলেছি-তুমি ছাড়া ডাবল-বি চালাতে পারবে না কেউ! এটা তোমার পাওনা, বেন, কারণ ডাবল-বির সবকিছুই নিজের মত করে দেখেছ। ঝামেলার সময় কাঁধে দায়িত্ব। তুলে নিয়েছ, নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছ। আমাদের মধ্যে তোমাকেই বেশি গুরুত্ব দিত বাবা, যেন জানত সত্যিকার উত্তরসূরী কে হবে, বিপদে কে ভরাডুবি ঠেকাবে।
বুঝলাম, কার্ল ব্রেনেলের হৃদয়ে স্থায়ী একটা আসন ছিল আমার। কিন্তু ওর লাজুক মেয়ে যে এমন নির্লজ্জ ভাবে পালক-ভাইকে দখল করে নেবে…বলো তো, অরিগনের মেয়েগুলোর কি হবে, আমার পথ চেয়ে বসে আছে যারা?
দুম করে কিল বসিয়ে দিল মিরিয়াম, চোখে আগুন, এদিকে রক্তিম হয়ে গেছে মুখ। নির্লজ্জ ভাবে বা জোর করে নয়, আপসে এবং পূর্ণ সম্মতির সঙ্গে, অর্থপূর্ণ স্বরে শুধরে দিল মেয়েটি। অরিগনের মেয়েরা বসে থাকুক না অপেক্ষায়, আমার কি! আজীবন আইবুড়ো হয়ে না থাকতে চাইলে কারও না কারও গলায় ঝুলে পড়া। উচিত ওদের! কিন্তু বেন স্লেজেলকে পাবে না ওরা, আগামী রোববারেই তার গায়ে ব্র্যান্ড বসিয়ে দেব আমি!
হেসে উঠল বেন। এত তাড়াতাড়ি?
উঁহু, কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নই আমি। কোন্ দিন আবার ট্রেইলে বেরিয়ে পড়ো, কে জানে! পুরুষ মানুষকে বেশিদিন অপেক্ষা করিয়ে রাখতে নেই, বিগড়ে যায় তাহলে।
আরিব্বাস, এত জ্ঞান পেলে কোত্থেকে? যেন কয়েকটা পুরুষের গায়ে ব্র্যান্ড বসিয়েছ আগে?
আমার পুরুষ একজনই। ছয় বছর আগেই যদি ব্র্যান্ড বসাতাম, তাহলে বেসিন ছেড়ে যেতে হত না তাকে। এবার আর ভুল করতে রাজি নই!
বেঁচে থাকলে কার্ল ব্রেনেল নিশ্চয়ই এখন চাবকাত আমাকে!
নিশ্চয়ই! দুষ্ট হাসি দেখা গেল মিরিয়ামের ঠোঁটে। রাজি না হলে!
Leave a Reply